Sunday, June 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 92



প্রকৃতির বিচার পর্ব-০২

0

#প্রকৃতির_বিচার
#পর্ব_০২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

নয়না তার শাশুড়ীর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। নয়নার শাশুড়ী তার বিয়ের গল্প নয়নার সাথে করছে। তার শাশুড়ীর কথায় নয়না হেসে হেসে উঠছে। নয়নার হাসি মাখা মুখ দেখে নয়নার শাশুড়ীর প্রশান্তি পাচ্ছে। নয়নার শাশুড়ী হামিদার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। অনেক চেষ্টা করেও উড়ানের পর আরেকটা সন্তানের মুখ তিনি দেখতে পারেননি। এতে তার কোনো দুঃখ নেই। বিধাতা যদি তাকে পুত্রসন্তান দিয়ে খুশি হন তাহলে বিধাতার খুশিতেই তার খুশি। নয়নার এই মানুষটার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে বিরক্ত লাগে। যখন উড়ান বাংলাদেশ ছিল। তখন হামিদা বেগমকে নয়নার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু জোহানের সাথে সম্পর্ক হবার পর থেকে আর কাউকে ভালো লাগে না। নয়নার শাশুড়ীর ভালোবাসা নয়নার কাছে বিষাক্ত লাগছে। নয়না বিরক্ত নিয়ে চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। নয়নার শাশুড়ী হাসতে হাসতে বলল,

–জানো মা আমার ছেলে তো বিয়েই করতে চাইতো না। আমি তো আমার ছেলেকে চিনি। ছেলেটা আমার খুব দাম্ভিক। খুব সহজে সবার সাথে মিশতে পারে না। কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে পারে না। নিজের আবেগ গুলো নিজের মধ্যে চাপা রাখে। উড়ান আমাদের ভালোবাসে জানি, সে আমাদের ভালো রাখার জন্য সবকিছু করতে পারে। কিন্তু উড়ান যদি বিয়ে না করে বিদেশ যেত। তাহলে উড়ানের পিছুটান হতো না। তুমি আছো বলেই উড়ানের পিছুটান তৈরি হয়েছে। আমার ছেলেটা যখন ফোনে কথা বলে তখন খুব সুন্দর করে বলে মা আর তিনটা বছর তারপরে আমি তোমাদের কাছে চলে আসব। অথচ বিয়ের আগে এই ছেলে আমাকে বলতো। অনেক টাকার মালিক না হওয়া পর্যন্ত সে দেশে আসবে না। আর আজ দেখো বলে কি না দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে যাবে। আমার ছেলেটা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার ছেলের সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। তুমি কখনো আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিও না। আমি আমার ছেলের ব্যথা সহ্য করতে পারব না।

নয়না কৃত্রিম হেসে বলল,

–আমি অনেক ভাগ্যবতী জানেন, মা। তা না হলে আপনাদের মতো একটা পরিবার আমি পাই। আপনার মতো শাশুড়ী পাওয়া এই যুগে খুবই দুষ্কর। এই যুগের শাশুড়ীরা পরের মেয়েকে দিয়ে কাজ করাতে পারলে বাঁচে। সেখানে আমি নয়টায় ঘুম থেকে উঠি তবুও আপনি আমাকে কিছু বলেন না। উল্টো আমার সুখের কথা চিন্তা করে বাসায় কাজের লোক রেখেছেন। আমি এত সুখ রেখে কোথায় যাব বলেন? আমার এই সুখে কারো নজর না লাগুক। আপনি, আব্বা, উড়ান এই তিনজন আমার পৃথিবী। আপনারা না থাকলে আমার পৃথিবী থাকবে না। আপনারা কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমি যদি কখনো ভুল করি তাহলে বকে দিবেন। আমি আমার ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করব। আমি আপনাদের কিছুতেই হারাতে চাই না।

–আমার একটা মেয়ের অনেক শখ ছিল জানো, বউ মা। আমি অনেক চেষ্টা করেও আরেকটা বাচ্চা নিতে পারিনি। আমি মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম। যে আমার ছেলের বউ হয়ে আসবে। আমি তাকে আমার মেয়ের মতো করে আগলে রাখব। আমি কখনো বুঝতেই দিব না সে আমার ছেলের বউ। আমি তোমাকে কখনো নিজের মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না। আমি আজকালকার যুগের মতো শাশুড়ী হতে চাই না। আমি একটু ভিন্ন ধরনের শাশুড়ী হতে চাই। যে শাশুড়ী ছেলে তার বউকে বেশি ভালোবাসলে ঈর্ষা করবে না। যে শাশুড়ী ছেলের বউয়ের ঘুমানো সহ্য করতে পারবে না। ছেলের বউ কাজ না করলে যে শাশুড়ী হাজারটা কথা শোনাবে। আমি তোমার শ্বশুরকেও বলে দিয়েছি। আমরা বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসব কোনো কাজের মেয়ে না। আমি জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। সেই কষ্ট তোমাকে পেতে দিব না।

–আপনি এত ভালো কেন বলতে পারেন? আপনার মতো চিন্তাধারা যদি সব শাশুড়ীর হতো। তাহলে প্রতিটি সংসারে অশান্তি নামক কোনো শব্দ থাকতো না। আপনি যে আমায় এতটা ভালোবাসেন। আপনার ভালোবাসার মূল্য আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দিয়ে যাব, মা। আপনি সারাজীবন এমন থাকবেন আর আমাকে এভাবে ভালোবেসে যাবেন। আপনার ছেলে বিদেশ থেকে আসলে আমাকে ভুলে যাবেন না কিন্তু।

–পাগলি মেয়ে একটা! মা কখনো তার মেয়েকে ভুলে যেতে পারে? তুমি আমার কাছে বসো আমি তোমার চুলে তেল দিয়ে বিনুনি করে দেই। এতে তোমার চুল সুন্দর হবে।

নয়নার শ্বশুর রমিজ রহমান চা হাতে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। রমিজের পেছনে পেছনে কাজের মেয়ে নীলাও আসলো। নয়নার বুঝতে বাকি রইল না। নীলার কষ্ট হচ্ছিল তাই রমিজ নীলাকে সাহায্য করছে। নয়না মানুষ দু’টোর ব্যবহার দেখে আসলেই মুগ্ধ হয়। একটা মানুষ এতটা ভালো কীভাবে হতে পারে? রমিজ একটা একটা করে চা সবার হাতে তুলে দিল। রমিজ বিছানায় বসে পায়ের ওপরে পা তুলে বলল,

–আমাকে রেখেই তোমরা সব গল্প করে ফেলছো। আমি তোমাদের এতটাই পর হয়ে গেলাম? বুঝেছিস নীলা তোকে আর আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই বাড়িতে সবাই আমাদের রেখেই একা একা আড্ডা দেয়।

নীলা দাঁত কেলিয়ে বলল,

–হেহে আপনি কী যে কন না, বাজান। আপনে এই বাড়ির মালকিন। আপনে যদি গৃহত্যাগী হন তাইলে উড়াই ভাই আইয়া আমাগো হগলরে বাড়ি থাইকা বার কইরা দিব।

নয়না কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

–আপনি আমার বাবা হন। মেয়ে কখনো তার বাবাকে ভুলে যেতে পারে। আমি জানতাম আপনি নামাজ শেষ করে এই ঘরেই আসবেন। তাই আমি আর মা মিলে চুলে তেল দিচ্ছিলাম।

রমিজ হেসে বলল,

–বুঝলে বউমা। আমি একটা বুদ্ধি করেছি। আমার একটা জায়গা খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের আল্লাহর রহমতে কোনো ঋণদেনা নেই। আমরা চাইলেই একটা সুন্দর বাড়ি বানিয়ে ফেলতে পারি। আমার ছোটো বেলা থেকেই একটা বাড়ি বানানোর অনেক শখ ছিল। কিন্তু আমরা তো নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলাম। তাই চাইলেও সব শখ পূরণ করতে পারতাম না৷ আমার পোলাডা আল্লাহর রহমতে ভালো টাকা ইনকাম করে। কয়টা বছর খাটাখাটুনি করলে একটা বাড়ির দেওয়ার টাকা হয়ে যাবে। আমি অনেক বড়ো বাড়ি দিব। সেখানে আমাদের চারজনের সংসার হবে। আমার নাতিনাতনি আসলে আমি তাদের নিয়ে খেলব। শেষ বয়সটা নাতিনাতনিদের সাথে হেসে খেলে পার করতে চাই। আমাদের বাসায় অনেক মানুষ ভাড়া থাকবে। সেই ভাড়ার টাকায় আমাদের সংসার চলে যাবে। আমাদের পোলাকে আর বিদেশ যেতে হবে না। আমি ভাবছি উড়ানকে কথা গুলো বলব। আমার পোলার কষ্টের টাকা অযাচিত কাজে যাতে ব্যবহার না হয়। সেদিকে আমাদের সবার খেয়াল রাখতে হবে। আমার পোলাকে তোমরা সবাই সময় দিবে বেশি বেশি। পোলাডা আমার দশ বারো ঘন্টা কাজ করে। কাজ শেষে যদি আমাদের সাথে কথা বলতে না পারে তাহলে তার কষ্ট দ্বিগুন বৃদ্ধি পাবে। আমরা যত পারব উড়ানকে সঙ্গ দিব। উড়ানকে কখনো একাকিত্ব অনুভব করতে দিব না।

নয়না অভিমান করে বলল,

–আমাকে এতটুকু ভরসা করেন না, আব্বা। আপনার ছেলে না খেলে আমি খাই না। দু’জন ভিডিও কলে বসে একসাথে খাই। উড়ান ফোন দেওয়ার সাথে সাথে ফোন রিসিভ করি। আমাকে আপনি এভাবে বলতে পারলেন?

–আমি শুধু তোমাকে না সবাইকে বলেছি, মা৷ তুমি আমার কথায় কষ্ট পেও না। এখন বলো জায়গা কেনা আর বাড়ির দেওয়ার ব্যাপারে তোমাদের সবার মতামত কী?

নয়না বলল,

–আপনি বাড়ি দিবেন এটা তো ভালো কথা।

হামিদা বেগম বলল,

–তবে সব ছেলের উপরে চাপিয়ে দিও না। আমাদের এই বাড়িটা বিক্রি করে জায়গা কিনবে আর উড়ানের টাকায় বাড়ি দিবে ঠিক আছে।

–এটা তুমি মনের মতো কথা বলেছ।

–আমি সব সময় মনের মতো কথা বলি।

হামিদা বেগম আর রমিজ রহমানের খুনসুটি শুরু হয়ে গেল। তাদের খুনসুটি দেখে নীলা আর নয়না হেসে ফেলল।

চলবে…..

প্রকৃতির বিচার পর্ব-০১

0

#প্রকৃতির_বিচার
#পর্ব_০১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

প্রেমিকের বুকে মাথা রেখে প্রবাসী স্বামীর সাথে কথা বলছে নয়না। নয়নার স্বামী উড়ান দুই বছর ধরে প্রবাসে আছে। বাবা-মায়ের পছন্দে নয়নাকে বিয়ে করেছিল উড়ান। ছয়মাস নয়নার সাথে সংসার জীবন কাটিয়ে। পরিবারকে ভালো রাখার তাগিদে তাকে বিয়ে ছয়মাস পর সূদুর প্রবাসে পাড়ি জমাতে হয়েছে। ছয়মাসে নয়নাকে ভিষণ ভালোবেসে ফেলছে সে। তার অস্তিত্ব জুড়ে শুধুই নয়না। এই মেয়েটার হাসি মুখ উড়ানের সকল ক্লান্তি দূর করে দেয়। এই মেয়েটার জন্য তার দেশ তাকে খুব করে কাছে টানে। তার মাঝে মাঝে মন চায় সবকিছু ছেড়ে নয়নার কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু সে মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ একটা ছেলে। অনার্স শেষ করেও যখন চাকরির দেখা মিলছিল না। তখন বাধ্য হয়েই প্রবাসে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। ছেলের যেন ঘরে ফেরার টান থাকে সেজন্যই উড়ানকে বিয়ে করে বিদেশ পাঠিয়ে ছিল তার বাবা-মা। সেই থেকে গড়ে উঠেছে দু’জনের প্রণয়নে সম্পর্ক। নয়না কর্ণে ফোন ধরে বলল,

–তুমি খেয়েছ, জান? তুমি জানো না তুমি না খেলে আমি খেতে পারি না। তুমি খেতে বসলে অবশ্যই আমাকে ভিডিও কল দিবে। তুমি আর আমি দু’জন একসাথে খেতে বসব।

–তুমি এতটা ভালো কেন বলো তো, বউ? আমি অনেক ভাগ্যবান আমি তোমার মতো বউ পেয়েছি। আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না। তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে আমি একা হয়ে যাব। তোমাকে ছাড়া আমার নিজেকে নিঃস্ব নিঃস্ব লাগে। আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তারা তোমাকে আমার জীবনে নিয়ে এসে দিয়েছে। আমি তো বিয়ে করতেই চেয়েছিলাম না ভাগ্যিস বিয়েটা করেছিলাম। তা না হলে তোমার মতো পরীকে হাতছাড়া করে ফেলতাম।

–তোমার ভাগ্যে আল্লাহ আমাকে রেখেছে। তুমি আমি না চাইলেও আমাদের মিলন হবেই। তাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো। তোমার কাজ শেষ হতে কত সময় লাগবে?

–আমি এখন কাজ করছি। আমার কাজ শেষ হতে দুই ঘন্টা সময় লাগবে। আমার লক্ষী বউটা রাগ করে না। কাজ শেষ না করলে মালিকের হাতে বকা খাব। তুমি কি চাও তোমার বরটা মালিকের হাতে বকা খাক?

–আমি থাকতে আমার স্বামীকে বকা দিবে কার এত সাহস? আমি গিয়ে তোমার মালিকের চুল একটা একটা করে ছিড়ব এটা মাথায় রেখো।

নয়নার কথা শুনে উড়ান মনোমুগ্ধকর হাসি হাসলো। অধর জুড়ে যেন সুখেরা রাজত্ব করছে। যে মেয়েটা তার মানসিক শান্তির কারণ। সেই মেয়েটাই তার বেঁচে থাকার কারণ। উড়ান নয়নার জন্য বিধাতার কাছে দোয়া প্রার্থনা করল। বিধাতার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করল। হৃদয়ের গহীনে আনন্দরা ছন্দ তুলে আনন্দ উল্লাস করছে। উড়ান নরম কণ্ঠে বলল,

–আমি তোমাকে দুই ঘন্টা পরে ফোন দিব। তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আমার বাবা-মায়ের খেয়াল রেখো তাদের কখনো কষ্ট দিও না। তোমার কাছে এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার নেই আমার। তুমি আমার বিশ্বাসের মূল্য দিও। কখনো আমার হক নষ্ট করো না। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার হক কখনো নষ্ট করব না। আমাকে দেখো না আমি কিন্তু আমার কথায় অনড় আছি। আমার সহযোগীরা কতকিছু করে। আমাকে ডাকে আমিও যেন তাদের সাথে যাই। কিন্তু আমি তাদের সোজা না বলে দেই। আমার ঘরে আল্লাহর রহমত আছে। আমি কীভাবে পাপের মধ্যে জড়িয়ে যাব। আমার অনেক কষ্ট হয় জানো তবুও আমি পাপের পথে হাঁটি না।

–তোমার ব্যবহার, কথা সবকিছু আমাকে মুগ্ধ করে। তুমি মানুষটাই মুগ্ধতা দিয়ে জড়ানো। তোমাকে যত ভালোবাসব ততই কম হয়ে যাবে। তুমি এভাবেই সারাজীবন আমার হয়ে থেকো আমিও সারাজীবন তোমার হয়েই থাকব কথা দিলাম।

–তোমার কথা আমাকে মানসিক শান্তি দিল, নয়না। আমি এবার শান্তিতে কাজ করতে পারব। তুমি আব্বু আম্মুর সাথে গিয়ে গল্প করো। আমি রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।

নয়না ফোন কেটে দিতেই জোহান নয়নার হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে নয়নার উপরে শুয়ে পড়ল। নয়নার ললাটের চুল গুলো নাড়তে নাড়তে বলল,

–তোমার স্বামী আমার থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসে?

–এসব তুমি কী বলছো?

–তুমি যখন তোমার স্বামী সাথে ভালোবাসা দিয়ে কথা বলো তখন আমার সহ্য হয় না। আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যায়। তোমাকে আমি অন্য কারো পাশে সহ্য করতে পারি না, নয়না। তুমি কেন বুঝো না তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি। তুমি তাড়াতাড়ি উড়ানকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। তোমাকে ছাড়া আমি আর থাকতে পারব না।

–তোমাকে ছাড়া থাকতে আমারও ভালো লাগে না। তুমি একটু অপেক্ষা করো। উড়ান অনেক ভালো ছেলে ওকে ডিভোর্স দেওয়ার মতো কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কোনো কারণ ছাড়া একটা মানুষকে ডিভোর্স দেওয়া যায় না। উড়ান দেশে আসুক সে দেশে আসলে আমি একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। আমার উড়ানের বাবা-মায়ের চোখে খারাপ হতে হবে। উড়ানের বাবা-মা এত ভালো যে আমি চাইলেও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারি না। উড়ান তার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। তাদের কোনো মেয়ে নেই। তারা আমাকে একটা কাজ করতে দেয় না। আমার কষ্ট হবে বলে বাসায় কাজের লোক রেখেছে। আমাকে তারা রাজরাণীর মতো করে রেখেছে। এত ভালো মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করা যায় বলো?

–ওরাই তোমার কাছে সব? আমি তোমার কেউ না? আমার মূল্য তোমার জীবনে নেই? একটা পুরুষ তোমাকে প্রতিনিয়ত ভালোবাসি বলছে। তোমাকে নিয়মিত বউ বলে ডাকছে। তোমাকে কাছে পাওয়ার কত ব্যাকুলতা তার মনে। দেশে আসলে সে তোমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবে। তুমিও তার সাথে শুয়ে রাত কাটাবে। আমি এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। তুমি উড়ানকে ডিভোর্স দিবে কি না বলো?

–তুমি যদি আমাকে না বুঝো তাহলে কে বুঝবে শুনি? তুমি কোনো কামাই করো না। উড়ান বেশ মোটা অংকের টাকা আমাকে পাঠায়। সেখানে থেকে আমি উড়ানের বাবা-মাকে কিছু টাকা দেই সংসার চালানোর জন্য আর বাকিটা নিজের কাছে রেখে দেই। আমি ভাবছিলাম টাকাটার পরিমাণ আরেকটু বড়ো হোক। তুমি আমি পালিয়ে যাবার পর সেই টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা করতে পারি। খালি ভালোবাসা দিয়ে তো আমাদের পেট চলবে না।

জোহান নয়নার গালে চুমু খেয়ে বলল,

–এত বুদ্ধি নিয়ে তুমি রাতে ঘুমাও কীভাবে বলো তো? আমি তো তোমাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি। আমি কখনো এটা ভেবে দেখিনি সংসার করতে গেলে অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। তোমার মতো মেয়ে লাখে একটা হয় তোমাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারব না। তুমি টাকা জমাও সেই টাকা দিয়ে আমি ব্যবসা করব। আমাদের ব্যবসা যদি একবার সফল হয়ে যায়। তাহলে আমাদের বড়োলোক হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। তুমি এক কাজ করো আমাকে দশ হাজার টাকা দাও। আমার মা খুব অসুস্থ বুঝেছ। আমি এই মাসে মাকে টাকা পাঠাতে পারিনি এই মাসের টাকাটা তুমি দিয়ে দাও। আমি তোমাকে পরের মাসে তোমার টাকা পরিশোধ করে দিব।

–আমার টাকা মানে তোমার টাকা। তোমার মা তো আমারও মা। আমি কি আমার মাকে টাকা দিতে পারি না। আমাকে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে আর কখনো ছোটো করবে না।

–ওকে জান।

কথাগুলো বলেই জোহান শার্টের বোতাম খুলতে লাগল। জোহানকে শার্টের বোতাম খুলতে দেখে নয়না লজ্জায় লাল হয়ে যেতে লাগল। প্রায় তো সে জোহানের কাছে আসে তবুও যে কেন তার লজ্জা ভাঙে না। নয়নার পাঁচ আঙুলের ভাজে নিজের হাত ঢুকিয়ে দিয়ে নয়নাতে মত্ত হয়ে উঠল জোহান। নয়নাও প্রেমিক পুরুষের ডাকে সাড়া দিয়ে ভালোবাসার সমুদ্র ডুবে যেতে লাগল। দু’জন প্রেমিক হৃদয় ভালোবাসার জোয়ারে ভাসল। কিন্তু ভাসল না কেবল প্রকৃতি তার বোধহয় ভিষণ মন খারাপ। নীল অম্বরটা কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বিশাল আকাশটা গর্জন করে বলছে প্রকৃতির বিচার তুমি খুব শীঘ্রই পাবে।

চলবে…..

মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(শেষ পর্ব)

আজ দুই দিন ধরে আমান অদিতির ফোনে ম্যাসেজ দিচ্ছে। কিন্ত অদিতি ইগ্নোর করছে। কারণ, অদিতি সত্যিই বিরক্ত। আমানকে ও অন্য রকম ভেবেছিলো, নি:সন্দেহে আমান অনেক কেয়ারিং। কিন্তু না জেনে কেন এভাবে মন্তব্য করবে?

রাতের বেলা খাবার টেবিলে বসতেই হঠাৎ করেই আমান এসে টেবিলে বসে। বিরক্তিতে অদিতি ভ্রু কুঞ্চিত করে। আমান! এখানে! অদিতির বাবা এখনো খেতে আসে নি। আর মা রান্নাঘরে।

– অদিতি, আমি সরি। আপনি আমার কোন ম্যাসেজেরই উত্তর দিচ্ছেন না, এজন্য এভাবে অনাহুতের মতো আসতে বাধ্য হলাম৷

– আপনি অনাহুত কেন হবেন? আমার বাবা মা তো আপনাকে বাড়ির সদস্যের আসন দিয়েছেন।

– আপনি তো দেন নি!

– মানে?

-মানে খুব সহজ। আমি মানছি আমার এভাবে কথা বলা উচিৎ হয় নি। কিন্তু আমাকে তো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া উচিৎ ছিলো। আমার ‘সরি’ বলার সুযোগটুকু তো দেবেন। আমার বাবা মা মারা যান ছোটবেলায়। এরপর বোর্ডিং স্কুলে তারপর হোস্টেল, হল আর এখন একটা স্টুডিও এপার্টমেন্টে এভাবেই চলছে জীবন। এই যে আপনি খাওয়ার টেবিলে বসে আছেন, আপনার মা রান্নাঘরে কাজ করছেন একটু পরেই আপনার বাবা আসবেন – একসাথে বসে রাতের খাবার খাবেন। ঠিক এমন একটা জীবন আমার কাছে স্বপ্ন। দেখুন, আমি আজীবন বাউন্ডুলে গোছের। মানুষের জন্য দৌড়াই ঠিকই কিন্তু মানুষ আমাকে কতোটা ভালোবাসে? কতোটা মনে রাখে? প্রয়োজনের সময় আমাকে কল দেয় – ভাই এক ব্যাগ রক্ত লাগবে, যোগাড় করে দিতে পারবেন? কিন্তু প্রয়োজন মিটলে একবার জানতে চায় না, এই যে আমি সকাল থেকে রক্ত যোগাড়ে ছুটছি, আমার আদৌ সারাদিন খাওয়া হয়েছে কিনা! আরেক দল আছে, ঠিক খোঁজ নেয় কিন্তু সে বড় স্বার্থের জন্য। কারণ আমার চাচা অনেক ধনী, অনেক প্রভাবশালী, অনেক জায়গায় তাঁর জানাশোনা। এর বাইরে কেউ কখনো মাথা হাত রাখে নি, জিজ্ঞাসা করে নি – কেমন আছি, দুপুরে খেয়েছি কিনা!

আপনার বাবা, মা সর্বপ্রথম আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে – বাবা, আজ সারাদিন বড্ড ছোটাছুটি করেছো, আজ আর কোথাও যেও না। আমাদের সাথে খেয়ে, এখানেই ঘুমিয়ে থাকো। আপনার মা যখন শুনেছে আমার কেউ নেই, দুপুরে দুপুরে ফোন দেয় – আমান, বেটা খেয়েছো? নিজের দিকে খেয়াল রেখো।

বিশ্বাস করেন, এমন করে কেউ কখনো বলে নি। এমন করে কেউ আমাকে ভালোবাসে নি।

একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে থামে আমান। ওর গলা ধরে এসেছে। চোখের কোণে জল। অদিতি বুঝতে পারে আমানের কষ্ট। অদিতির এতোটা রিএ্যাক্ট করা বোধ হয় ঠিক হয় নি!

– তবে অদিতি আপনার যুদ্ধটা কিন্তু আমার চেয়ে কম কঠিন না। বরং অনেক সময় আরো বেশি। আমি বুঝি আপনি মেধাবী কিন্তু শুধুমাত্র বাবা মায়ের সাথে থাকার জন্য অন্য কোন চাকরির চেষ্টা করেন নি। এর চেয়ে বড় কষ্ট যেটা আপনাকে প্রতি নিয়ত স্বীকার করতে হচ্ছে, তা হলো – এভাবে বিয়ে না করে থাকা। আমাদের সমাজ সম্পর্কে আমি ভালো করেই জানি। একটা বয়সের পরে বিয়ে না করলে বা না হলে সমাজ তাকে যেভাবে হেনস্থা করে, এ যেন মৃত্যু সমতুল্য। আপনার বাবা মাও ভীষণ দু:শ্চিন্তায় থাকেন। আমি আপনাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি ভাবতে থাকেন। পজিটিভ হলে ভালো, নেগেটিভ হলে আমি আপনার সামনে আসবো না।

প্রশ্নবোধক চোখে তাকায় অদিতি। আমান কি বলবে? কিসের প্রস্তাব?

– অদিতি আপনি সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। আপনাকে যে কেউ পছন্দ করবে। সত্যি বলতে আমিই পছন্দ করি। এখন তো প্রেম করার বয়স নেই। যদি জীবনে চলার পথের সঙ্গী হিসেবে আমাকে কিছুটা হলেও পছন্দ হয়, জানাবেন। অবাক হবেন না, আমি জানি যে আমি কিছুটা বোহেমিয়ান। তবে এটুকু নিশ্চিত থাকেন, আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন নই। যাদেরকে আমি ভালোবাসি, যারা আমার পরিবার, তাদের জন্য আমার সব প্রায়োরিটি। তাদের জন্য আমি জীবন দিতে পারি।

– আচ্ছা, আগে দেখতাম মেয়েকে পাওয়ার জন্য বাবা মা’কে পটানো হতো। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাবা – মা’কে পাওয়ার জন্য মেয়ে’কে পটানো হচ্ছে! নট ব্যাড। ভেবে দেখি – আমি আমার বাবা- মা’কে হারাতে চাই কিনা!

– কে বললো, বাবা – মা’কেই শুধু চাই? বরং এক্ষেত্রেও এটাই সত্য যে, মেয়ে’কে পাওয়ার জন্যই বাবা – মা’কে পটাচ্ছিলাম!

অদিতির চোখের দিকে তাকিয়ে আবেগী কন্ঠে বলে আমান। অদিতি লজ্জা পায়। কিন্তু অদিতি তো দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। অনেকেই তাকে ‘আয়রন লেডি’ বলে!

– এটা প্রমাণ করতে হবে। আর এই বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত আমার একার! কারণ আমি জানি আমার বাবা মা বায়াসড, সব আপনার পক্ষে!

মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে আমান। নাহ, মেয়েটা আসকেই অন্য রকম – মনে মনে ভাবে আমান। অদিতি কিছুটা মুচকি হেসে সরে পড়ে। এতোক্ষণে বাবা মা কেউ ডাইনিং এ আসলো না, তার মানে সবাই সবকিছু জানে! ওকে আমিও দেখবো- কিভাবে খেলা জমে!

‘আমি বাউন্ডুলে ঘুড়ি
যে আমাকে বাসবে ভালো
তার আকাশেই উড়ি
আমি বৃষ্টি ইলশেগুঁড়ি
মাথায় করে রাখলে আমায়
খেলবো লুকোচুরি
খেলবো লুকোচুরি’

অদিতি গান শুনছিলো। অনুপম রায়ের গান ওর ভালো লাগে। এই গান’টা শুনতে ওর ভালোই লাগে আবার আমানের কথাও মনে হয়ে হাসি পায়। আমান তো নিজেকে বাউন্ডুলে বলে। আমানের সাথে অদিতির বাবা মা মিলে বিয়ের জন্য খুব লেগেছে কিন্তু অদিতির একটাই কথা – আমান যে ওকে পছন্দ করে এর প্রমাণ কি? আমান নিশ্চিত বাবা মায়ের ভালোবাসার লোভে অদিতিকে বিয়ে করতে চায়!

কি অদ্ভুত কথা? তাই হয়? – লুৎফা বেগম বলেন। কিন্তু আসল বিষয়টা আহসানুল হক বুঝতে পারেন। আমানের কানে টিপস দেন – মেয়ে পটাও, এ যুগের ছেলে হয়ে এটুকু বুঝো না?

ব্যাস, একে তো নাচুনি বুড়ি তার উপরে ঢোলের বাড়ির মতো অবস্থা হলো যেন। আজ গোলাপ, কাল দোলনচাঁপা। এরপর অন্য কোন ফুল এভাবেই রোজ সকালে কিছু না কিছু হাতে আমান দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর দুই দিন পর পর কফি খাওয়ার দাওয়াত। নানা রকম শাড়ির গিফট। মাঝ রাতে কল – অদিতি, বাসার নিচে আছি, এক কাপ চা হবে!

অদিতির ভালো লাগে অবশ্যই। কিন্তু বোঝাতে দেয় না। এই সময়গুলো আসলেই দারুণ লাগে। বিয়ে তো হবেই, অদিতির রাজী না হওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ, অদিতির মূল চিন্তার বিষয় হলো বাবা মা৷ সেখানে আমান বাবা মা’কে মাথায় করে রাখে, সুতরাং ‘না’ বলার তো কারণই নাই! কিন্তু আমানের এই পাগলামিগুলো অদিতি ইনজয় করে। খুব ভালো লাগে।

কিন্তু একদিন সকালে আমান আর আসলো না। সারাদিন আর খোঁজ নেই। পরের দিনই না। অদিতি উদ্বিগ্ন হয়, আমানের নাম্বারে কল দেয় – বন্ধ। বাবা মা’ও কিছু বলতে পারেন না। এমন তো হয় না? বাবা মা’কে কিছু না বলে তো কোথাও যায় না! তাহলে? উফ আর ভাবতে পারে না অদিতি, ওর মাথা ছিঁড়ে যায় যেন।
পরের দিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে বাবা মা ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে। তাদের চোখে মুখে চিন্তার ছায়া।

– অদিতি, গুছিয়ে নে। আমান কক্সবাজারে। আমাদের সেখানেই যেতে হবে। এয়ারের টিকিট কেটেছি। এক্ষুণি যেতে হবে!
বাবার কন্ঠে এমন কিছু ছিলো যে অদিতি আর প্রশ্ন করতে সাহস পায় না। যা পারে গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন। কোন এ্যাকসিডেন্ট? খুব খারাপ অবস্থা না হলে এয়ারে যাচ্ছে কেন! মুখ শুকিয়ে যায়।
কক্সবাজারে নেমে বাবা ওদের নিয়ে একটা অভিজাত হোটেলে উঠলে অদিতি প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়

– আমানের চাচা ঠিক করে দিয়েছেন। ব্যাগ রেখে ফ্রেস হয়েই আমানকে দেখতে যাবো।

– বাবা, আমার ফ্রেস হওয়ার দরকার নেই।

– আচ্ছা, রুমে ব্যাগ রেখে আয়।

অনিচ্ছায় রুমের চাবি নিয়ে চলে যায়। পেছনে বাবা মা মিটিমিটি হাসতে থাকে।

অদিতি দরজা খুলতেই চমকে যায় – আমান হাঁটু গেড়ে বসে আছে। হাতে একটা রিং

– আমাকে কি তোমার জীবন সঙ্গী করবে অদিতি? প্লিজ

– একদমই না। কতো বড় বাটপাড়, আমাকে মিথ্যে বলে এনেছে। আমি চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম।

রেগে বের হয়ে যাচ্ছিলো অদিতি। আমান জোর করে জড়িয়ে ধরে। থমকে যায় অদিতি।

– এছাড়া কোন রাস্তা পাচ্ছিলাম না প্রিয়া। তুমি এতো ঘুরাচ্ছিলে কেন? আর কতো ঘুরবো? সারা’টা জীবন তো ঘুরেই গেলাম। এখন একটু শান্তির গৃহকোন চাই।

অদিতির কানে ফিসফিস করে বলে আমান। এরপর ওকে ছেড়ে দেয়। হাত ধরে রুমের ব্যালকনিতে নিয়ে যায়৷ ব্যালকনি থেকে সমুদ্র দেখা যায়।

– কি সুন্দর তাই না অদিতি? এখানে বাবা মা কেউ নেই। শুধু তুমি আর আমি। এখানে আমাকে গ্রহণ করো প্লিজ!

অদিতি কাঁপা হাত বাড়িয়ে দেয়। আমান আংটি পরিয়ে দেয়। আংটি পরিয়ে শক্ত করে হাত ধরে থাকে। সামনে আদিগন্ত সমুদ্র, সীমাহীন আকাশ। অদিতি – আমান সেদিকে তাঁকিয়ে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে থাকে।

সমাপ্ত।

মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-১২

0

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(পর্ব ১২)

লুৎফা আর আহসানুল হকের মুখে খালি আমানের নাম। উনারা উঠতে বসতে খালি এই নাম জপ করে। অদিতি সেদিন না পেরে বলে উঠে

– আচ্ছা মা আমানের মধ্যে কি পেলে বলো তো? আমার নামও এতোবার নাও না, যতোবার আমানের নাম নাও!

অদিতি মোটেও ঈর্ষান্বিত নয়। বরং ভীষণ ভালো লাগে। একশ একবার এই নাম জপলেও ওর খারাপ লাগবে না। কিন্তু সমস্যা হলো এই নাম শুনলেই ওর বিবশ লাগে। কাজ কর্মে ব্যাঘাত হয়।

– অদি, আমান এতীম ছেলে এটা ভুলিস না!

পাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলেন আহসানুল হক।

– হুম এতীম কিন্তু অসহায় নয়। নিজে জব করে আবার গার্ডিয়ান হিসেবে আছে বড়লোক আন্তরিক চাচা।

– আচ্ছা ভাব, একদিন বৃষ্টির দিনে ওর খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করলো কিন্তু চিৎকার করে বলতে পারে না – মা, আজ কিন্তু খিচুড়ি রান্না করবে। বলতে পারে না, বাবা অনেকদিন ইলিশ মাছ কিনছো না কেন?

গম্ভীরমুখে বলেন লুৎফা বেগম। পরিবেশটা গুমোট হয়ে যায়। আসলেই, বাবা মা যাদের নেই তারাই বোঝেন কতোটা ভালোবাসাহীন তারা।

– আমাদের বাসায় রান্না করলো কি ভীষণ উৎসাহ নিয়ে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নাকি রান্না শিখেছে, আমাদের নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবে৷ তোর মা কতো নিষেধ করলো কিছুতেই শুনলো না। এরপর ওর রান্নার প্রশংসা করলে খুশিতে চোখ মুখ কেমন জ্বল জ্বল করছিলো। এখন বল এমন ছেলের কথা কে না বলবে? যে কীনা চেনা অচেনা যে কারো বিপদে দৌড়ে যায়!

অদিতি চুপ করে থাকে। আসলেই বাবা মা আমানকে বেশ পছন্দ করে আর এই পছন্দের অন্যতম কারণ বুঝি শূণ্যস্থান পূরণ। শোভন আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে তাদের মনে যে একটা শূণ্যস্থানের তৈরী হয়েছে কিছুটা হলেও প্রলেপ লেগেছে। প্রকৃতিই শূণ্যস্থান পছন্দ করে না, কাউকে না কাউকে দিয়ে সেই শূণ্যস্থান ভরাট করে দেয়।

এরপরের দিনগুলো বেশ নাটকীয়তায় চলে যাচ্ছে। আমানের সাথে অবশ্য অদিতির তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু প্রায় দিনই তার কোন না কোন সুকর্মের ঘটনা অদিতির কানে আসে। এই যেমন আজ আহসানুল হককে জোর করে মর্ণিং ওয়ার্কে নিয়ে গেছে, আসার সময় কোথা থেকে টাটকা সবজী আর মাছ নিয়ে এসেছে। কিংবা অদিতির মা’কে চেক আপ করতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। তারপর মাঝে মাঝেই রান্না, গল্প, আড্ডা তো আছেই। আমান আমান শুনতে শুনতে অদিতির তো একটু একটু ঈর্ষা যে লাগছে না তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বাবা মা যে ভালো আছেন, উচ্ছ্বল আছেন এটাই অদিতির বড় পাওয়া।

অবশেষে একদিন রাতে অদিতির হোয়াটসঅ্যাপে সেই কাঙ্খিত ম্যাসেজ – কাল কখন ফ্রি থাকবেন?
অদিতি বিকালেই ফ্রি থাকে। সেটাই জানালো। স্থান ঠিক হলো, নিরিবিলি একটা কফিশপে। কিন্তু এরপরই ঘুম হারাম হলো অদিতির। কি বলতে চায় আমান?

নানান রকম চিন্তা ভাবনায় রাত এবং দিনটা কেটে বিকালে নির্ধারিত ক্যাফেতে আসে অদিতি। ইচ্ছা করেই আজ শাড়ী পরেছে। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেয়ার পর থেকে অদিতি অবশ্য মাঝে মধ্যেই শাড়ী পরে। এই পোষাকের মধ্যে একটা আলাদা আভিজাত্য, সৌন্দর্য আছে সেটা একদম সাদামাটা সুতি শাড়ি হলেও। অদিতি তাঁতের সুতি শাড়ীই পরে বেশি৷ ওর মনে হয় দেশীয় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সবার নৈতিক দায়িত্ব আর দামে কম এবং ভালো মান।

এমনি একটা নীল জমিনে চিকন লাল পাড়ের একটা শাড়ি পরে অদিতি ক্যাফেতে আসে। শরৎ শুরু হলেও গরমটা কমে নি। ওর নাকের ডগায় শিশির বিন্দুর মতো ঈষৎ ঘাম জমে আছে। চুলগুলো পেছনে একটা পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আঁটকানো। আমান একটু বোহেমিয়ান টাইপের হলেও ওর একটা গুণ হলো কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে পারলে সময়ের দু পাঁচ মিনিট আগে উপস্থিত হয়। আজো তার ব্যতিক্রম নয়। হালকা গ্রে কালারের একটা টি শার্ট আর জিন্স পরেছে, এক মাথা চুল কিছুটা এলোমেলো তাতে আরো ভালোই লাগছে যেন। অদিতিকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সামনে এগিয়ে এলো।

– বাহ, শাড়ীতে তো আপনাকে দারুণ লাগে!

চোখে মুখে একটা মুগ্ধতা নিয়ে বলে আমান। এটা যে ও মন থেকেই বলছে তা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যায়।

– শাড়ীতে সব মেয়েকেই ভালো লাগে।

বসতে বসতে বলে উঠে অদিতি।

– বলেন কি খাবেন? আগে অর্ডার দিই।

মেন্যু কার্ড হাতে নিয়ে অদিতির দিকেই এগিয়ে দেয়।

– শুধুই এক কাপ গরম কফি। আর তার আগে বলুন এভাবে সমন দিয়ে ডাকার কারণ কি?

অদিতির এই কথায় ওর স্বভাব সুলভ চরিত্রের অংশ হিসেবে হা হা করে হেসে উঠে আমান।

– বাহ আপনার তো ভালো সেন্স অফ হিউমার আছে। আমি তো ভাবতাম পদার্থ বিজ্ঞানের ম্যাডাম যখন, কিছুটা খটোমটো টাইপের। এখন দেখি না, ভালোই রসিক আছেন!

অদিতি অপ্রস্তুত হয়। চুপ করে থাকে, ঠিক কি বলবে বুঝতে পারে না। আমানেরই তো কথা বলা উচিৎ, কি বলতে চায় সে!

– আসলে অদিতি আপনাকে ডেকেছি কারণ আমার মনে হয়েছে আপনার বাবা এবং মা’কে আপনার আরেকটু সময় দেয়া উচিৎ। কথা’টা ঠিক কিভাবে নেবেন জানি না, হয়তো অহেতুক নাক গলানোও মনে হতে পারে। কিন্তু আসলেই তাদের আরেকটু যত্ন দরকার, আরেকটু সময় দেয়া প্রয়োজন।

সত্যিই রাগ হয় অদিতির। আমান কতোটুকু জানে ওদের সম্পর্কে? অদিতির প্রচেষ্টা সম্পর্কে? না জেনে এভাবে উপদেশ দেয়া কেন!

– আমান, আমাদের সম্পর্কে আপনি কতোটুকু জানেন আমি জানি না। কিন্তু আপনি আমার বাবা মা’কে নিয়ে ভাবছেন, তাদের মঙ্গল কামনায় এই কথাগুলো বলছেন এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আরো কৃতজ্ঞ আমার বাবা মা’কে সময় দেয়ার জন্য। কিন্তু দেখুন আমান, চোখের দেখার বাইরেও একটা জগৎ আছে। এই যেমন আমি বাবা মা’কে সময় দিতে পারি না। কারণ আমাকে তাঁদের জন্যই, তাঁদের স্বপ্ন পূরণের জন্য ছুটতে হয়। আমার লজ্জা করছে যে এগুলো আপনাকে বলছি। হয়তো কখনোই বলতাম না, কিন্তু আপনি প্রসঙ্গ উঠানোতে বলছি। আমরা যে বাসায় থাকি সেটা ভাড়া বাসা। অথচ বাবার আজীবনের ইচ্ছা যে নিজেদের একটা টিনসেড হলেও বাড়ি হবে, একটা আঙ্গিনা থাকবে। তার পেনশনের সব টাকাই তো ভাইয়া নিজের ব্যবসায় লাগিয়ে আলাদা হয়ে দিব্যি নিজের মতো আছে। কিন্তু আমি রাত দিন এক করে ছুটে চলেছি এই স্বপ্ন পূরণে। মা তো বিয়ে সংসারের কথা বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে বাদ দিয়েছে কিন্তু আপনিই বলুন এই বয়স্ক শিশু দুইজনকে রেখে আমি কোথায় যাবো?

একটানা অনেক কথা বলে থামে অদিতি। ওর খুব বিরক্ত লাগছে। নিজের উপর নাকি আমানের উপর নাকি অফিশপে ঠিকমতো কাজ না হওয়া এসি’র উপর অদিতি তা বুঝতে পারে না। চুপ করে বসে থাকে। আমানও যেনো কিছুটা অপ্রস্তুত। চুপচাপ কফি শেষ করে।

– এবার তাহলে আসি, কফির জন্য ধন্যবাদ ।

আর কোন কথা না বলে, কোন উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বের হয়ে যায় অদিতি৷ কফিটা কি বেশি তিতকুটে ছিলো? জিহবা, মন সব এমন তিতে হয়ে গেলো কেন!

(চলবে)

মেয়েটি যেন ভিন্ন রকম পর্ব-১১

0

#মেয়েটি_যেন_ভিন্ন_রকম

(এগারতম পর্ব)

Aise zaroori ho mujhko tum
Jaise hawayein saanson ko
Aise talashun main tumko
Jaise ki per zameeno ko.

এই গানটা অদিতির অসম্ভব ভালো লাগে। একটা হিন্দি মুভির গান। কিন্তু এর আবেদন, এর রেশ যে কাটেই না। অদিতির হাত এখন ভালোই বলা যায়। স্কুলে যাচ্ছে নিয়মিত। ছাত্র – ছাত্রীরা অদিতিকে ভীষণ পছন্দ করে। ফিজিক্সের মতো কঠিন সাবজেক্টকে খুব ঝরঝরে করে হাতে কলমে বুঝিয়ে দেয়৷ এজন্য অবশ্য অদিতিকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়। ইউটিউবে দেশে বিদেশের বিভিন্ন লেকচার ফলো করে, নোট নেয়। বিভিন্ন লেকচারের সাথে হাতে কলমে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সূত্রগুলোর বাস্তব পরীক্ষা দেখায়। সেগুলো অদিতি বাসায় আগে নিজে করে, ভালোভাবে পারলে তারপর স্টুডেন্টদের দেখায়। ওর ক্লাসে স্টুডেন্ডরা শতভাগ মনোযোগ দিয়ে করে৷

আমানের সাথে অদিতির আর কথা হয় নি। অদিতি আর কল দেয় নি। বার বার কল করাটা হ্যাংলামি দেখায়। এমনটা অদিতি পারে না।

আজ স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দরজার বাইরে থেকেই মনে হলো ভেতরে বেশ উচ্চস্বরে কথা, হাসি হই হুল্লোড় চলছে। এটা তো তাদের বাসার পরিবেশ নয়! বাবা অবসরের পরে নামাজ পড়া, বই পড়া নিয়েই সময় কাটিয়ে দেন। মা বরাবরের মতোই সংসারের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। অদিতি বাসায় ফেরে ক্লান্ত হয়ে আবার ক্লাসের জন্য নোট নেয়া আর ফ্রিল্যান্সিং নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করে। ওর খুব ইচ্ছা বাবার জন্য এক টুকরো জমি কেনা, যেটা বাবার খুবই শখ কিন্তু অদিতিদের জন্যই এই শখটা পূরণ হয় নি। অদিতির ভাই শোভন ব্যবসাতে ভালোই লাভ করছিলো। কিন্তু অদিতির হাতে ফ্রাকচার হওয়ার ঠিক পরপরই ঘোষণা দেয়, সে একটা মেয়েকে পছন্দ করে এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। বাবা অদিতিদের ইচ্ছাকে খুব সম্মান করে। কিন্তু মা মনে কষ্ট পায়। অদিতির বাবা অদিতির অসুস্থতার কথা চিন্তা করে কিছুদিন পরে শোভনের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবে বলে জানায়। কিন্তু শোভন বেঁকে বসে। মেয়েটার নাকি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এখনই যা করার করতে হবে!

অদিতির মা লুৎফা বেগম আজীবন ছেলের পক্ষ নিয়েছেন। এমনকী ছেলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে মেয়েকে কটূ কথাও শুনিয়েছেন। কিন্তু আজ লুৎফা বেগম যেন অন্য রকম মানুষ হতে গেলেন। নিজের রাগ ক্ষোভ চাপতে না পেরে এতো বড় ছেলের মুখে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। যার বোন মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে বলা যায়, সে এখন কিভাবে বিয়ের জন্য জিদ করতে পারে! শোভনেরও রাগ উঠে যায়। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে তখুনি বাড়ি আছে আর লোকমুখে অদিতিরা শুনতে পায় – এর পরদিনই সেই মেয়েকে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে। মাঝখান থেকে সারা জীবনের সঞ্চয় পেনশনের টাকা থেকে বঞ্চিত হলেন আহসানুল হক। লুৎফা বেগম ইদানীং খুব মনোকষ্টে ভোগেন, ছেলের এই স্বার্থপরতা মানতে পারেন না।

এইসব ঘটনায় ঘরের পরিবেশ থমথমে থাকে। সেখানে কে এসে এমন হাসির হিল্লোল তুললো!
কলিং বেল চেপে ধরতেই দরজা খুলে মুখে বিরাট এক হাসি বুলিয়ে সামনে এসে আমান দাঁড়ায়। অদিতির বুকের হার্টবিট মিস হয়ে যেন। ভেতরে যেতেই দেখে বাবা মা হাসি মুখে ডাইনিং রুমে।

– আরে দেখ, আমি রান্না করবো কি আমান রান্নাঘরে ঢুকে রান্না করেছে। আমরা তো তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম!

হাসি মুখে লুৎফা বেগম অদিতিকে ঘোষণা দেয়ার ভঙ্গিতে জানায়৷ অদিতির তো অবাকের পর অবাক হওয়ার পালা। অদিতির বাবাও কথা শুরু করেন

– আমি বাপু টেস্ট না করে থাকতে পারলাম না। খাশির মাংসের কোরমা তো লা জবাব। আর কতো গল্প যে পারে ছেলেটা।

অনেক অনেক দিন পরে গুমোট আকাশে যেন রোদের ঝলকানি। ভালো লাগে অদিতির। কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে বসে পড়ে। কয়েক রকমের ভর্তা, খাশির মাংস আর ডাল। কিন্তু প্রতিটা আইটেমই অসাধারণ।

– আপনি তো দারুণ রান্না করেন।

– হুম একলা মানুষের সব শিখতে হয়। আর তাছাড়া ছেলেদের জন্য হাস্যকর হলেও সত্য যে, আমি রান্না করতে পছন্দ করি।

– আরে হাস্যকরের কি আছে, সারা দুনিয়ায় সব বড় বড় হোটেলের শেফরা হলেন ছেলে। মেয়েরা ভাবে তারা ছাড়া আমরা না খেয়ে মরবো!

অদিতির মায়ের দিকে তাকিয়ে টিপ্পনী কেটে বলে অদিতির বাবা। অদিতির মা কথা বলে না। খাওয়া শেষে অদিতির বাবার হাতে বাসন কাসন ধরিয়ে দেয় – কাজ করে বোঝ এখন!

অদিতিও হাসে প্রাণ খুলে। আস্তে করে আমানকে ধন্যবাদ দেয়।

– আপনাকে আমার কিছু কথা বলার ছিলো।

আমান হঠাৎ সিরিয়াস মুডে কথা বলে।

– জি অবশ্যই বলেন

– ব্যস্ত থাকেন জানি, তবুও প্রতিদিন নিয়ম করে বাবা মা’কে সময় দেবেন। উনারা এখন ছোট বাচ্চার মতো, আপনার সঙ্গ চায়। আমার নেই, আমি বুঝি কি জিনিস আপনার আছে আর আমার নেই!

হঠাৎ গলাটা যেন ধরে আসে আমানের। দ্রুতই অদিতির বাবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। লুৎফা বেগম মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেন। অদিতি আমানের সাথে সাথে আসে। আস্তে করে নরম স্বরে বলে

– ধন্যবাদ

– কেন? কিসের জন্য?

– সব কিছুর জন্যই।

– শুকনো ধন্যবাদে কাজ হবে না।

– তাহলে?

– চলেন একদিন কফি খাই!

বুকের ভেতরে রক্ত ছলকে উঠে অদিতির, ভীষণ আপ্লুত হয়। কিন্তু বাইরে বুঝতে দেয় না। মুখে ভদ্রতার পরিমিত হাসি ঝুলিয়ে সম্মতি জানায়।

(চলবে)

মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-১০

0

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম

(দশম পর্ব)

“তুমি না হয় সূর্য হলে
আমি অহর্নিশ তোমাকে ঘিরে
প্রদক্ষিণ করলাম।”

অদিতির মনে আজ কাল এমন কিছু কথা ঘুরপাক খায়। অচেনা আবেগে উদ্বলিত হয়। সেদিনেই সেই এক্সিডেন্ট, অচেনা ছেলের সান্নিধ্যে আসা আর এখন এই অচেনা আবেগ – সবকিছুই অন্য রকম লাগে অদিতির। এর মধ্যে গায়ে আজ কয়েকদিন ধরে জ্বর। জ্বরের ঘোরে আরো যেন কল্পনা বাস্তব মিলিয়ে ফেলে। মাঝে মধ্যে মনে হয় সেই ছেলেটি এসেছে, ওর কপালে যেন হাত রেখে বলছে- ‘চিন্তা নেই, একদম ঠিক হয়ে যাবেন।’

আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে, এই সবই স্বপ্ন ছিলো। আসলেই কি স্বপ্ন ছিলো?

আমান হলো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো লোক। জি ঠিকই ভাবছেন এই আমানই সেদিন অদিতিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর অদিতির বাবা মা আসা পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি যা করার আমানই করেছে। এমনকি পরেও যথেষ্ট ঝামেলা নিয়েছে কারণ অদিতির বাবা মা বয়স্ক হওয়াতে আমান তাঁদের কিছুই করতে দেয় নি। অদিতির ভাই শোভন ব্যবসার কাছে শহরের বাইরে ছিলেন। অন্যের বিপদে অনেকেই ছুটে আসে, বড় জোর হাসপাতালে ভর্তি করা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু এই ছেলেটা অনেক বেশি আন্তরিক, ভীষণ আপন আপন।

হাতের ফ্রাকচারের চেয়েও জ্বরটা বেশি ভোগালো অদিতিকে। আজ দুপুরের পর থেকে জ্বর নেই। মুখটা কেমন তেতো তেতো। বাসায়ই আছে, একদিনই হাসপাতালে ছিলো। বড় রকমের কোন সমস্যা না থাকায় পরেরদিনই ছাড়পত্র পেয়ে যায়। লুৎফা বেগম বেশি করে মরিচ দিয়ে ঝাল মুড়ি নিয়ে আসেন। মেয়েটা কিছু খেতে পারছে না, একটু যদি মুখে দিতে পারে।

– এই তো এখন জ্বর নেই। জ্বরের ঘোরে কি সব বকছিলি। সাগরের ঢেউ দেখবো, হাত ধরো হাবিজাবি। তুই বুঝতে পেরেছিস কিনা জানি না, আমান ছেলেটা এসেছিলো। তোর ধুম জ্বর, রুমে এসে তোকে দেখে চলে গেছে।

অদিতির সারা শরীর আবার শির শির করে উঠে, আবার জ্বর আসবে নাকি! আমান তাহলে ঠিকই এসেছিলো, ও জ্বরের ঘোরে ভুল দেখে নি। কিন্তু কপালে হাত দেয়ার বিষয়টা হয়তো মনের কল্পনা মাত্র৷

আমান, বাবা মা হারা অনেকটা ছন্নছাড়া যুবক। ছন্নছাড়া বলতে বিপদগামী, চালচুলোহীন নয়। ওর চাচা আশরাফ খান বেশ ধনী একজন ব্যবসায়ী, তিন কন্যার পিতা, আমানের অভিভাবক। আমানকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন বরং আরো বেশিই বলা যায়। আমানের কোন দোষ ত্রুটি যেন উনার চোখেই পড়ে না। অপত্য স্নেহ আমানের জন্য। কিন্তু আমান যেন বন্য ঘোড়া, নিজের ইচ্ছা মতো ঘুরে বেড়ায়, মানুষের উপকার করার নেশায় ছুটতে থাকে।

এমন না যে আমান চাচার টাকায় ঘোরে, বরং বেশ ভালো একটা চাকরি করে। ইমপ্লোয়ী হিসেবেও দক্ষ কিন্তু দোষ একটাই হুটহাট গায়েব হয়ে যায়। এই যেমন সেদিন মার্কেটের পাশে এক বৃদ্ধ হাউমাউ করে কাঁদছে। ছেলের কাছে এসেছিলো, রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। ঠিকানা ঠিকঠাক বলতে পারে না। ছেলের ফোন নাম্বার একটা আছে কিন্তু সেই নাম্বারে কেউ কল রিসিভই করে না। আমান সাথে করে রেলস্টেশনে আসে, টিকিট কেটে গ্রামে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু ঠিক ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে আমানের মনে হয়, বয়স্ক মানুষ আবার যদি হারিয়ে যায়! ছেলে তো মনে হয় ইচ্ছা করেই দায়িত্ব এড়ানোর জন্য ফোন ধরছে না। ব্যস আরেকটা টিকিট কেটে চলে যায় বৃদ্ধের সাথে সেই সুদূর রংপুর।

এই হলো আমান। যা মনে হয় তাই করাই ওর স্বভাব। বোর্ডিং আর হোস্টেলে কেটেছে অনেকটা সময়। এরপর ওর চাচা খুব চেয়েছিলো নিজের কাছে রাখতে কিন্তু সে রাজী হয় নি। একটা কথাই বলেছিলো- চাচী আমাকে ভালোবাসেন, আমি চাই এই ভালোবাসা অটুট থাকুক। তবে এটা ঠিক আশরাফ সাহেবের হস্তক্ষেপ না থাকলে আমানের চাকরি করাই কঠিন হতো, যদিও এটা ওর তৃতীয় চাকরি গত দুই বছরে।

এই কিছুটা ছন্নছাড়া ছেলেটার প্রেমেই মজেছে অদিতি। মেয়েগুলো কেন জানি ঠিক এই ধরণের ছেলের প্রেমেই বেশি মগ্ন হয়। কিছুটা আবেগে কিছুটা মায়ায়৷ অদিতি সুস্থ হয়ে আমানের ফোন নাম্বারটা নেয়। বাবার কাছেই নাম্বারটা ছিলো। দুইদিন ফোন দিয়ে দেখে বন্ধ। সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না জানায়। চিন্তিত হয় অদিতি, ফোন নাম্বার কি তাহলে ঠিক নেই! তবুও পরেরদিন আবার ফোন দেয়, এবার রিং বাজে। অদিতির বুকে ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে।

– হ্যালো, কে বলছেন প্লিজ

– আমি অদিতি

অদিতির মনে হয় – ও ভুল করছে, শুধু নাম বললে কি আর চিনবে! কিন্তু অদিতির ‘ভুল করেছে’ ভাবনাটাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ফোনের ওপার থেকে একটা প্রানোচ্ছ্বল কন্ঠ বলে উঠলো

– আরে অদিতি, আপনার জ্বর কমেছে? হাতের কি অবস্থা? প্লাস্টার কবে খুলবে? আপনি তো মনে হয় খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আন্টি তো তাই বলছিলো। না খেলে সুস্থ কিভাবে হবেন বলেন তো?

একেবারে তব্দ খেলো অদিতি। এতো কথা সে আশা করে নি। কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য ফোন দিয়েছিলো।

– আমি এখন ভালো আছি। জ্বর নেই। দুই দিন পরেই প্লাস্টার খুলবে। আমি আসলে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য ফোন দিয়েছি। আপনি আমার জন্য যেভাবে দৌড়াদৌড়ি করেছেন তা আপন আত্নীয় ছাড়া কেউ করে না।

– তা আমাকে আপন আত্মীয়ই মনে করুন না, তাহলে আর এই কৃতজ্ঞতা জানানোর মতো এতো ফরম্যাল কাজ করা লাগে না।

– না মানে আমি আসলে সেটা বুঝাতে চাই নি।

– অদিতি, আমি এখন কোথায় জানেন? আমি এখন বান্দবানে। গত দুই দিন ট্রেকিং করেছি। এসব পাহাড়ে বা সমুদ্রে আসলে নিজেকে খুব ছোট্ট মনে হয়। তখন জাগতিক সব দু:খ, কষ্ট সব তুচ্ছ মনে হয়। এই যে আপনি এতোটা ফরমাল হয়ে বলছেন, সামাজিক জীব হিসেবে একদম পারফেক্ট বিষয় কিন্তু এই পাহাড়ি পরিবেশে মনে হচ্ছে এসবও কতো তুচ্ছ।

– এটা তুচ্ছ হতে পারে কিন্তু এভাবে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া তো তুচ্ছ নয়। কয়জন পারে এমন, বলেন? এমন মানুষকে কদর করাও তো দরকার, সেটাও কিন্তু তুচ্ছ কোন বিষয় নয়। আমরা এই ধরণের মানুষের মূল্যায়ন করি না বলেই আজ সমাজে স্বার্থপর মানুষে ভরে যাচ্ছে।

– অদিতি আপনার কথাগুলো এবং কথা বলার স্টাইল দারুণ। উহু এভাবে ফোনে হবে না। সামনাসামনি চা বা কফির কাপে আপনার সাথে যুক্তি পাল্টা যুক্তির ঝড় তুলতে হবে। দেখা হবে শিঘ্রীই। ততক্ষণে ভালো থাকুন।

অদিতিকে অবাক করে দিয়ে ফোন রাখলো আমান। অদিতি খালি ভাবতে থাকলো- এটা কি হলো!

(চলবে)

মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-০৯

0

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম

(নবম পর্ব)

অদিতির মা ওর বিয়ে নিয়ে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত। মেয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে। লোকজন কি বলবে, সমাজ কি বলবে, এরপর আর ভালো সম্বন্ধ হবে না – প্রতিদিন নানা কথায় মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। অদিতির সাথে এই নিয়ে প্রায় প্রতিদিন কথা কাটাকাটি হয়। এদিকে অনার্স পরীক্ষা শেষ, টিউশনি বা অন্য কিছু করছে না। তাবাসসুমকে পড়ানোর পরে আর কাউকেও পড়ায় নি। তানভীরের কথা মাঝে মাঝে মনে হয়, কিন্তু সে বুঝে শুনেই তানভীরকে পাত্তা দেয় নি।

তানভীর ধনীর দুলাল। তাবাসসুমের ভাই হিসেবে অসাধারণ সন্দেহ নেই কিন্তু অদিতি সামান্য হাউজ টিউটর। সে হিসেবে দূরত্ব বজায় রাখাই ঠিক আছে। বয়সের উন্মাদনায় আর ইগোর জন্য অদিতির প্রতি সাময়িক ভালো লাগার জন্ম নিতে পারে কিন্তু এগুলোকে প্রশ্রয় না দেয়ায় ভালো।
যাক সে চ্যাপ্টার শেষ। এখন কিছু না করলে মায়ের কথায় বাসায় টিকে থাকা দায়। এদিকে বাবাই অদিতিকে সব সময় সাপোর্ট দিয়ে আসছেন। কিন্তু তাঁরই চাকরি আছে আর ছয় মাস। এজন্য উনিও মানসিকভাবে একটু ভঙ্গুর অবস্থায় আছেন৷ তার উপরে মায়ের জোরাজুরিতে গ্রামের যেটুকু জমিজমা ছিলো, সব বিক্রি করে ভায়ের ব্যবসার পুঁজি করে দিয়েছেন। এটাতেও বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছেন। সব মিলায়ে বাসার অবস্থা থমথমে।

অদিতি বসে না থেকে অনলাইনে কিছু কোর্স করে ফেলে, ফ্রিল্যান্সিং এর উপর। এরসাথে বাবার সাহায্যে ওদের কোয়ার্টারের পাশেই একটা হাইস্কুলে যোগদান করে৷ খুব ভালো স্কুল না, কিন্তু অভিজ্ঞতা তো বাড়বে। তাছাড়া তাবাসসুমকে পড়ানোর সময় বুঝতে পারে, ও আসলে পড়াতে ভালোবাসে। স্টুডেন্টদের মন বুঝতে পারে। মা এখন মাঝে মধ্যেই ‘মাস্টারনি’ বলে খোঁচা দিলেও অদিতি সেটা গায়ে মাখে না। আর ব্যস্ততাও একটা কারণ। ফ্রিল্যান্সিং এর সাথে স্কুলের ক্লাস – বেশ ব্যস্ত একটা জীবন।

অদিতি যে বিয়ে করতে চায় না, বিষয়টা এমন না।কিন্তু এখুনি নয়। আরো ভালো চাকরি পেতে চায়। বাবার পাশে দাঁড়াতে চায়, ঠিক যেভাবে ছেলেরা দাঁড়ায়। এজন্য হয়তো ভালো কোন পাত্র নাও পেতে পারে। কারণ তখন সমাজের চোখে বয়স বেশি মেয়ে হয়ে যাবে। তাতে অদিতির যায় আসে না। ওর একজন ভালো মনের জীবনসঙ্গী প্রয়োজন। তার অর্থ না থাকলেও কিংবা প্রচলিত অর্থে সফল না হলেও অদিতির কোন আপত্তি নেই।

সেদিন স্কুল বন্ধ। অদিতি একটু আরাম করে ঘুমাচ্ছিলো। বিকালের একটু আগেই ওর মা ঠেলে ঠুলে ঘুম ভাঙায়৷

– ওঠ তোর সাবিনা খালা এসেছে। যা মুখ ধুয়ে আয়।

সাবিনা খালা হলো অদিতির মায়ের চাচাতো বোন৷ এই মহিলাকে অদিতি দুই চোখে দেখতে পারে না। অসহ্য একটা মানুষ। নিজের পয়সার গরমে বাঁচে না। কিন্তু এখন ঘুম ভেঙে মায়ের সাথে ক্যাচাল করতে ভালো লাগছে না। উঠে হাত মুখ ধুয়ে বসার ঘরে ঢোকে।

– হ্যাঁ রে ও লুৎফা, মেয়ের বয়স হইছে খেয়াল করোস নাই? হায় হায় চোক্ষের নিচে কালি ফালাইয়ে কি হইছে! আরো আগে ক্যান বিয়া দেস নাই। কথায় কয় যৌবনে কাকও সুন্দর!

অদিতির মাথা দিয়ে আগুন বের হয় যেন। চোখ গোল করে মায়ের দিকে তাকায়। লুৎফা বেগম প্রমাদ গোনে। মেয়ের চরিত্র তো জানে, না জানি কি বলে বসে। সাবিনা আপাও সুবিধার লোক না। গলা শুকিয়ে যায় লুৎফার৷

– খালা তাহেরা আপা এখন কেমন আছে?

লুৎফাকে অবাক করে দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা শুরু করে অদিতি।

– আছে কুনু রকম।

বিরস মুখে বলেন সাবিনা। তাহেরা হলো সাবিনার বড় মেয়ে। ক্লাস টেনে থাকতেই বেশ বড়লোক পরিবারে বিয়ে দেয়। কিন্তু জামাই খুব মারধোর করে। একবার তো হাসপাতালেই ভর্তি থাকতে হয়েছিলো।

– ইশ তাহেরা আপার কি কপাল! এতো সুন্দরী একটা মেয়ে, কি তার গায়ের কালার, আর তাকে কিনা দুইবেলা জামাই এর মাইর খেতে হয়!

সাবিনার মুখ যেন একদম চুন হয়ে যায়। আর কথা বের হয় না। আরাম করে যে রসে টইটম্বুর রসগোল্লা খাচ্ছিলেন তা যেন গলায় আঁটকে যায়। বিষম খেয়ে তাড়াতাড়ি পানি মুখে দেন।

– লুৎফা আজ যাই রে। তোর ভাই আবার বাসায় এসে আমাকে খুঁজবে।

সাবিনা দ্রুত চলে যান। আজ বহুদিন পরে মা মেয়ে একসাথে অনেকক্ষণ ধরে হাসতে থাকেন।

এই ঘটনার পরে অদিতির মা লুৎফা অনেকটা নরম হয়ে যান। ভাবেন, মেয়ের কপালে বিয়ে থাকলে হবে, না হলে হবে না। এই নিয়ে আর বাসায় অশান্তি করতে উনারও ভালো লাগে না। অদিতির ভাই শোভন বেশ মন দিয়ে ব্যবসা করছে। ইলেকট্রনিকস এর ডিলারশিপ। এবার এতো গরম পড়েছে যে ফ্যান, এসি, এয়ারকুলারের ভীষণ চাহিদা।
অদিতি মাস্টার্স শেষ করে। এদিকে ফ্রিল্যান্সিং এ বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছে। টাকা যা পায় হাতে কিছু রেখে বাবার হাতে তুলে দেয়। আহসান সাহেব নিতে চান না। কিন্তু অদিতি গোঁ ধরে

– বাবা, আমি মেয়ে বলেই কি তুমি আমার টাকা নিতে চাও না?

– না রে মা। এতো কষ্ট করে উপার্জন করিস। নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ কর আর বাকি টাকা জমিয়ে রাখ, কাজে লাগবে।

– তুমিও তো কষ্ট করেই উপার্জন করে আমাদের পেছনে খরচ করেছো। আর নিজের কোন শখ আহ্লাদটা পূরণ করেছো শুনি? একটা ভালো পাঞ্জাবী পর্যন্ত তোমার নেই। আমি জানি তোমার বহুদিনের শখ আড়ং থেকে কাজ করা একটা পাঞ্জাবী কেনা। এই টাকা দিয়ে তুমি একটা পাঞ্জাবী কিনবে।

আহসানুল হক মেয়ের সাথে পেরে উঠেন না। সংকোচ লাগলেও মেয়ে যখন যা দেয় নেন। মেয়েটা বড্ড খুশি হয়।

মাস্টার্সের পরেই ভালো একটা হাইস্কুলে চাকরির প্রস্তাব পায় অদিতি। যোগদান করতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। সরকারি চাকরি পাওয়া সময় সাপেক্ষ আবার বিভিন্ন জায়গায় ছুটতে হয়। অদিতি বাবা মায়ের কাছেই থাকতে চায়।

সেদিন স্কুল থেকে রিক্সা করে বাসায় ফিরছিলো। স্কুলটা কিছুটা দূরে । এখন তো বাবার চাকরি শেষ, একটা ভাড়া বাসায় থাকে। কোথা থেকে একটা সিএনজি দ্রুত পাশ কাটাতে গেলেই অদিতির রিক্সায় ধাক্কা লাগে। রিক্সা কাত হয়ে পড়ে যায়। অদিতিও পড়ে যায় কিন্তু সৌভাগ্যবশত একদাম রাস্তায় না পড়ে সাইডে পড়ে। হাতে বেশ ব্যথা পায়। আশেপাশের লোকজন দাঁড়িয়ে দেখে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসার আগ্রহ দেখায় না। এমন সময় একজন তরুণ দৌড়ে আসে। অন্যদের তাড়া দিয়ে সাথে আনে৷ রিক্সা টেনে তোলে। রিক্সাওয়ালাকে ধরে। তরুণ ছেলেটি অদিতির কাছে এসে ভীষণ আন্তরিক কন্ঠে জানতে চায়- কোথায় লেগেছে। অদিতির মনে হয় ওর বাম হাত ভেঙে গেছে৷ ছেলেটা ওকে ধরে অপর একটা সিএনজি ডেকে মেডিকেলে নিয়ে যায়। অদিতির হাতে ফ্রাকচার হয়েছে!

ডাক্তার দেখানো,এক্স রে, রিপোর্ট, মেডিসিন নিয়ে ছেলেটা দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। অদিতির বাবা মা’কে সংবাদ দেয়া হয়েছে, উনারা আসছেন। কিন্তু অপরিচিত একটা মেয়ের জন্য এই ছেলেটার এতো দৌড়াদৌড়ি দেখে অদিতি মুগ্ধ হয়।

এই প্রথম অদিতি টের পায় হাতের ফ্রাকচারের সাথে মনেও কিছুটা গন্ডগোল হয়েছে!

(চলবে)

মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-৭+৮

0

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(৭ম পর্ব)
বেশিরভাগ মেয়েদের বৃষ্টি ভীষণ পছন্দ। কিন্তু অদিতির একদম পছন্দ নয়। কারণ তার মারাত্মক এলার্জি। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলেই হাঁচি শুরু হয়ে যায়। এরপর আসে জ্বর।

ক্লাস, পড়ার ফাঁকে টিউশনি করে অদিতির সময়গুলো বেশ তির তির করে চলে যাচ্ছে। তাবাসসুম বেশ ভক্ত হয়ে গিয়েছে, খালি মিনিট বিশেক ওর সাথে কে ড্রামা আর হাল ফ্যাশান নিয়ে আলোচনা করতে হয়। অদিতির জন্য এটা কষ্টকর বটে কারণ কাজল, লিপস্টিক আর ফেস পাউডার ছাড়া মেকাপের আর কোন কিছু আছে বলে ওর জানা নেই। এখন গুগল, ইউটিউব আর ফেসবুকের কিছু পেইজের ভরসার দায় সারে অনেকটা। একদিন টিউশনিতে যাওয়ার পথে বৃষ্টিতে পড়লো অদিতি। সকালে এমন রোদ মনেই হয় নি যে বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই মেঘের আনাগোনা। ঠিক যখন রিক্সা ছেড়ে তাবাসসুমদের বাসার লনে পা রাখলো, একদম ঝুম বৃষ্টি। অদিতির এমন রাগ হলো। সে আকাশের দিকে মুখ তুলে অনেকটা রাগতস্বরেই বলো উঠলো- ‘এইটা কোন কথা? অসময়ে কেন বৃষ্টি!’ অদিতির মুখভঙ্গি দেখলে যে কারো হাসি লাগবে এবং হাসলোও একজন। যাকে অদিতি দেখতে পায় নি।

তাবাসসুমের ভাই তানভীর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। সাধারণত সে এই সময় বাসায় থাকে না। এজন্য অদিতিকে কখনো দেখে নি। কিন্তু তাবাসসুমের বকবকানির কল্যাণে অদিতির বিষয়ে জানতে বাকি নেই। বোন’টাকে অসম্ভব ভালোবাসে তানভীর। যতো ব্যস্ততায় থাকুক, প্রতিদিন এক ঘন্টা বরাদ্দ বোনের জন্য। তাবাসসুম খুব সরল, এই বয়সের কিশোরী মেয়ের মধ্যে কী জটিলতাই বা থাকবে! কিন্তু কিছুতেই পড়ার টেবিলে বসানো যাচ্ছিলো না। নতুন মিস পড়ানো শুরু করার পর থেকে তাবাসসুমের বেশ উন্নতি হয়েছে। সন্ধ্যায় নিয়মিত পড়তে বসছে। ক্লাস টেস্টে এই প্রথম ভালো করেছে। এজন্য তানভীর ভাবছিলো অদিতির সম্মানী আরো বাড়িয়ে দেয়া উচিৎ। আর তাছাড়া ওদের মা বলেন, অদিতি মোটেও সময় হিসাব করে পড়ায় না। এটাও মেয়েটার আন্তরিকতার লক্ষণ অবশ্যই।

আজ অদিতিকে প্রথম দেখলো তানভীর। খুব সাদামাটা বেশভূষায়। মেয়েটা লিপস্টিক পর্যন্ত দেয় না! এমন মেয়ে কিভাবে ওর বোনকে বশ করলো, ভাবতেই অবাক লাগে তানভীরের। তাবাসসুমের হাল ফ্যাশান আর মেকাপের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। অদিতি নামের মেয়েটাকে ওর খুব ইন্টারেস্টিং মনে হলো।

সেদিন পড়াতে পড়াতেই অদিতির হাঁচি শুরু হলো। ইশ! এই ভয়টাই পাচ্ছিলো অদিতি। তাবাসসুম যদিও টিস্যু বক্স এনে দিয়েছে কিন্তু অদিতির মনে হলো ওর গামছা হলেই ভালো হয়! গঙ্গা যমুনা সব যেন ওর নাম দিয়ে বইছে! কিন্তু বিপত্তি হলো আরেকটা, তাবাসসুমের ভাই দেখা করতে চায়। তাবাসসুমের ভাই’কে দেখার ইচ্ছা অদিতিরও ছিলো, এতো গল্প শুনেছে তার। কিন্তু এই অবস্থায় দেখা করার মোটেও ইচ্ছা নেই। এদিকে তাবাসসুম নাছোড়বান্দা। অগত্যা না করার উপায় থাকলো না।

– আপনাকে তো দেখি অসুস্থ দেখাচ্ছে। সালাম বিনিমিয়ের পরে তানভীর প্রথম এই কথা’টাই বললো৷

অদিতি চরম বিব্রত। কোন রকমে বললো

– আমার আসলে বৃষ্টির পানিতে এলার্জি হয়। আজ গায়ে বৃষ্টির পানি লেগেছে।

তানভীর উঠে বাইরে যেয়ে আবার ফিরে আসলো।

– আপনার জন্য আদা মশলা দিয়ে চা দিতে বললাম, একটু আরাম পাবেন। আর এতো বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। মানুষের অসুস্থতা, অসুখ বিসুখ থাকবেই। এটা তো আমাদের জীবনেরই অংশ। আমি আসলে আপনাকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য এসেছি। তাবাসসুমের তো হাউজ টিউটিরই টিকে না। ও তো বেশ দুষ্টু আর একদম পড়তে চাইতো না। কিন্তু আপনি যেন যাদু করেছেন। বোন’টা আমার নিয়মিত পড়তে বসছে। আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

– কি যে বলেন, এতো কৃতজ্ঞতা জানানোর কিছু নেই। ও আসলে মেধাবী মেয়ে। কিন্তু বন্ধুর অভাব, সঙ্গীর অভাব। এই বয়সের মেয়েরা ভাবে- কেউ আমাকে বোঝে না, আমি বড়ো একাকী, বাবা মা আমাকে বুঝতে চায় না। আর সবচেয়ে বড় কথা, কিশোর কিশোরীরা শাসন মানতে চায় না। বিদ্রোহ করে, ওদের খুব সময় নিয়ে বোঝাতে হয়। বন্ধুর মতো মিশতে হয়। আমি জাস্ট এটাই চেষ্টা করেছি।

অদিতির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতায় তানভীর মুগ্ধ হয়। ওর মনে হয় এই মেয়েটা অন্যরকম। খুব গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করে। এতো সাধারণ ভাবে এখনকার মেয়েরা চলে না। আবার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর কথা বলার ধরণই বলে দেয় প্রবল আত্নসম্মানবোধ সম্পন্ন। ভালো লাগে তানভীরের।

– আপনি তো বাসায় ফিরবেন। আমিও বাইরে যাবো। তাবাসসুম বলছিলো আশেপাশেই আপনাদের বাসা। তার উপরে অসুস্থ, আপনাকে পৌঁছে দিই।

– অনেক ধন্যবাদ। দারোয়ানকে বলে একটা সিএনজি ডেকে দিলেই হবে।

নাক মুছতে মুছতে বলে অদিতি।

মেয়েটা আসকেই অন্য টাইপের। মনে হয় কিছুটা অহংকারীও, কি জানি! মনে মনে এটা ভাবতে ভাবতে বের হয়ে যায় তানভীর। ও আসলে কিছুটা আহত হয়েছে। এভাবে যেচে কাউকে লিফট দিতে চাইলো আর প্রত্যাখাত হলো, ভাবতেই পারে নি। তরুণীদের মধ্যে বেশ কদর আছে তানভীরের। আর অহমেও একটু লাগলো বুঝি।

অদিতির এসবে মাথাব্যথা নেই। কারণ ঠান্ডায় ওর আসলেই মাথাব্যথা করছে। বাসায় ফিরে ওষুধ না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই।

(চলবে)

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(অষ্টম পর্ব)

ইগো একটা অদ্ভুত জিনিস। কেউ কারো প্রতি আগ্রহ দেখালে বিতৃষ্ণা লাগে আবার এড়িয়ে গেলে আগ্রহ বাড়ে। এই যেমন অদিতির কোন ছেলের প্রতিই কোন আকর্ষণ নেই কিন্তু এই যে তার বিতৃষ্ণা এতে আরেকজনের আগ্রহ বেড়েছে – তানভীরের।

দুপুরে বা বিকালে তানভীর কখনোই বাসায় থাকতো না। সকালে বের হয়ে বেশ রাত করেই ফিরতো। কিন্তু ইদানীং তাকে বিকালের দিকে মাঝে মধ্যেই চায়ের কাপ হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ঠিক যে সময়ে অদিতি পড়াতে আসে। অদিতি তাকে দেখে কি দেখে না, তানভীর ঠিক বুঝতে পারে না। তানভীর আসলে অদিতির সাথে একটু কথা বলতে চায়, পরিচিত হতে চায়। অদিতির সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্তু অবাক হয় এটা দেখে যে, অদিতির নূন্যতম আগ্রহ নেই। এমন না তরুণীদের কাছে তানভীরের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই, বরং ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। স্মার্ট, সুদর্শন এবং সর্বোপরি ধনী পরিবারের এস্টাবলিশ তানভীরের জন্য বাস্তবেই অনেকে লাইন দিয়ে আছে।

তানভীর বিষয়টা ইনজয় করে কিন্তু পাত্তা দেয় না। ওর অনেক বন্ধুদের এই পাত্তা দিয়ে ধরা খেতে দেখেছে। কোথায় যায়, কোথায় খায়, কি করে, কেন করে – এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বেচারারা নাজেহাল একেবারে। উফ অসহ্য লাগে তানভীরের। ন্যাকা মেয়েদের এতো কেনা গোলাম টাইপের সম্পর্কে সে জড়াবে না।

কিন্তু অদিতি এমন একেবারে এড়িয়ে যাবে, সেটা তানভীরের পুরুষত্বে লাগে। আজ এজন্য ইচ্ছা করেই লিভিং রুমে বসে বেশ গুরুত্বের সাথে পত্রিকা পড়ছিলো । পত্রিকাতে আসলে পড়ার কিছুই নাই, জাস্ট সময় কাটানো। আসল উদ্দেশ্য অদিতির সাথে দেখা করা। লিভিং রুম দিতেই তাবাসসুমের রুমে যাবে। অদিতি যেমনই হোক, একটু হাই হ্যালো না করে কি পারবে!

– হাই কেমন আছেন?

অদিতিকে ব্যস্ত হয়ে রুম পার হতেই তড়িঘড়ি করে তাকে থামিয়ে দেয় তানভীর।

– জি ভালো। বাহ আপনি তো মুরুব্বিদের মতো করে বসে আগামীকালের খবর আজ তাও বিকালে পড়ছেন! এখনকার জেনারেশন তো অনলাইনেই মুহূর্তের মধ্যে তাজা খবর পড়ে ফেলে!

ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় তানভীর। নাহ এই মেয়েটি একদমই সুবিধার না। চুপ করে বসে পড়ে তানভীর। অদিতি সেই একই গতিতে তাবাসসুমের রুমে চলে যায়।

রাতে খাওয়ার টেবিলে অদিতির মা বেশ গরম হয়ে উঠেন। প্রসঙ্গ অদিতির বিয়ে। মেয়ের অনার্স শেষ হয়ে যাচ্ছে, এখন বিয়ে না দিলে আর ভালো পাত্রই পাওয়া যাবে না।

– আমি পড়া শেষ না করে বিয়ে করবো না, মা

– সেই পর্যন্ত কোন রাজপুত্র তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবে?

– আমার কোন রাজপুত্রের প্রয়োজন নেই, আমি নিজে খুব সাধারণ ঠিক তেমনি সাধারণ একজন ছেলে হলেই হবে।

– কবে পড়া শেষ হবে, সে পর্যন্ত তোমাকে বসায়ে খাওয়াবো? বাপের অবস্থাও তো দেখতে পারো।

– ভায়ের পড়া শেষ হয়েছে আরো দুই বছর আগে। ভাইয়াকে যদি বাপ বসিয়ে খাওয়াতে পারে, আমাকেও নিশ্চয় পারবে!

– তুমি দিন দিন বেয়াদব হচ্ছো। ভায়ের সাথে তোমার কি তুলনা। ভাই তো চাকরি নিয়ে অন্য কোথাও যাচ্ছে না, তুমি তো শ্বশুরবাড়িতে আজ হোক কাল হোক চলে যাবা। আয় ইনকাম যদিওবা কিছু করো আমাদের কি যায় আসে? এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে বছরে একদিন আসবা কিনা সন্দেহ!

– লুৎফা, তুমি কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছো আজ!

– হ্যাঁ, আমি তো সত্য কথা বলি এজন্য কারো ভালো লাগে না। পাইছে বিনা বেতনের বান্দী। সারাদিন কাজ করো, চরকির মতো ঘুরো কিন্তু কিছু বলা যাবে না। এই মেয়েকে বুড়ী করে পস্তাবে বললাম। আর দুই বছর পরেই রিটায়ার্ড হবা, তখন বুঝবা আমার কথার মানে।

অদিতির মুখ, সারা শরীর যেন তেতো হয়ে উঠে। না খেয়েই উঠে পড়ে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। মা আজীবন তাকে এমনই পর পর করে চলেছে। ভায়ের সাথে তাকে এতোটাই বৈষম্য করে যে মেনে নেয়া কষ্টকর। মাঝে মধ্যে মনে হয় বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু বাবার কথা মনে হলেই ওর মন শান্ত হয়ে আসে। বাবার জন্য সে সব করতে পারে। বাবার মনে কষ্ট দেয়ার কথা ভাবতেও পারে না।

সকালে না খেয়েই ভার্সিটিতে চলে যায়। তীব্র ক্ষুধা লাগে দুপুরে। ক্যান্টিনে খেয়ে নিয়ে বিকালে ছোটে তাবাসসুমকে পড়াতে। আজো তানভীর দাঁড়িয়ে আছে, ব্যালকনিতে। অদিতি ঠিক বুঝতে পারে কিন্তু পাত্তা দেয় না। বড়লোকদের নানা রকম বিলাসিতা, নানা রকম ফ্যান্টাসী থাকে। ভালোবাসা নামের ভালো লাগা তেমনই এক ফ্যান্টাসী। অদিতি তানভীরকে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেই সে এখন অদিতির প্রতি মরিয়া। কিন্তু অদিতি জানে সে কেন এই বাড়িতে আসে, সমাজে ওর অবস্থান কোথায় এবং কোন সীমারেখায় থাকতে হবে। নাহ, এর একটা বিহীত করতে হবে- মনে মনে ভাবে অদিতি।

আজ তাবাসসুমকে পড়ানো শেষে ওর মা’কে ডেকে সুন্দর করে বলে যে, এই মাস পরে অদিতি আর পড়াবে না। সামনে ওর নিজেরও পরীক্ষা। তাবাসসুম একথা শুনে খুব আপত্তি করছিলো কিন্তু অদিতি বুঝায়ে বললো। কিছু মায়া কাটানোর কাজ শুরুতেই করতে হয়।

অসম্ভব ঘটনা ঘটলো পরদিন। তাবাসসুমকে পড়াতে লিভিং রুম ক্রস করতেই তানভীর সামনে আসলো

– আপনি আর পড়াবেন না কেন?

– কারণ আপনি!

– আ আ আমি! আমি কি করেছি?

– আপনি প্রতিদিন ঠিক আমার আসার সময়ে হয় ব্যালকনিতে না হয় লনে কিংবা লিভিং রুমে বসে থাকেন। আগে তো কখনো আপনাকে দেখিনি। এর কারণ কি?

– আমি আমার বাসায় থাকলে আপনার কি সমস্যা?

– আর আমি আমার পারসোনাল কারণে পড়ানো ছাড়লে আপনার কি সমস্যা?

– কারণ আমার বোনের ক্ষতি হবে। প্রয়োজনে আমি আর আপনার সামনে আসবো না।

– দেখুন, আপনার মা খুব বিশ্বাস নিয়ে আপনার বোনকে আমার কাছে পড়াতে দিয়েছে। আমি যদি সেই সুযোগে আপনার সাথে গল্প করি কিংবা কথা বলি কিংবা কোন কথা না হওয়া সত্ত্বেও আপনি এইভাবে আমার আসার সময়ই এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন, আপনার মা অবশ্যই বুঝবেন যে কোন না কোন ঘাপলা আছে। আর উনি ঘটনা কিছুই না হওয়া সত্ত্বেও দায়ী করবেন আমাকে। আমাকে সুবিধাবাদী ভাববেন আর আমাকে শুধু নয় প্রয়োজনের তাদিগে টিউশন করতে আসা সব মেয়েদেরই উনি খারাপ ভাবতে শুরু করবেন। এজন্য এটাই ভালো যে আমি আর না পড়াই, এখানে আর না আসি। ভালো থাকবেন।

গট গট করে হেঁটে গেলো অদিতি। তানভীর সত্যিকার অর্থেই হাঁ করে রইল!

মাসের শেষ পাঁচদিন তানভীরকে আর দেখা যায় নি। মাস পূর্ণ হলে অদিতিও ছেড়ে দেয় তাবাসসুমকে পড়ানোর কাজ।

(চলবে)

মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-০৬

0

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম
(৬ষ্ঠ পর্ব)

আজ অদিতির টিউশনির প্রথম দিন। ছাত্রী ক্লাস সিক্সে পড়ে। আজ মূলতঃ অদিতির ইন্টারভিউ মানে তাকে দিয়ে ছাত্রী পড়ানো চলবে কিনা, এটাই কষ্টিপাথরে যাচাই বাছাই করা হবে। অনেকটা এভাবেই বলেছেন নন্দিতা আপু। আপু অদিতির সিনিয়র। ভালো পরিচয়, উনি নিজে টিউশনি করেন। আপুকেই ধরেছিলো একটা টিউশনি খুঁজে দেয়ার জন্য। বেশ ভালো অভিজাত এলাকায় আপু এই মেয়েকে খুঁজে দিয়েছেন। এখন দেখা যাক কি আছে অদিতির কপালে!

দোতলা একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি, অফ হোয়াইট কালারের বড় বাসা। সামনে সবুজ লন। দারোয়ানকে নিজের নাম এবং কেন এসেছে জানাতেই সে আবার ইন্টারকমে যোগাযোগ করে। ঐ পাশ থেকে গ্রীণ সিগন্যাল পেতেই অদিতিকে ড্রইং রুম দেখিয়ে দেয়। এই বাড়িতে অনেক গাছ আছে, এটা দেখে অদিতির খুব ভালো লাগে। ও নিজেও গাছ পছন্দ করে। কিন্তু কোয়ার্টারের ছোট্ট ব্যালকনীতে কাপড় শুকিয়ে আর গাছ লাগানোর জায়গা থাকে না। ড্রইং রুমে নানা রকম পেইন্টিং আছে, যেটা অদিতি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো। এমন সময় একজন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা নেমে আসলেন।

সুন্দর একটা সুতি শাড়ি পরে আছেন। এমন শাড়ি এখন নানা অনলাইনের পেইজে দেখা যায়। ১০০০-১২০০ টাকা দাম। ভদ্রমহিলার গমের মতো গায়ের রঙের সাথে মাস্টার্ড কালারের শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউজে অসাধারণ লাগছে। নাকে একটা ছোট্ট ডায়মন্ডের নোজ পিচ ছাড়া আর কোন অলংকার নেই। বড় চোখ আর একটু চাপা নাকের ফর্সা গোলগাল চেহারা। কিন্তু উনার মুখ জুড়ে কেমন একটা মায়া জড়িয়ে আছে। দেখলেই মনে হয় অনেকদিনের চেনা আন্তরিকতা।

অদিতি ভদ্রতা করে উঠে দাঁড়িয়েছিলো। উনি বসতে বললেন।

– আপনার নাম তো অদিতি আহসান? আমি রেহনুমা খানম। ছুটকি মানে তাবাসসুমের মা। আমরা তাবাসসুমকে বাসায় ছুটকি ডাকি। ছোট কিনা এজন্য। আপনার সম্পর্কে নন্দিতা বলেছে, আপনি ফিজিক্সে পড়েন। সুতরাং মেধাবী সন্দেহ নেই। বরং আমার মেয়েটা ফাঁকিবাজ। দেখেন একটু বুঝিয়ে পড়াশোনায় মন লাগাতে পারেন কিনা। আমার আসলে দরকার ওর বন্ধু হতে পারে মানে ওকে বুঝে এবং বুঝায়ে পড়াশোনায় ফেরাতে পারে এমন কাউকে। আমি নিশ্চিত আপনি পারবেন।

– আমি আপনার মেয়ের মতো, প্লিজ তুমি করে বলবেন।

– মেয়ের মতো তো বটেই। তুমি করেই বলি, আমার এক ছেলে আছে, যে তোমার চেয়ে বড়, এবার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করলো। শোন ছোট হলেও তুমি একজন শিক্ষক, সুতরাং পেমেন্টের বিষয়ে কথা বলাটা বিব্রতকর। নন্দিতা যেটা বলেছিলো সেটাই ফাইন্যাল। তোমার ঢংগী ছাত্রীকে ডাকছি পরিচিত হও।

শেষের কথা বলে মিষ্টি হাসি দিলেন রেহনুমা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো অদিতি। মনে মনে শংকিত ছিলো, না জানি কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়! কিন্তু আন্টি বেশ ভালো। নন্দিতা আপু এই তাবাসসুমকে কিছুদিন পড়িয়েছে কিন্তু এখান থেকে আপুর হোস্টেল অনেক দূরে হওয়ায় আর পড়াবেন না। অদিতিদের বাসা হতে আবার খুব বেশি দূরে নয়।

– মিস আপনি কে ড্রামা দেখেন? কিম সু হিউন কে আপনার কেমন লাগে?

ছাত্রীর মুখের প্রথম কথা শুনে তব্দা খেয়ে কয়েক মিনিট বসে থাকলো অদিতি। ছাত্রীখানা তার কোরিয়ান গার্লদের মতো করে চুল কেটেছে। গালে লাল আভা, নিশ্চিত একটু ব্লাশার লাগিয়েছে। সর্বনাশ, একে কিভাবে পথে আনবে! মনে মনে প্রমাদ গোণে। পরে ভাবে এর সাথে আগে ভাব করতে হবে। যষ্মিনদেশে যদাচারের মতো এর সাথেও এর মতো করেই মিশতে হবে।

– বাহ তোমার তো দারুণ রুচি। কে ড্রামা নাকি আসলেই সেই লেভেলের ভালো। বেশিরভাগ মেয়েরই রুচি খারাপ বুঝলে। এজন্য তাদের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলতেও ভালো লাগে না। যাই বলো তোমাকে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে, একদম কোরিয়ান সুইট গার্ল!

তাবাসসুম খুব খুশি হয়। এই প্রথম একটা মনের মতো মিস পেলো! আগেরগুলো ছিলো সব কাট্টা খোট্টা, এক পড়া ছাড়া কিচ্ছু বুঝতো না। সেই মিস তেমন না, বেশ সুন্দর করেই কথা বলে।

– মিস, আজকে কিন্তু পড়বো না।

– আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার সম্পর্কে বলো। তোমার পছন্দ, ভালো লাগা এসব নিয়ে। কে ড্রামা ভালো লাগে তা তো আগেই বলেছো। এছাড়া আর কি কি বা কাকে ভালো লাগে এসব।

তাবাসসুম অতি উৎসাহে গল্প করতে থাকে। এক ফাঁকে বলে – আমার প্রিয় মানুষ হলো আমার ভাইয়া। পৃথিবীর সবাই আমার বিপক্ষে গেলেও ভাইয়া আমার পক্ষে। আমার জন্ম হলে সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন আমার ভাইয়া। আমার সব আবদার, চাওয়া সব ভাইয়ার কাছেই করি। জানেন, আমার ভাইয়া হওয়ার পরে আম্মুর আর বেবি হচ্ছিলো না। তখন ভাইয়া খুব আফসোস করতো একটা ভাই বোনের জন্য। আমি হলে এজন্য ভাইয়া খুব খুশি হয়েছিলো।

ভায়ের কথা বলতে বলতে তাবাসসুমের চোখ কেমন জ্বলজ্বল করে। অদিতির ভীষণ ভালো লাগে৷ ইশ! ওদের ভাই বোনের সম্পর্ক যদি এমন হতো! ওর ভাইয়া ওকে অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। অদিতি কোন কাজ না পারলে বা কোন কাজে অসফল হলে ভাইয়া বরং খুশিই হয়। মেয়ে হয়ে অদিতি কেন মেধাবী বা ওর চেয়ে ভালো জায়গায় ভালো সাবজেক্টে পড়ছে এটা ওর ভাই শোভন নিতেই পারে না। আর ওদের মায়ের একচেটিয়া সমর্থন ওর ভায়ের দিকে।

কেমন যেন মন খারাপ হয় অদিতির একই সাথে তাবাসসুমের ভাইকে দেখার বেশ একটা আগ্রহ জাগে।

(চলবে)

মেয়েটি যেন ভিন্নরকম পর্ব-০৫

0

#মেয়েটি_যেন_ভিন্নরকম

(৫ম পর্ব)

সন্ধ্যা নামছে যেন অতি ধীর গতিতে। ডেকোরেটরের লোকজন তাদের হাঁড়ি, কড়াই, গ্লাস, প্লেট সব গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়তি খাবারগুলো নেয়ার কেউ নেই। অদিতির বাবা বলে দিয়েছেন ওদের নিয়ে যেতে। অদিতিরা কেউই খায় নি। ভেবেছিলো বিয়ে পড়ানো হলেই খেতে বসবে। কিন্তু বিয়েও হলো না, বাড়ির কারো খাওয়াও হলো না।

গ্রামের বাড়ি হলেও অদিতির চাচারা বেশ সুন্দর করে উঠান রেখেই একতলা পাকা বাড়ি করেছেন। রান্নাঘর আর স্নানের ঘর বাইরে৷ বাড়ির মাঝের একটা ঘরে সবাই বসে অনেকটা বসার ঘরের মতো। সেখানেই খাটের উপর বসে আছে অদিতির মা এবং চাচী। চেয়ারে অদিতির চাচা এবং বাবা। অদিতি আর ওর ভাই শোভন গেলো সেখানে।

– ঝোঁকের মাথায় তো বিয়ে ভেঙে গেলো, এখন কি হবে বুঝতে পারছি না।

অনেকটা ভাঙা গলায় বললেন অদিতির চাচা সিরাজুল হক।

– আমার মেয়েটার সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। কে বলেছিলো বড়দের বিষয়ে নাক গলাতে!

ফুঁসে উঠেন অদিতির মা লুৎফা। মেয়ের পাকনাকি ভীষণ অপছন্দ। বিয়ে ভেঙে গেলে গ্রাম এলাকায় আবার বিয়ে হওয়া যে কি কঠিন, এই পিচ্চি মেয়ে কি বুঝবে!

– আমরা যেটা করতে পারি নি, অদিতি সেটাই করেছে। বরং দরকার ছিলো ওদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া। তোমাদের কি মনে হয়, হাত পা ধরে বিয়ে দিলে শম্পাকে ওরা আদরে রাখতো? ঐ মহিলা প্রতিনিয়ত জ্বালাতো। আর ছেলেটাও তো ওর মায়ের কথার কোন প্রতিবাদ করে নাই। এমন মেরুদন্ডহীন ছেলের কাছে বিয়ে না দিয়েই ভালো হয়েছে।

গম্ভীর গলায় অদিতির বাবা মেয়েকে সাপোর্ট দেন।

– কিন্তু শম্পাকে কি বলবো? কিভাবে বোঝাবো? মেয়েটা তো এখনো বিয়ের সাজগোজ খোলে নি।

অদিতির চাচী কান্নার সুরে বলতে থাকে।

– আমিই সাজ উঠাতে, কাপড় চেঞ্জ করতে নিষেধ করেছি। কারণ শম্পা আপুর আজই বিয়ে হবে!

ঘরে যেন কোন বোমা ফেটেছে। সবাই অবাক হয়ে হতবিহ্বল হয়ে অদিতির দিকে তাকিয়ে আছে। অদিতির মায়ের মুখ শুকিয়ে যায়। এই মেয়েটা না জানি আবার কি অকান্ড করে!

– চাচা, আপনি ভালো করেই জানেন এই গ্রামের সালাম ভাই শম্পা আপুকে পছন্দ করে। আপনার কাছে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু আপনি রাজী হন নি। কারণ সালাম ভাই চাকরি করে না, গ্রামেই ব্যবসা করে। সালাম ভাই কিন্তু এম এ পাশ কিন্তু উনি আর দশটা ছেলের মতো চাকরি না খুঁজে, ঘুষ দিয়ে চাকরির চেষ্টা না করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এটা কি অপরাধ? অযোগ্যতা? চাকরি করলে উপযুক্ত ছেলে আর না করলে বা ব্যবসা করলে অনুপযুক্ত, এই ধারণা একদম ভুল। আমি যতো দূর জানি সালাম ভাই সদালাপী, বিনয়ী ছেলে। পাকা বাড়িও আছে। আর সেখানে বিয়ে হলে তো শম্পা আপু গ্রামেই থাকতো, যখন তখন দেখতে পারতেন।

– সে তো মা যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন এই বিয়ে ভাঙা মেয়েকে কে বিয়ে করবে!

– চাচা, সালাম ভাই অবশ্যই এখনো রাজী হবেন। আর উনার তো মা বাবা কেউই বেঁচে নেই, উনার অভিভাবক নেই। এজন্যই তো আরো বেশি এই প্রস্তাবে রাজী ছিলেন না, তাই না চাচা? অথচ মাতৃ পিতৃহীনদের আরো বেশি ভালোবাসা উচিৎ। এখন দেখেন এটাই শাপে বর হবে। আমি শিউর সালাম ভাই রাজী হবেন। আর উনার বাবা মা না থাকায় ‘বিয়ে ভাঙা’ মেয়ে এমন অপবাদ দেয়ার কেউ নেই।

– তুই চুপ কর। জীবনটা নাটক সিনেমা পেয়েছিস নাকি? যা ইচ্ছা করে যাচ্ছিস, বলে যাচ্ছিস। তোকে এখানে কে ডেকেছে? আর তোমাকেও বলি মেয়েকে ঠেকাও। আদর দিয়ে আর সব কথায় সায় দিয়ে আর মাথায় তুলো না।

খেঁকিয়ে উঠেন লুৎফা। মেয়ের কথা বার্তা আর সহ্য হচ্ছে না।

-মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে। ওর সাথে এমন ব্যবহার করবে না। অদিতির কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। আজই বিয়ে দিতে পারলে ভালো। কারণ গ্রাম এলাকায় যতো সময় যাবে ততই নানান কথার হাত পা হবে। কিন্তু তার আগে শম্পার সাথে কথা বলা সবার আগে জরুরী। কারণ মেয়েটা একটা ট্রমার মধ্যে পড়েছে। সেখানে একটু সময় না দিয়ে আজই আরেক জায়গায় বিয়ে দেয়ার কথা মানতে পারবে তো!

এই কথায় শম্পার মায়ের যেন হুঁশ হয়। তাই তো উনার তো আগে মেয়ের পাশেই থাকা উচিৎ। অবশ্য নিজের ছোট বোনকে বসিয়ে রেখে এসেছিলেন। তবুও সবার কথা বার্তার মাঝেই ছুটে যান মেয়ের কাছে। মেয়েটাকে তো ধাতস্ত করতে হবে। ওর মনের অবস্থাও জানতে হবে।

এদিকে ভায়ের সাথে আরো দুই একটা কথা বলে অদিতির বাবাও গেলো শম্পার ঘরের দিকে। সালামের বিষয়টা একটু শুনতে হবে। অদিতির কথাই ঠিক। সালাম ছেলেটা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো কিন্তু ব্যবসা করে বাপ মা নেই এজন্য শম্পার বাবা রাজী হয় নি। এখন নিজেই সেই কথা স্বীকার করলেন। চাকরিজীবী ছেলে দেখে আরো ভালো করে খোঁজ না নেয়ার জন্য আফসোস করলেন।

শম্পার রুমে ঢোকার আগে অদিতির বাবা আগে ধরলেন অদিতিকে। এ কিভাবে সালামের কথা জানলো! তবে কি শম্পার সাথে সালামের কোন সম্পর্ক ছিলো!

– বাবা, আমি জানতাম তুমি আমার কাছে আসবা আর আরো জানি কি জিজ্ঞাসা করবা

দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে অদিতি। আহসানুল হক মেয়ের সরলতা, বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসিকতায় মুগ্ধ হন। মেয়েকে কিছুই জিজ্ঞাসা করেন না। মাথায় হাত দিয়ে বলে

– এমনি থাকিস মা।

এরপর শম্পার ঘরে ঢুকে ওর পাশে বসেন। নরম স্বরে বলতে থাকেন

– মা রে জানি খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু হাত পায়ে ধরে এই বিয়ে হলে আমরা যে আরো চিন্তায় থাকতাম। যা হয়েছে সব আল্লাহর ইচ্ছা। অদিতি কোন একটা ছেলের কথা বলছিলো – সালাম নামে। চিনো নাকি? অদিতি তো তার সাথে বিয়ের কথা বলছিলো।

– চাচা, সালামকে আমি গ্রামের একজন হিসেবেই চিনি। শুনেছিলাম সে বিয়ের প্রস্তাব দিলে আব্বা রাজী হয় নাই, কারণ সে এতীম। এই বিষয়টা আমার ভালো লাগে নাই। তার চরিত্র খারাপ বা অসৎ, অলস হলে আলাদা কথা। কিন্তু বাবা মা নেই বলে কি তার বিয়ে হবে না! এটাই একদিন অদিতিকে বলেছিলাম। আর বিয়ে ভাঙাতে আমি মোটেও দু:খ পাই নি। এই যুগেও যারা গায়ের রঙ আর কতোটুকু লম্বা সেই হিসেব করে সুন্দর অসুন্দরের মাপ করে আর কবুল বলার আগ মুহূর্তে বিয়ে ভেঙে দেয় সেখানে বিয়ে না হওয়ায় আশীর্বাদ।

– মা, তুমি কি এই ছেলেটার উপর আরেকটু ভরসা করবে?

– চাচা, অদিতি এতো সাহসী, এতো ভালো কেন জানেন? কারণ তার বাবা আপনি। আমি আপনাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি।

আহসানুল হক বের হয়ে এখানে সেখানে ফোন দিয়ে সালামের খোঁজ খবর নেয় এবং আরো দুই একজন নিয়ে হাজির হয় সালামের সামনে।

গ্রামে কারো জানতে বাকি নেই যে শম্পার বিয়ে ভেঙেছে। সালামও জানে। ঘরে বসে টিভি দেখছিলো, এমন সময় আহসানুল হক অনেকটা করজোড়ে দাঁড়ায়।

সালাম আহসানুল হককে চিনে। ছুটে এসে হাত ধরে। আহসানুল হক সালামের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলেন

– তোমার বাবা মা নেই বলে বিয়ে হয় নি। দেখো তো বাবা, আমাকে বাবা হিসেবে মানতে পারো কিনা। তাহলে আমি না হয় তোমার বাবা হয়ে আর শম্পার চাচা হয়ে বিয়েটা দিতাম।

মনে মনে হয়তো ভাবছো মেয়ের বিয়ে ভাঙায় এসব বলছে। সেটা সত্যি কথা, অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার মেয়েপক্ষের লোক হয়ে হাত পা ধরতেও আপত্তি নেই। তবুও আমাদের মেয়েটা আর কষ্ট না পাক।

– আপনি মেয়েপক্ষ না, ছেলেপক্ষ।

ধরা গলায় বলে সালাম।

সেদিন রাত ১২ টায় সালাম শম্পার বিয়ে হয়। অদিতি জোরে গান ছেড়ে পিচ্চিদের নিয়ে নাচতে থাকে।

(চলবে)