Monday, June 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 89



কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৩

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৩)

নবনীতা উন্মা’দের মতো ছুটতে ছুটতে যেদিকে দুই চোখ যায় সেদিকেই পালিয়ে যাচ্ছিল।তবে সে বেশি দূর পালাতে পারল না।একটু দূরে যেতেই ফাহাদ খপ করে তার একহাত টেনে ধরল।প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’পালাচ্ছিস কোথায়?তোর বরের কাজকর্মের প্রতিদান নিয়ে যা।’

নবনীতা এক ঝাড়ায় তার হাত ছাড়িয়ে পুনরায় সামনের দিকে ছুটে।ছুটতে ছুটতে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।সে এতো দ্রুত দৌঁড়াতে পারে না।তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা জন্মগত।হাঁপাতে থাকা শরীরটা ছুটতে ছুটতে টেনে টেনে নিশ্বাস নেয় কতোক্ষণ।শ্বাস টানতে টানতে অস্ফুটস্বরে শব্দ করে,’আল্লাহ! রক্ষা করো।’

ফাহাদ তাকে পুনরায় পেছন থেকে টেনে ধরে।নবনীতা শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে।তার দৃষ্টি ফাহাদের হাতে থাকা র’ক্তাক্ত ছু’রির দিকে।যেই ছু’রি নবনীতার সমস্ত বাধা অতিক্রম করে একটু একটু করে এগিয়ে আসছিল তার পেটের দিকে।সে চিৎকার ছুড়ে সর্বশক্তি দিয়ে।ফাহাদকে প্রতিহত করার অভিপ্রায়ে সে পেছন ফিরে তার নাক বরাবর ঘু’ষি মা’রে।

দুই মিনিটের হাতাহাতি তে নবনীতার বাহু আর পিঠের অসংখ্য জায়গা কেটে ঝর ঝর করে র’ক্ত ঝরা শুরু করল।ফাহাদের নিজেরও হাত কাটলো।এই জীর্ণ দেহের মেয়েটিকে ধরাশায়ী করতে ফাহাদের এতো কষ্ট হবে,সেটা সে কল্পনাও করেনি।সে রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’মা***গী একটা! ম’রার আগেও ভোগান্তি দিচ্ছে।হাত ছাড় ফকিন্নি।’

নবনীতা টেনে টেনে শ্বাস নেয়।এই মুহুর্তে স্রষ্টা ব্যতীত কে তাকে রক্ষা করবে?চারদিকে মিউজিক প্লেয়ার দিয়ে বাজানো গানের শব্দের মাঝে নবনীতার চিৎকার কেমন করে পৌঁছাবে তাদের কাছে?নবনীতা তবুও চিৎকার দেয়।মৃ’ত্যুভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে,’বাঁচাও।প্লিজ কেউ বাঁচাও।’

ফাহাদ অবশেষে একটা আঘাত জোরাল ভাবে করতে সক্ষম হলো।হাতের ছু’রি টা প্রায় ইঞ্চি দুইয়ের মতো নবনীতার কাঁধের ভেতর প্রবেশ করল।নবনীতা অম্বর কাঁপিয়ে চিৎকার ছুড়ল,’বাবা!!’
সাথে সাথেই গল গল করে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত ছুটলো তার।নবনীতা বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে শেষ চেষ্টা চালাল।ফাহাদের হাত না চেপে সে এক ধাক্কায় তার হাতের ছু’রি টা দূরে ছুড়ে মারল।এই প্রচেষ্টায় সে সফল হয়েছে।তার ধাক্কায় ছু’রিটা ফাহাদের হাত ছেড়ে আলমারির নিচে গিয়ে পড়ল।যার অবস্থান ফাহাদের নাগালের অনেক বাইরে।

বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে।ফাহাদ যেটুকু সময়ে সব হবে ভেবেছিল,সেটুকু সময়ে সব হয়নি।আসাদের মতো মানুষকে মা’রতে তার দুই মিনিটও লাগে নি।আর এই চুনোপুঁটির মতো মেয়ে রীতিমতো তার ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছে।সে আর মাটিতে ঝুঁকে ছু’রি খোঁজার চেষ্টা করল না।আর দশ সেকেন্ড এদিক সেদিক হলেই সে ধরা পড়ে যাবে।সে একটা অশ্রাব্য গা’লি মুখ থেকে বের করে এক ধাক্কায় নবনীতাকে মেঝেতে ছুড়ে মারল।তারপরই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে পালাল সেখান থেকে।নিচে আরহামের গার্ডদের দেখা যাচ্ছে।তারা এই ভবনে ঢুকার আগেই তাকে পালাতে হবে।

নবনীতা মেঝেতে বসেই দুই দিকে দেখল।সেদিনের মতো তার হাতের কাছে কিছু নেই যেটা সে সোজা ফাহাদের ঘাড় বরাবর মারতে পারে।উল্টো সে নিজের শরীরের যন্ত্রণায় অস্থির।র’ক্তে র’ক্তে তার সমস্ত শরীর ভেসে যাচ্ছে।সে আস্তে করে তার শরীরটা মেঝেতে এলিয়ে দিলো।এতোক্ষণ ধস্তাধস্তি তে সে শরীরের ব্যাথা অনুভব করেনি।কিন্তু এখন একটু সময় যেতেই কাঁধের মারাত্মক যন্ত্রণায় সে ফুঁপিয়ে উঠল।নিজের রক্তে তার নিজেরই বমি পাচ্ছে।চটচটে আঠালো তরলটি তার সারা শরীরে গড়িয়ে পড়ছিল।কি বিভৎস দেখাচ্ছে তাকে।

বাবার কথা আবারো মনে পড়ছে তার।অনেক গুলো বছর আগে বাবাকে সে এমন জঘন্য অবস্থায় দেখেছিল।বাবা তো সেদিন বাঁচে নি।নবনীতা কি বাঁচবে?সে অসহ্য যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে উঠে।ভাঙা কন্ঠে বাবাকে একবার ডাকে।নিভু নিভু চোখে সামনে তাকাতেই দেখে আরহাম অস্থির হয়ে এলোমেলো পায়ে তার দিকে ছুটে আসছে।

তার কাছে আসতেই আরহাম স্তব্ধ হয়ে কতোক্ষণ আগাগোড়া তাকে দেখল।দেখা শেষ হতেই সেকেন্ডের ব্যবধানে মাটিতে বসে তার র’ক্তমাখা শরীরটা নিজের সাথে চেপে ধরল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’পরী!’

নবনীতা বুজে আসা চোখে তাকে দেখে।তার চোখ দু’টো ভীষণ অনুভূতিশূন্য আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।তার সমস্ত শরীর সময়ের পরিক্রমায় ঠান্ডা হয়ে আসছে।সে কাঁপা কাঁপা হাতে আরহামের বাহু ধরে।থেমে থেমে নিশ্বাস নিয়ে বহু কষ্টে বলে,’আরহাম! আমার কিছু হলে শুভি আর চিত্রকে দেখবেন প্লিজ?তারা আমার কাছে আমানতের মতো।প্লিজ একটু দেখবেন?’

তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল,অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল।তবুও নবনীতা তার কথা শেষ করল।আরহাম হতভম্ব আর অবাক হয়ে সেভাবেই মাটিতে বসে রইল।সে শূন্য চোখে মাথা নিচু করে নবনীতার শান্ত মুখশ্রী দেখে।সেদিন সে গু*লি খাওয়ার পর নবনীতা যেমন করে তাকে ধমকে উঠেছিল,তেমনি করে ধ’মকে উঠে বলে,’এ্যাই পরী।চোখ বন্ধ করছো কেন?বলেছি না চোখ বন্ধ না করতে?’
.
.
.
.
‘সিস্টিক ফাইব্রোসিস।অটোসোমাল রিসেসিভ ডিজঅর্ডার।জেনেটিক্যাল সূত্রে সন্তান জন্মগতভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়।এই ডিজঅর্ডার টি এখন পর্যন্ত অনিরাময় যোগ্য।অর্থাৎ সিস্টিক ফাইব্রোসিসের কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই।এটি রক্তশূণ্যতা জনিত একটি প্রকট ব্যথি।উত্তর ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে এই রোগ প্রথম দেখা যায়।তারপর ধীরে ধীরে সেই ব্যথি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে।আপনার ওয়াইফ মিসেস নবনীতা জন্মসূত্রেই এই ডিজঅর্ডারে ভুগছেন।’

হেমাটোলোজিস্ট মতিন আহমেদ খসরু তার হাতে থাকা রিপোর্ট গুলো ধরে রেখে এক টানে কথা গুলো শেষ করলেন।তার সামনে বসে থাকা যুবকটি তার কথার পিঠে কেবল নিষ্প্রাণ চোখে তার দিকে একবার তাকায়।দৃষ্টি মিলতেই সে আবার চোখ নামিয়ে নেয়।মতিন আহমেদ শান্ত চোখে তার পাঞ্জাবির বুকের দিকটা দেখে।যেটা তা’জা র’ক্ত শুকিয়ে রক্তিম হয়ে আছে।শুধু পাঞ্জাবি না,তার সমস্ত শরীরেই এখানে সেখানে র’ক্তের ছিটা।যুবকটা আইসিইউ বেডে স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটির স্বামী।

মতিন সাহেব একটু থেমে আবারো বললেন,’নবনীতা জন্মের পর থেকেই এই জেনেটিক্যাল ডিজঅর্ডারের পেশেন্ট।একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত সে সুচিকিৎসায় ছিল।যার কারনে তার তেমন সমস্যা হয়নি।কিন্তু বিগত ছয় বছর যাবত সে সুচিকিৎসা দূরে থাক,ন্যুনতম যেই চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন ছিলো,সেটাও নেয়নি।অ্যানিমিয়া বিষয়টা হেলাফেলার না।বারবার বলেছি তাকে।সে কানে নেয়নি।সময় মতো র’ক্ত নেয় নি।নাজুক শরীরটাকে যাচ্ছে তাই কষ্ট দিয়েছে।আর আজকে যেটা হলো,যেই পরিমান র’ক্ত তার শরীর থেকে বেরিয়েছে,এরপর পুরোপুরি সুস্থ হতে নবনীতার বেশ সময় লাগবে।তার শরীরে এমনিতেই র’ক্তের প্রচুর অভাব।’

আরহাম একটু নড়েচড়ে উঠল।জীর্ণ গলায় বলল,’নবনীতার এই অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই?’

মতিন আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।নমনীয় গলায় বলেন,’স্পেসিফিকালি এক শব্দে বললে বলব-না,নেই।কিন্তু সুচিকিৎসায় থাকলে এই অবস্থা থেকে কিছুটা ভালো অবস্থায় যেতে পারবে।কিছুটা না অবশ্য,বেশ ভালোই থাকতে পারবে।নবনীতার সমস্যাটা জন্মগত এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই সমস্যা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।নাথিং টু ডু আরহাম।জেনেটিক্যাল ডিসঅর্ডার এমনই হয়।প্রতি মাসে মাসে র’ক্ত নিয়ে,ঔষধ খেয়ে তাকে বাকি জীবন পার করতে হবে।আরো ভালো হয় যদি ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা করতে পারো।তবে এখন না,বছর খানেক যেতে দাও।শরীরটা একটু মজবুত হোক।নবনীতা একটু ধাতস্থ হোক,তারপর।’

আরহাম তার চুল টেনে ধরে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ে।তার শরীর এখনো কাঁপছে।সে একটা শুকনো ঢোক গিলে জানতে চায়,’পরীর জ্ঞান ফিরবে কখন?’

‘আপাতত সামনের দুই দিন একটু অবজারভ করতে দাও।এখনি জ্ঞান ফেরা নিয়ে ভাবছো কেন?কি পরিমান ব্লিডিং হয়েছে তুমি নিজের চোখে দেখেছো।তার জীবন যে আছে এটাই কি বেশি নয়?’

আরহাম নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়।নিঃশব্দেই পা বাড়ায় সামনের দিকে।তার ভয়,তার আশংকা সবটা সত্য হয়েছে।তার সমস্ত কিছুর শোধ তোলা হয়েছে দু’টো নিষ্পাপ মানুষের র’ক্তের বিনিময়ে।যাদের একজন ইতোমধ্যেই তার পৃথিবীর অধ্যায় শেষ করে ফেলেছে।

যতবারই সে চোখ বুজে,নবনীতার শ্বাস টানতে থাকা শরীরটা তার মনসপটে ভেসে ওঠে।তখনই সে আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না।তার বাবার মৃত্যুও সুখকর কিছু ছিল না।তবে এরকম চোখের সামনে আপন মানুষদের র’ক্তাক্ত শরীর সে আগে দেখেনি।কি যন্ত্রণাময় সে দৃশ্য! অথচ তার রাজনৈতিক জীবন চলাকালীন এমন কত কত নিষ্পাপ মানুষের ব*লি হয়েছে।সে সবটা জেনেছে,তবুও দলের বিপরীতে গিয়ে কিছু বলে নি।কারণ তারা তার কেউ ছিল না।তাদের মৃ’ত্যুতে তার হৃদয়ে র’ক্ত’ক্ষ’র’ণ হয়নি।কারণ সে তাদের আপনজন ছিল না।প্রতিহিংসার নোংরা রাজনীতি যখন তারই ঘরে এসে থাবা দিলো,তখন আরহাম টের পেল এতোদিনে নির্বিচারে খু’ন হওয়া শতো শতো নিষ্পাপ প্রাণদেরও একটা ঘর ছিল।সেই ঘরে তাদের প্রিয়তম কিংবা প্রিয়তমারা ছিলো।তারা সেই ঘরে আর কখনোই ফিরতে পারে নি।

আরহাম মতিন আহমেদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত আর ভঙ্গুর পায়ে করিডোরে এসে দাঁড়ায়।রিমি তাকে দেখতেই তার কাছে ছুটে যায়।অধৈর্য হয়ে বলে,’উনি কি বলেছেন ভাইয়া?নবনীতা ঠিক আছে তো?’

আরহাম আস্তে করে মাথা নেড়ে বলল,’আছে।ঠিকই আছে।জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে হয়তো।’

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুভ্রার পাশাপাশি চেয়ারে গিয়ে বসে।শুভ্রার সমস্ত মুখ তখনো রক্তিম।কাঁদতে কাঁদতে তার নাজেহাল অবস্থা।এতো কান্না সে বাবা মা মা’রা যাওয়ার পরেও কাঁদেনি।আজ কাঁদছে।সে যখন পাঁচ মিনিটের জন্য গ্লাসের দরজা দিয়ে আপাইকে দেখার সুযোগ পেল,তখনই সে পা উঁচু করে ভয়ে ভয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখল।যেই জীর্ণ অবস্থায় সে তাকে দেখেছে,তারপর থেকে সে ঝরঝর করে কেঁদেই যাচ্ছে।আপাইয়ের পুরো শরীর জুড়ে শুধু ব্যান্ডেজ আর ব্যান্ডেজ।সেই সাথে আশেপাশে কতো রকমের যন্ত্রপাতি।আবার তার শ্বাসপ্রশ্বাসও চলছিলো কৃত্রিম উপায়ে।কি ভয়াবহ সে দৃশ্য!

জীবনের দুঃখের রাত গুলো শুভ্রা আর চিত্রা আপাইয়ের বুকে গুটিশুটি মে’রে কাটিয়েছে।আজ প্রথমবার শুভ্রা চরম অসহায় মুহূর্তে ছুটে যাওয়ার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছে না।রিমি আপু তার খুব খেয়াল রাখছে।কিন্তু রিমি আপু তো আর পরী আপাই না।পরী আপাইয়ের কোনো বিকল্প নেই।সেই শূন্যতা পূরণ করবে,এমন মানুষ পৃথিবীতে আর দু’টো আসে নি।

আরহাম চিত্রার হাত টেনে তাকে নিজের কাছে আনে।মেয়েটা সেই তখন থেকে ভয়ে আর আতঙ্কে মিইয়ে গেছে।তার চাঞ্চল্যে,তার ছুটোছুটি সবকিছু এক জায়গায় এসে থমকে গেছে।আরহাম তার মাথায় হাত বুলিয়ে মোলায়েম গলায় বলল,’কি হয়েছে চিত্র?এতো ভয় পাচ্ছ কি নিয়ে?ভাইয়াকে বলো।’

চিত্রা নাক টেনে টেনে আরহামের দিকে তাকায়।তার চুপশে যাওয়া মলিন মুখটা একটু সময় যেতেই ভয়াতুর গলায় প্রশ্ন করে,’আপাই কি ম’রে যাবে আরাম ভাই?এরপর কি আমি আর কখনোই আপাইয়ের কাছে ঘুমোতে পারব না?’

তার প্রশ্ন শুনেই আরহামের বুক ধ্বক করে উঠে।একটা বাচ্চা মেয়ে কতোখানি অসহায় হলে এমন একটা প্রশ্ন করতে পারে?কতোখানি আতঙ্কে থাকলে একটা বাচ্চা নিজের দুরন্তপনা থেকে সরে আসে?

আরহাম তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।গাঢ় কন্ঠে আশ্বাস দিয়ে বলে,’না চিত্র।তোমার আপাইয়ের কিচ্ছু হবে না।তোমাদের এতো একা করে সে যাবে কোথায়?’

সে কথা শেষ করেই শুভ্রাকে দেখল।শুভ্রা তখনও নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন করে যাচ্ছিল।আরহাম গলা খাকারি দিয়ে ডাকল,’শুভ্রা! এ্যাই শুভ্রা।’

শুভ্রা কোনোরকমে কান্না গিলে জবাব দেয়,’জ্বী ভাইয়া।’

‘তোমার আপাইয়ের কিছু হবে না শুভ্রা।একটা দিন যেতে দাও।তারপরই তার জ্ঞান ফিরবে শুভ্রা।তুমি আইসিইউ দেখে ভয় পাচ্ছো কেন?আইসিইউ তে আছে মানেই তার অবস্থা খারাপ,এমন কিছু কিন্তু না।’

আরহাম থামে।একটু সময়ের জন্য নিরব থেকে কিছু একটা ভাবে।তারপরই সমস্ত নিরবতা ছাপিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে,’তোমার কাছে কিছু কথা জানার ছিল শুভ্রা।প্লিজ একটু বলবে?’

‘কি ভাইয়া?’ নাক টানতে টানতে জানতে চায় শুভ্রা।

‘তোমাদের হোম টাউন কি ঢাকার বাইরে?’

‘জ্বী।আমাদের জন্ম চট্টগ্রামে।’

আরহাম কিছু একটা বুঝে ফেলার মতো করে মাথা নাড়ল।তারপরই পুনরায় জানতে চাইল,’নবনীতার পাস্ট রেকর্ড অনুযায়ী সে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খুব ভালো চিকিৎসার মাঝে ছিল।এমনকি কয়েকবার চেক আপের জন্য সিঙ্গাপুরেও গিয়েছিল।এরপর গত ছয় বছর ধরে সে আর নিয়মিত চেক আপের মাঝে ছিল না।এটার কারণ কি?’

শুভ্রা তার এলোমেলো চুলগুলো কানের কাছে গুজে নেয়।একটু পর পর তার হেঁচকি তুলে কান্না আসছে।ওয়াজিদের তাকে দেখেই মায়া হলো।সে মলিন মুখে বলল,’এমন করে কাঁদে না শুভ্রা।তোমার আপাই ঠিক আছে।আরহাম বললো তো।’

শুভ্রা দুই হাতে চোখ মুছে।আরিশ তার থেকে সামান্য খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে একবার তার মুখটা দেখল।সে একটু আগেই তার ভার্সিটি শেষে সোজা এদিকে এসেছে।তার আজকে পরীক্ষা ছিল।তার গলায় এখনো তার আইডি কার্ড টি ঝুলানো।

_____

‘আমার বাবার নাম নূর আহমেদ।চট্টগ্রামে আমার বাবার খুব ভালো পরিচিতি আছে।ব্যবসা করে আর বাবাকে চিনে না,এমন মানুষ খুব কমই আছে।বাবা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার ছিলেন,চট্টগ্রামের বেশ কিছু ফ্যক্টরি তার নিজের নামে ছিল।যদিও তার কিছু আমার বাবা আমার দাদার কাছ থেকে পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিল।আমার ছোট চাচার তুলনায় বাবা ব্যবসায় খুব বেশি নাম করেছিল।দাদার ফ্যক্টরি বাদেও বাবা নিজের টাকায় আরো অনেক কারখানার মালিক হয়েছিল।আমাদের তিন বোনেরই জন্ম হয়েছে চট্টগ্রামের একটি আলিশান বাংলো বাড়িতে।ছোটবেলা টা আমার আভিজাত্যেই কেটেছে।তবে এই অর্থ বিত্ত আর জৌলুস সবচেয়ে বেশি দেখেছিল আপাই।কলেজ জীবন শেষ করা পর্যন্ত আপাই খুব আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল।আপাইয়ের আলমারি ভর্তি শুধু দেশি বিদেশি ব্র্যান্ডের জামা ছিল।আপার ঘরটা আমার একটু একটু মনে পড়ে।এত্তো বিশাল একটা ঘর! আমাদের পুরো ফ্ল্যাটের সমান ছিল তার একটা রুম।আপাই চিকিৎসার উদ্দেশ্য বাদেও অনেক অনেক দেশে ঘুরেছে।বাবা ভীষণ ভালোবাসতো তাকে।বাবা তাকে ছোট বেলা থেকেই একভাবে বড় করেছে।আপাই জন্মগতভাবে অসুস্থ ছিল।বাবা তাকে সবসময়ই চেক আপের মাঝে রাখতো।তবে অসুস্থতার জন্য বাবা আপাইকে বসিয়ে রাখে নি।আপাই ড্রাইভিং থেকে শুরু করে সুইমিং সবকিছুই পারতো।নিজে নিজে শিখেছে।বাবা সাহায্য করেছে।আপাইয়ের এতো সাহস ঐ ছোটবেলা থেকেই একটু একটু করে বাবা তার মধ্যে তৈরি করেছিলেন।আমাদের জীবন অতিমাত্রায় সুখে যাচ্ছিল ভাইয়া।কিন্তু সেই সুখ এক রাতেই ম্লান হয়ে গেল।বাবার পিএ সহ আরো কিছু বিজনেস পার্টনার মিলে ষড়’যন্ত্র করে বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে আমাদের বাগানে নিয়ে কু’পিয়ে হ’ত্যা করল।প্রথমে বাবা,তারপর মা।আমার তো সেই স্মৃতি অল্প অল্প মনে পড়ে।শুধু মনে আছে মা কে মা’রার সময় বাবা আপাইকে জোর গলায় কিছু বলেছে।আর তারপরই আপাই আমাদের দুই বোন কে নিয়ে ছুটতে ছুটতে সেই রাতেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে।পরদিন সকালে বাগানেই বাবা আর মায়ের লা’শ পাওয়া গিয়েছিল।আপাই সিদ্ধান্ত নিল কেস করবে।কিন্তু থানায় কেউ এই হ’ত্যা মামলার কেস পর্যন্ত নেয় নি।তারপর আমাদের বাড়ি থেকে শুরু করে সমস্ত সম্পত্তি রাতারাতি ভাগযোগ হয়ে গেল,অথচ আমাদের জানানোও হলো না।কারণ আমরা কেউই তখন প্রাপ্তবয়স্ক হইনি।বাবার পিএ আর বিজনেস পার্টনার রা তো অন্যায় ভাবে আমাদের অধিকাংশ সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছিল।এরপরেও যা কিছু বাকি ছিল,আমার একমাত্র চাচা সবকিছু দখলে নিলেন।আপাই বিরোধ করল।বলল বাবার কষ্টের সম্পদের এক আনাও সে কাউকে দিবে না।সেই লড়াইয়ে আপাই জিততে পারেনি।দেশীয় আইনে নাকি মেয়েরা কখনোই তার বাবার সব সম্পদ পায় না।তবুও যা একটু পাওয়ার কথা,সেটাও কেড়ে নেওয়া হলো আমাদের থেকে।আমরা শুরুতে একটু আশ্রয়ের আশায় চাচার বাড়িতে জায়গা নিলাম।চাচার বাড়িতে আমরা খুব বেশিদিন থাকতে পারিনি।তার কারণ আপাইয়ের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য।আমার চাচাতো ভাই তাকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লাগল।চাচাও এ নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করলেন।বললেন বাড়িতে থাকতে হলে বিয়ে করতে হবে।কিন্তু আপাই কিছুতেই রাজি হলো না।চাচাতো ভাইয়ের সাথে সে বিয়ে বসবে না,কিছুতেই বসবে না।মিরাজ ভাইয়া,মানে আমার চাচাতো ভাইও আপাই কে ভীষণ উত্ত্যক্ত করা শুরু করেছিল।সে যখন বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়ে আপার গায়ে হাত দেওয়ার দুঃসাহস দেখালো,তখন আপাই কষিয়ে তাকে দু’টো থাপ্পড় দেয়।এরপরই আপাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরা আর চাচার বাড়ি থাকবো না।রাতারাতি আমরা চাচার বাড়ি ছেড়ে দিলাম।ছেড়ে দিলাম নিজেদের শহরও।সেই রাতেই দুই বোনকে নিয়ে আপাই চলে আসলো ঢাকা।আমাদের স্থান হলো মামার বাড়িতে।আপাই তখন এডমিশন পরীক্ষার্থী।শুরুর কয়েকদিন আপাই কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না।নতুন বাসা,নতুন মানুষ,নতুন শহর-সবমিলিয়ে আপাই দিনরাত শুধু দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতো।একদিকে বাবা মা হারানোর যন্ত্রণা,অন্যদিকে আমার আর চিত্রার দায়িত্বভার,সব মিলিয়ে আপাই পাগল হয়ে যাচ্ছিল।তার উপর মামার বাড়িতে মধ্যবিত্ত জীবনযাপনে নিজেকে মানিয়ে নিতে রীতিমতো কয়েকদিন নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করল আপাই।কিন্তু পড়াশোনা ছাড়ে নি একটুর জন্যও।চিত্রাকে বুকের উপর রেখে ঘুম পাড়াতে পাড়াতেই আপাই নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেল।কিছু ক্যাশ টাকা ছিলো আমাদের কাছে।আপাই সেসব টাকা দিয়ে একটা কোচিং-এ ভর্তি হলো।আপাই কেবল একমাস সময় পেয়েছিল।কারণ চাচার বাসায় থাকা অবস্থায় আপাই বইটা পর্যন্ত হাতে নিতে পারেনি।তারপর এই এক মাসের প্রস্তুতিতেই আপাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে।যদিও তার স্বপ্ন ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি তে পড়ার,কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।এই অল্প সময়ে এরকম জঘন্য অবস্থায় আসলে কারো পক্ষেই সেই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব নাকি জানি না।আপাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।আমার স্কুল পরিবর্তন করা হলো।মামার তখন চাকরি ছিলো।খাবারের টাকা মূলত মামাই দিতো।বাজার সদাই সহ সংসারের সমস্ত খরচ মামাই বহন করতো।তারপর বছর দু’য়েক যেতেই মামা পর পর দুই বার স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেলেন।আমরা সাগর থেকে গিয়ে পড়লাম মহাসাগরে।তারপর শুরু হয় আমার আপাইয়ের নতুন সংগ্রাম।পড়াশোনার পাশাপাশি আপাই টিউশন সহ অন্যান্য পার্ট টাইম জবের খোঁজে লেগে পড়ল।হন্য হয়ে একটা চাকরি খোঁজা শুরু করল।পাকাপোক্ত কোনো চাকরিই আপাই পাচ্ছিল না।পরে আপাই যখন যেই চাকরি পেত,সেই চাকরির জন্যই ইন্টারভিউ দিতো।পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের সবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিল আপাই।মামি আমাদের থাকার খোঁটা দিতেন,খাওয়ার খোঁটা দিতেন।সেই খোঁটা থেকে আমাদের বাঁচানোর জন্য আপাই নিজেই ভাড়ার টাকা আর বাজারের টাকার জোগান দিত।চিত্রার মা বাবা দুইটাই ছিলো আপাই।আপাই যে আমাদের কি পরিমান ভালোবাসে আর সেই ভালোবাসার জন্য সে কি পরিমান ত্যাগ স্বীকার করেছে,সেটা আমি কোনোদিন মুখে বলে শেষ করতে পারব না।চিত্রা আর আমি অসুস্থ হলে আপাই রাত জেগে আমাদের সেবা করত।সবসময় বলত আমরা দু’জন নাকি তার কাছে বাবা মায়ের আমানত।আপনি জানেন না ভাইয়া,আপাই আমাদের সুখের জন্য ঠিক কি কি বিসর্জন দিয়েছে।যেই আপাই আলমারি ভর্তি জামা নিয়ে নতুন নতুন জামার খোঁজ করত,সেই আপাই ঘুরে ফিরে দুই তিন সেটা জামা পরেই মাস পার করে দিত।মামি আমাদের খাবার নিয়েও যন্ত্রণা দিত।আপাই কি করতো জানেন?’

দীর্ঘ সময় ধরে অনর্গল কথা বলার পর শুভ্রা কিছুক্ষণ থেমে একটু দম নিল।হাসপাতালের করিডোরে তখন পিনপতন নিরবতা।করিডোরে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে,আশ্চর্যান্বিত চোখে শুভ্রাকে দেখে যাচ্ছিল।একমনে শুনে যাচ্ছিল তার সমস্ত কথা।একটু পর পর ভাবছিল সে কি সত্যি বলছে?সত্যিই কি এটা কারো জীবনের গল্প?জীবন কখনো এতো নাটকীয় হয়?মেয়েরা কখনো এতো ভালো হয়?এতো ত্যাগ স্বীকার কি কোনো বোন তার অন্যান্য বোনদের জন্য করে?

শুভ্রা আচমকা হু হু করে কেঁদে উঠল।দুই হাত মুখে চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,’আপাই কোনোদিন তার ভাগের মাংসের টুকরো টা খেত না।আপাই সেটা রেখে দিয়ে কেবল ঝোল আর আলু খেত।আর মাংসের টুকরো টা পরের দিন আমাকে আর চিত্র কে ভাগ করে দিত।তাকে জিজ্ঞেস করলে বলত সে নাকি জীবনে অনেক ভালো ভালো খেয়েছে।বাকি জীবন আর খেতে না পারলেও চলবে।আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না,কিন্তু বছরের পর বছর আমার আপাই এই কাজই করে গেছেন।আমার আপাই পরী।সে সত্যিই আমার আর চিত্র’র পরী আপাই।’

কিছু সময়ের বিরতির পর শুভ্রা শান্ত কন্ঠে পুনরায় বলতে থাকে,
‘আপাই অসম্ভব রূপবতী।সেটা আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।সবাই জানে।আপাইয়ের জন্য প্রচুর বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল।এর মাঝে একজন ছিল সেনাবাহিনীর মেজর।আমাদের বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের ভাগ্নে।ছুটিতে বেড়াতে এসেই আপাইকে দেখে পাগল হলো।সে তাকেই বিয়ে করবে।লোকটা নিরেট ভদ্রলোক ছিল।আপাইয়েরও তাকে পছন্দ হয়েছিল বোধহয়।কারণ অন্যান্য সম্বন্ধ যেমন আপাই শোনা মাত্রই প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল,এই সম্পর্কটা আপাই এক নিমিষেই প্রত্যাখ্যান করে নি।সে সময় নিল।মেজর লোকটার কাছে জানতে চাইল বিয়ের পরেও আমার আর চিত্রার সমস্ত দায়িত্ব আপাই বহন করবে।আর আপাই চাকরি করবে।সম্ভবত উনি এতে রাজি ছিলেন না।আর আপাই তখন বরাবরের মতোই বিয়েটা ভেঙে দিলো।আপাই সব ছেড়ে ছুড়ে শুধু আমার আর চিত্র’র খাওয়া পরা নিয়ে পড়ে থাকত।তার ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসার নমুনা আমি মুখে কেমন করে বলব?নিজের জীবনটাই যে আমাদের খুশির জন্য মলিন বানিয়েছে,তাকে আমি কেমন করে কয়েক বাক্যে পরিচয় করাবো?সে আমার আপাই।সে চিত্র’র আপাই।সে এই শূন্য খা খা,হায়নাতে ভরা পৃথিবীতে আমাদের এক মাত্র আশ্রয়।সে আমার আর চিত্র’র জীবনে সত্যিকারের পরী হয়ে আসা পরী আপাই।’

শুভ্রা থামল।পুরোপুরি ভাবে তার কথা শেষ করল।শেষ করেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ মুছল।সে ক্লান্ত হয়ে গেছে কথা বলতে বলতে।অথচ বলা শেষ করার পর তার মনে হলো সে তো কিছুই বলতে পারেনি।তার উচিত ছিল আরো কিছু বলা।এতো অল্প কথায় পরী আপাইকে পরিচয় করানো সম্ভব?

করিডোরে দাঁড়ানো প্রতিটি জীব মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তার কথা শুনে।রোজ রোজ তাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো মেয়ে মানুষটির অতীত এতো লোমহর্ষক?এতো যন্ত্রণার?এতো সংগ্রামের?এতো আত্মত্যাগ কেউ কারো জন্য করে?মেয়েটি নিজের নামের অর্থকে স্বার্থক করেছে।সে সত্যিই পরী।দুষ্টু মানুষের ভীড়ে মিশে থাকা একটা মিষ্টি পরী।

আরহাম একটু নড়ে উঠে তার একহাত শুভ্রার মাথায় রাখে।তার স্নেহের পরশ পেতেই শুভ্রা পুনরায় ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়।আরহাম ভরাট গলায় বলে,’কান্না করে না শুভ্রা।তোমার আপাই তো একটা আস্ত ফাইটার।তার কিচ্ছু হবে না।নবনীতা নূর হেরে গেলেও পরী আপাই কিছুতেই হারবে না।’

আরিশ আলগোছে চোখ মুছে।মৃদু হেসে জড়ানো কন্ঠে বলে,’সিরিয়াসলি?চোখ ভিজে গেছে আমার!’

আদি মাথা নিচু করে ছোট করে জবাব দেয়,’আমারও।’

তাসনুভা তো শুভ্রা কথা শুরু করার পর পরই দুই চোখে পানির ফোয়ারা খুলে বসেছে।আরিশ তার চোখ মুখের অবস্থা দেখেই তার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল,’যা তাস! কাঁদতে কাঁদতে একটা নদী বানিয়ে ফেল।ন্যাকু একটা!’

রাত একটু বাড়তেই আরিশ আর তাসনুভা বাড়ি ফিরে গেল।তাসনুভার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে।রিমি বিভাকে নিয়ে দূরের আরেকটা চেয়ারে গিয়ে বসল।ওয়াজিদ আর আদি করিডোরের এক পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে কথাবার্তা বলছিল।চিত্রা একটু আগেই আরহামের কোলে ঘুমিয়ে গেছে।আরহাম আনাড়ি হাতে তাকে ধরে রেখেছে।আগে কখনো এমন করে কোনো বাচ্চা তার কোলে ঘুমায়নি।তার ভয় হচ্ছে।যদি পড়ে যায়?

শুভ্রা মাথা নামিয়ে চুপচাপ জড় পদার্থের মতো বসেছিল।কাঁদতে কাঁদতে এখন আর চোখ দিয়ে পানিও আসছে না তার।আরহাম একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল।আচমকা কিছু মনে পড়তেই সে কিছুটা ব্যস্ত,কিছুটা অস্থির আর খুব বেশি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল,’আচ্ছা শুভ্রা,তোমার আপাইয়ের ঐ মেজরের নাম কি ছিল?সে কি দেখতে খুব বেশি সুন্দর ছিল?আচ্ছা সেসব ছাড়ো।বলো তো,আমি বেশি সুন্দর নাকি তোমার আপাইয়ের সে মেজর?’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩২

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩২)

‘শুভি! আপাইয়ের কুচিটা একটু ধরে দে তো।’

নবনীতা দুই হাতে অর্ধেক পরা শাড়িটা ধরেই গলা ছেড়ে ডাকল।একবার,দুইবার,তিনবার।শুভ্রার কোনো বিকার নেই।নবনীতা শেষে বিরক্ত হয়ে আবার ডাকল,’হচ্ছে টা কি শুভি?আসবি তুই?’

আরহাম অর্ধেক খাওয়া আপেলটা কা’মড়াতে কা’মড়াতে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো।স্বাভাবিক গলায় বলল,’শুভ্রা নেই।কলেজের জন্য বেরিয়ে গিয়েছে।’

‘আয়হায়! এখন কি হবে?’

ভীষণ উদ্বিগ্ন শোনায় নবনীতার কন্ঠ।আরহাম আগাগোড়া একনজর তাকে দেখে কপাল কুঁচকে বলে,’সমস্যা কি?তুমি তো নিজে নিজেই শাড়ি পরতে জানো।শুভ্রাকে ডাকছো কেন?’

‘এটা সিল্কের শাড়ি।আগে কখনো সিল্ক পরিনি।ভীষণ ঝামেলা করছে শাড়িটা!’

আরহাম আরো একবার শাড়িটা দেখে।এটা সে দুইদিন আগে কিনেছে।তাসনুভা আর সে আড়ংয়ে গিয়েছিল।তখনই শাড়িটা তার চোখে পড়েছে।প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছে।দেখতেই মনে হয়েছে তার একটা বউ আছে,সেই বউ রোজ রোজ সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরে স্কুলে যায়।সেই সুন্দরী বউকে এমন একটি শাড়ি গিফট করলে মন্দ হয় না।

সে তক্ষুনি এটা কিনে নিয়েছে।শাড়ির ম্যাটারিয়েল সম্পর্কে তার ধারণা নেই।কিন্তু এই মুহূর্তে নবনীতার উদ্ভ্রান্ত মুখশ্রী দেখে তার মনে হচ্ছে শাড়ির কাপড় টা খুব একটা সুবিধার না।সে হাতের আপেল টা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে এসে নবনীতার গলায় ঝুলিয়ে রাখা আঁচলের অংশটা হাতে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল,’ধুর! এতো পিছলা কেন?’

নবনীতা চোখ পাকায়।গট গট করে বলে,’কেনার আগে দেখেন নি পিছলা না খসখসা?এখন বলে লাভ আছে?’

‘লাভ নেই।তবে কেনার সময় দূর থেকে দেখে অনেক সুন্দর লাগছিল।শাইনিং দেখাচ্ছিল খুব।তাছাড়া তোমাকেও তো গায়ে ধরার পর ভালোই দেখাচ্ছে।’

নবনীতা ঘাম মুছতে মুছতে জবাব দেয়,’কিন্তু পরতে তো জান বের হচ্ছে।’

আরহাম এগিয়ে এসে নির্দ্বিধায় নবনীতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’দাও দেখি।আমি চেষ্টা করি।’

‘আপনি আগে কখনো কুচি ধরেছেন কারো?’ সন্দিহান হয়ে জানতে চায় নবনীতা।

আরহাম নাক ছিটকায়।ছিটকে রেখেই বলে,’ইউউউ!! আমি কেন মেয়ে মানুষের কুচি ধরব?আমি কি ছ্যাবলা নাকি?’

‘তো এখন এসেছেন কেন?এসে আর ছ্যাবলা হতে হবে না।’ বিক্ষিপ্ত মেজাজে উত্তর দেয় নবনীতা।

‘উফফ তুমি তো বউ।তোমার বিষয়টাই আলাদা।’

কথা শেষেই আরহাম মোবাইল বের করল।ইউটিউব ঘেটে জামাই বউ মিলে কয়েকটা ভিডিও বের করে দেখল।আরহাম বহু কষ্টে কুচি ধরে সুন্দর করে সেট করে কুচিগুলো নবনীতার দিকে এগিয়ে দিলো।নবনীতা শক্ত করে ধরায় আগেই সে সেটা ছেড়ে দেয়।ফলসরূপ সমস্ত কুচি পুনরায় ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।এই দৃশ্য দেখে দু’জনই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।আরহাম একপ্রকার চিৎকার করে বলল,’পরী!! এটা কি করেছ?’

নবনীতাও তারই মতো চেঁচিয়ে উঠে বলল,’আপনি এটা কি করেছেন?ঠিক মতো ধরার আগে ছেড়ে দিয়েছেন কেন?’

আরহাম আশাহত হয়ে মাথা নামায়।পুনরায় হাঁটু গেড়ে বসে।কুচিগুলো ঠিক মতো ধরে নিজেই নবনীতার পেটের কাছে গুজে দেয়।নবনীতা পেটের কাছে তার হাত লাগতেই কেঁপে উঠল।আরহাম মাথা তুলে তার দিকে তাকায়।গম্ভীর গলায় বলে,’এমন লাফ দিয়ে উঠার কিছু নেই।বর হই আমি তোমার।’

নবনীতা সরু চোখে তাকে দেখে।বর দেখে কি এখন কাছে এলে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে?বর হোক আর যেই হোক,অনুভূতির বিষয়টা তো পাল্টে যাচ্ছে না।এই লোককে কি করে নবনীতা বোঝাবে যে বর কাছে এলেও মানুষ অল্প সল্প কাঁপে!

নবনীতা পুরো শাড়ি সেট করেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।আরহাম ঠোঁট গোল করে বড়ো বড়ো চোখ করে বলে উঠে,’ওয়াও! লুকিং গরজিয়াস!’

তারপরই একটা হাত নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সামান্য ঝুঁকে বলল,’মে আই হোল্ড ইউর হ্যান্ড ডার্লিং?’

নবনীতা একগাল হাসল।হাত বাড়িয়ে একহাতে আরহামের বাহু আর অন্যহাতে তার কনুইয়ের কাছটায় জড়িয়ে ধরে শব্দ করে হেসে উঠে ন্যাকা সুরে বলল,’ইয়েস ডার্লিং।ইউ ডেফিনেটলি ক্যান।’
বলেই সে আরো এক দফা হাসল।ইদানিং সে নতুন প্রেমিকাদের মতো কারণে অকারণে উঠতে বসতে কেবল হাসে।আবার পরক্ষণেই সামান্য রূঢ় আচরণে তার দুই চোখ ছলছল করে উঠে।সে দাবাং নবনীতার খোলস ছেড়ে ইদানিং হুট করেই অভিমানী নবনীতা হয়ে যাচ্ছে।

বসার ঘরে আসতেই আরহাম চিত্রকে দেখল।সে এক মনে কার্টুন দেখছে টিভিতে।গত সপ্তাহে আরহাম টিভি কিনে লোক আনিয়ে বসার ঘরে সেট করে দিয়েছে।সারাদিন একটা বাচ্চা ঘরে থাকে।সে কতো আর রং পেন্সিল দিয়ে খেলবে?একটু তো বিনোদনের প্রয়োজন আছে।

আরহাম সেই চিরচেনা আদুরে স্বরে ডাকল,’চিত্র! ভাইয়ার কাছে এসো।’

চিত্র এক ডাকেই তার কাছে ছুটে গেল।আরহাম তাকে কোলে নিয়েই বলল,’চুলের এই অবস্থা কেন?’
বলেই আবার ফোড়ন কেটে বলল,’তোমার মহামানবী আপাই ইদানিং নিজে রং ঢং করতে করতে বাচ্চাটার আর খেয়াল রাখার সময় পায় না মনে হচ্ছে।’

নবনীতা মুখ হা করে তাকে দেখল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’সকালেই বেঁধে দিয়েছি।সে কি পরিমান দুষ্টুমি করে! নিজেই সব এলোমেলো করেছে।’

আরহাম তার একহাত দিয়ে চিত্রার দুইগাল চেপে ধর টুশ টুশ করে দু’টো চুমু খায়।আদর দিয়ে বলে,’সোনা বাচ্চা একটা!’

নবনীতা ভেংচি কেটে বলল,’ইশশশ রে! আপনার আহ্লাদ পেয়ে পেয়েই এমন বাদড় হচ্ছে দিন দিন।সারাদিন এতোবার আদর করার কি আছে হ্যাঁ?যত্তসব ন্যাকামোর দোকান।’

বলেই সে চোখ পাকিয়ে চিত্রার দিকে তাকায়।কড়া গলায় বলে উঠে,’টেবিলের উপর খাতা রাখা আছে।আসার পর যেন দেখি ওয়ার্ড সবগুলো লিখা শেষ হয়েছে।ঠিক আছে?’

চিত্রা মুখ কুঁচকায়।বিরক্ত স্বরে জবাব দে,’আচ্ছা ঠিক আছে।’

নবনীতা আর আরহাম সাদেক সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে দরজা লক করে বেরিয়ে গেল।লকের চাবি শুভ্রা আর নবনীতা দু’জনের কাছেই আছে।

লিফট থেকে নেমে দুই কদম সামনে যেতেই আরহাম পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরল।নবনীতা তার অকস্মাৎ টেনে ধরায় বেশ খানিকটা হকচকায়।অবাক হয়ে পেছনে দেখে।আরহাম তাকে কাছে এনেই তার দুই হাত মুড়িয়ে পিঠের সাথে চেপে ধরে।নবনীতার দুই হাতের কবজি বাঁধা পড়ে আরহামের বলিষ্ঠ হাতের শক্ত বন্ধনে।

আরহাম আরেক হাতে নবনীতার গাল চেপে ধরে।তার চেপে ধরাতেই নবনীতার মুখ হা হয়ে গেল।সে গোল গোল চোখে অবাক হয়ে সামনে দেখে।তাকে চূড়ান্ত রকমের হতবাক করে দিয়ে আরহাম তার দুই গালে দুইবার দুইবার করে মোট চারবার চুমু খেল।শেষে তার টমেটোর মতো লাল হয়ে থাকা গালে আলতো করে কাম’ড়ও দিলো দুইটা।

নবনীতা হতভম্ব হয়ে বোকা বোকা মুখ করে সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল কতোক্ষণ।প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মতো মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাও তার নেই।আরহাম সত্যিই তাকে চুমু খেয়েছে?তাও আবার পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে।সে নিশ্বাস বন্ধ করে ফ্যালফ্যাল চোখে আরহামের চোখে চোখ রাখে।চমকে তার পলক ফেলাও বন্ধ হয়ে গেছে।

আরহাম তার বিস্মিত,হতবাক আর থমকে যাওয়া রূপ দেখেই বাঁকা হাসে।মাথা নামিয়ে নবনীতার কানের কাছে এসে গাঢ় স্বরে বলে,’গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি চিত্রাকে চুমু খেলে নাকি তার পরী আপাইয়ের সাংঘাতিক রকমের হিংসে হয়? তাই এখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি চিত্রাকে দু’টো চুমু খেলে তার আপাইকে চারটা খাবো।যতো কিছুই হোক,বউ বেশি ইম্পরট্যান্ট।তাই না?’

কথা শেষ করেই সে নবনীতাকে ছেড়ে দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝে সেই বাঁকা হাসি ধরে রেখেই সামনে এগিয়ে যায়।পেছনে পড়ে রয় আশ্চর্যে স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া একটি মেয়ে যে কিনা ক্ষণিক আগেই স্বামীর মিষ্টি ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে।নবনীতা আনমনে নিজের এক হাত গালে ছোঁয়ায়।লোকটা তাকে চুমু খেয়েছে?তাও আবার এই জায়গায় দাঁড়িয়ে?নবনীতা এখন তার সামনে যাবে কেমন করে?সে তো লজ্জায় লাল নীল বেগুনি গোলাপি সব হয়ে যাচ্ছে।

আরহাম গাড়ির দরজা খুলে পেছনে ফিরে দারাজ কন্ঠে ডাকে,’পরী! পরে অবাক হবে।এখন গাড়িতে উঠে বসো।আজও আমরা দেরি করে ফেলেছি ভীষণ।’
.
.
.
.
লিলিপাই কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের সামনে আরহামের নিজস্ব ব্যবহারের বাড়াবাড়ি রকমের দামি গাড়িটা এসে থামতেই চারদিক থেকে সবাই সেই গাড়িটা ঘিরে দাঁড়াল।প্রথমেই গার্ডরা এসে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনলো।স্কুল অথোরিটিও অভ্যর্থনার ব্যাপারে বেশ সচেতন ছিলো।

প্রায় আট দশ জন দেহরক্ষীর কড়া নিরাপত্তায় আরহাম আর নবনীতা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।নবনীতা রোদের আঁচ টের পেতেই চোখে সানগ্লাস লাগায়।তারপর উদাস মুখ করে এদিক সেদিক তাকায়।কি একঘেয়ে জীবন! আশেপাশে এতো মানুষ,কিন্তু তবুও ছুটে গিয়ে তাদের সাথে মেশা যায় না।সর্বক্ষণ নিজেদের একটা গন্ডিতে আটকে রাখতে হয়।দেহরক্ষীদের নিরাপত্তা ব্যতীত বড় কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া যায় না।এর চেয়ে তো নবনীতার আগের জীবনই ভালো ছিল।যখন যেখানে মন চায় যেতে পারত।

আরহাম গাড়ি থেকে নেমেই হাসি মুখে সবাইকে অভিবাদন জানায়।একহাতে নবনীতার কাঁধ জড়িয়ে ধরে।স্কুলের প্রিন্সিপাল ডেইসি মিস ছুটে এসেই ফুলের তোড়া টা তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে বলল,’স্যার আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আসার জন্য।’

বিনিময়ে আরহামও হাসল।মেকি হাসি।সে জীবনেও এই কচি বাচ্চাকাচ্চাদের অনুষ্ঠানে আসতে চায় নি।বউয়ের ফাপড়ে পড়ে আসতে হয়েছে।তবুও সে নিখাঁদ আন্তরিকতা দেখিয়ে বলল,’না না।আমারও ভীষণ ভালো লাগছে এখানে এসে।’

সে আরেকটু সামনে এগুতেই তার হাতে থাকা ফুলের তোড়া টা নবনীতার হাতে তুলে দিলো।চাপা স্বরে বিড়বিড় করে বলল,’নেও।এসব বালসাল তোমার কাছেই রাখো।’

নবনীতা ফুলের তোড়া টা হাতে নিয়ে মাথা নুয়িয়ে ঘ্রাণ নেয়।আবেশে চোখ বুজে বলে,’ইশশ কি সুন্দর ঘ্রাণ! মোটেও বালছাল না।’

স্কুলের মাঠে পুরো অনুষ্ঠানের সেট আপ করা হয়েছে।অতিথিদের বসার জন্য এক পাশে ছাউনির মতো করা হয়েছে।প্রথম সারিতে বড়ো বড়ো কিছু সোফার মতো আরামদায়ক আসবাব,আর পেছনে সব চেয়ার রাখা।আরহাম আর নবনীতা গিয়ে বসল একেবারে সামনে।এইটুকু আসতে আসতে আরহাম আরো অনেক গুলো ফুলের তোড়া পেয়েছে।যার সবগুলোই নবনীতা তার দুই হাত দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে।

নির্ধারিত আসনে বসার পরেই ক্যামেরা ম্যানরা ক্যামেরা হাতে ছুটে এসেই তাদের ছবি তোলা শুরু করল।আরহাম আরাম করে একহাত সোফার পেছনে রাখে।ভরাট কন্ঠে বলে,’হাসি হাসি মুখ করে ছবি তোলো পরী।এটাও আমাদের শর্তের অন্তর্ভুক্ত।’
কথা শুনেই নবনীতা এলোমেলো হাসল।সে আজকে কথা দিয়েছে সে সব কথা শুনবে।সুখী দম্পতিদের ন্যায় আচরন করবে।সে আরহামের একেবারে কাছাকাছি এসে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ক্যামেরার দিকে তাকায়।দু’জনের হাসি হাসি মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে সবটাই নিছক লোকদেখানো।দাম্পত্যের দ টাও এখনো তাদের মাঝে আসে নি।তবে তারা একটু আকটু চেষ্টা করছে।হয়তো কখনো আসবে,হয়তো বা না।

কিছু সময় যেতেই নবনীতা উসখুস করা শুরু করল।তার অস্থির আচরণ রোদচশমার আড়াল থেকেই আরহামের দৃষ্টিগোচর হলো।সে তীক্ষ্ণ চোখে প্রশ্ন ছুড়ে,’কি হয়েছে তোমার?এমন অস্থিরতা করছ কেন?’

নবনীতা মলিন মুখে জবাব দেয়,’আমি সব ম্যামদের সাথে একসাথে থাকতে চাই।আমি টিচার্স রুমে যেতে চাই।’

আরহাম থমথমে মুখে তাকে দেখে।একটু পরেই ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,’শর্ত ভাঙছো তুমি।কথা ছিল তুমি সবসময় আমার সাথেই থাকবে,ভীড়ভাট্টা এড়িয়ে চলবে।’

নবনীতা মন খারাপ করে উত্তর দেয়,’কিন্তু এটা তো আমার স্কুল।আমারও তো যেতে ইচ্ছে হয়।বাচ্চা গুলো ট্রায়াল রুমে আছে।আমার তাদের দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

আরহাম প্রতিউত্তর না করে সামনে দেখে।উত্তর দেওয়ার কোনো মানে নেই।সে এদিকে আসার আগে থেকেই নবনীতার সাথে তার কথা হয়েছিল নবনীতা এখানে এসে তার সাথে সাথে থাকবে।তার কথা মেনে চলবে।আসার পরেই ম্যাডাম নিজের কথা থেকে সরে যাচ্ছে।এখন আর চুপচাপ বসে থাকা তার পোষাচ্ছে না।

আরহাম আসার সাথে সাথেই আনুষ্ঠানিক ভাবে অনুষ্ঠান শুরু হয়।জাতীয় পতাকা উত্তোলন,জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন,কুরআন তেলাওয়াত,গীতা পাঠ-সবকিছু শেষ হতেই অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হলো।প্রথমেই ছোট ছোট সবুজ ঘাসে আবৃত মাঠে নৃত্য পরিবেশন করল নার্সারির এক ঝাঁক মিষ্টি বাচ্চারা।

আরহাম নাক মুখ ছিটকে চুপচাপ তাদের নাচ দেখে।বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে,’যতোসব আন্ডাবাচ্চাদের ভেতর এসে আটকা পড়লাম।এগুলা যায় আমার প্রফেশনের সাথে?’

তার মহাবিরক্ত মুখটা দেখেই নবনীতা দুই চোখ সরু করে বলল,’ইশশ রে! এখন খুব প্রফেশন আসছে।নির্বাচনের আগে তো সারাক্ষণ যার তার বাচ্চাকে পেলেই কোলে নিয়ে আদিখ্যেতা করতেন।এখন এরা আন্ডাবাচ্চা হয়ে গেছে তাই না?’

আরহাম কুশনে ঠেস দিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলে,’নির্বাচনের আগে তো কতো কিছুই করেছি।তবে অনেস্ট স্পিকিং,এসব বালবাচ্চা আমার একদমই ভালো লাগে না।চিত্রার ব্যাপারটা ভিন্ন।চিত্রা প্যা পু করে না।’

‘আমার স্টুডেন্ট রা প্যা পু করছে?কতো মিষ্টি করে নাচছে! সবগুলোই একেকটা রসগোল্লা,কি সুন্দর লাগছে রে!’

নবনীতা মুগ্ধ আর আনন্দিত চোখে ছোট ছোট বাচ্চাদের নাচ দেখে।ক্ষণিক পর পরই তালি বাজায়।গলা ছেড়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে বলে,’খুব খুব খুব সুন্দর হচ্ছে বাচ্চারা।’

আরহাম সেই হাসিমাখা মুখটা প্রাণ ভরে দেখে।বিরক্তিকর প্রোগ্রামে একটা ইন্টারেস্টিং আর সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে নবনীতার ভেতরকার উচ্ছ্বসিত আর কিশোরী স্বত্তাটির বহিঃপ্রকাশ।আরহাম সেই চমৎকার দৃশ্য মন ভরে দেখে।পরিবারের দায়িত্বে মুর্ছা যাওয়া মেয়েটির কি সত্যিই কোনো শখ আহ্লাদ ছিলো না?নাকি পরিস্থিতির চাপে সে কোনোদিন নিজের শখ প্রকাশই করতে পারেনি?এই যে কাঠখোট্টা নবনীতার আড়াল থেকে ইদানিং একটা কিশোরী নবনীতা উঁকি দিচ্ছে।এই নবনীতার তো অনেক অনেক শখ আছে।সে শখ করে,জেদ ধরে,আহ্লাদ করে।আরহাম তাকে কেমন করে বোঝায় তার এই দুরন্ত নবনীতাকে কতোখানি ভালোলাগে!

দুই তিনটা নাচ হওয়ার পরেই আরহাম খেয়াল করল নবনীতার মুখটা আচমকাই মলিন হয়ে গেছে।সে তার মলিন দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখল নবনীতার কিছু কলিগ বড়ো একটা জাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে।তাদের একজন ইশারায় নবনীতাকে ডাকল।হাত নেড়ে বলল,’এসো না।’

নবনীতা অসহায় মুখ করে ডানে বায়ে মাথা নাড়ায়।মুখ না খুলেই আচরণে বোঝায় সে যেতে পারবে না।তারপরেও কি একটা ভেবে আবারো পাশ ফিরে কাচুমাচু হয়ে বলে,’আমি একটু যাই আরহাম?এটা তো আমার স্কুল।আমারও তো যেতে ইচ্ছে হয়।’

আরহাম গম্ভীর মুখে সামনে দেখতে দেখতে উত্তর দেয়,’ভীড় দেখছ?কতো রকম মানুষ চারদিকে।সিকিউরিটি লেভেল একদমই লো।কোনো সেফটি নাই।’

‘আমি তো দূরে যাচ্ছি না।এই সামনেই।মৌরি আর রাত্রির কাছে।’

‘প্রয়োজন নেই।চুপচাপ বসে থাকো।’

নবনীতা থম মেরে চুপচাপ বসে থাকে।মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের করে না।ক্ষণিক বাদে আরহাম তার হাতের উপর নিজের হাত রাখল।নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নেয়।মৃদু ধমক দিয়ে বলে,’ধরবেন না।ভালো লাগছে না।’

আরো দশ মিনিট যেতেই আরহাম গাঢ় স্বরে ডাকে,’পরী!’

নবনীতা গট গট করে উত্তর দেয়,’কি?’

‘যেতে চাইছো কলিগদের কাছে?’

সাথে সাথে পাশ ফিরে নবনীতা।জ্বলজ্বল চোখে আরহামকে দেখেই ভীষণ চঞ্চল হয়ে বলে,’হ্যাঁ,চাই।’

‘আচ্ছা যাও।তবে জিপিএস অন রেখো।আর চোখের সামনে থেকো।’

মুহূর্তেই চোখ মুখ আনন্দে ভরে উঠে নবনীতার।তার ঠোঁটে প্রশস্ত হাসির দেখা মেলে,যেই হাসিতে আকাশ সমান কৃতজ্ঞতা মিশে আছে।নবনীতা খুশিতে আত্মহারা হয়ে আরহামের একহাত চেপে ধরে।সুমিষ্ট কন্ঠে বলে উঠে,’আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।সত্যিই ধন্যবাদ।’

সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়।ছুটে যেতে চায় তার কলিগদের কাছে,তার স্টুডেন্টদের কাছে।এই ভীড়ভাট্টার মাঝে সেও মিশে যাবে।তার এমন জীবনই ভালো লাগে।একটু সামনে যেতেই আরহাম তাকে পিছু ডাকে।নিরেট স্বরে শান্ত মুখ করে বলে,’বেশি দূরে যেও না পরী।এসব ফাংশন আমার কাছে সুবিধার লাগে না।’

সে পেছন ফিরল।দ্রুত মাথা নেড়ে আশ্বাস দিলো,’অবশ্যই অবশ্যই।এখানেই আছি।’

সে চলে যেতেই আরহাম ঘাড় ঘুরিয়ে তার দেহরক্ষীদের দেখল।আসাদ নামের একজন কে উদ্দেশ্য করে খানিকটা আদেশের সুরে বলল,’যাও তো আসাদ।তোমার ম্যাডামের আশেপাশে থাকো।সামনে যেও না।এমন ভাবে পাহারা দিবো যেন সে টের না পায়।’

আসাদ মাথা নেড়ে তৎক্ষনাৎ চলে গেল সামনের দিকে।আরহাম পায়ের উপর পা তুলে চোখের উপরের সানগ্লাসটা খুলে একবার জহুরি চোখে আশপাশ দেখে।ভেতরটা খচখচ করছে।এতো অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে কেন?চারদিকে এতো ভীড়।অথচ আরহামের মনে হচ্ছে আশপাশে কেমন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য ভাব।এমন দোলাচলে কেন ভুগছে সে?এমন অস্বস্তি হচ্ছে কেন তার?

হালকা নীল রঙের সিল্কের শাড়িটার আঁচল সামলে নবনীতা ছুটে যায় তার কলিগদের কাছে।মৌরি তাকে দেখেই টিপ্পনী কেটে বলল,’বাবারে! বর তো একেবারে চোখে হারায় নবনী।সুন্দরী মেয়েদেরই কপাল।বর সারাদিন বউ বউ করে।’

নবনীতা লাজুক হাসল।বাধা দিয়ে বলল,’ধ্যাত।এমন কিছু না।’

নবনীতা তার কলিগদের সাথে বেশ কিছু ছবি তুলল।তার ক্লাসের বাচ্চারাও তাকে দেখে ছুটে এসেছে।সে নিচু হয়ে তাদের সবাইকে একে একে জড়িয়ে ধরল।দূর থেকে এক জোড়া চোখ শান্ত চাহনিতে বারংবার তাকে দেখে।তার ঠোঁট,তার হাসি,তার প্রাণবন্ত ভাব সবকিছুই তাকে মুগ্ধ করে।এই মেয়েটির প্রতি সে বাড়াবাড়ি রকমের টান অনুভব করে।দিন কে দিন সেই টান সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎই একটা ছেলে বাচ্চা ছুটে এলো আরহামের দিকে।তার হাতে একটা টকটকে লাল সতেজ গোলাপ।সে সেটা আরহামের দিকে বাড়িয়ে দেয়।ফোকলা দাঁত বের করে হেসে হেসে বলে,’দিস ইজ ফর ইউ।’

আরহাম চোখের উপর থেকে সানগ্লাস সরিয়ে তাকে দেখে।একহাত দিয়ে বাচ্চাটি কে কাছে এনে তার হাতের ফুলটি নেড়ে চেড়ে দেখে।ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান হয়ে বলে,’ফর মি?বাট হোয়াই?’

‘বিকজ ইউ আর লুকিং গ্রেট।আমিও বড় হয়ে তোমার মতো হতে চাই।’

আরহাম তার কথা শুনেই হাসল।এই বাচ্চাটি কে তার পছন্দ হয়েছে।শুধু এই বাচ্চা না,যারাই তার প্রশংসা করে,তাদের সবাই কেই আরহামের ভালো লাগে।কি অদ্ভুত! প্রশংসা জিনিসটা এতো মজার কেন?মন চায় কানের কাছে সারাদিন কেউ গান গেয়ে গেয়ে প্রশংসা করুক।আর আরহাম আরাম করে সেসব শুনবে।

সে তার চুলগুলো সেট করতে করতে বলল,’আমার ফুল লাগবে না চ্যাম্প।তুমি বরং এটা আমার হোম মিনিস্টার কে দিয়ে আসো।’

ছেলেটা জিজ্ঞাসু চোখে খানিকটা কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকায়।আরহাম তাকে কাছে এনে তার কাঁধ জড়িয়ে একহাত সামনে তুলে তর্জনী আঙুল নবনীতার দিকে তাক করে বলল,’ঐ যে তোমার নবনী মিস কে দেখছ না?এই ফুলটা তাকে দিয়ে আসো।দিয়ে বলবে তিড়িংবিড়িং কম করতে।ঠিক আছে?’

ছেলেটা তার কথা এক মনে শুনল।সে বলা শেষ করতেই সে ছুটে গেল নবনীতার দিকে।নবনীতার একেবারে কাছাকাছি এসেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে বাচ্চা বাচ্চা গলায় বলল,’মিস।দিস ইজ ফর ইউ।’

বলতে বলতেই সে হাতের ফুলটা নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দেয়।নবনীতা মাথা নামিয়ে তাকে দেখে।তার হাতের ফুলটা দেখতেই সে হাঁটু গেড়ে বসে।ফুলের ডালটায় এক আঙুল ছুঁয়িয়ে তার দিকে দেখে হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করে,’আমার জন্য এই সুন্দর ফুল?’

‘হু’

সতেজ আর পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত রক্তিম গোলাপটি নবনীতা সাদরে গ্রহণ করল।টেনে টেনে দু’বার ঘ্রাণ নিল।খুশি হয়ে বলল,’ধন্যবাদ সোনা।মিস ভীষণ খুশি হয়েছি।’

ছেলেটা কয়েক পল তাকে দেখেই আধো আধো বুলিতে বলল,’তিলিংবিলিং কম করবে তুমি।কেমন?’

নবনীতার কিছুক্ষণ লাগল তার কথা বুঝতে।বোঝার পরেই সে খিলখিল করে হেসে উঠল।বলল,’তাই নাকি?এ কথা কে বলেছে?মহামান্য এমপি মহাশয়?’

বাচ্চাটা আঙুল তুলে আরহামকে দেখায় যে কিনা পায়ের উপর পা তুলে অনেক্ষন যাবত তাদের দিকেই দেখছিল।নবনীতা ফুলটা মুখের কাছাকাছি এনে মুচকি হেসে আরহামকে দেখে।দেখেই লাজুক হাসে।আরহাম প্রগাঢ় চাহনি তে সেই হাসি উপভোগ করে।বিনিময়ে সেও মুচকি হাসে।আড়চোখে একবার আসাদের অবস্থান দেখে।আসাদ তাকে ইশারায় আশ্বস্ত করে।অথচ আরহাম আশ্বস্ত হতে পারে না।একজন তাকে পাল্টা জবাব দিবে বলে তার ধারণা।ধারণা না,অবশ্যই দিবে।অথচ এতো দিনেও তার দলের কর্মীদের গায়ে একটা আঁচড়ও পড়েনি।এটা কেমন করে সম্ভব?এতো নির্লিপ্ততা তো প্রকাশ্য আক্রমণের চেয়েও বেশি আতঙ্কের।আরহাম এক মাসের উপরে সেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।ভালো জিনিসেও ইদানিং তার সন্দেহ হয়।
.
.
.
.
মৌরি ছবি তোলা শেষে সাবলীল গলায় বলল,’চলো আমরা ট্রায়াল রুমে যাই।বাচ্চারা কেমন সেজেছে একটু দেখে আসি।’

নবনীতা বিব্রত হয়ে এদিক ওদিক দেখে।বিষন্ন হয়ে বলে,’না না।আমি যাব না মৌরি।তোমরা যাও।’

রাত্রি তার একহাত চেপে জোর গলায় বলল,’কেন যাবে না হ্যাঁ?বাচ্চারা তাদের নবনী মিস কে কতো পছন্দ করে! তুমি তাদের দেখবে না?অতো বরের চিন্তা করতে হবে না।একদিন একটু বরের চোখের আড়াল হলে কিছু হবে না।চলো তো।’

বলেই সে নবনীতার একহাত ধরে টানতে টানতে তাকে ট্রায়াল রুমের দিকে নিয়ে গেল।নবনীতা যেতে যেতে অপ্রস্তুত হয়ে একবার আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম এখনো তাকে দেখেনি।সে কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত।

ট্রায়াল রুমে এসেই নবনীতা চোখ মেলে ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখে।একেকজন কি সুন্দর সুন্দর জামা পরেছে! সুপারম্যান,স্পাইডারম্যান,ম্যাজিশিয়ান আরো কতো কিছু।নবনীতা এদের সবার সাথে দুষ্টুমি করল।বসে বসে সবাইকে আদর দিলো।বিনিময়ে তার ব্যাগ আবারো চকলেটে ভরে গেল।বাচ্চারা যে তাকে কি বুঝে এতো চকলেট দেয় কে জানে!

যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।প্রতিযোগিতারা একে একে করে ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে মঞ্চে গিয়ে তাদের অভিনয় প্রদর্শন করছে।এমনই সময় ট্রায়াল রুমে একটি বাচ্চা মৃদু শব্দে কেঁদে উঠে।

নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে।জানতে চায় কি হয়েছে সোনা?বাচ্চাটা মন খারাপ করে বলল,’আমার ম্যাজিশিয়ান হ্যাট বাড়িতেই রেখে এসেছি মিস।’

নবনীতা উদাস মুখ করে বলে,’আয়হায়।এখন কি হবে তাহলে?’

মৌরি অন্য আরেকটা বাচ্চার গালে কিছু একটা আঁকছিল।সে আঁকার ফাঁকেই বলল,’আরে ইনডোরে যে বাচ্চাদের প্লে জোন আছে,তার পাশেই তো একটা রুম আছে।কতো রকমের কস্টিউম আছে সেখানে।ম্যাজিশিয়ান হ্যাট তো সেখানেই পাওয়া যাবে।’

নবনীতা একগাল হেসে আঁচল সামলাতে সামলাতে বাচ্চা টা কে দেখে বলল,’এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’
সে ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে দ্রুত পা বাড়ায় ইনডোরের দিকে।পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাকে হ্যাট আনতে হবে।

আসাদ অতি গোপনে তার পিছু পিছু আসে।সে যেন টের না পায় অতোখানি দূরত্ব নিয়েই দাঁড়ায়।নবনীতা চঞ্চল পায়ে হেঁটে ইনডোরে প্রবেশ করল।আসাদ দাঁড়ালো গেট থেকে সামান্য ভিতরে।এই জায়গা টা একদম ফাঁকা।মানুষ সব মাঠে।এদিকে কেউ নেই।মিউজিক প্লেয়ারে উচ্চশব্দে গান বাজছে।এদিকের কোনো শব্দ সেখানে পৌঁছানোর উপায় নেই।

এক জোড়া চোখ বহু সময় ধরে এই মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।অপেক্ষায় ছিল এমন একটি নিরব নিস্তব্ধ আর যুতসই সময়ের।একদিন দুইদিনের অপেক্ষা না,প্রায় মাসখানেকের অপেক্ষা।এতোদিনে সে সুযোগ পেয়েছে।

সে এগিয়ে যায় নিঃশব্দে। শক্তিতে সে আসাদের সাথে পারবে না।পারতে চায়ও না।সে তাকে বধ করবে বুদ্ধিতে।আসাদের পেছনে যেতেই সে তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ল।আসাদ পেছন ফিরে পরিস্থিতি টের পাওয়ার আগেই সে পর পর তিনবার আসাদের চোখ বরাবর ছু’রি চালাল।বুকে কিংবা শরীরের অন্য কোথাও চালালে এতো সহজে তাকে হারানো যেত না।চোখ সবচেয়ে নাজুক জায়গা।মাথায় আ’ঘাত করার জন্য গায়ের জোর লাগে,অ’স্ত্রও ভীষণ ধাঁরালো হতে হয়।সবচেয়ে সহজ হয় চোখে আ’ঘাত করা।এক আ’ঘাতেই কুপোকাত।সে আঘাত করেই দুই হাতে শক্ত করে তার মুখ চেপে ধরে।আসাদ বিস্ফারিত চোখে তাকে দেখে।শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ শরীরটা সদ্য জ’বা’ই’কৃ’ত মুরগির মতো ছটফট করে কতোক্ষণ।মুখ ফুটে কিছু একটা বলতে চায়।

ফাহাদ চোখ মুখ খিঁচে তার মুখটা চেপে রাখে।হঠাৎই তার দৃষ্টি যায় সামনে।দেখতে পায় তার চেয়ে কয়েক হাত দূরে একটি নারী অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে।যার চোখে মুখে চূড়ান্ত মাত্রার বিস্ময়।যে বুঝতে পারছে না এসব কি হচ্ছে।ফাহাদ র’ক্তিম চোখে তাকে দেখল।

নবনীতা দুই হাতে টুপি টা হাতে চেপেই আতঙ্কিত হয়ে দুই পা পেছায়।তার হাত কাঁপছে থরথর করে।একটু আগে যে দৃশ্য সে দেখেছে,এটা দেখার পর কোনো মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব না।একজোড়া আতঙ্কিত চোখের সাথে এক জোড়া হিংস্র চোখের দৃষ্টি বিনিময় হয়।মুখ ঢাকা অবস্থাতেও নবনীতা সেই চোখের মালিককে অনায়াসে চিনে নেয়।এই তো প্রথম না।আগেও তো সে এমন অবস্থায় তাকে দেখছে।

বরফের মতো জমে যাওয়া শরীরটা আচমকা নড়েচড়ে উঠে।টের পায় আসাদের পর ফাহাদের পরবর্তী শিকার সে নিজেই।মস্তিষ্ক সচল হতেই সে এক চিৎকার দিয়ে ছুটে পালায়।এই দম বন্ধকর মুহূর্তে তার সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।সে ছুটতে ছুটতে ব্যাকুল হয়ে চেঁচায়,’আল্লাহ বাঁচাও।’

ফাহাদ তক্ষুনি আসাদ কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।উল্কাবেগে ছুটে যায় করিডোরের দিকে।তার হাতের ছু’রি টা তখনো র’ক্তরঞ্জি’ত।সেই ছু’রি থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত ঝরছে।এখনো তার আসল শিকার বাকি।

আসাদ তখন যন্ত্রণায় কাতরে কাতরে ছটফটাচ্ছিল।ঘন ঘন নিশ্বাসে তার শ্বাসরোধ হয়ে আসছিল।কিন্তু দায়িত্ব পালনে সে সর্বদা তৎপর।জীবনের শেষ সময়েও আসাদ নিজের দায়িত্ব পালন করল।সে তার কোমরে গুজে রাখা ওয়াকিটকি তে আন্দাজে হাত দিলো।হাতড়ে হাতড়েই সাইরেন বাজিয়ে বাকি সদস্যদের এলার্ট করল।তার কিছুক্ষণ পরেই তার কাপঁতে থাকা শরীরটা চিরতরের মতো শান্ত হয়ে গেল।আসাদ তার ইহজীবনের সমাপ্তি ঘটালো দায়িত্বপালন রত অবস্থায়।

আরহাম আচমকাই লক্ষ্য করল আশে পাশে কোথাও নবনীতার অস্তিত্ব নেই।চারদিক দেখেই সে তড়াক তরে উঠে দাঁড়ায়।ব্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।পেছন ফিরে গার্ডদের দেখে হম্বিতম্বি করে বলল,’আসাদ কে বলো তো তোমাদের ম্যাডাম যেখানেই আছে,তাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে।’

তার কথা ঠিক মতো শেষ হওয়ার আগেই একজন তীব্র উৎকন্ঠায় চেঁচিয়ে উঠে বলল,’স্যার! আসাদ তার ওয়াকিটকি থেকে রেড সিগন্যাল পাঠাচ্ছে।’

আরহাম রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠল,’রেড সিগনাল মানে?সে কোথায়?পরী কোথায়?এক্ষুনি তার লোকেশন ট্রেস করো।’

বলে সে আর অপেক্ষা করে না।অনুষ্ঠানের মাঝপথেই সবকিছু ছেড়ে এক দৌঁড়ে ছুটে যায় মাঠের অন্যদিকে।যেই আতঙ্কে ভেতরটা শুরু থেকে অস্থির হয়েছিল,সেই আতঙ্কই সত্যি হয়েছে।আরহাম নিশ্বাস বন্ধ করে ছুটে যায় ক্লাসরুমের বিল্ডিং গুলোর দিকে।দরদর করে ঘামতে থাকা শরীরটা অস্থির হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।ঠিক তখনই ইনডোর থেকে একটি তরুণীর গগনবিদারী আর্তচিৎকার তার কর্ণগোচর হয়।এক আওয়াজেই আরহাম থমকায়।শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায় হিমশীতল ধারা।তার নিস্তব্ধতার মাঝেই তরুণীটি পুনরায় চেঁচায়।বরাবরের মতোই প্রতিটা চিৎকারে সে খুঁজে যায় নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে।মানুষটি তার জন্মদাতা,মানুষটি সেই মেয়েটির বাবা।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩১

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩১)
[রিচেক দিতে পারিনি]

নবনীতা একমনে স্টুডেন্টদের এসাইনমেন্ট চেক করছিল।খাতা দেখার সময় সে চোখে চশমা ব্যবহার করে।সে একটা এসাইনমেন্ট দেখা শেষ করে অন্য একটা এসাইনমেন্টে হাত দেয়।

আজ তার বিবাহিত জীবনের আটত্রিশ দিন পূর্ণ হয়েছে।আটত্রিশ দিনে আটত্রিশ রকমের ঘটনা ঘটেছে।ভালো বিষয় হচ্ছে এই দিনগুলোতে তাদের সম্পর্কটা সহজ হয়েছে।বিয়ের সময় যেই বাজে সমীকরণের মাঝে তারা আটকে ছিল,সেই সমীকরণে কিছু পরিবর্তন এসেছে।নবনীতার ইদানিং মনে হয় আরহাম মানুষটা অতোটাও মন্দ না।কিছু গোড়ামি আছে,কিছু একরোখা আচরণ সে প্রায়শই করে।তবে সব মিলিয়ে এতোটাও খারাপ না।

ফার্স্ট ইম্প্রেশন কে মাঝে মাঝেই বেস্ট ইম্প্রেশন বলে ধরা হয়।অর্থাৎ তুমি প্রথম দেখায় যাকে পছন্দ করবে,তাকে তোমার আজীবন ভালো লাগবে।আর প্রথম দেখায় তোমার যাকে ভালো লাগবে না,গোটা জীবনেও তুমি তার প্রতি ভালো লাগা আনতে পারবে না।নবনীতা আজকাল রাত দিন হন্য হয়ে এই প্রবাদের মালিক কে খুঁজে।সামনে পেলে ঠাটিয়ে দু’টো দিত।একেবারে ভিত্তিহীন একটা প্রবাদ,যার কোনো সত্যতা নেই।আরহামকে তার প্রথম দেখায় স্রেফ একটা ক্ষমতা লিপ্সু আর দাম্ভিক মানুষ মনে হয়েছিল।তারপর সময়ের পরিক্রমায় সে একটা নতুন আরহামকে চিনেছে।যেই আরহামকে এক শব্দে দাম্ভিক কিংবা ক্ষমতা লিপ্সু বলেই নবনীতা পাশ কাটিয়ে দিতে পারে না।আরহামের আড়ালে আরেকটা আরহাম আছে।বিয়ের পর সেই আরহামের সাথে নবনীতার পরিচয় হচ্ছে।পরিচয় হওয়ার পর থেকেই মনের মাঝে একটা কথাই বাজে-‘নাহ,লোকটা এতোও খারাপ না’

তার কিছু গোড়ামি আছে।নবনীতার ব্যক্তি স্বাধীনতায় মাঝে মাঝেই সে হস্তক্ষেপ করে ফেলে।সেদিনও সে বাড়াবাড়ি করেছে।কিন্তু সবচেয়ে চমৎকার দিক সে নিজ থেকে এসে নিজের মেল ইগো কে পাশে সরিয়ে সরি বলতে শিখেছে।বাড়াবাড়ি করার পর সেটার জন্য ক্ষমা চাওয়াটা শাহরিয়ার আরহামের চরিত্রের নতুন একটি দিক।সারাক্ষণ নবনীতাকে ট্র্যাক করা,প্রতি মুহূর্তে ফোন দিয়ে আপডেট রাখা,স্কুল বাদে বাড়ির বাইরে বের হতে না দেওয়া,প্রতিটা বিষয়ে তার উপর পুরুষালী শাসন কায়েম করা-এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে সে সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি আরহাম কে খুঁজে পায়।যে আরহাম প্রাণপণ এই সংসার টা টিকিয়ে রাখতে চায়।আরহামের চোখে সে এই সম্পর্কের জন্য টান দেখতে পায়।সেই চোখে নবনীতা একটা অদ্ভুত ব্যাকুলতা খুঁজে পায়।ঐ দিনশেষে তার একটা কথাই মনে হয়-ছেলেটা এতোটাও পাষন্ড না।বরং অনায়াসে ঘর করার মতো।

নবনীতা আনমনে এসাইনমেন্টের উপর আঁকিবুঁকি করে।সামনের মাসে তাদের রিসেপশন।তারপরই নবনীতা পাকাপাকি ভাবে আরহামদের বাড়ি চলে যাবে।প্রথম প্রথম আরহাম প্রায় রোজই তার বাড়ি আসতো।ইদানিং ব্যস্ততা বেড়েছে।সপ্তাহে বড়ো জোর দুইদিন আসে।এলেও পুরো সময় ফোন নিয়ে পড়ে থাকে।অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি তার ফোনে প্রতি মিনিটে মিনিটে নতুন নতুন মানুষদের কল আসতেই থাকে।এবং এরা সবাই বড় মাপের মানুষ,বড়ো বড়ো রাজনীতিবিদ।নবনীতা উচ্চবিত্ত জীবন দেখেছে।কিন্তু রাজনৈতিক জীবন দেখেনি।বৈবাহিক সূত্রে তার সেই জীবন দেখার সুযোগও হচ্ছে।নেতাদের ডজন খানেক বিশ্বস্ত চ্যালা থাকে,যারা কথায় কথায় কোনোকিছু না বুঝেই সহমত ভাই সহমত ভাই করে চেঁচায়।ভাই যদি বলে সূর্য দক্ষিণ ওঠে,এতেও এরা গড্ডালিকা প্রবাহের ন্যায় সেটাই বিশ্বাস করে নেয়।নেতাদের একজন পিএ থাকে।যেকোনো সাধারণ মানুষ চাইলেই নেতা পর্যন্ত যেতে পারে না।আগে পিএ’র সাথে আলোচনা করে এপয়নমেন্ট নিতে হয়।তারপর গিয়ে ভাগ্য ভালো হলে নেতারা একটু দেখা দেয়।

নবনীতা এসাইনমেন্ট দেখার ফাঁকেই মিষ্টি করে হাসে।বাচ্চাগুলো যে মাঝে মাঝে কি করে! সেদিন চিত্রার সাথে ঝগড়া করতে গিয়ে সে আরহাম কে জড়িয়ে ধরেছে।তাও একেবারে দুই হাতে শক্ত করে।বিষয়টা সে টের পেয়েছে যখন আরহামও তাকে বিনিময়ে তারই মতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে।টের পেতেই তার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসল।সে পাথরের মূর্তির মতো কতোক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।না সরতে পারছিল,না কিছু বলতে পারছিল।

আবার সেদিন বিভার সাথে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে গিয়ে নবনীতা হোঁচট খেয়ে সোজা আরহামের গায়ে গিয়ে পড়েছে।বিভা তো এক দৌঁড়ে অন্য ঘরে চলে গেছে।কিন্তু নবনীতা তো বাঁধা পড়ে গেছে আরেক জায়গায়।আরহাম মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে তাকে দেখল।এক হাত নবনীতার পিঠে রেখে জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’কি চাই?’

নবনীতা উঠতে গিয়েও উঠতে পারল না।কেবল মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো,’কিছু না।হোঁচট খেয়েছি।’

আরহাম আর কিছু বলার আগেই ঘরের বাইরে শুভ্রার গলার আওয়াজ পেতেই নবনীতা ছিঁটকে দূরে সরে এলো।আরহাম বিক্ষিপ্ত মেজাজে মনে মনে কতোক্ষণ গালমন্দ করল।কাকে গালি দিয়েছে সে নিজেও জানে না।

সারাদিন বাড়িতে শতরকমের ঘটনা ঘটে।আর স্কুলে আসলেই নবনীতার একটার পর একটা ঘটনা মনে পড়ে।সেগুলো ভেবেই সে দিনভর মুচকি হাসে।সহকর্মীরা গোল গোল চোখ করে তাকে দেখে।নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তার,স্বামী এমপি।টাকা পয়সার অভাব নাই।সে সুখে থাকবে না তো কে থাকবে?সে মুচকি হাসবে না তো কে হাসবে?

স্কুলের হেড টিচারের নাম ডেইজি।তিনি ক্লাসটাইম শেষ হতেই নবনীতার কাছে আসলেন।ঠিক নবনীতার পাশাপাশি চেয়ারে গিয়ে বসলেন।নবনীতা কিছুটা চমকায়।বিচলিত হয়ে জানতে চায়,’কিছু বলবেন ম্যাম?’

মিসেস ডেইজি কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে ভীষণ বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন,’আসলে নবনী,তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।’

নবনীতা হাতের কলম টা ডেস্কের উপর ফেলে সরাসরি মিসেস ডেইজির চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,’জ্বী ম্যাম বলুন না?’

‘আসলে সামনের সপ্তাহে তো আমাদের স্কুলে কালচারাল প্রোগ্রাম।বাচ্চাগুলো খুব এক্সাইটেড।আমরা চাচ্ছি প্রোগ্রামটা বেশ জাকজমক করে সেলিব্রেট করতে।এজন্য আমরা আরহাম স্যার,মানে আপনার হাসবেন্ড কে গেস্ট হিসেবে ইনভাইট করতে চাই।স্যার তো এতো নরমাল কোনো ফাংশন এটেন্ড করেন না জানি।কিন্তু আপনি যদি একটু বলেন তাহলে নিশ্চয়ই উনি সেটা ফেলতে পারবেন না।আপনি কি আরহাম স্যারকে একবার বলবেন?খুব বেশি সময় নষ্ট করব না তার।এই ধরুন ঘন্টা খানেক মতো।প্লিজ নবনী,মানা করবেন না।’

নবনীতা অপ্রস্তুত হয়ে তার দিকে তাকায়।গালের নিচে হাত রেখে বিচলিত হয়ে বলে,’আমি বলব উনাকে?’

‘জ্বী।স্যার আপনার কথা ফেলতে পারবেন না।’

নবনীতা নিজ মনে উত্তর দেয়,’স্যার কবে আমার কথা শুনেছে?সে তো নিজের মর্জির মালিক।আমি বললেই কি?’

সে ভদ্রতার খাতিরে স্মিত হেসে উসখুস করতে করতে জবাব দেয়,’জ্বী আচ্ছা।আমি বলে দেখব।’

‘কথা দিচ্ছেন তো?আমি তাহলে আজ রাতেই উনার কাছে ইনভাইটেশন নিয়ে যাবো।’

‘না না।আজ না।আমি আগে উনার সাথে কথা বলি।তারপর আপনাকে জানাব।তখন যাবেন প্লিজ।’ ভীষণ তাড়াহুড়ো করে উত্তর দেয় নবনী।

মিসেস ডেইজি আর দিরুক্তি করলেন না।সে যখন আশ্বাস দিয়েছে তখন নিশ্চয়ই কোনো একটা ব্যবস্থা হবে।মিসেস ডেইজির সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা শেষে নবনীতা তার ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

গেইটের কাছে আসতেই তার ব্যাগে থাকা মোবাইল ফোনটি যান্ত্রিক শব্দে বেজে উঠল।নবনীতা তাড়াহুড়ো করে সেটা হাতে নেয়।আরহাম ফোন দিয়েছে।হাত ঘড়িতে সময় দেখতেই সে বুঝল আজ সে মিনিট দশেক দেরি করেছে।ফোন রিসিভ করে কিছু বলার আগেই অন্য পাশ থেকে কড়া গলায় প্রশ্ন এলো,’কোথায় তুমি?এখনো গাড়িতে উঠো নি কেন?’

নবনীতা আরো এক দফা বিরক্ত হয়।আরহাম যতোই চেষ্টা করুক,তার বচনভঙ্গিতে ভয়াবহ রকমের সমস্যা আছে।ভালো কথাও সে মেজাজ দেখিয়ে বলে।নবনীতা শান্ত হয়ে জবাব দেয়,’মাত্র বেরিয়েছি।স্কুল গেইটের সামনে।’

‘ওহহ আচ্ছা।’ গমগমে স্বরে প্রতিউত্তর করে সে।

নবনীতা গাড়িতে উঠে পুনরায় তাকে ফোন দিলো।আরহাম ফোনটা কানে চেপেই যথাসাধ্য নরম গলায় বলল,’বলো পরী।’

নবনীতা বিচলিত আর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।একটু একটু লজ্জাও হচ্ছে তার।শেষে লজ্জা শরম সব একদিকে সরিয়ে সে জানতে চায়,’আপনি আজ বাড়ি আসবেন না?’

অন্যপাশে পিনপতন নিরবতা।সেই নিরবতায় নবনীতার অস্বস্তি আরো বহুগুন বেড়ে যায়।প্রায় মিনিট খানেক পরে মুঠোফোনের অপরপ্রান্ত থেকে হিম শীতল কন্ঠে জবাব আসে,’আসছি।একটু পরেই আসছি।’

নবনীতা সাথে সাথে ফোন কেটে দেয়।কোলের উপর থাকা দুই হাত আচ্ছা মতো কচলায়।আরহাম তাকে কি ভাবছে কে জানে! সে নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দেয়,এতো ভাবার কি আছে?আরহামও তো হুটহাট তার বাড়ি চলে আসতো।সে তো কখনো লজ্জা পেত না।নবনীতা কেন পাবে?

***

আরহাম এসেছে দুপুর দুইটার দিকে।আজ দরজা খুলেছে শুভ্রা।আরহাম তাকে দেখেই চমকে উঠে বলল,’কি ব্যাপার?তুমি আজ বাসায়।কোচিং-এ যাও নি?’

শুভ্রা মাথা নেড়ে জবাব দেয়,’না ভাইয়া।আজ বন্ধ।’

‘ওহহ আচ্ছা।’
আরহাম এদিক সেদিক তাকায়।ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়,’তোমার আপাই কোথায়?’

শুভ্রা রান্নাঘরের দিকে আঙুল তুলে বলল,’আপাই রান্নাঘরে।আপনার জন্য রান্না করছে।’

আরহাম চোখ বড় বড় করে বলল,’বলো কি?রান্না করছে আমার জন্য?আমার তো লক্ষ্মণ ভালো ঠেকছে না।’

শুভ্রা জবাবে কেবল মুচকি হাসল।আরহাম একহাত পাঞ্জাবির পকেটে রেখে উৎসুক হয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়।ভেতরে উঁকি দিতেই দেখে চারদিকে শুধু ধোঁয়া।এর মাঝে নবনীতার পিঠ আর হাত সামান্য দেখা যাচ্ছে।আরহাম মুখের সামনে হাত নাড়তে নাড়তে বলল,’হেই সেনোরিটা! মে আই কাম ইন?’

নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়।দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,’ইয়েস।ইউ ক্যান।’

আরহাম দ্রুত ভেতরে এলো।হাত নাড়তে নাড়তে বলল,’রাধছো টা কি?ধোঁয়া তে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।’

নবনীতা একহাতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,’বাটার চিকেন।কিন্তু ধোঁয়া হয়েছে অন্য কারণে।আমি শুরুতে একটা ভুল করে ফেলেছিলাম।’

আরহাম আতঙ্কিত হয়ে বলল,’এ খাবার খাবে কে?’

নবনীতা অবাক হয়ে বলল,’খাবে কে মানে?আপনি খাবেন।আর কে?’

আরহাম এক হাত বুকে চাপে।আঁতকে উঠে বলে,’কি সর্বনাশ! মরে টরে যাব নাকি?চেহারা দেখে তো সুবিধার মনে হচ্ছে না।’

নবনীতা কটমট চোখে একবার সেদিকে তাকায়।আরহাম সেই চাহনির তোয়াক্কা না করে বলল,’এতো চোখ রাঙিয়ে লাভ নাই।আগে তুমি খাবে।দশ মিনিট পরেও যদি না মরো,তাহলে আমিও খাবো।বুঝেছ?’

____

নবনীতার বানানো বাটার চিকেন খুব একটা বাজে হয়নি।আরহাম মুখে দিয়েই প্রসন্ন হেসে বলল,’নট ব্যাড পরী।ভালোই হয়েছে।’

নবনীতা মুখ বাঁকা করে বলল,’মানলাম রান্না কম পারি।তাই বলে এতোও খারাপ না আমার রান্নার হাত।আর কয়েকবার ট্রাই করলেই হয়ে যাবে।’

আরহাম সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।চিত্রা খাওয়া শেষেই ঘুম দিয়েছে।শুভ্রা বসেছে পড়ার টেবিলে।তার টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে কিছুদিন পর।পড়তে যদিও তার ভালো লাগে না খুব একটা।তবুও সে পড়ছে।সে জীবনে কিছু একটা হতে চায়।সে তার আপাইকে গর্বিত অনুভব করাতে চায়।

নবনীতা সবকিছু গুছিয়ে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে তার ঘরে এলো।আরহাম তখন বারান্দায়।বরাবরেই মতোই তার কানে ফোন।সে ফোনালাপে ব্যস্ত।নবনীতা ঢিলেঢালা খোপা টা খুলে আবার শক্ত করে সেটা বাঁধলো।আরহাম কথা শেষে ফোন কেটে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো।

আসতেই তার চোখ যায় নবনীতার দিকে।তার পরনের শাড়িটা সেই সকালে গায়ে জড়িয়েছে সে।স্কুল থেকে ফিরে সে আর সেটা খুলেনি।সোজা রান্নাঘরে গিয়েছে দুপুরের খাবার রান্না করার জন্য।তার শাড়ি বেশ খানিকটা নড়বড়ে হয়ে পিঠ ছেড়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে।

আরহাম চুপচাপ এগিয়ে যায় তার দিকে।নবনীতা পেছন ফিরতেই তার সাথে থাক্কা খায়।অবাক হয়ে বলে,’কি হয়েছে?কিছু বলবেন?’

আরহাম কোনো ভণিতা কিংবা সংকোচ ছাড়াই হাত বাড়িয়ে তার কোমর চেপে তাকে নিজের একেবারে কাছাকাছি এনে দাঁড় করায়।নবনীতা ঘটনার আকস্মিকতায় ধড়ফড়িয়ে উঠে।বিস্ফারিত চোখে সামনে দেখে।আরহাম শাড়ি গলিয়ে তার কোমরে একহাত রাখল।নবনীতা ঈষৎ কেঁপে উঠে দ্রুত মাথা নামিয়ে নেয়।মন চাইছে এক ধাক্কা দিয়ে ছুটে পালাতে।কিন্তু সেটা সম্ভব না।বিয়ে হয়েছে তার।পালানোর আর কোনো উপায় নেই।

সে মনে মনে নিজেকে বোধায়,’সিন ক্রিয়েট করিস না নবনী।জামাই লাগে তোর।ধরতেই পারে,কাছে আসতেই পারে।’
সে টেনে টেনে আরো কয়েকবার শ্বাস নিয়ে মাথা নামিয়ে নেয়।হৃদস্পন্দন এতো বেশি বেড়ে গেছে যে তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি সেটা ফেটে নবনীতা হার্ট অ্যাটাক করে ম’রে যাবে।

আরহাম অন্য হাতে তার মুখের সামনে চলে আসা ছোট ছোট চুল গুলো সরায়,আলতো করে তার ঘাড়ের পেছনে হাত রাখে।দু’জনের দূরত্ব তখন গুনে গুনে এক কিংবা দুই ইঞ্চি।নবনীতা দুই হাতে শক্ত করে তার শাড়ি খাঁ’মচে ধরে।মনে মনে নিজেকে খুব করে শা’সায়,’উল্টো পাল্টা এক্সপ্রেশন দিবি না নবনীতা।নাক ছিটকাবি না।নরমাল থাক,একদম নরমাল।বর না তোর?’

সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে শান্ত থাকার।অথচ পালস রেট নিয়ন্ত্রণের বাইরে।আরহাম তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঘোরলাগা গলায় ডাকে,’পরী!’

নবনীতা মাথা নামিয়ে চোখ মুখ খিঁচে জবাব দেয়,’জ্বী?’

আরহাম একটা শ্বাস ছেড়ে গাঢ় স্বরে বলল,’উই আর ম্যারিড ফর মোর দ্যান ওয়ান মান্থস।ডোন্ট ইউ থিংক আমাদের আরেকটু ক্লোজ হওয়া উচিত?নিজেদের প্রয়োজনে,সম্পর্কের প্রয়োজনে,সবকিছুর প্রয়োজনে?’

নবনীতা দু’টো শুকনো ঢোক গিলে।টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে বুকের ভেতরের তোলপাড় নিয়ন্ত্রণ করে।একেবারে ধিমি স্বরে জবাব দেয়,’জ্বী’

‘সেটা কখন?কবে?’

নবনীতা নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে।মনের মাঝে চলমান সকল দোলাচল একদিকে সরিয়ে সে সুমিষ্ট কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে জবাব দেয়,’আপনি যেদিন চাইবেন সেদিনই।’

আরহাম হাসল।প্রসন্ন,নির্মল আর স্বচ্ছ হাসি।সে টের পাচ্ছে তার দুই হাতে বন্দি নারী কায়া টি একটু সময় পর পরই থেমে থেমে কাঁপছে।তার সমস্ত তেজ,জেদ আর চোখ রাঙানি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

আরহাম একপেশে হেসে তাকে ছেড়ে দিলো।এক লাফে খাটে উঠে বলল,’এই বাড়িতে এসব রোমান্স টোমান্স সম্ভব না।ঘর ভর্তি বাচ্চাকাচ্চা সারাদিন প্যা পু করে।লজ্জায় আমার মাথা কাজ করে না।তোমার বাড়ি এটা পুরাই বেবি কেয়ার হোম হয়ে যাবে ক’দিন বাদে।’

নবনীতা তার কথা শুনতেই মুচকি হাসল।তার কথার জবাব না দিয়ে ঠিক তার মুখোমুখি এসে বসল।আরহাম চোখ সরু করে বলল,’ব্যাপার কি বলো তো?লক্ষ্মণ তো ভালো না।তুমি তো এতো ভদ্র মানুষ না।’

নবনীতা সে কথা পাত্তা না দিয়ে অত্যাধিক কোমল স্বরে বলল,’আমার একটা কথা শুনবেন আরহাম?শুনেই রিজেক্ট করা যাবে না,মানতে হবে।’

****

কয়েক সেকেন্ড অপলক নবনীতাকে দেখার পর আরহাম শব্দ করে হেসে উঠল।হাসতে হাসতেই বলল,’সিরিয়াসলি পরী?’

নবনীতা থতমত খেয়ে বলল,’এভাবে হাসার কি আছে?আমি কি কোনো কৌতূক করেছি?’

আরহাম হাসি থামায়।গম্ভীর গলায় বলে,’তো হাসব না?আমি কি পাড়া মহল্লার পাতি নেতা?যে যেখানে খুশি নিয়ে যাবে,যেকোনো অনুষ্ঠানে নিয়ে বসিয়ে রাখবে?একটা ওয়েট আছে আমার।সব অনুষ্ঠানে আমি যেতে পারব না পরী।’

নবনীতা হাল ছাড়ল না।গো ধরে বলল,’প্লিজ আরহাম।এই প্রথম আর শেষবার।আর কখনো বলব না প্লিজ চলুন।সর্বোচ্চ দেড় দুই ঘন্টাই লাগবে।বেশি না।’

‘নো।নেভার।এতো জায়গায় গেলে আমার ওয়েট কমে যাবে।প্রেসটিজ ডাউন হবে।আমার একটা ব্যক্তিত্ব আছে।এই ব্যক্তিত্বের একটা ভার আছে।’

নবনীতা চটপট জবাব দেয়,’সেখানে গেলে ব্যক্তিত্ব হালকা হবে না।প্লিজ চলুন না।তারা কতো আশা করে আমার কাছে রিকুয়েষ্ট করেছে।’

‘না,পারব না।সব জায়গায় যেতে পারব না।এতো সস্তা নাকি আমি?’

নবনীতা আরেকটু এগিয়ে এসে তার দুই হাত লুফে নেয়।অনুনয় করে বলে’প্লিজ।আসুন না।বাচ্চারা খুব খুশি হবে।’

আরহাম খ্যাক করে উঠে বলল,’বাচ্চারা কেন খুশি হবে?আমি তাদের বাপ লাগি?’

নবনীতক হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।আরহাম তার মলিন মুখটা দেখেই বাঁকা হেসে বলল,’আচ্ছা যাও।যাবো আমি।কিন্তু কয়েকটা শর্ত আছে আমার।’

নবনীতার দুই চোখ খুশিতে চকমক করে উঠে।সে চঞ্চল হয়ে জানতে চায়,’কি শর্ত?’

আরহাম খাটে শুয়ে এক পায়ের উপর এক পা রেখে বলল,’শর্ত হলো তুমি আমাকে সুন্দর করে রিকুয়েষ্ট করবে।বলবে আরহাম স্যার প্লিজ আপনি চলুন।আপনি না গেলে আমার একদমই ভালো লাগবে না।আপনি প্লিজ আপনার পদধূলি ফেলে আমাদের ধন্য করুন।বলো বলো,এখনি বলো।’

নবনীতা কড়া চোখে একবার তাকে দেখে।তারপরই অত্যাধিক কোমল গলায় ন্যাকা সুরে বলে উঠে,’নেতাদের নেতা,সব নেতার বড় নেতা,মহামান্য আরহাম! আপনি প্লিজ আমাদের ছোট খাটো স্কুলের কালচারাল প্রোগ্রামে চলুন।একটু পায়ের ধুলো দিন।আমরা ধন্য থাকবো।চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।প্লিজ স্যার মানা করবেন না।’

আরহাম চোখ বড় বড় করে তার কথা শুনল।সে থামতেই জোরে জোরে হাততালি দিয়ে বলল,’চমৎকার! চমৎকার! আমি যতটুকু চেয়েছি,তার চেয়েও বেশি বলেছো।খুশি হয়েছি আমি।বলে দাও তোমার ডেইজি ম্যামকে আমি তার স্কুলের ফাংশনে আসছি।’

নবনীতা তার কথা শুনেই প্রশস্ত হাসে।যাক,সে তাকে রাজি করাতে পেরেছে।এই নিয়ে অনেক দ্বিধায় ছিল সে।আরহাম যে যেতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক।তার আজ সারাদিনের খাটুনি স্বার্থক।

****

উত্তরবঙ্গে বন্যার তান্ডব বেড়েই চলেছে।প্রায় ছয়টি জেলার অসংখ্য গ্রাম বন্যায় তলিয়ে গেছে।অবস্থা দিনকে দিন বেগতিক হয়েই যাচ্ছে।বন্যার্তদের সহায়তায় সারাদেশে বিভিন্ন এনজিও,বিভিন্ন সংঘটন থেকে সম্মিলিত ভাবে সাহায্য তোলা হচ্ছে।

রাজনীতিতে চ্যারিটি বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ।আবেগপ্রবণ জাতির মন জয় করার জন্য লোক দেখানো দান খয়রাতের কোনো বিকল্প নেই।ব্যাপক অর্থ দান করলেই যেকোনো রাজনৈতিক নেতা জনগণের চোখের মধ্যমণি হয়ে উঠে।আরহাম এই সুযোগ হাতছাড়া করার পাত্র না।তার অর্থায়নে বন্যা কবলিত মানুষদের সহায়তার জন্য বিরাট পরিসরে ত্রাণ কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়েছে।

সে দুইদিন ধরেই এসব নিয়ে ব্যস্ত।ওয়াজিদ আগে থেকেই সোশ্যাল এক্টিভিটিজের সাথে যুক্ত।সে আর আদি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা সশরীরে বন্যা কবলিত এলাকায় যাবে।

সন্ধ্যার পরেই ত্রাণসামগ্রী ভর্তি বড়ো বড়ো কার্টন গুলো বিশালাকার ট্রাকে তোলার ব্যবস্থা করা হলো।আরহাম সন্ধ্যার একটু পরে সেখানে গেল।গিয়েই একটা কার্টন হাতে তুলে তোফায়েল কে ডেকে বলল,’এদিকে আয় তো তোফায়েল।আমার পকেট থেকে ফোনটা বের কর।’

তোফায়েল তার কথা মতো ফোন বের করল।আরহাম একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,’আমার একটা সুন্দর ছবি তোল।দেখে যেন মনে হয় কাজ করতে করতে আমি হাঁপিয়ে গেছি।’

তোফায়েল ঠোঁট টিপে চাপা স্বরে হাসে।আরহামের নির্দেশ মতো চটপট তার কয়েকটা ছবি তুলে।রাত দশটার পরে সবার মিলিত প্রচেষ্টায় কাজ কিছুটা কমে এলো।আরহাম তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে এসেই হাত পা ছেড়ে ইজিচেয়ারে বসল।

একটু পরে আদিও ভঙ্গুর পায়ে হেঁটে এসে তার মুখোমুখি সোফাতে বসল।হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’ওয়াজিদের এনার্জি আছে ভাই।আমি তো কয়েক কার্টন তুলেই শেষ।’

আরহাম জিজ্ঞাসু হয়ে জানতে চায়,’স্যার কি এখনো ঐদিকেই আছেন?’

‘হু।একনাগাড়ে কাজ করেই যাচ্ছে।সত্যিকারের সমাজসেবক যাকে বলে।’

পিঁক পিঁক শব্দ হচ্ছে।আরহাম হাতড়ে হাতড়ে দ্রুত পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে।নবনীতা ফোন দিয়েছে।সে ফোন রিসিভ করেই বলল,’বলো পরী।’

অন্যপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন আসে,’বাসায় আসবেন না আজ?’

আরহাম হাসি হাসি মুখে জবাব দেয়,’এই তো আসছি।আরেকটু সময় লাগবে।’

‘ওহহ আচ্ছা।কাল কিন্তু কালচারাল প্রোগ্রাম।মনে আছে?’

‘জ্বী ম্যাডাম।মনে আছে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

নবনীতা সাথে সাথেই ফোন কেটে দিলো।আরহাম ফোন রেখেই আদির দিকে তাকায়।ভাব নিয়ে বলে,’বউয়ের ফোন,বাড়ি যেতে বলছে।আর এদিকে থাকা সম্ভব না।’

আদি চোখ তুলে তাকে দেখে।মুখ খিঁচিয়ে বলে,’শা’লা চুটিয়ে সংসার করছিস তাই না?’

আরহাম মাথা নাড়ে।কলার ঠিক করতে করতে বলে,’একদম তাই।’

সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।আরো আধ ঘন্টার মতো নিচে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে তার গাড়িতে করে ধানমন্ডির উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়।কাল সে লিলিপাই কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কালচারাল প্রোগ্রামে যাবে।ল্যাদা ল্যাদা বাচ্চাদের নিয়ে আহ্লাদ করতে হবে।কি পরিমান বিরক্তিকর বিষয়!

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩০

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩০)

লিলিপাই কিন্ডারগার্টেন স্কুল।ধানমন্ডি থেকে সামান্য খানিকটা দূরে।নবনীতা স্কুলের নেমপ্লেট টা আরেকবার দেখেই ভেতরে পা বাড়ায়।

আরহাম তাকে বলেছিল সামনের দুই বছর তার মন মতো কোনো চাকরি করতে।যেটা তার ভালো লাগে।সে অনেক ভেবে বের করেছে সে এমন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতে চায়।যেহেতু বেতনের চিন্তা নেই,তাই বেতনের বিষয়টা সে তেমন একটা ভাবল না।কেবল ভাবল নিজের মনের শান্তির কথা।সে বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে।তার চাকরিটাই যদি হয় বাচ্চাকাচ্চা কেন্দ্রিক তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই নেই।

সে যখন আরহাম কে জানিয়েছে সে বাচ্চাদের টিচার হতে চায় তখন আরহাম গোল গোল চোখে কতোক্ষণ তাকে দেখল।তারপরই উপহাস করে বলল,’খুবই গরীব স্বপ্ন তোমার।’

নবনীতার কাছে মোটেও এটা কোনো গরীব স্বপ্ন না।তার বাচ্চা কাচ্চা ভীষণ ভালো লাগে।এদের সাথে সময় কাটাতেই তার আনন্দ হয়।সে জায়গায় তার চাকরিটাই যদি হয় মানুষের সাথে সময় কাটানো,তাহলে তো কোনো কথাই নেই।

আরহাম তার ইচ্ছে শুনেই কতোক্ষণ হাসল।শেষটায় বিদ্রুপ করে বলল,’তাহলে এক কাজ করো।কিন্ডারগার্টেনের টিচার না হয়ে বেবি সিটার হয়ে যাও।সারাদিন ডজন খানেক বাচ্চা কানের কাছে প্যা পু করে চিৎকার করবে।তখন খুব ভালো লাগবে।’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকায়।গো ধরে বলে,’মোটেও না।আমার বাচ্চাদের প্যা পু ও ভালো লাগে।’

সে শাড়ির কুচি সামলে ভেতরে যায়।সে ক্লাস থ্রি-এর সেকশান সি এর ক্লাস টিচার।সে তাদের ম্যাথামেটিকস পড়ায়।ছোট ছোট বাচ্চা গুলো ফ্রক আর শকস পরে ছুটে ছুটে ক্লাসরুমে আসে।এই দৃশ্য তার খুবই ভালো লাগে।তারা সবাই তাকে নবনী মিস বলে ডাকে।

নবনীতা অনুভব করে স্কুলে তার একটা আলাদা নাম ডাক আছে।সেটা অবশ্য নিজের যোগ্যতার কারণে না,স্বামীর যোগ্যতার কারণে।এমপির স্ত্রী বলেই সম্ভবত কলিগরা তাকে একটু বেশিই পাত্তা দেয়।সবাই তার সাথে একটু মাখো মাখো সম্পর্ক বজায় রেখে চলে।সে বিনিময়ে কেবল সহজ আর সাবলীল আচরণ করে তাদের সাথে।

ক্লাসরুমে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা।তার বয়স অনেক অল্প।তার মতো এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে সচরাচর কেউ কিন্ডারগার্ডেনে চাকরি নেয় না।তার বয়সের কারণেই সম্ভবত বাচ্চারা তাকে খুব পছন্দ করে।রোজই তারা তাকে এটা সেটা এনে দেয়।তাদের চকলেট পেতে পেতে তার ব্যাগ ভরে গেছে।সে মানা করলেও তারা তার হাতে চকলেটের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়।

আজও সুহানা নামের একটি মেয়ে রোল কল করার পর গুটি গুটি পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।নবনীতা হাজিরা খাতা থেকে চোখ সরিয়ে তাকে দেখেই মিষ্টি হেসে বলল,’হোয়াটস হ্যাপেন সুহানা?এনিথিং রং?’

সুহানা তার ফোকলা দাঁত বের করে হাসল।ডান হাতে মুঠ করে চেপে রাখা চকলেট টা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গালভর্তি হেসে বলে,’মিস।দিস ইজ ফর ইউ।’

নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’সত্যি?থ্যাংকস।বাট আই ডোন্ট নিড দিস।তুমি খেয়ে নাও।মিস তাতেই খুশি হবো।বুঝেছ?’

সুহানা নারাজ হলো।নবনী মিসের প্রস্তাব তার পছন্দ হয়নি।মিসের জন্য আনা জিনিস সে কেন খাবে?তাহলে কি সেটা আর গিফট হলো?সে গো ধরল।হাত পা নেড়ে বলল,’নো মিস।প্লিজ টেইক দিস।’

নবনীতা কপালে হাত রেখে অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।এদের ভালোবাসাময় যন্ত্রণা থেকে তার মুক্তি নাই।সে সুহানার জেদের কাছে পরাজিত হয়ে হাসি হাসি মুখ করে চকলেট টা হাতে নিল।সুহানা চকলেট দিয়েই তার কাছে এলো।ফিসফিস করে বলল,’মিস আমাকে আজকে একটা স্টার বেশি দিবে,ওকে?’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকায়।ঠোঁট গোল গোল করে বলে,’ওরে দুষ্টু! চকলেট ঘুষ দিয়ে বেশি বেশি স্টার নেওয়ার বুদ্ধি।এই ছিলো তোমার পেটে?’

বলেই সে হাত বাড়িয়ে সুহানার পেটে সুরসুরি দেয়।সুহানা হাসিতে গড়াগড়ি খায়।হেসে উঠে নবনীতা নিজেও।ইশশ! কি সুন্দর এই জীবন! কতো ভালো আছে নবনীতা! সে আর কিছু চায় না।বাকি জীবনটা এমন করে পার করে দিতে পারলেই হলো।

স্কুলের ক্লাসটাইম শেষ হতেই সে অফিসরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বসল।মৌরি নামের তার একজন কলিগ তাকে দেখেই বলল,’নবনী! তুমি আজ ফ্রি আছো?’

নবনীতা কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিরেট স্বরে জবাব দেয়,’জ্বী আছি।কেন আপা?’

‘চলো না আজ কোথাও ঘুরে আসি আমি,তুমি,প্রভা আর রাত্রি মিলে।’

নবনীতা বলপয়েন্ট কলমটা গালে চেপেই ভাবুক হয়ে বলল,’আজ?আচ্ছা আমি ভেবে দেখছি।’

তার সামনে বাচ্চাদের ক্লাস টেস্টের খাতা গুলো রাখা।সে দশ বারোটার মতো খাতা কেটে বাকি খাতা গুলো গুছিয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত ড্রয়ারে গিয়ে রাখল।তারপরই আনুমানিক একটার দিকে সব কাজ শেষ করে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল।

স্কুলের সামনে আসতেই কালো রঙের প্রাডো গাড়িটি তার দৃষ্টিগোচর হয়।সে চুপচাপ হেঁটে সেটাতে চড়ে বসে।এই গাড়ির মালিক তার স্বামী।স্বামী রোজ রোজ এই গাড়ি পাঠায় তাকে আনা নেওয়া করার জন্য।নবনীতা শুরুতে কয়েকবার বিরোধ করেও কাজ হয়নি।শেষটায় বাধ্য হয়ে সে সবটা মেনে নিয়েছে।

নবনীতা ইদানিং আরহামের কিছু অদ্ভুত চারিত্রিক দিকের সাথে পরিচিত হচ্ছে।যার মধ্যে একটি তার ডমিন্যান্ট স্বত্তা।স্ত্রী কে নিয়ে তার কিছু অদ্ভুত হাইপোথিসিস আছে।যেমন-নবনীতা যেকোনো যানবাহনে চড়তে পারবে না,বাড়ি থেকে বের হলে তাকে আরহামের পাঠানো গাড়ি দিয়েই যাতায়াত করতে হবে।এর চেয়েও বিরক্তিকর বিষয় তাকে সবসময় নিজের জিপিএস অন রাখতে হবে।এমনকি প্রতিদিন স্কুল শেষে আরহামকে ফোন দিয়ে জানাতে হবে সে স্কুল থেকে বেরিয়েছে।নবনীতা এসবের সাথে লড়াই করতে করতে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ পরাজয় মেনে নিয়েছে।

সে চিরকাল আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা মানুষ।পুরুষালি শাসন বলতে সে কেবল বাবার শাসনকেই বুঝত।তারপর আর তার জীবনে অন্য কোনো ছেলে অভিভাবক হয়ে এসে তাকে শাসন করেনি।এখন তার বিয়ে হয়েছে।স্বামী আছে।সে তাকে ভালো মন্দ বলবে।নবনীতার এতে আপত্তি নেই।নবনীতার আপত্তি তার স্বামীর কিছু বাড়াবাড়ি আচরণ নিয়ে।আরহাম তার ইমেইলের এক্সেস পর্যন্ত নিজের কাছে রাখে।স্ত্রী হিসেবে এই বিষয়টা তার কাছে কিছুটা অপমানজনক মনে হয়।তবে সে ইদানিং আর তেমন কিছু বলে না।বিয়ে যখন মেনে নিয়েছে,তখন একসাথে সংসারের বিষয়টিও মেনে নিয়েছে।সেক্ষেত্রে অপরপক্ষের মানুষের ত্রুটি গুলো নিয়ে খামোখা ঝামেলা বাধিয়ে লাভ নেই।ঝামেলা বাধালে যদি কোনো কাজ হতো তাহলে এক কথা।আরহাম যে কি পরিমান গোয়ার আর জেদি সেটা নবনীতা তার বিয়ের একমাস না হতেই টের পাচ্ছে।তাকে বলে কোনো লাভ নেই।সে যেটা বুঝার সবসময় সেটাই বুঝে বসে থাকে।তার ভাবনা চিন্তার উপর নিজের ভাবনা চিন্তা চাপিয়ে দেওয়া নবনীতার জন্য অসম্ভব।

সে বাড়ি গিয়েই গোসল সেরে নেয়।সকালে সে মুরগির মাংস রান্না করেছিল।এখন সেটা গরম করে চিত্রা কে খাইয়ে দিতে হবে।বেলা তিনটা নাগাদ কলিং বেল বেজে উঠে।নবনীতা মাত্রই চিত্রাকে খাইয়েছে।শুভ্রা আসার সময় হয়েছে।সে কালো রঙের শাড়ির আঁচল সামলে দ্রুত দরজার দিকে যায়।দরজা খুলেই সে খানিকটা চমকায়।

আরহামের সাথে তার চোখাচোখি হতেই আরহাম ক্লান্ত স্বরে বলে,’হাই সেনোরিটা! কেমন আছ?’

‘আপনি এই সময়ে?’

‘হু,সন্ধ্যার আগে আর কাজ নেই।ভাবলাম দুপুরে এখানেই খেয়ে যাই।’

নবনীতা দরজা বন্ধ করতে করতে ছোট করে জবাব দেয়,’ওহহ আচ্ছা।’

আরহাম তার বেডরুমে গিয়েই পাঞ্জাবির দু’টো বোতাম ঢিলে করে আরাম করে খাটে শোয়।গলা ছেড়ে ডাকে,’পরী একটু পানি দাও প্লিজ।’

নবনীতা অলস ভঙ্গিতে হেঁটে এসে পানির গ্লাসটা তার সামনে বাড়িয়ে দেয়।আরহাম পুরোটা পানি শেষ করে গ্লাসটা তার হাতে ফিরিয়ে দিলো।জানতে চাইল,’তুমি খেয়েছ কিছু?’

‘নাহ,শুভি আসলে একসাথে খেতাম।শুভি তো এলো না।আপনাকে দিয়ে দিব খাবার?’

‘নাহ,শুভ্রা এলেই খাবো নে।’

শুভ্রা আসলো আরো পনেরো মিনিট পর।সে আসার পরেই নবনীতা সবকিছু টেবিলে বেড়ে দেয়।আরহাম খেতে খেতেই জানায়,’তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে পরী।’

নবনীতা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,’সেটা কি?’

‘শাহাদাতের রিলিজের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম।বলল সামনের সপ্তাহে অথবা এর পরের সপ্তাহে তাকে ডিসচার্জ করা হবে।তারপর তুমি তাকে তোমার কাছেই রাখতে পারবে।’

নবনীতা খেতে খেতেই উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠে,’বাহ! দারুন খবর তো।’

‘শাহাদাত আর বিভাকে কোথায় রাখতে চাও?এই বাসায়?নাকি চাইল্ড হোমে?’

নবনীতা দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,’অবশ্যই এই বাসায়।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।তোমার এখানেই রেখো।কিন্তু এদের তো সময় দিতে হবে।তুমি নিজেই তো স্কুলে থাকো।কিভাবে কি করবে?’

নবনীতা ব্যস্ত হয়ে জবাব দেয়,’সে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।চিন্তার কিছু নেই।’

খাবার শেষ করেই সে চটপট সব গুছিয়ে নেয়।আরহাম জহুরি চোখে একনজর আগাগোড়া তাকে পরোখ করে।তার এই নতুন চাকরির সবচেয়ে চমৎকার দিক হচ্ছে তার রোজ রোজ নিয়ম করে শাড়ি পরা।অন্তত আরহামের কাছে এই দিকটাই ভালো লেগেছে।শাড়িতে তাকে চমৎকার লাগে।সুডৌল ছিমছাম শরীরে সে যখন শাড়ি জড়ায় তখন আরহামের মনে হয় সে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে তাকে দেখে যাক।তাকে আজকাল চমৎকার লাগে।সত্যিকারের পরীনিতা মনে হয়।একেবারে নতুন বউয়ের মতো বেশভূষা।

খাবার শেষ করে আরহাম ম্যাগাজিন হাতে শোয়ার ঘরে প্রবেশ করল।নবনীতা তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চোখে কাজল দিচ্ছিল।আরহাম জানতে চায়,’তুমি ঘরে বসে বসে এমন সাজগোজ করছ কেন?স্ট্রেঞ্জ!’

নবনীতা চোখে কাজল পরতে পরতে উত্তর দেয়,’আমি আজ এক জায়গায় যাচ্ছি।’

মুহুর্তেই মুখের হাসি মিলিয়ে যায় আরহামের।অতিশয় শীতল গলায় সে জানতে চায়,’কোথায় যাচ্ছ?’

‘কোথায় যাচ্ছি সেটা ঠিক জানি না।তবে উত্তরার কোনো একটা ক্যাফে তে যাচ্ছি।’

‘সাথে আর কে কে?’

আরহাম প্রশ্ন করেই চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকায়।নবনীতা এখনো তার মুখোভঙ্গি লক্ষ করেনি।সে এক চোখে কাজল দেওয়া শেষ করে অন্য চোখের দিকে মনোযোগ দেয়।আয়নাতে নিজেকে দেখতে দেখতেই বলে,’আমি,প্রভা,মৌরি আর রাত্রি।আমরা চারজনই যাচ্ছি।’

‘কার অনুমতি নিয়ে যাচ্ছো?’

গম্ভীর আর থমথমে গলায় করা প্রশ্নটা কর্ণগোচর হতেই নবনীতা কিছুটা ভড়কায়।পেছন ফিরে আরহাম কে দেখে বোকা বোকা হয়ে বলে,’জ্বী?’

‘তুমি কার অনুমতি নিয়ে এতো দূর যাচ্ছ পরী?’

‘অনুমতি মানে?আমরা অফিস কলিগ রা যাচ্ছি।অনুমতির কি আছে?আপনার গাড়ি তেই তো থাকব আমি।’

‘অনুমতির অনেক কিছু আছে।উত্তরা যাচ্ছ সেজেগুজে আবার বলছ অনুমতির কি আছে।অনুমতি নিয়েছ তুমি আমার?’

নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা টুলটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।হতবাক কন্ঠে বলে,’আরহাম! আমার কি এইটুকু স্বাধীনতা নেই যে আমি আমার মেয়ে কলিগদের সাথে একটু উত্তরায় যেতে পারব?’

‘না নেই।তোমাকে বলেছি আমাকে জিজ্ঞেস করে বাড়ির বাইরে যেতে।স্কুলে চাকরি করতে দিয়েছি এটাই অনেক।তুমি আবার ঘুরাঘুরি শুরু করেছ কবে থেকে?রিমির সাথে যেখানে মন চায় যাও,আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই।কিন্তু এর বাইরে সব কাজেই তোমাকে অনুমতি নিতে হবে পরী।আই হ্যাভ নট গেভ ইউ দ্যাট মাচ ইনডিপেনডেন্স।’

নবনীতা অবিশ্বাস্য চোখে তাকে দেখে।খানিকটা উঁচু স্বরে বলে উঠে,’আপনি মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছেন।কিছু বলি না দেখে আপনি রীতিমতো অনধিকার চর্চা করছেন।’

আরহাম তার চেয়েও উঁচু গলায় চেঁচায়,’কোনো অনাধিকার চর্চা করছি না।অধিকার আছে আমার।আমার বউ কোথায় যাবে না যাবে সেই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার আছে।তুমি শাড়ি পরে সেজেগুজে উত্তরা যাচ্ছ আর একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করো নি?তোমার কি আমাকে তথাকথিত সুইট,বউকে অগাধ ফ্রিডম দেওয়া হাসবেন্ড মনে হয়?’

নবনীতা ব্যথিত চোখে তাকে দেখে।শেষটায় মলিন মুখে বলে,’আপনি একটু বাইরে যাওয়া নিয়ে এতো গুলো কথা বলছেন?আমি তো এতো গুলো দিনে এই প্রথম বাইরে যাচ্ছি।তারাই আমাকে বলেছে যাওয়ার জন্য।’

‘যেই বলুক।তুমি কেন যাবে?তুমি আমাকে বলেছো একবারও?অকারণে মেয়েদের বাইরে ঘুরাঘুরি আমার পছন্দ না।’

‘আরহাম!’ খুবই করুণ শোনায় নবনীতার কন্ঠ।
‘আমাকে আপনি সন্দেহ করছেন?’

আরহাম পুরো শরীর আস্তে করে এলিয়ে দেয় তোশকে।দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’সন্দেহ না পরী।সন্দেহের কিছু নেই।মেয়েদের প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া আমার পছন্দ না।তাসনুভাও তো কতোবার বাড়ির বাইরে যেতে চায়।আমি যেতে দেই?মেয়েদের ঢ্যাং ঢ্যাং করা আমার একদমই ভালো লাগে না।তুমি পরবর্তীতে আর কখনো আমার অনুমতি না নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করবে না বুঝেছ?’

নবনীতা নিরুত্তর হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকে দেখে।শেষে দুই হাতে নিজের শাড়ি চেপে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।ছোট করে জবাব দেয়,’জ্বী বুঝেছি।’

তার কথা শেষ হওয়ার একটু পরেই তার মুঠোফোনটি শব্দ করে বাজতে শুরু করে।নবনীতা নির্বিকার চিত্তে সেটা রিসিভ করার আগেই আরহাম ছোঁ মেরে ফোনটা তার হাতে নেয়।নবনীতা কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে তাকে দেখে।আরহাম ফোন রিসিভ করেই গাঢ় স্বরে বলে,’আমি নবনী না।আমি তার হাসবেন্ড বলছি।’

অন্যপাশ থেকে হয়তো আরো কিছু বলল।নবনীতা সেগুলো শুনে নি।সে কেবল শুনেছে আরহাম হাস্কি স্বরে জবাব দিচ্ছে,’পরী আজ যেতে পারবে না।আমরা পলিটিক্যাল পারসনরা নিজেরাও হুটহাট কোথাও যেতে পারি না।আমাদের ফ্যামিলি মেম্বাররাও যেতে পারে না।’

কথা শেষ করেই সে শীতল চোখে নবনীতার দিকে তাকায়।নবনীতার চোখ দু’টো রাগে কষ্টে মনের দুঃখে একটু পর পর আর্দ্র হয়ে যাচ্ছিল।সহ্যেরও একটা সীমা থাকে।আর কতো ধৈর্য ধরতে হবে তাকে?সে চুপচাপ মাথা নামিয়ে নেয়।তার সত্যিই বুকে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।এই ব্যথার নাম কি?কে জানে!

আরহাম তার এই কাঁদো কাঁদো মুখশ্রীর তোয়াক্কা করল না।সে কল কেটেই ফোনটা বিছানায় আস্তে করে ছুড়ে মারল।আরো কিছুক্ষণ বাতাস খেয়ে পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়ালো।বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নবনীতার কাছটায় এসে বলল,’মন খারাপের কিছু নেই।আমার সাথে সংসার করতে হলে এসব মানিয়ে নিতে হবে।আমি যথেষ্ট ছাড় দিয়েছি তোমায়।এর চেয়ে বেশি সম্ভব না।’

কথা শেষ করেই সে হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।সে যাওয়ার পরেও নবনীতা কয়েক মিনিট সটান দাঁড়িয়ে রইল।একটু হুশ ফিরতেই ধপ করে খাটে গিয়ে বসল।কেবল কলিগরা একসাথে ঘুরতে যেতে চেয়েছে বলে এতো কথা?নবনীতা কি এতোই উড়নচণ্ডী যে বর তাকে শাসনে বেধেছে?কবেই বা সে এমন সমবয়সীদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে গিয়েছে?রিমি ছাড়া তো সে তেমন কারো সাথেই মিশে না।

সে চুপচাপ খাটে গিয়ে শোয়।চাদর খাঁমচে ধরে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে কান্না গিলে।সবকিছু কেমন অসহ্য লাগছে।মানুষটা এতো অদ্ভুত কেন?একটু ভালো লাগতেই পরমুহূর্তে এমন একটা কাজ করে যেটা এক নিমিষেই ভালো লাগা টুকু গায়েব করে দেয়।

আরহাম সব কাজ শেষে বাড়ি ফিরল রাত দশটায়।এসেই বড়ো বড়ো পা ফেলে নবনীতার ঘরে আসলো।আসতেই দেখল নবনীতা চিত্রাকে সাথে নিয়ে শুয়ে শুয়ে ফোন দেখছে।

নবনীতা আরহামের অস্তিত্ব টের পেতেই নড়েচড়ে উঠে।অন্যমনস্ক চোখে এদিক সেদিক দেখে।আরহাম চিত্রার গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,’চিত্র! যাও তো।তুমি বসার ঘরে গিয়ে আপাইয়ের ফোন দেখ যাও।’

চিত্রা ফোন নেওয়ার আগেই নবনীতা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়।চোখ পাকিয়ে কড়া গলায় ধমকে উঠে,’একদম ফোনে হাত দিবে না।আমার ফোন কি কোনো সরকারি সম্পদ?’

আরহাম আড়চোখে তাকে দেখল।কথাটা চিত্রকে বললেও আসল উদ্দেশ্য যে আরহামকে শোনানো,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।সে ভয় পাওয়ার ভান করে বলল,’বাপরে! ম্যাডাম দেখি হেব্বি ক্ষেপেছে!’

সে তার পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে চিত্রার হাতে তুলে নিয়ে বলল,’যাও চিত্র।তুমি ভাইয়ার ফোনে গেমস খেল।নাও।’

চিত্রা ফোন হাতে পেয়েই মহাসুখে এক দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।নবনীতা অন্যদিকে চোখ সরিয়ে গজরাতে গজরাতে বলল,’চিত্র কিন্তু নষ্ট হচ্ছে এসব করে করে।সারাক্ষণ ফোন হাতে থাকলে অল্পতেই পেকে যাবে।’

আরহাম স্মিত হেসে নবনীতার আরেকটু কাছাকাছি এসে বসল।গাঢ় স্বরে ডাকল,’পরী!’

নবনীতা এক দৃষ্টিতে সিলিং দেখতে দেখতে জবাব দেয়,’কি?’

‘রাগ হয়েছ?’

‘নাহ।’

আরহাম ডান হাত দিয়ে তার কবজি চেপে ধরল।নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে বলল,’আবার কি?’

আরহাম দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’চলো আমরা ঘুরতে বের হই।’

নবনীতা হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠে,’কিসব যা তা বলছেন?কোথায় যাব আমরা?’

‘কেন?তারা যেখানে গিয়েছে সেখানে যাব।কলিগদের সাথে যেতে পারো নি,বরের সাথে যাবে।সমস্যা কি?’

নবনীতা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যপাশে ফিরে কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়,’প্রয়োজন নেই।আমি কোথাও যেতে চাই না।’

আরহাম কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে আধশোয়া হয়।গম্ভীর কিন্তু অমায়িক কন্ঠে বলে উঠে,’আহা! রাগ হচ্ছো কেন?চলো না।শাড়ি তো পরাই আছে।চট করে একটা রাইড দিয়ে আসি চলো।’

‘দরকার নেই।’

‘দরকার আছে।’

নবনীতা উত্তর না দিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে নেয়।তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।অদ্ভুত! সে কি কচি খুকি হয়ে যাচ্ছে আজকাল?এইটুকু সামান্য বিষয়ে তো চিত্রাও কাঁদে না,অথচ তার কান্না পাচ্ছে।

আরহাম ঝুকে এসে তার মুখটা দেখতেই চমকে উঠে বলল,’সর্বনাশ! তুমি কাঁদছো পরী?’

নবনীতা চোখ মুছে।দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,’না তো।কাঁদছি না।পাগল নাকি?’

আরহাম খাট থেকে উঠে এসে তার মুখোমুখি গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে।আলতো হাতে তার হাত চেপে ধরে কন্ঠে কিছুটা মধু মিশিয়ে বলে,’রাগ হয়েছ পরী?আচ্ছা যাও সরি।বাট মাই ইনটেনশন ওয়াজ নট রং।আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না পরী।’

নবনীতা নাক টানতে টানতে বলল,’বচনভঙ্গি বলতেও একটা শব্দ আছে আরহাম।আপনি ভীষণ রুড।প্রচন্ড খ্যাটখ্যাটে স্বভাবের।’

আরহাম হাসল।হাসতে হাসতেই জানতে চাইল,’আর তুমি?তুমি কেমন স্বভাবের?’

‘জানি না।তবে আপনার চেয়ে ভালো।’

আরহাম তার হাত দু’টো আরো একটু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,’চলো।এখন যাই।মন ভালো হবে।’

নবনীতা দ্রুত মাথা নাড়ে।ব্যস্ত হয়ে বলে,’না না প্লিজ।এখন আর ইচ্ছে হচ্ছে না।’

আরহাম আর জোর করল না।উল্টো জানতে চাইল,’খেয়েছ?’

‘নাহ’

‘চলো খাবো।’

‘আচ্ছা’

নবনীতা চুপচাপ উঠে গিয়ে টেবিলে খাবার বেড়ে দেয়।সবাইকে খাইয়ে দিয়ে সব কিছু গুছিয়ে নিজের ঘরে আসতে আসতে প্রায় বারোটার উপরে বাজল।সে ঘরে আসলো হাই তুলতে তুলতে।প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে।আলসেমি তে সে গায়ের শাড়িটাও খুলে নি।সে খাটে বসেই খোপা খুলে দিয়ে সমস্ত চুল উন্মুক্ত করল।আরহাম গালের নিচে হাত রেখে ড্যাব ড্যাব করে কয়েক পল তাকে দেখে।

নবনীতা বালিশের উপর সমস্ত চুল ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।প্রায় মিনিট পাঁচেক পর আরহাম নিজ থেকেই ডাকল,’পরী!’

অন্য পাশ থেকে আগের মতোই ঠান্ডা গলায় জবাব আসে,’জ্বী?’

‘বিং প্রোটেক্টিভ ডাজ নট মিন বিং টক্সিক।আমি আমার ফ্যামিলি কে একটা সেফ জোনে রাখতে চাই।এটা নিশ্চয়ই মন্দ কিছু না।তাই না?’

নবনীতা সাথে সাথে উত্তর দেয়,’কিন্তু আপনার বলার টোন টা খুবই হার্শ।’

‘আচ্ছা যাও।এখন থেকে এভাবে বলব না।কিন্তু তুমিও কথা দাও তুমি এখন থেকে আমার অনুমতি বাদে যখন তখন বাড়ি থেকে বের হবে না।’

নবনীতা হতাশ ভঙ্গিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,’ঠিক আছে।যেমনটা আপনি বলবেন।’

সে ঘুমিয়ে পড়ল কয়েক মিনিটের ব্যবধানে।অথচ আরহাম জেগে থাকল আরো দীর্ঘসময়।নবনীতার ঘুম গাঢ়।এটা আরহাম আগেই টের পেয়েছে।সে ঘুমিয়ে পড়তেই আরহাম এক হাতে তার ডান হাতটা নিজের হাতে নেয়।বালিশের উপর তার চুল ছড়িয়ে রাখা ছিল।আরহাম অন্যহাত দিয়ে তার চুলে আঙুল চালায়।গভীর ঘুমে অসাড় রমণীর সুশ্রী মায়াভরা মুখশ্রী দেখেই সে স্মিত হাসল।অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে বিড়বিড় করে বলল,’দুঃখীত পরী।এ জীবনেও তোমাকে সেরকম স্বাধীনতা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।আমার কিছু এথিকস আছে।আই ক্যান নট ওভারলুক দ্যাম।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২৯

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২৯)

আকাশে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে।সেই গর্জন খানিক বাদেই বর্ষণ রূপে ধরণী কোলে নেমে এলো।সময়টা শরৎের শুরুর দিকে হলেও বর্ষার আধিপত্য তখনও বিরাজমান।রাত বাড়তেই আকাশ কালো করে মেঘ জমলো।এগারোটা নাগাদ সেই মেঘ বৃষ্টিরূপে ঝর ঝর করে ভূপৃষ্ঠে নেমে এলো।

নবনীতা জানালায় মুখ নিয়ে সেই বৃষ্টি দেখে।ক্ষনিকের ব্যবধানে রীতিমতো ঝড় শুরু হয়েছে।দূরের নারিকেল গাছটা বাতাসের দাপটে একেবারে কয়েক ফুট পর্যন্ত নিচে নুয়ে এলো।নবনীতা উদ্বিগ্ন হয়ে বাইরে তাকায়।এই কিছুক্ষণ আগেই আরহাম বেড়িয়েছে বাড়ি থেকে।

তার গাড়ি দুপুরের দিকেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।সেটা মেকানিকের কাছে পাঠিয়ে সে অন্য গাড়ি দিয়ে এখানে এসেছিল।সেই গাড়িটা পরে আবার আরিশের ভার্সিটিতে গিয়েছে তাকে আনতে।

নবনীতা চিন্তিত হয়ে নিজের দু’হাত কচলায়।আরহাম তো গাড়ি সব পাঠিয়ে দিয়েছে।এই ঝড়ের মাঝে সে যাবে কেমন করে?নবনীতা একবার জানালা দিয়ে নিচে উঁকি দেয়।বিল্ডিংয়ের খোলা জায়গায় একবার আরহাম কে খোঁজার চেষ্টা করে।প্রথম বারে সে তাকে দেখতে পায়নি।অন্য জানালা দিয়ে খোঁজার পর সে তাকে খুঁজে পেয়েছে।বেচারা ঝুম বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে কাউকে ফোন দিচ্ছিল।নবনীতা মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করে।এভাবে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকার কি প্রয়োজন?পার্কিং এরিয়ার ভেতরে ঢুকে গেলেই তো পারে।নবনীতা একবার এগিয়ে যায় দরজার দিকে।তারপর আবার হনহনিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে।ডেকে আনলে ঐ লোকের ভাব বেড়ে যাবে।ভিজুক গিয়ে বৃষ্টির পানিতে।তার কি?

আরহাম কাকভেজা হয়ে আরো একবার রোকনের নম্বরে ডায়াল করল।রোকন জসিম কাকার বড় ছেলে।সে মূলত বাড়ির গাড়ি ড্রাইভ করে।আরহাম তাকে কল দিয়েই খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল,’কোথায় তুই রোকন?’

রোকন কল রিসিভ করেই বলল,’ভাই আমি একদম গেইটের সামনে।ভেতরে আসছি।’

আরহাম তাকে বাধা দিয়ে বলল,’থাক আর দরকার নেই।এমনেই ভিজে গেছি।তুই থাক।আমি আসি।’

সে কল কেটে সামনে এগিয়ে যায়।আচমকা পেছন থেকে সুমিষ্ট নারীকন্ঠ ভেসে আসে,’এ্যাই শুনুন।’

আরহাম পেছন ফিরে।দেখতে পায় পার্কিং এরিয়ার একপ্রান্তে নবনীতা দাঁড়িয়ে আছে।তার হাতে একটা ছাতা।সে সেটা খুলে আরহামের দিকে এগিয়ে গেল।ছাতাটা আরহামের মাথার উপর ধরে খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল,’কোথায় যাচ্ছেন আপনি?আপনার গাড়ি না নষ্ট?’

আরহাম প্রথম কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকে দেখে।পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে।তারপরই হাসি মুখে বলে,’হু।নষ্ট।আমি ক্যাব বুক করে যাবো।’

নবনীতা ছাতার নিচ থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে বৃষ্টির গতি দেখে।তারপর আরো একবার আরহামের দিকে তাকায়।একটা বাক্য গলা পর্যন্ত এসে আটকে আছে।সেটা মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।সে কিছুক্ষণ ইতিউতি করে শেষ পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করে বলল,’এই ঝড়ের মাঝে আর ক্যাব ট্যাব বুক করতে হবে না।ঘরে আসুন।’

আরহাম বিস্ফারিত নয়নে তাকে দেখে।মুহুর্তেই তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।সে দুই ঠোঁটের মাঝে সে হাসি ঝুলিয়ে গর্ব করে বলল,’জানতাম।জানতাম তুমি আমায় ফিরিয়ে নিতে আসবা।আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব না।তুমি কেন,আমাকে কেউই এমন অপমান করে তাড়িয়ে দিতে পারে না।’

নবনীতা হতাশ চোখে তাকে দেখে।এর কথার জবাব দিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানে নেই।মানুষ নিজেকে নিয়ে দুই রকম কম্পেক্সিটি তে ভুগে।হয় সুপেরিয়র,নয়তো ইনফেরিয়র।আরহাম ভুগছে সুপেরিয়র কম্পেক্সিটি তে।যেখানে সবকিছুতেই তার নিজেকে সেরা মনে হয়।

সে খুব সাবলীল ভঙ্গিতে আরহামের হাতের কবজি চেপে ধরে তাকে পার্কিং এরিয়ার ভেতরে নিয়ে এলো।তারপর ছাতা বন্ধ করে চুপচাপ লিফটের দিকে এগিয়ে গেল।

সে লিফটের বাটন চাপতেই আরহামের মুঠোফোন যান্ত্রিক শব্দে বেজে উঠে।আরহাম তড়িঘড়ি করে কলটা রিসিভ করেই কানে চেপে ধরে।অন্যপাশ থেকে রোকন উদ্বিগ্ন হয়ে বলছে,’ভাইয়া আপনি কোথায়?’

আরহাম মুঠোফোন টা নিজের আরো কাছাকাছি এনে চাপা স্বরে বলে উঠল,’আমি আজ বাড়ি যাব না রোকন।তুই যেই পথে এসেছিস,ঐ পথেই ফিরে যা।আর কোনো প্রশ্ন করবি না বাল।’

বলেই সে কল কেটে দেয়।কিসের রোকন কিসের কি?বউ বলেছে বাড়ি আসতে।আরহাম তাকে কেমন করে মানা করবে?সে তো খুব ভদ্র মানুষ।মুখের উপর কাউকে মানা করা তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ।

সে খুশি মনে লিফটে এসে নবনীতার পাশাপাশি দাঁড়ালো।নবনীতা তাকে উপরনিচ থেকে সন্দিহান হয়ে বলল,’সব তো ভিজিয়েছেন।পরার মতো আর কোনো কাপড় আছে?’

আরহাম হাই তুলতে তুলতে জবাব দেয়,’সব আছে।তুমি কি আলমারি খুলো নি?’

‘খুলেছি।তবে আপনার কাপড়ে হাত দেইনি।’

সে থামে।পুনরায় নিজ থেকে প্রশ্ন করে,’কবে এনেছেন এগুলা?’

আরহাম চোখ বন্ধ করে ম’রার ভান করে বলল,’তুমি যখন ফিফটি পার্সেন্ট ম’রে গিয়েছিলে,তখন এনেছি এসব।’

নবনীতা কড়া চোখে একবার তার দিকে তাকায়।থমথমে মুখে জানতে চায়,’এটা কোনো মজা করার জিনিস?’

আরহাম জিভ কাটে।ফিচেল হেসে বলে,’সরি সরি।জাস্ট জোকিং।’

লিফট টেনথ ফ্লোরে আসতেই নবনীতা বড় বড় পা ফেলে নিজের এপার্টমেন্টে ঢুকে গেল।আরহাম একটু গা ঝেড়ে গায়ের অতিরিক্ত পানি টা মেঝেতে ফেলে তারপর ঘরে প্রবেশ করল।রুমে আসতেই নবনীতা তার তোয়ালে টা আরহামের দিকে বাড়িয়ে দিলো।খানিকটা জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’লাগবে?নাকি এটাও বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন?’

আরহাম এক টানে সেটা হাতে নেয়।গম্ভীর মুখে বলে,’না আনি নি।’

সে ওয়াশরুমে গিয়েই বেসিনের কল ছেড়ে আঁতকে উঠে।দ্রুত বেরিয়ে এসে বড়ো বড়ো চোখ করে বলে,’সর্বনাশ! গিজার নেই?’

নবনীতা বাঁকা চোখে তাকে দেখল।অলস ভঙ্গিতে জবাব দিলো,’জ্বী না জনাব।গিজার ফিজার নেই।বালতি আর মগ যে আছে সেটাই আপনার ভাগ্য।’

আরহাম আতঙ্কিত মুখে বলল,’এই পানিতে গোসল করলে আমি ম’রে যাবো পরী।’

নবনীতা খাট ঝাড়ার ফাঁকে একনজর তাকে দেখে শান্ত গলায় জবাব দেয়,’ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে কেউ ম’রে না।’

‘তবুও।মারাত্মক ঠান্ডা।তুমি ধরে দেখ একবার।’

নবনীতা এগিয়ে এসে পানি ধরল না।উল্টো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সোজা।আরহাম ভড়কে গিয়ে নিজে নিজে বলে উঠল,’কিরে ভাই! পাত্তাই দিলো না।’

সে আরেক দফা পানি ছেড়ে হাত ভিজিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলো।তার পক্ষে এই পানিতে গোসল করা সম্ভব না।সে বেরিয়ে এসেই কাউকে ফোন দিলো।মৃদুস্বরে জানতে চাইল,’অবস্থা কি?’

অপর পাশ থেকে ভরাট গলায় জবাব এলো,’এখনো মরে নি।’

আরহাম ক্রুর হেসে প্রতিউত্তর করে,’থাক।জানে মা’রিস না।বাঁ’চিয়ে রেখে একটু কষ্ট দে।ম’রে গেলে আবার ঝামেলা।’

সে নিঃশব্দে ফোনটা কেটে সাইড বক্সের উপর রাখে।কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই ঘুরে দাঁড়ায়।নবনীতা এসেছে।তার হাতে একটা পাতিল।পাতিলের পানি থেকে ধোঁয়া উঠে চারপাশ ঘোলা হয়ে যাচ্ছে।নবনীতা সেই পানিটুকু বালতি তে গিয়ে ঢাললো।আরহাম তার পেছনে এসে প্রশ্ন করল,’এসব কি?’

নবনীতা ক্লান্ত স্বরে জবাব দেয়,’নিন।পানি গরম করে দিয়েছি।এটা দিয়ে গোসল করে নিন।’

আরহাম পানি থেকে ওঠা ধোঁয়া দেখেই বলল,’সাংঘাতিক! এই পানিতে তো আমার গা পু’ড়ে যাবে।’

নবনীতা কটমট চোখে তার দিকে তাকায়।চটে যাওয়া মেজাজে উত্তর দেয়,’অদ্ভুত তো! সাথে ঠান্ডা পানি মিক্স করে নিবেন।কমন সেন্স নেই নাকি?’

আরহাম ফিচেল হাসে।মনে মনে জবাব দেয়,’আছে।সবই আছে।কিন্তু তোমায় ক্ষেপাতে ভালো লাগে।’

সে আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।নবনীতা পা বাড়ায় রান্নাঘরের দিকে।সারাদিনে একবারও মামির কথা মনে হয় না।কেবল রান্নাঘরে পা দিলেই তার কথা মনে আসে।মনে হয় এই একটা কাজ তো ছিল যেটা মামি থাকলে তার করা লাগতো না।এখন সবকিছু সামলে রান্নাবান্না করতে সে হিমশিম খাচ্ছে।যা বানায় সেটাই খাওয়ার অযোগ্য হয়।সে করবে টা কি?

আরহাম বেরিয়ে এসেই চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে গেল।নবনীতা চুপচাপ খাটে এসে বসে।বিয়ের দিন সে বসে বসে ঘুমিয়েছে।এরপর কিছুদিন সে জ্বরের ঘোরে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়েছে।আজ সে একদম সুস্থ।বিয়ের পর এই প্রথম সে সজ্ঞানে আরহামের সাথে ঘুমাবে।

আরহাম খাটের অন্যপাশে বসতেই সে কোলবালিশ এনে খাটের ঠিক মাঝামাঝি রাখল।আরহাম সেটা দেখেই কপাল কুঁচকে বলল,’এটা আবার কেমন ফাইজলামি?তুমি কি হিন্দি সিরিয়ালের মতো কাজ কারবার শুরু করেছ নাকি?’

নবনীতা আশ্চর্য হয়ে উত্তর দেয়,’অদ্ভুত তো! আপনি রোজ রোজ খুঁজেন।তাই আগে থেকেই এনে দিলাম।’

‘ওহহ আচ্ছা।ধন্যবাদ।’

নবনীতা ঘরের এলইডি লাইট বন্ধ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।পাশ থেকে আরহাম গাঢ় স্বরে জানতে চায়,’ঔষধ খেয়েছ পরী?’

সে পাশ ফিরে।একনজর আরহাম কে দেখেই কিছুটা অবাক,কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে উত্তর দেয়,’না।ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘এখন খেয়ে নাও।’

‘ঠিক আছে।’

নবনীতা চুপচাপ উঠে গিয়ে ঔষধের বক্স টা হাতে নিল।হাতে নিয়েই আড়চোখে একবার আরহামকে দেখল।আরহামের কাছ থেকে এই ছোট্ট দায়িত্ববোধ টুকুও সে আশা করেনি।তার ঔষধ নিয়ে কেউ ভাববে,এমনটা আগে কখনো হয়নি।সে টের পায়,স্বামীর কাছ থেকে এই সামান্য যত্ন পেয়ে তার মন ভালো হয়ে গেছে।সে ঔষধ খেয়েই আবার চুপচাপ শুয়ে পড়ল।

রাতের মাঝামাঝি সময়ে আরহামের ক্রমাগত একের পর এক হাঁচির শব্দে নবনীতার ঘুম ভেঙে যায়।সে দ্রুত পাশ ফিরে।আরহাম আরেকটা হাঁচি দিয়েই নাক চেপে ধরে।দাঁত দাঁত পিষে একটা অশ্রাব্য গালি দেয়।নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকায়।আরহাম তাকে দেখতেই বিরক্ত হয়ে বলে,’এভাবে দেখছ কেন?হাঁচিকে গালি দিয়েছি,তোমাকে না।’

নবনীতা গম্ভীর হয়ে বলল,’সেই গালিতে হাঁচি অনেক অপমানবোধ করেছে।যতোসব।’

আরহাম আরো কয়েকটা হাঁচি দিলো।টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে নাক মুছে বলল,’শা’লার বৃষ্টি।বা’লের বৃষ্টি।’

নবনীতা চোখ মুখ খিঁচে ধরে উঠে যায়।দ্রুত পা চালিয়ে আবার রান্নাঘরে যায়।মিনিট দশেকের মাথায় চায়ের কাপ হাতে তার ঘরে আসে।এসেই কাপটা আরহামের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

আরহাম ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করে,’এটা আবার কি?’

‘আদা লেবুর চা।খেয়ে নিন।আরাম পাবেন।’

আরহাম চটপট সেটা হাতে নিল।নিয়েই চোখ তুলে নবনীতাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,’থ্যাংকস।আল্লাহ তোমার বরকে দীর্ঘজীবী করুক।’

বলেই সে চায়ের কাপে একটা চুমুক দেয়।প্রথম চুমুকেই সে নাক মুখ ছিটকে চেঁচিয়ে উঠে,’ইসসস ছি! কি বানিয়েছ এসব?এটা তোমার মুখের ভাষার চেয়েও তিতা।ইসসস! বমি পাচ্ছে আমার।’

নবনীতা বুকে হাত বেঁধে নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,’আদা লেবুর চা এমনই হয়।এটা তো কেউ মজার জন্য খায় না।সুস্থ হওয়ার জন্য খায়।’

আরহাম তার একহাত ধরে কাপটা তার হাতে তুলে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,’তুমি খাও এসব।আমি প্রয়োজনে দেরিতে সুস্থ হবো,তাও এই অখাদ্য খাবো না।’

বলেই সে পুনরায় শোয়ার জন্য উদ্যত হয়।নবনীতা তার অন্য হাত দিয়ে খপ করে আরহামের বাহু চেপে ধরে।চোখ পাকিয়ে রাগী স্বরে বলে,’খেতে হবে।কষ্ট করে বানিয়েছি না?নিন খেয়ে নিন।না খেলে কষ্ট পাব।’

আরহাম চোখ সরু করে প্রশ্ন ছুড়ে,’তুমি কষ্ট পেলে আমার কি?যাও কতোক্ষণ কান্না করো।’

নবনীতা থমথমে মুখে বলল,’এটা না খেলে বাকি রাত এমন হাঁচি দিতে থাকবেন।এই হাঁচিতে আমার ঘুম হবে না।নিন এটা খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।’

আরহাম চুপচাপ লটকানো মুখে কাপটা হাতে নেয়।নবনীতা শান্ত গলায় বলল,’নাক বন্ধ করে একটানে খেয়ে নিন।এতো খারাপ লাগবে না আর।’

আরহাম তার কথা মতো শ্বাস বন্ধ করে একটা চুমুক দেয়।নাহ,আগের মতো জঘন্য লাগছে না।তবে শ্বাস ছাড়তেই আবার বিচ্ছিরি একটা গন্ধ নাকে এসে লাগছে।আরহাম নাক মুখ খিঁচে পুরোটা চা শেষ করল।পাশ ফিরতেই দেখল নবনীতা ঘুমিয়ে কাদা।

সে আনমনে হাসে।বিগত কয়েকদিন মেয়েটা তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে।আজকে মনে হয় না এমন কিছু হবে।কারণ আজকে সে নিজের আগের ফর্ম ফিরে পেয়েছে।সে এখন আর তার দিকে ফিরেও তাকাবে না।

আরহাম সাইডবক্সের উপর চায়ের কাপ টা রেখে এক হাতের উপর ভর দিয়ে সামান্য ঝুঁকে নবনীতা কে দেখে।দেখেই বিড়বিড় করে বলে,’ম্যাডাম মহা সুখে ঘুমাচ্ছে।’

সে আর রাত জাগলো না।কোলবালিশ টা জড়িয়ে ধরেই আরো কয়েকটা হাঁচি দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।কাল সকালে আবার এক জায়গায় যেতে হবে।সড়ক পরিদর্শন করতে।কি হাস্যকর ব্যাপার! রাস্তা হবে রাস্তার মতো।সে পরিদর্শন করে কি করবে?সে কি ইঞ্জিনিয়ার?নাকি মিস্ত্রি?
.
.
.
.
মাঝরাতের একটা ফোন কলেই ফাহাদ এক প্রকার ছুটতে ছুটতে হসপিটালে আসল।তাকে দেখতেই অন্যান্য ছেলেরা সরে দাঁড়ায়।সে এগিয়ে এসে একজনের কাছে জানতে চায়,’কি অবস্থা এখন মিলনের?’

তার সামনাসামনি দাঁড়ানো ছেলেটা মলিন মুখে জবাব দেয়,’খুব একটা ভালো না।’

‘হয়েছা টা কি?কিভাবে হলো এসব?’

‘আরহামের দলের ছেলেরা সন্ধ্যার দিকে তাকে ধরে নিয়ে গেছে।তারপর কয়েক ঘন্টা যাবত মে’রে মে’রে এই হাল করেছে।আমরা কয়েকজন যখন তাকে হসপিটালে নেওয়ার জন্য আনতে গিয়েছি তখন আমাদের শা’সিয়ে দিয়েছে।বলেছে ভুল করেও যেন তাদের ভাবির নামে কোনো নোংরা কথা না ছড়াই।’

ফাহাদ কথা শুনেই চিৎকার করে উঠে,’তারা এতো কিছু বলল,আর তোরা কি করছিলি?আঙুল চুসছিলি?’

ছেলেটা কাচুমাচু হয়ে জবাব দেয়,’আমরা কি করব ভাই?তাদের কাছে কতো রকমের অ’স্ত্র আছে।আরহাম তো তাদের সবকিছুর বৈধতা দিয়ে রেখেছে।এরা একেকজন নিজেকে মন্ত্রী মিনিস্টার ভাবা শুরু করেছে আজকাল।’

ফাহাদ দুই হাত মুঠ করে এগিয়ে যায়।মিলন কে আইসিইউ তে রাখা হয়েছে।ফাহাদ গলা উঁচু করে একবার ভেতরের দৃশ্য দেখে।দেখতেই সে আঁত’কে উঠে।আজ ক্ষমতা হাতে নেই বলে আরহাম যা খুশি তা করছে।

সে দেয়ালে একহাত রাখে।টেনে টেনে বড়ো করে দু’টো শ্বাস নেয়।হিংস্র শ্বাপদের ন্যায় ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,’কাজটা ভালো করিস নি আরহাম।সামান্য কারণে তুই র’ক্তপাত করেছিস।এই র’ক্তের বদলা আমি র’ক্ত দিয়েই নিব।’

বলেই সে একপেশে হাসল।ঠোঁটের কোণায় সেই সূক্ষ্ম হাসি ফুটিয়ে ভরাট স্বরে বলল,’তুই আমার শক্তিতে হাত দিয়েছিস।আমি তোর কলিজায় হাত দেব।আর যাই হোক,খু’নের হাত আমার তোর চাইতে বেশি পাকা।’

***

‘আমি আর এই চাকরি টা করব না আরহাম।’

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল আরহাম।তখনই নবনীতা তার পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়।আরহাম পাশ ফিরে তাকে দেখে।কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চায়,’কেন বলো তো?তোমাকে তো চেহারা দেখে চাকরি দেওয়া হয়নি।যোগ্যতা দেখেই দেওয়া হয়েছে।তাহলে সমস্যা টা কোথায়?’

‘সমস্যা আছে।আপনি বুঝবেন না।’

‘ঠিক আছে।তুমি যা ভালো মনে করো।রেজিগনেশন লেটার জমা দিয়ে দিয়ো।তারপর অন্য চাকরি খুঁজো।’

নবনীতা হতাশ হয়ে মাথা নামিয়ে নেয়।নিরেট স্বরে বলে,’বাড়িটাও আমি ছেড়ে দিতে চাই।’

আরহাম তার থেকে চোখ সরিয়ে সামনে দেখে।সূর্যের আঁচ একটু একটু করে বাড়ছে।আরহাম সামনে দেখতে দেখতেই জবাব দেয়,’বাড়ি ছেড়ে যাবে টা কোথায়?সবকিছুতে এতো ইগো দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই।’

‘ইগো না।বিষয়টা লজ্জার।’

‘কেমন লজ্জা?তুমি আমার মালিকানাধীন ফ্ল্যাটে থাকছো।এটা লজ্জার বিষয়?তাহলে আর বউ বলে পরিচয় দিও না।সেটাও লজ্জার।’

নবনীতা গম্ভীর হয়ে বলল,’মোটেই নিজেকে নিয়ে লজ্জা পাচ্ছি না।আমি এখানে একা থাকছি না।আমার পুরো পরিবার থাকছে।তাদের থাকার খরচা আপনি দিবেন এই বিষয়টা লজ্জার।’

নবনীতা কথা শেষ করেই ঘরে গিয়ে বসল।আরহাম আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেষটায় ধীর পায়ে ঘরে এসে নবনীতার থেকে সামান্য কিছুটা দূরে গিয়ে বসল।বসতেই গম্ভীর হয়ে বলল,’আমি তোমাকে একটা সাজেশন দিতে পারি।’

নবনীতা ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়,’সেটা কি?’

‘তুমি আপাতত কিছুদিন টাকার চিন্তা ছেড়ে দাও।আই মিন জব করো।বাট ইনকামের বিষয়টা নিয়ে ভেবো না।ভালো না লাগলে আমার অফিসের জবও ছেড়ে দাও।আপাতত এমন একটা চাকরি নাও যেটা কেবল তোমার হাত খরচের টাকা টা এনে দিবে।যেই চাকরি টা তোমাকে মানসিক প্রশান্তি এনে দিবে।চাকরির ফাঁকে একটু স্কিল ডেভেলপ করো।তারপর বড়ো কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে এপ্লাই করবে।এই ধরো আরো বছর দুয়েক পরে।ঐসব কোম্পানিতে বেতন হয় লাখের উপরে।তুমি তখন নিজের মতো করে চলবে।তোমার পরিবারের পুরো খরচা তুমিই বহন করবে।আপাতত আইনত অভিভাবক হিসেবে তোমার সকল দায়িত্ব আমি নিলাম।তোমার দায়িত্বের মধ্যে যেহেতু তোমার ফ্যামিলির দায়িত্ব আছে,তাই আমি সেই দায়িত্বও নিলাম।পার্মানেন্ট না।কিছুদিনের জন্য।তুমি তো মাত্র গ্রেজুয়েশন শেষ করেছ।দুই টা বছর সময় নেও।এই সময়টুকু আমি তোমার দায়িত্ব নিলাম আরকি।এরপর তুমিই সবকিছু সামলে নিও।ঠিক আছে?’

নবনীতা চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবলো।মাথা তুলে সন্দিহান গলায় বলল,’দুই বছর পর তো পরিস্থিতি এমন নাও থাকতে পারে।’

‘না থাকুক।তুমি বলো প্রস্তাব পছন্দ হয়েছে নাকি?’

নবনীতা হাই তুলতে তুলতে অলস গলায় জবাব দেয়,’অপছন্দ হলেও কিছু করার নেই।আপাতত এটাই মেনে নিতে হবে।’

আরহাম স্মিত হাসে।প্রসন্ন চিত্তে বলে উঠে,’এই যে বেয়াদবি না করলে তোমাকে কতো ভালো দেখায় জানো?সবসময় এমন আমার কথা শুনবে,বুঝেছ?মেয়ে মানুষ বেশি ফটর ফটর করলে আমার অসহ্য লাগে।’

নবনীতা তীর্যক চোখে তাকে দেখে।দাঁত কিড়মিড় করে শক্ত মুখ করে বলে,’আর ছেলেরা মেয়েদের এমন হেয় করলে আমার অসহ্য লাগে।’

আরহাম সে কথা গায়ে মাখল না।উল্টো সবকিছু উড়িয়ে দেওয়ার ভান করে উঠে দাঁড়ালো।নবনীতাকে সে আকাশ পরিমান স্বাধীনতা দিয়েছে।সে নিজের সব গোড়ামি থেকে বেরিয়ে তাকে চাকরির অনুমতি দিয়েছে।স্বামী হিসেবে এর চেয়ে বেশি করা তার পক্ষে সম্ভব না।নবনীতাকে সে অসম্ভব পছন্দ করে।কিন্তু সে ভেবে নিয়েছে সে কখনোই সেটা তাকে বুঝতে দিবে না।মেয়ে মানুষ অনুভূতি বুঝে নিলেই অপরপাশের মানুষটাকে পুতুলের মতো ব্যবহার করে।আরহাম কেন পুতুলের মতো ব্যবহৃত হবে?বাবা যেই ভুল করেছে আরহাম সে ভুল করবে না।

সে সামান্য কিছু খেয়েই তার কাজে বেরিয়ে পড়ল।তার হাঁচি কিছুটা কমেছে।তবে এখনো ঠান্ডা লেগে আছে।নাকের কাছটায় কিছু এতটা সুরসুরি দিচ্ছে।সব মিলিয়ে তার অসহ্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।

আরহাম বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই নবনীতা রান্নাঘরে গিয়ে আরো কয়েকটা পরোটা ভেজে নেয়।আরহাম কালকে রেডিমেড ফ্রোজেন পরোটাও এনেছে।নবনীতা যদিও সামনাসামনি কিছুটা বিরক্ত হয়েছে,কিন্তু মনে মনে সে খুশিই হয়েছে।তার অর্ধেক কষ্ট কমে গেছে।মাঝে মাঝে আরহাম এমন হাত ভরে ভরে খাবার আনলে মন্দ হয় না।

সে লক্ষ্য করছে ইদানিং সে আরহামের সাথে মেজাজ দেখাতে পারে না।রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের তার ভালো লাগে না।পুরোনো কিছু ঘটনার জের ধরে সে আরহামকেও খুব একটা পছন্দ করে না।কিন্তু তা স্বত্তেও আরহামকে তার আগের মতো বিরক্ত লাগে না।এর কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে।

সে অসুস্থ অবস্থায় আরহাম প্রায় সময়ই তার আশে পাশে থাকতো।নিজের রাজনৈতিক ব্যস্ততার মাঝেও সে মনে করে নবনীতার নিয়ম করে ঔষধ খাওয়ার ব্যাপার টি মাথায় রেখেছিল।রোজ রাতে সে অসংখ্য বার পাতলা কাপড় ভিজিয়ে তার মাথায় জলপট্টি দিয়ছে।এই সামান্য সহমর্মিতা টুকুও নবনীতার জন্য অনেক।এই এতো গুলো বছরে মামা বাদেও সে একজন অভিভাবক পেয়েছে।সেই অভিভাবক হয়তো নিরেট ভদ্রলোক না,কিন্তু নবনীতার তো তাকে মন্দ লাগছে না আজকাল।

দুপুরের একটু পরে রিমি বাড়ি এলো বিভাকে সঙ্গে করে।বিভা এখন মোটামুটি সবাইকেই চিনতে পারে।কিন্তু তার উচ্চারনে ভয়াবহ সমস্যা।সে আধো আধো বুলিতে অনেক কথা বলে।কিন্তু সেই কথা বুঝতেই নবনীতা আর রিমির বিশাল সময় লেগে যায়।

নবনীতা বিভাকে দেখতেই হাত বাড়ায়।হাসি হাসি মুখ করে বলে,’আসো তো বিভু।পরী আপুর কাছে আসো।’

বিভা এক ডাকেই ঝাপিয়ে তার কোলে এলো।নবনীতা টুপ করে তার গালে দু’টো চুমু খেয়ে বলল,’বলো তো আমার নাম কি?’

বিভা একটু ভাবে।পর পরই হাত নেড়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,’পয়ী।’

নবনীতা তার সম্বোধন শুনেই হেসে ফেলল।তারপর রিমির দিকে আঙুল তুলে বলল,’আর এটা?এটা কে?’

বিভা আগের মতো করেই জবাব দেয়,’লিমি।’

রিমি চোখ পাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,’ধ্যাত! এর উচ্চারনে অনেক সমস্যা।র আর ল গুলিয়ে ফেলে।স্কুলে না দিলে ঠিক হবে না।’

নবনীতা একগাল হাসল।বিভাকে কোল থেকে নামিয়ে খাটে রেখে বলল,’ব্যাপার না।আরেকটু বড় হোক।সব শিখে যাবে।’

চিত্রা গোল গোল চোখ করে একবার বিভাকে আর একবার তার আপাইকে দেখে।কোনো এক অজানা কারণে তার বিভাকে ভালো লাগে না।শুরুতে লাগত।সে নিজেই গিয়ে গিয়ে তাকে কোলে নিত।এখন আর লাগে না।বিভা তার সব খেলনায় হাত দেয়।এটা যদিও চিত্রা মেনে নিয়েছে।কিন্তু বিভা তার আদরেও ভাগ বসিয়েছে।এটা সে মানতে পারে না।

নবনীতা আর রিমি অন্য ঘরে যেতেই সে এক থাবায় নিজের কালার বক্স টা বিভার হাত থেকে কেড়ে নেয়।বিভা পিটপিট চোখে তাকে দেখে।আবারো এগিয়ে এসে তার কালার বক্সে হাত দেয়,চেষ্টা করে নিজের কাছে টেনে নিতে।চিত্রা বিরক্ত হয়ে তাকে ধাক্কা দেয়।মুহূর্তেই দু’জনের মাঝে হাতাহাতি শুরু হলো।শেষমেশ চিত্রা বিরক্ত হয়ে তার গালে একটা খাঁমচি দিলো।

এক খাঁমচি তেই বিভা ঠোঁট ভেঙে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।চিত্রা ভীষণ ভড়কায়।এইটুকুতেই কেঁদে দিলো?নবনীতা এক ছুটে ঘরে আসে।আঁতকে উঠে বলে,’কি হয়েছে সোনা?কে মেরেছে?’

____

দীর্ঘসময় ধরে কলিং বেল বেজে যাচ্ছে।ভেতরে নবনীতার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।অথচ কেউ দরজা খুলছে না।আরহাম বিরক্ত হয়ে আরো একবার বেল বাজায়।

দরজা খুলল আরেকটু পরে।দরজা খুলেছে রিমি।আরহাম কে দেখেই সে সৌজন্যসূচক হাসল।আরহাম ভেতরে এসে আশপাশ দেখে বলল,’ডন কোথায়?তার আওয়াজ পাচ্ছিলাম।’

রিমি চোখ দিয়ে ইশারা করে নবনীতার ঘরটা দেখায়।চাপা স্বরে বলে,’ডন আজকে হেব্বি রেগে আছে।’

‘কি বলো?কার উপর?’

‘চিত্র’

আরহাম হকচকায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’কিহ! চিত্র’র উপর?’

সে দ্রুত এগিয়ে যায় নবনীতার ঘরের দিকে।নবনীতা তার আওয়াজ শুনে মাত্রই ঘর থেকে বেরিয়েছিল।আরহাম তাকে দেখেই জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’হয়েছে টা কি?’

নবনীতা কোনো জবাব না দিয়ে তার হাত চেপে ধরে।তাকে টানতে টানতে নিজের রুমে নিতে নিতে বলে,’নিজেই দেখুন হয়েছে টা কি।’

ঘরে গিয়েই আরহামের চক্ষু চড়াকগাছ।চিত্রা ঘরের এক কোণায় কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখ ছলছল করছে।আরহাম দ্রুত তার কাছে এগিয়ে যায়।একটানে তাকে কোলে নিয়ে তার চোখ মুছে দিয়ে নবনীতার দিকে ফিরে আশ্চর্য হয়ে বলে,’এসব কি পরী?তুমি এইটুকু বাচ্চাকে পানিশমেন্ট কেন দিচ্ছো?’

নবনীতা গটগট করে হেঁটে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।কোমরে হাত রেখে বলে,’আপনার চিত্র কি করেছে শুনবেন?’

‘কি?’

নবনীতা বিভাকে সামনে এনে তার গালটা দেখিয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে বলল,’দেখুন।চিত্র সামান্য একটা কালার বক্সের জন্য তাকে খাঁমচি মেরেছে।আঁচড়ের দাগ বসিয়ে দিয়েছে বেয়াদব টা!’

আরহাম একবার বিভাকে দেখল।তারপরই চিত্রার দিকে ফিরে মন খারাপ করে বলল,’ভেরি ব্যাড চিত্র।বিভু কতো ব্যথা পেয়েছে বলো।’

নবনীতা এক টানে চিত্রাকে আরহামের কোল থেকে নামিয়ে নিচে এনে দাঁড় করায়।নামিয়েই আরহামকে চোখ রাঙানি দিয়ে বলে,’হয়েছে।এতো মিষ্টি মিষ্টি কথায় কাজ হবে না।চিত্র’র শাস্তি হচ্ছে সে আজকে আর আপনার কোলে উঠতে পারবে না।আপনি এখন থেকে শুধু বিভু কে আদর করবেন।’

আরহাম বিচলিত চোখে একবার বউকে,আরেকবার তার ছোট শ্যালিকা কে দেখে।চিত্রা নবনীতার কথা গ্রাহ্য না করে পুনরায় আরহামের দিকে ছুটে যায়।

সে আসার আগেই নবনীতা শক্ত করে আরহামকে জড়িয়ে ধরে তাকে চিত্রার কাছ থেকে আড়াল করে নেয়।জড়িয়ে ধরেই সে কড়া গলায় বলে,’না,আজ আর টুপ করে কোলে চড়তে দিব না।’

আরহাম ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে কতোক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।সে বাঁধা পড়েছে নবনীতার সুদৃঢ় হাতের বন্ধনে।এই একত্রিশ বছরের দীর্ঘ জীবনে এই প্রথম কোনো নারী কায়া তার এতো বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে।সে টের পায় মেয়েটির হৃদপিণ্ড ধুক ধুক শব্দে স্পন্দিত হচ্ছে।তার মাথা এসে ঠেকেছে আরহামের কাঁধের কাছে।অথচ তার সমস্ত মনোযোগ চিত্রার দিকে।চিত্রাকে আজ কিছুতেই সে আরহামের সাথে আহ্লাদ করতে দেবে না।

আরহাম বিমুগ্ধ চোখে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।তাকে জড়িয়ে ধরে রাখা মেয়েটি তার হাতের বন্ধন আরো জোরাল করে।আরহাম হাত বাড়িয়ে কেবল আলতো হাতে তার পিঠ ছোঁয়।চোখ মেলে মন ভরে আয়নার দৃশ্য টুকু দেখে।দৃশ্যটা চমৎকার।তার দেখতে ভালো লাগছে।চোখের ক্যামেরায় সে চটপট সেই দৃশ্যের ছবি তুলে নেয়,যেটা জীবনভর সংরক্ষিত থাকবে মন নামক মেমোরিতে।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২৮

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২৮)
[রিচেক নাই]

স্যাতস্যাতে একটা ঘর।বহুদিনের পরিত্যক্ত দালান।দালানের শৈবাল জন্মানো দেয়ালগুলো থেকে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ে।পুরো ঘরেই কেমন উটকো আর গুমোট গন্ধ।

ঘরটা খুব বেশি বড় না।আবার একেবারে আটসাটও না।ঘরে একটা জানালা আছে,লোহার শিক কাঠের কপাট।ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা চেয়ার।সেই চেয়ারে একজনকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে।তার দুই হাত পেছনের দিকে মুড়িয়ে তারপর বাঁধা হয়েছে।ছেলেটার মাথা নুয়ানো।মুখ দেখা যাচ্ছে না।পরনের সাদা রঙের গেঞ্জির জায়গায় জায়গায় ধুলো মেখে নোংরা দেখাচ্ছে।তার লম্বা মতোন শরীরটা কোনো এক অজানা আতঙ্কে একটু পর পর কেঁপে উঠছে থরথর করে।

তাকে এখানে এনে শুরুতেই কয়েক দফা চড় থাপ্পড় দেওয়া হয়েছে।তারপর থেকে দীর্ঘসময় সে এভাবেই আছে।ঘরে না কেউ আসছে,আর না তার হাতের বাঁধন খোলা হচ্ছে।

আরো অনেকটা সময় গড়ানোর পর ঘরের দরজা খুলল।মাথা ঝুকিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল একজন যুবক।চেয়ারে বেঁধে রাখা ছেলেটা কেবল তার পা জোড়া দেখল।মুখ তুলে আর চেহারা দেখার চেষ্টা করল না।সে জানে এটা কে।পা জোড়া এগিয়ে আসে তার দিকে।ছেলেটা টের পায় সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তার হৃদস্পন্দন বাড়ছে।তাকে কি আজ মে’রে ফেলবে?ফেলতেও পারে।অসম্ভব কিছু না।এদেশে সবই সম্ভব।

পা জোড়ার মালিক কাছাকাছি আসতেই কোনো কথা না বলে শুরুতেই ঠাটিয়ে তার দুই গালে দুইটা চড় বসায়।সেই শব্দ আসবাবপত্র বিহীন বন্ধ ঘরে বার কয়েক প্রতিধ্বনিত হয়।সে মাথা তুলে।সামনের ব্যক্তির হিংস্র মুখখানা একটি বারের জন্য অবলোকন করে।দু’জনের চোখ মিলতেই যুবকটি দাঁতে দাঁত পিষে গা’লি দেয়,’কু’ত্তার বাচ্চা একটা!’

নাফিস পুনরায় মাথা নামিয়ে নিল।দুই চড়েই তার মাথা ঘুরছে।আরহাম একহাতে তার কলার ধরে অন্যহাতে তার চুল মুঠ করে ধরে তার মাথা টেনে তুলে।থমথমে গলায় বলে,’আমাকে সেদিন তুই শরবত দিয়েছিলি তাই না?শরবতে কি ছিল সত্যি সত্যি বল তো।’

নাফিস জবাব না দিয়ে গোল গোল চোখে শুধু সামনে দেখে যায়।আরহামের মেজাজ বিগড়ায়।নিরবতার পুরষ্কার স্বরূপ নাফিজ পেল আরো একটি জোরাল প্রহার।আঘাতে আঘাতে তার শরীর অবসন্ন হতে শুরু করে,চোখ দু’টো বুজে আসে।কিন্তু তাতে কার কি?সামনে থাকা মানুষটা থোড়াই সেসব গায়ে মাখে।

আরহাম ধৈর্য ধারণে চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থ হয়ে দাঁত কিড়মিড় করে চেঁচিয়ে উঠে,’কু’ত্তার বাচ্চা! প্রশ্ন কানে যায় না?তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি।এতোক্ষণ কিন্তু হাতে মে’রেছি,মুখ না খুললে কিন্তু এরপর ডোজ বাড়াবো।দেখি,তাড়াতাড়ি বল তো।তোরও সময় বাঁচবে,আমারও।’

নাফিজ টেনে টেনে কয়েকবার শ্বাস নেয়।অস্ফুটস্বরে বলে,’জ্বী আমিই শরবত দিয়েছিলাম।’

আরহাম দুই হাত মুঠ করে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।ওয়াজিদ দরজা খুলে ভেতরে এসে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়।আরহামের কোনো ভরসা নাই।রাগের মাথায় সে যা-তা করে ফেলতে পারে।আশেপাশে কেউ না থাকলে সবকিছু ঘেটে ঘ বানাবে এই ছেলে।

আরহাম থমথমে গলায় প্রশ্ন করে,’শরবতে কি ছিলো?’

নাফিজ কিছু সময় নিরব থাকে।আরহাম তার চুল টেনে ধরে আবারো গর্জন করে বলে,’এ্যাই জানোয়ার! এক প্রশ্ন কয়বার করতে হয় তোকে?এরপরের বার একদম জানে মেরে দিব এক কথায় উত্তর না দিলে।’

নাফিজ টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে বলে,’কি ছিল জানি না।আমাকে শুধু মেশাতে বলা হয়েছিল।’

‘কে বলেছে?’

‘মিলন ভাই’

আরহাম ভ্রু কুঁচকায়।জানকে চায়,’কোন মিলন?ফাহাদের চ্যালা মিলন?’

‘জ্বি’

আরহাম দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে।ওয়াজিদ পেছন থেকে চাপা স্বরে বলে,’কোনো হাই পাওয়ারের ড্রাগস দিয়েছে সম্ভবত।ফাহাদের কাছে তো এসবের অভাব নেই।’

আরহাম ক্লান্ত হয়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।পুনরায় নাফিজ কে দেখে প্রশ্ন করে,’মিলন তোকে কি কি বলেছিল খুলে বল তো।’

নাফিজ পরাজিত সৈনিকের ন্যায় একে একে সব খুলে বলে।শেষটায় কাঁপা স্বরে বলে,’মিলন ভাই বলেছিল আপনাকে শরবত টা খাওয়াতে পারলে পাঁচ হাজার টাকা দিবে,আর নবনীতা আপুকে টিচার্স রুমে পাঠিয়ে দরজা বন্ধ করতে পারলে বাকি পাঁচ হাজার দিবে।’

আরহাম তার কথা শুনল।নাফিজের প্রতিটা বাক্যে,প্রতিটা শব্দে তার মাথায় খু’ন চেপে যাচ্ছিল।সে নাফিজের নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,’ব্যাস পাঁচ হাজার?এইটুকু টাকার লোভে এতো বড় অন্যায় করে ফেললি?একবার মনেও হয়নি যে ধরা খাবি?’

নাফিজ নিরুত্তর।সে জানত না আরহাম বিষয়টা নিয়ে এভাবে ঘাটাবে।কিংবা আরহাম তার চেহারা মনে রাখবে।অতো দূর পর্যন্ত ভাবলে সে নিশ্চয়ই এতো অবলীলায় এই কাজটা করত না।

আরহাম সজোরে তার গালের দুই পাশ চেপে ধরে ক্ষেপাটে সুরে বলল,’তোর এই সামান্য টাকার লোভে একটা মেয়ে কি পরিমান হেনস্তা হচ্ছে জানিস?বিনা দোষে মেয়েটা কি পরিমান মানসিক নিপীড়নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে একবার চিন্তা করেছিস?একটা মেয়ে,যার কোনো দোষ নেই,যে কিচ্ছু জানে না,যার কোনো রাজনৈতিক মোটিভ নেই,সেই মেয়েটাকে তুই কেবল পাঁচ পাঁচ দশ হাজারের জন্য এমন নরক যন্ত্রণা দিয়ে দিলি?জানিস ঐ মেয়েটা কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে?কেমন আছে?’

বলতে বলতেই তার মুখ র’ক্তিম হয়।মুখোভঙ্গি হয় আগের চেয়েও হিংস্র।ভালোমন্দ কিছু না ভেবেই সে সোজা নাফিজের গলা চে’পে ধরে।ক্রোধান্বিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠে,’একেবারে পুতে দেব শা’লা।শু’য়োর একটা।শুধুমাত্র তোর জন্য আজকে পরীর এই অবস্থা।ফাহাদ আর তার দলের ছেলেরা তো জানোয়ার।সেটা আগে থেকেই জানি।তুই কলেজের ছাত্র হয়ে ঐ কুকুরদের কথা কেন শুনেছিস?’

নাফিদ নিভু নিভু চোখে একটু সামনে তাকানোর চেষ্টা করে।তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না ঠিকঠাক।কেবল ঘট ঘট শব্দ হচ্ছে।তার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।ওয়াজিদ দ্রুত ছুটে যায় তাদের দিকে।আরহাম কে টেনে তার থেকে দূরে সরায়।খানিকটা ধমকের সুরে বলে,’হচ্ছে টা কি আরহাম?ছাড় ওকে।’

আরহাম হাত ছাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকে দেখল।ওয়াজিদ তার কাঁধে হাত রেখে বলল,’খামোখা মারামারি তে যাচ্ছিস কেন?এতে কি নবনীতার সম্মান ফিরে আসবে?যেটা করলে নবনীতা বেটার ফিল করবে সেটাই কর।’

আরহাম কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।ফুঁসতে থাকা শরীরটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়।গভীর চোখে একবার নাফিজ কে দেখেই সে বরফ শীতল কন্ঠে বলল,’আমাকে যা যা বলেছিস,পুরোটা কলেজ অথোরিটির সামনে গিয়ে আবার বলবি।যদি একটা শব্দও এদিক সেদিক করেছিস,তো দেখিস আমি তোর কি করি।’

সে একটু পিছিয়ে গেল।নাফিজ কে শেষ আরেকবার দেখেই নাক ছিটকে বলল,’শা’লা ছাচড়া! দশ হাজারের জন্য আমার পিছে লেগেছে।আমি কি এতোই সস্তা?’
.
.
.
.
সিটি কলেজের টিচার্স রুমে তখন মোটামুটি সব শিক্ষকই উপস্থিত ছিলেন।ক্লাস ইন্টারভাল চলছে।সবার সামনেই চায়ের কাপ রাখা।চুমুকে চুমুকে নানারকম আলোচনা চলছিল।মহিলা শিক্ষকরা এক জায়গায় জটলা বেঁধে গুনগুন করে যাচ্ছিল।ঠিক তখনই কলেজের পিয়ন কাদের একপ্রকার দৌঁড়ে দৌঁড়ে টিচার্স রুমে এলো।এসেই হড়বড় করে বলল,’আরহাম স্যার এসেছেন কলেজে।প্রিন্সিপাল স্যার বলেছেন সবাই কে ঠিক ঠাক হয়ে বসতে।উনি একটু পরেই এখানে আসবেন।’

মুহুর্তেই পুরো ঘরে সাড়া পড়ে গেল।আড্ডা ছেড়ে সবাই যে যার কাজে লেগে গেল।নিজেদের ডেস্ক গুছিয়ে পরিপাটি হয়ে যার যার চেয়ারে বসল।কোনো নোটিশ ছাড়াই কলেজে এমপি এসেছে,এটা মোটেই স্বাভাবিক ব্যাপার না।

আরহাম ধুপধাপ পায়ে টিচার্স রুমে প্রবেশ করল।তার পেছন পেছন আসলো কলেজ প্রিন্সিপাল আর তোফায়েল।তাকে দেখেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো।আরহাম সবার উদ্দেশ্যে ছোট করে সালামের জবাব দেয়।

কোনোরকম ভণিতা কিংবা মেকি সৌজন্যে না দেখিয়ে শুরুতেই সে প্রশ্ন ছুড়ে,’নিতু ম্যাডাম কে এখানে?’

পুরো রুমের শিক্ষকরা তার প্রশ্ন শুনেই ঘাড় ঘুরিয়ে একজনের দিকে তাকায়।তাদের সবার দৃষ্টি অনুসরণ করে আরহামও সেদিকে তাকায়।দেখতে পায় একজন অল্পবয়স্কা রমণীকে।যার পরণে সবুজ রঙের শাড়ি।সবার গোল গোল চোখ দেখে সে কিছুটা অপ্রস্তুত,আবার কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ।

আরহাম এগিয়ে যায় তার দিকে।ঠিক মুখোমুখি হতেই বুকে হাত বেঁধে জানতে চায়,’মিসেস নিতু সারোয়ার।আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?’

নিতু মাথা নামিয়েই মিনমিনে গলায় জবাব দেয়,জ্বী।

আরহাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।দুই হাত মুঠ করে ভেতরের ক্রোধটুকু হজম করে নেয়।ওয়াজিদ তাকে বার বার সাবধান করেছে কোনোরকম হঠকারিতা না করতে।সেও ভেবে নিয়েছে অকারণে সিন ক্রিয়েট করবে না।সে একজন পলিটিক্যাল পারসন,পাবলিক ফিগার।জনসম্মুখে যে কোনো কিছু তাকে ভেবে চিন্তে করতে হয়।সে মিসেস নিতুকে ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,’উনিশ তারিখ বিকেলে এই রুমে একটা ঘটনা ঘটেছিল।আপনি নিশ্চয়ই জানেন।’

নিতু বাড়তে থাকা হৃদস্পন্দন কে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে আনতে জবাব দেয়,’জ্বী।’

‘ওকে ফাইন।সেদিন অনেকেই টিচার্স রুমে এসেছিল।টিচার্স রুমে আমি আর আমার ওয়াইফ ছিলাম।আই ওয়াজ ড্রাঙ্ক এন্ড শী ওয়াজ টোটালি ফাইন।রাইট?’

নিতু এবার আর উত্তর দিলো না,উল্টো নামিয়ে রাখা মাথাটা আরো একটু নামিয়ে নিল।

আরহাম শক্ত মুখে পুনরায় ডাকল,’মিসেস নিতু!’

তার কন্ঠে যেই চাপা ধমক মিশে ছিল,সেই ধমকেই নিতু ঈষৎ কেঁপে উঠল।কাচুমাচু হয়ে বলল,’জ্বী স্যার।’

‘সেদিন সবাই দেখেছে।ইউ ওয়্যার ইন দ্যা সেইম রুম।এক ঘরে ছিলাম আমরা।কিন্তু আমরা কি খুব বেশি অপ্রীতিকর অবস্থায় ছিলাম?মাই হেড ওয়াজ অন হার শোল্ডার(আমার মাথা তার কাঁধে ছিল)।এই দৃশ্য তো পার্কে গেলে অহরহই দেখা যায়।এই সাধারণ বিষয়টি কে আপনি কতোখানি টেনেছেন আমি কি নিজের মুখে বলব নাকি আপনি নিজে বলবেন?’

অতিশয় শীতল কন্ঠের রেষানলে পড়ে নিতুর সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসে।তিরতির করে কাঁপতে থাকা শরীরটা সময়ের সাথে একেবারে ঠান্ডা হয়ে এলো।টের পেল গলা দিয়ে শব্দ আসছে না।বলার মতো কিছু তার কাছে নেই।

আরহাম তার থেকে চোখ সরিয়ে পুরো রুমে থাকা বাকি মানুষদের দেখে।খানিকটা উঁচু স্বরে বলে,’এই মহিলা,অর্থাৎ মিসেস নিতু ঠিক কারণে জানি না,সেদিনের ঘটনাকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে,রংচং মাখিয়ে এমন নোংরা ভাবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছে যে তার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল নবনীতা আর আমি কতো কিছুই না করে ফেলেছি।জাস্ট এক রুমে ছিলাম আমরা।এছাড়া নবনীতার সাথে এমন পরিস্থিতিতে কখনোই কোনোদিনই আমাদের দেখা যায়নি।কিন্তু মিসেস নিতুর ভাষ্য মতে নবনীতার এপার্টমেন্টে নাকি প্রায়শই আমার যাতায়াত হতো।আমি আর নবনীতা নাকি আগেও বহুবার ধরা খেয়েছি।লাইক সিরিয়াসলি?ধরা খেয়েছি মানে?আমরা কি চোর নাকি ডাকাত যে ধরা খাবো?শুধু তাই না।মিসেস নিতু সোশাল প্ল্যাটফর্মে এই কথাও বলেছেন যে নবনীতা নাকি সব নেতাদের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখে।সে নাকি,,,’

আরহাম আর বাক্যটা শেষ করতে পারল না।তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।সেসব ভাবলেই শরীর ঘিন ঘিন করে।সে নিজেকে আরেক দফা সামলে নিয়ে বলল,’একটা মেয়েকে অপদস্ত করতে ইচ্ছে হলো।আর যা নয় তাই বলে দিলাম।ব্যাস হয়ে গেল।তাই না?’

তোফায়েল বড় বড় চোখ করে তাকে দেখল।পুরোটা সময় আরহাম শুধু নবনীতাকে নিয়েই বলল।কোথায়,একবারো তো নিজের জন্য কিছু বলল না।অথচ বিয়ের আগে সে বলেছিল বউয়ের গুন গাওয়া ছেলেদের তার অসহ্য লাগে।অথচ অবাক করা ব্যাপার সে এখন নিজের বউয়ের গুনই গাইছে।

আরহাম নিজের চুল ঠিক করে।থমথমে আর পিনপতন নিরবতা বিরাজ করা কক্ষের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে গাঢ় স্বরে বলে,’একটি মেয়ে নিজের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে আছে।জীবনের বহু আনন্দের জলাঞ্জলি দিয়ে সে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে।সেই মেয়েটাকে চরিত্রহীনার তকমা দিয়ে পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া হলো।কেন?কারণ তার তো কেউ নেই।মা নেই,বাবা নেই কেউ নেই।তাই না?তাকে কে ডিফেন্ড করবে?যা মন চায় বলে দেই।আওয়াজ তোলার আছেই বা কে?’

রুম ভর্তি টিচাররা একবার চোখ তুলে তাকে দেখে।কেউ কেউ আশ্চর্য হয়ে তার কথা শুনে।পুরো রুমভর্তি মানুষদের আরো বেশি বিস্মিত করে দিয়ে আরহাম গাঢ় স্বরে বলে উঠে,’যারা মনে করে পরীর কেউ নেই,তাই তাকে যা খুশি বলা যাবে।তারা সবাই জেনে রাখুক পরীর জন্য আমি আছি।আমি পরীর হাসবেন্ড।আমার স্ত্রীর গায়ে কালি ছুড়লেই সে নোংরা হবে এটা ভাবার কোনোই কারণ নেই।পালক ছিঁড়ে ফেললেই ময়ুর কাক হয়ে যায় না,ডানা থাকলেই প্রজাপতি পাখি হয় না।যে যা সে তাই থাকে।’

প্রিন্সিপাল আকরামুল হক ব্যস্ত হয়ে তার দিকে এগিয়ে যান।অমায়িক স্বরে বলেন,’নবনীতা ম্যামকে তো কটু কথা বলার কোনো কারণ দেখছি না।সিসি টিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গেছে উনি রুমে ঢুকার পর নাফিজ নামের একটি ছেলে বাইরে থেকে তার দরজা বন্ধ করেছে।যেহেতু দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ছিল,সেক্ষেত্রে এসব কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না।’

আরহাম তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।পুনরায় মিসেস নিতুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে সতর্ক করে বলে,’আপনার চাকরি থাকবে নাকি থাকবে না জানি না।আমার মতে এমন গুজব ছড়ানো মানুষের চাকরি না থাকাই ভালো।যাকগে,আপনার চাকরি নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।কিন্তু আপনি যদি জনসম্মুখে এসে নিজের অপরাধ স্বীকার না করেন,তাহলে আমি আপনার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিব।’

নবনীতা কে নির্দোষ প্রমাণ করা খুব বেশি কঠিন ছিল না।সমস্ত কিছু নবনীতার পক্ষেই কথা বলছিল।নাফিজের অকপট স্বীকারোক্তি,মিসেস নিতুর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা,সিসি টিভি ফুটেজ অনুযায়ী নবনীতার সবকিছুর সাথে অসম্পৃক্ততা-সবকিছুই প্রমাণ করে দেয় নবনীতা নূরের নামে যা কিছু ছড়ানো হয়েছে তার সবটাই ভিত্তিহীন,বানোয়াট।পুরোটাই স্রেফ গুজব।

আরহাম সিটি কলেজে তার কাজ শেষ করেই আবার গাড়িতে উঠে। মোতাহের তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে নিজ থেকে বলে উঠে,’সমতট লেনে যাও মোতাহের।’

****

তিনদিন জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকার পর চতুর্থ দিন নবনীতা কিছুটা সুস্থ বোধ করল।এই তিনদিন সে হাতে গোনা কয়েকবার নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছে।তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য শাহানা খাতুন প্রায় প্রতিদিনই দুইবার করে তার বাসায় আসতেন।আরহামই তাকে এই কয়েকদিন নবনীতার খেয়াল রাখার দায়িত্ব দিয়েছে।

আগের দুই দিন তাকে স্যালাইন দিতে হয়েছিল।একবার অবশ্যও অক্সিজেনও নিতে হয়েছে।এখন সে কিছুটা সুস্থ।জ্বরও কমে গেছে অনেকটা।সে ঘুম ভাঙার পরেই তার পাশে শাহানা খাতুন কে দেখে ম্লান হাসল।অসুস্থ গলায় বলল,’আন্টি আপনি আজকেও এসেছেন?’

শাহানা খাতুন তার মাথায় হাত রাখেন।মিষ্টি স্বরে বললেন,’তুমি একেবারে চাঙা না হওয়া পর্যন্ত রোজই আসবো আমি।’

সেদিন বিকেলে নবনীতা নিজে নিজেই পুরো বাড়ি হাঁটার শক্তি পেল।শুভ্রা তখন তার কোচিং-এ,চিত্রা কে রিমি নিজের সাথে তার বাসায় নিয়ে গেছে দুপুরের দিকে।বলেছে সন্ধ্যার দিকেই আবার চলে আসবে।পুরো বাড়িতে কেবল নবনীতা আর সাদেক সাহেব বাদে আর কেউ নেই।নবনীতা বসার ঘরের সোফাতে চুপচাপ বসেছিল।তার মাথায় অসংখ্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল।তার কি করা উচিত এ নিয়ে সে দ্বিধান্বিত।রাগের বশে সে চাকরি ছেড়ে দিতে পারে,এপার্টমেন্ট ছেড়ে দিতে পারে।কিন্তু রাগ দিয়ে জীবন চলে না।সবকিছু ছেড়ে সে যাবে কোথায় এই চিন্তাও তার করতে হবে।এই জীবনটা তার হলেও এই জীবনের সব সিদ্ধান্ত সে নিজের মন মতো নিতে পারে না।তার সাথে আরো কয়েকটা প্রাণ জুড়ে আছে।যেই প্রাণগুলোর দায়িত্ব নবনীতা নিজের কাঁধে নিয়েছে।যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তার তাদের কথা ভাবতে হয়।

তার ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠে।নবনীতা কিছুটা চমকায়।এসময়ে কে আসবে?সে রুগ্ন শরীরটা কোনোরকমে টেনে টেনে দরজার কাছে যায়।আলতো হাতে লক ঘুরিয়ে দরজা খুলে।দরজার অন্য পাশে দাঁড়ানো মানুষদের দেখে সে আগের চেয়েও বেশি আশ্চর্য হয়।

লুবনা আর মিসেস ইয়াসমিন এসেছে তার এপার্টমেন্টে।তাকে দেখামাত্রই মিসেস ইয়াসমিন সবেগে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন।নবনীতা অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরায় কয়েক কদম পিছিয়ে গেল।পরক্ষণেই আবার তাল সামলাতে নিজেও তার পিঠে এক হাত রাখল।

মিসেস ইয়াসমিন জড়ানো গলায় বললেন,’নবনীতা,তুমি আমাকে ভুল বুঝো না মা।আমি তোমায় অনেক ভালো মন্দ বলে ফেলেছি।তাও কোনো যাচাই বাছাই ছাড়া।তুমি আমাকে মাফ করে দাও মা।আমি রাগের মাথায় একটা ভুল করে ফেলেছি।’

নবনীতা ফ্যালফ্যাল চোখে সবকিছু দেখে।মিসেস ইয়াসমিন তাকে ছেড়ে দিয়ে হাত জোড় করে মাফ চাইল।নবনীতা কেবল ক্লান্ত গলায় বলল,’মাফ চাওয়ার প্রয়োজন নেই আন্টি।এসব নিয়ে আর আমার কোনো অনুভূতি কাজ করে না।’

সে চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসে।লুবনা বসে তার ঠিক পাশে।তাকে দেখতেই লুবনা মলিন মুখে বলে,’প্লিজ আপু।আমার সাথে আর রাগ করে থেকো না প্লিজ।’

নবনীতা তার মাথায় হাত ছোঁয়ায়।মিষ্টি হেসে বলে,’না লুবনা।তোমার সাথে আমি কখনোই রাগ হয়নি।’

মিসেস ইয়াসমিন তার কাছে এগিয়ে এসে তার হাতে একটা আইসক্রিমের বক্স আর কয়েকটা মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন।নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলে এসব কি?
মিসেস ইয়াসমিন তার গালে হাত ছুঁয়িয়ে ভরাট গলায় বললেন,’বাহ রে! তোমার নতুন সংসারে কি খালি হাতে আসবো নাকি?যদিও খুব বেশি কিছু আনতে পারি নি।এই কয়েকটা জিনিসই এনেছি।’

নবনীতা ধিমি স্বরে প্রতিউত্তর করে,’এসবের কোনো দরকার ছিলো না আন্টি।’

মিসেস ইয়াসমিন জোরপূর্বক সবগুলো প্যাকেট তার হাতে চাপিয়ে দিলেন।প্রশস্ত হেসে প্রশ্ন করলেন,’বর কোথায়?’

নবনীতা প্রশ্ন শুনেই ভড়কে গেল।বর কোথায় সে জানে না।বরের সাথে তার কথা হয় নি।বর নিজের কথা ভেঙে রোজ রাতেই তার বাড়ি আসে।আর এসেই তার পাশাপাশি বালিশে হাত পা ছেড়ে ঘুমায়।সে এতোটাই অসুস্থ আর মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিল যে বরের সাথে এই নিয়ে ঝগড়া করারও সময় পায়নি।

সে অপ্রস্তুত হেসে জবাব দেয়,’এই তো আছে।কথা হয়নি আজ।’

সে তাদের সোফায় বসিয়ে রান্নঘরে গেল।বাড়িতে তো মনে হয় না কিছু আছে।কি খেতে দিবে তাদের?তাদের খাবারই তাদের খেতে দিবে?ছিহ! কি লজ্জার বিষয়!

‘হ্যালো সেনোরিটা!’

ডাক শুনেই পেছন ফিরে নবনীতা।অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ‘আপনি?’

আরহাম নিঃসংকোচে রান্নাঘরে এলো।জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’হ্যাঁ আমি।খবর পেলাম তুমি নাকি মুখে মুখে বেয়াদবি করার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছ? তাই চলে এলাম পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে।ভালো করেছি না বলো?’

নবনীতা কপাল কুঁচকায়।অন্যদিকে ফিরে বিরক্তি ধরা গলায় বলে উঠে,’খুব ভালো করেছেন।’

কথা শেষ করেই সে আরহামের হাতের খাবারের প্যাকেট গুলো দেখে।কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চায়,’এসব কি?’

আরহাম ঝটপট জবাব দেয়,’এসব খাবার।চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।’

নবনীতা অধৈর্য হয়ে বলল,’সেটা আমি জানি।কিন্তু এতো কিছু কার জন্য এনেছেন?’

‘আপাতত লুবনা আর তার মা কে দাও।বিকেলে শুভ্রা আর চিত্র বাড়ি এলে তাদের কেও দিবে।’

নবনীতা মুখের উপর কিছু বলতে গিয়েও আর বলল না।বসার ঘরে লুবনা আর মিসেস ইয়াসমিন অনেকক্ষণ যাবত বসে আছেন।সে তাড়াতাড়ি খাবার গুলো প্লেটে নিয়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।টি টেবিলে সেগুলো রেখে সে সোফায় গিয়ে বসল।আরহামও হেলেদুলে গুনগুন করে হেঁটে এসে ঠিক তার পাশটায় বসল।নবনীতা কটমট চোখে একবার তাকে দেখে।তার চোখ রাঙানিতে আর যাই হোক,শাহরিয়ার আরহাম বিচলিত হয় না।সে উল্টো আরো আয়েশ করে বসল।নবনীতা গোমড়া মুখ করে অল্প একটু সরে এলো।আরহাম কথার ফাঁকেই উঠে এসে পুনরায় সে দূরত্বটুকু মিলিয়ে নেয়।নবনীতা অগ্নিচোখে তাকে দেখে।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু।এখনো আগের হিসেব কিছু বাকি আছে।’

আরহাম সেসব উড়িয়ে দিয়ে এক গাল হেসে বলল,’বেশি বেশি করাই আমার স্বভাব।আর আগের হিসেব আমারও বাকি আছে।রাতে সব হিসেব হবে।এক চুলও ছাড় দেওয়া হবে না।’

‘সহমত।’

‘আমিও সহমত।’

লুবনা আর তার মা আরো কিছুক্ষণ থেকেই চলে গেল।শুভ্রা একটু আগে বাড়ি ফিরেছে।চিত্রা আর রিমি এখনো আসেনি।নবনীতাকে আরেক দফা বিস্মিত করে দিয়ে সে রাতে সিটি কলেজের প্রিন্সিপাল আর দু’জন শিক্ষক তার বাড়ি এলেন।একজনের নাম সুপর্ণা,অন্যজনের নাম নিতু।

প্রিন্সিপাল আকরামুল হক প্রচন্ড বিনয়ী ভঙ্গিতে তার কাছে ক্ষমা চাইলেন।নবনীতা লোকজনের এমন হঠাৎ পরিবর্তনে হকচকিয়ে যায়।সে দ্রুত হাত নেড়ে বলে,’না না প্লিজ।হাত জোড় করার কিছু নেই।আপনি আমার অনেক সিনিয়র।আপনার এসবের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই স্যার।’

‘না থাকুক।আমার কলেজে ঘটনা টা ঘটেছে।আমার আরো আগেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।যাই হোক,নাফিজ সবকিছু স্বীকার করেছে।নিতুও নিজের ভুল স্বীকার করেছে।আশা করি তোমাকে আর মিথ্যা অপবাদ নিয়ে চলতে হবে না।সত্যটা সবাই জেনে গেছে।তুমি কোনো অপরাধ করো নি নবনীতা।নিজেকে কখনোই সেরকম কিছু ভাববে না।তোমার জন্য আমার অনেক অনেক শুভকামনা।’

এতো কিছুর উত্তরে নবনীতা কেবল বোকা বোকা হাসে।জীবনটা হুট করেই রোলার কোস্টারের রাইডের মতো হয়ে গিয়েছে।হঠাৎ একেবারে একটার পর একটা ভালো ঘটনা তাকে খুশিতে আসমানে তুলে দিচ্ছে।তারপরই একটার পর একটা বাজে ঘটনা তাকে এক আছাড় দিয়ে জমিনে এনে ফালাচ্ছে।আপাতত সে আসমানে আছে।সন্ধ্যার পর পর একটার পর একটা মানুষ তার বাড়িতে আসতে থাকল।হাত জোড় করে নবনীতার কাছে ক্ষমা চাইল।অথচ নবনীতা এদের চিনেও না।এরা নিজেরাই নিজেদের ভুল স্বীকার করে মাফ চেয়েছে।নবনীতা আশ্চর্য হয়।এসব হচ্ছে টা কি?তার মতো এতো সাধারণ একটা মানুষের সাথে এতো নামি দামি লোকজন কেন দেখা করতে আসছে?এতো ভিআইপি ট্রিটমেন্টের যোগ্য তো সে না।সে সবাই কে ‘ইটস ওকে’ বলতে বলতে ক্লান্ত।শেষটায় সে শুধু সৌজন্যসূচক হেসে মাথা নাড়ল।আর কতোবার ইটস ওকে বলবে?

আরহাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার চোখে মুখের উজ্জ্বলতা দেখে।মলিন আর মূর্ছা যাওয়া মুখটা হঠাৎই কেমন আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে জ্বল জ্বল করছে।তার চোখের ঝলমলে দৃষ্টি বলে দিচ্ছে তার মন ভালো।আরহাম মন ভরে সে দৃশ্য দেখে।সে চায় তার মন সবসময়ই ভালো থাকুক।

সবাইকে বিদায় করার পর নবনীতা অবশিষ্ট খাবার গুলো সব টেবিলে বেড়ে দেয়।সবার খাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে সে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে গেল।ঘরে যেতেই সে দেখল আরহাম খাটের একপাশে শুয়ে আছে।তার হাতে ফোন।একমনে সে স্ক্রল করেই যাচ্ছে।

নবনীতা তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।চাপা স্বরে বলে,’কি সমস্যা আপনার?’

আরহাম স্ক্রিন থেকে চোখ সরায়।অবাক হয়ে শুধায়,’আমার আবার কিসের সমস্যা?’

‘আপনি এখানে শুয়ে আছেন কেন?’

‘তো কোথায় শুবো?’

‘অদ্ভুত! রোজ রোজ এদিকে কি?আপনার ফ্ল্যাট বলে যা খুশি করবেন নাকি?আপনি আপনার বাড়ি যান।’

আরহাম চোখ বড় বড় করে বলল,’এতো বড় অপমান! তুমি আমায় অপমান করছ?’

নবনীতা শান্ত চোখে তাকে দেখে।গম্ভীর মুখে জবাব দেয়,’জ্বী অপমান করছি।লজ্জা থাকলে এরপর থেকে যখন তখন বাড়ি আসবেন না,আর আমার খাটে ঘুমাবেন না।যান নিজের বাড়ি যান।’

আরহাম তৎক্ষনাৎ খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।দারাজ কন্ঠে বলল,’তুমি আমায় অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছ?’

নবনীতা খাটের এক কোণায় গিয়ে বসে দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’জ্বী তাড়িয়ে দিচ্ছি।মানসম্মান থাকলে আর এমন ডেইলি ডেইলি এখানে আসবেন না।’

আরহাম গজরাতে গজরাতে জবাব দেয়,’তুমি আমাকে এমন করে বলতে পারলে?যাও আর আসবো না।জীবনেও কোনোদিন এখানে পা দিবো না।তোমার এদিকে না আসলেই কি?আমার কি জায়গার অভাব আছে?’

‘সেটাই তো।অভাব নেই।তবুও কেন রোজ রোজ এখানে এসে বসে থাকেন বুঝি না।’

আরহাম চোখ পাকিয়ে তাকে দেখে।দরজার দিকে গিয়ে নবনীতাকে ডেকে বলে,’আমি কিন্তু চলে যাচ্ছি পরী।’

‘জ্বী যান।’

‘আর কখনো আসবো না কিন্তু।’

‘অনেক উপকার হবে।ধন্য হবো আমি।’

‘আমি সিরিয়াস।’

‘আমিও সিরিয়াস।এখন যান।’

আরহাম হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল।লিফটের বাটন চেপেই রাগে গজ গজ করে বলল,’যাহ আর আসবো না তোর ফ্ল্যাটে।ভালো ব্যবহার করি দেখে আমার কোনো দাম নাই।এবার আর ডাকলেও আসবো না।মরে ভূত হয়ে গেলেও আসবো না।কিছুতেই আসবো না।হুহ।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২৭

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২৭)

ভোরের একটু আগে নবনীতা সামান্য নড়েচড়ে উঠল।তার চঞ্চল চোখের পাতা দেখেই আরহাম নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়।চুপচাপ গিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে।চোখের উপর এক হাত রেখে আড়চোখে সেদিকে তাকায়।

নবনীতার ঘুম ভাঙতেই প্রথমে সে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজের অবস্থান অনুমান করল।তারপরই মাথা তুলে একনজর আরহাম কে দেখল।দেখেই হতাশার শ্বাস ছাড়ল।এখনও ঘুমুচ্ছে।একবারও কি ঘুম ভাঙে না এই লোকের?

হাতের অ্যালবাম টা আঁকড়ে ধরে সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই টের পেল তার পিঠের দিকটা অবশ হয়ে গেছে।নবনীতা উঠতে গিয়েও আর উঠতে পারল না।একহাতে ভর দিয়ে ধপ করে খাটে বসে পড়ল।পিঠ আর কোমরের ব্যথায় আনমনে মৃদু আর্তনাদ করল।

আরহাম চোখের সামনে থেকে হাত সরায়।ঘুম জড়ানো গলায় জানতে চায়,’কি হয়েছে?’

নবনীতা তার দিকে ফিরল।তাকে দেখতেই মুখ শক্ত করে বলল,’কি আর হবে?সকাল হচ্ছে।আর কিছু হয়নি।আপনি পড়ে পড়ে ঘুমান।যেই ঘুমের নমুনা! মানুষ ম’রলেও টের পাবেন না।’

আরহাম তার কথা শুনতেই ঠোঁট টিপে হাসে।অদ্ভুত! সে নিজেই চায় আরহাম যেন তার কাছ না ঘেঁষে।আবার নিজেই বলছে মরে গেলেও টের পাবে না।মেয়েরা আসলে চায় টা কি?

সে নবনীতার দিকে ফিরে জানতে চাইল,’এনি প্রবলেম?’

নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’নো।নো প্রবলেম।আপনি ঘুমান।’

কথা শেষ করেই সে উঠে দাঁড়ায়।অ্যালবাম টা স্বস্থানে রেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।সাদেক সাহেবের ঘর থেকে টুকটাক শব্দ আসছে।নবনীতা তার ঘরে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল,’মামা পানি কিন্তু খুব ঠান্ডা।আমি চুলায় পানি বসাচ্ছি।সেটা দিয়ে ওযু করবে।’
বলে আর সে উত্তরের অপেক্ষা করে না।রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে স্টোভ জ্বালিয়ে পাতিলে করে পানি বসায়।তারপর আবার ব্যস্ত পায়ে হেঁটে যায় শুভ্রার ঘরে।ঘরে উঁকি দিতেই সে দেখল ঘর একদম ফাঁকা।কপালে ভাঁজ পড়ে তার।কোথায় গেল এরা সবাই?

বসার ঘরে ফ্যান চলছে।নবনীতা দ্রুত সেখানে গেল।গিয়েই দেখল এরা সবাই কার্পেটের উপর তোশক আর চাদর বিছিয়ে ঘুমুচ্ছে।নবনীতা হাসি মুখ করে তাদের দেখল।একপাশে রিমি,তার পাশে শুভ্রা,শুভ্রার পাশে চিত্রা।চিত্রা আর বিভা পাশাপাশি।তাদের সাথে আরো একজন ছিল।তাকে দেখতেই নবনীতা কিছুটা চমকাল।আনমনে বিড়বিড় করল,’তাসনুভাও এসেছে?’

তাসনুভা ঘুমিয়েছে একেবারে একপাশে।মেয়েটার মুখটা দেখতে ভীষণ আদুরে লাগছে।নবনীতা সবাইকে ডিঙিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়।ঠিক তার শিয়রে গিয়ে বসে।হাত বাড়িয়ে তার চুলে বিলি কাটে।মেয়েটার সাথে তার অনেকদিন কথা হয় না।সে মেয়েটাকে ইদানিং এড়িয়ে যায়।অথচ এড়িয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।নবনীতার সমস্যা তার ভাইয়ের সাথে।তাসনুভা কি দোষ করেছে?তাসনুভা তো তাকে পছন্দ করে।একেবারে স্বচ্ছ তার অনুভূতি।নবনীতা আলতো করে তার কপালে চুমু খেল।সেও তো চিত্র আর শুভ্রার মতোই ভীষণ একা।কতো মিষ্টি একটা মেয়ে!

মিনিট দশেক বসে থাকার পর নবনীতা আবার রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়।পানি ফুটছে সম্ভবত।মামার ঘর পর্যন্ত গরম পানি পৌঁছে দিতে হবে।সে সবকিছু গুছিয়ে ওযু করল। বিয়ের পরদিন সকালে নামাজ পড়ে প্রার্থনা করলে দাম্পত্য জীবন সুখের হয়।এ কথা সে বহু মানুষের মুখে শুনেছে।তবে নবনীতা দাম্পত্য জীবন সুখী হওয়ার প্রার্থনা করে না।সুখী না হোক,কেবল সহনীয় হলেই হলো।কোনোরকমে এক ছাদের নিচে থাকতে পারলেই হবে।সুখ দিয়ে কি হবে?সেটা এমনিতেও তার জীবন থেকে নাই হয়ে গিয়েছে।

সে নামাজ শেষে কতোক্ষণ ইউটিউব ঘাটল।কি নাস্তা বানানো যায় মাথায় আসছে না।তাসনুভার পছন্দ কেমন সেটাও সে জানে না।তাসনুভা যেহেতু আজ প্রথম তার বাসায় থাকছে,তার উচিত তার পছন্দসই কিছু করা।শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নিল সে আলু পরোটা বানাবে।অনেক আগে একবার বানিয়েছিল,খুব একটা ভালো হয়নি।আজকে আবার চেষ্টা করবে।ভালো হলে তো হলোই,নয়তো মানিয়ে নিবে।

সে কেবলই ময়দার প্যাকেটে হাত দিয়েছে,তক্ষুনি কলিং বেল বেজে উঠল।নবনীতা এক দৌঁড়ে সেখানে যায়।ডোর ভিউয়ারে চোখ রেখে দরজার সামনে দাঁড়ানো মানুষটি কে দেখে।দেখতেই অবাক হয়ে বলে,’আদি ভাইয়া এসেছে! এতো সকালে!’

সে দ্রুত পেছন ফিরে রিমির কাছে যায়।হাঁটু মুড়ে বসে তাকে ঠেলতে ঠেলতে বলে,’এ্যাই রিমি ওঠ।আদি ভাইয়া এসেছে।ঘরের যা অবস্থা করেছিস! কোথায় বসাবো উনাকে?’

রিমি ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে।উঠেই এপাশ ওপাশ দেখে অস্থির হয়ে বলে,’কি হয়েছে?কে ম’রেছে?’

নবনীতা কপাল চাপড়ায়,’কেউ ম’রে নি।আদি ভাইয়া এসেছেন।ওঠ এখন।’

রিমি দ্রুত উঠে বসে।তার আর নবনীতার কথায় শুভ্রাও চোখ ডলতে ডলতে সামনে তাকায়।নবনীতা গাঢ় স্বরে বলে,’যা শুভি।নিজের ঘরে যা।’

শুভ্রা এক ডাকেই চুপচাপ ওঠে নিজের ঘরে চলে গেল।রিমি গেল ডাইনিং রুমে।সোফাতে বসতে না পারলেও চেয়ারে অন্তত বসতে পারবে আদি।

নবনীতা দরজা খুলতেই আদি তাকে দেখে প্রশস্ত হাসল।উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,’গুড মর্নিং নবনীতা!’

বিনিময়ে নবনীতাও এক গাল হাসল।দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,’আসুন ভাইয়া।ভেতরে আসুন।’

আদি ঘরে এসেই বসার ঘরের চিত্র দেখে অবাক হয়ে বলল,’তাসনুভা ফ্লোরে ঘুমিয়েছে কাল?’

নবনীতা এগিয়ে এসে মৃদু স্বরে বলল,’জ্বী ভাইয়া।কেন?ওর অভ্যাস নেই এসবে?’

‘নাহ।আরহামদের তো কখনো নিচে ঘুমাতে দেখিনি।যাকগে ব্যাপার না।সবাই মিলে ফ্লোরিং করে ঘুমানোর মজাই আলাদা।’

নবনীতা কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলল,’আসলে আমি জানতাম না তাসনুভা বাড়িতে আছে।তাহলে আমি অবশ্যই তাকে এভাবে রাখতাম না।’

আদি কিছুটা বিরক্ত হলো।কন্ঠে সেই বিরক্তি ধরে রেখেই বলল,’তুমি আবার এতো হেজিটেট করছ কেন?আমি অবাক হয়েছি,রাগ হইনি।’

কথা শেষ করেই সে ডায়নিং রুমে পা বাড়ায়।নবনীতা চুপচাপ তার পেছনে এসে দাঁড়ায়।রিমি তার হাত দেখেই অবাক হয়ে বলল,’সেকি! হাতে এসব কিসের প্যাকেট?’

আদি তার হাতের প্যাকেট গুলো টেবিলে রেখে নিরেট স্বরে বলল,’তোমাদের জন্য নাস্তা এনেছি।শারমিন খালা তো রাতেই চলে গিয়েছে।তাই ভাবলাম আমিই নাস্তা কিনে নেই।তোমরা নিজেরাও তো স্টুডেন্ট।অতো রান্নাবান্না নিশ্চয়ই জানো না।’

রিমি স্মিত হাসল।যাক,একটা ভালো কাজ হয়েছে।সকাল সকাল রান্না করা একটা বিশাল ঝামেলা।সে আর নবনী কেউই রান্না জানে না।দু’জন মিলে অখাদ্য বানানোর চেয়ে কিনে আনা খাবার খাওয়া ভালো।

নবনীতা এগিয়ে এসে মুখভার করে বলল,’কি দরকার ছিল?আমরা তো কিছু একটা বানিয়েই নিতাম ভাইয়া।শুধু শুধু আবার এতো কিছু আনলেন কেন?’

রিমি চোখ পাকিয়ে তাকে দেখে।নবনীতা ইশারায় জানতে চায়-কি হয়েছে? রিমি মনে মনে উত্তর দেয়,’কচু বানাতিস তুই।যতোসব অখাদ্য খাওয়ানোর ধান্দা।’

আদি পাখা ছেড়ে চেয়ার টেনে বসল।চারদিক দেখে বলল,’আমার বন্ধু কোথায়?এখনো ঘুমে?’

নবনীতা ছোট করে জবাব দেয়,’জ্বী।’

আদি ঘড়িতে সময় দেখেই খানিকটা বিচলিত হয়ে বলল,’মাত্র সাতটা আটচল্লিশ বাজে।বেশি সকাল সকাল এসে পড়েছি তাই না?’

রিমি দিরুক্তি করে বলল,’না না ভাইয়া।ঠিকই আছে।আমরাই লেইট।’
সে কথা শেষ করেই নবনীতাকে দেখে খানিকটা ধ’মকে উঠে বলল,’দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস?যা ভাইয়া কে ডেকে আন।বল আদি ভাইয়া এসেছে।’

নবনীতা চমকে উঠে বলল,’ডাকবো মানে?আমি কি করে ডাকবো?’

‘অদ্ভুত! যেমন করে ডাকে এমন করে ডাকবি।’

নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আদিকে দেখে।আদি সামনে না থাকলে রিমি কে কিছু কথা বলা যেত।এখন আর সেটা সম্ভব না।সে মাথা নামিয়ে গটগট করে হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল।

ঘরে এসেই সে ত্যাড়ছা চোখে একবার আরহাম কে দেখে।এগিয়ে এসে গলা উঁচিয়ে বলে,’আদি ভাইয়া এসেছে বাসায়।’

আরহামের কোনো ভাবোদয় হলো না।সে উল্টো আওয়াজে বিরক্ত হয়ে অন্য পাশে ফিরে গেল।নবনীতা আরো একবার উঁচু স্বরে বলল,’আদি ভাইয়া এসেছে।সাথে খাবারও এনেছেন।উঠতে বলেছে আপনাকে।’

আরহাম বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’সমস্যা কি?এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন?’

নবনীতা কোমরে হাত রেখে তার চেয়েও দ্বিগুন বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়,’আদি ভাইয়া এসেছেন।একসাথে নাস্তা করবে আপনার সাথে।উঠুন।’

আরহাম তার কথা পাত্তা না দিয়ে চোখের উপর একহাত রেখে বলল,’এই সাত সকালে কেউ কারো বাসায় আসে?আদির খাবার আদিই খাক।’

নবনীতা চোখ মুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকে দেখে।তারপরই বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।এর সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নাই।আজকে তার কাজ আছে।সে আজকে থেকে আবার অফিস জয়েন করবে।নয়টা বাজলেই সে অফিসের জন্য বেরিয়ে যাবে।

সে আলমারি ঘেটে নীল রঙের একটা জামা বের করে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে ছুটে।গোসল শেষে বের হতে হতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেছে।বের হয়েই সে তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল।তাড়াহুড়ো করে ভেজা চুলে চিরুনী চালালো।

তার খট খট আওয়াজে আরহামের ঘুম উড়ে গেল।সে আড়মোড়া ভেঙে বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরতেই দেখল নবনীতা ভেজা চুল নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছে।চুলের পানিতে তার পুরো পিঠ ভিজে যাচ্ছে।আরহাম এক লাফে উঠে বসল।অবাক হয়ে বলল,’ভেজা চুল নিয়ে এমন টানা হ্যাঁচড়া করছ কেন?ভেজা চুল আঁচড়াতে হয় না।জানো না এটা?’

নবনীতা পেছন ফিরে।কটমট করে বলে,’বেশি কথা বলবেন না।আপনার কাছে জানতে চেয়েছি?আমার চুল আমি বুঝে নিবো।’

আরহাম ত্যাড়ামি করে বলল,’একদমই না।তোমার চুল তুমি বুঝে নিবে না।তুমি এমন টেনে টুনে সব চুল ছিঁড়ে ন্যাড়া হয়ে গেলে আমি তোমাকে বউ বলে পরিচয় দেব না।’

‘দিয়েন না।খুব উপকার হবে আমার।’

বলেই সে আবার ভেজা চুপচুপে চুলে চিরুনী দিয়ে টানাটানি শুরু করে।আরহাম দ্রুত উঠে তার কাছে যায়।নবনীতার কোলের উপর রাখা তোয়ালে টা নিজের হাতে নিয়ে সহজ গলায় বলে,’চুল তো মুছো নি ভালো করে।দেখি এদিকে ফিরো।’

নবনীতা বড় বড় চোখে তাকে দেখে।কড়া গলায় বলে,’কি যা তা বলছেন?এতো আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।নিজের কাজে যান।’

আরহাম সেসব পাত্তা দিলো না।সে তোয়ালে হাতে নিয়ে নবনীতার কাছাকাছি এসে সেটা নবনীতার মাথায় চাপিয়ে তার চুলগুলো ঝেড়ে দিলো।নবনীতা চুল মোছার ফাঁকেই চেঁচিয়ে ওঠল,’আরে আস্তে।সব রাগ কি আমার চুলের উপর ঝাড়ছেন নাকি?থামুন।থামুন।আমার কিন্তু মাথা ব্যথা করবে এখন।’

আরহাম থামল।নবনীতার চুলে হাত দিয়ে বলল,’দেখো।চুল অলরেডি অর্ধেক শুকিয়ে গেছে।ঠিক মতো মুছতেও তো জানো না।আবার বড় বড় কথা বলো।’

নবনীতা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে।চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে একটু সামলে উঠতেই চেঁচিয়ে উঠে,’পুরো দুনিয়া ঘুরছে আমার।এতো উপকার ভবিষ্যতে আর না করলেও হবে।’

আরহাম হাসল।এলোমেলো চুলগুলো সব তার মুখের উপর পড়ে আছে।তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।সে দেয়ালে হেলান দিয়ে কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়,’এই সাত সকালে এমন মাঞ্জা মেরে যাচ্ছ টা কোথায়?’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে কঠিন মুখ করে বলল,’মোটেই মাঞ্জা মেরে যাচ্ছি না।কেবল চুলই শুকাচ্ছিলাম বসে বসে।’

সে একটু থেমে খুশি খুশি মুখ করে বলল,’আমি আজ অফিসে জয়েন করছি অনেক দিন পর।’

আরহাম ঠোঁট উল্টে বলল,’বাব্বাহ! চাকরি করছ নাকি?’

নবনীতা আত্মবিশ্বাস নিয়ে জবাব দেয়,’অবশ্যই।তাও চমৎকার একটা অফিসে।’

‘কেন কেন?চমৎকার কেন?’ উৎসুক হয়ে জানতে চায় সে।

‘অফিসের লোকজন খুব ভালো।বিশেষ করে গভর্নিং বডির মেম্বার আর সিইও।আমি বলে বোঝাতে পারব না।আমাকে তারা অনেক ভালোভাবে ট্রিট করে।’

আরহাম ঠোঁট টিপে আসে।মনে মনে বিড়বিড় করে,’সিইও সামনে এলেই তো সব প্রশংসা গায়েব হয়ে যাবে ম্যাডাম।’

তবে মুখ ফুটে তেমন কিছু বলেনি।শুধু বলেছে ভালো,বেশ ভালো।
নবনীতা অবশ্য থামে নি।সে আরো দশ মিনিট অফিসের গুন গেয়েছে।আরহাম দুই কান খুলে সবটা শুনেছে।এতো শান্তি তো রোমান্টিক গান শুনলেও লাগে না।মনে হচ্ছে কানের ভেতর কেউ মধু ঢেলে দিচ্ছে।সে শেষটায় চাপা স্বরে বলল,’অফিসের সিইওর জন্য একটু দোয়া করে দিও তো।সে যেন বউ নিয়ে সুখে থাকতে পারে।’

নবনীতা আয়না থেকে চোখ সরিয়ে আরহাম কে দেখে বলল,’অবশ্যই সুখে থাকবেন।উনি নিরেট ভদ্রলোক।সুখে না থাকার প্রশ্নই আসে না।’

নবনীতা আধভেজা চুলটা কোনোরকম ক্লাচারের সাহায্যে আটকে অল্প কিছু খেয়ে নেয়।তাসনুভা খাবার ঘরেই ছিল।সে একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে।নবনীতা তাকে দেখেই মিষ্টি করে হাসল।তার থুতনিতে হাত রেখে বলল,’আমার এখন বের হতে হবে তাসনুভা।পরে কোনোদিন তোমার সাথে মন ভরে কথা বলল কেমন?’

সে দ্রুত গতিতে বাসা থেকে বের হয়।নাস্তা খাওয়া শেষে আরহাম সাদেক সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আদি আর তাসনুভা কে সাথে করে বেড়িয়ে গেল।তার আবার সন্ধ্যার দিকে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে।

নবনীতার অফিস বরাবরের মতো আজও ভালো কেটেছে।তবে আজ কেন যেন সবাই গোল গোল চোখে তাকে দেখছিল।নবনীতা কিছুটা হকচকায়।সম্ভবত তার বিয়ের বিষয়টি তারা জেনে গেছে।কিন্তু নিজ থেকে কিছু বলতে পারছে না।নবনীতা আর এসব নিয়ে এতো মাথা ঘামায় না।যার যা ভাবার ভাবুক।তার কি?তাকে তো আর কিছু বলছে না।

দুপুরের একটু পরেই সে অফিস থেকে বেরিয়ে লুবনার বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়।লুবনার আবার পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে।ফাঁকিবাজ টা কিছুই পারে না।তাই নবনীতা ইদানিং তাকে নিয়মিতই পড়াচ্ছে।

লুবনার বাসার কলিং বেল চাপতেই খটখট শব্দে দরজা খুলে গেল।দরজা খুললেন মিসেস ইয়াসমিন।নবনীতাকে দেখামাত্রই তিনি নাক ছিটকালেন।তার অদ্ভুত চাহনি দেখে নবনীতা নিজেই ভড়কে গেল।অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক দেখল।তার এমন ঘৃণাভরা দৃষ্টির কারণ কি নবনীতা?নাকি তার আশে পাশে থাকা অন্যকিছু?

মিসেস ইয়াসমিন কয়েক পল তাকে দেখেন।তারপরই খানিকটা ভৎসনা করে বলেন,’তোমার আর লুবনাকে পড়াতে হবে না।তোমার মতো মেয়ের কাছে আমি মেয়ে পড়াবো না।’

নবনীতা হতভম্ব হয়ে তার কথা শুনলো।তোমার মতো মেয়ে মানে?কেমন মেয়ে সে?সে একটা শুকনো ঢোক গিলে গলা ভিজায়।মিসেস রোকেয়া তার সেই মলিন মুখ দেখে দমলেন না।উল্টো আগের চেয়েও কঠিন গলায় বললেন,’তোমাকে খুব ভালো মেয়ে ভেবেছিলাম।তুমিও সেই বাকিদের মতোই।শরীর বেঁচে সংসার চালাও আবার বড় বড় কথা বলো।’

তার কথা শুনেই নবনীতার কান ঝা ঝা করে উঠে।সে বোকা বোকা হয়ে কেবল বলে,’আন্টি কি যা তা বলছেন।’

মিসেস ইয়াসমিন কর্কশ গলায় জবাব দেন,’যা তা বলছি না।সব জেনেই বলছি।মা বাপ নেই,এধরনের মেয়েদের আমার খুব ভালো করে চেনা আছে।এরা যার তার সাথে শুয়ে যায়।ভেবেছিলাম তুমি আলাদা,অন্যরকম।এখন দেখছি তুমিও ঐ তাদের মতোই।নেতার সাথে ফষ্টিনষ্টি করে এখন তার ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করেছ।’

নবনীতা দুই কদম পিছিয়ে গেল।ঘটনার আকস্মিকতায় তার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না।একটু ধাতস্থ হতেই সে জোর গলায় বলল,’এসব কি বলছেন আপনি?আপনি আমার নামে নোংরা অপবাদ দিচ্ছেন।আমি নিজের টাকায় ফ্ল্যাটে থাকি।ভাড়া দিয়ে থাকি।’

‘হ্যাঁ।খুব জানা আছে।এমপির অফিসে কাজ করো,তার বাড়িতে থাকো,স্কুল কলেজে গিয়ে নষ্টামি করো,আবার বলো ভাড়া দিয়ে থাকো।খুব চেনা হয়েছে আমার তোমাকে।এই হলো তোমার সংগ্রামের নমুনা।আকাম কুকাম কি করেছ কে জানে,শেষে আবার বাধ্য হয়ে বিয়েও নাকি করেছে।যাকগে,এসব আমার বলে আর কাজ নেই।তুমি আমার মেয়েকে আর পড়াতে আসবে না।তোমার মতো টিচার আমার লাগবে না।’

নবনীতা ফ্যালফ্যাল চোখে তার পুরোটা কথা শুনল।উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য অপর পক্ষের কথা বোধগম্য হতে হয়।অথচ মিসেস ইয়াসমিন এতোক্ষণ কি বললেন,তার সিংহভাগই তার বোধগম্য হলো না।শুধু সে এইটুকু বুঝল মিসেস ইয়াসমিন এক নিমেষেই তার এতো বছরের সংগ্রাম,এতো বছরের পরিশ্রমের উপর আঙুল তুলেছেন।নবনীতার কষ্ট,তার ত্যাগ তিতিক্ষা সবকিছুকে একটা নোংরা বিশেষণ দিয়ে বিশেষায়িত করে দিয়েছেন।

সে পুনরায় চেঁচিয়ে উঠে বলে,’কি সব উল্টা পাল্টা বাজে কথা বলছেন আপনি আমার নামে।আপনাকে সম্মান করি তাই বলে আপনি যা খুশি বলবেন?আমি আমার যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি।’

তার চেঁচানো তে মিসেস ইয়াসমিনের কোনো ভাবোদয় হয়নি।তিনি কটমট করে বললেন,’তোমার যোগ্যতা যে কি সেটা ফেসবুকে ঢুকলেই বোঝা যায়।যাও গিয়ে তোমার নামি দামি কাস্টমারদের খুশি করো।আমার মেয়েকে তোমার পড়াতে হবে না আর।’

বলেই তিনি ধাম করে তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করলেন।নবনীতা স্তম্ভিত হয়ে আরো দুই পা পেছায়।তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে,অপমানে শরীর ঝলসে যাচ্ছে।ইয়াসমিন আন্টি তাকে এসব কথা বলছে?তার চরিত্র নিয়ে এতো বাজে বাজে কথা বলছে?সে নষ্টা?সে শরীর বেঁচে খায়?শেষ?এইটুকুই?এইটুকুতেই নবনীতার পরিচয় দেওয়া শেষ?

নবনীতা আরো কয়েক কদম পেছায়।শেষে দুই হাত মুখে চেপে মেইন রোডের দিকে ছুটে।মূল সড়কে আসতেই যে গাড়ি সামনে পেল সেটাতেই চড়ে বসল।বসেই নিজের দুই হাত মুখের উপর চেপে হাউমাউ করে কতোক্ষণ কাঁদলো।বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত নিজেকে সামলে রাখা তার পক্ষে সম্ভব না।তবুও সে নিজেকে কয়েক দফা শান্ত রাখার চেষ্টা করে।রাস্তাঘাটে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা তার উদ্দেশ্য না।সে কোনোরকম বাড়ি যেতে পারলেই বাঁচে।সে দ্রুত চোখ মুছে দুইবার বড়ো করে শ্বাস টানে।পরোক্ষনেই আবার তার চোখ ভিজে উঠে।বারবার কেবল মনে হয় এতো সহজে কথা গুলো বলে দিলো?একবারও যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করল না?

***

আরহাম অনুষ্ঠান শুরুর একটু পরে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো।প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে তার মুঠোফোনটি আনুমানিক রাত আটটার দিকে পিঁক পিঁক শব্দ করে বেজে উঠল।সে ফোন হাতে নিয়ে দেখল রিমির কল।কপালে ভাজ পড়ে তার।দ্রুত কল রিসিভ করেই সে জানতে চায়,’কি হয়েছে রিমি?এনি প্রবলেম?’

রিমি অন্যপাশ থেকে কি বলল জানা নেই,তবে তার কথা শুনতেই আরহাম উঠে দাঁড়ায়।ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে সেখান থেকে।গাড়িতে উঠেই তাড়াহুড়ো করে বলে,’মোতাহের তাড়াতাড়ি তোমার ম্যাডামের এপার্টমেন্টে যাও তো।
.
.
.
.
সুখ এমন এক দুর্লভ বস্তু যা সবার জীবনে বেশি সময়ের জন্য স্থায়ী হয় না।নবনীতারও হয়েছে তাই।যেই আকাশ ছোঁয়া সুখ তার ধূসর জীবনটাকে রংধনুর সাত রঙের ন্যায় রাঙিয়ে দিয়েছিল,সেই সুখ হঠাৎই কর্পূরের ন্যায় উবে গেল।নবনীতা জানতে পারল,যেই অফিস নিয়ে সে রোজ রোজ এতো গর্ব করতো সেই অফিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আর কেউ না,শেখ শাহরিয়ার আরহাম।অফিস জয়েনিং এর অর্ধমাস পূর্ণ হওয়ার পর সে যখন বিষয়টি জানলো,তখন তার আনন্দ উচ্ছ্বাস সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

সে আজ বাড়ি ফিরে হন্য হয়ে তার অফিসের ওয়েবসাইট ঘেটে এই তথ্য বের করেছে।এই বিষয় টা ঠিক মতো হজম করার আগেই আরো একটা বিষয় সে জানতে পারল,যেটা হুট করেই হজম করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

সে জানতে পারল যেই বাড়িতে সে এতোদিন যাবত থাকছে,যেই ফ্ল্যাটের মেঝের উপর সে দাঁড়িয়ে আছে,কাগজে কলমে সেই ফ্ল্যাটের মালিক শাহরিয়ার আরহাম নিজেই।এটা আরহামের নিজের এপার্টমেন্ট।যেটাতে নবনীতা এতোদিন নির্দ্বিধায় থাকছিল।যেই আরহাম কে জড়িয়ে তার নামে নোংরা কথা উঠছিল,সেই আরহামের এপার্টমেন্টেই সে গুনে গুনে সতেরো দিন কাটিয়েছে।

নবনীতা বাড়ি ফিরে আরো একবার গোসল করল।সে কি করবে?এই চাকরিটা ছেড়ে দিবে?বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে?
তারপর?তারপর কি হবে?কোথায় যাবে সে?তার তো কোনো জায়গা নেই যাওয়ার।এই কিছুদিনে সে যেই পরিমান কেঁদেছে,সারা জীবনেও অতোখানি কেঁদেছে নাকি সন্দেহ।এখন কাঁদতেও তার ক্লান্ত লাগে ভীষণ।আরহামের উদ্দেশ্য সে জানে না।ঠিক কি কারণে সে তাকে নিজের অফিসে কাজ দিয়েছে,নিজের বাড়িতে ঠাই দিয়েছে সে জানে না।জানতে চায়ও না।মানসিক ভাবে সে এসব নিয়ে ভাবার মতো অবস্থায় নেই।সে শুধু তাকে নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনা কেমন সেটা অনুমান করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।তার সমস্ত মনোযোগ শুধু সেসব নিয়েই।

চরিত্রের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে যখন আঘাত লাগে,তখন দৃঢ় আর মজবুত ব্যক্তিত্বের মেয়েটিও পড়ন্ত বিকেলের অস্তমিত সূর্যের ন্যায় নুয়িয়ে পড়ে।সকল তেজ,জেদ কেমন যেন এক লহমায় দমে যায়।নবনীতার সাথেও তাই হলো।সেই রাতে তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো।জ্বরের প্রকোপ এতোই বেশি হলো যে সে চোখ বন্ধ রেখেই অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে গেল।রিমি তার কপালে হাত রেখেই আঁতকে উঠে।দ্রুত জলপট্টির ব্যবস্থা করে।কোনো কিছু না ভেবেই আরহামের নম্বরে ডায়াল করে।

আরহাম তার এপার্টমেন্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বেজে গেল।সে গিয়েই এলোমেলো পায়ে নবনীতার ঘরে যায়।রিমি বসেছিল তার পায়ের কাছটায়।আর শুভ্রা আর চিত্র বসেছে ঠিক তার পাশে।চিত্রর চোখে মুখে ভয়,উৎকন্ঠা।আপাই এমন জ্বরের ঘোরে প্রলাপ করছে,সেটা সে জীবনে এই প্রথম দেখেছে।শুভ্রা তাকে দেখেই সরে এলো।আরহাম গিয়ে বসল তার ঠিক পাশটায়।তাসনুভার জ্বর হলে সে যেভাবে তার কপালে হাত রাখে,তেমন করেই সে নবনীতার কপালে হাত রাখল।তাপমাত্রা অনুমান করেই চিন্তিত হয়ে বলল,’থার্মোমিটারে জ্বর মেপেছিলে রিমি?’

‘জ্বী ভাইয়া।একটু আগে ১০৪ ছিলো,এখন ১০৩ আর ১০৪ এর মাঝামাঝি নেমে এসেছে।’

আরহাম কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল।এমন পরিস্থিতি তে সে আগে পড়েনি।তার কি করা উচিত?নবনীতাকে আগলে নেওয়া উচিত?কিন্তু সে এসবে অভ্যস্ত না।তার কেমন অদ্ভুত লাগে সবকিছু।সে শেষটায় তার একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।কোমল কন্ঠে ডাকে,পরী,এ্যাই পরী!’

নবনীতা ক্ষণিকের জন্য টেনে টেনে চোখ খুলে।তার বুজে আসা চোখ দেখেই আরহাম অপ্রস্তুত হয়ে বলে,’বেশি খারাপ লাগছে পরী?’

নিজের প্রশ্নে তার নিজেরই বিরক্তি ধরে যায়।১০৩ ডিগ্রি জ্বর গায়ে নিয়ে শুয়ে থাকা মানুষ কে সে প্রশ্ন করছে খারাপ লাগছে কিনা।এর চেয়ে খাপছাড়া প্রশ্ন আর কি হতে পারে?

নবনীতা তার কথা শুনল নাকি বোঝা গেল না।একটু পরেই সে তার ডান হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে তার হাতের পিঠে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো।আরহাম তার এহেন কাজে থতমত খেল।এসব কি হচ্ছে?নবনীতা কাঁদছে?আশ্চর্য ঘটনা।সে কখনো তাকে কাঁদতে দেখেনি।

নবনীতা হেঁচকি তুলে ডাকল,’বাবা,ও বাবা।একটু কথা বলো বাবা।’

আরহাম নিঃশ্বাস বন্ধ করে তার কথা শুনে।এতো বেশি অপ্রস্তুত সে আগে কখনো হয়নি।মেয়েটা তার বাবাকে ডাকছে।কিন্তু সেই মানুষটা বেঁচে নেই।সে আরহামকে সেই মানুষটার জায়গায় কল্পনা করছে।এমন একটা অপ্রীতিকর মুহূর্তে আরহামের কি করা উচিত?

নবনীতা ঘোরের মাঝে থেকেই ফুপিয়ে উঠে বলল,’আমি হেরে গিয়েছি বাবা।তারা সবাই আমাকে চরিত্রহীনা বলছে।বলছে আমি নাকি…’
সে কথা শেষ করতে পারে না,তার আগেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।তারপরই আবার শরীরে একটু জোর এনে বলে,’তারা বলছে আমি নাকি শরীর বেঁচে আমার দুই বোনকে মানুষ করেছি।’
বলতে বলতেই সে হাউমাউ করে উঠে।

আরহাম চূড়ান্ত রকমের অপ্রস্তুত হয়ে ঘরে থাকা বাকিদের দিকে তাকায়।তারপরই চোখ সরিয়ে নেয়।কিছুটা লজ্জিত হয়ে মাথা নামিয়ে নেয়।

রিমি দ্রুত চিত্রা আর শুভ্রাকে সরিয়ে নিল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’এসো তো।আমরা অন্য ঘরে যাই।’

যাওয়ার আগে সে চাপা স্বরে আরহামকে বলল,’ভাইয়া কিছু প্রয়োজন হলে বলবেন।’

আরহাম সে কথার জবাব দেয় না।তার সমস্ত মনোযোগ খাটে শুয়ে থাকা মেয়েটির দিকে।যার শরীর তীব্র জ্বরে অল্প সল্প কাঁপছে।আরহাম তার হাতের উপর নিজের অন্য হাত টা রাখে।

কেয়ারিং হাসবেন্ড তথা যত্নবান স্বামীর সংজ্ঞা আরহাম জানে না।জীবনের কোনো এক মুহূর্তেও তার সেটা হতে ইচ্ছে করেনি।মনে হয়নি যে সে খুব বউয়ের যত্ন করবে।স্ত্রী কে নিয়ে তার চিন্তাভাবনা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম।মেয়েদের যত্ন করা,তাদের আগলে নেওয়া এই বিষয় গুলো কোনোদিনই তার মস্তিষ্কে কিংবা চিন্তা চেতনায় স্থান করে নেয়নি।

অথচ সেই রাতে আরহাম হুট করেই নিজেকে চূড়ান্ত রকমের যত্নবান স্বামী রূপে আবিষ্কার করল।সে টের পেল তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর গায়ে যেই নোংরা কথা গুলো কাদার মতো ছোড়া হচ্ছে,এই কাদা তার শরীরেও আবর্জনা রূপে জমা হচ্ছে।তার রাগ হয়,জেদ হয়।মন চায় যারা যারা এসব করছে তাদের কষিয়ে দু’ঘা দিতে।

নবনীতার মাথায় চেপে রাখা কাপড় টা ক্রমশ গরম হয়ে যাচ্ছিল।আরহাম কয়েকবার সেটা পানিতে ভিজিয়ে তার সমস্ত মুখ,হাত,গলা এমনকি পায়ের পাতাও মুছে দিলো।এমনকি তাকে আগলে ধরে ঔষধও খাওয়ালো।

নবনীতা রাতভর শুধু ঘুরেফিরে এক কথাই বলল।থেমে থেমে অগণিত বার ডাকল,’বাবা,বাবা।তুমি প্লিজ আমার কাছে চলে আসো বাবা।আমি আর পারছি না।’

তার চোখের পানিতে বালিশ ভিজলো,ভিজলো আরহামের হাতও।আরহাম কাঁপা কাঁপা হাতে তার মাথায় হাত বুলায়।চাদরটা ঠিক মতো টেনে তার গায়ে তুলে দেয়।বিগত দিনের মতো আজও নিদ্রাহীন রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।মাঝরাতেই নবনীতা আচমকা ফুপিয়ে উঠে,’বাবা! আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও।প্লিজ বাবা।প্লিজ।’

আরহাম থমথমে মুখে তাকে দেখে।অজানা কারণে তার রাগ হচ্ছে।অভিমান হচ্ছে খানিকটা।কিন্তু সে বিনিময়ে একবারের জন্যও রাগ ঝাড়লো না।কেবল মুখটা নবনীতার কাছাকাছি এনে মৃদু ধ’মকের সুরে বলল,’এসব কেমন কথা পরী?বাবা নেই তো কি হয়েছে?আমি তো আছি।তাই না বলো?’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২৬ (২)

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২৬)[দ্বিতীয় অংশ]
[রিচেক নেই।বুঝে নিয়েন কষ্ট করে]

একেবারে পরিপাটি পরিচ্ছন্ন একটি ঘর।দেয়ালে একটা সুন্দর ওয়াল পেইন্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।নবনীতার হাবিজাবি খরচার মাঝে এটাও অন্তর্ভুক্ত।সে বেতন হাতে পেয়েই এটা কিনেছে।

বাইরে খুব সুন্দর চাঁদের আলো।সেই আলোর সামান্য খানিকটা নবনীতার ঘরেও আসছিলো।কিন্তু বাল্ব জ্বালানোর কারণে সেই আলো আর বোঝা যাচ্ছিল না।নবনীতা চুপচাপ খাটের এক কোণায় বসেছিল।তার হাতে মুঠ করে রাখা ফুলদানি।আরহাম বাড়াবাড়ি করলেই সে তার মাথা ফা’টাবে।যদিও কারো মাথা ফাটানোর অভিজ্ঞতা তার নেই।যাক গে ব্যাপার না।অভিজ্ঞতা না হলে নতুন করে হবে।এটা আবার এমন কি?

দরজার লক ঘোরানোর শব্দতেই নবনীতা নড়েচড়ে বসল।ক্যাচ ক্যাচ শব্দে দরজা খুলেই আরহাম ভেতরে উঁকি দিয়ে একবার ভেতরের অবস্থা দেখল।নাহ,পরিস্থিতি ঠান্ডাই মনে হচ্ছে।সে আস্তে করে দরজা বন্ধ করল।ছিটকিনি তে হাত দিতেই নবনীতা চেঁচিয়ে ওঠল,’ঐটা লাগানোর কোনো দরকার নাই।বাইরে কোনো বাঘ সিংহ নেই যে আমাদের খেয়ে নিবে।’

আরহাম একবার তাকে দেখল।তারপরই শব্দ করে ছিটকিনি তুলে দরজা বন্ধ করল।পাশাপাশি লক ও করল।তারপর গট গট করে হেঁটে আসতে আসতে বলল,’আমার এভাবে দরজা খুলে উদাম হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস নেই।আমি দরজা বন্ধ করে উদাম হয়ে ঘুমাই।’

আরহাম খুবই সাচ্ছন্দ্য হেঁটে এসে আরাম করে খাটে বসল।মাথার বালিশটা পিঠের পেছনে রেখে হেলান দিলো।ঘাড় ঘুরিয়ে একবার নবনীতাকে দেখল।নবনীতা দ্রুত চোখ নামিয়ে শক্ত করে ফুলদানি টা চেপে ধরল।অবস্থা ভালো না।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই নবনীতা তার মাথা ফা’টিয়ে দু’ভাগ করবে।

আরহাম তাকে দেখেই কুটিল হেসে বলল,’হ্যালো সেনোরিটা।কেমন আছ?’

নবনীতা তীর্যক চোখে একবার তাকে দেখেই মাথা নামিয়ে নেয়।মনে মনে জবাব দেয়,’তোর সাথে বিয়ে হবার পর কেউ ভালো থাকতে পারে?’
অথচ মুখ ফুটে সে তেমন কিছুই বলল না।

আরহাম একটু কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে নেয়।তার কাটখোট্টা স্বরে মধু মাখিয়ে মেকি হেসে বলে,’তোমার মনে হয় না এখন আমাদের একটু সহজ হওয়া উচিত?’

নবনীতা এক শব্দে উত্তর দেয়,’না।’

আরহাম মুখ খিঁচিয়ে তাকে দেখে।একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলেও তো পারত।এমন মুখের উপর কে উত্তর দেয়?সে তবুও ভদ্রতা দেখিয়ে বলল,’যাকগে,সেটা তোমার বিষয় তুমি কি করবে।আমারটা আমি বললাম।আমি এতো পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে পারি না।এসব ঝগড়াঝাটি মেয়েদের স্বভাব।তুমিও এখন থেকে আমার সাথে ভালো করে কথা বলবে।আমি তোমার হাসবেন্ড।বুঝেছ?’

নবনীতা ফুলদানি থেকে হাত ছেড়ে দুই হাত হাঁটুর উপর রাখল।মাথা নুয়িয়ে চাপা স্বরে বিড়বিড় করল,’নে’শাখোর একটা!’

আরহাম তার কথা শুনতেই তেঁতেঁ উঠে বলল,’এ্যাই বেয়াদব! তুমি কি বললে?’

নবনীতা অন্যদিকে চোখ সরিয়ে চুপচাপ সেদিকে দেখে।আরহামের দুই হাত নিশপিশ করছে।মন চাচ্ছে ঠাটিয়ে দু’টো চড় দিতে।কিন্তু এটা সম্ভব না।নবনীতার সাথে এসবে যেতে চায় না সে।নবনীতার কোনো ভরসা নেই।সে সিদ্ধান্ত নিল সে আর তাকে ঘাটাবে না।অনেক সৌজন্যে দেখিয়েছে।বিনিময়ে নে’শাখো’র তকমা পেয়েছে।এখন সে হাত পা ছড়িয়ে আরামের ঘুম দিবে।নবনীতার সাথে পরেও কথা বলা যাবে।বিয়ে হয়েছে তাদের।কথা বলার জন্য গোটা জীবনই পরে আছে।আপাতত ঘুমিয়ে যাওয়াই ভালো।

সে এক টানে গায়ের পাঞ্জাবি টা খুলে নিল।নবনীতা লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে হতবাক হয়ে বলল,’এসব কি?’

আরহাম নিজেও অবাক হলো।চোখ বড় বড় করে বলল,’কি আবার কি?গরম লাগছে আমার।’

‘এজন্য সব খুলে ফেলবেন?’

‘সব খুলিনি।পাঞ্জাবি খুলেছি।তুমি যেমন শাড়ি পাল্টেছ অনেকটা তেমন।’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে বলল,’এতো শখ থাকলে বাড়ি যেতে পারলেন না?আরেকজনের বাড়িতে পড়ে আছেন কেন?’

আরহাম মহা বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,’সেটা তোমার মামাকে বলো না।আমাকে কেন বলছ?আমি কি তোমার সাথে থাকার জন্য হেদিয়ে মরছি?’

নবনীতা চুপচাপ আবার খাটে এসে বসল।তার পেঁচার মতো করে রাখা মুখটা একবার দেখেই আরহাম পিঠের পেছনে রাখা বালিশটা খাটে ফেলে তার উপর মাথা রাখল।খানিকটা আদেশের সুরে বলল,’ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরিয়ে স্পিড বাড়াও তো।গরম লাগছে ভীষণ।’

নবনীতা কটমট করে বলল,’পারব না।নিজে উঠে বাড়ান।’

আরহাম চোখ বন্ধ করেই গাঢ় স্বরে বলল,’স্বামীর সাথে বোয়াদবি করতে নেই।যাও স্পিড বাড়াও।’

নবনীতা খাটের এক কোণায় রাখা ফুলদানি টা তুলে আরহামের মাথা বরাবর সেটা উঁচিয়ে ধরল।মন চাইছে এখনই এটা তার মুখ বরাবর ছেড়ে দিতে।কিন্তু সে এই কাজ করবে না।আর যাই হোক,সে পাগল না।ফুলদানি টা স্বস্থানে রেখে সে উঠে গিয়ে পাখার স্পিড বাড়ায়।আরহাম কতোক্ষণ এপাশ ওপাশ করে বিরক্ত হয়ে বলল,’এ্যাই পরী! একটা কোলবালিশ দাও তো।’

নবনীতা চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়,’পারব না।এতো আদর যত্ন করতে পারব না।কিছু বলছি না দেখে একটার পর একটা বলেই যাচ্ছেন।’

আরহাম চোখ খুলল।মুচকি হেসে বলল,’তাহলে কিছু বলো।এমন চুপ মেরে আছো কেন?’

নবনীতা কথা না বাড়িয়ে আলমারি থেকে কোলবালিশ বের করে আরহামকে দিলো।আরহাম সেটা পেতেই গাঢ় স্বরে বলল,’ধন্যবাদ।এমনই স্বামীর সেবা করতে থাকো।’

নবনীতা কথা বাড়ালো না।ঘরের বাতি নিভিয়ে চুপচাপ রুমের সাথে থাকা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।আরহামা মাথা তুলে একবার সেদিকে দেখল।তার কি এখন ভালো জামাইয়ের মতো সেদিকে যাওয়া উচিত?গিয়ে সঙ্গ দেওয়া উচিত?নাকি আরামে একটা ঘুম দেওয়া উচিত?

আরহাম বেছে নিল শেষেরটা।সে হাত পা ছড়িয়ে মরার মতো ঘুম দিবে।বউদের বেশি প্যাম্পার করা উচিত না।বেশি লাই দিলে মাথায় উঠে যাবে।তখন এদের মাথা থেকে নামাতে কষ্ট হবে।বউদের বেশি ভালোবাসলে পরিণাম খুব একটা ভালো হয় না।আরহাম এর ভুক্তভোগী।সে নিজ চোখ দেখেছে।সে বারান্দায় গেল না।উল্টো নবনীতার মাথার বালিশটাও নিজের কাছে এনে সেটা তার মাথার উপর চেপে ধরল।এভাবে না ঘুমালে সে ঘুমুতে পারে না।

নবনীতা বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়ায়।এখান থেকে চারদিকে দৃশ্য বেশ ভালো লাগে।আকাশটাও ভালো দেখা যায়।সে বাতি নেভানোর পরই টের পেল আজকের চাঁদটা বেশ বড়।হয়ত কাল কিংবা পরশুই পূর্ণিমা।নবনীতা বারান্দার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ে।

বিয়ে নিয়ে সে বিগত ছয় বছরে একটি বারও ভাবে নি।যত সম্বন্ধ এসেছিল,সে দুই মিনিটের জন্যও কিছু না ভেবে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে।সে কখনোই সংসার কিংবা স্বামী এই বিষয় গুলো মস্তিষ্কে ঠাই দেয় নি।এখন ঘটনা প্রবাহে সে একজনের স্ত্রী।বিয়ে হয়েছে।ক’দিন বাদে সংসারও হবে তার।হবে অবশ্যই।সে কতোদিন আর পালিয়ে বেড়াবে?কিন্তু দুঃখের বিষয় যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে তাকে তার পছন্দ না।

অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এক জিনিস।নতুন করে দু’জন দু’জনকে চিনবে।এই ব্যাপারটা মানানসই।কিন্তু তার তো সেই অবস্থাও নেই।নতুন করে নিজের বর কে জানার কিছু নেই।তার বর যে কি জিনিস সেটা সে বিয়ের আগেই জেনে নিয়েছে।তার পরবর্তী দিনগুলো কেমন কাটবে ভাবলেই তার কেমন অসহ্য লাগে সবকিছু।

সে আবারো আকাশ দেখে।কৈশোরে বিয়ে নিয়ে টুকটাক কিছু ইচ্ছে ছিল তার।মনে হতো কোনো এক পূর্ণিমা রাত্তিরে বিবাহের পর নিজের বর কে নিয়ে সে চন্দ্র বিলাশ করবে।জীবনের ভালো মন্দ অসংখ্য গল্প তাকে শোনাবে।অথচ তার বিয়েতে সেরকম কিছুই হয় নি।

সে আধঘন্টা পর নিজ থেকেই ভেতরে এলো।চাঁদের আবছা আলো তে মোটামুটি সবকিছুই দেখা যাচ্ছিল।নবনীতা একবার অন্যমনস্ক হয়ে খাটের দিকে তাকাতেই তার দুই চোখ স্থির হলো।আরহামের ঘুমের ধরন দেখেই তার হাসি পেল।সে দ্রুত একহাতে তার মুখ চেপে ধরল।মুখে সেই হাসি ধরেই সামনে এগিয়ে গেল।

সাইডবক্সের উপর তার ফোন রাখা ছিল।সে সেটা হাতে নিয়েই চটপট তার কয়েকটা ছবি তুলে নিল।হাসি চেপে রাখার পরেও তার হাসি বেরিয়ে যাচ্ছিল।নিজের বাচ্চামো দেখে তার নিজেরই মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।কিন্তু কি আর করার?মন কে যতোই শক্ত খোলসে ঢেকে রাখুক না কেন,সে তো সবসময়ই সুযোগ বুঝে সেই আগের নবনীতা কে খুঁজে আনার চেষ্টা করে।যেই নবনীতা ছয় বছর আগেই বিলীন হয়ে গেছে।যেই নবনীতা ছয় বছর আগেই নিজের ভালো থাকা ছেড়ে দিয়েছে।

নবনীতা তার টেবিলের উপর থেকে পুরোনো ফটো অ্যালবাম টা হাতে নেয়।পাতা উল্টে উল্টে নিজেদের পুরোনো ছবি দেখে।এগুলো দেখলেই সে ভীষণ আবেগী হয়ে যায়।বিশেষ করে বাবার ছবি দেখলে।সে তার মা কে ভালোবাসে না বিষয়টা একদমই এমন না।কিন্তু বাবাকে সে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে।বাবা তাকে ছোট বেলা থেকেই সাহসী রূপে বড় করেছে।বাবা তাকে জীবনের বহু পাঠ দিয়েছে।সে বাবাকে সাংঘাতিক ভালোবাসে।আজকের এই বিশেষ দিনে যতবারই চোখ বন্ধ করছে,ততবারই তার বাবার প্রতিচ্ছবি চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে।নবনীতা আলগোছে চোখ মুছে।বাবা সবসময় বলত নবনীতার জীবনে খুব ভালো কেউ আসবে।নবনীতার সংসার জীবন ভীষণ সুখের হবে।বাবার এই কথা মনে পড়তেই সে আরেকবার খাটের দিকে চোখ নেয়।আরহাম এখন বালিশ ছেড়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে।নবনীতা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।বাবার এই সুন্দর দোয়া আল্লাহ কবুল করেনি।বাবা তার জীবনে যেই সুপুরুষের আগমন চেয়েছিল,সেই সুপুরুষ আর যেই হোক,আরহাম না।

নবনীতা চুপচাপ পাতা উল্টায়।তার ইচ্ছে ছিল বিয়ে হলে বরকে সারারাত বসে বসে তার পুরোনো অ্যালবাম দেখাবে।তার বর সেই ছবি দেখে আশ্চর্য হয়ে বলবে,’আরে! এটা তুমি?’
নবনীতা তখন একগাল হেসে মাথা নেড়ে বলবে,’হ্যাঁ।এটা আমিই।চেনা যাচ্ছে না তাই না?’

***

আকাশে চাঁদ উঠেছে।সেই সাথে আছে অগণিত তারা।শরৎ শুরু হতেই প্রকৃতির রূপ হুট করেই পাল্টে গেছে।আকাশ কিছুটা স্বচ্ছ দেখাচ্ছে।সেই আকাশ পানে দেখেই ওয়াজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।হাতের সিগারেট টা শেষ হওয়ার পথে।সে তাদের বাড়ির ছাদে বসেছে।রেলিংয়ের দুই পাশে দুই পা ঝুলিয়ে।হঠাৎই ছাদের দরজায় কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই সে ঘাড় ঘুরায়।তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কে দেখামাত্রই চমকে উঠে বলে,’কি রে?তুই?এতো রাতে?’

আদি নিঃশব্দে হেঁটে তার পাশে গিয়ে বসল।ঠিক তারই মতো করে দুই দিকে দুই পা ঝুলিয়ে।ওয়াজিদ তাকে সাবধান করে বলল,’ধরে বসবি কিন্তু।পড়ে যাবি না হয়।’

আদি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’তোরা যে কি ভাবিস আমাকে বুঝি না।বিদেশে থাকি মানে এই না যে দেশের সবকিছু ভুলে গেছি।এতো আদিখ্যেতা করতে হবে না আমাকে নিয়ে।’

আদি কথা শেষ করেই ওয়াজিদের হাত দেখে।দেখেই বুক চাপড়ে বলে,’জানতাম।জানতাম তোকে এমন দেবদাস রূপেই দেখব।আমার আন্দাজ কখনো ভুল হয় না।’

ওয়াজিদ বিরক্ত হয়ে বলল,’কি যা তা বলছিস! দেবদাস কেন হতে যাবো?’

আদি মুখের হাসি মিলিয়ে নিল।গম্ভীর স্বরে ডাকল,’ওয়াজিদ!’

ওয়াজিদ ম্লান হাসল।ছোট করে বলল,’বল।’

‘আই ক্যান রিড আইস ওয়াজিদ।আমি চোখের ভাষা বুঝতে পারি মানুষের।স্পেশালি তোর আর আরহামের।’

‘হুম।আমি জানি।’

‘তুই তবুও আমার সামনে ভণিতা করছিস।’

‘কোথায় ভণিতা করেছি?তুই আমার কাছে কিছু জানতে চাস নি।চেয়েছিস কি?’

আদি শীতল কন্ঠে বলল,’জানতে চাই নি।কারণ যা বুঝার সেটা আগেই বুঝে গিয়েছি।’

ওয়াজিদ বিনিময়ে কেবল মলিন মুখে হাসল।আদি আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’তুই নবনীতাকে এখনো পছন্দ করিস?’

ওয়াজিদ দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’নাহ।একসময় করতাম।এখন করা ছেড়ে দিয়েছি।’

আদি একটা শুকনো ঢোক গিলে।নিরেট স্বরে বলে,’আরহামও মেয়েটাকে পছন্দ করে।জানিস?’

‘জানি।জানি বলেই ছেড়ে দিয়েছি।নয়তো একবার হলেও বলতাম।’

ওয়াজিদ থামল।দীর্ঘসময় দুই পক্ষের মাঝে পিনপতন নিরবতা।তারপরই সব নিরবতাকে ছাপিয়ে ওয়াজিদ বলতে শুরু করল,’আই ট্রুলি বিলিভ আরহাম মেয়েটাকে পছন্দ করে।এবং আমি যতখানি ভেবেছিলাম,আরহাম তাকে তার চেয়েও বেশি পছন্দ করত।সেজন্যই নিজের পছন্দ ছেড়ে দিয়েছি।’

কথা শেষ করেই সে আদির বিষন্ন মুখটা একবার দেখে নিল।ওয়াজিদ আলগোছে হেসে বলল,’মন খারাপের কিছু নেই আদি।আমি মন থেকে বিশ্বাস করি নবনীতাই সেই মেয়ে যেই মেয়ে আরহামকে তার বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের করে আনতে পারবে।’

সে থামল।একটু শ্বাস নিল।জিরিয়ে নিয়ে বলল,’নবনীতাকে নিয়ে আমি আরহামের মধ্যে একটা সিগনিফিকেন্ট চেঞ্জ দেখতে পাই।আরহাম মেয়েটিকে পছন্দ করে।সিটি কলেজের সেই ঘটনার পর থেকে আমি তার মাঝে একটা অনুশোচনা,একটা অস্বস্তি,একটা মন খারাপের ভাব দেখতে পেতাম।সেই মন খারাপের পুরোটাই ছিল নবনীতাকে নিয়ে।তার সবসময় এটাই মনে হতো তার জন্য একটি মেয়ের নামে উল্টা পাল্টা কথা ছড়ানো হচ্ছে।এই বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে আদি।আরহাম বিচলিত ছিলো একটি মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা তুলার বিষয়ে।যেই আরহাম কে আমি চিনতাম সেই আরহাম দিনরাত মেয়েদের গালমন্দ করত।সেই আরহামের মাঝে যখন আমি এই পরিবর্তন দেখলাম,তখন আমার মনে হলো আমার পিছিয়ে যাওয়াটাই উত্তম।তুই জানিস সে কি পরিমান পাগলামি অলরেডি করে ফেলেছে?
নবনীতার এক রিলেটিভ কে ধরে এনে থ্রেটও দিয়েছে সে যেন নবনীতার আশেপাশে না ঘুরে।ভাবা যায়?’

আদি গাঢ় স্বরে বলল,’একদম।আমারও এক ই কথা।আমি ভেবেছিলাম তোর ব্যাপারটা তাকে বলব।কিন্তু তার দিক থেকে যেই স্ট্রং ফিলিংস টা আমি উপলব্ধি করেছি,সেটার সামনে দাঁড়িয়ে আর কিছু বলতে ইচ্ছে হয়নি।আমার মনে হয়েছে সে খুব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।’

ওয়াজিদ মাথা নেড়ে এক লাফে ছাদে নেমে এলো।রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আদিকে দেখে ফিচেল হেসে বলল,’আমি ভেবেছিলাম সে কেবল ইনফেচুয়েশনে ভুগছে।তবে আমি নিজের কথা ফিরিয়ে নিয়েছি।সে মেয়েটিকে খুব বেশি পছন্দ করে।কিন্তু তার মেল ইগোর কারণে স্বীকার করছে না।তুই তো জানিসই কি পরিমান গোয়ার আর জেদি সে! ঐ জেদ ধরেই বসে আছে।আমি জানি নবনীতার সাথে সামনের দিনগুলো তে থাকতে থাকতে সে নিজের সমস্ত জেদ আর তেজ ছেড়ে দিয়ে নিজের সত্যিকারের স্বত্তাটিকে ফিরে পাবে।আর সেই আরহাম অবশ্যই নবনীতার শূন্য খা খা জীবনে শ্রাবণের বর্ষণ নামিয়ে আনবে।সবদিক ভেবে নিজের পিছিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো আদি।নবনীতা কেবল আমার ভালো লাগা।কিন্তু তুই আর আরহাম আমার জীবনের অংশ।এমন একটি ব্যাপার নিয়ে আমি আরহামের সাথে আমার এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারব না।আরহাম আর তোর সাথে কথা না হলে আমার সারাদিন কেমন মন খারাপ থাকে।নবনীতা জীবনে না থাকলেও চলবে,তবে এই জীবনে আরহামের থাকা টা জরুরি।’

আদি তার কথা শুনল মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়।একটি ছেলে নির্দ্বিধায় নিজের অনুভূতিটুকু বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে।কারণ সে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চায় না।যেই বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল স্কুল জীবন থেকে।তারপর একে একে বাইশটি বছর কেটে গেছে।ক্লাস টু এর বেঞ্চে লিখে রাখা তিনটি নাম এখনও একসাথে আছে।তাদের মাঝে রক্তের সম্পর্ক নেই।তবে একটি চমৎকার সম্পর্ক আছে,আত্মার সম্পর্ক,বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

আদি রেলিং থেকে নেমে শক্ত করে ওয়াজিদ কে জড়িয়ে ধরল।জড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় করল,’তুই জীবনে খুব সুখী হবি ওয়াজিদ।আমার মনে হয় তোর জন্য আল্লাহ চমৎকার কিছু ভেবে রেখেছেন।মিলিয়ে নিস আমার কথা।’

ওয়াজিদ জবাবে কেবল এক গাল হাসল।ভবিষ্যৎ নিয়ে সে আর ইদানিং ভাবে না।সামনে কি হবে সেটা নিয়ে তার আগ্রহও কাজ করে না।মা তার জন্য মেয়ে দেখছে।মা যাকে বলবে ওয়াজিদ তাকেই বিয়ে করবে।এ বিষয়ে সে আর নতুন করে কিছু ভাবতে ইচ্ছুক না।

***

ঠিক রাত তিনটার দিকে এপাশ ওপাশ করতে গিয়ে আরহামের ঘুম ভাঙল।ঘুম ভাঙার পর আশপাশ দেখে সে বুঝতে পারল এটা তার ঘর না।একটু ধাতস্থ হতেই তার মনে পড়ল আজ তার বিয়ে হয়েছে আর এই ঘরটা নবনীতার।

মনে পড়তেই সে এক লাফে উঠে বসল।পুরো ঘর ফাঁকা।মেয়েটা গেল কোথায়?সে একবার বারান্দায় উঁকি দিলো।বারান্দা একদম ফাঁকা।আরহাম খুব বেশি মাথা ঘাটালো না।নিশ্চয়ই রিমিদের ঘরে গিয়েছে।সে আবারো ধপ করে শুয়ে পড়ল।পাশ ফিরতেই কিছু একটা দেখে সে হকচকিয়ে ওঠে।খাটের এক পাশে নবনীতার হাত দেখা যাচ্ছে।সে নিজের হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে।

আরহাম দ্রুত খাট থেকে নামল।এগিয়ে এসে দেখল মেয়েটা বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে।সে বসেছে ফ্লোরে,আর মাথা রেখেছে খাটে।আরহাম এগিয়ে এসে তার ঠিক মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসল।খেয়াল করল তার কোলের উপর একটা ফটো অ্যালবাম।আরহাম অতি সন্তর্পণে সেটি হাতে নিল।

ধীরে সুস্থে অ্যালবাম টা খুলতেই সে বুঝলো এটা নবনীতার ফ্যামিলি অ্যালবাম।আরহাম উঠে গিয়ে বারান্দার সামনের পর্দা গুলো দুই ধারে চাপিয়ে দিলো।তারপর আবারো হেঁটে এসে নবনীতার পাশাপাশি গিয়ে বসল।চাঁদের রূপালি আলোতে চারদিক ভালোই দেখাচ্ছে।কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন নেই।

আরহাম একে একে সবগুলো ছবি দেখল।দেখতে দেখতেই সে কিছুটা আশ্চর্য হলো।নবনীতার বাবার মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে।কোথাও দেখেছি কি?ঠিক মতো মনে পড়ছে না।কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয় অ্যালবামের অধিকাংশ ছবিই নামি দামি রিসোর্টে তোলা,তার মধ্যে কিছু আবার দেশের বাইরে।আরহাম কেবল বিস্মিত নয়নে সেসব দেখে।ছবিতে যেই হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে এই মেয়েটিই নবনীতা?এতো সুন্দর! কতো দামি দামি পোশাক! বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কি হাসি!বেশভূষা চালচলন সবকিছুতেই আভিজাত্যের ছোঁয়া স্পষ্ট।এতোটা আভিজাত্যের মাঝে থাকার পর এই মেয়েটি এই কষ্টের জীবনে কেমন করে মানিয়ে নিল?তার মা বাবা কোথায়?মা বাবা না থাকুক,কোনো আত্মীয় স্বজনই কি নেই?

আরহাম অ্যালবাম দেখতে দেখতেই অবাক হয়ে বলল,’এগুলো পরীর ছবি?বিশ্বাসই হচ্ছে না।সত্যিই পরীর মতো দেখাচ্ছে।’

সে অ্যালবাম বন্ধ করে পুনরায় সেটা নবনীতার কোলের উপর রাখল।চোখ মেলে একবার গভীর দৃষ্টিতে নবনীতাকে দেখতেই সে খেয়াল করল নবনীতা আজ চুল বাঁধে নি।এলোমেলো চুল সব মুখের উপর এসে ভীড় করছে।আরহাম কাঁপা কাঁপা হাতে তার মুখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো।

একটি চাঁদের আলোয় আলোকিত রাত।সেই আলোতেই ছিমছাম ঘরটাতে আরহাম গালের নীচে হাত রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল।তার মুখ,তার কপাল,তার চোখ,তার ঠোঁট,তার নাক,তার গাল কোনোকিছুই বাদ গেল না।আরহাম সিদ্ধান্ত নিল বাকি রাতটুকু সে এভাবেই বসে থেকে কাটাবে।আরামে ঘুমানোর চেয়ে ফ্লোরে বসে বসে এই অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকন করা আরো বেশি ভালো।সে মুখে সূক্ষ্ম এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে নির্নিমেষ মেয়েটিকে দেখে গেল।তার নাম পরী।সে সত্যিই পরী।যে পরীকে আরহাম তার ঘরে আনতে চেয়েছিল।পরীটা অবশেষে তার ঘরে এসেছে।কি চমৎকার ব্যাপার!

নবনীতার চন্দ্র বিলাশের স্বপ্ন পূরণ হলো,সেটাও তার অগোচরে।সে জানলও না তার বর পুরো রাত জেগে জেগে শুধু তাকেই দেখেছে।তার তাকে অ্যালবাম দেখানোর ইচ্ছে ছিল।সেই সুপ্ত বাসনাও পূরণ হলো।কিন্তু মেয়েটা টেরও পায়নি।আরহাম আরো একবার হাত বাড়িয়ে তার চুলগুলো ঠিক করে দিলো।তার ইচ্ছে হচ্ছে নবনীতার একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতে।কিন্তু সেটা সম্ভব না।মেয়েটা জেগে যেতে পারে।সে আর মাঝরাতে কোনো ঝামেলা চায় না।সে হাসি মুখে আরো একবার তার দিকে তাকায়।অস্ফুটস্বরে বলে,’পরী! তোমাকে আমার এলোমেলো,ছন্নছাড়া আর উদ্ভ্রান্ত জীবনে স্বাগতম।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২৬ [২]

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২৬)[প্রথম অংশ]

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর রিমি ব্যস্ত হয়ে পড়ল খাবার দাবারের আয়োজন নিয়ে।সারাহ চারদিক দেখে ঘাম মুছতে মুছতে হাঁসফাঁস করে বলল,’কি একটা অবস্থা! এসি পর্যন্ত নেই এখানে।’

তাসনুভা তার কথা শুনেই মুখ ভেংচায়।মনে মনে বিড়বিড় করে,’ফকিন্নি একটা!’

নবনীতা বিয়ের যাবতীয় কাজ শেষ হতেই চুপচাপ উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।চিত্রা হেঁটে গিয়ে বসল ঠিক আরহামের পাশে।আরহাম তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,’কেমন আছো চিত্র?’

চিত্রা হাসল।মাথা নেড়ে জানাল সে ভালো আছে।আরহাম আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল,’তোমার এখন কেমন লাগছে চিত্র?’

চিত্র দুই হাত প্রসারিত করে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,’এতো বেশি ভালো।তুমি এখন থেকে সত্যি সত্যিই আমার ভাইয়া।’

আরহাম তাকে তার এক কোলের উপর বসিয়ে টুপ করে তার দুই গালে চুমু খেয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’একদম একদম।আজ থেকে আমি অফিসিয়ালি তোমার আরাম ভাই চিত্র।’

____

শাড়ির আঁচল রিমিকে ভীষণ বিরক্ত করছিল।সে অবশেষে বিক্ষিপ্ত মেজাজে আঁচলটা কোমরে গুজে নিল।বসার ঘরটা কেমন নোংরা দেখাচ্ছে।সবাই এখন টেবিলে বসে খাচ্ছে।শারমিন তাদের বেড়ে দিচ্ছে সবকিছু।এই ফাঁকে রিমি দ্রুত ঝাড়ু নিয়ে বসার ঘরটা একটু ঝেড়ে নিল।ঝাড়া শেষেই সে চোখ বুলিয়ে একনজর পুরো ঘর দেখল।দেখেই গর্ব করে বলল,’সাব্বাশ রিমি।কি চমৎকার কাজ করিস তুই!’

সে ঝাড়ু টা কাঁধের উপর রেখে পেছন ঘুরল।ওয়াজিদ খাওয়া শেষে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কেবলই বসার ঘরে এসেছিল।রিমি এই ঘরে আছে জানলে সে কোনোদিনই আসত না।আসা মাত্র কোথা থেকে একটি ঝাড়ু শূন্যে ভেসে তার কাঁধে এসে ধাক্কা খায়।

সে ধাক্কা খেয়েই হকচকিয়ে উঠে।তবে সে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে এই কাজ কার।সে থমথমে মুখে সামনে তাকায়।রিমি হতভম্ব হয়ে গোল গোল মুখ করে তাকেই দেখছে।সে মুখ খোলার আগেই ওয়াজিদ একটানে বলে উঠে,’সরি ভাইয়া।মিস্টেক হয়ে গেছে।নেভার মাইন্ড।’

রিমি থতমত খেয়ে মুখ বন্ধ করে নেয়।কি অদ্ভুত! সে এটাই বলতে যাচ্ছিল।অথচ ওয়াজিদই নিজ থেকে সেটা বলে দিয়েছে।তার হতবাক চাহনি কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ওয়াজিদ সোফায় গিয়ে বসল।তাসনুভা বসার ঘরে এসেই রিমি কে দেখামাত্র বলল,’সে কি! তুমি এই শাড়ি পরেই এতো কাজ করছ?’

ওয়াজিদ একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বসেছিল।সে তাসনুভার কথা শুনতেই ম্যাগাজিন থেকে চোখ সরায়।একবার রিমিকে দেখে।দেখতেই একবার মুখ টিপে হাসল।কোমরে আঁচল গুজে ঝাড়ু হাতে তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।সে আনমনে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বিড়বিড় করে বলে,’পুরাই কাজের বেটি সখিনা।’

রিমির সাথে ওয়াজিদের নেভার মাইন্ড রিলেশন তখনো চলমান।সে খাবার শেষে সবাইকে ক্ষীর দিচ্ছিল।সবাই ঠিক মতোই দেখেশুনে হাতে নিল।একমাত্র ওয়াজিদ ম্যাগাজিনে চোখ রেখে আন্দাজে বাটিটা হাতে নিল।সে ঠিক মতো ধরার আগেই রিমি বাটিটা ছেড়ে দিলো।ফলাফল-সমস্ত ক্ষীর গিয়ে পড়লো ওয়াজিদের কোলের উপর।

রিমি আঁতকে উঠল।পরক্ষণেই চেঁচিয়ে উঠে বলল,’এইবার আপনার দোষ।একটু দেখে নিবেন না?’

ওয়াজিদ একবার নিজের কোল,আর একবার রিমির মুখ দেখল।তারপরই দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’তুমি এরপর থেকে আমার ধাঁরের কাছেও আসবে না।গর্দভ একটা!’

রিমি তেঁতেঁ উঠে কিছু বলতেই যাচ্ছিল,কিন্তু হঠাৎই কিছু মনে পড়ায় সে থেমে গেল।ওয়াজিদ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক ফোরামের সদস্য।কোনো কাজ লাগলে তার কাছেই যেতে হবে।খামোখা ঝগড়া করে সম্পর্ক খারাপ করে লাভ নেই।শেষে ভোগান্তি ঐ রিমিকেই পোহাতে হবে।

***

‘হচ্ছে টা কি শুভি?আধঘন্টা ধরে টানাটানি করছিস।কানা নাকি তুই?’

নবনীতার গায়ের সমস্ত গয়না শুভ্রা অতি সন্তর্পণে খুলে এনেছে।কেবল ঝাপটা টা এমন ভাবে চুলের সাথে আটকে গেছে যে শুভ্রার পক্ষে সেটা এক টানে বের করা সম্ভব হচ্ছিল না।সে মুখ কাচুমাচু করে বলল,’একটু ধৈর্য ধরো আপাই।হয়ে যাবে।’

নবনীতা চটে গিয়ে বলল,’সেটা তো সেই তখন থেকে শুনছি।হয়ে যাবে,হয়ে যাবে।আর কখন হবে?তাড়াতাড়ি কর।’

শুভ্রা হতাশ চোখে তার বোনকে দেখে।বিয়ের পর সে একছুটে নিজের ঘরে এসেছে।এসেই নিজের গয়না নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে।কানের দুল নিয়ে এমন টান দিচ্ছিল যে শুভ্রা ছুটে না এলে সে নির্ঘাত কান ছিঁড়ে সেটা বের করে আনতো।

অবশেষে শুভ্রা সক্ষম হয়েছে ঝাপটা টা তার মাথা থেকে আলাদা করতে।নবনীতা অলংকার মুক্ত হতেই দ্রুত উঠে দাঁড়ায়।শাড়ির কুচি সামলে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়।শুভ্রা হাতে থাকা গয়না গুলো নবনীতাকে দেখিয়ে বলল,’এগুলো কি করব আপাই?’

নবনীতা আলমারিতে কাপড় খোঁজার ফাঁকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে দেখে।তার থমথমে মুখ দেখেই শুভ্রা তব্দা খায়।নবনীতা বরফ শীতল গলায় উত্তর দেয়,’এগুলো সব খেয়ে ফেল।’

বলেই আবার সে নিজের কাজে মন দেয়।আলমারি ঘেটে একটা সাদামাটা জামা বের করে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়।শুভ্রা তার হাতের জামা দেখেই মুখ কুঁচকায়।বিয়ের দিন কেউ এমন জামা পরে?যাক গে,বিয়ে যে করেছে এটাই তো অনেক।জামা নিয়ে বললে আবারও একটা ত্যাড়া উত্তর দিবে।শুভ্রা গয়না গুলো বাক্সে রেখে রান্নাঘরে গেল।রিমি আপু একা একা সব করছে।সে সাহায্য করলে কাজ একটু এগিয়ে যাবে।

নবনীতা লম্বা সময় নিয়ে গোসল করে যখন বের হলো,তখন দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছিল বিকেল পাঁচটা পনেরো।নবনীতা খাটের উপর রাখা ওড়না টা গায়ে চাপিয়ে বসার ঘরের দিকে উঁকি দেয়।সবাই সেখানেই আছে।রিমি আবার তাদের জন্য খাবারও অর্ডার করেছে।

নবনীতা একবার যাবে ভেবেও পরে আর গেল না।তাসনুভার সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।সেদিন মেয়েটা বাড়ি এলো।একটু কথা বলার জন্য কতো অনুনয় বিনয় করল।নবনীতা তো তার দিকে ফিরেও তাকায়নি।তার এখন ইচ্ছে করছে তাসনুভার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে।কিন্তু সেটা সম্ভব না।তার কারণ হচ্ছে তাসনুভার বড় ভাই।যে কি-না তাসনুভাকে আগলে ধরে বসে আছে।এখন অবশ্য সে তাসনুভার ভাই না কেবল,তার স্বামীও।নবনীতা তাচ্ছিল্য করে হাসল।এ নাকি স্বামী! একে দেখে মনে হচ্ছে একটু আগে এর বিয়ে হয়েছে?

নবনীতা তাড়াতাড়ি দরজা ভিড়িয়ে নিজের খাটে গিয়ে বসল।তার কি?সে নিজেও তো কোনো বিবাহিত মেয়ের মতো আচরণ করছে না।সে পাখা ছেড়ে দিয়ে বালিশে মাথা রাখে।তার সাথে একটা অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে কিছুক্ষণ যাবত।বিগত কয়েকদিন তার কেমন অশান্তি অশান্তি লাগছিল।কিন্তু বিয়ের পর থেকেই সে অশান্তি ভাবটা কেটে গেছে।খুবই অদ্ভুত! তার এখন আরো বেশি কষ্টে থাকার কথা।কিন্তু অবাক করা বিষয় তার অতোটাও খারাপ লাগছে না।উল্টো হালকা লাগছে।কবুল বলার আগেও তার মুখ দিয়ে শব্দ আসছিল না।অখচ বিয়ে হওয়ার পর মনে হচ্ছে এমন কি হয়েছে?বিয়েই তো হয়েছে।সবার হয়,তার হয়েছে।সে তো আর সংসার করছে না।

নবনীতার শান্তি অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।সন্ধ্যার পরই রিমির ঘর গোছানো দেখে নবনীতা কপাল কুঁচকায়।অবাক হয়ে বলে,’এতো গোছগাছ করছিস কেন?তোর বিয়ে লেগেছে?’

রিমি গোছাতে গোছাতেই নিরেট স্বরে বলল,’না আমার লাগেনি।তোর লেগেছে।’

নবনীতা হাই তুলতে তুলতে অলস ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,’সে তো শেষ ও হয়ে গেছে।’

রিমি আড়চোখে একবার তাকে দেখে।তারপরই মুচকি হেসে বলে,’বিয়ে হয়েছে।বাসর তো আর হয়নি।সেটার ব্যবস্থা করছি।’

নবনীতা এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।চেঁচিয়ে উঠে বলে,’কি?বাসর হবে মানে?ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি?’

রিমি নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,’না ময়না।কোনো ইয়ার্কি হচ্ছে না।বিয়ের পর সবারই বাসর হয়।ইটস ভেরি সিম্পল ডার্লিং।’

নবনীতা দুই কদম এগিয়ে আসে।নিশ্বাস বন্ধ করে বলে,’রিমি! আমাদের এটা কোনো নরমাল বিয়ে না।বিয়ের সময় এমন কিছু বলা হয় নি।বলেছিল যে যার মতো যার যার ঘরে থাকবো।’

‘সেটা তো থাকবিই।’

‘তাহলে এসব বাসর টাসর কেন?’

‘আরহাম ভাই আজ তোর ঘরে থাকবেন।’

নবনীতা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠে,’কিন্তু কেন?’

রিমি তার সামনে তুই হাত জোর করে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,’আমি জানি না রে বইন।তুই গিয়ে তোর মামাকে জিজ্ঞেস কর।তোর মামাই আমাকে বলেছে সব করতে।বিয়ের রাতে বর বউ একসাথেই থাকে।এটাই নিয়ম।’

নবনীতা কতোক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল।তারপরই জেদ দেখিয়ে বলল,’করব না আমি বাসর।ঐ নেশা’খোরের সাথে এক ঘরে আমি কিছুতেই থাকবো না।’

‘ভেরি গুড।এখন এই ক্যাচাল আমার কাছে না করে তোর মামার কাছে গিয়ে কর।আমাকে বলছিস কেন?’

নবনীতা অসহায় মুখে হেঁটে এসে ধপ করে খাটে বসে পড়ল।আতঙ্কিত চোখে রিমিকে দেখে বলল,’ঐ বদমাশ টা যদি কিছু করে?তখন?’

রিমি তার কথা শুনেই খিলখিল করে কতোক্ষণ হাসল।শেষটায় পেটে হাত চেপে বলল,’বিয়ে হয়েছে তোর নবনী।কিসব যা তা বলছিস।কিছু করে মানে?পা’গল নাকি তুই?’

‘বার বার এক কথা বলবি না তো।আমাদের কোনো স্বাভাবিক বিয়ে হয়নি।এসব নিয়ে আমি একবারও ভাবিনি।’

‘না ভাবলে এখন ভেবে ফেল।’চটপট উত্তর দেয় রিমি।

নবনীতা আশাহত হয়ে কতোক্ষণ খাটে বসে থাকল।মামাকে কিছু বলে লাভ নেই।সে মামাকে বলেছে সে সব কথা শুনবে।নবনীতা ক্লান্ত চোখে পুরো ঘরটা একবার দেখল।খাটের সাইড বক্সের দিকে চোখ পড়তেই সে থামল।সেটার উপর একটা পিতলের ফুলদানি আছে।নবনীতা সেটা নেড়ে চেড়ে দেখে।সে প্রথমে ঐ বদমাশ টা কে মুখ দিয়ে বারণ করবে।তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে সে সোজা এটা দিয়ে তার মাথা ফা’টিয়ে দিবে।সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।সে এটাই করবে।এরপর যা হওয়ার হবে।

***

রাত প্রায় নয়টার দিকে আদি ঘড়ি দেখতে দেখতে উঠে দাঁড়াল।আরহাম তখন সাদেক সাহেবের ঘরের সাথে থাকা বারান্দায় কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত।বিকেলের পর থেকেই তার একটার পর একটা ফোন আসছে।সে সেগুলোর জবাব দিতে দিতে হয়রান।

আদি আরো একবার সময় দেখে বলল,’চল আমরা মিলে আরহামকে লুট করি।’

তাসনুভা চোখ তুলে অবাক হয়ে জানতে চায়,’লুট করব মানে?’

‘আহা! শা’লা একটু পরে বউয়ের কাছে যাবে না?আমরা যাওয়ার আগে তার রোড ব্লক করে দিব।মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করব।টাকা না দিলে বউয়ের কাছে যেতে দিব না।’

তাসনুভা আপত্তি করে বলল,’কিন্তু ভাইয়াদের বাসর তো নরমাল বাসর না।’

আদি খ্যাক করে উঠে বলে,’এসব আবার কেমন কথা?নরমাল এব-নরমাল আবার কি জিনিস?বাসর বাসরই।ভেতরে গিয়ে এরা চুলোচুলি করুক,মারামারি করুক,একটা আরেকটা কে খু*ন করে ফেলুক।আমাদের কি?’

আরিশ তার কথা শুনে কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,’ভাইয়া নিজেও তো বউয়ের কাছে যেতে চায় না।সেক্ষেত্রে আমরা বাঁধা দিলে সে তো আরো খুশি হবে উল্টো।’

আদি গালে হাত রাখে।গম্ভীর হয়ে বলে,’রাইট।কথায় যুক্তি আছে।দাঁড়া অন্য কিছু ভাবি।’

আরহাম সব কাজ শেষ করে বারান্দা থেকে বেরিয়ে বসার ঘরের দিকে যেতেই আদি সহ বাকিরা তাকে ঘিরে ধরল।সারাহ বাদে সবাই সেখানে উপস্থিত ছিল।সারাহ দুপুরে কোনোরকমে খেয়েই চলে গিয়েছে।তার নাকি এখানে ভীষণ গরম লাগছে।এসি ছাড়া থাকার তার অভ্যাস নেই।

আরহাম চোখ সরু করে বলল,’কি?সমস্যা কি?’

আদি বুকে হাত বেঁধে বলল,’সমস্যা কিছু নেই।’

‘তাহলে এমন ঘিরে ধরেছিস কেন মৌমাছির মতো?’

আদি কোনো ভূমিকায় গেল না।সোজা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’টাকা দে।’

‘কি?টাকা দিব মানে?কোন সুখে টাকা দিব তোকে?যা সর।’

আরহাম তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আগেই আদি দ্রুত তার দুই কাঁধ চেপে ধরল।আরিশ জেদ ধরে বলল,’না ভাইয়া,আজকে আমাদের টাকা দিতেই হবে।বাসর ঘরে যাওয়ার আগে এমন টাকা দেওয়ার নিয়ম আছে।’

আরহাম তার কথা শুনেই কুটিল হেসে বলল,’কেন কেন?না দিলে কি করবি?আমার প্রাইভেসি নষ্ট করবি?কর।আমার কোনো আপত্তি নাই।’

‘জ্বী না।তোমার প্রাইভেসি নষ্ট করব না।তোমার সিকিউরিটি নিশ্চিত করব।’

আরহাম বিস্মিত হয়ে শুধায়,’আমার সিকিউরিটি আবার কি?’

আদি দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’তোর ডন বউ যদি তোকে মে’রে ফেলে?তখন আমরা গিয়ে তোকে বাঁচাবো,বুঝলি?আর টাকা না দিলে মরে ভূত হয়ে গেলেও আমরা তোকে বাঁচাতে যাবো না।হুহ।’

আরহাম স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনে।গুনে গুনে তিন সেকেন্ড পরে সে শব্দ করে হেসে উঠে উপহাস করে বলে,’হোয়াট?সে আমাকে মা’রবে?আর আমি চুপ করে বসে থাকবো?’

ওয়াজিদ আশ্চর্য হয়ে বলল,’তুইও উল্টো আরো কয়েকটা দিবি নাকি?’

আরহাম পাঞ্জাবির কলার টেনে ঠিক করল।ভাব নিয়ে বলল,’শোন।আমি আরহাম।শাহরিয়ার আরহাম।বউ কেমন করে পোষ মানাতে হয় সেটা আমি জানি।’

সে থামল।গোল গোল কয়েক জোড়া চোখের দৃষ্টি তারই দিকে।আরহাম গম্ভীর হয়ে বলল,’মাত্র তো বিয়ে হয়েছে।দেখবি এমন টাইট দিব,গর্জন টর্জন ভুলে সারাদিন শুধু ম্যাও ম্যাও করবে।’

আরিশ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল,’কে?তুমি না ভাবি?’

আরহাম থতমত খায়।আদি হো হো করে হেসে উঠে বলে,’এক্সাক্টলি।সেটাই জানতে চাইছিলাম।’

আরহাম সেসব কথা গায়ে মাখল না।পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তার পকেটে থাকা মানিব্যাগের পুরোটাই তাদের হাতে তুলে দিলো।আদি দুই হাত দিয়ে সেটা বুকের সাথে চেপে ধরল।প্রশস্ত হেসে বলল,’ইশশ শান্তি! যা যা শুভ বাসর মোবারক।ম’রে গেলে জেনে রাখিস আমরা তোকে খুব ভালোবাসতাম।’

আরহাম কুটিল হাসে।এক হাতে তুড়ি মেরে তাচ্ছিল্য করে বলে,’মাত্র তো বিয়ে হয়েছে।এই তেজ এই জেদ আর ক’দিন পর থাকবে না।দেখবি আমি পাত্তা দিব না,তাও নবনীতা আরহাম আরহাম করে হেদিয়ে মরবে।দেখে নিস।’

আরহাম নবনীতার ঘরে ঢোকার আগে তিনবার দোয়া ইউনুস পাঠ করে গায়ে ফু দিলো।বলা তো যায় না।যেই মেয়ে! ঘরে ঢুকতেই দা বটি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে।

আদি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।গম্ভীর হয়ে বলে,’ভবিষ্যৎে যে কি হবে,তার একটু আভাস এখনই পাওয়া যাচ্ছে।’

আরহাম কটমট করে বলল,’চুপ থাক।তুই বেশি বুঝিস।’

সে ধীর পায়ে এগিয়ে আস্তে করে দরজার সামনের লক ঘোরায়।আদি পেছন থেকে সতর্ক করে বলল,’সাবধান বন্ধু! বেশি চুটকি ফুটকি বাজাতে যাস না আবার।মেয়ে কিন্তু সুবিধার না।’

আরহাম নবনীতার ঘরে যেতেই আদি দ্রুত তার মানিব্যাগ খুলল।খুলতেই তার চোয়াল ঝুলে গেল।সে আঁতকে উঠে বলল,’কি রে?এটা তো খালি।’

সে পুরো ব্যাগ হাতড়ে একটা চিরকুটের মতো কিছু পেল।সেটা খুলতেই দেখল সেখানে বড়ো করে লিখা “ঘোড়ার আন্ডা”
আদি খ্যাক খ্যাক করে উঠে বলল,’শা’লা একটা জাত ছ্যাচড়া।ছ্যাচড়ামোর ও একটা সীমা থাকে।’

তাসনুভা চোখ সরু করে বলল,’কাগজের পেছনেও তো কিছু লিখা আছে।দেখো তো।’

আদি দ্রুত কাগজ টা উল্টে নেয়।মাথা নেড়ে বলে,’তাই তো’
কাগজের পেছনে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,’সব টাকা আমার বড় শ্যালিকা কে দিয়ে দিয়েছি।সব কাজ তো সে ই করেছে।তোদের মতো ঘোড়ার আন্ডা সার্ভিস দেওয়া পাবলিকের জন্য আমার পক্ষ থেকেও ঘোড়ার আন্ডা সালামি দিলাম।’

চিরকুটের লিখা পড়েই রিমির হাসি পেল।বিকেলেই আরহাম তাকে তার মানিব্যাগের সব টাকা বের করে দিয়ে দিয়েছে।সে সেগুলো আলমারিতে যত্ন করে রেখেছে।আদি চিরকুট পড়েই রিমির দিকে দেখে গজরাতে গজরাতে বলল,’শা’লা কতো বড়ো বাটপার! যাহ,এবার তোর বউ তোকে মে’রে ফেলুক।আমরা কেউ কিছু বলব না।তোর বড় শ্যালিকা গিয়ে তোকে বাঁচাবে।’

রিমি তার কথা শুনেই চোখ পাকিয়ে বলল,’মে’রে ফেলবে মানে?আমার দুলাভাই কি সস্তা নাকি?’
কথা বলেই সে এক আঙুল তুলে মিছেমিছি হুংকার দিয়ে বলল,’আমার দুলাভাইয়ের গায়ে যদি আজ একটা আঁচড়ও লাগে,তাহলে লা’শ পড়বে লা’শ।এ আমি বলে দিলাম।’

তার কথার ধরনে কিছু একটা ছিল।যেটা শত অস্বস্তির মাঝেও ওয়াজিদের মন ভালো করে দিলো।সে তার কথা শুনতেই হো হো করে হেসে ফেললো।বাকিরা সব চোখ ঘুরিয়ে তাকে দেখছিল।ওয়াজিদ মুখে হাত চেপে হাসি থামানোর চেষ্টা করল।রিমি অবাক হয়ে কয়েক পলক তাকে দেখে গেল।কতো সুন্দর হাস্যোজ্জ্বল একটি মুখ! অথচ এই সুন্দর প্রাণবন্ত হাসি এতোদিন গাম্ভীর্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে ছিল।এই প্রাণবন্ত ওয়াজিদ কে রিমির ভালো লাগছে,বেশ ভালো লাগছে।

চলবে-

ধৈর্যের পরীক্ষা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#ধৈর্যের_পরীক্ষা
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি।
#পর্ব_শেষ

এরপর থেকে রাতুল সারিকাকে তার ভার্সিটিতে নিজের বাইকে করে দিয়ে আসে আর নিয়েও আসে।একদিন সে তাড়াতাড়ি সারিকাকে নিতে চলে গেলে দেখে সারিকার ছুটি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে।আসলে সারিকা টিউশন আর ক্লাসের সময় মিলিয়ে বেশি সময় বলেছে বাসায়।আর সে এখন টিউশনে গিয়েছে। তাই সে ভার্সিটিতে নেই।সে সারিকাকে ফোন করে বলে ভার্সিটির সামনে আসতে বলে।সারিকা এসে দেখে রাতুল আজ তাড়াতাড়ি এসে পরেছে। সারিকা তাড়াতাড়ি নিজের টিউশনি শেষ করে রাতুলের কাছে আসে।রাতুল তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে না,,হেলমেট পরিয়ে এবং নিজে পরে বাইক স্টার্ট দেয়।

বাসায় এসে শান্ত কন্ঠে বলে~~

“তোমার আজ থেকে টিউশনি করানো বন্ধ। আমি তোমার যাবতীয় দায় দায়িত্ব নিয়েছি তাই আমিই তোমার সব খরচ চালাবো”।

“”এই বিষয়ে আমাদের বাসর ঘড়েই কথা হয়েছে। আমি এই বিষয়ে কোন তর্কে যেতে চাই না।শুধু একটাই কথা বলতে চাই যে আমার মনের দায়িত্ব নিতে পারে না তাকে আমার অন্য দায়িত্বও নিতে হবে না।””

এক পর্যায়ে তাদের দু’জনের কথা কাটাকাটি হয়।রাতুল সারিকাকে কিছু কটু কথা বলে রেগে অনামিকার বাসায় চলে যায়।সে চায় না সারিকাকে আর এই লোক দেখানো সম্পর্কে বেধে রাখতে।খুব শীঘ্রই তাকে মুক্ত করে দিবে এই সম্পর্ক থেকে।তার জন্য আগে অনামিকাকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে হবে।তাই সে অনামিকার বাসায় যায়।গিয়ে দেখে তাদের বাড়ি খুব সুন্দর করে সাজানো।তাদের বাসার ভেতরে ঢুকে দেখে অনামিকা বধু বেশে বসে আছে আর তার পাশে সেইদিনের সেই ছেলেটা।অনামিকাও রাতুলকে দেখে একটু অপ্রস্তত হয়ে যায়।সে রাতুলকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে~

‘”দেখো তুমি তোমার মায়ের পছন্দে বিয়ে করে ফেলেছ আমিও আমার বাবার পছন্দে করে ফেললাম।ভেবে দেখলাম আমাদের এই সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ নেই। তাই যে যার মতো পছন্দের জীবন সাথী নিয়েই থাকাটা বেটার।আশা করি বুঝতে পেরেছ আর কোন ঝামেলাও করবে না ভবিষ্যতে আমার বিয়ে নিয়ে।”

রাতুল একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে~

“করব না কোন ঝামেলা।শুধু একটা কথা বলো তো,,বিয়েটা তুমি তোমার বাবার পছন্দের করেছো নাকি নিজের?”

এই পর্যায়ে অনামিকা কিছু বলতে পারে না জোর গলায়।সে আমতা আমতা করে বলে~

“বাবার”।

“হয়েছে। আর বলা লাগবে না। আজকে জানো এইখান থেকে গিয়ে খাশ মনে দুই রাকাআত শোকরানা নামাজ পড়বো তোমার মতো একজন ফ্রড থেকে বাচিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ আমাকে। আর সারিকার মতো একজন পূন্যবতী মেয়েকে আমার বউ হিসেবে দিয়েছেন তাই”।

অনামিকা রেগে কিছু বলতে চাইলে রাতুল তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায়।মনের কষ্টে একটা দূরে নদীর তীরে যেয়ে বসে থাকে।রাতে অনেক লেট করে ফিরে। বাসায় এসে দেখতে পায় সারিকা এখানে না ঘুমিয়ে তার জন্য ওয়েট করছে।

সে মনে মনে আল্লাহর কাছে অনেক ধন্যবাদ দেয় তাকে এমন একজন স্ত্রী দেওয়ার জন্য। আজ সে বুঝতে পারছে বাসর রাতে কেন সারিকাকে ওই কথাগুলো বলার ওর এতেটা বিধস্ত দেখাচ্ছিলো।

রাতুল ফ্রেস হয়ে এসে দেখে সারিকা তার খাবার নিয়ে বসে আছে। সেও চুপচাপ বসে পরে খেতে। মনে করে সারিকাকে জিজ্ঞেস করে সে খেয়েছে কিনা। সারিকা গম্ভীর মুখে বলে সে খেয়েছে। রাতুল জানে সে খায় নি। কারণ একদিন ময়না(বাসার হেল্পিং হ্যান্ড) কথায় কথায় বলে দিয়েছিলো রাতুল না আসা পর্যন্ত সারিকা খায় না।
সে এক লোকমা ভাত সারিকার মুখের সামনে ধরে।সারিকা অবাক হয়ে যায়।সে পুনরায় জানায় সে খেয়ে নিয়েছে রাতের খাবার। রাতুল শান্ত কন্ঠে বলে~

“মিথ্যাটা একটু পরে বলো। আগে ভাতটা নাও মুখে।দেখো তুমি যদি লোকমা টা না নাও আমিও খাবো না।”

সারিকা উপায় না পেয়ে তার সাথেই খেতে লাগলো।বিয়ের পর আজই প্রথম রাতুল তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মনে মনে খুশিতে ফেটে পরলেও মুখে তা প্রকাশ করে না সারিকা।

খাওয়ার পর সারিকাকে বেলকনিতে আসতে বলে রাতুল আগে আগে সেখানে চলে যায়।সারিকা এটো থালাবাসন রান্নাঘরে রেখে আসে,,তারপরে গিয়ে রাতুলের পাশে বসে।তারপর রাতুল আস্তে ধীরে অনামিকার সব কথা বলে।সেই সাথে এ-ও বলে সে এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে চায়।এতক্ষণ সব চুপ করে শুনলেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারে না সারিকা।সে বলে~

“আজ অনামিকা ছেড়ে গিয়েছে বলে আপনি এই সম্পর্কটাকে কন্টিনিউ করতে চান,,সে যদি না যেতো তাহলে আমাদের কিন্তু এক না এক সময় বিচ্ছেদ ঠিকই হতো। আমি কেন আপনার সেকেন্ড চয়েজ হবো? আমারও অধিকার আছে কারো ফার্স্ট চয়েজ হওয়ার। আপনি চাইলেও আমি এখন আর সম্পর্কটাকে চাই না। খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে মুক্ত করে দেবো।

“আমি কি ভালোবাসার এতটাই অযোগ্য যে সকলে আমায় ছেড়ে চলে যায়?”

“উহু,,আপনি মানুষ হিসেবে চমৎকার আর স্বামী হিসেবেও। যদিও সেটা আপনার লোক দেখানো। কিন্তু আপনি একটা কথা বলেন আমাকে,,কাল যদি অনামিকা আবার আপনার কাছে ফিরে আসতে চায় আপনার মন কি একবারও বলবে না তাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখি। তখন আমি তো আবার সেই লোক দেখানো সম্পর্কে পরে যাবো। আমি কেন এমন দোদুল্যমান সম্পর্কে থাকবো? আমার কি অধিকার নেই স্বামীর সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার? তাই বলছি,,আমাকে ছেড়ে দেন। আমি চলে যাওয়ার পর না হয় যে আসবে তাকে নিজের ভালোবাসাটা দিয়েন।আমার এখন ভালোবাসতে ভয় হয় এই ভেবে,, কোন দিন জানি আপনি আমাকে ত্যাগ করেন।

রাতুল নিজের জায়গা ছেড়ে সারিকার সামনে এসে তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।তারপর বলে~

“একবার বিশ্বাস করে দেখো ঠকবে না কথা দিচ্ছি। ঠকে যাওয়া মানুষ কখনো অন্যকে ঠকায় না।

সারিকা রাতুলের চোখের চোখ রাখে। তার চোখ জোড়া অশ্রুতে পরিপূর্ণ কিন্তু ছেলে বলে সেগুলো বের করতে পারছে না। সারিকা রাতুলের চোখ দেখে তার মনে অবস্থা বুঝতে পারে। তাই সে বলে~

“দিলাম একটা সুযোগ। কিন্তু আপনাকে নিজেই এই বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।”

রাতুল হাসি মুখে সারিকার কথা মেনে নেয়। এরপর থেকে শুরু হয় তার বিশ্বাস অর্জনের মিশন। দিন যায়,, মাস যায় সারিকার প্রতি রাতুলের ভালোবাসা দিন দিন আরো বাড়তে থাকে। রাতুল মাঝে মধ্যে একা একা বসে ভাবে কেন সে অনামিকার আগে সারিকাকে ভালবাসলো না? তাহলে বাসর রাতে ওই সকল কথা বলে সারিকাকে কষ্ট দিতে হতো না।

আগে রাতুল শুধু জুম্মার নামাজটা পড়ত এখন সে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।এ কদিন রাতে সারিকা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে উঠলে দেখে রাতুল আগে থেকেই নামাজ পড়ছে। সে একটু অবাক হয় তাও কিছু বলে না। উঠে নিজের মতো ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজে দাড়ায়।

________________

কয়েক বছর পর~

“এই সারা এই দিকে আসো। আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন। নতুন বিছানাটা চাদরটা কালারস দিয়ে কি করে ফেলেছো।”

সাড়ে চার বছরের বাচ্চাটা মায়ের মার থেকে বাঁচতে দাদুর শাড়ীর আঁচলের তলায় লুকিয়ে পড়ে। মিসেস রহমানও তাকে নিজের আঁচল দিয়ে ঢেকে চুপ করে বসে থাকে। তার পুত্র বধু যে ভীষণ ক্ষেপেছে। হাতের কাছে পেলেই দুটো না লাগিয়ে দেয় নাতনিটাকে।শ্বাশুড়ির রুমে ঢোকার আগেই কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পায় মেয়েটি। গিয়ে দরজা খুলে দেখে তার সাহেব এসেছে। লোকটাকে দেখে তার যেনে রাগ আরে বৃদ্ধি পায়। এই লোকটার আশকারা পেয়ে মেয়েটা দিন দিন বাদরকেও অতিক্রম করে ফেলছে।

অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে বউয়ের এমন রুদ্রাণী রূপ দেখে কিছুটা ভরকে যায় রাতুল। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বউ তার চলে যায় কিচেনে। ফ্রেশ হতে নিজেদের রুমে ঢুকলে চক্ষু তার কপালে উঠে যায়।বিছানার চাদরের এই বেহাল অবস্থা দেখে বুঝতে পারে কি কারণে তার মিসেস রেগে আছে। সে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতে চলে যায়। এসে দেখে বউ তার রুম গুছাচ্ছে আর তাদের বাপ-বেটির পিন্ডি চটকাচ্ছে। রুম গোছানো শেষ হয়ে গেলে সারিকা রুম থেকে বের হতে গেলে রাতুল তাকে আটকে দেয়। টেনে নিয়ে আবদ্ধ করে নিজের বুক পিঞ্জরায়।সারিকা প্রথমে ছটফট করলেও কয়েক মুহূর্তে শান্তও হয়ে যায়।রাতুল তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে~~

“ওকে বকো না আর।আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো এমন আর না করতে।”

সারিকা যেনো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। মেয়েকে বকার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এতটা আদর। যা বেটা লাগবে না তোর এই আদর।সে বলেই ফেলে~~

“মেয়েকে যেনো আর না বকা দেই তাই এতো কাহিনী। ছাড়ুন লাগবে না আপনার আদর।দেন মেয়েকে আরো লায়।পরে বাদর হয়ে মাথায় উঠে নাচবে তখন বুঝবেন কত ধানে কত চাল।ছাড়ুন বদ লোক।”

রাতুল হেসে দেয় সারিকার এমন কথা শুনে। সে নিজের ডান হাত সারিকার গালে রেখে আলতো করে স্লাইড করতে করতে বলে~

“মেয়ের মাকে বুঝি এমনিতে আদর করি না। ওহ্ হো,কয়েকদিন ধরে তো করতে পারছি না। আচ্ছা ম্যামের কি এই কারণে অভিমান হয়েছে? আজকে রাতে সব অভিমান শেষ করে দেবো। ঠিক আছে মিসেস রহমান?”

সারিকা রাতুলের বুকে আলতো করে কিল দিয়ে বলে~~

“অসভ্য লোক আমি কি তা বলেছি। শুধু আজেবাজে কথা।”

“বলতে হবে কেন.? আমি বুঝি না মনে হয়।”

“কচু বুঝেন। খেতে আসুন। পাজিটা আপনার জন্য ওয়েট করে বসে আছে আজ।”

রাতুল সারিকার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে ছেড়ে দেয়।

রাতে মা-মেয়ে রাতুলের বুকে ঘুমিয়ে আছে। রাতুল এখনো ঘুমাইনি। সে তাদের দুজনের মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে মনে বলছে~~

~~আলহামদুলিল্লাহ।আমি আজ সুখী,,পরিপূর্ণ। আমি অর্জন করে পেরেছি সারিকার বিশ্বাস। তার বদলে পেয়েছি এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা আর আমার কলিজার টুকরাকে। হে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন,, আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে আজ এত সুখী করার জন্য আর আমাকে ধৈর্যের পরীক্ষায় জিতিয়ে দেওয়ার জন্য।

~~সমাপ্ত