Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 94



উষ্ণতা পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪১

আঁখি পনেরো হাজার টাকার কথা বলেছে। মনিকার আগে মালিহার বুকটা লাফিয়ে উঠলো। পনেরো হাজার টাকা সে কোত্থেকে দেবে! তাদের অবস্থা দেখে আঁখি বলল, “পাগল! একেকজন পনেরো দেবে নাকি! সবাই মিলে। তাহলে একজন পাঁচ হাজার টাকা দিলেই হচ্ছে।”
“আপনি কি দিতে চাচ্ছেন?” মনিকার প্রশ্নে আঁখি শোয়া থেকে উঠলো, “পাতলা একটা আংটি হবে। স্বর্ণের যেই দাম, ভালো কিছু দিতে হলে আমাদের কলিজা কা’টতে হবে। তাও কম পড়তে পারে।” বড় করে হাই তুললো আঁখি। এতো ঘুম আসছে কেনো! ভার্সিটি বন্ধ থাকলে যা হয়। অন্যদিন ঠিকই তো এই সময়ে এই ল্যাব থেকে ঐ ল্যাবে ছুটোছুটি করতে হয়। আজ আলস্য একদম জেঁকে ধরেছে।
“পাতলা একটা আংটি?” কেমন করে বলল মালিহা। প্রিয় বান্ধবীর জন্য এমন উপহার যেনো পছন্দ হলো না।
“তার চেয়ে আমরা ভালো একটা কম্বো দিই। একটা শাড়ি, কিছু ইউনিক ডিজাইনের অর্নামেন্টস, পারফিউম এসবের একটা সেট। কেমন হবে?”
“এটাও ভালো আইডিয়া। বাজেটও কম লাগবে।” আঁখি বলল।
“আমি খুঁজব?” মালিহা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল।
“খোঁজো। যেগুলো ভালো লাগবে সেভ করে রেখো। আমি একটু ঘুমাই।”
মনিকা মালিহার বিছানায় এসে বসলো। একবার আঁখির দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলল, “আঁখিপুর সেই বন্ধু বাসায় প্রস্তাব পাঠিয়েছে।”
মালিহা চোখ বড় করে তাকালো। চেঁচিয়ে উঠবে সেসময় মনিকা মুখ চেপে ধরে চোখ রাঙিয়ে বলল, “আগেই চেচাবি তো আর কিচ্ছু বলব না।”
মালিহা মাথা নাড়ল। একটুও চিৎকার করবে না সে।
“আম্মা তো রেগে কাই হয়ে আছে। এক ভার্সিটির ছেলে। আমি নাকি কিছু করেছি। বল তো নিজের মা সন্দেহ করলে কেমনটা লাগে?” বিরক্ত মুখে বলল মনিকা।
“আঙ্কেল কি বলছে?”
“আব্বা বলল খোঁজ নিয়ে দেখি আগে। প্রস্তাব দিলেই আমরা একপায়ে রাজি হয়ে যাবো এমন তো না। আর আমিও ছেলের পক্ষ কিছু বলিনি তাই আমা আর কিছু বলতে পারছে না। সব ঠিক বলে তারপর আঁখিপুকে বলব। নয়তো আপু শুধু লেগপুল করবে।”
মালিহা ভগ্ন কণ্ঠে বলল, “বিয়ের পর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সবাই মিঙ্গেল হয়ে গেলো!”
“তুইও হয়ে যা।”
“আমার আর বিয়ে! হাহ!”

বৃহস্পতিবার বিকেলে আর তিশার সাথে দেখা করা হলো না। আজিজা ছোট্ট একটা খাম হাতে দিয়ে বললেন, “আমার মেয়ের জন্য অনেক কষ্ট করেছ। ধন্যবাদ।”
মালিহা খাম হাতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
“ফুপু আপনি..”
“সময় সুযোগ পেলে আবার এসো মালিহা। যার ভবিষ্যত নিয়ে এত চিন্তা ভাবনা করেছো তাকে একবার দেখে যেও।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মালিহা। টাকার সম্পর্ক ছিল এটা? কত সহজেই ছিন্ন করা গেলো।
“তিশার সাথে একবার দেখা করা যাবে?”
“না। ও ওর টিচারের কাছে পড়ছে।”
খাম থেকে অর্ধেক টাকা বের করে আজিজার হাতে দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো মালিহা। বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। পড়ন্ত রোদে সে যখন হাঁটতে শুরু করেছে তখন তিশা ছুটে এসেছে রাস্তার সাথে লাগোয়া বারান্দার এক প্রান্তে। মালিহা পিছু ফিরলো না। ফিরলে দেখতে পেতো উদগ্রীব এক জোড়া চোখের মাঝে টলমল অশ্রুর খেলা।

মালিহা ভেবে দিশেহারা হচ্ছিল বাচ্চাটার জন্য কি নেবে। ইতমিনান বলল, “চল একটা প্লাস্টিকের গামলা নিই। বড়সর। লাল টকটকে দেখে।”
“গামলা নেবো কেনো?” মুখ কুঁচকে বলল মালিহা।
“গোসল করাবে। মুখ বাঁকা করছিস কেনো? দুইদিন পর তো গামলায় করেই গোসল করাবে। আর কিছু বেবী লোশন টোশন নে তাহলেই হবে। এতো ভাবনা চিন্তা করার কি আছে?”
“কোথায় মুখ বাঁকা করলাম আমি।”
“না তুই করিস নি। আমার চোখ দেখেছে। চল দ্রুত। নাহলে আজকে আর নামাজে যাওয়া লাগবে না।”
দোকানে জোর জবরদস্তি করে মালিহা অর্ধেক টাকা দিলো। ইতমিনান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এতো ঝগড়াটে হয়েছিস কবে থেকে? আমি তোর থেকে গুণে গুণে সাত বছরের বড়। মান সম্মান দিস কিছু? এখন এটা আমাকে চেয়ে নিতে হবে? চুপ কর। কথা বলবি না। হাট। হাট সামনে।”
মালিহা চুপচাপ হাঁটতে শুরু করলো। সে ভেবেই পেলো না ঝগড়া করলো কখন। লতার বাড়ির সামনে তাকে নামিয়ে দিয়ে ইতমিনান মসজিদে চলে গেলো। গামলার ভেতর আরো কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে ভেতরে গেলো মালিহা। লজ্জায় তার চোখ মুখ ছোট হয়ে এলো। কে কবে গামলা নিয়ে দাওয়াত খেতে গেছে!
লতার বাড়িতে ছোটখাট আয়োজন করা হয়েছে। কাছের কিছু আত্মীয়স্বজন। তারাও সব লতার শশুরবাড়ির দিকের। মালিহা অবাক হয়ে। ভাই এমন হয়? বোনের মুখটা দেখতেও ইচ্ছা করে না? আল্লাহ তার শত্রুকেও এমন ভাই না দিক।

লতা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। দৌড়াদৌড়ি যা করার তার শাশুড়িই করছে। বোঝা যাচ্ছে সবটা সে আনন্দের সাথেই করছে। একমাত্র মৃ’ত সন্তানের চিহ্ন, আনন্দ থাকা স্বাভাবিক।
কয়েকজন মালিহার হাতের গামলা দেখে হাসলে লতার শাশুড়ি বলল, “কাজের কাজ করেছো মেয়ে। সবাই একই জামা এনেছে তাও আবার দুই তিনমাসের জন্য একেবারে। দোকানে সামনে যা পেয়েছে আর কি। তা আমার নাতি কি বড় হবে না? দুই তিনমাস ধরে এইটুকুন থাকবে? তার থেকে এই ভালো। কাজের জিনিস।” এদিক ওদিক ঘুরিয়ে গামলাটা দেখলেন মহিলা। মালিহার লজ্জা কমলো।
“এই লতা আয় বাবুকে গোসল করিয়ে দেই। নতুন গামলায় নতুন গোসল।”
মালিহা চোখ জুড়িয়ে দেখলো লতা এবং তার শাশুড়ির উজ্জ্বল চোখমুখ। বাচ্চাটা যেনো বাতি। তার দিকে তাকালেই তাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
নামাজ পড়ে এলে পুরুষদের খেতে দেয়া হলো এক ঘরে। মহিলাদের আরেক ঘরে। এক মহিলা মালিহাকে আপাদমস্তক দেখে বললেন, “তুমি আর তোমার ভাই একসাথে থাকো নাকি?”
মালিহা হকচকিয়ে গেল। বলল, “না। একসাথে থাকবো কেনো। ভাইয়া অফিসের কাছে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। ওখানেই থাকে। আর আমি ভার্সিটির হোস্টেলে থাকি।”
“ওহ।”

ফেরার পথে ইতমিনান বলল, “বাড়ি যাবি কবে?”
“কয়েকদিন পর যাবো। তুমি কবে যাবা?”
“আমি তো কালকেই যেতে চাচ্ছি।”
“অফিস ছুটি দিয়ে দিলো এতো তাড়াতাড়ি?”
“না। আমি ছুটি নিয়েছি। একটু দরকার।”
“ওহ।”
“তুই একা যেতে পারবি তো?”
“ওদিকের কয়েকজন মেয়ে আছে। ওদের সাথে যাবো।”
“তাই করিস।” পরপর মনে মনে বলল, “এই শেষবার।” মালিহা তার দিকে তাকালে ঝটপট চোখ সরিয়ে নিলো সে। চোখ ছোট করে তাকালো মালিহা। তার দিকেই তাকিয়ে ছিল না?

তার পরেরদিন সকাল আটটার ট্রেনেই বাড়ির পথ ধরলো ইতমিনান। আয়েশা খুশিতে বাকবাকুম। ছেলেকে বলে রেখেছেন এলেই মেয়ে দেখতে নিয়ে যাবেন। ইতমিনান তৈরি হয়েই যাচ্ছে। এসপার ওসপার একটা করেই আসবে। ভেতরে ভেতরে বেশ অস্থির সে। ফুপু কিভাবে নেবেন বিষয়টা। দাদি আর বাবাকে রাজি করতে পারলেই পরিবেশ তার দিকে থাকবে। দুই মহিলা নিজেদের মাঝে যতো চায় ঝগড়া করুক তার কাজে বাগড়া না দিলেই হলো। দরকার হলে ইতমিনান বলবে, “তোমরা যেনো সারাজীবন সুন্দর করে ঝগড়া করতে পারো তার ব্যবস্থাই তো করছি।” সাই সাই করে চলে যাওয়া গাছাপালার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো ইতমিনান। নিজেকে তার কাছে স্কুল পড়ুয়া অস্থির বালক মনে হচ্ছে।

.

বাড়িতে এসে তাকে স্থির থাকতে দেননি আয়েশা। ইতমিনান বলল, “আজই এলাম। কাল যাই?”
“তোর উপরে আমার কোনো ভরসা নেই। আজকে দেখে এলে কি হবে?”
“আমি খুব ক্লান্ত মা।”
“বাড়ি ফিরে তোর গা মালিশ করে দেবো আমি।”
“মা।”
“বল।”
“কে কে যাবে?”
“তোর বাপ আমি আর তুই। মিলি যাবে কি না বলেনি এখনও। অবশ্য ওর বাড়ির কাছে। যেতেও পারে।”
“ফুপু যাবে না?” মিনমিন করে বলল ইতমিনান।
“রাবেয়া এখন যেয়ে কি করবে? পছন্দ হলে তখন না হয় নাহয় যাবে।”
“একটা দেখার বিষয় আছে না! ওরা দেখবে আমাদের কতো আত্মীয়। ফেলনা ভাবতে পারবে না।” আড়চোখে মায়ের দিকে তাকালো ইতমিনান। টোপ কাজে দিয়েছে মনে হচ্ছে।
“আচ্ছা তাহলে বলছি ওকে।”
ইতমিনান মনে মনে প্রস্তুতি নিলো। আশ্চর্য! এতো ভয় ভয় লাগছে কেনো!

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪২

ইতমিনানের গলা শুকিয়ে গেছে। মেয়ের বাড়িতে এলাহী কারবার। বিশাল এক সোফায় তাদের বসতে দেয়া হয়েছে। সোফার চেহারা রাজকীয় ধরনের। সেদিকে তাকালেই বাড়ির আর্থিক অবস্থা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। মেঝের টাইলস চকচক করছে। নিচে তাকিয়ে নিজের চেহারা দেখতে পেলো ইতমিনান। মায়ের মুখের দিকে তাকালো। আয়েশা মোটামুটি হতভম্ব অবস্থায় আছেন। সেই তুলনায় রাবেয়া স্বাভাবিক।
মকবুল আলীর পাশে মেয়ের বাবা, চাচা, মামা সম্পর্কের প্রায় আটজন বসে আছেন। সকলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ইতমিনানের দিকে। তার গলা শুকিয়ে যাওয়ার এটাই প্রধান কারণ।
“মা আমার তো কোনো মামা নেই। চাচা নিজের পথ ধরেছে। এতো ষন্ডা ষন্ডা লোকের পাশে তোমার স্বামীকে নিতান্তই নিরীহ দেখাচ্ছে।”
আয়েশা ছেলের ফিসফিসানি শুনলেন। আদতেও তাই। তার শুকনো বরটাকে এই লোকগুলোর পাশে দুর্ভিক্ষ থেকে উঠে আসা মানব বলে মনে হচ্ছে।
হঠাৎ ছোট ছোট কিছু ছেলেমেয়ে আসতে শুরু করলো। সবার হাতে একটা করে থালা। কাজিন একজন ভাই এসে টি টেবিল সরিয়ে বড় একটা টেবিল মাঝে রেখে গেলো। ছোট ছেলে মেয়েগুলো একে একে আসছে আর একটা করে প্লেট রাখছে। ইতমিনান মনে মনে গুনতে শুরু করলো, “এক, দুই, তিন, চার…”
লাইন ধরা ছেলেমেয়েগুলো সম্ভবত বয়স অনুযায়ী আসছে। আস্তে আস্তে বড় মুখ দেখা যাচ্ছে। তেরো নাম্বারে যেয়ে বেশ সাজগোজ করা একটা মেয়ে এলো। তার হাতের ট্রেতে চায়ের কেটলি। ইতমিনান চা দেখে নিশ্চিত হলো। এটাই তাহলে বোনের পছন্দের পাত্রী।
মেয়ে বসলো মামা চাচার মধ্যিখানে। চারপাশে বিশাল চেহারার পাহারাদার, মাঝে রাজকন্যা। সেই রাজকন্যা আবার সয়ম্বরা। মৌমাছির হুলের মতো একেকটা দৃষ্টি ইতমিনানের দিকে ধেয়ে আসছে। নিজেকে প্রার্থীর স্থানে পেয়ে ইতমিনানের নিজের প্রতি মায়া হলো। কি ভয়ানক দৃশ্য!
পাত্রীর মা চাচীরা এসে আয়েশা, রাবেয়ার সাথে খাতির জুড়লেন। মিলির কথা শুনে সে কেনো আসেনি এ নিয়ে খানিক আফসোস করলেন। ইতমিনান কথার ধরন শুনে বুঝলো তার মা, ফুপু এদের সাথে আলাপ জমাতে পারছেন না। পারার কথাও নয়। একজন চুপ করে তো আরেকজন সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরে। কেউ একটার কথা দ্বিতীয়বার বলছে না। আর্থিক স্বচ্ছলতার উন্মুক্ত বহিঃপ্রকাশ। ইতমিনান দম ছাড়লো। আলাপ না জমার যথেষ্ট কারণ আছে। তাদের সম্পদের বর্ণনা দশ সেকেন্ডের মাঝে বলে শেষ করা সম্ভব। কাজেই মকবুল সাহেব যে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
এক পর্যায়ে এক মামা গম্ভীর স্বরে বললেন, “ছেলে মেয়েকে ওদিকে পাঠিয়ে দিন। তারা নিজেদের মাঝে আলাপ সারুক।”
মেয়েকে অগ্রগণ্য পেলো ইতমিনান। অগত্যা তার পিছু নিতে হলো। নিজেকে কষে দুটো ধমক দিতে ভুললো না। মনের কথাটা আরো আগে বলে দিলে আজ পরের মেয়ের পিছু পিছু ঘুরতে হতো না।
বারান্দাও বেশ বড়। তার ভাড়ার ফ্ল্যাট এপাশ থেকে ওপাশ ঠিক যতোটা এদের বারান্দাই ততোটা। যাক একটা শক্ত পয়েন্ট পাওয়া গেছে। আয়েশাকে বোঝাতে সুবিধা হবে।
“আপনি কোথায় চাকরি করেন?”
চমকে গেলো ইতমিনান। নিজের ভাবনায় এতই ডুবে ছিলো যে মেয়েটার উপস্থিতি ভুলে গিয়েছিল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “পলিফাইবারে, একটা প্রাইভেট কোম্পানী।”
“কোন পোস্টে? স্যালারি কতো?”
মেয়েটার স্পষ্ট অভিব্যক্তিতে অবাকই হলো ইতমিনান।
“জেনারেল ওয়ার্কার। কারেন্ট স্যালারি থার্টি ফাইভ।”
একটা ত্যাড়ছা বাক্য মেয়েটার থেকে আশা করেছিল ইতমিনান। তবে সে তেমন কিছুই বলল না।
“নতুন চাকরি খোঁজার চেষ্টা করছেন?”
“করেছিলাম। তেমন পাচ্ছি না আর। তাই আপাতত খোঁজা বাদ দিয়েছি।”
“ওখানেই পার্মানেন্ট হওয়ার ইচ্ছা।”
“আপাতত।”
“আপনি তো আমাকে দেখছেনই না। দেখে নিন। পরে আবার কোথায় পাবেন?”
ইতমিনান হাসলো। তার মাথায় তো একজন জেঁকে আছে। আর একজনকে দেখার কি দরকার? কোনো মানেই নেই।
“হাসছেন কেনো? আপনি তো আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করছেন না।”
“যেটুকু জানা জরুরী ছিল সেটা জেনে গেছি। আর কিছু জানতে চাই না।”
“কিভাবে জানলেন?” মেয়েটার কণ্ঠে কৌতূহল। তবে সেটা আর পূরণ হলো না। দরজার ফাঁক দিয়ে দূরে রাবেয়াকে দেখে ইশারায় ডাকলো ইতমিনান। তিনি কথাচ্ছলে উঠে এলেন। মেয়ের হাত ধরে বললেন, “এসো গল্প করি।” ইতমিনান হাঁফ ছাড়লো। কখন যে বাড়ি যাবে!
মকবুল আলী ভেবেছিলেন মেয়ের পক্ষ বিস্তারিত শুনে একবাক্যে না করে দেবে। কিন্তু তাদের কথাবার্তা শুনে নিমরাজি মনে হলো। মকবুল আলী বললেন, “বড় আপ্যায়ন করলেন ভাইজান! আজ উঠি। আমাদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে একটু আলাপ পরামর্শ করি।”
বেশ আন্তরিকতার সাথেই বিদায় দিলেন তারা। জুতা পড়ার ফাঁকে ইতমিনান শুনলো চৌদ্দ পনের বছর বয়সী একটা ছেলে বলছে, “আমার একটুও পছন্দ হয়নি। ভ্যান্দা মার্কা ছেলে। নড়েও না চড়েও না। আমাদের দুলাভাই হিসেবে একটুও মানাবে না।” ইতমিনানের মন চাইলো ছুটে যেয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে।

সারা রাস্তা স্ত্রীকে বকতে বকতে গেলেন মকবুল আলী।
“কি এতো তাড়াহুড়া! খোঁজ নাই খবর নাই, নাচতে নাচতে চলে গেলা মেয়ে দেখতে। তোমার মেয়ের কাছে আমি আগে ফোন দেই। নিজের জায়গা বোঝেনা ও? আশ্চর্য লাগছে আমার। ওখানে সম্বন্ধ করার কথা ভাবে কিভাবে ও?”
রাবেয়া নিচুস্বরে ধমক দিলেন, “আহ! ভাইজান রাস্তায় কি শুরু করলেন? ফোন টোন সব বাড়ি যেয়ে হবে। রাখেন ফোন। রাখেন আগে। গাড়ির ভেতরে যতো হৈ হট্টগোল। ভাবি কি খোঁজ নিবে? আপনি খোঁজ নেন নাই কেনো?”
ননদের কথা মনে ধরলো আয়েশার। পছন্দ না হলেই তোমার মেয়ে তাই না?
ইতমিনান মনের সুখে হাওয়া খাচ্ছে। ভাঙাচোরা গাড়িকে তার কাছে চাঁদের গাড়ি মনে হচ্ছে। দেখতে যাওয়া মেয়েটার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলো সে। স্পষ্ট মনে পড়ল না। তবে মেয়েটা বেগুনি রঙের শাড়ি পড়েছিল। এটা মনে আছে। নিজেকেই বাহবা দিলো ইতমিনান, “কি একটা ভালো মানুষ বর পেতে যাচ্ছিস যদি জানতি রে মালিহা!”
“এই বেয়াদব! তুই শিস বাজাচ্ছিস কোন সাহসে? তোর পাশে যে তোর বাপ বসে আছে খেয়াল নাই?”
বাবার ধমকিতে ইতমিনানের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। খপ করে মুখে হাত দিলো সে। শিস দিলো কখন? আশ্চর্য তো।

বাড়ির পরিবেশ শান্ত। আয়েশা মুখ কালো করে খাবার গোছাচ্ছেন। মকবুল আলী ঘরে একা একাই বকবক করছেন। ইতমিনান উঠলো। এইতো মোক্ষম সুযোগ।
রাবেয়ার ঘরে নক করলো।
“কে?”
“ফুপু আমি।”
“দরজা খোলা। আয়।”
ভেতরে ঢুকলো ইতমিনান। রাবেয়া কাত হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছেন। ইতমিনান উকি দিয়ে দেখলো রাফি ঘুমিয়ে গেছে।
“কান্নাকাটি করেছে নাকি?”
“না। আমার ছেলে ভদ্র। তোদের মতো অসভ্য না।”
“আমি অসভ্য ছিলাম?”
“তুই, মালিহা, মিলি, মিতুল সবাই অসভ্য ছিলি। শুধু আমার ছেলেই ভালো। সবার কথা বাদ। তুই তো এখনো অসভ্য আছিস।”
“এমন কথা বলতে পারলা ফুপু? আমি তোমার একমাত্র বড় ভাতিজা।”
নরম কণ্ঠে বলল ইতমিনান। ছেলেকে সাবধানে শুইয়ে উঠে ইতমিনানের কান ধরলেন রাবেয়া।
“হতচ্ছাড়া! সেদিন অর্ধেক কথা বলে ফোন বন্ধ করেছিস কেনো? তোর বান্দরামি কিভাবে ঠিক করতে হয় আমি ভালো করেই জানি।”
“লাগছে ফুপু।”
“লাগার জন্যই ধরেছি।”
“আমি তো তোমার কাছে সেই কথাই বলতে আসলাম।”
এই পর্যায়ে নরম হলেন রাবেয়া। তবে কণ্ঠের গম্ভীরতা কমলো না, “কি বলবি?”
রাবেয়াকে ধরে বিছানায় বসালো ইতমিনান। নিজেও বসলো পাশে। আকুল হয়ে বলল, “ফুপু আমি এখানে বিয়ে করব না।”
“সে তোর বাপ দেবে বলে ভাবছিস?”
“অন্য জায়গায়ও করবো না।”
“কেনো চির কুমার থাকবি?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ! একটাই জীবন। বিয়ে না করে ম’রে যাবো? বিয়ে তো করবো ফুপু।”
“তাহলে?”
“আমার পছন্দ আছে।” কণ্ঠ নিচু করে বলল ইতমিনান।
মুহূর্তেই রাবেয়ার চোখ মার্বেলের আমার ধারণ করলো।
“হতচ্ছাড়া! শহরে যেয়ে তুই এই করিস? এই তোর চাকরির নমুনা?” এবার চুলের গোছা ধরলেন রাবেয়া।
“আহ! ফুপু! লাগে তো! আমি অসহায় বান্দা। সেই বান্দার সাহায্যে আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়েছে। আমার মা তো রাজি হবে না। তুমি যদি দয়া করে আমার ঘর বসাতে সাহায্য করো। ছাড়ো না ফুপু!”
রাবেয়া ছাড়লেন, “মানবে না কেনো তোর মা?”
“শত্রুর চোখে যাকে দেখে তাকে আত্মীয় করবে কেউ?” মাথায় হাত বুলিয়ে বলল ইতমিনান। ব্যাথায় তার মুখ কুঁচকে গেছে। সন্দেহী কণ্ঠে রাবেয়া বললেন, “মেয়েটা কে?”
ইতমিনান নির্বিকার গলায় বলল, “মালিহা।” তার সমস্ত মনোযোগ পড়ে যাওয়া দুটো চুলে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৩

রিপা ছুটি দিয়ে দিয়েছে। তারা নাকি এই ভ্যাকেশনে কোথায় ঘুরতে যাবে। মালিহা বাড়িতে ফোন দিলো।
“কবে আসবি আপা?”
“এই কাল পরশুর ভেতরে দেখি।”
“কাল পরশু! দুইদিন পরে আয়।”
“কেনো?”
“আমরা বাড়ি যেয়ে নিই। তুই এখন এলে মামা বাড়ি উঠতে হবে। কোনো দরকার নেই। আর দুটো দিন থাক। আমরা আগে বাড়ি যাই।”
“মামা বাড়ি গেলে কি হবে?”
“এতো কথা বলিস কেনো? আমি বলছি না আসবি না?” শক্ত কণ্ঠে বলল মিতুল। মালিহা হেসে ফেললো, “যথা আজ্ঞা বড় ভাই। আপনার জন্য কি আনবো বলুন।”
“কিছুই আনতে হবে না। বড় দেখে দুটো নোট রেখে দিস। ওগুলোই নেবো।”
“ধড়িবাজ হয়েছো খুব!”
“যা মনে হয়।”
“মা কই?”
“ঘুমাচ্ছে।”
“কবে যাবি তাহলে?”
“আজকে মাকে বলি। কাল নাহয় পরশু চলে যাবো ইনশাআল্লাহ্। তারপর আসিস তুই।”
“আচ্ছা।”
মালিহা ফোন রেখে ভাবলো টাকার জোগাড় কিভাবে করবে। আঁখির কাছে বলল, “আপু টাকা বাড়ি থেকে এসে দিলে হবে না?”
“আরে চিল! অনলাইনের বিষয়। এর ভেতরে অর্ডার দিয়ে রাখবো। নীতিকে দিতে পারলেই হলো। চয়েস করে তোমরা ছবি দিও। আমি নাহয় রিসিভ করে রাখবো। পরে তোমরা আমাকে টাকা দিয়ে দিও। হয়ে গেলো!”
সহজ সমাধানে খুশি হলো মালিহা। মনিকার সাথে মিলে শাড়ি, চুড়ির দারুন একটা সেট সিলেক্ট করে ফেললো।

ইতমিনান ভেবেছিলো রাবেয়া এক দফা চিৎকার চেঁচামেচি করবেন। কিন্তু তাকে স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখে ভয়ই পেলো সে।
“ফুপু?”
“ও ফুপু!”
রাবেয়া ভাতিজার দিকে তাকালেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন, “তুই সত্যি মালিহাকে পছন্দ করিস?”
“হু।” নিচু কণ্ঠে বলল ইতমিনান।
“আর মালিহা?”
“মালিহা কী?”
“ঔ তোকে পছন্দ করে?”
“জানিনা।” ইতমিনানের স্বর কিছুটা বিষণ্ন শোনালো।
“মানে?”
“মালিহা তো এসব কথা কিছু জানেনা। আমি বলিনি ওকে।”
রাবেয়া যেনো স্বস্তি পেলেন। দম ছেড়ে বললেন, “তোর মা মানবে না, ওর মাও মানবে না। মাত্র সম্পর্কগুলো একটু ভালো হওয়ার দিকে। তুই এখন এসব কথা কিভাবে বলিস ইতু?”
ইতমিনান কাতর কন্ঠে বলল, “মা আমার বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে ফুপু।”
“বয়স হলে লাগবে না?”
“সেটা তো সমস্যা না। কিন্তু আমি যে মালিহাকে পছন্দ করি..” অস্বস্তি ঘিরে ধরলো ইতমিনানকে।
রাবেয়া নরম কণ্ঠে বললেন, “অবুঝ সাজিস না ইতু। তুই সবই জানিস।”
“জানি। আমি কি মালিহার জন্য বেশি খারাপ অপশন?”
“আহা! আমি কখন সেকথা বললাম।”
“তুমি আমার কথার উত্তর দাও।”
“না। খারাপ হবি কেনো?”
“তাহলে তুমি একটু সাহায্য করছো না কেনো?”
“বিয়ে তো শুধু দুটো মানুষের মিল না। পরিবারেও মিল। যেখানে মুখ দেখাদেখি অবস্থা নেই সেখানে আত্মীয়তা হবে কিভাবে? মতি ভাই বেঁচে থাকলে এই কথা বলতে পারতি তুই?”
চাচার মুখটা মন করে যেনো শক্তি ফিরে পেল ইতমিনান। মনে মনে বলল, “আরও আগেই পারতাম।” পরক্ষণেই ফুপুকে বলল, “তুমি কি ভাবছো আমি মালিহার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছি?”
“ধুর অশান্তি! এক ধাপ বেশি বুঝিস কেনো? ওর বাপ বেঁচে থাকলে তার সামনে এই কথা বলতে পারতি কি না তাই বল।”
“পারতাম।” ইতমিনানের দৃঢ় কন্ঠস্বর। রাবেয়াকে যেনো সেই দৃঢ়তা ছুঁয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ করে ভাতিজার চেহারা দেখলেন তিনি। কতগুলো হিসেবে কষে নিলেন যেনো। গুরুতর কণ্ঠে বললেন, “আমি নাহয় সাহায্য করলাম। কিন্তু আমাকে যেভাবে বলেছিস তোর মা’কে, মালিহার মা’কে এভাবে বলতে পারবি?”
ফুপুর মুখের দিকে তাকালো ইতমিনান। সময় ব্যয় না করে বলল, “ইনশাআল্লাহ্।”
সেই ক্ষণে আয়েশার ডাক শোনা গেলো। সবাইকে খেতে ডাকছেন তিনি।

.

ভাতের দানা নেড়েচেড়ে ধোঁয়া ওঠা ভাতকে ঠান্ডা বানিয়ে ফেলেছে ইতমিনান। কিছুক্ষণ পরপরই রাবেয়ার দিকে তাকাচ্ছে সে। তিনি নিশ্চিন্ত মনে ভাজি খেলেন। তারপর ইলিশ মাছের লেজ নিয়ে মনের সুখে কাঁটা বাছতে শুরু করলেন। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে ইতমিনান। রাবেয়া চোখ তুললেই ইশারা করলো সে। কিন্তু তিনি নির্বিকার। ওদিকে আয়েশাকে বকেই চলেছেন মকবুল আলী।

“তোমার মেয়ে আমার ফোন ধরছে না কেনো? আগে থেকে ফোন দিয়ে সাবধান করে দিয়েছো না? কোনোদিন ধরবে না নাকি?”
“চেঁচামেচি করবে না তো। তোমার মেয়ে তোমার মেয়ে কি? মেয়ে কি আমার একার? তোমার না? মেয়ে দেখেছে, পছন্দ হয়নি, শেষ। এতো হামতাম করার কি আছে?”
“তা যদি বুঝতেই তাহলে আজকে আর ঐ বাড়িতে যেতে হতো না।” মুখ ঘুরিয়ে নিলেন মকবুল আলী। রাবেয়া বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললেন, “আহ! কি শুরু করেছেন আপনারা? দেখছেন না কাঁটা বাছছি? একটা ভেতরে ঢুকলেই তো বাড়িতে সে আসবে। আমাকে ওপারে পাঠানোর ধান্দা বন্ধ করো। তুই খাচ্ছিস না কেনো? বড়লোক মেয়ের শোকে গলা দিয়ে ভাত নামছে না?”
মকবুল আলী বোনের দিকে চেয়ে রইলেন। ইতমিনান থতমত খেয়ে গেল। রাবেয়া আরেক লোকমা ভাত খেয়ে বললেন, “শোনেন ভাবি মেয়ে আনতে হবে সমান ঘরের থেকে। কমও না, বেশিও না। সমান সমান। তাহলে শ্বশুর বাড়িকে নিচু করে দেখতে পারবে না আবার তাকেও নিচু হয়ে থাকতে হবে না।”
“তাই করতে হবে।” আয়েশা ননদের পাশে বসলেন।
“আমার কাছে এমন মেয়ের খোঁজ আছে।” পানির গ্লাস হাতে নিলেন রাবেয়া। ইতমিনানের কাশি শুরু হয়ে গেলো। আয়েশা তড়িঘড়ি করে ছেলের দিকে পানি এগিয়ে দিলেন। রাবেয়া চোখ রাঙালেন। ভীতুর ডিম একটা!
মকবুল আলীকে উৎসুক দেখা গেলো, “কে? তোদের ঐদিকে?”
“মেয়ে মানুষের খোঁজ। দেবো ভাইজান?” স্পষ্ট খোঁচাটা গিলে নিলেন মকবুল আলী। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই আয়েশা হেসে ফেললেন।
“বল।” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মকবুল আলী। রাবেয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, “মালিহা। আমাদের মালিহা।”
আয়েশার হাত চট করে থেমে গেলো। মকবুল আলী চোখ বড় করে তাকালেন বোনের দিকে। আড়চোখে সকলকে পরোখ করে নিলো ইতমিনান। সন্তর্পনে এক লোকমা ভাত মুখে দিলো।
“কি বললে রাবেয়া?”
“একদম সমান সমান ভাবি। না কম, না বেশি। খাপে খাপ মিলে যাবে।”
“যা বলছো ভেবে বলছো রাবেয়া?” আয়েশার গম্ভীর কণ্ঠে রাবেয়া গলা খাঁকারি দিলেন।
“হ্যাঁ ভাবি। সব বাদ দিন। মেয়েটা তো খারাপ না বলুন?”
“ওকে খারাপ ভালো কোনো কিছু ভাবার দরকার নেই। দুনিয়ায় মেয়ের কি অভাব পড়েছে?”
“তা পড়েনি। কিন্তু আপনার ছেলের মন মালিহার ওপরই পড়েছে।”
তৎক্ষণাৎ ছেলের দিকে তাকালেন তিনি। ইতমিনান চোখমুখ খিচে বসে ছিল। এই পর্যায়ে চোখ খুললো। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও সে জানে তার ভেতরে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
“রাবেয়া কি বলছে ইতু?”
ইতমিনান বার দুয়েক কাশলো বটে কিন্তু কিছু বলতে পারলো না।
“তুই মালিহাকে পছন্দ করিস?”
ইতমিনান মাথা নিচু করে ছিল। এই পর্যায়ে মায়ের চোখে চোখ রাখল। ছেলের সেই নীরবতার ভাষা পড়তে আয়েশাকে বেগ পেতে হলো না। মেয়ের আশঙ্কাকে সত্যি হতে দেখে আ’হত হলেন তিনি। তার মনে হলো ছেলে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
“তুই জানিস আমি ওদের পছন্দ করি না।” চুপ করে রইলো ইতমিনান। মন তো সে ইচ্ছে করে দেয়নি। কোনোদিন ভাবেইনি এই পরিস্থিতিতে তাকে পড়তে হবে।
আয়েশা উঠে ঘরে চলে গেলেন। তার আধ খাওয়া প্লেট পড়ে রইলো টেবিলে। রাবেয়ার খাওয়া তখন শেষ। ভাতিজাকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, “ছুটে যাস না কেনো? এখন তোর কাজ।”
বাবার দিকে তাকালো ইতমিনান। মকবুল আলী স্তব্ধ হয়ে বসে সবটা শুনছিলেন। ইতমিনান বলল, “তোমারও কি একই মত বাবা?”
মকবুল আলী ছেলের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, “এই কথাটা তো আমার মাথায়ই আসেনি! যা মা’র কাছে যা। কেমন ছেলে হয়েছিস দেখি।” বাবার সমর্থনে যেনো শক্তি পেলো ইতমিনান। প্লেট নিয়ে ছুটে গেলো মায়ের কাছে। আয়েশা গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছেন। ইতমিনান কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, “ওকে আমি কখনোই মানব না। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে চাইলে আমাকে বাদ দিতে হবে।”
উচ্ছল হাতটা থেমে গেলো। ইতমিনান বুঝলো পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৮

তিন ঢোকে বোতল খালি করে ফেললো ইতমিনান। ছুড়ে দিলো রাস্তার একপাশে পড়ে থাকা ভগ্নপ্রায় ডাস্টবিনে। মানিককে বলল, “একটা স্কুলে ভর্তি হও মানিক।”
“কি করতে?”
“পড়াশোনা শিখবা।”
“দরকার নাই। পড়াশোনা শিখলে মানুষ নিজেরে নিয়া অহংকার করে।”
“সবাই করে না। আমিও কিন্তু পড়াশোনা করেছি। তোমার কি আমাকে অহংকারী মনে হয়?”
এই যাত্রায় মানিক চুপ করে গেলো। ঘাড় চুলকে বলল, “পড়াশোনা তো ম্যালা কঠিন।”
“সব কাজই কম বেশি কঠিন। সারা দিন রোদে ঘুরে ভাঙা বোতল, প্লাস্টিক খোঁজা কঠিন, সামান্য একটা সাইনবোর্ডের কাগজকে সম্বল করে রাত কাটানোও কঠিন। অনেকের জন্য এক ঘুমে রাত কাবার করাও কঠিন। পৃথিবী দেখতে সহজ, টিকে থাকতে কঠিন।”
এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল ইতমিনান। মানিক চোখ বড় করে বলল, “আপনে দেখি জ্ঞানও দিতে পারেন।”
“কেনো আমাকে কি তোমার অজ্ঞ মূর্খ মনে হয়?”
“পাগল মনে হয়। কুত্তার নাম ঠিক করতে যেই ব্যাডা মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারে তারে আমার আস্তা পাগল মনে হয়।”
“প্রেস্টিজ তো আর রাখলে না মানিক। এমনিতেই বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। তুমি এসব কথা বললে তো নিজের উপর আর কনফিডেন্সও থাকবে না।” কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল ইতমিনান।
“আমার কারবার সব পাগল মাইনষের সাথেই হওন লাগে। হোটেলে পাইসি এক মিন্টু।”
“কেনো মিন্টু কি করেছে?”
“এতো কিসু আপনের জানা লাগবো না।”
মাগরিবের আযান দিতে শুরু করেছে। হঠাৎ কি মনে করে ইতমিনান বলল, “মানিক চলো মসজিদে যাই।”
ভুরু কুঁচকে মানিক বলল, “কি করতে?”
“নামাজ পড়তে। আবার কি করতে?”
“আমারে সহি সালামতে দ্যাখলে আপনের ভাল্লাগে না? আবার ‘মাইর খাইতে আমি যাই আর কি।”
“দেখি আজকে কে মা’রে। চলো!”
মানিকের হাত টেনে নিয়ে গেলো ইতমিনান। লালপাহাড় মসজিদের বাইরে জুতোর সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। ওজুখানায় মানিককে দেখে অনেকে আড়চোখে তাকালো। উদাম গা। রোদ পড়া রুগ্ন দেহের ভেতরে আবদ্ধ বুকের খাঁচা স্পষ্ট। চোখেমুখে রুক্ষতা। চুল এলোমেলো। পরনে ময়লা প্যান্ট। হাঁটুর বেশ খানেক নিচে তার অবস্থান। এদিক ওদিক অগুণিত ছেড়া।
মুসল্লিরা একে একে কাতারে দাঁড়াচ্ছে। মানিককে পাশে নিয়ে দাঁড়ালো ইতমিনান। অনেকে এসে ইতস্তত করছে। এমন ছেলের পাশে দাঁড়ালে গায়ে ময়লা লেগে যাবে। চকচকে পাঞ্জাবিতে ময়লার দাগ কে-ই বা চায়। তবে তার পাশ ঘেষে দাঁড়ানো শার্ট প্যান্ট পরিহিত যুবকের দিকে তাকিয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস করছে না। ছেলেটার ঘূর্ণায়মান চোখ দুটোই বলে দিচ্ছে সে যে ছেলেটার অভিভাবক। হঠাৎ বছর চারের এক বাচ্চা ছেলে এসে মানিকের পাশে দাঁড়ালো। মুখ ঘুরিয়ে মানিককে দেখে চওড়া একটা হাসি দিলো। তবে সেটা স্থায়ী হলো না। সম্ভবত সম্পর্কে ছেলেটার দাদা লোকটি তাকে বকতে বকতে সরিয়ে নিলেন।
“আগে আগে দৌড়ে গেছো কেনো? আমার সাথে দাঁড়াতে বলেছে না তোমার মা? যার তার সাথে দাঁড়ালেই হলো?”
মানিক অবশ্য কষ্ট পেলো না। এসব শুনতে শুনতে এখন আর গায়ে লাগে না। তবে ইতমিনান লোকটাকে দেখলো। শুভ্র দাঁড়ি মুখে। মাথায় টুপি। বাহ্যিক আবরণে মুসলমান বুঝতে ভুল হয় না। কিন্তু ভেতরটা?
ইকামতের পর সকলে নামাজ শুরু করলো। মানিকের পাশটা খালি পড়ে রইলো। অথচ পেছনের কাতার ভরপুর।
ফরজ নামাজ শেষে ইমাম সাহেব বললেন, “সুন্নত পড়ে আপনারা চলে যাবেন না। খুব বেশি তাড়া না থাকলে একটু দাঁড়াবেন। পাঁচটা মিনিট আপনাদের থেকে নেবো।”
বয়সে বৃদ্ধ, মর্যাদায় অধিষ্ঠিত লোকটার কথা সবাই শুনলো। সুন্নত শেষে কাউকে বের হতে দেখা গেলো না। ইমাম সাহেব সান্ধ্য জিকির সংক্ষিপ্ত করে বললেন, “ইসলামের প্রাথমিক যুগের গল্প আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি। সেগুলো শুনে সেই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের বিস্ময় জন্ম নেয়। মনে হয়, আহা একবার যদি তাদের সাথে দেখা করতে পারতাম। রূপকথার চরিত্রের মতো মানুষগুলোকে কি শুধু তখনই আমাদের মনে পড়ে? অন্য সময় কি ভুলে যাই?”
কয়েকজন মাথা নাড়লেন। না তারা ভোলেন না।
“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনারা ভুলে যান। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক দরিদ্র সাহাবী ছিলেন। সেই দরিদ্রের নমুনা জানেন? অনেকের নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত, এই লজ্জাস্থান ঢাকার এক টুকরো কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। নবীজী কি তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন? নাকি বলেছিলেন ওরকম পোশাক পড়ে মসজিদে যাওয়া নিষেধ অথবা তার মজলিশে? বলেননি। বরঞ্চ তাঁর আশপাশে এমন লোকের আধিক্য ছিলো। মক্কার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত বংশের, পৃথীবির শ্রেষ্ঠ মানুষটার চলাফেরা এঁদের সাথেই ছিলো। আমরা করা নিজেদের তাঁর অনুসারী দাবি করছি তাদের আশপাশে এমন লোকেরা ভিড়তে ভয় পায় কেনো? আপনারা ভাববেন। যতদিনই লাগুক না কেন ভাবনা শেষ হতে। ভাববেন। আপনাদের কাছে আমার আর্জি।”
ইমাম সাহেব কাউকে কটাক্ষ করলেন না। কোনো কটু বাক্য বললেন না। কিন্তু উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের দৃষ্টি গেলো মানিকের পাশের ফাঁকা কাতারের দিকে।
এক এক করে মানুষ বের হতে লাগলো। ইতমিনান দেখলো মানিক কখন যেনো ইমাম সাহেব কাছে চলে গেছে। কতক্ষন কথা বলল তারপর নিজেই ফিরে এলো।
“কি হয়েছে?”
“হুজুররে এট্টু টেশ করতে গেসিলাম। পাশ করছে।” নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল মানিক।
“কি টেস্ট?”
“বান্দায় বিরাট ভাষণ দিলো তাই দ্যাখতে গেলাম তার মনের ভিত্রে কি আছে। কইলাম আমারে আরবী শিখাইতে পারবেন? ট্যাকা পয়সা আমার নাই। দিতেও পারমু না।”
ইতমিনান আগ্রহ করে বলল, “কি বললেন?”
“খুশি খুশি রাজি হইসে। শালা নিজের ঘাড়ে নিজে বোঝা নিসি। বেশি বুঝলে যা হয়।” মানিক বিরক্ত হলো। সেই পড়াশোনাই তাকে এখন করতে হবে। তবে ইতমিনান উৎফুল্ল হয়ে ইমাম সাহেবের কাছে ছুটে গেলো। অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরে বলল, “ধন্যবাদ চাচা। অনেক ধন্যবাদ।” বলেই আবার মানিকের কাছে চলে এলো। ভদ্রলোক থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

মিতুল কলকল করে কথা বলছে। মালিহা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। কতদিন পর ভাইটাকে এমন খুশি হতে দেখছে! এক পর্যায়ে নাজিয়া ফোন নিলেন।
“মালিহা তোর চাচা বলছে ওদিকে না যেতে। বাড়ি চলে যেতে। তুই কি বলিস?”
“তুমি থাকতে পারবে মা?”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাজিয়া বললেন, “ওখানে গেলে তো আর তোর বাবাকে পাবো না। এখানেও পাবো না। একই বিষয়।”
মালিহা চুপ করে গেলো। এর বিপরীতে দেয়ার মতো কোনো স্বান্তনা তার জানা নেই।
“কালকে এগারো হাজার টাকা পাঠাবো মা। ইনশাআল্লাহ্।”
“টাকা নিয়ে সমস্যা হবে না মনে হয়। তোর চাচা আজকে মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে গেলো। ধান তোলার সময়ও এসেছে।”
“তাও রেখে দাও। যদি লাগে।”
“আচ্ছা। তোর ছুটি কবে?”
মালিহার বুকটা জুড়িয়ে গেলো। কতদিন পর মা এতো আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছে।
“আর দুইটা ক্লাস হবে। কিন্তু স্টুডেন্টদের তো এখুনি ছুটি দিতে পারব না। আর কয়েকটা দিন পড়াতে হবে।”
“বেশি ছুটোছুটি করিস না। আল্লাহ যেটুকু ভাগ্যে রেখেছেন তাই যথেষ্ট। রাখি।”
বহুদিন পর মালিহার বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেলো। মনে হলো নাজিয়ার মনটা যেনো একটু নরম হয়েছে। আশপাশ নিয়ে যেনো চিন্তা করতে শুরু করেছে। মালিহা কায়মনো বাক্যে রবের কাছে প্রার্থনা করল, তার মায়ের দুঃখের ভার যেনো রব কমিয়ে দেন।

মালিহা ঘুমাতে গেলো প্রশান্ত মন নিয়ে। শুতে যাওয়ার আগে আঁখির কাছে শুনলো তুষারের খবর। আঁখির ভাষ্যমতে সে ম’রতে ম’রতে বেঁচে ফিরেছে। হয়তো পথ পাল্টানোর একটা সুযোগ। কে জানে সে বুঝবে কি না..

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৯

বইয়ের উপর মাথা রেখে ঝিমুচ্ছিল মালিহা। ফোনের শব্দে ধড়ফড় করে উঠলো। নাজিফা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ফিসফিস করে বলল, “এই মালিহা! রুমে আছো?”
“আছি।”
“একটু আসলাম।”
দরজা খুলে ঢুকে পড়ল নাজিফা।
“তুমি কি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলে?”
“হ্যাঁ।”
“বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোন দিলে!”
“হু। একটা বিপদে পড়েছি। আজকে দুপুরের ক্লাসের শেষ একদম ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। কি যে করিয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না। কয়েকজনের নোট দেখলাম কিন্তু সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। একটু হেল্প করবে?”
“অবশ্যই। দাঁড়িয়ে আছো কেনো বসো।”
টেবিল থেকে নোট খাতা টেনে নিলো মালিহা। খুঁজে খুঁজে আজকের লেকচার বের করলো।
“কোন জায়গাটা বোঝোনি?”
“শেষের দুইটা টপিক।”
“আচ্ছা। তোমার খাতাটা দাও। লিখে বোঝাই।” মাথা নেড়ে বলল মালিহা। তার চোখমুখ থেকে ঘুম উধাও। নাজিফা চটপট খাতা বাড়িয়ে দিলো। টানা বিশ মিনিটের মাথায় টপিক দুটো শেষ হলো। নাজিফা বলল, “আমি একটা সলভ করি। তুমি দেখো।”
“আচ্ছা করো।”
কয়েক জায়গায় ভুল করলো নাজিফা। মালিহা আবার বোঝাল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দশটা পার হয়েছে। নাজিফাকে বলল, “তুমি একটু ট্রাই করো। আমি নামাজটা পড়ে আসি।”
“এখনও পড়নি?”
“না।”
“দ্রুত যাও।”
ওড়না গায়ে জড়িয়ে দরজার কাছে গেলো মালিহা। কি মনে করে পেছন ঘুরল। মনিকা ঘুমাচ্ছে। একটু পর উঠে পড়তে শুরু করবে। আঁখি কানে হেডফোন দিয়ে বসে আছে। ধীর পায়ে আঁখির সামনে যেয়ে দাঁড়ালো মালিহা। আঁখি একবার দেখে হেডফোন সরিয়ে বলল, “কিছু বলবে?”
“জি আপু। আপনার নামাজ পড়া হয়ে গেছে?”
“না।” মাথা নাড়ল আঁখি।
“তাহলে চলুন একসাথে পড়ি।”
আঁখি কথায় কথায় রাগ করা ধরনের মেয়ে নয়। তাকে যেকোনো কথা ভয় ছাড়াই বলা যায়। কাজেই প্রথম বারের মতো কাজটা করতে মালিহার ভয় লাগলো না।
কিন্তু আঁখি বেশ অবাক হলো। কারণ প্রায় দুই বছরের এই দীর্ঘ সময়ে মালিহা কখনও এমন কথা বলেনি। কালে ভদ্রে সে নামাজে দাঁড়ায়। মালিহা নিয়মিতই পড়ে বলতে গেলে। কিন্তু কখনও তাকে ডাকেনি। তাই অবাক চোখেই মালিহার দিকে তাকিয়ে রইলো আঁখি। মালিহা ইতস্তত করে বলল, “কিছু মনে করলেন আপু?”
“না। তবে হঠাৎ বললে তাই একটু অবাক হয়েছি।”
“ওহ। পড়বেন না আপু?”
“তুমি পড় মালিহা।” শান্ত কণ্ঠে বলে হেডফোন দিয়ে কান ঢেকে দিলো আঁখি। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ল্যাপটপ স্ক্রিনে। মালিহা নড়লো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু বললোও না। আঁখি নিজেই কিছুক্ষণ পর বলল, “কি হবে নামাজ পড়ে মালিহা? এলোমেলো জীবন গুছিয়ে যাবে? কতদিন তো পড়ে দেখেছি। কিছুই তো হলো না। নামাজ আমার মতো মানুষের জন্য না বুঝলে।” কি বোর্ডে খটখট করতে করতে বলল আঁখি। একবারও তাকালো না মালিহার দিকে। মালিহাকে বুঝি আঁখির দুঃখগুলো ছুঁয়ে গেলো। কিন্তু স্বান্তনা স্বরূপ কিছুই বলতে পারলো না সে। দাঁড়িয়ে রইলো আগের মতো করেই।
“আসসালামু আলাইকুম আপু!” নতুন কণ্ঠের দিকে তাকালো আঁখি। মেয়েটার মুখ চেনা তবে পরিচিত নয়।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
“আমি নাজিফা তাবাচ্ছুম। ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনমিক্স, সেকেন্ড ইয়ার।”
মাথা নাড়ল আঁখি, “কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। বেয়াদবি নেবেন না আপু। আপনার সাথে কি একটু কথা বলা যাবে?”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে হেডফোন খুলে রাখলো আঁখি। নাজিফা ইতস্তত করে বলল, “সরি আপু। আপনার কাজে বিরক্ত করলাম।”
“সমস্যা নেই। বসো। মালিহা বসো।”
নাজিফাকে কথা বলতে দেখেই মালিহার মনে হয়েছে সে কিছু একটা ভেবেছে। তার থাকার দরকার নেই। সে বলল, “আমি নামাজটা পড়ে আসি। আপনারা গল্প করুন।”
রুম থেকে বের হয়ে গেলো মালিহা। রুমে রয়ে গেলো তিনটি নিশ্চুপ প্রাণী।
কণ্ঠে যতোটা সম্ভব মায়া, বিনয় ঢেলে ধীর স্বরে নাজিফা বলল, “আপনার কি আল্লাহর প্রতি অনেক অভিযোগ আপু?”
আঁখি চুপ করে বসে ছিল। নাজিফার কথায় তার মুখের দিকে তাকালো। কাষ্ঠ হেসে বলল, “আমার কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। যার ভাগ্য খারাপ তার কোনো অভিযোগ থাকা না থাকা সমান।”
“ভাগ্য খারাপ হলে আপনি এখন হাসপতালের বিছানায় থাকতে পারতেন, অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া নিশ্বাস নিতে পারতেন না, কোমায়ও থাকতে পারতেন, আপনার বাবা মা’রা যেতে পরতো, মা প্যারালাইজড হতে পারতো। তেমন কি কিছু হয়েছে?
“তুলনা দিচ্ছো?”
“আপনি তুলনা করে ভাগ্যকে খারাপ বললেন। আমি তুলনা করেই দেখালাম সেটা এতটাও খারাপ নয়।”
আঁখি চুপ করে রইলো। তার মনের গভীরের কষ্টের কথা নাজিফা জানলো না। কিছু বললোও না। বসে রইলো এই আশায় আঁখি কিছু বলবে।
মনিকা পাশ ফিরলো। বিছানা থেকে মোটা একটা বই মেঝতে পড়ে গেলো। সেই শব্দে আঁখি বার কয়েক চোখের পলক ফেললো। নাজিফা হঠাৎ খেয়াল করলো আঁখির চোখদুটো দেখলেই তার মনের অবস্থা যেনো পরিষ্কার বোঝা যায়। টলটলে আঁখি জোড়ায় অভিমানের ঢেউ। না পাওয়ার বেদনা। কি গভীর দুঃখ!
“নামাজ পড়ে কি করবো? আল্লাহকে ডেকেই বা কি করবো? তিনি তো আমার ডাকে সাড়া দেন না।”
“এটা একটা কথা বললেন আপু! আল্লাহ সবসময় জেগে আছেন। তিনি সর্বত্তোম শ্রোতা। আপনি যেভাবে তাঁকে ডাকবেন তিনি সেভাবে আপনাকে স্মরণ করবেন। আপনি আল্লাহকে মনে মনে ডাকলে আল্লাহও আপনাকে মনে মনে স্মরণ করবেন। আপনি যদি মুখে বলে ডাকেন তিনিও আপনাকে সেভাবেই ডাকবেন। এক শাইখের লেকচারে একবার শুনেছিলাম, যখনই কোনো বান্দা আল্লাহকে ডাকে তখনই তিনি লাব্বাইক বলে সাড়া দেন। নেককার, নামাজী, রোজাদার কোনো ব্যক্তি একবার আল্লাহকে ডাকলে তিনিও একবার লাব্বাইক বলেন। কিন্তু কোনো গুনাহগার ব্যক্তি একবার ডাকলে আল্লাহ তিনবার বলেন। লাব্বাইক, লাব্বাইক, লাব্বাইক। কেনো এই পার্থক্য বলুন তো?”
আঁখি এক মনে শুনছিলো। নাজিফা বুঝলো না সে বিরক্ত হচ্ছে কি না। আঁখি বলল, “জানি না।”
“নেককার ব্যক্তির নিজের নেক আমলের উপর ভরসা থাকে যে হয়তো সেগুলোর উসিলায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু গুনাহগার ব্যক্তির সেই ভরসা নেই। আল্লাহর রহমত তার একমাত্র ভরসা। আল্লাহ বলেন আমি তাকে কিভাবে ফিরিয়ে দিই? আপনি ডাকতে চাইছেন না অথচ আল্লাহ আপনার ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
আঁখির নেত্রপল্লব কেঁপে উঠল। নাজিফা হেসে বলল, “আল্লাহ আমাদের সবচেয়ে নিকটে কখন থাকে জানেন? নামাজের সময়। সেসময় বান্দা এবং তার রবের মাঝে কোনো পর্দা থাকে না। বুঝতে পারছেন আপু? আল্লাহ আমাদের কণ্ঠনালীর চেয়েও বেশি কাছে থাকেন। একবার ভাবুন!”
আঁখি মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। নাজিফা কিছু বলল না। একবার দরজার দিকে তাকালো। মালিহা হারিয়ে গেলো নাকি!
“কিন্তু আল্লাহ তো আমার ডাকে সাড়া দেন না। আমাকে মনে হয় তিনি ভালোবাসেন না।”
মিষ্টি হেসে নাজিফা বলল, “ডাক্তার ওষুধ দেয়ার সময় বারবার বলে দেন ডোজ কমপ্লিট করতে। আমরা ধৈর্য ধরে সেটা করি। স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টের রেজাল্ট পেতে হলে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু এই বেলায়ই আমরা কেনো অধৈর্য্য হয়ে পড়ি? মায়ের চেয়ে এমনকি নিজের চেয়েও যিনি আমাদের বেশি ভালোবাসেন তিনি কি আমাদের ডাক শোনেন না? অবশ্যই শোনেন। তিনি আপনাকে ভালো না বাসলে আপনি এখন আল্লাহর সম্পর্কে শুনতেই পেতেন না আপু। এই যে আপনি শুনতে পারছেন অনেকে সেই সুযোগটুকুও পায় না। আমরা ভাবি আমরা নামাজ পড়ছি না আল্লাহ তো আমাদের কোনো শাস্তি দিচ্ছেন না। অথচ আমরা বুঝি না দিনে পাঁচবার তাঁর সাথে কথা বলার, সাক্ষাৎ করার সুযোগ আমরা পাচ্ছি না। তাঁকে একটা সিজদাহ আমরা দিতে পারছি না। এটা কি শাস্তি না?”
উঠে দাঁড়ালো নাজিফা। আঁখির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি ভাবুন আপু। মন দিয়ে ভাবুন। যে আপনার সবচেয়ে আপন তাঁর সাথে আপনার কেনো এই দূরত্ব। আসি। অনেক বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না।”
নাজিফা চলে গেলো। মালিহার খাতায় ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে রাখলো।
“তুমি তো লাপাত্তা হয়ে গেলে মালিহা। আমি টপিক বুঝেছি। এর বিনিময়ে তোমাকে ধন্যবাদ দেবো না। আল্লাহকে বলবো যেনো তিনি তোমাকে এর বেস্ট বিনিময় দান করেন। চলে গেলাম।”
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলো নাজিফা। আঁখি বসে রইলো। নড়চড়হিন অবস্থায়। সে অনুভব করছে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। জং ধরা হৃদয়ে টোকা লেগেছে। ঝরঝরিয়ে মরচে পড়ে যাচ্ছে। ঝাঁকি লাগছে মস্তিষ্কে। চোখে মুখে পানি দিতে গেলো আঁখি। অথচ সে বুঝলোই না কখন ওযু করে দাঁড়িয়ে পড়ল বাধ্য বান্দার মতো।

তিশাকে আজ দেখাচ্ছে প্রথম দিনের মতো। চুপচাপ। পাঁচটা কথা বললে একটা উত্তর দিচ্ছে। মালিহার কষ্ট হলো। মেয়েটা এমন মনম’রা হয়ে আছে কেনো।
“তিশা তোমার কি মনে খারাপ?”
“কথা বলো তিশা।”
“না মিস। মন খারাপ না।”
“তাহলে শরীর?”
“না।”
“তাহলে কি হয়েছে।”
বিষণ্ন কণ্ঠে তিশা বলল, “আমি ভালো মার্ক পাই না কেনো মিস? ভালো মার্ক না পেলে আম্মু আমাকে ভালবাসে না।”
“আম্মু তোমাকে সবসময় ভালোবাসে। কিন্তু বেশি মার্ক পেলে একটু খুশি হয়। এই যা।”
“না মিস। আপনি জানেন না তাই বলছেন। যেদিন কম মার্ক পাই আম্মু আমার সাথে কথা বলে না, আমাকে ভাত বেড়ে দেয় না। আমার দিকে তাকায়ও না। বেশি খারাপ করলে অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে। আমার খুব কষ্ট হয় মিস।” ফুপিয়ে উঠলো তিশা। মালিহার বুকটা ধুক করে উঠলো। এটুকু মেয়ে কতোটা কষ্ট বুকে চেপে আছে। তিশার মাথায় হাত দিয়ে এক হাতে তাক কাছে টেনে নিলো মালিহা।
“কেদো না তিশা। আমি তোমার আম্মুকে বলব যেনো এরকম না করেন। তিশা যে কতো সুন্দর পড়াশোনা পারে এটা তো তিনি জানেন না। কান্না থামাও তিশা।”
তিশা চোখ মুছলো। মালিহা বলল, “তোমার “গোল্ডেন বার্ড” গল্পটা পড়েছি। আমার তো মনে হচ্ছে তুমি কোনো বই থেকে কপি করেছো।”
“কপি করিনি মিস। একদিন আমি স্বপ্নে একটা সোনালী পাখি দেখেছিলাম। সেটাকে নিয়েই লিখেছি।”
উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে মালিহা বলল, “দারুন হয়েছে তিশা। এটা তো ম্যাগাজিনে দিলে প্রথমবারেই ছেপে দেবে।”
“আমার লেখা ছাপাবে?”
“ছাপাবে না কেনো? এতো সুন্দর লেখা যার ভালো লাগে না তার চোখ নষ্ট, মাথা নষ্ট।”
তিশা হেসে ফেললো, “লেখা পাঠায় কিভাবে মিস?”
“আমি পাঠিয়ে দেবো। কোনো চিন্তা নেই। তুমি শুধু মন ভালো করে থাকো। একটু হাসো তো।”
তিশা হাসলো। মালিহা চেয়ে দেখলো সেই মায়াবী মুখের হাসি।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মালিহা। দিনের দুই প্রান্তে দুটো বাচ্চা পড়ায় সে। একজন বাবা মায়ের আহ্লাদী কন্যা। অথচ তাদের প্রতি মেয়েটার কোনো টান নেই। মালিহা অবাক হয়ে দেখেছিল লামিয়ার দুই ঘণ্টার দীর্ঘ বকবকানির মাঝে কোথাও তার বাবা মা নেই। অথচ তারা মেয়ের মুখ থেকে ডাকটা শুনতেই মুখিয়ে থাকে। আর একজন এই তিশা। মেয়েটা শুধু মায়ের ভালোবাসা চায়। অথচ তিনি সংখ্যায় লেখা মেধার মানের আড়ালে নিজের ভালোবাসা চাপা দিয়ে বসে আছেন। পৃথিবী বড়ই বিচিত্রময়!

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪০

কাঁধের ওপর লাগানো ওড়নার সেফটিপিন আরেকবার দেখে নিলো রিপা। ডান হাতে ঘড়ি পড়ে চটপট চুল আঁচড়ে নিলো। লামিয়ার বাবা ডাকছে। কোনরকমে লাইট ফ্যান অফ করে ছুটলো ড্রয়িং রুমে। লামিয়া ওখানেই পড়ে।
মালিহার ধারণার চেয়েও লামিয়া একটু বেশি চটপটে। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ সব লিখতে পারে। কিন্তু সংখ্যার দিক দিয়ে একটু পিছিয়ে আছে। মালিহা বলল, “লামি দশ থেকে বলতে শুরু করো।”
“ভুল হলে কি করবে?”
“আবার পড়াবো।”
“আচ্ছা।” ঘাড় কাত করলো লামিয়া। চোখ বন্ধ করে বলতে শুরু করল, “দশ, এগারো, বারো, তেরো..”
মালিহা চুপ করে আছে। লামিয়া একটু পর চোখ খুলে ঠোঁট উল্টে বলল, “ভুলে গেছি।”
“তিনের পরে কতো?”
“চার।”
“চারের প্রথম অক্ষর কী?”
“চ।”
“তেরোর পর চৌদ্দ। তেরোর প্রথমে ত চৌদ্দর প্রথমে চ। একই না?”
“তাই তো!” লাফিয়ে উঠলো লামিয়া।
“লাফালাফি করে না। চেয়ার থেকে পড়ে গেলে তখন বুকরি হয়ে যেতে হবে?”
“বুকরি আবার কি?”
“দাঁত পড়ে গেলে তো বুকরিই বলে।”
“না না! আমার দাঁত পড়ে গেলে চকলেট খাবো কী দিয়ে? লাফানো যাবে না।” মুখের উপর দুই হাত রেখে বলল লামিয়া।
“আচ্ছা এবার পড়।”
“ত চ প।”
“এগুলো কি?”
“মিলিয়ে নিলাম। এবার পড়ছি। তিন, চার, পাঁচ। তেরো চৌদ্দ, পনেরো। কিন্তু পাঁচের পরে ছয়। পনেরোর পরে ষোল কেনো? ছ আর ষ এবার মেলাবো কিভাবে?” বইয়ে আঙুল রেখে বলল লামিয়া।
মালিহা হাফ ছাড়লো। দুই দিনেই সে বুঝে গেছে আগের টিচারগুলো কেনো দশ হাজার টাকা রেখেও চলে গেছে। বিড়বিড় করলো মালিহা, “হে আল্লাহ্! আমাকে ধৈর্য দান করো।”
সেই ক্ষণে ছুটে এলো রিপা। লামিয়াকে কোলে নিয়ে বলল, “মিসকে বিরক্ত করছো?” মেয়ের গালে চুমু দিল রিপা। লামিয়া বিরক্ত হলো। মুখ কুঁচকে বলল, “আমি ভালো মেয়ে। মিসকে বিরক্ত করবো কেনো?”
মালিহা হাসলো, “ও তেমন দুষ্টুমি করে না।”
“মুখ তো থামে না। দুষ্টুমি করবে কখন?”
লামিয়াকে নামিয়ে বিদায় নিলো রিপা, “থাকো মালিহা। আসি।”
আশপাশে তাকালো মালিহা। ন্যানিকে দেখা যাচ্ছে না। দ্রুত পায়ে রিপার কাছে যেয়ে বলল, “আপা!”
“বলো মালিহা।” পেছন ঘুরল রিপা।
“কিছু মনে করবেন না। আসলে পড়ানোর সময় কেউ সামনে বসে থাকলে আমার একটু অকোয়ার্ড লাগে।” ইতস্তত করলো মালিহা।
“এভাবে বলছো কেনো? তোমার যেভাবে পড়িয়ে সুবিধা সেভাবে পড়াবে। আজ থেকে নাহয় লামিয়ার রুমে বসো। আমি বলে যাচ্ছি ঘর গুছিয়ে দিতে।”
“ইয়ে আপা.. ওর ন্যানিরা কেউ না থাকলেও ভালো হয়।”
এতক্ষণে বিষয়টা বুঝলো রিপা।
“ওহ! ওর কথা বলছো? আসলে ছোট থেকে মেয়েটাকে কাছে কাছে রেখেছে তো তাই কাছ ছাড়া করতে চায় না আর কি।”
“সেটাতে অবশ্যই আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যখন আমি পড়াবো তখন আমাকে আমার মতো করে পড়াতে দিতে হবে।” স্পষ্ট কন্ঠে বলল মালিহা। পূর্বের জড়তা ভাবটা আর নেই। তার বক্তব্য যে স্পষ্ট করে বলতে হবে এটা সে বুঝতে পেরেছে।
এক পলক মালিহাকে দেখে রিপা বলল, “আচ্ছা। আমি ওকে বলবো।”
মালিহাকে নিজে ঘরে নিয়ে গেলো লামিয়া। বেজায় খুশি সে। এক এক করে খেলনাগুলো বের করতে গেলে মালিহা তাকে আটকালো।
“এখন পড়ার সময়। পড়া শেষ করে তারপর সব খেলনা দেখবো।”
“প্রমিস?”
“হ্যাঁ।”
চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখলো মালিহা। প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট যে লামিয়া পায় এটা এই দুই দিনে বুঝেছে। কিন্তু তার পরিধি যে এতোটা সেটা বুঝতে পারেনি। একেক দেয়ালের রং একেক রকম। কিন্ত সবগুলোর মাঝে সূক্ষ্ম একটা মিল আছে। বিছানাটা রাজকীয় ধরনের। বারান্দায় বিশাল এক দোলনা উঁকি দিচ্ছে। এতো আয়োজন তবুও মেয়ের মনে তাদের জায়গা নেই কেনো?
“লামি!”
“হু।” মন দিয়ে লিখছে লামিয়া। মালিহা উৎসুক কণ্ঠে বলল, “তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? আব্বুকে নাকি আম্মুকে?”
“কাউকে না।” স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল লামিয়া।
“কেনো?”
“ওরা আমার সাথে খেলে না, গল্প করে না, ঘুমানোর সময় আদর করে না। শুধু মাঝে মাঝে এটা সেটা এনে দেয়। আমি জারা মামনিকে বেশি ভালোবাসি।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল, “সে কে?”
“তুমি তো চেনো। আমার সাথে সবসময় থাকে যে? সে। আমাকে অনেক আদর করে। কোনো বুয়া আমাকে মা’রলে তাদের অনেক বকা দেয়। জানো?”
মালিহা স্থির হয়ে বসে রইলো। বাবা মা দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত আর এদিকে তাদের মেয়েকে নিয়ে যে কাড়াকাড়ি চলছে সে বিষয়ে বেখবর। মালিহার মায়া হলো রিপার জন্য। সন্তানের মনের কোথাও যে বাবা মা থাকতে পারে না তাদের দুঃখ কি এই বিশাল অর্থ সম্পদ দিয়ে মেটে?

আজকে শেষ ক্লাস। তারপর পি এল শুরু। পূজার ছুটির সাথে মিলিয়ে সেটা বেশ কয়েকদিন গড়াবে। তারপরই ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। এখন পড়া একটু এগিয়ে না রাখলে তখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে হবে।
ক্লাস থেকে এসে সিলেবাস দেখছিল মালিহা। মোটামুটি অনেকটাই কভার করতে পেরেছে সে। যেটুকু বাকি আছে আশা করা যায় সেটা এই বন্ধের মাঝে পড়ে ফেলতে পারবে। হাফ ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। পেটে ভয়ংকর ক্ষুধা। কিন্তু শরীরে আলস্য ভর করেছে। ক্যান্টিন থেকে খাবার যে আনবে সেটাও মন চাইছে না।
এলোমেলো চিন্তা করতে করতেই চোখ লেগে এসেছিল মালিহার। কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে চোখ খুলল সে। মাথা উঠিয়ে তাকালো। মনিকা একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মনিকার মুখ উল্টো দিকে থাকায় মালিহা কিছু বুঝতে পারল না। মাথা নামিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার আগেই মনিকা এসে তাকে ধাক্কা দিলো।
“এই মালিহা! এই! ওঠ। আঁখি আপুর কি হয়েছে রে?”
মনিকার চোখ মুখ অবিশ্বাস। মালিহা কিছু বুঝলো না।
“কি হবে?”
“কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। ঐ দেখ!” একপাশে সরে গেলো মনিকা। মালিহা দেখলো আঁখি রুকু দিচ্ছে। হালকা একটা হাসি ফুটল তার ঠোটে।
“আঁখি আপু তো নামাজ পরে না সেভাবে। আজকে পড়ছে কেনো? কোনো বিপদে পড়েছে নাকি?”
“জানিনা তো। এমনিতেই পড়ছে মনে হয়।”
“যারা নিয়মিত পড়ে না তারা বিপদে পড়লেই পড়ে। দাঁড়া আপুর কাছেই শুনি। নামাজটা শেষ হোক।”
“কিন্তু যদি আপু ভাবে এবার থেকে নিয়মিত পড়বে তাহলে আপনি এই প্রশ্ন করলে আপুর খারাপ লাগবে।”
মনিকা ভাবলো। খারাপ লাগতে পারে।
“তাহলে শুনবো না?”
“থাক। কিছু বলার হলে আপু তো নিজে থেকেই আমাদের বলবে। নাহলে কিছুতেই বলবে না।”
“ঠিক বলেছিস।”
“আপু আগামী শুক্রবার নীতির আকদ।”
“কিহ! সত্যি?”
“হ্যাঁ। এখন বিয়ে পড়িয়ে রাখবে। পরে উঠিয়ে নেবে।”
মনিকার অস্থিরতা চোখে পড়ার মতো। যতটুকু জানে বলল মালিহা।
“তাহলে তো আমাদের গিফট টিফট কিছু দিতে হয়। কি দিবি তুই?”
“বুঝতে পারছি না। কি দিলে ভালো হয়?”
“ভালোর তো শেষ নেই। চল সবার টাকা মিলিয়ে কিছু দিই।”
“আচ্ছা আপনি ভাবুন কি দেয়া যায়। তারপর বলেন।”
“আমিও আছি কিন্তু!”
পেছন থেকে আঁখি বলল। মালিহা তাকিয়ে দেখলো চারপাশে কালি হয়ে যাওয়া চোখের উজ্জ্বলতা।

মালিহা যখন তিশার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে তখন আকাশে কালো মেঘ। তবুও সে উত্তেজিত তিশার সাথে দেখা করার জন্য। মেয়েটাকে বলতে হবে তার লেখা সে জমা দিয়ে দিয়েছে। মালিহার দৃঢ় বিশ্বাস লেখাটা ছাপাবেই। হয়তো দুইদিন পর।
ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করলো মালিহা। বেজেই চলেছে। মালিহার বিরক্ত লাগে ফোন ধরতে। ফোন জিনিসটাই তার কাছে ভালো লাগে না।
ইতমিনান ফোন দিয়েছে। সময় দেখলো মালিহা। অফিস বাদ দিয়ে ফোন নিয়ে কি করছে সে!
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কোথায় তুই?”
“রাস্তায়।”
“কই যাস?”
“পড়াতে।”
“ওহ। আচ্ছা শোন। লতা আপা তোকে দাওয়াত দিয়েছে।”
“কিসের দাওয়াত?”
“ছেলের আকিকার। এই শুক্রবারে। আমাকে বারবার বলেছে যেন তোকে নিয়ে যাই।”
মালিহা ইতস্তত করলো। গেলে তো কিছু না কিছু নিয়ে যেতে হবে। আজই সব টাকা পাঠিয়ে দিলো। আর আজই পর এক খরচে লিস্ট হাতে এসে উঠছে।
“আমি যেয়ে কি করবো? তোমার কলিগ তুমি যাও।”
“এসব কি কথা? রান্না বান্না করে খাইয়েছিস। ওরা তোকে দাওয়াত দিতেই পারে। রেডি থাকবি। বারোটার দিকে তোকে দিয়ে তারপর আমি জুমআ ধরবো।”
মালিহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেঁটে দিলো ইতমিনান। মালিহা ভাবলো ইরিনার কাছে ফোন দিয়ে টাকাটা চাইবে। নাহলে লতা আপার বাড়ি খালি হাতে যেতে হবে। তখনই ইরিনাকে ফোন দিলো সে।
“হ্যালো কে?”
“ইরিনা আমি মালিহা।”
“ওহ মালিহা। কেমন আছো?”
“এই তো ভালো। ক্লাসে আসছো না যে? অসুস্থ?”
“তা একটু।”
“ওহ। ইরিনা আমার টাকাটা কি আজ দিতে পারবে? একটু দরকার ছিল।”
“আমি তো হলে নেই। বাড়িতে এসেছি।”
“সমস্যা নেই আমি তোমার বাড়ি থেকেই নিয়ে আসবো নাহয়।”
“আচ্ছা। তিন রাস্তার মোড়ে এসে আমাকে ফোন দিও।”
“আচ্ছা। ধন্যবাদ ইরিনা। অনেক উপকার হলো।”
স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল মালিহা। টাকাটা আসলেই এখন দরকার।

মালিহা ভেবে রেখেছিল আজ আজিজার সাথে কথা বলবে। সেই অনুযায়ী তিশাকে পড়ানোর আগে আজিজার কাছে বলল, “ফুপু আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“বলো।” মালিহার বিপরীতে বসলেন আজিজা।
“তিশাকে আপনি কেমন ভাবেন আমি জানিনা। ও কিন্তু অনেক ট্যালেন্টেড। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ভয় পেয়ে যায়।” আজিজা কিছু বলছেন না, চুপ করে মালিহার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মালিহা আবার বলল, “পরীক্ষার বিষয়টাই ধরুন। যে প্রশ্নগুলো আসে সব ওর পড়া। আমি নিজে পড়িয়েছি, রিভাইজ করিয়েছি। কিন্তু পরীক্ষার হলে ও নার্ভাস হয়ে পড়ে এজন্য ঠিকঠাক লিখতে পারে না। মার্কও তুলতে পারে না। কিন্তু এজন্য আপনি যদি ওকে সাপোর্ট না করে উল্টো বকা দেন তাহলে সেটা ওর জন্য আরো কঠিন হয়ে যাবে।”
“কি বলতে চাও তুমি?”
“আপনি মা। ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ। সেই মানুষটার থেকে ও ভালোবাসা আশা করে, উৎসাহ আশা করে। আপনাকে খুশি দেখতে চায় তিশা। কিন্তু সেটা কখনোই পারে না বলে ও নিজে প্রতি ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছে। ওর মেন্টাল কন্ডিশন ভালো নেই।”
“আমি আমার মেয়ের সাথে কেমন ব্যবহার করব এটা তোমার থেকে শিখতে হবে?”
“ভুল বুঝবেন না ফুপু। আমি আপনার ছোট। কিন্তু কিছু বিষয় আপনি বুঝতে পারছেন না। এগুলোর ইফেক্ট সরাসরি তিশার উপরে পড়ছে। আপনি ওর..”
“তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি বেয়াদবি করছো? পারিবারিক বিষয়ে অনধিকার চর্চার অনুমতি তোমাকে কে দিয়েছে?”
“তিশা আমার স্টুডেন্ট। ওর ভালো মন্দের বিষয়টা আমি দেখব না?”
“না। তুমি আসবে, পড়াবে, চলে যাবে। এর বাইরের কিছু তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।”
দম ছেড়ে মালিহা বলল, “কি করলে ও ভালো করে পড়তে পারবে সেটাও চিন্তা করব না?”
আজিজকে চুপ দেখে মালিহা আবার বলল, “বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার কিছু অবুঝপনার জন্য তিশার ফিউচার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
এই পর্যায়ে আজিজা উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন, “তিশা অপেক্ষা করছে। যাও।”
আজিজা চলে যাওয়ার পরও মালিহা কিছুক্ষণ বসে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠলো তিশার ঘরে যাওয়ার জন্য। আর কি করতে পারে সে? কিন্তু সে জানলো না আগামীকাল তার জন্য কি অপেক্ষা করছে।

আকাশটা মেঘলা। যেকোনো সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। বিকেলের শেষ প্রান্ত হলেও মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে যেনো সময় আরো পেরিয়ে গেছে।
তিন রাস্তার মোড়ে এসে ইরিনাকে ফোন দিলো মালিহা। রিং বেজে বেজে ফোন কে’টে গেলো। আবার ফোন দিলো। এবার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। মালিহা ভাবলো নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়তো। জায়গা বদলে আরেক জায়গায় দাঁড়িয়ে ফোন দিলো সে। একই অবস্থা। সময় গড়ালো। মেঘ ঘনালো। অন্ধকার গাঢ় হয়ে রাত নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রকৃতির সাথে অন্ধকার হলো মালিহার মুখও। অযাচিত চিন্তারা হা’না দিল মন পাড়ায়। তাদের দুর করে দিতে চাইলো মালিহা। সম্ভব হলো না। ফোনের ভেতর থেকে যান্ত্রিক কণ্ঠ তখনও ইরিনার ব্যস্ততা জানান দিচ্ছে। হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো। অচেনা জায়গায় নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো মালিহার। লোকজন ছুটে এসে দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়াচ্ছে। একজন মহিলা জামা ঝাড়তে ঝাড়তে মালিহার পাশে এসে দাঁড়ালো। বৃষ্টি একভাবে ঝরেই চলেছে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। নিজের ফোন বন্ধ করলো মালিহা। পাশের মহিলার দিকে তাকালো। নরম কণ্ঠে বলল, “আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আপনার ফোন থেকে একটা কল দেয়া যাবে?”
মহিলা বিরক্ত মুখে সালামের উত্তর নিলো। মালিহার মনে হলো সে বোধহয় ফোন দিতে আগ্রহী নয়। বিষণ্ন দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো সে। হঠাৎ কথায় চমকে গেলো, “কি হলো নাও! ফোন চেয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে?”
মালিহা ফোন নিলো। কিন্তু কৃতজ্ঞের হাসি হাসতে পারলো না। মুখস্থ হয়ে যাওয়া ইরিনার নাম্বার ডায়াল প্যাডে তুললো ঝটপট করে। ফোন কানে ধরলো। তার বুক দুরুদুরু করছে। হঠাৎ কোথাও বাঁজ পড়ল।ছলকে উঠলো হৃদয়। ঠিক তখনই ওপাশ থেকে কেউ বলল, “হ্যালো! কে বলছেন?”
কিছুক্ষণ ফোন ধরে রইলো মালিহা।
“কি আজব! কথা বলছেন না কেনো?”
ফোন কেটে দিলো মালিহা। ধন্যবাদ জানিয়ে মহিলাকে তার ফোন ফেরত দিলো। বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে মালিহা ভাবলো, আকাশ কি কারো থেকে দুঃখ পেয়েছে?

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৫

এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো মালিহার হলে এসেছে ইতমিনান। তবে এবার উল্টোটা হয়েছে। মালিহা ডেকেছে আর ইতমিনান সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে। প্রতিবার তো মালিহাই চমকে যায়।
দুর্বল শরীর নিয়ে রান্না করতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। ভ্যাপসা গরম যেনো আগুনের তাপকে আর উত্তপ্ত করেছে। ঘামে জবুথবু অবস্থা মালিহার। নিজের কাছেই বিরক্ত লাগলো তার। একেবারে গোসল করে নামবে? কিন্তু ইতমিনান তো মেসেজ দিয়েছে। নিশ্চয়ই নিচে বসে আছে। থাক খাবারটা আগে দিয়ে আসা যাক।
পরিষ্কার বড় একটা ওড়না গায়ে জড়িয়ে ব্যাগ দুটো হাতে নিলো মালিহা। সিঁড়ি ভেঙে নেমে যখন ওয়েটিং রুমের সামনে এলো তখন ইতমিনান তাকে আবার ফোন দেয়ার পাঁয়তারা করছে। মালিহাকে দেখে সে ফোন রেখে দিল। পরিশ্রান্ত কণ্ঠে মালিহা বলল, “সরি বেশি দেরি হয়ে গেলো।”
মালিহার মুখটা দেখলো ইতমিনান। চুলার আঁচ যেনো এখনও মুখে লেগে আছে।
“সমস্যা নেই।”
“এই ব্যাগটা ওদের। একটা বাটিতে লতা আপার জন্য স্যুপ দিয়েছি। এখন খেতে দেবে কি না জানিনা নাহলে রাতের জন্য রেখে দিতে বলবে। আর নিচেরটায় আঙ্কেল আন্টির জন্য খাবার।”
“কি রান্না করেছিস?” ব্যাগ হাতে নিয়ে সেদিকে নাক দিলো ইতমিনান। মালিহা কপাল কুঁচকে বলল, “যা বাজার করে এনেছিলে তাই রান্না করেছি। এটা তোমার।” আরেক হাতের ব্যাগ এগিয়ে দিলো মালিহা। ইতমিনান ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার জন্য রান্না করেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“তুই?”
“হু।”
ইতমিনানের নজরে চমক। মালিহার কেনো যেনো অস্বস্তি হলো সেই চোখে চোখ মেলাতে।
“কই ধরো।”
ইতমিনান ঢোক গিললো। তার বাজার করাই উচিৎ হয়নি। আর না উচিত হয়েছে আজকে হলে আসা। এই রান্না বান্না করে খাইয়ে মেয়েটা তার স্মৃতিতে ঘাটি গেড়ে বসে থাকতে চাইছে। ভয়ংকর পরিকল্পনা!
ইতমিনানকে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মালিহা বলল, “তাড়াতাড়ি যাও। ওরা সবাই না খেয়ে বসে আছে।”
“তুই যাবি না?”
“না আজকে আর যাচ্ছি না। শরীরটা ভালো লাগছে না। গোসল করব। শোনো ওনাদের বলবে খাবার নিয়ে যেনো টেনশন না করে। এই দুই দিন আমিই রান্না করে দেবো ইনশাআল্লাহ্। ”
“আচ্ছা।”
“মনে করে বলবে কিন্তু!”
“আচ্ছা।”
ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো ইতমিনান। মুহূর্তেই আবার ফিরে এলো মালিহার সামনে। মালিহা হকচকিয়ে গেল। মাত্রই না বের হলো!
“তোর জন্য রেখেছিস?”
“কি?”
“খাবার?”
“রেখেছি।”
“আচ্ছা খেয়ে নিস। আরেকটা গ্লুকোজ কিনে দিয়ে যাবো?”
“না বিশ্রী লাগে।” মুখ বেঁকিয়ে বলল মালিহা। ইতমিনান আর কিছু বলল না। চলে গেলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

বৃদ্ধ দম্পতি অনাকাঙ্খিত সম্মানে আপ্লুত হলেন। ইতমিনান যখন বলল, “হাসপাতালে যতদিন আছেন খাওয়ার ব্যাপারটা আমার ওপরে ছেড়ে দিন। আপনারা মা আর বাচ্চার খেয়াল নিন।”
“এক বেলা যে নিয়ে এসেছো এই অনেক বাবা। রোজ রোজ তোমাকে কষ্ট করতে হবে না।” লতার শাশুড়ি জবাব দিলেন।
“মালিহা আমাকে বারবার বলে দিয়েছে। ও তো রান্না বান্না করে বসে থাকবে। আপনারা যদি সেই খাবার না গ্রহণ করেন তাহলে আর কি করা..” হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল ইতমিনান।
লতার শ্বশুর বললেন, “কিন্তু প্রতিদিন কেমন দেখায় বলো? তোমাদেরও তো কষ্ট হয়।”
“ডাক্তার বলেছে আপাকে পরশু রিলিজ করে দেবে। আজকের দিনের খাবারের পাঠ শেষ। থাকলো বাকি একদিন। শুনুন আঙ্কেল! রিজিকের বিষয় আসমানে সেট করা আছে। আপনি আমার সাথে জোরাজুরি করলেও তো আর সেটা পাল্টে যাবে না!”
এরপর আর কোনো কথা বলার থাকে না। ঘুমন্ত লতার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন লতার শাশুড়ি। একটা চিন্তা কমলো।

দুপুরে খেয়ে একটু শুয়েছিল মালিহা। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। ঘামটা কি শুধুই গরমের? ধপ করে উঠে বসলো সে। হঠাৎ ঘুম থেকে এভাবে ওঠায় মাথাটা ঘুরে উঠলো। এক হাত মাথায় রেখে চারপাশে তাকালো মালিহা। না তুষার কোথাও নেই। উহু ঠিক হলো না। তুষার বাস্তবে নেই। কিন্তু তার সত্তা যেনো মালিহার পিছু ছাড়ছে না। দুঃস্বপ্নের মতো ঘুমের ঘোরেও মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। দম ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল মালিহা। এই ভোগান্তির শেষ কোথায়?

পড়ন্ত বিকেলে নাজিফার রুমে গেলো মালিহা। রুমের ভেতর সিনিয়র দুজন তখন পড়াশোনায় ব্যস্ত। নাজিফা বের হয়ে বলল, “চলো ছাদে যাই?”
“চলো।”
দিনভর পৃথিবী উত্তর করে সূর্য একটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাপ কমে এসেছে। এই তো নিয়ম। যৌবনে দাপিয়ে বেড়ানো লোকটা বৃদ্ধ বয়সে লাঠি খোঁজে। সূর্যের কি এখন বৃদ্ধ বয়স চলছে?
“নাজিফা সূরা ফাতিহাটা একবার শোনাবে?”
নাজিফা আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। মালিহার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে হেসে বলল, “সুরা ফাতিহা কেনো? অন্য সুরা না কেনো?”
“জানিনা। এই সুরাটা শুনতেই বেশি ইচ্ছা করে।” মাথা নেড়ে বলল মালিহা। নাজিফা কণ্ঠ নিচু করে মুখের একপাশে ডান হাত রেখে বলল, “একটা গোপন কথা শোনো। কারো যদি কোনো সুরা একটু বেশি প্রিয় হয়, অন্য সুরার থেকে বিশেষ বলে মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে সেই সুরাটায় আল্লাহ তার জন্য কোনো গোপন মেসেজ রেখেছেন।”
মালিহা চোখ বড় করে বলল, “সত্যি?”
চোখ বন্ধ করে আশ্বস্ত করলো নাজিফা, “ইয়েস।” গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “শুরু করি তাহলে?”
“আচ্ছা।”
দুইবার কাশি দিলো নাজিফা। গলা পরিষ্কার করে পড়তে শুরু করলো কুরআনের মা’কে। ছাদে আরো কয়েকজন গল্পে মশগুল ছিলো। হঠাৎ নাজিফার কণ্ঠে সকলে অঘোষিতভাবে চুপ করে গেলো। কেউ যেনো তাদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছে “কোনোভাবেই এখন কথা বলা যাবে না!”
মালিহার মনে হলো নাজিফা তার ভেতরে জমে থাকা সবটুকু বিনয় ঢেলে দিয়ে তিলাওয়াত করলো। সাত আয়াতের সুরাটা মিনিটেই শেষ হয়ে গেলো। নাজিফা থামলে মালিহা বলল, “তুমি কি এটা আমাকে রেকর্ড করে দেবে? মাঝে মাঝে শুনতাম।”
“অবশ্যই দেবো। কিন্তু শর্ত আছে।” হেসে বলল নাজিফা। ম’রা রোদ পড়া সেই হাসিটুকু মালিহার কাছে চমৎকার লাগলো।
“কি শর্ত?”
“কোনো ছেলে মানুষ যেনো না শোনে।”
“আচ্ছা।”
“ইনশাআল্লাহ্ বলো। ভবিষ্যত নিয়ে কিছু বললে ইনশাআল্লাহ্ বলতে হয়। এর অর্থ যদি আল্লাহ চান।”
“ইনশাআল্লাহ্।”
নীরবতা নেমে এলো দুজনের মাঝে। স্বচ্ছ নীলাকাশে পাখিদের ছোটাছুটি দেখা যাচ্ছে। সবাই নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত। কর্ম ব্যস্ত দিন পার করে সকলে ছুটছে শান্তির নীড়ে।
“নাজিফা?”
“হু?”
“চারপাশে যে এতো সমস্যা হয়, ছেলেরা মেয়েদের টিজ করে, হ্যারাস করে এর সমাধান কি? আল্লাহ নিশ্চয়ই কিছু বলেছেন?” আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল মালিহা। নাজিফাও সেদিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো, “অবশ্যই বলেছেন। এতো এতো কথা বলেছেন। মেইন কথা হলো পর্দা করতে হবে।”
“মেয়েরা পর্দা করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? কিন্তু বোরখা পড়া মেয়েরাও তো কম ভোগান্তির শিকার হয় না।” সেদিনের চিত্রটা মানসপটে ভেসে উঠলো। সে নিজেই তো বোরখা পড়ে ছিলো।
নাজিফা হেসে বলল, “লম্বা উত্তর। ধৈর্য ধরে শোনো।” জোরে একটা শ্বাস টানলো নাজিফা। সম্ভবত প্রস্তুতি নিয়ে নিলো।
“আমাদের একটা কমন সমস্যা হচ্ছে পর্দা মানেই বুঝি বোরখা পড়া মেয়ে। অথচ পর্দা নারী পুরুষ দুজনের জন্যই।”
“ছেলেদেরও পর্দা আছে নাকি?” মালিহার চোখে বিস্ময় দেখা দিলো।
“অবশ্যই আছে। নারীদের আগে কুরআনে পুরুষদের পর্দা করতে বলা হয়েছে। তাহলে বোঝো তাদের পর্দা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ!”
“ছেলেরাও কি বোরখা পড়বে নাকি?”
“আরে নাহ! ওদের হলো চোখের পর্দা। নজরে পর্দা। বেগানা নারী মানে যাদের সাথে বিয়ে করা জায়েয তাদের দিকে ভুলে একবার দৃষ্টি চলে গেলে সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইচ্ছা করে কোনো মেয়ের দিকে তাকানো তাদের জন্য হারাম। আর পোশাকের কিছু রুলস রেগুলেশন আছে।”
“বাপ রে! এটা তো কঠিন। এটা কি মেইনটেইন করা যায় নাকি?”
“সম্ভব হওয়া না হওয়াটা পরের বিষয়। মূল কথা হলো চেষ্টা। তুমি চেষ্টা করছ নাকি সেটা আল্লাহ দেখবেন। তোমার আপ্রাণ চেষ্টাই তাঁর কাছে ধর্তব্য। ফলাফল যা হয় হোক। একমাত্র তিনিই আছেন যিনি আমাদের ফলাফলের আগে মনের নিয়তকে, আপ্রাণ চেষ্টাকে যথার্থ মূল্যায়ন করেন।”
মালিহা বেশ কিছুক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবলো। বলল, “কিন্তু আমাদের আশেপাশে কয়জন ছেলে চোখ নামিয়ে চলে?”
“আল্লাহই জানে এমন কেউ আছে নাকি। না থাকলেও এটা আল্লাহর বিধান। ছেলেদেরকে নজর নামাতে হবে, মেয়েদের সৌন্দর্য ঢেকে রাখতে হবে। এই দুটো কাজ হলো গাড়ির দুই পাশের দুই চাকার মতো। ব্যালেন্স করে চলতে হয়। মেয়েরা নিজেদের ঢেকে চললো কিন্তু ছেলেরা নজরের হেফাজত করলো না, আবার ছেলেরা নজরের হেফাজত করলো কিন্তু মেয়েরা নিজেদের সৌন্দর্যের সস্তা প্রদর্শনী মেলে বসলো তাহলে ব্যালেন্স হবে না। চাকা ছোট বড় হয়ে যাবে। সমাজ নামের গাড়ি এদিক সেদিক বেঁকে গিয়ে খাদে পড়ে যাবে। তারপর এই যে আশপাশে যা হচ্ছে..” কাঁধ শ্রাগ করে বলল নাজিফা।
“কিন্তু মেয়েরা পর্দা করেও যদি লাঞ্ছনার শিকার হয় তাহলে আর পর্দা করার দরকার কি?” মালিহার ভেতর থেকে যেনো তুষারের প্রতি জমাট বাঁধা ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে। সে তো নিজেও বোরখা পড়ে। তাহলে কেনো তাকে ঐ অবস্থায় পড়তে হলো।
“আসলে দেখো আমরা পর্দা বলতে বুঝি বোরখা পড়া আর মাথা ঢাকা। বিষয়টা কিন্তু এমন না। কুরআন বা হাদীসে বোরখার কথা বলা হয়নি। কিছু শর্ত দেয়া হয়েছে। সেই শর্ত অনুযায়ী তুমি যেই পোশাক পড় সেটাই চলবে। কিন্তু আজকালকার বোরখাগুলো বোরখা কম লেহেঙ্গা বেশি। বডি স্ট্রাকচার বোঝা যায় যে বোরখা পড়লে সেটা কোনো বোরখা হলো? আবার কেউ ঢিলা বোরখা পড়লো, মাথা ঢাকলো কিন্তু বের করে রাখা মুখটা সেজেগুজে বের হলো। তাহলে লাভ কী হলো? সেই তো সৌন্দর্য প্রদর্শন। পর্দার সঠিক পোশাক পড়েও অনেকে বাকিটুকু মানে না। কুরআনে, হাদীসে বেগানা পুরুষের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বলা হয়েছে, বিনা প্রয়োজনে দেখা সাক্ষাৎ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলেকে বন্ধু ভেবে তার সাথে ঘুরতে যায় তাহলে আর বোরখার কি কাজ হলো? নবীজী স্পষ্ট করে বলেছেন নির্জনে কোনো মহিলা যেনো কোনো বেগানা পুরুষের সাথে এবং কোনো পুরুষ যেনো কোনো বেগানা মহিলার সাথে দেখা না করে। কারণ সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হয় শয়তান। মদদ দেয়ার কাজটা সে করে দেয়। তাই তাকে সেই সুযোগটাই দেয়া যাবে না।”
দম ছাড়লো নাজিফা। মালিহা এই যাত্রায় চুপ করে গেলো। সেদিন কোচিংয়ে সে তুষারের সাথে একা ছিল। একদম একা।
“দেখো মালিহা যদি কেউ আল্লাহকে মানে তাহলে তার বিধান মানতে আর সাত পাঁচ ভাবার দরকার হয় না। তিনি বলেছেন, আমি মেনেছি। এই হলো নীতি। যুক্তিগুলো হলো মনকে ঠান্ডা করার জন্য বোনাস। কিন্তু পৃথিবীর কেউ যদি পর্দার বিধান না মানে তবুও সেটা আল্লাহর কাছে বলবৎ থাকবে। এর জন্য অবশ্যই জবাব দিতে হবে। নিশ্চয়ই তোমার হয়ে অন্য কেউ জবাব দিয়ে দেবে না? আর চেষ্টা করে যে মানুষ চাঁদে চলে গেছে সে চাইলে নজরের হেফাজতও করতে পারে। এটা আমার বিশ্বাস। আল্লাহর বিধান মানতে কেউ চেষ্টা করবে আর আল্লাহ সাহায্য করবেন না এমন হতেই পারেনা। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া তো কিছুই সম্ভব না। তাই আমাদের চেষ্টা আর সেই অনুপাতে আল্লাহর সাহায্য। কাম তামাম!”

মালিহা তার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। একে একে সবটা মেলাতে তার এক মুহুর্ত লাগলো। সমাজ, চাকা, বিধান সবটা যেনো পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। বুকের ভেতর প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো। পর্দা যে শুধু কয়েক গজ কাপড়েই নয়, খানিকটা মনে, খানিকটা মস্তিষ্কে, অনেকটা চোখে এটা বুঝতে পেরেই সব জট খুলে গেলো।
মাগরিবের আযান দিলে উঠে দাঁড়ালো নাজিফা, “মালিহা চলো যাই। আযান দিচ্ছে।”
মালিহা উঠে দাঁড়ালো। প্রশান্ত একটা মন নিয়ে সে আজ তার রবের সামনে দাঁড়াবে।

পেঁপে ঘন্ট দিয়ে খুব আয়েশ করে খেলো ইতমিনান। খেয়েই যেনো তার বুদ্ধি খুললো। চট করে রাবেয়াকে ফোন দিয়ে দিলো। হঠাৎ ভাস্তির ফোন পেয়ে রাবেয়া অবাক হলেন।
“ব্যাপার কি? এতদিন পর ফুপুরে মনে পড়ল?”
“উল্টা ঝাড়ি। তুমিও তো খোঁজ নাও না।”
“এমনই বলে সবাই।”
“কেমন আছো?”
“ভালোই।”
“ফুপু তোমার কাছে একটা আবদার আছে।”
“কি আবদার?” রাবেয়াকে উৎসুক দেখা গেলো। এ যেনো ছোট্ট ইতমিনান বায়না ধরছে।
“এখন বলবো না। সামনের ছুটিতে বাড়ি এসে বলবো। আমি কিছু জানি না। সব তুমি করবা।”
“কিছু বলে না আবার বলে তুমি সব করবা। আগে খোলাসা করে বল দেখি।”
“এখন না। বাড়ি যাই আগে।”
“বেয়াদ্দব ছ্যাড়া! এক্ষণ তাইলে এই কথাটা বলে আমার মাথা নষ্ট করার কি দরকার ছিল? এই অশান্তি নিয়ে এবার আমি ঘুমাবো কেমনে?”
ফুপুর ধমকানিতে হাসলো ইতমিনান। অনেকদিন পর ফুপুকে জ্বালিয়ে শান্তি শান্তি লাগছে।
“বেশি না ফুপু। আর মাত্র বিশ দিন পর আমি আসছি। ততদিন একটু সবুর করো। আর হ্যাঁ! মা’মলা কিন্তু সিরিয়াস!” শেষটুকু গম্ভীর কণ্ঠে বলল ইতমিনান।
“হতচ্ছাড়া..!” বাকিটুকু শোনার আগেই কল কেঁটে দিলো ইতমিনান। সাথে সাথেই ফোন বন্ধ করে দিলো। ফুপু এখন ফোনের পর ফোন করবে। ধরার প্রশ্নই ওঠে না।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৬

নীতি ফোন করেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু কাজের কথা কিছুই বলছে না। মালিহার মনে হচ্ছে নীতি কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।
“নীতি কি আগডুম বাগডুম শুরু করলি? আমাকে কিছু বলবি তাই নিয়ে ভাবা ভাবির কি আছে?”
“সিরিয়াস কথা দোস্ত। আমার প্রেশার একবার হাই হয়ে যাচ্ছে আবার লো হয়ে যাচ্ছে।” বিমর্ষ কণ্ঠে বলল নীতি।
“আঙ্কেল আন্টি সবাই সুস্থ আছেন তো?”
“খালি সুস্থ? বিন্দাস আছে। আলহামদুলিল্লাহ।”
“তাহলে আবার কি হচ্ছে?”
“তোকে আসার আগে কি বলেছিলাম?”
“কি বলেছিলি?”
“একটু ভাববি তো নাকি!”
মালিহা ভেবে ভেবেও কিছু মনে করতে পারলো না।
“বিশেষ কিছু বলেছিস বলে তো মনে পড়ছে না।”
“তা কেন মনে থাকবে?” পরপর দম ছাড়লো নীতি। কণ্ঠ নিচু করে বলল, “তোর আঙ্কেল আন্টি তো ঘটনা ঘটায় ফেলসে!”
“কি করেছে?” মালিহাও ফিসফিসিয়ে শুনলো।
“পাত্র টাত্র দেখে একাকার। এখন আমারে বলে বিয়ে নাকি পড়ায় রাখবে পরে তুলে নিবে।” শেষেরটুকু কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল নীতি। কথাটা বুঝতে পারেই মালিহা চেঁচিয়ে উঠলো, “তোর বিয়ে!”
সেই চিৎকারে ঘুমে ঢুলতে থাকা মনিকা তড়াক করে উঠে বসলো, আঁখি মুখের পানি গিলতে যেয়ে কাশতে শুরু করলো, ফোনের ওপাশে থাকা নীতি কান থেকে ফোন সরিয়ে বলল, “কালা করে দিবি নাকি বইন?”
মালিহা বিব্রত বোধ করলো। আঁখি, মনিকা দুজনকেই সরি বলল।
“নীতি! সত্যিই তোর বিয়ে?”
“কথাবার্তা চলছে।”
“তুই রাজি?”
“ছেলেটা ভালোই বুঝলি?” জামার সুতা টানতে টানতে বলল নীতি।
“কি করে?”
“মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।”
মালিহা হতাশ কণ্ঠে বলল, “এ তো বারো মাসের ভেতরে তেরো মাসই সমুদ্রে ভেসে বেড়াবে। তোর সাথে সংসার করবে কখন?”
“ছুটিতে এসে।”
মালিহা চোখ বড় করে বলল, “তার মানে তুই রাজি হয়ে গেছিস? ছুটিতে সংসার করবি সেই প্ল্যানও করা হয় গেছে। কতো ফাস্ট রে তুই নীতি!”
“আমি আর কি ফাস্ট! ছেলেরা টার্বো স্পিডে চিন্তা করে। ঐ ছেলে দেখ গা ভাবনায় আমার নাতি নাতনির দাদা, নানা হয়ে গেসে।”
এবার মালিহা কাশতে শুরু করলো। নীতির হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই হাসি নিভে গেলো, “কতো প্ল্যান করেছিলাম বিয়ে নিয়ে। কিন্তু কিছুই তো হলো না।”
“এই যে বললি এখন শুধু বিয়ে পড়িয়ে রাখবে। তাহলে প্রোগ্রামের সময় তো সব হবে।”
“কিন্তু এখন তো তুই নেই।”
ছোট্ট একটা কথা। পাঁচটা শব্দের। কিন্তু সেই বাক্যের ওজন যে কি বিশাল, সেটা কি অবলীলায় বলে ফেলা নীতি জানে? যেতে পারবে না এই কথাটা মালিহার একবারও এমন কথা মনে হয়নি। খারাপ লাগা তো পরের বিষয়। অথচ মেয়েটা সেটা মনে করে মন খারাপ করে বসে আছে।
“পাগলী মেয়ে! তুই কি এখনই শশুর বাড়ি চলে যাচ্ছিস? প্রোগ্রামের সময় আমি থাকবো ইনশাআল্লাহ্।”
“বিয়ে তো বিয়েই। ওটা হবে বাসি বিয়ে। টাটকা বিয়ের সময় আর তুই থাকলি কই!”
মেয়েটার মন খারাপ কমছে না। মনটা ঘোরানো দরকার। কি মনে করে মালিহা বলল, “নীতি! নতুন একটা টিউশন পেয়েছি জানিস?”
“আবার আরেকটা? এতগুলো করবি কখন তুই?”
“কোচিংয়েরটা ছেড়ে দিয়েছি।” মলিন কণ্ঠে বলল মালিহা।
“কেনো?”
“ভালো একটা পেলাম। ছোট্ট একটা বাচ্চা। পাঁচ বছরের। ওকে পড়ানো আর কি। কিন্তু দশ হাজার টাকা দেবে বলেছে। তাহলে এটা বেশি লাভের না?” কৌশলে কোচিংয়ের বিষয়টা এড়িয়ে গেলো মালিহা। নীতি বলল, “আঁখি আপু মাইন্ড করবে না তো?”
“না আপু জানে। সমস্যা নেই।” আঁখি জানে বটে, কিন্তু সেটুকু নীতি জানে না।
“পি এল দেবে কবে?”
“আর তিনটা ক্লাস হবে। তারপর একেবারে পূজার ছুটি সহ পি এল দিয়ে দেবে।”
“আমার পড়াশোনা লাটে উঠে গেলো।”
“কারেকশন! বলো সমুদ্রে ভেসে গেলো!”
নীতি হাসলো লজ্জার হাসি। মালিহা মনে মনে দোয়া করলো, এই হাসিখুশি মেয়েটা সারাজীবন খুশি থাকুক।

একটু আগে আগেই বের হলো মালিহা। লতাকে দেখে একেবারে তিশাকে পড়াতে যাবে। জ্বরের অজুহাত দিয়ে বেশ কয়েকদিন পিছিয়ে গেছে। ইতমিনানকে ফোন করেছিল। তার অফিস ছুটি হতে এখনও ঘণ্টা খানিক দেরি হবে। কাজেই মালিহা একাই গেলো। সঙ্গে নিলো খাবার। সকালেরটা ইতমিনান এসে নিয়ে গিয়েছিল।

মালিহা ভাবছিল আজ মুখ ঢাকবে কি না। বেশি কিছুই করতে হবে না। গলার কাছে থেকে স্কার্ফের কিছুটা অংশ নাকের উপর ফেলে দিলেই হলো। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাসের পরিবর্তন করতে ইতস্তত লাগলো। বাইরের রোদ জড়তাকে আরেকটু জোরালো করলো। গরম লাগবে না? এই চিন্তাটাই মালিহাকে আটকে দিল। কয়েকদিন যাক, তারপর থেকে শুরু করবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো মালিহা। ভাবনার দরজা বন্ধ হলো সেখানেই।

হাসপাতাল তখন নীরব। রোগীদের গোঙানি নেই, প্রিয়জনদের আহাজারি নেই। সব শান্ত। ভাতঘুম পর্ব চলছে। আলস্য জেঁকে ধরেছে দিনের মাঝখানে। মালিহা আরেকটু আগেই আসতে চেয়েছিল। লতার শাশুড়ি তাকে এই সময়ে আসতে বলেছে। দরজা ধাক্কা দিলে ভদ্র মহিলা খুলে দিলেন। হাসি মুখে মালিহাকে স্বাগত জানালেন। মালিহা ভেতরে এসে দেখলো লতা বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে। বেডের মাথার কাছে অংশটা একটু উঁচু করা। যেনো শোয়াও হচ্ছে আবার বসাও। মালিহা মুখ হাত ধুয়ে লতার শিয়রে বসলো। লতা তার দুই হাত ধরে বলল, “কাল খুব উপকার করেছো ভাই। কিন্তু কিছু বলার সাধ্য আমার ছিলো না।”
“কিছু বলতে হবে না আপা। এমন কিছুই করিনি।”
“র’ক্ত নাহয় কতো মানুষই দেয়। কিন্তু নিজের ঘাড়ে এই ঝামেলা কে টেনে নেয়?” শাশুড়ি খাবার বাড়ছিলেন। সেদিকে ইশারা করে বলল লতা।
“আপা রিজিক তো আপনার আমার হাতে নেই। যার যখন যেখানে রিজিক আছে সে তখন সেখান থেকেই খাবে। এই তো নিয়ম।”
লতা হতাশ কণ্ঠে বলল, “ভাই বোন সব একই কথা বলে। চেহারার মিল লাগবে না। কথা শুনেই বোঝা যায় এক কোম্পানির প্রোডাক্ট।”
মালিহা খিলখিল করে হেসে ফেললো। সেই হাসির শব্দে বাচ্চাটা পিটপিট করে তাকালো।
“ও কি খুব বিরক্ত করে আপা?”
“কাল থেকে ঘুমাচ্ছে তো ঘুমাচ্ছেই। ওর বাপও হওয়ার পর এক সপ্তাহ ঘুমের উপর দিয়ে গেছে। ও সেদিকেই যাচ্ছে মনে হয়।” সদ্য দাদি হওয়া মুখটায় ছেলের স্মৃতিচারণ করলেন মহিলা। লতা হাসলো। স্বামীকে হারানোর দুঃখের হাসি, ছেলেকে পাওয়ার সুখের হাসি।

খাওয়া দাওয়া শেষে লতা বলল, “আরেকজন আসবে কখন?”
“ভাইয়া? অফিস ছুটি হলে তারপর আসবে বলল তো।”
“তোমার ভাই নিজেকে খুব চালাক মনে করে। কিন্তু আমি যে বয়সে ওর বড় সেটা মনে হয় ভুলেই গিয়েছে।”
মালিহা ভুরু কুঁচকে বলল, “কেনো? কি হয়েছে?”
“ও কি করেছে শুনবে? বসকে বলে আমার জন্য ছুটি নিয়েছে। আমাদের অফিসে তো এমন লং টাইম ছুটির কোনো সিস্টেম নেই। তাই উনি হাতেম তাই হয়ে আমার ভাগের কাজ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। এবং আমাকে কিছুই জানাননি। আমি তো আর ঘাস খাই না। ঠিকই জেনে গিয়েছি। মহাপুরুষ হতে চান তিনি! ওসব করতে যেয়ে যে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে বান্দার?”
লতার কথায় ক্ষোভ, মুখে কৃতজ্ঞতা, চোখে জল।
“ভালোই তো করেছে।” চিকচিক করতে থাকা জোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে বলল মালিহা।
“তা তো তুমি বলবেই। ভাইয়ের হয়ে সাফাই গাইতে হবে না!”
লতা হেসে ফেললো, “ও হলো ছুপা রুস্তম। ভাবে মানুষ যেনো চোখে পট্টি বেঁধে চলে। আর কোথায় কোথায় কি করেছে আল্লাহই জানে।”
মালিহা দেখলো বিরক্তিমাখা কথার আড়ালে ঝরে পড়া স্নেহ, কৃতজ্ঞতা।

কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথেই তিশা ছুটে এসে দরজা খোলে। নিত্যকার চিত্র। আজ ব্যতিক্রম হওয়াতে মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল। বাড়িতে কেউ নেই নাকি? আরো কয়েকবার বেল চাপলো মালিহা। আজিজা বেগম এলেন পাঁচ মিনিট পর। এই কাঠফাটা রোদে বাইরে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেই ব্যাপারে তার কোনো উদ্বিগ্নতা নেই। শান্ত ভঙ্গিতে দরজা খুললেন তিনি। মালিহা সালাম দিল।
“কেমন আছেন ফুপু?”
“আছি। যেই জ্বরের জন্য এই সপ্তাহ মিস দিলে সেই জ্বর সেরেছে?”
মালিহা চুপ করে গেলো। এক সপ্তাহ তো সে মিস দেয়নি। সাকুল্যে চারদিন। কিন্তু জ্বরের পেছনের কাহিনী তো কেউ জানে না।
“জি সেরেছে।”
কথা বলতে বলতে ঘরে চলে এলো দুজনে। আজিজা বললেন, “তোমার জ্বর ছাড়লেও তোমার ছাত্রী জ্বর বাঁধিয়েছে। আজ পড়তে পারবে বলে মনে হয় না।”
মুহূর্তেই মালিহার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এই কথাটা কি তাকে ফোন জানানো যেতো না? তাহলে এতোটা পথ তাকে কষ্ট করে আসতে হতো না। সে যে কয়েকদিন আসতে পারবে না সেটা তো ঠিকই জানিয়েছিল। বড় করে নিশ্বাস নিল মালিহা। কোনোভাবেই এখানে রাগ দেখানো যাবে না। ভাবলো এসেই যখন পড়েছে মেয়েটার সাথে অন্তত দেখা করে যাক।
“তিশা কি ঘুমাচ্ছে? ওর সাথে একবার দেখা করে যেতাম।”
“যাবে। তার আগে তোমার সাথে আমার কথা আছে।” আজিজার কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো যা মালিহাকে চিন্তা করতে বাধ্য করলো।
“জি বলুন।”
“তুমি জানো তিশা একটু কম বোঝে। একটু না অনেকটাই কম বোঝে। তাকে কোথায় সিলেবাসের পড়া বোঝাবে তা না করে তুমি ওকে নতুন নতুন পড়া শেখাচ্ছো। তাতে হচ্ছে টা কি? ওর টেস্টের রেজাল্ট আগের থেকেও খারাপ হচ্ছে। শোনো মালিহা! ওকে নতুন কিছু শেখাতে হবে না। গল্প লেখার উৎসাহ দিতে হবে না। তোমার কাজ স্কুলের পড়া পড়ানো, ঐটুকুই ভালো মতো করো।”
অপমানে মালিহার মুখ থমথমে হয়ে এলো। সবটা শুকনো ঢোকে গিলে সবটা অপমান পেটের ভেতর পাঠিয়ে দিলো। যতক্ষণ গলার কাছে থাকবে ততক্ষণ ব্যাথা হতে থাকবে।
আজিজা চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে তুলনামূলক শান্ত কণ্ঠে বললেন, “এসো। তিশা ওর ঘরেই আছে।”
মালিহা ছোট ছোট পদক্ষেপে তিশার ঘরে গেলো। অন্ধকার রুম। দরজা খুলতেই এক ফালি আলো মেঝে স্পর্শ করলো। বিছানায় শুয়ে থাকা তিশার রুগ্ন দেহ নজরে এলো। আজিজা দরজা খুলে বিদায় নিলেন। মালিহা হাঁপ ছাড়লো। মহিলা সামনে থাকলে সে আরাম করে কথা বলতে পারতো না।
“তিশা?” তিশার মাথায় হাত রেখে ডাকলো মালিহা। মেয়েটা চোখ খুলল। জ্বর যেনো একেবারে কাবু করে ফেলেছে। উঠে বসতে চাইলে তাকে মালিহা সাহায্য করল।
“আজকে তো পড়তে পারবো না মিস।”
“পড়তে হবে না তিশা। আমি তোমাকে দেখতে এসেছি।” জোর করে ঠোঁটে হাসি টেনে আনলো মালিহা।
“আমার তো মাঝে মাঝেই এমন জ্বর আসে মিস। সেজন্য পড়ায় আরো পিছিয়ে যাই।”
“তাহলে ডাক্তারের কাছে যাও না কেনো? মাঝে মাঝে এভাবে জ্বর আসা তো ভালো কথা না।” তিশার দুর্বল মুখে হাত বুলিয়ে দিলো মালিহা।
“ডাক্তার দিয়ে কি হবে? যতদিন আম্মু আমার সাথে এমন করবে ততদিন আমার এভাবে জ্বর আসবে?”
“আম্মু কি করেছে?”
“আপনি তো কয়দিন আসেননি মিস। প্রথম যেদিন এলেন না সেদিন আমার একটা টেস্ট হয়েছে। ইংলিশ টেস্ট। কালকে সেটার রেজাল্ট দিয়েছে। বিশে চার পেয়েছি। তাই আম্মু আমাকে অন্ধকার ঘরে আটকে রেখেছিল। আমি অন্ধকারে খুব ভয় পাই মিস। এজন্য সবসময় জ্বর চলে আসে।”
“নাম্বার কম পেলেই তোমাকে অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে?”
“হ্যাঁ।”
মালিহা যারপরনাই অবাক। কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। নিজের মেয়ের সাথ কেউ এমন করতে পারে? নাম্বার কম পেয়েছে কিন্তু মেয়েটার চেষ্টা দেখবে না? এমন তো না সে সময় নষ্ট করে। যথেষ্ট চেষ্টা করে তিশা। সব জিনিস এক দেখায় ক্যাচ করতে না পারলেও লেগে থাকার মনোবল মেয়েটার আছে। কিন্তু এই কাজের মাধ্যমে তিশাকে ভেতর থেকে গুড়িয়ে দেয়ার মানে কি?
কি মনে হতেই বালিশের নিচ থেকে একটা খাতা বের করলো তিশা। জ্বরতপ্ত শরীরে যেনো আনন্দ ফিরে এলো।
“মিস আপনার সব হোমওয়ার্ক করেছি। দেখুন একটু আগেও করছিলাম। কিন্তু ইংলিশটা আম্মু ছিঁড়ে ফেলেছে।” মলিন কণ্ঠে বলল তিশা। মালিহা খাতাটা হাতে নিলো। একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে গেলো। চেনা পদ্ধতির বাইরের প্রশ্নগুলো মেয়েটা খুব আগ্রহভরে করেছে। একটাও বাদ রাখেনি। ইংলিশও নিশ্চয়ই খুব সুন্দর করে লিখেছিল? তিশার লেখা ইংরেজি গল্পের উপর মালিহার এক ধরণের লোভ কাজ করে।
“মিস আমি ইংলিশ আরেকবার আপনাকে লিখে দেবো। লুকিয়ে লুকিয়ে লিখবো। আম্মু ধরতে পারবে না।”
ফিসফিসিয়ে বলল তিশা। মালিহা তিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। হাসার চেষ্টা করলো। ভেতর থেকে সায় পেলো না। সে কি আজিজা বেগমকে এমন অমানবিক আচরণের কারণ জিজ্ঞেস করবে? তাকে কি বোঝাবে? সেই অধিকার কি তার আছে?

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৭

বাড়িটা বেশ বড়সড়। গতদিন সেভাবে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। আজ দেখছে মালিহা। লামিয়াদের বাড়িতে তখন তোড়জোড়। রিপা ছোটাছুটি করছে বটে। তবে মালিহা দেখলো কাজ করছে সব বুয়ারা। কাজের লোকেরও অভাব নেই। একজন রান্নার জন্য, একজন ঘর পরিষ্কার করার জন্য, একজন লামিয়ার পেছনে সর্বক্ষণ লেগে আছে। মালিহাকে আসতে দেখে লামিয়ার জন্য বরাদ্দ জন লামিয়াকে ডাকতে গেলো। বুকে পুতুল আঁকড়ে ঢুলতে ঢুলতে বের হলো লামিয়া। তার পেছন পেছন ছুটে আসা মহিলার ভাষা শুদ্ধ। কাপড় চোপড়েও গোছালো ভাব। মালিহা ভাবলো একে বুয়া বলা যায় না। ন্যানি বললে ঠিক হয় কি?
ন্যানি লামিয়াকে কোলে নিয়ে বললেন, “এভাবে বের হয়েছো কেনো লামিয়া? মিস বলবে লামিয়ার কাপড় চোপড় নেই। অগোছালো মানুষকে কেউ পছন্দ করে?”
লামিয়া হু হা করলো। তার ঘুম পুরোপুরি ভাঙেনি। ন্যানি তার মুখ হাত ধুইয়ে, ব্রাশ করিয়ে, জামা পাল্টে দিলেন। লামিয়া এবার লাফাতে লাফাতে এলো। মালিহাকে জাপটে ধরে বলল, “মালি মিস কেমন আছো?”
“ভালো আছি লামিয়া। তুমি কেমন আছো?”
“আমি তোমাকে মালি বলেছি। তুমি আমাকে লামিয়া বললে কেনো? লামি বলবে। ঠিকাছে?” ঘাড় কাত করলো মালিহা। লামিয়ার ছোট ছোট চুলগুলো নেড়ে দিলো।
“মিসকে আপনি করে বলো লামিয়া। তুমি বলতে হয় না।”
লামিয়ার ন্যানি কিছুটা দূরে চেয়ার পেতে বসেছেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে পুরোটা সময় বসেই থাকবেন। কিন্তু এভাবে কেউ গ্যাট মে’রে বসে থাকলে যে মালিহার অস্বস্তি হয় সেটা তাকে কে বোঝাবে। মালিহা ইতস্তত করে বলল, “বলুক সমস্যা নেই। ছোট মানুষ কি অতো বোঝে।”
“বোঝে না বলেই বোঝাতে হবে। এটাই বোঝানোর বয়স।” স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন মহিলা। মালিহা ভাবলো ভালো ঝামেলায় পড়া গেছে। সে লামিয়াকে কি শেখাবে এই মহিলাই তাকে শেখানোর জন্য বসে আছে।
পুরোটা সময় এই অবস্থাই চলল। মালিহা লামিয়াকে একটা বলে ন্যানি সেটার প্রতিবাদ করে লামিয়াকে আরেকটা করতে বলেন। এক পর্যায়ে মালিহা বিরক্ত হলো। তার আসার দরকার কি? এই মহিলা একাই তো একশো। তবে মালিহার বিরক্তি বিস্ময়ে রূপ নিলো যখন লামিয়ার বাবা মা দুজনেই চলে গেলো কিন্তু তাকে কিছু বলে গেলো না। লামিয়াকেও উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেলো না। সম্ভবত সে ইতোমধ্যেই এসবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

মিতুল চুপচাপ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মকবুল আলির এতক্ষণে চলে আসার কথা। আসছে না কেনো? দুপুরে এই খাওয়ার সময়টুকুই তার ছুটি। এখুনি তো দৌড়ে আবার দোকানে যেতে হবে। খারাপ লাগে না মিতুলের। কাজের মাঝে থাকলে অযথা চিন্তা এসে মাথায় ঘুরপাক খায় না। মাস শেষে কিছু টাকা হাতে আসবে এই চিন্তাটাও আপন মামার বাড়িতে আশ্রিত জীবনে একটি স্বস্তি দেয়। মাথার পেছনে হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল মিতুল। আপাটার জন্য বড় চিন্তা হয়। ক্লাস সেভেনে উঠেই সে আপাকে ছাড়িয়ে লম্বা হতে শুরু করেছে। এখন দেখলে মনে হয় সে বড় ভাই আর আপা যেনো তার ছোট্ট বোনটি। সেই বোনটা ঐটুকু শরীর নিয়ে সকাল বিকাল টিউশনি করে কাহিল হয়ে পড়ছে। র’ক্ত ঘাম এক করে চিন্তা করছে কতো সহজে ঐ শহরে শিফট হওয়া যায়। মালিহা এসব কিছুই তাকে বলেনি। কিন্তু সে তো তার আপাকে চেনে। কণ্ঠ শুনে একটু হলেও আঁচ করতে পারে। মিতুল বোঝে না সহজ সমাধানটা কেনো মায়ের ভালো লাগে না। নিজেদের বাড়ি থাকতে এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানোর দরকারটাই বা কি?

অর্ধেক বন্ধ দরজার ওপাশে থেকে মামীর চিৎকার ভেসে আসছে। এমন চিৎকারের জন্যই মিতুলের কানটা পুরো মাস ধরে অপেক্ষা করেছে। গতকাল রাতে বেতন পেয়েছে সে। খুব কম হলেও প্রথম বেতনের আবেগ, অনুভূতি আলাদা। সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়ে স্কুল থেকে আসার পথে বাজার করে এনেছে। সেই বাজারের ব্যাগ নিয়েই হৈ চৈ বাধিয়েছেন মামী। সাইফের হাতেও একটা আইস্ক্রিম ধরিয়ে দিয়েছে মিতুল। ছেলেটার মনে প্যাঁচ নেই। বাবা মা যেদিকে চালাবে সেদিকেই চলবে। প্রকাশ্যে তার বিরোধীতা না করা পর্যন্ত ভাগের মায়াটুকু আটকে রাখত চায় না মিতুল। যেমনই হোক, তার ভাই তো।

“বলেন তো আপা! এইটুকু ছেলে কাজ করে তাই দেখতেই কষ্ট লাগে। সে আবার হাত ভরে বাজার নিয়ে আসছে। মিতুলের যা কাজ না!”
ভাই বউয়ের চোখ মুখের ভান ধরা বিরক্তিটুকু ধরতে বেগ পেতে হলো না নাজিয়াকে। এজন্যই মিতুল জোর করে কাজে ঢুকেছে। কি মনে করে তিনি বললেন, “তুমি তো গোসল করে ফেলেছো। মুরগিটা আমাকে দাও। কেঁ’টে রাখি।”
“ছি ছি আপা! কি বলেন? আমি থাকতে আপনি কাটবেন কেনো? গোসল দরকার হলে আবার করবো। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। ফ্রিজে লেবুর শরবত বানানো আছে। কষ্ট করে মিতুলকে দিন। যেই গরম! একটু পরই তো দোকানে চলে যাবে।”
নাজিয়া চুপচাপ সাইফের মায়ের উচ্ছ্বাস দেখলেন। মাসের উপরে এই বাড়িতে আছে তারা। একটা দিনও কিছু হাতে দিয়ে মিতুলকে দিতে বলেনি। আজ হঠাৎ লেবুর শরবত কোত্থেকে এলো? ইনিয়ে বিনিয়ে মাঝে মাঝেই বলতেন একা এতো মানুষে কাজ করতে পারেন না। নাজিয়া একটু হাত লাগলে সুবিধা হয়। কিন্তু সদ্য বৈধব্যের চাদরে মোড়া নাজিয়ার সংসারের প্রতি মায়া, টান উঠে গিয়েছিলো। হাত বাড়িয়ে কিছুই করতে মন চাইতো না। খাওয়াটুকু খেতেন শরীর চালানোর জন্য। আজ মহিলার অভিব্যক্তি দেখতে নিজ থেকে মুরগীটা কাঁটতে চেয়েছিলেন। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগলো না। ভারী বুক নিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত মিতুলের জন্য নিয়ে গেলেন।

মিতুল সবটাই শুনেছে। অভিজ্ঞতা যেনো হুট করে তার বয়স দশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। মাথার উপর ছায়া না থাকলে গ্রীষ্মের রোদ চিনতে দেরি হয় না। তারও হয়নি। আফসোস মা তার ভাইকে নিজের ছাতা ভেবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ডাট ভাঙা ছাতা যে কারো কাজে আসে না এটা বুঝতে দেরি করে ফেলেছেন।
মায়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে অর্ধেক শরবত খেলো মিতুল। বাকিটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিলো। নাজিয়া দুর্বল কণ্ঠে নিষেধ করলেন, “খাবো না। তুই খা।”
“খাও খাও। ঠুস করে আমিও নাই হয়ে গেলে তখন বুঝবা। তুমি তো আগে কিছুই বোঝো না।”
নাজিয়ার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। জাপটে ধরলেন ছেলেকে, “এমন কথা বলতে পারলি বাপ?”
“এমন কথা কি? হায়াত মউতের ভরসা আছে? আমরা এই আছি এই নাই। জীবন এমনিতেই অনিশ্চিত তার ভিতরে নিজেদের মানুষগুলোর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করার কি দরকার বলো?”
শেষটুকু নরম কণ্ঠে বলল মিতুল। মুখ শুকনো করে বসে থাকা মায়ের দিকে তাকালে তার বুকটা হু হু করে ওঠে। নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটা হারিয়ে মা যেনো নিজেও হারিয়ে যেতে চাইছে।
নাজিয়া অবশ্য মিতুলের কথার গূঢ় রহস্য বুঝলেন না। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন ছেলের ঘর্মাক্ত মুখখানি। মিতুলের আফসোস হয়। মা কেনো আপাকে কখনও এভাবে আদর করে না?

দুপুরে খাওয়ার আগে আগে মকবুল আলী এলেন। মিতুলকে জড়িয়ে ধরলেন সস্নেহে। নাজিয়া তার আগমনের কারণ বুঝতে চেষ্টা করলেন।

“পুকুরে মাছ ধরলো সেদিন। বেচে কিনে যা হলো তাই দিতে আসলাম। ওরা তো মিতুলকে সেভাবে চেনে না। তুমি বললে এরপর থেকে তোমার কাছে দিয়ে যাবে।”
নাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন মকবুল আলী। নাজিয়া একবার টেবিলে রাখা টাকার দিকে তাকালেন। তিনি কিছু বলার আগেই মিতুল বলল, “আমি এসব ঝামেলায় যাচ্ছি না। মা-র আরো আগে যাওয়ার দরকার নাই। আপনার যদি অসুবিধা না হয় তাহলে আপনি এই দিকটা একটু দেখেন।”
মকবুল আলী মাথা নাড়লেন, “অসুবিধা কি? আগেও তো ওরা আমার কাছেই দিত। আমি তোর দাদির কাছে দিতাম। এখন তোদের কাছে দিয়ে দিবো। সমস্যা নাই।”
কিছুক্ষণ নীরবতার পর মকবুল আলী বললেন, “মালিহা বলল ওখানে বাসা বাড়ি খোঁজা শুরু করবে। তোমার কি যাওয়ার নিয়ত পাকা করে ফেলেছো?”
মিতুল মায়ের দিকে তাকালো। নাজিয়া চুপ করে আছেন। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে।
মকবুল আলী নিজেই বললেন, “অনধিকার চর্চা হয়ে যায় তাও বলি। কিছু মনে নিও না। ওখানে মেয়েটা পড়াশোনার জন্য থাকে। বাসা ভাড়া নেয়া তো মুখের কথা না। একটা বাসা গোছগাছ করতে কতকিছু লাগে। সেসব কি এখন কিনবা নাকি এখান থেকে টেনে নিয়ে যাবা? দুইটাই কষ্টের বিষয়। আবার বছরের এই সময়ে মিতুলের ট্রান্সফার ওর জন্যে সমস্যার হবে। পরের বছর এসএসসির প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন যদি সেই স্কুলে খাপ খাওয়াতে না পারে তাহলে ওর পড়াশোনায় মনযোগ হারাবে। ওখানে নিজেদের মানুষ বলতে কেউ নাই। বিপদে আপদে কার কাছে যাবা? আমি বলি কি নিজের বাড়িঘর থাকতে এতো ভোগান্তির দরকারই বা কি? নিজের বাড়ি থাকবা কোনো ঘর ভাড়া লাগবে না। আশপাশে পরিচিত মানুষ। এখানে তোমার ভাই, ওখানে আমরা আছি। ছেলেটা কাজ করতে শিখেছে। আল্লাহ চাইলে তোমার বেশি কষ্ট হবে না। ঠান্ডা মাথায় ভাবো মালিহার মা। স্বামীর ভিটা একবার ছাড়লে ফিরে আসা জটিল হয়ে যাবে।”
এতক্ষণ পর নাজিয়া মুখ খুললেন, “তাহলে আমাকে কি করতে বলেন?”
মকবুল আলী আশা করেননি নাজিয়া তার করে পরামর্শ চাইতে পারে। মায়ের নরম কণ্ঠ শুনে মিতুলের মনে আশার সঞ্চার হলো। জন্মস্থানের সাথে নাড়ির টান থাকে। কেই বা সেই টান ছিন্ন করতে চায়।
“তুমি নিজের বাড়িতে ফিরে চলো। তোমার বাড়ি, তোমার সংসার। মতি তোমার হাতে ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব দিয়ে গেছে, তার বাড়িঘর ছেড়ে গেছে। সেগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব তো তোমারই। আগের মনোমালিন্য ভুলে যাও। আমি বড়, আমার উচিত ছিল ভাইয়ের সাথে ঝগড়ায় না যাওয়া। অথচ ঝগড়াটা আমিই জিইয়ে রেখেছি।” কৌশলে স্ত্রীর কথা এড়িয়ে গেলেন। জনসম্মুখে স্ত্রীর বদগুন বলে তাকে ছোট করায় কোনো ফায়দা নেই। তিনিও হুশ হারিয়েছিলেন। নয়তো স্ত্রীর অন্যায় কথায় তাল দেবেন কেনো!
“তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে যেয়ে সম্পদ হারিয়ে ফেললাম। তারপর হুশ ফিরল। কিন্তু মানুষটার ফেরার তো আর উপায় নাই।” কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো মকবুল আলীর। আজ শুধু ছোট ভাইটার কথা মনে হয়ে বুক পুড়ছে। কিন্তু আগে হলে ক্ষমা চাওয়ার কথা তিনি চিন্তাই করতে পারতেন না।
নাজিয়া হকচকিয়ে গেলেন। সম্পর্ক যেমনই হোক, তিনি ভাসুর হন, বয়সে বড় মানুষটার থেকে এমন কথা শুনে তার পাথর মন কেঁদে উঠলো। নিজে মায়ের পেটের ভাই তো কোনোদিন কাছে বসিয়ে দুইদণ্ড ভরসার কথা শোনালো না। যে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয় না তার কাছে ভরসার বাণী আশা করা যে বোকামি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন নাজিয়া।
“মালিহার সাথে একবার কথা বলে নেই ভাইজান। তারপর আপনাকে জানাবো।”
“ইনশাআল্লাহ্।” মকবুল আলীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। হাসলো মিতুলও। নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আশা এবং মায়ের মুখে বোনের প্রতি গুরুত্ব তাকে পুলকিত করেছে। এবার বুঝি এই পরগাছা জীবনের ইতি ঘটলো।

ফুরফুরে মন নিয়ে অফিস থেকে বের হলো ইতমিনান। তার মন ভালো করার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল মানিক এবং লালপাহাড়। উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে তাদের দিকে এগিয়ে গেলো ইতমিনান।
“আরে মানিক মিয়া যে! কি অবস্থা তোমার?”
“ভালা।” মানিকের চোখে মুখে ইতস্তত ভাব। ইতমিনান ভুরু কুঁচকে বলল, “কি হয়েছে?”
“কি হইবো? কিসুই না। বড়লোক মাইনষের স্বভাব খালি সন্দেহ করা।”
“আমি মোটেও বড়লোক নই মানিক। পকেটে টাকা নাই, বাড়িতে বউ নাই। বড়লোক বলার কোনো কারণ নাই।” হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল ইতমিনান। চলতে শুরু করল সে। তার সাথে মানিক। পেছনে লালপাহাড়।
“ক্যান আপনের বউ কই গেসে?” মানিকের কণ্ঠে চিন্তার আভাস।
“বিয়েই তো করিনি। বউ পাবো কোথায়?”
মানিকের চিন্তা বদলে বিরক্তি প্রকাশ পেলো। ঢোলা প্যান্টের পকেট থেকে ছোট একটা বোতল বের করে ইতমিনানের দিকে বাড়িয়ে বলল, “বউ আছে আপনের শশুর বাড়ি। আপনে মাল খান।”
বড় বড় করে মানিকের দিকে তাকালো ইতমিনান। তার হাতে ক্লেমনের বোতল। মানিক গলা ফাটিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “ভদ্দর লোকের ভয়। মালের নাম শুইন্নাই চোখ খুইলা আসতাছে।”
ইতমিনান ছোট্ট বোতলটা হাতে নিলো। আপ্লুত চোখে দেখলো কারো ইনকামের প্রথম খরচ।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩২

তুষারকে কুকুর কামড়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। কোচিংয়ে মোটামুটি হুলুস্থুল পড়ে গেছে। সব টিচার তুষারকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে নিতু নির্বিকার। তার অতো হেলদোল নেই। ম’রে টরে গেলে একটা কথা ছিল। সে এসেছে বেতন নিতে। তুষারের অনুপস্থিতিতে সমস্যা হবে না। সে নিজেরটা নিজে নিয়ে নিতে পারে। সেই এখতিয়ার তার আছে।
তুষারের টেবিলের ড্রয়ারে এই দুইদিনের বেতন রাখা আছে। অনেক স্টুডেন্ট বেতন দিয়ে দিয়েছে। মাসের পাঁচ তারিখের মাঝে অগ্রিম বেতন দেয়া নিয়ম। সেখান থেকে গুণে গুণে নিজের বেতনটা নিয়ে নিলো নিতু। কয়েকজন বাঁকা চোখে তাকালো। শব্দ করে ড্রয়ার বন্ধ করে নিতু বলল, “আপনারা না রোগী দেখতে যাবেন? যাচ্ছেন না কেনো? নিজেরাই রোগী হয়ে গেলেন নাকি?”
বয়স এবং পদে বাকি টিচাররা নিতুর থেকে নিচের দিকে আছে। কাজেই কেউ উচ্চবাচ্য করলো না। সবাই হাসপাতালের পথ ধরলে নিতু কোচিং বন্ধ করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ক্লাস টাইম হয়ে এসেছে। টেবিলের উপর নতুন তালা চাবি। দরজাটাও নতুন। তুষার বেশ গুছিয়ে এনেছিল। বোঝাই যাচ্ছে।
নিতু ব্যাগ হাতে নিতেই আঁখি এসে হাজির হলো। দুজনে ক্লাসমেট হলেও কথা বার্তা খুব কম হয়। নিতু হলে থাকে না। দেখা সাক্ষাৎও সেভাবে হয় না। তবুও আঁখিকে দেখে নিতু চমকালো না। যেনো জানাই ছিল আঁখি আসবে। ফের চেয়ারে বসলো নিতু। বিনা বাক্য ব্যয়ে সামনের চেয়ার ঠেলে দিলো। আঁখিকে আসন গ্রহণের নিঃশব্দ আহ্বান।
“কেমন আছো?”
“ভালো। তুমি?” নিতু আঁখির চোখের দিকে তাকালো। সেখানে চাপা একটা ক্ষোভ আছে। প্রকাশ না করার সর্বোচ্চ চেষ্টায় রত মেয়েটা। তবুও নিতু বুঝে ফেললো। কেনো? তার নিজের ভেতরেও কি ওরকম ছাই চাপা ক্ষোভ আছে? কে জানে।
“আছি। কোচিং বন্ধ করে দিচ্ছিলে নাকি?” আশপাশে তাকিয়ে বলল আঁখি। কেউ নেই। বোঝাই যাচ্ছে।
“হ্যাঁ। ক্লাস টাইম শেষ। আমারও ক্লাস আছে। ক্যাম্পাসে যাবো।”
“ওহ। আমি মালিহার বেতনটা নিতে এসেছি।” নিতুর দিয়ে তাকিয়ে বলল আঁখি। নিতুর ভুরু কুচকে এলো।
“মালিহার বেতন কি ওর নিয়ে যাওয়া উচিত না? এখানে প্রক্সি দেয়ার মানে কি?”
আঁখির মনে হলো নিতু তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে খোঁচা দিচ্ছে। কারণটা বুঝলো না সে। নিতুর সাথে তো তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। এই নিয়ে আর মাথা ঘামালো না আঁখি। সোজাসাপ্টা বলল, “মালিহা প্রচণ্ড অসুস্থ। কয়েকদিন আগে সিরিয়াস জ্বর এসেছিল। দুর্বল হয়ে পড়েছে। ক্লাসও করছে না। আর ও আমাকে পাঠায়নি। ও এই বিষয়ে জানেও না। আমি নিজেই এসেছি। ভেবেছিলাম তুষারের সাথে দেখা করবো। কাজেই প্রক্সি দেয়ার কথাটা ভিত্তিহীন।”
“রাগ করলে নাকি? মালিহা সম্ভবত এখানে আর আসবে না। ওর এই মিনমিনে ভাবটা আমার পছন্দ না। যাই হোক। মনে হচ্ছে তুমি সবটা জানো। আরো একটু জেনে যাও। তুষারকে গতকাল কুকুর কামড়েছে। সিভিয়ার অ্যাটাক। ভালোই হয়েছে।”
আঁখি দৃশ্যত চমকে গেলো। বিস্ময় ভাব তাকে ঘিরে রইলো। তুষারের ঘটানো ঘটনা, তুষারের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। কোথাও যেনো খুব সূক্ষ্ম একটা মিল আছে, একটা যোগসূত্র আছে। আঁখি মেলানোর চেষ্টা করলো। পারলো না। নিতুর কণ্ঠে তার ধ্যান ভাঙলো।
“এই যে মালিহার বেতন।” পরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার একটু তাড়া আছে। কিছু মনে করো না। বের হতে হবে।”
“সমস্যা নেই। ধন্যবাদ। আমি আসছি।”
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আঁখি ভেবে ভেবে কাহিল হয়ে গেলো। তার সিক্সথ সেন্স বলছে ঘটনাটা যেনো কাকতালীয় নয়। পরিকল্পিত। তবে ভাবনার কুল কিনারা পেলো না সে। আঁখি বেমালুম ভুলে গেলো জগতের কোনকিছুই আসলে কাকতালীয় নয়। অদৃশ্য এক সত্তা সব ঘটনার মাঝেই যোগসূত্র রেখে দেন। খুব সূক্ষ্মভাবে।

অনেকদিন পর চুলা জ্বা’লিয়েছে ইতমিনান। এতদিন হোটেলের খাবারে খেয়ে খেয়ে তার পেট পচে গেছে। এমনটাই তার ধারণা। বাজারে নতুন টমেটো এসেছে। কিনে নিয়ে আসা টমেটো চচ্চড়ি আর গরম ভাত। খাবারটার চেহারা মনে করতেই পেটে আরেকটা পাক দিলো। ভাত তখনও হয়নি। মাত্র চাল ফুটতে শুরু করেছে। মনটা ঘোরানো দরকার। নয়তো খাবারের চিন্তায় চোখ অন্ধকার হয়ে আসবে।
টমেটো চচ্চড়ি ঢেকে রেখে ঘরে গেলো সে। ভেজা হাত গেঞ্জিতে মুছে ফোন হাতে নিলো। নিজের সর্বনাশ নিজে কিভাবে করে কেউ তার কাছে শিখুক। ভাবতেই ইতমিনানের হাসি পায়। যে মেয়েটার কণ্ঠ শুনলে, যে চেহারাটা দেখলে প্রতিনিয়ত সে দুর্বল হয়ে পড়ে তাকেই বারবার দেখতে চাওয়ার, শুনতে চাওয়ার কি আকুলতা। এজন্যই বুঝি পোকার দল ছুটে ছুটে আগুনের কাছে যায়।
চারবার রিং বাজার পর ফোন ধরলো মালিহা। শোনা গেলো তার দুর্বল কণ্ঠ, “আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আছি আলহামদুলিল্লাহ্। ঠান্ডা লেগেছে নাকি?”
“একটু জ্বর এসেছিল।”
“কবে?” ইতমিনান শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো।
ইতস্তত কণ্ঠে জবাব দিলো মালিহা, “ঐদিন রাতে।”
কিছুক্ষণের নীরবতা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতমিনান বলল, “ঠান্ডা কি বেশি? ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?”
“না। ক্যাম্পাসের মেডিকেল সেন্টার থেকে চেকাপ করিয়ে এসেছি। ওষুধ দিয়েছে।”
“আচ্ছা। বেশি খারাপ লাগলে বলিস।”
“আচ্ছা।”
“মালিহা?”
“হু।”
“বিকেলের ঐ টিউশনিতে যাচ্ছিস?”
“এই কয়দিন যাইনি। আজ থেকে যাবো ভাবছি।”
“আমি এক জায়গায় কথা বলেছিলাম। আমার ফ্রেন্ডের বোনের ছেলে না মেয়ে যেনো। ছোট বাচ্চা। তোর আগ্রহ থাকলে কথা বলব। দুই এক ঘন্টা ওকে সময় দিতে হবে। এই আর কি। গেলে বলিস।”
মালিহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
“বাসা কোথায়?”
“আমিও জানি না। রনি, আমার ফ্রেন্ড যেতে বলেছে একদিন। সেদিন যেয়েই নাহয় কথাবার্তা বলে দেখলাম। সুবিধা হলে যাবি নাহলে বাদ। এখানে তো কোনো জোর নেই।”
“তোমার কেমন ফ্রেন্ড?” ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো মালিহা। ইতমিনান বুঝলো।
“ভালো বন্ধু। তবে ওটা তো ওর বাড়ি না। ওর বোনের বাড়ি। ও তো ওখান থাকেও না। আর গেলে তো সব দেখে শুনেই আসবো। যাবি?”
মালিহার মন হলো ইতমিনানের আগ্রহ আছে। এই উপকারী মানুষটার কথায় সে না বলবে কিভাবে?
“আচ্ছা যাবো ইনশাআল্লাহ্।”
“আচ্ছা রাখি।”
“হু।”

.

রাত নামতেই নাজিফা এলো। মালিহার হাত ধরে বলল, “কেমন আছো? ক্লাসে যাচ্ছো না। অসুস্থ?”
মালিহা প্রথম প্রশ্নটা নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করলো। কেমন আছে সে? বিপদের মুখ থেকে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে এনেছেন। আর একটু এদিক সেদিক হলে কি হতে পারতো সেটা মালিহা চিন্তাও করতে পারে না। দুঃসহ ভবিষ্যতের হাতছানি থেকে বেঁচে আসা একটা মানুষ কেমন থাকে?
দৃঢ় কন্ঠে মালিহা বলল, “আলহামদুলিল্লাহ্। অনেক ভালো আছি। একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। শরীরটা তাই ভালো লাগছিল না। এজন্য ক্লাসে যাইনি।”
“দ্রুত ভালো লাগিয়ে ফেলো। আর ক্লাস মিস দিলে মাথা আর মাথা থাকবে না।” নাজিফা হাসলো। যোগ দিলো মালিহাও। যাওয়ার সময় কি মনে করে মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে গেলো নাজিফা। মালিহার মনে হলো ঐ স্পর্শটুকুর তার খুব দরকার ছিল। খুব বেশি।

রাত আটটার দিকে আঁখি রুমে এলো। মালিহার হাতে তুলে দিলো বেতনের সাত হাজার টাকা। মালিহা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “আপনাকে দিয়ে দিলো?”
“নিতু দিয়েছে। তুষারকে নাকি কুকুর কামড়েছে। হসপিটালাইজড।”
মালিহা চমকে উঠলো। যে লোকটা দুদিন আগে নিজে হিং’স্রাত্মক আচরণ করেছে তার সাথেই আবার একই ঘটনা ঘটলো!
ফোন বেজে উঠল কথা থামালো মালিহা। নিতু ফোন দিয়েছে। খোঁজ খবর নেয়ার পর নির্বিকার কণ্ঠে নিতু বলল, “কোচিংয়ে আসা বাদ দিলে তুষারের কি যাবে আসবে? তার চেয়ে ওর সামনে দিয়ে সব কাজ করবে। ও দেখবে আর ফুলবে। কিছুই করতে পারবে না।”
“কিছুই করতে পারবে না?” যেনো নিজেকেই জিজ্ঞে করলো মালিহা। কে নিশ্চয়তা দিলো যে তুষার একই কাজ পুনরায় করার চেষ্টা করবে না?
“এভাবে ভীতু হয়ে থাকলে তো জীবনে চলতে পারবে না।”
নিতুর কথার বিপরীতে মালিহা ভাবলো সে ভীতু? বেশ! ভীতুই সই।
“এভাবে সারাজীবন আমি চলতেও চাই না আপু। শুধু কয়েকটা দিন। ভাইটা বড় হলেই আমি ইস্তফা নেবো।”
নিতু আর কিছু বলল না। ফোন রেখে মালিহা ভাবলো, তুষারদের মুখোমুখি না হওয়াকে ভীতু বলে? এড়িয়ে যেয়ে সে যদি বিপদ থেকে বেঁচে যায়? তবুও?

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৩

অফিসে এসে চমকপ্রদ এক তথ্য পেলো ইতমিনান। বস নাকি নোটিশ দিয়েছেন। সেই নোটিশ পড়ে সকলে বসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ইতমিনান নিজেও সেটা পড়লো। প্রশংসা করার মতোই বটে। অফিসের সকল নারী কর্মীর জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি হিসেবে চার মাস সময় বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রশান্তির হাসি হাসলো ইতমিনান। লতা আপা শেষ মেষ ছুটি পেয়েই গেলো। ফুরফুরে মন নিয়ে তার দিন শুরু হলো। ঘণ্টা খানিক পর বসের রুমে ডাক পড়ল তার। মনে মনে হিসাব করলো কোনো কাজ উল্টাপাল্টা হয়েছে নাকি। উহু! মনে পড়ছে না। প্রমোদ গুনলো ইতমিনান। বস তো আলাদা করে কাউকে ডাকেন না। যা বলার মিটিংয়েই বলে দেন। কপালে কি আছে আল্লাহই জানেন।
দুরু দুরু বুক নিয়ে অনুমতি চাইলো ইতমিনান। ভদ্রলোক দরাজ গলায় ভেতরে ঢুকতে বললেন। লোকটা চোখ থেকে চশমা খুলে ল্যাপটপের শাটার আধ বোজা করে রাখলেন। ইশারায় ইতমিনানকে বসতে বললেন। ইতমিনান বসলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “আজকে নোটিশ বোর্ড চেক করেছেন?”
“জি স্যার। করেছি।”
“এটার ক্রেডিট কিন্তু আপনার!”
“সরি। ঠিক বুঝলাম না স্যার।”
“আমার মিসেস তো ঘটনা শুনে রেগে-টেগে একাকার। মহিলা কর্মী অফিসে আছে অথচ ম্যাটার্নিটি লিভ নেই। আপনার আবেদনের কথা শোনার পর তো বাড়িতে টেকাই দায় হয়ে পড়েছিল। হা হা!”
বসকে আজ বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। ইতমিনানের কাছে তাই মনে হলো। বউয়ের ঝাড়ি খেয়ে এতো আনন্দ? বিয়ের সমীকরণ বড়ই জটিল!
“আপনার জন্য কফি বলবো নাকি চা?”
থতমত খেয়ে গেলো ইতমিনান। কিসের ভেতর কি। বসের অফার ফিরিয়েও দিতে পারল না।
“চা।” ভেতরে ঢোকার সময় ইতমিনানের বুক দুরু দুরু করছিলো। এখন মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তাও ভালো। বসের থেকে চায়ের অফার পেয়েছে। চাট্টিখানি কথা নাকি!
ভদ্রলোক পিয়নকে ডেকে দুই কাপ চা দিতে বললেন। হাসিমুখে ইতমিনানের দিকে তাকালেন। বললেন, “আপনি একটা অস্বাভাবিক আবেদন করেছিলেন। ভাবতেই কেমন অযৌক্তিক লাগছিল। লং টাইম তো এভাবে কারো প্রক্সি দেয়া সম্ভব না। তার চেয়ে আপাতত রুল সেট করে দিলাম। কিন্তু আপনি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?”
“কোন বিষয়ে স্যার?”
“এই যে, ম্যাটার্নিটি লিভ নিয়ে।”
কিছুক্ষণ ভাবলো ইতমিনান। মাথা নাড়িয়ে বলল, “না স্যার। কোন বিষয়ের কথা বলছেন ধরতে পারছি না।”
ভদ্রলোক আবার হাসলেন। কণ্ঠ নিচু করে বললেন, “লতা ছাড়া কিন্তু অফিসে বিবাহিত আর কোনো মহিলাই নেই। কাজেই এই রুল আপাতত অ্যাপ্লাই হওয়ার কোনো চান্স নেই।”
ইতমিনান ভাবলো। আসলেই। এই অফিসে একমাত্র বিবাহিত মহিলা লতা। আবার বিধবাও বটে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান। বস হেসেই যাচ্ছেন। তার কাছে সম্ভবত মনে হচ্ছে তিনি খুবই চালাকি একটা কাজ করেছেন। বউয়ের ঝাড়ি খেয়ে বিবেক নড়ে উঠেছে। ম্যাটার্নিটি লিভ সেট করেছেন। প্রশংসা পেয়েছেন। অথচ কেউ ছুটি পাচ্ছে না। চালাকি বটে। খুশি হওয়ারই কথা। ইতমিনান অল্পবিস্তর হাসলো। তৃপ্তি করে উচ্চপদস্থ চা খেলো।

পরের শনিবারে রনির বোনের বাড়িতে মালিহাকে নিয়ে গেলো ইতমিনান। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান। তার ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আর যার উপর দিয়ে পুরোটা গেছে তার না জানি কেমন লাগে। মালিহার দিকে তাকালো ইতমিনান। একভাবে বসে আছে। কোনো নড়চড় নেই। একটু পর রিপা এলো। রনি তার পিছু পিছু। রনি হাসিমুখে সকলকে পরিচয় করিয়ে দিলো। রিপা মালিহার হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে গেল। মালিহার কাছে মনে হলো রিপা বেশ মিশুক। ইতমিনানের কাছে সে শুনেছে, রিপা নাকি বিদ্যুৎ অফিসে বড় পোস্টে চাকরি করে। সাধারণত যেমন হয়, বড় পদে চাকরিরত ব্যক্তি সবসময় একটু অন্যরকমভাবে চলতে পছন্দ করে। যেনো তার কথা বার্তায়ই পদ মর্যাদা বোঝা যায়। সাধারণভাবে চলতে তাদের অনেকের নারাজ। রিপাকে দেখে তেমন কিছু মনে হলো না। খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে বিছানায় খেলতে থাকা মেয়ের পাশে তাকে বসিয়ে দিলো রিপা।
“এই যে তোমার ছাত্রী। ও কিন্তু খুব জ্বালাতন করে। বুয়াদের কাউকে এক দণ্ড স্থির থাকতে দেয় না। বাড়ি এসে সবই শুনি। তুমি কতদিন টিকতে পারো সেটাই দেখার পালা।” মালিহা স্মিত হাসলো। হাত বাড়িয়ে দিলো মেয়েটার দিকে। সে চোখ বড় বড় করে মালিহার দিকে তাকিয়ে ছিল। নতুন কাউকে দেখে সম্ভবত পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। তার মাঝে মালিহা হাত বাড়িয়ে দিলে ঝট করে কোলে চলে এলো। মালিহা প্রায় বিছনায় শুয়েই পড়ছিল। সে মনে করেছিল অচেনা মানুষের কাছে বাচ্চাটা আসবে না। অপ্রস্তুত থাকার কারণে এলোমেলো দশায় পড়তে হলো। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠলো। যেনো খুব মজা পেয়েছে। রিপা গলা মোটা করে বলল, “লামিয়া! এমন করে না।”
লামিয়া একবার মায়ের দিকে তাকালো। তবে মায়ের আদেশ নিয়ে আর ভাবলো বলে মনে হলো না। মালিহার গালে এক আঙুল দিয়ে চিকন গলায় বলল, “তোমার নাম কি?”
মালিহা হাসলো। মেয়েটা বেশ চটপটে।
“মালিহা।”
“পুরো নাম বলো। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে পুরোটা বলতে হয়।” একদম বড়দের মতো করে বলল লামিয়া।
“মালিহা ইসলাম।”
“আমার নাম ইয়াশা জান্নাত লামিয়া। তোমার আর আমার নামের একটা মিল আছে। কি বলো তো?”
“জানি না তো।”
“তোমার নাম মালি আর আমার নাম লামি। মিল না!”
“হ্যাঁ! তাই তো!”
“আমার বয়স পাঁচ বছর। তোমার কতো?” পাঁচ আঙুল তুলে দেখালো লামিয়া।
“তোমার থেকে ষোলো বছরের বড় আমি। তাহলে বলো আমার কতো বছর।”
“একটু সহজ করে বললে কি হয়? আমি তো ষোলো পর্যন্ত গুনতেই পারি না। বারোর পরে শুধু বাইশ চলে আসে। তেরোটা আসতেই চায় না।” ঠোঁট উল্টে বলল লামিয়া।
রিপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “শুরু হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা এতো কথা বলতে পারে!” পরপর লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন থেকে মালিহার কাছে তোমাকে পড়তে হবে। মিস বলে ডাকবে তাকে। নামো এখন।”
পড়ার কথা শুনে লামিয়ার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। মালিহার দিকে তাকিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে নরম কণ্ঠে বলল, “তুমি আমাকে পড়াবে? মা’রবে? গল্প করবে না?”
“মা’রব কেনো? এমন মিষ্টি পাখিকে কেউ মা’রতে পারে? গল্পই তো করবো। গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে একটু পড়বো।”
লামিয়া নিরস গলায় বলল, “মা’রতে পারে। সবাই আমাকে মা’রে।”
রিপা বিব্রত হয়ে বলল, “যাও লামিয়া বুয়া চা বানিয়েছে নাকি দেখে আসো। দ্রুত যাও।”
লামিয়া ছুটে গেলো। মালিহা বুঝলো মেয়েটার মন ঘোরানো খুবই সোজা। কিন্তু রিপার লুকোছাপা তার চোখ এড়ালো না।

বেশ কিছুক্ষণ থেকে দুজনে বের হলো। ঘড়িতে তখন সকাল এগারোটার কাছাকাছি সময়। ইতমিনান বলল, “কেমন লাগলো?”
“ভালোই। ভার্সিটির কাছে আছে। যাতায়াতে সুবিধা হবে।”
ইতমিনান মাথা নাড়লো। মালিহা ইতস্তত করে বলল, “বেতনের কথা তো কিছু বলল না।”
“তোকে বলেনি? রনি যে বলল আমাকে।” মালিহা ইতমিনানের মুখের দিকে তাকালো। ইতমিনান আবার বলল, “দশ দেবে বলেছে।”
“দশ হাজার!” মালিহার কণ্ঠে বিস্ময়।
“লামিয়ার আগের টিচারকেও এমনই দিত। কিন্তু লামিয়া নাকি বেশি দুষ্টুমি করে তাই ছেড়ে দিয়েছে।”
ঢোক গিললো মালিহা। কতো দুষ্টুমি করে যে দশ হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে দিলো!
“খাটনিও তো কম হবে না। প্রতিদিন দুই আড়াই ঘণ্টা সময় দিতে হবে। এসব বাচ্চা কাচ্চা সামলানো ধৈর্যের বিষয়। তাছাড়া রনির দুলাভাই বিশাল বড়লোক। সেই রমরমা ব্যবসা। এই মাসে দুবাই যায় ঐ মাসে অস্ট্রেলিয়া যায়। বিশাল ব্যাপার স্যাপার। ওদের কাছে দশ হাজার কোনো বিষয় না।”
মালিহা মনে করলো বিদায়ের সময়ে রিপার করা আকুতি। সে হাত ধরে বলেছিলো তার মেয়েটার যেনো খেয়াল রাখে। মালিহার ভয় হলো। সে পারবে তো?

ইতমিনানকে কে যেনো ফোন করলো। হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে পড়লো সে। মালিহা ঘাবড়ে গেল। নানান দুশ্চিন্তা খেলে গেলো মাথায়। ইতমিনান ফোন রেখে বলল, “তোকে হল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার এক কলিগকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ইমারজেন্সি অবস্থা। তুই একা যেতে পারবি না?”
“পারবো। কি হয়েছে তার?”
“প্রেগনেন্ট ছিলো। পেইন উঠেছে।” বলতে বলতে একটা রিকশা ডেকে দিলো ইতমিনান। ভাড়া মিটিয়ে দেয়ার সময় মালিহা নিষেধ করলেও শুনলো না। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, “পৌঁছে আমাকে একটি মেসেজ দিস।”
মালিহা কণ্ঠ উঁচু করে বলল, “সাবধানে যেও।”
ইতমিনান ততক্ষণে বিপরীত দিকে ঘুরে গেছে। আতিপাতি করে রিকশা খুঁজছে। মালিহার রিকশা ছেড়ে দিলেও সে পেছনে তাকিয়ে রইলো। ইতমিনান ফোনে কথা বলছে। কি যেনো বলে পেছনে তাকালো। মালিহার রিকশার দিকে ছুটতে শুরু করলো। মালিহা দ্রুত রিকশাওয়ালাকে বলল, “মামা! দাঁড়ান দাঁড়ান!”
রিকশা থামতে থামতে ইতমিনান পাশে চলে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “মালিহা তোর ব্লা’ড গ্রুপ কি?”
“এ পজেটিভ।”
“ব্লা’ড দিতে পারবি? ইমারজেন্সি দুই ব্যাগ লাগবে।”
“পারবো।”
ইতমিনান রিকশাওয়ালাকে হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে দিলো। নিজেও আরেকটা রিকশা নিয়ে ছুটলো হাসপাতালের দিকে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩৪

ওয়েটিং রুমে বসে আছে বয়স্ক দুজন ব্যক্তি। দুজনেরই চোখে মুখে ভয়। ঘামে জবুথবু হয়ে সেখানে এলো ইতমিনান। তার পেছনে মালিহা। ইতমিনানকে দেখে যেনো বৃদ্ধ মানুষ দুজন হালে পানি পেলো। তড়িৎ গতিতে উঠে এসে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। কান্নার শব্দ এতোই জোরে ছিলো যে অপারেশন থিয়েটার থেকে নার্স বেরিয়ে এলো। বিরক্ত মুখে বলল, “এখানে এতো শব্দ করবেন না। ভেতরে ডাক্তার, রোগী সবার সমস্যা হচ্ছে।” বলেই ফিরে যেতে চাইলো নার্স মহিলাটি। আবার ফিরে এসে বলল, “আপনাদের র’ক্ত ম্যানেজ করার কথা বলেছিলাম। করেছেন?”
ইতমিনান এগিয়ে এলো, “জি। হয়েছে। রোগীর কি অবস্থা? নরমালে হবে?”
“বেবীর পজিশন উল্টো হয়ে আছে। নরমাল সম্ভব না। সি সেকশনে যেতে হবে। রোগীর শরীরে র’ক্ত নেই বললেই চলে। কে র’ক্ত দেবে?”
মালিহা এগিয়ে এলো, “আমি।”
“কিছু টেস্ট করতে হবে। দ্রুত আসুন।”
নার্স মহিলা অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে গেলো। পরপরই বের হয়ে এসে মালিহাকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও ছুটলো। ইতমিনান বৃদ্ধ লোকটার হাত ধরে বলল, “কান্নাকাটি করবেন না আঙ্কেল। আল্লাহ ভরসা।”
লোকটা উপর নিচ মাথা নাড়ালো। লতার শাশুড়ি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। দেখে মনে হলো যেন শরীর ছেড়ে দিয়েছে।
“আঙ্কেল আন্টি কি অসুস্থ?”
“না। আমরা আর কি অসুস্থ হবো। মেয়েটার চিন্তায় এই অবস্থা..”
ইতমিনান আর কিছু বলল না। অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে লাগলো। গলার কাছের দুটো বোতাম খুলে দিলো। উপরে তাকিয়ে দেখলো ফ্যান আছে। আশপাশে তাকিয়ে সুইচ খুঁজলো। সুইচ বোর্ডের ভয়ানক অবস্থা। এক জায়গা থেকে লাল কালো তার বেরিয়ে আছে। গরমটা সয়ে নিলো ইতমিনান। জীবন বাঁচানো ফরজ।
মালিহা ফিরে এলো। সেই নার্সটি এসে বললেন, “কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স আসবে। তার সাথে যেয়ে র’ক্ত দিয়ে আসবেন।” মালিহা সম্মতি জানালে মহিলা অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়ল।

দুই ব্যাগ র’ক্ত নিয়ে মালিহা আর নড়তে পারছে না। নার্স মালিহার হাত থেকে ক্যানোলা বের করে ইতমিনানকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, “ওনাকে একটু গ্লুকোজ খাইয়ে দিন। কিছুক্ষণ রেস্ট করলে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্।”
ইতমিনান তখনই গ্লুকোজ কিনে আনলো। দুইদিন আগের জ্বর আর আজ রক্ত দিয়ে মেয়েটা একদম নেতিয়ে পড়েছে। কিছুটা গ্লুকোজ খেয়ে মালিহা বলল, “আমি এখানেই একটু শুয়ে থাকি। থাকতে দেবে না?”
ইতমিনান কর্মরত নার্সের দিকে তাকালো। তিনি আশ্বস্ত করে জানালেন থাকা যাবে। মালিহা রোগীর স্পর্শ মাখা মলিন সাদা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। হাতটা ব্যথায় নাড়ানো যাচ্ছে না। ইতমিনান মালিহাকে বলল, “তুই এখানে থাক। আমি ওদিকে যাই। সমস্যা হলে ফোন দিস।”
মালিহা দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ইতমিনান ছুটলো অপারেশন থিয়েটারের সামনে। ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ আসছে। ডেলিভারি হয়ে গেছে? লতার শ্বশুরকে আশপাশে দেখা গেলো না। লতার শাশুড়ি অস্থির হয়ে উঠে বসেছেন। বাচ্চার কান্না সম্ভবত তাকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি জুগিয়েছে। ইতমিনান তাকে বলল, “আন্টি আংকেলকে দেখছি না।”
“কোথায় যেনো গেলো। একটু আশপাশে দেখো তো বাবা।”
মহিলা নিজেই জানেন না। ইতমিনান তাকে আর ঘাটালো না। এদিক ওদিক ঘুরল। ভদ্রলোককে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বাচ্চার কান্না যেহেতু শোনা যাচ্ছে আশা করা যায় আর কিছুক্ষণের মাঝেই তাকে বের করে আনবে। এর মাঝে লোকটা গেলো কোথায়।
করিডোরের শেষ মাথায় একটা ঘর। তার দরজা অর্ধেক বন্ধ। ইতমিনান একবার সেই ঘরে উঁকি দিলো। ভেতরটা নজরে আসতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেলো। লতার শ্বশুর মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছেন।
লতার শশুরের সাথে ইতমিনানের বেশ কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। একবার আযানের সময় তাকে মসজিদে যাওয়ার কথা বললে তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান। ইতমিনান বুঝে আর তাকে জোর করেনি। এ তো জোর জবরদস্তির বিষয় নয়। সেই একই মানুষটাকে আজ স্বেচ্ছায় মালিকের দরবারে ধর্না দিতে দেখে ইতমিনান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মানুষ বড়ই আজব প্রাণী। নিজ প্রয়োজন কড়ায় গন্ডায় বোঝে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তা তার মাঝে থাকে না। প্রয়োজনের সময় যার কাছে নিজেকে উজাড় করে দেয়, প্রয়োজন মিতে গেলে তাকে ভুলে যায় বেমালুম।
প্রায় দশ মিনিট পর সিজদাহ থেকে উঠে বসলেন ভদ্রলোক। আস্তে ধীরে সালাম ফেরালেন। ইতমিনান দরজা নক করে বলল, “আঙ্কেল বাবুকে মনে হয় নিয়ে আসবে। আসুন?”
ভদ্রলোক তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলেন। ইতমিনান তার পিছু পিছু গেলো। ওয়েটিং রুমে পৌঁছাতেই মনোরম এক দৃশ্য দেখে চোখ জুড়ালো দুজনে। লতার শাশুড়ি বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাউমাউ করে কেঁদে চলেছে। লতার শ্বশুর এগিয়ে যেয়ে বাচ্চাকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বুকে ঠেকালেন। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ্!”
তার দরাজ গলার শব্দ ইতমিনানের ধ্যান ভাঙলো। লোকটা তখনও চোখ বন্ধ করে আছে। কাকে মনে করছে? মৃ’ত ছেলেকে নিশ্চয়ই?
“ছেলে নাকি মেয়ে?”
মিহি কণ্ঠের শব্দে পেছনে তাকালো ইতমিনান। মালিহা দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
“তুই উঠে আসলি কেনো?”
“ওখানে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। মেয়ে নাকি ছেলে হয়েছে?”
“শুনে নিই দাঁড়া।”
ইতমিনান লতার শ্বশুরের কাছে যেয়ে উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করলো। মালিহা বেজায় বিরক্ত হলো। শুনলেই হয়। এমন উকি দেয়ার কি আছে। মালিহা নিজেই মহিলার দিকে এগিয়ে গেলো।
“আন্টি ছেলে নাকি মেয়ে?”
“ছেলে।” চোখ মুছে তৃপ্ত কণ্ঠে বললেন মহিলা।
“আপা কেমন আছেন?”
“কিছুক্ষণ পর কেবিনে দিয়ে দেবে। ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ্।”
মালিহা ইতমিনানের কাছে যেয়ে বলল, “বাচ্চার বাবা কই? দেখছি না যে।”
এক নজর মালিহার দিকে তাকালো ইতমিনান। বলল, “মা’রা গেছে।”
মালিহা কথাটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না। ভেবেছিল বাচ্চার বাবা বোধহয় দূরে কোথাও। কিন্তু সেই দুরত্ব যে অসীম সেটা বুঝতে পারেনি। মুহূর্তেই বাচ্চাটার জন্য বুকে এক সাগর মায়া অনুভব করলো সে। সে তো তার বাবাকে দেখেছে, বাবার আদর স্নেহ পেয়েছে। যথেষ্ট স্মৃতি আছে সারাজীবন ধরে মনে করার জন্য। কিন্তু এই ছোট্ট বাচ্চাটা তো বাবাকে চিনলোই না। বাবা কাকে বলে সে তো জীবনে বুঝবেই না। ধীর পায়ে হেঁটে লতার শ্বশুরের সামনে গেলো মালিহা। র’ক্তাভ মুখটায় নজর রেখে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো।
“নেবে মা?”
লতার শ্বশুরের নরম কণ্ঠ। মালিহা মাথা নাড়লো, “না আঙ্কেল। হাতে জোর পাচ্ছি না। পরে যায় যদি!”
ইতমিনান অবশ্য এগিয়ে এলো। আগ্রহ করে ছেলেটাকে কোলে নিলো। ইতস্তত করে লতার শ্বশুরকে বলল, “ইয়ে আঙ্কেল.. বাচ্চার কানে তো আযান দিতে হয়। আমি দিই?” বলেই মনে হলো ভুল গিয়ে গেছে। তিনি বাচ্চার দাদা। তার নিশ্চয়ই ইচ্ছে মৃ’ত ছেলের শেষ চিহ্ন হিসেবে পাওয়া নাতির কানে তিনি আযান দেবেন। ভদ্রলোক সৌজন্য করে হ্যাঁ বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই ইতমিনান বলল, “না থাক। আপনিই দিন। বাচ্চার দাদার হক বেশি।”
হাসিমুখে বলে ছেলেকে এগিয়ে দিলো ইতমিনান। ভদ্রলোক বেশ আপ্লুত কন্ঠে আযান দিলো। এর মাঝেই লতাকে কেবিনে নিয়ে গেলো। ইতমিনান গলা নিচু করে মালিহাকে বলল, “লতা আপার সাথে তো চেহারার কোনো মিলই নেই। তুই পেয়েছিস?”
“আমি তো লতা আপাকেই দেখিনি।”
“ওহ তাই তো!”

লতা নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আছে। মালিহাকে দেখে সম্ভবত চিন্তে পারেনি। লতার শাশুড়ি এগিয়ে এসে বললেন, “ইতমিনানের চাচাতো বোন। ওই তো তোমাকে র’ক্ত দিলো।”
লতা কৃতজ্ঞ চোখে তাকালো মালিহার দিকে। মালিহা তার হাত চেপে ধরলেও কিছু বলতে পারলো না। শ্বাস নিলেও মনে হচ্ছে সেলাইয়ে টান পড়ছে।
কি মনে করে মালিহা লতার শাশুড়িকে বলল, “আন্টি ওর নানা নানী কেউ বেঁচে নেই?”
মহিলা নাতিকে জড়িয়ে বসে ছিলেন। এক পলক মালিহার দিকে তাকিয়ে বললেন, “না গো মা। অভাগীর কেউ নেই। ভাই যা আছে, সৎ ভাইও তার চেয়ে ভালো হয়। বিয়ের পর থেকে একটা দিন মেয়েটার কোনো খোঁজ নেয়নি।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মহিলা। মালিহা চট করে লতার দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কথাগুলো শুনেছে নাকি বোঝা যাচ্ছে না।
মালিহার শরীর ততক্ষণে দুর্বল ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি বুঝতে বেশি সময় লাগলো না তার। দরজার বাইরে বসে থাকা ইতমিনানের কাছে গেলো সে। তার পাশেই লতার শ্বশুর বসে আছে। ইশারায় ইতমিনানকে ডাকলো মালিহা।
“কি হয়েছে?”
“লতা আপার কেউ নেই?”
“শ্বশুর শাশুড়ি আছে। এই যে ছেলে হলো।”
“বাপের বাড়ির?”
“না থাকার মতোই।”
“তাহলে আমি হলে চলে যাই।”
“এর সাথে তোর হলে যাওয়ার কি সম্পর্ক?”
“কিছু রান্না করে আনতে হবে না? মহিলা মানুষ শুধু আপার শাশুড়ি। তাকে এখন মা ছেলের কাছেই থাকতে হবে। উনি কি রান্না করে আনতে পারবেন?” লতার শশুরকে ইশারা করে বলল মালিহা। “তাছাড়াও রোগীকে এখন হালকা পাতলা খাবার খাওয়াতে হবে। বাইরের জিনিস তো একদম না।”
“এই জিনিসটা তো আমার মাথায়ই আসেনি।” ঘড়ির দিকে তাকালো ইতমিনান একটা তের বাজে। মালিহাকে বলল, “তুই একটু বস। আমি নামাজটা পড়ে বাজার করে আনি।”
মালিহা নিষেধ করল না। এই শরীর নিয়ে বাজারে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার ছিলো না।
লতার শ্বশুরকে ডাকলো ইতমিনান, “আঙ্কেল আযান দিচ্ছে। চলুন নামাজটা পড়ে আসি?”
ভদ্রলোক বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাল মেলালেন ইতমিনানের সাথে। ইতমিনান স্মিত হাসলো।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-২৯+৩০+৩১

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৯

মনিকা দম ছাড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। একবার জলপট্টি দিচ্ছে, একবার হাত পা মালিশ করছে, আবার মাথায় পানি ঢালছে। কিন্তু মালিহার জ্বর কমার কোনো লক্ষণ নেই। দিশেহারা হয়ে আঁখিকে বলল, “আপু একটু দেখুন। ওর তো জ্বর কমছে না। কি করবো?”
আঁখি চিন্তিত মুখে মালিহাকে দেখছিল। দুই বছর ধরে দেখছে মেয়েটাকে। হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার মতো মেয়ে সে নয়। হালকা বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে এটা কেনো যেনো মনে হচ্ছে না আঁখির। গম্ভীর মুখ মালিহার বিছানার সামনে এসে সে দাঁড়ালো। মনিকা তখন মালিহার পায়ে তেল দিচ্ছে। সামনে রাখা চেয়ারটা টেনে সেখান থেকে বালতি তুলে নিয়ে আঁখি বলল, “তুমি তেল মালিশ করো। আমি ওর মাথায় পানি দিচ্ছি।” মনিকা তাই করলো। পানি পাল্টে এনে বসলো আঁখি। মালিহার মাথার কাছে। চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ডান হাতে পানি ঢালতে শুরু করলো। বাম হাত বুলিয়ে দিলো মাথায়। তাপ যেনো শরীর থেকে বের হয়ে শেষ হচ্ছে না। এতো জ্বর কিভাবে বাঁধালো মেয়েটা?
ঘড়িতে তখন সাতটা দশ। নীতি বিরতিহীনভাবে ফোন দিচ্ছে মালিহার ফোনে। শেষমেষ মনিকা রিসিভ করলো।
“হ্যালো নীতি?”
নীতি ধমক দেয়ার জন্য মুখ খুললেও কথাটুকু গিলে নিলো। মনিকা আপু কেনো?
“মনিকা আপু?”
“হ্যাঁ। মালিহার খুব জ্বর রে! বেহুশের মতো পড়ে আছে।”
ঘাবড়ে যাওয়া কণ্ঠে নীতি বলল, “কখন জ্বর এলো? ওর তো জ্বর টর বেশি একটা আসে না। মেপেছিলেন? কতো ডিগ্রি?”
“মাপিনি। একশ তিন চার তো হবেই। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে মনে হয়। আমি তেল মালিশ করছি। আঁখি আপু মাথায় পানি দিচ্ছে। দেখি কিছু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেবো। দোয়া কর রে নীতি।”
নীতিকে শেষটুকু বলতে হতো না। তার মুখ বাক্য না সাজালেও মন ইতোমধ্যে মালিহার সুস্থতার জন্য রবের কাছে ধর্না দিতে শুরু করেছে।
মনিকা ফোন রাখতেই আঁখি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “ওকে ধরো মনিকা। কিছু খাওয়াতে হবে।”
আঁখি মাথা ওঠাতে চেষ্টা করলো। হঠাৎ করেই গুঙিয়ে উঠলো মালিহা। কান্না যেনো ছিটকে বের হলো তার বুক থেকে। বিড়বিড় করতে শুরু করলো সে। আঁখি চমকে গিয়েছিলো কান্নার শব্দে। পরপর মাথা নিচু করলো কথা বোঝার জন্য। ভগ্নকণ্ঠে মালিহা বলছে, “ছেড়ে দিন..না..তুষার ভাই..ছেড়ে দিন..আল্লাহ!”
আঁখির কপালের ভাঁজ সহসাই টান টান হয়ে গেলো। চোখ দুটো যেনো কোটর ছেড়ে বের হয়ে আসতে চাইলো। শুকনো ঢোক গিললো সে। মনিকা তাড়া দিলো, “আপু! ধরুন ওকে?”

মালিহা যখন কোচিংয়ের কথা বলেছিল তখনই ইতমিনান খোঁজ নিয়েছে। যতটুকু খোঁজ করা যায় সে করেছে। তুষারের মুখটা সে চেনে। সেই চেনা মুখটা খুঁজতেই বিকেলেও গিয়েছিলো ওখানে। পায়নি। ভাঙা দরজাটা কোনো রকমে লাগানো ছিল। আশপাশের মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করেছিল ইতমিনান। একজন অপরিচিত মানুষের মতো কোচিংয়ের খোঁজ নিয়েছে। তারা বলেছে আজ সকালে নাকি একটা মেয়ে ওখানে আটকে গিয়েছিলো, তারপর একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এসে দরজা ভেঙে ভেতরের মেয়েটাকে বের করে নিয়ে গেছে। কোচিংয়ের স্যারকে কেউ দেখেনি। মানুষগুলো গম্ভীর মুখে বলছিলো, “ভিতরে বহুত কাহিনী আছে বুচ্ছেন মামা?” ইতমিনান গুরুতর ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে চলে এসেছে। বুঝতে পেরেছে ওরা কেউ জন না আটকা পড়া মেয়েটা যে এই ভার্সিটিরই ছাত্রী।

পেটের ভেতর শব্দ হচ্ছে। দুপুরে দুই লোকমা খেলেও তারপর আর কিছু পেটে পড়েনি। খেতে ইচ্ছেই করেনি। খুঁজে খুঁজে এই শহরে চাকরি করার কি কারণ ছিলো তার? কেউ কি জানে? জানে না। শুধু তার মন জানে। আর জানে সেই মনের মালিক। সেই শহরের একমাত্র পরিচিত মানুষটা, তার মনকে অবাধ্য করে দেয়া মানুষটার ঐ অবস্থা ইতমিনানকে যেনো চোখের পলক ফেলতেও ভুলিয়ে দিয়েছে। আর একটু, শুধুমাত্র আর কিছুটা সময় পরে গেলে কি হতো? কেমন অবস্থায় দেখতো মালিহাকে? আদৌ দেখতে পেতো? ভাবতেই ইতমিনানের গায়ে কাঁটা দেয়। ভাবনার গতি রুদ্ধ হয়ে সাথে কাজের। মুখটা বিতৃষ্ণায় ভরে আসে। ক্ষুধা লাগলেও কিছু খেতে মন চায় না। চোখের উপর হাত রাখল ইতমিনান। একটু ঘুমানো দরকার। কিন্তু সেই উপায় কি আছে? চোখ বন্ধ করলেই মালিহার কান্নামাখা মুখটা ভেসে উঠছে। ধপ করে উঠে বসলো ইতমিনান। বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো। হু হু করে ছুটে এলো ঠান্ডা হাওয়া। জানালার জং ধরা গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো ইতমিনান।

চোখ বন্ধ করলেও ভাবনার গতি রুদ্ধ করা গেলো না। সে ছুটতে ছুটতে মালিহার কাছেই চলে গেলো। কি করছে মেয়েটা এখন? খুব কান্নাকাটি করেছে? কার সাথে মন খুলে কথা বলবে? কারো কাছে নিশ্চয়ই এই ঘটনা বলবে না? বাড়িতে কিছু বলেছে কি? নাহ, বলার কথা না। চাচীর সাথে তো ওর অতো খোলামেলা সম্পর্ক নয়। তাহলে? মেয়েটা কি একা একাই কেঁদে কেঁদে গুমরে বেড়াচ্ছে?
রিংটোন ইতমিনানকে আর ভাবতে দিলো না। আয়েশা ফোন দিয়েছেন। কিন্তু আজ তো মমতাময়ীর সাথে আন্তরিকতাসহ কথা বলতে পারবে না ইতমিনান। তার মুখ দিয়ে যে কথাই আসছে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন ধরলো ইতমিনান। আয়েশা প্রথমে সালাম দিয়ে বিজয়ী কণ্ঠে বললেন, “আজকে আমি আগে সালাম দিয়েছি!”
ইতমিনান হাসলো। অল্পবিস্তর সে হাসি।
“কেমন আছো মা?”
“ভালো আছি। তোর কি শরীর খারাপ? কণ্ঠটা এমন লাগছে কেনো?” আয়েশার কপালে চিন্তার ভাঁজ।
“না শরীর খারাপ না। অফিসে একটু কাজের চাপ।”
“অফিস অফিস করে তো তুই ম’রেই যাবি দেখছি। সেই কবে গিয়েছিস। বাড়িতে আয় আব্বা!” আকুতি করে বললেন আয়েশা।
ইতমিনান বলল, “কই কবে গিয়েছি? এক মাসের একটু বেশি হলো এলাম। এতো ঘন ঘন বাড়ি গেলে আমার আর চাকরি করা লাগবে না। তাছাড়া কয়েকদিন পরই দুর্গা পূজার ছুটি দেবে। তখন তো বাড়িতে যাবোই।”
“আমি এতো কিছু বুঝি না। পূজার ছুটি সেই কবে! এর আগে একবার আসবি না?”
“অনেক কাজ মা। এখন তো যাওয়া সম্ভব না।” নরম কণ্ঠে বলল ইতমিনান। সে তো আর কাউকে বলতে পারছে না যে দুজনের কাজ সে একাই করছে। কাউকে বলার দরকারও নেই। যে জন্য করছে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হলেই হলো। লতা আপা বাচ্চা সহ সুস্থ থাকলেই হলো।
“শোন ইতু! আমি তোর জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। এবার যখনই আসবি মেয়েকে দেখতে যাবো। তোর কোনো কথা আর শুনবো না। চাকরি ফাকরির কথা অনেক শুনেছি। তোকে তো আর রাক্ষসের সাথে বিয়ে দেবো না যে খাওয়াতে পারবি না। নিজে খেতে পারলে বউকেও খাওয়াতে পারবি। আর সবচেয়ে বড় কথা যার যার রিজিক তার তার। তাই ওসব নিয়ে চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। বিয়ে করলে আল্লাহ রিজিকে বরকত দেন।”
“মা!” একই সাথে বিস্ময়, চিন্তা তাকে ঘিরে ধরলো।
“কোনো মা না। আমি ওদের কথা দিয়ে দিয়েছি।”
“কিসের কথা দিয়েছো? বিয়ের?” ইতমিনানের স্বর আটকে গেলো।
“আরে না। ধুম করে আবার বিয়ের কথা দেয়া যায় নাকি? দেখতে যাবো এই কথা দিয়েছি। মেয়ে, মেয়ের পরিবার সব দিক দিয়েই আমার পছন্দ হয়েছে। মিলির ননদের কেমন আত্মীয়। যাক তুই আয়। তোর পছন্দ হলেই তারপর কথাবার্তা আগানো যাবে।”
শেষ কথাটুকু শুনে দম ছাড়লো ইতমিনান। পছন্দ হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। এবার যেয়েই রাবেয়া ফুপুর সাথে কথা বলতে হবে। একটা কিছু ব্যবস্থা না করলে হচ্ছে না।
“আচ্ছা।”
“আরেকটা কথা শোন ইতু।” এবার যেনো আয়েশার কণ্ঠটা আরেকটু গম্ভীর শোনা গেলো।
“বলো।”
“ওখানে কাছাকাছি আছিস, চাচাতো ভাই চাচাতো ভাইয়ের মতোই থাকবি। অবিবেচকের মতো কোনো কাজ করবি না। তোকে নিয়ে আমার অনেক শখ।”
ইতমিনান প্রতি উত্তর করতে পারলো না। আয়েশা কল কেঁটে দিয়েছেন। অব্যক্ত ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ইতনিনান যেনো খেই হারালো। শেষের কণ্ঠটা শখ নয় যেনো হু’মকির কথা বলল। সবটা এতো জটিল হয়ে যাচ্ছে কেনো?
ফোনের স্ক্রিন সামনে এলে অজান্তেই মালিহার নাম্বার খুঁজলো ইতমিনান। একবার ফোন দিয়ে দেখবে মেয়েটার কি অবস্থা? কিছুক্ষণ আগের আদেশ ভুলে ফোন দিলো সে। কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষটা সেই ডাকের প্রতি উত্তর করলো না। ইতমিনান ক্লান্তির শ্বাস ছাড়লো। ভাবলো হয়তো ঘুমাচ্ছে মালিহা।

সারা শরীর ঘেমে গেছে। ঘুমের মাঝেই মালিহার অস্বস্তি লাগলো। মশারি বোধহয় কোনো দিক দিয়ে পড়ে গেছে। সেই ফাঁক দিয়ে মশা ঢুকে উল্লাস প্রকাশ করে মুখের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সহসাই ফোন ধরতে পারলো না মালিহা। চোখ টেনেটুনে যখন খুললো তখন ফোন কেঁটে গেছে। ঘুম ভেংগে গেলেও উঠে বসলো মালিহা। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। কিছুক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলো সে। শরীরের ঘর্মাক্ত ভাবটা বিরক্ত করলে জামা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলো। আজ পুরো রুমের লাইট বন্ধ। কি ব্যাপার? সবাই ঘুমিয়ে গেছে নাকি?
আস্তে ধীরে খাট থেকে নামলো মালিহা। তবে সে খেয়াল করেনি নীতির বিছানায় কেউ শুয়ে আছে। তাকে দেখেই উঠে এলো আঁখি। অন্ধকারে মালিহা ভয় পেয়ে গেলো। আঁখি আশ্বস্ত করতে বলল, “আমি আঁখি। ভয় পেয়ো না।” আলগোছে মালিহার হাত ধরলো আঁখি। মালিহা দম ছাড়লো।
“কি হয়েছে? খারাপ লাগছে?”
“না আপু। ঘেমে গেছি। জামাটা পাল্টাবো। আপনাদের খুব বিরক্ত করলাম।” শেষটুকু বিব্রত কণ্ঠে বলল মালিহা। আঁখি সৌজন্য মাখা উত্তর করলো না। শুধু মাথা নাড়লো। ফের যেয়ে মালিহার বিপরীতে নীতির বিছানায় বসলো। মালিহা জামা নিলো। একটু পানি খেলো। আঁখি মাথা নিচু করে দুই হাত বিছানায় ঠেকিয়ে বসে আছে। মালিহা যখন দরজার সিটকিনিতে হাত রাখলো তখন আঁখির ফিসফিসানি কণ্ঠ শোনা গেলো, “তুষার তোমার সাথে কি করেছে মালিহা?”
মালিহার হাত সহসাই থেমে গেলো। সে অনুভব করতে পারলো তার হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে। হু হু করে

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩০

কোনো এক অজানা কারণে হল পাড়া আজ নিঝুম। রুমগুলো অন্ধকার। বাতি নিভিয়ে সবাই পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের দেশে। থেকে থেকে ভেসে আসছে হুতুম প্যাঁচা আর নাম না জানা এক পাখির ডাক। নিশ্ছিদ্র নীরবতাকে খুব যত্ন করে গভীর করে তুলছে গুটিকয়েক শব্দের উৎস। মালিহা অনুভব করছে তার শরীর আবার ঘেমে উঠছে। আঁখি জানলো কিভাবে? তুষার কি সবাইকে বলে দিয়েছে? সবাই জেনে গেছে? কতটুকু জেনেছে? কপালের স্বেদ বিন্দু মুছতে কম্পমান হাত তুললো মালিহা। আঁখি নীরবে সবটা দেখলো। বারান্দার আলো জানালার কাঁচ ভেদ করে রুমের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জানিয়ে দিচ্ছে ঘরটা কতো অন্ধকার।
“আমার পাশে বসো মালিহা।”
মালিহা দ্বিতীয় কোনো বাক্য ব্যয়ের প্রয়োজন মনে করলো না। চুপচাপ আঁখির পাশে বসলো। আঁখি ঘুরে বসলো মালিহার দিকে। ক্রমশ শীতল হতে থাকা মালিহার হাত জোড়া নিজের মুঠোয় নিলো। হালকা চাপ দিয়ে বলল, “আমাকে সবটা বলো মালিহা। তোমাকে ওখানে আমি পাঠিয়েছি। আমার ভরসায় তুমি সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের কাছে গিয়েছ। আমাকে জানতে হবে। বলো।”
মালিহা আঁখির দিকে তাকালো। আঁখির মুখে আলো লাগছে। মালিহা অন্ধকারে। তার মনে হলো এই বেশ। তার মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যাবে না। থেকেও না থাকার মতো করে কথাগুলো বলে ফেলবে। ফাঁকা ঢোক গিললো মালিহা। নিজের মতো করে বলতে শুরু করলো ঘটনা।
মনিকা “সর সর” করে উঠলো। ঘুমের ভেতরে কথা বলার অভ্যাস আছে তার। কি যেনো বিড়বিড় করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ঘুলঘুলি থেকে একটা টিকটিকি মাথা বের করে আশপাশ দেখলো। সুযোগ বুঝে ছাদের মাঝখানে যেয়ে ডাকতে শুরু করলো। টিকটিক টিকটিক..
আঁখি শান্ত ভঙ্গিতে সবটা শুনলো। কথার মাঝে বাঁধা দিলো না। হু হা করলো না। মালিহা যখন নিজের বক্তব্য শেষ করে চুপ করে বসে আছে তখন শুধু আঁখি বলল, “সরি মালিহা। না জেনে তোমাকে মানুষের মতো দেখতে একটা প্রাণীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। পারলে আমাকে মাফ করে দিও।”
কথাটুকু শেষ করে উঠে পড়ল আঁখি। মালিহা হঠাৎ করেই বলল, “কাউকে বলবেন না আপু। প্লিজ!” এক মুহুর্ত থামলো আঁখি। পরপর দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো। মালিহা উদ্বিগ্ন হলো না। রাত বিরাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিডিং রুমে কাটানোর রেকর্ড আছে আঁখির।
কিছুক্ষণ পর মালিহা নিজেও উঠলো। জামা পাল্টাতে গেলেও পানির সংস্পর্শে এসে গোসলের সিদ্ধান্ত নিলো। চুল তখনও আঁধভেজা। কাজেই ওটাকে দ্বিতীয়বার ভেজানোর ভাবনা বাদ দিলো।
ঝরঝরে শরীরকে ঘিরে ধরলো মসৃণ নীরবতা। মস্তিষ্ক সচল হলো। আজকের ঘটনার প্রভাব কতদূর গড়াবে? কোচিংয়ে যাওয়ার এক মাস হয়ে গিয়েছিল। তুষারের কথা অনুযায়ী দুই একদিনের মাঝে তার হাতে সাত হাজার টাকা আসার কথা ছিল। সে তো দ্বিতীয়বার আর ঐ কোচিংয়ে যাবে না। টাকাটাও পাবে না? আচ্ছা আশপাশের মানুষ কিছু জানে? জানলে কতোটা জানে? ভার্সিটিতে তার কথাটা কি প্রচার হয়ে যাবে? মানুষ কি তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে? আর ভাবতে পারলো না মালিহা। তার জীবনটা এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেনো?
টেবিলের উপরে রাখা কুরআন শরীফের উপর চোখ পড়ল। হাত বাড়িয়ে সেটা টেনে নিলো মালিহা। অপলক দেখলো তাকে। এই বইয়ের মাঝে লিখে রাখা প্রত্যেকটা কথা রবের। প্রত্যেকটা কথা। ভাবতেই কেমন যেনো লাগলো। অথচ গলা দিয়ে টু শব্দ করতে ইচ্ছে করছে না। দেয়ালে হেলান দিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো মালিহা। কুরআনটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলো। কুরআন কি শুষে নিতে পারবে তার হৃদয়ের সবটুকু জট?

লতার কাছে ফোন দিয়েছিলো ইতমিনান। ভালো আছে সে। রনির কাছে ফোন দেবে কি না ভাবছে। ছেলেটা তো আর কিছু বলল না। হ্যাঁ না কিছু তো একটা বলবে। ভাবতে ভাবতে ফোন দিলো ইতমিনান। বন্ধুর খোঁজ তো নেয়াই যায়। প্রথমবারে রনি কল রিসিভ করলো না। ইতমিনানও আর ফোন দিলো না। একটু পর রনি কল ব্যাক করলো।
“কেমন আছিস দোস্ত? সরি রে! এতদিন যোগাযোগ করতে পারিনি।”
“না সমস্যা নেই। আছি ভালোই। তোর কি অবস্থা?” ইতমিনানের গলায় স্বভাবসুলভ উৎফুল্ল ভাবটা নেই। তবে রনি সেটা ধরতে পারল না।
“আব্বু খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল মাঝে। আব্বুকে নিয়ে ছোটাছুটি করতে যেয়েই আর তোকে কল টল করতে পারিনি।”
“কি হয়েছে আংকেলের?”
“আর বলিস না। ছোটখাট স্ট্রোক করেছিল। তারপর এক ইতিহাস।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রনি।
“এখন কেমন আছেন?”
“আছে আলহামদুলিল্লাহ। এখন ভালোই আছে।”
“তুই সুস্থ আছিস তো?”
“বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেলো ইতমিনান। এই একটা মাসে আমাকে এই কথাটা কেউ জিজ্ঞেস করেনি। যে-ই ফোন দেয় আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করে, আব্বুর খোঁজ নেয়। তুই প্রথম আমার খোঁজ নিলি।” রনির গলায় স্পষ্ট অভিমান। বন্ধুর মনোভাব টের পেয়ে ইতমিনান বলল, “অসুস্থ মানুষের খোঁজই তো সবাই নেবে তাই না? তাকে নিয়ে ভয় বেশি। তোর কাছে ফোন দিয়ে তো জানতেই পারছে যে তুই ভালো আছিস।”
স্মিত হেসে রনি বলল, “বোঝাচ্ছিস? বোঝা। আর কারো থেকে না শুনতে চাইলেও অন্তত.. আচ্ছা বাদ দে এসব। তোর ঐ চাচাতো বোনটার কি খবর? আমি আপাকে বলেছিলাম। আপা বলেছে একদিন যেয়ে দেখা করে আসতে। তুইও আয় ওর সাথে। দেখা করি একদিন।”
ইতস্তত করলো ইতমিনান। সে যে কিছু করেছে এটা মালিহাকে জানাতে চাইছিল না। কিন্তু আজ যা হলো তারপর মেয়েটাকে একা কোথাও যেতে দেয়ার কথে মনে পড়লেই ভয় লাগছে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সম্মতি দিলো সে।
“কবে যাবো?”
“আচ্ছা আমি আপার সাথে কথা বলে তোকে জানাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”

দম ছাড়লো ইতমিনান। অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। আজকাল চিন্তা তার পিছু ছাড়ছে না। একটা শেষ হয় তো নতুন আরেকটা চিন্তা এসে যোগ হয়।

নীতিকে খুব বেশি মিস করছে মালিহা। আর কিছু না হোক নীতির হাতটা ধরে বসে থাকলেই তার শান্তি লাগতো। মেয়েটাকে ফোন করা দরকার। তবে কোনোভাবেই এদিকে আঁচ দেয়া যাবে না তাকে। নীতি অস্থির হয়ে যাবে।
বিছানায় শুয়ে এই চিন্তাই করছিলো মালিহা। মনিকা সকালে তাকে কি যেনো খাওয়ালো। বিদঘুটে স্বাদ। মালিহা কিছু বলতেও পারেনি। এতো আগ্রহ করে, যত্ন করে কেউ কিছু খাওয়ালে নিষেধ করা যায় না। নাক মুখ বন্ধ করে খেয়েছে মালিহা। কিন্তু একটু খেয়েই পেট ভরে গেছে। তারপর মনিকা জোর করে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। যদিও মালিহা বলেছিলো এখন তার ওষুধের দরকার নেই। কিন্তু মনিকা শোনেনি। আঁখির কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো তার। চোখ খুললো মালিহা। আঁখি রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“ক্লাসে যাবে না?”
“না আপু। ভালো লাগছে না।”
আঁখি চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “কোচিংয়ে যাবে না? মাসের বেতনটা..”
“পেলে তো ভালো হতো আপু। কিন্তু আমি আর ঐ লোকটার মুখোমুখি হতে চাচ্ছি না।”
আবার চোখ বন্ধ করলো মালিহা। শুয়ে পড়লো নিশ্চিন্তে। আসলেই নিশ্চিন্তে?
আঁখি মালিহার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। ব্যাগ ঘাড়ে বের হয়ে গেলো। তার মাথায় ঘুরছে নিতুর কথা। নিতুর সাথে দেখা করতে পারলে কাজ হতো। বেশ কয়েকজনের কাছে খোঁজ করে নিতুর নাম্বার সংগ্রহ করলো আঁখি।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩১

মানিক কিভাবে লালপাহাড়কে রাজি করিয়েছে ইতমিনান জানে না। তবে আজ কয়েকদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লালপাহাড় ইতমিনানের সাথে হাঁটতে রাজি হয়েছে। ইতমিনান অবশ্য বলেছে প্রতিদিন একটা করে পাউরুটি সে পাবে। তবে লালপাহাড় চুক্তিতে কতটুকু সায় জানিয়েছে সেটা জানা যায়নি।
পড়ন্ত বিকেলে লালপাহাড়কে নিয়ে হাঁটছে ইতমিনান। পকেটে তার ছোট্ট একটা পলিথিন। পলিথিন বের করে সেখান থেকে নির্দিষ্ট জিনিসটা লালপাহাড়ের নাকের সামনে ধরলো ইতমিনান। প্রথমে সে খুব আগ্রহ নিয়ে নাক এগিয়ে দিলো। কিন্তু একই জিনিস বুঝতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইতমিনান বিব্রত হলো। ঠিক কতবার এক জিনিসের গন্ধ পেলে সেই গন্ধ আর কোনো কুকুর ভোলে না এটা তো সে জানে না। কাজেই সকাল বিকাল হোমিওপ্যাথি ডোজের মতো কাজটা করে যাচ্ছে সে। তবে এই ক্ষণে লালপাহাড়ের প্রতিক্রিয়া দেখে ভয় পেলো ইতমিনান। বিরক্ত হয়ে আবার তার উপরে ঝাপিয়ে পড়বে না তো কুকুরটা?

ক্যাম্পাসের সেকেন্ড গেট। এখানে ছোটখাট একটা পার্ক আছে। বাচ্চাদের পার্কটা বিকেল হলে জমজমাট হয় ওঠে। বাবা মা বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে আসেন। কখনও কখনও দাদা দাদীকেও দেখা যায়। পকেটে হাত গুজে হাঁটছে ইতমিনান। একটা মুখের খোঁজ করে চলেছে কয়েকদিন ধরে। পাচ্ছে না। আজ হোক কাল হোক, আসবেই তো। সেই আশাতেই সকাল বিকাল এই এলাকায় চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে সে। কোচিংয়ের সামনে আসতেই সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো ইতমিনান। কোচিংয়ের সদর দরজায় আজ তালা নেই। হাট করে খোলা। ভেতরে আলো জ্বলছে। তার মানে নিশ্চয়ই মানুষ আছে? সন্তর্পনে মুখোমুখি একটা চায়ের দোকানে বসলো ইতমিনান। নিজের জন্য চা নিলেও লালপাহাড়কে আজ কিছু দিলো না। সে জানে দুপুরের পর থেকেই কুকুরটা না খাওয়া। মানিক কথায় কথায় বলেছে। লালপাহাড় ইতমিনানের পায়ের কাছে বসে আছে অনুগত ভঙ্গিতে। তবে সময় পেরিয়ে গেলেও যখন নিত্যদিনের মতো খাবার পেলো না তখন সে মনিবের মুখের দিকে তাকালো। ইতমিনান নিচু হয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “এখনকার জন্য সরি। আপাতত তোমার হাঙ্গার এবং অ্যাঙ্গার এই দুটো ইস্যুই আমাকে কাজে লাগাতে হবে। তবে প্রমিস! কাম তামাম করতে পারলেই স্পেশাল ট্রিট আছে। ওকে?”
লালপাহাড় কিছু বুঝলো কি না বোঝা গেলো না। তবে ইতমিনানের হাতের খাবারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। একটু দূরে যেয়ে সামনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসলো। ইতমিনান তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে দেখলো লালপাহাড়ের সামনের ডান পায়ে নতুন একটা ক্ষত। এখনও শুকায়নি। তার মানে ব্যাথা আছে নিশ্চয়ই? তার কুচকানো ভুরুর নিচে চোখদুটো চকচক করে উঠলো। জিহ্বা বের করে সে যখন শ্বাসকার্য চালাচ্ছে তখন পরিকল্পনার সাগরে ভেসে লালপাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট নেড়ে শব্দহীন ভাষায় ইতমিনান বলল, “মানুষ বড়ই স্বার্থপর লালপাহাড়!”

তিন কাপ চা শেষ করে ফেলেছে ইতমিনান। বড় শান্ত তার ভঙ্গি। বোধ হয় এই প্রথম একসাথে তিন কাপ চা শেষ করলো সে। তবুও তার মাঝে বিরক্তির লেশ মাত্র নেই। দরকার পড়লে আরো তিন কাপ খেতে পারবে সে। দৃঢ় চিত্তে বসে আছে ইতমিনান। দোকানীর অলক্ষ্যে একবার তাকে পরোখ করে নিলো সে। পকেটে হাত দিয়ে ফোন বের করলো। অযথাই হোম স্ক্রিনে হাত ঘুরিয়ে কানে ধরলো ফোনটা। সেকেন্ড দশেকের মাঝে কথা বলতে শুরু করলো ইতমিনান।
“কতো দুর তুই?”
“আমি তো সেকেন্ড গেটে বসে আছি।”
“এই হবে পনেরো মিনিট।”
“আচ্ছা আয়। দ্রুত আয়। মাগরিবের আগে বাসায় যাবো।”
ফোন পকেটে রাখলো ইতমিনান। কথাগুলো বেশ জোরেই বলেছে। দোকানীসহ দোকানে থাকা বাকি দুইজন ক্রেতা স্পষ্টই সব কথা শুনেছে। মনে মনে হাসলো ইতমিনান। ফোনের ওপাশে তো কেউ ছিলোই না!

পাখিরা যখন ঘরে ফিরে যেতে শুরু করেছে তখন আকাঙ্খিত মানুষটা বাইরে বের হলো। দম ছাড়লো ইতমিনান। এভাবে কবে কার জন্য আকুল হয়ে অপেক্ষা করেছে স্মৃতিপাতা ঘেঁটে ঘুটেও পেলো না। আস্তে ধীরে উঠলো সে। পাঁচ কাপ চায়ের দাম মিটিয়ে দিলো। তুষার কোচিংয়ের দরজায় তালা দিচ্ছে। ইতমিনান রুমালটা শেষবার লালপাহাড়ের নাকের সামনে ধরলো। লালপাহাড় স্পষ্টতই বিরক্ত হলো। এবার নিজের স্বভাববিরুদ্ধ একটা কাজ করলো ইতমিনান। লালপাহাড়ের অভুক্ত পেটে বেশ জোরে একটা লাথি দিলো। কেউ সেভাবে বিষয়টায় গুরুত্ব দিলো না। কুকুরের আবার জান! কিন্তু লালপাহাড় লাফ দিয়ে সরে গেলো। ইতমিনানের কাছে এমন ব্যবহার পেয়ে তো সে অভ্যস্ত নয়। তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো লালপাহাড়। ইতমিনান তুষারের দিকে তাকালো। রাস্তা পার হয়ে এদিকে আসবে। দুই দিকে তাকিয়ে যানবাহনের অবস্থা দেখছে। ইতমিনান লালপাহাড়ের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে ঠোঁট নেড়ে বলল, “সরি!” লালপাহাড় সেসব বোঝার সময় পেলো না। তার আগেই নিজের পায়ের ক্ষত স্থানে জোরে চাপ অনুভব করলো। চিৎকার করে উঠলো লালপাহাড়। আত্মরক্ষায় ইতমিনানের দিকে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে গেলো। ইতমিনান তড়িৎ গতিতে রাস্তা পার হয়ে তুষারের সাথে ইচ্ছা করে ধাক্কা খেলো। অপেক্ষা না করে পেছনে চলে গেলো। একদম পেছনে দেয়ালের ওপাশে লুকিয়ে পড়লো। তুষার বিরক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে একবার ইতমিনানের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। লালপাহাড় আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ইতমিনানের পিছু নিয়েছিল। তুষারের সাথে ধাক্কা খেলে পরিচিত গন্ধ, পেটের ক্ষুধা, পায়ের ব্যথা একাকার হয়ে লালপাহাড়কে চরম উত্তেজিত করে তুললো। কে তাকে লাথি দিয়েছে, কে ব্যথা দিয়েছে সব ভুলে সামনের মানুষটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তুষার গড়গড় করতে থাকা কুকুর দেখে স্বাভাবিকভাবেই ভয় পেলো। অজান্তেই দৌড় শুরু করলো আরেক দিকে যাওয়ার জন্য। লক্ষ্যকে দৌঁড়াতে দেখে লালপাহাড় খুশি হলো। তার উত্তেজনা বাড়লো। চার পায়ে দৌড়ে সে হামলে পড়ল তুষারের ওপর। প্রথম কামড়টা দিলো তার পায়ে। তুষার খেই হারিয়ে পড়ে গেলো রাস্তায়। হাত দিয়ে সরাতে চাইলো কুকুরটাকে। বাঁধা পেয়ে লালপাহাড় হাতেও কামড় দিলো। চিৎকার করে উঠলো তুষার। তার শরীরের র’ক্ত তখন মাটি ছুঁয়েছে। দেয়ালের ওপাশ থেকে তৃপ্তির হাসি হাসলো ইতমিনান। আরো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো।

তুষারের চিৎকারে রাস্তার লোকজনের মনোযোগ সেদিকে গেছে। অনেকেই আশপাশ থেকে হৈ হৈ করছে। তবে কুকুরটার এমন মা’রমুখো ভঙ্গি দেখে কেউ এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না। ততক্ষণে তুষারের শরীরের আরো কয়েক জায়গায় জখম করে ফেলেছে লালপাহাড়। ইতমিনানের চোখে ভাসছে মালিহার বাম গালের আঙুলের ছাপ। যখন লালপাহাড় তুষারের গালে কামড়ে ধরলো তখন ইতমিনান এমন ভঙ্গিতে ছুটতে ছুটতে এলো যেনো তার কি হারিয়ে গেছে। তুষারকে ধরাশায়ী এবং লালপাহাড়কে তার উপরে দেখে যেনো সে আতকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলো লালপাহাড়ের কাছে। লালপাহাড়ের তখন চারদিকে কোথাও খেয়াল নেই। ইতমিনান কাছে এসে জোরেশোরে ডাকলো, “লালপাহাড়!”
কুকুরটা তাকালো। ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে একবার ঘড়ড়ড় করে উঠলো। ইতমিনান আবার ধমকে উঠলো, “কি হচ্ছে এসব! সরে এসো। সরে এসো বলছি!”
ততক্ষণে লালপাহাড়ের উত্তেজিত ভাবটা থিতিয়ে এসেছে। আরেকবার ঘড়ড়ড় করে এক পা পিছিয়ে গেলো সে। সেই সুযোগে ইতমিনান তুষারের কাছে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “এখনও জ্ঞান আছে দেখছি! মালিহা কিন্তু জ্ঞান হারিয়েছিল।”
তুষারের চোখ তখন নিভু নিভু হয়ে আসছে। তবে জ্ঞান সে হারায়নি। কান ঠিকমতোই কাজ করছিল। মালিহার নাম শুনে চট করে ব্যাথাতুর চোখ দুটো বড় হয়ে গেলো। ইতমিনান ঘাড়টা আরেকটু নিচু করে তুষারের মাথার পেছনে হাত দিলো। দুর থেকে দেখলে মনে হয় যেন তুষারকে ওঠানোর চেষ্টা করছে সে। চাপা কন্ঠে ক্ষোভ ঢেলে দিলো। হিসহিসিয়ে বলল, “এক কুকুর আরেক কুকুরকে কামড়াচ্ছে। মালিহাকে দেখাতে পারলে কি যে শান্তি লাগতো!”

ইতমিনানকে এগিয়ে যেতে দেখে আর লালপাহাড়কে সরে আসতে দেখে আশপাশের লোকেরা ততক্ষণে এগিয়ে গেছে। তুষারের চারপাশে ঘিরে ধরেছে। ইতমিনান মাথা তুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “অটো ডাকুন কেউ। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
দুইজন অটো খুঁজতে গেলো। কয়েকজন ইতমিনানের পাশে এসে তুষারকে ধরে দাঁড় করালো। গাড়িতে ওঠানোর সময় ইতমিনান তুষারের কানে ফিসফিস করে বলল, “বেঁচে থাকলে ভালো হওয়ার সুযোগ আসবে। আর ম’রে গেলে তো হলোই। হয় কুকুরের কামড় মনে রেখে বাঁচতে হবে নয়তো কবরে ডান্ডার বারি হজম করতে হবে। Have a great journey!” চকচকে একটা হাসি দিলো ইতমিনান। গাড়িটা ছেড়ে দিলেও তুষার বড় বড় চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।

নিজের হাতের দিকে তাকালো ইতমিনান। র’ক্ত লেগে চটচট করছে। চায়ের দোকানের পাশের চাপকল থেকে হাত ধুয়ে নিলো। লালপাহাড় তখন এইটুকু মুখ করে ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইতমিনান একটু এগিয়ে দোকানগুলো ছাড়িয়ে সামনে গেলো। লোকচক্ষুর অন্তরালে যেয়েই হাতের ইশারায় লালপাহাড়কে ডাকলো। কুকুরটা মনিবের ইশারা পেয়েই দৌড়ে চলে গেলো। ইতমিনান যেয়ে থামলো একটা ফার্মেসীর সামনে। লালপাহাড় তার পিছু পিছু। তার চোখেমুখে অপরাধবোধের ছাপ স্পষ্ট। ইতমিনান হাতে গ্লাভস পড়ে লালপাহাড়ের পায়ের জখমে ওষুধ দিলো। ছোট একটা ব্যান্ডেজ করে দিলো। লালপাহাড় কুঁই কুঁই করে ডাকলে নীল গ্লাভস পড়া ডান হাতটা লালপাহাড়ের মাথায় রাখলো ইতমিনান। লালপাহাড় সাথে সাথেই আবার কুঁই কুঁই করলো। ইতমিনান হেসে বলল, “আজকে রাতে স্পেশাল ট্রিট। কসাইয়ের থেকে তরতাজা হাড্ডি এনে দেবো। চলবে?”
লালপাহাড় মাথা নামিয়ে কুঁই কুঁই করে উঠলো।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-২৬+২৭+২৮

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৬

চুলগুলো অগোছালো। সামনের দিকের কিছু চুল কপালে পড়ে আছে অবহেলায়। অযত্নে গোঁফ বড় হয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। চেহারার পরতে পরতে ক্লান্তির হাতছানি। মালিহা এসবই খেয়াল করলো এক দেখায়। ইতমিনানের চোখে চোখ পড়তেই পলক ফেলতে বাধ্য হলো সে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কি পিপাসার্ত, ক্লান্ত সেই চাহনি!
“কেমন আছিস?”
মালিহার কাছে মনে হলো খুব কষ্ট করে টেনে হিঁচড়ে ভেতর থেকে শব্দগুলো বের করলো ইতমিনান। সে কি অসুস্থ?
“ভালো আছি। তুমি কি অসুস্থ?”
“নাহ।”
“তাহলে তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“কেমন?” গালে হাত দিলো ইতমিনান।
“রোগী রোগী দেখাচ্ছে। কি হয়েছে?”
“অফিসে কাজের একটু প্রেশার।”
“তুমি নাকি অন্য জায়গায় চাকরি করবে?” অন্যদিকে তাকালো মালিহা। ইতমিনানের মুখটা দেখে তার অকারনেই মায়া লাগছে।
“তোকে কে বলল?”
“শুনলাম।”
“অন্য জায়গায় চাকরি খুঁজছি। চাকরি হলো সোনার হরিণ। খুঁজলেই পাওয়া যায় নাকি? মনে হচ্ছে এটা নিয়েই থাকতে হবে।” হতাশার স্বরে বলল ইতমিনান।
“ওহ।”
“আজকে বসতে দিবি না নাকি?”
মালিহা হতচকিত হলো। তাই তো! কথা বলতে বলতে বসার কথা বলতেই ভুলে গেছে সে। দ্রুত একটা চেয়ার টেনে দিলো। ইতমিনান হেসে বলল, “আরে তাড়াহুড়ার কিছু নেই।”
“তুমি সত্যিই অসুস্থ না?”
“না।” হাসলো ইতমিনান। এখানে তার খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। আয়েশা ফোনে শুধু কন্ঠ শুনতে পান। চেহারা দেখতে পেলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে ছুটে আসতেন। হাতের প্যাকেট মালিহার দিকে এগিয়ে দিলে সে বলল, “তুমি রোজ রোজ এসব নিয়ে আসো কেনো?”
“আমি তো এলামই এই দুইদিন। কিছু না নিয়ে আসা যায়। এসব নিয়ে আসার সময় মনে হয় তোকে শ্বশুরবাড়ি দেখতে যাচ্ছি।” ইতমিনান শব্দ করে হেসে ফেলল। মালিহা লজ্জা পেলো। বেহায়া দৃষ্টিতে লজ্জা রাঙা মুখটা দেখলো ইতমিনান। সহসাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে।
“বাড়িতে কথা হয়? জমির ব্যাপারে শুনেছিস কিছু?”
মাথা নেড়ে মালিহা বলল, “কথা হয়। কিন্তু জমি নিয়ে নতুন করে আবার কি হয়েছে?”
“বাবা দলিল পত্র রেডি করে ফেলেছে। সেদিন তো চাচীর সেটা কথা বলে এসেছে শুনলাম। জানিস না তুই কিছু?”
মালিহা ভাবুক হলো। মিতুল তাকে কিছু বলল না কেনো? পরক্ষণেই তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। ইতমিনান বলল, “ধানী জমি আর পুকুর তোরা পাবি আর..”
“দয়া করছো?” ইতমিনানকে কথা শেষ করতে দিলো না মালিহা। তার আগেই ঠান্ডা কণ্ঠে বলল।
“দয়া আবার কিসের? এগুলো তোদের হক।”
“হকের নামে দয়া।” একগুঁয়ে কণ্ঠে বলল মালিহা। ইতমিনানের এবার রাগ হলো।
“থাপ্পড় খাবি! এক ধাপ বেশি বুঝিস কেন সবসময়? চাচার অংশের জমি তোরা পাবি না?”
মালিহা মাথা নিচ করলো। জোরে শ্বাস ফেললো ইতমিনান।
“আমি যেনো না শুনি এসব নিয়ে তুই আর কোনো তর্ক করেছিস। বড়রা সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিশ্চয়ই বুঝে শুনে?”
মালিহা মাথা নিচু করেই রইলো। ইতমিনান অস্থির হলো। ঐ মুখটা দেখার জন্যেই তো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে সে। এভাবে মাথা নিচু করে দেখার জন্য নাকি!
“এই মাথা উঠা। তাকা আমার দিকে!”
মালিহা মাথা ওঠালেও ইতমিনানের দিকে তাকালো না।
“সমস্যা কি? তাকাতে বললাম না?”
“তুমি সেদিন রাস্তায় আমাকে বকেছো। আবার এখন ক্যাম্পাসে এসে বকছো। ভালো করে বললেই তো হয়। এতো বকাবকির কি আছে?”
ইতমিনান হাসলো। পরপর ত্যাড়া কণ্ঠে বলল, “তুই উল্টাপাল্টা কথা বলতে পারবি আর আমি বকলেই দোষ। আচ্ছা যা! সব দোষ আমার। তা বল কোচিং কেমন লাগছে?”
মুহূর্তেই মালিহার চেহারার রং পাল্টে গেলো। চামড়ার ভাঁজে খেলে গেলো এক রাশ চিন্তা। চোখের পাতায় ভেসে উঠলো তুষারের চাহনি। মালিহা সরাসরি কখনও ধরতে পারেনি। কিন্তু তার মনে হয় তুষার যেনো সুযোগ পেলেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অবশ্যই মুখে নয়। বেশ ঢোলা একটা বোরখা পড়ে সে। তাহলে তুষার কি দেখে? মালিহার চিন্তা হয়, অস্বস্তি হয়, ভয় হয়।
ইতমিনান স্পষ্ট দেখলো মালিহার কপালের ভাঁজ, চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ। অপেক্ষা করল মালিহার নিজ থেকে বলার জন্য। মালিহা বলল, “ভালোই।”
“শিওর?”
“হু।”
ইতমিনানের মন চাইলো মালিহার মাথায় হাত রাখে। ভরসা দিয়ে বলে ভয় নেই, আমি সবসময় তোর পাশে আছি। হাতটা রাখা হয় না। সম্পর্ক তার সীমারেখা টেনেছে বহু আগেই। সেই গণ্ডি পেরিয়ে আর কিছু করা হয় না। তবে মুখে বলতে তো বাঁধা নেই।
“কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবি।”
মালিহা তাকায় ইতমিনানের চোখে। তার লুকানো দুশ্চিন্তাটা কি ইতমিনান ধরে ফেলেছে? জানে না সে। কিন্তু ইতমিনানের চোখের ভরসাটুকু তাকে ভয়ের গুহা থেকে টেনে বের করে আনে। ফিসফিসিয়ে বলে, “এই যে আমি আছি না!”
“বলব।” শান্ত স্বরে বলে মালিহা। হঠাৎই তার চোখ যায় ইতমিনানের গেঞ্জিতে। ভালো করে খেয়াল করতেই হেসে ওঠে সে।
“তুমি গেঞ্জি উল্টা পড়েছো!”
মালিহাকে হাসতে দেখে ভুরু কুঁচকে যায় ইতমিনানের। পরপর মালিহার কথা শুনে নিজ গেঞ্জির দিকে তাকায় সে। লজ্জিত বোধ করে ইতমিনান। তাড়াহুড়া করার ফল। কালো গেঞ্জির উল্টা সোজা না দেখেই পড়ে ফেলেছে। সামনের দিকে কোনো ডিজাইন না থাকায় বুঝতে সময় লেগেছে। বিব্রত কণ্ঠে ইতমিনান বলল, “অন্ধকারে এখন কে আমার উল্টা গেঞ্জি দেখতে যাচ্ছে?”
“এই যে আমি দেখে ফেললাম।” হাসলো মালিহা। মন খুলে। অনেকদিন পর। ইতমিনান চেয়ে দেখলো অপলক। হাসি থামিয়ে মালিহা বলল, “মিলি আপা কেমন আছে?”
“তুই ফোন দিস না?”
“আমার ভয় লাগে।”
“ও কি তোকে ফোনের ভেতর থেকে মা’রতে পারবে? ভয় পাওয়ার কি আছে? নিজেই খোঁজ নিবি।”
ইতস্তত করে মালিহা বলল, “আচ্ছা নেবো।”
মোবাইলে সময় দেখে ইতমিনান। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “এবার উঠি।”
ইতমিনানের আগে মালিহা উঠে দাঁড়ায়। ইতমিনান ওঠে ধীর গতিতে। ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত দিয়ে মালিহার দিকে তাকায় সে। কিছু পল। অপলক। সেই দৃষ্টির সামনে মালিহা সংকুচিত হয়ে যায়। যেনো ইতমিনান তার চেহারাটা মেপে নিচ্ছে। ঘনঘন পলক ফেলে মালিহা। হঠাৎ করেই নীতির কথাটা মনে হয়। ইতমিনানের এই দৃষ্টির অর্থ কী?
“আসি। কোনো সমস্যা মনে হলেই আমাকে ফোন দিবি। মনে থাকবে?”
“থাকবে।”
ইতমিনান বের হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সিঁড়ি ঘরে যায় মালিহা। সেখানে দাঁড়িয়ে হলের বাইরের অংশ দেখা যায়। সে জায়গাটায় পৌঁছাতেই নজরে পড়ে ইতমিনানের দেহাবয়ব। সদর দরজার ওপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ঢোক গিলে মালিহা। কাঁচের উপরে রাখা তার হাতটা কেঁপে ওঠে। কেনো দাঁড়িয়ে আছে ইতমিনান? মন মনের সহজ উত্তর মালিহাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়।

°

ইটের টুকরো তার পায়ের আঘাতে ড্রেনে পড়ে যায়। ঠোঁট কামড়ে মালিহার দুশ্চিন্তা মাখা মুখটা আরেকবার দেখে নেয় ইতমিনান। মনের গোপন কোণে ছোট্ট একটা সিন্দুকে মেয়েটার অনেক ভঙ্গির ছবি আছে। ইচ্ছে হলেই টুক করে সেই সিন্দুক খুলে একটা একটা করে দেখতে থাকে সে। কিন্তু তৃষ্ণা বাঁধ না মানলে সরাসরি মানুষটাকে দেখা জরুরী হয়ে যায়। ইতমিনান নিজেকে নিয়ে চিন্তিত হলো। এভাবে চলতে থাকলে মন আর মানবে না। মা মালিহাকে মানবে না। আজও একবার ফোন করে মেয়ে দেখার কথা বলেছে। ইতমিনানের শক্ত সন্দেহ হয় তার মা মেয়ে দেখা শুরুও করে দিয়েছে। পছন্দ হলেই হয়তো তাকে তাগাদা দিতে শুরু করবে। জোর হয়তো করবে না। কিন্তু ইতমিনান কতদিন ঠেকিয়ে রাখবে? একবার কি বলে দেখবে? নাহ্। মা মানবে না। বাবা? বাবা কি তাকে খারাপ ভাববে? মালিহার দুর্বল সময়ের সুযোগ নিচ্ছে এমনটা ভাবতেই পারে। তাহলে আর কে আছে? রাবেয়া ফুপু? হ্যাঁ! ফুপুর সাথে একবার কথা বলা যায়। কিন্তু কি বলবে ইতমিনান। তার কথা এলোমেলো হয়ে যায়। অনুভূতিরা সারিবদ্ধ হয়ে হাজিরা না দিয়ে ছুটোছুটি করতে শুরু করে। মালিহার চিন্তা মাখা মুখটা দেখলে আর নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না ইতমিনান। মেয়েটার কিসের এতো চিন্তা?

ভোর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বিছানাটা যেনো দুহাত বাড়িয়ে মালিহাকে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে। মালিহাও আলিঙ্গনে সায় জানিয়েছে। দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট। এমন করেই ফজরটা মিস হয়েছে। উঠতে উঠতে সাতটা বেজে গেলো। মালিহার শব্দ পেয়ে নীতি ধড়ফড়িয়ে উঠলো। বিছানার কাছে রাখা ব্যাগটা আরেকবার দেখে নিলো। আজ বাড়িতে যাবে সে। নীতির মা কয়েকদিন ধরেই যেতে বলছেন। নীতি বলেছিলো পরীক্ষা দিয়ে একেবারে যাবে। তারা মানলেন না। নীতি শেষমেষ মেনে নিয়েছে। দুই দিনের জন্য বাড়িতে যাচ্ছে সে। তবে তার সন্দেহ হচ্ছে তার বাবা মা তার জন্য পাত্র দেখছে। কেনো যেনো বাবা মা বাড়িতে যেতে বললেই তার এই কথা মনে হয়। ঘুম থেকে উঠেই মালিহাকে সে বলল, “ভালো করে চাঁদ মুখটা দেখে নে মালিহা। বিয়ে হয়ে গেলে তখন রূপ পাল্টায় যাবে।”
মালিহা হাই তুলে বলল, “ফালতু কথা বাদ দে। বিয়ে টিয়ে করলে ফোন দিস। পাত্রকে একবার সতর্ক সংকেত দিতে হবে।”
“বান্ধবী নামের কলঙ্ক তুই।”
“আচ্ছা।”
নীতি ধুপধাপ করে বাইরে চলে গেলো। মালিহার একটুও কোচিংয়ে যেতে মন চাইছে না। আঁখির বিছানায় তাকাতেই দেখলো হেডফোন কানে দিয়ে ল্যাপটপ চাপছে সে। তুষারের ব্যাপারটা কি একবার আঁখিকে বলবে। পরক্ষণেই মত পাল্টায় মালিহা। আঁখি যদি খারাপ ভাবে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠলো সে। কাযা নামাজ পরে বিছানায় বসে রইলো কতক্ষন। আজকে এতো বিরক্ত লাগছে কেনো?

দুজনে একসাথেই বের হলো। নীতি অটোতে উঠলের সেকেন্ড গেটের দিকে গেলো মালিহা। দূরে এহসানকে দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি একটু থামতেই মানুষ বের হয়ে পড়েছে। দ্রুত সেই রাস্তা পাল্টে ফেললো মালিহা। হঠাৎ এহসানের প্রতি একটা শ্রদ্ধা কাজ করলো। সেদিনের পর ছেলেটা তাকে আর বিরক্ত করেনি। না ক্লাসে, না অন্য কোথাও। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। আকাশে কালো মেঘ। মনে হচ্ছে যখন তখন ঝমঝমিয়ে আবার নামবে বৃষ্টি। তার ভাবতে দেরি হলো বৃষ্টি পড়তে নয়। হতভম্ব হয়ে গেলো মালিহা। বের হওয়ার সময় বৃষ্টি কমে গিয়েছিলো। ছাতা আর নেয়া হয়নি। শক্ত একটা ধমক দিলো নিজেকে। আশপাশে দোকানও নেই একটু দাঁড়ানোর মতো। এসব ভাবতে ভাবতেই ভিজে গেলো অনেকটা। দৌঁড়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। দোতলায় বারান্দা। তার নিচ বরাবরই দাঁড়ালো মালিহা। বোরখার দিকে তাকাতেই বিরক্তিতে মুখটা তিক্ত হয়ে গেলো। পিচ্ছিল কাপড়টা গায়ের সাথে এটে আছে। হলে ফিরে যাবে? ধমক নিশ্চিত। এর আগেও একদিন বৃষ্টির কারণে যাবে না বলে ফোন দিলে তুষার তাকে ধমক দিয়েছে। দম ছাড়লো মালিহা। এভাবেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ঘণ্টার কাঁটা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়েছে। বৃষ্টির গতি কমতেই রাস্তায় নেমে পড়লো সে। পাঁচ মিনিট হেঁটে কোচিংয়ে পৌঁছালো। ঢুকতেই মনে হলো শুনশান নীরবতা। কি ব্যাপার? ছেলেমেয়েরা এখনও আসেনি নাকি? অফিস রুমের লাইট জ্বলছে। বাকি সব রুমের লাইট বন্ধ। উঁকি দিতেই তুষার বেরিয়ে এলো। আলুথালু তার বেশ। পাশের ফ্ল্যাটেই সে থাকে। বলতে গেলে নিচ তলাটা তার দখলে। মালিহা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তুষার আপাদমস্তক তাকে দেখলো। মালিহা কাঠ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
“এখনও কেউ আসেনি?”
“এই ঝড় বৃষ্টিতে কে আসে?” তুষারের কণ্ঠটা কেমন যেনো শোনালো। মালিহা তাকালো তার দিকে। সে এখনও মালিহার বোরখার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ একদম সরাসরি। ধারণা সত্যি হলো। মালিহার মন চাইলো কলমের নিপ তুষারের চোখে ঢুকিয়ে দিতে।
“নিতু আপু আসেনি?”
“না। কেউ আসেনি। তুমি বসো। বোরখা টোরখা খোলো। ভিজে তো চপচপে হয়ে গেছো।”
পুরো কোচিংয়ে কেউ নেই। মালিহার কেমন যেনো লাগলো। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। নিতুর কাছে একবার ফোন দেবে? ছেলেমেয়েরা কেউ আসছে না কেনো? জড়সড় ভঙ্গিতে চেয়ারে বসলো সে। হঠাৎ শব্দে ধ্যান ভাঙলো। তুষার দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনের সদর দরজাটা বন্ধ। সে হেসে বলল, “বৃষ্টির পানি এসে তো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”
সেই হাসি দেখে মালিহার মনে হলো তার মাথা ঘুরছে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৭

কোচিংয়ের সামনে একটা টিনশেড দোকান। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অবাধ্যের ন্যায় ছুটোছুটি করছে। উল্লাস নৃত্য। তাদের উল্লসিত শব্দ গীতিকারের কাছে সুরের মূর্ছনা তৈরি করতে পারলেও মালিহার গায়ে শব্দগুলো যেনো কাঁটার ন্যায় বিধছে। শরীরে তখনও বৃষ্টির পানি। তার মাঝে নিজের জায়গা করে নিয়েছে স্বেদবিন্দু। তুষার তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি অটল হয়ে আছে মালিহার দিকে।

“এভাবে ভেজা কাপড়ে থাকতে ভালো লাগছে তোমার? তুমি চাইলে আমি হেল্প করতে পারি।”

মৃগী রোগীর ন্যায় মালিহার হাতটা কেঁপে উঠলো। দাঁতে দাঁত বারি খেলো প্রচণ্ড গতিতে। মালিহা বুঝলো তাকে শক্ত থাকতে হবে। কিন্তু কেনো শক্ত থাকতে হবে সেই চিন্তাটাই তাকে ভেতরে থেকে বিবশ করে দিলো। চেয়ারেই বসে রইলো মালিহা। পাথরের মূর্তির ন্যায়। তুষার এক পা এগিয়ে আসতেই কারেন্ট চলে গেলো। চোখের সামনে অন্ধকার দেখতেই যেনো মালিহা আসল আলোর দেখা পেলো। বুকটা উত্তেজনায় ধড়ফড় করতে শুরু করলো। ব্যাগ হাতড়ে ফোন বের করতে যেয়ে সে বাঁধা পেলো কয়েকবার।

“পরিবেশ মনে হচ্ছে আমাদের সাহায্য করছে। কি বলো মালিহা?”

ফোনের স্ক্রিন জ্বলে উঠতেই মালিহার মুখটা দৃশ্যমান হলো। তুষার এগিয়ে এলো। অন্ধকার ঘরে শুধু মালিহার মুখটা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি, ঘামের পানি মিলে একাকার অবস্থা। সন্তর্পনে মালিহার পাশের চেয়ারে বসলো তুষার। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, “মালিহা তোমার এই শক্ত শক্ত ভাবটা দেখেই কিন্তু আমি ভেতর থেকে নড়ে গিয়েছি। বি ইজি। এখানে অতিরিক্ত ভাবার কিছুই নেই।”
হঠাৎই মালিহার চোখ যেনো জ্বলে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তুষারের দিকে। হালকা হেসে তুষার বলল, “জবরদস্তি করতে কেমন লাগে তার অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে তুমি চাইলে আজ সেটাও হয়ে যাবে।” তুষারের মুখের হালকা হাসিটা মালিহার ভয়ের আগুনে যেনো হাওয়া দিলো। বসে যাওয়া গলা থেকে সে খুব কষ্ট উচ্চারণ করলো, “আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?”
“অবুঝের মতো কথাবার্তা বলবে না তো! এখানে ক্ষতির কিছুই নেই। শুধু লাভ আর লাভ।” আয়েশ করে বসলো তুষার।
“আমি চিৎকার করবো।”
“করতে চাইলে করো। এখানে আসার মতো কেউ নেই। আর সব টিচারদের আমি আসতে গ্রুপে নিষেধ করে দিয়েছি। গ্রুপ চেক করোনি এটা তোমার সমস্যা। আমি তো তোমাকে ডেকে আনিনি।”
পত্র পত্রিকা তেমন একটা পড়ে না মালিহা। তবে আশপাশের ঘটনা ফেসবুকের দৌলতে কানে আসতে দেরি হয় না। চোখে ভাসে বর্ণনা করা চিত্র। আত্মার মৃ’ত্যুর শুরুটা কি এমনই হয়? মালিহা ফাঁকা ঢোক গিললো। কাকে ফোন দেবে সে? কার কাছে সাহায্য চাইবে? ঠোঁটের আগায় অজান্তেই আল্লাহর নাম চলে এলো। ভাঙা কণ্ঠে কিছু বলার আগেই তুষার তার স্কার্ফে হাত দিলো। সেই স্পর্শের রুক্ষতা মালিহার ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। চট করে উঠে দাঁড়ালো সে। তুষার শক্ত কণ্ঠে বলল, “পালানোর চেষ্টা করবে না মালিহা।” বলতে বলতেই মালিহার কাছে যেয়ে দাঁড়ালো সে। মালিহা পেছাতে চাইলে খপ করে তার হাত ধরলো তুষার।
“আমাকে যেতে দিন তুষার ভাই।” খুব কষ্টে বলল মালিহা। তুষার কি আগে থেকেই পরিকল্পনা এটেছিল? সে জানতো মালিহা আসবে? এই একা কোচিংয়ে তার ম’রণ হবে?
“প্রশ্নই ওঠে না। দেখো মালিহা, বি লজিক্যাল! এখানে কে আমাদের দেখতে আসছে? কেউ জানবেই না কি হচ্ছে। জাস্ট একটু এনজয়। তারপর তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার। আমাকে কি তোমার রে’পিস্ট টাইপ লোক মনে হয় নাকি?”
মালিহার কান ঝা ঝা করে উঠলো। হাত ছড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা ফলস্বরূপ কাঁধ থেকে ব্যাগ আর হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো। টর্চ থেকে গেলো নিচে। মালিহার চিৎকার করতে মন চাইলো। ভেতর থেকে ভয়টা ফুপিয়ে কান্না আকারে বের হলো।
“আমাকে ছেড়ে দিন তুষার ভাই। আমি ম’রেই যাবো।”
“এসব কথা আমাকে টলাবে না মালিহা। প্রথম দিন থেকেই তোমার পার্সোনালিটি আমার কাছে অ্যাট্রাক্ট করেছে। এমন একটা দিনের অপেক্ষায়ই আমি ছিলাম। আজ দেখো তুমি নিজেই সুযোগ করে দিলে। কি মনে করো? এই আলখাল্লা পড়ে থাকলে মানুষ কিছু বুঝবে না? ছোট মানুষ!” মালিহার বোরখায় টান দিলো তুষার। কাঁধের কাছের সেফটিপিন টান লেগে চামড়ার ভেতর ঢুকে গেলো। হঠাৎ করেই জোরে ধাক্কা দিলো মালিহা। তুষার টেবিল ধরে দাঁড়ালো। হাত ছাড়া পেয়েই ফোন উঠিয়ে ভেতরের একটা ক্লাস রুমে ঢুকে পড়ল মালিহা। সাথে সাথেই দরজা বন্ধ করে দিলো। কপালের দুই পাশের শিরা দপদপ করছে। মালিহা বুঝলো না কি করবে। মন চাইলো নিজের গলা নিজের হাতে টিপে ধরতে।
“আল্লাহ আল্লাহ বাঁচাও। আল্লাহ বাঁচাও..” বলতে বলতেই ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো মালিহা। কম্পনরত হাতটা দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। ফোন হাতে নিয়েও বুঝলো না কাকে কল করবে। এলোমেলো চিন্তার মাঝেই মস্তিষ্কে ইতমিনানের মুখটা উঁকি দিলো। তার বলে যাওয়া কথাটা “কোনো সমস্যা মনে হলেই আমাকে ফোন দিবি। মনে থাকবে?”
মালিহাকে বেশি কষ্ট করতে হলো না। শেষবার ইতমিনানের সাথেই তার কথা হয়েছিল। একবার চাপ দিতেই ফোন চলে গেলো ইতমিনানের কাছে।
“হ্যালো ভাইয়া!”
খট করে শব্দ হলো। দরজা বাইরে থেকে খুলে ফেলেছে তুষার। মালিহার কানে আর কিছুই ঢুকলো না। তুষার যখন তাকে টানতে টানতে ঘরের আরেক কোণায় নিয়ে গেলো তখন মালিহা শুধু নিজের মৃ’ত্যুর দোয়া করলো। ফোনটা অবহেলায় পড়ে রইলো এক কোণে। ওপাশের অস্থির মানুষটার স্বস্তি ফেরাতে কেউ পাল্টা জবাব দিলো না।

মানিকের সাথে আজ বেশ কয়েকদিন যাবৎ দেখা সাক্ষাৎ নেই। ইতমিনান ভাবলো লালপাহাড়কে নিয়ে মানিকের ডেরায় যাবে। তবে আবহাওয়া তাকে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে কর্দমাক্ত পথে যেতে মন চাইলো না ইতমিনানের। পিচ ঢালা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো সে। বিশাল কালো ছাতাটা তাকে এবং লালপাহাড়কে বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখছে। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ভার্সিটির প্রথম গেটে এসে গেলো ইতমিনান খেয়ালই করলো না। লালপাহাড়ের কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো। সে একটা কুকুরের সাথে ঝগড়া করতে শুরু করেছে। আকাশের দিকে তাকালো ইতমিনান। বৃষ্টি আবার বেড়েছে। লালপাহাড়কে নিয়ে একটা দোকানের ছাউনিতে দাঁড়ালো। ছাতা বন্ধ করতেই মোবাইল বেজে উঠল। মালিহার নাম দেখে ঈষৎ হাসলো ইতমিনান। এখন তো কোচিংয়ে থাকার কথা। তাহলে আবার কি হলো? ভুরু কুঁচকেই কল রিসিভ করলো সে। ইথারে ভেসে এলো মালিহার অস্থির, ভয়ার্ত কন্ঠ,
“হ্যালো ভাইয়া!”
“হ্যালো? এই কি হয়েছে তোর?”
মালিহার আর কোনো শব্দ পেলো না ইতমিনান। শুধু ভেসে এলো তার কান্নার শব্দ। সাথে পুরুষালি একটা কণ্ঠের আভাস। চিন্তার গতি লাগাম ছেড়ে টগবগিয়ে দৌড়ে এলাকা ছাড়লো। ছাতা ফেলেই দৌঁড়াতে শুরু করলো ইতমিনান। একমাত্র লক্ষ্য সেকেন্ড গেটের পাশের কোচিংটা। ইতমিনানকে দৌঁড়াতে দেখে লাল পাহাড় ঘেউ ঘেউ করতে করতে নিজেও দৌড় দিলো। অঝোর ধারার বৃষ্টিতে বিরক্ত আশপাশের মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখলো এক যুবক এবং এক কুকুরের অস্বাভাবিক দৌড় প্রতিযোগিতা।

নিতু তিতিবিরক্ত। কোচিংয়ের বন্ধ দরজা দেখে তুষারকে ফোনের পর ফোন করে চলেছে সে। দরজায় ধাক্কা দিয়েছে বেশ কয়েকবার। এসেছে প্রায় পনের মিনিট হয়ে গেলো। এই বৃষ্টির মাঝে এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা যায়? কাপড় প্রায় পুরোটাই ভিজে গেছে। ছাতার কল্যাণে উপরের দিকটা রক্ষা পেয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে আবার কল করলো নিতু। তুষারের বাচ্চাকে শিক্ষা না দিলে তার শান্তি হবে না। এই সকালে গেট না খুলে থাকার মানে কি? ছেলেমেয়েরা নিশ্চিত এসে ফিরে গেছে। নয়তো তার ফোন এতোগুলো কল মিস হয়েছে কেনো?
নিজের উপর হওয়া বিরক্তিটা সরাতে পারলো না নিতু। ফোন সাইলেন্ট করার এই বদ অভ্যাসের জন্য কতো ভোগান্তিই যে পোহাতে হয়েছে তবুও স্বভাবটা বদলালো না। ডেটা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে গ্রুপ চেক করা হয়নি। সে যা হোক, তুষার নিশ্চিত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। আর ছেলেমেয়েরা তাকে না পেয়ে নিতুর কাছে ফোন দিয়েছে। সেও রিসিভ করতে পারেনি। কলিং বেল চেপে ব্যর্থ হলো নিতু। কারেন্ট নেই। আবার দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো সে। সে নিজে শান্তির ঘুম নষ্ট করে এসেছে। তুষারকেও ঘুমাতে দেবে না।
হঠাৎ কুকুরের ডাকে আতকে উঠলো নিতু। দরজার সাথে সেটে দাঁড়াতেই দেখলো কাকভেজা এক যুবক এবং তার পিছু পিছু আসছে বিশালদেহী লাল রঙের একটা কুকুর।

পেপার ওয়েট দিয়ে তুষারের কপালে আঘাত করেছে মালিহা। অন্ধকারে শুধু তুষারের আর্তনাদটা শুনেছে। বুঝতে পেরেছে তুষারের আঘাত লেগেছে। চোখে লাগলে বেশি ভালো হবে। কোথায় লাগলো কে জানে।
আঘাত পেয়ে জায়গাটা চেপে ধরলো তুষার। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। পরপরই মালিহাকে ছুড়ে ফেললো মেঝেতে। তার ফোনে কল এসেছে। টেবিলের উপর পড়ে আছে অবহেলায়। একবার এসে থামলো না। একের পর এক কলের শব্দে বিশ্রী গালি দিলো তুষার। মালিহা তখন উঠে দেয়ালের কাছে সেটে বসেছে। এক হাতে ধরে রেখেছে কাঠের চেয়ারের পায়া। ফোন সাইলেন্ট করে মালিহার দিকে এগিয়ে এলো তুষার। মালিহা চেয়ার তুলে তুষারের দিকে ধাক্কা দিলো। ছুড়ে দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও সেটা হলো না। শরীরের শক্তি ভয় শুষে নিয়েছে। হৃদপিণ্ডের অস্থিরতা বুকটা স্থির থাকতে দিচ্ছে না।
এবার শুরু হলো দরজা ধাক্কানো। তুষারের মনে হলো সাজানো গোছানো পরিবেশটা হঠাৎ করেই বিগড়ে গেছে। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে হাতের মুঠোয় মেয়েটাকে পেয়েও কার্য হাসিল না করতে পারার চিন্তা তাকে উন্মাদে পরিণত করলো। ছুটে এসে মালিহার খোপা করা চুলের গোছা এলোমেলো স্কার্ফের উপরেই টেনে ধরলো।
“কাকে ফোন করেছ? কে আসবে তোমাকে বাঁচাতে? কেউ আসবে না। কেউ না!” চিৎকার করলো তুষার। এভাবে হেরে যেতে হবে ভাবলেই তার র’ক্ত গরম হয়ে আসছে। প্রত্যেকবার তার প্ল্যান মাফিক সব হয়েছে। কেউ টু শব্দ করার সাহস পায়নি। এবার কেনো এমন হবে? মানবে না সে। কোনোভাবেই না।
কিন্তু তুষারের মানার আশায় আর কিছু থেমে রইলো না। সদর দরজার উপর যেনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একের পর এক আঘাতে দরজা তার স্থায়িত্ব হারাতে বসলো।

উপরের সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হলো ইতমিনান। অস্থির ভঙ্গিতে নিতুকে বলল, “আজ কি কোচিং ছুটি? ছুটি হলে মালিহা কোথায়? কি হলো! কথা বলছেন না কেনো!” শেষের কথাটুকু চিৎকার করে বলল ইতমিনান। নিতু কেঁপে উঠলো।
“না কোচিং তো ছুটি না।”
“তাহলে দরজা বন্ধ কেনো?”
“জানিনা। আমিও তো কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছি।”
ইতমিনান আর কিছু শোনার প্রয়োজবোধ করলো না। আসতে আসতে মালিহাকে পঞ্চাশ বারের কাছকাছি ফোন দিয়ে দিয়েছে। রিসিভ হয়নি। অনুমানের ভিত্তিতে এখানে এসেছে ইতমিনান। ছুটি না হওয়া সত্ত্বেও বন্ধ দরজা তাকে আর কিছু ভাবতে দিলো না। অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো পুরোনো দরজাটার উপরে।

.

তুষার বুঝতে পারলো সে হয়তো ধরা পড়ে যাচ্ছে। মালিহাকে কষে একটা থাপ্পর মা’রলো।
“তোর ভাব আমি ছুটিয়ে দেবো ***। এই তুষারকে তো চিনিস না!”
মালিহার ঠোঁট ফেঁটে গেলো। দুর্বল শরীর নিয়ে সে আর নড়তে পারলো না। তুষার চলে গেলো আরেকদিকে। ওপাশের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়া তার লক্ষ্য।
ধরাম করে একটা আওয়াজ হলো। ভেঙে গেলো দরজার নব। ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো ইতমিনান। পিছু পিছু নিতু। এই লোকের কাজের আগা মাথা সে বুঝতে পারছে না। ভেতরে ঢুকতেই নিতুর চোখ কপালে ওঠার দশা। পুরো ঘরের উপর দিয়ে যেনো ঝড় বয়ে গেছে। বার কয়েক তুষারকে ডাকলো সে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। ইতমিনান অস্থির ভঙ্গিতে আরেক রুমে ঢুকলো। চিৎকার করলো, “মালিহা! মালিহা!” লালপাহাড় দরজায় দাঁড়িয়ে আগ্রহী চোখে ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো শুধু একটা ইশারার অপেক্ষা।
টেবিলের পেছনে কাপড়ের টুকরো নজরে আসতেই সেদিকে গেলো নিতু। ভয়ার্ত গলায় ডেকে উঠল, “মালিহা!”
তখন শুধু মালিহার শ্বাস চলছে। গালের একপাশ লাল হয়েছে নিজের রঙে। ফ্যাকাশে মুখটা একটু বেশীই সাদা লাগছে। চিৎকার শুনে দৌড়ে এলো ইতমিনান। নিতু হাঁটু গেড়ে মালিহার সামনে বসে আছে। তার হাত ধরে ওঠানোর চেষ্টা করছে। খুব কষ্টে চোখের পাতা টেনে খুললো মালিহা। ইতমিনানের মুখটা নজরে আসতেই জ্ঞান হারালো সে। ইতমিনান দেখলো মালিহার নাক থেকে বইতে শুরু করেছে র’ক্তে’র সূক্ষ্ম এক ধারা।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৮

অল্প কিছুক্ষণ। সেই ক্ষণের মাঝেই রিলেটিভিটির সূত্রটা হাড়ে হাড়ে টের পেলো ইতমিনান। মালিহার চোখ খুলতে লাগলো গুণে গুণে ছয় মিনিট। কিন্ত ইতমিনানের মনে হলো তার শ্বাস ছয় ঘণ্টার জন্য আটকে গিয়েছিলো। ছেঁড়া স্কার্ফ, কপাল থেকে বেরিয়ে আসা এক গাছি চুল, গালের সাথে লেগে থাকা টকটকে লাল র’ক্ত, কুচকে যাওয়া কর্দমাক্ত বোরখা, বন্ধ চোখ। ইতমিনানের মনে হচ্ছিল মালিহা চোখ না খুললে তার চোখ আর কিছুক্ষণের মাঝেই বন্ধ হয়ে যাবে।
সেই যাত্রায় ইতমিনান বেঁচে গেলো। মালিহা চোখ খুললো। সে নিতুর কোলে পড়ে আছে। এই বিষয়টা বুঝতে তাকে আরো কিছু সময় ব্যয় করতে হলো। সামনে দন্ডায়মান ইতমিনানকে দেখে আশপাশে তাকালো। তুষার নেই। কোথাও নেই। হালে পানি পেলো মালিহা। নিতু নরম কণ্ঠে ডাকলো, “মালিহা?”
ব্যস! ঐ ডাকটুকুর আশায়ই যেনো মালিহা ছিলো। হামলে পড়ল নিতুর বুকে। নিতু পরম মমতায় জড়িয়ে নিলো। ঠিক একজন বড় বোনের মতো। মালিহার হেঁচকি উঠে গেলো। নিতুর পিঠে নখ বসিয়ে দিয়েও ক্ষান্ত হলো না সে। তার চোখে খানিক আগের দৃশ্য জ্বলজ্বল করছে। বুকটা ওঠানামা করছে হাপড়ের ন্যায়।
পুরো ঘরে আর কোনো আওয়াজ নেই। লালপাহাড় একবার কুঁই কুঁই করে উঠেছিল। মালিহার কান্নার আওয়াজ থেমে গেছে। ক্লান্ত হয়ে মালিহা থামলো। তবে নিতুকে ছাড়লো না।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে। আশপাশের কয়েকজন এসে উঁকি দিতে শুরু করেছে। ইতমিনান বের হলো। কড়া কণ্ঠে ধমক দিয়ে বলল, “ভিড় জমিয়েছেন কেনো? এখানে কি?”
তারা বলবে কিভাবে এখানে কি? কি হচ্ছে তাই দেখতেই তো এসেছে। একজন কুকুর নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে দরজা ভাঙতে শুরু করলো তাহলে মানুষ জড়ো হবে না? যারা ছিল ইতমিনানের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে চলে গেলো। ইতমিনানের বুক আশঙ্কায় দুরু দুরু কাঁপছে। ক্ষতর চাইতে তার চিহ্ন বেশি ভয়ানক। মালিহার জীবনকে সে ভয়ানক হতে দিতে চায় না। দম ফেলে দোকানে গেলো সে। পানির বোতল হাতে ফিরে এলো। মালিহার সামনে ধরতেই চোখ তুলে তাকালো সে। বিপদের সময় অপরিচিত এই শহরে সবচেয়ে পরিচিত মানুষটাকে দেখে কেঁদে দিলো। ইতমিনান হাঁটু ভেঙে বসলো। শান্ত ভঙ্গিতে বোতলের মুখ খুলে মালিহার মুখের সামনে ধরলো।
“খা।”
মালিহা ধরলো বটে। কিন্তু খেতে পারলো না। পানি ছলকে পড়লো তার গায়ে। নিতু সাহায্য করলো। উঠে চেয়ারে বসলো মালিহা।
নিতু ঘটনা আগেই আঁচ করতে পেরেছে। এতক্ষণে মালিহা শান্ত হওয়াতে বলল, “জানোয়ারটা কোথায়?”
“পালিয়ে গেছে।” ঠোঁট ভেঙে এলো মালিহার। ইতমিনান পকেটে হাত গুজলো। তার হাত নিশপিশ করছে মালিহার মাথায় রাখার জন্য। রাখবে না সে। অদৃশ্য এক অভিমান তাকে ঘিরে ধরেছে। হাতছানি দেয়া দুর্ঘটনা তার চিত্তকে শিকড় থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে নিতু মালিহাকে বলল, “উনি?”
“চাচাত ভাই।”
“জানালে কিভাবে?”
“ফোন করেছিলাম।”
সূক্ষ্ম চোখে মেয়েটাকে দেখলো নিতু। কাপড় চোপড়ের বেহাল দশা হলেও তারা স্থানচ্যুত হয়নি। মেয়েলি চোখে ঘটনা আঁচ করতে অসুবিধা হলো না। পুনরায় মালিহাকে বুকে টেনে নিল নিতু। মেয়েটার প্রতি এমন স্নেহ আগে কখনোই অনুভব করেনি সে।

বেশ অনেকটা সময় পরে নিতু ইতমিনানের কাছে এলো। মালিহা চেয়ারে শক্ত হয়ে বসে আছে। একবার সেদিকে তাকিয়ে ইতমিনানের কাছে বলল, “কি ভাবছেন? কি করবেন এখন?”
ইতমিনান যেনো চমকে উঠলো। উদাস ভঙ্গি ভেঙে চোখ বড় করে তাকালো।
“হু?”
“বলছি এখন কি করবেন? মালিহা?” নীতি বিরক্ত হলো। লোকটাকে তার চটপটে বলে মনে হলো না। তখন থেকে একভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে। নট নড়ন চড়ন মার্কা অবস্থা।
“কি করবো?” অবুঝের ন্যায় প্রশ্ন করলো ইতমিনান।
“আশ্চর্য! এভাবে বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করছেন কেন? একটা ডায়েরি তো করতেই পারেন। প্রয়োজন হলে আমি সাক্ষী দেবো। বিষয়টা তো এভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না।”
“ডায়েরি?” যেনো নিজেকেই শোনালো ইতমিনান। পরপর আবার নীরবতা। লালপাহাড় সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। আশপাশ পর্যবেক্ষণ করছে। সকালে ঝগড়া করা সেই কুকুরটা খুঁজছে নাকি কে জানে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ইতমিনান ভাবলো। ডুব দিল চিন্তার অতলে। ডায়েরি, পুলিশ, ইনকোয়ারি, গল্প, গুজব, মালিহা? মালিহার দিকে তাকালো ইতমিনান। বড় বড় ভাব দেখায়। ভেতরটা তো ছোট থেকেই ইতমিনানের চেনা। শক্ত হয়ে থাকা মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কতোটা ভেঙে গুড়িয়ে গেছে সে জানে। ভাঙা মানুষটাকে আরো টুকরো করার প্রশ্নই ওঠে না।
ঢোক গিলে ইতমিনান বলল, “আমি কোনো ডায়েরি করবো না।”
“তাহলে কি করতে চান আপনি? এভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন? সরি টু সে কিন্তু মালিহার অভিভাবক হিসেবে কোনো কাজই আপনি করছেন না।”
“কীটটা মাস্টার্স করছে। কিছুদিনের মাঝেই বেরিয়ে যাবে। এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। মালিহা মাত্র সেকেন্ড ইয়ারে। মানুষ তিল থেকে তাল বানাবে সেই তালের বোঝা মাথায় নিয়ে ওকে এখানে বছরের পর বছর থাকতে হবে। আমাদের এখানে চেনা পরিচিত কেউ নেই। একটা ডায়েরীই সমাধান না। একবার ওর সম্মান হারিয়ে গেলে সেটা মাটি খুঁড়েও আর ফেরত পাওয়া যাবে না।”
নিতুর রাগ হলো। কটমট করে সে বলল, “আপনাদের মতো মানুষগুলোর এমন চিন্তার কারণেই এসব জানোয়ার আরো আশকারা পায়। আপনারা যদি প্রতিবাদ না করেন তাহলে ও আবার সুযোগ পাবে না?”
ঈষৎ হাসলো ইতমিনান। নিতুর কাছে মনে হলো তাচ্ছিল্য মাখা হাসি। লালপাহাড়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে ইতমিনান বলল, “আপনি নিজেও তো প্রতিবাদ করেননি। চুপ করে গিয়েছিলেন কেনো? শুধু ক্লাসমেট বলে?” ফের লালপাহাড়ের দিকে তাকালো ইতমিনান। নিতু ভয়ানক চমকে গেলো। এতটাই যে শেষ পর্যন্ত না ইতমিনানের দিকে সরাসরি তাকালো না-ই বা আর একটা শব্দও খরচ করলো।
টেবিলের নিচে এক জোড়া জুতা পেলো ইতমিনান। বইয়ের নিচ থেকে একটা রুমাল। জিনিসগুলো এনে লালপাহাড়ের সামনে রাখলো সে। লালপাহাড় একবার মুখ উঠিয়ে ইতমিনানের দিকে তাকালো। ইতমিনান চোখ দিয়ে ইশারা করল জিনিসগুলো শুঁকে নিলো নিজের নাক দিয়ে। গন্ধটা গেঁথে নিলো মস্তিষ্কে। খুঁজে খুঁজে একটা প্যাকেট পেলো ইতমিনান। সেটায় রুমাল রেখে প্যাকেটটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।

মালিহাকে বিদায় দিলো নিতু। চলে গেলো ভার্সিটিতে। ইতিমিনান কিছু না বললেও মালিহা তার পিছু নিল। একটা অটো দাঁড় করালো ইতমিনান। বড় সিটে মালিহা বসলে লালপাহাড়কে ওঠালো। অটোওয়ালা গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলেন। ইতমিনান তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আর কাউকে নিয়েন না মামা। পুরা ভাড়া দিয়ে দিবো।”
মালিহার কোনাকুনি বিপরীতের সিটে বসলো ইতমিনান। লালপাহাড় জিহ্বা বের করে বাইরে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত জার্নি বাই অটো উপভোগ করছে।
মালিহা আরেকটু গুটিয়ে গেলো। ঝাঁকি লাগলেই পা কুকুরটার গায়ে লাগছে। তখনই তার দিকে তাকাচ্ছে কুকুরটা। ইতমিনান বিষয়টা খেয়াল করে লালপাহাড়কে সরিয়ে আনলো।
হলের সামনে এসে নামলে ইতমিনান মালিহার হাতে তার কাঁধ ব্যাগটা ধরিয়ে দিলো। মালিহা অবাক হলো না। আপাতত সে অনুভূতি শূন্য অবস্থায় আছে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ইতমিনানের মুখের দিকে সসংকোচে একবার তাকিয়ে চলে গেলো হলের ভেতরে।
চোখের সামনে থেকে মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো ইতমিনান। তারপর চোখ বন্ধ করলো। মুখ ওঠালো আকাশের দিকে। লালপাহাড় দেখলো ইতমিনানের কণ্ঠনালি ওঠানামা করছে। টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার বন্ধ চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে।

খুব কষ্টে শরীরটা টেনে দুই তলা পর্যন্ত নিয়ে গেলো মালিহা। ব্যাগ থেকে চাবি বের করতে যেয়ে ব্যাগটা পড়ে গেলো। তালার গায়ে চাবি ছোয়ানোর আগে আবার চাবিটা পড়ে গেলো। নীরব বারান্দায় দরজার সিটকিনি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো মালিহা। জোরে জোরে শ্বাস নিলো কয়েকবার। ক্লাস টাইম। পুরো হলে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ আছে। কাঁপতে থাকা হাতে তৃতীয়বারের চেষ্টায় তালা খুললো। রুমে ঢুকতেই যেনো দম ঠেকে এলো তার। সব জানালা খুলে দিলো। বৃষ্টির পানি দিয়ে গোসল সেরে সজীব রোদ হুটোপুটি খেয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। মালিহা নিজেও সেই রোদের সাথে তাল মেলালো।
শরীর ঠাণ্ডা ফ্লোর ছুঁতেই চোখ বন্ধ করলো। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠলো তুষারের চেহারা। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো মালিহা। আশপাশে তাকালো। না কেউ নেই। এক হাতে স্কার্ফ খুললো। বোরখা টান দিয়ে খুলতেই বাম কাঁধ ব্যথায় টনটনিয়ে উঠলো। চুলগুলো এক হাতে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো মালিহা। কোনো রকমে এক সেট কাপড় নিয়ে বেডের নিচ থেকে বালতি টেনে বের করলো। এলোমেলো পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করল। ধপ করে ফ্লোরে বসতেই ভিজে গেলো তার সর্বাঙ্গ। নোনতা জলের মিশ্রণে মালিহা ধুয়ে ফেলতে চাইলো সবটুকু নোংরা স্পর্শ।

দীর্ঘক্ষণ ভেজার পর যখন মালিহা বের হলো তখন তার শরীর হিম শীতল। চেহারাটা দেখাচ্ছে র’ক্তশূন্য। রুমে ঢুকে বালতি রেখে ওড়না মাথায় জড়ালো মালিহা। ফ্লোরে বসেই মাথা ঠেকিয়ে দিলো সেখানে। অবাধ্য অশ্রু পথ পেলো। ভেজা চুলের পানি শুষে সেই হিম পরশ সন্তর্পনে মালিহাকে ফিরিয়ে দিলো মেঝে। এক সময় মালিহার ঠান্ডা শরীর গরম হয়ে এলো। ঝাপসা চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে খুব কষ্টে বিছানায় গেলো সে। পরিশ্রান্ত চোখের পাতা যখন বন্ধ করলো তখন মালিহার আশপাশে কেউ নেই। কেউ না।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-২৩+২৪+২৫

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৩

নামাজ ঘরটা দোতলায়। একদম কোনার দিকে। পশ্চিম পাশে হওয়ায় পড়ন্ত সূর্যের তাপটা থেকে যায় রাতের বেলায়ও। ফ্যান ছাড়লেও দেয়ালের গরম শরীর ছুঁয়ে দেয়। গরম লাগে। গলা থেকে মাথায় প্যাঁচানো ওড়নাটা ঢিল করে দেয় মালিহা। একটু বাতাস লাগতেই হাঁফ ছাড়ে। নীতি মোবাইলে বুদ হয়ে আছে। মালিহা গুতা দিলো তাকে।
“কি রে? এখনও কেউ আসে না কেনো? আর তো মাত্র পাঁচ মিনিট আছে।”
নীতি মুখ বাঁকিয়ে বলল, “এ কি কোনো রাজা মহারাজা মিটিং ডেকেছে যে সবাই আড্ডাবাজি ফেলে এখানে আসবে? সবাই মহাব্যস্ত।”
“কিন্তু কমন রুমে তো দেখলাম অনেকে আড্ডা দিচ্ছে। ওরাও তো গ্রুপে আছে।”
“দেখ তো নাজিফার মেসেজটা সিন করেছে কতজন। আঠারজন। ধর বড় জোর আটজন খুব বিজি। তাহলে আর দশজন আসতো না? সবগুলো দেখ গিয়ে ওখানে আড্ডা দিচ্ছে। কার নতুন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে, কার ব্রেকআপ হয়েছে। দুনিয়ার ফাতরা আলোচনা।”
মুখ কুঁচকে নিলো নীতি। নাজিফা একটা মেসেঞ্জার গ্রুপে তাদের অ্যাড করেছে। নামাজ ঘরে কোনো কারণে একত্রিত হলে গ্রুপে ছোট্ট একটা মেসেজ দিয়ে দেয় নাজিফা। চল্লিশের কাছাকাছি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা। কিন্তু নিয়মিত খুব কমই। মালিহা বলল, “থাক বাদ দে।”
মালিহার কথা শেষ হতেই নাজিফা এলো। তাদের দেখে যেনো মুখের উজ্জ্বলতা বাড়ল মেয়েটার। তার পিছু কিছু এলো আরো দুজন। পাঁচজনের দলটা গোল হয়ে বসতেই নাজিফা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো।
“এই প্রথম আমরা পাঁচজন এখানে!”
“কেনো? এর আগে কতজন হতো?” নীতি প্রশ্ন করলো।
নাজিফা মলিন কণ্ঠে বলল, “এই দুই, তিন এমন।” তার ঠোঁটে তখনও ঝুলছে হাসি।
“গ্রুপে তো দেখলাম আটত্রিশ জন মেম্বার। মেসেজ সিন করেছে আঠারোজন। তাহলে এতো কম মানুষ আসে কেনো?”
“সবার তো টাইমিং মেলে না। ব্যস্ত থাকে হয় তো।”
“ব্যস্ত না ছাই।” বিড়বিড় করে বলল নীতি। নাজিফা বলল, “আজ হঠাৎ করেই ডাকলাম। তেমন জরুরী কিছু না। নতুন একটা লেকচার শুনেছি। সূরা ফাতিহার। সেটাই কিছুটা নোট করে এনেছি।”
চারজন খুব মনে দিয়ে নাজিফার কথা শুনছিল। মালিহা বাকি মেয়ে দুজনকে খেয়াল করলো। মুখ চেনা। অন্য ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
সম্ভাষণে কিছু কথা বলে নীতি যখন সূরা ফাতিহা পড়তে শুরু করলো তখন মালিহা এবং নীতি দুজনেই বিস্মিত হয়ে নাজিফার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ। পাঁপড়িগুলো হালকা কাপছে। সুর মিশিয়ে যেভাবে সূরা ফাতিহা নাজিফা পড়লো তাতে মালিহার মনে হলো জীবনে প্রথমবার এই সূরা শুনলো সে। নীতি ঢোক গিললো। নাজিফা চোখ খুলে সকলের দিকে তাকিয়ে বাংলা অর্থ বলল। টুকে আনা নোট থেকে দেখে ব্যাখ্যা বলল নাজিফা। কতরকম কতো কথা! নীতির মাথা ঘুরে গেলো। মাত্র সাতটা আয়াতে এতো কাহিনী! এতো গোপন তথ্য! তত্ত্বের এই আয়োজন মালিহা কখনও টের পেয়েছে? কতোই তো পড়েছে এই সূরা।

দীর্ঘ বিশ মিনিট একভাবে বলার পরে থামলো নাজিফা। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “তোমাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।”
মেয়ে দুটো কি যেনো বলল মালিহা বা নীতি কেউই সেটা লক্ষ্য করলো না। তাদের বিস্ময় তখনও কাটেনি। কিছু সময় পর সেই মেয়ে দুইজন চলে গেলো। মালিহা এবং নীতির দিকে তাকিয়ে নাজিফা বলল, “অনেক সময় চলে গেলো। আসলে আমার কথা অনেক বেঁধে যায় তো এজন্য সমস্যা হয়। নাহলে কথা বেশি ছিল না।” লজ্জিত কণ্ঠে বলল নাজিফা। কথা বলার সময়ই নীতি লক্ষ্য করেছে। শব্দের মাঝে যেনো হুটহাট বেঁধে যায়।
“আরবীর অনেক এক্সেন্ট আছে নাকি? ইংলিশের মতো?”
মালিহার প্রশ্নে নাজিফা বলল, “সে তো আছেই। সব ভাষায়ই কম বেশি এক্সেন্ট আছে।”
“সূরাটা তুমি কোন এক্সেন্টে বললে?”
“আরে না। আমি পারিই একরকম করে। তাজবীদ দিয়ে পড়লেই হলো। কয়েকটা পদ্ধতি আছে যদিও।”
“কিন্তু তোমার পড়া আমার কাছে অচেনা লাগলো। মনে হলো সূরা ফাতিহা এই প্রথম শুনলাম।” নীতি বলল। নাজিফা হাসলো, “একেকজন তো একেকরকম করে পড়ে তাই এমন লাগতে পারে।”
“আচ্ছা আমি একবার পড়ি। তুমি দেখো আমার পড়া হয় নাকি।” নীতি নাজিফার দিকে এগিয়ে বসলো। নাজিফা সম্মতি জানালে নীতি পড়তে শুরু করলো। কিছুক্ষনের মাঝেই শেষ হয়ে গেলো। নাজিফার দিকে তাকিয়ে নীতি বলল, “হয়েছে?”
“তাজবীদে একটু সমস্যা আছে। ঐটুকু ঠিক করলেই হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”
নীতির মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। এতদিনের এতোবার সুরাটা পড়া তাহলে ভুল হয়েছে? নীতির মুখ দেখে নাজিফা কি যেনো বলতে চাইলো। পরক্ষণেই চুপ করে গেলো। আর বলা হলো না।
নামাজ ঘর থেকে বের হয়ে নীতি মালিহাকে বলল, “দোস্ত পারিই দুই চাইরটা সূরা। এইগুলাও যদি ভুলে ভরা হয় তাইলে কেমনে কি?”
“আমিও তো তাই ভাবছি। সেই ছোটবেলায় হুজুরের কাছে শিখেছি। এতদিন তো এভাবেই পড়েছি। তাহলে ভুল হচ্ছে কেনো? হুজুর তো এভাবেই শিখিয়েছে।”
“হ্যাঁ বললেন উনি। শিখছিস কোন ল্যাদা কালে? এতো বছরে ভুলে গেছিস না? কতো রুলস আছে বলতে পারবি? আমরা নিজেরাই চর্চা করি না। আর দোষ হুজুরের না?”
মালিহা মুখ কাচুমাচু করলো। কমন রুম পার হওয়ার সময় ক্লাসের একজন আটকে দিলো। গল্প করলো বেশ কিছু সময়। সেখান থেকে আসার পথে এক রুমের সামনের খোলা বারান্দায় দাঁড়ালো দুজনে। এখান থেকে দূরে ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। টিমটিমে আলো জ্বলছে। হঠাৎ পাশের রুম থেকে সুরের মূর্ছনা ভেসে এলো।
“আমারও পরানো যাহা চায়। তুমি তাই তুমি তাই গো..”
ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে চলেছে মন মাতানো আওয়াজ। সেই আওয়াজের খানিকটা খুব সন্তর্পনে, খুব সূক্ষ্মভাবে ঢুকে পড়লো দুটো মনের গভীরে। যেখানে একটু আগেই চিন্তারা জায়গা করে নিয়েছিল, অস্থির হয়ে উঠেছিল। সেই মনটা হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলো। হারিয়ে গেলো সুরের আঁকাবাঁকা গলির রঙিন দুনিয়ায়। সেখানে নেই কোনো চিন্তা, কোনো অস্থিরতা।

নীতি সকাল সকাল উঠে জামাকাপড় বাছাই করছে। মালিহা বিরক্ত হলো এক পর্যায়ে।
“নিজে বস্তি বানাবি বানা। আমাকে বিরক্ত করছিস কেনো? এখন আমি বের হবো না?”
“একদম বকবি না মালিহা! একটা ড্রেস সিলেক্ট কেউ দিতে বলেছি বলে এতো ফুটেজ খাচ্ছিস। টাকা কামাই করা শিখেই তুমি পা দুটো আকাশে নিয়ে ঘুরছো? কয়দিন পর তো তোমাকে আর পাওয়াই যাবে না। বললেই হয়..”
হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো মালিহা। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, “থাম! আল্লাহর ওয়াস্তে থাম! দে শাড়ি চুড়ি সব নামা। আজকে আমার কোচিং গোল্লায় যাক।”
নীতি মুখ বাঁকিয়ে বিছানার উপর ছড়ানো জামা দেখিয়ে বলল, “শাড়ি না। থ্রি পিস। চোখ না চুলা?”
ক্ষিপ্ত চোখে নীতির দিকে তাকালো মালিহা। হিজাবে শেষ সেফটিপিন লাগিয়ে আয়নার সামনে থেকে সরে এলো। বিছানার দিকে যেতেই নীতি ঘুরে মালিহার বিছানায় যেয়ে বসলো।
“আজকে এত বেছে বেছে জামা পড়া লাগবে কেনো এটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। আজকে স্পেশাল কি আছে?”
“স্পেশাল কিছু থাকা লাগবে কেনো? এমনিতে সুন্দর জামা পড়তে পারি না আমি?”
“ঝগড়া করছিস কেনো? এমনিদিন তো এগুলো শিকেয় তুলে রাখিস। হঠাৎ কোন বুদ্ধির ঠেলায় এগুলো নামাতে মন চাইলো শুনবো না?”
চড়া কণ্ঠ নামিয়ে মিনমিন করে নীতি বলল, “কালকে আম্মু ফোন করে ঝেড়েছে। এগুলো কেনো এখনও পড়ছি না তাই। বের করে দেখি একটা জামা বুকের কাছে ফেসে গেসে। ঐটা আর পড়াও যাবে না। তাই এগুলো পড়ে ফেলবো ভাবছি।”
“চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।” বলেই একটা হালকা অক্ষী রঙের থ্রি পিস নীতির কাছে ছুড়ে দিলো মালিহা। নীতি বকবক করতে থাকলেও তার একটা কথাও আর কানে নিলো না। ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার সময় শুধু বলল, “আজকে আমার জন্য জায়গা না রাখলে রাতে তোর মশারি খুলে রেখে দেবো নীতি!”
নীতি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই মিটিমিটি হাসলো। মালিহা কোচিং থেকে নির্দিষ্ট সময়ে বের হতে পারে না। কিছুটা সময় আগে পরে হয়ে যায়। অনেক সময় স্যারও চলে আসেন। সেজন্য মালিহার জন্য জায়গা রাখাও সম্ভব হয় না। কিন্তু ও মালিহার পাশে না বসে অন্য করো পাশে বসেছে এজন্য কি সে হিংসে করছে? দারুন তো! আজ তো তাহলে নীতি জায়গা রাখবেই না!

তুষার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মালিহা ঢোকার সময় ইচ্ছা করে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটুর জন্য ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেলো মালিহা। দেয়াল ঘেঁষে ভেতরে ঢুকলো। কপাল কুঁচকে তাকালো তুষারের দিকে। তার কানে ফোন। কিছু একটা নিয়ে খুব গুরুতর ভঙ্গিতে আলোচনা করছে। বিরক্ত হয় মালিহা। তুষারের এই আচরণগুলো তার ভালো লাগে না। বিরক্তিভাব আড়ে আড়ে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টায় বালি ফেলে তুষার হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সে বলে, “এতো গুটিয়ে থাকো কেনো মালিহা? ফিল ফ্রি। নয়তো তোমার অভিব্যক্তি তো কেউ বুঝবে না।” মালিহা মাঝে মাঝে বলতে চায়, “ফিল ফ্রি মানে কি? ঝাঁপ দিয়ে আরেকজনের গায়ে পড়ে যাওয়া?” বলা হয় না। চাকরিতে টান পড়লে অসুবিধা। এক সিনিয়র। তার উপরে মাসের সাত হাজার যাবে হাওয়ায় ভেসে।
ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো মালিহা। সরাসরি ক্লাসে চলে গেলো। নিতু নেই। খোঁজ করতেই জানা গেলো আজ তার ছুটি। ক্লাসে ঢুকে মালিহা খুশিই হলো। ছেলে মেয়ে আলাদা দুটো সরিয়ে বসেছে। মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা রাখা। উৎফুল্ল চিত্তে ক্লাস নিলো সে। মনে হলো সবাই আনন্দ নিয়েই ক্লাসটা করেছে। মাঝে মাঝে গতদিনের ছেলে মেয়েদুটোর দিকে নজর দিতে ভোলেনি সে। মুখে মৃদু মৃদু মন খারাপের ভাব। সে হোক। দুদিন পরই ঠিক হয়ে যাবে।
ক্লাস থেকে বের হয়ে মালিহার সেই উৎফুল্ল ভাব কিন্তু আর রইলো না। তুষার তাকে ডাক দিয়েছে। হঠাৎ তলবের কারণ বুঝলো না মালিহা। তার তো আরো একটা ক্লাস আছে। অগত্যা অফিস রুমে গেলো সে।
তুষারের মুখটা গম্ভীর দেখাচ্ছে। মালিহা মনে করতে চেষ্টা করলো কোনো ভুল হয়েছ কি না।
“বসো মালিহা।”
“ক্লাস ছিলো ভাইয়া। আপনি বলুন।”
“আমি জানি ক্লাস আছে। বসো।” শেষটুকু বেশ জোর দিয়ে বলল তুষার। মালিহা ভড়কে গেলো। বসে পড়ল চেয়ারে।
“কোচিং কেমন লাগছে? ভালো তো?”
“জি ভাইয়া।” গম্ভীর কণ্ঠে এমন প্রশ্ন ঠিক মেলাতে পারলো না মালিহা। তুষারের মুখে স্বভাবসুলভ হাসিটা নেই।
“বুঝতেই পারছি। নয়তো নিজের মনে করে সিস্টেমে চেঞ্জ করা শুরু করতে না। একটু বেশিই ভালো লাগছে।” মাথা নেড়ে বলল তুষার।
“বুঝলাম না।”
“ক্লাস সেভেনের সিটিং সিস্টেম চেঞ্জ করেছো তুমি। কেনো?”
চট করেই বিষয়টা ধরতে পারলো মালিহা। এ কারণেই কি তুষার রেগে আছে?
“আমি একটা প্রশ্ন করেছি মালিহা। একটু পরেই সব টিচার এখানে চলে আসবে। আমি ম্যাটারটা তার আগেই ক্লোজ করতে চাইছি। এখন তুমি যদি সবার সামনে ক্ল্যারিফিকেশন দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করো তাহলে সেটা তোমার বিষয়।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে চেয়ারে হেলান দিলো তুষার। মালিহা ভেবে পেলো না ঘটনা ঠিক কিভাবে তুষারের কাছে বর্ণনা করবে। ছেলেমেয়ে দুটো কিভাবে বসে ছিলো এটা সে তুষারের কাছে কখনোই বলতে পারবে না। আমতা আমতা করে বলল, “মেয়েরা ছেলেদের পাশে বসে অতোটা কমফোর্টেবল ফিল করে না। তাই আর কি..”
“স্কুল, কলেজ পাশ করে ভার্সিটি শেষ করে ফেললাম। কোচিং চালাচ্ছি তিন বছরের বেশি হয়ে গেলো। আর তুমি দুদিন এসেই এতো বড় বিষয়টা বুঝে ফেললে? আমি তো দেখি অনেক মেয়ে আরো ইচ্ছা করে ছেলেদের পাশে বসে।” তুষারের কণ্ঠে স্পষ্ট খোঁচা। মালিহা সংকুচিত বোধ করলো। তুষার শক্ত কণ্ঠে বলল, “তোমার ধ্যান ধারণা নিজের ভেতরেই রাখো মালিহা। এটা তোমার নিজস্ব জ্ঞান ছড়ানোর জায়গা নয়। আসবে পড়াবে, টাকা পাবে, চলে যাবে। একস্ট্রা কোনো কাজ তোমাকে করতে হবে না। এবার যাও।”
অপমানে মালিহার মুখটা থমথমে হয়ে গেলো। মন চাইলো ছুটে পালিয়ে যেতে। হলো না। মাস শেষে টাকা দরকার। পরবর্তী ক্লাসের দশ মিনিট ইতোমধ্যে চলে গেছে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৪

মেজাজের অবস্থা বেজায় খারাপ। সেই খারাপ মেজাজ নিয়েই ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হলো। পরীক্ষা সমাগত। এমন সময় ক্লাস মিস দেয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা’রা। কাজেই অপমানের স্মৃতি বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে মুখে ব্যস্ততার ছাপ ধরে পা চালাচ্ছে মালিহা। চেহারায় প্রলেপ দেয়া আজকাল সে ভালই শিখেছে।

ক্লাসের সামনে আসতেই দেখলো স্যারও ঢুকছেন। শিক্ষকের আগে ঢোকার জন্য দৌঁড়ে গেলে অল্পের জন্য ধাক্কা খেতে খেতেও বেঁচে গেলো। কিন্তু স্যারের চোখ রাঙানি এড়িয়ে যাওয়া গেলো না। পরপরই নিজেকে ধমক দিলো মালিহা দরজা কি একটাই নাকি! অন্য দরজা দিয়েও তো ঢোকা যেতো।

রুমে ঢুকতেই মনটা বিষিয়ে গেলো। এখানেও ছেলেমেয়ে একসাথে বসেছে। মুহূর্তেই সেদিনের দৃশ্যটা আর আজকের অপমান মনে হয়ে গেলো। যতোই জিনিসগুলো ভুলে থাকতে চাইছে ততোই যেন মস্তিষ্কে সেগুলো জেঁকে বসছে। এমনটাই বোধহয় নিয়ম। যাকে ঠেলেঠুলে মস্তিষ্ক থেকে বের করার ইচ্ছা থাকে সেই যেনো চূড়ান্ত জেদ নিয়ে জেঁকে ধরে। মেজাজ খারাপ হওয়ার আরেকটু বাকি ছিলো। নীতিকে যখন দেখলো সেজেগুজে একটা মেয়ের সাথে বসে হাসাহাসি করছে সাথে সাথেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। মেয়েটাকে পইপই করে বলে এসেছিল যেনো ওর জন্য জায়গা রাখে। ফাজিল মেয়ে ইচ্ছা করে এমন করেছে। এমনই মনে হলো মালিহার। আরেকপাশে যেয়ে বসবে তারও উপায় নেই। একটা ছেলে ওপাশে বসেছে। উপায় না পেয়ে একদম শেষের দিকে যেয়ে বসতে হলো। দুইজন মেয়ের মাঝে একটা চেয়ার ফাঁকা ছিল। সেদিকেই গেলো মালিহা। নীতি মালিহার দিকে তাকিয়ে হাসতে ভুললো না। সেই হাসি দেখেই মালিহা বুঝলো এসব নীতি ইচ্ছা করেই করেছে।

খাতা কলম বের করেও কিছুই নোট করতে পারলো না মালিহা। ক্ষণে ক্ষণে শুধু তুষারের করা ঠান্ডা অপমানের কথা মনে হচ্ছে। তুষার অবশ্য সেই রেশ ধরে থাকেনি। পরের সময়টুকু এমন আচরণ করেছে যেনো কিছুই হয়নি। মালিহা ততোটা নির্বিকার থাকতে পারেনি। তার ছোট মুখটা ছোটই থেকে গেছে। নিজের উপরে অসন্তুষ্ট হয় মালিহা। কেনো সে মানুষের কথাগুলো উড়িয়ে দিতে পারে না? সবার কথাই কি ধরে বসে থাকতে হবে? ক্লান্তির শ্বাস ছেড়ে ঘাড় ঘোরায় দুই বেঞ্চ সামনে বসে থাকা নীতির দিকে। সহসাই ভুরু কুঁচকে আসে। নীতির পাশে বসে থাকা ছেলেটা একটু পরপরই নীতির দিকে তাকাচ্ছে। আড়চোখে। মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল। নীতির দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখলো মালিহা। আকাশী রঙের থ্রি পিস পড়া। হাত খোপা করা চুলের উপরে ওড়নার একাংশ অবহেলায় পড়ে আছে। সজীব দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। গোসল করে এসেছে নাকি? পাশের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে হাসছে। সেই হাসি চোখ দিয়ে গিলছে ছেলেটা। মালিহার উত্তপ্ত মেজাজে যেনো গরম হাওয়ার হলকা বয়ে গেলো।

ক্লাস শেষ হতেই নীতির কাছে ছুটে যেতে চাইলো মহা। তার আগেই নীতি উঠে সামনে এগিয়ে যাবে ঠিক সেসময় তার পাশের ছেলেটা নীতির বাহুর উপরে হাত রেখে টান দিলো। ঘটনা বুঝতে না পেরে ছেলেটার দিকে তাকালে সে বলল, “সবাই একসাথে গেলে ধাক্কা লাগবে তাই আটকে দিলাম। ফাঁকা হোক তারপর যেও।” মুচকি হাসলো ছেলেটা। নীতি কিছু বলল না। কিন্তু কাছাকাছি আসায় পুরোটাই শুনলো মালিহা। চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো তার। ক্লাসের মাঝখানে সে লক্ষ্য করেছে এই ছেলে নিজের টেবিল নীতির টেবিলের সাথে ঘেঁষে রেখেছিল। ফলে নড়াচড়ার কারণে হুটহাট স্পর্শ লেগেছে। নীতি সেদিকে ততোটা খেয়াল করেনি। তবে মালিহার এখন স্পষ্ট বুঝলো ছেলেটা সবটুকু ইচ্ছা করে করেছে। মালিহা যেয়ে একদম নীতির সামনে দাঁড়ালো। নীতি তাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছেলেটাকে শক্ত কণ্ঠে মালিহা বলল, “এখানে মিছিল হচ্ছে না যে ওকে আটকে রাখতে হবে।” নীতির হাত ধরে তাকে নিজের দিকে এনে ছেলেটার একটু কাছে যেয়ে কণ্ঠ নিচু করে বলল, “হাত পা সামলে রাখবে বুঝেছো? ওগুলো শুধু তোমার একার নেই।”
নীতির হাত ধরে হনহন করে রুম ছাড়লো মালিহা। নীতি আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। বেচারি হাঁটতে না পেরে প্রায় দৌঁড়াতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে বলল, “হইসে কি ভাই? দৌড়াস কেনো? থাম!”
মালিহার হাত টেনে ধরলো নীতি। মালিহা সহসাই তার হাত ঝেড়ে ফেলে দিলো। শক্ত কণ্ঠে বলল, “আমি ধরলে ভালো লাগছে না? ঐ ছেলে ধরছিল তখন ভালো লাগছিল? বলদ! বুদ্ধি হবে কবে তোর? ছেলেটার কোলে উঠে বসে পড়তে পারলি না? এই জন্যেই সেজেগুজে এসেছিস!”
নীতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মালিহা ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। নীতির চোখ ভরে আসতে চাইলো। মালিহা এভাবে বলতে পারলো!

লালপাহাড়ের দেখা নেই। গতকাল আসেনি, আজ সকালেও তাকে পাওয়া গেলো না। ইতমিনান মানিকের ডেরায় চলে গেল। দেখা গেলো লালপাহাড় মানিকের ঝাড়ি খাচ্ছে। তাকে দেখেই মানিক এক দফা ঝাড়ি দিলো।
“বড়লোক মাইনষের যতো ঢং! কুত্তারে বিরানি খাওয়ায় কে? খাইয়া যে হ্যায় ল্যাটকা মাইরা পইড়া রইসে অখনে এইডারে দ্যাখবো কে? যত্তসব ঝামেলা আমার ঘাড়ে আইয়া জুডে।”
ইতমিনান ইতিউতি করলো। কিন্তু বলার মতো কিছু পেলো না।
“এখন কি করতে হবে?”
“কিছুই করা লাগবো না। অর ব্যাপার অয় নিজেই বুঝবো। আপনে উদয় হইসেন কি মনে কইরা?”
এতক্ষণে ইতমিনানকে ভাবতে দেখা গেলো।
“মানিক মিয়া তুমি কি আমার সাথে এক জায়গায় যেতে পারবে?”
“কুন জাগা?” মানিকের সন্দেহ হতে শুরু করলো। এই লোক খাতিরদারি করে তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? পাচার টাচার করে দিবে নাকি?
“এই কাছেই। জামে মসজিদের পাশে। একটু চলো। পাঁচ মিনিটের মা’মলা।”
“আমারে দিয়া আপনের কি কাম? আপনের ভাব সাব আমার সুবিধার লাগে না।” বাঁকা কণ্ঠে বলল মানিক।
“খুব জরুরি দরকার মানিক মিয়া। এই দুনিয়ায় সবাই সবার দরকারেই আছে। চলো যাই?”
মানিক সন্দেহ করলেও ভয় পেলো না। এই শহরের অলিগলি তার চেনা। এই লোক উল্টা পাল্টা কিছু করতে চাইলে মানিক ছেড়ে দেবে নাকি?
ইতমিনানের দিকে তাকালো মানিক। একেবারে সাহেব সেজে এসেছে। মুখ ভেংচালো সে। এসব সং সাজা দেখলে তার গা জ্বলে। লালপাহাড়ের মুখের কাছে কিছু ঘাস রেখে তাবু থেকে বের হল। চকচকে শার্ট প্যান্ট পড়া একজন যুবকের পাশে খালি গায়ের মানিককে বোধহয় বেমানান লাগলো। আশপাশের অনেকেই তাকিয়ে রইলো কৌতূহলী দৃষ্টিতে।

ইতমিনান একটা হোটেলের সামনে এসে থেমেছে। মানিক ভাবতে শুরু করলো। এই লোক কি খাওয়াতে নিয়ে এসেছে? মনে তো হয় না। কুচকানো ভুরু নিয়েই চারপাশ পর্যবেক্ষণ করলো সে। ঊনিশ বিশ কিছু চোখে পড়লেই গায়েব হয়ে যেতে তার সময় লাগবে না। এদিক ওদিক দেখতে গিয়ে একটা ছেলের মুখ তার নজরে বিধলো। ছেলেটাও তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মানিককে দাঁড় করিয়ে ইতমিনান ভেতরে যেয়ে কি বলল সেসব মানিক শোনেনি। ইতমিনান বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। হাসি হাসি মুখ করে মানিকের হাত ধরে বলল, “চলো ভেতরে যাই।”
মানিকের বিস্ময় পাহাড় ছুঁয়ে গেলো। নিজের ডান হাতের দিকে তাকালো সে। কেউ কি কোনোদিন তার হাত ধরেছে? হ্যাঁ ধরেছে তো। মসজিদ থেকে যেদিন তাকে সবাই মিলে বের করে দিলো সেদিন ধরেছিল।
মানিক এমনভাবেই ঘোরে চলে গিয়েছিল যে চোখ দিয়ে শুধু দেখলো ইতমিনান মুখ নাড়িয়ে কিছু বলছে। কি বলছে কিছুই শুনতে পেলো না সে। যখন ইতমিনান তার ঘাড়ে হাত দিলো তখনই তার ধ্যান ভাঙলো।
“মানিক মিয়া এভিনিউ! এখানে কাজ করবে? ঐ যে ঐ ছেলেটার সাথে। হোটেল বয়দের যেসব কাজ আর কি। এখানেই খাওয়া দাওয়া করবে। রাতে থাকতে চাইলে থাকতে পারো। কিছু টাকাও পাবে। করবে?”

মিন্টু আপাদমস্তক মানিককে দেখলো। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে। বাদ পড়ল না তার বাম বাহুতে মিলিয়ে যেতে থাকা কাটা দাগটাও। ইতমিনানের কথা শুনে আবার তাকালো মানিকের দিকে। এই ছেলের জন্যই সেদিন লোকটা খোঁজ নিয়ে গিয়েছিল?

মানিক কিছু বলতে পারলো না। ইতমিনান ঘড়ি দেখল। তার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে। মানিকের ঘাড়ে রাখা হাত শক্ত করে বলল, “তুমি চাচার সাথে কথা বলে নিও। ভালো লাগলে থেকো। আমার সময় হয়ে যাচ্ছে। যাই কেমন?”

মানিক দেখলো ইতমিনান চলে যাচ্ছে। তার সামনের বদ্ধ জানালা খুলে শীতের নরম রোদ তার গায়ে মাখিয়ে চলে যাচ্ছে। তার হাতে ঘাড়ে রেখে গেছে ভরসা মাখা হাতের স্পর্শ। যেই স্পর্শ মানিকের কাছে ছিল অনাকাঙ্খিত, দুর্মূল্য।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২৫

ভাগ্য মালিহা এবং নীতিকে এক করেছে দেশের দুই প্রান্ত হতে। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বরাদ্দকৃত রুম ভাগাভাগির মাধ্যমে সম্পর্কের শুরু। এক বিষয়, এক ক্লাস হওয়াটা সম্পর্কের পালে হওয়া দিয়েছে। সময়ের নদীতে স্রোতের সাথে ভাসতে ভাসতেই তারা আজ এক অপরের সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। সহযাত্রী থেকে সঙ্গী হওয়াটা সহজ নয়। সহযাত্রী তো কত মানুষই হতে পারে। লোকাল বাসে পাশের সিটের মানুষটাও সহযাত্রী। কিন্তু তার সঙ্গী হওয়ার দায় নেই। যখন তখনই সে নেমে যেতে পারে। ইতি টানতে পারে স্বল্পক্ষণ সফরের। কিন্তু সঙ্গী মানুষটা এমন নয়। সে একই সাথে সহযাত্রীও বটে। নীতি এবং মালিহা টুকরো টুকরো সময় একত্রিত করে সহযাত্রীর ধাপ পেরিয়ে আজ একে অপরের সঙ্গী।

ফুলের মালা গাঁথতে গেলে কতো সুতাই তো নষ্ট হয়। ছিঁড়ে যায়, গিট পাকিয়ে যায়। কিন্তু মালা তৈরি হয়ে গেলে ছেঁড়া বা গিট লাগা অংশটুকু আর চোখে পড়ে না। সম্পর্ক যদি ফুলের মালা হয় তবে সুতার গিট সেখানে অবাঞ্ছিত নয়। তার দিকে দৃষ্টি গেঁথে ফেলে আর ফুলের মালা গাঁথা হবে না। কিন্তু ছোট্ট একটু ছেঁড়া অংশ অথবা একটা গিট, অদেখা করে যদি মন মনন মালা গাঁথতে ব্যস্ত থাকে তবে সম্পর্কের মাঝে থাকা সেই গিটগুলো লুকিয়ে পড়বে তার সৌন্দর্যের আড়ালে।

দুই বছরের এই পথচলায় নানান জিনিস নিয়ে দুজনের মাঝে মন কষাকষি হয়েছে। প্রথম প্রথম এমন বেশি হতো। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। খাপ খাওয়াতে নিজের সাথে নিজেকে যখন যুঝতে হয়েছে তখন অপর পক্ষের মানুষটার আচরণ অপছন্দনীয় হয়ে সমস্যা যেনো বাড়িয়েছে। কিন্তু দিন কেঁটে যেতেই যখন চোখের মায়ার সাথে মনের টান তৈরি হলো তখন যেনো আচমকাই অপছন্দনীয় আচরণগুলো কর্পূরের মতো উবে গেলো। দুজনেই খেয়াল করলো অমিলগুলো সহ্য করার শক্তি তাদের মাঝে এসে গেছে। মিলগুলোর মিলিত শক্তি যেনো তাদের বন্ধন আরেকটু শক্ত করেছে।

সেই মালিহার কাছে এমন ব্যবহার পেয়ে নীতি কষ্ট পেয়েছে। মনের গভীরে যেয়ে আঘাত লেগেছে। ক্ষণে ক্ষণে নাক টানছে সে। মালিহা তাকে বকা দেয়। শক্ত কথা বলে। কিন্তু কখনও এভাবে আঘাত করে বলে না। আজ কেনো বলল? নীতি ভেবে পায় না। কষ্টে তার চোখটা ভরে আসে। পলক ঝাপটে অবাধ্য অশ্রুকে কঠোর শাসনে বেঁধে রাখে সে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে যায় হলের রুমে।

রুম বাইরে থেকে তালা দেয়া। কপাল কুঁচকে আসে নীতির। মালিহা এখনও আসেনি? “যেখানে খুশি যাক!” ভাবলেও মন মানে না। তার সাথে রাগ করে কোথাও গেলো নাকি? রুমে ঢুকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে নীতি। দরজায় ছিটকিনি দিতেও ইচ্ছা করে না।

শুয়ে থেকে কখন যে চোখটা লেগে এসেছিল নীতির খেয়াল নেই। যোহরের আযান কানে যায় এবং বুকে ব্যাথা শুরু হতেই ঘুম ভেঙে যায় তার। বুকে ভর দিয়ে শোয়ার কারণেই এই অবস্থা হয়েছে। ধীর গতিতে উঠে বসে সে। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে সামনে তাকাতেই চোখ স্থির হয়ে যায়। মালিহা নিচে পাটি বিছিয়ে খাবার সাজাচ্ছে। চট করে তখনকার কথা মনে হতেই আবার ঘুরে ধুয়ে পড়ে নীতি। মালিহা ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে দেখে সবটা।

খাবারের প্লেট দুটো ঠিক করে রেখে নীতির বিছানায় বসে মালিহা। নীতির গায়ে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলে, “আয় খেয়ে নে।”
নীতি ঝাড়া দিয়ে হাত ফেলে দেয়। মালিহা আবার হাত রাখে। নীতি আবার ফেলে দেয়। মালিহা এবার নীতির হাত শক্ত করে ধরে।
“মনিকা আর আঁখি আপু এলে ওদের ফ্রাইড রাইস দিয়ে দেবো কিন্তু!”
“কে চেয়েছে তোর কাছে? ফ্রাইড রাইস না খেয়ে কি আমি ম’রে যাচ্ছি?”
“সরি নীতি!” নমনীয় কণ্ঠে বলে মালিহা। নীতির অভিমান আরো বাড়ে।
“সত্যি সরি। ঐ ছেলেটা কি করছিলো তা তো তুই জানিস না। পুরো ক্লাসে ইচ্ছা করে তোর গা ঘেষে বসে ছিল। পা দিয়ে খোঁচানোর চেষ্টা করেছে। পারেনি। শেষে ইচ্ছা করে তোর হাত ধরেছে। ওখানে কি অতো ভিড় ছিল তুই নিজেই বল?”
নীতি চুপ করে খানিক সময় ভাবে।
“কিন্তু ও আমার সাথে এমন করবে কেনো? এমনও না যে আমাকে পছন্দ করে। দুই বছরে মনে হয় দুই দিনও আমার সাথে ওর কথা হয়নি।”
“যতো শয়তানি!” মুখ শক্ত করে বলে মালিহা।
“তাই বলে তুই আমাকে ঐরকম করে বকবি?” কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল নীতি। মালিহা বলল, “এতো সেজেগুজে গিয়েছিস কেনো ওখানে? অসভ্য ছেলেপেলের ভিড়ের মধ্যে তুমি রূপ দেখাতে গিয়েছ আর আমি বললেই দোষ!”
“আমি কি অতো শত ভেবে গিয়েছি নাকি?” মিনমিন করে বলল নীতি।
মালিহার কণ্ঠ তখনও শক্ত, “ভাববি না কেনো? সারা দুনিয়ার সব ভাবতে পারিস এই বেলা কি হয় তোর?”
“আরো কতো মেয়েরা কতরকম করে যায়। তুই দেখিস না? ওদের কিছু হয় না কেনো?”
“বিষয়টা হওয়া না হওয়া নিয়ে না। কেউ তোর দিকে তাকিয়ে তোকে স্ক্যান করছে, ফালতু মজা নিচ্ছে এটা যদি তোর কাছে স্বাভাবিক মনে হয় তাহলে তো আর ভাবাভাবির কিছু নেই। যাদের মিন করে তুই বললি তাদের প্রতি ওদের দৃষ্টি খেয়াল করে দেখবি। শয়তানের হাড্ডি সব!”
দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে গেলো। নীতির দিকে তাকিয়ে মালিহা বলল, “তোকে বাইরে বকার জন্য সরি। রুমে এসে বকা দরকার ছিল। আর লিপস্টিক দিয়েছিস কেনো? ক্লাস করতে যাস নাকি রূপ দেখাতে?”
“আবার বকবি না মালিহা!”
“একশ বার বকব! ঐ রাস্কেল তোর দিকে কীভাবে তাকিয়ে ছিল দেখেছিস? সেসব দেখবি কেনো? পরানের বান্ধবীদের সাথে তো গল্প করেই কুল পাস না। তাদের জন্যে আবার জায়গা ধরে রাখা হয়। আরেকদিন তোকে সেজেগুজে যেতে দেখি শুধু!”
নীতি বুঝলো মালিহার মেজাজ গরম। নিষ্পাপ মুখ করে বলল, “ফ্রাইড রাইসটা খাই? ক্ষুধা লেগেছে।”
বিনা বাক্য ব্যয়ে নিচে নেমে বসলো মালিহা। নীতিও সুড়সুড় করে বসে পড়ল। মালিহাকে আর ঘাটালো না। খেয়ে টেয়ে মেজাজ ঠান্ডা হলে মালিহা নিজেই কোচিংয়ের ঘটনা খুলে বলল। মুহূর্তেই মন খারাপের কথা ভুলে গর্জে উঠলো নীতি।
“শালা তো ট্যাটনা আছে। সাবধানে থাকবি মালিহা।”
বিরক্ত মুখে মালিহা বলল, “ট্যাটনা আবার কেমন শব্দ!”
“এমনই শব্দ। যেমন ব্যবহার এমন নাম। আমি বলছি তুই ঐ ছেলের থেকে দূরে দূরে থাকবি। টাকাটা কোনরকম নিতে পারলেই হলো।”
“থাম তুই। আঁখি আপুর সামনে আবার এভাবে বলিস না। উনি খারাপ ভাববে।”
নীতি ভেংচি কাটলো, “খারাপকে খারাপ ভাববে না তো কি জমজম কূপের পানি ভাববে?”

নাজিয়া আজকাল আরও চুপচাপ হয়ে গেছেন। নিজের সংসার না। তেমন কোনো কাজ নেই। কয়েকদিন হলো তিনি এগিয়ে গেলেও সাইফের মা তাকে আর তেমন কাজ টাজ করতে দেন না। সেই ব্যবহারের গূঢ় রহস্য বুঝতে পেরে ভেতর থেকে তিনি ভেঙে গেছেন। তার ভাই যখন স্ত্রীর সাথে আচরণে তাল দিয়েছে তখন থেকে তার মুখের কথা আরো কমে এসেছে। আজকাল মিতুল এটা ওটা নিয়ে আসে। সাইফের মা খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। তার ভাই মানুষের কাছে গর্ব করে বলেন মিতুল কতো বড় হয়ে গেছে। নিজেই কাজ করতে নেমে গেছে। এসব কথা নাজিয়ার ঘায়ে মলম লাগানোর বদলে বরং আরো খোঁচায়। আচরণের স্পষ্ট বদল না বোঝার মতো অবুঝ তিনি নন। এবং গতদিন যখন মালিহার বড় চাচা এসে জমি ভাগাভাগির বিষয়ে কথা বলে গেছে তারপর থেকে তাদের সাথে সবাই মেহমানের মতো আচরণ করছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন নাজিয়া। তিনি তো ভাইয়ের মেহমান নন। নিজের বোন। একই মায়ের পেটের। সেই ভাইটার কাছেও দুদিনেই বোঝা হয়ে গেলেন? মিতুলের কথা তো তাহলে কিছু ভুল নয়। আর না মালিহার কাছে নিয়ে যেতে চাওয়াটা মেয়েটার বাড়াবাড়ি। জানালার শিক ধরা হাতটা শক্ত হয়। চোখের জলে ভেসে যায় এক সুখ স্মৃতি। ছোট বোনের মুখে হাসি ফোঁটাতে পেরে বড় ভাইয়ের মুখে সে কি হাসি!

শার্ট খুলে রেখেও যখন মায়ের কোনো হেলদোল দেখলো না তখন মিতুল আস্তে করে ডাকলো।
“মা!”
নাজিয়া তড়িৎ ঘুরে তাকান। ছেলেকে দেখে সাথে সাথে চোখ মোছেন। সেটুকু মিতুলের চোখ এড়ায় না। ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় সে। কণ্ঠে নমনীয়তা টেনে বলে, “কি হয়েছে মা?”
“কিছু না। এই এমনি বসে ছিলাম। বস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসি।”
“লাগবে না। বসো তুমি।” হাত ধরে আটকালো মিতুল।
“আপার কাছে ফোন দাও তুমি?”
“মালিহাই তো দেয়।”
“আপা তো দিবেই। তাই বলে তুমি দিবে না? আমরা দুজন এখানে আছি। আপার সাথে তো কেউ নেই। গতকাল চাচা এসে কি বলে গেছে সেগুলো আপাকে জানিয়েছো?”
“না।”
“একটু ফোন করে জানিও। আপা খুশি হবে। আমাদের জন্যেই তো এতো খাটাখাটনি করছে। আপারও তো ইচ্ছা হয় তুমি ফোন দিয়ে আপার খোঁজ নিবে।”
“আচ্ছা বুঝেছি। বস তুই। পানি নিয়ে আসি।”
নাজিয়া সব বুঝলেও কিন্তু মালিহার কাছে ফোন দিলেন না। দিতে ইচ্ছা করলো না। জায়গা পাল্টানোর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তিনি। কারোর দয়া রাখবেন না তিনি। কারো না।

ইতমিনানের উপর দিয়ে যেনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দুটো মানুষের কাজ একা করতে যেয়ে তাকে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে। অফিসের মোটামুটি সবাই জেনে গেছে ইতমিনান লতার প্রক্সি দিচ্ছে। ইতমিনান বিব্রত বোধ করে। বিষয়টা তার একদমই ভালো লাগে না। কিন্তু আপাতত তাকে লতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না বলে বাঁচোয়া।
অফিস বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতে করতে মাঝে মাঝে মানিকের খোঁজে যায় সে। ছেলেটা ভালো আছে। নতুন এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে এখন সেটা দিয়ে লালপাহাড়কে লাথি মা’রে। কুকুরটাও সেই লাথি খেয়ে কুঁই কুঁই করে।
সময় কেঁটে যায়। দিন গড়িয়ে সপ্তাহ যায়। মালিহাকে আর দেখা হয় না। ইতমিনানের অবাধ্য মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। ইতমিনান লাগাম ছেড়ে দেয়। চোখ দুটো অশান্ত হয়ে গেলে যখন নিজেকে আটকে রাখা দায় হয়ে যায় তখন আবারো ছুটে যায় মালিহার ক্যাম্পাসে। এলোমেলো বেশে ছুটে যায় হলের সামনে।
নীতি গম্ভীর কন্ঠে মালিহাকে বলে, “মালিহা ইয়ার্কি না। সত্যি বলছি। আমার গাট ফিলিং হচ্ছে তোর এই ভাই তোর প্রতি উইক।”
ফোন হাতে ওড়না মাথায় টেনে নেয় মালিহা। নীতির কথা শুনলেও গা করে না। কিন্তু নিচে এসে যখন শক্ত সামর্থ্য ইতমিনানের অগোছালো রূপ দেখে তখন নীতির বলা কথাটা কানে প্রকট আকারে বাজতে শুরু করে।
“আমার গাট ফিলিং হচ্ছে তোর এই ভাই তোর প্রতি উইক।”

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-১৯+২০+২১+২২

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৯

হলের দুপুরে তখন সূর্যের একপেশে আলো। কেউ ক্লাস থেকে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে তো কেউ বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানে ব্যস্ত। আজ ক্লাস ছিলো না। সবাই গেছে কাছের একটা রিসোর্টে। সেই হিসেবে আজ মালিহা এবং নীতিকে মেহমানদারী করবে নাজিফা। ছোটাছুটি করে রান্না করছে সে। রান্নাঘর ব্লকের এক কোনায়। ছুটতে ছুটতেই যেনো হাফ লেগে যায়। একবার তেল আনতে ভুলে যায় তো একবার লবণ। রুমে ইনডাকশন ব্যবহারের উপায় নেই। ইনডাকশন কানেক্ট করলেই বাতিগুলো নিভু নিভু শুরু করে। হল কর্তৃপক্ষের চালাকি। মেয়েরাও চালাক কম নয়। রাইস কুকারেই সব রান্নাবান্না সেরে ফেলে।
মুরগি রান্না শেষ হতেই চাল ধুয়ে নিলো নাজিফা। একবার ভাবলো প্রেশার কুকারে দেয়। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে আবার ভাত কেমন দলা দলা হয়ে থাকে। প্রেশার কুকারের চিন্তা বাতিল করে হাড়িতেই ভাত রান্না করে ফেললো নাজিফা। ফ্যানা যখন হাড়ির মুখ থেকে পড়ে যেতে চাচ্ছে তখনই সে ফুঁ দিয়ে সেগুলোকে আবার হাড়ির ভেতরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই করতে করতে কয়েকবার হাতে ছ্যাকা খেলো। নিজের মনেই হাসলো নাজিফা। ফ্যান গলানো তাকে দিয়ে হবে না। ভাত রান্না শেষ করে চটপট একটা গামলায় ভাত বেড়ে নেড়েচেড়ে ফ্যানের নিচে ঢাকনা দিয়ে রেখে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখ কপালে ওঠার দশা। দুইটা বেজে দশ। জামা নিয়ে ছুটলো বাথরুমের দিকে। লাইনে না দাঁড়াতে হলেই হয়েছে।

নামাজ শেষ করে যখন নাজিফা সালাম ফেরালো তখন ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা তিন ছুঁই ছুঁই করছে। তড়িঘড়ি করে মালিহাকে ফোন দিলো নাজিফা। তক্ষুনি চলে আসতে বলল।

নীতি মোজোর বোতল ডান হাতে রেখে বাম হাত দিয়ে মালিহাকে খোঁচা দিলো।
“দোস্ত! মনে হচ্ছে বেড়াইতে যাচ্ছি।”
“বেড়াতেই তো। এক ব্লক থেকে আরেক ব্লকে।” মালিহা হাসলো। নাজিফার রুমের সামনে পৌছুতেই দেখলো সে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাতে দুজনের হাত ধরে নাজিফা মলিন কণ্ঠে বলল, “অনেক দেরি করে ফেললাম। একদম সরি!”
“আরে না না! কোনো সমস্যা নেই। অন্যদিন এমন সময়ই তো আমরা খাই।” সম্মতির আশায় নীতির দিকে তাকালো মালিহা। নীতি মাথা ঝাঁকালো। নাজিফা তাদের ঘরে নিয়ে গেলো।
নাজিফার বেডের সামনে যেয়ে নীতি যারপরনাই অবাক হলো। তার মুখ দেখেই সেটা বোঝা গেলো। মালিহা পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলল, “মুখ বন্ধ কর নীতি!” নাজিফার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাকি রুমমেটরা কোথায়?”
মেঝেতে পাটি বিছিয়ে নাজিফা বলল, “ঐ কর্ণারের আপু মাস্টার্সের। তার বিয়ে হয়ে গেছে। ওখান থেকেই যাতায়াত করেন। আপুর অপজিট সাইডে আমাদের ব্যাচের একজন। অন্য ডিপার্টমেন্টের। আর আমার পাশে সেকেন্ড ইয়ারের একজন। কেউ নেই। সবাই যার যার বান্ধবীর সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল নাজিফা। মালিহা হাসলো।
নীতি তখনও অপলক নাজিফার টেবিল, আলমারি, বিছানার সাথে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকার অবশ্য কারণ আছে। পুরো রুমের দেয়াল সাদা রঙের। কিন্তু নাজিফার পাশের দেয়ালটা হালকা গোলাপী রং করা। তার মাঝে আবার ছোট ছোট ফ্লোরাল পেইন্টিং। বিছানার চাদর যেনো দেয়ালের রঙের সাথে ম্যাচ করে কেউ বিছিয়েছে। টেবিলের বইগুলো সব সারি সারি করে গুছিয়ে রাখা। এক কোনায় আবার ঝুড়িভর্তি কসমেটিকস প্রোডাক্ট দেখা যাচ্ছে। নীতি বিস্মিত হয়ে নাজিফাকে বললে, “তুমি ওগুলো ইউজ করো!”
নাজিফা দেখলো নীতি তার স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টের দিকে আঙুল তাক করে আছে। স্মিত হেসে নাজিফা বলল, “ঐ আর কি। টুকটাক করি।”
কিন্তু নীতি দেখেই বুঝলো টুকটাক নয়, পুরোদস্তুর ব্যবহার করে নাজিফা।
“এই তোমরা বসো।” খেতে ডাকলো নাজিফা। খাবার দাবার সব সাজানো হয়ে গেছে। মালিহা মোজোর বোতল পাশে রাখতেই নাজিফা খেয়াল করলো। হৈ হৈ করে উঠলো সে, “আরে! তোমরা কি বাইরের মানুষ নাকি! কিছু নিয়েই আসতে হবে এটা কেমন কথা?”
“তুমিও তো বাইরের মানুষ না। তুমি আমাদের খাওয়াতে পারলে আমরা পারবো না কেনো?” মালিহা রগড় করে বলল। নাজিফা হেসে বলল, “আচ্ছা হার মানলাম। চলো খাওয়া শুরু করি। এই নীতি! কোথায় হারালে তুমি?”
নীতির বিস্ময় তখনও কাটেনি। নাজিফা ক্লাসে যায় বোরখা, নিকাব করে। চোখদুটো কোনরকম দেখা যায়। হাত, পাও ঢাকা থাকে। অনেকে আড়ালে তাকে প্যাকেট বলে হাসাহাসি করে। এজন্য কেউ তার সাথে তেমন মেশে না। অবাক করার বিষয় হলো ক্লাসের আরো কয়েকজন মেয়েও এভাবে চলাফেরা করে। কিন্তু ছেলেদের সাথে তাদের সে কি খাতির! ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট চালাচালি থেকে ক্লাসে হাসি তামাশা। সবটাই সবাই দেখে। তাদের ধারণা নাজিফাও সেই কাতারেরই একজন। দুদিন গেলেই বোঝা যাবে। তবে নীতির কাছে নাজিফাকে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু বোরখা পড়ে, নিকাব করে নাকমুখ ঢাকা নাজিফার সাথে সানস্ক্রিন, টোনার মেখে রূপচর্চা করা নাজিফাকে কিছুতেই মেলাতে পারে না সে। শেষমেষ নীতি বলেই ফেলল, “নাজিফা! তুমি যে এমন রূপচর্চা করতে পারো এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
প্লেটে ভাত বাড়া শেষে নাজিফা তখন আলু ভাজি তুলে দিচ্ছে। হেসে বলল, “কেনো বলো তো?”
“না তুমি তো বোরখা টোরখা পড়। হুজুর টাইপ মানুষেরা আবার এগুলোকে অপচয় মনে করে। তাই আর কি..”
“নাও শুরু করো।” প্লেট এগিয়ে দিলো নাজিফা। পানি ভর্তি গ্লাস আর ছোট একটা বাটি দিলো হাত ধোয়ার জন্য। ভাতে হাত দিয়ে হাসিমুখে বলল, “তোমাকে ভালোবেসে কেউ কিছু উপহার দিলে তুমি কি করবে নীতি? যত্ন করবে না?”
“অবশ্যই করবো।” মুখে ভাত নিয়েই বলল নীতি। মালিহা চোখ রাঙালো। মুখে খাবার নিয়ে কথা বলা আবার কেমন অভ্যাস!
“আল্লাহ আমাকে অনুগ্রহ করে, দয়া করে রোগমুক্ত স্কিন দিয়েছেন। কতো মেয়েদের ত্বকে সমস্যা। এটা না ওটা লেগেই থাকে। কতো ট্রিটমেন্ট নিতে হয়! সেখানে আমি না চাইতেই সুস্থ ত্বক পেয়েছি। আমার কি উচিৎ না সেই নিয়ামতের যত্ন নেয়া?”
নীতি মাথা নাড়লো। এভাবে তো ভেবে দেখে হয়নি।
“আমাদের দেহের এমন কোনো অংশ নেই যেটায় সমস্যা হলে তার ইফেক্ট আমাদের উপরে পড়বে না। ছোট থেকে ছোট প্রত্যেকটা অংশ মূল্যবান। ঠিকমতো খাবার না খেলে শরীর চলে না, চুলের যত্ন না নিলে চুল পড়ে যায়, দাঁতের যত্ন না নিলে সেখানে সমস্যা হয়। তাহলে স্কিনের যত্ন নিতে হবে না? আমরা ভাত খেলে কি সেটা অপচয় মনে করি? তাহলে এগুলো অপচয় হবে কেনো?”
“সেটাই তো।” মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলল মালিহা। নাজিফার প্রত্যেকটা কথা শুনতে তার ভালো লাগছে।
“কিন্তু তুমি তো মুখ-টুখ ঢেকে থাকো। যত্ন আত্তি করো আর যতোই সাজো না কেনো কেউ তো দেখবে না।”
“আমি তো ছেলেদের সামনে মুখ ঢেকে থাকি। মেয়েদের সামনে না। আর এগুলো তো করছি নিজের জন্য। নিজেকে ভালো রাখার জন্য। তাহলে কেউ দেখলো কি দেখলো না তাতে কি যায় আসে?”
নীতি থমকে গেলো। নিজের জন্য? নিজেকে ভালো রাখার জন্য? কথা দুটো তাকে ভাবনার অতলে পাঠিয়ে দিলো। তার চেনাজানা বেশিরভাগ মেয়েরা বাইরে বের হওয়ার সময় বেছে বেছে সবচেয়ে সুন্দর জামাটা গায়ে জড়ায়। কৃত্রিম প্রসাধনীতে নিজেকে সাজায়। এমনকি সে নিজেও। কিন্তু হলে অথবা বাড়িতে নিজেকে সেভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয় না। কেমন আলস্য জেঁকে ধরে। কেই বা দেখতে আসছে? এই কথাটাই ভাবনাকে আরো প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। কিন্তু নিজের জন্যেও যে নিজের যত্ন নেয়া যায় এই বিষয়টাই যেনো নীতির মাথায় কখনও আসেনি।
“এই নীতি তুমি কি আলু ভাজি দিয়েই সব ভাত খাবে নাকি? তরকারি নাও।” নিজের হাতে তুলে দিলো নাজিফা। লাজুক হেসে বলল, “মুরগির মাংসে না লবণ একটু কম হয়েছে। রান্নার সময় বুঝতে পারিনি। কিছু মনে করো না প্লিজ! আমি লবণ নিয়ে আসছি।”
“থাক আনতে হবে না। আমার কাঁচা লবণ খাই না। আর তাছাড়া লবণ বেশি হয়ে গেলে সমস্যা। অতোটাও কম হয়নি। তুমি বললে বলেই এখন খেয়াল করছি।”
গল্পে কথায় সময় গড়ালো। নীতিকে ঘুরেফিরে তার বেডের চারপাশটা দেখতে দেখে নাজিফা কাছে এসে বলল, “আল্লাহ সুন্দরতম। তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। তাহলে কেনো আমরা নিজেকে আরেকটু সুন্দর করে তার কাছে উপস্থাপন করবো না?” নীতি তাকিয়ে রইলো অপলক। তার চিন্তার গতি সেকেন্ডে কিলোমিটার ছুঁয়েছে। আল্লাহর সামনেও নিজেকে উপস্থাপন করা যায়?
বিদায় বেলায় নাজিফা বিনয়ী কণ্ঠে বলল, “পরশু তো শুক্রবার। সেদিন রাতে এশার আগে আগে নামাজ ঘরে আসতে পারবে? একটু গল্প করতাম।”
মালিহা মাথা নাড়ল। মেয়েটার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে। না করার কারণ নেই।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি ইতমিনান। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত ফেসবুকিং করার ফল। প্রয়োজনীয় কোনো কাজ ছিল না। শুক্রবারকে সামনে রেখে একটু বিনোদনের আশায় নীল সাদার জগতে ডুব দিয়েছিলো। আঙুলের অদরকারি ব্যায়াম হিসেবে স্ক্রল করে গেছে মিনিটের পর মিনিট। সম্মোহনী নীল রশ্মি চোখের ঘুম যেনো চম্বুক দিয়ে শুষে নিয়েছে। ক্লান্ত হয়ে ফোন রেখে দিলেও ঘুম এসেছে তারও পরে। ফলাফলস্বরূপ ফজর মিস। যখন তার ঘুম ভেঙেছে সূর্য তখন উঁকি দিচ্ছে ঘুমের চাদর ছেড়ে। নিত্যকার অভ্যাস অনুযায়ী বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই কুকুরতার দেখা মিললো। লেজ নাড়াতে নাড়াতে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকালো ইতমিনান। সাড়ে ছয়টা বেজেছে। ব্রাশ করে কাযা নামায পড়ে বাড়ি থেকে বের হলো। কুকুরটা তাকে দেখেই এগিয়ে এলো। ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলো। ইতমিনান ভুরু কুঁচকে তাকালো। মানিক মিয়াকে দেখে কুঁই কুঁই করে আর তাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করছে। এই ডাকের পার্থক্যের মাধ্যমে কি প্রকাশ পায়?
“তোমার তো একটা নাম দেয়া দরকার মানিকের কুকুর। তোমার মনিব কই?” কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বলল ইতমিনান। যদিও সে জানেনা কুকুরটা তার কথা বুঝবে কি না। তবে দেখা গেলো কুকুরটা তার দিকে একবার তাকিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে ঘুরে যেয়ে রাস্তা ধরলো। ইতমিনান তার পিছু নিলো। আজ শুক্রবার। ছুটির দিনে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা ঝুলিতে ভরতে পারলে মন্দ হবে না।

পথ চলতে চলতে রেল লাইনের পাশে এসে থামলো কুকুরটা। সেখানে ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর। প্রকৃতপক্ষে এগুলোকে ঘর বললে পরিচিত ঘরকে উপহাস করা হয়। ঘর মানুষের আশ্রয়স্থল, শান্তির নীড়। কিন্তু রাস্তাঘাটে সাইনবোর্ড বানানো কাগজ দুপাশে ফেলে এখানে যেটা তৈরি করা হয়েছে সেটা তাবুর কাছাকাছি একটা জিনিস। যার ক্ষমতা নেই এর নিবাসীকে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফানের নিষ্ঠুর তান্ডব থেকে রক্ষা করার। এ যেনো শিশুমনের অবুঝ খেলা, এই জায়গা আমার, ঐ জায়গা তোমার। ইতমিনান নিশ্বাস ছাড়ল। চিত্র শিল্পীরা নাকি রঙের হাজার ধরন চেনে। কিন্তু যে জীবনের রং চিনেছে তার কাছে সেই হাজার রকম রঙের বাহার নস্যি বৈ কিছু নয়।

কুকুরটা একটা তাবুর মাঝে ঢুকে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেলো মানিক ইটের টুকরো কুকুরটার দিকে নিক্ষেপ করতে করতে বেরিয়ে আসছে। কুকুর ছুটে ইতমিনানের পায়ের কাছে এসে থামলো। মানিক মিয়া ঘুম ভাঙ্গা কণ্ঠে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। ইতমিনান গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “মানিক মিয়া এভিনিউ! আছো কেমন?”
মানিক থেমে গেলো। এই পর্যন্ত তাকে কেউ এই নামে ডাকেনি। খুঁচিয়েছে, মজা করেছে। এমন নাম কারো হয় নাকি? গম্ভীর স্বরে মানিক বলল, “এইখানে আপনের কি কাম?”
ইতমিনানও মানিকের মতো স্বর গম্ভীর করে বলল, “খুবই গুরুত্বপুর্ন কাজ মানিক মিয়া। কুকুরটার একটা নাম ঠিক করতে এসেছি। কিছু বলে ডাকতে পারছি না।”
কুকুরটা কুঁই কুঁই করতে করতে মানিকের পা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মানিক গোল গোল চোখে ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি নতুন কোনো পাগলের পাল্লায় পড়লো? কুকুরের নাম ঠিক করতে এখানে এসেছে! কি আশ্চর্য!

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২০

ট্যুর থেকে ঘুরে এসে সবাই সেই গল্প নিয়ে বসেছে কমন রুমে। একদল সামনের দিকে টিভি দেখছে। সম্ভবত সিনিয়র কেউ। নাহলে পেছনে এতো মেয়ে দেখে সাউন্ড কমাতো। সাউন্ড তো কমলোই না বরং মেয়েদের কিচির মিচির আওয়াজে খানিকটা বেড়ে গেলো। কেউ কেউ তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো। সিনিয়র বলে দাপট দেখাচ্ছে? হুহ!

নীতি টেনে ধরে মালিহাকে গল্প শোনাতে নিয়ে এসেছে।
“দোস্ত তোর মধ্যে তো স্বাদ আহ্লাদ কিস্যু নাই। আয় মানুষের স্বাদ দেখে যদি তোর মনে মধ্যে কিসুমিসু তৈরি হয়।” এই কথা বলে মালিহার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে নীতি। কিন্তু নীতি কি জানে মালিহার মনের গভীর গোপনে কতো স্বাদ আহ্লাদ দায়িত্বের বিশাল আস্তরণের নিচে চাপা পড়ে গেছে?

আসর জমে যখন জমজমাট তখন এলো ইরিনা। নীতি মালিহাকে খোঁচা দিয়ে ইরিনাকে দেখালো। ইরিনা তাদের পাশেই বসেছে। তবে তাদের খেয়াল করেনি। মালিহা আস্তে করে বলল, “ইরিনা! কেমন আছো? আঙ্কেল কেমন আছে?”
বড় বড় চোখে মালিহার দিকে তাকালো ইরিনা। অপ্রস্তুত হয়ে একটা হাসি দিল। সেই হাসি চোখ দিয়ে মাপলো নীতি। তার চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে আছে।
“আচ্ছা তোমার সাথে পরে কথা বলছি কেমন?”
বলেই গল্পে মজে গেলো ইরিনা। এক ফাঁকে উঠে অন্য চেয়ারে বসলো। মালিহার কাছে অবাক লাগলো। ইরিনা এমন করলো কেনো? নীতি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “চ্যাং মাছের মতো চ্যাঙ চ্যাঙ করো? ছাই দিয়ে এমন করে ধরবো না!”
সত্যি সত্যিই আসর শেষে ইরিনার হাত খপ করে ধরলো নীতি। ইরিনা যেনো ফেঁসে গেলো। মালিহা বলল, “আঙ্কেল কেমন আছে?” নীতির কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “হাতটা ছেড়ে দে। কেমন দেখা যায়?” নীতি ধমক দিয়ে বলল, “চুপ কর তুই!” পরপর ইরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাবা নাকি এক্সিডেন্ট করেছে? ঘটনা কি? কেমন আছেন আঙ্কেল?” ইরিনা নীতির সন্দেহী দৃষ্টির সামনে বিব্রত বোধ করলো। কোনমতে বলল, “ভালো।” হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো সে। পারলো না।
“আঙ্কেল এক্সিডেন্ট করেছে আর তুমি ঘুরতে চলে গেলে? এটা একটা কথা হলো?”
“আসলে আম্মুই বলল মন টন খারাপ যেয়ে যেনো বান্ধবীদের সাথে ঘুরে আসি।”
“ওওও! আচ্ছা আজকে তো শুক্রবার, মালিহার টিউশনি নেই। বিকালে চলো আঙ্কেলকে দেখে আসি। আমাদের একটা মানবিক দায়িত্ব আছে না? এই মালিহা! গ্রুপে মেসেজ দিই। তাহলে কয়েকজন মিলে একসাথে যেতে পারবো। ভালো হবে না ইরিনা? তোমাদের বাড়ি আমাদের নেবে তো?”
“আব্বু তো এখনো হাসপাতালে। বাড়ি নিয়ে গেলে তারপর যেও কেমন?” ইতিউতি করে বলল ইরিনা।
“আর কতো মিথ্যা বলবে ইরিনা? তোমার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে অথচ ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়েও জানে না। কিন্ত হাসপাতালে থাকা অসুস্থ সে মানুষটা ফোন করে বেশ ভালোভাবেই তোমাকে বকছে! কি আশ্চর্য না?” এখানে আসার আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কারো সাথে ইরিনাকে ঝগড়া করতে দেখেছে নীতি। কথার এক পর্যায়ে আব্বু বলে ডাকতেই সে বুঝলো ফোনের অপর পাশে ইরিনার বাবা তারপর একটু কাছে গিয়ে ভালো করে বাকি কথা শুনে এসেছে সে। নিশ্চিত হয়েছে ইরিনা তার বাবার সাথেই কথা বলছে। সন্দেহ তো নীতির তখনই হয়েছে যখন শুনেছে ইরিনা ট্যুরে যাচ্ছে। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে কেউ ইরিনার বাবার এক্সিডেন্টের খবর জানে না। সন্দেহ গাঢ় হয়েছে নীতির। তার বিশ্বাস এই মেয়েকে চেপে ধরলেই কথা বের করা যাবে, “সত্যিটা বলবে নাকি আমি তোমার বাড়িতে ফোন দেবো? আমার কাছে কিন্তু তোমার বাবার নাম্বার আছে।” আজ সকালেই নাম্বারটা সংগ্রহ করেছে নীতি। ইরিনা এবার বাস্তবিকই ভয় পেলো। মালিহার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল, “তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে এসব কথা কাউকে বলবে না।”
মালিহা অবাক হয়ে নীতির কথা শুনছিল। কিন্তু ইরিনার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে এটা কেউ শুনলেই বা কি? সেটাই বুঝতে পারলো না মালিহা।
“আরে আমার দিকে তাকাও ইরিনা। বলো ফোন দেবো নাকি ডিপার্টমেন্টের গ্রুপে বলবো তুমি মালিহার টাকা মে’রে দিয়েছো? কোনটা?” ভুরু উঁচু করলো নীতি। আশপাশে তেমন কেউ আর নেই। টিভিও ততক্ষণে বন্ধ হয়েছে। ইরিনা চমকে আশপাশে তাকিয়ে বলল, “না না নীতি! আমি মালিহার টাকা মে’রে দেবো কেনো? সব ওকে আমি ফেরত দেবো।”
“কিন্তু সেই টাকা দিয়ে তুমি করেছো কি?”
তাকে ইতস্তত করতে দেখে নীতি ফোন হাতে নিলো। ইরিনা গড়গড় করে বলল, “আব্বু আম্মু আমাকে একদম কোথাও যেতে দিতে চায় না। ট্যুরের কথা বললেও এক বাক্যেই না করে দিয়েছে। আবার সামিরের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগটাও মিস করতে পারছিলাম না। তাই মালিহাকে মিথ্যে বলেছি।”
ইদানিং সামিরের সাথে ইরিনার চলেফেরা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছিল। সেসব কথায় কান দেয়নি মালিহা। এক ইরিনা নিজেই স্বীকার করলো। নীতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইরিনার হাত ছেড়ে দিলো।
“তাই বলে এভাবে মালিহাকে মিথ্যে বলবে?”
মালিহার বুকের ভেতর ঢোল পেটানোর আওয়াজ হলো। বিশ্বাস ভাঙার কষ্টের চেয়ে ভয় হলো বেশি। তার চার হাজার টাকা সে ফেরত পাবে তো?

মানুষের অনুভূতির কি রং হয়? কেনো হয় না? যেই অনুভূতির কবলে পড়ে পাল্টে যায় পৃথিবীর ইতিহাস, উল্টে যায় সব নিয়ম সেই অনুভূতি দেখতে কেমন? শাড়ি পরিহিতা রমণীর আভিজাত্যে ভরপুর কুচি নাকি এই রেল লাইনের পাশে বেড়ে ওঠা এক শিশুর শীর্ণ দেহ। অনুভূতির কতগুলো রং? ঠিক কতগুলো? গুণে কি শেষ করা যাবে?

চারপাশে গাঢ় চোখে তাকালো ইতমিনান। তার পরনে ট্রাউজার এবং একটা টি শার্ট। কিন্তু এই পরিবেশে নিজেকে তার বড়ই বেমানান লাগছে। কোনো পুরুষের গায়ে জামা নেই। তবে লুঙ্গির গিটটা বড় মজবুত। নারীদেহের বসন মলিন হলেও সম্মান রক্ষা করার মতো। নিজেকে এখানে উটকো মনে হলো ইতমিনানের। অস্বস্তি কাটাতে মানিকের দিকে তাকালো। তার চোখ দুটো স্বাভাবিকের তুলনায় বড় দেখাচ্ছে। কুকুরটা মানিকে পায়ের কাছে যেয়ে ঘেঁষে বসলো। বসলো মানিক নিজেও। ইতমিনান তার দিকে এগিয়ে যেয়ে বলল, “এভাবে কুকুরের শরীর ঘেঁষে বসা ঠিক না। ওর গায়ে কতো রোগ জীবাণু আছে জানো?”
তাচ্ছিল্য মাখ হাসি ফুটে উঠল মানিকের চোখেমুখে। কুকুরের কাঁধে হাত রাখলো। যেনো সে কতকালের পুরনো বন্ধু।
“এইখানে যতো মানুষ থাকে তারা জন্ম থেইকাই রোগ জীবাণু গায়ে মাইখা বড় হয়। আপনেগো ভূষণ শার্ট প্যান্ট আর আমাগো ভূষণ রোগ জীবাণু। আর কথা হইলো গিয়া বড়লোক মাইনষের কাছে এই আমরাই আস্তা রোগ জীবাণু। তয় আর সমেস্যা হইলো কই?”
কুকুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলো মানিক। এই প্রথম মানিককে কুকুরটার সাথে নরম ব্যবহার করতে দেখলো ইতমিনান। তার কাছে মনে হলো হাজার আঘাতের মাঝে এই এইটুকু স্নেহমাখা স্পর্শের জন্যই কুকুরটা মানিকের পিছু ছাড়ে না। আচ্ছা এই স্নেহ নামের অনুভূতিকে ল্যাবে নিয়ে ক্লোন করা যায় না? ঢুকিয়ে দেয়া যায় না নিষ্ঠুর মানুষগুলোর অন্তরে? বিজ্ঞান কি পারবে অনুভূতিকে কণিক্যাল ফ্লাস্কে মুখ বন্ধ করতে? ডান হাত হাঁটুতে রেখে বসলো ইতমিনান।
“কুকুরটার একটা নাম ঠিক করি মানিক। বলো কি রাখা যায়?”
“কুকুরের আবার নাম লাগবো ক্যান? বড়লোক মাইনষের যতসব ঢং!”
মুখ বাঁকিয়ে বলল মানিক। ইতমিনান থতমত খেয়ে গেল, “কুকুরটা মনে হয় আমার কথা বুঝতে পারে বুঝলে? তো ওকে কিছু বলার সময় কি বলে ডাকবো? কুকুর কুকুর বললে কেমন একটা লাগে না?”
“কেমুন আবার লাগবো? কুকুর হইলো কুকুর। লাগালাগির কি আছে?” মানিকের বলা শেষ হতেই কুকুরটা কুঁই কুঁই করে উঠলো। ইতমিনান বুঝলো না সে মানিককে সায় জানালো নাকি নিজের জন্য একটা নাম চাইলো। তবু ধরে নিলো মনিবভক্ত কুকুর মানিকের পক্ষ নিলো।
“আচ্ছা কালাপাহাড় রাখলে কেমন হয়? এই নামের কিন্তু ইতিহাস আছে।” আর কোনরকম যুক্তি দেখালো না ইতমিনান। মানিক চোখ কুঁচকে নিলো, “ইতিহাস পাতিহাঁস দিয়া আমি করুম কি? আমার কুত্তা কি কালা? নাকি গরীব মাইনষের জিনিস দ্যাখলেই আপনেগো সব কালা কালা লাগে? কালাপাহাড় কওন যাইবো না। তয় লালপাহাড় চলে।” কুকুরটার গায়ের লাল রঙ্গা পশমে হাত বুলিয়ে দিলো মানিক। কুকুরের রুগ্ন দেহের দিকে তাকালে কোনো দিক দিয়েই তাকে পাহাড় বলা যায় না। দেহের কিছু জায়গায় সাদা ছোপ ছোপ দাগ থাকলেও শরীরজুড়ে লাল রঙের আধিক্য।
ইতমিনান সম্মত হলো।
“বেশ! তাহলে লালপাহাড় বলেই ডাকবো।”
চোখ মটকে মানিক বলল, “মাইনষের মতো নাম রাখলেন তাইলে আকীকা দিবেন না?”
আবারও থতমত খেলো ইতমিনান। তার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মানিক পড়াশোনা করলে নির্ঘাত ঘাগু আইনজীবী হতো। কথার মারপ্যাঁচে বিড়ালকেও ঘেউ ঘেউ করতে বাধ্য করতো। তবে মনের ভাব লুকাতে ইতমিনান মোটামুটি পারদর্শী। উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে বলল, “আজ শুক্রবার। একটা ভুঁড়িভোজ করাই যায়। আকীকা না করে বিরিয়ানি খেলে চলবে না?”
মানিক শুরুতেই বুঝেছে এই লোকের মাথার স্ক্রু ঢিলা। একে ফুঁসলিয়ে যে কাজ উদ্ধার করা সম্ভব সেটা তার চতুর মস্তিষ্কে ধরা পড়তে এক মিনিটও লাগেনি। এই মানুষগুলো আছে বলেই তো এখনো চোখ বন্ধ করে হেঁটে হেঁটে পয়সা পাওয়া যায়। ইতমিনানের জন্য মায়া হলো মানিকের। আহারে বোকা মানুষ!
“সইত্য খাওয়াইবেন নাকি ঢপ?”
“সত্যিই খাওয়াবো।”
“তাইলে আইজকা আর কামে যামু না।”
“কি কাজ করো তুমি?”
“টুকাইগিরি করি।” হাই তুলে বলল মানিক।
“আচ্ছা আজকে আমার বাসার সামনের মসজিদে আসো। একসাথে নামাজ পড়ে তারপর বিরিয়ানি ভোজ হবে।”
“মশকরা করেন আমার লগে?” চোখ রাঙিয়ে বলল মানিক।
“কেনো? তুমি কি হিন্দু?”
“মা বাপ তো চিনলাম না। তাই কি র’ক্ত যে গতরে আছে কইতে পারি না। তয় একবার মসজিদে গেসিলাম। শুক্কুরবার জিলাপি দেয়। ভাবলাম নামাজ পইড়া দুইটা জিলাপি খামু তাইলে দুপুরের খাওন হইয়া যাইবো। মসজিদে ঢুইকা বইসি কি বই নাই মানুষ এক্কেরে দৌড়াইয়া আইসে। আমি নাকি চুরি করতে গেসি। কইলাম না নামাজ পড়তেই গেছি। তা আমারে জিগায় গায়ে জামা কো? আমার কি কুনু জামা আছে যে পইড়া যামু? তারপর মাইরা ধইরা বাইর কইরা দিসে। মসজিদ হইলো জামা কাপড় ওয়ালা, আতর ওয়ালা মাইনষের। আমগো না। আপনে যান।”

ইতমিনান থমকে গেলো। আহা মানুষ!

সেই দুপুরে মানিক ইতমিনানের বাড়ির সামনে গেলো না। দেখা গেলো না লালপাহাড়কেও। তবু ইতমিনান নামাজ শেষ করে তিন প্যাকেট বিরিয়ানি কিনলো। চলতে শুরু করল মানিকের নড়বড়ে তাবুতে। মানিক তখন পুকুরে দাপাদাপি করতে ব্যস্ত। ইতমিনান যেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। মানিক এসে তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইলো। ইতমিনান বিনা আহ্বানে সাইনবোর্ডের কাগজে বানানো তাবুর ভেতরে অনায়াসে ঢুকে পড়ল। ময়লা, ছেড়া একটা চটের বস্তার উপর বসে বিরিয়ানির প্যাকেটগুলো খুলে রেখে হাসিমুখে বলল, “মসজিদ আতর ওয়ালা মানুষের হলেও আল্লাহ কিন্তু সবার। জানো মানিক মিয়া এভিনিউ? তোমার, আমার, এই যে লাপাহাড়ের। সব্বার!”
মানিক অবাক হয়ে দেখলো লালপাহাড় কুঁই কুঁই করতে করতে ইতমিনানের পাশে যেয়ে বসছে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২১

মালিহা থমকে গেছে। কমন রুম থেকে এসে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি সে। নীতি বুঝতে পারছে মালিহার মনের অবস্থা। মালিহার পাশে বসে সে ধীর কণ্ঠে বলল, “এর আগেও একবার ও এমন করেছে। তোর মনে নেই? ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে?” কথা শেষ করে মনিকা এবং আঁখির দিকে তাকালো নীতি। তারা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। মালিহা কথা বলল না। চুপ করে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। নীতির ফোন বেজে উঠলে নিজের বিছানায় গেলো সে।

চোখ বন্ধ করতেই ইরিনার মুখটা ভেসে উঠলো। মনে পড়ল নিজের ভাইকে পড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে ইরিনাই সবার আগে এগিয়ে এসেছিল। মেয়েটার চোখে নিজের জন্য স্পষ্ট সমবেদনা দেখেছিল মালিহা। হঠাৎ করেই তাচ্ছিল্য মাখা একটা হাসি মালিহার ঠোঁটে জায়গা করে নিলো। সমবেদনা? আসলেই কি কেউ অনুভব করতে পারে সমবেদনা? আরেকজনের কষ্টের সেই অনুভূতির সমান বেদনা? মালিহার ভাবনায় ছেদ পড়ল। ফোন বাজছে। চোখ বন্ধ করেই ফোন কানে ঠেকালো মালিহা।
“আসসালামু আলাইকুম আপা। কেমন আছিস?”
সন্তর্পনে একটা ঢোক গিললো মালিহা। দুঃখ বড়ই সংক্রামক। বাতাসের আগে ভেসে আরেকজন মন মস্তিষ্ক দখল করে ফেলতে পারে।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোর কি অবস্থা?”
“আপা তোকে একটা কথা বলব। রাগ করবি না বল?”
মালিহা চোখ খুলল। ভুরু কুঁচকে গেলো তার।
“কি করেছিস?”
“আগে বল রাগ করবি না?”
“রাগ করার মতো কথা হলেও করবো না?”
“না। আমার সাথে তোর কিসের রাগ? আমি তোর একমাত্র ছোট ভাই না?” আহ্লাদী কণ্ঠে বলল মিতুল। মালিহা হাসলো।
“আচ্ছা বল। আগে শুনি।”
মিতুলের কণ্ঠ হঠাৎ ধীর হয়ে গেলো। ফিসফিসিয়ে সে বলল, “বাজারে একটা সারের দোকানে কাজ নিয়েছি আপা।”
“কি!” মালিহা চমকে গেলো, “কাজ নিয়েছিস মানে?”
“পার্ট টাইম জব। স্কুল ছুটির পর থেকে এশা পর্যন্ত থাকবো। মাসে তিন চার হাজার পাওয়া যাবে বুঝলি।”
মালিহা উঠে বসলো। রুমে থাকা তিনজনের দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো। বারান্দায়ও বেশ অনেকেই আছে। সিঁড়িঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বলল, “তোকে কে বলেছে কাজ করতে?”
“কেউ না।”
মিতুলের ভাবলেশহীন কণ্ঠ মালিহাকে আরও রাগিয়ে দিলো, “তাহলে এতো বেশি বুঝিস কেনো? তোর কাজ এখন পড়াশোনা করা। ঐটাই মন দিয়ে কর। এইসব কাজ টাজ বাদ দিবি।”
মিতুল নরম কণ্ঠে বলল, “এই বাড়িতে থাকতে আমার ভালো লাগে না আপা। মামা মামীর ব্যবহারও ভালো লাগে না। শুধুমাত্র মায়ের জন্য আছি। মা’কে কি ফেলে দেয়া যায়? কিন্তু আমি তো অথর্ব না। তাহলে এমন ব্যবহার মানবো কেনো? মাস শেষে হাতে টাকা এনে তুলে দেবো। দেখবি অশান্তি অর্ধেক কমে গেছে।”
মালিহা নিভলো। সে তো এখানে আরামে আছে। অন্তত থাকা, খাওয়া নিয়ে তাকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। কিন্তু মিতুল অন্য একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ব্যবহারও পাচ্ছে সেরকম। মালিহা মলিন কণ্ঠে বলল, “ওখানে খুব কষ্ট হচ্ছে সোনা?”
মিতুল হাসলো, “জীবন যদি গোলাপের গালিচা হয়, কাঁটার উপস্থিতি তো সেখানে আবশ্যক।”
মালিহা চুপ করে গেলো। ছোট্ট মিতুলটা কেমন বড় বড় কথা বলছে।
“পড়াশোনাটা ঠিক মতো করবি মিতুল। আমি একটা টিউশনি করছি। আরেকটা কোচিংয়ে ঢুকেছি। তুই চিন্তা করিস না।”
“আপা আরেকটা কথা।”
“কি?”
“আমি দাদীর থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছি।”
পুরো ঘটনা শোনালো মিতুল। মালিহা বলল, “ভাইয়ার সাইকেলটা নিলে কি হতো?”
“যেই লাউ সেই কদুই থাকতো। আচ্ছা শোন, মানুষের ছেলেপেলে পড়াতে যেয়ে আবার নিজের পড়াশোনার কথা ভুলে যাস না।”
মালিহা হেসে ফেলল, “আচ্ছা বড় ভাই। মনে থাকবে।”
“হু। একদম মাথায় গেঁথে রাখ।”
“মা কেমন আছে?”
“ভাইয়ের বাড়িতে আছে না? দুইবেলা করলা ভাজি খাওয়ালেও সে বিন্দাস আছে।”
“মা যে কেনো জেদ ধরে আছে!”
ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করে মালিহার মনে হলো একবার বড় চাচার সাথে কথা বলা দরকার। মানুষটা তাদের জন্য ভেবে ভেবে কাহিল হয়ে পড়ছে। ভাবনা চিন্তা করে ফোনও দিলো মালিহা। কিন্তু ফোন ধরলেন আয়েশা।
“কেমন আছেন চাচী?” ইতস্তত করে বলল মালিহা। এই মানুষটার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা হয় না ঠিক কতগুলো মাস হয়ে গেছে?
“আছি ভালো। তুমি কেমন আছো?” কণ্ঠে গাম্ভীর্য আনার খানিকটা ব্যর্থ চেষ্টা করলেন আয়েশা।
“জি আলাহামদুলিল্লাহ ভালো। চাচা কেমন আছেন? আর দাদি?”
“সবাই ভালো আছে। শুনলাম তুমি নাকি খুব খাটাখাটনি করছো?”
“না সেরকম না। ঐ টুকটাক কাজ করছি।”
“যাই করো নিজের শরীরের যত্ন নেবে। ওখানে কেউ নেই তোমাকে দেখেশুনে রাখার। নিজের যত্ন তোমাকে নিজেই নিতে হবে।”
মালিহার চোখ ভিজে আসতে চাইলো। মাও তো এভাবে বলতে পারে। কই বলে না তো। ঢোক গিলে মালিহা বলল, “জি চাচী।”
“নাও তোমার চাচা এসেছেন। কথা বলো।”
ফোন দিয়ে হাফ ছাড়লেন আয়েশা। মেয়েটার জন্যে খারাপ লাগছে। এতটুকু বয়সে বাপের ছায়া হারিয়ে অকূল পাথারে পড়েছে।

মেয়ের কল দেখে মনে মনে প্রমোদ গুনলেন আয়েশা। গলা খাঁকারি দিয়ে কল রিসিভ করলেন। যতোটা সম্ভব কন্ঠস্বর নরম করে বললেন, “আমার মা কেমন আছে?”
মিলি খেঁকিয়ে উঠলো, “রাখো তোমার মা! কি করেছো তুমি হ্যাঁ? আমি তোমাকে কি বলেছিলাম?”
“আচ্ছা। আমি কি বলি শোন।”
“কিচ্ছু শুনতে পারবো না। আমার শ্বশুরবাড়িতে কি বলব? আমাকে ফকিন্নি মার্কা জমি দিয়েছে?”
“মিলি! আমার কথা শোন!” ধমকে উঠলেন আয়েশা। মিলি থামলো।
“ফকিন্নি মার্কা কোনো জমি তোমাকে দেয়া হবে না। দরকার হলে আমার ছেলের ঘাড়ে সেই জমি গছিয়ে দেবো। আমাদের ভাগের সবচেয়ে ভালো জমি তোমাকে দেবো। নিজের স্বার্থের চিন্তা করা দোষের কিছু নয় মিলি। কিন্তু সেজন্য অন্যের ক্ষতির চিন্তা করা কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষের হতে পারে না। অন্তত আমি তোমাদের সেই শিক্ষা দিইনি। মালিহা বা মিতুল কেউ বাইরের মানুষ নয়। একই র’ক্ত তোমাদের শরীরে। তোমার আপন ভাইবোন হলে কি করতে মিলি? নিজেকে মালিহার জায়গায় ভাবতে পারো?…”
টুট টুট করে শব্দ হলো। কান থেকে ফোন নামিয়ে আয়েশা দেখলেন মিলি কল কেঁটে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। মেয়েটা এমন অন্ধ হয়ে গেলো কিভাবে?

সেদিন তুষারের আচরণে মালিহা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। তুষারের অব্যক্ত ইঙ্গিত বুঝতে তার কষ্ট হয়নি। কিন্তু সহকর্মী এমন মন মানসিকতা রাখলে তার সাথে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অস্বস্তির। বিশেষ করে প্রস্তাব প্রার্থী যখন সেদিকে এগিয়ে যেতে চায় না। কিন্তু মালিহার ভুল ভাঙতে সময় লাগলো না। যখন সে খেয়াল করলো তুষারের এমন সহজলভ্য মন্তব্যের শিকার নিতুও। অর্থাৎ ওটা তুষারের স্বভাব। হাফ ছাড়লো মালিহা। নিজের পূর্বের চিন্তায় লজ্জিত হলো। সবসময় একধাপ বেশি বোঝা অভ্যাস হয়ে গেছে।
মালিহা অবাক হলো নিতুকে দেখে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই গতদিন কি একটা ঝামেলা করে সে বিদায় নিয়েছে। নিতুর সাবলীল ব্যবহার মালিহাকে ধন্দে ফেলে দেয়। মনে হয় আদৌ তেমন কিছু হয়েছিল কি? স্মৃতিপাতায় সেসব ঘটনা জ্বলজ্বল করতেই মালিহার কণ্ঠনালীতে একটা প্রশ্ন এসে মশার মতো পিনপিন করতে থাকে। নিতুকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো সে তার নাম পাল্টে ফেলবে কি না। জিজ্ঞেস করা হলো না। এখনও সে নিতুর অ্যাসিস্টেন্ট কি না!

নিতু নির্দিষ্ট টপিক বুঝিয়ে পড়া দিয়ে ক্লাস থেকে বিদায় নেয়। ক্লাস ওয়ার্ক দেখা এবং ভুল ধরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব মালিহার। একটা করে খাতা দেখে এবং ভুলগুলো তুলে সবার সামনে বুঝিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীদের হাতে কোনো কাজ না থাকায় গল্পের আসর জমে উঠছিল। মালিহা টেবিলে স্কেল দিয়ে শব্দ করলো। সবাই চুপচাপ হয়ে বসলো। দৃষ্টি নামিয়ে খাতার দিকে তাক করতেই মালিহার কপাল কুঁচকে গেলো। আবার সামনে তাকালো সে। একদম পেছনের বেঞ্চে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসে আছে। সব ক্লাসেই ছেলেমেয়েরা একসাথে বসে। প্রতি বেঞ্চে দুইজন করে। তবে পেছনের বেঞ্চে বসা ছেলেমেয়ে দুটোর অভিব্যক্তি তার কাছে সুবিধার মনে হলো না। হাতের খাতাটা তুলে সে বলল, “এটা কার?”
পেছনের দিক থেকে দ্বিতীয় বেঞ্চের একটা মেয়ে হাত তুলে বলল, “মিস আমার!”
মালিহা খাতা নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। উহু! ছেলেমেয়ে দুটোর কোনো হেলদোল নেই। নিজেদের মাঝেই তারা বিভোর। খুব সন্তর্পনে একটা রাউন্ড দিয়ে খাতাটা মেয়েটার কাছে দিয়ে এলো সে। যেই দৃশ্য অবলোকন করলো তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। মেয়েটার এক পা ছেলেটার পায়ের উপরে। দুজনে দুজনার হাত এমনভাবে ধরে রেখেছে যেনো শক্ত কোনো গিট বাঁধা। মাথা নিচু করে কি যেন ফিসফিস করে চলেছে। মালিহার কপালের দুই পাশের শিরা দপদপ করে উঠলো। এই করতে এরা এখানে আসে!
ডাস্টার দিয়ে টেবিলে জোরে শব্দ করলো মালিহা। ক্লাসরুম মোটামুটি চুপচাপ ছিলো। ফলে শব্দটা আরো বিকট হয়ে সবার কানে বাজলো। কেঁপে উঠলো যেনো সবাই। দৃষ্টি তাক করলো মালিহার মুখের দিকে।
চোখমুখ শক্ত করে মালিহা বলল, “কাল থেকে ছেলেরা একপাশে আর মেয়েরা আরেকপাশে বসবে। অন্যথা যেনো আমি না দেখি।”
সকলে অবাক হয়ে তার কথা শুনল। এমন আদেশ তো কেউ তাদের কখনও দেয়নি। স্কুলেও তো তারা একসাথেই বসে।
“কি বলেছি বুঝতে পেরেছো তোমরা? মনে থাকবে?” চড়া কণ্ঠে বলল মালিহা। তার দৃষ্টি একদম শেষের বেঞ্চের ছেলেমেয়ে দুটোর উপর। তাদের খানিকটা দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে। বসেছেও একে অপরের চেয়ে এক হাত দুরত্বে। তার প্রশ্নে সবাই একসাথে বলল, “ইয়েস মিস!”
মুখ গোল করে দম ছাড়লো মালিহা। নিজেকে শান্ত করলো। এরা এখনও ছোট। নরম কাদামাটি। ভালোবাসা দিয়ে বোঝালে নিশ্চয়ই বুঝবে। সেই পথই অবলম্বন করবে মালিহা। চোখ ঘুরিয়ে এক নজরে সবাইকে দেখে নিলো। শেষ বেঞ্চের ছেলে মেয়ে দুটোর মুখে ছেয়ে আছে আষাঢ়ের কালো মেঘ।

বসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইতমিনান। ভেতরে ভেতরে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে সে। এভাবে একভাবে তাকিয়ে থাকার কি মানে? তার কি রূপ খুলেছে? পেছনে হাত মোড়া করে দাঁড়িয়ে আছে সে। নয়তো মুখটা একবার ছুঁয়ে দেখা যেতো।
বস চোখের রিমলেস চশমাটা আরেকটু নিচে নামিয়ে চশমার ফাঁকা দিয়ে বললেন, “যা বলছেন ভেবে বলছেন তো?”
“জি স্যার।” দৃঢ় কন্ঠে বলল ইতমিনান। সে বোঝে না চশমার ফাঁকা দিয়েই যদি দেখবে তাহলে চশমাটা পড়ার দরকার কি?
“আপনাকে কিন্তু অফিস টাইমের মাঝেই একস্ট্রা কাজ করতে হবে।”
“জানি স্যার।”
“ওকে। আমি বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখবো।” মাথা নাড়িয়ে বললেন ভদ্রলোক। ইতমিনান বিনয়ী কণ্ঠে বলল, “বেয়াদবি নেবেন না স্যার। যদি সম্ভব হয় আপনার মেয়েকে তার জায়গায় রেখে ভাববেন। এবং আপনার কাছে আমার রিকোয়েস্ট থাকবে ম্যাম যেনো এই বিষয়টা না জানেন।”
“ওকে।”
“ধন্যবাদ স্যার। আসসালামু আলাইকুম।”
সালাম দিয়ে রুম ত্যাগ করলো ইতমিনান। ঊর্ধ্বতন চেয়ে দেখলেন হালকা পাতলা গড়নের এক যুবককে।
রুম থেকে বের হয়ে লতার ডেস্কের দিকে তাকালো ইতমিনান। ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে সে। পরপরই আবার কি বোর্ডে আঙুল চালানো শুরু করলো। অনাগত জীবনকে আরেকটু আরামে রাখার চেষ্টা। খটখট খটখট…

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২২

তিশার গালে তিন আঙুলের ছাপ। চোখমুখ ভয়াবহ রকমের ফোলা। বাম গালটা বেশি ফুলে আছে। প্রচ্ছন্ন একটা লাল আভা পুরো মুখে রাজত্ব করছে। থেমে থেমে নাক টানছে তিশা। মালিহা আনমনে মেয়েটার গাল ছুঁয়ে দিতেই কেঁপে উঠল তিশা।
“মিস গালে ব্যাথা।”
“কি হয়েছে তিশা?” নরম কণ্ঠে বলল মালিহা।
চোখ মুছে তিশা বলল, “আম্মু মেরেছে।” মেয়েটা অল্পতেই কান্না করে দেয়।
“কেনো মেরেছে? দুষ্টুমি করেছো?”
“না। ইংলিশ টেস্টে কম নাম্বার পেয়েছি। তাই।”
মালিহার ভুরু কুঁচকে এলো। ইংলিশে কম? “কতো পেয়েছো?”
“পঞ্চাশে পনের।” মাথা নিচু করে বলল তিশা। মালিহা এবার বাস্তবিকই অবাক হলো। ইংলিশে কম পাওয়ার মেয়ে তিশা নয়। এটা সে চোখ বন্ধ করে বলতে পারে। অন্তত এতদিন পড়িয়ে এটুকু মালিহা বুঝতে পেরেছে। ফলে তার সন্দেহ হলো।
“আমাকে প্রশ্নটা দেখাও তো। কাছে আছে?”
“না। আমি ঘর থেকে নিয়ে আসছি।”
তিশা উঠলো। ছোটখাট মেয়েটা সবসময় ফ্রক পড়ে থাকে। দেখতে আরো ছোট লাগে।
কাগজ হাতে ফিরে এলো তিশা। মালিহা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব প্রশ্ন দেখলো। গদ বাঁধা প্রশ্ন। মডেল বইয়ে এমন হাজারখানেক নমুনা আছে।
“এগুলো পারো নি?”
ডানে বায়ে মাথা নাড়লো এক তিশা।
“কেনো পারোনি?”
“পরীক্ষায় বসলে আমি আর কিছু মনে করতে পারি না মিস।”
“ভয় করে?”
“হু।”
“সব সাব্জেক্টে নাকি শুধু ইংলিশে?”
“সব সাব্জেক্টে।”
মালিহা চুপ করে গেলো। ভাবলো কিছুক্ষণ। পরপর প্রশ্নটা আবার দেখলো। সেটা একপাশে থেকে রেখে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, “তিশা আমি তোমাকে একটা টাস্ক দেবো। পাজল টাস্ক। কমপ্লিট করতে পারলে গিফট পাবে। রাজি?”
তিশা কয়েকবার পলক ফেললো, “কি টাস্ক?”
“একটা কমপ্লিটিং স্টোরি লিখবে। The Hair and Tortoise. একদম নিজের মতো করে। একটা প্যারাগ্রাফ লিখবে, My Country। কিন্তু কোথাও যেনো My শব্দটা না থাকে। অংক বইটা দাও দাগিয়ে দিই।”
মালিহা আড়চোখে দেখলো তিশা সবটা খুব আগ্রহের সাথে পরোখ করছে। ফোলা মুখেও মৃদু ঝলকানি দেখা গেলো। পড়ানো শেষে বলল, “টাস্কগুলো করবে কিন্তু?”
“করবো মিস।”
“তোমার আম্মুকে ডেকে দাও তো একটু।”
তিশা ঘরে যাওয়ার একটু পর আজিজা এলেন। মালিহা সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে বলল, “বেয়াদবি নেবেন না ফুপু। তিশার টিউটর হিসেবে একটা কথা বলছি। মেয়েটার লুকানো ট্যালেন্ট আছে। আপনি হয়তো কখনো খেয়াল করেননি। ও ইংলিশে দুর্দান্ত। সঠিক পরিচর্যা পেলে আরো ভালো করবে। আপনি ওর নোটবুকটা সময় পেলে একবার চোখ বুলিয়ে দেখবেন। আর পরীক্ষায় খারাপ করার কারণ আসলে ওর ভয়। অতিরিক্ত প্যানিক করার কারণে ও স্থির মস্তিষ্কে পরীক্ষা দিতে পারে না। আশা করি এটাও শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।”
আজিজা চুপচাপ প্রতিটা কথা শুনলেন। প্রত্যুত্তর দিলেন না। তিশার জন্য কম টিউটর তো রাখা হয়নি। কেউ এই কথাটা বলেনি কেনো?

লতার চোখেমুখে অবাক ভাব। বিষয়টা মেনে নিতে তাকে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। কাগজটা হাতে নিয়ে সে বসের দিকে তাকালো। ভদ্রলোক নির্বিকার। দরজায় খুটখাট শব্দ হতেই ধ্যান ভাঙলো তার। ফিরে গেলো নিজের ডেস্কে। ছুটির তখনও কিছু সময় বাকি। চেয়ারে বসে শরীর এলিয়ে দিলো লতা। মাথার ঘণ্টা টেনে চোখের উপর ফেলে দিলো। চোখটা ভিজে আসতে চাইছে। দয়া হোক আর অনুগ্রহ এটুকুর খুব দরকার ছিল লতার। আর পারছিলো না। শরীরটা আর চলছিল না। কিন্তু মাথার উপর শক্ত কোনো হাত নেই, চোখের পানি ফেলার মতো কোনো বুক নেই, নিজের একটা ঢাল নেই। যু’দ্ধের এই দুনিয়ায় সে নিজেই নিজের ঢাল। আরেকজন আসছে। তাকেও ছায়া দিতে হবে। এখনই পুড়ে ভস্ম হওয়া চলবে না। নিজেকে শক্ত করতে চাইলো লতা। ইতমিনান ডাকলো, “আপা? কোনো সমস্যা?”
ঘোমটার উপর দিয়েই চোখ চেপে ধরলো লতা। আলগোছে সেটা মাথায় রেখে বলল, “বসের সুমতি হয়েছে বুঝলি? আমাকে দুই মাসের ছুটি দিয়েছে।”
ইতমিনান অবাক হলো, “তাই নাকি! ভালো তো। আপনার সুবিধা হলো।”
“সুবিধা মানে সুবিধা? এই শরীর নিয়ে আর নড়তে পারছিলাম না। পায়ে পানি জমে ঢোল হয়ে গেছে। ওঠাতে গেলে মনে হয় এক মন ওজন। পেটের ভেতর আরেকটা। অস্থির অস্থির লাগে। যাক আল্লাহ ব্যাটাকে সুবুদ্ধি দিয়েছে। দোয়া করি এই কাজের বিনিময়ে সে জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার পাক।”
ইতমিনান শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বলল, “আমিন।” মুখে বলল, “তাহলে তো কাল থেকে আর আপনার দেখা পাচ্ছি না। যদি এই অধমকে করুণা করে দরকার হলে একটা ফোন দিতেন আমি কৃতার্থ থাকতাম।”
লতা হেসে ফেললো ইতমিনানের বলার ধরণে।
“দেবো দেবো। একেবারে মোক্ষম সময় ফোন দেবো। তখন বুঝবি ঠ্যালা।”
ইতমিনান তাকিয়ে রইলো ঘড়ির দিকে। নিজের সাথেই যেনো তার পাল্লা। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা। কেউ থেমে নেই। ইতমিনানের খুব ইচ্ছে হলো লতার হাত দুটো ধরে। তার ভয় হচ্ছে। ডেলিভারির সময় তো কতকিছুই হয়। লতার সাথে যদি আর দেখা না হয়? পলক ঝাপটালো ইতমিনান। পাল্টে ফেলতে চাইলো চিন্তার স্রোত।
“নিজের যত্ন নিয়েন আপা। ভাইয়ার সবচেয়ে দামী আমানত আপনাকে সে দিয়ে গেছে।”
চলে গেলো ইতমিনান। লতা সেই নিষ্ঠুর মুখটা মনে করলো। অকূল পাথারে তাকে একা ভাসিয়ে বিদায় নিয়েছে লোকটা। উহু, বিদায় নেয়নি। না বলেই চলে গেছে। বুকটা ভারী হতে চায় লতার। নিজেকে সামলে নেয় সে। পুরো শরীরটা ভারী। এর মাঝে আলাদা করে বুকের ভার সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।

অফিসের পাশের টং দোকানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ইতমিনান। দোকানটা ছোট একটা গলির ভেতরে। রাস্তা থেকে সহসাই অন্ধকারে ঘেরা জায়গায় দাঁড়ানো লোকগুলোকে দেখা যায় না। কিন্তু এদিকে দাঁড়ানো মানুষগুলো রাস্তাটা বেশ দেখতে পারে। দুই কাপ চা শেষ করেছে ইতমিনান। আর খাওয়ার ইচ্ছা নেই। কিন্তু যার জন্য সে দাঁড়িয়ে আছে তার দেখা নেই। কতক্ষন পড়ায় মেয়েটা? ঘড়ি দেখল ইতমিনান। সময় তো হয়েছে। অস্থির ভঙ্গিতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে গলির মুখে এসে দাঁড়ালো সে। সাই সাই করে বাস, ট্রাক যাওয়া আসা করছে। একটা নেড়ি কুকুর পুরোনো পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল ঘেষে ঘুমিয়ে আছে। সুখের ঘুম নাকি ক্ষুধা ভুলে থাকার ঘুম? ইতমিনান জানে না। শুধু জানে নিজের সর্বনাশ সে নিজে করেছে। এই অস্থিরতার জন্ম দেয়া মনকে লাই দিয়েছে। শব্দ দিয়ে সাহায্য না করলেও নীরবতায় সম্মতি দিয়েছে। সেই সম্মতি পেয়ে মন তার আনকোরা অনুভূতির পসরা সাজিয়ে বসেছে। ইতমিনান জানে না এই অনুভুতির উপযুক্ত কোনো ভবিষ্যত আছে কি না। বলা ভালো সে জানে, নেই। কিন্তু সেই জানাটুকু অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। বেহায়া চোখদুটোকে খিচে বন্ধ করে ইতমিনান। তাকিয়ে তাকিয়েই সর্বনাশটা করেছে সে। যখনই দৃষ্টি তার সূক্ষ্মতম দুর্বলতায় পা পিছলে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখনই তার উচিত ছিল তাকে ঘুরিয়ে দেয়া। লক্ষ্যবস্তুকে পরিবর্তন করে ফেলা। ইতমিনান সেটা পারেনি। নিজের মনকে শক্ত শিকলে বেঁধে রাখতে পারেনি। সে জানে ক্ষতি আসলে তারই হচ্ছে। মায়াটুকু বেড়ে মন থেকে মস্তিষ্ককে গ্রাস করতে চাইছে। সংযম ভেঙে দিতে চাইছে। তার ভবিষ্যত সঙ্গিনীর জন্য যেই অনুভূতিগুলো খুব যত্নে সাজিয়ে রাখার কথা সেই সাজানো গোছানো অনুভূতিকে উলোট পালট করে দিচ্ছে। ইতমিনান খেই হারায়।
“কি ভাই? ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?”
চোখ খোলে ইতমিনান। এক ভদ্রলোক তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। তাকানোরই কথা। দিনে দুপুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ ঘুমাতে শুরু করলে তার দিকে মানুষ অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাবে বৈ কি। বিব্রত বোধ করলো ইতমিনান। সর দাঁড়ালো একপাশে। তখনই দৃষ্টিগোচর হলো গাঢ় পেস্ট কালারের বোরখা পরিহিতা মেয়েটা এদিকেই আসছে। একই রঙ্গা কাপড়ে মাথা আবৃত। রোদে পুড়ে ক্লান্ত হওয়া মুখটা লাল হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপরই ডান হাত দিয়ে ঠোঁটের উপরের ঘামটুকু মুছে ফেলছে সে। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরা। যেনো কোনো অমুল্য রতন। এক লোকের সাথে ধাক্কা লাগার মতো অবস্থা তৈরি হতেই ভুরু কুঁচকে নিলো সে। কপালে তৈরি হলো সূক্ষ্ম কয়েকটা ভাঁজ। দ্রুত পাশ পরিবর্তন করে হাঁটতে লাগলো। পেছন ঘুরে লোকটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। আবার সামনে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। নাকের ডগার ঘাম মুছে নিলো। দেখতে দেখতে চলে গেলো অপলক দৃষ্টির আড়ালে। ইতমিনান চোখ বন্ধ করলো। মালিহা হেঁটেই যাতায়াত করছে। সে খেয়াল করলো তার মনের অস্থিরতাটুকু আর নেই। ইতমিনান জানে এই ক্ষণিকের স্বস্তি তাকে নিয়ে ফেলবে জটিল অস্থিরতার সাগরে। নিজেকে সামলাতে চায় ইতমিনান। পারে না। মন যে লাগামছাড়া হয়েছে।

কাহিল ভঙ্গিতে গলি ছেড়ে বের হলো সে। বাড়ি ফিরতে মন চাইলো না। শূন্য ঘর ভাবনার রশি গড়িয়ে কোথায় ফেলবে কে জানে। ইতমিনান দেখতে শুনতে এই মিষ্টি ভাবনাকে ভয় পাচ্ছে। পালিয়ে থাকতে চাইছে তাদের থেকে, পারছে না। একবারের দুর্বল দৃষ্টি মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলো ইতমিনান। আহা! স্মৃতিটুকু যদি মুছে দেয়া যেতো। কষ্টের কালো ছাপ, নাকে রুধিরার তরল ধারা, শক্ত কণ্ঠে আত্মসম্মান..সবটুকু যদি ভুলে থাকা যেতো! সবটুকু!

নিজের অজান্তেই যে ইতমিনান কখন খাবার হোটেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি। মানুষের আনাগোনা একটু কম। এই বিকেলে কেই বা ভাত খেতে আসে। হোটেল বয় কাস্টমার পেয়ে যারপরনাই খুশি হলো। দ্রুত ইতমিনানের দিকে এগিয়ে এসে বলল, “টেবিল খালি হইসে। আসেন দুরুত কইরা বইসা পড়েন।”
ইতমিনান ছেলেটার খুশি কেড়ে নিতে চাইলো না। ক্ষুধার কোনো চিহ্ন পেটে না থাকলেও একটা খালি টেবিলে যেয়ে বসলো। এনার্জি বাল্ব জ্বলছে। যেনো সরাসরি চোখে এসে লাগছে। কিছু পোকা লাইটের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। ছেলেটা এসে গলার গামছা দিয়ে টেবিলের পানি মুছে দিলো। কিছু খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে ছিল। সেটাও মুছলো। ফের সেই গামছা গলায় ঝুলিয়ে বলল, “কি খাইবেন?”
“তোমাদের এখানে সবচেয়ে ভালো হয় কোনটা?”
ছেলেটা চকচকে চোখে বলল, “আমার তো ছুডু মাছের সালুন আর কলাইয়ের ডাইল বেশি স্বাদের লাগে।”
“আচ্ছা সেগুলোই আনো।”
ছেলেটা কিছুক্ষণের মাঝেই সব নিয়ে হাজির হলো। দোকানে তখন অবশিষ্ট খরিদ্দার বলতে শুধু ইতমিনানই আছে। বেশ গরম লাগছিলো তার। ছেলেটাকে বলল, “ঠান্ডা কিছু আছে?”
“আছে। কোকা কোলা আছে। দিমু?”
“না। ক্লেমন আছে?” মাথা নেড়ে বলল ইতমিনান।
“থাকার কতা। বন দেইখ্যা লই।”
যেমন চট করে গিয়েছিলো তেমন চট করেই ফিরে এলো ছেলেটা। হাতে ছোট একটা ক্লেমনের বোতল। তার গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি। ক্লান্ত নাকি বোতলটা?
“তুমি এখন কি করবে?”
“থাল বাসন ধুমু। আপনের কুনু দরকার হইলে ডাক দিয়েন। ওস্তাদ গ্যাছে বিড়ি খাইতে।”
ক্যাশ কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে ফাঁকা পেলো ইতমিনান। তার মানে কর্তা মহাশয় ছেলেটাকে বেশ বিশ্বাস করেন। সামনের চেয়ার দেখিয়ে ইতমিনান বলল, “একটু বসো। একা খেতে ভালো লাগে না।”
ছেলেটা অবাক হলেও বসলো। সম্ভবত এমন আদেশ কেউ তাকে কখনো করেনি। গলার গামছায় বুকের ঘাম মুছলো সে। ইতমিনান তার দিকে প্লেট এগিয়ে দিতেই ইবাকের চূড়ান্ত হলো ছেলেটা।
“কি হইলো?”
“খাও।”
“আমি খামু ক্যান? আপনে অডার দিসেন। আপনে না খাইবেন।”
“তোমার জন্যই দিয়েছি। তোমার পছন্দ শুনে নিলাম না?”
ছেলেটার বিস্মিত চোখে এবার সন্দেহ দেখা গেলো। কিশোর ছেলেটা শহরের নিয়ন বাতির নরম আলোর আড়ালের ঘৃণ্য দৃশ্য জানে। বাইরের চাকচিক্য তাই তাকে টানে না।
“আমি খামু ক্যান? খামু না। নিজে খাইবেন না তাইলে চাইলেন ক্যান? মশকরা করেন?” একটু শক্ত গলায় বলল সে। বেশি শক্ত হলে মুশকিল। ওস্তাদের কাছে খবর গেলে পেটে টান পড়তে সময় লাগবে না।
“আমি আসলে এখানে একা থাকি বুঝলে। বাবা মা সবাই গ্রামে। গল্প করার মতো মানুষ পাই না। তোমাকে দেখে মনে হলো গল্প করা যাবে। তাই বললাম। তোমার ভালো না লাগলে বাদ দাও।”
ইতমিনান দেখলো ছেলেটা গামছা ছেড়ে ভাতের মাঝে হাত ঢুকিয়েছে। প্রিয় ছোট মাছের সালুন দিয়ে ভাত মাখছে। চোখে তার লোভ।
ক্লেমনের মুখ খুলে এক ঢোক খেলো ইতমিনান।
“তোমার নাম কি?”
“মিন্টু।” ভাত ভর্তি মুখে উত্তর দিলো মিন্টু। দৃশ্যটা বড়ই বিদঘুটে দেখালো।
“বয়স কতো তোমার?”
“চইদ্দো।”
“এখানে কাজ করো কবে থেকে?”
“তিন বছর হইবো মনে হয়।”
“খাওয়া দাওয়া এখানেই করো?”
“হু।”
“স্কুলে যাও?”
“ইস্কুলে যাইয়া কি করুম? এই রাস্তায় সারাদিন ইদুর মা’রার বিষ ব্যাচে যেই ব্যাডা হ্যায় পড়ছে এইট পর্যন্ত। তয় হইসে কি? আকামের খাটনি। কাম করতাসি, খাওন পাইতাসি। আর কুনু চিন্তা নাই।”
“তোমার বাসায় কে কে আছে?”
“কেউ নাই। আইসি একা, রইসি একা, যামু একা।”
ঢকঢক করে পুরো পানির গ্লাস ফাঁকা করে ফেললো মিন্টু। ইতমিনানের সহসাই মানিকের কথা মনে পড়লো।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-১৬+১৭+১৮

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৬

এশার আযান দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। একদিন খুতবায় ইতমিনান শুনেছে, আযানের পর দোয়া করলে নাকি সেই দোয়া কবুল হয়। আজ খুব মনোযোগ দিয়ে আযান শুনে তারপর দোয়া করেছে সে। আর কিছুক্ষণ পর জামাআত শুরু হবে। ওযু করে ফোন হাতে নিলো ইতমিনান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন হাতে নিলো। বিড়বিড় করে বলল, “আল্লাহ প্লিজ!”
কল যাচ্ছে। অদ্ভুত এক শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর এক নারী কণ্ঠে শোনা গেলো “আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহপূর্বক কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন! ধন্যবাদ।”
ইতমিনানের কপালে ভাঁজ পড়লো। ইংরেজিতে একই জিনিস শোনার আগে কল কেঁটে দিলো সে। আবার কল দিলো। ইতমিনান ভেবে পায় না সবসময় নারী কণ্ঠই কেনো শোনা যায়। কোনো পুরুষ কি ওখানে কাজ করে না নাকি নারীদের জন্য জায়গাটা সংরক্ষিত? তার অদ্ভুত ইচ্ছা এই শব্দগুলো কোনো একদিন কোনো পুরুষ কণ্ঠে শুনবে। আচ্ছা, কেমন লাগবে? খুব বেশি অদ্ভুত?

এবার কল ঢুকলো। মায়ের স্নেহময়ী কণ্ঠে ইতমিনানের ধ্যান ভাঙলো।
“কেমন আছো আব্বা?”
“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ আব্বা। ভালো আছি। কি করো?”
“ওযু করে আসলাম। নামাজে যাবো। মা!”
“বলো আব্বা।”
ইতমিনানের বুকটা ঠান্ডা হয়ে যায় যখন আয়েশা তাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকেন। কেমন একটা স্নেহ মাখা পরশ আছে ডাকটায়।
ইতমিনান চেষ্টা করলো কণ্ঠ সর্বোচ্চ নরম করতে, “আমি তোমার কেমন ছেলে মা?”
আয়েশা হেসে ফেললেন, “তুই আমার বিয়ের বয়স হওয়া অবিবাহিত ছেলে।”
হেসে ফেললো ইতমিনান নিজেও।
“বলো মা।”
“তুই আমার বাধ্য ছেলে। কেনো? কি হয়েছে?”
“কিছুই হয়নি। শুনলাম আমার মা আমাকে কেমন ভাবে। মা তুমি অনুমতি দিলে একটা কথা বলব।”
“কি আশ্চর্য! অনুমতির কি আছে? বল।”
“আচ্ছা। আমি যা বলব তুমি আগে মন দিয়ে শুনবে। অপছন্দ হলে আগেই রাগ করবে না। আগে ভাববে। আমাকে প্রশ্ন করবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেবে। ঠিকাছে?”
আয়েশার মনটা খচখচ করতে লাগলো। কি এমন বলবে ইতমিনান?
“ঠিকাছে বল।”
“বলো তো রিজিকের মালিক কে?” ইতমিনান যেনো ছোট বাচ্চা। আয়েশার কাছে তাই মনে হলো।
“আল্লাহ। আবার কে।”
“ঠিক বলেছো। এখন আল্লাহ আমাদের যেই রিজিক দেবে তার বাইরে কিছু ভোগ করার সাধ্য তো আমাদের নেই। আবার যেটা আমাদের জন্য আল্লাহ বরাদ্দ করে রেখেছেন সেটা কেড়ে নেবে এমন সাধ্যও কারো নেই। তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমরা যদি স্বার্থপর চিন্তাভাবনা করে শুধুমাত্র নিজের সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করি, অন্যকে বিপদে ফেলতে দুইবার না ভাবি তাহলে কি আমাদের জন্য বরাদ্দ থাকা রিজিক বরকত থাকবে মা?”
“না। অন্যের কথা চিন্তা না করলে আল্লাহ আমাদের কথা চিন্তা করবে কেনো?”
“এটাই তো। আমার মা আমাকে ছোট থেকে অন্যের চিন্তা করতে শিখিয়েছে। নিজের সুযোগ সুবিধার আগে আরেকজনের সুবিধা দেখতে শিখিয়েছে। এখন সেই শিক্ষা আমি কি করে ভুলি বলো তো?”
ইতমিনানের সুরে সম্মান। মায়ের শিক্ষার প্রতি ভক্তি। আয়েশার ভালো লাগার সাথে সাথে কপালে ভাঁজ পড়ল।
“ভুলতে বলছে কে তোকে?”
“তোমরাই তো।”
“আমি কবে বললাম?”
“তুমিই তো বললে মালিহাদের চিন্তা না করে নিজেদের চিন্তা করতে।”
আয়েশা চুপ করে গেলেন। ইতমিনান আবার বলল, “জানো মা মালিহা সকালে প্রায় দুই আড়াই ঘণ্টা একটা কোচিংয়ে পড়ায়। তারপর ক্লাস করে। ক্লাস শেষ করে যে বিশ্রাম নেবে সেই সুযোগও নেই। বিকেলেও একটা টিউশনি করছে। সেটা আবার ওর ক্যাম্পাস থেকে অনেক দূরে। আমার অফিসের সামনে দিয়ে যায়। পুরোটা রাস্তা হেঁটে যায় হেঁটে আসে।” ইতমিনান চুপ করলো। কথাগুলো যেনো আয়েশার কর্ণকুহরে ভেদ করে সোজা বুকে যেয়ে লাগলো। ঐটুকুনি মেয়ে এতো কষ্ট করছে!
“কেনো?” হতবিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করলেন আয়েশা।
“ও তো চাচী আর মিতুলকে এখানে নিয়ে আসতে চায়। সেজন্য বাসা ভাড়া নিতে হবে না? একটা সংসার চালাতে গেলে কতো রকম খরচ আছে। তুমি তো জানোই।”
আয়েশার এবার বিরক্ত লাগলো, “আমি বুঝি না নিজের বাড়ি থাকতে কেনো অন্য জায়গায় যাওয়া লাগবে।”
“চাচী কিন্তু বাপের বাড়ি চলে গেছে মা।”
“ওর মাথায় ঘিলু আছে? ভাইয়ের বাড়ির মজা কয়দিন থাকবে? বুদ্ধি তো নেবে না। ভাববে তার ভালো আমরা দেখতে পারি না। তোর বাপ গিয়েছিলো না বোঝাতে? এক গাদা কথা শুনিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা মুখ শুকনো করে চলে গেল। আজকে বাড়ি এসেছিল। কি অবস্থা চেহারার!” শেষ কথায় যেনো মায়া ঝরে পড়ল। ইতমিনান স্বস্তি পেলো। সে জানতো তার মায়ের মনে মায়া আছে। সেটা যে কিসের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল সেটাই বুঝতে পারছিলো না।
“ঐ জন্যেই মনে হয় মালিহা ওদের নিয়ে আসতে চাচ্ছে। আচ্ছা মা এবার বলো তো আমি যে পুকুর আর ফসলি জমিটা ওদের দেয়ার কথা বলেছি সেটা তোমার কেনো অপছন্দ হয়েছে?”
আয়েশা চুপ করে রইলেন। এই মুহূর্তে আগের সেই রাগ বা ক্ষোভ কোনোটাই নেই। উল্টো মালিহা আর মিতুলের জন্য কেমন মায়া লাগছে।
“আমার আর মিলির অবস্থা যদি ওদের মতো হতো তাহলে তুমি কি বলতে বলো।”
“তুই তোর বাবার সাথে কথা বল। আর পুকুর ঐ মতিনের কাছে আর যেনো না রাখে। ব্যাটা এক নম্বরের চোর।”
ইতমিনানের ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। চকচক করে উঠলো পুরো চেহারা। মন চাইলো আয়েশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।
“মা তোমাকে তো এখন আমার জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে।” উৎফুল্ল স্বরে বলল ইতমিনান।
আয়েশা প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বললেন, “বাড়ি এসে যতক্ষন ইচ্ছা জড়িয়ে ধরে থাকিস। কবে আসবি বাপ?”
“জানিনা। কিন্তু তোমাকে একবার আমার এখানে নিয়ে আসবো। কেমন জায়গায় থাকি দেখে যাবা।”
আয়েশা সম্মতি জানালেন। ফোন রাখার পর তার মনে হলো বুকটা হালকা হয়ে গেছে। যেনো কোনো ভারী বোঝা সেখান থেকে নেমে গেছে।
ফোন রেখে মুখে হাত দিয়ে বসে রইলো ইতমিনান। চট করে উঠে ঘড়ির দিকে তাকালো। খাটের এক কোনায় রাখা টুপিটা মাথায় দিয়ে দ্রুত ঘর ছাড়লো। যে তার দোয়া এক বলাতেই কবুল করে নিয়েছে তাঁর দরবারে হাজিরা না দিয়ে কি থাকা যায়!

করিডোরের এই অংশটা কখনও ফাঁকা থাকে না। কেউ না কেউ সবসময়ই থাকে। কিন্তু এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির কারণে এখন জায়গাটা ফাঁকা। মালিহা চুপচাপ বসে ছিল। একা থাকলে রাজ্যের চিন্তা এসে মস্তিষ্কে মিছিল শুরু করে। একটার পর একটা চিন্তায় মালিহা যখন হাঁপিয়ে উঠলো তখনই তাকে কেউ ডাকলো।
“এই মালিহা! ভিজছো কেনো?”
মালিহা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। নাজিফা দাঁড়িয়ে আছে। নাজিফা অপজিট ব্লকে থাকে। এই করিডোর ব্লক দুটোর মাঝে যেনো একটা সেতুবন্ধন।
মালিহার উত্তর না পেয়ে নাজিফা এগিয়ে এসে তার কাছে দাঁড়ালো।
“ভিজছো কেনো মালিহা? জ্বর আসবে তো। এদিকে এসো।”
উঠে এলো মালিহা। না করতে ইচ্ছা করলো না তার। কেউ এমন যত্ন নিয়ে ডাকলে কি তার ডাক উপেক্ষা করা যায়?
“তোমার কি মনে খারাপ মালিহা?”
“নাহ।” মালিহা মলিন হাসলো।
“আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ।”
“তেমন কিছু না। বাবার কথা মনে পড়ছিল।”
নাজিফার মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো। মালিহার হাত ধরে বলল, “এই দুঃখের কোনো স্বান্তনা হয় না মালিহা। তবে তুমি চাইলে আমি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি।”
“বলো।”
“আংকেলের জন্য তোমার মনে যেই ভালোবাসা সেই ভালোবাসা কিন্তু অন্য কারো মনে এভাবে নেই। প্রত্যেকটা সম্পর্কের দাবি আলাদা। সেই দাবি থেকে ভালবাসাগুলোও ভিন্ন রকম হয়। কিন্তু আমরা বোকা এই নির্মল ভালোবাসার অনুভূতিকে পেছনে ফেলে ভাড়া করা অনুভূতি কাজে লাগাই।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল। বিষয়টা যে তার কাছে স্পষ্ট না সেটা বুঝতে পারল নাজিফা।
“আংকেলের মৃ’ত্যুর পর নিশ্চয়ই খাওয়া দাওয়া হয়েছে?”
“হ্যাঁ তিন দিনের দিন মিলাদ হয়েছে।”
“দোয়া হয়েছে না?”
“হ্যাঁ।”
“অথচ দেখো ওদের মনে কি আংকেলের জন্য এমন আবেগ আছে? ওদের দোয়ার গভীরতা শুধু বাঁধা ধরা কিছু কথার মাঝেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তোমারটা? এটা একদম খাঁটি।”
মালিহা চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল, “তাহলে আমি কি করবো?”
“শেষরাতে আল্লাহ অপেক্ষা করেন জানো? কে তাঁকে ডাকবে সেই অপেক্ষা। তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন তাঁর বান্দা তাঁর কাছে কি চাইবে। তিনি কবুল করে নেবেন। সেই সময়ে তোমার কষ্ট, ভালোবাসা, আবেগ সবটা তাঁর দরবারে হাজির করে তুমি আংকেলের হয়ে ক্ষমা চাইবে। তার কবর জীবনটা যেনো কষ্টদায়ক না হয় সেই আকুতি করবে। আংকেলের জন্য এভাবে আর কে দোয়া করবে বলো? তোমরাই তো তার শেষ সম্বল।”

মালিহার মনটা যেনো কেঁদে উঠলো। নিজের জন্য তার বাবার আর কিছুই করার নেই। কিচ্ছু না!
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর নাজিফা বলল, “ট্যুরে যাচ্ছো না?”
মালিহা গলা খাঁকারি দিলো, “নাহ। তুমি?”
“আমিও যাবো না। নীতি যাবে?”
“না। আমি বলেছিলাম যেতে। আমাকে ছাড়া যাবে না।” মালিহা হাসলো। বন্ধুর অকারণ জেদে খুশির হাসি।
“তাহলে ঐদিন দুপুরে আমার সাথে খাবে। ঠিকাছে? আমি স্পেশাল খিচুড়ি খাওয়াবো তোমাদের। না করবে না মালিহা।”
নাজিফা উৎফুল্ল হয়ে বলল। মালিহা ইতস্তত করলো। ঐদিন যে নীতিকে ফ্রাইড রাইস খাওয়াতে চেয়েছে। কিন্তু নাজিফা কখনও বলে না। তাকে নিষেধ করাটা কেমন দেখায়। অনেকক্ষণ ভেবে-টেবে বলল, “আচ্ছা ঠিকাছে।”
নাজিফা খুশি হলো, “ইনশাআল্লাহ!”

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৭

নীতি পড়ছিল। মালিহা পেছন থেকে কতক্ষন উঁকিঝুঁকি দিলো। মনিকা ঘুমাচ্ছে। একটু পরে উঠে পুরো রাত জাগবে। আঁখি রুমে নেই। সম্ভবত নিচ তলায় গেছে।
“কি সমস্যা? উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিস কেনো?”
মালিহা থতমত খেয়ে গেল, “কয়টা চোখ তোর?”
“উপরের দুটোই তো শুধু দেখো। অন্তরের চোখের কি খবর রাখো হে বালিকা!” নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল নীতি। মালিহা ধপ করে নীতির বিছানায় বসে পড়ল। তার মুখে অন্ধকার। নীতি ভুরু কুঁচকে বলল, “কাহিনী কি? ফটাফট ঝেড়ে কাশ।”
“নীতি!”
“বলো সোনা!”
মালিহা বিরক্ত হলো। এই মেয়েটা কখনও সিরিয়াস হবে না।
“তোকে ট্যুরের দিন ফ্রাইড রাইস খাওয়াতে চেয়েছিলাম না?”
“প্ল্যান ক্যানসেল করলে তোর সাথে আমার দুই মিনিটের ব্রেকাপ মালিহা!” আঙুল তুলে শাসালো নীতি। নীতির আঙুল মুঠোয় পুরে মালিহা বলল, “আগে শুনবি তো! নাজিফা ঐদিন দুপুরে আমাদের দুজনকে দাওয়াত দিয়েছে।”
“হঠাৎ?”
“ট্যুরে তো নাজিফাও যাবে না। তাই বলল। আর তাছাড়া ও কখনও বলে না। এমন করে ধরলো যে না করতে পারলাম না। তোকে পরের শুক্রবার ফ্রাইড রাইস খাওয়াবো দোস্ত ইনশাআল্লাহ। পাক্কা প্রমিস!”
মালিহার চেহারার দিকে তাকিয়ে নীতি বলল, “এতো করে বলছিস তাই মেনে নিলাম। আমার আবার দয়ার শরীর।”
মালিহা হাসলো। “ঘুমিয়ে গেলাম।”
নীতি অবাক হয়ে বলল, “এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাবি! মাত্র বাজে সাড়ে দশটা।”
“সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠবো। তাই।”
“আচ্ছা। আমাকে ফজরের সময় একটু ডেকে দিস তো। পরপর চারদিন ফজর কাজা হয়ে গেসে। ভাবতেই অশান্তি লাগসে। ম’রার ঘুম!”
“আচ্ছা ডাকব ইনশাআল্লাহ।”

বেডের চার কোণায় চারটা স্ট্যান্ড। ছোট্ট মশারিটা একেবারে খাপে খাপ মিলে যায়। ভেতরে ঢুকে মশারির চারপাশে গুঁজে নিজের লাইট বন্ধ করলো মালিহা। বালিশে মাথা রাখলো। সাথে সাথেই মনিকার পার্সোনাল লাইটটা জ্বে’লে উঠলো। প্রত্যেকের বেডের কোণায় টেবিলের উপর একটা করে পার্সোনাল রিডিং লাইট। রুমের মাঝ বরাবর একটা বড় রড লাইট। তবে রিডিং লাইটের আলো মেইন লাইটের চেয়ে কিছু কম নয়। মনিকার বেড মালিহার কোনাকুনি। কাজেই লাইট জ্বা’লালে সেটা সরাসরি মালিহার বিছানায় এসে পড়ে। সেই লাইটের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বুকের ওড়না মুখে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মালিহা। পৃথিবীটা এমনই। কারো জীবনে অন্ধকার তো কারো জীবন আলোয় ভরপুর।

°
চারদিকে শুনশান নীরবতা। হলের কিছু ঘরে তখনও বাতি জ্ব’লছে। তবে তেমন সাড়াশব্দ নেই। সারাদিনের ক্লান্তি মাখা শরীর বিশ্রামের কাঁথা গায়ে জড়িয়ে রাতের কোলে ঘুমুচ্ছে। মনিকা ঘুমে বিভোর । তার মাথার কাছের জানালা খোলা। সেই জানালা গলিয়ে হলদেটে নরম আলো ঢুকে পড়ছে ছাত্রী হলের দোতলার এক রুমে। বাহিরে জোৎস্নার ফিনিক ফুটেছে। সম্ভবত চন্দ্র মাসের চৌদ্দ অথবা পনেরো তারিখ। চাঁদ তার পূর্ণযৌবনা রূপ দিয়ে পৃথীবির সকল প্রাণকে সম্মোহিত করে চলেছে। সম্মোহিত প্রাণীরা সেই সৌন্দর্যে বশীভূত হয়ে ভুলে গেছে চাঁদেরও কলঙ্ক আছে।

ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের অস্পষ্ট শব্দ মাড়িয়ে নতুন একটা শব্দ হলো। “বিপ বিপ।” এদিক ওদিক হাতড়ে বালিশের নিচে মোবাইলটা খুঁজে পেলো মালিহা। এক ক্লিকে বন্ধ করে দিলো নতুন সেট করা অ্যালার্ম। উঠে বসে কতক্ষন ঝিম ধরে রইলো। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। কানের কাছ দিয়ে একটা মশা চলে যেতেই ঘুমটা পাতলা হয়ে গেলো। চোখ টেনেটুনে দেখলো মশারি নিজেকে তোশকের ভার থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে ঝুলছে। হাত দিয়ে মশাটা তাড়িয়ে দিতে চাইলো মালিহা। মশারির স্বাধীনতায় তার সুখের সমাপ্তি। বিছানা থেকে নেমে সন্তর্পনে দরজার ছিটকিনি খুললো। দরজার সাথেই তার বিছানা। অপর দিকে নীতি। সেও গভীর ঘুমে মগ্ন। বারান্দায় যেতেই জোৎস্নার মোলায়েম রোশনাই তার শরীর ছুঁয়ে দিলো। নিজের হাত উঠিয়ে দেখলো মালিহা। কি অদ্ভুত! দিনে সূর্যের যেই আলো শরীর টাটিয়ে দেয় সেই একই আলো চাঁদ নিয়ে উষ্ণতা ছড়ায়। মোলায়েম উষ্ণতা। ওয়াশরুমের দিকে গেলো মালিহা। এই রাতে কষ্ট করে ওঠার লক্ষ্য পূরণের পালা।

পুরো একটা মানব সমাজ যখন মগ্ন ঘুমে, বিভোর কোনো এক সুখ স্বপ্নে ঠিক সেই সময় মুখে বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে জায়নামাজে দাঁড়ালো মালিহা। নাজিফা বলেছিলো আল্লাহ এই সময় অপেক্ষা করেন। তার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। আল্লাহ তার জন্য অপেক্ষা করছেন! কি আশ্চর্য!
তখনও রাত জাগ্রত, সাক্ষী আকাশের তারা। চাঁদ প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদায় জানানোর। ঠিক সেসময় মাটির বুকে মাথা রেখে আসমানে চিঠি পাঠালো মালিহা। ছোট্ট একটা চিঠি।
“আমার জীবনে জোৎস্নার মতো মোলায়েম উষ্ণতা দান কারো ইয়া রব!”

ইতমিনান এই কুকুরটাকে এখানে আসার পর থেকেই লক্ষ্য করছে। লক্ষ্য করার বিশেষ কারণও অবশ্য আছে। কুকুরের চেহারায় বিশেষ কিছু নেই। তবে কুকুরটা যেনো ইতমিনানকে ফলো করে। ভোর সকালে উঠে সে যখন মসজিদের দিকে যায় তখন পিছু পিছু কুকুরটাও যায়। প্রথম কয়েকদিন ইতমিনান বিষয়টা ধরতে পারেনি। একদিন খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো। কিন্তু কুকুরের এই আচরণের রহস্য কি? ইতমিনান কুকুরের সাইকোলজি জানে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একবার পাখির সাইকোলজি জানার ঝোঁক উঠলো। লাইব্রেরি থেকে ম্যাগাজিন। কিছুই বাদ রাখেনি সে। সেই হিসেবে পাখি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকলেও কুকুর বিষয়ে সে অজ্ঞ। রাস্তায় রাতে চলে কিছু রিকশা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এছাড়া শহর এখনও ঘুমন্ত। শুধু জেগেছে মুয়াজ্জিন। ইতমিনান আড়চোখে কুকুরটাকে একবার দেখলো। কেমন হেলেদুলে তার পিছু পিছু আসছে।
কি মনে হতেই মসজিদের সামনে এসে আর না এগিয়ে বিপরীত রাস্তায় গেলো ইতমিনান। কুকুরটা মনে হলো বিভ্রান্ত হয়ে গেলো। মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে লাগলো। একবার মসজিদের দিকে তাকায় তো একবার ইতমিনানের দিকে। ইতমিনান বুঝে গেলো এই কুকুর তার গন্তব্য জানে। ফিরতি পথ ধরে মসজিদের ভেতর ঢুকলে কুকুরটা তার দিকে তাকিয়ে ঘেউ করে উঠলো। ইতমিনানের মনে হলো কুকুরটা বলছে, “আমাকে এভাবে বিভ্রান্ত করার মানে কি?”
“তুমি কি কোনো গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য?” ভুরু কুচকে বলল ইতমিনান। তার কন্ঠ গম্ভীর। কুকুর আবার শব্দ করলো, “ঘেউ!” ইতমিনান আশপাশে দেখে মসজিদের ভেতরে ঢুকে গেলো। কেউ এভাবে কথা বলতে দেখলে সমস্যা। তখন মসজিদের বদলে হেমায়েতপুরে যেতে হবে।

°

নামাজ শেষে বের হয়ে ইতমিনান দেখলো কুকুরটা তখনও রাস্তায় বসে আছে। ইতমিনান খেয়াল করলো ঠিক তার জুতো বরাবর সামনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আছে কুকুরটা। পাহারা দিচ্ছে নাকি? ইতমিনান জুতো পড়ে সামনের চায়ের দোকানে গেলো। এই স্নিগ্ধ সকালে এক কাপ চা খেলে মন্দ হয় না। ইতমিনান দেখলো কুকুরটা লেজ নাড়িয়ে তার পিছু পিছু আসছে।
একটা দুধ চা দিতে বলে পুরোনো কালচে পড়া একটা বেঞ্চে বসলো ইতমিনান। কুকুরটা তার পাশেই বসেছে। জিহ্বা বের করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চা নিয়ে কুকুরটার দিকে তাকালো ইতমিনান। কেমন করে তাকিয়ে আছে দেখো! লোভী কুকুর! মুখ ঘুরিয়ে চায়ে চুমুক দিলো সে। এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায় নাকি। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো কুকুরটা এখনও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এ তো মহা জ্বা’লা!
“চাচা একটা পাউরুটি দিন।”
চায়ের সাথে পোড়া পাউরুটি অনেকের প্রিয় খাবার। দোকানী বলল, “পোড়ায়া দিমু?”
“না। এমনিই দিন।”
বেশ বড় গোলগাল একটা পাউরুটি নিলো ইতমিনান। কুকুরটার সামনে হাতে পাউরুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
“চাচা পাউরুটি কি কুকুরের লিগা?”
ইতস্তত করে ইতমিনান বলল, “জি চাচা।”
“তাইলে সামনে দিয়া দেন। খাড়ায়া রইলেন ক্যান?”
ইতমিনানের কাছে বিষয়টা ভালো লাগলো না। বলল, “পেপার আছে চাচা? ছোট একটা টুকরা দিন তো।”
“কুকুরে খাইবো। হ্যার কি আর এইসবের চিন্তা আছে নি?” হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ দিলো দোকানী। ইতমিনান কিছু বলল না। কাগজের উপর পাউরুটি রেখে কুকুরটার সামনে দিলো। দোকানে থাকা আরেকজন বয়স্ক লোক বলল, “মানুষের মন বুঝো? ইনি কাগজে পাউরুটি দেয়। আরেকজন গরম চা গায়ে ঢাইলা দিব। দুনিয়া বড়ই আজব জায়গা হে!”
কুকুরটা একবার ইতমিনানের মুখের দিকে তাকিয়ে পাউরুটির দিকে তাকালো। পরপরই “ঘেউ ঘেউ” করে উঠলো। ইতমিনান কুকুরের ভাষা জানে না। না জানে প্রতিক্রিয়ার অর্থ। তবে তার মনে হলো কুকুরের চোখটা চিকচিক করছে। রোদ উঠলো নাকি?

নামাজ পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল মালিহা। মুয়াজ্জিনের আযান শুনে তারপর ঘরে ঢুকেছে। নীতিকে ডেকে নামাজ পড়েছে। হু হা করে নীতি আবার ঘুমিয়ে গেলে আবার ডেকেছে মালিহা। এক পর্যায়ে নীতি উঠেছে। বই খাতা নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো মালিহা। খোলা জায়গাটায় বসে পড়তে শুরু করলো। ভোর শেষ হলো। সূর্য উঠলো। দিনের কুসুমের মতো সুরজ যখন দাপট দিয়ে আলো ছড়াতে শুরু করলো তখন ঘরে এলো মালিহা। ফোন হাতে নিতেই দেখলো তখন মাত্র সাড়ে ছয়টা। অবাক হলো সে। কতো কাজ করলো। মাত্র সাড়ে ছয়টা বাজে! হেলেদুলে কোচিংয়ে যাওয়া যাবে। বোরখা টোরখা পড়ে হল থেকে বের হলো। মনটা কেমন ফুরফুরে লাগছে। মনে হচ্ছে ডানা থাকলে প্রজাপতির মতো একটু উড়ে বেড়াতো।

সাতটা বাজার দশ মিনিট আগেই কোচিংয়ে ঢুকলো মালিহা। সেখানকার পরিবেশ তখন থমথমে। তুষারের মুখের দিকে তাকিয়ে মালিহার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই।

স্কুলের জন্য বের হওয়ার আগে মামার মুখোমুখি হলো মিতুল। মামার মুখে তখন স্বভাবসুলভ হাসিটা নেই। মিতুলের মনে হলো কোনো কারণে মামার মন খারাপ।
“তুমি নাকি কোথায় কাজ নিসো?”
মিতুল বুঝলো প্রশ্নটা তাকেই করা হয়েছে।
“জি মামা।”
“এটা কেমন কথা মিতুল? আমার বাড়ি থেকে তোমার কাজ করা লাগবে কেনো?” মামার মুখ থমথম করছে। মুখের ভাত গিলে মিতুল বলল, “তেমন কিছু না মামা। বাড়ি থাকলে তো খেলাধুলা করতে পারতাম। এখানে তো বন্ধু বান্ধব নাই। ঘরে সারাদিন ভালো লাগে না। তাই ভাবলাম বসে না থেকে কিছু করি। আপনি কষ্ট পেয়েছেন মামা? তাহলে আমি আর যাবো না।”
সাইফের প্লেটে ডিম ভাজা তুলে দিয়ে স্বামীর কনুইয়ে গুতো দিলেন সাইফের মা। ভদ্রলোক তাকাতেই চোখ রাঙালেন। মিতুল হাসি লুকিয়ে পানি খেলো। মামা আমতা আমতা করে বললেন, “তোমার যদি ভালো লাগে তাহলে আমি কষ্ট পাবো কেনো। তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি।”
মিতুল মাথা নাড়িয়ে উঠে পড়ল। হাত ধুয়ে মায়ের আঁচলে মুছে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “তোমার ভাই এতো ভালো কেন মা?” মিতুলের ঠোঁটের কোণায় তখন খেলা করছে ছোট্ট একটা হাসি।”

চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৮

নিতু থমথমে মুখে ক্লাস নিচ্ছে। তার সাথে আছে মালিহা। এক সপ্তাহের জন্য নিতুর সাথে সাথে তাকে থাকতে হবে। কিছুটা ট্রেনিংয়ের মতো। তারপর মালিহা ক্লাস নিতে পারবে। আপাতত অন্য ক্লাস যেনো খালি না হয় সেজন্য তুষার ক্লাস নিচ্ছে।
নিতু অকারণ ধমকাধমকি করছে। মালিহার কাছে অন্তত তাই মনে হলো। তারা এখন ক্লাস সেভেনে। সেভেনের বাচ্চারা নিশ্চয়ই অনার্স পড়ুয়া ছাত্রদের মতো ব্যবহার করবে না? কিন্তু নিতু তাদের থেকে তেমন ব্যবহার আশা করছে। আশা ভঙ্গ হওয়ার দরুন তার মেজাজ চটে গেছে। মালিহা বুঝতে পারছে না এটা নিতুর নিত্যকার স্বভাব নাকি আজই সে এমন করছে। বাচ্চাগুলো দিকে তাকিয়ে তার মায়া হলো। ভয়ে সবাই শুকনো মুখে বসে আছে। না বুঝলে যে প্রশ্ন করবে সেটাও পারছে না।
ক্লাস শেষ করে নিতু আগে আগে বের হয়ে গেলো। সে যেতেই ছেলেমেয়েরা ফিসফিস করে শুরু করে দিলো। সেটা ক্রমান্বয়ে চেঁচামেচিতে পরিণত হলো। এর মাঝেই কয়েকজন ছেলের কথা শুনল মালিহা। বিস্ময়ে, লজ্জায়, অপমানে তার কান বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। নিতু একটা টাইট জিন্স এবং হাঁটু অবধি লম্বা শার্ট পড়েছিল। ক্লাসে মেজাজ দেখানোর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিছু ছেলে নিতুর ড্রেসআপ নিয়ে কথা বলছে। তাদের পাস করা কমেন্টগুলো পোশাক থেকে দেহ পর্যন্ত যেয়ে যখন সীমারেখার সীমানা ছাড়িয়ে গেলো তখন বোর্ড মোছা ডাস্টার দিয়ে টেবিলের উপর জোরে শব্দ করলো মালিহা। হঠাৎ এমন শব্দে পুরো ক্লাস থমকে গেলো। মালিহা অগ্নিচোখে সেই ছেলেদের দলটার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই হনহন করে ক্লাস থেকে বের করে গেলো।

অপমানে মালিহার গলা বুঝে এলো। নারীদেহের অপমান কি তার অপমান নয়? কতটুকুই বা বয়স এই ছেলেগুলোর? বড়জোর তের চৌদ্দ। এর মাঝেই এমন মানসিকতা কিভাবে তৈরি হলো তাদের? হঠাৎ করেই ভয় পেলো মালিহা। মিতুলও কি এমন চিন্তাধারা নিয়ে বেড়ে উঠছে। কে রাখে তার খোঁজ?

°

অফিসরুমে আসতেই তুষার তাকে ইশারায় বসতে বলল। নিতু তার পাশের চেয়ারে। হঠাৎ করেই টেবিলে চাপড় মে’রে ক্ষুব্ধ কন্ঠে নিতু বলল, “তোর এই থার্ড ক্লাস কোচিংয়ে আমি আর থাকবো না।”
অভিজ্ঞ শিক্ষক হারানোর স্পষ্ট হুমকি। তুষারের ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও তার মুখ দেখে মনে হলো না সেখানে ভয়ের ছিটেফোঁটা আছে। একপেশে হাসি হেসে সে বলল, “কেনো ফার্স্ট ক্লাস কোচিংয়ে অফার পেয়েছিস নাকি?”
“আমার সাথে একদম ফাজলামি করবি না তুষারের বাচ্চা!”
“আহা! বউ বাচ্চা তুলে কথা বলবি না নিতু। ইট হার্টস!” বুকে হাত দিয়ে আহত স্বরে বলল তুষার। মালিহা অবাক হলো। তুষার বিবাহিত?
মালিহার দিকে আঙুল তাক করে নিতু বলল, “ওকে এখানে ডেকেছিস কেনো? ওর সামনে আমাকে অপমান করবি এজন্য? মজা নিচ্ছিস? তোর ঐ তিন আঙুল টিচারের পিন্ডি চটকে আমি ভর্তা বানাবো।”
“একজন শিক্ষিকার মুখে এ কেমন ভাষা হে বিধাতা!” উপরের দিকে তাকিয়ে বলল তুষার। নিতুর ধৈর্যের বাঁধ যেনো ভেঙে গেলো, “বেয়াদব! আজকেই এখানে আমার শেষ দিন। এরপর যদি আমাকে এখানে দেখিস নিজের নাম আমি পাল্টে ফেলবো।” ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো নিতু। হঠাৎ করেই যেন ঝড় থেমে গেলো। মালিহা অবাক হয়ে তখনও দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তুষার তুড়ি দিলো, “হেই মালিহা!”
চটপট সামনে তাকালো মালিহা। তুষারের মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেশ।
“এসব নরমাল বুঝলে? যতো তাড়াতাড়ি অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারবে ততোই ভালো।”
মালিহা বলল, “কোনো সমস্যা ভাইয়া? আপু এভাবে রিয়্যাক্ট করলো..”
“সমস্যা? তা একটু আছে বলতে পারো। নিতুর ক্লাস নেয়ার কিছু স্টাইল স্টুডেন্টদের পছন্দ না। ও পড়িয়ে টপিক ক্লিয়ার করে দিত পারে। এবং সেটা দারুণভাবে। কিন্তু কখনও কোনো কোয়েশ্চেন নিতে চায় না।”
“কিন্তু কোয়েশ্চেন না করলে ছেলেমেয়েরা বুঝবে কিভাবে?” মালিহা অবাক হয়ে বলল।
“ঐ যে বললাম ও দারুণভাবে টপিক ক্লিয়ার করে দেয়। ওর নিজের ওপর এতোই কনফিডেন্ট যে ওর মনেই হয় না এরপরও কারো প্রশ্ন থাকতে পারে। কেউ যদি কোনো প্রশ্ন করেও ফেলে তাহলে ওর ইগো হার্ট হয়। একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা করে। আজকে সকালে টুটুল এসে বলল এভাবে চলতে থাকল স্টুডেন্ট কমতে বেশিদিন লাগবে না, কোচিংয়ের দুর্নাম হবে ব্লা ব্লা। এসব শুনেই নিতুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।” বড় করে দম নিলো তুষার।
“কিন্তু এটা তো সলিউশন হলো না। আপু এক্সপেরিয়েন্সড একজন। তার তো বোঝার কথা।”
“বোঝার কথা থাকলেও বোঝে না। যাক ও যাওয়াতে আজ একটা সুবিধা হলো। তোমাকে আজ আর ওর পিছু পিছু ঘুরতে হবে না। নিজের মতো করে পরের ক্লাসগুলো নিয়ে নাও।”
“কিন্তু আপু যে বললেন আর আসবেন না।” ইতস্তত করে বলল মালিহা। তুষার হেসে বলল, “ওটা তোমার আপু মাসের ভেতর চার পাঁচবার বলে। যখন ছুটি দরকার তখন নিজেই একটা ক্যাচাল লাগিয়ে নেয়। তারপর দুই তিনদিনের জন্য হাওয়া। অবশ্য এবার দুই তিনদিন থাকবে না। আমার অ্যাজাম্পশান বলে ও কাল সকলেই চলে আসবে। কারণ এতদিন লেডি টিচার হিসেবে ও একাই ছিলো। এবার তুমিও যোগ হয়েছ। কাজেই নিজের পজিশন টিকিয়ে রাখতে হলে নিতুকে আসতেই হবে। She is a tough girl, you know!” কথা শেষ করেই চোখ টিপ দিলো তুষার। মালিহা বিব্রত হলো। চোখ নামিয়ে আশপাশে তাকালো মালিহা। তুষার অপলক মালিহার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার এই নজর লুকানোটা মারাত্মক!”
চট করে তুষারের দিকে তাকালো মালিহা। তার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। তুষার তড়িঘড়ি করে বলল, “মাইন্ড করলে নাকি? আমি তো জানি ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েটা ফ্রি মাইন্ডের হয়। এটুকুতে রাগ করার কথা না। অন্তত আমার আশপাশের মেয়েদের দেখে এটাই মনে হয়।”
মালিহা শক্ত গলায় বলল, “সবাই এক না।” পরপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “নেক্সট ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। আমি উঠছি।”
মালিহার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলো তুষার। টেবিলের ওপর হাত রেখে সেখানে গাল ঠেকিয়ে রাখলো।

অফিসে এসে ঝামেলায় করে গেছে ইতমিনান। তার ওয়ালেট পকেটে নেই। কিছু খুচরা টাকা পকেটে ছিল বলে রিকশা ভাড়া দিতে পেরেছে। নয়তো রাস্তায় মান সম্মান যেতো। কিন্তু অফিস গেটে এসে ঝামেলায় পড়েছে। আইডি কার্ড ওয়ালেটে ছিলো। সেটা মনিটরের সামনে শো না করলে অ্যাবসেন্ট দেখাবে। বাড়ির পথ ধরে যে ফেরত যাবে সেই উপায়ও নেই। অফিস টাইম শুরু হয়ে গেছে। এখন বের হলে সমস্যা। আবার ওয়ালেট পাওয়া যাবে কি না তাও নিশ্চিত না। হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো ইতমিনান।
ম্যানেজার লোকটি ইতমিনানকে লক্ষ্য করছিলেন। কাছে এসে বললেন, “কি ব্যাপার ইতমিনান সাহেব? কোনো সমস্যা?”
ইতমিনান ইতস্তত করে বলল, “ওয়ালেটটা সম্ভবত হারিয়ে ফেলেছি স্যার। খুঁজে পাচ্ছি না।”
“ভেরি স্যাড! এখানে কি ওয়ালেট খুঁজছেন?”
“না স্যার। আমার আইডি কার্ড ওয়ালেটে ছিলো। অ্যাটেনডেন্স দেয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। তখন খেয়াল করলাম ওয়ালেট নেই।”
“ওহ। তাহলে তো সমস্যা হয়ে গেলো। কি করবেন এখন?”
“কোথাও পড়ে গেলেও তো এতক্ষণে কারো হাতে চলে গেছে। এখন ফেরত যাওয়া বোকামি হবে। আজ অফিস শেষে নতুন আইডি কার্ডের জন্য অ্যাপ্লিকেশন করে যাবো।”
ম্যানেজার লোকটা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। ইতমিনান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ওয়ালেটে তিন হাজার টাকা ছিল। আরো কিছু খুচরা। সব গেলো। হঠাৎ মনে হলো এনআইডি কার্ডের অরিজিনাল কপিও ওখানেই ছিলো। মুখটা তেতো হয়ে এলো ইতমিনানের। নতুন করে এই কার্ড বানাতে গেলে এখন ঝামেলার এক শেষ হবে। উফফ!

অফিস শেষে বের হওয়ার আগে রেজিস্টার সেন্টারে গেলো ইতমিনান। আইডি কার্ডের জন্য অ্যাপ্লিকেশনের কথা বলতেই দায়িত্বরত লোকটা অবাক হয়ে বলল, “আপনার কার্ডের কি হয়েছে স্যার?”
“আজ সকালে ওয়ালেট হারিয়ে গেছে। তার সাথে ওটাও গেছে।”
“তাহলে আজ আপনি অ্যাটেনডেন্স দিলেন কিভাবে?”
“দিইনি তো।”
“কিন্তু এখানে যে আপনার অ্যাটেনডেন্স শো করছে।”
কম্পিউটার মনিটরে একটা ফাইল ওপেন করলো লোকটা। ইতমিনান ঝুঁকে দেখলো আসলেও তাই। চিন্তিত হয়ে বলল, “কিভাবে হলো?” হঠাৎ তার কপালের ভাঁজ সমান হয়ে গেলো। এই বিষয়ে অফিসে শুধু ম্যানেজার সাহেব জানেন। এবং তার এখতিয়ার আছে অ্যাটেনডেন্স মনিটরিং করার। কোনভাবে কি তিনিই? ইতমিনান অবাক হলো। ম্যানেজার লোকটার হাবভাবে দেখে মনেই হয়নি তিনি ইতমিনানের কার্ড হারিয়ে যাওয়ায় ব্যথিত হয়েছেন। সাহায্য যে করতে পারেন এটা ইতমিনানের মাথায়ই আসেনি। কি আশ্চর্য না? একটা মানুষের কয়েক লাইনের কিছু কথা দিয়ে আমরা তার সমগ্র সত্ত্বাকে এমন কাতারে ফেলে দিই যার সাথে সেই মানুষটার যোজন যোজনের দূরত্ব।
“আপনি একটা কার্ড ইস্যু করে দিন ভাই।”
লোকটা অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম দিতেই ইতমিনান চটপট সেটা পূরণ করে ফেলল। মনটা শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ছে। মানুষের ভেতরটা পড়া কি কঠিন!

অফিস থেকে বের হতেই ইতমিনানের নিজেকে হিমু মনে হলো। কোনো টাকা পয়সা নেই। এমনকি ওয়ালেটও নেই। পরক্ষণেই মত পাল্টালো সে। হিমুদের পঞ্জাবীতে পকেট থাকে না, পায়ে জুতা থাকে না। তার প্যান্টে দুটো পকেট, শার্টে একটা বুকপকেট, পায়ে পালিশ করা কুচকুচে কালো শু। হিমু হওয়ার প্রাথমিক ধাপেই সে অসফল।
এবার নিজেকে উদাস সন্ন্যাসী ভাবলো ইতমিনান। টাকা পয়সা জীবনের সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ জিনিস। সেই ঝামেলা থেকে সে ভারমুক্ত। আহা! ভারহীন জীবনের সে কি স্বাদ! সন্ন্যাসী অনুভূতির মাঝেই মালিহার কথা মনে হলো। এখন তো সে টিউশনিতে। যাবে নাকি একবার? বাড়ি তো তার চেনাই। পরক্ষণেই সেই ভাবনাও ঘুচে গেলো। টাকা নেই, পয়সা নেই মালিহার কাছে যেয়ে করবে কি? তাকে রিকশায় উঠিয়ে নিয়েও আসতে পারবে না। গন্তব্যহীন পথিকের মতো হাঁটতে লাগলো সে। এদিক ওদিক অচেনা জায়গাগুলো ঘুরে দেখলো। মাগরিবের আযান দিলে কাছের একটা মসজিদে ঢুকে পড়ল।

ইতমিনান যখন বাড়ি ফিরল তখন অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। বাড়ির সামনে আসতেই অবাক হলো সে। কুকুরটা বসে আছে। ও কি নাইট ডিউটি করবে বলে মনস্থির করেছে?
কুকুরটার কাছে পৌঁছুতেই সে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। সেই শব্দ শুনে কোত্থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এলো। ইতমিনান অনুমান করলো নয় অথবা দশ বছর বয়স। পড়নে শুধু ময়লা, ছেড়া একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। ঊর্ধ্বাংশ উদাম। সেখানে জ্বলজ্বল করছে চামড়ার সাথে লেপ্টে থাকা বুকের খাঁচা।
“আপনে কে?”
ইতমিনান থতমত খেলো। এই প্রশ্ন তার করার কথা না? ইতমিনানের নীরবতায় ছেলেটা যেনো বিরক্ত হলো। সহসাই রোদপোড়া চেহারাটা কুঁচকে গেলো।
“এইডারে চিনেন?” কুকুরের দিকে ইশারা করে বলল ছেলেটা।
“চিনি। এটা তোমার কুকুর?”
ছেলেটা গম্ভীর হয়ে বলল, “জানিনা, কেউ দলিল কইরা দেয় নাই।”
“কুকুর দলিল করে দিতে হয়?” ইতনিনান হাসলো।
“কইতে পারি না। এই বাড়িতে আপনে থাকেন?”
সামনের বাড়ির দিকে ইশারা করলো ছেলেটা।
“হ্যাঁ।”
“কয় তলায়?”
“নিচ তলায়। কেনো বলো তো?”
ছেলেটা শক্ত গলায় বলল, “আপনার অতি মূল্যবান এক জিনিস আমার কাছে আছে। বলেন সেইটা কি।”
“আমার মূল্যবান জিনিস তোমার কাছে যাবে কিভাবে?”
“রাস্তায় ফালায় রাখলে যে কারুর কাছেই যাইতে পারে।” ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বলল।
ইতমিনান বিস্মিত হয়ে বলল, “ওয়ালেট!”
পকেট থেকে ইতমিনানের ওয়ালেট বের করে ছেলেটা বলল, “আপনের মানিব্যাগ পাইসে এই কুত্তায়। সেই সকাল থিকা নিজে বইসা রইসে আমারেও বসায়া রাখসে।” ধপ করে কুকুরের গা ঘেষে বসে পড়ল ছেলেটা। ইতমিনানের দিকে ওয়ালেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তিন হাজার দুইশ পনের ট্যাকা আছিলো। পনের ট্যাকা দিয়া আমি আর অয় খাইসি। আপনে কুন সুমায় আইবেন তাতো জানতাম না তাই সারাদিন এইখানেই আছিলাম। কামে যাইতে পারি নাই। কাইল কাম শ্যাষ আইসা ট্যাকা দিয়া যামুনে। ন্যান ধরেন।”
ইতমিনান আপ্লুত হলো। ওয়ালেট হাতে নিয়ে বলল, “তোমার নাম কি?”
ছেলেটা গম্ভীর গলায় বলল, “মানিক মিয়া এভিনিউ।”
“মানিক মিয়া এভিনিউ কারো নাম হয় নাকি?”
“খালি মানিক হইলো কম দামী নাম। মিয়া এভিনিউ জোড়া লাইগা দামী নাম হইসে।”
“তুমি আমার অনেক বড় উপকার করলে। আমি তোমার জন্য কি করতে পারি বলো।”
“কিসুই না। সারাদিন এক জায়গায় বইসা থাইকা মাজা ব্যাকা হয়া গ্যাসে। অখন বাইত যামু। এই উঠ।”
কুকুরের গায়ে একটা লাথি দিলো মানিক। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করার বদলে কুঁই কুঁই করে ডাকলো আর লেজ নাড়ালো। ইতমিনান বুঝলো কুকুরটা এই ধরনের ব্যবহারে অভ্যস্ত। ক্ষণকালের মাঝেই আধারের গলির ভেতরে হারিয়ে গেলো মানিক এবং তার কুকুর। ইতমিনান অপলক তাকিয়ে রইলো। ঐ তো হিমু! নগ্ন পায়ের হিমু। ময়লা থ্রি কোয়ার্টার পড়া হিমু। ছেঁড়া ফাটা পকেট ওয়ালা হিমু।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-১৩+১৪+১৫

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৩

সাইকেলের বেহাল দশা। সিটের দিকে তাকিয়ে মিতুলের কাঁদতে মন চাইলো। কিন্তু কান্নাকাটি করা যাবে না। নাইনে পড়া ছেলে কান্নাকাটি করলে মানুষ আগে হাসবে। মন ভরে হাসবে। কেউ তার কারণ খুঁজবে কি না সন্দেহ।

“দেখছো? সাইকেল একদম পোক্ত আছে না? তোমার সমস্যা পানি পানি হয়া গেলো। সাই করে যাবা আর সাই করে আসবা।”
মিতুল দেখলো তার মামা হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। মিতুলের সে হাসিটা একটুও পছন্দ হলো না। এই সাইকেলে বসে গেলে তার পশ্চাৎদেশ যে সুস্থ থাকবে না সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সন্দেহের বিষয় হলো এই জিনিসটা কেনো আর কারো নজরে পড়ছে না।
স্কুল ড্রেস পড়ে মিতুল খেতে বসলো। প্লেটের এক কোণায় ঢেঁড়স ভাজি। মুখে দিতেই বুঝলো গত রাতের বাসি। ঠান্ডা হয়ে আছে। নিশ্চয়ই ফ্রিজে ছিল। মিতুল মুখ কুঁচকে নিতে পারল না। এজন্য গতদিন মায়ের কাছে “নবাবজাদা” বলে বকা খেয়েছে। নিঃশব্দে খেয়ে উঠলো বটে। কিন্তু উঠতেই মনে হলো পেটে পাক দিচ্ছে। ঘরে গেলো ব্যাগ নিতে। এক ঘরেই মা ছেলে থাকছে। নাজিয়া খাটে থাকেন আর মিতুল নিচে। নাজিয়া নিচে থাকতে চেয়েছিলেন। মা’কে নিচে শুইয়ে নিজে উপরে থাকার কথা ভাবতেই পারে না মিতুল। এটাও ভাবতে পারে না কেনো তাদের নিজেদের বাড়ি রেখে মা এখানে থাকতে চায়। শুধু তিন বেলা খাওয়ার জন্য? চিন্তাটা মিতুলের মনে বিতৃষ্ণা এনে দেয়।

“মা আমি যাচ্ছি।”
নাজিয়া কোনো একটা বই পড়ছিলেন। চশমার ফাঁকা দিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। মুখের ভাব দেখেই বুঝলেন কিছু একটা হয়েছে।
“কি হয়েছে?”
“কি হবে? কিছু না।”
“বল আমাকে।”
“তোমাকে বলে কি করবো? শুধু শুধু বকা খেতে হবে। তার চেয়ে ঠান্ডা, বাসি ঢেঁড়স ভাজি খাওয়াই ভালো।”
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে মিতুল বলল, “তোমার ভাস্তির মার্কা মা-রা সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি। আমার চিন্তা তো তোমার নেই, অন্তত এই দোয়া করো যেনো ঐ ভাঙ্গা সাইকেল ওরকম ভাঙ্গা অবস্থাতেই তোমার ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে পারি।”
কণ্ঠের রেষটুকু লুকাতে পারলো না মিতুল। নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের অসন্তুষ্টি তিনি বোঝেন। কিন্তু এর প্রতিকার তার জানা নেই। স্বামীর বাড়িতে স্বামীর অনুপস্থিতিতে ভাসুরের দয়ায় থাকতে হতো। সেটা তার পক্ষে সম্ভব না। আবার এখানে ভাইয়ের বউয়ের মুখে সদা সর্বদা মেঘ ঘনিয়ে থাকে। কোনো উপায় খুঁজে পান না নাজিয়া। খুঁজতে চেষ্টাও আর করেন না।

আজ প্রথমবার কোচিংয়ে যাচ্ছে মালিহা। ইতমিনান খোঁজ খবর নিয়ে জানিয়েছে কোচিংয়ের হিস্ট্রি নাকি ভালো। আঁখি এগিয়ে দিতে চেয়েছিল। মালিহা বিনয়ের সাথে নিষেধ করেছে। মানুষটা তার জন্য অনেক করেছে। এরপরও তার থেকে অযাচিত সুবিধা নিতে থাকলে মালিহার নিজের কাছেই খারাপ লাগবে। সেকেন্ড গেটের একটু আগে এহসানের সাথে দেখা হলো। এহসান সম্ভবত মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিল। মালিহাকে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো।
“হেই মালিহা!”
মালিহা তাকালো। অন্য যেকোনো সময় দেখা হলে হালকা একটা সৌজন্যের হাসি ছুঁড়ে দেয়। এবার সেটা না দেখে এহসান বলল, “তুমি কি এখনো আমার ওপরে রেগে আছো?”
“না, তুই তো কাল ক্ষমা চেয়েছিস। তাহলে আর রাগ কিসের?”
মালিহার মুখে তুই শুনে এহসান যেনো চমকে গেলো। হাঁটা থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মালিহার দিকে। মালিহা পিছু ঘুর বলল, “কোনো সমস্যা?”
“তু..তুমি আমাকে তুই বলছো!”
“হ্যাঁ। তোর ভালো লাগছে না?” মালিহার নিষ্পাপ প্রশ্ন।
এহসান বুঝলো না কি বলবে। ডান হাত দিয়ে মুখ মুছে উপরের দিকে তাকিয়ে মুখ গোল করে নিশ্বাস ছাড়লো। মালিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাসায় কি এখন বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো যাবে?”
মুহূর্তেই মালিহার মুখ শক্ত হয়ে গেলো। শক্ত কণ্ঠে সে বলল, “কি বলতে চাও?”
“এই যে! তোমার তুমিটাই ন্যাচারাল। তুই বললে অদ্ভুত লাগে।”
“এর সাথে প্রস্তাবের কি সম্পর্ক?”
“এই যে আমি তোমার আগে পিছে ঘুরি, এমনি না নিশ্চয়ই? তুমি সম্ভবত আমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছো না। বাট আমি এক্ষেত্রে একদম সিরিয়াস। আন্টির নাম্বারটা দাও। তোমাকে আর কিছু ভাবতে হবে না।”
এহসান পকেট থেকে ফোন বের করলো। মালিহা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নরম কণ্ঠে বলল, “আমার কথাটা শোনো এহসান।”
“শুনবো, সেজন্যই নাম্বার চাচ্ছি। সারা জীবন ধরেই তোমার কথা শুনবো।” মিষ্টি একটা হাসি ছুড়ে দিলো এহসান। কিন্তু হাসিটা মালিহার যাচ্ছে মোটেও মিষ্টি লাগলো না।
“এহসান, জীবন সঙ্গীর সাথে মানসিকতার মিল হওয়া আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা তোমার সাথে আমার নেই। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। চিন্তা চেতনায় বিস্তর ফারাক। এই গ্যাপ নিয়ে দুর থেকে একে অপরকে ভালো লাগতে পারে কিন্তু জীবন কাটানো সম্ভব না।”
“আমার কোন জিনিসটা তোমার পছন্দ না বলো। আমি এখুনি চেঞ্জ করে ফেলবো।” আকুল হয়ে বলল এহসান।
“এই যে! এটাই পছন্দ না। তোমার ব্যক্তিত্ব কি এতোটাই ঠুনকো যে কারো পছন্দ না হলেই পাল্টে ফেলবে? এভাবে ভাবতে গেলে জনে জনে চিন্তা করে তোমার সব বদল করতে হবে। সেই বদলে মাঝে তুমি নিজেই হারিয়ে যাবে।” হাতঘড়ি দেখলো মালিহা। আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে চেয়েছিল। হলো না। ঠিক সময়ে যাওয়া যায় নাকি সেটাই চিন্তা।
“আমি তো সবার চিন্তা করছি না। শুধু তোমার..”
“এহসান তুমি কি চাও অ্যাকাডেমিক লাইফের বাকিটুকু আমরা অপরিচিতের মতো কাটাই?”
এহসান থমকে গেলো। এক দলা কষ্ট বুক থেকে গলায় উঠে ঘূর্ণি পাকাতে লাগলো।
“মালিহা তুমি কি আমাকে নিয়ে একটু ভেবে দেখতে পারো না?”
এবার মালিহার সত্যিই মায়া হলো।
“আমাকে ভুল বুঝো না। কিন্তু এই অ্যাপ্রচের কারণে তোমার সাথে আগামীতে আমি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারবো না। আর মানসিকতার বিষয়টা খুব ডিফিকাল্ট। এটা সহসাই চেঞ্জ করা যায় না।”
এহসান কিছু বলল না। শূন্য দৃষ্টিতে মালিহার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই দৃষ্টির সামনে মালিহার নিজেকে অসহায় লাগলো। অস্বস্তি হলো।
“এহসান, আই অ্যাম সরি। তুমি যথেষ্ট ভালো একজন ছেলে। কিন্তু..”
এহসান ডান হাত ওঠালো। মুখ ঘুরিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে মালিহার দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল, “আমি কোনো ধরনের সিম্প্যাথি চাই না। যেটা চেয়েছিল সেটা যখন দিতে পারোনি আর..” কথা শেষ করলো না এহসান। দৃষ্টি আড়াল করে বলল, “আমি সম্ভবত তোমাকে দেরি করিয়ে দিয়েছি। সরি। সরি ফর এভরিথিং।” এহসান ঘুরে দাঁড়ালো। চলে গেলো মুহূর্তের মাঝেই। মালিহা ফোস করে নিশ্বাস ছাড়ল। খারাপ লাগলেও তার কিছু করার নেই। কিছু জিনিসে মানুষের হাত পা বাঁধা থাকে। তবে এহসানের জন্য সে মন থেকে দোয়া করলো। এহসান যেনো তার নিজের মতোই ভালো একজন জীবনসঙ্গিনী পায়।
দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো মালিহা। আর দেরি করা যাবে না। তার দ্রুত পদ চারণায় রাতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো মর্মর করে উঠলো। যেগুলো সৌন্দর্য ছড়িয়েছিল গতকালও।

অফিস রুমটা বেশ ছোট। কেমন আটসাট একটা ভাব। মিনিট পনের হবে মালিহা এখানে বসে আছে। এর মাঝে ছেলেমেয়েরা যাওয়া আসা শুরু করে দিয়েছে। এটাই সম্ভবত যাওয়া আসার একমাত্র দরজা। মালিহা ধারণা করলো। আসার পর একটি মেয়ে তাকে এখানে বসিয়ে দিয়ে গেছে। মেয়েটিও সম্ভবত এখানকার টিচার।
গলা খাকারি দিলো কেউ। মালিহা ঘুরে তাকালো। একজন যুবক প্রবেশ করতেই দাঁড়িয়ে দিলাম দিলো মালিহা। ছেলেটি হেসে সালামের উত্তর নিলো। মালিহার মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল, “বসো বসে। তুমিই মালিহা?”
“জি ভাইয়া।” ইতস্তত করে বলল মালিহা। “আঁখি আপু..”
“হ্যাঁ আঁখি আমাকে ফোন করেছিল কাল রাতে। আমি তো ভেবেছিলাম ওর মতোই কেউ। কিন্তু এখন দেখছি..”
মালিহার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল ছেলেটি। সেই নজর অবশ্য মালিহা খেয়াল করলো না।
“বাই দ্যা ওয়ে! আমি তুষার। তুষার আবদুল্লাহ। মাস্টার্স,ডিপার্টমেন্ট অফ বায়ো টেকনোলজি।”
মালিহা হেসে বলল, “ইন্ট্রো তো আমার দেয়ার কথা ভাইয়া।”
তুষার মাথা নেড়ে বলল, “আঁখি আমাকে তোমার ইন্ট্রো গুলিয়ে খাইয়ে দিয়েছে। তোমার থেকে ওটা নেয়া যাবে না। নাহলে আঁখি আবার বলবে ওর রুমমেটকে আমি র‍্যাগ দিয়েছি। আমি এসবে নেই।” হাত তুলে সমর্পণ করার ভঙ্গিতে বলল তুষার। মালিহা হেসে ফেলল। তুষার এক পলক সেই হাসির দিকে তাকিয়ে বলল, “চা অর কফি?”
“কিছু না ভাইয়া। থ্যাংকস।”
“আরে শুধু আজকের জন্যই। রোজ রোজ খাওয়ানোর মতো পয়সা আমার নেই। অন্যদিন শুকনো কথা হবে। আজ একটু গলা ভেজাও।”
“বেশ। রং চা, দেড় চামচ চিনি।”
“ওকে।”
তুষার উঠে গেলো। মালিহার মনে হলো তুষার মানুষটা বেশ সহযোগী মনোভাবাপন্ন। কাজ করে শান্তি পাওয়া যাবে। মিনিট পাঁচেকের মাঝে তুষার ফিরে এলো। মালিহার দিকে কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আঁখির কাছে আমি তোমার ব্যাপারে মোটামুটি সবই শুনেছি। এরপরও তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।”
এক চুমুক চা খেলো মালিহা।
“আমার তেমন কিছু বলার নেই।”
“আচ্ছা। তাহলে আজ সিক্স আর সেভেনে একটা ইন্ট্রো দাও। চাইলে একটা ডেমো ক্লাস নিতে পারো। আউট অফ রুটিন। তাহলে স্টুডেন্ট তোমার সম্পর্কে জানবে। আগামী ক্লাসে আগ্রহী হবে।”
“ঠিকাছে।”
“আপাতত তুমি সিক্স আর সেভেনে মেজর সাব্জেক্টের অ্যাসিস্টেন্ট হিশেবে থাকো। ওগুলো তদারকি করছে আমার আরেক ক্লাসমেট, নিতু। চেনো ওকে?”
মালিহা মাথা নাড়ল। চেনে না সে।
“সমস্যা নেই। একই জায়গায় কাজ করতে গেলে চেনা পরিচয় হয়ে যাবে। কি বলো?”
“জি।”
“আচ্ছা। আর স্যালারির বিষয়টা ক্লিয়ার করি। তুমি আসার আগে একটা ছেলে ছিলো এই পোস্টে। কলেজ পড়ুয়া। সামনে একজ্যাম তাই লিভ নিয়েছে। ওর স্যালারি ছিলো পাঁচ। কিন্তু যোগ্যতার দিক দিয়ে তুমি ওর থেকে এগিয়ে আছো তাই পাঁচ দিলে সেটা না ইনসাফি হবে। আপাতত সাত দিয়ে শুরু হোক। বাকিটা সময় এবং কাজ বলে দেবে। ওকে?”
“ইয়েস।”
মালিহার ভালো লাগলো। সুন্দর একটা সময় পার করলো ছোটো ছেলেমেয়ে গুলোর সাথে। এর মাঝে নিতুর সাথেও দেখা হয়ে গেলো। এই মেয়েটাই প্রথমে তাকে অফিস রুমে বসিয়েছিল।

“দোস্ত তুই আর আমি বাদে ক্লাসের সবাই মিঙ্গেল হয়ে গেসে।”
মালিহা চুলে তেল দিচ্ছিল। নীতি উপুর হয়ে শুয়ে বিলাপ করছে। মালিহা বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই আগে সোজা হয়ে শো। একটু পর বুকে ব্যাথা করছে বলে প্যা পু করলে আমার হাতের চড় খাবি।”
তড়াক করে উঠে বসে নীতি বলল, “ধাই কিলো চড় কি কিমাত তুম ক্যায়া জানো গে রাজাবাবু!”
“নাটক কম কর।”
“মালিহা রে! তোর মতো একটা ষন্ডা মার্কা কাজিন থাকলেও মনডারে একটু স্বান্তনা দিতে পারতাম।”
“থাপ্পড় খাবি নীতি!”
“তাই দে! সবার একজন আছে রে!”
“সবার আছে মানে কি? নাজিফাও ঐ পার্টির নাকি?”
“আরে না! ও হইলো হুজুর মানুষ। নাক মুখ যেমনে ঢেকে রাখে কে ওরে গুতাইতে আসবে।”
“ওইরকম করে ক্লাসে তো আরও অনেকে যায়।” চুলগুলো বেনি করতে শুরু করলো মালিহা। নীতি তার কাছে গিয়ে নিজে বেনি করা শুরু করলো।
“ছাই যায়। হলে এসে ক্যাটরিনা কাইফ সেজে যে ছবি স্টোরি দেয় সেগুলা কি ছেলেরা দেখে না ভাবছিস?”
“তাহলে মুখ ঢেকে ক্লাসে যেয়ে লাভ কি?”
“ওদের কাছে যেয়ে তুই শুনিস। একেকটা দুনিয়ার ফাতরা।” নিজের মতো করেই নীতি বলতে লাগলো, “ক্লাসের ভিতর ছেলেমেয়েগুলোর পারলে একটা আরেকটার কোলে উঠে পড়ে। এমন জায়গায় কেউ সিঙ্গেল থাকে নাকি? অবশ্য তোর মতো রসকষ ছাড়া হইলে সম্ভব।”
“নীতি।”
“বল।”
“আজকে এহসানের সাথে দেখা হয়েছিল।”
“আমারও হইসিলো।”
বিরক্তি নিয়ে নীতির দিকে তাকালো মালিহা। তারপর সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল। নীতি কতক্ষন হা করে তাকিয়ে ছিল। শেষমেষ বলল, “বইন তোর জীবনে আমি তো বিয়ার বাত্তি দেখি না! এমন ক্যা তুই?”

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৪

“তুই সত্যিই যাবি না?” কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো নীতি।
“না। পাগল নাকি? এখন যেতে হলে আবার কতগুলো টাকার দরকার। তুই যা না! ক্লাসের অনেক মেয়েই তো যাচ্ছে।”
“তো? ওদের সাথে কি আমার ইন্টুবিন্টু চলে নাকি যে ওদের লেজ ধরবো আমি? আমার সবকিছুই তো তোমার সাথে মালিহা।” দুঃখী মুখ করে বলল নীতি।
মালিহা বিরক্তির স্বরে বলল, “তাহলে যাইস না। ঐদিন তোরে ফ্রাইড রাইস খাওয়াবোনে যাহ।” বিছানা গুছিয়ে শেষ করলো মালিহা। নীতি চমকে বলল, “সত্যি!”
“ইনশাআল্লাহ্।”
নীতি ঠাস করে শুয়ে আবার কল্পনায় হারিয়ে গেলো। আহা! কতদিন ফ্রাইড রাইস খাওয়া হয় না! আবার কি মনে হতেই ঝট করে উঠে বলল, “এই জানিস ইরিনা ট্যুরে যাচ্ছে।”
“ওর বাবা না অসুস্থ?” মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল।
“সেইটাই তো। এই মেয়ের মতিগতি আমি বুঝি না ছাই।”
“তুই কিভাবে জানলি ও যাবে? ও তো ক্লাসেই আসে না।”
“ওর জিগরি দোস্ত বলসে।” কাঁধ শ্রাগ করে বলল নীতি।
“তোর কাছে ওর নাম্বার আছে?”
“কার? ইরিনার? না নাই।”
“ওর কাছে ফোন দিলে জানা যেত ওর বাবার কি অবস্থা।”
“ধুর! তুই এই চিন্তা বাদ দে তো। ও কবে নিয়মিত ভার্সিটি করসে?” টেবিলে যেয়ে বসলো নীতি। কিছু অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে।
মালিহা চিন্তায় পড়ে গেলো। তার শুধু ইরিনার বাবাকে নিয়ে চিন্তে হচ্ছে না। তার চিন্তার বড় একটা কারণ ঐ চার হাজার টাকা।

লতার সাত মাস চলছে। উঁচু পেটটা নিয়ে চলাচল করতে বেশ কষ্ট হয়। তবুও পেটের দায়ে ছুটতে হয় এদিক থেকে ওদিক। হাতের ফাইলটা শেষবার চেক করে বসের কাছে পাঠিয়ে দিলো লতা। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। পিঠটা যেনো ছিঁড়ে যেতে চাইছে। তাও ভালো ইতমিনান এই ডেস্ক তার সাথে অদল বদল করেছে। নয়তো কোনার ডেস্কে থাকলে গরমেই সিদ্ধ হতে হতো।

ইতমিনান লতার দিকে তাকিয়ে চিন্তায় পড়লো। এই মাসে সবাইকেই ছোটখাট ফিল্ড ট্রিপ দিতে হবে। পোস্টপন্ড করা সম্ভব না। লতা কিভাবে এই কাজ করবে? ঘড়ির দিকে তাকালো ইতমিনান। টিফিন ব্রেক শুরু হয়েছে। ফাইল খোলা রেখেই লতার ডেস্কের সামনে দাঁড়ালো। শব্দ শুনে চোখ খুললো লতা। তাকে দেখে হাসলো খানিক।
“কি অবস্থা তোর?”
“আপা আপনি ফিল্ড ট্রিপে যেতে পারবেন?” চিন্তিত স্বরে বলল ইতমিনান।
“না পেরে তো উপায় নেই ভাই।” সোজা হয়ে বসলো লতা।
“আপনি একবার বসের কাছে একটা দরখাস্ত দিন। উনিও তো মানুষ। বুঝবেন নিশ্চয়ই।”
“বস মানুষ কি না জানিনা তবে তার ম্যানেজার বিশাল বড় মাপের মানুষ। আমাকে বলেছে অসুবিধা হলে যেনো চাকরি ছেড়ে দিই। কোনো ছুটি ফুটি হবে না।”
বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেলো ইতমিনানের মুখ। কিছু না বলে নিজের ডেস্কে চলে গেলো সে। টিফিন বক্স নিয়ে ফেরত এলো লতার কাছে।
“এটা খান।”
লতার মাঝে কৌতূহল দেখা গেলো, “কি এনেছিস?”
“আলুর পরোটা।” মুখ গোজ করে বলল ইতমিনান। এক টুকরো মুখে দিয়ে লতা বলল, “তুই কি খাবি?”
“চা খাবো। আপনি খাবেন?”
“না। চা খেলে আমার গরম লাগে। তোর শেফ হওয়া উচিত ছিল রে ইতমিনান। অবশ্য সমস্যা নেই। বউকে রেধেবেড়ে খাওয়াবি। দেখবি তোর বউ তোকে মাথায় করে রাখবে।”
ইতমিনান কিছু বলল না। লতার হাসি হাসি মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চলে গেলো ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতেই শুনলো আশপাশের ডেস্কের মানুষ ফুসুর ফুসুর করছে। সে জানে এই গোপন আলাপের বিষয়বস্তু সে এবং লতা আপা। গা করে না ইতমিনান। এই কাজ ছাড়া ওরা আর পারেই বা কি?

ইতমিনান এখানে জয়েন করেছে দুই মাসের কাছাকাছি হবে। যখন সে এখানে আসে তখন লতার পাঁচ মাস। বয়সে এবং পদে দুই দিক থেকেই লতা ইতমিনানের চেয়ে অনেক উপরে। প্রথম দিকে সে অবাক হতো। লতার যে চলতে ফিরতে খুব অসুবিধা হয় এটা তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইতমিনান ভাবতো তাহলে এই সময়টায় বাহিরে অফিস করার কি দরকার? ঘরে বসে বিশ্রাম করাটাই বেশি জরুরি। উত্তর পেতে বেশিদিন লাগলো না। লতা বিধবা। তার স্বামী মা’রা গেছে প্রেগন্যান্সির প্রথম মাসেই। বেচারা জানতেও পারেনি অনাগত সন্তানের বাবা হিশেবে তার নাম লেখা হয়ে গেছে। অফিসের কম বেশি অনেকেই লতাকে দেখতে গিয়েছিলো। লতা এখানে কাজ করে প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে। সেই হিসেবে অনেকের ঘনিষ্ঠ ছিলো। স্বামী হারিয়ে লতা তখন অকূল পাথারে। তার দুঃখের কলস পূর্ণ করতেই যেনো তার ভাই দুইজন তার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিলো। মা-বাবা ছাড়া যেই ভাইদের হাতে মানুষ হয়েছে লতা, সেই ভাইয়েরাই দায়িত্বের ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তবে লতার বয়স্ক শশুর শাশুড়ি তার পাশে রইলেন অভিভাবকের মতো। লতার না ছিলো কোনো ননদ, না ছিলো কোনো দেবর। তিনজন মানুষের পরিবারে সেই রইলো একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শ্বশুর বা শাশুড়ি কারো পক্ষে সম্ভব নয় নতুন করে রোজগার করা। কাজেই বুকে পাথর বেঁধে পেট চালানোর চিন্তা করতে হলো লতাকে।
প্রথম দিকে একবার ছুটির সময় লতা মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। সকলেই আতঙ্কিত হলো। কিন্তু ইতমিনান দেখেছিল, একটা মানুষও সেদিন এগিয়ে যায়নি। নিজের ডেস্কের চেয়ারেই পড়ে ছিল লতা। ইতমিনান যেতে ইতস্তত বোধ করছিল। মহিলা মানুষ। হাসপাতালে নিতে চাইলে আগলে ধরতে হবে। অন্তত গাড়ি পর্যন্ত তো ওঠাতে হবে। ইতমিনানের অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু কেউ যখন এগিয়ে গেলো না তখন অস্বস্তিকে দূরে থেকে ইতমিনান এগিয়ে গিয়েছিল। মিলি এভাবে পড়ে থাকলে সে কি নিশ্চিন্তে থাকতে পারতো?
পানি ছিটিয়ে দেয়ার পরও লতার জ্ঞান ফিরল না। অগত্যা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলো। সাহায্য করলো অফিসের রান্নার কাজে নিয়োজিত এক মহিলা। সেদিন থেকেই লতা ইতমিনানকে ভাই বলে ডাকে। তাকে ম্যামের বদলে আপা ডাকতে বলেছে। আর সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে তাদের নিয়ে মুখরোচক সব গল্প। ইতমিনান দেখে মেয়েরাই এই গল্পে সবচেয়ে এগিয়ে। অথচ এই আগানোটা যদি সেদিন আগাতো তাহলে ইতমিনানের সাহায্যের প্রয়োজন হতো না।
খালি কাপের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইতমিনান। মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী।

মিতুল কানে হাত দিতে চাইছে। পারছে না। নাজিয়া তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছেন। প্রেশার কুকারের সিটির মতো বেজে চলেছে তার চেয়ে এক বছরের ছোট মামাতো ভাই।
“আমার কতো শখের সাইকেল! এবার এটা নিয়ে আমি বাইরে যাবো কিভাবে? এটা চালাবো কিভাবে? আপনি বলেন ফুপু। আব্বু কি আমারে আরেকটা সাইকেল কিনে দিবে? দিবে না। আমি জানি। মিতুল ভাই ইচ্ছা করে এমন করছে। আমার সাথে মিতুল ভাইয়ের যত রাগ।”
মিতুল ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলো। বিছানায় বসতেও ভয় লাগছে। পেছনে কিছুর সাথে স্পর্শ লাগলেই ছ্যাঁত করে উঠছে।
“কি করেছিস তুই সাইকেলটার অবস্থা?” গরম কণ্ঠে বললেন নাজিয়া।
“সকালেই তোমাকে বলে গিয়েছি, ঐ সাইকেলের মুমূর্ষু অবস্থা। আমি আহামরি কিছুই করিনি।” বিছানায় বসে মুখ কুঁচকে নিলো মিতুল।
“তুই করিসনি তো কে করেছে?” নাজিয়া বেগমের রাগ যেনো কমছে না। ভাইয়ের বউ মুখ কালো করে তাকে কিছু না বললেও সযতনে এড়িয়ে গেছে। সেই চাহনি যেনো তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
“আমি আগেই বলেছি মা, সাইকেলের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। সিটের কভার আগে থেকেই ছেড়া ছিলো। আমি বসার পর আর এক ইঞ্চি হয়তো ছিঁড়েছে। এছাড়া আর কিছু হয়নি। তোমার ভাস্তি যেনো আজকেই তার সাইকেল প্রথম দেখছে বলে মনে হচ্ছে।” বিদ্রুপ করে বলল মিতুল। তখনই বাইরে থেকে চিৎকারের আওয়াজ এলো।
“দিছস ক্যান? সাইকেল দেওয়ার সময় মনে ছিল না? ভাতের সাথে সাইকেলে গিলা শুরু করসে!” সাথে মা-রের শব্দ। পরপর কান্নার আওয়াজ। নাজিয়া বেগমের মাথায় আগুন ধরে গেল। সশব্দে মিতুলের গালে চড় দিলেন। মিতুল পূর্বের চাইতেও অধিক শান্ত অবস্থায় বসে রইলো। টু শব্দটাও করলো না।

খাওয়ার সময় মামাতো ভাইয়ের পাশেই বসলো মিতুল। খাবার দিতে এসে মিতুলের সামনে প্লেট এক প্রকার ছুঁড়ে দিলো মামী। মিতুল ঠান্ডা চোখে একবার প্লেটের দিকে তাকালো, একবার মামীর দিকে। নিঃশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে সোজা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।

.

দুপুরের তপ্ত রোদ চারদিকে রাজত্ব করছে। ধীরে সুস্থে হেঁটে যাচ্ছে মিতুল। মামা বাড়ি থেকে তাদের বাড়ির দূরত্ব ভালোই। সাইকেলে যেতেই আধা ঘণ্টা লাগে। হেঁটে নিশ্চয়ই এক ঘণ্টা লাগবে। মিতুল জানে না। এর আগে কখনো সে হেঁটে যায়নি।

মিতুলের কাছে ঘড়ি নেই। তবে তার মনে হলো এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় গেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বড় করে একটা দম ছাড়লো মিতুল। বুক,পিঠ ঘেমে চটচট করছে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ওপাশে উঠান দেখা যাচ্ছে। কিছু দড়ি বাধা। দড়িতে কাপড় ঝুলছে। পানি শুকিয়ে নিতে রোদ গায়ে মাখছে। নিজের গায়ে রোদ মেখে অভাবের পানি এভাবে নিংড়ে ফেলে দিতে পারবে না? মিতুল ভাবলো। কোনো সদুত্তর পেলো না।

“মিতুল তুই!”
মকবুল আলীর চোখে মুখে অবাক ভাব। মিতুল শান্ত কণ্ঠে সালাম দিল। বাবার ভাই। অসম্মান করার প্রশ্নই ওঠে না। সে কোনোদিন তার চাচাকে অসম্মান করেনি। ভবিষ্যতেও করবে না।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তোর কি অবস্থা আব্বা? কেমন আছিস?” মিতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মকবুল আলী। তার ঘাম চটচটে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। মিতুলের মনে হলো তার ভেতরে জ্বলতে থাকা আগুনে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছে। হঠাৎ করেই মনে হলো এই যেনো বাবা। তার মৃ’ত বাবা। ধীর কণ্ঠে মিতুল বলল, “পিপাসা লাগছে চাচা। পানি খাবো।” অথচ সে ভেবে এসেছিল শুধু দাদির সাথে দেখা করবে। আর কারো সাথে কোনো কথা বলবে না।
মকবুল আলী মিতুলকে সযতনে ঘরে নিয়ে গেলেন। আয়েশা তখন ঘুমে। নিজ উদ্যোগে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি মিশিয়ে ভাস্তিকে দিলেন। পুরো পানিটুকু এক নিশ্বাসে শেষ করলো মিতুল। মকবুল হা হা করে উঠলেন।
“একবারে খায় না আব্বা! গলায় বাঁধবে। তিনবারে খাবা। পানি তিনবারে খাওয়া সুন্নত।”
মিতুল বলল, “দাদি ঘরে আছে না?”
“আছে আছে। চলো যাই।”
রাশেদা সুপুরি কাটছিলেন। মকবুল অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকলে নাতিকে দেখলেন রাশেদা। কঠিন চোখ ছলছল করে উঠলো। মিতুল দাদির খোঁজ খবর নিয়ে বলল, “আমাকে কিছু টাকা ধার দিবা দাদি?”

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১৫

মকবুল আলীর জোরাজুরিতে মিতুল বলতে বাধ্য হলো টাকা তার কেনো লাগবে।
“একটা সাইকেল কিনবো চাচা।”
“ইতুর সাইকেলটা বাড়িতে পড়ে আছে। ঐটাই নিয়ে যা।”
“না। দাদি তুমি চার পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারবা?”
“চার পাঁচ হাজার টাকায় সাইকেল হয় রে পাগল?” মকবুল স্নেহের সুরে শাসন করলেন।
“সেকেন্ড হ্যান্ড হয় না?”
“তুই সেকেন্ড হ্যান্ড নিবি কেনো? আমি তোকে নতুন সাইকেল কিনে দিতে পারি। সেই সামর্থ্য আল্লাহ আমাকে দিয়েছে।”
মিতুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আর নতুন কোনো ঝামেলার দরকার নাই চাচা। আপনি আমাকে একটা কাজ ঠিক করে দেন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যেনো করতে পারি।”
রাশেদা চমকে উঠলেন। “তুমি কাজ খুঁজছো কেনো ভাই?”
মিতুল জবাবহীন বসে রইলো। কিছুই বলল না। মকবুল আলী হতাশ নিশ্বাস ফেললেন।
“বাজারে একটা সারের দোকান আছে। ঐটায় কাজ করবি?”
“আপনার পরিচিত?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আপনি একটু কথা বলে দিয়েন।”
“বলব।”
রাশেদা টাকা দিলে মিতুল তার হাত ধরে বলল, “দাদি তুমি দোয়া করো এই টাকা যেনো তোমাকে ফেরত দিয়ে দিতে পারি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।” রাশেদা নাতির মাথায় হাত বোলান। ছোট্ট ছেলেটা কেমন এক নিমিষে বড় হয়ে গেছে।
বেরিয়ে আসার সময় আয়েশার সাথে দেখা হলো। আয়েশা যেনো ভূত দেখলেন। মিতুল হেসে বলল, “চাচী ভালো আছেন? দাদিকে দেখতে এসেছিলাম।”
সদ্য ঘুম ভাঙ্গা আয়েশা বেশি কিছু বুঝলেন না। বলা ভালো বুঝতে চাইলেন না। আজকাল তিনি অন্য এক চিন্তায় মগ্ন থাকেন। সবসময়।
পার্ট টাইম কাজ হিশেবে সময়টা মিলল না। দোকানির কথা মিতুলকে দোকান বন্ধ করা পর্যন্ত থাকতে হবে। জিজ্ঞেস করে জানা গেলো এশার আযান দিলেই তিনি দোকান বন্ধ করে দেন। মিতুল রাজি হয়ে গেলো। সে বাড়ি থেকে দূরে থাকতে চায়। যে বাড়িতে সম্মানের সাথে বাস করা যায় না, সেই বাড়ি থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে চায়।
দোকানে কথা শেষ করে মামা বাড়ি গেলো মিতুল। এবার রিকশা নিলো। হাতে বেশ কিছু টাকা আছে। বাড়ি পৌঁছে কোনদিকে না তাকিয়ে ভাঙ্গা সাইকেলটা নিয়ে আবার বের হয়ে গেলো। পেছন থেকে নাজিয়ার গলা শোনা যাচ্ছে। মিতুল ফিরে তাকালো না। সাইকেল ঠিক করতে নিয়ে গেলো। সেটার দৈন্য দশা। মেরামত করার চাইতে আরেকটা কিনে ফেলা ভালো। দোকানের লোকটা সেই পরামর্শই দিলো। মিতুল বলল, “আপনি ঠিক করে দেন। কতো লাগবে সারতে?”
“তাও ধরেন পনেরশ তো লাগবেই।”
মিতুল হিশাব কষলো। পাঁচ হাজার থেকে পনেরশ বাদ দিলে থাকে সাড়ে তিন হাজার।
“আপনাদের এখানে সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল পাওয়া যাবে?”
“যাবে।”
“তিন হাজার টাকার ভেতরে কেমন সাইকেল আছে?”
“একটা দাম বললেন ভাই? পাঁচ ছয় হইলে একটা ভালো সাইকেল নিতে পারবেন।”
“পাঁচ ছয় হইলে আমি একটা নতুন সাইকেলই নিয়ে নিতাম। আছে নাকি আপনি বলেন।”
লোকটা থতমত খেয়ে সাইকেল দেখালো। অপর পাশে ভাঙ্গা সাইকেলের সার্ভিসিং চলছে। বেশ দেখে টেখে মিতুল সাড়ে তিন হাজারের মাঝেই একটা সাইকেল নিয়ে নিলো। পুরোনো সাইকেল ঠিক করে ভ্যানে তুলে নিজের সাইকেলে চেপে বাড়ির পথ ধরলো। নিজের সাইকেলে বসে একটা শুকনো ঢোক গিললো মিতুল। বুকটা একটু ঠান্ডা লাগছে।

ভালো মন্দ খোঁজ নিয়ে মালিহা বলল, “ইদ্দত শেষ হওয়ার আগেই তুমি ঐ বাড়িতে কেনো গেলে মা?”
নাজিয়া ছ্যাঁত করে উঠলেন যেনো।
“তোরা গুষ্ঠি মিলে আমার পিছে লাগছিস কেনো? নিজের ভাইয়ের বাড়িও আমি আসতে পারবো না?” মালিহা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। খোলা করিডোর মোটামুটি শূন্য। আশপাশে তাকিয়ে বলল, “অবশ্যই যাবে মা। কিন্তু ইদ্দত শেষ না করে জরুরী কাজ ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়াই ভালো।”
“খুব হুজুর হয়েছিস দেখছি।”
“মা!” আহত স্বরে বলল মালিহা। “এভাবে বলছো কেনো? ইদ্দতের নিয়ম তুমি জানো না?”
“তোরা যা শুরু করেছিস মনে হচ্ছে আমি কিছুই জানিনা।”
মালিহা এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না। চলেই যখন গেছে কি আর করার।
“তুমি কি একেবারে ওখানে গেছো?”
“হ্যাঁ।”
“কেনো? মিতুলের তো স্কুলে যাতায়াতে সমস্যা হবে। তাছাড়া নিজেদের বাড়ি থাকতে অন্য কারোর বাড়িতে থাকার কি দরকার?”
নাজিয়া বিরক্ত হলেন। শাশুড়ি, ভাসুর, ছেলে, মেয়ে সবাই এক গান গাইছে। তার রাগ হলো। বিধবা হয়েছে বলে সবাই তার উপরে খবরদারি করতে শুরু করেছে। কেনো? সে কি অসহায় হয়ে পড়ে আছে নাকি?
“তোর বাপও জীবনে আমার কাছে এতো কৈফিয়ত চায়নি যতো তোরা চাচ্ছিস। স্বামী ম’রে গেছে এখন তো ছেলেমেয়ের ইশারাতেই চলতে হবে। বল, কতো পারিস বল।”
মালিহা হাল ছাড়লো। কোনোভাবেই মা’কে সে বোঝাতে পারছে না। প্রসঙ্গ পালিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, “মা! জানো একটা কোচিংয়ে চাকরি পেয়েছি। ওরা বলেছে সাত হাজার টাকা দেবে। আরেকটা টিউশনি পেয়েছি। ওখানে তিন হাজার। এবার আস্তে আস্তে বাড়ি খুঁজতে শুরু করবো। কি বলো?”
“হুম।” বাইরে থেকে কথাবার্তার আওয়াজ আসতেই নাজিয়া বললেন, “রাখলাম। পরে আবার কথা বলব।”
নাজিয়াকে ততোটা আনন্দিত মনে হলো না। ভাইয়ের কাছে আছেন সেখানেই মেয়ে তার উপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য যেনো মুখিয়ে আছে। দুর দেশে পাড়ি জমালে তো উঠতে বসতে তাদের মর্জি লাগবে।
মালিহা ফোন রাখলো। তার কোনো অনুভূতিই নাজিয়াকে ছুঁতে পারছে না। কষ্ট পেলো মালিহা। স্বামীর অনুপস্থিতিতে নাজিয়া কি এতটাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে? কাউকেই কেনো বিশ্বাস করতে পারছে না?

বাড়ি পৌঁছে সাইফের সাইকেল নামিয়ে ঘরের দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখলো। অন্ধকার তখন জেঁকে বসেছে। টুং টাং শব্দ শুনে মামী ঘরের ভেতর থেকে উঁকি দিলো। দুটো সাইকেল সহ মিতুলকে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। ভ্যান চলে যেতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।
“এই সাইকেল কার?”
“সাইফের।” ছোট্ট করে উত্তর দিলো মিতুল। পুরো সাইকেল রং বদলে অন্যরকম হয়ে গেছে। এটা যে পুরোনো ভাঙ্গা সাইকেল সেটা চেনাই যাচ্ছে না।
কথা বার্তার শব্দ শুনে নাজিয়া এবং সাইফ বের হয়ে এলো। ছেলেকে দেখে নাজিয়ার বুকটা কামড়ে উঠলো। মুখটা শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে আছে।
“তুমি সাইকেল সারায় নিয়ে আসছো?” মামীর কণ্ঠে বিস্ময়। মিতুল বলল, “ভাইয়ের জিনিস নষ্ট করে ফেলেছি। ঠিক করে দিতে হবে না? নাহলে ছোট ভাই আমার থেকে কি শিখবে?” মিতুলের কণ্ঠে না আছে কোনো ক্ষোভ, না আছে কোনো খোঁচা। শান্ত, নির্মল ভঙ্গিতে কথা বলে অপর পক্ষের বুক জ্বা-লিয়ে দিচ্ছে সে। বুকটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে মিতুলের।
সাইফ খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। আনন্দের আতিশয্যে মিতুলের কাছে যেয়ে বলল, “কবে থেকে সাইকেলটা ঐভাবে পড়ে ছিল! আব্বু ঠিকই করে দিত না। থ্যাংক ইউ মিতুল ভাই।” মায়ের প্রশস্ত চোখ সাইফের নজরে এলো না। সাইকেলের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করায় মামী তখন ভেতরে ভেতরে হাঁসফাঁস করছে। মিতুল হেসে সাইফের চুল নেড়ে দিলো। আয়েশা এতক্ষণে কথা বললেন, “ঐ সাইকেল কার?”
“আমার।”
“টাকা কোথায় পেয়েছিস তুই?”
“সাইফ এবার কিন্তু সাইকেল যত্ন করে রাখতে হবে। বুঝেছিস?”
“হু।”
“টাকা কোথায় পেয়েছিস?”
“মামী আমার সাইকেল কি ঘরের ভেতরে রাখতে পারি?” স্পষ্ট উপেক্ষা। নাজিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
মামী চমকে বললেন, “হ্ হ্যাঁ হ্যাঁ! রাখো রাখো।”
ঘরের ভেতরে সাইকেল উঠিয়ে রাখতে রাখতে মিতুল হেসে বলল, “বুঝলেন মামী? একজন সাইকেলের ব্যবস্থা করে দিলো। সাইফের সাইকেল কি আমি রোজ নিতে পারবো? ওর নিজেরও তো লাগবে। ভালো হলো না?”
“হ্যাঁ ভালোই তো।” মামী আসলে বুঝতে পারছেন না তার কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। ছেলেটা কি তাকে অপমান করছে? নাকি অন্য কিছু?
সাইফ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে সাইকেল দেখছে। সেদিকে একবার দেখে নিজের ঘরে চলে গেলো মিতুল। বিছানায় বসতেই নাজিয়া ঘরে এসে দোর দিলেন। মিতুল শান্ত চোখে দেখলো। সকালে চড়টার কথা মনে পড়লো। খোলা দরজার ওপাশ থেকে পুরো ঘটনা দেখেছিল তার মামী।
“কে টাকা দিয়েছে তোকে?”
“আমি একজনের থেকে ধার নিয়েছি। একেবারে কেউ দিয়ে দেয়নি।” ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল মিতুল।
“কে দিয়েছে?” নাজিয়ার গলা চড়াও হলো। উত্তেজিত হয়ে উঠছেন তিনি। মিতুল উত্তর না দেয়ায় নাজিয়া আবার বললেন, “এই টাকা ফেরত দিবি কিভাবে তুই?”
“কাজ করে।”
“কে দেবে তোকে কাজ?” তাচ্ছিল্য করে বলেলন নাজিয়া।
“কাজ ঠিক করে এসেছি।”
নাজিয়ার মাথায় যেনো বাজ পড়লো। ছেলের কাছে এসে হাত ঝাকিয়ে বললেন, “সব তোর চাচার বুদ্ধি তাই না? মানুষের সামনে আমার ভাইকে ছোট করার কি চমৎকার চিন্তা!” মিতুল ঢোক গিললো। ভেতর থেকে আসা চিৎকারটুকু গিলে নিলো।
“কারো বুদ্ধি না। আমার নিজের বুদ্ধি।”
“টাকা দিয়ে কি প্রমাণ করতে চায় তারা? আমার ভাই ফকির? খাওয়াইতে পারে না? কাজ করবি তুই আর মানুষ থু থু করবে আমার ভাইরে। এই! আমার ভাইয়ের সাথে তোর শত্রুতা কিসের? তোর কোন ভাতে ছাই দিসে?”
মিতুল বলতে চাইলো তোমার ভাই আমাকে ভাত দেয় না। ছাইই দিয়েছে। কিন্তু বলল অন্য কথা, “এসব কথা রাখো মা।”
“রাখবো কেনো? কোন নবাবের ছেলে তুই? কি একটা বলসে কি বলে নাই ছ্যাঁত করে উঠে চাচার কাছে নালিশ দিতে চলে গেসিশ। ওখানে যেয়ে টাকা চাইতে লজ্জা লাগলো না?”
“ভাইয়ের বাড়ির এতো সুন্দর আপ্যায়ন যদি তোমার খারাপ না লাগে তাহলে আমার চাচার থেকে আমি টাকা নিলে সেটা খারাপ লাগার কিছু দেখি না। এইটা যেমন তোমার র’ক্ত ঐটা আমার র’ক্ত। মতিয়ার আলীর ছেলে ভাইস্যা আসে নাই যে মানুষের লাত্থি ঝাটা খাবে। আমার বাপরে কবর দিসি, তার মান সম্মান আমি কবর দেই নাই।”
না চাইতেও কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে ফেললো মিতুল। নাজিয়া যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সংবিৎ ফিরতেই বললেন, “এতদিনে রক্ত কথা বলসে! ভালোই তো! বংশের ধারা বলে কথা!”
মিতুল শুয়ে পড়ল। নিজের জন্মদাত্রীর সাথে তর্কে জেতার কোনো ইচ্ছেই তার নেই।

“তোর মা তো তোর বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।”
ক্লান্তির নিশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান, “আমি কি বলেছি বিয়ে করব না? বলিনি তো। আরেকটু ভালো স্যালারির একটা চাকরি পেয়ে নিই। তোমার টাকায় সংসার চলছে তো তাই টের পাচ্ছি না। আমার এই বেতন দিয়ে বাঁচতে হলে নাকানি চুবানি খেতে হবে।”
মকবুল আলী হাসলেন। সহসাই সেই হাসি আবার বন্ধ হয়ে গেলো।
“মিতুলটা ভালো নেই রে। মানুষের বাড়ি যেয়ে রাত কাটানোর ছেলে ও না। অথচ মামা বাড়ি যেয়ে থাকতে হচ্ছে।”
“কিছু হয়েছে বাবা?”
আজকের পুরো ঘটনা শোনালেন মকবুল আলী। ইতমিনান চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাবা হারা ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য পরিস্থিতি এতো জটিল হয়ে পড়ছে কেনো?

খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মালিহা। মেঘের চাদর গায়ে মেখে ঘুম দিয়েছে চাঁদ। সেই মেঘ ঝরিয়ে দিচ্ছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বারান্দার এই অংশে কোনো ছাদ নেই। চোখ বন্ধ করতেই বন্ধ পাতার উপর এক ফোঁটা বৃষ্টি টুপ করে পড়লো। যেনো তার চোখকে আরেক বৃষ্টি ঝরানোর জন্য আশকারা দিলো। মালিহার বুকটা ভারী হয়ে উঠলো। আজ খুব করে বাবাকে মনে পড়ছে। তার যেকোনো আনন্দে এই মানুষটা সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। মায়ের সাথে তার সম্পর্ক সবসময়ই শীতল। বাবার অনুপস্থিতিতে যেনো তাতে বরফ জমেছে। তার আনন্দগুলো মা’কে ছোয় না, তার দুঃখগুলো মা’কে ভাবায় না। কেনো? মালিহা জানে না। তবে তার মনে হয় মা যেনো তাকে আপন ভাবতে পারে না। নিজেকে একা মনে হলো মালিহার। খুব একা।

চলমান।