মনের দিক দিয়ে কিছুদিন ধরে এতখানি বিপর্যস্ত ছিলাম যে ডায়রিতে কিছু লিখবার কথা মনেও আসেনি। কিন্তু এখন কাপাকাপা হাতে লিখতে বসলাম। আজকের পর হয়ত আর কোনোদিনই কিছু লেখা হবে না।
হয়ত বলছি কেন, আজকের পর আসলেই কিছু লেখা আর হবে না।
আমার মতো একজন সাহসী, কঠোর মনের মেয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবে, কোনোদিন ভাবতে পারিনি। কিন্তু জীবনের এ মোড়ে এসে এমন ভাববার পিছে যে কারণ রয়েছে, তাতে আমি খুব বেশি অবাক হচ্ছি না। একজন মায়ের পক্ষে সবই সম্ভব। সন্তানের জন্য দুনিয়ার শেষ প্রান্তেও যাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন পড়লে নিজের বিনিময়ে সন্তানের সুরক্ষা করা সম্ভব।
হ্যাঁ, আনাহিতার সুরক্ষার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। ওকে সবধরণের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করব, এ কারণেই এমন চরম সিদ্ধান্ত নিতে আমি বাধ্য হলাম।
আকাশ, তুমি যাতে আমাকে ভুল না বোঝো, এজন্য সবকিছু আমি লিখে রেখে যাচ্ছি। আনাহিতা বড়ো হলে ওকেও বুঝিয়ে বোলো মা ওকে খুবি ভালোবাসে। কিন্তু মা’র পক্ষে সম্ভব হল না ওরসাথে থাকা, ওকে বড়ো হতে দেখা মা’র ভাগ্যে ছিল না।
নাহ, আর কাঁদব না। অনেক কেঁদেছি। কেঁদে কেঁদে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। অনেকবার ভেঙে পড়েছি। কিন্তু আর না, আমি এখন বদ্ধপরিকর।
সবটুকুই লিখব, কোনোকিছু বাদ দেব না।
আনাহিতা বিছানায় আরামে ঘুমাচ্ছে, ঘুমের মধ্যে ওর ঠোঁটে এক একবার করে স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠছে। আমি তৃষিত চোখে দেখছি আর ঝটপট লিখে চলেছি।
হাতে সময় বেশি নাই।
একমাস আগে আমিনা চলে গেছে। এই প্রথম একজন অনাত্মীয়ের সাথে বিচ্ছেদে আমার মন কেঁদে উঠেছিল। আমিনাকে আমি পছন্দ করে ফেলেছিলাম, হয়ত একটু আধটু ভালোও বেসে ফেলেছিলাম।
যাবার আগে আমিনা একগাদা জিনিস আমাকে আর আনাহিতাকে উপহার দিয়ে গেল। কিসব দোয়া পড়ে আমাকে ফুঁ দিল। ছলছল চোখে আমি বললাম
— আমিনা, তোমাকে খুব মিস করব।
কথা বলতে গিয়ে আমিনার গলা ভেঙে গেল
— আমিও, দীবা। একটা অনুরোধ করছি, প্লিজ রক্ষাকবচটা সাথে রেখো।
কিছু বললাম না। আসলে ইদানিং কারিনার কথা আমার মনেই পড়ত না, আমি আনাহিতাকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম। লেখার ঘরেও সেভাবে যাওয়া হয় না। আনাহিতা রাতে ঠিকঠাকভাবে ঘুমাতে শুরু করতে ওকে নিয়ে ও ঘরে রাত কাটাবার আর প্রয়োজন পড়েনি। লিখালিখিও আপাতত বন্ধ। তাই লিখবার ঘরে যেতাম না তেমন। কাজের খালা সকালে একবার পরিষ্কার করে দরজা বন্ধ করে চলে যেত। আমি ড্রয়িংরুম আর বেডরুমের মধ্যেই আনাহিতাকে নিয়ে আনাগোণা করতাম।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আমিনা জোর দিয়ে বলল
— আমার কথা একেবারে উড়িয়ে দিও না প্লিজ, দীবা। অনেকসময় কারিনা কোনো কারণে হিংসা করলে সে তোমার দুর্বল জায়গা খুঁজে নেবে। তারপর সেটার ক্ষতি করতে পারে। হয়ত আমি একটু বেশি ভাবছি, তারপরেও…
আমি তাড়াতাড়ি বললাম
— আমার কথা ভাববার জন্য আমি কৃতজ্ঞ, আমিনা। কিন্তু কারিনা আর আসে না। ওকে অনেকদিন দেখি না। হয়ত আমার বোরিং জীবন দেখে বিরক্ত হয়ে গেছে।
কথাটা হাল্কা করবার জন্য হাসলাম আমি।
উত্তরে কিছু বলল না আমিনা। আনাহিতাকে চুমা খেয়ে, আমাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল। আগামী বছরে আবার দেখা হবে, দুজনে দুজনকে কথা দিলাম।
আমিনাকে দেয়া কথা রাখতে পারব না ভেবে খুব খারাপ লাগছে।
আমিনা চলে যাবার প্রায় একমাস বাদে আনাহিতার ভীষণ ঠান্ডা লাগল। নিয়ে ছুটলাম ডাক্তারের কাছে। চিকিৎসা চলল। কিন্তু মুশকিল হল রাতে। ওকে যতবার ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দেই, নাক বন্ধ থাকার কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম ভেঙে কেঁদে ওঠে। ওকে তখন কোলে নিয়ে হাঁটতে হয়। সোজা হয়ে থাকলে ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু যেই বিছানায় শুইয়ে দেই, পাঁচ মিনিটের মধ্যে উঠে পড়ে।
কয়েকদিন চলবার পর বুঝলাম এভাবে হবে না। আকাশের সকালে কাজ থাকে। দুজনেই জেগে থাকবার কোনো মানে হয় না।
আবার ওকে নিয়ে লিখবার রুমে চলে এলাম। আমাকে তো রাতে উঠতেই হয় আনাহিতাকে খাওয়ানোর জন্য। আকাশ অন্তত ঘুমাক।
তখন থেকেই শুরু হল নতুন ঘটনা।
(চলবে)
সবার কমেন্ট ভীষণ এঞ্জয় করছি। ইদানিং গল্প তেমন দেয়া হয় না আইডি’তে। চুরি হবার ভয়ে। কিন্তু এই যে পাঠকের সাথে ইন্টার একশান, এটা আমি কত মিস করছিলাম বুঝতে পারছি।
আনাহিতা যখন তিনমাস শেষ করে চারমাসে পড়ল, তখন একদিন হঠাত করে সারারাতের কান্না বন্ধ করে দিল। ধীরে ধীরে আমাদের জীবন কিছুটা আয়ত্তে চলে এল। রাতে কিছুটা হলেও ঘুমাতে পারলাম। যদিও ওকে খাওয়াতে আমাকে উঠতেই হত।
এরমাঝে লেখালিখি একরকম বন্ধই হয়ে গেছিল। আনাহিতা পেটে আসতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওরদিকে পুরা মনোযোগ দেব, ওর সমস্ত কাজ নিজে হাতে করব। ও একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত অন্য কিছুতে মনোযোগ দিব না। এ কয়মাসে আমার কারিনাকেও তেমন দেখিনি, অথবা বলা যেতে পারে আমি খেয়াল করেই দেখিনি। আনাহিতাকে দেখভাল, ঘুমের ওলটপালট এসব নিয়ে এমন বিদ্ধস্ত ছিলাম যে কোনোদিকে আর মনোযোগ ছিল না আমার। একা হাতে সবকিছু করতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে আমি অনড় থাকলাম। আসলে ছোটবেলায় বহুসময় একা থাকতে হয়েছে আমাকে। অনেকসময় বেশ রাত পর্যন্ত। বাবার সাথে মার প্রচন্ড তিক্ততার মধ্য দিয়ে ছাড়াছাড়ি, জীবিকার প্রয়োজনে মা’র লম্বা সময় ধরে বাইরে থাকা, এসব কারণে সে আমাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারেনি। এখন মা’র সাথে সম্পর্ক অনেকখানি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে ঠিকই কিন্তু একসময় এনিয়ে মনে প্রচুর রাগ আর অভিমান পুষে রাখতাম। মা’র সাথে এনিয়ে বহু চিল্লাচিলি রাগারাগিও হয়েছিল। আনাহিতাকে যেন এর ভেতর দিয়ে যেতে না হয়, এ ব্যপারে আমি বদ্ধ পরিকর। বিয়ে যখন করেইছি, তখন আমার একটা ছোট্ট সুন্দর ছবির মতো সংসার থাকবে, ফুটফুটে বাচ্চা থাকবে, এ প্রতিজ্ঞা করেই আমি আকাশকে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ে হবার পরে আমি আমার বিবাহিত জীবন ও মাতৃত্বকে এতখানি উপভোগ করছি যে অনুভব করতে পারছি এমন এক স্বপ্ন আমি ছোটবেলা থেকেই মনের খুব গোপনে লালন করে রাখতাম।
আজ দুপুরে আমি আর আনাহিতা একচোট ঘুম দিয়ে উঠলাম। বিকালে বারান্দায় ওকে কোলে নিয়ে হাঁটছি, দরজায় কে জানি নক করল। খুলে দেখি আমিনা। আমাকে দেখে হাসল
— ভয়েভয়ে নক করেছি, দীবা। ভাবলাম ঘুমিয়ে আছ কিনা।
— নাহ, আমিনা। উঠে পড়েছি। ভেতরে এসো।
— থাক। বরং চলো নীচে এক চক্কর হেঁটে আসি। তুমি তো বাইরে যাওয়া বন্ধই করে দিয়েছ। এভাবে থাকা ঠিক না। মাঝেমাঝে বাইরে বের হবে, দেখবে মন ফ্রেশ হবে।
কী মনে করে সাথেসাথে রাজি হয়ে গেলাম। যেমন ছিলাম তেমন ভাবেই আনাহিতাকে কোলে করে বের হয়ে এলাম। কম্পাউন্ডের মধ্যেই থাকব, কে আর দেখবে।
— চলো তাহলে। দুইটা চক্কর দিয়ে আসি।
নীচে নেমে এক পাক হাঁটতে ফ্রেশ বাতাসে আসলেই মন চনমন করে উঠল। আনাহিতাকে কোলে নিয়ে আমিনার সাথে গল্প করতে করতে হাঁটছি, সামনে পড়ল এক কুচকুচে কালো বিড়াল। ভালো মোটাতাজা। আমার ঠিক সামনে পড়তে আমি থমকে দাঁড়ালাম। বিড়ালটাও দাঁড়িয়ে পড়ল, সটান আমার চোখে তার হলুদ চোখ রাখল, তারপর থাবা উঠিয়ে মিয়াঁও মিয়াঁও করতে লাগল। বিড়ালটার কান্ড দেখে আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। এমনিতেই বিড়ালের প্রতি বিশেষ প্রীতি নাই আমার।
দেখতে দেখতে বিড়ালটা দুই কদম এগিয়ে এল। আমার স্যান্ডেল পরা পায়ে খামচি দিতে পারে ভেবে চমকে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম। আমিনা রাগত স্বরে মরোক্কান ভাষায় কিযেন বলতে বলতে বিড়ালটাকে তাড়া লাগাতে সে পালিয়ে গেল।
আনাহিতাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললাম
— কী আশ্চর্য! এমন করল কেন? আমি তো ওকে কিছুই করিনি। বরং ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে ওকে চলে যাবার সুযোগ করে দিলাম।
আমিনা এক অদ্ভুত প্রশ্ন করল
— দীবা, তোমাকে যে রক্ষাকবচটা দিয়েছিলাম, ওটা পরে থাকো তো, তাই না?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করল
— পরো না? আধুনিক মানুষ, এসব বুজরুকি বিশ্বাস করো না, তাই না?
আমাকে এবারেও চুপ থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— সম্ভব হলে পরে থেক। ব্যপারটা আমার ভালো লাগল না।
— কী ভালো লাগল না, আমিনা?
— বিড়ালটাকে। স্বাভাবিক লাগল না।
— স্বাভাবিক না? কী হতে পারে? বিড়াল হয়ত ভেবেছে আমি ওর লেজে পাড়া দিব বা কিছু।
— না দীবা। ওটা বিড়াল নাও হতে পারে।
— তো কী হতে পারে?
— কেন যেন মনে হচ্ছে এ তোমার কারিনা। অনেকসময় ওরা বিড়ালের রূপ ধরেও আসে। কোনো কারণে তোমার ওপরে রেগে রয়েছে হয়ত। ঠিক বুঝতে পারছি না।
— সে কী! রাগবে কেন? আমি তো ওকে অনেকদিন ধরে দেখি না। এমনকি রাতের বেলায় আকাশের যাতে ঘুমের অসুবিধা না হয়, তারজন্য লেখার ঘরে একটা খাট ফেলে আনাহিতাকে নিয়ে দুই একদিন থেকেছি। তখনও ওকে দেখিনি।
চিন্তিতমুখে আমাকে দেখল খানিক আমিনা
— ও ঘরে আনাহিতাকে নিয়ে থাকো? তাহলে নিশ্চয় ও তোমাকে আর আনাহিতাকে দেখেছে। কিন্তু জানতে দেয়নি।
— কেন?
— কেন বলতে পারব না, দীবা। কিন্তু ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না এটুকু বলতে পারি। হয়ত ওর বাচ্চা নাই। তাই তোমাকে হিংসা করছে। কিছু একটা আছে তো বটেই।
আমি হাসলাম। সামান্য বিড়ালের কান্ড নিয়ে এত সিরিয়াস হবারও কিছু নাই
— চলো ফিরে যাই। আকাশের আসবার সময় হয়ে গেছে।
লিফট থেকে বের হয়ে বিদায় নেবার সময় আমিনা গম্ভীরভাবে বলল
— পারলে রক্ষাকবচটা পরে থেকো, দীবা। তোমাকে অনেক স্নেহ করি। তোমার কিছু হোক, আমি চাই না। আমিও মাসখানেকের মধ্যে ফিরে যাচ্ছি। তোমাকে দেখে রাখতেও পারব না।
আমিনা চলে যাচ্ছে বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত হলাম। তাই বলে মাছ লকেটটা পরতেও মন সায় দিল না। যত্তসব বুজরুকি।
আসলে শক্ত, সাহসী আর বাস্তববাদী হিসাবে বড়ো হবার কারণে এসবকে দুর্বল চিত্তের লক্ষণ বলে ভাবতে শিখেছিলাম। মন কিছুতেই সায় দিল না এক সামান্য লকেটের ওপরে নিজের সুরক্ষার ভার ছেড়ে দিতে।
(চলবে)
আমি এক ফুটফুটে মেয়ের মা হয়েছি। নাম রেখেছি আনাহিতা। অর্থাৎ নিষ্পাপ। আকাশ আর আমার দুজনেরই এ নাম পছন্দ। তবে নিষ্পাপ হলেও সে আমাদের কম জ্বালাচ্ছে না। রাত্রি হলেই গলা ফাটিয়ে এই যে চিৎকার আরম্ভ করে, ভোররাতে গিয়ে সেটা শেষ হয়। তারপর সারাদিন ঘুম। ডাক্তার বলেছে কোলিক। চিন্তার কিছু নাই, ঠিক হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। ঠিক হতে হতে তিনমাসে গিয়ে ঠেকল। ইতোমধ্যে আমার রাতের ঘুমের অভ্যাস চলে গেছে, সারারাত ওকে নিয়ে একবার হাঁটি, একবার বসি। দিনের বেলায় পড়ে পড়ে ওরসাথে ঘুমাই।
আনাহিতার কথা পরে বলল। তার আগে আমার প্রেগন্যান্সির সময়ের দুই একটা কথা লিখে রাখা জরুরী মনে করছি।
প্রথম দেখার কিছুদিনের মধ্যে আমিনার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। প্রতিবেশির সাথে এতখানি যাওয়া আসা এই প্রথম। দিনের বেলায় ও ইউনিভার্সিটি নিয়ে ব্যস্ত থাকত। কিন্তু বাসায় ফিরে প্রায়ই রাঁধতে বসে যেত। মরোক্কান কুসকুস, তাজিন ও আরো অনেক ডিশ সে রেঁধে আমাকে খাওয়াতে লাগল। প্রগন্যান্সির ঐ সময়ে খাওয়া নিয়ে আমি ভীষণ খুঁতখুঁতে হয়ে গিয়েছিলাম। আমিনার খাবারগুলি আমার মরা জিভকে নতুন করে জীবন দিল যেন। গোগ্রাসে খেতাম আমি, দেখে আমিনার চেহারায় সন্তোষটি ফুটে উঠত।
একবার বাসায় একা ছিলাম, আকাশ অফিসের ট্যুরে গেছে, আমিনা আমাকে রাতের খাবারের দাওয়াত দিল। গিয়ে দেখি এলাহী কারবার। টেবিল ভর্তি করে ডিশের পর ডিশ।
খেতে খেতে অনেক গল্প হল। একসময় মনে পড়তে প্রশ্ন করলাম
— আমিনা, তুমি প্রথমদিন আমাকে দেখে কেন বলেছিলে যে আমার মধ্যে ছায়া রয়েছে? কথাটার মানে কী?
অল্প হাসল আমিনা
— আমি দেখেছিলাম ছায়া, দীবা। তোমার চোখে। ভয়ের কিছু নাই। সে তোমারি আরেক সত্ত্বা বা মিরর ইমেজ বলতে পারো।
খুব কৌতূহল হল। আমিনাকে এ পর্যন্ত আধুনিক মানুষ হিসেবে ভেবে এসেছি। ওর মুখ থেকে এমন কথা শুনব, ভাবিনি। প্রশ্ন করলাম
— কেন একথা বলছ খুলে বলবে প্লিজ?
একটু চুপ করে রইল আমিনা। তারপর আরম্ভ করল
— তুমি নিশ্চয় ভাবছ চলনে বলনে আধুনিক মানুষ হয়েও এমন আজগুবি কথা বলছি কেন, তাই না?
আসলে হয়েছে কী, এখন আমরা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছি, সবাই নানান ধরণের পেশায় নিযুক্ত আছি। কিন্তু দুই পুরুষ আগেও আমরা মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, ছিলাম এক গুপ্ত সংঘের সদস্য। প্রকাশ্যে কিছু করার সুযোগ ছিল না কারণ আইন করে আমাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয়া হয়েছিল।
খুব কৌতূহল হল। জানতে চাইলাম
— কী করতে তোমরা?
— নানান অলৌকিক ব্যপার নিয়ে সাধনা চলত আমাদের সংঘে। এবং সেসব শুধুমাত্র মেয়েদের মাঝেই ছড়িয়ে দেবার নিয়ম ছিল, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তবে সেসব গুপ্ত রীতি রেওয়াজ মানুষের উপকারে ব্যবহার করা হত। আমাদের সঙ্ঘের অন্তর্ভুক্ত হবার প্রথম শর্তই ছিল কারো অপকার করা যাবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কঠোর সাধনার ফলে প্রাকৃতিকভাবে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব প্রখর হয়, আমরা সহজেই আশেপাশের অনেককিছু অনুভব করতে পারি। যেমন তোমারটা করেছি।
চমতকৃত হয়ে গেলাম আমি। বিশ্বাস করব কী করব না, বুঝতে পারলাম না।
— আমার মাঝে যে ছায়া দেখেছ তা নিয়ে বিস্তারিত জানো কিছু?
— হুম, জানি। আফ্রিকা, মিডল ইস্ট এসব জায়গায় কারিন বা কারিনা কথাটা বেশ প্রচলিত। ছেলেদের কারিন বলা হয় আর মেয়েদের কারিনা। মূলত কারিন বা কারিনা হচ্ছে তোমার ছায়া বা দ্বৈত সত্ত্বা। যাকে বলে মিরর ইমেজ। প্রতিটি মানুষেরই কারিন বা কারিনা রয়েছে। বেশিরভাগ সময়ে দুজনে দুজনার অস্তিত্ব সম্পর্কে আজীবন টের পায় না। যদিও দুজনের মধ্যে গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত দুজনের জীবন হুবহু একরকম হয়। এমনকি জন্ম মৃত্যুও একসাথে ঘটে। কিন্তু যদি দুজনের জীবনের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয় আর তোমার কারিন/কারিনা যদি সেটা টের পেয়ে যায়, তবে অনেকক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনতে পারে। তখন সে হতে পারে তোমার ইভেল টুইন।
— কেমন বিপদ? সে কি আমাকে মেরে ফেলতে পারে?
যত শুনছি ততোই আগ্রহ পাচ্ছি। আমার লেখার জন্য চমৎকার আইডিয়া, সন্দেহ নাই।
— না, সে তোমাকে কখনোই মেরে ফেলবে না। কারণ তোমাকে মারলে তার নিজের অস্তিত্বও মুছে যাবে।
— যাক বাবা। তাহলে কোনো চিন্তা নাই। একটু আধটু দুষ্টুমি করলে ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করব না।
আমার বুকশেলফের বইগুলির দশা মনে পড়তে হাসতে হাসতে বললাম। আমিনাও ঠোঁট টিপে হাসল।
— অন্যান্য দেশের কারিন বা কারিনাকে নিয়ে যে বিশ্বাস রয়েছে তার থেকে আমাদের বিশ্বাসে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
— এক মিনিট, আমিনা। অন্যান্য দেশে কী বিশ্বাস করে?
হাসল আমিনা, আমার কৌতূহল দেখে
— ইহুদী লোককথায় বলে তুমি আর তোমার কারিন একদম এক হবে। তুমি মেয়ে হলে, সেও মেয়ে। তোমার বিয়ে, ছেলেমেয়ে হলে তারও হবে। তোমার মৃত্যু হলে সেও সাথেসাথে মারা যাবে।
কিন্তু ইজিপ্সহিয়ান বা কিছু আরব দেশে আবার ভিন্ন মতবাদ। তাদের বিশ্বাস ছেলেদের থাকবে মেয়ে কারিনা আর মেয়েদের ছেলে কারিন। তারপর অবশ্য বিয়ে বা ডিভোর্স হলে অপরদিকেও তাই হবে। মৃত্যুও একই সময়ে হবে।
— এখন তোমাদের মরক্কোতে কী বিশ্বাস, সেটা বলো প্লিজ।
— মরোক্কোতে কারিন/কারিনার সাথে সম্পর্কটা আরো এক ধাপ জটিল। আমাদের বিশ্বাস প্রতিটি মানুষের কারিন/কারিনা তো থাকেই, সাথে আকাশেও একটা তারা থাকে, সেই সাথে স্বর্গের গাছে একটা করে পাতা বরাদ্দ থাকে। সবার ভাগ্য একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অসুখ করলে কারিন/কারিনারও অসুখ করে, তারার উজ্জলভাব কমে যায়, গাছের পাতা হলদেটে হতে আরম্ভ করে। মরে গেলে কারিন/কারিনাও মরে যায়, তারা খসে পড়ে, পাতাও গাছ থেকে ঝরে পড়ে।
— বাব্বাহ। খুবি ইন্টারেস্টিং।
টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল আমিনা। বেডরুম থেকে লাল মখমলের ছোট্ট থলে টাইপের ব্যাগ এনে আমার হাতে দিল।
— তোমার জন্য, দীবা।
আমি তো অবাক
— আমার জন্য?
— হুম। মরক্কো থেকে আনিয়ে নিলাম। রক্ষাকবচ। সবসময় পরে থেকো। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাছাড়া আমি তো রয়েইছি। এবারে আমি সামারের পরেও কন্ট্রাক্ট এক্সটেন্ড করেছি। কাজেই তোমার ওপরে নজর রাখতে পারব।
বিস্মিত হলাম, খানিকটা সংকুচিত হয়েও গেলাম বলা চলে। কারো কাছ থেকে উপহার নিতে আমি সংকোচবোধ করি। উপহার কেন, কারো সাহায্যও আমি সহজে নেই না। কিন্তু একজন এত ঝামেলা করে সুদূর মরোক্কো থেকে আমার জন্য জিনিস আনিয়ে নিয়েছে আর আমি অকৃতজ্ঞের মতো নিতে অস্বীকার করব, এতখানি অভদ্রও আমি না। ধন্যবাদ দিয়ে থলেটা হাতে করে বাসায় চলে এলাম।
থলে থেকে বেরুলো মাছের আকৃতির এক লকেট, কালো সুতায় বাঁধা। জিনিসটা কাঠের, ওপরে মাছের অবয়ব খোদাই করা। বেশ সুন্দর। আমি হয়ত পরতাম মালা হিসাবে কিন্তু রক্ষাকবচ শব্দটাই আমার মনে অস্বস্তির সৃষ্টি করছে। এসব জিনিসে বিশ্বাস নেই। আমি অতিপ্রাকৃত জিনিসে বিশ্বাস করি ঠিকই, কিন্তু তাদের কাছ থেকে রক্ষা পাবার জন্য তাবিজ কবজ পরে ঘুরে বেড়াব, এতখানি রক্ষণশীল আমি নই। কেউ জানলে হেসে কুটিপাটি হবে। বিশেষ করে আমার মা। এদিকে আকাশ তো হাসতে হাসতে সোফা থেকেই পড়ে যাবে।
কারো হাসির পাত্র হতে আমার খুব অনীহা।
ফ্যান্টাসি নিয়ে লেখালিখি করলেও আসলে আমি ভীষণ বাস্তববাদী, খুব সাহসীও। না হয়ে উপায় ছিল না। আমার সিঙ্গেল প্যারেন্ট মায়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে গিয়ে অনেক ধরণের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে শিখে গেছিলাম। খুব অল্প বয়স থেকে আমাদের নিয়ে লোকের নোংরা অপবাদ, কুটনামি, অপপ্রচার, এমনকি বিনা কারণে ক্ষতি করবার চেষ্টা, অসহযোগিতা সয়ে এসেছি। মাকে দেখেছি আমার অমানুষ বাবাকে ছেড়ে আসবার জন্য কত ধরণের অনভিপ্রেত ঘটনা বা কথার মুখোমুখি হতে। যা একজন অল্পবয়সী মেয়ের সামনে হওয়া কোনো ভাবেই উচিৎ ছিল না। যারজন্য আমিও খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যেতে বাধ্য হয়ে ছিলাম। অন্তত মনের দিক দিয়ে। ফালতু ভাবালুতা বা অল্প বয়সের অতি আবেগ আমার মনের মধ্যে শিকড় গেড়ে বসবার চান্সই পায়নি। আমি নিজেকে গড়ে তুললাম স্বাধীনচেতা, সাহসী আর বাস্তববোধসম্পন্ন হিসাবে। অন্যের ওপরে নির্ভর করতে শিখিনি। অন্যের উপহাস তো আমার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।
সেখানে একটা মাছ আকৃতির লকেটের ওপরে নিজের সুরক্ষার ভার ছেড়ে দেব ভাবাটাই হাস্যকর। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে থলেটা ওখানেই রেখে দিলাম।
(চলবে)
বি দ্র— আমাদের রাত্রে(দেশের সকালে) আরেকটা পর্ব দেয়া হবে এখন থেকে। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টায় দুইটা করে পর্ব।
সবাই খুশি তো? আমাকে বাহবা দিন, প্লিজ! 🤣
তিনমাসের বেশি হয়ে গেছে ডায়রিতে কিছু লিখিনি। আসলে লিখবার মতো কিছু ছিল না। কারণ আমি বাসায় ছিলাম না। মায়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।
ব্যপারটা তাহলে খুলেই বলি। ডিসেম্বারের শুরুতে কনসিভ করেছিলাম। টের পাইনি তবে জানুয়ারিতে অল্প অল্প ব্লিডিং হচ্ছিল দেখে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে জানতে পারি। ডাক্তার আমাকে ফুল রেস্টে থাকতে বলল। ইউটেরাসে নাকি বেশকিছু গ্রোথ রয়েছে। যাহোক, প্রাথমিকভাবে আমি আর আকাশ দুজনেই হতবাক হয়ে গেছিলাম। এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেবার কথা আমরা চিন্তাও করিনি। কিন্তু ঘটেই যখন গেছে, তখন কেমন এক মমতা চলে এল ভ্রুণটার প্রতি। কোনোমতেই একে হারাতে চাই না আমরা। মা’র বাড়িতে গিয়ে থাকবার সিদ্ধান্ত নিলাম, আকাশও বারবার বলতে লাগল। তিনমাস পার হয়ে গেলে বিপদের আশংকা কমে যাবে, ডাক্তার বলল। আমি তাও তিনমাস পার করে আরো একমাস কাটিয়ে আজ বাসায় ফিরে এলাম। আমাকে ছাড়া আকাশের কষ্ট হচ্ছে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। যদিও সে কখনো কিছু বলে না।
লিফট আমাদের তলায় পৌঁছে গেল। ল্যান্ডিং এ বের হতে দেখি চারিদিকে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আকাশ আমাকে বলেছিল আমাদের পাশের ফ্ল্যাট খালি হয়েছে, আজ নিশ্চয় নতুন ভাড়াটে এসেছে। খোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম যদি কিছু দেখা যায়। আমি খুব বেশি মিশুকে না হলেও মানুষ দেখতে পছন্দ করি। লেখায় খুব কাজে দেয়। তাছাড়া প্রতিবেশীর সাথে মৌখিক সদ্ভাব রাখতেও পছন্দ করি। শুধু অকারণে যাওয়া আসা, গসিপ এসব পছন্দ করি না।
ভাবতে না ভাবতেই এক মাঝবয়সী মহিলা বের হয়ে এল। মহিলা আফ্রিকান, পরণে খুব রঙচঙে কাফতান, মাথায় কাফতান কাপড়ের পাগড়ি জাতীয় জিনিস বাঁধা। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে হাসল।
— হাই, আমি আমিনা হই।
— হাই, আমি দীবা।
— নাইস টু মিট ইউ, দীবা। তোমার বাসা হয়?
আঙুল দিয়ে আমাদের এপার্টমেন্ট দেখিয়ে দিল আমিনা। ওর জোড়াতালি দিয়ে বাংলা কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম
— হ্যাঁ, আমিনা। তুমি বাংলা জানো?
— হুম। আমি এভ্রি ইয়ার আসি তো। ছাত্রদের পড়াইতে।
প্রথম দেখায় আমিনাকে ভালো লেগে গেল আমার। পরে কথায় কথায় জেনেছিলাম ও মরোক্কোর মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। সামারে বাংলাদেশের এক নামকরা ইউনিয়ার্সিটিতে পড়াতে আসে ভিজিটিং প্রফেসার হিসাবে। ইংরেজি সাহিত্য।
বাহ! একজন ভিনদেশী প্রফেসারকে প্রতিবেশী হিসাবে পেয়ে খুব খুশী হলাম আমি। মরক্কো নিয়ে বরাবর কৌতূহল ছিল। মনেমনে ভেবে রেখেছিলাম মরক্কোকে পটভূমি রেখে ফ্যান্টাসী উপন্যাস ফেঁদে ফেলব। আমিনার কাছ থেকে নিশ্চয় অনেক সাহায্য পাওয়া যাবে ভেবে উৎসাহিত হয়ে পড়লাম।
আমিনা খুব করিৎকর্মা। জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাবার জন্য লোক থাকলেও সে নিজেই একটা বড় বাক্স অবলীলায় তুলে নিল। দেখে আমি বললাম।
— সরি, আমিনা। আমার সাহায্য করা উচিৎ। কিন্তু ডাক্তার আমাকে ভারী তুলতে মানা করেছে।
— না না। নো ওয়ারিজ। প্রেগনেন্সিতে ওয়েট ক্যারি করিতে হইবে না। দেখা হইবে, দীবা।
আমাকে হতবাক করে দিয়ে আমিনা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। ও জানল কিভাবে যে আমি প্রেগন্যান্ট? আমাকে দেখে কোনোমতেই বোঝা সম্ভব না।
চাবি ঘুরিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে মনটা প্রসন্ন হয়ে গেল। আমার অনুপস্থিতিতে ঘরবাড়ির অবস্থা ছন্নছাড়া হয়ে নাই। দুজন পরিচারিকা রয়েছে। একজন পরিস্কার করে, অন্যজন রান্না। বেডরুমে ঢুকে হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রাখছি, আকাশের ফোন এল।
— পৌঁছেছ, দীবা?
— হু, পৌঁছেছি।
— শোনো, রান্নার খালাকে তোমার পছন্দের খিচুড়ি, বেগুন ভাজি, আলু ভর্তা, ভুনা মাংস করে রাখতে বলে দিয়েছিলাম। দেখেছ?
— এইমাত্র ঢুকলাম, আকাশ। ব্যাগ রাখছি বেডরুমে।
— খুব সাবধানে থাকবে কিন্তু। খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কিছু ধরতে হবে না। তোমার কিছু লাগলে আমি এসে করে দিব।
— আচ্ছা বাবা!
হাসতে হাসতে ফোন কেটে দিয়ে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালাম। কুকারে হাড়িতে রান্না করা রয়েছে, এখনো গরম। গরম থাকতে থাকতেই খেয়ে নিতে হবে।
খেতে বসে ভাবলাম আমিনা ব্যস্ত, খাবার কিছুটা দিয়ে এলে ওকে আর ঝামেলা করতে হয় না। ঝটপট বক্সের মধ্যে সাজিয়ে ফেললাম। কিন্তু যাবার আগে আমার লেখার ঘরটায় একবার ঢুঁ মারা দরকার। এতক্ষণ এসেছি, একবারও গেলাম না। ঘরটা যেন হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছে।
দরজা ঠেলে ঢুকতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘরে জিনিস বেশি নাই কিন্তু যা আছে, সব লন্ডভন্ড হয়ে রয়েছে। বুকশেলফ থেকে কেউ বইগুলি যেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে ঘরের চারিদিকে ফেলেছে। মোমবাতি দানটা একদিকে উল্টে পড়ে রয়েছে। শখের জিনিসপত্রের এমন অবস্থা দেখে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না, ঝটপট দুহাতে সবকিছু তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় সাজিয়ে ফেললাম। কাজের খালা যখন এসেছিল তখন নিশ্চয় এ ঘরটাও পরিষ্কার করেছিল, একফোঁটা ধূলা কোথাও নাই। তারমানে যা হয়েছে, খালা চলে যাবার পরেই হয়েছে।
চোখের কোণে কী যেন নড়ে উঠল। তাকিয়ে দেখি আয়নায় সে উঁকি দিয়েই সরে পড়ল। মুখখানি থমথমে। মনে হল এ ওরই কাজ। এতদিন আমাকে দেখেনি, তাই রাগ করে জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে।
বাব্বাহ! এত রাগ! মজাই লাগল আমার। আমাকে মিস করেছে দেখি।
খাবারের বক্স দেখে আমিনা খুব খুশি হল
— ওয়াও, আমি বাঙালি ফুড ভালোবাসি, দীবা। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।
— মোস্ট ওয়েলকাম, আমিনা। গরম গরম থাকতে খেয়ে নাও। আমি চললাম। ঘুমে পড়ে যাচ্ছি।
— চলো তোমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেই।
দরজা বন্ধ করবার আগে আমিনা অদ্ভুত এক কথা বলল
— তোমার মাঝে আরেকজনের ছায়া দেখছি, দীবা।
আমি তখন ঘুমে চোখ খুলে রাখতে পারছি না। না শোনার ভান করে ঝটপট ফিরে এসে বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
(চলবে)
রিচের অবস্থা যা! মনে হচ্ছে অবস্থার উন্নতি করতে “বাসরঘরে লালবাত্তি!” লেখা ছাড়া উপায় নাই! তয় কারিনার আরেকটা পার্ট দিলাম। আপনারা যারা পড়বেন কষ্ট করে কমেন্ট টমেন্ট কইরেন!
কারিনা (২)
(২)
০২/০১/২০২৪
ভাবছি এখন থেকে অদ্ভুত ব্যপারটা ডায়রিতে লিখে রাখব। স্কুলে পড়তে ডায়রি লিখবার অভ্যাস ছিল। বহুদিন লিখি না। কিন্তু এখনকার ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর, লেখালিখির কাজে আসতে পারে ভেবে লিখে রাখবারই সিদ্ধান্ত নিলাম। দেখা যাক, কতটুকু কাজে আসে!
আজকের কথাটা চট করে লিখে ফেলি। সকালে যথারীতি আকাশ কাজে চলে গেছে। আমিও উঠে জগিং, গোসল, নাস্তা প্রভৃতি সেরে লিখতে বসেছিলাম। এখন বাজে এগারোটা। ব্রেক নিতে উঠলাম। রান্নাঘরে এসে চা বানাচ্ছি, ধপ করে শব্দ হল। খানিক পরে আরেকবার। কান খাড়া করলাম আমি। শব্দটা আমার লিখবার ঘর থেকে আসছে বুঝতে পারছি। গত কয়দিন ধরে ঘর খালি থাকলে, সাথে আমি বাসায় একা থাকলে খুটখাট শব্দ আসে ওঘর থেকে টের পাই। প্রথম প্রথম আমি দৌড়ে যেতাম। গিয়ে অবশ্য কিছু দেখতাম না। শুধু টেবিলের ওপরে জিনিসপত্র সামান্য এদিক ওদিক করা থাকত। অন্য কেউ হয়ত খেয়ালও করত না। কিন্তু ঐ যে বললাম আমি একটু পিটপিটে স্বভাবের। যে জিনিস যেখানে থাকবার কথা, সেটা সেখানে থাকতে হবে। সামান্য নড়াচড়া করলেও আমি টের পাব।
যাই হোক, খুব একটা পাত্তা দেইনি, ভয়ও পাইনি। একে তো সাহসী, উপরন্ত আমি জানি এ কার কাজ। এ আমারই কাজ। মানে ঠিক আমি না। তবে আমার মতো দেখতে এক মেয়ের। টেবিলের ওপরে যে ভারী এন্টিক আয়নাটা রয়েছে, সেখানে ও থাকে। কিছুদিন হল ওকে আমি দেখতে পেয়েছি। প্রথম প্রথম এক ঝলক দেখা দিয়েই সরে যেত। কয়দিন যেতে উঁকি দিয়ে মুখটা সরিয়ে নিত না। মনোযোগ দিয়ে কৌতূহলী চোখে ঘরের চারিদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত, আমাকেও দেখত। একদিন আমার চোখে চোখ পড়তে আমি হেসে ওকে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম। তাতে ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো আগ্রহে যেন ফেটে পড়ল। আমার হাসির জবাবে ওরও ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। সামান্য চমকে উঠলাম। ওর হাসিটা অবিকল আমার মতো। অবশ্য ও দেখতেও হুবহু আমার কার্বন কপি। কাজেই হাসিটা আমার মতো হবে, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নাই।
চা হাতে করে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বুকশেলফের দিকে। আমার বইগুলি লেখক অনুসারে পরিপাটি করে সাজানো থাকে। এখন দুটা বই মাটিতে পড়ে রয়েছে। আরেকটা বই কেউ টেনে বের করার চেষ্টা করেছে বোঝা যায়। অন্যান্য বই থেকে সামান্য আগানো রয়েছে সেটা। ধুপধাপের কারণ বোঝা গেল এতক্ষণে। কয়েকদিন আগে থেকেই সে আয়না থেকে বের হয়ে এসে টেবিলের ওপরে রাখা মোমদানটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখত, আমার চায়ের মগও এদিক সেদিক সরিয়ে রাখত। আজ মনেহয় সাহস করে টেবিল থেকে বুক শেলফ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে আমার বইয়ে হাত দিয়েছে।
যদিও আমার জিনিসে হাত দেয়া ঠিক পছন্দ করি না কিন্তু ওর প্রতি আমারও কৌতূহল কম না। কে ও? কেন ও হুবহু আমার মতো দেখতে? ও থাকে কোথায়? কিভাবে আমার খোঁজ পেল? ও কি কিছু চায় আমার কাছ থেকে? এসব প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে তুলল। আকাশকে বলিনি, বললে ও বিশ্বাস করবে না, হয়ত আমাকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে দৌড় দিবে। ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করে না। কেন যেন মনেহয় ওকে আকাশ দেখতে পাবে না। শুধু শুধু বলে লাভ নাই।
কিন্তু ওকে আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। মনের মধ্যে গল্পের বীজ ধীরে, খুব ধীরে অঙ্কুরিত হচ্ছে। দেখি ও কী করে। ওকে ঘিরেই গল্প লেখা যাবে নাহয়।
০৭/০১/২০২৪
আজ ওর পূর্ণ অবয়ব প্রথমবারের মতো দেখতে পেলাম। সকালে উঠতে একটু দেরীই হয়ে গেছিল। বিছানা ছাড়তেও ইচ্ছা করছিল না, কেমন ক্লান্ত অবসন্ন লাগছিল। পাত্তা না দিয়ে জোর করে বিছানা ছাড়লাম। প্রতিদিনের মতো জগিং এও গেলাম। ফিরে এসে যথারীতি গোসল নাস্তা সারলাম, লিখবার ঘর থেকে কোনো সাড়া নেই। ভাবলাম আজ হয়ত ওর দেখা পাব না।
কিন্তু ঘরে ঢুকতেই ওকে দেখলাম বুকশেলফের সামনে। আমারি একটা বই খুলে মনোযোগ দিয়ে ফ্ল্যাপে আমার ছবিটা দেখছে। হুট করে আমি ঢুকতে চমকে গিয়ে হাত থেকে বইটা পড়ে গেল। তারপর এক দৌড়ে নিমেষে সে আয়নায় ঢুকে পড়ল। মাত্র এক ঝলক আমি ওকে দেখতে পেলাম কিন্তু তারমধ্যেও বুঝলাম ওতে আমাতে কোনো তফাত নেই। অনায়াসে ওকে আমি বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।
ইন্টারেস্টিং! ভেরি ইন্টারেস্টিং!
একটা গল্প লিখতেই হবে ওকে নিয়ে।
(চলবে)
দরজায় অনেকবার নক করছি, চাবি নিয়ে বেরুতে ভুলে গেছি দেখে নিজেকে একচোট গালাগাল করলাম। চারবার নক করবার পর ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দিল আকাশ। আমাকে দেখে ভুরূতে ভাঁজ ফেলে বলল
— তুমি? আমি ভেবেছিলাম তুমি পাশের রুমে।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম
— তুমি তো জানোই এসময়ে আমি জগিং করতে যাই। পাশের রুমে আছি ভাবলে কেন?
আকাশের চোখে তখনো ঘুম লেগে রয়েছে। বাচ্চাদের মতো মাথা চুলকে বলল
— কী জানি। মনে হল একবার শব্দ পেলাম ওঘর থেকে। ভাবলাম তুমি হয়ত লিখছ।
— ওপরের তালায় শব্দ হলে অনেকসময় ওরকম মনে হয়।
— তাই হবে। সোফায় বসে পড়ল আকাশ।— উঠিয়েই যখন দিলে, এক কাপ চা খাওয়াও দেখি, ডার্লিং।
— তাহলে একটু অপেক্ষা করতে হবে, ডার্লিং। জগিং শেষে গোসল না করে কিচেনে যাই না আমি, জানোই তো।
ওমনি আকশের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। তড়াক করে উঠে আমার পিছু নিতে নিতে বলল
— গোসলেই যখন যাবে, তার আগে নাহয়…
আমি ওর হাতের নাগালের বাইরে গিয়ে হাসতে হাসতে খুন হয়ে গেলাম
— এই অসভ্য। দিনে দুপুরে এসব কী! তোমার অফিস নাই বুঝি!
— শালার অফিস! অবলীলাক্রমে অফিসের গুষ্টি কিলালো আকাশ।
মাত্র ছয়মাস আমাদের বিয়ে হয়েছে। ৯০% সম্বন্ধের বিয়ে, ১০% প্রেম। মানে বিয়ের কথা পাকা হতে হতে যতটুকু প্রেমে পড়া যায় আরকি। গত ছয়মাস ধরে তাই একে অন্যকে চিনে নিচ্ছি। বিবাহিত জীবন উপভোগ করছি। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে আমি, সেজন্য বিয়ে নিয়ে মনেমনে অনেক ভয় ছিল। যারজন্য ভেবেচিন্তে আকাশকে বেছে নিয়েছিলাম। এ সিদ্ধান্ত নিতে মনের থেকে মগজকে অগ্রভাগে রেখেছিলাম। মায়ের জীবনের প্রতিফলন নিজের জীবনে দেখতে চাইনি বলে। এখন মনে হচ্ছে হয়তবা আমি ভুল করিনি। আকাশের সাথে এ কয়মাসের যৌথ জীবনে ছন্দপতন একবারও হয়নি। ছোট্ট একটা সংসার হয়েছে আমাদের। নিজের হাতে গুছিয়ে নিচ্ছি। ফাঁকেফাঁকে আমার লেখালিখিও চলছে। দুই বেডরুমের বাসার সেকেন্ড বেডরুমটাকে আমার লেখার ঘর হিসেবে সাজিয়ে নিয়েছি।
ভার্জিনিয়া উলফের এ রুম অফ ওয়ান’স ওন।
লেখার টেবিল, ল্যাপটপ আর একটা বুকশেলফ ছাড়া রুমটাকে অযথা জিনিসপত্র দিয়ে জঙ্গল বানাইনি। টেবিলের ওপরে অবশ্য দুটো প্রিয় জিনিস রয়েছে। সুগন্ধী মোমবাতি। সাথে এন্টিক দোকান থেকে কেনা সোনালি আয়না। ছোট গোলাকৃতি আয়নাটার নিজস্ব স্ট্যান্ড আছে। সুন্দর কারুকাজ করা তাতে। মোমবাতি জ্বালিয়ে লিখতে লিখতে যখন আয়নায় মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে দেখি, নিজেকে ভীনদেশের এক রাজকুমারী বলে মনে হয়। অবশ্য আমি লিখিও ফ্যান্টাসী। সেজন্য এ অনুভূতিটা লেখার সময় খুব কাজে দেয়।
— ওকি, গোসলে না গিয়ে ওঘরে যাচ্ছ কেন? এসেই লিখতে বসবে নাকি?
— আসছি। একটা ইমেইল এক্সপেক্ট করছি। দেখি এলো কিনা। জরুরি ইমেইল।
লেখার ঘরে ঢুকে ল্যাপটপ অন করে চেক করলাম। আসেনি। টেবিলের সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে নিলাম। লেখার টেবিলটা আমার অতি প্রিয়। এখানে শুধু ল্যাপটপ, আয়না আর মোমবাতি থাকে। আর কিছু রাখি না। ওহ, আমার প্রিয় চায়ের মগটাও থাকে। লিখবার সময় চা চাই আমার। সাথে একটা ছোট্ট নোটবুক আর আকাশের কাছ থেকে উপহার পাওয়া দামী কলম। নোটবুকে নানান আইডিয়া টুকে রাখি, চা খেতে খেতে প্লটিং করি।
চিন্তিতভাবে মগটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি ডানহাতি। মগটাও ডানদিকে থাকে সবসময়। আজ সকালে উঠে যখন চা খেয়েছিলাম তখন ডানদিকে রেখেই উঠে পড়েছিলাম যতদূর মনে পড়ে।
কিন্তু এখন মগটা বাদিকে আয়নার গা ঘেঁষে রয়েছে।
এখানে বলে রাখি, আমার একটু পিটপিটে স্বভাব রয়েছে। যে জিনিস যেখানে থাকবার কথা, সে জিনিস সেখানেই থাকতে হবে। চা খেতে হলে আমি ডানহাতে মগ ধরে লেখার টেবিলের ডানদিকে রাখি। এর অন্যথা কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আজ হঠাত বাদিকে কেন?
ঘরের চারদিকে ভালো করে দেখলাম। সবকিছু ঠিকঠাক, যেভাবে রেখে গেছিলাম, সেভাবেই রয়েছে। শুধু মগটা মনে অস্বস্তির জন্ম দিচ্ছে।
মগ তুলে ডানদিকে রাখলাম। কী মনে করে সাথে নিয়েই বের হলাম। যদিও এ সময়ে আমি চা খাই না, তাও আজ নাহয় খেলামই আকাশের সাথে।
ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে প্রশ্ন করলাম
— আকাশ, তুমি কি আমার রুমে গেছিলে?
আকাশের চেহারায় কনফিউশান দেখা দিল
— আমি? আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম, দীবা। তোমার রুমে কখন যাব?
মন থেকে ব্যপারটা ঝেড়ে ফেলে আমি বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। মনের ভুলে বা দিকে রেখেছি, এনিয়ে এত চিন্তার কী আছে?
(চলবে)
‘রাঙামাটি যাওয়ার পর আমি আর রিমি পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম।তারপর একটা নিরাপদ জায়গায় খোঁজে আমরা একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম।কিছু ভুলবোঝাবুঝি হওয়াতে উনার মনে হলো আমাদের উদ্দেশ্য খারাপ।আর তাই উনি মসজিদের ইমাম ডেকে আমাদের বিয়ে পড়ালেন।সেই হিসেবে আমি আর রিমি হাসব্যান্ড ওয়াইফ।’
ওয়াজিদ তার কথা শেষ করে মাথা তুলে সোজাসুজি সামনে তাকালো।তার সামনে তার মা বাবা আর রিমির বাবা মা বসে আছে।তাদের চার জোড়া চোখ ওয়াজিদের উপর নিবদ্ধ।ওয়াহিদুল সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন,’এতো বড়ো কথাটা তাহলে তুমি এতোদিন গোপন করলে কেন?’
ওয়াজিদ ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে বলল,’ভীষণ ফ্রাস্টেটেড ছিলাম।মাথা কাজ করছিল না।বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত।তাই হঠকারিতা দেখিয়ে ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।ভেবেছিলাম বিষয়টা গোপন রাখব।জানি পুরোটাই আমার ভুল।আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট।বিয়ের মতো সেনসিটিভ ইস্যু আসলে গোপন রাখা যায় না,রাখা উচিতও না।আমি ভালো করে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা নিয়ে ভাবিনি।আমি জানি আমি ভুল।আমি লজ্জিত তার জন্য।’
শীলা কড়া গলায় বললেন,’তাহলে এখন?এখন তুমি কি চাইছো সেটা বলো।’
ওয়াজিদ ঘন ঘন শ্বাস ছেড়ে নিজের মাথা নামিয়ে নেয়।দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে গাঢ় স্বরে বলে,’আমি চাইছি এই বিয়েটা মেনে নিয়ে সবকিছু এখানেই সমাধান করতে।দিপ্তর সাথে তার বিয়েটা ভেঙে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।কারণ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ঠিক,কিন্তু আমাদের বিয়েটা তো হয়েছে।তাই আমি চাইছি রিমিও যেন বিয়েটা মেনে নেয়।এটা নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি না হোক।’
আরহাম সোফার একপাশে পায়ের উপর পা তুলে বসেছিল।তাদের কথা শেষ হতেই সে বাজখাঁই গলায় চেঁচাল,’এতো বড় ঘটনা তুই কোন আক্কেলে গোপন রেখেছিস?রেখেছিস তো রেখেছিস,এখন যখন তোর কথা মতো রিমি একটা জীবন বেছে নিয়েছে,তাতে তোর সমস্যা টা কোথায়?’
ওয়াজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল।শক্ত মুখ করে জবাব দিলো,’সমস্যা এটাই যে রিমি আমার ওয়াইফ।আমি আমার ওয়াইফের আরেকটা বিয়ে মানতে পারছি না।তোর কোনো সমস্যা?’
আরহাম বাঁকা হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’না।আমার কোনো সমস্যা নেই।’
কাবেরী আহমেদ খানিকটা বিচলিত হলেন।যদিও ঘটনা গুলো যে ঘটবে,এই নিয়ে তিনি আগে থেকেই অবগত ছিলেন।কিন্তু এখন যখন ব্যাপারগুলো চোখের সামনে হচ্ছে,তিনি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলেন।তিনি বড় বড় চোখে সামনে থাকা ছেলেটাকে দেখেন।কি সুন্দর সুপুরুষ একটা মুখ! এই সুন্দর মুখের বলিষ্ঠ দেহের ছেলেটার সাথে রিমির বিয়ে হয়েছে?তিনি তো ভাবতেই পারছেন না বিষয়টা।নবনীতা তাকে অনেক আগে জানিয়েছে রিমির বিয়ের ব্যাপারটা।কিন্তু তিনি একবারো ভাবেন নি যে ছেলেটা বিয়ের জন্য রাজি হবে,কিংবা এই সম্পর্ককে নিজ থেকে স্বীকৃতি দিবে।অথচ তার ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ছেলেটা অকপটে সবটা স্বীকার করে নিল।তিনি দু’চোখ ভরে ছেলেটাকে দেখেন।আহা! কি সুদর্শন! কি অমায়িক!
****
ওয়াহিদুল সাহেব রিমির ঘরে এসেই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে গলা খাকারি দিলেন।সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়।তিনি খানিকটা এগিয়ে এসেছে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বললেন,’আমার মন হয় ওয়াজিদের বিয়ের ব্যাপারটা যে আমরা আগেই জানি,এটা তাকে না জানালেই ভালো হয়।সে ভীষণ প্রেসটিজিয়াস এসব ব্যাপারে।সে যদি জানতে পারে আমরা জেনে বুঝে শুধুমাত্র তাকে জব্দ করার জন্য এতো ভাবে তাকে ভোগান্তি দিয়েছি,তাহলে সে কষ্ট পাবে।আর আমার ছেলেকে তো আমি চিনি।একবার রাগ হলে কয়েক সপ্তাহ ধরে সে মন খারাপ করে রাখে।কাউকে কিছু বলে না,নিজে নিজে কষ্ট পায়।তাই এই বিষয়টি আমরা নিজেদের মধ্যে রাখলেই ভালো হয়।’
নবনীতা খাট থেকে নেমে দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’জ্বী আঙ্কেল।আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।আমরা কেউ ভাইয়াকে কিছু জানাবো না।’
ওয়াহিদুল সাহেব আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।তিনি যেতেই বাকিরা পুনরায় নিজেদের আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে গেল।তাদের এখন আরো একটা কাজ করতে হবে।তাদের ওয়াজিদের সামনে দিপ্তকে রিফিউজ করার নাটক করতে হবে।দেখাতে হবে যে তারা ওয়াজিদের কথার প্রেক্ষিতে রিমির অন্যত্র ঠিক হওয়া বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।সেজন্য গুছিয়ে তাদের আরো কিছু মিথ্যা বানাতে হবে।
আরিশ কপালে হাত চেপে বলল,’বাপ রে! এখন তো আমারও অন্তত জলিলের মতোন বলতে ইচ্ছে হচ্ছে একটা মিথ্যা কথা বললে অনেকগুলো মিথ্যা কথা বলার সমান মিথ্যা কথা বলা হয়ে যায়,তবুও মিথ্যা মিথ্যাই থেকে যায়।’
নবনীতা তার হাতের কাছে থাকা কুশনটা আরিশের দিকে ছুড়ে মেরে ধমক দিয়ে বলল,’যা তো তুই।বের হ এখান থেকে।মাথা ঘুরাচ্ছে আমার এতোবার মিথ্যা শুনতে শুনতে।’
আরিশ দাঁত কেলিয়ে বেরিয়ে গেল।নবনীতা কান চেপে বলল,’কি অদ্ভুত! এখনো কথা গুলো আমার কানে বাজছে।’
.
.
.
.
নবনীতা আর আদি তাদের পরিকল্পনায় একশো পার্সেন্ট সফল হয়েছে।ওয়াজিদকে কিছু বুঝতে না দিয়েই তারা দিপ্তর ব্যাপারটা পুরোপুরি মিটিয়ে দিয়েছে।
সেদিন সন্ধ্যায় ওয়াজিদ আরো বেশি কিছু সময় রিমিদের বাড়িতে ছিল।সে যখন জানাল এই বিয়ে কিংবা রিমি,কাউকে মেনে নিতেই তার আপত্তি নেই,তখনই সবাই তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে নিয়ে মাতামাতি শুরু করল।ওয়াজিদ এই ব্যাপারে কোনো কথা বলেনি।রিমির অন্য কোথাও বিয়ে হচ্ছে না,এটাই তার জন্য শান্তির।বাদ বাকি যা খুশি হোক,এতে তার আপত্তি নেই।
সবার সম্মতিতে তার আর রিমির পুনরায় বিয়ে করার জন্য আরো একটি দিন ধার্য করা হয়েছে।যেহেতু তারা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেনি,তাই আইনত তাদের সম্পর্কের কোনো বৈধতা নেই।পাশাপাশি তাদের বিয়েটাও স্বাভাবিক ভাবে হয়নি।তাই তাদের অভিভাবকরা মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুনরায় সকলের সামনে তাদের বিয়ে হবে।সেই হিসেবে কালকে তার বিয়ে।
রিমির সাথে ইদানিং তার সামান্য কথা হয় ফোনে।রিমির আচরণ আগের তুলনায় বেশ স্বাভাবিক।তবে ওয়াজিদের মনে হয় আগের সেই রিমি যেন হুট করেই কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।ঐ রিমিকে ওয়াজিদ মিস করে,তার ছটফটে চঞ্চল স্বত্তাটি ওয়াজিদের ভীষণ প্রিয়।অথচ এই বিষয়টা সে তখন টের পেল,যখন তার সেই চঞ্চল ভাবটা গভীর কোনো মহাসাগরের তলদেশে তলিয়ে গেল।
***
‘রিমি! এ্যাই রিমি! ঘুম থেকে উঠ।আজ না তোর বিয়ে?’
নবনীতা রিমির ঘরে এসে তার খাটের কাছে এসে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ায়।রিমি কপাল কুঁচকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,’প্লিজ যা।ঘুমটা নষ্ট করিস না।’
‘যাব মানে?আজ না তোর বিয়ে?’
‘তো?এখনো অনেক সময় বাকি।ওরা বাড়ি ছাড়ার দশ মিনিট আগে ডেকে দিস।উঠে রেডি হয়ে যাবো।’
নবনীতা কপালে একহাত চেপে অবাক হয়ে বলল,’সেকি কথা! তুই কি মার্কেটে যাচ্ছিস যে তোকে দশ মিনিট আগে ডেকে দিব?উঠ,তাড়াতাড়ি উঠ।’
সে কোনোরকমে তার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে শোয়া থেকে তুলে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসালো।রিমি চোখ ডলতে ডলতে তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বলল,’বাজে কয়টা?আমার তো মনে হচ্ছে মাত্র সকাল হলো।ধুর! মন চাইছে বিয়ে ক্যানসেল করে আরো কতোক্ষণ ঘুমাই।’
রিমির বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন তাদের বাড়ির ছাদেই করা হয়েছে।তাদের বাড়িটা যথেষ্ট বড়।ছাদেও ভালোই জায়গা আছে।কাল রাতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকজন এসে খুব সুন্দর করে তাদের বাড়ির ছাদটা সাজিয়েছে।এখন আর ছাদে উঠে মনে হয় না এটা কারো বাড়ি,মনে হচ্ছে এটা কোনো কনভেনশন হলের আউটডোর সেকশন।
রিমিকে সাজাতে বসিয়ে নবনীতা তাড়াহুড়ো করে নিজের বাড়িতে আসল।আরহাম আজ সকাল থেকেই তার এপার্টমেন্টে।সে চিত্রা আর শুভ্রাকে রেডি করে নিজের ঘরে এসে আলমারি থেকে একটা মেরুন রঙের শাড়ি বের করল।
আজকের শাড়িটা একটু ভারি।শাড়ি পরতে তার সময় লাগল বিশ মিনিট।এই বিশ মিনিট এক জোড়া চোখ তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল।নবনীতা কাঁধের কাছটায় সেফটিপিন গেঁথে সামনে দেখে বিরক্ত গলায় বলল,’এবার তো চোখ টা সরান।কি একটা অবস্থা!’
আরহাম খাট ছেড়ে উঠে এসে একটানে নবনীতাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।তার হাত যখন নবনীতার শাড়ি গলিয়ে তার উদর স্পর্শ করতে মরিয়া,তখনই নবনীতা আঁতকে উঠে দুই হাত জোড় করে বলল,’না না।এখন না প্লিজ।অনেক কষ্টে পিন আপ করেছি আরহাম।’
আরহাম আচমকাই উন্মত্ত হয়ে তার সারা মুখে চুম্বন করে।তারা অকস্মাৎ উন্মাদনায় নবনীতা হকচকিয়ে উঠল।সে একটু ছাড়া পেতেই কোনোরকমে বলল,’সবাই এখন দরজা ধাক্কানো শুরু করবে।এখন না প্লিজ।’
আরহাম অধৈর্য হয়ে বলল,’তো কখন?’
নবনীতা তার চেয়েও অধৈর্য হয়ে জবাব দেয়,’বিয়েটা আগে শেষ হোক।বাড়ি ফিরে নেই।এরপর ভাবা যাবে।’
নবনীতা নিজ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমি করে বলল,’আরশাদ এখানেই থাকবে।’
‘ইসস ছিহ!’
‘ওমা।ছি এর কি আছে?এইটুকু বাচ্চা।আর সে তো ঘুমিয়েই থাকে।সমস্যা কি?’
আরহাম নাক ছিটকে বলল,’ইসস।তোমার কোনো লজ্জাশরম নাই নাকি?আমি এসব পারব না।বাচ্চাকাচ্চার সামনে ইসস।ওয়াক থু।আরশাদকে আজকের মতো শুভ্রার কাঁধে চাপিয়ে দাও।’
কথা শেস করেই সে নবনীতাকে ছেড়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।আদি একটু আগে ফোন দিয়ে বলল তারা নাকি বেরিয়েছে।এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা।সে আরো একবার তাকে ফোন দিয়ে বলল,’কিরে?কোথায় তোরা?আমরা সবাই রেডি।তাড়াতাড়ি আয়।’
ওয়াজিদের শেরওয়ানির রং অফ হোয়াইট।রিমির গাঢ় লাল লেহেঙ্গার সাথে এটা বেশ মানানসই।সকাল থেকেই তার কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছে।শুরু থেকে ঘটনা গুলো সব মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।কি থেকে কি হয়ে গেল।চট করেই ওয়াজিদ সংসারের জালে জড়িয়ে গেল।যাকগে।যা হলো ভালোই হলো।রিমির সাথে অবশেষে তার বিয়েটা তো হচ্ছে।বউকে পরেও ভালোবাসা যাবে।ভালোবাসার জন্য গোটা জীবন পড়ে আছে।আপাতত বউকে অন্য কারো বউ হওয়া থেকে আটকানো গেছে এটাই অনেক।
রিমির সাজ শেষ হতেই সে চুপচাপ স্টেজে গিয়ে বসল।ওয়াজিদদের গাড়ি আরো আগেই এসেছে।চারদিকে মানুষ জনের হৈচৈ।ওয়াজিদ বসেছে রিমির মুখোমুখি।তাকে দেখতেই রিমির হাসি পেল।সে দ্রুত মাথা নামিয়ে মিটমিট করে হাসল।তার কেন হাসি পাচ্ছে সে জানে না।শুধু মন চাচ্ছে ওয়াজিদের হাতে একটা রুমাল ধরিয়ে দিয়ে বলতে,’এটাকে একটু পুরান দিনের জামাইদের মতো মুখের উপরে চেপে ধরুন তো।দারুণ লাগবে আপনাকে।’
সে মাথা নামিয়ে কতোক্ষণ নিঃশব্দে হাসে।দুপুরের একটু পরেই কাজি এনে পুনরায় শরিয়ত মোতাবেক সমস্ত নিয়ম মেনে ওয়াজিদ আর রিমির বিয়ে পড়ানো শেষ হয়।বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সই করার মাধ্যমে রিমি আইনতভাবে একদম পাকাপোক্ত ভাবে ওয়াজিদের সহধর্মিণীর পরিচয় পেল।বিয়ের কাজ শেষ হতেই ওয়াজিদ উঠে এসে রিমির পাশাপাশি বসল।
আদি হাসি হাসি মুখ করে তাদের দেখল।আরহাম তার কাঁধে নিজের কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে কুটিল হেসে বেসুরা গলায় গান ধরল,
‘বন্ধু যখন বউ লইয়া,
আমার বাড়ির সামনে দিয়া,
হাইট্টা যায়।
বুকটা ফাইট্টা যায়।’
বলেই সে নিজে নিজে কতোক্ষণ হাসে।আদি বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বলল,’হাসার কিছু নেই।আমার সময় এলে আমিও বিয়ে করব।’
আরহাম মুখে সেই হাসির রেখা ধরে রেখেই বলল,’ওহহ ভালো কথা।তোর ইজমার কি খবর?গ্র্যাজুয়েশন শেষ?’
‘হু।কতো আগেই তো।দুই বছর আগেই শেষ।’
‘তো?বিয়ে করছিস কবে?’
আদি নিরুদ্বেগ হয়ে বলল,’কে জানে?নেক্সট ইয়ার প্রবাবলি।’
****
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই সবাই স্টেজে এসে দাঁড়াল।আরহাম একটা সোফায় বসে পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে গলা উঁচু করে বলল,’ক্যামেরা ম্যান কোথায়?ডাক দে তো।সবার একটা ছবি তুলে দিতে বল।’
তাসনুভা গালে হাত রেখে সবার দিকে তাকায়।আদি হেঁটে এসে তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’চলো বাচ্চা।স্টেজে চলো।’
সে দ্রুত মাথা নেড়ে জানাল সে স্টেজে যাবে না।স্টেজে উঠতে তার কষ্ট হবে।
আদি তার ডান হাত ধরে বলল,’তোমার কোনো কষ্ট হবে না।আমি নিয়ে যাবো তোমায়।চলো।’
তাসনুভা তবুও দিরুক্তি করে বলল,’না না আমি যাব না।তোমরা যাও।’
আরিশ তার অন্য হাতটা লুফে নিয়ে গাঢ় স্বরে বলল,’চল চল।ভাইয়াও ধরছি।এক লাফে উঠে আয়।’
তাসনুভা একটা সোফায় বসতেই আদি তার পেছনে এসে দাঁড়াল।বিভা এখানে সেখানে ছুটোছুটি করছিল।ওয়াজিদ তাকে কোলে তুলে বলল,’এ্যাই দুষ্টু।তুমি এখানে বসো।’
নবনীতা আশেপাশে কোনো সোফা খালি না পেয়ে আরহামের পায়ের কাছে বসে তার হাঁটুতে পিঠ দিয়ে হেলান দিলো।আরহাম বাঁকা হেসে বলল,’গুড।এটাই হচ্ছে বউদের জায়গা বুঝেছ?’
নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে।ডান হাতে আরহামের পেটে একটা কিল মেরে কটমট করে বলে,’কথা একটু কম বলেন।যতোসব উল্টাপাল্টা কথা!’
আয়নায় নবদম্পতিদের মুখ দেখা বর্তমানে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার একটি অংশ।রিমি কাবেরী আহমেদের হাত থেকে আয়নাটা একটানে নিজের হাতে নিতে গিয়েই বিপত্তি বাঁধালো।তার একটানে আয়নাটা ওয়াজিদের মুখের উপর গিয়ে পড়ল।ওয়াজিদ গোল গোল চোখে কপাল ডলতে ডলতে তার দিকে তাকায়।রিমি দ্রুত জিভ কাটে।মিনমিন করে বলে,’সরি ভাইয়া।একদমই দেখতে পাইনি।নেভার মাইন্ড।’
ওয়াজিদ কতোক্ষণ জ্বলজ্বল চোখে তাকে দেখে।তারপরই হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলে।মাথা নামিয়ে চাপা স্বরে বলে,’এখন ঠিক আছে।তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে আমার।’
আরিশ চোখ মেলে নিজের বসার জন্য জায়গা খুঁজে।স্টেজের একেবারে বামপাশে শুভ্রা চিত্রাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার অন্য পাশটা খালি।আরিশ কি সেখানে গিয়ে দাঁড়াবে?শুভ্রা কিছু মনে করবে না তো?
তার ভাবনার মাঝেই শুভ্রা নিজ থেকে তাকে ডাকল।হাত নেড়ে বলল,’আসুন না ভাইয়া! এখানে দাঁড়ান।জায়গা আছে তো।’
আরিশ মাথা নিচু করে স্টেজে উঠে।বিড়বিড় করে নিজে থেকেই প্রশ্ন করে,’কোথায় জায়গা আছে?স্টেজে নাকি তোমার মনে?তোমার মনে হলে ভেবে দেখতে পারি।’
ক্যামেরা মান তার এঙ্গেল ঠিক করল।আরহাম আরশাদকে তার এক কোলের উপর বসিয়ে তার চুল ঠিক করতে করতে নবনীতাকে খোঁচা দিয়ে বলল,’ছেলেটার চুলটাও তো একটু সুন্দর করে আঁচড়ে দাও নি।আবার বড় বড় কথা বলো।দেখো তো কেমন লাগছে চুলগুলো।’
নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’আমার কি দোষ?সে সারাক্ষণ চুল টানে।’
আরহাম সে কথার উত্তর না দিয়ে আরশাদকে দেখে।তারপরই তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে সামনে দেখাতে দেখাতে বলে,’দেখি তো আমার নায়ক ছেলে,,একটু সামনে তাকাও তো।তোমার সুন্দর মুখটা দেখিয়ে আমাদের এই ছবিখানা ধন্য করো।’
বলেই সে একহাত নবনীতার কাঁধে রাখল।নবনীতা তার একহাতে আলতো করে আরশাদের পা দু’টো জড়িয়ে ধরল।শিলা আক্তার তাদের দেখেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,’খুব সুন্দর আরহাম।একদম পারফেক্ট ফ্যামিলি মনে হচ্ছে।’
সবাই ক্যামেরার লেন্সে মনোযোগ দেয়।আর ঠিক তখনই ক্যাননের লেটেস্ট মডেলের ডিএসএলআর ক্যামেরায় খ্যাচ খ্যাচ শব্দ করে বন্দি হলো অনেকগুলো হাস্যোজ্জ্বল মুখের সম্মিলিত ছবি।
সময় সামনে অগ্রসর হবে।পৃথিবীর চলমান রীতিনীতিতে পরিবর্তন আসবে।ক্যালেন্ডারের পাতায় অনেকগুলো বছর কেটে যাবে।কিন্তু এই স্মৃতিগুলো চিরকাল অ্যালবামের পাতায় বন্দি থাকবে।অলস দুপুরে কিংবা ক্লান্ত বিকেলে জীবনের গতিময়তায় যখন তারা হাঁপিয়ে উঠবে,তখন এই ছবি গুলো দেখে তারা নষ্টালজিয়ায় ফিরে যাবে।মনে হবে-‘এই তো আমরা।কতো প্রাণবন্ত! কতো উচ্ছ্বসিত! কতো সুন্দর ছিল আমাদের সেই জীবন।’
*****সমাপ্ত******[দ্বিতীয় অধ্যায়]
[এরই সাথে গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি টানলাম।আমার পরিকল্পনা ছিলো আরহাম আর নবনীতার সম্পর্কে একটা কনক্লুশান টানার।সেই সাথে বাকিদের ঘটনাও কিছুটা সামনে এগোনোর।সবটাই হয়েছে।তাই দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি এখানেই সমীচীন মনে হয়েছে।
খুব শীগ্রই তৃতীয় অধ্যায় শুরু হবে।খুব সম্ভবত সেটাই হবে গল্পের শেষ অধ্যায়।একটু বড়ও হবে তৃতীয় অধ্যায়টা।পাঠকরা চাইলে এখানেও সমাপ্তি ধরে নিতে পারেন।আবার চাইলে তৃতীয় অধ্যায়ও পড়তে পারেন।তবে আগেই জানিয়ে রাখি,তৃতীয় অধ্যায়ে রাজনীতির বিষয়বস্তু পুরোদমে ফিরে আসবে।সুতরাং যারা রাজনীতি পছন্দ করেন না,তারা এখানেই গল্পের সমাপ্তি ধরে নিতে পারেন।]
রিমি গোসল শেষে বেরিয়ে বিভার কাছে গিয়ে বসল।বিভার শরীরটা কাল রাত থেকে গরম।জ্বর আসবে মনে হচ্ছে।সে হাত দিয়ে তার তাপমাত্রা পরোখ করল।ছোট্ট মাথাটায় হাত বুলিয়ে বলল,’খারাপ লাগছে সোনা?’
বিভা চুপটি করে তার কোলে মাথা রাখে।রিমি গলা উঁচু করে ডাকে,’আম্মু।এ্যাই আম্মু! বিভার গা টা ধরে দেখো তো।কেমন গরম গরম লাগছে।’
কাবেরী আহমেদ এলোমেলো পা ফেলে ঘরে এলেন।রিমির কথার জবাব না দিয়েই বিভাকে কোলে তুলে বললেন,’দেখি তো পাখি কি হয়েছে তোমার।’
তিনি তাকে নিয়ে তার ঘরে চলে গেলেন।রিমি চুপচাপ খাটে গিয়ে বসে।হঠাৎই ডোরবেল বেজে উঠল।কাবেরী রুম থেকে চেঁচালেন,’যা তো রিমি।দেখ কে এসেছে।’
রিমি বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল।নাক মুখ কুঁচকে বসার ঘর পর্যন্ত হেঁটে এসে কোনোরকমে দরজা খুলল।দরজা খুলতেই সে চমকে উঠল।ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বলল,’আপনি?’
ওয়াজিদের হিমশীতল দৃষ্টি কয়েক মিনিট তাড়িয়ে তাড়িয়ে তাকে দেখল।রিমি সেই চাহনিতেই দ্বিগুণ বিচলিত হলো।ওয়াজিদ একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে গুরুগম্ভীর গলায় বলল,’তুমি কি আমাকে ব্লক দিয়েছ রিমি?’
রিমি দ্রুত ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।সে কখন ব্লক দিলো?নিশ্চিত এগুলো আদি আর নবনীতার কাজ কারবার।সে পুনরায় সামনে দেখে।কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,’জ্বী না।আমি এমন কিছু করিনি।’
ওয়াজিদ সেই প্রসঙ্গ আর টানলো না।জানতে চাইল,’তোমার নাকি কাল কিসব ব্রাইডাল শাওয়ার?’
‘আমি সেসব কিছু জানি না।বাকিরা জানে।’
‘তুমি তাহলে বিয়েটা ভাঙছ না?’
রিমি অস্বস্তিতে কতোক্ষণ নিজের পরনের জামাটা খাঁমচে ধরে।কি বিরক্তিকর অনুভূতি! সে কোনোরকমে বলে,’আপনি এখন আসুন।’
ওয়াজিদ হতভম্ব চোখে তার দিকে তাকায়।অপমানে তার সমস্ত শরীর ঝনঝন করছে।কান দু’টো গরম হয়ে মনে হচ্ছে এখনই ধোঁয়া বেরিয়ে যাবে।কি সুন্দর অপমান করে দিলো তাকে! সে ঘরের ভেতর পা ও দেয়নি।এখনই বলছে আপনি এখন আসুন।সে চোখ মুখ শক্ত করে বলে,’তোমার বলতে হবে না।আমি এমনিতেও তোমার বাসায় বসতে আসিনি।কথা বলতে এসেছি।’
‘কথা শেষ?’
ওয়াজিদ কোনোরকম উত্তর না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।যেমন বড় বড় পায়ে সে এসেছিল,তেমন বড় বড় পায়ে সে বেরিয়ে গেল রিমিদের চারতালা বাড়ি থেকে।
.
.
.
.
আরহাম বাড়ি ফিরতেই আদি তাড়াতাড়ি তার পাশাপাশি সোফায় গিয়ে বসল।আরহাম চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করল,’সমস্যা কি তোর?’
‘সমস্যা তো অনেক।আপাতত একটাই সমাধান কর।’
‘সেটা কি?’
আদি হাই তুলতে তুলতে বলল,’রিমির জন্য একটা নকল পাত্র জোগাড় করে দে।’
আরহাম তাজ্জব হয়ে বলল,’কি?কি করব?’
‘পাত্র জোগাড় করবি।’
‘কেন?’
‘ওয়াজিদ নাকি তার সাথে দেখা করবে।’
আরহাম বড় বড় চোখ করে বলল,’সত্যি?সে এমন কিছু বলেছে?’
‘হ্যাঁ।আমাদের তো কিছু বলে না।নবনীতাকে বলেছে তাকে যেন রিমির উড বি এর নম্বর দেয়।’
আরহাম সোফায় হেলান দিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,’তো পরী বলে দেক যে তার কাছে নম্বর নেই,দেওয়া সম্ভব না।’
আদি খ্যাক করে উঠে বলল,’কেন কেন?সম্ভব না কেন?তুই বুঝতে পারছিস না।এটা প্ল্যানেরই একটা অংশ।আমরা দেখতে চাই ওয়াজিদ কেমন রিয়েকশান দেয়।এজন্য এসব করাটা জরুরি।’
তার কথা শুনেই আরহাম ফিক করে হেসে দিলো।আস্তে করে তার কাঁধে একটা চড় মেরে হাসতে হাসতে বলল,’এ্যাই তোর বয়স কতো রে?এমন টিনএজ দের মতোন কাজ কেন করছিস?’
‘এতো কিছু বুঝি না।তুই একটা নকল পাত্র জোগাড় করে দে।তাও কালকের মধ্যে।ব্যাস এটাই শেষ কথা।’
আরহাম পড়েছে মহা বিপাকে।শুরুতে ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলেও সময় গড়াতে সে বুঝল বাকিরা সত্যিই চাইছে সে যেন কাউকে নকল পাত্র বানিয়ে ওয়াাজিদের সামনে হাজির করে।নতুন খেলনা গাড়ির জন্য আরিশ যেমন বায়না ধরত,রাতে বাড়ি ফিরে নকল জামাই এনে দেওয়ার জন্য সে তেমনই বায়না ধরল।এতে নাকি খুব মজা হবে।ওয়াজিদ নাকি তাকে দেখেই লুচির মতো ফুলবে।
আরহাম আশ্চর্য হয় এদের কাজকর্ম দেখে।এমন পাগলামো শুরু করেছে কেন এরা?এখন সে নকল জামাই পাবে টা কোথায়?এসব কি হয় নাকি?রাতে নবনীতা ফোন দিয়েও তাকে এই কথাই বলল।তার নাকি এমন একটা নকল জামাই লাগবে ওয়াজিদকে আরো বেশি ক্ষেপানোর জন্য।আরহাম আশ্চর্য হয়ে বলল,’তুমিও কি এসব পাগলের দলে নাম লিখিয়েছ?এরা সব ক’টার মাথায় সমস্যা।’
নবনীতা ফোন কানে চেপেই সামান্য শব্দ করে হাসল।
‘ভালোই লাগছে আমার।বিশেষ করে আপনার বন্ধুর বিষয়টা।আসলে বিয়ে জিনিসটাই অদ্ভুত তাই না?কবুল বলার পরেই মানুষ কেমন পাল্টে যায়।অন্য মানুষটার জন্য আপনাআপনিই কেমন ভালো লাগা কাজ করে মনের ভেতর।তাই না?’
আরহাম চাপা হাসল।
‘হুম।ঠিকই বলেছ।’
কিছুসময় চুপ থেকে সে আবার ডাকল,’পরী।’
‘হু?’
‘তোমাকে মিস করছি।তোমার কথা মনে পড়ছে।’
অন্যপাশের মানুষ টা অষ্টাদশী কন্যার ন্যায় লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে উত্তর দেয়,’জ্বী।আমারও মনে পড়ছে।’
‘কি মনে পড়ছে?’
সে হাসল।কোনোরকমে বলল,’সব।’
‘পরী’
‘হু?’
‘একটু বলো তো।’
‘কি বলব?’
‘যেটা আমি শুনতে পছন্দ করি।’
নবনীতা কন্ঠ পরিষ্কার করে বলল,’আমি আপনাকে ভালোবাসি।এত্তো এত্তো ভালোবাসি।’
‘আবার।’
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি।’
‘আবার’
নবনীতা ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ে।খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,’আই লাভ ইউ।আর বলতে পারব না।’
‘কেন বলতে পারবে না?তুমি বলেছিলে সত্যি কথা দিনে একশোবার বলা যায়।তুমি মাত্র তিনবার বলেছ।’
নবনীতা তার কথার ধরন শুনেই হেসে ফেলল।
‘কিছু খেয়েছ?’
‘জ্বী।আপনি?’
‘হু খেয়েছি।ঔষধ?’
‘নাহ।এখন খাবো কথা শেষ করে।’
আরহাম অলস ভঙ্গিতে বলল,’তোমার না আজ ফিরে আসার কথা ছিল?আসোনি কেন?’
‘শুভিটা বড্ড কান্নাকাটি করে।একটা পরীক্ষা শুরু হলেই তারপর আমি চলে আসবো।’
‘ওহ’
‘রাগ হয়েছেন?’
‘ঐ তো।একটুখানি।তুমি আর আরশাদ নেই তো।ঘরটা কেমন খালি খালি লাগে।’
নবনীতা ফোনটা কানে চেপেই স্মিত হাসল।ঘাড় ঘুরিয়ে খাটের মাঝামাঝি শুয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখেই আরো এক গাল হেসে বলল,’আরশু আপনাকে চেনে জানেন?আজ আমরা গ্যালারি তে ছবি দেখছিলাম।আপনার ছবি আসতেই সে খুশিতে লাফিয়ে উঠল।হাত নেড়ে নেড়ে কতো কিছু যে বলল,কিছুই বুঝি নি।আমার মনে হচ্ছে আরশু তার বাবাকে চিনে গেছে।’
নবনীতা আশা করেছিল অন্যপাশ থেকে একটি হাসিখুশি উত্তরের।তার সেই আশায় জল ঢেলে দিয়ে আরহাম অত্যাধিক শীতল কন্ঠে বলে উঠল,’আরশাদ আমার ছেলে না।সে কেন আমাকে বাবা বলবে?আমি নিজের বাচ্চার মুখে বাবা শুনতে চাই।কোনো এডপ্টেড চাইল্ডের মুখে না।’
‘আরহাম!’
‘হোয়াট?’
‘এভাবে কেন বলছেন?’
‘তো কিভাবে বলব?নিজের সন্তান নিজেরই হয়।আমার যার তার জন্য এতো মায়া আসে না।তুমি দেখাও না আরশাদের জন্য মায়া।আমি তো বারণ করি নি।আমাকে আবার এসব বাবা টাবা বানিয়ে আহ্লাদ শুরু করছ কেন?অসহ্য লাগে আমার এসব।’
‘ওহ।’
‘এখন তো তুমি রাগ করছ।’
‘রাগ করি নি।কষ্ট পেয়েছি।’
‘কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই।এটাই আমি।নো গুড ভাইবস,নো ফেইক ইমোশানস।’
নবনীতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।জানালা দিয়ে হেমন্তের সুন্দর বাতাস তার এপার্টমেন্টের ছোটো খাটো ঘরটায় আসছে।সেই বাতাসে কেমন এতটা মন খারাপের ভাব আছে।বাতাসটা গায়ে লাগতেই তার মনখারাপ ভাব আরো বেড়ে যায়।
‘গুড নাইট।ঘুম পাচ্ছে আমার।কয়েকটা কাজ আছে হাতে।সেগুলো শেষ করে ঘুমুতে হবে।ফোন রাখছি।’
কোনোরকম বলেই ফোন কাটল আরহাম।সে যা বলেছে তার জন্য সে আফসোস করছে না মোটেও।বাবা ডাকটা অনেক মাহাত্ম্যপূর্ণ।সে পরীর মতো দয়ার ভান্ডার না।তার কিছু সমস্যা আছে।তাকে যে কেউ বাবা ডাকবে এই বিষয়ে তার তীব্র আপত্তি আছে।তার ঔরসজাত সন্তান ছাড়া অন্য কেউ কেন তাকে বাবা ডাকবে?এতো আবেগ তার নেই।পরীর ভেতর এতো আবেগ থাকলে সে আহ্লাদ দেখাক।আরহামকে কেন জড়ায় এসবে?
.
.
.
.
গ্রীন লঞ্জের সামনে এসেই ওয়াজিদ হাত ঘড়িতে সময় দেখে।এতোক্ষণে তো ঐ ছেলের এসে পড়ার কথা।সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিফটে উঠল।আজ সে একজনের সাথে দেখা করতে এসেছে।তার নাম দিপ্ত।পেশায় একজন প্রকৌশলী।তার আরো একটি পরিচয় আছে।সে ওয়াজিদের বিবাহিত স্ত্রীকে বিয়ে করতে চায়।কি বিচ্ছিরি ব্যাপার সেপার!
সে সিক্সথ ফ্লোরে এসেই ডানে বায়ে মাথা নেড়ে তার বুক করে রাখা টেবিলটা খুঁজল।টেবিলটা চোখে পড়তেই সে দ্রুত পায়ে সেখানে এগিয়ে যায়।গিয়েই দেখে টেবিলের একটা চেয়ারে একজন ছেলে মাথা নিচু করে বসে আছে।
ওয়াজিদ কাটকাট স্বরে ডাকে,’এক্সকিউজ মি।তুমি কি দিপ্ত?’
ছেলেটা মাথা তোলে।কোনোরকমে জবাব দেয়,’জ্বী আমি।’
ওয়াজিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকে আগাগোড়া পরোখ করল।সে একটা হালকা রঙের টিশার্ট পরেছে।হাতে স্মার্ট ওয়াচ।গলার দিকে সানগ্লাস ঝুলিয়ে রাখা।তার মুখটাও ভীষণ প্রানবন্ত।তাকে প্রথম দেখাতেই সুপুরুষ মনে হয়।চেহারায় একটা বড়োলোকি ঠাঁট বাট আছে।থাকবে না কেন?সে তো বড়লোকই।এজন্যই তো রিমি নিজের স্বামী ফেলে তাকে বিয়ে করতে মত দিয়েছে।প্রথম দর্শনেই ওয়াজিদের কেমন হিংসা হলো ছেলেটিকে দেখে।
সে চুপচাপ তার চেয়ারে গিয়ে বসল।সে ভেবেছিল সে অনেক গুছিয়ে কথা বলবে।কিন্তু দীপ্তকে দেখার পর থেকে তার আর কোনো সুন্দর কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে।তার রীতিমতো বিরক্ত লাগছে এই ছেলেকে।সে কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই জানতে চাইলো,’রিমির সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।রাইট?’
দিপ্ত মাথা তুলে।আপ্রাণ চেষ্টা চালায় নিজের অসহায় চাহনি গোপন করার।সে কোনো রিমিকে চিনেই না।সে আরহামের কাছে গিয়েছিল তার একটা সমস্যার কথা জানাতে।সে পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।সে পড়াশোনা করেছে আর্কিটেক্ট নিয়ে।তার ডিজাইন যথেষ্ট ভালো হওয়া স্বত্তেও রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তির রেকমেন্ডেশনের অভাবে সে বড় কোনো কাজ পাচ্ছে না।এই সমস্যার কথা জানাতে সে শাহরিয়ার আরহামের কাছে গিয়েছিল।তারপর কোথা থেকে কি হলো,আরহাম তাকে এক নতুন ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দিলো।বলল তাকে নাকি একদিনের জন্য পাত্র সাজার অভিনয় করতে হবে।কি উদ্ভট বিষয়! উপায়ন্তর না পেয়ে দিপ্ত এ আজগুবি কাজে শামিল হয়েছে।এখন কোনোরকমে কেটে পড়তে পারলেই তার জন্য ভালো।
সে ছোট করে বলল,’জ্বী।’
ওয়াজিদ নিজের শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে কোনোরকম ভূমিকায় না গিয়ে বলল,’রিমিকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না।রিমি অলরেডি ম্যারিড।আমাদের ধর্মে বিবাহিত মেয়েরা স্বামী বেঁচে থাকতে তালাক ব্যতীত অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে না।রিমির কোনো তালাক হয়নি,আর তার স্বামী বেঁচেও আছে।সুতরাং সে আর কাউকে বিয়ে করতে পারবে না।’
‘রিমির স্বামী কে?’
ওয়াজিদ এক পলক স্থির দৃষ্টিতে তাকে দেখল।তারপরই গম্ভীর হয়ে বলল,’আমি।শী ইজ মাই ওয়াইফ।তুমি আজকেই বিয়েটা ভেঙে দিবে।রিমি আমার স্ত্রী।তুমি কেন তাকে বিয়ে করবে?দেশে কি আইন আদালত কিছু নেই?’
দিপ্ত একবার নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখল।তারপরই নিচু স্বরে বলল,’ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রুফ যে রিমি তোমার ওয়াইফ?’
ওয়াজিদ সাথে সাথে চোখ তুলে।তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে দিপ্তর কলার চেপে ধরে চেঁচায়,’কি?কিসের প্রুফ দেব আমি?আমাকে তোমার মিথ্যেবাদী মনে হয়?আমার আর রিমির বিয়ে হয়েছে।সবচেয়ে বড় প্রুফ রিমি নিজে।রিমি এই কথা অস্বীকার করতে পারবে?’
দিপ্ত হকচকিয়ে গেল।সে কল্পনা করেনি ভরা রেস্টুরেন্টে ওয়াজিদ এই কাজ করবে।লজ্জায় সে মাথা নামিয়ে নিল।অথচ ওয়াজিদ আশপাশের তোয়াক্কা না করেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ওয়ার্নিং দিচ্ছি।যতো দ্রুত পারো বিয়েটা ভেঙে অন্য পথ দেখ।নয়তো বিষয়টা তোমার জন্য ভালো হবে না বলে দিলাম।’
বলেই সে হনহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো।তার মাথা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গরম হচ্ছে।এতো অসহ্য লাগছে কেন সবকিছু তার?গাড়িতে বসেই সে টেনে টেনে শ্বাস নেয়।চোখ বন্ধ করতেই তার একটা দৃশ্য মনে পড়ল।
তার মুখোমুখি সোফাতে একটা মেয়ে বসে আছে।সবুজ রঙের জামাটা তার শরীর অনুপাতে বেশ ঢিলা।কাচুমাচু মুখ।চোরা দৃষ্টিতে একবার ওয়াজিদক দেখেই সে দ্রুত মুখ নামিয়ে নেয়।মাঝবয়সী লোকটা তাকে কবুল বলতে বলায় সে মিনমিনে স্বরে তিনবার কবুল বলল।তারপর?তারপর সে ধর্ম মোতাবেক ওয়াজিদের স্ত্রীয়ের মর্যাদা পেল।অথচ মেয়েটি এখন বলছে সে এই বিয়ে মানে না।এটাও কি সম্ভব?সে কেমন করে পারছে আরেক লোকের সাথে বিয়ে করতে?ওয়াজিদ তো জীবনেও এমন কিছু করতে পারত না।
গাড়ির সিটে মাথা রেখেই সে দু’টো ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ল।এই কাটকাট কথা বলা রিমিকে তার ভালো লাগছে না।এই রিমিকে সে চায় না।সে চায় প্রানবন্ত,হাস্যোজ্জ্বল,আর সবকিছুতে ভুল করে ফেলা সেই বাচ্চাসুলভ আচরণের মেয়েটিকে।এই কঠিন মুখ করে রাখা মেয়েটাকে তার একদমই ভালো লাগে না।
বাড়ি ফেরার পর মোবাইল হাতে নিয়ে তার মন আরো এক দফা খারাপ হলো।আজ নাকি কিসব ব্রাইডাল শাওয়ার।সবাই রিমির বাড়িতে গিয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি তুলছে।নবনীতা পুডিং বানিয়েছে,ফালুদা করেছে।আদি চাওমিন রান্না করেছে।সবাই মিলে আনন্দ করছে।ওয়াজিদ ছবিগুলো জুম করে শুধু রিমির মুখোভঙ্গি দেখল।মেয়েটা কি খুশি?সত্যিই সে বিয়ে করে ফেলবে?কবুল বলার সময় একবারো তার ওয়াজিদের কথা মনে পড়বে না?ওয়াজিদ তো তার হাসবেন্ড।মনে পড়া উচিত।
_____
পরের দিন বিকেলে শীলা আক্তার একটা সুন্দর মাল্টি কালারের জামদানি গায়ে জড়িয়ে খুব সুন্দর করে সাজলেন।ওয়াহিদুল সাহেবও আলমারি ঘেটে একটা সুন্দর পাঞ্জাবি বেছে নিলেন।
শীলা নিজের সাজগোছ শেষ করে ওয়াজিদের কাছে এলেন।এসেই তাকে তাড়া দিয়ে বললেন,’তুমি এখনো রেডি হও নি?চলো চলো দ্রুত রেডি হও।আমাদের দেরি হচ্ছে।’
ওয়াজিদ মাথা তুলে নিচু স্বরে বলল,’আমি না গেলে হয় না মা?তোমরা যাও প্লিজ।’
শীলা তার কথায় আপত্তি জানিয়ে দ্রুত মাথা নেড়ে বললেন,’না না।তোমাকেও আসতে হবে।চলো চলো।এক্ষুনি রেডি হবে।’
ওয়াজিদ এক প্রকার বাধ্য হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।তিরিক্ষি মেজাজে নিজের আলমারির দিকে এগিয়ে গেল।আজ নাকি রিমির গায়ে হলুদ।কাল তার বিয়ে।রাগে ওয়াজিদের সমস্ত শরীর রি রি করছে।ঐ বদমাশ দিপ্ত তার মানে বিয়েটা ভাঙেনি।কতো বড়ো সাহস! যাকগে,সেও দেখে নিবে এই বিয়ে কেমন করে হয়।
এখন আবার রিমির মা ফোন দিয়ে তাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে হলুদে আসার জন্য।হলুদের আয়োজন নাকি তাদের বাড়ির ছাদে করা হয়েছে।আশেপাশের পরিচিত কয়েকজন আত্মীয় স্বজনদের নিয়েই সম্ভবত আজকের আয়োজন।শুধু আশেপাশের মানুষরা এলে ওয়াজিদের পুরো পরিবারকে বলল কেন?সে কি তাদের প্রতিবেশী লাগে?
শীলা আক্তার আর ওয়াহিদুর সাহেবের উৎসাহ দেখে ওয়াজিদের মনে হচ্ছে হলুদটা বোধহয় তার।এতো আনন্দ কেন দেখাচ্ছে তারা?ওয়াজিদের অস্বস্তি কেবল বেড়েই যায় তরতর করে।আর কতো সহ্য করবে সে?নিজের বউয়ের হলুদ! এই জিনিসও তাকে চুপচাপ সহ্য করতে হবে?
তারা রিমিদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছায় সন্ধ্যা সাতটায়।ছাদে পা রাখার পরেই সবার প্রথমে তার চোখ যায় রিমির দিকে।সে পরেছে একটা বাসন্তী রঙের শাড়ির।দু’জনের দৃষ্টি মিলতেই ওয়াজিদ একটা শুকনো ঢোক গিলে।কি আশ্চর্য! মেয়েটাকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে কেন?এতো দিন যাবত সে তাকে দেখছে।কই কখনো তো এতো সুন্দর দেখায়নি তাকে।
সে চুপচাপ চেয়ারে গিয়ে বসে।তার নির্নিমেষ দৃষ্টি স্টেজে বসে থাকা মেয়েটার দিকে।মেয়েটা খুব সম্ভবত তার এই ধাঁরালো আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির খপ্পরে পড়ে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে।তাতে ওয়াজিদের কিছুই যায় আসে না।সে তার হাজব্যান্ড।এই কথাটা রিমি ভুলে যায় নাকি?তার এমন দেখাতে কোনো দোষ নেই।সে একশোবার দেখবে।রিমি মানা করার কে?
সবাই একে একে রিমিকে হলুদ ছোঁয়াল।নবনীতা হঠাৎই ব্যস্ত পায়ে ওয়াজিদের সামনে এসে বলল,’ভাইয়া! আপনি রিমিকে হলুদ ছোঁয়াবেন না?’
ওয়াজিদ কপাল কুঁচকে বলল,’কেন?আরহাম আদি কেউ তো তাকে হলুদ দেয়নি।’
‘আগে আপনি শুরু করুন না।’
ওয়াজিদ কথা বাড়াল না।সে সোজা হেঁটে স্টেজে গিয়ে রিমির পাশ ঘেঁষে বসল।রিমি চমকে উঠে একটু বাম পাশে সরে এলো।ওয়াজিদ দাঁত কিড়মিড় করে তার কোমর চেপে একটানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো।রিমি আঁতকে উঠে পাশ ফেরে।ওয়াজিদ সামান্য হলুদ হাতে নিয়েই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’এতো নক্তামি করবে না রিমি।দূরে যাচ্ছো কেন?তোমার আর আমার সম্পর্ক এমন ভাব ধরার সম্পর্ক না।’
রিমি এক টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কটমট চোখে বলল,’আমাদের সম্পর্ক খ্যাক খ্যাক করে হাসার মতো কিছুও না।দূরে থাকবেন আমার থেকে।মাতব্বরি একটু কম করবেন।’
ওয়াজিদের চটে যাওয়া বিক্ষিপ্ত মেজাজ তার সহ্যের সকল বাঁধ ভাঙতেই দাবানলের মতো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।সে গদি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,’আমি তোমার কে মানে?আমি তোমার হাসব্যান্ড।হাসব্যান্ড মানে স্বামী।মানে বর,মানে জামাই।বুঝেছ?হাসব্যান্ড হই তোমার।তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।সজ্ঞানে কবুল বলে বিয়ে হয়েছে।তুমি আমার ওয়াইফ।আমি একশোবার মাতব্বরি করব।আমার সেই অধিকার আছে।’
কথা ছিল রবিবার বিকেলে সবাই রাঙামাটি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে।কিন্তু সেই কথা গাহ্য না করে আরহাম ঠিক করেছে সে আজ সকালেই সবাইকে নিয়ে ঢাকা ফিরবে।এই সিদ্ধান্তের একমাত্র কারণ মুহিত তাশদীদ।এছাড়া এতো দ্রুত রাঙামাটি ছাড়ার আর কোনো কারণ নেই।সে মুহিতের আশেপাশে পরীকে সহ্য করতে পারছে না।একটা সময় তো তাদের মাঝে কিছুমিছু ছিলো।পরী যতোই বলুক পারিবারিকভাবে দেখা হয়েছে,কিন্তু সে নিজেও তো এসবে মৌন থেকে সম্মতি দিয়েছিল।তার মানে অবশ্যই তার মনে একটা সফ্ট কর্ণার আছে মুহিতের জন্য।এই কথাটা ভাবলেই আরহামের মন খারাপ হয়ে যায়।সবার জীবনে কেউ না ছিল,শুধু তার জীবনেই কোনো অতীত নাই।কতো ভালো হতো যদি তারও একটা অতীত থাকতো! তাহলে সেই অতীত নিয়ে সেও পরীকে কাউন্টার অ্যাটাক দিতে পারত।তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি,তার জীবনে পরী ব্যতীত আর কোনো নারীর উপস্থিতি কোনোদিনই ছিল না।সে কোনোদিনই এসব মেয়েঘটিত বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি।সে হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।কথা ছিল সে ফাইভ পাশ মেয়ে বিয়ে করে আঙুলের উপর নাচাবে।অথচ কি থেকে যে কি হয়ে গেল!
নবনীতা গাড়িতে উঠেই জানালার পাশ দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে বলল,’আজকের আবহাওয়া অনেক সুন্দর।এমনিতেই ঠান্ডা বাতাস আছে।এসি ছাড়ার কোনো দরকার নাই।’
আরহাম সে কথা পাত্তা না দিয়ে নবনীতার দিকে ঝুকে জানালা বন্ধ করতে করতে নিরেট স্বরে বলল,’আর কাজ নাই খেয়ে দেয়ে।পুরো রাস্তার বালু মুখে মেখে মানুষকে চেহারা দেখিয়ে দেখিয়ে ঘুরি আমরা।আমাদের তো কোনো সিকিউরিটির দরকার নেই।’
নবনীতা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়।যেটাই করতে যায়,সেটাতেই সমস্যা।এখন তো তার শ্বাস নিতেও ভয় হয়।দেখা যাবে সে শ্বাস নিতে গেল,আর আরহাম বলল না তুমি এখানে শ্বাস নিতে পারবা না।তখন সে অবাক হয়ে জানতে চাইবে কেন?আরহাম তখন গম্ভীর মুখে উত্তর দিবে-সিকিউরিটি পারপাস।
নিজের চিন্তাভাবনায় তার নিজেরই হাসি পায়।আরহাম তার মুখ দেখেই কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,’কি ব্যাপার?এভাবে পাগলের মতো হাসছ কেন?’
সে দ্রুত মাথা নাড়ে।চারদিক দেখে বলে,’না না কিছু না।’
আরহাম গভীর মনোযোগে তার মুখোভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে।তার প্রাণবন্ত আর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা বলে দিচ্ছে তার মন ভালো।যাওয়ার আগে সে একবারও মুহিতকে দেখেনি,মুহিতও তার কাছে আসে নি।এটাও আরহামের জন্য একটা স্বস্তির বিষয়।সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয় মুহিত বিবাহিত।বউ বাচ্চা আছে।আরহামের বউ আছে,সাথে একটা রেডিমেড বাচ্চাও আছে।সে তার সিটে বসেই নবনীতার কাঁধে মাথা রেখে হাত টা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’হাতটা একটু টিপে দাও তো পরী।কেমন চিনচিন করছে।’
***
ওয়াজিদ গাড়িতে উঠার আগেই কড়া গলায় আদিকে শাসিয়ে নিল,’তুই যদি আজ আবার বাড়াবাড়ি করিস,তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।আমি রিমির পাশে বসব না।এই নিয়ে তুই আরেকটা কথা বললে আমি অন্য বাসে বাড়ি ফিরব বলে দিলাম।’
আদি তার হাত ধরে টানতে টানতে বাসে উঠল।ভীষণ বিরক্ত গলায় বলল,’আচ্ছা করব না কোনো বাড়াবাড়ি।সবকিছুতে এতো হাইপার হয়ে যাস কেন?চিল ম্যান।’
ওয়াজিদ গজরাতে গজরাতে তার সিটে এসে বসল।একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে যে তারা আজই ফিরে যাচ্ছে।যতো দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারবে,ততই তার শান্তি।নয়তো এখানে থাকলে যতোবার সে রিমিকে দেখবে,ততবারই তার মাথা গরম হবে।বাড়ি ফিরেই সে দুইদিন তার ঘর থেকে বের হবে না।এ মুহূর্তে সবকিছু তার অসহ্য লাগছে।এই অসহ্য ভাব কেটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে কিছুতেই বাড়ি থেকে বের হবে না।
রিমি আড়চোখে একবার তাকে দেখল।আহারে! রিমির কারণে তার মন খারাপ হয়েছে।অথচ রিমি কারো মন খারাপ করতে চায়নি।সে ভাবেনি ওয়াজিদ এমন উদ্ভট বাহানা দিবে।আর দিলেও একবার তো তাকে বলবে! অথচ সে কিছুই বলেনি।বিয়ের পর এমন ভাব করছে যেন রিমি ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু করেছে।অথচ রিমি নিজেও যে ঘটনার ভুক্তভোগী এই স্বাভাবিক কথাটা তার মাথায় ঢুকছে না।
রিমির মাঝে মাঝে হাসি পায়।ওয়াজিদ যেমন করে পুরোটা দোষ তার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে,আসলেই কি সব দোষ তার?ওয়াজিদের কি কোনো ভুল নেই?সে আর এসব নিয়ে ভাবল না।সে খেয়াল করেছে এসব ভাবলেই তার মন খারাপ হয়।এর চেয়ে ভালো সে আর এসবে মাথাই ঘামাবে।এর চেয়ে ভালো চিত্রার সাথে আড্ডা দেওয়া।চিত্রার কথা শুনলেই তার মন ভালো হয়ে যায়।
সব যাত্রীরা গাড়িতে উঠে বসতেই ছোটখাটো ভিআইপি বাসটা সাঁই সাঁই করে যাত্রা শুরু করে ঢাকার পথে।আদি একবার পাশ ফিরে ওয়াজিদকে দেখে।ওয়াজিদ স্বভাবতই বেশ অন্তর্মুখী।কিন্তু এতোটাও না।অথচ আজকাল ছেলেটা ঠিক মতো কথাও বলছে না।সে আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখে।গম্ভীর হয়ে বলে,’হয়েছে টা কি তোর?একটু খুলে বল না আমাকে।’
ওয়াজিদ এক ঝাড়ায় তার কাঁধ ছাড়িয়ে নেয়।বিরক্ত হয়ে বলে,’ছাড় তো।ভালো লাগে না এসব।আমারটা আমাকে বুঝতে দে।প্লিজ! সবকিছুতে কথা বলিস না।’
আদি থেমে গেল।আর টু শব্দও করল না।কি অদ্ভুত! সে তার সাথে এমন রূঢ় আচরন করছে কেন?সে তো ভালো কথাই বলেছে।
.
.
.
.
প্রায় দু’সপ্তাহ গড়িয়েছে।সবার জীবনেই ব্যস্ততা বেড়েছে।শুভ্রা পুরোদমে নিজের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে।তার পরীক্ষার আর বারো দিন বাকি।চিত্রকে আজকাল সে খুব একটা সময় দিতে পারে না।চিত্র মামির সাথেই থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়।আর শুভ্রা থাকে বই খাতা নিয়ে।মাঝরাতে পড়তে পড়তেই হঠাৎ তার আপাইয়ের কথা মনে পড়ে।তখনই তার দুই চোখ ছাপিয়ে কান্না আসে।আপাই থাকলে এখন তার পাশাপাশি জেগে থাকতো,তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।তাকে খুব বেশি আদর দিত,ভালোবাসতো।চিত্র তো মামির মিছেমিছি আদরে মানিয়ে নিয়েছে।শুভ্রা তো নিজেকে মানাতে পারছে না।কিছুতেই মানাতে পারছে না।পরীক্ষার আগের দিনগুলোতে আপাই যেভাবে তার যত্ন করতো,এই যত্ন এখন আর কে করবে?
রাতে পড়ার ফাঁকেই আচমকা সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।তারপরই শক্ত করে নিজের মুখ চেপে ধরে।কি সাংঘাতিক! সে এভাবে কাঁদছে কেন?
রাত তিনটা।শুভ্রা ডুব দিয়েছে মার্কনিকভ’স ল এর মেকানিজমে।বাড়ির সামনের গাছ থেকে কোনো একটা পাখি কর্কশ,কানে ধরা শব্দে ডাকছে।শুভ্রার মোবাইল ফোনটা হঠাৎই শব্দ করে বেজে উঠল।সে তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নেয়।স্ক্রিনের নামটা দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে।সে এক লহমায় কল রিসিভ করে সে ফোনটা কানে চাপে।অন্য পাশ থেকে নবনীতা মোলায়েম স্বরে বলে,’এখনো সজাগ শুভি?’
‘হু’
‘পড়ছিস?’
‘হু’
‘পড়ছিস নাকি কাঁদছিস?’
দীর্ঘসময় চেপে রাখা কান্নাটা আর বোধহয় বাঁধ মানলো না।নবনীতার কন্ঠ শুনতেই শুভ্রা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।কান্নার মাঝেই বলল,’তোমাকে ছাড়া আর থাকতে পারছি না আপাই।প্লিজ একটু বাড়ি আসো।বেশি না,একদিনের জন্য।আরহাম ভাইকে একটু বলো না।’
অন্যপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না।জবাব দিবে কেমন করে?শুভ্রা তো জানে যে সে নিজেও কাঁদছে।নবনীতা কান্না গিলে কোনোরকমে বলল,’আর রাত জাগিস না শুভি।ঘুমিয়ে যা।সকালে ফোন দিয়ে তুলে দিব আমি।তখন আবার পড়িস।’বলেই সে জবাবের অপেক্ষা না করে ফোন কাটে।
কথা শেষ হওয়ার পরেও নবনীতা আরো দীর্ঘসময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে।বুক চিরে কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।আর চোখ দু’টো একটু পর পর অশ্রুতে ভেসে যায়।সে পেছন ফিরে আরহামকে দেখে।সে নিশ্চিন্তে হাত পা ছড়িয়ে আরামে ঘুমুচ্ছে।অথচ নবনীতা পুরু রাত নির্ঘুম কাটালো।কান্না করে করে তার চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে।শুভ্রার কথা অনেক মনে পড়ছে।সে বাড়ি যেতে চায়।গতকালই আরহামকে এই কথা বলেছিল সে।অথচ আরহাম মুখের উপর মানা করে দিলো।নবনীতা বারান্দার মেঝেতে বসে আলতো করে মাথাটা রেলিংয়ে রাখে।নিজ থেকেই বিড়বিড় করে,’আপাই আছি শুভ্রা।সবসময়ই তোর আর চিত্রর সাথে আছি আমি।’
____
আরহাম তার অফিসেই ছিলো।নানারকম মানুষ এটা সেটা নিজেদের প্রয়োজনে তার কাছে আসছিলো।সে মেকি হাসি ফুটিয়ে সবার কথা শুনল।ভেতরে ভেতরে সব অসহ্য লাগছে তার।এতো বকবক করতে তার ভালো লাগে না।তাও আবার অচেনা মানুষদের সাথে।কিন্তু কি আর করার! এমন পেশায় জড়িয়েছে যে মানুষ ছাড়া তার আর কোনো গতি নাই।
সন্ধ্যার একটু আগেই তোফায়েল তার কাছে এসে বলল,’ভাই,,ভাবির বোন এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।’
শুভ্রা কতোক্ষণ মেঝে দেখে।তারপরই মাথা তুলে ক্ষীণ স্বরে বলে,’আমার পরীক্ষা ভাইয়া।দোয়া করবেন আমার জন্য।’
আরহাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।এগিয়ে এসে একটা হাত শুভ্রার মাথায় রেখে বলে,’পরীক্ষা ভালো হবে।দোয়া করে দিলাম।যদিও আমার দোয়ায় হিতে বিপরীত হওয়ার চান্স আছে,তবুও করলাম।’
বলেই সে তার মানিব্যাগ থেকে পাঁচটা কচকচে হাজার টাকার নোট শুভ্রার দিকে বাড়িয়ে দিলো।শুভ্রা সেই টাকা নিল না।তার পরিবর্তে আরহামের ডানহাতটা আলতো করে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,’ভাইয়া আমার টাকা চাই না।আমার অন্য কিছু চাই।’
আরহাম কপাল কুঁচকায়।
‘সেটা কি?’
‘আমার আপাইকে চাই।আপনি প্লিজ কিছুদিনের জন্য আপাইকে আমাদের বাসায় থাকতে দিন।প্লিজ ভাইয়া।আর কিছু চাইবো না আপনার কাছে।’
আরহাম কয়েক পল তাকে দেখে।তারপরই শান্ত ভঙ্গিতে মুঠোফোন বের করে কোথাও একটা ডায়াল করে।কল রিসিভ হতেই গম্ভীর হয়ে বলে,’ব্যাগ গোছাও।রোকন একটু পরেই গাড়ি নিয়ে আসছে।সে আসলে গাড়িতে উঠে বসবে।’
.
.
.
.
নবনীতা তার ঘরের খাটে শুয়েই কতোক্ষণ গড়াগড়ি খেল।আরশাদ খাটের একপাশে আরামে ঘুমুচ্ছে।আজ সে অনেকগুলো দিন পরে তার এপার্টমেন্টে এসেছে।অবশেষে!! অবশেষে আরহাম তাকে আসতে দিয়েছে।এখানে আসার পর থেকেই সে একটু পর পর খিলখিল করে হাসছে।তার কোনো কারণ ছাড়াই ভালো লাগছে।
সে খাটে শুয়েই মাথা তুলে একবার রিমিকে দেখে।যার চাহনিতে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট।নবনীতা কপাল কুঁচকে বলে,’কি রে?এমন করে বসে আছিস কেন?কথা বল।তোর আবার কি হয়েছে?’
রিমি উদাস চোখে তার দিকে তাকায়।মলিন মুখে জবাব দেয়,’না তো।কিছু না।’
আজকে বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব।বিভা এসেছে,রিমি এসেছে।নবনীতাও অনেকদির পর এসেছে।আগে যদিও সে বহুবার এসেছে।তবে রাতে থাকার অনুমতি সে অনেকদিন পরে পেয়েছে।তাই সে রিমিকে সহ ডেকে এনেছে।ভেবেছে দু’জন মিলে জমিয়ে আড্ডা দিবে।অথচ এখানে আসার পর থেকে রিমি মুখে কুলুপ এটে বসে আছে।না নিজ থেকে কিছু বলছে,না নবনীতার কথায় সাড়া দিচ্ছে।
নবনীতা খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।রিমির সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে বলল,’ব্যাপার কি রিমি?তোর কি হয়েছে বল তো।’
‘কিছু না।’
‘মিথ্যো বলবি না।সত্যি সত্যি বল।’
রিমি মাথা তুলে।মলিন সুরে বলে,’বাড়ি থেকে বিয়ে দেখছে আমার।’
‘তো?এটা তো আরো আগের ঘটনা।এখন এতো মন খারাপ করছিস কেন?’
রিমি জবাব দিলো না।নবনীতা তার পাশাপাশি বসে তার কাঁধ জড়িয়ে বলল,’এ্যাই মেয়ে! কি হয়েছে বল না।’
‘প্রমিজ কাউকে বলব না।’
.
.
.
.
কলিংবেলটা অনেকক্ষণ হলো বাজছে।নবনীতা কুচি ধরে ছুটে এসে দরজা খুলতেই তব্দা খেল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি ব্যাপার?তোমরা?’
তাসনুভা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’তোমাকে খুব মিস করছিলাম।তাই চলে এসেছি এখানে।’
আরহাম গট গট করে হেঁটে সোফায় গিয়ে বসল।পাঞ্জাবির দু’টো বোতাম খুলে ক্লান্ত গলায় বলল,’তোমার ছানা পানারা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারে না।তাই সবাই কে নিয়ে এলাম।সাথে আদি দামড়া টাও এসেছে।সে নাকি একা থাকতে পারবে না।’
নবনীতা চোখ সরু করে তাকে দেখে।সে কবে এতো ভালো হলো যে সবাইকে খুশি করতে নিজের বাড়ি ছেড়ে নবনীতার এপার্টমেন্টে এসে উঠেছে?সবাই যখন নিজেদের কাজে ব্যস্ত তখন আরহাম হঠাৎই তার এক হাত টেনে বলল,’আসল ঘটনা হচ্ছে আমি নিজেই তোমাকে মিস করছিলাম।তাই বাকিদের অযুহাত বানিয়ে চলে এলাম।কেমন হয়েছে আমার আইডিয়া?’
সবাই একটু স্থির হতেই নবনীতা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজে চওড়া গলায় বলো,’শোন শোন।আমার একটা কথা আছে।’
বলেই সে আরহাম আর আদির দিকে তাকালো।তারা তাকে দেখতেই সে কটমট করে বলল,’আজকে আপনাদের সুশীল বন্ধুর কীর্তিকলাপ শুনাবো।এরপর তাকে কি করা উচিত সেটা আপনারাই বলবেন।’
নবনীতা কটমট করে জবাব দিলো,’জ্বী।তাও আবার নিজের দোষে।এখন সব দোষ সে আমার বান্ধবীর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।’
বলেই সে রিমির দিকে তাকায়।রিমি সবার গোল গোল চাহনিতে নিজেকে আরো বেশি দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিল।নবনীতা বলেছিল সে কাউকে কিছু বলবে না,অথচ সে বলল তো বলল,একদম ওয়াজিদের বন্ধুদের সবটা বলে দিলো।এখন কি হবে?সেই তো ওয়াজিদ শোনার পরে তার সাথেই রাগারাগি করবে।রিমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।আবার একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছে সে।
আদি ক্ষেপাটে সুরে চেঁচায়,’কি রে?ঐ বেয়াদবটা কি এতো বড়ো ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল নাকি?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’
নবনীতা চুপচাপ ফ্লোরে বিছিয়ে রাখা কার্পেটে গিয়ে বসল।গালের নিচে হাত রেখে বলল,’এটা এক ধরনের অন্যায়।বিয়ে করার পর বলছে বিয়ে মানি না।এটা কেমন কথা?আমার এই বিষয়টা একদমই ভালো লাগেনি।এই ঘটনায় ৯০% দোষ আপনাদের বন্ধুরই।’
নবনীতা দায়সারা হয়ে জবাব দেয়,’রিয়েলাইজ করানোর দরকার নেই।সে যা চাইছে যেমন চাইছে,সব তেমনই হবে।আমরা কেউ তার এই বিয়ে স্বীকারই করব না।দেখি সে কেমন করে হাসি মুখে সবকিছু মেনে নেয়।’
.
.
.
.
পার্টি অফিসে যাওয়ার পরই আরহাম গালভর্তি হেসে ওয়াজিদকে জড়িয়ে ধরল।ওয়াজিদ আজ অনেকগুলো দিন পরে এখানে এসেছে।আরহামের অতিমাত্রায় ভালো আচরণে সে ভড়কে গিয়ে বলল,’কিরে?ব্যাপার কি?’
‘ব্যাপার কিছু না।আয় বোস।’
সে শান্ত পায়ে সোফায় গিয়ে বসল।আজ তার মন যথেষ্ট ভালো।রাঙামাটি থেকে ফেরার পর কিছুদিন তার মেজাজ খারাপ ছিলো প্রচন্ড।অকারণেই রেগে যাচ্ছিল।এখন তার মেজাজ ভালো।সময়ের সাথে সবকিছুতেই নিজেকে ধাতস্থ করেছে সে।সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিমি নামের ঐ মেয়েটি সামনে এলেই সে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসবে।তার সাথে ওয়াজিদের আর কোনো কথা না হলেও চলবে।
আরহাম কিছুক্ষণ নিজেদের নিয়ে কথা বলল।তারপর হুট করেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,’আরে তোকে তো সুখবর দেওয়াই হয়নি।’
ওয়াজিদ স্থির চোখে তাকে দেখল।তারপরই অল্প হেসে বলল,’কংগ্রেচুলেশানস।’
আরহাম থতমত খেয়ে বলল,’আমাকে কেন এসব বলছিস?’
‘তো কাকে বলব?তুই বাবা হচ্ছিস এটার জন্য তো তোকেই বলব।’
আরহাম কতোক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে তাকে দেখে।তারপরই হো হো করে কিছুক্ষণ ঘর কাঁপিয়ে হাসে।হাসতে হাসতেই বলে,’ওরে বেকুব! আমি কোনো বাবা টাবা হচ্ছি না।’
‘তাহলে?আর কি সুখবর?’
আরহাম চেয়ার ছেড়ে উঠে ওয়াজিদের পাশাপাশি গিয়ে বসল।বসেই একটা হাত তার কাঁধে রেখে আমোদে গলায় বলল,’জানিস?রিমির তো বিয়ে হচ্ছে।পাত্র আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।’
চকিতে পাশ ফিরে ওয়াজিদ।চোখে মুখে সেই চমক রেখেই প্রশ্ন করে,’কি?কার বিয়ে হচ্ছে?’
‘রিমি রিমি।আমার বড় শ্যালিকা।সিদরাতুল মুনতাহা।’
খুবই দ্রুত জবাব দেয় আরহাম।জবাব দিয়েই একবার ওয়াজিদের দিকে আড়চোখে তাকায়।বোঝার চেষ্টা করে তার মতিগতি।ওয়াজিদ ক্ষণকাল চুপ থাকে।তারপরই অত্যাধিক ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,’রিমি বিয়েতে রাজি হয়েছে?’
আরহাম কুটিল হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’অবশ্যই হয়েছে।বয়স কি কম হয়েছে নাকি?রাজি হবে না কেন?পাত্র ভালো,অবশ্যই রাজি হয়েছে।’
ওয়াজিদ আনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।মাথার পেছনে একটা হাত রেখে ক্লান্ত স্বরে বলে,’বাহ ভালো।আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দিস।’
কথা শেষ করে সে এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।আরহাম কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইলো,’কিরে?কোথায় যাচ্ছিস?মাত্র তো এলি।’
ওয়াজিদ সামনে যেতে যেতে ছোট করে জবাব দেয়,’কাজ আছে।পরে আসবো।’
গাড়িতে বসার পরেই ওয়াজিদ মিনিট দুয়েক চুপচাপ বসে থাকল।হঠাৎই কেমন যে অস্বস্তি হচ্ছে তার! কেন হচ্ছে?রিমির বিয়ের কথা শুনে?রিমি বিয়ে করছে তো কি হয়েছে?করুক বিয়ে।বয়স হয়েছে বিয়ে করবে,এটাই তো স্বাভাবিক।ওয়াজিদ আস্তে করে স্টিয়ারিংয়ে মাথা রাখে।বিষয়টা তার ভালো লাগছে না।বিয়ে করবে মানে?বাকিরা না হয় জানে না,কিন্তু রিমি তো জানে।জেনে বুঝে সে কেন অন্য কাউকে বিয়ে করবে?
ওয়াজিদ বের হতেই আরহাম দ্রুত ফোন হাতে নিল।নবনীতা ফোন করছে।সে কল রিসিভ করেই বলল,’শালা কথা শুনেই বেরিয়ে গেছে।’
নবনীতা অধৈর্য আর ব্যাকুল গলায় জানতে চায়,’বিয়ের কথা শোনার পর কেমন এক্সপ্রেশন দিলো?’
আরহাম মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে বলল,’তেমন সিরিয়াস কিছু না।ভেরি নরমাল।শুভেচ্ছা জানালো রিমিকে।’
নবনীতা লটকানো মুখে বলল,’ধ্যাত।আমি ভেবেছিলাম কিছু একটা হলেও বলবে।’
আরহাম বিরক্তি জড়ানো কন্ঠে জবাব দেয়,’বলেনি তো কিছু।এখন কি করার আছে?তোমার আইডিয়াই ফ্লপ।ওয়াজিদ হ্যাজ নো ফিলিংস ফর রিমি।’
নবনীতা চুপচাপ হতাশার শ্বাস ছাড়ে।আরহাম গাঢ় গলায় বলল,’আমাদের অন্য কোনো কনক্লুশানে যেতে হবে পরী।এভাবে কিছু হবে না।’
এরপর কি হলো আরহাম জানে না,নবনীতা হঠাৎই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে চেঁচিয়ে উঠে বলল,’আরহাম!! ওয়াজিদ ভাইয়া রিমিকে কল দিয়েছে।’
আরহাম তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।চোখ বড় বড় করে বলে,’কি বলো?সত্যি?’
‘হু।আপনি ফোন রাখুন।আমি একটু ঘটনাটা বুঝে আসি।’
.
.
.
.
রিমি জড় পদার্থের মতো ফোন হাতে বসে আছে।তার হাত অল্প অল্প কাঁপছে।সে চোখ তুলে সামনে দেখল।আদি আর নবনীতা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।সে মিনমিনে গলায় বলল,’এবার তো কলটা রিসিভ করি।চারবার দিয়েছে।আর কতো অপেক্ষা করাবো?’
সে দুই কদম এগোয়।একহাত উপরে তুলে রিমিকে চড় মারার ভঙ্গিতে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’ফোন রিসিভ করার পর যদি একটাও মিষ্টি কথা বলেছিস,তবে আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’
আদি তার কথায় সম্মতি জানিয়ে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’হ্যাঁ হ্যাঁ।একদম পাত্তা দিবে না রিমি।তুমি নরম হলেই সে আলগা ভাব দেখানোর সুযোগ পাবে।তুমি তাকে পাত্তাই দিবে না।’
রিমি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।কাল রাতে নবনীতা আর আদি মিলে বুদ্ধি বের করেছে তারা ওয়াজিদকে রিমির বিয়ে নিয়ে ক্ষেপাবে।ওয়াজিদকে বলবে রিমির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।মোদ্দাকথা তারা কেউই নিজ থেকে ওয়াজিদকে জানাবে না যে তাদের বিয়ের ব্যাপারটা সবাই জেনে গেছে।উল্টো তারা এমন কিছু করবে যাতে ওয়াজিদ নিজেই উপায়ান্তর না পেয়ে নিজের বিয়ের কথা নিজেই জানিয়ে দেয়।সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ওয়জিদের দুই মিত্র আর নবনীতা আটঘাট বেঁধে নেমেছে।
নয়বার ফোন দেওয়ার পর দশম বারে রিমি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে।তার সামনে নবনীতা মোটা একটা বই হাতে দাঁড়িয়ে আছে।উদ্দেশ্য-সে বেশি নরম কথা বললেই ঠিক তার মুখ বরাবর বইটা ছুড়ে মারবে।
রিমি একটু শ্বাস টেনে কল রিসিভ করে।কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।’
নবনীতা একছুটে তার কানটা রিমির ফোনের সাথে চেপে ধরে।একপক্ষের কথা শুনলে সে ব্যাপারটা ঠিক বুঝবে না।ওয়াজিদ আগের মতো করেই জানতে চাইল,’তোমার কি মনে আছে যে তুমি অলরেডি কারো সাথে বিয়ে করেছ?’
রিমি থমকায়।কিছু সময় চুপ থাকে।নবনীতা আড়চোখে তার দিকে তাকায়।নবনীতাকে অবাক করে দিয়ে রিমি অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,’না আমার মনে নেই।কারণ আমার কোনো বিয়ে হয়ই নি।’
ওয়াজিদ ভড়কে গিয়ে বলল,’হোয়াট?মাথা ঠিক আছে তোমার?বিয়ে হয়নি মানে?দেখো রিমি।আমার মুখ খোলাবে না তুমি।তোমার বিয়ে হয়েছে।কেউ না জানুক।তুমি এটা জানো।’
‘না।কোনো বিয়ে হয়নি আমার।বাপ নেই ,ভাই নেই,কাছের মানুষ কেউ নেই।বর কনের নিজেদের সম্মতি নেই।এটাকে কি বিয়ে বলে নাকি?এই বিয়ে আমি মানিই না।’
সে জবাব দিলো দ্ব্যর্থহীন ভাবে,কোনোরকম জড়তা কিংবা ভয় ছাড়াই।বলতে গিয়েই সে টের পেল কোনোরকম চাপে পড়ে নয়,বরং তার ভেতর থেকেই কথাগুলো বেরিয়ে আসছে।নবনীতার ধমকে সে এসব বলে নি।সে নিজের মনের কথাটুকুই বলেছে।রিমি হাস্যোজ্জ্বল,প্রাণবন্ত।সে কোনো কিছু খুব একটা গায়ে মাখে না।অথচ ওয়াজিদ নামের মানুষটা তার সেই স্বভাবটাকেই তার ব্যক্তিত্বহীনতা ভেবে নিল।রিমি ব্যক্তিত্বহীন না।চটপটে হওয়া মানে ব্যক্তিত্বহীন হওয়া না।এই সোজা কথাটা ওয়াজিদকে বুঝতে হবে।
ওয়াজিদ তার কথার ধরন শুনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেল।গোল গোল চোখ করে বলল,’বিয়ে মানো না মানে?’
‘বিয়ে মানি না মানে এই বিয়ে কে বিয়ে বলতেই আমার আপত্তি আছে।আপনি যেমন চান এই বিয়ে নিয়ে কোনো কথা না উঠুক,আমিও চাই।আমি চাই আপনি আপনার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায় থাকি।’
ওয়াজিদ চুপচাপ তার কথা শুনে।সে থামতেই ওয়াজিদ গম্ভীর গলায় ডাকে,’রিমি।’
‘কি?’
‘হ্যাভ ইউ গন ক্রেজি?রিলিজিয়ন বলতেও একটা জিনিস আছে।আমরা একটা ধর্ম মেনে চলি।সেখানেও কিছু রুলস রেগুলেশনস আছে।ধর্ম মোতাবেক বিয়ে হওয়ার পর আমরা নিজের মর্জি মতো সেই বিয়ের বৈধতা দিতে পারি না।’
‘আপনিই তো বলেছেন যে ধর্মে এমন বাপ ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া বিয়ে হয় না।’
ওয়াজিদ বড় বড় শ্বাস টেনে রাগ নিয়ন্ত্রণ করল।তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’তো সেজন্য কি আমি এখন আরেকজনকে বিয়ে করছি?তুমি কোন আক্কেলে বিয়ে তে রাজি হয়েছো?’
রিমি ফোনটা এক কান থেকে সরিয়ে অন্য কানে চেপে ধরল।ভাবলেশহীন হয়ে প্রতিউত্তর করল,’জানি না।’
সে গিয়ে চুপচাপ আগের মতো খাটে বসল।খানিকটা দুঃখী,খানিকটা হতাশ,আর খুব বেশি বিচলিত গলায় বলল,’এসব ভালো লাগছে না রে।পরে আবার একটা ঝামেলা হবে।আমার এসব ঝামেলা ভালো লাগে না।’
_______
রিমির ঝামেলা ভালো না লাগলেও রিমির আশেপাশের মানুষদের ঝামেলা বড়ই ভালো লাগে।ওয়াজিদ নিজ থেকে ফোন দেওয়ার পর নবনীতা আর আদি দু’চোখে নতুন করে সম্ভাবনার আলো দেখতে পেল।আরহাম পুরো ঘটনা শুনেই প্রসন্ন হেসে বলল,’এখন মনে হচ্ছে কিছু একটা হলেও হতে পারে।তবে রিমিকে বলবে একদম ছাড় না দিতে।শালা আরেকটু ভুগুক।’
রিমি ছাড় দিবে কি দিবে না এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও রিমির নেই।নবনীতা আর আদি সারাক্ষণ তাকে বুদ্ধি দেয় কি করতে হবে।ওয়াজিদ তাকে এরপরেও বহুবার ফোন দিয়েছে।তারা দু’জন আর কল রিসিভই করতে দেয় নি।
নবনীতা দুই দিন যেতেই আরেকটা বুদ্ধি বের করল।রিমির সার্টিফিকেট সংক্রান্ত কাজে ক্যাম্পাসে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো।সে আরহামকে বলল এই খবরটা যেন ওয়াজিদের কাছে পৌঁছে দেয়।আরহামও চট করে এক মিনিটে অন্য কথার প্রসঙ্গ এনে কথার ফাঁকে ফাঁকে এই বিষয়টাও ওয়াজিদকে জানিয়ে দিলো।
ওয়াজিদ কথাটা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না।আরহাম নবনীতার এপার্টমেন্টে ফিরেই বলল,’ধুর ছাতা! শালা কোনো রিয়েকশানই দেয় নাই।’
নবনীতা চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে চাপা স্বরে বলল,’আপনার বন্ধু তো আপনাদের মতো বোকা না।সে ঠিকই কাল ক্যাম্পাসে যাবে।অথচ ভাব দেখাচ্ছে তার কিছুই যায় আসে না।’
বলেই সে চায়ের কাপটা আরহামের দিকে এগিয়ে দিলো।আরহাম চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সন্দিহান গলায় বলল,’তোমার মনে হচ্ছে ওয়াজিদ কাল রিমির সাথে দেখা করার বাহানায় ক্যাম্পাসে যাবে?’
‘অবশ্যই।মনে হয় না।সে অবশ্যই অবশ্যই যাবে।’
আরহাম আরেকটা চুমুক দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’আচ্ছা দেখা যাক কি হয়।’
.
.
.
.
রিমি ক্যাম্পাসের ভেতর পা রেখেই কপালের ঘাম মুছে এদিক সেদিক তাকায়।আজকে রোদের তেজ অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি।আসতে আসতেই সে ঘেমে গেছে।সে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার সামনে এগিয়ে গেল।
সে অনেকখানি এগিয়ে যেতেই আরো একটা গাড়ি এসে থামল ক্যাম্পাসের সামনে।আদি,নবনীতা আর আরিশ হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।নবনীতা চারদিক দেখে বলল,’কি মনে হয়?ওয়াজিদ ভাইয়া কি আসবে?’
আরিশ দ্রুত উপরনিচ মাথা নেড়ে জবাব দেয়,’হু ভাবি।আমার মনে হয় আসবে।গাট ফিলিং আসছে আমার।’
সে কথা শেষ করার আগেই আদি চাপা কন্ঠে চেঁচায়,’ঐ যে ওয়াজিদের গাড়ি।লুকা ভাই লুকা!’
তিনজনই ছুটে গিয়ে গাড়ির পেছনে লুকায়।নবনীতা মাথা বের করে উঁকি দিয়ে সামনে দেখল।গাড়ি থামতেই ওয়াজিদ আস্তে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।চোখের সামনে রোদ চশমা চাপিয়ে সে দ্রুত ভেতরে পা বাড়ায়।
রিমি কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে বের হতে হতে বারোটার মতো বাজলো।সে প্রশাসনিক ভবনের নিচতালায় নেমে একটু সামনে যেতেই কোথা থেকে একটা হাত শক্ত করে তার ডান হাতের কবজি চেপে ধরল।ধরেই একটানে তাকে প্রশানিক ভবনের পেছনে নিয়ে এলো।
নবনীতা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আরহামের সাথে কথা বলছিলো।আজ তার দুইটা মিটিং আছে মোট।একটা শেষ হয়েছে একটু আগে,আরেকটা একটু পর শুরু হবে।এই অবসর সময়টা সে ব্যস্ত ছিলো নবনীতার সাথে ফোনালাপে।নবনীতা ফোন দিয়েই চটপটে গলায় জানায় ওয়াজিদ নাকি ক্যাম্পাসে এসেছে।সে,আদি আর আরিশও প্রত্যক্ষ দর্শন করার জন্য ক্যাম্পাসে এসেছে।আরহাম তার কথা শুনেই আলগোছে হাসল।কি অদ্ভুত বাচ্চা বাচ্চা কাজ কারবার!
হঠাৎই নবনীতা ফোনের অন্যপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠে,’আরহাম!! ওয়াজিদ ভাইয়া রিমির হাত ধরে টেনে কোথায় যেন নিয়ে গেছে তাকে।’
তার কথা শুনেই আরহাম চমকে উঠে।রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে বলে,’কি বলছ কি?টেনে নিয়ে গেছে মানে?ছিহ!’
‘ধুর।কথা বলার জন্যই নিয়েছে মনে হয়।’
আরহামের মন চাইল বাকিদের মতো এই বাচ্চামো কাজ কারবারে যোগ দিতে।মন চাইছে এখনই ছুটে গিয়ে দেখতে ওয়াজিদ রিমিকে ঠিক কি বলছে।অথচ এমন এক পেশায় সে জড়িয়েছে যেখানে এসব হুটহাট কোথাও যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’পরী! আমিও দেখতে চাই ওদের।’
নবনীতা মিষ্টি হেসে তাকে আশ্বস্ত করল,’সমস্যা নাই।আমি রেকর্ড করে রাখব।রাতে আপনাকে সব দেখাব।’
____
রিমি চোখ তুলে তার হাত ধরে রাখা ব্যক্তিটাকে একনজর দেখেই চোখ নামিয়ে নিল।ওয়াজিদ ক্ষেপাটে গলায় প্রশ্ন করল,’মোবাইল কোথায় তোমার?’
‘আছে।আমার সাথেই আছে।’
‘আছে সেটা আমিও জানি।দুই দিন ধরে কয় হাজার ফোন দিয়েছি তোমাকে?ধরো নি কেন?’
রিমি মাথা নামিয়েই নিচু গলায় বলল,’ব্যস্ত ছিলাম।’
ওয়াজিদ হঠাৎই খেকিয়ে উঠল,’কিসের ব্যস্ত?কার সাথে এতো ব্যস্ত তুমি?’
বলার পর তার নিজেরই মনে হলো সে একটু বেশি রূঢ় আচরণ করে ফেলছে।অথচ এসবের জন্য সে মোটেও লজ্জিত না।সে আরো বেশি বেশি এমন আচরণ করবে।কিসের এতো ব্যস্ততা তার?বিবাহিত মেয়ে নাকি আবার বিয়ে করবে।দেশে কি আইনকানুন,ধর্ম কর্ম বলতে কিছু নেই?
সে পুনরায় কটমট করে বলে,’বিয়ে টা এখনো ভাঙছ না কেন?বলেছি না ভেঙে দিতে?’
রিমি চোখ তুলে তারই মতো কটমট করে বলল,’কেন ভাঙব?অকারণে বিয়ে কেন ভাঙব?’
ওয়াজিদ আশ্চর্য হলো।ভীষণ ভীষণ আশ্চর্য।সে ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে এসে রিমির দুই কাঁধ চেপে দাঁতে দাঁত পিষে কিড়মিড় করে বলল,’কেন মানে?বিবাহিত হয়ে আরেকটা বিয়ে করবে তুমি?তুমি আমার ওয়াইফ।আমাদের বিয়ে হয়েছে।এতোটাও গোল্ড ফিশের মতো মেমোরি না তোমার যে বারবার এই কথা তোমাকে মনে করাতে হবে আমার।’
রিমি তার কথা শুনেই তাচ্ছিল্য করে হাসল।এক ঝাড়ায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,’বাপ ভাইয়ের সম্মতি ছাড়া কোনো বিয়ে হয় না।এ বিয়ের কোনো বৈধতা নেই।’
ওয়াজিদ ফ্যালফ্যাল চোখে তার দিকে তাকায়।একটু শুকনো ঢোক গিলে ধিমি স্বরে বলে,’তিন কবুল বলে বিয়ে হয়েছে আমাদের রিমি।সব নিয়ম মেনেই হয়েছে।তুমি বিয়েটা অস্বীকার করছ রীতিমতো।ইউ আর বিকামিং সো ডিসরেসপেক্টফুল টুয়ার্ডস মি।’
রিমি উত্তর না দিয়েই সামনের দিকে পা বাড়ায়।ওয়াজিদ দ্রুত হেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।পুনরায় তার হাতটা চেপে ধরে চোখ গরম করে বলে,’সমস্যা কি তোমার?এতো ভাব দেখাচ্ছো কেন?’
রিমি হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,’আপনার সমস্যা কি?বারবার এমন হাত ধরছেন কেন?’
‘কি হয়েছে?হাসছো কেন?কৌতুক করেছি আমি?বিবাহিত অবস্থায় মেয়েরা আরেক বিয়ে করতে পারে না।এই কথা তুমি জানো না?অলরেডি বিবাহিত হয়ে তুমি ঢ্যাং ঢ্যাং করে আরেক বিয়ে করছ! শোন রিমি,বেহুদা বকবক করে আমি আমার এনার্জি ওয়েস্ট করতে চাই না।তুমি প্লিজ কথা না বাড়িয়ে বিয়েটা ভেঙে দাও।আর কথা বাড়াতে চাই না আমি।’
রিমি তার কথা শুনল।সে থামতেই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রিমি সামনের দিকে পা বাড়াল।যেতে যেতে জোর গলায় বলল,’আমার টা আমাকে বুঝতে দিন।আমাকে নিয়ে মাতব্বরি একটু কম করবেন।’
বলা শেষেই সে হনহনিয়ে হেঁটে সামনে চলে গেল।ওয়াজিদ শান্ত,ধাঁরালো চোখে তার প্রস্থান দেখে।তার রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে এসব দেখে।রিমি তার সাথে এমন আচরণ কেন করছে?সে নিতে পারছে না এসব।
রাতে সে আবারো তার নম্বরে ফোন দেয়।অতি আশ্চর্যের বিষয় একটা রিং হয়েই ফোনটা কেটে যাচ্ছে।ওয়াজিদের বিশ মিনিট সময় লাগলো এটা বুঝতে যে রিমি তাকে ব্লক মেরেছে।বোঝার পরেই তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।বারবার মনে হচ্ছিল এটা কি সত্যি?রিমি সত্যিই তাকে ব্লক মেরেছে?
সে রাতভর তার ঘরের এ’মাথা ঐ’মাথা পায়চারি করল।আরহাম আর আদি রিমির বিয়ে নিয়ে খুব এক্সাইটেড।এটা সেটা কতো কিছু কিনছে।আর ওয়াজিদ রীতিমতো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে এসব ভাবতে ভাবতে।মেয়েটাকে সে ভালোবাসে না।কিন্তু মেয়েটা তার বউ।নিজের বউয়ের অন্যত্র বিয়ে জগতের কোনো ছেলের ভালো লাগে?ওয়াজিদের তো একটুও লাগছে না।
সে পরের দুই দিন অনেকভাবে রিমি পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টা করল।তার সোশাল মিডিয়ার একাউন্ট গুলো থেকেও সে ওয়াজিদকে ব্লক করেছে।কতো বড়ো বেয়াদব হলে মানুষ এমন কাজ করে?এক তার বান্ধবী,যে কি-না বিয়ের পর সব তেজ একপাশে সরিয়ে সুন্দর করে সংসার করছে।অন্যদিকে সে যে কি না বিয়ের আগে বেকুবের মতোন হাসতো,অথচ বিয়ে হতেই কেমন তেজ দেখানো শুরু করেছে।বিরক্তকর! মেয়েটা অতিমাত্রায় ঘাড়ত্যাড়া।
এক বিকেলে নবনীতার এপার্টমেন্টে ওয়াজিদের পদধূলি পড়ল।নবনীতা তাকে দেখেই সৌজন্যসূচক হেসে বলল,’আসুন ভাইয়া।ভেতরে এসে বসুন।’
ওয়াজিদ ভেতরে আসল না।তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভেতরে আসার কোনো ইচ্ছে তার নেই।সে তাড়াহুড়ো করে জানতে চাইল,’তোমার ফ্রেন্ড রিমির বাড়ির এড্রেসটা দাও তো।’
বলার পরেই সে আবার নিজের সাফাই গেয়ে বলল,’আসলে আমার একটা কাজ ছিলো ভার্সিটি সংক্রান্ত।তাই তার বাড়ির এড্রেসটা প্রয়োজন।’
সাদা রঙের মিনি বাসটা রাঙামাটি গিয়ে পৌঁছুলো সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ।গাড়ি থামতেই সবাই নড়ে চড়ে উঠল।আরহাম নবনীতার কাঁধে মাথা রাখা অবস্থাতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে প্রশ্ন করে,’এসে গেলাম নাকি?চাকা ঘুরে না কেন?’
নবনীতা আড়চোখে তার দিকে তাকায়।থমথমে মুখে বলে,’জ্বী।এসে পড়েছি।এবার মাথাটা সরান।কাঁধ ব্যথা হয়ে গেছে আমার।’
রিমি বাস থামতেই সবার আগে দৌঁড়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো।এসেই বড় করে দু’টো শ্বাস নিল।আহা! মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণ! কাল রাতটা তার কিভাবে কেটেছে সেই জানে।কয়েকবার তো মনে হচ্ছিল সে বমি করেই দিবে।পরে অবশ্য ওয়াজিদের আতঙ্কিত মুখটা দেখেই সে বহু কষ্টে বমি চেপে রেখেছিল।পুরো বাসে তার চেয়েও ছোট ছোট মানুষরা বমি করছে না,আর সে বমি করছে।কি জঘন্য আর লজ্জাজনক ব্যাপার! যদিও দুই তিনবার সে ওয়াক ওয়াক করেছে,কিন্তু বমি আসেনি।ওয়াজিদ দ্বিধান্বিত হয়ে প্রশ্ন করেছিল,’বাস থামাতে বলব?একটু বের হয়ে পানি খাবে?’
রিমি শুধু মাথা চেপে উত্তর দিয়েছে,’নাহ,দরকার নেই।’
—
‘এখন কেমন লাগছে রিমি?’
পেছন থেকে ওয়াজিদের আওয়াজ শুনতে পেয়েই রিমি ঘুরে দাঁড়ায়।সামান্য হেসে জবাব দেয়,’আগের চেয়ে অনেক ভালো।’
ওয়াজিদ সৌজন্যসূচক হেসে সামনে এগিয়ে গেল।মেয়েটির উপর শুরুতে রাগ হলেও শেষে তার ফ্যাকাসে মুখটা দেখে তার ভীষণ মায়া হয়েছে।ইশশ! মেয়েটা নিজেও তো ভীষণ কষ্ট পেয়েছে! ভোরের একটু আগে তার ক্লান্ত মাথাটা সে এলিয়ে দিয়েছিল ওয়াজিদের কাঁধে।ওয়াজিদ কিছু বলেনি।শুধু ঠান্ডা কন্ঠে একবার বলেছিল,’বেশি খারাপ লাগলে আমাকে জানাবে।দু’মিনিট বাস থামালে এমন কিছু ক্ষতি হয়ে যাবে না।’
রিমি পাশ ফিরে একবার ওয়াজিদকে দেখে।যে কি না ধীর পায়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।এই লোকটিকে রিমি কি বিশেষণ দিয়ে বিশেষায়িত করবে?নিখাঁদ ভদ্রলোক?অত্যন্ত ধৈর্যশীল?নাকি ভীষণ অমায়িক?কে জানে।তবে সে এইটুক জানে এই মানুষটা অনেক আলাদা।তার জায়গায় অন্য লোক থাকলে এতোদিনে রিমি নিশ্চিত দু’টো চড় খেয়ে ফেলত।ওয়াজিদ আক্ষরিক অর্থে ভদ্রলোক বলেই রিমি এখন পর্যন্ত কোনো চড় থাপ্পড় খায়নি।
নবনীতা গাড়ি থেকে নেমে চারদিক দেখে বলল,’ইশশ! কি সুন্দর!’
চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়।সবুজে সবুজে মিশে একাকার অবস্থা।মাথার উপর গাঢ় নীল আকাশ।আরহাম গাড়ি থেকে বের হতেই মিলিটারি দের একটি গাড়ি তাদের সামনে এসে থামল।নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’আর্মিদের গাড়ি কেন?’
গাড়ি থেকে সবার প্রথমেই যে লোকটা বেরিয়ে এলো,তার উচ্চতা চোখে পড়ার মতো।উঁচা,লম্বা,পেটানো শরীর।এক দেখায় বলা যায় লোকটা সুদর্শন।সে গাড়ি থেকে নামতেই আরহাম তার বুকের পাশের ব্যাচটা দেখে।সেখানে লিখা মুহিত তাশদীদ।তিনি সামনে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করলেন।হাস্কি স্বরে বললেন,’ওয়েলকাম স্যার।আমি মেজর মুহিত।এই দুইদিন আপনাদের সব সিকিউরিটির দায়িত্ব আমার।আপনাদের যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ইনফর্ম করতে পারেন।’
আরহাম জবাবে কেবল স্মিত হাসল।মুহিত তার থেকে চোখ সরিয়ে তার পাশে থাকা মেয়েটাকে দেখে।দেখতেই তার চোখ স্থির হয়।তার সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটা দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়।মুহিত একটা শুকনো ঢোক গিলে।একবার মেয়েটার মুখ,আরেকবার তার হাত দু’টো দেখে।যেই হাতে সে শক্ত করে নিজের কুচি চেপে ধরেছে।
আদি ডাকতেই আরহাম কথা বলতে বলতে তার দিকে এগিয়ে গেল।নবনীতা পড়েছে এক অথৈ সাগরে।এই সাগরের নাম অস্থিরতার সাগর।কি বিচ্ছিরি আর বিব্রতকর মুহূর্ত! মুহিত গলা খাকারি দেয়।ঠান্ডা গলায় জানতে চায়,’হাই মিসেস নবনীতা।কেমন আছো?’
মুহিত স্মিত হেসে বলল,’অবশেষে তাহলে তুমি বিয়ে করেই নিলে।গুড।গুড চয়েজ।গুড ডিসিশন।পাত্র আমার চেয়েও বেশি পাওয়ারফুল পারসন আই মাস্ট সে।’
নবনীতা অন্যদিক দেখতে দেখতে কন্ঠ স্বাভাবিক করে বলল,’জ্বী।আপনি না বললেও আমি জানি।’
‘সেটা ঠিক।তবে তুমি যেটা জানো না তা হলো আমিও বিয়ে করে নিয়েছি।একটা ছোট্ট ছেলেও আছে।’
নবনীতা অল্প হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’দারুন ব্যাপার।সংসার জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।’
‘তোমাকেও।’
‘ধন্যবাদ।’
নবনীতা কোনোরকমে উত্তর দিয়ে সামনে হেঁটে যায়।মুহিত চট করে পেছন ঘুরে প্রশ্ন ছুড়ে,’তুমি বলেছিলে রাজনীতিবিদ তোমার একদমই পছন্দের না।’
নবনীতা থামে।কথাটা কেন যেন গায়ে গিয়ে লেগেছে।সে পেছন ফিরেই কটমট করে বলল,’রাজনীতিবিদ পছন্দ না।তবে সেটা বর হলে অন্য বিষয়।আরহামকে আমার পছন্দ।আপনি আমার পছন্দ নিয়ে না ভেবে নিজের পছন্দ নিয়ে ভাবুন।’
বলেই সে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায়।কি অদ্ভুত বিষয়! এই লোক এখন এসব কথা তুলছে কেন?দেখছে না নবনীতার ইতোমধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে।এখন এসব কথা তুলে লাভ আছে?উপরন্তু তার নিজেরও সংসার আছে।তার উচিত নিজের বউ বাচ্চা নিয়ে ভাবা।এখন এসব কথা বলার কোনো মানেই নেই।
সে এগিয়ে গিয়ে আরহামের একহাত জড়িয়ে ধরে।আরহাম কপাল কুঁচকে সন্দিহান গলায় জানতে চাইল,’ঘটনা কি বলো তো?তুমি হঠাৎ এতো ভালো ব্যবহার করছ কেন?তোমার হুটহাট পতিব্রতা আচরণ আমার ভীষণ ভয় লাগে কেন জানি।’
নবনীতা ঠোঁট চেপে হাসল।নিজের মাথাটা আলতো করে আরহামের কাঁধে রেখে সামনে হাঁটতে হাঁটতে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’ঘটনা কিছুই না।এমনিই মন চাইছে দু’জন মিলে হাঁটতে।আমি না আপনার অর্ধাঙ্গিনী?অর্ধেক অঙ্গ ছাড়া আপনি চলবেন কেমন করে শুনি?’
.
.
.
.
সানশাইন অরফানেজ সেন্টার।প্রায় একশো শতাংশ জমি নিয়ে পুরো অরফানেজ হোমটা বানানো হয়েছে।সামনে সুন্দর একটা বাগান।একপাশে স্কুল,স্কুলের সামনে খেলার মাঠ।আরেক পাশে থাকার জায়গা।সবমিলিয়ে জায়গাটা দেখতে ভালোই লাগে।
নবনীতা অরফানেজ সেন্টারের নাম দেখেই ঠোঁট উল্টে বলল,’বাপরে! অরফানেজ সেন্টারের নাম তো খুব ইউনিক।আপনার বাবা মনে হয় খুব এস্থেটিক মানুষ ছিলেন।বাটারফ্লাই,সানশাইন-দু’টো নামই ভীষণ এস্থেটিক।’
আরহাম তার কথা শুনেই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠে বলল,’আমার বাবা যদি জানতো ভবিষ্যতে তার দেওয়া নাম নিয়ে কেউ এতো কৌতূহল দেখাবে,তাহলে বাড়ির নামটাও আজিজ ভিলা না দিয়ে এস্থেটিক কিছু একটা দিতো।’
বলেই সে আরো কিছুক্ষণ হাসে।নবনীতা চোখ পাকিয়ে কেবল একনজর তাকে দেখলো।সবকিছু নিয়ে হাসি ঠাট্টা করাই বোধহয় আরহামের স্বভাব।সে কতো সুন্দর একটা কথা বলেছে,আর আরহাম সেটাকে স্রেফ উপহাস করে উড়িয়ে দিলো।
অরফানেজ হোমের একদম কাছাকাছি কয়েকটা কটেজ আছে।সবাই ক্লান্ত শরীরটা টেনে কোনোরকম হেঁটে এসে যার যার কটেজে গিয়ে বিশ্রাম করল।আরহাম ঘরে ঢুকেই ধাম করে খাটে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে কতোক্ষণ শ্বাস নিল।নবনীতা কটেজে আসা মাত্রই সে মুখ খিঁচে বিরক্ত হয়ে বলল,’কাল রাতে আমি একটুও ভালো করে ঘুমুতে পারিনি।তোমার কাঁধ এতো শক্ত! বাপরে বাপ।হাড্ডি ছাড়া তো কিছুই নেই শরীরে।খেয়ে খেয়ে মাংস বাড়াবে বুঝেছ?তাহলে আরাম করে ঘুমানো যাবে।’
নবনীতা তীক্ষ্ণ চোখে তাকে পরোখ করল।কিছুক্ষণ চুপ থেকে শেষে দুষ্টুমি করে বলল,’মাংস বাড়ার একটা সাইড ইফেক্টও আছে।আপনি তখন আর হুটহাট ঘরে ঢুকেই আমাকে কোলে তুলতে পারবেন না।একটু রয়ে সয়ে তারপর কোলে নিতে হবে।’
আরহাম সাথে সাথে চোখ খুলে।গোল গোল চোখ করে নবনীতাকে দেখে তব্দা খেয়ে বলে,’কি বললে তুমি?’
নবনীতা আর উত্তর দিলো না।সে খুব ভালো করেই জানে আরহাম তার কথা শুনেছে।শুনেছে বলেই এমন প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে।
আরহাম তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।এক ছুটে নবনীতা কাছে গিয়ে তার থুতনি উঁচু করে বড় বড় চোখ করে বলে,’সিরিয়াসলি?তুমি ইদানিং লাগাম ছাড়া কথা বলছ পরী।আমার কিন্তু লজ্জা লাগে এসব।’
নবনীতা ঠোঁট উল্টে বলল,’আরে বাবারে! কতো লজ্জা আপনার! আর আপনি যখন রাতে বাড়ি ফিরে ঘর ভর্তি লোকের সামনে ডাকেন এ্যাই পরী! রুমে এসো তো।তখন লজ্জা লাগে না?’
‘না লাগে না।কারণ জামাই একশোটা কারণে বউকে ডাক দিতে পারে।কেন ডাকছে সেটা মানুষ কি করে জানবে?মানুষ কি আমার রুমে ঢুকে বসে আছে নাকি?’
নবনীতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,’জ্বী বুঝেছি।আপনিই ঠিক।এবার ছাড়ুন আমায়।’
আরহাম তাকে ছাড়ল না।উল্টো আচমকাই তাকে কোলে তুলে একপেশে হেসে বলল,’ছাড়ার জন্য তো ধরিনি ডার্লিং।’
নবনীতা আঁতকে উঠে চারপাশ দেখে চাপা স্বরে চেঁচায়,’কি সর্বনাশ! এখনই?’
‘হ্যাঁ তো কি হয়েছে?’
‘কেউ ডাকলে?’
‘ডাকুক।সব ক’টা আ বিয়াত্তা।এগুলো ডাকলেও পাত্তা দিব না ব্যাস।এরা কেমন করে বুঝবে ম্যারিড লাইফের মজা?’
নবনীতা তার বচনভঙ্গি দেখেই ফিক করে হেসে ফেলল।সে তার সেট করে রাখা চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলল,’এখন লজ্জা করে না?’
‘নাহ করে না।তোমার আর আমার মাঝে লজ্জা নামের কোনো ফাংশন নেই।গট ইট?’
বাচ্চারা চোখ মেলে এক ঝাঁক আগন্তুক দের দেখে।এরা নাকি দুই দিন এখানেই থাকবে।এই মানুষগুলোকে তাদের ভালোই লাগছে।কতো সুন্দর হেসে হেসে আদর দিচ্ছে তাদের।তাদের অভাবের জীবনে সবচেয়ে বেশি অভাব বোধহয় এই আদরটুকুর ই।
আজকে রাতে বেশ ভালো রান্নার আয়োজন করা হয়েছে।আরহাম আগেই জানিয়ে রেখেছিল এই ব্যাপারে।সেই রান্নার ঘ্রান একটু পর পর এসে নাকে লাগছে।রিমি নাক টেনে টেনে বলল,’বিরিয়ানি তে ঝাল বেশি হয়েছে।’
রিমি বোকা বোকা হেসে জবাব দেয়,’জ্বী ভাইয়া।আমার ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় অনেক শক্তিশালী।আমি শুঁকে শুঁকেই সব টের পেয়ে যাই।’
ওয়াজিদ তার কথা শুনেই মাথা নামিয়ে চাপা কন্ঠে বিড়বিড় করে,’তুমি তো টের পাবেই।ভাল্লুকদের ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় এমনিতেও স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রখর।’
আদি রিমির দিকে দেখে দাঁত কেলিয়ে বলল,’তোমার মতো মানুষই তো রোজার সময় দরকার।আমরা রান্না করব।আর তুমি গন্ধ শুঁকে বলে দিবা কি কম হয়েছে।দারুণ একটা ব্যাপার!’
‘না ভাইয়া।এখানে একটা সমস্যা আছে।’
‘আবার কি সমস্যা?’
‘আমি ঝাল,তেতো আর টকের বিষয়টা বুঝত পারি।কিন্তু লবনের বিষয়টা কেবল গন্ধ শুঁকে বলতে পারি না।’
আদি আশাহত হলো।মাটিতে থাকা কয়েকটা ঘাস ছিঁড়ে দূরে ছুড়ে মেরে বলল,’ধ্যাত! তুমি তো তাহলে আসল জিনিসটাই পারো না।’
.
.
.
.
সবাই বিস্তীর্ণ মাঠটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে।বাচ্চারা এখানে সেখানে ছুটোছুটি করছে।আদি মাথা তুলে আকাশ দেখে।খোলা আকাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা গুলো দেখে সে ভরাট গলায় বলে,’আহা কি সুন্দর আবহাওয়া! কেউ একটা সুন্দর গান গাও না।এ্যাই ওয়াজিদ।তুই ই একটা গান গা।তাক লাগিয়ে দে আমাদের।দেখিয়ে দে তোর লুকানো প্রতিভা।’
ওয়াজিদ বিরক্ত হয়ে বলল,’বাজে বকিস না তো।এসব গান টান আমি পারি না।’
শুভ্রা প্রফুল্ল স্বরে বলল,’আপাই কিন্তু দারুণ গান গায়।একদম সত্যি কথা।’
সাথে সাথেই সবাই নবনীতাকে চেপে ধরল একটা গান গেয়ে শোনানোর জন্য।নবনীতা বোকা বোকা হেসে বলল,’আরে ধ্যাত! আমি এতোও ভালো গাই না।’
‘যাই পারো।একটা গেয়ে শোনাও।’
নবনীতা আর বেশি মানা করল না।সে গালের নিচে হাত রেখে কতোক্ষণ ভাবল।আরহামের স্থির দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ।সে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে।সে কি গান গায় এটা শোনার জন্য সে উদগ্রীব।নবনীতা কতোক্ষণ ভেবেচিন্তে একটা গান মনে করল।তারপরই সুমিষ্ট কন্ঠে অল্প স্বল্প সুর তুলে গাইলো,
Chaahe tum kuchh na kaho maine sun liya
Ki saathi pyaar ka mujhe chun liya
Chun liya… maine Sun liya haa!
Pehla nasha, pehla khumar
Naya pyaar hai naya intezar
Kar loon main kya apna haal
Aye dil-e-bekaraar
Mere dil-e-bekaraar
Tu hi bata… mm..
আরহাম তব্দা খেয়ে তার দিকে তাকায়।সে না হিন্দি পারে না?তাহলে এখন সে কোন দেশের গান গাইছে?আমেরিকার নাকি কানাডার?সে চাপা স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’সব বুঝেও না বুঝার ভান ধরে।বেয়াদব একটা!’
***
সেই রাতে তারা বেশ জমিয়ে আড্ডা দিলো।রাতে খাওয়া দাওয়া শেষেও যে যার মতো হেঁটে বেড়ালো।সেনাবাহিনীর লোকজন আশেপাশেই আছে।তাই ভয়ের কোনো কারণ নেই।আরহাম নিজেই বলেছে সবাই মন মতো ঘুরতে।যেকোনো প্রয়োজনে মুহিতকে সবকিছু জানাতে।
নবনীতা,শুভ্রা আর চিত্রা বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল।তারা তাদের সাথে লুকোচুরি,রক পেপার সিজার,কানামাছির মতো ছেলেমানুষি খেলা খেলছিল।মাঝে মাঝে এই বাচ্চাদের বাহানায় নিজেদের শৈশবে পরিভ্রমণ করালে মন্দ হয় না।আরহাম ব্যস্ত ছিল কালকের দিনের প্রস্তুতি নিয়ে।সে চাইছে কালকে এদিকে একটা পিকনিকের আয়োজন করতে।বাচ্চাগুলো ছুটোছুটি আর খেলাধুলার সুযোগ পাবে।সেই সাথে তারা নিজেরাও ভালো সময় কাটাতে পারবে।সে রান্নাঘরে গিয়েই ব্যস্ত হয়ে বলল,’সবকিছু পরিমান মতো আছে তো?না হলে আমাকে জানাবে কিন্তু।’
বাকিরা বেরিয়েছে নৈশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।সারাহ ফোন দিয়ে নানারকম শর্ট স্ন্যাপ নিচ্ছিল।আদি তার ফোনের ছবিগুলো দেখে প্রসন্ন হেসে বলল,’বাহ! তোমার ফোনের ছবি গুলো চমৎকার হয়েছে।মেইল করে পাঠিয়ে দিও তো আমাকে।’
তাসনুভা তার হাঁটুতে কিল বসাল।দাঁত কিড়মিড় করে নিচু স্বরে বলল,’তুমি যদি আর একবারো সারাহ-র সাথে কথা বলো,তাহলে আমি আর জীবনেও তোমার সাথে কথা বলব না।’
আদি এক হাতে তার হুইলচেয়ারের হাতল আর অন্যহাতে নিজের কান ধরে মাথা ঝুকিয়ে বলল,’সরি সরি।এই যে কানে ধরলাম।আর হবে না বাচ্চা।তবুও তুমি মনে কষ্ট নিও না।’
ওয়াজিদ তার পেছন পেছন এগিয়ে আসে।খানিকটা ধ’মকের সুরে বলে,’এখানে কেন এসেছ?এদিকে তো লোকজন কেউ নেই।সবাই অন্য দিকে।এদিক থেকে সরে এসো।পাহাড়ি এলাকায় এতো একা একা ঘুরা ভালো না।’
রিমি হঠাৎ তার আওয়াজ শুনেই লাফ দিয়ে উঠে।তারপরই পেছন ফিরে বড় বড় চোখ করে বলে,’ওহহ আপনি।ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।’
সে চটপটে হয়ে সামনে পা বাড়ায়।হঠাৎই তার জুতোটা স্লিপ কেটে তার এক পা রাস্তা থেকে ছিটকে নিচের দিকে গিয়ে পড়ল।রিমি তাল হারাতে হারাতে এক চিৎকার দিলো,’ওয়াজিদ ভাইয়া বাঁচান!’
ওয়াজিদ চমকের পিলে পেছন ফিরে।সে কিছু বুঝে উঠার আগেই রিমি তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়।টান খেতেই ওয়াজিদ আঁতকে উঠে চিৎকার দেয়,’এটা কি করছ তুমি?’
রিমি তাল হারিয়ে সোজা পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে এলো।পুরোটা সময় সে শক্ত করে ওয়াজিদের হাত চেপে রাখল।মরলে সে একা মরবে কেন?জীবনসঙ্গী যেমন আছে,তেমন একটা মরণসঙ্গীও থাকা দরকার।যার সাথে শান্তিতে মরা যায়।ওয়াজিদ হবে তার মরণসঙ্গী।
পাহাড়ের উচ্চতা খুব বেশি না।তবে বেশ ঢালু পাহাড় হওয়াতে গড়াতে গড়াতে দু’জন বেশ দূরে কোথাও গিয়ে থামল।একটা শক্ত ভূমিতে নিজের অস্তিত্ব টের পেতেই ওয়াজিদ এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।রিমি তখনও মাটিতে।সে তাকে তুলল না।উল্টো খেঁকিয়ে উঠে বলল,’পুরাই ফালতু মাথাখারাপ আকামলা একটা মেয়ে।নিজে একা পড়ছিলে,আবার আমাকে সাথে টেনেছো কেন?সহ্যেরও একটা সীমা থাকে।’
রিমি উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ে।কাচুমাচু মুখ করে বলে,’সরি ভাইয়া।ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।তাই এমন করেছি।নেভার মাইন্ড প্লিজ।’
‘একদম ঠাটিয়ে চড় দেব বেয়াদব।এখন এই জায়গা থেকে আমি তাদের কাছে ফিরব কেমন করে?’
ওয়াজিদ পকেট হাতড়ায়।তারপরই হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে।যা ভেবেছে তাই,মোবাইলটা গড়িয়ে কোথাও পড়ে গেছে।অবশ্য মোবাইল থাকলেও বা কি?এই জায়গায় তো নেটওয়ার্কও পাওয়া যাবে না।সে রাগে ফুসতে ফুসতে চারদিক দেখে।এই অন্ধকারে সে এই মেয়েটিকে নিয়ে কোথায় যাবে?এতো রাতে খারাপ মানুষের ভয় তো আছেই।সেই সাথে আছে হিং*স্র জন্তু,জানোয়ারের ভয়।সে কতোক্ষণ নিজের চুল টেনে শেষে খপ করে রিমির হাতটা ধরে সামনে হাঁটা শুরু করল।রিমি অবাক হয়ে বলল,’সেকি!কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
ওয়াজিদ পেছন ফিরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’আর একটাও কথা বলবে না।নয়তো এদিকেই ফেলে রেখে চলে যাব।ছাগল কোথাকার! গর্দভ একটা!’
রিমি একহাত মুখে চেপে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’না না,আর কিছু বলব না।তবুও আমাকে আপনার সাথে সাথে রাখুন।’
ওয়াজিদ দ্রুত কদম ফেলে সামনে এগোয়।কেবল একটা ঘর পেলেই হবে।অন্তত আজ রাত টা কাটানোর জন্য।অবশেষে আধঘন্টার মতো হাঁটার পর সে উঁচু টিলার উপর একটা বাঁশের ঘর দেখতে পেল।দেখেই তার মুখে হাসি ফুটল।সে রিমিকে টিলার নিচে দাঁড় করিয়ে কড়া গলায় বলল,’দাঁড়াও আগে দেখে আসি ভেতরে কেউ আছে নাকি।চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।আমি ডাকলে তারপর এসো।’
সে ধুপধাপ পায়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়।কয়েকবার কড়াঘাত করতেই একটা বৃদ্ধ ব্যক্তি দরজা খুলল।ওয়াজিদ তাকে দেখেই সালাম দিলো।অমায়িক কন্ঠে বলল,’আসলে আমরা একটা বিপদে পড়েছি।আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি।আপনি কি আজকে রাতের জন্য আমাদের এদিকে থাকতে দিবেন?ভোর হতেই আমরা চলে যাব।’
লোকটা আগাগোড়া তাকে দেখেই সূচালো চোখে প্রশ্ন করে,’আমরা মানে?তুমি আর কে?’
ওয়াজিদ আঙুল তুলে রিমিকে দেখায়।রিমি বৃদ্ধ লোকটাকে দেখা মাত্রই হাত তুলে হাই দেয়।ওয়াজিদ সামনে ফিরে জোরপূর্বক সামান্য হেসে প্রতিউত্তর করে,’জ্বী।আমি আর আমার ওয়াইফ।’
সে খুব ভালো করে জানে অন্য পরিচয় দিলে তাদের কিছুতেই এখানে জায়গা দেওয়া হবে না।তারচেয়ে ভালো আপাতত জামাই বউ পরিচয় দিয়ে কোনোরকমে রাতটা পার করে দেওয়া।সকাল হলেই তারা বেরিয়ে যাবে এখান থেকে।
তার বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে।লোকটা তাদের অবস্থা দেখে মায়া করে তাদের ঘরে জায়গা দিলো।ওয়াজিদ ঘরে এসেই হাত মুখ ধোয়ার জন্য চাপকলের কাছে গেল।আর রিমি গিয়ে বসল বসার ঘরের বেতের সোফায়।বাড়িতে কেবল দু’জন মানুষ থাকে।বৃদ্ধ লোক আর তার স্ত্রী।
রিমি সোফায় বসতেই বৃদ্ধা মহিলা এক গ্লাস পানি হাতে এগিয়ে এলেন।রিমি তাকে দেখে মিষ্টি করে হাসল।বৃদ্ধা জানতে চাইলেন,’কয় মাস হয়েছে তোমার বিয়ের?নাকি অনেক বছর আগেই বিয়ে করেছ?’
রিমি পানি খাওয়ার মাঝেই বিষম খেল।কাশতে কাশতে দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’আরে না না।আমরা কোনো জামাই বউ না।আমাদের কারো বিয়েই হয়নি এখনো।’
রিমি ভয়ে ভয়ে ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।কাচুমাচু মুখে বলে,’না।আমরা পরিচিত কিন্তু বিবাহিত নই।’
____
হট্টগোলের শব্দ কানে যেতেই ওয়াজিদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো।বসার ঘরে আসতেই বৃদ্ধ লোকটা তাকে দেখামাত্র গর্জে উঠল,’মিথ্যুক! মেয়ে নিয়ে রঙ্গতামাশা করতে এসে পরিচয় দেও জামাই বউ বলে?এটা কি আমার বাড়ি,নাকি কোনো আবাসিক হোটেল?নষ্টামি করার আর জায়গা পাও না?’
ওয়াজিদ হতভম্ব হয়ে তার কথা শুনে।তারপরই চোখ সরিয়ে রিমির কাচুমাচু মুখটা দেখে।এরপর চুপচাপ মাথা নামিয়ে নেয়।গর্দভটা নিশ্চিত আরেকটা গর্দভগিরি করেছে।
***
রাত তখন কয়টা সে হিসেব ওয়াজিদের নেই।সে চোখ নামিয়ে বাঁশের ঘরটার মেঝে দেখে।তারপরই একটা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে।সে বার বার বোঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে এই মেয়েটার সাথে তার কিছুই নেই।পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে তারা বিপদে পড়েছে,তাই সাহায্য চেয়েছে।তারা যেন তাকে সাহায্য করে এজন্যই সে মিথ্যে বলেছে।নয়তো তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।দরকার পড়লে আজ রাতটা সে দরজার সামনে থেকেই কাটিয়ে দিবে।তার এতেও কোনো সমস্যা নেই।
কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছিল না,তখন সে তাদের কাছে আরহামের পরিচয় দিলো।জানাল যে তারা আরহামের সাথেই এসেছে।তার কথায় কাজ তো কিছু হলোই না,উল্টো বৃদ্ধ লোকটি চটে গিয়ে বলল,’তোর এমপির নাম তোর কাছেই রাখ।তোর ব্যবস্থা আমি করছি।এখন থেকে আর মিথ্যা বলে নষ্টামি করতে হবে না।আমি তোর পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করছি দাঁড়া।কত্তোবড় সাহস! আমার সাথে বাহাদুরি করে।’
তারপরই তিনি এই রাতের মাঝে কোথা থেকে একজন লোক সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরল।ওয়াজিদ কথাবার্তায় বুঝল লোকটা কোনো মসজিদের ইমাম।যে এসেছে তাদের বিয়ে পড়াতে।কি অদ্ভুত আর নাটকীয় বিষয়! আদির অনেক শখ ছিলো এরকম গ্রামবাসীর খপ্পরে পড়ে বিয়ে করার।অথচ সেই শখ ওয়াজিদের জীবনে বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে।আশ্চর্য বিষয়! স্রষ্টা তো আদিকে এভাবে বিয়ে করালেও পারতো।ওয়াজিদের সাথে এমন হচ্ছে কেন?সে কি দোষ করেছে যে এমন বিচ্ছিরি পরিস্থিতিতে তার বিয়ে হতে হবে?কেন জগতের সব বিব্রত পরিস্থিতি ওয়াজিদের ঝুলিতে এসে জমা হয়?
সে নির্বিকার হয়ে কবুল বলে।কবুল বলার পরেও তার বিশ্বাস হচ্ছিল না তার যে বিয়ে হয়ে গেছে।এসব কি?এগুলো কোনো বিয়ে হলো?মা নাই বাপ নাই,কেউ নাই।কেবল কবুল বলল আর বিয়ে হয়ে গেল?এটাও কি সম্ভব?
সে চোখ তুলে রিমিকে দেখে।রিমি মাথা তুলে চোরা চোখে সামনে দেখতেই ওয়াজিদের চোখ মুখের অবস্থা দেখে দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়।কি ভয়ংকর সে চাহনি! এতো ভয়ংকর ভাবে তাকিয়ে আছে কেন এই লোক?ওয়াজিদ একহাত মুঠ করে দাঁত কিড়মিড় করে।এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।একবার এই ছাগলটাকে হাতের কাছে পাক।চড় মেরে এর বাপের নাম যদি ভুলিয়ে না দেয়,তবে সেও ওয়াজিদ না।
বিক্ষিপ্ত মেজাজে ছোট্ট ঘরটাতে ঢুকেই ওয়াজিদ ফুসতে ফুসতে রিমির দিকে তাকায়।রিমি তার উপস্থিতি টের পেতেই মিনমিনে স্বরে বলল,’মিথ্যে বলেছেন সেটা তো আমাকে আগে জানাবেন নাকি?’
ওয়াজিদ তার দিকে তেড়ে এসে চেঁচায়,’আর একটা কথা যদি বলো না,এদিকেই গলা চেপে ধরব।অপদার্থ গাধা কোথাকার!’
রিমি আড়চোখে একবার তাকে দেখে।পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে তাকে ভেঙচি কাটে।ভাব এমন দেখাচ্ছে যেন এই বিয়েতে সে একাই কষ্ট পেয়েছে।আর রিমির খুব আনন্দ হচ্ছে।রিমি নিজেও তো এমন পরিস্থিতি চায় নাই।ঐ লোক কি নিজের কোনো দোষ খুঁজে পাচ্ছে না?বিষয়টা অনেকভাবেই কাটানো যেত।জামাই বউ বলার দরকার টা কি ছিল?
ওয়াজিদ অনেকক্ষণ ঘরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পায়চারি করে।শেষটায় বড় বড় কদমে রিমির মুখোমুখি বসে এক আঙুল তুলে কড়া গলায় বলল,’শোনো রিমি।এভাবে কোনো মানুষের বিয়ে হয় না।বিয়েতে কনের বাবা অথবা ভাইয়ের সম্মতি লাগে।মূল কথা যারা বিয়ে করছে তাদের সম্মতি লাগে।দু’জনের পরিবারের সামনে কবুল বললে তবেই সেটা বিয়ে হয়।এভাবে মাঝরাতে লোক ডাকিয়ে বিয়ে পড়ালে সেটাকে বিয়ে বলে না।অন্তত আমার এটাকে বিয়ে বলে মনে হয় না।আমি এটাকে বিয়ে হিসেবে গণ্যই করছি না।যাই হোক,সে কথা পরে।এখন যেটা বলব সেটা মন দিয়ে শুনো।কাল যখন আমরা আমাদের কটেজে ফিরব,তখন তুমি কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলবে না।একদম টু শব্দও করবে না।আমি সব বলব।আর তুমি চুপ থাকবে।ভুলেও বিয়ের কথা মুখে আনবে না।আমাদের কোনো বিয়ে টিয়ে হয়নি।
রিমি কোনোরকম চোখ তুলে তাকে দেখে।তারপরই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে,’ওকে ওকে।নো প্রবলেম।’
ওয়াজিদ খাট থেকে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে অত্যন্ত বিরক্তি ধরা কন্ঠে বলে,’তোমাকে কিছু বলে নিজের শক্তি অপচয় করতেও আমার রুচিতে লাগে।বললে তো কাজ হবেই না,খামোখা আমার শক্তি খরচ হবে।শুধু এইটুকু বলছি,তুমি আমার থেকে দূরে দূরে থাকবে।আগেও বলেছি,এখনও বলছি।বাট এখন আমি সিরিয়াস।প্লিজ রিমি,হাত জোড় করছি।দূরে থাকো তুমি।তোমাকে দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়।’
রিমি মাথা নামিয়ে বেডশিটের প্রিন্ট দেখে।যদিও খারাপ লাগা উচিত না,কিন্তু কোনো একটা অজানা কারণে তার খারাপ লাগছে।এমন দুম করে বলে দিলো তার থেকে দূরে থাকতে?রিমি কি ছ্যাচড়া?গায়ে পড়া স্বভাবের?নয়তো এমন করে বলল কেন?সে কেবল ছোট করে জবাব দিলো,’আচ্ছা ঠিক আছে।’
ওয়াজিদ কতোক্ষণ তার চুল টানে।কতোক্ষণ তার মুখটা দুই হাতে চেপে ধরে বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ে।বলে তো দিয়েছে যে সে এসব মানে না।কিন্তু তারপর কি?এতো বড় একটা বিষয় সে কতদিন ধামাচাপা দিবে?আদৌ কি সেটা সম্ভব?ওয়াজিদের মস্তিষ্ক বলে এটা সম্ভব না।কোনো না কোনো ভাবে একদিন মানুষ এটা জানবেই।এরপর কি হবে?সে দ্রুত মাথা নাড়ে।আর এসব ভাবতে পারবে না।ভাবলেই তার মাথা ব্যথা হয়।
ভোরের আলো ফুটতেই সে তাড়াহুড়ো করে বাঁশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।রিমিকে ডাকার প্রয়োজন বোধ করল না।রিমি তো দেখছেই সে বেরিয়ে যাচ্ছে।তার উচিত নিজ থেকে তার পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে আসা।ওয়াজিদ কেন ডাকবে তাকে?এতো তোষামোদি সে করতে পারবে না।
রিমিকে অবশ্য তোষামোদ করার কিছু নেই।সে নিজেই চুপচাপ বেরিয়ে এলো।ওয়াজিদ চোখ মেলে চারদিক দেখে নিজেদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে।তারপরই অনুমানে খানিকটা সামনে এগোয়।
ওয়াজিদ পেছন না ফিরেই সামনে যেতে যেতে জবাব দিলো,’পারব না আস্তে হাঁটতে।দ্রুত কটেজ যেতে হবে।আস্তে হাঁটা সম্ভব না।’
সে ইচ্ছাকৃতভাবে তার হাঁটার গতি বাড়ায়।রিমি যেতে যেতে এই টিলা ঐ টিলার সাথে হোঁচট খায়।হোঁচট খেতেই মুখ দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে।ওয়াজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে একবারও তাকে দেখল না।
পাক,আরো কয়েকটা ব্যথা পাক।সে ব্যথা পেলে ওয়াজিদ পৈশাচিক আনন্দ পায়।হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এসে ওয়াজিদ সঠিক পথ খুঁজে পেল।সে কেবল একবার পেছন ফিরে বলল,’তাড়াতাড়ি এসো।রাস্তা পেয়ে গেছি।’
রিমি একপ্রকার ছুটতে ছুটতে তাকে অনুসরণ করে।হঠাৎই পায়ে খানিকটা যন্ত্রণা শুরু হতেই সে মাথা ঝুকায়।মুহূর্তেই তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়।সে চওড়া গলায় চেঁচায়,’ভাইয়া!!! আমার পা দেখুন।’
ওয়াজিদ পেছন ফিরে।এগিয়ে না এসে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই প্রশ্ন করে,’সমস্যা কি?আবার কি হয়েছে?’
রিমি কোনোরকমে পা টা তুলে বলল,’আমার পায়ে জোঁক ধরেছে ভাইয়া।দেখুন রক্ত খেয়ে খেয়ে কি অবস্থা করেছে পায়ের।’
ওয়াজিদ তার কথা শুনল।তারপরই সামনে ফিরে হনহন করে হেঁটে যেতে যেতে বলল,’খেয়ে ফেলুক।সব রক্ত খেয়ে ফেলুক।আরো তো কতো মানুষ আছে।কই তাদের তো কিছু হয় না।জোঁক শুধু তোমাকেই কেন ধরে?পুরাই অসহ্য লাগছে আমার।’
‘ভাইয়া! এখন কি করব?’
‘জানি না আমি কি করবে।আমি কিছু করতে পারব না।’
সে বড়ো বড়ো পায়ে সামনে হেঁটে যায়।তার এখন কটেজে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে হবে।মাথা এমনিতেও যথেষ্ট গরম।এখন আর অন্য ঝামেলা সে সহ্য করতে পারবে না।
রিমি শূন্য চোখে তার প্রস্থান দেখে নেয়।তার অজান্তেই তার দুই চোখ ভরে এসেছে।সে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে।ধ্যাত! এইটুকুতে কেউ রাগ করে?সে নিজেকে বোঝায় ওয়াজিদের ভাইয়ের মন খারাপ,তাই সে এমন আচরণ করেছে।নয়তো সে ঠিকই এগিয়ে এসে রিমির ব্যাপারটা ভালো করে দেখতো।
সে দ্রুত তার পেছন পেছন ছুটে।চোখ দু’টো তবুও যে কেন বারবার ভরে আসছে কে জানে!
***
রিমি আর ওয়াজিদের অনুপস্থিতি সবার আগে টের পেল আদি।সারারাত এদিক সেদিক ঘুরাঘুরির পর ভোরের দিকে তারা যখন সবাই সবার কটেজে ফিরে এলো,তখন দু’জনকে না দেখতে পেয়ে সে খানিকটা চিন্তিত হলো।প্রায় দশ মিনিট এখানে সেখানে খোঁজাখুঁজির পর সে নিশ্চিত হলো ওয়াজিদ সত্যিই আশেপাশে কোথাও নেই।
সে খানিকটা দ্বিধায় পড়ল।আরহামকে কি এখনই জানিয়ে দিবে?নাকি আরেকটু অপেক্ষা করবে?আরিশ আর তাসনুভা তো ঘুমিয়ে কাদা।আরহামকে বললে সে আবার অকারণে অস্থিরতা দেখাবে।আচ্ছা মুহিত কোথায়?তার থেকে সাহায্য নেওয়া যায়।
আদি দ্রুত মিলিটারি টেন্টের দিকে ছুটে।মুহিত তখন টেন্টের বাইরেই ছিলো।তার ঘুম ভেঙেছে একটু আগে।আদি তাকে দেখতেই বড় বড় পা ফেলে তার কাছে গেল।বিচলিত গলায় বলল,’এক্সকিউজ মি মুহিত।আমি আমার ফ্রেন্ড ওয়াজিদকে অনেকক্ষণ যাবত দেখছি না।কটেজে ফেরার পর থেকে সে আর সাথে আরেকজন মেয়ে মিসিং।তুমি কি একটু দেখবে ব্যাপারটা?’
মুহিত সাথে সাথে সামনে যেতে যেতে বলল,’কতোক্ষণ আগের ঘটনা?এসো তো,আমার সাথে এসো।দেখছি আমি ব্যাপারটা।’
মুহিতের খুব বেশি মাথা ঘামাতে হলো না এই ব্যাপারে।একটু সামনে আসতেই আনুমানিক দুইশো মিটার দূরত্বে একটা ছেলের অবয়ব দেখতে পেয়ে সে দ্রুত দূরবীনে চোখ রাখে।তারপরই সেটা আদির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,’দেখো তো।এটা তোমার বন্ধু না?’
আদি দূরবীন টা চোখের উপর ধরেই চঞ্চল হয়ে বলল,’আরে হ্যাঁ।এটাই ওয়াজিদ।’
সে দূরবীনটা মুহিতের নিকট ফিরিয়ে দেয়।ওয়াজিদের আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না।সে নিজেই দৌড় লাগায় সামনের দিকে।ওয়াজিদের কাছাকাছি এসেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’তুই কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?’
বলে সে আর দাঁড়ায় না।আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে হেঁটে কটেজের দিকে চলে যায়।এখানে থাকলেই সে উল্টাপাল্টা বলে ফেলবে।তার চেয়ে ভালো কটেজে কতোক্ষণ ঘুমিয়ে মনটাকে একটু ঠান্ডা করা।
রিমি ফ্যাকাশে হেসে সামনের দিকে হেঁটে এলো।আদি কপাল কুঁচকে বলল,’ঘটনা কি বলো তো?ওয়াজিদ এমন থম মেরে আছে কেন?হয়েছে টা কি?’
সে দ্রুত মাথা নেড়ে জানায়,’এমন কিছু না ভাইয়া।রাস্তা হারিয়ে গিয়েছিলাম আমরা।’
‘ওহহ আচ্ছা।’
রিমি নিজ থেকেই করুণ স্বরে ডাকে,’ভাইয়া!’
‘হু?’
‘ভাইয়া একটা সমস্যা হয়েছে।’
‘সেটা কি?’
রিমি নিজের পা দেখায়।কাচুমাচু হয়ে বলে,’জোঁক সব রক্ত খেয়ে নিচ্ছে।’
আদি আঁতকে উঠে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে।চোখ বড় বড় করে বলে,’আল্লাহ! এসব কি?’
‘এসব জোঁক।রক্ত খেয়ে শরীরের সাথে লেগে থাকে।লবন ছিটিয়ে এদের শরীর থেকে আলাদা করতে হয়।’
আদি দ্রুত নাক চেপে ধরে।মুখ খিঁচিয়ে বলে,’ইসস!! কি বিচ্ছিরি! বমি পাচ্ছে আমার।’
‘বমি পেলে নাক ধরছেন কেন?’
আদি মাথা তুলে।নাক চেপে ধরেই বলে,’আমি পোকার শরীর দেখেই তার ঘ্রাণ বুঝে ফেলি।এই পোকাটার গন্ধ ভালো না।’
***
নবনীতা ঘুম ভাঙার পরেই চুপচাপ হেঁটে কটেজের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।আজকে তার ঘুম একটু দেরিতেই ভেঙেছে।আরহাম আরো অনেক আগে উঠেছে।সে ব্যস্ত কিসব রান্নাবান্না নিয়ে।কালকে আসার পর থেকে এই পর্যন্ত সে পাঁচবারের উপরে জামা পাল্টেছে।তার বডি স্প্রে-র গন্ধে ঘরে ঢোকা যায় না।একটা বডি স্পে তো বোধ হয় মাখতে মাখতে শেষই করে ফেলেছে।টি শার্ট গুলো খুলে খুলে যেখানে খুশি সেখানে ফেলে রেখেছে।এই পুরো ঘর গোছাতেও তো নবনীতার আধঘন্টা লাগবে।
সে সবকিছু গুছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।তাদের পাশের ঘরে শুভ্রা আর চিত্র ঘুমিয়েছে।সে লক ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিতেই দেখল তারা কেউ ঘরে নেই।নিশ্চয়ই বাচ্চাদের কাছে গিয়েছে।কোমর সমান চুলগুলোকে একহাতে পেঁচিয়ে কোনোরকমে ক্লাচারে পুরে সে তার কটেজ থেকে বের হলো।
দূরে আরিশকে দেখা যাচ্ছে।সে আকাশের ছবি তুলছে খুব মনোযোগ দিয়ে।আদি মোবাইলে একটানা বকবক করেই যাচ্ছে।নবনীতার সাথে চোখাচোখি হতেই সে হাত তুলে হাই দেয়।নবনীতা জবাবে কেবল মুচকি হাসে।
বেলা বাড়তেই সবাই দুপুরের খাবারের জন্য মাঠে এসে জড়ো হলো।শুধু ওয়াজিদ ছাড়া।আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’ঘটনা কি?ওয়াজিদ কোথায়?’
আদি মাথা চুলকে বলল,’কে জানে! তার নাকি ঘুম পাচ্ছে খুব।একটু পরে নাকি আসবে।’
রিমি মলিন মুখে ওয়াজিদের কটেজের দিকে তাকায়।সে আছে বলেই সম্ভবত খেতে আসতে চাইছে না।জিনিসগুলো যে হুট করে কেমন হয়ে গেল,সে নিজেও কিছু বুঝতে পারছে না।তার নিজেরও কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে।সে ভেবে রেখেছে সে বাসায় গিয়ে মন মতো কাঁদবে।আপাতত এসব কান্না একটু চেপে রাখাই ভালো।
চিত্রা সে কথা গায়ে মাখলো না।সে ছুটে এসে নবনীতাকে জাপ্টে ধরে বলল,’আপাই তুমি না বলেছিলে আমরা কোথাও বেড়াতে গেলে একসাথে ছবি তুলব?’
নবনীতা তার থুতনিতে হাত রেখে দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’আরে তাই তো।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।এই শুভি এদিকে আয় তো।’
শুভ্রা হাসিমুখে এগিয়ে আসে।নবনীতা আরিশকে ডেকে মিষ্টি হেসে বলল,’ভাই আমাদের তিন বোনের একটা সুন্দর ছবি তুলে দাও তো।আমরা আবার নতুন করে অ্যালবাম সাজাবো।’
আরিশ তারই মতো মিষ্টি হেসে ক্যামেরা সেট করে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।কয়েকটা ছবি তোলার পরেই চিত্রা দু’জনকে ফেলে সামনের দিকে ছুটে যায়।
কালো রঙের টিশার্ট টা পেছন থেকে কেউ টেনে ধরতেই আরহাম পেছন ফিরে।চোখ পাকিয়ে জানতে চায়,’কিরে চিত্র! জামা ধরে টানিস কেন?জানিস না আমার টিশার্ট গুলো আমার কতো পছন্দের?’
চিত্রা তার হাত চেপে তাকে সামনে টানতে টানতে বলল,’তাত্তারি আমার সাথে এসো।’
সে তাকে টেনে নিয়ে আরিশের সামনে দাঁড় করায়।রিনরিনে গলায় বলে,’আমাদেরও অনেক গুলো ছবি তুলে দাও আরু।আমরা আমাদের নতুন অ্যালবামে সব জমাবো।’
আরিশ তার কথা শুনেই মুচকি হাসল।এই মিষ্টি বাচ্চাটা তাকে ভালোবেসে ছোট্ট করে আরু বলে ডাকে।এই সম্বোধনটা আরিশের বেশ ভালো লাগে।সে ক্যামেরার এঙ্গেল ঠিক করতে করতে বলল,’ওকে বস।এখনই তুলে দিচ্ছি।’
আরহাম আর চিত্রা অগনিত ছবি তুলল।একেক ছবির একেক পোজ।নবনীতা কপাল চাপড়ে বলল,’কি একটা অবস্থা! আপনি তো আমার সাথেও এতো গুলো তুলেননি।আর চিত্রর সাথে এতো গুলো?’
আরহাম মুখ কুঁচকে বলল,’তুমি কি চিত্র’র মতো এতো কিউট নাকি?নয়তো তোমার সাথেও তুলতাম।তুমি হচ্ছো প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারদের মতো।কেমন জানি অদ্ভুত।দেখলেই মনে হয় রেগে আছো।’
***
নবনীতা একশো বারের উপরে দরজা ধাক্কায়।অথচ আরহাম দরজা খোলা তো দূর,একবার সাড়া পর্যন্ত দিলো না।নবনীতা পড়েছে বিপাকে।সে পুনরায় অনুনয় করে ডাকলো,’আরহাম! প্লিজ দরজা টা অন্তত খুলুন।আমার কথা তো শুনুন।’
আজ আবার একটা ঝামেলা হয়েছে।বিকেলে নাস্তার জন্য অনেকরকম স্ন্যাকস বানানো হচ্ছিল।হঠাৎই মুহিত তার পাশে এসে বলল,’তুমি না ফুচকা খুব পছন্দ করো?তাই আমি তোমার জন্য সেটার ব্যবস্থাও করেছি।যদিও এখানকার ফুচকা ঢাকার মতো এতো মজা না।তবুও কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়।খেয়ে দেখতে পারো।’
নবনীতা বিব্রত হয়ে তার দিকে তাকায়।ভদ্রতার খাতিরে সামান্য হেসে জবাব দেয়,’জ্বী ধন্যবাদ।’
একটু এগিয়ে সামনে দেখতেই তার চোখ কপালে উঠল।যেই ভয়টা সে পেয়েছিল সেটাই হয়েছে।আরহাম তাকে আর মুহিতকে একসাথে দেখে নিয়েছে।দূরের একটা গাছের নিচে সে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।তার স্থির,অতিমাত্রায় শীতল দৃষ্টি নবনীতার দিকে নিবদ্ধ।সে বোকা না।দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো তার জন্য অসম্ভব কিছু না।নবনীতা চোরা চোখে আবারো তাকে দেখে।কি অদ্ভুত! সে এতো ভয় পাচ্ছে কেন?সে তো কোনো অন্যায় করেনি।মুহিত তো তার প্রেমিক না।তাহলে এতো ভয় কিসের?
সে ভয় পাচ্ছিল আরহামের প্রতিক্রিয়া নিয়ে।আরহাম যদি কিছু করে?যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে পরিস্থিতি নষ্ট করে তখন?তখন নবনীতার চেয়ে অপ্রীতিকর অবস্থায় আর কেউ পড়বে না।সে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে আরহামের কাছে যায়।গিয়েই তার একটা হাত লুফে নিয়ে অত্যন্ত কোমল কন্ঠে অনুনয় করে,’প্লিজ আরহাম।আপনি মুহিতকে কিছু করবেন না প্লিজ।’
আরহাম আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকায়।তার কথা শুনেই তার সমস্ত শরীর ঝনঝন করে উঠেছে।সে বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,’সিরিয়াসলি?তুমি এখনো তোমার সেই মেজর কে নিয়ে ভাবছ?’
আরহাম এক ঝাড়ায় নিজের হাত সরিয়ে নেয়।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’চুপ করো তো।সারাক্ষণ কানের কাছে মুহিত মুহিত শুনতে ভালো লাগে না।থাকো তুমি তোমার মুহিতকে নিয়ে।নিশ্চিন্তে থাকো।আমি কিছু করব না।যা খুশি করো তুমি।’
বলেই সে হনহনিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।নবনীতা শাড়ির কুচি চেপে ধরে ছুট লাগায় তার পেছন পেছন।আরহাম পেছন ফিরে কর্কশ কন্ঠে চেঁচায়,’একদম আমার ঘরে আসবে না।তোমার মুখটা দেখতেও অসহ্য লাগছে আমার।’
বলা শেষ করে নিজের রুমে গিয়ে সেই যে সে দরজা বন্ধ করেছে,তারপর দুই ঘন্টায়ও আর খোলার নাম নেই।নবনীতা দুই ঘন্টা যাবত তার দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে একপ্রকার ক্লান্ত।সে শেষমেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’আমি দরজার সামনেই আছি।আপনার যদি একটু করুণা হয় এই মেয়েটার জন্য,তাহলে দয়া করে দরজা টা খুলবেন।নয়তো সারারাত এভাবেই থাকুন।’
নবনীতা ধীর পায়ে হেঁটে তার পাশটায় গিয়ে বসল।তার চুলে হাত ছুয়িয়ে নিচু স্বরে ডাকল,’আরহাম! ও আরহাম! কথা তো শুনুন।’
‘কি শুনব?তোমার প্রেমকাহিনী শুনতে আমি আগ্রহী নই।’
‘আগ্রহী না হলেও শুনতে হবে।’
সে এক লাফে উঠে বসে।দ্রুত কদমে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।নবনীতা তার মতিগতি বুঝতেই ছুটে গিয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।গাঢ় স্বরে বলল,’না না।এখন যাওয়া যাবে না।’
আরহাম মুখ খিঁচে তার হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল।বিরক্ত গলায় বলল,’ভালো লাগে না তো।সরো তুমি।বিরক্ত লাগছে ভীষণ।বালের ম্যারিড লাইফ।আমি আগেই ভালো ছিলাম।’
বলেই সে নিজেকে বন্ধনমুক্ত করে।নবনীতাও নাছোড়বান্দা।সে পুনরায় শক্ত হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে।নরম গলায় বলে,’একটা গান গাই?’
আরহাম উত্তর না দিয়ে কেবল সটান দাঁড়িয়ে থাকল।নবনীতা মুচকি হেসে সুমিষ্ট কন্ঠে কেবল দুই লাইন গাইলো,
‘আভি না যাও ছোড় কার,[এখনই ছেড়ে যেও না,]
ইয়ে দিল আভি ভারা নেহি।[আমার মন এখনো ভরে নাই]
.
.
.
.
ঘরের এক কোণায় হলদে রঙের বাতি জ্বলছে।নাতিশীতোষ্ণ হৃদয় জুড়ানো বাতাস পর্দা ঠেলে ঘরের ভিতর প্রবেশ করছে।অগ্রহায়ণ শুরু হবে কিছুদিন বাদেই।বাতাসে শীতের আগমনী বার্তা স্পষ্ট বিদ্যমান।
চব্বিশ বছর বয়স্কা মেয়েটি আস্তে করে তার স্বামীর বক্ষস্থলে মাথা রাখে।তারপরই শক্ত করে দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে।সে অনুভব করে এই মুহুর্তটা তার ভীষণ প্রিয়।এই যে বিষন্ন আর বিক্ষিপ্ত মনটা হুট করেই কেমন ভালো হয়ে গেছে,এই ব্যাপারটা তার খুব ভালো লাগে।অন্যপাশের মানুষটাও তো আচমকাই ঠান্ডা হয়ে গেছে।মেয়েটির চেয়ে তো তার অনুভূতি আলাদা কিছু না।
মেয়েটি মুচকি হেসে বলতে শুরু করে,’তো এটা হলো আমার গল্প।যেই গল্পটা আপনাকে শুনতেই হবে।আমি ছিলাম একেবারের বাস্তবতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া একজন মানুষ।বাবা নেই,মা নেই।শুধু আছে দু’টো ছোট্ট বোন আর মাথার উপর এত্তো এত্তো দায়িত্বের বোঝা।আমি ভীষণ উদ্ভ্রান্ত ছিলাম।জীবন তার করুণতম রূপ আমার সামনে মেলে দিয়েছিল।তারপর আমার জীবনে একজন মানুষের আগমন হলো।সে এলো আর কি হলো জানি না।আমি হুট করেই নিজের কৈশোরে ফিরে গেলাম।যেই কৈশোর আমার জীবন থেকে অনেক আগেই চলে গিয়েছিল।আমি অভিমান করা শিখলাম,আমি গাল ফুলানো শিখলাম।আমি সব শিখে গেলাম।আমি নিজেকে চূড়ান্ত রকমের আবেগী নারী রূপে আবিষ্কার করলাম।অথচ আমি ছিলাম ভীষণ মজবুত,প্রখর আত্মসম্মানে ভরপুর।পরে বুঝলাম,আত্মসম্মান কমে নি।আমিই নতুন একটা আমিকে খুঁজে পেয়েছি।এই আমিটাকেও আমার ভালো লাগে খুব।আপনি জানেন,যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে তাকে আমার কতোখানি ভালো লাগে?এই যে সে মন খারাপ করল,আমি নিজে ছটফট করতে করতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি।কারণ তার মনে কষ্ট দিতে আমার ভালো লাগে না।আমি কি করে তাকে বুঝাই সে ব্যতীত আমার জীবনে আর কেউ নেই?কি করে বোঝাই সে ছাড়া আমার এতো যত্ন আর কখনো কেউ করেনি?কি করে বুঝাই তার মতো করে কেউ কখনো আমার জন্য ভাবে নি।মাঝরাতে কাকভেজা হয়ে যেই মানুষটা আমার জন্য ফুচকা হাতে হসপিটালে এসেছিল,তাকে কি করে কষ্ট দিব আমি?আমি কেমন করে তাকে বুঝাই তাকে আমি কতোখানি ভালোবাসি?ভালোবাসা কি মুখের স্বীকারোক্তি তে বোঝানো যায়?নাকি আচরণে বোঝাতে হয়?সে কি আমার আচরনে বুঝে না আমি তাকে কতোখানি ভালোবাসি?’
আরহাম চুপচাপ তার কথা শুনল।নবনীতা থামতেই সে কাঁপা স্বরে বলল,’তুমি আমাকে ভালোবাসো পরী?’
নবনীতা মাথা না তুলেই জবাব দেয়,’হু বাসি।’
সময় গড়ায়।আচমকা নবনীতা ফুপিয়ে উঠে।তার হাতের বন্ধন আরো শক্ত করে ক্রন্দনরত স্বরে বলে,’আমি এজন্য আপনাকে বারণ করিনি যে আপনি মুহিতকে কিছু করলে আমার তার জন্য কষ্ট হবে।আমি এজন্য বারণ করেছি কারণ আপনি কিছু করলে সেই ঘুরে ফিরে আপনারই সমস্যা হবে।আপনি কেন বুঝতে চান না?সবকিছুতে হঠকারিতা ভালো না।’
আরহাম সেসব কিছু শুনলো না।সে আগের মতোই বলল,’আমায় ভালোবাসো পরী?’
নবনীতা মাথা তুলে।একহাতে তার খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি গালে হাত রেখে অন্য গালটায় প্রগাঢ় চুমু খায়।ঘোরলাগা কন্ঠে বলে,’হুম বাসি।একশোবার বাসি।’
‘তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো?’
‘জ্বী।সত্যিই।’
‘আবার বলো তো।’
নবনীতা আলগোছে হাসে।একবার বড়ো করে শ্বাস টেনে বলে,’জ্বী আমি নবনীতা নূর,চিত্র আর শুভির পরী আপাই,তাসনুভা আর আরিশের পরী ভাবি,আর আপনার পরী সত্যিই আপনাকে এতো এতো এতো বেশি ভালোবাসি।আপনি চাইলে আমি একশোবার এই কথা বলতে পারব।কারণ সত্য কথা দিনে একশোবার বলা যায়।’
আরহাম তার কথা শুনেই শব্দ করে হাসল।নবনীতা চোখ মুছে বলল,’আপনি সেদিন একটা কথা ভুল বলেছিলেন।আপনি বলেছিলেন আপনার মা আমার চেয়েও ভাগ্যবতী কারণ তিনি স্বামী হিসেবে খুব ভালো কাউকে পেয়েছিলেন।কিন্তু আজ আমি বলছি আমি আপনার মায়ের চেয়েও বেশি ভাগ্যবতী কারণ আপনার মা জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই ভালোবাসা ধরে রাখতে পারেনি।কিন্তু আমি পারব।আমি সারাজীবন এই ঘর,সংসার এই সবকিছুকে ধরে রাখব।এই যত্ন ভালোবাসা সবকিছুতে আমার লোভ জন্মেছে।আমি আর এসব ছাড়ছি না আরহাম।’