Monday, August 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 99



ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৯

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৯

“সায়েমকে তুমি শাড়ি দিতে চাও না এমন কিছু বলেছ?”

“না তো মা। আমি কেন এমন বলব? আমি এমন কিছুই বলিনি।”

“না মানে হুট করে ও শাড়ির কথা তুলল। আবার গিফট দিবে বললো।”

“আমি নিজেও অবাক হয়েছি মা। আপনি তো দেখছেন ওখানে আমাকে। আমি নিজেই অবাক হয়েছি শাড়ির কথা তোলায়। আমি তো আপুকে উপহার দেওয়ার কথাই বলতাম। আর যদি শাড়ি নিয়ে ওনাকে কিছু বলতাম তাহলে তো তিনি আপনাকে এসে বলতেনই। আপনার কাছ থেকে তো কোনো কিছু লুকাবে না। আমি যদি শাড়ি দিতে না চাইতাম সেটাও আপনি জানতে পারতেন। এটা তো আপনি জানেন তিনি সবকিছুই আপনার সাথে শেয়ার করেন।”

“হ্যাঁ তা ঠিক। আমার ছেলে কাছে আগে আমি সবকিছু। তারপর অন্য কেউ। আচ্ছা আমি যে তোমাকে রাতে শাড়ি দিলাম তখন কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?”

“জ্বি জিজ্ঞাসা করছে তো। আমি বললাম যে আপনি গিফট দিয়েছেন।”

“এটার বদলে ঐ শাড়ি দিতে বলছি, এরকম কিছু বলেছ নাকি?”

” আপনি তো বদলের কথা বলেনই নাই মা। আপনি তো আমাকে এমনিই শাড়ি দিলেন না? বললেন নতুন বউ, বোনের বিয়েতে লাল কাতান সুন্দর লাগবে। সায়েমও সেটাই বলল যে আমাকে ভালো লাগবে। লাল রং নাকি আপুর পছন্দ না। এজন্য আপু শাড়িটা নেয় নি। তবে আমাকে ভালো লাগবে। আর আপনার প্রশংসা করলো। বলল যে দেখছ আম্মু কত সুন্দর শাড়ি রেখেছে তোমার জন্য। আম্মু কত ভালো।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো করবেই। শেলীর পছন্দ অপছন্দের কিছু না। আমিই তো আমার ছেলের বৌয়ের জন্য এত সুন্দর শাড়িটা রেখে দিয়েছি। শেলীর পছন্দ না কে বলছে?লাল রং আবার পছন্দ না হয় নাকি। এটা তো অদল বদল না। এমনি বললাম শেলীকে ঐ শাড়িটা দিলে ও খুশি হত। থাক এটাই ভালো হয়েছে। দুটোই থাক তোমার কাছে। একটা বোনের বিয়েতে পরবা, আরেকটা মীরার ননদের বিয়েতে। আমাদের কী কম আছে নাকি। একমাত্র ছেলের বৌ তুমি। মানুষ দেখুক কত হাত খোলা আমাদের। ছেলের বৌ আর মেয়ে পার্থক্য করি না।”

“জি মা। ধন্যবাদ মা।”

***

“থ্যাঙ্ক ইউ।”

“কেন? থ্যাঙ্ক ইউ কেন?”

“আপনি বিষয়টা অনেক সুন্দর করে ম্যানেজ করেছেন। মা আর আপুও আমার উপর রাগ করতে পারেননি। আবার উপহারটাও আমার কাছেই থাকলো।”

“শাড়িটা তোমারই। তোমার কাছেই তো থাকবে। দেখ আমি স্বীকার করছি আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি কিভাবে ব্যালেন্স করতে হয়। এখন চেষ্টা করছি শিখতে আম্মুকে কষ্ট না দিয়ে কিভাবে তোমার পাশে থাকা যায়। আম্মুকে কষ্ট দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আম্মু আমার উইকনেস। আপুর সাথে আর্গুমেন্টে যাওয়া মানে আম্মুর সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো। সেজন্য হয়তো অনেক সময় আপু কিছু বললে বা চাইলে তুমি না চাইলেও মানতে হবে। কিন্তু আমি চেষ্টা করব আমাদের দুনিয়াটা ওই দুনিয়া থেকে আলাদা রাখতে। সব সময় হয়তো পারব না। তখন তুমি না হয় একটু ম্যানেজ করে নিও। দুজন দুজনের মুখোমুখি দাঁড়ালে কেউই তো মানসিক শান্তি পাই না। যতই তুমি স্ট্রং ভাব দেখাও আমি জানি তুমিও শান্তি পাও না। বিষয়টা তাই এমন ভাবে হ্যান্ডেল করতে চেয়েছি যেন উপহারটা তোমার হাতেই থাকে। আপু বা আম্মুও রাগ করার সুযোগ না পায়। আজ আপুকে দিলে আমি যদি আবার তোমাকে কিনে দিতামও তা কখনোই হয়তো একই রকম অনুভূতি দিত না। এখন আপু জানলো যে আপুও আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তুমিও বোধহয় জানলে যে আমার ওয়াদা মিথ্যা ছিল না। আমি সত্যি আমাদের সম্পর্ক সুন্দর করতে চাই।”

“ধন্যবাদ।”

“কী শুকনা শুকনা ধন্যবাদ, থ্যাংক ইউ এসব দিচ্ছ।”

“শুকনা, শুকনা?”

“হুম। আমাকে বলো আমি কাটখোট্টা, রোমান্টিক না এই সেই। তো আমি শিখব কার কাছে এসব। গার্লফ্রেন্ড ছিল না। বৌও পেলাম এমন একজন যে আজ পর্যন্ত তুমি করে বলে না। রোমান্স করা তো দূর। নাটক সিনেমায় কত কিছু দেখি।”

“আমার মনে হয় খুব বয়ফ্রেন্ড ছিল?”

“তো ঠিক আছে। দুজনেরই ছিল না। দু’জনই শিখি। শুরু তো করি।”

“যেমন?”

“তুমি আমাকে তুমি করে বলা দিয়ে শুরু কর। আর আমি…”

বলতে বলতে সায়েম তুলতুলের হাত টেনে কাছে নিয়ে এসে কপালে একটা ছোট্ট চুমু এঁকে দেয়।

“এভাবে।”

খুব ছোট্ট একটা ঘটনা। একটু পাশে থাকা। প্রথম বার শরীরের সীমানা ছাড়িয়ে মনের কাছাকাছি আসা। এইটুকুতেই আবেগের জোয়ার আসে। আর তা তো আসবেই। মান অভিমানের পালা শেষে শুধু কথার বাঁধনই সহজ হয়ে যায় না। শরীরি আবেগও সহজ আর সুন্দর হয়ে যায়। পলি জমা বুকের মতো স্থবির নদীতেও ঢেউ ওঠে। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো কলকল করে ওঠে জমানো কথাগুলো। সবশেষে এক অপরের গভীর স্পর্শে যা শান্ত হয়। ভালোবাসাবাসির মাঝে শুধু শায়েরী, কবিতার স্থান হয় না। তাতে অবশ্যাম্ভাবী শরীরও আসবে। তবে তখন বিষয়টা শুধু শারীরিক না হয়ে পূর্ণতার নাম হয়, সুখের নাম হয়। বিয়ের এতদিন পর যেন সায়েম আর তুলতুল অবশেষে সেই সুখের সন্ধান পেল। সায়েমকে গভীর করে আঁকড়ে ধরে তুলতুল নিজের কাছেই ওয়াদা করলো ক্ষণিক পাওয়া এই সুখ হাতের মুঠো থেকে হারাতে দিবে না। বালু হোক বা জলকণা, এই মুহুর্তগুলো ধরে রাখতে বারবার সে হাত মুঠো করবে।

***

“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম মা। কেমন আছ তুমি?”

“জি আন্টি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?”

“হ্যাঁ, মা। আমিও আছি ভালোই। আরও ভালো হব যদি আন্টি না ডেকে আম্মু ডাক।”

“জি ডাকব।”

“তোমাদের ওখানে কি অবস্থা? বেয়াইন ফোন দিয়েছিল। খুব কেনাকাটা হচ্ছে নাকি?”

“জি, বাসায় তো উত্সব চলছে।”

মীরা লজ্জা মিশ্রিত হাসি হাসে।

“শোন মা, আরমান আঙটি কিনতে বের হয়েছে।”

“জি আমাকে দেখা করতে বলেছে। আমি কাছাকাছিই আছি।”

“আচ্ছা আচ্ছা তাই তো বলি এত শব্দ কেন। বাইরে তুমি। ঠিক আছে রাখি তাহলে এখন। তোমরা দেখে কেনাকাটা কর।”

***

“বাইরে দাঁড়িয়ে যে? চলুন ভেতরে যাই।”

“না বাইরেই বসি। দোকানে কথা বলা যাবে না।”

“আঙটি কিনব না?”

“কিনে ফেলেছি।”

“আমি আসার আগেই কিনে ফেললেন? বুঝেছি সারপ্রাইজ। সমস্যা নাই। দেখি।”

“চলুন ফুড কোর্টের একপাশে বসি।”

দুপুর হয়নি এখনো। এই সময়টা ফুড কোর্ট খালি।

“দেখি আঙটি।”

আরমান পকেট থেকে বক্সটা বের করে দেয়। খুব সিম্পল একটা আঙটি। মাঝে ফুলের মতো ডিজাইন যাতে পাথর চকমক করছে। মীরার একটু ভারী ডিজাইন পছন্দ ছিল। এটা বড়ো বেশি সিম্পল মনে হচ্ছে। আরমানের জন্য ওরা সাত আনার আঙটি বানিয়েছে। এটা মনে হচ্ছে বড়োজোর তিন আনা হবে। মীরা মন খারাপ করে না। আরমানকে অবশ্য কিছু বলে না। আঙটি তো আরমানের একার আয়ে কেনার কথা না। আন্টিতো বলেছিল তিনি ভালো বাজেট ঠিক করেছেন।
মীরা বক্স খুলে আঙটি পরতে যায়।

“কী করছেন?”

“পরে দেখছি হয় কিনা। সাইজ ছোটো মনে হচ্ছে।”

“এটা আপনার সাইজ না।”

“আমার না? কার? ওহ আচ্ছা, আন্টির জন্য নিয়েছেন নাকি? তাই তো বলি এনগেজমেন্টের আঙটি এত হালকা হওয়ার কথা তো না।”

“খুব হালকা মনে হচ্ছে?”

“না গিফটের জন্য ঠিক আছে।”

আরমান মীরার হাত থেকে আঙটিটা নিয়ে বক্সে রাখে।

“মীরা জরুরি কিছু কথা ছিল। মন দিয়ে শুনবেন প্লিজ।”

“মীরা, আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি। কখন কোথায় কিভাবে জানি না। খামখেয়ালী, উড়নচণ্ডী, বাঁধনহারা এই আমি কখন ভালোবাসার বেড়াজালে জড়িয়েছি টেরই পাইনি। যখন টের পেয়েছি তখন আর জাল ছিঁড়ে বের হওয়ার পথ নেই। কোনোদিনও কোনো সম্পর্কে না জড়ানো আমার কাছে ভালোবাসা অক্সিটোসিন হরমোনেরই একটা নাম ছিল। এড্রেনালিন রাশ যেমন আমাদের উদ্দাম করে দেয়। তেমনি অক্সিটোসিন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণকে প্রেম অ্যাখ্যা দেয়। এসব হরমোনের ক্রিয়া আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়ই ছিল। অথচ সেই আমি রাতের পর রাত ঘুমাতে পারি না। হঠাৎ করে নিজের একজন মানুষ পাওয়ার তীব্র চাহিদা তৈরি হলো। নিজের কেউ, যে মানুষের ভীড়ে আমার হাত জড়িয়ে গায়ে ঘেঁষে হাটবে। আমি যখন বাইকে গতির ঝড় তুলব, আমার শার্টের কোণা খামচে ধরবে। বৃষ্টি দেখলে আমার তাকে নিয়ে ভিজতে ইচ্ছে করে। রাস্তার পাশে টঙ এর দোকানে তাকে নিয়ে চা খাওয়ার বড়ো তৃষ্ণা হয়। সে একান্ত আমার নিজের মানুষ হবে। যাকে যখন তখন ভালোবাসি বলা যায়, বলা যাবে। চোখ বন্ধ করলেই আমি তার চেহারা দেখতে পাই। কিন্তু আমি ক্ষমা চাই। সেই চেহারাটা আপনার নয়।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৮

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৮

“আম্মু ডেকেছিল কেন?”

তুলতুল ভেবেছে সায়েম শুয়ে পড়েছে। এমনিতেই আজ লম্বা সময় বাইরে ছিল। বাসায় ফিরে দেখে মেহমান। তাই তুলতুল হাত মুখ ধুয়ে নিজ থেকেই রান্নাঘরে গিয়েছে। রাতের খাবারের জন্য শাশুড়ির সাথে পোলাও, ডিমের কোর্মা করেছে। মেয়ের জামাইয়ের জন্য রোস্ট জান্নাত আরা নিজেই করেছেন। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর টেবিল আর কিচেন গুছিয়ে রাখতে তুলতুলের অনেকটা সময় লেগেছে। খাওয়া শেষে সবাই আবার চাও খেয়েছে। টায়ার্ড লাগছে বলে সায়েম রুমে চলে এসেছিল। বাকিরাও যার যার রুমে চলে গিয়েছে। শেলীর থাকার কথা ছিল না। সায়েমের বাবা মার অনুরোধে আজ রাতটা থাকবে ঠিক করে। জান্নাত আরার সাথে কথা বলে আসতে আসতে তুলতুলের ধারণা ছিল সায়েম শুয়েই পড়েছে।

“শাড়ি দিলেন।”

“কিসের শাড়ি?”

তুলতুল প্যাকেট থেকে বের করে দেখায়। নতুন কাতান শাড়িই মনে হচ্ছে। শাড়িটা চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে দেখেছে। মনে পড়ে সায়েমের। শাড়িটা সায়েমের ফুপির গিফট। শেলী আর যুবায়েরের বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু শেলীর পছন্দ হয়নি তাই রেখে গিয়েছিল। জান্নাত আরা বলেছিলেন কারও অনুষ্ঠানে গিফট করে দিবেন। যদিও শাড়িটা বেশ সুন্দর। কিন্তু শেলীর কেন পছন্দ হয়নি জানে না সায়েম। লাল কাতানে বৌ বৌ ভাব আছে। সায়েমের ভালোই লাগে। কাউকে গিফট করার চেয়ে তুলতুলকে দেওয়াই ভালো হয়েছে। ওকে মানাবে। মায়ের প্রতি ভালোলাগা কাজ করে। কড়া ভাব দেখালেও ঠিকঔ ছেলের বৌয়ের প্রতি মায়া আছে। থাকবেই না কেন? আদরের একমাত্র ছেলের বৌ বলে কথা।

“এই শাড়িটা তোমাকে মানাবে। লাল টুকটুকে।”

“আপনার পছন্দ হয়েছে?”

“আমার পছন্দ অপছন্দের কিছু না। আম্মু দিলেন তোমাকে। আমি বললাম মানাবে। তোমারও কি আপুর মতো লাল ভালো লাগে না?”

“মানে?”

“না মানে, আপুর ধারণা আপুকে কড়া রঙে মানায় না। সেজন্য বললাম।”

“না তেমন কিছু না। লাল তো সুন্দর রঙ। আসলে আপনার পছন্দ হলে বলার কিছু নেই। আমি ঐ শাড়িটা আপুকে দিয়ে দিচ্ছি। তবে আমি না দিয়ে আপনি দিলেই ভালো হয়। আপনি আমাকে প্রথম কোনো উপহার কিনে দিয়েছেন। সেটা কত দামের তা বিষয় না। আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি তা অন্য কারও হাতে দিতে গেলে হয়তো নিজের অজান্তেই… ”

“কী? বুঝলাম না। তুমি কী বলছ?”

“না মানে আপুর জন্যও শাড়ি কেনা দরকার ছিল। আমার আসলে মাথায় আসেনি। তখন তো আমিই নিতে চাইছিলাম না। এর উপর অতিরিক্ত টাকা খরচের কথা কী করে মাথায় আসবে। কিন্তু উপহার পেয়ে সত্যি ভীষণ ভালো লেগেছে। আমার পরা না হোক আপনি দিয়েছেন এটাই বড়ো।”

“আম্মু কি আজকের কেনা শাড়িটা আপুকে দিতে বলেছে?”

“বললেন দিলে ভালো দেখায়। এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে। সকালে চাইলে দিতে পারি বললেন।”

“আচ্ছা।”

সায়েম আর কিছু বলে না। বালিশ গুছিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করে। তুলতুল হতাশ চোখে সায়েমের দিকে এক পলক তাকিয়ে শাড়ির প্যাকেটেটা আলমারিতে রেখে দেয়। কেন জানি ঐ শাড়িতে একবার হাত বুলায়। কেমন একটা অদ্ভুত আশা জেগেছিল এবার। মনে হয়েছিল সায়েম হয়তো মানা করবে। মা বোনের সামনে না হোক, আড়ালে হলেও বলবে, “তোমাকে কিনে দিয়েছি, তুমি রাখ। আপুর জন্য আবার কিনে আনব।”

অথচ শুধু ‘আচ্ছা’ বলে শুয়ে পড়লো। তুলতুল ঠোঁট কামড়ে চোখের জল আটকে দেয়। যদি সায়েম এত নির্লিপ্ত হতে পারে তবে সেও হবে। মানুষটাই নিজের না হলে, তার দেওয়া কোনো কিছুই তো নিজের হয় না। সবই মায়া। মায়ার জালে ফাঁসতে চায় না তুলতুল। মায়া বড়ো কষ্ট।

***

রাত গভীর হচ্ছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম নেই দুটি মানুষের চোখে। তুলতুলের বলা কথাগুলো ভেবে দেখে মিতুল। আজীবন শুনে এসেছে ভালোবাসার প্রকাশটা ছেলেদের তরফ থেকেই আসে। মেয়েদের শুধু সায় দিতে হয়। এখন মিতুল কী করে এর ব্যতিক্রম হবে? আরমানকে কী করে বলবে সে তাকে পছন্দ করে। পরিচিত মানুষ হিসেবে নয়, মনের মানুষ হিসেবে পছন্দ করে। পছন্দ কথাটা হয়তো ভুল। সে তাকে ভালোবাসে। এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করে। যে আকর্ষণে বুকের ভেতর জোয়ার আসে। যে আকর্ষণে ঠোঁট দুটো চুপ থাকলেও চোখ অনবরত কথা বলে যায়। মনের ভেতর সুখ সুখ ব্যথা জাগে। কী এক অদ্ভুত জ্বলুনিতে শরীর মন জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়। অথচ কী আশ্চর্য। যার জন্য অহর্নিশ এই জ্বালা। সে যেন কিছুই টের পায় না। চোখের ভাষা বোঝা কি এতই কঠিন? এরপরও মুখ ফুটে বলতেই হয় ‘ভালোবাসি’?

বললো না হয় মিতুল। তারপর? তারপর যদি আরমান যদি না করে দেয়? যদি পরিবারে কথাটা জানিয়ে দেয়? মিতুল কিমল পারবে কাউকে চেহারা দেখাতে? তুলতুলের শ্বশুরবাড়িতেও কত সমস্যা হবে। কেননা আরমান এবং মিরা দুজনই তুলতুলের শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্কিত। মিতুল কি করে বোনের সংসারে আরও অশান্তি নিয়ে আসবে? এমনিতেই যেখানে তুলতুলকে নানা পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় ভয় হল আরমান যদি তাকে না করে দেয় নিজেই নিজের কাছে ছোটো হয়ে যাবে না? প্রত্যাখ্যানের এই আঘাত কি করে সইবে? তুলতুল বলে সাহস করে মনের কথা বললেই নাকি হয়!

এই দূরত্ব মেটাতে শুধু কি সাহস যথেষ্ট? মিতুল না হয় সাহস করে বলেই দিলো ‘আরমান, আপনাকে আমি ভালোবাসি। সূর্য উঠলেই হারিয়ে যাবে জেনেও যেভাবে শিশির বিন্দু ভালোবাসে কিরণকে। ঝিকিমিকি আলোয় অভ্যর্থনা জানায় সে ভোরকে। যতটা ভালোবাসে পতঙ্গ আগুনকে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করে না। আমিও সেই শিশির, সেই পতঙ্গ। হারিয়ে যেতে পারি জেনেও যে ঝাপ দিতে দ্বিতীয়বার দ্বিধা করবে না।”

কিন্তু এরপর যদি আরমান না করে দেয়? সেই নায়ের ভার তো মিতুল নিতে পারবে না।

মিতুল কি তবে দূরত্বের অভ্যাস করবে? সম্পর্কে যাওয়ার আগেই কি তবে শেষ হয়ে যাওয়ার চর্চা করতে হবে? কী আশ্চর্য কোন সম্পর্কের কথা ভাবছে মিতুল? কেন ভাবছে? আজ বাদে কাল অন্য আরেকজনের সাথে বিয়ে হতে চলছে মিতুল এবং আরমান দুজনেরই। তাদের জীবনে অন্য কেউ আসতে চলছে। এরপরও এসব ভাবা অন্যায়। খুব অন্যায়। এখন আর পাওয়ার নয়, বরং ভোলার অভ্যাসটা করতে হবে। মিতুল জানে না কী করে। কিন্তু করতে হবে।

***

“চোখের গভীরতা মিছে কভু হয়?
হে প্রিয় এসো ফিরে, লাগে বড় ভয়।
দিকবিদিকশুন্য আজ চঞ্চল সে চোখ,
আখি আজও নেশাতুর তোমাতেই ঝোঁক।

কেন ফেলে গেলে চলে, হলে চোখের আড়াল?
অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করে ধারালো করাল!
চক্ষু মুদিলে আজও ভাসে সব স্মৃতি,
যেখানেই রও প্রিয় নিও মোর প্রীতি।”

লাইনগুলো কয়েকবার আওড়ায় আরমান। কার লেখা লাইন জানে না। মুখ বইতে একটা পেজে ক্যাপশনটা খুঁজে পেয়েছে। সেই তখন থেকে লাইনগুলো পড়তে গিয়ে বারবার মিতুলের চোখদুটো মানসপটে ভেসে উঠছে। আজকের মিতুল আর আগের মিতুলে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেই হাসিখুশি ঝর্ণার মতো চঞ্চল মেয়েটা যেন শান্ত পুকুর হয়ে গিয়েছে। কাকচক্ষু কালো চোখে ভীড় করেছে বিষাদ। আজ যতবার চোখে চোখ পড়ছিল, যেন অব্যক্ত ভাষায় কিছু বলে
যাচ্ছিল। আরমান কি কিছু মিস করে যাচ্ছে?

***

সকালে নাস্তার টেবিলে নাস্তা শেষে সবাই বিদায়ে প্রস্তুতি নেয়। ভোরে ভোরেই নাস্তা সেরেছে সবাই। যুবায়েররও অফিস আছে, তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। সায়েমও অফিস যাবে। জান্নাত আরা তুলতুলকে চোখের ইশারা করেন। শাড়ির বিষয়টা বলতে চাইছে বুঝতে পারে মিতুল। শেলীও উসখুস করছে।

“আপু, একটা কথা বলার ছিল।”

“কী?”

শেলী আগ্রহী মুখে তাকায়। তুলতুল উত্তর দেওয়ার আগেই সায়েম বলে,

“মিতুল, মানে তুলতুলের ছোটো বোনের আকদ হবে। সবাইকে দাওয়াত দিবে। ও তোমাদের আগেই একটু জানিয়ে দিচ্ছে আর কী। তোমাদের বাড়িতেও তো বিয়ে সামনে। ডেট আগে পড়ে রেখ।”

“আহ্ হা সায়েম, তুলতুলকে বলতে দে ও কী বলতে চাইছিল।”

জান্নাত আরা অস্থির হন।

“এটাই আম্মু। ও আপু, কালকের শাড়িটা কি তোমার খুব পছন্দ হয়েছে? এমন নিতে চাও?”

“হ্যাঁ অবশ্যই। মীরার বিয়েতে পরলাম।”

“আচ্ছা আমি তাহলে ঐ দোকানে খোঁজ নেব। কালেকশনে আছে কিনা। দোকানের ব্যাগটা বরং এনে দেই। ওখানে দোকানের ঠিকানা নাম্বার দেওয়া আছে। এক কাজ করো না, বিয়ের শপিং তো তোমরাই করবা। তখন খোঁজ করে দেইখ আছে কিনা। থাকলে অন্য রঙের একটা নিয়ে নিও সেম শাড়ি। টাকা আমি দেব। গিফট।”

জান্নাত আরা ছেলের কথা শুনে থ। কিছু বলার ভাষা খুঁজে না পেয়ে তুলতুলের দিকে তাকান। তুলতুলের চোখেও বিস্ময়। যুবায়ের কথা টেনে নিয়ে বলে,

“আরে তোমার দিতে হবে কেন? আমার বোনের বিয়েতে, নিজের বৌকে একটা শাড়ি আমিই কিনে দিতে পারি। ঠিকানাটা দিও।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৭

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৭

ফারহান মনোযোগ দিয়ে মিতুলের প্রোফাইল দেখতে থাকে। তুলতুলের বিয়ের সময় থেকে এ পর্যন্ত পোস্ট করা ছবি, স্ট্যাটাস নানা অনুভূতির শেয়ার সব খেয়াল করে মনোযোগ দিয়ে। এর আগের বেশিরভাগ পোস্টই কলেজ লাইফ নিয়ে, সদথে নানা মিম শেয়ার। তুলতুলের বিয়ে পরবর্তী সময়ের পোস্টগুলো আলাদা। বেশকিছু সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড করা। সুন্দর ক্যাপশন দেওয়া ছবিগুলোতে। ছবিগুলো নিঃসন্দেহে আরমানের তোলা। একক ছবি আছে অনেক।।বন্ধুদের সাথে ফুচকা পার্টির ছবি আছে, লেকের ধারে এত চমৎকার কিছু এস্থেটিক ছবি তোলা। যা বোঝাই যাচ্ছে প্রফেশনাল কারও তোলা। ছবিগুলোতে আরমানের রিঅ্যাকশনও আছে। মিতুলের ইদানীংকার পোস্টগুলো কেমন বিষণ্ন। ফারহান হঠাৎ কেমন অস্থিরতায় ভোগে। এতদিন তার প্রতি মিতুলের অনাগ্রহ বা দূরত্বের কারণটা ফারহাকেই ভেবেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ফারহাই সত্যি কথা বলেছে। ফারহা এই ইঙ্গিত অনেক আগেই দিয়েছিল। বলেছিল মিতুলের পছন্দ ফারহান নয়। মিতুল শুধুমাত্র পারিবারিক চাপে এই বিয়েতে মত দিয়েছে। যদিও ফারহানের নার্সাসিস্ট মন তখন এই কথাটাকে গুরুত্বই দেয়নি। ধরেই নিয়েছিল ফারহা জেলাস হয়ে এইসব বলছে। এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল যো মিতুল ফারহানকে পছন্দ না করার প্রশ্নই আসে না। তাই তো মিতুলের ঠান্ডা আচরণ, নিষ্প্রভ মুখ সবকিছু তার নজর এড়িয়ে গিয়েছে। আজ আরমান সামনে না আসলে তা নজরে আসতোও না। ফারহানের পাশে মিতুল ছিল, আর আরমানের পাশে মীরা। অথচ পুরোটা সময় যেন মিতুল আর আরমানের চোখই কথা বলে গেল। আরমানকে ফারহানের ইচ্ছে করে করা অপমানগুলো মিতুলকে বিচলিত করছিল তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল। বোঝাই যাচ্ছে আরমান আর মীরার মাঝেও সেই টানের অনুপস্থিত যা বিয়ে ঠিক হওয়া জুটির মাঝে থাকা উচিত। এমন নয় তো মিতুলের সাথে ফারহানের বিয়ে হচ্ছে বলে, শুধু তাকে দেখাতেই আরমান আর মীরার বিয়ে? যেন মিতুল জেলাসের বশে হলেও এই শৃঙ্খল ভেঙে বের হয়?

ফারহানের রোখ চেপে যায়। না, এটা সে হতে দিবে না। নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সে মিতুলকে বিয়ে করতে এগিয়েছে। শর্মিলা আহমেদ তো শুরু থেকেই এই বিয়েতে নিজের অমতে রাজি তা ফারহান জানে। মিতুলের সাথে তার বিয়েটা এখন আর আবেগে সীমাবদ্ধ নেই। এমনিতেই মিতুলের নিষ্প্রাণ আচরণ তাকে ক্ষুদ্ধ করে দিয়েছে। সবসময় সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ফারহানের জন্য এ অভিজ্ঞতা নতুন। মিতুলকে সময় দেওয়া যাবে না। ফারহা বা অন্য কারও কাছে নিজেকে ছোটো করা যাবে না। রোখ চেপে যায় ফারহানের। মিতুলকে ফোন দিতে গিয়েও দেয় না। নাহ,এখন কিছুই বলবে না। মিতুল এই ধারণা নিয়েই তার জীবনে প্রবেশ করুক যে ফারহান কিছুই জানে না, কিছুই বুঝেনি। কিন্তু ফারহানের বদলে অন্য কাউকে পছন্দ করার ক্ষোভও সে ভুলবে না। মিতুলের ইচ্ছে থাক না থাক বিয়ে হবেই। কাউকে হাসাহাসি করার সুযোগ সে দিবে না। বিয়ের পর সে মিতুলকে বোঝাবে অবহেলা, তাচ্ছিল্য আর অনাগ্রহ কাকে বলে। হেলা ফেলায় পড়ে থেকে হলেও তারই সংসার করতে হবে। এর থেকে মিতুলের মুক্তি নেই, যতদিন না ফারহান নিজে তাকে মুক্তি দিচ্ছে।

***

তুলতুল আর সায়েম বাড়ি ফিরে দেখে শেলী এসেছে। তুলতুল একটু ভয়ই পায় মনে মনে। মীরা অভিযোগ করেনি তো। যতই হোক, ফারহান তার বোনের হবু বর। তুলতুলের পক্ষের আত্মীয়। সামান্য বিষয়টাও তখন বড়ো হয়ে যাবে।

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আসসালামু আলাইকুম আপু।”

“ওয়ালাইকুম সালাম। এত দেরি যে তোমাদের? মীরা তো কখন বাসায় পৌঁছে গেল। তোমাদের সাথে নাকি দেখা হয়েছে যমুনায়। একসাথে খেলে তোমরা।”

“জি। ঐ মিতুলকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে দেরি হলো।”

“সায়েম, কেমন দেখলি ছেলেকে?”

“ভালোই। দেখতে শুনতে ভালো। ভালো পজিশনে আছে। পারিবারিক অবস্থানও ভালো।”

“বাহ্ সব ভালো। যতই ভালো হোক, আমার ভাইয়ের চেয়ে ভালো পাওয়া সম্ভব না।”

যুবায়ের শেলীর দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। সবকিছুতে অযথা খোঁচাখুঁচি ভালো লাগে না।

“আরে আমাকে এমন করে দেখছ কেন? দুষ্টুমি করলাম। আমার ভাই ভালো না? এই যে সারাদিন শ্বশুর বাড়ির ডিউটি করলো। শ্যালিকার জন্য খরচ করছে। কয়জন পাবে এমন?”

যুবায়ের কিছু বলার আগেই সায়েম বলে,

“আমার কোনো খরচ হয়নি আপু। খাবারের বিল ফারহানই দিয়েছে। আর করে না কে বললো। আমার দুলাভাই কম করে নাকি।”

শেলী কথা এড়াতে তুলতুলের দিকে মন দেয়।

“তুলতুল, বসো। হাতে শাড়ির ব্যাগ নাকি? কে দিলো?”

“ফ্রেশ হয়ে আসি আপু। একবারে ফ্রেশ হয়ে এসে বসছি।”

“শাড়ি কে দিয়েছে বললে না তো?”

“শাড়ি আপনার ভাই পছন্দ করে কিনে দিয়েছেন।”

“সায়েম? বাহ্ সায়েম শাড়িও কিনতে পারে? দেখেছ আম্মু আজ পর্যন্ত তোমার আমার জন্য কখনো কিনেছে?”

“তোমরা ওর পছন্দে শাড়ি কিনেছ কোনোদিন? বলো টাকা দিয়ে দিতে।”

“আচ্ছা তোমার সমস্যা কী? তুমি আমাকে খোঁচাচ্ছ কেন? তুলতুল দেখি সায়েমের শাড়ির পছন্দ কেমন?”

জলপাই রঙের শাড়িতে গোল্ডেন স্ট্রাইপ। খুব সিম্পল, কিন্তু খুবই অভিজাত।

“সত্যি এই শাড়ি সায়েম পছন্দ করেছে!মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। এমনি এমনি বলি আমার ভাইয়ের কথা। দেখ জীবনে এত সুন্দর শাড়ি বৌয়ের জন্য এনেছ?”

যুবায়ের হাত উঠিয়ে নেয়। জান্নাত আরাও স্বীকার করেন আসলেই শাড়িটা দারুণ হয়েছে।

***

“ধন্যবাদ মীরা, আপনি বাসায় কিছু বলেননি।”

“আপনি না করায় যে বলিনি তা শুধু নয়। এমনিতেই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। একজনের নীচু মানসিকতার উত্তর দিতে যদি আরেকজনের বাসায় সমস্যা সৃষ্টি করি। সেটা তো একই আচরণ হলো। তবে… ”

“তবে কী?”

“আমার মনে হলো আপনি তুলতুল ভাবি, মিতুলের জন্য অনেক বেশি কনসার্ন।”

আরমান চুপ করে থাকে।

“কী হলো চুপ করে আছেন যে? আচ্ছা বাদ দিন।বলুন আমরা কবে শপিং এ যাব? আঙটি কিনে ফেলি। এনগেজমেন্টের বাকি আর এক সপ্তাহ। নাকি আঙটি নিজেদের মতো কিনে ফেলতে বলবো আম্মাকে?”

“মীরা আমি আঙটি কিনে নেব।”

“আমি সাথে যাব না?”

“দেখি।”

“আরমান, আপনি কি চিন্তিত?”

“মীরা আমি পরে ফোন দিচ্ছি। রাখি হ্যাঁ।”

***

“কী বলেন আপনি? তিনদিন পরই আকদ মানে? এত তাড়াতাড়ি?”

“আরে আমরাই তো বলছি আলাদা করে এনগেজমেন্ট করার দরকার নাই। ছোটো করে অনুষ্ঠান হোক। এখন নাকি ফারহান বলতেছে তাহলে এনগেজমেন্ট না করে আকদ করে ফেলতে। আমাদের উপর চাপ পড়লো না। পরে ছেলে পক্ষের রিসেপশন বড়ো করে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম।”

“রাজি হয়ে গেলেন?”

“হ্যাঁ না করার কী আছে। এই বাসার ছাদেই আয়োজন করে ফেলব। ক্যাটারিং এর লোক ডেকে ছোটো স্টেজ করে ফেলব। শোনো জেসমিন আর শফিকরে দাওয়াত দিতে হবে। আপন চাচা চাচী বিয়েতে না থাকলে খারাপ দেখায়। আম্মাকে সাথে নিয়ে যাব ওদের বাসায়। মিতুলকেও বিষয়টা জানিয়ে দিও। তুলতুলের শাশুড়ির সাথে কথা বলে তুলতুলকে আনাও। এই কয়দিন এখানে থাকুক বোনের সাথে।”

“তুলতুলের বাড়িতেও তো আয়োজন।”

“আরে সেটা তো তুলতুলের ননাসের বাড়িতে। তুমি বেয়াইনের সাথে কথা বল।”

***

“মা ডেকেছিলেন?”

“হ্যাঁ বসো তুলতুল।”

জান্নাত আরা এসময় ডেকে নেওয়ার কারণ তুলতুল আন্দাজ করতে পারছে। সায়েমের শাড়ি কিনে দেওয়ার বিষয়টা হয়তো হজম হয়নি। এতদিনে এইটুকু বোঝার ক্ষমতা ওর হয়েছে।

“সায়েম তোমাকে শাড়ি কিনে দিয়েছে খুবই ভালো। আমি ঐ সব শাশুড়ির মতো না যে ছেলে, ছেলের বৌকে কিছু দিলো আর তাতে কলিজা কালো করব। আমার ছেলেও দিল খোলা হাত খোলা।”

তুলতুলের হাসি পায়। এতদিনে এই প্রথম সায়েম কিছু নিজ থেকে কিনে দিয়েছে। তবু মাথা নেড়ে সায় দেয়।

“কিন্তু তুলতুল। সায়েমের মনে না থাকলেও তোমার তো মনে রাখা উচিত ছিল এই ছেলেটা কোথা থেকে এসেছে। তার মা আছে, বোন আছে। আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি, আজ আছি কাল নাই। এতকিছুর চাহিদা রাখি না আর। মনেও রাখি না। ছেলের টাকা শুধু শুধু নষ্ট করতেও চাই না। কিন্তু শেলীও তো সায়েমের কিছু হয় তাই না? তারও তো হক আছে। আমি না হয় মা হক ছেড়ে দিলাম। বোনকে কিভাবে ছাড়তে বলি? কিছু যখন কিনবা, তখন স্বামীকে মনে করিয়ে দিতে হয় এসব। ঘরের সবার মনের কথা ঘরের বৌকে মনে রাখতে হয়।”

“মা, সবার মনের খবর রাখতে গেলে তো সায়েমেরই সমস্যা হয়ে যেত। আপনি না হয় নিবেন না। কিন্তু যুবায়ের ভাই, দাদী, বাবা, বাবু সবার জন্য তো কিছু না কিছু নিতে হতো। আমি তাই কিছু বলিনি। আমিও নিতে চাইনি। উনি বললেন মিতুলের বিয়েতে পরতে পারব। বিয়ের পর তো কেনাকাটা করা হয়নি।”

“বোনের বিয়েতে এত হালকা কেন পরবা? তোমার বিয়ে হলো কয়দিন। কাতান পরবা। তুমি নতুন বৌ, এখন জমকালো শাড়ি পরবা, সাজবা। এসব হালকা শাড়ি হলো তোমার চেয়ে যাদের বয়স সামান্য বেশি, তাদের জন্য। দেখ আমি এই শাড়ি বের করছি।”

জান্নাত আরা একটা লাল কাতান শাড়ি বের করে দেন।

“এটা পইরো। নতুন বৌ। তুমি বরং ঐ শাড়িটা নিজের হাতে শেলীকে দিয়ে দাও। তুমি দিচ্ছ বলে। দেখবা কত খুশি হবে।”

তুলতুল শাড়ি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। জান্নাত আরা সন্তুষ্টির হাসি হাসেন। তুলতুল এত সহজে মেনে নিবে ভাবেননি।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৬

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৬

ওয়াশরুম থেকে বের হতে না হতেই আরমানের মুখোমুখি হয় মিতুল। মিতুলের চোখের কাজল লেপটে গিয়েছে। আলগোছে কান্নার জল মোছা হয়েছে বুঝতে পারছে আরমান।

“মিতুল কিছু হয়েছে? তুমি কাঁদছিলে?”

“কই না তো। আপনি এখানে কী করেন?”

“সায়েমের সাথে দেখা করতে এসেছি। মিতুল, তোমার সাথে কি ঐ লোক কোনো অসভ্যতা করেছে? করলে নির্দ্বিধায় বল।”

আরমানের চোয়াল শক্ত হতে দেখে অবাক হয় মিতুল। আরমান হঠাৎ রেগে যাচ্ছে বুঝতে পারছে। মিতুলের দেরি হচ্ছে কেন দেখতে তুলতুলও এগিয়ে আসে। তুলতুলকে আসতে দেখে মিতুল তাড়াতাড়ি বলে, “কিছু হয়নি। চোখে কী যেন পড়েছে। আমি বরং মুখ ধুয়ে আসি।”

“কী হলো আরমান ভাই? হাত ধোয়া হয়েছে? মিতুল কই? আবার ওয়াশরুমে গেল?”

“হ্যাঁ, চোখে কী নাকি পড়েছে। মুখ ধুতে গেল। আপনি নক দিয়ে একটু দেখুন।”

***

খাবারের টেবিলে সব স্বাভাবিকই হয়েও হলো না। মীরা বুঝতে পারছে না হঠাৎ আরমান এত থমথমে হয়ে আছে কেন। এখানে আরমানেরই মীরার খেয়াল রাখার কথা। অথচ মীরা যেন এখানে আরমানের পাশে থেকেও নেই। তুলতুল সবার সাথে মীরার পরিচয় করিয়ে দেয়। মীরা ও আরমান অবশ্য একসাথে খেতে চায়নি। কিন্তু ফারহান আর সায়েম কিছুতেই তাদের আলাদা বসতে দিবে না।

“তো আরমান ভাই, কী করছেন?”

“খাচ্ছি।”

ফারহান থতমত খায়।

“না মানে, জব না ব্যবসা। কোন প্রফেশনে আছেন?”

“ছবি তুলি।”

“ছবি তোলেন? আচ্ছা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের বিজনেস।”

“না ভাই। ছবিই তুলি। ওয়েডিং ফটোগ্রাফার না। তবে সায়েমের বিয়ের ছবি আমারই তোলা।”

“ওহ, তাই নাকি। বিয়ের ছবিগুলো আমি দেখেছি মিতুলের ফেসবুকে। দারুণ তুলেছেন। মিতুলের সিঙ্গেল ছবিগুলোও তাহলে আপনার তোলা। ইসস প্রফেশনালি নিতেই পারতেন। আয় খারাপ না। আমিও আপনাকেই বুক করতাম। আমার বাজেটও বড়ো। তবে আপনার হবু ওয়াইফ মানে মীরা আপু ভাগ্যবান। পার্সোনাল ফটোগ্রাফার পেয়ে যাচ্ছেন। আপু করেই বললাম। মাইন্ড করেননি তো। সময়বয়ী বা বয়সে আমার বড়ো হবেন মনে হলো।”

সায়েম আর তুলতুল বিব্রত বোধ করে। যদিও ফারহান হেসে হেসেই কথা বলছে। তবু কথাগুলো অপমানজনকই লাগছে। মীরা অস্বস্তিতে ভুগছে বোঝাই যাচ্ছে।

“আরমান। আম্মু ফোন দিচ্ছেন। সন্ধ্যা হচ্ছে তো। বাসায় যাব। কেনাকাটা আরেকদিন করব। বাসায় কী জানি ইমার্জেন্সি আছে।”

তুলতুলের দিকে তাকায় সায়েম। তুলতুল বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে।

“আরে এখনই তো গয়নার দোকানে যাচ্ছি আমরা। আঙটি পছন্দ করে যান আপু। চলেন যাই।”

“না তুলতুল ভাবি। আমার আলাদা পছন্দ এমনিও নাই। আরমানের কাছে মাপ দেওয়া আছে। ও পছন্দ করে তার বাজেটে যা নিবে তাই চলবে।”

“বাহ আপু, আরমান ভাই তো ভাগ্যবান। এত বুঝদার স্ত্রী পাচ্ছেন। আপনিও ভাগ্যবান।”

“আমি কেন ভাগ্যবান? এই বয়সে বর পাচ্ছি বলে? আপনি আমার বয়স যত ভাবছেন তত না ভাইয়া। আমি আপনার চেয়ে ছোটো না হলেও সমবয়সীই হব। কিন্তু এখনো মেয়েদের সবাই কুড়িতে বুড়িই ধরে নেয়।”

“আরে না না। আপনি কী বলেন এসব।”

“দুষ্টুমি করলাম। দুষ্টুমি কী আপনি একাই করতে পারেন নাকি।”

মীরা বের হতে উদ্যোত হলে আরমানও উঠে যায়।

“ঠিক আছে। আপনারা কেনাকাটা করেন। আমি মীরাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।”

মীরার মন খারাপটা কিছুটা হলেও ভালো হয়ে যায়। আরমান তার সাথে উঠে না আসলে মীরার খুব অপমানবোধ হতো।

***

“তুলতুল কেমন লাগছে ছেলে? সায়েম বাবা কী বলে?”

“আমি বললে বিশ্বাস করবেন না। সায়েম বাবার কথা বিশ্বাস করলে বলি, ছেলে কিঞ্চিৎ অভদ্র। আর আপনাদের যা ধারণা, মিতুলকে খুবই পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইছে। মাথায় করে রাখবে। তাও মনে হলো না। তিনি তো নিজের প্রেমেই মগ্ন। বাপরে নিজে নিজে এত বিশেষ ভাবতে কাউকে দেখিনি। নিজেকে বড়ো দেখাতে সামনের মানুষটাকেও অপমান করে ফেলে। আমার ননাসের ননদের সাথে দেখা হয়েছে সেখানে। সায়েমের কাজিনের সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওনাদের কেমন ছোটো করলেন খাওয়ার টেবিলে। তাছাড়া আমার মনে হলো মিতুলও এই বিয়েতে খুশি না। মিতুলকে আমি একটুও হাসতে দেখিনি। বরং মনে হলো ওয়াশরুমে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে। আমি ভাবতাম আমার কপালেই ঠোকর খাওয়া লেখা আছে। এখন মনে হচ্ছে মিতুলের কপালও খুব একটা সুবিধার হবে না।”

ফরিদা বেগমের খুবই বিরক্ত লাগে। মেয়েগুলো এমন হয়েছে কোথা থেকে।

“খারাপ কী দেখলি? মিতুলকে কত সুন্দর শাড়ি কিনে দিলো। খাবারের বিলও নাকি সে দিয়েছে।”

“কী রঙের শাড়ি? মিতুলকে জিজ্ঞেসও করেনি তার পছন্দের রঙ কি। নিজের পছন্দে কিনে হাতে ধরিয়ে দিলো।”

“এটাও দোষ? মন বড়ো না হলে বিয়ে হওয়ার আগেই কেউ এভাবে কেনাকাটা করে দেয়? তোর জামাই দিয়েছিল। মন থাকতে হয়।”

“আচ্ছা। তাহলে এখন আপনাদের সাধের বড়ো জামাইয়ের মন ছোটো হয়ে গেল। এই সেই, যার সাথে রাগ দেখিয়েছি বলে বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি দুটোই আমার জন্য…। ”

“তোর জন্য কী? তোর সমস্যা নিজের কারণে হয়েছে। এই চটাং চটাং কথা। এগুলো বাবার বাড়িতে মানে, শ্বশুর বাড়িতে না। আড কথা ঘুরাস না। কাল পর্যন্ত সায়েমের এই ঐ কত দোষ ছিল।।আজ আমি একটু বলতেই তুইও কি ফোঁস করিস নাই? এটাই স্বামী স্ত্রীর টান। আর বুঝলাম না তোদেরও কী দরকার ছিল তোর শ্বশুর বাড়ির মানুষদের একসাথে নিয়ে বসার। সায়েম যে হিসাবি এটা তুইও জানিস। আরমান তো মনে হয় না কিছু করে। এতজনের বিল ঐ ছেলে হাসিমুখে দিলো। তাও খারাপ বলার মানেই হলো হিংসা।”

“কে হিংসা করে আম্মু? আমি মিতুলকে? না সায়েম ফারহানকে? বোনের বড়োলোক ঘরে বিয়ে হলে আমি হিংসা করব? না করি না। বোনের ভাগ্য যদি আমার চেয়ে ভালো হতে দেখতাম। তাহলে হয়তো মনের ভেতর একটা দীর্ঘশ্বাস জাগলেও জাগতে পারতো। কিন্তু হিংসা না।”

***

“মিতুল, যাচ্ছি রে।”

“আজ থেকে যাও না আপু। বিয়ের পর তুমি একদিনও থাকলে না।”

“আজ সারাদিন বাইরে ছিলাম। তাও আবার সায়েম কে নিয়ে। জানি না বাসায় সবাই কেমন গাল ফুলিয়ে আছে। এর মাঝে যদি মীরা আপু বাসায় গিয়ে কোনো কথা লাগায় তাহলে তার ঝাঁঝও আমাকেই নিতে হবে।”

“তুমি তো তাহলে ঝামেলায়ই পড়ে গেলে।”

“আরে ঝামেলার কিছু নাই। এসব স্বাভাবিক। মিতুল, শোন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। আমাকে বলতো ফারহান কি তোর সাথে অসভ্যতা করেছে? করলে বল আমি সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব বিয়ে ভাঙতে। দেখি কে বিয়ে করায়।”

“না তো আপু। সত্যি এমন কিছু করলে আমিই থাপ্পড় মেরে দিতাম। হাত উঠে যেত আমারই। এমনিতেই ওনাকে আমার ভালো লাগে না। আচ্ছা, তুমি এটা কেন জিজ্ঞাসা করছ?”

“জানি না আরমান ভাই আমাকে ম্যাসেজ দিলেন। ওনার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। আমারও মনে হয়েছে তুই খুব চুপচুপ ছিলি।”

“আরমান ভাই বেশি বুঝে। এমন কিছু না। আমাকে না দেখে ওনার হবু বৌকে দেখুক। আর ওনার হবু বউটাকে দেখেছ। তিনিও তো আমাদের সাথে ফ্রি হতে পারছিলেন না। শুধু অন্য লোকের দোষ ধরে লাভ আছে?”

“বাব্বাহ, তুই দেখি ফারহান সাহেবের সাইড নিচ্ছিস। শোন, মীরা আপু অস্বস্তি বোধ করা স্বাভাবিক। তিনি আমাদের কাউকে ভালো করে চেনেন না। হবু বরকে নিয়ে আমাদের সাথে বসে আছেন স্বস্তি বোধ না করতেই পারেন। কিন্তু আপনার হবু বর সত্যি বলতে ভদ্র ভাষায় সামনের মানুষটাকে ছোটো ফিল করান। আমরা কি ওনাকে বলেছি বিল দিতে? নিজে জোর করে বিল দিলেন, সেটা আবার জানিয়েও দিলেন।”

“লোকটা শো অফ করতে পছন্দ করে আপা।”

“আচ্ছা মিতুল, তোর কি অন্য কাউকে পছন্দ?”

“নাহ। আর পছন্দ হলেও কী। আমার পছন্দের মানুষও যদি আমাকে পছন্দ করতো তাহলে তো এই নার্সাসিস্টকে বিয়ে করতাম না। বিয়ে যেহেতু এখানে করছি তখন অন্য সব প্রশ্ন অবান্তর।”

“তুই যাকে পছন্দ করেছি তাকে কি শুধুই পছন্দ করেছিস না ভালবেসেছি?”

“জানিনা আপু। মোহও হতে পারে।”

“তা সেই লোকটা কি জানে তুই তার মোহে মোহাবিষ্ট?”

“সেটাও জানি না। তাছাড়া ওনার সাথে আমার কোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”

“কেন নেই? বিবাহিত?”

” বলা যায়।”

” বলা যায় মানে? একটা উত্তর হবে। হয় বিবাহিত না হলে অবিবাহিত। বলা যায় মানে কী? মিতুল আমাদের এ জীবনটা কত অনিশ্চিত জানিস না? এখানে বলা যায়, ভাবা যায়, হতে পারে নাও পারে এসব সম্ভাবনা অসম্ভাবনার জায়গাযই থাকা উচিত না। তাকে ভালবাসলে মুখ ফুটে বলে দে। উনি করে বলছিস। তোর চেয়ে অনেক বড়ো? কলেজের স্যার?”

“আরে নাহ। একটু বড়ো। তবে স্যার না।”

“শোন, বড়জোর কী করবে? না করে দিবে তোকে। তাও ভালো। তুই তো তুই জেনে মরবি যে যাকে তুই ভালোবেসেছিস সে তোকে ভালোবাসিনি। কিন্তু যাকে তুই ভালোবেসেছিস সে হয়তো তোকে ভালোবেসেছিল অথবা হয়তো বাসেনি। এমন হয়তোর ভাবনা তোকে সারা জীবন খুঁচিয়ে যাবে। ভালবাসলে বলতে হয়। কে আগে বললো কে পড়ে এসব হিসাব করলে চলবে না। এই ফারহান নামক নার্সাসিস্ট কে জীবনে আসতে দেওয়ার আগে একবার যার জন্য ভালোবাসা মনে এসেছে তাকে বলেই দেখ।”

“পারবো না আপু। এ এখন আর হয় না।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৫

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৫

“শর্মিলা, তুমি যা ভেবেছিলে তা তো হয়নি। বিষয়টা এখন এনগেজমেন্টে চলে এসেছে। রফিক সাহেবের ফ্যামিলি তো মনে হচ্ছে এনগেজমেন্ট না সরাসরি আকদ করিয়ে ফেলতে আগ্রহী।”

“মানে?”

“আমাকে ফোন দিয়েছিলেন রফিক সাহেব। বললেন এনগেজমেন্ট আলাদা করে না করে সেই দিনটাতেই ছোটোখাটো অনুষ্ঠান করতে চান। মানে মৌলানা ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেন।”

“কেমন ছোটোলোক। আমি ভেবেছিলাম বিষয়টা আর আগাবেই না। ওনারাই না করে দিলে ফারহানকে বোঝানো সহজ ছিল।”

“ওনাদের দোষ কোন দিচ্ছ? এই বিয়ের জন্য তোমার ছেলের আগ্রহটাই মূল কারণ। আর বরাবরের মতো তুমি ছেলেকে সরাসরি না করতে পারবে না অথচ তুমি ছেলের ইচ্ছা মানতেও পারছ না। শর্মিলা, হয় তুমি ছেলে কে স্পষ্ট করে এখান থেকে ফিরে আসতে বলো। কারণ বুঝিয়ে বলো কেন তোমার এই সম্পর্ক পছন্দ না। আর না হয় স্বাভাবিকভাবে মেনে নাও। নতুন পরিবার শুরু হওয়ার আগেই পারিবারিক দ্বন্দ্ব ভালো লাগছে না।”

“আমি ওনাদের আকারে ইঙ্গিতে স্পষ্ট বুঝিয়েছি যে আমার ছেলের পছন্দে এই বিয়েতে আগানো।।আমার কোনো আগ্রহ নেই। ওনাদের এতটুকু আত্মসম্মান থাকবে না? পরিবারেরই এক মেয়েকে রেখে আরেক মেয়েকে কী সুন্দর তুলে দিতে রাজি। আশ্চর্য।”

“এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই। মানুষ যেখানে নিজের আপন মেয়ের ক্ষেত্রেও মেনে নেয়, সেখানে এ তো কাজিন। কত ঘটনা আছে এমন, বড়ো মেয়েকে দেখতো গিয়ে ছোটো মেয়েকে পছন্দ করে। বাবা মা নির্লজ্জের মতো সেই ফালতু প্রস্তাবেও রাজি হয়ে যায়। পাত্র হাতছাড়া করতে চায় না। আর এখানে তো কাজিন।মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় আত্মসম্মানের এক অদ্ভুত পারদ আছে। ছেলেমেয়ে নিজের পছন্দে যোগ্য সঙ্গী বিয়ে করলেও তাদের ইজ্জত চলে যায়। অথচ নিজের পছন্দে মেয়েকে চরম অযোগ্য লোকের হাতে তুলে দিলেও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয় না। সব মেয়ের ভাগ্য বলে চালিয়ে দেয়।”

***

তুলতুল আর সায়েম শপিং মলের সাইডে একটু কেনাকাটা আছে বলে মিতুল আর ফারহানকে একা কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্টে বসার সুযোগ করে দেয়। অর্ডার করার আগে আগে চলে আসবে তারা। বিশ মিনিট দুজন একটু আলাদা কথা বলুক। ইচ্ছেটা ফারহানেরই। তুলতুল আর সায়েমও মানা করে না।

“মিতুল, তোমার সমস্যা কি?”

“জি?”

“আমি আসার পর থেকে দেখছি, তুমি কেমন অন্যমনস্ক। দেখ মিতুল, আমি তোমার অস্বস্তি বুঝতে পারছি। তবে তুমি তোমার কাজিনের বিষয়টা নিয়ে ওভারথিংক করছ। এটা খুবই সিম্পল সহজ ঘটনা। তোমার কাজিনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। পারিবারিক ভাবে দেখেছি। জানার বোঝার জন্য ফেসবুকে এড হয়েছি। চ্যাট করেছি। এবং ফিল করেছি ও আমার টাইপ না। ব্যস। এখানে তোমার কাজিন যেমন প্রিটেন্ড করছে যেন আমি ওকে কথা দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করছি। বিষয়টা একদমই তা নয়।”

“আমি তো এসব বিষয়ে আপনাকে কিছু বলিইনি। ফারহা আপুর সাথে আমার কথাই হয় না এখন বলতে গেলে। আপুও আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন আপু এমনটা ভাবে বা বলে যে একজনকে কথা দিয়ে অন্যজনকে বিয়ে করছেন? আপনাদের এখনো কথা হয়?”

“কথা হয় বলতে কী বোঝাচ্ছ? দেখ আমি আগেও বলেছি, আমি মেয়েদের এমন এটেনশন পেয়ে অভ্যস্ত। আমার একটা আলাদা চার্ম আছে। মেয়েরা আমার প্রতি এট্রাক্ট হয়, এতে আমার কোনো হাত নেই।”

মিতুলের বিরক্ত লাগে। এই লোকটা এত আত্মকেন্দ্রিক। আমি, আমি রোগে আক্রান্ত।

“আপনি কী প্রশ্নের কী জবাব দিচ্ছেন? আচ্ছা আমার সাথে তো আজ আপনার প্রথম এভাবে দেখা করা। পারিবারিক ভাবে দেখাও হয়নি। ছাদে না কোথায় যেন আমাকে দেখে আপনার পছন্দ হয়েছে। তারপর সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো। দুটো বিষয় কেমন আলাদা হয়ে গেল না? ফারহা আপুকে দেখে, কথা বলে আপনার মনে হলো আপু আপনার টাইপ না। অথচ আমাকে না জেনেই মনে হলো আমি টাইপ! এইজন্য মনে একটু প্রশ্ন আসলো। আর কিছু না। আপনার জানার আগ্রহ হয় না আমাকে?”

“তুমি কিন্তু নিজেকে একটু বেশিই প্রায়োরিটি দিচ্ছ। লেট মি ক্লিয়ার ইউ, আমার অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। আমি যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বিলং করি সেখানে ছেলে মেয়ের বন্ধুত্ব থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করার সময় আমার কিছু আলাদা ক্রাইটেরিয়া আছে। আমি ওভার স্মার্ট মেয়ে সঙ্গী হিসেবে চাই না। তাদের সাথে আমি অলরেডি মিশেছি। আমি জানি তাদের সাথে পরবর্তী জীবন কেমন হতে পারে। হানি শুধু এই জন্য তুমি আমার টাইপ হয়েছ। তোমাকে পছন্দ করার কারণ যদি তুমি ভাবো যে তুমি খুব সুন্দর, খুবই আকর্ষণীয় কেউ। আমি তোমার প্রতি লাড্ডু হয়ে গিয়েছি তাহলে তুমি ভুল। আমার কাছে তোমাকে সিম্পলি একটা ওয়াইফ মেটেরিয়াল মনে হয়েছে। এর বেশি কিছু না। তুমি যদি এর বেশি বুঝতে চাও বা নিজেকে এর বেশি মনে কর, তাহলে তোমার কাজিনের মত তোমাকেও ছাড়তে আমার সময় লাগবে না। ফারহানকে রাগিও না। ফারহান তার বাবা-মার রাগের ধার ধরে না। তোমার নখরা যথেষ্ট দেখেছি। আর না। শুধু এটা বোঝানোর জন্যই আজ আলাদা করে ডাকা। তোমার বাবা মা আমার পরিবার থেকে প্রস্তাব পেয়ে বর্তে গিয়েছেন। তোমার কাজিন এখনো আমি ডাক দিলে হাজির হয়ে যাবে। এরপরও তুমি নিজের এটিটিউট ঠিক না করলে পস্তাতে তোমাকে হবে। আমার সাথে রাগ দেখাতে আসবে না।”

***

“নবরূপায় ঢুকি চল। এলোমেলো হেঁটে কী হবে।।কী কিনবা?”

“আমার কোনো কেনাকাটা নেই। কেনার প্ল্যান করে তো আসিনি।”

“সবসময় প্ল্যান করার কিছু নেই। বিয়ের পর তো তোমাকে শপিং এ আনা হয়নি। আজ কিনে দেই চল। মনে মনে তো আমাকে কিপটা উপাধি দিয়ে বসে আছ নির্ঘাত। নিজেও তো পছন্দ করে কেনাকাটা করতে পারো।

“কিছু লাগলে চেয়ে নিতে বলেছিলেন। চেয়ে চেয়ে জরুরি জিনিস নেওয়া যায়। শপিং তো করা যায় না। নিজে পছন্দ করে যে কিনব, আমার হাতে তো টাকা থাকে না। ভার্সিটিতে যাওয়ার হিসাবের ভাড়ার বাইরে আমার ব্যাগ ফাঁকা।”

“তুলতুল, অনেককিছুই আমি বুঝি না। আমার আসলে মা আর বড়ো বোনের বাইরে বন্ধু ধরনের কোনো মেয়েদের সাথে সম্পর্ক ছিল না। বড়ো বোনও মা সম। ছোটো বোন হলে হয়তো মেয়েদের আচরণটা ভালো বুঝতাম। তারপরও আমি স্বীকার করি, আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেইনি। আমার মা, বোন, স্ত্রী সবার জায়গাটা আলাদা রাখা দরকার ছিল। কিন্তু তুমিও যদি অভিমান পেলেপুষে রাখ। সম্পর্ক সহজ হবে না। চেয়েই নাও। আমি তো দিতে না করিনি।”

***

“সায়েম কোথায় আছ ভাই? আমি আর মিরা যমুনাতে ঢুকলাম। তোমরা আছ না চলে গিয়েছ?”

“না আছি। নিচেই আছি। ইনফিনিটি সামনে। আসবা?”

“হ্যাঁ দাঁড়াও আসতেছি। মীরা, আমার কাজিন সায়েম আর ওর ওয়াইফ তুলতুল ভাবিও আছে এখানে। আপনি তো চেনেন ওনাদের।”

“হ্যাঁ। সায়েম ভাই তো আমার ভাইয়ার শ্যালক। না চেনার কী আছে।”

“চলেন যাই তাহলে। ওদের সাথে দেখা করি।”

মীরার যদিও ইচ্ছে ছিল আজকের দিনটা আরমানের সাথে একদম একা কাটানোর। তাই কাউকে সাথেও আনেনি। মনে হয়েছিল একা কিছুক্ষণ সময় কাটানো দরকার। তাহলে আরমানকে বুঝতে তার জন্য সহজ হতো। কেন জানি মিরার মনে হচ্ছে আরমানের সাথে কোথায় জানি একটা গ্যাপ রয়ে যাচ্ছে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে প্রেমের বিয়ের মত অতি আবেগ থাকবে না স্বাভাবিক। কিন্তু এতটা নীরাবেগও কি স্বাভাবিক? তাই যখন আরমান এখানে আসার প্রস্তাব করে মীরার ভীষণ ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল সে আসলে একটু বেশিই ভাবছে। আরমানও হয়তো তাদের বিষয়টা সহজ করতে চায়। তাই একা দেখা করতে চেয়েছে। এখানে এসে আবার কাজিন, তাদের ওয়াইফকে নিয়ে ব্যস্ত হলে নিজেদের সময় কাটানো হবে কী করে!

***

আরমান আর মিরাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের অংশে চলে আসে সায়েম এবং তুলতুল। মিতুল ওয়াশরুমে গিয়েছিল। ফারহানের কথাগুলো খুব গায়ে লেগেছে। ফারহান অবশ্য কড়া কথাগুলোর পরই আই লাভ ইউ বলেছে। অথচ লাইনটা শুনে মিতুলের গায়ে শিহরণের বদলে কানে সিসা ঢেলেছে। এখন তবে এমন ভাবেই ভালোবাসা পেতে হয়? কারও মনের মতো হয়ে মন পেতে হয়? মিতুল ফারহানকে কিভাবে বলবে, মিতুল জেদী, রাগী মেয়ে নয়। অভিমানী। অভিমানী মেয়েরা রাগী হয় না। ঝগড়ার সময়ও তাদের রাগী কণ্ঠের আগে চোখে পানি চলে আসে। মনে নিদারুণ কষ্ট, চোখের কোণে জল, আর কান্নায় লাল হয়ে যাওয়া নাক নিয়ে তারা অপেক্ষায় থাকে কখন মনে কষ্ট দেওয়া মানুষটা বুকে টেনে নেবে।

কিন্তু এই অভিমানী মেয়েগুলোই সবচেয়ে বেশি দৃঢ় হয়। মান অভিমানের পালা শেষে যদি তারা ভালোবাসা না পায়। তবে তাদের নরম কাঁদা মাটির মনটা পাথরের মতো শক্ত হতেও সময় লাগে না। এদের ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসতে জানতে হয়। জোর খাটিয়ে আদায় করা যায় না।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৪

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৪

“মিতুল, কী হইছে তোর?”

“কী আম্মু?”

“তোর চেহারার এমন হাল কেন? এমনি তো সবসময় সাজগোজের মাতামাতির শেষ নাই। রান্নাঘরে যা পাবি নিয়ে মুখে মাখবি। এই জন্য মানা করি সব মুখে দিতে না। ব্রণ উঠছে কয়টা দেখছিস? নাকের ডগায় ব্রণ বসে আছে। সারারাত মোবাইল টিপিস। চোখের নিচে কালি পড়ছে কেমন। চুল আঁচড়াস না কয়দিন?”

“পরীক্ষার চাপ আম্মু। রাত জেগে পড়ছি।”

“কী পরীক্ষা?” জীবনে কোনোদিন এমনে পড়ালেখা করতে দেখি নাই। এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার মত পরীক্ষার আগে তোকে কখনো এরকম রাত জেগে পড়তে দেখছি মনে পড়ে না। কত চিল্লাইসি পড়ার জন্য। এখন অনার্সে কী এমন লেখাপড়া করতেছিস? সত্যি করে বল মিতুল তোর কোনো কাহিনী আছে? মতিগতি আমার ভালো ঠেকতেছে না ক্যান?”

“আমার আবার কিসের মতিগতি? আর এখন পড়ালেখা করলে খারাপ? এইচএসসির সময় পর্যন্ত পড়ার জন্য মার খেলাম। সেই পড়ালেখার চেয়ে এখন চেহারা দামী? তাহলে তখন ভালো রেজাল্টের জন্য মারতে কেন?”

“পড়ালেখা করা খারাপ এই কথা তো বলি নাই। তোর চালচলনের কথা বলছি। কী বুঝাইছি তুই বুঝতে পারিস নাই এই কথা বলিস না। তোরা দুই বোন অ বললে অজগর বুঝিস। মিতুল সত্যি করে বল কলেজে কারো সাথে কোনো সম্পর্ক হয়েছে তোর? বিয়ের কথা শুরু হওয়ার পর থেকে এমন মরা চেহারা করে আছস। অথচ তোর এসব নিয়ে বেশি লাফালাফি করার কথা ছিল।”

“তাহলে এখন আমি আমার নিজের বিয়ে নিয়ে লাফালাফি করব? তখন তোমরাই বলবা আমি বেশরম।”

“শোন মিতুল, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দেই তুই আর এটা ভাবিস না যে তুলতুলের বাহানায় তুই আমাদের চাপ দিবি। তোর ইচ্ছামত কাজ হবে। শোন, বাবা-মা কখনো খারাপ চায় না। তুলতুলের খারাপ কিছু হইছে? শুরুতে যা একটু সমস্যা হইছে সেটা তুলতুল নিজের ঘ্যাড় তেড়ামির কারণেই হইছে। এখন কী সুন্দর সংসার করতেছে। বাবা-মার কথা শুনলে কেউ খারাপ থাকে না।”

“আপু তাহলে ভালো আছে? যদি ভালো থাকার মানে এটা হয় যে বাবার বাড়ির পথে ভুলে যাওয়া, কথা বলতে ভুলে যাওয়া। তাহলে আপু ভালই আছে। আর আমিও তাহলে ভালোই থাকব। আপনাদের কাছে যদি ভালো থাকা এটাই হয় আমারও কোন সমস্যা নাই। আমরা অ তে অজগর বুঝি আর যাই বুঝি, আপনারা তো বোঝেন আমাকে নিয়ে সন্দেহ করার কিছু নাই আম্মু।”

“না থাকলেই ভালো। শোন আমি না, রাতুল তোর সাথে যাবে।”

“রাতুল তো ছোটো মানুষ।”

“সেটাই তো। কিন্তু ফারহান বাবা মনে হয় মুরুব্বী কেউ যাক চায় না।”

“এই কথা কি উনারাই জানিয়েছেন?”

“ফারহানের মা বললেন। ফারহান এখন একটু একা কথা বলতে চায়। আমিও বললাম একদম একা তো পাঠাতে পারব না। রাতুলকে দেই।”

“রাতুল না আম্মু। আমি গেলে আপুকে সাথে করে নিয়ে যাব।”

“এটা ভালো বলছিস।তাহলে তুই তুলতুলের সাথে কথা বলে দেখ। আমিও তাহলে মনে হয় শান্তি পাই। একদম একা পাঠাতে চাই না। আমার তো এসব ঢং ই ভালো লাগে না। বিয়েশাদিতে মুরুব্বিরা যা ঠিক করবে তাই তো শেষ কথা। ফারহানের মাও কেমন গা বাঁচিয়ে চলে।”

“এসব ঢং মনে হলে বাদ দেওয়া যায় নাআম্মু? এমনিতেও তো এই প্রস্তাব নিয়ে দেখ কত অশান্তি। চাচা চাচী তো আমাদের ঘর আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন একরকম। ফারহা আপু আমার সাথে আগের মতো কথা বলে না।”

“না বললে নাই। জেসমিন সারা জীবন বহুত নাটক দেখাইছে। আমি চুপচাপ দেখছি না। এখন সেও একটু দেখুক। একটু ভালো চাকরি, পড়ালেখা করে যে ভাব নিতো। আমি অল্প শিক্ষিত, গৃহিণী। আমি দিন দুনিয়ার কিছু জানি না। এমন ভাব যেন তার মেয়ে কোনো রাজকন্যা। দেখুক এখন, আমার মেয়েরাও কম না।সেদিন কত কথা শুনালো আমাকে। হইছে কে কী ভাবতেছে এসব তোর লাগবে না। তুই তুলতুলকে ফোন দে। মাথায় একটু তেল দিয়ে শ্যাম্পু টেম্পু কর। চুল তো চুল, চেহারা কেমন দেখা যাইতেছে তোর।”

চাচী আর মায়ের মাঝে এই দূরত্ব মিতুলকে যতটা না অবাক হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে নিজের নরম সরম মায়ের এই রূপ দেখে। ফরিদা বেগম যে মনে মনে জেসমিনের প্রতি এমন একটা মনোকষ্ট পুষে রেখেছেন, হাসিমুখের আড়ালে তা চাপা দিয়ে রেখেছেন। আজ বুঝতে পারছে।

***

আরমান, মিতুলের ছবিগুলো ডিলিট করতে গিয়েও পারিনি। নিজের বিয়ে ঠিক হয়েছে, যার ছবি দেখছে দু’দিন পর সেই মেয়েও অন্যের স্ত্রী হবে। এভাবে তার ছবি দেখা অন্যায়। অথচ ডিলিট বাটন টিপতে গিয়েও পারে না। থাকুক কিছু সুন্দর স্মৃতি। ল্যাপটপের কোনো এক গোপন ফোল্ডারে।

মিতুলের চোখের উপর আঙ্গুল বুলিয়ে যায় আরমান। যদি বাস্তবেও এই চোখের পাতা ছুঁয়ে দেওয়া যেত। সেদিন বৃষ্টিতে মিতুলের চোখের পাতা ছুঁয়ে জল নামছিল। আরমানের অবাধ্য দু ঠোঁট তা ছুঁয়ে দিতে উন্মাতাল ছিল। কিন্তু নিজের অন্যায় খায়েশের লাগাম টানতে জানে আরমান। তবুও সেই তৃষ্ণা তো ভোলা যায় না। ফিতে কাটা টেপরেকর্ডারের মতো মাথার ভেতর বারবার সেই মুহুর্ত ঘুরতে থাকে। মিরার কথায় মন দেওয়া হয় না। বিয়ে নিয়ে মিরা আলোচনা করতে চায়। আঙটির জন্য আঙ্গুলের মাপ চাই। শেরওয়ানির রঙটা কেমন হবে? শাড়ি কি লাল নেবে না সোনালি। অথচ নতুন সূচনার এই গান নয়, বিচ্ছেদের বেহালার সুরই শুধু কানে বাজে।

এই শহরটাই বিচ্ছেদের। এখানে ধরে রাখার চেয়ে মানুষ ছেড়ে বাঁচাটাই আগে শিখে। প্রিয়র হাত আঁকড়ে ধরে রাখতে চাওয়া ব্যক্তিটাই এই শহরে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। ধরে রাখতে গেলেই এখানে ব্যথা পেতে হয়। নিঃস্ব হতে হয়। তাই এখানে মানুষ ছেড়ে দেওয়াটাই আগে শিখে। বেঁচে থাকা তখন সহজ হয়ে যায়।

***

“ম্যাসেনজার দেখেননি?”

“না তো। কেন?”

“আঙটির ডিজাইন পাঠালাম। কোনটা পছন্দ হয় দেখেন। একসাথে গিয়ে কিনতেও পারেন। বিকেলে স্বর্ণের দোকানে যাব।”

“আমি এসব বুঝি না। তাছাড়া ছেলেদের এমনিও গোল্ড পরা নিষেধ।”

“কিন্তু এনগেজমেন্টের জন্য তো লাগবে। আকদ হয়ে যাবে ঐদিন। ফর্মালিটির জন্য তো লাগে। আচ্ছা আমার আঙুলের মাপও দিয়েছি। আমার আঙুল ভারী। মাপ মতো না নিলে হবে না। শুনছেন কী বলছি?”

“হ্যাঁ। আসলে এসব তো মা দেখবেন।”

“আপনি আসবেন না? বসুন্ধরায় যাব।”

***

“কী ভাই? হঠাৎ আজ আমাকে ফোন?”

“ভাই এই কথা বলো না। কাজিনদের ভেতর একমাত্র তুমিই সেই যার সাথে নিয়মিত কথা বলি।”

“হুম। সেটা তখন যখন তুমি মিয়া কোনো চিন্তায় থাক।”

“তুমি তো জানো, আমার ঐ ভাবে কখনো কোনো বন্ধু হয়ই নাই। আম্মা এত বেশি আগলে আগলে রাখেন স্কুলে। এরপর কলেজ, ভার্সিটি পর্যন্ত সেই রেশ টেনে গেলাম। যা দরকার আম্মা করে রাখতেন। বাকি বিষয়গুলো আপা দেখতেন। আমি কবে এমন একা হয়ে গেলাম নিজেই বুঝিনি। তুমি ব্যস্ত হলে থাক।”

“আরে সায়েম। আমি মজা করলাম ভাই। কী হয়েছে বল। স্যরি স্যরি।”

“না ঠিক আছে ভাই। তোমারও সামনে বিয়ে। কাজ আছে অনেক।”

“কোনো কাজ নাই। এমনিতে আমার নিজেরও কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।”

“তোমার কী হয়েছে? বিয়ে নিয়ে আপত্তি আছে?”

“এমনি গল্প করতে ইচ্ছে করতে পারে না? কিন্তু বারবার বিয়ের কথা টানার কারণ কী? ভাবির সাথে কোনো সমস্যা?”

“সমস্যা আমার নিজের। আসলে তুমি তো জানো। আম্মু, আপা সবসময় এত আদরে রাখছেন। আমি আসলে আহ্লাদ পেয়ে অভ্যস্ত। বিবাহিত জীবনটা এমন মনে হচ্ছে না।”

“হওয়ার কথাও না। সারাজীবন লেখাপড়া নিয়ে থাকা, কোনো প্রেম ঘটিত ঘটনায় না থাকা তুমি আইডিয়াল ছেলে। কিন্তু মেয়েদের কাছে আইডিয়াল স্বামী হওয়ার ক্রাইটেরিয়া মনে হয় এটা না। এ বিষয়ে যদিও আমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই। আমার অবস্থা তোমার চেয়েও খারাপ। কিন্তু এটা বুঝি, মা বোনের ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসে। পার্টনারের ভালোবাসাটা অর্জন করে নিতে হয়। তেমার মনে যেহেতু ভালোবাসার চাহিদা জেগেছে এ পর্যায়ে এসে। তাহলে দাম্পত্যে তুমি তার কমতি অনুভব করছ। সময় দাও ভাই নিজেদের। স্ত্রীকে সময় দেওয়ার মানে মা বোনকে অবহেলা না। ভাবি তোমার সময় ডিজার্ভ করে। আজ তো ছুটিরদিন। বাইর কোথাও যাও।”

“আমিও তাই ভাবছি। কেমন জানি একটা মানসিক দূরত্ব। তুলতুল মেয়ে খারাপ না। আমিও ভাই ছেলে খারাপ না। কিন্তু মাঝেমাঝে রাগের বশে হার্ট করে ফেলি।”

“রাগটা কোথায় দেখাও এটাও বিষয়। আমার মনে হচ্ছে তুমি চাচী, শেলী আপা ওনাদের সামনে ভালো থাকতে স্ত্রীর উপর চোটপাট কর। ভুল বললাম? এটা কর না। সবারই আত্মসম্মান আছে।”

“থ্যাংক ইউ ভাই। মন হালকা লাগছে। আজ এমনিও বাইরে যাওয়ার সুযোগ আছে। তুলতুলের ছোটো বোন মিতুলের বিয়ের কথা চলছে। আজ বিকেলে যমুনায় যাওয়ার কথা। আঙটি পছন্দ করবে, ছেলে একটু বসে কথাও বলতে চায়। এটা ভালো আসলে। আমার বিয়ের সময় এসব বুঝিই নাই। আম্মু আর আপা পছন্দ করলেন। গিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। আজকাল কেউ এমন করে? অন্ততঃ ফোনে তো কথা বলা দরকার ছিল। সম্পর্কের শুরুই হলো মানসিক দূরত্ব দিয়ে।”

“যনুনায় যাচ্ছ তাহলে? কোন জুয়েলার্স?”

“জড়োয়া হাউসে।”

“আমারও তো মিরার সাথে যাওয়ার কথা। আঙটি দেখতে।”

“তাই? ভালোই হলো। দেখা হবে হয়তো তাহলে।”

“হ্যাঁ দেখা হবে।”

ফোন রেখে আরমান মিরাকে টেক্সট করে, “বসুন্ধরা না, চলেন যমুনায় যাই। জড়োয়া হাইসে। ওখানে চা কফি খাওয়ার ভালো প্লেস আছে। দূরে মনে হলে আপনি চাইলে সাথে কাউকে নিয়ে আসতে পারেন।”

মিরা ফিরতি টেক্সটে জানায়, “আপনি বাইক নিয়ে এসে নিয়ে যেতে পারবেন না? আমি মেইন রোডেই দাঁড়ালাম।”

“ওকে।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৩

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৩

(এই পর্বকেও রোমান্টিক বলাই যায়? নাকি মান অভিমানের?)

“চা খাবে?”

“চা? আচ্ছা দাও।”

তুলতুল নিজ থেকে চা দিতে চাওয়ায় সায়েম অবাক হয় একটু। ইদানীং খেয়াল করছে শুরুর দিনগুলোর মতো তুলতুল আর গায়ে পড়ে সায়েমের কোনো কাজ করে না।
না সেই ক্ষুব্ধ ভাব, অভিমানী চোখ, অযথা ঠোঁটের ভাঁজে রাগের কিছুই আর নেই। বরং বড়ো বেশি শান্ত, নির্মোহ, নিস্পৃহ। যেন সায়েমের কাছে নিজেকে আলাদা করে প্রকাশ করার কিছু নেই। অথচ বিরহে আছে তাও নয়। গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে তুলতুলকে চুল আঁচড়াতে দেখেছে বহুবার। তুলতুলের দীঘল কালো চুলে নাক ডুবিয়ে সেই গান শুনতে সায়েমের মনে যে কখনো খায়েশ হয়নি তা নয়। সে তো সাধুসন্ন্যাসী নয়। কিন্তু শারীরিক বিষয়ে তুলতুলের সেই রূপ খুঁজে পায় না। না ঠেলে সরিয়ে দেয়, না প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে। স্ত্রীর কাছ থেকে গভীর আলিঙ্গনের সময় পাওয়া এমন নিষ্প্রাণ আচরণ মাঝেমাঝে সায়েমকে বিরক্ত করে তোলে, কখনো হতাশ। অথচ অন্য সময় তুলতুলকে এমন লাগে না। ছবি দেখছে, হাসছে সবকিছু স্বাভাবিক। তার জীবনে যেন সায়েমের আলাদা করে কোনো প্রয়োজন নেই। সায়েম না থাকলেও সে যেমন খুশি, সায়েম থাকলেও তেমন। সায়েমের উপস্থিতি আলাদা কিছু নয়। সায়েম সন্দেহ করার মতো কিছু পায় না। তবুও গোপনে ফোন ঘাটে। তুলতুলের ফোনে যেন গোপন কিছুই নেই। কোনো পাসওয়ার্ড দেওয়া নেই। চ্যাটবক্সে মিতুলের সাথে ফোনে কথা বলার হিস্ট্রি। বান্ধবীদের কাছ থেকে ক্লাস নোট নেওয়ার ছবি। এর বাইরে কিছু নেই। তুলতুলের ফেসবুকেও যেন নেই সায়েম। সেই বিয়ের ছবিটা প্রোফাইল পিকচারে দেওয়া। বাকি নৈমিত্তিক সব গাছ, ফুল, নিজের দৈনন্দিন জীবননামা। যাতে সায়েমের অস্তিত্ব নেই।

অবশ্য সায়েম কিছু করতে বললে তুলতুল অবহেলা করে না। কিন্তু ঐ যে বলতে হয়। বললেই শার্ট প্যান্ট আয়রন হয়। আলমারি গুছিয়ে দেয়। চা বানিয়ে আনে, পানির জগটা ভরে এনে কামরার দরজা লাগায়। না বললে দরজাটাও লাগায় না। সারাদিন হাট করে খোলা থাকে। যেন তাদের মাঝে প্রাইভেসির কোনো বালাই নেই, প্রয়োজন নেই।

“চা।”

তুলতুলের বাড়ানো চায়ের কাপে সায়েমের ধ্যান ভাঙে।

“আজ কী হলো হঠাৎ। না চাইতেই চা। এমনিতে তো এই রুমে যে একজনের অস্তিত্ব আছে। তুমি বোধহয় তাই ভুলে যাও।”

“এমন কেন বলছেন? কিছু লাগবে? বললেই তো করে দেই। চা দিতে মা বললেন। বললেন জিজ্ঞেস করতে চা খাবেন কিনা?”

“তাই তো বলি, তুমি নিজ থেকে কেন খেয়াল করবে। চাইতে হবে। কাজ থেকে আসি যখন মাথা ভার হয়ে থাকে। চা পেলে ভালো লাগে।”

“আপনি চান খেয়াল রাখি? চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পছন্দ হলো না যে। প্রথম প্রথম নিজ থেকে চা বানিয়ে আনতাম। মা বিরক্ত হতেন। অসময়ে সন্ধ্যায় চা খেলে আপনার ঘুম হবে না বলতেন। আপনি তো তখন বলেননি যে চা খেলে ভালো লাগে। অথচ আমার মনে হতো অফিস থেকে ফিরে এককাপ চা পেলে আপনার ভালো লাগবে। কিন্তু বুঝেছিলাম ভুল ভাবছি। এরপর দেখতাম আপনিই চা চান। কিন্তু আমার কাছে না, মায়ের কাছে। মা আমাকে বানিয়ে দিতে বলে। আমি বানিয়ে আনি। বাকি বিষয়গুলোও তাই। খেয়াল ভেবে যা করি, তা বিরক্তির কারণ হয়ে যায়। গুছিয়ে রাখলে খুঁজে পান না। মা হাত না দিলে তা ঠিক মনে হয় না। এভাবে খেয়াল রাখা যায়?”

সায়েম একটু বিব্রত হয়ে যায়। মনে পড়ে একদিন একটু রাগ দেখিয়েই বলেছিল, ওর কাজগুলো করার আগে তুলতুল মাকে দেখিয়ে নেয় না কেন। জিনিস নতুন জায়গায় রাখলে সায়েম খুঁজে পায় না। তুলতুল বলেছিল সায়েম কী কিভাবে চায় তা বললে সে সেভাবে অবশ্যই করবে। কিন্তু সায়েমই এ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। ঘরোয়া কাজ মেয়েলী মনে হয়। তুলতুল নিজ থেকে করতে গেলে জান্নাত আরার ঠিক মনে হয় না, একই কাজ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নেড়ে চেড়ে বলবেন এবার ঠিক হলো। তাই এখন তুলতুল না বললে হাতই দেয় না।

জান্নাতের আরা ভেবেছিলেন তুলতুল শাশুড়ির সাথে পাল্লা দিতে স্বামীর কাজে ভাগ চাইবে। যেভাবেই হোক সায়েমের পছন্দের রান্না, সায়েমের কাজগুলো করে হলেও সায়েমের কাছাকাছি যেতে চাইবে। যেভাবে দশজন মন জেতার চেষ্টা করে। কিন্তু তুলতুল সেদিকে হাঁটলই না। শাশুড়ির সংসার নিজের করে পাওয়ার চেষ্টা অথবা সায়েমকে জয় করার লড়াইয়ে নামার বদলে বরং নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হলো। এমন না যে সংসারের কাজ করে না। কী করতে হবে তা নির্ধারিতই থাকে। বাকিসময় নিজের মতো করে রুম গোছায়। জান্নাত আরা সেখানেও হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তুলতুল কোনো চাদর বিছালে বলতেন মানায়নি। অযথাই বদলাতেন। অথচ তুলতুলকে দেখে মনেই হতো না এতে তার কিছু আসে যায়। অযথাই জান্নাত আরার পরিশ্রম পণ্ডশ্রম। অবসরে বারান্দার গাছের যত্ন নেয়। নিড়ানি দেয়, পানি দেয়। সায়েমের সাথে গল্প করার যেন কোনো আগ্রহই আর বাকি নেই। সায়েম মায়ের রুমে গিয়ে গল্প করে। মাঝেমাঝে আগ্রহ নিয়ে দরজায় তাকিয়ে দেখে তাদের গল্পের মাঝে অনাহূত অতিথি হয়ে তুলতুল কি আসতে চায় কিনা। কিন্তু না, তুলতুল সেই সময়টা পড়তে বসে। মাঝেমধ্যে জান্নাত আরা নিজেই ডেকে এটা সেটা দিতে বলেন। তুলতুল দিয়ে চলে আসে। দাদী শাশুড়ি তুলতুলকে বোঝার চেষ্টা করেন। নাত বৌয়ের এই নিরামিষ আচরণ দেখে হতাশও হন। ভেবেছিলেন বৌ শাশুড়ি ভালো দ্বন্দ্ব দেখবেন। অথচ এই মেয়ে যেন উল্টো পথে হাঁটে।

স্বস্তিতে জান্নাত আরা নিজে আছেন তাও নয়। তুলতুল কয়েকদিন নিজের মতো রাঁধতে গিয়েছিল। আগে কিছুই বলতেন না। খেতে বসলে বলতেন সায়েম এই খায় না, তিনি আজ এটা খাবেন না মুখে রুচি নেই, একটু জলদি ভর্তা করে নিতে। এখন কী রান্না হবে তুলতুল তা জান্নাত আারাকে আগেই জিজ্ঞাসা করে নেয়। সায়েমকে ম্যাসেজ করে জানায় এই এই রান্না হবে, খাবে কিনা না অন্য কিছু রাঁধবে। বিষয়টা আপাত দৃষ্টিতে স্বস্তিদায়ক মনে হলেও ঠিক তা নয়। এ যেন মুখোমুখি না দাঁড়িয়েও এক ধরনের বিরোধিতা করা। অপরপক্ষে যতই কোমরে আঁচল গুঁজে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হোক না কেন এ পক্ষ ততটাই নিঃস্পৃহ।

“তুলতুল, দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসো। আচ্ছা না থাক। তুমি বসো। আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি। আজ তোমার সাথে চা খাই।”

এসময়টা চা হাতে সায়েমের মায়ের ঘরে গল্প করতে যাওয়ার কথা। সায়েমের জন্য চা বানানোর সময় নিজের জন্যও এককাপ বানায় তুলতুল। পড়তে পড়তে চা খেতে ওর ও ভালো লাগে। নিজেকে ভালো রাখার এই পথগুলো তুলতুল নিজেই আবিষ্কার করে নিয়েছে। সেদিনের সেই রিকশাওয়ালা মামার কথার পর থেকে তুলতুলের মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। যাদের কাছে তার চোখের পানির মূল্য তৈরি হয়নি, তাদের নেক নজর পাওয়ার জন্য কান্না করে অর্থ শুধু নিজের উপর জুলুম করা।

“আজ আমার সাথে চা খাবেন যে?”

“চা খাব না। গল্প করব। তুমি তো অনেক গল্প করতে পারো। তোমার বান্ধবীরা বলেছিল তুমি নাকি মারাত্মক বুদ্ধিমতী, বাকপটু। এত মজা করে গল্প বল যে হেসে পেটে খিল ধরে। মিতুলের সাথে ফোনে গল্প করার সময় কী চমৎকার করে হাসো। আমার সাথে তো এমন করো না। তাছাড়া বিয়ের এতোদিনেও তুমি করে বললে না। কেন?”

“কেন? আমি যদি বলি আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা বেয়াদবি হিসেবে গণ্য হলো। আমার বুদ্ধি আমারই জন্য কাল হলো। বেশি বোঝা শুরু করলাম। কিন্তু সঠিক সময়ে তার লাগাম আপনিই টেনেছেন। আপনিই বুঝিয়েছেন আপনার উপর আমার অধিকার কতটুকু। ততটুকু যতটুকু না দিলে আপনি থেকে তুমিতে আসা যায় না। আমাদের কথা বলার জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করার দরকার কোনোদিনই ছিল না। কেননা সম্পর্কের ভেতর কিছু আগল থাকলেই চলে। আমার জন্য আপনার শাসন বারণ এই দরজার এপাশেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারতো। তাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গিয়ে সবার কিন্তু আপনিই করেছেন।”

“তুমি তাহলে মনের ভেতর এসব পুষে রেখেছ?”

“পুষে রাখিনি। তবে নিজের সীমা কতটুকু তা মনে রেখেছি।”

“এতো অভিযোগ হলে এত কাছাকাছি থাকা কেন। একই বিছানায়। বাহুডোরে? ভালোবাসা নেই তাতে?”

“সেই বাহুডোরে ভালোবাসা টের পান? কিছু বিষয় দায়িত্বের সাথে সাথে। অধিকারের সাথে আসে। আর তাতে ভালোবাসা আছে কিনা তা জোর গলায় বলা যায় না। প্রত্যেকটা মানুষের ভালোবাসার একটা আলাদা রূপ আছে। কেউ ঝগড়ার মাঝেও ভেজা চোখে ভালোবেসে যায়। কেউ দৈনন্দিন সব কাজের ফাঁকে নিজের মানুষটার চোখে একটু ভালোবাসার খোঁজ পেতে নানা ছুতোয় বারবার সামনে আসে। অযথাই কপালের টিপটা ঠিক করে। আঁচড়ানো চুল আবার আঁচড়ায়। ঘর্মাক্ত নিজের মানুষটা যখন দিনশেষে ঘরে ফিরে, তার কপালে জমে থাকা ঘামের ফোঁটায়ও কিন্তু ভালোবাসা থাকে। ভালোবাসার জন্য শরীর কাছে আসা লাগে না সবসময়। তবে হ্যাঁ গভীর ভালোবাসার পর যখন শরীর কথা বলে, তার ভাষা অনেক বেশি সুন্দর হয়। আহ্লাদী তরুণী হোক, বা বাস্তবতার আঘাতে ক্লিষ্ট তরুণ। দিনশেষে সবাই ই নিজের মানুষটার কাছ থেকে শুধু শারীরিক স্পর্শ না, বরং উষ্ণ অভ্যর্থনা চায়। একটা আদুরে আলিঙ্গন চায়। সবার সামনে প্রয়োজন নেই। ভালোবাসা লোক দেখিয়ে করতে হয় না। আড়ালেই একটু জড়িয়ে ধরা, কপালের ঘামটুকু মুছে দেওয়া, কখনো একটা নির্দোষ চুমু। এইটুকু নিয়েই জীবন কাটানো যায়। রোজ ঘড়ি ধরে গল্প করতে হয় না। কাজের ফাঁকে একটু খুনসুটি, এক কাপ চা খেতে খেতে দুটো ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে পরিবারের বাকিদের ভুলেও যেতে হয় না। হানিমুনে না নিলেও চলে। কিন্তু মাঝেমধ্যে বাইকের পেছনে বসিয়ে একটু বাইরে গলি পর্যন্ত নিয়ে যেতে, হুড খোলা রিকশায় বসে বৃষ্টি বিলাস করতে, ছাদে বসে চাঁদ দেখতে কিংবা মোড়ের টং এ চা খেতে খরচ লাগে না। লাগে একটু ইচ্ছে। এইটুকু করতে পারলে ভালোবাসা কারও চেয়ে নিতে হয় না। এমনিই আসে। হুড়মুড়িয়ে বর্ষার হঠাৎ বৃষ্টির মতো।”

তুলতুল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

“যান, মা ডাকছে। অপেক্ষা করছেন আপনার।”

ডাকটা সায়েমের কানেও গিয়েছে। কিন্তু আজ কেন জানি উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না। নিজের হেলায় সুন্দর কিছু অনুভূতি কি জীবন থেকে হারিয়ে ফেলছে?

এতদিন মনে হতো নারীদের অস্ত্র হলো অযথা দুর্বোধ্য অভিমান, আর চোখ ভরা জল। অথচ আজ মনে হচ্ছে কিছু অভিমানের ভাষা বোঝা খুব কঠিন কিছু না। তবে একটু সময় নিয়ে চিনতে হয়। যদি একটু নরম হলে, একটু আদরে জড়িয়ে নিলে কিছু অভিমান ইতি হয়। তবে সেইটুকু না করাটাই অপরাধ।

সঙ্গমের সময় সঙ্গীকে বুকে জড়িয়ে নেওয়াটাই ভালোবাসা নয়। বরং মাঝেমধ্যে এমনিতে বুকে জড়িয়ে সঙ্গীর না বলা শব্দগুলো বুঝে নিতে হয়। এতে সম্পর্ক সহজ হয়, একে অপরকে তখন ভালোবাসতে শুরু করে। সম্পর্কে পালতে হলে ভালোবাসাটাই পালতে হবে, অভিমান নয়। এতে বরং সম্পর্কটা ক্ষয় হয়।

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২২

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২২

মিতুল কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় একটাও খালি রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ বাসায় তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। মায়ের শরীরটা ভালো না। আজ কলেজে আসতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার ডেট ছিল আজ। ডেট মিস করলে মার্কস কাটা যাবে। তাই বাধ্য হয়ে এসেছে। ভেতরে ভেতরে একটু অস্থিরতা বোধ করছি মিতুল। গতকাল রাতে রফিক সাহেব জানিয়েছেন ফারহান মিতুলের সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চায়। কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসতে চায়। মিতুলকে ফরিদা বেগম নিয়ে যাবেন।

যদিও আলাদা করে কথা বলার কী আছে রফিক সাহেব বোঝেন না। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে মুরুব্বিরা যা ঠিক করবেন তাইতো হবে। হ্যাঁ ছেলের অবশ্যই মেয়ে পছন্দ করার বিষয় আছে। কিন্তু এই ছেলে মেয়ে আলাদা করে কথা বলার তর তরিকা উনার পছন্দ না। কিন্তু তুলতুলের ঘটনার পর জোর গলায় নাও করতে পারছেন না। যদিও এখন মনে হচ্ছে স্ত্রী ফরিদা ঠিকই বলেছেন। এসব তো ভাগ্যের বিষয়। কার স্বামী রগচটা না হয়ে ঠান্ডা হবে কার স্ত্রী শুধু দেখতেই ভালো না, সাথে গুণবতীও হবে, এগুলো তো মানুষের হাতে থাকে না। কিছু জিনিস কপালেও থাকে। আর সায়েম তো খারাপ ছেলে নয়। বরং ছেলে মানুষ তো এমনই হয়। আজকাল মেয়েদের ভেতরেই বরং ধৈর্য কমে গেছে। এই যে এখন তুলতুল ধৈর্য ধরে সংসার করছে, সব কী সুন্দর ঠিক হয়ে গেছে। তুলতুলের কোনো অভিযোগ নাই, ওকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ির নালিশ নাই। মিতুলের ক্ষেত্রেও তাই হবে যদি মিতুল ফারহার বিষয়টা গুরুত্ব না দিয়ে বিয়ের পর স্বামীকে নিজের করে নিতে পারে। তাহলে অন্য কিছুতে কিছু যায় আসে না। মিতুল আর ফারহার আলাদা জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলে কয়েকবছর পর এসব কারও মনেও থাকবে না। দেখাই হবে কয়দিন। আপন বোনে দেখা হয় না মাসে। এখানে তো চাচাতো বোন। শুরু শুরুতে একটু পারিবারিক গ্যাদারিং গুলো এড়িয়ে গেলেই হবে।

আর ভাই ভাই একদিন এমনিতেই আলাদা হয়। তিনি আর শফিক সাহেব তো আগেই আলাদা হয়েছেন। এখন সামান্য মন কষাকষিতে কী যায় আসে। যার যার আলাদা পরিবার। বরং ফারহানের পরিবারের জাঁকজমক দেখে মনে মনে রফিক সাহেব সন্তুষ্ট। সায়েমের চাইতেও ভালো পরিবারে বিয়ে দিচ্ছেন ছোটো মেয়ের। সায়েমের পরিবার তো নিজেদেরকে হনু ভেবে একটা ভাব দেখাচ্ছিল। এখন তারাও বুঝবেন তাদের চাইতেও ধনী পরিবার, যোগ্য ছেলে উনার মেয়েদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করতে আগ্রহী। এটা কি কম বড় জবাব দেয়া হলো? বাকি অন্যদের ইচ্ছা অনিচ্ছাটা এখানে বড় কোন বিষয় না। তারপরও ছেলে যখন চাইছে আলাদা করে বসুক একদিন। মিতুলের মা না হয় সাথে যাবে। ছেলেও কি আর একা আসবে? পরিবারে কেউ তো সাথে আসবেই নিশ্চয়ই। তাই নিমরাজি হয়েছেন।

এদিকে মিতুলের অবস্থা খারাপ। এটা কি প্রেম নাকি শুধুই পাগলামি অনুভূতি জানা নেই। তবু সেই অজানা অনুভূতির জ্বালায় মিতুলের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। সেদিনের পর থেকে আরমানের নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলে না। যখন তখন হুটহাট ম্যাসেজ আসে না। মিতুল এলোমেলো কথা লিখে, একা একা বিশাল বিশাল রচনা লিখে, ঝগড়া করে গদ্য লিখে। কিন্তু সেন্ড বাটনে চাপ দেওয়া হয় না। আরমানের মনে কষ্ট দিয়েছে, ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু স্যরির কথা লিখতে গেলেই কেমন ভালোবাসার কথামালা হাত জড়িয়ে নাকি কান্না করতে থাকে।

“ওদিন আমি কথাটা এভাবে বলতে চাইনি। আমার ভুল হয়েছে। আপনাকে মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিয়েন।” এই লাইন লিখতে গিয়ে মিতুল লিখে,

“এই ব্যাটা, এত ভাব কেন? কী এমন বলছিলাম যে ভাব নিচ্ছ? জানো না মেয়েদের সাথে ভাব নেয় কাপুরুষেরা। মেয়েরা রাগ করলেও তাদের সাথে গরম হতে নেই। এই কথাটা কেউ আপনাকে বলেনি? আমি তো রেগে ছিলাম। আপনি বুঝি একটু ভালোবেসে কথা বলতে পারেননি। আমাকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে এলোমেলো কথা বলানোর দরকার ছিল? এখন আবার কথা বন্ধ রেখেছেন। আমার কষ্ট হয় না? আমায় অন্য কেউ নিজের করে নিয়ে গেলে তখন বুঝবেন। অবশ্য কী আর বুঝবেন। আপনি তো এখন মিরার স্বপ্নে বিভোর।”

এসব কী লিখছে দেখে হতভম্ব হয় মিতুল। অতঃপর ম্যাসেজও আর পাঠানো হয় না।

*** মিতুল রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়। মেইনরোডে গিয়ে দেখতে হবে কী আছে। ছাতার পক্ষে এই বৃষ্টির ছাট আটকানো অসম্ভব। ভিজে যাচ্ছে মিতুল। হঠাৎ একটা বাইক এসে পাশে ব্রেক কষে। মিতুল ভয় পেয়ে যায়। বখাটে কেউ নয়ত? মাথা থেকে হেলমেট খুলে আরমান বলে,

“কিছু পাবে না এখন। বাইকে উঠো। নামিয়ে দেই।”

মিতুলের মন চায় লোকটাকে দুটো লাগাতে। অথচ বিনা বাক্য ব্যয়ে সুর সুর করে বাইকে উঠে বসে।

“একদিন বোধহয় শিখিয়েছিলাম, বাইকে কিভাবে বসতে হয়। ভুলে গিয়েছ বোধহয়। অবশ্য সামনে চার চাকার মালকিন হবে। বাইকে বসা না শিখলেও চলবে।”

মিতুল নেমে দাঁড়িয়ে যায়।

“ঠিকই বলেছেন। আপনি বরং মিরাকে শেখান।”

আরমান মিরার কথা শুনে অবাক হয়। মিতুল মিরাকে হিংসে করছে?

“সে তুমি বিয়ের পর শিখে নিও। আমিও যাকে শেখানোর শিখিয়ে নেব। এখন আপাততঃ এই দুই চাকার বাইকে বস।”

মিতুল সামনের দিকে হাঁটা শুরু করছে দেখে আরমান মিতুলের হাতটা টেনে ধরে। বিদ্যুৎ চমক খেলে যায় মিতুলের দেহ মনে। এক মুহূর্তের জন্য অবশ লাগে শরীর।

“আই অ্যাম স্যরি। আচ্ছা আর কিছু বলব না। যেভাবে বসার বস। আসো নামিয়ে দেই। তুমি বৃষ্টির পানি সহ্য করতে পারো না। নির্ঘাত জ্বর বাঁধাবে।”

এরপর আর না করা যায় না। মিতুল উঠে বসে। আরমান বাইক টান দিতেই শার্টের কোনা খামছে ধরে।

“এই জন্য ঠিক করে বসতে বলেছি। ব্যাগটা মাঝে দিয়ে বস। গায়ে গা লাগবে না। তুমিও অস্বস্তি অনুভব করবে না। আমিও নিজের মতো চালাতে পারব। ভয় পেও না, আমি তোমাকে পড়তে দেব না।”

মিতুল মনে মনে বলে, “আমি তো পড়তেই চাই। প্রেমে পড়তে চাই। অথচ আপনিই মাঝে দেওয়াল তুলে দিয়ে বলছেন পড়তে দিবেন না। ঠিক আছে দিয়েন না।”

মিতুলের মনের কথা তো আর আরমানের শোনা হয় না। বাইকের গ্লাসে শুধু এক তরুণীর বৃষ্টি ভেজা নির্মল মিষ্টি মুখ আড় চোখে দেখে আর ভাবে,

“আমি ভবঘুরে একজন মিতুল। আমার সাথে তেমার জীবন অনিশ্চিত ভেলা। তোমার সিদ্ধান্তই সঠিক। এত মিষ্টি সুন্দর একটা মেয়ে তুমি। তুমি এমন কাউকেই ডিজার্ভ কর যে এমন বৃষ্টির দিনে তোমাকে লং ড্রাইভে নিয়ে যেতে পারবে। বৃষ্টির একটা ছাটও তোমার গায়ে লাগতে দিবে না। ভিজে জ্বর উঠতে দিবে না। তবু আজ এই বৃষ্টির দিনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। রোজ তোমার কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকার কী এক অদ্ভুত রোগে পেয়েছিল। হয়তো আজকের এই দিনটির জন্যই। এমন একটা দিন পাব বলেই। এক তরফা ভালোবাসতে সবাই পারে না মিতুল। তবে আমি খুব ভালো করেই পারব। হয়তো একটা সময় আমাদের সমস্ত যোগাযোগ পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের সম্পর্ক কোনো নাম পাওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। তবু তখনও আমি তোমাকেই ভালোবেসে যাব।’

***

” আপনি এখানে কী করছিলেন?”

“একটা অকাজে এসেছিলাম।”

“অকাজে? বুঝেছি। আচ্ছা আপনি আমার সাথে স্বাভাবিক কথা বললে কী হয়?”

“আরে সত্যি অকাজে এসেছিলাম। এক বন্ধুর বাসায় আড্ডা দিলাম। আমার অনেক ফ্রি টাইম যে।”

“আপনার পেজ দেখেছি। অনেক সুন্দর হয়েছে আলতা দীঘির ছবিগুলো। আপনার তো অনেক ফলোয়ার।”

“আমার না, ছবির ফলোয়ার।”

“ছবি তো আপনার তোলা। আপনি ছবি তোলা পেশা হিসেবে নেন না কেন?”

“নিয়েছি তো। তবে আমার পেশাটা আলাদা। আমার রুটিন জব ভালো লাগে না। আমি যাযাবর ধরনের মানুষ।”

“যাযাবর রা তো সংসারী হয় না। আপনি তো বিয়ে করছেন।”

“বিয়ের পর বৌ যায়াবরের সংসার হবে। বেদেদের মতো একবার এক জায়গায় খুঁটি গাড়ব।”

মিতুলের খুব কান্না পায়। বলতে ইচ্ছে করে, “এই খারাপ লোক শোনেন। ছোটোবেলা থেকে আমারও খুব জিপসি হওয়ার শখ। আমাকে আপনার সঙ্গী করে নেন। আপনার সাথে সূর্য ডোবা দেখব। আলতা দীঘি দেখব। খোলা মাঠের শিশিরে পা ভিজিয়ে হাঁটব। এমন বৃষ্টির দিনে খুব ভিজব। ভিজে জ্বর বাঁধাব। আপনি আমাদের অস্থায়ী কুটিরে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে সেই জ্বর নামাবেন। আমার চার চাকা চাই না। আপনার সাথে এই দুই চাকার বাহনেই সংসার পাতব।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২১

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২১

আরমান শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসে। মিরাকে এত আয়োজন করে দেখতে আসবে না

“আমার পছন্দ অপছন্দের কিছু নাই মা। তোমার যদি মনে হয় মেয়ে ভালো, এবং তোমার অপদার্থ ছেলেকে জেনেশুনে বিয়ে করতে রাজি। তাহলে আমারও কোনো আপত্তি নেই।”

“এসব কী কথা আরমান। তুই আবার পিছলাতে এসব বলছিস। একটা বার মেয়ে দেখ। কথা বল। ভালো না লাগলে জোর করব না সত্যি।”

আরমান মায়ের হাতটা ধরে বলে,

“মজা করছি না মা। সত্যি বলছি। আমার ভালো খারাপ লাগার কিছু নেই। আমাকে ভালো লাগে কিনা সেই প্রশ্ন হলে আমি অবশ্যই যাব।”

“তুই কি হেঁয়ালি শুরু করলি।”

“আচ্ছা চলো, তুমি যেহেতু আমাকে ছাড়া মানবেই না।

***

“মিরা আপনার সাথে আমার পরিচয় নেই। শেলী আপার বিয়ের সময় হয়তো এক দুই বার দেখা হয়েছ। পারিবারিক আয়োজনে হয়তো চোখাচোখি হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে আপনার বিষয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না। হয়তো আমার বিষয়েও আপনার কোন ধারণা নেই। হয়তো আমাদের দুজনেরই দুজনের বিষয়ে কখনো কোনদিন কোনো আগ্রহ ছিল না বলেই এমনটা হয়েছে। তবু আজ দুজন এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম আমি আপনাকে বলতে চাই যদি আপনার পরিবারের চাপ থাকে তাহলে আমাকে পরিষ্কার বলতে পারেন।”

“কী ধরনের চাপের কথা বলছেন? জোর করে বিয়ে দেওয়ার? এই বয়সের মেয়েদের আর জোর জবরদস্তি করতে হয় না। তারা নিজেরাই ভাবে বিয়ে করে বাবা মাকে উদ্ধার করি। ভাইকে চিন্তা মুক্ত করি। ভাবির ভ্রু কুঞ্চন থেকে মুক্তি পাই।”

“আমাদের দেশের মানুষের একটা সমস্যা আছে। বিয়ের একটা প্রাথমিক বয়স তারা মাইন্ড সেট করে ফেলে। সেই বয়সে সবচাইতে স্ট্যান্ডার্ড কিছু ক্রাইটেরিয়া তারা সেট করে। যে ক্রাইটেরিয়া ছাড়া পাত্র-পাত্রী মিলে না। মানে পাত্র পাত্রীর গুণ মিলে না। পাত্রী লম্বা ফর্সা সুন্দর ধর্মপরায়ণ আধুনিকা সুরাঁধুনি এসব গুন থাকতে হয় আর পাত্রের জন্য মূল ক্রাইটেরিয়া হলো তার ক্যারিয়ার। বিসিএস হলে সবচাইতে বেস্ট। এবারে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয় ভালো ব্যবসায়ী। আপনাকে বলি আমি সেই ক্রাইটেরিয়া তে পড়িই না। বলার মত কোন কাজই করি না। তবে পেট চলে যায়। সেদিক থেকে ভাবলে আমার মত ছেলে কারও ড্রিমবয় টাইপ স্বামী হওয়া সম্ভব না। এভাবেই অ্যারেঞ্জ বিয়ে করতে হবে আমাকে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তো বিষয়টা তা নয় আপনি কারো প্রেসারে পড়ে কিছু করার দরকার নেই।”

মীরা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে তারপর আরমানকে বলে,

“আমার জন্য বিষয়টা আলাদা মনে হওয়ার কারণ?আদর্শ পাত্রীর যে বর্ণনা দিলেন সে অনুযায়ী তাহলে আমিওআদর্শ পাত্রীর ক্রাইটেরিয়াতে পড়ি না। আমার শ্যামলা বর্ণ, খাটো হওয়া কোনটাই বোধহয় আমার পারদ কে উঁচু করে না। পড়ালেখাও গড়পড়তা মানের। সব কোনোমতে চলে ধরনের। তবু পরিবার চেয়েছিল আপনার বর্ণনা মতে একজন আদর্শ পাত্রের সাথে বিয়ে হোক। সেই খোঁজে বেলা পার হয়েছে। এখন সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে বিবাহ উত্সব অনুষ্ঠিত করার প্রয়াস।”

“তাহলে কি তুমি সেজন্যই বিয়েতে রাজি? কেউ না পেলে কেউ হলেই চলবে বলে?”

“বলতে পারেন। আপনার জন্য হয়তো বিষয়টা তা নয়। ত্রিশ প্লাস বয়স ছেলেদের জন্য কিছু না।”

“কিন্তু পছন্দের মেয়ের পাণিপার্থী হওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই।”

“তাহলে আমরা দু’জনই তবে দু’জনের জন্য যথাযথ। কেউ না পাওয়ার চেয়ে কেউ পেলেও ভালো।”

“কেন এতে লাভ কী হবে? ”

” এতে ক্ষতি বা কী? বিয়ে তো করতেই হবে। প্রথমে সবাই সেরাই খোঁজে।’

“না পেলে চলনসই হলেও নিতে রাজি?”

“ছেলেদের আবার চলনসই কী? ছেলেদের মুখে এসব কথা কখনো শুনিনি। রিজেকশন পেলে ছেলেদের অনুভূতি কেমন হয় আমি জানি না। তবে নারী হিসেবে আমার রিজেকশন পাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আর তাতে দেখেছি বেশিরভাগ ছেলেরাই ভাবে সোনার আংটি বাঁকাও ভালো।”

“তাহলে আমি বাঁকা হলেও ভালো বলে মনকে বুঝ দিচ্ছেন? ”

“আপনিও তো আমাকে… ”

“থামলেন যে?”

“বাদ দিন। অন্য আরেকদিন।”

“আচ্ছা তাহলে অন্য আরেকদিন।”

***

“আপু, তোমার দেবরের কী খবর?”

“আরমান ভাইয়ের?”

“হুম। বিয়ে ঠিক?”

“হ্যাঁ বিয়ে তো ঠিকই।”

“হ্যাঁ বলে দিয়েছেন?”

“ওটা তো একরকম হ্যাঁই ছিল। বাকিটা ফর্মালিটি।”

“ওহ। বিয়ে কবে?”

“আগে তো এনগেজমেন্ট হবে।”

“কবে?”

“এই তো এই মাসের বাইশ তারিখ। ছোটো করে ঘরোয়া অনুষ্ঠান হবে। আসবি তো সবাই। বাসায় দাওয়াত দিবে। শেলী আপা তো খুশি। অল্পতে ননদ পার হচ্ছে। যা দেখলাম মেয়েদের অল্পতে পার করতে পেরে সবাই খুশি হয়। আচ্ছা এদের কথা বাদ দে। বাড়িতে এত কাহিনি হলো সে নিয়ে বল। আম্মু আর চাচীর কি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ?”

“বন্ধই তো। ফারহা আপু এসে আমাকে কত কথা শুনিয়ে গেল। আমি নাকি হিংসা করে ঐ লোককে পটিয়েছি।”

“তুই কী বললি?”

“একবার ভেবেছিলাম সব ব্যাখ্যা করব। পরে বাদ দিলাম। বললাম ভাই যা ভেবে খুশি হও মনে শান্তি পাও তাই ভেবে নাও।”

“বাহ রে এত সহজে তুই ছেড়ে দিলি? দোষ না করে দোষী বানালো তুই কিছুই বললি না?”

“কী বলবো আপু। ফারহাপুর জায়গা আমি থাকলে আমিও বোধহয় এ ভাবেই রিয়েক্ট করতাম।”

“ছেলেটার সাথে ফারহার সম্পর্ক কেমন ছিল জানা উচিত। তোদের আর কথা হয়েছে?

” ফারহানের সাথে? হ্যাঁ নক করেছিল।”

“কী বললি?”

“বললাম বিষয়টা এভাবে জটিল না করলে ভালো হতো। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে।”

“সে কী বলে?”

“বলে এসব তার চিন্তার বিষয় না। তাকে অনেকেই চায়। ভংচং এসব কথা। নার্সাসিস্ট একটা।”

“ছেলেটাকে খুবই ইনসেনটিভ মনে হচ্ছে। ফারহার সাথে আসলেই ঠিক হয়নি। আব্বু আম্মু তাও গোঁ ধরছে!”

“ছেলে মানুষ তো এমনই।”

“সেটাও ঠিক। সায়েমকেই দেখ না।”

“আপু সায়েম ভাইয়ের সাথে মিটমাট করবি না?”

“করব। ইনফ্যাক্ট করা শুরু করেছি।”

“গুড।”

“গুড ব্যাডের কিছু নেই। বনে বেঁচে থাকতে হলে শিকারি হতেই হয়।”

“মানে?”

“মানে পালিয়ে পালিয়ে চললে নিজেই শিকার হয়ে যাব। তাই শিকারি হয়েই মাছ শিকার করব।”

“তোমার কথা কিচ্ছু বুঝি না। বিয়ের পরে আর রহস্যময়ী হয়ে যাচ্ছে। ”

“আমি বুঝে ফেলেছি।”

“কী?”

“পুরুষের দুর্বলতা।”

“মানে?”

“সায়েমের নখরামি স্বভাব পূরণ করার জন্য মা বোন আছে। কিন্তু দরজা বন্ধ হলে অন্য আরেকটা দুনিয়া। এই দুনিয়ায় ওর আমাকে প্রয়োজন। আমারও এখন প্রয়োজন থেকে প্রিয়জন হতে হবে। যেহেতু বের হয়ে আসবো না। তাই সেখানেই থাকার জায়গা বানাতে হবে। ”

“আপু একটা কথা বলব?”

“জানি কী বলবি। তুই আমাকে কী বুঝবি আমি নিজেই নিজেকে বুঝতে পারছি না। আচ্ছা আগে সফল হই তারপর তোকে বুঝিয়ে বলব। ঠিক আছে?

“আপু আমি ফারহানকে বিয়ে করতে চাই না। অথচ আব্বু আম্মুর কেমন রোখ চেপে গিয়েছে। চাচার উপর রাগ করে হলেও এখানে বিয়ে দিবে।”

“অপেক্ষা কর।”

“কিসের?”

“পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। আগে কিছু বলার দরকার নেই। তোর যেহেতু কোনো পছন্দ নেই তাই আগে কিছু বলতে যাস না। বাকিটা অপেক্ষা কর।”

“যদি সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যায়?”

“শোন বিয়ে যদি করতেই হয় এমন ছেলে কে করবি যে অন্যের কথাও চলে না, নিজের জিদেও চলে না। যার একটা ভালো মন আছে। যে সম্মান দিতে জানে। যে অন্যের মতে চলে তার পা অন্যের মর্জিতে চলে। যে নিজের জিদে অন্যকে চালিত করে সে স্বার্থপর হয়। জীবনসঙ্গী সহমর্মী হওয়া উচিত প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। খুব কষ্ট বিষয়টা। আমার খুব কষ্ট হয়। তুই এই কষ্টটা পাস তা আমি চাই না।”

“আমিও না আপু। কিন্তু আমি যাকে চাই সে যদি আমাকে না চায় তাহলে তো নিয়তি কে মেনে নিতে হয়।

“তুই কাকে চাস?”

“কথার কথা।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২০

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২০

“তুলতুল।”

“জি আপু।”

“মুখ ফুলে গিয়েছ দেখি। আমাদের বাসার আলো বাতাসে মাশাল্লাহ স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে।”

“জি আপু আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আপু দেখেন হাত, পা, মুখ সব ফুললেও ওজন গিয়েছে কমে। বিয়ের আগে ছিলাম একান্ন কেজি। এখন আটচল্লিশ।”

“মেশিন নষ্ট নাকি দেখ।”

“চলেন দেখি।”

তুলতুল সত্যি সত্যি ওজন মাপার মেশিন নিয়ে আসে।

“আপু আপনার ওজন কত? মেপে দেখলে বুঝব মেশিন ঠিক আছে না ভুল।”

“বাদ দাও। আমি তো থাইরয়েডের রোগী। ডায়েট করলেও ওজন কমে না। আমার ওজন বেশিই দেখাবে। আর তুমি কিন্তু মোটা হও নাই।।বিয়ের পর মেয়েদের চোখমুখ একটু ফুলে, এতে আরও সুন্দর লাগে। তোমাকেও লাগছে।”

শেলীর বিরস মুখের প্রশংসা তুলতুল গায়ে মাখে না। মেশিনটা নিয়ে রেখে আসে। মানুষের চিন্তা করার অনেক সময় থাকে। তুলতুলের চিন্তা করার সময় হলো গোসলঘর। মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালতে ঢালতে তুলতুল ঘটনাপ্রবাহ ভাবে। কী হলে কী হতে পারে। নতুন বিয়েতে মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো আতংক এই থাকে যে কোন অপরাধে জানি বাবার বাড়িতো নালিশ পৌঁছে যায়, যার সর্বশেষ পরিণতি হতে পারে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া না হলে চলে যেতে বাধ্য করা। যে অপরাধে এই শাস্তি এই সমাজে হয় সেই অপরাধের কিছুই না করে সেই ধরনের মানসিক শাস্তি ইতোমধ্যে পেয়ে গিয়েছে। বাবা মায়ের মনেও সর্বোচ্চ ভয় এটাই যে মেয়ে বাড়িতে ফিরে আসবে। তো এরচেয়ে খারাপ হওয়ার আর কিছু নেই। যখন সর্বোচ্চ খারাপের দর্শন আর অনুভব হয়েই গিয়েছে। তখন আর কিসের পরোয়া? বলে না ‘সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কী ভয়’। নিজের সংসার খারাপ না করেই সায়েমকে বোঝাতে হবে শুধু মায়ের ছেলে হলেই ভালো ছেলে হওয়া যায় না। বোনের জন্য ভালো ভাইয়ের মতো স্ত্রীর জন্য যোগ্য স্বামীও হতে হয়।

***

“মিতুল, তোর চোখ মুখ ফুলে এ কী অবস্থা হইছে! ভাতও খাস নাই। বুঝছি বোন চলে যাওয়ায় খুব কষ্ট হইছে। এখন তুইও আমারেই দোষ দে। রাগ দেখা।”

“আম্মু, আপনার আর আব্বুর সাথে আমরা কোনো দিন আগে রাগ দেখাই নাই। এখনো দেখাব না। আপু কেন গিয়েছে জানেন না? আপুর শাশুড়ি কড়া হলেও সমস্যা ছিল না, যদি ভাইয়া আপুকে একটু বুঝত। আর ওনারা তো আপনাদের ডেকে নিয়ে বিচার বসায়। আপুর কত অপমান লাগে এসব। এজন্য চলে গিয়েছে। অযথা আপনাদেরও ছোটো করতে চায় নাই।”

“তোরা এখন কী চাস? আমরা সমানে সমান গলাবাজি করব? বয়স কম, বুঝ নাই। একপক্ষ আগুন হলে আরেকপক্ষ পানি হতে হয়। না হলে চলে না। যা হাতমুখ ধো। এত নরম হলে দুনিয়ায় চলবি কিভাবে?”

মিতুল স্বস্তি বোধ করে অবশ্য। মা যে তুলতুলের বিষয়টা ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি এতেই শান্তি। না হলে কান্নার কী ব্যাখ্যা দিত মিতুল। স্বস্তির স্থায়ীত্ব অবশ্য বেশিক্ষণ হয় না। মিতুলের দাদী বাড়ি ফিরেছেন থমথমে মুখে। ফিরেই ছেলে আর ছেলের বৌয়ের বিচার বসিয়েছেন। অভিযোগকারী মিতুলের চাচা চাচী। অপরাধী মিতুলের বাবা মা।

“আম্মা ঘটনা কী তাই তো বুঝলাম না? শফিক কী হইছে?”

“কী হয়েছে তা তো আপনি আর ভাবি জানেন বড়ো ভাই।”

“সেটাই তো জানতে চাইছি। বিষয়টা কী?”

“বিষয়টা বিশ্বাস ভাঙার। আমি কোনোদিন ফারহা আর মিতুলকে আলাদা চোখে দেখি নাই। ফারহার জন্য সুন্দর কিছু, ভালো কিছু কিনলে মিতুল আর তুলতুলকেও দেওয়ার চেষ্টা করছি। যেন না পেয়ে ওদের মন ছোটো না হয়। ফারহার জিনিস, আমার জিনিস কোনো ব্যবহার করতে দিয়েছি। যেন বোনে বোনে হিংসা না জাগে। বুঝতেই পারি নাই হিংসা তো অন্যদিক থেকেও আসতে পারে।”

“আহ্ জেসমিন। কী শুরু করলে। কোন কথা বলতে কোন কথা টানছ।”

শফিক সাহেব স্ত্রীকে থামিয়ে দেন।

“থামালে কেন ভাই। শুনি একটু। কী কী দয়া করলে তোমরা। ফারহার জন্য নতুন পুতুল আসলে পুরানো পুতুল ফেলে না দিয়ে মিতুল, তুলতুলকে দিয়েছ। জেসমিনের দামি শাড়ি পরতে দিয়েছ। কখনো কখনো ফারহার জামা জুতো একবেলা পরতে দিয়েছ। ফারহার জন্য কেনা দামি দামি জিনিস দেখতে দিয়েছো, ধরে খেলতেমদিয়েছ। আর কী?”

“আর কিছু না ভাবি?”

“আমি তো তাই জিজ্ঞাসা করলাম। আর কী?”

“আলাদা সংসার হওয়ার আগে-পরে আপনাদের দায়দায়িত্ব শফিক নেয়নি? বাসাও আপনাদের ছেড়ে দিলাম।”

“বাসা ছাড় নাই জেসমিন। পুরানা বাসায় থাকবা না বলে উপরে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছ। আর এই সাজানোর টাকা পয়সা এই সংসারে বসে গুছিয়েছ। একসাথে সংসার থাকার সময় তুলতুলের আব্বা তোমাদের কাছ থেকে একটা পয়সা বাজার খরচ নেয় নাই। সেটা হিসাব করছ কয় টাকা হয়?”

“তুমি খাবারের খোটা দিচ্ছ ভাবি? অথচ সবাই জানে ভাইয়া কী হিসাবি মানুষ। আমাদের এমনি এমনি কেউ টানেনি। আমরা দু’জনই আয় করা মানুষ। দুই হাতে খরচ করছি। আমি এভাবে চিন্তাই করি নাই এই যে হিসাব রাখতে হবে। কিন্তু মনে করে দেখ আম্মার কয়দিন আগে অপারেশন হলো। পিত্তের পাথর ফেলা লাগলো। সেই টাকা কে দিয়েছে? আম্মার ওষুধের টাকা কে দেয়?

” হ্যাঁ এখন তোমরা দাও। অথচ এর আগে আব্বার সমস্ত চিকিৎসা তুলতুলের বাবাই করিয়েছেন।
আম্মাকেও নিয়েও ডাক্তারের কাছে কম দৌঁড়াদৌঁড়ি করছেন।”

“হুম কে যে কত করার মানুষ সবাই জানে। কার হাতের ফাঁকে দিয়ে পানি পড়ে না এই কথা অন্তত কারও অজানা না। ফারহার বাবা আম্মাকে প্রাইভেট চেম্বারে দেখায়। বিশ ত্রিশ টাকার টিকেটে সরকারি হাসপাতালে না।”

রফিক সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কথা যত বাড়ছে, এক অপরকে তত আঘাত দিয়ে নগ্ন আক্রমণ করছে। তিনি সইতে না পেরে একটা ধমক দিয়ে ফরিদাকে চুপ করতে বলেন। শফিক সাহেবও জেসমিনকে মুখ বন্ধ করতে বলেন। রফিক সাহেব ভাইকে বলেন,

“শফিক এ বাড়িতে মহিলাদের এত মুখ চলা কবে থেকে শুরু হলো? ভাইয়ে ভাইয়ে যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে ভাই ভাই কথা বলে সমাধান করি। আম্মা মুরুব্বি জীবিত আছেন। আম্মা বলুক কী হয়েছে। বাকিরা চুপ থাকবে। আম্মা আপনি বলেন কী সমস্যা?”

“ঠিক আছে আমি বলতেছি। তোরা আগে চুপচাপ শোন। তারপর বলবি কার কী কথা আছে। রফিক ফারহার জন্য যে ছেলে দেখতেছে জেসমিন আর শফিক সে কথা তুই জানোস?

রফিক সাহেবের আগে শফিক সাহেবই উত্তর দেন,

“জানার তো কথা। আমি তো ভাইয়ের সাথে আলোচনা করছিলাম।”

রফিক সাহেব মাথা নাড়েন।

“জি আম্মা বলছিল শফিক।”

“সেই ছেলে কে সেটা জানোস?”

“তখন জানতাম না। এখন জানি।”

“কবে থেকে জানোস? মিতুলের জন্য একই ছেলে দেখার আগে না পরে?”

রফিক সাহেব চুপ করে থাকেন। শফিক সাহেব বলেন,

“দেখলেন আম্মা, আমি বলছি না ভাইজান সব জানেন। আপনি বলেন এসব করা কি খুব দরকার ছিল? এক বোনের জন্য কথা চলার সময় গোপনে আরেক বোনকে দেখানো। এসব কেমন আচরণ?”

যদিও জেসমিনকে চুপ থাকতে বলা হয়েছিল তবুও জেসমিন উত্তর না দিয়ে পারেন না। বলেন,

“ভাইকে জিজ্ঞাসা না করে ভাবিকে জিজ্ঞাসা করেন। আমরা বাড়িতে থাকব না এমন দিনে উনাদেরকে ডেকে মেয়ে দেখানো এসব ঘরোয়া রাজনীতির বুদ্ধি মহিলাদের মাথা থেকে আসে, পুরুষের না।”

ফরিদাও সমান বেগে উত্তর দেন,

“আমি কোনো বুদ্ধিও করি নাই রাজনীতিও করিনি। উনারাই আমাদের সাথে যোগাযোগ করলেন। রাহেলা জানাইছে যে মিতুলকে উনাদের ছেলের বেশি পছন্দ হয়েছে। উনারা ফারহার ব্যাপারে আগ্রহী না। মিতুলকে ওনারা একটু বাসায় এসে দেখতে চায়। আমরাও না করতে পারি নাই। ফারহার সাথে কি কোনো পাকা কথা হইছে? না তারা পাকা কথা দিয়েছে? তাদের ফারহাকে পছন্দ হয় নাই। মিতুল আর ফারহা তো আপন বোন না। তারা যদি মিতুলকে পছন্দ করে এতে অন্যের জ্বলে কেন?”

কথায় কথা বাড়ে সমাধান আসে না। মিতুল বা ফারহা বড়োদের এসব কথার মাঝে আসে না ঠিকই। কিন্তু দু’জনের মনেই কেমন একটা বিপরীতমুখী বিতৃষ্ণা। ফারহার অপমানে অন্তর জ্বলে যাচ্ছে। এভাবে তাকে ছোটো করতে পারলো ফারহান। আর মিতুলের মনে হচ্ছে ঐ লোকটা প্রস্তাব পাঠালো কেন। ঘর তো বটেই, আরমানের সাথেও তার জটিলতা তৈরি হয়েছে তার জীবনে ফারহানের উপস্থিতিতে। তার জীবনে ফারহানের অস্তিত্ব না থাকলে আজ আরমানকে এই কথা বলতোই না। চারদিকে কেমন জানি অশান্তির জাল বুনেই চলছে।

(চলবে)