Monday, June 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 85



মিত্রাভান থানোস পর্ব-০২

0

#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_______০২

নিতু দেখল, দরজার ওপাশে শিহাব দাঁড়ানো। তার ঠোঁটের কোণায় অদৃশ্য এক হাসির রেখা ফুটে আছে।

নিতু ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। টের পেল, হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। গলা শুকিয়ে এসেছে। কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছে না সে। এসব কী হচ্ছে তার সাথে? চোখের পলক ফেলতে কয় সেকেন্ড সময় লাগে? শিহাব তার আগেই তিন তলায় আসল কী করে?

‘কী হয়েছে নিতু? চোখ-মুখ এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন?’

শিহাবের কণ্ঠজুড়ে কৌতূহল। কপালে চিন্তার বলিরেখা। নিতু তাকে কিছু বুঝতে দিল না। দরজা থেকে সরে গিয়ে শিহাবকে জায়গা করে দিল। আপাতত সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিল। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল,

‘আমি ঠিক আছি। আপনি ভেতরে আসুন। আজ এতো দেরি হলো যে?’

‘পুরোনো কিছু কাগজপত্র চেক করছিলাম। সময়ের দিকে একদম খেয়াল ছিল না। পরে বাইরে বের হয়ে দেখি ইতোমধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে।’

‘ইশ! ঘেমে-টেমে একদম নেয়ে উঠছেন। ভেতরে এসে বসুন। আমি পানি নিয়ে আসছি।’

শিহাব ভেতরে ঢুকল। শোবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে গায়ের শার্ট খুলে ফেলল। তখনি তার পিঠের ক্ষতটার দিকে নজর পড়ল নিতুর। সে তৎক্ষণাৎ শিহাবকে দাঁড় করিয়ে দিল। তীক্ষ্ম চোখে পিঠের ক্ষত পরখ করল। ক্ষত তেমন গভীর নয়। কিন্তু লাল হয়ে আছে। অনেকটা গভীর আঁচড়ের মতো।

‘এখানে কাটল কী করে? আমাকে বলেন নি কেন?’

সে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল। প্রত্যুত্তরে শিহাব বলল,

‘তেমন কিছু না! ছেড়ে দাও।’

‘ছেড়ে দিব মানে? কী বলছেন আপনি? কতখানি কেটে গেছে। ইনফেকশন হতে পারে। এদিকে এসে বসুন তো।’

‘এইটুকুতে কিছু হবে না। এমনি ঠিক হয়ে যাবে।’

নিতু কোনো বারণ শুনল না। শিহাবকে টেনে একপ্রকার জোর করে বিছানায় বসিয়ে দিল। ফার্স্ট এইড বক্স এনে ক্ষত পরিষ্কার করতে লাগল। কেমন লাল হয়ে র ক্ত জমাট বেঁধে আছে। অথচ শিহাব নির্বিকার! কোনো আহা উঁহু নেই। এই মানুষ কি ব্যথা, বেদনা অনুভব করে না? অথচ তার আঘাত দেখে নিতুর অন্তর পুড়ে যাচ্ছে।

নিতু খুব নরম মনের মানুষ। অল্পতে দুঃখ পায়। কষ্ট হয়। শিহাবের ব্যথায় তার দু চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। পরিষ্কার শেষে খুব যত্ন করে মলম লাগিয়ে দিল। তারপর আবার প্রশ্ন করল,

‘কী করে এমন হলো বললেন না তো?’

‘আজকে স্যারের সাথে বের হয়েছিলাম। অফিসের আশপাশটা দেখছিলাম। ওখানে হুট করে কিছু একটা উড়ে এসে আক্রমণ করে। পাখি-টাখি হবে কিছু। আচমকা এসে আঁচড় দেয়। কিছু বুঝে উঠার আগে আবার উধাও হয়ে যায়।’

‘এতখানি কেটে গেছে আপনি কিছু করেননি কেন? ডাক্তারের কাছে যাবেন না?’

‘ডাক্তার তো ঘরেই আছে। আমার সকল রোগের ওষুধ। তাই তো ছুটে ঘরে চলে এলাম।’

নিতু লজ্জা পেল। চোখ-মুখ রক্তিম হয়ে উঠল। এভাবে কেউ বলে? তার বুঝি লজ্জা করে না! সে লাজুক স্বরে বলল,

‘হাতমুখ ধুয়ে নিন। আমি নাস্তা দিচ্ছি।’

বলে সে রান্নাঘরে গেল। চায়ের জন্য চুলায় পানি গরম বসাল। তার চোখেমুখে উপচে পড়া খুশি। সে শিহাবের সকল রোগের ওষুধ! এতো সুন্দর কথাটা! কানে এখনো বাজছে। শিহাব তাকে এতো ভালোবাসে? পাতিলের ফুটন্ত গরম পানির দিকে চেয়ে সে মুচকি মুচকি হাসল। তার মনে পড়ল শিহাবের সাথে বিয়ের ঘটনা।

নিতু বাপ-মা মরা মেয়ে। বড় হয়েছে দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে। বড় অনাদরে আর অবহেলায়। ও বাড়িতে কত গঞ্জনা আর বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে! উপেক্ষিত হতে হয়েছে। একমুঠ ভাতের জন্য সারাদিন ফাই-ফরমাশ খাটতে হয়েছে। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করার সুযোগ পর্যন্ত হয়নি। আরেকটু বয়স হতে যখন বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকল, বাড়ির সবাই ঝামেলা বিদায় করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। ভাগ্যিস মামা তাকে একটু স্নেহ করতেন। তিনিই তো শিহাবের সাথে তার সমন্ধ এনেছিলেন। তাকে শিহাবের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

শিহাব অনেকটা তারই মতো। সাত কূলে আপন বলতে কেউ নেই। বড় হয়েছে ইয়াতিমখানায়। অনেক কষ্টে পড়াশোনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো চাকরি পেয়েছে। একসময় যখন বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে থাকে, তখন সৃষ্টিকর্তার উসিলায় নিতুর সন্ধান পায়। সোমবারের এক বিকেলে তাকে দেখে যায়। প্রথম দেখায় বোধ হয় ভালো লেগে গেছিল। কারণ তার পরের শুক্রবারে তাদের বিয়ে হয়ে যায়।

শিহাবের প্রতি নিতুর এই প্রগাঢ় আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সব বিয়ের পরে সৃষ্টি হয়েছে। আস্তে আস্তে! মানুষটা এতো ভালো! তার প্রচুর যত্ন নেয়। ভালোমন্দ খেয়াল রাখে। আদর করে, ভালোবাসে। কত সুন্দর করে কথা বলে। সে বার বার মুগ্ধ হয়ে যায়।

নিতুর মুখের হাসি আস্তে আস্তে উবে গেল। চায়ের কাপে চিনি মেশানোর সময় তার আবার মনে পড়ল। সন্ধার ঘটনাটা। শিহাব এতদ্রুত তিনতলায় পৌঁছাল কী করে? নাকি তার দেখার ভুল ছিল? গভীর চিন্তায় পড়ে গেল সে।

‘এতো অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছ?’

শিহাবের আচমকা আগমনে দেহ কেঁপে উঠে নিতুর। চাপের কাপ ছলকে উঠে। গরম চা হাতে পড়তে সে মৃদু আর্তনাদ করে। সঙ্গে সঙ্গে শিহাব ছুটে আসে। নিতুর হাতটা মুঠোয় নিয়ে ট্যাপের পানি ছেড়ে দেয়। বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘একটা কাজ মনোযোগ দিয়ে করো না নিতু! তোমাকে নিয়ে আর পারি না। কোনোদিন বড়সড় দূর্ঘটনা ঘটে যায় যদি?’

শিহাব মৃদু স্বরে তাকে ধমকায়। হাতটা পরখ করে বলে,

‘কেমন লাল হয়ে গেছে। বেশি জ্বালাপোড়া করে?’

‘না!’

‘আসো বার্ন ক্রিম লাগিয়ে দেই।’

তাকে নিয়ে শিহাবের ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তা নিতুর ভালো লাগে। বেশ উপভোগ করে। সে মনে মনে হাসে। আর গভীরভাবে উপলব্ধি করে। এই মানুষটা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।

______

রাত্রি যত গভীর হচ্ছে নিতুর তত ভয় বাড়ছে। শিহাব তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। অথচ নিতুর বার বার মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়লেই মানুষটা উধাও হয়ে যাবে। সে খুব করে চেষ্টা করছে জেগে থাকার। কিন্তু পারছে না। ক্রমেই শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। যেন কেউ দু চোখে যত্ন করে রাজ্যের ঘুম ঢেলে দিয়েছে।

মন ও মস্তিষ্কের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করেও নিতু জেগে থাকতে পারল না। একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
______

নিতুর গাঢ় ঘুম ভাঙল পরদিন সকালবেলা। তখন ঘরময় আলো। চোখ খুলে শিহাবকে পাশে পেল না। নিশ্চয়ই অফিসে চলে গেছে। অনেকটা বেলা হয়েছে যে। সে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে পড়ল। মেঝেতে পা রাখতে হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল। পড়ে যেতে নিতে দ্রুত বিছানা চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিল। মাথার ভেতর এমন করছে কেন? ধপ করে সে বিছানায় বসে পড়ল। এতো দূর্বল দূর্বল লাগছে!

সে দীর্ঘক্ষণ বিছানায় আধ শোয়া হয়ে রইল। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। শরীর কাঁপছে। হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। কিছু খেলে শক্তি ফিরবে হয়তো। সে আস্তে ধীরে উঠে ওয়াশরুমে গেল।

দুপুরবেলা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ছিল নিতু। মাথার ভেজা চুলে চিরুনি করছিল। তখন তার প্রথম নজরে এলো। ঘাড়ের কাছে একটা সূক্ষ্ম দাগ মনে হচ্ছে। কামড়ের দাগ। সূচালো মুখের কোনো জন্তু কামড়ে দিয়েছে যেন! তার কপাল কুঁচকে গেল। বার কয়েক ঘাড়ে হাত বুলাল। এখানে কখন, কী কামড় দিল? তার তো স্মরণে নেই।

(চলবে)

মিত্রাভান থানোস পর্ব-০১

0

#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____০১

আজও মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল নিতুর। পাশ ফিরে দেখল শিহাব নেই। সে কয়েক রাত ধরে খেয়াল করছে মাঝরাতে শিহাব কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। আবার হুট করে তাকে রুমে দেখা যায়। প্রায়ই ঘুম ভাঙ্গলে সে শিহাবকে বিছানায় পায় না। আবার খানিক বাদে পুরুষালী একজোড়া হাত তাকে গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে নেয়।

শিহাবের নিঃশব্দ পদচারণা। যেন হাওয়ায় ভেসে চলাফেরা করে। নিতু এতোদিন বিষয়টা আমলে নেয়নি। কিন্তু আজ এই মধ্যরাতে ঘুম ভাঙতে খটকা লাগল। সবকিছু একের পর এক মনে হতে থাকল।

শিহাব আর তার নতুন বিয়ে। সবেমাত্র মাস দুই গড়িয়েছে। পারিবারিক বিয়ে হলেও এই কিছুদিনে মানুষটা তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে। তাকে ছাড়া সে নিজের কথা ভাবতেই পারে না। শিহাবও তাকে খুব ভালোবাসে। তাকে প্রতিনিয়ত চোখে হারায়। তবুও মানুষটার কিছু কিছু বিষয় তাকে ভাবিয়ে তুলছে। সে ঘুমিয়ে পড়ার আগে শিহাব জেগে থাকে। ঘুম ভাঙতেও দেখে শিহাব জেগে আছে। আবার ভোরবেলা যখনি উঠুক দেখবে সে ইতিমধ্যে উঠে পড়েছে।

এতকিছু ভাবতে নিতুর কেন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। ঘুমের রেশ কেটে গেছে। গায়ে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে দ্রুত উঠে পড়ল সে। শিহাব কোথায়? সে ঘরে খুঁজল, আশপাশে খুঁজল, ওয়াশরুমেও খুঁজে দেখল শিহাব নেই।

তাদের দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাট। রান্নাঘরে আলো জ্বলছে। সেই আলোতে চারপাশ পরিষ্কার। নিতু পাশের রুমের দিকে এগোল। রুমের দরজা হাট করে খোলা। খা খা করছে। শিহাব নেই। বসার ঘর, রান্নাঘর কোথাও সে নেই। নিতু বুঝতে পারল শিহাব ফ্ল্যাটে নেই। হয়তো বাইরে গেছে। কোনো জরুরি কাজে। সে ঘুমাচ্ছিল দেখে হয়তো বলে যায়নি। ডেকে তুলেনি।

মনকে প্রবোধ দিয়ে সে ঘুমানোর কথা ভাবল। আচমকা তার নজর আটকে গেল ফ্ল্যাটের দরজায়। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল, দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো। তার মনে পড়ল ঘুমানোর আগে সে নিজে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছিল। তাহলে শিহাব বাইরে বের হলো কিভাবে?

নিতুর দেহে শীতল এক রক্তস্রোত বয়ে গেল। মনে হলো, দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে। কোনো সমীকরণ মিলছে না। সে কোনো রকমে টলতে টলতে শোবার ঘরের দিকে এগোল। ঘরে ঢুকতে দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে এলো। আবছা আলোয় খেয়াল করল এক পুরুষ অবয়ব। বিছানায় আধ শোয়া হয়ে বালিশে হেলান দিয়ে আছে। শিহাব? নিতু জ্বরগ্রস্তের মতো কাঁপতে লাগল। তাকে দেখে শিহাবের কোনো ভাবান্তর হলো না। স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় গেছিলে?’

শিহাবের প্রশ্নে নিতু কয়েক সেকেন্ড কিছু বলতে পারল না। সে কুলকুল করে ঘামছে। নিজেকে দ্রুত সামলে নিল। পরক্ষণে জড়ানো গলায় বলল,

‘ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি খেয়ে আসলাম।’

‘পাশে আসো। শুয়ে পড়ো।’

নিতুর কেন জানি ভয় ভয় করছে। তবুও সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে বলল,

‘আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ঘুম ভাঙতে দেখি পাশে নাই।’

শিহাবকে কয়েক মুহূর্ত দ্বিধান্বিত দেখাল কি? নিতু বুঝতে পারল না। তবে সে এবারো স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘কোথায় আর থাকব? বারান্দায় ছিলাম। একটা সিগারেট টেনে আসলাম।’

নিতুর শরীর আরো হিম হয়ে এলো। তার স্পষ্ট মনে আছে সে শিহাবকে বারান্দায় খুঁজেছে। বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা দু বার চোখ বুলিয়েছে। কোথাও সে ছিল না। তাহলে মিথ্যে কেন বলছে? শিহাব কোথায় ছিল? হঠাৎ করে রুমে উদয় হলো কী করে?

নিতু আর ভাবতে পারল না। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। শিহাব হঠাৎ তার বাহুতে টান দিল। সে হুমড়ি খেয়ে তার বুকে গিয়ে পড়ল। শিহাব তাকে জড়িয়ে আদুরে গলায় বলল,

‘আমায় পাশে না পেয়ে ভয় পেয়েছ নিতু?’

নিতু উত্তর দিতে গিয়েও পারল না। শিহাব তাকে আগলে নিয়ে বলল,

‘এতসব কী ভাবছ? কেমন যেন লাগছে তোমাকে। শরীর ঠিক আছে?’

‘হুঁ। একটু মাথা ধরেছে।’

‘আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়ো।’

‘আপনার শরীর এতো গরম কেন? জ্বর এসেছে?’

নিতুকে বিচলিত দেখাল। সে চিন্তিত হয়ে শিহাবের চিবুকে, কপালে হাত বুলাল। শিহাব মুচকি হাসল। তাকে আশ্বস্ত করে বলল,

‘জ্বর আসেনি। এমনি মাঝে মাঝে আমার শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। গোসল করলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এসব বাদ দাও। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।’

নিতু বালিশে মাথা রাখল। খুব চেষ্টা করেও চোখমুখ থেকে আতঙ্কের ভাব সরাতে পারল না। সে চোখ বন্ধ করল। শিহাব তার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিল। নিতুর শ্বাস ভারী হয়ে আসতে উঠে পড়ল।

ওয়াশরুম থেকে পানি ছাড়ার শব্দ কানে আসতে নিতু ধপ করে চোখ খুলল। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। এসব কি হচ্ছে তার সাথে? সে আস্তে করে উঠে গিয়ে আরেকবার বারান্দা পরখ করল। বারান্দার কোথাও সিগারেটের টুকরো নেই। শিহাবের গা থেকেও গন্ধ আসেনি। তার চেয়ে বড় কথা। সে স্পষ্ট দেখেছে বারান্দায় কোনো জনমানবের চিহ্ন ছিল না।

সে আর ভাবতে পারছে না। খুব অসহায় লাগছে। এমন কি হয়েছে যে সে আসলে বারান্দায় আসেনি? শিহাব সত্যি সত্যি বারান্দায় ছিল? এটা তো হওয়ার কথা নয়। ওয়াশরুম দেখার আগে সে বারান্দায় খুঁজেছিল।

বড্ড অসহায়ত্ব নিয়ে সে ফের বালিশে মাথা রাখল। তার আর ঘুম এলো না। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওয়াশরুমের পানে। ভেতর থেকে অবিরত পানি ছাড়ার শব্দ আসছে।

ঘন্টাখানেক পর ওয়াশরুমের ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো। নিতু চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করল। ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হলো। তারপর বরফ শীতল এক দেহ তাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরল। নিতু নড়েচড়ে উঠল। শিহাব তার কানের লতিতে চুমু খেয়ে ডাকল,

‘বউ!’

এতক্ষণের সন্দেহ, উসখুসানি সমস্ত কিছু কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। কর্পূরের মতো উবে গেল সমস্ত ভাবনা। নিতু পাশ ফিরে শিহাবের উন্মুক্ত শীতল বুকে মুখ লুকাল। শিহাব তার গালে, ঠোঁটে, বুকে, পিঠে নিজের স্পর্শ গাঢ়তর করল। নিতুও সাড়া দিল। এই মানুষটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। মানুষটা জানে সেটা?

______

ভরদুপুর। নিতু বারান্দায় এসে দাঁড়াল। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। গহীন অরণ্য! দুপুর সূর্যের আলো পড়ে বনের গাছপালা ঝিকঝিক করছে। মুক্ত বাতাস। নিতু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। যত দিন যাচ্ছে, এই সবুজ অভয়ারণ্য তত আপন হয়ে উঠছে তার।

শিহাব বাসায় নেই। তার নয়টা-পাঁচটা অফিস। সে বনবিভাগে কর্মরত। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্বে আছে। শিহাবের চাকরি সূত্রে তাদের এই সবুজ অরণ্যে বসবাস। খুব ছোটবেলা থেকে নিতুর সবুজের প্রতি আলাদা একটা টান। তার জন্যই কি শিহাবের সাথে তার পরিচয় হলো? অনাকাঙ্খিত ভাবে জীবন জড়িয়ে গেল? এতে সে অবশ্য ভীষণ খুশি।

দূর থেকে হঠাৎ পুলিশের গাড়ির শব্দ ভেসে এলো। নিতু খানিক চমকে গেল। হঠাৎ পুলিশ এসেছে কেন? কারো কোনো বিপদ হয়নি তো? সে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করল। পারল না। সরে এলো।

দুদিনের ময়লা জমে আছে। নিচে ফেলে আসার সময় নিতু ঘটনাটা শুনল। তাকে পুলিশ আসার কারণ জানাল সিরাজ সাহেবের স্ত্রী। সিরাজ সাহেব বনবিভাগে রিসার্চ সহকারী হিসেবে আছে। শিহাবের মুখ থেকে তার ব্যাপারে শুনেছিল একবার।

সে জানাল,

‘নিতু, শুনেছ কি না! বনে একটা লা শ পাওয়া গেছে। লা শের সারাদেহ ক্ষত বিক্ষত। হৃদপিন্ডটা কেউ যেন খু বলে খেয়েছে। মনে হচ্ছে হিং স্র কোনো জন্তুর কাজ।’

‘সে কি!’

নিতুর ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। এতগুলো দিন হলো এই জঙ্গলে আছে। এমন ঘটনা তো কখনো শুনেনি। সে কোনরকমে বলল,

‘লা শটা কার ভাবি? খোঁজ পাওয়া গেছে?’

‘এখনো পাওয়া যায়নি। চেহারা দেখে নাকি বুঝার উপায় নাই। পুলিশ এসেছে শুনলাম।’

নিতু আর দেরি করল না। তার শরীর টলছে। সে কোনরকমে রুমে চলে এলো। তার কপাল জুড়ে চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠেছে। মন কেন জানি কু ডাক গাইছে। কালরাতে সে শিহাবকে ঘরে পায়নি। আবার কালরাতেই বনে একজন মানুষ ম রতে হলো? এই দুটো ঘটনার মধ্যে কি কোনোভাবে যোগসূত্র আছে? ধুর ছাই! সে কিসব আবোল তাবোল ভাবছে।

মনে মনে নিজেকে বকা দিল নিতু। তার এইসব উদ্ভট ভাবনার জন্য এক ধরনের অপরাধবোধ সৃষ্টি হলো। শিহাব তার স্বামী। তারই মতো রক্ত মাংসের মানুষ। তাকে নিয়ে এসব কি ভাবছে সে! ছিঃ! নিজের সমস্ত ভাবনাকে দূরে সরিয়ে সে কাজে মনোযোগ দিল।

বিকেলের মধ্যে শিহাব প্রতিদিন বাসায় ফেরে। আজ নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। সে ফিরছে না। দেরি হচ্ছে দেখে নিতু আবার চিন্তায় পড়ে গেল। বার বার বারান্দায় গিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। শিহাব আজ এতো দেরি করছে কেন?

চারিদিক সন্ধ্যা নামছে। রক্তিম সূর্য পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে গেছে। তখন রাস্তা দিয়ে শিহাবকে আসতে দেখা গেল। তাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নিতু। অপলক তাকিয়ে রইল শিহাবের পানে। আবারো সুদর্শন, বলিষ্ঠ দেহের মানুষটার প্রেমে পড়ল।

নিতুর তাকিয়ে থাকা অবস্থায় শিহাব বিল্ডিং এ ঢুকল। সে চোখ ফেরানোর আগেই ডোরবেল বেজে উঠল। আকস্মিক শব্দে খানিক চমকে উঠল সে। শিহাব তো এত তাড়াতাড়ি তিনতলায় পৌঁছানোর কথা নয়। এই অসময়ে আবার কে এলো?

সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। দেখল, দরজার ওপাশে শিহাব দাঁড়ানো। তার ঠোঁটের কোণায় অদৃশ্য এক হাসির রেখা ফুটে আছে।

(চলবে)

জীবনের গোপন ডাকবাক্স পর্ব-১৩

0

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

“মা আমি আর ঐ বাড়িতে কোনোদিন ফিরে যাবো না।”
—-এটা তুই কি বলছিস? স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এরকম হালকা পাতলা মান অভিমান হয়েই থাকে। তাই বলে কেউ নিজের সোনার সংসার ফেলে আসে? এটা একমাত্র বোকারাই করে।
—-মা এটা হালকা পাতলা নয়। তুমি কিছু জানো না বলেই একথা বলছো। এখন এবিষয়ে আর কিছু বলতে চাইছি না। আমি প্রচন্ড ক্ষুধার্ত।আমাকে কিছু খেতে দাও।
—-তুই ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়। আমি তোর জন্য খাবার আনছি।
সাথী ক্লসেট থেকে একটা ম্যাক্সি বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আসলে ওর পুরো শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। ঢিলাঢালা জামা পড়তে ইচ্ছা করছে। এমনকি মাথার চুলের গোড়াগুলো পর্যন্ত প্রচন্ড ব্যথা করছে। ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে কামিজটা খুলে ম্যাক্সিটা পড়তে গিয়েই আয়নাতে রোশানের আঘাতের চিহ্নগুলো চোখে পড়লো। ঘাড়ের কাছে, বুকে কোমরে তলপেটে ওর আঘাতের চিহ্নগুলো কালশিটে হয়ে আছে। রোশান ওকে বলতো এমন জায়গায় আঘাত করবে যা ও কাউকে দেখাতে পারবে না। হঠাৎ ওর মনে পড়লো সারাজীবন ওর বোন দিতির পিছনে ও লেগে ছিলো। সবসময় দিতির ক্ষতি করার চেষ্টা করতো। কিন্তু দিতি নিরবে ওর অত্যাচারগুলো হজম করেছে। শুধু ফাহিমভাইকে যখন ও মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ফাসিয়ে দিলো সেদিনই ওকে শুধু একটা থাপ্পড় দিয়েছিলো। বিনা অপরাধে ও বোনটার পিছনে সারাজীবন লেগেছিলো। অথচ আজ রোশান ওকে বিনা অপরাধে এভাবে দু,মাস ধরে আঘাত করে গেল। ও দুমাস সহ্য করে সম্পর্ককে জলাঞ্জলি দিয়ে ফিরে আসলো। আর ওর বোনটা এতোদিন ধরে সহ্য করে গেল। হয়তো সেই অপরাধের ফল ওকে এভাবে ভোগ করতে হলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ওর মা সালেহা খাতুন প্লেটে করে ভাত নিয়ে এসেছেন। সাথী দুগাল খাইয়ে দিতেই ও আর খেতে চাইলো না। দিতির সাথে করা অপরাধের গ্লানি ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো। ও পানি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ওর মা জোর করলো কিন্তু এতে কোনো লাভ হলো না। কিচেনে এটো প্লেট রেখে হাত ধুয়ে সালেহা বেগম মেয়ের পাশে এসে বসলেন। এবং মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য বুঝানোর চেষ্টা করলেন। মায়ের কথায় বিরক্ত হয়ে সাথী একসময় শোয়া থেকে উঠে বসলো। তারপর ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তোমার কাছে আমার জীবনের মুল্য বেশী নাকি আমার বড় লোক শ্বশুর বাড়ির মুল্য বেশী।
—-থাক,এতো বড় বড় কথা বলতে হবে না। ডিভোর্স হয়ে গেলে এই সমাজ তোর দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে তুই ডিভোর্সি। তোর চরিত্রে ঝামেলা আছে বলেই তোকে ডিভোর্স দেওয়া হয়েছে। সমাজের এই কটু কথাগুলো সইতে পারবি তো?
—-আগে হলে পারতাম না। এখন সব সয়ে নিতে পারবো। কারণ এগুলো আমার পাপের শাস্তি।
এরপর ওর ঘাড়ের কাছে চুলগুলো সরিয়ে মাকে দেখালো। ওখানে একটা তীব্র কালশিটে দাগ পড়ে আছে। সালেহা বেগম চমকে উঠলেন। সেদিকে তাকিয়ে সাথী কাষ্ঠ হাসি হেসে বললো,
—-এটা তো কিছুই না। আমি তোমার সামনে উলঙ্গ হতে পারলে বুঝতে ও আমাকে কিভাবে নির্যাতন করেছে। সেই বিয়ের দিন থেকে কাল অবধি একদিনের জন্য ও বাদ দেয় নাই। প্রতিরাতে মদ খেয়ে এসে আমার উপর অত্যাচার করতো। ছোটোবেলা থেকে বাবা মায়ের আদর ভালোবাসা না পেয়ে বড় হয়েছে। তাই ওর মাঝে মায়া মমতা ভালোবাসা কোনো কিছুর অবশিষ্ট নাই। আমার পক্ষে ওর সাথে আর থাকা সম্ভব নয়।
সালেহা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। সোলেমান সাহেব রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সবটা শুনে বললেন,
—-তোমার মেয়ে নাকি ভালোবেসে বিয়ে করেছে? তাহলে ছেলের এই বিষয়গুলো ওর চোখে পড়েনি? আমার তো প্রথম দেখেই মনে হয়েছিলো এই ছেলের চরিত্রে ঘাপলা আছে। তখন তো মা মেয়ে ছেলের হয়ে সাফাই গাইলে।
ছেলের টাকা পয়সা দেখে তোমরা মা মেয়ে চোখে ঠুলি পড়েছিলে।
সালেহা বেগম শুনেই গেলেন। আজকে উনার আর কিছু বলার মুখ নেই। সোলেমান সাহেব মাগরিবের নামাজ পড়ে সান্ধ্যকালীন চা খেয়ে সাথীর রুমে গিয়ে দেখেন, ও ঘুমের মধ্যে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে আর বলছে,
“রোশান তুমি আমাকে এভাবে আর কষ্ট দিও না। আমি নিতে পারছি না। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও।” ডিম লাইটের মৃদু আলোতে সাথীর মুখটা দেখে উনি চমকে উঠলেন। মেয়ের মুখটা বড্ড ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। উনি একসময় সাথীর মাথায় হাত রাখেন। সাথে সাথে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সাথী চমকে উঠে ওর বাবার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সোলেমান সাহেব আলতো করে ধাক্কা মেরে বললেন,
—–তুই ওভাবে কেন তাকিয়ে আছিস। ভালো করে দেখ আমি তোর বাবা।
একসময় ঘুমের রেশ কেটে গেলে সাথী অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসে। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-আব্বু কাল আমাকে একটু কোর্টে নিয়ে যাবে?
—+কেন?
—-ফাহিম ভাইয়ের উপর করা আমি আমার মামলাটা তুলে নিবো।
সোলেমান একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—-সেই তো সঠিক লাইনে ফিরলি তবে বড্ড দেরী হয়ে গেল।
আমেনা খাতুন ঘরে বসেই বুঝতে পারছেন সাথীর সাথে খারাপ কিছু একটা হয়েছে। উনি ভাবছেন,কর্মফল মানুষকে আসলেই ভোগ করে যেতে হয়। হঠাৎ উনার দরজায় কড়ার নাড়ার শব্দ শুনে ভাবছেন,
এখন আবার কে এলো? সোলেমান তো রাত দশটার দিকে এসে দেখা করে যায়। আর সালেহা বেগম তে ভুলেও উনার মুখ দর্শন করেন না। এখন তো রাত আটটা বাজে। হাঁক দিয়ে বললেন,
—-কে?
—-আমি সাথী দাদীমা।
উনি এসে দরজা খুলে সাথীর দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন। মেয়ের চেহারার একি হাল হয়েছে। সাথীর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন,
সাথী দাদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আমাকে তোমার ঘরে ঢুকতে দিবে না?
সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন,
—-আয়,ভিতরে আয়।
—-অবশেষে আসতে বললে আমায়,ভেবেছিলাম দরজা থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবে।
—-সবাইকে নিজের মতো ভাবা ঠিক নয়।
সাথী জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টিটা মেলে ধরে বললো,
—+দাদী আমার সংসারটা ভেঙ্গে গেছে।
ও আর কিছু বলতে পারলো না। কান্নাগুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসলো। চোখের কোন বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমেনা বেগমের চোখ এড়িয়ে ও মুছে ফেললো। সাথীর কথা শুনে আমেনা বেগমের মনটা খারাপ হয়ে গেল। উনি একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ভাবছেন উনার ছেলে এই কষ্ট কিভাবে সামলাবে? দুটো মেয়ের জীবনে সুখ আসলো না। দাদীকে চুপ থাকতে দেখে সাথী বললো,
—–কিছু বলছো না যে?
—+কি বলার আছে এখানে? তুই তো নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিস। ছেলেকে ভালো করে দেখিসনি?
—আসলে এগুলো আমার পাপের শাস্তি। আর একটা কথা তুমি শুনলে খুব খুশী হবে। কাল কোর্টে গিয়ে ফাহিম ভাইয়ের কেসটা তুলে নিবো।
এ কথা বলে সাথী আর অপেক্ষা করলো না। ওঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাতে ও ডিনার না করেই শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুমাতে পারলো না। সারা রাত এপাশ ওপাশ করে পার করে দিলো। আসলে ছোটো বেলা দিতির উপর ও অনেক অন্যায় করেছে। আজ সেগুলো ওর অন্তরটাকে তুষের আগুনের মতো পুড়িয়ে মারছে।

খুব ভোরে উঠে ও রেডী হয়ে সোলেমান সাহেবকে তাড়া দিতে লাগলো। সোলেমান সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-কেবল তো আটটা বাজে। কোর্ট বসবে দশটায়। এতো আগে গিয়ে কি করবো?
সালেহা বেগম মামলা তুলে নেওয়ার কথা শুনে রেগে গিয়ে সাথীকে বললো,
—-আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া উচিত।
সোলেমান সাহেব রেগে গিয়ে বললেন,
—+নিজের মেয়ের এতো বড় সর্বনাশ ঘটার পরেও তুমি পরিবর্তন হলে না। একেই বলে কুত্তার লেজে হাজারো তৈল মর্দন করলে তা কখনও সোজা হয় না।
সাথী ওর মায়ের উপর রেগে গিয়ে বললো,
–+-তুমি আমার ব্যাপারে আর নাক গলাবে না। আমাকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও।
সাথী আর সোলেমান সাহেব দ্রুত কোর্টে চলে গেলেন। উকিলের কাছে মামলা তুলে নেওয়ার দরখাস্ত জমা দিয়ে আসলো। এরপর কোর্ট থেকে শুনানী দিন ধার্য করা হবে। জর্জ সাহেব দুপক্ষের কথা শুনে এরপর মামলা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।

শুনানীর দিন সাথী আর ওর বাবা সোলেমান সাহেব যথাসময়ে কোর্টে পৌঁছে গেলেন। ওদিকে দুপক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারক মামলা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সাথী কোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দিতির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
—-যদি পারিস আমাকে ক্ষমা করে দিস।
একথা বলে সাথী ওর সামনে থেকে চলে গেল। দিতি ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। শুনেছিলো অনেক বড় ঘরে ওর বিয়ে হয়েছে। তাহলে আজ ওর এ অবস্থা এমন হলো কেন? দিতির শরীরটাও ভালো না। একদম এ্যাডভান্স স্টেজে আছে। দিতির সাথীর সাথে কোনো কথা বলতে ইচ্ছে না। ও আসলে ফাহিমকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মামলা তুলে নেওয়ার পর জেলগেটে গিয়ে ওরা দাঁড়ালো। হতবিদ্ধস্ত অবস্থায় দীর্ঘ আটমাস পর ফাহিম জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। ছেলেকে বুকে পেয়ে আকরাম সাহেব নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। এদিকে সন্ধা নামতে শুরু করেছে। একটু আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ফাহিম এরপর দিতির কাছে এসে ওকে শক্ত কর জড়িয়ে ধরলো। ফাহিমকে পেয়ে আজ দিতির চোখের পানি বাঁধনহারা হয়ে ঝড়তে লাগলো। আকাশে তখনও মেঘ রয়েছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। উনি দিতি আর ফাহিমকে তাড়া দিয়ে নিজে ড্রাইভারের পাশের বসলেন। পিছনের সীটে ফাহিম আর দিতি বসলো। ফাহিম বড্ড ক্লান্ত। গাড়িতে উঠেই সীটে পুরো শরীরটা এলিয়ে দিলো। দিতি ফাহিমের কাঁধের উপর মাথা দিয়ে রাখলো। আজ ওর বড্ড সুখের দিন। এই মানুষটার জন্য ও কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে তা আল্লাহপাক জানেন। দিতি কাঁদছে ফাহিম গাড়ির ভিতর অন্ধকারে বসে ঠিক ন্বুঝতে পারছে। ফাহিম দিতির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ফিস ফিস করে বললো,
—-আজ থেকে তুমি আর কাঁদবে না। দেখলে তো সত্যের কল বাতাসে কেমন নড়ে।
ওদের বাড়ি পৌঁছাতে বেশ রাত হলো। দিতির ফুফু শাশুড়ী ক’দিনের জন্য যশোরে চলে গেলেন। বাড়ি পৌঁছে ফাহিম ওয়াশরুমে চলে গেল। কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে ভালেভাবে শাওয়ার নিলো। দিতি মিনারা খালাকে টেবিলে ভাত বাড়তে বললো। ওরা দ্রুত ডিনার করে ঘরে চলে গেল। আজকের আবহাওয়া বেশ সুন্দর। বৃষ্টি হওয়াতে শীতল হাওয়া বইছে। ফাহিম ঘরে এসে দিতিকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-জেলখানায় বসে আমি আল্লাহপাকের প্রতিদিন প্রর্থনা করতাম। আল্লাহপাক যেন আমাদের দু’জনকে আবারও মিলিয়ে দেন। মৃত্যু ছাড়া আমাদের যেন আর কখনও বিচ্ছেদ না ঘটে। আল্লাহপাক আমার দোয়া কবুল করেছেন।
সারারাত আজ ওদের দু’জনের চোখে ঘুম ছিলো না। এতোদিনের জমানো কথাগুলো দু’জন দুজনের মাঝে শেয়ার করলো।

অপরাধ প্রমানিত না হওয়ায় ফাহিম ওর চাকরি ফিরে পেলো। দিতি আবারও পড়াশোনা শুরু করলো। দিতির সংসারে সুখ যেন উপচে পড়তে শুরু করলো। কিন্তু সাথীর অবস্থা ক্রমে অবনতির দিকে চলে গেল। রোশান ওকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু দেনমোহরের টাকা সাথী পায়নি। যদিও অনেকে সোলেমান সাহেবকে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিলো। কিন্তু উনি রাজী হননি। কারণ জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করা সম্ভব নয়। সাথী আস্তে আস্তে সিজ্রোফেনিয়াতে আক্রান্ত হলো। ওকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। খবর পেয়ে দিতি আর ফাহিম ওকে দেখতে গিয়েছিলো। সাথীকে দেখে দিতির অনেক কষ্ট হলো। সাথীর উপর ওর অনেক রাগ ক্ষোভ ছিলো। কিন্তু এমন শাস্তি ও কখনও চায়নি। দিতি ওর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। সাথী দিতিকে চিনতে পারেনি। আপন মনে মনে বকবক করেই যাচ্ছে। দিতি ওকে কতোবার ডাকলো। কিন্তু সেই ডাক শোনার ব্যাপারে ওর কোনো হেলদোল নেই। সাথীর পৃথিবীটা যেন সবার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ওখানে কারো প্রবেশের অনুমতি নেই। ও এখন ওর নিজের পৃথিবী নিয়েই মহাব্যস্ত। সাথীর এমন পরিনতিতে ওদের পরিবারে সবাই একটা বড় ধাক্কা খেলো। সোলেমান সাহেব দিতির সংসারে ফিরে আসায় উনি খুশী হয়েছেন বটে তবে ছোটো মেয়ের এমন পরিনতি উনি মেনে নিতে পারেননি। সে কারনে সুস্থ মানুষ হঠাৎ স্ট্রোক করে বসলেন। দিতি এ্যাডভান্স স্টেজে থাকার কারনে বাপের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। তবে ফাহিম জামাই হয়েও ছেলের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছে। ছেলের এই অবস্থায় আমেনা বেগমও অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছেন। সাথীকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর সালেহা বেগম একদম নিরব হয়ে গিয়েছে। আপন মনে সংসারের কাজগুলো রোবটের মতো করে যায়। অথচ উনার একটু সহযোগিতায় এই সংসারটা কতনা সুখের হতে পারতো।

বন্ধুর এমন বিপদে আকরাম সাহেব সবকিছু ভুলে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। নিয়মিত খোঁজ খবর রেখেছেন। এরমাঝে দিতি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো। এই দুঃখের মাঝেও এই খবরটা দিতিদের পরিবারে একটু আনন্দ বয়ে আনলো। জীবন যেন এমনি। এখানে সব সময় জোয়ার ভাটার খেলা চলে।

সমাপ্ত।

জীবনের গোপন ডাক বাক্স পর্ব-১২

0

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাক বাক্স
পর্ব- বারো
মাহবুবা বিথী

রোশান নিজের বিরক্তি ও রাগ লুকিয়ে রেখে সাথীর প্রস্তাবে রাজী হয়। আসলে আজ অবধি রোশানকে কোনো মেয়ে এভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াইনি। সে কারনে সাথীকে নিজের করে পাওয়ার তরে একটা জেদ চেপে বসে। তাই রোশান ওর পরিবারে নিজের বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এতে ওর বাবা আফজাল চৌধুরী হাফ ছেড়ে বাঁচেন। ভাবলেন,ছেলে বুঝি তার উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। রোশানের মা নীলা চৌধুরীও ছোটোবেলা থেকে ছেলের উপর খুব একটা নজর রাখেননি। গর্ভনেস রেখে দিয়ে মা হিসাবে নিজের দায়িত্ব সেরেছেন। পার্টি নয়তো বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেশ বিদেশ ঘুরে নিজের জীবনটাকে পরিপূর্ণ উপভোগ করছেন। তেমনি রোশানো নিজের মতো করে সুখ খোঁজার চেষ্টা করেছে। এই সুখ খুঁজতে গিয়ে ও নিষিদ্ধ পল্লীতে যাওয়া থেকে শুরু করে কখনও বা সরাব পান করে জীবনের থ্রিল খোঁজার চেষ্টা করেছে।
যাইহোক রোশান বিয়ে করতে রাজী হওয়াতে সাথী ভীষণ খুশী। সাথীর আজ খুব আনন্দের দিন। রোশানের মা আসতে পারেননি। উনি এই মুহুর্তে সিঙ্গাপুরে আছেন। রোশানের বাবা রোশানকে সাথে নিয়ে লা মেরিডিয়ানে এসেছেন। এই খরচ উনিই বহন করবেন। সাথীর পরিবারের উপর উনি কোনোরকম চাপ দিতে নারাজ। এটা উনার সম্মান না করুনা সাথীর বাবা সোলেমান সাহেব সেটাই বোঝার চেষ্টা করছেন। রোশানের বাবা আফজাল চৌধুরী সাথে করে উনার কয়েকজন শুভাকাঙ্খি এনেছেন। ছেলের যেহেতু চারিত্রিক সমস্যা আছে সেক্ষেত্রে উনি খুব বেশী লোকজন নিয়ে আসেননি। আসলে ছেলের বিয়ে কতোদিন টিকবে এটা নিয়ে উনি নিজেই সন্দিহান। তাই খুব বেশী লোক জানাজানি করতে চাননি। এদিকে সাথী ওর বাবা মা আর দু’জন বন্ধুবান্ধব নিয়ে লা মেরিডিয়ানে চলে এসেছে। সাথীর দাদী আসেননি। কারণ উনিও বলে দিয়েছেন ফাহিম জেল থেকে ছাড়া না পাওয়া অবধি সাথী আর ওর মায়ের সাথে উনি কোনো সম্পর্ক রাখবেন না।একই বাড়িতে থেকে উনি আলাদা রান্না করে খান। সোলেমান সাহেব একটা রান্নার লোক রেখে দিয়েছেন।
সোলেমান সাহেব তার বন্ধু এবং বেয়াই আকরাম সাহেবকে দিতিকে সাথে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু দিতি সাফ ওর বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে ফাহিম যতদিন জেলখানায় বন্দী থাকবে দিতি সাথীর কোনো কিছুতে থাকবে না। এমনকি বাবার বাড়ির সাথেও তেমন সম্পর্ক রাখার পক্ষে দিতি রাজী নয়। এতে অবশ্য আকরাম সাহেব বাঁধা দিয়ে বলেছিলেন,
“সন্তান হিসাবে বাবার খোঁজ খবর করা তোমার জন্য ফরজ দায়িত্ব।”
দিতি অবশ্য কিছু বলেনি। তবে ওর ফুফু শাশুড়ী মোমেনা খাতুন দিতির উপরে খুব খুশী। সে তার ভাইকে বলেছে, “দিতি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
আকরাম সাহেবের বোনটার কোনো সন্তান হয়নি। সে কারনে নিজের স্বামীকে আবার বিয়ে দিয়েছেন। সেই ঘরে আবার সন্তান হয়েছে। উনি আকরাম সাহেবের কাছেই বেশী থাকেন। তবে ফসল উঠার সময় মাসদুয়েক যশোর সদরে চাউনিয়া গ্রামে স্বামীর সংসারে গিয়ে থাকেন। এটা তার স্বামীর আদেশ। যদিও ছোটো বউ এবং ছেলে মেয়েরা মোমেনা খাতুনকে অনেক সম্মান করে। তারপরও উনি বছরের বেশীরভাগ সময়ে ভাইয়ের কাছে থাকেন। আকরাম সাহেবও বড় বোনকে মায়ের মতো সম্মান করেন।

যারফলে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ নিয়ে সাথীর বিয়ের আনুষ্টানিকতা কোনোরকমে সম্পন্ন হলো। সোলেমান সাহেবের কাছে রোশান এবং ওর বাবাকে খুব একটা পছন্দ হয়নি। টাকার অহঙ্কার যেন ওদের শরীর থেকে চুঁইয়ে পড়ছে। তবে সাথী কিংবা ওর মায়ের এসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। ওদের কথা বড়লোকদের ওরকম এক আধটু অহঙ্কার থাকে। ওটাই ওদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করে রাখে। সুতরাং এতে কোনো সমস্যা নেই। সাথী রোশানের ব্যাপারে সবই জানতো। কিন্তু ওর বিশ্বাস বিয়ের পর ও রোশানকে বদলে ফেলতে পারবে। বিশলক্ষ টাকা দেনমোহরে ওদের আকদ সম্পন্ন হয়। সাথীর পুরো শরীর যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো। সালেহা বেগম মেয়ের কপালে এতো সুখ দেখে আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু সোলেমান সাহেবের কাছে ভালো লাগেনি। উনি বরং রোশানকে নিয়ে একটু শঙ্কিত আছেন। আকদ এর পর যদিও সোলেমান সাহেব সাথীকে পাঠাতে চাননি। অনুষ্টান করে সাথীকে তুলে দিবেন। কিন্তু উনার এ চাওয়া ধোপে টেকেনি। রোশানের বাবার কথা হচ্ছে বিয়ে যখন হয়ে গিয়েছে তখন নতুন বরবউকে আলাদা রাখা ঠিক নয়। তাছাড়া সাথী রোশানের সাথেই এখন থাকতে চাইছে। এতে অবশ্য সাথীর মা সালেহা বেগমেরও সমর্থন আছে। অবশেষে সাথী শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা হয়।

রোশান আর সাথীকে নিয়ে আফজাল চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ঐ রাতে উনিও সিঙ্গাপুরে রওয়ানা দেন। একটা বড় ব্যবসায়িক ডিল হওয়ার কথা আছে। বাসরঘরে সাথী বসে আছে। রোশানের কোনো পাত্তা নেই। রাত বারোটা পার হয়ে ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁয়েছে। ঢংঢং করে দেওয়াল ঘড়িটা সেটাই জানান দিচ্ছিলো। সাথীর চোখদুটো একটু লেগে এসেছে। হঠাৎ কে যেন ওকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিলো। ও কাঁচাঘুমে ধরমড়িয়ে উঠে তাকিয়ে দেখে রোশান অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর রোশান ওর চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে বললো,
—-আজ তোর বিয়ে করার সাধ আমি চিরজনমের মতো মিটিয়ে দিবো।
সাথী অসহনীয় যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠলো। তবে সাথী বুঝতে পারছে, রোশান এখন পরিপূর্ণ ড্রাঙ্ক অবস্থায় আছে। ওকে কিছু বলে লাভ নেই। এরপর ওর সাথে যা ঘটলো ও তা কখনও কল্পনা করেনি। রোশান নরখাদকের মতো ওর পুরো শরীরটাকে খুবলে খেলো। একসময় ক্লান্ত হয়ে রোশান ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল। আর সাথী রক্তাক্ত বিদ্ধস্ত অবস্থায় পুরো রাতটা পার করলো। চোখের জলে ওর বালিশ ভিজলো। অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করলো। বিয়ে, বাসর এসব নিয়ে ওর অনেক স্বপ্ন ছিলো। সব যেন আজ তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়লো। খুব ভোরে বিছানা থেকে উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওয়াশরুমে গেল। গিজার অন করে গরম পানি দিয়ে গোসল করে এসে ডিভানের উপর গা,টা এলিয়ে দিলো। রোশান আধোঘুম আধো জাগরনে পাশে হাত দিয়ে সাথীকে খুঁজলো। কিন্তু বিছানা খালি পেয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে পাশে সাথী নেই। তারপর আয়নাতে চোখ পড়তেই দেখে সাথী ডিভানে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। রক্তাক্ত বিছানা দেখে সাথীর কাছে গিয়ে সরি হয়। সাথীও ভাবে, হয়তো ড্রাঙ্ক অবস্থায় ভুল করে ফেলেছে। তাই ও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রোশান প্রতি রাতেই ওর সাথে পশুর মতো আচরণ করে। সাথীও আস্তে আস্তে কেমন যেন হয়ে যায়। রাত আসলেই ওর মাঝে প্যানিক এ্যাটাক শুরু হয়। এরমাঝে সাথী একদিন রোশানের এমন আচরনের জন্য প্রতিবাদ করেছিলো। এতে রোশান তেঁতে উঠে বলে,
—+তোর জন্য এটাই প্রযোজ্য। এটা মেনে নিয়েই থাকতে হবে।
সাথীও রেগে গিয়ে বললো,
—-আমি তোমার নামে নারী নির্যাতন আইনে মামলা দিবো।
সাথীর কথা শুনে রোশান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এরপর সাথীর চুলের মুঠি ধরে বলে,
—-+আমাকে ফাহিম পাসনি। ফাহিমকে নিয়ে তুই যে ষড়যন্ত্র করেছিলি তা আমি মোবাইলে টেপ করে রেখেছি। আমার বিরুদ্ধে মুখ খুলবিতো ওসির কাছে সব চালান করে দিবো। তোকে তখন লেহার গরাদে রাখা হবে। এখন তো শুধু আমি ভোগ করি। তখন থানার ওসি থেকে শুরু করে কনস্টেবল সবাই তোকে চেটেপুটে খাবে। আর ফাহিমকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে দিবে।
ভয়ে সাথী আর মুখ খুলেনি।এভাবে মাস দুয়েক যাবার পর ও শ্বশুর বাড়ি বনানী থেকে মিরপুরে বাবার বাড়িতে চলে যায়। ভর সন্ধায় কে যেন কড়া নাড়ছে। সালেহা খাতুন একটু বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে সাথীকে এরকম বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠেন। হাত ধরে মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলেন,
—-এ কি হাল হয়েছে তোর? রোশান আসেনি?
—-না,আসেনি।
—–তোর এভাবে একা আশা ঠিক হয়নি।

চলবে

জীবনের গোপন ডাকবাক্স পর্ব-১১

0

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব- এগারো
মাহবুবা বিথী

ওসির কথা শুনে দিতি সাথীকে ছেড়ে ফাহিমের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
—-ওসি সাহেব এখনও কিন্তু প্রমানিত হয় নাই আমার স্বামীই অপরাধী। সুতরাং আপনি আমার স্বামীকে দোষী সাবাস্ত করতে পারেন না।
ওসি সাহেব চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
—+দরজা বন্ধ করে আপনার স্বামী কি সতী সাদ্ধি হিসাবে আপনার বোনকে সাজিয়ে রেখেছেন? এসব কথা আমার সামনে বলতে আসবেন না। যেখানে আপনার বোন স্বাক্ষী দিলো আপনার স্বামী ওকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। সেখানে একজন রেপিস্টের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে আপনার লজ্জা করে না?
—+না করে না। কারণ একজন স্ত্রী একমাত্র বলতে পারে তার স্বামী কেমন চরিত্রের মানুষ। আর আমার বোনের কথা বলছেন তো? ও হচ্ছে মানসিক রোগী। সুতরাং ওর কথা বিশ্বাস করে একজন নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দিলে হাশরের ময়দানে আল্লাহপাকের কাছে আপনি কি জবাব দিবেন?
—+থাক, আপনাকে আর মানুষ চেনাতে হবে না। এই সব চোর ছ্যাচ্ছড় আর গুন্ডা বদমাশ নিয়ে আমরা সর্বক্ষণ কাজ করি। সুতরাং মানুষ আমরা ভালোই চিনি। কথায় আছে না চোরের মায়ের গলা বড়। আপনার অবস্থা হয়েছে ঐরকম।
ওসির কথা শেষ হওয়া মাত্রই সাথী চিৎকার দিয়ে বললো,
—-তোমার স্বামী আমাকে অসম্মান করা সত্বেও তুমি তোমার স্বামীর হয়ে কথা বলছো। বলবেই তো,কারণ সৎ কখনও আপন হয় না।
—এটা তোর ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য।
—-আপনারা চুপ করুন। আমাদেরকে কাজ করতে দিন।
ওসির ধমক শুনে ওরা দু’জন আপাতত চুপ করলো। তবে
দিতির কথাগুলো শোনার পর ফাহিম প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলো। এতোক্ষণ ও যেন একটা দমবন্ধ পরিবেশে ছিলো। ওর মনে হয়েছিলো দিতি মনে হয় ওকে সাপোর্টে করবে না। ওর কথাগুলো শোনার পর ফাহিম নিজেকে খুব হালকা অনুভব করলো। এবং একটু একটু করে সাহস বাড়তে শুরু করলো। সেই সাহসে ভর দিয়ে ও দিতিকে বললো,
—-তোমার ফোন থেকে আব্বুকে একটা কল দাও না। প্লিজ,
—-কি বলবো?
—+এখানে আসতে বলো।
—-আমার বোনের এরকম কর্মকান্ডে আমি বাবাকে কিভাবে মুখ দেখাবো?
—-সময়ের উপর ছেড়ে দাও।
দিতিকে ফাহিমের সাথে স্বাভাবিক কথা বলতে দেখে সাথী দৌড়ে এসে বললো,
—-আমি বুঝে পাই না ঐ রেপিস্টের সাথে তোমার কি এমন কথা থাকতে পারে? ওকে তোমার এখনিই ডিভোর্স দেওয়া উচিত।
সাথীর কথা শুনে দিতি কষে ওর গালে থাপ্পর বসিয়ে দিলো। দিতির এক থাপ্পড়ে ও ডিগবাজী খেয়ে পড়ে যেতেই ওর বাবা এসে সাথীকে ধরে ফেললো। সোলেমান সাহেবের সাথে দিতির দাদীও চলে এসেছে। মা মরা নাতনীটার এই বিপদে উনি আর বাসায় থাকতে পারলেন না। সাথীকে ধরে সোলেমান সাহেব দিতির দিকে তাকিয়ে বললো,
—-নিজের ছোটো বোনের উপর এ তোমার কেমন ব্যবহার?
—–তোমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করো ও আমার কতো বড় ক্ষতি করেছে। আমারতো ওকে খুন করতে ইচ্ছা করছে। ও ফাহিমের নামে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে আমার সংসারটা ভাঙ্গতে চাইছে।
দিতির দাদী সাথীর দিকে তেড়ে গিয়ে বললো,
—-ফোনে কিছুটা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম এই শয়তানী কিছু একটা ঘাপলা পাকিয়েছে। আজ তোকে বাড়ি নিয়ে শয়তানের আছর আমি তাড়াবো।
দিতির থাপ্পড়ের চাপটা কোনো রকমে সয়ে নিয়ে সাথী ওর বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে নিজের গালে হাত বুলিয়ে ভাবলো,আপুটার এতো পরিবর্তন কবে হলো। জন্মের পর থেকে আজ অবধি ওর গায়ে একটা ফুলের টোকাও দেয় নাই। সেই বোন আজকে ওকে আঘাত করলো। তবে ও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। মিথ্যা স্বাক্ষী দিয়ে হলেও ফাহিমকে ও জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে।
ওসি সাহেব উনাদের সবার বক্তব্য শুনে বললো,
—-কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যা বলছে সেটা আদালতে প্রমান হবে। এখন আপনারা আপনাদের মজলিশ বন্ধ করুন। আমাকে আসামীকে নিয়ে যেতে দিন।
ওসি কনস্টেবলকে ফাহিমের হাতে হাতকড়া পড়াতে বললো। দিতি দৌড়ে এসে ওসি সাহেবকে বললো,
—ওসি সাহেব ওকে থানায় নিবেন না। এটা আমাদের পরিবারের বিষয়। আমরা নিজেরা মিটিয়ে নিবো।
—-তা হয় না। আপনি আমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করবেন না। আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দিন।
এরপর দিতিও কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-তাহলে আমার স্বামীর সাথে আমাকেও নিয়ে যান।
সাথী দিতির কথাগুলো শুনে মনে মনে বললো,
—+ঢঙ্গির ঢং দেখে আর বাঁচি না। আর জামাইয়ের সুখ পেতে হবে না। এবার তোর স্বামী জেলের ভিতর পঁচে মরবে। তুই দেখবি আর হাহুতাশ করবি। আর কিছুই করতে পারবি না। এতোদিনে আমার মনের জ্বালাটা জুড়ালো।
আমেনা বেগম এসে দিতির পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
—–আল্লাহর রহমতে তোর কিছুই হবে না। তবে ওর কি হাল হবে সেটা শীঘ্রই বুঝতে পারবি।
সোলেমানসাহেব মা আর দুই মেয়ের কাহিনী দেখে তব্দা খেয়ে গেলেন। উনার কার পাশে দাঁড়ানো উচিত উনি বুঝতে পারছেন না।
ওসি সাহেব ফাহিমের হাতে হাতকড়া পরিয়ে উনাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। দিতিও কান্নাকাটি করে একটা সিএনজি ঠিক করে থানার দিকে রওয়ানা দিলো। দিতির সাথে ওর দাদীও রওয়ানা দিলো। সোলেমান সাহেব আরো একটা সিএনজি ভাড়া করে সাথীকে নিয়ে থানার পথে রওয়ানা দিলেন। দিতি এর মধ্যে ওর শ্বশুরকে ফোনে কিছুটা বললো। এবং উনাকে থানায় আসতে বললো। থানায় পৌঁছে সাথী ওসির কাছে মিথ্যা জবানবন্দী দিলো। আকরাম সাহেব বিদ্ধস্ত অবস্থায় থানায় আসলেন। দিতি ওর শ্বশুরকে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-বাবা আপনি যেভাবেই হোক ওর জামিন করানোর ব্যবস্থা করুন।
আকরাম সাহেব দিতিকে বললেন,
—- বিপদে ধৈর্য ধরতে হয়। তাহলে খুব সহজে বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এরপর বন্ধু সোলেমানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-আমার ছেলেকে আমি খুব ভালো করে চিনি। কিন্তু সাথী আজ যে কাজটা করলো এটা পরবর্তীতে ওর জীবনের উপর খারাপ প্রভাব ফেলবে।

সোলেমান সাহেবের আসলে বন্ধুকে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলেন না। নীরবে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কারণ ফাহিম বলেছে সাথী ওকে ডেকে এনেছে। আর সাথী বলেছে ও এখানে বেড়াতে আসছে বলে এমনি কুশলাদি জিজ্ঞাসা করার জন্য ফাহিমকে ফোন দিয়েছিলো। আর অমনি ফাহিম এসে ওর সাথে এই আচরণ করেছে। জন্মদিনের পার্টি করার কথা বলে সাথীর দু’জন বন্ধু এসে শেষ মুহুর্তে স্বাক্ষী দিলো। ওদের একজনের নাম রোশান আর একজনের নাম জারা। এতে ফাহিমের বিপদ আরো একটু বাড়লো। যদিও এদের দু’জনকে দিতি আজই প্রথম দেখলো। এও শুনলো কোচিং সেন্টারেই ওদের সাথে সাথীর বন্ধুত্ব হয়েছে।
এসব কথা শুনে আকরাম সাহেবের তার বন্ধু সোলেমানের জন্য খুব মন খারাপ হলো। সংসারের শাম্তির জন্য দিন রাত এক করে অর্থ উপার্জন করে গেছে। কিন্তু এদিকে সংসারে যে ঘুণ পোকা লেগে গিয়েছে তা ওর নজরে আসেনি। দিতির বিয়ের পরদিন সাথীর সাথে কথা বলে আকরাম সাহেবের সাথীকে খুব একটা পছন্দ হয়নি। তবে দিতির দাদী এসে আকরাম সাহেবকে বললেন,
—-চিন্তা করোনা বাবা,তোমার ছেলের কিছুই হবে না। বরং হিংসার বশবর্তী হয়ে বোনের সংসার ডুবাতে গিয়ে ঐ মেয়ে নিজের চরিত্রে কলঙ্ক লাগিয়ে ফেলেছে। সেই হুশ তো ওর এখন নাই। যখন হুশ ফিরবে তখন দেখবে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। আর এই কলঙ্কের দাগ ওকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

সাথী ওর মনের জ্বালা জুড়িয়ে ওর বাবা আর দাদীর সাথে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো। এদিকে রাত হয়ে যাওয়াতে কোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে আজকে আর জামিনের ব্যবস্থা করা গেল না। তবে আকরাম সাহেব জানেন এই মামলায় সহজে ফাহিমের জামিন হবে না। মনে মনে ভাবলেন নিজের শখ মেটাতে গিয়ে ছেলেটাকে উনি বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন। এই বিপদ থেকে ছেলেটা কবে উদ্ধার পাবে কে জানে? দিতি কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরের সাথে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
নিয়ম অনুযায়ী ফাহিমকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। অপরাধ প্রমানিত না হলে তাকে সসম্মানে চাকরিটা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এদিকে দিতির বাবার বাড়ির সাথে খুব একটা সম্পর্ক নেই। আদালতে মামলা চলছে। সোলেমান সাহেব সাথীকে মামলাটা উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু সাথীর মা সালেহা বেগম বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সাথীও ওর আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আকরাম সাহেব মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তবে দিতির মা হওয়ার খবর পেয়ে মানসিক শক্তি মনে হয় কিছুটা ফিরে পেলেন।

এরমাঝে ছ’মাস পার হয়ে যায়। সাথী পাবলিক কোনো ভার্সিটিতে চান্স না পেয়ে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। রোশান আগে থেকেই ব্রাকে পড়তো। সাথীর থেকে দু’বছরের সিনিয়র। জারার মাধ্যমে রোশানের সাথে সাথীর বন্ধুত্ব হয়। রোশানের বাবা একজন নামিদামী বিজনেসম্যান। ওরা অনেক বড়লোক। আর রোশানও হচ্ছে প্লেবয় টাইপের ছেলে। ও সাথীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো। সাথী তখন ওকে একটা শর্ত দেয়। শর্ত অনুযায়ী রোশান ফাহিমকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়। এখন শর্ত অনুযায়ী ও সাথীর সাথে সম্পর্কে জড়াতে চায়। কিন্তু সাথী এক্ষেত্রে বুদ্ধি খাটায়। রোশানকে হাতছাড়া করতে চায় না। ওর ধারণা প্রেম করে যদি রোশান ওকে ছ্যাঁকা দিয়ে চলে যায়। সে কারনে ওকে বিয়ে করতে বলে। এতে রোশান একটু বিরক্ত হয়। কেননা ওতো সেই ধরনের ছেলেই নয়। কারণ ও পোশাক বদলানোর মতো করে প্রেমিকা বদলায়।

চলবে

জীবনের গোপন ডাকবাক্স পর্ব-১০

0

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী

সাথী ফোনটা রাখার পর ফাহিম আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে কোনো রকমে গায়ে প্যান্ট শার্ট পরে নিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে পদ্মা রিসোর্টের দিকে রওয়ানা হলো। পরে মনে হলো পুলিশ সাথে নিয়ে রওয়ানা দিলে ভালো হতো। কিন্তু ওসব ফর্মালিটিস করতে গেলে দেরী হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। এতে সাথীর অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এর থেকে বরং আগে ঘটনাস্থলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে। কিন্তু ফোন তো করাই যায়। পকেটে হাত দিয়ে দেখে ফোনটা আনা হয়নি।কি আর করা। ভাবছে আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সাথীকে উদ্ধার করতে হবে। ঘন্টাখানিকের মধ্যে ফাহিম রিসোর্টে পৌঁছে যায়। সাথীর নির্দেশিত কটেজের সামনে গিয়ে ও কোনো হট্টগোল কিংবা মাস্তানটাইপের কাউকে দেখতে পায়নি। ও একটু অবাক হলো। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। ফাহিম একটু ভয় পেয়ে গেল। ভাবলো,ওকে আবার ওরা তুলে নিয়ে গেলো নাতো? সাথী যেভাবে ফোনে ওকে বললো তাতে এখানে বেশ ঝামেলা হওয়ার কথা। কটেজের সামনে গিয়ে দরজা নক করতেই সাথী দরজা খুলে হাসিমুখে ফাহিমকে আমন্ত্রণ জানালো। তখনও ফাহিম জানে না ওর জন্য আজকে কি দিন অপেক্ষা করছে। ফাহিম রুমে ঢুকে সাথীকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তুমি ফোনে যা বললে তার কিছুই তো আমি দেখতে পেলাম না?এদিকে দিতি রওয়ানা দিয়েছে। ডরমেটরীতে এসে আমাকে না পেলে চিন্তা করবে।
সাথী ফিঁচেল হাসি দিয়ে বললো,
—+ডরমেটরীতে যাওয়ার দরকার নেই। ওকে এখানে আসতে বলে দেই। একটু পরেই একটা নাটক মঞ্চস্থ হবে।
—-কি বলছো এসব? এতো রহস্য করে কথা বলা আমার পছন্দ না। সবকিছু খুলে বলো।
—–এতো তাড়া কিসের! আস্তে আস্তে সবই বলবো।
একথা বলে সাথী মিটমিট করে হাসতে লাগলো। এরমাঝে দিতিকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে পদ্মা রিসোর্টে আসতে বলে দিলো। সাথে সাথে এটাও জানিয়ে দিলো রিসোর্টে না আসলে ও ফাহিমের খারাপ চরিত্রের মুখোশটা দেখতে পারবে না। ফাহিমের কাছে সাথীর আচরণ একদম স্বাভাবিক লাগছে না।এরমধ্যে সাথী দরজা লাগিয়ে দিয়ে ফাহিমকে শক্ত জড়িয়ে ধরে বললো,
—+আপনি আপুকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করুন। আমি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না। তাই কৌশল করে আপনাকে ডেকে আনলাম।
ফাহিম ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
—+এসব তুমি কি বলছো? আমার দ্বারা কোনোদিন একাজ করা সম্ভব নয়। আমি দিতিকে ভালোবাসি।
সাথী আহত বাঘিনীর মতো ক্ষেপে গিয়ে বললো,
—মাই ফুট ভালোবাসা। আপুর মাঝে যা আছে আমার মাঝেও তাই আছে। বরং আমি একদম কচি ডাবের শাঁস। আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে দেখেন আপনার আর আমাকে ছাড়তে মন চাইবে না।
একথা বলেই সাথী টান দিয়ে ওর জামার বুকের অংশ ছিঁড়ে ফেললো। ফাহিম ওর পাগলামী দেখে রেগে গিয়ে বললো,
—-তুমি একটা সাইকোপ্যাথ। তা,না হলে কেউ নিজের বোনের স্বামীর সাথে এমন আচরণ করতে পারে না।
ফাহিমের কথা শুনে সাথী তেঁতে উঠে বললো,
—-এখনও সময় আছে আপনি আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান। তা,না হলে আপনার জন্য খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। আর একটা অপশন আপনার জন্য বরাদ্দ আছে।
—-কি,
—-আমাকে বিয়ে করতে হবে না। শুধু আপনার বউকে তালাক দিলেই হবে।
—এ অন্যায় আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।
—+তাহলে আর কি?জেলের ভাত খাওয়ার জন্য তৈরী হোন। তখন এমনিতেই আপনার বউ আপনাকে ডিভোর্স দিবে। আর যাই হোক একজন চরিত্রহীন লম্পট চরিত্রের মানুষের সাথে আমার বোন ঘর করবে না।
ফাহিম ওর কান্ডকারখানা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
—তুমি পাগলের মতো আচরণ কেন করছো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি শান্ত হও।
আবারও খ্যাক খ্যাক করে বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো,
—-আমাকে শান্ত হতে হবে না। আমার প্রস্তাবে রাজি না হলে আপনিই চিরজনমের মতো শান্ত হয়ে যাবেন।
ফাহিম রেগে গিয়ে বললো,
—-আমার পক্ষে তোমার এ প্রস্তাব মানা কিছুতেই সম্ভব নয়। এতে তোমার যা খুশি করতে পারো।
এরপর সাথী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে লাগলো। হোটেলের বয় বেয়াড়া ছুটে এসে দরজা নক করতে লাগলো। সাথী ওদের সাড়া পেয়ে চিৎকার করে বললো,
—-আপনি দুলাভাই হয়ে আমার এতোবড় সর্বনাশ করবেন না। আমি আপনার পায়ে পড়ছি।
এরপর নিজের চুলটা এলোমেলো করে দৌঁড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো। ততক্ষনে রিসোর্টের ম্যানেজার চলে এসেছে। সাথীকে দেখে বললো,
—আপনি তো আজ সকালে এসেছেন?এখানে তো জন্মদিনের পার্টি হওয়ার কথা?
সাথী কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-জ্বী,
এরপর ফাহিমের দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার বললো,
—-উনি কে?
—-আমার বোনের হাজব্যান্ড।
—-উনি এখানে কেন?
—-উনি আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে একজন। আমার বোনও পথে আছে। কিন্তু উনি রুমে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেডে শুইয়ে দিলো। আমি বাঁধা দেওয়াতে দেখেন আমার জামা কাপড় সব ছিঁড়ে ফেলেছে। এর আগেও আরো দু’বার চেষ্টা করেছিলো। কপাল গুনে বেঁচে গিয়েছিলাম।
এরপর হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে সাথী বললো,
—-আপনারা পুলিশে খবর দেন। এই রেপিস্টটাকে ধরে নিয়ে উচিত শিক্ষা দেওয়া উচিত।
একথা বলে আবারও কাঁদতে শুরু করলো। সাথীর আচরনে ফাহিম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। সাথীর সাথে তো ওর কোনো শত্রুতার সম্পর্ক তৈরী হয়নি। তাহলে ও এমন কেন করলো? ও কি করবে বুঝে পাচ্ছে না। ম্যানেজারকে কিছু বলতে চাইলে উনি বলেন,
—-আপনার যা বলা দরকার সেটা পুলিশের সামনেই বলবেন।
সাথীর ব্যবহারে ফাহিম প্রচন্ড ধাক্কা খেলো। আজ অবধি ওর জীবনে এতো বড় ধাক্কা আসেনি। বিপদ যখন আসে সবদিক থেকে আসে। আজ ফোনটাও আনতে ভুলে গেছে। ওর মনে হচ্ছে পায়ের তলার মাটিটা সরে যাচ্ছে। ও যতটুকু দিতিকে দেখেছে, সাথীকে ও খুব ভালোবাসে। সেক্ষেত্রে ওর কথা বিশ্বাস না করে যদি সাথীর কথা বিশ্বাস করে ভুল বুঝে দূরে সরে যায় তাহলে এতো অপমান নিয়ে ওর পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। অপরদিকে নারী নির্যাতন আর শিশু আইনে মামলা হলে জামিন তো হবেই না বরং চাকরি থেকে ওকে আপাতত সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। এরপর ডিপার্টমেন্টাল মামলা রজু করা হবে। ও জানে সামনে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে। ওদিকে ওর আব্বা এই ধাক্কা কিভাবে সামলাবেন ফাহিমের জানা নেই। ও ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। এবং হাত পা ছড়িয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে অপ্রকৃস্থিতের মতো বসে রইলো।
সাথী এর মাঝে ওর বাবাকে এখবর জানিয়ে দিলো। ওর বাবার এতোক্ষনে চলে আসার কথা। ফাহিমের অবস্থা দেখে মনে মনে কুটিল হাসি হেসে বললো,
—-বললাম বউটাকে ছেড়ে দে। আমার কথা শুনতে ভালো লাগলো না। এখন বুঝ ঠ্যালা।
এরমাঝে দিতি আর পুলিশ চলে আসলো। দিতিকে দেখা মাত্রই সাথী দৌড়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আর বললো,
—-আর একটু সময় পেলে ঐ রেপিস্টটা আমার সর্বনাশ করে ফেলতো।
সাথীর কথা শুনে দিতি ফাহিমের দিকে তাকালো। ফাহিম ও দিতির চোখের পানে তাকিয়ে ইশারায় বুঝাতে চাইলো, সাথী যা বলছে সব মিথ্যা বলছে। দিতিও ফাহিমের চোখে কোনো পাপ দেখতে পায়নি। কারণ ফাহিম ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো। পাপ করলে মানুষ কারো চোখের দিকে তাকাতে পারে না। লৌহজং থানার ওসি ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপনাকে তো ভালো মানুষ বলেই জানতাম।
ফাহিম রেগে গিয়ে ওসিকে বললো,
—-আপনি পুরো ঘটনা না জেনে এসব কি বলছেন?
—-জ্বি ঠিকই বলছি। যাদের ভিতরটা নোংরা তারাই উপরে উপরে খুব ভালো মানুষি দেখায়।
ফাহিম বুঝতে পারছে, এই ওসি তার পুরোনো শোধ তুলবে। একবার ওর কাছে এক সন্ত্রাসীর জামিনের জন্য সুপারিশ করেছিলো। ফাহিম যেন জামিন দেয় সেজন্য কিছু টাকাও অফার করেছিলো। ফাহিম তো টাকা নেয়নি উল্টো ঐ সন্ত্রাসীর জামিনও দেয়নি। আজ যখন ফাহিমকে বাগে পেয়েছে তখনতো ওকে নাকানি চুবানি খাইয়ে তারপর ছাড়বে।

চলবে

জীবনের গোপন ডাকবাক্স পর্ব-০৯

0

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী

ফাহিম আর দিতি হানিমুন প্যাকেজে হোটেল কক্স টুডে তে হানিমুন স্যুটে উঠেছে। ব্যাগটা রেখেই ওরা দুজন বুফেতে ব্রেকফাস্ট করে নিলো। এরপর বীচের দিকে বেরিয়ে পড়লো। সৈকতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেই দিতি ফেসবুকে পোস্ট করে দিয়ে মনে মনে ভাবলো,”সাথী এই ছবি টা দেখে অনেক খুশী হবে। ও হয়তো ভাবছে, ওর কারনে ওদের হানিমুন মাটি হয়ে গেল। বেচারা হয়তো মনে মনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এই ছবিটা দেখার সাথে সাথে ওর সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।”
দিতির আজকে ডাবল আনন্দ। কাল যখন শুনেছিলো সাথীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না সেই মুহুর্তে ওর পৃথিবীটা ভুমিকম্পের মতো দুলে উঠেছিলো। তখন মনে হয়েছিলো সাথীকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পাওয়াটা ওর সবচেয়ে কাঙ্খিত চাওয়া। অবশেষে সাথীর খোঁজ পেলো। পরম আনন্দে বাড়ি ফিরে মনে হয়েছিলো হানিমুন আজ হয়নি তো কি হয়েছে কাল হবে। বোনটাকে তো অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া গিয়েছে। তবে ফাহিমের জন্য ওর খারাপ লাগছিলো। পরীক্ষার কারনে এই মুহুর্তে ফাহিমের সাথে মুন্সিগঞ্জে যেতে পারবে না। বেচারা বড় শখ করে হানিমুনের ব্যবস্থা করেছিলো। না যেতে পারলে টাকার লোকসান তো হতোই মনের বোঝাপড়াটা অসম্পূর্ণ থেকে যেতো।
কিন্তু বাড়ি ফিরে যখন জানলো আগামীকাল প্লেনে ও কক্সবাজার যেতে পারছে ওর যে কি আনন্দ হয়েছিলো তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আজকের এমন একটা মধুরতম দিন ওর জীবনে আসবে ও কাল ভাবতেও পারেনি। আল্লাহপাকের অসীম রহমতে সব কিছু ভালোভাবে মিটে গেল। সাথীও বাড়ী ফিরে আসলো। এদিকে ওর ফুফু শাশুড়ী ওর শ্বশুরকে দিয়ে সকাল সাতটার প্লেনের টিকিট কেটে রেখেছিলো। ওর রিজিকে আল্লাহপাক লিখে রেখেছিলেন বলেই কোনো বাঁধাই আর বাঁধা হলো না। দিতি আজ ভীষণ খুশী। প্রিয় মানুষের সাথে সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে সুর্যোদয় আর সুর্যাস্ত দেখার আনন্দটাই একদম অন্যরকম।

সারি সারি ঝাউবনের মোহমায়া সাগরের উত্তাল জলরাশি আর বালুর নরম বিছানায় দিতি ফাহিমের প্রণয়ের আবেগে ভাসতে লাগলো। জীবন যে এতো সুন্দর হতে পারে দিতির ধারণা ছিলো না। মাকে হারিয়ে বড় হওয়া দিতির জীবনে ভালোবাসা ছিলো সোনার হরিণ। আজ আঁজলা ভরে ও স্বামীর ভালোবাসা গ্রহণ করছে। সমুদ্রের বালুকার গালিচায় দিতি ওর আর ফাহিমের নাম খুব গভীর করে লিখে ফাহিমকে বললো,
—-দেখো ঐ ঢেউ এসে আমাদের এই নাম কখনও মুছে ফেলতে পারবে না।
ফাহিম দিতির ছেলেমানুষীগুলো খুব উপভোগ করছে। তার পর দিতির কাছে খুব ঘণিষ্টভাবে বসে বললো,
—শুধু এই বালুর বিছানা কেন আমি তো তোমার নাম হৃদয়ে খোদাই করে লিখে রেখেছি। যেখান থেকে তোমার নাম কখনও মুছবে না। আল্লাহপাকের কালাম স্বাক্ষী রেখে তোমাকে আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য আমি গ্রহন করেছি। আমৃত্যু এই দায়িত্ব যেন আমি পালন করে যেতে পারি। আল্লাহপাক যেন আমাকে এই তওফিক দান করেন।
আনন্দ অশ্রুতে দিতির চোখের পাতাটা ভিজে গেল। আর মনে মনে গাফুরুর রাহীমের কাছে শোকরিয়া আদায় করলো।

অনেকক্ষণ সাগরের পানিতে দাপাদাপি করে রুমে ফিরে আসলো। গোসল করে যোহরের কসর নামাজ আদায় করে দিতি একটা নীল রঙের শিফন জর্জেটের শাড়ি পড়লো। হ্যাড ড্রায়ার দিয়ে চুলটা শুকিয়ে নিয়ে একটা পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকে শাড়ির সাথে ম্যাচ করে হেজাব পড়ে নিলো। মুখে হালকা প্রসাধনী ব্যবহার করলো। ফাহিম ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দিতিকে দেখে বললো,
—-তোমার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছি না। তোমাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
—-তাহলে হয়েছে,লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গেলে পেটে যখন ইঁদুর লাফানো শুরু করবে তখন আদর করার মজা বুঝবে। তাড়াতাড়ি কসর নামাজ পড়ে রেডী হয়ে নাও।
ফাহিমের একটু দুষ্টুমী করার ইচ্ছে ছিলো তাই হাত বাড়িয়ে দিতিকে ধরার চেষ্টা করলো। দিতি খিলখিল করে হেসে সরে গিয়ে বললো,
—-জনাব,সব রাতের জন্য তোলা থাক। এখন তাড়াতাড়ি চলো। আমার খুব ক্ষিদে লেগেছে। সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় মনে হয় খিদেটা বেড়ে যায়।

ওর খিদে লাগার কথা শুনে ফাহিম দুষ্টমীর চিন্তা আপাতত মাথা থেকে বাদ দিলো। দ্রুত রেডী হয়ে লাঞ্চ করে বীচে চলে আসলো। ফাহিমের এইআচরণটুকু দিতির খুব ভালো লাগলো। দিতির ইচ্ছেটাকে ও গুরুত্ব দিলো। সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে না। সারাটা রাত তো পড়ে আছে। আসলে দুজন দুজনকে কেয়ার করা, চাওয়া পাওয়ার গুরুত্ব দেওয়া,সর্বোপরি দুজনের দুজনকে বোঝার চেষ্টা করা। তাহলেই না জীবন অনেক সুন্দর হবে। দুজনে হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। সাগরের নীল জলের ঢেউয়ের সাথে দিতির নীল শাড়ি সব যেন মিলেমিশে একাকার। ফাহিমও দিতির সাথে ম্যাচ করে নীল রঙের পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা পড়ে নিয়েছে। দূর থেকে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন ভেসে আসছে। ফাহিম একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে মেরিন ড্রাইভের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো। রাস্তার একপাশে ফেনিল সাগরের ঢেউ আর অপর পাশে পাহাড় যেন ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ইনানী বীচে নেমে ফাহিম প্যারাসেলিং করতে চাইলো। দিতির ভয় লাগছে তাও বাঁধা দিলো না। ফাহিম প্যারাসেলিং শেষ করে ও আর দিতি মিলে কিছু ফটোশূট করলো। এমন সময় শ্রাবনের টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। এই সময়টাতে পর্যটকদের ভীড় কম থাকে। সেকারনে সৈকত অনেকটাই নিরিবিলি থাকে। হোটেল স্যুট গুলোতে ৫০% ডিসকাউন্ট থাকে। ফাহিমের জন্য সে কারনে এই খরচ বহন করা সহজ হয়েছে। নতুন চাকরিতে এতোটা ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য। ডিসকাউন্টের সুবিধা থাকায় ওর জন্য সহজ হয়েছে। ওরা দুজন আবার গাড়িতে উঠে বসলো। সন্ধা ঘণিয়ে আসছে। হোটেলের পথে রওয়ানা দিলো। সৈকত নিরিবিলি থাকলে যেমন ভালো লাগে তেমনি নিরাপত্তার বিষয়টা মাথায় রাখতে হয়। যদিও বীচের প্রহরায় পুলিশ থাকে তারপরও একটা দুটো অঘটন হঠাৎ ঘটে যায়। সেকারনে ফাহিম দিতিকে নিয়ে সন্ধার আলো আঁধারি নামার আগেই হোটেলে পৌঁছে গেল। ড্রেস চেইঞ্জ করে ওরা দুজন ক্যাফেতে চলে গেল। কফি আর স্ন্যাকস খেতে খেতে ওরা দুজন সমুদ্রের ঢেউ দেখতে লাগলো। সাগরের হিমেল হাওয়ায় মন প্রাণ সব শীতল হয়ে যায়। এরমাঝে ঝরছে শ্রাবনের টিপটিপ বৃষ্টি। শ্রাবনের বারিষধারার মাঝে অন্ধকার রাতে সমুদ্র দেখার আনন্দই আলাদা। দিতির কাছেও ভীষণ ভালো লাগছে। ভাগ্যিস ওর বিয়েটা শ্রাবন মাসে হয়েছে। রাতে ডিনার শেষ করে রুমে এসে দিতি রুমের লাগোয়া বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি স্পর্শ করতে লাগলো। ফাহিম একসময় দিতির পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ওর সরু কোমরটা জড়িয়ে ধরলো। ফাহিমের গভীর শ্বাস দিতির ঘাড়ের উপর পড়তে লাগলো। দিতি যেন এক অজানা শিহরনে কেঁপে উঠতে লাগলো। ফাহিমও হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি নিয়ে দিতির চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলো। ফাহিম একসময় দিতিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। বিয়ের একসপ্তাহ হতে চললো তবুও দিতির লজ্জা কাটেনি। ও ফাহিমের চোখের দিকে লজ্জায় বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। দিতির লজ্জাবনত মুখটা দেখতে ফাহিমের ভীষণ ভালো লাগছে। রাত গভীর হতে লাগলো। ফাহিম দিতিকে পাঁজাকোলা করে হোটেলের নরম বিছানায় শুয়ে দিলো।

দুদিন আনন্দে কাটিয়ে ওরা এয়ারে করে ঢাকায় ফিরে গেল। বাসায় ফিরতে ওদের সকাল দশটা বেজে গেল। কাল ফাহিমকে মুন্সিগঞ্জে ফিরতে হবে। এ কারনে দিতিকে নিয়ে ফাহিম বিকালের দিকে শ্বশুর বাড়িতে গেল। দিতির শ্বশুর আকরাম সাহেব ওকে বাবার বাড়িতে দুদিন থেকে আসতে বললেন। দিতিও অমত করলো না। ফাহিম দিতিকে নিয়ে সন্ধারদিকে শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে গেল। ওদের দুজনের সুখী সুখী চেহারাটা যেন সাথির শরীরে আগুন ধরিয়ে দিলো। দিতিকে রেখে ফাহিম বাসায় চলে আসলো। দিতিকে পেয়ে সোলেমান সাহেব ওর কাছে ওর শ্বশুর বাড়ির গল্প শুনতে চাইলেন। এবং মেয়ের জন্য সাথীর মাকে ওর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করতে বললেন। এতে যেন সাথীর জ্বালা আরো বেড়ে গেল। কিচেনে গিয়ে ওর মাকে বললো,
—–,আমার খুব অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে বিষ খাইয়ে ওকে মেরে ফেলি।
সালেহা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে শীতল স্বরে বললেন,
—-যুদ্ধে জিততে হলে অনেক সময় দু’পা পেছাতে হয়। কথাটা মনে রেখো।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে দিতি সাথীর রুমে চলে গেল। ইচ্ছে ছিলো দু’জন মিলে সারা রাত গল্প করবে। কিন্তু সাথী মাথা ব্যথার কথা বলে দিতির কাছ থেকে এড়িয়ে থাকতে চাইলে। অগত্যা দিতি দাদী আমেনা বেগমের কাছে চলে গেল। আমেনা বেগম দিতিকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে বললেন,
—-বিয়ের পর কখনও স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থেকো না। এতে সম্পর্কের গভীরতা হতে সময় লাগে।
—–কিম্তু আমার তো পরীক্ষা আছে। তাছাড়া এখন পড়ালেখা শেষ হয়নি।
—-ঠিক আছে। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতে ওকে তোমার কাছে চলে আসতে বলবে। ও আসতে না পারলে তুমি ওর ডরমেটরীতে চলে যাবে।
সাথীর আচরনে ও একটু অবাক হলো। সাথী কেন যেন ওর সাথে স্বাভাবিক হতে পারছে না। ওর ছোটো মাও কেন যেন স্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারছেন না। সবদিক বিবেচনা করে দিতি শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো।
দু,মাস ভালোই কাটলো। ফাহিম এই শুক্রবারে ঢাকায় আসতে পারবে না। ঢাকা থেকে সচিব মহোদয় যাচ্ছেন তাকে প্রটোকল দিতে হবে। দিতির সাথে কথা হয়েছে। ফাহিম ওকে শনিবারে আসতে বলেছে। ড্রাইভার দিতিকে পৌঁছে দিয়ে যাবে। সে কারনে ফাহিম নিশ্চিন্ত আছে।দিতিরও পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ভাবছে কটাদিন ফাহিমের সাথে ডরমেটরিতে কাটিয়ে আসলে মন্দ হয় না।
ফাহিম শুক্রবারে সচিব মহোদয়কে প্রটোকল দিয়ে শনিবার একটু ছুটির আমেজে বাসায় বিশ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। আজ দিতি আসছে সেই খুশীতে ফাহিম অনেক আনন্দিত। যদিও এক সপ্তাহ সময় পার হয়েছে কিন্তু ওর কাছে মনে হচ্ছে কতোদিন যেন ও দিতিকে কাছে পায় না।প্রাণভরে আদর করা হয় না। বিরহকাতর মনটা দিতিকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে। ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা এগারোটা বাজে। ভাবলো দিতির এই সময়ই রওয়ানা দেওয়ার কথা। মোবাইল স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে সাথী ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সাথী বলে উঠলো
—-ফাহিম ভাই আমার খুব বিপদ। আমি পদ্মা রিসোর্টে আছি। কিছু বখাটে ছেলে আমার ক্ষতি করতে চাইছে। প্লিজ আপনি এখনি চলে আসুন।
—–তুমি ওখানে কেন?
——ভাইয়া,এখন বেশী কথা বলার সময় নাই। সাক্ষাতে সব বলবো। প্লিজ আপনি চলে আসুন।

চলবে

জীবনের গোপন ডাকবাক্স পর্ব-০৮

0

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী

দিতি ফোন রেখে দৌড়ে নীচে লিভিং রুমে চলে আসলো। ওখানে ওর শ্বশুর আর ফাহিম গল্প করছিলো। দিতিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে ফাহিম জিজ্ঞাসা করলো,
—দিতি,কোনো সমস্যা?
—-সাথীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফাহিম অবাক হয়ে বললো,
—-আমি তো তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। কে ফোন দিয়েছিলো?
—-আব্বু কাঁদতে কাঁদতে ফোনে একথা জানালো।
কথাগুলো বলে দিতিও কাঁদতে শুরু করলো। আকরাম সাহেব দিতির কান্না দেখে বললেন,
—-এখন কান্নার সময় নয়। তুমি ভেঙ্গে পড়লে তোমার বাবা মাকে কে সামলে রাখবে।
এরপর ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-দেখ তো তোর পরিচিত মিরপুর থানায় কেউ আছে নাকি?
—-খোঁজ তো নেওয়াই যায়। কিন্তু —
দিতি অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-কিন্তু কি?
—-ওর তো একটা বদনাম রটে যাবে। পরবর্তীতে ওর বিয়েশাদী সর্বোপরি ওর ভবিষ্যত হুমকির মুখ পড়বে।
আকরাম সাহেব একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,
—-এখন প্রতিটি সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যত নিয়ে পরে ভাবা যাবে। তুই দেরী না করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়।
দিতির এখানে থাকতে এই মুহুর্তে ভালো লাগছে না। ওর মনে হচ্ছে এই সময় ওর বাবার পাশে থাকা উচিত। সে কারনে শ্বশুরকে বললো,
—-আব্বু আমি ফাহিমের সাথে যেতে চাচ্ছি।
ফাহিম তৎক্ষনাত বলে উঠলো,
—-তুমি থানায় গিয়ে কি করবে?
দিতি একটু কাঁদ কাঁদ হয়ে বললো,
—-আব্বুর এই সময়ে আমার তার পাশে একটু থাকা উচিত।
আকরাম সাহেব ফাহিমকে বললেন,
—-ঠিক আছে ও যখন যেতে চাইছে তখন ওকে একটু সাথে নিয়ে যা। থানায় যাওয়ার আগে ওকে ও বাড়িতে নামিয়ে দিস।
মোমেনা খাতুন নিজের ঘরে এশার নামাজ পড়ছিলেন। লিভিংরুমে ওদের হাঁকডাক আর ব্যস্ততায় বেরিয়ে এসে বললেন,
—-কিরে ফাহিম ঘরে কি ডাকাত পড়েছে? এতো চিৎকার চেঁচামেচি কিসের?
আকরাম সাহেব বুঝলেন বোনের নামাজে মনে হয় ডিস্টার্ব হয়েছে। তাই একটু মোলায়েম স্বরে বললেন,
—সোলেমানের ছোটো মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সকালে কোচিং এর উদ্দেশ্য বের হয়েছে। রাত দশটা বাজতে চললো এখনও বাসায় ফেরেনি।
মোমেনা খাতুন ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-ঐ মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে নয়। ও তোমাকে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেঁচতে পারবে। তুমি যেতে চাইছো যাও। মাঝখানে নিজেদের বেরাতে যাওয়াটা মাটি করলে।
দিতি একটু বিরক্ত হলো। কিন্তু বাইরে থেকে কাউকে বুঝতে দিলো না। ফাহিমকে তাগিদ দিয়ে বের হয়ে গেল। ওরা চলে যাবার পর মোমেনা খাতুন আপন মনে বললেন,
“যতসব ঝামেলা। যেমন মা তেমন তার ছা।”
দিতিরা বের হয়ে মিরপুর থানার দিকে রওয়ানা দিলো। শ্যামলি পার হতেই দিতির মোবাইলটা বেজে উঠলো। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। দিতি ফোনটা ধরতে চাইছিলো না। ফাহিম দিতিকে ফোনটা ধরতে বললো। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে সাথী কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-আপু তুই কি সাজেকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিস?
দিতি ব্যস্ত হয়ে বললো,
—-আমার যাওয়ার কথা এখন থাক। তুই কোথায় কি অবস্থায় আছিস বল?
—–আমি নোভাদের বাসায় আছি। তুই তো ওদের বাসা চিনিস। এখানে চলে আয়। আমি তোকে সাক্ষাতে সব বলবো।
নোভাদের বাসা মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকায়। একটু ভিতরে হওয়াতে গাড়ি নিয়ে যেতে ওদের খুব কষ্ট হলো। ফাহিম গাড়িতেই বসা ছিলো। দিতি দরজা নক করতেই নোভা এসে দরজা খুলে দিলো। দিতির খুব লজ্জা লাগছিলো। এতো রাত পর্যন্ত সাথী ওখানে আছে কিংবা কি কান্ড ঘটিয়েছে এসব ভাবতে ভাবতে পুরোটা পথ এসেছে। আঙ্কেল আন্টিকে কি বলবে? বাসায় এসে দেখে নোভার বাবা মা কেউ বাসায় নেই। উনারা একটা বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছেন। নোভা দিতিকে ওর রুমে নিয়ে গেল। দিতি নোভার রুমে সাথীকে এ অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে গেল। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা আছে। ব্যান্ডেজের বাইরে হালকা রক্তের দাগ লেগে আছে। সাথী দিতিকে দেখে শোয়া থেকে অনেক কষ্টে উঠে বসলো। দিতি ওকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তোর এ অবস্থা কি করে হলো?
সাথী বলার আগেই নোভা বললো,
—আপু ও রিকশা থেকে পড়ে গিয়েছিলো। সাথে সাথে মাথার ঐ জায়গা কেটে গিয়ে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিলো। ও জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। আমি সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। ওখানেই মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হলো। ওর জ্ঞান ঘন্টা খানিক আগে ফিরে এসেছে। তারপর আমি ওকে নিয়ে বাসায় ফিরেছি। ওর মোবাইল বন্ধ ছিলো। আমি আসলে আপনাদের বাসায় ফোন দিতে সাহস পাইনি। আঙ্কেল আন্টিকে কি বলবো বুঝে পাচ্ছিলাম না। ওর জ্ঞান ফিরে আসার পর আপনাকে ও ফোন দিতে চাইলো।
সাথী ব্যথায় গোঙ্গাতে লাগলো। তারপর কোনো রকমে দিতিকে বললো,
—-আব্বুকে জানাতে সাহস হয়নি। দেখা যাবে আমার কোচিং এ যাওয়াই বন্ধ করে দিবে। তোর কথা আব্বু ফেলতে পারবে না। তুই বুঝিয়ে বললে আব্বু আর কিছু বলবে না।
—-ঠিক আছে,এখন বাড়ি চল। তুই হাঁটতে পারবি তো।
সাথী মাথা নাড়িয়ে বললো,”পারবে।”দিতি নোভাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মনে মনে আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করলো। ও আসতে পথে মনে মনে কত কি ভেবেছে। ও কি কিডন্যাপ হলো নাকি এক্সিডেন্ট করে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকলো নাকি কোনো বাজে ছেলের পাল্লায় পড়লো। যাক ভালোয় ভালোয় ওকে ফিরে পেয়েছে। গাড়ির কাছে আসতেই ফাহিম গাড়ি থেকে নেমে সাথীকে বসতে বললো। সাথী ফাহিমকে দেখে বললো,
—–সরি ভাইয়া,আমার কারনে আপনাদের হানিমুনে যাওয়া হলো না।
—-সমস্যা নাই,হানিমুনে পরেও যাওয়া যাবে। তোমাকে যে আমরা সহিসালামতে ফিরে পেয়েছি এজন্য আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া জানাই।
সাথী ফাহিমের কথা শুনে মনে মনে বললো,”আপনার হানিমুন করার ইচ্ছা শুধু স্বপ্নেই দেখতে পাবেন।”
দিতি ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ওর বাবাকে পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বললো। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সোলেমান সাহেবের মনটা এমনিতেই বেশ নরম হয়ে আছে। সেখানে সাথীকে বড় কোনো বিপদে পড়তে হয়নি। মেয়ে সহিসালামতে বাড়ি এসেছে এতেই উনি অনেক খুশী। ফাহিম আর দিতিকে থাকতে বললো। অন্য আর একদিন এসে থাকবে এ কথা বলে বিদায় নিলো। সাথী অবশ্য চাইছিলো না আজকে দিতি আর ফাহিম থাকুক। তাহলে ওর শয়তানী ধরা পরে যাওয়ার শঙ্কা আছে।

পরদিন সকাল এগারোটায় ওর দাদীর ডাকে সাথীর ঘুম ভাঙ্গলো। দাদী খুব খুশী হয়ে উনার মোবাইলে দিতি আর ফাহিমের একসাথে কক্সবাজারের সীবিচের ছবি দেখালো। সাথে সাথে সাথীর মাথায় আগুন ধরে গেল। টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে ছুড়ে মারলো। মুহুর্তেই গ্লাসটা ভেঙ্গে কাঁচগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়লো। এরপর নিজেই নিজের মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেললো। ওর দাদী তাকিয়ে দেখে সাথীর মাথায় কোনো ক্ষত নাই। দাদী রেগে গিয়ে ওকে বললো,
—-তারমানে,তুই দিতিকে হানিমুনে যেতে দিবি না সেই কারনে এই শয়তানী করেছিস তাই না? কি লাভ হলো? পারলি আটকাতে,পারলি না। এসব শয়তানী বাদ দিয়ে মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর। আজ সকাল সাতটার ফ্লাইটে ওরা কক্সবাজার গিয়েছে।
—-বুড়ি আমি তোর নাতনীকে সুখী হতে দিবো না। ছোটো বেলার যেমন ওর পুতুলগুলো ভেঙ্গে দিতাম তেমনি আজ ওর সংসার আমি ঠিকই একদিন ভেঙ্গে দিবো।
ওদের চিৎকার চেঁচামেচিতে সালেহা বেগম সাথীর রুমে দৌড়ে চলে আসতেই কাঁচের টুকরো দিয়ে পা কাটলো। এসব দেখে আমেনাখাতুন ঐ ঘর থেকে চলে গেল। সালেহা বেগমের পা দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরছে। সাথী ওর মাকে রিকশা করে তাড়াতাড়ি পাড়ার ক্লিনিকে নিয়ে গেল। কাঁটা জায়গায় চারটা স্টিচ পড়েছে। খুব সাবধানে ওর মাকে ঘরে নিয়ে আসলো। টিটেনাসের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। সালেহা বেগমের জ্বর জ্বর লাগছে। মাকে একগ্লাস গরম দুধ খাইয়ে শুয়ে দিলো। এরপর নিজের ঘরের কাঁচের টুকরোগুলো পরিস্কার করে ফেললো। দুপুরের রান্না ওকেই করতে হলো। আমেনা খাতুন ঘরে বসে মনে মনে বললেন,”শয়তানী করলে এভাবেই তার ফল ভোগ করতে হয়।” তবে এই মেয়েকে ঘরে রাখা যাবে না। শীঘ্রই ওর বিয়ে দিতে হবে। নইলে দিতিটার জীবনটাকে ও নষ্ট করে দিবে।

চলবে

জীবনের গোপন ডাকবাক্স পর্ব-০৭

0

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

দিতি ধীর পায়ে উপরে উঠে এলো। মেয়েটার মুখটা বিষন্ন দেখে মোমেনা খাতুনের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আসলে এটাই জীবনের বাস্তবতা। প্রতিটি নারীকে যখন তার চেনা পৃথিবীটা ছেড়ে আসতে হয় তখন তার বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। ঐ বেদনা শুধু নারীরাই বুঝতে পারবে। হয়তো এই কারনে দিতির মনটা খারাপ। কিন্তু দিতির ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম। আর দশটা মেয়ের মতো ওর জীবন তরীটা বয়ে চলেনি। বাবার বাড়িতে দাদীই ছিলো ওর একমাত্র আদর ভালোবাসার জায়গা। বাবা তো সেই সকালে বেরিয়ে যেতো আসতো রাত দশটায়। বাবার ছিলো অডিটের চাকরি। যদিও ছুটির দিনগুলোতে বাসায় থাকলে উনি দিতিকে একটু সময় দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু অডিটের চাকরি করাতে মাঝে মাঝে আবার ট্যুরে যেতে হতো। কখনও চিটাগাং কখনও বা রংপুর। মধ্যবিত্ত পরিবারের সবার সুখ স্বাচ্ছন্দের কথা চিন্তা করে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সেই কারনে কোনোদিন বাবাকে দিতি তার কষ্টের কথাগুলো বলতে পারেনি। ইদানিং দাদী একটা কথা প্রায় বলতো,” দ্রুত বিয়ে করে নিজের একটা আপন মানুষ গড়ে নে। যে তোকে সারাজীবন বুক দিয়ে আগলে রাখবে। এ বাড়িতে আর বেশিদিন থাকিস না। আমার বয়স হয়েছে। কবে দুম করে মরে যাই তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। তখন তোকে কে আগলে রাখবে?”
ফাহিমকে ওর ভালোই লেগেছে। মানুষটার আচার আচরনে কোনো মেকীভাব চোখে পড়েনি। তারপরও সাথীর কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো। ফাহিম নাকি ওকে সস্তা ভেবেছে। তাই সস্তার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। নিজের ঘরে এসে দিতি খাটের এক কোনে বসে পড়লো। ফাহিম তখন ওয়াশরুমে ছিলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দিতির বেদনা ভারাক্রান্ত মুখটা দেখে ফাহিমের খুব কষ্ট হলো। ওকে একটু নিবিড়ভাবে কাছে পাবার তরে দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিলো। ফাহিমকে এ কাজ করতে দেখে দিতি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-দিনে দুপুরে দরজায় ছিটকিনি দিলে কেন?
—-একজন বিবাহিত পুরুষ কখন দরজায় ছিটকিনি তুলে দেয় তাও জানো না?
—-দিনে দুপুরে এসব দুষ্টুমি করা চলবে না।
একথা বলে মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। ফাহিম দিতির মুখে বিষাদের ছায়া দেখতে পায়। ওর পাশে বসে কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। ফাহিমের হাতের স্পর্শে দিতি যেন একটু কেঁপে উঠে। ফাহিম দিতির কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলে,
—-তোমার মনটা খারাপ আমি তা বুঝতে পারছি। আপনজনদের ছেড়ে আসলে কষ্ট হবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিবো।
ফাহিমের কথাগুলো শুনে দিতি মনে মনে বলে,”আমার মন খারাপ তো আমার ভাগ্যকে নিয়ে। জন্মের পর মায়ের ভালোবাসা পাইনি। বাবাকে কোনোদিন নিজের কষ্টের কথা বলিনি। মায়ের আদর পাওয়ার জন্য বাবা যাকে এনে দিলেন সে কোনোদিন আমার দিকে ভালোবাসার হাত বাড়ায়নি। আজকে সেই ভালোবাসাটুকু পাওয়ার জন্য তোমার কাছে এসেছি। তুমিও যদি অবহেলা করো তাহলে আমার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই।”
দিতিকে নিরব দেখে ফাহিম ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
—-তুমি আমার উপর ভরসা করতে পারো। আমি জানি, তুমি মেন্টালি আপসেট। তাই তুমি সময় নিতে চাইছো নাও। আমাকে চিনো জানো তারপর না হয় আমরা আমাদের দাম্পত্যকে সুন্দরভাবে ভালোবাসার ছোঁয়ায় শুরু করবো। এরপর ফাহিম কিছুক্ষণ নিরব থাকে। দিতির মুখটার পানে অপলক তাকিয়ে থাকে। দিতি ওর দিকে নস তাকিয়ে বুঝতে পারে ফাহিম ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দিতি ওর লাজরাঙ্গা মুখটা তুলে একবার ফাহিমের দিকে তাকায়। ফাহিম দিতির চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে বলে,
—-তোমার কাছে একটা কথা জানতে মন চাইছে।
—বলো,
—-হানিমুনটা কি আমাদের পানসে হবে?
দিতি একটু আড়ষ্ট হয়ে বলে,
—-সেটা সময়ই বলে দিবে।
নক করার শব্দে দিতি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে মিনারা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে দেখে দিতি বলে,
—-কিছু বলবেন মিনারা খালা?
—ফাহিম ভাইজান কই? নীচে টেবিলে ভাত বেড়ে দেওয়া হয়েছে। আফা আপনাদের ভাত খাইতে ডাকছে। মিনারা বেগম চলে যাবার পর দিতি দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ফাহিমকে বললো,
—-বাবা আর ফুফু টেবিলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চলো খেতে যাই।
ফাহিম শোয়া থেকে উঠে দিতিকে বললো,
—-আজ বিকেলে একটু শপিং এ বের হই। তোমার যদি টুকটাক কিছু কেনা লাগে কিনে নিও।
দিতিও মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে ফাহিমের সাথে রুম থেকে বের হলো। দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে এসে বিশ্রাম নিয়ে শপিং এ বের হলো। ফাহিম দিতিকে নিয়ে আগে দিয়াবাড়ি ঘুরতে গেল। এখন অক্টোবর মাস। কাশ ফুলের মেলা বসেছে। সে সৌন্দর্য দেখতে অপরুপ লাগে। নৌকায় চড়ে দিতির ঘুরে বেড়াতে খুব ইচ্ছে হলো। ফাহিমও সানন্দে রাজী হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো মেয়েটার মনটা এতে যদি একটু ফুরফুরে হয়। গোধুলীর আবীর রাঙ্গানো আলো এসে পড়েছে দিতির মুখের পরে। মেয়েটাকে অপূর্ব লাগছে। লেকটার দুপাশে ফুটে আছে কাশফুল। মাঝখান দিয়ে এক মায়াবতী কন্যাকে নিয়ে ফাহিম ভেসে চলছে। নিজেকে রুপকথার রাজকুমারের মতো মনে হচ্ছে। নৌকা ভ্রমন শেষে বাইরে ডিনার সেরে কিছু শপিং সেরে ওরা দু’জন বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।

রাত গভীর হতে চললো। সাথীর দুচোখে ঘুম নেই। নির্ঘুম থাকার কারনে চোখদুটো জ্বালা করছে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দুর আকাশের তারাগুলোর পানে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,দিতি তোমার অবস্থান হবে খসে পড়া নক্ষত্রের মতোন। তোমার সংসারটাকে আমি তছনছ করে দিবো। হয় তোমার বরকে আমার করে নিবো নয়ত তোমাদের দুজনকে আলাদা করে দিবো। এই আমার শপথ। আগামীকাল তোমাদের হানিমুনে যাওয়া আমি ভেস্তে দিবো। জন্মের পর থেকেই যে দিতিকে ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে করেছে আজ তাকে রাজরানী হতে দেখে সাথী কিছুতেই মানতে পারছিলো না। মায়ের কাছে শুনেছে বাবা চায়নি সাথীর জন্ম হোক। কারণ দিতির যেন কোনো অবহেলা না হয়। এটা শোনার পর থেকে দুবছরের বড় হলেও সাথী সব সময় দিতিকে অবহেলা আর অপমান করে গিয়েছে। এতে সাথী নিজের ভিতরে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে।

খুব সকালেই ফাহিমের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ও দিতির ঘুমন্ত নিস্পাপ মুখটার দিকে অপলক তাকিয়ে রয়। হঠাৎ দিতিরও ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখে ফাহিম ওর মুখের পরে মুগ্ধতার দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। দিতি চোখ কছলে জিজ্ঞাসা করে,
—-এভাবে কি দেখছো?
—-,আমার স্বপ্নে দেখা রাজকুমারীকে।
—-আর দেখতে হবে না। এবার ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ওজু করে আসো। একটু পরেই সুর্য উঠে যাবে। নামাজ শেষ করে নীচে গিয়ে সবাই মিলে একসাথে চা খাবো।

ওরা দুজন ফজরের নামাজ আদায় করে নীচে চলে যায়। আকরাম সাহেব খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। আজ একটু সকালে অফিসে যেতে হবে। বিদেশ থেকে বায়াররা আসছে। তাদের সাথে মিটিং এ বসতে হবে। ছেলেটাকে কিছুতেই নিজের ব্যবসার কাজে লাগাতে পারলো না। সে সরকারী চাকরি করবে। তার আমলা হওয়ার ইচ্ছা। উনি ভেবেছিলেন ছেলের কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে শেষ বয়সে নিশ্চিন্তে সময় কাটাবেন। তা আর হলো কই? তবে তিনি আশাহত হননি। মনে মনে ভাবছেন দিতিকেই তার ব্যবসার হাল ধরার উত্তরসুরী হিসাবে তৈরী করে নিবেন। নীচে এসে দিতি শ্বশুরকে সালাম দিয়ে কিচেনে চলে গেল। ফাহিমও সালাম দিয়ে বাবার পাশে বসে পত্রিকার একটা পেইজ নিজের দিকে টেনে নিলো। একটু পরে ফাহিমের ফুফুও চলে আসলো। মিনারা খালা ট্রেতে করে চা আর বিস্কুট দিয়ে গেল। দিতি সবার কাপে চা টিপট থেকে চা ঢেলে এগিয়ে দিলো।

পুরোটা দিন ওদের দুজনের বেশ ব্যস্ততায় কাটলো। ফাহিমের কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছিলো। এরমাঝে এক ফাঁকে দিতি ওর সুটকেস গুছিয়ে নিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত আটটা বাজে। দিতির ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে ওর বাবা ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওর বাবা কাঁদ কাঁদ স্বরে বললো,
—-সাথীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর ফোন বন্ধ। সেই সকালে কোচিং এর কথা বলে বেড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত বাসায় ফিরেনি। আমি ওর পরিচিত সব জায়গায় খোঁজ করেছি। কেউ ওর খোঁজ দিতে পারেনি। আমি এখন কি করবো মা। ফাহিমকে বলে দেখ না, ও যদি কিছু একটা করতে পারে। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে।
বাবার এরকম আকুতি শুনে দিতি সান্তনা দিয়ে বললো,
—-তুমি এতো টেনশন করো না। তোমার শরীর খারাপ করবে। ফাহিমকে বলে দেখি ও কিছু করতে পারে কিনা।

চলবে

জীবনের গোপন ডাকবাক্স পর্ব-০৬

0

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

আজ শ্বশুর বাড়িতে ফাহিমের দ্বিতীয় দিন। আজকের রাতটা থেকেই কাল সকালে দিতি আর ফাহিম চলে যাবে। পরশু রাতেই ওরা হানিমুনের উদ্দেশ্যে সাজেক রওয়ানা হবে। তিনদিন থেকে অর্থাৎ শনিবার ওরা রাতের বাসে ঢাকার পথে রওয়ানা দিবে। রবিবার ফাহিমকে আবার মুন্সিগঞ্জে গিয়ে অফিস করতে হবে।
আকাশে আজ পূর্ণশশীর জোৎস্না। রাতে ডিনার করার পর দিতির দাদী ফাহিমকে মজা করে বলছে,
—-ভাইয়া আজ আকাশে ফকাফকা জোৎস্নার আলো ঝরছে। চাঁদ ওর সবটুকু রুপের সুধা পূর্ণিমার রাতে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিয়ে মাতাল করে তোলে। এমনরাতে তোমার দাদাজান আমাকে নিয়ে উঠোনে মাদুর বিছিয়ে বসে থাকতো। আর ভাওয়াইয়া গান শোনাতো। তুমি ও আমার নাতনীটাকে নিয়ে ছাদে গিয়ে বসো। এখনি তো দুজন দুজনকে বোঝার সময়।
ফাহিম মুচকি হেসে বললো,
—-দাদী,দাদাজান অনেক রোমান্টিক ছিলেন তাই না?
—–সেদিনগুলোর কথা মনে হলে আজও বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে। মানুষটা আমাকে খুব ভালোবাসতো। যাও ভাই তোমরা ছাদে গিয়ে বসো।
একথা বলে এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিতির দাদী নিজের ঘরে চলে যান।
দাদীর কথা শুনে সাথী মনে মনে বললো,”বুড়ির ঢং দেখলে শরীরটা জ্বালা করে।” সাথীও দুপদাপ করে নিজের ঘরে চলে গেল।
ফাহিমের জোৎস্না খুব ভালো লাগে। ওর ইচ্ছে করছিলো দিতিকে নিয়ে ছাদে যেতে। কিন্তু বলতে পারছিলো না। দাদী বলাতে ওর সুবিধাই হলো।
দিতিকে নিয়ে ফাহিম ছাদে চলে গেল। মুক্ত বাতাসে ওরা দু’জন বসে আছে। সাথী ওর ঘর থেকেই দিতি আর ফাহিমের হাসির শব্দ শুনতে পারছে। মনে মনে সাথী বলছে দিতিটা কি বেহায়া! এভাবে বাজারের মেয়েদের মতো করে কেউ হাসে? ঐ হাসির শব্দ ওর শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। সেই আগুনে দিতির স্বামী আর সংসারকে ওর পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ও একা কেন জ্বলবে? দিতিকেও জ্বালিয়ে মারবে।
ফাহিম অপলক দিতির দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদের আলো দিতির মুখের উপর এসে পড়েছে। সে আলোতে দিতিকে যেন ফাহিমের কাছে স্বপ্নে দেখা রাজকুমারীর মতো লাগছে। চাঁদের আলোতে দিতি স্পষ্ট দেখতে পারছে ফাহিমের দুচোখে মুগ্ধতার দৃষ্টি। দিতি বেশীক্ষণ সেই দৃষ্টির পানে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। ফাহিম দিতির পাশে একটু ঘনিষ্ট হয়ে বসে। দিতির খুব লজ্জা লাগছে। ফাহিম আস্তে আস্তে ওর ঠোঁটটা দিতির কানের লতির কাছে নিতেই ও বলে উঠলো,
—-চা খাবে? আমারও একটু চায়ের তেষ্টা পেয়েছে।
ফাহিম কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
—তুমি এত বেরসিক কেন? কোথায় কোন কথা বলতে হয় তাও শিখোনি।
দিতি মুচকি হেসে বলে,
—-এভাবে খোলা ছাদে রোমান্স করা ঠিক না?
—-আমি তো তোমার সাথে কিছুই করিনি।
—-তবুও হঠাৎ কেউ যদি ছাদে এসে আমাদের এভাবে ঘনিষ্ট অবস্থায় দেখে ফেলে তাহলে আমার খুব লজ্জা লাগবে।
—রোমান্স যদি করেও থাকো পর পুরুষের সাথে তো করছো না। এতে লজ্জা কিসের? নিজের স্বামীর সাথে করছো।
—-আচ্ছা, আমার বড্ড অপরাধ হয়েছে। এবার মশলা দিয়ে খুব সুন্দর করে তোমার জন্য চা বানিয়ে আনছি। তারপর সারারাত ছাদে বসে তোমার সাথে প্রেম করবো।
—-তোমার যাওয়ার কি দরকার? সাথীকে একটু বলোনা আমাদের দুজনের জন্য দু’কাপ চা দিয়ে যেতে? নতুন দুলাভাইয়ের জন্য ও এটুকু করতে পারবে না।
—-ও মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বানিয়ে আনছি। খুব বেশী সময় লাগবে না।
দিতি জানে, সাথীকে বলাই বৃথা। এরচেয়ে নীচে গিয়ে ও চা বানিয়ে আনবে। চা বানানোটা জরুরী নয় আসলে ফাহিমের দুষ্টুমী থেকে বাঁচতেই নীচে চলে আসলো। পাশাপাশি সাথীটাকেও ডেকে আনবে। বেচারা নীচে একা রয়েছে। হাজারও হোক সাথী ওর বোন। কোনোদিন সাথীকে ও সৎ বোনের চোখে দেখেনি। সাথী ওকে কি চোখে দেখেছে, এটা নিয়ে ওর কোনো ভাবনা নেই। দিতি কিচেনে গিয়ে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়ে সাথীর রুমে এসে দেখে ও চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দিতি ভাবছে ও ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আর ডাকলো না। দিতি রুমের দরজার কাছে যেতেই সাথী বলে উঠলো,
—-আপু তোর কি লাজ শরম নেই। এভাবে বেহায়ার মতো এতো জোরে হাসছিস কেন? আশে পাশের মানুষ শুনলে কি ভাববে? বিয়ে কি আর কারো হয় না? নাকি জগতে তুই একাই বিয়ে করেছিস?
সাথীর কথা শুনে দিতি অবাক হয়ে বলে,
—-তুই আমার সাথে এভাবে কেন কথা বলছিস ? তুই যেভাবে বলছিস আমি কিন্তু অতো জোরে হাসিনি। আমার লিমিট আমি জানি। তাছাড়া যদি হেসেও থাকি আমি আমার স্বামীর সাথে হেসেছি।
বলে দিতি আর একমুহুর্ত অপেক্ষা করলো না। চা বানিয়ে ছাদে চলে গেল। তবে ওর মুডটা সাথী নষ্ট করে দিলো। সাথী মনে মনে এটাই চেয়েছিলো। ঘরে শুয়ে সাথী সিঁড়ি দিয়ে ওদের দুজনের নামার শব্দ পেলো। ওদেরকে নামতে দেখে সাথী নিজের মনে হেসে বলতে লাগলো,
—-তোকে তো আমি সুখী হতে দিবো না। তুই আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছিস আমি তোর সুখ কেড়ে নিবো।
রাতের দ্বিপ্রহর পার হলো। সাথীর চোখে কোনো ঘুম নেই। ও কল্পনায় দেখতে পারছে ফাহিম দিতিকে প্রাণ ভরে আদর করছে। আর ও অশান্তিতে ভুগছে।এমনিতেই এই দু’দিন সারাক্ষণ চোখের সামনে ফাহিমকে দিতির সাথে থাকতে দেখে ওর অন্তরে এক অদ্ভূত দাহন তৈরী হয়েছে। এই দাহনে দিতিকে পুড়িয়ে মারতে ইচ্ছা করছে।

সকালবেলা ঘরের ভিতর খসখস শব্দে সাথীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাকিয়ে দেখে দিতি আলমারী থেকে কিছু কাপড় বের করছে। ওদিকে তাকিয়ে সাথী একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—-তুই আমাকে একটু শান্তি করে ঘুমাতেও দিবি না?
—-সরি বোন, কাল রাতে আমরা হানিমুনে রওয়ানা দিবো। সেজন্য আমার কিছু থ্রীপিচ বের করছি। ওখানে শাড়ি পরতে চাইছি না।
হানিমুনে যাওয়ার কথা শুনে সাথীর অন্তরটা হিংসায় জ্বলে উঠলো। কন্ঠে তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বললো,
—তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
দিতি খুশীতে ঝলমল করে উঠে বললো,
—-আমার না পাহাড় খুব ভালো লাগে। তাই সাজেকে যাওয়ার প্লান করেছি।
—-তোর ভাব দেখে মনে হচ্ছে সিমলা,মানালী কিংবা থাইল্যান্ড যাচ্ছিস। সেই তো ব্যাঙের লাফ। আমি দেশের ভিতরে কোথাও হানিমুনে যাবো না। আমি সুইজারল্যান্ড কিংবা দুবাই অথবা ইউরোপের কোনো একটা দেশে হানিমুনে যাবো।
—-সে তো অনেক টাকার ধাক্কা।
—তাতো হবেই। ব্যাটা হাতি পালবে কিন্তু হাতির খোরাকী দিবে না তা কি করে হবে? সম্রাট শাহজাহান যদি উনার বউয়ের জন্য তাজমহল গড়ে দিতে পারে তাহলে আমার বর আমার জন্য কেন এটুকু করতে পারবে না। তোকে এসব সস্তা জায়গায় ফাহিমভাই নিতে পেরেছে কারণ উনার কাছে তোর তেমন একটা মুল্য নেই। অবশ্য তুইও এটুকু পেয়েই বর্তে গেছিস।
সাথীর কথাগুলো শুনে দিতি খুব কষ্ট পায়। সেদিকে তাকিয়ে সাথী নিজের মনের প্রশান্তি অনুভব করে। ও খাট থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেল। আর মনে মনে ভাবলো,”কি করে তুমি হানিমুনে যাও সেটাই এখন দেখার বিষয়।”
দিতির মনটা খারাপ হলেও বাইরে থেকে কারো কাছে কিছু প্রকাশ করলো না। কারণ বিয়ের এই কয়দিনে ও বুঝেছে ফাহিমের ভালোবাসায় কোনো ফাঁক নেই। যাইহোক ব্যাগ গুছিয়ে সবার কাছে বিদায় নিয়ে ফাহিমের সাথে শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা দিলো। পুরোটা পথ ওর মুখটা ভার ছিলো। ফাহিমও খেয়াল করলো। কিন্তু ও মুখে কিছু বললো না। ভাবছে,বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাবে মনতো একটু খারাপ হবে। আজ যেহেতু ওয়ার্কিং ডে। সে কারনে রাস্তায় ভালোই জ্যাম আছে। উবারে করে যেখানে বিশমিনিটে যাওয়া যায় সেখানে একঘন্টা লাগলো। ফাহিম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা বারোটা বাজে। বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই ওর ফুফুশাশুড়ী এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
—তুই আসা মাত্রই আমার ভাইয়ের বাড়ীটা যেন আনন্দে ঝলমল করছে।
দিতি ফুফুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-আপনার শরীর ভালো আছে ফুফু?
—+তোর মিষ্টিমুখটা দেখার সাথে সাথে আমার শরীর মন দুটোই ভালো হয়ে গেল।
আশরাফ সাহেবও এসে দিতিকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—+তোমাদের বাড়ির সবাই ভালে আছে মা?
—+আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছে।
এরপর আশরাফ সাহেব ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—+হোটেল কক্স টুডে তে তোদের জন্য রুম বুক করা হয়েছে। তুই কি গ্রীনলাইনের টিকিট কেটেছিস?
—হুম,
ফাহিম নিজের ঘরে চলে গেল। দিতির ফুফুশাশুড়ীও ওকে ঘরে গিয়ে ফ্রেস হতে বললেন।

চলবে