Monday, June 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 88



কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৪৪

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪৪)[প্রথম অংশ]

তাসনুভা অমলেটের অপেক্ষায় রান্নাঘরের সামনে বসেছিল।আফরোজা বেগম তার নিজের কাজে ব্যস্ত।তাসনুভার কথা শুনার সময় তার নেই।সে কি এই বাড়ির ঝি নাকি?

আদি আপেল খেতে খেতে সিঁড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছিল।নবনীতা সম্ভবত তার ঘরে আরশাদকে খাওয়াচ্ছে।রান্নাঘরের দরজায় তাসনুভাকে দেখতেই সে থামল।এগিয়ে এসে বলল,’ব্যাপার কি?এদিকে কি কাজ?’

তাসনুভা গালের নিচে হাত রেখে ক্লান্ত গলায় বলল,’হঠাৎ অমলেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।ফুফুকে বলেছি করে দিতে।’

‘তো?এখনো ভাজা হয় নি?’

‘ফুফুর অন্য কাজ আছে।সেটা শেষ করে তারপর আমাকে অমলেট করে দিবে।’

অতি ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর করে সে।আদি তাড়াতাড়ি আপেল খাওয়া শেষ করেই নিজের টি শার্টে হাত মুছতে মুছতে বলল,’চলো।ভাইয়া করে দিচ্ছি।’

তাসনুভা অবাক হয়।চোখ গোল গোল করে জানতে চায়,’তুমি রান্না পারো?’

‘ঐ আরকি।অমলেট টা অন্তত করে নিতে পারি।’

আদি দ্রুত পায়ে কিচেনে গেল।ফ্রাইপেন টা হাতে নিয়েই চুলায় বসিয়ে স্টোভ অন করল।আফরোজা বেগম ছুটে এসে ব্যস্ত গলায় বললেন,’আরে তুমি করছ কেন?আমি তো বললাম অবসর হয়ে আমিই করে দিব।’

আদি তার দিকে ফিরল না।ফ্রাইপেনে তেল ঢালতে ঢালতে সেদিকে দেখেই বলল,’একটা অমলেট খাওয়ার জন্য একটা মানুষ এতোক্ষণ বসে থাকবে?দুই মিনিটের ব্যাপার।আপনি আপনার কাজ করুন।আমি করে নিচ্ছি।’

সে কি খুব সূক্ষ্মভাবে আফরোজা কে একটা খোঁচা দিলো?চটপট শুনিয়ে দিলো যে তুমি চাইলেই দুই মিনিটে কাজ টা করে নিতে পারতে।করো নি কারণ তোমার করতে ইচ্ছে হয় নি।তিনি কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দিলেন।যা খুশি করুক।তার কি?

তাসনুভা হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।সন্দিহান গলায় বলল,’তোমার বানানো অমলেট খেতে ভয় হচ্ছে।’

‘কেনো বলো তো?’

‘তোমাকে দেখে কোনোভাবেই মনে হয় না তুমি রান্না জানো।’

আদি চোখ পাকায়।কপট রাগ দেখিয়ে বলে,’আমার ট্যালেন্ট নিয়ে এতো বড়ো সন্দেহ?যাও,আজ আমি তোমাকে অমলেটের সাথে এগ নুডলসও করে খাওয়াব।’

তাসনুভা ঠোঁট উল্টে বলল,’বাপরে! অমলেট,আবার সাথে এগ নুডলসও।পুরাই হাই প্রোটিন খাবার দাবার।’
.
.
.
.
‘আমার মামিকে তোমার কেমন লাগে তাসনুভা?’

আদির বানানো নুডলস এক চামচ মুখে দিয়েই তাসনুভার দিকে দেখে প্রশ্ন করল নবনীতা।
আদি আজকে একটা চমৎকার নুডলস রান্না করেছে।অনেকটা চাওমিন স্টাইলে।নবনীতা মুখে দেওয়া মাত্র স্বীকার করেছে আদির রান্নার হাত বেশ ভালো।

এই মুহূর্তে তারা চারজন লিভিং রুমের সোফাগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সবার হাতেই নুডলসের বাটি।

তাসনুভা প্রশ্ন শুনেই মুখ ভেঙচিয়ে বলল,’জাস্ট অসহ্য লাগে।একটুও ভালো লাগে না।’

নবনীতা ঝুকল।গম্ভীর হয়ে জানতে চাইল,’কিন্তু কেন?’

‘কেন মানে?উনি তোমাদের সাথে অনেক অন্যায় করেছে।ভালো লাগার কি আছে?’

‘কেন?কেন ভালো লাগবে না?উনি তো চিত্র কে খুব আদর করে।এটা দেখে তো তোমার ভালো লাগা উচিত।তাই না?’

তাসনুভা মুখ বাঁকা করে বলল,’ঐটাতো ভন্ডামি।উনি ফাপড়ে পড়ে বাধ্য হয়ে চিত্রাকে আদর করছে।যেন ঐ বাড়িতে তাদের থাকতে দেওয়া হয়।উনি মন থেকে তাকে ভালোবাসে না।ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে বলেই এতো আদর দেখাচ্ছে।’

নবনীতার এই উত্তর পছন্দ হলো না।সে বিরক্তিতে চ-কারান্ত শব্দ করে বলল,’উহু।সেটা তোমার ভাবার বিষয় না।আমার মামি আমার সাথে অতীতে কি করেছে সেটা দিয়ে তোমার কি?তুমি কি কখনো নিজের চোখে তাকে আমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে দেখেছ?’

তাসনুভা তাজ্জব হয়ে বলল,’অদ্ভুত তো! সে এখন কেন তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করবে?তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করলে তো উনারই সমস্যা।কিন্তু আমি জানি উনি কোনো ভালো মানুষ না।’

‘অবশ্যই উনি ভালো মানুষ।উনি চিত্র কে খুব আদর করে।এটা দেখে আমরা বলতেই পারি উনি ভালো মানুষ।চিত্রও তো উনাকে পছন্দ করে তাই না?’ জোর গলায় উত্তর দেয় নবনীতা।

তাসনুভা বোকার মতো ফ্যালফ্যাল চোখে কতোক্ষণ তাকে দেখে।তারপরই আশ্চর্য হয়ে বলে,’কি অদ্ভুত কথা বলছ ভাবি! তুমি নিজে তার আসল রূপটা দেখেছ।তাও বলছ সে ভালো মানুষ।চিত্রার পার্সপেক্টিভ থেকে তুমি কেন তাকে জাজ করছো?তার আসল রূপ চেনার জন্য শুভ্রা আর তোমার পার্সপেক্টিভ থেকে জাজ করতে হবে।’

নবনীতা তার উত্তর শুনেই প্রসন্ন হাসল।তারপর হঠাৎই সেই হাসি মিলিয়ে নিল।চোখ মুখ শক্ত করে গুরুগম্ভীর স্বরে বলল,’ঠিক যেমন চিত্রার সাথে কেমন আচরণ করছে এটা দেখে আমার মামির স্বরূপ বিচার করা যায় না,তেমনি তোমার সাথের আচরণ দেখে তোমার মায়ের স্বরূপ বিচার করা যাবে না।তোমার মা কেমন সেটা জানতে হলে আরহামের চোখ দিয়ে দেখতে হবে,আরহামের পার্সপেক্টিভ থেকে ভাবতে হবে।’

আদি তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে সামনে তাকায়।বিস্ফারিত নয়নে আবিষ্কার করে এতোক্ষণের এতো কথার মূল উদ্দেশ্য আসলে অন্যকিছু।কি চমৎকার উপমায় মেয়েটা সবটা বিষয় এই পর্যন্ত এনেছে! সে দ্রুত তার বাটিটা টি-টেবিলে রেখে তাদের কথোপকথনে মনোযোগ দেয়।

তাসনুভা একটু ভড়কে গেল।পরক্ষণেই আবার মলিন মুখে বলল,’তার মানে তুমিও মানছো ভাইয়া তার সাথে যা করেছে সেটা ঠিক?’

‘এক শব্দে যদি জবাব দেই তাহলে বলব হ্যাঁ,সেটাই ঠিক।তোমার মা কে ভালোবাসার মতো কোনো গুন তার মাঝে আছে নাকি আমার জানা নেই।’

তাসনুভা আশাহত হয়ে মাথা নামিয়ে নেয়।আরিশ শান্ত চোখে একবার নবনীতাকে দেখে,আরেকবার দেখে তাসনুভা কে।মায়ের প্রতি তার কখনোই ভাইয়ার মতো বিদ্বেষ কাজ করে না।তবে মা আদর দিলেই আরিশ সেই আদর গায়ে মেখে নিবে,এতোটাও আবেগী সে না।যে চলে গেছে,সে চলে গেছে।আবার কেন ফিরে আসবে?তার সাথে আরিশদের সম্পর্ক সেদিনই শেষ যেদিন সে তাদের ফেলে চলে গিয়েছে।আরিশের তো জীবনেও ইচ্ছে হয় না তার হাতে আদর নেওয়ার।যেই মহিলা তাকে ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে জীবনে একবারো স্কুলে নিয়ে যেতে পারে নাই,সেই মহিলার জন্য কিসের এতো দরদ?আরিশের তো এতো দরদ আসে না।

মা কে নিয়ে ভাইয়া যে রোজ রোজ গালমন্দ করে এটা আরিশের ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না।গালি দিবে কেন?মা তো।চলে গেছে,এখন এই নিয়ে কথা না বললেই তো হয়।কিন্তু না,ভাইয়া প্রতিদিন দুই বেলা মনে করে তাকে গালি দিবে।আরিশ চায় ঐ মহিলাকে নিয়ে ভালো মন্দ কোনো কথাই না উঠুক বাড়িতে।কিন্তু সে অন্ধ না।তাসলিমা নামের সেই চরম অকৃতজ্ঞ মেয়ে মানুষের জন্য আরিশ তার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবে না।এই ভাই ছিল বলেই আরিশ আর তাসনুভা আজ বহাল তবিয়তে আছে।ভাই যদি শক্ত হাতে সংসারের হাল না ধরত,ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে না নিত,তাহলে কতো আগেই বাড়িঘর সব নিলামে তুলে তারা রাস্তায় গিয়ে বসত।ভাইয়ের কাছে সে কৃতজ্ঞ।একটা লম্বা সময় মানসিক ট্রমার ভেতর দিয়ে যাওয়া ছেলেটা নানা ঘটনায় নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করেছে।অথচ এই খোলসের ভেতর একজন অসহায়,মানসিক যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হতে থাকা মানুষ ছিল।যাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এই পছন্দ আসতে হয়েছে।সেই পরিশ্রমী,উদ্যোমী আর প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষটিকে আরিশ ভালোবাসে।আরহাম নামের নেই ক্ষেপাটে লোকটিকে আরিশ খুব বেশি ভালোবাসে।ভাইয়ের সাথে রূঢ় আচরণ সে কোনোদিনই করতে পারবে না।সে জায়গায় তাসলিমার মতোন মানুষদের জন্য ভাইয়ের সাথে দুর্ব্যবহার?সত্যিই হাস্যকর বিষয়।

নবনীতা একবার গলা খাকারি দিয়ে বলতে শুরু করল,’মামি আমাদের সাথে এই ছয়টা বছর খুব একটা ভালো আচরণ করেনি।সবসময় কেমন অবজ্ঞাই করেছে মামার বাসার থাকি,মামার টাকায় খাই।খোঁটা তো দিবেই।তাই না?আমি আর শুভ্রা সেই খোঁটা শুনেছি।বুঝতে পেরেছি তাদের সংসারে আমাদের আগমন তার খুব একটা পছন্দ হয়নি।ছয় ছয়টা বছর কোনোরকমে পড়েছিলাম।কয়েকবার মুখে মুখে উত্তর দিয়েছি অতিষ্ঠ হয়ে।নিজে উপার্জন করে সংসারে টাকা দিয়েছি।কিন্তু ঐতো দিনশেষে মামির সংসার তো মামির ই ছিল।আমরা ছিলাম উটকো ঝামেলা।সেই মামি কে আমি আর শুভ্রা চিনি।সেই অবহেলা ভৎসনা আমরা সহ্য করেছি।আমরা জানি আমাদের মামি কোনোদিনই ভালোবাসেনি।অথচ দেখো,চিত্র কিন্তু দিব্যি তার সাথে মিশে যাচ্ছে।চিত্রকে সে খুব স্নেহ করে।কারণ আমার বিয়ে খুব ক্ষমতাসীন কারো সাথে হয়েছে।এখন আর পরী কিংবা তার বোনদের সাথে দুর্ব্যবহার করা চলবে না,তাই করছে না।’

নবনীতা এইটুকু বলে থামল।কয়েকটা শ্বাস ফেলে একটু জিরিয়ে নিল।তারপরই পুনরায় ঠান্ডা স্বরে বলতে শুরু করল,’ধরো আজ থেকে দশ বারো বছর পর কোনো একদিন আমি মন খারাপ করে বললাম মামির বাড়িতে আমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করে থাকতে হয়েছে,মামি আমাদের উঠতে বসতে প্রচন্ড অপমান করেছে।আর ঠিক তখনই চিত্র উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র বিরোধ করল যে না,এটা হতেই পারে না,মামি এসব করতেই পারে না,আমি মামিকে নিয়ে ভুলভাল বলছি।তখন আমার কেমন লাগবে বলো তো?’

তাসনুভা মাথা নামিয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।আরিশ চোখ তুলে তার ভাবভঙ্গি দেখে।তারপরই পুনরায় নবনীতার কথায় মন দেয়।মেয়েটা অত্যন্ত গুছিয়ে কথা বলতে পারে।ভাইয়ার উচিত ঘেউ ঘেউ না করে ভাবির কাছ থেকে ঠান্ডা গলায় কথা বলা শেখা।তাহলে ভাইয়ারও জীবনের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

‘তোমার ভাইয়া অতীতের কোনো এক সময়ে খুব জঘন্য একটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল।তুমি অবশ্যই সেটা জানো।সেই সময়টা তুমি দেখোনি,ঠিক যেমন আমার কঠিন সময়টা চিত্রা দেখেনি।দেখেছে,তবে ভবিষ্যৎে মনে থাকবে না।তোমার মায়ের আসল রূপ তোমার ভাইয়া দেখেছে।যাই হোক।তুমি যথেষ্ট বুঝদার।শুধু এইটুকু বুঝে নিও যে মানুষটা নিজের শয্যাশায়ী স্বামী,তিনটে ফুটফুটে সন্তান ফেলে অন্যত্র বিয়ে করে নিতে পারে,সে কোনোদিনই নিজের সন্তানদের ভালোবাসতে পারে না।তার বর্তমান স্বামী যদি ভালো হতো,তাহলে সে তোমাদের দিকে ফিরেও তাকাতো না।অন্তত তার মতো স্বার্থপর মানুষের জন্য তোমার ভাইয়াকে ভুল বুঝো না।তোমার ভাইয়া বাকিদের জন্য কি করেছে জানি না।তোমাদের জন্য যথেষ্ট করেছে।এইটুকু কৃতজ্ঞ তোমাদের তার কাছে থাকা উচিত বলে মনে করি।’

অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাবে জোর গলায় পুরোটা কথা শেষ করে নুডলসের বাটি হাতে নবনীতা উঠে দাঁড়ায়।তার বচনভঙ্গি কিছুটা কড়া হয়েছে।কিন্তু তার কাছে এটাই সমীচীন মনে হয়েছে।একটা পুরোদস্তুর স্বার্থপর মহিলার জন্য তাসনুভা তার ভাইয়ের সাথে বাজে আচরণ কেন করবে?সে কি জানে না ভাই তাদের কতো ভালোবাসে?নবনীতা মিষ্টি মিষ্টি কথায় মানুষের মন জয় করতে ইচ্ছুক না।যা তার কাছে উচিত মনে হয়,সে তাই বলে।

****

আরহাম বাড়ি ফেরার দশ মিনিট পরেই টেলিভিশন ছেড়ে বসল।আজ একটা রেকর্ডেড টক-শো প্রচার করা হবে তার।তাও আবার মূলধারার একটি চ্যানেলে।এই নিয়ে সে ভীষণ এক্সাইটেড।সে রিমোটের বাটন চেপে ভলিউম বাড়ায়।

নবনীতা আড়চোখে একবার তার কাজকর্ম দেখে।ভলিউম বাড়িয়ে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত করা হয়েছে।আর চার বাদ রেখেছে কেন?সেটাও দিয়ে দিতো।সে সেদিকে খেয়াল না দিয়ে পুনরায় তাসনুভার দিকে তাকায়।দু’জনে চোখাচোখি হতেই সে কড়া স্বরে বলে,’বড্ড অলস তুমি।’

সে আজ তাসনুভার নার্স শাহানা খাতুনের সাথে কথা বলেছে।তিনি বললেন তাসনুভার উচিত একটু দাঁড়ানোর চেষ্টা করা।শুরুতেই হয়তো পারবে না,তবে কয়েকবার চেষ্টা করলেই তাসনুভা ওয়াকিং স্টিকের সাহায্যে হাঁটতে পারবে।এই কথা শোনার পরেই নবনীতা কোমর বেঁধে নেমেছে তাসনুভাকে তার নিজের পায়ে দাঁড় করানোর মিশনে।

তাসনুভা হতাশ।ভীষণ হতাশ।সে পারে না নিজের পায়ে দাঁড়াতে।অনেক চেষ্টা করেছে।দাঁড়ানোর আগেই তার সমস্ত শরীর মাটিতে পড়ে যেতে চায়।সে কোনো ভাবেই দাঁড়াতে পারে না।অথচ ভাবি এই কথা মানতেই চাইছে না।বলছে সে নাকি চাইলেই হাঁটতে পারবে।কি হাস্যকর কথা! দাঁড়াতেই জান যায়,আর সে নাকি হাঁটবে।ভাগ্যিস দৌঁড়াবে বলে নি।

নবনীতা পুনরায় তার একহাত ধরে টান দিলো।জোর গলায় বলল,’দেখি দেখি আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করো।’

তাসনুভা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।ফলাফল আগের মতোই।সে ধাম করে পুনরায় হুইলচেয়ারে গিয়ে পড়ল।আরহাম টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে বসার ঘরের খোলা জায়গায় তাদের কাজকর্ম দেখে।পরীর উপর তার মেজাজ গরম হচ্ছে।শুধু শুধু কি দরকার বাচ্চা মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার?পরী কি কোনো ডাক্তার?সে জানে তাসনুভা কখন হাঁটবে?যত্তোসব! টেনে টেনে তাসনুভার হাল বেহাল করে দিচ্ছে এই মেয়ে।আরহাম কিছু বলতে গিয়েও বলল না।বললেই তাসনুভার উপর তার রাগ শেষ হয়ে যাবে।সে গো ধরেছে এই রাগ অভিমান সে নিজে আগ বাড়িয়ে শেষ করবে না।যা খুশি হোক।টেনে টেনে হাত লম্বা করে ফেলুক।তাও সে কিছু বলবে না।

একবার দুইবার তিনবার।অনেক গুলো চেষ্টার পর অবশেষে একবার তাসনুভা কোনোরকমে পা টা মেঝেতে ছোঁয়ায়।নবনীতা আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার দেয়,’আরহাম! তাসনুভা ফ্লোরে পা দিয়েছে।’

আরহাম সাথে সাথে সেদিকে ফিরে।নবনীতা তাসনুভার কাঁধ থেকে ধীরে ধীরে হাত সরায়।উৎসাহী গলায় বলে,’তুমি পারবে তাসনুভা।তুমি অবশ্যই পারবে।’

তাসনুভা চোখ মুখ খিঁচে মাটিতে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।দুই সেকেন্ড কোনোরকম থাকার পড়েই পুনরায় তার শরীরটা নিচের দিকে হেলে পড়ে।

আরহাম তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।সামনে ছুটতে ছুটতে নিশ্বাস বন্ধ করে চেঁচায়,’পড়ে যাবি তাস।একটু জোর খাটিয়ে দাঁড়িয়ে থাক।পড়িস না প্লিজ।’

তাসনুভা পুরোপুরি পড়ে যাওয়ার আগেই শক্তপোক্ত হাত জোড়া তীব্র বেগে ছুটে এসে তার কাঁধের দুই পাশে হাত রেখে তাকে আগলে নেয়।তাসনুভা গোল গোল চোখে তার দিকে তাকায়।দৃষ্টি বিনিময় হতেই আরহাম চোখ সরিয়ে নেয়।সে একটু দূরে সরতে নিলেই তাসনুভা এক ঝাপে তাকে জড়িয়ে ধরল।হু হু করে উঠে বলল,’ছাড়বে না ভাইয়া।’

আরহাম থামল।না ছাড়ল,না ধরল।কেবল সটান দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ।তাসনুভা একহাতে চোখ মুছে বলল,’আই অ্যাম সরি।’

আরহাম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।ছোট করে বলে,’ইটস ওকে।এখন ছাড়।’

‘না ছাড়ব না।’

‘কেন ছাড়বি না?’

‘কারণ আমার কথা এখনো বাকি।’

‘কি কথা তোর?’

তাসনুভা তার হাতের বন্ধন আরো শক্ত করে।মৃদু হেসে গাঢ় স্বরে বলে,’আই লাভ ইউ ভাইয়া।এই অধমকে এই বারের মতো ক্ষমা করে দাও।আর কখনো ঐ ব্যাপারে তোমার সাথে বেয়াদবি করব না কথা দিচ্ছি।’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪৪)[দ্বিতীয় অংশ]

অতিমাত্রায় বিচলিত মন যখন হুট করেই অতিমাত্রায় প্রফুল্ল হয়ে উঠে,তখন ব্যক্তির পক্ষে আবেগ নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।আরহামের সম্ভবত এমন কিছুই হয়েছে।তাসনুভার এতো মিষ্টি সুরে মাফ চাওয়া,আর তার চেয়েও মিষ্টি সুরে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করা তাকে ভীষণ ভীষণ আনন্দ দিয়েছে।তার মন এতো বেশি ভালো হয়ে গেছে যে সেই রাতে সে ঘন্টার পর ঘন্টা তার বোনকে নিয়ে হাঁটার অনুশীলন করেছে।

তাসনুভা কেবল দুইবার সেকেন্ডের জন্য দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।অন্য সকল বার সে ব্যর্থ হয়েছে।কিন্তু আরহাম হতাশ হয়নি।একটা নতুন আশার আলো তার চোখে এসে ভীড় করেছে।সে স্বপ্ন দেখে তাসনুভা অবশ্যই হাঁটতে পারবে।হয়তো খুব শীগ্রই সেদিন আসবে না।তবে একদিন না একদিন এই মেয়েটা পুনরায় নিজের পায়ে দাঁড়াবে।আরহামের বিশ্বাস সেই দিন আসবেই।

আজ সে হুট করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।নবনীতা রাতে ঘরে আসা মাত্র সে মাথার পেছনে হাত রেখে আধশোয়া থাকা অবস্থায় বলল,’তোমার জিনিসপত্র সব গোছাও পরী।’

নবনীতা চমকায়।দুই চোখ বড় বড় করে বলে,’সেকি! কেন?’

আরহাম গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো,’তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিব।আর ভালো লাগে না তোমাকে।’

নবনীতা কপাল কুঁচকে কতোক্ষণ তাকে দেখে।তারপরই আবার মাথা নেড়ে অন্য কাজে মন দেয়।আরশাদ একটু আগে ঘুমিয়েছে।সে ঘরে এলেই পুরো ঘর এলোমেলো করে দেয়।নবনীতা তাড়াতাড়ি ফ্লোর থেকে তার খেলনাগুলো হাতে তুলে।আরহাম আশ্চর্য হয়ে বলল,’এ্যাই পরী! তুমি আমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছো না কেন?’

নবনীতা খেলনা গুলো যথাস্থানে রাখতে রাখতে গম্ভীর হয়ে বলল,’কারণ আপনাকে সিরিয়াসলি নেওয়ার মতো কিছু নেই।’

আরহাম আড়চোখে তাকে দেখে।নবনীতা সব কাজ শেষ করে তার মুখোমুখি বসে ব্যস্ত হয়ে বলল,’এখন ঘটনাটা কি একটু খুলে বলুন তো স্যার।’

আরহাম তার একহাত টেনে তাকে নিজের উপর ফেলল।কপালের চুলগুলো সরিয়ে সেখানে ছোট ছোট দু’টো চুমু খেল।নবনীতা মাথা তুলে সরু চোখে জানতে চাইল,’এটা আমাকে ভালো না লাগার নমুনা?’

বলতে বলতেই দু’জন একসাথে হেসে ফেলে।নবনীতা তার মাথাটা আরহামের বুকে ফেলে কিছুক্ষণ তার নিশ্বাসের শব্দ শুনে।তারপরই নিজ থেকে ডাকে,’আরহাম!’

‘হু?’

‘রাগ একটু নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবেন।সেই সাথে মুখের ভাষা সংযত রাখবেন।বড্ড বেশি গালমন্দ করেন আপনি।’

আরহাম ফিচেল হাসল।মুখে সেই হাসি ধরেই জবাব দিলো,’আচ্ছা।চেষ্টা করব,বাকিটা জানি না।’

সে নবনীতার দুই কাঁধে হাত চেপে তাকে সোজা করে বসালো।দু’জনের চোখাচোখি হতেই সে একপেশে হেসে বলল,’আসো,কাছে আসো।তোমাকে পেয়ে একটু মন ঠান্ডা করি।’
.
.
.
.
মোটামুটি সাইজের লাগেজটা কানায় কানায় কাপড় দিয়ে পূর্ণ হতেই নবনীতা কপাল চাপড়ে বলল,’কি সাংঘাতিক ব্যাপার! দুই দিনের সফরে এতো কাপড়?’

আরহাম বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকালো।কাপড় গুলো চেপে চেপে কোনোরকমে লাগেজের চেইন বন্ধ করল।তারপরই সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,’হ্যাঁ,আমার একটু বেশিই কাপড় লাগে।’

‘কেন?আপনি কি আরশাদ?আরশাদই না দশ মিনিট পর পর প্যান্ট ভিজিয়ে নষ্ট করে।’

আরহাম মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করে।কাল রাতে সে চট করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা সবাই দুই দিনের জন্য রাঙামাটি যাবে।রাঙামাটিতে তার বাবার একটা এনজিও আছে,বাচ্চাদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা একটা স্কুল আছে।তার মনে হচ্ছে আরিশ আর তাসনুভাকে এই জিনিস গুলো দেখানো প্রয়োজন।তাদের জানানো প্রয়োজন তাদের বাবা কতো অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন।সে ভ্রমণ উপলক্ষে ব্যাগ ভর্তি টিশার্ট আর ট্রাউজার নিলো।এই দুই তিন দিন সে পাঞ্জাবি তে হাতও দিবে না।টি-শার্ট পরবে,আর তার পরে ভরে ভরে বডি স্প্রে মাখবে।

নবনীতা আলমারি থেকে তিনটা শাড়ি বের করে গলার স্বর চওড়া করে বলল,’সব তো আপনার জামা দিয়েই ভর্তি।আমার শাড়ি কেমন করে নিব?’

আরহামে তার হাতের শাড়ি তিনটা দেখে।দেখেই মুখ কুঁচকে বলে,’এতো শাড়ি কেন?একটা নাও।দুই দিনেরই তো ব্যাপার।’

নবনীতা মুখ শক্ত করে একনজর তাকে দেখে।তারপরই এগিয়ে এসে লাগেজের চেইন খুলে অনেক কষ্টে চেপে চেপে শাড়ি তিনটে ভেতরে জায়গা করে রাখে।আরহাম তাকে মৃদু স্বরে ধমকে উঠে বলল,’আমার আয়রন করা কাপড় গুলো নষ্ট হচ্ছে।’

নবনীতাও কটমট চোখে উত্তর দিলো,’হোক।’

‘তুমি একটুও সম্মান করো না আমাকে।’

‘জ্বী।আর আপনি অনেক করেন।’

‘সম্মান বউরা করে।জামাইরা না।’

‘বাপরে! এই ফতোয়া কে দিলো আপনাকে?নাকি আপনি নিজেই বানিয়েছেন?’

আরহাম তর্কে গেল না।তার মেজাজ এখন যথেষ্ট ভালো।পরীর সাথে ক্যাচ ক্যাচ করে সে মন মেজাজ খারাপ করতে চায় না।আজ রাত তিনটায় তারা যাত্রা শুরু করবে।এখন বাজে রাত নয়টা দুই।সে হঠাৎই ব্যস্ত পায়ে নবনীতার দিকে এগিয়ে যায়।খপ করে তার হাতের কবজি চেপে ধরে বলে,’চলো তো।এক জায়গায় যেতে হবে আমাদের।এক্ষুনি।’

নবনীতা আশ্চর্য হয়ে শুধায়,’সেকি! কোথায় যাবো আমরা?

আরহাম সেই কথার উত্তর না দিয়ে টেনে টেনে তাকে গাড়িতে নিয়ে বসালো।আজ আর মোতাহের ড্রাইভ করছে না।রাতে বাড়ি থেকে বের হলে আরহাম নিজেই ড্রাইভ করে।

নবনীতা গাড়িতে বসেই একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল।কোথায় যাচ্ছি,কেন যাচ্ছি,কি করতে যাচ্ছি,আরহাম কেন তাকে সহ নিয়ে যাচ্ছে,কি হয়েছে,কেন হয়েছে কতো কিছু! আরহাম মহাবিরক্ত হয়ে বলল,’একটু চুপ করবে তুমি?’

বলেই সে মিউজিক প্লেয়ারে গান ছাড়ে।গান ছাড়তেই তার মনে হলো এই পরিস্থিতিতে একটা সুন্দর গান ছেড়ে পরীর কাছে তার মনের ভাব প্রকাশ করাই যায়।একটু বোঝানোই যায় যে পরী তার কাছে ঠিক কেমন।যেহেতু মুখ দিয়ে সে মধুমাখা কথা বলতে পারে না।সেক্ষেত্রে গান দিয়েই কাজ চালানো উত্তম।

সে অনেক ঘেটে একটা গান বের করল।এই গানটা সে শুনেছিল ‘রুস্তম’ নামের একটি ভারতীয় সিনেমা দেখতে গিয়ে।তার ভার্সিটি জীবনের শেষের দিকের ঘটনা।সিনেপ্লেক্সে একটা মুভি বেশ নাম করেছিল।আদি,সে আর ওয়াজিদ মিলে অতি উৎসাহে সেই মুভি দেখতে গিয়েছিল।মুভি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ যেতেই আরহামের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।যতই মুভি সামনে এগোয়,পঁচিশের টগবগে যুবকের কপালের রগ তত বেশি দৃশ্যমান হয়।মুভির মূল বিষয়বস্তু কি আরহাম জানে না।তবে তার কাছে এটা স্রেফ পরকীয়ার প্রমোশন বলে মনে হয়েছে।

গল্পের নায়ক রুস্তম একটি মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে।সে পেশায় একজন নেভি অফিসার।তার জাহাজে থাকাকালীন অবস্থায় তারই সহধর্মিণী তার অগোচরে তার সহকর্মীর সাথে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়ায় আর ব্যক্তিত্বহীন ছ্যাবলা রুস্তম তার বউকে ঠাটিয়ে দু’টো চ’ড় মারার জায়গায় তার সহকর্মীকেই মেরে দেয়।তারপর সে নিজের স্ত্রীকে ক্ষমা করে দিলো।বাহ! কি অসাধারণ বিচার! আরহাম শেষের সিনটুকু দেখেই দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’আমার রিভলভার টা দে তো ওয়াজিদ।রুস্তম,তার নষ্টা বউ আর সাথে প্রোডিউসার বদমাশটাকেও গু’লি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আসি।’

“kaheen kisi bhi gali mein jaaun main
teri khushboo se Takraaun main
har raat jo aata hai mujhe
wo khwaab tu…

tera mera milna dastoor hai
tere hone se mujhme noor hai
main hoon soona sa ek aasmaan
mehtaab tu…

O karam khudaya hai
tera pyar jo paaya hai
tujhpe marke hi toh
mujhe jeena aaya hai

O tere sang yaara
khushrang bahara
tu raat deewani
main zard sitaara

O tere sang yaara
khushrang bahara
main behta musafir
tu Thehra kinara”

বেশ সময় নিয়ে পুরোটা গান শেষ হলো।আরহাম আড়চোখে একবার তার স্ত্রীকে দেখে।মেয়েটা কি বুঝল এই কথা গুলো যে সে তাকে উৎসর্গ করেছে?
সে বুঝল নাকি বোঝা গেল না।কারণ নবনীতার দৃষ্টি গাড়ির গ্লাস গলিয়ে রাস্তার দিকে নিবদ্ধ।আরহাম কপাল কুঁচকে আরো একটা গান বাজায়।

Aisa dekha nahi khoobsurat koi
Jism jaise Ajanta ki murat koi
Jism jaise nigahon pe jadoo koi
Jism nagma koi jism khushboo koi

Jism jaise mehakti hui chandni
Jism jaise machalti hui ragini
Jism jaise ke khilta hua ik chaman
Jism jaise ke suraj ki pehli kiran

Jism tarsha hua dilkasho dilnashin
Sandli sandli marmari marmari

Husan-e-jaana ki tareef mumkin nahi
Husan-e-jaana ki tareef mumkin nahi
Afreen afreen afreen afreen
Tu bhi dekhe agar toh kahe humnashin
Afreen afreen afreen afreen

Husan-e-jaana ki tareef mumkin nahi

Husan-e-jaana ki tareef mumkin nah

এই গানেরও পটভূমি আছে।রাহাত ফাতেহ আলি খানের গানের সিরিজ শুনতে গিয়ে সে এই গানটা শুনেছে।তারপরই সে কয়েকবার এই গানটা পর পর প্লে করেছে।তার ধারণা কোনো নারীর সৌন্দর্য বর্ণনার জন্য এর চেয়ে চমৎকার গান আর হতেই পারে না।পরী যে সত্যিই তার কাছে অপ্সরীর ন্যায় এই কথাটা পরীকে গানে গানে বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

অথচ তার ভাবনায় এক বালতি পানি ফেলে নবনীতা যেভাবে ছিল সেভাবেই বসে রইল।কি আশ্চর্য! জামাই এতো সুন্দর সুন্দর গান বাজাচ্ছে,আর বেয়াদব মেয়েটা কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না।তার খটকা লাগল।সে সঙ্গে সঙ্গে পাশ ফিরে জানতে চাইল,’এ্যাই মেয়ে! তুমি হিন্দি জানো?অথবা উর্দু?’

নবনীতা জানালা থেকে চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে।ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দেয়,’না জানি না।’

আরহাম চটে যাওয়া মেজাজে চেঁচায়,’কেন জানো না?’

‘অদ্ভুত তো!উর্দু আর হিন্দি কি আমার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ নাকি ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ যে জানতেই হবে?’

আরহাম থমথমে মুখে তাকে দেখে।বোয়াদবটা হিন্দি জানে না।তাহলে সে কার জন্য এতোক্ষণ গান বাজালো?তার মন চাইছে এক্ষুনি তার গাল বরাবর একটা চড় মেরে বলতে,’বলদের বাচ্চা! প্রতিবেশী দেশের ভাষা যে জানিস না,বর্ডারে ঘুরতে গিয়ে বিএসএফ এর খপ্পরে পড়লে তখন কি করবি?কিভাবে তাদের বুঝাবি যে তুই ক্রিমিনাল না?তখন তো ঠিকই হাত নেড়ে নেড়ে বলতে হবে,’হামকো কুচ মাত কারো।হাম বেগুনাহ হ্যায়।’
সে আর কিছু বলল না।কেবল লটকানো মুখে ড্রাইভিং চালিয়ে যাচ্ছিল।

আরহামের মুঠোফোন বেজে উঠল একটু পরেই।সে ফোন তুলে কতোক্ষণ হ্যালো হ্যালো করল।নেটওয়ার্কের সমস্যা,কিছু শোনা যায় না।ওয়াজিদের ফোন।জরুরি কারণ ছাড়া ওয়াজিদ ফোন দেয় না।সে দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।পুনরায় গলা ছেড়ে বলে,’হ্যালো হ্যালো! আরে বাল তুই হ্যালো হ্যালো করছিন কেন?আমার কথা শুনিস নাকি এটা বল।’

সে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই নবনীতা মুচকি হাসে।গাড়ির জানালায় হাত রেখে মাথাটা হাতের উপর রেখে সে আরহামকে দেখতে দেখতে সুর তুলে,’

Ek din aap yu hamako mil jaaege
Phul hi phul raaho me khil jaaege
Maine sochaa na thaa
Ek din zindagi itni hogi hasi
Jhumegaa aasamaa gaaegi ye zami
Maine sochaa na thaa..

***

‘শুভি আর চিত্র আমাদের সাথে যাবে মানে?’

একপ্রকার বিক্ষিপ্ত মেজাজে প্রশ্ন ছুড়ল নবনীতা।আরহাম এক লাফে শুভ্রার ঘরের খাটে উঠে দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’তারা যাবে কারণ একা একা ঘুরতে আমার ভালো রাগে না।ট্যুর একমাত্র জিনিস,যেখানে আমি মানুষ পছন্দ করি।মানুষ ছাড়া সফর জমে না।আমি চিত্র আর শুভ্রাকেও আমার সাথে নিতে চাই।আর তারা অবশ্যই আমার সাথে যাবে।

নবনীতা চোখ পাকিয়ে চওড়া গলায় বলল,’সবকিছুতে এতো গা ছাড়া ভাব ভালো লাগে না।শুভ্রার এইচএসসি পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে।এখন সে ঘুরতে যাবে?পড়াশোনা এতো সহজ বিষয়?’

‘উহু।শুভ্রা সব পারে।সে তো আমার মতো পরীক্ষার রুটিন হাতে পেয়ে পড়তে বসা মানুষ না।সে আগেই পড়া গুছিয়ে নিয়েছে।তাই না শুভ্রা?’

আরহামের প্রশ্ন শুনেই শুভ্রা বোকা বোকা হাসল।আপাই যেভাবে চোখ দিয়েই তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে,এমতাবস্থায় সে আর নিজ থেকে কিছু বলতে চায় না।পরে দেখা যাবে সব ছেড়ে আপাই তার পেছনে লাগবে।

আরহাম গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করল,’আচ্ছা বলো তো সাইন থেটা বাই কস থেটা সমান সমান কতো?’

শুভ্রা ঠোঁট টিপে হাসল।নিচু স্বরে বলল,’টেন থেটা।’

আরহাম নবনীতার দিকে দেখে কড়া গলায় বলল,’দেখেছ?শুভ্রা সবই পারে।আর দুইদিনে পড়ে সে কোনো বিদ্যাসাগর হয়ে যাবে না।পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনে ভ্রমণেরও দরকার আছে।’

নবনীতা হতাশ হয়ে দু’টো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে আলমারির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,’এ্যাই শুভি-চিত্র! তোমরা কি কি জামা নিবে দেখে নাও তাড়াতাড়ি।’
.
.
.
.
আরহাম বহুবছর পরে মিনি বাস দিয়ে ট্যুরে যাচ্ছে।শেষ গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে।এরপর আর যাওয়া হয়নি।অনেকবছর পর আজ আবার যাচ্ছে।সাথে দুইটা অন্য গাড়িও অবশ্য যাচ্ছে।তবে ভ্রমণের জন্য না,নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।

আরহাম তোফায়েল আর তামজিদকেও তাদের সাথে নিয়েছে।জীবন,জীবনের ভাই রোকন,সারাহ,রিমি,ওয়াজিদ মোদ্দাকথা কেউ বাদ যায়নি।বাদ গিয়েছে শুধু পরীর আদরের বাচ্চা আরশাদ।রাঙামাটিতে এখন প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া।নবনীতা নিজেই দোলাচালে ভুগছিলো এই নিয়ে।শেষে সে ঠিক করেছে আরশাদ এই দু’টো দিন চাইল্ড হোমেই থাকুক।আরহাম এতো করে চাইছে একটু মন মতো সময় কাটাতে,সে এখন আরশাদকে নেওয়ার কথা বললেই সে শেয়ালের মতো খ্যাক খ্যাক করে উঠবে।আর সে চায়ও না কিছু বলতে।সবকিছুতে সে অবুঝের মতোন আচরণ করতে পারে না।মাঝে মাঝে নিজেদের একান্ত সময়েরও প্রয়োজন আছে।

সবাই আনুমানিক পৌনে তিনটার দিকে আরহামদের বাড়ির গেইটের একটু সামনে এসে দাঁড়াল।তাসনুভার মন আজকে ভীষণ ভালো।কতোদিন পর তারা ঘুরতে যাচ্ছে।কি মজার ব্যাপার! আদি নিজের একটা সেলফি তুলেই ইনস্টায় পোস্ট করল।ওয়াজিদ বাঁকা চোখে একনজর তাকে দেখল।বিরক্ত হয়ে বলল,’তোর হাইব্রিড বান্ধবীকে পাঠাবি না ছবি?’

আদি হাসতে হাসতে জবাব দেয়,’নাহ,পোস্ট তো দিয়েছি।সেখান থেকেই দেখে নিবে।’

রিমির ক্যাবটা পৌঁছুলো সবচেয়ে দেরিতে।গাড়ি থামতেই সে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলো।নামতে গিয়েই সবার প্রথমে সে ওয়াজিদের জুতোর উপরে ভুলবশত নিজের পা রাখল।ওয়াাজিদ এক ঝাড়ায় নিজের পা তার পায়ের নিচ থেকে বের করে হনহনিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।রিমি ভীষণ লজ্জিত হলো।আদি দু’জনের অবস্থা দেখেই স্মিত হেসে রিমিকে বলল,’কোনো ব্যাপার না রিমি।এমন একটু আকটু হয়ই।’

গাড়িতে বসার সময় সবাই যার যার জায়গা মতো বসল।আরহাম নবনীতা,আরিশ তাসনুভা,শুভ্রা চিত্রা,তোফায়েল তামজিদ,জীবন রোকন।বিপত্তি বেধেছে আরেক জায়গায় গিয়ে।কথা ছিলো রিমি আর সারাহ বসবে একসাথে আর ওয়াজিদ আর আদি বসবে একসাথে।

কিন্তু গাড়িতে উঠামাত্রই আদি একপ্রকার ধাক্কাধাক্কি করে সারাহ-র পাশের সিটটায় গিয়ে বসল।ওয়াজিদ চোখ পাকিয়ে বলল,’সমস্যা কি তোর?তোর আমার পাশে বসার কথা ছিলো।’

আদি সেই কথা পাত্তা না দিয়ে সারাহ-র দিকে ফিরে বলল,’আমার তোর পাশে বসার শখ নেই।আমি এখানেই বসব।’

আরহাম পেছনে ফিরে তাকে দেখেই তিরিক্ষি মেজাজে চেঁচায়,’সমস্যা কি তোর?এতো জ্বালাস কেন সবকিছুতে?তুই এদিকে বসলে রিমি কোথায় বসবে?’

‘কেন?ওয়াজিদের সাথে।সিম্পল হিসাব।’ চটপট জবাব দেয় আদি।

ওয়াজিদ আঁতকে উঠে।কি সর্বনাশা কথা! ঐ পাগলটার সাথে সে বসবে?সে চোখ বড় বড় করে বলে,’কি?রিমি আমার সাথে বসবে?’

‘হু।এনি প্রবলেম?যা গিয়ে চুপচাপ বয়।’

ওয়াজিদ বিরক্ত হয়ে আরহাম কে ডাকল,’আরহাম! আদিকে কিছু বল।’

আরহাম পেছন না ফিরেই নাক মুখ কুঁচকে বলল,’পারব না।তোদের ঝামেলা তোরা মিটমাট কর।আমাকে টানবি না।’

ওয়াজিদ কতোক্ষণ ইতিউতি করল।শেষটায় যখন দেখল আদি তার কথায় অনড় তখন সে হতাশ হয়ে রিমিকে দেখে বলল,’যাও,ভেতরে যাও।’

‘আমি জানালার পাশে থাকব?’

‘হু।আমি জানালার সাইডে থাকলে আজ আর ঘুমাতে পারব না।সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে কখন তুমি ধাক্কা দিয়ে আমায় নিচে ফেলে দাও।তোমার তো আবার রেকর্ড ভালো।এজন্যই ভয় হয়।’

রিমি খুশি খুশি মনে উইনডো সিট দখল করে নেয়।ওয়াজিদ একটু দূরত্ব রেখে তার পাশটায় গিয়ে বসে।তাসনুভা লুচির মতোন ফুলতে ফুলতে পেছন ফিরে।সারাহ কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে।আদি তাকে দেখতেই সে চটে গিয়ে বলল,’এতোই মেয়ে মানুষের সাথে বসার হলে রিমি আপুর সাথে গিয়ে বসতে,আমার সাথে এসে বসতে।ঐ চুন্নিটার পাশেই কেন বসতে হবে তোমার?’

আদি চোখ টিপে হিশহিশ করে বলল,’আরে তুমি বুঝবে না।আমি আরেকটা বিয়ের ফুল ফোটানোর পরিকল্পনা করছি।সেজন্য এটা করা লাগতো।’

‘সাংঘাতিক! তুমি সারাহ কে বিয়ে করবে?’

‘ধ্যাত! পাগল নাকি? তুমি এতো কথা বলো না তো বাচ্চা।শুধু ঘাড় বাঁকা করে বাম পাশের মানুষদের কাজকর্ম দেখো।’

বাস ছেড়েছে বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে।রিমি শুরুতে খুবই বকবক করল।তার বকবকে ওয়াজিদের কান ধরে যাচ্ছিল।হঠাৎই সে কেমন চুপচাপ হয়ে গেল।ওয়াজিদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।যাক,এখন একটু ঘুমানো যাবে শান্তিতে।

আধঘন্টা পর যখন ওয়াজিদের চোখ একেবারে লেগেই আসছিল,তখন পাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠটি রিনরিনে স্বরে তাকে ডাকল,’ওয়াজিদ ভাইয়া!’

ওয়াজিদ ঘুমের ঘোরে বলল,’হু?’

‘আমার ভীষণ বমি পাচ্ছে ভাইয়া।’

সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে ওয়াজিদ।আঁতকে উঠে পাশ ফিরে বলে,’কি?কি পাচ্ছে তোমার?’

রিমি কাচুমাচু মুখে উত্তর দেয়,’বমি।বন্ধ গাড়িতে বেশিক্ষণ থাকলে আমার বমি পায়।অন্য সময় এক দুই ঘন্টা পরে বমি পেত,আজ বেশি আগে আগে পাচ্ছে।’

ওয়াজিদ ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।আতঙ্কিত কন্ঠে চেঁচায়,’আরহাম! সে নাকি বমি করবে!’

আরহাম গাড়ি ছাড়তেই ঘুমে তলিয়ে গেছে।নবনীতা ওয়াজিদের কন্ঠ শুনেই উঠে দাঁড়ায়।উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,’আয়হায়! বেশি খারাপ লাগছে?’

ওয়াজিদ অপ্রস্তুত হয়ে ডানে বায়ে দেখে বলল,’না না।তুমি বসো।আমি দেখছি।’

বাস ড্রাইভার বরকত উদ্দীন কোনোরকমে একটা পলিথিনের জোগাড় করল।ওয়াজিদ সেটা হাতে নিয়েই মুখ খিঁচে বলল,’নেও বমি করো।’

‘এখন আসছে না।’

‘তো কখন আসবে?’ ভীষণ অধৈর্য শোনায় যুবকের কন্ঠ।

‘আমি জানি না।’

‘আচ্ছা জানতে হবে না।আমি ধরেছি।বমি আসলে আমাকে একটা ধাক্কা দিও।তাহলেই হবে।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৪৩

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪৩)

[শরীর ভালো না খুব একটা,একটু পরে রিচেক দিয়ে দিব,আপাতত কষ্ট করে পড়ুন]

ঝলমলে সুন্দর প্রভাত।সূয্যিমামা উঁকি দিয়েছে আরো অনেক আগে।সোনালি রোদের আভা পর্দা ভেদ করে সুন্দর পরিপাটি ঘরটার ভেতরে এসে পড়ছিল।হাতের কাছের মুঠোফোনে আগে থেকেই এলার্ম সেট করা ছিল।নির্ধারিত সময় হতেই সেটা যান্ত্রিক শব্দ তুলে কয়েকদফা বাজলো।মুঠোফোনের মালিক বিরক্তিতে মুখ খিঁচে কোনোরকমে হাতড়ে হাতড়ে সেটা বন্ধ করল।তারপরই একহাত পাশে রেখে অনুমানে কাউকে খুঁজল।যখনই সে টের পেল মস্ত বড় খাটটায় সে বাদে আর কেউ নেই তখন আস্তে আস্তে সে চোখ খুলল।

চোখ খুলেই সবার আগে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে।তারপরই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।নয়টা চুয়াল্লিশ বাজে।এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে সে! ধুর এতোক্ষণ কোথায়?ঘুমালোই তো ভোরের একটু আগে।সে গলার স্বর চওড়া করে ডাকে,’পরী! এ্যাই পরী!’

ঘরের বাইরে দেখেই চঞ্চল গলায় উত্তর আসে,’এই তো এদিকে।’

‘কোথায়?ভেতরে এসো।’

নবনীতা বড় বড় পায়ে ভেতরে আসে।তার পরনে গাঢ় সবুজ তাঁতের শাড়ি।আঁচলটা মনে করে কোমরে গুজে রাখা হয়েছে।আরহাম তাকে দেখে শুরুতে হাসল।পরমুহূর্তেই আবার মুখ কুঁচকালো।সেই রকম মুখ করেই বলল,’সারাক্ষণ আসাদের বাচ্চাকে সাথে সাথে নিয়ে ঘুরতে হয়?’

নবনীতা আরশাদকে কাউচের উপর রাখল।সাথে সাথে দিরুক্তি করে বলল,’উহু।বলুন পরীর বাচ্চা।’
বলেই সে আরশাদের দিকে তাকায়।মিষ্টি হেসে বলে,’তাই না রে বাবা?তুমি একটা পরীর বাচ্চা না?’

আরশাদ ছোট ছোট চোখে তার দিকে তাকায়।আরহাম আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে দায়সারাভাবে বলল,’পাক্কা গৃহিণীদের মতো দেখাচ্ছে তোমায়।’

নবনীতা ফিক করে হেসে দিলো।মাথা নেড়ে জানাল,’আমি পাক্কা গৃহিণীই।’

আরহাম আরো একবার মোবাইল ফোনে সময় দেখে।তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমের দিকে ছুটতে ছুটতে বলে,’ফুফুকে বলো তো খাবার দিতে।কাজ আছে আমার।বের হতে হবে।’

বলেই সে বড় বড় কদমে ওয়াশরুমে যায়।ঝটপট গোসল সেরে একটা ট্রাউজার পরে উদাম শরীরটার উপর কাঁধের দুই পাশে তোয়ালে ফেলে বেরিয়ে আসে।আলমারি খুলতেই টি শার্ট আর ফর্মাল শার্ট গুলো অসহায় চোখে তার দিকে তাকায়।সে লটকানো মুখে সাদা রঙের পাঞ্জাবি টা হাতে নেয়।আফসোস করে বলে,’এই এক ইউনিফর্ম পরতে আর ভালো লাগে না।’

___

তাসনুভা আর আরিশ একটু আগেই খেতে বসেছে।আদি বেরিয়েছে আটটার দিকে।তার কোন আত্মীয় নাকি অসুস্থ।সে তাকে দেখতে বনানীর একটা হাসপাতালে গিয়েছে।

নবনীতা ডায়নিং-এ এসেই একনজর তাসনুভাকে দেখল।তার ফোলা ফোলা চোখ মুখ দেখেই তার মায়া হলো।আহারে! মেয়েটা নিশ্চয়ই কেঁদেছে রাতভর।

তাসনুভা আনমনে চামচ দিয়ে প্লেটে শব্দ করে।তার মনে অভিমানের পাহাড় জমেছে।কাল সে যখন নিজে নিজে ঘুরাঘুরি করছিল,তখন একটা মহিলা তাকে টেনে নিয়ে গেল এক কোণায়।সে মুখের সামনে থেকে শাড়ির আঁচল সরাতেই দেখতে পেল মহিলাটা আর কেউ না,তার মা।

“মা” এই শব্দটা তাসনুভার কাছে কতোখানি মূল্যবান সেটা কি বড় ভাইয়া জানে?তাসনুভা সবসময় বইয়ে পড়েছে,মায়েরা বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে।মায়েদের মতো আপন কেউ হয় না।তাসনুভারও তো একটা মা আছে।তারও তো সেই মায়ের আদর খেতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু বড় ভাইয়া সেটা হতে দেয় না।তাসনুভা আর আরিশের ধাঁরও ঘেঁষতে পারে না মা।ভাইয়ার ভীষণ রাগ মায়ের উপর।তাই বলে তাসনুভা একটুখানি মায়ের আদর গায়ে মাখতে পারবে না?

নবনীতা একটা পরোটা তার প্লেটে তুলে দিলো।নরম গলায় বলল,’খাওয়া শুরু করো তাসনুভা।মন খারাপ করে লাভ নেই।এক দুই দিন যাক।সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তাসনুভা মাথা তুলে।মন খারাপ করে বলে,’ভাইয়া কালকে আমাকে বলেছে মায়ের নাম মুখে আনলে নাকি এক চড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।এটা কি ঠিক হয়েছে?তুমি দেখেছো কাল সে রাগের মাথায় আমাকে চড় মারতে এসেছিল?আমার মনে হয় ভাইয়ার এখনো একটা সাইকিয়াট্রিস্টের প্রয়োজন।’

নবনীতা একটা ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে আরিশের প্লেটে খাবার তুলে দিলো।সারাহ মাত্র চেয়ার টেনে টেবিলে এসে বসেছে।ঘুমে তার চোখ দু’টো ভেঙে যাচ্ছে।সে হাই তুলতে তুলতে নিজেই নিজের প্লেটে খাবার নেয়।

নবনীতা একটা চেয়ার ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।তাসনুভার দিক থেকে বিষয়টা একরকম।সে কিছুটা আঁচ করতে পারছে।তাদের মা যখন চলে যায়,তখন আরহামের ম্যাচুরিটি ছিল একরকম।আর তাসনুভা ছিল মাত্র দুই বছরের।তার দিক থেকে তার মায়ের কদাকার রূপটা অনুধাবন করা কিছুটা কষ্টসাধ্য।কারণ সে আরহামের মতো নিজ চোখে মায়ের অন্যায় গুলো দেখেনি।এই বিষয়টাই নবনীতা বার বার আরহামকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়।আরহাম এই সোজাসাপ্টা বিষয়টা কেন যেন মানতেই পারে না।কাল সে বাগানে দাঁড়িয়ে গজরাতে গজরাতে বলেছে তাসনুভা যদি ঐ নাম মুখে আনে তাহলে সে তাসনুভাকে সহ ধাক্কা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।এটা কোনো কথা হলো?যেই ভাই বোন দু’টো কে সে এতো বছর যত্ন আর ভালোবাসায় আগলে রেখেছে,ক্ষণিকের রাগের বশে সে তাদেরই এমন কথা বলে দিলো?

একজন মানুষের রাগের আড়ালে মাঝে মাঝে তার অভিমান,তার যন্ত্রণা মিশে থাকে।আরহামের রাগ,তার দুর্ব্যবহার সবকিছুর আড়ালে তার চাপা আর্তনাদ মিশেছিল।যেই আর্তনাদ নবনীতা শুনতে পেয়েছে।সেই আর্তনাদ শোনার জন্য ম্যাচুরিটির প্রয়োজন।অথচ তাসনুভার সেই ম্যাচুরিটি আসেনি।এই কথা আরহাম কবে বুঝবে?

আরহাম পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে ধুপধাপ করে নিচে নামল।এসেই তড়িঘড়ি করে চেয়ার টেনে টেবিলে বসল।ভেজা চুলগুলো এক হাতে ঝাড়তে ঝাড়তে তাসনুভাকে দেখে বলল,’তাস ভাইয়াকে একটা প্লেট দে তো।’

বলার পরেই তার মনে পড়ল কাল রাতে তাসনুভার সাথে তার বাকবিতণ্ডা হয়েছে।আর এক পর্যায়ে সে বলেছে তাসনুভা যেন তাকে আর কখনোই ভাই না ডাকে।অথচ সকালে তাড়াহুড়োয় সে সেই কথা দিব্যি ভুলে গেছে।সে বিরক্তি হলো ভীষণ।নিজেকে মনে মনে একটা অশ্রাব্য গালি দিলো।

তাসনুভা চুপচাপ একটা প্লেট এগিয়ে দেয়।আরহাম গোমড়ামুখে সেটা হাতে নেয়।আড়চোখে একবার তাসনুভার মতিগতি দেখে।প্লেট দিয়েই সে পুনরায় খাওয়াতে মনোনিবেশ করেছে।আরহামের মন চাচ্ছে ঠাস ঠাস তাকে দু’টো চড় দিতে।এইটুকু মেয়ের এতো রাগ কিসের?সে কাকে ভাব দেখায়?আরহামকে?

সে তাচ্ছিল্য করে হাসল।সে কি কম ভাব দেখাতে জানে নাকি?সে একমনে পরোটা ছেড়ে মুখে দেয়।আয়েশ করে পুরোটা খায়।মাঝে একবার চোখ তুলে তাসনুভার লাল লাল হয়ে থাকা মুখটা দেখে।হঠাৎই তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো।তাসনুভার সাথে কথা না বলেই তাসনুভাকে জ্বালাতন করার একটা দারুণ বুদ্ধি তার মাথায় এসেছে।

সে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে আরিশকে জিজ্ঞেস করল,’আরিশ!আজকে ভার্সিটি আছে ভাইয়া?’

অত্যাধিক কোমল কন্ঠ।আরিশ তব্দা খেল।সামনে দেখে বলল,’জ্বী ভাইয়া।আছে।’

‘ওহ।কখন বের হবে?’

‘এই তো খেয়েই বের হবো।’

‘চলো আজ ভাইয়া তোমাকে ড্রপ করে দিব।এই কয়েক মাস তোমার সাথে একবারো ঠিক মতো কথা হয়নি।আমার যে একটা ভাইও আছে ভুলেই গিয়েছিলাম।’

নবনীতা তীর্যক চাহনিতে তাকে দেখল।কথা তো নয়,যেন মুখ থেকে মধু গড়িয়ে পড়ছে।তাসনুভা মুখ ফুলিয়ে সামনে দেখে।আরিশ ভাইয়ার সাথে এতো আদর দেখাচ্ছে কেন বড় ভাইয়া?এতো ভার্সিটিতে ড্রপ করার কি আছে?সে কি কচি খোকা?

আরহাম তার সেই আধার করে রাখা মুখটা দেখেই চওড়া হাসে।তীর একদম জায়গা মতো চুঁবেছে।বেয়াদব টা এখন বুঝুক ভাই মুখ সরিয়ে নিলে কেমন লাগে।সে উঠে গিয়ে আরিশের মাথায় হাত বুলায়।আদরে কন্ঠে বলে উঠে,’এসো এসো।ভাইয়া তোমাকে ড্রপ করে দিব।তুমি হচ্ছো আমার কলিজার ভাই।যত যাই হোক,কখনো ভাইয়ার মুখে মুখে তর্ক করো না।’

শেষ কথাটা সে ইচ্ছাকৃতভাবে টেনে টেনে বলল।আগুন যখন ধরিয়েই দিয়েছে,একটু ঘি ঢেলে দিলে মন্দ হয় না।তাসনুভা মুখ ফুলিয়ে কতোক্ষণ ফুসলো।শেষে যে ঠেসটা তাকেই দিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।দুই ভাই ভালোবাসায় গদো গদো হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।তারা বেরিয়ে যেতেই তাসনুভা মুখ তুলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’দেখেছ ভাবি?ইচ্ছে করে আমাকে ঠেস মারার জন্য এসব বলেছে।’

নবনীতার এদের কান্ড দেখেই হাসি পেল।এরা কি বাচ্চা নাকি?কি অদ্ভুত রাগ প্রকাশের ভঙ্গি এদের! সে এর মাঝে কি মতামত দিবে?তার তো কেবল হাসি পাচ্ছে।সে মুখ চেপে হাসল।সহজ গলায় বলল,’বাদ দেও তাসনুভা।দুই দিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
.
.
.
.
নূর আহমেদের বুদ্ধিমতী কন্যা নবনীতা নূর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে একজন আদর্শ ঘরনি হবে।যেহেতু এই এক-দেড় বছর সে কোনো চাকরি করছে না,তাই এই পুরোটা সময় সে চুটিয়ে সংসার করবে।রান্না যদিও সে পারে না।রিমি বলেছে সে নাকি জঘন্য রাঁধে।একশব্দে যাকে বলে অখাদ্য।কিন্তু নবনীতা হাল ছাড়ছে না।সে ভেবেছে এখন থেকে সে টুকটাক রান্না শিখবে।

আরহাম আর আরিশ চলে যেতেই সে প্রথমে শুভ্রার নম্বরে ফোন দিলো।তারা কাল রাতেই সাদেক সাহেব আর মিসেস রোকেয়ার সাথে চলে গেছে।শুভ্রা বলছিল আজ নাকি সে কলেজ যাবে না।তাই এই সময়ে ফোন দিতে কোনো সমস্যা নেই।ফোন ধরার পরেই সে প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসল।এটা সেটা অসংখ্য বিষয়ে কথা বলার পর সে কুচি সামলে রান্নাঘরে গেল।আরশাদ এখন তাসনুভার সাথে খেলা করছে।নবনীতা এই মুহূর্তে পুরাই অবসর।

রান্নায় সে আনাড়ি হলেও দু’টো জিনিস সে ভালোই বানাতে পারে।এক.পুডিং দুই.ফালুদা।আরহাম ফালুদা খুব পছন্দ করে।সে ভেবে নিয়েছে আজকে সন্ধ্যায় সে ফালুদা বানাবে।

সে রান্নাঘরে পা রাখতেই আফরোজা বেগমের সাথে তার চোখাচোখি হলো।আফরোজা বেগম দ্রুত অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলেন।তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তিনি নবনীতার উপর কিছুটা বিরক্ত।নবনীতা সেসব পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে গেল কেবিনেটের দিকে।

রহিমা একমনে পেয়াজ কুচি কুচি করে যাচ্ছে।নবনীতা তাকে ডেকে জানতে চাইল,’খালা বাসায় কি সাগুদানা আছে?’

রহিমা জবাব দেওয়ার আগেই আফরোজা বেগম বলে উঠলেন,’কেন?সাগুদানা দিয়ে তোমার কি কাজ?’

নবনীতা সামনে তাকায়।স্বাভাবিক গলায় বলে,’ফালুদা বানাবো আমি।’

‘এই ভর দুপুরে ফালুদা?’ কিছুটা বিদ্রুপ মেশানো গলায় জানতে চাইলেন আফরোজা বেগম।

নবনীতা কটমট চোখে তার দিকে দেখে।থমথমে মুখে বলে,’এখন বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিব।কয়েক ঘন্টা ঠান্ডা হলে খেতে বেশি ভালো লাগে।’

রহিমা হাতে থাকা পেয়াজটা কেটেই উঠে গিয়ে নবনীতাকে সাগুদানা দিতে উদ্যত হয়।আফরোজা বেগম কর্কশ গলায় বললেন,’রহিমা! তুই কাজ ফেলে উঠে যাচ্ছিস কেন?সবগুলো পেয়াজ আগে কাট।’

নবনীতা সরু চোখে আফরোজা বেগমের মুখখানা অবলোকন করে।তারপরই বুকে হাত বেঁধে কড়া গলায় বলে,’আমি একটা জিনিস চেয়েছি আন্টি।এক মিনিট সময় নষ্ট করে সেটা দিলে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে না।রহিমা খালা,প্লিজ আমাকে সাগুদানাটা বের করে দাও।’

আফরোজা বেগম বিক্ষিপ্ত মেজাজে নিজের কাজে মন দিলেন।কি ত্যাদড় মেয়ে রে বাপ! নিজের টাই আগে করিয়ে নিবে।গুরুজন বলে যে আফরোজা কে মান্য করবে,সেরকম কোনো লক্ষ্মণই তার মাঝে নেই।অথচ তিনি ভেবেছিলেন আরহাম বিয়ে করলে কোনো মিঁও মিঁও করা মেয়েকেই বিয়ে করবে।

নবনীতা সাগুদানার প্যাকেটটা হাতে নিয়েই দ্রুত ফ্রিজ থেকে দুধের বোতল বের করল।চুলার কাছে এসে একটা পাতিলে করে দুধ জ্বাল করতে নিলেই আরেকটা বিপত্তি বাঁধলো।রান্নাঘরে মোট চারটা স্টোভ।তিনটাতে আফরোজা বেগম রান্না করছিলেন।নবনীতা দুধ জ্বাল করার জন্য চুলার কাছে আসতেই তিনি আরো একটা পাতিলে পানি আর আলু নিয়ে সেটা চতুর্থ স্টোভের উপর বসালেন।

নবনীতা তাজ্জব হয়ে তার কাজ দেখল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’এখন এটা কেন বসালেন?আমি দুধ জ্বাল করব কিসে?’

আফরোজা বেগম গমগমে গলায় জবাব দেন,’বিকেলে আমি আলু পুরি বানাবো।তাই আলু সিদ্ধ করতে হবে।’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে তাকে দেখে।রাগে তার পুরো শরীর রি রি করছে।এই মহিলা যে ইচ্ছে করে এমন করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু কেন করছে?নবনীতা তো তার কোনো ক্ষতি করেনি।এমনকি আজই প্রথম তারা এতো কাছ থেকে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে।

সে কতোক্ষণ চুপ থেকে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিল।থম মেরে কিছুক্ষণ চারপাশ দেখল।তারপরই সোজা লুছনি এনে আলু সেদ্ধর পাতিলটা চুলা থেকে নামিয়ে একপাশে সরিয়ে রাখল।

আফরোজা বেগম চমকে উঠে চেঁচালেন,’এটা তুমি কি করলে?’

নবনীতা দুধের পাতিলটা চুলায় বসাতে বসাতে দায়সারা হয়ে জবাব দেয়,’আপনার পাতিল নামিয়ে আমার পাতিল রেখেছি।’

‘কেন?’

‘কারণ আমাকে ফালুদা বানানোর পর কয়েক ঘন্টা সেটাকে ফ্রিজে রাখতে হবে।তাই আমার কাজ আগে শেষ হওয়া প্রয়োজন।আপনার তো আর আলু সিদ্ধ করে সেটাকে ফ্রিজে রাখতে হবে না।’

খুবই ঝটপট মুখের উপর জবাব।বলতে গিয়ে মেয়েটা একটুও অপ্রস্তুত বোধ করল না,একটুও দ্বিধায় পড়ল না।দ্বিধায় পড়ার কি আছে?এই মহিলা যে ইচ্ছাকৃতভাবে তার কাজে বাগড়া দিচ্ছে সে এটা আরো আগেই বুঝে গেছে।সুতরাং একে মান্য করার কোনো মানে নাই।সবার সাথে এতো আন্তরিকতা সে দেখাতে পারে না।

সে কোনোকিছুতে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কাজে মন দেয়।আজ সে সবার জন্য ফালুদা বানাবে।বিকেলে সবাই একসাথে বসে সেটা খাবে।সে কাজের ফাঁকেই রহিমা খালাকে ডাক দিয়ে বলল,’খালা রোকন কে বলো তো দুইটা বক্স আইসক্রিম এনে রাখতে।ফালুদার উপর দিব।’

সে কাজ শেষ করতে করতে বেলা গড়ালো।মাঝটায় একবার সে দুপুরের খাবার খেয়েছে আর যোহরের নামাজ পড়েছে।সব কাজ শেষ করে রান্নাঘর ছাড়তে তার সাড়ে তিনটা বাজল।

আরহাম ফিরল বিকেল পাঁচটার দিকে।ফিরেই সে গলা ছেড়ে ডাকল,’পরী! এ্যাই পরী! তাড়াতাড়ি নিচে এসো তো।’

নবনীতা এক ডাকেই চঞ্চল চপলা পায়ে নিচে নেমে এলো।এসেই হাসি মুখে বলল,’আমি ভেবেছি আরেকটু পরে আসবেন।’

আরহাম ক্লান্ত হাসে।চেয়ার টেনে টেবিলে বসে গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,’কাজ শেষ।তাই চলে এলাম।’

সে ফুচকার প্যাকেট টা তার দিকে এগিয়ে দিলো।ব্যস্ত গলায় বলল,’নেও ধরো।তোমার ফুচকা।আসার সময় চোখে পড়ল,ভাবলাম নিয়ে নেই।অনেক গুলো এনেছি।আমার বেয়াদব বোনটাকেও একটু দিও।’

নবনীতা প্রশস্ত হাসল।প্যাকেট টা টেবিলে রেখে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,’দাঁড়ান সবাইকে ডেকে দিচ্ছি।’

বিকেলে সবাই হই হই করে ডায়নিং-এ খেতে বসল।আজকের ডাইনিংয়ের মেইন ডিশ নবনীতার বানানো ফালুদা।আরিশ ফালুদা টা দেখেই বলল,’খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ভাবি।খেতেও মজাই হবে মনে হচ্ছে।’

সে হাসিমুখে সবাইকে যার যার প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়।সবার প্রথমে ফালুদা মুখে দিলো আরহাম।দিয়েই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।চোখ বড় বড় করেই সে নবনীতার দিকে তাকায়।এটা কি ছিল?সে এখন কি করবে?গিলবে নাকি ফেলবে?

একে একে সবাই ফালুদা মুখে নিতেই গোল গোল চোখ করে তার দিকে তাকালো।মুহূর্তেই নবনীতার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।সে ভয়াতুর কন্ঠে বলল,’কি হয়েছে তোমাদের?সবাই এমন করে দেখছ কেন আমায়?’

সবার আগে অ্যাকশনে গেল আরহাম।ওয়াক করে পুরোটা ফালুদা মুখ থেকে বের করে সে পাশের প্লেটো ফেলল।তার পক্ষে এই অখাদ্য গেলা সম্ভব না।যতই সে বউকে কষ্ট দিতে না চাক,এই খাবার খাওয়া হচ্ছে নিজের উপর নিজে অত্যাচার করা।তার দেখাদেখি বাকিরাও সাহস করল।নবনীতা ব্যথিত চোখে তাদের দেখেই নিজেও এক চামচ মুখে নিল।মুখে নিয়েই সে সেকেন্ডের মাথায় সেটাকে উগলে দিলো।মুখে হাত চেপে বলল,’ইসসস ছি! এতো লবন কেন?’

তাসনুভা কাচুমাচু হয়ে বলল,’থাক ভাবি।মন খারাপ করো না।তুমি হয়তো আইসিং সুগারের জায়গায় ভুলে লবন দিয়ে দিয়েছো।’

নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’অসম্ভব।এটা হতেই পারে না।’

সবার মুখ দেখে তার মনে হলো কেউ ঠিকমতো তার কথা বিশ্বাস করছে না।সে চোখ ঘুরিয়ে একবার আফরোজা বেগমকে দেখে যে কি না ঠোঁট চেপে হাসি থামাতে ব্যস্ত।

নবনীতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’আমি এক্ষুণি প্রমাণ করে দিতে পারব এই কাজ আমার না।’

বলেই সে ছুটল রান্নাঘরের দিকে।আফরোজা বেগম হকচকিয়ে উঠেন।কি সর্বনাশা কথা! প্রমাণ করবে মানে?নবনীতা ফিরে এলো মিনিটের মাথায়।এসেই তার একহাতের মুঠোয় চেপে রাখা ডিভাইসটা সবার সামনে তুলে ধরল।হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’এটাই প্রমাণ করবে যে আমি আইসিং সুগার দিয়েছি না লবন দিয়েছি।’

***

মিনি স্পাই ক্যামেরা।আকারে অতিক্ষুদ্র একটি ডিভাইস।যেটা কিনা খালি চোখে দেখাই যায় না।এই ডিভাইজটা গত কয়েক ঘন্টা করে রান্নাঘরের তাকের ফাঁকে সেট করা ছিল।নবনীতা ল্যাপটপে সেই ডিভাইসের ফুটেজ বের করল।যেখানে পুরোপুরি স্পষ্ট দেখা না গেলেও বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে সে ফালুদা বানিয়ে রান্নাঘরে থেকে বেরোনোর পর আফরোজা বেগম তার খাবারে কিছু একটা মিশিয়েছেন।নবনীতা পর পর কয়েকবার ভিডিওটা চালায়।পেছন ফিরে সবাইকে দেখে জোর গলায় বলে,’দেখেছ?আমি তো বলেছি যে আমি এতো বড় ভুল করতেই পারি না।’

আফরোজা বেগমের মনে হলো মস্ত বড়ো আকাশের পুরোটাই তার মাথায় ভেঙে পড়েছে।এই মেয়ে আগে থেকে কেমন করে বুঝে গেল যে তার অনুপস্থিতিতে এমন কিছু হবে?নবনীতা উঠে দাঁড়ায়।আফরোজা বেগমের সামনে দাঁড়িয়েই বুকে হাত বেঁধে চোয়াল শক্ত করে বলে,’সিরিয়াল শুধু আপনি একা দেখেন না।আমিও দেখি।বুঝেছেন?এরপর থেকে আমার পেছনে লাগবেন না বলে দিলাম।’

তাসনুভা আর আরিশ ইয়া বড় চোখ করে তাকে দেখে।আরিশ হতবাক হয়ে বলে,’মাই গড! একে যে তোফায়েল ভাইয়া লেডি ডন ডাকে,একদম ঠিকই ডাকে।’

আদি মাথা দুলিয়ে হাসে।মুখে একহাত চেপে অস্ফুটস্বরে বলে,’ফুফু শকস,নবনীতা রকস।’

আরহাম কতোক্ষণ কাশলো।কি একটা অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়েছে সে।পরী যে মাঝে মাঝে কি করে! এখন সে এখানে কিই বা বলতে পারে?নবনীতা নিজেই তো তার আচ্ছা মতোন ডিটারজেন্ট ছাড়া ধোলাই করে দিয়েছে।আরহাম মাথা নামিয়েই বিড়বিড় করে,’ডেঞ্জারেস মেয়ে মানুষ!’

নবনীতা পেছন ফিরে।সবাই কে দেখে একগাল হেসে বলে,’মন খারাপের কিছু নেই।আমি বড় একটা বাটিতে অর্ধেক ফালুদা আগেই সরিয়ে রেখেছি।আমার রুমে আছে।এক্ষুণি নিয়ে আসছি।’

সে ঝড়ের বেগে তার ঘরে গেল।ফিরলোও ঝড়ের বেগে।এসেই নিজের হাতে বাটিটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,’এবার খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে?’

****

আরিশ এক চামচ ফালুদা মুখে দিয়েই প্রসন্ন হেসে বলল,’জিও ভাবি! খুব মজা হয়েছে।’

তাসনুভা নবনীতার ডান হাতে চুমু খেয়ে খুশিতে গদো গদো হয়ে বলল,’একেবারে তোমার মতো মিষ্টি হয়েছে ভাবি।’

নবনীতা জবাবে কেবল মুচকি হাসল।অন্য একটা বাটিতে একটু ফালুদা,জেলি আর আইসক্রিম দিয়ে সেটা আরহামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিজে তার পাশাপাশি চেয়ারে গিয়ে বসল।আরহাম একটু মুখে দিয়েই পাশ ফিরে বলল,’অনেস্ট স্পিকিং,খুব ভালো হয়েছে পরী।’

নবনীতা মাথা নামিয়ে সেই প্রশংসা লুফে নেয়।আরহাম একটু ঝুঁকে ফিশফিশ করে বলল,’পরী ম্যাডাম! একটু শুনুন তো।’

নবনীতাও মাথা নামিয়ে তারই মতোন হিশহিশিয়ে জানতে চায়,’কি স্যার?’

আরহাম ভয় পাওয়ার ভান ধরে বলল,’ম্যাডাম আপনি যে সারাক্ষণ স্পাই ক্যামেরা সাথে নিয়ে ঘুরেন,আমার বেডরুমেও কি কয়েকটা ফিট করে রেখেছেন নাকি?’

নবনীতা মাথা নিচু করে মুচকি হাসল।উপরনিচ মাথা ঝাকিয়ে গর্ব করে বলল,’একদম তাই।বেশি তেড়িবেড়ি করলে আপনি যে একটা ভন্ড নেতা,সেই সত্য সবার সামনে উন্মোচন করে দিব।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৪২

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪২)

কার্তিকের রজনী।রাত বাড়তেই হেমন্তের ঠান্ডা আর হৃদয় জুড়ানো বাতাস বইতে শুরু করেছে।আচ্ছা,বসন্তকে কেন ঋতুরাজ বলা হয়?সবচেয়ে সুন্দর ঋতু তো হেমন্ত।না আছে কাঠফাটা রোদ,না আছে শরীর হিম করা অতিশীতল শৈত্য প্রবাহ।কেবল মন প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা পবন,আর সেই সাথে স্বচ্ছ একখানা আকাশ।এতো চমৎকার একটা ঋতু কেমন করে ঋতুরাজ হওয়ার দৌড় থেকে বাদ পড়ল?বড়ই ভাবনার বিষয়।

রাত তখন কয়টা সেই খবর কারো নেই।ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটা একটা সিগারেট শেষ করেই পুনরায় দ্বিতীয় সিগারেট হাতে নেয়।তপ্ত নিশ্বাস আর অদৃশ্য অনলে তার ভেতর জ্ব’লে পু’ড়ে ছাড়’খার হয়ে যাচ্ছে।সে সামনে দেখে।দূর থেকে অজানা কোনো পাখির ডাক ভায়োলিনের সুরের মতো ভেসে ভেসে আসে।আচ্ছা ভায়োলিনের সুর কিসের প্রতীক?বিষাদের?নাকি বিরহের?

নবনীতা শম্বুক গতিতে হেঁটে ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ায়।একটু আগেই একটা বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে।সে মাথা নামিয়ে তার দুই হাত দেখে।হাত দু’টো এখনো কাঁপছে তার।

তারা সবাই খাওয়া শেষে যে যার মতো হাঁটছিল।হঠাৎ আরহামের খেয়াল হলো আশেপাশে কোথাও তাসনুভা নেই।স্বাভাবিকভাবেই তার উদগ্রীব আর সন্দেহপ্রবন মন এই বিষয় টা স্বাভাবিক ভাবে নিল না।সে ব্যস্ত হলো তাসনুভাকে খোঁজা নিয়ে।খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে সে দেখতে পায় তাসনুভা ইয়ার্ডের এক মাথায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে।সেই মানুষটা তাসনুভান গাল ছুঁয়ে,হাত ধরে তাকে আদর দিচ্ছে।

এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।কিন্তু এরপরের ঘটনা গুলো ঘটল খুব দ্রুত।আরহাম সেই মানুষটার মুখ দেখতেই উন্মাদের মতো ছুটে গেল তার দিকে।তার পেছন পেছন আদি আর ওয়াজিদও ছুটল।আরহাম বিনা কিছু ভেবে তার কোমরে গুজে রাখা রিভলবার টা তাক করল মানুষটার কপাল বরাবর।গর্জে উঠে বলল,’তোমার সাহস কি করে হয় আমার বাবার বাসায় ঢুকে আমার বোনকে ছোঁয়ার?’

ইয়ার্ডের দিকে হট্টগোল কানে যেতেই নবনীতা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে।সামনের দৃশ্য একবার দেখতেই তার চোখ কপালে উঠে।কি সর্বনাশ অবস্থা! আরহাম রিভলবার তাক করেছে,তাও একটা মাঝবয়সী মহিলার দিকে।আদি আর ওয়াজিদ গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচায়,’সর আরহাম! মাথা খারাপ তোর?ঘরে যা।প্লিজ ঘরে যা।’

আরহাম তার চেয়েও দ্বিগুণ জোরে চেঁচায়,’যাব না।এর সাহস কি করে হয় আমার বাবার বাড়িতে পা রাখার?একে মেরে এর চ্যাপ্টার ক্লোজ করে এরপরই আমি যাব বাল।’

ওয়াজিদ তাকে টানতে টানতেই বিরক্ত গলায় বলল,’তোর পাগলামির কি কোনো শেষ নেই আরহাম?দয়া করে বিষয়টা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যাওয়ার আগেই ভেতরে যা।’

সে সেসব তোয়াক্কা করে না।পুনরায় ছুটে যায় সামনের দিকে।দাঁতে দাঁত পিষে বলে,’আমাকে উগ্র হতে বাধ্য করবে না।বের হও আমার বাড়ি থেকে।’

নবনীতা ছুটে গেল।চোখ বড় বড় করে কড়া স্বরে বলল,’এসব কি হচ্ছে আরহাম?এভাবে কেউ কারো সাথে কথা বলে?’

‘এ্যাই মেয়ে! তুমি আমাকে জ্ঞান দিবে না বলে দিলাম।পাত্তা দেই বলে সবকিছুতে মতামত দিতে আসবে না।অসহ্য লাগে আমার।’

এতোদিনের কোমল আচরণ।তারপরই এমন ভৎসনা! নবনীতা শূন্য চোখে তার দিকে দেখে দুই পা পিছিয়ে আসে।রিমি আর শুভ্রা ঠিক তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।সে শাড়ির আঁচলটা খাঁ’মচে ধরে মাথা নামিয়ে নিল।ওয়াজিদ আর আদি মিলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করল।মাঝবয়সী মহিলাটা আর্দ্রচোখে একবার তাসনুভাকে দেখে।তারপর দেখে আরিশকে,যে বসে আছে দূরের একটা চেয়ারে।যার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি এখানে সেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে।মহিলাটা চোখ তুলে নবনীতাকে দেখল।যাওয়ার আগেই কোমল স্বরে বলল,’তুমি আরহামের স্ত্রী?’

সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।মুখ ফুটে আর কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না।মহিলাটা একটু পরেই নিরবে চলে গেল।কিন্তু সবকিছু সেখানেই মিটমাট হলো না।আরহাম চড়াও হলো তাসনুভার উপর।দুই ভাইবোনের মাঝে কথা কাটাকাটি হতে হতে সেটা চরমে রূপ নিল।আরিশ কেবল নিষ্ক্রিয় দর্শকের মতোন সবটা দেখল।নবনীতা দেখল তাদের তিনজনকে।তাসনুভার কথা শুনতেই সে বুঝে গেছে মহিলাটা তাদের মা।এরপর আরহাম যখন বাগানের কয়েকটা গাছে কিল ঘুষি মেরে হনহন করে বাড়িতে চলে গেল,তারপর আদিও তাকে সামান্য কিছু কথা সংক্ষেপে বলল।নবনীতা শুনল,বুঝতে পারল ব্যাপারটা একান্তই তাদের পারিবারিক বিষয়।

____

ছাদের দরজা পেরিয়ে নবনীতা দুই কদম ভেতরে আসে।আরহাম পেছন না ফিরেই কাটকাট গলায় চেঁচায়,’আর এক পা ও সামনে আসবে না।জ্ঞান চাই না আমার।নিজের জ্ঞান নিজের কাছেই রাখো।’

নবনীতা তার কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না।উল্টো হেঁটে এসে তার মাথাটা আলতো করে আরহামের পিঠে রাখল।হাত বাড়িয়ে পেছন থেকেই তাকে জড়িয়ে ধরল।আরহাম আশ্চর্য হয়ে মাথা তুলল।সে আশা করেনি নবনীতা এতো কিছুর পর তাকে এসে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরবে।কিছুক্ষণ তাজ্জব হয়ে থাকার পর সে কিছুটা ধাতস্থ হলো।তার মনে হলো তার চটে যাওয়া মেজাজটা একটা মিষ্টি আলিঙ্গনেই কেমন হুট করে শান্ত হয়ে গেছে।কি অদ্ভুত! আমাদের মনের তোলপাড়,বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমরা কতোরকম পন্থা অবলম্বন করি।অথচ সামান্য একটা আলিঙ্গনই যথেষ্ট আমাদের বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ককে মুহুর্তেই শান্ত করে দেওয়ার জন্য।

আরহাম একটু স্থির হয়েই অনুতপ্ত স্বরে বলল,’আমি আজকেও তোমার সাথে রূঢ় আচরণ করেছি পরী।এজন্য এখন আমার কষ্ট হচ্ছে।আমার একটা বাজে স্বভাব আছে।আমি একজনের রাগ আরেকজনের উপর ঝাড়ি।প্লিজ তুমি বুঝে নিও।’

নবনীতা চোখ বন্ধ করেই প্রগাঢ় স্বরে জবাব দেয়,’জ্বী।সমস্যা নেই।আমি বুঝতে পেরেছি।’

কিছুক্ষণ সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর নবনীতা তাকে ছেড়ে দিয়ে তার পাশাপাশি এসে দাঁড়াল।ঠান্ডা গলায় বলল,’মাঝে মাঝে মনের কথা খুলে বললে মন হালকা হয় আরহাম।বিশ্বাস না হলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।’

আরহাম কতোক্ষণ দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়ায়।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাদের মেঝেতে গিয়ে বসে।তার দেখাদেখি নবনীতাও তার পাশাপাশি বসল।আরহাম সামনে দেখতে দেখতে বলল,’একটু আগে যেই মহিলাটা আসল,সে সম্পর্কে আমার মা হয়।জানো?’

নবনীতা ছোট করে জবাব দিলো,’জ্বী,দেখেই বুঝতে পেরেছি।’

আরহাম দু’টো ঢোক গিলে।কতোক্ষণ নিজের মাথার চুল নিজেই টানে।আনমনে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।নবনীতা তার কাঁধে হাত রেখে তাকে ডাকল।আরহাম পাশ ফিরতেই সে তার কোলের দিকে চোখ নামিয়ে বলল,’শুভির যখর মন খারাপ হয়,তখন সে আমার কোলে মাথা রেখে সবকিছু খুলে বলে।সে বলেছে কোলে মাথা রেখে নিজের দুঃখের কথা বললে নাকি বেশি ভালো লাগে।আপনি একটু চেষ্টা করে দেখুন তো।’

আরহাম তার কথা শুনেই ফিচেল হাসল।বাধ্য স্বামীর মতো এক বাক্যেই তার মাথাটা নবনীতার কোলে রেখে কোমল গলায় বলল,’আমি বলা শুরু করার আগেই বুঝতে পারছি এভাবে কথা বললে আমি বেশি শান্তি পাব।’

সে থামে।একটু কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে,’বাবার সাথে মায়ের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক ভাবে।আমার বাবা বেশ অভিজাত বংশের সন্তান ছিলেন।স্বাভাবিক ভাবেই সে সময়ে এমন বড়লোকদের বিয়ে হতো মফস্বলের স্বল্পশিক্ষিত কোনো সুন্দরী মেয়ের সাথে।আমার বাবার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।মফস্বলের একটি অল্পবয়স্কা মেয়ের সাথে তার বিয়ে হলো।মেয়েটি প্রাথমিকও পাশ করতে পারেনি।বুঝতেই পারছো,কতো অল্প বয়সে তাদের বিয়ে হয়েছিল।কিন্তু আমার বাবা ছিলেন পৃথিবীর চমৎকার মানুষদের একজন।অন্তত আমার তাই মনে হয়।বাবা বিয়ের পর তথাকথিত পুরুষদের মতোন নিজের স্ত্রীকে কেবলই বংশ বাড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন নি।আমার বাবা তাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী ভেবে তার মন বোঝার চেষ্টা করেছিলেন।জানতে চেয়েছিলেন সে কি চায়,তার কি ইচ্ছে।আমার মা তোমার চেয়েও বেশি সৌভাগ্যবতী ছিলো।কারণ তিনি স্বামী রূপে একজন নিরেট ভদ্রলোককে পেয়েছিল।আমার মা পড়তে চেয়েছিল,বাবা তাকে পড়ালেন।খুন্তি আর হাড়ি পাতিলের জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।যেখানে সংসার জিনিসটাকে তার জঞ্জাল মনে হবে না।মনে হবে সংসার আসলে জীবনের একটা নেয়ামতের মতো।মা গ্রেজুয়েশন শেষ করল।পাশাপাশি সংসারও সামলালো।রান্নাবান্না সব মা নিজেই করতো।কিন্তু জিনিসগুলো সময়ের সাথে পাল্টে যাওয়া শুরু করল।আমি ছোট থাকতেও মা ভীষণ সংসার কেন্দ্রিক ছিল।পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের সংসারের জন্যও ভীষণ নিবেদিত ছিল মা।কিন্তু যতোই বড় হচ্ছিলাম,দেখছিলাম মা’র আর সংসারে মনোযোগ নেই।বাবার শাড়ি পরা খুব পছন্দ ছিল,অথচ মা একদমই শাড়ি পরত না।তাকে নাকি শাড়ি পরলে গেঁয়োদের মতো দেখায়।রান্নাবান্নাও মা আর আগের মতো করত না।সংসারে তার কোনো মনোযোগই ছিল না।তার সমস্ত মনোযোগ তার বন্ধু বান্ধব আর ক্যারিয়ার নিয়ে।বাবা তার পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন,অত্যন্ত ভালোবাসা দিয়ে তাকে বোঝালেন।ফলাফল শূন্য।মা এসব বললেই চটে যেত।বলত বাবা নাকি তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে।বিষয়টা হাস্যকর তাই না?যে তোমাকে স্বাধীনতার সংজ্ঞা শেখালো,তাকেই তুমি স্বাধীনতার জ্ঞান দাও?’

আরহাম কিছুসময়ের জন্য থামল।নবনীতা একটা হাত বাড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলায়।চুলের ফাঁকে আঙুল চালাতে চালাতে আর্দ্র কন্ঠে বলে,’পানি আনব আরহাম?’

আরহাম জবাবে কেবল ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।তারপর টেনে টেনে বড়ো করে কয়েকটা শ্বাস নেয়।এখন যেই কথা গুলো সে বলবে সেগুলো বলার জন্য তার শক্তি প্রয়োজন,অনেক বেশি মানসিক শক্তির প্রয়োজন।তাকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রত্যেকটা ঘটনা বলে যেতে হবে।সে একটু দম নিয়ে আবারো বলতে শুরু করল,’যাকগে।সংসারে টুকটাক ঝামেলা হয়ই।সেটা বড় বিষয় না।আমার বাবাও বিষয় টা স্বাভাবিক ভাবেই নিলেন।কিন্তু পরবর্তীতে বাবার জীবনে একটা ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এলো।টানা কয়েকমাস অসুস্থ থাকার পর বাবা একটা ফুল মেডিকেল চেক আপ করান।তারপর জানতে পারেন তার শরীরে ক্যা’ন্সার বাসা বেঁধেছে।তাও বোন ম্যারো ক্যান্সার।তুমি কি জানো ক্যান্সারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা কোন দুইটা ক্যান্সারে হয়?
লিউকেমিয়া আর বোন ম্যারো ক্যান্সারে শরীরে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা অনুভূত হয়।অস্থিমজ্জার ক্যান্সারে শরীরের প্রত্যেকটা হাড়ে এতো বেশি যন্ত্রণা হয় যে তোমার কাছে মনে হবে এমন ভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে তো মরে যাওয়াই তুলনামূলক ভালো।সেই যন্ত্রণা আমি মুখে বলে বোঝাতে পারব না।আমি নিজেও সেই যন্ত্রণা টের পাইনি।আমার বাবার মতো সরল সোজা আর পরোপকারী মানুষটা সেই যন্ত্রণা ভোগ করেছেন।মা শুরুতে কিছুদিন কাঁদল,তারপরই হঠাৎই কেমন স্বাভাবিক হয়ে গেল।বাবার কেমোথেরাপি শুরু হলো।শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহের মানুষটা হঠাৎই কেমন দুর্বল হয়ে পড়লেন।সারাদিন হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে কাঁ’তরাতেন।মা কখনো সেখানে যেত,কখনো বা যেত না।দুই মাস যেতেই মা এতো স্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করল যেন স্বামীর ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টা খুবই সাধারণ।হতেই পারে এমন।অতো দুঃখের কিছু নেই।কিন্তু আমি মানতে পারলাম না।আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় বাবার এই মুমূর্ষু দশা আমি ছেলে হয়ে সহ্য করতে পারলাম না।রাত দিন ভুলে আমি হসপিটালে পড়ে রইলাম।
বাবার সহকর্মী ছিল নোমান আঙ্কেল।তার সাথে আগেই মা’র যোগাযোগ ছিল।তিনি রাজনৈতিক নানা কাজে আমাদের বাড়ি আসতেন।তখন থেকেই পরিচয়।বাবার অসুস্থতায় সেই পরিচয় আরো বাড়ল।বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে নোংরামিতে রূপ নিল।আমার বাবা যখন শয্যাশায়ী,তখন আমার মা ফাইভস্টার হোটেলে তারই সহকর্মীর সাথে গিয়ে রঙ্গতামাশায় ব্যস্ত থাকতেন।সেই খবর আমাদের কানে এলো বাবারই অন্য সহকর্মীদের মাধ্যমে।আমার বাবা কেমোথেরাপির মতোন মরণ যন্ত্রনায় ও এতো ভেঙে পড়েন নি,যতোটা ভেঙে পড়েছিলেন মায়ের এই জঘন্য প্রতারণার খবরে।আমার পুরো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেল।লোক জানাজানিতে মায়ের অবশ্য ভালোই হলো।উনি প্রকাশ্যে নোমানের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন।হাসপাতাল বেডে থাকা অবস্থাতেই মা আর বাবার ডিভোর্স হলো।আমি অসহায় চোখে সবটা দেখলাম।একবার ভাবলাম কিছুই বলব না।তারপরই আবার কি হলো জানি না,মা যেদিন আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যায় সেদিন আমি ছুটে গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরলাম।হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললাম,’প্লিজ মা।আমাদের এতো বড় শাস্তি দিও না।প্লিজ মা,একটু দয়া করো।এভাবে আমাদের ফেলে দিও না।বাবার এই অবস্থা,তুমি চলে গেলে আমাদের আর থাকবে কি?প্লিজ মা।এই কাজ করো না।আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলিটা তুমি ভেঙে দিও না।মানুষের এতো এতো তিরষ্কার আর নোংরা কথায় আমরা বাঁচবো কেমন করে?আমাদের তিনজনের জন্য হলেও তুমি ঐ লোককে বিয়ে করো না।একটু রহম করো আমাদের।’ মা কিন্তু সেদিন আমার এই আকুল আর্জি কানে তুলেনি।সংসার,স্বামী,সন্তান সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মা হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলেন আজিজ ভিলার চৌকাঠ ছেড়ে।সেই সময়ের যন্ত্রণা আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না।তুমি হয়তো জানো বোন ম্যারো ক্যান্সারের কোনো চিকিৎসাই নেই।কেমোথেরাপি দিলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের মতো বাঁচা যায়।এরপরই নিশ্চিত মৃত্যু।আমার বাবা হসপিটালের বিছানায় শুয়ে সেই মৃত্যুর দিন গুনছিল।আর আমি হচ্ছিলাম দিনে দিনে বদ্ধ উন্মাদ।স্কুলে গেলেই নোংরা নোংরা কথা বলে ব্যাচমেটরা বুলিং করতো।মানসিকভাবে ট্রমাটাইজ হয়ে যাচ্ছিলাম।ঐদিকে বাবার অবস্থা দিনকে দিন আরো খারাপ হচ্ছিল।তুমি হয়তো তাকে দেখো নি,তুমি হয়তো তাকে চেনো না।কিন্তু তুমি কি তার যন্ত্রণার একাংশও অনুভব করতে পারছ পরী?যদি অনুভব করতে পারো তাহলে বুঝবে স্রষ্টা তাকে আক্ষরিক অর্থেই মরণ যন্ত্রনা দিয়েছিলেন।বলিষ্ঠ দেহের,ক্ষমতাসীন মানুষটা যে কি-না ব্যবসার ক্ষেত্রে,রাজনৈতিক অঙ্গনে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াতো,সেই মানুষের প্রভাবশালী জীবনটা বন্দী হলো হাসপাতালের একটা ছোট্ট কেবিনে।নিজ স্ত্রীয়ের প্রতারণা,সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ,মৃত্যুর দিকে একটু একটু এগিয়ে যাওয়া-সবমিলিয়ে আমার বাবা একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন।আয়নায় নিজের কদাকার রূপটা তার সহ্য হতো না।আমি সেই কষ্ট কাছ থেকে দেখেছি।আমি আমার জীবনের শেষ কান্নাটুকু তখনই কেঁদেছি।তুমি জানো,আমার স্কুল রেজাল্ট যথেষ্ট ভালো ছিল।কিন্তু সেই ঘটনার পর আমি ফিজিক্স আর ম্যাথে ফেইল করলাম।কারণ আমার ব্রেইনে নতুন করে কিছু প্রসেসই হতো না।তাসলিমা নামের অকৃতজ্ঞ মেয়ে মানুষটি পুনরায় বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াল।সদ্য বিবাহিত স্বামীর সাথে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে লাগল।অন্যদিকে তাকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসা মানুষটা হসপিটাল বেডে ধুকে ধুকে মরছিল।ছয়মাস পর শুনলাম আমার মা অন্তঃসত্ত্বা।তার জীবনে সুখের কোনো অভাব নেই।ফেসবুকের পাতায় পাতায় তিনি সেই সুখ বর্ণনা করতেন,তার সুখী দাম্পত্যের ছবি দেখাতেন।অথচ ঠিক সেই সময়ই পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে তিনজন অনাথ তাদের সদ্য গত হওয়া বাবার লা’শ সামনে নিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে বসেছিল।আমার বাবা এক বুক যন্ত্রনা নিয়ে পৃথিবী ছাড়লেন।যাওয়ার আগে আমার সারা মুখে চুমু খেলেন।সেটাই ছিল,আমার জীবনের শেষ আদর।বাবা আমাকে অথৈ সাগরে ফেলে চলে গেলেন।শুরুতে খুব কাঁদলাম,এরপর চোখের পানি সব শুকিয়ে এলো।বাবার মৃ’ত্যু সহ্য হচ্ছিল না।দুই দুইবার সুইসাইড এটেমপ্ট নিলাম।আল্লাহ বাঁচিয়ে নিল প্রতিবারই।ওয়াজিদ আর আদি খুব বেশি সাপোর্ট দিলো।আমি এক বছর ড্রপ দিলাম।ভালো রেজাল্ট থাকা স্বত্তেও ছেলে দু’টো আমার সাথে ড্রপ দিলো।আমি ছয়মাস সাইকিয়াট্রিস্টের অবজারভেশনে ছিলাম।ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলাম।তবে মনে মনে মেনেই নিলাম জগতের সবচেয়ে নোংরা কীট হলো মেয়ে মানুষ।তারপর দিন গেল।আরিশ আর তাসনুভা তাদের বেঈমান অকৃতজ্ঞ মা কে মিস করতো।কথায় আছে না?পাপ বাপ কেও ছাড়ে না।তাসলিমারও তাই হয়েছে।বিয়ের এক দুই বছর যেতেই নোমান তার রূপ পাল্টালো।তাসলিমাকে সংসারের জঞ্জালে বেঁধে দিলো।তার হুটহাট বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করল।মোদ্দাকথা একেবারে চার দেয়ালের গৃহিনী জীবনে তাসলিমা বন্দি হলো।তখনই সে টের পেল প্রথম স্বামীর কাছে যেই সম্মান আর ভালোবাসা পাওয়া যায়,তার কিয়দংশও দ্বিতীয় স্বামীর কাছে পাওয়া যায় না।সে এরপর নিজের ভুল বুঝে আমাদের কাছে ফিরে আসতে চাইল।আমি সাথে সাথে তাকে তাড়িয়ে দিলাম।ফিরে আসবে মানে?কিসের জন্য ফিরে আসবে?বাবাই যখন আর নেই,তখন তার ফিরে আসা দিয়ে কি হবে?আমাদের ঘর যখন একবার ঘটা করে ভেঙেই গেছে,তখন আর নতুন করে তাকে ঘরে তোলার প্রয়োজনটা কি?তুমি জানো বাবার মৃত্যুর পর আমি যখন যখন একটু একটু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিলাম,তখন আরিশ আর তাসনুভা পুরাই অবহেলার মধ্যে দিয়ে বড় হচ্ছিল।তাসনুভা খেলতে গিয়ে দোতালার সিঁড়ি থেকে সোজা নিচে গিয়ে পড়ল।সুস্থ সবল মেয়েটা হাঁটার ক্ষমতা হারালো।র’ক্তমাখা শরীরটা দুই ঘন্টা সেভাবেই ফ্লোরে পড়ে থাকার পর বাড়ির একজন পরিচারিকার নজরে এলো।আমাদের তো অর্থের অভাব ছিল না।তাহলে তাসনুভার ছোট্ট শরীরটা এমন অবহেলায়,রাস্তার কোনো পশুর মতো কেন পড়েছিল বলতে পারো?
কারণ আমাদের একটা মায়ের অভাব ছিল।মায়ের অভাবে সংসার টা তছনছ হয়ে গেল।তাসনুভার এই ঘটনার পর আমি নড়ে চড়ে বসলাম।বুঝতে পারলাম এই সংসারের হাল আমাকে ধরতেই হবে।আমি ব্যবসার কাগজে হাত দিলাম,রাজনীতিতে পা দিলাম।শপথ নিলাম বাবার পরিশ্রম করে দাঁড় করানো ব্যবসা কিছুতেই গুড়িয়ে যেতে দিব না।অনুভূতিশূন্য হয়ে জীবনের একটা দীর্ঘসময় পার করলাম।আর তারপর আজকের এই আরহামের জন্ম।আরিশ আর তাসনুভার খুব দয়া হয় তাসলিমার প্রতি।কিন্তু আমার হয় না।কারণ আমি তার আসল চেহারা দেখেছি।এখনের চেহারাটা তো নকল।নিজের করা ভুলের অনুশোচনা করছে সে।কিন্তু সেই সময়ের চেহারা যদি তুমি দেখতে,তাহলে তুমি জীবনেও তাকে মাফ করার কথা মুখে আনতে না।আমি এই জীবনে কোনোদিনও তাকে মাফ করব না।সে যদি আমার কৈশোর ফিরিয়ে দিতে পারে,আরিশ আর তাসনুভার শৈশব ফিরিয়ে দিতে পারে,তবে মাফ করার কথা ভাবতে পারি।অন্যথায় আমি তাকে কোনোদিনই মাফ করব না।সবকিছুর মাফ হয় না।সবকিছুর পরিশেষে ইটস ওকে বলে রফাদফা করা যায় না।অন্তত আরহাম তার বাবার সাথে সেই বেঈমানী করবে না।যেই বাড়ির চৌকাঠ ছেড়ে তাসলিমা হনহনিয়ে বেরিয়ে গেছে,এই চৌকাঠ সেদিনই তার জন্য হারাম হয়ে গেছে।আমি আমার বাবার বাড়ি,এমনকি তার এক আনা সম্পদেও তাসলিমাকে ভাগ বসাতে দিব না।এটাই আমার শেষ কথা।আমি এই জীবনে তাকে মাফ করব না।তার জন্য যদি শুনতে হয় আমি পাষণ্ড সন্তান,তবে তাই হোক।আমি আমার মায়ের চোখে নির্দয় হতে রাজি,কিন্তু বাবার চোখে বেঈমান হতে রাজি না।আমার বাবা আমার হৃদয়ের একটি অংশ।শেখ আজিজ এখনো বেঁচে আছেন তার সন্তানের বক্ষপিঞ্জরের একটি অংশে।তিনি চিরকাল সেখানেই থাকবেন।আমি তাকে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।’

রাতের গভীরতা তখন আরো বেড়েছে।আরহাম কথা বলা বন্ধ করেছে অনেক আগে,কিন্তু নবনীতার হুশ ফিরল আরো অনেক পরে।সম্বিৎ ফিরতেই সে চোখ মুছে,মাথা ঝুকায়।আরহামের কপালের একপাশে প্রগাঢ় চুমু খায়।জড়ানো কন্ঠে বলে,’আই অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ আরহাম।আপনি সেদিন বললেন আমি নাকি ফাইটার।এখন আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে আপনিও একজন ফাইটার।আরিশ আর তাসনুভা যদি কোনোদিন এই সবগুলো কথা শুনে তাহলে তারাও এটাই বলবে।আমার তো মনে হচ্ছে এক্ষুনি তাদের ডেকে কথা গুলো বলি।আপনি ঠিক বলেছেন আরহাম।সব অপরাধের ক্ষমা হয় না।আমিও এই ব্যাপারে সহমত।সবকিছুর পরিশেষে একটা ক্ষমা প্রার্থনা অতীতের যন্ত্রণা লাঘব করতে পারে না।তবে আমি চাই আপনি একটু ঠান্ডা মাথায় বিষয় গুলো হ্যান্ডেল করুন।আপনি বেশি হাইপার হয়ে যান তো।সেজন্য মানুষ আপনাকেই ভিলেন ভাবে।আপনি না রাজনীতি করেন?আপনার তো জানার কথা যে যতো সিম্পেথি অর্জন করতে পারে,জনগনের পাল্লা তার দিকেই ভারি থাকে।আপনি তাহলে এগ্রেসিভ হয়ে আপনার মায়ের দিকের পাল্লা ভারি করছেন কেন বলুন তো?’

আরহাম মাথা তুলে তাকে দেখে।তার বিস্মিত বিমুগ্ধ চাহনি দেখেই নবনীতা ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়,’কি হয়েছে?’

সে চট করে উঠে বসে।নবনীতার দুই হাত আগলে নিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে প্রচন্ড আবেগ আপ্লুত হয়ে বলে উঠে,’বিশ্বাস করো পরী,আমাকে এমন করে কেউ কোনোদিন বলেনি।কসম কেটে বলতে পারি কেউ কোনোদিন আমার দিকটা বুঝেনি।তুমি প্রথম ব্যক্তি যে আমার পার্সপেক্টিভ থেকে বিষয়টা ভেবেছ।’

নবনীতা হাসল।একহাত ছাড়িয়ে নিয়ে আরহামের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,’আমি যে আপনার বউ,তাই আপনার প্রাসপেক্টিভ থেকে ভেবেছি।আপনি কি জানেন,আপনার পাজরের হাড় থেকেই যে আল্লাহ আমাকে বানিয়েছে?’

আরহাম তার কথা শুনেই একগাল হাসল।তারপরই মাথা নামিয়ে নিল।তার মুখে বিষন্নতার স্পষ্ট ছাপ।নবনীতা একটু থেমে ডাকল,’আরহাম!’

‘হু?’

‘এদিকে তাকান।’

আরহাম চোখ তুলে।ঠিক নবনীতার চোখ বরাবর তাকায়।নবনীতা তার খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি গালে একহাত রেখেই খানিকটা এগিয়ে যায়।এগিয়ে এসে গতকালকের মতো করেই প্রগাঢ় চুমু খায়।আরহাম প্রথমে চমকাল,তারপরই ধাতস্থ হয়ে একটানে দু’জনের দুরত্ব টুকু মিলিয়ে নিল।নবনীতা কয়েক দফা চুমু খেয়েই সরে এসে একগাল হেসে দুষ্টুমির ছলে বলল,’আপনি কাল আমার দুঃখ কষ্ট শুষে নিয়েছিলেন।আমি আজ আপনার দুঃখ কষ্ট শুষে নিলাম।হয়েছে না হিসাব বরাবর?’

আরহাম তার গালে হাত রেখেই মিষ্টি করে হাসল।নবনীতার দুই হাতে কয়েকটা চুমু খেয়ে গাঢ় স্বরে বলল,’যেদিন চিত্রর সাথে তোমাকে দেখেছি,সেদিনই উপলব্ধি করেছি,আমার চেনাজানার বাইরে মেয়ে মানুষের আরো একটি স্বরুপ আছে।তুমি মা না হয়েও চিত্র’র মা হয়ে উঠেছিলে।নিজের মা কে দেখার পর তোমার এই অসাধারণ রূপটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।মনে হলো আমার মা জন্ম দিয়েও মা হতে পারে নি,আর পরী জন্ম না দিয়েও মা হয়ে উঠতে পেরেছে।সেই পরী আপাইকে আমি বড্ড ভালোবাসি।’

নবনীতা চটপট প্রশ্ন করল,’আর আপনার সেনোরিটা কে?তাকে ভালোবাসেন না?’

আরহাম স্মিত হাসল।নবনীতার উড়তে থাকা চুল গুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে চাপা স্বরে বলল,’ঐটাকেও একটু একটু বাসি বোধহয়।’

নবনীতা দুই হাতে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরল।সহজ গলায় বলল,’মন খারাপ করে না আরহাম।জীবন এমনই।দুঃখে কষ্টে জর্জরিত হতে থাকার পর হঠাৎই সুখের দেখা পেয়ে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার নামই জীবন।আমরা অনেকটা সময় মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছি।এখন আমরা সুখে থাকব,ভালো থাকব।তাই না বলুন?’

আরহাম আচমকাই তার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরল।আকুল হয়ে বলল,’পরী! আমি জানি আমি কোনো ভালো মানুষ নই।ভীষণ এলোমেলো,রুক্ষভাষী আর কাঠখোট্টা স্বভাবের লোক আমি।তোমার মতো মিষ্টি আর ধৈর্যশীল হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।কিন্তু তা স্বত্তেও তুমি কি গোটা জীবন আমাকে সহ্য করে নিতে পারবে?এই ত্রুটিপূর্ণ আমি টার সাথেই এক মনে সংসার করে যেতে পারবে?বলো না।আমি কিন্তু চিরকাল এমনই থাকব।হয়তো তোমার সান্নিধ্যে কিছুটা শুধরে যাব।কিন্তু তোমার মতো এতো ভালো হতে পারব না।তুমি এই মাথাগরম লোকটার সাথে পুরো জীবন কাটাতে পারবে পরী?হু?’

নবনীতা কপাল কুঁচকায়।আরহামের মতো করেই কড়া স্বরে বলে,’কাটাতে পারব মানে?বিয়ে হয়েছে আমাদের।এখন এসব পারব নাকি পারব না,এসব কথার কোনো মানে নেই।বিয়ে যখন হয়েছে,সংসার তখন করতেই হবে।ঘর করব না বলতে কোনো শব্দ নেই।ঘর করতে হবে।হবেই হবে।’

তার কথা শেষ হতেই দু’জন সমস্বরে হেসে ফেলল।আরহাম এক লাফে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল।গা ঝাড়া দিয়ে একটা হাত নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়েই চঞ্চল কন্ঠে বলল,’উঠে এসো সেনোরিটা।’

নবনীতা হাসিমুখে সেই হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ায়।ঠিক মতো দাঁড়ানোর আগেই আরহাম তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।নবনীতা আঁতকে উঠে বলল,’সর্বনাশ! বাচ্চাগুলো এখনো সজাগ।দেখে ফেললে?’

আরহাম বিরক্তিতে মুখ খিঁচে বলল,’রাখো তো তোমার বাচ্চাকাচ্চার চিন্তা।এতো কিছু খেয়াল করতে পারব না।দেখলে দেখুক।আমার কি?’

নবনীতা দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরল।মুচকি হেসে বলল,’কি অদ্ভুত বিষয় তাই না?দুঃখ বিলাশ করতে এসে আমরা প্রেম নিবেদনে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।হিহিহি।’

আরহাম মাথা নাড়ল।বিজ্ঞের মতোন ভাব নিয়ে বলল,’এগুলো কেমিস্ট্রির ল’অব রোমান্স।তুমি ফিজিক্সের মানুষ এসব বুঝবে না।’

‘আচ্ছা তাই নাকি?তো শুনি একটু আপনার ল অব রোমান্স।’ হাস্যোজ্জ্বল মুখে জানতে চাইল নবনীতা।

আরহাম ভাব নিয়ে বলল,’ল অব রোমান্সের চতুর্থ সূত্র অনুযায়ী দুঃখ কষ্টের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক সমানুপাতিক।যত বেশি তুমি কাঁদবে,ততবেশি তোমার ভালোবাসতে মন চাইবে।এটাই সাইন্স।চাইলে তোমার মোটা মোটা বইগুলোতে লিখে রাখতে পারো।’

নবনীতা খিলখিল করে কতোক্ষণ হাসল।তার সাথে সাথে আরহাম নিজেও কিছুক্ষণ হাসল।অতীতের সকল দুঃখ কষ্ট,পাওয়া-না পাওয়া কে পেছন ফেলে আরহাম হালকা মনে সামনে এগিয়ে গেল আর নবনীতাকে উপহার দিলো একটি চমৎকার সুন্দর রজনী।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৪১

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪১)

‘আমার মনে হচ্ছে আরশু যখন বড়ো হবে,তখন মেয়েরা লাইন ধরে তার পেছন পেছন ঘুরবে।’

আরশাদকে কালো রঙের একটা আরামদায়ক পোশাক পরানোর পরেই গোল গোল চোখ করে কথাটা বলে উঠল নবনীতা।আরহাম ঘরের এক কোণার ইজিচেয়ারে হালকা দুলতে দুলতে তাদের দিকে তাকায়।এখন সময় রাত দুইটা তিন।অথচ বাড়ির কারো চোখে ঘুম নেই।পুরো বাড়ির হই-হুল্লোড় দেখে মনে হচ্ছে এখন সবে মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে।

নিচ থেকে আরিশ আর তাসনুভার কানে ধরা শব্দ ভেসে আসছে।চিত্রা অবশ্য কিছুক্ষণ আগেই ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।কিন্তু বিভা এখনো সজাগ।শুভ্রা হতাশ চোখে তার দিকে দেখেই অনুরোধের সুরে বলল,’ঘুমা না রে মা।এতোক্ষণ কিভাবে সজাগ আছিস?’

রিমি ব্যস্ত পুরো বাড়ির ডেকোরেশন নিয়ে।এই ডেকোরেশনের চক্করে পুরো বাড়ির এ’মাথা সে’মাথা ঘুরতে গিয়ে সে ওয়াজিদের সাথে কয়েক দফা বারি খেয়েছে।রিমির মনে হয় সে দিনে যতবার পানি খায়,তার চেয়েও বেশি বারি খায়।একটা ধাক্কা খাওয়ার পরে মাথা তুলে কিছু বলার আগেই ওয়াজিদ ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠে,’নেভার মাইন্ড রিমি।’

বাগানের একেবারে পেছনের দিকে রান্নাবান্নার আয়োজন করা হয়েছে।আদি কতোক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়েছিল।শেষে মশার কা’মড় আর প্যান প্যান শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে সে বাড়ির ভেতরে এসেছে।এসেই সে তাসনুভার মুখোমুখি সোফায় বসল।তাসনুভা হাই তুলতে তুলতে চারপাশ দেখছিল।আদি তাকে দেখতেই চোখ বড় বড় করে বলল,’কি ব্যাপার বাচ্চা?তুমি এখনো ঘুমাও নি কেন?দেখছ না চিত্রা ঘুমিয়ে গেছে?তোমারও উচিত ঘুমিয়ে পড়া।’

তাসনুভা একগাল হাসল।সমস্ত মুখে সেই হাসি ধরে রেখেই বলল,’ভাইয়া।আমি কিন্তু আর বাচ্চা নেই।চিত্রার সাথে আমার তুলনা চলে না।’

আদি একহাত নেড়ে বলল,’অতো কথা বুঝি না।তোমাকে সেই জন্মের পর থেকে দেখছি।একেবারে যেদিন তুমি হও সেদিনও আম্মু আব্বু আর আমি গিয়েছিলাম হসপিটালে।আম্মু তোমাকে কোলে নিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলছিল দেখো দেখো! আরহামের কতো সুন্দর একটা বোন হয়েছে।
আমি তখন ফাইভে পড়ি বোধহয়।ওয়াজিদ আর আমি তখন যা টানাটানি করতাম তোমাকে নিয়ে!’

বলতে বলতেই সে হেসে ফেলল।তাসনুভা অবাক হয়ে বলল,’সত্যি?ওয়াজিদ ভাইয়াও এমন করত?’

‘তো?করত মানে?সে সারাক্ষণ বাড়ি আসলেই তোমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো।আমরা বাগানে ক্রিকেট খেলতাম।আর সে শান্তিপ্রিয় মানুষ তোমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো।আসলে ওয়াজিদ হচ্ছে মেয়েদের তথাকথিত গ্রীন ফ্ল্যাগ।যোগ্য পুরুষ হওয়ার সব যোগ্যতাই তার আছে।ওয়াজিদ তো ছিল সোনা মায়ের সবচেয়ে প্রিয় বাচ্চা।সারাদিন সোনা মায়ের কথা মতো চলত।সোনা মা যেই আদর করতো তাকে!’

আদি থামল।কথায় কথায় সে অনেকটা বলে ফেলেছে।তার মনে হচ্ছে তার আরো আগেই লাগাম দেওয়া উচিত ছিল।কিন্তু সে দেয়নি।সে মাথা তুলে চোরা চোখে তাসনুভার দিকে তাকায়।দেখতে পায় তাসনুভার মুখের হাসি কমতে কমতে একটা সময়ে এসে একেবারে মিলিয়ে গেছে।সেই জায়গায় কেমন একটা বিষাদের ছাপ ফুটে উঠেছে।আদি নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হলো।সে কি লাগাম দিতে জানে না?কি দরকার ছিল পুরান কথা বলে মেয়েটার মন খারাপ করার?সে কথা ঘুরানোর উদ্দেশ্যে নিজ থেকেই আবার বলল,’সে যাই হোক।তুমি সত্যিই আমার কাছে একটা বাচ্চা।আমেরিকা যাওয়ার আগেও যখন তোমায় দেখেছিলাম,তখনও বাচ্চা ছিলে।এখনো বাচ্চাই লাগে।বুঝেছ বাচ্চা?’

***

আরশাদ পিটপিট চোখে সামনে থাকা মেয়েটাকে দেখে।নবনীতা খুশি হয়ে বলে,’দেখুন আরহাম,সে কিভাবে আমার দিকে তাকায়।আমার মনে হচ্ছে আরশাদ আমাকে চিনে ফেলেছে।তাই না আরহাম?’

আরহাম ব্যবসার কাগজ গুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে ছোট করে জবাব দেয়,’হু।’

নবনীতা একহাতে আরশাদের চুলগুলো ঠিক করে।তারপরই আগের মতো চঞ্চল কন্ঠে বলে উঠে,’আরশু কিন্তু এখনই নায়কদের মতোন দেখতে।আমার তো মন চায় তাকে নায়ক বানাতে।কিন্তু আমি ভেবেছি তাকে আমি নায়ক বানাবো না।কারণ এতে করে তার বিয়ে দিতে সমস্যা হবে।এতো মেয়ের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করার পর কোন ভালো মেয়ে তার সাথে বিয়ে করবে শুনি?আমি ঠিক ভেবেছি না আরহাম?’

আরহাম পাতা উল্টাতে উল্টাতে গম্ভীর গলায় বলল,’হু।’

‘আমি একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করেছি আরহাম।শুনতে চান?’

‘হু’

‘আমি লক্ষ করলাম আরশাদের সাথে আসাদের নামেরও এতো মিল নেই যত মিল আপনার নামের সাথে আছে।আরহাম আরশাদ।শুনতেই কেমন ভালো লাগে তাই না?’

‘হু’

‘আরশাদ যখন বড় হবে তখন দেখবেন ফেসবুক আইডিতে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্টের জ্বালায় টিকতে পারবে না।মেয়েরা বড্ড জ্বালাবে আমার সোনা বাচ্চাটাকে! কিন্তু কি আর করার?আমার আরশুকে আল্লাহ বানিয়েছেই এতো সুন্দর।হোয়াট টু ডু নাও? হিহিহি।’

‘হু’

নবনীতা কপাল কুঁচকায়।পাশ ফিরে সরু চোখে আরহামকে দেখে।যার সমস্ত মনোযোগ তার সামনের টি টেবিলে ছড়িয়ে রাখা কাগজগুলোর উপরে।সে কি আদৌ কিছু শুনছে নাকি খামোখাই এক নাগাড়ে হু হু বলে যাচ্ছে?

নবনীতা চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করে,’আমার নাম কি আরহাম?’

‘হু।’

‘আমি আপনার কি হই?’

‘হু’

‘আপনি একটা গর্দভ।’

‘হু’

নবনীতা খিল খিলিয়ে হাসল কিছুক্ষণ।তার হাসির শব্দ শুনেই আরহাম চোখ তুলল।অবাক হয়ে বলল,’কি হয়েছে?হাসছ কেন?’

নবনীতা সাথে সাথেই হাসি বন্ধ করে মুখ গোমড়া করে বলল,’কিছু না।আপনি কাজ করুন।কথায় কথায় না বুঝে হু হু করার দরকার নেই।’

বলেই সে আবার আরশাদের দিকে মন দেয়।গালের নিচে হাত রেখে বিমুগ্ধ কন্ঠে বলে,’এ্যাই আরশু।সত্যি করে বলো তো তুমি কি আসাদের বাচ্চা নাকি ভিনদেশের কোনো পরীর বাচ্চা?সত্যি করে বলবে কিন্তু।’

আরহাম ভারি গলায় ডাকল,’পরী! শুনো তো?’

‘কি?’ জবাব এলো খুবই কাঠখোট্টা স্বরে।

আরহাম শেষ একবার কাগজ গুলো তে চোখ বুলিয়ে ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।চুপচাপ খাটে গিয়ে বসে আরশাদের হাতটা টেনে ধরে ভাবুক হয়ে বলে,’তো কি বলছিলা তুমি?আরশাদ কিসের মতো হয়েছে দেখতে?আবার বলো তো।এখন মন দিয়ে শুনব।’

নবনীতা তীক্ষ্ণ চোখে কতক্ষণ তাকে দেখে।দুই মিনিট সময় যেতেই সে পুনরায় নতুন উদ্যোমে বলতে শুরু করে,’বলছিলাম যে আরশু বড় হলে মেয়েরা তাকে খুব জ্বালাবে।আমি কিন্তু আমার ছেলেকে একদমই যেন তেন মেয়েদের সাথে মিশতে দেব না বলে দিলাম।’
.
.
.
.
সকাল হতে না হতেই আরহাম কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।লিভিং রুমে পা দিতেই সে দেখল তাসনুভা সোফাতে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে।রিমি ঘুমাচ্ছে তার পাশাপাশি সোফাতে।ওয়াজিদ আর আদিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

সে দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়।আদি বাগানে বসে রোজকার মতো ফোনে কথা বলছিল।আরহাম এগিয়ে এসেই কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে,’ওয়াজিদ কোথায়?’

আদি কান থেকে ফোন সরিয়ে চটপটে গলায় জবাব দেয়,’কে জানে?কোথায় নাকি চারটে বিড়ালের বাচ্চা পাওয়া গেছে অসুস্থ অবস্থায়।ওয়াজিদ সাহেব সেখানে গিয়েছেন তাদের রেসকিউ করতে।’

আরহাম তার কথা শুনেই নাক ছিটকে গালি দিলো,’শা’লা! এই দেশে মানুষের জীবনেরই কোনো দাম নাই।আর সে এসেছে বিলাইয়ের বাচ্চাকে রেসকিউ করতে।কি একটা অবস্থা! এতো আবেগ আসে কোথা থেকে?’

আদি স্মিত হাসে।পুনরায় মাথা নামিয়ে মুঠোফোনের কথোপকথনে মশগুল হয়।আরহাম সামনে যেতে যেতে বিরক্তিতে বিড়বিড় করে,’আরেক প্রেমিক পুরুষ! সারাদিন শুধু প্যাক প্যাক করে।’

সে পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে ব্যস্ত হয়ে কাজের তদারকি করে।আজকের পুরোটা দিন ভীষণ ব্যস্ততায় যাবে তার।সে কাজের ফাঁকেই তার খুব বেশি কাছের সহকর্মীদের ফোনকল দেয়।আরো একবার আন্তরিক হয়ে রাতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানায়।

নবনীতারও ঘুম ভেঙেছে খুব সকালে।রাত তিনটার একটু পরে তার চোখ লেগে এসেছিল।এরপর আর কিছু মনে নেই তার।এখন বাজে ভোরটা পাঁচটা ছাব্বিশ।সে উঠেই দ্রুত ওযু করল।নতুন বাড়িতে আজ তার প্রথম দিন।একটা সুন্দর সূচনা বাধ্যতামূলক তার জন্য।সে নামাজ পড়েই আরশাদকে দেখে।বাচ্চাটা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে।নবনীতা ছুটে যায় তার দিকে।গিয়েই দু’টো চুমু খায় কপালে।সে কি আরশাদকে একটু বেশিই ভালোবাসে না?হয়তো বাসে।তাতে কি?সে তো তারই বাচ্চা।নবনীতা অন্তত তাই ভাবে।নিজের বাচ্চাকে ভালোবাসা কোনো অন্যায় না।

সে তাড়াতাড়ি সেরেলাক গুলে তার ঘরে আসে।আরশাদ তিনঘন্টা ধরে কিছু খায়নি।বেলা বাড়তেই রিমি ছুটতে ছুটতে তার ঘরে এলো।এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’কি রে তুই রেডি হবি কখন?’

নবনীতা বিচলিত হয়ে জবাব দেয়,’এখন কেন?অনুষ্ঠান না বিকেলের দিকে শুরু হবে?’

‘বিকেলে হবে কিন্তু তোকে তো সাজতে হবে সুন্দর করে।তাই তোর আগে আগেই রেডি হতে হবে।’

নবনীতা কপালে হাত রেখেই কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল,’প্রায় তিনমাস আগে হওয়া বিয়ে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা একটু বেশি বেশি হচ্ছে।এতো কাহিনি করতে ভালো লাগে না।’

‘তোর লাগে না কিন্তু আমাদের লাগে।’

নবনীতা মুখ খিঁচে জানতে চায়,’তাসনুভা কাল বলছিল কে নাকি আসবে সাজাতে?এটা কি সত্যি?’

রিমি উপরনিচ মাথা নাড়ে।দ্রুত জবাব দেয়,’হু,মেক আপ আর্টিস্ট।আমাদের সবাইকেই সাজাবে।’

নবনীতা অসহায় চোখে এদিক সেদিক তাকায়।মেক আপ জিনিসটা আসলে মন্দ না।সাজানোর পর তো মানুষকে ভালোই দেখায়।সমস্যা হলো মেক আপের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা।নবনীতার তো পিঠ ধরে যায় বসতে বসতে।কি যে যন্ত্রনা! সে পাশ ফিরে একবার অপেন ক্লসেটে ঝুলানো তার মাল্টি কালারের শাড়িটা দেখে।শাড়িটার বেশির ভাগ জুড়েই আছে গাঢ় লাল রং।কেবল ব্লাউজের অংশে সামান্য সবুজ,নীল আর কালোর মিশ্রণ আছে।শাড়িটা সুন্দর,বেশ সুন্দর।

***

শীলা আক্তার তার জামদানি শাড়িটার আঁচল নিয়ে ভীষণ ঝামেলায় পড়েছেন।শাড়ির আচলটা বার বার মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।তিনি ঠিক মতো হাঁটতেও পারছেন না।হঠাৎই কোথা থেকে একটি মেয়ে এসে মাটি থেকে তার আঁচল টা তুলে নিজের হাতে নেয়।মিসেস শীলা চমকে ঘুরে দাঁড়ান।পেছন ফিরতেই গোলগাল মুখের মেয়েটিকে দেখে বললেন,’আরে! তুমি আবার কষ্ট করে তুলতে গেলে কেন?’

মেয়েটা মাথা নেড়ে জবাব দেয়,’না আন্টি সমস্যা নেই।’

শীলা এগিয়ে গেলেন।জানতে চাইলেন,’নাম কি তোমার মা?’

মেয়েটা হাসিমুখেই উত্তর দিলো,’সিদরাতুল মুনতাহা।ডাকনাম রিমি।’

মিসেস শীলা আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন।বললেন,’বাহ খুব ভালো নাম।’

ওয়াজিদ পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বাড়ির ভেতরে আসতেই দোতালার দৃশ্য থেকে থমকে গেল।চোখ বড় বড় করে আবিষ্কার করল মা যেই মেয়েটার সাথে কথা বলছে সে আর কেউ না-রিমি।সে নিচ তালার বসার ঘর থেকেই উপরে দেখে চেঁচায়,’সাবধানে কথা বলো মা।এই মেয়ে নিশ্চিত আবার কোনো না কোনো অঘটন ঘটাবে।’

রিমি চোখ পাকায়।গরম চোখে একবার ওয়াজিদকে দেখে।এতোক্ষণ পর্যন্ত তো সে একটাও অঘটন ঘটায় নি।সে রেলিংয়ে হাত রেখে নিচের দিকে ঝুঁকে।চটে যাওয়া মেজাজে বলে,’আজ আমি কি অঘটন ঘটিয়েছি শুনি?’

দোতালার রেলিংয়ে খুবই নড়বড়ে অবস্থায় একটা ফুলের ঝুড়ি রাখা ছিল।ফুলগুলো কাজে লাগানো হয়েছে,তবে ঝুড়িটা এখনও নেওয়া হয়নি।রিমির হাত লাগতেই সেটা এক নিমিষে রেলিং থেকে ছিটকে নিচে গিয়ে পড়ল।ঘটনা এতো দ্রুত ঘটল যে রিমি কিছু ঠাহর করার আগেই সেই বিশালাকৃতির ঝুড়িটা ওয়াজিদের মাথায় গিয়ে পড়ল।

হকচকিয়ে উঠে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে রিমি।এটা কি হলো?কেমন করে হলো?দুনিয়ার সব ভুল কেন সে ওয়াজিদের সামনেই করে?ওয়াজিদ মুখ থেকে ঝুড়ি সরানোর আগেই সে দ্রুত শিলা আক্তারের হাতে তার শাড়ির আঁচল গুজে দিয়ে ভোঁ দৌড় দিলো তাসনুভার ঘরের দিকে।

ওয়াজিদ মাথার উপর থেকে ফুলের ঝুড়ি সরিয়ে কটমট চোখে উপরে তাকায়।তারপরই তিরিক্ষি মেজাজে চেঁচায়,’ঐ আহাম্মক নিষ্কর্মা টা কোথায় মা?’

শীলা আক্তার চোখ পাকিয়ে ছেলেকে দেখেন।মৃদু ধ’মকে উঠে বলেন,’এসব কেমন কথা ওয়াজিদ?এভাবে কথা বলে কেউ?এক্সিডেন্টালি হয়ে গেছে।তুমি এতো রাগ হচ্ছো কেন?’

ওয়াজিদ ফুসতে ফুসতে জবাব দিলো,’আর কতো শান্ত থাকব?তুমি একে চিনো না।সারাক্ষণ একটা না একটা গর্দভগিরি করতেই থাকে এই মেয়ে।শী ইজ সাচ আ ননসেন্স।আমাকে দেখলেই এর পাগলামি এক ডিগ্রী বেড়ে যায়।তুমি দয়া করে এই বেকুবটার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবে।’

কথা শেষ করেই সে হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল।শীলা আশ্চর্য হয়ে তার ছেলের কাজকর্ম দেখেন।এই ছেলে তো যথেষ্ট ধৈর্যশীল।সেই সাথে চাপা স্বভাবের।সে একটি মেয়েকে এমন করে ধমকাচ্ছে,বিষয়টা আসলেই অবিশ্বাস্য।

মিসেস শীলা আর কথা না বাড়িয়ে তাসনুভার ঘরে গিয়ে বসলেন।ঘরে যেতেই তিনি দেখলেন কনেসহ সবাই সেদিকেই আছে।নবনীতার সাজ একটু আগেই শেষ হয়েছে।তাসনুভা মাত্র সাজার জন্য বসেছে।মিসেস শীলা ঘরে আসতেই তাসনুভা গালভর্তি হাসল।তারপর নবনীতার দিকে ফিরে পরিচয় করালো,’ভাবি এটা শীলা আন্টি।ওয়াজিদ ভাইয়ার আম্মু।’

নবনীতা প্রশস্ত হেসে তার কাছে এগিয়ে যায়।আন্তরিক কন্ঠে জানতে চায়,’কেমন আছেন আন্টি?’

মিসেস শীলাও জবাবে প্রসন্ন হেসে জানালেন,’ভালো আছি মা।খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।’

তিনি খাটে গিয়ে রিমির পাশাপাশি বসলেন।রিমি তাকে দেখেই বোকা বোকা হাসে।মিসেস শীলা সহজ হয়ে জানতে চায়,’তুমি সাজবে না রিমি?’

ছটফটে তরুণী চপলা কন্ঠে উত্তর দেয়,’জ্বী আন্টি।তাসনুভার পরেই আমি সাজবো।’

বিভা দৌড়ে দৌড়ে তার কাছে আসে।এসেই তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।রিমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় জানতে চায়,’কি রে বিভু?হাঁপিয়ে পড়েছিস?’

মিসেস শীলা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়,’তোমার ভাইয়ের মেয়ে নাকি?’

রিমি বিভাকে দেখতে দেখতেই হাসি মুখে জবাব দিলো,’না আন্টি।আমার কোনো ভাই নেই।’

‘তাহলে?এটা কে?’

রিমি একটা দম নেয়।বিভার চুলে আঙুল চালাতে চালাতেই একে একে সব ঘটনার বিশদ বর্ণনা দেয়।কিভাবে নবনীতা বিভাকে পেল,কিভাবে নবনীতার কাছ থেকে সে বিভাকে নিল,কিভাবে বিভা তার পরিবারের স্থায়ী সদস্য হয়ে উঠল-সবকিছু সে একে একে খুলে বলে।শীলা আক্তার অভিভূত হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের তার সেই কথা শুনেন।কি সাবলীলভাবে মেয়েটা ঘটনাটা বর্ণনা করছে! যেন বিষয়টা খুবই সাধারণ।অথচ তার মনে হলো এই বিষয়টা অত্যন্ত অসাধারণ।একটা অবিবাহিত মেয়ে নিঃসংকোচে একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত বাচ্চাকে মেয়েকে লালন পালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে,এই বিষয়টা সত্যিই চমৎকার।মিসেস শীলা টের পান মেয়েটিকে তার ভালো লাগছে।একটু বেশিই ভালো লাগছে।

***

শাড়ি পরবে না জামা পরবে এই নিয়ে পুষ্পিতা নূর অনেক বেশি দ্বিধাদ্বন্দে পড়েছিল।তার শাড়ি পরার ইচ্ছে ছিল।তবে আপাইয়ের চোখ রাঙানির ভয়ে সে সেটা মুখ ফুটে বলতে পারছিল না।কিন্তু আপাই নিজে তাকে বলেছে সে যেন আজ শাড়িই পরে।তাই আজ সে শাড়ি পরেছে।তাও আবার তার পছন্দের গাঢ় মেজেন্টা রঙের।

আরিশ তাসনুভা আর সারাহ-র একটার পর একটা ছবি তুলতে তুলতে শেষে ক্লান্ত হয়ে বলল,’আর পারব না।তোরা ক্যামেরা ম্যানকে দিয়ে তোলা।আমার পক্ষে আর সম্ভব না।’

সারাহ নিজেও কয়েকটা ছবি তুলে নাক মুখ কুঁচকে বিরক্তি বিরক্তি ভাব ধরে সেখান থেকে চলে এলো।আরিশ দূর থেকে আরহাম আর নবনীতার একটা ছবি তুলে।তাদের দু’জনকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে।

শুভ্রানী তার প্রিয় রঙের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে ছোট ছোট পায়ে সামনে এগোয়।সে আজ উঁচু জুতা পরেছে,ছোট ছোট পা ফেলার এটাই কারণ।আরিশ অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক দেখতে গিয়ে তাকে দেখল এবং দেখার পর চটপট আরো কয়েক পলক তাকে দেখে নিল।তারপরই চোখ সরিয়ে নিল।ভেতরটা সেই কবে থেকে খচখচ করছে।এটা কি ঠিক হচ্ছে?সে নিজ মনে আপনাআপনি বিড়বিড় করে,’মাত্র উচ্চমাধ্যমিক আরিশ।একটু লজ্জাশরম রাখা উচিত শরীরে।’
তক্ষুনি আবার মনের গহীন থেকে অন্যরকম উত্তর আসে-‘আরে সারাজীবন কি আর উচ্চমাধ্যমিকে থাকবে নাকি?ক’দিন বাদেই তো গ্রেজুয়েশন লেভেলে চলে যাবে।

‘আরিশ ভাইয়া!’

ডাক শুনেই পেছন ঘুরে সে।বিষন্ন মুখে আবিষ্কার করে তাকে ডেকেছে শুভ্রা।সে লটকানো মুখে সামনে এগিয়ে যায়।জানতে চায়,’কি হয়েছে?’

‘আমার,চিত্র’র আর রিমি আপুর একটা ছবি তুলে দিন না প্লিজ।’

আরিশ বিরস মুখে ক্যামেরা সেট করে।লটকানো মুখেই চটপট কয়েকটা ছবি তুলে।শুভ্রা ছবি গুলো দেখেই খুশি হয়ে বলে,’খুব সুন্দর হয়েছে ভাইয়া।’
আরিশ মুখ খিঁচে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ল।এখানে থাকলেই এই মেয়ে ভাইয়া ভাইয়া করতে করতে কানের পোকা বের করে ফেলবে।

***

নবনীতা অনেকটা সময় স্টেজে বসে থাকার পর শেষে অধৈর্য হয়ে উঠে এলো।এতোক্ষণ বসে থাকা যায় নাকি?পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে তার।সে স্টেজ থেকে নেমে সামনে এগিয়ে যায়।

আরহাম তখন প্রবীণ নেতাদের সাথে কুশল বিনিময় করছিল।নবনীতাকে দেখতেই সে এগিয়ে গেল।হাত ধরে টানতে টানতে বলল,’তোমাকেই খুঁজছিলাম।চলো পরিচয় করাই।’

নবনীতা বিরক্তি জড়ানো মুখে কোনোরকমে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে সবার সাথে পরিচিত হলো।বেশভূষায় তো বেশ এলিট শ্রেণীর মানুষ মনে হচ্ছে।অথচ সব ক’টার পেট জনগনের টাকা মেরে ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়েছে।সে বেখেয়ালি চোখে চারদিক দেখে।আরহাম খানিকটা আফসোসের সুরে বলে,’তোমাকে তো জালাল আঙ্কেলের সাথে দেখা করাতে পারলাম না এখনো।আঙ্কেল শহরে নেই।শহরে আসলে একদিন ইনভাইট করব নে।’

নবনীতা আড়চোখে তাকে দেখেই গটগট করে বলল,’বাপরে বাপ! এই জালাল আঙ্কেলের নাম শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত।’

‘উহু,তুমি বুঝতে পারছ না।আঙ্কেলই আমাকে সবকিছুতে পরামর্শ দেয়।’

নবনীতা সোজাসুজি তার দিকে ফিরে।থমথমে মুখে জবাব দেয়,’বুঝেছি।আপনার ধ্বংসের কারিগর তাহলে আপনার ঐ জালাল আঙ্কেলই।’

আরহামের এই উত্তর একদমই পছন্দ হলো না।সে তীব্র আপত্তি করে জানাল,’একদমই না।সে আমাকে রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝিয়েছে।আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।’

নবনীতা আর কথা বাড়ায় না।সে লক্ষ্য করেছে রাজনীতিবিদ দের মধ্যে একটা কমন ফিচার থাকে।সেটা হলো তারা নিজেরা যেটা ভাবে,নিজেরা যা বুঝে সেটাকেই তারা চিরন্তন সত্য রূপে গ্রহণ করে।এর বাইরে অন্য কারো বোঝানো তে তারা কান দেয় না।

রাত একটু বাড়তেই আরিশ গলা ছেড়ে ডাকল,’ভাইয়া ভাবি।ডাইনিং-এ এসো।আরহাম মোবাইল ফোনে সময় দেখেই বলল,’মাত্র নয়টা বিশ।এনিওয়েজ,খেয়ে নেই চলো।

___

মহানগর অফিসের সাধারণ সম্পাদক মোসাদ্দেক হক।তার মেয়ের নাম শায়লা।শায়লার বয়স খালি চোখে অনুমান করাটা কষ্টসাধ্য।একবার তাকে দেখাচ্ছে খুবই ছোট,আবার হুট করেই মনে হচ্ছে সে এতোটাও ছোট না।

বাগানের একদিকে খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।খাবারের টেবিল গুলো নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখা হয়েছে।উপরে খোলা আকাশ,চারদিকে মরিচবাতির হলুদাভ রোশনাই-সবমিলিয়ে চারদিক ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে।আরহাম সেখানে আসতেই শায়লা এক দৌড়ে এগিয়ে যায়।আহ্লাদী স্বরে বলে,’কেমন আছেন ভাইয়া?’

নবনীতা তখন মাত্রই চেয়ার টেনে খেতে বসেছে।তার একপাশে তাসনুভা,অন্যপাশে আরিশ।চিত্রা আর বিভা আরো অনেক আগেই খেয়ে নিয়েছে।শুভ্রা আর রিমি বসেছে তাসনুভার পাশাপাশি চেয়ারে।টেবিলের সবগুলো চোখ খাঁড়া হয়ে আরহাম আর শায়লা কে দেখছিল।তাসনুভা নবনীতার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে,’মোসাদ্দেক আঙ্কেলের মেয়ে।খুবই ন্যাকা আর গায়ে পড়া স্বভাবের।’

নবনীতা সরু চোখে সামনে দেখতে দেখতেই জবাব দেয়,’সেটা তো দেখতেই পারছি।’

আরিশ মাথা কাত করে।সাবধানী গলায় বলে,’দেখলেই তো হবে না।ডাইরেক্ট একশানে যেতে হবে।দেখো ভাইয়া কেমন হেসে হেসে কথা বলছে।এটা তো একদমই মেনে নেওয়ার মতো না।’

নবনীতা কটমট করে বলল,’সেটাই তো।মেয়ে মানুষ ভাল্লাগে না তো এমন হেসে হেসে কথা বলার কি আছে?ঢং দেখলে বাঁচি না।’

শায়লা হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়াল।আরহাম মনে মনে দুইটা খাস বাংলা গালি ঝেড়ে তার হাতের সাথে নিজের হাত মিলাল।তাদের পাশেই মোসাদ্দেক হক দাঁড়িয়ে আছেন।এই পরিস্থিতিতে হাত মেলানোই উত্তম।হাত মিলিয়েই সে নাক ছিটকে হাতটা সরিয়ে নেয়।নবীনতা চোখের অনলে কতোক্ষণ তাকে ভ’স্ম করল।চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ইশশ রে! মুখের হাসি থামেই না।’

আরিশ গমগমে স্বরে বলল,’ভাবি এটা কিন্তু একদমই ভালো লক্ষ্মণ না।’

তাসনুভা ঝুঁকল।কন্ঠ খাদে নামিয়ে হিশহিশ করল,’ঠিকই তো।আজ হাত ধরেছে।কাল অন্যকিছু ধরলে?’

নবনীতা চোখ বড় বড় করে আঁতকে উঠে।আরিশ চেঁচিয়ে উঠে বলল,’কি!! কি বললি তুই?অন্য কিছু মানে?ইস ছি!’

তাসনুভা বোকা বোকা হয়ে জবাব দেয়,’জড়িয়ে ধরার কথা বলেছি।এমন অদ্ভুত রিয়েক্ট করছ কেন?’

আরিশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে দমে গেল।নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে কড়া চোখে একবার তার দিকে তাকায়।মাথায় আস্তে করে একটা গাট্টা মেরে বলে,’খালি নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরে তাই না?’

তিনজনই পুনরায় সামনে তাকায়।আরিশ আর তাসনুভার চিন্তাধারায় এক বালতি পানি ঢেলে আরহাম শায়লা চোখের আড়াল হতেই সামনের টেবিলে থাকা টিস্যুবক্স থেকে টিস্যু নিয়ে দ্রুত হাত মুছে।মুছেই বিড়বিড় করে আরো কিছু গালি ঝাড়ে।

মুহূর্তেই চোখ জোড়া আনন্দে ঝলমল করে উঠে নবনীতার।জীবনে এই প্রথম আরহামের ‘আই হেইট ওম্যান’ কোয়ালিটি টা নবনীতার মন কেড়েছে।ঠিকই তো আছে।অন্য মেয়ে কেন হাত ধরবে তার?
আরহাম তাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়।চেয়ার টেনে ধপ করে বসে বিক্ষিপ্ত মেজাজে বলে উঠে,’আই হেইট দৌজ শাহবাগীজ।অতিমাত্রায় বাল পাকনা মেয়ে মানুষ আমার জাস্ট অসহ্য লাগে।বাট হোয়াট টু ডু?পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার ঠিক রাখতে হলে এসব সহ্য করতেই হবে।’

নবনীতা গালের নিচে হাত রেখে কতোক্ষণ তাকে দেখে।নিজেও মনে মনে উত্তর দেয়,’ইয়েস ইয়েস।অন্যের বর নিয়ে হাতাহাতি করা পাকনিদের আমারও পছন্দ না।আপনার সাথে এ ব্যাপারে সহমত আমি।’

সে দুই দিক ফিরে আরিশ আর তাসনুভাকে দেখে।তারপরই গর্ব করে চাপা স্বরে বলে উঠে,’দেখেছ আমার বর কতো ভালো?এমন ছেলে তোমরা আর দু’টো পাবে?’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৪০

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪০)

নবনীতার গায়ে জড়ানো শাড়িটার রং গাঢ় নীল।নীলের মাঝে কয়েক ফোঁটা কালো মেশালে যেমন রং হয়,অনেকটা এমন।সে শাড়ি পরেই চুপচাপ কতোক্ষণ নিজের রুমে বসে থাকল।শূন্য চোখে একবার পুরো ঘরটা দেখল।এখন বিকেল তিনটা বাজে।আরহামদের গাড়ি আর একটু পরেই চলে আসবে।আর তারপর?

নবনীতা মাথা নামিয়ে বড়ো করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।তারপর সে চিরতরে বাড়ির মানুষদের ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে।নিজের ভাবনায় তার নিজেরই হাসি পায়।তার আবার পরিবার ছিল কবে?সে তো সবসময়ই ছন্নছাড়া।তবে তার জীবনে দু’টো অমূল্য রত্ন আছে।এই রত্নগুলোকে সে ভীষণ ভালোবাসে।এদের ছাড়া সে থাকবে কেমন করে?আদৌ কি এদের ছাড়া থাকা তার পক্ষে সম্ভব?

সে মাথা কাত করে একবার আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে।কাল সারারাত সে জেগে ছিল।মিশ্র অনুভূতি গুলো তাকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।একদিকে নতুন জীবনে পদার্পণের কৌতূহল,অন্যদিকে দুই বোনকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা-সব মিলিয়ে নবনীতার কেমন এলোমেলো লাগে সবকিছু।

শুভ্রা খাবার শেষে তার ঘরে এসে চুপচাপ ফ্লোরে বসল।ঠিক তার পায়ের কাছটায়।তারপর আলতো করে তার কোলে মাথা রাখল।নবনীতা ঈষৎ কেঁপে উঠল।চমকানো গলায় বলল,’কি রে শুভি?কি হয়েছে তোর?’

শুভ্রা ক্ষণকাল চুপ থাকার পর শেষে মৃদু স্বরে বলল,’আমি খুব ভালো করে পড়ব আপাই।তুমি টেনশন করো না।’

নবনীতা স্মিত হাসে।মাথা নামিয়ে শুভ্রার কপালের একপাশে চুমু খেয়ে নরম স্বরে বলে,’জানি তো শুভি।তোরা দুইজনই তো আমার লক্ষী বোন।আপাইয়ের কোনো অভিযোগ নেই তোদের কাছে।শুধু আছে কৃতজ্ঞতা।ছয় বছর তোদের কে যেমন তেমন রাখার পরেও তোদের কাছে আমি পৃথিবীর সেরা মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি।এই পরী আপাই তার শুভি আর চিত্র’র কাছে খুব বেশি কৃতজ্ঞ।আমার একাকিত্বের জীবনটা রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য পরী আপাইয়ের পক্ষ থেকে শুভি আর চিত্রকে এতো এতো ভালোবাসা।’

শুভ্রা তার কোলে মাথা রেখেই হু হু করে কেঁদে ফেলল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’তোমাকে ছাড়া থাকবো ভাবলেই কান্না পায় খুব।’

***

আরহামদের গাড়ি এসেছে আনুমানিক চল্লিশ মিনিট আগে।আরহাম আসেনি।আদি,আরিশ,তাসনুভা আর রিমি এসেছে।আরহাম তখনো তার মহানগরের অফিসে।কি নাকি জরুরি মিটিং আছে।

নবনীতা ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সাদেক সাহেবের ঘরে গেল।গিয়েই হালকা করে কাশলো।ঠান্ডা স্বরে ডাকল,’মামা! জেগে আছ?’

সাদেক সাহেব শোয়া অবস্থায় সামান্য মাথা তুলে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,’হ্যাঁ মা।জেগে আছি।আয় না।’

নবনীতা এসে খাটের এক কোণায় বসল।বসেই দ্রুত মাথা নামিয়ে নিল।এই মুহূর্তে কেঁদে ফেলে সে পরিবেশ নষ্ট করতে চায় না।সে আর্দ্র গলায় বলল,’মামা ওরা চলে এসেছে।আরহাম আসলেই আমিও তাদের মাথে চলে যাব মামা।কালকে তাদের বাড়িতে অনুষ্ঠান।বেঁচে থাকলে একেবারে সেখানেই আবার দেখা হবে।’

কথা শেষ করে সে একটু দম নিল।তারপরই একবার নাক টেনে পুনরায় বলতে শুরু করল,’মামা আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।তুমি আমার কাছে বাবার মতোই।আমরা তিনবোন কোনোদিনই তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না।কখনোই না।শোধ করতে চাইও না।থাকুক,কিছু ঋণ আজীবনই থাকুক মামা।আমরা সেই ঋণের বোঝা নিজেদের উপর নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে চাই।বিদায় বেলাতেও তোমার কাছে আরো একটা আবদার করে গেলাম মামা।আমার কলিজা দু’টো কে একটু দেখে রেখো।চিত্র খাবার নিয়ে ভীষণ জ্বালায়।বেশি কিছু করতে হবে না,শুধু একটু ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করবে খেয়েছে নাকি।তাহলেই হবে।’

সাদেক সাহেব স্থির নয়নে কয়েকপল তাকে দেখলেন।মেয়েটা মাথা নামিয়ে নিজের দুই হাত একটানা কচলে যাচ্ছে।দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।তিনি আদুরে গলায় ডাকলেন,’কাছে আয় পরী।একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।’

নবনীতা যেন এই কথারই অপেক্ষায় ছিল।সাদেক সাহেব কথা ঠিক মতো শেষ করার আগেই নবনীতা তার পায়ের দিক থেকে উঠে তার মুখোমুখি বসে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল।প্রচন্ড আবেগপ্রবণ হয়ে বলল,’আমাকে তুমি মাফ করে দিও মামা।অনেক মুখের উপর কথা বলেছি।ঠাস ঠাস উত্তর দিয়েছি।প্রচুর ভোগান্তি দিয়েছি তোমাদের।আর দিব না।তুমি মনে কোনো কষ্ট রেখ না।প্লিজ মামা,তুমি আমার চিত্র আর শুভি কে একটু দেখে রেখ।’

সাদেক সাহেব একটা হাত তুলে আলতো করে তার মাথায় রাখলেন।সামনে তাকাতেই দেখলেন চৌকাঠে একটি যুবক ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তিনি আন্তরিক গলায় ডাকলেন,’আরে আরহাম! এসো না বাবা।’

চকিতে মাথা তুলে পেছন ফিরে নবনীতা।আহরাম ধীর পায়ে হেঁটে এসে তাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়।সাদেক সাহেব নবনীতার একটা হাত নিয়ে আরহামের হাতে তুলে দিলেন।আবেগ জড়ানো কন্ঠে বললেন,’এই মিষ্টি মেয়েটার খেয়াল রেখ আরহাম।হয়তো কিছুটা স্পষ্টভাষী,সামান্য জেদি।তবে মন থেকে খুবই সরল।তুমি মেয়েটাকে দেখে রেখো।’

আরহাম জবাবে কেবল আস্তে আস্তে দুইবার মাথা নাড়ল।সাদেক সাহেবের ঘরে আরো কিছুক্ষণ থাকার পর তারা দু’জনই উঠে এলো।নবনীতা শেষ একবার তার ঘরে গিয়ে আলগোছে চারদিকে চোখ বুলায়।হঠাৎই দরজা লাগানোর শব্দে সে কিছুটা চমকে পেছন ফিরে।খানিকটা আশ্চর্যের সুরে বলে,’কি ব্যাপার?দরজা বন্ধ করলেন কেন?’

আরহাম দরজায় ঠেস দিয়েই বাঁকা হাসল।তারপরই একটানে নবনীতাকে তার কাছে এনে নিজে ঘুরে গিয়ে নবনীতাকে দরজার সাথে ধাক্কা দিয়ে দাঁড় করাল।দরজার লকটা পিঠের সাথে লাগতেই নবনীতা দাঁতে দাঁত পিষে খেকিয়ে উঠল,’পাগল নাকি?দেখেন না দরজায় যে লক আছে?এভাবে কেউ ধাক্কা দেয়?ধুর! পিঠটাই ব্যথা হয়ে গেছে।’

আরহাম একপেশে হাসল।হাত বাড়িয়ে নবনীতার চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো।নবনীতা দুই চোখ সরু করে বলল,’কাহিনি কি?এমন উদ্ভট আচরণ করছেন কেন?মাথা ঠিক আছে?’

আরহাম আচমকাই একহাত তার ঘাড়ের পেছনে নিয়ে তাকে একটানে নিজের একেবারে কাছাকাছি নিয়ে এলো।চোখজোড়া আপনাআপনি বড় হয়ে এলো তার।একপ্রকার নিশ্বাস বন্ধ করে সে জানতে চায়,’হচ্ছে টা কি আরহাম?’

আরহাম জবাব দিলো না।উল্টো নবনীতাকে চূড়ান্ত রকমের হতবাক করে দিয়ে সে তার ওষ্ঠাধরে প্রগাঢ় চুম্বন করে।কতো সময়ের জন্য?নবনীতা জানে না।সে পাথরের মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল।সে পলক ফেলার পাশাপাশি নিশ্বাস নেওয়াও ভুলে গেছে।তার বিস্ফারিত চোখ জোড়া দেখেই আরহাম স্মিত হাসল।এগিয়ে গিয়ে একই কাজের পুনরাবৃত্তি করল।তার শক্তপোক্ত শরীরটার অকস্মাৎ ঘনিষ্ঠতায় নবনীতা লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নুয়িয়ে পড়ছিল।আরহাম একহাতেই তাকে আগলে নিল।নবনীতা পুরোটা সময় একটা শব্দও করল না।শেষটায় যখন দরজার লকটা ভীষণ জোরালভাবে পিঠে এসে আঘাত করছিল,তখন সে আলতো হাতে আরহামকে একটা ধাক্কা দিলো।

ব্যস এতেই আরহাম চটে গেল।এক ধাক্কায় নবনীতাকে সরিয়ে দিয়ে সে নিজেও দুই কদম পিছিয়ে এলো।নবনীতা অবাক চোখে তার দিকে তাকাতেই সে বিক্ষিপ্ত মেজাজে তার উপর চড়াও হলো।

‘নিজ থেকে কাছে আসি ভালো লাগে না?আর আসবো না যাও।থাকো তুমি নিজের মতো।’

বলেই সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।নবনীতা এক দৌঁড়ে তার কাছে এসে তার হাতটা টেনে ধরে।তাড়াহুড়ায় উত্তর দেয়,’অদ্ভুত তো! আগে পুরো কথা শুনবেন তো।’

কথা শেষেই সে পেছন ঘুরে।পিঠের উপরে থাকা চুলগুলো সরিয়ে শাড়িটা এক ইঞ্চির মতো নিচে নামিয়ে বিরক্তি ধরা গলায় বলে উঠে,’দেখুন।লকটার সাথে চাপা খেয়ে কি অবস্থা হয়েছে।’

আরহাম একনজর দেখল।তারপরই বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল,’ওহ আচ্ছা বুঝেছি।’

‘কিন্তু আমি কিছু বুঝিনি।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ মুখ শক্ত করে প্রতিউত্তর করে নবনীতা।এক পা সামনে এসে কাটকাট গলায় বলে,’এসব কি আরহাম?’

আরহাম ভ্রু কুঁচকায়,-‘কি মানে কি?’

সে আবারো দু’জনের দূরত্ব মেটায়।পুনরায় সুপ্ত ইচ্ছেদের লাই দেয়।চুমুতে চুমুতে প্রিয়তমার সমস্ত মুখ সিক্ত করে তবেই দূরে সরে আসে।নবনীতার লজ্জায় রক্তিম মুখখানা দেখেই কুটিল হেসে বলে,’তোমার মনে খুব দুঃখ।দুঃখ গুলো শুষে নিলাম ডার্লিং।এই বাড়িতে এই রুমে এটাই আমাদের লাস্ট রোমান্স।’

নবনীতা মাথা নত করেই বিড়বিড় করে,’ছি! শুষে নিলাম আবার কি?কিসব অ’শ্লীল শব্দ!’

‘অ’শ্লীল শব্দ আবিষ্কারই তো হয়েছে আমাদের মতো কাপলদের জন্য।জামাই বউ অ’শ্লীল কথা বলবে না তো কারা বলবে?তুমি কি জানো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কৌতুক হলো অ’শ্লীল কৌতুক?একটা শোনাব নাকি ডার্লিং?’

নবনীতা দুই হাত জোর করে নতজানু হয়ে বলল,’মাফ চাই।এসব অ’শ্লীল কথা আমি শুনতেও চাই না।আপনি এসব নিজের কাছেই রাখেন।’

আরহাম হাসতে হাসতে জবাব দেয়,’আমিও এখন বলতে চাই না।বিকেলে এসব জমে না।এসব বলার উপযুক্ত সময় রাত বারোটার পর।বুঝেছ?’

নবনীতা একবার কড়া চোখে তার দিকে তাকায়।তারপরই দরজা খুলে হনহন করে বেরিয়ে যায়।বসার ঘরে আসতেই চিত্রা তার দিকে ছুটে যায়।তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তার শাড়ির কুচির ভাঁজে মুখ লুকিয়ে বলে,’আপাই তুমি চলে যাচ্ছ?’

নবনীতা আর্দ্র কন্ঠে জবাব দেয়,’চলে যাচ্ছি না সোনা।সপ্তাহে একদিন আসব নে।’

ছোট্ট বাচ্চাটা অসহায় চোখে মাথা তুলে উপরে তাকায়।নবনীতা সেই দৃষ্টি দেখতেই শক্ত করে নিজের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে।ভাঙা কন্ঠে বলে উঠে,’কাঁদে না সোনা।এমন করে কাঁদলে আপাই কি করে তোমায় রেখে যাব বলো?’

আরহাম এগিয়ে এসে চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,’চলো পাখি।তোমাকেও নিয়ে যাই আমাদের সাথে।কয়টা দিন সেখানে থেকে আসবে।’

নবনীতা দ্রুত মাথা নাড়ে।আপত্তি করে বলে,’না না।এটা হয় না।চিত্র এদিকেই থাকবে।’

মিসেস রোকেয়া বড় বড় পা ফেলে সামনে এগিয়ে এলেন।নমনীয় স্বরে বললেন,’আরে চিত্রকে নিয়ে এতো ভেব না।আমি তো আছিই।আমি তাকে দেখে রাখব।দেখি তো চিত্র।মামিমণির কাছে এসো তো।’

চিত্র একবার তাকে দেখে।একবার আরহামকে দেখে।তারপরই হাসি মুখে মিসেস রোকেয়ার কাছে এগিয়ে যায়।মামিমণি কে তার ভীষণ পছন্দ।সে তো চিত্রা কে খুব আদর দেয়।সে এগিয়ে এসেই মিসেস রোকেয়ার হাত ধরে।তিনি সামান্য ঝুঁকে স্নেহমাখা কন্ঠে বললেন,’দেখি তো চিত্র।সুন্দর করে আপাই কে বিদায় দাও তো।’

চিত্র দাঁত বের করে হাসল।একহাত তুলে রিনরিনে স্বরে বলল,’তুমি যাও আপাই।আমি মামিমণির কাছেই থাকব।’

শুভ্রা বিষম খায়।চিত্রা আর মিসেস রোকেয়ার এই মাখো মাখো সম্পর্ক দেখলেই তার চোখ ব্যথা করে।মনে হয় চোখ দু’টো এক্ষুনি খুলে হাতে চলে আসবে।চিত্র কি বোকা?মামি যে একটা গিরগিটি এটা কি সে বুঝে না?পরমুহূর্তেই আবার তার মনে হয় চিত্র তো সত্যিই বোকা,মাসুম বলেই হয়তো ছলনা আর কপটতা বুঝে না।

শুভ্রা চায় ছলনা কিংবা লোক দেখানোর খাতিরে হলেও মামি যেন চিত্রকে আদর করে।শুভ্রাকে আদর দেওয়ার প্রয়োজন নেই।শুভ্রা এখন বড়ো হয়েছে।চিত্র তো ছোট।চিত্রকে একটু ভালোবাসা দিলেই হবে।

নবনীতা এগিয়ে এসে মিসেস রোকেয়ার দুই হাত চেপে অনুনয় করে বলল,’শুভি আর চিত্রকে একটু যত্ন করো মামি।কি কি খেতে চায় রান্না করে খাইয়ে দিও।বাজার লাগলে আমাকে ফোন করে বলো।তবুও বাচ্চা দু’টোকে খাবারের কষ্ট দিও না।’

মিসেস রোকেয়া অপ্রস্তুত হয়ে এখানে সেখানে তাকায়।তার বিগড়ানো মেজাজ আরও বেশি বিগড়ে যাচ্ছে।সবার সামনে পরী এমন করে তাকে বলে দিলো যে খাবারের কষ্ট দিও না।সবাই এখন কি ভাববে তাকে?তিনি চাপা স্বরে জবাব দিলেন,’তুমি এসব ভেবো না।আমি দেখে রাখব।’

নবনীতা সব শেষে শুভ্রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।শুভ্রা মেয়েটা কিছুক্ষণ শব্দ করে কাঁদল।অথচ নবনীতার চোখ দিয়ে পানি বের হলো না।এতো মানুষের সামনে তার কান্না আসে না।গলার কাছটায় সব দলা পাকিয়ে যায়।সে শুভ্রার মাথার হাত বুলিয়ে ছোট্ট করে চুমু খায়।তারপরই আর কোনোদিকে না দেখে বড় বড় পা ফেলে সামনে এগিয়ে যায়।যতই সে এদিকে থাকবে,ততই সে আরো বেশি দুর্বল হবে।সে মন শক্ত করে।নিজেই নিজেকে বোঝায়-মেয়েদের জীবন এমনই হয় নবনীতা।মানিয়ে নেওয়াই জীবন।প্রথমে একটু কষ্ট হবে,তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে।মাও তো নিজের ভাই বোন ছেড়ে বাবার বাসায় গিয়েছে।এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

গাড়িতে বসেই সে দুই হাতে মুখ চেপে মাথা নামিয়ে কতোক্ষণ দুই চোখ বন্ধ করে রাখল।আরহাম গাড়িতে বসেই সহজ গলায় বলল,’তুমি চাইলে চিত্র আর শুভ্রাকে নিয়েও আসতে পারতে।কালকে রাতেই তো অনুষ্ঠান।তারা একটা দিন থাকতো।সমস্যা কি ছিল?এমনিতেও আজকে সারা রাত সবাই হই হুল্লোড়ের মাঝেই থাকবে।’

নবনীতা চোখ বন্ধ রেখেই নিরেট স্বরে জবাব দেয়,’এতো সহজে সবকিছু হলে তো হতোই।আপনি না খুব প্র্যাকটিক্যাল মানুষ?এতো ইমপ্র্যাকটিক্যাল কথা বলছেন কেমন করে?’

আরহাম ফিচেল হাসল।ব্যাক সিটে গা এলিয়ে দিতে দিতে প্রগাঢ় স্বরে বলল,’চিত্র’র ব্যাপারে আমি ভীষণ ইমপ্র্যাকটিক্যাল।শী ইজ সামথিং সো ডিফরেন্ট।আমি চিত্রকে ভালোবাসি।’

নবনীতা ঠোঁট উল্টায়।কটাক্ষ করে বলে,’ইশশ রে! ভালোবাসা দেখে বাঁচি না।’

আরহামদের বাড়ির সামনে আসতেই মোতাহের দুইবার হর্ণ বাজায়।নবনীতা একনজর চোখ তুলে বাড়ির মূল ফটকের পাশে থাকা নামটা পড়ে-আজিজ ভিলা।

গাড়ি থামতেই আরহাম বেরিয়ে এসে নবনীতার পাশের দরজাটা খুলল।মাথা ঝুঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’আসুন ম্যাডাম।আপনার পদধূলি ফেলে আমাদের ধন্য করুন।’

নবনীতা চুপচাপ সেই হাত ধরে নেমে এলো গাড়ি থেকে।সামনে তাকাতেই দেখল সেই বিশাল অট্টালিকা সম বাড়িটা।কি সুন্দর চোখ ধাঁধানো একটা বাড়ি! নবনীতা কল্পনায় একবার নিজেদের বাড়িটার কথা ভাবল।তাদেরও তো এতো সুন্দর একটা বাড়ি ছিল।আহা! কোথায় গেল সেই দিন গুলো!

সে বাড়ির ভেতর গিয়ে কিছুক্ষণ লিভিং রুমে বসল।তাসনুভা আর আরিশ অনেকক্ষণ তার সাথে বসে গল্প করল।সে মুখে অল্প হাসি ফুটিয়ে তাদের কথার জবাব দিয়েছে।অথচ ভেতরে ভেতরে তার বুক ফেঁটে কান্না আসছে।মন চাইছে গলা ছেড়ে নার্সারি পড়ুয়া বাচ্চাদের মতো কতোক্ষণ কাঁদতে।আফরোজা বেগম এক ফাঁকে এসে তাকে দেখে গিয়েছে।দেখতেই তার চোখ ছানাবড়া।কি সুন্দর এই মেয়ে! নিশ্চয়ই রূপ দেখেই আরহাম গলেছে।পরক্ষণেই তার মনে হলো ধ্যাত,আরহাম তো এসব রূপ টুপ গুনেও না।কি দেখে যে পাগল হয়েছে কে জানে।তিনি এক পলক দেখেই পুনরায় চলে গেলেন।

নবনীতা রাত আটটার দিকে হাত মুখ ধুয়ে আরহামের ঘরে গিয়ে বসল।সে বাথরুমে গিয়ে টানা ত্রিশ মিনিট কেঁদেছে।আরহাম কাজের ফাঁকেই একবার তার চোখ মুখ দেখল।তারপরই কিছু না বলে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

রাত নয়টার দিকে তাসনুভা আর আরিশের ডাকে নবনীতা নিচে নেমে এলো।আসতেই দেখল বসার ঘরে সবাই এতো এতো কাপড়চোপড় আর অর্নামেন্টস ছড়িয়ে বসে আছে।সে সেখানে উপস্থিত হতেই তাসনুভা চঞ্চল হয়ে বলল,’ভাবি! এসো এসো।দেখো তো কোন শাড়িটা ভালো লাগে তোমার।’

পুরো ঘর ভর্তি শাড়ি আর জুয়েলারি।এতো এতো শাড়ির মাঝে নবনীতার একটি শাড়ি বেছে নিতে কষ্ট হচ্ছিল।সে হয়রান হয়ে বলল,’সবই তো ভালো লাগে।যেকোনো একটা বাছতে পারছি না।’

সে চুপচাপ গোমড়া মুখে তাসনুভার পাশাপাশি এসে বসল।সামনের টি টেবিলটা নানারকম মুখরোচক খাবারে ভর্তি।নবনীতার মায়া হলো।আরো একবার মনে পড়ল চিত্রা আর শুভ্রার কথা।ইশশ বাচ্চাগুলো কতো খুশি হতো এই মজার মজার খাবার পেলে! সেই সাথে সবাই মিলে এতো মজা করছে।চিত্রা আর শুভি তো মানুষ পছন্দ করে খুব।দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতো।

গাড়ির হর্ণের শব্দ কানে যেতেই তাসনুভা খুশি খুশি মুখ করে বলল,’ভাইয়া এসেছে মনে হচ্ছে।’

লিভিং রুমে সবার প্রথমে আরহাম আসেনি।এসেছে একটা ছোট্ট মেয়ে,যে মেয়েটা নবনীতার ভীষণ আদরের।সে ছুটতে ছুটতে সেখানে এসেই নবনীতার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে তাকে দেখল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’চিত্র! তুই?’

‘হু।ভাইয়া নিয়ে এসেছে।’

নবনীতা বোকা বোকা চোখে সামনে তাকায়।আরহাম লিভিং রুমে এসেই নবনীতার অন্যপাশ টায় এসে বসল।তার পেছন পেছন শুভ্রাও ভেতরে এলো।আরিশ তাকে দেখেই একগাল হাসল।যাক,ভাইয়া একটা কাজের কাজ করেছে এতোদিনে।

নবনীতা থমথমে মুখে আরহামের দিকে ফিরল।বিরক্ত হয়ে বলল,’কি দরকার ছিল এসবের?মানুষ কি বলবে?’

আরহাম দায়সারা হয়ে জবাব দেয়,’মানুষের বলা দিয়ে কিছু যায় আসে না।আর এমনিতেও আজ রাতে সবাই এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।রিমিকে ফোন দিয়েছি।রিমি আসছে।ওয়াজিদও আসবে।আমি চাই আজকের দিনটা সবাই যার যার মতো খুশিতে থাকুক।কোনো ঝামেলা আর কান্নাকাটি চাই না আমি।’

নবনীতা মাথা নামিয়ে স্মিত হাসে।ক্ষীণ কন্ঠে বিড়বিড় করে,’ইচ্ছে করে কাঁদি নি।কান্না চলে আসে।কি করব?’

***
ধবধবে সাদা বেবি গাউনটা হাতে নিয়েই আরহাম ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেল।একবার গাউন,আর একবার চিত্রাকে দেখে বলল,’বুঝতে পারছি না চিত্র।একবার মনে হচ্ছে পরলে মানাবে ভীষণ,আবার মনে হচ্ছে ফ্যাকাশে রক্তশূণ্যর রোগীদের মতোন লাগবে।’

চিত্রা নিজেও গালের নিচে হাত দিয়ে ভাবনায় মত্ত হয়।লিভিং রুমে সবাই কালকে পরার জন্য শাড়ি আর পাঞ্জাবি সিলেক্ট করছিল।আরহাম অবশ্য চিত্রা আর বিভার কথা ভেবে কয়েকটা বাচ্চাদের জামাও রাখতে বলেছিল।বিভার জন্য নবনীতা একটা জামা বেছে নিয়েছে।সেই জামা সকলের মনঃপুত হয়েছে।কিন্তু বিপত্তি বেধেছে চিত্রার জামা বাছাই করতে গিয়ে।চিত্রার সবকিছুতেই খুতখুতে স্বভাব।যেকোনো জামা পরানোর পরেই সে টালবাহানা শুরু করে এই জামা সে পরবে না,এটা নাকি তাকে গুতায়।

নবনীতা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বলল,’যা তোর যেটা ভালো লাগে ঐটা পর।আমার কাছে আসবি না আর।কয়েক ঘন্টার বিষয়,আর সে আছে গুতাগুতি নিয়ে।যা সর তো।’

চিত্রা কথা শুনেই তাকে ভেঙচি কাটে।নবনীতা নিজেও তাকে ভেঙচায়।আরহাম দু’জনের কাজ কর্ম দেখেই মাথা নামিয়ে চাপা স্বরে হাসে।তারপরই সে একটা সাদা গাউন হাতে নিয়ে খুব মনোযোগী হয়ে নেড়েচেড়ে দেখে।

সাদা গাউনটা গায়ে ধরতেই চিত্রা মুখ ফুলিয়ে বলল,’এটাও গুতায়।’

আরহাম কপাল চাপড়ায়।কি একটা জ্বালায় পড়েছে সে! নবনীতা চটে যাওয়া মেজাজে ধমকায়,’তুই তাহলে কালকে একটা মারু হাফপ্যান্ট পরে ঘুরিস চিত্র।এতোই যখন আরাম খুঁজিস তুই,তোর জন্য ঐটাই ঠিক আছে।’

চিত্রা মুখ কুঁচকে অন্যদিকে চোখ সরায়।আরহাম দু’টো জামা হাতে নিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,’অতো কিছু বুঝি না।এই দুইটার মধ্যে যেকেনো একটাই বেস্ট হবে।চিত্র! তুমি দু’টোই পরবে।পরে ভাইয়াকে দেখাবে।ভাইয়া তারপর ডিসাইড করব তুমি কোনটা পড়বে।কেমন?’

চিত্রার এই প্রস্তাব পছন্দ হলো।সে সাথে সাথেই শুভ্রাকে নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে ছুটল।শুভি তাকে সুন্দর করে জামাটা পরিয়ে দিবে।তারপর সে আর আরাম ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নিবে সে ঠিক কোন জামাটা কালকে পরবে।

তারা দু’জনেই যেতেই নবনীতা কটমট চোখে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম তার চাহনি দেখেই ভড়কে গিয়ে বলল,’কি ব্যাপার?এমন করে দেখছ কেন?’

নবনীতা চোখের দৃষ্টি আগের মতো রেখেই চাপা কন্ঠে বলে উঠে,’কাল আমার রিসেপশন।কোথায় আমাকে তো একবারো বললেন না যে পরী তুমি যেই শাড়িটা পরবে সেটা একবার ট্রায়াল দিয়ে নাও।চিত্র কে ঠিকই বললেন।আমার রিসেপশন,অথচ আমি কি পরব না পরব সেটা নিয়ে আপনার কোনো চিন্তা নেই।চিন্তা হচ্ছে সব চিত্রকে নিয়ে।এজন্যই তো চিত্র আপনাকে এতো পছন্দ করে।এতো পেম্পার করলে কে না পছন্দ করবে?হুহ।দু’জনের ভাব দেখলে বাঁচি না।’

আরহাম ভ্রু দ্বয় টানটান করে প্রশ্ন করে,’সিরিয়াসলি?তুমি এতো হিংসুটে?আগে তো টের পাই নি।’

নবনীতা মুখ খিঁচে অন্যদিকে ফিরে।আরহাম সোফায় হেলান দিয়ে একহাতে নবনীতার কাঁধ জড়িয়ে ধরে।নবনীতা বাদে কেউ যেন শুনতে না পায় ঠিক এতোটাই নিচু স্বরে হিশহিশ করে বলে,’চলো রুমে চলো।তোমার সাথেও একটু ভাব জমাই।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৮+৩৯

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৮)

গাড়িতে বসেই নবনীতা অস্থিরতা শুরু করল।বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছিল,’কোথায় যাচ্ছি আমরা?কি কাজ?বলুন না।’

আরহাম বিরক্ত হয়ে বলল,’একটু চুপ থাকবে তুমি?কখন থেকে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছ।তোমার ঘ্যান ঘ্যানে অতিষ্ঠ হয়ে মোতাহের এক্ষুনি এক্সিডেন্ট করে ফেলবে।’

নবনীতা সাথে সাথে চুপসে গেল।মন খারাপ করে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে আরহামের দিকে পিঠ করে বসল।আরহাম ক্লান্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।আবার রাগ হয়ে গেল নাকি?সে সামান্য এগিয়ে এসে নবনীতার ডান হাতের কবজি চেপে ধরল।ধরার সাথে সাথেই নবনীতা হাত ছাড়িয়ে নিল।

আরহাম একটু ঝুঁকে তার কাছে এলো।কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করল,’গাড়িতে কিন্তু মোতাহের আছে।তুমি কি চাও তার সামনেই আমি তোমার কোমর চেপে ধরি?’

নবনীতা আঁতকে উঠে পাশ ফিরে।দ্রুত ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।এক লাফে আরহামের পাশাপাশি এসে বসে।আড়চোখে একবার তাকে দেখেই বিড়বিড় করে বলে,’সেটা করলে কি একা আমার মানহানি হবে?’

‘না আমারও হবে।সেজন্যই তো করলাম না।’

আরহাম চুলে হাত দিয়ে সেগুলোকে টেনে টেনে একটু সেট করল।তারপরই হাত ঘড়িতে সময় দেখে হাই তুলতে তুলতে বলল,’চারটা তিন বাজে।যেতে যেতে সাড়ে পাঁচটা তো বাজবেই।’

তার ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে গাড়িটা পাঁচটার কিছু সময় পরেই সাভারে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাল।আরহাম খানিকটা চমকে উঠে বলল,’কি ব্যাপার! এতো দ্রুত আসলাম কীভাবে?’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে বলল,’আসবেনই তো।ভিআইপি ট্রানজিট ইউজ করলে সবাই সব জায়গায় সময়ের আগেই যায়।আপনি জানেন,এই আপনার একটা গাড়ির জন্য কতোগুলো গাড়িকে বসিয়ে রাখা হয়েছে?’

আরহাম কলার ঠিক করতে করতে বলল,’সো হোয়াট?এখন আবার বলো না যে এটাও অন্যায়।অবশ্যই আমরা ভিআইপি।নরমাল মানুষ আর আমরা কি এক কাতারে পড়ি নাকি?নরমাল মানুষের শত্রু হয় হাতে গোনা।আর আমাদের তো শত্রুর অভাব নাই।আমাদের এমন এক্সট্রা সিকিউরিটিতে থাকতে হয় সবসময়।এসব মেইনটেইন করেই পলিটিশিয়ানদের চলতে হয়।’

নবনীতা অন্যদিকে ফিরে ভেঙচি কাটে।বিদ্রুপ করে বলে,’আপনারা যে খুব ভালো মানুষ।এজন্যই শত্রুর অভাব নাই।’

‘এ্যাই তুমি কি বললে?’

নবনীতা জিভ কাটল।গাড়ি থেকে বের হতে হতে হড়বড় করে জবাব দিলো,’না তো।কিছু তো বলি নাই।’

গার্ডরা গাড়ি থেকে নেমে ঠিকঠাক অবস্থানে দাঁড়াতেই আরহাম আর নবনীতা গাড়ি থেকে নেমে এলো।নবনীতা সামনে তাকাতেই দেখল তারা একটা চাইল্ড হোমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

চাইল্ড হোমের সামনের মূল ফটকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ‘বাটারফ্লাইজ অরফানেজ হোম’।নবনীতা মন দিয়ে নামটা পড়ল।তারপরই আরহামের সাথে পা মেলাতে মেলাতে বলল,’বাটারফ্লাই কেন?’

আরহাম ঠোঁট উল্টে বলল,’কে জানে! বাবা দিয়েছে এই নাম।আই হ্যাভ নো আইডিয়া ডার্লিং।’

‘এটা আপনার বাবার তৈরি চাইল্ড হোম?’

‘জ্বী।আমরা শুধু জনগণের টাকা মারি না।মাঝে মাঝে আমরা নিজেদের টাকায় জনগণের জন্য করিও।বুঝেছেন?’

আরহামের ভাবসাব দেখেই নবনীতা মুখ খিঁচিয়ে বলল,’হয়েছে হয়েছে।অমন ভালো রাজনীতিবিদ আপনার বাবার সময়টাতেই ছিল।এখনের গুলা সবই টাউট বাটপার।’

আরহাম দুই দিক দেখে দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে বলল,’তাই নাকি?তা কি টাউটারি বাটপারি করেছি আমি?’

সে থামল।পরমুহূর্তেই দাম্ভিকতা দেখিয়ে বলল,’শোনো মেয়ে! আমরা জনগণের টাকা মেরে বড়লোক হয়নি।উই আর রিচ ফ্রম রুটস।খানদানি বড়লোক আমরা।বনেদি পরিবার বোঝ?বনেদি পরিবার থেকে বিলং করি আমরা।আমার দাদা,পরদাদা,পরদাদার পর দাদা-সবাই বড়লোক।আমরা রাজনীতি করি শখের বশে,ক্ষমতার আশায়।নয়তো রাজনীতিতে আমাদের আর কোনো কাজ নেই।জনগণের টাকা মা’রার প্রশ্নই আসে না।অলরেডি যা সম্পদ আছে,পরবর্তী চৌদ্দ প্রজন্ম বসে বসে খেতে পারবে।’

নবনীতা চোখ উল্টে একবার তাকে দেখে।যদিও সে ভুল কিছু বলে নি।বিয়ের পরে নবনীতা আরহামের অগোচরে তার শ্বশুরকে নিয়ে টুকটাক গবেষণা করেছে।রাজনীতিবিদ মানুষ।স্বভাবই নবনীতা কৌতূহলী ছিল এই নিয়ে।তবে তার গবেষণার ফলাফল তার অনুমানের চেয়েও ভালো এসেছে।শেখ আজিজ হোসেন সত্যিকার অর্থেই সৎ এবং নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ ছিলেন।তাছাড়া রাজনীতিতে আসার আগেই তিনি ব্যবসায় প্রচুর নাম কুড়িয়েছেন।নবনীতার মাঝে মাঝে মনে হয় সে তাকে বাস্তবেও কোনো এক সময় দেখেছিল।অসম্ভব কিছু তো না।তাদের বাড়িতে প্রায়শই বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায়ীরা আসতো তার বাবার সাথে দেখা করতে,কথা বলতে।আজিজ হোসেন তাদের মাঝে একজন হলেও হতে পারেন।

সে চুপচাপ আরহামের পাশাপাশি হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করল।চারদিকে চোখ বুলিয়ে পুরো নিচতালা দেখে নিল।নিচ তালায় মূলত বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য স্কুল রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে কয়েকটা।একেবারে দক্ষিণ দিকে বড়োসড়ো একটা রান্নাঘর।সেখানে সবার জন্য এটা সেটা রান্না করা হয়।দোতালা আর তিনতালায় বাচ্চারা থাকে।চারতালা পাচতালা স্টাফদের রুম আর অফিস রুম।

আরহাম ভেতরে এসেই নবনীতাকে বলল,’আমি চার তালায় যাচ্ছি।এসব বাচ্চাকাচ্চার ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগে না আমার।তুমি তো নিচেই থাকবে তাই না?’

নবনীতা জোরে জোরে উপরনিচ মাথা নাড়ে।প্রয়োজনের চেয়েও উঁচু স্বরে বলে,’অবশ্যই অবশ্যই।’

আরহাম হালকা করে ধমক দিয়ে বলল,’আস্তে কথা বলো।মেয়ে মানুষ এতো জোরে কথা বলে?’

নবনীতা মুখের উপর একহাত রাখল।কন্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,’সরি সরি।আর হবে না।’

আরহাম হনহনিয়ে ধুপ ধাপ পা পেলে উপরে চলে গেল।যাওয়ার আগে গার্ড একজন কে ডেকে বলল,’তোমার ম্যামের আশেপাশেই থেকো।’
যদিও আজ সে খুব বেশি চিন্তিত না সিকিউরিটির বিষয়ে।এই এলাকা পুরোটাই তার নিয়ন্ত্রণে।এখানে ঝামেলা বাধানোর মতো দুঃসাহস কেউ করবে না।

সে যেতেই নবনীতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।এই লোক সাথে থাকলেই সারাক্ষণ তাকে অবজেকশনের উপর রাখে।এর চেয়ে সাথে না থাকাই ভালো।

সে শাড়ির কুচি সামলে দোতালায় উঠে।দোতালায় আসতেই বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি আর ছুটোছুটির আওয়াজে তার মন ভালো হয়ে গেল।সে ছুটে গেল ভেতরের দিকে।

দোতালায় মোট ষোলো টা রুম।প্রতিটা রুমে ছয়টা করে খাট।প্রতি খাটে দুই জন ঘুমায়।নবনীতা একে একে সবগুলো ঘরে উঁকি দিলো।কিছু কিছু ঘর একদম ফাঁকা।কিছু ঘরে আবার প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত মানুষ।বাচ্চারা সব নানারকমের খেলায় ব্যস্ত।কেউ আবার আরামে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে।

নবনীতা একটা ঘরে উঁকি দিয়েই বেড়ালের মতো গলায় ডাকল,’ম্যাও ম্যাও।কেউ কি আছে?’

ঘরভর্তি বাচ্চারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে।নবনীতা এতোগুলো মিষ্টি মুখ একসাথে দেখেই হেসে ফেলল।অনেক গুলো উৎসুক চোখ অবাক হয়ে আগাগোড়া তাকে পরোখ করে যাচ্ছিল।নবনীতা ধীর পায়ে ভেতরে এলো।উচ্ছ্বাস মাখা কন্ঠে বলল,’আমি বসি তোমাদের সাথে?কি খেলছ তোমরা?’

বাচ্চারা শুরুতে একটু কপাল কুঁচকায়।এতো বড়ো মেয়ে তাদের সাথে খেলবে?সে খেলা জানে?তারা কেউ শুরুতে তার কথা গায়ে মাখল না।ইশারায় বোঝাল এতো বড়ো মেয়ের সাথে তারা খেলবে না।

নবনীতা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,’কি হলো?পছন হয়নি আমাকে?’
.
.
.
.
শুভ্রার কেমিস্ট্রি প্রাইভেট থাকে বিকেলে।সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু সামনে যেতেই টয়োটার কালো গাড়িটা ঠিক তার সামনে এসে থামল।সে প্রথমে একটু চমকাল।তারপরই চট করে গাড়ির মালিককে চিনে নিল।আরিশ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে তাকে দেখে বলল,’শুভ্রা! ভাইয়া কি এখনো তোমাদের বাসায়?’

শুভ্রা মাথা নাড়ল।নম্র স্বরে বলল,’না ভাইয়া।ভাইয়া তো আরো আগেই বের হয়েছে আপাই কে সাথে নিয়ে।’

ভাইয়া?কেন যেন ডাকটা মনঃপুত হলো না আরিশের।সে কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হলো।গমগমে স্বরে বলল,’ওহ আচ্ছা।ভাইয়ার সাথে একটা কাজ ছিল।’

বলেই সে দ্রুত গাড়ির গ্লাস তুলল।শুভ্রা মাথার ওড়না টেনে ঠিকঠাক মতো দিয়ে চুপচাপ সামনে এগিয়ে গেল।এই বড়লোক এলাকায় রিকশা চলে না।রিকশার জন্য তাকে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়।একটু সামনে যেতেই কালো গাড়িটা আবার তার পাশাপাশি এসে থামল।শুভ্রা কৌতূহলী হয়ে পাশ ফিরল।আরিশ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে নিরেট স্বরে বলল,’এসো তোমায় ড্রপ করে দেই।’

তার কন্ঠ কিছুটা অন্যরকম শোনাল।তার চোখ দু’টো রোদচশমার আড়ালে লুকানো।তার অভিব্যক্তি শুভ্রা ঠিক মতো বুঝতে পারছে না।সে জোরপূর্বক সামান্য হেসে বলল,’না না ভাইয়া।আমি চলে যেতে পারব।আপনি কেন আবার ঝামেলা করছেন?’

‘আমি তোমাকে বলেছি আমার ঝামেলা হচ্ছে?’ অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করল আরিশ।

শুভ্রা থতমত খেয়ে তার দিকে তাকাল।কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল।তার কেমিস্ট্রি প্রাইভেটে যেতে সময় লাগে প্রায় আধঘন্টার মতো।ঝিগাতলায় তার কোচিং সেন্টার।আরিশ ঠিক তার কোচিং-এর সামনে এসে ব্রেক কষল।শুভ্রা আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপনি কেমন করে জানলেন আমার কোচিং এই বিল্ডিংয়েই?’

আরিশের মন চাইল নিজেই নিজেকে কতোক্ষণ জুতোপেটা করতে।তার কি মাথায় ন্যুনতম বুদ্ধি নেই?সে কোন বুঝে গাড়িটা ঠিক জায়গা মতো এনে থামাল?সে কতোক্ষণ দুই হাত কচলায়।শেষে আমতা আমতা করে বলল,’না মানে এই এলাকায় তো খুব বেশি বিল্ডিং নেই।যেই কয়টা আছে সবই মানুষের থাকার বাসা।এটা দেখে মনে হলো কোচিং থাকলে এটাতেই থাকবে।তাই আরকি।অন্য কিছু না।’

শুভ্রা কিছু একটা বুঝে ফেলার মতো করে মাথা নাড়ল।তারপরই আরিশকে একটা ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা সরূপ একগাল হাসি উপহার নিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে এলো।সে নামতেই আরিশ কতোক্ষণ স্টিয়ারিংয়ে মাথা ঠুকল।ভাইয়া ঠিকই বলে।তার মতো গর্দভ আর ব্রেইনলেস এই শহরে কমই আছে।

কোচিং সেন্টারের দরজায় তালা ঝুলানো দেখতেই কপালে ভাঁজ পড়ল শুভ্রার।সে দারোয়ান চাচার কাছে এগিয়ে এসে বলল,’চাচা কোচিং এর দরজা এখনো খুলেননি কেন?সময় তো হয়ে গেছে।’

দারোয়ান লোকটা হাই তুলতে তুলতে অলস ভঙ্গিতে বলল,’লোকমান স্যার আজ পড়াবেন না।কলেজের জরুরি মিটিংয়ে আটকে গেছে।বলেছে আজকের ক্লাস কালকে হবে।’

শুভ্রা চোখ বড় বড় করে বলল,’কালকে হবে মানে?এই কথা আগে জানাবে না স্যার?’

‘আমি কি জানি?আমাকে বলল যারা যারা আসবে তাদের জানিয়ে দিতে।’

শুভ্রা মন খারাপ করে বলল,’ধ্যাত।স্যার সবসময় এমন করে।আমাদের তো দূর থেকে আসতে হয়।একটু আগে জানালে ক্ষতি কি?’

সে বিক্ষিপ্ত মেজাজে কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল।আরিশ মাত্রই তার গাড়ি স্টার্ট দিয়েছিল।শুভ্রাকে বিল্ডিংয়ের সামনে দেখেই সে দ্রুত গ্লাস নামিয়ে চমকে উঠে বলল,’কি ব্যাপার?তুমি নেমে আসলে কেন?’

শুভ্রা এগিয়ে যায়।বিরক্ত হয়ে বলে,’আর বলবেন না ভাইয়া।আজ নাকি স্যার পড়াবেন না।দারোয়ান চাচা এইমাত্র জানাল আমাকে।’

আরিশ মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল,’ওহ আচ্ছা।ব্যাপার না।চলো তোমাকে আবার বাড়ি পৌঁছে দেই।’

শুভ্রা ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল।তাড়াহুড়ো করে বলল,’না না ভাইয়া।প্লিজ।আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।’

আরিশ শীতল চোখে তাকে দেখে।তারপরই মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠে,’সমস্যা নেই।উঠো।’

শুভ্রা বোকা বোকা হেসে গাড়িতে উঠে বসল।সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলল,’আসলে আমার না গাড়ি ভালো লাগে না।সেজন্য চড়তে চাই না।’

‘গাড়ি ভালো লাগে না?স্ট্রেঞ্জ! তাহলে কি ভালো লাগে?’

‘রিকশা।আমি,আপাই আর চিত্রা মাসের শুরুতে আপাই বেতন পেলে রিকশা তে করে ঘুরতাম।ঐ কথায় আছে না?রিকশার মতো শৌখিন যান আর একটিও নেই।আমাদেরও হয়েছে সেই অবস্থা।রিকশার মতো মজা আর কিছুতেই পাই না।’

আরিশ গাড়ি চালানোর ফাঁকে একবার তাকে দেখল।সে শান্তভাবে কথা বলতে পারে না।কথা বলার সময় অনবরত দুই হাত নাড়ে।এটা অবশ্য আরিশের ভালোই লাগে।সে একগাল হেসে বলল,’তা অবশ্য ঠিক।রিকশায় চড়ার মজাই আলাদা।’

রবীন্দ্র সরোবরের সামনে এসেই আরিশ তার গাড়ির গতি কমালো।চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে পাশ ফিরে শুভ্রাকে দেখেই বলল,’আইসক্রিম খাবে শুভ্রা?’

শুভ্রার মন চাইছিল জোরে জোরে দশবার উপরনিচ মাথা নেড়ে বলতে,’হ্যাঁ ভাইয়া।অবশ্যই খাবো।কেন খাব না?এক্ষুণি কিনে আনুন।’

কিন্তু সেটা সম্ভব না।আপাইয়ের দেবরকে এমন করে বলাটা ভালো দেখায় না।সে মাথা নেড়ে বলল,’না ভাইয়া,খাব না।’

বলার পরেই সে মনে মনে দোয়া করল,’আল্লাহ প্লিজ।আবার যেন খাওয়ার জন্য সাধে।প্লিজ আল্লাহ!’

আরিশ আবারো বলল,’খাও না।এদিকে একটা আইসক্রিম পাওয়া যায়।খুব মজা।তুমি খেলে আমিও একটা খেতাম।’

শুভ্রা মিনমিনে স্বরে কোনোরকমে বলে,’না না ভাইয়া।দরকার নেই।’
ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ চটে আছে।সে মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’এতো খাওয়ানোর ইচ্ছে হলে বাইরে গিয়ে কিনে আন না বাপ।এতোবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?গিয়ে দু’টো কিনে আনলেই তো পারিস।’

আরিশ সিটবেল্ট খুলতে খুলতে সহজ গলায় বলল,’দাঁড়াও আমি দু’টো নিয়ে আসছি।’

শুভ্রা সাথে সাথে নিজের মুখ চেপে ধরে।কি সর্বনাশ! এই লোকটি অন্তর্যামী নাকি?তার মনের কথা শুনে নিল নাকি কোনোভাবে?কি ভয়ানক ব্যাপার সেপার!

আরিশ কয়েক মিনিট বাদেই দুই হাতে দুই আইসক্রিম নিয়ে ফিরল।গাড়িতে বসেই একটা আইসক্রিম শুভ্রার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল,’খেয়ে দেখ তো কেমন?’

শুভ্রা একটু খেয়েই বলল,’ভীষণ ভালো।’

বিনিময়ে আরিশ কেবল প্রশস্ত হাসল।সে হাসিমুখেই টুকটাক কথা বলতে বলতে আইসক্রিম খাওয়া শেষ করল।শুভ্রা তার আইসক্রিমটা শেষ হতেই পাশ ফিরে ঝলমলে হেসে বলল,’থ্যাংক ইউ ভাইয়া।আইসক্রিম টা সত্যিই অনেক মজা।’

মুহূর্তেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেল আরিশের।সব তো ঠিকই ছিল।মাঝখানটায় এই ভাইয়া এলো কোথা থেকে?এতো সুন্দর সুন্দর কথার মাঝে এই ভাইয়াটা কোথা থেকে ঢুকে পড়ল?সে দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দেয়।মেজাজ যা একটু ফুরফুরা হয়েছিল,এক ভাইয়া শব্দে সব ভেস্তে গেল।

***

আরহাম হিসাবের খাতায় দ্রুত চোখ বুলায়।বাবার মৃ’ত্যুর পর সে ই চাইল্ড হোমের সবকিছু দেখাশোনা করে।তার বাবার খুব শখের প্রতিষ্ঠান এটি।এই চাইল্ড হোমের অসংখ্য বাচ্চাকে তিনি নিজে পরম স্নেহে মানুষ করেছেন।তার উপার্জনের একটা বিরাট অংশ তিনি চাইল্ড হোমের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেছেন।আরহাম সপ্তাহে কিংবা মাসে একবার হলেও এখানে আসে,সবকিছু তদারকি করে যায়।

হঠাৎই তার আজ মনে হলো তার বউ প্রচন্ড বাচ্চা পাগল।এমন জায়গায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ নবনীতাই পাবে।তাই সে আজ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।বাচ্চাকাচ্চার প্যা পু কিভাবে একটা মানুষের কাছে আনন্দের হতে পারে আরহাম জানে না।তার বাবারও এসব পছন্দ ছিল।তার বউয়েরও এসব পছন্দ।মাঝখানটায় তারই এসব আদিখ্যেতা ভালো লাগে না।নিজের উপর সে নিজেই হতাশ।বাবা তার আদর্শ।অথচ বাবার ভালো কোনো বৈশিষ্ট্যই তার ভেতর নেই।

নিচ থেকে বাচ্চাদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে।সেই আওয়াজ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তিড়তিড় করে বাড়ছে।আরহাম বিরক্ত হয়ে ফাইল থেকে চোখ সরায়।তিরিক্ষি মেজাজে ধমকে উঠে,’কি শুরু করেছে এই বাচ্চাগুলো?এটা কি চিড়িয়াখানা?কেউ এদের থামাও।’

তার কথা শুনেই চাইল্ড হোমের একজন স্টাফ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’আসলে স্যার।ম্যাডামই বাচ্চাদের নিয়ে নিচে নেমেছে খেলার জন্য।আমরা তাই কিছু বলিনি।’

আরহাম সাথে সাথে হাতের ফাইলটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ায়।দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় রুমের খোলা জানালার দিকে।জানালার ধারে একহাত রেখেই নিচে উঁকি দেয়।দেখতে পায় নবনীতা ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে চাইল্ড হোমের সামনের বিরাট মাঠটায় কি যেন খেলছে।কিছুক্ষণ দেখতেই সে বুঝল খেলাটার নাম কানামাছি।নবনীতা এ’মাথা ঐ’মাথা ছুটছে আর একটু পর পর খিলখিল করে হাসছে।বাচ্চারাও তার পিছু পিছু ছুটছে।কেউ আবার আধো আধো বুলিতে তাকে ডাকছে।এই দৃশ্য দেখতেই আরহামের ঠোঁটে হাসি ফুটল।কি চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে! কি অভূতপূর্ব এই দৃশ্য! নবনীতা এক পর্যায়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল।তারপরই দু’টো ঘাসফুল ছিঁড়ে হাতের মুঠোয় নিল।আরহাম বুকে হাত বেঁধে সে দৃশ্য দেখল।মেয়েটা কি জানে যে সে নিজেই একটা ফুল?

আরহাম চুপচাপ সমস্ত কাজ ফেলে নিচে নেমে এলো।নামতেই দেখল বাচ্চারা মিলে খিলখিল করে হাসতে হাসতে নবনীতার চোখ বেঁধে দিচ্ছে।নবনীতা হাসিমুখ করে বলছে,’আস্তে আস্তে।এতো জোরে কেউ বাঁধে?মাথা ব্যথা হয়ে যাবে আমার।’

তার চোখ বাঁধার পরে একটা বাচ্চা তিন আঙুল সামনে তুলে বলল,’বলো তো কয়টা আঙুল সামনে?’

নবনীতা আন্দাজে বলল,’উমম,তিনটা।’

সাথে সাথে বাচ্চাগুলো চেঁচিয়ে উঠল।হাত পা ছুড়ে বলল,’তুমি চিটিং করেছ।হবে না হবে না।’

নবনীতা কপাল চাপড়ে হতাশ হয়ে বলল,’আরে বাবারে চিটিং করলে কি ঠিকটা বলতাম?না দেখে বলেছি বলেই তো ঠিকটা বলে ফেলেছি।’

বাচ্চারা তার কথা বিশ্বাস করল না।তারা আরো শক্ত করে তার চোখ বাঁধলো।শেষটায় যখন নিশ্চিত হলো সে আসলেই চোখে দেখছে না তখন দুই তিন পাক ঘুরিয়ে তাকে এক ধাক্কা দিয়ে সামনে ছেড়ে দিলো।এই মেয়েটাকে তাদের ভীষণ ভালো লেগেছে।মেয়েটা কতো সুন্দর করে তাদের সাথে খেলা করছে! সে তাদের বলেছে আজ রাতেও সে এদিকে থাকবে।রাতভর লুকোচুরি খেলবে।ইশশ! ভাবতেই তো আনন্দ হচ্ছে তাদের!

নবনীতা দুই দিকে হাত ছড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে আনমনে এদিক সেদিক ছুটে যায়।বাচ্চারা তাকে একটু ছুয়েই অন্যদিকে ছুটে পালায়।আরহাম একটু একটু করে তার দিকে এগিয়ে যায়।একপর্যায়ে একেবারে তার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়।নবনীতা তার আশেপাশে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই সাথে সাথে শক্ত করে জাপ্টে ধরল তাকে।ধরতেই তার মুখের হাসি গায়েব হলো।সে একহাত আরহামের পিঠে রেখেই খানিকটা বিচলিত হয়ে বলল,’কে?’

আরহাম তার একহাত নবনীতার শাড়ি গলিয়ে তার কোমরে গিয়ে রাখল।নবনীতা আঁতকে উঠে কাঁপা স্বরে বলল,’আরহাম?’

আরহাম অতি সন্তর্পণে তার শাড়িটা কোমর থেকে পিঠ পর্যন্ত তুলে দিলো।নিজেদের দূরত্ব আরো বেশি কমিয়ে নিয়ে গম্ভীর মুখ করে বলল,’আমি ছাড়া তোমায় আর এমন করে কে ধরবে পরী?অবশ্যই এটা আমি।’

নবনীতা লজ্জাবতী গাছের মতো মিইয়ে গিয়ে অতিশয় ক্ষীণ কন্ঠে বলল,’ছাড়ুন না।বাচ্চারা দেখছে তো।’

আরহাম গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’দেখুক।আমার কি?বউকে ধরা কি কোনো পাপ নাকি?’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৯)

অফিস রুমে এসেই নবনীতা অস্থির হয়ে পাশ ফিরে বলল,’আপনি থাকুন না এদিকে।আমি নিচে যাই প্লিজ।’

আরহাম শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে বিরক্তি মেশানো কন্ঠে বলল,’চুপচাপ আমার সাথে থাকতে বলেছি না?এতো কথা বলছ কেন?’

নবনীতা তার চেয়েও দ্বিগুণ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকায়।তাকে অফিস রুমে আনার কি দরকার ছিল?সে কি এখানকার বস নাকি কর্মচারী?শুধু শুধু তাকে চারতালা উপরে এনেছে।

একটু পরেই একজন কর্মচারী তার সাথে তার কোলে করে একটি ছোট্ট বাচ্চাকে সাথে নিয়ে অফিসে এলো।বাচ্চাটার পরনের জামা দেখে বোঝা যাচ্ছে সে একজন ছেলে।বয়স নবনীতা খোলা চোখে অনুমান করল-দুই।বাচ্চার চোখ দু’টো গাঢ় খয়েরি রঙের।

নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলে,’এটা কে?’

আরহাম তার পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়।দুই হাত বগলদাবা করে গম্ভীর হয়ে বলে,’ওর নাম আরশাদ।আসাদের ছেলে।আসাদকে তো নিশ্চয়ই চেনো।সেদিন তোমাকে সিকিউরিটি দিতে গিয়ে তার নিজের জীবন সেক্রিফাইস করতে হয়েছিল।’

নবনীতা ব্যথিত চোখে সামনে তাকায়।এই বাচ্চাটার বাবা নেই?এইটুকু বয়সেই সে এতিম?কি যন্ত্রণাময় হতে যাচ্ছে তার বাকি জীবনটা! বাবা ছাড়া জীবন কেমন সেটা নবনীতার চেয়ে ভালো আর কে জানে?

আরহাম একটু দম নিয়ে বলল,’আসাদের ওয়াইফ ডেলিভারির সময়ই মা’রা গিয়েছিল।তারপর এই ছোট্ট বাচ্চাটা তার কাছেই বড় হচ্ছিল।হি ওয়াজ অ্যাবসোলুটলি আ স্টানিং ম্যান।কিন্তু তার মৃ’ত্যুর পর আরশাদের পৃথিবীতে মা আর বাবা বলতে আর কিছুই রইল না।আসাদের মৃ’ত্যুর পরই এই বিষয়ে আমি জানতে পারি।তারপর খবর নিয়ে জানলাম তার দাদা বাড়িতেও এমন কেউ নেই যে তার দায়িত্ব নিবে।তাই আমরা তাকে এখানে নিয়ে এসেছি।’

মুহূর্তেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল নবনীতার।চোখ জোড়া হঠাৎই সেকেন্ডের ব্যবধানে ভিজে ওঠল।সেই আর্দ্র চোখেই সে সামনে থাকা বাচ্চা ছেলেটাকে দেখে।কি নিষ্পাপ মুখটা! তার কেউ নেই।নবনীতার মতো সেও ভীষণ একা।তার বাবাকে খু’ন করা হয়েছে।সেই খু’নের সাখে নবনীতা কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে।কোনো না কোনোভাবে এই বাচ্চাটার সর্বহারা হওয়ার পেছনে নবনীতা দায়ী।কি যন্ত্রণাময় সে অনুভূতি!

সে এগিয়ে এসে আরশাদ নামের সেই ছোট্ট ছেলেটিকে দুই হাতে আগলে ধরে।একটানে নিজের কোলে এনেই কয়েকটা চুমু খায়।বাচ্চাটা এতো আদুরে কেন?সব বাচ্চাই আদুরে।তবে এই বাচ্চাটাকে নবনীতার কেন যেন বেশিই মায়া লাগছে।সে তাকে নিজের সাথে কতোক্ষণ শক্ত করে জড়িয়ে রাখল।মাথায় হাত বুলিয়ে ইচ্ছে মতো আদর দিলো।সাধারণত ছেলে বাচ্চা গুলো হয় ভীষণ দুষ্টু।অথচ আরশাদ নামের এই বাচ্চাটি বয়সের তুলনায় অতি মাত্রায় শান্ত।এই পুরোটা সময়ে সে একটি বারের জন্যও কাঁদলো না।কেবল ছোট ছোট চোখের পাতা ফেলে বার কয়েক নবনীতাকে মনোযোগ দিয়ে দেখল।

আরহাম হাতঘড়ি তে সময় দেখতেই ব্যস্ত হয়ে বলল,’চলো পরী।আমরা এখন বের হই।ভালোই সময় হয়েছে।’

নবনীতা সিক্ত চোখে তার দিকে তাকায়।আরশাদ তখনও তার বক্ষে চুপটি করে শান্ত বাচ্চাদের মতো ঘাপটি মেরে পড়েছিল।নবনীতা হঠাৎই বাড়াবাড়ি রকমের অনুনয় করে বলল,’আরহাম আমি আরশাদকে আমার সাথে রাখি প্লিজ?প্লিজ আরহাম,মানা করবেন না।আমি আর কখনো আপনার কাছে কিছু চাইব না।প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’

আরহাম তব্দা খেল এক কথাতেই।এক প্রকার বিষম খেয়ে বলল,’কি?সাথে রাখবে মানে?এটা আবার কেমন কথা?’

‘সাথে রাখব মানে আরশাদ এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে।আমি তাকে সবসময় নিজের কাছে রাখতে চাই।’

নবনীতা পুরো কথা গুছিয়ে শেষ করার আগেই আরহাম এক ছুটে তার কাছে এসে ছো মেরে আরশাদকে তার কাছ থেকে নিজের কাছে আনল।তারপরই সে তাকে অন্য স্টাফদের নিকট কোনো রকমে হস্তান্তর করে নবনীতার একহাত চেপে কড়া গলায় বলল,’চলো।দেরি হচ্ছে আমাদের।এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে তুমি আরো পা’গল হয়ে যাবে।’

নবনীতা জেদ ধরল আবারো।আরহামের সাথে পা মেলাতে মেলাতেই বলল,’প্লিজ আরহাম।এইটুকু একটা বাচ্চা।এসব চাইল্ড হোমে সে কেমন করে থাকবে?আসাদের এই পরিনতির জন্য কোনো না কোনোভাবে আমি দায়ী।আমি কিছুটা হলেও তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই।সামান্য পরিমান হলেও একটা প্রতিদান দিতে চাই।প্লিজ আরহাম!’

আরহাম সেই কথায় বিন্দু পরিমান কর্ণপাত না করে চুপচাপ বড় বড় পা ফেলে গাড়িতে উঠল।নবনীতা ব্যথিত হলো,সেই সাথে অপমানিত বোধ করল প্রচন্ড।আত্মসম্মানে লাগল খানিকটা।এমন এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টা তার গায়ে লেগেছে।তার মন খারাপ করাটা বাড়াবাড়ি কিছু না।সে ঠিক করেছে পুরো গাড়ি সে আর কোনো কথা বলবে না।তার কথার যখন কোনো দামই নেই,তখন বকবক করে সে খামাখা শক্তি অপচয় করবে কেন?

আরহাম তার পেঁচার মতো মুখটা দেখেই গজগজ করে বলল,’মোতাহের স্টেশনে চলো।’

মোতাহের থতমত খেয়ে বলল,’জ্বী স্যার?কোথায় যাব?’

‘স্টেশন।রেলস্টেশনে যাব আমরা।’
আরহাম কথা শেষ করেই নবনীতার দিকে তাকায়।যার সমস্ত মনোযোগ জানালার অন্যপাশে।চোখ জোড়া একনাগাড়ে শুধু বাইরের দৃশ্যই দেখে যাচ্ছে।আরহাম কাঠখোট্টা স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’আমরা সেখানে গিয়ে সব এতিম বাচ্চাদের ধরে ধরে নিজেদের বাসায় নিয়ে আসব।এসে পেলে পেলে বড় করব।তারপর আমরা পুরো শহরের সব এতিম বাচ্চাদের নিয়ে আসব নিজেদের ঘরে।পেলে পুলে বড় করে তারপরই থামব।কারণ এদের দেখলে আমাদের খুব মায়া হয়।আমাদের মনের ভেতর এতো মায়া যে সেই মায়া মনের মতো ছোট্ট জায়গায় আর জায়গা হচ্ছে না।সেই অবশিষ্ট মায়া এখন আমাদের ব্রেইনে জায়গা নিয়েছে। আমরা শুধু আবেগ দিয়ে ভাবি।বিবেক?সেটা আবার কি?খায় না পিন্দে?’

আরহাম থামল।অপরপক্ষ অতিশয় শান্ত।ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দেওয়া তো দূর,পুরোটা সময়ে একটু নড়ল পর্যন্ত না।আরহাম ফুঁসতে ফুঁসতে একহাতে তার বাহু চেপে কটমট করে বলল,’এ্যাই পরী এদিকে তাকাও।আমার কথার উত্তর দাও।’

নবনীতা সাথে সাথে পাশ ফিরল।বিরক্ত গলায় বলল,’কি উত্তর দিব?স্টেশনের বাচ্চা আর আরশাদ তো এক না।আরশাদের এই পরিনতির পেছনে কোনো না কোনো ভাবে আমি জড়িয়ে আছি।তাকে সবার সাথে মেলাচ্ছেন কেন?’

‘আচ্ছা মেলাব না।তাই বলে তুমি তাকে বাড়ি নিয়ে আসবে?কোথায় রাখবে তাকে?তুমি নিজেও তো অসুস্থ।তাছাড়া এখানে আরশাদ যথেষ্ট যত্নের মাঝে থাকবে।কি দরকার শুধু শুধু বাড়ি এনে ঝামেলা বাড়ানোর?’

নবনীতা ব্যথিত নয়নে তার দিকে তাকায়।মলিন মুখ করে বলে,’ঝামেলা আরহাম?এইটুকু একটা বাচ্চা ঝামেলা হয়ে গেছে?এতোই ঝামেলা যে আপনি তাকে বাড়ি আনার কথা শুনেই এমন তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে ফিরে এলেন?’

আরহাম মহাবিরক্ত হয়ে বলল,’ধুর অতোকিছু বুঝি না।আমি তোমার মতো মহামানব নই।এমন কি আমি সুইট পার্সনের কাতারেও পড়ি না।এসব যার তার জন্য আবেগ কাজ করে না আমার।কি করার আছে বলো?হোয়াট টু ডু নাও?আমি এমনই।আল্লাহ এভাবেই বানিয়েছে আমাকে।’

‘মিথ্যা কথা।আল্লাহ সবাইকে ভালোভাবেই বানায়।দুনিয়াতে আসার পর মানুষ হয় ভালো হয়,নয়তো খারাপ হয়।’

‘ঐ আরকি।এক ই কথা।আমি খারাপ মানুষ।হয়েছে তোমার?অদ্ভুত বিষয় পরী! আরশাদের কথা তুমি জানতে পর্যন্ত না।আমিই তার খোঁজ নিলাম।তাকে তুমি পর্যন্ত পৌঁছালাম।তার ভবিষ্যতের জন্য ভাবলাম।তুমি সেসবের কিছু দেখলে না।তুমি পড়ে আছ কেন তোমাকে তাকে সাথে আনতে দেই নি এই নিয়ে।আরে বাবা সবকিছুতে এতো আবেগ দেখালে হয় না।এমন করতে থাকলে একসময় দেখবে আমাদের বাড়িটা আর বাড়ি থাকবে না,ছোটখাটো চাইল্ড হোম হয়ে যাবে।পৃথিবীতে অনেক বাচ্চাই মা বাবা ছাড়া বড়ো হচ্ছে।এখন আমরা কি তাদের সবাইকে নিজ হাতে বড়ো করতে পারব?এটা হয় না পরী।বি প্র্যাকটিক্যাল।’

নবনীতা তার দিকে না ফিরে পুনরায় বাইরের দিকে চোখ নেয়।মেয়েরা যুক্তিতে হেরে গেলে রেগে যায়।সে নিজেও রেগে আছে প্রচন্ড।কারণ আরহামের যুক্তি খন্ডন করার মতো উপযুক্ত কোনো জবাব তার কাছে নেই।এই কারণে তার মেজাজ আরো বিগড়ে আছে।মন চাইছে টেনে টেনে আরহামের সব কয়টা চুল ছিঁড়তে আর চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে,’ঐ বেটা,এতো যুক্তি দেস কেন?এতো কিছু শুনতে চেয়েছি আমি?’

অথচ সে কিছুই বলল না।ভাব দেখাল যে সে কিছু শুনতেই পায়নি।আরহাম শীতল চাহনিতে একবার তাকে দেখে।তারপরই একেবারে জানালার কাছাকাছি গিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে আনমনে স্ক্রল করা শুরু করে।অনেক হয়েছে।এই মেয়েকে অতিরিক্ত পাত্তা দেওয়াই তার ভুল হয়েছে।এখন সে আর ফিরেও তাকাবে না।যা খুশি করুক।তার কি?তারও প্রেসটিজ আছে।তারও রাগ হয়,জেদ হয়।

নবনীতার এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি এসে থামতেই আরহাম ফোনের স্ক্রিনে আরো মনোযোগী হয়ে দৃষ্টি রাখল।সে তাকাবেই না বামপাশে।নিজে নিজে গাড়ি থেকে নেমে চলে যাক।তার তাকানোর কি আছে?

নবনীতা বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকায়।এই লোক কি অন্ধ নাকি?দেখছে না বাড়ি চলে এসেছে?তাহলে নামছে না কেন?সে কতোক্ষণ নিজে নিজে ছটফট করল।কতোক্ষণ শাড়ির আঁচলের একমাথা নিজের আঙুলে প্যাচালো।শেষে কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলল,’বাড়ি এসে গেছে।দেখেছেন?’

আরহাম ফোন চালাতে চালাতেই জবাব দেয়,’হু।দেখেছি।’

‘তাহলে?নামছেন না যে?’

‘স্ট্রেঞ্জ! আমি কেন নামব?তোমার ফ্ল্যাট,তুমি নামো।’

নবনীতা বেশ খানিকটা চমকাল।হতবাক কন্ঠে বলল,’আমি নামব?’

অন্য দিক থেকে গুরুগম্ভীর কন্ঠে জবাব এলো,’হুম।’

নবনীতা একবার শান্ত চোখে তাকে দেখল।তারপরই গাড়ির দরজা খুলে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো।তারপর ইচ্ছেকৃতভাবে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করল।আরহাম ফোন চালানোর মাঝেই শব্দ করে হাসল।বিড়বিড় করে বলল,’বেয়াদব একটা।যত কিছুই হোক,তেজ কমে না।’

নবনীতা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতেই সে সামনে ফিরে তাড়া দিলো,’চলো মোতাহের।বাড়ি চলো।’

নবনীতা ধুপধাপ পা ফেলে লিফটে উঠল।সে এখনো বুঝতে পারছে না রাগটা আসলে কে করেছে।সে চুপচাপ গাড়িতে বসেছিল।আরহামের হঠাৎ কি হলো?সে এমন ভাব ধরেছে কেন?নবনীতা বন্ধ লিফটের ভেতরই দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’বউ রাগ করলে কোথায় রাগ ভাঙাবে।আর বেয়াদবটা নিজেই রাগ করে বসে আছে।ধ্যাত!’

সে বাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি শাড়ি পাল্টে ঢিলেঢালা কাপড় পরল।চিত্রা তখন শুভ্রার সাথে বসার ঘরে বসে কিসব কার্টুন নিয়ে আলাপ করছিল।নবনীতা বাতি নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকল কতোক্ষণ।চোখ বন্ধ করলেই আরশাদ বাচ্চাটার মুখটা মনে পড়ে।সে হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা খুঁজে রিমিকে কল দেয়।কল রিসিভ হতেই ক্ষীণ কন্ঠে বলে,’আমার মনটা ভালো নেই রিমি।একটু আজাইরা বকবক করে মন ভালো করে দে তো।’
.
.
.
.
সারাহ ভ্যানিটি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল।তার গায়ে নেভি ব্লু রঙের স্লিভলেস টপস।আরহাম গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল।সিঁড়ির কাছে যেতেই সে আর সারাহ মুখোমুখি হলো।সারাহ তাকে দেখতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে এক ধাপ উপরে উঠে গেল।

আরহাম আগাগোড়া তাকে দেখল।কপাল কুঁচকে বলল,’এসব কি পরেছিস?শালীন হয়ে চলতে পারিস না?’

সারাহ বোকা বোকা হেসে এদিক সেদিক দেখে বলল,’স..সরি ভাইয়া।আসলে,,,’

‘যাচ্ছিস টা কোথায় এতো রাতে?’ কাটকাট গলায় প্রশ্ন করে আরহাম।

সারাহ মিনমিনে গলায় জবাব দেয়,’ফ্রেন্ডের বাসায়।’

আরহাম চোয়াল শক্ত করে তাকে দেখে।তারপরই ভরাট পুরুষালী কন্ঠে বলে উঠে,’বেশি বাড় বাড়িস না সারাহ।এতো রাতে বাইরে কি?এগুলো কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়েদের কাজ?যা ঘরে যা।’

সারাহ লটকানো মুখে তাকে দেখল।তারপরই কাঁদো কাঁদো হয়ে ঘুরে দাঁড়াল।অন্তত আরহাম ভাইয়ের মুখের উপর তর্ক করার সাহস তার নেই।সে দুই ধাপ উপরে যেতেই আরহাম কড়া গলায় তাকে একটা ধমক দিয়ে বলল,’এ্যাই শোন! পরের বার থেকে কাপড়চোপড় ভেবে চিন্তে পরবি।এসব যদি আরেকবার দেখি তাহলে বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিব।’

সারাহ আর দাঁড়াল না।মাথা নিচু করে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল।আরহাম ভাইয়ের মুখের উপর সে কখনোই কিছু বলে না।বাড়ির বাকিরাও বলে না।

আরহাম নিজেও ঘরে এসে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলো।রুমে এসে ফোন হাতে নিতেই দেখল নবনীতার দুইটা মিসড কল।সে ফোনটা আস্তে করে খাটের উপর ছুঁড়ে মারল।সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকে সে ফোন রিসিভ করবে না।সব রাগ কি শুধু নবনীতার একাই আছে?আরহামেরও যথেষ্ট ইগো আছে।সে কোনো সস্তা না।পরীকে এই কথা বুঝতে হবে।

___

চিত্রা রাতে নবনীতার পাশে শুয়েই দুই হাত ছড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।নবনীতা প্রশস্ত হেসে বলল,’কি সোনা?হঠাৎ এতো আদর দিচ্ছিস যে?ঘটনা কি?’

চিত্রা তার বুকে মাথা গুজে লাজুক হেসে বলল,’শুভি বলেছে তুমি নাকি চলে যাবে?চলে গেলে তো আর আদর দিতে পারব না।তাই দিচ্ছি।’

তার কথা শুনতেই নবনীতার দুই চোখ ভরে এলো।সে চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে জড়ানো কন্ঠে বলল,’না সোনা।আমি চলে গেলেও কয়দিন পর পর এসে এসে আদর নিয়ে যাব। ঠিক আছে?’

চিত্রা মুখ তুলল না।যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে রইল।নবনীতা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে স্নেহমাখা কন্ঠে বলল,’চিত্র! তুমি না আমার সোনা বাচ্চা?আপাই চলে গেলে তুমি কিন্তু একটু কম দুষ্টুমি করবে বুঝেছ?শুভি নিজেও তো ছোট মানুষ তাই না?তুমি তাকে জ্বালাতন করবে না।কথায় কথায় কান্না করবে না ন্যাকু বাচ্চাদের মতো।শুভি কে পড়তে দিবে মন মতো।শুভিকে না আমরা ডাক্তার বানাবো?মন মতো না পড়লে ডাক্তার হবে কেমন করে বলো?তুমি শুভির সাথে মিলেমিশে থাকবে।আমার লক্ষী সোনা তুমি।চুলগুলো বারবার এলোমেলো করে ফেলো তুমি।আপাই তোমাকে সুন্দর সুন্দর হেয়ার ব্যান্ড কিনে দিব,তুমি ভালো বাচ্চা হয়ে থাকবে কেমন?তুমি কিন্তু বড়ো হচ্ছ চিত্র।বাচ্চামো একটু একটু করে কমিয়ে নিবে বুঝেছ?’

চিত্রা মাথা নাড়ল।শুভ্রা ঘরে উঁকি দিয়েই ভেতরের দৃশ্য দেখে মন খারাপ করে বলল,’আপাই এগুলো ঠিক না।আমাকে পড়তে বসিয়ে তুমি এখানে চিত্রকে আদর দিচ্ছ।’

নবনীতা মাথা তুলে মিষ্টি হেসে বলল,’আয় না শুভি।তোর কথাই ভাবছিলাম।তাড়াতাড়ি আয়।’

শুভ্রা তাড়াতাড়ি এসে তার পাশে শোয়।নবনীতা চিত্রার মতো তার মাথাতেও হাত ছুঁয়িয়ে বলল,’শুভি রে! পড়াশোনা টা মন দিয়ে করিস।আমি তো আর্কিটেকচার নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম,পারি নি।তুই যেন তোর স্বপ্ন পূরণ করতে পারিস।হেলাফেলা করিস না পড়া নিয়ে।আপাই থাকব না ডাক দেওয়ার জন্য।নিজের তাগিদে পড়বি কেমন?’

শুভ্রা তার কথা শুনেই আচমকা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’কি রে শুভি?কি হয়েছে?’

শুভ্রা কোনোরকমে কান্না থামিয়ে মলিন মুখে বলল,’আপাই আমরা কি ভাইয়া কে বলতে পারি না যে তোমার সাথে যেন আমাদেরও ঐ বাড়িতে নিয়ে যায়?’

নবনীতা আলগোছে হাসে।শুভ্রার গালে হাত রেখে রিনরিনে মেয়েলি কন্ঠে বলে উঠে,’ধুর! কি বোকার মতো কথা বলিস।এসব কি হয় নাকি?’

আজকে সম্ভবত অমাবস্যা।আকাশে চাঁদের কোনো অস্তিত্বই নেই।আবহাওয়া টা মন্দ না।ভালোই।নবনীতা রাতভর দুই বোনকে আদর দিয়ে বোঝাল।সে হয়ত কিছুদিন বাদেই চলে যাবে।বাচ্চাগুলো যে কিভাবে থাকবে তাকে ছাড়া ভাবলেই তার কান্না পায়।তারা তো তাকে ছাড়া মাছটা পর্যন্ত বেছে খেতে পারে না।এই বাচ্চাগুলোকে ছাড়া সেও বা কিভাবে থাকবে?জীবন এতো কষ্টের কেন?সবসময় মেয়েরাই কেন সব ছেড়েছুড়ে চলে যায়?

শুভ্রা আর চিত্রা রাত বাড়তেই ঘুমিয়ে যায়।অথচ নবনীতার চোখে ঘুম নামে না।শুভ্রার মতো তারও মন চায় আরহামকে ফোন দিয়ে বলতে আপনি প্লিজ এই বাচ্চা দু’টোকেও সাথে নিয়ে নিন।কিন্তু এটা সম্ভব না।কিছুতেই সম্ভব না।এতো আবেগ ভালো না।তাকে বাস্তবিক হতে হবে।তার বিয়ে হয়েছে প্র্যাকটিক্যাল থিংকিং পারসনের সাথে।বাচ্চা দু’টো কে সাথে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।এটা হয় না।সে তাচ্ছিল্য হেসে বিড়বিড় করল,’বি প্র্যাকটিক্যাল নবনীতা।আবেগ দিয়ে সবকিছু হয় না।’

***

সময় এতো দ্রুত যায় কি করে নবনীতা সত্যিই জানে না।দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে,তাও চোখের নিমিষে।নবনীতার মনে হলো সে পলক ফেলার আগেই সময় দৌঁড়ে দৌঁড়ে চলে গেছে।সাত দিন কেটে গেছে।অথচ সে তো সেদিন মাত্র বলল তার যেতে আরো অনেক দিন বাকি।

সন্ধ্যার পর থেকেই একটু পর পর তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।কাল সে এই বাড়ি ছেড়ে দিবে।চিত্র আর শুভিকে ছেড়ে নতুন বাড়িতে চলে যাবে।ঐ নতুন বাড়িতেই সে সারাজীবন থাকবে।নবনীতা যতবারই এই কথা ভাবে,ততবারই এক ফোঁটা অশ্রু তার অনুমতি ছাড়াই চোখ বেয়ে গাল পর্যন্ত নেমে আসে।

শুভ্রা ভেজা চোখেই তার লাগেজ গোছাচ্ছিল।নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’রাখ তো এসব।কাল গোছানো যাবে।এগুলো দেখলেই আমার কান্না পাচ্ছে।’

বলেই সে খাটে গিয়ে বসল।চিত্রা ড্রয়িং বুকে আপেল আঁকার চেষ্টা করছিল।কিন্তু তার আপেলের একপাশ অন্যপাশের মতো সমান সমান গোল হচ্ছিল না।সে রাবার দিয়ে কয়েক দফা সেটা মুছল,অথচ ফলাফল শূন্য।বার বার একপাশ বেশি গোল,অন্যপাশ চেপ্টা হয়ে যাচ্ছে।শেষে বিরক্ত হয়ে সে হাতের পেন্সিলটা খাটে ছুঁড়ে মারল।

নবনীতা চোখ রাঙিয়ে হালকা ধমক দিয়ে বলল,’এসব কেমন আচরণ চিত্র?এতো রাগ কেন তোর শরীরে?দেখি কি এমন এঁকেছিস?’

সে হাত বাড়িয়ে খাতাটা হাতে নিল।তারপরই ফিক করে হেসে উঠে বলল,’নাহ চিত্র,ভালোই এঁকেছিস।একদম পারফেক্ট আপেল।সত্যিকারের আপেল গুলো তো এমন আঁকাবাঁকা সাইজেরই হয়।খুবই বাস্তবসম্মত আপেল হয়েছে।তোর আরাম ভাইকে এটা দেখাস।সে খুব খুশি হবে।তার আবার বাস্তবসম্মত জিনিস খুব পছন্দ।’

বলতে বলতেই সে আরো এক দফা হাসল।ঠিক তখনই বাড়ির কলিংবেলটা পর পর দুইবার বাজল।নবনীতা হাসি থামিয়ে ভাবুক হয়ে বলল,’এখন কে এলো?দুইবার বেল তো কেবল আরহামই বাজায়।’

তার ভাবনার মাঝেই আরহাম বড় বড় পা ফেলে তার রুমে প্রবেশ করল।তার দুইহাত দিয়ে সে শক্ত করে একটা বাচ্চাকে নিজের সাথে চেপে ধরেছে।ঘরে এসেই সে নবনীতাকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’ট্যান ট্যানা।দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।’

নবনীতা এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।নিশ্বাস বন্ধ করে বলে,’আরশাদ!’

সে ছুটে যায় তার কাছে।এক থাবার আরশাদকে আরহামের কাছ থেকে নিয়ে নিজের কাছে আনে।গালে দু’টো চুমু খেয়ে বলে,’আরেকটা সোনা বাচ্চা আমার!’

আরশাদ বাস্তবিক অর্থেই অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদা ছিল।তার চোখে মুখে একটা ভিনদেশী বাচ্চাদের ছাপ ছিল।নবনীতা তাকে একনজর দেখেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,’আরশাদ একটু বেশিই সুন্দর তাই না?বড় হয়ে নায়ক হবে মনে হচ্ছে।’

আরহাম কপাল কুঁচকাল।নাক ছিটকে বলল,’ইউউউ!!!নায়ক হবে কেন?সে কি অভিনয় করবে নাকি?আরশাদ হবে রিয়েল লাইফ হিরো।ঠিক তার বাবার মতো।’

নবনীতা হাসল।আরশাদকে পুনরায় আরহামের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’ধরুন একটু।আমি পানি নিয়ে আসছি।’

আরহাম ধরল না।উল্টা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে শুভ্রাকে দেখে বলল,’শুভ্রা,ভাইয়াকে একটু পানি খাওয়াও তো।’
শুভ্রা সাথে সাথেই রান্নাঘরের দিকে ছুটল।আরহাম মাথা নামিয়ে চিত্রাকে দেখেই একটানে তাকে নিজের কোলে তুলল,এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,’কি রে ভাইয়া?চুলগুলো সব এমন এলোমেলো কেন?পরী আপাই ইদানিং আর যত্ন করে তাই না?সারাদিন নিজের রংঢং নিয়ে ব্যস্ত থাকে।’

চিত্রা খিলখিল করে হাসে।দুই দিকে মাথা নেড়ে রিনরিনে স্বরে বলে,’না না।আপাই ই তো বেঁধে দিয়েছে।আমিই দৌঁড়াদৌঁড়ি করে এলোমেলো করেছি।’

আরহাম বিনিময়ে কেবল অল্প করে হাসল।তারপর নবনীতার পাশাপাশি এসে বলল,’কি ম্যাডাম?দিনকাল কেমন চলে?’

নবনীতা আড়চোখে একবার তাকে দেখে।তারপরই মুখটাকে গম্ভীর করে বলে,’চলে।ভালোই চলে।জীবন খুব প্র্যাকটিক্যালি চলছে।নো আবেগ,অনলি বিবেক।’

কথা শেষ হতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো।চোখাচোখি হতেই দু’জন সমস্বরে হেসে ফেলল।নবনীতা হাসির ফাঁকেই ঠোঁট টিপে বলল,’ভালো কথা মনে পড়েছে।আপনার চিত্র সোনাও আজকে একটা প্র্যাকটিক্যাল কাজ করেছে।’

আরহাম কৌতুহলী হয়ে বলল,’সেটা কি?’

নবনীতা খাটের দিকে ইশারা করে বলল,’সে একটা আপেল এঁকেছে।খুবই প্র্যাকটিক্যাল আপেল।একদিক বোঁচা।’
বলেই সে আরো কিছুক্ষণ হাসল।আরহাম চিত্রাকে কোল থেকে নামিয়ে দ্রুত আর্ট বুকটা হাতে নিল।সেখানে একনজর দেখেই গর্ব করে বলল,’সাব্বাশ চিত্র! এই না হলো আমার যোগ্য অনুসারী।’

সে আরাম করে খাটে বসল।তারপর চিত্রার এক হাত টেনে তাকে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলল,’শোন চিত্র।আরেকটু বড় হ।তারপর তোকে আমি আমার ডান হাত বানাব।তোফায়েল আমাকে বাইরের সব খবর এনে দিবে।আর তুই আমাকে ঘরের ভেতরের সব খবর এনে দিবি।বুঝেছিস?’

চিত্রা বুঝল নাকি বুঝা গেল না।সে কেবল তার কথা শেষ হতেই তার মাথাটা আরামের বুকের সাথে ঠেস দিয়ে দুইহাত আরহামের হাঁটুর উপর রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।আরহাম তাকে একটানে নিজের কোলে বসিয়ে চোখ সরু করে বলল,’তারপর বলো,তোমার চান্দি গরম আপাই এই সাত দিনে কি কি পাকনামি করেছে?’

***

বাড়ির সবাই ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে গেছে।নবনীতা আস্তে করে চেয়ার টেনে টেবিলে বসল।এতো আস্তে চেয়ার টানলো যেন কেউ শুনতে না পায়।তারপরই কলম হাতে নিয়ে চটপট লিখা শুরু করল।আজ আর তার ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না।মনে যা আসবে,সে সবটাই লিখবে।
*
*
‘আমি আর আরহাম কেউ কাউকে ঘটা করে সরি বলি না।সেরকম তোড়জোড় করে মাফও চাই না।আমরা হুট করেই একজন আরেকজনের সাথে অতিমাত্রায় ভালো আচরণ করা শুরু করি।এই যেমন গত সাতদিন কেউ কাউকে দেখিনি।ফোনে একবার কথা হয়েছিল,তাও বাজার করা নিয়ে।এই সাতদিন দু’জনেই রাগে অভিমানে ফুলে ফুলে লুচি হয়েছি।তার ইগো সে নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না।আমার ইগো আমি এতোবার ফোন দেওয়ার পরেও সে ফোন তুলেনি,তাই আমিও আর নিজ থেকে কথা বলব না।সাতদিন দু’জনই বিষধর গোখরা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে কাটিয়েছি।শেষটায় জনাবের মনে দয়া হলো।সে আর ফোন দিলো না,উল্টো আরশাদকে সহ আমার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলো।সে সামনে দাঁড়াতেই কি হলো কে জানে,আমার সমস্ত রাগ এক নিমিষেই পড়ে গেল।মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে গেল।সাতদিনের মন কষাকষি এক সেকেন্ডই ঠিক হয়ে গেল।খুশিতে আমি হলাম বাকুম বাকুম।তারপরই দু’জন অতিমাত্রায় ভালো আচরণ শুরু করলাম।কারণ সরি বলতে আমাদের অনেক আপত্তি আছে।কেউ কারো কাছে ছোট হতে পারব না।তার চেয়ে মিষ্টি মিষ্টি আচরণ করে ক্ষমা প্রার্থনাই আমাদের সমীচীন মনে হয়েছে।

লিখছি আর ঠোঁট টিপে হাসছি।কি ছিলাম আমি,আর কি হয়ে গেলাম?অদ্ভুত বিষয়! আরহাম নিজেও বোধহয় নিজেকে দেখলে আমারই মতো অবাক হয়।কি ছিল সে,আর কি হয়ে গেল।আজ আমাদের বিবাহিত জীবনের চুয়াত্তর দিন পূর্ণ হয়েছে।ভাবা যায়! সেদিনই তো কাঁদতে কাঁদতে বিয়ের জন্য সায় দিলাম।সেই বিয়েরও তিন মাস হয়ে যাচ্ছে।বড়ই আশ্চর্যের বিষয়।তিন মাস না হতেই আমরা দু’টো মানুষ আবিষ্কার করলাম ব্যক্তিজীবনে আমরা যতোই দুই মেরু তে থাকি না কেন,বিবাহিত জীবনে এই দুই মেরু বারবারই একে অন্যকে ভূ-চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করেই যাচ্ছে।বাড়াবাড়ি রকমের মেল ইগোকে একপাশে সরিয়ে আরহাম ছুটে আসছে ধানমন্ডির এই ছোট্ট ফ্ল্যাট টা তে।আর বাড়াবাড়ি রকমের জেদকে একপাশে সরিয়ে আমি ছুটে যাচ্ছি আরহাম নামের ভীষণ বিরক্তিকর,কিন্তু ভীষণ পছন্দের মানুষটির দিকে।জ্বী,আমি নবনীতা নূর সজ্ঞানে শাহরিয়ার আরহামকে নিজের জীবনসঙ্গী রূপে মেনে নিয়েছি।খুব করে চাইছিলাম যেন আমি তার সাথে মুখ ফুলিয়ে রাখতে পারি,ভাব দেখাতে পারি।কিন্তু আরহামের সাথে বেশিক্ষণ মুখ ফুলানো যায় না।কেবল আমার মন ভালো করার জন্য সে আজ আরশাদকে সেই সাভার থেকে এখানে নিয়ে এসেছে।ভাবা যায়?এই বিষয়টা ভাবলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়।

আরহামের অনেক বদঅভ্যাস আছে।তার কিছু কিছু আচরণ দেখলে আমার তাকে রীতিমতো অনুভূতিশূন্য রোবট মনে হয়।কিন্তু পরমুহূর্তেই সে এমন একটা আচরণ করবে,যেটা দেখলে আমার মন আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়।

আমি কি দিন দিন ভীষণ আবেগী হয়ে যাচ্ছি?কে জানে?হয়তো বা।আরহামের ভাষায় আমি আজকাল বাংলা সিনেমার শাবানা হয়ে যাচ্ছি,ঠু মাচ ড্রামাটিক,ঠু মাচ ইমোশনাল।কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।বাবা মায়ের মৃত্যুর পর এতো যত্ন,এতো গুরুত্ব,এতো পাত্তা আমাকে আর কেউ দেয়নি।চিরায়ত বাঙালি নারীদের মতো আমিও সেই যত্নে আটকে গেছি।এই ছয়টি বছরে আমি মন খারাপ করাই ভুলে গিয়েছিলাম।কারণ যেই মন খারাপে মন ভালো করার মানুষই থাকে না,সেই মন খারাপ করে লাভ কি?এই তিনমাসে আমি আবারো মন খারাপ করা শিখেছি,অভিমান আবারো আমার মনে বাসা বাঁধার সুযোগ পেয়েছে।কারণ আমার অভিমান ভাঙানোর মতো একজন চমৎকার মানুষ আমার জীবনে এসে গেছে।

আমার এই ডায়রিটা যদি কখনো কেউ পড়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে মাথাখারাপ অথবা পাগল ভাববেন।কারণ ডায়রির শুরুতে আমি আরহামকে মনের আশ মিটিয়ে গালমন্দ করেছি।সেই আমিই আজকের দিনে এসে তাকে চমৎকার মানুষ বলছি।কিন্তু সেদিন আর আজকে,দুইদিনই আমি আমার মনের কথা লিখেছি।

আমার মনের একটি সুপ্ত বাসনা আছে।যদি কোনোদিন আমি সুযোগ পাই আরহামের কাছে কিছু একটা চাওয়ার,তাহলে আমি চাইব আরহাম যেন রাজনীতি ছেড়ে দেয়,সে যেন এই সবকিছু থেকে দূরে সরে আসে।কারণ এই রাজনীতিই তার সমস্ত অমানবিক আচরণের মূল।আমি চাই আরহাম বিজনেসকেই মূল প্রাধান্য দিক।আমার এই দেশের রাজনীতি একদমই ভালো লাগে না।ভালো ভালো মানুষরাও রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর পাল্টে যায়।আমি চাই না আরহাম পাল্টাক।কারণ সে পাল্টে গেলে আমার,নবনীতার পুরো পৃথিবীটাই পাল্টে যাবে।প্লিজ আল্লাহ,আরহামকে তুমি এমনিই রেখো।আর কিছু চাই না আমার।’

~নবনীতা নূর
১০ম কার্তিক,১৪২৯ বঙ্গাব্দ

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৭

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৭)

রিমি বিভার হাত ধরে ছুটতে ছুটতে হাসপাতালের ভেতরে এলো।বাইরে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি হচ্ছে।সে হসপিটালে এসেই পিছলে গেল খানিকটা।তারপরই আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল।মাথা নামিয়ে বিভাকে দেখেই মিষ্টি হেসে বলল,’দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে কেমন লাগে বিভু?’

বিভা দাঁত কেলিয়ে জানায়,’কুব মজা।’

রিমি তাকে নিয়েই হাসপাতালের মাঝে ছুট দেয়।হাসপাতাল এখন একদমই ফাঁকা।সে হাসতে হাসতে বলল,’আয় আমরা স্কেটিং করি।বিভা বিনিময়ে কেবল প্রাণখোলা হাসল।বাচ্চাদের হাসির শব্দ পৃথিবীর চমৎকার শব্দগুলোর একটি।সেই হাসির ঝংকারে হাসপাতালের নিচ তালার খোলা জায়গাটা আচমকাই কেমন উৎসবমুখর হয়ে উঠল।

ওয়াজিদ দাঁড়িয়ে ছিল ক্যান্টিনের দরজার কাছে।চৌকাঠে হেলান দিয়ে সে স্থির চোখে একবার দু’জনকে দেখে।রিমি আর বিভা মনের আনন্দে ছুটে যাচ্ছিল এই মাথা থেকে ঐ মাথা।ওয়াজিদ চোখ মুখ কোঁচকায়।এটা আবার কেমন পা’গল?হাসপাতালে এমন দৌঁড়াদৌঁড়ি কে করে?

_____

উষান গলায় ঝুলানো ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে কয়েকবার এঙ্গেল ঠিক করল।এই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে সে আটকা পড়েছে একটা হসপিটালে।তার ক্যামেরা টা ওয়াটার প্রুফ না।পানি পড়লেই নষ্ট হওয়ার আশংকা আছে।সে বেরিয়েছিল ছবি তোলার উদ্দেশ্যে।ফটোগ্রাফি তার শখ।অবেলার বৃষ্টি সেই শখে পানি ঢেলে দিয়েছে।সে বিরক্ত হয়ে হাসপাতালে ঢুকে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিল।

হঠাৎই নিচতালার একটি দৃশ্যে তার চোখ আটকায়।খোলা জায়গায় একটি অল্প বয়সী মেয়ে একটি ছোট বাচ্চাকে নিয়ে মনের আনন্দে ছুটোছুটি করছে।তাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখেই উষানের মুখে হাসি ফুটল।সে ছবি তোলার জন্য একটি পারফেক্ট সিনারিও পেয়ে গেছে।সে সাথে সাথে ক্যামেরা অন করল।ভেবে নিল তাদের অগোচরেই সে তাদের কিছু ছবি তুলবে।দুই টা ছবি তুলতেই সে রিমিকে ডাকল,’এক্সকিউজ মি আপু।একটু শুনবেন?’

রিমি হাসি মুখেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে।সহজ গলায় জানতে চায়,’হ্যাঁ হ্যাঁ বলো।’

উষান ক্যামেরা হাতে এগিয়ে আসে।সৌজন্যসূচক হেসে বলে,’আমি শখ থেকেই ফটোগ্রাফি করি। আমি আপনাদের দু’টো ক্যান্ডিড ছবি তুলেছি।এখন চাচ্ছি নির্দিষ্ট পোজে তুলতে।আপনি কি কয়েকটা পোজ দিবেন যেন প্রোপার একটা মোমেন্ট ক্রিয়েট হয়?’

রিমি দ্রুত মাথা নাড়ে।প্রাণবন্ত হেসে বলে,’অবশ্যই অবশ্যই।মাই প্লেজার।’

উষান একগাল হেসে বলল,’আপু আপনার নাম?’

উচ্ছ্বসিত তরুণী মিষ্টি হেসে জবাব দেয়,’সিদরাতুল মুনতাহা।ডাকনাম রিমি।’

ওয়াজিদ সমস্ত মুখ বিকৃত করে তাকে দেখল।রতনে রতন চিনে,আর পা’গলে পা’গল চিনে।সে অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে,’যতোসব পা’গলের আখড়া! হাসপাতালে এসেছে মোমেন্ট ক্রিয়েট করতে।’

‘এক্সকিউজ মি ভাইয়া।’
উষানের ডাক শুনেই সামনে তাকায় ওয়াজিদ।খানিকটা বিচলিত হয়ে বলে,’আমাকে ডাকছ?’

‘জ্বী ভাইয়া।আসলে আপনার পজিশন একদম পারফেক্ট।আপনি কেবল আমি রেডি হতে বললেই রিমি আপু আর বিভার দিকে তাকাবেন।তাহলে ব্যাকগ্রাউন্ড টা খুব ভালো আসবে।’

ওয়াজিদ তাজ্জব হয়ে বলল,’কি অদ্ভুত! আমায় কেন এসবে আনছ?তোমরা তুলো না তোমাদের ছবি।’

‘আমরা তুললেই তো হবে না।ছবিটা এস্থেটিক হতে হবে।সেজন্য আপনাকেও ফ্রেমে আসতে হবে।’ ত্যাড়ামি করে জবাব দিলো রিমি।

ওয়াজিদ বিরক্ত হয় ভীষণ।সে কড়া করে কিছু বলে না দেখে সবাই যা খুশি তাই করে তার সাথে।যাই হোক,অল্পতে রে’গে যাওয়া তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ।সে বুকে হাত বেঁধে থমথমে মুখে বলল,’এক মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারব না।যা করার তাড়াতাড়ি করো।’

যদিও সে এক মিনিট দাঁড়াবে বলেছে,কিন্তু মনোযোগ দিয়ে বিভা আর রিমিকে দেখা শুরু করার পর তার মনে হলো আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ালে মন্দ হয় না।দু’জনকে ভালোই দেখাচ্ছে।

ছবি তোলার পর রিমি এগিয়ে যায় উষানের দিকে।আগ্রহী হয়ে বলে,’দেখি ভাইয়া।ছবি গুলো দেখাও তো।’

দু’জন ব্যস্ত হলো ছবি দেখা নিয়ে।ওয়াজিদ হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে সামনে এগিয়ে এসে বিভাকে কোলে তুলে নিল।মিষ্টি স্বরে জানতে চাইল,’কেমন আছ বিভা?’

বিভা শুধু মাথা নাড়ল।রিমি পাশ ফিরে বলল,’আপনি বিভুকে নিয়ে উপরে যান না।আমি একটু পরে আসছি।’

ওয়াজিদ তার দিকে ফিরে গম্ভীর হয়ে বলল,’কোনো দরকার নেই।তুমি কাজ শেষ করো।একসাথেই যাব।’
.
.
.
.
‘আফু।আমার রাস্তায় থাইক্কা অভ্যেস।আমি ঘর বাড়িত ঘুমাইতাম পারি না।’

কথার ধরনেই আরহাম মাথা নামিয়ে হেসে ফেলল।শাহাদাত তাকে দেখেই মুখ কাচুমাচু করে বলল,’ভাইয়া।কিছু কন না সুন্দরী আফুরে।আমি এতো বড়ো বাসাত থাকতে পারুম না।’

নবনীতা মুখ শক্ত করে কড়া চোখে তার দিকে তাকায়।গম্ভীর হয়ে বলে,’থাইক্কা আবার কি শাহাদাত?থেকে বলবে।তোমাকে না বলেছি সুন্দর করে কথা বলতে?সেই তো অশুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলছ।’

‘জন্মের থেক্কা,থুক্কু থেকে,,জন্মের থেকে আমি এমনেই কথা কইতাছি আপা।গত তিনদিন মেলা চেষ্টা করছি।আমার পক্ষে সম্ভব না।শুদ্ধ আমার মুখের তে বাইর ই হয় না।কি করুম?তাও তো বস্তির বাকি পোলাদের থেক্কা আমার কথা ভালা।বিশ্বাস না হলে আপনে গিয়া দেইখা আসেন।’

একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠে কথা গুলো বলল শাহাদাত।নবনীতা জবাবে কেমন চোখ পাকিয়ে একবার তাকে দেখল।তাকে সে বলেছিল শুদ্ধ করে কথা বলতে আর তার বাড়িতে এসে থাকতে।অথচ দু’টো প্রস্তাবের একটাও শাহাদাতের পছন্দ হয়নি।সে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে এমন বন্ধ ঘরে থাকতে পারবে না।তার নামি দম বন্ধ হয়ে যায়।

নবনীতা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে।ছোটখাটো একটা মিটিং রুম হয়ে গেছে তার কেবিন টা।আরহাম,আদি,ওয়াজিদ,রিমি,শুভ্রা,চিত্রা,বিভা,শাহাদাত মোটামুটি সবাই তার কেবিনে আছে।তারা কথা বলছিল শাহাদাত আর বিভার থাকা নিয়ে।

নবনীতা চাইছিল শাহাদাত তার কাছেই থাকুক।কিন্তু শাহাদাতের নাকি তার বাসায় মন টিকে না।দশ তালার উপর থেকে তার কিছুই ভালো লাগে না।ঘরে বসে কোনো খেলাই তার ভালো লাগে না।সে বড় হয়েছে একভাবে।বন্ধুদের সাথে কাবাডি,হাডুডু ,ক্রিকেট,ফুটবল এসব খেলেই সে একটা লম্বা সময় পার করেছে।এখন এই বন্ধ জীবন তার ভালো লাগে না।তার নিজেকে বন্দি বন্দি লাগে।বার বার কোথাও ছুটে যেতে মন চায়।এই ইট পাথরের দেয়ালে আবদ্ধ জাকজমকের জীবন তাকে বিমুগ্ধ করে না।উল্টো তার মনে হয় এমন বন্ধ ঘরে তার দ’ম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ওয়াজিদ তার অবস্থা কিছুটা উপলব্ধি করতেই গম্ভীর হয়ে বলল,’আমার মনে হয় শাহাদাত কে কোনো বোডিং স্কুলে দিয়ে দিলেই ভালো হবে।মাসে একবার সে বাড়ি আসবে,আর বাকি সময়টা তার স্কুলের বন্ধুদের সাথে থাকবে।এতে করে সে আর একাকিত্ব অনুভব করবে না।বিভিন্ন কো কারিকুলাম এক্টিভিটিজে অংশ নিবে,খেলাধুলা করবে।বোডিং স্কুলের ডিসিপ্লিনের মাঝে পড়ে গেলে কথাবার্তা এমনিতেই সুন্দর হয়ে যাবে।আমার অন্তত তাই মনে হয়।আর সত্যি বলতে নবনীতার বাসায় সে আসলেই কমফোর্ট ফিল করবে না।এর চেয়ে বোডিং স্কুলই বেটার অপশন।সমবয়সীদের সাথে থাকবে।তারও মন ভালো থাকবে।আর সবমিলিয়ে এটাই বেস্ট হবে।’

আরহাম তার কথা শুনেই ডান হাত দিয়ে একটা তুড়ি বাজিয়ে বলল,’বেস্ট ভাই।এর চেয়ে সুন্দর সলিউশন আর হতেই পারে না।একদম সবদিক দিয়ে পারফেক্ট।’

সে থামল।পাশ ফিরে নবনীতাকে দেখে কপাল কুঁচকে বলল,’কি ম্যাডাম?আইডিয়া কেমন লেগেছে?’

নবনীতা গালের নিচে হাত দিয়ে একটু ভাবল।তারপরই শাহাদাতকে দেখে দুই চোখ সরু করে বলল,’সত্যিই তুমি আমাদের বাসায় থাকতে চাও না?’

শাহাদাত দ্রুত দুই দিকে মাথা নাড়ে।নবনীতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,’তাহলে আর কি?থাকো তুমি বোডিং স্কুলে।বেতের বারি যখন পড়বে পিঠের উপর ধাম ধাম,তখন আবার আমার কথা মনে করবে না কিন্তু।’

শাহাদাত এক সেকেন্ডও দেরি না করে মুখের উপর ঠাস করে জবাব দিলো,’ঐ বন্ধ ঘরে থাকার থেইক্কা পিডা খাওন আরো ভালা।’

তার কোনোরকম ভণিতা ছাড়া স্পষ্ট অকপট জবাবে নবনীতা ভড়কে গেল।আরহাম পুরো ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতেই বলল,’শাহাদাত রকস,পরী শকস!’

আদি আর ওয়াজিদও তার কথায় ফিক করে হেসে ফেলল।হাসি সংক্রামক।দেখা গেল আস্তে আস্তে নবনীতা বাদে পুরো কেবিনের সবাই ই চাপা স্বরে হাসা শুরু করল।নবনীতা চোখ পাকিয়ে সবাইকে দেখে।তারপরই গজ গজ করে বলে,’ঠিক আছে বাপ।থাক তোর যেখানে খুশি।আমার বাসায় তোকে থাকতে হবে না।’

শাহাদাত হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দুই হাত সামনে তুলে বলল,’অনেক ধন্যবাদ আপা।’

নবনীতা তার থেকে চোখ সরায়।রিমি আর বিভা তখন কাউচে বসে অদ্ভুত একটা খেলা খেলছিল।এই খেলার নাম নবনীতা জানে না।শুরুতেই দু’জনে ভন ভন করে কিছু একটা বলে।তারপরই হঠাৎ কি হয় কে জানে,দু’জনেই একসাথে তাদের মুখ চেপে ধরে।নবনীতা তাদের দেখেই বিড়বিড় করল,’আরেক পা’গল!’

সে কন্ঠ চওড়া করে ডাকে,’রিমি!’

রিমি তার দিকে ফিরল।ভ্রু উঁচিয়ে বলল,’কি?’

‘বিভুকে নিয়ে কি ভেবেছিস তুই?’

রিমি দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’কি আর ভাববো?বিভু আমার কাছেই থাকবে।তোর বাড়িতে এমনিতেও অনেক মানুষ আছে।আমার বাড়িতে শুধু আমি,আব্বু আর আম্মু।বিভা আসার পর থেকেই ঘরটা একটু প্রাণ ফিরে পেয়েছে।আব্বু তো রোজ বিভার সাথে খেলা করে।আম্মু আবার এটা সেটা কতো কিছু বানায় তার জন্য।আমি বড়ো হওয়ার পর আম্মু আব্বু একদম একা হয়ে গিয়েছিল।এখন বিভা আসাতে ঘরটা একটু ভরা ভরা লাগে।আমি তাকে আমার কাছেই রাখতে চাই।’

কথা শেষ করেই সে বিভার কপালে একটা চুমু খায়।ওয়াজিদ আড়চোখে একবার তাকে দেখল।মেয়েটার একটা চমৎকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাকে বারবার মুগ্ধ করে।সেটা হলো তার সরলতা।একেবারে স্বচ্ছ সুন্দর আর নির্ঝঞ্ঝাট মেয়ে মানুষ।ওয়াজিদ একমুহূর্তে তার সাথে রাগ হলেই পরমুহূর্তে তার মনে হয় থাক বাচ্চা মানুষ,বুঝে নি হয়তো।বিভা নামের সম্পূর্ণ অচেনা কন্যা শিশুটির প্রতি তার এই মাতৃসম আচরণ ওয়াজিদের মনে দাগ কাটে।এতো সহজে কি কোনো একটি মেয়ে একটি ছোট্ট শিশুর দায়িত্ব নিতে পারে?নবনীতার প্রতি মেয়েটার ভালোবাসাও চোখে পড়ার মতো।ওয়াজিদের মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটা বড্ড সরল।অন্তত এই সুবিশাল আর স্বার্থপর পৃথিবীতে একা চলার মতো যেই ধূর্ততা প্রয়োজন সেটা তার মাঝে নেই।

আলোচনা চলল আরো বিশ মিনিটের মতো।শেষে সিদ্ধান্ত হলো শাহাদাত কে ভালো মানের কোনো বোডিং স্কুলে ভর্তি করানো হবে।আর বিভা থাকবে রিমির সাথে।নবনীতা শেষ একবার শাহাদাতের দিকে দেখে কড়া গলায় বলল,’আমি তো মুখে বলেছি।বোডিং স্কুলে গিয়ে কথা না শুনলে আর এমন বিচ্ছিরি ভাষায় কথা বললে বেতের বারি একটাও মাটিতে পড়বে না।’
.
.
.
.
ব্যস্ততায় আর জীবনের গতিময়তায় কেটে গেছে আরো কিছু দিন।নবনীতা এখন কিছুটা সুস্থ।ঠিক মতো নিজে নিজে হাঁটাচলা করতে পারে।জখমও শুকিয়ে এসেছে প্রায় সবগুলো।কেবল কাঁধ আর হাতের একটা জায়গা এখনো পুরোপুরি শুকায়নি।তবে শরীরের চিনচিন ব্যথা অনেকখানিই কমে গেছে।

তার হসপিটালের দিনগুলো ভালোই কাটে।সেদিনের পর থেকে সে রোজ রাতে এক প্লেট করে ফুচকা খেয়েছে।আরহাম নিজ হাতে সেগুলো কিনে এনে বানিয়েছে।নবনীতার ইদানিং নিজেকে কোনো উচ্চমাধ্যমিকে পড়ুয়া কিশোরী মনে হয়।মনে হয় সে শুভ্রার সমবয়সী হয়ে গেছে।আরহাম সামনে থাকলে সে এতো বকবক করে! চলে গেলেই তার হুশ হয়।মনে হয় ধ্যাত! বেশি কথা বলে ফেলেছি।

যত্ন জিনিসটা ভীষণ অদ্ভুত।বহুদিন যত্ন না পেতে পেতে যখন শরীরটা যত্নের সংজ্ঞাই ভুলে যায়,তখন হুট করেই সামান্য যত্নে শরীর মন দু’টোই জুড়িয়ে যায়।নবনীতা অনেক গুলো বছর পর যত্ন পাচ্ছে।কেউ একজন রোজ ঘুমের আগে তার পিঠের পেছনে থাকা বালিশটা খাটে রেখে একহাত চেপে তাকে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।কেউ একজন রোজ এক ঘন্টার জন্য হলেও তাকে দেখে যাচ্ছে।তার শিয়রে বসে একমনে তার কথা শুনে যাচ্ছে।নবনীতার মনে হচ্ছে তীব্র খরা উপেক্ষা করে হঠাৎই তার জীবনে মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এসেছে।সে সুখী।সংসার জীবন নিয়ে তার এখন পর্যন্ত খুব বেশি অভিযোগ নেই।শুরুর দিকে কয়েকটা অভিযোগ ছিল।তবে এই কিছুদিনে সে সেসব ভুলে নতুন উদ্যমে সংসার জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন এতো তেড়িবেড়ি করে লাভটা কি?আর যাই হোক,আরহাম তো এতো বেশি জ’ঘন্যও না যে তার সাথে এক ছাদের নিচে ঘর করা যাবে না।

***

‘কোনো এক আহাম্মক বলেছিল-ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা বেস্ট ইম্প্রেশন।অর্থাৎ প্রথম দেখায় আমাদের একজন মানুষ কে কেমন লাগে,সেটার উপরই নির্ভর করে বাকি জীবন আমাদের তাকে কেমন লাগবে।এই কথাকে আমি লিখিত ভাবে অস্বীকার করলাম।আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে,তাকে প্রথম দর্শনে আমার বিন্দু পরিমানও ভালো লাগে নি।মনে হয়েছিল এর মতোন শিক্ষিত গোয়ার আর দু’টো নেই।এরপর যতগুলো সাক্ষাৎ হলো,কোনো সাক্ষাৎেই আমার তাকে ভালো লাগল না।মনে হলো এই যুগে এসেও এই মূর্খ এসব আদিম যুগের চিন্তাভাবনা নিয়ে বেঁচে আছে কেমন করে?আমার তাকে এতোই অপছন্দ হলো যে আমার ছোট্ট বোনকে যখন সে কোলে তুলে আদর করতো,তখন আমার ব্রহ্মতালু অব্দি জ্বলে উঠতো।তারপর নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের বিয়ে হলো,সেটাও একপ্রকার বাধ্য হয়ে।চারিদিকের এতো এতো কথায় একপ্রকার নিজের কাছে নিজে হেরে গিয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম এই গোয়ারকে আমি বিয়ে করব।

মূল কাহিনী শুরু হলো বিয়ের পর।বিয়ের আগে আমি যেই মানুষটিকে দেখামাত্রই নাক ছিটকাতাম,বিয়ের পর আমি আবিষ্কার করলাম মানুষটা আসলে নাক ছিটকানোর মতো এতোটা খারাপও না।বিবাহিত জীবনে সে এখন পর্যন্ত আমার জন্য কি কি করেছে তার একটা লিস্ট দেই-

★সে আমাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়েছে।
★সে আমার আর আমার পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে,তাও হাসিমুখে।
★সে আমাকে চমৎকার চমৎকার কিছু শাড়ি কিনে দিয়েছে,যেগুলো গায়ে জড়ানোর পর নিজেরই নিজেকে অপ্সরা মনে হয়।
★সে জ্বরের প্রকোপে ভুলভাল প্রলাপ করতে থাকা আমিটা কে পরম যত্নে আগলে নিয়েছিল।কয়েক রাত সে আমার কথা ভেবে নির্ঘুম কাটিয়েছে।
★মেয়েদের পড়াশোনার কথা শুনলেই যার গায়ে ফো’সকা পড়ে,সেই লোকটাই আমাকে স্কুলে চাকরি করার অনুমতি দিয়েছিল।
★সে আমার সম্মান রক্ষার্থে রীতিমতো এলাহি কান্ড বাঁধিয়েছে।
★আমার রান্নায় লবনের পরিমান মাত্রাতিরিক্ত বেশি হওয়া স্বত্তেও সে বলেছে আমি নাকি ভালোই রান্না করেছি।
★সে দুই রাত ধরে হসপিটালে কাটিয়েছে যেন জ্ঞান ফিরলেই সবার প্রথমে আমি তাকে দেখতে পাই।
★সে শাহাদাতের সমস্ত খরচ বহন করেছে।এটার কারণও স্রেফ আমার মনের খুশি।কারণ আমার জামাই নিজের পরিবারের মানুষ ছাড়া আর কারো জন্য দরদ দেখায় না।
★সে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভেজা শরীর নিয়ে আমার জন্য ফুচকা হাতে হসপিটালে এসেছে।

আরো কিছু বাদ যেতে পারে।কারণ আমার আবার আজকাল শর্ট টাইম মেমোরি লস হচ্ছে।অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছি আমি।

তো যাই হোক,এই হলো অতি সংক্ষেপে আমার সংসার জীবনের বিবরণ।আমার স্বামীর নাম কি লিখতে হবে?যাকগে,লিখেই দেই।তার নাম শাহরিয়ার আরহাম।তার ভাষ্যমতে এই শহরে এমন কেউ নেই যে তাকে চিনে না।কথা অবশ্য সত্য।এমপি মানুষ,তাকে মোটামুটি সবাই ই চেনে।

উপরের কথা গুলো স্রেফ আবেগের বশে লিখি নি।এসব লিখার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে।এবার আসি মূল কথায়।আমার জামাইয়ের যেমন ভালো ভালো গুন আছে,তেমন তার কিছু মারাত্মক খারাপ গুনও আছে।এর মধ্যে প্রথম তার মুখের ভাষা।তার মুখের কথা শুনলে মাঝে মাঝে আমার মন চায় মাটি ফাঁক করে ভেতরে চলে যাই।সেদিন সে চেয়ারের সাথে উষ্টা খেল।খেতেই পারে,খুব স্বাভাবিক বিষয়।কিন্তু এরপর সে চেয়ারকে এমন বিচ্ছিরি একটা গালি দিলো যে আমার মনে হলো আমার কান দু’টো কে একটু ওযু করিয়ে আসি।
এই গেল মুখের ভাষা।এবার আসি তার মেজাজ নিয়ে।তার মুড সুইংয়ের কাছে মেয়ে মানুষও ফেইল।ধরা যাক বিকাল পাঁচটার দিকেই সে আমাকে সেনোরিটা ডেকে ডেকে আহ্লাদে গদো গদো হচ্ছে।পাঁচটা দশেই কিছু একটা হলো আর সে রীতিমতো রাসেলস ভাইপারের মতো ফণা তুলে আমাকে ছো’বল মারতে উদ্যত হলো।মানে তার যে কখন কি হয় সেই জানে।গতকাল মুঠোফোনে আমাদের তুমুল ঝগড়া হলো।ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি ধৈর্য হারা হয়ে যা নয় তাই বলেছি।সেই বলার প্রেক্ষিতে সেও আমাকে যা না তাই বলেছে।শেষে বলল সে নাকি আর ঘরই করবে না আমার সাথে।বলেই কল কেটে দিলো।এরপর সারারাত আমি অনুশোচনায় ছটফট করেছি।তারপর সকালে উঠে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে তার সমস্ত অবদান আমি একটা একটা করে ডায়রিতে টুকে রাখব।যখনই তার উপর আমার প্রচন্ড রাগ হবে,তখনই আমি ডায়রি খুলে এগুলো পড়ব আর রাগ কমাবো।বুদ্ধিটা দারুণ না?

যাকগে।আর কথা না বাড়াই।তবে আমার অল্প দিনের সংসার জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে আমার জনাব আজই বাড়িতে আসবেন আর দরজা খুলতেই দুষ্টু হেসে বলবেন-‘হাই সেনোরিটা!কেমন আছ?তুমি নাকি কাল আমায় ভীষণ মিস করেছ?তাই চলে এলাম দেখা করতে।’

নবনীতা নূর
২রা কার্তিক,১৪২৯ বঙ্গাব্দ

ডায়রির এইটুকু লিখা হতেই বাড়ির কলিং বেলটা পর পর দু’বার বেজে উঠল।সেই শব্দেই চেয়ারে বসে থাকা তেইশের তরুণীটি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো।মুহূর্তেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটল,চোখ জোড়া হলো চঞ্চল।হাতের কলমটা টেবিলে ছুড়েই সে ছুটে যায় দরজায় দিকে।

মিসেস রোকেয়া দরজা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই সে চেঁচিয়ে উঠে,’দাঁড়াও মামি।আমি দরজা খুলব।’

মিসেস রোকেয়া অবাক হলেন।তারপরই তাজ্জব বনে গিয়ে দুই কদম পিছিয়ে এলেন।চোখ মেলে দেখলেন মেয়েটার মুখের সেই স্বচ্ছ হাসি।চোখ দু’টো এতো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে কেন?এতো দুরন্তপনা তার মধ্যে বাসা বেঁধেছে কবে?

সে চটপট দরজা খুলে।অন্যপাশে দাঁড়ানো মানুষটি থমথমে মুখে তার দিকে তাকায়।নবনীতা প্রশস্ত হাসে।অন্যদিকের মানুষটা অনেকক্ষণ চুপ থেকে শেষটায় গম্ভীর হয়ে বলে,’হাই সেনোরিটা কেমন আছ?’

নবনীতা হাসিমুখে জবাব দেয়,’ভালোই আছি।আসুন,ভেতরে আসুন।’

আরহাম ভেতরে এলো।চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসল।মিসেস রোকেয়া পানির জগে হাত দিতেই নবনীতা একটানে সেটা নিজের হাতে নিয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,’এটা আমি দিচ্ছি মামি।তুমি খাবার বেড়ে দাও।’

মিসেস রোকেয়া নিঃশব্দে রান্নাঘরে চলে এলেন।তার ভেতরটা কেন জানি জ্বলছে।এতো সুখে আছে পরী?এতো গুছিয়ে সংসার করছে?ঐ বড়লোক,পয়সাওয়ালা,ক্ষমতাধর ছেলেটা এতো মেয়ে ফেলে পরীর মতো সাধারণ আর ছাপোষা একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে?পরীর ঝুলিতেও আল্লাহ এতো সুখ জমা রেখেছিল?আশ্চর্য ব্যাপার!

পানি খাওয়া শেষ হতেই নবনীতা হাত বাড়িয়ে বলল,’দিন গ্লাস দিন।’
আরহাম গ্লাস দিলো না।উল্টা নবনীতার হাত ধরে একটানে তাকে নিজের উপর এনে ফেলল।নবনীতা আঁতকে উঠে বলল,’সর্বনাশ! মামি এক্ষুণি রান্নাঘর থেকে বের হবে।’

আরহাম সে কথা গায়ে মাখল না।উল্টা তার পিঠে হাত বুলিয়ে তার গালে নাক ঘষতে ঘষতে প্রগাঢ় স্বরে বলল,’তুমি নাকি কাল আমায় ভীষণ মিস করেছ?তাই চলে এলাম দেখা করতে।’

নবনীতা মুচকি হাসল।মাথা নামিয়ে নিচু স্বরে বলল,’হ্যাঁ করেছি।কিন্তু আপনি বলেছিলেন আপনি আর সংসার করবেন না আমার সাথে।সেটার কি হলো?’

‘সেটা আবেগের ঠেলায় বলেছি।সংসার করব না বলতে কোনো শব্দ নেই।বিয়ে হয়েছে,এখন সংসার করতেই হবে।ভালো লাগে না বলতে কিছু নেই।না লাগলে লাগাতে হবে।তবুও সংসার ছাড়া যাবে না।’

মিসেস রোকেয়ার উপস্থিতি টের পেতেই নবনীতা ছিটকে দূরে সরে এলো।পাঁচ মিনিট পর শুভ্রাও কলেজ আর কোচিং শেষ করে বাড়ি এসে পৌছুলো।নবনীতা চিত্রাকে ডেকে খাওয়ার টেবিলে বসাল।প্রথা এখনো ভার্সিটি থেকে আসেনি।সে ইদানিং সময় মতোই বাড়ি ফিরছে।কয়দিন এমন সুন্দর ভাবে থাকবে কে জানে! নবনীতার আবার তাদের বেশি ভালো রূপটাও হজম হচ্ছে না।

গত পরশু সকালে সে হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে।তারপর বাড়িতে আসার পর থেকেই সে সাংঘাতিক রকমের যত্ন ভালোবাসা পাচ্ছে।মিসেস রোকেয়ার যত্ন দেখলেই তার চোয়াল ঝুলে যায়।মন চায় সাহস করে একদিন বলেই দিতে,’মামি তুমি এখনো অভিনয়ের জন্য অডিশন দিচ্ছো না কেন?দিলে তুমি নির্ঘাত সিলেক্ট হয়ে যাবে।’

আজকেও একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।সবাইকে খাবার বেড়ে দেওয়ার পর মিসেস রোকেয়া নিজ হাতে চিত্রাকে ভাত মেখে খাওয়ালেন।নবনীতা যদিও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি,কিন্তু শুভ্রা এই দৃশ্য দেখতেই পলক ফেলা ভুলে গেল।দেখার পর থেকে সেই যে সে মুখ খুলেছে আর বন্ধ করার নাম নেই।নবনীতা আলতো করে তার মাথায় একটা গাট্টা মেরে ধমক দিলো,’মুখ বন্ধ কর শুভি।’

শুভ্রা সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ করল।মিসেস রোকেয়া ডাল আনার জন্য আবার রান্নাঘরে যেতেই শুভ্রা হড়বড় করে বলল,’এটা আমাদের মামি রোকেয়া?নাকি অন্য কারো সাথে অদল বদল হয়ে গেছে?আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না আপাই।’

নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসল।এক লোকমা ভাত মুখে তুলে খেতে খেতে বলল,’পাওয়ার অফ মানি শুভি।টাকাই সকল সুখের মূল বুঝেছিস?এজন্যই তো বলি,মন দিয়ে পড়াশোনা কর।প্রতিষ্ঠিত হয়ে টাকা পয়সা কামাই কর।তখন দেখবি জগতের সবাই তোকে কুর্নিশ করছে।’

****

খাওয়া শেষ হতেই নবনীতা তার ঘরে গেল।আরহাম আড়মোড়া ভেঙ্গে তার ঘরে এসেই ধাম করে বিছানায় গিয়ে পড়ল।নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’সমস্যা কি?আস্তে বসা যায় না?’

‘না,যায় না।’

আরহাম ফোন স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।নবনীতাকে তাড়া দিয়ে বলল,’চলো তো।তাড়াতাড়ি একটা সুন্দর শাড়ি পরে রেডি হও।এক জায়গায় যাবো আমরা।’

নবনীতা আশ্চর্য হয়ে জানতে চায়,’সেকি! কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘সেটা তো গেলে দেখতে পারবেন ম্যাডাম।এখন তাড়াতাড়ি রেডি হন।’

নবনীতাকে গভীর ভাবনায় ফেলে দিয়ে আরহাম আবার ফোন চালাতে মশগুল হলো।নবনীতা আলমারি খুলেই চিন্তায় পড়লো।এতো এতো শাড়ি! সে কোনটা পড়বে?

সে শেষ পর্যন্ত সাদা আর নীলের মিশেলে একটা শাড়ি বেছে নেয়।আলমারি বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেটাকে গায়ের উপর ফেলে দেখে।তারপরই পেছন ফিরে আরহামকে ডেকে বলল,’আরহাম! এটা সুন্দর না?’

আরহাম ফোন থেকে চোখ তুলে।গম্ভীর হয়ে বলে,’হুম সুন্দর।’

শাড়ি পরতে নবনীতার সময় লাগলো মাত্র ছয় মিনিট।যেহেতু এটা সিল্কের শাড়ি না,তাই অন্য কেউ কুচি ধরার প্রয়োজনও নেই।সে নিজে নিজেই পুরোটা শাড়ি পরল।তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুল টেনে তাড়াহুড়ো করে সেখানটায় বসল।তার সামনে ড্রেসিং টেবিল ভর্তি জিনিস।সে যেদিন হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ হয়েছে,সেদিন বিকালেই একজন ডেলিভারি ম্যান এসে এসব দিয়ে গেছে।নবনীতা তাজ্জব হয়ে জানতে চায় এসব কে পাঠিয়েছে?ডেলিভারি ম্যান জানাল শাহরিয়ার আরহাম আগেই সবকিছুর পিল পে করে দিয়েছেন।

নবনীতা একেবারে অল্প সাজলো।তবে একদমই প্রসাধনীমুক্ত থাকলো না।জামাইয়ের সাথে ঘুরতে গেলে একটু আধটু সাজাই লাগে।নয়তো এতোগুলো জিনিস কি ডেট এক্সপায়ার্ড হয়ে নষ্ট হবে নাকি?

সে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখল আরহাম তার একদম পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।সে কিছুটা হকচকায়।আরহাম তাকে দেখেই নিজের পকেট থেকে কয়েকটা নেতিয়ে পড়া বেলি ফুল বের করে তার সম্মুখে বাড়িয়ে দিলো।নবনীতা বোকা বোকা হয়ে ফুলগুলো দেখে।আরহাম শুরুতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।পরে সমস্ত জড়তা কাটিয়ে গাঢ় স্বরে বলে উঠে,’শুভ্রা বলছিল তোমার নাকি বেলি ফুল ভীষণ পছন্দের?তাই বাগান থেকে তুলে নিয়ে এসেছি।এখন আবার বলবে না এগুলার এমন বেহাল দশা কেন।পাঞ্জাবির ভেতরে চাপা পড়ে এই অবস্থা হয়েছে।নাও তোমার কাছে রাখো এগুলা।

নবনীতা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকায়।আরহাম দ্রুত তার হাত টেনে ধরে সবগুলো ফুল তার হাতের মুঠোয় গুজে দিলো।তারপর চোখ তুলে নবনীতাকে দেখতেই সে থতমত খেল।তাজ্জব হয়ে বলল,’সেকি! তোমার চোখ এমন পানিতে টইটম্বুর কেন?তুমি কাঁদছ?কি সর্বনাশ! ফুল নেতিয়ে গেছে দেখে তুমি কাঁদছ?তুমি,,,’

সে কথা শেষ না করতেই নবনীতা আচমকা এক কদম সামনে এসে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল।সেই হাতের বন্ধন এতোই সুদৃঢ় ছিল যে কিছু সময়ের জন্য আরহাম নিজেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।সে রোবটের মতো সটান দাঁড়িয়ে রইল কতোক্ষণ।পরে যখন হুশ হলো,তখন তার চেয়েও জোরালভাবে সে তাকে জড়িয়ে ধরল।আদুরে গলায় বলল,’কি হয়েছে পরী?কাঁদছ কেন বলো তো।’

নবনীতা তার বুকে নিজের মাথা টা চেপে ধরেই শব্দ করে হেসে ফেলল।কান্না মুছতে মুছতে মিষ্টি স্বরে বলল,’আমাকে কখনও কেউ এভাবে ফুল দেয় নি আরহাম।কখনো কেউ এমন করে যত্ন করেনি।সত্যি বলছি।আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমার জীবনেও যত্নের মতো সুন্দর বিষয়টি এসে গেছে।আমার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না।’

সে এভাবেই কতোক্ষণ তার স্বামীর বক্ষস্থলে মিশে রইল।শেষটায় বাচ্চা বাচ্চা গলায় ডাকল,’আরহাম! ও আরহাম!’

আরহাম স্মিত হেসে বলল,’জ্বী ম্যাডাম বলুন।’

‘আপনি এমনই থাকবেন প্লিজ।ঠিক আছে?’

আরহাম আরো একদফা হাসল।নবনীতার মুখটা দুই হাতের আজলে নিয়ে তার দুই চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বলল,’ওকে বস।এমনই থাকব।তুমিও এমনই থেকো।শুধু ঝগড়া একটু কম করো কেমন?’

নবনীতা মাথা নামিয়ে লাজুক হাসল।ক্ষীণ স্বরে বলল,’দেখা যাক।’

আজ তার মন মাত্রাতিরিক্ত ভালো।সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাড়ি এসেই সবার প্রথমে সে ডায়রি খুলে বসবে আর চটপট সেখানে নতুন করে যোগ করবে-

★সে আমার জন্য বাগান থেকে এতোগুলা বেলি ফুল পেড়ে এনেছে।ওহহ হ্যাঁ,সে আজ আমার চোখের পাতায় চুমু খেয়েছে,শেষে আবার কপালেও।কে বলে প্রথম ইম্প্রেশনই সব?আমি সেই আহাম্মকের গুষ্টি মা’রি।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৬

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৬)

সকাল হতেই ডিউটিরত নার্স নবনীতার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে কেবিনে এলেন।আরহাম তখনও নবনীতার শিয়রে বসে চুপচাপ তাকে দেখছিল।কেবিনে নার্স আসতেই সে নড়েচড়ে বসে।দ্রুত পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে আনমনে তার উপর স্ক্রল করে।নার্স নিশ্চয়ই ভাবছে সে তার বউয়ের প্রেমে মাতোয়ারা।এখন তাকে এমন একটা ভাব নিতে হবে যেন নার্সের মনে হয় বউয়ের দিকে তার কোনো মনোযোগই নেই।সে তো বউকে দেখছে না,সে দেখছে ফোন।

আনুমানিক সাতটা নাগাদ সে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো।হাসপাতালের প্রশস্ত করিডোর তখন জনমানবশূন্য।কেউ নেই আশেপাশে।শুধু ডাক্তার আর নার্সরা একটু পর পর হেঁটে হেঁটে নিজেদের কেবিনে যাচ্ছিল।আরহাম কয়েক দফা হাই তোলে।করিডোরে রাখা চেয়ারগুলোর একটিতে বসে মাথা নামিয়ে কতোক্ষণ ঝিমায়।

হঠাৎ তার মনে হলো সে বাদেও এই করিডোরে আরো কেউ আছে।সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলল সে।পাশ ফিরতেই দেখল করিডোরের শেষ মাথায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।তার পা দু’টো দেখা যাচ্ছে।আরহাম সাথে সাথে চোখ তুলে উপরে তাকায়।তাজ্জব হয়ে আবিষ্কার করে মহিলাটির পরিচয়।

মা শব্দটা বড়ই অদ্ভুত।কেবল একটা অক্ষর,অথচ কতো গভীরতা মেশানো এই শব্দে।আরহামের জীবনেও তো মা শব্দটা কম অর্থপূর্ণ না।মা তাকে বাস্তবতা শিখিয়ে গেছে।মা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সব মা-ই মমতাময়ী হয় না।তার কাছে তো আরহাম গোটা এক জীবনের শিক্ষা পেয়েছে।

আরহাম দুই হাত মুঠ করে উঠে দাঁড়ায়।তার দুই চোখ হঠাৎই দপ দপ করে অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠেছে।কপালের রগগুলো তার অনিচ্ছায় ফুলে ফেপে যাচ্ছে।দাঁত কিড়মিড় করছে,হাত নিশপিশ করছে।কেন এই মহিলা বারবার সামনে আসছে?কেন তাকে দুই দন্ড শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না?কেন তাকে বাধ্য করছে সীমা লঙ্ঘন করতে?

সে সামনে আগায় না।কেবল দূর থেকেই দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’এদিকে কি?দূরে যাও।’

তাসলিমা দ্বিধান্বিত হয়ে দুই পা সামনে বাড়ায়।কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই আরহাম দুই হাত কানে চেপে চেঁচায়,’কাছে আসবে না।দূরে যাও।অসহ্য লাগে আমার তোমাকে।’

তাসলিমা সেখানেই থেমে গেলেন।আর সামনে আসার চেষ্টা করলেন না।শুধু কাঁপা স্বরে ডাকলেন,’আরহাম! আমার বাবা!’

আরহাম দুই পা পেছায়।হঠাৎই তার কন্ঠস্বর পাল্টে যায়।কানে হাত চেপেই সে নরম গলায় বলে,’প্লিজ তুমি যাও।ভালো লাগছে না আমার।’

তাসলিমা গেলেন না।তবে ব্যথিত গলায় বললেন,’অনেক কষ্টে এই পর্যন্ত এসেছি বাবা।বাড়িতে মিথ্যা অযুহাত দিয়েছি।তুমি আমাকে এখন তাড়িয়ে দিবে?আমি তোমার মা।’

আরহাম একহাত মাথায় চেপেই দুর্বল গলায় বলল,’আমি উল্টাপাল্টা কিছু করে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করতে চাই না।যাও এখান থেকে।মাথা গরম করবে না আমার।’

তাসলিমার হঠাৎ রাগ হলো।মনঃক্ষুন্ন হলো ভীষণ।ছেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে এমন রূঢ় আচরণ করছে?তিনি এগিয়ে আসতে আসতে কন্ঠে জোর দিয়ে বললেন,’তুমি আমাকে এভাবে তাড়াতে পারো না আরহাম।আমি তোমাদের মা।তুমি আমার দু’টো ছেলেমেয়ে কে আমার থেকে দূরে সরাতে পারো না।তাদের দেখার অধিকার আমার আছে।তুমি আর কত বছর ধরে তাদেরকে তাদের মায়ের কাছ থেকে দূরে রাখবে?এটা কি অন্যায় না?’

‘অন্যায়?তোমার মুখে তুমি ন্যায় অন্যায়ের কথা বলছ?তোমার কি লজ্জা শরম কিছু নেই?’ চমকের পিলে প্রশ্ন করে আরহাম।সে টের পাচ্ছে তার দুর্বলতা কেটে যাচ্ছে।সেই জায়গায় একটু একটু করে ক্রোধ এসে জমা হচ্ছে।অতীতের জ’ঘন্য স্মৃতি সব মাথাচারা দিয়ে উঠছে।নির্ঘুম থাকার দরুণ ঈষৎ লাল হয়ে থাকা চোখজোড়া হঠাৎই ক্রোধানলে জ্বলে উঠে রক্তিম আভা ধারণ করল।আরহাম চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল,’নির্লজ্জ হওয়ারও একটা সীমা থাকে।তুমি সেই সীমাও পার করে ফেলেছ।তুমিই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছ।এখন এসব কেন করছ?ভাল্লাগে না এসব।যাও তুমি।’

তার ফুঁসতে থাকা মুখটা দেখেই তাসলিমার দুইচোখ ভরে এলো।এতো ঘৃণা তার জন্য?এতো ভৎসনা দুই চোখে?তিনি একটু দম নিলেন।ভগ্ন কন্ঠে বললেন,’তুমি,আরিশ আর তাসনুভা আমার সন্তান।এই সম্পর্ক তুমি অস্বীকার করতে পারবে?আরিশ আর তাসনুভার মাথে তুমি আমার দেখা করতে দাও না।কতোখানি পা’ষাণ হয়েছ তুমি একবার দেখেছ?’

আরহাম তার কথা শুনেই শব্দ করে হেসে ফেলল।সেই তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে মেখেই বলল,’আমি পা’ষাণ?তুমি আমাদের ছেড়ে গিয়েছ।আমরা তোমায় ছাড়ি নি।আমার বোনের এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ী।আমাদের জীবনের এই ছন্নছাড়া অবস্থার জন্য তুমি দায়ী।আমাদের এতো অপমান,এতো হেনস্তা,এতো যন্ত্র’ণা সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী।আমাদের আর তোমাকে প্রয়োজন নেই।তুমি যাও।আমার মেজাজ খারাপ হওয়ার আগে তুমি যাও।’

‘যাব না।দেখি তুমি কি করতে পারো।আমি দেখতে চাই আমার সন্তান ঠিক কতোখানি হিংস্র হতে পারে।’

তাসলিমা ঠিক তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।দুইজনের দৃষ্টি মিলতেই আরহাম দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়।সমস্ত শরীর গিজ গিজ করছে।অসহ্য লাগছে সবকিছু।মা কে প্রহার করা কি মহাপাপ?হয়তো।আরহাম তো এমন কিছু করতে চায় না।কিন্তু এই মহিলা কেন সামনে আসে বারবার?সে সামনে আসলেই আরহাম অনুভব করে সে আসলে কোনোদিনই অতীত ভুলতে পারেনি।ঐ এক জায়গায় আরহাম বারবার আটকে যায়,সবকিছু থমকে যায়।মহিলাটা কাছে এলেই সে দমে যায়।একমুহূর্তে রাগ হলে পরমুহূর্তেই আবার অন্যরকমের দুর্বলতা জেঁকে ধরে তাকে।সে মাথা নামিয়ে হসপিটালের ফ্লোর দেখে।দুই হাত মুঠ করে চাপা স্বরে বলে,’প্লিজ।তুমি যাও।যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফিরে যাও।আমি নিয়ন্ত্রণ হারাতে চাই না,পরিবেশ নষ্ট করতে চাই না।তুমি যাও।কক্ষনো কোনোদিনও সামনে আসবে না।প্লিজ,এবার আমাদের একটু শান্তি দাও।’

তাসলিমা ছলছল চোখে তাকে দেখে।হাত তুলে দুই চোখ মুছেন।ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠেন,’মা অপরাধ করেছি।সেই জন্য তুমি অনেক বছর অভিমান করেছ আরহাম।মা কে শাস্তি দিয়েছ।তোমাদের কাছেও আসতে দাও নি।যন্ত্রণা কি আমার কম হয়েছে তোমাদের ছাড়া?এবার অন্তত সব ভুলে যাও বাবা।মা কে একটু তোমাদের দেখার সুযোগ দাও,একটু কথা বলার সুযোগ দাও।একটি বারের জন্য ক্ষমা করে দাও।’

ক্ষমা-সবটা কানে যেতেই আপনাআপনি চোখ বড় হয়ে উঠল তার।সে খানিকটা চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ক্ষমা?কিসের ক্ষমা?তোমাকে ক্ষমা করার আমি কে?তোমাকে যেই মানুষটা ক্ষমা করতে পারত সে একমাত্র আমার বাবা।বাবাই যখন আর বেঁচে নেই,তখন এই ক্ষমা দিয়ে আমি করব টা কি?আমি বেঈমান না।আমি আমার বাবার কষ্টগুলো ভুলিনি।আমি কোনোদিনই তোমাকে মানতে পারব না।আরিশ আর তাসনুভাকেও মানতে দিব না।তোমার ন্যাকা কান্না আমার অসহ্য লাগে।যাও তুমি এখান থেকে।’

তাসলিমা কান্না মুছতে মুছতেই একবার চোখ তুলে তাকে দেখলেন।তারপরই কি মনে করে একহাত বাড়িয়ে তার গালে রাখলেন।ব্যাস,এতেই খেই হারালো সে।চমকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাড়ায় তার হাত সরিয়ে নিল আরহাম।চাপা স্বরে গর্জে উঠে বলল,’একদম মে’রে ফেলব গায়ে ধরলে।’

‘আরহাম!’

‘রাগ উঠাবে না আমার।যাও এখান থেকে।’

তাসলিমার বদ্ধ ধারণা তার আদরের সন্তান কখনোই তার গায়ে হাত দিবে না।তিনি এগিয়ে এসে আরহামের মাথায় হাত ছোয়ালেন।তার মসৃণ চুলের ভাজে আঙুল চালালেন।আরহাম বিস্মিত হয়ে কয়েক পল তাকে দেখে।তারপরই তাসলিমার বদ্ধমূল ধারনা কে ভুল প্রমাণ করে সে চোয়াল শক্ত করে এক ধাক্কায় তাকে পেছনের দিকে সরিয়ে দেয়।

তাসলিমা সেই জোরাল ধাক্কায় তাল সামলাতে ব্যর্থ হয়ে মেঝের দিকে হেলে পড়লেন।পুরোপুরি নিচে পড়ার আগেই দু’টো হাত শক্ত করে তাকে চেপে ধরল।একটানে তাকে উঠে দাঁড় করালো।তাসলিমা পেছন ফিরে তাকে দেখেই জড়ানো কন্ঠে বললেন,’নওফেল! তুমি?তোমাকে না নিচে থাকতে বলেছিলাম?’

কিশোর ছেলেটা তার কথার জবাব না দিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকায়।তার শান্ত চোখ জোড়ার সাথে অন্যপাশের মানুষটার র’ক্তিম চোখজোড়া মিলতেই তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

আরহাম তাকে আগাগোড়া পরোখ করে।সাদা রঙের টি-শার্ট,ব্ল্যাক জিন্স,হাতে স্মার্ট ওয়াচ,গলার কাছে সানগ্লাস ঝুলানো,চুলগুলো খুব সুন্দর করে কেটে রাখা।একেবারে সাদামাটা হেয়ার কাট।চোখ দু’টো কার মতো?আরহাম বড়ো বড়ো শ্বাস টেনে একটা ঢোক গিলে।চোখ দু’টো আরিশের মতো।

সে এগিয়ে যায়।গলা খাকারি দিয়ে অত্যন্ত কর্কশ স্বরে চেঁচায়,’এ্যাই ছেলে! তোর মা কে নিয়ে এক্ষুনি বিদায় হ এখান থেকে।যা যা।গেট লস্ট।’

নওফেল স্থির চোখে আরো একবার তাকে অবলোকন করে।তারপরই ঠান্ডা স্বরে বলে,’আমার মা কেন বলছ?সে কি তোমার মা না?’

আরহাম অত্যাধিক খিটখিটে হয়ে ধমক দিলো,’ঐ শালা! তুই আমাকে সম্পর্ক শিখাবি?একটা থা’প্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিব।এইটুকু ছেলে আমাকে সম্পর্ক শেখাতে এসেছে! যা তোর মা কে নিয়ে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ।’

‘কেন?হাসপাতাল কি তুমি কিনে নিয়েছ?’

নওফেলের ত্যাড়া জবাবে আরহামের মেজাজ আরো বিগড়ায়।সে তেড়ে এসে কিছু বলার আগেই কোথা থেকে ওয়াজিদ ছুটে এসে ঠিক নওফেলের সামনে এসে দাঁড়াল।সে দাঁড়াতেই নওফেল আরহামের চোখের আড়াল হলো।আরহাম তাকে সরাতে সরাতে বলল,’দেখি সর তো ওয়াজিদ।এর সাথে আমি কথা বলছি।’

ওয়াজিদ তাকে জাপ্টে ধরল।পেছন ফিরে খানিকটা চঞ্চল হয়ে বলল,’নওফেল প্লিজ তুমি সোনা মা কে নিয়ে যাও এখান থেকে।প্লিজ।’

আরহাম তার দুই হাত সরাতে সরাতে খেকিয়ে উঠে বলল,’কিসের সোনা মা হ্যাঁ?বা’লের কথা বলছ।বা’লের আবেগ দেখাস। ঘোড়ার আ’ন্ডা সোনা মা আমার! বল তাসলিমা।ন’ষ্টা তাসলিমা।অন্য লোকের সাথে রঙ্গ তামাশা করা মহিলা।’

তাসলিমা দুই হাত মুখে চেপে দুই কদম পেছালেন।নওফেল ম্লান মুখে তার দিকে তাকায়।তারপরই আবার চোখ নামিয়ে নেয়।ওয়াজিদ একহাতে আরহামের মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে উঠে,’আরহাম স্টপ ইট ফর গড সেক।বাড়াবাড়ি করছিস।থাম।প্লিজ।এটা হসপিটাল।’

আরহাম থামল না।উল্টা ওয়াজিদের চেপে রাখা হাতের নিচ থেকেই মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে চেঁচাল।তার কথা ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছিল না।ওয়াজিদ তাকে জাপ্টে ধরে অনুনয় করল,’প্লিজ ভাই পায়ে ধরি।এখনো তেমন লোকজন নেই।লোক জানাজানি হলেই আবার মিডিয়ার ঝামেলায় গিয়ে পড়বি।প্লিজ।অনুরোধ করছি তোকে।তুই থাম।’

নওফেল শক্ত করে তার মায়ের হাত চেপে ধরে।তারপরই কোনোদিক না দেখে সোজা হেঁটে যায় তিনতালার সিঁড়ির দিকে।সেই হাতটা সে ছাড়ল নিচে নেমে গাড়ির লক খোলার সময়।

প্রথমেই সে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে স্টিয়ারিং দখলে নেয়।তারপরই গাড়ির গ্লাস নিচে নামিয়ে তাসলিমাকে দেখে বলল,’মা দয়া করে গাড়িতে উঠে বসো।অনেক হয়েছে।’

তাসলিমা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় এদিক সেদিক দেখে ভঙ্গুর পায়ে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসে।বসেই ব্যাক সিটে গা এলিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে।নওফেল স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে পেছন ফিরে স্বাভাবিক হয়ে বলল,’মা,আই নো আরহাম লোকটা ভীষণ রুড।বাট আই ডোন্ট থিংক হি হ্যাজ ডান এনিথিং রং।লাইক তার জায়গা থেকে চিন্তা করলে আমার তাকে খুব একটা খারাপও লাগে না।মানে তুমি ভাবো,সে কিন্তু ভুল কিছু বলে নাই।তুমিই তো সব ছেড়ে বাবার কাছে এসেছিলে।তাহলে এখন কেনো তাদের কথা ভাবছ?ইজ ন্ট ইট সাউন্ডস সো উইয়ার্ড?কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে না বিষয়টা?’

নওফেল উত্তরের আশায় তাসলিমার মুখের দিকে তাকায়।অথচ তাসলিমার এলোমেলো দৃষ্টি গাড়ির বাইরের পার্কিং লটে।দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর চোখে কিছু একটা দেখছে।কিন্তু আসলে সে কিছুই দেখছে না।নওফেল বুঝতে পারল মা আর তার কথার জবাব দিবে না।সে আর ঘাটায় না।মা কে তার অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে হয়।মায়ের করা ভুল গুলো কি নওফেল উপলব্ধি করতে পারে না?পারে তো।অবশ্যই পারে।তার বয়স হচ্ছে।সে আর কচি বাচ্চা না।আশপাশের মানুষ যা বলবে তাই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার বয়স তার নেই।সে বড় হচ্ছে।ভালো মন্দ সে বোঝে।মা বাবার অন্যায়ও সে বুঝে।মা বাবা যেটা করেছে নওফেল ছোট বেলায় সেটাকে সমর্থন করলেও বয়স বাড়তেই সে উপলব্ধি করেছে এটা অন্যায়।স্পষ্ট অন্যায়।শাহরিয়ার আরহামকে তার একটা সময় অসহ্য লাগতো।মনে হতো এই ছেলের জন্য মা এতো কাঁদে! অথচ এখন আর তার তাকে অসহ্য লাগে না।উল্টো মনে হয় তার এমন ঘৃণা করাটাই কি স্বাভাবিক না?মায়ের এমন হাউমাউ কান্নাও এখন তার কাছে স্রেফ প্রকৃতির প্রতিদান বলে মনে হয়।মা অনেক গুলো মানুষকে কাঁদিয়েছে।এখন প্রকৃতি মাকে কাঁদাবে।এটাই তো নিয়তি।এতে এতো মন খারাপের কি আছে?
.
.
.
.
আদি ঘুম থেকে উঠে খুব বেশি সকালে।ভোরের সাথে সাথে।তারপরই বাগানে গিয়ে কতোক্ষণ বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলে।তার দেশে আসার পর টাইমজোন নিয়ে ভীষণ সমস্যা হচ্ছে।আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের প্রায় ১১/১২ ঘন্টা সময়ের ব্যবধান।আদি যখন ঘুমায়,তারা তখন সজাগ।আবার সে যখন সজাগ,তারা তখন ঘুমে।এজন্য ইদানিং সে খুব ভোরে ভোরে উঠে।তারপরই ঘন্টা লাগিয়ে ফোনে কথা বলে।

তাসনুভা এই বিষয়টা অনেকদিন যাবত খেয়াল করছে।সে সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই মদিনা খালাকে বেল বাজিয়ে তার ঘরে ডাকল।সে ঘরে আসতেই মিষ্টি হেসে বলল,’খালা আমাকে একটু হুইলচেয়ারে বসিয়ে দাও না প্লিজ।’

মদিনা হাসিমুখেই তাকে ধরে ধরে চেয়ারে বসায়।তাসনুভা ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় যায়।বারান্দায় যেতেই তার চোখ যায় বাগানে।আদি বাগানের এক ধারে মাটিতে বসে ফোনে কথা বলছে।তার একহাত ফোনে,অন্যহাতে সে একটার পর একটা ঘাস ছিঁ’ড়ছে।

তাসনুভা গলা উঁচিয়ে ডাকে,’ভাইয়া,ও ভাইয়া!’

আদি ফোন কানে চেপেই মাথা তুলে উপরে তাকায়।ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,’কি ভাইয়া?’

‘এতো সকালে বাগানে কি করো?’

আদি ফোনটা কানের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে গলা খাঁড়া করে বলল,’বাড়ির ফোন।কথা বলছি।’

তাসনুভা শুনতে পেরেই মাথা নাড়ল।চটপটে স্বরে বলল,’ওহ আচ্ছা বুঝেছি।’

আদি আরো আধঘন্টা কথা বলল।তাসনুভা ঘরে এসে তার এলোমেলো চুল গুলো আঁচড়ে সুন্দর করে দু’টো বেণী করল।হাত মুখ ধুয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা বই হাতে নিল।কাগজে কলমে এখন সে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন।উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর সে আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেয়নি।নিতে ইচ্ছেও হয়নি।এই হুইলচেয়ারে করে রোজ রোজ নিচে নামা,তারপর গাড়িতে উঠা,তারপর গাড়ি থেকে নেমে আবার হুইলচেয়ার,তারপর আবার ক্লাসে যাওয়া।সবকিছু মিলিয়ে তার প্রচন্ড ক্লান্ত লাগে।সে ঘরে থেকেই টুকটাক বই পড়ে।ফিকশন তার খুব ভালো লাগে।ইংলিশ ড্রামার উপর লেখা বইও তার ভীষণ প্রিয়।তার সবচেয়ে পছন্দের ড্রামা ম্যাকবেথ।এই নিয়ে বহুবার সে এটার লিখিত বই পড়েছে।আজও সে কি মনে করে সেই বইটাই হাতে নিল।আদি বেশ ব্যস্ত পায়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিল।যাওয়ার পথেই অন্যমনস্ক হয়ে তাসনুভার ঘরের দিকে চোখ যেতেই সে থামল।দ্রুত দুই কদম পিছিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখল।

বারান্দার পর্দা গুলো হালকা বাতাসে উড়ছে।ভোরের অল্প আলোতে পুরো ঘর আলোকিত হয়েছে।হিমেল বাতাসের ঝাপটা তাসনুভার মুখে এসে লাগছে।সে মনোযোগী হয়ে বই পড়ছে।আদি তাকে ডাকতে গিয়েও আর ডাকল না।সে ভাবছে সে তার অজান্তেই তার একটা ছবি তুলবে।ক্যান্ডিড ছবি যাকে বলে।পরে তাসনুভার জন্মদিনে সেটা বাঁধাই করে তাকে গিফট করবে।আইডিয়াটা মাত্রই তার মাথায় এসেছে।

সে দ্রুত ক্যামেরা অন করে চটপট তার কয়েকটা ছবি তুলে নিল।ছবিগুলো তার মনঃপুত হয়েছে।প্রথম দেখাতেই ভালো লাগছে।ছবি তোলে শেষ হতেই সে ভেতরে উঁকি দিয়ে গলা খাকারি দেয়,’হেই বাচ্চা! আসি?’

সঙ্গে সঙ্গে চোখ তোলে তাসনুভা।উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,’এসো এসো।’

আদি এক পা ভেতরে আসতেই তাসনুভা আগ বাড়িয়ে বলল,’আজ হসপিটালে যাবে?’

‘হু।যাব বোধহয়।’

‘ভাবিকে কবে নাগাদ ডিসচার্জ করা হবে তুমি জানো?’

‘নাহ।সেটা বলতে পারছি না।’

তাসনুভা চটপটে হয়ে বলল,’তুমি জানো,ভাইয়া যে ভাবিকে বাড়িতে আনার প্ল্যান করছে?’

আদি ভ্রু কুঁচকায়।-‘তাই নাকি?’

‘হু।আমার তাই মনে হচ্ছে।’

আদি ফিচেল হাসল।মাথা নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল,’আসুক।বাড়িতে সব ব্যাচেলর।বউটউ আসলে মজাই হবে।কি বলো?’
.
.
.
.
বাংলায় প্রবাদ আছে-দুধের মাছি।অর্থাৎ সুসময়ের বন্ধু।কিছু মানুষের আগমন হয় আমাদের জীবনের ভীষণ ভালো সময় গুলোতে।ভালো সময় ফুরিয়ে যেতেই তারাও ফুরিয়ে যায়।নবনীতার সুখী সংসারেও দু’টো দুধের মাছির আগমন হয়েছিল।সেটাও সে হসপিটালে থাকা অবস্থায়।

কোনো এক সকালে মিসেস রোকেয়া আর তার কন্যা প্রথা কাচুমাচু করে হাসপাতালের তৃতীয় তালায় এসে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল।আরহাম প্রথম দেখায় তাদের চিনতে পারে নি।যখন তারা পরিচয় দিলো,তখন সে ছুটে গেল তাদের কয়েকটা কথা শোনানোর জন্য।এরা কি আদৌ মানুষের কাতারে পড়ে? সাদেক সাহেবের মতোন একটা অসুস্থ মানুষকে ফেলে এরা কেমন করে চলে যেতে পারল?

সে কিছু বলতে পারে নি।ওয়াজিদ তাকে থামিয়ে নিয়েছে।ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলেছে হাসপাতালে তামাশা করার কোনো মানে নেই।আরহাম আর কিছু বলে নি।যদি কিছু বলারই হয়,তবে পরী বলবে।সে চুপচাপ করিডোরের এক কোণার চেয়ারে গিয়ে বসল।একটু পরে তার আবার বাইরে বের হতে হবে।

মিসেস রোকেয়া প্রায় দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করলেন।নবনীতার ঘুম ভাঙার পর তাকে কেবিনে ডাকা হলো।এই পুরাটা সময় তিনি দু’হাত কচলে সটান দাঁড়িয়ে থাকলেন,অপেক্ষা করছিলেন তার ঘুম ভাঙার।

তিনি আর প্রথা কেবিনে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আরহাম নিজেও বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।সে আজকে ফ্যাক্টরিতে যাবে।গত সপ্তাহে একবারো যাওয়া হয় নি।সে বের হওয়ার আগেই ওয়াজিদ তার কাঁধে হাত চাপল।মোলায়েম গলায় বলল,’মেজাজ ঠান্ডা রাখবি।ঠিক আছে?’

আরহাম একপেশে হাসল।মাথা নেড়ে জানাল,’ওকে ব্রো।যেমনটা তুমি বলবে।’

****

কাজ শেষ করে আরহাম ফিরেছে বিকাল নাগাদ।কেবিন পর্যন্ত যাওয়ার আগেই শিলা নামের একজন নার্স তাকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে বলল,’স্যার আপনি এসেছেন?ম্যাম সেই তখন থেকে আপনার খোঁজ করছে।’

আরহাম মাথা নামিয়ে ম্মিত হাসে।তারপরই গম্ভীর হয়ে জানতে চায়,’কেন?এনি প্রবলেম?শরীর খারাপ নাকি?’

‘না স্যার।তেমন কিছু না।মতিন স্যার একটু আগেই তার রিপোর্টস চেক করেছেন।সবকিছু ঠিকই আছে।’

আরহাম আর কথা না বাড়িয়ে সোজা ছয় নম্বর কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।কাঁচের দরজায় চোখ রাখতেই দেখল ভেতরে নবনীতা এক মনে নিজের হাত দেখে যাচ্ছে।

আরহাম ভেতরে ঢুকতেই সে কিছুটা চমকাল।তারপরই হম্বিতম্বি করে বলল,’একটা জরুরি কথা ছিল।’

আরহাম তার ঠিক সামনাসামনি বসল না।সে গিয়ে বসল রুমের এক পাশে থাকা কাউচে।বসেই কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করল,’আবার কি কথা?’

নবনীতা কতোক্ষণ ইতস্তত করল।তারপরই ক্ষীণ স্বরে বলল,’আজকে মামি আর প্রথা এসেছিল হসপিটালে।’

‘হু।এরপর?’

‘এরপর আর কি?মাফ টাফ চাইল।বলল মামার কথা নাকি মনে পড়ে খুব,আমাদের কথাও মনে পড়ে।ঐ বাড়িতে নাকি মন টিকে না।মামিরও দিন দিন শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।প্রথা,,,,’

‘মোদ্দাকথা,তোমার মামি আর তোমার বোন আবার তোমাদের কাছে ফিরে আসতে চায় তাই তো?’ মাঝপথে নবনীতাকে থামিয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করল আরহাম।

নবনীতা আস্তে করে উপরনিচ মাথা নাড়ে।মৃদুস্বরে জবাব দেয়,’জ্বী।সেটাই বলল।’

‘আর তুমি?তুমি কি বললে?’

নবনীতা আড়চোখে তাকে দেখে।ভাবুক হয়ে বলে,’সোজাসুজি কিছু বলিনি।আপনার ফ্ল্যাট।আপনাকে জিজ্ঞেস না করে বলতে ইচ্ছে হয় নি।আফটার অল আমি তো আপাতত চাকরি টা কন্টিনিউ করতে পারছি না।আপনিই তো সব খরচ দিচ্ছেন।আমি কেমন করে মামিকে থাকার অনুমতি দিব?’

আরহাম গম্ভীর হয়ে বলল,’এতো গভীরে গিয়ে ভাবার দরকার নেই।তোমার মন চাইলে রাখো।কি?তোমার মন চায়?’

নবনীতা ম্লান হেসে মাথা নাড়ে।নমনীয় স্বরে বলে,’আসলে মামির অনেক অনেক অন্যায় আছে।আমি জানি।কিন্তু মামি কখনো আমাদের তাড়িয়ে দেয়নি।মামির বাড়িতে খুব সুখে ছিলাম,তা না।কিন্তু মামি তো তার বাড়িতে জায়গা দিয়েছে।এই একলা শহরে ঐ ঠাই টাও মূল্যবান ছিল।রান্নাও তো সব মামিই করত।কতোগুলো বছর এক সাথে থেকেছি! মামি অমন করে কাঁদলো,আমার মায়া হচ্ছে ভীষণ।’

আরহাম অবাক হলো ভীষণ।চোখ বড় বড় করে বলল,’ডু ইউ রিয়েলি থিংক যে ঐ মহিলা মন থেকে কান্না করেছে?তুমি কি এতোই স্টুপিড?তোমার মনে হয় উনি সত্যিই এসব মন থেকে বলছেন?’

নবনীতা অবাক হলো এর চেয়েও বেশি।চোখে মুখে সেই আশ্চর্য ভাব ধরে রেখেই বলল,’আপনি কি করে জানেন মামি মন থেকে বলেছে নাকি অন্য উদ্দেশ্যে বলেছে?মামির সাথে তো আপনার দেখাই হয়নি।এর আগেই সে কেমন বুঝে গেছেন?’

আরহাম আশ্চর্য হয়।মেয়েটা তার থেকে কথা গোপন করছে।মামির বাড়াবাড়ি অন্যায় গুলো অতি সন্তর্পণে আরহামের কাছ থেকে আড়াল করে যাচ্ছে।অথচ সে কি জানে যে শুভ্রা আরো আগেই সবকিছু আরহাম কে বলে দিয়েছে?

নবনীতা অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে দেখতে দেখতে বলল,’আমি তো আর সবসময় ঐ বাড়িতে থাকতে পারব না।আপনার বাড়িতে যেতে হবে।তো তখন বাড়িতে কেউ তো একজন লাগবে যে রান্নাবান্না করবে।তাছাড়া মামির বাসাতে এতোবছর ছিলাম।মুখের উপর না তো করতে পারি না।মামার ওয়াইফ মামি।মামারও তো কথা বলার জন্য একজন মানুষ প্রয়োজন।অনেক কিছু একসাথে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি মামি আর প্রথা থাকলেই মনে হয় ভালো হবে।আর আমি জানি,মামি এই বাড়িতে থাকলে আর কোনো খারাপ আচরণ করবে না।’

‘কেন বলো তো?এতো গাট ফিলিং কি করে হচ্ছে তোমার?’

নবনীতা পাশ ফিরে আরহামকে দেখল।দেখতেই মুখে হাসি ফুটিয়ে ন্যাকা গলায় বলল,’কারণ আপনি যে আমার জামাই তাই।নবনীতাকে মামি পাত্তা না দিলেও আরহামের বউকে মামি ভীষণ পাত্তা দিবে,খুব বেশি যত্ন করবে।আমার অন্তত তাই মনে হয়।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৫

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৫)[প্রথম অংশ]

নোমান সাহেব রাতের খাবার শেষে কেবলই নিজের ঘরে পা রেখেছিলেন।তাসলিমা তখন খাট ঝেড়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।কালকের দিনটা তার জন্য বিশেষ।কাল একজন বাড়িতে আসবে।সে তাসলিমার ভীষণ ভীষণ প্রিয়।

নোমান সাহেব চোখের চশমাটা খুলে খাটের পাশের সাইড বক্সে রাখতেই কোথা থেকে আমেনা খাতুন তার ঘরের সামনে ছুটে এলেন।বন্ধ দরজায় কড়াঘাত করতে করতে চঞ্চল কন্ঠে চেঁচালেন,’নোমান দরজা টা খুলো।নিচে এসে দেখে যাও ঐ ছেলেটা আমার ফাহাদের কি অবস্থা করেছে।’

নোমান সাহেব ধড়ফড়িয়ে উঠলেন।এক দৌঁড়ে ছুটে গেলেন দরজার দিকে।তাসলিমা নিজেও চমকায়।ফাহাদের আবার কি হয়েছে?তাকে কিছু করার মতো দুঃসাহস কে দেখাবে?নোমান সাহেব আমেনা খাতুনের পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই তাসলিমাও দ্রুত তাদের অনুসরণ করলেন।দোতালার খোলা করিডোরে আসতেই নিচের দৃশ্য দেখে তার কদম শ্লথ হয়।থমকে যায় সবকিছু।চোখ গিয়ে আটকায় নিচতালার ওপেন স্পেসে দাঁড়ানো সুঠাম দেহী যুবকের দিকে।

আরহাম একহাতে ফাহাদের কলার ধরে তাকে টানতে টানতে তার বাড়ির ভেতর এনেই সজোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারল।ফাহাদ নিভু নিভু নিস্তেজ চোখে একবার মাথা তুলে তাকে দেখার চেষ্টা করল।তার মুখ দিয়ে থেমে থেমে একটু পর পর র’ক্ত বের হচ্ছে।সারা শরীরে ধুলো মেখে নোংরা হয়ে আছে।

আমেনা খাতুন সিঁড়ি থেকে নেমেই আবারো ছুটে গেলেন সেদিকে।কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ ফুলে গেছে।খালেদ সাহেব আজ বাড়ি নেই।জরুরি কাজে শহরের বাইরে গিয়েছেন।এমন একটা দিনে আজিজ হোসেনের রগচটা ক্ষেপাটে ছেলেটা তার ছেলেকে মা’রতে মা’রতে অর্ধমৃত করে তার বাড়ির দুয়ারে এনে ফেলেছে।ছেলেটার চোখের হিংস্রতা দেখেই আমেনা মিইয়ে গেলেন।কি জ্বলজ্বলে আর র’ক্তিম দু’টো চোখ! যা থেকে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে আগ্নেয়গিরির লাভা।

আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যায়।মাটিতে হাত পা ছেড়ে লুটিয়ে পড়া যুবকটির কলার টেনে তাকে কোনোরকমে উঠে বসায়।তারপরই তার পুরো বাড়ির লোকের সামনে ঠাটিয়ে তার দুই গালে পর পর দু’টো চড় মারে।আমেনা বেগম আঁতকে উঠেন।ছুটে গিয়ে মেঝেতে বসে দুই হাতে ফাহাদ কে জড়িয়ে ধরেন।অনুনয় করে বলেন,’ছেড়ে দাও বাবা।আর মেরো না।ম’রে যাবে আমার ছেলেটা।’

আরহাম ক্ষেপাটে সুরে গর্জন তুলে,’ম’রে যাক।আমার কি?মর’লে একটা আবর্জনা দূর হবে।’

নোমান সাহেব আশ্চর্য হয়ে তার কাজকর্ম দেখে।কতোখানি বেপরোয়া হলে একটা ছেলে তার প্রতিপক্ষকে তারই বাড়িতে এসে মারতে পারে! তিনি এগিয়ে যান।গলা খাকারি দিয়ে জোর গলায় ধমকে উঠে বলেন,’এসব কি?এটা একটা একটা ভদ্র মানুষের বাসা।রাত বিরাতে এসব কি শুরু করেছ তুমি?’

আরহাম তার কন্ঠ শুনতেই সেদিকে তাকায়।তার শানিত আর রক্তিম চাহনি দেখেই নোমান সাহেব কিছুটা ভড়কে গেলেন।তাসলিমা নিশ্বাস বন্ধ করে সিঁড়ির কিনারায় এসে দাঁড়ান।আরহাম ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুখ খিঁচে গালি দেয়,’ঐ কু’ত্তার বাচ্চা! তোর মতো কু’ত্তা এখন আমাকে ভদ্রলোকের সংজ্ঞা শেখাবে?তুই কোথাকার ভদ্রলোক হ্যাঁ?’

নোমান সাহেব তার এক কথাতেই দমে গেলেন।অপমানে আর লজ্জায় দ্রুত মাথা নামিয়ে নিলেন।চোরা চোখে একবার এদিক সেদিক দেখলেন।বাড়ির বাকি সদস্যদের দৃষ্টিও তার দিকে।বাড়িভর্তি লোকের সামনে ছেলেটা তাকে নির্দ্বিধায় যা নয় তাই বলছে।জনাব আজিজ হোসেনের নম্রতা ভদ্রতার ছিটেফোঁটাও তার মাঝে নেই।

আরহাম তার লজ্জিত মুখটা দেখেই পৈশাচিক আনন্দ পায়।তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠে বলে,’অন্যের বউ নিয়ে সংসার করিস।তুই আবার আমাকে ভদ্রতা শেখাস?তা কোন ভদ্রলোক অন্যের বউকে নিয়ে সংসার পাতে আমাকে একটু বল তো।শা’লা নিজেও চরিত্রহীন আর ভাতিজাও হয়েছে একটা চরিত্রহীন।দুই বিয়ে করেছে,তার মাঝে একটাও টিকে নাই।টিকবে কেমন করে?এমন নষ্ট বাড়িতে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে সংসার করতে পারে?যতোসব নষ্টা মানুষের আখড়া!’

নোমান সাহেব দাঁতে দাঁত পিষে তাকে সাবধান করল।রাগত স্বরে কঠিন গলায় বললেন,’চুপ করো তুমি।তুমি যে চরম বেয়াদব আর বেপরোয়া সেটা আমি জানি।নিজের আচরণে আর সেটা প্রমাণ করতে হবে না।ফাহাদ কে কেন মেরেছ তুমি?ক্ষমতা পেয়েছ বলে যা খুশি তাই করবে নাকি?’

‘হ্যাঁ,যা খুশি তাই করব।তুই পারলে ঠেকা।আর তোর ভাতিজা কে বলবি পরের বার যদি আমার বাড়ির কারো দিকে হাত বাড়ায়,তাহলে এই শরীরটা আর শরীরের জায়গায় থাকবে না।কে’টে কু’চি কু’চি করে বুড়িগঙ্গায় ভাসাব।জারজ বেজন্মা কোথাকার! আমার ঘরের দিকে হাত বাড়ায়।কত্তো বড় কলিজা!’

আরহাম চিবিয়ে চিবিয়ে তার ক্রোধটুকু ঢেলে দিয়েও ক্ষ্যান্ত হয় না।একবার বড় করে শ্বাস নিয়েই পুনরায় কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠে,’আমি আজিজ হোসেন না।তার মতো নমনীয় আচরণ আমার থেকে আশা করবি না।আমি কোনো দয়ার ভান্ডার না।আরেকবার আমার পরিবারের দিকে হাত বাড়াবি,তো সব কয়টা কে জুতা পেটা করব।শা’লা ইতরের দল!’

তাসলিমা কাঁপতে থাকা শরীরে দুই ধাপ নিচে নেমে এলেন।আরহাম অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক চোখ নিতেই তার সাথে তার চোখাচোখি হলো।তাসলিমা সঙ্গে সঙ্গেই ঝর ঝর করে কেঁদে দিলেন।

আরহাম শান্ত হলো।স্থির দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকে দেখল।থেমে থেমে বড় করে দু’টো শ্বাস নিল।দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা নামিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।নিজেই মনে মনে বলল,’দুর্বল হবি না আরহাম।প্লিজ দুর্বল হবি না।এই মহিলার সামনে তুই দুর্বল হবি না।’

আরহাম আবারো সামনে তাকায়।তাসলিমা হেঁচকি তুলতে তুলতেই আরো দুই ধাপ নেমে এলেন।আরহাম ফ্যালফ্যাল করে কতোক্ষণ তাকে দেখে।তারপর দেখে তার পোশাক।এটা কি পরেছে?শাড়ি?অথচ বাবা তাকে কতো বলত শাড়ি পরতে।সে বছরে ছ’মাসে একবার পরত।শাড়ি নাকি ওল্ড ফ্যাশন।এখন কেমন করে শাড়ি পরছে?এখন সেটা ওল্ড হয়নি?

আরহাম আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না।কিছুক্ষণ আগের আবেগ অনুভূতি সব মাটিচাপা দিয়ে সে এক দলা থুথু মেঝেতে ফেলল।তারপরই তাসলিমার দিকে একটা ভৎসনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সাথে সাথে এক প্রকার ছুটে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।

গাড়িতে বসেই সে দুই হাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে কতোক্ষণ সেখানে মাথা ঠুকল।এই মহিলাকে দেখলে তার এমন পাগল পাগল লাগে কেন?কেন সে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়?এতো বছরেও কি সে তাকে পুরোপুরি ঘৃণা করতে পারে নি?এখনো কি মনের গহীনে কোথাও তার প্রতি আরহামের দুর্বলতা রয়ে গেছে?

রোকন একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল।আরহাম গাড়িতে বসতেই সে ছুটে এলো গাড়ির কাছে।ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইল,’সব ঠিক আছে ভাই?’

আরহাম উত্তর দিলো না।কেবল তড়িঘড়ি করে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে পেছনের সিটে গিয়ে বসল।তারপরই কতোক্ষণ নিরব থেকে শেষটায় ভারি গলায় বলল,’তুই ড্রাইভ কর রোকন।আমি করলে এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।’
.
.
.
.
শুভ্রা দীর্ঘসময় তার আপাইকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইল।নবনীতা কাঁপা কাঁপা হাতে তার মাথায় হাত বুলায়।জড়িয়ে আসা গলায় ধীরে ধীরে বলে,’আমি ঠিক আছি তো শুভি।এতো ভয় পাচ্ছিস কেন বল তো?’

শুভ্রা জবাব দেয় না।উল্টো নিজের শরীরটা আরো বেশি গুটিয়ে নেয়,ছোট্ট বেড়াল ছানার মতো টেনে টেনে আপাইয়ের শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ নেয়।যদিও এখন তার শরীরে কেবল ঔষধ আর স্যানিটাইজারের ঘ্রাণ মিশে আছে,তবুও সবকিছুকে ছাপিয়ে শুভ্রা তার পরী আপাইয়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে।

নবনীতা তার মাথায় একহাত রেখেই পাশ ফিরে চিত্রা কে দেখে।চিত্রা এখনো নবনীতাকে স্পর্শ করে নি।এমনকি তার খাটেও বসে নি।সে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশাপাশি,তার থেকে একটু দূরে।নবনীতা মিষ্টি হেসে তাকে কাছে ডাকল।

‘চিত্র! এ্যাই চিত্র! আপাইয়ের কাছে আসবে না?এসো এসো!’

চিত্র এক পা এগোয়।পিট পিট করে চোখের পাতা ফেলে রিনরিনে গলায় বলে,’তুমিই আমার আপাই?’

নবনীতা হাসে।হাস্যোজ্জ্বল মুখে জবাব দেয়,’জ্বী সোনা।আমিই তোমার আপাই।কেন?আমাকে কি আর চেনা যাচ্ছে না?’

চিত্রা তার দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো।একবার আগাগোড়া তাকে দেখে গম্ভীর হয়ে বলল,’তোমাকে মমি দের মতো লাগছে আপাই।’

নবনীতা তার কথা শুনেই খিলখিল করে কতোক্ষণ হাসল।একহাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে তার কপালে চুমু এঁকে বলল,’হ্যাঁ রে সোনা।আপাতত কিছু দিন মমি হয়েই থাকতে হবে।এখন বলো,তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?’

চিত্রা দুই দিকে মাথা নেড়ে প্রশস্ত হাসল।নবনীতার জীর্ণ বুকে ঝাপিয়ে পড়তে পড়তে চঞ্চল গলায় বলল,’না,একটুও পাচ্ছি না।’

শুভ্রা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নেয়।নিজের আর আপাইয়ের মাঝে চিত্রাকে জায়গা দিতে দিতে মেজাজ দেখিয়ে বলে,’এসেছে।সবকিছুতে ভাগ বসাতে এসে গেছে।’

নবনীতা দুই বোনকেই জড়িয়ে ধরল।শুভ্রা দরজার দিকে দেখতে দেখতে ভয়াতুর কন্ঠে বলল,’ডাক্তার অথবা নার্সরা যদি দেখে কথা বলতে এসে আমরা রীতিমতো খাটে উঠে শুয়ে গিয়েছি,তাহলে সব ক’টাকে রামধমক দিবে।’

নবনীতা স্মিত হেসে দুই জনের মাথায় হাত ছোঁয়ায়।গাঢ় স্বরে বলে,’কিচ্ছু হবে না।কেউ কিছু বলবে না।তোরা থাকলে আমি আরো দ্রুত সুস্থ হবো।’

মাতৃত্ব একটা অদ্ভুত বিষয়।যে গর্ভে ধারণ করে সে জননী,আর যে লালন পালন করে বড়ো করে সে মা।নারীস্বত্তার চমৎকার দিকগুলোর একটি হলো মেয়েরা জননী না হয়েও মা হতে পারে।মেয়েদের মধ্যে অন্তর্নিহিত হিসেবে এই গুণটি উপস্থিত থাকে।পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটিও যখন দুই মাসের একটি বাচ্চাকে কোলে তোলার বায়না ধরে,তখনও তার মাঝে একটা অদ্ভুত মাতৃত্ব কাজ করে।মেয়েরা আক্ষরিক অর্থে মা হওয়ার আগেও বহুবার মা হয়।

নবনীতাও তার ব্যতিক্রম না।যেই দু’টো প্রাণকে ঘিরে তার জীবন আবর্তিত হচ্ছে,তাদের নিকট সে মায়ের চেয়ে কম কিছু না।আক্ষরিক অর্থে সে তাদের বোন।অথচ চিত্রা নামের ছোট্ট মেয়েটির নিকট আপাই আর মা শব্দটির মাঝে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই।তার জীবনে মা বলতে যেই স্বত্তাটি উপস্থিত তার নাম পরী।যে তাকে বুকে চেপে মানুষ করেছে,যে নিজে না খেয়ে তাকে খাইয়েছে,যে তার সব পছন্দের খেলনা কিনে দিয়েছে,যে নিজের এলোমেলো চুল ফেলে তার চুল বেঁধে দিয়েছে।যে নিজের ভাগের মজাদার খাবার টুকুও চিত্রাকে খাইয়েছে।মা কেমন হয় চিত্রা জানে না।কখনো জানতে ইচ্ছেও হয় নি।মা শব্দের যে সংজ্ঞা আছে,সেই সংজ্ঞার সাথে তো তার আপাইয়ের সংজ্ঞা মিলে যায়।তাহলে চিত্রা কেন মা কে খুঁজবে?তার তো আপাই আছে তাই না?

এই কয়টা দিন চিত্রা কোনোকিছু ভালো মতো খায়নি।হসপিটালের বেডে যেই মেয়েটা লাচার হয়ে পড়েছিল,সেই মেয়েটা খাইয়ে না দিলে চিত্রার কোনো খাবার মজা লাগে না,সে ঘুম না পাড়ালে তার ঘুম আসে না।এতোগুলো দিন পর চিত্রা তাকে পেতেই একেবারে আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে ধরল।বাচ্চা বাচ্চা গলায় বায়না ধরে বলল,’পরী! আজকে তুমি আমাকে খাইয়ে দিবে কেমন?

নবনীতা তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একগাল হেসে উত্তর দিলো,’অবশ্যই।আমার দুইটা কলিজার টুকরাকেই আজকে আমি খাইয়ে দিব।ডাক্তার যা খুশি বলুক।আমি আজ আমার বোনদের নিজ হাতে খাওয়াব।’

____

পরের দিন রাতে নবনীতার কেবিনে ছোট ছোট পা ফেলে একজন কিশোর উপস্থিত হলো।তাকে দেখেই নবনীতার দুই চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল।সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,’শাহাদাত তুমি?’

শাহাদাত শান্ত হয়ে আরো দু’পা সামনে আসে।তার চোখ মুখ স্বাভাবিক।তাকে একেবারে সুস্থ দেখাচ্ছে।সে এগিয়ে এসে নবনীতার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,’আপনে তাইলে আসমানের হুর না?’

নবনীতা ভড়কে গিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল,’কি?আমি কেন হুর হতে যাবো?’

‘প্রথম দিন আপনেরে দেইখা হুরই ভাবছিলাম।আপনে কোনো কারণ ছাড়াই আমারে টাকা দিসিলেন।এমনে তো মাইনষে অকারণে কেউ কারো লেগ্গা কিছু করে না।তাই।’

নবনীতা একগাল হাসে।পরক্ষণেই আবার চোখ মুখ শক্ত করে বলে,’লেগ্গা আবার কেমন কথা?বলো কেউ কারো জন্য কিছু করে না।’

শাহাদাত মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,’কেউ কারো জইন্য কিছু করে না।’

‘জইন্য না জন্য।’

‘জ্বে,জন্য।’

‘জ্বে না,জ্বী।’

শাহাদাত হাঁফ ছেড়ে বলে,’জ্বী।’

শুভ্রা আর চিত্রা কেবিনের একপাশের সোফায় বসে তার কথা শুনছিল।সে থামতেই শুভ্রা উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত চেপে বলল,’কি সর্বনাশ! এর আর এর বোনের উচ্চারণে তো ভয়াবহ সমস্যা।’

নবনীতা কড়া গলায় বলল,’এ্যাই শাহাদাত।তুমি এখন থেকে শুদ্ধ করে কথা বলবে বুঝেছ?’

‘জ্বে আফা।’

‘আবার জ্বে!’

‘জ্বী আফা।’

‘আফা না।বলো আপা।না না আপা না।বলো আপাই।বলো তো দেখি।’

শাহাদাত হাই তুলতে তুলতে জবাব দেয় আপাই।

রিমি এসেছে গুনে গুনে তিন মিনিট পরে।বরাবরের মতোই বিভা তার কোলে।সে কেবিনে এসেই শাহাদাত কে দেখে মৃদু হাসল।তারপর বিভাকে দেখে বলল,’কি বিভা?এটা কে?’

বিভা নিজের আঙুল নিজেই কা’মড়াতে কা’মড়াতে জবাব দেয়,’বাইয়া।’

রিমি বিরক্ত হয়-‘উহু,বাইয়া না মনা।বলো ভাইয়া।’

শাহাদাত এগিয়ে এসে তাকে কোলে নিল।অবাক হয়ে বলল,’বিভা এতো সুন্দর হইছে কেমনে?বিভারে বিদেশি বাচ্চাগো মতোন লাগতাছে।’

তার কথা শুনেই পেছন থেকে নবনীতা চাপা স্বরে ধমক দেয়,’লাগতাছে কি শাহাদাত?বলো লাগছে।’

শাহাদাত কাচুমাচু মুখ করে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকে দেখে।কি অদ্ভুত সমস্যা এসে জুটেছে তার ঘাড়ে! সে এতো শুদ্ধ কেমন করে বলবে?এই জীবনে সে কোনোদিন এতো শুদ্ধ বলেনি।তাও বস্তির বাকিদের তুলনায় সে কতো সুন্দর করে কথা বলে! তবুও এই সুন্দর আপাটার তার কথা পছন্দ না।সে সিদ্ধান্ত নিল যতক্ষণ সে তার সামনে থাকবে ততক্ষণ সে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে।কোনো শব্দই করবে না,না মুখ ফুটে কিছু বলবে।

রাত বাড়তেই নবনীতা এদিক সেদিক দেখে।আনমনেই একজনকে খুঁজে।সেই যে সেদিন বেরিয়েছে,এরপর আর একবারো তার কেবিনে আসেনি।এতো অদ্ভুত কেন মানুষটা?এক মুহূর্তে এতো বেশি যত্ন দেখিয়ে পরমুহূর্তেই এমন পাল্টে যায় কেন?এই তিনদিন নবনীতার কীভাবে কেটেছে,সে কেমন ছিল-একবারো কি এসব জানতে ইচ্ছে হয়নি তার?অথচ নবনীতার জ্ঞান ফেরার পর সে যেই যত্ন দিয়ে তাকে আগলে নিয়েছিল,পরের তিনটে দিন নবনীতা চাতক পাখির মতো সেই যত্নের অপেক্ষা করতো।অথচ মানুষটা একবারো এলো না।এসে অস্থিরতা দেখালো না।চঞ্চল হয়ে জিজ্ঞেস করল না হাই সেনোরিটা! কেমন আছ তুমি?

নবনীতার অভিমান হয়।অল্প স্বল্প কষ্টও হয়।এতো দায়সারা মানুষ হয়?সেদিনই তো বড় গলায় বলল কোনো ভয় নেই,সে আছে।তাহলে এই তিনটে দিন সে কেন এলো না?কেন তার উদ্ভট কাজকর্মে নবনীতার মন ভালো করে দিলো না?সে কি বুঝে না সে না এলে নবনীতার তার কথা মনে পড়ে?সেও তো নবনীতার পরিবার।সে নিজের মুখেই এ’কথা বলেছে।পরিবার ছাড়া যে নবনীতার ভীষণ একা একা লাগে এই কথা কি তার অজানা?

নবনীতা বড় করে দুই বার শ্বাস টানে।সে আর এসব ভাববে না।এতোকিছু ভাবার কি আছে?তাদের কোনো প্রেমের বিয়ে হয়নি যে জামাই তাকে চোখে হারাবে।যেই পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে,সেই তুলনায় সে ভালোই আছে।অন্তত সম্মানের সাথে বেঁচে তো আছে।এটাই অনেক।নেতা শ্রেণির লোকদের কাছ থেকে সে এর চেয়ে ভালো আর কি আশা করে?এরা হয়ই এমন হিপোক্রেট।

বার বার বোঝানো স্বত্বেও মন তার কথা বুঝে না।ঘুরে ফিরে বার বার তার মন খারাপ হয়ে যায়।তার কষ্ট হয়।কেমন খালি খালি লাগে।মনে হয় সব আছে,তাও কিছু একটা নেই।

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৫)[দ্বিতীয় অংশ]
[রিচেক নেই]

আকাশে এক ফালি চিকন চাঁদ মোহনীয় দ্যুতি ছড়াচ্ছে।চাঁদের আকার দেখে মনে হচ্ছে এর বয়স বেশিদিন হবে না।এক ফালি চাঁদ যেন উচ্ছ্বসিত তরুণীর প্রাণখোলা হাসির প্রতীক।

ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে বসে থাকা যুবক হাতে থাকা সিগারেটে শেষ টান দেয়।তারপরই সেটাকে মাটিতে ছুড়ে এক পা দিয়ে পিষে ফেলে।তারপর উদ্ভ্রান্ত চোখে আকাশ দেখে।এক ফালি চাঁদ আর তার সাথে অসংখ্য মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা।আরহাম কিছুক্ষণ আকাশ দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়।আনমনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বুকের বা পাশটা পোড়াচ্ছে ভীষণ।সেদিকে ঝড় হচ্ছে,কালবৈশাখীর তান্ডবে সবকিছু চুরমার হচ্ছে,অনুভূতির টানাপোড়েনে ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছে সে।সে হাতড়ে হাতড়ে পকেট থেকে একখানা ছবি বের করে।ছবিটা বেশ পুরোনো।গত সতেরো বছরে সে বহুবার রাগের মাথায় ছবিটা দুমড়ে মুচড়ে মুষ্টিবদ্ধ করেছে,পুড়ে ফেলতে চেয়েছে,ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছে।কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো এক অজানা কারণে সে ছবিটা ছিঁড়তে পারে নি।ছবিটা পাঁচজন মানুষের সুখী সংসারের ছবি।পাঁচটা প্রাণের একই ছাদের নিচে থাকার ছবি।

আরহাম একহাতে নিজের চুল টেনে ধরে।নিজেই কতোক্ষন নিজের হাঁটুতে কিল ঘুষি মা’রে।সে কেন অতীত থেকে বের হতে পারছে না?কেন সে একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে গেলেই পরমুহূর্তেই অনেক বেশি অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে?

আদি ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ায়।দুই হাতে তার কফির মগ।সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে।সে নিঃশব্দে এগিয়ে এসে আরহামের পাশটায় গিয়ে বসল।হাতের মগটা তার দিকে এগিয়ে দিলো।আরহাম পাশ ফিরে একবার মগটা দেখেই বিনা বাক্য ব্যয়ে সেটা হাতে নিল।

‘আরহাম!’

নিরবতা ছাপিয়ে আদির প্রথম সম্বোধন।

আরহাম তার দিকে না ফিরেই জবাব দেয়,’হু?’

‘কি হয়েছে ভাই?এই ক’দিন ধরে দেখছি।কেমন এলোমেলো হয়ে আছিস।কি হয়েছে?আমাকে বল।’

আরহাম জবাব দিলো না।কেবল সময় যেতেই নিচে দেখে আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

আদি তার কাঁধে হাত রাখে।নিরেট স্বরে প্রশ্ন করে,’তুই বলেছিলি ফাহাদের সাথে বাড়াবাড়ি করবি না।সেই তো বাড়াবাড়ি করলি।এভাবে কেউ কাউকে মা’রে?যদি ম’রে যায়?’

আরহাম এক ঝাড়ায় নিজের কাঁধ থেকে তার হাত সরায়।গজরাতে গজরাতে উত্তর দেয়,’মর’লে ম’রুক।আমার কি?ম’রার জন্যই মে’রেছি।ম’রে যাক।ফাহাদের বাড়ির সবাই ম’রে যাক।খুশি হবো আমি,শান্তি পাব খুব।’

আদি প্রতিউত্তর না করে চুপচাপ আকাশ দেখে।আরহাম কতোক্ষণ নিজের হাত কচলায়,কতোক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে এপাশ ওপাশ দেখে।তারপরই গম্ভীর হয়ে বলে,’শুরুতেই এতো এগ্রেসিভ হইনি।ঐ ফাহাদই প্রথমে স্ল্যাং ইউজ করেছে।পরী আর আমার ম্যারিড লাইফ নিয়ে নোংরা ওয়ার্ড ইউজ করেছে।আই সয়্যার।নয়তো এমনভাবে জীবনেও মা’রতাম না।’

‘ফাহাদ তো এমনই।তুই তো জানিসই।যাক গে,সে ম্যারিড লাইফ নিয়ে বললেই কি?তার নিজেরই তো দুই দুইটা বিয়ে ভেঙেছে।তাকে মে’রেছিস,এই নিয়ে নো কমেন্টস।কিন্তু নিজের সংসারে অশান্তি করছিস কেন?রোজ রোজ হসপিটালে যাচ্ছিস,রাতের পর রাত কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখছিস।অথচ তার ঘুম ভাঙার আগেই চলে আসছিস।এই আচরণের মানে কি?’

আদির উদগ্রীব আর প্রশ্নাত্মক চাহনি দেখেই আরহাম ফিচেল হাসল।মাথা চুলকে বলল,’কোনো মানে নেই।বউকে এতো পাত্তা দেওয়া ভালো বিষয় না।সেজন্য পাত্তা দিচ্ছি না।একবার তো দেখা হয়েছেই।এতো রোজ রোজ কথা বলার কি আছে?পুরোপুরি সুস্থ হোক।এরপরই কথা বলব।’

‘অদ্ভুত! রোজ রোজ গিয়ে দেখে আসছিস।কিন্তু বলছিস পাত্তা দেওয়া ভালো না।এটা কেমন কথা?’

‘আমার দেখা আমি দেখছি।আমি চাই না নবনীতা জানুক আমি রোজ রোজ হসপিটালে যাচ্ছি।’

আদি মাথার একপাশে হাত চেপে বিভ্রান্ত হয়ে বলল,’তুই যে কি ভাবিস আর কি করিস তুই ই জানিস।তোর কাজকর্ম মাঝে মাঝে আমার মাথায় ধরে না।’

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রাতের গভীরতা বাড়ে।সময় তখন রাত নয়টা একুশ।আকাশ কালো হয়ে এসেছে।রূপালি চাঁদের রোশনাই একটু বেড়েছে বোধহয়।আরহাম কফি শেষ করে টেনে টেনে দ্বিতীয় সিগারেট টা শেষ করার পর ছাদের রেলিং থেকে নেমে এলো,ঠেস দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়ালো।একটা ঢোক গিলে কিছু কথা বলার প্রস্তুতি নিল।গুছিয়ে সে কথা বলতে পারে না।তবুও চেষ্টা করছে আজ যেন গুছিয়ে সবটা বলতে পারে।আদি তার মতিগতি বুঝতেই তাকে সময় দিলো।অপেক্ষা করল তার নিজ থেকে কিছু বলার।

আরহাম দুই হাত বগলদাবা করে দাঁড়ায়।নিস্তব্ধ রাতের নিরবতা কাটিয়ে গাঢ় পুরুষালি কন্ঠে বলতে শুরু করে,’তাসলিমা যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায়,তখন আমি ক্লাস সেভেনে।আরিশ বোধহয় ওয়ান অথবা টু তে,ঠিক মনে নেই।আর তাস তখনো বাচ্চা।দুই বছর বয়স।মা যেই সময়টাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেল সেই সময়টাতে আমার আশেপাশের মানুষরা এতো নোংরা নোংরা কথা বলতে শুরু করল যে আমি মেন্টালি আনস্টেবল হতে শুরু করলাম।জানি তুই সবটা জানিস,তবুও বলছি।মায়ের এই নোংরা রূপটা আমি কেন জানি সহ্যই করতে পারি নি।আমার বুক ফেটে কান্না আসতো।সেই সময়টা একটু একটু করে আমার মাঝে কি হলো জানি না,জগতের সকল নারীদের প্রতি আমার মন বিষিয়ে এলো।দেখলেই গা ঘিন ঘিন করত।মন চাইতো এক চড় মেরে হাত পা বেঁধে বাড়িতে এনে ফেলে রাখি।নারী স্বাধীনতা আর নারী শিক্ষার কথা শুনতেই নাক ছিটকে দূরে সরে আসতাম।সেই থেকে পণ করলাম আমি বিয়ে করলে ফাইভ পাশ কোনো মেয়েকেই বিয়ে করব,প্রয়োজনে অশিক্ষিত গণ্ডমূর্খ মেয়ে বিয়ে করব।তবুও এমন মেয়ে বিয়ে করব না যার এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো,কিংবা যে খুব হাইলি এম্বিশাস হয়।সেই ধারণা নিয়ে একটা দীর্ঘসময় কাটিয়ে দিয়েছি।তারপরই আমার জীবনে পরী এলো।উচ্চশিক্ষিত,প্রচন্ড রকমের মেধাবী,সেই সাথে ফিউচার নিয়ে হাইলি এম্বিশাস।সাথে আবার প্রতিবাদী,তেজস্বী,প্রখর আত্মসম্মানে ভরপুর।মোদ্দাকথা আমার চাহিদার ঠিক বিপরীত একটা স্বত্তা।আমার তাকে প্রথম দেখাতেই কেমন ত্যাদড় আর বেয়াদব মনে হয়েছে।তবে একটা সময় নবনীতার বাইরে আমি তার আরেকটি রূপ দেখলাম।সেই রূপের নাম পরী আপাই।একটি অনাথ মেয়ে,যে দায়িত্ব নিয়েছিল আরো দু’টো অনাথ মেয়ের।নিজের বোনদের যেই ভালোবাসায় সে মুড়িয়ে রেখেছিল,তাতে তাকে বোন কম আর মা মনে হতো বেশি।আমি সেই পরী আপাই কে প্রথম দিনেই পছন্দ করে ফেললাম।দিন গেল,মাস গেল।কিন্তু সেই পরী আপাই তার মুগ্ধতা ছড়ানো বন্ধ করল না।আমি ধীরে ধীরে তার ব্যক্তিত্বের প্রত্যেকটা দিক মেনে নিতে শুরু করলাম।তার প্রতিবাদ,তার আত্মসম্মান,তার সবকিছু।আমাকে গু*লি থেকে বাঁচানো,চূড়ান্ত রকমের সাহসী হয়ে ফাহাদকে জনসম্মুখে চড় মা’রা,বিভা আর শাহাদাতের দায়িত্ব নেওয়া-সবকিছু মিলিয়ে পরী সত্যিকার অর্থেই প্রমান করে দিলো সে আসলেই পরী।আমি সেই পরীকে পছন্দ করলাম।পছন্দ করলে অবশ্য দোষ ছিল না।আমি তাকে বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ করলাম।সেই পছন্দকে ইনফ্যাচুয়েশনের নাম দিলাম।সেই বাড়াবাড়ি পছন্দের জের ধরে আমি নিজে তাকে চাকরি দিলাম।তার স্বাবলম্বী হওয়ার লড়াইয়ে আড়ালে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।হঠাৎই আমার মনে হলো আমি তো মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার ঘোর বিরোধী।আমি কেন তার সাহায্য করছি?একবার সরে এলাম,একবার জড়িয়ে গেলাম।দোলাচালে ভুগতে ভুগতে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত পরাজয় মেনে নিলাম।মেনে নিলাম পরীর প্রতি এই দুর্বলতা আর কখনোই কাটবে না।পরীর সাথে আমার বিয়ে হলো।সংসার জীবনে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার স্ত্রী ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে।তার মাঝে রাগ অভিমান দুঃখ সবই আছে।সংসার জীবন চলল কিছুদিন।সে আমাকে মেনে নিল,আমি তাকে।এর মাঝেই এমন একটা বাজে ঘটনা ঘটল।আমি এই কয়েকটা দিন পাগল পাগল হয়ে কাটিয়েছি।মনে হচ্ছিল একমাত্র আমার ওয়াইফ হওয়ার অপরাধে মেয়েটা শাস্তি পেল।তুই জানিস,এসব ইনফ্যাচুয়েশন,লাইক,ফিলিংস,সিম্পেথি,,এসবকিছু আসলে ভুয়া।আসল কথা হলো পরী কে আমি ভালোবাসি।এটা আমি টের পাই তখন যখন পরী আমার হাতে মাথা রেখে ঘুমাতো আর আমি ছ্যাবলার মতো ড্যাব ড্যাব করে তাকে দেখতাম।দ্যাট টাইম আই ফেল্ট আমারই বিবাহিত স্ত্রী কে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।স্ট্রেঞ্জ তাই না?মানুষ বছরের পর বছর চেষ্টা করেও বউকে ভালোবাসতে পারে না,আর আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেললাম,তখনই ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম।এখন আমার নিজেকে চোর চোর মনে হয়।মনে হয় পরীর সামনে যাবো,আর চট করে ধরা পড়ে যাব।পরী তখন আমার ইমোশানস,আমার ভালোবাসাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমাকে দূর ছাই করে তাড়িয়ে দিবে।পরীও বাকি মেয়েদের মতো ভাব ধরবে।দাম দিবে না আমাকে।এই বিচ্ছিরি ফিলিংস এভয়েড করার জন্য আমি তার সামনে যাই না।এমনিতেও অনেক বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি তার সামনে।আর না।পরীকে আমি এখন থেকে কম কম পাত্তা দিব।এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।’

আদি আদর্শ শ্রোতার ন্যায় তার পুরো কথা শুনল।কথা শেষ হতেই সে হো হো করে হেসে ফেলল।আরহাম ভড়কে গিয়ে বলল,’হাসছিস কেন?মাথায় সমস্যা তোর?’

আদি তক্ষুনি হাসি থামাল না।উল্টো আরো কিছুক্ষণ হেসে তারপর পেটে হাত চেপে বলল,’সিরিয়াসলি?বউকে ভালোবেসে বউয়ের থেকে পালাতে এই আমি তোকেই দেখছি।মানে তুই প্রেমে পড়বি,কিন্তু কিছুতেই অন্যজনের সামনে সেই প্রেম স্বীকার করবি না।মানে জেদ আর গোড়ামিরও তো একটা সীমা থাকে।’

আদি হাসি থামিয়ে আরহামের দিকে দেখল।তার চোখ মুখ শক্ত।বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে রেখে সে সামনের দৃশ্য দেখছে।আদি সমস্ত হাসি ঠাট্টাকে একপাশে সরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,’দেখ ভাই।এতো কিছু বুঝি না।তবে যা বুঝি তা থেকে বলছি তুই যেমন করে ভাবছিস বিষয়টা একদমই এমন না।সব মেয়েই যে ভালোবাসার বিনিময়ে অবহেলা করবে এমনটা মোটেই না।আর আমার অবজারভেশন বলে নবনীতাও তোকে পছন্দ করে।মেইবি তার অনুভূতি তোর মতো প্রখর না,বাট শী ফিলস ফর ইউ।আমি হাসপাতালে তার চোখে মুখে তোর জন্য টান দেখেছি।তুই সামনে আসতি না,আর সে তোকে খুঁজত।মুখে বলত না,তবে খুঁজত।তার মধ্যে আমি অস্থিরতা দেখেছি আরহাম।দয়া করে নিজের জেদ আর গোয়ার্তমির জের ধরে নিজের ঘরটা ভাঙিস না।আজ রাতে যখন যাবি তখন নবনীতার কেবিনের ভেতরে ঢুকে তাকে দেখে আসবি।প্লিজ আরহাম।গিভ লাইফ অ্যানাদার চান্স।আমার মন বলে একসময় এই মেয়েটা তোকে তোর চাইতেও দ্বিগুণ ভালোবাসবে।প্লিজ ভাই।জেদ ধরিস না।’
.
.
.
.
হাসপাতালের একেবারে সামনে ঝুলানো ঘড়িটা বারোটা বাজতেই ডং ডং শব্দ করে চারদিক আন্দোলিত করল।চারদিকের ভীড় সময়ের সাথে কমে আসছে।আপন আত্মীয় ছাড়া প্রায় সবাই-ই হসপিটালে ছেড়ে চলে এসেছে।সিনিয়র ডাক্তার রা সবাই নিজেদের চেম্বারে বসে হালকা ঝিমুচ্ছিলেন।নার্সরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত।

কেবিন নাম্বার ছয় তখন ফাঁকা।একটু আগেই সবাই বেরিয়ে গিয়েছে।তেইশোর্ধ অভিমানী তরুণী তখন মাথা নিচু করে নিজের জীর্ণ হাতটা বার বার দেখে যাচ্ছিল।এই নিয়ে চারদিন তার বৈধ পুরুষ তার সামনে আসে না।কথা নাই,বার্তা নাই।এমনকি কোনো ঝগড়াও নাই।তবুও সে আসে না।এই বেয়াদবির মানে কি?নবনীতা কোনোদিন এমন বেয়াদবি করেছে তার সাথে?অকারণে এমন গায়েব হয়ে গেছে?বিবাহিত স্ত্রীর প্রতি এমন উদাসীন আচরণ কতোটা অসম্মানজনক সে কি জানে?

বারোটার একটু পরে আরহাম এক প্রকার ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে এলো।তার শরীর অল্প বৃষ্টিতে সামান্য ভিজে গেছে।সে কেবিনের সামনে এসে গা ঝাড়া দিলো।কাঁচের দরজায় আনমনে চোখ রাখতেই দেখল কেবিনের ভেতরের মেয়ে মানুষটি তখনও জেগে আছে।

আরহাম আস্তে করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।ভেতরে আসতেই তার সাথে নবনীতার চোখাচোখি হতো।নবনীতা সেকেন্ডের মাথায় চোখ সরিয়ে নিল।এতো গুলো দিনে তার আসার সময় হয়েছে?সে আর সেদিকে তাকাবেই না।বসে থাকুক একা একা।সে কোনো কথাই বলবে না।

আরহাম তার হাতে থাকা প্যাকেট টা নবনীতার চোখের আড়াল করে চুপচাপ টুলে গিয়ে বসল।তার মাথার চুলগুলো বৃষ্টির পানিতে অর্ধেক ভিজে গেছে।তার আজ মন ভালো।অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকার পর সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে প্রাণ খুলে সংসার করবে।এরপর যা হবে দেখা যাবে।

সে টুলে বসতেই একবার সামান্য ঝুকে নবনীতার মুখটা দেখল।নবনীতা তার চাহনি বুঝতেই আরো বেশি অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নিল।আরহাম সেসব গায়ে মাখল না।একটু এদিক সেদিক দেখে সেই চিরায়ত স্বরে বলে উঠল,’হাই সেনোরিটা! কেমন আছ?’

মুহূর্তেই নবনীতার চোখ খুশিতে ছলছল করে উঠল।কতোদিন এই ডাক শুনেনি সে! সে মাথা তুলল না।তবে ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসল।আরহাম সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে আবারো প্রশ্ন করল,’কেমন আছ গো পরী আপাই?একটু তাকাও আমার দিকে।একটু দেখি,কথাবার্তা বলি।রাত বিরেতে বর কে কেউ ফিরিয়ে দেয় বলো?’

নবনীতা চোখ নামিয়ে দু’হাত কচলাতে কচলাতে জবাব দেয়,’ফিরিয়ে তো দেইনি।এসেছেন।বসে থাকুন।আমার কি?’

‘তোমার অনেক কিছু।তুমি আমাকে দেখবে।মিষ্টি হেসে জবাব দিবে।কথা বলবে।এমন থম মেরে বসে আছ কেন শুনি?’

নবনীতা মিনমিনে গলায় উত্তর দেয়,’জানি না।’

‘পরী! এ্যাই পরী।’

আদুরে সম্বোধনে কানে যেতেই নবনীতার ভেতরটা আন্দোলিত হয়।মনে হয় কোনো একটা আনন্দের জোয়ার সমস্ত শরীর দিয়ে বয়ে গেছে।সে মাথা নামিয়েই ক্ষীণ কন্ঠে জানতে চায়,’কি হয়েছে?’

‘রাগ হয়েছ পরী?’

‘হয়েছি বোধ হয়।’

‘কতোখানি?’

নবনীতা চাপা স্বরে হাসল।লাজুক কন্ঠে বলল,’অনেক খানি।’

আরহাম নিজেও হাসল।কৌতূহলী হয়ে বলল,’উই আর বিহেভিং লাইক ম্যারিড কাপলস।রাইট?’

নবনীতা অবাক হয়ে বলল,’বিহেভিং মানে?উই আর ম্যারিড।কিসব আবোল তাবোল বকছেন!’

‘নাহ।দেখলাম তোমার মনে আছে নাকি।’

‘যতোসব আজগুবি কথাবার্তা।’

আরহাম একটা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে।চোখ তুলে নবনীতার মলিন মুখখানা দেখে।যদিও এখন তাকে মলিন দেখাচ্ছে না।তাকে দেখাচ্ছে ভীষণ চটপটে আর আনন্দিত।এই আনন্দের কারণ কি?সে এসেছে বলেই মেয়েটা এতো খুশি হয়েছে?কে জানে!

আরহাম একটু এগিয়ে এসে নবনীতার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করল,’তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি জিনিসটা তোমার পছন্দ হবেই হবে।’

নবনীতা চোখ পাকায়।উদগ্রীব হয়ে শুধায়,’সেটা কি?’

আরহাম তার পিঠের কাছে থাকা হাতটা বের করে সামনে আনে।স্বচ্ছ পলির ভেতরে থাকা লোভনীয় জিনিসটা দৃষ্টিগোচর হতেই নবনীতা হসপিটাল বেডে শুয়ে থেকেই চেঁচিয়ে উঠে,’ফুচকা!!!’

আরহাম দ্রুত তার ঠোঁটে আঙুল চেপে ঈষৎ ধমকে উঠে,’আস্তে আস্তে! মানুষ দেখলে কি বলবে?মাঝরাতে কেউ এভাবে চেঁচায়?’

নবনীতা এক ঝাড়ায় তার হাত সরিয়ে নেয়।খুশিতে গদো গদো হয়ে বলে,’দেখুক গিয়ে।আমার বরের সাথে আমি চেঁচাই না লাফাই,তাতে লোকের কি?’

কথা শেষ করেই সে জ্বলজ্বল চোখে আরহামের হাতে থাকা ফুচকার প্যাকেট টা দেখে।দেখেই একবার ঠোঁট ভিজিয়ে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলে,’প্লিজ আরহাম।এক্ষুণি আমায় দিন এটা।’

আরহাম চোখ সরু করে আগাগোড়া তাকে দেখে।তারপরই বিদ্রুপ করে বলে,’এহহহ শখ কতো! এতো সহজে দিয়ে দিব?তুমি জানো এই ফুচকার জন্য আমাকে কতো কষ্ট করতে হয়েছে।এই রাতে সব দোকান বন্ধ।খুঁজতে খুঁজতে তোমার ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে হয়েছে।বৃষ্টিতে ভিজে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে এটা আনতে হয়েছে আমার।এতো সোজা না।’

নবনীতা তার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার একহাত জড়িয়ে ধরল।সুর টেনে বলল,’সেজন্যই তো আপনাকে এতো পছন্দ করি।আপনার মতো ভালো মানুষ এই দুনিয়ায় কয়টা আছে বলুন?’

আরহাম একহাত বাড়িয়ে নবনীতার একগাল টেনে চাপা স্বরে বলল,’বাপরে! পাম পট্টি তো ভালোই দিতে পারো দেখছি।পুরাই সুবিধাবাদী।’

নবনীতা দুই হাত এক করে আকুল কন্ঠে আর্জি জানাল,’প্লিজ আরহাম।খেতে দিন।’

‘দিব।তবে শর্ত আছে।’

নবনীতা তাড়াহুড়ো করে বলল,’সব শর্তে রাজি।একবার তো দিন।’

আরহাম ফুচকার প্যাকেট খুলতে খুলতে আড়চোখে তাকে দেখে বলল,’ইশশ রে! আগ্রহ দেখো না ম্যাডামের।’

***

‘তোমার শর্ত হলো তুমি সুস্থ হলে দশবার কানে ধরে উঠবস করবে।’

‘সেকি! কেনো?’

আরহাম চোয়াল শক্ত করে জবাব দিলো,’আমার অবাধ্য হওয়ার জন্য।তোমাকে বলেছিলাম চোখের সামনে থাকতে আমার।তুমি অতি পাকনামি করে আরেক জায়গায় গিয়েই ভেজাল করেছ।সুস্থ হতেই তুমি দশবার কান ধরে উঠবস করবে।গট ইট?’

নবনীতা দ্রুত মাথা নাড়ল।তাড়াহুড়ো করে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।ডিল।দশবার না,শরীর ভালো থাকলে বিশবারও করতে পারি।কোনো সমস্যা নেই।এখন প্লিজ এটা দিন।’

আরহাম ফুচকার সাথে ওয়ান টাইম প্লেট আর চামচও এনেছে।প্লেটে সবকিছু ঢেলে সে ফুচকা বানাতে বানাতে বলল,’যতক্ষন না বানানো হচ্ছে ততক্ষণ একটানা বলতে থাকো-আমি একটা পাকনা।পাকনামি করতে গেলেই আমি বিপদে পড়ি।ভবিষ্যতে আমি একটু কম পাকনামি করব।’

তার কথা শুনেই নবনীতা খিলখিল করে হেসে ফেলল।তারপরই মাথা দুলিয়ে ছোট বেলার স্বরবর্ণ শেখার মতো করে একনাগাড়ে তোতাপাখির মতো বলা শুরু করল, ‘আমি একটা পাকনা।পাকনামি করতে গেলেই আমি বিপদে পড়ি।ভবিষ্যতে আমি একটু কম পাকনামি করব। আমি একটা পাকনা।পাকনামি করতে গেলেই আমি বিপদে পড়ি।ভবিষ্যতে আমি একটু কম পাকনামি করব। আমি একটা পাকনা।পাকনামি করতে গেলেই আমি বিপদে পড়ি।ভবিষ্যতে আমি একটু কম পাকনামি করব।………..’

আরহাম ফুচকা বানাতে বানাতেই মাথা নামিয়ে কতোক্ষণ হাসল।শেষটায় হাসি থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,’তুমি কি জানো তুমি যে একটা জোকার?’

নবনীতা মাথা নাড়ল।গালভর্তি হেসে বলল,’জ্বী জানি।সেটাও রিসেন্টলি হয়েছি।আপনার সাথে থাকতে থাকতে।’

আরহাম শেষ ফুচকাটা বানাতে বানাতে ভাবুক হয়ে বলল,’সেটা অবশ্য ঠিক।তোমার সাথে থাকতে থাকতে আমারও নিজেকে ইদানিং জোকার লাগে।’

নবনীতা ফুচকা খেতে গিয়েই দেখল তার দুই হাতের কোনোটাই অবসর নেই।আরহাম তার ফুচকায় টক ভরতে ভরতে বলল,’থাক হয়েছে।আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

‘উমমম।হচ্ছে না।শুধু ঝাল টক কেন দিচ্ছেন?মিষ্টিটাও দিন সাথে।’

আরহাম তাজ্জব বনে গিয়ে কতোক্ষণ তাকে দেখল।এই অবস্থাতেও এতো আয়োজন করে খেতে হয়?তারপরই হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে দু’টো টকই একটু একটু মিশিয়ে তার দিকে ফুচকা টা এগিয়ে দিলো।

নবনীতা প্রথম ফুচকা টা মুখে নিয়েই এমন প্রসন্ন প্রতিক্রিয়া দেখালো যে আরহামের তাকে দেখেই হাসি পেল।সে একই ভাবে দ্বিতীয় ফুচকা টা বানিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল,’নিন ম্যাডাম এটাও নিন।’

নবনীতা খেতে খেতেই আরহামের দিকে দেখে বলল,’আপনিও একটা খান না।খুব মজা।খেলেই মন ভালো হয়ে যাবে।’

‘থাক।তুমিই খাও।আমার এসব ভালো লাগে না।’

নবনীতা আর জোরাজুরি করল না।ফুচকা খেতে সে কাউকেই জোরাজুরি করে না।খেলে খাবে,না খেলে নাই।বেঁচে যাওয়া ফুচকা খাওয়ার জন্য তো সে আছেই।সে সমস্ত ফুচকা শেষ করে আনন্দ আপ্লুত হয়ে বলল,’উফফফ! মন মেজাজ সব ভালো হয়ে গেছে আমার।আপনার মতোন স্বামী হচ্ছে ইহজনমের সৌভাগ্য বুঝেছেন?’

নিজের কথায় তার নিজেরই হাসি পায়।আরহাম আশ্চর্য হয়ে কয়েক পলক তাকে দেখেই ফিক করে হেসে দিলো।নবনীতা জিভ কাটলো।বোকা বোকা হয়ে বলল,’একটু বেশি বলে ফেলেছি তাই না?’

জবাবে আরহামও মিষ্টি হেসে বলল,’হু।আমারও তাই মনে হচ্ছে।’

বাকি রাতটা দু’জনের কেউই আর ঘুমালো না।আরহামকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নবনীতা নিজেই রাতভর শত রকমের কথা বলে গেল।এই চারদিন কি হয়েছে,শাহাদাত কি কি উদ্ভট কাজকর্ম করেছে,চিত্রা আর বিভা কয়বার নিজেদের মধ্যে চুলাচুলি করেছে-সবকিছু।আরহাম ধৈর্যশীল শ্রোতার মতো একমনে সবটা শুনে গেল।দেখে গেল নবনীতার আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বাচাল মেয়েটিকে।এই মেয়ে এতো কথা বলতে জানে?এতো বকবক করতে পারে সে?অদ্ভুত! তাকে দেখে আরহামের একবারো মনে হয়নি সে এতোখানি চঞ্চল।

ভোরের একটু আগেই নবনীতা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।অথচ আরহাম গালের নিচে একহাত রেখে একটানা ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে দেখে গেল।মেয়েটা কি জানে আরহাম তাকে কতোখানি ভালোবাসে?সে কি জানে তার এই সামান্য শখ পূরণের জন্য আরহাম বৃষ্টি বাদল উপেক্ষা করে কতোখানি পথ পাড়ি দিয়েছে?

সে নবনীতার একটা হাত নিজের হাতে নেয়।মাথা নুয়িয়ে সেখানে ছোট করে চুমু খায়।নিজ থেকেই খানিকটা আবেগী হয়ে বলে,’আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি পরী।এই সম্পর্কে আমি আমার একশো পারসেন্ট দেব।আই প্রমিজ।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৪

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৪)[প্রথম অংশ]

‘ভাই।স্কুলের সিসি টিভি ক্যামেরা গুলো আগেই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।ঘটনার কোনোরকম ফুটেজ সিসিটিভি তে ধরা পড়েনি।’

তোফায়েল ঠান্ডা গলায় কথা বলেই সামনে তাকায়।তার থেকে কয়েক হাত দূরে আরহাম দাঁড়িয়ে আছে।তার একহাত দেয়ালে।তোফায়েল থামতেই আরহাম পেছন ফিরে তাকে দেখল।থমথমে মুখে বলল,’ফুটেজের কোনো প্রয়োজন নেই।আমি জানি এই কাজ কার।’

ক্ষণিকের নিরবতা।কিছু সময় বাদেই নিরবতা ভেঙে তোফায়েলের প্রশ্ন,’আপনি কিছু করবেন না তাকে ভাই?’

আরহাম ধীর পায়ে হেঁটে করিডোরের এক পাশের চেয়ারে বসে।মাথা নিচু করে মেঝে দেখে।অতিশয় শীতল কন্ঠে জবাব দেয়,’না,করব না।আপাতত পরীর জ্ঞান ফিরুক একবার।এখন আমার অন্যকিছুতেই আগ্রহ নেই।পরী সুস্থ হোক।তারপর ঐ রাস্কেলের সাথে আমার বোঝাপড়া হবে।’

তোফায়েল জবাবে কেবল একবার মাথা নাড়ল।ভাই গতকাল থেকে হাসপাতালে।মাঝে একবার ঘন্টাখানেকের জন্য পার্টি অফিসে এসেছিল।তারপর বাড়ি গিয়ে গোসল সেরে আবারও এখানে।তোফায়েল ইদানিং টের পাচ্ছে তার তথাকথিত ‘আই হেইট ওম্যান’ টাইপের বড় ভাই সময়ের সাথে সাথে ‘আই লাভ পরী’ টাইপের বড় ভাইয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে।তার বিশ্বাস হয় না সামান্য একটা মেয়ের জন্য ভাই এতো বেশি ব্যস্ত হচ্ছে,এতো বেশি আবেগ ঝরাচ্ছে।আরহাম প্রতিশোধ আর পাল্টা জবাবে বিশ্বাসী।অথচ সেই আরহাম তার স্ত্রীর মুমূর্ষু অবস্থায় ক্ষণিকের জন্য তার প্রতিশোধ কে পাশে সরিয়ে স্ত্রীয়ের সুস্থতার কথা ভাবছে,বিষয়টা সত্যিই আশ্চর্য হওয়ার মতো।তোফায়েল আশ্চর্য হয়েই তাকে দেখে।দিনরাত পরী পরী করার পরেও ভাই বড় গলায় বলে,’পরীর প্রতি আমার কোনো ফিলিংস কাজ করে না।’
তোফায়েলের তখন চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে,’ফিলিংস কাজ না করতেই এতো পাগলামি,যখন কাজ করবে তখন কি করবেন?’
.
.
.
.
রিমি সিসিইউ এর দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ।সে একটু আগেই এসেছে।নবনীতাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়েছে।যদিও এখনো তার জ্ঞান ফিরেনি,কিন্তু তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে।ডাক্তার মতিন আহমেদ আশ্বাস দিয়েছেন আজ অথবা কাল তার জ্ঞান ফিরতে পারে।

রিমির একহাতে বিভার ছোট্ট হাত বন্দি।সে নিজের অন্য হাতের আঙুল খেতে খেতে এদিক সেদিক দেখছিল।ওয়াজিদ মাত্রই হসপিটালে পা রেখেছে।কাল রাতে চলে যাওয়ার পর সে আর আসেনি এদিকে।সন্ধ্যা নামতেই তার মনে হলো তার আরেকবার সেখানে যাওয়া উচিত।একটু সশরীরে গিয়ে খবর নেওয়া উচিত।সে তৃতীয় তালায় আসতেই সবার আগে রিমিকে দেখল।দেখতেই এগিয়ে এসে অত্যন্ত অমায়িক কন্ঠে জানতে চাইল,’নবনীতার এখন অবস্থা কি রিমি?কিছু জানো?’

রিমি চোখ সরিয়ে তাকে দেখল।মৃদুস্বরে বলল,’জ্বী ভাইয়া।এখন নাকি একটু ভালো অবস্থা।কেবিনে শিফট করা হয়েছে।’

‘ওহহ আচ্ছা।’

চোখ নামিয়ে বিভাকে দেখতেই ওয়াজিদ পুনরায় প্রশ্ন করে,’বিভা কিছু খেয়েছে?’

‘জ্বী।খাইয়ে এনেছি।’

ওয়াজিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে করিডোরে রাখা চেয়ার গুলোর দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,’ওখানে গিয়ে বসো না।কতোক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবে?বিভার ও তো পায়ে ব্যথা হবে।তুমি তাকে নিয়ে সেখানে গিয়ে বসো।’

রিমি তার এক কথাতেই সেখানে গিয়ে বসল।বিভাকে বসালো তার ডান পাশে।ওয়াজিদ এক নজর তাদের দেখেই সামনে এগিয়ে যায়।ফিরে আসে দুই কাপ চা আর দু’টো বাটার বান হাতে।এসেই ঠিক রিমির মুখোমুখি দাঁড়ায়।এক কাপ চা আর একটা বান তার দিকে বাড়িয়ে গাঢ় স্বরে বলে,’নাও রিমি।এটা খেয়ে নাও।’

রিমি অবাক হয়ে মাথা তোলে।বিস্মিত মুখে প্রশ্ন করে,’এসব কেন?’

‘তুমি কিছু খেয়ে এসেছ?’

‘না খাইনি।’

‘জানি।সেজন্যই নিয়ে এসেছি।একেবারে অড টাইম একটা! নিজেও কিছু খাইনি।ভাবলাম তোমার জন্যও নিয়ে আসি।’ খুবই সাবলীল ভঙ্গিতে জবাব দেয় ওয়াজিদ।আরহাম তখন ঘন্টাখানেকের জন্য পার্টি অফিসে গিয়েছে।নবনীতার কেবিনের সামনে তখন শুধু সে আর রিমি।আর সাথে বিভা।শুভ্রা আর চিত্রা বোধ হয় একটু পরে আসবে।

সন্ধ্যায় এক কাপ চা আর সাথে বাটার বান অথবা বিস্কুট-ওয়াজিদের প্রিয় খাবার গুলোর একটি।সন্ধ্যায় চা না খেলে তার অস্থির লাগে।চা কেনার পরেই তার মনে হলো সেখানে রিমিও আছে।সেও নিশ্চয়ই কিছু খায়নি।তার জন্য আরেক কাপ চা নিলে মন্দ হয় না।যেই ভাবা,অমনি কাজ।সে নিজের পাশাপাশি রিমির জন্যও চা আর বান নিল।

রিমি বিষন্ন মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে ওয়ান টাইম চায়ের কাপে হাত রাখে।সে হাত রাখার পরেও ওয়াজিদ সেটা ছাড়ল না।সন্দিহান গলায় বলল,’ঠিক মতো ধরেছ তো?ছাড়ব?নাকি ছাড়লেই সব চা তোমার গায়ে গিয়ে পড়বে?দেখো কিন্তু,আবার শরীর পু’ড়ে ফেলো না।আমি কিন্তু তখন নেভার মাইন্ড বলে সবকিছু মিটমাট করতে পারব না।’

মন খারাপের দিনেও তার কথা শুনে রিমির হাসি পেল।সে হালকা শব্দ করে হাসল।চায়ের কাপটা ঠিক মতো ধরে স্বচ্ছ গলায় বলল,’না ভাইয়া।ঠিক মতোই ধরেছি।আপনি ছাড়ুন।’

ওয়াজিদও বিনিময়ে স্মিত হেসে কাপটা ছেড়ে দিলো।রিমির বাম পাশটায় বসে বাটার বান টাও তার হাতে দিলো।রিমি চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েই বলল,’বাহ! খুব মজা তো চা টা!’

‘হু।আমার ভীষণ প্রিয়।হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে আনি নি।হাসপাতালের সামনের এক টং দোকান থেকে এনেছি।’

রিমি হাসল।বলল,’দারুন মজা।’

চা আর বান খাওয়া শেষেই রিমি কাপটা দুমড়ে মুচড়ে একহাতে নিল।ওয়াজিদ চোখ পাকিয়ে তাকে দেখল।তার মতিগতি ঠাহর করার চেষ্টা করল।রিমি এক চোখ বন্ধ করে ডাস্টবিনের দিকে নিশানা ঠিক করে।তার লক্ষ্য কাপটা সেখানে ছুড়ে মারার।সে আরো একবার ঠিক মতো সব দেখেই সেটাকে সজোরে ছুড়ে মারে ডাস্টবিনের দিকে।ওয়ান টাইম কাপটা রিমিকে চূড়ান্ত মাত্রার হতাশ করে দিয়ে উড়তে উড়তে একজন ভদ্রলোকের গায়ে গিয়ে পড়ল।ভদ্রলোক করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিলেন।কিছু একটা উড়ে তার গায়ে পড়তেই তিনি হকচকিয়ে ওঠলেন।

রিমি নিজেও হতবাক,হতাশ আর চূড়ান্ত রকমের বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।কাঁদো কাঁদো হয়ে মাঝবয়সী লোকটার দিকে তাকায়।মিনমিনে স্বরে বলে,’সরি আঙ্কেল।লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়েছে।সিস্টেক হয়ে গেছে।’

ওয়াজিদ কতোক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে তাকে দেখে।সব কাজেই একটা মানুষ ভুল করতে পারে এটা সে রিমিকে না দেখলে বিশ্বাসই করত না।সে মাথা নামিয়ে ফিক করে হেসে দেয়।চাপা স্বরে রিমিকে বলে,’নেভার মাইন্ড-এটা বাদ গেছে।এটাও বলে দাও।’

রিমি ত্যাড়ছা চোখে একবার তাকে দেখে।মাথা নিচু করে ভেঙচি কাটে।পরক্ষণেই আবার সে যার গায়ে কাপ ছুড়েছে তাকে দেখে বিনয়ী স্বরে বলে,’সরি আঙ্কেল।প্লিজ রাগ হবেন না।’

লোকটা রাগ হলো না।উল্টো তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাপটা তুলে যথাস্থানে ফেলল।তারপরই দ্রুত গতিতে হেঁটে যেতে যেতে রিমিকে একবার দেখে বলল,’সমস্যা নেই মা।আমি রাগ হইনি।’

রিমি নিশ্চিন্ত হয়ে চেয়ারে বসে।বিভা একটু পর পর হাই তুলছে।ওয়াজিদ জানতে চায়,’তাকে আবার এনেছ কেন?হসপিটালে কতো জীবানু।বাচ্চা মানুষ।অসুস্থ হয়ে গেলে?’

রিমি বিভাকে নিজের সাথে চেপে ধরে।চঞ্চল হয়ে জবাব দেয়,’আরে ভাইয়া।আম্মু আর আব্বু বাসায় নেই।নানুর বাসায় গিয়েছে।কোথায় রেখে আসবো বলেন?তাই সাথেই নিয়ে এসেছি।আর যা দুষ্টু এটা! শুধু দুষ্টুমি করে।তাই নিজের সাথেই রাখি।’

‘তোমার কাছে থাকলে দুষ্টুমি করে না?নাকি তোমার দুষ্টুমি দেখেই ঠান্ডা হয়ে যায়?নিজের দুষ্টুমি ভুলে যায়।’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে ওয়াজিদ।

রিমি আড়চোখে একবার তাকে দেখেই চোখ সরিয়ে নেয়।তারপরই আবার লাজ শরমের মাথা খেয়ে আরো দুইবার তাকে দেখে।তার লাজ শরম আরেকটু কম হলে ভালো হতো।তখন সে সোজাসাপটা বলে দিতে পারত,’শুনেন ওয়াজিদ ভাই,আপনি মুখটা কে গোমড়া করে না রেখে সবসময় এমন হাসবেন।আপনাকে হাসি মুখে দেখতে খুবই ভালো লাগে।প্রয়োজনে এই হাসির বিনিময়ে আপনি আমাকে টুকটাক ভিল্লাও দিতে পারেন।আই উইল নেভার মাইন্ড।হুহহ!’

বিভার মাথায় একটু হাত বুলাতেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।তার ঘুমন্ত মুখটা দেখেই রিমি চতুর্থবারের মতো হাই তুলল।হাসি আর কান্না সংক্রামক।এই কথা রিমি আগেই শুনেছে।তবে তার মাঝে মাঝে নিজেকে দেখলে মনে হয় ঘুমও সংক্রামক।তার সামনে কেউ ঘুমালেই তার শরীর ভেঙে ঘুম আসে।এখনো ঘুমে সে চোখ খোলা রাখতে পারছে না।

কিছু সময় যাবত নিজের সাথে বোঝাপড়া করার পর রিমি হাল ছেড়ে দিলো।মাথাটা সামান্য পেছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে সে চোখ বন্ধ করল।মিনিট বিশেক সেভাবে থাকার পরই আচমকা তার মাথাটা আলতো করে এসে ওয়াজিদের কাঁধে গিয়ে ঠেকে।ওয়াজিদ নিজের কাঁধে তার মাথা দেখতেই থতমত খায়।সে অস্বস্তিতে খানিকটা নড়েচড়ে উঠে।তার এখন কি করা উচিত?মেয়েটা তো ইচ্ছে করে এমন করে নি।ঘুমের ঘোরে এমনটা হয়েছে।ওয়াজিদের কি তাকে সরিয়ে দেওয়া উচিত?নাকি যেভাবে আছে সেভাবেই বসে থাকা উচিত?

মিনিট দুয়েক উসখুস করার পর ওয়াজিদ সিদ্ধান্ত নেয় রিমির যতোক্ষণ না ঘুম ভাঙে,সে ততক্ষণ এভাবেই বসে থাকবে।রিমির মুখটা ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল! ক্লান্ত দেখেই হসপিটালের মতো জায়গায় অবেলায় ঘুম দিয়েছে।এই অবস্থায় তাকে সরানোর কোনো মানে নেই।থাকুক,এভাবেই থাকুক।একটু ঘুমাক।

রিমি মেয়েটি কে নিয়ে সে কখনোই সেভাবে ভাবে নি।তবে তার মন বলে মেয়েটা ভীষণ ভালো।সে যে ভীষণ ভালো তার একটা প্রমাণ হলো বিভার প্রতি তার স্বচ্ছ আর নির্মল ভালোবাসা।বিভার সাথে তার কোনো র’ক্তের সম্পর্ক নেই।তবুও মেয়েটি কে সে নিজের কাছে রেখেছে।সব সময় সাথে নিয়ে নিয়ে ঘুরছে।এতোটুকু করার জন্য একজন মানুষের একটি চমৎকার হৃদয় থাকা প্রয়োজন।সেই চমৎকার হৃদয় রিমির কাছে আছে।নবনীতার প্রতি তার ভালোবাসা নির্ভেজাল,নিঁখাদ।ওয়াজিদ জানে সে খুবই ভালো মেয়ে।কেবল খানিকটা চঞ্চল,এই যা।

রিমি আরাম করে ঘুমায়।আর ওয়াজিদ সোজা হয়ে চুপচাপ বসে থাকে।না একটু নড়ে,না একটু পেছনে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করে।এই ঘুম দীর্ঘসময় স্থায়ী হবে না।মানুষ বাড়তেই রিমির ঘুম ভাঙে যাবে।ওয়াজিদ তখন সরে আসবে।

***

শুভ্রা প্রাইভেট থেকে বেরিয়েছে সন্ধ্যা সাতটার দিকে।দুপুরের প্রাইভেট টা আজ স্যারের সমস্যার কারণে সন্ধ্যার দিকে পড়ানো হয়েছে।সে বেরিয়ে একটু সামনে আসতেই টয়োটার সেই কালো রঙের গাড়িটা একদম তার পাশ ঘেঁষে থামল।চমকে শুভ্রা দুই কদম পেছায়।এক নজর গাড়িটা দেখতেই সে চিনে নেয় এটা কার গাড়ি।

আরিশ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখেই সহজ গলায় বলল,’হাই মিস শুভ্রা!’

তার পাশের সিটে চিত্রা বসা ছিল।আরিশের অভিবাদন শুনে সেও তাকে অনুসরণ করে বলল,’হাই মিস শুভ্রা!’

শুভ্রা তার কন্ঠ শুনেই মাথা ঝুকায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’কি রে তুই?’

আরিশ তার হয়ে জবাব দেয়,’হু।আমিই নিয়ে এসেছি তাকে।তুমি এখন ঝটপট পেছনে গিয়ে বসো।’

শুভ্রা চোখ গোল গোল করে বলে,’আমরা কি হসপিটাল যাচ্ছি?’

‘হু’

শুভ্রা দ্রুত চিত্রার পাশে এসে গাড়ির দরজা খুলে।ভিতরে ঢুকে চিত্রাকে কোলে নিতে নিতে বলে,’আমি সামনেই বসব।পেছনে কেউ নেই।একা একা বসতে ভালো লাগে না।’

আরিশ স্মিত হাসল।স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেই সামনে দেখতে দেখতে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।সামনেই বসো।সিটবেল্ট বেঁধে নাও দ্রুত।’

শুভ্রা তাড়াহুড়ো করে সিটবেল্ট বাঁধে।চিত্রাকে ঠিক মতো নিজের কোলে বসিয়ে আরিশের দিকে ফিরে বলে,’আপাইয়ের কি জ্ঞান ফিরেছে?আরহাম ভাইয়া কিছু বলেছে আপনাকে?’

‘নাহ এখনো বোধহয় ফিরে নি।ভাইয়া এমন কিছু এখন পর্যন্ত বলে নি আমাকে।’

শুভ্রা মুখখানা আধার করে জবাব দেয়,’ওহহ আচ্ছা।’

আরিশ ড্রাইভিংয়ের মাঝেই নিজের সাফাই গেয়ে বলল,’আসলে আমি ধানমন্ডির এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।তো পরে ভাবলাম চিত্রা কেও সাথে নেই।এরপরে আবার ভাবলাম চিত্রাকে নিলে তুমি বাড়ি এসে তাকে খুঁজবে।তাই ভাবলাম তোমাকেও নিয়ে নেই।এছাড়া আর কোনো কারণ নেই এদিকে আসার।’

শুভ্রা মাথা নিচু করে উত্তর দেয়,’জ্বী ভাইয়া।জানি।আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের কথা ভাবার জন্য।’

আরিশ তার দিকে না ফিরে ড্রাইভিং-এ মনোনিবেশ করে,স্বস্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।শুভ্রা তাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু ভাবছে না সেটা খুবই স্বস্তির বিষয়।কিন্তু যেটা স্বস্তির বিষয় না তা হলো সে ইদানিং শুভ্রাকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবছে।একবার সে ভাবনা মাথায় এলেই তার কেমন নিজের উপর রাগ ধরে যায়।শুভ্রা মাত্র উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে।বাচ্চা একটা মেয়ে।তাকে নিয়ে আরিশ কেন ভাববে?সে কি বিকৃত মস্তিষ্কের নাকি?যতসব উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা!

তারা হসপিটালে পৌঁছায় আরো চল্লিশ মিনিট পরে।শুভ্রা সেখানে গিয়েই দেখল করিডোরে মোটামুটি সবাই উপস্থিত।আরহাম আর আদি একটু আগেই এসেছে।আরহাম ফোনে কারো সাথে কথা বলছে।তাদের পাশাপাশি দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াজিদ।তার নাক বরাবর একটা চেয়ারে রিমি বসা।যে কিনা ঘুম থেকে উঠেও একের পর এক হাই তুলেই যাচ্ছে।

আদি একনজর ওয়াজিদ কে,আরেক নজর রিমিকে দেখে।দেখেই ঠোঁট টিপে হাসে।তার গা জ্বালানো হাসিতে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে ওয়াজিদ প্রশ্ন করে,’সমস্যা কি তোর?এমন মিটমিট করে হাসছিস কেন?মানসিক সমস্যা আছে তোর?’

আদি হাসি থামায় না।উল্টো আলতো করে ওয়াজিদের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,’সমস্যা তো কিছু না দোস্ত।আবার বলতে গেলে অনেক সমস্যাই আছে।যাই হোক,আমার তো জ্যোতিষীর চোখ।অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছি আমি।উমমম ওয়াজিদ! নট ব্যাড।গুড চয়েস।আমি এপ্রুভাল দিয়ে দিলাম যাহ।’

ওয়াজিদ এক ঝাড়ায় তার কাঁধ থেকে আদির হাত সরায়।নাক মুখ খিঁচে বলে উঠে,’কি যা তা বলছিস।পুরাই একটা ফাউল তুই!’

কথা শেষ করে পুনরায় সে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকায়।করিডোরে সবার প্রথমে এসেছিল আদি।ওয়াজিদ তখন মাথা নামিয়ে ফোন স্ক্রল করছিল।আদি তাকে আর তার কাঁধে রিমির মাথা দেখেই চটপট তাদের একটা ছবি তুলে নিল।ছবি তোলা শেষ হতেই সে এগিয়ে এসে টিপ্পনী কেটে বলল,’বাহ ওয়াজিদ।হসপিটালেই শুরু করে দিয়েছিস নাকি?ভেরি রোমান্টিক ব্যাপার সেপার!

ওয়াজিদ চোখ তোলে।অবাক হয়ে বলে,’মানে?রোমান্টিকের কি আছে এদিকে?’

‘হয়েছে হয়েছে।আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া এতো সোজা না।আমি সব বুঝি।তুমিও গোপনে গোপনে ভালোই রোমান্টিক দেখছি।’

ওয়াজিদ আর কথা বাড়ায় না।আদিকে কিছু বোঝানোর চেয়ে নিজের মাথায় নিজে বারি দেওয়া আরো ভালো।আদি এসব ব্যাপারে কিছুই বুঝতে চায় না।

রিমি ঘুম ভাঙার পরেই নিজের মাথা অন্য কারো কাঁধে আবিষ্কার করল।সে অবাক হয়ে গেল যখন দেখল কাঁধটা ওয়াজিদের।তার বিস্ময়ভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।একটু পরেই সে খেয়াল করল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার মুখ থেকে লালা বের হয়ে ওয়াজিদের কাঁধের কাছটা খানিকটা ভিজিয়ে দিয়েছে।ওয়াজিদ থমথমে মুখে একবার তাকে আর একবার নিজের কাঁধ দেখে।তারপরই বিড়বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলে পকেট থেকে টিস্যু বের করে কাঁধের দিকটা মুছে নেয়।

রিমি নিজেও দ্রুত তার মুখের আশপাশ মুছে নিল।ওয়াজিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে হনহন করে সামনে এগিয়ে যায়।আদি নিজেও হেলেদুলে তার পেছন পেছন এগিয়ে আসে।তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে দাঁত কেলিয়ে বলে,’ব্যাপার না বন্ধু।আজ লালা ফেলে কাঁধ ভিজিয়েছে।কাল ভালোবাসার বৃষ্টিতে হৃদয় ভেজাবে।এভাবেই তো সবকিছু হয়।এভাবেই তো প্রেম ভালোবাসা ফাংশন করে।বুঝিস না কেন?’

ওয়াজিদ কটমট চোখে তার দিকে তাকায়।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’সবসময় এসব ফাইজলামি ভালো লাগে না কিন্তু।অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছিস তুই।’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৪)[দ্বিতীয় অংশ]

একটা ফুলে ফুলে ভরে থাকা বাগান।নিস্তব্ধ নিশুতি রাত।চারিদিকে ঘোর অন্ধকার।সেই অন্ধকারের চেয়েও বেশি অন্ধকার কিশোরী মেয়েটির ভবিষ্যৎ।সে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো।মাথার উপর এক ফালি চাঁদ।সেই চাঁদও তার মতোই অসহায়।একটু দূরেই একজন মাঝবয়সী লোক মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।পরনের কাপড়টি র’ক্ত মেখে কেমন যেন দেখাচ্ছে।দৃশ্যটা বাজে,খুব বেশি বাজে।

মাঝবয়সী লোকটার লাগাতার ছু’রিকাঘাতে অবসন্ন শরীরটা হঠাৎই একটু নড়েচড়ে উঠে।ঘোলাটে আর বিবর্ণ চোখ তুলে সে সামনে দেখে বলে,’পরী! তুমি আমার সাহসী মেয়ে।ভয় পাবে না।পালাও মা।দূরে কোথাও পালাও।তোমাকে বাঁচতে হবে।ছোট ছোট দু’টো বোনের জন্য তোমায় বাঁচতে হবে।পালাও।’

লোকটার কথা জড়িয়ে যায়।রক্ত জমাট বেঁধে শরীরের এদিক সেদিক লেপ্টে থাকে।এসবের মাঝেই তিনি পুনরায় ক্ষীণ কিন্তু দৃপ্ত কন্ঠে বলে উঠেন,’তুমি পারবে পরী।তোমাকে পারতেই হবে।বাবা হয়তো বাঁচবো না।কিন্তু তুমি থাকবে।তুমি আমার সাহসী মেয়ে।ভয় পেয় না।পালাও মা।এক্ষুনি পালাও।’

কিশোরী মেয়েটি দুই হাত মুখে চেপে ছিটকে দুই কদম সরে আসে।তার চোখের পানিতে তার নিজের বুক ভেসে যাচ্ছে।সে কি করবে?কোথায় যাবে?এই বিশাল পৃথিবীতে সে কেমন করে টিকে থাকবে?সে তো একা না।আরো দু’টো ছোট্ট প্রাণ তার দিকে চেয়ে আছে।

বহুবার চেষ্টা করার পর সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনে।বাস্তবতায় ফিরে আসতেই সে টের পায় বাবা মা আর বেঁচে নেই।বাবার ঘোলাটে চোখটা দীর্ঘসময় ধরে পলক ফেলছে না।শরীরের নড়চড় বন্ধ হয়ে গেছে।সে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না।চার মাসের ছোট্ট বোনটাকে বুকে চেপে ধরে সে ছুটে পালায় বাড়ির বাইরে।ছুটতে ছুটতে তার পা ধরে আসে।তার স্কুল পড়ুয়া এগারো বছর বয়সী বোনটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠে,’আর পারছি না আপাই।আর না।’

সে থামে।কংক্রিটের খড়খড়ে রাস্তায় ধপ করে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।একটু শান্ত হতে নিলেই কানে বাজে-পালাও! পালাও!পালাও!’

এক হাত কানে চেপে কিশোরী মেয়েটি টেনে টেনে কয়েকবার শ্বাস নেয়।জীবনের যেই নতুন সংগ্রামে সে নেমেছে,সেই সংগ্রাম সম্পর্কে সে সামান্য কিছুও জানে না।সে একহাতে চার মাসের বাচ্চা মেয়েটিকে বুকে চেপে অন্য হাতে তার অন্য বোনটিকে জড়িয়ে ধরে।তারা তার প্রাণেরই অংশ।সে এদের কিচ্ছু হতে দেবে না।সে একাই এদের মা বাবা হবে।তাকে হতেই হবে।সমস্ত প্রতিকূলতা,সমস্ত অন্যায় থেকে সে এদের রক্ষা করবে।নয়তো সে কেমন করে প্রমাণ করবে সে সত্যিই তার বাবার সাহসী কন্যা?

সে আনমনে তাদের নিজের কাছে ডাকে।তার মনে হচ্ছে বাচ্চা দু’টো তার কাছ থেকে খুব দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে।একটা অন্ধকার রাস্তায় তারা একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে।সে হকচকিয়ে উঠে তাদের ডাকে।ব্যাকুল হয়ে বলে,’কোথায় যাচ্ছ তোমরা?এই দেখো আপাই এদিকে।তোমরা আপাই কে ছেড়ে কোথায় যাচ্ছ?এসো,এসো।এক্ষুণি আমার কাছে এসো।নয়তো হারিয়ে যাবে।’

কানের কাছে কোথাও যান্ত্রিক শব্দে কিছু একটা টিক টিক করে যাচ্ছে।হসপিটালের স্ট্রেচারের বিরক্তিকর শব্দ ভেসে ভেসে কর্ণকুহরে এসে বারি খায়।ফিনাইলের কটু গন্ধ অক্সিজেন মাক্স ভেদ করে নসিকা রন্ধ্রে গিয়ে পৌঁছায়।প্রতিটা ইন্দ্রিয় একে একে সচল হয়।নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা হাতটা সামান্য কেঁপে উঠে হসপিটাল বেড আঁকড়ে ধরে।অস্পষ্ট আর জড়ানো কন্ঠে ডাকে,’আমার শুভি! আমার চিত্র!’

ডিউটিরত নার্স তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেই সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন।তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক।তিনি এক দৌঁড়ে ছুটে যান ডাক্তারের চেম্বারে।গিয়েই উচ্ছ্বসিত হয়ে ব্যস্ত গলায় বললেন,’পেশেন্ট রেসপন্স করছে স্যার।তার সেন্স ফিরছে ধীরে ধীরে।’

মতিন আহমেদ সে কথা শুনতেই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।ব্যস্ত ভঙ্গিতে সামনে পা ফেলতে ফেলতে বলেন,’গ্রেট।আমি এটারই অপেক্ষায় ছিলাম।’

মতিন আহমেদ দ্রুত কেবিনে গেলেন।একটু একটু করে জ্ঞান ফিরতে থাকা তরুণীটি পুনরায় ডাকে,’আমার শুভি! আমার চিত্র!’

মতিন আহমেদ অল্প হেসে মাথা নাড়েন।নিজ থেকেই বললেন,’দেখো অবস্থা।এখনো বোনদের কথাই বলে যাচ্ছে।’

চারদিকের নানারকম শব্দের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে নবনীতার অবশ শরীরটা একটু একটু করে সচল হলো।মস্তিষ্ক আর ইন্দ্রিয়সমূহ সবকিছুর সাথে একটুখানি খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হতেই নবনীতা ধীরে ধীরে চোখ খুলল।কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর শেষটায় সে ঠিক মতো চোখ খুলতে সক্ষম হলো।চোখ খুলতেই সে প্রথমে যাকে দেখল তার নাম ডাক্তার মতিন।ঢাকায় আসার পর তিনিই তার চেক আপ করতেন।নবনীতা চোখ মেলতেই তিনি হাসি মুখ করে বললেন,’কংগ্রেটস নবনীতা।লাইফ গেইভ ইউ অ্যানাদার চান্স।’

নবনীতা জবাবে কেবল দুই ঠোঁট সামান্য প্রসারিত করল।শরীরের জায়গায় জায়গায় চিন চিন ব্যথা হচ্ছে।সে কতো ঘন্টা এভাবে পড়ে ছিল কে জানে! কিন্তু এখন তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।

মতিন আহমেদ তার কেবিন থেকে বেরিয়েই আরহামের কাছে এগিয়ে গেলেন।বেশ সাবলীল গলায় বললেন,’তোমার ওয়াইফের জ্ঞান ফিরেছে আরহাম।চাইলে একটু দেখা করে আসতে পারো।’

আরহাম চকিতে তার দিকে ফিরে।একপ্রকার নিশ্বাস বন্ধ করে জানতে চায়,’সত্যি?যেতে পারব আমি?’

প্রশ্ন শেষ হতেই সে নতুন করে আবার প্রশ্ন করে,’গিয়ে কি চুপচাপ বসে থাকব?নাকি সেও আমার সাথে কথা বলতে পারবে?’

জনাব মতিন আহমেদ শব্দ করে হেসে ফেললেন।সেই হাসি ধরে রেখেই বললেন,’না না।চুপ করে বসে থাকতে হবে না।তুমিও কথা বলতে পারবে।’

আরহাম জ্বল জ্বল চোখে কেবিনের দিকে পা বাড়ায়।কেবিনের দরজায় হাত দিতেই তার কিছু একটা মনে পড়ে।সে চোখ ঘুরিয়ে শুভ্রা তার চিত্রা কে দেখে।তারপরই তাদের কাছে এগিয়ে এসে বলে,’তোমরা আগে যাবে নাকি আমি?তোমার আপাই তো আবার শুভি আর চিত্র বলতে অজ্ঞান।’

শুভ্রা ব্যস্ত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল,’না না ভাইয়া আগে আপনিই যান।আমরা পরে যাব।’

আরহাম আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পায়ে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।সৌজন্যের খাতিরে তার বলা উচিত ছিল শুভ্রাকে।সে সৌজন্য দেখিয়ে বলেছে।বলার সময়ই মনে মনে দোয়া করছিল শুভি যেন তাকেই যেতে বলে।নয়তো ভীষণ ঝামেলা হয়ে যেত।পরী জ্ঞান ফেরার পর সবার আগে যাকে দেখবে সেই মানুষটা আরহাম হবে না,এটা হতেই পারে না।সে একেবারে নিঃশব্দে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল।

নবনীতা তাকে দেখতেই অল্প হাসার চেষ্টা করল।আরহাম চুপচাপ হেঁটে ঠিক নবনীতার কাছাকাছি রাখা টুলটায় গিয়ে বসল।দু’জনের চোখাচোখি হতেই সে হাত তুলে বোকা হেসে বলল,’হাই সেনোরিটা।কেমন আছ?’

নবনীতা রুগ্ন হাতটা নিজের মুখের কাছে এনে তার অক্সিজেন মাক্সটা সরাল।থেমে থেমে জড়ানো কন্ঠে বলল,’ভালোই আছি মনে হচ্ছে।’

আরহাম গোল গোল চোখে কয়েক পলক তাকে দেখে।নতুন করে কি বলা যায় তার মাথায় আসছে না।যেটা বলার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে সেটা এখন বলা যাবে না।কি বিচ্ছিরি পরিস্থিতির মাঝে পড়েছে সে।অবশেষে চেরাগ বাতি দিয়ে অনুসন্ধান করার পর সে একটা কথা খুঁজে পেল।সে প্রসন্ন হেসে বলল,’আমি দুই দিন ধরে সারাক্ষণ এদিকেই ছিলাম।কেন জানো?’

নবনীতা একপেশে হাসে।একবার মাথা নেড়ে জানায় সে জানে না।আরহাম ভাব নিয়ে বলল,’কারণ আমি চেয়েছি জ্ঞান ফেরার পর সবার প্রথম যেন তুমি আমাকেই দেখ।আর দেখ,আমার চাওয়া পূরণ হয়েছে।’

নবনীতা থমথমে মুখে জবাব দেয়,’জ্বী না জনাব।পূরণ হয়নি।আমি সবার আগে ডাক্তার আর নার্স কে দেখেছি।তারপর আপনাকে।’

আরহাম বাঁকা চোখে তাকে দেখল।বিরক্ত হয়ে বলল,’ধ্যাত! ঐ দেখার কথা বলিনি।আপনজনদের কথা বলেছি।’

নবনীতা শান্ত চোখে তার দিকে তাকায়।ঠিকই তো।ডাক্তার আর নার্স তো তার আপনজন না।তার আপনজন তো তার সামনে বসে থাকা এই ছেলেটা।যেই ছেলেটা রাজনীতিবিদ হিসেবে যেমন তেমন,কিন্তু ফ্যামিলি ম্যান হিসেবে এক শব্দে অসাধারণ।নবনীতা চোখ মেলে তাকে দেখে।লোকটার চোখ বলছে সে সত্যিই দুই রাত ঘুমায়নি।কেন ঘুমায় নি?নবনীতার জন্য?নবনীতা তার কে হয়?

আরহাম দীর্ঘসময় চুপচাপ থাকার পর নবনীতার ক্যানুলা লাগানো রুগ্ন হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।জড়ানো কন্ঠে বলে,’আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় আচরণ করেছি পরী।আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট।বাট এই দেখ,আমি তোমায় ছুঁয়ে প্রমিজ করছি,আমি তোমাকে আর কষ্ট দিব না।সত্যি সত্যি বলছি।তুমি এখন থেকে খুব ভালো থাকবে।এসব চাকরি বাকরির চিন্তা ছাড়ো।তুমি মন দিয়ে সংসার সাজাবে।বুঝেছ?’

নবনীতা ক্লান্ত ঘুম ঘুম চোখে আবারো তাকে দেখে।টেনে টেনে কয়েকটা শ্বাস নেয়।আরহাম কে তার অনেক কিছুই বলার ছিল।কিছু বিষয়ে সে আরহামের উপর নাখোশ।অথচ এই পরিস্থিতিতে সেসব কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। অপর পক্ষের মানুষটা যখন এতোখানি সহানুভূতি দেখায়,তখন নবনীতা আর কঠিন থাকতে পারে না।

আরহাম একটা হাত তুলে নবনীতার মাথায় রাখে।রাখতেই নবনীতার ক্লান্ত মুখটা দেখে গাঢ় স্বরে বলে,’তুমি এতো প্যারা নিচ্ছ কেন?আমি তো আছি।আমি থাকতে তুমি এতো কষ্ট কেন করবে?’

খড়খড়ে মরুর বুকে একটুখানি বৃষ্টি নেমে এলে যেমন অনুভূতি হয়,আরহামের একটু খানি স্নেহের বাণীতে নবনীতার ঠিক তেমনই অনুভূত হলো।এই ছয়টা বছর সে বিরামহীন ছুটে গেছে।মস্ত বড় পৃথিবীতে সে একাই লড়াই করেছে,অগনিত বার হোঁচট খেয়েছে।বার বার অনুভব করেছে তার জীবনে একটা শক্ত খুঁটির খুব অভাব।শুভ্রা আর চিত্রার মাথা গোজার ঠাই আছে।অথচ নবনীতার কেউ নেই।কেউ নেই যে কিনা নবনীতার কাছে আসবে আর বলবে,’এতো কষ্ট কেন করছ পরী?এই তো আমি আছি।আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই।’

নবনীতা আর্দ্র চোখে আবারো সামনে তাকায়।তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে,বক্ষপিঞ্জরে চলছে কালবৈশাখীর তুমুল তান্ডব।সে আনমনে এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দেয়।আলগোছে হাসে।যেই হাসিতে মিশে আছে খুব বেশি কৃতজ্ঞতা।তাকে এই প্রথমবারের মতো কেউ এমন করে আশ্বাস দিয়েছে।নবনীতা তো তার কাছ থেকে কখনোই এমনটা আশা করে নি।তার বাধ্য হয়ে,শুভ্রার সাথে রাগ দেখিয়ে,নিজের অভিমানের বশবর্তী হয়ে করা বিয়ে যার সাথে হয়েছিল,তার আর বর্তমানের আরহামের মাঝে কতোখানি পার্থক্য আছে! এই আরহাম কে নবনীতার মন্দ লাগে না।একটুও মন্দ লাগে না।

দু’জন চুপচাপ স্থির দৃষ্টিতে একে অন্যকে দেখে।নবনীতা কেবল মিষ্টি হেসে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।এই হাতটা তার স্বামীর।যেই স্বামীর অন্যায় অপরাধ নবনীতা গুনেও শেষ করতে পারবে না।কিন্তু সব দোষের ঊর্ধ্বে তার যেই গুনটি নবনীতাকে মুগ্ধ করে তা হলো নবনীতার প্রতি তার অপ্রতিরোধ্য টান।নবনীতা এই ছয় বছরে এতো রকম মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছে,যে মানুষ চিনতে তার খুব একটা সময় লাগে না।সেই অভিজ্ঞতা থেকেই সে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে শাহরিয়ার আরহাম তাকে পছন্দ করে।যেই পছন্দে কোনো খাঁদ নেই।

আরহাম অনেকক্ষণ উসখুস করার পর শেষটায় ধৈর্যহারা হয়ে বলল,’পরী তোমাকে আরো একটা কথা বলার ছিল।জানি হসপিটাল উপযুক্ত জায়গা না।তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।’

নবনীতা কপাল কুঁচকায়।একটু নড়েচড়ে উঠে জানতে চায়,’সেটা কি?’

আরহাম হড়বড় করে প্রশ্ন করে,’তোমার নাকি একটা মেজরের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল।আর তুমিও নাকি প্রথমবারেই সেই বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করোনি।এটা কি সত্যি?’

বিস্ময়ে নবনীতার মুখ হা হয়ে গেল।এমন একটা প্রশ্নের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।সে আশ্চর্য হয়ে বলল,’মেজর?কিসের মেজর?কার মেজর?’

‘আর কার?তোমার মেজর।তোমাদের বাড়িওয়ালার ভাগ্নে।তোমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল,ঐ মেজর।’

আরহাম কথা শেষেই চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকায়।নবনীতার বিস্ময়ভাব তখনো কাটেনি।কতোক্ষণ গোল গোল চোখে আরহাম কে দেখেই সে ফিক করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতেই চাপা স্বরে বলল,’ওহহ আচ্ছা মনে পড়েছে।’

‘মনে পড়েছে মানে?আবার কি মনে পড়েছে?ঐ বেগানা পুরুষকে মনে পড়ার কি আছে হ্যাঁ?’ খিটখিটে হয়ে প্রশ্ন করে আরহাম।

এই প্রশ্ন তেও নবনীতার হাসি পেল।সে মুচকি হেসে জবাব দিলো,’আচ্ছা তাহলে আর মনে করব না।ঠিক আছে?’

আরহাম জবাব না দিয়ে কেবল মাথা নাড়ল।তারপরই আবার ব্যস্ত হয়ে বলল,’একটা প্রশ্ন করি?’

‘জ্বী স্যার।করুন।’

‘সত্যি করে বলবে কিন্তু।’

‘জ্বী।অবশ্যই।বলুন আপনি।’

আরহাম একটু এগিয়ে এলো।কৌতূহলী হয়ে বলল,’আচ্ছা সত্যি করে বলো তো ঐ মেজর বেশি সুন্দর ছিল নাকি আমি?লাইক আমাকে বিয়ে করার পর তোমার কি একবারও মনে হয়েছে যে “ধ্যাত!এর চেয়ে তো ঐ মেজর কে বিয়ে করলেই বেশি ভালো হতো”?বলো তো সত্যি করে?’

নবনীতা নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে হাসি আড়াল করল।কয়েক সেকেন্ড ভেবে ভীষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,’সেটা বলার জন্য তো আমার আবার তার কথা মনে করতে হবে।আপনি তো এই মাত্র বললেন তার কথা মনে করা যাবে না।তাহলে কিভাবে উত্তর দিব?’

আরহামকে দেখাল তার চেয়েও বেশি চিন্তিত।অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তার পর সে মুখ বাঁকা করে জবাব দিলো,’আচ্ছা এক মিনিটের জন্য মনে করো।তারপর আবার ভুলে যেও।’

নবনীতা এবার সত্যি সত্যি শব্দ করে হেসে ফেলল।কোথাকার কোন মেজর।কতো বছর আগের কাহিনী।তার কথা তো নবনীতা কবেই ভুলে গেছে।এখন কেমন করে সে আবার এসব মনে করবে?

সে দুষ্টু হেসে আরহামকে দেখে বলল,’যতোটুকু মনে পড়ে,ঐ মেজরটাই বেশি সুন্দর ছিল।হাইটেও আপনার চেয়ে বেশি ছিল বোধ হয়।’

আরহাম আশাহত হলো,সেই সাথে কিছুটা ব্যথিত।সে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করল,’জামাই বউয়ের একটা পারফেক্ট হাইট ডিফারেন্স থাকতে হয়।আমাদের টাই বেস্ট।তোমার ঐ মেজর জিরাফ।’

‘হু।হতেই পারে।আমি আমার টা বললাম আরকি।’

‘তুমি তোমার টা বললা মানে?তুমি নিজের বর কে ফেলে আরেকজনের গুণ গাইছো?এটা কতো বড়ো অপরাধ তুমি জানো?তোমার উচিত ছিল আমার প্রশংসা করা।আর তুমি ঐ মেজরের প্রশংসা করছ?এটা কেমন বেয়াদবি হ্যাঁ?’

নবনীতা জবাবে কেবল ঠোঁট টিপে হাসে।ঐ মেজরের চেহারা তার মনেও নাই ঠিক মতো।তবুও আরহাম কে ক্ষেপাতে তার ভালো লাগছে।

আরহাম বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে ফিরে বলল,’এটা একদমই ঠিক না।আমি বাদেও তোমার জীবনে আর কেউ ছিল,ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছি না।তোমার সফ্ট কর্ণারের জায়গাটাও বা কেন আরেকজন পাবে শুনি?নট ফেয়ার।’

নবনীতা দুই চোখ সরু করে বলল,’সফ্ট কর্ণারের জায়গা আরেক জন পাবে মানে?আমার সফ্ট কর্ণার এখন কার জন্য আছে?’

‘অবশ্যই আমার জন্য।আই নো।তুমি আমাকে নিয়ে ভীষণ অবসেসড আমি জানি।’ দায়সারাভাবে জবাব দেয় আরহাম।

নবনীতা ফিচেল হাসে।দিরুক্তি করে জবাব দেয়,’জ্বী না জনাব।আমার আপনার প্রতিও কোনো সফ্ট কর্ণার নেই।’
বলেই সে আরো কিছুক্ষণ মাথা নামিয়ে নিঃশব্দে হাসে।

আরহাম কটমট চোখে তাকে দেখেই তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠে,’তোমার মতো বেইমান আমি দু’টো দেখিনি।এতো কিছু করার পরেও তুমি এই কথা বলছ।এজন্যই আমার মেয়ে মানুষ পছন্দ না।যাও কাল থেকে আমি আর এখানে আসবোই না।তুমি থাকো তোমার মতো।’

বলেই সে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।নবনীতা দ্রুত তার একহাত চেপে ধরে।মিষ্টি হেসে অনুরোধ করে,’প্লিজ আরহাম।এক্ষুণি যাবেন না।আরো কিছুক্ষণ থাকুন।থেকে আমার মন ভালো করে দিয়ে তারপর যান।’

তার বচনভঙ্গি এতো সুন্দর ছিল যে আরহাম এক কথাতেই সব মান অভিমান ভুলে গেল।সাথে সাথেই সে পুনরায় টুলে গিয়ে বসল।নবনীতা তার হাতটা পুনরায় নিজের মাথায় রেখে বলল,’আপনি সামনের পাঁচ মিনিট আমার মাথায় হাত রেখে একটানা বলবেন-তোমার কোনো ভয় নেই পরী,আমি আছি।
কি?বলতে পারবেন না?’

আরহাম অবাক হয়ে বলল,’কি অদ্ভুত ব্যাপার! এক কথা এতোবার বলব কেন?আমি কি পাগল?নাকি তোমার মাথায় সমস্যা?কোনটা?’

নবনীতা জেদ ধরে বলল,প্লিজ,বলুন না।আমার শুনতে ভালো লাগে ভীষণ।’

আরহাম হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে নবনীতার মাথায় হাত বুলায়।নবনীতা আবেশে চোখ বুজে।আরহাম গলা খাকারি দিয়ে কন্ঠ পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে,’তোমার কোনো ভয় নেই পরী।আমি আছি।তোমার কোনো ভয় নেই পরী।আমি আছি।তোমার কোনো ভয় নেই পরী।আমি আছি……….’

একবার,দুইবার,তিনবার,নবরীতার কথা মতো আরহাম পাঁচ মিনিটে অগণিত বার টেপ রেকর্ডারের মতো এক নাগাড়ে একই কথা বলে গেল।কে জানে,এই কথায় নবনীতা কি এমন মজা পেয়েছে।আচমকাই তার চোখ যায় নবনীতার বুজে রাখা চোখ দু’টোর দিকে।সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করে নবনীতা নিঃশব্দে কাঁদছে।তার চোখ ছাপিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরছে।আরহাম থমকায়।থতমত খেয়ে প্রশ্ন করে,’এ্যাই পরী! তুমি কাঁদছো কেন?আমি আবার কি করলাম?’

নবনীতা চোখ খুলে।একহাতে গালের কাছটা মুছতে মুছতে জড়ানো কন্ঠে বলে,’খুশিতে কাঁদছি।আপনি বলতে থাকুন।প্লিজ থামবেন না।’

আরহাম বোকা বোকা হয়ে আবারো যন্ত্রের ন্যায় এক কথা বারংবার বলতে থাকে।সে জানে না এই কথায় কি এমন মাধুর্য আছে,যেটা তার বউ এতো এতো শুনতে চাইছে।

সে জানল না তার সামান্য কিছু বাক্য মা বাবা হারানো মেয়েটির তপ্ত মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছে।কাঠফাটা গ্রীষ্মে বৃষ্টির আগমন যতো আনন্দের,তার এই কথাগুলোও নবনীতার কাছে ঠিক ততোটাই আনন্দের।নবনীতা টের পায় এই কথা গুলো শুনতে তার ভীষণ ভালো লাগছে,সে এসবের মাঝে তৃপ্তি খুঁজে পায়।মন চায় এক দৌঁড়ে কোনো একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে ছুটে যেতে আর চিৎকার করে বলতে,’এই দেখো,আমি একা নই।আমার সাথে আরেকজন আছে।আমার ভয় নেই,কোনো ভয় নেই।’

চলবে-