Monday, August 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 97



উষ্ণতা পর্ব-০১

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
সূচনা পর্ব:

স্টেশনে পা রাখার জায়গা নেই। মালিহা বোঝে না জায়গাটা সবসময় কেনো সরগরম থাকে। বাস স্ট্যান্ডে তো সবসময় এতো লোক থাকে না। তাহলে এখানে কেনো? দুই বছর ধরে যাতায়াত করলেও এই কেনো উত্তর মালিহা আজও পায়নি। ভিড় ঠেলে বের হতে মালিহার দম আটকে যাবার জোগাড় হলো। এমনিতেই দম আটকে বুকটা যেনো ভার হয়ে আছে। দুপুরে হঠাৎ পাওয়া ফোনটা তার নিত্য পার করা সরল সূত্রের মতো অঙ্ককে জ্যামিতির জটিল চৌহদ্দিতে ফেলে দিয়েছে। কঠিন উপপাদ্যের মতো লাগছে সময়টা। না পারছে শেষ নামাতে নাই বা পারছে ছেড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে।

দুটো ক্লাস শেষ করে যখন মালিহা ফোন হাতে নিলো তখন তার স্ক্রিনে ভাসছে চৌদ্দটা মিস হয়ে যাওয়া কলের নোটিফিকেশন। তড়িঘড়ি করে মায়ের নাম্বারে ব্যাক করতেই শুনতে পেলো রাবেয়া ফুপুর গলা। বলা ভালো ভাঙ্গা গলা। কেনো গলা ভেঙেছে, মায়ের ফোন কেনো রাবেয়া ফুপু ধরেছে কোনো প্রশ্নই করা হলো না। ফুপুর একটা কথাতেই মালিহা অস্থির হয়ে উঠলো। ফুপু জানালেন মতিয়ার সাহেব ছোটো একটা এক্সিডেন্ট করেছেন। মালিহা যেনো একটু আসে। মালিহা ছোটো ভাই মিতুলকে ফোন দিলো। সে ধরলো না। অস্থির মালিহা আবার মায়ের ফোনে ফোন করলো। কেউ ধরলো না। মালিহাকে আশঙ্কার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যেনো তার পরিবার ভারী মজা পেয়েছে। সবাই এক মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।

হল থেকে আসার সময় নীতি এসেছে তার সাথে। নীতি তার রুমমেট। চারজনের রুমে বাকি দুইজন সিনিয়র হলেও নীতি তার ব্যাচের এমনকি তার সাবজেক্টের। মেয়েটা অনবরত বকবক করে চলেছে।
“মালিহা! তুই খামাখা টেনশন করছিস। আমার টেনশন হচ্ছে অন্য বিষয়ে। কি বিষয় বল তো?”
মালিহার মন চাইছিল নীতিকে চুপ করতে বলতে। কিন্তু বলা হলো না। সবসময় সবকিছু বলা যায় না। বিরস মুখে তাকে বলতে হলো, “কি বিষয়ে?”
“সচরাচর এমন ক্ষেত্রে কি হয় জানিস? বাবা মা ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়। আঙ্কেল বলবে “মা মালিহা! দেখো আমার শরীরের অবস্থা! তোমাকে নিয়ে আমি খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। সৎ পাত্রে তোমাকে দিয়ে যেতে পারলে সেই চিন্তাটা কমতো।” শোন বিয়ে থা যাই করিস একটা খবর অন্তত দিস। প্লিজ মালিহা না বলে বিয়ে করে নিস না।”
পেছন পেছন আসছিল এহসান। সে আতকে উঠে বলল, “এসব কি কথা?”
তার কথার জোরে নীতি ভয় পেয়ে মালিহাকে আঁকড়ে ধরলো। হিজাবে টান লেগে পিন বোরখার ভেতর দিয়ে চামড়ায় ঢুকে গেলো। ব্যথায় মুখ কুঁচকে নিলো মালিহা। সেটা খেয়াল করে নীতি বলল, “সরি সরি দোস্ত! এহসানের বাচ্চা এমন করে হালুম করলো যে ভয় পেয়ে গেলাম।”
বুকে ফু দিলো নীতি। বোরখার হাতায় মুখের ঘাম মুছলো মালিহা। এহসান বলল, “বিয়ে টিয়ের মা-মলা নাকি মালিহা?”
নীতি খ্যাক করে উঠলো। “এতো গাধা কেনো তুই? ওকে কেউ কিছু বলেছে যে ও জানবে? ও বললো না? তুই শুনিসনি?” একপাশে সরে মালিহার দিকে এসে নীতি বিড়বিড়িয়ে বলল, “ছাগলটা কেনো লেজ ধরেছে কে জানে।”
মালিহার সব কিছু বিরক্ত লাগছিল। বড় করে দম নিয়ে সে বলল, “এহসান তুমি চলে যেতে পারো। নীতি তুইও চলে যা। এতো সময় কষ্ট করার জন্য..”
“ফালতু আলাপ করবি তো ট্রেন লাইনে তোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবো মালিহা। তোর এই রসকষ ছাড়া ধন্যবাদ নিতে আমি আসিনি। তোকে ট্রেনের সিটে বসিয়ে দিয়ে তারপরেই আমি যাবো। এহসান তুই যা।”
“দুইজন মেয়েকে এভাবে এক রেখে যাওয়া কি ঠিক কাজ? মালিহা উঠুক তারপর তোকে নিয়ে ক্যাম্পাসে যাবো।”
মালিহা দম ছাড়লো। আর বোঝানোর চেষ্টা করলো না। হাতঘড়ির দিকে তাকালো সে। দুপুর তিনটা। ট্রেনের সময় সাড়ে তিনটা। তবে ঠিক সময়ে আসলে হয়। দেরি করে স্টেশনে পৌঁছানো এদেশের ট্রেনের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য। বাড়ি যেতে অন্তত তিন ঘণ্টা লাগবে। ক্রসিং হলে তো কথাই নেই।
নীতি আশপাশে তাকালো। এহসানকে দেখে বিরক্তিতে তার মাথার তালু গরম হয়ে যাচ্ছে। নীতির ধারণা অনুযায়ী এহসান হাফ লেডিস ধরনের ছেলে। তাই তাকে দেখলেই বিরক্ত লাগে। অথচ এমন লাগার কোনো কারণ নেই। এহসান কখনও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। একটু দূরে একটা বেঞ্চে এক ভদ্রলোক বসে আছে। তার পাশে দুই জন মহিলা। আরেকজন বসলে চারজনকে ঠাসাঠাসি করে বসতে হবে। নীতি মনে মনে দোয়া করলো, “আল্লাহ ঐ ব্যাটাকে উঠিয়ে দাও আল্লাহ! আমার অসহায় বান্ধবীটাকে বসার সুযোগ করে দাও। প্লিজ!”
হঠাৎ করেই লোকটা উঠে কোনদিকে চলে গেলো। নীতি যারপরনাই আনন্দে লাফিয়ে উঠে হাততালি দিলো। এহসান অবাক হয়ে বলল, “লাফালাফি করছিস কেন?”
নীতি সেই কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। এক হাতে মালিহার ব্যাগ আরেক হাতে মালিহাকে টেনে বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো। মালিহাকে বসিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসলো। এহসানের দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচু করলো। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। এহসান তাদের সাহায্য করার জন্য থাকলেও সেটার কিছুই করতে পারল না। করলো নীতি। এহসান অপমানিত বোধ করলো কি না বোঝা গেলো না। তবে মালিহার দিকে এগিয়ে যেয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “মালিহা তুমি কি চিপস টিপস কিছু খাবে? নাকি জুস আনবো?”
নীতি মুখ ভেঙ্গালো। “মালিহা তুমি কি চিপস টিপস কিছু খাবে? আহা চান্দু আমার! তুমি তুমি করছিস কেনো? আমাকে তুই বলিস ওকেও বলবি।”
এহসান সে কথা শুনেও শুনলো না। মালিহা বলল, “কিছু খাবো না। জার্নিতে আমি কিছু খেতে পারি না।”
“আচ্ছা।”
মুখ গোমড়া করে নীতির পাশে এসে দাঁড়ালো এহসান। নীতি বলল, “ঠিক হয়েছে। বেশি আহ্লাদ দেখাতে গেছিস কেনো? ও যে কি জিনিস তাতো তুমি জানো না মামা!”
এহসান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “না জানলেও জানছি।”

হঠাৎ নীতি দেখলো বেঞ্চে বসে থাকা সেই লোকটা আসছে। এসে কি বলবে আমা জায়গায় কেনো বসলেন? এহসানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “স্টেশনে কি জায়গা ধরার সিস্টেম আছে নাকি?”
“কি?”
“গাধা! কথা শুনিস না কেনো? কানে সমস্যা?”
“এতো কথা না বলে কি বললি সেটা বললেই তো হয়।”
এহসান বিরক্ত হলো।
“বলছি স্টেশনের বেঞ্চে কি জায়গা ধরার সিস্টেম আছে?”
“আরে না! কি সব ফালতু প্রশ্ন।”
নীতিকে এভাবে বলতে পারে এহসান যেনো শান্তি পেলো। নীতি কটমট করে তাকালো। পারলে মনে হয় মটর ভাজার মতো চিবিয়ে খেতো। আফসোস পারলো না। নীতি দেখলো লোকটা হন্তদন্ত হয়ে ফোন কানে নিয়ে আরেক দিকে ছুটে যাচ্ছে। নীতি স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ক্লাসে একদিন জায়গা ধরার কারণে তার ব্যাগ এক মেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। সেই ভয়টাই এখানে কাজ করেছে।
মালিহা ফোন বের করলো। অজানা আশঙ্কা মনটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। বাবার সাথে কথা হয়েছে দিন দুই আগে। মায়ের সাথে বলতে না পারা কথাগুলো বাবার সাথে বলে মনে ভার কমায় মালিহা। কাজেই মতিয়ার আলীর জায়গা তার কাছে মা তৌহিদার থেকে অনেক বেশি স্বস্তির। সেই স্বস্তিমাখা মানুষটার হঠাৎ বিপদ মালিহাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। রাবেয়া ফুপুর কণ্ঠ ইঙ্গিত করছিলো তিনি অনেক কেঁদেছেন। কেনো? এতো কান্নার কি হয়েছে?

কোনো এক বিচিত্র কারণে আজ ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশন ছুঁয়েছে। নীতি যারপরনাই অবাক।
“কি রে! কাহিনী কি? কি মনে করে ট্রেন এতো তাড়াতাড়ি এলো? ডাল মে কুছ কালা হ্যা!”
“তোর সবকিছুতে সন্দেহ নীতি। মালিহাকে ট্রেনে তোল।”
“ও হ্যাঁ হ্যাঁ। মালিহা পানির বোতলটা নে।”
মালিহা বোতল নিলো। তড়িঘড়ি করে ছুটতে যেয়ে হাতের পার্স পড়ে গেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো ভেতরের সব জিনিস। নীতি, এহসান তুলতে সাহায্য করলো। মালিহার হাত ঠান্ডা হয়ে আসছে। ট্রেন চলে যাবে না তো? সাইরেন বাজলো। নীতি ব্যাগ হাতে দিলে মালিহা ছুটতে যেয়ে পড়ে গেলো। নীতি তুলে ধরলো মালিহাকে। নরম কণ্ঠে বলল, “প্যানিক করিস না মালিহা। ট্রেন আছে। তুই হাঁট।”
নীতির কথা অনুযায়ী ট্রেন থামলো না। আস্তে আস্তে ছুটতে শুরু করলো। ছুটলো মালিহাও। তবে হাতলের নাগাল পেলো না। তার মনে হচ্ছে যেনো বাবাকে আর দেখা হবে না। মতিয়ার আলী যেনো তার থেকে অনেক দূরে হলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই কেঁদে ফেলল মালিহা। ট্রেন কি একটু থামতে পারে না?
মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রোদের মতো একট হাত বেরিয়ে এলো দরজার ওপাশ থেকে। হাতের মালিককে মালিহা দেখলো না। তবে হাতটাকে তার মনে হলো খড়কুটো, যে ডুবন্ত মালিহাকে বাঁচাতে এসেছে। খুব কষ্টে হাতটা ছুঁতে পারলো মালিহা। বাকি কাজটুকু হাতের মালিক করে নিলো। এক টানে তাকে তুলে নিলো ট্রেনের ভেতরে। মালিহা যেয়ে পড়লো লোকটার বাহুতে। পেছনে তাকিয়ে দেখলো প্ল্যাটফর্ম শেষ হয়েছে। সেই শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে নীতি। পেছনে দাঁড়িয়ে এহসান। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে সামনে তাকালো মালিহা। দেখলো একটি অতি পরিচিত মুখ খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে।

ধাতস্থ হয়ে সরে এলো মালিহা।
“তুমি এখানে?”
ইতমিনান বলল, “তোর সিট কোথায়?”
“ঘ ৫৪।”
“চল।”
ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে গেলো ইতমিনান। মালিহার মনে হলো এই ইতমিনানকে সে চেনে না। কয়েক বছর আগে দেখা বন্ধুসম ইতমিনানের সাথে এই মানুষটার কোনো মিল নেই। তার চোখেমুখে গাম্ভীর্যের ছাপ। মুখে এটে থাকা দাঁড়ি সেই গাম্ভীর্যে আরো একটু রোশনাই ছড়িয়েছে। এই মানুষটাকে দেখলে হঠাৎ করেই প্রাণখোলা হওয়া যায় না। বরঞ্চ এক অপরিচিত সম্মান এসে মনের কোণে জায়গা করে নেয়।
মালিহাকে বসিয়ে ইতমিনান বলল, “এখানেই চাকরি পেয়েছি। এক মাসও হয়নি এসেছি।”
যে মানুষটার সাথে দিনে দুইবার দেখা হতো সেই মানুষটার জীবনের খবর আজ মালিহা জানে না। জীবন বুঝি এমনই?
“কোথায় যাচ্ছো?”
ইতমিনান প্রথমেই অবাক হয়েছিল। মালিহার শান্ত মুখশ্রী থেকে নিঃসৃত প্রশ্ন তাকে বুঝতে সাহায্য করলো যে মালিহা কিছুই জানে না। জানাতেও চাইলো না ইতমিনান। দুঃখের চৌম্বকীয় জাল থেকে যতো দূরে সরে থাকা যায়।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতমিনান বলল, “বাড়িতে।”
“ওহ। জানো ভাইয়া বাবা এক্সিডেন্ট করেছে।”
ইতমিনান তাকালো। তার কাছে মনে হলো ক্লাস নাইনে পড়া মালিহা কথা বলছে। মালিহা বদলায়নি। সেই আগের মতোই আছে। চার বছর আগের মতো। যে সহজ ভাষায় সহজ কথা বলতে পারে। কিন্তু ইতমিনান জানে আজকের পর মালিহা আর এমন সহজ সরল থাকতে পারবে না। বাস্তবতা তাকে এমন থাকতে দেবে না। ইতমিনান বুঝলো না তার কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ। পরের যেটুকু মালিহা জানেনা সেটুকুও সে জানে। সেই জানাটুকু তার গলা আঁকড়ে ধরেছে। কথা বলতে দিচ্ছে না ঠিকমতো। ইতমিনান কোনমতে বলল, “ওহ।”
মালিহার মনে হলো ইতমিনানের বাহ্যিক অবয়বের সাথে তার অন্তঃকরণও পাল্টে গেছে।
“আমি পাশের বগিতে আছি। কিছু দরকার হলে বলিস।”
ইতমিনান দ্রুত পায়ে চলে গেলো। মালিহা আবার সঙ্কট সাগরে চিন্তার ঢেউয়ে আবর্তিত হতে লাগলো। কিছুক্ষণের মাঝেই ট্রেনের ঝাকুনিতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

আসনে বসতেই ইতমিনানের মনে হলো বড় বেশি গরম লাগছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলেও লাভ হলো না। কপালের ঘাম মুছলো ইতমিনান। মালিহার শান্ত মুখটা চোখে ভাসছে। যোগাযোগের সুতো ঢিল হলেও কি সে মালিহাকে কখনও ভুলেছিলো? রক্তের বাঁধন ভোলা কি এতোই সহজ? যেই বাঁধন সৃষ্টিকর্তা বেঁধে দিয়েছেন কার সাধ্য তা ছিন্ন করে? ছটফট করতে করতে ইতমিনান বেশ কয়েকবার মালিহাকে দেখে এলো। প্রত্যেকবারই তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো। যেভাবে মালিহা ঘুমোচ্ছে তাতে তার ব্যাগসহ পুরো মানুষটাকে তুলে নিয়ে গেলেও সে ঠিক পাবে না। ফলে ইতমিনানের আনাগোনা আরো বাড়লো। তার পাশের আসনের লোকটা বিরক্ত হলো বারবার এমন ওঠাতে। ইতমিনান পাত্তা দিলো না। তার কেনো যেনো মনে হলো আসন্ন ঝড় থেকে মালিহাকে বাঁচানোর দায়িত্ব তার। একমাত্র সেই পারবে কাজটা করতে।

আঁকাবাকা মাঠ, হাজার রকম পরিবেশ, অনেকগুলো ক্রসিং পেরিয়ে ট্রেন যখন গন্তব্যে পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ইতমিনান মালিহার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। শেষ আধা ঘণ্টা সে এখানে দাঁড়িয়েই কাঁটিয়েছে। নামার সময় মালিহাকে সে ডেকে বলল, “মালিহা ওঠ। নামতে হবে।”
কাজ হলো না। হাতের ব্যাগ দিয়ে মালিহাকে ধাক্কা দিলো ইতমিনান। মালিহা হুড়মুড়িয়ে উঠলো। তাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় না দিয়েই টেনে সঙ্গে নামালো ইতমিনান। তারা নামতেই ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গেলো। মালিহা যখন বুঝলো তারা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে তখন মনে হলো আকাশটা থমথম করছে। পরিবেশটা ভয়ানক কিছুর জানান দিচ্ছে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২

প্রতিবার মতিয়ার আলী এবং মিতুল স্টেশনে অপেক্ষা করে। এবার কেউ নেই। মালিহার বুকটা কামড়ে উঠলো। বাবার অনুপস্থিতি এখন থেকেই চোখে কাঁটার মতো বিধছে। সামনে এগিয়ে যেতেই ইতমিনান ডেকে উঠলো, “মালিহা দাঁড়া। রিকশা ডাকি।”
ফোন বাজলে পার্স থেকে বের করে দেখলো নীতি। কানে ধরতে না ধরতেই হড়বড় করে মেয়েটা বলল, “দোস্ত পৌছাইসছিস? আমি এসেই ঘুমায় গেছিলাম। এজন্য ফোন দিতে পারিনি। তোর ব্যাগ মোবাইল সব ঠিক আছে? কিছু চুরি হয়নি তো?”
“নীতি আমি আমার ফোন দিয়েই তোর সাথে কথা বলছি।”
“ওহ হ্যাঁ! তাইতো!”
“মাত্র ট্রেন থেকে নামলাম। অনেকগুলো ক্রসিং ছিলো তাই দেরি হলো।”
“সাবধানে যা দোস্ত। মিতুল আসছে?”
“না। আমার এক কাজিন আছে।”
“আচ্ছা। আংকেলের খবর বলিস।”
“ঠিকাছে।” ফোন রেখে কাপড়ের ব্যাগের কথা মনে পড়তেই হায়হায় করে উঠলো মালিহা।
“আমার ব্যাগ ট্রেনে ফেলে এসেছি।”
“তাহলে এটা কার?” হাত উঁচু করলো ইতমিনান।
“ওহ।” মালিহা নিভে গেলো।
“এই মনোযোগ নিয়ে তুই দুই বছর ভার্সিটিতে কিভাবে পড়লি আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।”
মালিহা উত্তর দিলো না।
“ভাইয়া, বাবার সাথে তোমার কথা হয়?”
ইতমিনান রিকশা খুঁজতে খুঁজতে অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলো, “হতো।”
মালিহা উদগ্রীব হয়ে বলল, “এখন আর হয় না? তুমিও বাবার সাথে রাগ করে আছো?”
থমকে গেলো ইতমিনান। মালিহাকে তাড়া দিয়ে বলল, “এটায় তুই ওঠ। আমি পরেরটায় আসছি।”
“কোথায় আসছো?”
ইতমিনান সময় নিয়ে বলল, “তোদের বাড়িতে।”
“সত্যি!”
মালিহার অবাক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাদের দাদা মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। তখন থেকেই বন্ধনে ঢিল পড়েছে। সম্পর্কের সুদৃশ্য জ্বাল ছিঁড়েছে সম্পত্তি নামক কীট। শুরু হলো রেষারেষির। নিশিরাতে দাদীর ভূতের গল্প শুনে জড়াজড়ি করা ভাইবোনগুলোরও কালে ভদ্রে দেখা হয় না। আগুনে ঘি ঢেলেছেন মালিহা এবং ইতমিনানের মা। তাদের ফুপু রাবেয়া নিজ উদ্যোগে সব মিটমাট করতে চাইলেও ইতমিনানের মা আয়েশা জিইয়ে রাখলেন রাগ। বাজার সদাই করতে গেলে যখন মতিয়ার আলীর সাথে বড় ভাই মকবুল আলীর দেখা হয় দুজন দুদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যান। ফলাফল স্বরূপ কমে গেলো আসা যাওয়া। সম্পর্কের রঙিন ঘরে ধুলো জমলো, মাকড়সার জাল ঘর বুনে সংসার পাততে শুরু করলো। আসল মানুষগুলো ভুলে গেলো তাদের মাঝে কি শক্তিশালী এক সম্পর্ক ছিল।

রিকশা বাড়ির যতো কাছে যাচ্ছে কোনো এক তীক্ষ্ম আওয়াজ মালিহার কানে বাড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন উদয় হলো। এতো বছর পর হুট করে আজই কেনো ইতমিনান তাদের বাড়িতে যাচ্ছে? মনের ইতিবাচক সত্ত্বা বলল নিশ্চয়ই অসুস্থ চাচাকে দেখতে যাচ্ছে। মালিহা মানতে চাইলো। তবে সেই সময়টুকু পেলো না। রিকশা বাড়ির সামনে আসতেই ভেতর বাড়ি থেকে নাজিয়া বেগমের চিৎকার শোনা গেলো। মালিহা দিক ভুলে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকলো। পেছনের রিকশা থেকে ধীরে সুস্থে নেমে ভাড়া মেটালো ইতমিনান। রিকশা দুটো চলে গেলেও সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ এসে জাপটে ধরলো তাকে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দেহটা আঁকড়ে ধরলো ইতমিনান। বৃদ্ধ বাবাকে বুকে নিয়ে মনে হলো এর চেয়ে বেশি ভারী দুনিয়ায় আর কিছু হতে পারে না। মকবুল আলীর কি এতই কষ্ট? কষ্ট মাপার কোনো যন্ত্র কেনো নেই? যেই অনুভূতি থেকে সৃষ্ট রোগ নির্ণয়ের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্র সেই অনুভূতিকেই কেনো এতো হেলাফেলা?

মালিহার মনে হচ্ছে তার কান থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। পরীক্ষার হলে প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পারলে তার এমন লাগে। তখন খুব করে বাবাকে মন পড়ে। মনটা চায় বাবার বুকে যেয়ে লুকিয়ে থাকতে। কিন্তু মালিহা মতিয়ার আলীর বুক খুঁজে পাচ্ছে না। মাথা সামনে পেছনে প্যাঁচানো সাদা গজ কাপড়ে। আবক্ষ কাফনে ঢাকা দেহটা মতিয়ার আলীর, এই খবরটা তার মস্তিষ্ক যখনই তার মনে পাঠাচ্ছে তখনই এক যু-দ্ধ বেঁধে যাচ্ছে। মন মননের দ্বিমুখী যু-দ্ধ মালিহা সইতে পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো ছাউনি দেয়া উঠোনে। আশপাশের মানুষ হাহাকার করে উঠলো।
“আহাগো! মাইয়াডা শোক সামলাইতে না পাইরা জ্ঞান হারাইসে। ধরো ওরে ধরো কেউ।”

নাজিয়া বেগম বুক চাপড়ে কাঁদছেন। বৃদ্ধা রাশেদা বেগম পুত্র হারানোর শোক ভুলে পুত্র বধূর কাছে এগিয়ে গেলেন। তার শক্ত কণ্ঠ এবং স্পষ্ট উচ্চারণ যে কাউকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
“কান্না থামাও বউমা। আশপাশে পুরুষ মানুষ আছে। নিজের দিকে খেয়াল করো। মেয়ে এসেছে। ওকে দেখো।”
রাশেদা বেগমের ভগ্ন কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালেন নাজিয়া। বিগত দিনের সকল মন কষাকষি ভুলে হুমড়ি খেয়ে বৃদ্ধা শাশুড়ির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আহাজারি করে বললেন, “আমার কি হবে মা? আমার ছেলেমেয়ের কি হবে? আমার সব শেষ হয়ে গেলো।”
রাশেদা বেগম সন্তর্পনে নাজিয়ার শাড়ির আঁচল তুলে দিলেন। আশপাশের মহিলাদের নির্দেশ দিলেন তাকে ঘিরে ধরতে। পাশেই মালিহা শুয়ে আছে। একজন তাকে ধরে নাজিয়ার বুকে দিলেন। নাজিয়ার কান্না থামলো না। কান্নার গতি বেড়ে গেলো।
“ও মালিহা রে! তুই তো এতিম হয়ে গেলি রে! আল্লাহ তুমি কি করলা?”
“আহা মালিহার মা! এসব কোন ধরনের কথা? হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। মরণ আজ হোক কাল হোক আসবে। তাই বলে তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলে নিজের ঈমান আমল নষ্ট করবা কেনো?”
আশপাশের অনেকে রাশেদা বেগমকে চেনে না। তারা কিছুটা অবাক হলো। ছেলে হারিয়ে এমনভাবে শক্ত থাকতে কাউকে বোধহয় তারা দেখেনি। কণ্ঠের কি তেজ! সম্মান যেনো আপনাতেই চলে আসে।

মালিহার জ্ঞান ফিরলে কিছুক্ষণের জন্য তার স্মৃতি ভ্রম হলো। আশপাশ বুঝতে সময় লাগলো। যখন বুঝতে পারল ততক্ষণে সে এতিম। নাজিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে মা বলে ডাকতেই তিনি আবার হাউমাউ করা কান্না শুরু করলেন। কিন্তু মালিহার মুখ তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে গেলো। যখন সে বুঝল তার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের মানুষটা ইহলোক ত্যাগ করেছে, তার সাথে শেষ সাক্ষাৎটুকু মালিহা করতে পারেনি তখন অশ্রু তার গাল ভেজালেও কন্ঠরোধ হয়ে গেলো। চোখের পাতায় ফেলে আসা একুশ বছরের স্মৃতি নিজ উদ্যোগে তাদের মেলে ধরলো। হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ সবটাই জীবন্ত। শুধু মানুষটাই প্রাণহীন।

ইতমিনান মিতুলকে খুঁজলো। ছেলেটা আশপাশে কোথাও নেই। আয়েশা ছেলের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “কাকে খুঁজছিস আব্বা?”
“মিতুল কই?”
“জানিনা। আমিও অনেকক্ষণ দেখিনি।”
ইতমিনান মাকে লক্ষ্য করলো। কথাটা বলা উচিত হবে কি না ভাবতে ভাবতেই মকবুল আলী এলেন। ইতমিনান কথাটা গিলে নিলো। বলা হলো না।
“ইতমিনান লা-শ সকাল পর্যন্ত রাখা কি ঠিক হবে?”
ইতমিনান বিড়বিড় করলো। “লা-শ! লা-শ!” এক মুহূর্তের মাঝেই একটা প্রাণবন্ত দেহ কেমন করে লা-শে পরিণত হয়। রুহের কি মাহাত্ম্য!
“মালিহার নানা বাড়ি থেকে সবাই এসেছে?”
“ওর মামার সাথে দেখা হয়েছে। আর কেউ তো আসার নেই।”
“মিতুল কোথায়?”
“তোর দাদির ঘরে। তখন থেকে কান্নাকাটি করছে।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতমিনান বলল, “এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?”
“রাস্তা পার হতে যেয়ে প্রাইভেট ধাক্কা দিয়েছে। উল্টে পড়ে একদম মাথায় আঘাত লেগেছে। দুইদিন আগেও আমার সাথে দেখা হয়েছিল। তখন যদি একটু কথা বলতাম..”
বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মকবুল আলী। জমিয়ে রাখা অভিমানটুকু এখন কেবল তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
ইতমিনান বলল, “আমি মিতুলের সাথে দেখা করে আসি। তুমি কবর খুঁড়তে বলো।”

রাশেদা বেগমের ঘর অন্ধকার। দেয়ালের সাথে খুলতে থাকা তাসবীহর দানাগুলো চকচক করছে। ইতমিনানের কাছে এই জিনিসটা রহস্যময় লাগে। জ্বলজ্বল করে অন্ধকারের গভীরতা বুঝিয়ে যেনো গা ছমছম করে দেয়া এর কাজ।
“মিতুল!”
ডাকার সাথেই লাইট জ্বালিয়ে দিলো ইতমিনান। মতিয়ার আলীর বাড়িতে এলে রাশেদা বেগম এই ঘরেই থাকেন। সেই হিসেবে ঘরের আনাচে কানাচে ইতমিনানের চেনা। তাদের যাওয়া আসা কমে গেলেও রাশেদা বেগম নিয়ম করে ছেলেদের বাড়িতে থাকেন।
মিতুল মাথা ওঠালো না। হাঁটুতে ভর দিয়ে দুই হাত দিয়ে মুখে ঢেকে রেখেছে সে। পিঠ ক্রমাগত কেঁপে কেঁপে উঠছে।
“মিতুল?”
মিতুল নিজের ঘাড়ে রাখা ইতমিনানের হাত ঝাড়া দিলো। লাল চোখ দুটো তার দিকে তাক করে গলায় আক্রোশ নিয়ে বলল, “কিসের জন্য এসেছো?”
ইতমিনান চুপ করে ক্রোধটুকু গলাধঃকরণ করলো। তার দোষ অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্পত্তির জের ধরে মালিহা, মিতুলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো কারণই তার ছিলো না। বংশের বড় সন্তান হিসেবে তার উচিত ছিল বাবা মাকে বোঝানো। সম্পর্কের ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়া। সেটা না করে সে উল্টো তাদের কথায় সায় দিয়েছে। কাজেই শাস্তি তার প্রাপ্য। কিন্তু সে কি শাস্তি পাচ্ছে না? পিতৃতুল্য চাচার মরদেহ কি শাস্তি হিসেবে যথেষ্ট নয়?
“আমার বাবার লাশ দেখতে এসেছো? যাও দেখো। বাইরে আছে। আমাকে বিরক্ত করো না।”
ইতমিনান নির্নিমেষে মিরুলকে দেখলো। ছোট্ট ছেলেটা দেখতে দেখতে এইটে উঠে গেছে। রাগ দেখাতে শিখে গেছে।
“মালিহা এসেছে।”
নরম কণ্ঠটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে যতোটা সময় লাগে ততটুকু সময়ই মিতুল স্থির ছিলো। তারপর ছুটে চলে গেলো বাইরে। মিতুলের জায়গায় মাথা নিচু করে বসলো ইতমিনান। নিজের কাছে নিজে অপরাধী হলে বিচারক হবে কে?

মিতুল বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তবে মালিহার নড়চড় নেই। যেনো একটা প্রাণহীন জড়ো পদার্থ। একে একে সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। আফসোসের সুর শোনালো, স্বান্তনা দিলো। মালিহা টু শব্দ করলো না। কিন্তু যখনই খাটিয়া কাঁধে ইতমিনান তার সামনে এসে বলল, “মালিহা, চাচাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
মালিহা কেঁদে ফেললো। বুকভাঙ্গা কান্নার শব্দ গিলতে ঠোঁট দুটো চেপে ধরে রাখলো। মালিহার মনে হলো কেউ তার কলিজাটা দুই ভাগ করে নিয়ে যাচ্ছে।

চলমান।

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
শেষ_পর্ব
~মিহি

তিথি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। শৈশবের পাশে মিত্তিম দাঁড়িয়ে। মেয়েটাকে শৈশবের পাশে দেখে এই মুহূর্তে তিথির আর খারাপ লাগছে না। যে শৈশবকে পাওয়ার জন্য সব করতে রাজি ছিল তিথি, সে অনুভব করতে পেরেছে আদতে সে শৈশবকে ভালোবাসেনি। মিত্তিমের শৈশবের প্রতি যে বিশ্বাস তার তিল পরিমাণও সে কখনো করতে পারেনি শৈশবকে। মিত্তিম কিভাবে শৈশবকে এতটা বিশ্বাস করে? মাত্র ক’দিনের ভালোবাসায় এমন বিশ্বাস কী করে জন্মায়? তিথির চোখের কোণা বেয়ে জল গড়ালো। সে শৈশবকে হারিয়েছে, নিজের দোষেই হারিয়েছে। অথচ এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছিল সে শুধু শৈশবকে পাওয়ার আশায়। এভাবে কখনো কাউকে পাওয়া যায়? ভালোবাসা ব্যতীত এক ষড়যন্ত্রে নেমে ভালোবাসা পাওয়ার আশা ঠিক কতটা অনর্থক তা বুঝেছে সে।

-“শৈশব, তোমার কাছে স্যরি বলার মুখটুকুও নেই আমার। তবুও বলতে চাই। যে অন্যায় তোমাদের সাথে আমি করেছি, তা ক্ষমার অযোগ্য। আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা। মিত্তিম তোমাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে শৈশব। ওর মতো করে তোমাকে কখনো কেউ ভালোবাসতে পারবে না। এই মেয়েটার হাতটা ধরে রেখো সবসময়।”

শৈশব কোনো কথা বললো না। তিথিকে সে ক্ষমা করতে পারবে না। মুখে বললেও সেটা মিথ্যেই রয়ে যাবে, মনের সায় কখনোই আসবে না। তার চেয়ে বরং চুপ থাকাটাই শ্রেয়। শৈশব কেবল একটা কাজ করলো। মিত্তিমের হাতটা শক্ত করে নিজের হাতের মাঝে মেশালো। মিত্তিম অবাক চোখে তাকালো শৈশবের দিকে। তিথির চোখ নোনাজলে ভিজে উঠলো, কণ্ঠে টের পাওয়া গেল মনের আর্তনাদের বিষাদ।

-“জানি আমার বলাতে কিছু যায় আসে না, তবুও চাইবো তোমরা ভালো থেকো সবসময়। আমি তোমাদের সামনে আর কখনো আসবো না তাই ক্ষমা চেয়ে নিলাম। এখন তোমরা এসো। আমার আর কিছু বলার নেই।”

শৈশব তৎক্ষণাৎ মিত্তিমের হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে এলো। এ মুহূর্তে শৈশবকে প্রচণ্ড অমানবিক মনে হলেও শৈশবের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে সে।

শৈশব মিত্তিম ফিরলো একটু পরেই। আকলিমা বেগম মিত্তিমকে ভেতরে বসতে বললেন একটু। তিনি শৈশবের সাথে সাথে আলাদা কথা বলবেন। মিত্তিম মাথা নাড়লো। শৈশবের খানিকটা নার্ভাস লাগছে। সে জানেও না কোন প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হবে এখন।

-“ভয় পাচ্ছো শৈশব?”

-“একটু।”

-“আমি তোমাদের অপেক্ষা করতে বলেছি ঠিকই কিন্তু আমি কখনোই বলিনি তোমাদের যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করতে। আমি জানি এটা সম্ভব না। মিত্তিম তোমার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল। তোমাদের কথা বন্ধ হলে মেয়েটা নিজেকে কখনো সামলাতে পারবে না তবুও অপেক্ষা করতে বলেছি কেন জানো?”

-“কেন?”

-“সহজে পেয়ে গেলে মানুষ প্রায়শই মূল্য দিতে ভুলে যায়। ও তোমাকে একটু অপেক্ষা করেই অর্জন করুক। মাঝেমধ্যে ওকে কল কোরো, ও একটু জানুক যে সব পরিস্থিতিতেই তুমি তাকে একই রকম ভাবে ভালোবাসবে। বুঝেছো?”

-“জ্বী।”

-“আসি তবে, সাবধানে থেকো।”

শৈশব আর কিছু বললো না। তার মনের আনন্দ সে ব্যক্ত করার অবস্থায়ও নেই। মিত্তিম তার মায়ের সাথে চলে গেল। শৈশব দূর থেকে দেখলো তাকে। এই দেখাটাই বোধহয় দূর থেকে শেষ দেখা হবে, পরেরবার শৈশব খুব কাছ থেকে দেখবে মিত্তিমকে। মিত্তিমের মাঝে মিশে অনুভব করবে তাকে। শৈশব মাথা নিচু করলো। চোখ ছলছল করছে তার, মিত্তিমকে পেয়ে যাওয়ার খুশি!

___________________________________________________________________________________________

মিত্তিমের পরীক্ষা আগামীকাল। শৈশব এ সপ্তাহে ফোন করেনি তাকে। মেয়েটা একটুও ডিসট্র্যাক্ট হোক চায়নি সে। তবে আজ প্রচণ্ড অসহায় লাগছে। মন অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। শৈশব মিত্তিমের মায়ের নম্বর ডায়াল করলো। রাত এগারোটা পেরিয়েছে। কল কাটবে কাটবে করেও কাটা হলো না। আকলিমা বেগম ফোন ধরলেন। শৈশব সালাম দিল। আকলিমা বেগম উত্তর দিলেন। শৈশব আকলিমা বেগমের কণ্ঠে আরো দুশ্চিন্তায় পড়লো।

-“আন্টি মিত্তিম? ও কি পড়ছে এখন? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে?”

-“ঘুমোচ্ছে।”

-“আচ্ছা আন্টি। সকালে আমার তরফ থেকে বেস্ট অফ লাক জানায়েন।”

-“ঠিক আছে।”

-“আন্টি কিছু হয়েছে?”

-“না শৈশব। সব ঠিক আছে। তোমার পরীক্ষা চলছে না?”

-“হ্যাঁ এইতো চলছে আর কী।”

-“ভালোভাবে পরীক্ষা দাও।”

ব্যস! এটুকু খোঁজখবর নিয়েই কথার সমাপ্তি ঘটলো। শৈশব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। প্রায় পাঁচ মাস হচ্ছে মিত্তিমকে দেখেনা সে, এতটা অস্থির আগে তো লাগেনি। আজ হঠাৎ এ অস্থিরতা কেন? মিত্তিমের পরীক্ষার জন্য কি তার টেনশন হচ্ছে? বোধহয়! শৈশবের খানিক বাদেই মাথা ধরলো। একটু ঘুমোনো দরকার কিন্তু ঘুম আসছে না। শৈশব ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো।

শৈশবের ঘুম ভাঙলো দুপুর বারোটার পর। লাফ দিয়ে উঠলো সে। ওষুধের প্রভাব এতক্ষণ থাকবে বুঝে উঠতে পারেনি। ভাগ্যিস দুদিন বাদে পরীক্ষা। শৈশব উঠে ফোন হাতে নিতেই দেখলো ফায়াযের নম্বর থেকে সাতান্নটা মিসড কল। শৈশব হাতমুখ ধুয়ে ফায়াযের নম্বরে কল করলো। ফোন সুইচড অফ বলছে। শৈশব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শৈশব মায়ের নম্বরে কল করলো। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। ঘণ্টা দেড়েক পর ফায়াযই কল ব্যাক করলো। শৈশব তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলো কল।

-“কী সমস্যা? কল করে ফোন অফ ক্যান তোর? মাও কল ধরছে না।”

-“ভা..ভাইয়া তুই একটু আসবি?”

-“ফায়ায কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই? সবাই ঠিক আছে তো?”

-“তুই প্লিজ একটু আয় ভাইয়া!”

ফায়াযের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসলো। সে আর কথা বলতে পারলো না। শৈশব প্রচণ্ড চিন্তায় পড়লো। দ্রুতই বাসের টিকিট কাটলো। প্রথম যে বাসটা পেল সেটারই। আজ মিত্তিমের পরীক্ষা, ফায়াযেরও তো পরীক্ষা ছিল। কী এমন হলো! শৈশব চিন্তায় ঠিকমতো বসতেও পারলো না। সবকিছুই দোদুল্যমান লাগছে তার নিকট। জ্যাম না থাকায় খুব একটা দেরি হলো না শৈশবের পৌঁছাতে। বাস থেকে নেমে প্রথম ফায়াযকেই কল করলো সে। ফায়ায হাসপাতালের ঠিকানা দিল। শৈশবের হৃদস্পন্দন কমে আসছে। হাসপাতাল? কে অসুস্থ? মা? শৈশবের মাথায় চিন্তাগুলো যত ঘুরপাক খাচ্ছে, তত তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে। প্রচণ্ড টেনশনে কোনোরকম সে হাসপাতালে পৌঁছালো। আকলিমা বেগম বসে আছেন এককোণে, তার পাশে মিত্তিমের বাবা। ফায়ায এবং আহসিনা বেগমও একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। শৈশব অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চাইছে। মন বারবার বলছে যা সে ভাবছে তেমন কিছু না হোক। শৈশবকে দেখামাত্র ফায়ায প্রচণ্ড দুর্বল অনুভব করলো। ভাইকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো সে ক্রমাগত। শৈশবের সেটুকু শক্তিও অবশিষ্ট নেই যে সে ফায়াযকে সামলাবে তবু ভাইয়ের বাহু আঁকড়ে স্তব্ধ গলায় সে প্রশ্ন করলো,”কী হয়েছে?”

ভাইয়ের প্রশ্নের কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারলো না সে। আইসিইউ এর দিকে তাকালো শুধু। শৈশব ছুটে গেল সেদিকে। বন্ধ দরজার কাঁচঢাকা অংশে মিত্তিমের ক্ষতবিক্ষত শরীরে অজস্র ব্যান্ডেজ দেখে দাঁড়ানোর ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো সে।

-“মিত্তিমকে কোচিংয়ের সামনে থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এক সপ্তাহ আগে। ড্রাগস দিয়ে পরপর…”

-“পরপর কী ফায়ায?”

-“ধর্ষণ করা হয়। সাতদিনের মাথায় পুলিশ ট্রেস করে ঐ চারজনকে ধরে। মিত্তিমের অবস্থা খুব খারাপ, ইন্টার্নাল ইঞ্জুরি অনেক বেশি। সবাই নিষেধ করেছিল তোকে হঠাৎ করে জানাতে। কিন্তু কাল রাত থেকে মিত্তিমের অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ ছিল। আমি তোকে কল করেছিলাম, তুই রিসিভ করিসনি।”

শৈশবের নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সে কেন ঘুমের ওষুধ গেল? এত অস্থির লাগার পরেও কেন একবার মিত্তিমকে দেখার আকুতি জানাতে পারলো না? প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে শৈশবের নিজের উপর! সব তো ঠিক ছিল। ভালোবাসা, বিশ্বাস, পরিবার! সবকিছু ঠিক ছিল ওদের মধ্যে তবে ভাগ্য এমন নিষ্ঠুর পরিহাস কেন করলো?

_____________

মিত্তিমের হালকা একটু জ্ঞান ফেরার পর শৈশব দেখতে চাইলো তাকে। শৈশবের সে আকুতি ফেলবার মতো নির্দয় সেখানে কেউ ছিলেন না। শৈশব এসে পাশে বসলো মিত্তিমের। মেয়েটার হাতে অজস্র ক্ষত। মিত্তিম শৈশবকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিল, মাথা নিচু করে ফেললো। শৈশব মিত্তিমের হাত ধরার চেষ্টা করলো। মিত্তিম হাত সরিয়ে নিল।

-“মিত্তি! এমন কোরো না প্লিজ, আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিও না এভাবে।”

-“আ..আপনি আ..আমার কাছে আ..আসিয়েন না। আমার গা..গায়ে যথেষ্ট নোংরা লেগে আছে। ছুঁয়েন না আমাকে।”

শৈশব পাগলের মতো মিত্তিমের হাতটা আলতো করে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ক্ষত হাতটা অজস্র চুমু খেল। তার প্রিয় মানুষটাকে এ অবস্থায় দেখার ক্ষমতা তো বিধাতা তাকে দেননি! শৈশবের বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। পাঁচ মাস আগে মিত্তিমকে যখন সে দেখেছিল, তখন সে বলেছিল পরেরবার মিত্তিমকে খুব কাছ থেকে দেখবে। এভাবে দেখার প্রত্যাশা তো সে করেনি! তবে কেন এত নিষ্ঠুরতা তার সাথেই? কেন মিত্তিমের উপর দিয়ে এত বড় নৃশংসতা চালালো নিয়তি? মিত্তিম কথা বললো না আর। শৈশবকে চলে যেতে ইশারা করলো। শৈশব অসহায়ের মতো উঠে যেতে নিল। মিত্তিম কাঁপা হাতে কেবল আওড়ালো,”ভালোবাসি!” শৈশব পাশে বসে মিত্তিমের হাত ছুঁয়ে ভালোবাসি বললো বারবার। সে কি জানতো এটাই শেষবার নিজের প্রিয়তমাকে ভালোবাসি বলার?

রাত বারোটা নাগাদ মিত্তিম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। ড্রাগের ওভারডোজ আর ইন্টার্নাল ক্ষত- সব মিলিয়ে তার শরীর আর টিকে থাকতে পারেনি বেঁচে থাকার যুদ্ধে। শৈশব মিত্তিমের লাশ দূর থেকে দেখেছে। একটু কাছে গিয়ে দেখার সাহস পায়নি। মিত্তিমকে সাদা কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় দেখার শক্তিটুকু সে পায়নি।

______________________________

মিত্তিম চলে যাওয়ার পর থেকে শৈশবের অদ্ভুত একটা রোগ হয়েছে। সে এটাকে ঠিক রোগ বলতে চায় না। সে মিত্তিমকে দেখতে পায়, সবসময় দেখতে পায়। অন্যকেউ দেখতে পারে না কিন্তু শৈশব মিত্তিমকে সবসময় নিজের কাছে দেখে, কথা শোনে। শৈশব পরিবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে চেয়েছিলেন তাকে। শৈশব যায়নি। শৈশব মিত্তিমকে হারিয়ে ফেলতে চায় না। সে মিত্তিমকে হাসতে দেখছে, ছুঁতে নাই বা পারলো! একটু কথা বলতে তো পারছে, জড়িয়ে নাই বা ধরতে পারলো! অস্বাভাবিক আচরণ তো করছে না সে, একটা মানুষের উপস্থিতি তাকে শান্তি দিচ্ছে। মানুষটা অন্য কারো নজরে না পড়ুক, সে দেখতে পারছে তার ভালোবাসাকে। এটুকু খুশি তার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না!

শৈশব গলার টাই ঠিক করছে। ইন্টারভিউ আছে আজ তার। সময়গুলো বড্ড দ্রুত পেরিয়েছে। মিত্তিম ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। শৈশব তাকালো সেদিকে। মিত্তিম মুচকি হেসে বললো,”বেস্ট অফ লাক, মি.ইংলিশ মিডিয়াম।”

শৈশব মুচকি হাসলো। একটা কথা মাথায় ঘুরতে লাগলো তার,”তুমি আমার সবকিছুতেই ছিলে, কেবল ভাগ্যে ছিলে না!”

সমাপ্ত

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১৭

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১৭তম_পর্ব
~মিহি

-“দেখো শৈশব, তোমাদের এ প্রেম যে হঠাৎ তা আমিও বুঝেছি। আমি চাচ্ছি তোমার কথাই রাখতে। মিত্তিমের এডমিশন অবধি অপেক্ষা করো তোমরা। আমি তোমার মায়ের সামনেই এসব বলছি যেন কোনো সমস্যা না ঘটে।”

শৈশব মিত্তিমের মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখ বর্ষার ঘন কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো দেখাচ্ছে কেন? মেয়েটার মন খারাপ? কেন? মিত্তিমের কি এ সিদ্ধান্তে আপত্তি আছে? শৈশবের মাথায় প্রশ্নরা ঘুরপাক খাচ্ছে একাধারে।

-“আমার আপত্তি নেই আন্টি তবে মিত্তিমের মতামতটাও জানা উচিত আমাদের।”

-“তোমাদের কিছুক্ষণ একা কথা বলা উচিত। ভাবী, আপনার আপত্তি না থাকলে…”

আহসিনা বেগম এতক্ষণ চুপ ছিলেন। এবার সায় দিলেন। তিনিও চাচ্ছেন বাচ্চা দুটো নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিক। শৈশব ইশারা করলো। মিত্তিম মায়ের দিকে তাকিয়ে সম্মতি পেয়ে ধীরে ধীরে এগোলো। শৈশব তার পেছন পেছন গেল। ছাদটা ইদানিং মিত্তিমের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে। ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। শৈশবের শরীরের চিরচেনা গন্ধটা ভেসে আসছে। শৈশব তার অতি সন্নিকটে। এ নিকটবর্তী থাকাটাও মিত্তিমকে পোড়াচ্ছে এখন। তাকে যে প্রতীক্ষার পরীক্ষায় বসতে হবে এখন। মায়ের কথার অর্থ মিত্তিম বুঝেছে। তিনি মিত্তিমের ভালোর জন্যই বলেছেন তবে এ ভালো মিত্তিমের ভালো লাগছে না।

-“আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে মিত্তি?”

মিত্তিম চোখ মেললো। শৈশবের চোখে অদ্ভুত আকুতি। শৈশব অনুমতির অপেক্ষা করলো না। মিত্তিমের মাথা চেপে ধরলো নিজের বুকে। শৈশব অনুভব করতে পারছে মিত্তিম কাঁদছে। শৈশবের শার্ট খামচে ধরে ক্রমাগত কাঁদছে মেয়েটা। শৈশব মিত্তিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

-“মিত্তি! আমি হারিয়ে যাচ্ছি না তো, তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? এমন করলে কিন্তু এখনি বিয়ে করে নিয়ে যাবো।”

-“চলো।”

-“তাই? এখন নিয়ে গিয়ে বউকে কী খাওয়াবো?”

-“আমি কি হাতির সমান খাই নাকি যে কী খাওয়াবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো!”

-“না জান, আমি আমার বউকে সমস্ত কিছু প্রভাইড করতে চাই। তোমার কোনো কিছূতে যেন কমতি না থাকে সেই ব্যবস্থা করে তবেই আমি একেবারে তোমাকে নিজের করে নিব। ততদিন আমার হাতটা ধরে আমার পাশে থাকবে না?”

-“থাকবো। তুমি রাখলেই থাকবো!”

মিত্তিমের কথার ভাঁজে প্রচণ্ড অভিমানের উপস্থিতি দিব্যি টের পেল শৈশব। সে আসলেই একটা বাচ্চার প্রেমে পড়েছে, অভিমানী বাচ্চা।

-“মিত্তি!”

-“হু!”

-“আমাকে বিশ্বাস করো তুমি?”

-“নিজের চেয়েও বেশি।”

-“তবে এটুকু জেনে রাখো আমি তোমারই থাকবো, শুধুই তোমার। তোমার অপেক্ষা করবো আমি, তোমাকে কাছে পাওয়ার অপেক্ষা করবো, তোমার কণ্ঠে কবুল শোনার অপেক্ষা করবো।”

-“আমি তো এই অপেক্ষা চাইনি শৈশব! আমি এই অপেক্ষার যন্ত্রণা নিতে চাইনি। আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি, তোমাকে পাশে রেখেই স্বপ্ন পূরণে ছুটতে চেয়েছি। আমি তোমাকে অপেক্ষায় রেখে থাকতে পারবো না শৈশব।”

-“থাপ্পড় লাগাবো এখন! আমার চক্করে পড়াশোনার বারোটা বাজাবা? আমি তো তোমারই পাগল, এখন পড়াশোনায় মন দাও। সঠিক সময়ের জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে কেবল। ভালো সবকিছুই দেরিতেই আসে, বুঝছো জান?”

-“না! আমি কিচ্ছু বুঝিনি। আমি কিছু বুঝতে চাইনা। তোমাকে কিভাবে বোঝাবো আমি যে তোমাকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না! আমি চাইলেও তোমার সাথে হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে পড়ায় মন বসাতে পারবো না। তুমি আমার অভ্যেস শৈশব! যে অভ্যেসটা আমি ছাড়তে চাইনা।”

শৈশব মিত্তিম দু’গালে হাত রেখে কপালে আলতো করে চুমু খেল। মিত্তিম ফের কান্নায় ভেঙে পড়লো। এ ক্ষণিকের বিচ্ছেদটাও যে বড্ড যন্ত্রণার! শৈশবের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না মিত্তিম, তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। শৈশবের চোখেও তো নিশ্চিত সে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করবে। এ যন্ত্রণা তার সহ্য হবে? কোনোভাবে না! মিত্তিমের কান্না থামছে না, চেয়েও থামাতে পারছে না সে।

___________________________

-“আজ হঠাৎ এত চুপচাপ?”

-“ফাইজা, কখনো যদি আমাদের অপেক্ষা করতে হয় সঠিক সময়ের জন্য, আমরা পারবো?”

-“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”

-“এমনি মনে হলো। বাদ দাও, আপু কোথায়?”

-“ভাইয়ার সাথে বেরিয়েছে ভাবী।”

-“ওহ! তুমি কী করছো?”

-“বসে বসে একটা গাধার কথা শুনছি।”

-“ওহ!”

ফায়াযের এমন নিষ্ক্রিয় জবাবে আশাহত হলো ফাইজা। সে তো ভেবেছিল ছেলেটা রীতিমতো ঝগড়া বাঁধাবে অথচ শুধু ওহ বললো? ফায়াযের মন কি মারাত্মক খারাপ? বোধহয়! নাহলে এত নিষ্প্রভ আচরণ তো করার কথা নয়।

-“তোমার কি মন খারাপ ফায়ায?”

-“জানিনা। তুমি আমায় ভালোবাসো ফাইজা?”

ফাইজা বরাবরের মতো উত্তর দিল না। সে ফায়াযকে ভালোবাসে কিন্তু বলতে চায় না। তার বদ্ধমূল ধারণা পুরুষ মানুষ ভালোবাসি শোনার আগ অবধিই এফোর্ট দেয়, ঐ শব্দটুকু উচ্চারণের পর পুরুষের আবেগ কমে যায় কয়েকগুণ হোক সেটা হাজারগুণ সত্যিকারে ভালোবাসা।

-“ফাইজা, পরে কথা বলি আমরা?”

-“আচ্ছা।”

ফায়াযের কণ্ঠের শীতল অভিমান ঠিকই টের পেল সে। ফাইজার কি বলে দেওয়া উচিত সেও ফায়াযকে মারাত্মক ভালোবাসে?

-“ফায়ায শোনো…”

-“বলো!”

-“ভালোবাসি।”

ফায়াযের বোধহয় হৃদয় থেমে গেল। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারলো না।

-“কী বললে? আবার বলো!”

ফাইজা এবার খানিকটা উৎসাহেই বলে বসলো,

-“ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি…”

তৎক্ষণাৎ তার মা হোসনে আরা দরজা ধাক্কালেন। ভয়ে ফোন হাত থেকে পড়ে গেল ফাইজার। হোসনে আরা ওপাশ থেকে চেঁচাচ্ছেন।

-“কী রে তুই কাকে ভালোবাসি বলিস? দরজা খোল তো! দিনদাহারে দরজা লাগাইছোস ক্যান তুই?”

ফাইজা দ্রুত ফায়াযের কল কেটে নম্বর ডিলিট করে দরজা খুলে দিল। হোসনে আরা সন্দিহান চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

-“কীরে কী করছিলি?”

-“গানের কলি খেলছিলাম।”

-“কার সাথে?”

-“ঐ তো একটা রেডিও স্টেশন থেকে কল আসছিল। বললো আমি নাকি একটা লটারি জিতছি, তার জন্য আমার একটা গান গেয়ে শোনানো লাগবে।”

-“গাধার বাচ্চা বলদ হইছে একটা! বুদ্ধিশুদ্ধি কবে যে হবে! পড়তে বস যা, এইসব ভং ছেড়ে বই ধর।”

ফাইজার মাথায় চাটি মেরে হোসনে আরা বেগম বেরিয়ে গেলেন। ফাইজা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। একটুর জন্য ধরা খায়নি। একবার যদি মা খালি জানতে পারতো, তবে তার আর রক্ষে নেই। পৃথিবীতে হিটলারের পুনর্জন্ম হলে বোধহয় তার মায়ের মধ্য দিয়েই হতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনে ফায়াযের নম্বর ফারিয়া দিয়ে সেভ করলো সে। অতঃপর টেক্সট করে জানান দিল মায়ের উপস্থিতি। ফায়ায খানিকটা হাসলো টেক্সট পড়ে, সেও অবশেষে লুকোচুরি প্রেমে ফারাতে চলেছে। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে তার।

__________________________

-“আমাদের জীবনে সব ঠিক হয়ে যাবে তো শৈশব? নতুন কোনো ঝামেলা আসবে না তো?”

-“না মিত্তি, আমি আর কোনো ঝামেলা আমাদের জীবনে আসতে দিব না। বুঝেছো তুমি? তুমি এত চিন্তা কোরো না রে, সব ঠিক করে দিব আমি। আমি আছি তো! বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”

-“আমি তোমাকে কী পরিমাণ বিশ্বাস করি তা তুমি আন্দাজও করতে পারবে না শৈশব। তোমাকে আমি যথেষ্টের অতিরিক্ত বিশ্বাস করি।”

শৈশব মুচকি হাসলো। পকেটে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে তার। এ মুহূর্তে প্রচণ্ড বিরক্তবোধ হচ্ছে ফোনের ভাইব্রেশনে তবুও সে কলটা রিসিভ করলো। অপরপাশ থেকে কান্নারত একটা কণ্ঠ এসে ভেসে এলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কেবল লোকটা বললো,”আমার মেয়েটা বিষ খেয়েছে। বাবা তুমি দয়া করে একটু আসো।” শৈশব স্পষ্ট শুনতে পারছে না কিছু তবে কণ্ঠটা ঠিক চিনতে পারলো। মুহূর্তেই তার মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে আসলো। মেয়েটা এমন পাগলামি করতে পারে শৈশব ভুলেও ভাবেনি। এতটা পাগলামি! মানুষ হারানোর পর হাজার চেষ্টা করলেও কি হারানো মানুষ ফিরে পায়? পায় না!

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১৬

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১৬তম_পর্ব
~মিহি

বাড়ির পরিবেশ যথেষ্ট নীরব। একপাশে তিথি এবং তার বাবা-মা বসে, অন্যদিকে মিত্তিমের মা এবং মিত্তিম। আহসিনা বেগম বুঝে উঠতে পারছেন না হচ্ছে টা কী। শৈশবও আসার পর থেকে কিছুই বলছে না। কেবল ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলো। মিত্তিমের মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ালো সে।

-“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আপনার মেয়ে এবং আমি পরস্পরকে ভালোবাসি কিন্তু এ মুহূর্তে আমার উপর যে অপবাদ আনিত হয়েছে তা আপনার সামনেই ক্লিয়ার হোক এটা আমি চাই। সেজন্য আপনাকে এভাবে আসতে বলেছি। আমি ভুল করে থাকলে দুঃখিত কিন্তু আপনার এখানে উপস্থিত থাকাটা আমার সঠিক মনে হয়েছে।”

আহসিনা বেগম চমকালেন। মিত্তিম আর শৈশব? তিনি তো ভেবেছিলেন মিত্তিম এবং ফায়াযের মধ্যে কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে! অবশেষে তার বড় ছেলে কিনা এই লক্ষী চঞ্চলাবতীর প্রেমে মাতোয়ারা হলো? মনে মনে হাসতে চাইলেও পারছেন না তিনি, পরিস্থিতি এখনো হাসির অনুকূল নয়। তিথির বাবা-মা মাথা নিচু করে বসে আছে। মেয়ের কাণ্ডে রীতিমতো অপমানিত বোধ করছেন তারা। তাদের মেয়ে কিভাবে তাদের মান-সম্মান নিয়ে এভাবে খেললো বুঝে উঠতে পারছেন না তারা অথচ ছেলেটাও বলছে সে অন্য মেয়েকে ভালোবাসে। এক মুহূর্তের জন্য মেয়ের চিন্তায় চোখে ভিজে উঠে তিথির বাবার। শৈশব খেয়াল করে সেটা। মিত্তিমের মায়ের সাথে কথা শেষ করে সে তিথির বাবা-মায়ের মুখোমুখি হয়, তিথির দিকে তাকায় না অবধি। ওর মুখের দিকে তাকানোর রুচিটুকুও অবশিষ্ট নেই শৈশবের।

-“আঙ্কেল আন্টি, আপনার মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ হয়েছে। আপনার মেয়ে নিজেই শেষ করেছে। হঠাৎ দুই বছর পর তার কী মনে হলো যে আমার বাচ্চা তার গর্ভে এমন কথা নিয়ে হাজির হলো? যেখানে সম্পর্কই নেই আমাদের, সেখানে আমার বাচ্চা কিভাবে আসবে?”

তিথি এবার চেঁচিয়ে উঠলো। সবার সামনে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। শৈশবের দিকে আঙুল তুললো আরো দৃঢ়ভাবে।

-“তুমি সবকিছু এভাবে অস্বীকার করতে পারছো শৈশব? এত সহজে? আফরা আপুর বিয়েতেই আমাদের আবার দেখা হয়, কথা হয়। এমনকি আমি তোমার ঘরে..”

তিথি কাঁদতে শুরু করে আবার। শৈশব কিছু বলছেই না। তিথির নাটক কতক্ষণ চলে তা জানার অপেক্ষায় আছে সে বোধহয়।

-“দেখো তিথি, তুমি আমার ঘরে আসার পর আমি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যাই। তোমার মতো চরিত্র আমার না যে মাঝরাতে তুমি ঘরে ঢুকলেই আমি তোমার সাথে কিছু করে বসবো! তুমি কেন এই নাটক করছো? আমি তো মরে গেলেও তোমাকে বিয়ে করবো না।”

-“তুমি বিয়ে না করলে আমি আমার গর্ভের বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবো শৈশব?”

-“কী আজব! ওয়েট, তুমি তো প্রেগন্যান্ট? ঠিক আছে চলো হাসপাতালে। তোমার আবার প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাও আমার সামনে। আমার তোমার উপর তিল পরিমাণ বিশ্বাস নাই।”

তিথি ঢোক গিললো। হাসপাতালে গেলেই তো সে ধরা পড়ে যাবে। তিথি শেষ চাল চাললো।

-“আমার প্রচণ্ড দুর্বল লাগছে শৈশব। তোমার এত সন্দেহ থাকলে প্রেগন্যান্সি কীট নিয়ে আসো, আমি আবার টেস্ট করে দেখাচ্ছি।”

শৈশব রাজি হলো না। সে হাসপাতালেই নিয়ে যাবে তিথিকে। তিথির ব্যাগে একটা প্রেগন্যান্সি কীট আগে থেকেই আছে কিন্তু হাসপাতালে গেলে তো সব সত্য ফাঁস হবেই। তিথি বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। শৈশব তিথির উত্তরের অপেক্ষা করলো না। মেডিকেল রিপোর্টগুলোর ছবি তুললো ফোনে। তিথি আটকাতে ধরলো।

-“শৈশব কী করতে চাচ্ছো তুমি? আমার রিপোর্টের ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করতে চাও আমাকে? অবশ্য এছাড়া আর কীই বা করবে! কাপুরুষ তুমি! একটা মেয়েকে ব্যবহার করে এভাবে ফেলে দিচ্ছো। তোমার বাচ্চাটার কথা অন্তত ভাবো শৈশব।”

শৈশবের ফোন হাতে নিয়ে অন্যদিকে এসে বসলো। তিথির গলা বসে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। সে মিত্তিমের মায়ের সামনে বসলো।

-“আন্টি! বিশ্বাস করুন আমি আর শৈশব একে অপরকে অনেক ভালোবাসতাম, এখন যা হচ্ছে সবটাই একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য। আমি মিত্তিমকেই সবার আগে সবকিছু জানিয়েছিলাম। ও বিশ্বাস করেনি। আপনি অন্তত বিশ্বাস করুন।”

-“তুমি যদি সত্যিই প্রেগন্যান্ট হয়ে থাকো তবে তোমার হাসপাতালে যেতে সমস্যা কী মা? আবার চেক করাও! তাহলেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যায়।”

তিথি বুঝলো হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সবটা। অজ্ঞান হওয়ার নাটক করলো সে। ভাবলো বোধহয় একটু শান্তি পাওয়া যাবে। তা হলো না, শৈশব তার এক পরিচিত ডাক্তারকে কল করে আসতে বললো। ভয়ে হাত পা কাঁপছে তার। ডাক্তারের নাম শুনতেও ভয় লাগছে এখন। কপালে যে কোন শনি নাচছে তার সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না।

__________________________

ডাক্তার প্রায় মিনিট দশেক তিথিকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করে ঘরের বাইরে আসলো। সবাই অপেক্ষা করছে বাইরে। তিনি এসে বসলেন মাঝখানে।

-“শৈশবের ধারণাই সঠিক। আমিও তো তাই দেখলাম আর অজ্ঞান হওয়ার ব্যাপারটা সম্ভবত স্ট্রেস থেকে। শরীর তো সুস্থই।”

-“আপনাকে ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব।”

ডাক্তার চলে যেতেই শৈশব তিথির বাবা-মাকে অনুরোধ করলো তাকে নিয়ে যেতে। তিথি তা জানতে পেরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো। এতদূর এসে এভাবে খালি হাতে সে কোনোক্রমেই যাবে না। শৈশবের কলার ধরে অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করলো সে।

-“তুমি এটা করতে পারো না শৈশব! প্লিজ!”

-“থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিব। ন্যূনতম লজ্জা নাই তোমার? তোমার রিপোর্ট আমি আমার পরিচিত গাইনোকলজিস্টকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছে এই রিপোর্ট ফেক। তারপরও তুমি নাটক করেই যাচ্ছো! বের হও বাড়ি থেকে এখনি। তোমার মুখও আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে।”

তিথির বাবা-মা আর অপমান সহ্য করতে পারলেন না। মেয়েকে তৎক্ষণাৎ টেনে বাইরে নিয়ে গেলেন তিনি। শৈশবের মাথা ধরেছে। কোনোরকম সোফায় বসে কপালে হাত দিল সে। মিত্তিম বুঝতে পারছে শৈশবের প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে কিন্তু তার এ মুহূর্তে কিছু করার নেই। মায়ের সামনে সে মোটেও শৈশবের কাছে যেতে পারবে না। সে সাহস এখনো তার হয়নি। একটু পর শৈশব নিজেই উঠে মিত্তিমের মায়ের সামনে বসলো।

-“আন্টি দুঃখিত! আপনার এসব নাটক দেখতে হলো! আমি আপনার মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবাসি এবং একমাত্র আপনার মেয়েকেই ভালোবাসি। আপনার অনুমতি থাকলে আমি তাকে আমার করে রাখতে চাই চিরতরে।”

-“তুমি কি এখনি বিয়ে করতে চাইছো?”

-“না আন্টি। মিত্তিমের এডমিশন শেষ হোক। এরপর ও যেখানেই থাকুক না কেন, আমি বিয়ে করে নিব। ততদিনে আমারও একটা স্ট্যাবল ক্যারিয়ার তৈরি হোক। তবে আপনি চাইলে এখনি আমাদের বিয়ে করিয়ে রাখতে পারেন।”

-“আমি যদি বলি তোমার এই মুহূর্তে আমার মেয়েকে বিয়ে করে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে হবে, তোমার আপত্তি আছে?”

-“নেই। আমি সামলে নিব। বিয়ে হয়ে গেলে সে আমার স্ত্রী আর স্ত্রীর ভরণপোষণ সহ যাবতীয় দায়িত্ব আমি কাঁধে তুলে নিতে দ্বিধা করবো না।”

-“দেখো শৈশব, তোমাদের এ প্রেম যে হঠাৎ তা আমিও বুঝেছি। আমি চাচ্ছি তোমার কথাই রাখতে। মিত্তিমের এডমিশন অবধি অপেক্ষা করো তোমরা। আমি তোমার মায়ের সামনেই এসব বলছি যেন কোনো সমস্যা না ঘটে।”

শৈশব মিত্তিমের মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখ বর্ষার গন কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো দেখাচ্ছে কেন? মেয়েটার মন খারাপ? কেন? মিত্তিমের কি এ সিদ্ধান্তে আপত্তি আছে? শৈশবের মাথায় প্রশ্নরা ঘুরপাক খাচ্ছে একাধারে।

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১৫

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১৫তম_পর্ব
~মিহি

শৈশব প্রচণ্ড বিরক্ত। তার মা আহসিনা বেগম হঠাৎ জরুরি তলব করেছেন এখনি বাড়িতে ফিরতে হবে। শৈশব বুঝে উঠতে পারছে না কিছু। সে এখানে এসেছে মাত্র ক’টা দিন হয়েছে। এত তাড়াহুড়োর মধ্যে তাকে কখনো বাড়ি থেকে ডাকেনি। বড়সড় কোনো বিপদ হলো না তো? আহসিনা বেগম কিছু বললেন না, কেবল জানালেন দ্রুত বাড়িতে আসার কথা। মায়ের এ হেন আচরণে শৈশব খানিকটা বিরক্তই হলো। আচমকা এমন করে বললে আসা যায়? তৎক্ষণাৎ টিকিট কেটেও রাত দশটার টিকিট পাওয়া গেল কোনোক্রমে। রাতে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা প্রায় শূণ্যের কোঠায় তার। রাতে ঠিকঠাক ঘুম না হলে সে মাথাব্যথায় চোখ তুলতে পারে না আর বাসে ঘুমোনোর মতো বিশ্রি অভিজ্ঞতাও তার নেই। আচ্ছা, অভিজ্ঞতাটাকে বিশ্রি বলা কি ঠিক হলো? সে তো কখনো এ অভিজ্ঞতার কবলে পড়েইনি। বিরক্তিতে চ’কারান্ত শব্দ করে ছোটখাটো একটা ব্যাগ গোছালো সে। তিনজোড়া কাপড় আর দরকারি কাগজপত্র নিল সাথে। সব গুছিয়ে বিছানায় রেখে মিত্তিমের নম্বরে কল করলো সে। মিত্তিমের নম্বর বন্ধ বলছে। শৈশব বুঝে উঠতে পারছে না এ সময় ওর নম্বর বন্ধ কেন?

_________________________

-“আসমা তুই বেশি করে ফেলেছিস! তুই তোর দেবরকে বাড়িতে আনার আগে আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজনবোধ করলি না? এত সাহস পেলি কোথায় তুই?”

-“আপা, ও তো হুট করে আসতে চেয়েছে। তাছাড়া অল্প সময়ের জন্যই এসেছিল। তা নিয়ে এমন করার কী আছে? তুমি যে তাড়াহুড়ো করে এলে, তাতে মনে হচ্ছে তোমার মেয়েকে আমরা খেয়ে ফেলেছি! তোমার মেয়ে তো দরজা লাগিয়ে বসে আছে। আমার দেবর বেচারা লজ্জাবোধ থেকেই চলে গেল এখন।”

-“তাও ভালো ওর এটলিস্ট লজ্জা আছে!”

-“তুমি বলতে কী চাইছো? মেয়েকে নিয়ে এত নাচানাচি করার কী আছে? তোমার মেয়ের রেজাল্ট আমি জানিনা? যে মেয়ে এস.এস.সিতে গোল্ডেন পায় নাই, এবার পাইলো অটোপাশ, সে কি পড়ে ঈশ্বরচন্দ্র হবে?”

-“আসমা তুই বেশি বলতেছিস এখন।”

-“আপা দেখো, আমি ওর ভালো চাই। দুইদিন পর যারে তারে ধরে এনে বলবে বিয়ে করবো, তখন?”

-“ও যদি এমন বলে, আমি নিজে দাঁড়িয়ে ওদের বিয়ে দিব। তোর সমস্যা? আমার মেয়ে যার কাছে নিজের ভালো থাকা খুঁজে পাবে, আমি বিয়ে দিব তার সাথে। তোর সমস্যা?”

-“তাই বলে যার তার সাথে?”

-“তোর দেবর আমার মেয়ের চেয়ে কমপক্ষে এগারো বছরের বড়! এমন ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার চেয়ে আমার মেয়ের ধরে আনা যা তা ছেলেই ভালো।”

আসমা প্রচণ্ড অপমানবোধ করে বাড়ি থেকে বের হলো। সে চলে যেতেই আকলিমা বেগম মিত্তিমের ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন। মিত্তিম সবই শুনেছে এতক্ষণ। মায়ের ডাকে সে দরজা খুলে দিল।আকলিমা বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মায়ের স্পর্শ পেয়ে মিত্তিম চোখের পানি আটকাতে পারলো না। এতক্ষণের জমে থাকা ভয়, মানসিক চাপ সব মিলিয়ে অশ্রু হয়ে ঝরলো তার আদ্র চোখ বেয়ে। আকলিমা বেগম তৎক্ষণাৎ স্থির হলেন এবং দৃঢ় এক সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত হলেন।

-“তোমার পছন্দের কেউ আছে মিত্তিম?”

মিত্তিম চমকালো। মায়ের শীতল কণ্ঠের সম্মুখে এ প্রশ্ন বড্ড বেমানান লাগছে তার। মিত্তিম মিথ্যে বলার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না, কোনোভাবেই না।

-“আমার উত্তর চাই মিত্তিম! সত্যি জানতে চাই আমি।”

-“আছে।”

-“ছেলেটা কে?”

-“ফারহায ইফতেখার শৈশব।”

-“ফায়াযের বড় ভাই?”

-“হ্যাঁ!”

-“তুমি কি নিশ্চিত ছেলেটা তোমাকে বিয়ে করবেই?”

-“হ্যাঁ।”

-“আমি যদি এখনি বিয়ে করতে বলি?”

মিত্তিম ঘাবড়ালো। তার মা কি সত্যিই এসব বলছে নাকি সবটা কল্পনা বুঝে উঠতে পারছে না সে।

-“বলো মিত্তিম।”

-“করবে।”

-“বেশ, চলো আমি ওর মায়ের সাথে দেখা করতে চাই।”

মিত্তিম কিছু বললো না। আকলিমা বেগম মিত্তিমের বাবাকে কল করে স্রেফ এটুকু বললেন,”তোমার মেয়ের জীবনের অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি।” তার বাবা খুব নরম স্বরে প্রত্যুত্তর করলেন,”তোমার নেওয়া সব সিদ্ধান্তে আমার সম্মতি আছে।” মিত্তিম শুনলো চুপচাপ। বিবাহ বন্ধন বোধহয় এর চেয়ে সুন্দর হতে পারে না। মিত্তিমের ঠোঁটে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো, আশেপাশে ফোনটা খুঁজতে লাগলো সে। ফোন খুঁজে পেল ঘরে, অফ হয়ে আছে। দ্রুত ফোন চালু করতেই দেখলো শৈশবের অনেকগুলো টেক্সট আর কল। দ্রুত কল ব্যাক করলো মিত্তিম। অনেক কথা বলার আছে তার। শৈশব তড়িৎ গতিতে রিসিভ করলো।

-“কোথায় ছিলে মিত্তি এতক্ষণ? ফোন অফ! তুমি ঠিক আছো?”

-“হ্যাঁ! তোমাকে কিছু বলার আছে।”

-“আমারো! আমি আগে বলি।”

-“আচ্ছা বলো। আমি আসছি তোমার কাছে।”

-“মানে?”

-“জানিনা! মা আর্জেন্ট কল করে বললো বাসায় ফিরতে। আজ দশটায় বাস। কাল সকালবেলা আবার আমার এই বোরিং মুখটা দেখতে হবে তোমার।”

মিত্তিম কিছুটা অবাক হলো। এত চটজলদি ডাকা? তিথি কি তবে সত্যিই শৈশবের বাড়িতে গেছে? মিত্তিম কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।

-“শৈশব, আমি কিছু বলতে চাই।”

-“হ্যাঁ, এখন বলো কী বলতে চেয়েছিলে।”

-“আসলে তিথি আপু আমার সাথে দেখা করেছে আজ। হুট করেই ক্লাসে যাওয়ার সময় টেনে নিয়ে গেল ক্যাফেতে। আগের রাতে টেক্সট করে বলছিল সে প্রেগন্যান্ট। তোমাকে যেন বিশ্বাস না করি, তুমি অন্য সব ছেলেদের মতো।”

-“তুমি কী বলেছো?”

-“আপনি সব ছেলের কাছে গেছেন কেন?”

শৈশব শব্দ করে হেসে উঠলো। মিত্তিমের কাছ থেকে এমস সোজাসাপ্টা জবাব সে আশা করেনি।

-“তারপর কী হলো?”

-“আজ ক্যাফেতে রিপোর্ট দেখালো। তাও বিশ্বাস করিনি তাই উল্টোপাল্টা বললো। আমি বলেছি পারিবারিকভাবে কথা বলতে। আমার মনে হচ্ছে আন্টি এজন্যই ডেকেছে তোমাকে।”

-“আচ্ছা বুঝেছি।”

-“আসলে…আমি না মাকে আমাদের কথা বলেছি। মা জিজ্ঞাসা করেছে তুমি আমাকে এখনই বিয়ে করতে পারবে কিনা! আমি হ্যাঁ বলেছি। এখন মা আন্টির সাথে কথা বলতে যেতে চাচ্ছে।”

-“এখন তো তিথিও আছে বোধহয়। আজ যেও না। আন্টিকে বলো আমি কাল আসছি। যা কথা বলতে চায়, আমার সামনেই যেন বলে।”

-“আচ্ছা!”

-“আই লাভ ইউ মিত্তি!”

-“আই লাভ ইউ টু…”

মিত্তিম মুচকি হাসলো। খুব অদ্ভুতভাবে সব ঘটছে যেন। সে কি কখনো ভেবেছে তার মা হঠাৎ শৈশবের কথা জানতে চাইবে? আচ্ছা মা কি রাজি হবে? মিত্তিমের ভাগ্যে শৈশবের থাকাটা চিরস্থায়ী হবে তো?

___________________

তিথি এখনো কাঁদছে। আহসিনা বেগম চুপচাপ দেখছেন। ফায়ায মনে মনে কটমট করছে আর বলছে,”নাটক কম করো পিও!” সরাসরি বলার সাহস পাচ্ছে না। শৈশবের বাবা বাড়িতে নেই। তিনি থাকলেও বিশেষ কিছু হতো না। বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড করার কর্তৃত্ব আহসিনা বেগমের হাতে। তিনিই যখন চুপ, তখন বাড়িতে আর কোনো ঝড় ওঠার সম্ভাবনা নেই।

-“তোমার বাবা-মাকে ডাকো।”

তিথির কান্না থেমে গেল আচমকা। বাড়িতে এখনো সে জানায়নি। জানলে কী প্রতিক্রিয়া হবে তাও সে জানে না কিন্তু এতদূর আসার পর এভাবে পিছু ফিরলে তার সবই যাবে।

-“ওনারা এখনো জানেন না। আমাকে মেরেই ফেলবে আন্টি। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।”

-“আজব! এসব আবার কেন বলছো, একবার তো বলেছো। তোমার বাবা-মাকে আসতে বলো। শৈশব কাল আসছে। আমি আগে ওনাদের সাথে কথা বলি। তারপর শৈশবের সামনেই সব কথা হবে। তোমার কোনো আপত্তি আছে?”

-“না আন্টি!”

আহসিনা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। তিথি কাঁপা কাঁপা হাতে মায়ের নম্বর ডায়াল করলো। তার বাড়িতে কী ঝড় যে উঠবে জানে না সে! কল রিং হচ্ছে, তিথি বারংবার ঢোক গিলছে।

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১৪

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১৪তম_পর্ব
~মিহি

-“আপনি সময় নষ্ট করছেন আপু। আপনার যা বলার বলে ফেলেছেন তো। আপনি প্রেগন্যান্ট এইটা আপনার পরিবারে জানান, আপনার প্রেমিকের পরিবারে জানান। অযথা আমাকে কেন বিরক্ত করছেন?”

-“শৈশবের মোহে তুমি অন্ধ হয়ে গেছো মিত্তিম!”

-“প্রথমত আমার কোচিং ক্লাস ছিল, আপনি রাস্তা থেকে টেনে এনেছেন এই ক্যাফেতে। আপনার এখন পরিবারে জানানো উচিত! আমি কে? আমাকে এভাবে এক্সপ্লেইন করার কী আছে?”

-“মিত্তিম, তুমি আমার রিপোর্ট চেক করো। প্লিজ আমার সাহায্য দরকার।”

-“আপু, আপনি আপনাদের পরিবারে জানান। সমস্যা কোথায়? যার বাচ্চার মা হচ্ছেন তার পরিবারে জানালেই তো সমাধান হয়!”

-“বেশ! তুমি মেনে নিতে পারবে তো?”

-“হাসালেন আপু। শৈশবকে আমি চিনি, বিশ্বাস করি। মানুষ দেখলেই চেনা যায় আপু কার পক্ষে কী সম্ভব! শৈশব যদি সত্যিই আপনার এ অবস্থা করে থাকে, তবে ও কখনোই অস্বীকার করতো না আপনাকে। আপনাদের ব্রেকাপ তো অনেক আগেই হয়েছে। তবে এখন হঠাৎ এই সুখবর কোত্থেকে?”

-“আফরা আপুর বিয়ের সময় এক রাতে আমি শৈশবের ঘরে গিয়েছিলাম।”

-“আর তাতেই শৈশব গলে গেল? ভালোই! আপনার এক্টিং তো প্রধানমন্ত্রী আপার লেভেলের। পরেরবার স্ক্রিপ্ট ভালো আনিয়েন।”

মিত্তিম হাসতে হাসতে উঠে বের হতে নিল। তিথি পেছন থেকে কেবল বললো,”একটা মেয়েই যে একটা মেয়ের সবচেয়ে বড় শত্রু হয় তা বোধহয় তোমার মতো মেয়েকে না দেখলে কখনো জানতেই পারতাম না!” মিত্তিমের তাতে কিছু যায় আসলো বলে বোধ হলো না। সে খানিকটা হেসেই ক্যাফে থেকে বের হলো। আজ এই ফায়াযটা ক্লাস করতে আসেনি বলেই এই শাকচুন্নি তার সাথে দেখা করার সুযোগটুকুও পেত না। আসমা যে আবার কিছু বলবেন তেমন আশাই করেছিল সে কিন্তু সে কিছু বলছে না। শৈশবকে তিথির ব্যাপারটা জানানো দরকার কিন্তু আসমা থাকতে তা কোনোভাবে সম্ভব না। মিত্তিম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ শৈশবের ভার্সিটি নেই তবুও মিত্তিম চাইলেই শৈশবের সাথে কথা বলতে পারবে না। আসমার বাজের দৃষ্টি যে প্রতিক্ষণ তার উপরে থাকবে এও নিশ্চিত। আজ অনি না আসায় বাড়ি যথেষ্ট শান্ত।

ক্লাসে আর যাওয়া হলো না মিত্তিমের। চুপচাপ বাড়িতে ফিরে এসেই নিজের খালার সম্মুখীন হলো। কোনো কথা না বলে চুপচাপ ঘরে ঢুকলো সে। আসমা রান্না করছে দেখে খানিকটা অবাক লাগলো মিত্তিমের।

-“মা তো রান্না করে রেখে গেছে। আপনার কিছু লাগলে আমাকে বললেই হতো।”

-“কেন? আমি কি আগে রান্না করিনি? একজন মেহমান আসবে আর কী!”

-“মেহমান? কই মা তো আমাকে জানায়নি কিছু।”

-“আপা জানেনা। আমিও জানতাম না, আমার নিকটাত্মীয়। হঠাৎ কী যেন দরকার পড়েছে এদিকে তাই আসছে।”

-“ওহ আচ্ছা। তবুও মাকে জানাতে পারতেন। আমি জানিয়ে দিচ্ছি।”

-“আমি জানাচ্ছি, তুই অত চিন্তা করিস না। যা গোসল সেরে নে।”

আসমার কথাবার্তা কেমন একটা মনে হচ্ছে মিত্তিমের কিন্তু কিছু না বলে গোসলে ঢুকলো সে। মাথাটা ধরেছে। এই তিথির বকবকানি! ওকে আপু ডাকাই ভুল হয়েছে, ডাইনী একটা! মিত্তিম গোসল সেরে বের হয়ে চুল মুছে নিল ভালোমতো। ডাইনিং থেকে হাসাহাসির শব্দ আসছে। পুরুষ কণ্ঠের শব্দ পেয়ে মিত্তিম খানিক চমকালো। মেহমান আসবে বলেছিল খালামণি কিন্তু পুরুষ কিনা মহিলা তা অবশ্য বলেনি। ওড়না গায়ে জড়িয়ে ঘরের দরজা খুলতেই চমকালো সে। সোফায় বসে থাকা লোকটাকে মিত্তিম চেনে। আসমার দেবর, শাহেদ। এই লোকটাকে তার খালা এখানে ডেকেছে? মিত্তিমের আচমকা প্রচণ্ড ভয় হলো। হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে তার। এজন্যই কি তবে তার খালা আগে থেকে কিছু জানায়নি?

-“আয়, এদিকে আয়! ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস ওভাবে? দেখ কে এসেছে!”

মিত্তিম কী করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। এক পাও এগোতে ইচ্ছে করছে না তার। সে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। আসমা নিজে এসে মিত্তিমের বাহু ধরলো যেন ছেলে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। মিত্তিমের প্রচণ্ড রাগ হলো। হাত সরিয়ে নিলো সে। আসমা শাহেদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মিত্তিমকে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকলো।

-“সমস্যা কী তোর? এমন ভাব করছিস মনে হয় তোর বিয়ে দিচ্ছি আমি!”

-“তুমি মাকে না জানিয়ে ঐ লোকটাকে কেন এনেছো?”

-“ঐ লোকটা মানে? আমার আত্মীয় আসতে পারে না আমার বোনের বাড়িতে?”

-“অবশ্যই আসতে পারে কিন্তু কাউকে না জানিয়ে হুট করে কেন? তার মধ্যে ন্যূনতম জ্ঞানবোধ নেই? তোমাকে আমি কম চিনি না খালামণি! যা ইচ্ছে করো, আমি এ ঘর থেকে বের হবো না।”

আসমা কিছু বলতে যাবে তার আগেই শাহেদ ডাকলো। মিত্তিম এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আসমা বের হতেই ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিল সে। ফোন বের করে তৎক্ষণাৎ মায়ের নম্বর ডায়াল করলো সে। আকলিমা বেগম ক্লাসে ছিলেন। কল ধরতে পারলেন না তিনি। মিনিট দশেক পর মিত্তিমের বেশ কয়েকটা মিসড কল দেখে কল ব্যাক করলেন তিনি। মিত্তিম ভয়ে কাঁপছে তখনো। কেন যেন ঐ লোকটার দৃষ্টি বড্ড ভয়ানক লাগে তার। অদ্ভুত একটা নজরে তাকায়। মিত্তিম বোঝে এ দৃষ্টি মোটেও সুবিধের নয়। আকলিমা বেগম কল করতেই সাথে সাথে রিসিভ করলো সে। গলা কাঁপছে তার।

-“মা…”

-“কী হয়েছে মা? তোর কণ্ঠ এমন লাগছে কেন? শরীর খারাপ তোর?”

-“মা..খা..খালামণি এ..এসেছে।”

-“হ্যাঁ তুই তো জানতি কিন্তু কী হয়েছে?”

-“উনি ওনার দেবরকে এনেছে মা। আমার ঐ লোকটাকে ভালো লাগে না মা। আমি ওনার সামনে যেতে চাই না। ত..তুমি এসো মা..তুমি প্লিজ এসো..”

-“আচ্ছা আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না, আমি আসছি এখনি।”

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই মিত্তিম আরো ভয় পেল। আসমা ডাকছে বাইরে থেকে কিন্তু সেসব মিত্তিমের কানেই ঢুকছে না। এ মুহূর্তে কোনোক্রমেই সে ঘর থেকে বের হবে না। বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে সে। নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় শৈশবকে কল করার দুঃসাহসটুকু পাচ্ছে না। শৈশবকে কী করে বোঝাবে সে এইটুকু সময়ে সবটা?

______________________

মিত্তিমের সাথে দেখা করার পর তিথি ভেবেছিল বোধহয় কাজ হবে কিন্তু মেয়েটা বেহায়াপনার সর্বোচ্চ ধাপে থাকে মেয়েটা। আস্ত একটা নির্লজ্জ শাকচুন্নি! তিথির রাগে মাথা গজগজ করছে। শৈশবের পরিবারকে এবার সে জানাবেই। এই মিথ্যে দিয়েই শৈশবকে আবার নিজের করে পাবে সে। তিথি আর কিছু ভাবলো না। এখন যা হবে হোক, শৈশবকে সে নিজের করেই ছাড়বে।

শৈশবের মা তাহমিনা বেগম মাত্র ঘরদোর গুছিয়ে ডাইনিংয়ে বসেছেন। ফায়ায গেছে আফরার বাড়িতে। শৈশবের বাবাও বেরিয়েছেন। কলিংবেলের শব্দে খানিকটা বিরক্তই হলেন তাহমিনা। দরজা খুলে তিথিকে দেখে অবাক হলেন। বিস্মিত মুখেই ভেতরে আসতে বললেন।

-“তুমি? এ সময়? তুমি তো কখনো এভাবে হঠাৎ আসোনি। বসো এসো!”

তিথির চোখমুখ লাল। বাড়ি থেকেই খানিকটা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সে। তাহমিনা বেগম তার চোখমুখের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করছে না কেন?

-“বসো এসো। তোমার কী হয়েছে? এমন অবস্থা কেন চোখমুখের? কোনো বিপদ হয়েছে কি?”

এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তিথি। তাহমিনাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো। অকস্মাৎ এমন কান্নায় নিজেকে সাপোর্ট পিলার হতে দেখে তাহমিনা খানিকটা ভড়কালেন। তিথিকে বসিয়ে পানি খাওয়ালেন তিনি।

-“কী হয়েছে? বলো তো আমাকে ভালো করে।”

-“আ..আমি অনেক বড় একটা ভুল করেছি আন্টি! আ..আমায় প্লিজ মাফ করে দিন..”

-“কী হয়েছে সেটা তো বলো।”

-“আ …আমি আর শৈশব একে অপরকে ভালোবাসতাম আন্টি। আ..আমরা…আমরা আসলে বুঝতে পারিনি কিভাবে সব….”

-“যা বলবে ক্লিয়ারলি বলো। কথা ঘুরিয়ো না।”

-“আ..আমি প্রেগন্যান্ট আন্টি! আমি শৈশবের বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি!”

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১৩

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১৩তম_পর্ব
~মিহি

-“মিত্তিম, আমার তোমাকে কিছু বলার আছে। বিশ্বাস খুব দুর্লভ বস্তু! আর অপাত্রে তা দান করলে জীবন বরবাদ যেমন আমি করেছিলাম। শৈশবকে খুব ভালো মনে হচ্ছে না এখন? আমারো হতো! তার এই ভালোমানুষির ছল কখনো বুঝিনি আমি। যা চেয়েছে সবটাই দিয়েছে তাকে। সব বলতে কী বুঝিয়েছি তা আশা করে তোমাকে এক্সপ্লেইন করতে হবে না। আমি ভাবিনি দুনিয়ার সব ছেলের মতো শৈশবও এসবের উদ্দেশ্যেই আমার সাথে জড়িয়েছিল। যাই হোক, আমি প্রেগন্যান্ট মিত্তিম! শৈশবকে এখনো জানাইনি কারণ ও আমার কল ধরবে না কখনো। তোমাকে জানাচ্ছি যেন আমার মতো ভুল তুমি না করো। পৃথিবীর সব ছেলের মতো শৈশবও একটা ভালোমানুষির মুখোশ পড়ে আছে মিত্তিম! উদ্দেশ্য হাসিল হলেই তোমাকে রাস্তায় ফেলে দিবে।”

-“পৃথিবীর সব ছেলেকে টেস্ট করতে গেছিলেন কেন আপু?”

মিত্তিমের টেক্সটে তিথির মাথায় রীতিমতো আগুন ধরে গেল।এ কেমন বেহায়া মেয়ে? সম্পর্কের কয়দিন হইছে যে এত বিশ্বাস উথলে উঠতেছে? তিথি ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়লো। মাথা ঠাণ্ডা করতে হবে। মিত্তিমকে এভাবে টেক্সট করে হবে না। ওর সাথে সামনাসামনি দেখা করে ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে হবে একটু, তাতেই কাজ হবে। লং ডিসট্যান্সে অত বিশ্বাস আর কয়দিনই বা থাকে? প্রথম প্রথম তো তাই খুব উড়তেছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে। তিথির মাথা রাগে দপদপ করছে, পরক্ষণেই শৈশবের কথা খুব মনে পড়ছে তার। সে এই ছেলেকে ছেড়েছিল এটা ভেবে যে শৈশব আর কখনো অন্য কাউকে চাইবে না নিজের জীবনে। শৈশব এত সহজে তার জায়গা অন্য কাউকে কী করে দিতে পারে? এই ছিল তার ভালোবাসা? তিথির মাথা ঝিমঝিম করছে। তার আর শৈশবের মুহূর্তগুলো মানসপটে ভেসে উঠছে। প্রথম যেদিন মুখ ফুটে সে শৈশবকে বলেছিল ভালোবাসার কথা! আচ্ছা শৈশব তো বলেছিল তিথির জায়গা সে কখনো কাউকে দিতে পারবেনা তবে এখন ঐ মেয়েকে এত সহজে সে জায়গা কী করে দিয়ে দিল?

_______________

-“সারাদিন কী কী করলেন?”

-“ভার্সিটি, ল্যাব, অ্যাসাইনমেন্ট! জানো মিত্তি, আজ মেডিসিন নেওয়ার জন্য ফার্মেসিতে ঢুকছিলাম। একটা কাপল আর ছেলেটার কোলে পাঁচ-ছয় মাসের একটা বাচ্চা। এত কিউট লাগলো দেখে! নিজেদেরকে ইম্যাজিন করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আমি বাসায় জানাবো তোমার এডমিশন পরীক্ষা শেষ হলেই।”

-“এত তাড়াতাড়ি?”

-“হুহ! যদি বিদেশে যেতে হয় মাস্টার্সের জন্য, তাহলে আমি আপনাকে ওয়াইফি বানায়ে রেখে যেতে চাই। বুঝেছেন?”

-“জ্বী বুঝেছি। আপনি এখন রেস্ট করেন।”

-“আর তুমি পড়াশোনা করো।”

-“যথা আজ্ঞা!”

মিত্তিম ফোন রেখে একবার ভাবলো তিথির কথা কি শৈশবকে জানাবে? ছেলেটা যদি অযথা দুশ্চিন্তা করে? এমনিতেই ভার্সিটি নিয়ে যথেষ্ট প্যারা খাচ্ছে, এর মধ্যে এসব উটকো ঝামেলা ওর কানে তোলা কি উচিত হবে? তিথির কথার উপর সিকিভাগ বিশ্বাসও মিত্তিমের নেই। ঐ মেয়েটাকে প্রথমবার দেখার পর থেকেই মিত্তিম বুঝেছে এ মেয়ের পক্ষে সব সম্ভব। মাঝরাতে অযাচিতভাবে শৈশবের ঘরে ঢুকে পড়ার ষড়যন্ত্র যে করতে পারে, তার এসব কথায় শৈশবকে ন্যূনতম অবিশ্বাস মিত্তিম করবে না। মিত্তিম ফোন রাখেনি এখনো হাত থেকে। শৈশব হুট করেই বলে উঠবে, মিত্তি আমার কাছে থাকো আরেকটু! মিত্তিমের খুব ভালো লাগে এই বাক্যটা। শৈশবকে ইদানিং প্রতিমুহূর্তে মনে করে সে। শৈশবের ব্যস্ততাকে নিজের সতীন মনে হয়। এত কেন ব্যস্ত থাকবে ছেলেটা? অর্ধাঙ্গিনীর মতো অধিকার ফলাতে ইচ্ছে হয়। ইশস! মিত্তিম কি বড্ড বাচ্চামি করে ফেলছে? অবশ্য বাচ্চাবেলারই তো প্রেমিক। তার সাথে বাচ্চামি করা মিত্তিমের ভালোবাসাগত অধিকার। শৈশব টেক্সট করলো ঠিক পাঁচ মিনিট পর।

-“আই লাভ ইউ আ লট মিত্তি!”

-“আই লাভ ইউ টু মি.ইংলিশ মিডিয়াম মুরগী!”

-“এই তুমি আমাকে মুরগী বললে?”

-“বললাম।”

-“জেন্ডার চেঞ্জ করে ফেলছো। ছিঃ!”

-“আচ্ছা শুনুন।”

-“জ্বী আমার প্রাণপ্রেয়সী, বলুন।”

শৈশবের কথায় খানিক লজ্জা পেল। ছেলেটা মাঝেসাঝে এমন শব্দ আওড়ায় যে মিত্তিমের প্রচণ্ড লজ্জাবোধ হয়। শৈশবকে সে এত দ্রুত এত অধিক ভালোবেসে ফেললো কী করে? অকস্মাৎ ভালোবাসার অনুভূতি নাকি অনিশ্চিত হয়! মিত্তিমের বেলায় তো হচ্ছে না, শৈশবের প্রতি তার অনুভূতি প্রতিমুহূর্তে বেড়েই চলেছে। ভালোবাসা, স্নেহ, শৈশবকে একটু যত্ন করবার আকাঙ্ক্ষা তাকে প্রতিমুহূর্ত অতৃপ্ত রেখেছে। শৈশবের সাথে এ রাস্তার দুরত্ব তাকে হুটহাট বড্ড পীড়িত করে।

-“শৈশব, আমার আপনাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগছে না।”

-“মিত্তি! ধৈর্য ধরো সোনাপাখি। তোমাকে ধৈর্য রাখতে হবে, পড়াশোনায় মন দিতে হবে। আমি এবার বাড়িতে ফিরলে আব্বু আম্মুকে জানাবো।”

-“ওনারা রাজি না হলে?”

-“তুমি পাগল মিত্তি? ওনারা ছোট থেকে তোমাকে চেনেন, স্নেহ করেন। তোমাকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন। তবে কেন আপত্তি থাকবে তাদের?”

-“জানিনা শৈশব। ভয় লাগে আমার।”

-“শোনো, ফারহায ইফতেখার শৈশব তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ! বুঝেছো আফিয়া রুশতাহানা মিত্তিম?”

-“বুঝেছি।”

-“বেশ! এখন পড়ো। পড়া শেষ করে আমাকে নক দিবা।”

মিত্তিম সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখলো। তার মোটেও এখন পড়তে বসতে ইচ্ছে করছে না। তিথির কারণে খানিকটা মেজাজ খারাপ হয়েছে বৈকি তার উপর কাল আবার তার অতি সোহাগের খালা আসছেন। ভদ্রমহিলার আসলেই লজ্জা নেই। কথাটা ভেবে মিত্তিম অবশ্য খানিকটা সংকোচবোধ করলো। আপন খালাকে এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু ঠিক কতখানি ক্ষোভ যে মিত্তিমের মনে জন্মেছে তা সে কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না।

_________________

সকাল থেকে মারাত্মক রোদ উঠেছে। সেই রোদে অযথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের নাটক দেখছে ফাইজা। একপাশে আকাশে মেঘ করেছে একটু। তিনি আধ ঘণ্টা যাবত ঠাওর করার চেষ্টা করছেন আটা শুকোতে দেবেন কিনা। ফাইজা বিরক্তমুখে কিছু বলতেও পারছেন না। মহিলার মেজাজ ভালো নেই আজ। ফাইজার বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে। কিছু না বলতেই ছ্যাঁত করে উঠতেছেন একটু পরপর। একটু আগেই আফরাকে ঝেড়েছেন অযথা। ফাইজার দিকেও বাজ পড়বে পড়বে ভাব। আটা শুকোতে দিয়ে ফাইজাকে বললেন চুপ করে এখানেই বসে থাকতে, বৃষ্টি আসলে যেন ডাক দেয়। ফাইজা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না তার মায়ের মাথা ঠিক আছে কিনা! এই রোদে বসে সে অপেক্ষা করবে কখন বৃষ্টি আসে?

-“মা, আমি রোদে বসে থাকবো?”

-“নাহ!”

-“থ্যাংকু মা!”

-“নিচে গিয়ে ডাইনিং রুমটা মুছে দে।”

ফাইজার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তার মা তাকে কাজ করতে দেখলে কী আরামটা যে পান! রাগে গজগজ করতে করতে ফাইজা বালতি ভর্তি পানি নিয়ে ওড়না কোমরে বেঁধে ঘর মোছা শুরু করলো। আচমকা কলিং বেল বেজে ওঠাতে খানিক বিরক্তই হলো সে। তেজী ভাব নিয়ে দরজা খুলেই চমকালো সে। ফায়ায দাঁড়িয়ে। চক্ষু চড়কগাছ হলো ফাইজার। এই ছেলে এমন ফুলবাবু সেজে এসেছে কেন? ইশস! ফাইজা নিজের দিকে তাকালো। মারাত্মক অস্বস্তিতে নিজের ঘরে ছুট লাগানোর প্রস্তুতি নিল সে।

-“এই যে! মিস.ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল, পালাচ্ছেন নাকি?”

-“না…না! পা..পালাবো কেন?”

-“আরেব্বাস! তুমি তোতলাতেও পারো? এই আগে খেয়াল করিনি তো।”

-“থাপ্পড় চেনো?”

-“না তো। চেনাও, তোমার থাপ্পড় খেতে খুব একটা খারাপ লাগবেনা।”

-“কেন এসেছো?”

-“মা আপু আর আপনাদের জন্য পিঠা পাঠিয়েছে।”

-“ভেতরে এসে বসো।”

ফায়ায মাথা নাড়ালো। ফাইজা আগে আগে এগোলো। ফায়ায পিছু পিছু। মেয়েটার এ রূপ মোটেও মন্দ লাগছে না তার। মায়া বোধহয় এটাই? আচ্ছা ফায়াযকেও কি ফাইজা ভালোবাসে? ফায়ায যদি এখন ফাইজাকে তার মনের কথা জিজ্ঞাসা করে? খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে? ফায়ায ধৈর্য রাখতে পারছে না। মনের কথাটুকু অতিসত্বর ফাইজা জানিয়ে দিক তাকে! এইটা জানার উদ্দেশ্যেই সে এসেছে মূলত।

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১২

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১২তম_পর্ব
~মিহি

শৈশব ব্যস্ত থাকবে আন্দাজ করেছিল মিত্তিম কিন্তু ব্যস্ততার মাত্রা তাকে এখন পীড়া দিচ্ছে। সারাদিন ক্লাস, তারপর অ্যাসাইনমেন্ট, ছেলেটার উপর দিয়ে সারাদিন রীতিমতো ঝড় চলে। সেই ঝড় শেষ করে মিত্তিমের সাথে কথা হলে মিত্তিম অনুভব করে শৈশবের ক্লান্ত কণ্ঠের নিষ্ক্রিয়তার মাঝের তীব্র ভালোবাসা। আজ বৃহস্পতিবার। শৈশবের ক্লাস শেষ সাড়ে ছয়টায়। ফিরতে ফিরতে বোধহয় আটটা বাজবে। মিত্তিম অপেক্ষা করে শৈশবের ফেরার। অপেক্ষা? বড্ড যন্ত্রণাদায়ক শব্দ না? কিন্তু মিত্তিমের ভালো লাগে। শৈশবের প্রতীক্ষায় ক্ষণ গুণতে সে প্রশান্তি অনুভব করে। শৈশব যথাসময়ে না ফিরলে মিত্তিমের হৃদস্পন্দন ধীরগতিতে নেমে আসে। সম্ভবত সর্বোচ্চ স্বল্প সময়ে সে শৈশবকে তীব্রভাবে ভালোবেসে ফেলেছে। পরক্ষণেই একটু আধটু ভয় করে তার। ভালোবাসা শব্দটা সুখ অপেক্ষা বিষাদই বেশি তার নিকট। নিলয়ের স্মৃতি খানিকটা পোড়ায় এখনো। প্রথম প্রথম সম্পর্কই কেমন যেন পার্ফেক্ট থাকে। যত সময় গড়ায়, পারফেকশনের মরীচিকায় মোড়ানো কমতিগুলোও প্রকট আকার ধারণ করে। শৈশব কখনো মিত্তিমের প্রতি এমন কোনো আচরণ করেনি যার দরুন মিত্তিমের মনে একটুও ভয় বাসা বাঁধে কিন্তু মিত্তিম চাইলেই সব ভুলে বসতে পারে না। তার প্রতিমুহূর্ত ভয় হয়। মানুষ অবশ্য ভয় পাওয়ারই বস্তু। আর মানুষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য হলো এরা বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়। নিলয়ও তো একসময়ে মিত্তিমের খুব কাছের মানুষ ছিল। মিত্তিমের প্রথম ভালোবাসা! বেপরোয়াভাবে মিত্তিমকে চাইতো ছেলেটা, দিনশেষে সেও বদলেছে, তার অনুভূতিও ফিকে হয়েছে। দ্বিতীয়বার ফের এমন এক সম্পর্কে মিত্তিমের ভয় হওয়া অস্বাভাবিক মোটেও নয় কিন্তু শৈশবের প্রতি মিত্তিমের বিশ্বাস খানিকটা বেশিই। মিত্তিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সাড়ে আটটা বাজে, শৈশব এখনো বাসায় আসেনি? আসলে একবার জানাবে না? মিত্তিম ফোন হাতেই বসে ছিল। আকলিমা বেগম এসে ঝাড়ি দিলেন। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ফোন হাতে বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। মিত্তিমের মন খারাপ হলো। এখন কেন যেন অল্পতেই মন খারাপ হয়ে আসে, চোখ বেয়ে জল গড়ায় সহজেই। মিত্তিম আবার দুর্বল হয়ে পড়ছে? বাড়তি চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে ফোন সাইডে রেখে বই নিয়ে বসে মিত্তিম। যদিও পড়ায় তার বিন্দুমাত্র মন নেই, শৈশবের সাথে কথা না হওয়া অবধি একটুও স্বস্তি পাবে না সে।

শৈশব মেসেজ দিলো সোয়া দশটা নাগাদ। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে বাড়িতে ঢুকেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। না গোসল করেছে আর না কিছু খেয়েছে। উঠেই খেয়াল হলো মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে। মিত্তিম নিশ্চিত অপেক্ষা করছে। তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিয়ে মিত্তিমকে টেক্সট করলো।

-“মিত্তি, আ’ম স্যরি জান! খুব ক্লান্ত ছিলাম, এসে ফ্রেশ হওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছি। মাত্র উঠলাম। রাগ কোরো না জান প্লিজ!”

মিত্তিম তখন ছিল টিভির ঘরে। ইদানিং দশটা নাগাদ মায়ের পাথে কী এক সিরিয়াল দেখতে বসে। নায়িকাটা মানবতার দেবী সাজে আর নায়ক শালা টক্সিক! এই দুটোকে গালি দিতে দিতেই মিত্তিমের সারাদিনের ফ্রাস্ট্রেশন কেটে যায়। সাড়ে দশটায় নাটক দেখে ডিনার করে ফোনের কাছে আসতে আসতে পৌনে এগারোটা বাজলো। মিত্তিমের মন মারাত্মক খারাপ ছিল। শৈশবের টেক্সটে মন গললো মিত্তিমের। বড্ড মায়া লাগলো। সারাদিন ভার্সিটি থেকে এসে এখন আবার নিজে রান্না করে খাওয়া, বাসার সমস্ত কিছু নিজে গোছানো আবার এসাইনমেন্ট- সব মিলিয়ে শৈশবের উপর বড্ড চাপ হয়ে যায়। স্বভাবতই সে চাইলেই মিত্তিমকে সারাটাদিন সময় দিতে পারবে না। যেদিন ভার্সিটি থাকে না সেদিন দিব্যি সারাদিন মিত্তিমের বকবক শোনে সে বিন্দুমাত্রিক অভিযোগ না করেই। শৈশবকে কল করলো মিত্তিম। শৈশব কল ধরতেই কল কেটে দিয়ে টেক্সটের রিপ্লাই করলো।

-“আমাকে অপেক্ষা করিয়েছেন কতগুলো!”

-“ইশস জান! স্যরি সোনাপাখি।”

মিত্তিম মুচকি হাসে। শৈশবকে দেখে বড্ড কাঠখোট্টা মনে হতো অথচ এই লোকটা যখন এত মিষ্টি করে জান, সোনাপাখি এসব বলে তখন মিত্তিমের রাগ আর কোথায়ই বা থাকে!

-“আচ্ছা জান শোনো, আমার একটু কাজ আছে। আমি শেষ করে নিই। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো তাড়াতাড়ি।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি ঘুমাবেন। টা টা!”

-“টা টা!”

শৈশব অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বসলো। এক সপ্তাহ ধরে জমিয়েছে। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। সবকিছু সামলাতে গিয়ে মারাত্মক হিমশিম খাচ্ছে সে। মিত্তিমকে সময়ই দেওয়া হচ্ছে না এসবের চক্করে। একে তো ইতটা দূরে থাকে তার উপর একটু সময় না দিতে পারার অনুতাপ শৈশবকেও পোড়াচ্ছে ভীষণভাবে।

________________

ফাইজা ঘরের দরজা বন্ধ করে বারান্দায় এসে বসলো। ফায়ায কল করেছে। এ বাড়িতে প্রাইভেসি শব্দ নেই বললেই চলে। কে কোত্থেকে কী যে বলে ওঠে! ফাইজা ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলো। ফায়ায সালাম।দিল তাকে। প্রত্যুত্তর করলো ফাইজা, কণ্ঠ কাঁপছে তার।

-“তুমি কি ভয় পাচ্ছো ফাইজা? সমস্যা হলে কল রেখে দিই?”

-“না না…”

-“তো কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে আমার সাথে?”

-“না আসলে…”

-“ইচ্ছে করছে না?”

-“ধূর!”

ফাইজা বিরক্ত হলো। এই ছেলেটা এমন কথা প্যাঁচাচ্ছে কেন? ইচ্ছে করে বিরক্ত করছে ফাইজাকে।

-“আচ্ছা ফাইজা শোনো, রাগ টাগ করো না বুঝলে? তুমি রাগ করলে তোমার নাক টমেটোর মতো লাল হয়ে যায়। ঐ লাল নাকের উপর তোমার গোলাপি ফ্রেমের চশমা কি বিচ্ছিরি লাগবে ভাবো!”

-“তুমি একটা বজ্জাত! বেয়াদব ছেলে কোথাকার, ইতর, অসভ্য, রামছাগল, বলদ, গরু, ভে…”

-“ফাইজা আই লাভ ইউ!”

ফাইজার কথা গলাতেই আটকে গেল। কী বললো ছেলেটা? ডিড হি প্রপোজ? ফাইজার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বাড়তে লাগলো। হাত কাঁপছে তার, ফোনটা কখন যে হাত থেকে পড়ে যাবে আল্লাহ মালুম।

-“কী হলো? উত্তর তো দাও! কিছুই বলবে না?”

ফাইজা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঠোঁটে হাসি ঝুলছে তার। অবশেষে বলদটা প্রপোজ করেছে। এই সময়টার জন্য যথেষ্ট প্রতীক্ষা করেছে ফাইজা। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে আসছে। ফাইজা মাত্রই কিছু বলতে যাবে এর আগেই তার মা চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই ফাইজু, তোর গ্যাস ভালো হইছে নাকি ওষুধ আনতে দিব?” কথাটা এতটাই চেঁচিয়ে বলেছেন তিনি যে ফাইজাও বুঝলো কথা ফোনের অপর প্রান্ত অবধিও পৌঁছেছে। মারাত্মক অপ্রস্তুত মুহূর্তে পড়ে কল কেটে রাগে গজগজ করতে করতে বাইরে আসলো সে। তার মা ফারহানা মাত্র মুখে পান পুরেছেন। ফাইজা এসে কটমট করে তাকালো।

-“মা! এত চেঁচিয়ে বলা লাগে তোমার?”

-“ক্যান? কী রাজকার্য করতেছিলি?”

-“না মানে অনলাইন ক্লাস করতেছিলাম। স্যার পড়া ধরছিল, এর মধ্যে তুমি এইসব বলে চেঁচায়ে উঠছো! সবাই হাসতেছে আমার উপর।”

-“ও! তাইলে তো বাঁচায়ে দিছি। তুই এমনেও পড়া পারতি না, আরো বেশি হাসতো। তার চেয়ে এই অপমান ভালো আছে নে!”

ফাইজা মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। এই মহিলা রোস্টিংয়ে ক্যারিমিনাতিকেও ছাড়ায়ে যাবে। মুখ গোমড়া করে আফরার ঘরের দিকে এগোলো সে।

_______________________

মিত্তিমের ফোনে প্রায় মাঝরাতে কিছু টেক্সট এসেছে। মিত্তিম সেসব দেখেছে ভোরবেলা। প্যারাগ্রাফের সমান একটা টেক্সট,

-“মিত্তিম, আমার তোমাকে কিছু বলার আছে। বিশ্বাস খুব দুর্লভ বস্তু! আর অপাত্রে তা দান করলে জীবন বরবাদ যেমন আমি করেছিলাম। শৈশবকে খুব ভালো মনে হচ্ছে না এখন? আমারো হতো! তার এই ভালোমানুষির ছল কখনো বুঝিনি আমি। যা চেয়েছে সবটাই দিয়েছে তাকে। সব বলতে কী বুঝিয়েছি তা আশা করে তোমাকে এক্সপ্লেইন করতে হবে না। আমি ভাবিনি দুনিয়ার সব ছেলের মতো শৈশবও এসবের উদ্দেশ্যেই আমার সাথে জড়িয়েছিল। যাই হোক, আমি প্রেগন্যান্ট মিত্তিম! শৈশবকে এখনো জানাইনি কারণ ও আমার কল ধরবে না কখনো। তোমাকে জানাচ্ছি যেন আমার মতো ভুল তুমি না করো। পৃথিবীর সব ছেলের মতো শৈশবও একটা ভালোমানুষির মুখোশ পড়ে আছে মিত্তিম! উদ্দেশ্য হাসিল হলেই তোমাকে রাস্তায় ফেলে দিবে।”

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১১

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১১তম_পর্ব
~মিহি

-“তিথি তোর মাথা গেছে? শৈশব খুন করে ফেলবে যদি তুই এমন কিছু করিস!”

-“ও কী করতে পারে সেটাই আমি দেখবো। আমি যা প্ল্যান করছি সেটাতে আমাকে সাহায্য করবি শুধু। বুঝেছিস?”

-“এটা ঠিক না ভাই, আমি রিস্কে পড়ে যাবো। কেউ যদি জানতে পারে…”

-“কেউ জানবে না…তুই শুধু তোর কাজটা কর!”

তিথি হাসলো। কী ভয়ানক ষড়যন্ত্র যে তার মস্তিষ্কে চলছে তা এখনো কেউ আন্দাজটুকুও করতে পারেনি। শৈশব? সে তো মোটেও না! এই ষড়যন্ত্রের মায়াজালে বাঁধা তো তাকেই পড়তে হবে। রাইমার থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে তিথি নিজের বাড়িতে ফিরলো। গোলমালটা শুরু কোত্থেকে করবে তা চিন্তা করতে লাগলো গভীরভাবে। পরক্ষণেই মাথায় আসলো প্ল্যান! শৈশব তাকে বিয়ে কখনোই করবেনা, তাই আঘাতটা শৈশবের দুর্বল জায়গাতেই আনতে হবে।

_____________________

-“ঢাকা ফিরে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়বেন আপনি, তাই না?”

-“একটু তো ব্যস্ত হবোই, জান! ভার্সিটি তিনদিন। আর বাকি চাযদিন পুরোটা সময় আপনার জন্য কিন্তু তুমি মোটেও সারাদিন আমার সাথে কথা বলবা না। পড়াশোনায় মন দাও। এইচএসসিতে অটোপাশ পাইছো, এডমিশনে কোনো অটো নাই। বুঝছো? বুয়েট ইজি না!”

-“ধূর! বুয়েটই লাগবে কে বলছে? যেকোনো একটা ভার্সিটি হলেই হবে আমার।”

-“ঢাকার যেটাতেই পড়ো তুমি, আমার সমস্যা নেই জান কিন্তু তোমার সাথে লং ডিসট্যান্সে থাকার যন্ত্রণা আমার সহ্য হবেনা মিত্তি।”

-“আহারে! নিজে যখন আমাকে না বলে চলে গিয়েছিলেন?”

-“আ’ম স্যরি মিত্তি! ছোট থেকে তোমার কাছে থাকলে আমাদের জীবনটা কত সুন্দর থাকতো। আমাদের জীবনে অন্য কেউ কখনোই আসতো না।”

-“বাদ দিন তো। বাস কয়টায় কাল?”

-“সকালেই।”

-“ওহ তার মানে আজই শেষ দেখা হলো? একটাবার বলেনও নি যে কাল চলে যাবেন!”

-“বললে মন খারাপ করে থাকতা এণ্ড আই কান্ট বিয়ার দ্যাট!”

-“হইছে হইছে! কথায় কথায় ইংলিশ ঝাড়েন কেন? ইংলিশ মিডিয়াম বাঁদর একটা!”

-“এই তুমি আমাকে বাঁদর বললা?”

-“ইশস! ভুল হইছে স্যরি, আপনি তো বাঁদর না সোনা। আপনি মানকি, ইংলিশ মিডিয়াম মানকি একটা!”

মিত্তিম হেসে কুটিকুটি হলো। শৈশব ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সে হাসি শুনে মুগ্ধতার চাদর বুনলো নিজের চারিধারে। শৈশবের নীরবতাই খানিকটা অবাক হলো মিত্তিম।

-“চুপ কেন এত?”

-“তোমাকে শুনতে ভালো লাগছে।”

-“এত ভালো লাগার কারণ?”

-“ভালোবাসি যে! আই লাভ ইউ মিত্তি, আই লাভ ইউ আ লট, মোর দ্যান এনিথিং ইন দিজ ইউনিভার্স!”

-“এণ্ড আই লাভ ইউ ইন এভরি ইউনিভার্স!”

-“ইশসস! তোমার মুখে ইংলিশ শুনতে ভালোই লাগতেছে। আরেকটু বলো তো জান।”

-“বাটারিং করতেছেন জান নাকি টন্ট করতেছেন?”

-“আরে আসলেই সুন্দর লাগতেছে জানপাখি।”

-“ধূরর! এমন একটা ইংলিশ মিডিয়াম ছেলেরে ডেট করতেছি আল্লাহ! সারাজীবনেও ইংলিশ নিয়ে একটু ফ্লেক্স নিতে পারবো না। এই শোপেন, আপনার ইংলিশ শুনলে না আমার নিজের স্কিল নিয়ে ট্রাস্ট ইস্যুজ হয়। আপনি ভুল করে বাংলাদেশে জন্মাইছেন।”

-“ভুল করে আর কোথায়? তোমাকে পাওয়ার ছিল বলেই এ ধরিত্রীতে জন্মানো।”

-“বাপ রে! বাংলাতেও ভারী শব্দ বলেন দেখি, নাইস! আচ্ছা শোনেন আমি ফোন রাখি। দরজা বন্ধ অনেকক্ষণ। আম্মু ডাকবে যেকোনো সময়।”

-“আচ্ছা জান।”

-“আপনার বাস কয়টায়?”

-“সকাল আটটা।”

-“সাথে কে যাবে?”

-“কে আবার যাবে? বাচ্চা নাকি আমি?”

-“ওহ আচ্ছা টাটা!”

-“টাটা!”

মিত্তিম ফোন রেখে মুচকি হাসলো। ছেলেটা বাচ্চা না কে বললো? সব আচার আচরণ তো বাচ্চাদের মতোই। শৈশবের দিকে তাকিয়ে মিত্তিমের মাঝেমাঝেই মনে হয় ছেলেটা কেবল উচ্চতায় বড় হয়েছে এই যাহ! এখনো তেমনই লাজুক আর ইনোসেন্ট রয়ে গেছে। যদিও খুব রাফ এণ্ড টাফ সাজার ট্রাই করে কিন্তু মিত্তিমের সামনে তা পারে না। মিত্তিম ধরে ফেলে এ চতুরতা কিন্তু শৈশবের এই গাম্ভীর্য তার ভালো লাগে। কী সুন্দর কপালে ভাঁজ পড়ে! মিত্তিমের ইচ্ছে করে ভাঁজ পড়া সে কপালে একটু চুমু খেতে। শৈশবকে জড়িয়ে রাখতে নিজের মাঝে। এই ছেলেটা তার জীবনে শান্তি ফিরিয়েছে, তাকে ভালোবাসা শব্দটার ভয় থেকে বের করেছে। আচ্ছা, শৈশব কেন আগে আসলো না তার জীবনে? তাহলেই তো সমস্ত সমস্যা মিটে যেত। শৈশবই থাকতো তার জীবনজুড়ে। মিত্তিমের জীবনটা কত সুন্দর হতো তখন! পাস্ট লাইফ ট্রমা ডিল করতে হতো না তাকে। সবকিছু কত্ত স্বাভাবিক থাকতো। একটা স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন তো সেও দেখেছিল। মিত্তিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখন এসব ভেবে লাভ নেই। শৈশব তার জীবনে আসার সুন্দর মুহূর্তটুকু সুন্দরভাবেই রাখতে চায় সে। এ মুহূর্তে পুরোনো কোনো কথা তুলে নিজের ক্ষত হৃদয়কে ফের দগ্ধ করতে চায় না সে মোটেও।

________________

ঘড়ির কাঁটায় সাতটা দশ। বাসস্ট্যান্ডে হেঁটে গেলেও বড়জোর দশ মিনিট লাগবে। শৈশব সবার থেকে বিদায় নিল। মিত্তিম বোধহয় ঘুম এখনো, সকাল থেকে টেক্সট করেনি। শৈশবও নিজ থেকে কল করলো না এখন। ঘুমোক মেয়েটা, বাসে উঠে বরং কল করবে। এখন কথা বললেই মিত্তিমের মনটা খারাপ হবে। শৈশব চাইলেও তার মন ভালো করতে পারবে না এখন। বাসস্ট্যান্ডের রাস্তা মিত্তিমের বাসার উল্টোদিকে। মেইন রোডে আসতেই চমকালো শৈশব। মিত্তিম দাঁড়িয়ে আছে, বাঁকা চোখে শৈশবের দিকে তাকিয়ে আছে। শৈশবকে দেখতেই এগিয়ে আসলো সে।

-“লুকিয়ে লুকিয়ে চলে যাচ্ছে। চোর একটা!”

-“তোমাকে জানালে তো তুমি মন খারাপ করতা জান, সেজন্যই তো জানাইনি। আমি তোমার মন খারাপ কীভাবে সহ্য করতাম?”

-“লুকিয়ে গেলে বুঝি মন খারাপ কম হতো? আপনি বাটপার! এখনি আমাকে লুকানো শিখছেন, ঢাকায় গিয়ে কী না কী করে বেড়াবেন। ছিঃ!”

-“আহারে জানপাখি আমার। পরেরবার আসলে আমাকে ধরে বেঁধে রেখে বিয়ে করে নিও। তারপর আমি তোমার বর হয়ে যাবো। তখন তো কেউ আমার দিকে নজরও দিতে পারবে না।”

-“ততদিন নজর দিক সবাই সেটা চাচ্ছেন? লুচ্চা কোথাকার! আপনার সাথে আমার কথাই নাই সরেন।”

-“আচ্ছা সোনাপাখি, আসো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। রাগ করেনা কলিজা। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, বুঝছো জান? আমার জীবনে মেয়েমানুষের উপস্থিতি খুব কম। আম্মু, আপু আর তুমি ছাড়া এখন আমার জীবনে অন্য কোনো নারী নেই। আর তোমরাই পার্মানেন্ট, বুঝছো আমার জান?”

-“সরেন সরেন পাম দিয়েন না!”

শৈশব হাসলো। বাসস্ট্যান্ডে আসতে বেশিক্ষণ লাগলো না। শৈশব বাসে ওঠা অবধি মিত্তিম অপেক্ষা করলো। নোট ফটোকপি করার বাহানায় বেরিয়েছিল সে সকাল সকাল। শৈশবকে আরেকবার দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। ঢাকা যাওয়ার পর তো আর চাইলেও দু’চোখ ভরে দেখতে পারবে না তাকে। মিত্তিমের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে আসে। সে কি মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়েছে শৈশবের প্রতি? বোধহয়!

__________

তিথি ফোন হাতে নিয়ে মুচকি হাসছে। ফোনে কিছু মেডিকেল রিপোর্টের ছবি। বস্তুত এসব তিথির প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট যা দিয়ে সে শৈশবকে ফাঁসাতে চেয়েছিল কিন্তু শৈশব যে এসব মানবে না তা তিথির বোঝার বাইরে না। তাই তিথি জানে শৈশবকে আঘাত কোনদিক থেকে করতে হবে। মিত্তিমের নম্বর তিথির ফোনে ইতোমধ্যে সেভড করা। নম্বর যোগাড় করা মোটেও কঠিন ছিল না যদিও তবে এখনকার কাজটা কঠিন। শৈশব এখনো ঢাকা ফেরেনি, আজ ফিরবে। এ তথ্য তিথি জেনেছে। শৈশব এখানে থাকতে মিত্তিমকে কিছু জানানো যাবে না। শৈশব ব্যস একবার ঢাকা পৌঁছাক। তারপর মিত্তিমকে নিয়ে খেলবে তিথি। সশব্দে হেসে ওঠে তিথি। এ নিষ্ঠুর হাসির শব্দ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার তার কানেই ফিরে আসে। তিথির হাসি থামে না, যে ভয়ানক খেলায় সে নেমেছে তাতে শৈশবের জীবনটা বোধহয় বরবাদ হতে বাকি নেই! আদৌ কি সে কখনো একটুও ভালোবেসেছিল শৈশবকে? ভালোবাসলে এভাবে কষ্ট দেওয়া যায়?

চলবে…

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১০

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
১০ম_পর্ব
~মিহি

-“কী হয়েছে মিত্তি? মন খারাপ?”

-“আপনি একা এভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন? আপু বা আঙ্কেল আন্টি দেখলে?”

-“হয়েছে টা কী তোমার? তুমি আমি আমার রুমেও একা ছিলাম! ইউ কিসড মি!”

-“তখন বাড়িতে অনেক মানুষ ছিল তাই কেউ খেয়াল করেনি কিন্তু এখন অবশ্যই সন্দেহ করবে।”

-“করলে করুক। আমি কি সেসবের ধার ধারি? সন্দেহ করলে ভালো, বিয়ে দিয়ে দিবে আমাদের। সমস্যা কোথায়?”

মিত্তিম মাথা নিচু করলো। মনে চলতে থাকা দোটানার নিরসন কোথায় হবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। মিত্তিমের মাথা নিচু করা শৈশবের নজর এড়ালো না। শৈশব দু’হাতে মিত্তিমের বাহু আঁকড়ে ধরলো। অকস্মাৎ শৈশবের স্পর্শে মিত্তিম তাকালো তার দিকে। চোখ ছলছল করছে মিত্তিমের। নিজের সাথে জড়ানো দ্বন্দ্বটা বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল যুদ্ধ! শৈশব কিছুক্ষণ মিত্তিমের চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। দুজনে ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে। ফায়ায নিচে গেছে আফরাকে ডাকতে। শৈশব সিঁড়িঘরের দরজার দিকে খেয়াল করলো। কারো পায়ের শব্দটুকুও নেই। মিত্তিমের চোখ বেয়ে গড়ানো প্রথম অশ্রুফোঁটাটাও ঠোঁট দিয়ে শুষে নিল শৈশব। মিত্তিম কেঁপে উঠে দূরে সরে গেল। শৈশবের ছোঁয়ার থেকে খানিকটা বাইরে। চোখে ভয়ের ছাপ।শৈশব বুঝে উঠতে পারছে না মিত্তিম তাকে এত ভয় পাচ্ছে কেন হঠাৎ?

-“মিত্তি কী হয়েছে তোমার? তুমি আমাকে কেন ভয় পাচ্ছো এভাবে? আ’ম স্যরি! আমার স্পর্শ খারাপ লেগেছে বুঝেছি। আমি স্পর্শ করবো না তোমাকে কিন্তু প্লিজ এভাবে ভয় পেয়ে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ো না আমার দিকে। ইট’স হার্টিং মি জান!”

-“শৈশব প্লিজ লিভ মি অ্যালোন!”

-“আমি পারবো না। আমি তোমাকে সাফার করতে দেখতে পারবো না মিত্তি। প্লিজ বলো কী হয়েছে, আমি কিছু করেছি? আচ্ছা আমি স্যরি জান, প্লিজ! তুমি এভাবে মন খারাপ করে থেকো না।”

শৈশবের দিকে তাকাতে মিত্তিমের চোখে বাঁধছে। এই ছেলেটা এত ভালো কেন? মিত্তিমের এভাবে যত্ন শেষবার কে নিয়েছিল? নিলয়? নাহ! সে কখনো এভাবে স্যরি বলেনি, এভাবে কনসার্ন দেখায়নি। বেপরোয়া ভালোবেসেছিল নিলয়, কোনোকিছুর ধার না ধেরে। এমন মানুষগুলোর মিথ্যে কথার জালেই মেয়েসমাজ কেন যেন জড়িয়ে পড়ে অথচ শৈশব যখন মন থেকে যত্ন করতে চাইছে তখন পৃথিবীর সমস্ত দ্বিধা এসে ঘিরে ধরছে তাকে। আমরা সবসময় কেন ভুল মানুষকে ভালোবাসি বুঝতে বাকি নেই মিত্তিমের। কিন্তু শৈশবকে ভালোবাসার সিদ্ধান্তটা তো মোটেও ভুল নয়। এই ছেলেটা নিতান্তই একটা বাচ্চা এখনো যাকে সযত্নে আগলে রাখতে ইচ্ছে করে মিত্তিমের। শৈশবের কাতর চাহনি দেখেই যে মিত্তিমের চোখ বেয়ে অবিরত অশ্রু গড়াচ্ছে তা ব্যক্ত করতে পারছে না মিত্তিম।

-“মিত্তি, তোমার কী হয়েছে? আমরা এখানে একা দাঁড়িয়ে এজন্য সমস্যা? আচ্ছা আমি নিচে চলে যাচ্ছি, মিত্তি! প্লিজ তবুও তুমি এভাবে মন খারাপ করে থেকো না।”

শৈশব মাথা নিচু করে দরজার দিকে এগোতেই মিত্তিম শৈশবের হাত টেনে ধরলো। শৈশবের বাহু জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। পরমুহূর্তেই একটু উঁচু হয়ে কয়েক ন্যানোসেকেন্ডের জন্য শৈশবের ওষ্ঠ স্পর্শ করলো। শৈশব এমন অকস্মাৎ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। মিত্তিম সাথে সাথে সরে গেল। শৈশব মৃদু হেসে মিত্তিমের দু’গালে হাত রেখে কপালে চুমু দিল।

-“আমার পিচ্চির মান ভেঙেছে?”

-“আপনার উপর মান করিনি তো!”

-“ফায়ায এখনো আসছে না কেন বলো তো!”

-“ও আপনাকে আর আমাকে প্রাইভেসি দিচ্ছে। ও মোটেও আপুকে ডাকতে যায়নি। ও ভাবছে আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন। তাই সে নিজের ভাইকে তার হবু ভাবীর সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে।”

-“বাহ! এত ভালো কেন আমার ভাইটা!”

-“আপনার প্রাক্তনের কথাও সব জানে ফায়ায?”

-“আংশিক! কতটুকু জানে তা জানিনা। আর তিথির কথা ভেবো না মিত্তি। ওকে আমি প্রাক্তন ভাবিনা।”

-“ওহ? প্রাক্তন ভাবেন না?”

-“মিত্তি! আই লাভ ইউ, শী ইজ আ স্ট্রেঞ্জার নাও! বুঝছো? আমার লাইফে ও আর এক্সিস্ট করে না, বুঝছো জান?”

মিত্তিমের প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে শৈশবকে জড়িয়ে ধরতে। এই ছেলেটা এত ভালো কেন? গ্রিন ফ্ল্যাগ? নোপ…এই ছেলেটা গ্রিন গার্ডেন!

-“জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে জান?”

মিত্তিম চমকালো। ছেলেটা মন পড়তে পারে নাকি? শৈশব আলতো করে মিত্তিমকে কাছে টেনে নিলো। মিত্তিম ক্ষণিকের জন্য শৈশবের বুকে মাথা রাখার সুযোগ পেল।

-“এখন নিচে যাই? আপনাকে আর আমাকে এতক্ষণ এখানে দেখলে ফায়ায আরো সন্দেহ করবে।”

-“করুক!”

-“শৈশব!”

শৈশব মুচকি হেসে মিত্তিমকে ছেড়ে সরে দাঁড়াতেই কারো পায়ের শব্দ পেল। শৈশব তৎক্ষণাৎ খানিকটা দূরে সরে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। একটু পরপর গুনগুন করছে। মিত্তিম বুঝতে পারলো শৈশব গান শুনছে। এয়ারবাডস কানে, এতক্ষণ খেয়াল করেনি। মিত্তিমও অন্যদিকে ঘুরে তাকালো। ফায়ায এসে দুজনকে দুই প্রান্তে দেখে খানিকটা আশাহতই হলো। তার সন্দেহ সত্যি না হওয়ায় সে যে যথেষ্ট বিষাদগ্রস্ত তা তার মুখমণ্ডল বলে দিচ্ছে। ফায়ায এসে মিত্তিমের পাশে দাঁড়ালো।

-“কী রে, এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়েই ছিলি?”

-“না নাচছিলাম!”

-“আরে বেডি, হুদাই চেতিস ক্যান? না মানে ভাইয়ার সাথে টুকটাক কথা হইলো নাকি?”

-“তুই কয়দিন আগে কইলি তোর ভাইয়ের প্রেমিকা আছে, তারপর বললি বিয়ে করবে, তারপর বললি প্রাক্তন, এখন বলতেছিস তোর ভাইয়ের আমাকে পছন্দ। গাঁজা দিচ্ছে কে তোকে? ফাইজা?”

-“ধূর! ফাইজা মেইবি আমাকে সিরিয়াস না রে।”

-“কেন?”

-“এখন অবধি আমাকে টেক্সট করেনি।”

-“তুই কর!”

-“কিন্তু আমার কাছে তো নম্বর নাই ওর।”

-“ওকে নিজের নম্বর দিয়েছিস?”

-“ইয়ে মানে না…”

বলেই ফায়ায মাথা চুলকাতে লাগলো। মিত্তিম সজোরে ফায়াযের পিঠে এক ঘা বসিয়ে বলে উঠলো,”বলদ একটা!” ফায়ায পিঠের ব্যথায় কুঁকড়ে খানিকটা দূরে সরে গেল।

-“গাধা! যা আপুর ফোন থেকে নম্বর খোঁজ।”

-“নম্বর চুরি করবো?”

-“তোর প্রেম করার দরকার নাই! ছাগল একটা!”

মিত্তিমের প্রলয়ঙ্করী রূপ দেখে সেখানে দাঁড়ানোর মতো সাহস অবশিষ্ট রইলো না ফায়াযের। উল্টোদিকে ছুটলো সে। শৈশব তৎক্ষণাৎ এসে মিত্তিমের হাত চেপে ধরলো শক্ত করে।

-“তুমি ওকে টাচ করলা কেন?”

-“ওকে তো আমি সবসময় মারি!”

-“আর মারবা না জান।”

-“আপনার জ্বলতেছে?”

-“নাহ!”

-“একটুও জ্বলতেছে না?”

-“পিটাবো তোমাকে বেঁধে রেখে! মাইর চিনো? হ্যাঁ জ্বলতেছে আমার, আমার জান অন্য কোনো ছেলেকে স্পর্শ করলে আমার জ্বলবেই।”

-“আচ্ছা বুঝছি! এত অবসেশন ভালো না, মি.ইংলিশ মিডিয়াম!”

-“তুমি আমার সেই নেশা মিত্তি যেটা ভালো হোক কিংবা খারাপ, আমার রক্তে মিশতে বাধ্য! এ নেশার ঘোরে সর্বোচ্চ মাতলামি করতে আমি অপেক্ষারত!”

-“খুব সাহিত্য ঝাড়া হচ্ছে যে?”

শৈশব মিত্তিমের চোখের দিকে তাকালো। এই মেয়েটার চোখে এত মায়া কেন? মায়ার সাগর জমা করেছে চোখে? অদ্ভুত! এ সাগরে বারংবার ডুবছে শৈশব, অতল গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে যেন। সে তো সাঁতার জানেনা, তাই বুঝি ডুবছে এভাবে?

_____________________

-“তিথি তোর মাথা গেছে? শৈশব খুন করে ফেলবে যদি তুই এমন কিছু করিস!”

-“ও কী করতে পারে সেটাই আমি দেখবো। আমি যা প্ল্যান করছি সেটাতে আমাকে সাহায্য করবি শুধু। বুঝেছিস?”

-“এটা ঠিক না ভাই, আমি রিস্কে পড়ে যাবো। কেউ যদি জানতে পারে…”

-“কেউ জানবে না…তুই শুধু তোর কাজটা কর!”

তিথি হাসলো। কী ভয়ানক ষড়যন্ত্র যে তার মস্তিষ্কে চলছে তা এখনো কেউ আন্দাজটুকুও করতে পারেনি। শৈশব? সে তো মোটেও না! এই ষড়যন্ত্রের মায়াজালে বাঁধা তো তাকেই পড়তে হবে।

চলবে…