মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর এক নাম্বারে আসতে ওদের খুব একটা সময় লাগেনি। আজকে আবার ছুটির দিন শনিবার। সে কারনে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে রাস্তা বেশ ফাঁকা ছিলো। বাড়ি আসতে সাথীর দুপুর বারোটা বেজে যায়। সোলেমান সাহেব বাড়িতে এসেই ওয়াশরুমে চলে যান। একটু পরেই যোহরের আযান দিবে। সোলেমান সাহেব মসজিদে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করেন। তাই গোসল করে মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাড়িতে পৌঁছে সাথী ওর মায়ের ঘরে গিয়ে বললো,
—বাবাকে আটকাতে পারলে না?
—তোর বাবাকে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু আমার কথা শোনেনি। তোর দাদী ডেকে নিয়ে কি যেন বললো? আর অমনি সাত সকালে তোকে আনতে ছুটে গেল। আর আমিও বুঝে পাই না ঐ ফাহিমকে তোর লাগবে কেন? দুনিয়াতে কি ছেলের আকাল পড়েছে?
—+বুড়িকে আমি এমন শাস্তি দিবো যেন বাপের নাম পর্যন্ত ভুলে যাবে।
—-তোকে তার বাপের নাম ভোলাতে হবে না। আমি ফাহিমের থেকে ভালো ছেলে দেখে তোর বিয়ে দিবো।
মায়ের কথাশুনে সাথীর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। তাই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে বললো,
—কেন আজ ভালো সাজার চেষ্টা করছো মা? বিয়ে দেওয়ার আগে একটু খোঁজ নিয়ে দেখলে না ছেলে রাজপুত্র নাকি কামার পুত্র। সৎ মেয়েকে বিয়ে দিলে রাজপুত্রের সাথে। আর নিজের মেয়ের বিয়ে দিবে কি ঘুটে পুত্রের সাথে? বিশাল তিনতলা বাড়ি আমলার চাকরি তোমার সৎ মেয়ের তো অহঙ্কারে মাটিতে পা পরবে না। আমি সেটা মেনে নিতে পারবো না। ওর সুখের সংসার আমি ভাঙ্গবোই। ছোটোবেলায় তুমি তো আমাকে আপুর পিছনে লাগিয়ে দিতে? আপুর খেলনা ভেঙ্গে ফেলা, গল্পের বই গুলো পুড়িয়ে ফেলা, আপুর পছন্দের জামাগুলোকে ছিঁড়ে ফেলা এগুলো তো তুমি আমাকে শিখিয়েছো। আমিও এই কাজগুলো করতে খুব আনন্দ পাই। আপুর সব কিছু নষ্ট করে দেওয়ার পর ও যখন দুঃখ পেয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে তখন আমার যন্ত্রণাগুলো কমতে থাকে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছি বাবা আর দাদী ওকে আগলে রাখে। ঐ আগলে রাখাটা আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
—-এ বিয়ে ঠেকানো যেতো না। খুব ছোটো বেলায় দিতি আর ফাহিমের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। ওসব ভেবে মাথা গরম করে লাভ নেই। আমাদের মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হবে।
যোহরের নামাজ আদায় করে দিতির দাদী সাথীর মায়ের ঘরে এসে সাথীকে বললো,
—-এখনও সময় আছে নিজেকে শুধরে নে। যে অন্যের ঘরে আগুন দেয় আল্লাহপাক তার ঘরটাই আগে আগুন লাগিয়ে দেন। সুতরাং সাবধান।
সাথী কিছু বলার আগেই সালেহা বেগম তেতে উঠে বললেন,
—-এসব হয়েছে আপনার জন্য। আপনার ছেলে আমার স্বামী হলেও মনে মনে এখনও দিতির মরা মাকে ভালোবাসে। এমনকি উনি আর সন্তানও নিতে চাননি। আমি জোর করেছি বলে জন্মের পর থেকে আমার মেয়েটাকে অবহেলা করে। একমাত্র আপনার জন্য আমার মেয়ে আর আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেল।
—+এসব তুমি ওর সামনে কি বলতেছো সালেহা? তোমার মাথা ঠিক আছে। তুমি যদি এসব কথা ওর কানের কাছে বলতে থাকো তাহলে ও কোনোদিন ভালো মানুষ হতে পারবে না। আজ আমার জন্য তুমি চৌধুরী বাড়ির বউ হতে পেরেছো। বাপের বাড়িতে কি অবস্থায় থাকতে সেটা ভুলে যেও না। আমি তোমাকে এসব কথা বলতে চাইনি। কিন্তু তোমার আচরনে বলতে বাধ্য হয়েছি। তোমাকে বউ করে আনার আগে একটা অনুরোধ করেছিলাম। মাতৃহারা মেয়েটাকে একটু মায়ের ভালোবাসা দিও। আর তুমি কি করেছো ভুলে গেছো? যদি সত্যি কথা বলি তাহলে এটাই বলতে হয় তুমি চাওনি মেয়েটা বেঁচে থাকুক। একবার মেলায় ঘুরতে নিয়ে গিয়ে ওকে মেলাতে রেখে এসে বললে,
“ও নাকি হারিয়ে গিয়েছে।”
আল্লাহর রহমতে তোমার ভাই আবার ওকে মেলা থেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো। ভাগ্যিস তোমার ভাই সেদিন মেলাতে ঘুরতে গিয়েছিলো। তুমি ইচ্ছে করেই মা মরা মেয়েটাকে মেলাতে রেখে এসেছিলে।
—-আপনি আর আপনার ছেলে সবসময় আমাকে সন্দেহ করেন। তাহলে দিতিকে আমি কিভাবে মায়ের আদর দিবো। আমি যদি আমার কলজেটা কেটে নিয়ে ওকে আদর করে খাওয়াতাম তারপরও আপনারা বলতেন আমি দিতিকে বিষ খাওয়াচ্ছি।
—+এখনও সময় আছে মেয়েকে সুবুদ্ধি দিয়ে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলো। না হলে আখেরে তোমাকে পস্তাতে হবে। কথাটা মনে রেখো। আর একটা কথা কাল দিতি আর ফাহিম আসবে, ওদের যেন আদর যত্নের ত্রুটি না হয়।
এ কথা বলেই দাদী আমেনা খাতুন ঘর থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। দিতির কষ্টের জন্য উনার সবসময় নিজেকে দায়ী মনে হয়। সে কারনে মেয়েটার দিকে নজর রাখতে চেষ্টা করেন। সালেহাকে বড় আশা করে ছেলের বউ করে এনেছিলেন। নিজের দুরসম্পর্কের চাচাতে বোনের মেয়ে। ওর বাবার বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। নদী ভাঙ্গা পরিবারের মেয়ে। একসময় ওদের অনেক জমি জমা ছিলো। সব এখন আঁড়িয়াল খাঁর পেটের ভিতর। মেয়েটা যেন একটু ভালো থাকে বিনিময়ে মা মরা মেয়েটাকে যেন একটু ভালোবাসে। কিন্তু বিয়ের পরেই পুরো ভোল পাল্টে ফেললো। নিজে তো দেখতোই না বরং দিতির জন্য যে কাজের লোক রাখা হতো তাকে নিজের কাজে ব্যস্ত রাখতো। আর দিতিটা সারাদিন মাটিতে গড়াগড়ি খেতো। উনার বাতের ব্যথার কারনে উনিও দিতিকে কোলে রাখতে পারতেন না।
পরদিন দিতি আর ফাহিমের আসতে বিকেল হয়ে যায়। সালেহা বেগম মেয়ে দিতি আর জামাই ফাহিমকে শরবত আর মিষ্টি খাইয়ে বরণ করে নেন। সাথীকে বলেছিলো দিতির খাটটা ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিতে। কিন্তু সাথীর বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আর জোর করেনি। সালেহা বেগম মেয়ে আর জামাইয়ের জন্য পিঠে পায়েশ কেক মিষ্টি নানা পদের ফল দিয়ে বিকালের নাস্তা পরিবেশন করেন। একটু বেশী করার চেষ্টা করেন। স্বার্থ তো আছে। নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। তখন ছেলে খুঁজে আনার দায়িত্ব হয়তো দিতি আর ফাহিমকে দিতে হতে পারে। তাই সম্পর্কটাকে মিষ্টি করতে সালেহা বেগম আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যাই হোক পুরো বাড়িতে আজ আনন্দ বিরাজ করছে। সোলেমান সাহেবও ভীষণ খুশী। ফাহিম শ্বশুরের সাথে গল্প করছে। দিতি আর সাথী ওদের বাসার ছাদে চলে গেল। মিরপুর এক নম্বরে জোনাকী রোডে সোলেমান সাহেব তিনকাঠা জমি করে পাঁচতলা বিল্ডিং এর ফাউন্ডেশন দিয়ে আপাতত একতলা করেছেন। সাথী দিতিকে ছাদে সিঁড়িতে পৌঁছে দিয়ে বললো,
—–আপু তুই ছাদে গিয়ে অপেক্ষা কর আমি দুলাভাইকে ডেকে আনছি।
দিতি ছাদে চলে যায়। ও হাঁটতে ছাদের কিনারে চলে আসে। ওখানে টবে করে বিভিন্ন ধরনের ফুলগাছ লাগানো হয়েছে। সাথী আস্তে আস্তে পা টিপে ছাদে আসলো। আর দিতিকে যখনি ধাক্কা মারতে যাবে অমনি ফাহিম এসে বললো,
—সাথী তুমি কি করছো?
সাথে সাথে ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,
—-,তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম।
ফাহিমের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলো এ কি রকম পরীক্ষা!
—-আমি তোমার পরীক্ষার ধরণটা বুঝলাম না।
—-আমি তো আপু ফেলে দেইনি। কেবল ফেলে দেওয়ার ভাণ করছিলাম, আর অমনি আপনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন। ঠিক আমার বোনের জন্য আপনার এই চিৎকারটাই দেখতে চেয়েছিলাম।
দিতি ওদের দুজনের কথোপকথন শুনে ফাহিমকে বললো,
—-আমি তোমাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। ওতো তোমাকে ডেকে আনতে গেল।
—–হ্যা, ওতো আমাকে ডেকে আনলো। আমি বাবার সাথে গল্প করছিলাম।
—-শালী হয়ে একটু ঠাট্টামশকরা তোমার সাথে করতেই পারে। এতে তুমি এতো রিঅ্যাক্ট করছো কেন?
ফাহিম একদম দিতির কাছে চলে আসলো। তারপর সাথীর দিকে তাকিয়ে বললো,
—আর কখনও আমার সাথে এ ধরনের ঠাট্টা মশকরা করবে না।
সাথী ধরা পড়ার ভয়ে ওখান থেকে কেটে পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে ভাবলো ব্যাটা আর এক সেকেন্ড দেরী করে আসলে তোর কি এমন অসুবিধা হতো। বউটাকে হয়তো চিরতরে হারিয়ে যেতো। তাতে কি? পুরুষমানুষের আবার বউয়ের অভাব হয় নাকি?
সাথী নিচে আসার সাথে সাথে দিতির শ্বশুর আকরাম সাহেব বললেন,
—-আসো,তোমার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম।
সাথী আহ্লাদে গদগদ হয়ে বাড়ির সবার সাথে চা পর্বে অংশ নেয়। দিতির ফুফু শাশুড়ী সাথীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-তুমি সকালে ফজরের নামাজ পড়ো না?
সাথী থতমত খেয়ে বললো,
—-পড়ি তো ফুফু। নতুন জায়গা তো তাই—–
—–নতুন জায়গা হলেও এবাড়িতে বাথরুম নামাজের জায়গা, জায়নামাজ সবই আছে। অতো ভোরে উঠলে,নামাজটা পড়ে নিতে পারতে।
সাথীর মুখটা সাথে সাথে কালো হয়ে গেল। মনে মনে ভাবছে,বুড়িটার সমস্যা কি? আমার পিছনে কেন পড়ে আছে? আমি তো ওর বাড়াভাতে ছাই দিতে আসেনি। তাহলে আমাকে নিয়ে ওর কি সমস্যা?
আকরাম সাহেব সাথীর দিকে তাকিয়ে নিজের বোনকে বললেন,
—-আপা,আমার বন্ধু সোলেমান তার মেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞান ভালোই দিয়েছে। তুমি ও নিয়ে এতো প্যারা নিও না।
ফাহিম মুচকি হেসে সাথীর দিকে তাকিয়ে বললো,
—-পারতপক্ষে ফুফুর সামনে খুব একটা এসো না। তোমাকে তাহলে একদিনেই মাওলানা বানিয়ে ছাড়বে।
এবার ফাহিম আর দিতির দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-তোমরা দুজন নামাজ পড়েছো?
ফাহিম সাথে সাথে বললো,
—-তুমি তো জানো,আমি কখনও নামাজ ক্বাজা করি না। আর দিতিও নামাজ পড়েছে।
দিতির দিকে তাকিয়ে ফাহিমের ফুফু বললেন,
—-ওরে তো দেখলেই আমার দিলটা ঠান্ডা হয়ে যায়।
দিতির ফুফুশাশুড়ীর কথা শুনে সাথী মনে মনে বলে, বুড়ির আদিখ্যেতা দেখলে শরীরটা আমার জ্বলে যায়। এমনসময় বাড়ির গেটের সামনে ওরা সবাই একটা সিএনজি থামার শব্দ শুনতে পায়। আকরাম সাহেবের ততক্ষনে চা খাওয়া শেষ হয়েছে। উনি গেটের বাইরে এসে হাঁক দিয়ে বলেন,
—-ফাহিম দেখো, কে এসেছে?
ফাহিম বের হয়ে দেখে ওর শ্বশুর সোলেমান সাহেব হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সিএনজি থেকে নামছে। দিতি আর সাথীও ফাহিমের পিছুপিছু বের হয়ে আসলো। আকরাম সাহেব সোলেমান সাহেবকে দেখে বললেন,
—-আসসালামু আলাইকুম বন্ধু।
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
দুই বন্ধু নিজেদের বুকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন। দিতিও ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—বাসার সবার শরীর ভালো আছে বাবা?
—-আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছে।
এরপর আকরাম সাহেব বললেন,
—কি ব্যাপার বন্ধু! মেয়েদের না দেখে আর থাকতে পারলে না?
—-মানে, আমি ছোটো মেয়েটাকে নিতে এসেছি। দুই বোন চলে আসাতে আমাদের বাড়ীটা একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তাই সাথীকে নিতে এলাম।
ফাহিম সালাম দিয়ে শ্বশুরের হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বললো,
—-বাবা ভিতরে আসেন।
বাবাকে দেখে সাথীর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো, ঠিক বুড়িটা বাবাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাথীকে নিরব দেখে সোলেমান সাহেব বললো,
—-কিরে মা,তুই এতো চুপচাপ কেন?
সাথী একটু ঝাঁঝ নিয়ে বললো,
—আপুর বিয়ে এমনিতেই তোমার উপর অনেক ধকল গিয়েছে। কষ্ট করে তোমার আসার দরকার ছিলো না। আমাকে মিস করছো সেটা জানালেই হতো। ফাহিমভাইয়া আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতো।
ফাহিমের ফুফু সাথীর উপর বিরক্ত হয়ে বললেন,
—-বিয়ের পর বরবউকে জোরে বের হতে হয়। তাই ফাহিম তো তোমার সাথে যেতে পারতো না।
—-এটা কোন হাদিসে লেখা আছে ফুফু।(তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সাথী বললো)
—আমি তো বলিনি হাদিসে লেখা আছে। এটা মুরুব্বিদের কথা। বরং তোমার আব্বা অনেক বুদ্ধিমান মানুষ। নিজের সোমত্ত মেয়েকে নিতে এসে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাথীকে এভাবে কথা বলতে দেখে সোলেমান সাহেব বললেন,
—-সাথী, উনি তোমার মুরুব্বি হোন। মুরুব্বিদের সাথে এভাবে কথা বলতে হয় না। শুধু তোমার কেন উনি আমারও মুরুব্বি হোন। আমার কোনো ভাইবোন নেই। তবে এই আসমা আপুকে আমি আমার বড় বোনের জায়গাটা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দিয়ে রেখেছি।
সাথী মনে মনে বললো, বলেছি ঠিক করেছি। মাই ফুট বড়বোন। আর তোমার বিচক্ষণতার ও খেতাপুরি। পাঠিয়েছে তো দাদী। ঐ বুড়িকে আমার ভালোই চেনা আছে। বাড়ি গিয়ে বুড়ি আমি তোমার মজা বুঝাবো।
ছোটোবেলায় ওর বাবা দিতির জন্য খেলনা কিংবা পছন্দের জিনিস কিনে আনলে ওর দাদী সেটা সাথীর চোখ এড়িয়ে যত্নে নিজের কাছে তুলে রাখতেন। এটা ওর দাদীর আজীবনের অভ্যাস। যদিও সাথী দিতির জিনিসগুলো নষ্ট করার সুযোগ খুঁজতো। এবং তক্কে তক্কে থাকতো। বুড়ি আর কতোদিন লুকিয়ে রাখবে। বুড়ি বাথরুমে যাবে, গোসলে যাবে,নামাজ পড়বে। একদিন না একদিন তো সুযোগ আসবেই। যেদিন সত্যি সুযোগ এসে যায় সাথী আর একমুহুর্ত অপেক্ষা করে না। তোষকের তলা থেকে চাবি বের করে আলমারী খুলে দিতির খেলনাটা বের করে ভেঙ্গে আবার ঠিক জায়গায় রেখে দিতো। যতদিন সাথী একাজটা করতে পারতো না একধরনের অশান্তি ওকে তাড়া করে ফিরতো। আর যেদিন ওর উদ্দেশ্য সফল হয়ে যেতো ওর অন্তরটাতে এক ধরনের শান্তি বিরাজ করতো। দিতি আর ওর দাদীর কষ্ট দেখে সাথীর মনে এক ধরনের আনন্দ অনুভব হতো। সাথীর এই চরিত্রের সাথে ওর দাদীর ভালো পরিচয় আছে। একারনে উনি আর দেরী মা করে সাতসকালে ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এই যেমন এখন সাথীকে এক ধরনের অশান্তি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। দিতির সুখী সুখী চেহারা আর ফাহিম এর দিতির প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টি ওকে এখন পুড়িয়ে মারছে। আর দাদীর উপর ওর ভীষণ রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাড়ী গিয়ে সবার আগে দাদীর চুলগুলো টেনে ছিঁড়তে হবে।
নাস্তা করেই সোলেমান সাহেব সাথীকে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন।
দিতি যদিও যাবার সময় ওর বাবাকে বলেছিলো,
—-আব্বু কালকেই তো আমি আর ফাহিম ও বাড়িতে যাবো। তখন সাথী আমাদের সাথে যেতো। এখন ওকে বাড়ি না নিয়ে গেলে হতো না?
—-নারে, বাড়িটা বড্ড খালি খালি লাগছে।
সাথী ওদের কথোপকথন শুনে মনে মনে বললো,
—খালি বাড়ি না ছাই। জানি তো তুমি তোমার বড় মেয়েকেই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসো।
সবার কাছে বিদায় নিয়ে সাথী আর সোলেমান সাহেব বাড়ির পথে রওয়ানা দিলেন। ফাহিমও ওদেরকে এগিয়ে দিতে বের হয়ে গেল।
সোলেমান সাহেব আগে আগে হাঁটছেন। সাথী আর ফাহিম পিছু পিছু হাঁটছে। দুজনেই চুপচাপ। নিরবতা ভেঙ্গে ফাহিম বললো,
—তোমার সাথে ভালো করে আলাপই হলো না।
সাথী ফাহিমকে বেকায়দায় ফেলতে বলে উঠলো
—-আপনি আলাপ পরিচয় করতে চাননি তাই হয়নি। আপনি তো আব্বুকে একবারও আমাকে রেখে যেতে বললেন না।
—-না,না তা হবে কেন? বাবা তোমাকে নিয়ে যেতে আসছেন নিশ্চয় কিছু প্রয়োজন আছে। তাই আমি আর কিছু বলিনি। ঠিক আছে এখন বাবাকে বলি।
ফাহিম যদিও ভদ্রতা করে কিংবা নিজের ছোটো শালীকে নিজের ছোটো বোনের দৃষ্টিতে দেখে কথাগুলো বলেছে। কিন্তু সাথী মনে মনে ভীষণ পুলকিত হলো। তাই আনন্দের আতিশয্যে ফাহিমকে বললো,
—-আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে ফাহিম ভাই।
ফাহিমও ভদ্রতা দেখিয়ে বলে,
—-তুমি খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে।
সাথী ফাহিমকে কথাগুলো যদিও ঠাট্টা করে বলেনি কিন্তু ফাহিম ঠাট্রা মশকরা হিসাবেই ধরে নিয়েছে। সেসময় পাশদিয়ে একটা সিএনজি যাচ্ছিলো। সেটাকে থামিয়ে ফাহিম সোলেমান সাহেব আর সাথীকে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে আসলো।
সাথী চলে যাওয়াতে দিতির ফুফুশাশুড়ী মনে মনে ভীষণ খুশী হলেন। উনি সাথীকে খুব একটা পছন্দ করেন না। উনি দিতির মাকেও চিনতেন। কারণ সোলেমান আর আকরামরা কালকিনি থানায় একই গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন। সোলেমান আর আকরাম বাল্যকালের বন্ধু। সোলেমানের বউটা পাশের গ্রামের মিয়া পরিবারের মেয়ে। দেখতে অনেকটা দিতির মতোই ছিলো। দিতির জন্মের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে নিহার বানু মারা যায়। এরপর সোলেমান আর বিয়ে করতে চায়নি। বউটাকে সোলেমান
খুব ভালবাসতো। যাই হোক দিতির জন্য সোলেমান পরে আবার বিয়ে করে। কিন্তু বাস্তবে মেয়েটার কপালে মায়ের আদর জুটেনি। অপরদিকে সাথী আর ওর মা সবসময় এই অসহায় মেয়েটার পিছনে লেগে থাকে। এগুলো সবই উনি জানেন।
সাথী দিতির ফুফু শাশুড়ীর সাথেই শুয়েছে। বুড়িতো শোয়া মাত্রই নাক ডাকতে শুরু করেছে। ভেবেছিলো দিতির মামে কিছু কথা উনার কাছে বলবে। কিন্তু সেই সুযোগটা আর হলো না। অবশ্য দিতির টেনশনে ওর চোখেও ঘুম আসছিলো না। হোক বোনের জামাই তাতে কি? ওর তো প্রথম ক্রাশ। ভালোলাগার পুরুষ। কি জানি দিতি কি করছে ওর প্রেমিক পুরুষের সাথে? এই ভাবনায় দুচোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছে। বোনের স্বামীর উপর চোখ পড়েছে বলে সমাজ সংসারে নানাজনে নানা কথা বলবে। এটা নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যথা নেই। এখানে ও এক ঢিলে দুটো পাখি মারবে। দিতির ঘর ভাঙ্গবে আর ভালোবাসার মানুষটাকে সম্পূর্ণ নিজের করে নিবে। কেনই বা নিবে না।জন্মের পর থেকে দেখেছে বাবা দিতিকে সবসময় চোখে হারায়। দাদীমা ওকে আগলে রাখে। এজন্য ও দিতিকে একদম সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া দিতি ওর মায়ের মতো হয়েছে। পাঁচ ফুট ছ’ ইঞ্চি লম্বা, ছিপছিপে গড়ন ফর্সা গায়ের রং,ভাসা ভাসা দুটি চোখ আর কোমর ছাপানো চুল। ও জানে, দিতি ওর থেকে সুন্দর। তারপরও কিছু আত্মীয় স্বজন বাসায় এসে ওর রুপের প্রশংসায় মত্ত থাকবে। অপরদিকে সাথীর গড়ন মাঝারি,গায়ের রং শ্যামলা, ওর চুলগুলো কোঁকড়া দেখতে যে ও খুব খারাপ তা নয়। কিন্তু ওর বডিলয়াঙ্গুয়েজের ধরণটা ভালো না। তারউপর কূটনামীর স্বভাব তো আছে। ছোটোবেলা থেকে দিতির পিছনে লেগে থেকে কূটনামী বুদ্ধি ভালোই রপ্ত করেছে। ওর এসব স্বভাবের কথা ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজনরা ভালোই জানে। সেই কারনে ওরাও সাথীকে এড়িয়ে চলে। আর সাথীরও সেই সব আত্মীয় স্বজনদের দেখলে খারাপ ব্যবহার করে। পাশাপাশি ও দিতিকেও সহ্য করতে পারে না।
ভোরের দিকে সাথীর দু,চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসলো। হঠাৎ ফোনটা আর্তনাদ করে বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রীনে দাদী নামটা দেখে ওর মাথার চাঁদি গরম হয়ে গেল। মনে মনে বললো,বুড়িটা আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিবে না। পাশে তাকিয়ে দেখে দিতির ফুফু শাশুড়ী বিছানায় নেই। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই দিতির ফুফু শাশুড়ী ওয়াশরুম থেকে ওজু করে বের হয়ে আসলো। সাথী রুমের ভিতর কথা না বলে দরজা খুলে নীচের হলরুমে চলে এসে চারপাশটা ভালো করে দেখে বললো,
—বুড়ি তুমি আমাকে শান্তিতে একটু ঘুমাতেও দিবে না? কি ভাবছো আমি এখানে বসে তোমার পেয়ারে নাতনির সংসার ভাঙ্গছি? আর যদি ভাঙ্গতে চাই তুমি কি বাঁধা দিয়ে রাখতে পারবা?
—-এ তোর কেমন কথার ছিরি! বোন হয়ে কেন তুই বোনের সংসার ভাঙ্গতে যাবি। দেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে যে বোনের স্বামী নিয়ে টানাটানি করবি। নাকি কোনো ছেলে তোরে বউ করে নিতে চায় না?
সাথীর মেজাজটা বিগড়ে গেল। ফোনে ধমক দিতে গিয়ে তাকিয়ে দেখে আকরাম সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। নিজেকে সামলে আকরাম সাহেবকে শুনিয়ে খুব মিষ্টি করে বললো,
—-এখন ফোন রাখলাম দাদীমা।
আকরাম সাহেবকে দেখে সাথী বললো,
—-আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তোমার বুঝি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস।
—–জ্বী আঙ্কেল। সকালে উঠে নামাজ পড়ে বাড়ির সবাইকে চা দেওয়া আমার রোজকার অভ্যাস। এই দাদী ফোন দিয়ে বললো,আমি বাসায় নেই দেখে দাদীকে এখন কে চা বানিয়ে দিবে? ফজরের নামাজ পড়ার পর আমার আর বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় না।
—-বাহ্ এই বয়সে এটা আয়ত্ব করে নিয়েছো। খুব পূন্যের কাজ। এখনকার ছেলেমেয়েরা রাত জেগে কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে ওদিকে দেরী করে ঘুম থেকে উঠে। দাদী বুঝি খুব আদর করে তাই না? অনেক ভাগ্যবতী তোমরা দু,বোন, দাদীর আদর পাও।
—দাদী অবশ্য আপুর থেকে আমাকেই বেশী ভালোবাসেন।
—-তুমি ছোটো সে কারনে তোমাকে তো একটু বেশী ভালোবাসবে।
এমনসময় এ বাড়ির অ্যাসিসটেন্ট মিনা খালা এসে আকরাম সাহেবকে বলে,
—-খালু আপনারে চা দিবো?
—-নাহ্ ফাহিম আর বউমা ঘুম থেকে উঠুক তারপর একসাথে চা খাবো।
আকরাম সাহেবের কথা শুনে সাথী মনে মনে বললো,” বুড়ো আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। এতোদিন তো বউমা ছাড়াই চা খেয়েছো। আজ বউমার আগে আমার সাথে চা খেলে সমস্যা কি। বলা যায় না আমিও তো আপনার বউমার জায়গাটা দখল করে নিতে পারি।”
সাথীকে মিনা খালার খুব একটা ভালো লাগেনি। উনি জানেন সাথী দিতির সৎবোন। ফাহিমের বউটাকে উনার ভালোই লেগেছে। জন্মের পর মাকে হারিয়েছে। সৎ মা তো সৎ মাই। তাছাড়া এরকম সমত্ত মেয়ে বউয়ের সাথে আসাটা উনার খুব একটা ভালো লাগেনি। উনি যতটুকু জানেন বউয়ের সাথে খাটের বুড়ি হিসাবে দাদী নানীরাই আসে। উনার আবার একটা খারাপ অভ্যাস আছে। আড়ি পেতে উনি সবার কথা শোনেন। তাই ফার্ণিচার মোছার ছুতায় সাথীর কথাগুলো কর্ণ কুহরে নিতে লাগলেন।
—-আঙ্কেল শোনেন ছোটো বলে নয়, আমি বাড়ির সবার কথা শুনি বলে সবাই আমাকে আপুর থেকে বেশী ভালোবাসে। আপুতো বরাবর নিজের মতো চলে। লেখাপড়াটাও ঠিকমতো করতো না। এইজন্য তো সাতসকালে আব্বু বিয়ে দিয়ে দিলো। তাছাড়া আপুর কিছু সমস্যাও আছে। সারারাত ফোনে ছেলে বন্ধুদের সাথে গল্প করে এদিকে সকালে দেরী করে ঘুম থেকে উঠে। এটা নিয়ে বাসায় নিত্য ক্যাঁচাল লেগেই থাকতো। তাছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ানো তার একটা স্বভাব।আঙ্কেল আপনি আব্বুর ছোটোবেলার বন্ধু। তাই আপন ভেবে ঘরের কথা কিছু বলে ফেললাম। আপনি আবার কিছু মনে করলেন নাতো?
আকরাম সাহেব কি বলবেন বুঝে পেলেন না। মনে মনে ভাবলেন,মা,মরা মেয়েটাকে মায়া দেখাতে গিয়ে নিজের ছেলের আবার ক্ষতি করে বসলেন নাতো? এমনসময় মিনা খালার দিকে চোখ পড়তেই উনি একটু চমকে উঠলেন। কারণ এতোক্ষণ যা কথা হয়েছে সব নিশ্চয় উনার অন্তরে গেঁথে গিয়েছে। একটু বিরক্ত হয়ে মিনা খালাকে বললেন,
—-এতো সকালে তোমাকে ফার্ণিচার মুছতে কে বলেছে?যাও কিচেনে গিয়ে চায়ের পানি চুলায় চাপিয়ে দাও।
এমনসময় দিতি আর ফাহিম সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো। দিতি আকরাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
—বাবা, আসসালামু আলাইকুম।
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুমিও তো দেখি বেশ সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েছো।
—হা বাবা,আমি প্রতিদিন খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠি। দাদীর সাথে একরুমে থাকি। সেকারনে ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে দাদী আর আব্বুকে চা বানিয়ে দেই।আমি কিচেনে গিয়ে আপনাদের সবার জন্য চা বানিয়ে আনছি।
এরপর দিতি সাথীর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হেসে বললো,
—-কিরে সাথী, সুর্য আজকে কোনদিকে উঠলো? তুই আজ এতো সকালে উঠে পড়েছিস?
দিতির কথা শুনে ও একটু থতমত খেলো। এতোক্ষণ তো সব মিথ্যা কথা আকরাম সাহেবকে বানিয়ে বলেছে। এঝন ধরা পড়ার ভয়ে বললো,
—-আঙ্কেল,আমি আপনাদের ছাদটা একটু ঘুরে আসি।
একথা বলে সাথী ছাদে চলে গেল।
আকরাম সাহেব দু’বোনের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। ভাবতে লাগলেন, ছেলের বিয়ে দিতে গিয়ে এ কোন গোলক ধাঁধায় উনি পড়লেন। দিতি কিচেনে চা বানাতে চলে গেল। এর মাঝে দিতির ফুফু শাশুড়ীও নীচে চলে আসলেন। ফাহিম পাশে বসে মোবাইলে মেইলগুলো চেক করতে লাগলো। বোনের যেহেতু জহুরীর চোখ তাই নিজের ভিতরের অস্বস্তি কমাতে বোনকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-বউ তোমার কেমন লাগলো?
একগাল হেসে বললেন,
—-বউ খুব ভালো হয়েছে। তবে ওর বোনটা সুবিধাজনক নয়। সারারাত মোবাইলে খুটখাট করলো। সেই আলোতে আমার ঘুমটা ভালো হয়নি। আবার সাত সকালে কে যেন ফোন দিয়েছে? ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
এরমাঝে দিতি চা আর পাকোড়া নিয়ে আসলো। বিয়ের পরদিন কিচেনে ঢুকতে দেখে ফুফু শাশুড়ী বললেন,
—-তুমি কেন আজ কিচেনে ঢুকতে গেলে? মিনাতো ভালোই চা বানায়।
—-আপা সব বাবা বানিয়েছে। আমি শুধু নিয়ে আসলাম।
দিতির ব্যবহারে মিনা খালা খুব খুশী। মনে মনে বললো, “আহা বউটা আমারে কি সম্মান দিয়া কথা কইলো,চোখে আমার পানি আইসা গেল। আমারে নিতে দিলো না। নিজেই সব রেডী করে নিয়া গেল।”
সবার হাতে চা তুলে দিয়ে বোনকে ডাকতে দিতি ছাদে চলে গেল। সাথী তখন ছাদে বসে ফেসবুক ক্রল করছে। দিতি ওর সামনে গিয়ে বললো,
—-সাথী, নীচে চল,চা খাবি না?
সাথী ওর আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখলো। চুলগুলো ভেজা। এখনো চুলের গোড়া দিয়ে পানি পড়ছে। পিঠের কাছে আঁচলটা ভিজে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
—-সারারাত বুঝি ফাহিমভাই তোকে খুব আদর করেছে। একা একাই বরের আদর খেলি।
সাথী ওকে হিংসা করে এটা দিতি জানে। কিন্তু ও প্রকাশ করে না। কারণ হিংসেটা ছাইচাপা আগুন হয়ে আপাতত থাক। প্রকাশ করলে যদি দাঁউ দাঁউ করে জ্বলতে থাকে। তখন হয়তো সবকিছু পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে। তাই বলে বোনের স্বামীকে নিয়ে সাথী এ ধরনের কথা বলবে এটা দিতির মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সাথীকে বুঝতে না দিয়ে বললো,
—আমি তো ফাহিমের কলেমা পড়া বউ। সেকারনে ওর আদর তো আমার একার খাওয়ার কথা তাই না? নীচে চল,সবাই অপেক্ষা করছে।
দিতির কথা শুনে সাথী মনে মনে বললো,
“তোমাকে তো সুখে শান্তিতে সংসার করতে দিবো না।”
সাথী চলে যাবার পর দিতির একটু ভয় ভয় করছিলো। আসলে ফাহিমের সাথে ওর অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছে। যদিও আজকাল বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে লাভ ম্যারেজে বিশ্বাসী। কিন্তু দিতির কাছে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজটাকেই ভালো লাগে। তবে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে ফাহিম ওকে ফোন দেয়নি বলে ও একটু অবাক হয়েছে। দিতির একবার ফোন দিতে ইচ্ছা হয়েছিলো। কিন্তু মায়ের জন্য দেয়নি। সাথী জানতে পারলে মাকে জানিয়ে দিতো। তখন এটা নিয়ে বাড়িতে মা নানা অশান্তির সৃষ্টি করতো। দিতির এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু মা ওকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে চাইছে। দিতির কারনে মেয়ে সাথীর ভবিষ্যত নিয়ে মা খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। অথচ দিতির বাবা সোলেমান সাহেব দুই মেয়েকে সমান ভালোবাসেন। সেই ছোটোবেলা থেকে খেলনা, জামা, গল্পের বই থেকে শুরু করে যা কিছুই কিনেন না কেন দুজনের জন্যই কিনে আনেন। জন্মের পর থেকে মায়ের আদর পায়নি বলে বড়মেয়েটাকে একটু বেশী চোখে হারান। এটাই সাথীর মা সহ্য করতে পারেন না। মুখে হয়তো কিছু বলেন না তবে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে বুঝিয়ে দেন।
বছরখানিক আগের কথা। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে।ভর্তি কোচিং শুরু করেছে। কোচিং সেন্টারটা বাসার কাছেই ছিলো। ও হেঁটেই আসা যাওয়া করতো। একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে কিছু ছেলে ওর পিছনে হেঁটে আসে আর নানা রকম নোংরা মন্তব্য করে। বেসুরো গলায় হিন্দী গান গাইতে থাকে। তখন ওর মা রিকশা করে বাড়ি ফিরছিলো। পথে এই দৃশ্য দেখে ওর মা সেদিন দিতির বাবাকে বলেছিলো,
—-তুমি দিতিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দাও। তা,না হলে কবে যে তোমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিবে তার কোনো ঠিক নাই।
বাবা রেগে গিয়ে সালেহা বেগমকে বলেছিলো,
—-আর যাই করো সালেহা,আমার দিতি মায়ের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করবে না।
দিতি ভাবে,মানুষের মন কিভাবে এতো নোংরা হয়। ওর মা তখন মোবাইল বের করে ওর বাবাকে ছবি দেখিয়েছিলো। ছবিটা এমনভাবে তুলেছিলো দেখে মনে হচ্ছে দিতি ঐ ছেলেগুলোর সাথে হাঁটছে। মা,বাবার পাশের রুমেই দিতি আর সাথী থাকতো। তাই নিজের ঘর থেকেই ওর বাবা মায়ের সব কথাই শুনতে পেলো। অথচ এতে দিতির কোনো দোষ ছিলো না। দেখতে সুন্দরী ছিলো বলে প্রায়ই ওকে এ ধরনের ঘটনার স্বীকার হতে হতো। এসব নানা কথা ভেবে বাবাকে নিশ্চিন্ত রাখতে দিতি অবশেষে বিয়েতে রাজী হয়। দাদীমাও ওকে বলেছিলো,
—-যতো তাড়াতাড়ি পারিস বিয়ে করে স্বামীর সংসারটাকে আপন করে নে। এভাবে হিংসার অনলে নিজেকে আর পোড়াস নে। আমার বয়স হয়েছে। কবে দুম করে মরে যাবো তার কোনো ঠিক নেই। তখন কে তোকে চোখে চোখে রাখবে?
ফাহিম নাকি ওকে না দেখেই বিয়েতে রাজী হয়েছে। তবুও দিতির বাবা বন্ধু আকরামকে বলেছিলো,
—–বন্ধু তোমার ছেলেকে নিয়ে এসো। ওরা দুজনা দুজনকে দেখুক। আজকালকার যুগের ছেলেমেয়ে দেখেশুনে বিয়ে করুক। যাতে তুমি আর আমি কোনো দোষের ভাগিদার না হই।
ফাহিম যেদিন দেখতে আসে দিতি একপলক ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলো। সেকারনে চেহারাটাও আবছা মনে আছে। বিয়ের আসরে ওদের আবার দেখা হলো। লজ্জা সঙ্কোচের আড়ষ্টতায় ভালো করে ফাহিমের দিকে তাকাতে পারছিলো না। দিতি ভাবছে ফাহিম যদি বিয়ের আগে ওর সাথে ফোনে কথা বলতো তাহলে আজকে দুজনের রসায়নটা একটু স্বাভাবিক হতো।
অনেকক্ষণ বসে থেকে পা দুটো ব্যথা হয়ে আছে। আসলে বউ হতে গেলেও অনেক কষ্ট করতে হয়। সারাদিন সেজেগুজে বসে থাকা, সমস্ত আত্মীয়স্বজনের সাথে হাসিমুখে কথা বলা,ফটোশুট করা এসব করতে গিয়ে দিতির খুব ক্লান্ত লাগছে। ও বিছানা থেকে নেমে পুরো রুমটাতে চোখ বুলাতে লাগলো। বেশ পরিপাটি করে গুছানো। রুমের সাথে একটা এটাচ বাথ আছে। একটা বড় খাট,ড্রেসিং টেবিল একটা ডিভান আর একটা আলমারী রয়েছে। খাটের পাশে একটা সাইট টেবিল রয়েছে। ফার্ণিচার গুলো মনে হয় সেট করে কেনা হয়েছে। রুমের ভিতরে একটা দরজা আছে। দিতি দরজাটা খুলে দেখে ওপাশে একটা বিশাল ব্যলকনি রয়েছে। ওখানে নানা ধরনের ফুলের গাছ রয়েছে। ওর নাকে একটা পরিচিত ফুলের মিষ্টি সুবাস এসে লাগলো। পরে মনে হলো এতো হাসনাহেনার সুবাস। ব্যালকনিতে একটা দোলনা রয়েছে। দিতি গিয়ে দোলনাটায় বসে আস্তে আস্তে দোল খেতে লাগলো। হঠাৎ বারান্দার স্পট লাইটটা জ্বলে উঠলো। সামনে শেরওয়ানি আর পাগড়ী পরে একজন তামিল নায়ক দাঁড়িয়ে আছে। পুরো মুখে তার ছড়িয়ে আছে অপরুপ স্নিগ্ধতা। এখানে তো কেউ নেই যে ওকে বেহায়া বলবে। তাই ও ওর বরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
—আপনি এখানে,আর আমি আপনাকে সারা ঘর খুঁজে বেড়াতে লাগলাম।
—-আমি তো ব্যালকনিতে ছিলাম।
—-তা বুঝবো কি করে? দরজাটাতো ভিজিয়ে রেখেছিলেন। ভাবলাম বউয়ের বুঝি জামাই পছন্দ হয়নি। তাই বাসর না করেই মনে হয় পালিয়ে গেল।
দিতি মনে মনে ভাবলো মানুষটার বেশ রসবোধ আছে। ও নিজের দৃষ্টিটা নামিয়ে নিলো। লোকটা ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে তা ও ভালোই বুঝতে পারছে। লোকটাকে একটু বেকায়দায় ফেলতে মজা করে ও বললো,
—অমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখছেন?
—-আমার লালপরীটাকে দেখছি। যে আমাকে আমৃত্যু ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখবে।
দিতি মনে মনে ভাবছে মানুষটা বড্ড নির্লজ্জ। তাই প্রসঙ্গ এড়াতে বললো,
—-আপনার বারান্দাটা বেশ সুন্দর। তবে একটা ময়না পাখি পুষে খাঁচায় রাখলে আরো ভালো লাগতো। বারান্দায় বসে ময়না পাখিটার সাথে গল্প করা যেতো।
ফাহিম হেঁটে হেঁটে দিতির একদম কাছে চলে আসলো। ওর বুকের ধুকপুকানি বাড়তে লাগলো। দিতির কানের কাছে মুখটা এনে বললো
—-ভালোবেসে একটা ময়না পাখি আজ আমার ঘরে এনেছি। আপনি দেখেননি? দিবানিশি শয়নে স্বপনে তার সাথে গল্প করবো। সুখ দুঃখকে ভাগাভাগি করে নিবো।
এইকথাগুলো বলে ফাহিম মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। কথাগুলো শুনতে দিতির খুব ভালো লাগলো। কিন্তু একরাশ লজ্জার অবগুন্ঠনে নিজেকে ঢেকে দিতে মন চাইলো। মাথা নিচু করে দোলনায় বসে রইলো। দিতির অবস্থা ফাহিম হয়তো বুঝতে পেরেছে। সে কারনে ওকে বললো,
—- ব্যালকনিতে দোলনায় বসে কি বাসর রাত পার করবেন? এতো সুন্দর করে সাজানো বাসর খাটটা তো কষ্ট পাবে। এখন তো অক্টোবর মাস। আর একটু রাত বাড়লে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করবে। তখন আবার ঠান্ডা লাগলে আমার দোষ হবে। ঘরে চলুন।
দিতি ফাহিমের পিছু পিছু ঘরে এসে খাটের কোনায় বসলো। ফাহিম ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
—-লেহেঙ্গা চেইঞ্জ করে একটা আরামদায়ক পোশাক পরে নিন। ঐ আলমারীতে শাড়ি সালোয়ার কামিজ ম্যাক্সি সব রাখা আছে। আপনার যেটা ভালো লাগে সেটা নিয়ে নিন।
দিতি একটা সালোয়ার কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। দিতির দাদী বলে দিয়েছিলো বাসর রাতে ওরা দুজনে মিলে একসাথে যেন দুরাকআত নফল নামাজ পড়ে নেয়। তাই ড্রেস চেইঞ্জ করে দিতি ওজু করে আসলো। ফাহিমকে বললো ওজু করে আসতে।
দুজনে এশার নামাজ আদায় করে নিয়ে একসাথে দুরাকআত নফল নামাজ আদায় করলো। একবিছানায় ফাহিমের সাথে ঘুমাতে দিতির খুব অস্বস্তি হচ্ছে। ফাহিম হয়তো দিতির সমস্যা কিছুটা আঁচ করছিলো। সে কারনে ওকে বললো,
—-আপনার সমস্যা হলে আমি ডিভানে শুয়ে পড়বো। আমার সমস্যা হবে না।
ছ’ফুটের মতো লম্বা মানুষটা ডিভানে কিভাবে ঘুমাবে? তাই দিতি আস্তে করে বললো,
—না,আমার সমস্যা হবে না।
দুজনে খাটের দুই পাশে এমনভাবে শুয়ে পড়লো মাঝখানে অনায়াসে আর একজন ঘুমাতে পারবে। খুব ভোরে দিতির ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলতেই দেখে ফাহিম ওর মুখপানে তাকিয়ে আছে। দিতির চোখে চোখ পড়তেই ফাহিম মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
—-এরকম মুখের দিকে তাকিয়ে শতবর্ষ অনায়াসে পার করে দেওয়া যায়।
দিতি আর সাথী দুবোন। তবে একই মায়ের পেটের নয়। দিতির জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। সেই থেকে দাদী আর বাবা ওকে আগলে রাখতো। কিন্তু দিতির বয়স যখন একবছর সবে তখন হাঁটতে শিখেছে। সারাদিন এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াতো। পাশাপাশি ও খুব চঞ্চল ছিলো। তাই ওর দাদীর পক্ষে ওকে সামলে রাখা কঠিন হয়ে যায়। উনার আবার আর্থারাইটিসের সমস্যা আছে। দিতির পিছনে সারাক্ষণ ছুটতে গিয়ে ব্যথাটা বেড়ে যায়। ওদিকে দিতির বাবাও খুব একটা সময় দিতে পারে না। তাই এক ছুটিরদিন সকালে নাস্তা করার সময় দিতির দাদী ছেলেকে বলেন,
—-বাবা,বুড়ো মাকে আর কতোদিন কষ্ট দিবি? আমার পক্ষে এই বয়সে তোর মেয়েটাকে সামলানো কঠিন হয়ে যায়।
—-,তা,আমাকে কি করতে বলো। অফিস ফেলে এখন ওকে আমাকেই দেখাশোনা করতে হবে?
—-বাবা আমি কি তোকে তাই বলেছি?
—-একটা ফুলটাইম কাজের খালা রেখে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।
—-তা যায়। তবে সেতো ঐ কাজের খালাই হবে তাই না? মা তো হতে পারবে না। দিতির জন্য একজন মায়ের খুব দরকার।
—–এই কাজটা আমাকে করতে বলো না মা। তাছাড়া এক গাছের ছাল আর এক গাছে কখনও জোড়া লাগে না। বরং জটিলতা বাড়ে।
—-বাবা, তুই আমার উপর এ বিষয়টা ছেড়ে দে। দেখে শুনে এমন মেয়ে আনবো যে আমার দিদি ভাইকে মাথায় করে রাখবে। তাছাড়া এভাবে তো জীবন চলতে পারে না। তোর ও তো পুরোটা জীবন পড়ে আছে।
মায়ের পিড়াপীড়িতে দিতির বাবা সোলেমান সাহেব আর না,করতে পারলেন না। অবশেষে বিয়েতে মত দিলেন।
দিতির দাদী নিজের দূরসম্পর্কের খালাতো বোনের মেয়ে সালেহাকে নিজের ছেলের বউ করে আনলেন। দিতির নতুন মা সালেহা বেগম এ বাড়িতে বউ হয়ে এসে সানন্দে দিতিকে কোলে তুলে নিলেন। সন্তান স্নেহে মেয়েটাকে লালন পালন করতে লাগলেন। এটা দেখে সোলেমান সাহেব দিতির নতুন মাকে ভালোবাসতে শুরু করলেন।কিন্ত বছরখানিক পর যখন সাথীর জন্ম হয় সেই থেকে দিতির প্রতি একটু একটু করে সালেহা বেগম অবহেলা শুরু করলো। সোলেমান সাহেব কর্পোরেট সেক্টরে জব করেন। সকালে যান সন্ধায় আসেন। সে কারনে দিতির প্রতি ওর নতুন মায়ের অবহেলা উনার চোখে পড়েনি। দিতির দাদী চোখে বিষয়টা ধরা পড়েছে। কিন্তু ছেলের কানে তোলার সাহস হয়নি। কারণ ছেলে তো আগেই বলেছিলো,এক গাছের ছাল কখনও আর এক গাছে জোড়া লাগে না। তাই দিতিকে উনি নিজের কাছেই রাখেন। দিতি দেখতে ওর মায়ের মতো হয়েছে। অপূর্ব সুন্দরী। আর তেমনি মেধাবী। বাবার কাছ থেকে মেধাটা পেয়েছে। অপরদিকে সাথী দেখতে ওর মায়ের মতো হয়েছে। মুখের গড়ন খারাপ না তবে গায়ের রঙ শ্যামলা। আর লেখাপড়াতে মোটামুটি। দিতির মতো অতটা মেধাবী নয়।
মা না থাকাতে দাদীর আদর পুরোটাই দিতির কপালে জোটে। ছোটোবেলা থেকে সাথী এই বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। এমনকি ওর এটাও মনে হতো বাবাও দিতিকে বেশী ভালোবাসে। সেই কারনে বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দিতিকে হিংসা করতে শুরু করে। তবে দিতি ওকে খুব ভালোবাসতো। দিতির জন্য কোনোকিছু ওর বাবা হাতে করে আনলে সেটা সাথী দিতিকে দিতো না। যেমন দুজনের জন্য হয়তো দুটো জামা এনেছে। সাথী নিজের জামাটা রেখে দিতিরটাই পছন্দ করতো। দিতিও হাসিমুখে দিয়ে দিতো। এভাবে পাশাপাশি দুবোন বড় হতে থাকে। দিতি যখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে তখন সোলেমান সাহেবের বন্ধু আকরাম খাঁ দিতিকে নিজের ছেলের পুত্রবধু হিসাবে পছন্দ করে। কিন্তু দিতি বিয়ে করতে চায় না। ও পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু বাবা সোলেমান সাহেব দিতিকে বুঝিয়ে বলেন,
—-দিতি মা আমার,আমি আকরামের সাথে কথা বলেছি। তুই বিয়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবি। তোর যতদূর পড়তে মন চায় ওরা তোকে ততদূর পড়াবে। আর একটা কথা, ফাহিমের মতো ছেলে হয় না। বাবা মায়ের বাধ্যগত সন্তান। এবছর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ম্যাজিস্টেট হিসাবে মুন্সিগঞ্জে জয়েন করেছে। তুই আর অমত করিস না মা।
দিতির আর অমত করেনি। অবশেষে ফাহিমের সাথে দিতির বিয়ে হয়ে যায়। সালেহা বেগমও চেয়েছিলেন এই বোঝা দ্রুত ঘাড় থেকে নেমে যাক। উনার ধারনা দিতির কারনে সাথী পরিপূর্ণভাবে বাবার আদর পায় না। কিন্তু সাথীর হলো সমস্যা। বিয়ের আসরে বর ফাহিমকে দেখে ওর মনে হয় এই মানুষটাকেই ওর জীবনে খুব প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে পথের কাঁটা দিতিকে সরিয়ে দিতে ও দ্বিধা বোধ করবে না।
বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতস শেষ করে দিতি যখন ফাহিমের সাথে শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা দেয় তখন সাথী অনেক কান্নাকাটি করে। যদিও পুরোটা ওর অভিনয় ছিলো। হাপুস নয়নে ওকে কাঁদতে দেখে দিতির শ্বশুর আকরাম বন্ধু সোলেমানকে বললেন,
—-তোর যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে সাথীও আমাদের সাথে গিয়ে ক’টাদিন থেকে আসুক। এতে দিতিরও সময়টা ভালো কাটবে।
এতে দিতির দাদী বাঁধা দেয়। কিন্তু সাথীর ও বাড়িতে যাওয়ার আগ্রহের কারনে এ বাঁধা আর ধোপে টিকে না। তবে সাথীর মা সালেহা বেগমের নিরবতা দেখে দিতির দাদী অস্বস্তি বেড়ে যায়। মা মেয়েতে কি ফন্দি আঁটছে কে জানে? মাতৃহারা মেয়েটা যেন বরে ঘরে সুখে থাকে দিতির বিদায় বেলায় পরমকরুণাময় আল্লাহপাকের কাছে উনি এই দোয়া করতে থাকেন।
দিতিট শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে সাথী চোখ আরো বেশী টাটাতে থাকে। অনেকটা জায়গা জুড়ে তিনতলা বাড়ি। সামনে বিশাল বড় গেট। সাভারের গেন্ডা এলাকায় দিতির শ্বশুর বাড়ি। গেটের কাছে গাড়ির হর্ণ শোনা মাত্রই দারোয়ান এসে গেট খুলে দেয়। দিতির শাশুড়ী মা বেঁচে নেই। বছরখানিক আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। ফাহিম ওর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বউকে বরণ করে ঘরে তোলার জন্য আকরাম সাহেব তার বড় বোনকে নিয়ে এসেছেন। উনি বিয়ে বাড়িতে যাননি। কারণ ঘর দোর গুছানো, ফাহিমের বাসর খাট সাজানো, রাতের রান্না এসব নানাবিধ দায়িত্বের কারনে উনি বিয়ে বাড়িতে যাননি। বউকে বরণ করার জন্য উনি অপেক্ষা করছেন। দিতি আর ফাহিম হেঁটে এসে নীচের হলঘরের সামনে দাঁড়ালে উনি মিষ্টি আর শরবত খাইয়ে নতুন বর বউকে ঘরে তুলে নেন। এরপর দিতির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে বলেন,
—আকরাম তোর পছন্দ আছে বলতে হবে। দেখেশুনে একটা পরীকে তুই তোর ছেলের বউ করে এনেছিস।
দিতির শ্বশুর খুশীতে ডগমগ হয়ে বোনকে বললেন,
—-বউ তোমার পছন্দ হয়েছে আপা?
—-কি বলিস এমন মায়াকাড়া চেহারার মানুষটাকে পছন্দ না করে কি থাকা যায়।
দিতির প্রতি এতো প্রশংসা বাক্য শুনে সাথীর শরীরটা জ্বলতে থাকে। তাই সামনে এসে দিতির ফুফু শাশুড়ীকে সালাম দিয়ে বলে,
—-ফুফী আমি সাথী। আপনার বউমার ছোটো বোন।
সালামের উত্তর দিয়ে দিতির ফুফু শাশুড়ী অবাক হয়ে মনে মনে ভাবছেন,
—-দিতির বাবা মায়ের এ কেমন আক্কেলবুদ্ধি। এরকম একজন সোমত্ত মেয়েকে কি করে ওরা পাঠালো।
মনে মনে অসন্তষ্ট হলেও দিতির ফুফুশাশুড়ী বর বউকে বরণ করে ঘরে তুলেন। সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে দিতিকে বাসর ঘরে পৌঁছে দেন। সাথীও এসে দিতির সাথে বাসর খাটে বসে। ঐ রুমেই বসে দিতি আর সাথী ডিনার করপ নেয়। এদিকে ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুয়েছে। সাথীর ঐরুম থেকে বের হওয়ার কোনো নামগন্ধ নেই। সেদিকে তাকিয়ে দিতির ফুফু শাশুড়ী প্রচন্ড বলে বিরক্ত হন। এবং সাথীকে ডেকে পাঠান। অনিচ্ছা সত্বেও সাথী দিতির বাসর ঘর থেকে বের হয়ে ফুফুশাশুড়ীর কাছে এসে বলে,
—-ফুফু আমায় ডেকেছেন?
আনাহিতা খুব ভয় পেয়ে গেছিল। তীব্রভাবে কাঁদছিল। ওকে নিয়ে পায়চারী করতে করতে বুঝতে পারলাম খুব বড়ো ধরণের একটা ভুল করে ফেলেছি। বেডরুমে না ঢুকে যদি সোজা বাইরে বেরিয়ে পড়ে দরজা বন্ধ করে দিতাম তবে বিড়ালটা কোনোভাবে বাড়ির বাইরে আসতে পারত না। এখন বেডরুমে আমি পুরাপুরিভাবে আটকা পড়ে গেলাম, সাথে ফোনও নাই যে কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারব। উপরন্ত সাথে রয়েছে আনাহিতা যার ওপরে বিড়ালটার তীব্র আক্রোশ দেখা যাচ্ছে।
এই প্রথম খুব অসহায় লাগল। মনে হল আমি একেবারে কোণঠাসা হয়ে পৃথিবীর এককোণে পড়ে গেছি। সমস্ত পৃথিবী যেন যোগসাজশ করে আমাকে বিপদে ফেলবার মতলব করছে। আমি কি নিজেকে বাঁচাতে পারব? আমার বাচ্চাকে বাঁচাতে পারব?
সাথেসাথে আরেকজনের কথা চকিতে মনে পড়ে গেল।
মা!
মাও কি বাবার সাথে ছাড়াছাড়ির পর এমনটা অনুভব করেছিল? ছোট আমাকে নিয়ে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে পড়ে গিয়ে কি তারও মনে হয়েছিল যে সে এ পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা? কেউ একজন নেই যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে? এজন্যই কি সে বদলে গেছিল?
আনাহিতাকে নিয়ে বেশ অনেক্ষণ হাঁটলাম। কিছুক্ষণ আগেই ওকে ওষুধ খাইয়েছিলাম, তার প্রভাবে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল সে। ওদিকে ড্রয়িংরুম থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। মরে গেল নাকি বিড়ালটা? যে শক্তিতে তাকে আমি লাথি মেরেছি, তাতে মরেও যেতে পারে। দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়েও বেমক্কা চোট লাগতে পারে।
হঠাত করে দরজায় ঘষঘষ শব্দ আরম্ভ হল। কান পেতে শুনে বুঝতে চেষ্টা করলাম এ কীসের শব্দ। মনে হচ্ছে কেউ ধারাল কিছু দিয়ে দরজার নীচের অংশ চিড়বার চেষ্টা করছে।
— ম্যাও!
নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমি। ও মানে কারিনা মরেনি। লাথি খেয়ে কিছুক্ষণ পড়ে ছিল। এখন দরজা আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দেবার চেষ্টা করছে।
ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল একটা স্রোত নেমে গেল।
আনাহিতাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমি ওরদিকে পলকহীন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে এল আমার। আমি আবার পায়চারী শুরু করলাম।
আমার চরিত্রের একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বিপদে আমার মাথা একেবারে ঠান্ডা হয়ে যায়। খুব ঠান্ডা মাথায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারি আমি তখন। বিপদের গুরুত্ব নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করে তার সবচাইতে ভালো সলিউশান একচক্ষু দানবের মতো, গোয়ারের মতো আঁকড়ে ধরি।
এও আমার ছেলেবেলা থেকে পাওয়া শিক্ষা। মনে আছে কিশোরীকালে একবার মা অফিসের কাজে আটকা পড়েছিল। আমাকে ফোন করে বলেছিল আসতে দেরী হবে, আজ যেন প্রাইভেট টিউটারকে আসতে মানা করে দেই।
ফোন রাখতে না রাখতেই দরজায় টিউটার কলিং বেল বাজালো। আমি দরজা খুলে তাকে জানালাম যে আজ পড়ব না। সে এক গ্লাস পানি চাইল। তাকে ড্রইং রুমে বসিয়ে পানি নিয়ে এসে তার সামনে ধরতেই সে আমাকে এক ঝটকায় তার কোলে বসিয়ে আমার সদ্য উদ্ভিন্ন বুকে হাত দিয়েছিল। নিশ্চয় বুঝে ফেলেছিল বাসায় কেউ নাই। ছাড়া পাবার জন্য আমি তখন ছটফট করছি। তাতে সে যেন মজা পেয়ে গেল। সাপের মতো তার হাত আমার শরীরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতে থাকল।
সেদিনও বিপদ বুঝে হুট করে আমার মাথা একদম ঠান্ডা হয়ে গেছিল। আমি ছটফট করা বন্ধ করলাম। টিউটারের অলক্ষ্যে সাইড টেবিল থেকে ফুলদানিটা তুলে নিয়ে স্যারের মাথার পিছে সর্বশক্তি দিয়ে বাড়ি দিয়েই লাফ মেরে কোল থেকে উঠে পড়লাম।
স্যার ততক্ষণে দুহাতে মাথা চেপে ধরে সামনে ঝুঁকে পড়েছে।
ফুলদানি উঁচিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা গলায় আমি হিসহিস করে উঠলাম
— আপনি যাবেন নাকি আরেকটা বাড়ি দিব? আমার এক চিৎকারে কিন্তু ফ্ল্যাটের অন্যেরা দৌড়ে আসবে।
কোনোমতে উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেছিল সে সেদিন। আর কোনোদিন তাকে দেখিনি।
আমি খুব স্বাভাবিকভাবে দরজাটা লাগিয়ে গোসলে চলে গেলাম। অনেক্ষণ গোসল করবার পর শরীরের নোংরা, ক্লেদাক্তভাবটা যখন কমল, তখন বের হয়েই মা’র মুখোমুখি পড়ে গেলাম। মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল
— এই রাতে গোসল করলে?
আমার অভিব্যক্তি খুব স্বাভাবিক থাকল
— বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। ওপরতলার দুষ্টু ছেলেটা ময়লা ফেলল, বাতাসে পুরোটাই গায়ে এসে লেগেছিল। গোসল না করে উপায় ছিল না, মা।
আজো যখন দেখছি আমার ওপরে, না আমার ওপরে না, আমার আনাহিতার ওপরে বিপদ নেমে আসছে তখন হুট করেই আমি একদম শান্ত হয়ে গেলাম। উত্তপ্ত মাথাটা নিমেষে ধীরভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সমাধান খুঁজতে লাগল।
দরজায় ক্রমাগত আঁচড় দিচ্ছে কারিনা। ধীরে ধীরে ওর শক্তি বেড়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছি। এক একবার করে কাঠ চিড়ে যাবার শব্দও পাচ্ছি। কিন্তু ভিতরে আমি নিস্কম্প। পায়চারী করতে করতে ভাবতে লাগলাম কেন কারিনা এমন করছে? এতদিন ধরে যাওয়া আসা করছে, কখনো তো ওকে হিংস্র দেখিনি। ও তো আমি। আমার মধ্যে যদি হিংস্রতা না থাকে, ওরমধ্যে আসবে কেন?
কারণ বের করতে মনের মধ্যে আঁতিপাঁতি করে খুজতে থাকলাম আমি।
মনে পড়ল আমিনা বলেছিল
— তোমার আর কারিনার জীবন হুবহু একরকম হবে। এমনকি জন্ম মৃত্যুও একসাথে ঘটবে। কিন্তু যদি দুজনের জীবনের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয় আর তোমার কারিনা যদি সেটা টের পেয়ে যায়, তবে অনেকক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনতে পারে। তখন সে হতে পারে তোমার ইভেল টুইন। কিন্তু সে তোমাকে কখনোই মেরে ফেলবে না। কারণ তোমাকে মারলে তার নিজের অস্তিত্বও মুছে যাবে।
আরেকবার নীচে বিড়াল যখন আমাকে প্রায় আক্রমণ করছিল তখন আমিনা বলেছিল
— ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না, দীবা। হয়ত ওর বাচ্চা নাই। তাই তোমাকে হিংসা করছে। কিছু একটা আছে তো বটেই।
হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি।
পেয়েছি!
এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা।
কারিনার সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে। কোনোভাবে সে আমার সন্ধান পেয়ে কৌতূহলী হয়ে বারবার এসেছে। আমিও নিজের লেখার কাজে ওকে ব্যবহার করব বলে প্রশ্রয় দিয়েছি। একসময়ে ওর কৌতূহল অনেকটাই কমে এসেছিল। তার আসা অনিয়মিত হয়ে পড়ল।
কিন্তু অনেকদিন বাদে এসে আনাহিতাকে আবিষ্কার করে সবকিছু বদলে গেল।
হাতের উল্টাপিঠের মতোই কারিনা আমাকে চেনে, চেনে আমার মনের অলিগলি। কারণ সে তো আমিই। দীবা ও কারিনা একই ব্যক্তি। কিন্তু আনাহিতা হবার পর আমি ওর কাছে হয়ে গেলাম অপরিচিত। কারণ ও আমার মাতৃরূপটা চিনতে পারছে না।
কেন চিনতে পারছে না?
তার একমাত্র কারণ হচ্ছে কারিনা নিজে মা না। যারজন্য আনাহিতাকে নিয়ে আমার অবসেশানটা ও ধরতে পারছে না। আর পারছে না বলেই ওর মাঝে এসেছে অভিমান। অভিমান থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে তীব্র প্রতিশোধের ইচ্ছা। এদিকে আমার মাতৃত্ব হচ্ছে আমার সবচাইতে বড় দুর্বলতা। এটাকেই কারিনা টার্গেট করেছে।
তারমানে কারিনা যদি কোনোভাবে দরজা ভাঙতেও পারে, তবে সে আমার কোনো ক্ষতি করবে না, আনাহিতার ক্ষতি করবে। হয়ত তাকে মেরে ফেলবে। হয়ত বলছি কেন, নিশ্চয় মারবে।
এর সমাধান একটাই। কারিনাকে চলে যেতে হবে।
কিন্তু কিভাবে?
দরজার মাঝবরাবর পর্যন্ত চিড়বার শব্দ পেলাম। এতক্ষণ শব্দটা আসছিল দরজার নীচে থেকে।
তবে কি? তবে কি কারিনা আরও শক্তিশালী হচ্ছে? আমার আর ওর মানসিক দ্বন্দে কি ও জিতে যাচ্ছে? ও কি বিড়াল থেকে ধীরে ধীরে মানুষের রূপ নিচ্ছে?
মানুষেররূপে এলে তো ওর শক্তিও বহুগুণে বেড়ে যাবে। তখন কী হবে?
দৌড়ে গিয়ে ড্রয়ারটা টেনে খুললাম। ভেতর থেকে মাছ লকেট আর থলেটা বের করলাম। পাগলের মতো দৌড়ে গেলাম আনাহিতার কাছে। ওর বালিশের তলায় গুঁজে দিলাম থলেটা।
চড়াৎ!
দরজার কিছু অংশ নখের আঁচড়ে ভেঙে এল টের পেলাম। কারিনা কি তাহলে এখন বিড়াল মানবী? আঁচড়ের শব্দটা আবার দরজার মাঝবরাবর থেকে এল। এত উঁচুতে কোনো বিড়াল পৌঁছাতে পারবে না।
মাছ লকেট হাতে দরজার দিকে দৌড়ে গেলাম। এ দরজার হাতলে চাবির ফুটা নাই, অটোমেটিক লক। নাহলে কারিনা নিশ্চয় ফুটা গলে চলে আসবার চেষ্টা করত। পারছে না বলে দরজা আঁচড়ে কামড়ে ভেঙে দিতে চাইছে।
মাছ লকেটটা দরজা ঘেঁষে মেঝেতে রাখতেই ম্যাও শব্দে ভারী কিছু ছিটকে পড়বার শব্দ পেলাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই দ্বিগুণ আক্রোশে কারিনা দরজার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে যেন সে এবারে দরজা ভেঙেই ছাড়বে। শব্দটাও দরজার ওপরভাগ থেকে আসছে। তারমানে কি কারিনা এখন আমার চাইতেও শক্তিশালী হয়ে গেছে?
রাগ! ক্ষোভ! প্রতিশোধের ইচ্ছা!
সবকয়টাই কারিনার মধ্যে বিদ্যমান। এসবই কি ওর শক্তির উৎস?
তাহলে যত বাধাপ্রাপ্ত হবে, ততোই ওর হিংস্রতা বেড়ে যাবে!
কিন্তু কেন এমন হল? মাছ লকেট কাজ করছে না কেন?
মনে পড়ল আমিনা বলেছিল
— প্লিজ লকেটটা পরে থেকো, দীবা। কবচের শক্তি বাড়ে পরে থাকলে, ফেলে রাখলে একসময়ে এর ক্ষমতা নাই হয়ে যাবে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত বারোটা। আকাশ পৌঁছাবে সকাল আটটার ফ্লাইটে। তারপরে ট্রাফিক জাম ঠেলে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল দশটা।
চড়াৎ।
দরজার আরো একটা অংশ চিড়ে গেল বুঝতে পারলাম। কারিনা ভীষণ শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
পরিষ্কার বুঝতে পারলাম সকাল দশটা পর্যন্ত কারিনাকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তার আগেই ও দরজা ভেঙে ফেলে ঘরে ঢুকে পড়বে। তারপরে…তারপরে… আনাহিতাকে!
না!
চিৎকার করে উঠলাম আমি।
না! আনাহিতার গায়ে একটা আঁচড়ও পড়তে দিব না আমি। সারা পৃথিবীও যদি আমার বিপক্ষে যায়, তাও আনাহিতাকে আমি রক্ষা করব।
সে রক্ষা করবার একটাই উপায়।
বাথরুমে গেলাম, কাউন্টারের ওপরে আকাশকে দেয়া আমার উপহার পুরানো আমলের রেজার সেট সাজানো রয়েছে, সাথে সোনামুখী ব্লেড।
ব্লেডটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম।
তারপর নির্বিকার মুখে লাইট অফ করে দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
টেবিল চেয়ারে বসলাম, ড্রয়ার খুলে ডায়রীটা বের করলাম। তারপর ব্লেডটা হাতে তুলে নিয়ে পরপর দুই কব্জীতে কয়েকটা পোঁচ দিলাম। গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগল।
ঠান্ডা চোখে একবার সেদিকে দেখলাম। তারপর নিস্কম্প হাতে পেন তুলে লিখতে আরম্ভ করলাম।
মা, তোমাকে আমি যেন বুঝতে পারছি। তুমি শুধু মা ছিলে না। ছিলে দোষ গুণে মেলানো একজন মানুষ।
ভুল তুমিও করেছিলে, ভুল আমিও করেছি। আমরা তো মানুষ, মহামানব না।
আকাশ, তোমার সাথে অল্প কয়দিনই থাকতে পারলাম। কিন্তু তারমাঝেই পুরুষদের প্রতি আমার ঘৃণা তুমি অনেকখানি মুছে দিয়েছিলে। এ কথাটা তোমাকে কোনোদিন বলিনি, এ দুঃখ আমার রয়ে যাবে।
আনাহিতা, মা তোমাকে খুবি ভালোবাসে। মা’কে ভুল বুঝো না।
মাসখানেক পরের কথা
দরজায় চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকল আকাশ। দরজা থেকেই একবার চারিদিক তাকিয়ে দেখল।
দীবার সাজানো সংসার। কী খুঁতখুঁতে ছিল দীবা। অথচ আজ ওর হাতে গড়া সংসারটা লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে রয়েছে। চারিদিকে ধূলা।
দরজা বন্ধ করে ভিতরে এসে দাঁড়াল আকাশ। সেদিন সকালের কথা ও পারতপক্ষে মনে করতে চায় না। ঐদিনের পর আর এখানে আসেওনি। কিন্তু আজ আসতেই হল। এগারোটায় টাইম দেয়া আছে। ওরা এসে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। এ অভিশপ্ত জায়গার কিছুই রাখবে না আকাশ। তারপরে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে ও এ বাড়ির সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দেবে।
সেদিন সকালে জ্যামটা একটু বেশিই ছিল। তিতিবিরক্ত হয়ে গেছিল ও। উবারে বসে কয়েকবার দীবাকে কল দিতে চেষ্টা করেছিল। দীবা ধরেনি। ভেবেছিল ঘুমুচ্ছে।
এত সুন্দর একটা দিন ছিল সেদিন। আসতে আসতে ভাবছিল অপ্রত্যাশিতভাবে একটা দিন ছুটি পেয়েছে, দীবাকে বলবে
— চল, আজ আমরা বাইরে কোথাও খেয়ে আসি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আকাশ। মানুষ ভাবে কী আর হয় কী।
ঘরে ঢুকেই চমকে গেছিল। সারা ঘর লণ্ডভণ্ড।
— দীবা! দীবা!
বেডরুম থেকে আনাহিতার কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই সেদিকে ছুটে গেছিল। গিয়ে দেখল দরজা ভেতর থেকে লক করা। বারবার ডাকা সত্ত্বেও দীবার সাড়া নাই। দরজাটাও নীচের দিকে কেউ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছে কিন্তু পুরাটা পারেনি।
দিশেহারার মতো কিচেনে দৌড়ে গিয়ে কাবার্ডে রাখা হাতুড়িটা নিয়ে ফিরে এসে দরজার নবে পাগলের মতো বাড়ি মারতে থাকল ও।
কেমন করে একসময়ে দরজা খুলেছিল এখন আর মনে করতে পারে না। কিন্তু ভিতরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখল, সেটা ওর আজীবন মনে থাকবে।
আনাহিতা বিছানায় গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। আর দীবা ঘরের চেয়ার টেবিলে বসে রয়েছে। চোখদুটো খোলা, হাতদুটো দুপাশে ঝুলছে, চারিদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত।
তারপরে তেমনকিছু মনে করতে পারে না ও।
একসময় দেখে পুলিশ, বাবামা, দীবার মা’কে। কে জানি অনাহিতাকে কোলে করে নিয়ে গেল।
শুধু এটুকু মনে আছে, পুলিশ আসবার আগেই ও দীবার রক্তমাখা খোলা ডায়রিটা নিজের ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। কারণ সেখানে আকাশ নামটা দেখেছিল। ও চায়নি দীবা ওকে ব্যক্তিগতভাবে যা লিখে রেখে গেছে তা সবার হাতেহাতে ঘুরুক।
দরজার সামনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল আকাশ। কার্পেটে বেশ বড় জায়গা জুড়ে গোল কালো দাগ। যেন তেলতেলে আলকাতরা শুকিয়ে রয়েছে। আজ আকাশ জানে ও কিসের দাগ। সেদিন খুব আশ্চর্য হয়েছিল।
রুমে ঢুকবার সাহস হল না আকাশের। পুরা রুমজুড়ে শুকনো রক্তের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
বুকটা মুচড়ে উঠল আকাশের। লক্ষ কোটিবারের মতো আজকেও মনের মধ্যে হাহাকার উঠল
— কেন, দীবা, কেন? কেন বিশ্বাস করে আমাকে একটিবার বললে না?
দীবার ডায়রীটা পড়েছে আকাশ। বুঝতে পেরেছে কতখানি আত্মত্যাগ দীবা করেছে। অথচ ঘরে বাইরে দীবার দুর্নামে কান পাতা যাচ্ছে না।
সবাই ছিঃ ছিঃ করছে। এতটুকু বাচ্চাকে অরক্ষিত রেখে কোনো মা এভাবে আত্মহত্যা করে?
এতোই যদি মরবার শখ তো আকাশের ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। ওর হাতে বাচ্চাটাকে বুঝিয়ে দিয়ে নাহয় যে জাহান্নামে খুশি চলে যেতে। এটা একটা মায়ের কাজ হল?
শুধু আকাশ জানে সত্যটা। কিন্তু এ সত্য প্রকাশ করার নয়। দীবা এখন সবার স্মৃতিতে থাকবে শুধু মিথ্যা দুর্নাম নিয়ে।
দীবার মা মেয়ের শোকে উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেছেন। কিছুদিন আগে ওদিকের আত্মীয়স্বজনেরা এসেছিল। খুব কুন্ঠার সাথে আনাহিতাকে চেয়েছিল। বলেছিল উনি শোকে মারাও যেতে পারেন। আনাহিতাকে ওর কোলে দিলে হয়ত উনি এ শোক সামলে উঠতে পারবেন।
আকাশের মাবাবার একেবারে ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আকাশই আনাহিতাকে দিয়ে দিল। ডায়রিটা পড়ে শাশুড়িকেও সে আগের চাইতে ভালো করে বুঝতে পারছে। মাঝে দুবার গেছিল উনার বাসায়। মুখোমুখি সোফায় দুজনে চুপ করে বসেছিল। কিছু তো বলবার নাই। একসময়ে উনি বুকফাটা আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলেন কিন্তু আকাশের চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও পানি বেরুলো না।
মাবাবা খুব আফসোস করছেন। সিঙ্গেল প্যারেন্ট মায়ের মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়াই উচিত হয়নি বলছেন। নাহলে কোন মেয়ের এমন মাথাখারাপ হয় যে দুধের বাচ্চা সামনে রেখে এভাবে নিজের মৃত্যু ডেকে আনে?
কী একটা তামাশা!
আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাবার আর জো রইল না।
তাদেরকে টুকটাক বলতেও শুনেছে
— আকাশকে আবার বিয়ে দিতে হবে। মুখ শুকনা করে ঘুরে বেড়ায় ছেলেটা। এবারে ভালো ফ্যামিলি দেখে মেয়ে আনব।
শুনে এত দুঃখেও ওর হাসি পেয়েছে।
বিয়ে!
আবার!
দীবা যে ওর মনজুড়ে, শরীরের প্রতিটা কোষজুড়ে বাস করছে। সম্ভব হবে কি সে জায়গাটা অন্য কাউকে দেয়া?
মনে হয় না।
আর দীবা যারজন্য এত বড়ো আত্মত্যাগ করল, সেই আনাহিতাকে পুরা মনোযোগে বড়ো করাই কি ওর জীবনের লক্ষ হবে না এখন?
নাহলে দীবার স্মৃতিকে যে ভয়ংকরভাবে অপমান করা হবে।
ওদের সাজানো গোছানো জীবন কারিনা এসে তছনছ করে দিল। ভাবতে চায় না আকাশ, কিন্তু না চাইলেও এসে পড়ে। রাতে ঘুমাতে পারে না, শুধু পায়চারী করে। বারবার মনেহয় যদি সেসময়ে ও বাড়িতে থাকত তাহলে কি আজ দীবা বেঁচে থাকত?
কেন দীবা ওকে বলল না?
— আকাশ, তোমার সাথে অল্প কয়দিনই থাকতে পারলাম। কিন্তু তারমাঝেই পুরুষদের প্রতি আমার ঘৃণা তুমি অনেকখানি মুছে দিয়েছিলে। এ কথাটা তোমাকে কোনোদিন বলিনি, এ দুঃখ আমার রয়ে যাবে।
— এ দুঃখ তো আমারও রয়ে যাবে, দীবা। কেন বলোনি? তাহলে আমি বুঝতাম যে স্বামী হিসাবে, একজন পুরুষ হিসাবে আমি খুব একটা খারাপ নই।
সারাদিন একদম স্বাভাবিকভাবে কাটল দেখে প্রাথমিক যে ভীতি আমার মনের মধ্যে গেড়ে বসেছিল, বিকেল হতে হতে অনেকখানিই মুছে গেল। আনাহিতাকে নিয়ে নীচে নামলাম। দূরে বাচ্চারা খেলছে, খানিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আনাহিতাকেও দেখালাম। আগে বাচ্চাদের কখনো মনোযোগ দিয়ে দেখিনি আমি। এখন দেখি। নিজে মা হয়েছি বলেই হয়ত। একদিন আমার আনাহিতাও এভাবেই বড় হবে, খেলবে, ছোটাছুটি করবে, স্কুলে যাবে। ভাবতেই ভালো লাগল।
সন্ধ্যা নেমে আসতে বাড়িতে ফিরে এলাম। ঘর একদম চুপচাপ, কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি আরেকটু নিশ্চিন্ত হলাম। যাক, কারিনা চিরতরে চলে গেছে। আর আসবে না।
টিভিটা চালিয়ে দিয়ে ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বিছানো কার্পেটে আনাহিতাকে ছেড়ে দিয়ে আমি নিজেও বসে পড়লাম।
আমাদের বাসায় একটা কুক্কু ক্লক আছে। প্রতি ঘন্টায় পাখি বের হয়ে কুক্কু ডেকে সময়ের হিসাব দেয়। আমি খুব শখ করে গুলশান থেকে কিনে এনেছিলাম।
সেই কুক্কু বার্ড জানান দিল রাত নয়টা বেজে গেছে। আমি আনাহিতাকে খাওয়াব বলে উঠে পড়লাম। ওর ব্যবহৃত অধিকাংশ জিনিস লেখার রুমে রয়ে গেলেও যা আছে তাই দিয়ে আপাতত কাজ চালাচ্ছি। কালকে আকাশ এলে দেখা যাবে।
ঠাস করে শব্দ হল। কান খাড়া করলাম আমি। শব্দটা লেখার ঘর থেকে আসছে। কেউ যেন কিছু একটা দেয়ালের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারল।
আবার শব্দ! তারপর পরপর!
এবারে বুঝে গেলাম।
সারাদিন পর কারিনা ফিরে এসেছে। এসেই জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে।
প্রথমে ভাবলাম উপেক্ষা করব। কতক্ষণ আর জিনিস ছোঁড়াছুড়ি করবে? একসময় না একসময় ওকে থেমে যেতেই হবে। তাছাড়া ও ঐ ঘরের মধ্যেই থাকে। ড্রইংরুমে আসে না। আসতে চাইলেও পারবে না। দরজা লক করা রয়েছে।
স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে আমি পাশের ডাইনিং টেবিলে গেলাম আনাহিতার খাবার তৈরী করতে। ফিডার ভরতে ভরতে টের পেলাম শব্দের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এখন তারসাথে যুক্ত হয়েছে বিজাতীয় ভাষায় তর্জন গর্জন। যেন কারিনা ভোরের অপমানের জবাব দিতে এসেছে।
তাড়াতাড়ি গিয়ে আনাহিতাকে কোলে তুলে নিলাম। দরজা উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠলাম
— কারিনা, তুমি চলে যাও। তোমাকে আমি আর চাই না। আর কখনো এসো না প্লিজ।
জবাবে কারিনা যেন তান্ডব আরম্ভ করল ও ঘরে। এতক্ষণে আমার সাহসী মনোভাবে চিড় ধরল। আমি এবারে অনুনয়ের সুরে বললাম
— প্লিজ কারিনা। যদি আমার ব্যবহারে মনকষ্ট পেয়ে থাকো তো আমি সরি। কিন্তু তুমি চলে যাও। আমি জানি তুমিই আমি। তোমাকে আমি ভয় পেতে চাই না।
জবারে দরজায় ভারী কিছু আছড়ে পড়ল। খুব সম্ভব মোমদানিটা।
পরমুহূর্তে দরজায় ধাম ধাম বাড়ি পরতে থাকল। আমি এবারে সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। যদিও দরজাটা লক করা রয়েছে, ভারী দরজা খোলা ওরপক্ষে সম্ভবও হবে না, তাও। কেন যেন মনে হল ভোরে যে কারিনাকে দেখেছিলাম, তার চাইতে এ কারিনা অনেক শক্তিশালী। এমনভাবে দরজা ঝাঁকাচ্ছে যে সেটা এক একবার করে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
আনাহিতাকে কার্পেটের ওপরে নামিয়ে রেখে আমি দরজার দিকে ছুটে গেলাম
— প্লিজ প্লিজ কারিনা। তোমাকে আমি চাই না। প্লিজ তুমি চলে যাও।
উপায়ান্ত না দেখে আমি পাশের ভারী সোফা টেনে দরজার সামনে বসিয়ে দিলাম।
আনাহিতা কাঁদতে শুরু করল। ওদিকে দরজায় অবিরাম বাড়ি পড়লে। সাথে বিজাতীয় ভাষায় তর্জন গর্জন। কারিনার রাগ যেন বেড়েই চলছে।
ভয় পেয়ে আমি ফোনের খোঁজ করতে থাকলাম। রাত বেশ হয়ে গেছে কিন্তু মা’কে জানিয়ে দেব যে আমি আসছি আজ রাতে। এখানে থাকা আর উচিত হচ্ছে না।
কিন্তু ফোন কোথাও খুঁজে পেলাম না। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ড্রয়িং রুম লণ্ডভণ্ড করে ফেললাম কিন্তু ফোনের হদিস মিলল না।
হঠাত মনে পড়ল আনাহিতাকে নিয়ে নীচে যখন গেছিলাম, তখন এক ব্যাগে করে ওর ডায়াপার, দুধের বোতলের সাথে ফোনটাও রেখেছিলাম।
কিন্তু এখন সে ব্যাগ দেখছি না।
তাহলে কি আমি ব্যগটা নীচে ফেলে এসেছি? ভাবতেই মাথা খারাপ হয়ে গেল। ওদিকে দরজায় সমানে বাড়ি পড়ছে।
এক মুহূর্তের জন্য আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। আধুনিক যুগের মানুষ, ফোন ছাড়া আমার চলবে কেমন করে? উবারই বা ডাকব কেমন করে?
এ বিপদে আমিনার কথা মনে পড়ল। ওকে ফোন করে বুদ্ধি নেয়া দরকার। কিন্তু ফোন তো নেই।
সাথেসাথে মনে পড়ল ফোন থাকলেই বা কী! আমিনা নিজেও ফোন বাড়িতে রেখে মায়ের কাছে চলে গেছে।
জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে চাইলাম। হুট করে দরজায় বাড়ি মারা থেমে গেল। বদলে শুরু হল ভোরের সেই অদ্ভুত হিসহিসে শব্দ। আমি মন্ত্রপূতের মতো দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দরজার হাতলের ফুটো দিয়ে ঘন কালো রঙের আধা তরল আধা বায়বীয় কিছু একটা বের হয়ে চুইয়ে চুইয়ে সোফার ওপরে পড়তে লাগল।
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। এসব কী হচ্ছে। আমি কি ভুল দেখছি? এ কি কোনো দুঃস্বপ্ন?
একসময়ে হ্যান্ডেলের ফুটা দিয়ে কালো জিনিস চুইয়ে পড়া বন্ধ হল। কিন্তু সোফার ওপরে থাকা আধা তরল আধা বায়বীয় জিনিসটা যেন প্রাণ পেল। ওল্টাতে পাল্টাতে লাগল, বেশ কয়েকবার মোচড়ামুচড়ি করবার পর আমারি চোখের সামনে সেটা এক বিড়ালের রূপ নিল।
কালো, মোটাতাজা!
দেখেই চিনলাম। সেই কালো বিড়ালটা! আমিনার সাথে নীচে হাঁটতে গিয়ে একবার এর সামনে পড়েছিলাম।
বিড়ালটা থাবা উঁচিয়ে আমার উদ্দেশ্যে রাগতভাবে “ম্যাও” করে উঠল। পরমুহূর্তে সোফা থেকে লাফ দিয়ে আনাহিতার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এতক্ষণ আমি পাথর হয়ে সব দেখছিলাম। আনাহিতার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তেই সাথেসাথে আমার যেন প্রাণ ফিরে এল। এক ছুটে গিয়ে প্রচন্ড জোরে লাথি কশালাম। লাথির চোটে বিড়ালটা ছিটকে সামনের দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
তিলমাত্র দেরী করলাম না। ক্রন্দনরত আনাহিতাকে তুলে নিয়ে দৌড়ে বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকলাম।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
অনেকদিন পর আজ রাত্রে আনাহিতা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল দেখে আমিও দিলাম এক ঘুম। এন্টিহিস্টামিনের প্রভাবে হয়ত। একবার ভেবেছিলাম বেডরুমেই চলে যাব কিন্তু সাথে আনাহিতার এত জিনিস, কট এসব কিভাবে নিয়ে যাব ভেবে আকাশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ঠিক করলাম।
এরমধ্যে মা ফোন করে খোঁজ খবর নিল। জিজ্ঞেস করল
— আমি এসে থাকব?
— না, মা। আমি একদম ঠিক আছি, আনাহিতাও অনেকটা সেরে উঠেছে। তুমি আর এ ঝামেলাটা কোরো না।
— আচ্ছা, প্রয়োজন পড়লে জানিও।
আসলে ঠিক কথা বলিনি আমি। একটানা রাত্রি জেগে আমার অবস্থা ক্লান্ত বিধ্বস্ত। সকালে ঘুম থেকে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে বিছানা থেকে তুলতে হয়। এক একদিন মনে হয় আর এক সেকেন্ডও আমি পার করতে পারব না।
তারপরেও আমি মা’কে আসতে বললাম না কেন?
অনেক ভাবলাম এনিয়ে। একসময়ে আবিষ্কার করলাম আমি আসলে আনাহিতাকে আমার একান্ত নিজস্ব জিনিস বলে মনে করি। আমার আর আনাহিতার এক আলাদা পৃথিবী রয়েছে। এখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই। কারণ কাউকেই আমি তেমন বিশ্বাস করতে পারি না, কারো ওপর ভরসা করতে পারি না। এর মূলে রয়েছে আমার ছেলেবেলা। বাবার ওপরে ভরসা বা বিশ্বাস করার তো প্রশ্নই ওঠে না। সে একজন ব্যর্থ বাবা, ব্যর্থ স্বামী। মা যদিও আমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছিল কিন্তু বাবার সাথে ছাড়াছাড়ির পর মার মাঝে পরিবর্তন এসে গেছিল। সে তখন তার চাকরী, তার নতুন স্বাধীন জীবন নিয়ে এতোটাই ব্যতিব্যস্ত ছিল যে আমাকে খানিকটা অবহেলার মাঝেই বড়ো হতে হয়েছে। এক এক সময়ে মনে হয়েছে মা হয়ত আমাকে কিছুটা রেজেন্টই করে। আমি না থাকলে হয়ত সে নতুনভাবে জীবনটা গড়ে তুলতে পারত, এ ভাবে।
আরো ভেবে দেখলাম বয়সের সাথে সাথে মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা শান্ত হয়ে এলেও ছোটবেলার কিছু ব্যপারের জন্য আমি এখনো মা’কে পুরাপুরি ক্ষমা করতে পারিনি।
এজন্য মা’কেও আমি ভরসার বা বিশ্বাসের জায়গা ভাবি না।
বাকি রইল আকাশ। আকাশের সাথে আমার সম্পর্ক চমৎকার, বোঝাপড়া চমৎকার। কিন্তু আকাশের সাথে আমার সম্পর্কটার বয়স কতটুকু?
মাত্র দুই বছর বা তার একটু বেশি। আমি যে মানসিকতার মেয়ে তাতে এত তাড়াতাড়ি কারো ওপরে ভরসাও করি না, বিশ্বাসও করি না।
কিন্তু আনাহিতা সম্পূর্ণ আমার। আমার রক্ত মাংসে গড়া, আমার দেহে তিলতিল করে বড় হওয়া সন্তান। তাই পৃথিবীতে আমার সবচাইতে প্রিয়, সবচাইতে আপন, সবচাইতে বিশ্বাসের কিছু যদি থাকে তো সে আনাহিতা।
যাক, অনেক আবোল তাবোল ভাবলাম। অনেকদিন আমিনার সাথে কথা হয় না। ডায়াল করতেই ওপার থেকে আমিনা ধরল।
— কেমন আছ দীবা? ছোট্ট আনাহিতা কেমন আছে?
— দুজনেই ভালো আছি, আমিনা। তোমার খবর বলো।
টুকটাক কথা বললাম। আমিনার তাড়া ছিল। কিছুক্ষণ পরে সে যাবে ওর মায়ের সাথে দেখা করতে। ওর মা কাছের এক মরুভূমিতে একা বাস করে। সেখানে গোপনে ওরা ওদের সংঘের কিছু কাজ করবে।
— আমি দেখতে চাই, আমিনা। লেখার কাজের জন্য। ওখানে পৌঁছে আমাকে ভিডিও কল দিতে পারবে?
— সম্ভব না, দীবা। সেখানে সেল ফোন নিষিদ্ধ। বললাম না আমাদের সব কার্যকলাপ নিষিদ্ধ। আমি তো ফোন বাড়িতেই রেখে যাব। কয়টা দিন দুনিয়ার সাথে বলতে গেলে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
— ওহ।
আমি আর আমিনাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখলাম না।
রাতে আনাহিতাকে নিয়ে শোবার সাথেসাথে দুজনে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লাম। সেই ঘুম একেবারে গিয়ে ভাঙল ভোরবেলায়। আজও লাইট নিভিয়ে শুয়েছিলাম। ঘরের মধ্যে আলো আধারি। ঘুম ভাংতেই শুনলাম অদ্ভুত এক শব্দ, যেন ঘরের মধ্যে সাপ হিসহিস করছে। বা কেউ খুব রেগে রয়েছে।
সাথেসাথে চোখ খুলে গেল। সামনে যা দেখলাম, তাতে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।
কারিনা!
কটের ওপরে ঝুঁকে পড়ে আনাহিতার মুখের প্রায় এক ইঞ্চি দূরত্বে নিজের মুখ নিয়ে রাগতভাবে এমন শব্দ করছে। তারপরে কর্কশ গলায় বিজাতীয় ভাষায় কী যেন বলতে লাগল। পুরা অবয়বে ফুটে উঠছে তীব্র রোষ।
চোখের পলকে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। তারপর কারিনাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে উঠলাম
— এই এই। সরো সরো।
কারিনা এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। ঘরের অল্প আলোতে মনে হল ওর চোখদুটোতে সাদা অংশ বলে কিছু নেই, পুরোটাই কালো।
আমি আবার চেঁচিয়ে উঠলাম
— সরো সরো, সরে যাও ওর কাছ থেকে।
বলতে বলতেই আমি দৌড়ে গিয়ে কারিনা’কে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলাম। ওর শরীরটা ঠিক মানুষের শরীরের মতো বলে বোধ হল না, কেমন নরম, হাত দিলে দেবে যাচ্ছে যেন। তারপরেও আমি এত জোরে ওকে ধাক্কা দিয়েছিলাম যে সামলাতে না পেরে ও মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।
নিমেষে আমি আনাহিতাকে কোলে তুলে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বের হয়ে এলাম। কী মনে করে দৌড়ে বেডরুম থেকে চাবি এনে লেখার রুমের দরজা লক করে দিলাম। কারিনা কখনো লেখার রুমের বাইরে আসে না, তারপরেও সাবধানতা অবলম্বন করতে ছাড়লাম না।
একটু ধাতস্থ হবার পর কান পেতে শুনবার চেষ্টা করলাম। ও ঘরে নিশ্ছিদ্র নীরবতা। কারিনার উপস্থিতির কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। যাক, চলে গেছে ও। নিশ্চয় বুঝেছে সে এখানে আর ওয়েলকাম না। আর আসবে না হয়ত। তারপরেও আমি এ বাসায় আর থাকব না। কাল আকাশ এলেই আমরা নতুন বাসার খোঁজে নেমে পড়ব। কাল কেন, আমি আজই খোঁজ শুরু করে দিব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বাসা বদল করে ফেলতে হবে।
আয়না!
আয়নাটা দিয়ে কারিনা আসা যাওয়া করে। কাজেই আয়নাটা সরিয়ে ফেললেই ও আর আমার বা আনাহিতার নাগাল পাবে না। বুঝলাম আয়নাটাকে বিদায় করতে হবে।
কিন্তু কিভাবে?
এ মুহূর্তে ও ঘরে যাওয়া কি ঠিক হবে?
মাথাটা দপ দপ করছিল। বাথরুমে গিয়ে আমি চোখেমুখে পানি দিলাম।
ঠিক করলাম আপাতত দরজা লক করা আছে, কাজেই আমরা নিরাপদেই আছি। কাল আকাশ এলে ও ঘরে ঢুকে আয়নাটা প্রথমে ভাঙব, তারপরে ভাঙা অংশ দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসব।
প্ল্যানটা সাজিয়ে ফেলে আমি একটু শান্ত হলাম। আনাহিতাকে চেঞ্জ করে খাওয়ালাম, নিজেও নাস্তা করলাম।
ও ঘর থেকে টু শব্দ পেলাম না। বুঝে নিলাম কারিনা চলে গেছে। ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়াতে নিশ্চয় অপমানিতবোধ করেছে, তাই চলে গেছে। আর আসবেও না হয়ত। এতক্ষণে আমি রিলাক্স করে দৈনন্দিন কাজ শুরু করলাম। কালকেই আকাশ চলে আসবে ভেবে আরেকটু স্বস্তিবোধ করলাম।
বাকি দিনটা আনাহিতার সাথে খেলা করে, ফোনে আকাশের সাথে খুনসুটি করে, বাড়ির খোঁজ করে কাটিয়ে দিলাম।
আকাশ, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না। তোমাকে আসল কথাটা বলিনি কারণ মনে করেছিলাম তুমি হেসে উড়িয়ে দেবে। শুধু বলেছিলাম বাড়িতে জিনিসপত্র রাখবার জায়গা হচ্ছে না, এজন্য তিন বেডরুমের বাড়িতে সিফট করতে চাই। কেন যে তখন বললাম না! জানালে তুমি হয়ত আমাকে এ বাড়িতে থাকতে মানা করতে। কিম্বা আমার কথা শুনে হাসতে। কিন্তু আমি যে সাহসী, আমি যে স্বাধীনচেতা, আমি যে অন্যের উপহাস সহ্য করতে পারি না, তাই তোমাকে বাড়ি বদলের আসল কারণ জানালাম না। ভেবেছিলাম নিজেই সব সামলে নিতে পারব।
(চলবে)
আকাশ যাবে কয়েকদিনের অফিস ট্যুরে। যদিও যেতে চাইছিল না। আমিই ওকে ঠেলে পাঠালাম। ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে কোনো ছন্দপতন হতে দেয়া ঠিক না। এদিক দিয়ে আমি খুবি বাস্তববাদী। যা করতে হবে, তা করতে হবে। বললাম
— আমি আনাহিতাকে নিয়ে ঠিক থাকতে পারব। চিন্তার কিছু নাই।
— কিন্তু, দীবা…
— কোনো কিন্তু না, আকাশ। এমনিতেও রাত্রের অধিকাংশ সময় তো আমিই দেখে রাখি। এখন পুরাটাই নাহয় দেখলাম।
চিন্তিত সুরে আকাশ বলল
— তারপরেও, দীবা। তোমার মা’কে বলবে কয়দিন এসে থেকে যেতে?
— আরে নাহ। এত সামান্য ব্যপারে মা’কে ডাকাডাকি করবার কোনো দরকার নাই। মা নিজেই অফিস বাসা করে ক্লান্ত থাকে।
— তাহলে তুমিই কয়টা দিন গিয়ে থাকো না।
— আরে বাবা, এত চিন্তা কোরো না তো। আমরা ঠিক থাকব। তোমার মেয়ের আড়াই মাইল লটবহর দুদিনের জন্য বাঁধাছাঁদা করবার কোনো ইচ্ছা নাই আমার।
বাধ্য হয়ে রাজি হল আকাশ। কিন্তু আমাকে বারবার বলতে লাগল সাবধানে থাকবার জন্য, ওকে ফোনে আপডেট দিতে থাকবার জন্য।
আজ সকালে আকাশ রওনা দিবে। আনাহিতা ভোরবেলার দিকে এই যে ঘুমায়, সে ঘুম ভাংতে ভাংতে একেবারে বারোটার মতো বেজে যায়। সেই ফাঁকে আমিও ওরসাথে ঘুমিয়ে নেই। তবে আজ আকাশ যাবে বলে উঠে পড়েছি। বহুদিন পরে আমরা একসাথে নাস্তা খেতে বসলাম।
আকাশের রওনা দেবার তাড়া ছিল। আমাকে শেষবারের মতো সাবধান করে দিয়ে, চুমু খেয়ে আকাশ চলে গেল। দরজা বন্ধ করে টেবিল থেকে পাউরুটি মাখন ফ্রিজে তুলে রাখছি, ওঘর থেকে আনাহিতা তীব্রভাবে কেঁদে উঠল
— এই যে আসছি আমি!
ফ্রিজে জিনিস তুলতে তুলতে উঁচু গলায় সাড়া দিলাম আমি।
আনাহিতা এখন আমার গলা চেনে। ঘুম ভেঙে কাউকে না দেখলে যখন কেঁদে উঠে, তখন আমি সাড়া দিলেই ওর কান্না বন্ধ হয়ে যায়। বোঝে মা একটু পরেই আসছে।
তবে বেশি দেরী করা যায় না অবশ্য। তখন আবার শুরু করে দেয় কান্না।
কিন্তু আজ আমার গলার সাড়া পেয়েও আনাহিতার কান্না থামল না। বরং আরো বাড়ল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল।
— আসছি! আসছি।
বলতে বলতে দরজা খুলে ঢুকে ওকে কোলে তুলে নিলাম। সাধারণত কোলে নিলেই ওর কান্না বন্ধ হয়ে যায়, আজ হল না। ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে অনেক্ষণ হাটলাম। বহু সময় লাগল ওকে ঠান্ডা করতে। একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে কটে শুইয়ে দিয়ে আমি গোসলে চলে গেলাম। উঠেই যখন পড়েছি, দিন শুরু করি, এখন আর ঘুম আসবে না।
গোসল সেরে বেডরুমে কাপড় পড়ছি, আনাহিতা আগেরবারের মতোই তীব্র, তীক্ষ্ণ গলায় কেঁদে উঠল। কোনোমতে ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে দিয়েই ছুটলাম। গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। এবারে ওকে ঠান্ডা করতে আরো সময় নিল। কোনো কারণে আনাহিতা আজ খুবি ইরিটেটেড হয়ে আছে।
ভাবলাম ওকে গোসলটা দিয়েই দেই। একয়দিন ঠান্ডার জন্য শুধু গা মুছিয়ে দিয়েছি। গোসল দিলে আরাম লাগবে ওর।
জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ওর কাপড় খুলতেই চমকে চেঁচিয়ে উঠলাম।
এ কী!
আনাহিতার হাতে পায়ে এসব দাগ কেন? একবার মনে হচ্ছে ফুসকুড়ি, একবার মনে হচ্ছে খামচির দাগ। ওর কি কোনো অসুখ হয়েছে? গাটাও গরম লাগল।
নিয়ে ছুটলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার অনেক সময় নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। তারপর প্রশ্ন করল
— ঘরে কি পোকামাকড়ের উপদ্রব রয়েছে? ইঁদুর? কিছু খামচে দিয়েছে মনে হচ্ছে।
— না, ডাক্তার। আমি অসম্ভব খুঁতখুঁতে মানুষ। আমার ঘরে পোকা থাকবে, ইঁদুর ঘুরে বেড়াবে, খাবারে মুখ দিবে, ভাবলেই তো আমার ঘেন্না লাগবে। তাছাড়া এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ম্যানেজমেন্ট থেকে সবসময় পোকার ওষুধ দেয়া হয়। কাজেই ঘর একদম ঝকঝকে তকতকে থাকে।
— তাহলে আনাহিতার সাবান শ্যাম্পুতে কোনো চেঞ্জ হয়েছে কি?
— তাও হয়নি, ডক্টর।
— হুম।
ওষুধ লিখে দিলেন তিনি। নিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম। তিনি বললেন খেয়াল রাখতে। হয়ত আনাহিতার কিছু একটাতে এলার্জি রয়েছে যা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না।
ফিরে এসে ওর সমস্ত জামাকাপড়, বেডিং ধুলাম। বাকি দিনটা ভালোভাবেই কাটল। পরেরদিনও।
(চলবে)
আনাহিতাকে নিয়ে আমি আমার লেখার ঘরে চলে এলাম। সাথে এল আনাহিতার জিনিসপত্র। একটা বাচ্চার যে এত জিনিসের প্রয়োজন হয়, আগে জানতাম না। এখন ঘরের যেদিকে তাকাই, সেদিকেই ওর কাপড়চোপর, ওর খেলনাপাতি, ওর দুধের সরঞ্জাম দিয়ে ভর্তি।
আমার সেই লেখার ঘরটাকে আর চিনতেই পারি না। তারজন্য অবশ্য আমার কোনো আক্ষেপ নেই। সবকিছুরই সময় আছে, একসময় আনাহিতাও রুটিনে এসে পড়বে, তখন ওকে আকাশের জিম্মায় ঘন্টা দুয়েকের জন্য দিয়ে আমি আবার লেখালিখি শুরু করব, এমনটাই প্ল্যান আমার।
বলতে ভুলে গেছি, আমিনা চলে যাবার কিছুদিনের মধ্যে মরক্কো থেকে আমার নামে এক প্যাকেজ এসেছিল। ভেতরে আনাহিতার জন্য সুন্দর মরক্কান কাফতান, তারসাথে ছোট এক থলেতে কিছু। কিন্তু থলের মুখটা এমনভাবে বন্ধ করা যে কিছুতেই খুলতে পারলাম না। দেখে মনে হল সীল গালা করা। আমিনার সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে ও বলল
— কাফতান আমাদের ঐতিয্যবাহী পোশাক, দীবা। তাই ভাবলাম আনাহিতার জন্য পাঠাই।
— আর থলেতে কী রয়েছে, আমিনা? আমি তো খুলতেই পারছি না।
একটু চুপ করে রইল আমিনা
— থলেতে সাত রকমের চাল রয়েছে। মন্ত্রপূত। আনাহিতাকে সবরকমের বিপদ আপদ থেকে প্রোটেক্ট করবে। এটা ওর বেবি কটের সাথে বেধে দিও, দীবা।
আমি আর কিছু বললাম না এনিয়ে। তবে কাফতানের জন্য আমিনাকে প্রচুর ধন্যবাদ জানালাম। মনেমনে ঠিক করলাম আনাহিতা সুস্থ হলেই ওকে পরিয়ে ফটো তুলে আমিনাকে পাঠিয়ে দিব। এত সুন্দর একটা জিনিস।
আর থলেটা? ওটার জায়গা হল বেডরুমের ড্রয়ারে, সেই মাছ লকেটের পাশে।
লেখার ঘরে প্রথম কয়টা রাত নির্বিঘ্নেই কাটল। আমি লাইট জ্বালিয়ে রাখতাম সারারাত। কারণ একটু পরপরই উঠতে হত। কটে দেয়ামাত্র নাক বন্ধ হয়ে আনাহিতা কেঁদে উঠত। তখন ওকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে হেঁটে বেড়াতাম।
ঘুম না হবার ফলে আমাদের দুজনেরই অবস্থা কাহিল। একরাতে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। লাইটটাও মনে হয় আকাশ কোনো একসময়ে এরুমে এসে নিভিয়ে দিয়ে গেছিল।
আধা ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছিল ঘরময় কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে, এটাসেটা উলটে পালটে দেখছে। আমি তখন এতোই ক্লান্ত যে চোখ খোলবার শক্তিটুকুও ছিল না। তবে আন্দাজ করে নিলাম যে অন্ধকারে কারিনা এসেছে এতদিন পরে। এখন ঘরময় ঘুরে ঘুরে দেখছে। হয়ত সেও অবাক হয়েছে ঘরের আমূল পরিবর্তনে।
কয়দিন বাদে এক সকালে উঠে দেখি জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যেখানে যে জিনিসটি থাকবার কথা, সেখানে সেটি নেই।
আমার পিটপিটে স্বভাবের কথা আগেই বলেছি। আনাহিতা হবার পর জিনিসপত্র প্ল্যানমাফিক এমনভাবে সাজিয়ে রাখি যেন হাতের কাছে সবকিছু থাকে, রাতে ওর ডায়াপার চেঞ্জ করতে বা ওকে ফিড করতে যেন আমাকে বারবার বিছানা ছাড়তে না হয়।
সাথেসাথে মনে পড়ে গেল আরেকদিনের কথা। আমি তখন আনাহিতাকে চারমাসের পেটে নিয়ে সবে মা’র বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিলাম। সেদিনও কারিনা এমন করেই জিনিসপত্র সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল।
ব্যপারটাতে খুব একটা খুশি না হলেও তেমন পাত্তা দিলাম না। লিখবার ঘর আগের মতো নাই দেখে কারিনাও বিরক্ত হয়ত। কিন্তু কিছু করার নাই। ওকে অভ্যস্ত হতে হবে। নাহলে চলে যেতে হবে।
এরপর কয়েকদিন চুপচাপ গেল। কারিনার উপস্থিতি টের পেতাম না। এলেও অন্তত জিনিসপত্র ছোঁড়াছুড়ি করত না। আমি এদিকে আনাহিতাকে নিয়ে এতোই ব্যতিব্যস্ত যে সেটাকে এমনকিছু গুরুত্ব দিলাম না।
একরাতে আনাহিতাকে অনেক্ষণ কোলে নিয়ে হাটবার পর দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওকে কটে না দিয়ে আমার পাশেই রেখেছিলাম, কিছুক্ষণ পরেই আবার উঠতে হবে দুধ খাওয়াবার জন্য।
চটকা দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। কাঁচা ঘুম ভেঙে আধা অন্ধকারে প্রথমে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঘরের লাইটটা নিভিয়ে দিলেও স্ট্রিটলাইটের তেরছা আলো পর্দা ভেদ করে ঢুকে ঘরটাকে সামান্য আলোকিত করে রেখেছে।
চোখ প্রথমেই গেল আনাহিতার ওপরে। ভেবেছিলাম ও নিশ্চয় কেঁদে উঠেছে, যারজন্য আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। কিন্তু নাহ, দিব্যি ঘুমিয়ে রয়েছে আমার রাজকন্যাটা। নিশ্চিন্ত হয়ে আবার চোখ বন্ধ করব, চমকে বড়সড় একটা ঝাঁকুনি খেলাম।
আনাহিতার ওপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে কারিনা ওকে নিবিষ্ট মনে দেখছে। বড়োবড়ো চোখে বিস্ময়।
ধীরে ধীরে আনাহিতার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কারিনা আমার দিকে তাকালো। একে অন্যের দিকে আমরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। তারপরেই এক দৌড়ে গিয়ে কারিনা আয়নাতে ঢুকে পড়ল।
ওরচোখে কিছু একটা ছিল, আমি ঠিক ধরতে পারিনি সেদিন। অভিমান কি?
নাকি ক্ষোভ?
নাকি তারও বেশিকিছু?
(চলবে)