Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 99



ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১৭

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ১৭

“আরমান, কই ছিলি তিনদিন?”

“ছবি তুলতে গিয়েছিলাম।”

“ছবি তুলতে গিয়েছিস জানি। কোথায় গিয়েছিলি?”

“আলতা দীঘি।”

” আলতা দীঘি! এ আবার কোন জায়গা?”

“খুব সুন্দর একটা জায়গা মা। বলা যায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটা নীড় ছিল আলতা দীঘি। কিন্তু আমরা মানুষেরা সেটাও নষ্ট করে ফেলছি। দীঘির জায়গা ভরাট করে উদ্যান করা হচ্ছে।”

“বলিস কী? জায়গার নাম আলতা দিঘী। আর সেই দীঘি ভরাট করে উদ্যান হচ্ছে! তুই কি বেড়াতে গিয়েছিলি?”

“বেড়াতে যাইনি মা। মৃত প্রায় দীঘিটাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম।”

“এই না বললি ছবি তুলতে গিয়েছিস?”

” হ্যাঁ ছবিই তো তুলেছি। যেন বাঁচাতে পারি।”

“তোর এসব কথার কোন মানে বুঝি না। কী করছিস, কেন করছিস আল্লাহ জানেন। ছবি তুলে দিঘী বাঁচানো এগুলো কোন কাজ? এসব করে কি জীবন চলবে?”

“জীবন কিসে চলে মা? সবাইকে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। না হলে বড় কর্পোরেট চাকরি করতে হবে এমন তো নয়। পৃথিবীতে হাজারটা পেশা আছে। আমার পেশাও তেমনই একটা।”

” তুই যে দীঘি, খাল বিলের ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিস সেটাকে কি কেউ পেশা বলে? মানুষ জিজ্ঞেস করে এত পড়াশোনা করে কি শেষ পর্যন্ত তুই বিয়ের ভিডিওগ্রাফি করিস? মানুষের অনুষ্ঠানের ছবি তুলিস?”

“অনুষ্ঠানের ছবি তোলার জন্য অসংখ্য প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার আছে মা। এবং এটাও বর্তমানে খুব জনপ্রিয় পেশা। আমি প্রকৃতির ছবি তুলি সেটাও একটা পেশা।”

“এটাই যদি পেশা হবে তাহলে লেখাপড়া করলি কেন?”

“মা তুমি কিন্তু একটা পেশাকে খাটো করে দেখছ। লেখাপড়া সব পেশার জন্য প্রয়োজন। আমি যখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে কথা বলি, কাজ করি, তখন আমার এই পড়ালেখাটাই কাজে দেয়। আমি অনেকদিন তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আমাদের বোঝার বাইরে। না আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না তুমি কোনদিন বুঝতে পারবে। আমি কি তোমার কাছে টাকা পয়সা চাই? আমার হাত খরচ থেকে শুরু করে কোন খরচ আমি তোমার কাছ থেকে নেই না। তাহলে তো তুমি বুঝতেই পারছ আমি আয় করি। এই বাড়িটা আমাদের নিজেদের। কোন ভাড়া লাগে না বরং আমি যদি সংসারের জন্য খরচ করতে চাই তুমি মানা কর। বল বাবার পেনশনে ভালোই যাচ্ছে। অন্য জায়গা থেকেও আমাদের টুকটাক আয় আসে। বলো তোমার সংসার খরচের প্রয়োজন নেই। আমি নিজে শখ করে কিছু টাকা তোমার হাতে দিলে তুমি খরচ না করে রেখে দাও। তোমার টাকার প্রয়োজন হয় না। তাহলে অভাবটা কোথায়? আমাকে কেন গতানুগতিক চাকরি নয়তো ব্যবসা করতে হবে? শুধু কি সবার কাছে বলার জন্য?”

“হ্যাঁ সবার কাছে বলার জন্য। কারণ সবাই জানতে চায় তুই কী করছিস। আমি তো বলতে পারি না আমার গ্রাজুয়েট ছেলে ছবি তোলে। না তার কোনো ইভেন ম্যানেজমেন্টের কোম্পানি নেই। সে আগানে বাগানে গিয়ে, দীঘির পাড়ে গিয়ে ছবি তোলে। তুই বল সমাজে এই জিনিসের কোনো দাম আছে? মানুষের কথা শুনতে তো ভালো লাগে না।”

“তো শোনার প্রয়োজনটা কী? মানুষের কথা শুনতে হবে কেন? তুমি বলে দিও আমার ছেলে ভবঘুরে। কিছুই করে না। হেঁটে হুটে খায়।”

“এই কথা বললে পাত্রীপক্ষ তোর কাছে পাত্রী দিবে?”

“পাত্রী চায় কে?”

“আমি চাইছি। আমার একটা মাত্র ছেলে। আমি ছেলের বউ দেখব না? নাতি নাতি দেখবো না? সারা জীবন নিজের মত চললি এই একটা আবদার কবে থেকে তোর কাছে করে যাচ্ছি। সেটাও তুই আমার রাখবি না?”

“বিয়ের বাহানায় তুমি আমাকে গৃহবন্দি করতে চাচ্ছ মা। কিন্তু জেনে রাখ কেউ যদি গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী হতে চায় তাহলে তাকে বিয়ে নামক বন্ধনে বেঁধে ঘরে ফেরানো যায় না। পথিক যখন তার গন্তব্য জানে তখন সে হারায় না। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া পথিককে তুমি কখনোই গন্তব্যের ঠিকানা দিতে পারবে না।”

“তাহলে কি তুই কোনদিন বিয়ে-শাদী করবি না? চিরকুমার থাকবি?”

“কেন করব না? যার সাথে ঘর বাধতে ইচ্ছা করবে তেমন কাউকে পেলে অবশ্যই করব।”

“শোন বাবা, আমার শরীরটা ইদানীং ভালো থাকে না। আমার একটা অনুরোধ রাখ। মিরার সাথে একটু দেখা কর। মেয়েটার বয়স তোর কাছাকাছি। দেখতে শুনতেও খারাপ না। ভালো ফ্যামিলির মেয়ে আমার ধারণা তোর সাথে বনবে ভালো। তুই অগোছালো বাঁধনহারা। মিরা পরিণত বয়সের মেয়ে। হয়তো সংসারী হয়ে এই সংসারটাকে আগলে রাখতে পারবে।”

“মিরাটা কে?”

“শেলীর ননদ।”

“শেলী আপার ননদ! তাকে তুমি পেলে কই?

” শেলী ফোন দিয়েছিল। মানে শেলী না ঠিক। জান্নাত দিয়েছিল।”

“কী বললেন আন্টি? আন্টি তো আমাকে খুব একটা নেক নজরে দেখেন বলে মনে হয় না। সেখানে মেয়ের ননদের জন্য আমাকে পাত্র মনোনীত করেছেন! বিস্ময়কর ব্যাপার স্যাপার। পাত্রী অন্ধ না তো? নাকি কানে শুনে না? দাঁড়াও দাঁড়াও দ্বিতীয় তৃতীয় বিয়ে নয়তো?”

“এমন কিছু না।”

“এমনি এমনি সিঙ্গল পিস কোনরকম খুঁত ছাড়া পাত্রী আমার মত অকর্মার ঢেঁকির জন্য আন্টি আর আপা চাইছেন? শেলী আপার আপন ননদ? নাকি উনার শ্বশুরের আব্বার দূর সম্পর্কের মেয়ে?”

“চুপ কর ফাজিল। দূর সম্পর্কের মেয়ে মানে কী? মেয়ের কোন খুঁত নেই। সব ঠিক। বয়স আটাশ বছর। ওরা একটু ছেলে নিয়ে বাছবিচার করছিল শুরুতে। এখন বয়স যাচ্ছে বেড়ে, কিন্তু পাত্র মেলাতে পারছে না। তাছাড়া শেলীর স্বামী যুবায়ের তোকে নাকি খুব পছন্দ করে। সেই শেলীর কাছে বলেছে। তোর নাকি কী পেজ টেজ দেখেছে। আরও কী বললো অনেক ফলোয়ার না কী। ওর নাকি তোকে গুণী মনে হয়েছে। প্রথমে তো শেলীও অবাক হয়েছিল। যুবায়েরের আগ্রহে তোর জন্য জান্নাত কথা আগালো।

” আহ্ আমি তো ধন্য। পরিবারের ভেতর কারও তো মনে হলো আমি গুণী। তবে আটাশ বছর এমন কোনো বয়স না। পাত্র মিলাতে পারছে না মানে? আজকালকার মেয়েরা ত্রিশের পরেও বিয়ে করে। ঘটনা অন্য মা, ঘটনা অন্য। তোমার এই ডিফেক্টেড ছেলের জন্য পাত্রী চাওয়ার বিষয়টা স্বাভাবিক না।”

“এক কথা বারবার বলবি না তো। কিসের ডিফেক্টেড? তুই ই তো মাত্র বললি যে মেয়ে বোবা না কালা? তা তুই অন্ধ না বোবা কালা? তোর কী ডিফেক্ট?”

“দেখো মা, অন্ধ হওয়া বা কানে না শোনা, এমনকি পঙ্গু হওয়াও ডিফেক্ট না। মানুষ সর্বোত্তম সৃষ্টি। আমি তো মজা করেছি। তবে হ্যাঁ চরিত্র ভালো না হওয়া, মন ভালো না হওয়া, মানুষ ভালো না হওয়া অবশ্যই ডিফেক্ট। তুমি আন্দাজে আমাকে জোর করো না। আগে খোঁজ নাও।”

“অবশ্যই খোঁজ নেব। তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোকে নিয়ে কি আমি পথে পড়েছি যে যেনতেন মেয়ের সাথে আমি তোর বিয়ে দিয়ে দিব? তুই কোনো কাজ করিস না তো কী হয়েছে? ঢাকা শহরে আমাদের একটা বাড়ি আছে। কয়জনের ঢাকা শহরে বাড়ি থাকে? তুই যদি কোনো কাজ নাও করিস তোর বউ চালানোর মতো ব্যবস্থা আমাদের আছে। কিন্তু যদি খোঁজ নিয়ে দেখি মেয়েটা ভালো তাহলে তুই বিয়েতে না করবি না। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি অনশনে বসব। তোর এই ছন্নছাড়া জীবন আমার আর ভালো লাগে না।”

“এখনই এমন চাপ দিও না মা।”

“এখনই চাপ মানে? আর কত সময় প্রয়োজন বল? ত্রিশ বছর বয়স পার হয়ে গিয়েছে। আর না হলে তুই মেয়ে দেখা। দেখিতো কত ভালো মেয়ে তুই পছন্দ করতে পারিস। যদি না পারিস তাহলে আমি যেখানে বলব সেখানেই তোকে বিয়ে করতে হবে।
কথা দে।”

“কথা দিলাম।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১৬

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ১৬

“আমাদের বাসায় আগে কোনোদিন আসেননি। আজ হুট করে আসলেন। বড়ো মামা মামীও ছিলেন। আম্মু তোকে কলেজ যেতে মানা করেছেন। এই সবকিছু তোর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? মিতুল, তুই বোকা তো না। বুঝতে পারিস নি তোকে দেখতে এসেছিল।”

“তা কী করে হয় আপু? এই লোকের সাথে ফারহা আপু বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

” তুই কিভাবে জানিস বিয়ে ঠিক হয়েছে? চাচা চাচী কী বলেছেন?”

“না। কিন্তু ফারহা আপু ছাদে এই লোকের ছবিই দেখিয়েছিল। আমার মনে আছে। এক পলক দেখেছি কিন্তু এই লোকই ছিল। ফেসবুকেও তারা কমন ফ্রেন্ড। আমি তো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে ফেললাম। এখন কি হবে? হয়তো আব্বু আম্মু জানতেন না যে ফারহা আপুর জন্য এই পরিবারের সাথে কথা হচ্ছে? হয়তো বড়ো মামার পরিচিত। তিনিই সাথে করে নিয়ে এসেছেন।”

“হতে পারে মামার পরিচিত। আব্বু আম্মুও হয়তো জানেন না। কিন্তু ওই পরিবারও কি জানতো না? তারা যদি;ফারহাকে দেখেই থাকে, তাহলে একই পরিবারের আরেকটি মেয়েকে কেন দেখতে আসবে? এটা কখন হয় জানিস? অনেক সময় পাত্রী দেখতে এসে মানুষ বড়ো বোন রেখে ছোটো বোনকে পছন্দ করে ফেলে। এমন হয়নি তো যে তারা ফারহাকে দেখতে গিয়ে তোকে পছন্দ করেছে? আর তাই তোকে সামনাসামনি দেখতে কোনো সূত্র ধরে বাসায় এসেছে।”

“ফারহা আপু বলেছিলেন তোমার বিয়েতেই ওনাদের দেখা। সম্ভবত নিচ তলার যে আরেকটা বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল তারা ওই বিয়ের অতিথি ছিল। আমাদের আত্মীয় হন। যদিও অনেক দূরের লতায় পাতায় সম্পর্ক। রাহেলা আন্টি আছে না, উনার শ্বশুর পক্ষের আত্মীয়। আমরা এই জন্য চিনি না। কিন্তু উনারা সেদিন ওই বিয়েতে ছিলেন উপরের তলায় তোমার বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। এজন্যই ফারহা আপু এত সেজেগুজে বিয়েতে গিয়েছে। আপু তো দেখলাম খুব খুশি ছিল যেমন হাজব্যান্ড চায় তেমনি পাচ্ছে এমনটাই তো বলল। আমি সত্যি বুঝতে পারছি না আপু। এখন নিজেকে বোকাই মনে হচ্ছে। ফারহা আপু দেখতে তো সুন্দর। আর চাচা চাচী আমাদের চাইতে ধনী। আমি বরং অতটা সুন্দর না। অন্তত ফারহাপুর তুলনায় না। তাহলে ফারহা আপুকে রেখে আমাকে কেন পছন্দ করবে!”

“তুই ফারহার চেয়ে কম সুন্দর? তোরা দু’জনই দু’জনের মতো সুন্দর। কারও হয়তো শরতের সাদা মেঘ ভালোলাগে, কারও বর্ষার ঘোর কালো। দুই সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।”

“যাই বলো, তারপরও বললেই হলো? আমরা কি কোন পণ্য যে উল্টাপাল্টা দেখে যেটা পছন্দ হবে সেটা নিবে? আমি এসব মানি না।”

“তোর আমার মানা না মানায় কী আসে যায়? কারা আমাদের মতামত চায়? আমার বিয়ের সময় সায়েমের সাথে দুমিনিট কথা বলার সুযোগ কি পেয়েছিলাম? অবশ্য পেলেও হয়তো লাভ হতো না। এখনো মানুষ, ভাত কাপড়ে মারে না তল কথায় মারলে কী হইছে, ধারণা নিয়েই বাঁচে।”

“মানে আপু?”

“মানে বাদ দে। শোন, তবে তুই ফ্রেন্ডশিপ রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করছিস ভালোই হয়েছে। দেখ তো ছেলেটা তোকে কিছু বলে কিনা। আন্দাজ করতে পারিস কিনা। আম্মু কিছু না বললে তোর এখন কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নাই। মিতুল তোর কোনো পছন্দ আছে?

মিতুল একমুহূর্ত চুপ থাকে। ভালোবাসার কোনো মানুষ নেই। আরমানকে মিতুলের ভালো লাগে। কিন্তু তাকে কি পছন্দের মানুষ বলা যায়। তাছাড়া আরমান তুলতুলের শ্বশুর বাড়ির মানুষ। এমন কিছু মিতুল ভাবেই নি।

” পছন্দের মানুষ বানানোর কোনো সুযোগ তো পাইনি আপু। আচ্ছা আপু, তুমি কবে আসবা?”

“কোথায়?”

“বাসায়।”

“আব্বুর বাসায়?”

“আমাদের বাসায়।”

“বাসার লোক তো আমাকে নিলো না মিতুল। এখন আমি আব্বুর বাড়ির মেহমান। দাওয়াত না দিলে মেহমান আসে না।”

“এভাবে বলো না আপু। সায়েম ভাইয়াকে বলে একদিন আসো।”

“এটাই তো ইচ্ছে করে না রে। বাদ দে। কলেজে যাব। তুই আসিস। কথা হবে। আমি কলেজ থেকে কিছু নোটস নেব। সামনে পরীক্ষা। ক্লাস তো করলাম না। মিতুল শোন।”

“বলো আপু।”

“তোর বয়সটা আমার চেয়েও কম। বিয়ের বয়স হয়নি বলব না। কিন্তু বিয়েটা পুতুল খেলায় যতটা সুন্দর। বাস্তবে তা না। মনে আছে রোমান্টিক নাটক দেখতাম আমরা। এলাকার গুন্ডা, জেদি, বখাটে ছেলেকেও বিয়ের পর ভালোবেসে কতটা বদলে দেওয়া যায় দেখাতো। সত্যিটা এমন না। বদলাতে হলে বদল হওয়ার মতো একটা মন থাকতে হয়। না হলে পাথরে মাথা ঠুকে শুধু নিজেরই মাথা ফাটে। আমার সাথে পুতুল খেলা খেলতে দিয়েছি। তোর সাথে দিবি না। সারা জীবনের সঙ্গী অন্ধ ভাবে বেছে নিস না। ভালোর সঙ্গার শেষ নেই। তোর জন্য কে কতটা ভালো তা বুঝেশুনে আগাবি।”

“মানুষ চিনব কিভাবে আপু? সবাই তো নিজের ভালোটাই দেখায়।”

“মানুষ বহুরূপী। তবু আমাদের চোখ-কান খোলা থাকলে আমরা বুঝি ভালো মানুষ আসলে শুধু নিজেকে ভালোবাসে না। তারা সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে ভালোবাসে। শুধু নিজেকে ভালোবাসে স্বার্থপর মানুষ।”

***

“কী করছো মিতুল? গত কয়েকদিন তোমার সাথে যোগাযোগ হয়নি। স্যরি মেসেজের রিপ্লাই দিতে লেট হয়ে গেল।”

“কোথায় ছিলেন আপনি? তিন দিনে একবারও মেসেজের রিপ্লাই দিতে পারেননি! অসুস্থ ছিলেন?”

“ঢাকার বাইরে ছিলাম।”

“কেন?”

“একটা কাজ ছিল।”

“চাকরিতে ঢুকেছেন বুঝি?”

“বারেহ! চাকরি ছাড়া কাজ হয় না?

“হয়। ব্যবসায়িক কাজে গিয়েছিলেন?”

“চাকরি ব্যবসা কিছুই নয়। আমাকে দিয়ে এসব হয় না।”

“তবে যে বললেন কাজ?”

“ভুল হয়েছে। একটা অকাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। সেখানে নেটওয়ার্কের অবস্থা খুব খারাপ। ফোনে কথা বলা যায়। কিন্তু ইন্টারনেটের কানেকশন দুর্বল।”

“ফোন দিতেন।”

“তুমি ধরতে? তোমার বাসায় না খুব কড়াকড়ি।”

“ফোনে প্রেম করায় কড়াকড়ি। কথা বলতে নয়।”

“যাক।”

“কী?”

“আমার তাহলে প্রেম করার উপায় নেই। তুমি তো আমাকে আগেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিলে।”

“তা কোথায়?”

“তাহলে লিস্টে আছি?”

“আরমান ভাই, ফাজলামো করবেন না প্লিজ।”

“আচ্ছা স্যরি। তবে ধন্যবাদ।”

“কেন?”

“আমাকে মনে করার জন্য। সমাজের চোখে অকর্মা লোকজনকে সহজে কেউ মনে রাখতে চায় না। সেখানে তুমি তিনদিন খোঁজ না পেয়ে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে নক করলে। এই বদ্যানতায় আমি অভিভূত।”

“খুশি হলেন? না খোঁটা দিলেন?”

“খোঁটা কেন দেব? তোমার সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক তো নাই যে তুমি আমাকে মিস করবা। মিস করে ফোন দিবা। হোয়াটসঅ্যাপে নক করেছ। এই তো বেশি।”

“আচ্ছা, বিদায় এখন। আম্মু ডাকছে।”

“বাই।”

মিতুল মনে মনে বলে, “আমি আপনাকে সত্যি মুস করছি। কিন্তু ফোন দেওয়ার মতো কোনো সম্পর্ক নেই সে কথা তো নিজেই বললেন। কী করে ফোন দেই।”

আরমানও ভাবছে, মিতুল অধিকার না দিলে, অধিকারের দাবি রাখা যায় না। মানানসইও না।

***

আনোয়ারা পারভীন, আরমানের অপেক্ষা করছেন। আরমান খেতে বসলে বিয়ের কথা তুলবেন। পাত্রী পরিচিত। দেখতে শুনতে ভালো। সবচেয়ে বড়ো কথা তারা আরমানের খামখেয়ালি স্বভাবের কথা জেনেও খুব আগ্রহী। আরনোয়ারা পারভীনের মন বলছে, বিয়ে হলে আরমান সংসারী হবে। সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল হবে। স্বাভাবিক ভাবে রাজি না হলে এবার তিনিও পিছু হটবেন না। একটা মাত্র ছেলে। এভাবে ছন্নছাড়া জীবন কাটাতে দিতে পারেন না।

***

তুলতুল স্বাভাবিক ভাবেই শ্বশুর বাড়িতে কাজ করে চলছে। জান্নাত আরা খুশিও, আবার কেমন জানি মন খচখচ করে। তুলতুল বাড়িতে যাওয়ার কথাও বলে না। তুলতুলের মা ফরিদা ফোন দিয়েছিলেন। তুলতুলকে কিছুদিনের জন্য বাড়িতে নিতে চান। বৌভাতের পর এতোদিনে আর যায়নি। তিনিও মানা করেননি। কিন্তু দেখা গেল তুলতুল নিজেই বেঁকে বসেছে। তার নাকি সামনে পরীক্ষা। এবাসা ওবাসা করলে পড়া হবে না। সিয়ামও তুলতুলকে ঘাটায় না ইদানীং। তুলতুলের ঠান্ডা ব্যবহারে প্রথমে খুব রাগ দেখালেও, এখন কেমন বিব্রত লাগে। সেদিন সেভাবে তামাশাটা না করলেই ভালো হতো মনে হয়। কিন্তু ইগোর জন্য ক্ষমাও চাইতে পারে না।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১৫

0

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ১৫

শর্মিলা আহমেদ বাসায় ফিরে স্বামী জুলফিকার আহমেদের সাথে মিতুলের বিষয়ে আলোচনা করলেন। মিতুল কে জুলফিকার আহমেদের খুব ভালো লেগেছে। মিষ্টি একটা মেয়ে। নম্র হাসিখুশি।সে তুলনায় ফারহাকে খুব একটা ভালো লাগেনি। দেখতে দু’জনই সুন্দর। কিন্তু একমাত্র ছেলের বৌ হিসেবে মিতুলের জন্যই মন টানে ওনার। শর্মিলা আহমেদ অবশ্য স্বামীর সাথে একমত নন। ওনার মনে হচ্ছে ফারহান যেমন ছেলে, যেমন তার পছন্দ তার সাথে ফারহাই ঠিক হবে। নিজের ছেলেকে চিনেন তিনি। সাধারণ কিছু তার পছন্দ না। সবকিছুই একটু বিশেষ চাই। যদিও আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তার ছেলের জেদ, একগুঁয়েমি এই সব কিছু মানিয়ে নিতে মিতুলের মতোই একটা মেয়ে প্রয়োজন। কিন্তু শর্মিলা আহমেদ ভালোভাবেই জানেন একদিকে ফারহান যেমন চৌকস তেমনি দ্বিধায় ভোগা একজন মানুষ। ছোটবেলা থেকেই ফারহানের প্রতিটি জিনিস দু তিনটি করে লাগতো। দোকানে নিয়ে গেলে যা কিনতে চায় তা একটার জায়গায় দু তিনটে তার পছন্দ হতো। শেষ পর্যন্ত তার পছন্দেই একটি কিনে দেওয়া হলেও বাসায় এনে সেটাই আর ভালো লাগতো না। কখনো সুযোগ পেলে বদলানো হতো কখনো বা ফারহান বদলাতেই চাইতো না। তার সবগুলোই লাগবে। হোক একই ডিজাইনের আলাদা আলাদা রঙ। একমাত্র ছেলে হিসেবে ফারহানের এই জেদগুলো তিনি পূরণ করেছেন। দুটি সন্তান গর্ভে মারা যাওয়ার পর ফারহানকে পেয়েছেন তিনি। তাই হয়তো শাসনের চেয়ে আদরের পরিমাণটা অনেক বেশি হয়েছে। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে তিনি বুঝতে পারছেন পরিমিত শাসনও ভালোবাসার অংশ। জীবনসঙ্গী তো কোন বস্তু নয় যে একই রকম দু তিনটে রাখবে। তিনি ভালভাবে বুঝতে পারছেন ফারহান মিতুলের সারল্যে আটকে গিয়েছে কিন্তু ফারহার মোহ থেকে এত সহজে ফারহান বের হতে পারবে এই বিশ্বাসও ওনার নেই।

“মিতুলের সমস্যা কী?”

“কোনো সমস্যা নাই।”

“তাহলে?”

“তোমার ছেলে যে পরিমাণ স্ট্যাটাস, পশ জীবন যাপন করতে ও দেখাতে অভ্যস্ত। তোমার মনে হয় না তার পাশে মিতুলকে বড়ো সাধাসিধা লাগবে। শুধু দেখতে মিষ্টি হলেই তো হলো না। বাকি আর কিছুই কি ফারহানের টেস্টের? ফারহান এখন শুধুই একই বাসার দুটো সমবয়সী মেয়ে দেখে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে। যে সিদ্ধান্তহীনতায় ও সারা জীবন ছিল। তুমি নিজেই আমাকে কয়দিন আগে কী বলেছিলে? বলেছিলে ফারহানের সব জিদ, আহ্লাদ মেনে নিয়ে ওকে আমি এমন বানিয়েছি।।আজ তুমি নিজেও ওর একগুঁয়ে জিদের কাছে বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছ না? গত একবছরে ও কতগুলো মেয়ে দেখলো নিজেই বলো? মিতুলের মতো মেয়ে কি বাকিদের তুলনায় একদম আলাদা যে ওর জন্য ফারহান মরিয়া হয়ে যাবে? নাহ্ এটা শুধুই একটা আকর্ষণ। মিতুলকে পেয়ে গেলেই ও আকর্ষণ হারাবে।”

“আমার মনে হচ্ছে ফারহানের সমস্যা না। সমস্যা আসলে তোমার। তুমি রফিক সাহেব আর শফিক সাহেবের ভেতর তুলনা করছ। তুমি তাদের স্ত্রীদের ভেতর তুলনা করছ। তাই মিতুলের চেয়ে ফারহা তোমার উপযুক্ত লাগছে।”

“আমার এখন কাউকেই উপযুক্ত লাগছে না। এখানে কোনো রকম সম্পর্কে জড়াতেই আর আমি আগ্রহী না। হ্যাঁ শফিক সাহেবের সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক অবস্থা ভালো। ওনার স্ত্রী জেসমিনও ভালো পজিশনে চাকরি করেন। একমাত্র মেয়ে ফারহার জন্য তারা সবকিছুই অনেক বেশি করবেন যা মিতুলের পরিবার করবে না। রফিক সাহেব চাইবেন যত সহজে মেয়ে ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়ে পার করা যায়। এর জন্য ওনারা ছোটো ভাইয়ের পরিবারের সাথেও ছল করলেন। দেখ না শুক্রবারের বদলে বৃহস্পতিবার যেতে বললেন। ওনাদের মা ও বাসায় ছিল না। বোঝাই যাচ্ছে ফারহার বিষয়টা ওনারা জানেন। তাই ইচ্ছে করে অপরপক্ষকে অজানায় রাখলেন। এই জানা সামনে আসলে কখনোই তা মেনে নেওয়া সহজ হবে না। পারিবারিক কোন্দলের কারণ হবে।”

জুলফিকার সাহেব আধশোয়া থেকে উঠে বসেন।

“তাহলে তুমি মিতুলের বাসায় যেতে রাজি হলে কেন?”

“ছেলের জন্য।”

“মানে?”

“ছেলে চেয়েছে মিতুলের বাসায় যেন প্রস্তাব যায়। আমি আমার মতো বোঝাতে চেয়েও বোঝাইনি। কেন জানো?”

“কেন?”

“এতে তার পাওয়ার জিদ আরও বাড়বে। ও ভাবুক নাটাই ওর হাতে আছে। ছেলের জিদে খেলনা বাড়িতে এনে দিয়েছি। কুকুর পালতে চেয়েছে, রাজি হয়েছি। ছেলের বৌ ছেলের জিদে হবে না। বৌ আমি তেমনই চাই যে ঘরসংসার বুঝবে না। স্বামী আগলে রাখা বুঝবে না। ছেলের বৌ দরকার। আমার দরকার ছেলের জন্য একটা পুতুল পুতুল মেয়ে। সাজবে, ঘুরবে, ফিরবে, আমার ছেলেকে সঙ্গ দিবে। কিন্তু ছেলে আমারই থাকবে। দিনশেষে আশ্রয়, যত্ন পেতে তাকে মায়ের কাছেই আসতে হবে। ছেলের বৌয়ের জন্য আমার কোনো বিধিনিষেধ নাই। বরং সে মুক্ত পাখি হয়ে ঘুরুক, সংসার করা না বুঝুক। তাতেই আমার চলবে। পাখি হয়ে উড়লেও উড়বে আমার করা এই সোনার সংসারের খাঁচায়। আমার ছেলেকে নিয়ে ফুড়ুৎ হওয়ার ইচ্ছেও করবে না। আর ফারহা তেমনই হতো। ছেলেকে সঙ্গ দিত, সেজেগুজে ঘোরাঘুরি করত, আরাম-আয়েশে থাকতো। সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার ঝামেলায় ও যেত না। ওর এসবে মাথাব্যথা থাকত না। মিতুল সংসারে এসেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের মতো স্বামী সংসার নিজের করে পেতে চাইবে। স্বামীর যত্ন করবে। যত্নে রত্ন মিলে। আমার একটা মাত্র সন্তান। ও বৌকে নিয়ে সুখী হোক। তা আমি অবশ্যই চাই। কিন্তু বৌ আসলে মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে না যাক। ওর পছন্দের খাবারের আব্দার আমার কাছেই করুক। ওর ছোটো ছোটো বিষয়গুলো জন্য আমার কাছেই আসুক। আমি তাই ইচ্ছে করে শেষ পর্যন্ত ওর জেদ মানার অভিনয় করলাম। যেন আমার উপর অভিমান না থাকে যে আমি ওকে ওর পছন্দের মেয়ে বিয়ে করালাম না। আমি চাই আজকের এই ঘটনা মিতুল এবং ফারহা দুজনকেই আমার ছেলের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিক। কেননা যদি মিতুলের উপরে ফারহাকে বিবেচনা করে আমি এ বাড়ির বউ করি তখন ফারহানের মনে হবে আমি ওর পছন্দ গুরুত্ব দেইনি। আবার মিতুল কেও আমি বাড়িতে আনতে চাইনা। তাছাড়া যাকেই আনবো অপরপক্ষ আত্মীয় হয়েই থাকবে। আমি আর তা চাই না। আমি অন্য কোথাও আমার ছেলের জন্য পাত্রী দেখবো।”

“আজকের ঘটনা কিভাবে এসব করবে?”

“তোমার মনে হয় এসব চাপা থাকবে? দু’পক্ষই ফারহানকে হবু জামাই ভাবছে। নিজেরা যখন নিজেদের মুখোমুখি হবে তখন সম্পর্কের হৃদ্যতা ভাঙার পাশাপাশি স্বপ্নও ভাঙবে।”

“মেয়েটা কিন্তু লক্ষীমন্ত। তুমি ভেবে দেখ। অনেক সময় আমরা পরিকল্পনা করি এক,আল্লাহ করেন আরেক। তুমি কী করে নিশ্চিত যে সব যাচাই করে যে শ্বেত শুভ্র ফুল তুমি ঘরে তুলবে। দিন শেষে তাই ধতুরা হয়ে তোমার প্রাণ নিবে না? সবকিছু ক্যালকুলেশন করে হয় না শর্মিলা। লক্ষী একটা মেয়ে হয়তো ফারহানকে আরও ঘরমুখো করতে পারে।।আমাদের কাছে নিয়ে আসতে পারে। সুতো ধরে রাখতে গিয়ে যেন এমন না হয় যে সুতোই ছিঁড়ে গেল।”

***

ফারহান মিতুলকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। মিতুল লোকটাকে চিনতে না পেরে রিকুয়েষ্ট ক্যানসেল করবে ভাবে। কিন্তু চেহারা চেনা লাগছে। কই যেন দেখেছে। নামটাও পরিচিত। “ফারহান, ফারহান” মনে মনে আওড়ায়। মনে পড়ে, ফারহার যে ছেলের সাথে বিয়ের কথা চলছে, সে ছেলের নাম ফারহান বলেছিল ফারহা। মিতুল কৌতূহলী হয়ে প্রোফাইল খুলে। হ্যাঁ, কমন ফ্রেন্ডে ফারহার নাম। পাবলিক কয়েকটা ছবি স্ক্রল করে দেখে। একটা কমিউনিটি সেন্টারে তোলা কিছু ছবি। চিনতে পারে মিতুল। এটা সেই কমিউনিটি সেন্টার যেখানে তুলতুলের বিয়ে হয়েছিল। ওনারাও সেই কমিউনিটি সেন্টারে গিয়েছিল। একটা ছবিতে লেখা ‘বাবা মায়ের সাথে’। ছবির লোকগুলোকে চিনতে পারে মিতুল। আজই এসেছিলেন ওনারা এই বাসায়। শর্মিলা আহমেদ এবং জুলফিকার আহমেদ। মিতুল অবাক হয়ে যায়। এই যদি ফারহাকে পছন্দ করা পাত্র পক্ষ হয়, তাদের বড়োমামা কী করে চিনেন! আজ এবাসায়ই বা এলেন কেন! মিতুলকে পাশে বসিয়ে অনেককিছু জিজ্ঞেসও করেছিল। মিতুল অবাক হলেও রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করে নেয়। মায়ের সাথে কথা বলার আগে তুলতুলের সাথে কথা বলবে ভাবে।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১৪

0

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ১৪

ফরিদা অবাক হয়েছেন যে স্বামী মেয়ের বিয়ে নিয়ে মায়ের সাথে আলোচনা না করে তার সাথে করছে। রফিক সাহেব সাধারণত পারিবারিক সিদ্ধান্তগুলো মায়ের সাথে আলোচনা করে নেন। ফরিদাকে জানান না বিষয়টা তেমন নয় তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর। অথচ আজ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ফরিদার সাথে কথা বলছেন। আসলে তুলতুলের বিয়ের পর নানা ঘটনা আর পরিস্থিতি দেখে রফিক সাহেব আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন। তুলতুলের জন্য তিনি তো সব দেখে বিবেচনা করেই সায়েমের পরিবারকে ঠিক করেছিলেন। সায়েমের পরিবারের সবাই শিক্ষিত এবং সামাজিকভাবে সম্মানিত। সায়েম নিজেও ভালো একটি চাকরি করে। তাদের তেমন কোনো দাবি দাওয়াও ছিল না। রফিক সাহেব একটু হিসেবী মানুষ। তিনি চেয়েছিলেন অল্প খরচের ভেতরেই মেয়ের ভালো বিয়ে দিতে। তাই সায়েমের পরিবারকে ভালোই মনে হয়েছিল। আর তা পেরেছিলে না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব হিসেব আসলে এভাবে হয় না। ঘর বর ভালো হলেই মেয়ে সুখী হবে এই নিশ্চয়তা নেই। তারা কিছু চায়নি, কিন্তু না পেয়ে খুশিও হয়নি। চাইতে হবে কেন? উপহার আসবে স্বতঃস্ফূর্ত। আর তা হয়নি বলে তুলতুলের শাশুড়ি যে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন তা তার আচরণ এবং কথায় বোঝা গিয়েছে। তিনি কথায় কথায় বলেছিলেন, “আমরা কিছু চাইনি আপনারাও কিছু দেননি। ঠিকই আছে আমরা তো ঘরের এর জন্য ভালো একটা বউ চেয়েছিলাম জিনিস নিয়ে তাই আমাদের মাঝে কোন আক্ষেপ ছিল না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমরা তো ঠকেই গেলাম না লক্ষী এলো, না লক্ষ্মীর মত বউ এলো।”

মিতুল আর তুলতুলের মাঝে বয়সের পার্থক্য খুব কম, তবু আরো কিছুদিন পর মিতুলের বিয়ে দিতে চাইছিলেন। একসাথে দুই মেয়ের বিদায় বাবা হিসেবে তার জন্য কষ্টের। কিন্তু রাহেলা ফোন করেছিল। রাহেলা রফিক সাহেবের দূর সম্পর্কে আত্মীয়। রাহেলস বললেন বিয়ের অনুষ্ঠানে মিতুল কে দেখেছে ছেলে। ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে। যদিও রাহেলা আরেকটি কথাও বলেছে যে এই ছেলের প্রস্তাব রাহেলা দিয়েছে ফারহার জন্য। কিন্তু ছেলের পছন্দ হয়েছে মিতুলকে। নিঃসন্দেহে ছেলেদের পারিবারিক অবস্থা ভালো। আর কোন ভাই বোন নেই। একমাত্র ছেলে এবং ছেলের কথাই শেষ কথা। অর্থাৎ তুলতুলের স্বামীর মত মায়ের কথায় পরিচালিত হওয়ার ছেলে নয়। এই কথাটা জেনে রফিক সাহেবের মনে হচ্ছে আগেরবার এই বিষয়টাকে তিনি গুরুত্ব দেননি। সেবার সায়েম তো বিয়ের আগে তুলতুলকে দেখতেই আসিনি। সায়েমের মা আর বোন দেখে গিয়ে আংটি পরিয়েছে। মা বোনের উপর কথা বলে না, এমন ছেলে সমাজে ভদ্র নামে পরিচিত ঠিকই। কিন্তু তারা স্বামী হিসেবে আসলে খুব একটা ভালো হয় না। স্বামী হওয়ার জন্য উশৃংখল বা বেয়াদব ছেলে হতে হবে তা নয়। তবে অন্তত মেরুদণ্ড সোজা থাকা প্রয়োজন। আর এখানেই রফিক সাহেবের মনে হয়েছে সায়েম কখনোই তুলতুলের জন্য তার পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবেনা। বরং সময়ে সময়ে সায়েম নিজেই তুলতুলের পথটা কঠিন করে দিবে। এবার তাই তিনি এমন পাত্র চান যার কথাই পরিবারে শেষ কথা হবে।

“ফরিদা, তুমি মা মেয়ের বিয়ের ভালো-মন্দ তোমার সাথে আমার আলোচনা করা উচিত। তুলতুলের বিয়ের সময় তুমি আমাকে বলেছিলে যে তুলতুলের শ্বশুর বাড়ির লোকজন, বিশেষ করে শাশুড়িকে তোমার খুব একটা সহজ সরল মানুষ লাগছে না। অথচ আমি তোমার এই কথার গুরুত্বই দেইনি। আমার কাছে মনে হয়েছিল বিয়ের জন্য ছেলে কী চাকরি-বাকরি করে, ছেলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা কেমন সামাজিক মর্যাদা কেমন এসবই জরুরী। বাকি ছেলের মেজাজ মর্জি কেমন, শাশুড়ি ননদ কেমন এসব মেয়ালী বিষয়। এসবের কোনো গুরুত্ব নাই। আম্মাও বললেন মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে মানিয়েই চলতে হয়। এই মানানো যে এত জটিল বিষয়, মেয়ে বিয়ে না দিলে বুঝতাম না।”

“আপনি নিজেরে দোষ দিতেছেন কেন? এইটা তুলতুলের ভাগ্য। আর কম-বেশি শ্বশুর বাড়ি এমনই হয়। কারো একটু বেশি মানাইতে হয় কারো কম। আম্মা ভুল কিছু বলেন নাই। আমরা তুলতুলরে যদি কথায় কথায় এভাবে নালিশ করতে দেই সেটাই বরং ওর জন্য ক্ষতি। আম্মা ঠিকই বলছেন নতুন নতুন এত কথায় কথায় তুলতুলের জবাব দেওয়া ঠিক না। শ্বশুর বাড়িতে একটু মুখ কম চালানো ভালো। বোবার শত্রু নাই। আমি এত কইরা মেয়েরে বুঝাইলাম যে ওই বাড়িতে শুরুতেই যেন ঠাস ঠাস উত্তর না দেয়। প্রথমদিকে সবকিছুই একটু বেশি চোখে লাগে। কয়দিন মুখটা বন্ধ রাখলেই ভালো। কিন্তু মেয়েটা কথা বুঝলে তো। আরে পারিবারিক বিয়ে জামাইয়ের সাথে এখনো কোনো রকম ভাব ভালোবাসাই হয় নাই এখন তো জামাই মায়ের হয়েই কথা বলবে। তুলতুলের আগে নিজের জায়গা বানাইতে হবে। সেটা না করে তাই করল যা ভয় পাইছি। শুনেন ও যদি ফোন দেয় আমরা খোঁজখবর নেব। কিন্তু ওরে নালিশ করার সুযোগ দেয়া যাবে না। তা হইলে মেয়ের কোনদিনও শশুর বাড়িতে মন বসবে না। শ্বশুর বাড়িতে আমরা কি কম শুনছি? এমন কথায় কথায় বাড়ি চলে যাব বললে আর চব্বিশ বছর সংসার করা লাগতো না।”

“এখন মিতুলের ব্যাপারটা কী করা যায়? মিতুল কে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিব না ভাবছি। তাছাড়া প্রস্তাব নাকি ফারহার জন্য ছিল। শফিক আর জেসমিন রাগ করে যদি।”

“ভালো হইলে মানা করবেন কেন? খোঁজ খবর নেন। আর কথা তো হইতেই পারে। ফারহার সাথে তো কথা আগায় নাই। আগালে তো শুনতাম, জানতাম। ছেলে বিয়ের অনুষ্ঠানে মিতুলকে দেখে পছন্দ করছে। আমাদের তো কোনো হাত নাই। রাহেলার আত্মীয় স্বজন সব ধনী মানুষ। ভালোই হবে।”

“এই শুক্রবার ছেলের বাবা মা আমাদের বাড়িতে আসতে চায়। তাহলে হ্যাঁ করে দেই? আসুক সামনাসামনি কথা বলি। শফিক আর জেসমিনরে কী বলবা?”

“কিছু বলার নাই। এখনো তো কিছু ঠিক হয় নাই। শুক্রবার না, ওনাদের বৃহস্পতিবার আসতে বলেন। দুপুর বেলা আসুক। জেসমিন আর শফিক ভাই ওই সময় অফিসে থাকে। আগে আমরা কিছু কথাবার্তা বলি। শুধু শুধু তুলতুলের মত আগেভাগেই সবাইকে জানানোর কিছু নাই। যদি আপনি কিছু মনে না করেন তাহলে আম্মাকে একটু আপার বাসায় দিয়ে আইসেন। আম্মা থাকলে জেসমিন আর শফিক ভাই ও সব জানতে পারবে তখন দেখা যাবে আরেক ঝামেলা। এর চেয়ে আগে নিজেরা বসি, আমি ভাইজান আর ভাবিরে খবর দেব। ভাইজান মুরুব্বি মানুষ। ওনাদের সাথে কথা বলে ভালো লাগলে আগাবেন। তখন না হয় সবাই জানল। আমার পরামর্শ চাইলেন তাই বললাম এমনিতে তো কিছু বলার সুযোগই পাই না।”

রফিক সাহেব এবার স্ত্রীর কথাই রাখলেন। মেয়েদেরও কিছু বলেনি। বৃহস্পতিবার নিজের অসুখের বাহানা করে ফরিদা মিতুলকে বাসায় রেখে দেন। রাতুলকেও মামা বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কথা ছিল অনানুষ্ঠানিক ভাবে কথাবার্তা হবে। তাই সবকিছু একদম ছোটো পরিসরেই রাখা হয়
দুপক্ষের অল্প কয়েকজন মানুষ আসেন। ফারহানের বাবা অবসরে গিয়েছেন। কোনো কাজের চাপ নেই এখন। তাই দুপুরে আসতে কোনো আপত্তি ছিল না। ফারহানের অফিস ছিল।নতাই আসা হয়নি। মিতুলও আন্দাজ করতে পারেনি কারা এলো। ফরিদা এবার কনে দেখা ধরনের কিছুই করেনি। মিতুল স্বাভাবিক ভাবে চা নাস্তা নিয়ে গিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি তার জন্য পাত্র দেখতে পারে সে ধারণাই তার নেই। ধরেই নিয়েছে বাবার ব্যবসা সংক্রান্ত পরিচিত কেউ। এমন মানুষেরা মাঝেমাঝেই মিতুলের মামার সাথে আসেন মিতুলদের বাসায়। মিতুলের মামা আর বাবা একই ব্যবসা করেন। বেশকিছু কমন পরিচিত মানুষ আছে ওনাদের।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১৩

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ১৩

ফারিহা অস্বস্তিতে ভুগছে। ফারহান কী চাইছে বুঝতে পারছে না। মোটামুটি নিয়মিত এখন তাদের ফেসবুকে চ্যাট হয়। ফারিহা স্পেস দিচ্ছে রোমান্টিক লাইনে আগানোর, অথচ ফারহান যেন ইশারা বুঝেও বুঝতে পারছে না। এখন বিষয়টা ফারিহার ইগোতে এসে দাঁড়িয়েছে। সবসময় ফারিহা এটেনশন পেয়ে অভ্যস্ত, দিয়ে নয়। অথচ এই ছেলেকে সুযোগ দেওয়ার পরও পিছলাচ্ছে। চিন্তিত ফারহার মা জেসমিনও। রাতে ঘুমুতে এসে স্বামী শফিক সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন,

“আচ্ছা, জুলফিকার সাহেবের সাথে তোমার কোনো যোগাযোগ হয়েছে?”

“কোন জুলফিকার সাহেব?”

“আশ্চর্য! ফারহার একটা প্রস্তাব আসলো না? ছেলের নাম ফারহান, তার বাবা জুলফিকার সাহেব।”

“ওহ। ওনার সাথে তো আমার সরাসরি পরিচয় নাই। আলাপচারিতা যা হয়েছে তা তো রাহেলার জামাইয়ের মাধ্যমে। কেন বলো তো?”

“আর কেন? একটু গল্প করতাম এই জন্য।”

“এ্যাঁ?”

“কী ভ্যা ভ্যা কর? কী জন্য আবার? ওনারা ফারিহার বিষয়ে কিছু জানালেন না যে?”

“বাদ দাও না। আমরাও তো কিছু জানাইনি।”

“আমরা আবার কী জানাব? আমি তো রাহেলাকে সেদিন রাতেই বলেছি যে আমাদের দিক থেকে পজেটিভ। রাহেলা বললো ছেলের পরিবারও পজেটিভ। শীঘ্রই কথা আগাবে। এরপর আর খবর নাই।”

“আরে দিন গেল কয়টা? গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করতেও তো আনইজি লাগে। তবে তাদের তরফ থেকে না হলে তো তারা জানাতেন। বিয়ে শাদীর বিষয়, মানুষ সময় নেয়। কয়দিন যাক আমি খোঁজ নেব।”

“এ কী ধরনের আচরণ? না বলবে কেন? আমাদের মেয়ে কী ফেলনা? সবদিক থেকে পজেটিভ হওয়ায় তো আমরা মেয়ে দেখালাম। না হলে আমি ফারহাকে এভাবে কারও সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে পাঠাতাম? দুই পরিবারে সব কথাবার্তা মিললো বলেই তো ছেলেমেয়েকে একসাথে কথা বলার সুযোগ দিলাম। আমার কানে তো আরেকটা খবর এসেছে।”

“কী খবর?”

“ওরা নাকি আরও মেয়ে দেখেছে সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে। ফারিহাই একমাত্র কন্যা ছিল না। এ কেমন কথা? ছেলের জন্য একসাথে একাধিক মেয়ে দেখেছে, তাও একই জায়গায়!”

“এটা কেমন কথা। না না এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। আমি তো জহিরের সাথে কথা বলব। রাহেলা তো এমন কিছু বলেনি। আমি ভাবলাম বিয়ে শাদীর বিষয়, মানুষ সময় নেয়। কিন্তু এসব কী? কী ঘোড়ার ডিম হয়ে গিয়েছে পাত্র পক্ষ? আমার সামাজিক অবস্থান কোনো অংশে কম নাকি? ওরা কী জানাবে আমিই জহিরকে মানা করে দেব।”

“আস্তে, উত্তেজিত হইয়ো না। হুট করে মানা করে দিবে কী? ফারিহার ছেলেকে পছন্দ হয়েছে বুঝেছি। ইনিয়েবিনিয়ে জানতে চেয়েছিল ওরা কিছু জানিয়েছে নাকি। এখন হুট করে না হয়েছে শুনলে মেয়ে মনে কষ্ট পাবে না।”

“ও মনে কষ্ট পাওয়ার কী আছে? ওর কী প্রেম ছিল যে কষ্ট পাবে! তাছাড়া আমরা রিজেক্ট করব। কারও সাহস আছে নাকি আমার মেয়ে রিজেক্ট করবে।”

“উফ্ জ্বালা তোমার সাথে কথা বলা মুশকিল। রিজেক্ট তো এখনো ওরাও করেনি। এই বিষয়ে তুমি রাহেলার বর মানে জহির ভাইয়ের সাথে আগে কথা বল। একাধিক কন্যা দেখার বিষয়টা লুকানোয় যে আমরা মনোক্ষুণ্ণ হয়েছি তাও জানিও। দেখ কী বলে। আগে জানি তো এই চুপচাপ থাকার কারণ কী।”

***

টুংটাং ম্যাসেজে মিতুলের সাথে আরমানের কথা জমে উঠে। খুবই সহজ সাধারণ চ্যাট। আরমানের ভালো লাগে। যদিও বয়সের পার্থক্যটা ওকে মনে মনে খুব খোঁচায়। তবু নিজেকে নিভৃত রাখতে পারে না। মিতুলের চপলতা, সহজ সরল আচরণ, অকৃত্রিম মানসিকতা তাকে ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করে। মিতুলের দিক থেকে বিষয়টা যে তেমন নয় বুঝে। হয়তো মিতুল তাকে সেই নজরে দেখেই না। অথবা যেমন ছেলে মিতুল চায়, তেমনটা আরমান নয়। আজকাল মেয়েরা অনেক বৈষয়িক হয়। ভালো ক্যারিয়ার, কেতাদুরস্ত চলাফেরা, সিকিউরড লাইফ তাদের কাছে বেশি কাম্য। ওসব কবিতা আর কল্পনার দুনিয়া তাদের টানে না। মিতুলের দিক থেকে তেমন কোনো ইশারা পায় না বলেই আরমানের প্রপোজ করার সাহস হয় না। তবু সময়ে সময়ে মিতুলকে ইনবক্সে নক করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা হয় না।

***

তুলতুলের দিনগুলো যাচ্ছে নিস্তরঙ্গ। নতুন বিয়েতে যে পাগলামি টান, আদর ভালোবাসার মাখামাখি থাকার কথা। তার কিছুই যেন নেই। রাত যায় দিন আসে। শারীরিক বিষয়গুলো নিয়ম করে হয়। তুলতুলের ভূমিকা থাকে পুতুলের মতো। তুলতুলের এই নিস্প্রভ আচরণে সায়েমের বিরক্ত লাগে। তুলতুলের এই ঠান্ডা আচরণ একধরণের বিদ্রোহ বুঝেও কিছু করতে পারছে না, মানতেও পারছে না।

***
“ফরিদা, একটা প্রস্তাব এসেছে।”

“কিসের প্রস্তাব?”

“মিতুলের জন্য। ছেলের নাম ফারহান। বংশ ভালো, চাকরি ভালো। কথা আগাব ভাবছি। কী বল?”

“কী বলেন! কিভাবে কী হইলো?”

“আসো বসো বলি।”

ফরিদা অবাক হয়ে স্বামীর পাশে বসে। শুনে সবটা।

(চলছে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১২

0

ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব- ১২

সায়েম তুলতুলের উপর রাগ করে লম্বা সময় কথা বলছে না। তুলতুল কী করবে বুঝতে পারছে না। রাগ করার কথা ওর, ভুল আচরণ তার নয় সায়েমের ছিল। অথচ সায়েম এমন ভাব করছে যেন তুলতুলই দোষ করেছে। এই বাড়িতে সায়েমেই তুলতুলের সবচেয়ে আপন, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্য ওর সায়েমকে প্রয়োজন। অথচ সায়েমই যেন আরেক পরীক্ষার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“আপনি আমার সাথে কথা বলছেন না কেন?”

“কী বলব?”

“না মানে সকাল থেকে মনে হচ্ছে আমাকে এভয়ড করছেন। রাগ দেখাচ্ছেন।”

“এমন কেন মনে হলো? আমি কি তোমাকে বকেছি? ”

“বকেননি, কিন্তু কথাও তো বলছেন না। সারা দুপুর আলাদা থাকলেন।”

“আলাদা থাকলাম মানে? আপু আজ সন্ধ্যায় চলে যাবেন। আম্মুর রুমে ভাইয়া আর আপুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আলাদা থাকা মানে কি? বিয়ে হয়েছে মানে কী এখন রাত দুপুর সবসময় তোমার সাথে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকব?”

“আমি তাই বলেছি! আমাকেও ডাকতে পারতেন। আমিও আপনাদের আড্ডায় শরীক হতাম।”

“ডাকতে হবে কেন? তুমি কি মেহমান? নিজে এসে বসতে পারো না? আপু কত মনে কষ্ট নিয়ে বললো যে আজ চলে যাবে অথচ তুমি রুম থেকেই বের হও না।”

“আমি নতুন বৌ। আপনারা ডেকে না নিলে আমি নিজ থেকে গিয়ে বসে থাকতে পারি? আর সারাদিন আমি সবার সাথেই ছিলাম। দুপুরে খাবার খাওয়ার পর রুমে এসেছি।”

“তুলতুলে, তুমি ভীষণ তর্ক বাজ। মুখে মুখে উত্তর দিয়েই যাচ্ছ। যাই হোক, এটিচিউড না বদলালে আমার সাথে কথা বলতে আসবে না।”

তুলতুল মাথা পুরোই ফাঁকা হয়ে যায়। সে কি সায়েমকে স্যরি বলবে? কিন্তু কেন বলবে? করেছি কী? উচিত কথাটা বলেছে এই তো।

শেলী অবশ্য বিদায় নেওয়ার আগে আর নতুন করে কিছু করে না। জান্নাত আরাকেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। শেলী আর যুবায়েরের বিদায়ের পর জান্নাত আরা কিছুক্ষণ রেস্ট নিবেন ঠিক করেন। সায়েম নিজের রুমে না এসে মায়ের রুমেই গিয়ে বসে। তুলতুল যখন ও ঘরে যায় দেখে সায়েম মায়ের পাশে আধশোয়া হয়ে গুটগুট করে গল্প করছে। তুলতুলের শ্বশুর বাইরে হাঁটতে গিয়েছেন। তুলতুলকে ঢুকতে দেখে সায়েম কথা বন্ধ করে দেয়।

“কী তুলতুল, কিছু বলবা?”

“না এমনি আপনাদের সাথে গল্প করতে আসলাম। আপু চলে গেলেন আপনার নিশ্চয়ই মন খারাপ।”

“মেয়ে তো এখন মেহমান। বেড়াতে আসবে যাবে এই স্বাভাবিক। তোমার বিয়ে হয়েছে তুমিও বুঝবা। বাবার বাড়ির মায়া না কমালে স্বামী, শ্বশুর বাড়িকে আপন করা যায় না৷ স্বামীর মান,শ্বশুর বাড়ির মান এসব মেয়েদের বুঝতে হয়। আমার মেয়েকে তো আমি সেই শিক্ষা দিয়েছি। ছিল তো তোমার চোখের সামনে। দেখেছ তো স্বামীকে কেমন মাথায় তুলে রাখে। তুমি বিয়ের দুইদিনও না যেতে মুখেমুখে তর্ক করো, ভুল ধরো। আসলে এক দুই দেখায় মেয়ে পছন্দ করতে হয় না। খানদানি মেয়ে না হলে আসলে স্বামী শ্বশুর বাড়ির সম্মান যে নিজের সম্মান তা বোঝে না।”

তুলতুল থ হয়ে যায়। এতক্ষণ রাগ করেনি, অভিমান করেনি বললেও ঠিকই মায়ের কাছে সময় মতো নালিশ করেছে। নিশ্চয়ই দুলা ভাই সামনে থাকায় বোনের কানে তুলতে পারেনি। কিন্তু এখন সুযোগ পেয়েই মায়ের কানে তুললো।

“আমি কি কিছু করেছি মা? অজান্তে ভুল হলে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু আমার জানামতে আমি স্বামী, শ্বশুর বাড়ির অসম্মান হয় এমন কোনো আচরণ করিনি।”

জান্নাত আরা উঠে বসেন।

“তুমি সায়েমের সাথে রাগ দেখাওনি? তোমাদের বাড়ির দুটো সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলতেও পারবে না সায়েম। তোমার মা বাবাকে তো বলে নাই। আমাদের বলছে। এই শিক্ষা আমার ছেলেমেয়েকে দিয়েছি। তারা অন্যের বাড়িতে গিয়ে এমন আচরণ করে না।”

“আচ্ছা।”

“কী আচ্ছা?”

তুলতুল চেয়ার টেনে বসে।

“এখন থেকে রাগ,অভিমান, বদনাম যা করার রাস্তায় গিয়ে করব। এখানে করা যাবে না।”

“এর মানে কী?”

“না মানে তাহলে আমি এগুলো করব কোথায়? আমি তো মা কিছুই বুঝতেছি না। মা, দাদী বিদায় দিতে গিয়ে বললো এখন থেকে এই আমার বাড়ি। স্বামী, শাশুড়িই আমার আপন। আবার এখানে শুনছি এটা শ্বশুর বাড়ি, রাগ দেখাতে হলে নিজের বাড়িতে গিয়ে করতে। অথচ নিজের বাড়ি তো নাই। আপাততঃ কখনো খুব কষ্ট পেলে, রাগ হলে রাস্তায় গিয়ে কতক্ষণ চিল্লাচিল্লি, কান্নাকাটি করে আসব।”

সায়েম আধশোয়া থেকে উঠে বসে, “বলছি না আম্মু, অসম্ভব তর্কবাজ মেয়ে। ঠান্ডা মাথায় কেমন উত্তর দেয় দেখ। তুমি বলছিলা ঠান্ডা স্বভাবের। কিন্তু একেই বলে মিচকে শয়তান।”

***

বিয়ের কয়েকদিন না যেতেই তুলতুলের বিচার বসতে সময় লাগে না। রফিক সাহেব, ফরিদা আর মাকে নিয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি আসেন। চেয়েছিলেন ভাইকেও বলতে। কিন্তু ফরিদা দেয়নি। যতবেশি মানুষ জানবে তত কথা ছড়াবে। এমনি তুলতুলকে দেখতে দাদীর খুব ইচ্ছে করছে, এই বাহানা দিয়ে এসেছেন। যদিও মিতুলের চাচী কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছন কোনো সমস্যা কিনা। ফরিদা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। মিতুল, রাতুলকে নিয়ে আসা হয়নি। মিতুল বুঝতে পারছে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু কী, তা বুঝতে পারছে না।

“শোনেন বেয়াই সাহেব, আমার যখন বিয়ে হয়, আমার বয়স তখন মাত্র সতেরো বছর। আমার তিন ননদের দুই ননদ বয়সে আমার বড়ো ছিল। তাদের বিয়ে হয়েছে আমার বিয়ের পর। এই যে আপনার সামনে সায়েমের বাবা আছেন, জিজ্ঞেস করেন তিন ননদ নিয়ে কতবছর সংসার করেছি। সবার মন জুগিয়ে চলেছি। নিজের দোষ থাক না থাক, যখন কেউ শাসন করেছি মেনে নিয়েছি। এই যে শাশুড়ি তো সামনেই আছেন। বলুক মিথ্যা বলছি না সত্য। অথচ আপনার মেয়ে এ বাড়িতে আসার সপ্তাহ পার হয়নি, এখনই মুখেমুখে তর্ক করে। স্বামী মানে না, শাশুড়ি মানে না। ছেলে মা বোনের সাথে সময় কাটাবে তা পছন্দ করে না। এসব নিয়ে আমার ছেলের সাথে রাগ দেখায়। বলেন তো, বড়োলোক ঘরের দুলালী বৌ করো আনিনি। যৌতুক নেইনি।।শুধু চেয়েছি একটা ভদ্র ছেলের বৌ। তাহলে পেলাম টা কী? আমাদের একমাত্র ছেলে, কত প্রস্তাব হাতে ছিল। কত সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিত, ধনী পরিবারের মেয়ের বাবারা মেয়ে দিতে বসে ছিল। কিন্তু শেষে তো আমরাই ঠকে গেলাম। এমন বৌ আনলাম যে স্বামীকেও মানে না। আমার ছেলের কাছে আমি নিজেই ছোটো হলাম। মেয়ে তো আমার পছন্দের ছিল। ভুল তো আমি করছি।”

রফিক সাহেবের মাথা ভোঁভোঁ করছে। তুলতুল এত বেয়াদব, মুখরা, জেদী এসব তিনি বাবা হয়ে এই তেইশ বছরে বোঝেননি, যতটা এনারা কয়েকদিনেই বুঝে ফেলেছেন!

ফরিদা মেয়েকে বাদ দিয়ে মেয়ের জামাইয়ের দিকে তাকান। সায়েম মায়ের পাশে পিট সটান করে বসে আছে। বিচারকের ভঙ্গিতে। শ্বশুর বাড়িতে স্বামী নিজের না থাকলে মেয়েদের আর কিছুই থাকে না। এখানে ওনার মেয়েটার তাহলে আপন কেউই নেই।

তুলতুল নিঃশব্দে কাঁদছে। একদিন আগেও যে আত্মবিশ্বাস তার নিজেকে নিয়ে ছিল। তা গুঁড়িয়ে দিতেই যেন আজ এই বিচার সভা। বাবা মায়ের লালনপালন, শিক্ষা যত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, ততটাই মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে তুলতুল।

“আব্বু, আমি বাসায় যাব।”

***

রফিক সাহেব খেতে বসেছেন। খাওয়া গলা দিয়ে নামছে না। সে বাসায়ও তেমন কিছু মুখে দিতে পারেননি। মেয়ের বিচার বসলে সেখানে বসে খাওয়া যায় না। মেয়েদের খুব আদরে বড়ো করেছেন তা নয়। কিন্তু হেলাফেলা অবহেলা করেছেন সেটাও নয়। হ্যাঁ তিনি মেয়েদের বিষয়ে হিসেবি মানুষ ছিলেন। এরজন্য মেয়েরা মাঝেমাঝে অভিমান করলেও কোনোদিন অভিযোগ করেননি। রাতুলের জন্য অতিরিক্ত কিছু বাসায় আসলে হিংসা করেনি। সাধ্যের বাইরে কিছু চেয়ে জেদ করেনি। সেই মেয়ে হঠাৎ বেয়াদব, জেদি, হিংসুটে তকমা পেয়ে যাওয়াটা ওনার জন্য একটা বিস্ময়ই। মেয়েটা কী বেদনার্ত কণ্ঠে বলেছিল, “আব্বু, আমি বাসায় যাব।”

তিনি মেয়েকে না নিয়েই চলে আসলেন। মেয়েটা নিশ্চয়ই কত কষ্ট পাচ্ছে মনে। কিন্তু তুলতুলের মা আর দাদী তুলতুলকে আনতে দিলেন না। ওনাকে কথাই বলতে আটকালেন। বরং মেয়ে অবুঝ, না বুঝে হয়তো এমন করেছে। আর এমন মুখেমুখে তর্ক করবে না বলে সায়েম আর জান্নাত আরার মন ভুলিয়েছেন। তুলতুলকে সায়েমের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হলো। শেষমেষ সায়েমের বাবা আর দাদীর হস্তক্ষেপে ক্ষমা পর্ব সমাপ্ত হয়। সায়েমের দাদী তুলতুলের মুখ আঁচল দিয়ে মুছে জড়িয়ে ধরে রুমে নিয়ে গেলেন। এমন হুট করে বিচার সভা ডাকায় জান্নাত আরাকে ভৎসনাও করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে জান্নাত আরা আর সায়েমের ইচ্ছায় এই বিচারসভা বসেছে। সায়েমের দাদীকে এসব জানানার কোনো প্রয়োজন তিনি ভাবেননি। আর সায়েমের বাবার মুখ স্ত্রীর সামনে কতটা খোলেন, বোঝাই গিয়েছে।

বাসার পরিবেশ থমথমে দেখে মিতুল কিছু জিজ্ঞেস করে না। কিন্তু জানার জন্য ছটফট করতে থাকে। বোনের কাছে ফোন না দিয়ে ম্যাসেজ করে। সবকিছুনা বুঝতে পারলেও তুলতুলের ফিরতি ম্যাসেজ থেকে জানতে পারে আজ কী হয়েছে। বোনের সাথে কথা বলতে মিতুলের মনটা অস্থির হয়ে আছে। বুঝতে পারছে তুলতুল কষ্ট পাচ্ছে। খুব কষ্ট পাচ্ছে।

***

তুলতুল দাদী শাশুড়ির রুমেই ছিল লম্বা সময়। ইচ্ছে করছে রাতে ভাত না খেতে, নিজের রুমে না যেতে।

“নাত বৌ, তোমারে বুদ্ধিমান ভাবছিলাম। তুমি আমার কথার মানে বুঝ নাই। তুমি ভাবছ সায়েমরে তুমি রাগ দেখাইয়া, চোখে চোখ রাইখা শায়েস্তা করবা। তা সম্ভব না। একসময় তোমার শাশুড়ির জায়গায় আমি আছিলাম। আমার তিন মাইয়া আছিল। একমাত্র পোলার বৌ, মাইয়াগো বিয়া দেওনের বাকি। পোলার তাড়াতাড়ি বিয়াতে আমার মত আছিল না। কিন্তু তোমার শ্বশুর বিয়া ঠিক করলো। আমি না করতে পারি নাই। বৌ আসলো, আমার খেয়াল ছিল ছেলে বৌয়ের নেওটা জানি না হয়। সফলই আছিলাম। মাইয়াগো বিয়া দিলাম। শরীরের শক্তি কমলো। তোমার শাশুড়ির হাতে সংসার গেল। তোমার শাশুড়ি চালু মাইয়া আছিল। সে বুঝছে শাশুড়ি কাছ থেইক্কা পোলারে আলাদা করার চাইতে, স্বামীরে নিজের করা সহজ। আমার পোলাও আরেক সায়েম আছিল। মা বইনের উপর নির্ভরশীল। মা যখন দুর্বল, বোনরা দূরে, আস্তে আস্তে বৌয়ের উপর নির্ভরশীল হইয়া গেল। তখন মায়ের সামনে বৌয়ের জন্য জবান ছুটতো না। এরপর বৌয়ে উপরও আর জবান চলে না। কিন্তুক একটা ভুল সেও করছে। ছেলেরে মা বইনের উপর নির্ভরশীল বানাইছে। আমারে দেইখাও শিক্ষা নেয় নাই। এই রকম পোলারা মেরুদণ্ড ছাড়া হয়। এরা কোনোদিন কালারে কালা, ধলারে ধলা কইতে পারে না। এদের সাথে টিক্কা থাকতে হইলে কৌশলী হইতে হইব।”

তুলতুল এরপর উঠে নিজের রুমে চলে যায়। বুঝতে পারছে দাদী ওকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছেন আসলে। শাশুড়ি বৌয়ের মানসিক দ্বন্দ্বের গুটি হিসেবে তুলতুলকে জান্নাত আরার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে জান্নাত আরাকে তারই ঔষধের স্বাদ দিতে চাইছেন।

চলবে

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১১

0

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ১১

ফারহা খুশি মনে বাসায় আসে। গতকাল রাতেই আজ দেখা করার প্ল্যান হয়েছিল। যদিও মায়ের সাথে এ নিয়ে ফারহার কোনো কথা হয়নি। জানে ফাইনাল কথা না হওয়ার আগে মা জীবনেও একসাথে ঘোরার অনুমতি দিবে না। কিন্তু ফারহান যখন ওকে একসাথে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দিলো, ফারহা না করার প্রশ্নই আসে না। যদিও আগ্রহটা ফারহার দিক থেকেই বেশি ছিল। ফারহা গতকাল লম্বা সময় ফারহানের সাথে চ্যাট করেছে। নানা কথায় বলেছে এরেন্জ বিয়ে নিয়ে ওর ভয় লাগে। মনে হয় হুট করে অচেনা কারও সাথে বিয়ে হলে যদি মানসিক মিল না হয়? তাই যার সাথে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে, তাকে আগে কিছুটা জানার, বোঝার ইচ্ছে ফারহার। তখন ফারহান প্রস্তাব দেয় একসাথে কফি খাওয়ার। ফারহা জানতো এভাবে বললে ফারহান ঠিকই দেখা করবে। ফারহার মা একটু চিন্তিত। কারণ বেশকিছুদিন পার হয়ে গেলেও ফারহানদের বাসা থেকে এখনও হ্যাঁ না কিছু জানানো হয়নি। যদিও ফর্মাল মেয়ে দেখা ছিল না। তাও এরপর কিছু না কিছু তো জানানোর কথা। ফারহাকে কেউ হুট করে কিছু না জানিয়ে না করার কথা না। ফারহা নিজেও আত্মবিশ্বাসী ছিল। যদিও ফারহানকে দিয়েই তার জন্য প্রথম ছেলে দেখা। চাকরি, পরিবার, ছেলে সব যাচাই করে এই প্রথম কোনো ছেলের ব্যাপারে আগানো হলো। ফারহা একমাত্র মেয়ে। মেয়ের জন্য একজন রাজপুত্র না হলেও, দেখতে শুনতে, পারিবারিক এবং আর্থিক অবস্থাও ভালো এমন পাত্রই তারা চান।

ফারহানদের পরিবার থেকে সরাসরি কোনো কিছু জানানো না হওয়ায় ফারহা নিজেই কথা চালিয়ে যায়। ফারহানের সাথে কথা বলার সময় ফারহার মনে হয়নি সে অনাগ্রহী। তাহলে কথা কেন বাড়াচ্ছে না তাই বুঝতে চেয়েছিল। তাই নিজেই আগ্রহী হয়ে একান্তে দেখা করার বিষয়টা তোলে। ফারহান সহজেই টোপ গিলেছে। অথবা হয়তো টোপের অপেক্ষায়ই ছিল। ফারহান আধুনিক ছেলে, হুট করে এক দেখায় বাবা মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে করে ফেলার মতো না। সে তো মিতুলের বর সায়েমের মতো না। ফারহা তাই নিজেই উদ্যোগ নিয়েছে। ভালো লেগেছে খুব। ক্লাস থেকে আগেই বের হয়েছিল। আগেই বলেছিল পার্কে বসতে পারবে না। এসব বাদাম চিবিয়ে, ধুলা হাওয়া খেয়ে ডেট করা মেয়ে ফারহা না। ফারহানও নিজের ক্লাস বোঝাতে সময় নেয়নি। সুপরিচিত কফি শপে নিয়ে গিয়েছে। এক্সপ্রেসো কফি, ক্রোসেন্ট আর ব্রাউনি দিয়ে ব্রান্চ সেরেছে। খাবার সামান্য হলেও, বিল মোটা আসার কথা। সেটাও কপাল সামান্য না কুঁচকে দিয়ে দিয়েছে ফারহান। ফারহা গোল্ড ডিগার না। নিজেও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কিন্তু লাইফ পার্টনার অবশ্যই এমন চায় যে তার লাইফস্টাইল মেইনটেইন করতে পারে। না হলে প্রেম করতে চাওয়া হাভাতে ছেলের অভাব ছিল না। কিন্তু এসব কাব্যিক প্রেম ফারহার পছন্দ না। এসব প্রেম সাময়িক জানে ফারহা। বিয়ের সময় ছেলের যোগ্যতাই দেখবে সবাই।

খুশি মনে শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে চলে যায়। জানে খুব শীঘ্রই ফারহানদের তরফ থেকে এগুনো হবে। মনটা ফুরফুরে ফারহার।

ফারহান গাড়ি চালাতে চালাতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। ফারহার সাথে কথা হচ্ছে। দেখা হচ্ছে। মিতুলের বিষয়ে সে কিছুই জানে না। মিতুলের সাথে হুট করে বিয়ের কথা ভাবার আগে আরও জানাবোঝার দরকার। যোগাযোগের জন্য ফেসবুক ব্যবহার করতে হবে। তারপর মায়ের সাথে কথা বলবে।

***

বিকেলে মিতুল ছাদে উঠলে ফারহার সাথে দেখা হয়। যদিও মাঝেমধ্যে মিতুল আর তুলতুলের অতি মিষ্টি ভাবে ফারহার ডায়াবেটিস ফিল হয়। তবুও কাজিনদের সম্পর্ক তো এত সহজেই নাই হয়ে যায় না। ফারহার আর কোনো ভাইবোনও নেই। তাই সকালে মুখে বিরক্তি ধরে রাখলেও, বিকেলে আবার তাদের কাছে এসেই মনের কথা বলে। তুলতুল আর মিতুল ফারহার এই স্বভাবের সাথে অবগত। বাবা মায়ের অতি আদর আহ্লাদে ফারহাও বেশ আহ্লাদী। পরিবারের সবাই ই তা অবগত। তাই ফারহার কিছু আচরণে অসন্তুষ্ট হলেও সবাই মেনে নেয়।

“মিতুল, কী করিস?”

“কিছু না। কাপড় নিতে আসলাম।”

“তোর দাঁড়িওয়ালার কী খবর রে?”

মিতুল বিষম খায়।

“আমার দাঁড়িওয়ালা কে?”

“ফটোগ্রাফার। নাম কী যেন?”

মিতুল ভয় পায়। ফারহা কি মিতুলকে বাইরে দেখেছে?

“কী বলো উল্টাপাল্টা। আরমান নাম ওনার।”

“লোকটা কিন্তু তোর প্রতি ক্রাশ খাইছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।”

“পাগল। কত বড়ো আমার থেকে।”

“কত বড়ো? দশ বছর?”

“জানি না।”

“তোর তো বিশ। এই বয়সে সবমেয়েকে নাকি সুন্দর লাগে। আর ঐ ব্যাটা কিছু করে না। বয়স হয়ে গেল ত্রিশ। তোর প্রতি ক্রাশ না খেলে কার উপর খাবে? এই ব্যাটাগুলো বিশ বাইশের উপর উঠতে পারে না। তুইও যদি ক্রাশ খেয়ে থাকিস তাহলে বয়স পার হওয়ার আগে ল্যান্ড করিস। না হলে ফুস।”

মিতুল বুঝতে পারছে না ফারহা কি ওকে সুন্দর বললো? না ওর বয়সটা সুন্দর বললো? না ওকে খোঁচালো। উফ্ ও এত গাধা কেন? খুশি হবে না দুঃখী? আর আরমান লোকটার কথা ভালো বললো না খারাপ? লোকটার সাথে প্রেম করলে ভালো হবে বোঝালো? না এই লোকের সাথে প্রেম না করলে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে, কিন্তু বর পাবে না বোঝালো!

“আপু, তোমার কথা কিছুই বুঝতেছি না।”

“হইছে, ঢং করিস না তো। সবসময় এত ইনোসেন্ট ভাব নেস। তোর থেকে তুলতুল আপু ভালো। এত ভাব ধরে না। বুদ্ধিমতী। আর তুই সবসময় এমন ভাব করিস যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারিস না।”

“কী জানি। এত কিছু বুঝি না। আর আব্বুকে চেন না? বুড়ো ধরে বিয়ে দিক, বা এলেবেলে কারও সাথে দিক। সেটা আব্বুরই সিদ্ধান্ত হবে। আমাদের তো আর তোমার ভাগ্য নাই যে সব মন মতো হবে।”

“হুম। আমার জন্য ছেলে দেখেছে জানিস তো। ফারহান নাম। খুব স্মার্ট, ভালো জব, একমাত্র ছেলে। ছোটোবোন আছে, কিন্তু কয়দিন পর তো বিয়েই হয়ে যাবে। ছিমছাম পরিবার। শুধু আমার হ্যাঁ থাকলেই হলো। আমি আম্মুকে বললাম ভেবে দেখি। এত তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই।”

“খুব ভালো। আচ্ছা আপু, আমি নামি এখন।”

ফারহা দৌড়ে গিয়ে ধরে।

“আরে নামবি আর কী। কাপড় রাখ ছাদে। জরুরি কথা আছে।”

“কী কথা?”

“রাখ আগে।”

“নাহ্ শুনব না। আর শোনো, আমাকে বোকা ভাব যে ঠিকই ভাবো। তবে আমি ইনোসেন্ট না হলেও তোমার মতো অতিচালাকও না।”

“আমি কী করছি?”

“বিয়ের ভিডিও এসেছে জানো? তুমি যে ইচ্ছে করে ঝোল লাগিয়ে দিলে আঁচলে তা কিন্তু ভিডিও তে থাকতেও পারে। বরের টেবিলের কাছে তো ভিডিও হচ্ছিল। সবাই দেখলে কী ভাববে বলো? আমার মনে হয় চাচী বিষয়টা আন্দাজ করেছেন। তাই শাড়ি নিয়ে কিছু বলেননি, বরং আমাকে দিয়ে দিলেন। চাচা চাচী তো সবসময় তোমাকে আড়াল করে রাখেন। তোমার তো এই স্বভাব নতুন না আপু। তোমার চেয়ে ভালো কারও দেখলেই অযথা হিংসা। এই যে তুমি কথায় কথায় প্রশংসাচ্ছলে ঠাট্টা করো। আমরা বুঝেও না বোঝার ভাব করি। যেন তুমি আবার নাকিকান্না শুরু না করো। আমি যেমনই হই ছিঁচকাদুনে বা বোকা, অন্তত কাউকে অযথা খোঁচাই না।”

মিতুল একটু চাপা মেরেছে। বিয়ের ভিডিওতে ফারহাকে দেখা যাবে কিনা জানে না যদিও। তবে ফারহা যে করেছে, সেই ছবি আরমান পাঠিয়েছে। তার ক্যামেরায় উঠেছে। আরমানের কথা এড়াতে ছবির কথার বদলে ভিডিওর কথা বললো। এই কথাটা তুলতে চায়নি মিতুল। কিন্তু মুখ ফসকে বলেই ফেললো। এখন মনে হচ্ছে রাতুলের কথাই ঠিক। ফারহা জুতোও ভাঙাই দিয়েছিল। এই মেয়েটার হিংসুটে স্বভাব কখনো পরিবর্তন হবে না। মিতুলই বেহায়ার মতো বারবার সব ভুলে গিয়ে হাসিমুখে ফারহার সাথে সহজ হয়ে যায়।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১০

0

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ১০

মাকে কী বলে বের হবে, ভাবতে ভাবতে মিতুলের ভয়ে জ্বর আসার অবস্থা। এই সময় বাবা, চাচা কাজে থাকেন। রাতুল স্কুলে। অন্য সময় হলে নোটস নেওয়ার কথা বলে বের হতে পারতো। এখন তো এই বাহানাও নেই। আর কিছুদিন পর ক্লাস শুরু হবে। এখন পড়ালেখার বাহানা নেই। ফারহার ক্লাস চলছে। সে বের হয়ে গিয়েছে। আফসোস হচ্ছে মিতুলের, কেন ক্লাশটা এখনো শুরু হলো না। অনেক ভেবেচিন্তে বান্ধবীকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেয়।

“মিতুল, কী করিস?”

“কিছু লাগবে আম্মু?”

“পেঁয়াজগুলো কেটে দিবি? খালার সময় হয়নি।”

“আসছি।”

মিতুল পেঁয়াজের সাথে তরকারিও কেটে দেয়। সহকারী খালা প্রতিদিন তিন কাজ করেন। ঘর মোছা, থালাবাসন মাজা, আর ভারী কাপড় ধোয়া। যার যার পরার কাপড় সে সে গোসলের সময় ধুয়ে ফেলো। ভারী কাপড় কয়েকদিন জমিয়ে খালা একদিন ধুয়ে দেন। যেদিন কাপড় থাকে না, কুটা বাছা করে দেন। আজ কাপড় ছিল। কুটা বাছা করা হয়নি। একয়দিন এমনিতেও মেহমানের চাপ গিয়েছে, বেশি সময় থাকতে হয়েছে। খালা আজ তাই তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন।

মিতুল চাল ধুয়ে বসিয়ে দিতে গেলে ফোন আসে।।হাত মুছে ফোন ধরে।

“হ্যাঁ ঝুমুর। নাহ, টাকা কই? উমম… আম্মুকে জিজ্ঞেস করে জানাচ্ছি। তবে মনে হয় না।”

মিতুল ফোন রাখলে ফরিদা জিজ্ঞেস করেন,

“ঝুমুর কেন ফোন দিয়েছে? কী না বললি?”

“ঝুমুর আমাদের চটপটি খাওয়াবে। ডাকছে।”

“এই সকাল এগারোটা বাজে কিসের চটপটি?”

“বিকালে ওর কী কাজ আছে। বলতেছে ক্লাস শুরু হয়ে গেলে একজন এক ডিপার্টমেন্টে চলে যাব। দেখা হবে না। ও বোধহয় কাল আবার দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। ক্লাস খোলার সময় হলে আসবে। তাই আজ ডাকলো আমাদের কয়েকজনকে। আমি, ঝুমুর, সোনিয়া, লাবণ্য। লাবণ্যের আব্বু ওকে নতুন ফোন কিনে দিয়েছে। লাখ টাকা দাম। আইফোন। যা সুন্দর ছবি আসে। লাবণ্য নাকি বলেছে ফোন নিয়ে আসবে। আমরা একসাথে ছবি তুলব।”

“এত কী ছবি তোলা বুঝিনি। দুইদিন আগে বোনের বিয়েতে আশ মিটিয়ে ছবি তুলে হয়নি? আর এইটুকু মেয়ের ফোন লাখ টাকা! বাপমায়ের রক্ত পানি করা টাকা নষ্ট করা।”

“আমি কিছু বলছি? আমার কাছে তো টাকাও নাই। আসতে যেতে রিকশাভাড়াও তো লাগে। আমি তো না ই করে দিয়েছি। তুমি জিজ্ঞেস করায় বললাম। আর আরেকজনের মেয়ে লাখ টাকার ফোন নিলেও বা আমার কী। আমার ফোন তো পনেরো হাজার টাকার। ছবি ওঠে ঝাপসা। অন্যের ফোনে ছবি না তুলে আর করব কী। আমি লাখ টাকা দূর, ত্রিশ হাজার টাকার ফোনও কোনোদিন কিনতে পারব না। তাও যে ওরা আমার সাথে এখনো বন্ধুত্ব রাখছে এই বেশি।”

“কেন রাখবে না? বন্ধুত্ব টাকা দিয়ে হয়?”

“এখন হয় আম্মু। এখন টাকা থাকলে সব হয়। সুন্দর শাড়ি হয়, কারও কাছ থেকে নিয়ে পরতে হয় না। দাগ লাগার ভয় পেতে হয় না। মনের মতো জুতো হয়, চকচকে সাজ হয়, গয়না হয়, দামী ফোন হয়। সবই হয়।”

মিতুল ভাত বসিয়ে দিয়ে রুমে চলে যায়। নাহ প্ল্যান কাজ করলো না। ম্যাসেজ দিয়ে ঝুমুরকে বলেছিল একটু পর ফোন দিতে। ঝুমুর ডাকছে দেখলে মা মানা করবে না হুট করে এসময়ে বের হতে। ইচ্ছে করেই এই সময়টা নিয়েছে। এসময় লেকের পাড়ে লোক কম থাকে। ফাঁকা পাবে। বাবা, চাচা থাকবে কাজে। রাতুল স্কুলে। না হলে মা আবার বলতো, রাতুলকে সাথে নিয়ে যা। সবমিলিয়ে এই সময়টা বের করলো। বাকি চার নাচুনে বুড়িদের তো বলতেই তারা রাজি। এমনিতেই মিতুলের ছবি দেখে তাদের মাথা খারাপ। সেই ফটোগ্রাফারের কাছে ফ্রি ছবি তোলার সুযোগ পেলে না করে কী করে!

আসলে সেদিন যখন মিতুলকে তার বান্ধবীর বাসায় নামিয়ে দেয়। আরমানের পরিচয় পেয়ে সেদিনই তো মিতুলের বান্ধবী অস্থির। রীতিমতো ‘ভাইয়া, আমাদের একদিন ছবি তুলে দিবেন? আমাদের বান্ধবীদের খুব শখ ফ্রেন্ডস থিমে ছবি তুলব। রিলসের জন্য সুন্দর সুন্দর শর্ট নেব। আমাদের টাকা নাই তাই ফটোগ্রাফার ভাড়া করতে পারি না।’

মিতুলের এত বিব্রত লাগছিল। একদম ডাহা মিথ্যা কথা। সুযোগ পেলেই এর তার ডিএসএলআর ক্যামেরায় ছবি তোলে। যদিও এটা সত্যি, টাকা পয়সা দেয় না। কারণ ক্যামেরার মালিকও তাদের মতো স্টুডেন্ট মানুষ। শখের ফটোগ্রাফার। মেয়েদের সঙ্গ পেলেই খুশি। কিন্তু আরমান তো বড়ো মানুষ। এসব বাচ্চামি আব্দার করা কি যায়?
অথচ লোকটা রাজি হয়ে গেল। কাজকর্ম নেই দেখে বোধহয়। কিন্তু যদি টাকা চায়!
মিতুল আরমানকে আলাদা করে একপাশে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই আরমান হেসেই উড়িয়ে দেয়। বলে লাগবে না কিছু। দুই প্লেট চটপটি খাওয়ালেই হবে। আজকের তারিখ আর সময়টা মিতুলেরই ঠিক করা। এখন মিতুলই যদি না যেতে পারে? শয়তানগুলো ঠিকই লেকেরপাড়ে চলে যাবে। ছবি তুলবে। মিতুলই মিস করবে। মিতুল কি আরমানকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিবে যে আসতে পারবে না? মিতুলই তো আরমানের সাথে পরিচয়ের সূত্র। সে না থাকলে আরমান কেন আসবে? আরমান তো ওদের চেনেই না।

“নে ধর।”

“কী?”

“একশোর বেশি দিতে পারব না। তোদের বাবা আমাকে কয়টাকা দেয় জানিস? তাড়াতাড়ি চলে আসবি। একটার ভেতর।”

“সত্যি যাব?”

মিতুলের মুখটা একশো ওয়াটের বাল্বের মতো জ্বলে ওঠে।

“যাহ।”

“কিন্তু এখনই তো বাজে এগারোটা একটায় কিভাবে আসব? দুইটা বাজবে।”

যদিও বলেই আর অপেক্ষা করে না। দ্রুত রেডি হতে হবে। বৌভাতে পরবে বলে ঠিক করা জামাটাই পরে নেয়। সাজা যাবে না বেশি। মা সন্দেহ করবে।।কানের দুল আর চুড়ি পথেই পরে নিবে। গাঢ় করে চোখে কাজল দেয়। টিপ দিতে গিয়েও দেয় না। কেমন লজ্জা লাগছে। তারপরও টিপের পাতাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।

***

“মিতুল, চুল খুলে দাও”

“আমার চুল স্ট্রেইট করা না। এলোমেলো লাগবে।”

“ট্রাস্ট মি। ভার্জিন সবকিছুর একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।”

মিতুল ভার্জিন মানো জানে। একমুহূর্ত একটু আড়ষ্ট হয়ে যায়। পরমুহূর্তে বোঝে যে আরমান ন্যাচারাল চুলের কথা বলছে।

মিতুল বেনী খুলে দেয়। গাঢ় কালো কাজল চোখ, কপালে কালো টিপ। মিতুলকে লাগছে চমৎকার। আরমান ক্যামেরায় চোখ রাখে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ আসছে। আলোছায়া পড়ছে সদ্য যৌবনে পা রাখা তরুণীর মুখে। এই ফ্রেমটা ক্যামেরাবন্দী করতে হবে।

আরমানকে মেয়েরা ঘিরে ধরেছে। সবাই স্ক্রিনে ছবি দেখছে। কোনো কোনোটা ডিলিট করার আব্দারও করছে।

“মিতুল, তুই যে কী ফটোজেনিক। তোকে ছবিতে অন্য রকম সুন্দর লাগে।”

লাবণ্যের কথায় আরমানও সায় দেয়। মিতুলের চেহারার গঠনটা যেন ছবি তোলার জন্যই। বিভিন্ন এঙ্গেলে তোলা সোলো ছবিগুলোর ফ্রেম অসাধারণ এসেছে। সবাই এখন চটপটির অর্ডার দিয়ে বসেছে।

“এ কী এত কেন?”

“দুই প্লেট চটপটি পারিশ্রমিক ছিল। মনে নেই?”

“আমার চটপটির দাম তাহলে তুমি দিলে?”

“জি।”

“তাহলে আবার দেখা পাওনা রইলো। ফুচকাটা আমার তরফ থেকে হবে।”

***
মিতুলদের বাসাটা পুরানো দিনের তিনতলা বাসা। পৈতৃক জায়গায় বাড়ি। নিচতলায় বড়ো একটা বসার ঘর। একপাশে লাইব্রেরির মতো অনেক বই রাখা। মিতুলের দাদা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উপ- পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন। শিক্ষিত মানুষ হওয়ার পাশাপাশি সৌখিনও ছিলেন। পড়তে পছন্দ করতেন। ব্যক্তিগত সংগ্রহকে লাইব্রেরির রূপ দিয়েছিলেন। নিচতলায় দুটো অতিথি কামরাও আছে। মিতুলরা দোতলায় থাকে। একসময় ফারহারাও একসাথেই থাকতো। কিন্তু পরিবার বড়ো হওয়ায়, আর চাচার আয় ভালো হওয়ায় তিনতলা নতুন করে তুলে কয়েকবছর আগে চাচা চাচী উপরের তলায় সিফট হয়েছেন। মিতুলদের দোতলা পর্যন্ত তাই বাসা পুরানো দিনের। আর তিনতলা আধুনিক। মিতুলের চাচা চাচী প্রায় বিভিন্ন উপলক্ষে এই কথা মনে করিয়ে দেন যে ওনারা পৈতৃক বাড়ি বড়ো ভাইকে ছেড়ে দিয়েছেন। নিজেদের থাকার জায়গা নিজেরাই করে নিয়েছেন। বাবার সম্পদ থেকে কিছুই নেননি।

যদিও তিনতলা করেছেন বাবার জমিতেই। তাছাড়া লম্বা সময় একসাথে ছিলেনও। কিন্তু আসলে তারা ঝগড়া ঝামেলা করে বলে না। হেসে হেসে কথাচ্ছলে বলে। তাই কথাটা হঠাৎ হঠাৎ শুনতে খারাপ লাগলেও কেউ ফিরতি জবাব দেওয়ার কথা ভাবে না। বিশেষ করে রফিক সাহেব কিছু না বললে, ফরিদার বলার প্রশ্নই আসে না।

মিতুল বাড়ির গেট খুলে ঢোকার আগে খেয়াল করেনি গলির সামনে গাড়ি ঘোরাতো থাকা মানুষটা হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে ওকে দেখছে। এলো চুলের মিষ্টি মেয়েটার কপাল ঘামে ভিজে উঠেছে। টিস্যু নেই। ওড়নায় মুখ মুছে নিচ্ছে। গড়পড়তার সাধারণ বাঙালি তরুণী। একটু আগেই ফারহার সাথে ছোটোখাটো একটা ডেট করে আসা ফারহান সিদ্ধান্তটা নিয়েই নেয়। বাসায় গিয়েই মায়ের সাথে কথা বলবে।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-০৯

0

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ৯

বিয়ের কয়েকদিনেই তুলতুল বুঝতে পেরেছে, শ্বশুর বাড়িতে তার প্রধান চ্যালেঞ্জ শাশুড়িকে জয় করা নয়। ননাসের সাথে মানিয়ে চলাও নয়। শ্বশুরের আদর অর্জনও নয়। তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, স্বয়ং স্বামী। সায়েম খুবই আহ্লাদে বড়ো হওয়া ছেলে। এতটা মা ঘেঁষা হওয়ার কারণ হলো, সায়েম প্রতিটি কাজে মায়ের উপর নির্ভরশীল। নিজের জামা, জুতো পর্যন্ত নিজে গুছিয়ে রাখা জানে না। যেহেতু তুলতুল নতুন, তাই সায়েমের কখন কী প্রয়োজন তা বুঝতেও পারে না। সায়েমের আব্দার হোক বা প্রয়োজন তা মায়ের কাছেই এখনো সীমাবদ্ধ।

তুলতুল ফিরানিতে গিয়ে মাত্র একদিন ছিল। বাবার বাড়িতে পৌঁছায় সন্ধ্যা সাতটায়। জান্নাত আরা তখনই বলেছিলেন সায়েমের রাতে থাকার প্রয়োজন কী। সায়েম নিজের বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারে না। কষ্ট হবে। তুলতুল বুদ্ধিমতী মেয়ে। ঠান্ডা স্বভাবের বলে কখনোই হইহই করার অভ্যাস তার নেই। সে ঠিক করেছিল সায়েম কী করবে তা সায়েমের হাতেই ছেড়ে দিবে। তাই জান্নাত আরার কথায় বিন্দুমাত্র আপত্তি জানিয়ে প্রতিবাদ করে না। জান্নাত আরা ধারণা করেছিলেন একটু হলেও তুলতুল প্রতিক্রিয়া দেখাবে। শেলী নিজেই সায়েমের সামনে তুলতুলকে প্রশ্ন করে,

“তুলতুল, তোমরা রাতে থাকবে?”

“আমি তো আসলে জানি না আপু। নিয়ম কী? রাতে থাকতে হয় না খেয়ে চলে আসতে হয়?”

“নিয়মের কিছু নাই। বৌভাতের পর নতুন বৌ বাবার বাড়িতে ফিরানিতে যায়। বাবা মা নতুন শাড়ি কাপড় দেয়।”

“রাতে থাকে না।”

“সেটা তোমাদের ইচ্ছে।”

“আপনি আর ভাইয়া কি ছিলেন?”

শেলী উওর দেওয়ার আগেই তুলতুলের দাদী শাশুড়ি বলেন, “হুম ছিল না আবার। জামাই লইয়া তিনদিন আছিল। নয়া নয়া শ্বশুর বাড়িত কম, শেলী তো বাপের বাড়িতই বেশি পইড়া থাকতো।”

“ভাইয়াও থাকতো?”

“তুলতুল এসব কেন জিজ্ঞেস করছ? তুমি আমার সাথে তুলনা করছ? আমার আব্বু আম্মু আমাকে আদর করে রেখেছেন। তোমার আব্বা আম্মা বলেন নাই কিছু?”

“না আপু। কী বলেন। তুলনা কী? আমি আসলেই জানি না কিছু। আম্মা তো এগুলো কিছু বলেন নাই। মিতুল, রাতুল সবাই অপেক্ষায় আছেন বললেন। আদর তো সায়েমকেও দিবে অবশ্যই।”

সায়েম বিরক্ত হয়ে বলে, “কী শুরু করলা তোমরা। আমি কী করব বলো তো?”

শেলী মানাও করতে পারে না। বেলুন চুপসে গিয়েছে একটু আগে দাদীর কথায়। আর এখানে তুলতুলকেও ধরতে পারবে না। কারণ তুলতুল তো কিছু বলেইনি। তুলতুলদের বাসায় এসে সায়েমের ভালোই লাগে। সবাই বেশ খাতির করছে। জামাই আদরের চূড়ান্ত বলা যায়। জান্নাত আরা জানিয়েছিল কোন কোন খাবার সায়েমের বেশি পছন্দ। তাই রান্না করা হয়েছে। রাত বাড়তে থাকে। জান্নাত আরা আর ফোন দেননি, বলা ভালো সায়েমের বাবাই দিতে দেননি। মিতুল, তুলতুলের রুমটাই সায়েম আর তুলতুলের জন্য গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

“তুলতুল আমি যাই তাহলে। তুমি থাকো আজ। সবাই তো তুমি থাকবে আশা করে আছেন। কাল এসে নিয়ে যাব।”

“আচ্ছা।”

“আমি চলে গেলে কেউ কিছু মনে করবে?”

“করতেও পারে। সবাই তো আপনি সহ থাকবেন জানে।”

“তাহলে যাব না?”

“তা তো আপনার ইচ্ছে। আমি বলে দেব আপনি নিজের বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারেন না।”

সায়েম ছটফট করে। কেউ একজন তার হয়ে তার সিদ্ধান্ত নিয়ে দিলে ভালো হতো মনে হয়। শেষ পর্যন্ত নতুন বৌয়ের মায়া, বিছানার মায়ায় চেয়ে বেশি হয়ে যায়। যদিও বাড়ি ফিরে এসে মায়ের থমথমে মুখ দেখে সায়েম বুঝে মা চেয়েছিল সায়েম চলে আসবে। এবার সায়েম সেই অস্বস্তিটাকে বিরক্তি বানিয়ে তুলতুলকে ফেরত দিচ্ছে। বসার ঘরে বসে বসে সায়েম যখন অযথাই বদনাম করছিল, সৌভাগ্য হোক বা দুর্ভাগ্য তুলতুল তা শুনে ফেলে। স্বামীর দ্বিচারিতা তুলতুলের একদম ভালো লাগে না। ঐ বাসায় একবারও মনে হয়নি কিছু সায়েমের খারাপ লাগছে, অপছন্দ হচ্ছে। অথচ সায়েম এখন অবলীলায় বলে যাচ্ছে, রুম ছোটো ছিল, গরম লাগছিল, মুরুব্বিরা বলায় থাকলো।

“বুঝলি আপা, চিংড়ির মালাইকারী তোমার মতো কেউ বানায় না। মুখে দিয়ে মনে হলো বলি যে একদিন আমার আপুর কাছ থেকে রেসিপি… ”

তুলতুল আর দাঁড়িয়ে না থেকে চা নাস্তার ট্রে নিয়ে ভেতরে আসে। সায়েম বিব্রত হয়ে কথা গিলে নেয়। শেলীর মুখটা চকচক করছিল।

“থামলি কেন? ও বৌ মাইন্ড করবে?”

“না আপু। মাইন্ড কেন করব? ও তো গলদা চিংড়ি তিন পিস নিয়েছিল। তারপরও বলেছিল আপুর রান্না চিংড়ি হলে কমপক্ষে ছয় সাত পিস খায়।”

সায়েম বিষম খায়। মিতুলের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সহজ কথা বলছে। শেলীও রাগ করবে নাকি বলবে এক মুহুর্তে বুঝে না।

“তুলতুল, তুমি আমার ছেলের খাওয়ায় নজর দাও কেন? তিনপিস নিয়েছে তুমি গুনেছ?”

“না না মা ছিঃ। আমিই তো পাশে দাঁড়িয়ে দিলাম। আমি আরও দিতে চেয়েছিলাম। তখন বললেন যে আপুর রান্না চিংড়ি হলে আরও নিতো।”

জান্নাত আরা দ্বিধায় পড়ে যান। তুলতুল আসলে সহজ সরল, না বেশি বুদ্ধিমান!

***

“তুলতুল, তুমি আমাকে টিটকারি করে মজা পেয়েছ?”

“আমি কী করলাম?”

“আমি বুঝি নাই ভেব না।”

“না আমিই আসলে বুঝিনি। আমার মনে হয়েছিল আপনার সব ভালো লেগেছে। কিন্তু বুঝলাম আমি যা বুঝেছি, তা ঠিক বুঝিনি।”

“আমি কি তোমাদের বাসায় কোনো সিনক্রিয়েট করেছি? এখনাে আম্মু আর আপুকে মিস করেছি বুঝাতে এমন টুকটাক কথা বলেছি। ওনারা খুশি হলে কোনো সমস্যা আছে?”

“আমাদের বাসা, রান্না এসব নিয়ে নেগেটিভ বললে ওনারা খুশি হবেন?”

“আমি তেমন বলেছি?”

“তো কী বললেন?”

সায়েমের মেজাজ খারাপ হয়। প্রথম দিন তুলতুলকে যতটা নরম সরম ভেবেছে। আসলে তা নয়। তুলতুলও মনে মনে ঠিক করেছে যুদ্ধ না করলেও সংসার সমরাঙ্গনে সে লড়াই না করে একপেশে হার হারবে না। শুধু ভয় এতে সংসারটাই না যুদ্ধ ক্ষেত্র হয়ে যায়। এখানে যে শাশুড়ি বনাম বৌ না। এখানে যে স্নায়ুযুদ্ধটা স্বামী বনাম স্ত্রীর

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-০৮

0

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ৮

মিতুল মুগ্ধ হয়ে ছবিগুলো দেখছে। কী চমৎকার এসেছে ছবিগুলো। আচ্ছা লোকটা নাকি কিছু করে না। শেলী আপার ভাষায় ‘হেঁটেহুঁটে খায়’।
তা ওয়েডিং ফটোগ্রাফির কাজ করলেও তো পারে। আজকাল কত আনাড়ি ছেলেপেলেরাও ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনে পেজ খুলে ফটোগ্রাফার বনে গিয়েছে। আর এই লোকটার হাত এতো ভালো, চাইলে ফটোগ্রাফার হয়েও তো ইনকাম করতে পারে। মিতুলের ক্লাসমেট সুমনার বয়ফ্রেন্ড ফটোগ্রাফার। সারাদিন ক্যামেরা নিয়ে ঘোরে। এমন ভাব নিয়ে চলে যেন ফটোগ্রাফার না, সিনেমার পরিচালক। হ্যাংলা মেয়েগুলো সেই ছেলের ক্যামেরায় ছবি তোলার জন্য মুখিয়ে থাকে। সুমনাও বয়ফ্রেন্ডের হাতে নিজের সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে পোস্ট করে। এমন একজন পার্সোনাল ফটোগ্রাফার থাকায়, সবাই সুমনাকে একটু হিংসাই করে। ম্যাসেজ টাইপ করে,

“থ্যাংক ইউ সো মাচ। ছবিগুলো খুব সুন্দর হয়েছে।”

“ইউ আর ওয়েলকাম।”

***

ফারহান ল্যাপটপ খুলে বসেছে। অফিসের কাজ আছে। ফারহার ম্যাসেজ দেখে ফেসবুক খুলে বসে। ফারহা বেশ স্মার্ট মেয়ে। ফারহান কন্টাক্টের জন্য নাম্বার চাইলে সহজেই নাম্বার অদলবদল করেছে, ফেসবুকে এড হয়েছে। ফারহান বুঝতে পেরেছে ফারহা ওর প্রতি ইন্টারেস্টেড। কিন্তু এই এটেনশন ফারহানের জন্য নতুন কিছু না। ফারহানের মতে তারমতো হ্যান্ডসাম ছেলে, যার ভালো জব, ভালো ফ্যামিলি আছে, তারজন্য বিয়ের পাত্রী পাওয়া কোনো বিষয় না। বরং ডেটিং অ্যাপসের মতো যেকোনো মেয়েকে রাইট লেফট সোয়াপ (swap) করা যায়। আপাততঃ ফারহাকে রাইটেই রেখেছে। তাই ইগনোর করছে না। তবে মিতুলের বিষয়টাও মাথা থেকে বের করেনি। আরও একটু দু’জনকেই যাচাই বাছাই করতে হবে।

ফারহা বিয়ের ছবি আপলোড করেছে। বেশিরভাগই নানা ঢং এ তোলা নিজের ছবি। কিছু গ্রুপ ছবি আছে। ফারহার ফেসবুক আইডির লিংক ধরে মিতুলের আইডি ওপেন করে ফারহান।প্রোফাইলের ছবিটাতেই নজর আটকে যায়। ছবিটা সাধাসিধা। কিন্তু ভীষণ আকর্ষণীয়। ফারহা সুন্দর নিঃসন্দেহে। ফারহানের মায়েরও ইচ্ছে ফারহাকেই বৌ করা। বাবার একমাত্র মেয়ে, আর্থিক অবস্থা ভালো, মেয়ের জামাইকে মাথায় করে রাখবে। মিতুলের খোঁজও নিয়েছেন। দেখতে শুনতে ভালোই। কিন্তু আর কিছুই আহামরি বলার মতো না। ফারহানকে তাই আরেকটু ভাবতে বলেছেন তিনি।

***

মিতুলের ছবিগুলো আত্মীয় আর বন্ধুমহলেও সাড়া ফেলেছে। ফারহার এত বিরক্ত লাগছে। এত চমৎকার সাজ, পোশাক পরলো সে, আর সবাই কিনা ঘুরেফিরে শুধু মিতুলের কথা বলে। কী সুন্দর লাগছে? ঘোড়ার ডিম। আসলে মিতুল ভালো জামাকাপড় কম পরে, তাই একটু ভালো শাড়ি পরে সাজতেই সবার চোখে লেগেছে আর কিছু না। মিতুলকে বকা খাওয়ানোর কাজেও ফারহা সফল হয়নি। ড্রাই ওয়াশের পরও শাড়িতে দাগ হালকা আছে এখনো। তবে এ নিয়ে ফারহার আম্মু কোনো রাগ দেখাননি। শাড়িটা মিতুলের কাছ থেকে নেয়ওনি। ওকেই রেখে দিতে বললেন। বললেন মিতুলকে মানিয়েছে খুব। ও গিফট হিসেবে রাখুক। মিতুলের খুশি দেখে কে। যত্তসব।

***

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাথায় দেওয়ার মতো পানি না, আবার না দিলেও চুল মুখে অস্বস্তি। মিতুল ছাতা নিয়ে বের হয়নি। বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বের হয়েছে। কিছু ছবি প্রিন্ট করতে দিবে। বান্ধবীকে সাথে নিয়েই যাবে ভেবেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বের না হলেই ভালো হতো। মা মানাও করছিল, কিন্তু মিতুলের অস্থিরতা বাঁধ মানলে তো। ছাতাটাও নিয়ে বের হয়নি। ঠিক ঠিক ঠান্ডা লাগবে। তুলতুল আজ বিকেলে সায়েমকে নিয়ে বাড়িতে আসবে। কত পরিকল্পনা ছিল, ঠান্ডা লাগলে কিছু করা হবে না। ইতোমধ্যে হাঁচ্চি শুরু।

“ঠান্ডা সহ্য না হলে বৃষ্টি বিলাস কেন?”

“আপনি এখানে কিভাবে?”

“কেন এই রাস্তায় থাকা দোষ নাকি?”

“না মানে তা বুঝাইনি। ভালো আছেন?”

“জি। কই যাচ্ছেন?”

“বান্ধবীর বাসায়।”

“কতদূরে?”

“এই তো দশ মিনিটের রাস্তা।”

“রিকশা ডেকে দেব?”

“না থাক। বাসায় চলে যাই। আবহাওয়া খারাপ। আজ আপু আসবে ভাইয়াকে নিয়ে। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আসলে সব মজা পন্ড হবে।”

“বাসা কত দূর?”

“তাও দশ পনেরো মিনিটের রাস্তা।”

“হেঁটেই এলেন?”

“হুম।”

মিতুলের অস্বস্তি লাগে। লোকটা কি তাকে ফকির ভাবছে? বৃষ্টির ভেতর টাকা নেই বলে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে।

“রিকশা পাওয়া মুশকিল এই আবহাওয়ায়। পেলেও দেখবেন না করে দিবে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, সুন্দরী মেয়েদের না করার ক্ষমতা একমাত্র রিকশাওয়ালা ভাইদের আছে।”

আরমানের হাসিটা ভালো লাগে মিতুলের। আসলেই রাস্তায় রিকশা কম। মিতুল ভেবেছিল হেঁটেই চলে যাবে, বিশ মিনিটের হাঁটা পথ। টাকাটাও বেঁচে গেল। সেই টাকা জমিয়ে মিতুল বড়োলোক হবে না। তবে এক প্লেট ফুচকার টাকা হয়ে যাবে। ফুচকা, চটপটি দেখলে মিতুলের মাথা ঠিক থাকে না।

“আমি নামিয়ে দেই?”

“না লাগবে না। আমি রিকশা নিয়ে নেব।”

” অস্বস্তি বোধ করলে মাঝখানে আমার ল্যাপটপ ব্যাগটা রেখে দিলেন। তাহলে গায়ে স্পর্শ লাগবে না।”

“আমি কী এটা বলেছি?”

“তাহলে আসেন নামিয়ে দেই।”

মিতুল ইতস্তত করে উঠে বসে। তার পরিবার সহজ পরিবার না। বেশ কনজার্ভেটিভ। অথচ মিতুল এই লোকটার সাথে এত সহজ ভাবে মিশছে কেন! বাবা দেখে ফেললে নিশ্চয়ই ভালো ভাবে নিবেন না। মিতুল, তুলতুলের কোনো ছেলেবন্ধুই নেই এই পর্যন্ত। অবশ্য লোকটা সায়েম ভাইয়ার কাজিন। বাবা জানলেও নিশ্চয়ই খুব একটা রাগ করবে না।

“বাইকে বসার একটা নিয়ম আছে। তা ফলো না করলে পড়ে যেতে পারেন। এত জড়োসড়ো হয়ে বসার কিছু নাই। আমি ছেলে ভালো।”

মিতুলের মাথায় ছোটো সাইজের একটা হেলমেট পরিয়ে দেয় আরমান। মিতুল মনে মনে ভাবে আরমান নিশ্চয়ই হাত খরচের জন্য পাঠাও বাইকের মতো বাইক রাইড দেয়। না হলে এক্সট্রা হেলমেট কেন রাখবে! হতেই পারে, হেঁটে তো মানুষের হাত খরচ আসে না। ইসস এর চেয়ে ফটোগ্রাফার হওয়াই তো ভালো ছিল। কষ্ট কম, ভাববেশি।

বাইক চলতে শুরু করলে ভীষণ ভালো লাগতে থাকে মিতুলের। মনে হচ্ছে অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে। বাতাস তো বটেই, বৃষ্টির ছাটটাও ভালো লাগছে।

(চলবে)