Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 97



ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০৭

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
৭ম_পর্ব
~মিহি

মিত্তিম শৈশবের সাথে কথা শেষ করে পিছু ফিরতেই শৈশব পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। মিত্তিমের কানে কানে আলতো করে বলে উঠলো,”মিসেস.ফারহায ইফতেখার শৈশব, আই লাভ ইউ আ লট!” মিত্তিম কেঁপে উঠলো। হৃদস্পন্দনের ঊর্ধ্বগতি অনুভব করলো ঠিকই। মুচকি হেসে শৈশবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরে এসে অনিকে পর্যবেক্ষণ করলো। অনিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাবে ঠিক সে মুহূর্তে আবার অশুভ কলিং বেলটা বেজে উঠলো। মিত্তিম দ্রুত অনিকে অন্য ঘরে ফোনে কার্টুন চালিয়ে বসিয়ে দিল। নিজের ঘরে ফিরে শৈশবকে ডাকলো।

-“আল্লাহ! এবার কে আসলো? খালামণি ফিরে আসলো না তো?”

-“মিত্তি রিল্যাক্স, আমি এখানেই আছি। যাও দরজা খোলো।”

-“না না! আপনার এখানে থাকা যাবে না। একটা কাজ করেন। আমি দরজার পিছনে লুকাবো আপনাকে। দরজা খুলে খালামণি যখন ঢুকবে, আমি কোনোভাবে খালামণিকে ডিসট্র্যাক্ট করবোনি। আপনি তাড়াতাড়ি বের হবেন। বুঝছেন কথা?”

-“হ্যাঁ জান বুঝছি!”

-“ইশসস! এই টেনশনেও জান-কলিজা বের হয় কেমনে মুখ দিয়ে?”

-“ভালোবাসায়। চলো দরজা খোলো।”

শৈশবকে দরজার পাশে লুকায়ে ধীরে ধীরে দরজা খুললো মিত্তিম। যা ভেবেছিল তাই, তার খালামণি ফিরেছে। আসমাকে দেখে ঘাবড়ালেও মুখে তা প্রকাশ করলো না মিত্তিম।

-“খালামণি? চলে আসলে যে?”

-“ফোনটা ফেলে গেছি। তাছাড়া বাইরে রোদ, পরে বের হবো আরেকটু।”

-“আচ্ছা আসো। আমার ঘরে একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে মণি, চলো তো একটু দেখো।”

-“শব্দ? কিসের? আচ্ছা চল দেখি।”

-“না না আমার ভয় লাগতেছে। তুমি যাও।”

আসমা বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিত্তিমের ঘরে ঢুকলো। মিত্তিম তাড়াহুড়োয় শৈশবকে বের করলো দরজার পেছন থেকে।

-“তাড়াতাড়ি যান এখন।”

-“মিত্তি..”

-“যান তাড়াতাড়ি!”

শৈশব মিত্তিমের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। পরক্ষণেই মিত্তিমের গালে চুমু খেল গভীরভাবে। “ভালোবাসি জান..” বলেই শৈশব তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে বের হয়ে গেল। মিত্তিম গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। এই ছেলেটা আস্ত পাগল একটা! দরজা লাগিয়ে সামনে তাকাতেই মিত্তিম খেয়াল করলো অনি দরজা হালকা একটু ফাঁকা করে তাকিয়ে আছে। ঢোক গিললো মিত্তিম। মেয়েটা কিছু দেখলো কিনা! এখনকার ওয়ানে পড়া বাচ্চাকাচ্চাও যথেষ্ট পাকনা। মনে মনে খানিকটা ভয় পেলেও হাসিমুখে অনির দিকে এগোলো সে।

-“অনি? কী হয়েছে?”

-“কিছুনা আপ্পি। মা যাবো।”

-“মণি তো আমার ঘরে। তুমি ফোনটা রেখে মণির কাছে যাও!”

-“আচ্ছা আপ্পি।”

অনি যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিত্তিম। যাক মেয়েটা কিছু দেখেনি। ফোন হাতে পেয়েই ছাদের দিকে দৌড় দিল মিত্তিম। শৈশবকে একবার কল করা উচিত। ছেলেটা কি যেতে পারলো নাকি আবার কোনো বিপদে পড়লো? তড়িঘড়ি করে শৈশবের নম্বরে কল দিল সে। দু’বার রিং হতেই কল ধরলো শৈশব।

-“বাড়ি পৌঁছেছেন?”

-“হুহ, রেডি হচ্ছি। বাসায় কেউ নাই। আপুর বৌ ভাত যে আজ!”

-“আপনি যাবেন না?”

-“না, আম্মুকে আগেই জানিয়েছিলাম যাবো না। আম্মু বলেছিল তোমাকে নিয়ে আসতে। কিন্তু তোমার ওখানে গিয়ে ভাবলাম সুযোগ পেয়েছি একটু একা টাইম স্পেন্ড করার। ছাড়বো কেন? তাই বাহানা করলাম যে তুমি অসুস্থ!”

-“আপনি আসলেই বদমাশ লোক একটা!”

-“জ্বী, আমি বদমাশ! আপনাকে এখন তাহলে অফার করি আমার বাসায় এসে আমাকে একটু কফি খাওয়ানোর?”

-“লুচ্চা কোথাকার!”

-“কফি খাওয়াতে বলছি আজব! মনমাইন্ড এত নেগেটিভ কেন হ্যাঁ? ফ্রেন্ড সার্কেল অশ্লীল তোমার!”

-“আমার ফ্রেন্ড শুধু আপনার ভাই-ই। আপনি অশ্লীল!”

-“আচ্ছা মিত্তি স্যরি তো! মজা করছিলাম জানপাখি, রাগ কোরো না।”

মিত্তিম কিছু বলতে যাবে তার আগেই আসমা ডেকে উঠলো নিচে থেকে। মিত্তিম তড়িঘড়ি করে শৈশবকে বিদায় জানিয়ে নিচে নামলো। অনি সোফায় বসে খেলছে। আসমা তাকে ভেতরে পাঠিয়ে মিত্তিমকে সোফায় বসতে বললো। মিত্তিম ঢোক গিললো। হঠাৎ এত জরুরী তলব? ঘটনাটা কী?

-“বাড়িতে কেউ আসছিল মিত্তিম?”

-“না তো খালামণি! কেউ আসলে তো দেখতেই পারতা!”

-“অনি নাকি কোন এক ছেলেকে দেখছে বাড়িতে … তোর সাথে!”

-“কীহ? তুমি গেলা একটু আগে, আসলাও সাথে সাথে। এর মধ্যে বাড়িতে কোন ছেলে আসবে? কী যা তা বলো? ফায়ায ছাড়া আমার কোনো ছেলে বন্ধু আছে?”

-“দেখ মিত্তিম সত্যি বল! অনি মিথ্যা বলে না। ও একটা ছেলেকে দেখেছে তোর কাছে।”

-“খালামণি, অনি বাচ্চা। তুমিই ভাবো, ছেলে কোত্থেকে আসবে এখানে? আকাশ থেকে পড়বে ছেলে? তার চেয়ে বড় কথা আসবেই বা কেন? তোমরা মা মেয়ে সিরিয়াল একটু কম দেখো তো! কী যা তা শুরু করছো মণি!”

-“দেখ, তোর ভালোর জন্য বলতেছি। বয়সটা তো ভালো না। প্রথম দেখাতে সবাইকেই একদম সাধুপুরুষ মনে হয়। দেখলেই মনে হবে আরে এর চেয়ে ভালোমানুষ তো দুনিয়ায় নাই কিন্তু কয়টা দিন যাওয়ার পর এমন যন্ত্রণা দিবে যে সারাজীবন সেই রেশ ধরে কাঁদা লাগবে। সময় থাকতে শুধরে যা!”

-“ধূর! যা ইচ্ছে বলো তুমি, আমি ঘরে গেলাম।”

মিত্তিম কপট রাগ দেখিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বুকে ফুঁ দিল। বড় বাঁচা বাঁচছে। এই অনিটাও হয়েছে পাজি! মিত্তিমকে বললো না কিছু অথচ মাকে ঠিকই বলে ফেলেছে। এমন খালাতো বোন থাকলে শত্রুর তো দরকারই নাই। মিত্তিমের অবশ্য মনটা খারাপ হয়ে এসেছে। খালামণি এভাবে না বললেও পারতো তাকে! সে তো আর ইচ্ছে করে শৈশবকে আনেনি। যা হয়েছে সব কাকতালীয়! শৈশবকে ফের কল করলো মিত্তিম তবে খানিকটা ধীরস্থির হয়ে।

-“হ্যালো..”

-“বলো মিত্তি!”

-“অনি দেখেছে তোমাকে আর মণিকে বলে দিয়েছে।”

-“শিট! তোমাকে বকছে? ঝামেলা করছে কোনো?”

-“না। আমি মণিকে বুঝাইছি এমন কিছু না।”

-“মিত্তি আই এম রিয়েলি স্যরি! আমি তোমাকে এভাবে বিপদে ফেলতে চাইনি। আমি তোমাকে না দেখে থাকতে পারছিলাম না। তার উপর তুমি সাফার করতেছিলা এটা সহ্যও করতে পারতেছিলাম না।”

-“শৈশব রিল্যাক্স! বুঝছি আমি কিন্তু এখন একটু সাবধানেই থাকি। মণি এত সহজে বিষয়টা ছাড়বে না। আমার ভয় লাগতেছে।”

-“ভয় কিসের? যদি ঝামেলা করে, আমি তোমার বাসায় প্রস্তাব পাঠাবো! ব্যস হয়ে গেল।”

-“তোমার মনে হয় আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবে? আমার ক্যারিয়ার নিয়ে যারা এত টেন্সড! আমার এডমিশন নিয়ে সবাই অনেক আশাবাদী। আমার বিয়ের চিন্তা ভুলেও করবেনা আমার পরিবার।”

-“জানি মিত্তি! তুমি তোমার পড়াশোনাতেই ফোকাস করো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছি যখন তখন অবশ্যই করবো।”

“মিত্তিম দরজা খোল তো…” আসমার ডাকে তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিল মিত্তিম। ভয়ে বুক কাঁপছে তার। খালামণি আবার কিছু টের পেল নাকি? রীতিমতো হাদিস বেড়ে গেছে মিত্তিমের। ভয়ে ভয়েই দরজাটা খুললো সে। আসমা অনুসন্ধানী চোখে তাকিয়ে আছে।

-“তোর ফোনটা দে তো।”

-“কেন?”

-“দিতে বলছি দে!”

মিত্তিম কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা আসমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আসমা কল লিস্ট চেক করলো। আননোন নম্বর দেখেই সন্দেহটা নিশ্চিত করলো সে। পরক্ষণেই কষে একটা চড় লাগালো মিত্তিমের গালে। মিত্তিম কিছুটা দূরে ছিটকে গেল। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তার খালামণি তাকে এমন অকস্মাৎ চড় মারলো! কী বুঝে আসমা তাকে চড় মেরেছে তাও জানেনা মিত্তিম। শৈশবের নম্বরটা অবধি সেভ করা নেই তবে কেন আসমা এমন করলো?

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০৬

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
ষষ্ঠ_পর্ব
~মিহি

“মিত্তি…” কণ্ঠটা চিনতে অসুবিধে হলো না মিত্তিমের। শৈশবের কণ্ঠ এটা তবে গম্ভীর নয়, খানিকটা ম্লান। গতকাল রাতেও এই নম্বর থেকেই কল এসেছিল, হঠাৎ মায়ের উপস্থিতিতে রিসিভ করতে পারেনি সে। সকালে ফের কল?মিত্তিম ভাবলো তৎক্ষণাৎ কলটা কেটে দিবে কিন্তু শৈশবের কণ্ঠের কাতরতা তাকে যথেষ্ট মায়ায় জড়ালো। কলটা কাটতে পারলো না সে।

-“বলুন।”

-“মিত্তি, তিথির সাথে আমার বর্তমানে কোনো সম্পর্ক নেই! ওকে আমি কেন বিয়ে করতে যাবো?”

-“আপনার যাকে ইচ্ছা হয়, করুন বিয়ে! আমার কী?”

-“তোমার কিছু না?”

-“নাহ!”

-“মিত্তিম, বাচ্চামি কোরো না। আমি তোমার কথাই ভাবছি, সামনে তোমার এডমিশন। এই সময়টা শেষ হোক, তারপর আমি ঐ তিনটা গোল্ডেন ওয়ার্ডস তোমাকে হাজারবার বলবো। প্লিজ অপেক্ষা করো আমার জন্য!”

-“আমি অযাচিত কোনো আশা মনে রেখে কষ্ট পেতে চাই না। ভালো এটাই হবে যে আপনিও আমাকে শীঘ্রই ভুলে নিজের আগের জীবনে ফিরে যান। দুইদিনের একটা মেয়েকে নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি প্রয়োজন?”

-“তুমি এক্ষুণি বাসায় আসো, উই নিড টু টক!”

-“এই যে মি.ইংলিশ মিডিয়াম, আমার আপনার সাথে আর কোনো কথা বাকি নেই! খবরদার আমাকে যদি আর কল দিছেন।”

মিত্তিম খট করে কলটা কেটে দিল। শৈশবকে কিছু বলার সুযোগটাও দিল না। কল কাটার পর মিত্তিম মুচকি হাসলো। শৈশবের প্রতি তার অনুভূতি ইদানিং প্রখর হতে শুরু করেছে। ছেলেটা আস্ত একটা গ্রিন ফ্ল্যাগের বাগান! সুইট, ইনোসেন্ট, হট এণ্ড কিউট জেন্টলম্যান! মিত্তিম নিজের ধ্যানধারণা দেখে নিজেই লজ্জা পেল! কী পরিমাণ বেহায়া হয়ে পড়েছে সে! ইশসস! বড্ড বেহায়াপনা দেখাচ্ছে তার মনটা ইদানিং!

-“এই মিত্তিম! আমি স্কুলে যাচ্ছি, দরজাটা লাগিয়ে দে।”

মিত্তিম বিছানা ছেড়ে উঠে দরজাটা লাগিয়ে দিল। মিত্তিমের বাবা চাকরিসূত্রে ভিন্ন শহরে থাকেন, বাড়িতে মিত্তিম ও তার মা থাকে। মিত্তিমের মাও বিকেল অবধি স্কুলে থাকেন, একটা প্রাইমারি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা তিনি। দরজা বন্ধ করে টিভির সামনে বসতেই কলিং বেল বাজলো। মিত্তিম ভাবলো তার মা কিছু ফেলে গেছে, সেটাই নিতে এসেছে বোধহয়। টিভি অফ করে দরজা খুলতেই চমকালো সে। শৈশব দাঁড়িয়ে সামনে। চোখ কচলে পুনরায় তাকিয়ে একই দৃশ্য দেখে খানিকটা ভড়কালো সে।

-“ভেতরে আসতে বলবে না?”

-“আপনি এখানে কেন আসছেন?”

-“তুমি আসোনি তাই! বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো এভাবে? একটু কথা ছিল!”

মিত্তিম আশেপাশে তাকিয়ে শৈশবকে ভেতরে আসতে বলবো। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে কেউ দেখে নিলে বিপদ হবে, যদিও ওদের বাড়ির কাছাকাছি তেমন কোনো বাড়ি নেই। শৈশবকে হলে বসালো মিত্তিম।

-“বলেন কী বলবেন।”

-“একটু চা-কফি অফার করলেও পারতে!”

-“দরকার আপনার, আসছেন আপনি, চা-কফি খাওয়ানোর বাধ্যবাধকতা আমার নাই। কী বলবেন বলে ফেলুন। আপনার এখানে বেশিক্ষণ থাকা উচিত না।”

-“আমার কাছে এসে বসো। শান্তিমতো কথা বলতে দাও!”

-“আমাকে কোলে বসায়ে কথা বলা লাগবে আপনার? মুখ নাই? মুখ দিয়ে বলেন, শুনতেছি!”

শৈশবের হঠাৎ কী হলো কে জানে! সে সত্যিই মিত্তিমের হাত টেনে ধরে তাকে কোলে বসালো। মিত্তিম ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ঠিকই কিন্তু শৈশবের শক্ত বাঁধনে ঝাপটাঝাপটি করে বিশেষ কোনো লাভ হলো না।

-“আমি কিন্তু চিল্লাবো!”

-“চিল্লাও!”

-“আপনি একটা বদমাশ লোক! আপনার সাহস কিভাবে হয় একটা মেয়ের বাড়িতে ঢুকে জোরজবরদস্তি করার? আমি পুলিশকে কল দিব!”

-“মিত্তি আই লাভ ইউ!”

মিত্তিমের হাত দুর্বল হয়ে আসলো। এতক্ষণ ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও ক্ষণিকের জন্য হাতজোড়া যেন অবশ হয়ে গেল। শৈশব তাকে আই লাভ ইউ বললো? কেন? সে তো অপেক্ষা করতে চেয়েছিল! তবে এখনি কেন বললো? মিত্তিমের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো অশ্রুজলে। চোখ বেয়ে দু ফোঁটা নোনজল জড়ালো। শৈশবের কনিষ্ঠ আঙুল সে অশ্রুজল বেশি দূর গড়াতে দিল না।

-“মিস.আফিয়া রুশতাহানা মিত্তিম, আমি ভালোবাসি তোমাকে। বুঝেছো?”

মিত্তিম যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। শৈশবের কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে ঠিকই কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখানোর নিউরন বোধহয় কাজ করছে না। মিত্তিমের হাত কাঁপছে রীতিমতো। শৈশব মিত্তিমের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল।

-“মিত্তি, ভেবেছিলাম আরো পরে বলবো। আই ওয়াজ রেডি টু ওয়েট কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবো না আমি। আমার তোমাকেই চাই আর সারাজীবনের জন্য চাই। তাই অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করেনি, বলে দিলাম মনের কথা। তুমি উত্তর দিও ভেবেচিন্তে, কোনো তাড়াহুড়োয় ফেলছি না তোমায়।”

মিত্তিম কিছু বলার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। ভয়ে লাফ দিয়ে উঠলো মিত্তিম। এই অসময়ে কে আসলো? কেউ এসে যদি শৈশবকে ভেতরে দেখে তবে তো কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে!

-“উঠুন তাড়াতাড়ি! আপনি আসলে একটা বলদ, এভাবে আমার বাসায় আসছেন হুট করে! এখন বাইরে কে আসলো কে জানে, আপনি তাড়াতাড়ি আমার ঘরে গিয়ে লুকান। আমি দেখি কে আসলো।”

-“লুকাবো মানে?”

-“হাইড এন্ড সিক খেলবো! আরে ভাই, মাইর না খাইতে চাইলে লুকান।”

শৈশবকে ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দরজা লাগালো মিত্তিম। অতঃপর দরজা খুললো বাড়ির। মিত্তিমের খালা আসমা বাইরে দাঁড়িয়ে, সাথে তার মেয়ে অনি। মিত্তিম মনে মনে বলে উঠলো,”পড়ছি আজ মাইনকার চিপায়!” খালার আসার কথা ছিল বিকেলে, তিনি আসছে সকালে। মিত্তিম কী করে বুঝে উঠতে পারলো না। আসমা তাকে খানিকটা সরিয়েই হলের সোফায় এসে বসলো। অনি দৌড় দিল মিত্তিমের ঘরে ঢোকার জন্য। মিত্তিম কোনোরকম তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে টিভির সামনে বসিয়ে দিল। কিন্তু ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। তার খালা যদি কোনোভাবে শৈশবের উপস্থিতি টের পায় তবে এ বাড়িতে আজ ভূমিকম্প, সাইক্লোন, টর্নেডো সব আসবে আর এই সবকিছু যাবে তার উপর দিয়েই। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়? অনি চুপচাপ মিত্তিমের ঘরের দরজা খুলে কখন ভেতরে ঢুকেছে টেরই পায়নি মিত্তিম। যখন খেয়াল হলো ততক্ষণে যথেষ্ট দেরি হয়ে গিয়েছে। অনি মিত্তিমের বিছানায় উঠে খেলছে, আর আসমা মিত্তিমের বইখাতা দেখছে। মিত্তিমের হৃদস্পন্দন ক্রমেই থেমে গেল। শৈশব কোথায় গেল? কোথায় লুকালো ছেলেটা? ঘণ্টা তিনেক মারাত্মক দুশ্চিন্তায় কাটার পর খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ পেল মিত্তিম। আসমা মার্কেটে যাবেন, অনিকে মিত্তিমের কাছে রেখে। আসমা বের হতেই অনিকে টিভি এবং ফোন দিয়ে মিত্তিম ঘরে ঢুকলো। ধীরস্বরে শৈশবকে ডাকলো। খাটের নিচ থেকে উঁকি দিল শৈশব। সারা মুখ ঘেমে একাকার। শৈশব বের হয়ে মিত্তিমের সামনে দাঁড়াতেই মিত্তিম শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বোকা বনে গেল শৈশব। নিজের ওড়না দিয়ে শৈশবের ঘর্মাক্ত মুখ মুছে দিল মিত্তিম। প্রচণ্ড মায়ামাখানো সে চাহনিতে ফের একবার ঘায়েল হলো শৈশব। মিত্তিমের স্নেহে নাকি যত্নে গললো নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না।

-“আপনাকে না দেখে আমি টেনশন করতেছিলাম! আপনি গাধা? আপনি কেন আসতে গেলেন বাসায়?”

-“মিত্তি..জান আমার, আস্তে! তোমার খালাতো বোন বাসায় সোনাপাখি! আস্তে বলো।”

-“আপনি..আপনি একটা গরু, ছাগল, ভেড়া, বলদ…ইংলিশ মিডিয়ামের গাধা একটা!”

-“এতক্ষণ ধরে এই গরমে সিদ্ধ হলাম এসব শোনার জন্য?”

-“আমি ভালোবাসি আপনাকে শৈশব!”

মিত্তিম প্রচণ্ড শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো শৈশবকে। আলতো করে শৈশবের গালে চুমু খেল। শৈশবের মৃদু মুচকি হাসিতে লজ্জা ঘিরে ফেললো তাকে।

-“মিত্তি, যাই এখন? আজ আপুর বৌভাত অথচ এতক্ষণ ধরে আমি এখানে।”

-“হ্যাঁ, আমি অনিকে সামলাচ্ছি। আপনি চুপচাপ চলে যাবেন। আর আশেপাশে তাকাবেন একটু।”

-“ঠিক আছে।”

মিত্তিম শৈশবের সাথে কথা শেষ করে পিছু ফিরতেই শৈশব পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। মিত্তিমের কানে কানে আলতো করে বলে উঠলো,”মিসেস.ফারহায ইফতেখার শৈশব, আই লাভ ইউ আ লট!” মিত্তিম কেঁপে উঠলো। হৃদস্পন্দনের ঊর্ধ্বগতি অনুভব করলো ঠিকই। মুচকি হেসে শৈশবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরে এসে অনিকে পর্যবেক্ষণ করলো। অনিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাবে ঠিক সে মুহূর্তে আবার অশুভ কলিং বেলটা বেজে উঠলো।

চলবে..

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০৫

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
৫ম_পর্ব
~মিহি

“আমার মনে হচ্ছে আপুর পর ভাইয়াও বিয়ে সেরেই ফেলবে। কাল দেখলাম তিথি আপুকে ভাইয়ার রুমে।” ফায়ায ফোন চালাতে চালাতে মিত্তিমকে কথাগুলো বলছে। মিত্তিমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো তৎক্ষণাৎ। ফায়ায খেয়াল করার আগেই চোখ মুছে ঘুরে দাঁড়ালো মিত্তিম। হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা আছে না, আমরা সবসময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি? মিত্তিমও বেসেছে। অবশ্য এটা ভালোবাসা? গুণে গুণে কয়টা দিনই বা সে শৈশবের সাথে একটু ভালো থেকেছে? দু’দিনে কি ভালোবাসা হয়? একটু আধটু ভালোবেসেছিল তো ছোটবেলায়। তখন সে অনুভূতি ছিল বেনামী। শৈশবের সংস্পর্শে থাকতে ভালো লাগতো তার। শৈশব যে সেসব মনে রেখেছে এটা জেনেই বোধহয় মিত্তিম দুর্বল হয়েছে তার প্রতি। এটা ভালোবাসা নয়, কোনোক্রমেই এটা ভালোবাসা নয়।

-“কী রে তুই এমন মুখ গোমড়া করে আছিস যে? আপুর বিয়ের দিনও তুই এমন করে বসে আছিস কেন? তোর কী হইছে বল তো। ওয়েট, তুই আবার তোর ঐ বলদ এক্সটারে নক দিছিস নাকি?”

-“না, ওর চিন্তা আমি বাদ দিছি। ও আমারে চিট করছে না কী করছে আমার আর জানার শখ নাই। রেড ফ্ল্যাগ কোলে নিয়ে ঘোরার শখ নাই আমার।”

-“হুহ! আবার উনি নক দিলেই গলে যাস না যেন।”

-“তোর মনে হয় যে আমি ওর এত টক্সিসিটির পর আবার গলে যাবো?”

-“এক বছর হয়ে গেছে তোর ব্রেকআপের। তুই নিজেকে ভালো রাখার ট্রাই করছিস একটুও? প্রেম করার টাইমে তো এই বন্ধুরেও মনে ছিল না। প্রেমে অন্ধ হইছিলি!”

মিত্তিম ফায়াযের পাশ থেকে সরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফায়াযের কথার আঘাত ঠিক কতটা ক্ষত করেছে তাকে তা বোঝানোর সামর্থ্যও তার নেই। ছেলেটা বাচ্চা স্বভাবের ঠিক আছে কিন্তু কিছু কথা তো বুঝেশুনে বলতেই পারে। মিত্তিমেরও তো খারাপ লাগে, সবসময় হাসি মুখে মেনে নেয় মানে তো এই না যে তার কোনোকিছুতেই খারাপ লাগে না। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলো মিত্তিম। ছাদ ছাড়া পুরো বাড়িই লোকে লোকারণ্য। নিরিবিলি বলতে এটুকুই আছে স্রেফ। মিত্তিমেরও প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। একে তো শৈশবের ঘটনা, তার উপর ফায়াযের কথাগুলো। নিজেকে প্রচণ্ড ভঙ্গুর একটা সত্তা মনে হচ্ছে মিত্তিমের। নিজেকে সামলানো বোধহয় ভুলেই গেছে সে। ছাদে পা রাখতেই একজোড়া হাত আঁকড়ে ধরলো তাকে। শৈশব? স্পর্শটা বড্ড বেশি চিনে ফেলেছে কি মিত্তিম? এই অল্প সময়ের ব্যবধানে চিনলো সে এই স্পর্শ নাকি ছোটবেলার অনুভূতিগুলো এখনো প্রখর? মিত্তিম শৈশবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। শৈশব কেন তাকে আঁকড়ে ধরছে বারবার? ঐ একটা চুমুর খাতিরে? ঐ একটা স্পর্শের অনুতাপে? আজ সাফ সাফ বলে দিবে মিত্তিম। ঐটা শুধুই একটা ঘটনা কেবল, ভুলক্রমে ঘটিত ঘটনা। তার দায় শৈশবকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে না। কথাগুলো ভাবতেই মিত্তিমের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে আসে, সব শুন্য মনে হচ্ছে তার। পায়ের নিচ থেকে জমিনটাও যেন সরে যাচ্ছে। ভালোবাসা? আদতেই কি এটা ভালোবাসা নাকি অন্য কোনো অনুভূতি?

_______________________________________________________

-“মিত্তিম? তুই ওয়াশরুমে?”

মিত্তিম চোখ মুখে পানি দিল। মেকআপ করেনি ভাগ্যিস! ছাদ থেকে এসে ফায়াযের রুমটা ফাঁকা ছিল, অন্যথায় ফায়ায হাজারটা প্রশ্ন করতো তার চোখে পানি দেখে। ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলো মিত্তিম। মিত্তিমের মুখটা দেখে ফায়ায আন্দাজ করতে পারলো নিশ্চিত কিছু হয়েছে। মিত্তিমকে এখন কিছু জিজ্ঞাসা করলো না সে। হুটহাট কান্না করে ফেলতে পারে মেয়েটা।

-“মিত্তিম, চল আপু ডাকছে তোকে। তোর শরীর খারাপ লাগছে? আপু চলে যাচ্ছে। দেখা করে নে, তোকে আমি রেখে আসছি।”

-“ঠিক আছে। তোর রেখে আসতে হবে না, সবে তো বিকাল। আমি যেতে পারবো।”

ফায়াযকে কিছু বলার সুযোগ দিল না মিত্তিম। কবুল বলার সময়টুকু বাদে মিত্তিমের দেখা পায়নি আফরা। শ্বশুরবাড়ির ননদ, খালা শাশুড়ি, চাচি শাশুড়ি সবাই তাকে ঘিরে রেখেছিল। একটু যে খোঁজ নিবে সে সুযোগটাও পায়নি। বিদায়টাও তাড়াতাড়ি হচ্ছে। আফরা মিত্তিমের সাথে দেখা না করে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। মিত্তিমকে দেখেই মন কেমন করে উঠলো আফরার। এই মেয়েটাকে সে ছোটবোনের মতো স্নেহ করেছে, বড্ড মায়া মেয়েটার চোখে। মিত্তিমকে জড়িয়ে ধরতেই চোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু ঝরতে লাগলো আফরার। মিত্তিম আফরাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেও খানিকটা কান্নাই করে বসলো। আফরাকে ছেড়ে দাঁড়াতেই চোখ পড়লো অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শৈশবের দিকে। শৈশবের চোখ মারাত্মক লাল। ছেলেটা কান্না করেছে? ওহ হ্যাঁ! বোনের বিদায় বলে কথা, একটু তো কান্না করাই স্বাভাবিক।

আফরার বিদায়ের পরপরই বাসায় ফিরেছে মিত্তিম। ফায়ায আসতে চেয়েছিল কিন্তু মিত্তিম জোর করেছে না আসার জন্য। ফায়ায জোর করতে পারেনি বিপরীতে। মিত্তিমের মন খারাপ বিষয়টা সেও বুঝেছে, এখন জোর করলে মেয়েটা কিছু বলবে না। উল্টো হিতে বিপরীত হবে। বাধ্য হয়েই মিত্তিমকে একাই যেতে দিল সে। মিত্তিম বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ করলেই শৈশবের মুখটা বারবার ভেসে উঠছে, ঐ রক্তিম দৃষ্টি! নিজের উপর বিরক্ত হয় মিত্তিম। শৈশবকে ঠিকঠাক চেনেও না সে, আগের শৈশব আর এখনকার শৈশবের মধ্যে তফাত কতটুকু তাও তো সে জানেনা। ফোনটা হাতে নিল মিত্তিম। ফেসবুকে ঢুকতেই শৈশবের আইডিটা আসলো পিপল ইউ মে নো’তে। মিত্তিম আইডিতে ঢুকলো। ছবিগুলো দেখলো এক এক করে। শৈশবের আগের চেহারা আর এখনকার চেহারার মাঝে মিল খোঁজার চেষ্টা করলো, মিল পেল না। স্বভাবে মিল আছে কি? হয়তো! চোখটা তো এখনো আগের মতোই মায়াকাড়া! এ চোখের মায়ায় সে পড়েছিল ছোটতেই, এখনো ফের সে চোখের মায়াতেই পড়েছে। শৈশবের ছবি দেখতে দেখতে মন খারাপ কমলো খানিকটা। ফায়াযের বলা বাক্যগুলো মাথায় ঘুরলো না আর। তিথির প্রতি শৈশবের ভালোবাসা এখনো আছে? থাকলে সে মিত্তিমকে কেন কাছে টানতো? প্রশ্নে নিজেকে জর্জরিত করলো সে। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেললো অকস্মাৎ! ফেইক আইডি থেকে শৈশবের আইডিতে রিকোয়েস্ট দিল। আজ তো ব্যস্ত ছেলেটা, নির্ঘাত ফেসবুকে ঢুকবে না। মিত্তিম শৈশবের ছবিগুলোই দেখতে লাগলো বারেবারে। শৈশবের চোখটা! অপরিবর্তনশীল চোখ! এখনো বড্ড মায়া চোখটাতে। মিত্তিম চোখ বন্ধ করলো। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো আবছা আবছা সামনে আসলো তার। শৈশবকে সে জড়িয়ে ধরতো পেছন থেকে, হুটহাট, অকস্মাৎ সে জড়িয়ে ধরা! শৈশব মুচকি হাসতো মাঝে মাঝে, কখনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। মিত্তিম শৈশবের গালে চুমু খাওয়ার পর সে কেবল হা করেছিল একটু। ঐ প্রতিক্রিয়া মনে করতেই মিত্তিমের হাসি পেল। তখন বুঝ থাকলে নিশ্চিত বলতো মুখ বন্ধ করতে অন্যথায় আস্ত একটা হাতি ঢুকে যাবে ঐ মুখে। ছোটবেলা! বড্ড রঙিনই ঠিল ছোটবেলা! তারপর শৈশব চলে গেল, ফায়াযের সাথে বন্ধুত্ব ভালোই চললো। শৈশবকে একটু আধটু মনে করা চলতোই কিন্তু ছেলেটার সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎ আর হলো না। ঠিক সেসময় জীবনে একটা আস্ত আগুন পেল যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়লো স্বেচ্ছায়। আগুনের নাম নিলয়। এই আগুন তার এক জীবনের অর্ধেকাংশ ইতোমধ্যে বিষাক্ত করে ফেলেছে। মারাত্মক রকমের একটা আঘাত মিত্তিম পেল, তবুও অনুভূতিগুলো বড্ড বেহায়া ছিল নিলয়ের বেলায় কিন্তু ধৈর্য আর কতদিনই বা টিকতো? নিলয়ের আঘাত তাকে বাধ্য করলো জীবনে এগোতে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিত্তিম। শৈশবের মনে কি তার জন্য একটুও ভালোবাসা আছে? বোধহয় না! যা করছে সেসব শুধুই অনুশোচনা থেকে হয়তো। মিত্তিম হয়তো ভালোবেসেছিল তাকে সেই ছোট্টবেলায় কিন্তু শৈশব তো বাসেনি। সে বরাবরই নিষ্ক্রিয় ছিল মিত্তিমের অনুভূতিগুলোর বিপরীতে। হাতে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। মিত্তিম স্ক্রিনের দিকে খেয়াল করলো, আননোন নম্বর? আননোন নম্বর থেকে তাকে কে কল করছে এখন?

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০৪

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
৪র্থ_পর্ব
~মিহি

মিত্তিম ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। গা গুলাচ্ছে তার। মাথা ঘোরানো খানিকটা কমেছে ঠিকই কিন্তু শৈশবকে চুমু খাওয়ার ভয়ানক স্মৃতিটা তাকে নিজের দৃষ্টিতেই হেয় করে ফেলেছে। পারলে সে এখন নিজের ঠোঁট কেটে রক্তাক্ত করে ফেলতো। বাড়িভর্তি মানুষ, একটু শান্তিতে চোখের জল ফেলার সুযোগটুকুও নেই। কেন এসেছিল সে এখানে? শৈশবের প্রেমিকার নোংরা কথাগুলো শুনতে? তার আত্মসম্মানবোধ কি মরে গেছে ইদানিং? মিত্তিম তাকালো নিচের দিকে। মাথাটা ঘুরছে ফের, তাল সামলাতে পারলো না আর সে কোনোভাবেই।
রেলিং ঘেঁষে সামনের দিকে আগাতে ধরেছে সবে, তৎক্ষণাৎ একজোড়া বাহু তার হাত আঁকড়ে ধরলো। মিত্তিম নিজেকে সামলাতে পারলো না। হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো ছাদের মেঝেতে। ফায়ায কোনোরকম মিত্তিমকে ধরে একপাশে সিমেন্টের আসনে বসালো। মিত্তিমের তখনো পৃথিবীটা ঘুরছে, সব অন্ধকার দেখছে সে। ফায়ায দু’বাহু ধরে ঝাঁকাচ্ছে তার।

-“মিত্তিম! কী হয়েছে তোর? চোখ খোলা রাখ, কথা বল আমার সাথে।”

ফায়ায কথা বলা অব্যাহত রেখেছে। খানিক বাদে মিত্তিম একটু স্থির হলো। মাথা ঘোরানো কমলো। ফায়াযকে হাত সরিয়ে নিতে ইশারা করে ধাতস্থ হয়ে বসলো সে। ফায়াযও খানিকটা নিশ্চিন্ত হলো তখন।

-“তোর কি মাথা গেছে? তুই কত বড় বেআক্কেল রে? তোর মাথা ঘুরতেছে আর তুই ছাদে এসে দাঁড়ায়ে আছিস? গাধা কোথাকার! তুই এক্ষুনি নিচে চল, আমি বাসায় রেখে আসবো তোকে। তোর রেস্ট দরকার। এই হইচইয়ের মধ্যে তোর থাকার দরকার নাই।”

-“হুহ চল!”

মিত্তিমও মনে মনে চাইছিল এখান থেকে চলে যেতে। মন টিকছে না তার এখানে কোনোভাবেই। ফায়ায ধরে নামাতে চাইলো, মিত্তিম নিষেধ করলো। এখন স্বাভাবিক সে। সিঁড়ি বেয়ে নামলো ধীরে ধীরে। ফায়ায পেছন পেছন নামলো। নিচে আসতেই ফের হইচইয়ের মাঝে পড়লো মিত্তিম। ফায়াযের ডাক পড়লো। বিরক্তির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো সে। তৎক্ষণাৎ শৈশব এসে দাঁড়ালো ফায়াযের পাশেই।

-“কী রে? ডাকতেছে তো তোকে!”

-“ভাই, আমি একটু মিত্তিমকে রাখতে যাবো। ও অসুস্থ, তুমি একটু দেখো তো।”

-“আমি বাইরে যাচ্ছি কাজে, আমি রেখে আসতেছি। তুই শোন কেন ডাকতেছে!”

ফায়ায মিত্তিমের দিকে তাকালো। মিত্তিম কিছু বলছে না। শৈশবকে না করার মতো কোনো কারণও ছিল না ফায়াযের তাই সেও রাজি হলো। মাঝখান থেকে মিত্তিম পড়লো মুসিবতে। যার থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছে, তার নাগালেই এসে পড়েছে সে। কী অদ্ভুত এ অদৃষ্টের পরিহাস! মিত্তিম দ্রুত পায়ে আগে আগে বের হলো। সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব। রাস্তা সচরাচর ফাঁকাই থাকে। দুর্বল শরীরে বেশি জোরে হাঁটতেও পারলো না মিত্তিম। শৈশব দ্রুতই তার পাশাপাশি আসলো। মিত্তিমের হাত আঁকড়ে ধরলো। পরমুহূর্তটুকু কল্পনাতীত! শৈশব খানিকটা জোর করেই মিত্তিমকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মিত্তিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিক মিত্তিমের হাত পা অসাড় হয়ে আসলো। অল্পক্ষণ পরেই মিত্তিমকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে নিজের সামনে দাঁড় করালো শৈশব।

-“একটু স্থির হও মিত্তি, আমার কথাটুকু শোনো। তিথি আমার প্রেমিকা না, ও আমার প্রাক্তন। আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম এটা সত্যি কিন্তু ও আমাকে ছেড়েছে! ও নিজে থেকে আমার কাছে এসেছিল, নিজে থেকেই সরে গেছে। আমি ভালোবেসেছিলাম এটাই আমার ভুল। তুমি যখন আমার জীবনে এসেছো, তখন আমি পুরনো সবকিছু ভুলতে চেয়েছি মিত্তি!”

-“আপনার কোনো ভুল নেই, আমি পাগলামি করে ফেলেছি। প্লিজ আপনি বাদ দিন এসব। আপনার জীবনে অযথা সমস্যা বাড়াতে চাইনা আমি।”

মিত্তিম পিছু ফিরে তাকালো না। দ্রুত পায়ে এগোলো। শৈশব পিছু পিছু আসলো। মিত্তিমের বাড়ির দরজা অবধি এলো। আশ্বস্ত হলো যে মেয়েটা ঠিকঠাক পৌঁছেছে, অতঃপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অবশ্য এটাই প্রথম আসা নয়, গতদিনও লুকিয়ে মিত্তিমের পিছু করেছে সে। মেয়েটা একাকী বেরিয়ে যাবে ধারণা ছিল না তার সেজন্য আড়াল থেকেই আগলে রেখেছে পথটুকু।

শৈশব ধীর পায়ে হাঁটছে ফাঁকা রাস্তায়। কী অদ্ভুত সবকিছু! মাত্র সে মিত্তিমের প্রতি নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে শুরু করেছিল অথচ কিছু শুরু হওয়ার পূর্বেই সব শেষ হয়ে গেল। একটা দিনের ব্যবধানে সব ধুলিসাৎ হওয়ার উপক্রম। এতটা ভালো ভাগ্য কেন তার? একটু খুশিও কেন তার জীবনে স্থায়ী হয়না? নিয়তির কি ভালো লাগে তার ফাথে খেলতে? শৈশবের সমস্ত রাগ তিথির উপর বর্তাচ্ছে। মেয়েটার প্রতি তার ভালোবাসা একরকম পাগলামি ধরনের ছিল অথচ প্রচণ্ড অসহায় মুহূর্তে মেয়েটা তাকে ছেড়ে দিল। এখন তবে ফেরার অহেতুক প্রচেষ্টা চালানোর অর্থ কী? এক বোকামি আর কতবারই বা করবে শৈশব?

____________________

মিত্তিমের ঘুম হলো না রাতে। অনুতাপ ঘিরে ধরলো ক্রমশ। শরীরের অসুখ সারলো ঠিকই কিন্তু মনের সাথে চলতে থাকা ভয়াবহ যুদ্ধটা তাকে কী ভীষণ ক্ষত করছে তা দেখার সাধ্য তো কারো নেই। বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার দুঃসাহসটুকু দেখাবে সে। শৈশবকে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। একটা চুমু খাওয়া নিয়েই বোধহয় শৈশবেরও অনুতাপ কিন্তু এই কারণে শৈশবকে সমস্যায় ফেলবে না সে। তিথি মেয়েটার মতো না সে সুন্দরী, না তার মধ্যে কোনো গুণ আছে, সে কাউকে ডিসার্ভ করে না নিজের জীবনে। ভয়ানক অতীত তো মিত্তিমের জীবনেও কম নয়। ছোটবেলায় এক ভাইয়ের অকস্মাৎ ছুঁয়ে ফেলার মানসিক যন্ত্রণা! ছয় বছর বয়সের ঐ লালসার শিকার হওয়ার স্মৃতিটুকু বড্ড সময় কুঁড়ে খেয়েছে তাকে তিক্ত বিষাদে। অতঃপর এক প্রেমের বসন্ত এসেছিল জীবনে। মাত্রাতিরিক্ত ভালোবেসে ফেলেছিল মিত্তিম তাকে সেজন্যই বোধহয় ছেলেটা হারিয়ে গেল। ফায়ায নিষেধ করার পরেও গাধার মতো ঐ ছেলেটার কাছে অনুনয় করেছে সে। এই যন্ত্রণা ভুলে শৈশবের মুখোমুখি হলো বছর খানেক বাদে। পুরনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিল। শৈশবের কাছে আসা প্রচণ্ড দুর্বল করে ফেললো তাকে। মিত্তিমের নিজেকে মারতে ইচ্ছে করছে। এত দুর্বল কেন হয়ে উঠলো সে? যেখানে একবার এই ভালোবাসা তার অর্ধেক জীবন শেষ করতে বসেছিল, ফের সেই মায়ায় জড়ানোর প্রত্যাশা কী করে রাখতে পারলো সে? মাথাটা চিনচিন করছে যন্ত্রণায়। চোখ বন্ধ করলো সে। নিদ্রারা বোধহয় প্রতীক্ষায় ছিল। চোখ বন্ধ করামাত্র মিত্তিমের চোখে এসে বসলো।

___________

তিথি বেশ কিছুক্ষণ ধরে শৈশবের ঘরের আশপাশটা খেয়াল করলো। এখন মাঝরাত। শৈশবের সাথে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলার উপযুক্ত সময়। কারো দেখার সুযোগ নেই, বিয়েবাড়ি নিয়ে উদগ্রীব সবাই আর যদি দেখেও ফেলে তবে তা তিথির জন্যই ভালো। একসাথে একজোড়া ছেলে মেয়েকে এক ঘরে দেখলে পরবর্তী ঘটনা কী ঘটবে তা তো জানার অপেক্ষা রাখে না। তিথি তো সেটাই চায়, শৈশবকে বোঝাতে হবে এখন। ছোট ছিল, ভুল করে ফেলেছে একটা। এখন যথেষ্ট ম্যাচিউর দুজন, এখন অন্তত ভুলটা শুধরে নিয়ে আবার এক হয়ে যাওয়া উচিত তাদের। শৈশব যে তিথিকে কতটা পাগলের মতো ভালোবাসে তা তো তিথির অজানা নয়। শৈশবের দরজায় নক করলো তিথি বেশ কয়েকবার। শৈশব ভেতর থেকে জিজ্ঞাসা করলো কে কিন্তু তিথি উত্তর করলো না। দরজায় নক করতেই থাকলো। ফায়ায দুষ্টুমি করছে ভেবে শৈশব দরজা খুললো। দরজা খোলামাত্র তিথি চটজলদি ভেতরে ঢুকলো। শৈশব সেদিকে খেয়ালটুকুও করলো না। তিথি ঘরে ঢুকেছে দেখামাত্র সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তিথির একটা কথাও শুনলো না, এভনকি তাকে কিছু বলার সুযোগটাও দিল না। শৈশব জানে তিথির উদ্দেশ্য। কম বোকামি তো করেনি এই মেয়ের চক্করে। এখন উচিত শিক্ষা হয়েছে তার। আদতেও কি সে চিনেছে তিথিকে? তিথির ষড়যন্ত্রের একটুও বুঝতে পেরেছে? তিথি কী করবে তার ধারণাটুকুও যে সে রাখেনি। বোধহয় এটাই তার জন্য কাল হবে শীঘ্রই।

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০৩

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
৩য়_পর্ব
~মিহি

শৈশবের জীবনে আরেকটা মেয়ে আছে! শুধু মেয়েই না, প্রেমিকা! মিত্তিমের শরীর ঘামতে লাগলো। প্রেমের জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে বোধহয়। শৈশবকে নিয়ে সবে একটু স্বপ্ন ঘিরেছিল তার মনে, আদতে তা দুঃস্বপ্নই রইলো। নিজের পছন্দের মানুষের জীবনে অন্য নারীর উপস্থিতি এবং সেই নারীরই রাজত্বের গল্প শুনতে কেমন লাগে? নিশ্চয়ই খুব খারাপ? মিত্তিমের প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। অযাচিত একটা আশা সে বাঁধতে গিয়েছিল। শৈশবের ঠোঁট অবধি স্পর্শ করেছে সে! ছিঃ, নিজেকে ধিক্কার দিল মিত্তিম।

ফায়াযের জোরাজুরিতে মন গললো না মিত্তিমের, শরীরটাও সায় দিচ্ছে না। আজ মেহেন্দীর অনুষ্ঠান, মিত্তিমের মোটেও ইচ্ছে করছে না ফের শৈশবের মুখোমুখি হতে। ফায়াযকে যা তা বুঝিয়ে দূর করলো সে, পারলো না আফরা আপুকে। বিকেল গড়ানোর আগে শরীরটা সারলো তার, আফরাও পেয়ে বসলো তাকে। সোজা বাড়িতে এসে জোরজবরদস্তি করেই তুলে নিয়ে গেল ও বাড়ি। মিত্তিমের পড়নে সাধারণ একটা কুর্তি, বিয়েবাড়ির জাঁকজমকে নিজেকে বড্ড ফিকে লাগছে তার। আগে কিছু মনে হতো না তবে ইদানিং নিজেকে বড্ড পর মনে হচ্ছে মিত্তিমের। শৈশবের সামনে না পড়ার সর্বোচ্চ প্রয়াস করলো মিত্তিম কিন্তু কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়? মিত্তিম অনুষ্ঠান থেকে সরে থাকার জন্য মাথা ঘোরার বাহানা করছিল কিন্তু আফরা তাকে বিশ্রামের জন্য শৈশবের ঘরেই পাঠালো। ঐ একটা ঘরই একমাত্র খালি এখন, শৈশব অনুষ্ঠানে ব্যস্ত আর কী। যদিও মেহেন্দীর অনুষ্ঠানে পুরুষদের আনাগোনা একটু কমই।

শৈশবের বিছানায় বসতেও দ্বিধা হচ্ছে মিত্তিমের। কোনোরকম বিছানায় বসে দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো সে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। গাধার মতো একটা কাজ করে বসেছে সে। চোখ ছলছল করছে মিত্তিমের। আচমকা কারো পায়ের শব্দে চমকে উঠলো সে। ঝাপসা চোখে সামনে তাকাতেই খেয়াল করলো একটা মেয়ে, ভয়াবহ সুন্দরী মেয়েটা। মিত্তিমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে এই মেয়েটা শৈশবের প্রেমিকা। মিত্তিম বোকার মতো তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। মেয়েটা এগিয়ে এসে খানিকটা দূরত্বে রাখা শৈশবের স্টাডি টেবিলের কমফোর্ট চেয়ারটাতে বসলো। মিত্তিম চেয়ে চেয়ে দেখছে কেবল। চুলে হাত নাড়তে নাড়তে মেয়েটা ফের মিত্তিমের দিকে তাকালো।

-“তুমি এ ঘরে কী করছো? কে তুমি? আফরা আপুর সাথে দেখলাম একবার, এখন শৈশবের ঘরে। শৈশবকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছো বুঝি?”

মিত্তিম কিছু বলতে পারলো না। মেয়েটার কথার সুর বড্ড অপমানজনক ঠেকছে তার কাছে। অন্য সময় হলে মিত্তিম দশটা কথা শুনিয়ে দিত কিন্তু নিজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মেছে তার এখন। তাছাড়া মেয়েটা শৈশবের প্রেমিকা, তাকে কিছু বলার অধিকার মিত্তিমের নেই। বরং মিত্তিমের উচিত ক্ষমা চাওয়া। অনুমতিবিহীন মিত্তিম তার প্রেমিকের ওষ্ঠ দখলের দুঃসাহস দেখিয়েছে। মিত্তিমের নিশ্চুপ থাকা মেয়েটাকে আরো রাগান্বিত করলো।

-“এই মেয়ে? তিথি শিকদারের কথা ইগনোর করে বসে আছো? তোমার এত সাহস? শৈশবের ঘরে কেন ঢুকেছো? উদ্দেশ্য কী তোমার? তাও আবার এমন অবলা সেজে ঢুকেছো! লোক ডেকে বিয়ে করিয়ে নিতে চাও নাকি ফাঁসিয়ে? চেহারা দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে কোন জায়গার মেয়ে তুমি!”

‘কোন জায়গার মেয়ে’ কথাটার ইঙ্গিত মিত্তিম বোঝেনি। কিন্তু পরক্ষণেই সজোরে শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালো সে। কাচের একটা পানিভর্তি বোতল ভেঙে চুরমার হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শৈশব দরজায় দাঁড়িয়ে। বোতলটা প্রচণ্ড জোরে আছাড় মারা হয়েছে মেঝেতে। কাজটা যে শৈশবকে তা বুঝতে বাকি নেই মিত্তিমের কিন্তু শৈশব এমন কেন করলো? সে এ ঘরে এসেছে বলে নাকি শৈশবের বিছানায় বসার অপরাধে? শৈশব এগিয়ে এসে তিথির মুখোমুখি দাঁড়ালো।

-“কার পারমিশন নিয়ে তুমি এই চেয়ারে বসছো? আমার ঘরে ঢোকার সাহস তোমায় কে দিছে?”

মিত্তিম ভ্রু কুঁচকালো। কথাগুলো শৈশব তিথিকে বলছে? নাকি তাকে পরোক্ষভাবে অপমানের চেষ্টা করছে প্রেমিকার সামনে? তিথি অবশ্য উঠে দাঁড়ালো। “তুমি তো আবার মেয়েঝাতির আরাধ্য পুরুষ! তোমাকে দেখামাত্র মেয়েরা শুয়ে পড়ে। থাকো নিয়ে!” তিথি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মিত্তিমের এতক্ষণ মাথা ব্যথা না করলেও এখন প্রচণ্ড মাথা ধরলো। কান্না কোনোরকম গিলে সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। শৈশব মিত্তিমকে তৎক্ষণাৎ ধরলো। মিত্তিম সরে দাঁড়ালো খানিকটা।

-“খবরদার আমার গায়ে হাত দিবেন না আপনি! আমায় ক্ষমা করুন, আমি প্রচণ্ড গাধা তাই আপনাকে ছোটবেলার মানুষটা ভেবে ভুল করে ফেলেছি।”

-“মিত্তি প্লিজ, ভুল বুঝো না আমাকে।”

-“আপনাকে আমি ভুল কিংবা ঠিক কিছুই বুঝতে চাই না, আপনি সামনে থেকে সরেন। আপনার প্রেমিকা রাগ করেছে, তাকে মানান গিয়ে!”

মিত্তিম নিজেকে সামলে শৈশবের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শৈশব পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো নীরবে। মিত্তিমের কথা বোঝার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছে সে।

________________

ফায়ায মিত্তিমকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মেয়েটা আসার পর বলেওনি তাকে। কী যে হয়েছে তাও বলছে না। আচমকা ফাইজা এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো তার। হঠাৎ ফাইজার উপস্থিতিতে খানিকটা ভড়কালো ফায়ায।

-“কী অবস্থা ভাইয়া? ভালো আছো?”

-“আছি, এত ঢঙ করে ভাইয়া ডাকা লাগবে না নাও।”

-“আমাদের নামের কত্ত মিল দেখছো? একদম ভাই-বোনের মতো!”

-“ফাইজা মজা কোরো না, মজা শোনার মুডে আমি নাই!”

ফায়ায বিরক্ত হয়ে সরে যেতে নিল। ফাইজা পেছন থেকে ফায়াযের হাতটা ধরলো, বেশ শক্ত করেই। ফায়াযের হাতটা ধরে রেখেই তার সামনে আসলো। মুখোমুখি এসে নিজের হাতটা মেলে ধরলো ফায়াযের সামনে। হাতে মেহেদী দিয়ে খুব ছোট করে ডিজাইন করে ‘ফায়ায’ লেখা। ফায়ায নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। লাভ এট ফার্স্ট সাইটের এপ্লিকেশন ঘটলো তবে তার জীবনে? সে তো ভেবেছিল সব অনুভূতি একতরফা! ফায়ায ঘোরের মধ্যে চলে গেল যেন মুহূর্তেই।

-“আমি মজা করবো তোমার সাথে, সবসময় করবো। তুমি শুনবা, সহ্য করবা! সারাজীবন! বুঝছো ভাইয়াআআ?”

ফায়ায হেসে ফেললো। মেয়েটা মন গলানোতে বড্ড পারদর্শী যে। ফাইজার হাতের তালুতে আলতো করে চুমু খেল সে। ফাইজা কেঁপে উঠে হাত সরিয়ে নিল লজ্জায়। ফায়াযের চোখে চোখ রাখার সাহসটুকুও আর পেল না। মাথা নিচু করে পালালো সেখান থেকে। ফায়ায আড়চোখে ফাইজার পালানো দেখলো। অল্প সময়েই বড্ড মায়া জন্মেছে তার মেয়েটার প্রতি। মিত্তিমের কথা ভুলতেই বসেছিল ফায়ায, তৎক্ষণাৎ মনে পড়ায় দ্রুত মিত্তিমকে খুঁজতে লাগলো সে।

মিত্তিম ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। গা গুলাচ্ছে তার। মাথা ঘোরানো খানিকটা কমেছে ঠিকই কিন্তু শৈশবকে চুমু খাওয়ার ভয়ানক স্মৃতিটা তাকে নিজের দৃষ্টিতেই হেয় করে ফেলেছে। পারলে সে এখন নিজের ঠোঁট কেটে রক্তাক্ত করে ফেলতো। বাড়িভর্তি মানুষ, একটু শান্তিতে চোখের জল ফেলার সুযোগটুকুও নেই। কেন এসেছিল সে এখানে? শৈশবের প্রেমিকার নোংরা কথাগুলো শুনতে? তার আত্মসম্মানবোধ কি মরে গেছে ইদানিং? মিত্তিম তাকালো নিচের দিকে। মাথাটা ঘুরছে ফের, তাল সামলাতে পারলো না আর সে কোনোভাবেই।

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০২

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
২য়_পর্ব
~মিহি

“ইউ কিসড অন মাই লিপস! জানাবো এটা ফায়াযকে?” শৈশব ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্ন করলো। মিত্তিম রাগে কটমট করছে। শৈশব যেভাবে তাকিয়েছিল তাতে সে মনে করেছিল বোধহয় ফায়ায দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। আদতে তেমন কিছুই না। কেউ নেই সেখানে। এখন আবার ফায়াযকে জানানোর কথা বলে জ্বালানো হচ্ছে। বেয়াদব-ইতর লোক একটা!

-“বলবো মিত্তি?”

-“আপনি একটা আস্ত ইংলিশ মিডিয়াম বাঁদর। রাস্তা ছাড়েন।”

-“আচ্ছা যাও। আমি বাঁদর আর তুমি একটা নিষ্পাপ বাচ্চা হু স্টোল মাই ফার্স্ট কিস!”

মিত্তিম আর দাঁড়ালোই না সেখানে। সরে আসার প্রয়াস করলো। পেছন থেকে ফের একবার চেঁচালো শৈশব,”আফিয়া রুশতাহানা মিত্তিম, আই উইল ওয়েট ফর ইউ!” মিত্তিমের ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুললো না চাইতেও। সেখান থেকে সরে গেল সে ঠিকই কিন্তু চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো ছোটবেলার দুষ্টুমি। ইশস! শৈশব তাকে বড্ড লজ্জায় ফেলেছে সেসব মনে করিয়ে দিয়ে। ফায়াযকে খুঁজতে লাগলো সে আশেপাশে। এই ছেলেটা কোথায় হারিয়েছে কে জানে।

________

গান বাজছে। মিত্তিম ব্যস্ত চোখে ফায়াযকে খুঁজছে। ব্যস্ততার সর্বোচ্চ রেকর্ড বোধহয় ঐ ধারণ করে রেখেছে আজ। আচমকা আলো এসে পড়লো মিত্তিমের দিকে। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে মিত্তিম তাকালো এদিক-সেদিক। ফায়ায সেন্টারে এসে দাঁড়ালো, মিত্তিমকেও ইশারা করলো আসতে। আফরাও ততক্ষণে এসে পড়েছে। তিনজনের একটা ডান্স পারফরমেন্সের কথা ছিল কিন্তু এই ইংলিশ মিডিয়াম বাঁদরটা সব ভুলিয়ে দিয়েছে মিত্তিমকে। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজলো যথারীতি। মিত্তিম নাচলো প্রচণ্ড আনমনে। ফায়ায বারবার তাকিয়ে দেখলো মিত্তিমের উদাসীনতা। গান শেষ হতেই মিত্তিম সেন্টার থেকে সরে ছাদের দিকে এগোলো। সবকিছুই অস্বস্তিতে ফেলছে তাকে। ফায়ায, ফায়াযের বাবা-মা তাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করে, সে কিভাবে শৈশবের দিকে হাত বাড়াতে পারে? শৈশবকে নিয়ে কল্পনাটুকুও তার করা অনুচিত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছু ফিরতেই মিত্তিম দেখলো ছাদের দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শৈশব। আশেপাশে কেউ নেই। মিত্তিম দ্রুত ছাদ থেকে নামার চেষ্টা করলো। শৈশব মিত্তিমের হাত আটকে ধরলো। শান্তভাবে প্রশ্ন করলো,

-“আমাকে ইগনোর কেন করছো তুমি?”

-“আমার হাত ছাড়েন ভাইয়া। কেউ দেখলে উল্টাপাল্টা ভাববে।”

-“ভাবুক, আই ডোন্ট কেয়ার! তুমি আমার কথা বোঝোনি? আমি যখন বলছি আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো, তাহলে সমস্যা কোথায়? তোমার এডমিশন টাইমে তোমার সামনে এসেই ভুল করলাম মেইবি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আসতে হতো। মিত্তি শোনো…”

-“আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না। প্লিজ, আমার ঘুম পাচ্ছে। আমাখে যেতে দিন।”

শৈশব হাত ছেড়ে দিল। এমন আচমকা হাত ছেড়ে দেওয়াতে মিত্তিমের মন আরো খানিকটা খারাপ হলো। এত সহজে ছেড়ে দিল? মিত্তিম মনে মনে নিজেকে গালি দিল। বেহায়া মন এত কেন তার? হাত ছেড়েছে ভালোই তো করেছে! তড়িঘড়ি করে নিচে নামলো সে। আফরার সাথেই ঘুমোয় রাতে মিত্তিম কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে ঘুম আর কার চোখেই বা আছে? ফায়ায থাকলে সারাটা রাত আড্ডা দিতেই যাবে কিন্তু এখন মিত্তিমের প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুম না পেলেও ঘুমোতে ইচ্ছে করছে তার। মন প্রচণ্ড খারাপ লাগছে বিধায় মিত্তিম কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হলো। ফায়াযের বাসার একটু সামনেই মিত্তিমদের বাসা। বড়জোর পাঁচ মিনিট হাঁটতে হয় তবে রাস্তাটা খানিকটা শুনশান। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে সতর্ক পায়ে মিত্তিম এগোলো বাড়ির দিকে। দুয়েকবার মনে হলো কেউ বোধহয় পিছু করছে। প্রচণ্ড ভয়ে ঘাড় ঘোরানোর সাহস হলো না তার। একছুটে বাড়ির দরজায় এসে বেল দিল। মিত্তিমের মা আঞ্জুমান আরা দরজা খুলেই মেয়েকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হলেন।

-“কী রে? তুই একা এসেছিস নাকি?”

-“না না মা, ফায়ায এগিয়ে দিয়ে গেল দরজা অবধি।”

-“ওহ! তা আসতে বললি না কেন ওকে?”

-“ওর তাড়া আছে। আমি ঘুমোবো, মাথা ধরেছে।”

-“আচ্ছা আয়।”

মিত্তিম ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতেই অনুভব করলো বাসার সামনের মূল রাস্তাটা থেকে কোনো একটা অবয়বের সরে যাওয়া। বুকের অভ্যন্তরে ধক করে উঠলো তার। কেউ কি পিছু নিয়েছিল? কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে না তো?

রাতে ভয়ানক জ্বর আসলো মিত্তিমের। প্রেমের জ্বর? বোধহয়! দুঃস্বপ্নও দেখলো কতক। শৈশব এগোচ্ছে ক্রমশ তার দিকে, এসবকে দুঃস্বপ্ন বলা যাবে কি?

____________

সকাল সকাল মিত্তিমকে নিতে ফায়ায এলো। জ্বরে কাঁবু মেয়েটা বিছানায় হেলান দিয়ে টম এণ্ড জেরী দেখতে দেখতে খিচুড়ি মুখে তুলছে। ফায়ায এসেই বসলো তার আর টিভির মাঝখানে। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললো মিত্তিম। খিচুড়ির প্লেটটা সজোরে সরিয়ে রাখলো মিত্তিম।

-“মুখের সামনে থেকে সর!”

-“চড়ুইপাখি আমার, রাগ করিস না তো! তুই কাউকে না বলে এভাবে চলে আসবি তাই বলে? রাতে তোকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না দেখে কত টেনশনে ছিলাম জানিস? পরে তুই টেক্সট করে বললি যে বাসায় এসেছিস। ফোন করলাম, ফোন অফ করে রেখেছিস। কী হয়েছে বলবি তো আমাকে। কেউ কিছু বলেছে তোকে?”

-“তোর প্যাঁচাল শেষ হলে সামনে থেকে সর। শরীর ভালো লাগছিল না তাই বাসায় আসছি। আমার বাসা কয়েক ক্রোশ দূরে না যে একা আসতে পারবো না।”

-“তুই জানাবি না কেন? একা কেন বের হবি তুই?”

-“সব তোকে জানায়ে করতে হবে আমার?”

ফায়ায তাকালো মিত্তিমের দিকে। মিত্তিম তো কখনো এভাবে কথা বলে না। রাগ করলেও তা স্বাভাবিক রাগ, এই রাগের ঝাঁঝ অন্যরকম ঠেকছে ফায়াযের। অসুস্থ শরীর বলে কি এমন করছে মেয়েটা?

-“চড়ুই, তোকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগবে না রে। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হ। তুই বিয়েতে না থাকলে আমিও আপুর বিয়েতে থাকবো না।”

-“মেয়েদের মতো ঢঙ করিস না তো! তোরে চিনি না আমি? খুব তো বিয়ানের পেছনে ঘুরছিলেন আপনি ভাইয়া, দেখিনি আমি? লুচ্চা শালা! যাই হোক, চয়েস ভালো আছে। চালায়ে যা, প্রেম হলে তোর কপাল!”

ফায়ায মুখ কাঁচুমাচু করতে লাগলো। ফাইজার কথা ধরতে পেরেছে মিত্তিম? ফাইজা আরফার ননদ। নামের মিল থাকায় দুজনকে তো ভাইবোন বানিয়ে ফেলার ছক কষছে কিছু আত্মীয়। ফায়াযের সেসবে গা জ্বলে যায়। নাম কাছাকাছি হলেই ভাইবোন হতে হবে নাকি? ফাইজার দিক থেকেও অবশ্য একটু আধটু ইটিশপিটিশ আছে বোধহয়। ফায়াযের দিকে মেয়েটার তাকানোর চাহনিটা অনেক কিছুই ব্যক্ত করে। ফায়াযকে অন্যমনস্ক দেখে মিত্তিম চুপচাপ বিছানার অন্যপাশে সরে কার্টুন দেখতে লাগলো। খানিক পরে ঘোর ভাঙলো ফায়াযের। ফের সামনে গিয়ে বসলো।

-“তুই কি চাইতেছিস তোরে আমি লাত্থি দিয়ে বের করি শালা?”

-“দেখ বোন, তোর পা ধরি আমি। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হ, কয়দিন পর তো শৈশব ভাইয়ার বিয়েটাও খাওয়া বাকি। এখনি তোর ক্যান অসুস্থ হওয়া লাগলো?”

-“শৈশব ভাইয়ার বিয়ে? কবে?”

-“জানিনা। ভাইয়ার তো প্রেমিকা আছে, কি সুন্দর সে মেয়ে ভাই! ভাইয়ার সেইম এইজ আর কী, ভাইয়ার কলেজের ক্লাসমেট ছিল। মেয়েটা আবার আমার ছোট ফুপুর ফ্রেন্ড। ফুপু তো ভাইয়ার এইজেরই। বিয়েতে আসবে বলছিল। আজ সকালেই আসছে, পুরাই আগুন সুন্দরী মেয়ে!”

-“শৈশব ভাইয়ার প্রেমিকা? ওহ আচ্ছা…”

শৈশবের জীবনে আরেকটা মেয়ে আছে! শুধু মেয়েই না, প্রেমিকা! মিত্তিমের শরীর ঘামতে লাগলো। প্রেমের জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে বোধহয়। শৈশবকে নিয়ে সবে একটু স্বপ্ন ঘিরেছিল তার মনে, আদতে তা দুঃস্বপ্নই রইলো। নিজের পছন্দের মানুষের জীবনে অন্য নারীর উপস্থিতি এবং সেই নারীরই রাজত্বের গল্প শুনতে কেমন লাগে? নিশ্চয়ই খুব খারাপ? মিত্তিমের প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। অযাচিত একটা আশা সে বাঁধতে গিয়েছিল। শৈশবের ঠোঁট অবধি স্পর্শ করেছে সে! ছিঃ, নিজেকে ধিক্কার দিল মিত্তিম।

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-০১

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
সূচনা_পর্ব
~মিহি

“একটা চুমু খেলেই যে আপনার আমাকে বিয়ে করতে হবে এমন কোনো শর্ত আমি আপনাকে দিইনি, শৈশব। আপনার জীবনে যে প্রথম এসেছে, আপনার প্রথম ভালোবাসা, হোক সে আপনার প্রাক্তন, তাকেই বিয়ে করুন আপনি। আমি আটকাতে যাবো না।” মিত্তিমের কথার ঝাঁঝ শৈশব টের পেল না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা স্বরে শৈশবকে অপর একজন নারীর সাথে মেনে নিল মিত্তিম? বিয়েও করে নিতে বললো? একটুও কি ভালোবাসেনি মেয়েটা তাকে? ঐ চুমুটা স্রেফ শরীরের তাড়নায় এগিয়ে আসা?

বিয়েবাড়ির ব্যস্ততায় কারো আশেপাশে দেখার সময় নেই। মিত্তিম এবং শৈশব যে একসাথে নিখোঁজ এ খোঁজটাও কারো নেই। প্রচণ্ড চঞ্চল মিত্তিমের হুট করে হিমশীতল হয়ে যাওয়া শৈশবের বুকে আঘাত করলো। ইচ্ছে করলো মিত্তিমকে ফের বাহুতে জড়িয়ে নেওয়ার দুঃসাহস দেখাতে। কিন্তু প্রচণ্ড অভিমান তারও এখন।

-“মিত্তি, আমি তিথিকে বিয়ে করবো? এটা চাও তুমি?”

-“হ্যাঁ।”

-“কেন? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করলে তোমার অসুবিধা কোথায়? তুমি ছাড়া আমার লাইফে আর কাউকে আমি আসতে দিব না। যতদিন অপেক্ষা করতে হয় আমি করবো। তুমি শুধু বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”

-“আমার ভাগ্যের উপর আমি বিশ্বাস রাখি। আমার যা ভাগ্য তাতে আপনাকে নিয়ে প্রত্যাশা করার দুঃসাহস দেখিয়ে আমি নিজেকে আঘাত করতে পারবো না শৈশব। আমাদের মিল হওয়ার থাকলে সেটাও ভাগ্যের উপরেই ছেড়ে দিলাম আমি।”

মিত্তিম শাড়ির কুঁচি সামলে শৈশবের সামনে থেকে সরে গেল। শৈশব, ফারহায ইফতেখার শৈশব! আর্কিটেকচারে থার্ড সেমিস্টারে পড়া এক সুদর্শন, নারীজাতির আরাধ্য প্রেমিক-পুরুষ। মিত্তিমের বাল্যকালের বন্ধু ফায়াযের একমাত্র জৈষ্ঠ ভ্রাতা। ফায়ায অবশ্য এখনো জানেনা তার ছোটবেলার একমাত্র বান্ধবীটি তারই বড় ভাইয়ের প্রেমপিপাসায় মরিয়া। মিত্তিম শৈশবের কাছ থেকে সরে ফায়াযের ঘরের ওয়াশরুমে আসলো। আজ ফায়াযের বড় বোন আফরার বিয়ে। বাড়িভর্তি মেহমান। ওয়াশরুমের ট্যাপ চালু করে মুখে হাত গুঁজে কান্না করে বসলো সে। শৈশবকে সে কতদিনই বা চিনেছে? তিনদিন বড়জোর? হতে পারে ছোট থেকে দেখে এসেছে কিন্তু খুব কাছে আসার মুহূর্ত তো ঐ তিনটা দিনই। আফরার বিয়ে উপলক্ষে ফায়ায ধরে-বেঁধে সাতদিন আগেই আনিয়েছে মিত্তিমকে। বাসা কাছাকাছি হওয়ায় অসুবিধেয় পড়তে হয়নি। তাছাড়া আফরার সাথে মিত্তিমের ভাব খানিকটা বেশিই। আফরার বিবাহপূর্ব অনুষ্ঠানে এসেই দীর্ঘসময় পর শৈশবকে দেখা মিত্তিমের। গায়ে হলুদের দিন সাদা টি-শার্ট আর ক্যাজুয়াল ট্রাউজারে মারাত্মক এলোমেলো চুলে শৈশব এসে দাঁড়িয়েছিল মিত্তিমের সামনে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট? বোধহয়! চঞ্চল মিত্তিম কেমন শান্ত হয়ে গেল শৈশবের সামনে। হাজারটা গল্পের মাঝেও তার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অবশ্য তার চোখের চাহনি যে শৈশবে মত্ত তা খেয়াল করার দৃষ্টি তখন কারোই ছিল না। সন্ধ্যে নাগাদ আফরা মিত্তিমকে সাজিয়ে দিল। সংগীতের অনুষ্ঠান তখন। ফায়াযকে খুঁজতে খুঁজতে তার ঘরে ঢুকলো মিত্তিম। শৈশব তখন সবে গোসল করে বেরিয়েছে ওয়াশরুম থেকে। গায়ে জড়ানো টি-শার্টে পানির ছিটেফোঁটা, চুল থেকে পানি ঝরছে টপটপ করে। মিত্তিম দাঁড়াবে নাকি বের হয়ে যাবে এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে তার পা বোধহয় পাথরের মতো জমে গেল।

-“ফায়াযকে খুঁজছো? ও বোধহয় ছাদে গেল।”

-“ও..আচ্ছা ভা…ভাইয়া।”

-“তোতলাচ্ছো কেন? আমি কি দেখতে এতই ভয়ঙ্কর নাকি? তুমি মিত্তিম তাই না? ছোটবেলায় আমি ঘুমালে তুমি আমার বুকের উপর উঠে আমার চুল নাড়তে!”

মিত্তিম প্রচণ্ড লজ্জা পেল। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়া একটা মেয়েকে লোকটা ছোটবেলার এমন অকওয়ার্ড কাহিনী শোনাচ্ছে? লজ্জা নেই? আরে ছোট ছিল সে, একটু আধটু দুষ্টুমি তো করতেই পারে। মিত্তিম কিছু বলে ওঠার আগেই বিদ্যুৎ চলে গেল। অনুষ্ঠান বাইরে, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় সবাই সেদিকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শৈশব ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখলো। সামান্য আলো আঁধারিতে শৈশবকে আরেকটু বেশিই আকর্ষণীয় লাগছে মিত্তিমের। শৈশব চুলে হাত চালাতে চালাতে ফের এক তীক্ষ্ম বাণ ছুঁড়লো মিত্তিমের দিকে।

-“তুমি ছোটবেলায় আমাকে হাগ করতে, মনে আছে তোমার?”

মিত্তিম বোধহয় জমে গেল এবার। শৈশবকে জড়িয়ে ধরতো সে, অনেকটা দুষ্টুমিই করতো শৈশবের সাথে। ফায়াযের সাথে মারামারি চলতো কিন্তু শৈশবের বেলায় যেটুকু ছিল সব আদর। শৈশবের গায়ের সাথে মিশে টম এণ্ড জেরী দেখতে দেখতে কখনো শৈশবের বুকের উপর চড়াও হতো সে। ইয়া মাবুদ! এসব কী করেছে সে ছোটবেলায়? কেন করেছে?

-“আই ইউজড টু লাভ ইওর টাচ, মিত্তি!”

শৈশবের এ কথায় জমে গেল মিত্তিম। শৈশব এগোলো। মিত্তিম প্রচণ্ড ঘামছে, কপালের একপাশে চুল অনেকখানি জায়গা দখল করে ফেলেছে। শৈশব একহাতে চুলগুলো সরিয়ে দিল। মিত্তিমের খানিকটা কাছে এসেই ফিসফিস করলো,”তোমার মনে আছে তুমি আমার গালে চুমু খেয়েছো একবার?” ব্যস! মিত্তিমের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। মিত্তিম ভেবেছিল শৈশবের বোধহয় ছোটবেলার কিছু মনে নেই। এ ছেলে তো তাকে গুণে গুণে তার কীর্তিকলাপ মনে করাচ্ছে। পরক্ষণেই শৈশব একটা ভয়াবহ কাজ করে বসলো। মিত্তিমের গালে চুমু খেয়ে বসলো। অতঃপর বিড়বিড় করে আওড়ালো,”তুমি আমার ফার্স্ট কিস নিয়ে নিয়েছিলে, আই রিটার্নড ইট। মাই ফার্স্ট কিস শ্যুড বি স্পেশাল, ইট শ্যুড বি অন মাই লিপস! বুঝছো মিত্তি?” শৈশব আগুনে ঘি ঢাললো বোধহয়। কেননা পরক্ষণেই মিত্তিম আলতো করে শৈশবের ঠোঁট ছুঁলো। অতঃপর অনুভব করলো তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কী করে ফেললো সে? শৈশব নিশ্চুপ তখনো। মিত্তিমকে কাছে টেনে ফের মিত্তিমের ঠোঁটের কাছে আসতেই মিত্তিম চোখ বন্ধ করে শৈশবের চুল টেনে ধরলো। ব্যথায় উফ করে উঠলো শৈশব। ঘোর ভাঙলো মিত্তিমের। বিদ্যুৎ এসেছে। চারদিক আলো জ্বলে উঠতেই নিজেকে শৈশবের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ পেয়ে প্রচণ্ড লজ্জায় কুঁকড়ে আসলো সে। তৎক্ষণাৎ ও ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করতেই শুনতে পেল শৈশবের কণ্ঠ। গুনগুন করছে ছেলেটা,

“We were just kids when we fell in love
Not knowing what it was
I will not give you up
This time…”

লিরিক্স বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো মিত্তিমের কিন্তু বোঝার পরক্ষণের অনুভূতিটা হলো ভয়াবহ। শৈশব কি বোঝানোর চেষ্টা করছে তাকে? মিত্তিম ও শৈশবের বয়সের পার্থক্য বড়জোর তিন বছরের। আর মিত্তিম খুব ছোটবেলায় শৈশবকে জড়িয়ে ধরে রাখতো, তার সাথে অনেকটা সময় কাটাতো এসব মিথ্যে না। তবে সে অনুভূতির নাম কি ভালোবাসা? যদি এসব ভালোবাসা হয়ে থাকে তবে মিত্তিমের এখন প্রচণ্ড অভিমান করা উচিত। মিত্তিমকে না জানিয়ে ছেলেটা বয়েস স্কুলে চলে গিয়েছিল। ঐ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটার প্রতি মিত্তিমের এখনো বিতৃষ্ণা থাকা উচিত যা শৈশবকে তার থেকে দূরে সরিয়েছিল ছোটবেলায়। মিত্তিম দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরোলো। কানের কাছে শোঁ শোঁ করছে তার। সবকিছু যেন ঝাপসা লাগছে। প্রচণ্ড উদভ্রান্ত সে ফায়াযের সামনে পড়লো।

-“কী রে? তোকে এমন শ্যাওড়াগাছের পেত্নীর মতো লাগছে কেন? এত হাঁপাচ্ছিস? কী চুরি করে আসছিস?”

-“কি…কিছু না।”

-“ভাই! তুই মিত্তিম তো? তোরে পেত্নী বলছি আমি আর তুই এত শান্ত? কেউ তোরে জাদু করছে, তুই আয় তো। আম্মুর কাছে চল তো, তোরে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিবে।”

-“সর তো তুই। দূর হ চোখের সামনে থেকে।”

ফায়ায কিছু না বলে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। মিত্তিম তখনো হাঁপাচ্ছে। খানিক বাদে শৈশব এলো তার সামনে। সাদা পাঞ্জাবী গায়ে জড়ানো। মিত্তিম কয়েকটা হৃদস্পন্দন মিস করলো বোধহয়। এ ছেলেকে দেখলেই এখন তার নিঃশ্বাস থেমে আসবে। যে মারাত্মক ঝটকা সে খেয়েছে তাতে আপাতত তার মস্তিষ্ক স্থির হচ্ছে না। ফায়ায একটু পরেই তার জন্য গ্লাসভর্তি লেবুর শরবত আনলো। মিত্তিমের হাতে ধরিয়ে দিতেই ডাক পড়লো তার। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আবার ছুটলো সে। মিত্তিম মাত্র গ্লাসটা ঠোঁটে ঠেকানোর প্রস্তুতি নিয়েছে, শৈশব ডেকে উঠে!

-“মিত্তি! সাবধানে, তোমার ঠোঁটে এখনো আমার স্পর্শ। শরবতের সাথে সেটুকুও ধুয়ে খেয়ে ফেলো না কিন্তু!”

-“সমস্যা কী আপনার? ফ্লার্ট করছেন আমার সাথে? আপনার ছোট ভাইয়ের বন্ধু আমি! আপনার ছোট বোনের…”

-“তুমি আমাকে বড় ভাই ভাবো?”

মিত্তিম পড়লো মুসিবতে। না বলতে পারছে না সে, হ্যাঁ তো মুখ দিয়ে বেরোবে না।

-“তুমি আমাকে ভাই মনে করে হাগ করতা? ভাই ভেবে গালে কিস করছিলা? আর একটু আগে ভাই মনে করে আমার ঠোঁটে…”

মিত্তিম শৈশবের মুখ চেপে ধরলো। এই লোকটা আস্ত ঠোঁটকাটা। ইংলিশ মিডিয়ামের বাঁদর একটা! আচমকা মিত্তিমের মনে হলো তার পিছনে কেউ আছে এবং তাদেরকেই দেখছে। শৈশব বড় বড় করে চোখ করে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। ভয়ে কুঁকড়ে পেছনে ফিরলো মিত্তিম। ফায়ায না তো? সর্বনাশ!

চলবে…

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
শেষ পর্ব

“আপনি ফান করছেন তাই না? রসিকতা হচ্ছে?”

“মীরা, আমি জানি আপনি হার্ট হয়েছেন। কিন্তু দেখুন আমার মনে হলো এখনই এর ইতি টানা উচিত হয়েছে।”

“আপনার এখন মনে হলো ইতি টানা উচিত হয়েছে!যখন সব ঠিক। এনগেজমেন্টের প্রস্তুতি চলছে?”

“মীরা, আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমি জানি আমি যেই এক্সকিউজই দেই কোনোটাই যথাযথ নয়। কিন্তু আমি এসব চাইনি। ভালোবাসার অনুভূতিটা আমার জন্য এত অদ্ভুত ছিল যে আমি নিজেই নিজেকে তারজন্য প্রস্তুত করতে পারছিলাম না। এরইমাঝে জানতে পারি যাকে নিজের অজান্তে চেয়েছি, তার বিয়ে।”

“আর এইজন্য আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন তাই না? আপনার ভাবভঙ্গি দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। দেবদাসের মতো ঘুরছিলেন। এখন কী হয়েছে? আপনার গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে ভেঙে গিয়েছে? তাই এখন আমাকে আবার বাদ দেওয়া যায় তাই না?”

“নাহ্। তার বিয়ে ভাঙেনি। সে আমার গার্লফ্রেন্ডও নয়। সে এখনো জানেই না আমি তাকে ভালোবাসি।”

“তাহলে সমস্যা কী? ওনাকে বিয়ে করে জীবন গুছাতে দিন। আমরাও আমাদের মত জীবন গুছিয়ে নেই। আমি চেষ্টা করব আজকের এসব কথা ভুলে যেতে। আপনিও অতীত টেনে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ খারাপ করবেন না।”

“মীরা আপনি বুঝতে পারছেন না! এভাবে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলে আমরা কেউ সুখী হব না। আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারব না। স্বাভাবিক একটা বৈবাহিক জীবন আমাদের হবে না। এখন যা আপনার কাছে কোনো বিষয় নয়, তখন তাই বড়ো হয়ে যাবে।”

“যাবে না। কেননা কোনো কিছুই এখন আমার সম্মানের চেয়ে বড়ো না। আপনি কি বুঝতে পারছেন না বিয়েটা ভেঙে গেলে আমি কতটা অসম্মানিত হব।”

“মীরা এসব কিছুই কি ভালোবাসাহীন বিয়ের চেয়ে বড়ো?”

“অবশ্যই বড়ো। বড়ো না হলে একটা বেকার অপদার্থ ছেলেকে আমি বিয়ে করতে রাজি হতাম না। একরকম আপনার সমস্ত দুর্বলতা অগ্রাহ্য করে এই বিয়ের আয়োজনে রাজি হয়েছি আমি। শুধুমাত্র আমার পরিবারের ইচ্ছায়। আমি অন্য সব বিষয় কম্প্রোমাইজ করে রাজি হয়েছি যেন আমার বাবা মা চিন্তামুক্ত হয়।”

“ওনারা নিশ্চয়ই আপনাকে সুখী দেখতে চায়। আমার সাথে আপনি সুখী হবেন না। আমি টের পেয়েছি আমরা দু’জন একদম অন্য রকম ভাবনা রাখি। আপনি বাস্তববাদী বৈষয়িক একজন। আমি অনেকটা ছন্নছাড়া ধরনের। আমার মায়ের ধারণা আপনি আমার ছন্নছাড়া জীবন গুছিয়ে দিবেন। কিন্তু এটা আমাদের ভুল নয় কি? বিয়ে কোনো আসাইলাম নয়। এটা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার নয় যেখানে একজন পার্টনার অপরজনকে কারেকশন করবে। তাছাড়া আমি নিজেকে বদলাতে চাইও না।”

“আপনি যাকে চাইছেন সে আলাদা? আপনার এই বাউণ্ডুলে ছন্নছাড়া জীবন মেনে নিবে?”

“আমি জানি না। আমি তাকে এখনো নিজের অনুভূতি জানাইনি। আমার হাতে সে সময়ও নেই। আজ তার বিয়ে।”

“সেই মেয়েটা কি মিতুল?”

আরমান চুপ করে থাকে। মিতুলকে বদনাম করতে চায় না।

“বলবেন না?”

“আমি কাউকে বদনাম করতে চাই না। কিন্তু আমু শুধু এই বিয়েটা করতে চাই না। এ প্রতারণা। আপনার সাথে, আপনি অবশ্যই এমন কাউকে ডিজার্ভ করেন যে ছন্নছাড়া, বাউণ্ডুলে যেমনই হোক না কেন। অন্তত আপনাকে ভালোবাসবে। বাহুতে একজনকে জড়িয়ে, হৃদয়ে আরেকজনকে নিয়ে ঘুমাতে যাওয়াটাও কি প্রতারণা নয়? এ প্রতারণা আমার নিজের সাথেও। আমি অনন্ত এই জাল ছিঁড়ে বের হতে চাই।”

“সে জানে না আপনি থাকে ভালোবাসেন কিনা। অথচ আপনি তার প্রেমে এতটাই হাবুডুবু খাচ্ছেন যে তার নাম নিয়ে তাকে বদনামও করতে চান না। আর আমার প্রতি এতটাই অনুভূতিশূন্য যে এমন সময় আমার হাত ছেড়ে সমস্ত অপমান, গ্লানি আমার ঝুলিতে রেখে যেতেও দ্বিধা নেই? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা মেয়ের হুট করে বিয়ে ভাঙার প্রভাব জানেন? আপনি কোনো প্রিন্স চার্মিং নন। না ভালো জব করেন। না বিশাল খানদানী ধনী পরিবারের ছেলে। তারপরও এতটা কম্প্রোমাইজ করে এই বিয়ের আয়োজন হয়েছিল শুধু আমি মেয়ে বলে, বয়স হয়ে যাচ্ছে। বাবা, মা, ভাই সবার চিন্তা। সেই চিন্তা মুক্ত করতে।”

“এটা ভুল মীরা। আপনি কেন কম্প্রোমাইজ করবেন। এটা সুখ দিবে না। আপনি এখনি ব্যক্তি আমাকে সম্মানের চোখে দেখে গ্রহণ করছেন না। করছেন কম্প্রোমাইজ হিসেবে। যে সম্পর্কের শুরুটাই এমন করে হয়, তা থেকে সুখ আসে না। আপনি শিক্ষিত, সুন্দর, আর যে বয়সের কথা বলছেন, তা কিছুই না। ত্রিশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বিয়ে কোনো আশ্চর্য কিছু নয়। আমরাই এই ট্যাবু বানিয়েছি।”

“আপনি ঠিকই বলেছেন। এই বিয়ে অতি অবশ্যই ভাঙা উচিত। তবে তার সাথে আরেকটা জরুরি কাজ কি জানেন? যার জন্য এই আঙটি কিনেছেন তাকে একবার অন্ততঃ বলেন। আজ আপনি আমার সাথে যা করলেন তা আপনাকে বীরপুরুষ বানায়নি। পুরোপুরি কাপুরুষ হওয়ার আগে নিজের জন্য দাঁড়ান। আসি।”

মীরাকে যুবায়ের গাড়ি দিতে চেয়েছিল। ইচ্ছে করেই না করেছিল। উবারে করে এসেছে। মনে মনে একটা শখ লালন করছিল। ওদিনের মতো আজও মীরা একা বলে আরমান বাইকে করে পৌঁছে দিয়ে আসবে। মীরা আদরে বড়ো হওয়া মেয়ে। কষ্ট দেখেনি, করতেও হয়নি। সবাই বলে বাবা মা ভাইয়ের অতি আহ্লাদের জন্য মীরার বর খুঁজে পেতে এত দেরি হয়েছে। প্রথমে এত অল্প বয়সে বিয়ে দিবে না। তারপর যোগ্য আরও যোগ্যের খোঁজ। কখন যেন বয়সটা সমাজের বানিয়ে দেওয়া মাপকাঠিতে বেশি হয়ে গেল। রিজেকশনটা এবার অপরপাশ থেকে আসতে শুরু করলো। তবু কখনো বাবা, মা, ভাইকে দোষী মনে হয়নি। অথচ আজ মনে হচ্ছে। একসময় যারা বিন্দুমাত্র কম্প্রোমাইজ করতে চাইছিলেন না। আজ তারা যেকোনো ভাবে বিয়ে দিতে চাইছিল না? নাকি দোষটা তার ভাগ্যের। আরমানকে সে অনেকবার শুনিয়েছে যে বাউণ্ডুলে, ছন্নছাড়া। শুধু নিজের আত্মসম্মানের ভঙ্গুর কাঁচ যেন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো না হয়। অথচ এখন মীরা আর নিজেকে সামলাতে পারছে না। প্রাণপণে চেষ্টা করেছিল, আরমান বারবার যে সম্পর্কের ভবিষ্যত নেই বলে যুক্তি দিচ্ছিল। তাকেই একটা নাম দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরেছে এভাবে তো হয় না। যখন বর্তমানে অতীতের ছায়া পড়ে, তখন আর তার কোনো ভবিষ্যত থাকে না। বিদায় তখন অবশ্যম্ভাবী। সেই বিদায়ে একপক্ষ চোখ নামিয়ে পালিয়ে, অপরপক্ষ বুকের ভেতরটা ধ্বসে পড়ার অনুভূতি নিয়ে সরে আসে। অক্টোবর রেইন নেমেছে। শিউলি ফোঁটার বেলায়, ঝড়ো বৃষ্টি। মীরা আস্তে রিকশার হুডটা নামিয়ে দেয়। ভিজে যাক সব, ধুয়ে যাক সকল কষ্ট। একতরফা জেগে ওঠা ভালোবাসার জ্বলুনি কমে যায়। আজ এই শহর তলিয়ে যাক।

***

“মাশাল্লাহ মিতুল কী সুন্দর লাগছে তোকে। সিম্পল একটা সাজেই পারফেক্ট লাগছে। একদম একটা পরীর মতো।”

মিতুল মুচকি আসে। মিতুলকে নিয়ে তুলতুল পার্লারে এসেছে। আজই আকদ হবে। ফারহানের বাসা থেকে খুব সুন্দর একটা জামদানি পাঠানো হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে খুব দামী। বিয়ের গয়নাগুলো বাসায়। গোল্ড নিয়ে পার্লারে আসেনি। চুরি ছাড়া গোল্ডপ্লেটের কোনো গয়না আনেনি সাথে। আকদ বলে সবকিছুই সিম্পল রাখা হয়েছে।
তুলতুল পার্লারের মেয়েটাকে ডেকে বলে,

“আপু শাড়িটা পরিয়ে দিন। বাসা থেকে ফোন আসছে।”

তুলতুল নিজেও হালকা সাজবে। ওদের দু’জনকেই সায়েম এসে নিয়ে যাবে। তুলতুল সাজতে বসে। মিতুলকে পার্লারের আপুটা শাড়ি পরাতে নিয়ে যায়। মিতুল ফোনটা তুলতুলের কাছে রেখে যাবে ভেবেও কী মনে করে হাতে করে নিয়ে যায়। মেয়েটা শাড়ির ভাঁজ খুলবে এমন সময়ই ফোন আসে, আরমানের নাম দেখে চমকে যায় মিতুল। ধরবে না ধরবে না করেও রিসিভ করে।

“হ্যালো।”

“হ্যালো মিতুল। আমি তোমার পার্লারের নিচে। খুব জরুরি কথা আছে। একটু নামবে প্লিজ।”

“মানে কী বলেন এসব? আমি কোন পার্লারে আপনি কিভাবে জানেন?”

“সায়েমের কাছে শুনেছি। ও একটু পর তোমাদের নিতে আসবে। প্লিজ একটু নিচে নামবে? আমি সিঁড়িতে আছি। দুটো কথা বলেই চলে যাব।”

“আপু, ফোন রাখেন। এত নড়াচড়া করলে শাড়ি পরাতে পারব না।” পার্লারের আপুর দিকে এক নজর তাকিয়ে মিতুল বলে, “আসছি দাঁড়ান।”

আরমান সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মিতুল পেটিকোট ব্লাউজের উপর কামিজ পরে মাথায় ওড়না জড়িয়ে নেমে এসেছে। এত অদ্ভুত পোশাকেও কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। আরমানের মনে পড়ে না কখনো কোথাও এত সুন্দর মুখ দেখেছে। সন্ধ্যা এখনো নামেনি। তবে রাস্তায় রাস্তায় জ্বলে উঠছে বাতি। গোধূলি রাঙা বিকেল শেষ হতে চলেছে। প্রাকৃতিক আলো, আলো আর কৃত্রিম আলোর এক অন্যরকম যুগলবন্দি। সেই আলোতে দাঁড়িয়ে আছে এক অপ্সরা।

“কী এত জরুরি কথা, যা আজ এখনি বলতে হবে?”

“আজই বলতে হবে। অপেক্ষা করার সময় যে নেই। এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছি। কথাটা বলেই আমি চলে যাব। তোমাকে কোনো বিপদে ফেলতে নয়। তোমার জীবনটা কঠিন করতে নয়। কিন্তু আজ এই কথাটা না বলে গেলে আমি বাঁচতে পারব না। মনে হচ্ছে দমবন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি। বলে গেলেই আমার মুক্তি। তোমার কোনো সিদ্ধান্ত, মতামত জানতে না। আমার নিজের জন্যই আজ এখানে আসা।”

“আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

আরমান এগিয়ে আসে। মিতুলের চোখে চোখ রেখে বলে,

“তোমার চোখে আমি জীবন দেখেছি,
যে জীবন মৃত্যুর কথা বলে না।
বলে অমরত্বের কথা।
সেই অমরত্ব দেশে দেশে নানা নামে পরিচিত।
আমি তার নাম দিয়েছি ভালোবাসা, ভালোবাসা।

অনাদি-অনন্তকাল এই চোখে চেয়ে রব নির্নিমেষ
আমার দিন কেটে যাক তোমায় দেখে
সন্ধ্যা নামুক, রাত কেটে হয়ে যাক শেষ।
তবু প্রতিটি প্রভাতে আমি বলব,
ভালোবাসি ভালোবাসি, ভালোবাসি অনিঃশেষ।”

মিতুলের পা দুর্বল লাগে। এই শব্দটা শোনার জন্য কতদিনের হাহাকার। কত রাত জাগা। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল নামক বিষণ্নতার আবাস গড়া। মিতুল বসে পড়ে সিঁড়িতে। আরমান ভয় পেয়ে ছুটে আসে।

“কী হয়েছে? ঠিক আছ? মিতুল”

“না ঠিক নেই। ঠিক ছিলাম না। কিন্তু এখন আপনি আমাকে আরও… ”

“মিতুল। আই অ্যাম স্যরি। প্লিজ মিতুল। আমি চলে যাচ্ছি। তুমি উপরে যাও।”

“চলে যাচ্ছি মানে? এসব আমাকে বলে আপনি এখন চলে যাবেন?”

“হ্যাঁ। আমি শুধু তোমাকে আমার মনের কথা জানাতে এসেছিলাম। তোমার জীবন নষ্ট করতে না।”

“তারপর কী করবেন? মীরাকে বিয়ে করবেন?”

“মীরার সাথে আমার বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি। আমি ওকে বিয়ে করতে পারব না।”

মিতুলের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। পরক্ষণেই আবার চোখে রাগ। আরমান অবাক হয়ে যায়।

“ওহ তাই? আর আমাকে রেখে যাবেন আরেকজনকে বিয়ে করতে?”

“আমি তো জানি না।”

“কী জানেন না? বুড়া হাবড়া। এমন অবুঝের ভাব করছেন। আমি ফারহানকে বিয়ে করব না। কোথায় নিবেন, কী করবেন জানি না। আর যদি নিয়ে যেতে পারেন জীবনেও আপনার চেহারা দেখাবেন না।”

বলতে বলতে মিতুল কেঁদে দেয়। আরমান কী ভেবে পকেট থেকে আঙটিটা বের করে।

“মিতুল এই মুহূর্তে এটা ছাড়া আর কিছু নেই। কোনো প্রস্তুতি নেই। খুব সিম্পল একটা আঙটি…”

আরমানের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতুল হাত বাড়িয়ে দেয়। আরমান আঙটিটা পরিয়ে দেয়।

এদিকে মিতুল পার্লারে নেই। নিচে নেমেছে জানতে পেরে তুলতুলও সাজ অসমাপ্ত রেখে নিচে নেমে আসে। সিঁড়িতে মিতুল আর আরমানকে এভাবে দেখে ভীষণ অবাক হলেও ঘটনা বুঝতে তুলতুলের দেরি হয় না। হায়রে বোকা মেয়ে মিতুল। একবারও কেন তুলতুলকে বললো না। আর তুলতুলেরও কিভাবে এসব চোখ এড়িয়ে গেল! তুলতুল নিচে নেমে আসতে দেখে আরমান মিতুলের হাত জড়িয়ে ধরে।

ভাবি, আপনার বোনটাকে আমি খুব ভালোবাসি। এই মুহূর্তে নিশ্চিত হলাম মিতুলও আমাকে ভালোবাসে। আমি ওকে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের আটকাবেন না প্লিজ।”

মিতুল অসহায় চোখে তুলতুলের দিকে তাকায়। আজ এখান থেকে আরমানের হাত ধরে বের হওয়ার ফলাফল সহজ হবে না। মিতুলের জন্য তো নয়ই। তুলতুলের জন্যও না। শ্বশুর বাড়িতে তুলতুলকে অনেককিছুর মুখোমুখি হতে হবে। তুলতুল একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে।

“আমার বোনটাকে ভালো রাখবেন।”

মিতুল আর আরমান যখন কাজী অফিস থেকে বের হয়। তখন শহর জুড়ে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। পাশে একটা ক্যাফেতে গান বাজছে, “ধর যদি হঠাৎ সন্ধ্যে, তোমার দেখা আমার সঙ্গে…”

(শেষ)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৯

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৯

“সায়েমকে তুমি শাড়ি দিতে চাও না এমন কিছু বলেছ?”

“না তো মা। আমি কেন এমন বলব? আমি এমন কিছুই বলিনি।”

“না মানে হুট করে ও শাড়ির কথা তুলল। আবার গিফট দিবে বললো।”

“আমি নিজেও অবাক হয়েছি মা। আপনি তো দেখছেন ওখানে আমাকে। আমি নিজেই অবাক হয়েছি শাড়ির কথা তোলায়। আমি তো আপুকে উপহার দেওয়ার কথাই বলতাম। আর যদি শাড়ি নিয়ে ওনাকে কিছু বলতাম তাহলে তো তিনি আপনাকে এসে বলতেনই। আপনার কাছ থেকে তো কোনো কিছু লুকাবে না। আমি যদি শাড়ি দিতে না চাইতাম সেটাও আপনি জানতে পারতেন। এটা তো আপনি জানেন তিনি সবকিছুই আপনার সাথে শেয়ার করেন।”

“হ্যাঁ তা ঠিক। আমার ছেলে কাছে আগে আমি সবকিছু। তারপর অন্য কেউ। আচ্ছা আমি যে তোমাকে রাতে শাড়ি দিলাম তখন কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?”

“জ্বি জিজ্ঞাসা করছে তো। আমি বললাম যে আপনি গিফট দিয়েছেন।”

“এটার বদলে ঐ শাড়ি দিতে বলছি, এরকম কিছু বলেছ নাকি?”

” আপনি তো বদলের কথা বলেনই নাই মা। আপনি তো আমাকে এমনিই শাড়ি দিলেন না? বললেন নতুন বউ, বোনের বিয়েতে লাল কাতান সুন্দর লাগবে। সায়েমও সেটাই বলল যে আমাকে ভালো লাগবে। লাল রং নাকি আপুর পছন্দ না। এজন্য আপু শাড়িটা নেয় নি। তবে আমাকে ভালো লাগবে। আর আপনার প্রশংসা করলো। বলল যে দেখছ আম্মু কত সুন্দর শাড়ি রেখেছে তোমার জন্য। আম্মু কত ভালো।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো করবেই। শেলীর পছন্দ অপছন্দের কিছু না। আমিই তো আমার ছেলের বৌয়ের জন্য এত সুন্দর শাড়িটা রেখে দিয়েছি। শেলীর পছন্দ না কে বলছে?লাল রং আবার পছন্দ না হয় নাকি। এটা তো অদল বদল না। এমনি বললাম শেলীকে ঐ শাড়িটা দিলে ও খুশি হত। থাক এটাই ভালো হয়েছে। দুটোই থাক তোমার কাছে। একটা বোনের বিয়েতে পরবা, আরেকটা মীরার ননদের বিয়েতে। আমাদের কী কম আছে নাকি। একমাত্র ছেলের বৌ তুমি। মানুষ দেখুক কত হাত খোলা আমাদের। ছেলের বৌ আর মেয়ে পার্থক্য করি না।”

“জি মা। ধন্যবাদ মা।”

***

“থ্যাঙ্ক ইউ।”

“কেন? থ্যাঙ্ক ইউ কেন?”

“আপনি বিষয়টা অনেক সুন্দর করে ম্যানেজ করেছেন। মা আর আপুও আমার উপর রাগ করতে পারেননি। আবার উপহারটাও আমার কাছেই থাকলো।”

“শাড়িটা তোমারই। তোমার কাছেই তো থাকবে। দেখ আমি স্বীকার করছি আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি কিভাবে ব্যালেন্স করতে হয়। এখন চেষ্টা করছি শিখতে আম্মুকে কষ্ট না দিয়ে কিভাবে তোমার পাশে থাকা যায়। আম্মুকে কষ্ট দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আম্মু আমার উইকনেস। আপুর সাথে আর্গুমেন্টে যাওয়া মানে আম্মুর সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো। সেজন্য হয়তো অনেক সময় আপু কিছু বললে বা চাইলে তুমি না চাইলেও মানতে হবে। কিন্তু আমি চেষ্টা করব আমাদের দুনিয়াটা ওই দুনিয়া থেকে আলাদা রাখতে। সব সময় হয়তো পারব না। তখন তুমি না হয় একটু ম্যানেজ করে নিও। দুজন দুজনের মুখোমুখি দাঁড়ালে কেউই তো মানসিক শান্তি পাই না। যতই তুমি স্ট্রং ভাব দেখাও আমি জানি তুমিও শান্তি পাও না। বিষয়টা তাই এমন ভাবে হ্যান্ডেল করতে চেয়েছি যেন উপহারটা তোমার হাতেই থাকে। আপু বা আম্মুও রাগ করার সুযোগ না পায়। আজ আপুকে দিলে আমি যদি আবার তোমাকে কিনে দিতামও তা কখনোই হয়তো একই রকম অনুভূতি দিত না। এখন আপু জানলো যে আপুও আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তুমিও বোধহয় জানলে যে আমার ওয়াদা মিথ্যা ছিল না। আমি সত্যি আমাদের সম্পর্ক সুন্দর করতে চাই।”

“ধন্যবাদ।”

“কী শুকনা শুকনা ধন্যবাদ, থ্যাংক ইউ এসব দিচ্ছ।”

“শুকনা, শুকনা?”

“হুম। আমাকে বলো আমি কাটখোট্টা, রোমান্টিক না এই সেই। তো আমি শিখব কার কাছে এসব। গার্লফ্রেন্ড ছিল না। বৌও পেলাম এমন একজন যে আজ পর্যন্ত তুমি করে বলে না। রোমান্স করা তো দূর। নাটক সিনেমায় কত কিছু দেখি।”

“আমার মনে হয় খুব বয়ফ্রেন্ড ছিল?”

“তো ঠিক আছে। দুজনেরই ছিল না। দু’জনই শিখি। শুরু তো করি।”

“যেমন?”

“তুমি আমাকে তুমি করে বলা দিয়ে শুরু কর। আর আমি…”

বলতে বলতে সায়েম তুলতুলের হাত টেনে কাছে নিয়ে এসে কপালে একটা ছোট্ট চুমু এঁকে দেয়।

“এভাবে।”

খুব ছোট্ট একটা ঘটনা। একটু পাশে থাকা। প্রথম বার শরীরের সীমানা ছাড়িয়ে মনের কাছাকাছি আসা। এইটুকুতেই আবেগের জোয়ার আসে। আর তা তো আসবেই। মান অভিমানের পালা শেষে শুধু কথার বাঁধনই সহজ হয়ে যায় না। শরীরি আবেগও সহজ আর সুন্দর হয়ে যায়। পলি জমা বুকের মতো স্থবির নদীতেও ঢেউ ওঠে। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো কলকল করে ওঠে জমানো কথাগুলো। সবশেষে এক অপরের গভীর স্পর্শে যা শান্ত হয়। ভালোবাসাবাসির মাঝে শুধু শায়েরী, কবিতার স্থান হয় না। তাতে অবশ্যাম্ভাবী শরীরও আসবে। তবে তখন বিষয়টা শুধু শারীরিক না হয়ে পূর্ণতার নাম হয়, সুখের নাম হয়। বিয়ের এতদিন পর যেন সায়েম আর তুলতুল অবশেষে সেই সুখের সন্ধান পেল। সায়েমকে গভীর করে আঁকড়ে ধরে তুলতুল নিজের কাছেই ওয়াদা করলো ক্ষণিক পাওয়া এই সুখ হাতের মুঠো থেকে হারাতে দিবে না। বালু হোক বা জলকণা, এই মুহুর্তগুলো ধরে রাখতে বারবার সে হাত মুঠো করবে।

***

“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম মা। কেমন আছ তুমি?”

“জি আন্টি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?”

“হ্যাঁ, মা। আমিও আছি ভালোই। আরও ভালো হব যদি আন্টি না ডেকে আম্মু ডাক।”

“জি ডাকব।”

“তোমাদের ওখানে কি অবস্থা? বেয়াইন ফোন দিয়েছিল। খুব কেনাকাটা হচ্ছে নাকি?”

“জি, বাসায় তো উত্সব চলছে।”

মীরা লজ্জা মিশ্রিত হাসি হাসে।

“শোন মা, আরমান আঙটি কিনতে বের হয়েছে।”

“জি আমাকে দেখা করতে বলেছে। আমি কাছাকাছিই আছি।”

“আচ্ছা আচ্ছা তাই তো বলি এত শব্দ কেন। বাইরে তুমি। ঠিক আছে রাখি তাহলে এখন। তোমরা দেখে কেনাকাটা কর।”

***

“বাইরে দাঁড়িয়ে যে? চলুন ভেতরে যাই।”

“না বাইরেই বসি। দোকানে কথা বলা যাবে না।”

“আঙটি কিনব না?”

“কিনে ফেলেছি।”

“আমি আসার আগেই কিনে ফেললেন? বুঝেছি সারপ্রাইজ। সমস্যা নাই। দেখি।”

“চলুন ফুড কোর্টের একপাশে বসি।”

দুপুর হয়নি এখনো। এই সময়টা ফুড কোর্ট খালি।

“দেখি আঙটি।”

আরমান পকেট থেকে বক্সটা বের করে দেয়। খুব সিম্পল একটা আঙটি। মাঝে ফুলের মতো ডিজাইন যাতে পাথর চকমক করছে। মীরার একটু ভারী ডিজাইন পছন্দ ছিল। এটা বড়ো বেশি সিম্পল মনে হচ্ছে। আরমানের জন্য ওরা সাত আনার আঙটি বানিয়েছে। এটা মনে হচ্ছে বড়োজোর তিন আনা হবে। মীরা মন খারাপ করে না। আরমানকে অবশ্য কিছু বলে না। আঙটি তো আরমানের একার আয়ে কেনার কথা না। আন্টিতো বলেছিল তিনি ভালো বাজেট ঠিক করেছেন।
মীরা বক্স খুলে আঙটি পরতে যায়।

“কী করছেন?”

“পরে দেখছি হয় কিনা। সাইজ ছোটো মনে হচ্ছে।”

“এটা আপনার সাইজ না।”

“আমার না? কার? ওহ আচ্ছা, আন্টির জন্য নিয়েছেন নাকি? তাই তো বলি এনগেজমেন্টের আঙটি এত হালকা হওয়ার কথা তো না।”

“খুব হালকা মনে হচ্ছে?”

“না গিফটের জন্য ঠিক আছে।”

আরমান মীরার হাত থেকে আঙটিটা নিয়ে বক্সে রাখে।

“মীরা জরুরি কিছু কথা ছিল। মন দিয়ে শুনবেন প্লিজ।”

“মীরা, আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি। কখন কোথায় কিভাবে জানি না। খামখেয়ালী, উড়নচণ্ডী, বাঁধনহারা এই আমি কখন ভালোবাসার বেড়াজালে জড়িয়েছি টেরই পাইনি। যখন টের পেয়েছি তখন আর জাল ছিঁড়ে বের হওয়ার পথ নেই। কোনোদিনও কোনো সম্পর্কে না জড়ানো আমার কাছে ভালোবাসা অক্সিটোসিন হরমোনেরই একটা নাম ছিল। এড্রেনালিন রাশ যেমন আমাদের উদ্দাম করে দেয়। তেমনি অক্সিটোসিন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণকে প্রেম অ্যাখ্যা দেয়। এসব হরমোনের ক্রিয়া আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়ই ছিল। অথচ সেই আমি রাতের পর রাত ঘুমাতে পারি না। হঠাৎ করে নিজের একজন মানুষ পাওয়ার তীব্র চাহিদা তৈরি হলো। নিজের কেউ, যে মানুষের ভীড়ে আমার হাত জড়িয়ে গায়ে ঘেঁষে হাটবে। আমি যখন বাইকে গতির ঝড় তুলব, আমার শার্টের কোণা খামচে ধরবে। বৃষ্টি দেখলে আমার তাকে নিয়ে ভিজতে ইচ্ছে করে। রাস্তার পাশে টঙ এর দোকানে তাকে নিয়ে চা খাওয়ার বড়ো তৃষ্ণা হয়। সে একান্ত আমার নিজের মানুষ হবে। যাকে যখন তখন ভালোবাসি বলা যায়, বলা যাবে। চোখ বন্ধ করলেই আমি তার চেহারা দেখতে পাই। কিন্তু আমি ক্ষমা চাই। সেই চেহারাটা আপনার নয়।”

(চলবে)

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৮

0

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৮

“আম্মু ডেকেছিল কেন?”

তুলতুল ভেবেছে সায়েম শুয়ে পড়েছে। এমনিতেই আজ লম্বা সময় বাইরে ছিল। বাসায় ফিরে দেখে মেহমান। তাই তুলতুল হাত মুখ ধুয়ে নিজ থেকেই রান্নাঘরে গিয়েছে। রাতের খাবারের জন্য শাশুড়ির সাথে পোলাও, ডিমের কোর্মা করেছে। মেয়ের জামাইয়ের জন্য রোস্ট জান্নাত আরা নিজেই করেছেন। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর টেবিল আর কিচেন গুছিয়ে রাখতে তুলতুলের অনেকটা সময় লেগেছে। খাওয়া শেষে সবাই আবার চাও খেয়েছে। টায়ার্ড লাগছে বলে সায়েম রুমে চলে এসেছিল। বাকিরাও যার যার রুমে চলে গিয়েছে। শেলীর থাকার কথা ছিল না। সায়েমের বাবা মার অনুরোধে আজ রাতটা থাকবে ঠিক করে। জান্নাত আরার সাথে কথা বলে আসতে আসতে তুলতুলের ধারণা ছিল সায়েম শুয়েই পড়েছে।

“শাড়ি দিলেন।”

“কিসের শাড়ি?”

তুলতুল প্যাকেট থেকে বের করে দেখায়। নতুন কাতান শাড়িই মনে হচ্ছে। শাড়িটা চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে দেখেছে। মনে পড়ে সায়েমের। শাড়িটা সায়েমের ফুপির গিফট। শেলী আর যুবায়েরের বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু শেলীর পছন্দ হয়নি তাই রেখে গিয়েছিল। জান্নাত আরা বলেছিলেন কারও অনুষ্ঠানে গিফট করে দিবেন। যদিও শাড়িটা বেশ সুন্দর। কিন্তু শেলীর কেন পছন্দ হয়নি জানে না সায়েম। লাল কাতানে বৌ বৌ ভাব আছে। সায়েমের ভালোই লাগে। কাউকে গিফট করার চেয়ে তুলতুলকে দেওয়াই ভালো হয়েছে। ওকে মানাবে। মায়ের প্রতি ভালোলাগা কাজ করে। কড়া ভাব দেখালেও ঠিকঔ ছেলের বৌয়ের প্রতি মায়া আছে। থাকবেই না কেন? আদরের একমাত্র ছেলের বৌ বলে কথা।

“এই শাড়িটা তোমাকে মানাবে। লাল টুকটুকে।”

“আপনার পছন্দ হয়েছে?”

“আমার পছন্দ অপছন্দের কিছু না। আম্মু দিলেন তোমাকে। আমি বললাম মানাবে। তোমারও কি আপুর মতো লাল ভালো লাগে না?”

“মানে?”

“না মানে, আপুর ধারণা আপুকে কড়া রঙে মানায় না। সেজন্য বললাম।”

“না তেমন কিছু না। লাল তো সুন্দর রঙ। আসলে আপনার পছন্দ হলে বলার কিছু নেই। আমি ঐ শাড়িটা আপুকে দিয়ে দিচ্ছি। তবে আমি না দিয়ে আপনি দিলেই ভালো হয়। আপনি আমাকে প্রথম কোনো উপহার কিনে দিয়েছেন। সেটা কত দামের তা বিষয় না। আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি তা অন্য কারও হাতে দিতে গেলে হয়তো নিজের অজান্তেই… ”

“কী? বুঝলাম না। তুমি কী বলছ?”

“না মানে আপুর জন্যও শাড়ি কেনা দরকার ছিল। আমার আসলে মাথায় আসেনি। তখন তো আমিই নিতে চাইছিলাম না। এর উপর অতিরিক্ত টাকা খরচের কথা কী করে মাথায় আসবে। কিন্তু উপহার পেয়ে সত্যি ভীষণ ভালো লেগেছে। আমার পরা না হোক আপনি দিয়েছেন এটাই বড়ো।”

“আম্মু কি আজকের কেনা শাড়িটা আপুকে দিতে বলেছে?”

“বললেন দিলে ভালো দেখায়। এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে। সকালে চাইলে দিতে পারি বললেন।”

“আচ্ছা।”

সায়েম আর কিছু বলে না। বালিশ গুছিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করে। তুলতুল হতাশ চোখে সায়েমের দিকে এক পলক তাকিয়ে শাড়ির প্যাকেটেটা আলমারিতে রেখে দেয়। কেন জানি ঐ শাড়িতে একবার হাত বুলায়। কেমন একটা অদ্ভুত আশা জেগেছিল এবার। মনে হয়েছিল সায়েম হয়তো মানা করবে। মা বোনের সামনে না হোক, আড়ালে হলেও বলবে, “তোমাকে কিনে দিয়েছি, তুমি রাখ। আপুর জন্য আবার কিনে আনব।”

অথচ শুধু ‘আচ্ছা’ বলে শুয়ে পড়লো। তুলতুল ঠোঁট কামড়ে চোখের জল আটকে দেয়। যদি সায়েম এত নির্লিপ্ত হতে পারে তবে সেও হবে। মানুষটাই নিজের না হলে, তার দেওয়া কোনো কিছুই তো নিজের হয় না। সবই মায়া। মায়ার জালে ফাঁসতে চায় না তুলতুল। মায়া বড়ো কষ্ট।

***

রাত গভীর হচ্ছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম নেই দুটি মানুষের চোখে। তুলতুলের বলা কথাগুলো ভেবে দেখে মিতুল। আজীবন শুনে এসেছে ভালোবাসার প্রকাশটা ছেলেদের তরফ থেকেই আসে। মেয়েদের শুধু সায় দিতে হয়। এখন মিতুল কী করে এর ব্যতিক্রম হবে? আরমানকে কী করে বলবে সে তাকে পছন্দ করে। পরিচিত মানুষ হিসেবে নয়, মনের মানুষ হিসেবে পছন্দ করে। পছন্দ কথাটা হয়তো ভুল। সে তাকে ভালোবাসে। এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করে। যে আকর্ষণে বুকের ভেতর জোয়ার আসে। যে আকর্ষণে ঠোঁট দুটো চুপ থাকলেও চোখ অনবরত কথা বলে যায়। মনের ভেতর সুখ সুখ ব্যথা জাগে। কী এক অদ্ভুত জ্বলুনিতে শরীর মন জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়। অথচ কী আশ্চর্য। যার জন্য অহর্নিশ এই জ্বালা। সে যেন কিছুই টের পায় না। চোখের ভাষা বোঝা কি এতই কঠিন? এরপরও মুখ ফুটে বলতেই হয় ‘ভালোবাসি’?

বললো না হয় মিতুল। তারপর? তারপর যদি আরমান যদি না করে দেয়? যদি পরিবারে কথাটা জানিয়ে দেয়? মিতুল কিমল পারবে কাউকে চেহারা দেখাতে? তুলতুলের শ্বশুরবাড়িতেও কত সমস্যা হবে। কেননা আরমান এবং মিরা দুজনই তুলতুলের শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্কিত। মিতুল কি করে বোনের সংসারে আরও অশান্তি নিয়ে আসবে? এমনিতেই যেখানে তুলতুলকে নানা পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় ভয় হল আরমান যদি তাকে না করে দেয় নিজেই নিজের কাছে ছোটো হয়ে যাবে না? প্রত্যাখ্যানের এই আঘাত কি করে সইবে? তুলতুল বলে সাহস করে মনের কথা বললেই নাকি হয়!

এই দূরত্ব মেটাতে শুধু কি সাহস যথেষ্ট? মিতুল না হয় সাহস করে বলেই দিলো ‘আরমান, আপনাকে আমি ভালোবাসি। সূর্য উঠলেই হারিয়ে যাবে জেনেও যেভাবে শিশির বিন্দু ভালোবাসে কিরণকে। ঝিকিমিকি আলোয় অভ্যর্থনা জানায় সে ভোরকে। যতটা ভালোবাসে পতঙ্গ আগুনকে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করে না। আমিও সেই শিশির, সেই পতঙ্গ। হারিয়ে যেতে পারি জেনেও যে ঝাপ দিতে দ্বিতীয়বার দ্বিধা করবে না।”

কিন্তু এরপর যদি আরমান না করে দেয়? সেই নায়ের ভার তো মিতুল নিতে পারবে না।

মিতুল কি তবে দূরত্বের অভ্যাস করবে? সম্পর্কে যাওয়ার আগেই কি তবে শেষ হয়ে যাওয়ার চর্চা করতে হবে? কী আশ্চর্য কোন সম্পর্কের কথা ভাবছে মিতুল? কেন ভাবছে? আজ বাদে কাল অন্য আরেকজনের সাথে বিয়ে হতে চলছে মিতুল এবং আরমান দুজনেরই। তাদের জীবনে অন্য কেউ আসতে চলছে। এরপরও এসব ভাবা অন্যায়। খুব অন্যায়। এখন আর পাওয়ার নয়, বরং ভোলার অভ্যাসটা করতে হবে। মিতুল জানে না কী করে। কিন্তু করতে হবে।

***

“চোখের গভীরতা মিছে কভু হয়?
হে প্রিয় এসো ফিরে, লাগে বড় ভয়।
দিকবিদিকশুন্য আজ চঞ্চল সে চোখ,
আখি আজও নেশাতুর তোমাতেই ঝোঁক।

কেন ফেলে গেলে চলে, হলে চোখের আড়াল?
অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করে ধারালো করাল!
চক্ষু মুদিলে আজও ভাসে সব স্মৃতি,
যেখানেই রও প্রিয় নিও মোর প্রীতি।”

লাইনগুলো কয়েকবার আওড়ায় আরমান। কার লেখা লাইন জানে না। মুখ বইতে একটা পেজে ক্যাপশনটা খুঁজে পেয়েছে। সেই তখন থেকে লাইনগুলো পড়তে গিয়ে বারবার মিতুলের চোখদুটো মানসপটে ভেসে উঠছে। আজকের মিতুল আর আগের মিতুলে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেই হাসিখুশি ঝর্ণার মতো চঞ্চল মেয়েটা যেন শান্ত পুকুর হয়ে গিয়েছে। কাকচক্ষু কালো চোখে ভীড় করেছে বিষাদ। আজ যতবার চোখে চোখ পড়ছিল, যেন অব্যক্ত ভাষায় কিছু বলে
যাচ্ছিল। আরমান কি কিছু মিস করে যাচ্ছে?

***

সকালে নাস্তার টেবিলে নাস্তা শেষে সবাই বিদায়ে প্রস্তুতি নেয়। ভোরে ভোরেই নাস্তা সেরেছে সবাই। যুবায়েররও অফিস আছে, তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। সায়েমও অফিস যাবে। জান্নাত আরা তুলতুলকে চোখের ইশারা করেন। শাড়ির বিষয়টা বলতে চাইছে বুঝতে পারে মিতুল। শেলীও উসখুস করছে।

“আপু, একটা কথা বলার ছিল।”

“কী?”

শেলী আগ্রহী মুখে তাকায়। তুলতুল উত্তর দেওয়ার আগেই সায়েম বলে,

“মিতুল, মানে তুলতুলের ছোটো বোনের আকদ হবে। সবাইকে দাওয়াত দিবে। ও তোমাদের আগেই একটু জানিয়ে দিচ্ছে আর কী। তোমাদের বাড়িতেও তো বিয়ে সামনে। ডেট আগে পড়ে রেখ।”

“আহ্ হা সায়েম, তুলতুলকে বলতে দে ও কী বলতে চাইছিল।”

জান্নাত আরা অস্থির হন।

“এটাই আম্মু। ও আপু, কালকের শাড়িটা কি তোমার খুব পছন্দ হয়েছে? এমন নিতে চাও?”

“হ্যাঁ অবশ্যই। মীরার বিয়েতে পরলাম।”

“আচ্ছা আমি তাহলে ঐ দোকানে খোঁজ নেব। কালেকশনে আছে কিনা। দোকানের ব্যাগটা বরং এনে দেই। ওখানে দোকানের ঠিকানা নাম্বার দেওয়া আছে। এক কাজ করো না, বিয়ের শপিং তো তোমরাই করবা। তখন খোঁজ করে দেইখ আছে কিনা। থাকলে অন্য রঙের একটা নিয়ে নিও সেম শাড়ি। টাকা আমি দেব। গিফট।”

জান্নাত আরা ছেলের কথা শুনে থ। কিছু বলার ভাষা খুঁজে না পেয়ে তুলতুলের দিকে তাকান। তুলতুলের চোখেও বিস্ময়। যুবায়ের কথা টেনে নিয়ে বলে,

“আরে তোমার দিতে হবে কেন? আমার বোনের বিয়েতে, নিজের বৌকে একটা শাড়ি আমিই কিনে দিতে পারি। ঠিকানাটা দিও।”

(চলবে)