Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 95



উষ্ণতা পর্ব-১০+১১+১২

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১০

আঁখি বাহির থেকে এসে যথারীতি সেই কাপড়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে। শুধু বিছানায় গড়িয়ে ক্ষান্ত হয়নি। জুতাসহ ঘরের ভেতরে ঢুকে পুরো ঘর একবার চক্কর কেটেছে। মনিকার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। কতো কষ্ট হয় পুরোটা ঘর গোছাতে। বুঝবে কিভাবে? জীবনে কোনোদিন ঝাড়ু হাতে নিয়েছে নাকি সন্দেহ। তিক্ত গলায় মনিকা বলল, “আপু জুতো পড়ে হাঁটাহাঁটি করবেন না।”
আঁখি মনিকার বিরক্তি বুঝে আরেকবার চক্কর দিলো। কৌতুকের সুরে বলল, “খালি পায়ে হাটবো মনিকা? কাঁটা বিধবে তো।”
“কাঁটা বিধবে কেনো? ঘর আমি দিন কতবার ঝাড়ু দিই জানেন? সকাল বিকাল দুইবার। আজকে দুপুরে আবার মুছেছি। এরপরও যদি ঘরে কাঁটা পাওয়া যায় তাহলে আমি মাটি খাই।”
“আহা হা! মাটি খেও না। তাহলে আমার ক্লাসমেটের কি হবে বলো তো?”
মনিকার মুখ রাঙ্গা হলো। আঁখির ক্লাসমেট এক ছেলে তার পিছু ধরেছে প্রায় বছর হবে। কিন্তু মনিকার এতে সায় নেই। বছরের পর বছর ধরে সম্পর্ক করে যদি বিয়ে পর্যন্তই না গড়ায় তাহলে সেই সম্পর্কের মূল্য রইলো কোথায়? এসব খুচরো সম্পর্কে সে বিশ্বাসী না। সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে আগ্রহ থাকলে যেনো বাড়িতে যোগাযোগ করে। তবুও ছেলেটার দুই তিন দিনে একবার দেখতে আসা চাই। মনিকা বিরক্তির ভান করলেও বিষয়টা উপভোগ করে বটে।
মুখে মেকি বিরক্তির ভাব ধরে মনিকা বলল, “ওসব কথা বাদ দিন তো আপু। জুতো খুলুন। খুলে বাইরে রেখে আসুন।”
“যথা আজ্ঞা।”
আঁখির এই এক বিষয়। কারো কিছুতে যেনো মেয়েটার না নেই। মনিকা এই পর্যন্ত কতবার যে তার সাথে এসব খুঁটিনাটি তর্কে গিয়েছে তার হিসাব নেই। অবশ্য এটাকে তর্ক বল যায় না। আঁখি কখনই মনিকার বিপরীতে দুটো কথা বলেনি। মনিকা একাই কতক্ষন গজগজ করে থেমে যায়। প্রতিবার। এবারও থেমে গেলো মনিকা। নিজের বিছানার তোশকের নিচ থেকে ঝাড়ু নিয়ে আঁখির বিছানার সামনে গেলো। পুরো বিছানা এলোমেলো। চাদর ময়লা হয়ে কুঁচকে আছে। চার পাঁচটা বই এদিক সেদিক ছড়ানো। এক কোনায় মুড়ির কৌটা। মোবাইলের চার্জার আর ইয়ারফোন সম্ভবত নিয়েজদের ভেতরে প্রচুর ধস্তাধস্তি করেছে। কেনোনা এখন তারা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে মনিকা চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বলল, “এটা বিছানা নাকি গুলিস্তান? মানুষ এমন জায়গায় থাকে!”
আঁখি পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। মনিকা বিছানা গুছিয়ে চলে যেতেই ধপ করে শুয়ে পড়ল। মনিকা বিরক্তি লুকিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলো। তবে পুরোপুরি সক্ষম হলো না।
“আপু আপনি বাইরের জামা কাপড় ছেড়ে শুতে পারেন না? চাদরটা এভাবেই নোংরা হয়েছে।”
“আলসি লাগে মনিকা।”
“আপনার যতো অকারণ আলসি। ভোর বেলায় পুরো ভার্সিটি দৌঁড়ে দৌঁড়ে চক্কর কাটেন তখন আলসি কোথায় থাকে?”
আঁখি হাসলো। মনিকা আর কিছু বলল না। সিনিয়র হিসেবে যথেষ্ট বলা হয়েছে।
মালিহা এবং নীতি রুমে এলো প্রায় আধা ঘণ্টা পর। নীতি কোনো রকমে ব্যাগ রেখেই বালতি আর জামা কাপড় নিয়ে ছুটলো। মালিহা বলল, “একটু জিরিয়ে নে।”
“সারা দুনিয়ার ধুলোবালি আমার শরীরে এসে কুড়কুড় করছে। এখন আমার প্রধান গন্তব্য বাথরুম।”
মালিহা বোরখা খুলে ফুল স্পিডে ফ্যান ছাড়লো। সারা শরীর ঘেমে চটচট করছে। ফোন বাজতেই দেখলো মিতুলের কল।
“কেমন আছিস?”
“আছি। তোর কি অবস্থা আপা? তুই কি ক্লাসে?”
“না মাত্রই রুমে আসলাম। কিছু বলবি?”
মালিহার মনে হলো মিতুল ইতস্তত করছে। কিছুটা গম্ভীর হয়ে মিতুল বলল, “আপা আমরা এখন মামা বাড়িতে।”
মালিহা চমকালো, “আমাকে তো মা কিছু বলল না।”
“বললে কি তুই আসতে দিতি?”
“মামা কি যেতে বলেছিল? এখন এভাবে কেনো গেলো?”
“বলেছে। নামের বলা। মা সব বেঁধেছেদে নিয়ে এসেছে আপা।”
মিতুলের কণ্ঠ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো।
“কি বলছিস!”
“সত্যি বলছি। মা বলেছে এখান থেকে স্কুলে যেতে। এতো দূর থেকে যাওয়া আসা করা যায় তুই বল? আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না আপা। তুই মা’কে বল আমাদের বাড়ি ফিরে যেতে।”
মালিহা ভেবে পাচ্ছিল না সে কি বলবে। নাজিয়া এমন একটা কাজ তাকে না বলে কিভাবে করলেন সেটাই বুঝতে পারছিল না সে।
“আচ্ছা আমি কথা বলব। তুই মন খারাপ করিস না। দুপুরে খেয়েছিস?”
“না। আমরা আসার পর থেকে শুধু ভর্তা ভাত দিয়ে যাচ্ছে। মা তো বোঝে না। এসব কেনো দিচ্ছে আমি জানিনা মনে হয়! মনে হচ্ছে ভিক্ষা করতে এসেছি।”
“রাগ করে থাকে না সোনা। খাবারের সাথে কিসের রাগ? তোর রিজিকে যে খাবার ছিল সেটাই তো খাবি তাই না? দুটো বেজে গেছে। যা খেয়ে নে ভাই। আমি মায়ের সাথে কথা বলব। প্রমিস! আমার কথা শুনবি না?”
“যাচ্ছি।” একরোখা স্বরে বলল মিতুল। মালিহা চিন্তায় পড়ে গেলো। ইদ্দতের এই সময়ে কি এমন দরকারে ওখানে যেতে হলো। কেনো মালিহাকে একটুও জানালেন না নাজিয়া? মালিহা ভাবলো গোসল করে খেয়ে তারপর মায়ের সাথে কথা বলবে। মা কেনো মামাবাড়ি থাকতে চাচ্ছে সেটা জানা দরকার।

“কোচিং সেন্টারে পড়াবে নাকি মালিহা?”
“জি আপু?” ভাবনায় মশগুল থেকে আঁখির কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারলো না মালিহা।
“আমার এক ক্লাসমেট একটা কোচিং চালায়। সিক্স টু টেন। সেকেন্ড গেটের সামনে। ওর সাথে কথা বলেছিলাম। সকালে দুই ঘণ্টা সময় দিতে পারলে মাসে হয়তো সাত আট পেতে পারো। ভেবে দেখো।”
“আমি পড়াবো আপু!” সাত আট হাজার! মালিহার যেনো বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। মুহূর্তেই হিসাব করে ফেলল সে। কোচিং থেকে সাত আর তিশাকে পড়িয়ে তিন। এইতো দশ হাজার হয়ে গেলো! এবার একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারবে না?
“ওকে। ওর নাম্বারটা নাও। আমি তোমার কথা বলেছি।”
মালিহা ভেবে পেলো না কিভাবে আঁখির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবে। মনিকা বলল, “সকালে দুই ঘণ্টা, বিকালে আবার দুই ঘণ্টা। বুঝিস মালিহা!”
মালিহা হাসলো। আর্থিক সমস্যা মেটানোর সুবর্ণ সুযোগ লুফে নেয়ার হাসি।

গোসল সেরে এসে এসব শুনতেই নীতি মালিহাকে বলল, “তোর বিগ ব্রোরে ফোন দিয়ে বল।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল, “কি বলব?”
“কোচিংয়ের ব্যাপারে।”
“আমি তো ফোন দিয়ে কনফার্ম করে ফেলেছি। তাহলে ভাইয়াকে আর কি বলতে হবে?”
ইতমিনানের সাথে দেখা হওয়ার কথা নীতিকে জানিয়েছে মালিহা। সেই সুবাদে সবটাই তার জানা।
“দেখ মালিহা। শহরে একজন পরিচিত মানুষ থাকা অনেক বেনিফিটেড একটা বিষয়। আর সে শুধু তোর পরিচিত না, একেবারে আপন চাচাত ভাই। তার সাথে তুই প্রবলেম শেয়ার করলে, পরামর্শ চাইলে বিপদের সময় তাকে পাশে পাবি। নয়তো হুট করে যখন তোর দরকার হবে তখন সাহায্য চাইবি কিভাবে? আর তাছাড়া ব্যাটা এক্সপেক্ট করে তুমি তারে ফোন দিবা। একটু দাও না কেনো মালিহা? হু?”
নীতির মুখে কুশন ছুড়ে মারল মালিহা। চোখ রাঙিয়ে বলল, “বলেছি না এসব মজা করবি না?”
“মজা না দোস্ত। চোখ খুলে দেখলে তুই নিজেই বুঝতে পারবি। বাদ দে। ক্যান্টিনে যাই চল।”
“গোসল করিনি তো!”
“পরে করিস। আমার খিদা লাগসে।”
মালিহার হাত টেনে ধরে নিয়ে গেলো নীতি।

সন্ধ্যার তখন কেবল শুরু। ইতমিনান আজ বেশ কয়েকটা উপন্যাসের বই কিনে এনেছে। রাতের সময়টুকু এগুলো পড়ে কাটালে একা একা লাগবে না বলে তার ধারণা। অবশ্য এই একা লাগাটা নতুন ধরনের। এ সময় পরিবারের কাউকে মনে পড়ে না। মন মস্তিষ্ক শুধু একটা নিজের মানুষ চায়। একা ফ্ল্যাটে চাওয়াগুলো যেনো শরীরের উপর হামলে পড়ে। বেশ বিব্রত হয় ইতমিনান যখন সেসময় পরিচিত মেয়েলি চেহারাটা চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে। যেনো শুধু ঐ মুখটা দেখলেই এই একা লাগাটা কেঁটে যাবে। এক আধবার ভাবে ভার্সিটিতে গিয়ে মেয়েটার সাথে একবার দেখা করে আসতে। কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্ক যুক্তির পাহাড় বানিয়ে আটকে দেয়। আজ সেসব মনে আসার আগেই একটা বই নিয়ে বসলো সে।

উপন্যাসের যখন এক তৃতীয়াংশ শেষ হয়েছে তখন ইতমিনানের মনে হলো আজকের সবচেয়ে বড় ভুল এই বই নিয়ে বসা। নায়িকার চরিত্রে থাকা মেয়েটা যেনো খোদ মালিহা। ক্ষণে ক্ষণে তার উক্তি, তার বর্ণনা ইতমিনানের মনকে আরো অস্থির করে তুলল। ইতমিনান অবাক হয়। এ কেমন অনুভূতি? মালিহাকে সে দেখছে সেই ছোট্ট বেলা থেকে। তার চোখের সামনেই মেয়েটা এক থেকে বাইশে এসেছে। তবে হঠাৎ কেনো এই অস্থির অনুভূতির জন্ম? এটা কি শুধু মায়া? বাবা হারা মেয়েটার প্রতি এক টুকরো সহানুভূতি? ইতমিনান জানে না। তবে ক্লান্ত মস্তিষ্ক আজ তাকে যুক্তি দিয়ে আটকে রাখতে পারে না। বই-টই ফেলে সে ছুটে যায় ভার্সিটির পথে।

হলের সামনে পৌঁছানোর পরই ইতমিনানের টনক নড়ে। চলে তো এসেছে। কিন্তু মালিহাকে কি বলবে? কেনো এসেছে দেখা করতে? আবার ফেরত যায় ক্যাম্পাসের দিকে। বেশ কয়েকটা দোকান তখনও খোলা। ছেলেরা চায়ের আড্ডায় দুরুহ, জটিল কোনো বিষয়ের মীমাংসা করতে ব্যস্ত। দোকানে ঢুকে আতিপাতি করে বাটার বান খুঁজলো ইতমিনান। চার পাঁচ বছর আগের মালিহার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে সে জানে। এখন কি মেয়েটার খাদ্যাভ্যাস বদলেছে? আর না ভেবে আগের ধারণা অনুযায়ী খাবার কিনলো ইতমিনান। পাঁচটা বাটার বান, এক হালি কলা, কয়েকটা কাপ নুডুলস, কফির প্যাকেট নিয়ে পলিথিন ভর্তি করে ফেলল। যাক! এবার দেখা করতে যাওয়া যাবে। চেনাজানা মানুষ তো খাবার নিয়ে দেখা করতে আসতেই পারে। তাই না? যেনো নিজেই নিজেকে বোঝাতে চাইলো ইতমিনান

হলের ওয়েটিং রুমে বসে মালিহাকে কল করলো সে। পাশেই হল প্রভোস্টের রুম। ইতমিনানের মনে হলো প্রভোস্ট যেনো নজরদারি করতে পারে এজন্যই এটাকে ওয়েটিং রুম বানানো। সে হোক! সে তো মেয়েটাকে এক নজর দেখেই চলে যাবে।

.

মালিহা ইতমিনানকে কল দেয়ার কথা চিন্তা করছিল। তার আগেই ইতমিনানের কল এলো। মালিহা হতাশ নিশ্বাস ফেলল। সে একবারও আগে কল দিতে পারে না।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো ভাইয়া?”
“এইতো আছি। তুই হলে না?”
“হ্যাঁ।”
“একটু নিচে আসতে পারবি? ওয়েটিং রুমে?”
“কেনো? তুমি কি এসেছো নাকি?”
“হ্যাঁ। ঐ.. মাত্রই এলাম।”
হঠাৎ উত্তেজনায় মালিহা দৌঁড়ে বারান্দায় চলে এসেছিল। আবার রুমে ফেরত যেয়ে ওড়না নিয়ে ভালো করে মাথায় দিলো। কি আজব কথা! ইতমিনান নাকি এখানে!

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১১

ওয়েটিং রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল মালিহা। দোতলা থেকে ছুটতে হয়েছে অল্পই। কিন্তু জং ধরা পা নিয়ে দৌঁড়াতে যেয়ে হাঁপিয়ে গেছে বেশ। বুকের উচাটন থামছে না। কোমরে এক হাত রেখে এক জিরিয়ে নিলো মালিহা। থাই গ্লাসের দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে বসা ইতমিনানকে দেখা যাচ্ছে। এদিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে আছে সে। মালিহার কেমন যেনো লাগলো। এর আগে যতবার মতিয়ার আলী এসেছেন প্রত্যেকবার মালিহাকে আগে থেকে জানিয়ে এসেছেন। এভাবে হুট করে এসে কেউ তাকে চমকে দেয়নি। মালিহা জানে না ইতমিনান তাকে চমকে দেয়ার উদ্দেশ্যে এসেছে নাকি। তবে তার ভালো লাগলো। অচেনা শহরে পরিচিত একটা মানুষ হুট করে তার খোঁজ নিতে এসেছে। খারাপ লাগার কোনো কারণ নেই।
দরজা ডানে সরিয়ে ওয়েটিং রুমে ঢুকলো মালিহা। হালকা কাশি দিতেই ইতমিনান এদিকে ঘুরল। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো দুজনার। মালিহার অস্বস্তি লাগলো। চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। তবে ইতমিনান চোখ ভরে দেখে নিলো মালিহাকে। একটু দেখার জন্যই তো এই ছুটে আসা। নেভি ব্লু কালারের একটা ওড়না মালিহার মাথায়। তার মাঝে গোলগাল মুখটা যেনো ফুটে উঠেছে। এক গাছি চুল ওড়নার শাসন অমান্য করে বাহিরে উঁকি দিচ্ছে। অবাধ্য চুলগুলো চোখেমুখে পড়ে লুকানো সৌন্দর্যের ঠিক কতখানি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে ইতমিনান জানে না। তবে তার অস্থিরতা যে কমে এসেছে, অন্তর্দ্বন্দ্ব থেমে যে বুকটা শান্ত হয়েছে এটুকু সে জানে। শুধু এটুকুই তো চেয়েছিল সে। এর বেশি কি?
“কেমন আছিস?”
“ভালো। তুমি হঠাৎ?”
“এদিকেই এসেছিলাম একটা কাজে।”
কথা শেষ করলো না ইতমিনান। অযথা মিথ্যা বলার কোনো মানে হয় না। হাতের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো মালিহার দিকে। মালিহা যেনো হকচকিয়ে গেলো।
“এগুলো কি?”
“তোর জন্য নিয়ে এলাম।”
ইতমিনান তার ডান হাত বাড়িয়ে আছে। মালিহার হঠাৎ মনে হলো তার স্মৃতিকুঠি থেকে একটা সুন্দর ঘ্রাণ বের হয়ে চারপাশটা ঘিরে ফেলেছে। ঘ্রাণের আবহে সে হারিয়ে গেছে অনেক বছর আগে। যখন সে ফ্রক করে ঘুরে বেড়াতো। বাড়িতে এলেই ইতমিনান তার জন্য চকলেট নিয়ে আসতো। সেই কিশোর ইতমিনান যেনো তার সামনে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ তো!
“কি রে! নে?”
সুন্দর আবহ থেকে বের হলো মালিহা। হাত বাড়িয়ে পলিথিনটা ধরলো। তার সামনে কিশোর নয়, যুবক ইতমিনান দাঁড়িয়ে আছে।
“আমি আজ তোমাকে ফোন করতাম।”
“তাই?” যেনো মজার একটা কৌতুক শুনলো ইতমিনান। মালিহা রুষ্ট হলো।
“হ্যাঁ। কেনো? তোমাকে ফোন করা নিষেধ?”
“তোর ফোনের আশায় থাকতে থাকতে তো আমি বুড়ো হয়ে যাবো। তোর নাম্বার নিয়েছি কবে? এর মাঝে কতবার ফোন দিয়েছিস তুই?”
“তোমার নাম্বার আমার কাছে আছে কতো বছর ধরে জানো?” শান্ত কণ্ঠে বলল মালিহা।
ইতমিনান বিব্রত কণ্ঠে বলল, “কাউন্টার অ্যাটাক করা তো ভালোই শিখেছিস। এখানে ডিবেট করছিস নাকি?”
মালিহা দেখলো ইতমিনানের টি শার্টের গলার কাছটা ভিজে গেছে। সুইচ বোর্ডের কাছে যেয়ে ফ্যান অন করে সেখানে চেয়ার টেনে ইতমিনানকে উদ্দেশ্য ক্রি বলল, “বসো।”
ইতমিনান বসলো। মালিহা পলিথিন একপাশে রেখে বের হতে গেলে ইতমিনান বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”
“আসছি।”
পাশেই হলের ক্যান্টিন। আটটা বেজে গেছে কি? মালিহা ধারণা করলো এখন শেষ বেলার পাস্তাটুকু পাওয়া যেতে পারে। ধারণা সত্যি হলো। অল্প একটুই ছিলো। সাথে দুটো পেঁয়াজু নিলো মালিহা। একটা ঠান্ডা পানির বোতল।
“বিলটা পরে দিয়ে দেবো খালা। আর বাটি আমি দিয়ে যাচ্ছি।”
দোকানীকে কথা দিয়ে বের হয়ে এলো মালিহা। ওয়েটিং রুমে ঢুকে ইতমিনানের সামনে ধরলো সেগুলো।
ইতমিনান অবাক হলো বেশ। এখানে এসে আতিথেয়তা পাওয়ার কোনো আশাই তার ছিলো না। তবুও মালিহার বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে পানির বোতলটা নিলো আগে। আরেকটা চেয়ার টেনে মালিহা বসলো মুখোমুখি।
ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি খেয়ে ইতমিনান বলল, “অতিথি আপ্যায়ন করছিস?”
“হ্যাঁ। তুমি খাবার দাবার নিয়ে বেড়াতে আসতে পারো আমি আপ্যায়ন করলে কি দোষ?”
“দোষ দিচ্ছে কে? দে তোর হলের পাস্তা খেয়ে রিভিউ দিই।”
“রিভিউ দেয়া লাগবে না। ও আমি জানি।”
“আমাকে ফোন করতে চেয়েছিলি কেনো?”
এতক্ষণে নড়েচড়ে বসলো মালিহা।
“সেকেন্ড গেটের ওখানে এক বড় ভাইয়ের কোচিং আছে। সেখানে কাজ করার অফার পেয়েছি।”
মুখ নাড়ানো থামিয়ে এক পলক মালিহার মুখের দিকে তাকালো ইতমিনান। মেয়েটার মুখে একটা অপ্রকাশিত খুশির আভা।
“বড় ভাই বলতে?”
“আমাদের ভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে। আমার রুমমেট আপুর ক্লাসমেট।”
“কোন ক্লাস?”
“সিক্স থেকে টেন।”
“কথা হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“বেতনের কথা কিছু বলেছে?”
“বলল প্রথমে সাত দেবে।”
“ভালোই তো।”
মালিহা ইতমিনানের মনের অবস্থা বুঝলো না। খুশি নাকি রাগ? মুখ এমন আটকে রাখলে কেউ বুঝবে কিভাবে?
“ইয়ে.. তুমি একটু খোঁজ নেবে?”
“কিসের খোঁজ?”
“এই.. কোচিং কেমন এসব।”
“আমার খোঁজ নেয়ার কি দরকার? তুই তো নিজেই সব কনফার্ম করেছিস।”
রেগে গেছে। এতক্ষণে বুঝলো মালিহা। কেনো এতো রাগ? অ্যাডমিশনের সময় তুমি সাথে ছিলে? যখন বাড়িঘর ছেড়ে এখানে চলে এলাম তখন ছিলে? এখন এতো রাগ কোত্থেকে আসছে? মনে ভাবলেও মুখে কিছু বলল না মালিহা। শুধু শুধু আর রাগানোর দরকার নেই।
“আমি তো শুধু একটু কথা বলেছি। তুমি খোঁজ নাও। ভালো না লাগলে আর আগাবো না।”
ইতমিনানের মুখের টানটান পেশীগুলো যেনো একটু নরম হলো। তেমনই মনে হলো মালিহার। কাজ হয়েছে নাকি?
“নাম্বার দে।”
ঝটপট ফোন থেকে নাম্বারটা দিলো মালিহা। তখনই মায়ের মামাবাড়ি চলে যাওয়ার কথাটা মনে পড়ল। বিকেলে ফোন দিলেও নাজিয়া ধরেননি। মুখটা মলিন হয়ে গেলো মালিহার। ইতমিনান সেটা খেয়াল করে বলল, “কেউ কি হুম-কি দিয়ে মেসেজ দিয়েছে?”
“আমাকে কেউ হুম-কি দেবে কেনো?”
“তাহলে মুখটা কালো করে ফেললি কেনো?”
ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল ইতমিনান। মালিহা মলিন কণ্ঠে বলল, “মা মিতুলকে নিয়ে মামাবাড়ি চলে গেছে।”
“জানি।”
“কিভাবে জানো?”
“বাবা বলেছে।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান। “চাচী কখনোই আমাদের সাথে থাকতে চায় না রে মালিহা।”
মালিহার কষ্ট লাগলো। কষ্ট নিয়েই বলল ইতমিনান। বলেই মনে হলো একটা অতি জটিল বাস্তবতা নিজের সামনে প্রকাশিত হয়ে গেলো। যেই বাস্তবতা তাকে রুখে দেয়। তার অনুভূতিতে লাগাম টানতে বলে।

মিলির মেজাজ বিগড়ে আছে। তার ননদ এসেছে সপ্তাহের উপরে হয়ে গেলো কিন্তু যাওয়ার কোনো নামগন্ধ নেই। ভাইয়ের বাড়ি এসে থাক তাতে মিলির কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু রাতের বেলা নিজের সাত মাসের বাচ্চাটা তার বরের ঘাড়ে গছিয়ে দিয়ে নিজে শান্তির ঘুম ঘুমায়। একদিন দুইদিন ঠিক আছে। কিন্তু নিত্যকার রুটিন হয়ে যাওয়ার পর মিলি আর স্বস্তির ঘুম ঘুমাতে পারেনি। নিজের এখনও বাচ্চা কাচ্চা হয়নি। আনাড়ি হাতে ঐটুকু বাচ্চার দেখভাল করতে যেয়ে সে কাহিল হয়ে যায়। তার বরের আর কি? দুই তিনবার কোলে নিয়ে এসে সেই যে সটান হয়ে ঘুম দেয় বান্দা সকালের আগে আর কোনোভাবেই চোখ খোলে না। নির্ঘুম রাতগুলো যেনো মিলির মেজাজের পারদ আর এক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘরবাড়ি জ্বা-লিয়ে দিতে মন চাচ্ছে। কিন্তু তেমন কিছু করা যাবে না। তাহলে শাশুড়ি খ্যাচ খ্যাচ করার আরেকটা সুযোগ পাবে। মা মেয়ে মিলে ছেলেকে পুত্রবধূর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবে। মিলি বোকার মতো কিছু করবে না। এতদিন খুব কৌশলে শাশুড়ির রোষানল বাঁচিয়ে চলেছে। তবে আজ কেনো তাড়াহুড়োয় ভুল করা?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলো মিলি। চোখের নিচটা কালো হয়ে আছে। চট করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। আই শ্যাডোর বক্সটা বের করে নিপুণ হাতে চোখের নিচে আরেকটু ডার্ক সার্কেল এঁকে নিলো। মেকআপের কারসাজি দিয়ে মুখটা আরেকটু রুগ্ন করে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় যেয়ে বসলো। হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো। মিনিট পাঁচেক পর গোসল করে বের হলো মিলিয়ে স্বামী আরিফ। মাথা মুছতে মুছতে বিছানার সামনে দাঁড়ালো। মিলি আর যাই করুক আরিফের খেয়াল রাখতে কখনও গাফিলতি করে না। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে তার জামা কাপড় নিজেই গুছিয়ে সামনে এনে দেয়। আজ নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ায় স্ত্রীর দিকে তাকালো আরিফ। তখনই আঁতকে উঠলো সে। মিলিকে কি ভীষণ রুগ্ন দেখাচ্ছে!
“অ্যাই! কি হয়েছে তোমার?”
মিলি অলস ভঙ্গিতে চোখ খুলল। আরিফকে এক পলক দেখে বলল, “রাতে ভালো ঘুম হয়নি। মাথা ব্যাথা করছে।”
কথা সত্য। মিলির মাথা প্রকৃতই টনটন করছে। আরিফের মনটা অপরাধবোধে ছেয়ে গেলো। ঘড়ির দিকে একবার দেখে মিলির কাছে যেয়ে মাথায় হাত রেখে বলল, “শুয়ে থাকো। একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি মা’কে বলে যাচ্ছি যেনো তোমাকে না ডাকে।”
“আরে না! শেলী ওর ছেলেকে নিয়ে একা পারে নাকি? তোমার বলার দরকার নেই। মা আবার কিছু মনে করলে আমার খারাপ লাগবে।”
“নিজের ছেলে রাখতে পারবে না কেনো? এতদিন তো তুমি রেখেছোই। অসুস্থ হলে কি করবে? মা যদি জানে তোমার শরীর খারাপ তাহলে কিছুই বলবে না।”
“ছাই জানো তুমি!” মনে মনে ভেংচি কেঁটে হাজার কথা বললেও মুখে কিছু বলল না মিলি। আলগোছে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। পিঠটা ব্যাথা করছে।
“টেবিলের ওপরে তোমার খাবার আর টিফিন রেখে দিয়েছি। একটু কষ্ট করে খেয়ে নিও।”
“ আমি খেয়ে নিবো। তুমি ঘুমাও তো।” পোশাক বদল করতে করতে উত্তর দিলো আরিফ। শেলীকে কিছু বলার দরকার। নিজের বাচ্চা মানুষ কতদিন রাখতে পারে? যখন মা নিজে সুস্থ সবল হয়ে আরামের ঘুম ঘুমায়।
আরিফ বেরিয়ে যেতেই হাই তুলল মিলি। ঘুমে চোখটা বুজে আসছে। কিন্তু আর একটা গুরুত্বপূর্ন কাজ বাকি। মাথায় এই পোকাটা কবে থেকেই ঘুরছে। সুযোগের অভাবে পোকাটা আরেকজনের মাথায় ট্রান্সফার করা হচ্ছে না।

.

মেয়ের ফোন পেয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে হাত ধুয়ে নিলেন আয়েশা। গরমে গলা ঘেমে গেছে। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ফ্যানের নিচে দাঁড়ালেন।
“হ্যালো! কেমন আছিস?”
“আমি আছি আমার মতো। এখন তুমি কি বলবে তার উপরে ভালো খারাপ বলতে পারবো।”
“কেনো আমি কি খবর পড়ি নাকি যে তোকে ভালো, খারাপ খবর দিতে পারবো?” কৌতুক করে বললেন আয়েশা। তবে মিলি মোটেও সেই মেজাজে নেই। একে শরীরের বেহাল দশা তার ওপর নতুন চিন্তা। বিরক্ত হয়ে সে বলল, “ইয়ার্কি রাখো। তোমার ছেলের খবর বলো।”
গরম কণ্ঠে আয়েশা বললেন, “তোর ভাই হয়। সম্মান দিয়ে কথা বলবি।”
“ভাই ওটা মিতুলের। তুমি তোমার কলিজার ছেলের খবর বলো।”
“আছে ভালোই।”
“আছে না গেছে?”
“তোর হেয়ালি কথা রাখ তো মিলি। সোজা করে বল। নাহলে আমি ফোন রাখলাম।”
“ইহ! আমার কথা এখনই ভালো লাগছে না।” ভেংচি কেঁটে বলল মিলি। “তোমার ছেলের ওদিকে যে মালিহা থাকে তা জানো?”
“জানি। ইতু নিজেই বলেছে মালিহার ভার্সিটির পাশেই ও থাকে।”
“একটু দেখে শুনে রেখো তোমার ছেলেকে। তার তো আবার দয়ার শরীর। সেই দয়ার মাঝে আবার তোমার জা মালিহাকে ডুবিয়ে না দেয়।”
“কি বলতে চাচ্ছিস বল তো?” আয়েশাকে চিন্তিত দেখালো।
“ভাইয়ার চোখে তো ন্যাবা। মালিহাদের কোনো দোষই সে দেখতে পায় না। তার উপর থাকেও আবার সেই মেয়ের পাশে। কখন কি হয়ে যায় তার ঠিক আছে?”
আয়েশা কিছুক্ষণ থমকে রইলেন। এই চিন্তা তো তার মাথায় আসেনি। মিলি ফোন রেখে দিলো বটে। তবে নিজের মাথার পোকা আয়েশার মাথায় ঢুকিয়ে। ফুটন্ত তরকারি সামনে আয়েশা দাঁড়িয়ে রইলেন চিন্তিত ভঙ্গিতে। তার এখন কি করা উচিত?

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:১২

ইতমিনান খুব মন দিয়ে খিচুড়ি রান্না করছে। বেশ অনেকদিন আগেই একটা প্রেশার কুকার কিনেছিল সে। মন ভালো থাকলেই খিচুড়ি খাওয়া তার শখের পর্যায়ে পড়ে। আজ তার মন ভালো। কেনো ভালো সেটাও তার জানা। তবে সেই জানা জিনিসটা নিয়ে সে ঘাটাঘাটি করতে চায় না। মস্তিষ্ককে এক রকম ফাঁকি দিতেই এই রান্না রান্না খেলা।

বেশ কয়েকটা সিটি হয়ে গেছে। আর একটা হলেই নামিয়ে ফেলবে। এমন সময় আয়েশা বেগমের কল এলো। হাত ধুয়ে কল রিসিভ করলো ইতমিনান। নরম স্বরে সালাম দিয়ে কথা শুরু করলো।

“কি করো আব্বা?”
“খিচুড়ি রান্না করছিলাম।”
আয়েশা বেগম হাসেন। ছেলেটা কেমন একা একাই রান্না করে খায়।
“রান্না বান্না করতে কতো কষ্ট হয়! সারাদিন খাটাখাটনি করে এসে এই ঝামেলা ভালো লাগে? এই জন্যেই তো বিয়ে দিতে চাই।”
“বউ কি শুধু রান্না করে খাওয়ানোর মানুষ মা? একজন মানুষ মানে একটা দায়িত্ব। বউ মানে আরো বড় দায়িত্ব। এতো বড় দায়িত্ব নেয়ার মতো সামর্থ্য এখনও তোমার ছেলের হয়নি।”
শেষ সিটি বাজলো। চুলা বন্ধ করে ডিম নিলো ইতমিনান। এটা ভাজলেই এখন খেতে বসা যায়।
“তোর যতো আজগুবি কথা। রিকশা চালায় রাসেল, ওর ছেলেরে সেদিন বিয়ে দিলো না? আশপাশে মানুষ বিয়ে করছে না?”
“রাসেল চাচার ছেলের বউয়ের মতো ছেলের বউ চাও তুমি?” ইতমিনানের স্বরে কৌতুক। “তাহলে খোঁজো যাও।”
“ফাজলামি করবি না ইতু!” আয়েশা বেগম যেনো ধরা খেয়ে গেলেন।
ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে কড়াইয়ে তেল ঢাললো ইতমিনান। আয়েশা বললেন, “হ্যাঁ রে! মালিহা কেমন আছে?” আয়েশার বুক ধুকপুক করছে। ইতমিনান সেটা বুঝলো না। ডিম ফাঁটিয়ে কড়াইয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, “ভালোই আছে।” আয়েশার মনে হলো তেল নয়, তার কলিজাটা ছ্যাঁত করে উঠেছে। তার মানে ইতমিনান মালিহার নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছে?
কথা শুনতে না পাওয়ায় ফোন কানে ধরলো ইতমিনান, “মা?”
আয়েশার যেনো ধ্যান ভাঙলো, “হ্যাঁ?”
“কি হলো কথা বলছ না কেনো?”
আয়েশা চিন্তায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলেকে আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
“আচ্ছা তুই খা। আমি আবার পরে ফোন করবো।”
“আচ্ছা।” ইতমিনান অতো শত বুঝলো না। ক্ষুধায় তার পেট মোচড় দেয়া শুরু করেছে। একটুখানি পাস্তা খেয়েছে সেই কখন!

.

রাশেদা বেগমের ঘরে বসে আছেন মকবুল আলী। মায়ের ওষুধ পত্র নিয়ে এসেছেন। কথা বার্তা বললেও কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাকে।
“কি এতো চিন্তা করো?” রাশেদা নরম সুরে প্রশ্ন করলেন। মকবুল আলী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “জমি জমার একটা সুরাহা না হলে শান্তি পাচ্ছি না মা। এর মধ্যে মালিহার মা চলে গেলো বাপের বাড়ি। আমার ভাইয়ের ভিটা এখন খালি পড়ে আছে।”
রাশেদার বুকটা হু হু করে উঠলো। যেই জমি নিয়ে এতো টালবাহানা সেই জমিওয়ালা আজ বাড়ি ছাড়া, দুনিয়া ছাড়া।
“বড় বউ তো রাজি না। এর মধ্যে আবার এসব কথা তুললে অশান্তি শুরু হবে। তুই আগে বউরে বোঝা। তারপর আবার কথা তুলিস।”
আয়েশা হন্তদন্ত হয়ে শাশুড়ির ঘরে ঢুকলেন। রাশেদার দিকে একবার তাকিয়ে স্বামীকে বললেন, “আপনি একটু এদিকে আসেন তো।”
রাশেদা ভয় পেলেন যেনো।
“কোনো সমস্যা বউ মা?”
“না মা। সমস্যা নাই। একটু দরকার।”
মকবুল আলী ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে গেলেন। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আয়েশা যেনো জেঁকে ধরলেন।
“ছেলেটা এতো বড় হয়ে গেলো আপনি এখনও একটা সম্বন্ধ দেখেন না কেনো?”
হঠাৎ আলাপে মকবুলের কপালে ভাঁজ পড়ল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলেন।
“সম্বন্ধ তো আসেই। তোমার ছেলেই নিষেধ করে দেয়। পাত্র রাজি না থাকলে আমি কি করি পারি?”
“পাশের বাড়ির তালুইয়ের মতো কথা বলেন কেনো? ছেলে মেয়ের জিম্মা আমাদের না? বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। এখন বসায় রাখবো কেনো? ছেলে না হয় বুঝতে পারছে না। আপনি কই বোঝাবেন সেসব না করে নিজেও তাল দিচ্ছেন।”
“তুমি আবার এখন এসব নিয়ে পড়লা কেন?” মকবুল বিরক্ত হলেন।
“এসব আবার কি? আপনার মতো সারাক্ষণ ভাইরে কিভাবে সব সম্পত্তি দিয়ে দেয়া যায় সেই চিন্তা করব নাকি?”
“উল্টাপাল্টা কথা বলবা না আয়েশা।”
“কিছু উল্টাপাল্টা বলি নাই। বাপ মরা মেয়ে নিয়ে চিন্তায় আপনি রাতে ঘুমান না। সেই মেয়ের গতি করতে যেয়ে আমার ছেলেমেয়ের কপাল পুড়লে আমি মানবো কেনো?”
আয়েশা উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। মকবুল বুঝলেন না এতো রাগারাগির কারণ কি। বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, “তোমার এতো রাগের কি কারণ সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। আর এখানে ছেলেমেয়ের কথা আসছে কেনো? ওদের কোনো ক্ষতি আমি চাই?”
“অতো কিছু আমি বুঝি না। ওদের চিন্তা করতে যেয়ে ঐ মেয়েকে যদি আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দেন তাহলে সেদিন এই সংসারে আমার শেষ দিন।”
চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে আয়েশা নিজের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে ফেললেন। হনহনিয়ে চলে গেলেন ঘর ছেড়ে। মকবুল আলীর কপালের ভাঁজ সমান হলো। সহসাই ভাবলেন এই ভাবনাটা তার মাথায় আগে কেনো আসেনি? নিজের মাঝে এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করলেন মকবুল আলী।

ডিপার্টমেন্ট থেকে ট্যুরে যাচ্ছে। সেই নিয়ে সবার উত্তেজনার শেষ নেই। মালিহা যাবে না। তাই নীতিও যাচ্ছে না। এহসান বিষয়টা মানতে পারলো না। ক্লাস গ্যাপের মাঝে নিজের আসন ছেড়ে উঠে এলো মালিহার কাছে। কণ্ঠে অধিকার নিয়ে বলল, “এই মালিহা! তুমি যাবে না কেনো? তোমার আর নীতির ট্যুর আমি স্পন্সর করবো। কোনো না শুনছি না। নীতি! গোছগাছ শুরু করে দে।”
শেষটুকু নীতিকে উদ্দেশ্য করে বলল এহসান। শিটের পাতা ওল্টানোর মাঝে এমন বাক্য মালিহা আশা করেনি। চুপচাপ সবটুকু শুনলো সে। এহসানের বলা শেষ হলে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এতো দয়া দেখানোর জন্য ধন্যবাদ এহসান। আমি তোমার অফার গ্রহণ করছি না। এবং আশা করব এমন করে ভবিষ্যতে আমাকে দয়া করতে আসবে না।”
নীতি ঢোক গিললো। মালিহা চটেছে। এহসানের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “খুব উপকার করেছিস! কে চেয়েছে তোর অফার বলদ?”
এহসান থতমত খেয়ে গেছে। মালিহার প্রতিক্রিয়া দেখেই বুঝতে পেরেছে বিষয়টা সে একদমই পছন্দ করেনি। এলোমেলো ভঙ্গিতে সে বলল, “মালিহা তুমি কি মাইন্ড করলে নাকি? এটা আমার পক্ষ থেকে জাস্ট একটা ট্রিট।”
“কি উপলক্ষ্যে?” মালিহার কণ্ঠ শান্ত। এহসান আমতা আমতা করে বলল, “আসলে আমি ভেবেছি তোমার মন খারাপ সেজন্য তুমি যেতে চাচ্ছো না। এছাড়া এই কিছু না। তোমাকে হার্ট করার কোনো ইন্টেনশন আমার ছিলো না। ট্রাস্ট মি!”
“আমি যেতে চাচ্ছি না এহসান। নীতি যাবে কি না সেটা ওর বিষয়।”
ক্লাস ছেড়ে চলে গেলো মালিহা। নীতি কটমটিয়ে এহসানের দিকে তাকিয়ে বান্ধবীর পিছু নিলো।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-০৯

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৯

মিতুল বেজায় বিরক্ত। মা’কে যথেষ্ট বোঝানো হয়েছে। মিতুল বুঝতে পারছে নাজিয়া জেদ ধরেছেন। কিন্তু জেদটা ঠিক কার উপরে? মালিহা নাকি মকবুল আলী? মকবুল আলীর সাথে জেদ ধরে তার লাভটা কি! দাদির ঘরে গেলো মিতুল। তিনি যদি অন্তত নাজিয়াকে বোঝাতে পারেন।
“দাদি?”
রাশেদা বেগম শুয়ে ছিলেন। নাতির ডাকে উঠে বসলেন।
“আসো। ভেতরে আসো।”
“তোমার শরীর কেমন এখন?” ভেতরে আসতে আসতে বলল মিতুল।
“আলহামদুলিল্লাহ। ভালো। কিছু বলতে চাও?” মিতুলকে উশখুশ করতে দেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন।
“দাদি মা মামাবাড়ি যেতে চায়।”
রাশেদার ভুরু কুঁচকে গেলো।
“ইদ্দত তো সে হয়নি। দুইদিন পরে গেলে কোনো সমস্যা?”
“উফ তুমি বুঝতে পারছ না। মা ওখানে থাকতে যাচ্ছে। বেড়াতে না।”
রাশেদা চমকে উঠলেন। “কেনো? এখানে কি সমস্যা?”
“আমি জানিনা। তুমি মা’কে আটকাও। আমি অন্য মানুষের বাড়ি যেয়ে থাকতে পারবো না।”
নিজের কথা শেষ করে চলে গেলো মিতুল। রাশেদা চিন্তিত মুখে ঘর ছাড়লেন। নাজিয়ার এমন কাজের কারণ কি?

“ছোট বউ?”
নাজিয়া হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলেন।
“জি মা?”
“তুমি কি ব্যস্ত?” কৌশলে কথাটা জানতে চাইলেন রাশেদা। মিতুলকে মাঝে আনতে চাইলেন না।
“একটু গোছগাছ করছিলাম।”
“কিসের গোছগাছ?”
“ভাইয়ের ওখানে যাবো কয়েকদিনের জন্য?”
“তা যেও। কিন্তু তোমার ইদ্দতটা অন্তত শেষ হোক। এ সময় জরুরী প্রয়োজন ছাড়া স্বামীর ঘর থেকে বের না হওয়াই উত্তম।”
“আমার ভাই আমাকে যেতে বলেছে।” মুখ গোজ করে বললেন নাজিয়া।
“খুব বলেছে। যাওয়ার আগে একবার বলে নিয়ম রক্ষা করে গেছে। এতদিনে একবারও ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে? মা’কে বোঝাও দাদি। আমি ওখানে যেয়ে থাকতে পারবো না।”
ছেলের দিকে গরম চোখে তাকালেন নাজিয়া।
“আমার বাপের বাড়ি নিয়ে তোর এতো অসুবিধা কেনো? দুটো দিন যেয়ে থাকবো তাতে এমন করছিস কেন হ্যাঁ?”
“দুটো দিন? চারটা পাঁচটা গাট্টি হয়েছে দুটো দিনের জন্য? আমাকে কি তোমার অবুঝ বাচ্চা মনে হয়? মানুষের বাড়িতে আমি থাকতে পারবো না। আমার বাবার কি ঘরবাড়ি কিছু নেই?”
“আছে না! তোর বাপ তো জমিদার ছিলো। তোর জন্যে রাজ্য রেখে গেছে। খা! তুই আর তোর বোন মিলে ওগুলোই খা।”
রাশেদা ছেলেকে ডেকে আনলেন। কিন্তু নাজিয়া তাকে দেখে আরো ক্ষেপে উঠলেন যেনো। মকবুল আলী তাকে বোঝাতে গেলে কিছু তো শুনলেনই না। উল্টো কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন। এসব শুনে আয়েশা এসেও দুই কথা শুনিয়ে যেতে ভুললো না। মকবুল আলী হতাশ হয়ে রাশেদাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মিতুল অসহায় মুখে বসে রইলো। ক্রমেই তার চোখ ভিজে এলো। অতঃপর তাকে এক উদ্বাস্তুর জীবন পার করতে হবে? মা’কে তো সে একা ছাড়তে পারবে না। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলো মিতুল। জীবনের সুতোয় যেনো একের পর এক গিট লেগেই চলেছে।

নিজের কাছে জমানো চার হাজার টাকা ইরিনার হাতে তুলে দিলো মালিহা। ইরিনা তাকে জড়িয়ে ধরলো। মালিহার যেনো দম আটকে গেলো। ইরিনা কান্না মাখা কণ্ঠে বলল, “আগামী মাসের শুরুতেই তোমার টাকাটা ফিরিয়ে দেবো মালিহা। আব্বুর বেতনটা ওঠাতে যতটুকু দেরি।”
“ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা সমস্যা নেই। এসব নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। তুমি এই কয়েকদিন বাড়িতে থাকবে তো?”
ইরিনা দ্রুত মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ বাড়িতেই থাকবো। ক্লাসের যে কি হবে!”
“আমার থেকে নোট নিও।”
“তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব মালিহা। আমার কতো বড় উপকার করলে তুমি নিজেও জানো না। তোমার কাছে শেষ একটা অনুরোধ।”
“এভাবে বলছো কেনো? নিঃসঙ্কোচে বলো।”
“এই টাকার বিষয়টা তুমি কাউকে জানিও না।”
“আরে না! পাগল নাকি!”
কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বিদায় নিল ইরিনা। রুমে আসতেই নীতি মালিহাকে জেঁকে ধরলো।
“তুই ওকে টাকা দিলি কেনো?”
মালিহা হকচকিয়ে গেল।
“তুই দেখলি কিভাবে?”
“তুই কি ওকে লুকিয়ে দিয়েছিস নাকি? বের হওয়ার সময়ই দেখেছি।”
মালিহা আমতা আমতা করলে নীতি আবার তাকে ধাক্কা দিলো।
“কথা বলিস না কেনো?”
মালিহা দোনামনা করলো। ইরিনা তাকে নিষেধ করে গেলো। কিন্তু নীতি তো নিজেই দেখেছে। বলতে গেলে জেনেই গেছে।
“ওর বাবা নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। খুব খারাপ অবস্থা। ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।”
“তো?”
“তো মানে? এমন সময় টাকা পয়সার সংকট হয় না? তাই আর কি..”
“যাদের হিসাবের টাকা তাদের সংকট হয়। ওদের তো বেহিসাবি টাকা। ওর বাবার কি বিরাট ব্যবসা জানিস?”
“ব্যবসা? তাহলে আমাকে বেতন তোলার কথা বলল কেনো?”
“ওর বাপের এক্সিডেন্ট তাহলে ও হলে কি করছে? ওর বাড়ি তো হুলুস্থুল লেগে যাওয়ার কথা।”
“সব গুছিয়ে নিতে এসেছে মনে হয়। বাদ দে তো।”
মালিহা বললেও নীতি বাদ দিতে পারল না। ইরিনা তার বাবার ব্যবসার ব্যাপারে মিথ্যা বলল কেনো?

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৯(বর্ধিতাংশ)

ফোন হাতে বসে আছে ইতমিনান। রনিকে কল করবে কি করবে না সেই সিদ্ধান্তটাই গত বিশ মিনিট ভেবে নিতে পারছে না সে। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে রনির সাথে বেশ সখ্যতা থাকলেও শেষদিকে তার সাথে বেশি যোগাযোগ করা হয়নি। ফোনও রনি নিজেই দিত। যোগাযোগ মূলত ওর জন্যই করা হয়েছে। ইতমিনান যখন এখানে নতুন জয়েন করলো তখন একদিন হঠাৎ রনির সাথে দেখা। সে নাকি এদিকেই থাকে। বেশ উৎফুল্ল হয়েছিল ছেলেটা। পুরোনো বন্ধুকে পেয়ে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেছিলো। কিন্তু ইতমিনান বরাবরই মুখচোরা। গল্পের আসরে সে শুধু শোভা বর্ধন করতে পারে। আসর জমাতে পারে না। ঠিক এই কারণেই চেনা বন্ধু কাছে থাকা সত্ত্বেও ছুটে যেয়ে তার সাথে গল্প করা হয় না। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে সেই অকৃত্রিম বন্ধুর কাছে ফোন দিতেও কেমন লাগছে। নিজে থেকে যোগাযোগ যা-ও করছে সেটাও প্রয়োজনের খাতিরে। নিজের উপরই বিরক্ত হলো ইতমিনান। একটু গরজ করে যোগাযোগ করলে এখন এই বিপাকে পড়তে হতো না।

“হ্যালো?”
চমকে উঠলো ইতমিনান। ফোনের দিকে নজর পড়তেই দেখলো রনির নাম্বারে কখন যেনো কল চলে গেছে। সে-ই ওপাশ থেকে কথা বলছে। রনির নাম্বার সামনে নিয়েই ভাবনা চিন্তা করছিলো সে। কখন যেনো চাপ লেগে কল চলে গেছে।
“হ্যালো রনি?”
“কিরে ইতমিনান? আজকে কি রাতের বেলায় সূর্য উঠেছে নাকি? তুই ফোন করলি! What a pleasant surprise!”
শেষটুকু বেশ নাটকীয় স্বরে বলল রনি। ইতমিনান বিব্রত হলো।
“লেগ পুল করা বাদ দে তো।”
“ওকে ওকে! তো বলুন! এই অধম আপনার কি কাজে আসতে পারি?”
“এভাবে বলছিস কেনো? আমি কি তোকে কাজ ছাড়া কখনও ডন দিই না?”
“না। ফোনই দিস না তার আবার কাজ!”
রনির স্বরে স্পষ্ট রগড়। ইতমিনান সিদ্ধান্ত নিলো আজ সেসব কিছু বলবে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল, “কেমন আছিস?”
“বউ ছাড়া যেমন থাকা যায় তেমনই আছি।”
“তুই কি সবসময় এই চিন্তাই করিস?”
“যতদিন বিয়ে না হচ্ছে ততদিন এটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট চিন্তার একটা। আমি তো তোর মতো রোবট না ভাই!”
ইতমিনান হেসে ফেলল, “আমাকে তোর কোন দিক দিয়ে রোবট মনে হয়?”
“মানুষ মনে হওয়ার মতো কোনো অ্যাঙ্গেল নাই। চলতি ফিরতি রোবট। তোর বাড়ি বউ থাকলেও চিন্তা করতাম বউয়ের টানে বাইরে থাকতে চাস না। শালার একখান মানুষ বটে তুই!”
“আংকেল আন্টি কেমন আছে?”
“তুই কি কোনোভাবে আমার বোনের খবর জানতে চাচ্ছিস?” রনির কণ্ঠে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস।
“যাহ শালা!”
“আবার বলে শালা!”
“তুই নিজেও তো বলেছিস। আমি কিছু বলেছি?”
“তুই হলি বিয়াত্তা বোনের ভাই। তোরে শালা বললেই কি আর সম্বন্ধি বললেই কি? কিন্তু তুই আমারে বলবি ক্যান? আমার বোন কেবল নাইনে।”
“ভুল হইসে ভাই। মাফ কর আমারে।” স্যারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলল ইতমিনান। রবি হেসে ফেলল।
“কোনো সমস্যা ইতমিনান? কি বলতে চাচ্ছিস বলে ফেল। আমার কাছে একটা কথা বলবি তাও এতো ভাবতে হবে তোর?”
নিজের বড় ভাই নেই। বংশের বড় সন্তান সে। সবাইকে বড় ভাইয়ের মতো আগলে রাখলেও নিজে সেই অভিভাবকের ছায়া পায়নি ইতমিনান। এই ক্ষণে এসে তার মনে হলো রনি যেনো তার নিজের বড় ভাই। যে খুব ভরসা দিয়ে তার মনের কথা জানতে চাচ্ছে।
“আসলে একটা টিউশনি খুঁজছি। ভার্সিটি এরিয়ার আশপাশে হলে ভালো হয়।”
রনি গুরুতর ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, “কোনো সমস্যা দোস্ত? তোর চাকরি তো ভালো পদে।”
“আমার জন্য না।”
“তাহলে?”
মালিহার বিষয়টা খুলে বলল ইতমিনান। রনি বলল, “আমার বড় আপা ভার্সিটির পাশেই থাকে। রিকশা করে গেলে এই ধর দশ পনের মিনিট লাগবে। আপার মেয়েটার বয়স পাঁচ সাড়ে পাঁচ। আপা দুলাভাই দুজনেই জব করে। ও থাকে বুয়ার কাছে। ওর জন্য একজন খুঁজছিল।”
ইতমিনান বলল, “বাচ্চা কাচ্চা হলে তো ঝামেলার বিষয়।”
“ঝামেলা তোর কাছে। মেয়েরা বাচ্চা সামলানোতে জন্মগতভাবে এক্সপার্ট। আর ওকে দুপুর, বিকাল এই সময়ের দিকে থাকতে হতে পারে। তুই বললে আমি আপার কাছে ডিটেইলস শুনবো।”
দোনামনা করে ইতমিনান বলল, “আচ্ছা শুনিস। একটা টিউশনি করে যদি হয়ে যায় তাহলে তো ভালই হবে।”
শেষ কথায় রনিকে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিলো ইতমিনান। টাকা পয়সার বিষিয়ে কথা বলতে তার খুবই বিব্রত লাগে। কিন্তু মালিহার একটা সদগতি না করে সে শান্তি পাচ্ছে না।

“এই গল্পটা কে লিখেছে তিশা?”
“আমি লিখেছি।”
মালিহা বিস্মিত হলো। ইংরেজিতে লেখা গল্পটার কোথাও কোনো বানান ভুল নেই। এমনকি বাক্য বিন্যাস হয়েছে চমৎকার ভাবে।
“সত্যি তুমি লিখেছো?”
“জি মিস।”
মালিহার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। এই কয়েকদিনে মেয়েটার পড়াশোনার যে হাল দেখেছে তাতে এটা বিশ্বাস করা কষ্টই বটে। মেয়েটা কম বোঝে। সহজ পড়াগুলোও সহজে ধরতে পারে না। সেই মেয়ের খাতায় এমন ইংরেজি গল্প দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
“এতো সুন্দর করে লিখতে তুমি কোথায় শিখেছো?”
“গল্পের বই পড়ে।”
“তুমি ইংরেজি বই পড়?”
“জি।”
“তিশা তোমার এই গল্পটা আমি নিয়ে যাই?”
“কেনো মিস?” তিশার চোখে ভয় দেখা গেলো।
“আমার বান্ধবীকে দেখাবো। এত্তো দারুন লিখতে পারে আমার স্টুডেন্ট! এটা তো গর্ব করার মতো বিষয়।”
তিশার চোখ ভিজে এলো। ভিজে গেলো কণ্ঠও।
“জানেন মিস আম্মু আমাকে লিখতে দেখলে অনেক বকা দেয়।”
“কেনো?” মালিহার ভুরু কুঁচকে গেল।
“আম্মু বলে এগুলো লেখা ভালো না।” তারপর চারপাশে তাকালো। ফিসফিস করে তিশা বলল, “সেদিন এজন্য আম্মু আমাকে অন্ধকার ঘরে রেখে দিয়েছিল।”
মালিহাও ফিসফিস করো কথা বলল।
“তুমি অন্ধকার ভয় পাও?”
“অনেক। এজন্যই কথা না শুনলে আম্মু শুধু আমাকে অন্ধকারে রেখে আসে। মিস আপনি কি আম্মুকে বলবেন এমন যেনো না করে?”
“তিশা!”
ভেতর থেকে আজিজা বেগমের কণ্ঠ ভেসে আসতেই তিশা শব্দ করে পড়তে শুরু করলো। মালিহার কাছে বিষয়টা যেনো আর গোলমেলে ঠেকছে। মেয়েটা অন্ধকারে ভয় পায়। তাহলে ওকে এই শাস্তি দেয়ার মানে কি?

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-০৮

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৮

মাথার উপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। তবে তার সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় নেই মালিহার। চপল পায়ে সে চলেছে গন্তব্যে। গতকাল নীতির সাথে এসে জায়গাটা চিনে নিয়েছে। রিকশা করে যেতে লাগে বিশ টাকা। এক দিনে চল্লিশ, সপ্তাহে একশ বিশ, মাসে নয়শ। এই হিসাব গতকাল রিকশায় বসেই সে করেছে। আজিজা তিন হাজার টাকা বেতনে সমঝোতা করেছেন। তার মাঝে এক হাজার কোনোভাবেই মালিহা ভাড়ার পেছনে ঢালতে পারে না। আর পাঁচ মিনিট হাঁটলেই তিশার বাড়ি। হঠাৎ নিজের নাম শুনতে পেয়ে থেমে গেলো মালিহা। ঘাড় ঘোরালো না। ঐ তো! আবার কেউ ডাকছে। তাকেই? কে?

ইতমিনানের অফিস চারটায় ছুটি হয়। ব্যক্তিগত কাজ শেষ করতে পারায় সে চারটা বাজার আগেই বেরিয়ে আস্তে পেরেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো। আগে কই? তিনটা সাতচল্লিশ বাজে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজলো ইতমিনান। তখনই নজরে পড়ল বোরখা পরিহিতা ছুটন্ত এক নারী। ইতমিনানের ভুরু কুঁচকে গেলো। মালিহার মতো লাগছে না? একটু এগিয়ে গিয়ে ডাক দিলো সে। মেয়েটা থামলো তবে ঘুরে তাকালো না। আবার ডেকে ইতমিনান এগিয়ে গেলো।

মালিহা পিছু ফিরে দেখলো ইতমিনান। হঠাৎ দাঁড়ানোর কারণে মালিহার মনে হলো তার নিশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। ইতমিনান এগিয়ে এসে তাকে এমন করতে দেখে ভয় পেলো।
“মালিহা! কি হয়েছে তোর? বসবি কোথাও?”
মালিহা হাত নাড়িয়ে না করলো। এক হাত কোমরে রেখে আরেক হাত বুকে চাপ দিলো। ইতমিনান নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিলে ঢকঢক করে পানি খেলো মালিহা। তাকে কিছুটা শান্ত দেখালো।
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“স্টুডেন্ট পড়াতে।”
“তুই টিউশনি করাস?”
“গতকাল থেকে শুরু করেছি।”
“আমাকে তো বলিস নি।”
“তোমাকে বলার কথা ছিল?”
চুপ কর গেলো ইতমিনান। ধীর কণ্ঠে বলল, “বাসা কোথায়?”
“আর পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে।”
“রিকশা নিসনি কেনো?”
“তুমি এখানে কি করছো?”
মালিহা প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। ইতমিনান বুঝলো।
“আমার অফিস এখানেই।”
“চারটা থেকে পড়ানো শুরু। আমি যাই?”
“চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।।”
“আমি একাই যেতে পারবো।”
“চল।”
ইতমিনান মালিহার কথা শুনলো না। নিজের মতো এগিয়ে যেতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মালিহা বলল, “ঐদিকে না।”
ইতমিনান ঘুরে এলো। মালিহার পিছু নিলো।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর মালিহা বলল, “তুমি এখন আমাকে দয়া করছো ভাইয়া। আমার ভালো লাগছে না।”
“তোর কাছে দয়া মনে হচ্ছে কেনো?”
“বাবা বেঁচে থাকতে তো ঠিকঠাক যোগাযোগও করতে না। এখন এতো হেল্প করছো কেনো? নিশ্চয়ই দয়া করে।”
ইতমিনান বলল, “আমি যোগাযোগ করিনি। তুই কেনো করিসনি?”
মালিহা চুপ করে গেলো। বলল না ইতমিনানের খোঁজ করতে গেলেই চাচী আর মিলি আপা তাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছে। পুরোনো ক্ষত খোঁচানোর কি দরকার?
ইতমিনান হাসলো। মালিহার কাছে মনে হলো তাচ্ছিল্যের হাসি। জ্বলে উঠলো সে, “হাসছো কেনো? আশ্চর্য!”
“আমরা সবাই সামনের গল্প পড়ি মালিহা। পেছনের পটভূমি আমাদের অজানাই থেকে যায়।”
মালিহা এক পলক ইতমিনানের দিকে তাকালো। তার পটভূমি ইতমিনান জানে? নাকি কখনও জানার চেষ্টা করেছে? হঠাৎ অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বুকটা ভার লাগলো মালিহার। ছোট থেকে একসাথে বড় হওয়ার কারণে ইতমিনান এবং মিলি দুজনের প্রতি ছিলো তার অন্যরকম এক টান। শুধুমাত্র চাচাতো ভাইবোনের গন্ডিতে তা আটকে থাকেনি। মিলি বেশি আদর না করলেও কখনও খারাপ ব্যবহারও করেনি। কিন্তু ইতমিনান তার বন্ধু হয়ে উঠেছিল। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সবসময় তাকে পাশে পাওয়া যেত। মতিয়ার আলীর সাথে ইতমিনানের সম্পর্ক কখনও বাবা ছেলের চাইতে ভিন্ন কিছু ছিল না। সেই সব ফুলে সাজানো সম্পর্কগুলো হঠাৎ সম্পত্তির কাঁটায় ভরপুর হয়ে গেলো। হাত বাড়ালেই ক্ষত। আর সব বাদ কিন্তু মতিয়ার সাহেবের সাথে ইতমিনান কিভাবে যোগাযোগ না করে থাকতে পারলো? তার একটুও খারাপ লাগলো না? মালিহার মনে আছে, বাড়িতে ইতমিনানের পছন্দের কোনো খাবার রান্না হলেই মতিয়ার আলী ইতমিনানকে ধরে আনতেন। বিশেষ কোনো দিন ইতমিনানকে ছাড়া পার করতেন না। মানুষ বলতো বাপের চেয়ে চাচার দরদ বেশি। আহা! সব দরদ কর্পূরের মতো উবে গেলো।

বাড়ির সামনে পৌছুলে ইতমিনান একটা কেকের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো। মালিহা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। নিলো না।
“নে।”
“আমি কেক খাই না।”
“কেমন খাস না আমার জানা আছে। নে।”
“খাবো না।” মুখ গোজ করে বলল মালিহা।
“ধর!” মালিহা কেঁপে উঠল। এভাবে কেউ ধমক দেয়! খপ করে কেকটা নিয়ে বলল, “রাস্তাঘাটে একদম ধমকাধমকি করবে না।”
বলেই গটগট করে ভেতরে ঢুকে গেলো মালিহা। ইতমিনানের ঠোঁটের কোণায় ক্ষীণ হাসির রেশ দেখা গেলো সাথে খেলে গেলো এক চিন্তা। মালিহা পুরোটা রাস্তা এভাবে হেঁটে যাতায়াত করবে? মুহূর্তেই ইতমিনানের কপালে ভাঁজ পড়ল।

মালিহা বেশ কিছুক্ষণ ধরে বসে আছে। একজন মহিলা এসে চা বিস্কুট দিয়ে গেছে। এই গরমে ঘেমে নেয়ে মালিহার চা খেতে মোটেই ইচ্ছা করছে না। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি হলে আরাম করে খাওয়া যেত। কিন্তু চাইতেও তার লজ্জা করছে।
টেবিলে কলম দিয়ে শব্দ করছিল মালিহা। সেসময় আজিজা এলে সে সোজা হয়ে বসলো। আজিজা চেয়ারে বসে বললেন, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল।
“জি বলুন ফুপু।”
“তিশাকে কাল তোমার কেমন লাগলো?”
প্রশ্নের ধরনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো মালিহা। এটা কেমন প্রশ্ন? ইতস্তত করে বলল, “জি ভালো।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজিজা বললেন, “ওর কিছু সমস্যা আছে। সহজ জিনিস ও সহজে ক্যাচ করতে পারে না। অনেক সময় লাগে। এজন্যই ওর কোনো টিউটর বেশিদিন টেকে না। আর তাছাড়া..”
“তাছাড়া?”
“থাক এটা তুমি পড়াতে গেলেই বুঝবে। তোমার কাছে আশা থাকবে একটু সময় নিয়ে ওকে বোঝাবে।”
মালিহা মাথা নাড়লো। সে চেষ্টা করবে। আজিজা যাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝে তিশা এলো। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আসছে। মালিহা তাকিয়ে দেখলো টকটকে লাল রঙের একটা ফ্রক পড়ে আছে তিশা। লাল রংটা কেনো যেনো মালিহার চোখে বাধে। আজও বাঁধলো। তিশার দিকে তাকাতেই মনে হলো চোখে ব্যাথা করছে। মালিহা শুধু তিশার মুখের দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো।
“আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছো তিশা?”
হাসিমুখে সালাম দিলো মালিহা। তিশা তাকালো বটে কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। মালিহা ভাবলো হয়তো অস্বস্তি হচ্ছে। সে নতুন মানুষ। অস্বস্তি হতেই পারে। তিশা বসলো না। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মালিহা চেয়ার এগিয়ে বলল, “বসো তিশা।”
তিশা বসলো। তবে তার বসার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। যেনো জড়সড় হয়ে বসতে চাচ্ছে। তিশার মাথায় হাত দিয়ে নরম কণ্ঠে মালিহা বলল, “তিশা কি আমাকে ভয় পাচ্ছে? আমি তো তিশার ফ্রেন্ড।”
তিশা মাথা উঠিয়ে তাকালো। তার চোখ চিকচিক করছে।
“ফ্রেন্ড?” এই প্রথম কথা বলল তিশা। মালিহা মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ। তোমার বন্ধু আছে না?”
“না।”
মালিহা অবাক হলো। কিন্তু উল্টো কোনো প্রশ্ন করলো না।
“তাহলে আমাকে তোমার ফ্রেন্ড বানিয়ে নাও। বানাবে?”
“ফ্রেন্ড হলে আপনি কি করবেন? বকবেন?”
“না। বকবো কেনো?” মালিহার কাছে সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে।
“সবাই তো আমাকে বকে।”
“এতো কথা কিসের তিশা? বই বের করে পড়া শুরু কর।” হঠাৎ আজিজা ভেতরে এসে কড়া গলায় নির্দেশ দিলেন। তিশা তো তিশাই, মালিহা নিজেই ভয় পেয়ে গেলো। তিশা তড়িঘড়ি করে বই বের করলো। মালিহা কথা না বাড়িয়ে পড়ানো শুরু করলো। এর মাঝেই সে আবিষ্কার করলো মেয়েটা শুধু পড়া কম বোঝে এমন নয়, সাধারণ কথাবার্তাও সে খুব একটা বোঝে না। কারণটা ধরতে পারলো না মালিহা।

সন্ধ্যা থেকেই ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসে সেই পানির ঝাপটা এসে মুখে লাগছে। মালিহা ফোন কানে আরেকপাশে সরে গেলো। ফোনের ওপাশে রাশেদা বেগম।
“দুপুরে কি খেয়েছো?”
“আলু ভাজি আর ডাল।”
“খাওয়ার কষ্ট করছো কেনো মালিহা?”
মালিহা চুপ করে থাকলো।
“তোমার ওষুধ আছে দাদি?”
“আছে। তোমার বড় চাচা কিনে দিয়ে গেছে। খাওয়ার কষ্ট করবে না মালিহা। আমরা এখনো বেঁচে আছি।”
মালিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথা বলা শেষে দেখলো ইরিনা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। নজর তার দিকেই। তাকে তাকাতে দেখে ইরিনা এগিয়ে এলো।

“কেমন আছো মালিহা?”
“ভালো। তোমার মন খারাপ মনে হচ্ছে?”
ইরিনা মলিন হাসলো। মালিহা বলল, “কি হয়েছে? আমাকে বলা যাবে?”
ইরিনা মালিহার হাত ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-০৭

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৭

পকেট থেকে চাবি বের করলো ইতমিনান। দোতলা বাড়িটার নিচ তলায় দুটো রুম নিয়ে সে থাকে। মেসে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। একে তো রান্নার বেহাল দশা তার উপর নানান রকম মানুষের উপস্থিতি। ঠিক এই কারণেই কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টাও সে মেসে থেকেই কাটিয়েছে। দরজা খুলতেই ক্যাচ করে একটা শব্দ হলো। দরজার কাঠটা বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার।
এতদিন থেকে একাকীত্বটাই আপন হয়ে গেছে। দরজা খুললে অন্ধকার ঘর এখন আর খারাপ লাগে না। তবে মাঝে মাঝে খুব মন চায় দরজার ওপাশটায় কেউ তার জন্য অপেক্ষা করুক। অন্তত দরজাটা খোলার জন্য হলেও। ঠিক সেসময় মায়ের কথা মনে হয়। বাড়ির কথা মনে হয়। তবে কষ্টটা সয়ে গেছে। এই-ই যেনো জীবন। পাখির পালকের মতো ভেসে বেড়ানো।
আয়েশা কয়েক পদ রান্না করে দিয়েছেন। কাজেই আজ খাবারের জন্য কোনো চিন্তা করা লাগলো না। সেগুলো বের করেই খেয়ে নিলো ইতমিনান। আগামীকাল অফিসের জন্য কিছু কাগজ গোছাতেই একটা ফাইল হাতে এলো। উপরে বড় করে মালিহার নাম লেখা। ফাইল ভর্তি ফটোকপি করা সব কাগজ। একদম উপরের কাগজটা জ্বলজ্বল করছে মালিহার কলেজে থাকাকালীন ছবি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফাইলটা আগের জায়গায় রেখে দিলো ইতমিনান। সে জানেনা কেনো এই ফাইলটা যত্ন করে বাড়ি থেকে এখানে এনেছে। এটার তো এখানে কোনোই প্রয়োজন নেই। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোন হাতে নিলো ইতমিনান। একবার মালিহাকে কল করার কথা ভাবলো। মুহূর্তেই চিন্তা বদলে ফেললো। মেয়েটা হয়তো ক্লান্ত। ঘুমাতেও পারে। থাক কাল কল করা যাবে। ভেবেই আয়েশাকে ফোন দিলো। মা বাবার সাথে কথা বলে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। চোখের পাতায় চিন্তারা হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

গোসল করে আসতে না আসতেই খিচুড়ি নিয়ে বসলো নীতি। মালিহা ধমক দিল।
“চুলগুলো তো মুছবি নাকি?”
“ক্ষুধা লেগেছে। আগে খেয়ে নিই।”
“এক প্লেট বিরিয়ানি খেয়েও তোর ক্ষুধা লাগে কিভাবে?”
“আশ্চর্য! বিরিয়ানি খেয়েছি দুপুরে। এখন রাত। ঘড়ির দিকে তাকা। তোর সিস্টেমে ডিস্টার্ব দেখা দিসে।”
মালিহা বিরক্ত হয়ে নীতির দিকে এগিয়ে গেলো। মাথায় প্যাঁচানো গামছা খুলে মুছতে শুরু করলো। ওদিকে নীতি গপগপিয়ে খাচ্ছে।
“কোন ক্লাসের স্টুডেন্ট পড়াতে চাও মালিহা?”
আঁখির প্রশ্নে নীতি মালিহার দিকে তাকালো।
“তুই এখনই টিউশনি শুরু করে দিচ্ছিস?”
“খুঁজছি। আপু আপাতত কয়েকটা হলেই হচ্ছে। নাইন টেন অথবা ইন্টারমিডিয়েটের হলে ভালো হয়।”
“কয়েকটা! কয়টা করবি তুই? ক্লাস করে সময় পাবি?”
কণিকা গলা চড়ালো। মালিহা ধীর কণ্ঠে বলল, “অন্তত দুই তিনটা না হলে তো সমস্যা।”
“আচ্ছা মালিহা। আমি দেখব। তুমি টেনশন করো না।”
মালিহা কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। নীতি বলল, “দোস্ত চার রাস্তায় আমার এক রিলেটিভ আছে। লতায় পাতায় ফুপু। তার এইট পড়ুয়া এক মেয়ে আছে। টোকা দিয়ে দেখবো নাকি?”
“দেখ।”
নীতির চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে নিজের বিছানায় এলো মালিহা। কণিকা এগিয়ে এসে বলল, “ক্লাস, প্রেজেন্টেশন সব সামলে তিনটা টিউশনি করা কষ্টকর হয়ে যাবে।”
“এখনও তো পাইনি আপু। কে কেমন বেতন দেয় সেটা হিসেব করে খুঁজতে হবে।”
হিসাবের কথা আসতেই কণিকা চুপ করে গেলো। হিসাবের খাতা যে এখন মালিহার ঘাড়ে সেটা তো সে ভুলেই গিয়েছিলো।

এশার পর আশপাশের প্রায় সবাই মালিহার সাথে দেখা করতে এলো। এর মাঝে ব্যাচমেটই বেশি। খোঁজ খবর নেয়ার সাথে সাথে সবাই উদ্বেগ প্রকাশ করলো। কয়েকজন অগ্রগামী হয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলো। কণিকা মুখ মোচড়ালো। সাহায্য! এই চার বছরে ঢের সাহায্য তার দেখ হয়েছে। তবুও কিছু বলল না। আর এক বছর গেলেই মেয়েগুলো বুঝবে এই জায়গায় কেউ কারো নয়।

দুইজন সিনিয়র থাকায় কেউ এসে বেশিক্ষণ থাকে না। পাছে না আবার সিনিয়ররা রাগ করে বসে। তবে আজ সেদিকে কেউ লক্ষ্য করলো না। বলা ভালো গা করলো না। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে সবাই গেলো। রয়ে গেলো শুধু ইরিনা। এগিয়ে এসে মালিহার হাত ধরে সে প্রায় কেঁদেই ফেললো।
“আন্টি কেমন আছেন মালিহা?”
“আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছে।”
চোখ বন্ধ করে মালিহার হাত শক্ত করে ধরে ইরিনা বলল, “যদি কোনো কাজে আসতে পারি নির্দ্বিধায় জানাবে। প্লিজ!”
মালিহার মনে হলো সাহায্য করার তাড়া ইরিনার বেশি। সে স্বল্প হেসে বলল, “আপাতত আমার কিছু টিউশনি হলেই হচ্ছে।”
“এই আমার ছোট ভাই তো এবার নাইনে। ওকে পড়াবে তুমি?” মালিহার হাত ঝাঁকি দিয়ে বলল ইরিনা। মালিহা হ্যাঁ বলতেই যাচ্ছিল। কিন্তু নীতি পেছন থেকে ইশারা করছে না বলার জন্য। মালিহা কারণটা বুঝতে পারল না। কিন্তু হ্যাঁ বলতেও বাঁধলো। সে বলল, “আচ্ছা একটু ভেবে দেখি ইরিনা। তোমার বাসা কোথায় যেনো?”
“এই যে সদরে।”
“ভালোই দূরে তো।”
“বেশি দূরে না। বাসে গেলে আধা ঘণ্টা লাগে মোটে।”
“আচ্ছা আমি তোমাকে ভেবে জানাবো।”
“আচ্ছা। যাই তাহলে।”
ইরিনা যেতেই নীতিকে জেঁকে ধরলো মালিহা।
“নিষেধ করলি কেনো তখন?”
“ওর ভাইকে পড়াতে হবে না।”
“কেনো?”
“পরিচিত মানুষের টিউশনি না করাই ভালো।”
“পরিচিত হলেই তো আরো ভালো। আমার অবস্থা ভালোভাবে বুঝবে।”
নীতি মুখে বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে তুললে মালিহা বলল, “তোর ফুপুকে নক দিতে চাচ্ছিস তাহলে ওর ভাইকে পড়ালে কি সমস্যা?”
“এ আমার ডাইরেক্ট ফুপু না। চার পাঁচ বছরে একবার দেখা হয়। সে হয়তো জানেই না আমি এখানে থেকে পড়াশোনা করি। কাজেই ঐটা পরিচিতর কাতারে পড়ে না।”
“এমন করে বলছিস মনে হচ্ছে অপরিচিত সবাই ভালো?”
“তুই তো গাধা। ডান্ডা না খাইলে তোর শিক্ষা হয় না। সর সামনে থেকে। যা ভালো লাগে কর। যা!”
কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো নীতি। মালিহা আসলেই বুঝলো না এখানে সমস্যা কোথায় ছিল। তবে নীতির কথাও ফেললো না। ফেলতে পারল না। ইরিনাকে বলল দূরত্ব বেশি। যাতায়াতে অনেক সময় চলে যাবে। ইরিনা কি বুঝলো কে জানে। সেও আর জোর জবরদস্তি করলো না।

একটা ক্লাস মানেই যেনো একটা ঘটনা। মালিহার মাঝে মাঝে মনে হয় এটা ক্লাস না, থিয়েটার। কোনো না কোনো নাটক লেগেই আছে। নীতি অবশ্য এগুলো বেশ এনজয় করে। মালিহার বিরক্ত লাগে। ক্লাস গ্যাপের সময়টুকু সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেয়। আজ সেটা হলো না। পেটে প্রচুর ব্যাথা। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। ব্যাগের উপর মাথা রেখে মালিহা চোখ বন্ধ করে ছিল। নীতি আজ বিকেলে ওর ফুপুর কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে। আচ্ছা ওরা কতো টাকা দেবে? অন্তত তিন হাজার দেবে না? মালিহা হিসাব কষতে বসলো। বাড়ি ভাড়া, বাজার খরচ, পড়াশোনার খরচ চালাতে মোট কতো টাকা লাগে?
নীতির ধাক্কায় বিরক্ত হলো মালিহা। নীতি মুখ এগিয়ে ফিসফিস করে বলল, “দোস্ত দেখ! এদিকে তো সিনেমা শেষ হয়ে গেলো।”
“হলে হোক। আমার ভাল্লাগছে না।”
“তোর কোনোকালেই ভাল্লাগে না। অশান্তি! তাকাবি তো একবার!”
অনিচ্ছায় মুখ ওঠালো মালিহা। ক্লাসের ওপাশে ভিড়। ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“কি হয়েছে?”
“কি হয় নাই তাই বল! প্রপোজাল দিসে!”
“ওহ আচ্ছা।”
“ওহ আচ্ছা আবার কি? শুনবি না কে কারে দিলো?”
“ভালো লাগছে না নীতি।”
নীতি চুপ করে গেলো। কিছুক্ষণ পর উঠে মালিহাকে বলল, “চল বারান্দা থেকে ঘুরে আসি।”
মালিহা যেনো এক পায়ে খাড়া ছিলো। বলতেই বের হয়ে গেলো।
“নীতি।”
“হুম।”
“তোর ফুপুরা কি বড়লোক?”
নীতি এক পলক মালিহার দিকে তাকালো।
“আছে ভালোই।”
মালিহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনের রাস্তায় নজর দিলো। সেমিস্টার শেষ হয়ে আসছে। পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। ফি দিতে হবে যে!
এহসান ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এলো। নীতিদের কাছে এসে গলা খাঁকারি দিলো। নীতি বিরক্ত হলো।
“তুই এখানে আসছিস কেনো?”
“কেনো বারান্দা কি তোর একার? এখানে আসা আমার নিষেধ?”
“আমি কি তাই বললাম? এসে আমাদের কোলের উপরে উঠছিস কেনো? আর জায়গা নাই? দূরে যা।”
এহসান আহত হলো। নীতি সবসময় তার সাথে এমন ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে মনে হয় তার সাথে দুর্ব্যবহার করার জন্য যেনো মেয়েটা মুখিয়ে থাকে। সে মালিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “মালিহা কেমন আছো?”
“ভালো।”
“আন্টি, মিতুল ওরা কেমন আছে?”
“আছে ভালো।”
“ইয়ে মালিহা!”
“বলো।”
“কোনো হেল্প লাগলে আমাকে একটু বলবে প্লিজ। যদিও জানিনা কতোটা করতে পারবো। তবুও একটু..”
নীতি এতক্ষন চুপ করে ছিল। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই মালিহা এহসানের দিকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “এহসান, বিপদের সময় তুমি আমার পাশে যেয়ে দাঁড়িয়েছ। সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানালেও কম হবে। ধন্যবাদ দিয়ে আমি তোমাকে ছোটোও করতে চাই না। তুমি একজন ভালো বন্ধু। আশা করি একজন ভালো বন্ধু হয়েই থাকবে?”
এহসান ঢোক গিললো। মালিহা তাকে কি বোঝাতে চাইলো? মালিহা কথা শেষ করে দাঁড়ালো না। নীতি এহসানকে বলল, “ভাই ওর পিছু নেয়া বাদ দে। নাইলে কথা টথা যা বলতে পারিস এটাও বন্ধ হবে।”
নীতি চলে গেলে এহসান নিজেকে নিয়ে ভাবলো। মনটা যে বড় বেহায়া হয়ে উঠেছে। কি বলে এক পোষ মানাবে সে?

বসার ঘরটা বেশ বড়। শৌখিন আসবাব পত্র দিয়ে সাজানো। একেকটা জিনিসপত্র যেনো মালিকের রুচির পরিচয় বহন করে চলেছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো ঘরটা দেখে নিলো মালিহা। পাশেই নীতি বসে ফোন টিপছে।
“এই! এ তো দেখি বিশাল বড়লোকি কারবার! আমি তো জানতামই না আমার এমন মালওয়ালা একটা ফুপু আছে!”
মালিহা চাপা কণ্ঠে বলল, “মুখ বন্ধ কর নীতি। তোর অসহ্য মার্কা স্ল্যাং এখানে ইউজ করিস না।”
“দোস্ত! ধর ফুপুর একটা বড়সর ছেলে আছে!”
“তো?” ভুরু কুঁচকে বলল মালিহা।
“তো মানে বুঝো না? রাস্তা পাইলে না গাড়ি চালাবা।”
মুহূর্তেই মালিহার কপালের ভাঁজ টান টান হয়ে গেলো।
“তুই কি এখানে মা-ইর খাবি নাকি বাইরে যেয়ে খাবি?”
“বাইরে যেয়েই খাই। এখানে মান সম্মানের প্রশ্ন। কট খাইলে বাশ।”

কিছুক্ষণের মাঝে একজন মহিলা একটা বিশাল ট্রে নিয়ে এলেন। নীতি দেখেই মালিহাকে গোপনে গুতো দিলো। মালিহা চোখ রাঙানোর আগেই নীতির ফুপু আজিজা এসে উপস্থিত হলেন। দুজনেই সালাম দিলো।
“কেমন আছো তোমরা?” সালামের উত্তর নিয়ে অপর পাশে বসলেন আজিজা। তার কথাবার্তায় বেশ মার্জিত ভাব।
“আলহামদুলিল্লাহ ফুপু ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও ভালো আছি। এটাই তোমার বান্ধবী?”
“জি ফুপু। ওর কথাই আপনাকে ফোনে বলেছিলাম।”
“আচ্ছা কথা পরে হবে। আগে খাও। চায়ে চিনি দেয়া হয়নি। তোমরা কে কয় চামচ খাও একটু কষ্ট করে দিয়ে নাও।”
নীতি নিজ উদ্যোগে তার এবং মালিহার চা বানালো। মালিহাকে উশখুশ করতে দেখে আজিজা বললেন, “তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
“না না ফুপু। আসলে তিশার সাথে যদি একটু দেখা করতে পারতাম ভালো হতো।”
আজিজা পূর্ণ দৃষ্টিতে মালিহাকে একবার দেখে তিশাকে ডাক দিলেন। ছোটখাট গড়নের একটা মেয়ে ভেতরে থেকে ছুটে এলো। আজিজা চোখ রাঙালে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো। সবটাই দেখলো মালিহা।
“নীতিকে তো চেনোই। এটা নীতির বান্ধবী, মালিহা। যাও কথা বলো।”
তিশা ডাগর ডাগর চোখে একবার মালিহাকে দেখলো। চুপচাপ তার পাশে যেয়ে বসলো। মালিহার কাছে মনে হলো মেয়েটা একটা ছোটখাট পুতুল। মুখে মায়া মায়া একটা ভাব। কিন্তু সেই ভাবের কোনোটাই মেকি নয়। জীবনে এই পর্যন্ত বেশ অনেকবার মেকি ভাবের দেখা মিলেছে মালিহার। সে জানে মানুষের ব্যবহারের কৃত্রিম দিকটা কেমন হয়। এই যে আজিজা কম কথা বলছেন এটা অহংকার নয়, এটাই তার স্বভাব। এটুকু বুঝতে মালিহার এক মিনিটও লাগেনি। ঠিক তেমন করেই তিশা মেয়েটাকে চট করে তার মনে ধরে গেলো। সিদ্ধান্ত নিলো দুই হাজার টাকা দিলেও এই মেয়েকে সে পড়াবে। তিশার মাথায় হাত রেখে ধীর কণ্ঠে মালিহা বলল, “তুমি কি আমার কাছে পড়বে তিশা?”

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-০৬

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৬

ট্রেন চলেছে। ঝিকঝিক করে। একের পর এক গ্রাম, ধান ক্ষেত, নদী, বিল কতো কিছুই না পাশ কাটিয়ে গেলো! মালিহা এক মনে দেখলো। গাড়িতে উঠলেই ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। এবার তেমন হলো না। আগামীর চিন্তায় তার ঘুমটুকু তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়েছে। নীতি পাশ থেকে ধাক্কা দিলো। ফিসফিস করে বলল, “দোস্ত একটু বাথরুমে যাবো।”
“চল।”
ইতমিনান দুজনকে একসাথে উঠতে দেখে মালিহাকে ইশারা করলো। মালিহা সামনের দিকে চোখ দেখালে ইতমিনান না যাওয়াটাই সমীচীন মনে করলো। বগির শেষ মাথায় বাথরুম। তার সামনেই কয়েকজন অল্পবয়স্ক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলের আশপাশে সবার বয়স। নীতি ভেতরে ঢুকলে মালিহা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো। একটা ছেলে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো। আরেকজন একধাপ এগিয়ে সিটি দিলো। মালিহা রাগ করার বদলে আশ্চর্য হলো। তার ছোট ভাইয়ের বয়সী একেকটা ছেলে কি শুরু করেছে! একজন অন্যদিকে তাকিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে গেলে মালিহা চট করে সরে গেলো।
“এই যে ছোট ভাই! চোখ অন্যদিকে থাকলে তো দরজা থেকে পড়তে সময় লাগবে না। নাম্বারটা বলো এদিক ওদিক কিছু হলে বাড়িতে জানিয়ে দেবো।” ছেলেটার বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল ইতমিনান। তার হাত নিপুণভাবে ছেলেটার উঁচু হয়ে থাকা শার্টের কলার ঠিক করে দিচ্ছে। এক নজর দেখলে মনে হয় কি নরম ভাব। কিন্তু ইতমিনানের শক্ত চোয়াল মালিহার নজর এড়ালো না। ছেলেগুলো ভড়কে আরেকদিকে চলে গেলো। সম্ভবত আর কোনো মেয়ে একা আছে নাকি খোঁজ করতে। ইতমিনান কিছু না বলে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আগত ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় পড়লো মালিহা। তার সামনের পথগুলো এমন কাঁটায় ভরপুর। সে কি পারবে একা পুরোটা পথ পাড়ি দিতে? ঢোক গিলে নিজেকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলো মালিহা। হলো না। তার কাছে মনে হলো ছাতাবিহীন একটা মানুষের কাছে শরতের স্বচ্ছ মেঘগুলোও জ্বালাময়ী রোদ হয়ে ওঠে।

নীতি বের হয়ে মালিহার হাত ধরে বলল, “দোস্ত! পেট ঠান্ডা তো দুনিয়া ঠান্ডা। যা তুই একবার রাউন্ড দিয়ে আয়। আমি এখানে দাঁড়াই।”
ইতমিনান দরজার পাশ থেকে ঢুকে ভেতরে চলে গেলো। নীতি বড় বড় চোখ করে ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে আবার মালিহার দিকে তাকালো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “দোস্ত! তোর ভাই কি সব শুনে ফেলসে? আমি কি এখন দরজা থেকে ঝাঁপ দিবো?” মালিহা কিছু না বলে সিটে ফিরে গেলো। নীতি কাঁধের ওড়না মাথায় তুলে বড়সর ঘোমটা দিয়ে সিটে বসে জানালার দিকে মুখ ফেরালো। মালিহা শুনতে পেলো নীতি বিড়বিড় করছে, “আল্লাহ! তুমি সম্মান দেয়ার মালিক। ট্রেনের ভিতরে আমার সম্মানটা রিস্কে ফালাইয়ো না।”

জংশনে ট্রেন বেশ কিছু সময় থামলো। ইতমিনান মালিহার কাছে এসে বলল, “কি খাবি?”
“কিছু না।”
“আমি এখন কিছু নিয়েই আসবো। তুই বললে তোরই লাভ। নাহলে আমি যেটা আনবো সেটাই খেতে হবে।”
নিশ্বাস ছেড়ে মালিহা বলল, “ইসপি।”
“আর?”
“চিপস।”
“তোর বান্ধবী কি খাবে?”
“অ্যাই নীতি। কি খাবি?”
নীতি মালিহার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। ইতমিনানের উপস্থিতি টের পেয়ে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকেছে শুরুতেই। এবার ফিসফিসিয়ে বলল, “এক প্লেট ভাত খাইতে পারলে জানডা ঠান্ডা হইতো।”
মালিহা ইতমিনানকে বলল, “ট্রেনে বিরিয়ানি পাওয়া যায় না?”
“যায়।”
“এক প্যাকেট দিয়েন।”
“আচ্ছা।”
ইতমিনান যেতেই উঠে সোজা হয়ে বসলো নীতি।
“দোস্ত তোর ভাই হয় দরবেশ নাহয় ভিজা বিড়াল।”
“কেনো?” বিরক্ত হয়ে তাকালো মালিহা।
“মেয়ে মানুষ পটানোর প্রথম টেকনিক হলো তার খেয়াল রাখা। তোর ভাই সেইটা এক্কেবারে খাপে খাপ করতেসে। আর মনের মধ্যে পটাপটির কাহিনী না থাকলে সে তো দরবেশ বাবা। নিজ উদ্যোগে এসে এসে তোর খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। ভালো না? ভালো তো।”
“র-ক্তের টান বড় টান।”
“র-ক্ত এই পাঁচ বছর কই ছিলো? হিমালয়ের পাদদেশে হিম হয়ে ছিল? যতসব ফালতু আলাপ!”
মুখ ঝামটা দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো নীতি। মালিহা তাকে ঘাটালো না। কিছুক্ষণ পর ইতমিনান চিপস, জুস, বিরিয়ানি, পানি নিয়ে এলো। মালিহার কোলের উপর সব রেখে বিনা বাক্য ব্যয়ে চলে গেলো নিজের আসনে। ট্রেন কিছুক্ষণের মাঝেই আবার চলতে শুরু করল।
মালিহার খাওয়া কিছুক্ষণের মাঝেই হয়ে গেলো। জুস আর চিপসের প্যাকেট ব্যাগের এক কোণে রাখলো। মুখ ঘোরাতেই দেখলো নীতি এক লোকমা বিরিয়ানি তার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
“খাবো না নীতি।”
“তুই খাবি তোর ইয়ে মার্কা ভাইও খাবে।” বলেই মালিহার মুখে ঠুসে দিলো বিরিয়ানি। মুখে হাত রেখে খাবার চিবুতে চিবুতে মালিহা বলল, “ইয়ে মার্কা মানে?”
“উপরে ফিটফাট ভিতরে সদর ঘাট।”
মালিহা চোখ রাঙালো। নীতি তার থোড়াই কেয়ার করে।

পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে গেলো। আকাশ কমলা রঙের ঘোমটা কপালে ফেলে নতুন বধূ সেজেছে। মুয়াজ্জিনের আযান দুর থেকে ভেসে ভেসে আসছে। ইতমিনান কারো কাছে কিছু না শুনেই হলের উদ্দেশ্যে গাড়ি ঠিক করলো। মালিহা অবাক হয়ে বলল, “তুমি আমাদের সাথে যাবে?”
“হ্যাঁ। তোদের পৌঁছে দিয়ে যাই।”
নীতি মুখ বাকালো। মালিহা বলল, “আমরা যেতে পারতাম।”
ইতমিনান উত্তর দিলো না। অটো রিকশার পেছনে দুজনকে বসিয়ে নিজে চালকের পাশে বসলো। বিশ মিনিটের মাথায় মালিহা নিজের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলো। আঁধার ঘনিয়ে এলেও যুবক যুবতীরা সেদিকে মন দেয়নি। কারো ঘরে ফেরার তাড়া নেই। গুটিকয়েক ছাত্র একদিকের রাস্তা দিয়ে মসজিদের দিকে যাচ্ছে। বাকিরা সবাই আড্ডায় মশগুল। মালিহা সন্ধ্যার পর কখনও ক্যাম্পাসে থাকেনি। যত কাজই থাকুক, সূর্যের সাথে সাথে সেও নীড়ে ফিরে যায়। আজন্ম লালিত অভ্যাস পিছু ছাড়ে না। সেই কবে থেকে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরার অভ্যাস করিয়েছেন নাজিয়া। এমনকি মতিয়ার আলী সন্ধ্যার পর অকারণে বাইরে থাকলে তিনি বেজায় রাগ করতেন। টুকরো স্মৃতি নিউরনে সংকেত পাঠাতেই হাসি খেলে যায় মালিহার ঠোঁটে।
“কি রে! নাম!” নীতির ধাক্কায় মালিহার হুশ ফিরল। সে নিজেদের ব্যাগ নিয়ে ইতোমধ্যেই হলের গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। ইতমিনান ভাড়া মিটিয়ে মালিহার কাছে এলো।
“তোর নাম্বারটা আমাকে দে। আমার নাম্বার আছে তোর কাছে?”
“আছে। ফোন কেনার পর থেকেই আছে।”
ইতমিনান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। পরপর আবার তাড়া দিলো।
“কই দে!”
নাম্বার বলার পর মালিহা বলল, “আমি কারো অনুগ্রহ চাই না।”
ইতমিনান হতাশ সুরে বলল, “এগুলো তোর কাছে অনুগ্রহ মনে হচ্ছে? আমি কি তোর কেউ নই?”
“র-ক্ত সম্পর্কে কখনও জং ধরে না, সুতো ছিঁড়ে যায় না। আমাদের গেছে।”
ইতমিনান এই কথার কোনো প্রতিবাদ করলো না। কিন্তু ধীর কণ্ঠে বলল, “আমি তোর পর নই মালিহা।”
এক পলক ইতমিনানের দিকে তাকালো মালিহা।
“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। তুমি কতদূর থাকো?”
“পাশেই। রিকশায় উঠলে পাঁচ মিনিট লাগবে।”
“বেশ। তাহলে এসো।”
“কোনো দরকার হলে আমাকে একটা ফোন করিস। প্লিজ!”
বেশ আকুতির সুরে বলল ইতমিনান।
“আচ্ছা। আসি।”
মালিহা চলে গেলো। যতক্ষন না সে বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকলো ইতমিনান তাকিয়েই রইলো। এক সময় সে নিজেও প্রস্থান নিলো।

অনেকগুলো দিন পর নিজের রুমে মালিহা। দুইশ ছাব্বিশ নাম্বার এই রুমটাকে মালিহা নিজের বলেই ভাবে। না ভাবার কোনো কারণ নেই। রুমের মানুষগুলোর সাথে তার কোনো মনোমালিন্য নেই। নীতি এবং কণিকা আপুর সাথে বেশ ভাব। কণিকা ফোর্থ ইয়ারে। আরেক কর্ণারের বেডে আঁখি, মাস্টার্সের ছাত্রী। এই মেয়েটা একটু গম্ভীর। নিজের মতো থাকতে ভালবাসে। কারো সাতে পাঁচে নেই। তবে মালিহা, নীতি বা কণিকার সাথে জুনিয়র বলে কখনও খারাপ ব্যবহার করেছে বলে তাদের মনে পড়ে না।
গোসল করে জানালা খুলে বালিশে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল মালিহা। শরীর বিশ্রাম নিতে চাইলেও মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছে না। কিছুক্ষন এভাবে থাকার পর বুকে ব্যাথা হতে লাগলো। নাজিয়া কতো বকেন এভাবে না শোয়ার জন্য কিন্তু মালিহার খেয়ালই থাকে না। উঠে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো মালিহা। বহু দূরের কোনো বাড়ি অথবা দোকানে আলো জ্বালানো হয়েছে। গাছের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ সেই আলোক বিন্দু দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে জোনাকি নেচে বেড়াচ্ছে।
“মালিহা খিচুড়ি খা।”
মালিহা সামনে তাকালো। কণিকা হাতে খিচুড়ির ওকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“দ্রুত নে। আমার ক্ষুধা লেগেছে। খেতে বসবো।”
হাতে নিতেই মালিহা বুঝলো একদম গরম খিচুড়ি। অবাক হয়ে বলল, “গরম খিচুড়ি আপনি কোথায় পেলেন আপু?”
“রান্না করে আনলাম। তোর আমের আচারটা কোথায়?”
“শেষ হয়ে গিয়েছে। নীতির আছে। দাঁড়ান দিচ্ছি।”
নীতির টেবিলের শেলফ থেকে আমের আচারের কৌটা বের করলো মালিহা। মালিহার দিকে অপলক তাকিয়ে কণিকা বলল, “আন্টি কেমন আছে মালিহা?”
“আছে আপু।”
নিশ্বাস ছেড়ে বলল মালিহা। মেয়েটার মলিন মুখ দেখে কণিকার খেতে মন চাইলো না। কিন্তু ক্ষুধা লেগেছে ব্যাপক।
“আমার সাথে বস। একসাথে খাই।”
“নীতি গোসল করে আসুক।”
“আসতে থাকুক ও। তুই বস।”
এতবার বলার পর না করাটা বেমানান। মালিহা প্লেট নিয়ে বসলো। খিচুড়ি নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, “আঁখি আপু কোথায়?”
“জানিনা। আপুর কি কোনো টাইম টেবিল আছে? এই আছে এই নেই।”
সেসময়ই রুমে ঢুকলো আঁখি। কণিকা যেনো একটুর জন্য বেঁচে গেলো। আঁখিকে তার বেজায় ভয়। কেমন হুম করে থাকে সবসময়।
“কেমন আছো মালিহা?”
“জি আপু ভালো।”
“শরীর সুস্থ?”
“জি আপু।”
বেশ কিছুক্ষণ পর মালিহা দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপু আপনাদের কাছে একটা আবদার আছে।”
আঁখি বাইরের পোশাকেই বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিল। সেটা দেখে মুখ কুঁচকে খাচ্ছিল কণিকা। কণিকা চোখ তুলে মালিহার দিকে তাকালো। আঁখি বলল, “কি আবদার?”
“আমাকে কিছু টিউশনি খুঁজে দিতে পারবেন?”
চুপচাপ ঘরটায় কেবল কিছু দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-০৫

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫

একের পর এক পাওনাদার এসে চলেছে। মালিহা হাবুডুবু খাচ্ছে। মতিয়ার আলীর এতো ঋণ ছিলো! মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। এরা নিশ্চয়ই সুযোগসন্ধানী। কিন্তু প্রমাণ পত্র সামনে দেখে কিছু বলার উপায় থাকে না। ইতমিনানের সাহায্যে মতিয়ার আলীর জমানো টাকা থেকে কিছু টাকা তুলে এনেছে মালিহা। কিন্তু হাত মুঠো করার আগেই সব টাকা ঋণ মেটাতেই ফুরিয়ে গেলো। দিনশেষে মালিহা দেখলো আগামী এক সপ্তাহের বাজারটুকু খুব কষ্তে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে হবে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। মকবুল আলী স্মিত হেসে বললেন, “জীবন বড় কঠিন মা। কিন্তু তুমি যদি তাকে কঠিন মনে করে মগজে জায়গা দাও তাহলে সে তোমাকে পেয়ে বসবে। জীবনকে দেখবে পাহাড়ের মত। কখনও বন্ধুর পথ, কখনও ঢাল, কখনও চূড়া।” মালিহা কথাগুলো মাথায় গেঁথে নিলো, বুকে বেঁধে নিলো। বাবা তো তাকে ছাড়া বাঁচতে শিখিয়ে যায়নি।

সন্ধ্যার আগে আগে পাশের বাড়ির চাচী এলেন। সাথে অপরিচিত একজন মহিলা। মালিহা তাদের ভেতর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালো।
রাবেয়া তখনও যাননি। কিন্তু মনস্থির করে ফেলেছেন। আগামী কাল সকাল সকালই চলে যাবেন। এই মুহূর্তে তাকে আর এবাড়িতে প্রয়োজন নেই। বরঞ্চ বাড়তি তিনটা মানুষ কি খাবে সেই চিন্তায় মালিহার মুখ শুকিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। ভাতিজির এই কষ্টটুকু তিনি কমাতে চান।
অপরিচিত মহিলা দেখে রাবেয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল।
“এইটা কে গো?”
চাচী হেসে বললেন, “আমার ননদের প্রতিবেশীর বোনের মেয়ে।”
নীতির মাথা ঘুরে উঠলো। সে বাক্যটুকু তার মাথায় নিতেই চাইলো না।
“মালিহা কই আপা? ওরে দেখতে আসলাম।”
রাবেয়া বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, “মালিহা আছে। ওরে কেনো দেখতে আসছো?”
“এমনেই। বাপটা ম’রে গেলো। মেয়েটার কথা ভাবতেই কষ্ট লাগে।”
“তাহলে ভাবার দরকার কি?”
চট করে মুখে হাত দিলো নীতি। চাচী তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এইটা কে?”
“মালিহার বান্ধবী।”
“ওহ। আসলে আপা মালিহার কথা তারে বললাম। মনি আবার কারো দুঃখ দেখতে পারে না। সে আমারে একটা ভালো প্রস্তাব দিছে। আপনাদের কাছে সেটাই বলতে আসলাম।”
রাবেয়া মনে মনে এটার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। শুরু হয়েছে তবে। নাজিয়া, রাশেদা কেউই আশপাশে নেই। রাবেয়া নিজেকে মুক্ত অনুভব করলেন। যাক,কিছু বলার পর অন্তত রাশেদার চোখ রাঙানি খেতে হবে না।
মালিহা চা, নাস্তা নিয়ে এলো। এগিয়ে দিয়ে সামনে বসলো। নীতি তাকে ভুরু তুলে ইশারা করছে। মালিহাও ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?” নীতি নিজের ডান হাত গলার একপাশ থেকে আরেকপাশে নিয়ে গেলো। ফিসফিসিয়ে বলল, “তু তো গ্যায়ী কাম সে।” মালিহা বিরক্ত হলো। এই মেয়েটা সহজ কথা কখনও সহজে বলে না। অথচ পৃথিবীর জটিল কথাগুলো নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে অপর পাশের মানুষটাকে পাথর বানিয়ে দেয়।
“এই যে মনি। এটাই মালিহা।” চাচী উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বললেন। মনি নামক মহিলা নরম করে হেসে মালিহাকে বললেন, “আমার কাছে এসে বসো মা।”
মালিহা না করতে পারলো না। কেউ এতো সুন্দর কেউ ডাকলে না করা যায়? মহিলার পাশে বসতেই তিনি আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরলেন মালিহাকে। মালিহা বিস্মিত হলো। অনুভব করলো মহিলার অপত্য স্নেহ। জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিতে কিছু একটা ছিলো যাতে মহিলাটিকে মালিহার আপন বলে মনে হলো।
“কেমন আছো মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
মনি মোটামোটি চাচীর বয়সী। সেই হিসেবেই তাকে আন্টি বলা। কিন্তু চাচী হইহই করে উঠলেন।
“কি বলো! কি বলো! মনি আমারে ডাকে আন্টি। তুমি আমারে ডাকো চাচী। আবার মনিরে বলো আন্টি। কেমনে কি হইলো?”
নীতি পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছিল। মনি যে ইতোমধ্যে মালিহার মন জয় করে ফেলেছে এটা নীতি খুব বুঝলো। বিরক্ত হলো সে। মালিহা কি টোস্ট যে একটু পানি পড়লেই হ
গলে যেতে হবে? বিরক্তিকর! কিন্তু সম্পর্কের মারপ্যাঁচ আবার আসতেই তার মাথা ঘুরতে শুরু করলো।
“থাক মা। সমস্যা নেই। আন্টিই বলো।”
মালিহা স্বস্তির নিশ্বাস নিলো।
“শরীর সুস্থ আছে তো মা?”
“জি আন্টি।”
“কিসে পড়ছো এবার?”
“অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।”
“অনুমতি দিলে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব। কিছু মনে করতে পারবে না।”
মালিহা মহিলার ব্যবহারে মুগ্ধ হলো। মুগ্ধতা নিয়েই বলল, “অবশ্যই আন্টি। বলুন। কিছু মনে করবো না।”
“বিয়ে করার কোনো চিন্তা করেছ কি? জানি তোমার বাবা মা’রা গেছে এখন পরিস্থিতি কিছুটা জটিল। তবুও এ বিষয়ে তোমার চিন্তা জানতে চাইছি।”
মালিহা বিব্রত বোধ করলো।
“আন্টি দেখতেই তো পারছেন আমাদের পরিবারের বর্তমান অবস্থা। ভাইটা ছোটো। পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার মতো বয়স এখনো হয়নি। সেই মানুষটার মন মানসিকতা কেমন হবে এটা তো আগে থেকে বলা যায় না। এই বিপদের সময়ে সে যদি আমার পরিবারের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে আমার একুল ওকুল সব যাবে। তাই ভাইটা একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত এই বিষয়ে ভাবছি না।”
মালিহার উত্তরে মহিলা সম্ভবত খুব খুশি হলেন। তার চোখেমুখে হাসি খেলে গেলো। চায়ের কাপ হাত থেকে নামিয়ে বললেন, “সুন্দর বলেছ মা। তাহলে আমি আর এই বিষয়ে কিছু বলব না। কিন্তু সবাইকে নিয়ে ভাবতে যেয়ে নিজেকে ভুলে যেও না।”
মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন মনি। চাচী হায় হায় করে উঠলেন।
“কি আশ্চর্য! তুমি না ওর জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসলা? ওর পাশে এখন একটা খুঁটি দরকার না? একা একা কতদূর যাবে ও?”
মালিহার মনে হলো চাচী তাকে অবমূল্যায়ন করছে। মেয়ে বলে কি মালিহা তার পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবে না? মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো।
“বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর মন তৈরি হয়নি। ওকে জোর করে বিয়ে দিলে কি ও সুখী হবে? তার চেয়ে নিজের বিষয়টা বুঝে নিক। বড় হয়েছে। এটুকু নিশ্চয়ই বুঝবে। তোমার মা কই মালিহা?”
এতক্ষণে কথা বললেন রাবেয়া। মানতে দ্বিধা নেই মহিলার কথার ধরন তাকে পছন্দের তালিকায় রাখতে বাধ্য করেছে।
“নাজিয়া ঘুমায়।”
“আচ্ছা তাহলে উঠি। আপাকে আমার সালাম দিয়েন। সাবধানে থেকো মা। নিজের যত্ন নিও।”
মালিহার মাথায় হাত রেখে বললেন মনি। মালিহা নিবিষ্ট হয়ে দেখলো মনির প্রস্থান।
রাবেয়া বানু মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, “শুরু হয়ে গেছে মানুষের নাক গলানো।”
রাফি চুপি চুপি দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিল। মায়ের কাছে এসে বলল, “আম্মা মালিহা আপার বিয়ে?”
রাবেয়া ছেলেকে কোলে নিলেন।
“না রে বাপ। কিসের বিয়ে?”
রাফি মায়ের কল থেকে নেমে মালিহার কাছে গেলো। তার গায়ের সাথে লেপ্টে বসে বলল, “আপা আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি আমাকে বিয়ে করবা?”
নীতি চোখ কপালে তুলে বলল, “কি সর্বনাশের কথা!”
মালিহা হেসে ফেলল। বাবার অনুপস্থিতি, পরিবারের দায়িত্ব, ভবিষ্যত চিন্তা সবটা হঠাৎ মস্তিষ্ক থেকে যেনো মুছে গেলো। হাসতে হাসতে রাফিকে কোলে নিলো সে।
“আমাকে বিয়ে করবি? কেনো?”
“আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আপা।” মালিহার গলা জড়িয়ে ধরে বলল রাফি। মালিহা হাসি থামিয়ে রাফিকে জড়িয়ে নিলো। সে জানে ছোট্ট রাফির ভালোবাসা হয়তো চাহিদার এই দুনিয়ায় গোনার তালিকায় থাকবে না। তবে খাদহীন এই ভালোবাসাটুকু সে বুকের মাঝে রেখে দিতে চায়। খুব যত্ন করে। যেখান থেকে দুর্বল সময় শক্তি পাওয়া যায়।

“দোস্ত তোর চাচাত ভাই তোর থেকে কতো বছরের বড়?”
মালিহা কিছুক্ষন ভেবে বলল, “ছয় বছর হবে মনে হয়। কেনো?”
মুখের সামনে বালিশ ধরে নীতি বলল, “এইটা পুরাই আমার অ্যাসাম্পশান। কিন্তু নীতির সিক্সথ সেন্স বলতেসে ব্যাটা তোর প্রতি উইক।”
বালিশের নিচে মুখ ঢাকলো নীতি। তখনই আরেকটা বালিশ দিয়ে তাকে আক্রমণ করলো মালিহা।
“ফালতু আলাপ করার জন্যে এখানে থাকছিস? অসভ্য মেয়ে।”
“আমি আগেই বলসি এইটা আমার অ্যাসাম্পশান। আক্রমণ করার কোনোই কারণ দেখি না।”
মালিহা শান্ত হয়ে বলল, “ভাইয়া তার সব কাজিনকেই ভালোবাসে। খেয়াল রাখে। এতে অন্য কিছু ধারণা করার কিছু নেই।”
“না থাকলে নাই। কিন্তু হইতে কতক্ষন।”
মালিহা কথা বাড়ালো না। নীতি বলল, “কি ভাবিস?”
“ফিরে যেতে হবে নীতি। ওখানে গুছিয়ে নিতে না পারলে এদিকে অবস্থা ঠিকঠাক করা সম্ভব হবে না। সামনে আমার জন্য খুব কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।”
নীতি মালিহাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো।
“ভয় পাইস না দোস্ত। আমি তোরে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করবো।”
মালিহা জানে। নীতি নামক বাঁচাল মেয়েটার ওপর তার এই বিশ্বাস আছে।

গভীর রাতে ভাইয়ের ঘরে গেলো মালিহা। মিতুলের সাথে আলাদা করে দুদণ্ড সময় ব্যয় করা হয়নি। হালকা আলোয় মিতুলের নাকের নিচে অস্পষ্ট একটা দাগ দেখতে পেলো মালিহা। মিতুলের কি গোঁফ উঠছে? হাসি পেলো মালিহার। সেদিনের সেই ছোট্ট ভাইটা কতো বড় হয়েছে। আচ্ছা! সে কি আগামী দিনে মালিহার সঙ্গী হবে?

রাবেয়া সকালে মালিহার থেকে বিদায় নিলেন। মালিহা বলল তার যাওয়া পর্যন্ত থাকতে। রাবেয়া শুনলেন না।
“আমারও তো ঘর সংসার আছে নাকি? আর কয়দিন থাকবো?” অথচ তিনি জানেন আজ রান্না করার জন্য মালিহা পাঁচটা ডিম আলাদা করে রেখেছে। তারা চলে গেলে কিছু তো নিশ্চয়ই বাঁচবে।
“মাঝে মাঝে আমার মা’কে একটু দেখে যেও ফুপু। কিভাবে ওদের রেখে যাবো সেটাই বুঝতে পারছি না। মায়ের তো সংসারের দিকে কোনো খেয়ালই নেই।”
“তুই সব খেয়াল করছিস তাই তোর মা এমন করছে। তুই গেলেই দেখবি আবার নিজের দায়িত্ব পালন করছে। বেশি চিন্তা করিস না। আমি আসবো মাঝে মাঝে। বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করে যাবো। যাই।”

মকবুল আলীর বাড়িতে এসে ভাইকে ডেকে রাবেয়া বললেন, “ভাই আপনি মা’কে আপনার কাছে নিয়ে আসেন। ওদের এই টানাটানির মধ্যে ওখানে থাকার দরকার নাই।”
“আমিও ভাবছিলাম রাবেয়া। কিন্তু ওদের সাথে একটা মুরুব্বী মানুষ না থাকলে মালিহার মা যদি আরো ভেঙে পড়ে এজন্যেই কিছু বলি নাই।”
“সেই কথাও ঠিক। তাহলে কি করা যায়?”
“আমি মায়ের উসিলায় ওদের জন্য মাঝে মাঝে কিছু বাজার ঘাট করে দিয়ে আসবো। তুই চিন্তা করিস না।”
রাফি ইতমিনানের ঘরে গেলো।
“রাফি কেমন আছে?”
ইতমিনান কোলে নিতে চাইলে রাফি দূরে সরে গেলো। ইতমিনান ভুরু কুঁচকে বলল, “কি হলো?”
“তোমার কোলে উঠবো না। তোমাকে আমার ভয় করে।”
“কেনো?” অবাক হয়ে বলল ইতমিনান।
“তোমার চোখ অনেক ছোট। যাদের চোখ ছোট তাদের আমি ভয় পাই। মালিহা আপার চোখ বড়। আমি মালিহা আপাকে পছন্দ করি।”
“তাই?”
“হ্যাঁ। তুমি জানো আমি মালিহা আপাকে বিয়ে করব।”
“আচ্ছা!” বিস্ময়ের ভঙ্গিতে ভুরু উঁচু করলো ইতমিনান। কোমরে দুই হাত রেখে বলল, “মালিহা তোকে বিয়ে করবে?”
“কেনো করবে না? কালকে একজন আপার বিয়ের কথা বলতে এসেছিল। অন্য কেউ আপাকে বিয়ে করার আগে আমি আপাকে নিয়ে করে নিয়ে যাবো। আপা সারাদিন কান্নাকাটি করে। আমি আপাকে কাদতে দিবো না।”
ইতমিনানের কপালে ভাঁজ দেখা দিলো। ফুপুর কাছে যেয়ে তাকে জেঁকে ধরলো।
“ফুপু মালিহার জন্য সম্বন্ধ এসেছিল?”
রাবেয়া অবাক হয়ে বললেন, “তোকে কে বলল?”
“রাফি।”
“হায় আল্লাহ! এই ছেলেকে নিয়ে আমি করবো!”
“তুমি আমার কথার উত্তর দাও।”
“ঐ আসছিলো একজন।”
“মালিহা কি বলল?” উত্তেজিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো ইতমিনান।
“বলল এখন বিয়ের কথা ভাবছে না। আগে মিতুল বড় হোক। এইসব। তুই এতো লাফালাফি করিস কেনো?”
ইতমিনান বিব্রত ভিঙিয়ে বলল, “লাফালাফি করলাম কই? তোমার যত উল্টাপাল্টা কথা।”
ইতমিনান চল গেলেও রাবেয়া সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

মালিহা যাবার কালে নাজিয়া কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মালিহা শক্ত থাকতে পারলো না।
“তুমি কয়েকটা দিন একটু কষ্ট করে থাকো মা। আমি তাড়াতাড়ি তোমাদের ওখানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো।”
“তোর বাপ আমারে কই রেখে গেলো মালিহা। আমি কেমনে ঐ ঘরে একা থাকবো।”
রাশেদা ছেলের বউকে আগলে নিয়ে নরম কণ্ঠে বললেন, “মেয়েটা চলে যাচ্ছে। এভাবে কান্নাকাটি করলে ও ওখানে যেয়ে থাকবে কিভাবে? তুমি মা। ওকে সাহস দিয়ে পাঠাও।”
নাজিয়া চোখ মুছে মেয়ের কপালে চুমু দিলেন। ফের ঝরঝরিয়ে কেঁদে দিলেন। মেয়ের যাওয়ার দিন মানুষটা যেনো পাগল হয়ে যেত।
মিতুল বোনের ব্যাগ নিয়ে আগে হাঁটছিল। মকবুল আলীর বাড়ির সামনে থেকে ইতমিনান তার সাথে যোগ দিলো। মিতুল আড়চোখে তাকিয়ে বলল, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
“চাকরি করতে। ছুটি শেষ।”
“আজকেই ছুটি শেষ হলো?” সন্দেহী কণ্ঠে বলল মিতুল। ইতমিনান হেসে বলল, “তোর আপার সাথে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এই অবস্থায় একা একা যাওয়াটা ঠিক হবে না।”
মিতুলের ভাইসুলভ মনে ইতমিনানের ভাবনাটা পছন্দ হলো। তবুও বাঁকা কণ্ঠে বলল, “তোমার বোন আবার জমি নিয়ে লাফালাফি করবে না তো?”
“ওকে শশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। বলেছি আমরা যেটা বলবো সেটাই শুনতে হবে। নয়তো ও কিছুই পাবে না। ঠিক করিনি?”
মিতুল কথা বলল না। সে জানে মিলি এটুকুতে মেনে নেয়ার মেয়ে না।
ইতমিনান ভাবলো কতো কাঠখড় পুড়িয়ে বোনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মায়ের মাথা থেকে ভূতটা নামাতে পারেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। কবে এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে জানে না।

ট্রেনে উঠে ইতমিনানকে দেখে মনে মনে স্বস্তি পেলো মালিহা। ট্রেনে এর আগে টিকিট ছাড়া যাতায়াত করেনি সে। সিট পাওয়া যায় নাকি সেটাই চিন্তার বিষয়। পরিচিত, বিশ্বস্ত একজন সাথে থাকলে ভরসা পাওয়া যায়। তার ভরসা পুরোটা পথ রাখলো ইতমিনান। কিভাবে কিভাবে যেনো তিনটা সিট খুঁজে বের করে ফেললো। একটু পরপর খোঁজ নিলো। কোনো কিছু প্রয়োজন হলে তাকে জানাতে বলল। নীতি সবটা চুপচাপ দেখে মালিহার দিকে তাকালেই সে চোখ রাঙালো।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-০৪

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪

অনেকগুলো ছেলেমেয়ে বাড়ির দিকে আসছে। মিতুল খেয়াল করলো। দেখলো ইতমিনান তাদের আটকেছে। কথাবার্তা বলে ছেড়ে দিলো। মিতুল ইতমিনানকে সহ্য করতে পারছে না। ইতমিনানের সব কাজ তার কাছে আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে। একটা মেয়ে এসে বলল, “তুমি মিতুল না?”
মিতুল তাকালো। বসা থেকে উঠে বলল, “জি। আপনাকে তো চিনলাম না।” নীতি কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, “আমি নীতি।” মিতুলের কপালের ভাঁজ সমান হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আসুন।”
মালিহা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। নীতিদের দেখতে পেয়ে বের হয়ে এলো। নীতি ঝাপিয়ে পড়লো মালিহার উপর। মালিহা তাকে আগলে নিলো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো নীতির বাবা মা-রা গেছে এবং মালিহা তাকে স্বান্তনা দিচ্ছে। এহসান একদৃষ্টে মালিহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। পেছনে আসা ইতমিনান সেটা লক্ষ্যও করলো।
“নীতি থাম।”
“আমার অনেক কষ্ট লাগছে দোস্ত।”
নীতি হেঁচকি তুলে বলল। মালিহা নিচু স্বরে বলল, “আবার পরে কাদিস। ওরা এতো দুর থেকে জার্নি ওর এসেছে ওদের বসার ব্যবস্থা করতে হবে।” নীতি নাক টেনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
“আন্টি কোথায়? আমি আন্টির সাথে দেখা করে আসি।”
“ভেতরে আছে। মিতুল নীতিকে মা’র কাছে নিয়ে যা।”
ইতমিনান মালিহার কাছে এসে বলল, “সকালে কি খেয়েছিস?”
মালিহা এক পলক তাকিয়ে বলল, “কিছু না।”
ইতমিনান আর কিছু শোনার প্রয়োজন বোধ করলো না। সামনের ছেলেদের দিকে তাকালো। বলল, “ভাই! আমি মালিহার চাচাতো ভাই। তোমরা আমার সাথে এসো। মেয়েরা এদিকে থাকুক।”
দুইজন মেয়ে মালিহার নির্দেশে নীতির পিছু পিছু গেলো। ইতমিনান যাওয়ার আগে ফিসফিসিয়ে বলল, “কিছু করতে হবে না। আমি ফুপুকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফুপুকে ডেকে দে।”
মালিহার প্রকৃত অর্থেই রান্না করতে ইচ্ছে করছিল না। তাই এক বাক্যে মেনে নিয়ে রাবেয়ার যেচে গেলো সে।

রাবেয়া বেজায় চিন্তিত। এতদিন দ্বন্দ সংঘাত ছিলো ভাইদের মাঝে। সেটা এখন স্থানান্তরিত হয়েছে ভাইয়ের বউদের মাঝে। অবশ্য এতদিন পেছন থেকে তারাই কলকাঠি নেড়ে আসছিলো। প্যাঁচে পড়েছিল ভাইয়ের ছেলেমেয়েগুলো। মালিহার কথা মনে হতেই বুকটা ভার হয়ে যায়। মতি তো গেছে। তার মেয়েকে বিপদে ফেলে গেছে। আহা! বাপের আদরের মেয়ে। মালিহা কি দিয়ে কি করবে ভেবে পান না রাবেয়া।
“আম্মা!”
রাবেয়া সামনে তাকালেন। রাফি ডাকছে। পাঁচ বছরের ছেলেটা তার শেষ বয়সের সন্তান। দাম্পত্য জীবনের দীর্ঘ একটা সময় তিনি নিঃসন্তান হিসেবে কাটিয়েছেন। স্বামীর মন মানসিকতা ভালো ছিল বলে শাশুড়ির কথা শুনেও টিকতে পেরেছেন। নয়তো তার পাশের বাড়ির ছোট্ট একটা মেয়ে, এই মালিহার সমান, বিয়ের দুই বছরের মাঝে কোনো ছেলেপিলে হলো না বলে মেয়েটাকে বাপের বাড়ি রেখে এলো। তিনি অবশ্য আফজাল সাহেবকে বলেছিলেন আরেকটা বিয়ে করতে। একজন ডিভোর্সী মহিলাকে বিয়ে করলে তারও আশ্রয় হয়। আফজাল সাহেব বলেছিলেন, “আমার জীবনে ঝামেলার কোনো শেষ নাই রাফির মা। ডাইকা ডাইকা আর ঝামেলা আনার কাম নাই।” এই মানুষটা আজব। বিয়ের পর থেকেই ডাকে রাফির মা। যখন রাফির কোনো খোঁজ খবর নেই তখন ডাকে রাফির মা। অবশেষে দীর্ঘ অপেক্ষার সফর শেষ করে তারা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। আজ রাবেয়া প্রকৃত অর্থেই রাফির মা।
ছেলেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন রাবেয়া। মনে চায় মানিকটাকে কলিজার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে। আহা! তার বুকের ধন।
“বলো বাপ। ক্ষুধা লাগছে? কিছু খাবা?”
“না। আম্মা মালিহা আপার কি হয়েছে?”
রাবেয়ার বুকটা ভরে যায়। ছেলেটা কি সুন্দর কেউ কথা বলে! একদম স্পষ্ট করে। মাঝে মাঝে তিনি নিজেকে নিয়েই শঙ্কায় পড়ে যান। কখন না নজর লাগিয়ে দেন।
“কি হবে বাপ? কিছুই হয় নাই।”
“মালিহা আপা এবার আমাকে একবারও কোলে নেয়নি। মালিহা আপার মন খারাপ। কেনো আম্মা?”
“তোমার ছোট মামা কালকে মারা গেছে না? তাই মালিহা আপার মন খারাপ।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন রাবেয়া।
রাফি গম্ভীর হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আম্মা আমি মালিহা আপাকে বিয়ে করব।”
চারদিকে দুঃখের জাল বিছানো। তার মাঝে থেকেই রাবেয়া ফিক করে হেসে দিলেন।
“কেনো আব্বা?”
“মালিহা আপার মন খারাপ দেখলে আমার ভালো লাগে না। আমার সাথে বিয়ে হলে আপার মন ভালো হয়ে যাবে।”
“এই কথা তোমাকে কে বলেছে?”
“কেউ না। আমি জানি।”
রাবেয়া হাসেন। রাফি বলে, “হাসছো কেনো মা? মালিহা আপা আমাকে অনেক পছন্দ করে। মিতুল ভাইয়ার থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসে। আপা আমাকে বিয়ে করবে। তুমি আপাকে বলবা।”
“আচ্ছা। বলবো।”
রাফি মায়ের কোল থেকে নেমে গেলো। তার অনেক কাজ।
রাবেয়া বানু মায়ের কাছে গেলেন। একটা শলা পরামর্শ করা দরকার। মালিহা সেখানেই ছিলো। তিনি আশপাশে দেখে নাজিয়াকে ডেকে আনলেন।
“তুই এখন মিটিং বসালি কেনো?” রাশেদা বিরক্ত হলেন। আরেকটু পরেই এশার ওয়াক্ত হবে। রাবেয়া এখন কথা শুরু করলে থামবে না।
“দরকার আছে মা। এই মালিহা ওঠ।”
মালিহা চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে ছিল। উঠে বসতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো। ফুপুর দিকে তাকালো। রাবেয়া প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছেন।
“কি বলবা ফুপু?”
রাবেয়া নাজিয়ার দিকে তাকালেন। এক দিনের মাঝেই যেনো নাজিয়ার চেহারা অর্ধেক হয়ে গেছে। ভাইয়ের বউয়ের মাথায় হাত রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওদের একটা ব্যবস্থা করতে হবে না মা? মতির ছেলেমেয়েদের এখন কে দেখে রাখবে?”
রাশেদা বেগম যে এই বিষয়ে চিন্তা করেননি তা না তবে ভেবেছিলেন বড় ছেলেকে নিয়ে আলোচনায় বসবেন।
নাজিয়া চুপ করে ছিলেন। রাবেয়া বললেন, “তোমার ভাই কি বলে নাজিয়া?”
“তেমন কিছু বলে নাই আপা।”
নাজিয়ার বড় ভাই চলে গেছেন আজ বিকালে। যাওয়ার আগে অবশ্য স্বান্তনা দিয়ে গেছেন। নাজিয়া বললেন, “আমার মিতুল বড় হয়েছে। ওকে নিয়েই আমি থাকতে পারবো। কারো ঘাড়ের বোঝা হতে চাই না আপা।”
“মাথার উপরে একটা ছায়া লাগে না? মালিহা থাকবে ভার্সিটিতে। তুমি মিতুলরে নিয়ে এক কিভাবে থাকবা? ছেলে তো তোমার ঘরেই থাকে না।”
বেশ কিছুক্ষণের জন্য ঘরে নীরবতা নেমে এলো। হঠাৎ মালিহা বলল, “মা আর মিতুলকে আমি আমার ওখানে নিয়ে যাব।”
সবাই মালিহার দিকে তাকালো। এমন কথা কেউ চিন্তা করেনি।
“তোর ওখানে মানে?”
“আমার ভার্সিটির এলাকায়।”
“কোথায় থাকবি?” প্রশ্ন করলেন রাশেদা।
“বাড়ি ভাড়া নিবো।”
“আর চলবি কিভাবে?”
মালিহা সরাসরি মায়ের দিকে তাকালো। এবারের প্রশ্নটা তার ছিলো। নাজিয়ার চোখে একটা চাপা আক্রোশ দেখা যাচ্ছে। মালিহা জানে সেটা কেনো। নাজিয়া আবার বললেন, “সব তো দিয়ে দিয়েছিস তোর চাচাদের। ভাগে যেই জমি আসবে সেই জমি বিক্রি ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই।”
মালিহা শান্ত কণ্ঠে বলল, “টিউশনি করবো। ছোটখাট চাকরি পাই নাকি দেখবো।”
“সারা দেশে ভুঁড়ি ভুঁড়ি শিক্ষিত ছেলে ঘুরছে। তোরে চাকরি কে দিবে?”
“কে দিবে সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমার কাজ চেষ্টা করা। সেটাই আমি করবো।”
এমন সময় ঘরের দরজায় কাশির শব্দ শোনা গেলো। রাশেদা বেগম বললেন, “কে?”
“আমি মা।”
রাশেদা মেয়ে, বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আয়।”
মকবুল এলেন। সাথে ইতমিনান।
“আলোচনা কতদূর?”
মালিহা চাচার দিকে তাকালো। মকবুল এবং মতিয়ার আলীর কপাল একদম এক। মালিহার বুকটা খা খা করে উঠলো।
“কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারি নাই এখনো। আপনি আসছেন ভালো হয়েছে ভাইজান।”
“তুমি কি চিন্তা ভাবনা করছো? তোমার ভাই কি বলে?”
নাজিয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন মকবুল আলী।
“ভাইজান! মালিহা তো বলে অন্য কথা। ও নাকি নাজিয়া আর মিতুলরে নিয়ে ভার্সিটিতে যাইতে চায়।”
“ভার্সিটিতে কোথায়?”
ইতমিনান মালিহার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল। রাবেয়া বললেন, “বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে চায়। টিউশনি করতে চায়।”
রাশেদা বেগম মেয়েকে ধমক দিলেন, “আহ রাবেয়া! তুই থাম। নাজিয়ারে বলতে দে।”
“মালিহা! তুই কি চিন্তা করছিস?”
“মা আর মিতুলকে ওখানে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।”
“এখন তো সম্ভব না।” ইতমিনান বলল।
“এখন নিয়েও যেতে চাই না। আগে আমি যেয়ে টিউশনি ঠিক করি। বাসা দেখি। ব্যবস্থা হলে তারপর নয় যাবো। ততদিনে ইদ্দত শেষ হোক।”
আনুষাঙ্গিক আরো কিছু বিষয় আলোচনা হলো। ইতমিনান যাওয়ার আগে মালিহাকে বলে গেলো, “মালিহা আমার উপর তোর রাগ আছে কি না জানিনা। থাকলে সেটা জায়েজ না থাকলে তোর অনুগ্রহ। কিন্তু তোর কাছে আমার রিকোয়েস্ট থাকবে, আগের ঘটনার রেশ ধরে রাখিস না। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ডাকিস। নাহলে আমি নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব।” মালিহা কোনো উত্তর দেয়নি। নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছে।
নাজিয়া মনে মনে বেশ ক্ষুব্ধ হলেন। মেয়ে এবং মেয়ের চাচা কারো কথাই তার পছন্দ হলো না। মালিহাকে একা ঘরে পেতেই জেঁকে ধরলেন, “আমি তোর ওখানে যেয়ে থাকতে পারবো না।”
“কেনো?”
“ওখানে কে আছে আমার? বিপদ আপদে কে আসবে? তার থেকে তোর নানাবাড়ি যেয়ে থাকবো। তোর মামা কখনও আমাদের অবহেলা করেছে?”
“মা! বোঝার চেষ্টা করো। এটা দুদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া নয়। তুমি এখনো খামাখা ওখান যেয়ে থাকবে? নানা নানী কেউ নেই। মামী তোমাকে দুই কথা শোনালে তুমি উত্তর দিতে পারবে? কি দরকার?”
নাজিয়া মুখ গোজ করে থাকলেন। কোনো যুক্তিই তার পছন্দ হচ্ছে না। মালিহা মায়ের মনে কথা বুঝতে পেরে শান্ত স্বরে বলল, “মামা যদি তোমাকে নিয়েই যেতে চাইতো তাহলে যাওয়ার আগে কিছু বলে যেতো না? বলেছে কিছু?”
নাজিয়া বেগম ধমকে উঠে বললেন, “তুই আমার ভাইকে কি বলতে চাচ্ছিস? তোর চাচার মতো স্বার্থপর না সবাই।”
মালিহা বলতে চাইলো, “আজ সকালে তোমাকে জমি কে দিতে চেয়েছিল? আজ সন্ধ্যায় তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কে চিন্তা করে গেলো?” বলল না। এখন নাজিয়া কথা বোঝার মতো অবস্থায় নেই।

ঘরে যেতেই নীতি খপ করে মালিহার হাত ধরলো।
“কি হয়েছে?”
“ভয় পাচ্ছিলাম।” নীতি এদিক ওদিক তাকালো।
মালিহা বিছানা গোছাতে গোছাতে বলল, “এহসানরা চলে গেছে?”
“হু। সবাই ক্যাম্পাসে চলে গেছে। মালিহা।”
“বল।”
নীতি মালিহার দিকে তাকালো। কথাটা এখন বলা কি ঠিক হবে? না থাক। মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হোক। মালিহা শুনতেও চাইলো না নীতি কেনো তাকে ডাকলো।
“নীতি তুই কবে যাবি?”
“তোর সাথে।”
মালিহা দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকে ফিরে যেতে হবে। সেই একই রুটিনের আবর্তে ঘুরপাক খেতে হবে। কিন্তু বুকে শূন্যতা নিয়ে। এই শূন্যতা আর কখনই কোনো কিছু দিয়ে পূরণ হবে না।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-০৩

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩

জানালার পাশে বিশাল বড় এক কড়ই গাছ। সন্ধ্যা হলেই গাছের পাতা গুলো কেমন ঝিমিয়ে পড়ে। দিনের শুরু থেকে আবার শিরদাঁড়া টান টান করে বাতাসের সাথে দুলতে থাকে। দিনের আলোর সাথে সম্ভবত তাদের একটা অলিখিত চুক্তি আছে। যতক্ষন আলো থাকবে ততক্ষন পাতারা খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ প্রস্ফুটিত থাকবে। সেই কড়ই গাছটা রাতের নীরবতাকে যেনো আরো নিশ্ছিদ্র করেছে। দাফনের পর অনেকে চলে গেলেও প্রায় বারো চৌদ্দ জন খোলা উঠানে চেয়ার পেতে বসে আছে। অন্দরমহলে মহিলা সমাজও সজাগ। কারো চোখে ঘুম নেই। কারো নির্ঘুমতা শোকে তো কারো উদ্বিগ্নতায়।

রুমটা মালিহার। খুব বেশি বড় নয়। একটা খাট আর আলনা রেখেই যেনো ঘর ভর্তি হয়ে গেছে। টেবিল রাখার কারণে ঘরটা ঠাসা ঠাসা দেখায়। সেই কাঁঠাল কাঠের টেবিলে একটা চার্জার লাইট জ্বলছে। দেয়ালের দিকে তার মুখ ঘোরানো। যেনো আলো জ্বেলে অন্ধকারকে পরিমাপ করার চেষ্টা।
মালিহা শোকের আবহ থেকে একটুখানি সময় একান্তই নিজের জন্য, মতিয়ার আলীর জন্য টেনে বের করেছে। আঁধার যখন দর্প ভরে পৃথিবীতে রাজত্ব করছে তখন মালিহা আঁধারের দম্ভকে চূর্ণ করে সেই আঁধারের মালিকের দরবারে মাথা ঠুকে কাঁদছে। তার চোখ থেকে অশ্রু নির্গত হয় ভিজে পাতলা জায়নামাজ। বুকের কাছের ওড়নাটা ভিজেছে সেই কখনই। থেকে থেকে তার পিঠ কেঁপে উঠছে। তার কান্নামাখা ভেজা বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে গুনগুন করা কিছু শব্দ।

“আমার বাবার অনেক পাপ আল্লাহ। আমার বাবা মাঝে মাঝে নামাজ মিস দিয়েছে। দাদির সাথে অনেক সময় জোরে কথা বলেছে, খারাপ ব্যবহার করেছে। বড় চাচার সাথে সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া করেছে। তোমার সব হক ঠিকমতো আদায় করতে পারেনি। কিন্তু আমার বাবা তোমাকে ভালোবাসতো আল্লাহ। তার অন্তরের খবর তুমি আমার চেয়ে বেশি ভালো জানো। আমার বাবা তো তোমারই বান্দা বলো! আমি না চাইতেই তুমি আমাকে হাত, পা সব দিয়েছো। বাবা, মা, ভাই, বোন দিয়েছো। আজকে আমি তোমার কাছে আমার বাবার জন্য শান্তি চাইতে এসেছি আল্লাহ। তুমি কি তোমার ভিখারী বান্দাকে ফিরিয়ে দেবে? তোমার কাছে তো কোনো কিছুর অভাব নেই। আমার বাবাকে ক্ষমা করে দিলে তোমার কোনোই ক্ষতি হবে না। তুমি প্লিজ আমার বাবাকে ক্ষমা করে দাও। প্লিজ!”

মালিহার মাথা ভার ভার লাগছে। নাকের ভেতরে শিরশির করছে। দ্রুত নামাজ শেষ করলো সে। নাকের কাছে হাত দিতেই তরল আঠালো পদার্থ হাতে ঠেকলো। আলোর সামনে এসে দেখলো জায়নামাজ, ওড়না দুটোই র-ক্তে মাখামাখি। ঠিক কতটা দিন পর নাক থেকে রক্ত বের হলো মালিহা জানে না। তবে মনে পড়ে শেষবার অ্যাডমিশনের সময়ে খুব ঘন ঘন নাক থেকে র-ক্ত পড়তো। শরীরের ওপর, মনের উপর যখনই চাপ পড়েছে তখনই এমন হয়েছে। সেসময়টা বাবা পাশে ছিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করে বলতো, “কোনো চিন্তা নেই মা। আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছেন তাই হবে। তাঁকে বেশি বেশি ডাকো।” ডুকরে কেঁদে উঠলো মালিহা। সেই মানুষটা আজ নেই। তার পাশে নেই। এই বাড়িতে নেই। এমনকি এই দুনিয়ায় নেই। কোত্থাও নেই। আজ তার অস্তিত্ব এই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়েছে। মায়া মাখিয়ে “মা” বলে আর কেউ তাকে বাবার মতো করে ডাকবে না। বুঝবে না। বিছানায় শুয়ে পড়ল মালিহা। বুকটা ব্যাথা করছে। মাথা টনটন করছে। নাক থেকে গড়িয়ে পড়ছে টকটকে লাল তরল। তাকে থামানোর কোনো চেষ্টাই মালিহার নেই।

ইতমিনান বাবার পাশে বসে আছে। মকবুল আলী স্তিমিত হয়ে আছেন। বায়ান্ন বছরের শক্তপোক্ত মানুষটা কেমন যেনো ঝিমিয়ে গেছে। ইতমিনানের মনে হলো বিষয়টা বোঝানোর এখনই মোক্ষম সময়। নরম মনে নিশ্চয়ই তিনি পুরোনো জেদ ধরে বসে থাকবেন না।
“বাবা।”
মকবুল আলী অপলক নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলের ডাক তিনি শুনলেন না।
“বাবা।”
“হু!”
মকবুল আলী যেনো ধ্যান ছেড়ে বের হলেন। ইতমিনান বলল, “কি ভাবছিলে?”
মলিন হাসলেন মকবুল আলী।
“মতির কথা ভাবছিলাম। একই মায়ের পেটের ভাই আমার। অথচ শেষ সময়টা কি বিশ্রীভাবে কাটলো।”
ইতমিনান কিছু বলল না। মকবুল আলী নিজেই বললেন, “তুই আর মিলি যেমন আপন ভাইবোন আমি, মতি, রাবেয়া এমনই ভাইবোন। আমরাও ছোটবেলায় এক থালায় ভাত খেয়েছি। এক বাপের কাঁধে চড়েছি। এক মায়ের হাতেই বড় হয়েছি। অথচ দেখ। মতি ম-রার আগে আমি ওর সাথে বিরোধ করলাম সম্পত্তির জন্য। জায়গা জমির জন্য। অথচ এই ভাইয়ের কান্না থামানোর জন্যই আমি নিজের ভাগের খাবার, নিজের খেলনা ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম। পৃথিবীটা খুব কঠিন আব্বা। মাঝে মাঝে খুব ভয়ানক। র-ক্ত দিয়ে জুড়ে দেয়া সম্পর্ক র-ক্তা-ক্ত করেই ছিন্ন করে।”
হৃদয় নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মকবুল আলী।
“বাবা। একটা কথা বলতাম।”
“বল।”
“আমি যতদুর শুনেছি চাচার অনেক ঋণ ছিলো। ব্যবসা থেকে যা আয় ছিল সব ঋণ মেটাতেই চলে যাওয়ার কথা। তাহলে ওদের এখন আর কোনো আয়ের উৎস থাকলো না। ধানী জমি আর পুকুরটা যদি ওদের ভাগে দিতে তাহলে অল্প হলেও একটা ইনকাম সোর্স হতো।”
মকবুল আলী চমকে ছেলের দিকে তাকালেন। আশপাশে তাকিয়ে ছেলের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, “আমিও কথাটা ভাবছিলাম আব্বা। কিন্তু তোর মা’র জন্য বলতে পারছি না। মহিলা শুনলেই হুলুস্থুল বাধাবে।”
ইতমিনান বিষয়টা জানে। আজ সন্ধ্যায় বরকে সাথে নিয়ে এসেছে তার ছোট বোন মিলি। আয়েশাকে ইন্ধন যোগানোর এক সূত্র।
“আমরা মা’কে বোঝাবো। নাহলে এটা জুলুম হবে বাবা। এতিম দুটো ছেলেমেয়ের সাথে এমন ব্যবহার আল্লাহ সহ্য করবেন না।”
“তুই তোর মা’কে বলবি? ও তো তোর কথা ফেলতে পারে না।”
“বলবো।” দৃঢ় গলায় বলল ইতমিনান।
“রাবেয়া ফুপু কিছু মনে করবে না তো?” ইতমিনান জিজ্ঞেস করলো।
“না আব্বা। তোর ফুপু এসব সাত পাঁচে নাই। তারে ভাগ না দিলেও সে রা করবে না।”
“রা না করলে সেটা তার মহত্ত্ব। কিন্তু সেই সুযোগ নিয়ে আমরা জালিম হতে পারি না। কাল সকালে সবার সামনে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে। তুমি পাশে থাকলে আমি সাহস পাবো।”
“আমি তোর পাশেই আছি আব্বা।”
মকবুল আলী চোখ মুছলেন। যখন মাফ চাওয়ার এবং পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় নেই তখন অনুতাপ সম্ভবত পৃথীবির সবচেয়ে বড় এবং ভয়ংকরতম শাস্তি।

রাশেদা বেগমের শক্তপোক্ত রূপটা মিলি দেখতে পারে না। আহ্লাদ বিষয়টা তার মাঝে নেই। বংশের বড় মেয়ে হিসেবে বাড়তি কোনো খাতির সে দাদীর থেকে পায়নি। না পেয়েছে ইতমিনান। রাশেদা তার প্রত্যেক নাতি নাতনিদের সমান চোখে দেখেন। মনের গভীরে কারো প্রতি কোনো দুর্বলতা আছে নাকি সেটা কেউ জানে না। এটাই মিলির আশঙ্কা। মালিহার সাথে ন্যায়বিচার করতে যেয়ে মিলি নিজের সাথে নাইনসাফি করতে দেবে না। চারপাশ দেখে আয়েশার কাছে গেলো মিলি।
“মা! তুমি এখনো এখানে কি করছো?”
আয়েশা চা বানাচ্ছিলেন। হঠাৎ মিলি কথা বলায় চমকে গেলেন। বুকে হাত দিয়ে পেছন ঘুরে ধমক দিলেন।
“সর! এভাবে কেউ কথা বলে? শব্দ টব্দ করে আসবি তো নাকি? আমার বুক ধড়ফড় করছে।”
“এখন বুক ধড়ফড় করছে। একটু পর আরো কিছুর জন্য তৈরি হও।”
“এতো প্যাঁচানো কথা কোত্থেকে শিখেছিস তুই? সোজা কথা সোজা করে বলতে পারিস না?”
“রাখো তো তোমার চা। তোমার শাশুড়ির মতিগতি আমার ভালো ঠেকছে না।”
“কিসের মতিগতি?” আয়েশা ভুরু কুঁচকে তাকালেন।
“মালিহা সকালে মিটিং ডেকেছে জানো?”
“জানি।”
“তোমার শাশুড়ি না ওখানে দয়ার সাগর হাতেম তাই হয়ে জমি সব মালিহাদের দিয়ে দেয়।”
“এহ! বললেই হলো? তোর বাবার ভাগ আছে, তোর ফুপুর ভাগ আছে।”
“বাবা কালকে থেকে ঝিম মেরে আছে। ঐ বুড়ি যা বলবে তাই শুনবে। আর ফুপু তো আলু। মালিহার জন্যে তার মায়ার শেষ নাই। রেডি থাকো। নাহলে ঝটকা একটা খাবা। এতকিছু আমি বুঝি না। তোমার জামাই আছে। তার সামনে ফকিরি মার্কা জমি নিয়ে আমার মান সম্মান নষ্ট করবা না। এবার যা পারো করো।”
মিলি চলে গেলো। আয়েশা ভাবনায় পড়লেন। মিলি তো অবাস্তব কিছু বলেনি। ইতুর বাপের মনে এখন ভাইয়ের ছেলেমেয়ের প্রতি দরদ উথলে উঠলে সমস্যা। কয়েক বাড়ি পরেই মতিয়ার আলীর বাড়ি। যাবেন নাকি একবার?

এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে রাবেয়ার ছোটো ছেলে ফরিদের সাহায্যে উপস্থিত হলেন রাশেদা বেগম। তার উপস্থিতি যেনো পরিবেশের গাম্ভীর্য খানিকটা বাড়িয়ে দিলো। আশপাশের কৌতূহলী প্রতিবেশীরা ভিড় জমিয়েছে। বাদ যায়নি প্রয়াত মতিয়ার আলীর পরিবারও। অবশ্য মালিহার বাদ যাওয়ার কথা নয়। কারণ তার কথাতেই এই পরামর্শ সভা বসেছে। রাশেদা বেগম মালিহাকে ইশারা করলেন কথা বলতে। সালাম দিয়ে কথা শুরু করলো মালিহা।
“আমার বাবা মতিয়ার আলী, গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। আপনারা সবাই সেই সম্পর্কে জানেন। আমি তার হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। যদি আমার বাবা কোনোদিন আপনাদের কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকেন তাহলে তাকে মাফ করে দেবেন। মৃ-ত মানুষের সাথে আর কিসের বিরোধ? আর ব্যবসায়িক লেনাদেনায় যারা বাবার সাথে যুক্ত ছিলেন আমার বাবা যদি কারো কাছে আর্থিকভাবে ঋণী থাকেন তাহলে দয়া করে প্রমাণসহ আমাদের সাথে যোগাযোগ করবেন। যতক্ষন না এই টাকা শোধ হচ্ছে ততক্ষন আমার বাবা কবরেও শান্তি পাবেন না। যারা বাবার পরিচিত তাদের কাছে দয়া করে কথাগুলো একটু পৌঁছে দেবেন। আমি আবারও আমার বাবার হয়ে ক্ষমা চাইছি। আশা করি তার উপরে আপনারা কেউ আর কোনো দাবি রাখবেন না।”
পিনপতন নীরবতা চেয়ে গেছে পুরো উঠান জুড়ে। সেই ক্ষণে রাশেদা বেগম তার বর্ষীয়ান গলায় বলতে শুরু করলেন, “মকবুলের বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে আগে থেকেই বেশ টানাপোড়েন চলছে। আজকে এখানে আমার তিন ছেলে মেয়েই উপস্থিত আছে। তাদের সামনেই আমি এই সম্পত্তির একটা ব্যবস্থা করে দিতে চাই।”
মিলি কান খাড়া করে শুনছিল। এই পর্যায়ে এসে মায়ের হাতে চিমটি দিলো। আয়েশা বেগম তাকালে চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝালো, “মিললো তো আমার কথা?”
“প্রথমে আমি সবার দাবি দাওয়া শুনতে চাই। মকবুল বলো। কোন অংশটা তুমি নিয়ে চাও?”
“মা মতির শেষ সময়ে ওর সাথে আমার বিরোধ ছিলো এই সম্পত্তি নিয়ে। আমি নিজের জন্য বিশেষ করে কিছু চাই না। সবাই নিয়ে যেটা থাকবে তাই আমি নেবো।”
সবার মনেই যেনো একটা হাহাকার পড়ে গেলো। ঠিক এই কথাটাই মতিয়ার বেঁচে থাকতে বড় ভাই হিসেবে তিনি বলতে পারতেন না? তাহলে কি পাঁচ বছরের এই বিশাল বিচ্ছেদ হতো? হতো না। ঠেকে সবাই শিখেছে বটে। তবে মানুষকে হারিয়ে। কিন্তু এই সবার মাঝে আয়েশা নেই। তিনি ফুঁসে উঠলেন। ইশারায় স্বামীকে চোখ রাঙ্গালেন এই বেকুবি কথার জন্য। তবে মকবুল ভুলেও সেদিকে তাকালেন না। ইতমিনান বলল, “দাদি আপনি অনুমতি দিলে আমি একটা কথা বলতে চাই।”
“বলো ভাই। তুমি বংশের বড় ছেলে। তোমার কথা বলার অধিকার আছে।”
মালিহার দিকে এক পলক তাকালো ইতমিনান। তার দৃষ্টি আকাশে স্থির। কি দেখছে কে জানে?
“ধানী জমি আর পুকুরের ভাগটা মালিহাদের দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এই মুহূর্তে আমার বাবা আছে। তার উপার্জন আছে। আল্লাহর রহমতে আমিও চাকরি পেয়েছি। আরো ভালো চাকরির চেষ্টা করছি। ফুপাও নিজের জায়গায় স্বচ্ছল। কিন্তু চাচার পরিবারে উপার্জনক্ষম কোনো ব্যক্তি নেই। মালিহা, মিতুল দুজনেই ছোট। ইজারা দিয়ে হলেও তারা এখান থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য পাবে। যেটা এসময় ওদের সবচেয়ে বেশি দরকার।”
রাশেদা বেগমের চোখটা চকচক করে উঠলো। তবে তিনি কিছু বলার আগেই আয়েশা ভেতর থেকে হুড়মুড়িয়ে এসে জোর গলায় বললেন, “এসব কি বলছিস ইতু! দুটোই ওদের দিয়ে দিলে আর কি থাকে? আমরা কি পাবো তাহলে?”
ইতমিনান চোখ বন্ধ করলো। এক উঠান মানুষের সামনে তার মা জমির দাবিতে চিৎকার করছে। তার কাছ মনে হলো এর থেকে লজ্জার আর কিছু নেই। শান্ত গলায় সে বলল, “একটু ভেবে দেখো মা। ওদের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করো।”
“বুঝেছি অবস্থা। তাই বলে পুকুরও ওরা নেবে আবার ক্ষেতও ওরাই নেবে? বাকি ঐ ভাঙাচোরা জমি নিয়ে আমরা করবোটা কি?”
মিলি এসে যোগ দিলো ভেতর থেকে, “মা তো ঠিকই বলেছে ভাইয়া। আমাদের নিজের চিন্তাও তো একটু করতে হবে। সব ওদের দিয়ে দিলে হবে না।”
রাবেয়া এতক্ষণে কথা বললেন। তার ভাইয়ের কবরের মাটি এখনো শুকায়নি। এর মধ্যেই এটা জমি নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করেছে। মনুষ্যত্ব কি কিছুই বাকি নেই?
“মিলি তুই চুপ কর। তোর বাপ ভাই এখানে আছে। তাদের বুঝতে দে।”
“তুমি কথা বইলো না ফুপি। তোমার বরের তো কাড়ি কাড়ি টাকা। জমি তোমার না পেলেও সমস্যা নাই। কিন্তু আমি আমার বাপের থেকে পাবোই এক ভাগ। তাও যদি জোড়াতালি মার্কা হয় তাহলে চলবে কিভাবে?”
মকবুল আলীর মন চাইলো মেয়ের গালে ঠাটিয়ে চড় দিতে। কিন্তু এতো মানুষে মাঝে সেটা পারলেন না। শীতল কণ্ঠে বললেন, “মিলি ঘরে যাও।”
মিলি বাবার কথার ধার ধারলো না। তার বর আছে। এখানে কথা বলে জমি আদায় করে নিতে পারলে সেই কথা শ্বশুর শাশুড়ির কানেও যাবে। ইজ্জত বাড়বে বই কমবে না।
“ফয়সালার সময় কোথায় যাবো? আমার ভাগ আমাকেই বুঝে নিতে হবে। নাহলে তো দাদি বাপ ম’রা মেয়েকে সব দিয়ে দিতে চায়। বুঝিনা নাকি? ম’রা বাপ নিয়েও কেউ যে চালবাজি করতে পারে সেটা এই বুঝলাম।”
মুখ ভেংচি দিয়ে বলল মিলি। ইতমিনান আর সহ্য করতে পারলো না। কঠোর স্বরে হুংকার ছেড়ে বলল, “মিলি! একদম চুপ কর।” সেই স্বরে কেঁপে উঠল প্রত্যেকটা মানুষ। বাদ গেলেন না নাজিয়া বেগম নিজেও। শুধু শান্ত কণ্ঠে মালিহা বলল, “ক্ষেত, পুকুর কোনোটাই আমরা নেবো না। একটাও না।”
“মালিহা!” নাজিয়া বেগম মোটামুটি একটা ধমক দিলেন। তবে সেটা ধমকের পর্যায়ে পড়লো না। সারারাত কান্নাকাটি করে তার গলার জোর কমে গেছে। মালিহা সেই ধমক গায়ে মাখলো না। সবাই তার দিকে তাকালো, “আমার বাবা আমাকে চালবাজি করা শেখায়নি। আর না আমার রিজিক কেউ কেড়ে নিতে পারবে। ক্ষেত, পুকুর কোনোটাই আমরা নেবো না। তোমরাই নাও। আমাদের একটুখানি শান্তি দাও।”
ইতমিনান দেখলো আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করা মালিহার নাক থেকে র-ক্ত পড়ছে।

চলমান।

উষ্ণতা পর্ব-০১

0

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
সূচনা পর্ব:

স্টেশনে পা রাখার জায়গা নেই। মালিহা বোঝে না জায়গাটা সবসময় কেনো সরগরম থাকে। বাস স্ট্যান্ডে তো সবসময় এতো লোক থাকে না। তাহলে এখানে কেনো? দুই বছর ধরে যাতায়াত করলেও এই কেনো উত্তর মালিহা আজও পায়নি। ভিড় ঠেলে বের হতে মালিহার দম আটকে যাবার জোগাড় হলো। এমনিতেই দম আটকে বুকটা যেনো ভার হয়ে আছে। দুপুরে হঠাৎ পাওয়া ফোনটা তার নিত্য পার করা সরল সূত্রের মতো অঙ্ককে জ্যামিতির জটিল চৌহদ্দিতে ফেলে দিয়েছে। কঠিন উপপাদ্যের মতো লাগছে সময়টা। না পারছে শেষ নামাতে নাই বা পারছে ছেড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে।

দুটো ক্লাস শেষ করে যখন মালিহা ফোন হাতে নিলো তখন তার স্ক্রিনে ভাসছে চৌদ্দটা মিস হয়ে যাওয়া কলের নোটিফিকেশন। তড়িঘড়ি করে মায়ের নাম্বারে ব্যাক করতেই শুনতে পেলো রাবেয়া ফুপুর গলা। বলা ভালো ভাঙ্গা গলা। কেনো গলা ভেঙেছে, মায়ের ফোন কেনো রাবেয়া ফুপু ধরেছে কোনো প্রশ্নই করা হলো না। ফুপুর একটা কথাতেই মালিহা অস্থির হয়ে উঠলো। ফুপু জানালেন মতিয়ার সাহেব ছোটো একটা এক্সিডেন্ট করেছেন। মালিহা যেনো একটু আসে। মালিহা ছোটো ভাই মিতুলকে ফোন দিলো। সে ধরলো না। অস্থির মালিহা আবার মায়ের ফোনে ফোন করলো। কেউ ধরলো না। মালিহাকে আশঙ্কার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যেনো তার পরিবার ভারী মজা পেয়েছে। সবাই এক মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।

হল থেকে আসার সময় নীতি এসেছে তার সাথে। নীতি তার রুমমেট। চারজনের রুমে বাকি দুইজন সিনিয়র হলেও নীতি তার ব্যাচের এমনকি তার সাবজেক্টের। মেয়েটা অনবরত বকবক করে চলেছে।
“মালিহা! তুই খামাখা টেনশন করছিস। আমার টেনশন হচ্ছে অন্য বিষয়ে। কি বিষয় বল তো?”
মালিহার মন চাইছিল নীতিকে চুপ করতে বলতে। কিন্তু বলা হলো না। সবসময় সবকিছু বলা যায় না। বিরস মুখে তাকে বলতে হলো, “কি বিষয়ে?”
“সচরাচর এমন ক্ষেত্রে কি হয় জানিস? বাবা মা ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়। আঙ্কেল বলবে “মা মালিহা! দেখো আমার শরীরের অবস্থা! তোমাকে নিয়ে আমি খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। সৎ পাত্রে তোমাকে দিয়ে যেতে পারলে সেই চিন্তাটা কমতো।” শোন বিয়ে থা যাই করিস একটা খবর অন্তত দিস। প্লিজ মালিহা না বলে বিয়ে করে নিস না।”
পেছন পেছন আসছিল এহসান। সে আতকে উঠে বলল, “এসব কি কথা?”
তার কথার জোরে নীতি ভয় পেয়ে মালিহাকে আঁকড়ে ধরলো। হিজাবে টান লেগে পিন বোরখার ভেতর দিয়ে চামড়ায় ঢুকে গেলো। ব্যথায় মুখ কুঁচকে নিলো মালিহা। সেটা খেয়াল করে নীতি বলল, “সরি সরি দোস্ত! এহসানের বাচ্চা এমন করে হালুম করলো যে ভয় পেয়ে গেলাম।”
বুকে ফু দিলো নীতি। বোরখার হাতায় মুখের ঘাম মুছলো মালিহা। এহসান বলল, “বিয়ে টিয়ের মা-মলা নাকি মালিহা?”
নীতি খ্যাক করে উঠলো। “এতো গাধা কেনো তুই? ওকে কেউ কিছু বলেছে যে ও জানবে? ও বললো না? তুই শুনিসনি?” একপাশে সরে মালিহার দিকে এসে নীতি বিড়বিড়িয়ে বলল, “ছাগলটা কেনো লেজ ধরেছে কে জানে।”
মালিহার সব কিছু বিরক্ত লাগছিল। বড় করে দম নিয়ে সে বলল, “এহসান তুমি চলে যেতে পারো। নীতি তুইও চলে যা। এতো সময় কষ্ট করার জন্য..”
“ফালতু আলাপ করবি তো ট্রেন লাইনে তোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবো মালিহা। তোর এই রসকষ ছাড়া ধন্যবাদ নিতে আমি আসিনি। তোকে ট্রেনের সিটে বসিয়ে দিয়ে তারপরেই আমি যাবো। এহসান তুই যা।”
“দুইজন মেয়েকে এভাবে এক রেখে যাওয়া কি ঠিক কাজ? মালিহা উঠুক তারপর তোকে নিয়ে ক্যাম্পাসে যাবো।”
মালিহা দম ছাড়লো। আর বোঝানোর চেষ্টা করলো না। হাতঘড়ির দিকে তাকালো সে। দুপুর তিনটা। ট্রেনের সময় সাড়ে তিনটা। তবে ঠিক সময়ে আসলে হয়। দেরি করে স্টেশনে পৌঁছানো এদেশের ট্রেনের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য। বাড়ি যেতে অন্তত তিন ঘণ্টা লাগবে। ক্রসিং হলে তো কথাই নেই।
নীতি আশপাশে তাকালো। এহসানকে দেখে বিরক্তিতে তার মাথার তালু গরম হয়ে যাচ্ছে। নীতির ধারণা অনুযায়ী এহসান হাফ লেডিস ধরনের ছেলে। তাই তাকে দেখলেই বিরক্ত লাগে। অথচ এমন লাগার কোনো কারণ নেই। এহসান কখনও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। একটু দূরে একটা বেঞ্চে এক ভদ্রলোক বসে আছে। তার পাশে দুই জন মহিলা। আরেকজন বসলে চারজনকে ঠাসাঠাসি করে বসতে হবে। নীতি মনে মনে দোয়া করলো, “আল্লাহ ঐ ব্যাটাকে উঠিয়ে দাও আল্লাহ! আমার অসহায় বান্ধবীটাকে বসার সুযোগ করে দাও। প্লিজ!”
হঠাৎ করেই লোকটা উঠে কোনদিকে চলে গেলো। নীতি যারপরনাই আনন্দে লাফিয়ে উঠে হাততালি দিলো। এহসান অবাক হয়ে বলল, “লাফালাফি করছিস কেন?”
নীতি সেই কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। এক হাতে মালিহার ব্যাগ আরেক হাতে মালিহাকে টেনে বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো। মালিহাকে বসিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসলো। এহসানের দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচু করলো। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। এহসান তাদের সাহায্য করার জন্য থাকলেও সেটার কিছুই করতে পারল না। করলো নীতি। এহসান অপমানিত বোধ করলো কি না বোঝা গেলো না। তবে মালিহার দিকে এগিয়ে যেয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “মালিহা তুমি কি চিপস টিপস কিছু খাবে? নাকি জুস আনবো?”
নীতি মুখ ভেঙ্গালো। “মালিহা তুমি কি চিপস টিপস কিছু খাবে? আহা চান্দু আমার! তুমি তুমি করছিস কেনো? আমাকে তুই বলিস ওকেও বলবি।”
এহসান সে কথা শুনেও শুনলো না। মালিহা বলল, “কিছু খাবো না। জার্নিতে আমি কিছু খেতে পারি না।”
“আচ্ছা।”
মুখ গোমড়া করে নীতির পাশে এসে দাঁড়ালো এহসান। নীতি বলল, “ঠিক হয়েছে। বেশি আহ্লাদ দেখাতে গেছিস কেনো? ও যে কি জিনিস তাতো তুমি জানো না মামা!”
এহসান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “না জানলেও জানছি।”

হঠাৎ নীতি দেখলো বেঞ্চে বসে থাকা সেই লোকটা আসছে। এসে কি বলবে আমা জায়গায় কেনো বসলেন? এহসানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “স্টেশনে কি জায়গা ধরার সিস্টেম আছে নাকি?”
“কি?”
“গাধা! কথা শুনিস না কেনো? কানে সমস্যা?”
“এতো কথা না বলে কি বললি সেটা বললেই তো হয়।”
এহসান বিরক্ত হলো।
“বলছি স্টেশনের বেঞ্চে কি জায়গা ধরার সিস্টেম আছে?”
“আরে না! কি সব ফালতু প্রশ্ন।”
নীতিকে এভাবে বলতে পারে এহসান যেনো শান্তি পেলো। নীতি কটমট করে তাকালো। পারলে মনে হয় মটর ভাজার মতো চিবিয়ে খেতো। আফসোস পারলো না। নীতি দেখলো লোকটা হন্তদন্ত হয়ে ফোন কানে নিয়ে আরেক দিকে ছুটে যাচ্ছে। নীতি স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ক্লাসে একদিন জায়গা ধরার কারণে তার ব্যাগ এক মেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। সেই ভয়টাই এখানে কাজ করেছে।
মালিহা ফোন বের করলো। অজানা আশঙ্কা মনটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। বাবার সাথে কথা হয়েছে দিন দুই আগে। মায়ের সাথে বলতে না পারা কথাগুলো বাবার সাথে বলে মনে ভার কমায় মালিহা। কাজেই মতিয়ার আলীর জায়গা তার কাছে মা তৌহিদার থেকে অনেক বেশি স্বস্তির। সেই স্বস্তিমাখা মানুষটার হঠাৎ বিপদ মালিহাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। রাবেয়া ফুপুর কণ্ঠ ইঙ্গিত করছিলো তিনি অনেক কেঁদেছেন। কেনো? এতো কান্নার কি হয়েছে?

কোনো এক বিচিত্র কারণে আজ ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশন ছুঁয়েছে। নীতি যারপরনাই অবাক।
“কি রে! কাহিনী কি? কি মনে করে ট্রেন এতো তাড়াতাড়ি এলো? ডাল মে কুছ কালা হ্যা!”
“তোর সবকিছুতে সন্দেহ নীতি। মালিহাকে ট্রেনে তোল।”
“ও হ্যাঁ হ্যাঁ। মালিহা পানির বোতলটা নে।”
মালিহা বোতল নিলো। তড়িঘড়ি করে ছুটতে যেয়ে হাতের পার্স পড়ে গেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো ভেতরের সব জিনিস। নীতি, এহসান তুলতে সাহায্য করলো। মালিহার হাত ঠান্ডা হয়ে আসছে। ট্রেন চলে যাবে না তো? সাইরেন বাজলো। নীতি ব্যাগ হাতে দিলে মালিহা ছুটতে যেয়ে পড়ে গেলো। নীতি তুলে ধরলো মালিহাকে। নরম কণ্ঠে বলল, “প্যানিক করিস না মালিহা। ট্রেন আছে। তুই হাঁট।”
নীতির কথা অনুযায়ী ট্রেন থামলো না। আস্তে আস্তে ছুটতে শুরু করলো। ছুটলো মালিহাও। তবে হাতলের নাগাল পেলো না। তার মনে হচ্ছে যেনো বাবাকে আর দেখা হবে না। মতিয়ার আলী যেনো তার থেকে অনেক দূরে হলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই কেঁদে ফেলল মালিহা। ট্রেন কি একটু থামতে পারে না?
মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রোদের মতো একট হাত বেরিয়ে এলো দরজার ওপাশ থেকে। হাতের মালিককে মালিহা দেখলো না। তবে হাতটাকে তার মনে হলো খড়কুটো, যে ডুবন্ত মালিহাকে বাঁচাতে এসেছে। খুব কষ্টে হাতটা ছুঁতে পারলো মালিহা। বাকি কাজটুকু হাতের মালিক করে নিলো। এক টানে তাকে তুলে নিলো ট্রেনের ভেতরে। মালিহা যেয়ে পড়লো লোকটার বাহুতে। পেছনে তাকিয়ে দেখলো প্ল্যাটফর্ম শেষ হয়েছে। সেই শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে নীতি। পেছনে দাঁড়িয়ে এহসান। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে সামনে তাকালো মালিহা। দেখলো একটি অতি পরিচিত মুখ খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে।

ধাতস্থ হয়ে সরে এলো মালিহা।
“তুমি এখানে?”
ইতমিনান বলল, “তোর সিট কোথায়?”
“ঘ ৫৪।”
“চল।”
ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে গেলো ইতমিনান। মালিহার মনে হলো এই ইতমিনানকে সে চেনে না। কয়েক বছর আগে দেখা বন্ধুসম ইতমিনানের সাথে এই মানুষটার কোনো মিল নেই। তার চোখেমুখে গাম্ভীর্যের ছাপ। মুখে এটে থাকা দাঁড়ি সেই গাম্ভীর্যে আরো একটু রোশনাই ছড়িয়েছে। এই মানুষটাকে দেখলে হঠাৎ করেই প্রাণখোলা হওয়া যায় না। বরঞ্চ এক অপরিচিত সম্মান এসে মনের কোণে জায়গা করে নেয়।
মালিহাকে বসিয়ে ইতমিনান বলল, “এখানেই চাকরি পেয়েছি। এক মাসও হয়নি এসেছি।”
যে মানুষটার সাথে দিনে দুইবার দেখা হতো সেই মানুষটার জীবনের খবর আজ মালিহা জানে না। জীবন বুঝি এমনই?
“কোথায় যাচ্ছো?”
ইতমিনান প্রথমেই অবাক হয়েছিল। মালিহার শান্ত মুখশ্রী থেকে নিঃসৃত প্রশ্ন তাকে বুঝতে সাহায্য করলো যে মালিহা কিছুই জানে না। জানাতেও চাইলো না ইতমিনান। দুঃখের চৌম্বকীয় জাল থেকে যতো দূরে সরে থাকা যায়।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতমিনান বলল, “বাড়িতে।”
“ওহ। জানো ভাইয়া বাবা এক্সিডেন্ট করেছে।”
ইতমিনান তাকালো। তার কাছে মনে হলো ক্লাস নাইনে পড়া মালিহা কথা বলছে। মালিহা বদলায়নি। সেই আগের মতোই আছে। চার বছর আগের মতো। যে সহজ ভাষায় সহজ কথা বলতে পারে। কিন্তু ইতমিনান জানে আজকের পর মালিহা আর এমন সহজ সরল থাকতে পারবে না। বাস্তবতা তাকে এমন থাকতে দেবে না। ইতমিনান বুঝলো না তার কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ। পরের যেটুকু মালিহা জানেনা সেটুকুও সে জানে। সেই জানাটুকু তার গলা আঁকড়ে ধরেছে। কথা বলতে দিচ্ছে না ঠিকমতো। ইতমিনান কোনমতে বলল, “ওহ।”
মালিহার মনে হলো ইতমিনানের বাহ্যিক অবয়বের সাথে তার অন্তঃকরণও পাল্টে গেছে।
“আমি পাশের বগিতে আছি। কিছু দরকার হলে বলিস।”
ইতমিনান দ্রুত পায়ে চলে গেলো। মালিহা আবার সঙ্কট সাগরে চিন্তার ঢেউয়ে আবর্তিত হতে লাগলো। কিছুক্ষণের মাঝেই ট্রেনের ঝাকুনিতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

আসনে বসতেই ইতমিনানের মনে হলো বড় বেশি গরম লাগছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলেও লাভ হলো না। কপালের ঘাম মুছলো ইতমিনান। মালিহার শান্ত মুখটা চোখে ভাসছে। যোগাযোগের সুতো ঢিল হলেও কি সে মালিহাকে কখনও ভুলেছিলো? রক্তের বাঁধন ভোলা কি এতোই সহজ? যেই বাঁধন সৃষ্টিকর্তা বেঁধে দিয়েছেন কার সাধ্য তা ছিন্ন করে? ছটফট করতে করতে ইতমিনান বেশ কয়েকবার মালিহাকে দেখে এলো। প্রত্যেকবারই তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো। যেভাবে মালিহা ঘুমোচ্ছে তাতে তার ব্যাগসহ পুরো মানুষটাকে তুলে নিয়ে গেলেও সে ঠিক পাবে না। ফলে ইতমিনানের আনাগোনা আরো বাড়লো। তার পাশের আসনের লোকটা বিরক্ত হলো বারবার এমন ওঠাতে। ইতমিনান পাত্তা দিলো না। তার কেনো যেনো মনে হলো আসন্ন ঝড় থেকে মালিহাকে বাঁচানোর দায়িত্ব তার। একমাত্র সেই পারবে কাজটা করতে।

আঁকাবাকা মাঠ, হাজার রকম পরিবেশ, অনেকগুলো ক্রসিং পেরিয়ে ট্রেন যখন গন্তব্যে পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ইতমিনান মালিহার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। শেষ আধা ঘণ্টা সে এখানে দাঁড়িয়েই কাঁটিয়েছে। নামার সময় মালিহাকে সে ডেকে বলল, “মালিহা ওঠ। নামতে হবে।”
কাজ হলো না। হাতের ব্যাগ দিয়ে মালিহাকে ধাক্কা দিলো ইতমিনান। মালিহা হুড়মুড়িয়ে উঠলো। তাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় না দিয়েই টেনে সঙ্গে নামালো ইতমিনান। তারা নামতেই ট্রেন স্টেশন ছেড়ে গেলো। মালিহা যখন বুঝলো তারা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে তখন মনে হলো আকাশটা থমথম করছে। পরিবেশটা ভয়ানক কিছুর জানান দিচ্ছে।

চলমান।

#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:২

প্রতিবার মতিয়ার আলী এবং মিতুল স্টেশনে অপেক্ষা করে। এবার কেউ নেই। মালিহার বুকটা কামড়ে উঠলো। বাবার অনুপস্থিতি এখন থেকেই চোখে কাঁটার মতো বিধছে। সামনে এগিয়ে যেতেই ইতমিনান ডেকে উঠলো, “মালিহা দাঁড়া। রিকশা ডাকি।”
ফোন বাজলে পার্স থেকে বের করে দেখলো নীতি। কানে ধরতে না ধরতেই হড়বড় করে মেয়েটা বলল, “দোস্ত পৌছাইসছিস? আমি এসেই ঘুমায় গেছিলাম। এজন্য ফোন দিতে পারিনি। তোর ব্যাগ মোবাইল সব ঠিক আছে? কিছু চুরি হয়নি তো?”
“নীতি আমি আমার ফোন দিয়েই তোর সাথে কথা বলছি।”
“ওহ হ্যাঁ! তাইতো!”
“মাত্র ট্রেন থেকে নামলাম। অনেকগুলো ক্রসিং ছিলো তাই দেরি হলো।”
“সাবধানে যা দোস্ত। মিতুল আসছে?”
“না। আমার এক কাজিন আছে।”
“আচ্ছা। আংকেলের খবর বলিস।”
“ঠিকাছে।” ফোন রেখে কাপড়ের ব্যাগের কথা মনে পড়তেই হায়হায় করে উঠলো মালিহা।
“আমার ব্যাগ ট্রেনে ফেলে এসেছি।”
“তাহলে এটা কার?” হাত উঁচু করলো ইতমিনান।
“ওহ।” মালিহা নিভে গেলো।
“এই মনোযোগ নিয়ে তুই দুই বছর ভার্সিটিতে কিভাবে পড়লি আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।”
মালিহা উত্তর দিলো না।
“ভাইয়া, বাবার সাথে তোমার কথা হয়?”
ইতমিনান রিকশা খুঁজতে খুঁজতে অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলো, “হতো।”
মালিহা উদগ্রীব হয়ে বলল, “এখন আর হয় না? তুমিও বাবার সাথে রাগ করে আছো?”
থমকে গেলো ইতমিনান। মালিহাকে তাড়া দিয়ে বলল, “এটায় তুই ওঠ। আমি পরেরটায় আসছি।”
“কোথায় আসছো?”
ইতমিনান সময় নিয়ে বলল, “তোদের বাড়িতে।”
“সত্যি!”
মালিহার অবাক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাদের দাদা মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। তখন থেকেই বন্ধনে ঢিল পড়েছে। সম্পর্কের সুদৃশ্য জ্বাল ছিঁড়েছে সম্পত্তি নামক কীট। শুরু হলো রেষারেষির। নিশিরাতে দাদীর ভূতের গল্প শুনে জড়াজড়ি করা ভাইবোনগুলোরও কালে ভদ্রে দেখা হয় না। আগুনে ঘি ঢেলেছেন মালিহা এবং ইতমিনানের মা। তাদের ফুপু রাবেয়া নিজ উদ্যোগে সব মিটমাট করতে চাইলেও ইতমিনানের মা আয়েশা জিইয়ে রাখলেন রাগ। বাজার সদাই করতে গেলে যখন মতিয়ার আলীর সাথে বড় ভাই মকবুল আলীর দেখা হয় দুজন দুদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যান। ফলাফল স্বরূপ কমে গেলো আসা যাওয়া। সম্পর্কের রঙিন ঘরে ধুলো জমলো, মাকড়সার জাল ঘর বুনে সংসার পাততে শুরু করলো। আসল মানুষগুলো ভুলে গেলো তাদের মাঝে কি শক্তিশালী এক সম্পর্ক ছিল।

রিকশা বাড়ির যতো কাছে যাচ্ছে কোনো এক তীক্ষ্ম আওয়াজ মালিহার কানে বাড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন উদয় হলো। এতো বছর পর হুট করে আজই কেনো ইতমিনান তাদের বাড়িতে যাচ্ছে? মনের ইতিবাচক সত্ত্বা বলল নিশ্চয়ই অসুস্থ চাচাকে দেখতে যাচ্ছে। মালিহা মানতে চাইলো। তবে সেই সময়টুকু পেলো না। রিকশা বাড়ির সামনে আসতেই ভেতর বাড়ি থেকে নাজিয়া বেগমের চিৎকার শোনা গেলো। মালিহা দিক ভুলে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকলো। পেছনের রিকশা থেকে ধীরে সুস্থে নেমে ভাড়া মেটালো ইতমিনান। রিকশা দুটো চলে গেলেও সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ এসে জাপটে ধরলো তাকে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দেহটা আঁকড়ে ধরলো ইতমিনান। বৃদ্ধ বাবাকে বুকে নিয়ে মনে হলো এর চেয়ে বেশি ভারী দুনিয়ায় আর কিছু হতে পারে না। মকবুল আলীর কি এতই কষ্ট? কষ্ট মাপার কোনো যন্ত্র কেনো নেই? যেই অনুভূতি থেকে সৃষ্ট রোগ নির্ণয়ের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্র সেই অনুভূতিকেই কেনো এতো হেলাফেলা?

মালিহার মনে হচ্ছে তার কান থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। পরীক্ষার হলে প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পারলে তার এমন লাগে। তখন খুব করে বাবাকে মন পড়ে। মনটা চায় বাবার বুকে যেয়ে লুকিয়ে থাকতে। কিন্তু মালিহা মতিয়ার আলীর বুক খুঁজে পাচ্ছে না। মাথা সামনে পেছনে প্যাঁচানো সাদা গজ কাপড়ে। আবক্ষ কাফনে ঢাকা দেহটা মতিয়ার আলীর, এই খবরটা তার মস্তিষ্ক যখনই তার মনে পাঠাচ্ছে তখনই এক যু-দ্ধ বেঁধে যাচ্ছে। মন মননের দ্বিমুখী যু-দ্ধ মালিহা সইতে পারলো না। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো ছাউনি দেয়া উঠোনে। আশপাশের মানুষ হাহাকার করে উঠলো।
“আহাগো! মাইয়াডা শোক সামলাইতে না পাইরা জ্ঞান হারাইসে। ধরো ওরে ধরো কেউ।”

নাজিয়া বেগম বুক চাপড়ে কাঁদছেন। বৃদ্ধা রাশেদা বেগম পুত্র হারানোর শোক ভুলে পুত্র বধূর কাছে এগিয়ে গেলেন। তার শক্ত কণ্ঠ এবং স্পষ্ট উচ্চারণ যে কাউকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
“কান্না থামাও বউমা। আশপাশে পুরুষ মানুষ আছে। নিজের দিকে খেয়াল করো। মেয়ে এসেছে। ওকে দেখো।”
রাশেদা বেগমের ভগ্ন কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালেন নাজিয়া। বিগত দিনের সকল মন কষাকষি ভুলে হুমড়ি খেয়ে বৃদ্ধা শাশুড়ির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আহাজারি করে বললেন, “আমার কি হবে মা? আমার ছেলেমেয়ের কি হবে? আমার সব শেষ হয়ে গেলো।”
রাশেদা বেগম সন্তর্পনে নাজিয়ার শাড়ির আঁচল তুলে দিলেন। আশপাশের মহিলাদের নির্দেশ দিলেন তাকে ঘিরে ধরতে। পাশেই মালিহা শুয়ে আছে। একজন তাকে ধরে নাজিয়ার বুকে দিলেন। নাজিয়ার কান্না থামলো না। কান্নার গতি বেড়ে গেলো।
“ও মালিহা রে! তুই তো এতিম হয়ে গেলি রে! আল্লাহ তুমি কি করলা?”
“আহা মালিহার মা! এসব কোন ধরনের কথা? হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। মরণ আজ হোক কাল হোক আসবে। তাই বলে তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলে নিজের ঈমান আমল নষ্ট করবা কেনো?”
আশপাশের অনেকে রাশেদা বেগমকে চেনে না। তারা কিছুটা অবাক হলো। ছেলে হারিয়ে এমনভাবে শক্ত থাকতে কাউকে বোধহয় তারা দেখেনি। কণ্ঠের কি তেজ! সম্মান যেনো আপনাতেই চলে আসে।

মালিহার জ্ঞান ফিরলে কিছুক্ষণের জন্য তার স্মৃতি ভ্রম হলো। আশপাশ বুঝতে সময় লাগলো। যখন বুঝতে পারল ততক্ষণে সে এতিম। নাজিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে মা বলে ডাকতেই তিনি আবার হাউমাউ করা কান্না শুরু করলেন। কিন্তু মালিহার মুখ তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে গেলো। যখন সে বুঝল তার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের মানুষটা ইহলোক ত্যাগ করেছে, তার সাথে শেষ সাক্ষাৎটুকু মালিহা করতে পারেনি তখন অশ্রু তার গাল ভেজালেও কন্ঠরোধ হয়ে গেলো। চোখের পাতায় ফেলে আসা একুশ বছরের স্মৃতি নিজ উদ্যোগে তাদের মেলে ধরলো। হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ সবটাই জীবন্ত। শুধু মানুষটাই প্রাণহীন।

ইতমিনান মিতুলকে খুঁজলো। ছেলেটা আশপাশে কোথাও নেই। আয়েশা ছেলের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “কাকে খুঁজছিস আব্বা?”
“মিতুল কই?”
“জানিনা। আমিও অনেকক্ষণ দেখিনি।”
ইতমিনান মাকে লক্ষ্য করলো। কথাটা বলা উচিত হবে কি না ভাবতে ভাবতেই মকবুল আলী এলেন। ইতমিনান কথাটা গিলে নিলো। বলা হলো না।
“ইতমিনান লা-শ সকাল পর্যন্ত রাখা কি ঠিক হবে?”
ইতমিনান বিড়বিড় করলো। “লা-শ! লা-শ!” এক মুহূর্তের মাঝেই একটা প্রাণবন্ত দেহ কেমন করে লা-শে পরিণত হয়। রুহের কি মাহাত্ম্য!
“মালিহার নানা বাড়ি থেকে সবাই এসেছে?”
“ওর মামার সাথে দেখা হয়েছে। আর কেউ তো আসার নেই।”
“মিতুল কোথায়?”
“তোর দাদির ঘরে। তখন থেকে কান্নাকাটি করছে।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতমিনান বলল, “এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?”
“রাস্তা পার হতে যেয়ে প্রাইভেট ধাক্কা দিয়েছে। উল্টে পড়ে একদম মাথায় আঘাত লেগেছে। দুইদিন আগেও আমার সাথে দেখা হয়েছিল। তখন যদি একটু কথা বলতাম..”
বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মকবুল আলী। জমিয়ে রাখা অভিমানটুকু এখন কেবল তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
ইতমিনান বলল, “আমি মিতুলের সাথে দেখা করে আসি। তুমি কবর খুঁড়তে বলো।”

রাশেদা বেগমের ঘর অন্ধকার। দেয়ালের সাথে খুলতে থাকা তাসবীহর দানাগুলো চকচক করছে। ইতমিনানের কাছে এই জিনিসটা রহস্যময় লাগে। জ্বলজ্বল করে অন্ধকারের গভীরতা বুঝিয়ে যেনো গা ছমছম করে দেয়া এর কাজ।
“মিতুল!”
ডাকার সাথেই লাইট জ্বালিয়ে দিলো ইতমিনান। মতিয়ার আলীর বাড়িতে এলে রাশেদা বেগম এই ঘরেই থাকেন। সেই হিসেবে ঘরের আনাচে কানাচে ইতমিনানের চেনা। তাদের যাওয়া আসা কমে গেলেও রাশেদা বেগম নিয়ম করে ছেলেদের বাড়িতে থাকেন।
মিতুল মাথা ওঠালো না। হাঁটুতে ভর দিয়ে দুই হাত দিয়ে মুখে ঢেকে রেখেছে সে। পিঠ ক্রমাগত কেঁপে কেঁপে উঠছে।
“মিতুল?”
মিতুল নিজের ঘাড়ে রাখা ইতমিনানের হাত ঝাড়া দিলো। লাল চোখ দুটো তার দিকে তাক করে গলায় আক্রোশ নিয়ে বলল, “কিসের জন্য এসেছো?”
ইতমিনান চুপ করে ক্রোধটুকু গলাধঃকরণ করলো। তার দোষ অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্পত্তির জের ধরে মালিহা, মিতুলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো কারণই তার ছিলো না। বংশের বড় সন্তান হিসেবে তার উচিত ছিল বাবা মাকে বোঝানো। সম্পর্কের ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়া। সেটা না করে সে উল্টো তাদের কথায় সায় দিয়েছে। কাজেই শাস্তি তার প্রাপ্য। কিন্তু সে কি শাস্তি পাচ্ছে না? পিতৃতুল্য চাচার মরদেহ কি শাস্তি হিসেবে যথেষ্ট নয়?
“আমার বাবার লাশ দেখতে এসেছো? যাও দেখো। বাইরে আছে। আমাকে বিরক্ত করো না।”
ইতমিনান নির্নিমেষে মিরুলকে দেখলো। ছোট্ট ছেলেটা দেখতে দেখতে এইটে উঠে গেছে। রাগ দেখাতে শিখে গেছে।
“মালিহা এসেছে।”
নরম কণ্ঠটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে যতোটা সময় লাগে ততটুকু সময়ই মিতুল স্থির ছিলো। তারপর ছুটে চলে গেলো বাইরে। মিতুলের জায়গায় মাথা নিচু করে বসলো ইতমিনান। নিজের কাছে নিজে অপরাধী হলে বিচারক হবে কে?

মিতুল বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তবে মালিহার নড়চড় নেই। যেনো একটা প্রাণহীন জড়ো পদার্থ। একে একে সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। আফসোসের সুর শোনালো, স্বান্তনা দিলো। মালিহা টু শব্দ করলো না। কিন্তু যখনই খাটিয়া কাঁধে ইতমিনান তার সামনে এসে বলল, “মালিহা, চাচাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
মালিহা কেঁদে ফেললো। বুকভাঙ্গা কান্নার শব্দ গিলতে ঠোঁট দুটো চেপে ধরে রাখলো। মালিহার মনে হলো কেউ তার কলিজাটা দুই ভাগ করে নিয়ে যাচ্ছে।

চলমান।

ইংলিশ মিডিয়াম পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0

#ইংলিশ_মিডিয়াম
শেষ_পর্ব
~মিহি

তিথি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। শৈশবের পাশে মিত্তিম দাঁড়িয়ে। মেয়েটাকে শৈশবের পাশে দেখে এই মুহূর্তে তিথির আর খারাপ লাগছে না। যে শৈশবকে পাওয়ার জন্য সব করতে রাজি ছিল তিথি, সে অনুভব করতে পেরেছে আদতে সে শৈশবকে ভালোবাসেনি। মিত্তিমের শৈশবের প্রতি যে বিশ্বাস তার তিল পরিমাণও সে কখনো করতে পারেনি শৈশবকে। মিত্তিম কিভাবে শৈশবকে এতটা বিশ্বাস করে? মাত্র ক’দিনের ভালোবাসায় এমন বিশ্বাস কী করে জন্মায়? তিথির চোখের কোণা বেয়ে জল গড়ালো। সে শৈশবকে হারিয়েছে, নিজের দোষেই হারিয়েছে। অথচ এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছিল সে শুধু শৈশবকে পাওয়ার আশায়। এভাবে কখনো কাউকে পাওয়া যায়? ভালোবাসা ব্যতীত এক ষড়যন্ত্রে নেমে ভালোবাসা পাওয়ার আশা ঠিক কতটা অনর্থক তা বুঝেছে সে।

-“শৈশব, তোমার কাছে স্যরি বলার মুখটুকুও নেই আমার। তবুও বলতে চাই। যে অন্যায় তোমাদের সাথে আমি করেছি, তা ক্ষমার অযোগ্য। আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা। মিত্তিম তোমাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে শৈশব। ওর মতো করে তোমাকে কখনো কেউ ভালোবাসতে পারবে না। এই মেয়েটার হাতটা ধরে রেখো সবসময়।”

শৈশব কোনো কথা বললো না। তিথিকে সে ক্ষমা করতে পারবে না। মুখে বললেও সেটা মিথ্যেই রয়ে যাবে, মনের সায় কখনোই আসবে না। তার চেয়ে বরং চুপ থাকাটাই শ্রেয়। শৈশব কেবল একটা কাজ করলো। মিত্তিমের হাতটা শক্ত করে নিজের হাতের মাঝে মেশালো। মিত্তিম অবাক চোখে তাকালো শৈশবের দিকে। তিথির চোখ নোনাজলে ভিজে উঠলো, কণ্ঠে টের পাওয়া গেল মনের আর্তনাদের বিষাদ।

-“জানি আমার বলাতে কিছু যায় আসে না, তবুও চাইবো তোমরা ভালো থেকো সবসময়। আমি তোমাদের সামনে আর কখনো আসবো না তাই ক্ষমা চেয়ে নিলাম। এখন তোমরা এসো। আমার আর কিছু বলার নেই।”

শৈশব তৎক্ষণাৎ মিত্তিমের হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে এলো। এ মুহূর্তে শৈশবকে প্রচণ্ড অমানবিক মনে হলেও শৈশবের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে সে।

শৈশব মিত্তিম ফিরলো একটু পরেই। আকলিমা বেগম মিত্তিমকে ভেতরে বসতে বললেন একটু। তিনি শৈশবের সাথে সাথে আলাদা কথা বলবেন। মিত্তিম মাথা নাড়লো। শৈশবের খানিকটা নার্ভাস লাগছে। সে জানেও না কোন প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হবে এখন।

-“ভয় পাচ্ছো শৈশব?”

-“একটু।”

-“আমি তোমাদের অপেক্ষা করতে বলেছি ঠিকই কিন্তু আমি কখনোই বলিনি তোমাদের যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করতে। আমি জানি এটা সম্ভব না। মিত্তিম তোমার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল। তোমাদের কথা বন্ধ হলে মেয়েটা নিজেকে কখনো সামলাতে পারবে না তবুও অপেক্ষা করতে বলেছি কেন জানো?”

-“কেন?”

-“সহজে পেয়ে গেলে মানুষ প্রায়শই মূল্য দিতে ভুলে যায়। ও তোমাকে একটু অপেক্ষা করেই অর্জন করুক। মাঝেমধ্যে ওকে কল কোরো, ও একটু জানুক যে সব পরিস্থিতিতেই তুমি তাকে একই রকম ভাবে ভালোবাসবে। বুঝেছো?”

-“জ্বী।”

-“আসি তবে, সাবধানে থেকো।”

শৈশব আর কিছু বললো না। তার মনের আনন্দ সে ব্যক্ত করার অবস্থায়ও নেই। মিত্তিম তার মায়ের সাথে চলে গেল। শৈশব দূর থেকে দেখলো তাকে। এই দেখাটাই বোধহয় দূর থেকে শেষ দেখা হবে, পরেরবার শৈশব খুব কাছ থেকে দেখবে মিত্তিমকে। মিত্তিমের মাঝে মিশে অনুভব করবে তাকে। শৈশব মাথা নিচু করলো। চোখ ছলছল করছে তার, মিত্তিমকে পেয়ে যাওয়ার খুশি!

___________________________________________________________________________________________

মিত্তিমের পরীক্ষা আগামীকাল। শৈশব এ সপ্তাহে ফোন করেনি তাকে। মেয়েটা একটুও ডিসট্র্যাক্ট হোক চায়নি সে। তবে আজ প্রচণ্ড অসহায় লাগছে। মন অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। শৈশব মিত্তিমের মায়ের নম্বর ডায়াল করলো। রাত এগারোটা পেরিয়েছে। কল কাটবে কাটবে করেও কাটা হলো না। আকলিমা বেগম ফোন ধরলেন। শৈশব সালাম দিল। আকলিমা বেগম উত্তর দিলেন। শৈশব আকলিমা বেগমের কণ্ঠে আরো দুশ্চিন্তায় পড়লো।

-“আন্টি মিত্তিম? ও কি পড়ছে এখন? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে?”

-“ঘুমোচ্ছে।”

-“আচ্ছা আন্টি। সকালে আমার তরফ থেকে বেস্ট অফ লাক জানায়েন।”

-“ঠিক আছে।”

-“আন্টি কিছু হয়েছে?”

-“না শৈশব। সব ঠিক আছে। তোমার পরীক্ষা চলছে না?”

-“হ্যাঁ এইতো চলছে আর কী।”

-“ভালোভাবে পরীক্ষা দাও।”

ব্যস! এটুকু খোঁজখবর নিয়েই কথার সমাপ্তি ঘটলো। শৈশব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। প্রায় পাঁচ মাস হচ্ছে মিত্তিমকে দেখেনা সে, এতটা অস্থির আগে তো লাগেনি। আজ হঠাৎ এ অস্থিরতা কেন? মিত্তিমের পরীক্ষার জন্য কি তার টেনশন হচ্ছে? বোধহয়! শৈশবের খানিক বাদেই মাথা ধরলো। একটু ঘুমোনো দরকার কিন্তু ঘুম আসছে না। শৈশব ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো।

শৈশবের ঘুম ভাঙলো দুপুর বারোটার পর। লাফ দিয়ে উঠলো সে। ওষুধের প্রভাব এতক্ষণ থাকবে বুঝে উঠতে পারেনি। ভাগ্যিস দুদিন বাদে পরীক্ষা। শৈশব উঠে ফোন হাতে নিতেই দেখলো ফায়াযের নম্বর থেকে সাতান্নটা মিসড কল। শৈশব হাতমুখ ধুয়ে ফায়াযের নম্বরে কল করলো। ফোন সুইচড অফ বলছে। শৈশব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শৈশব মায়ের নম্বরে কল করলো। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। ঘণ্টা দেড়েক পর ফায়াযই কল ব্যাক করলো। শৈশব তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলো কল।

-“কী সমস্যা? কল করে ফোন অফ ক্যান তোর? মাও কল ধরছে না।”

-“ভা..ভাইয়া তুই একটু আসবি?”

-“ফায়ায কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই? সবাই ঠিক আছে তো?”

-“তুই প্লিজ একটু আয় ভাইয়া!”

ফায়াযের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসলো। সে আর কথা বলতে পারলো না। শৈশব প্রচণ্ড চিন্তায় পড়লো। দ্রুতই বাসের টিকিট কাটলো। প্রথম যে বাসটা পেল সেটারই। আজ মিত্তিমের পরীক্ষা, ফায়াযেরও তো পরীক্ষা ছিল। কী এমন হলো! শৈশব চিন্তায় ঠিকমতো বসতেও পারলো না। সবকিছুই দোদুল্যমান লাগছে তার নিকট। জ্যাম না থাকায় খুব একটা দেরি হলো না শৈশবের পৌঁছাতে। বাস থেকে নেমে প্রথম ফায়াযকেই কল করলো সে। ফায়ায হাসপাতালের ঠিকানা দিল। শৈশবের হৃদস্পন্দন কমে আসছে। হাসপাতাল? কে অসুস্থ? মা? শৈশবের মাথায় চিন্তাগুলো যত ঘুরপাক খাচ্ছে, তত তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে। প্রচণ্ড টেনশনে কোনোরকম সে হাসপাতালে পৌঁছালো। আকলিমা বেগম বসে আছেন এককোণে, তার পাশে মিত্তিমের বাবা। ফায়ায এবং আহসিনা বেগমও একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। শৈশব অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চাইছে। মন বারবার বলছে যা সে ভাবছে তেমন কিছু না হোক। শৈশবকে দেখামাত্র ফায়ায প্রচণ্ড দুর্বল অনুভব করলো। ভাইকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো সে ক্রমাগত। শৈশবের সেটুকু শক্তিও অবশিষ্ট নেই যে সে ফায়াযকে সামলাবে তবু ভাইয়ের বাহু আঁকড়ে স্তব্ধ গলায় সে প্রশ্ন করলো,”কী হয়েছে?”

ভাইয়ের প্রশ্নের কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারলো না সে। আইসিইউ এর দিকে তাকালো শুধু। শৈশব ছুটে গেল সেদিকে। বন্ধ দরজার কাঁচঢাকা অংশে মিত্তিমের ক্ষতবিক্ষত শরীরে অজস্র ব্যান্ডেজ দেখে দাঁড়ানোর ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো সে।

-“মিত্তিমকে কোচিংয়ের সামনে থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এক সপ্তাহ আগে। ড্রাগস দিয়ে পরপর…”

-“পরপর কী ফায়ায?”

-“ধর্ষণ করা হয়। সাতদিনের মাথায় পুলিশ ট্রেস করে ঐ চারজনকে ধরে। মিত্তিমের অবস্থা খুব খারাপ, ইন্টার্নাল ইঞ্জুরি অনেক বেশি। সবাই নিষেধ করেছিল তোকে হঠাৎ করে জানাতে। কিন্তু কাল রাত থেকে মিত্তিমের অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ ছিল। আমি তোকে কল করেছিলাম, তুই রিসিভ করিসনি।”

শৈশবের নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সে কেন ঘুমের ওষুধ গেল? এত অস্থির লাগার পরেও কেন একবার মিত্তিমকে দেখার আকুতি জানাতে পারলো না? প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে শৈশবের নিজের উপর! সব তো ঠিক ছিল। ভালোবাসা, বিশ্বাস, পরিবার! সবকিছু ঠিক ছিল ওদের মধ্যে তবে ভাগ্য এমন নিষ্ঠুর পরিহাস কেন করলো?

_____________

মিত্তিমের হালকা একটু জ্ঞান ফেরার পর শৈশব দেখতে চাইলো তাকে। শৈশবের সে আকুতি ফেলবার মতো নির্দয় সেখানে কেউ ছিলেন না। শৈশব এসে পাশে বসলো মিত্তিমের। মেয়েটার হাতে অজস্র ক্ষত। মিত্তিম শৈশবকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিল, মাথা নিচু করে ফেললো। শৈশব মিত্তিমের হাত ধরার চেষ্টা করলো। মিত্তিম হাত সরিয়ে নিল।

-“মিত্তি! এমন কোরো না প্লিজ, আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিও না এভাবে।”

-“আ..আপনি আ..আমার কাছে আ..আসিয়েন না। আমার গা..গায়ে যথেষ্ট নোংরা লেগে আছে। ছুঁয়েন না আমাকে।”

শৈশব পাগলের মতো মিত্তিমের হাতটা আলতো করে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ক্ষত হাতটা অজস্র চুমু খেল। তার প্রিয় মানুষটাকে এ অবস্থায় দেখার ক্ষমতা তো বিধাতা তাকে দেননি! শৈশবের বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। পাঁচ মাস আগে মিত্তিমকে যখন সে দেখেছিল, তখন সে বলেছিল পরেরবার মিত্তিমকে খুব কাছ থেকে দেখবে। এভাবে দেখার প্রত্যাশা তো সে করেনি! তবে কেন এত নিষ্ঠুরতা তার সাথেই? কেন মিত্তিমের উপর দিয়ে এত বড় নৃশংসতা চালালো নিয়তি? মিত্তিম কথা বললো না আর। শৈশবকে চলে যেতে ইশারা করলো। শৈশব অসহায়ের মতো উঠে যেতে নিল। মিত্তিম কাঁপা হাতে কেবল আওড়ালো,”ভালোবাসি!” শৈশব পাশে বসে মিত্তিমের হাত ছুঁয়ে ভালোবাসি বললো বারবার। সে কি জানতো এটাই শেষবার নিজের প্রিয়তমাকে ভালোবাসি বলার?

রাত বারোটা নাগাদ মিত্তিম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। ড্রাগের ওভারডোজ আর ইন্টার্নাল ক্ষত- সব মিলিয়ে তার শরীর আর টিকে থাকতে পারেনি বেঁচে থাকার যুদ্ধে। শৈশব মিত্তিমের লাশ দূর থেকে দেখেছে। একটু কাছে গিয়ে দেখার সাহস পায়নি। মিত্তিমকে সাদা কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় দেখার শক্তিটুকু সে পায়নি।

______________________________

মিত্তিম চলে যাওয়ার পর থেকে শৈশবের অদ্ভুত একটা রোগ হয়েছে। সে এটাকে ঠিক রোগ বলতে চায় না। সে মিত্তিমকে দেখতে পায়, সবসময় দেখতে পায়। অন্যকেউ দেখতে পারে না কিন্তু শৈশব মিত্তিমকে সবসময় নিজের কাছে দেখে, কথা শোনে। শৈশব পরিবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে চেয়েছিলেন তাকে। শৈশব যায়নি। শৈশব মিত্তিমকে হারিয়ে ফেলতে চায় না। সে মিত্তিমকে হাসতে দেখছে, ছুঁতে নাই বা পারলো! একটু কথা বলতে তো পারছে, জড়িয়ে নাই বা ধরতে পারলো! অস্বাভাবিক আচরণ তো করছে না সে, একটা মানুষের উপস্থিতি তাকে শান্তি দিচ্ছে। মানুষটা অন্য কারো নজরে না পড়ুক, সে দেখতে পারছে তার ভালোবাসাকে। এটুকু খুশি তার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না!

শৈশব গলার টাই ঠিক করছে। ইন্টারভিউ আছে আজ তার। সময়গুলো বড্ড দ্রুত পেরিয়েছে। মিত্তিম ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। শৈশব তাকালো সেদিকে। মিত্তিম মুচকি হেসে বললো,”বেস্ট অফ লাক, মি.ইংলিশ মিডিয়াম।”

শৈশব মুচকি হাসলো। একটা কথা মাথায় ঘুরতে লাগলো তার,”তুমি আমার সবকিছুতেই ছিলে, কেবল ভাগ্যে ছিলে না!”

সমাপ্ত