বিয়ের দিন সকাল থেকে হৈ হুল্লোড়। সাত’টা ছাগল জবাই হয়েছে ভোরের আলো ফোটার আগেই। সেগুলো কাটাকুটি করে রান্নাবান্না করছে স্থানীয় বাবুর্চিরা। মশলার ঘ্রাণে জায়গাটা ম ম করছে। চেনা, অচেনা, আধা চেনা আত্নীয় স্বজনে ভরে গেছে ঘর৷
এতো লোকজনের মাঝে অদিতির অস্বস্তি হয়। বিশেষ করে যখন কেউ বলে – ও তুমি আহসানের মেয়ে না? তা ডাগর হয়ে উঠছো তো। তোমারও তো বিয়ে দেয়া উচিৎ।
অদিতির হাসি পায়। বিয়ে হওয়া ছাড়া মেয়েদের বুঝি আর কোন কাজ নেই! কিন্তু অদিতি রাগ করে না বিরক্ত হয় না। কারণ এসবে লাভ নেই। বরং একটা হাসি হাসি মুখ করে। ভাবখানা এমন যে অদিতি তো বিয়ের জন্য রেডিই, ছেলে একজন আসলেই সে নিজেই ‘কবুল’ বলে ফেলবে। অবশ্য অন্য ধরণের কথাও শুনেছে।
– এই বয়সের মেয়ে একটু বেশি সাইজ্জা গুইজা মেকাপ করে ঘুরবা তা না তোমারে দেখে বুঝাই যায় না যে বিয়ে বাড়িতে আসছো!
রঙ চঙে সঙ সাজার কোন ইচ্ছাই অদিতির নেই। তবে শম্পা আপুকে সেই সুন্দর লাগছে। মানুষ এজন্যই বলে বিয়ের পানি পড়কে নাকি মেয়েরা সুন্দর হয়ে যায়! উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের শম্পা আপু শাড়ি গহনায় একদম জ্বলজ্বল করছে যেন।
দুপুর দুইটা নাগাদ বরপক্ষ আসলো। আসার কথা ১০০ জন কিন্তু এসেছে ১৫০ জন, ছোট মোট বাচ্চা কাচ্চা ধরলে আরো বেশিই হবে। অদিতিদের আত্নীয় স্বজনদের খাওয়া এর আগেই শুরু হয়েছে কারণ বড় ফুফুর মতো কিছু লোক আছেন যারা আবার বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারেন না বা তাড়াহুড়ায় সকালে নাকি খেতেই পারেন নি! অদিতির আবারও হাসি পায়। এসব মানুষের বিয়ে বাড়ি আসলেই এতো ক্ষুধা পায়! এর সাথে আছে এর জন্য একটু মিষ্টি দাও, ও আসতে পারে নাই তার জন্য একটু পোলাও রোস্ট বক্সে ভরে দাও। কনের বাবা মায়ের একটা শোক এবং কষ্ট থাকে, এতো বছর ধরে বুকে ধরে রাখা আদরের মেয়েকে অচেনা জায়গায় পাঠাতে হচ্ছে কিন্তু এসব আত্মীয় স্বজনের জন্য সেই শোকটুকু করারও সময় সুযোগ পায় না।
বরের বাড়ির লোকজন আসলে গেট ধরাধরি হলো কিন্তু কিছু আদায় হলো না। তারা নাকি এসব আজেবাজে খরচ করতে রাজি না। অদিতির বাবার ধমকে বাড়ির ছেলে মেয়েরা সরে গেলো। খাবারের সময় পার হয়ে যাচ্ছে, এজন্য অদিতির বাবা চাচারাই বরপক্ষকে বললো আগে খেয়ে নিতে, এরপর না হয় বিয়ে পড়ানো হবে। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে । এদিকে খাসির মাংস জমে যাচ্ছে, পোলাও ঠান্ডা হচ্ছে। সুতরাং ঝালর দেয়া বিশাল সামিয়ানার নিচে বরযাত্রীদের বিশাল বহর বসে গেলো খেতে। ভাত তেমন কেউ নেয় না, একেক জনের পাতে মাংসের পিরামিড। খেতে পারুক বা না পারুক মাংস নিয়ে সাজিয়ে রেখেছে স্তুপ করে। হাড়ি হাড়ি দই খালি হতে লাগলো।
জম্পেশ খাওয়া দাওয়া শেষে পানি খাওয়ায় (সেভেন আপ, কোকাকোলা) যখন সবাই ব্যস্ত তখন অদিতির বাবা এগিয়ে গেলো ছেলের বাবার দিকে, বিয়ে পড়ানোর অনুমতি নিতে। স্থানীয় কাজী সাহেব উপস্থিত, নীল রঙের কাবিননামায় লেখার জন্য প্রস্তুত। বর কনের আইডি কার্ডের খোঁজ করছেন।
এমন সময় হঠাৎ করে চিকন স্বরে কান্নার শব্দ। প্রথমে সবাই ভাবলো কনে বা কনের মা বুঝি কনে বিদায়ের বেদনায় কাঁদছেন কিন্তু শব্দ আসছে কনে যে ঘরে বসে আছে তার পাশের ঘর থেকে। সেখানে তো বরের বাড়ির মহিলারা বসে আছেন। তাহলে?
খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো কাঁদছেন বরেন মা। কারণ মেয়ে পছন্দ হয় নাই! শম্পাকে দেখতে এসেছিলো বর, তার বাবা, চাচা ও এক বন্ধু। বরের মা মোবাইলে ছবি দেখেছেন, সবার পছন্দে তারও পছন্দ। ভালো ঘরের লক্ষী মেয়ে, সংসারী। কিন্তু এখন সরাসরি দেখার পর তার মনে হয়েছে, তার ঘরের বড় বউ এর গায়ের রঙ আরেকটু উজ্জ্বল না হলে এবং আরেকটু লম্বা না হলে মান সম্মান থাকে না। দুই একজন বোঝাতে আসায় এমন চিৎকার দিয়ে কান্না। এক কথা মেয়ে পছন্দ হয় নাই! বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে অদিতির বাবা চাচারা। ভদ্রতার খাতিরে বলতেও পারছেন না যে, খাওয়া দাওয়ার পরে আপনাদের এ কী নাটক!
বর উঠে মায়ের কাছে গেলো। অদিতিরা কয়েকজন বরের মা যে রুমে আছে তার সামনে দাঁড়ানো। বরকে জড়িয়ে ধরে তার মা কেঁদে চলেছেন। একটাই কথা – আব্বা, এই মেয়ে তোর যোগ্য না। বরের বাড়ির দুই একজন মহিলা আত্নীয় এমনকী অদিতিদের দুই একজন বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু মহিলা নাছোড়বান্দা, উনি এই বিয়েতে রাজী না। এর মধ্যে বরের বাপও চলে এসেছে। তার কথা তো শুনছেই না, তার কারণেই নাকি ছেলের এমন খারাপ বিয়ে হচ্ছে! অগত্যা বরের বাপ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুক্ষণ এই নাটক চলছে। ঐদিকে অদিতির চাচী ওর মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন, উনার মেয়ের কপাল বুঝি ভাঙলো। শম্পার মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। অনুভূতিহীন। সারা বাড়িতে কানাঘুষা – বরের মায়ের মেয়ে পছন্দ না, এজন্য কাঁদছে।
আর সহ্য হলো না অদিতির। বরের মায়ের সামনে গিয়ে জোরে বলে উঠলো
– নাটক কম করেন। বিয়ে ঠিক হওয়ার এক মাস পরে বিয়ে হচ্ছে, আর বিয়ের দিন এসে ভরপেট খাওয়ার পরে আপনার মনে হলো যে, মেয়ে পছন্দ না! ইয়ার্কি পেয়েছেন।
বরের মা কান্না বন্ধ করে হা করে অদিতির দিকে তাকিয়ে আছে। অদিতির আত্নীয় স্বজন দুই একজন রে রে করে ছুটে আসছিলো, ঠেকালো অদিতির বাবা। উনি এই বরপক্ষের উপর যথেষ্ট বিরক্ত।
– যোগ্য না কে? আমাদের মেয়ে? মোটেও না। আপনার ছেলে, আপনাদের পুরো পরিবার আমার শম্পা আপুর যোগ্য না। আমাদের তো আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ যে খাবারের উপর দিয়ে, টাকা পয়সার উপর দিয়ে ধাক্কা গেছে। শম্পা আপুর জীবনের উপর দিয়ে যায় নি। বিয়ে হলে তো এই নাটুকে মহিলা আমার বোনের জীবন ছারখার করে দিতো।
অদিতির এমন কথায় মুখ খুলতে যায় বর। কিন্তু তাকে চুপ করিয়ে অদিতি কন্ঠের জোর আরো বাড়িয়ে বলে উঠে
– আপনি কোন কথা বলবেন না। আপনার মুরোদ বোঝা হয়ে গেছে। আমার বাবা চাচারা ভদ্র বলে আপনাদের পিঠ বেঁচে আছে এখনো। ভালোই ভালোই বের হয়ে যান আপনারা। খাবারের দাম ধরছি না, এই আপনাদের কপাল। ভাবছেন হাত পা ধরে বিয়ের জন্য রাজী করাবো? মোটেও না। আপনাদের মতো ছোটলোকের সাথে বোন বিয়ে দেয়ার কোনই ইচ্ছা নেই আমাদের। আর কোন নাটক করলে ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট করে দেবো। তখন কিন্তু সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না।
অদিতির কথায় উৎসাহিত হয়ে এর মধ্যেই ওর কিছু চাচাতো ভাই মোবাইলে ভিডিও শুরু করে দিয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে, বরযাত্রীরা সুড় সুড় করে বের হয়ে যায়৷
বেলা শেষের দিকে। বর যাত্রীদের সাথে অদিতিদের আত্নীয় স্বজনরাও সবাই চলে গেছে। বড় ফুফুর মতো কিছু লোকজনের যদিও ইচ্ছা ছিলো আরো কয়েকদিন থাকার, এই বিয়ে ভাঙা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করার কিন্তু অদিরির অগ্নিরূপের কথা স্মরণ হয়ে, থাকলে আরো হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে তারাও চলে গেছে।
বাড়িতে আছে অভুক্ত অদিতির বাবা, চাচা, মা, চাচী সহ ভাই বোনেরা, হাঁড়ি পাতিলের নিচে পড়ে থাকা কিছু খাবার, খাবারের সন্ধানে ঘুর ঘুর করা কয়েকটা কুকুর আর ভাবলেশহীন কনের সাজে বসে থাকা শম্পা।
বরযাত্রীরা তো যথেষ্ট শিক্ষা নিয়ে চলে গেলো৷ অন্যেরা গেলো ভরপেট খেয়ে। কিন্তু শম্পার কি হবে? এই চিন্তায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মাথায়।
(৩য় পর্ব)
গ্রামের বিয়ের একটা অন্যরকম আনন্দ আছে, মজা আছে। যেমন হলুদে একটা কুলোয় করে দূর্বা ঘাস, ধান, হলুদ, মেহেদী নিয়ে কনের মুখের সামনে ধরে গানের সুরে নানা রকম ছন্দ পড়ে। নানী দাদী গোছের কিছু মুরব্বী মহিলা এসব ছন্দে ছন্দে উরাধুরা নাচ দেয়। রঙ মাখামাখি হয়। এখন অবশ্য সব জায়গায় আধুনিকতার ছোঁয়া, হিন্দি সিরিয়ালের মতো করে সাজ দিয়ে হিন্দি গান বাজিয়ে নাচানাচি করে।
অদিতির এসব দেখতে ভালোই লাগছে। আরো দুইদিন আগেই সে গ্রামে এসেছে। তার আগে সে হবু বরের নাম্বার জোগাড় করে শম্পা আপুকে দিয়েছে কথা বলার জন্য। এই নাম্বার জোগাড় করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয় নি! মা’কে তো কিছুই বলা যায় না। সব কিছুতেই রিএ্যাক্ট করে। উনার কাছে মেয়ে মানে সসম্মানে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। ভাই তো একটা খচ্চর, এসব বললে কানমলা দেবে৷
বাকি থাকলো বাবা। একমাত্র উনিই অদিতিকে বোঝেন। অন্যের কাছে যা পাগলামি মনে হয়, তার মাঝেও যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেন। সেই বাবাকেই বলে কয়ে নাম্বারটা জোগাড় করেছে কিন্তু শম্পা আপু এমনই সরল সে কোন ফোন তো দেয় নি বরং বলছে তার নাকি লজ্জা লাগে! কিন্তু অদিতির মনেও একটা খটকা লাগে, ছেলেটা তো অন্ততঃ ফোন দিতে পারতো। বর্তমান সময়ে এসব তো কোন ব্যাপারই না।
শেষে অদিতিই সেই নাম্বারে কল দেয়।
– হ্যাল্লো দুলাভাই! আমাকে ঠিক চিনবেন না। আমি হলাম আপনার শালিকা। একটু দুষ্টু টাইপ মিষ্টি শালিকা। বলেন কেমন আছেন?
ঐপাশের ব্যক্তি তখন ঘোরে আছে। এতো সাবলিল মিষ্টি নারী কন্ঠের কথা শুনে থতমত খায়। কোন রকমে বলে
– জি ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?
– কিভাবে ভালো থাকি বলেন! আপনার বিয়ে ঠিক আর এখনো হবু বউ এর সাথে কোন কথাই বললেন না। মোবাইল জিনিসটা আছে কিসের জন্য? কথা বলার জন্য, তাই না?
– জি, ঠিক বলেছেন
– এতো জি জি করছেন কেন? আমি কি আপনার বস নাকি। আপনার হবু বউ এর নাম্বার ম্যাসেজ করছি। একটু তো হাই হ্যালো করেন। না হলে বিয়ের পরে প্রথম কথা হবে – বউ তোমার নাম কি? হি হি হি
ঐপাশের ছেলেটার তখন অবস্থা সঙ্গীন। এমন কাঁচ ভাঙা হাসির সাথে ভৎসনা, যে কোন পুরুষের শেষ করার জন্য যথেষ্ট! তবুও কিছুট ইগোতে লাগায় গলায় শক্তি এনে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা করে
– শালিকা যখন এমন সুন্দর করে হাসে, তখন বউ এর খোঁজ তো নিতেই হয়। দেন ফোন নাম্বার কথা বলে দেখি৷
আর বেশি কথা বাড়ায় না অদিতি। সবকিছুতে লিমিট রাখাই ভালো আর ও তো মূলতঃ কিছুটা ইজি করিয়েছে শম্পা আপুর জন্য। তবে অদিতি সফল বটে। সেদিনই শম্পা আপুকে ফোন দিয়েছিলো তার হবু বর। কি কথা হয়েছে না হয়েছে সেটা নিয়ে অদিতির মাথা ব্যথা নেই। তার চাওয়া ছিলো – উভয়পক্ষ পরিচিত হোক, স্বাভাবিক হোক দুই জনই।
তারপর আজকের হলুদের অনুষ্ঠান। শম্পার বোন সম্পর্কের সবাই এক রঙের শাড়ি পরছে আর ছেলেরা পাঞ্জাবী। দেখতে ভালোই লাগছে কিন্তু অদিতির কাছে এটাকে নিছক অপচয় মনে হচ্ছে। কারণ কাপড়ের যে কোয়ালিটি তাতে আরেকবার পরার মতো না কিন্তু সবার জন্য কিনতে গেলে যে টাকা খরচ হচ্ছে তাতে ওর বড় চাচার উপর বেশ চাপই যাবে। এর মধ্যে বড় ফুফুর মেজ মেয়ে শাড়ি পায় নি বলে ফুফু বেশ মুখ ভার করে বসে আছেন। ব্যাপারটা হলো বড় ফুফু সবার বড়। উনার মেয়েরাও প্রায় অদিতিদের মা চাচীদের বয়সীই বলা চলে। এখন উনি যে এমন কালারফুল রঙা চঙা শাড়ি পরতে চাইবেন তা কেউ বুঝতেই পারে নি। আর তাছাড়া কেনার সময় ভুল করে কম পড়ে গেছে৷ এখন ঐ কালারের পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া কেনা হয়েছে বেশ দূরের জেলা শহর হতে যা এই গ্রাম থেকে বেশ দূরের পথ।
বিয়ে বাড়িতে এমন ছোটখাটো হট্টগোল হবেই যেন। তবে অদিতিই এসে সমাধানের পথ বের করে। ওর শাড়িটা শম্পা আগেই আলাদা করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো যেন ম্যাচিং ব্লাউজ বানাতে পারে। শাড়ি তো তেমন পরে না, ব্লাউজ না থাকারই কথা। সেই শাড়িটা নিয়েই সে বড় ফুফুর হাতে দেয়।
– তুমি কি পরবা?
– শাড়ি ছাড়াও বহু রকম ড্রেস আছে ফুপি। আমি এই কালারের কাছাকাছি তেমন একটা ড্রেস পরে নেবো। আর তাছাড়া আমি শাড়ি খুব একটা ভালো সামলাতে পারি না।
– অ। তা তোমার মতো বয়সের মেয়েরা আজকাল কিন্তু ভালো শাড়ি পরতে পারে। তুমি তো দেখি একালের সাথে তাল মিলাইতে পারবা না।
– তাল মিলাতে গেলে তো আপনার মেয়ে শাড়ি পাইতো না ফুপি। আর আপনি তখন এভাবে মুখ কালো করে বসে থেকে আনন্দের পরিবেশ অন্য রকম করে ফেলতেন!
অদিতির ফুফু শাড়ি’টা নিলেন বটে কিন্তু মুখ’টা করলো তিতা করলা খাওয়ার মতো। এমন কড়া কথা শোনার অভ্যাস নাই তার। বড় বলে সবাই তাকে সমীহ করে আর বেশি সমীহ করে ঝামেলা বাঁধায় এজন্য!
হলুদের অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নেই হলো। মেয়েরা সব শাড়ি পরলেও অদিতি পরলো সাদা কমিজের সাথে সাদা চুড়িদার আর চুনরি বাটিকের মাল্টিকালারের একটা ওড়না। সবার মধ্যেও অদিতি আপন আলোয় ও আত্মবিশ্বাসে ভিন্নভাবে উজ্জ্বল।
কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো বিয়ের দিন, যা কেউ ভাবতেও পারে নি।
– ভালো বাবা, আর তাছাড়া আমি যেহেতু চাকরি বাকরি করবো না, আমার সিজিপিএ নিয়ে এত্তো চিন্তা নাই। নোট গিলে পরীক্ষায় ধুমধাড়াক্কা রেজাল্ট করার কোনই ইচ্ছা নাই!
অদিতিদের বাড়ির এই একটা নিয়ম। সারাদিন যে যেখানেই থাকুক, রাতের খাবার টেবিলে সবাই একসাথে বসে খাবার খাবে। এটা অদিতির বাবা আহসানুল হকের অলিখিত নির্দেশ। একইসাথে খাবার টেবিলে মোবাইল নিয়ে বসা যাবে না, এটাও কড়াভাবে বলে দেয়া।
– হুম। তাহলে তো ছেলে দেখা শুরু করতে হয়। চাকরি বাকরি যখন করবি না, তাহলে মন দিয়ে ঘর সংসার কর।
– সেই হিসাব করলে তো তোকেই আগে বিয়ে দিতে হয়। চাকরি পাচ্ছিস না, তো বিয়ে করে ঘর জামাই থাক। শ্বশুরবাড়িতে বাজার সদাই করে দিবি।
আরাম করে মুরগীর একটা হাড় চিবাতে চিবাতে বড় ভাই শোভনের খোঁচার বিপরীতে বড় একটা খোঁচা দিলো অদিতি। বাস্তবতা হলো, মাস্টার্স পাস শোভন বেকারই বলা যায়। এখানে ওখানে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে কিন্তু এখনো ব্যাটে বলে মেলে নি।
– তাহলে কী করতে চাও অদি?
বাবা প্রসঙ্গে ফেরেন। সন্তানদের ক্যারিয়ার নিয়ে আর দশজন বাবার মতো উনিও খুব চিন্তিত। আবার এদিকে উনার চাকরির মেয়াদও শেষের দিকে। তখন কোয়ার্টার সহ চাকুরির অন্য সকল সুবিধা পাওয়া যাবে না। ছেলেটা পড়াশোনায় মোটামুটি, এখনো আশাব্যঞ্জক কিছু করতে পারে নি। মেয়েটা সেই হিসেবে অনেক মেধাবী কিন্তু খামখেয়ালি। কখন যে কী করে আর বলে বোঝা মুশকিল৷
আমাদের দেশের বাবা মায়ের এই এক সমস্যা। সন্তান জন্মগ্রহণ থেকে শুরু করে নিজ পায়ে দাঁড়ানো এমনকী ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে বিয়ে দেয়া পর্যন্ত বাবা মা’কে করতে হয়। অথচ অধিকাংশ সন্তান এই বিয়ের পরেই নিজের সংসার সন্তান নিয়ে এমন নিমগ্ন হয়ে পড়ে যে, বাবা মা নামে পরম নি:স্বার্থবান কেউ যে জীবনে আছে তা বেমালুম ভুলে যায়৷
এসব নিয়ে মাঝে মধ্যেই ভাবে অদিতি। দেশের বাইরে, উন্নত রাষ্ট্রে তরুণরা অল্প বয়সেই নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে নেয়। এট বিষয়টা অদিতির দারুণ লাগে।
– বাবা আমি ব্যবসা করবো। মানে উদ্যোক্তা। এখন অনলাইনে এবং অফ লাইনে নানা রকম ব্যবসা করে অনেকেই সফল। কাপড় ধুয়ে হোম ডেলিভারি করা থেকে শুরু করে কেটে ধুয়ে পরিস্কার করা মাছ পর্যন্ত বিক্রি করছে। এমন কোন ব্যবসা করবো। আর শোন আমি দুই একটা টিউশনি করতে চাচ্ছি কারণ প্রতিনিয়ত বাবা মায়ের কাছে যে কোন বিষয়ে হাত পাততে আমার লজ্জা করে৷
এবার রে রে করে উঠেন অদিতির মা লুৎফা রহমান।
– হুম এইটাই তো বাকি ছিলো। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াবে। আর তোমার কিসের এতো অভাব শুনি যে টিউশন করাতে হবে?
– লুৎফা এভাবে বলছো কেন? কোন কাজই ছোট তো নয়ই আর টিউশনি করা গরীব বাচ্চাদের কাজ, এমন চিন্তা তোমার মাথায় আসলো কিভাবে? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশে স্টুডেন্টরা হোটেল রেস্তোরাঁয় কাজ করে সেখানে আমাদের দেশে তো টিউশনি ভালো অপশন। তবে মা, ইদানীং কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং খুব জনপ্রিয় হচ্ছে ঘরে বসে কাজ। তুমি অনলাইনে গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখতে পারো৷
– শোন শোভনের বাবা, শম্পার বিয়ের কথা ভুলে যেও না। আগামী সপ্তাহেই কিন্তু যেতে হবে।
– ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। কি মজা শম্পা আপুর বিয়ে। এবার গ্রামে যেয়ে কিন্তু এক সপ্তাহ থাকবো।
উল্লাসে মেতে উঠে অদিতি। খাওয়া শেষ করে দ্রুত রুমে এসে মোবাইল খোঁজে। উদ্দেশ্য শম্পাকে একটু খোঁচাখুঁচি করা। শম্পা ওর বড় চাচার মেয়ে। স্থানীয় একটা কলেজে অনার্স ফোর্থ ইয়ারে পড়ে। ভীষণ স্নিগ্ধ, মায়াবী আর গুণী একটা মেয়ে। অদিতিরা বাড়িতে গেলে বড় চাচার বাড়িতেই যেয়ে উঠে। শম্পা নানা রকম পিঠা বানায়, চাচী মজার মজার রান্না করে আর গল্পে আড্ডায় ওদের দিন কেটে যায়।
– আপু, তো দুলাভায়ের কি অবস্থা? রাতে ঘুমাচ্ছে নাকি হবু বউ এর চিন্তায় তার রাতের ঘুম হারাম?
টুক করে ম্যাসেঞ্জারে শম্পার উদ্দেশ্যে একটু খোঁচা পাঠিয়ে দেয় অদিতি। গ্রামে এর অনেক আগেই খাওয়া দাওয়া শেষ। সুতরাং শম্পা এখন রুমে, ফোনের কাছেই থাকার কথা – মনে মনে ভাবে অদিতি।
– তা আমি কিভাবে বলবো, তার সাথে কি আমার কথা হয়?
ফিরতি ম্যাসেজ শম্পার।
– কেন, কথা হয় না কেন? তুমি করবা বিয়ে, সংসার করবা তুমি তা টুকটাক কথা তো বলাই উচিৎ৷
– আমাকে যে দেখতে এসেছিলো, সেই সময়ই যা একটু দেখেছি৷ কথা তো হয় নি। আর এক মাসের মধ্যেই বিয়ে ঠিক। আমাকে মা শুধু বলেছে, ছেলে ভালো আছে, ভালো একটা চাকরি করে। পরিবারও ভালো। রাজী হয়ে যা। আমি তো আর কিছু বলি নি। ব্যাস বিয়ের আয়োজন চলছে। কেউ বলে নি যে ছেলে মেয়ে কথা বলুক বা সেই ছেলেও কখনো ফোন দেয় নি।
শম্পার ম্যাসেজের উত্তরে কি লিখবে ভেবে পায় না অদিতি। কিন্তু ওর মনে হয় বিষয়টা ঠিক হচ্ছে না। তার উপরে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। অদিতির তো এটা মনে হলেই আতংক লাগে। অচেনা জায়গায় অচেনা কারো সাথে সংসার করা! নাহ, শম্পা আপুর বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে – এটা নিয়ে কার সাথে কথা বলা যায় ভাবতে থাকে৷
– এই আপনারা গরমকালেও কেন কম্বল সাজিয়ে রেখেছেন? মানুষ কি সারা বছর কম্বল গায়ে দেয়?
– আপা, এটা তো ওয়াশের দোকান। ওয়াশ করে এভাবে রেখে দিয়েছি। যাদেরটা তারা নিয়ে যাবে।
– আমি লেখাপড়া জানি ভাই। উপরে স্পষ্ট করে লেখা আছে ফাহিম ড্রাই ওয়াশ। কিন্তু এই ঠা ঠা গরমের সময় পর্যন্ত মানুষ কম্বল রেখে দেয়? আবার কিছুদিন পরেই তো শীতকাল চলে আসবে!
– তা আপা বলতে পারি না। অর্ডারের জিনিস।
মাথা চুলকায় কামাল। সে এই দোকানের কর্মচারী। আজ দুপুরে খাওয়া ভালো হয় নাই। ডালে লবণ বেশি ছিলো আর মাছ’টা পঁচা। তার উপরে এই মেয়ে’টার উল্টা পাল্টা প্রশ্নে বিরক্ত লাগে। আবার মনটাও খারাপ হয় – আহা, এতো সুন্দর মেয়েটা এমন পাগল পাগল!
– কি বলছেন এমন বিড়বিড় করে? আমার মনে হয় কি জানেন? আপনারা ইচ্ছা করেই কম্বল সাজিয়ে রেখেছেন, এটা আপনাদের মার্কেটিং পলিসি।
– কিসের পলিসি আপা?
বোকার মতো প্রশ্ন করে হা করে থাকে কামাল।
– মার্কেটিং পলিসি। এমন কম্বল সাজানো দেখে কারো না কারো মনে পড়বে, তাই তো আমার কম্বলও তো এই বছর ওয়াশ করি নাই! তখন সে এখানে চলে আসবে। সাথে আরো কয়েকটা সোয়েটার, শাড়ি বা শার্টও আসতে পারে। তখন আপনাদের ব্যবসা তো রমরমা।
কামালের কাছে সুন্দর মতো পাগল মেয়েটা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু কামালের কপাল ভালো এজন্য অন্য একটা মেয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে।
– অদিতি এই ড্রাই ওয়াশের দোকানে কি করছিস? ব্যাটারি কিনে এসে দেখি তোর পাত্তা নেই। এখানে কেন?
এতোক্ষণ যে কামালের সাথে বকবক করছিলো, তার নাম অদিতি। অদিতি আহসান। কপালের পাশে কিছুটা চুল এলোমেলো হয়ে ঘামে লেপ্টে আছে। বান্ধবী মিতুর সাথে ভার্সিটি থেকে ফিরছিলো। হঠাৎ একটা রিক্সা দাঁড় করিয়ে দেয় মিতু। ওর ঘরের ওয়াল ক্লকটার ব্যাটারী শেষ। মনেই থাকে না। আজ রাস্তার পাশে একটা দোকান দেখে রিক্সা দাঁড় করিয়ে কিনতে গিয়েছিলো। আর সেই ফাঁকে অদিতি নজর বুলাচ্ছিলো আশেপাশে। এমন ঠা ঠা রৌদ্দুরের গরমে দোকানে কম্বল সাজিয়ে রাখা দেখে ওর হাসি পায়। ইচ্ছা করেই বিরক্ত করতে আসে।
অদিতির এই এক দোষ। ইচ্ছা করেই এমন দুষ্টামি করে। ক্যাম্পাসের সব মামারা ওকে এজন্য এড়িয়ে চলে। আড়ালে আবডালে বলে ক্ষেপি! তা একটু ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের আছে বৈ কি।
এই যেমন সেকেন্ড সেমিস্টারে ওদের একটা ওয়ার্কশপ হবে। তখন একজন টিচার ফাস্ট সেমিস্টারে কার সিজিপিএ কত জিজ্ঞাসা করে নাম টুকে নিচ্ছিলেন। অদিতি উঠে দাঁড়িয়ে বলে বসলো –
‘স্যার, যদি ভালো সিজিপিএ ধারীরাই আপনার ছাত্র ছাত্রী হয় এবং তারাই এসব ওয়ার্কশপে যেতে পারে তাহলে আমাদের আর ক্লাসে থাকার দরকার কী? আপনি এখন থেকে ওদের নিয়েই ক্লাস করেন। আমরা বাকি একশ জন চলে যাই!
শিক্ষক বেচারা আমতাআমতা করতে লাগলেন। শেষে সবার থেকেই নিলেন। সেই বার সবাই অদিতিকে বাহবা দিয়েছিলো। যদিও এরাই অনেকে তারছেড়া বলে!
মিতুর কাজ শেষ। বাড়ির দিকে চলতে থাকে দুই জন। আগে মিতুর বাসা এরপর অদিতির। মিতু নেমে গেলে বাকি’টা পথ একাই যায় অদিতি। রিক্সা থেকে নেমে বাড়তি একশ টাকা রিক্সাওয়ালার হাতে ধরিয়ে দেয়
ভার্সিটিতে এসে চমকপ্রদ এক তথ্য পেলো মালিহা। তুষারের ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়েছে। চমকে যাওয়ার মতোই খবর। এক প্রফেসরের থিসিস পেপারে কাজ করছিল সে। গুগল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সেটা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে সেই পেপারে। প্রফেসর পেপার জমা দিলে কর্তৃপক্ষ সেটা বাতিল করে দেয়, কারণ হিসেবে বলে তথ্য চুরির কথা। প্রফেসর তুষারকে চার্জ করলে সে এক বাক্যে অস্বীকার করে। সেখান থেকেই বাক বিতণ্ডার শুরু। একে একে বেরিয়ে আসে আরো তথ্য। নিজের লেখা বিভিন্ন ছোটখাট আর্টিকেলেও নাকি তুষার এই কাজ করেছে। কেলিয়ে দিয়েছে নিজের নামে। পুরো ভার্সিটিতে যখন তার কুকর্মের চর্চা চলছে তখন তার আক্রমণের শিকার হওয়ার মেয়েগুলো হঠাৎ কিভাবে যেনো একত্রিত হয়ে গেলো। গ্রুপে অ্যানোনিমাস পোস্টের মাধ্যমে বলতে থাকলো তুষারের কীর্তি। একজনকে দেখে সাহস পেলো আরো দুইজন। এভাবে একের পর এক ইস্যু তুষারের দিকে সরাসরি আঙুল তোলায় পালানোর জায়গা পেলো না তুষার। মেয়েগুলোকে গোপন ভিডিও দিয়ে হু’মকি দেয়ার সময়টুকুও পেলো না। থিসিস পেপার কেলেঙ্কারির চারদিনের মাথায় ভিসি নিজে তাকে পুলিশি হেফাজতে পাঠালো। ভার্সিটিতে শৃঙ্খলা রক্ষায় এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না।
পুরো ঘটনা শুনে মালিহার ভালো লাগলো। ভয়ংকর থাবা থেকে সে বেঁচে গেলেও অনেকেই হারিয়েছে জীবনের উচ্ছ্বাস। তাদের আওয়াজ তোলার দরকার ছিল। আরো ভালো হয়েছে অধিকাংশ মানুষের কাছে মেয়েগুলোর পরিচয় গোপন থাকায়। গ্রুপের অ্যাডমিন ছাড়া অন্যকেউ তাদের সম্পর্কে জানে না। এবং অ্যাডমিন দুজন কথা দিয়েছে মেয়েগুলোর কথা কাউকে জানাবে না। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে মালিহা। ঠোঁটে জায়গা নেয় এক টুকরো হাসি। নীতি ধাক্কা দিয়ে বলে, “তুই হাসছিস কেনো?”
ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসে মালিহা, “আজকে যদি আমার সাথে তুষার ভাই এমন কিছু করত তাহলে তুই খুশি হতি না?”
নীতি ভুরু কুচকে বলল, “খুবই বাজে উদাহরন। এমন কথা বলার কোনো দরকারই ছিলো না।”
হাঁটতে থাকা বান্ধবীর হাত আঁকড়ে ধরলো মালিহা। মেয়েটা এমন কথায় রাগ করেছে।
“কতদিনের ছুটিতে যাচ্ছিস! এভাবে আমার সাথে রাগ করে যাবি?”
“তুই এমন আলতু ফালতু কথা বলবি কেনো?”
“আচ্ছা আর বলবো না। কিন্তু নীতি?”
“হু।”
“আমাদের অনার্সের আর তিন বছর। তারপর তুই এক জায়গায়, আমি এক জায়গায়। আমাদের এমন যোগাযোগ কি আর হবে?”
থমকে দাঁড়ালো নীতি। চোখ ঘোরালো মালিহার দিকে। ঢোক গিলে বলল, “সেন্টি খাওয়াচ্ছিস কেনো? চিন্তা করতে এতো মন চাইলে সারপ্রাইজ টেস্টের কথা চিন্তা কর। যখন তখন নিয়ে স্যারেরা হার্ট ব্লক করে দেয়ার শপথ নিয়েছে।”
নীতির কথা ঘোরানো দেখে মালিহা হাসলো। শক্ত করলো হাতের বাঁধন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠল রুমের যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ক্যান্টিনে দেখা হলো নাজিফার সাথে। মেয়েটার মুখে সেই চিরচেনা এক টুকরো হাসি। মালিহা অবাক হয়ে। নাজিফার কি কখনও মন খারাপ হয় না? অথবা কষ্ট? মেয়েটার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। যেনো পৃথিবীর সব সুখ তার কাছে আছে। নীতিকে টেনে নিয়ে ক্যান্টিনে গেলো মালিহা। নাজিফার সামনে দাঁড়িয়েই বলল, “এই নাজিফা! তোমার কখনও মন খারাপ হয় না?”
সরাসরি এমন প্রশ্নে নাজিফা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল, “কেনো বলো তো?”
“তোমাকে তো কখনও মন খারাপ করতে দেখি না।”
নাজিফা হেসে বলল, “মন যখন আছে খারাপ তো হবেই। কিন্তু মনের ডাক্তারের কাছে সেই কথা না বলে চারপাশের মানুষকে দেখাবো কেনো? মনটা যিনি বানিয়ে দিয়েছেন তাঁর কাছে কাছেই মনের সব জমা আছে।”
হুট করে নাজিফাকে জড়িয়ে ধরলো মালিহা, “তুমি আমার অনেক উপকার করেছো নাজিফা। তোমাকে এর বিনিময় দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই।”
মালিহার পিঠে চাপড় দিয়ে নাজিফা বলল, “পাগলি! বিনিময় চেয়েছ কে? জান্নাতে তোমার বাড়ি একদিন দাওয়াত দিও। হিসাব টিসাব যা আছে সব ওখানেই উসুল করে নেবো।” মালিহা হাসলো। কৃতজ্ঞতার হাসি।
নীতির ব্যাগ গোছাতে সাহায্য করলো মালিহা।
“কয় মাসের সফর?”
“আর মাস! সাত দিনই ভালো মতো কা’টে নাকি দেখ।”
“কেনো? আমি তো ভাবলাম অন্তত এক মাস ঘুরবি।”
নীতি মিনমিন করে বলল, “সে তো একমাস ঘোরার কথাই বলেছে। কিন্তু তার তো হুটহাট ফোন আসে। দেখা যাবে বাসে উঠেছি তখনই ফেরত যেতে বলবে।” মন খারাপ করে বলল নীতি। তার হাত ধরে মালিহা বলল, “অযথা চিন্তা ভাবনা করিস না। আল্লাহ ভাগ্যে যতদিন রেখেছেন ততদিনই ঘুরতে পারবি। এদিকে দেখ। এসব কিছু নিবি?” কসমেটিকসের ঝুড়ি দেখালো মালিহা। নীতি কয়েকটা জিনিস বেছে নিলো। তার স্বামী কর্মক্ষেত্র থেকে এক মাসের ছুটি পেয়েছে। সেটা সে কাটাতে চায় নব বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে। পুরো দেশ ঘুরতে চায় এক এক করে।
“মালিহা! তোর সাইয়্যার কি খবর?”
এক চোখ টিপ দিলো মালিহা, “বিন্দাস!”
“বিয়ে করে মুখে বুলি ফুটেছে দেখি!”
“সাইয়্যা শিখিয়েছে!” ফিসফিসিয়ে বলল মালিহা। নীতি খিলখিল করে হেসে ফেললো।
“ব্যাটাকে দেখে মনে হয় না এতো কথা বলতে পারে। তুইই শিখিয়ে দিস।”
“তোর দেখতে হবেও না। নিজের ব্যাটার দিকেই মন দাও নীতি!” শাসন করার ভঙ্গিতে বলল মালিহা। আঁখি ঘরে এলো সেই ক্ষণে, “বিবাহিত মহিলা দুজন ভালোই আছে মনে হচ্ছে!”
“ভালো মানে ভালো! আমাকে চোখেই দেখছে না।” অনুযোগ ভরা স্বরে বলল মনিকা। সে বিছানায় শুয়ে ছিল। মালিহা তাকালো, “আমি ভেবেছিলাম আপনি ঘুমাচ্ছেন আপু! তাই ডাকিনি।”
“হু বুঝি বুঝি! তোমরা এখন জামাই ছাড়া আর কিছু দেখছোও না।”
নীতি যেয়ে মনিকাকে ধরলো আর মালিহা আঁখিকে। দুজনে একসাথে বলল, “তাহলে আপনাদেরও আপনাদের জামাই দেখাই চলুন!”
হেসে উঠলো সবাই। আরো এক টুকরো স্মৃতি জমা হলো মনের সিন্দুকে।
হঠাৎ করেই মালিহা চিন্তা করলো এক বছরের সম্পর্কটার কথা। বেঁচে থাকলে তিন বছর পর দুইজন থাকবে দুনিয়ার দুই দিকে। এই রুমের চারটা মানুষ চারদিকে। নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। স্বামীর সংসার, বাচ্চাদের লালন পালন। হঠাৎ এক ব্যস্ত দুপুরে এই রোদ পড়ে যাওয়া বিকেলের কথা মনে হবে। মনে হবে ক্যান্টিনে বাকি খাওয়ার প্রত্যেকটা হিসাব। চাঁপা ফুলের গন্ধে ভেসে আসবে মন খারাপের সুবাস। মন হাহাকার করবে। কিন্তু ফিরে আসা যাবে না এই রংচটা সিঁড়িঘরে। নোংরা বারান্দা দেখে আর নাক সিটকে বলা হবে না, “ইশ খালা! একটু দেখে পরিষ্কার করবেন তো!”
••
বিকেলে ইতমিনান বলল, “চল মালিহা তোকে একজনের সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি।”
“কার সাথে?”
“আরে চল আগে।”
গোছাতে গোছাতে মালিহা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “তুমি কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে আমাকে তুই করে বলবে না। মানুষ কি বলবে?”
“কি বলবে?”
“তোমাকে অশিক্ষিত বলবে। বউকে তুই তোকারি করে।”
“তাহলে মানুষের সামনে কি বলব?”
“কিছুই বলতে হবে না। চুপচাপ বসে থাকবে।”
“আচ্ছা। বউয়ের আদেশ শিরোধার্য।”
মালিহা দেখলো ইতমিনান একটা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়েছে। পেঁয়াজু ভাজতে দেখেই তার লোভ লেগে গেলো।
“এই পেঁয়াজু খাবো কিন্তু!”
ফিসফিসিয়ে বলল মালিহা। ইতমিনান শুনলো কি না বোঝা গেলো না। হাক ছেড়ে সে ডাকলো, “মানিক মিয়া!”
ভেতর থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এলো। মালিহা স্পষ্ট দেখলো ইতমিনানকে দেখে তার চোখ চকচক করে উঠেছে। কিন্তু মুখে নির্বিকার ভাব। যেনো কিছুতেই তার কোনো যায় আসে না।
ইতমিনান চওড়া হেসে বলল, “মালিহা এটা আমার বন্ধু!”
মানিক বিবশ চোখে ইতমিনানের দিকে তাকালো। বন্ধু? এই প্রথম! এর আগে কেউ কি বলেছে, দেখো দেখো এই ছেলেটা আমার কি হয়!
মানিকের দিকে ঝুঁকে ইতমিনান ফিসফিসিয়ে বলল, “বড়লোক হয়ে গিয়েছি মানিক মিয়া! এই যে আমার সম্পদ!”
মানিকের মাথায় হাত দিয়ে মালিহা বলল, “তোমার নাম কি?”
“মানিক মিয়া এভিনিউ!” উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল ইতমিনান। মানিক মুখ বাঁকা করে বলল, “এই নামে আর ডাকন যাইবো না।”
“কেনো?”
“নিজেই ঝামেলা করসি। কি আর কমু! সেই হুজুরে আমারে তার মাদ্রাসাত ভর্তি করাইসে। নাম শুইনা বলসে “জায়গার নাম মানুষের নাম হবে কেনো? মানুষের নামে জায়গা হবে।” একদম ভঙ্গি নকল করে বলল মানিক। ইতমিনান অবাক হয়ে বলল, “তুমি এখন মাদ্রাসায় পড়?”
“শুরু করি নাই। আগামী বছরের শুরু থিকা। ততদিন হুজুর কুরআন পড়াইবো।”
ইতমিনান খুশি হলো। বলল, “এই খুশিতে কয়েকটা পেঁয়াজু খাওয়া যাক। কি বলো মানিক মিয়া? আচ্ছা এখন তোমার জীবনের লক্ষ্য কি?”
“যেই মসজিদে মা’ইর খাইসি সেই মসজিদে ইমামতি করা।”
মানিক ভেতরে চলে গেলো। ইতমিনান অবাক হয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “ওকে আমি ভালো ভাবছিলাম। এ তো দেখি ডে’ঞ্জা’রাস!” মালিহা ভুরু কুচকে তাকিয়ে রইলো। কিছুই বুঝতে পারেনি সে। কোত্থেকে ছুটে এলো লালপাহাড়। ইতমিনানের পায়ের কাছে এসে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলো। মালিহা ভয় পেয়ে একপাশে গেলে ইতমিনান বলল, “ভয় নেই। ও বকা দিচ্ছে।”
“বকা দিচ্ছে!” মালিহা অবাক হয়ে বলল।
“হু।”
“তুমি চেনো নাকি?”
স্মৃতিকাতর দৃষ্টিতে ইতমিনান বলল, “অবশ্যই! এটা আমার ডান হাত।”
ইতমিনান লালপাহাড়ের সাথে কি কি যেনো বলতে শুরু করলো। মালিহা অতো খেয়ালও করেনি। হঠাৎ মানিক পেছন থেকে পেঁয়াজুর প্যাকেট এনে নিচু কণ্ঠে বলল, “আপনে ভালা মানুষ! আপনার বর কিন্তু পাগলা আছে। রাস্তার পোলাপান ধইরা মসজিদে নিয়া যায়। ব্যাডার মাথা ঠিক নাই। খেয়াল রাইখেন।”
সেই কথা ইতমিনানকে বললে সে হাসলো। প্রশ্রয়ের হাসি। যেনো এমন পাগল সে সারাজীবন থাকতে চায়।
ইতমিনান চলে গেলো মসজিদে। এটুকু পথ একাই বাড়ি গেলো মালিহা। পথে দেখা হলো ইরিনের সাথে।
বিদ্ধস্থ তার অবস্থা। ছুটে এসে মালিহাকে বলল, “মালিহা তোমার টাকাটা আমি কালই দিয়ে দেবো। এই সময়ে কালকে এখানে আসতে পারবে?”
হঠাৎ ইরিনকে দেখে মালিহা চমকেছে বটে। একে তো ভার্সিটিতে যায় না তার ওপর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যেন কয়েকমাসের রোগী। মালিহা অবাক হয়ে বলল, “কি হয়েছে তোমার? ভার্সিটিতে যাও না আর। কেনো?”
“কিছু না। কিছু হয়নি। বলো মালিহা কালকে এখানে আসতে পারবে? তোমার টাকাটা..”
সুন্দর করে হেসে মালিহা বলল, “দান করে দেয়া টাকা কেউ ফেরত নেয় নাকি? আমি তো নিই না।” তার চোখে ভাসলো কালো মেঘে ঢাকা সেই রাত। কয়েকটা ফোনকল, একই যান্ত্রিক কণ্ঠ।
ইরিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মালিহা বলল, “আসি। ভালো থেকো।”
••
লতা মালিহাকে সুন্দর একটা শাড়ি উপহার দিয়েছেন। কালো পাড় লাল শাড়ি। লাল জমিনের কার্নিশ ঘেষে চিকন কালো সুতার কাজ। মাঝে মাঝে কিছু চুমকি বসানো। সুন্দর করে শাড়িটা পড়ে চটপট করে সাজলো মালিহা। ইতমিনান এলে বেশ একটা চমক দেয়া যাবে।
শাশুড়ির ফোন পেয়ে তটস্থ হলো মালিহা। আয়েশার প্রতি ভয়টা তার আর কাটবে না বোধহয়।
“মালিহা তোমার মা কে বলবে আমার ওপরে এতো দয়া দেখানো লাগবে না।”
মালিহার কপালে ভাঁজ পড়ল।
“কি হয়েছে।”
“সেটা তোমার মায়ের কাছেই শুনে নিও।” খট করে কেটে দিলেন আয়েশা। নাজিয়ার কাছে ফোন দিলে জানা গেলো আয়েশা অসুস্থ থাকার কারণে নাজিয়া রান্না করে ছেলেকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। এতেই ক্ষেপে গেছেন আয়েশা। মালিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এটুকু যে পুরো কথা নয় সেটা সে জানে। আয়েশা কি বলেছেন সেটা যেমন তিনি বলবেন না। আবার নাজিয়া কি বলেছেন সেটা তিনি বলবেন না। নিজের দোষটা কেউ দেখছে না। আবার কাউকে একটু ছাড় দেয়ার মানসিকতাও তাদের নেই। তাদের মাঝে চাপা পড়েছে মালিহা। একূল অকূল, দুই কূলের ঢেউ আছড়ে পড়ে তার ওপর। উপরি পাওনা হিসেবে আছে মিলি। যে করছে চোরাবালির কাজ। মালিহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ইতমিনান যদি তার জন্য প্রশান্তির জায়গা না হতো তাহলে সম্পর্কের এসব টানাপোড়েন সে অদেখা করতে পারতো না। সকলের মাঝে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যেতো। আবার ফোনকলের শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। মিতুল ফোন দিয়েছে।
“আপা! জীবনে আমি বিয়ে করবো না। নিজের শান্তিপূর্ণ জীবন ধ্বং’স করার কোনো ইচ্ছাই আমার নাই।”
এক নিশ্বাসে বলে রাশেদার কানে ফোন দিয়ে চলে গেলো মিতুল। মালিহা বলল, “ও এসব বলল কেনো দাদি?”
“ওর কথা! মা চাচীর ঝগড়া দেখে এসব বলেছে। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্।” ক্লান্তির শ্বাস ছেড়ে বলল মালিহা। রাশেদা টের পেলেন সেই ক্লান্তি।
“এটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে গেলে হবে? তোমার ভূমিকা এখানে অনেক গুরুত্বপুর্ন। ইতুরও। একদিকে ঝুঁকে যাওয়ার উপায় নেই।”
“এজন্যই তো ভয় লাগে দাদি। পড়া ঝগড়া করবে তার ঝড় উঠবে আমাদের সম্পর্কের উপর দিয়ে।”
“অস্বাভাবিক না। তোমাদের মায়েরা একজন আরেকজনের সাথে সবসময় এমন ঝগড়াঝাঁটি করলে তো তার কিছুটা প্রভাব তোমাদের ওপরেও পড়বে। তোমরা নিজেরা শক্ত না থাকলে, বুদ্ধি দিয়ে বিচার না করলে টিকে থাকা কষ্ট। তখন সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই সেখানে অশ্রদ্ধা জায়গা করে নেবে। অনেক সাবধানে থাকবে।”
“দোয়া করো দাদি।” নিচু কণ্ঠে বলল মালিহা।
“আপাতত রাফির জন্য বেশি বেশি দোয়া করছি। ও যেনো একটা ভালো বউ পায়। তারপর সময় পেলে তোমাদের জন্য দোয়া করবো ইনশাআল্লাহ্।” হেসে ফেললেন রাশেদা। হাসলো মালিহা নিজেও।
কলিংবেলের শব্দ দরজা খুলতেই ইতমিনানের সাথে আরো একটা পুরুষ কণ্ঠের আভাস পেলো মালিহা। দরজার নবে ধরে কান এগিয়ে নিলো দরজার দিকে। কেউ একজন আছে ইতমিনানের সাথে। তালা খোলার শব্দ ইতমিনান নব মুচড়ে দরজা ঠেলে দিলো। মালিহার কপালে লাগলো দরজা। শাড়ি সামলে এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো সে।
ইতমিনান ঘরে এসে দেখলো তার ঘরের রানী রাগে ফুসছে। সে যেতেই ফেটে পড়ল যেনো।
চাপা কণ্ঠে হিসিহিসিয়ে বলল, “তোমার কোনো আক্কেল জ্ঞান আছে! ঠাস করে একটা পুরুষ মানুষ নিয়ে চলে এসেছ। আমাকে আগে থেকে জানাবে না?”
থতমত খেয়ে গেলো ইতমিনান।
“একদমই মনে পড়েনি।”
“নিজেকে এখনও ব্যাচেলর ভাবল মনে পড়বে কিভাবে?”
“আরে তোর স্টুডেন্টের মামা। ঐ যে রনি। লামিয়ার মামা।”
“তো তার সামনে এভাবে আমি শাড়ি টাড়ি পড়ে যাই আর কি!”
এতক্ষণে ভালো করে মালিহাকে খেয়াল করলো ইতমিনান। তখনই মনে হলো এই যে মালিহা তাকে ঝাড়ি দিচ্ছে! সে হেসে বলল, “সরি। ভুল হয়ে গেছে।”
“তোমার বন্ধুকে নিয়ে ঐ ঘরে ঢোকো। আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।”
“ডান চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। ঐটা ঠিক কর তুই। আমি চা দিচ্ছি।”
ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা দেখলো মালিহা। আসলেই লেপ্টে গেছে। ক্যামেরা দিয়ে কি আর সাজুগুজু করে যায়! একটা ছোট দেখে আয়না কিনতে হবে।
বন্ধুকে বিদায় দিয়ে বউকে মানাতে এলো ইতমিনান।
“তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি?”
“আয় দেখবি।”
মালিহা বের হলো ঘর থেকে। ডায়নিং রুমে একটা সাইকেল রাখা। ফুল দিয়ে সাজানো। মালিহা বলল, “সাইকেলটা কবে নিয়ে আসলে? আমাকে তো বলনি।”
“এটা নতুন। আজকেই কিনেছি।”
“আবার সাইকেল কিনেছো কেনো? বাড়িতে তো একটা আছেই!” এই কথা বললেও মালিহা সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেলো। ফুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো।
“বাড়িরটা বাড়িতেই থাকুক। এটা এখানে থাকবে। কতসময় কতো কাজে লাগে। তোকে এটায় করে ভার্সিটিতে দিয়ে আসবো।”
মালিহা হাসলো, “আচ্ছা।”
“মিতুর মতো সাজানোর চেষ্টা করেছি। হয়নি।”
“মিতুর মতো হয়নি। ইতুর মতো হয়েছে।”
“মালিহা বাইরে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চল সাইকেলে করে ঘুরে আসি।”
একবাক্যে রাজি হলো মালিহা।
“চলো।”
এদিকের নিয়ন বাতিগুলো সম্ভবত নষ্ট হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার বেশি একটা সুবিধা করতে পারছে না। চাঁদ যে আছে তার তো আর লোডশেডিং হয় না। তার জোৎস্না চুয়ে চুয়ে পড়ছে পুরো এলাকায়।
“তোর সেই প্রেমিকের কি খবর?”
সুন্দর আবহাওয়া উপভোগ করছিল মালিহা। ইতমিনানের পেটে রাখা ছিল তার হাত। সেখানে চিমটি দিয়ে বলল, “উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। ও কোনোকালেই আমার প্রেমিক ছিলো না।”
“উঃ! সাইকেল থেকে আমি একা পড়বো না। তোকে নিয়েই পড়বো কিন্তু!”
“ভালো হবে।।দুজন একসাথে বাড়ি বসে আহা উহু করবো।” হেসে বলল মালিহা। নিজেই আবার বলল, “এহসান আর্মিতে জয়েন করেছে।”
“তাই! কবে?”
“এই ইয়ার ফাইনালের পর। কয়েকদিন আগেই শুনলাম।”
“ভালোই হয়েছে।”
“আমি ভাবছি নরম সরম একটা ছেলে। আর্মিতে টিকবে কিভাবে?”
“ওকে নিয়ে তোর এতো ভাবা লাগবে না। আমাকে নিয়ে ভাব।”
“ভাবছি। আচ্ছা বলো তো তোমার শাশুড়ি আর আমার শাশুরি সবসময় এভাবে ঝগড়া করতে থাকলে আমাদেরও ঝগড়া হবে না?”
“আমাদের ঝগড়া ওরা না করলেও হবে। তুই যখন বলবি আমি শুনবো আর আমি যখন বলবো।”
মালিহা সন্দেহী কণ্ঠে বলল, “তারপর সরি কে বলবে?”
“অবশ্যই আমি!”
খিলখিলিয়ে হেসে ফেললো মালিহা। বাহবা দিলো ইতমিনানকে। জোৎস্না ছেয়ে যাওয়া সেই নীরব রাস্তায় তারা দেখলো না লাইটপোস্টের পাশেই বসে আছে এক জোড়া পাখি। কি সুন্দর তাদের কিচিরমিচির!
হকচকিয়ে গেলো ইতমিনান। ফোন এনে সামনে ধরলো। মিলিই ফোন দিয়েছে। ভারী কণ্ঠে ইতমিনান বলল, “মিলি? কি হয়েছে?”
“ভাইয়া! ভাইয়া!”
“হ্যাঁ! কি হয়েছে? কাঁদছিস কেনো মিলি?” ইতমিনানের অস্থির কণ্ঠে মালিহা উঠে বসলো। ইতমিনানের ভাবভঙ্গি দেখে ভয় পেয়ে গেলো সে। বাহু আঁকড়ে ধরে বলল, “এই! কি হয়েছে?” ইতমিনান মালিহাকে থামতে ইশারা করলো। ফোন লাউডস্পিকারে দিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “মিলি বল কি হয়েছে?”
“ইমন.. ইমন এক্সিডেন্ট করেছে ভাইয়া।” আবার কাঁদতে শুরু করলো মিলি।
ইতমিনানের কণ্ঠ উঁচু হলো। লাফিয়ে উঠলো সে, “কখন? পাশে কে আছে? বাবা মা কেউ এসেছে?”
মকবুল আলীর আওয়াজ শোনা গেলো। ইতমিনান বিস্তারিত শুনলো। রাত এগারোটার দিকে এক্সিডেন্ট করেছে ইমন। স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করলেও তারা চিকিৎসা শুরু করেনি। মধ্যরাতে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায়নি। এই খবর শুনে সকলে বিচলিত হয়ে পড়েছে।
“তাহলে এখানকার মেডিকেলে নিয়ে এসো বাবা।”
“ওখানে তো কাউকে চিনি না।”
“চিনতে হবে না। আমি দেখছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো।”
ফোন রেখে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে শুরু করলো ইতমিনান। আলনার কাছে যেয়ে জামাকাপড় বদলাতে শুরু করলো। মালিহা উঠে এলো, “কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“হাসপাতালে।”
“কাউকে চেনো?”
মাথা নাড়লো ইতমিনান। চেনে না সে।
“তাহলে যেয়ে কি করবে?”
“কিছু তো করতে হবে। হাসপাতালের লোকদের সাথে কথা বলে দেখি।”
“তোমার ফ্রেন্ড, ঐ যে লামিয়ার মামা। কি যেনো নাম? তার সাথে যোগাযোগ করে দেখো।”
রনির নাম মাথায় আসতেই তাকে ফোন দিলো ইতমিনান। দুইবারের মাথায় ফোন ধরলো রনি। ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল, “বল ইতমিনান।”
“একটা বিপদে পড়েছি রে!”
বিস্তারিত বলতেই রনি সজাগ কণ্ঠ বলল, “তুই বের হ। ঐদিকে গাড়ি পাবি? থাক আমি বাইক নিয়ে আসছি। আমার ফুপাতো ভাই মেডিকেলে ইন্টার্নি করছে। ওকে বলে দেখবো। তুই রেডি হয়ে থাক।”
ঝটপট গুছিয়ে নিলো ইতমিনান। মালিহা বলল, “আমিও যাই?”
“না না! তুই এখন যেয়ে কি করবি? আমি আগ যেয়ে দেখি।”
“মিলি আপা আসবে। যাই না!”
“অযথা জেদ করিস না মালিহা!” শক্ত কণ্ঠে বলল ইতমিনান। ধমক শুনে চুপ করে গেলো মালিহা। বাকি সময়টুকু মুখ কালো করে রাখলো।
তালা খুলে হঠাৎ করে পিছু ঘুরল ইতমিনান। একটু দূরে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মালিহার কাছে এগিয়ে গেলো। জড়িয়ে ধরে বলল, “রাগ করেছিস? তোকে সকালে নিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ্। উঠেছিস যখন একটু নামাজ পড়। আমার বোনটার জন্য দোয়া কর মালিহা। ওর ওপরে রাগ রাখিস না!” ইতমিনানের কণ্ঠ কেঁপে উঠল। তার পিঠে হাত রাখলো মালিহা। তাকে ভেজা কণ্ঠে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাইকের হর্ন বাজলো। বেরিয়ে গেলো ইতমিনান। রনির পেছনে উঠে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মালিহার দিকে। চিৎকার দিয়ে বলল, “দরজা বন্ধ কর! ভেতরে যা!”
মালিহা ভেতরে ঢুকে শুনলো বাইক ছাড়ার আওয়াজ। ওযু করে দাঁড়িয়ে গেলো নামাজে। সে জানে এখানে, এই সময় তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না। কাজেই আশা ভঙ্গ হওয়ার দুরাশা নেই।
•
মিলির অবস্থা বেহাল। কাঁদতে কাঁদতে দুইবার জ্ঞান হারিয়েছে সে। মকবুল আলী একা রোগী এবং আধা রোগী দুজনকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন। একটু পরপরই ড্রাইভারের কাছে শুনছেন আর কতদূর। আরো কত দূরে? রাতের শঙ্কিত অন্ধকারের বুক চিরে মাইক্রো বাসটা ছুটে চলেছে বেশ গতি নিয়ে। জ্যাম নেই, আশপাশে মানুষের হল্লা নেই। মকবুল আলীর কাছে শহরের রাস্তা অপরিচিত মন হলো। দীর্ঘ তিন ঘণ্টার পথ শেষ হলো দুই ঘণ্টা বিশ মিনিটে। ড্রাইভার ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে নামতেই ছেলের দেখা পেলেন মকবুল। হাত ধরার লাঠি পেয়ে যেনো নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। ভেঙে করলেন ছেলের বুকে। ইতমিনান সামলে নিলো।
“এখন কান্নাকাটির সময় বাবা? আগে ইমনের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
সব গুছিয়েই রেখেছিল দুজনে। রোগীকে দেখেই ডাক্তার জরুরী নির্দেশে অপারেশন থিয়েটারে লাঠিয়ে দিলেন। ভাইয়ের বুকে আছড়ে পড়ল মিলি।
“তুমি আমার ওপরে রাগ করেছো ভাই? আমাকে বদদোয়া দিয়েছো? নাহলে আমার এই অবস্থা হলো কেনো!”
ইতমিনান কিছুই বলল না। শুধু হাত রাখলো মিলির মাথায়। কিছুক্ষণের মাঝে মিলি আবারো জ্ঞান হারালো। নিরীক্ষা করে জানানো হলো অতিরিক্ত চিন্তা এবং ভয়ের কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো মিলিকে।
তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অপারেশন চলল। লাল লাল চোখ নিয়ে বসে থাকলো ইতমিনান। তার গলা শুকিয়ে এসেছে। বোনের মুখ চোখে ভাসলেই বাস্তবিক জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। এই দুই ঘণ্টার পুরোটা সময় বারবার শুধু ইমনের সুস্থতা কামনা করে এসেছে ইতমিনান।
ক্লান্তিতে যখন চোখটা লেগে এসেছে তখনই কারো গলার আওয়াজে চোখ খুললো ইতমিনান। ডাক্তার বের হয়েছেন। বিস্তারিত শুনলো ইতমিনান। পায়ের গোড়ালিতে ফ্র্যাকচার হয়েছে। ডান হাত ভেঙে গেছে। বাইক থেকে ছিটকে পড়ায় শরীরের অনেক জায়গা ছিলে গেছে। হাসপাতালে সপ্তাহ খানেক থাকতে হতে পারে। তারপর টানা এক মাসের বেড রেস্ট। আশা করা যায় তারপর এমন সুস্থ হয়ে যাবে।
সব শুনে হাফ ছাড়লো ইতমিনান। মকবুল আলী চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিলেন। মালিহার কথা মনে পরতেই ফোন বের করলো ইতমিনান। কল করার সাথে সাথেই ধরলো মালিহা।
“হ্যালো?”
“হ্যাঁ বলো। কি খবর ঐ দিকের।”
বিস্তারিত জানালো ইতমিনান। মালিহা স্বস্তি প্রকাশ করলো। শেষে বলল, “অপারেশনে ঢোকানোর পর আমাকে একটা কল দিতে পারতে। আমি চিন্তায় ছিলাম।”
ইতমিনান অপরাধ বোধ করলো।
“সরি মালিহা। ভুলে গিয়েছিলাম।”
“শুধু আমাকেই ভুলে গেছো নাকি বাড়ির সবাইকেও ভুলেছো?”
জিহ্বায় কামড় দিলো ইতমিনান। “কাউকেই জানানো হয়নি!”
“ভেরি গুড! কারা কারা এসেছে?”
“মিলি আর বাবা।”
“আচ্ছা সকালে এসে খাবার নিয়ে যেও। আমি কি যাবো তখন?”
“আমি নিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ্।”
চটপট বাড়িতে ফোন করলো ইতমিনান। আয়েশার কাছে বকাও খেলো খানিক।
••
দীর্ঘ এক সপ্তাহের পুরোটা সময় মিলি ভাইয়ের বাড়িতে থাকলো। প্রথমদিন মালিহার সাথে চোখাচোখিও করতে চাইলো না। মালিহা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। ইতমিনানের অনুপস্থিতিতে একদিন মিলির কাছে যেয়ে বলল, “আপা!”
মিলি তাকালো না। ইমনের কাপড় গোছানোর কাজে আরো একটু মনোনিবেশ করলো।
“আপা! কথা বলবে না আমার সাথে?”
মিলি উঠে চলে যেতে চাইলে মালিহা হাত ধরে বলল, “আপা আমি তো আগে তোমার বোন। তারপর ভাইয়ের বউ। আমার ওপরে রাগ থাকলে তুমি বকো। দুই একটা চড় থাপ্পড়ও মা’রতে পারো। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে রেখেছো কেনো?”
এই কথার উত্তর মিলি না দিলেও পরর্বতীতে মালিহার কথা শুনল। মালিহা কিছু বললে না শোনার ভান করে এড়িয়ে গেলো না। আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা না বললেও তাকে মালিহার সাথে কথা অন্তত বলতে দেখা গেলো।
দুঃখ করে ইতমিনানের সাথে সবটা শেয়ার করলো মালিহা।
“আপা আমার সাথে কথাই বলতে চায় না।”
ইতমিনান মালিহাকে স্বান্তনা দিলো।
“কয়েকদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্। তুই চিন্তা করিস না।”
মালিহা উত্তর দিলো না। সে সেদিন মিলিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে এটাও বলল না। সম্পর্ক এমনভাবেই টিকে রাখতে মালিহা পারবে কি না সেই বিষয়ে মিলি সন্দেহ প্রকাশ করে গেছে সেটাও বলল না ইতমিনাকে। মালিহা বুঝলো সবার মন একজীবনে রক্ষা করা যায় না।
ফাইলের কাগজগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে মালিহা। চোখের পলক পড়ছে অনেকটা সময় পরপর। তার হৃদকুঠুরিতে হা’না দিয়েছে সম্পূর্ণ নতুন এক চিন্তা। অজানা তথ্যগুলো তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে ভেতর থেকে। তিন চার বছর আগের কাগজগুলো হাতড়ে হাতড়ে দেখলো মালিহা। ফটোকপির কাগজে কালি মুছে আসছে। এক কোনায় মালিহার সাদাকালো ছবিটা জ্ব’লজ্ব’ল করছে। সকল প্রশ্নের উত্তর পেলেও মেনে নিতে সময় লাগছে মালিহার। ভয় হচ্ছে, বুক কাঁপছে।
“আপা! আপা!”
মিতুল স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। তার আওয়াজ পেয়ে কাগজগুলো সরিয়ে ফেলতে চাইলো মালিহা। শেষ রক্ষা হলো না। মিতুল সরাসরি তার ঘরে এলো। দেখে ফেললো রাশি রাশি কাগজ।
“এগুলো কি আপা?”
“ঐ আমার অ্যাডমিশনের কিছু কাগজপত্র।”
এলোমেলো ভঙ্গিতে সেগুলো গোছাতে শুরু করলো মালিহা। মিতুল স্কুল ব্যাগ রেখে বোনের সাথে হাত লাগালো। এক পর্যায়ে তার হাতে এলো ক্লাস এইটের বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষার ফর্ম। ভালো করে দেখতেই বুঝলো এটা তার নিজের। সেবার সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাওয়ায় মতিয়ার আলী তাকে নতুন সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। ভুলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভুরু কুঁচকে মিতুল বলল, “আপা তোর কাগজপত্রের ভেতরে আমার বৃত্তির ফর্ম কেনো?”
থমকে গেলো মালিহা। তাকালো ভাইয়ের হাতের কাগজের দিকে। মিতুল এগিয়ে দিলো, “এই দেখ।”
আসলেই ওটা বৃত্তি পরীক্ষার আবেদন ফর্ম।
“এই ফটোকপি কোথায় পেলি তুই? এই বৃত্তির খবর যে বাবা কোন জায়গা থেকে বের করে এনেছিল আজও জানলাম না। আমাদের স্কুলে কেউ কোনোদিন ওখানে পরীক্ষা দেয়নি। এই শহরে হয়ও না। সেই ইতু ভাইয়ের কলেজের ওদিকে পরীক্ষা দিয়ে এলাম।” শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলল মিতুল। গলাটা ঘেমে গেছে।
“মিতুল হতে তো পারে এটা ভাইয়াই করেছে।”
মিতুল কালবিলম্ব না করে বলল, “হতেই পারে। ভাইয়া হলো ছুপা রুস্তম। নাহ ছুপা রুস্তম বললে বেশি সম্মান দেয়া হয়। ইতু ভাই একটা ভীতু। সব লুকায় লুকায় করে।”
মালিহা শুনলো। বলল, “সব কি? আর কি করেছে?”
“এইটে বাবা আমাকে স্কুল পাল্টে দিলো কেনো? তোর মনে হয় বাবা নিজে নিজে খোঁজ পেয়েছে যে স্কুলের অবস্থা দিন দিন বাজে হচ্ছে? বাবা কোনোদিন আমার স্কুলে যায়নি, এমনকি আমার কাছে শোনেওনি পড়াশোনার কি অবস্থা। সেই মানুষ নিজের গরজে আমার স্কুল পাল্টাবে বলে তোর মনে হয়? সব ইতু ভাইয়ের কারসাজি। কোত্থেকে শুনেছে স্কুলের অবস্থা শোচনীয় তখন থেকেই বাবাকে বুঝিয়ে টুঝিয়ে আমার স্কুল পাল্টিয়েছে। সেদিন কথায় কথায় বলে ফেলেছে। ব্যাটা মা’র আঁচলের তলায় লুকিয়ে থেকে এসব করতো।” শেষের কথায় মিতুলের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ল প্রশ্রয়। মুখে অসন্তুষ্ট ভাব থাকলেও মালিহা ঢের বুঝলো ভাই তার ইতমিনানের আচরণে ঠিক কতোটা প্রসন্ন।
“মিতুল।”
“বল আপা।”
“আমার এই কাগজগুলো মানে আমার অ্যাডমিশনের সব কাজও ইতু ভাইই করেছে।”
“জানা কথা। বাবা এসব এতো বুঝতো? তখন ছোট ছিলাম তাই এসব প্যাঁচ ট্যাচ ধরতে পারিনি।”
“এখন বড় হয়েছিস?”
“তো? এই দেখ আমার গোঁফ উঠছে। দুইদিন পর দাঁড়ি উঠবে ইনশাআল্লাহ্।” ঠোঁটের উপর ইশারা করে দেখালো মিতুল।
“তোর কাছে অস্বাভাবিক লাগছে না?”
“কি অস্বাভাবিক লাগবে?”
“এই যে যারা আমাদের সাথে এতদিন কথা বলেনি তারাই হুট করে এতো সাহায্য করেছে জানতে পারছিস।”
“চাচার ভীমরতি ধরেছিল। বাবা মা’রা যাওয়ায় ভালো ধাক্কা খেয়েছে চাচা। চোখের পর্দা পড়ে গেছে। চাচীকে নিয়ে আমি অতো ভাবি টাবি না। মিলি আপা এখন তার নিজের বাড়িতে থাকে তাকে নিয়েও চিন্তা করার মানে নেই। আর ইতু ভাইয়ের আচরণে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তার থেকে ঐ রকম ব্যবহার আশাই করিনি। কিন্তু ব্যাটা ভীতু। মা বাবাকে তো বোঝাবি কিছু? না সেসব তিনি করবেন না। সব দোষ কাঁধে নিয়ে লুকায় লুকায় কীর্তি করবেন।” থামলো মিতুল। আবার বলল, “সত্যি বলতে কি আপা, সবচেয়ে বেশি কষ্ট আমি ইতু ভাইয়ের থেকেই পেয়েছিলাম। কিন্তু কি আর করার বল? ভীতু ভাইকে ট্যাবলেট খাইয়ে সাহসী বানানোর কোনো উপায় তো নেই।” হাসলো মিতুল। সেই হাসি দেখে মালিহার মনে হলো সত্যিই মিতুল বড় হয়ে গেছে। তাকে কি বলবে?
“মিতু!”
“দেখ আপা তুইও এবার মিতু বলা শুরু করিস না। প্লিজ!”
“আমার জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে।”
মিতুলের মুখের বিরক্তি ভাবটা চট করে উধাও হয়ে গেলো। সে জায়গায় ভর করলো একরাশ উত্তেজনা।
“কে দিয়েছে আপা? কবে দিলো?”
“বড় চাচা।” ইচ্ছে করেই বড় চাচার কথা বলল মালিহা। ইতমিনানের কথা বলতে হুট করেই যেনো লজ্জা পাচ্ছে সে।
“বড় চাচা মানে? কার জন্..” হঠাৎ করেই থেমে গেলো মিতুল। বড় বড় চোখ করে তাকালো মালিহার দিকে। তড়িৎ গতিতে উঠে এসে মালিহার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ইতু ভাই!”
মুখ নিচু করে মাথা নাড়ল মালিহা। পরপর মুখ উঠিয়ে মিতুলের দিকে তাকালো। তার মুখে খেলা করছে স্বচ্ছ, সুন্দর হাসি।
“শাশুরির ডলা সহ্য করতে হবে আপা। ইতু ভাই তো কিছু বলতেই পারবে না। তুই থাকতে পারবি?”
হাসি সরে জায়গা নিলো বোনের জন্য চিন্তা।
“কি করবো?”
“ইতু ভাই ভালো মানুষ। সমস্যা যা দুই একটা আছে ইগনোর করা যায়। কি বলিস?” মিতুলকে আনন্দিত দেখাচ্ছে।
“হু।”
“কিন্তু মা’কে রাজি করাবে কে?”
••
রাশেদা জোর করে নাজিয়াকে রাবেয়ার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। মিতুল, মালিহাও পিছিয়ে নেই। তারাও সাথে সাথে হাঁটছে। নাজিয়ার না যেতে চাওয়ার প্রধান কারণ সে শুনেছে আয়েশা, মকবুল আলীও ওখানে গেছেন। বিরক্ত কণ্ঠে সে বলল, “আমরা অন্যদিন গেলে হতো না মা?”
“আমি তোমাকে অনুরোধ করছি বউ মা। চলো। ওখানে যা হবে দেখে আগে থেকেই উত্তেজিত হবে না। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করবে। বয়স হয়েছে তোমার। কাঁধে অনেক দায়িত্ব। আমি চাই না একই ভুল তুমি বারবার করো।”
নাজিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল, “কি হবে ওখানে?”
“চলো, ওখানে গেলেই দেখতে পারবে। আমার ওপরে ভরসা আছে না?”
নাজিয়া মাথা নাড়লেন অস্বীকার করতে পারবেন না শাশুড়ি নামক এই মানুষটার উসিলায় কতো দিক দিয়ে কতো সাহায্য তিনি পেয়েছেন। তাকে ভরসা করবেন না তো কাকে করবেন?
••
রাবেয়া তো অসুস্থ না-ই বরং যেনো একটু বেশি সুস্থ। চড়ুই পাখির মতো এদিক ওদিকে ছুটছেন। কতো রকম নাস্তা যে জড়ো করেছেন!
আয়েশাকে দেখেও কিছু বললেন না নাজিয়া। না বললেন আয়েশা নিজে। দুজনের অবস্থা দেখে হতাশ নিশ্বাস ছাড়লেন রাশেদা। নাজিয়া এগিয়ে গেলেন ননদের দিকে।
“তুমি নাকি অসুস্থ? দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
“অসুস্থ মানে অসুস্থ! এই তোমাদের দেখে সুস্থ হয়ে গেলাম!” চকচকে হাসি হেসে বললেন রাবেয়া।
“তোমার সেবা করা লাগবে নাকি তুমি আপ্যায়ন করবে?”
“না না! আজকে আমি আপ্যায়ন করবো। আর খুব দ্রুতই যেনো আপ্যায়ন পেতে পারি সেই ব্যবস্থা করবো।”
“কি ব্যাপার বলো তো? মা কেমন করে কথা বললেন। কি খিচুড়ি পাকাচ্ছ?”
নাজিয়ার হাত ধরে রান্নাঘরে টেনে নিয়ে গেলেন রাবেয়া। একটা চেয়ারে তাকে বসালেন। ইদ্দতের সময় পেরিয়ে গেছে অনেক দিন আগেই। একটু একটু করে যেনো শোক কাটিয়ে উঠেছেন নাজিয়া। রাবেয়ার ভালো লাগলো। মুষড়ে পড়া মানুষকে দেখতে কারই বা ভালো লাগে!
“ভাবি একটা কথা বলবো। কিছু মনে করতে পারবে না।”
“বলো। এমন করছো কেনো তোমরা মা মেয়ে মিলে?”
“ইতুকে তোমার কেমন লাগে?”
অভিজ্ঞ মস্তিষ্কে কথাটা ধরতে বেগ পেতে হলো না নাজিয়াকে। রাবেয়া ছোটখাট একটা ধমকের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে নাজিয়া বললেন, “কি হিসেবে?”
ঢোক গিললেন রাবেয়া। “এই ধরো মেয়ের জামাই হিসেবে।”
নাজিয়ার শীতল দৃষ্টি দেখে রাবেয়া মনে মনে ভয় পেয়ে গেলেন।
“যেই মহিলা আমাকে দেখতেই পারে না সে আমার মেয়েকে নেবে কেনো?”
“তোমার মেয়ে কি ফেলনা নাকি! এভাবে বলছো কেনো?”
“সেটা ব্যাপার না রাবেয়া। আমার উপরের রাগ যদি আমার মেয়ের উপর ওঠায় তাহলে আমি মানব কেনো?”
নাজিয়ার হাত ধরলেন রাবেয়া। নরম কণ্ঠে বললেন, “বড় ভাবি নিজেই মালিহাকে চেয়েছেন তার ছেলের জন্য।”
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালেন নাজিয়া।
“পরে আবার বলবেন না তো লোভে পরে আমরা মেয়ে দিয়েছি?”
“বললেই আমরা ছেড়ে দেবো ভেবেছো? মা আছে, আমি আছি। মালিহা তো পানিতে ভেসে আসেনি। সবার কথা বাদ দাও। মেয়ে যার সাথে সংসার করবে তার কথা বলো।”
“ওকে নিয়ে তো আলাদা করে বলার কিছু নেই। সে ছেলে ভালো। এখন মায়ের সাথে বউয়ের সম্পর্ক ঠিকঠাক রাখতে পারলেই হলো।”
“তাহলে তুমি রাজি!” বয়স কম হলে রাবেয়া লাফিয়েই উঠতেন যেনো।
“মালিহার কাছে শুনতে হবে। আমার মেয়ের পছন্দ অপছন্দের দাম আছে।”
“অবশ্যই অবশ্যই।”
মেয়েকে এক ঘরে ডেকে বসালেন নাজিয়া। স্নেহ মাখা স্পর্শ খুব একটা মালিহা পায়নি। আজ সেটা পেলো।
মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “শুনছিস তো সবার কথা। তোর মত কি?”
মালিহা মাথা নিচু করলো, “তোমার অপছন্দের কিছু করবো না আমি মা।”
“ছেলেটাকে আমার অপছন্দ নয়। বাবা মায়ের স্বভাব সে খুব একটা পায়নি। তোর মত বল। ঐ মহিলার সাথে থাকতে পারবি?”
মালিহা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, “তুমি দোয়া করলে পারবো মা।”
নাজিয়া কিছু বললেন না। মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন।
••
ইতমিনানের দৃঢ় বিশ্বাস এসবই ভ্রম। শেষ সময়ে এসে তার মাথা নষ্ট করার যতো ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের সবটা করছে তার মন। জোট বেঁধেছে মস্তিষ্ক। সে শুনতে পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে এমন কিছু যা ইচ্ছের তালিকা থেকে কে’টেকুটে সরিয়েছে বহু আগেই। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর এগিয়ে আসছে। ইতমিনান দম ছাড়লো। বিড়বিড় করে বলল, “আল্লাহ্ আমাকে বাঁচাও!”
“আসসালামু আলাইকুম।”
না চাইতেও মুখ তুললো ইতমিনান। তাকাতেই চক্ষু স্থির হয়ে গেলো। ভ্রম বলে ভাবতে চাইলেও পরিবেশ সায় দিলো না। আকাশী রঙের পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে মিতুল। তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। রাফি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ধাক্কা খেলো টেবিলের পায়ার সাথে। দাদি তার বৃদ্ধ কণ্ঠস্বরে কথা বলছেন মকবুল আলীর সাথে। ভ্রম এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ হয়? রং বেরঙের হয়?
গলা খাঁকারি দিলো মালিহা। জড়ানো পায়ে হেঁটে গেলো বিছানার কাছে। সেখানে বসার পাঁচ মিনিটেও ইতমিনান কিছু বলল না। আড়চোখে একবার তাকে দেখলো মালিহা। বিড়বিড় করে বলল, “আমি তো ভেবেছিলাম এই ঘরে একটা মানুষ আছে। পাথরের সাথে দেখা করতে তো আসিনি।”
ইতমিনান শুনলো কি না বোঝা গেলো না। অপলক সেই দৃষ্টির সামনে লজ্জায় অস্বস্তি বোধ করলো মালিহা। এভাবে তাকিয়ে থাকার কি মানে! আরো দুইবার কাশলো সে। একটু জোরেই। নাহ! ইতমিনানের কোনো হেলদোল নেই। তিতিবিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো মালিহা। বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। ইতমিনান তখনও বিছানার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“ভেবেছিলাম তোমার সমস্যা ইগনোর করার মতো। কিন্তু যে হঠাৎ হঠাৎ স্ট্যাচু হয়ে যায় তার সাথে বোনের বিয়ে দেবো কিভাবে?” মিতুলের ধাক্কায় হুশ ফিরল ইতমিনানের। এসব যে বাস্তব সেটা বুঝতেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো সে। ছুটে গেলো ডায়নিংয়ে। আয়েশার সাথে চোখাচোখি হওয়ার অপেক্ষায় আকুল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ তিনি তাকাতেই স্থির হয়ে গেলো ইতমিনান। ছেলের চোখের ভাষা বুঝলেন আয়েশা। হেসে চোখের পলক ফেলতেই ইতমিনান বুঝলো তার জীবনের স্বপ্নমাখা সময়টা সে পার করছে।
••
মিলিকে মানাতে পারেননি আয়েশা। সব শুনে সেই যে মেয়েটা ফোন বন্ধ করলো তো করলোই। কোনোভাবেই তার সাথে কথা বলা গেলো না। জামাইয়ের সাথে কথা বললেও মেয়ের সাথে কথা বলতে পারলেন না আয়েশা। কিন্তু মিলির জন্য আর দেরি করতে চান না তিনি। ছেলের মনের অস্থিরতা তিনি টের পাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা যেই ছেলে তাকে সম্মান দিয়ে নিজের ইচ্ছেকে ভুলতে চেয়েছিল তার যথাযথ পছন্দের সম্মান করতে তিনি কসুর করবেন না। মালিহাকে তিনি ভেবে চিন্তেই মেনে নিয়েছেন। মেয়েটা খারাপ নয়। আশা করা যায় তিনি মানিয়ে নিতে পারবেন।
দুই পক্ষের আলোচনার সময় মালিহার মামাকে ডাকা হলো। সকলের সম্মতিক্রমে ঠিক চার দিন পর এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের পূর্বপরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। আয়েশা, নাজিয়া বা ইতমিনান, মালিহা কেউ কারো দিকে একবারের জন্যেও তাকালো না। রাবেয়া হতাশ হলেন। এদের মাঝে কিসের আত্মীয়তা হবে!
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫৫
আবারো একটা ট্রেন জার্নি। তবে একটু ভিন্ন। এক থেকে দুই আবার দুই থেকেই এক হওয়ার গল্প। অনুভূতিগুলো এক তরফা থেকে দুই তরফা হওয়ার গল্প। ছুটন্ত গাছপালার দিকে তাকিয়ে মালিহা ভাবছিল তার জীবন থেকেও এভাবে সময়গুলো ছুটে ছুটে গেছে। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কা’টাকা’টি হয়ে আজ সে সমানে দাঁড়িয়ে। যেখানে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে সুখ। ঘাড় ঘুরিয়ে বামে তাকালো মালিহা। ইতমিনান মনোযোগ সহকারে পেপার পড়ছে। তার দিকেই তাকিয়ে রইলো মালিহা, অপলক।
শেষের পাতা শেষ করে ইতমিনান পেপার ভাঁজ করলো। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “ঘুরেফিরে এক খবর! দুনিয়ায় যেনো আর কিছু হয় না। বাংলাদেশের কিছু মানুষ সিলেক্ট করা। এরা কখন কথায় যায় কি করে, কি খায় এসবই এদের নিউজ। পারলে এটাও লিখত এরা দিনে বাথরুমে কতবার যায়।”
ফিক করে হেসে ফেললো মালিহা। ইতমিনানের হাত পেঁচিয়ে ধরে বলল, “তুমি এতো রাগছো কেনো?”
“রাগবো না? দশ টাকা দিয়ে পেপার কিনেছি। এসব ফালতু নিউজ পড়ার জন্য?”
“জানোই যখন তাহলে কিনেছো কেনো?”
“যদি তাদের সুমতি ফেরে, যদি নতুন কিছু ছাপায় এই আশায়।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ইতমিনান।
মালিহা নড়েচড়ে বসলো। বাঁধন শক্ত করে বলল, “এই আমি এবার কোথায় যাবো?”
“কোথায় মানে? ভার্সিটিতে।”
ভুরু কুঁচকে মালিহা বলল, “বিয়ে করে ভার্সিটিতে থাকবো কেনো?” পরপর উৎফুল্ল হয়ে উঠলো সে, “তোমার ওখানে যাই?”
“পাগল নাকি! আমার ওখানে কিছুই নেই। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল কিছুই না। এমনকি চাদরও বোধহয় একটা আছে। আসার আগে দেখেছিলাম আগেরটা মাঝখান থেকে একদম ছিঁড়ে গেছে।”
“তো কি হয়েছে? উপরে ছাদ আছে, নিচে মেঝে আছে। আর তার মাঝখানে তুমি আছো। আমি থাকতে পারবো না কেনো?” শেষটুকু নিচু কণ্ঠে বলল মালিহা। ইতমিনানের কপালের ভাঁজ শিথিল হয়ে এলো। চোখ রাখলো মালিহার তৎক্ষণাৎ একটা চিন্তা হা’না দিলো তার মনে। পুরোনো তবে টাটকা।
“এই তোর সেই লুকানো প্রেমিকের কি খবর?”
“লুকানো প্রেমিক মানে?”
“বুঝতে পারছিস না, না?” শক্ত শোনালো ইতমিনানের কণ্ঠ।
“উল্টাপাল্টা কথে বলবে না বলে দিলাম। আমি ভালো মেয়ে। কারো সাথে কোনো আউল ফাউল কিছু করিনি।”
“কিছুই করিসনি কিন্তু পেছনে লাইন ঠিকই ধরিয়েছিস। বাহ!”
এতক্ষণে তার কথার অর্থ ধরতে পারল মালিহা।
“ওহ! এহসানের কথা বলছো? তুমি জানলে কিভাবে!”
“যাক স্বীকার করলি।”
“বলো তুমি জানলে কিভাবে।”
“এসেছিল না বাড়িতে। যেভাবে তাকিয়েছিল তোর দিকে। পুরাই দিওয়ানা! এবার গেলে কি বলবি?”
“আমি তো আরো আগেই ওকে বলে দিয়েছি যে এভাবে সময় নষ্ট না করতে। সরাসরি নিষেধ করার পর ও আর আমাকে বিরক্ত করেনি। ছেলেটা ভালোই।”
“ভালোই? তাহলে ওকে না করলি কেনো?”
“আমার টাইপের না। ওর মন মানসিকতা আমার সাথে মেলে না। এজন্য।”
“মিলিয়ে নিতে পারতি।”
“ফিলিং জেলাস হু হু!”
কঠোর দৃষ্টিতে মালিহার দিকে তাকালো ইতমিনান। রুক্ষ কণ্ঠে বলল, “আমার বউয়ের দিকে মানুষ তাকাবে কেনো? তাও আবার ঐরকম করে! এখন থেকে মুখ ঢেকে থাকবি। ঢাক এখুনি ঢাক।”
মালিহার কানে বারবার বাজলো “আমার বউয়ের দিকে মানুষ তাকাবে কেনো?”
“তাকালে তুমি চোখ উঠিয়ে নিতে পারবে না? সিনেমার হিরোদের মতো?”
বিরক্ত কণ্ঠে ইতমিনান বলল, “বাচ্চাদের মতো কথা বলছিস কেনো? কতজনের চোখ ওঠাবো আমি? তখন সারাজীবন তুই একাই থাকিস।”
“কেনো? তুমি কোথায় থাকবে?”
“কেনো জেলে। বউয়ের দিকে তাকানোর জন্য যদি মানুষের চোখ ওঠাতে শুরু করি তাহলে আমার আর বাইরে ঘুরে বেড়ানো লাগবে না। জেলে যেয়ে থার্ড ডিগ্রি নিতে হবে।”
হেসে ফেললো মালিহা।
“মিতুল বলেছিলো ইতু ভাই ভীতু। তাই তো দেখছি।”
ইতমিনান শান্ত কণ্ঠে বলল, “মজা না মালিহা। কতো জনের চোখ নামাবো আমি? নামালেও তাদের স্মৃতি থেকে তোকে সরাতে পারবো? সেই ক্ষমতা আমার আছে? আমি একজন পুরুষ। পুরুষের দৃষ্টি কেমন হতে পারে ভালো করেই জানি। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি, একটা ছেলে একটা মেয়েকে কিভাবে কিভাবে দেখতে পারে তুই চিন্তাও করতে পারিস না। সবার চোখের কন্ট্রোল আমার হাতে নেই। তার চেয়ে আমি নিজের চোখ কন্ট্রোল করবো আর তোকে লুকিয়ে রাখবো।”
“কতদিন লুকিয়ে রাখবে?”
“যতদিন পারি। যতদিন আল্লাহ আমার দেহে প্রাণ রেখেছেন।”
কথাগুলো মালিহার কাছে নাটকীয় মনে হলো না। ইতমিনান সেভাবে বলেনি। বলতে পারে না। খুব সাধারণভাবে বলা কথাগুলো তাকে প্রশান্তি দিলো। ইতমিনান, নামের যথার্থ প্রয়োগ।
হঠাৎ একজন ম্যাগাজিন বিক্রেতা এলো। চারপাশে তাকিয়ে হাক ছাড়লো বিক্রির উদ্দেশ্যে। সেদিকে তাকিয়ে ইতমিনান চাপা কণ্ঠে বলল, “দেখ দেখ কিভাবে তাকাচ্ছে! মুখটা ঢাক না মালিহা!” আকুতি করে বলল ইতমিনান। সেট করা হিজাব পুনরায় খোলা কষ্টের বিষয়। তবুও স্বামীর আকুতির সামনে সেই কষ্টটুকু নিয়ে চিন্তা করলো না মালিহা। বলল, “তাহলে তুমি উঠে দাঁড়াও। হিজাব খুলতে হবে।”
ইতমিনান ঝটপট উঠলো। স্ত্রীকে আড়াল করে দিলো লোকচক্ষু থেকে। একপাশ থেকে প্যাঁচ খুলে গলার ভাজের দিক থেকে কাপড় নিয়ে নাকের উপরে টেনে নিলো মালিহা। খোলা প্যাঁচ কানের দিকে পিন দিয়ে লাগাতেই ইতমিনানকে ইশারা করলো। বসে পড়ল সে। মালিহার মনে পড়ল একদিন ইতস্তত করে এই পদক্ষেপটা নেয়া হয়নি। আজ হলো। এই বুঝি সঙ্গীর প্রভাব।
ম্যাগাজিন বিক্রেতার দিকে চোখ যেতেই ইতমিনানের হাত ঝাঁকালো মালিহা।
“কি হয়েছে?”
“আমি একটা ম্যাগাজিন কিনব।”
“এগুলো তো সব বাচ্চাদের।”
“বাচ্চাদেরটাই কিনব। চলে গেলো চলে গেলো! ডাকো!”
ইতমিনান ডাকলো। মালিহা “বাটারফ্লাই”এর পঞ্চান্ন তম সংখ্যা কিনে নিলো। সূচিপত্র খুলে খুঁজতে লাগলো কাঙ্খিত নাম। পেয়ে গেলো নিচের দিকে গল্পের তালিকায়। উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বলল, “দেখো! আমার সেই স্টুডেন্ট! ঐ যে তিশা। বলেছিলাম না তোমাকে?”
মাথা নাড়ল মালিহা। টেনে নিলো বইটা। নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা বের করে গল্পটা পড়ল। বড় বড় অক্ষরে শিরোনামে লেখা “গোল্ডেন বার্ড”। গল্প শেষ করে ইতমিনানের চক্ষু চড়কগাছ।
“তোর স্টুডেন্ট তো মা’রা’ত্মক লেখে!”
“তাই না!” সাথে সাথেই মালিহার মুখে অন্ধকার ঘনালো। “ওর মা একদমই বোঝে না।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মালিহা।
“দোয়া কর। আর কি করবি তুই।”
“আজকে ওখানে যেয়ে আগে ওদের বাসায় যাব। ভেতরে ঢুকবো না। যাবে?”
এক পলক তাকালো ইতমিনান। তার অর্ধাঙ্গী চোখে মুখে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
••
কলিং বাজালো মালিহা। দাঁড়িয়ে রইলো ছায়ার দিকে। রোদ চড়াও হয়ে উঠছে। একজন লোক এগিয়ে এলো দরজার দিকে। মালিহা, ইতমিনানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল, “কাকে চাই?”
মালিহা বলল, “আজিজা আন্টি আছেন? বা তিশা?”
“কেউ নেই। দুজনেই একটু বাইরে গেছে। তোমাকে তো চিনলাম না।”
“আমি কিছুদিন তিশাকে পড়িয়েছিলাম। গত দেড় মাস আগে ছেড়েছি। আপনি?”
“ওহ। আমি তিশার বাবা।”
লোকটা দরজায় দাঁড়িয়েই কথা বলল। তাকে পেয়ে মালিহা যেনো চাঁদ হাতে পেলো। হাতের ম্যাগাজিন খুলে “গোল্ডেন বার্ড” বের করে কেঁচি গেটের ফাঁকা দিয়ে লোকটার দিকে ধরে বলল, “আঙ্কেল এই দেখুন! এটা তিশার লেখা গল্প। নামকরা ম্যাগাজিনে ছেপেছে। আন্টিকে বলেছিলাম। উনি সম্ভবত আপনাকে বলেননি। আপনি একটু দেখবেন আঙ্কেল। আল্লাহর রহমতে তিশার অসাধারণ গুণ আছে। সেটাকে এভাবে ম’রে যেতে দিয়েন না!”
ম্যাগাজিন হাতে দাঁড়িয়ে রইলো লোকটা। মালিহার আকুল কন্ঠস্বর তাকে ছুঁয়েছে কি না বোঝা গেলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মালিহা আবার বলল, “আপনার মেয়ে, আমি ওকে যতোটা ভালবাসি তার চেয়ে নিঃসন্দেহে আপনি বেশি ভালোবাসেন। আশা করব আপনিও আন্টির মতো ভুল করবেন না। আসি আঙ্কেল। আসসালামু আলাইকুম।”
পিছু ফিরল দুজনে। মালিহা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো গল্পের এদিক ওদিকে ছুটে বেড়ানো তিশার বাবার চোখ।
••
মালিহার জেদে তাকে নিয়ে এসেছে ইতমিনান। আসার আগে চারদিকে চোখ বুলিয়েছে। লালপাহাড়কে কোথাও দেখেনি। সম্ভবত তাকে না পেয়ে পেয়ে এই রাস্তা আসা ছেড়ে দিয়েছে কুকুরটা। ব্যাপার না। মানিকের কাছে গেলেই তাকে পাওয়া যাবে।
ঘরে কেমন গুমোট গন্ধ। কয়েকদিন আটকা থেকেই এই অবস্থা। ব্যাগ রেখেই দরজা জানালা খুলে দিলো মালিহা। বারান্দার দরজা খুলতেই এক ফালি রোদ ঝপ করে মেঝেতে পড়ল। সেই ক্ষণে শোনা গেলো যোহরের আযান। ইতমিনান দ্রুত গোসল করে বের হলো। মালিহাকে বলে বের হলো মসজিদের উদ্দেশ্যে। এবার মালিহা কোমর বেঁধে নামলো। ছোট্ট দুটো ঘর। আসবাবপত্র একেবারেই কম। সেগুলোই ঝেড়ে মুছে গুছিয়ে ফেললো। জানালা দরজায় মাকড়সার জাল ঝুলছে। সেগুলো পরিষ্কার করে ঘর ঝাড়ু দিলো। মেঝে মুছলো পানিতে কাপড় ধোয়ার পাউডার মিশিয়ে। এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময়ের মাঝে ঘর পরিষ্কার হয়ে গেলে গোসল ঢুকলো সে। ইতমিনান আসার আগেই নামাজে দাঁড়ালো।
ইতমিনান এলো আরেকটু দেরিতে। দুপুরের খাবার কিনলো বাইরে থেকে। ঘরের ভেতরে আসতেই তার চোখ জুড়িয়ে গেলো। তার ঘরে শোভা পাচ্ছে নতুন এক ফুল। যেই ফুল দুহাত তুলে মোনাজাত ধরেছে তার রবের কাছে। চারদিকে তাকালো ইতমিনান। ঘরের পরিবর্তন সহজেই চোখে ধরা পড়ল। প্লেট এনে সাজিয়ে ফেললো দুজনের খাবার।
নামাজ সেরে চটপট খেতে বসলো মালিহা।
“কি যে ক্ষুধা লেগেছে!”
“এতো কাজ করতে গিয়েছিস কেনো?”
“আবার তুই করে বলছো! আমার বাড়ির কাজ কে এসে করে দিয়ে যাবে?” হাসলো ইতমিনান। সুখের হাসি।
“শোনো, একটু হলে যাবো।”
“আচ্ছা।”
“তুমি অপেক্ষা করবে। তোমার সাথেই আবার চলে আসবো।”
“কেনো?”
“আমি হলে আর থাকবো না। খুব দরকার হলে তখন থাকবো। দরকারি জিনিসগুলো নিয়ে আসবো।”
“এতদিনের বান্ধবীদের ছেড়ে আসতে মন চাইবে?”
মালিহা মাথা নাড়ল। মনে মনে বলল, “বান্ধবীদের চেয়েও প্রিয় জিনিস পেয়েছি। মন চাইবে শুধু? অলরেডি চাইতে চাইতে লাফালাফি করছে।” কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে মালিহা বলল, “তুমি কিন্তু এখনো বললে না এই শহরে কেনো চাকরি নিলে।”
“চাকরি তো পাওয়া লাগে। বাড়ির কাছাকাছি কোথাও যখন পাচ্ছিলাম না তখন ভাবলাম এদিকেই আসি। দূরে যখন থাকতে হবে এখানেই থাকি।”
আর কিছু বলল না ইতমিনান। তবে মালিহা বুঝে নিলো অব্যক্ত কথাটুকু।
শেষ বিকেলে ব্যাগভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে ফিরল মালিহা। ইতমিনানের পুরাতন চাদর পাল্টে নতুন চাদর বিছিয়ে দিল। ডায়নিং রুম সাজালো কিছু পেইন্টিং, ফুলদানি দিয়ে। পাপোশ বিছিয়ে দিলো দরজার সামনে। টুকিটাকি জিনিস দিয়ে সাজিয়ে ফেললো তার ছোট্ট সংসার। এশার নামাজ পড়ে যখন ইতমিনান বাড়ি ফিরল তখন বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে আমূলে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ইতমিনান। এই বুঝি যত্নের ছোঁয়া!
••
একদিন গভীর রাতে মিলি ফোন দিলো। ঘুমন্ত চোখে ফোন রিসিভ করলো ইতমিনান। মস্তিষ্ক চালু হওয়ার আগেই তার কর্ণকুহর ভেদ করে প্রবেশ করলো গগনবি’দারী চিৎকার।
রাত জাগার কারণে ইতমিনান ফজরে উঠতে পারেনি। এজন্য আয়েশা তাকে একটু পর পরই বকছেন। ইতমিনান মুখ গোজ করে আছে। যার জন্য করে চুরি, সেই কয় চোর। রাতটা সে জাগলো কার জন্যে? ফজর কি ইচ্ছে করে মিস করেছে সে? যেনো তার কষ্ট লাগছে না! জোরে জোরে প্যান্ট ঝাড়ল ইতমিনান। সেই শব্দ শুনতে পেয়ে আয়েশা ঐ ঘর থেকে রুগ্ন গলায় ধমকে উঠলেন, “বেয়াদব! রাগ দেখাস কার সাথে? তোর রাগের ধার ধারি না আমি। আল্লাহ যখন প্রশ্ন করবেন তখন কি উত্তর দিবি? মায়ের সেবা করতে যেয়ে নামাজ কাযা হয়েছে? মাফ চাই! এমন সেবা সারা জীবনে আমার দরকার নাই।”
ইতমিনান জামাকাপড় পাল্টে মায়ের কাছে গেলো। সোজা কপালে হাত দিয়ে জ্বরের অবস্থা দেখলো। হাঁফ ছেড়ে বলল, “আমি যাচ্ছি।” আড়চোখে একবার পাশে ঘুমিয়ে থাকা মালিহার দিকে তাকাতে ভুললো না। আয়েশা বললেন, “ওকে এভাবে রেখে যাচ্ছিস কেনো? ভার্সিটিতে দিয়ে আয়।” ইশারা করলেন মালিহার দিকে। ইতমিনান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “যাবে না। ঘুমানোর আগে আমাকে বলেছে। আচ্ছা যাই। আসসালামু আলাইকুম।” ধরাম দরজা লাগিয়ে তালা দিয়ে গেলো ইতমিনান। ডুপ্লিকেট চাবি মালিহাকে দেখিয়ে দিয়েছে। কাজেই চিন্তা নেই।
দরজা বন্ধ করার শব্দে আয়েশার মেজাজ খিঁচড়ে এলো। মালিহা কেঁপে উঠল। পরপর চোখ খুলে আশপাশে তাকালো। কাঁচা ঘুম ভাঙার ফলে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। আয়েশা বেগম সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলেন, “একটা কাজ যদি ঠিক করে করতে পারে!”
উঠে কতক্ষন বসে রইলো মালিহা। বাথরুমের দিকে গেলে আয়েশা ভাবলেন হাতমুখ ধুতে যাচ্ছে। কিন্তু অনেকটা সময় পর মালিহা বের হলো বালতি হাতে। ফ্ল্যাটের বারান্দাটা একেবারে এইটুকু। মালিহার কাছে মনে হয় যেন পুরান ঢাকার রাস্তা। সেখানে বেঁধে রাখা দড়িতে কোনরকমে কাপড় মেলে দিলো সে। রাতে তার আর আয়েশার পাল্টে রাখা কাপড় বাথরুমেই দলা পাকিয়ে রেখে দিয়েছিল। সেসব ধুতে যেয়ে শাড়ির পাড় ভিজে যাওয়ায় নিচের দিকে জড়িয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। কুচি ধরে এগিয়ে এলো ঘরে। আয়েশাকে বলল, “চাচী কি খাবেন আপনি?”
আয়েশা নীরবে মালিহাকে পরোখ করছিলেন। মনে মনে মেয়েটার প্রতি মুগ্ধ হতে বাধ্য হয়েছেন। তার চোখে ভাসছে শুধু কাল রাতে ঝাপসা চোখে দেখা সেই দৃশ্যটা। ছেলের বুকে মাথা এলিয়ে পড়ে ছিলেন। তখন কোমল ছোঁয়ায় তার কষ্ট লাঘব করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে মেয়েটা। কুচিন্তায় যাকে দুর ছাই করছিলেন তার সাহায্যের মুখাপেক্ষী করিয়ে দিলেন সৃষ্টিকর্তা। কি নিদারুণ খেলা!
“মুখটা তিতা তিতা লাগছে। কিছু খাবো না।”
“কিছু না খেলে তো ওষুধ খেতে পারবেন না।”
“ওর ঘরে যে কি আছে তাও তো ভালো জানি না। কাল। এক প্যাকেট সুজি দেখেছিলাম। ওটাই নিয়ে এসো।”
“দুধ তো নেই।”
“পানি দিয়ে জাল দিয়ে আনো।”
মালিহা রান্নাঘরে গেলো। সুজি এনে আয়েশার কাছে দিকে তিনি নিজেই খেলেন। বাটির সবটা খাবার শেষ করে শান্ত বললেন, “লবণ দিতে বোধহয় ভুলে গেছিলে। খেয়াল রেখো।”
জিহ্বায় কামড় দিলো মালিহা। একদমই ভুলে গেছে।
“তুমি কি খাবে?”
“চা আছে দেখলাম। এক কাপ চা আর বিস্কুট খেলেই হবে।”
“তোমার পরীক্ষা না?”
“জি।”
“কবে থেকে?”
“কাল থেকে শুরু।”
“তাহলে আজকে চলে যাও। আমি আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। ইতুর বাবাকে বলবো এসে নিয়ে যেতে। তুমি যেয়ে পড়াশোনা করো।”
মালিহা মাথা নিচু করে বলল, “বই নিয়ে এসেছি চাচী। সমস্যা নেই। কালকে পরীক্ষা শুরুর ঘন্টাখানেক আগে চলে গেলেই হবে। আপনাকে এভাবে রেখে যাবো না।” মাথা নাড়ল মালিহা। আয়েশার কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেলো। কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। মালিহা পাশে বসেই গুনগুন করে পড়তে লাগলো।
••
মালিহা তখন রান্নাঘরে। তরকারি সাজিয়ে বসে আছে। কিন্তু কি যে রান্না করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। ভাবলো একবার আয়েশার যাচ্ছে যেয়ে শোনে। কিন্তু তার গম্ভীর প্রতিচ্ছবি মনে ভয় ধরিয়ে দিলো। অস্বস্তিতেই আর গেলো না সে। নিজের মতো করেই রান্না করতে শুরু করলো।
মিলির কাছে কথায় কথায় মালিহার কথা বলতেই মেয়েটা ক্ষেপে উঠলো যেন।
“আমি জানতাম ঐ মেয়ে ভাইকে ঘোল খাইয়েছে।”
“তোর ভাই নিজেই খেয়েছে। ওকে খাওয়ানো লাগেনি।”
“ফালতু কথা বলবে না মা। তুমি বাড়ি আসো। এবার ভাইয়ার একটা বিয়ে দিয়েই ছাড়বো।”
“সেবা টেবা পাচ্ছি ভালোই লাগছে। আর দুইদিন পরে যাবো ভাবছি।”
মিলির কপালে ভাঁজ পড়ল, “কে তোমার সেবা করছে এতো? ভাইয়া?”
“না। মালিহা।”
“মালিহা! ও কোত্থেকে এলো?”
অসুস্থতার ঘটনা জানালেন আয়েশা। মিলির সন্দেহ মাখা উত্তাপে যেনো আগুনের হলকা বয়ে গেলো।
“মা! ভালো চাইলে ওকে বের করো। তোমার ছেলের বাড়িতে ও কেনো এসেছে? ইচ্ছে করে এতো থাকার মানে কি! তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছো না?”
“পারছি।”
“তাহলে!” অস্থির হয়ে উঠল মিলি
“আরেকটু বোঝার বাকি আছে। তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবো।”
“কিসের সিদ্ধান্ত? মা! তোমার কথাবার্তা আমার কাছে ভালো লাগছে না। ভবিষ্যতে যেনো আমি বাপের বাড়ি যেতে না পারি সেই ব্যবস্থা করবে না দয়া করে।”
“আচ্ছা। একটা কাজ কর। মালিহার নাম্বার আছে তোর কাছে?”
“আছে। কেনো?”
“জামাইকে বলে দোকান থেকে ওর নাম্বারে পাঁচ হাজার টাকা পাঠা।”
“কি আশ্চর্য! কেনো?”
“আমি বলছি তাই। তোর কাছে থাকলে দে। আমি বাড়ি যেয়ে দিয়ে দেবো। না থাকলে ম্যানেজ করে দে।”
“তোমার মাথা পাগল হয়ে গেছে মা!”
ক্ষোভের সাথে শুরু করলেও কথাটা আর্তনাদ করে শেষ করলো মিলি। তার মায়ের আর বুদ্ধি হলো না!
যোহরের সময় যখন মালিহার ফোনে ম্যাসেজ এলো সতর্ক চোখে তাকালেন আয়েশা। ম্যাসেজ পড়তে পড়তে মালিহার চোখ প্রকাণ্ড আকার ধারন করলো। আয়েশা নীরবে সবটা দেখার উদ্দেশ্যে বালিশে হেলান দিলেন। এক ভুল তিনি দুইবার করবেন না।
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫১
কেউ তাকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। মালিহা দিন দুনিয়ার সব হিসাব করেও পেলো না কে তাকে টাকা পাঠাতে পারে। হঠাৎ ইরিনার নাম মাথায় এলো। কিন্তু সে তো তার কাছে চার হাজার টাকা পেতো। পাঁচ হাজার নয়। তবুও তৎক্ষণাৎ তাকে ফোন দিলো মালিহা। ভেসে এলো পুরোনো সেই কণ্ঠ। জানালো ইরিনা ব্যস্ত আছে। মালিহা বুঝলো তার নাম্বার এখনও ইরিনার ফোনের ব্ল্যাক লিস্টেই পড়ে আছে। তাহলে কে দিতে পারে? মেসেজে দেখানো নাম্বারে ফোন দিলো মালিহা।
“হ্যালো কে?” ফ্যাসফ্যাসে একটা পুরুষ কণ্ঠের শব্দ এলো। হকচকিয়ে গেলো মালিহা। এবার কি বলবে? আমতা আমতা করে বলল, “এই নাম্বার থেকে একটু আগে আমার রকেটে পাঁচ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে।”
“তো?”
“কে পাঠিয়েছে এটা আমি জানতে চাই।”
“আজব কারবার! কাস্টমারের বংশ পরিচয় রেখে দেই আমরা? আমরা তো ভাই পুলিশ না। সারাদিন কতো মানুষ এসে টাকা পাঠায়, টাকা তোলে সবার কথাও তো মনে থাকে না। তার উপর আবার কে পাঠাইসে এইটা কেমনে বলবো! মাফ করেন।”
খট করে লাইন কেটে গেলো। লোকটার উত্তর যুক্তিসঙ্গত। এতো মানুষের খোঁজ তারা জানবে কিভাবে। আর তার নাম্বারে কে টাকা পাঠিয়েছে এটা বের করা দুঃসাধ্যই বটে। মুখ কালো করে ডাল নামিয়ে রেখে রান্নাঘর পরিষ্কার করলো সে। আবার ঘরে যেতেই আয়েশা বললেন, “কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
“কে যেনো আমার নাম্বারে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছে চাচী! কিন্তু কে পাঠাবে?”
মালিহার চিন্তিত জবাব। আয়েশা বললেন, “হয়তো তোমার পরিচিত কেউ।”
“না আমার পরিচিত কারো কাছে আমি এতো টাকা পাই না।” মাথা নাড়ল মালিহা।
“তাহলে তো ভালই হলো। বিনা পরিশ্রমে পাঁচ হাজার টাকা পেয়ে গেলে। রেখে দাও।”
“কি বলেন চাচী! কার না কার টাকা! হয়তো আমাকে ভুল করে পাঠিয়েছে। আজকের দিনটা দেখি। যে পাঠিয়েছে সে তো বুঝবেই যে ভুল জায়গায় টাকা গেছে।” ভাবুক স্বরে বলল মালিহা। আয়েশা মেয়েটার চেহারা পরোখ করলেন। দেখতে চাইলেন চেহারার ভাঁজে কোথাও কৃত্রিমতা আছে নাকি। এই মেয়েকে তার ছেলে পছন্দ করেছে। নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে। সেই মেয়েটার চরিত্র সম্পর্কে মা হয়ে খোঁজ নেয়া তার দায়িত্ব। মিলির শঙ্কা মালিহা লোভী এবং এই কারণেই তার সাথে ইতমিনানের বিয়ে হলে মিলি আর তার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে না। লোভী মেয়েটা রাখতে দেবে না। আয়েশা ঠিক সেকারনেই মালিহাকে পরীক্ষা করে নিতে চাইছেন। গত রাতে মেয়েটার আচরণে তার মন নরম হয়েছে। শুধুমাত্র মতি বা নাজিয়ার মেয়ে হিসেবে দূরে ঠেলে দেয়াটা তার কাছে অন্যায় মনে হচ্ছে। মালিহাও যদি এমন মনে করতো তাহলে তো পরীক্ষা সামনে রেখে তার কাছে ছুটে আসত না। কাজেই তিনি সুন্দর একটা সিদ্ধান্তে আসতে চান। মালিহা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ছেলেকে নিষেধ করার আর কারণ থাকবে না। আর যদি সে পাঁচ হাজার টাকাকে সম্বল করে এগিয়ে যায় তবে তার স্বরূপ ইতমিনানের সামনে তুলে ধরতে তিনি কসুর করবেন না। হয়তো বিষয়টা আহামরি কিছু নয়। তবুও এর মধ্য দিয়েই মালিহার মানসিকতা যাচাই করবেন তিনি।
••
ইমারজেন্সি কারণ দেখিয়ে ইতমিনান হাফ ডিউটি করে বেরিয়ে গেলো। পরিচিত এক ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়েশার জন্য কিছু খাবার কিনলো। ভেবেছিল বাড়ি যেয়ে গোসল করে তারপর নামাজে যাবে। কিন্তু সময় সংকুলান হলো না। পথেই আযান দিয়ে দিলে নামাজ পড়ে নিলো ইতমিনান। অন্ধকার আকাশ দেখতে দেখতেই বাড়ি পৌঁছুল। কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকক্ষণ। এই প্রথম বাড়িতে কেউ আছে। তার মন চাইলো না কষ্ট করে তালা খুলতে।
মিনিট তিনের মাঝে ওপাশ থেকে খুটখাট শব্দ হলো। দরজার নব ঘুরলে মুখ ওঠালো ইতমিনান। শাড়ি পরিহিতা মালিহাকে দেখে মনে হলো এ তার বহু আকাঙ্খিত স্বপ্ন। দৃশ্যটাকে স্বপ্ন রূপ দিতেই যেনো মালিহা বলল, “ব্যাগ আমাকে দাও।”
অভিভূতের মতো ব্যাগ এগিয়ে দিলো ইতমিনান। মালিহা চলে গেলো। ইতমিনান দম ছাড়লো। পরিস্থিতি তাকে, তার মনকে আরো অবাধ্য করে তুলছে।
দুপুরে যখন মালিহা খাওয়ার তদারকি করলো, আয়েশার দেখভাল করলো তার পুরোটা সময় ইতমিনান মুখ নামিয়ে রাখলো। ভুল করেও মালিহার দিকে তাকালো না। তার স্বপ্নদৃশ্য তাকে হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। ইতমিনানের বুকটা দ্রুত গতিতে শব্দ করে। বারবার মনে হয় আয়েশাকে আরেকবার বোঝায়। আর একটা বার। একটা শেষ চেষ্টা। ভাবনা অনুযায়ী মুখ তুলতেই দেখে আয়েশা তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। ছেলের গোমড়া মুখ তার নজর থেকে আড়ালে যায়নি। তিনি মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেছেন সবটা। তবুও হুট করে কিছু করবেন না আয়েশা। বয়স হয়েছে। অভিজ্ঞতার ভারে চুলে পাক ধরেছে। ভুল করেছেন, শিক্ষাও নিয়েছেন। সেই শিক্ষা দিয়েই মালিহাকে যাচাই করবেন। ছেলের দুইদিনের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে তার ভবিষ্যত অদেখা করার মতো বোকা তিনি নন।
ইতমিনান ওষুধ খাইয়ে গেলে মালিহা ইতস্তত করে আয়েশার সামনে বসলো। এক নজর বারান্দায় ভেজা কাপড়ে দিকে তাকালো। মেঘলা আকাশের পর্দায় সূর্য গা ঢাকা দিয়েছে। রোদের উত্তাপ, উষ্ণতা কোনোটাই নেই। সকালে ধুয়ে দেয়া কাপড়গুলো সেই অবস্থায়ই আছে। ফলে গোসল করার ইচ্ছে থাকলেও তা পূরণ হয়নি। আয়েশার শাড়ি পড়েই দিন কাটাতে হচ্ছে।
“চাচী! ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
আয়েশা কাত হয়ে ছিলেন মালিহার বিপরীতে। তার কথায় উঠে বসলেন।
“না ঘুমাইনি। কিছু বলবে?”
বারকয়েক ঢোক গিলে মালিহা বলল, “চাচী বাবা মায়ের উপর রাগ রাখবেন না। অনেক সময় আপনাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে। একজন তো চলেই গেলো।”
চুপ করে গেলো মালিহা। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই মা কেমন যেনো হয়ে গেছে। আমার মায়ের উপর রাগ রাখবেন না চাচী। বাবাকেও মাফ করে দিয়েন।”
আয়েশার হাত জোড়া মুঠোয় নিলো মালিহা। তৎক্ষণাৎ আয়েশাকে ক্ষমা করে দিলো পূর্ববর্তী সকল তিক্ত কথার জন্য। সে ক্ষমা চাইছে তাহলে নিজে কেনো ক্ষমা করবে না?
আয়েশা ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন, “কেমন হয়ে গেলেও কথা শোনাতে ভোলেনি। তোমার মামা বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলো। ইতুর বাবা গেলো বোঝাতে। তাকে যা নয় তাই বলল। আমাকেও বাদ রাখলো না। যাক তার বুদ্ধি শেষ হলেও তোমার যে হয়নি দেখে খুশি হলাম।”
মালিহা চুপ করে রইলো। একবার বলতে চাইলো কথা তো আপনিও শুনিয়েছেন চাচী। আর বলল না। কথায় কথা বাড়ে। সে চায়না পুরোনো তিক্ত ঘটনার রেশ ধরে ভবিষ্যত নষ্ট করতে।
••
রাতে ভয়ে ভয়ে মায়ের কাছে গেলো ইতমিনান। মালিহা তখন নামাজ পড়ছে। আয়েশার হাত ধরে নিয়ে এলো আরেক ঘরে। আয়েশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
“মা।”
“বল। কি হয়েছে?”
ইতস্তত করলো ইতমিনান। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “তোমার শরীর এখন কেমন?”
“ভালো। কি বলতে চাচ্ছিস সোজাসুজি বল।”
“মা মালিহার ব্যাপারে আরেকবার যদি ভাবতে..”
আয়েশা চোখমুখ শক্ত করে বললেন, “এক কথা বারবার বলবি না।” ছেলের হাত ছাড়িয়ে ঘরে চলে গেলেন আয়েশা। ইতমিনান দাঁড়িয়ে রইলো শক্ত পাথরের ন্যয়। শেষ চেষ্টাটুকু বিফলে গেলো। নিজেকে ধিক্কার জানালো ইতমিনান। পছন্দের সম্মান আদায়ের সামর্থ্য যেহেতু তার নেই কাজেই পছন্দ করার অধিকারও তার নেই। মাথা নিচু করে দরজা আটকালো ইতমিনান। দরজার হাতলে হাত রেখে সে হঠাৎ বুঝতে পারলো তার মনে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়া অনুভূতিকে বের করে দেয়ার সময় এসেছে। অবচেতন মনে যাদের রেখেছিল খুব যতনে, পূর্ণ জ্ঞান থাকাবস্থায় তাদের মন কুঠুরি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে হবে। নিজের কাছেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো ইতমিনান। আর কখনও মালিহার দিকে ইচ্ছা করে তাকাবে না। মালিহা কেনো, আর কোনো মেয়ের দিকেই সে তাকাবে না। অপারগতার যন্ত্রণা মাখা লালাভ আঁখি জোড়াকে নেত্রপল্লবের কোমল আবরণে ঢেকে শুয়ে পড়ল ইতমিনান। অনুভূতিহীন হওয়ার সময় বোধহয় এসে গেছে।
••
আয়েশা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মালিহা গোছগাছ করে নিলো। পরীক্ষা দশটা থেকে শুরু। ঘড়িতে এখন আটটা ত্রিশ। কয়েকটা রুটি বানিয়ে আলু ভাজি করে সকালের নাস্তা সেরেছে সবাই। আয়েশা বলেছেন দুপুরের রান্না তিনি নিজেই করতে পারবেন। ভরসা পেয়ে মালিহা আর রান্নায় হাত লাগায়নি। গোছাতে গোছাতে বিড়বিড় করে বলল, “আজকেই টাকা তুলে কাউকে দিয়ে দেবো। এই পাঁচ হাজার টাকার চিন্তায় আমার ঘুম আসছে না। এখনি দিয়ে যাবো। নাহলে পরীক্ষাও দিতে পারব না। ঝামেলা!” হিজাবের শেষ পিন লাগিয়ে আয়েশার কাছে গেলো সে। আয়েশা পুরো কথাটাই শুনলেন।
“চাচী আপনি বললে আমি পরীক্ষা দিয়ে এখানে চলে আসবো।”
“সমস্যা নেই। এখন তো সুস্থ হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ্। তুমি ভালো মতো পড়াশোনা করো।”
মালিহা মাথা নাড়ল। ইতমিনান দরজা খুলেছে। সেই শব্দে ঘর ছেড়ে বের হলো সে। ইতমিনানকে দেখে বলল, “ভাইয়া এখানে আশেপাশে কোনো দোকান থেকে ক্যাশ আউট করা যাবে? রকেটে?”
জুতার ফিতার দিকে মনোযোগ দিয়ে ইতমিনান উপরে নিচে মাথা নাড়ল।
“যাক বাঁচলাম! তুমি তো জানো না! কে যেনো আমাকে কালকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। সারাদিন সারারাত অপেক্ষা করলাম কেউ ফোন দিয়ে টাকার কথা বলবে। কারো কেনো খোঁজই নেই। এই টাকা এখুনি তুলে আমি কাউকে দিয়ে দেবো। নাহলে আমার অশান্তি লাগছে। তোমার পরিচিত কেউ আছে যাকে দেয়া যায়?”
এবারও মাথা নাড়ল ইতমিনান। আছে। সে বের হলে মালিহা তার পিছু নিলো। মালিহা আয়েশার দিকে তাকিয়ে সালাম দিলে তিনি মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আড়চোখে দেখলেন ছেলের লালাভ আঁখি। কিন্তু ইতমিনান এর কিছুই দেখলো না। মালিহাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিলেও পুরো রাস্তায় মেয়েটার দিকে সে তাকালো না। একবারের জন্যও না।
••
এক মাসের মাথায় মালিহার পরীক্ষা শেষ হলো। বাড়ি থেকে জরুরী তলব এলো। ডাকা হলো ইতমিনানকেও। একই ট্রেনে দুজনে আবার ছুটলো বাড়ির পথে। মনকে শক্ত শেকল পড়ালো ইতমিনান। একই ভুল বারবার করে নিজেকে পুড়িয়ে অঙ্গার বানাতে চায় না সে।
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫২
ট্রেন ছাড়তেই নীতিকে ফোন দিলো মালিহা। নীতি রিসিভ করলো সাথে সাথেই।
“কি রে! কই আছিস এখন?”
“ট্রেনে। ছাড়লো মাত্র।”
“ছেড়েও দিয়েছে!”
“হ্যাঁ।”
“তোর উজবুক ভাইটা কই?”
“উজবুক বলছিস কেন?” মুখ কুচকে নিলো মালিহা।
“আমার কাছে লাগে তাই। সে কোথায়?”
ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো মালিহা। কোথাও দেখা গেলো না ইতমিনানকে।
“আশপাশে তো দেখছি না।”
“দেখ তোকে রেখে কোথাও কেটে পড়ল নাকি!”
“অসম্ভব!” দৃঢ় স্বরে বলল মালিহা
“এত্তো কনফিডেন্স! বাব্বাহ!”
মালিহা কিছু বলল না। নীতি আফসোস করে বলল, “পরীক্ষা শেষ। কই ভাবলাম শাড়ি টাড়ি পরে ছবি তুলে ব্যাটার মাথা ঘুরাবো আর তুই গেলি চলে।”
“তুই ভালো মানুষটাকে এতো জ্বা’লাস নীতি!”
“আসছে আমার ভালো মানুষ! এহ! আমার ভাল্লাগে তাই জ্বা’লাই। সেজেগুজে ছবি পাঠাবো। ব্যাটা সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে দেখবে আর দুঃখ দুঃখ কণ্ঠে গান গাবে, “কেমনে বাধিব হিয়া! মোর প্রিয়া আনবাড়ি যায় লাল শাড়ি গায় দিয়া!” খিলখিল করে হেসে উঠলো নীতি। হাসি ফুটলো মালিহার ঠোঁটেও।
“শাড়ি পড়বি তুই, জামাইকে ছবিও পাঠাবি তুই। তাহলে আমি থাকলেই কি আর না থাকলেই কি?”
“একা একা শাড়ি পড়তে ভাল্লাগে না।”
“আপুদের নিয়ে পর।”
“হ গর্ধব! আপুরা তো আমার সই লাগে!”
“কোনটা পড়বি?”
“ভাবসিলাম তোরা যেইটা দিসিশ ঐটা পড়বো।”
“সত্যি! আমাকে কিন্তু ছবি দিবি নীতি! তোকে একবার ঐ সেটটা পরে দেখতেও পারলাম না।” দুঃখ করে বলল মালিহা।
নীতি গম্ভীর কন্ঠে বলল, “এসব কথা বাদ দে দোস্ত। আমার কথা শোন। আমি ড্যাম শিওর এইবার তোর গলায় কাউরে ঝুলানোর ব্যবস্থা করছে।”
“তোমার খালি এইসবই মনে হয়। আগের বার কি বলসিলি মনে আছে? শুধু শুধু ভাইয়ার নামে মিথ্যা কথা। আর ফুপু অসুস্থ। এজন্য যাচ্ছি। ভুলে গেলি?”
“তোমার ভাইয়্যা যে মনে মনে তোমার সাইয়্যা হইতে চায় এইটা আমি জানি। কিন্তু ব্যাটা হঠাৎ এমন ঠান্ডা মে’রে গেলো কেন তাই তো বুঝলাম না।” ভাবুক কণ্ঠে বলল নীতি। আবার নিজেই বলল, “থাকলো কথা অসুখের? সব বাড়িতেই দুই চারটা মানুষ অসুস্থ হয় একটা বিয়ে দেয়ার জন্যে।”
“ফালতু কথা বলবি না! ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখছে। বিয়ে হবে।”
“মেয়ে দেখলেই বিয়ে হয়ে যায় না রে পাগলা! শোন মাগনা দুইটা উপদেশ দেই। এক নাম্বার উপদেশ বিয়ের কথা শুনে মনে লাড্ডুও ফাটাবি না আবার নার্ভাস হয়ে অক্কাও পাবি না। ঠান্ডা মাথায় ভাবনা চিন্তা করবি। লাইফটাইমের বিষয়। আর দুই নাম্বার উপদেশ হলো এক নাম্বার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবি।”
মালিহা নিশ্বাস ছাড়ল, “ভাবছিলাম বিয়ে হইলে তোর মাথার তার দুই একটা দুলাভাই ঠিক করে দিবে। কিসের কি! আমার আশা ভঙ্গ!”
“গরীবের কথা বাসি হইলে সত্যি হয়। এখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি হইলাম বড়লোক। আমার কথা টাটকাই সত্যি হবে দেখিস। ইনশাআল্লাহ্।”
মালিহা ফোন রেখে দিল। এই পাগলের কথা শুনতে শুনতে কবে না সে নিজেই পাগল হয়ে যায়। তবে নীতির একটা কথা ফেলনা নয়। ইতমিনানের চাহনি কয়েকদিন তাকে ভাবতে বাধ্য করেছিল। সে ভেবেছিল ইতমিনান হয়তো তাকে পছন্দ করে। ভাবনাটা মনে অস্বস্তির জন্ম দিলেও খারাপ লাগা সেখানে স্থান পায়নি। মানুষ হিসেবে ইতমিনান ভালো। ভালো মানুষের পছন্দ বলেই বোধহয় খারাপ লাগেনি। মাঝে মাঝে মনে হতো ইতমিনান নীরবে কিছু বলতে চাইছে। তবে সে চেষ্টা করেও কোনোদিন বুঝতে পারেনি। দুর্বোধ্য সে ভাষা। তারপর হঠাৎ করেই সে কেমন পাল্টে গেলো। পাল্টে গেলো বলাও পুরোপুরি ঠিক হবে না। মানুষটা সে একই আছে তবে তার প্রতি আকুল সেই চাহনিটা আর নেই। গত একটা মাসে না তাকে দরকার ছাড়া কল দিয়েছে নাই বা অপ্রয়োজনে কোনো কথা খরচ করেছে। কোনোদিন সুযোগ পেলে মালিহা শুনবে ইতমিনান তার কথার বাক্সে তালা ঝুলিয়েছে কি না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার দিকে তাকালো মালিহা। এবার জানালার পাশে সিট পায়নি। তবুও বেশি একটা খারাপ লাগছে না। আবার ভাবনায় ডুব দিল মালিহা। ইতমিনানের সাম্প্রতিক ব্যবহারের কারণে তার মনে হয়েছে সে বেশি বেশি ভাবনা চিন্তা করেছে। শুধু শুধু উদ্ভট কিছু চিন্তা করে অবাস্তব একটা সমীকরণ দাঁড় করাতে চেয়েছিল সে। এটাই এখন মনে হয়। আবার তিন দিকে তাকালো মালিহা। ইতমিনান কি তার থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে? কি আশ্চর্য!
••
ভাগ্যক্রমে এবার জানালার পাশে সিট পেয়েছে ইতমিনান। মালিহা পায়নি। একবার ভেবেছিল মালিহাকে বলে তার সিটে এসে বসতে। পরপর মনকে শাসিয়েছে। জানালার পাশে না বসলে আহামরি কিছু হবে না। কিন্তু মালিহার সাথে কথার সুতো বাড়তে থাকলে ইতমিনানের ক্ষতি হবে। ভ’য়াবহ ক্ষতি। এতদিনের কঠোর সংযম এক নিমেষে ভেঙে যাবে। ইতমিনান নিজেকে আর কষ্ট দিতে চায় না। মালিহা তার জায়গায় ভালো থাকুক। ইতমিনানও ভালো থাকতে চায় নিজের জীবনে।
সিটে মাথা এলিয়ে দিলো ইতমিনান। লালপাহাড় এবার বাড়ির সামনে এসে এসে ঘুরে যাবে। মানিককে যদিও বলে এসেছে তবে মানিক বলল কুকুরটা নাকি তার কথা শোনে না। নিজের নিয়ম অনুযায়ী ইতমিনানের বাড়ির সামনে যেয়ে অপেক্ষা করে। সেই সন্ধ্যায়ও যখন সে ফেরে না তখন লালপাহাড় প্রস্থান নেয়। আগের বার বাড়িতে ফেরার সময় এমনই হয়েছে। আয়েশাকে কুকুরটার কথা বললে তিনি যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এটা কুকুরই তো?”
“দেখে কি মনে হচ্ছে তোমার?” ইতমিনান উত্তর দিয়েছিলো।
“দেখতে তো কুকুর। কিন্তু জ্বিন টিন আবার কুকুরের বেশ ধরে থাকতে পারে।” চিন্তিত স্বরে বলেছিলেন আয়েশা।
ইতমিনান অবাক হয়ে বলেছিলো, “আমার পেছনে জ্বিন লাগবে কেনো?”
“ভোলা ভালা ছেলেদের পেছনে লাগতেই পারে। তাদের জ্বা’লানো সহজ। তুই সাবধানে থাকবি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিন কুল পড়ে নিজের গায়ে ফু দিবি। ঠিকাছে?”
“ঠিকাছে।”
হেসে ফেললো ইতমিনান। মায়ের যতো ছেলেমানুষী চিন্তা! পরপর হাসিটা নিভে গেলো। তার কতো ইচ্ছে ছিল লালপাহাড়ের সাথে মালিহার পরিচয় করিয়ে দেবে! সেসব বোধহয় আর হলো না। সব ইচ্ছে দুনিয়ার বুকে পূরণ হয় না। হতে নেই।
••
রাবেয়ার কথা শুনে মালিহা মোটামুটি পর্যায়ের হতভম্ব অবস্থায় আছে। অবচেতন মনের ঝাপসা সন্দেহ যে এভাবে কঠিন বাস্তবতায় রূপ নেবে তা সে চিন্তাই করতে পারেনি।
“কি সব বলো ফুপু!” সংকোচ করে বলল মালিহা। ফোনের ওপাশ থেকে খেঁকিয়ে উঠলেন রাবেয়া।
“কি সব বলি? আমার ভাতিজা কি খারাপ?”
“এসব কথা আসছে কেনো। শুনলাম তুমি সিরিয়াস অসুস্থ। এই তোমার অসুস্থতা!”
“অবশ্যই। ভাইয়ের মেয়ে বেদিশা হয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার চিন্তায় আমার মাথার আগল পাগল অবস্থা। তাহলে আমি অসুস্থ না তো কি?”
“আমি বেদিশা কই! আর এসব শুনেও মা আমাকে কিছু বলল না কেনো?”
“বেদিশা না হলে আমার ভাতিজার চেহারা দেখে একটু হলেও বুঝতে পারতি। আর তোর মা’র তো কোনো চিন্তা ভাবনা নাই। কি বলবে?”
মালিহা কিছু বলল না। সে যে কিছু সন্দেহ করেছিল সেসব বললে ফুপু আরো পেয়ে বসবে।
“তাও। আমি যখন বললাম ফুপু অসুস্থ তাই আসবো। তাহলেও কিছু বলবে না? আর ভাইয়াই বা আসলো কেনো?”
“কারণ তাকে ডাকা হয়েছে তাই।”
মালিহা বোকা বনে গেলো। ফুপা ফোন করে বলেছিলেন ফুপু খুবই অসুস্থ। তাই ছুটে আসা। সে তো ইতমিনানকে এই নিয়ে প্রশ্ন করতে পারত। সেটাও করেনি। মালিহা বলল, “মা পছন্দ করবে না ফুপু। মা’কে কিছু বলো নি না?”
“বললে তো বাড়ি এতক্ষণে রণক্ষেত্র হয়ে যেতো। বাদ দে তুই। ভাবির চিন্তা আমি করবো যদি তুই রাজি থাকিস। ভাবনা চিন্তা কর। সারাজীবনের ব্যাপার। কোনো জোর নাই। কিন্তু ভালো ছেলে একবার হাত ফসকে গেলে পরে কপাল চাপড়ালেও কাজ হবে না। মুরুব্বীর কথা। মন দিয়ে ভাব।”
মালিহা ফোন রেখে দিতে চাইলে রাবেয়া আবার বললেন, “শোন!”
“বলো “
“তোর বাপ কিন্তু তার ভাতিজাকে খুব পছন্দ করত।”
দুর্বল জায়গায় আ’ঘাত। মালিহা স্পষ্ট টের পেলো বাবার কথা শুনতেই তার মন অর্ধেক নরম হয়ে গেছে। মা, ভাই কেউ এসবের কিছু জানে না। নিজে নিজে ভাবতে ভাবতে হয়রান হয়ে পড়লো মালিহা। নীতির কথাগুলো মনে পড়ল। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে বলেছে। কিন্তু মাথায় আ’গুন জ্বা’লিয়ে দিলে সেটা ঠান্ডা থাকে কি করে! রাশেদা তাদের বাড়িতেই ছিলেন। তার কাছে যেয়ে শুয়ে পড়ল মালিহা। রাশেদা নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “শরীর কি অসুস্থ নাকি?”
“না।” দাদির কোলে মুখ গুঁজে বলল মালিহা। রাশেদা মালিহার কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। দরজার দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বললেন, “কি ভাবনা চিন্তা করলা?”
“কিসের?”
“আমার নাতির।”
তড়িৎ উঠে বসলো মালিহা। অবাক চোখে রাশেদার দিকে তাকাতেই তিনি জানালেন এসবই তিনি জানেন।
“ইতু তো সবই বলছে আমার কাছে। সেই দুই মাস আগেই।”
“দুই মাস!”
“হ্যাঁ। কিছু সমস্যার জন্য তোমাকে বলা হয় নাই।” মাথা নাড়লেন রাশেদা। বললেন না বড় বউয়ের অমতের কথা। যার মত পাল্টেছে তার পুরোনো মতের রেশ ধরে খোঁচাখুঁচি করার কোনো মানে হয় না।
মালিহা গাট হয়ে বসে রইলো। দুই মাস! ইতমিনান তাকে কতদিন ধরে পছন্দ করে? তার আগের ভাবনাগুলোই তাহলে ঠিক ছিল? হঠাৎ অভিমান মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। এতো বছরের সম্পর্কচ্ছেদের পর এখন হঠাৎ করে এই পছন্দের কি মানে? দাদির কাছে অসহায় কণ্ঠে বলল, “আমি কি করবো দাদি? কিছুই বুঝতে পারছি না। মা তো রাজি হবে না।”
“তার কথা পরে। তুমি রাজি থাকলে তাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমাদের। পারিপার্শ্বিক চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের চিন্তা করো।”
ফোন হাতে নিলো মালিহা। মেসেঞ্জারে ঢুকতেই নাজিফাকে অনলাইনে দেখা গেলো। তার কাছে পরামর্শ চেয়ে মেসেজ পাঠাল মালিহা। ক্ষনিকেই উত্তর দিলো নাজিফা।
“আমার মনে হয় দ্বীনের বিষয়ে ধারণা নেয়ার পর মন মানসিকতা সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট। মানসিকতা না মিললে বছরের পর বছর এক ছাদের নিচে থাকলেও মনের লেনা দেন ঘটে না। ফলে বিয়ে দুটো মানুষের হয় এবং তারা সারাজীবন দুইই থাকে। এক আর হতে পারে না।”
পরপর আরো একটা মেসেজ এলো, “আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। তিনি যেনো তোমাকে পথ দেখান। কোনটা তোমার জন্য ভালো হবে সেটা যেনো বুঝিয়ে দেন। আর নিজেও চোখকান খোলা রাখো। হতে পারে তোমার আশপাশের খুব ছোট কোনো বিষয় দিয়েও আল্লাহ ইশারা করতে পারেন। কাজেই, বি অ্যালার্ট!”
ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলো মালিহা। রাশেদা বললেন, “মালিহা, ঐ বাড়িতে আমার একটা ওষুধ রেখে আসছি। একটু এনে দিতে পারবা? মিতুল তো নাই। নাহলে ওকেই বলতাম।”
“যাচ্ছি দাদি।”
ঘোমটা টেনে বাড়ি থেকে বের হলো মালিহা। দুই বাড়ি পরেই মকবুল আলীর ঘর। দরজা ধাক্কা দিলে খুললেন মকবুল আলী নিজেই। মালিহার অস্বস্তি লাগলো। এখন কিভাবে এই বাড়ির মানুষগুলোর মুখোমুখি হবে সে! মনে মনে অনবরত বলতে থাকলো, “আল্লাহ আমাকে সাহায্য করো! আমাকে পথ দেখাও!”
মকবুল আলী উচ্ছ্বসিত হলেন ভাতিজিকে দেখে।
“কতদিন পরে এলি মা! চাচার বাড়ীতে আসতে মন চায় না?”
বিব্রত হাসলো মালিহা। মকবুল আলী তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কাউকে না দেখে মালিহা বলল, “বাসায় আর কেউ নেই?”
“না। ইতু তো বাইরে গেলো সকালেই। তোর চাচী মনে হয় পাশের বাড়িতে গেছে। দাঁড়া ডেকে আনি।”
“থাক থাক। আমি দাদির ওষুধ নিতে আসছি। রেখে গেছে বলল। চাচীকে ডাকার দরকার নাই।” মকবুল আলী জোর করলেন না। নিজের কাজে চলে গেলেন। মালিহা রাশেদার জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে যেয়ে খাটের মাথার কাছে ওষুধটা খুঁজলো। রাশেদা বলেছেন এখানেই আছে। চারপাশে খুঁজেও ওষুধ পেলো না। টেবিলের পাশে ছোট্ট একটা টুল মতো আছে। তার নিচে আবার তিন থাক ড্রয়ার। এক একটা করে সেগুলো খুলে ওষুধের খোঁজ করলো সে। প্রথম ড্রয়ারে পেলো কিছু কটন বাড আর ম্যাচ স্টিক। দ্বিতীয় ড্রয়ারে সেলাই করার সুতা। তৃতীয় ড্রয়ারে ধুলো পড়া কিছু ফাইল। শেষ ড্রয়ার আটকেই আবার খুলে ফেললো সে। মনে হলো যেনো নিজের একটা ছবি দেখলো। কৌতূহল বশত ফাইল বের করে তার উপরের ধুলো সরাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠল কলেজে থাকাকালীন একটা ছবি। কোনো একটা ফর্মের কোণায় পিন করা। নিজের ছবি দেখেই ফাইল খোলার প্রবোধ পেলো মালিহা। ফর্মটা বের করতেই স্পষ্ট হলো ভর্তি পরীক্ষার কাগজ। এক বান্ডিল কাগজের সবটাই তার শিক্ষা সংক্রান্ত। একটা কাগজে কিছু ভার্সিটির নাম লেখা। মালিহা লেখাটা চেনে। ইতমিনানের লেখা। তার পাশে পাশে একটা একটা ফোন নাম্বার। সাথেই কিছু নাম। নামগুলো চেনা চেনা লাগলো মালিহার। একটা মন পড়ল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যেয়ে ঐ ছেলেটার কাছেই মতিয়ার আলী ছিলেন। সেই ছেলেটা তাকেও থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। স্মৃতির লেজ ধরে আরো ঘটনা সামনে এলো। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেয়ে যাদের কাছে সাহায্য পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি এখানে তাদের নাম্বারগুলোই লেখা। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে মালিহার কষ্ট হলো না। সেসময় সে অবাক হয়ে ভাবত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে মতিয়ার আলীর চেনা মানুষ থাকে। একেকজন একেক দেশের। এই ক্ষণে সবটা পরিষ্কার হলো। তারা হয়তো ছিল ইতমিনানের বন্ধু। এবং এটার সম্ভাবনাই বেশি। সবগুলো কাগজ উল্টে পাল্টে দেখলো মালিহা। যেসব জায়গায় সে অ্যাপ্লাই করেছিল সবগুলোর ফটোকপি এখানে আছে। সাথে আছে বিশেষ কিছু নির্দেশিকা। তার মনে পড়ে মতিয়ার আলী পরীক্ষার আগের দিন রাতে এগুলো এনে দিতেন। বলতেন কম্পিউটার থেকে নামিয়ে এনেছেন। এই তাহলে সেই কম্পিউটার! প্রত্যেকটার কপি ইতমিনান নিজের কাছেও রেখেছে। কাগজগুলো রেখে দিতে গেলে কোণায় একটা মোচড়ানো কাগজ চোখে পড়ল। কৌতূহলে টইটুম্বুর মালিহা সেটাও বের করলো। পুরোনো কাগজটা টেনে ঠিক করে পড়তে বেশ বেগ পেতে হলো। মিনিট দুইয়ের মাথায় কাগজের লেখাগুলো বোধগম্য হলো তার। ইংরেজি লেটারটা চাকরি সংক্রান্ত। ঢাকায় প্রাইভেট একটা কোম্পানিতে উঁচু পদে চাকরি পেয়েছিল ইতমিনান। নিঃসন্দেহে তার বেতন বর্তমানটার চেয়ে ভালো। ইতমিনানের চাকরি সম্পর্কে জানে মালিহা। কাজেই এটুকু সে বলতে পারে। কিন্তু এই চাকরিটা ছাড়লো কেনো ইতমিনান? আবার সে নাকি ভালো চাকরি খুঁজেও পায় না। তবে এগুলো কি? প্রশ্নের ঘুরপাক ছোটখাট একটা সাইক্লোন বাঁধিয়ে দিলো মস্তিষ্কে। কাগজগুলো প্রমাণ করলো ইতমিনান সবসময় তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। নীরবে, নিভৃতে। যোগাযোগ..যোগাযোগ..! চট করে ধুলোমাখা ফাইলটা বুকে চেপে ধরলো মালিহা। তার বুকে যেনো কেউ ড্রাম পেটাচ্ছে। পরীক্ষার রেজাল্ট নেয়ার সময় যেমন লাগে ঠিক তেমন লাগছে। ইশারা, ইঙ্গিত বুঝতেই উঠে দাঁড়ালো সে। তখনই চোখ পড়ল খাটের নিচে, টুলের কোণায় রাশেদার ওষুধ। তুলে নিয়ে ছুটে গেলো সে। ওড়নার নিচে ফাইল নিয়েই ছুটলো বাড়ির দিকে। দরজার কাছে এসে চেঁচিয়ে বলল, “চাচা! দরজা লাগিয়ে দিন। ওষুধ পেয়েছি। চলে গেলাম।”
মকবুল আলী উত্তর দেয়ার আগেই পথে নামলো মালিহা। পথের তো কেবল শুরু।
••
ইতমিনান যখন শুনলো মেয়ে দেখতে যাওয়া হবে, নির্লিপ্ত রইলো সে। আয়েশা ছেলের কাছ থেকে একটু প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন। ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। ছেলেটা কি পাথর হয়ে গেলো! যেনো বিয়ে করতে বললেই করে নেবে। কাকে করছে সেসবে কোনো ধ্যান নেই।
“ছবি দেখবা না আব্বা?”
“যাচ্ছি তো মা। সামনাসামনি দেখতে পারবো।”
“তাও। আগে থেকেই দেখে নাও কেমন।”
“তোমার পছন্দই আমার পছন্দ মা।” হেসে বলল ইতমিনান। সেই হাসি তীরের ফলার মতো আয়েশার বুকে বিধলো।
ফুপুর বাড়িতে মেয়ে দেখার আয়োজন হয়েছে এটা শুনেও রা করলো না ইতমিনান। শান্ত ছেলের মতো বাবা মায়ের পিছু পিছু গেলো। রাফিকে কিছুক্ষণ আদর করে একটা ঘরে যেয়ে বসলো। সোফায় মাথা এলিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “জানাজা শেষ। এবার শুধু দাফনের পালা।”
হঠাৎ পরিচিত একটা কন্ঠস্বর এবং কিছু কথপোকথন তার চোখ খুলিয়ে দিলো। ইতমিনান অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন উসাইন বোল্টের রেকর্ড ভাঙার পথে ছুটছে। গিনেস বুক কি এই খবর পাবে?
মিতুলের আজ ছুটি। মালিক বেড়াতে যাওয়ায় দোকান বন্ধ। বাড়িতে অলস সময় পার করছিলো সে। হঠাৎ বাইরে থেকে ডাক এলো। অতি পরিচিত এক কণ্ঠ। উঠে এলো মিতুল। বিড়বিড় করে বলল, “চাচার ছেলে মেয়ে মানুষের মতো আমার পিছনে লাগছে।”
ইতমিনান এক হাতে ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল ভুরু কুঁচকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কি হয়েছে?”
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইতমিনান। মালিহা হলে একটা ধমক দিয়ে গেট খুলতে বলা যেতো। কিন্তু মিতুল নিজেই যেখানে রেগে বো’ম হয়ে আছে সেখানে তাকে আবার ধমক দেয়ার কোনো মানেই হয় না। আমতা আমতা করে ইতমিনান বলল, “কি করছিস?”
“ঘুমাই।” ত্যাড়ছা স্বরে জবাব ছিলো মিতুল। ইতমিনান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “চল ক্রিকেট খেলি।”
“অন্য মানুষের ব্যাট দিয়ে আমি খেলি না।” মিতুলের স্বরে স্পষ্ট ক্ষোভ।
“ব্যাট তো তোরই।”
“কে বলেছে আমার? এই ব্যাট আমার না। আমার কোনো ব্যাট ফ্যাট নাই।”
কিছুক্ষণ থেমে ইতমিনান বলল, “কেউ একজন আমার কাছে একটা ব্যাটের আবদার করেছিল। তার আবদার কিন্তু আমি রেখেছি।”
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মিতুল। যে বছর তাদের ঝগড়া হয় সে বছরই ইতমিনানের কাছে একটা ব্যাট চেয়েছিল সে। তখন সে কীসে পড়ত? ক্লাস ফোর হবে বোধহয়। আর ইতমিনান তখন ভার্সিটির ছাত্র। সে কি কথাটা মনে করে রেখেছ?
“এতদিন পর আবার ব্যাট কেনার কি মানে? ছোট মানুষ নাকি তুমি?”
হালকা হেসে ইতমিনান বলল, “এটা তো এখন কিনিনি। আরো তিন বছর আগেই কিনেছি।”
“তাহলে আমাকে দাওনি কেনো?” মিতুলের চোখের পলক পড়ছে না। নোনাজল এসে জমতে চাইছে সেখানে। অনুমতি পাচ্ছে না।
চকচকে ব্যাট দিয়ে মাটিতে শব্দ করলো ইতমিনান। সেটার দিকে তাকালেই বোঝা যায় মাঝে মাঝেই তার যত্ন নেয়া হয়। ধীর কণ্ঠে বলল, “তুই তো আমার সাথে কথা বলতিস না। তাই দিইনি।”
“এক কথা তুমি বারবার বলো ইতু ভাই! কই তোমার সাথে কথা বলিনি? তুমি ছুটিতে বাড়ি আসলেই ছুটে ছুটে যেতাম। চাচী তো বলতো তুমি নাকি আমার সাথে আর খেলবে না। আপার সাথে আর দেখা করবে না। এরপর আরেকবার যখন গিয়েছি চাচী কি বকাটাই না বকলো! তুমি তো আমাদের খোঁজও নাওনি। একবার আসোওনি।”
ইতমিনান সব ছেড়ে প্রথম বাক্যের ইতু ভাইয়েই আটকে রইলো। অভিমানের বরফ কি তবে গলতে শুরু করেছে? ইতিমিনান দরজার দিকে এগিয়ে যেয়ে বলল, “ভুল হয়ে গেছে। আর এমন হবে না মিতু! প্রমিস! আয় বাইরে আয়। চল এক ম্যাচ খেলে আসি।”
“মিতু বলবা না তো! শুনতে কেমন মেয়ে মেয়ে লাগে!” বিরক্ত কণ্ঠে বলল মিতুল।
“আয় মিতু। আমার ছুটি শেষ হয় যাচ্ছে। কাল পরশু চলে যাবো। আয় ভাই।”
মিতুল পাষাণ নয়। তার ইতু ভাইয়ের এমন করুন ডাক সে ফেরাতে পারলো না। দরজার ছিটকিনি খুলে সন্তর্পনে বেরিয়ে গেলো বাইরে। ইতমিনান হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়ার মতো করো তাকে আগলে নিলো। মিতুল ব্যাটটা হাতে নিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, “আর কখনও কথা বলা বন্ধ করবে?”
“প্রশ্নই ওঠে না!” মিতুলের ঘাড় জড়িয়ে ধরলো ইতমিনান।
••
মালিহা খেয়াল করেছে মিতুল ইতমিনানের সাথে কথাবার্তা বলছে। সুন্দর করে বলছে। ভালো লাগলো মালিহার। সম্পর্কগুলো ঠিকঠাক হয়ে যাক। আপন মানুষের সাথে মুখ কালো করে থাকা কি ভালো বিষয়! শ্বাস ছাড়লো মালিহা। চাচীর সাথেই কথাটা হয়ে ওঠে না। কি যে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি। কথা বলতে গেলেই আয়েশা এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন! মালিহা বোঝে এ কিসের ব্যস্ততা। মা’কে যেয়ে বলে চাচীর সাথে কথা বলতে। তার কোনো হেলদোল নেই।
“মা।”
নাজিয়া শুয়ে ছিলেন। মেয়ের ডাকে উঠে বসলেন।
“ঘুমাচ্ছিলে?”
“না। এমনি শুয়ে ছিলাম। কিছু বলবি?”
“বলবো। মা তুমি একবার ঐ বাড়ি যাও না কেনো? একটু চাচীর সাথে কথাবার্তা বলো।”
“সেও তো আসতে পারে।”
“চাচীও হয়তো এটা ভেবেই বসে আছে।”
“থাকুক। তিনি মনে করেন তার স্বামীর আর ছেলের মাথা খেয়েছি আমরা। জমির কথা তোলায় কতো কথা শুনিয়ে গেলো!”
“আবার চাচীই কিন্তু পরে আমাদের ঐ জমিগুলো দিতে বলেছে।”
“দয়া করেছে।”
“এভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকলে কেমন হয় মা? শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য। সেসবও ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে।”
“তুই কি আর কিছু বলবি?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মালিহা, “চলে যাবো মা। পরশু ইনশাআল্লাহ্।”
“আচ্ছা।”
মালিহা হাল ছাড়লো। চলে গেলো নিজের ঘরে।
নাজিয়া বেগম তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। প্রথম সন্তান। আবেগ, অনুভূতি দুটোই অন্যরকম। মেয়েটা হওয়ার পর তাকে পারতেন না মাথায় রাখেন। মানুষ দেখে মুখ টিপে হাসতো। বাঁকা কথা বলতো। নাজিয়া বেগম শুনেও শুনতেন না। কিন্তু একদিন ভ’য়ংকর এক স্বপ্ন দেখলেন। মালিহাকে বুকে চেপে বসে রইলেন সেই সারাটাদিন। সন্ধ্যার দিকে রাশেদার এক বান্ধবী দেখতে এলেন তাদের। কথায় কথায় বললেন এতো আদর করলে মেয়ের কপালে দুঃখের শেষ থাকবে না। মায়ের আদর নাকি মেয়ের বিপদ ডেকে আনে। রাশেদা প্রতিবাদ করলেন। ভিত্তিহীন কথা তিনি কোনোকালেই বিশ্বাস করেন না, সমর্থনও করেন না। কিন্তু নাজিয়ার ভীত মনে কথাটা গেঁথে গেলো। স্নেহের প্রকাশ কমিয়ে দিলেন তিনি। আস্তে ধীরে মেয়েটার সাথে কেমন দূরত্ব তৈরি হলো। সাথে জড়তা। সম্পর্কে শীতলতা চলে এলো। মিতুলকে যেমন বুকে টেনে আদর করা হয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া হয় তার কোনোটাই মালিহার সাথে আর করে হয় না। মেয়েটাও অভিযোগ করে না। হয়তো এটাই সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
••
যাওয়ার আগের দিন রাতে ইতমিনান আয়েশার কাছে গেলো। হাত ধরে বলল, “আমার সাথে কথা বলবে না মা?”
“কথা বলছি না কই? বলছিই তো।”
“এমন করে বললে তো আমার ভালো লাগে না। তুমি কি এখনো আমার সাথে রাগ করে আছো?”
“না।”
“তাহলে আমার সাথে চলো।”
আয়েশা অবাক হয়ে বললেন, “কোথায়!”
“আমার ওখানে।”
“পাগল নাকি! আমি যেয়ে কি করবো?”
“আমি কোথায় থাকি কিভাবে থাকি দেখে আসবে। চলো না মা।”
“পাগলামী করিস না ইতু। আমি গেলে তোর বাবার দেখভাল করবে কে?”
“বাবা দুটো দিন একাই থাকতে পারবে। দেখভাল কর লাগবে না। চলো তুমি। নাহলে আমি ভাববো আমার উপর তুমি এখনো রাগ করে আছো।”
আয়েশা হাল ছাড়ার ভঙ্গিতে বললেন, “জেদ করিস না। আমার কথা..”
ইতমিনান উঠে চলে গেলো। আয়েশা নিশ্বাস ছাড়লেন। এই জেদি ছেলেকে এখন বোঝাবেন কিভাবে তিনি?
মকবুল আলী হিসাব কষছিলেন। ইতমিনান অনেকক্ষণ তার পাশে চুপচাপ বসে রইলো। মকবুল আলী মাথা উঠিয়ে বললেন, “কি রে! কিছু বলবি?”
“হু।”
“বল। বসে আছিস কেনো?”
নড়েচড়ে বসলো ইতমিনান, “আমি কি অন্যায় কিছু করেছি বাবা?”
“কিসের অন্যায়?”
“ইদানিং আমি কি এমন কিছু করেছি যাতে তুমি কষ্ট পাও?”
মকবুল আলী ভেবে চিন্তে বললেন, “মনে তো হচ্ছে না।”
“তুমি কি আমার পাশে আছো বাবা?”
এই পর্যায়ে ছেলের কথার মর্ম উদ্ধার করতে সক্ষম হলেন তিনি। ইতমিনানের পাশে যেয়ে বসলেন। কাঁধে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বললেন, “মতির সাথে আমি অন্যায় করেছি। ওর মেয়েকে কাছে পেয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কে হবে?”
বাবার হাতটা শক্ত করে ধরলো ইতমিনান। ধীর কণ্ঠে বলল, “তুমি আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করো বাবা।”
“অবশ্যই করি বাবা। অবশ্যই করি। তোর মা’কে ভুল বুঝিস না। সে মানুষ খারাপ না।” গলায় কান্না আটকে বললেন মকবুল আলী। ইতমিনান মাথা নাড়ল। মা’কে ভুল বোঝার প্রশ্নই ওঠে না।
••
গোছগাছ করে ইতমিনান যখন বের হলো তখন দরজার কাছে একটা ব্যাগ রাখা। ভুরু কুঁচকে এলো ইতমিনানের। এটা কার ব্যাগ? সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে আয়েশা এলেন। তৈরি হয়ে। ইতমিনানের কপালের ভাঁজ মুছে গেলো। চকচক করে উঠলো দুই চোখ।
“তুমি আমার সাথে যাচ্ছো মা!”
“যেভাবে মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস না যেয়ে উপায় কি?”
“আরো কত কিছুর জন্য মুখ কালো করেছি তাতো দেখছো না।” বিড়বিড় করলো ইতমিনান। তবে সেটা আয়েশার কান পর্যন্ত পৌঁছুল না। বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। পথে এসে আয়েশার মেজাজ খারাপ হলো।
মালিহা দাঁড়িয়ে আছে বড় চাচার বাড়ির সামনে। ইতমিনান এলে মিতুল বোনের ব্যাগ সাইকেলে উঠিয়ে নিল।
“ও এখানে কী করছে?” শক্ত কণ্ঠে বললেন আয়েশা।
“মালিহাও তো যাবে।”
“আমাদের সাথে যাবে কেনো?”
“আহা মা! আমরা একই জায়গায় যাচ্ছি। এখন যদি আলাদা যাই মানুষ কি বলবে বলো! খারাপ বলবে না? আমি তো তোমাকে বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম।” বুদ্ধির ওপর কথা আসায় আয়েশা চুপ করে গেলেন। দম ছাড়লো ইতমিনান। মিতুলকে ইশারা করলো মালিহাকে নিয়ে আগে চলে যেতে। পেছন পেছন এলো ইতমিনান।
আয়েশা সেই যে মুখ বন্ধ করলেন সেই মুখ আর খুললেন না। মালিহার অস্বস্তি হলো, খারাপ লাগলো। চাচীর ব্যবহার মেনে নিতে কষ্ট হলো। সেই ক্ষণে মায়ের কথাও মনে পড়ল। তার সাথে চাচী এমন ব্যবহার করবে এটা জানলে মা কথা বলবেই বা কেনো! ট্রেনের ঝিকঝিকির মাঝে সারাটা পথ মালিহা ভাবলো কিভাবে সম্পর্কের অবাঞ্ছিত কাঁটাগুলো সরানো যায়। তার পাশে বসেই ভাবনায় বুদ রইলেন আয়েশা। ভেবে চললেন কিভাবে ছেলের মন মালিহার থেকে ফেরানো যায়। পাশাপশি দুজন সফর সঙ্গীর কি নিদারুণ বিপরীত চিন্তা!
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৮
হলে পৌঁছে দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও রিকশা ডেকে তাতে মালিহাকে উঠিয়ে দিতে হলো। সাথে আয়েশা আছেন। ইতমিনান মা’কে রাগাতে চায় না, না চায় মায়ের মনে কষ্ট দিতে। অথচ তার খুশিতেই মা কষ্ট পান। ভাবনাটা ইতমিনানকে দুঃখ দিলো। দম ছেড়ে সে দেখলো মালিহার রিকশা চলতে শুরু করেছে। একটিবার পেছন ফিরেও তাকাল না মালিহা।
মা’কে নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে গেলো সে। আয়েশা ঘুরে ঘুরে ছেলের ঘর দেখলেন। দেখার মতো কিছুই নেই। দুটো ঘর। এক ঘরে নিচে তোশক বিছিয়ে রাখা। সেটাও একজনের জন্য। প্রস্থ কম। তার উপরে শোভা পাচ্ছে মলিন একটা চাদর। পাশে একটা টেবিল। সেটাও বেশ নিচু ধরনের। নিচে বসেই কাজ করা যায়। তার পাশে একটা ট্রাংক। ভার্সিটিতে ভর্তির সময় এটা কেনা। কোনো এক বিচিত্র কারণে ছেলেটা এই ট্রাংকটা হাত ছাড়া করতে চায় না। একপাশে দেয়ালের সাথে লাগোয়া একটা আলনা। আরেক ঘর সম্পূর্ণ ফাঁকা। রান্নাঘরটা বেশ গোছালো। এক চুলার একটা গ্যাস। চাল, ডালসহ বেশ কিছু জিনিস সুন্দর করে গোছানো। বিছানার চাদরের দিকে ইশারা করে আয়েশা বললেন, “চাদর আর নেই ইতু? এটা তো ময়লা হয়ে গেছে।”
“আছে মা। ওটা বেশি বিছানো হয় না। তুমি হাত মুখ ধোও আমি বিছিয়ে দিচ্ছি।”
ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুমে গেলেন আয়েশা। বের হয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “একটা ঘর নিয়ে থাকিস তাহলে মেসে উঠলেই পারিস। শুধু শুধু একগাদা টাকা ভাড়া দেয়া।”
“মেসে হাজার রকম মানুষ থাকবে। আবার রান্নারও ছিরি নেই। আমি ওখানে থাকতে পারি না।” মুখ কুঁচকে বলল ইতমিনান।
“তোশক তো দেখছি একটা। তুই থাকবি কোথায়?”
“ওসব নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তুমি কি খাবে বলো। আজকে আমি তোমাকে রান্না করে খাওয়াই।”
আয়েশা হাসলেন ছেলের ছেলেমানুষী দেখে।
“আমি থাকতে তুই রান্না করবি কেনো?”
“সবসময় তো তুমিই করো। আজকে আমার হাতের রান্না খাও। বলো কি খাবে।”
“লাউ চিংড়ি।”
“আর?”
“করলা ভাজি।”
ইতমিনান মুখ বাঁকা করলো, “এই তিতা জিনিসটা যে তোমার এতো পছন্দ!”
ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে বাজারে গেলো সে। দেখে দেখে লাউ, চিংড়ি, করলা আর টুকটাক কিছু জিনিস নিয়ে এলো। বাড়িতে আসতেই চক্ষু চড়কগাছ। আয়েশা ইতোমধ্যেই ঘরে থাকা জিনিস দিয়ে রান্না করতে শুরু করেছেন। ছেলেকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, “আমি তোর রান্না খাবো, তুই আমার রান্না খাবি। শোধবোধ।”
“তুমি আমার সাথে শোধবোধ করতে নেমেছ। ভালোই!” একবার বলতে চাইলো মালিহার ভার্সিটি কাছেই। এতো রকম তরকারি রান্না করছো, ওকে একবার ডাক দিই। কিন্তু আয়েশা রাগ করতে পারেন ভেবে সেকথা আর বলল না।
হঠাৎ আয়েশা বললেন, “ওর কথা কি আর মনে হয়?”
ধ্যান ভাঙলো ইতমিনানের, “কার কথা?”
“মালিহার।”
ইতমিনান কিছুনা বললেও তার মুখের ভাষা পড়তে আয়েশার কষ্ট হলো না।
“তুই ওর সাথে সুখে থাকবি না বাপ। বুঝতে পারছিস না কেনো?”
“মা দোয়া না করলে কারো সাথেই সুখে থাকতে পারবো না। বুঝতে পারছি।” মাথা নাড়ল ইতমিনান।
“আহা! দেখ ওর মা বাবা সম্পত্তির জন্য আমাদের সাথ কেমন করলো। তাদের মেয়ে আর কতো ভালো হবে। ভবিষ্যতে তোর আর মিলির ব্যাপারেও এমন বলবে নাকি কে জানে!”
ইতমিনান শান্ত কণ্ঠে বলল, “আমার বাবা মা একই কাজ করা সত্ত্বেও যদি একটুখানি বোধ আমার ভেতরে থাকে তাহলে ওর আরেকটু বেশি থাকার কথা। কারণ সম্পর্ক রক্ষার প্রচেষ্টা ওদের বেশী ছিলো।”
আয়েশার মুখটা থমথমে হয়ে গেলো, “আমার সাথে তুলনা দিচ্ছিস?”
“তুমি মা। তোমার সাথে কারো তুলনা চলে!” হেসে বলল ইতমিনান। “আমার জীবনে যাই হয়ে যাক না কেন, তোমার জায়গাটা আমার কাছে সবসময় বিশেষ থাকবে মা। তোমাকে খুশি রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করবো। তাতে আমি যতো কষ্টই পাই না কেনো।” রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে পড়ল ইতমিনান। শেষ কথাটা সরাসরি আয়েশার বুকে আঘাত দিলো যেনো। ছেলেটা তাকে খুশি রাখার জন্য নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে! সত্যিই কি তাই?
°
ইতমিনান দুপুর থেকে লক্ষ্য করছে আয়েশা একটু পরপর হাঁচি দিচ্ছেন। খাওয়ার সময় সে চিন্তিত কণ্ঠে বলল, “তোমার কি ঠান্ডা লেগে গেলো মা?”
“পানি পাল্টেছে না? এজন্য একটু হাঁচি কাশি হচ্ছে। এসব একাই ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্।”
বলতে বলতেই কয়েকবার হাঁচি দিয়ে ফেললেন তিনি। ইতমিনান দেখলো আয়েশার নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। পুরো মুখেও একটা লালাভ ভাব। স্বস্তিতে থাকতে পারলো না সে। জোর করে টেনে এনে মাকে অস্বস্তিতে ফেললো না তো?
হাঁচি কাশি থেকে জ্বর আসতে সময় নিলো না। ইতমিনান যখন মাগরিবের নামাজ পড়ে এলো তখন দরজা খুলতে আয়েশা এগিয়ে যেতে পারলেন না। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে তালা খুললো ইতমিনান। ঘরে যেয়ে দেখলো আয়েশা অচেতনের মতো বিছানায় পড়ে আছেন। ভয়, শঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে এলো। দ্রুত এগিয়ে গেলো মায়ের কাছে। কিছুক্ষণ ডাকলো একভাবে, “মা! মা! এই মা! মা ওঠো!” শেষবার ওঠার জন্য বলার সময় আয়েশার হাতে হাত রাখতেই চমক উঠলো ইতমিনান। পুরো শরীর আগুন গরম হয়ে আছে। গালে, কপালে হাত রাখলো ইতমিনান। আ’গু’নের হলকা বের হচ্ছে যেনো। সে খেয়াল করে দেখলো আয়েশার ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। কতক্ষন ঝাকাঝাকি করার পরও যখন আয়েশা সাড়া দিলেন না তখন ছুটে পানি নিয়ে এলো ইতমিনান। খুঁজে খুঁজে একটা কাপড়ের টুকরো বের করলো। সে বুঝতেই পারছে না এইটুকু সময়ের মাঝে এতোটা জ্বর এসে গেলো কিভাবে! মাগরিবের নামাজের আধা ঘণ্টা আগে সে বেরিয়েছে। সর্ব সাকুল্যে এক ঘণ্টার কাছাকাছি কিছু সময় আয়েশা একা ছিলেন। এরই মাঝে এতো জ্বর চলে এলো!
কাপড় ভিজিয়ে আয়েশার কপালে কিছুক্ষণ ধরে রাখলো ইতমিনান। পুরো চেহারায়, হাতে, পায়ে পানি দিয়ে মুছে দিলো। আয়েশার কোনো সাড়া শব্দ নেই। ইতমিনানের না ঘুরে উঠলো। এই একা বাড়িতে মাকে নিয়ে সে কি করবে! হাসপাতাল বেশ অনেকটা দূরে। সে পর্যন্তও তো আয়েশাকে একা একা নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। কি করবে কি করবে ভাবতেই মালিহার নামটা মাথায় এলো। মালিহাকে নিয়ে এলে কেমন হয়? এমন অবস্থা শুনলে মেয়েটা নিশ্চয়ই না করবে না? ছুটে বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে গেলো সে। একজনকে আয়েশার কাছে বসিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ বেল বাজানোর পর এক বাচ্চা ছেলে দরজা খুলল। ইতমিনানকে হতাশ করে দিয়ে জানালো বাড়িতে কেউ নেই। কোমরে হাত রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ইতমিনান। ডান হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছে আবার ছুটে গেলো মায়ের কাছে। আয়েশা নড়াচড়া করছেন। কাছে গিয়ে নরম কণ্ঠে সে বলল, “মা! ও মা! খারাপ লাগছে তোমার? একটু কথা বলো না মা!” গলাটা কেঁপে উঠল ইতমিনানের। নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো তার। আয়েশা চোখ টেনে খুলতে চাইলেন। পারলেন না। কিছুক্ষণ হু হা করলেন খুব কষ্টে। ইতমিনান আয়েশার কপালে হাত রেখে উঠে দাঁড়ালো। এই অচেনা শহরে তার কেউ নেই। কিন্তু আল্লাহ সবসময় সব জায়গায় তার সাথে আছেন। সাহায্যকারী হিসেবে তাঁর চাইতে উত্তম আর কে হতে পারে? দরজার দিকে ছুটতে ইতমিনান বিড়বিড় করে বলল, “আমার মা’কে তোমার হেফাজতে রেখে গেলাম আল্লাহ। একটু দেখে রেখো! প্লিজ!”
হাঁটা পথ রিকশায় গেলো সে। পারলে উড়ে যেতো। তার হৃদস্পন্দন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। একা একা আয়েশা কি করছেন ভাবতেই বুকটা আরো জোরে ধক ধক করে উঠছে। হলের সামনে রিকশাটা দাঁড়াতেই ইতমিনান বলল, “ভাই একটু দাঁড়ান। আমি এখুনি চলে আসছি। আপনার রিকশাতেই ফেরত যাবো। একটু দাঁড়ান ভাই!”
দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো ইতমিনান। ওয়েটিং রুমে ঢুকে মনে হলো সে তো মালিহাকে কিছুই জানায়নি। তৎক্ষণাৎ পকেটে হাত দিলো ফোনের আশায়। আতিপাতি করে খুঁজেও কোথাও ফোন পেলো না। সে ফোন আনতে ভুলে গেছে! কষিয়ে একটা থাপ্পর দিতে মন চাইলো নিজেকে। রুমের ওপাশে ভেতরে যাতায়াত করা কিছু মেয়েকে ডেকে মালিহার কথা বলল। দুইজন চেনে না। তিনজনের বেলায় মেয়েটা যেনো চিনলো। ইতমিনান অনুনয় করলো একটু ডেকে দেয়ার জন্য। মেয়েটা মাথা নেড়ে ভেতরে গেলেও গেলো নিজের রুমের দিকে। তার মাঝে মালিহাকে ডাকার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। ইতমিনান সেসব আর দেখতে পেলো না। কপালের দিকের চুলগুলো মুঠি করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মালিহার নাম্বারও তো তার মুখস্থ নেই। কি করবে সে?
নিচে এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসেছিল নাজিফা। ইতমিনানের উচ্চকন্ঠে মালিহার খোঁজ তার কানে গেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পড়ল। আড়াল থেকে শুনে বুঝতে পারলো লোকটা মালিহাকেই খুঁজছে। দেরি করলো না সে। ছুটে গেলো মালিহার রুমে।
আঁখি অর্ডার করা জিনিসগুলো বের করেছিল। সবাই ভাবছিল নীতিকে এগুলো পড়লে ঠিক কতটা সুন্দর দেখাবে। আগামীকাল আসবে সে। মেয়েটাকে খুব একটা চমক দেয়া যাবে ভাবতে পেরেই পুলকিত হলো সকলে। সেই ক্ষণে ছুটে এলো নাজিফা। লোকটার চিন্তিত মুখ দেখে তার মনে হয়েছে ঘটনা গুরুতর। নয়তো এভাবে নিশ্চয়ই খুঁজতো না! আর যেভাবে মালিহার বর্ণনা দিচ্ছিল বোঝা যায় তার অতি পরিচিত কেউ। ছুটতে ছুটতে এসে ঘরে ঢুকে পড়ল নাজিফা। দরজায় নক করার কথা ভুলে গেলো। নাজিফাকে দেখে উচ্ছ্বসিত স্বরে মালিহা বলল, “এই নাজিফা এদিকে আসো। দেখো এগুলো নীতির জন্য কিনেছি।”
নাজিফা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এই শহরে তোমার পরিচিত কেউ আছে মালিহা?”
মালিহার ভুরু কুঁচকে এলো, “আছে। কেনো বলো তো?”
“কে সে?”
“আমার চাচাত ভাই।”
“উনিই সম্ভবত ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য। একটু দেখবে চলো তো। কয়েকজনের কাছে তোমার কথা বলছিলেন। ফোন আনতে ভুলে গেছেন মনে হয়। উনাকে দেখে ঘটনা বেশ সিরিয়াস মনে হলো। ”
মালিহা দৌড়ে বের হলো। মিনিটের মাঝেই পৌঁছে গেলো ওয়েটিং রুমে। ইতমিনান তখন পায়চারি করছে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে। মালিহাকে দেখে যেনো হালে পানি পেলো সে। তৎক্ষণাৎ এগিয়ে যেয়ে ভগ্ন কণ্ঠে বলল, “মালিহা মা.. মায়ের খুব জ্বর এসেছে। একটু যাবি তুই?”
মালিহার মনে পড়ল না এতো করুন স্বরে কবে ইতমিনানকে কথা বলতে শুনেছে সে। মাথা নেড়ে সে বলল, “একটা মিনিট দাঁড়াও। প্রভোস্ট ম্যামের কাছে বলে আসি।”
ছুটে ওপরে গেলো মালিহা। কোনরকমে বোরখা পরে গায়ের ওড়নাটাই ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো। আঁখি, মনিকাকে সংক্ষেপে সবটা বলে ব্যাগে ফোন আর বই নিয়ে নিচে চলে গেলো। প্রভোস্ট ম্যাম হলে নেই। তার পরিবর্তে আরেকজনকে জানিয়ে ইমারজেন্সি ছুটি নিলো মালিহা। মহিলা মালিহার নাম্বার, ইতমিনানের নাম্বার, ঠিকানা সব রেখে দিলো। তড়িঘড়ি করে বের হলো দুজনে।
রিকশায় বসতেই ইতমিনান যখন তার পাশে বসলো মালিহা হতভম্ব হয়ে গেলো। ইতমিনান কখনোই তার সাথে এক রিকশায় বসেনি। আগে পিছে দুটো রিকশা নিয়ে দুজন যাত্রা করেছে। মালিহা বুঝলো আজ ইতমিনানের সেই হুশ নেই। দ্রুত গতিতে সে রিকশাওয়ালাকে বলছে, “যেখান থেকে উঠেছিলাম ওখানেই চলুন মামা। একটু দ্রুত চলুন।”
ইতমিনান খেয়াল না করলেও মালিহার অস্বস্তির শেষ রইলো না। কাঁধের ব্যাগটা দুজনের মাঝে রেখে একপাশে চেপে বসলো সে। ইতমিনান সেসব খেয়াল করলো না। সে আবার বলল, “মামা! একটু দ্রুত চালান।”
“গাড়ি তো মামা পিলেন না। আমি তো আর উইড়া যাইতে পারি না।” বিরক্ত কণ্ঠে বললেন রিকশাওয়ালা। ইতমিনান তবুও থামলো না। বলেই চলল সে কথা। মালিহা বুঝলো চাচীর হঠাৎ অসুস্থতা ইতমিনানকে ঠিক কতটা আতঙ্কে ফেলেছে।
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৯
ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢুকেই থমকে গেলো ইতমিনান। বিদ্যুৎ চলে গেছে! মা তাহলে কিভাবে আছে! এই চিন্তা করে দরজা খোলা রেখেই ঘরের দিকে ছুটলো সে। মালিহা মোবাইলের টর্চ জ্বে’লেছে একটু আগেই। সেটা দিয়েই দরজা আটকে সিটকিনি তুলে দিলো।
ইতমিনান বিছানায় বসে আয়েশার হাত পা মালিশ করছে। ডায়নিং থেকে সেই দৃশ্য দেখে এগিয়ে গেলো মালিহা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো ইতমিনানের অস্থিরতা। আবার ডায়নিংয়ে যেয়ে বোরখা খুলে ওড়নাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। ইতমিনানের ঘরে ঢুকে আলনার এক কোনায় রেখে দিলো বোরখা। আয়েশার কাছে বসে এক পলক তার দিকে তাকালো। গালে, গলায় হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করলো জ্বরের উত্তাপ। অস্থির ইতমিনানকে বলল, “জ্বর কতো?”
“মাপিনি। থার্মোমিটার নেই।”
মালিহা অনুমান করলো একশো তিন তো হবেই। চারও হতে পারে। আয়েশার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে তার নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মালিহা এক পল ইতমিনানের দিকে তাকালো।
“বাসায় নাপা আছে?”
“না।” মাথা নাড়ল ইতমিনান।
“তাহলে নিয়ে আসো। আমি চাচীর কাছে বসছি।”
দেরি করলো না ইতমিনান। ছুটে গেলো। বাথরুম থেকে পানি ভর্তি বালতি নিয়ে এলো মালিহা। বিছানাটা মাটিতে। কিভাবে পানি দেবে মাথায়? উপায় না পেয়ে ইতমিনানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। দশ মিনিটের মাঝেই ফেরত এলো ইতমিনান। মালিহা ভাবলো আগে ওষুধটা খাওয়ানো দরকার। কিছু না বলেই উঠে পড়ল সে। ছোট্ট ফ্ল্যাট। কাজেই রান্নাঘর পেতে কষ্ট হলো না। অল্প কিছু ভাত নিয়ে তরকারি নিতে যেয়ে দেখলো লাউ চিংড়ি থেকে টক টক গন্ধ বের হচ্ছে। বুঝতে কষ্ট হলো না যে ওটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটু পানি ভাতে দিয়ে করলা ভাজি নিয়ে গেলো। বিছানায় বসে বলল, “ভাইয়া চাচীকে উঠিয়ে ধরো। খাইয়ে ওষুধ খাওয়াই।”
আয়েশাকে ওঠাতে ইতমিনানকে বেশ বেগে পেতে হলো। শরীরটা যেনো তিনি ছেড়েই দিয়েছেন। একপাশ থেকে তাক জাপটে ধরে রইলো ইতমিনান। মালিহা আস্তে ধীরে পুরোটা খাবার খাইয়ে দিল। আয়েশা বারবার মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন। চোখ বন্ধ করেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন মুখটা কি বিশ্রী তিক্ত হয়ে আছে। মালিহা বারবারই জোর করে খাওয়ালো। অল্প খাবারটা শেষ হতেই ওষুধ খাইয়ে দিলো। প্লেট রেখে এসে ইতমিনানকে বলল, “চাচীকে এভাবেই ধরে রাখো। শুইয়ে দিও না।”
একপাশে রাখা বালতিটা এগিয়ে নিয়ে এলো মালিহা। ইতমিনানের পাশে বসে আয়েশার গলার চারপাশে গামছা জড়িয়ে দিলো। আরেকটা ছোট বালতি এনে রাখলো তার মাথার নিচে। চুলগুলো খুলে ধীরে সুস্থে পানি দিয়ে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আয়েশা গোঙাতে শুরু করলে ইতমিনান উত্তেজিত হয়ে বলল, “এই কি হলো! মা এমন করছে কেন? পানি ঢালা বন্ধ কর। মা’র মনে হয় খারাপ লাগছে।”
“চুপ করো। ভালো লাগছে বলেই এমন করছে। এতক্ষণ একটা কথাও বলেছিলো?” ইতমিনান যতোটা অস্থির ঠিক ততটাই শান্ত মালিহা। পানি দেয়ার সাথে সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। আয়েশা চোখ পিটপিট করে একবার কি যেনো দেখলেন। আবার চোখ বন্ধ করলেন। পানি দেয়ার বিশ পঁচিশ মিনিটের মাথায়ও যখন জ্বর কমলো না তখন মালিহা বলল, “দোয়া টোয়া কিছু করতে পারো?”
“হ্যাঁ?” ইতমিনান যেনো বুঝলো না কথার মানে।
“তখন থেকে তো চ্যা চু করে যাচ্ছো। একটু দোয়া পড়ে তো মা’র চোখে মুখে ফু দিতে পারো।”
“আমি দোয়া করলে হবে?”
কণ্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে মালিহা বলল, “তাহলে যাও কাবা শরীফের ইমাম ধরে আনো।”
পরপর নিজেই বিড়বিড় করতে শুরু করলো। তার দেখাদেখি ইতমিনানও জানা দোয়া আউড়ে আয়েশার মুখে ফু দিলো। এই পর্যায়ে মালিহা বলল, “বাইরে যাও তো তুমি।”
“কেনো? কি করবি?”
“উফ! এতো প্রশ্ন করো কেনো? চাচীর গা মুছবো। যাও।”
নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ইতমিনান। মালিহা দরজা চাপিয়ে দেয়ার সময় ফেরত এসে বলল, “আলনার পাশে মা’র ব্যাগ রাখা। ওখান থেকে কাপড় নিস।”
“নেবো। তুমিও এখন রোগী হতে না চাইলে এই গেঞ্জি পালটাও।”
নিজের দিকে তাকিয়ে ইতমিনান দেখলো বুকের কাছ থেকে গেঞ্জি ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।
“একটা গেঞ্জি দে।”
আলনার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো মালিহা, “কোনটা দেবো।”
“দে, একটা দিলেই হলো।”
গাঢ় সবুজ রঙের একটা গেঞ্জি ইতমিনানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দরজা আটকালো মালিহা। আয়েশার সারা শরীর মুছে দিলো হালকা ভেজা গামছা দিয়ে। আয়েশা বিড়বিড় করে একবার কি যেনো বললেন মালিহা কিছুই বুঝল না। শুকনো একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে আয়েশাকে শুইয়ে দিলো মালিহা। হাঁফ ছেড়ে বসলো সে। একা একা কাজটা করা কঠিন ছিল বটে। কিন্তু সাহায্যকারী কেউ নেই। তাই কষ্ট করে হলেও তাকেই সবটা করতে হলো। উঠে দরজা খুলে দিলে ইতমিনান এমনভাবে ঢুকলো যেনো সে দরজায়ই দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষন। আয়েশার গালে, গলায় হাত রেখে তার মনে হলো জ্বর বোধহয় কিছু কমেছে।
মালিহা এশার নামাজ পড়েনি। ওযু করে এসে জায়নামাজ হাতে নিয়ে বলল, “পশ্চিম কোন দিকে?”
তখনই ইতমিনানের মনে পড়ল সেও নামাজ পড়েনি। জামায়াত তো ছুটে গেছেই আবার দেরিও হয়েছে।
“এই দিকে।” হাত দিয়ে দেখালো ইতমিনান। মায়ের হাত জোড়া ধরে বসে রইলো শিয়রেই। নামাজ শেষে মালিহা বলল, “চাচার সাথে কথা হয়েছে?”
“না।”
“ফোন দিয়ে কথা বলো। চিন্তা করবে না! চাচীর কথা বলার দরকার নেই। বলো ঘুমিয়ে গেছে।”
কথা বলে নামাজে দাঁড়ালো ইতমিনান। বই বের করে আয়েশার পাশে বসলো মালিহা। এক হাতে কপাল টিপতে টিপতে পড়তে লাগলো। সেই দৃশ্য দেখে ইতমিনানের বুক জুড়িয়ে গেলো। ইশ! মা’কে যদি একবার দেখানো যেতো কতোটা অসুখী লাগছে তার!
“তুমি শুয়ে পড়। দরকার হলে আমি ডাক দেবো। ঐ ঘরে শোয়ার জায়গা আছে?”
“আমি যাবো না।”
“সারারাত জেগে বসে থাকবে আর সকাল বেলা রোগী বাড়াবে? যাও তুমি। এখনও বসে আছো কেনো? ওঠো!”
রাত জাগলে ইতমিনান প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাড়ির সকালেই এটা জানে। একবার স্কুলের পরীক্ষার আগের দিন রাত জেগে পড়াশোনা করে সকালে এমন অসুস্থ হলো যে সেই পরীক্ষাই আর দিয়ে পারলো না। সেই থেকে তার এই কাহিনী মোটামুটি সবাই জানে। আয়েশার কপালে হাত রাখতেই জ্বরটা আগের থেকে কম মনে হলো। সে উঠলে মালিহা বইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “খেয়ে শোবে। নাহলে ভাত আমি তোমার মুখে ঢালবো।”
খাওয়ার কথা শুনতেই যেনো খিদেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। মনে হলো দুপুরের পর থেকে আর কিছুই খাওয়া হয়নি। মালিহাকে জোর করতে হলো না। ইতমিনান নিজেই খেয়ে নিলো। তাকে খেতো বললে মালিহা বলল, “সন্ধ্যা বেলা মুড়ি মাখা খেয়েছি। পেট ভরে আছে আমার। খাবো না।”
ইতমিনান জোর করলো না। ক্লান্ত শরীরে জায়নামাজ নিয়ে অপর ঘরে গেলো। সেটা ফ্লোরে বিছিয়ে হাতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। মায়ের কাছে মালিহা আছে ভেবেই নিশ্চিন্ত মনে চোখ বন্ধ করলো সে।
••
রাত তখন পূর্ণ যৌবন লাভ করেছে। তার তিমিরে ছিদ্র পাওয়া দায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে মালিহা। তার ভারী নিঃশ্বাসের বাতাস ঘুরছে রুমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। একটা হাত তখনও আয়েশার কপালে।
জ্বর ছাড়ায় ঘেমে উঠেছেন আয়েশা। শরীর ভেজা লাগায় ঘুমটা পাতলা হয়ে এলো। বিশ্রী একটা ঢেঁকুর উঠলো তখনই। চোখ মুখ কুচকে নিলেন তিনি। নড়াচড়া করলেন। উঠে বসতে চাইলেন। পারলেন না। কিন্তু মালিহার হালকা ঘুম ভেংগে গেল। ধড়ফড় করে উঠে সে আয়েশার দিকে তাকালো। তার মুখে হয় রাখলো। আয়েশা ভগ্ন কণ্ঠে বললেন, “ইতু!” তখনও তার চোখ বন্ধ। মালিহা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “খারাপ লাগছে চাচী? ভাইয়াকে ডাক দেবো?”
চোখ খুললেন আয়েশা। অন্ধকারে কিছু দেখলেন না। কিন্তু নাভির আশপাশে তীক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করলেন। বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ব্যাথাটা হঠাৎ হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠছে। মালিহা লাইট জ্বালালো। আয়েশার অস্বস্তি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচী? কি হয়েছে আপনার?”
আয়েশা তাকালেন। কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে বুঝলেন এটা মালিহা। তবে তখন রাগ করার শক্তি তার নেই। ধীর কণ্ঠে বললেন, “বসবো।”
মালিহা এগিয়ে গেলো। পিঠের পেছনে হাত রেখে আরেক হাতে আয়েশার হাত ধরে তাকে ওঠাতে চাইলো। সেসময় আয়েশার পেটে আরেকবার ঝিলিক দিয়ে উঠতেই গলগলিয়ে বমি করে দিলেন তিনি। সবটা পড়ল মালিহার গায়ে। একভাবে বমি করে রাতের অল্প স্বল্প খাবারের পুরোটাই উগড়ে দিলেন। শক্ত করে খামচে ধরলেন মালিহার ডান হাত।
আকস্মিক কান্ডে মালিহা হকচকিয়ে গেল। সরে যাওয়ার সময়টুকুও পেলো না। তারপরই আয়েশা এমনভাবে হাতটা আঁকড়ে ধরলেন যে তার আর সরে যাওয়া হলো না। আয়েশার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো সে। মনে হচ্ছে যেন আয়েশার জীবনটা বের হয়ে যাচ্ছে।
বমি শেষে বিছানায় এলিয়ে পড়লেন আয়েশা। মালিহা পড়ল বিপাকে। নিজের কাপড় পরিষ্কার করবে নাকি চাচীকে ধরবে। কামিজের ঝুলন্ত অংশটা হাতে ধরে ইতমিনানের ঘরের সামনে যেয়ে তাকে ডাকতে শুরু করলো, “ভাইয়া! ভাইয়া? ইতু ভাই!”
ইতমিনান তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। আজ তার গাঢ় ঘুম হয়নি। অবচেতন মনের প্রতিটি অংশ যেনো মায়ের অসুস্থতা সম্পর্কে সজাগ ছিলো।
মালিহাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু বুঝতে পারল না সে।
“একটু চাচীর কাছে যেয়ে বসো তো।”
ছুটে মায়ের কাছে যেতেই ইতমিনান দেখলো তিনি শুয়ে আছেন। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন। পাশে বসে তার হাত ধরতেই চোখ খুললেন আয়েশা।
“ইতু!”
“বলো মা! খারাপ লাগছে?”
“পানি খাবো।”
ইতমিনান মা’কে পানি খাওয়ালো। কিছুটা ধাতস্থ হলেন তিনি। মালিহা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো ভেজা জামা কাপড় গায়ে। সে তো কোনো জামা আনেনি। এবার উপায় কি হবে? ওড়নাটা শুকনা ছিলো। সেটাই গায়ে জড়িয়ে রেখেছিল কোনরকমে। টিস্যু দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা বমির অংশগুলো পরিষ্কার করে বিছানায় তাকালো। কোথাও কোনো ময়লা নেই।
“তোর জামা ভিজলো কিভাবে?” অবাক কণ্ঠে বল ইতমিনান। মালিহা সংকুচিত হয়ে গেলো। আয়েশা শান্ত কণ্ঠে বললেন, “আমি বমি করেছি।”
মালিহা কি করবে বুঝতে পারছিলো না। ভেজা কাপড় গায়ে নিয়ে কোথাও বসাও যাবে না। অগত্যা অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আয়েশা ছেলেকে বললেন, “আমার ব্যাগটা দে ইতু।”
“কি করবে মা?”
“দে আগে।” আয়েশা বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলছেন। ইতমিনানের বুকের চাপ যেনো কিছুটা কমলো। মায়ের হাতে ব্যাগ দিতেই তিনি একটা শাড়ি বের করে দিলেন। মালিহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “পরতে পারো?”
মালিহা চমকে গেলো। এমন সাহায্য সে আশা করেনি।
“জ..জি পারি।” শাড়িটা নিলো মালিহা। ভাঁজ খুলে আনুষাঙ্গিক জিনিস পেয়ে বাথরুমে চলে গেলো। পানির ফোঁটাগুলো মিশে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।
ইতমিনান মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এতো শান্ত কণ্ঠে, স্বাভাবিকভাবে মা যে মালিহার সাথে কথা বলতে পারে এটাই যেনো সে ভুলে গিয়েছিল।
“যা শুয়ে পড়। আমার ভালো লাগছে এখন।”
“না তোমার কাছে থাকি।”
“আমি ঘুমাবো। থাক তুই।” আয়েশা শুয়ে পড়লেন। ইতমিনান যখন উঠলো তখনই মালিহা ঘরে ঢুকলো। মালিহাকে দেখে ইতমিনানের মনে হলো যেন সদ্য বিবাহিত বধূ শাশুড়ি সেবায় মগ্ন। খুক খুক করে কাশতে কাশতে মায়ের দিকে তাকালো সে। তার চোখ বন্ধ। দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ইতমিনান। এবার একটা জম্পেশ ঘুম দেয়া যাবে।
আয়েশার পাশে বসে তার মাথায় হাত রাখতে ইতস্তত করছিল মালিহা। জেগে আছেন। কিছু যদি মনে করেন। তখনই আয়েশা শান্ত কণ্ঠে বললেন, “সারারাত তো নিজেই সব করেছো। এখন তাহলে অস্বস্তি লাগছে কেনো?”
মালিহা চমকে তাকালো। আয়েশা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মালিহা সেই দৃষ্টির রহস্য উদ্ধার করতে পারল না। ঘৃণা, ক্ষোভ কিছুই তো নেই সেথায়। তবে?
ছেলের চেহারা বোঝার চেষ্টা করছিলেন আয়েশা। ইতমিনান তার মুখের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “খাও মা।”
আয়েশা নিলেন না। ইতমিনান হাসলো। আয়েশার যাচ্ছে সে হাসি বড় অসহায় মনে হলো।
“আমার হাতে খেতেও তোমার আপত্তি?”
আয়েশা রা করলেন না। চুপচাপ ভাত মুখে নিলেন। তীর্যক কণ্ঠে বললেন, “মালিহা তোর সাথে অনেক যোগাযোগ করে?”
খাপছাড়া প্রশ্ন। মেয়েটার প্রতি যেই মায়াটুকু জড়ো হয়েছিল সেসব উধাও হয়ে গেছে। ছেলের এক স্বীকারোক্তিতে তিনি যেনো আগের রূপে ফিরে গেছেন। ইতমিনান বলল, “ও আমার সাথে যোগাযোগই করে না মা। এই দেড় দুই মাসে আমাকে একবার কল দিয়েছে। তাও বিপদে পরে। নয়তো আমিই দিই।”
“তুই দিস কেনো?”
উত্তর দিলো না ইতমিনান। এক মনে ভাত মাখতে থাকলো। চুপচাপ আয়েশাকে বোঝাতে চাইলো তার কল দেয়ার কারণটা। সেটা বুঝে আয়েশা ভেতরে ভেতরে জ্ব’লে উঠলেন। তবে ছেলের সামনে প্রকাশ করলেন না। এমন ভাবে ভাত চিবুলেন যেনো ওগুলো ভাত নয় আস্ত মালিহা আর নাজিয়া।
•
বিছানার সাথে লাগোয়া জানালাটা খোলা। কাত হয়ে সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে ইতমিনান। পাশেই পুকুর। পুকুরের সাথে বিরাট এক নারিকেল গাছ। এই গাছটার দিকে তাকালেই ইতমিনানের মনে পড়ে যায় বহু আগের একদিনের কথা।
কী এক কারণে যেনো মালিহার সাথে ঝগড়া করেছিল সে। সেই ঝগড়ার রেশ ধরে মালিহার হাতে মুঠো করে রাখা এক টাকার হলুদ কয়েন পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সে। মেয়েটার সে কি কান্না! কতো হবে তখন বয়স? দুই কি তিন। মালিহার উথাল পাথাল কান্নায় টিকতে না পেরে তাকেই আবার পুকুরে নামতে হলো। কাদায় মাখামাখি কয়েন হাতে দিতেই মালিহার কান্না থামলো। আয়েশা এক দফা বকলেন। তিনি তো আর জানতেন না ঘটনা তার সুপুত্রই ঘটিয়েছে।
হাহ! সেসব দিন যেনো চোখের পলকে চলে গেছে। টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে একটা জোনাকি উড়ে গেলো। ইতমিনানের মনে হলো মতিয়ার আলীর মৃ’ত্যুর পরদিন মালিহাকে দেখে ঠিক এমনই একটা আলো জ্বলেছিল তার মন কুঠিরে। টিমটিমে একটা আলো। ঠিক সেসময় সেই জোনাকিটা বের করে দিলে আজ তাকে ভুক্তভোগী অবস্থায় নির্ঘুম রাত কাটাতে হতো না। মালিহা তো বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মনে কোন অনুভূতি নেই, বোঝাও নেই। ইতমিনান নিজের জন্য স্বেচ্ছায় সব ডেকে এনেছে। সেই নজর। প্রথম দিনের অপলক নজরটাই তাকে কুপোকাত করে দিয়েছে। সেদিন ইমাম হুজুর খুতবার সময় বলছিলেন। কুরআনে নাকি মেয়েদের পর্দার আগে ছেলেদের পর্দার কথা বলা হয়েছে। ইতমিনান অবাক হয়েছিল। যখন শুনলো ছেলেদের নজর নামাতে বলা হয়েছে তখন হাড়ে হাড়ে সবটা টের পেলো। এই যুক্তি বুঝতে তাকে ঐ আয়াত দ্বিতীয়বার পড়তে হবে না। নিজের জীবন দিয়েই বুঝেছে সে। মালিহা তো কতবারই তার দিকে তাকিয়েছে। কিছুই তো হয়নি। কিন্তু সে বোকার মতো নজরের জালে আটকা পড়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে তার ইচ্ছানুযায়ী পরিস্থিতি তৈরি অসম্ভবই বটে। যদি সেটা নাই হয় তাহলে ভবিষ্যতে তার ঘরে থাকবে একজন, মনে আরেকজন। উফ! কি ভয়ানক! মুখ মুছলো ইতমিনান। মা একটু রাজি হলে খুব কি ক্ষতি হতো?
•
মিতুল নাজিয়াকে রাজি করিয়ে ফেলেছে। নাজিয়া যেনো তৈরিই ছিলেন। ছেলে একবার বলতেই তিনি গোছগাছ শুরু করে দিলেন। সাইফের মা কয়েকবার সাধলেন বটে। তবে তাতে বিশেষ জোর ছিলো না। নাজিয়া বুঝলেন সবটাই। মেনে নিলেন অব্যর্থ সম্পর্কের ব্যর্থ পরিণতি।
বিদায় বেলায় মকবুল আলী এবং ইতমিনান এসে হাজির হলো। নাজিয়া তো বটেই ইতমিনানকে দেখে মিতুলও অবাক হলো। সে তো চাচাকে জানিয়েছিল। ইতমিনান যে এখানে সেটাই তো সে জানতো না। জড়তা ঠেলে তাকে কিছু বলতেও পারলো না।
নাজিয়া মনে মনে আপ্লুত হলেন। ভাসুর আর তার ছেলের আগমনের বিষয়টা যে কতটা সম্মান দিলো তাকে সে আর কাউকে বুঝিয়ে দিতে হবে না। কি অদ্ভুত! যে ভাই ভাই করে ছেলেমেয়ের কথা অমান্য করে পাগল হয়ে ছুটে এসেছিলেন, সেই ভাই নিতে যাওয়া তো দূরের কথা একটা ফোন দিয়েও খোঁজ নেয়নি।
মকবুল আলী গাড়ি ডেকে ব্যাগপত্র উঠিয়ে দিলেন। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নাজিয়া বললেন, “তোমার বোনের বাড়ি যেও ভাই। আশা করি কখনও সেখানে অনাদর পাবে না।”
সাইফের বাবা কিছু বললেন না। মিতুল মামা মামীকে সালাম জানিয়ে গাড়িতে উঠলো। তার পাশে বসলো ইতমিনান। অটোর সামনে ড্রাইভারের পাশে বসলেন মকবুল আলী। নাজিয়া বিপরীতে বড় সিটে বসে ছিলেন। ইতমিনানকে বললেন, “কবে এসেছ?”
“গতকাল চাচী।”
“মালিহা বলল কয়েকদিন পর আসবে।”
“আমি শুনেছিলাম। আমার কিছু কাজ ছিল তাই আগে চলে এসেছি।” মাথা নাড়িয়ে বলল ইতমিনান। মকবুল আলী সামনে থেকে বিড়বিড় করলেন, “কাজ! হেহ!”
মিতুলের দিকে তাকিয়ে ইতমিনান বলল, “তোর কি অবস্থা?”
“ভালো।” শক্ত গলায় কাটকাট উত্তর দিলো মিতুল।
“আমার উপর এখনও রাগ করে আছিস?”
বাইরে তাকিয়ে মিতুল বলল, “যার তার সাথে আমি রাগ করি না।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইতমিনান। ছোট্ট মিতুল হলে তো দুটো চকলেটের বদলেই রাগ কমে যেতো। এখন কি করবে সে?
মকবুল আলী নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেও ইতমিনান গেলো না। বহুদিন না থাকায় ঘরে মাকড়সা জাল বুনেছে। ধুলোবালিতে একাকার অবস্থা। মিতুলের সাথে মিলে সবটা পরিষ্কার করলো সে। নাজিয়া করতে চাইলে তাকে জোর করে বসিয়ে রাখলো। নাজিয়া শান্ত হয়ে বসে রইলেন। আজকাল কিছুতেই আর তিনি জোর পান না। কাউকে জোর করতেও পারেন না।
দুপুর গড়িয়ে আযান দিলে কাজ শেষ হলো। মিতুলকে ডেকে ইতমিনান বলল, “আমার সাথে আয়।”
“কোথায়।”
“জুজুর কাছে।” দুষ্টুমিটা ধরতে বেগ পেতে হলো না মিতুলকে। ছোট বেলায় এই জিনিসের নাম শুনলেই সে অর্ধেক অজ্ঞান হয়ে যেতো। কিন্তু এখন সে বড় হয়েছে। ইতমিনান সেটা ভুলে গেলেও সে মনে করিয়ে দিতে ভুললো না। যখন দেখলো ইতমিনান বাড়ির পথ ধরেছে তখন মিতুল বলল, “তোমার মা জুজু?”
“বেয়াদব!” ধমকে উঠলো ইতমিনান। মিতুল হাসি চাপলো। জুজুর কথাটা কে বলেছিলো?
ভাত তরকারি নিয়ে বসে ছিলেন রাশেদা। নাতিকে পেয়ে জড়িয়ে ধরলেন। ময়লা শরীরেই শীর্ণ হাত বুলিয়ে দিলেন। তার টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে মিতুল বলল, “গা ময়লা হয়ে আছে দাদি। এখন ধইরো না।”
“ময়লা হোক আর পরিষ্কার হোক। আমারই তো।”
মিতুলের বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেলো। এই বুঝি আপন!
খাবার হাতে নিতেই আয়েশাকে নজরে পড়ল। বিনয়ী কণ্ঠে সালাম জানিয়ে মিতুল বলল, “ধন্যবাদ চাচী।”
আয়েশা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এদের পরিবারের কাউকেই তার সহ্য হচ্ছে না।
•
মালিহা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে পনেরো মিনিটের কাছাকাছি। মিতুল বারবার বলেছে যেন তার জন্য অপেক্ষা করে। উঠলো মালিহা। ভাবলো একরু এগিয়ে যায়। প্লাটফর্ম থেকে বের হয়ে প্রবেশ পথে দাঁড়ালো। তারও প্রায় তিন মিনিট পর মিতুলের চিৎকার ভেসে এলো, “আপা!”
চকিতে তাকালো মালিহা। তার বুকটা ধ্বক করে উঠেছে। মিতুল সাইকেল চালিয়ে আসছে। কাছে আসতেই ধমক দিল মালিহা, “এভাবে ডাকে কেউ? ভয় পাইনি?”
“তোর টিকটিকির হার্ট। ভয় পেলে আমি করবো?”
“চিৎকার করবি না তাতেই হবে।”
“দেখ সাইকেল এনেছি তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কাউকে ওঠাইনি জানিস? তুই উঠে যাত্রা শুরু কর।”
মালিহা তখন সাইকেলটা খেয়াল করলো।
পেছনের সিট ধরে বলল, “ধারের জিনিস।”
“আমি কি টাকা মে’রে দেবো ভেবেছিস? মিতুল ম’রে গেলেও ধাপ্পাবাজি করবে না। নে বিসমিল্লাহ বলে ওঠ।”
হঠাৎ করেই ইরিনার কথা মনে পড়লো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মালিহা বলল, “ইনশাআল্লাহ্।” পরপর আবার বলল, “এই বেলুন লাগিয়েছিস কেনো?”
“তোকে ওঠাবো তাই।” লাজুক কণ্ঠে বলল মিতুল। মালিহা হাসলো। বাবাকে এতো মনে পড়ছে কেনো? সিটের পেছনে তিনটা বেলুন ঝুলছে। সেগুলো খুলে হাতে নিলো মালিহা। বলল, “ফেঁটে যায় যদি!”
মিতুল ব্যাগ সামনে নিয়ে নিলো। মালিহা বসলে তার হাত টেনে নিজের পেটের উপর রেখে বলল, “আপা সাবধানে ধরিস। সুড়সুড়ি দিস না প্লিজ!”
সাথেই সাথেই সুড়সুড়ি দিলো মালিহা। মিতুল লাফিয়ে উঠে বলল, “ভরা রাস্তায় পড়ে গেলে তোর আমার দুজনেরই মান সম্মান যাবে। যা করার বাড়ি যেয়ে করিস।”
মালিহা শান্ত হয়ে বসলো। সুতোয় বাঁধা বেলুনগুলো হাওয়ায় উড়ছে। মিতুল পিঠের দিকে তাকালো মালিহা। ভাইটা এতো বড় হয়ে গেলো কবে?
“আপা!”
“হু!”
“জানিস কি হয়েছে?”
“কি হয়েছে?”
“চাচার ছেলের জন্য মেয়ে দেখছে। সেদিন নাকি এক মেয়ে দেখে এসেছে। সেই বড়লোক!”
চট করে মিতুলের মুখের দিকে তাকালো মালিহা। সম্বোধন নতুন হলেও চিনতে বেগ পেতে হলো না তাকে। মিতুল লোকমুখে শোনা বর্ণনা দিতে ব্যস্ত। মালিহার মনে পড়ে গেলো ইতমিনানের অপলক দৃষ্টিগলো। ওয়েটিং রুমে, সিঁড়িঘরে কাঁচের আড়াল থেকে সদর দরজায়, হাসপাতালে। নিজেকে কষে ধমক দিল মালিহা। নীতিটার কথার জন্যেই মনের মধ্যে ওসব এসেছে। নয়তো ইতমিনান কি কখনও তাকে কিছু বলেছে?
পুকুর পাড়ে নামলো মালিহা। বাকিটা হেঁটে গেলো মিতুলের সাথে গল্প করতে করতে। বেলুন হাওয়ায় ওড়ানোর এক ফাঁকে দৃষ্টি গেলো মকবুল আলীর বাড়িতে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে ইতমিনান। তার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা মালিহার অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিলো যেনো। তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে ফেললো সে। মালিহা বুঝতে পেরেছে কাপড়ের পর্দা হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে, তার ক্ষমতা নেই দৃষ্টির তীক্ষ্মতার আঘাত থেকে অন্তরকে রক্ষা করার। সেজন্য নেত্র পল্লব আছে। ছোট্ট ঐ পর্দা দিয়ে চোখদুটো ঢেকে দিলেই মনকে বাঁচানোর প্রাথমিক কাজটা সহজ হয়ে যায়। মালিহা তাই করবে। পরিণত বয়সে অযৌক্তিক ছেলেমানুষী করার কোনো মানেই হয় না।
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৫
আয়েশা চুলে তেল দিচ্ছিলেন। ছেলের দিকে সরু চোখে তাকালেন। টেবিলে কি যেনো ঘাটাঘাটি করছে। আজকাল ছেলেকে খুব চোখে চোখে রাখা শুরু করেছেন তিনি। মাথা বিগড়ে গেছে। জীবনটা বিগড়ানোর আগে লাগাম টানতে হবে। এতদিন মিলির কথায় বিরক্ত হলেও আজ যখন তার কথা সত্যি হতে দেখলেন তখন মনে মনে মিলির দৃষ্টির প্রশংসা না করে পারলেন না। তিনি মা হয়ে যেটা বুঝতে পারেননি সেটা মিলি বুঝে ফেলেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আয়েশা। ছেলেকে চিনতে কি বেশি ভুল হয়ে গেলো?
রাবেয়া চলে গেছে নিজের বাড়িতে। তাকে বারবার বলে দেয়া হয়েছে বিষয়টা পাঁচকান না করতে। তিনিও আশ্বস্ত করেছেন আয়েশাকে। আড়ালে ইতমিনানকেও। রাবেয়া বেশ অনেকক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেছেন। ইতমিনান মালিহাকে পাশাপাশি খারাপ লাগে না। বেশ মানায়। ছেলে তো রাজি। কিন্তু মেয়েটা রাজি না হলে তো বেচারারা মায়ের সাথে এই দ্ব’ন্দ্ব সং’ঘা’ত বিফলে যাবে। রাবেয়া ভেবে রেখেছেন মালিহার মনের খবর টেনে বের করবেন। আশা করা যায় খুব একটা কঠিন হবে না।
আয়েশা বারবার করে ইতমিনানকে বললেন মিলির সাথে দেখা করতে যেতে। ইতমিনান হু হা করলো। সেদিনই রাবেয়া ফোন দিয়ে ইতমিনানকে তার বাড়িতে দাওয়াত করলেন। ফুপুর দাওয়াত, না করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু মালিহা, মিতুলকেও বলা হয়েছে শুনে আয়েশার মাথা গরম হয়ে উঠলো।
“রাবেয়া! তুমি কি প্যাঁচ বাঁধাতে চাইছো বলো তো?”
“কি বললেন ভাবি? আমাকে আপনার প্যাঁচ বাঁধানো ননদ মনে হয়?”
“তাহলে মালিহাকে দাওয়াত করেছো কেনো?”
“ইতু যেমন আমার ভাতিজা ওরাও তো এমনই। তাছাড়া মালিহাকে একা করিনি তো। মিতুলকেও করেছি।”
“যা ইচ্ছা করো। কিন্তু আমার ছেলের গলায় মালিহাকে ঝোলানোর চিন্তা করবে না বলে দিলাম।”
“আপনার ছেলেই মালিহাকে গলায় নেয়ার জন্য লাফাচ্ছে। আমি কি করলাম?” বিড়বিড় করে বললেন রাবেয়া। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। ছেলে বলে কিছু করো, মা বলে খবরদার কিছু করবে না। আর ওদিকে আরেকজন মনের কোনো খোঁজ নেই। কি একটা হযবরল অবস্থা!
•
বইখাতা নিয়ে বসে আছে মালিহা। তবে পড়াশোনার প ও হচ্ছে না। বাড়ি এলে এই এক অবস্থা হয়। ব্যাগ ভর্তি বই আনা হয়। তারপর সেভাবেই ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। মাঝের ছুটিতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। তবে মালিহা মনে মনে রুটিন করেছে। এবার পড়তেই হবে। ইয়ার ফাইনাল বলে কথা। যেনো তেনো বিষয় তো নয়।
সেই বিকেলের সময় কোত্থেকে মিতুল ছুটতে ছুটতে এলো।
“এই আপা!”
“কি হয়েছে? ছুটে এলি কেনো?”
“এমনি। কিছু হয়নি। তুই রেডি হ।”
“কোথায় যাব?” মালিহার ভুরু কুঁচকে এলো।
“বাজারে। চল।”
“আমি বাজারে যাবো কেনো?”
“এতো কথা বলিস কেনো? কাজ আছে। চল চল! এক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে এসেছি। দেরি করলে হবে না। ওঠ না রে!”
মালিহাকে ঠেলেঠুলে পাঠালো মিতুল। সে রেডি হতেই সাইকেলে করে নিয়ে গেলো বাজারে।
চারদিকে হরেক রকম দোকান। জামা, জুতা, প্রসাধনীসহ নানান রকম দোকানের মাঝে এনে সাইকেল থামলো মিতুল। মালিহা নামলে লাজুক কণ্ঠে বলল, “আপা এক হাজার টাকা বাজেটের ভেতর তোর যা ইচ্ছা নে।”
সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ালো মালিহা। চারদিকে তাকিয়ে বলল, “এক হাজার টাকা কি লটারি পেয়েছিস?”
“না। আমার প্রথম মাসের বেতন। ওখান থেকে এক হাজার টাকা তোর জন্য রেখে দিয়েছিলাম।”
শীতল দৃষ্টিতে মিতুলের দিকে তাকালো মালিহা। ছেলেটা চুল কেটেছে। একদম কদম ছাট। উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটা রোদের যত্নে লালাভ রঙ ধারণ করেছে। ধীর গতিতে ডান হাতটা ভাইয়ের মাথায় রাখলো মালিহা। আজ নিজেকে সত্যিই তার ছোট বোন মনে হচ্ছে।
কয়েক দোকান ঘুরে টুরে একটা পার্স কিনলো মালিহা। কালো কাপড়ের উপর লাল সীতার হাতের কাজ। হালকা ডিজাইনের মাঝে চমৎকার। তার খুশি দেখে মিতুল বলল, “আপা যখন আমার আরো টাকা হবে তখন এই ব্যাগ তোকে দশটা কিনে দেবো।” মালিহা হাসলো। প্রশ্রয়ের হাসি।
পার্সের পেছনে এক হাজার টাকা শেষ হলো না। মালিহা বলল, “মা’র জন্য কি নিয়েছিস?”
“কিছু না।”
“মা’র ঘরে পড়ার পন্সটা দেখলাম নষ্ট হয়ে গেছে। চল একজোড়া জুতা কিনি।”
নাজিয়ার জন্য জুতা কিন রাশেদার জন্য গোটা দশেক পান নিলো মিতুল।
“দাদি আমাকে খুব ভরসা করে আপা। নাহলে আমি চাইতেই টাকা দিয়ে দিতো? এই ভরসার মর্যাদা আমাকে রাখতেই হবে।”
বাড়ি যাওয়ার পথে রাশেদার সাথে দেখা করতে গেলো মালিহা। সদর দরজায় ইতমিনানের মুখোমুখি হলো। মুখ নিচু করে চলে যেতে চাইলেও পারলো না। ইতমিনান বাঁধা দিল।
“কি রে! চোরের মতো করে কোথায় চলে যাচ্ছিস? আমি কথা বলছি শুনতে পারছিস না?”
এক পলক ভাইয়ের দিকে তাকালো মালিহা। মিতুল গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
“ভালো আছি।”
“আদব লেহাজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমি যে বয়সে বড়, আমাকেও তো শুনবি নাকি?”
“তুমি কেমন আছো?”
“যা ভেতরে ঢোক। আমার থাকা না থাকা দিয়ে আর কিছু চিন্তা করা লাগবে না।”
ইতমিনানের অসন্তোষ কণ্ঠে লজ্জিত হলো মালিহা। নিজের মনের ভেতর কি হয়েছে তাতে আরেকজনের সাথে লুকোচুরি করলে চলবে কেনো? এতে তো বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটবে। ইতমিনানের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। দুইদিন পর বিয়েও হয়ে যাবে। কাজেই এই লুকোচুরি করা বোকামি।
নিজেকে হাজার রকম বুঝ দিলো মালিহা। শেষতক স্বাভাবিক ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলো।
দাদির কাছে পানের প্যাকেট তুলে দিতেই তিনি বেজায় খুশি হলেন। মিতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “বড় হয়ে গেছিস দেখি ভাই! ইতু জীবনে এক প্যাকেট পান এনে দিলো না। আল্লাহ তোরে হেদায়াত দিক।”
“দাদি আমাদের বাসায় চলো।”
মালিহার দিকে ঘুরলেন রাশেদা, “যাবো রে। আজকেই যেতে চাইছিলাম। হঠাৎ পায়ের শিরায় টান পড়ল। এই দেখ, ডান পা নড়াতেই পারছি না। আল্লাহ ভালো করলে কালকে যাবো ইনশাআল্লাহ্।”
মালিহা মিতুল চলে গেলো। তবে এর মাঝে আয়েশা একবারের জন্যেও ঘর ছেড়ে বের হলেন না। মালিহা ভাবলো বোধহয় ঘুমাচ্ছে। রাশেদা মনে মনে কষ্ট পেলেন। ছেলেমেয়ে দুটো খালি মুখে চলে গেলো। তিনি একটু আগেই দেখেছেন আয়েশা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। এর মাঝেই ঘুমিয়ে গেলো? ভাবনার মোড় ঘোরাতে চাইলেন রাশেদা। জীবনের এই পর্যায়ে অনেক কিছু অদেখা করে চলতে হয়।
মিতুল বাড়ির দিকে না যেয়ে দোকানে ফিরে গেলো। এক ঘণ্টার একটু বেশি হয়ে গেছে। বকা না শুনলেই হয়েছে।
তারা দুজন বের হতেই দাদির কাছে ছুটলো ইতমিনান। আয়েশা মাত্রই কোথায় বেরিয়ে গেলেন। অথচ এতক্ষন ঘরের দুয়ার দিয়ে ছিলেন। এই সুযোগে যদি কিছু করা যায়।
“দাদি আসি?”
“আয় আয়।”
“মিতুল দেখি পান কিনে তোমারে হাত করে ফেলছে।”
রাশেদা হেসে বললেন, “মিতুলটা বড় হয়ে গেছে বুঝলি।”
“আর মালিহা?”
“মালিহা তো বড় হইছেই। বিয়ের সময় হয়ে গেলো। কোন বাড়ি যে যায়!” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রাশেদা। ইতমিনান সন্তর্পনে রাশেদার পাশে বসে বললেন, “আচ্ছা দাদি ছেলে হিসেবে আমি কেমন? আমার মন রাখার জন্য বলতে হবে না। সত্যি কথা বলো তুমি।”
রাশেদা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “চলনসই।”
ইতমিনানের মনটা টুকরো হয়ে গেলো। দাদি একটা মানুষ বটে! কোথায় আহ্লাদ করে বলবে তোর মতো ছেলেই হয় না! বলে কি না চলনসই! গুছিয়ে রাখা কথাগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো ইতমিনানের। ধীর কণ্ঠে বলল, “মালিহাকে তোমরা কেমন ছেলের সাথে বিয়ে দিবা? চলনসই ছেলে হলে হবে না?”। রাশেদা সতর্ক চোখে তাকালেন, “কি বলিস খোলাসা করে বল।”
এই পর্যায়ে দাদির হাত ধরলো ইতমিনান, “দাদি! মা’কে একটু বোঝাও না!”
কথার মানে বুঝতে পেরে রাশেদার চোখ কপালে উঠলো, “এই কি খেলনা ভাই? চাইলাম আর পেয়ে গেলাম।”
ইতমিনান কথা বলল না। করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দাদির দিকে। রাশেদা দম ছেড়ে বললেন, “নিজেই নিজের উপরে বোঝা নিয়েছিস। মালিহা কি বলে?”
“জানিনা।” রাশেদা বুঝলেন, সবটা একপাক্ষিক।
“মন সামলাতে হয় ভাই। মনের বাঁধন একবার ছুটে গেলে তারে আর আটকানো যায় না। মন বাঁধার জন্যে প্রথমেই চোখ নামাতে হয়। দেখ, তুই পু’ড়ছিস। কিন্তু যার জন্যে পু’ড়ছিস তার কোনো বিকার নাই। সে এসব পছন্দ করবে কি না তাও জানিস না।”
ইতমিনানের ছোট্ট বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গেলো, “মালিহা আমাকে পছন্দ করবে না?”
“আমরা তো জানিনা করবে কি না।”
“একটা চেষ্টা করে দেখা যায় না দাদি?”
“ধর মালিহা মানলো। কিন্তু তাও তো তোরা শান্তিতে থাকতে পারবি না। নাজিয়া তোরে পছন্দ করে। সে মানলেও আয়েশা মানবে না। বিয়ের পরে মা বউকে কে অপরের শত্রু হিসেবে দেখতে পারবি?”
ডানে বায়ে মাথা নাড়ল ইতমিনান।
“তাহলে আগে এর প্রতিকার কর।”
•
মিতুল ছুটি নিতে পারেনি। দুপুরে খাবার সময়টুকু শুধু ফুপুর বাড়িতে থাকতে পারবে বলে জানিয়েছে। বোনকে বলেছে আগেভাগে চলে যেতে। রাশেদা আসায় নাজিয়া আর একা রইলেন না। স্ফূর্ত চিত্তে বের হয়ে গেলো মালিহা। তবে বড় চাচার বাসার সামনে আসতেই ইতমিনান কোত্থেকে এসে পাশ ধরলো।
“তুই কি ফুপুর একমাত্র ভাতিজি? আর দুনিয়ায় কেউ নাই? সৌজন্য রক্ষা করার জন্যেও তো একটু বলতে পারিস।”
মালিহার মাথা থেকে ইতমিনানের কথা একেবারেই বেরিয়ে গিয়েছিল। তার মনেই হয়নি যাওয়ার বেলায় ইতমিনানের খোঁজ নিতে হবে।
“সরি।” মিনমিন করে বলল মালিহা।
দম ছাড়লো ইতমিনান। সরি দিয়েই সব ঠিক করা গেলে সকাল, দুপুর, বিকাল সে আয়েশার কাছে সরি বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো। কিন্তু আয়েশা তো মনে বজ্র আঁটুনি গেথেছে। ছেলেকে অবিবাহিত রাখবে তবু নাজিয়ার মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে না। সে মালিহা হোক আর যেই হোক না কেনো।
“তোর পরীক্ষা কবে থেকে?”
“ছুটির দুইদিন পর থেকেই।”
“ওহ। টিউশনি কেমন যাচ্ছে?”
“আর টিউশনি! আমার কপালে ঐসব নাই। বিকালে যেখানে পড়াতাম ওরা না করে দিয়েছে।”
ইতমিনানের কপালে ভাঁজ পড়ল, “কেনো? পড়াতে পারিস না?”
রুষ্ট হলো মালিহা। ইতমিনানকে পুরো ঘটনা বলল। ইতমিনান বলল, “টিউশনি করতে হয় চোখ কান বন্ধ করে। ছাত্রীর মুখের দিকেও তাকানো যাবে না। চোখ থাকতে হবে শুধু তার বই আর খাতায়।”
“মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে ভাইয়া। ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওর মা বুঝতেই পারছে না।”
ইতমিনান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পৃথিবীতে মানুষ আসে হাজার রকম সীমাবদ্ধতা নিয়ে। আর মানুষের আকাঙ্ক্ষা সব সীমাবদ্ধতার শিকল ছিন্ন করার।
•
রাবেয়া ছুটোছুটি করে রান্না করছেন। মালিহা এক কোনায় বসে আছে। রাবেয়া বললেন, “বোরখা খুলে আয় মালিহা। এই রান্না ঘরে বোরখা পরে থাকলে একটু পরই ঘেমে গোসল হয়ে যাবি।”
মালিহা বোরখা খুলে এসে ফুপুর পাশে বসলো। রাবেয়া ভালো করে একবার মেয়েটাকে দেখলেন।
“এই মালিহা!”
“হু!” মালিহা মেঝেতে আঁকিবুঁকি করতে ব্যস্ত।
“তোর কি কাউকে পছন্দ হয়? তেমন কেউ আছে?”
মালিহা চোখ তুলে সবিস্ময়ে ফুপুর দিকে তাকিয়ে রইলো।
চলমান।
#উষ্ণতা
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪৬
“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? কথা বল।”
মালিহার পেছনে দরজার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালেন রাবেয়া। ইতমিনান উঁকি দিচ্ছে।
“কেমন পছন্দ?”
“বিয়ে করার মতো পছন্দ।” নির্বিকারে বলে পেঁয়াজ ছোলায় মনোযোগ দিলেন রাবেয়া।
“তুমি আবার এসব নিয়ে পড়লে কেনো?”
“যা জিজ্ঞেস করি তাই বল। এতো কথা বলিস কেনো!”
“না কোনো পছন্দ নেই।”
“আসলেই নেই?” সন্দেহী চোখে তাকালেন রাবেয়া।
মালিহা মাথা নাড়ল, “না।”
দরজার পাশে একটা ছোট প্লাস্টিকের বালতি ছিলো। উঁকিঝুঁকি দিতে যেয়ে কখন সেটার পাশে চলে গেছে ইতমিনান খেয়াল করেনি। মালিহা যখন বলল আসলেই তার পছন্দ কেউ নেই তখন ইতমিনানের পায়ে লেগে বালতিটা পড়ে গেলো। শব্দে মালিহা ঘুরে তাকালে সাথে সাথেই দেয়ালের সাথে সেটে দাঁড়ালো ইতমিনান। রাবেয়া বেজায় বিরক্ত হলেন। মালিহাকে বললেন, “এদিকে ঘোর। যতো দুনিয়ার অশান্তি রান্নাঘরের দরজায় এসে ঘোরে।” মালিহা ভাবলো ফুপু বিড়ালকে বকছে। ইতমিনানের মুখটা ছোট হয়ে এলো। ভাঙলো মন, পড়ল বালতি, বকা দিলো ফুপু। এই নাহলে কানেশন!
রাবেয়া উঠে দাঁড়ালেন। বেরেস্তার জন্য কাটা পেঁয়াজ গরম তেলে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “তা কেমন ছেলে বিয়ে করবি?”
“কেনো? তোমার ছেলেকে!” মুখ টিপে বলল মালিহা। তোমার ছেলে বলে সবার আগে ইতমিনানের কথাই রাবেয়ার মনে হলো। তৎক্ষণাৎ ঘুরে তিনি বললেন, “কি বললি!”
“আমাকে তুমি তোমার পুত্রবধূ করবে না?”
রাফির কথা বুঝতে পেরে রাবেয়া বললেন, “ঢং করো! আমার কচি ছেলের জন্য কচি বউ আনবো। তুই তো বুড়ি হয়ে গেছিস।”
“আমি বুড়ো হলে তুমি হয়েছো এক্সপায়ার্ড। ফুপা নিতান্তই ভালো মানুষ বলে তোমাকে রেখে দিয়েছে।”
কটমট করে তাকালেন রাবেয়া। কিন্তু টপিক থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে বললেন, “ইয়ার্কি করিস না তো। বল কেমন চাইলে বিয়ে করবি?”
“মনে তো হচ্ছে তুমি আটঘাট বেঁধেই নেমেছো। অবশ্যই ভালো ছেলে বিয়ে করব। সবদিক দেখে যাকে ভালো বলা যায়। পারফেক্ট টাইপ না। চলনসই হলেই হবে। তোমার স্টকে কেমন ছেলে আছে বলো।”
চলনসই কথাটা শুনে ইতমিনানের বুকটা ধুক করে উঠলো। দাদি বলেছিল সে চলনসই। তখন কি কষ্টটাই না লেগেছিল! আহা! এখন এতো সুখ সুখ লাগছে কেনো? সেই ক্ষণে নিজের ফোনের রিংটোন শুনতে পেয়ে ঘরের দিকে ছুটলো ইতমিনান। রাফিকে ফোন দিয়ে বসিয়ে এসেছে। নয়তো এতো আরাম করে সব শুনতে পেত?
মালিহার কথাবার্তা মন দিয়ে শুনলেন রাবেয়া। তার মুখে অস্বস্তির কোনো ছাপ নেই। চাপা দেয়া কষ্ট নেই। কাজেই ধরে নেয়া যায় ইতমিনানে প্রতি আলাদা কোনো অনুভূতিও তার নেই।
“আমি কি ছেলে নিয়ে ব্যবসা করি যে সবসময় দু চারটা স্টকে থাকবে? আশ্চর্য কথাবার্তা!”
মালিহা হাসলো, “ফুপু এখনই আমার বিয়ের জন্য এতো তোড়জোড় করতে হবে না।”
“কেনো?”
“এই অবস্থায় কি আমার বিয়ের কথা চিন্তা করা ঠিক?”
“কি অবস্থা? বাপ ম’রলে মেয়েরা বিয়ে শাদি কিছু করে না নাকি?”
“না সেটা না। কিন্তু মিতুলটা ছোট। আবার মা কেমন যেনো হয়ে গেছে। দিন দুনিয়ার কোনো খোঁজ নেই।”
“তুই বিয়ে না করলে সব ঠিক হয়ে যাবে? আর এমনিতেও থাকিস তো সারাবছর আরেক দেশে। বিয়ের মতোই। তাহলে আবার?”
“বিয়ে হলে তো আরেক পরিবারে চল যেতে হবে। আমার মা ভাইকে দেখভাল করার বিষয়টা যদি তারা পছন্দ না করে?”
“তোর মা ভাইকে তুই দেখবি না তো কি পাড়ার মানুষ দেখবে? এমন বিষয়ে যাদের আপত্তি তাদের সাথে বিয়ে দেবই বা কেনো?”
এই পর্যায়ে মালিহা কিছু বলল না। তরকারি ঢেকে চুলার আঁচ কমিয়ে রাবেয়া নরম কণ্ঠে বললেন, “শোন মালিহা, সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। ছয় বছরের আগে প্রাইমারীতে ওয়ানে ভর্তি নেয় না। আবার দু চার বছর পর ঐ একই ওয়ানে ভর্তি হতে গেলে তখন আর সেই পড়া ভালো লাগে না। কারণ সময়। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটা করে ফেলতে হয়। তুই বড় হয়েছিস, বুঝতে শিখেছিস। যদি মনে করিস একটা পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার মতো মানসিকতা তোর তৈরি হয়েছে তাহলে আমি বলব আর দেরি করার কোনো মানে হয় না। একুশ বছরের কাজ আঠাশ বছরে করলেও চলে। কিন্তু একুশ বছরের আবেগ, অনুভূতি কোনোটাই তখন আর কাজ করে না। কেবল করার জন্যই করা।”
মালিহা মাথা নিচু করে বসেছিল। তার কিছুটা লজ্জা লজ্জা লাগছে। মেঝেতে আঁকিবুঁকি করতে শুরু করলো সে।
“মেঝেতে হাত লাগাস না। নোংরা হয়ে আছে।” মালিহা হাত উঠিয়ে ফেললো। ঝেড়ে কোলের উপর রেখে দিলো।
“তোর যেমন পছন্দ তেমন খোঁজ খবর করে নিবি। তাহলেই হলো। আমার হাতে ভালো একটা ছেলে আছে। কি বলিস?”
মুখ নিচু করে মালিহা বলল, “মায়ের সাথে কথা বলো ফুপু।”
“তার নিজেরই খোঁজ নাই। আচ্ছা বলবো।”
রাবেয়া স্বস্তির শ্বাস নিলেন। অর্ধেক ঝামেলা মিটলো। ইতমিনানের কথা শুনে কি বলে কে জানে। আগে ভাগেই জানানোর কোনো মানে নেই। আগে ছেলেটা মা’কে রাজি করাক।
•
দুপুরে মিতুল এলো চিপস, চকলেট নিয়ে। ইতমিনানের সাথে চোখাচোখি হলেও কথা বলল না। রাবেয়া খেয়াল করে বললেন, “কি রে! তুই ইতুর সাথে কথা বলছিস না কেনো?”
“কিছু বলার নেই।”
“বড় ভাইকে তো মানুষ সৌজন্য করেও দুটো কথা বলে।”
“কথা না বলে যে বছরের পর বছর পার করে দিতে পারে তার জন্য আমার কোনো সৌজন্যবোধ আসে না।”
ইতমিনান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। খানিকটা হাসলো। বড় ভাই বলতে মিতুল তাকেই চেনে। সেই ভাইয়ের হঠাৎ দূরত্ব সে মেনে নিতে পারেনি। বুকে অভিমানের পাহাড় জমেছে। ইতমিনান মায়ের আদেশ ডিঙিয়ে চাচার বাড়ির সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে চাচার সাথে অন্তরালের যোগাযোগটুকু সে কখনো ছিন্ন করেনি। সেটুকু তো কেউ জানেনা।
মিতুলের রাগ জায়েজ। প্রতিবাদ করে না ইতমিনান। ভাবে একবার তার কাছে ক্ষমা চাইবে। মিতুল বুঝদার ছিল। তার বয়সে এমন শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারতো না ইতমিনান। তাকে বোধহয় খানিকটা মেরুদন্ডহীন ভাবে মিতুল। মালিহাও কি?
ভাবনাটা তাকে শান্তিতে খেতে দিলো না। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকলো। হঠাৎ মালিহা বলল, “তোমার জন্য নাকি মেয়ে দেখাদেখি চলছে? তা ঘটনা কি বিয়ে পর্যন্ত গড়ালে বলবে? কি ফুপু তুমিও তো কিছু বললে না।”
রাবেয়া ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন। মিলি, ইতমিনান, মকবুল আলী যার ওপর যতটুকু রাগ ছিল সবটা প্রকাশ করে দিলেন। মিতুল বলল, “এখন তো তাও চেহারা দেখা যায় তখন দেখবি একটা চুলও আর দেখা যাচ্ছে না। দেখে নে দেখে নে! বংশের বড় ভাইকে দেখে নে।”
ফেরার পথে মিতুল দোকানে চলে গেলো। বাড়ি পৌঁছে ইতমিনান রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলো মিতুলের জন্য। তার বারান্দার পাশ দিয়ে যখন সে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল তখন ডাকলো ইতমিনান। মিতুল থামলো। কথা বলল না। দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে।
“আমার উপর তোর অনেক রাগ তাই না মিতুল?” গ্রিলের এপাশ থেকে প্রশ্ন করলো ইতমিনান।
“হওয়াটা কি ভুল?” আরেকদিকে তাকালো মিতুল।
“না। অবশ্যই না। আমি যদি তোর কাছে ক্ষমা চাই তুই কি আমাকে ফিরিয়ে দিবি?”
“তুমি ক্ষমা চাইলেই বা কি? আমি কি আমার গত পাঁচটা বছরের ইতু ভাইকে ফেরত পাবো?” মিতুল দাঁড়ালো না। সাইকেলের বেল বাজাতে বাজাতে চলে গেলো। ইতমিনান দাঁড়িয়ে রইলো গ্রিলের এপাশে। গ্রিল ডিঙিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা যে তার নেই।
•
আয়েশার ছটফটানি ইতমিনানের চোখ পড়েছে। ছুটির শেষ দিকে এক সন্ধ্যায় মায়ের পাশে বসলো সে। আয়েশার হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, “তুমি কি আমার উপরে রেগে আছো মা?”
আয়েশা হাত সরিয়ে নিলেন। ইতমিনান ক্লান্তির শ্বাস ছাড়লো।
“ছুটি শেষ হয়ে আসছে। আমি কি তোমার রাগ নিয়ে ফেরত যাবো?”
“আমার রাগের কোনো দাম আছে তোর কাছে?”
“অবশ্যই আছে।”
“তাহলে মালিহার বিষয়টা ভুলে যা।” একগুঁয়ে কণ্ঠে বললেন আয়েশা। ইতমিনানের স্বর আহত শোনালো, “মনের ওপর কি জোর চলে মা?”
“আমি কি তোর খারাপ চাই?”
“ভালোটা আমার সাথেই কেনো চাও না?”
“বুঝেছি। বড় হয়ে গেছিস। যা ভালো বুঝিস কর।”
ইতমিনান বসে রইলো ঘাড় নিচু করে। ভারী শ্বাসগুলো বুকের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকটাও ভারী হয়ে উঠেছে। চোখ ভিজে আসতে চাইলো ইতমিনানের। মিতুল তার ওপর রেগে আছে, মা তার ওপর রেগে আছে। অথচ সে সবার রাগ থেকে সবসময় দূরে থাকতে চেয়েছে। রুদ্ধ কণ্ঠে ইতমিনান বলল, “আল্লাহ বলেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। আমি সেই পা সারাজীবন যত্ন করতে প্রস্তুত। কিন্তু সন্তানের কিছুতে বোধহয় মায়েদের বেহেশত নেই। নাহলে তুমি এতো কঠোর হতে পারতে না। বলো মা?”
কথা শেষ করে চলে গেলো ইতমিনান। এমনিতেই সে সবার রাগ না চাইতেই পেয়ে গেছে। এবার চোখের জল দেখিয়ে করুণা পেতে চায় না।
আয়েশা ছেলের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মালিহার সাথে জীবনে যে সে সুখী থাকতে পারবে না এই সহজ সমীকরণটা কেনো বুঝতে চাইছে না ইতমিনান?