Tuesday, July 1, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 84



অথৈ মহল পর্ব-০৫

0


#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
রাত ১১ টা বাজে। নিবিড় পানি গরম করছে। অথৈ সোফায় বসে বার বার হাঁচি দিচ্ছে। নাক পিট পিট করছে একটু পর পর। পাশের সোফায় টমি বসে চিকেন খাচ্ছে। আর অথৈ যখনই হাঁচি দিচ্ছে তখনই সে খাওয়া বাদ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। ওর সামনে এক বক্স টিস্যু নিয়ে বসে আছে নীল। একটু পর পর ওকে একটা করে টিস্যু বের করে দিচ্ছে। অথৈ নাক মুছে টিস্যু শেষ করে ফেলেছে এমন অবস্থা।
শেষে টিস্যু ছিঁড়ে দুই জায়গায় আলাদা গোল করে নাকের দুই ছিদ্রর ভেতর ঢুকিয়ে বসে থাকে। এখন আর নাক দিয়ে পানি আসছে না। অথৈ নিজের এমন বুদ্ধি দেখে নিজেই কয়েক বার প্রশংসা করলো।

রিদ মাত্রই আসলো। কাব্য পাশে থেকে ওর কান্ড কারখানা দেখে যাচ্ছে। অথৈ উঠে গিয়ে কিচেনে উঁকি দেয়। নিবিড় পেছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কি সমস্যা তোমার? এখানে ঘুরঘুর করো কেন? বৃষ্টি তে ভিজে অসুখ বাঁধিয়ে শান্তি লাগছে খুব? ”

অথৈ দু দিকে মাথা ঝাঁকায়। বোঝায় একটু ও শান্তি লাগছে না তার। রিদ ড্রয়িং রুমে আসার আগেই ও দৌড়ে গিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে হাত-পা ছড়িয়ে। বাকিরা হঠাৎ ওর এই কাজে হতভম্ব। রিদ রুমে ঢুকেই সবার নাম ধরে ডাকতে থাকে। হঠাৎ সামনে পা বাড়াতেই চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে সোফায় গিয়ে নীলের কোলের উপর উঠে বসে।

এতক্ষণে সবাই মিলে বুঝলো অথৈ এর আসল উদ্দেশ্য। এমন অসুস্থ হয়েও মাথা থেকে ফাজলামির ভুত ছাড়েনি। রিদ বেচারা তো এসবের কিছুই জানে না। ওর বুকের ভেতর কেমন ঢিপ ঢিপ করছে এখনো।

“এই কাব্য, ওর কি ভুতে ধরলো নাকি। এভাবে নাকের ভেতরে মরা মানুষের মতো তুলো দিয়ে ওভবে ফ্লোরে পরে আছে কেন? আর তোরা তাকিয়ে দেখছিস সেটা! আশ্চর্য! ”

কাব্য উঠে আসে।
“এই মেয়ের আসলেই ভুতে ধরেছে। নীলেরই বা কি দরকার ছিল ওকে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নামতে দেওয়ার? ”

“অথৈ জেদ ধরলো। আমি মানা করেছিলাম তো। ”

কাব্য ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“এই তুই এখনো এভাবে মরার মতো শুয়ে থাকবি? উঠবি নাকি মা*ইর দিব দুইটা। ”

অথৈ এক লাফে উঠে দৌড়ে গিয়ে আবার সোফায় বসে। বলা বাহুল্য যে, কাব্য সবার থেকে অথৈ কে একটু বেশিই ভালোবাসে। নিজের ছোট বোনের মতো। এজন্য ওকে তুই করেই বলে।

নিবিড় পানি গরম করে একটা বাটিতে ঢেলে অথৈ এর সামনে রাখে। তারপর ওর উপরে একটা চাদর দিয়ে বলে জোরে জোরে শ্বাস নিতে। গরম ভাবটা যেন ভেতরে যায়।
এভাবে কিছুক্ষণ করার পর। সবার জন্য কফি নিয়ে আসে। অথৈ কে এক মগ চা হাতে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ শাসায়। অথৈ মুখ কাচুমাচু করে।

“আমি লাল চা খাব না। কফি বানিয়ে দাও। ”

কিন্তু কথাটা বলার সাথে সাথেই নিবিড় এমন ভাবে তাকালো যে ভয়ে ও চুপচাপ চা’য়ে চুমুক দেয়।

“আর কোনদিন যদি বৃষ্টি তে ভেজার আবদার করেছ। তখন দেখবে কি করি। একদম বাসায় নিয়ে রেখে আসব। এতগুলো কেয়ারিং ভাই পেয়েছ তো তাই বুঝতে পারছ না। নয়তো দেখতে। ”

অথৈ ঠোঁট ফুলিয়ে রিদের দিকে তাকায়।

“দেখলে ভাইয়া? আমাকে সব সময় এভাবে বকে। অসুস্থ মানুষ কে এভাবে বকতে হয় বলো তো? ”

রিদ ও ওর সাথে তাল মেলায়।
“আসলেই তো। এভাবে শুধু শুধু কেন বকছিস ওকে? ওর কি খারাপ লাগে না? ”
“হ্যাঁ, আরও আশকারা দে ওকে। মাথায় তোল। ”

নীল অথৈ এর কানে কানে এসে বলে,
“এই ব্যাটার কথা মাথায় নিও না তো। হুদাই গার্ডিয়ানের মতো ভাব নেয়। ব্যাটা খচ্চর। ”

অথৈ মুখ টিপে হাসে। কাব্য নীলের পিঠে একটা দুম করে মে*রে দেয়।

“তুই আবার ওকে ভুজুং ভাজুং বোঝাচ্ছিস। সব নষ্টের মূল তোরা দুজন। অগত্যা নীল আর অথৈ মুখ কাচুমাচু করে বসে থাকে। কিন্তু বেশি সময়ের জন্য না। একটু পরেই রুম কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।
_____
সকালে নিবিড় খাবার রেডি করে চা বানিয়ে অথৈ এর রুমে রেখে অফিসে চলে যায়।
অথৈ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়। চা যদিও হালকা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তবুও শেষ করে খাবার খেয়ে নেয়। ওর পুরো দিনটা কাটে টমি কে নিয়েই। ও গল্প করে। টমি লেজ নাড়ায়, মিউ মিউ শব্দ করে সাড়া দেয়। কখনো ওর গাল চেটে দেয়।

অথৈ নিবিড় কে কল দেয়।

“কিছু লাগবে অথৈ? ”
“ঢং করো? কিছু লাগলেই শুধু তোমায় কল দেই? তাছাড়া দেই না আমি? ”
“ইশ রে! মেয়ে দেখি রেগে যাচ্ছে। আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম। ”

অথৈ নাক টানতে টানতে কথা বলছে।
“বাসায় ফিরবে কখন? আমার একা একা ভালো লাগছে না। ”
“কাজ শেষ হলেই ফিরে আসব। ”
“কখন শেষ হবে? ”
“জানি না। তবে দ্রুত ফেরার চেষ্টা করব আমি। ”

“আচ্ছা, দুপুরে খেয়েছিলে? ”
“হ্যাঁ, তুমি খেয়েছ তো? ”
“খেয়েছি। ”
“ঔষধ? ”
“সব খেয়েছি। ”
“এইতো লক্ষি মেয়ে। ”

আরও কিছু সময় দুজন কথা বলে কল কেটে দেয়। অথৈ উঠে বাসার বাইরে যায়। আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে। টমি ওর কোলেই আছে। ঘাসের উপর ওকে নিয়ে শুয়ে পরে। টমি ওর চারপাশে মিউ মিউ করে ঘোরে। আবার একটু পর ওর কাছেই উল্টে শুয়ে থাকে। কখনো ডিগ বাজি দেয়। এটা টমি কিভাবে শিখেছে ও জানে না। ওর কাণ্ড দেখে অথৈ খিলখিলিয়ে হাসছে।

কিছুক্ষণ পরেই নিবিড়ের গাড়ি এসে ওর কাছে থেমে যায়। অথৈ শুয়েই আছে। কালো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিবিড় গাড়ি থেকে বের হলো। মনে হচ্ছে কোন এক তামিল মুভির হিরো আসছে তার দিকে এগিয়ে।
অথৈ ভাবতে থাকে, পুরুষ মানুষ কেন এত সুন্দর হবে? এমন সুদর্শন কেন হতে হবে? দেখলেই তো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কি আশ্চর্য! তার কি চরিত্রে সমস্যা শুরু হয়ে গেল নাকি।

অথৈ দুই গালে দুটো হালকা করে থাপ্পড় দিয়ে তওবা পাঠ করে। নিবিড় এসে ওকে হাত ধরে তুলে নেয়।

“কি হয়েছে? এভাবে কি বিড় বিড় করছো শুনি? ”
“কিছু না। এমনিতেই। ”
“একা খারাপ লাগছিল তোমার? ”

অথৈ ঠোঁট উল্টে চুপ করে থাকে। নিবিড় হেসে ওকে বলে,

“থাক আর ঠোঁট ফোলাতে হবে না। আসলে ইদানীং কাজের চাপটা বেড়েছে বুঝলে? তাই বেশি সময় অফিসে থাকতে হচ্ছে। কয়টা দিন যাক। তারপর চাপটা কমলে বাসাতেই থাকব বেশি সময়। ততদিনে মা আর নবনী ও বাসায় ফিরে আসবে। কথা হয়েছে ওদের সাথে। ”

অথৈ এর এবার মন খারাপ ভাবটা কেটে যায়। নিবিড় পকেট থেকে দুটো চকলেট বের করে দেয় ওর হাতে। চকলেট পেয়ে ঠোঁটের হাসিটা আরও চওড়া হয়ে যায়।
______
রাত বেড়েছে অনেক। ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কারেন্ট ও চলে গেছে। অথৈর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ভয় লাগছে ওর। আবার জোরে বিকট শব্দ হলো। দূরে কোথাও বাজ পরলো মনে হচ্ছে। অথৈ নিবিড় কে কল দেয়। যদিও ওর পাশের রুমেই নিবিড় থাকে। কিন্তু ওঠে গিয়ে ডাক দিতেও ভয় লাগছে। এদিকে নিবিড় ফোন ধরছে না। নিশ্চয় বৃষ্টির শব্দে শুনতে পাইনি।
অগত্যা অথৈ উঠে নিবিড়ের রুমে নক করে। আজকে আবার টমি ও নিবিড়ের সাথেই ঘুমিয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি আর নক করার পর নিবিড় শুনতে পায়। ঘুম ঘুম শরীরে টলতে টলতে চোখ কোচলে দরজা খুলে দেয়। দেখে অথৈ দাঁড়িয়ে আছে।

“কোন সমস্যা হয়েছে তোমার? শরীর ঠিক আছে? এত রাতে ডাকতে এলে যে। ”
“তুমি কি মানুষ? কিভাবে ঘুমাচ্ছো। কতবার কল দিলাম। তুমি ধরলেই না। ”
“ওহ কল করেছিলে? আমি শুনতে পাইনি। ”

“আমার ভয় লাগছে রুমে একা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমি আজকে তোমার সাথে থাকি? ”

এই পর্যায়ে নিবিড়ের চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায়। আঁতকে ওঠে সে। কি বলে এই মেয়ে! এত বড় একটা পুরুষ মানুষের সাথে রাতে ঘুমানোর আবদার করছে। তাও আবার এই বৃষ্টির রাতে। বোধ বুদ্ধি কবে হবে এই মেয়ের?

নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“আমার সাথে থাকবে মানে কি? ভয় নেই তোমার! রুমে গিয়ে ঘুমাও। এখন ২টা বাজে। আর একটু পরেই ভোর হবে। যাও। ”
“না। বললাম তো ভয় লাগছে আমার। ”

অথৈ গিয়ে বিছানায় পা তুলে বসে পড়ে। নিবিড় ওর কাছে গিয়ে বোঝাতে থাকে।

“শোনো অথৈ, তুমি রুমে যাও। গিয়ে আমায় কল দাও। যতক্ষণ তোমার ঘুম না আসে আমরা কথা বলব কলে। তারপর তুমি ঘুমিয়ে যেও। তোমার ভয় ও লাগবে না। ”

“পাশাপাশি রুমে থেকে কলে কথা বলব সারারাত? ”
“হ্যাঁ, ”
“এখানে আমি থাকলে কি সমস্যা। ”
“অনেক সমস্যা। তুমি এডাল্ট একটা মেয়ে। নিশ্চয় তোমাকে আমার বলে বোঝাতে হবে না সমস্যা টা ঠিক কোথায়। ”

অথৈ এর এবার মাথায় হুশ ফিরল। কিন্তু সেটা বেশি সময় স্থায়ী হলো না।

“তাতে কি? আমি ঘুমাব। তুমি জেগে থাকো এখানেই। বিছানার এক পাশে বসে থাক। ”
“সারারাত বসে থাকব আমি? ”
“চাইলে পাশে ঘুমাতেও পারো। আমার তো কোন সমস্যা নেই। আমার নিজের উপর কনট্রোল আছে। ”

অথৈ চোখ টিপে শুয়ে পড়ে। নিবিড় রুমের মধ্যেই পায়চারি করতে থাকে। অথৈ কিছু সময় পরেই ঘুমিয়ে যায়। নিবিড় কিচেনে যেয়ে বড় মগে কফি বানিয়ে নিয়ে আসে। মনের ভুলেও বিছানায় ঘুমানো যাবে না আজ।

একটু পর পর কফিতে চুমুক দিচ্ছে। এক মগ শেষ হতেই আরেক মগ নিয়ে আসছে। ঘড়িতে দেখল প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। বিছানার এক পাশে বসে থাকে। পিঠের নিচে বালিশ রেখে বসে আছে। না চাইতেও চোখ বার বার অথৈর দিকে যাচ্ছে। আর যাইহোক, সে পুরুষ মানুষ তো। যতোই ভালো হোক। তবুও এই ওয়েদারে একই রুমে যদি কোন সুন্দরী রমণী শুয়ে থাকে। তবে কার মনের মধ্যে বাজে চিন্তা উঁকি দেবে না? তবুও চোখ বন্ধ করে রাখে। কোন মতেই সে ওর দিকে তাকাবে না। বুঝ হবার পর থেকে কোন মেয়ে কে সে অসম্মান করেনি। আর করবেও না।

চোখ খিঁচে বন্ধ করে থাকতে থাকতে কখন নিবিড় ঘুমিয়ে গিয়েছে বুঝতে পাড়েনি। আর বসে থেকে কি ঘুমানো যায়? ঘুমের মাঝেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে।
_____
ভোরের আলো হালকা ফুটতে শুরু করেছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ করছে। নিবিড়ের ঘুম ভেঙে গেল। প্রায় অর্ধেকের বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থেকে অল্প একটু ঘুমানোর জন্য মাথা ব্যথা করছে ভীষণ। তবুও উঠে বসতে যাবে তখনি খেয়াল করে কেউ একজন তাকে হাত-পা দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। পাশে তাকায়। অথৈ এক পা তুলে দিয়ে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে।
এই অবস্থা দেখে নিবিড়ের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। কি করবে এখন সে? যদি ওর ঘুম ভেঙে যায় এখন? যদি তাকে ভুল বোঝে? নিজের উপর নিজের রাগ উঠছে তার। কেন এমন বেক্কলের মতো ঘুমিয়ে গেল।

বিবাহিত জীবন হলে এই মুহূর্তটা হতো সব থেকে সুন্দর। উদাম শরীরে একজন পুরুষ শুয়ে আছে। তাকে জড়িয়ে রেখেছে একজন সুন্দরী রমণী। দৃশ্য টা অনায়াসেই ভীষণ সুন্দর। কিন্তু এই মুহূর্তে নাউজুবিল্লাহ টাইপ হয়ে গেছে ব্যাপারটা। নিবিড় খুব সন্তর্পণে অথৈ কে সড়িয়ে দিয়ে ও নিজে উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়। এতক্ষণ যেন নিঃশ্বাস ও ঠিক ভাবে নিতে পারছিল না। কান দিয়ে গরম ধাপ বেড়িয়ে যাচ্ছে। উফ! কি অসহ্য।

নিবিড় মুখে পানির ঝাপটা দেয়। কোন নারীর সংস্পর্শ পেলে বুঝি আসলেই এমন পাগল পাগল অনুভূতি হয়?
____
চলবেধ

অথৈ মহল পর্ব-০৪

0


#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
প্রায় ১ ঘন্টা পর নিবিড় বাসায় ফেরে। বাসায় ঢুকেই আশেপাশে চোখ বোলায়। অবস্থা খুব খারাপ। চারদিকে সব জিনিস ছাড়ানো ছিটানো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছোট খাটো একটা ঝড় হয়ে গেছে। সোফার পেছন থেকে কেমন মৃদু চিৎকার আসছে। গিয়ে দেখে রিদ ফ্লোরে পড়ে গড়াগড়ি করছে। আর চিৎকার করছে। কাব্য অন্ধের মতো এদিক সেদিক হাতরিয়ে কি যেন খুঁজছে। আর উপরের সিঁড়ি দিয়ে নীল প্রাণ নিয়ে দৌড়ে নামছে। পেছনে অথৈ চা*কু নিয়ে দৌড়ে আসছে।

নিবিড় দৌড়ে গিয়ে অথৈ কে চেপে ধরে আটকায়।

“হয়েছে টা কি এখানে? কি সব দেখছি আমি অথৈ। ”

“আরে শুনো, এরা সব গুলো ডাকাতি করতে এসেছিল। আমি রুম থেকে পানি নিতে নিচে নামার সময় দেখি এরা তিনজন ড্রয়িং রুমে হাঁটাচলা করছে। তুমি তো জানোই আমি ভীষণ বুদ্ধিমতী। পরে চুপি চুপি একটা লাঠি নিয়ে এসে একটা কে পেছন থেকে মে*রেছি। আরেকটা তেড়ে আসছিল তাই ওটার চোখে মরিচের গুড়ো ছুঁড়ে দিয়েছি। যদিও বেশি লাগেনি। আর এটাকে চা*কু নিয়ে দৌড়ানি দিচ্ছিলাম।
আমাকে এবার ধন্যবাদ দাও। আমার জন্যই আজ তোমার কত বড় বিপদ হতে হতে বেঁচে গেল। এখন এদের পুলিশে দেব। ”

নিবিড় অথৈ এর কথা শুনে মাথা চাপড়ে বসে থাকে। নীল হাপাতে হাপাতে ওর পাশে গিয়ে বসে। রিদ ও উঠে খুঁড়িয়ে ওদের সামনে আসে।

“দোস্ত, এটা কে? বাসায় কি আজকাল লেডি কি*লার পুষতেছিস নাকি। এমন মার মে*রেছে কি বলব। মেয়ে না হলে একদম মে*রে নাকের নকশা পাল্টিয়ে ফেলতাম। ”

“এখানে আসতে আসতে ক্ষিদে পেয়ে গেছিল। কাব্য কে বললাম দেখ ফ্রিজে খাবার আছে কি না। কথা বলতে বলতেই দুম করে হামলা করলো। ”

ওদের কথা শুনে অথৈ বেকুব হয়ে গেছে। এতক্ষণে বুঝে গেছে কি ভুলটা সে করেছে।
নিবিড় রেগে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

“অথৈ, তোমার কি একটু ও কান্ড জ্ঞান নেই? কিছু না জেনে না বুঝেই এভাবে আমার বন্ধুদের মা*রলে? ”
“স্যরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি। ”

এতক্ষণে কাব্য ওয়াশরুম থেকে চোখ ডলতে ডলতে বের হয়।
“দোস্ত, আমার চোখ বুঝি এবার গেল। জ্বলে যাচ্ছে। ”

নিবিড় আরও রাগে কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অথৈ ভয়ে এক দৌড়ে ফ্রিজের কাছে যায়। ফ্রিজ খুলে বরফ বের করে নিয়ে কাব্যর কাছে আসে। কাব্য কে সোফায় বসিয়ে চোখে বরফ লাগিয়ে দেয় হালকা করে।

নিবিড় সবাই কে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলে অথৈ এর ব্যাপারে। শুনেই নীল বলে,

“কি ডেঞ্জা*রাস মেয়ে রে বাবা। তুই এখন না ফিরলে তো আমার দেহ থেকে মাথাটা আলাদা করে দিত। ”

রিদ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“অথৈ, তোমার আমাদের দেখে কোন দিক দিয়ে ডাকাত মনে হলো বলো তো দেখি। এত সুন্দর তিনটা হ্যান্ডসাম, স্মার্ট ছেলে। তাদের কিনা তুমি এক চুটকি তে ডাকাত বানিয়ে দিলে? ”

অথৈ রিদের দিকে তাকায়। মুখ কাচুমাচু করে বলে,
“আমি তো তোমাদের কাউকে চিনি না। আর সেভাবে ভালো করে মুখ দেখিনি। নিবিড় ও তোমাদের ব্যাপারে কিছু বলেনি। হুট করে কারোর বাসায় অচেনা তিনটা ছেলে কে দেখলে আমি ডাকাত ভাববো না? ”

ওর কথায় রিদ ভড়কে যায়। এমন পুচকে একটা মেয়ে তাকে কিনা তুমি করে বলছে! তাও আবার প্রথম পরিচয়েই? ”

নিবিড় রিদের ভাবনা টা বুঝতে পেরে বলে,
“আসলে অথৈ সবাই কে তুমি করেই বলে। এটা ওর অভ্যাস। কিছু মনে করিস না। ”
“না না কিছু মনে করছি না। ”

টমি ও সেখানে আসে। অথৈ সবাই কে টমির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। টমি নীলের কোলে বসে আছে। সবাই গিয়ে বাইরে বসে। অথৈ সবার জন্য চা আর হালকা নাস্তা রেডি করে নিয়ে যায়। সবাই মিলে খেতে খেতে আড্ডা দিতে থাকে। অথৈ কাব্যর কাছে যেয়ে পিঠে হাত রেখে নিচে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে।

“ভাইয়া, তোমার চোখ কি এখনো জ্বলছে? বরফ নিয়ে আসি? ”

কাব্য মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলো আরেক বার। কি মিষ্টি মেয়ে। কেমন বাচ্চামি দিয়ে ভরা। সেটা দেখলেই বোঝা যায়। ও যে অনুতপ্ত সেটা ওর চোখে মুখেই লেপ্টে আছে। কিভাবে এসে জিজ্ঞেস করছে এখনো জ্বলছে কিনা। তাহলে বরফ লাগিয়ে দেবে। কাব্য মাথা ঝাকালো।

“তেমন জ্বলছে না অথৈ। হালকা। সেরে যাবে এখনি। ”
“স্যরি গো ভাইয়া। এইযে কান ধরলাম। আর জীবনেও এমন করব না প্রমিস। ”

কাব্য ওর মুখ দেখে হেসে ফেলে। বাকিরা তখন ওদের খেয়াল করে। নীল ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস কর,
“এই কাহিনী কি রে? দুটো এমন ফিসফিস করে কি ফন্দি আটছিস? ”

কাব্য ওর হাতে থাকা চামচ দিয়ে নীল কে একটা খোঁচা মারে।

“চুপ কর ব্যাটা। বেশি কথা বলিস। ”
“বেশি কথা কখন বললাম। শুধু একটা প্রশ্ন করলাম। তাতেই এত ক্ষেপে গেলি বাপরে। ”

রিদ দুজনের পিঠ চাপড়ে দেয়।
“দুজনেই চুপ কর ভাই। সব সময় ঝগড়া লাগিয়ে দিস। দেখছিস না মেয়েটা ভড়কে যাচ্ছে। ”

ওরা চার বন্ধু জোরে হেসে ওঠে। অথৈ ফ্যালফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ও বুঝতে পারছে না। এরা কি নিয়ে হাসছে। এখানে তো হাসার মতো কিছু হয়নি? নাকি এদের পাগলাটে স্বভাব আছে। কে জানে?

বেশ কিছুদিন পর____
এখন অথৈ এর সাথে নিবিড়ের বন্ধুদের ভালো মিল হয়েছে। সবাই একদম ফ্রেন্ডলি মেলামেশা করে। অথৈ যা আবদার করে ওরা তিনজন সব শোনে। আর এক্সট্রা কেয়ার করার জন্য নিবিড় তো আছেই সাথে। এখানের সময় গুলো অথৈ এর কাছে পুরো স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। কি সুন্দর সব কিছু। জীবনের মানে টা বোধহয় এত বছর পর এখানে এসেই বুঝতে পারছে। উপভোগ করতে পারছে।

যখনি ওরা আসে। রিদ অথৈর পছন্দের চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম নিয়ে আসে। নীল এসে ওর সাথে লুডো খেলতে বসে যাবে। কাব্যর সাথে মারামা*রি লেগেই থাকে। নিবিড় ওদের সাথে মাঝে মাঝে খুনসুটি তে মেতে ওঠে।

আর সিগারেট নিয়ে সমস্যা এখনো আছেই। নিবিড় যখনি সিগারেট খায়। আগে অথৈ পেছন পেছন ঘুরতো। এখন সাথে টমি ও যোগ দিয়েছে। এদের যে কেন সিগারেটের ঘ্রাণ এত ভালো লাগে নিবিড়ের বুঝে আসে না। সব পাগল এসে তার ঘাড়েই জুটেছে।

নিবিড় লুকিয়ে ছাদে গিয়ে সিগারেট টানছে। একবার আশেপাশে আবার চোখ বুলিয়ে নিল। কেউ আছে কি না। কেউ নেই। ও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
হঠাৎ নিবিড় মিউ মিউ শব্দ শুনতে পেল। পেছনে তাকিয়ে দেখে অথৈ টমি কে কোলে নিয়ে ভ্রু নাচাচ্ছে। টমি লেজ নাড়িয়ে চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে আছে।

এই দৃশ্য দেখে নিবিড় পারে না ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে। সিগারেট নিচে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে আগুন নেভায়। অথৈ আরও একটু কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কি হলো নিবিড়, সিগারেট ফেলে দিলে কেন? আরেকটা এনে দেব? ”
“না বাপ। আর লাগবে না। আমি জীবনেও আর সিগারেট মুখে নেব না। শেষ। ”

“বলো কি! আমি ঘ্রাণ নিব কিভাবে তবে? ”
“চুপ করো তুমি। ”
“ওকে চুপ করলাম।

অথৈ ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। নিবিড় হুংকার ছাড়ে।

“এই যাবে তুমি এখান থেকে? ”
“যাচ্ছি তো। ”

এক দৌড়ে অথৈ নিচে চলে যায়।
_____
নিবিড় অফিসে গেছে। অথৈ সকাল থেকে বাসায় বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। নিবিড় কে ফোন করছে কিন্তু ধরছে না। পরে নীল কে ফোন করে।

“হ্যাঁ, হ্যালো অথৈ। ”
“ভাইয়া কোথায় তুমি? ”
“আমি তো অফিসে। ”
“নিবিড় ফোন ধরছে না কেন? ”
“ও এখন ব্যস্ত তাই। কোন দরকার? ”

“আমার এখানে একা ভালো লাগছে না। নিবিড় রুম থেকে বের হতে বারণ করে গেছে। কতক্ষণ এভাবে থাকা যায় বলো তো? ”

নীল ও ওর মতো করেই আহ্লাদি হয়ে বলে,

“নাহ, একদমই একা এত সময় থাকা যায় না। নিশ্চয় তোমার মন খারাপ হয়েছে। দাঁড়াও আমি ব্যবস্থা করছি। ”

খট করে ওপাশ থেকে নীল ফোন কেটে দিল। অথৈ আবার মন খারাপ করে বসে রইলো। ১৫ মিনিট পর বাসার সামনে থেকে গাড়ির হর্ণ শুনতে পায়। নীল ফোন করে আবার।

“অথৈ, আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি। দ্রুত তুমি ৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে এসো। আমরা ঘুরতে যাব আজ। ”

অথৈ এক দৌড়ে জামা বের করে নিয়ে আসে। চটজলদি পরে নেয়। হাতে থাকা রাবার ব্যান্ড দিয়ে চুলটা পেঁচিয়ে নিয়ে টমি কে কোলে তুলে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নামে। তারপর দৌড়ে যায় গাড়ির সামনে। নীল গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। অথৈ আসতেই দরজা খুলে দেয়।

“উফ! ভাইয়া তোমাকে বলা মাত্রই এভাবে অফিস বাদ দিয়ে চলে আসবে আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। ”
“এখন বিশ্বাস হয়েছে? ”
“হ্যাঁ, একদম। ”
“তাহলে গাড়িতে উঠে পরো। ”

অথৈ গাড়িতে বসে পরে। নীল ড্রাইভ করছে।
“এই ভাইয়া, আমরা কোথায় যাচ্ছি? ”
“তুমি বলো কোথায় যাবে। ”
“লং ড্রাইভ? ”

নীল মৃদু হাসে।
“ওকে। ”

নীল একটা গান ছাড়ে। হঠাৎ ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়। নীল কিছুটা বিরক্ত হয়।

“সিলেটের এই একটাই সমস্যা যখন তখন বৃষ্টি নামে। ”
“তুমি বিরক্ত কেন হচ্ছো ভাইয়া? বৃষ্টি ভালো লাগে আমার। গাড়ি থামাও না। ”

“মানে কি? গাড়ি কেন থামাবো? ”
“ভিজব আমি। ”
“এই একদম না। নিবিড় আমায় বকবে। ”
“উহু, কিচ্ছু বলবে না। ”
“বলবে। তুমি তো ওকে চিনো না। আমি চিনি। তোমার ঠান্ডা লাগলে আমার খবর করে দেবে। ”

অথৈ ঠোঁট উল্টায়। কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকায় নীলের দিকে। নীল ও অগত্যা মুখ কাচুমাচু করে তাকায়।

“আমায় বিপদে ফেলো না অথৈ। ”
“তবে জানালা খুলে দাও। ”
“একদম না। বৃষ্টির পানি ছিটে লাগবে। ”

শেষে উপায় না পেয়ে নীল গাড়ির দরজা খুলে দেয়। অথৈ নীল কে টেনে ধরে ওকেও বৃষ্টি তে ভেজায়। রাস্তার দু পাশে ছোট বড় কত পাহাড়। যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড়। কেমন সুখ সুখ লাগে এগুলো দেখলেই।

“ভাইয়া, এই জায়গা টা কি সুন্দর! ”
“হ্যাঁ, অনেক সুন্দর। ”
“আমাকে সবটা ঘুরে দেখাবে প্লিজ? ”
“দেখাব। তবে অন্যদিন। আজকে না। ”
“ঠিক আছে। ”

অথৈ খুশিতে আটখানা হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী এত সুন্দর কেন? নীলের ফোন গাড়িতে রেখে এসেছে। ওর ফোন বাজছে। কিন্তু ওরা বৃষ্টির শব্দে কিছু শুনতে পারছে না। ফোন বেজেই যাচ্ছে বার বার।

“অথৈ এখন চলো। ফিরতে হবে। ”
“আর একটু থাকি না ভাইয়া প্লিজ। ”
“আর এক মুহূর্ত ও না। তুমি মাত্র এসেছ সিলেট। এখনই অসুস্থ হলে একদমই চলবে না। ”

দুজনেই গাড়িতে এসে ওঠে। নীল ফোন ধরেই দেখে নিবিড় ৬ বার কল দিয়েছিল। নিশ্চয় অথৈ এর খোঁজ করতে। এবার আর ওর রক্ষে নেই। নীল ওর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। অথৈ বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে ফেলে।
____
চলবে

অথৈ মহল পর্ব-০৩

0


#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
চলো তোমাকে বাইরে নিয়ে যাই। বাইরে ঘুরে দেখলে তোমার মন আরও ভালো হয়ে যাবে।

অথৈ কে নিয়ে নিবিড় বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে শুধু সবুজে ঘেরা পাহাড়। মাঝখানের পাহাড়ের উপর নিবিড় দের বাসা। আশেপাশের সব চা শ্রমিকরা চা পাতা তুলছে। তাদের সেই নিজস্ব পোশাক। কাঁধে একটা ঝুড়ি। দুটো পাতাসহ কুড়িটা দুই আঙুল দিয়ে সুন্দর করে ছিঁড়ে ঝুড়ি তে রাখছে। কি সুন্দর দৃশ্য! শিল্পীর রংতুলি তে আঁকিয়ে রাখার মতো একটা দৃশ্য।

অথৈ কে এমন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিবিড় বলল,
“তোমার কফি কিন্তু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ”

নিবিড়ের কথায় অথৈ এর ঘোর কাটে। কফিতে চুমুক দেয়।

“বাহ! তোমার হাতের কফি ও কিন্তু দারুণ মজার। ”
“একটা ক্যাফে খুলে ফেলব নাকি তবে? ”

নিবিড়ের দুষ্টুমি কথা শুনে অথৈ হেসে ফেলে।
“হ্যাঁ, তুমি চাইলে নতুন ক্যাফে খুলে ফেলতেই পারো। আমি তখন তোমার ক্যাফে তে নিয়মিত যেয়ে কফি খেয়ে আসব। ”
“ইশ! তাহলে তো হয়েই গেল। ”

দুজনের ঠোঁটেই হাসি লেগে থাকে। অথৈ কিছু একটা ভাবে।

“জানো এখন আমার ছোট বেলার কথা খুব মনে পড়ছে। আমি যখন ছোট ছিলাম। তখন আব্বু আমাকে একটা চাকমাদের পোশাক কিনে দিয়েছিল। ওইটা পরে নাকি আমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল। তাই আব্বু ছবি তুলে বড় করে বাঁধাই করে তাদের রুমে রেখে দিয়েছে। ”

“সেই আব্বু কে ছেড়ে এসে কষ্ট লাগছে না? ”
“হ্যাঁ, হচ্ছে তো। ”
“বাসায় যাবে? ”
“না। গেলেই আমাকে বিয়ে করিয়ে দেবে। কিন্তু এখন আমি বিয়ে করতে চাই না। ”
“আচ্ছা। ”

“আমার পড়ালেখা এখনো কমপ্লিট হয়নি। পড়ালেখা শেষ করব। জব করব। তারপর বিয়ে নিয়ে ভাববো। ”
“বাহ! তাহলে তাই করবে।

হঠাৎ অথৈ একটা আবদার করে বসলো। ও নাকি চাকমাদের পোশাক পরে চা পাতা তুলতে যাবে। অগত্যা ওর কথা রাখতে নিবিড় অথৈর জন্য কিছু শাড়ি, চাকমাদের পোশাক আর ও যেগুলো পরে সব কিনে নিয়ে আসে। দুজন খাওয়া দাওয়া শেষ করে নেয়।

“নিবিড়? ”
“হু? ”
“তুমি কি জব করো? ”
“না। বিজনেস আছে আমাদের। ”
“তোমার বাবা এখানে আসে না? ”

“না। বাবা-মায়ের ডিভোর্স হবার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন। আমাকে ও নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মা যেতে দেয়নি। আমার ও ইচ্ছে হয়নি বাবার সাথে থাকার। যেখানে শান্তি পাবো না সেখানে গিয়ে কি লাভ। বাবা মাঝে মাঝে ফোন করে। খোঁজ নেয়। এইতো। ”

“আমি কি তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেললাম? ”

“আরে ধুর। এগুলো অনেক পুরনো কথা। সব পুরনো হয়ে গেছে। এখন সব স্বাভাবিক লাগে। সবাই সবার জায়গা থেকে ভালো থাকতে চায়। বাবা কেন তার ব্যতিক্রম হবে? যাইহোক, অনেক কথা হয়েছে। এবার এগুলো পড়ে এসো তো। রোদ উঠে গেছে। তোমার আর চা পাতা তোলা হবে না পরে। অবশ্য এখানে রোদ বৃষ্টির ঠিক নেই। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। ”

অথৈ পোশাক টা পড়ে নিল। তারপর আদিবাসীদের মতো করে সেঁজে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিবিড় কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকে। ও ভাবতে থাকে, একটা মানুষের মাঝে এত রকমের রুপ, সৌন্দর্য কিভাবে থাকতে পারে। ঠোঁটের উপরের ওই ছোট্ট তিলটা যেন সৌন্দর্য আরও দ্বিগুণ করে দিয়েছে।
অথৈ ওর দিকে তাকাতেই নিবিড় অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। দৃষ্টি সংবরণ করে। নিজেকে এই বলে বোঝায় যে, অন্য কোন মেয়ের দিকে এভাবে তাকানো উচিত নয় নিবিড়। দৃষ্টি নামা।

“এই, আমাকে কেমন লাগছে বলো তো? ”

নিবিড় না চাইতেও আরেকবার তাকায়।
“রঙিন প্রজাপতির মতো লাগছে। ”

অথৈ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
“সত্যি? ”
“১০০% সত্যি। ”
“প্রেমে পরেছো? ”
“এখনো পড়িনি। তবে পড়তে পারি। ”

নিবিড় চোখ টেপে। অথৈ চা বাগানে চলে যায়। নিবিড় ওকে ধরে ধরে পাহাড় থেকে নামিয়ে চা বাগানে নিয়ে যায়। অথৈ চা পাতা তুলতে থাকে। মাঝে মাঝেই হাসি দিচ্ছে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে। এই মুহূর্তটা ক্যাপচার না করলে চলে? একদমই না।

নিবিড় ফোন বের করে ক্যামেরা অন করেই অথৈর কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। যদিও অনুমতি ছাড়া কারোর ছবি তুলতে হয় না। কিন্তু কিছু সুন্দর মুহূর্ত পেতে চাইলে অনুমতির প্রয়োজন পরে না।

একটা ছবি তে অথৈ মুখে হাত দিয়ে হাসছে। প্রাণোচ্ছল সেই হাসি। আরেকটা তে চা পাতায় হাত দিয়ে ঝুঁকে আছে। আরেকটা তে কোমড়ে দুই হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। এমন আরও কিছু সুন্দর ছবি তুলেছে।

নিবিড় এই মুহূর্তে একটা সুখানুভূতি অনুভব করতে থাকে। যাকে বলা হয় “প্রেমময় সুখানুভূতি”।

হঠাৎ অথৈ ডেকে ওঠে।
“এই নিবিড় এদিকে এসো। ”
“হ্যাঁ, বলো। ”
“তুমিও চা পাতা তুলো। ভালো লাগবে। ”

তারপর দুজনেই চা পাতা তুলতে তুলতে গল্প জুড়ে দেয়। ওদের পাশেই কিছু চা শ্রমিক ছিল। তারা নিবিড় আর অথৈ কে দেখে মুচকি হাসে। প্রতিউত্তরে ও নিজেও হাসি দেয় ওদের দিকে তাকিয়ে।

অথৈ ওদের দিকে গভীর ভাবে তাকায়। দুজন মহিলা চা পাতা তুলছে। বাকিরা কিছুটা দূরে। শ্যামবর্ণের মানুষ গুলো কে দেখতে সুন্দর লাগছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের গায়ের রং এমন ছিল না। রোদের তাপে রোজ কাজ করে অযত্নে মুখ পুড়ে গেছে এমন লাগছে। কেমন মায়া মায়া ভাব।

অথৈ নিবিড়ের শার্ট খাঁমচে ধরে। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

“এই আমার না ওদের সাথে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ওরা কি আমার সাথে কথা বলবে? ”

নিবিড় ওর কথায় খুশি হয়। অহংকারহীন একটা মেয়ে। সবাই কিন্তু এদের সাথে কথা বলতে চায় না। উপরন্তু তাদের সংস্পর্শে বিরক্ত হয়। এজন্যই বোধহয় অথৈ বাকিদের থেকে আলাদা।

নিবিড় ও অথৈ এর মতোই ফিসফিস করে বলে,

“অবশ্যই কথা বলবে। কেন বলবে না। এরা কিন্তু অনেক আন্তরিক। বাইরে থেকে কেউ আসলে ভীষণ খুশি হয়। অতিথি পরায়ন তারা। ঘরে যাই থাকুক না কেন সেটা দিয়েই যত্ন করে আপ্যায়ন করার চেষ্টা করে। ”

“বাহ! দারুণ তো। ওরা কি আমাদের মতো করেই কথা বলবে? ”
“হ্যাঁ, আমাদের মতোই কথা বলবে। দাঁড়াও আমি কথা বলিয়ে দেই। ”

নিবিড় গিয়ে ওই দুই চা শ্রমিক কে ডেকে কথা বলে। ওর সাথের মেয়েটা ওদের সাথে কথা বলতে চায় শুনেই ওরা খুশি হয়। একজনের নাম মিতালী রানী আরেকজন স্বর্ণা রানী।

অথৈ ওদের সাথে হেসে সুন্দর ভাবে কথা বলে,
“আপনারা রোজ এখানে কাজ করেন? ”
“সোমবার থাইকা শনিবার কাম করি। সকাল ৮টা থাইকা সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত।
“অনেক্ষণ কাজ করতে হয় তো আপনাদের। বেতন ও মনে হয় অনেক দেয়। ”

ওর কথা শুনে মিতালী রানী ফিক করে হেসে দেয়।

“কি যে কও না মাইয়া। বেতন কই বেশি পাই। সারাদিন কাম কইরা পাই ১২০ টাকা। এই দিয়া কি সংসার চলে কও? ”
“বলেন কি! এত কম কেন? আমি ভাবলাম ৪-৫ হাজার টাকা দেয় হয়তো বা। ”

মিতালী আর স্বর্ণা এবার এক সাথে হেসে দেয় ওর কথা শুনে। এসব কথা নিবিড়ের জানা। সে চুপচাপ ওদের কথা শুনছে। অথৈ এর এই আগ্রহ গুলো ওর ভালো লাগছে। নিবিড় অথৈ কে এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়।

“অথৈ শোনো, ব্যাপারটা একদিনে ১২০ টাকা এরকমও না। মানে একজন চা শ্রমিক যদি দিনে ২৪ কেজি চা পাতা তুলতে পারে তাহলে সে পাবে ১২০ টাকা। বেশিরভাগ শ্রমিক ২৪ কেজি তুলতে পারেন না। ১৪-১৫ কেজি তোলেন সর্বোচ্চ। আর একটু বয়স্ক যারা তাদের চা পাতা তোলার পরিমাণ আরও কম। ফলে তারা পুরো টাকাটা ও পান না। ”

“কি বলছো! এটা কিন্তু ঠিক না। তাদের বেতন বাড়ানো দরকার। এই অঞ্চলে চায়ের চেয়ে রোমাঞ্চকর জিনিস আর কী আছে? আমাদের প্রেম, আড্ডা, গল্প, গান, বিপ্লব, বিদ্রোহ কোনো কিছুই চা ছাড়া হয় না। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, রেস্তোরাঁয় এক কাপ চায়ের দাম ৩০০-৪০০ টাকা। বড় অভিজাত রেস্তোরাঁয় আরও বেশি দাম।
আর এই দিকে যাদের মাধ্যমে আমরা চা পাতা পাচ্ছি। তাদেরকেই সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি না। বিষয়টা দুঃখজনক। ওদের সংসার কিভাবে চলে আমার মাথাতেই আসছে না। ”

“চা শ্রমিক রা অনেক দিন থেকেই দৈনিক ৩০০ টাকা পারিশ্রমিকের জন্য আন্দোলন করছে। আশাকরি এটা হয়ে যাবে। ”
“হয়ে গেলেই ভালো। ”

এর মাঝেই চা শ্রমিকদের মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়ে যায়। সবাই খেতে যাচ্ছে। তখনই স্বর্ণা নামের মেয়েটা নিবিড় আর অথৈ কে টেনে ধরে সামনের দিকে নিয়ে যায়। অথৈ বুঝতে পারে পারছে না কেন নিয়ে যাচ্ছে ওদের। নিবিড় ঠোঁট টিপে হাসছে। ও জানে কেন নিয়ে যাচ্ছে ওদের।

অথৈ দেখলো সবাই গোল হয়ে বসেছে। এখন ওদের খাবারের সময়। এটাও বুঝলো ওদের কে খাওয়ানোর জন্যই সাথে জোর করে স্বর্ণা নিয়ে এসেছে। নিবিড় কিছু বলছে না। অথৈ ওদের দেখে অবাক হচ্ছে।

অস্থির হয়ে বলে,
“আমরা খাব না কিছু। বাসায় চলে যাব এখনি। আপনারা খেয়েনিন। ”
“আমরা গরিব হইলে কি হইব, কাউরে কিন্তু অসম্মান করি না। স্যার এর সাথে আপনে প্রথম আইছেন। না খাওয়াইয়া তো যাইতে দিমু না। অল্প একটু খাইয়াই লাগবো। ”

অথৈ আনন্দিত হয়। এভাবে কেউ অচেনা মানুষদের আদর করে তা জানতেই পারতো না এখানে না আসলে। নিবিড়ের সাথে অথৈ ওদের মাঝে বসে পড়ে।

পরিশ্রান্ত কর্মযজ্ঞের ব্যস্ততায় ক্ষুধা জানান দেয়। পেটপূর্তির আয়োজন না হলে বাকি কাজ যে কাঙ্ক্ষিত গতিতে শেষ হবে না! তাই চাই বিরতি। খেতে হবে মধ্যাহ্নের খাবার। দরিদ্র শ্রমিকদের কপালে দামি খাবার জোটে না কোনো দিনই। তবে তারা যেটি খেয়ে থাকেন তা অনেকের কাছেই অজানা। অবিশ্বাস্যও বটে। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটে চা পাতার কুঁড়ি দিয়ে তৈরি হয় চা শ্রমিকদের ঐতিহ্যবাহী ভর্তা। মুখরোচক এই বিশেষ ভর্তার নাম ‘পাতিচখা।’

কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, তারা কেউ সকালে খেয়ে বের হন। কারও যদি সময় না থাকে তবে ছুটতে হয় খাবার নিয়েই। মধ্যাহ্নের খাবার বলতে সঙ্গে নিয়ে আসেন কেউ চাল ভাজা, কেউবা রুটি, কেউ কেউ মুড়ি, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা কিংবা শুকনো মরিচ এবং লবণ। সেগুলির সাথে চায়ের কুঁড়ির পাতা মিশিয়ে বানানো হয় বিশেষ ধরনের চা পাতার ভর্তা (পাতিচখা)। যা তাদের মধ্যাহ্নভোজের নিত্যসঙ্গী।
আলাপকালে জানা যায়, ক্লান্ত দুপুরে পাতিচখা খেয়ে দুর্বল স্নায়ু আবার সবল করে নেন। আবার শুরু হয় কর্মযজ্ঞ।

ওদের মধ্যেই একজন কচি পাতাগুলো একদম কুচিকুচি করে তাতে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, সেদ্ধ আলু আর চানাচুরকে সরিষার তেল দিয়ে সুন্দর করে মাখিয়ে নেয়। দেখতে এত সুন্দর আর লোভনীয় লাগছে যে অথৈর দেখেই জিভে পানি চলে আসছে।

একজন ভাতের পাত্র বের করে। ভাত গুলো বড় পাত্রে রেখে কাপড় দিয়ে বেঁধে রেখেছিল পাত্রের মুখটা। তাই এখনো হালকা গরম আছে। সবাই মিলে খাওয়া শুরু করলো। অথৈ গরম ভাতের সাথে পাতিচখা ভর্তাটা মাখিয়ে এক লোকমা মুখে নিয়ে শান্ত ভাবে খেয়ে নিল। তারপর খুশিতে জোরে একটা চিৎকার দেয়। উপস্থিত বাকি সবাই ওর চিৎকারে হকচকিয়ে যায়। নিবিড় ওর স্বভাব সম্পর্কে জানলেও বাকিদের তো জানা নেই।
নিবিড় সবাই কে শান্ত হয়ে খেতে বলে।

অথৈ সবাই কে জানালো খাবার টা কতটা মজার। এত মজার খাবার খুব কম খেয়েছে সে। চা শ্রমিকরা ও ওদের অল্প আপ্যায়ন করতে পেরেও খুশি হলো।

খাওয়া শেষে নিবিড় আর অথৈ সবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায়। বিদায়ের সময় স্বর্ণা মিতালীসহ বাকিরা ও ওদের একবেলা করে খাওয়ানোর জন্য অনুরোধ করে। নিবিড় সবাই কে কথা দেয় সময় করে একদিন এক এক করে সবার বাড়িতেই নিয়ে যাবে অথৈ কে। ওরা সবাই খুশি হয়।
_____
“নিবিড় ছাদে যাও। আমি দু মগ চা নিয়ে আসছি এখনি। ”
“আজ কি জ্যোৎস্না বিলাস হবে নাকি হু? ”

অথৈ নিবিড়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে গলা টা নিচে নামিয়ে বলে,
“জ্যোৎস্না বিলাস হলে মন্দ হবে নাকি জনাব? ”
“উহু, একদমই না। ”

অথৈ চা বানিয়ে নিয়ে নিবিড়ের হাতে দেয়। নিবিড় চা’য়ে চুমুক দিয়েই অথৈ এর দিকে তাকিয়ে হাসে।

“ভালো হয়নি? ”
“চমৎকার হয়েছে। ”
“হি হি, জানি আমি। ”

“চাঁদটা অনেক সুন্দর তাই না? ”
“হ্যাঁ, পুরো আকাশ জুড়ে নক্ষত্ররা জ্বলজ্বল করছে। আর সবার মাঝখানে চাঁদটা যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ”

“অসম্ভব সুন্দর একটা মুহূর্ত! ”
“আমার না চাঁদটা ধরে টুপ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ”
“হা হা, তাই নাকি। ”
“হ্যাঁ, তো। ”

“অথৈ, ”
“হুঁ? ”
“চাঁদের কি অহংকার হয় না? ”
“কেন হবে? ”
“এই যে, কতশত প্রেমিক তার প্রেমিকা কে চাঁদ নিয়ে আসার কথা বলে। যদি সম্ভব হতো তবে বোধহয় এতদিনে আমরা আর চাঁদের আলো দেখতে পেতাম না। সব প্রেমিকরা এক মুঠো করে চাঁদ তার প্রেমিকার জন্য নিয়ে যেতো। ”

নিবিড়ের এমন মজার কথা শুনে দুজনেই হাসে। মাঝখানে টমি এসে দাঁড়িয়েছে। নিবিড় টমি কে কোলে নিয়ে বলে,

“কি রে টমি? চাঁদে যাবি? ”

টমি মিউ মিউ করে ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়। যেন ও ঠাট্টা করে বলছে, এহ! নিজেরাই যেতে পারে না। আবার আমায় বলে।
______
পরদিন সকালে নিবিড় কি যেন খুঁজছে আর সিগারেট টানছে। আর নিবিড় যেদিকে যাচ্ছে। তার পেছন পেছন অথৈ ও সেদিকেই যাচ্ছে।
নিবিড় সেটা খেয়াল করে দাঁড়িয়ে যায়। অথৈ ও দাঁড়িয়ে থাকে। নিবিড় আবার অন্য জায়গায় যায়। অথৈ ও যায়।

ওর এমন কান্ড দেখে নিবিড় বলে,
“কি হচ্ছে? আমার পেছন পেছন ঘুরছো কেন? কিছু লাগবে? ”

অথৈ মাথা ঝাঁকিয়ে না সূচক মাথা নাড়ে।

“তাহলে? ”
“সিগারেট এর ঘ্রাণ টা আমার কাছে দারুণ লাগে। তাই তোমার পেছন পেছন ঘুরে ঘ্রাণ নিচ্ছি। ”
“সিগারেটের ঘ্রাণ তোমার ভালো লাগে! ”
“লাগে তো। ”
“অদ্ভুত মেয়ে তুমি! ”
“হি হি, এখন বুঝলে সেটা? আমি তো সবার থেকেই আলাদা। একদম অন্যরকম। ”
“বুঝলাম এখন থেকে আর বাসায় সিগারেট খাওয়া যাবে না। ”
“কেন? ”
“আমার সাথে সাথে তোমার আয়ু ও কমে যাবে। ”
“কচু হবে। ”

“আচ্ছা অথৈ শোনো, আমি বাইরে যাব একটু। দরকার আছে। তুমি বাইরের দরজাটা ভালো করে লক করে নিজের রুমে গিয়ে বসে থাকবে। একদম পাকনামি করে বাইরে বের হবে না। বাজে ছেলে আছে আশেপাশে অনেক। সুন্দর মেয়ে দেখলেই টুপ করে গিলে খাবে বুঝলে? ”

“এই ভয় দেখাচ্ছো কেন? ” আমি কি কাউকে ভয় পাই? ”

নিবিড় অথৈ এর গালে হাত রেখে বলে,
“সব জায়গায় সাহস দেখালে কাজ হয় না মেয়ে। আমি ফিরলে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাব। আপাতত লক্ষি মেয়ের মতো রুমেই থেকো প্লিজ। ”
“আচ্ছা, থাকব। ”

নিবিড় হেসে বাইরে চলে যায়।
_____
চলবে____

অথৈ মহল পর্ব-০২

0


#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
দুজনেই চুপ করে বসে আছে। নিবিড় মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকায়। ওর মাথার উপরের দোপাট্টা টা খুলে ফেলেছে। চুল গুলো খোঁপা করা। খোঁপায় এক গাদা গোলাপ ফুল দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রাউন কালার চোখের মণি। খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে সেই চোখ দুটো। একদম বিড়ালের মতোই আদুরে লাগছে। ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক। গায়ের রং টা ধবধবে ফরসা হওয়ায় লাল বেনারসিতে দারুণ মানিয়েছে। আর নাকের নোলক টা তো সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এক কথায় যাকে বলা হয় অপ্সরী।

দীর্ঘ জার্নির পর ওরা সিলেট পৌঁছায়। অথৈ শুধু চারপাশের দৃশ্য গুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ১৫ মিনিট পর ওরা বাসায় যায়। অথৈ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নিবিড়ের বাসাটা পাহাড়ের উপর। সুন্দর করে পাহাড় কেটে সামনে রাস্তা বানানো হয়েছে। সেই সিঁড়ি দিয়েই উপরে ওঠে যেতে হয়। বাসার চারপাশে চা বাগান।

“বাহ! তোমার বাসাটা কি সুন্দর। কত সুন্দর জায়গা এটা। চারপাশে চা বাগানে ঘেরা। একদম সবুজে সবুজময়। মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ। আচ্ছা, এই চা বাগান গুলো কার? ”

“আমাদের। ”
“সব গুলো তোমাদের? ”
“হ্যাঁ, সব গুলো আমাদের। আগে অন্যজনের ছিল। পরে বাবা কিনে নিয়েছেন। ”

ওরা কথা বলতে বলতে বাসার ভেতর যায়। অথৈ আবার কথা বলা শুরু করে।

“জানো? আমি এর আগেও একবার আব্বু-আম্মুর সাথে সিলেটে এসেছিলাম। কিন্তু তখন রিসোর্টে উঠেছিলাম। তাও আবার ২ দিনের জন্য। তাই সেভাবে কিছু দেখা হয়নি। ”

“এখন সব দেখে নিও। ”
“তোমার বাসাটা অনেক সুন্দর। আমাদের বাসাটা এর থেকেও অনেক বড়। কিন্তু এত সুন্দর না। আচ্ছা, তোমার বাসায় আর কাউকে দেখছি না তো? বাকিরা কোথায়? ”

“কেউ নেই এখন। আপাতত আমি একাই। ”
“কেন তোমার বাবা-মা কোথায় থাকে? ”
“মা আর ছোট বোন গিয়েছে চট্টগ্রাম। খালামণির বাসায়। আর বাবা অস্ট্রেলিয়া থাকেন। পরে বলব সেসব কথা। ”

অথৈ কাঁধ ঝাঁকিয়ে মাথা নাড়ায়। নিবিড় ওকে নিয়ে উপর তলায় যায়। নিবিড়ের রুমের বিপরীতেই আরেকটা রুম আছে। সেই রুমেই অথৈ কে থাকতে দেয়।

“রুম পছন্দ হয়েছে তো? ”
“হ্যাঁ, একদম রিসোর্ট এর মতো। অনেক সুন্দর। খুব গোছানো তোমাদের বাসাটা। কিন্তু এই বাসায় তোমাদের একা থাকতে ভয় লাগে না? আশেপাশে কোন বাসা নেই। কেমন মরুভূমি টাইপ। ”

নিবিড় বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করে,
“আমাদের তো ভয় করে না। অভ্যাস হয়ে গেছে। তোমার ভয় করছি নাকি হু? ”
“আরে না, অথৈ কখনো কাউকে ভয় পায় না বুঝেছো? ”

“বুঝলাম দুঃসাহসী রমণী। ওয়াশরুমটা ডান দিকে। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নাও। আমি খাবার রেডি করি। ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়। ”

অথৈ ফ্রেশ হয়ে ওর মা কে কল দেয়। তারপর এদিকের সব কথা তার মা কে জানায়।
বেশ খানিকক্ষণ কথা বলে এলোমেলো ভাবে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে যায় ওভাবেই।
_____
ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙ্গে। কিছুক্ষণ আশেপাশে তাকিয়ে থেকে ভাবার চিন্তা করে সে এখন কোথায়। এখন কি রাত নাকি দিন। অনেক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর সব কিছু মাথায় আসতেই লাফিয়ে ওঠে ফ্রেশ হতে যায়। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রুমে টমি কে দেখতে পায় না।

অথৈ নিচে নামে। কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। ও সেদিকে যায়। নিবিড় রান্না করছে কিছু একটা। আর টমি ওর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। দুজনের বেশ ভালোই মিল হয়েছে।

অথৈ উঁকি দেয়।
“ভেতরে আসো। উঁকি দিতে হবে না। ”

অথৈ চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। ভাবতে থাকে, কি দরকার ছিল চোরের মতো উঁকি দিয়ে দেখার? মাথায় একটা চাটি ও মারে। তারপর ভেতরে ঢুকে যায়। আড়চোখে নিবিড় ওকে দেখে ঠোঁট চেপে হাসি থামায়।

“এই তুমি রান্না করতে পারো? ”
“হ্যাঁ, পারি তো। রান্না করতে ভালো লাগতো টুকটাক। তাই মায়ের কাছে সব রান্না শিখে নিয়েছি। ”

“একটা কাজের লোক রাখলেই পারো। তাহলেই তো আন্টি চলে গেলে তোমার রান্না করতে হতো না। ”
“রেখেছিলাম। কিন্তু তার রান্না আমি আর নবনী খেতে পারতাম না। তাই পরে আর কাজের লোক রাখা হয়নি। ”

“নবনী তোমার বোন? ”
“হ্যাঁ, ”
“বেশ সুন্দর নাম তো। তোমার নামটা ও অনেক সুন্দর। এই প্রকৃতির মতোই। ”

নিবিড় হেসে ফেলে।
“তোমার নামটা ও কিন্তু অনেক সুন্দর। অথৈ, তোমার নামের অর্থ টা- খুব গভীর বোঝায় তাই না? ”
“হুম, যাকে কখনো ছোঁয়া যায় না। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ”

নিবিড় ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আসলেই কি তুমি ধরা ছোঁয়ার বাইরে? এই তুমি আবার সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসোনি তো? মায়াবী মৎসকন্যা তুমি? ”

নিবিড়ের কথার ধরনে অথৈ জোরে হেসে ওঠে। গা কাঁপিয়ে হাসতে থাকে। ওর হাসি দেখে নিবিড় ও হেসে ফেলে। হাসি অনেক টা ছোঁয়াচে রোগের মতোই।

“আমি তো মৎস্যকন্যা। সমুদ্রের তলদেশে থাকি বুঝলে? ”

নিবিড় মাথা নাড়িয়ে স্বায় দেয়,
“হুম বুঝলাম। তোমার মাধ্যমে তবে বোধহয় আমার সমুদ্রের তলদেশ দেখার সুযোগ হবে। দেখাবে তো আমায়? ”

অথৈ নিবিড়ের দুষ্টুমি কথাগুলো তে খুব মজা পায়।

“আচ্ছা, আমি যে তোমাকে তুমি করে বলি। তুমি কি কিছু মনে করো? আসলে আমি কারোর সাথে আপনি করে বলতে পারি না। তুমিতেই কমফোর্ট ফিল করি। ”

নিবিড় রান্নার ফাঁকে ফাঁকে অথৈ কে খেয়াল করছে। এই মেয়ে এক জায়গায় চুপ করে শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। হাঁটাচলা ওকে করতেই হবে। ওর থেকে টমি বেশ শান্ত।

নিবিড় উত্তর দেয়।
“প্রথমে একটু অদ্ভুত মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন আর হচ্ছে না। মনে হচ্ছে,তোমাকে এভাবেই মানায়। কিছু মানুষের জন্য বাকি সব নিয়ম থাকতে নেই। তাদের কে নিজেদের মতো থাকতে দেওয়া উচিত। সেই তেমন মানুষ টা তুমি। প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। ”

“ইশ! তুমি খুব সুন্দর করে কথা বলো তো। আমার অনেক ভালো লাগছে। ”
“তাই? ”
“হ্যাঁ, এই কি রান্না করছো তুমি? চিকেন ফ্রাই বানালে? ”
“হ্যাঁ, আর সাথে পরোটা। পছন্দ তোমার? ”
“ইশ! ভীষণ। দেখো আমার জিভে পানি এসে গেছে। ”

অথৈ কথাটা বলেই জিভ টা সুন্দর করে ঠোঁটের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল। নিবিড় ওর এমন বাচ্চামি দেখে হেসে ফেলে জোরে। অথৈ ও ওর দিকে বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে হেসে ফেলে। টমি অথৈ এর পা চাটতে থাকে আর মিউ মিউ করে। টমিকে কোলে তুলে নেয়।

নিবিড় কে জিজ্ঞেস করে,
“ওকে খেতে দিয়েছিলে? ”
“হ্যাঁ, দুধ ভাত দিয়েছিলাম। এক বাটি পুরো দুধ খেয়েছে। ”

অথৈ খুশি হয়। টমি কে আদর করে দিয়ে মাথায় একটা চুমু দেয়। নিবিড় অথৈ কে ডাকে।

“ম্যাম, টেবিলে আসুন। খাবার রেডি। প্লিজ খেয়ে বলবেন রেস্টুরেন্টের শেফ হওয়ার যোগ্যতা রাখি কি না। ”

নিবিড়ের বলার ভঙ্গিমায় অথৈ হেসে ওঠে। তারপর পরোটা অল্প একটু ছিঁড়ে নিয়ে চিকেনসহ মুখে নিয়ে চিবিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। মুখের খাবার টুকু শেষ করতেই অথৈ লাফিয়ে ওঠে। নিবিড় ভড়কে যেয়ে আরও দু কদম লাফিয়ে পেছনে চলে যায়। টমি ও জোরে মিউ মিউ করে ওঠে।

তারপর অথৈ বলে,
“আরে বাহ! তুমি তো বেশ দারুণ রান্না করো। একদম দুর্দান্ত। রেস্টুরেন্টের শেফদের থেকে তুমি বেস্ট। ”

নিবিড় বুকে কয়েক বার থুতু দিয়ে বলে,
“অথৈ, ধীরে খাও। ধীরে কথা বলো। আশেপাশের মানুষদের কি হার্ট অ্যাটাক করে মেরে ফেলবে নাকি। একটু হলেই তো আমার অ্যাটাক-ফ্যাটাক হয়ে যেত। ”

অথৈ শুধু হাসে। যাই হয়ে যাক না কেন এই মেয়ে শুধু হাসতেই থাকে। বাকি খাবার টুকু চুপচাপ বসে খায়। নিবিড় ও খেয়ে নেয়। অবশ্য নিবিড় ওর খাওয়া দেখছিল। কি মজা করে খাচ্ছিল।

রাত বাড়তে থাকে। ওরা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে। তারপর দুজন যার যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। টমি ও অথৈ এর কোলের মাঝে গিয়ে ঘুমায়।
_____
সকালে সূর্যের আলো মুখে পরতেই অথৈর ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সকালের মিষ্টি রোদটা উপভোগ করতে থাকে।

একটু পর দরজায় নিবিড় নক করে।
“অথৈ, উঠেছো?
“হ্যাঁ, ”
“আসব কি? ”
“এসো। ”

নিবিড় দুই মগ কফি নিয়ে এসেছে। সকাল সকাল মৃদু একটা হাসি অথৈ কে উপহার দিয়ে একটা মগ ওর হাতে দেয়।

“সুপ্রভাত ম্যাম। ”
“সুপ্রভাত। ”
“নতুন জায়গায় ঘুম কেমন হলো তোমার? ”
“দারুন। এক ঘুমে রাত শেষ। ”

অথৈ হাসলো। নিবিড় ও হাসি দেয়।

“তুমি চাইলে আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারো কিন্তু। ”
“আসলেই? ”
“হ্যাঁ। ”

নাম ধরে ডাকার অনুমতি পেয়ে অথৈ খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। নিবিড় এটাও খেয়াল করেছে, এই মেয়ে অতিরিক্ত খুশি হলে সেটা লাফিয়ে উঠে প্রকাশ করে। বাচ্চারা যেমন নতুন খেলনা পেলে খুশি হয়। ঠিক তেমন।

“তোমার টমি কই? ”
“কি জানি। নতুন জায়গা পেয়ে সে আমাকে রেখেই কোথায় কোথায় যেন একা একা চলে যাচ্ছে। ”
“তাহলে জায়গা টা ওর ও নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে অনেক। ”
“হ্যাঁ, এত সুন্দর জায়গা। পছন্দ না হয়ে উপায় আছে বলো? ”

নিবিড়ের ওর বাকবাকুম করা কবুতরের মতো কথা শুনতে ভালো লাগছে। মন ভালো করার মতো মেয়ে। অনেক্ষণ বিরক্ত ছাড়াই আড্ডা দেওয়া যায়। বাচ্চাদের সাথে থাকতে যেমন বিরক্ত লাগে না। এই মেয়েটা ও তেমন। অনেকটাই বাচ্চা বাচ্চা টাইপ।
_____
চলবে

অথৈ মহল পর্ব-০১

0

(১)
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
মন খারাপ যেভাবে পাল্লা দিয়ে ভারি হয়ে আসে। তুমি ও ঠিক সেই ভাবে মন খারাপের দিনে হুড়মুড়িয়ে চলে এসে ছিলে নীলাভ এক রাত্তিরে। যেভাবে ভোরে সূর্যের সূচনা হতেই রোদেরা ঝুপ করে জানালার থাই গলিয়ে বিছানায় এসে শরীরের আনাচে কানাচে ভরিয়ে দেয়। ঠিক সেই ভাবেই তুমি ঝুপ করে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে চলে এসে ছিলে হৃদয় গলিয়ে। যেভাবে টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ে। মনে হয় যেন অষ্টাদশী তরুণী নূপুর পায়ে রিনিঝিনি শব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক সেই ভাবেই রুমঝুম করে তোমার আগমন আমায় রাঙিয়ে দিয়েছিল। যেভাবে ষোড়শী রমণী প্রেমে পরলে গাঢ় করে পায়ে আলতা রাঙায়।

তুমি আমার সমুদ্রের বিশাল জলরাশি,
আর আমি তোমার আসমানের নীল।

৪ বছর হয়ে গেল! অথচ আজও অথৈ কোমা থেকে ফেরেনি। বার বার মনে হয় এই বুঝি অথৈ আমাকে ‘নিবিড়’ বলে বলে ডাক দেবে। কিন্তু সেটা এই ৪ বছরে একবার ও হয়নি। যেই মেয়েটা সারাদিন বকবক করে সবার মাথা খারাপ করে দিত। আজ সেই মেয়েটাই আইসিইউ এর ভেতর নিথর হয়ে পড়ে আছে। বাইরের আলো বাতাস না পেয়ে মেয়েটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মুখের দিকে তাকালেই বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে।

আচ্ছা, অথৈ তুমি যখন কোমা থেকে ফিরে আসবে তখন তোমার পাশে আমাকে দেখে কি আনন্দে কেঁদে ফেলবে? নাকি ভীষণ ভাবে চমকে যাবে? আমি জানি, রোজকার সেই ভুবন ভোলানো হাসি টা দেবে তুমি। অথৈ একবার তোমার চোখ খুলে দেখ, টমি তোমার অপেক্ষায় রোজ বসে তোমার ফেরার দিন গুনছে। সে ও তোমার অপেক্ষায় আছে এত গুলো বছর ধরে। জানো তো? আমাদের বাচ্চা টমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তুমি কবে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে বলো তো? তুমি জানো তো, আমার তোমাকে ছাড়া কত কষ্ট হয়। খুব মিস করি তোমার দুষ্টুমি গুলো।

সেই দিনটার কথা সব সময় মনে পড়ে। যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। একদম নাটকীয় সাক্ষাৎ তাই না বলো?

‘ফিরে দেখা’__
______
নিবিড় ট্রেনে উঠে ব্যাগটা কামরায় রেখে বাইরে যায় সিগারেট কিনতে। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে স্টেশনেই একটা সিগারেট ধরায়। কয়েক বার সুখ টান দেয়। দুই আঙ্গুলের ভেতর জ্বল জ্বল করে জ্বলছে সিগারেট। একটা করে টান দিয়ে মুখ দিয়ে একেক সময় একেক স্টাইলে ধোঁয়া ছাড়ছে। যে কেউ দেখলেই ভাববে চেইন স্মোকার। শেষ টান টা দীর্ঘ করলো। তারপর নিচে ফেলে পা দিয়ে আগুন টা নিভিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে।

ওর কামরায় পা দেওয়া মাত্র ভুত দেখার মতো চমকে উঠে দু কদম লাফিয়ে পেছনে চলে যায়। সচরাচর নিবিড় এভাবে ভয় পায় না। কিন্তু এখন হঠাৎ আচমকা ভয় পেয়ে গেছে। তার কামরায় বসে থাকা মেয়েটা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কোলের মধ্যে একটা বিড়ালছানা। বিড়ালটা ও গোল গোল চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে।

বউ সাঁজ! নিশ্চয় বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে। এইটুকুনি মেয়ে তার কি সাহস বাবা!

মেয়েটাই কথা শুরু করে,
“কি সমস্যা? ওই ভাবে লাফিয়ে গেলে কেন? আমি কি ভুত? ”

নিবিড় চোখ কচলায়। কিছু একটা ভাবে। কি বলবে ভাবছে।

“ম্যাম, আপনি এখানে! এই ভাবে? ”

মেয়েটা ভ্রু কুঁচকায়।
“আমি আবার তোমার ম্যাম হলাম কিভাবে? আমার তো মনে পড়ছে না আমি কোনদিন কোনো স্কুলের টিচার ছিলাম। ”

নিবিড় এবার থতমত খায়। তারপর চুপচাপ সামনের সিটে গিয়ে বসে।

“না মানে, অপরিচিত তো। তাই ম্যাম বলে সম্বোধন করলাম। ”
“থাক এত ভদ্রতা দেখাতে হবে না। আমি অথৈ। অথৈ জাফরিন। নাম ধরে ডাকবে বুঝলে? ”
“জি। ”

নিবিড় আর কিছু বলে না। এই বয়সের মেয়েরা একটু চটপটে স্বভাবের হয়। অথৈ মেয়েটাও ঠিক তেমন। এই বয়সের মেয়েরা নিজেদের সব কিছু থেকে আলাদা ভাবে। আরও অনেক অনেক পরিবর্তন আসে। যাইহোক, নিবিড় কানে ইয়ারফোন গুজে চোখ বন্ধ করে রাখে। গান শুনছে না। এমনিতেই।

এর মাঝেই অথৈর কল আসে।

“আম্মু, আমি ট্রেনে উঠে পরেছি। তুমি কোন চিন্তা করো না। আব্বু কেও সামলিও। ”
“______”
“আমার থাকা নিয়ে কোনো চিন্তা করো না তুমি আমি ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নেব। ”

“______ ”
“আল্লাহ হাফেজ আম্মু। ”

অপর পাশের কোন কথা নিবিড় শুনতে পায়নি। শুধু মেয়েটার বলা কথা গুলো শুনতে পায় সে। নিবিড় যা বুঝলো, মা-মেয়ের কথা শুনে সে হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। মা তার মেয়ে কে পালাতে সাহায্য করছে। এটাও কি সম্ভব? কি দুনিয়া আসলো!

অথৈ নিবিড়ের সামনে আঙ্গুল দিয়ে চুটকি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে।

“এইযে শুনছো? ”

নিবিড় আরও একবার ভড়কায়। এই পুচকে মেয়ে সেই তখন থেকে তাকে তুমি করে বলছে? তাও আবার অচেনা একজন মানুষ কে। এমন ভাবে ডাকছে যেন ওর বিয়ে করা বউ। তবুও নিবিড় বিস্মিত ভাবটা চেপে রেখে উত্তর দেয়।

“জি, বলুন। ”
“ট্রেনটা কোথায় যাচ্ছে? ”
“কেন আপনি জানেন না? ”

অথৈ দু দিকে মাথা নাড়ায়। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকে।

“নাহ তো। আমি দৌড়ে এসে শুধু টিকেট কেটেই ট্রেনে উঠে পরেছি। ”

নিবিড় কপাল চাপড়ায়। এমন মহা পাগল সে আগে কোনদিন দেখেনি।

“ট্রেন টা এখন সিলেট যাচ্ছে। ”
“ওহ, তোমার বাসা কি সিলেট? ”

“হ্যাঁ, আচ্ছা ম্যাম আপনার জন্য কোথাও কেউ অপেক্ষা করছে কি? জানতে পারি সেটা? মানে একা ছোট একটা মেয়ে তাই জানতে চাইলাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ। ”

অথৈ কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। কিছুক্ষণ হেসে তারপর হাসি থামিয়ে বলল,

“আমার জন্য কোথাও কেউ অপেক্ষা করছে না। আব্বু আমাকে তার এক বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগে ছিল। কতবার আব্বু কে বললাম, আমি ওই ছেলে কে বিয়ে করব না। কিন্তু আব্বু আমার কথা শুনছিলই না। শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না পেয়ে সিনেমাটিক ভাবে বউ সাঁজে লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি। আর এই পুরো ব্যাপার টা তে আম্মু আমাকে সাহায্য করেছে। কারণ, আম্মুরও ওই ছেলে কে পছন্দ না। ”

কথা শেষ করেই অথৈ বিশ্ব জয় করা হাসি দিল। যেন সে মস্ত বড় একটা কাজ করে ফেলেছে। তার কথা শেষ হতেই নিবিড় জিজ্ঞেস করল,

“সে কি! এত ছোট মেয়ে কে কেউ বিয়ে দেয়? পুলিশে খবর দিলেই তো হয়ে যেত। তাহলে আপনাকে আর এভাবে পালাতে হতো না। ”

অথৈ চিন্তিত হয়ে পড়ে। মাথা চুলকায়। গালে হাত দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ কি যেন ভাবে। তারপর নিবিড়ের দিকে তাকায়।

“এভাবে চিন্তা করিনি জানো? কিন্তু পুলিশে জানালে ও কিছু হতো না। আমার আব্বুর অনেক টাকা তো। পুলিশ কে চুপ করিয়ে দিত। ”

নিবিড় বুঝতে পারে ব্যপার টা। তাই ওই সম্পর্কে আর কিছু বলে না।

“তাহলে আপনি এখন কোথায় থাকবেন? ”
“বলব না। ”

অথৈ মুখ ভেংচি দিল। নিবিড় কিছু বলল না।

“বলব, তাহলে আমাকে তুমি ‘আপনি’ করে বলা বাদ দাও। ”

একদম বাচ্চামি আবদার। নিবিড়ের কেন যেন ভালো লাগল।

“আচ্ছা, তুমি করেই বলছি। তো এখন তুমি কোথায় থাকবে? মানে কার বাসায় গিয়ে উঠবে। ”
“তোমার বাসা কত বড়? ”

নিবিড় আরও একবার অবাক হয়। সে কি জিজ্ঞেস করল। আর এই মেয়ে কি বলল।

“কি হলো, বলছো না কেন? ”
“আমার ডুপ্লেক্স বাসা। কিন্তু অনেক বড়। ”
“রুম খালি আছে? ”
“হ্যাঁ, আছে। ”
“তাহলে আমি তোমার বাসায় থাকব। আমি যদি তোমার বাসায় থাকি। তাহলে কি তোমার কোন সমস্যা হবে? ”

একদম নিঃসংকোচ আবেদন। অচেনা একটা ছেলে কে বলছে তার সাথে তার বাসায় থাকবে। নিবিড় ভাবলো, মেয়েটার এখন অনেক বিপদ। কোথায় যাচ্ছে জানে না। কাউকে চেনে ও না। ও সাহায্য না করলে নিশ্চয় অন্য কোন ছেলের কাছে যেয়ে সাহায্য চাইবে। সব ছেলেই তো আর ভালো নয়। মেয়েটার সরলতার সুযোগ নিতে পারে।

নিবিড়ের উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে।

“কিছু বলছ না কেন? আমি তোমার বাসায় থাকলে তোমার কোন সমস্যা হবে? ভয় পেয়ো না। ফ্রি তে থাকব না। তোমাকে প্রতি মাসে ভাড়া দেব। জানো? আমার কাছে ২ লাখ টাকা আছে। আর অনেক গুলো গয়না ও আছে। ”

নিবিড় আচমকা অথৈ এর মুখ চেপে ধরে। ফিসফিস করে বলে,

“পাগল তুমি? এগুলো কথা কেউ এত জোরে বলে? চুপ করো। শরীরে একটু ও ভয় নেই। আমার বাসায় থাকতে চাইছো। আবার আমাকে এগুলো বলছো। যদি বাসায় নিয়ে গিয়ে তোমায় খুন করে সব কিছু আমি নিয়ে নেই? ”

অথৈ আবারও খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। ওর হাসি এবার আর থামছে না। গা কাঁপানো হাসি। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে কথা বলা শুরু করে।

“আমি ছোট থেকেই কারাতে, কুংফু সব ধরনের মারামা*রি শিখেছি। ”

তারপর সে তার ব্যাগ খুলে নিবিড় কে দেখায়। নিবিড়ের এবার বিষ্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ব্যাগের ভেতর মরিচের গুড়ো, ছুড়ি, কাঁচি, দাঁ, ছোট চাকু, হারপিক ইত্যাদি।

“আচ্ছা, হারপিক কেন? টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য? ”
“আরে ধুর, যদি কোন ছেলে বাজে কিছু বলে তবে মেরে একদম হারপিক খাইয়ে দেব। ”

“আমি কিন্তু তোমাকে একদম সহজ-সরল মেয়ে মনে করেছিলাম। কিন্তু তুমি ডেঞ্জা*রাস!
“হি হি, মানুষ যা দেখায়। মানুষ কিন্তু আসলে তা না। ভেতরে ভেতরে অন্য কিছু আছে। ”

নিবিড় এতক্ষণে মেয়েটার মুখে একটা বুদ্ধিমানের মতো কথা শুনতে পায়।

এতক্ষণে “মিউ মিউ” শব্দ শুনে দুজনে উপলব্ধি করে ওদের মাঝে আরও একজন আছে। নিবিড় জিজ্ঞেস করে,

“তোমার পোষা বিড়াল? অনেক সুন্দর কিন্তু। নাম কি ওর? ”
“টমি। ”
“বাহ! সুন্দর নাম তো। আমি ওকে কোলে নিলে কি আমায় খাঁমচি দেবে? ”
“আরে না। বাচ্চাটা আমার ভীষণ শান্ত। ”

নিবিড় টমি কে কোলের মধ্যে নেয়। টমি ও ওর শরীরের ওম পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে। মনে হচ্ছে ও ক্লান্ত। ঘুমাবে।
কিন্তু ঘুমায় না। টমি একটু পর পর লেজ নাড়ায়। আবার মিউ মিউ করে। নিবিড় ওর মাথায় আর গলায় হালকা সুড়সুড়ি দেয়। টমি আরও গা ঘেঁষে মিউ মিউ করে।

অথৈ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছে। ট্রেন তার গতিতে চলে যাচ্ছে। আশেপাশের সব কিছু পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে। মৃদু বাতাস বইছে। কিছুটা ভালো লাগা অনুভব হচ্ছে। কি সুন্দর এক প্রশান্তি!
অথৈ গুনগুন করে গান গায়। যদিও তার গানের কন্ঠ ভালো না। তবুও চেষ্টা করে। গান গাইতে ভালো লাগে। বেশিরভাগ সময় একা থাকলেই গায়। এখন অবশ্য জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে ভুলেই গেছে ওর পাশে আরও একজন মানুষ আছে।
_____
চলবে।

জন্মদাতা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#জন্মদাতা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_২(শেষ)

কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। সেই ভদ্রলোক আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে উনার বাড়ি যেতে বলতেন। ব্যস্ততায় সেটা সম্ভব হয়নি। গতকাল আমার চেম্বারে এসে এমনভাবে অনুরোধ করলেন সেই কথা আর ফেরাতে পারিনি। উনার মা-বাবা আর মৃতদের উপর উনি মিলাদ পড়াবেন, আমাকে যেতেই হবে। মাকে না জানিয়ে কিছু মিষ্টি আর ফলমূল কিনে উনার বাড়ি চলে আসলাম। দালান বাড়ি তবে বেশ পুরনো মনে হচ্ছে। রুমগুলো ও গোছানো। উনার মেয়ে স্ত্রী সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমায়। এমনভাবে সবাই আমায় আপ্যায়ন করল মনে হচ্ছে, আমি কোন মন্ত্রী।

সবাই যার যার কাছে ব্যস্ত। ভদ্রলোক আমার কাছে এসে বসলেন। গল্প করছেন। এক ফাঁকে আক্ষেপ করে বললেন, “যে ছেলের জন্য সব টাকা পয়সা খরচ করলাম। বড় চাকরি ধরিয়ে দিলাম। সে তার দাদা-দাদীর মিলাদ মাহফিলেও উপস্থিত হলো না৷ এমন অবাধ্য ছেলে যেন আর কারও ঘরে না হয়।” এইটুকুন বলে উনি উঠে দাড়ালেন। ওয়ারড্রবের ড্রয়ার থেকে একটা অ্যালবাম নিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন। খুব আগ্রহ করে প্রথমে উনার ছেলের ছবি দেখালেন। উনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসেন। এভাবে উনি উনার মা-বাবাসহ পরিবারের সবার ছবি একের পর এক দেখাতে লাগলেন। সবশেষে বহু পুরনো একটি ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল। ছবিটা পুরনো হলেও খুব যত্ন করে রাখা হয়েছে। ছবির চোখগুলো চকচক করছে এখনও। ছবিটা দেখামাত্র আমার ভেতর আত্মা শুকিয়ে আসছে একদম। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার মতো অবস্থা। ভদ্রলোক পলকহীন ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার কন্ঠস্বর ভারী হয়ে আসছে। কিছু বলার শক্তি পাচ্ছি না। নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইনি কে?”
আমতা আমতা করে জবাব দিলেন, “ও কিছু না মা। ছাড়ো।”
“বলুন না। সবার সাথে তো পরিচয় করালেন তাহলে ইনি বাধ যাবেন কেন! প্লিজ বলুন না ইনি কে?”

লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গম্ভীর হয়ে বললেন, “আসলে মা আমাদের কারও কারও জীবনে এমন ঘটনা ঘটে যায়, যা আমাদের বুকের জমিনে বড় পাথর হয়ে জমাট বেঁধে থাকে বছরের পর বছর। সেটা কাউকে বলতে পারি না আর বলার মতো নির্ভরযোগ্য মানুষ ও পাওয়া যায় না। আজ তুমি যখন জানতে চাইছো তোমাকে বলব। ভেতরে জমে থাকা পাথরটা আমি হালকা করতে চাই। জানিনা কেন মনে হচ্ছে তোমাকে সব বলা যায়। তোমাকে কেমন আপন আপন লাগছে।

আমি আমার জীবনের শুরুতে বড় একটা পাপ করে ফেলছি। যার মাশুল আজও দিয়ে যাচ্ছি তিলেতিলে।”
ধীর কন্ঠে করলাম, “ভুল কেন?”
“এই ছবিতে যাকে দেখতে পাচ্ছো, ইনি আমার প্রথম স্ত্রী।”
কথাটা আমার কানে বজ্রপাতের মতো শুনালো। আমি টের পাচ্ছি, আমার হাত পা কাঁপছে। উনাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “উনি এখন কোথায়? আপনার প্রথম স্ত্রী! ”
“জানিনা মা। অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোন খোজ পাইনি। তার সাথে আমার সংসার ছিলো তিন বছরের। প্রথমে আমরা খুব সুখেই ছিলাম। তারপর শুরু হলো নানান ঝামেলা। ঝামেলার মূল কারণ আমার মা-বাবা। তারা তাকে পছন্দ করতেন না। তার একমাত্র কারণ আমি নিজে তাকে পছন্দ করে বিয়ে করছিলাম। সবাই নানান ভাবে তার নামে বিভিন্ন কথা আমার কানে তুলতে লাগলো। একসময় তাদের কথা কানে তুলি। তখনই আমার স্ত্রীর সাথে বাধে ঝগড়া। একদিনও তার সাথে আমার ভালো কাটতো না। সে ছিল অন্যরকম। স্পষ্টবাদী আর প্রতিবাদী। কখনও কেউ অন্যায় কিছু বলে পার পেতো না। চট করেই তার প্রতিবাদ করতো। এইজন্য বেশিরভাগ মানুষ তাকে পছন্দ করতো না। একসময় আমার কাছেও এসব খারাপ লাগতে শুরু করল। ঝগড়া লাগলেই তাকে অপমান করতাম। তার আত্মসম্মান ছিলো প্রখর৷ তাতে আঘাত লাগলে সে সেটা সহ্য করে না। অপারগ হয়ে চলে গেল বাপের বাড়ি। তখন সে ছিলো পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা। আমার উচিত ছিলো তাকে দেখতে যাওয়া, খবর রাখা। কিন্তু আমি সেটা করিনি। আমার একটা মেয়ে হয়। মা-বাবা এই খবর শুনেই বলল, খবরদার আনতে যাবি না। ছেলে হলে এখনি আমরা নিয়ে আসতাম গিয়ে। মেয়ে দিয়ে করব কি! ঝুড়ি ঝুড়ি টাকা খরচ! আমিও ছেলের লোভে তাদের আর নিয়ে আসিনি।
তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়। দ্বিতীয় বিয়ে করি। একটা ছেলেও হয়। কত আদর যত্নে তারে মানুষ করি। কিন্তু সেই ছেলে বড় হয়ে চাকরি করে আমাদের মুখে লাথি ৃমারল। আমার মা মারা যাবার আগে বারবার আমার ছেলেকে দেখতে চাইতেন কিন্তু সে আসেনি। এসব আমার ছেলের দোষ না। একটুও না। সব আমার পাপের ফল। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ ঠিকই নেয়, আমারও নিয়েছে। আমি আমার ভুল বুঝতে পারি কয়েক বছর পর। তখন আমার মেয়ের খোজ নিতে প্রথম স্ত্রীর বাড়ি যাই। কিন্তু পাইনি। তারা নাকি অন্য জায়গায় চলে গেছে। মা-বাবা মারা যাওয়ার আগে অনেকবার তার সাথে দেখা করে মাফ চাইতে চাইছিলেন কিন্তু তার খুজোই পাইনি।

জানো মা! আমি নিজেও একবার অন্তত একবার দুনিয়া ছাড়ার আগে তার কাছে মাফ চাইতে চাই। মেয়েটারে একটু চোখের দেখা দেখতে চাই। জানিনা সেটা সম্ভব হবে কি না!”

এই অব্দি বলে উনি থামলেন। আমি স্পষ্ট উনার চোখ বেয়ে জ্বল গড়িয়ে পড়তে দেখছি। মানুষ কেন যে তার জীবনে এত বড় বড় ভুল করে, যার মাশুল সারাজীবন দিতে থাকে।
জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার আসল বাড়ি কোথায়? ”
বললেন, “ঢাকায় ছিলো। পরে একটা কারণে এ জায়গায় এসে বাড়ি বানাতে হলো।”

একটু কাঠ কাঠ গলায় এবার বললাম,
“আচ্ছা আপনার বিবেক ছিলো না? আপনি কেন আপনার মা-বাবার কথা শুনতে গেলেন। মা বাবার কথা ততক্ষণ শোনা উচিত যতক্ষণ সেটা ন্যায়ের পক্ষে থাকে। তারা আপনাকে মেয়ে হয়েছে বলে বাধা দিলো আর আপনিও কাপুরুষের মতো তাই করলেন। আপনি একজন মুসলিম হয়ে জানেন না! ইসলাম মেয়েদের কতটা সম্মান দিয়েছে। যার ঘরে প্রথম সন্তান মেয়ে সে বাবা মা খুবই ভাগ্যবতী। তাছাড়া সাইন্স অনুযায়ী ছেলে হোক কিংবা মেয়ে দুটোই নির্ভর করে একজন পিতার উপর৷
প্রকৃতি কি সুন্দর প্রতিশোধ নিলো আপনার উপর।ছেলে না হওয়াতে যে স্ত্রীকে আর মেয়েকে একলা ছাড়লেন। আল্লাহ আপনাকে ছেলে ঠিকই দিলেন কিন্তু তার মাধ্যমে শিক্ষা ও দিয়েছেন।”

এখানে বসে থাকতে আমার অস্বস্তি লাগছে। আমি বিশেষ দরকার বলে উনার কাছ থেকে উঠলাম। আসার আগে বলে আসলাম, “আপনার যখন যা লাগে দয়া করে নিজের মেয়ে ভেবে আমাকে জানাবেন। আমি আপনার পাশে থাকতে চাই। উনি না চাইলেও আজ থেকে মাসে মাসে আমি উনার খরচাপাতি করে দেবো। এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
আমার হঠাৎ চলে আসা দেখে উনি হা করে তাকিয়ে আছেন, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না।

বের হয়ে গাড়ির ড্রাইভিং ছিটে বসলাম। বোতল থেকে পানি নিয়ে ভালো করে চোখ মুখে ছিটালাম। একটা কথা মানতেই হবে, আমার মায়ের মতো আমিও ভীষণ স্ট্রং। নয়তো নিজের জন্মদাতার মুখ থেকে আমার আর আমার মায়ের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা শুনে কেই বা স্থির থাকতে পারে। হ্যাঁ ওই অ্যালবামের পুরনো ছবিটা আমার মায়েরই। আর ওই ভদ্রলোক আমার জন্মদাতা। যা আমি এখনি জানতে পারলাম। আমি ইচ্ছে করলে উনাকে আমার পরিচয় দিতে পারতাম কিন্তু দেইনি। পরিচয় দিলে উনি আমার মায়ের সাথে দেখা করতে চাইবেন। মাফ চাইতে চাইবেন। আমি সেটা হতে দিতে পারি না। মা সব ভুলে এখন ভালো আছেন। আমার জন্য উনি দ্বিতীয়বার বিয়েও করেননি। কি করে সেই পুরনো ব্যাথা আমি আবার নতুন করে মাকে দিতে পারি। এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি কখনোই পারব না৷ আমি আমার পরিচয় ও জন্মদাতাকে দেবো না। কিন্তু উনার সবকিছুতে সর্বোচ্চ সাহায্য করব।

কিছু কিছু ভুলের কোন ক্ষমা হয় না। জন্মদাতা তার মাশুল দিতে থাকুক।

শেষ বিকেলের শেষ সময়। সূর্যাস্ত যায় যায় অবস্থা। এক্ষুনি সন্ধ্যা নামবে। অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে আমার। আমি গাড়ি স্টার্ট দিলাম। সন্ধ্যার আগেই বাসায় পৌঁছাতে হবে।

সমাপ্ত||

জন্মদাতা পর্ব-০১

0

#জন্মদাতা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_১

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়। বাংলাতে সম্ভবত পৌষ মাস চলছে। চারদিকে হাড় কাঁপানো শীত। এই শীতকালেও কদিন ধরে আকাশে মেঘ মেঘ করছে। আজ সকালের দিকেও আবহাওয়া তেমন একটা ভালো ছিল না। ঝিরিঝিরি বাতাস আর শীতল ভাব ছিলো পুরো প্রকৃতি জুড়ে। আমি তৃপ্তি। একজন এমবিবিএস ডাক্তার৷ এই মুহুর্তে বসে আছি চেম্বারে। রোগীদের নিয়েই আমার পুরো দিন কাটে। সিরিয়ালের পর সিরিয়াল থাকে। প্রায় সময় হিমশিম খাই সামাল দিতে। কিন্তু আজকে ঝামেলা টা কম৷ তার কারণ হয়তো অসময়ে এই বৃষ্টি!

বৃষ্টির গতিটা খানিক কমে আসলে আমিও বের হয়ে যাব। বাকিটা দিন বাসায় কাটাবো। মাকে বলব, খিচুড়ি করতে আর আলাদা করে গরুর মাংস রান্না করতে। ঝুমবৃষ্টির দিনে যেমন খিচুড়ির তুলনা হয় না। তেমন আমার মায়ের হাতের রান্নার ও কোন তুলনা হয় না৷ মা আর মেয়ের আজ জমবে বেশ! সাথে গল্প!

রিফাত! আমার এসিস্ট্যান্ট। সে হঠাৎ এসে বলল, “ম্যাডাম একজন রোগী এসেছেন। পাঠিয়ে দেবো কী?”
মাথা নাড়িয়ে বললাম, “হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।”

একজন ভদ্রলোক গুটিশুটি পায়ে আমার চেম্বারে ডুকলেন। ভিজে জবজবে উনার শরীর। দেখেই বুজা যাচ্ছে, উনি ছাতা ছাড়া আসছিলেন আর হঠাৎ বৃষ্টিতে এই অবস্থা। আমি বসতে বলে একটা তোয়ালে এগিয়ে দিলাম। বললাম, “মুছে নিন মাথা।”

উনি মলিন হেসে মাথা মুছে বসলেন।
ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করলাম, “এমন ভিজে গেলেন কি করে? বৃষ্টি দেখে কোথাও দাড়াতে পারতেন।”
উনি কিছুটা অস্বস্তি ভাবে বললেন, “আসলে মাঝরাস্তায় হুট করে বৃষ্টি চলে আসলো। দাড়াবো কোথায় আর ছাতাই বা পাবো কোথায়!”

“ঠিক আছে। আপনার সমস্যা কি এবার বলুন?”

নড়েচড়ে বসলেন উনি। বললেন, “মুখে কোন রুচি নেই। খেতে ইচ্ছে করে না। এজন্য শরীর খুব দূর্বল। মাথা ধরা থাকে। কোমরের ব্যাথায় রাতে ঘুমাতে পারিনা।”

উনার বিপি চেক করে বললাম, “আপনার প্রেসার একদম ল। ভিটামিনের বড্ড অভাব। বয়স্ক হলে একটু আধটু কোমর ব্যাথা থাকে কিন্তু এর প্রধান কারণ হলোঃ ক্যালসিয়ামের অভাব। আমি আপনাকে কিছু ভিটামিন, ক্যালসিয়াম আর ব্যাথার ঔষধ লিখে দিচ্ছি। নিয়মিত খাবেন। ইনশাআল্লাহ আরাম পাবেন। শাক, কচু, ফলমূল, ডিম, দুধ এক কথায় পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করবেন।

উনি প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে সহজভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, “এতে কত টাকার ঔষধ হবে, মা? ”
“পনেরো শত এর মতো।”
“না, মা। আপনি আমাকে পাঁচশত টাকার মধ্যে ঔষধ দিন।”
আমি বেশ কৌতূহলী হলাম।
উনি ফের বললেন, “আসলে আমার পায়ের ব্যাথাটা বেশ বেড়ে গেছে তাই জন্য আপনার কাছে এসেছি নয়তো আসতাম না। আপাতত একটু ঔষধ হলে চলবে।”
“কিন্তু আপনার তো কোর্স ফুল করতে হবে। নয়তো কমেও কমবে না।”
ভদ্রলোক তো নাছোড় বান্দা। পাঁচশত টাকার ভেতরেই প্রেসক্রিপশনে ঔষধ লিখে দিতে হবে।
বললাম, “ঔষধের দোকানে বলবেন, উনারাই দিয়ে দেবেন। কিন্তু পরবর্তীতে সব ঔষধ রেগুলার চালানের চেষ্টা করবেন।”

উনি চলে যাচ্ছেন। কি যেন মনে করে হঠাৎ বললাম, “শুনুন!”
উনি ঘুরলেন। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কাছে কি টাকা নেই?”
মলিন হাসলেন, “আছে মা। দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে থেকে পাঁচশত টাকার ঔষধ নেবো। মেয়েটা গর্ভবতী। তার খুব ইচ্ছে করছে, গরুর মাংস খেতে। কোন কাজ কাম নেই। বাড়ির একটা গাছ বিক্রি করে এই টাকাটা যোগাড় করেছি। বাকি টাকা দিয়ে খরচপাতি আর মাংস নেবো।”

রোজ কতশত গল্প শুনি আমরা।তবুও যেন নিজের চোখের সামনে এমন একজন বাবার কথা শুনে ব্যাথিত হলাম। বেশ আশ্চর্য্য ও হলাম। ভদ্রলোককে দেখতে এতটা দরিদ্র মনে হচ্ছে না। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। আজ আমার কোন তাড়াহুড়ো নেই সেজন্য উনার সাথে বেশ গল্প পাতালাম। এমনিতেই মানুষের সাথে কথা জমাতে আমার বেশ লাগে। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কিছু করেন না, তাহলে সংসার কেমনে চলে?”

“এই তো কোনরকমে চলে। বাড়ির ফসলাদি বিক্রি করে। মাঝেমধ্যে দিনমজুরের কাজ পেলে করি।”
“এই বয়সে আপনি কাজ করেন! আপনার কোনও ছেলে নেই?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক। মনে হলো বহুদিনের নীরব ব্যাথা এই দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে বের করলেন। বললেন, “আমার একটা ছেলে আছে।ঢাকায় থাকে। বড় চাকরি করে। আমাদের খোঁজ খবর তেমন একটা নেয় না। মাঝেমধ্যে মন চাইলে কিছু টাকা পাঠায়।”

উনার কথা শুনে আমার ভেতরে খুব লাগলো। আমার বিবেক বলল মানুষটাকে সাহায্য করতে। রিফাতকে বললাম, “আজ আর কোন রোগী দেখব না। চেম্বার লক করে দাও।”

ভদ্রলোক কে বললাম, “আমার সাথে আসুন।”
“কোথায় যাবো?”
স্মিথ হাসলাম, “ভয় পাবেন না। কিডন্যাপ করব না।”

গাাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ভদ্রলোককে বেশ অস্বস্তি দেখালো। মাংসের দোকানে গিয়ে গাড়ি থামালাম। দুই কেজি গরুর মাংস নিলাম। উনার হাতে দিয়ে বললাম, “শুধু আপনার মেয়ে না আপনিও মন ভরে মাংস খাবেন।

উনি নিতে নারাজ। হয়তো আত্মসম্মানে লাগছে। আমি মুচকি হেসে বললাম, ” আমাকে আপনার মেয়ে ভাবুন। আর এগুলো নিন প্লীজ।”

উনি কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মাঝেমধ্যে এমন হয়, আমরা মাত্রারিক্ত অবাক হলে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।

ফের গাড়িতে উঠে ফার্মেসির সামনে গিয়ে গাড়ি থামালাম। উনার প্রেসক্রিপশনের সব ঔষধ কিনে উনার হাতে দিলাম। বললাম, আপনার কাছে যা আছে তা দিয়ে আপনি ফলমূল কিনে খাবেন।

উনি আবেগে আমার দুহাত জড়িয়ে ধরলেন, “তোমার মতো মানুষ আজকাল খুব কম আছে মা। নিঃসন্দেহে তোমার মা-বাবা তোমাকে খুব ভালো শিক্ষা দিয়েছেন।”
বিনিময়ে আমি নীরব নিস্তব্ধ হাসি টানলাম মুখে।
সন্ধ্যা হতে বেশি সময় নেই। বাসায় ফিরতে হবে নয়তো উনাকে উনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতাম।

উনি চলে যাচ্ছেন। কি মনে করে হঠাৎ ফিরে আসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার বাড়ি কোথায় মা?”
“আমার বাড়ি ঢাকায়। এ হসপিটালে পোস্টিং হয়েছি বছর তিনেক আগে। এখন এখানেই থাকি।”
“আপনার কার্ড টা দেওয়া যাবে মা? মাঝেমাঝে খোজ নেবো আপনার। আমি এলাকার সবাইরে আপনার কথা বলব। আমার বাড়ি পাশেই। যদি একদিন এই বাপের বাড়িতে পা রাখতেন, আমি খুব খুশি হতাম।”
ঠোঁটে হাসির রেখা টানলাম, “আমার তো সময় থাকে না।”
“সময় চাইলেই বের করা যায়। আপনার বাবা এরকম করে বললে আপনি কি না করতে পারতেন?” আমি আপনার বাবার বয়সী। একদিন চলে আসেন, আমি খুব খুশি হবো।”

“মেয়ে বলছেন আবার আপনি ডাকছেন! এটা বেমানান লাগছে। আপনি আমায় তুমি করেই বলবেন।”
তারপর উনার হাতে আমার কার্ড দিয়ে বললাম, “এখানে আমার নাম্বার আছে।”

বাসায় ফিরে চেন্জ করে ফ্রেশ হলাম। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে দেখলাম, মা আমার জন্য খাবার নিয়ে বসে আছেন। ঢাকনা সরাতেই দেখলাম, মা খিচুড়ি আর গরুর গোশত রান্না করছেন৷ অবাক হয়ে বললাম, “জানো মা! আমি ভাবছিলাম বাসায় ফিরে তোমাকে এটা রান্না করতে বলব, তুমি বলার আগেই করে ফেললে। কি করে জানলে মা?”
মা হেসে বললেন, “মেয়ের ৃমনের কথাই যদি না বুঝতে পারি, তাহলে কীসের মা হলাম!”

কথা বলতে বলতে খেতে বসলাম। মা খাচ্ছেন। আমি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মায়ের দিকে তাকাচ্ছি। আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে মায়ের মতো স্ট্রাগল করা মানুষ খুব কম দেখেছি। মায়ের কাছে আমার হাজারও প্রশ্নের উত্তর জানার আছে। অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু বলার সাহস হয় না আর বলেও লাভ নেই।

বেশ জমে ঠান্ডা পড়ছে। মা হুমায়ুন আহমেদের “কোথাও কেউ নাই” উপন্যাসটা পড়ছেন৷ আমি বেলকনিতে গিয়ে দাড়ালাম। সন্ধ্যার পরপরই বৃষ্টি কমে গেছে। আকাশ এখন স্বচ্ছ আর ঝকঝকে। সাদা আর নীল আকাশের মাঝখানে এক ফালি সোনালী চাঁদ চকচক করছে। তুলোর মতো গুড়ি গুড়ি মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে অজানা উদ্দেশ্যে।এমন সুন্দর আকাশ দেখে মনেই হবে না, সারাদিন বৃষ্টি ছিলো। আমি রাতের এই সৌন্দর্য দেখছি ঠিকই কিন্তু আমার মনে প্রানে এক অদ্ভুত শূন্যতা বিরাজ করছে।বাসায় আসার পর থেকে একবারের জন্যেও আমি ওই ভদ্রলোকের কথা মাথা থেকে সরাতে পারিনি। উনি নিজের অসুস্থতা এক পাশে রেখে মেয়ে কি খাবে তাতেই টাকাটা খরচ করবেন। কত ভালোবাসেন উনি উনার মেয়েকে। আমার উদাসী মনে প্রশ্ন জাগলো, সব বাবারাই কি তাদের মেয়েদেরকে এভাবেই ভালোবাসে? মেয়ের সুখেই তাদের সুখ হয়? তাহলে আমার বাবা! জন্মের পর থেকে আজ অব্দি আমি আমার বাবাকে দেখিনি। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, একটা ঝামেলায় মা নানুবাড়ি চলে আসেন। তখন মা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা ছিলেন। তারপর কেউ নাকি যোগাযোগ রাখেনি। মেয়ে হয়েছে জেনে আমার দাদা দাদী, বাবা কেউ নাকি মাকে ফিরিয়ে নিতে চায় নি। কত জঘন্য ছিলো আমার পরিবার।

যখন পুচকে ছিলাম। তখন নাকি মাকে বারবার জিজ্ঞেস করতাম বাবার কথা। বাবাকে দেখতে চাইতাম। মা তখন আগুন চোখে আমার দিকে তাকাতেন। পরে আর কিছু বলার সাহস হতো না।

বড় হলাম। মা সবটা আমায় বললেন। বুঝলাম। তারপর থেকে এমন বাবার কথা আমি আজ অব্দি মুখেও আনিনি। বাবার বাড়ি কোথায় সেটাও জানি। চাইলে খোজ নিতে পারতাম কিন্তু নেইনি৷ আগ্রহ নেই। মা বলেন, যারা আমাদের জীবনকে বিষিয়ে দেয়, তাদের ফের জীবনে ডেকে আনতে নেই। তাছাড়া যে বা যারা আমাকে আর মাকে ছেড়ে দিয়েছে তাদের কোন অস্তিত্ব আমাদের জীবনে নেই।

আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছেন। লেখাপড়া করিয়ে ডাক্তার বানিয়েছেন। নিজে চাকরি করতেন। নিজের ইনকামের টাকা দিয়ে তিলতিল করে আমাকে এই স্থানে দাড় করিয়েছেন। কখনও কারও কাছে মাথা নুয়ান নি। মা যেমন স্পষ্টবাদী তেমন প্রতিবাদী। আত্মসম্মানী আর একগুঁয়ে মেয়ে। উনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

এতদিন আমার জন্মদাতার কথা মনে না পড়লেও আজকে এক বাবার মেয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে আমাকে ভাবাচ্ছে। কেউ মেয়ের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয় আর কেউ মেয়ে সন্তান জেনে স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়। কী আজব দুনিয়া! আর কী আজব মানুষ!

আমার খুব ইচ্ছে করছে, মায়ের সাথে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা শেয়ার করতে। কিন্তু সেই সাহস হচ্ছে না আমার।

চলমান…..!

মিত্রাভান থানোস পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0

#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____৫ (শেষ পর্ব)

‘আমি পিশাচ। পিশাচ মিত্রাভান থানোস।’

বলে লোকটা হা হা করে হাসতে লাগল। র ক্ত হিম করা সে হাসির শব্দ। ভয়ে নিতুর গায়ের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। সে এসব কী শুনছে? এই পৃথিবীতে পিশাচের কোনো অস্তিত্ব আছে? থাকার কথা নয়! সে এ ব্যাপারে কোনোদিন কিছু শুনেনি। আবার চোখের সামনে যা দেখছে সেটা অবিশ্বাস করে কী করে? তার সামনে থাকা লোকটি কি সত্যি সত্যি পিশাচ?

নিতু আর ভাবতে পারছে না। এক লহমায় এতোদিনের সমস্ত ধাঁধার উত্তর পেয়ে গেল যেন। শিহাবের মাঝরাতে উধাও হওয়া, হঠাৎ আবার ভূতের মতো উদয় হওয়া, তার শব্দহীন চলাফেরা। সমস্ত কিছু মনে পড়ল নিতুর। তার আরো আগে বোঝা উচিত ছিল। এসব কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। এখন সে কী করবে? কীভাবে এই পিশাচের হাত থেকে রক্ষা পাবে!

নিতুর মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শিহাব কোথায়? তার স্বামী শিহাব! তাকে কি লোকটা মে রে ফেলেছে? সে থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীর নিয়ে পেছাতে লাগল। মিত্রাভান ধীরপায়ে এগিয়ে এলো। নিতুকে স্পর্শ করার আগেই নিতু মেঝেতে ঢলে পড়ল। জ্ঞান হারাল।
______

নিতুর যখন জ্ঞান ফিরল তখন মধ্যরাত। চোখ খুলে বুঝতে পারল না, সে কোথায় আছে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শরীরের তলায় শক্ত মাটি মনে হচ্ছে। সে হাতড়ে বুঝতে পারল সত্যি মাটি। ঘাস, লতাপাতার মধ্যে সে শুয়ে আছে। পিঠের নিচে মরা ডাল পড়েছে হয়তো। ব্যথা করছে। সে চোখ ডলে আশপাশটা ভালোমতো খেয়াল করল। চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে কিংকর্ব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। শরীর হিম হয়ে এলো।

সে ঘন জঙ্গলের মাঝে শুয়ে আসে। একা! সম্পুর্ণ একা!

নিতু উঠে বসল। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুততর হচ্ছে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসছে। খানিক আগে সে পাশের রুমে যা যা ঘটতে দেখেছিল সব সত্যি? সত্যিই কি সে এতোদিন একজন পিশাচের সাথে সংসার করেছিল? আবারো শিহাবের কথা মনে পড়ল তার। শিহাব কোথায়? তার শিহাবকে কি ঐ পিশাচটা মে রে ফেলেছে? নিতু কেঁদে ফেলল।

শুকনো গলায় কয়েকবার শিহাব শিহাব করে ডাকল। কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। মাথার উপর উঁচু উঁচু গাছপালা। পায়ের নিচে ছোট ছোট ঘাস। সেগুলো মাড়িয়ে নিতু এগিয়ে চলল। তাকে যে করেই হোক এই জঙ্গল থেকে বের হতে হবে। তাকে পালাতে হবে। ওই পিশাচের হাত থেকে বাঁচতে হবে।

নিতুর খালি পা। কয়েক পা এগোতে কাঁটা ফুটে গেল। ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠল সে। পরক্ষণে নিজের মুখ চেপে ধরল। এই গহীন জঙ্গলে নিশ্চয়ই অনেক হিং স্র জন্তু আছে। যখন তখন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সে সতর্ক ছুটে চলল।

কিছুদূর এগোতে খোলা জায়গা চোখে পড়ল। অনেকটা মাঠের মতো। গাছপালা কম। নেই বললেই চলে। সে এগিয়ে গেল। পায়ের তলায় নরম ঘাস। শেষরাতের শিশির পড়ে আর্দ্র হয়ে আছে। মাঠের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। মাথার উপর পূর্ণ চাঁদ। ফকফকা জোসনা। চাঁদের আলোয় এদিকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিতুর হঠাৎ কেমন ঘোর লাগল। মনে হলো, এসব কিছু তার স্বপ্নে ঘটছে। খানিক বাদে তার ঘুম ভাঙ্গবে। শিহাব তাকে জাগিয়ে তুলবে। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আদর করবে, ভালোবাসবে।

সময় পেরিয়ে যেতে লাগল। তার কিছুই হলো না। নিতু বেশ বুঝতে পারছে, এসব কোনো স্বপ্ন নয়। বরং ঐ পিশাচটা এতোদিন তাকে ঘোরের মধ্যে রেখেছিল। মিথ্যে মায়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছিল। আজ সব মায়াজাল ছিন্ন হয়ে গেছে।

হঠাৎ করে অনেকগুলো পশুর গর্জন কানে ভেসে এলো। চেনা শব্দ। এর আগে শুনেছে। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশপাশে তাকাল। তখন পাখির মতো কিছু একটা উড়ে এলো। তার খুব কাছাকাছি এসে থেমে গেল। নিতু কিছু বুঝে উঠার আগে সেটা একটা পুরুষ অবয়বে রূপ নিল।

নিতু ভয়ে ঢোক গিলে। কয়েক পা পিছিয়ে গেল। কোনরকমে উচ্চারণ করল,

‘মিত্রাভান!’

মিত্রাভানকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। দুচোখ থেকে আগুন ঠিকড়ে বের হচ্ছে। ঠোঁটে ক্রুর হাসি। হাসির ফলে তার সামনের র’ক্তমাখা দাঁতের পাটি বেরিয়ে পড়েছে। নিতু বুঝতে পারল তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই পিশাচ তাকে বাঁচতে দিবে না। তার চোখ জ্বলে উঠল। কন্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,

‘শিহাব কোথায়?’

‘মেরে ফেলেছি।’

‘কতদিন হলো?’

‘এই জঙ্গলে আসার কয়েকদিন পরেই।’

নিতু শিউরে উঠল। এতগুলো দিন হলো শিহাব তার কাছে নেই। অথচ সে কিচ্ছু টের পায়নি। সে চিনতে পারেনি এই বহুরূপী পিশাচটাকে। নিজের উপর রাগ হলো তার। সেই সাথে ভেতরে চাপা ক্রোধ ফুটে উঠল। সে চেঁচিয়ে উঠল।

‘কেন করলে তুমি এমন? কেন আমাদের পিছু নিয়েছ? কেন শিহাবকে মেরে ফেলেছ? আমরা কী ক্ষতি করেছি তোমার?’

কোনো উত্তর নেই। শুধু ক্রুর হাসি। হাড় হিম করা হাসি। নিতুর সহ্য হলো না। সে ছুটে গিয়ে মিত্রাভানের গলা চেপে ধরল। হিতে বিপরীত হলো। পিশাচটা পিছিয়ে গেল। পরমুহুর্তে একহাতে নিতুর গলা চেপে ধরল। শূন্য থেকে কয়েক হাত উঁচু করে ফেলল। নিতুর চোখ বড়বড় হয়ে গেল। জিহ্বা বেরিয়ে এলো। বাঁচার জন্য ছটফট করতে লাগল সে। কয়েক মিনিট পর পিশাচটা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। নিতু ছিটকে পড়ল। দূরে, বহুদূরে! গাছের গুঁড়ির সাথে লেগে মাথা ফেটে গেল। পেটে সুঁচালো কিছু একটা বিঁধল। ম রণ যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।

মাকে মনে পড়ল নিতুর। ক্ষীণ গলায় দু বার মা, মা করল। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। ধীরে ধীরে চোখ বুঁজে আসছে। পেট দিয়ে গলগল করে র ক্ত পড়ছে। শরীর নেতিয়ে আসছে। নিতু খুব করে টের পাচ্ছে, সে মা রা যাচ্ছে! শরীরটা সামান্য নাড়িয়ে সে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। অশ্রুসিক্ত চোখে আকাশের পানে তাকাল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের নরম আলো তার চোখেমুখে এসে পড়ছে। চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নিতুর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। সে ক্ষীণ আওয়াজ তুলে উচ্চারণ করল,

‘মা!’

তারপরই মৃ ত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।
________

জঙ্গলের শতবর্ষী প্রাচীন এক বৃক্ষের ডালে বসে আছে মিত্রাভান। মৃদু বাতাসে তার চুল উড়ছে। গায়ের আলখাল্লা উড়ছে। তার চেহারা কিছুটা চিন্তাক্লিষ্ট। তাকে আবার কিছুদিন ছুটতে হবে। নতুন কোনো দম্পতি খুঁজতে হবে। তাকে আবার এই সংসার সংসার ছেলেখেলা শুরু করতে হবে। তবেই তার এই অতৃপ্ত আত্মা শান্তি পাবে।

-সমাপ্ত

মিত্রাভান থানোস পর্ব-০৪

0

#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____০৪

নিতু অবাক চোখে শিহাবের পানে তাকিয়ে রইল। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। এসব কী ঘটছে তার সাথে? কোনটা সঠিক? সে নিজের চোখে যা দেখেছে সেটা? নাকি শিহাব যা বলছে তাই? সে কি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে?

নিতু হাঁসফাঁস করতে লাগল। তার অস্থির লাগছে। খুব করে কান্না পাচ্ছে। এই দুঃসময়ে মায়ের মুখটা বার বার মনে পড়ছে। এইসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর ভালো লাগছে না। সে আর কথা বাড়াল না। নির্বিকারে বলল,

‘আমি এখন ঘুমাব। বসে থাকতে পারছি না।’

‘একটু অপেক্ষা করো। আমি খাবার নিয়ে আসছি। কিছু খেয়ে মেডিসিন খাও। তারপর ঘুমাও। কেমন?’

নিতু কোনো উত্তর দিল না। শিহাব উঠে গেল। পেছন থেকে তার প্রতিটা পদক্ষেপ লক্ষ্য করল সে। গতকাল রাতে যেটা ঘটেছে সেটা এতো বেশি জীবন্ত যে স্বপ্ন হিসেবে মানতে পারছে না। আবার শিহাবকে অবিশ্বাস করে কী করে? মানুষটা যে তাকে চোখে হারায়। তার দুঃখে দুঃখ পায়। কষ্টে কষ্ট! সে তো মিথ্যে বলবে না।

নিতু আবার কাল রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করল। সে কখন শিহাবের জন্য ঘরের দরজা খুলে দিল? কিছুতেই মনে পড়ছে না।

খানিক বাদে প্লেটে খাবার নিয়ে শিহাব ঘরে ঢুকল। বিছানায় বসে বলল,

‘আমি খাইয়ে দেই?’

নিতু বাধা দিল। তার মস্তিষ্ক জুড়ে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শিহাবের থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে নিল। বলল,

‘আমি নিজে খেতে পারব।’

সে খাওয়া শুরু করল। ঢোক গেলার সময় গলায় ব্যথা অনুভূত হলো। এতটা ব্যথা যে তার চোখে জল চলে এলো। খাবার সব বিস্বাদ লাগছে। খেতে কষ্ট হচ্ছে। হলে হোক! শরীরের দূর্বলতা কাটানোর জন্য খাওয়া দরকার। তার কেন জানি মনে হচ্ছে, সম্মুখে একটা যুদ্ধ অপেক্ষা করছে। সেই যুদ্ধে তাকে লড়তে হবে। নিতু জোর করে খাবার শেষ করল। তারপর ওষুধ খেল।

খাওয়া শেষ হতে শিহাব প্লেট গুছিয়ে রাখল। নিতুকে শুইয়ে দিয়ে বলল,

‘একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।’

‘আপনি আজ অফিসে যাননি?’

‘তুমি এতো অসুস্থ। আমি কী করে যাব?’

নিতু বেশ অবাক হলো। ক্ষণিকের জন্য হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। মস্তিষ্কের চিন্তার বহর থামল। সে গাঢ় চোখে শিহাবের পানে তাকাল। কি নিষ্পাপ চাহনি মানুষটার। দুচোখে তার জন্য গভীর ভালোবাসা। এইসব ভালোবাসা যে মিথ্যে নয়। তবে কি নিতুর বুঝতে ভুল হচ্ছে? সত্যি সত্যি তার মাথায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে? সে কি ধীরে ধীরে লাগল হয়ে যাচ্ছে?

নিতু বেশি সময় নিল না। আবেগ মিশিয়ে বলল,

‘সরি।’

‘সরি? সরি কেন বলছ?’

‘এই যে আমার জন্য আজ কাজে যেতে পারলেন না।’

শিহাব হাসল। নিতু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। কী সুন্দর করে হাসে মানুষটা! তার স্বচ্ছ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিতু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। এতদ্রুত ঘুমিয়ে পড়ল যেন কেউ সম্মোহন করে ঘুম এনে দিল।
________

মাঝে সপ্তাহখানেক চলে গেছে। নিতুর জ্বর ছেড়েছে। তবে শরীরের দূর্বলতা কাটেনি। সে আগের থেকে আরো শান্ত আর ধীর হয়ে গেছে। চুপচাপ হয়ে গেছে একদম। চোখ-মুখ শুকিয়ে এমন হয়েছে যে নিজেকে দেখে হঠাৎ করে চেনা যায় না। সাথে ভয় বেড়ে গেছে। এখন দিনের বেলাতেও তার ভয়ংকর সব ভাবনা আসে। ভয় করে। সেদিনের দেখা অদ্ভুত প্রাণীটা আর দেখেনি সে। তবুও সারাক্ষণ চোখের সামনে কিসব ভাসতে থাকে। মনের মধ্যে সর্বক্ষণ ভয় কাজ করে।

নিজেকে ঘরে বন্দি করে ফেলেছে নিতু। তার কিছু ভালো লাগে না। কারো সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে না। কোনো কাজে মন বসে না। এই গভীর অরণ্য আর জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোথায় যাবে? আর শিহাবকে ছেড়ে কিভাবে যাবে? কোনো উপায় খুঁজে পায় না। আবার মনে শান্তি নাই। সারাক্ষণ অদৃশ্য কিছু একটা যেন তাকে তাড়া করে চলেছে।

আজ বৃহস্পতিবার। মাঝরাতে নিতুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘর অন্ধকার। পাশে হাতড়ে সে শিহাবকে খুঁজল। শিহাব বিছানায় নেই। নিতু তেমন অবাক হলো না। যেন সে জানে, এই সময় শিহাব ঘরে থাকবে না।

অন্ধকারে বড়ো বড়ো চোখে সে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। হঠাৎ তার কানে শব্দ এলো। অনেকগুলো জন্তু যেন একত্রে ডাকছে। কেমন ঘড়ঘড় শব্দ। বিদঘুটে। কানে লাগছে। শব্দটা আসছে পাশের ঘর থেকে। নিতু অনেক সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পা টিপে টিপে সে এগিয়ে চলল। বসার ঘরে আসতে রহস্যময় আলো দেখতে পেল। রান্নাঘরের পাশের রুম থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কিসের আলো এইটা? নিতু শব্দহীন ভাবে এগিয়ে গেল।

দরজা অল্প একটু ফাঁক হয়ে আছে। সেই ফাঁকটুকু দিয়ে নিতু ভেতরের দিকে তাকাল। ভেতরের দৃশ্য দেখে তার দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। বুক চিঁড়ে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইল। নিতু সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে মুখ চেপে ধরল।

রুমের ভেতর শিহাব দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ থেকে লাল আভা ঠিকড়ে বের হচ্ছে। তার সামনে সেদিনের দেখা অদ্ভুত প্রাণীটা। হঠাৎ প্রাণীটা মানুষের রূপ নিল। ভয়ংকর এক নারী মূর্তি। বেশভূষা অদ্ভুত। অন্যরকম!

‘তুমি নিতুকে আক্রমণ করেছ কেন? তোমাকে নিষেধ করেছি না?’

শিহাব রুক্ষ স্বরে তাকে প্রশ্ন করল। নারীমূর্তি বলল,

‘তুমি ওকে মে রে ফেলছ না কেন? আর কতদিন ওর সাথে সংসার করবে?’

‘আমার যতদিন মন চায়। খবরদার! তুমি আমার ব্যাপারে নাক গলাবে না। ভুলে যেও না আমার পরিচয়।’

‘আমি তোমার পরিচয় ভুলিনি। তুমি ভুলে গেছো। তুমি মানুষের রূপ ধরে আর কতোদিন থাকবে? ফাদার গ্রেগরিস তোমার তলব করেছেন।’

‘তুমি এখন দূর হও।’

‘তার আগে বলো। এই মেয়েটিকে কবে মে রে ফেলবে? আমি আর অপেক্ষা করব না। যেকোনো সময় ওর শরীর থেকে সমস্ত র ক্ত শুষে নিব। ওকে মে রে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলব।’

হুট করে শিহাবের কি যেন হয়ে গেল। চোখের পলকে তার চেহারা পাল্টে গেল। অন্য এক পুরুষ অবয়ব দেখতে পেল নিতু। যে পুরুষ শিহাবের চেয়ে বলিষ্ঠ, লম্বা আর শক্তিশালী। যার চোখেমুখে হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। প্রচন্ড রাগের কারণে তাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। তার এই রূপ দেখে নারীমূর্তি হেসে উঠল। সে হাসির শব্দে নিতু শিউরে উঠল। নারীমূর্তি বলল,

‘যাক! নিজের স্বরূপে ফিরেছ মিত্রাভান। মিত্রাভান থানোস। আমি তো তোমার আসল রূপটা ভুলে যেতে নিয়েছিলাম।’

নিতু বিড়বিড় করে নামটা উচ্চারণ করার চেষ্টা করল। পারল না। দুর্বোধ্য ঠেকল। এরা কারা? কী হচ্ছে এসব তার চারপাশে? সে কি আবারো স্বপ্ন দেখছে? সামনে যা ঘটছে সব তার চোখের ভ্রম? মস্তিষ্কের সাজানো কল্পনা?

নিতু থরথর করে কাঁপতে থাকল। ততক্ষণে মিত্রাভান নামের লোকটা নারীমূর্তির গলা চেপে ধরেছে। চেঁচিয়ে বলছে,

‘আমাকে রাগাবে না লিলিথ। তার ফল ভালো হবে না। তোমাকে এই পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে দু’বার ভাবব না কিন্তু। এক্ষুণি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।’

বলে সে ছুঁড়ে ফেলে দিল। নারীমূর্তি খানিক দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। রাগান্বিত চোখে লোকটার দিকে তাকাল। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।

নিতু ভয় আর বিস্ময় নিয়ে সব দেখছে। এই লোকটা কি বহুরূপী কেউ? কখনো শিহাবের রূপ নিচ্ছে। কখনো আবার মিত্রাভান? তারমানে এতোদিন সে যা সন্দেহ করেছিল সব ঠিক। শিহাবকে নিয়ে বার বার যে খটকা লাগছিল সব ঠিক। শিহাব মানুষ নয়? অন্যকিছু? কিন্তু সেই অন্যকিছু কী?

নিতুর মুখ থেকে অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এলো। শব্দ পেয়ে লোকটা দরজার দিকে তাকাল। মুহূর্তে একজোড়া লাল চোখের সাথে নিতুর দৃষ্টি বিনিময় হলো। ভয়ে সে চুপসে গেল। মুখ দিয়ে আপনাআপনি চিৎকার বেরিয়ে গেল। ছুটে পালিয়ে যেতে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে গেল।

নিতুকে দেখে লোকটা অবাক হয়নি। বরং সাবলীলভাবে এগিয়ে আসছে। তবে তার চোখে-মুখের হিংস্র ভাব দূর হয়নি। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে নিতু ভয়ে পিছাচ্ছে। সে জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘কে তুমি?’

‘মিত্রাভান থানোস।’

‘তোমার পরিচয়?’

‘আমি পিশাচ। পিশাচ মিত্রাভান থানোস।’

বলে লোকটা হা হা করে হাসতে লাগল। রক্ত হিম করা সে হাসির শব্দ।

(চলবে)

মিত্রাভান থানোস পর্ব-০৩

0

#মিত্রাভান_থানোস
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_____০৩

আজ সন্ধ্যা বয়ে গেল। তখনো শিহাব ফেরেনি। নিতু উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বার বার দৌঁড়ে গিয়ে পথ দেখছিল। কিন্তু শিহাবের ফেরার কোনো নাম-গন্ধ নেই। কয়েকবার ফোন করেও তাকে পাওয়া গেল না।

ইদানিং একা বাসায় থাকতে তার ভয় ভয় করে। কিসের ভয় সে বুঝতে পারে না। কিন্তু প্রচন্ড ভয় করে। মনে হয় অদৃশ্য কিছু একটা তাকে সারাক্ষণ নজরে নজরে রাখছে। তাকে দেখছে। দিনের বেলাতে ভয় অবশ্য কিছুটা কম থাকে। তবে অন্ধকার নামলে ভয়টা আরো বেড়ে যায়। কোথাও কোনো খুটখাট শব্দ হলে সে ভয়ানক চমকে উঠে। তারপর দীর্ঘ সময় বুক ধড়ফড় করে। সহজে থামে না।

সন্ধ্যার আগে আগে সবগুলো আলো জ্বালানো হয়েছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। মুহূর্তে পুরো ফ্ল্যাট অন্ধকারে ডুবে গেল। নিতু বেশ ঘাবড়ে গেল। এই সময় তো কোনোদিন বিদ্যুৎ যায় না। সে নিজেকে শান্ত রেখে ফোনটা খুঁজল। ফোন হাতের কাছে ছিল। পেয়ে গেল দ্রুত। রান্নাঘরে মোমবাতি রাখা আছে। আলো জ্বালিয়ে সেগুলো বের করল। তিনটে মোমবাতি জ্বালিয়ে সে ঘরময় আলো ছড়ানোর চেষ্টা করল।

শোবার ঘরে মোমবাতি হাতে ঢুকল সে। তখুনি জিনিসটা প্রথম দেখল। বাদুড়ের মতো পাখাওয়ালা একটা প্রাণী। ঘরের জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে আছে। ক্ষণে ক্ষণে পাখা ঝাপটাচ্ছে। মুখটা পেঁচার মতো। কাঠঠোকরার মতো সুঁচালো ঠোঁট। আকারে বড়সড়। অদ্ভুত। প্রাণীটার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রায় আঁতকে উঠল নিতু। অবিকল মানুষের চোখের মতো চোখ। টকটকে লাল চোখের মণি। তার দিকে চেয়ে আছে। ভয়ংকর সে দৃষ্টি। সে আবছা অন্ধকারে স্পষ্ট সব দেখতে পেল।

মারাত্মক ভয় জেঁকে ধরল নিতুর। থরথর করে শরীর কেঁপে উঠল। তবুও সাহস সঞ্চয় করে বলল,

‘হুশ, হুশ!’

সে দূর থেকে হাত দিয়ে প্রাণীটা তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। আর তাতে বিপত্তি ঘটল। চোখের পলকে প্রাণীটা উড়ে এসে তাকে আক্রমণ করল। তার গলা পেঁচিয়ে ধরল। হাতের মোমবাতিটা ছিটকে কোথায় যেন পড়ল। নিতু দুহাতে প্রাণীটা ছাড়ানোর চেষ্টা করল। পারল না। ক্রমশ সেটা আরো গলায় গেঁথে যাচ্ছে। ব্যর্থ হয়ে একসময় জ্ঞান হারাল সে।

_______

বাপের চেহারা নিতুর মনে নাই। মায়ের চেহারা একটু একটু মনে আছে। গোলগাল চেহারা ছিল মায়ের। হাসলে গালে গর্ত হতো। বেশ সুন্দরী ছিল। পাড়ার লোকেরা বলত, তার মায়ের বুদ্ধি শুদ্ধি একটু কম। তবে বড় ভালো মানুষ ছিল।

তার মা মরল তখন নিতুর বয়স কয় বছর? সাত-আট বছর হবে হয়তো। তারা থাকত গ্রামের ডালিম চাচার ভিটেতে। বহু পুরোনো ভিটে। প্রাচীন গাছপালায় ভরা। সেখানে দোচালা টিনের ঘরে তাদের যাবতীয় সংসার। ভালোই দিন যাচ্ছিল তাদের। মা সুতা কেটে, কাঁথা সেলাই করে রোজগার করত। দুজনের পেট আরামসে চলে যেত।

সেবার চৈত্রের শেষ সপ্তাহ। তীব্র দাবদাহ। গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। হঠাৎ একদিন আকাশের উত্তর কোণে কালো মেঘ জমল। আস্তে আস্তে ভারী হতে লাগল। তারপর হঠাৎ ঝড় উঠল। কালবৈশাখী ঝড়। সে কি তান্ডব ঝড়ের। ঘরের চালা উড়িয়ে নিবে যেন। মড়মড় করে গাছপালা উড়ছে। ভয়ে নিতু এতটুকু হয়ে গেল। মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদল।

মা সান্ত্বনা দিয়ে নিতুকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তাকে ঘুম পাড়িয়ে মা-ও ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আর উঠল না। মাঝরাতে গাছের ডাল ভেঙ্গে তার মায়ের গায়ের উপর পড়ল। ঘুমের মধ্যে মা মা রা গেল।

মায়ের থেকে কতটুকু দূরে ছিল নিতু? দুই কি তিন হাত হবে হয়তো। অথচ ওইটুকু দূরত্বের জন্য সে বেঁচে গেল। তার মা বাঁচল না। পুরোনো ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে মায়ের দেহটা আটকা পড়ে রইল সকাল পর্যন্ত। রুগ্ন, পরিশ্রান্ত আর ক্লান্ত দেহ!

আজ অনেকদিন পর নিতু মাকে স্বপ্নে দেখল। মায়ের ঝাপসা একটা ছবি। মা দূর থেকে হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে। নিতু বুঝতে পারছে না। সে মায়ের দিকে ছুটছে। মা যেন ততই দূরে সরে যাচ্ছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। তবুও মায়ের নাগাল পাচ্ছে না। সে ছুটছে তো ছুটছেই! ছুটছে তো ছুটছেই!

ধপ করে চোখ খুলল নিতু। চোখ খুলতে দিনের কড়া আলো চোখে লাগল। কপাল কুঁচকে গেল তার। চোখের উপর হাত রাখতে গিয়ে সে টের পেল তার শরীর গরম। গা পুড়ে যাচ্ছে।প্রচন্ড জ্বর উঠেছে। গলার গাছটায় শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে আছে। শিহাবকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। নিতু ক্ষীণ গলায় ডাকল,

‘শিহাব?’

দুই বার ডাকতে শিহাব ছুটে এলো। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘নিতু তুমি চোখ খুলেছ! আমি কি ভয়টা না পাচ্ছিলাম।’

ভয় শব্দটা কানে যেতে নিতুর কালরাতের কথা মনে পড়ল। সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। গলায় হাত চলে গেল। আয়না দিয়ে না দেখেও বুঝল, সারা গলায় আঁচড়ের দাগ। সে আতঙ্কিত হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল। শরীর মারাত্মক দূর্বল! শিহাব বাঁধা দিতে চাইল। নিতু মানল না। উঠে বসে শিহাবকে আঁকড়ে ধরল। রুগ্ন হাতজোড়া বার বার খুলে আসতে চাইল। সে ছাড়ল না। শিহাবকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রইল।

‘কী হয়েছে নিতু? এতো ভয় পাচ্ছো কেন? আমায় বলো।’

নিতু খানিক সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল। তারপর শিহাবকে ছেড়ে মুখোমুখি হলো। কাতর গলায় বলল,

‘আপনি কালরাতে কখন ফিরেছেন?’

‘একটু দেরি হয়েছিল বৈকি! আচ্ছা তার জন্য সরি। আর হবে না।’

‘ঘরে ঢুকলেন কিভাবে?’

‘কেন? দরজা দিয়ে।’

শিহাব কপাল কুঁচকে উত্তর দিল। যেন নিতুর ছেলেমানুষী প্রশ্নে খুব বিরক্ত। নিতু কিন্তু ভড়কাল না। আবারো প্রশ্ন করল,

‘দরজা খুলে দিল কে?’

এই প্রশ্নের উত্তরে শিহাব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। নিতুকে ঝাঁকিয়ে বলল,

‘তুমি ঠিক আছো নিতু?’

‘হুঁ, ঠিক আছি। আপনাকে যা প্রশ্ন করছি তার উত্তর দিন। দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল। তাহলে ভেতরে ঢুকলেন কীভাবে? কে খুলে দিল?’

‘কে খুলে দিবে? ঘরে তুমি ছাড়া আর কে আছে? তুমিই তো খুলে দিয়েছিলে।’

নিতুর বিস্ময়ের সীমা রইল না। শিহাব এসব কী বলছে? সে তো কালরাতে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে ছিল। সে দরজা খুলল কখন? কই! মনে তো পড়ছে না।

সে সন্ধিহান চোখে শিহাবকে দেখল। বলল,

‘আমি আপনাকে এখন কিছু কথা বলব। আপনি কথা দিন।আমার সব কথা বিশ্বাস করবেন?’

‘কী কথা?’

‘আপনি আগে কথা দিন যে বিশ্বাস করব।’

‘আচ্ছা করব।’

নিতু কাল রাতের ঘটনা একদম শুরু থেকে বলল। কিছুই বাদ রাখল না। বলার পর শিহাবের মুখোভঙ্গি তীক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করল। শিহাবকে খানিক চিন্তিত দেখাল। বলল সে,

‘তোমার একটা ডাক্তার দেখানো উচিত।’

‘ডাক্তার?’

‘হ্যাঁ, ডাক্তার। তুমি যা বলছ তার কিছুই ঘটেনি। এগুলো তোমার অস্থির মনের কল্পনা। কালরাতে একা ছিলে। তখন মস্তিষ্ক নানা রকমের ভয় দেখিয়ে ধোঁকা দিয়েছে। বা এমন হতে পারে স্বপ্ন দেখেছ। এগুলোকে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, জানো তো?’

নিতু প্রচন্ড দুঃখ পেল। ভেতরজুড়ে হতাশা গ্রাস করল। বিয়ের পর এই প্রথম বোধ হয় শিহাবের প্রতি সে এতটা হতাশ হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘তাহলে আপনি বলেন। কালরাতে কি হয়েছিল?’

‘কাল বেশ রাত করে ফিরেছিলাম। বার দুই ডোরবেল বাজালাম। তুমি খুলতে একটু সময় নিচ্ছিলে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে হয়তো ঘুমিয়ে গেছো। এজন্য আরো ঘন ঘন ডোরবেল বাজাই। তারপর তুমি ঘুম থেকে উঠে এসে খুলে দিলে।’

‘আমার গলায় আঁচড়ের দাগ এলো কী করে?’

‘এটা তুমি নিজে করেছ নিতু। কালরাতে ঘুমের ঘোরে। শেষরাতের দিকে যখন তোমার জ্বর আসল, তখন জ্বরের ঘোরে এগুলো করেছ। আমি বাঁধা না দিলে অবস্থা আরো বেগতিক হয়ে যেত।’

নিতু অবাক চোখে শিহাবের পানে তাকিয়ে রইল। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। এসব কী ঘটছে তার সাথে? কোনটা সঠিক? সে নিজের চোখে যা দেখেছ সেটা? নাকি শিহাব যা বলছে তাই? সে কি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে?

(চলবে)