২০ (অন্তিম পর্ব)
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
এখন ওরা যাবে কংলাক ঝর্ণায় গা ভাসাতে। এত কাছে থেকে ঝর্ণার পানি স্পর্শ না করলে কি চলে? ঝর্ণার কথা মনে পড়লেই গা শিরশির করে ওঠে যেন। নিবিড় স্থানীয় একজন গাইড সাথে নেয়। যদিও প্রয়োজন ছিল না। এখানে আগে ও এসেছিল। তবুও নিরাপত্তার জন্য নিয়ে নেয়।
অথৈ এক্সাইটেড অনেক। একটু পর পর বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করছে। নিবিড় সুন্দর ভাবে সেসব উত্তর দিচ্ছে।
গাইডসহ ওরা দুজন পাহাড়ের ঢালু তে ট্রেকিং করছে।
নিবিড়ের যত ভয় অথৈ কে নিয়ে। সাবধানে দুজন নামছে।
“অথৈ, সাবধানে পা ফেলো কিন্তু। দেখে দেখে আসো। ”
“এত চিন্তা করতে হবে না তোমার। আমি পারব। আচ্ছা, এই পাহাড়ের নাম কংলাক পাহাড় নাম দেওয়া হয়েছে কেন? ”
“কংলাক পাড়াটি কমলাক পাড়া নামেও পরিচিত। স্থানীয় তথ্য মতে, এই পাড়াটির পাশে বড় বড় কমলা বাগান অবস্থিত বলে এটিকে কমলাক পাড়া বলা হয়। পাহাড়ের নিচে কংলাক ঝর্ণা অবস্থিত এবং এই ঝর্নার নামানুসারেই এই পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে। ভাই ঠিক বললাম তো? ”
গাইড নিবিড়ের কথা শুনে হেসে ওর কথায় মাথা নাড়ায়। তিনি প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলছেন না। শুধু আশেপাশের জায়গা কোথায় কেমন সেগুলো টুকটাক বলছেন।
ট্রেকিং করতে করতে অথৈ হাপিয়ে গেছে। নিবিড় এক পাশে ওকে নিয়ে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়।
“কিছু সময় জোরে জোরে শ্বাস নাও একটু। ভালো লাগবে। ”
ওর কথামত অথৈ জোরে জোরে শ্বাস নেয়। যখন একটু হালকা লাগে তখন আবার হাঁটা শুরু করে।
সাজেকে ঝকঝকে রাস্তা, হ্যালিপ্যাড, রির্সোট এত পযর্টকে ঠাঁসা। তবে এই পথে সেসবের কোনো চিহ্ন নেই।
পুরোটা পথ এখনও বন্য! পথটা ক্রমাগত জঙ্গলে ঢেকে যাচ্ছে। কোনো রকমে পা ফেলে ফেলে পথ শেষ করতে হচ্ছে। পুরোটা পথ ঘন জঙ্গল আর প্রাচীন বৃক্ষে ঢাকা। বড় বড় লতা দেখে যে কারও মনে পড়ে যাবে টারজানের গল্প।
পাহাড় বেয়ে পুরোটাই নামার পথ। ক্রমশ নামছে ওরা। গতকাল সাজেকের উঁচু পাহাড় থেকে নিচের ভ্যালির জমানো মেঘের সৌর্ন্দয্য দেখেছিল। এসব পথে সারাটা সকাল মেঘের আনাগোনা। এখন সেই পথেই হাঁটছে।
উপর থেকে যতটা মসৃণ মনে হত, ততই বন্ধুর মনে হল এই পথে হাঁটতে এসে। অথৈ পাহাড়ি ট্রেকিং এ নতুন হওয়ায় পথ চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল ওর। অচেনা বুনো পরিবেশে ট্রেকিং করে নিচে আসার পর মিলল শীতল জলের ঝিরি পথ।
অন্যসব ঝিরির মতো এটাও পাথরে ঠাঁসা। দীর্ঘ পথ পাহাড় বেয়ে নামার পর এমন ঝিরিটা ওদের মধ্যে কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ করে দিল আবার ও। দুটো পাহাড়ের মাঝখানে বয়ে যাওয়া ঝিরির পথে ধরে কিছুদূর হেঁটে যায়। আরও সামনে ছোট–বড় পাথর ডিঙিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে উপর থেকে অনবরত। নিঃশব্দের পাহাড়জুড়ে ঝিরির এমন পথ চলা সত্যিকারের বন্য স্বাদ এনে দেয় প্রকৃতিতে।
ঝিরিতে বিশ্রাম সেরে আবার পাহাড় ধরে উঠতে হবে। দুপাশে জঙ্গল ঘেরা গভীর খাড়া পথ বেয়ে উঠতে থাকে। কিছুদূর যেতেই কানে আসল ঝর্ণার তীব্র আওয়াজ। সেই শব্দ হাঁটার গতি যেন বাড়িয়ে দিল। উঁচুনিচু পাহাড় বেয়ে নামতেই বড় পাথর ডিঙিয়ে চোখ পড়ে দীর্ঘ ঝর্ণার দিকে।
উঁচু পাহাড়ে খাঁজ বেয়ে উপর থেকে দুভাগে পড়ছে ঝর্ণা। তীব্র শব্দ ঘিরে রেখেছে এই অচেনা পরিবেশ। সুনসান নীরব পাহাড়ের মধ্যে একমাত্র শব্দ যেন এই জলের ধারা। অনবরত উপর থেকে বয়ে আসা এই পানির স্রোত বন্দি করে নিল অথৈ এর নজর। পুরোটা পথের ক্লান্তি রেখে আসলো এই জলের স্রোতে। নিচ থেকে উপরের দিকে তাকাতে ঝর্ণাটাকে বড়ই বিস্ময় মনে হল। এ যেন সত্যিকারের আদিমতা ঘিরে রেখেছে পুরো প্রাকৃতিক রাজ্য! মেঘে ঢাকা এমন একটা বিস্তৃত ভ্যালির বুকে এমন ঝর্ণা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
নিবিড় অথৈ কে ধরে ঝর্ণার নিচে নেমে আসলো। একটা পাথরের উপর ওকে বসিয়ে দিয়ে কোমর জড়িয়ে রাখে। যেন পিছলে পড়ে না যায়। উপর থেকে ঝর্ণার জলরাশি ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওদের। এই এখানে আসতে কত কষ্ট করল, কত ক্লান্তি সব এক নিমিষেই চলে গেল। প্রকৃতি কত সুন্দর ভাবে ওদের আগলে রেখেছে তার অপরুপ সৌন্দর্য দিয়ে।
অথৈ নিচে নামে। দুজন দুজন কে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। পাগলামি, বাচ্চামি, দুষ্টুমি সব এক সাথে শুরু হয়ে যায়। অনেক্ষণ এভাবে থাকার পর দুজনেই হাপিয়ে যায়। বসে থেকে চারপাশ দেখে। কিছু প্রেমকথন হতে থাকে। এমন পরিবেশে রোমান্টিকা তো আসবেই।
“আমাকে এই পৃথিবীর সুন্দর জায়গাটা দেখানোর জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ নিবিড়। ”
নিবিড় ভ্রু উচিয়ে তাকায়।
“এই, বর কে কারা ধন্যবাদ দেয় শুনি? ”
“উম্ম, কেউ না দিক। আমার দিতে ইচ্ছে করল। অবশ্যই দেওয়া উচিত। ”
“আচ্ছা, তবে আরও অনেক অনেক সুন্দর দৃশ্য আছে। সেগুলো এখনো আপনার দেখা বাকি। বুঝলেন বউ? ”
“ইশ! কিভাবে বলে। ”
“লজ্জা পেলে বুঝি? ”
“যাও তো। ”
“এরপর তোমাকে আরও অনেক সুন্দর জায়গায় নিয়ে ঘুরব। তোমার যেখানে ইচ্ছে করবে নিয়ে যাব। ”
“পরের বার ট্যুরে তবে কাব্য ভাইয়াদের ও যেতে হবে। ”
“হ্যাঁ, সবাই মিলে যাব তো। একদম হৈহৈ করতে করতে যাব। ”
এই সুন্দর মুহুর্তটা ওরা আরও অনেক্ষণ উপভোগ করে। যেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও যেতে তো হবেই।
পৃথিবীর আলো এখানে খুব কমই পড়ে বলে মনে হয়। বিকেল হতে হতে আলো যেন বিদায় জানাতে থাকলো ঝর্ণার উপর থেকে। পাহাড়ের দেয়াল আটকে দিচ্ছে সূর্যের আলোকরশ্মি।
আলোর আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার আগেই এই দীর্ঘ ঝর্ণাকে পেছনে ফেলে রওনা হলো ওদের নিজেদের গন্তব্যে।
_____
রাত বেড়েছে। নিবিড় বাইরে থেকে একটা ফানুস কিনে নিয়ে এসেছিল। দুজনে বারান্দায় চলে যায়। ফানুস উড়িয়ে দেয় এক সাথে। নিস্তব্ধ পাহাড়ের মাঝে দুটো মানব-মানবী। ফানুসের হলুদ আলোয় অথৈ কে তখন দেখাচ্ছিল ভীষণ আবেদনময়ী। ওরা আকাশে ফানুস উড়ে যাওয়া দেখে। আশেপাশের পাহাড়, আকাশ, মেঘ ওদের দেখে। এখানে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছে ওরা মেঘের উপর চলে এসেছে। মেঘের দেশে ভাসছে। চোখ ধাঁধানো সুন্দর এই সময়গুলো। গোটা জীবনে এমন এক জায়গায় একবার আসলে সৃষ্টিকর্তার কাছে আরও একটা দিন বেশি বাঁচার প্রার্থনা করতে ইচ্ছে করবে।
এখানে আসার পর থেকেই ওদের ফোন বন্ধ করা ছিল। দুজনেই চেয়েছিল যান্ত্রিক জীবন থেকে বেরিয়ে শুধুমাত্র প্রকৃতির সাথে মিশে দুজন নীরবে সময় কাটাবে। এক জীবনে আর কি বা চাওয়ার থাকতে পারে?
সাজেকে ওদের কয়েক দিন পেরিয়ে যায়। এর মাঝে বেশ কিছু জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে। আদিবাসীদের সাথে দেখা করেছে, কথা বলেছে। রুইলুই পাহাড়ের সবার গল্প শুনেছে, রিসাং ঝর্ণায় গিয়ে আরও একবার সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছে। বাইরে ক্যাম্পিং করে বারবিকিউ করে সারারাত পার করেছে। মধুচন্দ্রিমা কে ঠিক তার মতো করেই কাটিয়েছে। নিবিড় চায়নি কোন একদিন অথৈ তাকে কিছু নিয়ে অভিযোগ করুক। যদিও সে জানে মেয়েটা কোনদিন অভিযোগ করবে না। তবুও চেয়েছে শ্রেষ্ঠ সময়গুলো ওকে উপহার দেওয়ার। একজন বর হিসেবে তার বউ এর জন্য এতটুকু না করলে চলে কি?
_____
ওরা আজকে সিলেট ফিরে এসেছে। আসার সময় কল দিয়ে কাব্য, রিদ, নীল কে সবটা সাজিয়ে রাখতে বলেছে। অথৈ কে সারপ্রাইজ দেবে বলে এই দিনের জন্য কয় বছর কিভাবে অপেক্ষা করেছে সেটা শুধু নিবিড় জানে। আজকে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটা। গাড়ি থেকে কিছুটা দূরের রাস্তায় ওরা নেমে যায়। নীল এগিয়ে এসেছে। বাকিরা নিবিড়ের কথামত সব কিছু রেডি করে সেখানেই অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।
নিবিড় একটা কালো কাপড়ে অথৈ এর চোখ বেঁধে দেয়। ও চুপচাপ নিবিড়ের কর্মকাণ্ড দেখছে। একটু একটু করে দুজন এগিয়ে যায় সামনের দিকে। নিবিড় অথৈ এর চোখের বাঁধন খুলে দেয়। অথৈ ধীরে চোখ খুলে সামনে তাকায়। বিষ্ময়ে হা হয়ে যায় ঠোঁট দুটো।
এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি! যেন একটা আস্ত স্বর্গরাজ্যের সামনে ও এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা সবুজ পাহাড়। দুই পাশে শিমুল গাছ। লাল রঙা ফুল ফুটে আছে। গাছের নিচে ফুল পড়ে আছে অনেক। ঠিক দুটো গাছের মাঝের ফাঁকা জায়গা একটা কাঠের বাড়ি। যেমনটা অথৈ কল্পনা করত। চারপাশে ফুলের বাগান। নিবিড় ওর হাত ধরে আরেকটু সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।
বাড়ির নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে একটা নাম। ‘অথৈ মহল’।
কাব্য, নীল, রিদ এবং হৈমন্তী ওর উপর ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিয়ে জোরে এক সাথে বলে ওঠে।
“তোমার অথৈ মহলে তোমাকে স্বাগতম অথৈ। ”
অথৈ এর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। দৌড়ে গিয়ে কাব্য, নীল, রিদ,হৈমন্তী কে জড়িয়ে ধরে। নিবিড় সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের এই আনন্দ। আজকে বোধহয় সব পূর্ণতা পেল। নিবিড়ের মা এখানে আসেনি। ছেলে-ছেলের বউ একান্তে সময় কাটাবে সেখানে সে কিভাবে আসবে?
নবনী এসেছে টমি কে কোলে নিয়ে।
নিবিড় নবনীর কাছে থেকে টমি কে নিয়ে অথৈ এর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওকে ডাকতেই অথৈ ঘুরে তাকায়।
“আমি কি আমার কথাটা রাখতে পেরেছি অথৈ? তোমার আবদার কি আমি পূরণ করতে পেরেছি? খুশি হয়েছো তুমি? সবটা তোমার মনের মতো হয়নি? ”
অথৈ কথা বলতেই পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিবিড়ের গলা জড়িয়ে ধরে। নিবিড় ওকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে বলে।
“পাহাড় শুনছ? আমি আমার বউ কে ভীষণ ভালোবাসি। যেই ভালোবাসা তোমার সৌন্দর্যের থেকে ও স্নিগ্ধ। ”
অথৈ কাঁদতে কাঁদতেই হেসে ফেলে ওর পাগলামি দেখে। অথৈ চারপাশে ঘুরে দেখে। রুমের ভেতরে যায়। এক পাশে একটা সুন্দর বিছানা। সাদা চাদর বিছানো সেখানে। চারপাশে সাদা পর্দা দেওয়া। দক্ষিণ দিকে একটা বড় জানালা। সেই জানালা গলিয়ে বাতাস আসছে রুমের ভেতর। জানালার পাশেই বেশ কিছু ল্যাভেন্ডার কালার অর্কিড ফুল। অথৈ মুগ্ধ হয়ে চারপাশে দেখছে। দেয়ালে ঝুলছে গোল নকশা করা একটা আয়না। একটা বুকশেলফ। সেখানে কিছু বই সাজিয়ে রাখা। ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ফুলের টব।
পূর্ব পাশের দেয়ালে চোখ যেতেই অথৈ আরও একবার চমকে ওঠে। সিলেট আসার পর থেকে যত ছবি তুলেছিল। সব এই দেয়ালে লাগিয়ে রেখেছে। একেকটা ছবির সাথে দারুণ কিছু কথা ও লেখা।
অথৈ সবগুলো ছবি একটা একটা করে দেখতে থাকে। প্রথম ছবিটার দিকে তাকায়। অথৈ বউ সাঁজে ট্রেনের জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
এই ছবি কখন নিবিড় লুকিয়ে তুলেছিল ও জানতেই পারেনি। এখন দেখল।
এই ছবির পাশে লেখা, “আমার দেখা পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর একটা না হওয়া বউ। ”
অথৈ হেসে ওঠে এই লেখা দেখে। আরেকটা ছবি তে অথৈ ঝুঁকে চা পাতা তুলছে। ঠোঁটে হাসি লেগে আছে।
এখানে লেখা, “এক চিলতে রোদে ভয়ানক সুন্দর হাসির এক সুন্দরী রমণী। ”
অথৈ অবাক হবার ভাষা ও হারিয়ে ফেলেছে যেন। আরেকটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, অথৈ কাব্যর দিকে ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে। কাব্য ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
এখানে লেখা, “একটা ঠোঁট ফোলানো বাচ্চা মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাব্যর দুষ্ট হাসি। ”
অথৈ দেখল, আরও একটা সুন্দর ছবি। এই ছবিটা যখন পড়ে গিয়ে ওর কোমরে ব্যথা পেয়েছিল। ঠিক সেই সময়ের।
ছবিতে, অথৈ সোফায় বসে কাব্যর পায়ের উপর ওর দু’পা তুলে রেখেছে। নিবিড় মুখে খাবার তুলে খাওয়াচ্ছে। রিদ হাত নাড়িয়ে কিছু বলছে।
এই ছবিতে লেখা, “আমাদের আদরের ননীর পুতুল কে যত্ন করা হচ্ছে। ”
অথৈ খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। আরেকটা ছবি দেখতে পায়। এটা তোলা হয়েছিল যখন ওরা আদিবাসীদের রাসলীলা উৎসবে গিয়েছিল।
লেখা, “আমার দেখা এক অনন্য সুন্দর আদিবাসী সাঁজ কন্যা। যাকে দেখে প্রথম আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেগে বেড়ে গিয়েছিল। যার হাসিতে আমি আরও একদিন বাঁচার ইচ্ছা রাখি। ”
অথৈ বিষ্মিত হয়, পুলকিত হয়ে যায়। এরপর আরও আরও অসংখ্য ছবি দিয়ে ভর্তি। একটা ছবি তে টমি কে কোলে নিয়ে চুমু দিচ্ছে।
সেখানে লেখা, “দুটো আদুরে বিড়ালছানা। ”
যেদিন ওদের বিয়ে হয় সেই ছবিটা ও দেখতে পায় এখানে।
লেখা ছিল, “অবশেষে না হওয়া সুন্দর বউটা আমার হয়েই গেল। ”
যখন সাজেক গেল। মেঘ ছুঁয়ে দিচ্ছিল অথৈ। সেই ছবিটা ও এখানে।
লেখা, “স্বর্গরাজ্যে আমার ব্যক্তিগত মেঘপরী। ”
অথৈ পেছনে তাকায়। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বাকিদের চোখে ও পানি চিক চিক করছে। এদের না দেখলে বুঝতেই পারত না যে, ভালোবাসা কত রকমের সুন্দর হয়। এইযে সামনে হৈমন্তী মেয়েটা দাঁড়িয়ে। ওকে তো সেভাবে দেখেনি অথৈ। তবুও মেয়েটার চোখে অথৈ নিজের জন্য একটা মায়া দেখতে পায়।
একটা জীবনে হাজার রকম ভাবে অথৈ ওদের কাছে ভালোবাসা পেয়েছে। ভালোবাসতে শিখেছে। কিভাবে আগলে রাখতে হয় সেটা জেনেছে। ভালোবাসার মানুষ কে ছেড়ে না গিয়ে অপেক্ষায় থাকতে শিখিয়েছে। আর কি চাই জীবনে? আফসোস বলতে আর কিছুই নেই। ছোট্ট জীবনে না চাইতে সব কিছু পেয়ে গেছে।
অথৈ ওদের দিকে এগিয়ে যায়। সবাই এক সাথে জড়িয়ে থাকে অনেক্ষণ।
_____
বারান্দায় একটা দোলনা রাখা ছিল। এই পাশের দেয়ালে একটা পাহাড়ের ছবি লাগানো। অথৈ দু মগ চা নিয়ে বারান্দায় এসে দোলনায় বসে। এক মগ নিবিড় কে দেয়। টমি নিচে ঘুরাঘুরি করছে। চারপাশে ফুলের গাছ থেকে সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। নিবিড় তাকিয়ে দেখছে অথৈ কে। শাড়িতে ওকে সুন্দর লাগে। ল্যাভেন্ডার কালার শাড়ি পরেছে আজ।
“নিবিড়, ”
“হ্যাঁ, বলো। ”
“এমন একটা বাড়ির খুব ইচ্ছে ছিল আমার। তুমি আমার মতো করেই বানিয়েছ। শান্তি তে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় এখানে। ”
“যেখানে তুমি থাকবে। সেখানে শান্তি তো থাকবেই অথৈ। ”
“তুমি আমার সুখ নিবিড়। ”
নিবিড় মুচকি হাসে।
“শিমুল গাছ দুটো সুন্দর লাগছে না? ”
“হ্যাঁ, অনেক সুন্দর। আমার পছন্দের ফুল। ”
“তুমি এখানে একটু বসো। আমি দৌড়ে আসছি। ”
নিবিড় জলদি বাইরে চলে যায়। ফিরে আসে অনেকগুলো শিমুল ফুল নিয়ে। সুঁচ, সুতো নিয়ে এসে ফুল গুলো গেঁথে ফেলে। অথৈ অবাক হয়ে নিবিড় কে দেখছে।
একটু পর একটা ক্রাউন বানিয়ে ফেলে শিমুল ফুলের। তারপর সেটা অথৈ এর মাথায় পরিয়ে দেয়।
“ইশ! আমার শিমুল রাণী। ”
অথৈ জড়িয়ে ধরে নিবিড় কে। জোরে শ্বাস নেয়। বুক ভোরে নিবিড়ের শরীরের ঘ্রাণ নেয়। চোখ বন্ধ করে রাখে। নিবিড় ওর থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে কপালে চুমু দেয়।
“অনেক অনেক ভালোবাসবে বলো? ”
“আচ্ছা বউ, অনেক ভালবাসবো। ”
“বুকে জড়িয়ে রাখবে? ”
“এইযে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আর ছাড়ছি না। যেন বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে শান্তি পাও। ”
“আমি ঝগড়া করলে এসে চুমু খাবে? ”
“সব অভিমান ভুলে এসে কপালে, ঠোঁটে চুমু খাব। ”
“কোলে নিয়ে রুমের মধ্যে ঘুরবে? ”
“হ্যা ঘুরব তো। কোলে নিয়ে হুটহাট চুমু খাব। তুমি গলা জড়িয়ে ধরে রাখবে। তারপর তোমায় নিয়ে হারিয়ে যাব আবারও কোন এক পাহাড়ে। নয়তো সমুদ্র স্নানে। ”
“হ্যাঁ মাথায় হাত বুলিয়ে, গালে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিব। তুমি ঘুমিয়ে গেলে আমি তোমার সামনে একটা চেয়ার পেতে সারারাত বসে তোমার নিষ্পাপ মুখটা দেখব। ”
“উহু, বুকের মধ্যে থাকব।”
“আচ্ছা, বুকের ভেতর রাখব সারারাত। ”
“তুমি অন্য পাশে ঘুরলে। আমাকেও সেই পাশে ঘুরিয়ে বুকের মধ্যে চেপে রাখবে। ”
“আচ্ছা রাখব। সব সময় আমার বুকেই রাখব। ”
“নিবিড়, জানো তো তুমি আমার অজানা এক প্রাণোচ্ছল অনুভূতি । ”
“আর তুমি আমার দৈনন্দিন অভ্যাস। এই অভ্যাস একেবারে রক্তের সাথে মিশে আছে। ”
“ভালোবাসি বর।”
“ভালোবাসি বউ। ”
_____
রাতে নিবিড় বারান্দায় বিছানা পাতে। আজকে প্রথম ‘অথৈ মহলে’ জ্যোৎস্না বিলাস করবে ওরা। বিছানা করে অথৈ কে ডাকে। দুজনে শুয়ে থাকে সেখানে। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। চাদের আলো পুরোটা বারান্দায় ঝপ করে নেমে এসেছে। টমি মাথার পাশেই শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
ওরা দুজনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। বাইরে এখন আচমকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। খানিক পরেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বাতাসের দমকে বৃষ্টির পানি এসে ওদের গায়ে পড়ছে। কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা অথৈ এর গালে এসে লাগে। নিবিড় নেশাতুর চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
নিবিড় অথৈ এর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“বাইরে যাওয়ার কথা শুনলেই তুমি যেভাবে চট করে শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নিতে পারো।
সেভাবেই টুপ করে তুমি একটা শাড়ি পরে নেবে। তোমাকে তো যেকোন শাড়িতেই মানায়। আমিও ঝটপট একটা পাঞ্জাবি পড়ে নেব।
তারপর একদিন দুজন যেদিকে খুশি হারিয়ে যাব বন্য পাখি হয়ে। রইবে না কোন পিছুটান। তোমাতে আমি হারিয়ে যাব অজনা এক গন্তব্যে। ”
এর মাঝেই নিবিড়ের ফোনে টুং করে একটা ম্যাসেজের শব্দ আসে। কাব্য পাঠিয়েছে।
লিখেছে, “দোস্ত চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞাটা আর রাখতে পারলাম না বুঝলি? ভাবছি পৃথা কে বিয়েটা এবার করেই ফেলব। ”
নিবিড় ম্যাসেজ টা পড়ে প্রশান্তি তে ঠোঁট কামড়ে হাসে। অথৈ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
“শুনো অথৈ। ”
“বলো। ”
“সব স্মৃতিই তো স্মরণীয় করে রাখলাম। ‘অথৈ মহলে’ আজকের রাতটা ও না হয় ভালোবাসায় আদরে স্মরণীয় করে রাখি। ”
অথৈ লজ্জায় দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। নিবিড় ওকে কোলে নিয়ে রুমে চলে যায়। পর্দা ফেলে দেয় চারপাশে।
ঝুম বৃষ্টি তে চারপাশে তীব্র বর্ষণ হচ্ছে। দুটো মানব-মানবী এক আদিম লিলায় মত্ত হয়। মাতাল হয়, বেসামাল হয়। যেই এক হওয়ায় রয়েছে বৈধতা। এক অকৃত্রিম ভালোবাসা। প্রকৃতির মাঝে এই সুন্দর রাতটা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। ভালোবাসার নতুন এক সূর্যদয় হবে আরও একবার। আদর আদর এক সুন্দর সকালে রমণীর ঘুম ভাঙ্গুক তার প্রিয় পুরুষের বাহুডরে। সেই সকালটা হোক শুধুমাত্র ভালোবাসার।
_____
সমাপ্ত
১৮
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
সময় তার নিজ গতিতে চলতে থাকে। দিন, মাস ঘুরে আরেকটা নতুন দিনের শুরু হয় কিন্তু নিবিড়ের কাছে প্রতিটা দিনই সেই এক রকম লাগে। জীবনে কোন নতুন রং নেই, শান্তি নেই। সব কিছু এলোমেলো। মনের সাথে আর কতই বা যুদ্ধ করা যায়?
নিবিড় বেশিরভাগ সময় ক্লিনিকেই পড়ে থাকে। বাইরে থেকে মাঝে মাঝে দেখে। কোন কোন দিন ডক্টরের থেকে অনুমতি নিয়ে ভেতরে গিয়ে অল্প কিছু সময় দেখার সুযোগ হয়। নিবিড় তখন শ্বাস নিতেও ভুলে যায়। এই যন্ত্রণা অন্য কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। টমি ইদানীং নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কবে থেকে ও অথৈ কে দেখে না তার হিসেব নেই। ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে টমি ও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
দিন কখন কেমন যায় কে বলতে পারে।
নিবিড় নোটপ্যাডে নিয়ে বসে। লিখতে ইচ্ছে করছে কিছু। মনের ভেতর জমানো কথা লিখতে থাকে। যেই কথা গুলো অথৈ কে বলা হচ্ছে না। সেগুলো লিখে রাখে রোজ।
“আমার অথৈ,
কেন যেন আজ তোমাকে নিয়ে লিখতে হাত কাঁপছে, খারাপ লাগছে, কষ্ট হচ্ছে।
হিন্দু ধর্মে সাত জন্মে বিশ্বাস করে অনেকে। কিন্তু আমরা জানি মানুষের কখনো দ্বিতীয়বার জন্ম হয় না। যদি সত্যিই কোন ভাবে এমনটা হতো। তবে প্রতি ওয়াক্ত নামাজে বসে আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করতাম,
হাজার বার জন্ম নিলেও আমার জীবনের প্রথম নারী হিসেবে সাক্ষাৎ টা যেন তোমার সাথেই হয়। আর কোন নারীর দেখা অথবা সাক্ষাৎ আমি চাই না। শুধু এই একটা তুমি ছাড়া।
বারবার জন্ম আমি তোমার জন্যই নিতাম।
এত অল্প তো ভালোবাসিনি যে এই একটা জন্মেই সব ফুরিয়ে যাবে? এক জন্মে বুঝি ভালোবাসা শেষ হয়?
হ্যাঁ, হয়তোবা ভালোবাসা কারও কারও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তুমি তো সেই নারীদের মতো না?
তুমি সেই মানুষ যাকে প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমি অনুভব করি। এই অনুভূতিগুলো কি এতোটাই ফিকে? যার জন্য তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যাব?
ভালোবাসা বলতে আমি তোমাকেই বুঝি।
পৃথিবীতে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করে যাবো তুমি ফিরবেই। বাকি পুরো পৃথিবী আশা ছাড়লেও আমি কখনো ছাড়ব না।
এই যে প্রতি মুহূর্তে ভাবি একদিন তুমি আমার সমানে এসে দাঁড়াবে। তুমি একান্তই আমার হয়ে যাবে। সেই দিনটার জন্যই তো আমার এতো অপেক্ষা। এতো অস্থিরতা।
অপেক্ষা শব্দটা নাকি ভয়ানক।
আমি সেই ভয়ানক শব্দটাই মধুর মতো রোজ পান করি। আমি জানি তুমি একদিন আসবে। আমার জন্য আসবে।
প্রতিটা মুহূর্ত এই অপেক্ষাটা আমার ভীষণ সুন্দর মনে হয়। অপেক্ষা বলতে তো আমি তোমাকেই বুঝি অথৈ।
আমার আঙ্গিনায় একদিন বসন্ত আসবে। গাছে গাছে পাখি কিচিরমিচির করবে। হাজার রকমের ফুল ফুটবে। সেই রঙিন বসন্তটা আমি নিজের চোখে দেখবো।
এই যে এই অপেক্ষাটা? ভীষণ সুন্দর না তুমি বলো?
তুমি তো বলতে আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে।
তোমার বাচ্চামি আবদার আমি যত্ন করে পূরণ করব। এই অপেক্ষা গুলো কে আমি কিভাবে উপেক্ষা করি বলতো?
এই এতো আকুলতা-ব্যাকুলতা কার জন্য? কিসের জন্য? সবই তো তোমার জন্য।
এই এক জন্মে তোমার প্রতি ভালোবাসা আমার ফুরাবে কিভাবে বল?
এতো সামান্য ভালোবাসিনি তো আমি?
এতো ঠুনকো ভরসা নিয়ে তোমার সাথে পথ চলার স্বপ্ন দেখিনি তো আমি?
এই ভয়ানক অপেক্ষা কে সুন্দর ভাবে রোজ সাজিয়ে তো এমনি রাখিনি?
ভালো তো এমনি এমনি বাসিনি।
তোমাকে একান্ত নিজের করে পাবো বলেই তো ভালোবেসেছি।
তুমি আমার সারাজীবনের ভালোবাসা।
এই কয়েক বছরেই ছেড়ে দেই কিভাবে বল? ”
______
৩ বছর পর___
রিদ নিবিড়ের জন্য খাবার নিয়ে আসে। নীল ও সাথেই এসেছে। আইসিইউ এর বাইরে থেকে গ্লাসের ভেতর দিয়ে অথৈ কে ওই ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কেমন যেন ওর বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। নিবিড় কে সেখানে না পেয়ে বাইরে খুঁজতে যায়। গিয়ে দেখে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। কাব্য ও সেখানেই দাঁড়িয়ে। নীল গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে। নিবিড় ঘুরে তাকায়।
ওর মুখটা ও কেমন যেন হয়ে গেছে। কি ছন্নছাড়া ভাব। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। কি উদ্ভট চেহারা বানিয়ে ফেলেছে এই কয়েক বছরে। অথচ একটা সময় এই ছেলেটাই ছিল সব থেকে বেশি স্মার্ট। নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যথেষ্ট সচেতন ছিল। কি পরিপাটি হয়ে থাকতো সব সময়। আর এখন? মুখের দিকে তাকানোই যায় না।
রিদ ওর কাঁধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করে,
“খেয়েছিস কিছু? ”
নিবিড়ের চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। কিছু বলে না। কাব্য ইশারায় রিদ কে বোঝায়, ও কিছু খায়নি সকাল থেকে।
রিদ পাশে থেকে চেয়ার টেনে নিবিড় কে বসিয়ে দেয়।
“হৈমন্তী খাবার পাঠিয়েছে। চুপচাপ খেয়ে নে। মেয়েটা এত ব্যস্ততার মাঝে ও তোর জন্য সময় বের করে রান্না করেছে। আজকে যেন খাবারের বক্সে খাবার ভর্তি ফেরত না যায়। সবটা খাবি এখন। ”
হৈমন্তী রিদের স্ত্রী। গত বছর ঘরোয়া ভাবে ওদের বিয়ে হয়। যদিও নিবিড়ের এই দুঃসময়ে রিদের কোন ইচ্ছেই ছিল না বিয়ে করার। তবুও পরিবারের চাপে করতে হয়েছে। মেয়েটা অনেক ভালো। রিদের কাছে অথৈ এর গল্প শুনেছে অনেক। ওর গল্প শুনেই মায়ায় পড়ে গেছে। ওদের সব ছবি গুলো ও দেখেছে। কি হাস্যজ্বল মেয়েটা! মাঝে মাঝে হৈমন্তী ও ক্লিনিকে আসে। বাইরে থেকে অথৈ কে এক নজর দেখে আবার চলে যায়। নিবিড়ের এই অবস্থা দেখতে দেখতে মিসেস রেহেনা ও অসুস্থ হয়ে গেছে। তাই নিবিড়ের খাবার হৈমন্তী নিজে রোজ রান্না করে রিদের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
নিবিড়ের মাঝে মাঝে অবাক লাগে। ওর চারপাশের মানুষ গুলো এত ভালো কেন? এক নিমিশেই সবাই মায়ায় জড়িয়ে যায়। নাকি অথৈ মেয়েটাই বেশি মায়ার? যেখানে অথৈ থাকবে সেই জায়গায় ভালোবাসা আর মায়ায় ভর্তি থাকবে। সবাই কে নিজের অদৃশ্য মায়া দিয়েই যেন আকড়ে ধরে রাখে। এত ভালোবাসা এত টান ছেড়ে নিবিড় যাবে কোথায়?
নিবিড় কিছু বলে না আর। খাবার হাতে নেয়। খেতে নেবে তখনই বক্স টা ওর থেকে কাব্য নিয়ে নেয়। হাত ধুয়ে নিজেই নিবিড়ের মুখে খাবার তুলে দেয়। ওদের সবারই চোখে পানি চলে আসে। কে জানতো এমন একটা দৃশ্য একদিন ওদের নিজের চোখে দেখতে হবে?
অল্প খাওয়ানো শেষে নীল পানির বোতল এগিয়ে দেয়।
“এভাবে থাকিস না দোস্ত। অথৈ অবশ্যই সুস্থ হবে। আমাদের এত অপেক্ষা এত যত্ন এত ভালোবাসা, প্রার্থনা সব কখনোই বৃথা যেতে পারে না। ”
নিবিড় তবুও চুপ করে থাকে। ওর এই চুপ করে থাকাটাই যেন কেউ মেনে নিতে পারছে না। এমন নিশ্চুপ কেন হবে সে? এটা তো মানাচ্ছে না?
নিবিড় উঠে চলে যায় অথৈ এর কাছে। হাতের উপর আলতো করে হাত রাখে। ওর হাতের কাছে মাথাটা রেখে চুপ করে থাকে। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে অথৈ এর হাতের উপর পরে। নিবিড় নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।
কাব্য, রিদ, নীল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে এই কঠিন দৃশ্যটা অবলোকন করে। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি ওদের নেই। অথৈ তো ওদের ও বোন ছিল। কত ভালোবাসতো মেয়েটা কে ওরা। যেন ভাইয়েদের চোখের মণি সে। একটু আঘাত লাগলেই সবাই যত্ন করতো। ভুল করলে বকতো। আবার একটু পরে মাথায় তুলে রাখতো।
ভালোবাসার মানুষ গুলো কেন যে এভাবে দূরে চলে যায়। এ যেন থেকেও নেই। চোখের সামনে আছে। নিবিড় ওকে ছুঁতে পারছে। কিন্তু কোন সাড়া পাচ্ছে না। মৃত মানুষের মতো। যেন প্রাণহীন একটা দেহ পড়ে আছে।
নিবিড় নিজের মনেই জিজ্ঞেস করে, কবে ফিরবে? কবে গলা জড়িয়ে ধরবে? কবেই বা সে তার বাচ্চা বাচ্চা আবদার গুলো করবে?
আরও কতশত অপেক্ষার পর আনন্দ ফিরবে ওদের জীবনে? আরও কত বসন্ত পেরিয়ে গেলে ওদের আঙ্গিনায় ফুল ফুটবে? পাখিরা গান গাইবে? কবে অথৈ খিলখিলিয়ে হাসবে? নিবিড় হাসফাস করে। মনে হচ্ছে দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। চোখ অন্ধকার হয়ে আসে।
নিবিড় ভাবতে থাকে, অথৈ কে এমন ঝাপসা লাগছে কেন ওর? এমন কষ্ট হচ্ছে কেন? বুকে ব্যথা হচ্ছে। ও কি মারা যাচ্ছে? কই আর তো কিছু দেখা যাচ্ছে না? সব অন্ধকার। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার সব কিছু।
_____
পুরোনো স্মৃতি থেকে নিবিড় বেড়িয়ে আসে। ৪ বছর নাকি হয়ে গেছে। অথচ নিবিড়ের কাছে এটা ৪ যুগের সমান। মিসেস রেহেনা তো নিবিড়ের মা। অথৈ এর থেকে তার কাছে নিজের ছেলের প্রতি ভালোবাসা বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ছেলের চিন্তায় সে এখন বিছানায় পড়ে গেছে।
রোজই তিনি বলেন, অথৈ কে ভুলে যেতে। শুধু শুধু তার ছেলে কেন অন্য মেয়ের জন্য নিজের জীবনটা এভাবে শেষ করবে? তার নিজের দুটো ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখের একটা ছোট্ট সংসার ছিল। ছেলে বিয়ে করবে। নাতি-নাতনি হবে। সব মিলিয়ে ঘর ভর্তি দেখবেন। অথচ এই বয়সে এসে তিনি নিজের চোখে ছেলে কে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখছেন। তাই না চাইতেও মায়েদের স্বার্থপর হতে হয়। মায়েরা সন্তানের ভালো চায় সর্বদাই।
নিবিড় কারোর কথাই শোনে না। এইযে অথৈ অসুস্থ হলো। বাকি সবাই আশা ছেড়ে দিল। একমাত্র নিবিড় মনের জোর রেখে দিয়েছে। ওর বিশ্বাস অথৈ ফিরবে একদিন। সেই বিশ্বাসের জোরেই গত ২ বছর আগে একটা পাহাড় কিনেছে।
সেখানে বাড়ি করা ও শুরু করেছিল। এখন বাড়ির কাজটা সমপূর্ণ প্রায়। আজকে সেখানেই এসেছে। পাহাড়ের উপর ঝকঝকে একটা কাঠের বাড়ি। আজকে নেমপ্লেট লাগানো হয়েছে একটু আগে। ‘অথৈ মহল’ নামটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে আজ। নিবিড় অপেক্ষায় আছে অথৈ কে এই চমৎকার উপহার দিয়ে চমকে দেওয়ার জন্য।
বাড়ির সামনে বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগানো বাকি। তবে আগে থেকেই এখানে দুই পাশে দুটো শিমুল গাছ ছিল। তার মাঝখানেই বাড়িটা। অথৈ এর শিমুল ফুল পছন্দ। একদিন বলেছিল এই কথা। এটা দেখেই এই পাহাড় টা কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। এখনো ফুল ফোটেনি। নিশ্চয় অথৈ যখন এখানে আসবে। তখন গাছে গাছে ফুলে ভর্তি থাকবে। নিবিড়ের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে অনেক দিন পর।
রাতের খাবার শেষে হৈমন্তী সব কিছু গোছগাছ করে রুমে আসে। এসে দেখতে পায় রিদ কিছু বাঁধাই করানো ছবি গুলোর প্যাকিং খুলছে। হৈমন্তী এগিয়ে যায়।
“কি করছো তুমি? ”
“অথৈ এবং আমাদের সবার এতদিন যেগুলো ছবি তুলেছিলাম। সেগুলো বাঁধাই করে নিয়ে এসেছি আজ। সেগুলো খুলে দেখছি কেমন হলো। ”
“দাও তো দেখি ছবি গুলো। ”
হৈমন্তী ছবিগুলোর দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে মুগ্ধতা দেখতে পায় রিদ।
“ইশ! আপুটা কি সুন্দর ছিল তাই না? ”
“হ্যাঁ, ভীষণ সুন্দর ছিল। ”
“নিবিড় অথৈ এর জন্য একটা বাড়ি বানিয়েছে পাহাড়ে। এই ছবি গুলো ওদের রুমে সাজিয়ে আসতে হবে। অথৈ সুস্থ হয়ে যেন পুরো একটা সুন্দর মহল দেখতে পায়। ”
“রিদ, ”
“হু, বলো। ”
“নিবিড় ভাইয়া অথৈ আপু কে অনেক ভালোবাসে। এভাবেও ভালোবাসা যায় জানতাম না। ”
রিদ হৈমন্তীর গালে হাত রাখে।
“অথৈ মেয়েটা ভালোবাসার মতোই হৈমন্তী। তুমি ওর সাথে একবেলা কাটালেই মায়ায় পড়ে যাবে। এতটা স্নিগ্ধ, কোমল মনের একটা মেয়ে। ”
“দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক সে। আমি সত্যিই তার সাথে কিছু সময় গল্প করতে চাই। সবার পছন্দের এই মানুষটা কে না দেখতে পেলে আমার জীবনে সত্যিই আফসোস থেকে যাবে রিদ। ”
রিদ শুকনো একটা হাসি দেয়। হৈমন্তী কে নিয়ে শুয়ে পড়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
“তুমি ভীষণ ভালো হৈমন্তী। আমি অনেক ভালোবাসি তোমায়। এই এক জীবনে তোমাকে পাওয়া না হলে বোধহয় আমার আর কিছুই পাওয়া হতো না। কতটা বোঝ তুমি আমাকে। আমার জন্য আমার বন্ধুর এতটা খেয়াল রাখছ।
রোজ হাজার ব্যস্ততার মাঝেও রান্না করে পাঠাও। তোমার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো বা সহ্য করতো না। তোমার মনটা অনেক বেশি ভালো। ”
হৈমন্তী কিছু না বলে রিদের বুকে মুখ গুজে দেয়। চোখ বন্ধ করে রিদের কথাগুলো শুনতে থাকে।
ভালোবাসার কত রুপ তা সবারই অজানা। নিবিড় একজন কে ভালোবাসে পাগল হয়ে আছে। কাব্য কে পৃথা নামের মেয়েটা এত ভালোবাসার পর ও তার কোন অনুভূতি কাজ করে না তার। নিজেকে একা রাখতেই বেশি পছন্দ করে। কোন নারীর প্রেম তাকে আটকাতে পারে না। আর নীলের তো পুরো জগত তার বন্ধুদের ঘিরেই। এইতো গত বছর নীল কে ওর বাবা বিদেশ পাঠানোর কত চেষ্টা করল। নীল গেলই না। সে তার বন্ধু কে এই অবস্থায় ফেলে যাবে এটা ভাবাও যেন অন্যায়। আর রিদ তো আছেই বন্ধুর দুঃসময়ে সময়ে খেয়াল রাখতে। অথৈ এর স্মৃতিগুলো আগলে রাখতে আর ওর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে হৈমন্তী। এক অথৈ কে কেন্দ্র করে প্রতিটা মানুষের জীবন কোথাও একটা গেঁথে আছে। সেটা সবারই জানা।
_____
কাব্য আধঘণ্টা আগেই নিবিড় কে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে ছিল গোসল করে আসতে। নিবিড় ওয়াশরুমে । তখন ওকে বার বার নীল কল দিচ্ছিল। নিবিড় রিং শুনতে পায়নি। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই শুনতে পায় ফোন বাজছে। কল ধরতে ধরতেই কেটে যায়। কল লিস্ট চেক করে দেখে নীলের ১৭ টা মিসড কল উঠে আছে। আর কাব্যর ৬ টা। হঠাৎ এতগুলো কল দেখে বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। মনে কু ডাক দেয়। অজানা ভয়ের আশঙ্কা নিয়ে কাঁপা হাতে নীলের নাম্বারে কল দেয়।
নীল কল রিসিভ করেই একটা জোরে চিৎকার দিয়ে বলে,
“দোস্ত জলদি আয়। অথৈ এর রেসপন্স পাওয়া গেছে কিছুক্ষণ আগে ডক্টর জানিয়েছেন। ”
নিবিড় খুশি তে কি করবে বুঝতে পারে না। এত বড় সু খবর পাবে ভাবেনি এখন। আজকে পৃথিবীর সব থেকে বেশি আনন্দের দিন।
কল কেটে দৌড়ে আবার ওয়াশরুমে চলে যায়। ওযু করে দু রাকাত নফল নামায পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়। ওর মা কে গিয়ে খবরটা দেয়। মিসেস রেহেনা খুশি হয় অনেক। নবনী তো খুশিতে আরেক ধাপ এগিয়ে। সে ও তার ভাইয়ের সাথে যাবে ক্লিনিকে।
ডক্টর জানিয়েছেন, এখন আর ভয়ের কোন আশঙ্কা নেই। আল্লাহ চেয়েছেন বলেই এমন একটা মিরাকল হয়েছে। নয়তো এমন পেশেন্ট এত জলদি কোমা থেকে ফিরে আসে না। আর অল্প কিছুদিন ওকে অবজারভেশনে রাখতে হবে। তারপর বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। সময় মতো ঔষধ খাওয়ালে আর যত্ন নিলেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।
নিবিড়ের কাছে সব কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। অথৈ কে এখন সে সব সময় নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবে। এই আনন্দটা সে কোথায় রাখবে?
ওকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। নিবিড় টমি কে সাথে নিয়ে এসেছে। এতদিন ধরে টমি দেখতে পায়নি ওকে। আজকে দেখানোর অনুমতি পেয়েছে। টমি কে কোলে নিয়ে অথৈ এর পাশে বসে। টমি খুশি প্রকাশ করছে লেজ নাড়িয়ে। মিউ মিউ করছে। ওর কাছে যাওয়ার জন্য নড়াচড়া করছে শুধু। নিবিড় ধরে রেখেছে। অথৈ হাত দিয়ে ইশারায় নিবিড় কে কাছে ডাকে। নিবিড় একটু এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে চুমু খায়। টমির একটা পা অথৈ এর পেটের কাছে রাখে হালকা করে। টমি কে শান্ত করার চেষ্টা।
“গত ৪ বছরের গল্পটা ছোট ছিল না অথৈ। এই দিনের জন্য প্রতি ন্যানো সেকেন্ড আমি অপেক্ষা করে গেছি। তুমি ফিরবে বলে। তোমাকে ফিরতেই হতো। আমার এই পাগলামি করা মানুষটা ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচি বলো তো? সুস্থ হয়ে যাও। আগলে রাখব কলিজার ভেতর। ”
নিবিড় টমি কে নিয়ে বেড়িয়ে আসার পর নীল আর নবনী ভেতরে যায়। বেশি মানুষ এক সাথে যেতে নিষেধ করেছে। নবনী দাঁড়িয়ে থেকে শুধু দেখে। অথৈ এর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। নীল আলতো করে ওর হাতের উপর হাত রাখে।
“তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসো অথৈ। আমি অনেক গুলো সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দেব তোমার। একদিন দুপুরের গরম ভাতের সাথে তোমায় পাতিচখা ভর্তা বানিয়ে খাওয়াব। ”
অথৈ হাসার চেষ্টা করে। কতদিন পর যেন সে প্রাণ ফিরে পেল। কাছের মানুষ গুলো কে দেখতে পাচ্ছে।
একটু পর রিদ আর হৈমন্তী আসে। অথৈ তো হৈমন্তী কে চেনে না। রিদ কথা বলে।
“কেমন আছো অথৈ? ”
অথৈ কথা বলার চেষ্টা করে। রিদ থামিয়ে দেয়।
“এই কথা বলার দরকার নেই এখন। আজকে আমরা বলি। তুমি শুনবে। পুরোপুরি সুস্থ হলে অনেক কথা বলবে। তখন আমরা সবাই শুনব। এইযে আমার পাশের মেয়েটা কে দেখছ। ওর নাম হৈমন্তী। আমার বউ। মন খারাপ করবে না কিন্তু তুমি। আমি বিয়ে করতে চাইনি। জোর করে করিয়েছে। তুমি সুস্থ হলে সেসব গল্প হবে। রাগ করবে না আমার উপর। এইযে দেখ কানে ধরলাম। ”
অথৈ শুধু খুশিতে কেঁদেই যাচ্ছে। এই মানুষগুলো তাকে এত কেন ভালোবাসে? হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে খুশি হয় ওদের এক সাথে দেখে।
ওরা বেড়িয়ে গেলে কাব্য একাই ভেতরে আসে। হাঁটু মুড়িয়ে ফ্লোরেই বসে। অথৈ এর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“তুই জানিস? তুই আমার ছোট্ট কবুতর ছানা। সেই যে প্রথম যেদিন দেখলাম। কাছে এসে বললি, তোমার চোখে কি জ্বলছে ভাইয়া? আরও বরফ নিয়ে আসব কি?
আমি সেদিনই তোর মাঝে এক কোমল মেয়ে দেখেছিলাম। আমার আদরের বোন তুই। একবার সুস্থ হয়ে ফিরে আয়। আমরা আবার ঘুরতে যাব। তুই যা বলবি সব শুনব। যেখানে যেতে চাইবি সেখানেই নিয়ে যাব। পুরো একটা পৃথিবী তোকে এনে দেব অথৈ। ”
কাব্য এতটুকু বলে থেমে যায়। ওর চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে। অথৈ ও নীরবে চোখের পানি ফেলছে।
এতগুলো ভালোবাসার মানুষ কে ফেলে অথৈ কিভাবে চলে যেত? ওকে তো ফিরতেই হতো। এ যেন নতুন এক জন্ম। নতুন এক ভালোবাসার জন্ম। নতুন করে ফিরা আসার এক গল্প।
_____
চলবে
১৯
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
অথৈ কে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। নিয়ে আসার পর বেশ কিছুদিন নিবিড় ওকে বিছানা থেকে নামতেই দেয়নি। ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় ওকে ধরে নিয়ে যেত। আবার দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকত নিবিড়। দরজা অথৈ কে লক করতে ও দিত না। চাপিয়ে রাখতে বলত। নিবিড়ের ভয় লাগত, মাথা ঘুরে যদি পড়ে যায় তখন?
যতদিন না সুস্থ হয়েছে ততদিন অফিস বাদ দিয়ে বাসায় ওর সাথে থেকে ওর যত্ন নিত। বাকিরা অবাক হয়ে যেত। নিবিড় দায়িত্ববান এটা সবাই জানে। কিন্তু এতটা দায়িত্ব নিয়ে অথৈ কে এভাবে সুস্থ করে তুলবে এভাবে পাশে থাকবে সেটা কেউ ভাবেনি। এমন কি যখন অথৈ কোমায় ছিল। তখন নিবিড়ের পাগলামি দেখে নার্স, ডক্টররা ও অবাক হতো। এভাবে ও ভালোবাসা যায়? মানুষটা নিবিড় বলেই সম্ভব হয়েছিল হয়তো।
এখন বেশ ভালোই সুস্থ। টমি সারাক্ষণ ওর কোলে ওঠে বসে থাকে। অথৈ সবাই কে এভাবে এত কাছে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।
মিসেস রেহেনা ওর কাছে এসে হাত ধরে পাশেই বসেন।
“অথৈ মা আমার, ভেবেছিলাম হয়তো আর ফিরবে না তুমি। নিবিড় আমার একমাত্র ছেলে। ওর কষ্ট নিজের চোখে দেখতে পারছিলাম না। তাই ছেলেটা কে অনেক বার বলেছিলাম তোমায় ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করতে। কিন্তু ও তোমাকে এতটা ভালোবাসে যে কখনো আমার কথা পাত্তাই দেয়নি। তুমি আবারও আমাদের মাঝে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছো। আমি অনেক শান্তি পেলাম। আমার ওই সময়ের চিন্তা ভাবনার জন্য আমি লজ্জিত মা। পারলে মাফ করে দিও আমায়। ”
মিসেস রেহেনা চশমাটা খুলে চোখের পানি মুছলেন। অথৈ তাকে জড়িয়ে ধরে।
“এভাবে বলবেন না প্লিজ। আপনি তো আমারও মা। মায়েরা সব সময় সন্তানের ভালোই চাইবে। আপনি ও তার ব্যতিক্রম নন। আমি এতে কষ্ট পাইনি। আপনি আপনার জায়গা থেকে সঠিক ছিলেন। এইযে আল্লাহ সুস্থ করে দিয়েছেন আমায়। আমরা এখন থেকে আগের মতো অনেক আনন্দে সময় কাটাব। ”
মিসেস রেহেনা খুশি হলেন ওর কথায়। মেয়েটার এই সহজ সরল দিকটা সবাই কে মুগ্ধ করে দেয়।
নিবিড় অথৈ কে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। বাইরে বাতাস বইছে অনেক। অথৈ এর চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দুজনেই শান্ত পরিবেশে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কতদিন পর এভাবে এক সাথে। ৪টা বছর! ভাবতেই গা কেঁপে ওঠে। বাড়ির আশেপাশে থেকে কিছু পোকামাকড়ের শব্দ ভেসে আসছে।
আচমকা অথৈ নিবিড়ের দিকে ঘুরে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হু হু করে কেঁদে ওঠে। এ যেন নতুন ভাবে পাওয়া। ভালোবাসার মানুষ কে হারিয়ে ফেলার পর আবার পাওয়াটা ভীষণ ভাগ্যের। নিবিড় ও শক্ত করে ওকে জড়িয়ে রাখে
ছেড়ে দিলেই যেন হারিয়ে যাবে আবার।
“এত কেন ভালোবাসলে নিবিড়? ”
“তুমি আমার অভ্যাস হয়েছিলে অথৈ। মানুষ সব ছাড়লেও অভ্যাস কখনো ছাড়তে পারে না। আর যদি ছাড়তেই না পারি তবে ভালো কেন কম বাসব বলতো? ”
“সব পুরুষ যদি তোমার মতো হত! ”
“তোমার মতো নারী যে পাবে সে ও আমার মতোই পুরুষ হবে। দুদিকে না মিললে কিভাবে হয় বল? ”
“আমার প্রতিটা লোমকূপ জানে তোমায় কতটা ভালোবাসি। ”
“আর আমার প্রতিটা নির্ঘুম রাত জানে তোমাকে ছাড়া আমি কতটা অপূর্ণ। ”
নিবিড়ের কিছু একটা মনে হতেই অথৈ কে হাত ধরে নিয়ে যায় সামনের দিকে। ওর মায়ের রুমের সামনে যেয়ে ডাকতে থাকে। মিসেস রেহেনা উঠে এসে দরজা খোলেন। দুজন কে এভাবে হঠাৎ আসতে দেখে চমকে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলেনেন।
“কি হয়েছে বাবা? কিছু বলবে? ”
নিবিড় কিছুক্ষণ বোকার মতো মাথা চলকায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা নিচু করে বলে,
“মা, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই এখনি। বিয়ে করিয়ে দাও। ”
মিসেস রেহেনা ছেলের এমন কথায় ঠোঁট টিপে হাসেন। অথৈ ও আচমকা এমন কিছু আশা করেনি। প্রথমে হতবাক হয়ে গেলেও এখন লজ্জা পাচ্ছে। নিবিড় এখনো মাথা নিচু করে রেখেছে।
মিসেস রেহেনা একটু কড়া করে বলেন,
“দুজন যে যার রুমে যাও এখন। ”
_____
এখন রাত ২টা বাজে। এক ঘন্টা আগেই ওদের বিয়ে হয়েছে। কাব্যদের কল করার সাথে সাথেই ওরা সবাই চলে এসেছিল। অথৈ এর মামা হানিফ আহমেদ ও এসেছিলেন।
এখন ওরা দুজন ছাদে গল্প করছে। ঠিক গল্প নয়। এই মুহূর্তে দুজন রাতের আকাশ দেখছে। রাতের নিস্তব্ধতা, নক্ষত্র, একাকী চাঁদ, রাতের পাহাড় সব কিছু অদ্ভুত মোহময় লাগছে যেন।
নিবিড় অথৈ কে টুপ করে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে থাকে।
“এই পড়ে যাব তো আমি। ”
“ইশ! যেন আজ প্রথম কোলে নিচ্ছি। ”
“ছাদে থেকে কোলে নিয়ে বাসার বাইরে পর্যন্ত যাবে। ভারি লাগে না? ”
“তোমার যেই ওজন! ছোট্ট একটা পুতুল। এক চুটকিতেও তো তোমাকে তুলে নেওয়া যায়। ”
অথৈ চোখ ছোট ছোট করে নিবিড়ের দিকে তাকায়।
“এটা প্রশংসা ছিল নাকি তিরস্কার? ”
নিবিড় ওর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে আসার সময় কাব্যরা পাশের রুমের বারান্দা থেকে ওদের দুজন কে এভাবে দেখে জোরে শিস বাজাতে থাকে। অথৈ লজ্জায় নিবিড়ের বুকের সাথে মিশে যায় একেবারে। নিবিড় উপরে একবার ওদের দিকে তাকায়। তারপর মুচকি হেসে চলে যায়।
বাইরে যেয়ে নিবিড় ওকে কোল থেকে নামিয়ে নিচে বসিয়ে দেয়। নিবিড় ও বসে। অথৈ এসে নিবিড়ের কোল ঘেঁষে বসে। কি সব পোকা দূরে থেকে অদ্ভুত ভাবে ডাকাডাকি করছে। এখন আর আগের মতো তেমন জোনাকি পোকা দেখা যায় না। তবুও আজ দুয়েক টা করে আশেপাশে জোনাকি পোকা উড়তে দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি কিছু প্রাণী নিচের ঝোঁপের মাঝে নড়াচড়া করছে। সেই শব্দ রাতের নিস্তব্ধতা চিঁড়ে বেরিয়ে আসছে।
অথৈ নিবিড়ের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে কিছুক্ষণ। নিবিড় চুপচাপ অনুভব করছে আজকের এই সময়টা। কিভাবে কিভাবে অথৈ কে নিজের করে এতটা কাছে পেল। সবটা ভাবতে গেলে মাথার তালগোল পাকিয়ে যায়। জীবনের এই প্রাপ্তিটা অন্য রকম শান্তির।
নিবিড় নিচের দিকে ঝুঁকে অথৈ এর গালে একটা চুমু দেয়। ও কিছু বলে না। নিবিড় কে আরও গাঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরে। ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা যাচ্ছে। আজ চাঁদ গোল থালার মতো দেখা যাচ্ছে। আশেপাশের সব কিছু চাঁদের আলোয় আলোকিত।
এই আলোতে অথৈ কে কি যে মায়াবী লাগছে বলার ভাষা নেই নিবিড়ের। ওর বড় চুল গুলো আজ হৈমন্তী সুন্দর করে খোঁপা বেঁধে দিয়েছে। চুলে আবার বেলি ফুলের গাজরা পরিয়ে দিয়েছে। সেই ফুলের ঘ্রাণ আর অথৈ এর চুলের ঘ্রাণ দুটো এক সাথে মিশে এক অন্য রকম নেশা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। সেই নেশা কিভাবে নিবিড় কে আসক্ত না করে থাকতে পারে?
“অথৈ? ”
“হু, ”
“আমি যে বেসামাল হয়ে যাচ্ছি। ”
“হয়ে যাও। বারণ করেছে কে? ”
“তুমি চাও? ”
“বাঁধা দেওয়ার মতো কোন কারণ আছে বুঝি? তোমার ভালোবাসাময় গভীর আদরে আমি পাগল হবো, বেহুশ হবো, বেসামাল হবো। তোমার স্পর্শগুলো আমার লাগবেই এবার। ”
“এভাবে বলতে নেই। সামলাতে কষ্ট হবে। ”
অথৈ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। নিবিড় ভ্রু উচিয়ে তাকিয়ে থাকে।
“সমস্যা কি হুঁ? হাসছো কেন শুনি? ”
“আমার ইচ্ছে। ”
“আচ্ছা, তুমি মধুচন্দ্রিমায় কোথায় যেতে চাও বলো। ”
অথৈ একটু ও সময় না নিয়ে বলে দেয়,
“সাজেক ভ্যালি যাব। মেঘ ছুঁয়ে দেখব। আমার ভীষণ ইচ্ছে মেঘ ছোঁয়ার। ”
“আচ্ছা, যাব। ”
“সত্যি নিয়ে যাবে? ”
“আমার বউ একটা আবদার করেছে। আমি পূরণ করব না সেটা? পুরো পৃথিবী এক করে দেব তোমার আবদার রাখতে। ”
“এহ! আসলেই? ”
“কোন সন্দেহ আছে কি? ”
“উঁহু। ”
“বছর খানেক আগে একটা কথা বলেছিলাম। মনে আছে কি তোমার?
ওই যে বললাম, তোমার আমার একটা অন্যরকম বাসর সাজানোর ইচ্ছে হয়। কিছুটা ব্যতিক্রম। ওইযে তুমি বলতে পাহাড়ে একটা বড়ি হবে। বাড়ির নাম হবে “অথৈ মহল”। দেখা গেল সত্যি সত্যি নতুন করে বাসর সাজেকে করব। যত রোমান্স আদর সব ওখানে হবে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরব, বৃষ্টিতে ভিজব, ঝর্ণা স্নান শেষে আমরা ফিরব আমাদের অথৈ মহলে। ”
হঠাৎ করে এই কথাটা শুনে অথৈ বিষ্মিত হয়ে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের দিকে। কথা বলতে ও ভুলে যায় যেন। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নেয়।
“নিবিড় তোমার মনে আছে অথৈ মহলের কথা! ”
“মনে থাকবে না? আমার বউয়ের ইচ্ছে বলে কথা। ”
“কিন্তু সাজেক গিয়ে থাকব তো অল্প কিছুদিন। এর মাঝে বাড়ি কিভাবে হবে? ”
“আমি বলেছি না? তুমি চাইলে সব হবে। ”
“ম্যাজিক করে? ”
“দরকার পরলে আলাদিনের দৈত্য কে ধরে নিয়ে আসব। দৈত্য এসেই বলবে, ‘হুকুম করুন মালিক। ‘
আমি তখন ভাব নিয়ে বলব, আমার বউয়ের জন্য একটা অথৈ মহল বানিয়ে দাও। দৈত্য চট করে তখন বানিয়ে দেবে। দারুন হবে না ব্যপারটা? ”
অথৈ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে এতক্ষণ নিবিড়ের বলা কথাগুলো শুনছিল। ওর কথা শেষ হতেই হাসতে হাসতে ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়ে। হাসিতে ওর শরীর কাঁপছে। ঝনঝন শব্দ হচ্ছে। যেভাবে অষ্টাদশী তরুণী নতুন চুড়ি পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলে হেঁটে বেড়ায়।
নিবিড় তাকিয়ে দেখতে থাকে। পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর রমণী তার স্ত্রী। এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?
_____
ওরা সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। অথৈ টমি কে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা নিয়ে আসতে দেয়নি। টমি এখন কাব্যর সাথে আছে।
সাজেক ১৮০০ ফুট উচুতে, চিটাগাং হতে ১১৪ কি.মি. খাগড়াছড়ি। সেখান থেকে প্রায় ৭০ কি.মি. দূরে সাজেক। রাঙামাটি জেলায়। পাহাড়ি উচু নিচু রাস্তা, আঁকাবাঁকা, শেষ তিন কি.মি. রাস্তা সোজা ৪৫ ডিগ্রি হয়ে উঠে গেছে। সেই সাথে বিপজ্জনক বাঁক। তবে রাস্তা ভালো।
চমৎকার রিসোর্ট হলো সর্বাধিক উচ্চতায় আবস্থিত ‘রক প্যরাডাইছ’। এই পুরো ট্যুরের ব্যবস্থা করে দিয়েছে নিবিড়ের বন্ধুরা সবাই। আগে থেকে ওরা যোগযোগ করে রেখেছিল তাই রুম পেতে সুবিধা হয়েছে ওদের। আর এখানে নিবিড়ের পরিচিত কিছু লোকজন আছে।
সাজেকে আসার পথে অথৈ শুধু সুন্দর সুন্দর দৃশ্যগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। যার কোন ব্যাখ্যা হয় না। এত মনোমুগ্ধকর জায়গায় না আসলে বুঝতেই পারতো না বাংলাদেশ ও এত সুন্দর হতে পারে।
জার্নিতে যতটা ক্লান্ত লাগছিল রুমে ঢুকে ওদের সব ক্লান্তি চলে গেছে। আশেপাশের জায়গা তো এমনিতেই সুন্দর। তার উপর রুমটা এত সুন্দর ডেকোরেশন করা থাকবে সেটা নিবিড় ভাবেনি। এটাও তার বন্ধুদেরই কাজ। নিশ্চয় বলে রেখেছিল স্পেশাল ভাবে ওদের জন্য রুমটা ফুল দিয়ে সাজাতে। অথৈ এর আফসোস হচ্ছে। এত সুন্দর বিছানায় ঘুমাবে কিভাবে?
নিবিড় অথৈ এর দিকে আড়চোখে তাকায়। ও লজ্জা পাচ্ছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাই তাড়াহুড়ো করে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। নিবিড় হাসতে থাকে ওর এই লজ্জা পাওয়া দেখে।
দীর্ঘ জার্নিতে শরীরে ধুলাবালি লেগেছিল হালকা। ঘামে ভিজে গিয়ে আবার শুকিয়ে ও গিয়েছে। শরীর চিটচিটে হয়ে গেছে। তাই বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে শাওয়ার নেয়।
টাওয়েল দিয়ে চুল পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিবিড় হা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অথৈ ঠোঁট টিপে হাসে। চুল মুছে টাওয়েল টা নিবিড়ের মুখের উপর ছুড়ে ফেলে।
“অনেক দেখেছেন জনাব। এবার ঝটপট শাওয়ার নিয়ে আসেন। নয়তো মধুচন্দ্রিমায় এসে অসুস্থ হয়ে হাঁচি-খাশি দিতে দিতে আপনার সব আনন্দ ফুস হয়ে যাবে বুঝলেন? ”
নিবিড় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে, অথৈ সুন্দর একটা কালো ফিনফিনে জর্জেট শাড়ি পরে চুল গুলো পিঠময় ছড়িয়ে রেখে চোখে কাজল দিচ্ছে। নিবিড় চুল মুছে ভেজা টাওয়েল টা ওমনি ছোফায় রেখে দেয়। ব্যাগ থেকে একটা সাদা টি-শার্ট বের করে পরে নেয়। ও ঠিক কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। চোখ বার বার অথৈ এর দিকে চলে যাচ্ছে। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে। আয়নার দিকে দুজনেই তাকিয়ে আছে। নিঃশ্বাস ঘন ঘন পড়ছে। অথৈ এর ঘাড়ে নিবিড় থুতনি রেখে ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।
“আজকে শাড়ি পরলে যে? ”
“কেন পরা যাবে না বুঝি? ”
“যাবে তো। কিন্তু আমার হাসফাস লাগে। ”
অথৈ নিবিড়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে চোখে চোখ রাখে।
“সারা অঙ্গে শাড়ি জড়িয়ে আমার বিধ্বংসী চাহনিতে তোমাকে এলোমেলো করে দেব, বেসামাল করে দেব। আমি চাই এই ঝড় থেমে না যাক। আমার শাড়ির আঁচলের ভাঁজে তোমার জন্য প্রেম লুকিয়ে রাখি। প্রতিটা কুচি তে তোমার স্পর্শ কামনা করি। এই আমি শাড়িতে তোমায় মায়ায় রাখি বুঝলে? ভালোবাসি। ”
নিবিড় আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়। শরীর রিতিমত কাঁপছে। তখনই দরজায় নক করে কেও। নিবিড় বিরক্তি তে কপাল কুঁচকে ফেলে। ওকে ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে দেখে খাবার নিয়ে এসেছে। এত কিছুর মাঝে ভুলেই গিয়েছিল ওদের ক্ষিদের কথা।
নিবিড় খাবার নিয়ে দরজা লক করে দিল। খাবার দেখে নেয়। ভাত, ডাল, ব্যাম্বো চিকেন, খরগোশের মাংস। এতটা জার্নির পর এমন লোভনীয় খাবার দেখে পেটের ক্ষিদেরা এতক্ষণে জানান দিতে লাগল।
অথৈ এসে পাশে বসে দুজনের প্লেটে খাবার সাজিয়ে নেয়। দুজনেই সময় নিয়ে আয়েশ করে দুপুরের খাবার শেষ করল। যদিও বিকেল হয়ে গেছে প্রায়।
খাওয়া শেষ করে নিবিড় বিছানার উপর ছড়ানো ফুলগুলো ঝেড়ে নিচে এক পাশে রেখে দেয়। অথৈ কে নিয়ে এসে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার। শরীরে এখনো ক্লান্তি বোধ করছে অনেকটা। আর খাবার খেয়ে ঘুম ও পাচ্ছে অনেক। নিবিড় অথৈ এর চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে। এক সময় দুজনেই ঘুমিয়ে যায়।
সন্ধ্যায় নিবিড়ের ঘুম ভাঙ্গে। অথৈ এখনো ওর বুকের মাঝে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। মুখের উপর চুল এসে পড়েছে। আলতো করে নিবিড় চুলগুলো সরিয়ে দেয়। কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু দেয়। ও নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। নিবিড়ের আর ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডাকতে ইচ্ছে করে না। আবার ওকে রেখে উঠতে ও ইচ্ছে করে না। চুপচাপ ওভাবেই জড়িয়ে শুয়ে থাকে। ওর চুল থেকে এখনো সুন্দর একটা ঘ্রাণ আসছে। ওর শরীর থেকে ও অদ্ভুত এক ঘ্রাণ আসছে। অথৈ পারফিউম দেয়নি আজ। নিবিড় জানে সেটা। তবে এই সুন্দর ঘ্রাণ টা কিসের?
ভাবতে ভাবতেই হুমায়ূন আহমেদ এর একটা উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, প্রত্যেক টা মেয়ের শরীরে নির্দিষ্ট একটা ঘ্রাণ থাকে। ফুলের মতো। একেক জনের শরীরের ঘ্রাণ একেক রকম।
হয়তো তেমন ভাবেই অথৈ এর শরীর থেকে ও সেই ঘ্রাণ টা আসছে। অনেকটা কামিনী ফুলের মতো। নিবিড় জোরে একটা শ্বাস নেয়। সুন্দর ঘ্রাণটা তীব্র ভাবে বাড়তে থাকে। আবারও আচ্ছন্ন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
খানিক পরেই অথৈ এর ঘুম ভেঙে যায়। দুহাতে চোখ কচলায়। দেখতে পায় এখনো ও নিবিড়ের বাহুতে আকড়ে শুয়ে আছে। মুচকি হাসি দিয়ে ওঠে পড়ে বিছানা থেকে।
রাত ৮ টা বাজে প্রায়। ওদের দুজনেরই কফি পছন্দ। অথৈ তাই মনে করে ব্যাগ ভর্তি করে কফি বানানোর জন্য সব কিছু নিয়ে এসেছে আসার সময়। নিবিড় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। অথৈ চট করে এক মগ কফি বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। ওরা মুগ্ধ হয়ে রাতের দৃশ্য দেখে। এক মগ কফিতেই দুজনে চুমুক দেয়। গল্প করতে থাকে অনেক। কথার ফুলঝুড়ি যেন শেষ হয় না।
সুন্দর জায়গা, চারপাশে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, বাতাসের এলোমেলো হাওয়া, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পাশে সুন্দরী বউ। সব মিলিয়ে এক অপরুপ জাগতিক মোহাচ্ছন্ন প্রেমময় সুখানুভূতি। ভালোবাসার চাদরে আগলে রাখার মত একটা মুহূর্ত। এমন সুখ কয়জন পায়।
ভালোবাসা মাখানো আরও এক রাত সাক্ষী হয়ে থাকুক আজকের এই গভীর মুহূর্তের। বাতাসের তান্ডব বেড়ে চলেছে। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় কিছু সময়ের মধ্যেই। প্রকৃতি ও চাইছে আজকের রাতটা স্মরনীয় হোক নতুন ভাবে। ভালোবাসার ছন্দে কাব্য গাঁথা হোক আরও একবার। মিশে যাক দুটো মন, শরীর, আত্মা।
_____
নিবিড়ের ফোনে এলার্ম বাজতে থাকে। এখন ভোর ৬ টা বাজে। নিবিড় উঠে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে খানিকটা অবাক হয়ে যায়। অথৈ কে ডাকতে থাকে। ও ঘুম কাতুরে খুব। চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে। তার মধ্যে গতকাল জার্নি করে এসেছে। রাতে ঘুম ও হয়নি ঠিক ভাবে। যার ফলে এখন ওর ঘুম ভাঙ্গাতে নিবিড় কে কষ্ট করতেই হবে। আরও কিছু সময় ডাকতে থাকে।
“এই অথৈ, ওঠে পড়ো জলদি। ”
অথৈ ঘুমের মাঝে কিছু একটা বলে আবার ঘুমিয়ে যায়। নিবিড় আবারও ডাকে।
“আরে এখন না উঠলে বিশাল একটা জিনিস মিস করে ফেলবে। ”
“পরে দেখব। ”
“পরে আর পাবে না। উঠো। ”
অথৈ কে টেনে তুলে বসিয়ে দেয়। পানি নিয়ে এসে ওর মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে দেয়। এতক্ষণে অনেকটা ঘুম চলে যায়।
চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে লাফ দিয়ে ওঠে। কথা বলতেই যেন ভুলে যায়। বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে। কয়েকটা ঢোক চেপে নিবিড়ের দিকে তাকায়। নিবিড় হাসছে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
ওর পায়ের কাছে তুলোর মত এক গুচ্ছ মেঘ ভাসছে। রুমের চারপাশে তাকায়। আরও কয়েক জায়গা মেঘ ভাসছে। বুঝতে পারে বারান্দা দিয়ে মেঘ ভেসে রুমের মধ্যে চলে এসেছে।
অথৈ নিবিড়ের হাত চেপে ধরে।
“নিবিড় এটা কি সত্যি? ”
“সব সত্যি। ”
“আমি কি মেঘ ছুঁতে পারব? ”
“পারবে। ”
অথৈ এগিয়ে যায়। মেঘ ছুঁয়ে দিতেই পানি হয়ে ওর হাত দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। ওর সে কি খুশি!
নিবিড় ফোন নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে রাখে এই মুহূর্তের। এই ছবিগুলোই এক সময় ওদের জীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে।
অথৈ নিবিড় কে জড়িয়ে ধরে।
“পৃথিবীটা এখানেই থেমে যাক নিবিড়। আমি কখনো ভাবিনি আমার জীবনে এমন দিন আসবে। দুঃখ দিয়ে ভরা ছিল আমার আগের সেই জীবনটা। চারপাশে শান্তিতে শ্বাস নিতে পারিনি কখনো। দমবন্ধ লাগত। ভাগ্যিস সেদিন পালিয়ে ছিলাম। নয়তো তোমার দেখা আমি কিভাবে পেতাম বলো? আমার গর্ব হচ্ছে জানো তো? আমার একটা নিবিড় আছে। যে আমার সমস্ত আবদার হাসি মুখে পূরণ করে। সেটা ছোট হোক বা বড়। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, পৃথিবী শুনছো? আমার একটা নিবিড় আছে। ”
নিবিড় ওকে বুকে চেপে ধরে রাখে শক্ত করে। দুজনেরই চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে।
“অথৈ, কোনদিন ভাবিনি আমিও কাউকে এভাবে ভালোবাসতে পারব। এই বাচ্চা মেয়েটা আমার মনের এতটা জুড়ে নিয়ে বসে থাকবে সেটা আমি কোনদিন কল্পনাই করিনি। চোখ বন্ধ করলেও তোমায় দেখি। তুমি এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হলে আমি যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যাই। আমার পৃথিবী এলোমেলো লাগে। যতদিন বেঁচে আছি তোমাকে আগলে রাখতে চাই। এক বিন্দু কষ্ট তোমার হতে দেব না। এইযে তিনবার কবুল বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এই হাত আমৃত্যু ধরে রাখব। তোমার প্রতিটা ইচ্ছে পূরণ করতে আমার পুরো জীবনটা দিয়ে দেব অথৈ। পুরো পৃথিবী কে দেখিয়ে দেব, এভাবে ও ভালোবাসা যায়। ”
এই রিসোর্টে বারান্দায় দাঁড়ালেই সূর্যদয় দেখা যায়। দুজনে দাঁড়িয়ে থেকে সূর্যদয় দেখে।
এরপর ওরা সকালের নাস্তা করে বাইরে বেড়িয়েছে। আশেপাশে ঘুরে দেখবে। এখানে আছে আদিগন্ত উচু নিচু পাহাড়, থরে থরে সাজানো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অনন্ত কাল ধরে, আর মেঘেরা লুকোচুরি খেলে এরই ফাঁকে ফাঁকে। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি, এই আছে এই নেই। এক পলকে গুচ্ছ মেঘ এসে ঢেকে দেয় সবকিছু। কাছের কিছুই দেখা যায় না, ভিজিয়ে দিয়ে হারিয়ে যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর আবদুর রহমানের মত বলতে ইচ্ছে হয়, এক নিঃশ্বাস নিলে আয়ু বেড়ে যায় দশ বছর। আর নিশ্বাস ছাড়লে হাজারটা অসুখ বের হরে যায়। হু হু করে বয়ে যায় বাতাস। চুপচাপ বসে কান পাতলে বাতাসের ফিসফিসানি শোনা যায়। এক কথায় নিরেট, অকৃত্তিম, অব্যবহৃত প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া যায় অল্প সময়ের জন্য হলেও। বাংলার এক স্বর্গরাজ্য যেখানে বাসবাস করা যায় মেঘের সাথে।
_____
চলবে
১৬
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
____
সকাল ৯ টায় খাবার খেয়ে রিদ আর নিবিড় বেড়িয়ে পড়ে উত্তরার ৭ নাম্বার সেক্টরের উদ্দেশ্যে।
গাড়ি থেমে যায় ৫ তলার এক আলিশান বাড়ির সামনে। ওরা গাড়ি থেকে নামে। নিবিড় বাড়ির নেমপ্লেটের দিকে তাকায়। বাড়ির নাম “অলিন্দিতা ম্যানসন”
জানতে পারে এটা অথৈ এর মায়ের নাম। তার নামেই এই বাড়িটা। বাসার ভেতরে ঢোকে। অথৈ এর মামা হানিফ আহমেদের সাথে আগেই কলে কথা হয়েছিল। উনি এগিয়ে এসে ওদের কে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসায়। কাজের লোক এসে সবাই কে চা নাস্তা দিয়ে চলে যায়।
নিবিড় প্রথমে কথা শুরু করে,
“মামা, আপনাকে কলে সংক্ষেপে মূল বিষয়টা জানিয়েছি। এখন আপনি যদি আমাকে বাকিটা জানাতেন তবে অনেক উপকার হতো। ”
“হ্যাঁ, বলব বলেই তোমাদের এই সময়ে আসতে বলেছি। আমার মিসেস বাসায় নেই। সে থাকলে হয়তো বা ভালো করে কিছু বলতে পারতাম না। ”
“ঠিক আছে। শুরু থেকে বলবেন প্লিজ। ”
“এটা তো আমার বোনের বাসা। বোনের নাম অলিন্দিতা। বাসায় ঢোকার সময় নেমপ্লেটের নামটা দেখেছো হয়তো। আমার বোনের ছিল প্রেমের বিয়ে। দুজন দুজন কে এত ভালোবাসতো যা বলার বাইরে। এই বাড়িটা করার পর তাই অথৈ এর বাবা রিয়াদ চৌধুরী আমার বোনের নাম বাড়ির নেমপ্লেটে ঝুলিয়ে দেয়। দুজনের ভীষণ মিল ছিল। একটা দিন ও কেউ আলাদা থাকতে পারত না। যাক গে, সেসব কথা। এত কিছু না বলি। আসল কথায় আসি।
অথৈ তখন খুব ছোট। ৬ বছর বয়স। একদিন বিকেলে বায়না ধরেছে আইসক্রিম খাবে। অলিন্দিতার হালকা জ্বর তখন। ফ্রিজে আইসক্রিম নেই। ওর উঠতে ও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু মেয়ের জেদ। তার আইসক্রিম লাগবেই সেই সময়। ওর বাবা ও তখন বাসায় ছিল না। অফিসে ছিল।
অলিন্দিতা তখন জ্বরের শরীর নিয়েই উঠে বাইরে যায় আইসক্রিম কিনতে। শরীর টলছিল হালকা। কখন যে গাড়ি আসছে খেয়াল করেনি। ওর মাথা ঘুরে গেল সেই মুহূর্তে একটা মাইক্রো এসে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। গাড়ি টা ভয়ে আর দাঁড়ায়নি। চলে গেছে। রাস্তার কিছু মানুষ জন ধরে হসপিটালে নিয়ে যায়। আমরা সবাই জানতে পেরে তখনই চলে যাই। অথৈ এর বাবা ও অফিস থেকে চলে যায় হসপিটালে। তার অবস্থা তখন পাগল প্রায়। অলিন্দিতা কে আই সি ইউ তে রাখা হলো। দুদিন পর ডক্টর জানালো বোনটা মারা গেছে।
ওর বরের অবস্থা তখন কি বলব। একদম পাগলের মতো হয়ে গেল। কাজের মেয়ের থেকে শুনেছে মেয়েটার আইসক্রিমের আবদার রাখতেই সে গিয়েছিল। তখনই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই কথা শোনার পর ওই ছোট বাচ্চাটা কে অনেক মারলো। রোজ সারাক্ষণ অথৈ কে ওর বাবা বকতো। বার বার বলত,
“তুই তোর মা কে খু*ন করেছিস। তোর জন্য তোর মা মারা গেছে। সব তোর দোষ। কেন করলি এমন? আমার অলিন্দিতা কে কেন মা*রলি তুই? ”
ওই ছোট বাচ্চাটা এত কঠিন কথা বুঝতো না। ও শুধু বুঝতো ওর বাবা ওকে বকছে। একা একা কাঁদতো। ওর বাবা কখনো ভালো করে কথা বলত না ওর সাথে। ওকে দেখলেই ওই কথা বলত। আমি দেখলাম অথৈ মানসিক ভাবে ভেঙে পরছে। ছোট মেয়ে কতটাই বা বোঝে। যেই বয়সে ওর বাবা-মায়ের সঙ্গ দরকার ছিল। খেলাধুলার দরকার ছিল। সেই বয়সে ওকে সারাক্ষণ মিথ্যা দোষারোপ করা হচ্ছে। আমার খারাপ লাগত। তখন ওকে নিয়ে গেলাম আমাদের বাসায়। আমার দুটো মেয়ে ছিল। ওদের সাথে খেলতো। কিছুদিন ভালোই কাটছিল। ওর মানসিক অবস্থা ও একটু ভালোর দিকে আসছিল। কিন্তু সেখানে ও বেশিদিন ভালো থাকল না। আমার স্ত্রী ওকে সহ্য করতে পারত না। বুঝতেই পারছো সব মামিরাই তো ভালো হয় না। সে ও অথৈ কে বকাঝকা করত।
আমি আমার স্ত্রী কে কোনভাবেই শান্ত করতে পারতাম না। অথৈ এর এখানে অবস্থা আরও ভয়ানক হতে শুরু করল। তবে আমি যতক্ষণ বাসায় থাকতাম ওকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতাম। ওকে নিয়ে খেলতাম। বাইরে মাঝে মাঝে ঘুরতে নিয়ে যেতাম। এভাবেই দুই বছর কেটে গেল।
এর মধ্যেই একদিন শুনলাম অথৈ এর বাবা হঠাৎ করেই স্ট্রক করে মারা গেছেন সকালে।
আমরা ওই বাসায় গেলাম। জানাযা হলো। বাসার সামনেই অলিন্দিতার কবরের পাশে তাকে কবর দেওয়া হলো। তারপর আমরা সবাই এই বাসায় চলে আসলাম। তখন থেকে এখানেই থাকি। ধীরে ধীরে অথৈ এই মানসিক অবস্থায় বেড়ে যেতে থাকলো। একা একা আবল-তাবল বলত। কি সব যেন শুনে বিড় বিড় করতো। তারপর কান চেপে ধরে চিৎকার করতে করতে সেন্সলেস হয়ে যেত।
ভেতরে ভেতরে ততদিনে ও শেষ হয়ে গিয়েছে। কয়েক বার সুই*সাইডের চেষ্টা করেছে। তারপর সাইকোলজিস্ট দেখালাম। ট্রিটমেন্ট চলতে থাকল।
একদিন আমার স্ত্রীর মাথায় ভুত চাপলো। ওকে বিয়ে দিয়ে দেবে। নয়তো পরবর্তীতে মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হলে কে বিয়ে করবে সেটা নিয়ে তার চিন্তা বেড়ে গেল। বিয়ে না হলে পাগল মেয়ে কে সে ঘরে রাখবে না। অথচ আমরা কিন্তু ওদের বাসাতেই থাকি। মানুষ কতটা অকৃতজ্ঞ ভাবতে পারছো? যেদিন বিয়ে ঠিক হচ্ছিল। ওকে সাজানো হয়েছিল। ঠিক তখনই ও হারিয়ে গেল। কত খুঁজলাম আর পেলামই না। আমার স্ত্রী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ও আর আমাকে খুঁজতে দিল না। তবুও লুকিয়ে আমি খোঁজ করেছি। পুলিশে জানিয়েছিলাম। কিন্তু খুঁজে পেলাম না। যখন জানলাম তোমার কাছে ও এতটা ভালো আছে বিশ্বাস করো আমার এত ভালো লেগেছে। আমি সত্যিই আমার ভাগ্নিটা কে আমার নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসি। কিন্তু আমার স্ত্রীর জন্য বেশি সাহস পাই না। ”
হানিফ আহমেদ কথা শেষে চোখ মুছলেন। নিবিড় হতবাক হয়ে যায় সবটা শুনে। এতটুকু তো শুধু শুনলো। না জানি মেয়েটা ছোট থেকে কতটা আঘাত পেতে পেতে বড় হয়েছে। অল্পতেই তো কারোর এত বড় মানসিক সমস্যা শুরু হয়নি। কত বছর ধরে নিজের মধ্যে এই রোগটা পুষে রেখেছে।
পরিবারের মানুষ গুলো এমন কেন? এই মৃত্যু তে আদৌ কি ওই বাচ্চা মেয়ের কোন দোষ ছিল? একটা ছোট মানুষের যা বৈশিষ্ট্য থাকে সেটা ওর মধ্যে ও ছিল। আইসক্রিমের বায়না ধরেছিল। নিয়তি ওর মায়ের মৃত্যু ওভাবেই রেখেছিল। এতে ওর তো কোন দোষ নেই। কিন্তু শাস্তি টা ওই মেয়েটাই পাচ্ছে এখনো। যার ফলস্বরূপ, সে সুন্দর একটা জীবন কখনোই পায়নি।
নিবিড় উঠে দাঁড়ালো।
“মামা আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, অথৈ কে আমি সুস্থ করে তুলবো ইন শা আল্লাহ। সুন্দর একটা জীবন ওকে আমি দেবই। আপনি দোয়া করবেন। ”
হানিফ আহমেদের খুশিতে বুক ভরে গেল। নিবিড় কে জড়িয়ে ধরলেন। এতদিনের জমানো পাথরের মতো কষ্ট গুলো যেন বুক থেকে নেমে গেল।
“ভালো থেকো তোমরা। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু তোমাদের দেখতে আসব একদিন। ”
“জ্বি, মামা অবশ্যই আসবেন। ”
_____
অথৈ রাতের অন্ধকারে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় টমি কে নিয়ে। পেছনেই নিবিড় শব্দহীন পায়ে এগিয়ে আসে। অথৈ পেছনে না তাকিয়েই বুঝতে পারে নিবিড় এসেছে এখানে। নিবিড়ের শরীরের স্মেলটা অথৈ এর ভীষণ পরিচিত।
ও অন্ধকারে দূরের কালচে পাহাড় গুলো দেখতে থাকে। যদিও কুয়াশায় তেমন কিছু চোখে পরছে না। ঠান্ডায় শরীর হিম হয়ে আসছে। একটু পর পর দমকা বাতাসে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাতাল করা যেন পরিবেশটা। এত সুন্দর কেন পৃথিবী? কেউ কোন কথা বলছিল না।
অথৈ নিজেই কথা শুরু করে।
“নিবিড়? ”
“হু, ”
“জানো আমার একটা স্বপ্ন আছে? ”
“কি স্বপ্ন? ”
“কোন এক জায়গায় আমার একটা উচু পাহাড় থাকবে। সেই পাহাড়ের উপর আমার একটা কাঠের বাড়ি থাকবে। ছোট্ট একটা কুড়েঘর। দুজনের সংসার হবে। একটা বিছানা থাকবে শুধু। আর প্রয়োজনীয় যতটুকু দরকার। ঠিক ততটুকুই। ঘরের দেয়াল ভর্তি আমাদের কিছু সুন্দর মুহূর্তের ছবি।
ঘর থেকে বের হলেই চারপাশে শুধু সবুজ পাহাড়ের দেখা মিলবে। বাড়ির আঙ্গিনায় বাহারি ফুলের গাছ থাকবে। ফুলের গন্ধে ভ্রমর আসবে। আমি দেখব।
উপরে নীলাকাশ। সাদা মেঘ ভেসে বেড়াবে। আমি পাখির ডানার মতো দু হাত মিলে দাঁড়িয়ে থাকবো। আকাশ, বাতাস, পৃথিবী আমায় দেখবে। আমি যেন সুখের এক অন্য সাগরে ভাসবো। কি সুন্দর একটা মুহূর্ত হবে।
বলো তো আমার ইচ্ছে টা কেমন? ”
নিবিড় এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে শুনছিল ওর কথা গুলো। যেন ও মুখস্থ করে নিচ্ছিল সব। অথৈ এর ডাকেই ওর ঘোর কাটে। এক রাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে বলে,
“তোমার স্বপ্নটা তোমার মতোই সুন্দর, স্নিগ্ধ। ”
অথৈ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
“সত্যি বলছো? ”
“হ্যাঁ, ”
“বলো তো আমার এই স্বপ্ন কি কোনদিন পূরণ হবে? ”
“ইনশাআল্লাহ একদিন হবে। ”
অথৈ চোখ বন্ধ করে প্রশান্তি তে। নিবিড় কিছু কথা বলে।
“আমি তোমার নামে একটা পাহাড় কিনব প্রমিস করলাম। সেই পাহাড়ে একটা কাঠের বাড়ি বানাবো।
যেই পাহাড়ে বসে মেঘ ছোঁয়া যায়।
মেঘের সাথে মিতালী করা যায়।
নীলাকাশ দেখা যায়।
এমন একটা পাহাড়সহ বাড়ি আমি তোমাকে দেবই ইন শা আল্লাহ।
শুধু একবার তোমাকে আমি পেয়ে নেই।
বাড়িটার নাম দেব ‘অথৈ মহল’। ”
“কি বলছো তুমি এসব! আমার নিজস্ব বাড়ি? নাম হবে অথৈ মহল? উফ! এত সুন্দর নাম! আমি খুশিতে বোধহয় মরেই যাব নিবিড়। ”
“আমি তোমাকে বলেছি তো তোমার ছোট থেকে বড় সব স্বপ্ন পূরণ আমি করব। পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ের নিচে আমি এনে দেব যতক্ষণ আমার সামর্থ্য থাকবে। ভালো তো এমনি এমনি বাসিনি অথৈ। ভালোবেসে যদি তোমার স্বপ্নের সাথে তোমায় আগলেই না রাখতে পারি তবে প্রেমিকের খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছি কোন সাহসে বলো তো? ”
অথৈ নিবিড় কে জড়িয়ে ধরে। ওর কান্না পাচ্ছে প্রচন্ড। কোনদিন কি ভেবেছিল ওর জীবনে এমন সুখ ধরা দেবে এভাবে? কখনোই তো ভাবেনি। দুঃখ যার নিত্যসঙ্গী ছিল। এত সুখ তার কিভাবে সইবে? এক জীবনে এই মানুষটাই তার জন্য আশির্বাদ। নয়তো ওর সাথেই কেন আচমকা এভাবে এমন মানুষের পরিচয় হবে?
নিবিড় ঘাসের উপর বসে পড়ে। অথৈ কে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে দেয় ঘাসের উপর। টমি ও সেখানেই শুয়ে পড়ে। নিবিড় অথৈ এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। মাথার উপর নক্ষত্র ভরা জ্বল জ্বল করা আকাশ। ওরা ছাড়া আশেপাশে আর কেউ নেই। নীরব এই পরিবেশে শুধু দুটো মানুষ মনে মনে কথা আদান প্রদান করে যাচ্ছে। প্রকৃতি সাক্ষী এই দুই যুগলের প্রেমের।
“অথৈ। ”
“হু? ”
“তুমি তো তোমার ইচ্ছেটা বললে। আমি এবার আমার ইচ্ছাটা বলি। শুনবে কি? ”
“উম্ম, শুনবো। ”
“তোমার আমার একটা অন্যরকম বাসর সাজানোর ইচ্ছে আছে। একটু ব্যতিক্রম। এইযে তুমি বললে পাহাড়ে একটা বাড়ি হবে। বাড়ির নাম দেব আমি ‘অথৈ মহল’। তোমার তো পাহাড়, সমুদ্র পছন্দ। দেখা গেল সত্যি সত্যি আমরা বিয়ের পর বাসর সাজেকে করব। যত রোমান্স আদর সব ওখানে হবে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরব, বৃষ্টিতে ভিজব, সমুদ্র দর্শন শেষে আমরা ফিরব আমাদের অথৈ মহলে। দারুন হবে না ব্যাপারটা। ”
অথৈ খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। চোখ চিকচিক করে ওঠে।
“দারুন হবে মানে কি? একদম অপূর্ব হবে। ইশ! তুমি এত ভালো কেন? আমার স্বপ্ন গুলো সব চোখে ভাসছে। ওই দিন গুলো কি আমি সত্যিই দেখতে পারব নিবিড়? ”
“অবশ্যই দেখবে। আমি আছি তোমার সাথে, তোমার পাশে। আমাদের সমস্ত ভালো লাগা সব তোমার। আর তোমার সব খারাপ লাগাগুলো একান্তই আমার। ”
“না নিবিড়। আমরা সব কিছুই ভাগ করে নেব। সুখ-দুঃখ সবটা। তুমি আমি তো আলাদা না। ”
“অথৈ আরেকটা কথা বলি? ”
“বলো। ”
“আমার আল্লাহ তোমাকে খুব যত্ন করে বানিয়েছেন জানো? ”
অথৈ আর কিছু বলে না। নিবিড়ের দিকে ঘুরে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুজে দেয়। নিবিড় অথৈ এর মাথায় হাত বুলাতে থাকে। এক সময় অথৈ ঘুমিয়ে যায়। ওর ঘুমন্ত ঘন শ্বাস ছাড়ার শব্দটা শোনা যাচ্ছে। নিবিড় চোখ বন্ধ করে রাখে। ও নিজেও ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে। অথৈ কে তুলে ওর বাহুর উপর মাথা রেখে শুইয়ে দেয়। মাথার উপর দিয়ে রাত জাগা কিছু পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলে গেল। টমি মিউ মিউ করে নিবিড়ের বুকের উপর এসে শুয়ে থাকে।
____
চলবে
১৭
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
নবনীর পরীক্ষা শুরু হয়েছে গতকাল থেকে। তাই সকালে তাড়াহুড়া করে রেডি হচ্ছিল। মিসেস রেহেনা এক গ্লাস জুস আর ওমলেট বানিয়ে নিয়ে মেয়ের সামনে রাখলেন।
“উফ! মা, খাওয়ার সময় নেই এখন। ”
“বেশি কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নে। তারপর কলেজে যা। ”
“মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিও কেমন? ”
“আচ্ছা আপু। তুমি নিজের খেয়াল রেখ। ফিরে এসে অনেক গল্প করব কিন্তু। ”
“ঠিক আছে। ”
নবনী কলেজে চলে যায়। মিসেস রেহেনার ও আজকে ডক্টর দেখাতে যেতে হবে। বেশ কিছুদিন ধরে পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে অনেক। ঔষধ খেয়ে ও কাজ হচ্ছে না। তাই নিবিড় ভেবেছে, ওর মা কে ডক্টর দেখিয়ে তারপর অফিসে চলে যাবে।
কিন্তু সমস্যা অথৈ কে নিয়ে। বাসায় ওরা কেউ থাকবে না। যদিও কয়েক দিন ধরে একটা কাজের লোক রাখা হয়েছে। তাকে বলে দিয়েছে বাসায় কেউ না থাকলে যেন অথৈ এর খেয়াল রাখে ভালো ভাবে। তবুও নিবিড়ের চিন্তা হয় ভীষণ। বাইরের লোকের উপর ভরসা করে রেখে যাওয়ার সাহস পায় না।
অথৈ কে কাছে ডাকে।
“তুমি ও চলো আমাদের সাথে। ”
“কোথায় যাব। ”
“মা কে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ও চলো। বাসায় কেউ নেই তোমার একা ভালো লাগবে না। ”
“না সমস্যা নেই। আমি থাকতে পারব। আর ডক্টরের কাছে যেতে আমার ভালো লাগে না। ”
অথৈ হালকা ঠোঁট ফুলায়। নিবিড় আর কিছু বলে না। হাত দিয়ে ওর সামনে পড়ে থাকা চুল গুলো কানের পাশে সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
“শুনো, রিদ আর নীল অফিসের কাজে ব্যস্ত অনেক। কাব্য গিয়েছে চট্টগ্রাম। ওইযে পৃথা নামের মেয়েটা আছে না? কাব্য কে প্রায়ই ফোন করতো। ওকে পছন্দ করে। কাব্য পাত্তা দিত না। ওই মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। দেখা যাক ওদের প্রেম-টেম হয় কি না। যেহেতু সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। তাই কেউ এখন বাসায় আসতে পারবে না। তবুও নীল আর রিদ কে বলে রাখব। এর মধ্যে কেউ ফ্রি হলে চলে আসবে। তুমি চুপ করে টমির সাথে খেলবে ঠিক আছে? বাইরে একা বের হবে না। ছাদে ও যাওয়ার দরকার নেই। মৌটুসি আছে না? ওর সাথে গল্প করবে খারাপ লাগলে আচ্ছা? ”
অথৈ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। নিবিড় হালকা হেসে ওর কপালে বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে চুমু খায়। অথৈ নিবিড়ের মুখের দিকে কেমন যেন একটা মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।
“আসি অথৈ। নিজের খেয়াল রেখো। একদম দুষ্টুমি নয় কিন্তু। ”
অথৈ শুধু হাসে। ও মনে মনে ভাবে, যেন ও বাচ্চা মেয়ে। সবাই কতটা খেয়াল রাখে। মিসেস রেহেনা ও যাওয়ার সময় বার বার সাবধানে থাকতে বলে গেছেন সবাই ওকে কত্ত ভালোবাসে ভাবা যায়?
অথৈ ঘুমিয়ে গিয়েছিল শুয়ে থাকতে থাকতে। হঠাৎ স্বপ্ন দেখছে, একটা চলন্ত মাইক্রো ছুটে আসছে। ওর মা রাস্তা পার হচ্ছে। ঠিক সেই সময় মাইক্রোটা ওর মা অলিন্দিতা কে ধাক্কা দিয়ে চলে গেল। তারপরই একটা গগন কাঁপানো চিৎকার। তার শরীর টা রাস্তায় ছিটকে পড়ল। র*ক্ত দিয়ে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে।
অথৈ এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ধড়ফরিয়ে উঠে বসে। বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে অর্ধেক বোতল পানি শেষ করে। শরীর দিয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। এসির পাওয়ার আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। কোন কাজ হচ্ছে না। তার পর পরই কানে আবার সেই শব্দ আসতে থাকে।
এক ভাবে এই কথাগুলো কানের কাছে আসতে থাকে। ধীরে ধীরে শব্দ বেড়ে যায়। অথৈ সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করতে থাকে। আশেপাশে কেউ নেই এখন। কাজের মেয়েটা ও কোথায় যেন চলে গেছে। ও মাথা চেপে ধরে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। গলা কাটা পশুর মতো ছটফট করতে থাকে। অসহ্য যন্ত্রণায় যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে।
_____
নীলের কাজ শেষ করে নিবিড়দের বাসার উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়ে। কাজ শেষেই নিবিড় যেতে বলেছিল ওদের বাসায়।
নীল বাসায় গিয়েই অথৈ কে ডাকতে থাকে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই। পুরো বাসা খোঁজে কোথাও অথৈ কে পায় না। শেষে চলে যায় ছাদে। সেখানে ও নেই। চিন্তায় ওর শরীরে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। ওরা সবাই অথৈ এর রোগ সম্পর্কে জানে। তাই না চাইতে ও মনের মধ্যে কু ডাক দিচ্ছে। কি মনে করে যেন নীল ছাদের নিচের দিকে তাকায়। তখনই চমকে যায়।
কিভাবে যে দৌড়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে বাসার উত্তর দিকে ছুটে যায়। অথৈ নিচে পড়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে। র*ক্তে নিচে ভেসে যাচ্ছে। কোন রকমে ওকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে তুলে ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘুরায়।
নিবিড় কে শুধু কল দিয়ে বলল ক্লিনিকে যেন চলে যায় দ্রুত। তারপরই কল কেটে দেয়। নিবিড় বুঝতে পারে না কার কি হয়েছে। বার বার কল দেওয়ার পর ও নীল কল ধরছে না। অগত্যা নিবিড় ওর মা কে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায় ক্লিনিকের দিকে।
নিবিড় পৌঁছে দেখে রিদ ও সেখানে চলে এসেছে। দৌড়ে যায় ওদের কাছে।
“এই কি হয়েছে? সবটা না বলেই কল কাটলি কেন? তোরা দুজন এই জায়গায়। কাব্যর কিছু হয়েছে? ও কোথায়? কাব্যর না আজ চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা ছিল? ”
ওরা কিছু না বলে চুপ করে থাকে। নিবিড় আরও রেগে যায়।
“সমস্যা টা কি তোদের? কথা বলিস না কেন? আমি পাগলের মতো ছুটে এসেছি। কার কি হয়েছে বলবি প্লিজ? আঙ্কেল আন্টির কিছু হয়েছে কি? আরে ভাই, টেনশন হচ্ছে তো আমার। বোবা হয়ে গেছিস তোরা? ”
এর মাঝেই একজন নার্স আসেন।
“পেশেন্ট এর বাসার লোক না আপনারা? ওনার ৩ ব্যাগ এ+ ব্লাড লাগবে এখনি। অনেক ব্লাড চলে গেছে শরীর থেকে। প্লিজ ব্যবস্থা করুক আপনারা। হাতে বেশি সময় নেই কিন্তু। রোগীর অবস্থা বেশি ভালো না। ”
নিবিড় জিজ্ঞেস করে,
“পেশেন্ট টা কে? ”
“অথৈ জাফরিন লেখা ছিল নাম। ”
নার্সের কথা শুনে নিবিড় থমকে যায়। বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। নার্সের দিকে এগিয়ে যায়।
“এগুলো কি বলছেন আপনি? ”
নার্স নীলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনি তো অথৈ নাম লিখলেন। ”
নিবিড় কথা খুঁজে পায় না যেন। হাত-পা কাঁপছে। শরীর অবশ হয়ে আসছে মনে হয়। নীলের দিকে ঘুরে তাকায়। রিদ ওকে ধরে বসিয়ে দেয় চেয়ারে। তারপর শর্টকাটে ওকে সবটা বলে।
নিবিড় চুপ হয়ে যায় একদম। কাব্য গাড়িতে। ওর আসতে কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা লাগবেই। কাব্যর ব্লাড গ্রুপ এ+। আশেপাশে এখন ডোনার খুঁজতে হবে। নিবিড় কে আর যেতে দেয়নি ওরা। রিদ আর নীল আশেপাশের হসপিটালে খুঁজতে থাকে। একে ওকে ফোন করে ও খোঁজ নেয় কার ব্লাড গ্রুপ সেম হবে। কোথাও পায় না। নিবিড় ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেয় ব্লাড লাগবে। সেখানে একজন ছেলে কমেন্ট করেছে। তার সাথে ব্লাড গ্রুপ মিলেছে। কিন্তু ওনার বাসা অনেক দূর। তার আসতে তবুও ৩ ঘন্টা লাগবে। নিবিড় কি করবে বুঝতে পারে না আর।
এর মধ্যে ডক্টর আসেন। নিবিড় উঠে দাঁড়ায়।
“ডক্টর ও কেমন আছে? সুস্থ হবে তো? ”
“আপনি ওনার সম্পর্কে কি হন? ”
“হাসবেন্ড। ”
নিবিড় কেন এটা বলল ওর জানা নেই। হুট করেই মুখ দিয়ে এই একটা শব্দ বেড়িয়ে যায়।
“শুনুন মিস্টার, পেশেন্ট এর অবস্থা ভীষণ খারাপ। শুনেছি দোতলা থেকে লাফ দিয়েছে। এরপরেও যে উনি জীবিত আছেন এটাই শুকরিয়া। তবে মাথায় অনেক আঘাত পেয়েছে প্রচণ্ড। মাথার ভেতর ছোট ছোট কিছু টুকরো চলে গেছে। সেগুলো বের করতে হবে। কপাল ফেটে গেছে। নাক দিয়ে ও ব্লাড এসেছে অনেক। হাতের বিভিন্ন জায়গায় ছিলে গেছে। মানে যা তা অবস্থা। ব্রেইনে সার্জারি করাটা জরুরি। যত দ্রুত ব্লাডের ব্যবস্থা করতে পারবেন আমাদের তত তাড়াতাড়ি সবটা হয়ে যাবে। ”
“আমরা ব্লাড খুঁজছি ডক্টর। কিন্তু সার্জারি করলে কি ও সুস্থ হয়ে যাবে? ”
ডক্টর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলেন।
“দেখুন মিস্টার নিবিড়, এটা কিন্তু পুলিশ কেইস। তবুও আমি ঝামেলা করিনি। পুলিশে ও কল করিনি। শুরু থেকেই ট্রিটমেন্ট করে যাচ্ছি। এর একটা কারণ আছে। আমাদের ডক্টরদের কাছে সব পেশেন্ট একই সমান। তবে ওর ব্যাপারটা আলাদা ভাবে নিয়েছি। গত বছর আমার মেয়েটা ও সুই*সাইড করে মারা গেছে। ওর বয়সী হবে হয়তো। ওকে দেখেই আমার মেয়ের কথা মনে পড়ল। আমি পুরোপুরি চেষ্টা করব। বাকিটা আল্লাহ জানেন। আমরা তো শুধু মাত্র অজুহাত একটা। আল্লাহ কে ডাকুন। আর ব্লাড খুঁজে বের করুন। নয়তো কিছু বলতে পারছি না। ”
১ ঘণ্টার মধ্যে দুজন ডোনার পেয়ে যায় রিদ। অথৈ কে ওটি তে নেওয়া হয়। অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। নিবিড়ের মা আর বোন চলে আসেন। অথৈ এর মামা হানিফ আহমেদ শোনার পর তিনি ও চলে এসেছেন। কাব্য এখনো পৌঁছাতে পারেনি। একটু পর পর ও কল দিয়ে রিদের থেকে সব আপডেট নিচ্ছে। কাব্যর দূরে থেকে কিছু তেমন জানতে পারছে না। এতটুকু শুনেই ওর পাগল পাগল লাগছে। ও তো কম ভালোবাসে না অথৈ কে। নিজের ছোট বোনের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করত। কিসে ওর ভালো লাগা সব দেখত। সেই মেয়েটার এমন অবস্থা মেনে নেওয়ার মতো নয়। তবুও এই সময়েই ও পাশে নেই। পৃথার উপর রেগে যাচ্ছে। কেন আজ ওকে ডাকলো দেখা করার জন্য? আজকেই কেন? রাগ টা ঠিক কোথায় দেখাবে বুঝতে পারে না।
নিবিড় অপারেশন থিয়েটারের বাইরে চুপচাপ বসে থাকে। কোন কথা বলে না। হানিফ আহমেদ এসে ওর কাঁধে হাত রাখে। নিবিড় বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে করুণ চোখে ওনার দিকে তাকায়। হাতটা চেপে ধরে।
“আমি পারিনি মামা। আমি ওকে আগলে রাখতে পারলাম না। ব্যর্থ আমি। ”
“এতটা ভেঙ্গে পড়ো না নিবিড়। অথৈ সুস্থ হবে দেখে নিও। আর কে বলল তুমি পারনি? ব্যর্থ কেন হবে। তুমি তোমার সাধ্য মত চেষ্টা করেছো। আল্লাহর চাওয়ার বাইরে কিছুই হয় না। নিশ্চয় এর পেছনে কোন কারণ আছে। আল্লাহ দুঃসময় দিয়েছেন। তিনিই আবার সু সময় দেবেন। বিপদে ধৈর্য রাখতে হয়। ”
মিসেস রেহেনা বসে থেকে দোয়া পড়ছেন। নবনী মায়ের পাশে বসে কাঁদছে। রিদ, নীল তখনো দাঁড়িয়ে চুপচাপ। এর মধ্যেই কাব্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে।
“এই নীল, কি অবস্থা এখন? আর কত সময় লাগবে কিছু বলেছে কি? ”
“না দোস্ত। এখনো কিছু বলেনি। সার্জারি চলছে। দেখা যাক। ”
কাব্য নিবিড়ের কাছে এগিয়ে যায়। নিবিড় ওকে জড়িয়ে ধরে কিভাবে যেন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। শুনেছি পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না। কতটা কষ্ট পেলে তবে নিবিড় এভাবে কাঁদছে? এতক্ষণ ওর বুক ভার হয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল সবাই কাছে থেকে ও নেই। বুকটা হালকা করার মতো কাউকে যেন পাচ্ছিল না। কাব্য কে পেয়ে মনে হলো এবার বোধহয় বুকের ভারি বোঝাটা কমানো যায়।
কাব্যর চোখ থেকে ও কয়েক ফোঁটা পানি বেড়িয়ে আসে। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
“শান্ত হ দোস্ত। সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে ভেঙ্গে পরিস না তুই প্লিজ। ”
“ওকে সুস্থ করে দে না কাব্য। আমি মরে যাব সত্যি সত্যি। ওকে ছাড়া কিভাবে বাঁচব আমি? আমার কলিজা ছিঁড়ে যাবে না? আমার অথৈ কে এনে দে না ভাই। ও এমন কেন করল? আমারই দোষ। আমি কেন ওকে এভাবে রেখে গেলাম। আমার জন্যই আজ ওর এই অবস্থা। নয়তো আমার অথৈ এর তো এই অবস্থা হতো না আজ? আমি কিভাবে সহ্য করব? ”
কাব্য আর কিছু বলে না। রিদ আর নীল ও এসে ওদের দুজন কে জড়িয়ে ধরে। ৪ বন্ধুর এই করুণ দৃশ্য যেন চোখে দেখা যায় না। ভেতরটা মুচরে যাচ্ছে সবার। একটা মেয়ে সবাই কে কতটা মায়ায় ফেলে দিয়েছিল হুট করেই। কাব্য, নীল, রিদ ওদের ৩ জনের যেন একটাই বোন ছিল। আদরে মাথায় তুলে রাখার মতো। সেই মেয়েটাই এতক্ষণ ধরে চোখের আড়ালে সবার।
_____
দীর্ঘ ৫ ঘন্টা পর সার্জারি শেষ হয়। ডক্টর ওটি থেকে বেড়িয়ে আসেন। কাব্য এগিয়ে আসে।
“অপারেশন তো সাকসেসফুল হয়েছে। তবে আঘাতটা গুরুতর ছিল। আর সময় মতো ব্লাড না পাওয়ায় অপারেশন করতে বিলম্ব হয়েছে। তাই ৭২ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে পেশেন্টের কথা কিছু বলতে পারছি না। কোমায় ও চলে যেতে পারে। সব পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখুন আর আল্লাহ কে ডাকুন। ”
সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় এই কথা শুনে। কি বলবে ভেবে পায় না। নিবিড় পাথরের মতো হয়ে গেছে। ৭২ ঘন্টা কিভাবে কাটবে? এতটা সময়!
নিবিড় অথৈ এর কাছে থেকে এক পা ও নড়ে না। সারাক্ষণ ওর কাছেই বসে থাকে। মিসেস রেহেনা বাসায় গিয়ে রান্না করে রাখে। ওদের ৩ বন্ধুর মধ্যে যে কেউ খাবার নিয়ে এসে ওকে খাওয়ায়। রাতে ঠিক মতো ঘুমায় না। দিনে ও ঘুমায় না। মনে হয় ঘুমালে যদি ওর জ্ঞান ফেরে? তখন যদি ওর কিছু প্রয়োজন পড়ে? অথৈ তো অসুস্থ নিবিড় কে ডাকতে ও পারবে না। এই ভেবে দিন রাত জেগে থাকে। কাব্য ওর সাথেই থাকে। এই কেবিনে দুটো বেড আছে। কাব্য ওকে একটু ঘুমাতে বললে ও শোনে না কথা।
নিবিড় শুধু অথৈ এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটা কে এমন নীরব একদমই মানায় না। বার বার চোখ ঝাপসা হয়ে ভিজে আসে ওর। কষ্ট হয় ভীষণ। বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। অথৈ কে কথা দিয়েছিল ওকে একটা পাহাড়ে বাড়ি বানিয়ে দেবে। একটা ‘অথৈ মহল’ উপহার দেবে। সেটা কবে দেবে আর? মেয়েটার সুস্থ হতে হবে তো। যেভাবেই হোক।
৭২ ঘন্টা হতে আর মাত্র ৩ ঘন্টা বাকি। এই কয়দিনেই নিবিড়ের অবস্থা পুরোপুরি পাগলের মতো। চুল উষ্কো-খুষ্কো, দাড়ি কিছুটা বড় হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। ডক্টর যেই কয়বার অথৈ কে দেখতে আসে। সেই কয়বার নিবিড় কে ও বকে যায় এভাবে না ঘুমিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু নিবিড় এই মুহূর্তে আর কারোর কথাই শুনবে না। ওর মনেই তো শান্তি নেই। ওর ভালো থাকাটা আর হবে কিভাবে? ওর বেঁচে থাকার আনন্দই তো মৃত্যুর সাথে লড়ছে।
____
৭২ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অনেক্ষণ আগে। ডক্টর মুখ অন্ধকার করে জানিয়েছেন অথৈ কোমায় চলে গেছে। আইসিইউতে রাখা হয়েছে এখন ওকে। নিবিড়ের ও এখন হুশ নেই। কিছুক্ষণ আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। অতিরিক্ত দুর্বলতা, ঘুম না হওয়া, বিষন্নতা আর দুঃচিন্তায় ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গেছে। বাকিরা এখন নিবিড় কে নিয়ে ব্যস্ত আপাতত। কারোর যেন কোন খেয়াল নেই। সব কেমন হয়ে গেল কয়েক দিনের মধ্যে। এমন তো হবার কথা ছিল না?
সবাই হাসি-খুশি ভাবে জীবন পাড় করে দিচ্ছিল। সুন্দর কত মুহূর্ত ছিল! এখন সেসবই ধোঁয়াশা মাত্র।
____
চলবে
১৪
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
____
নবনী ওর বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গেছে। অথৈ এর একা একা ভালো লাগছিল না। ড্রয়িং রুমে টমির পিছনে ছুটোছুটি করছিল। নিবিড়ের মা মিসেস রেহেনা অথৈ কে ডাকলেন।
“এইযে, এদিকে আসো তো। ”
“জ্বি আন্টি। ”
“চা’য়ের আড্ডা জমাতে ইচ্ছে করছে। দুই মা-মেয়ে মিলে চা বানিয়ে ফেলি কি বলো? ”
অথৈ খুশিতে বাকবাকুম করে ওঠে।
“দারুন হবে। চলো বানিয়ে ফেলি। ”
মিসেস রেহেনা অথৈ কে সুন্দর ভাবে যত্ন করে চা বানানো শিখিয়ে দিলেন। গল্প করলেন টুকটাক। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে চা কাপে ঢেলে দুজনে চলে গেলেন বারান্দায়। মা-মেয়ের গল্প জমে গেল একদম। অথৈ এর মনেই হয় না এরা ওর দূরের কেউ। মনে হয় সবাই যেন কত কাছের।
নবনীর আহ্লাদি কথা, ওর মায়ের আদর, নিবিড়ের যত্ন। সব কেমন অন্য রকম ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে রেখেছে চার পাশে।
অথৈ এর আলুথালু চুল গুলো ছড়িয়ে ছিল পিঠময়। মিসেস রেহেনা চিরুনি নিয়ে আসলেন। চুল গুলো আচড়ে দিলেন। তারপর যত্ন করে খোঁপা করে দিলেন।
“কি সুন্দর চুল তোমার। এমন করে রাখো কেন? চুলের যত্ন নিতে হয় তো মেয়ে। ”
“আমার চুল আচড়াতে ইচ্ছে করে না। খোঁপা করতেও পারি না। ”
“দেখ তো মেয়ের কান্ড। কি বলে এগুলো। খোঁপা করা একদম সহজ তো। আসো আমি শিখিয়ে দেই। ”
“আচ্ছা। ”
“মাঝে মাঝে চুল বিণুনী ও করবে। তাহলে আর চুল ছিঁড়বে না। ”
অথৈ এর এত ভালো লাগে কথা গুলো। একদম মা মা ব্যাপার। চুলে খোঁপা করা ও শিখে গেল।
নিবিড় আজ দুপুরে ফিরেছে অফিস থেকে। ফ্রেশ হয়ে মায়ের রুমে যায়। দুপুরে সবাই এক সাথে খাবার খেয়ে যার যার মতো ঘুমিয়ে যায়।
_____
রাত বেড়েছে অনেকটা। ঘড়ির কাটা প্রায় ১টা ছুঁই ছুঁই। নিবিড় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট ধরায়। সামনে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টি তে। সিগারেটের ধোঁয়া কিছু টা উড়ে গিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সিগারেটের শেষ টান টা দীর্ঘ সময় ধরে নেয়। তারপর অল্প অল্প করে বেশ খানিকক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ে। আরও ১ ঘন্টা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বুকশেলফ থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “বৈকুন্ঠের উইল” বইটা নিয়ে চেয়ারে বসে। কয়েক পাতা পড়ে ফেলে।
সম্ভবত তখন রাত ৩ টা হবে। নিবিড় অথৈ কে চুপিচুপি ডাকতে থাকে। ঘুম জড়ানো চোখে অথৈ ওর দিকে তাকায়। ঘোর লাগা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, এখন ডাকার মানে টা কি?
অথৈ আবার ঘুমিয়ে যায়। খানিকক্ষণ পরেই বুঝতে পারে ও শূন্যে ভাসছে। আতঙ্কে চোখ মেলে তাকায়। দেখলো নিবিড় ওকে কোলে নিয়ে বাইরে যাচ্ছে। কথা বলতে যেয়েও থেমে যায়। ওই চোখে যেন কিছু একটা আছে। নিবিড় কি ওকে সম্মোহন করে ফেলল? এমন লাগছে কেন তবে?
নিবিড় হাঁটতে হাঁটতে ছোট্ট একটা পাহাড়ে চলে যায় অথৈ কে নিয়ে। তারপর ওকে নিচে নামিয়ে দেয়।
“অথৈ? ”
“হু? ”
“এত কাছে থেকে রাতের পাহাড় দেখেছিলে কখনো? ”
“উহু, তবে দেখার ইচ্ছে ছিল।বলেছিলাম তোমায়। ”
“হ্যাঁ, ”
“সেই আবদার পূরণ করতেই বুঝি এই মাঝরাতে আমায় তুলে নিয়ে আসলে? ”
নিবিড় ঠোঁট কামড়ে হাসে। বাঁকা চোখের চাহনি তে ওর দিকে তাকায়। এইযে এই চাহনি তে অথৈ শেষ হয়ে যায়। সেটা কি নিবিড় বোঝে না?
অথৈ এর ঘোর এখনো কাটেনি। ও কি পাহাড় দেখবে নাকি কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটা কে দেখবে? এমন বুকের ভেতর অশান্ত হয়ে যাচ্ছে কেন আজ? বুক ধরফর যেন বেড়েই যাচ্ছে তীব্র গতিতে।
তারারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। চাঁদটা যেন মিটিমিটি হাসছে। নিবিড় বুক ভরে আরও একবার শ্বাস নেয়।
“বাতাসের ঘ্রাণ টা কি দারুণ। ”
অথৈ ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
“বাতাসের আবার ঘ্রাণ আছে নাকি! কি বলো। ”
“হ্যাঁ, আছে। পৃথিবীর সমস্ত কিছুর ঘ্রাণ আছে। রাতের, বাতাসের, আকাশের, মাটির, গাছের, বৃষ্টির আরও অনেক কিছুর। একদম অন্যরকম এক ঘ্রাণ। মাতাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে এই ঘ্রাণে। ”
অথৈ আনন্দে আটখানা হয়ে যায়।
“সত্যি বলছো! ”
“হু, সত্যি। তুমি কি একবার চেষ্টা করতে চাও? ”
“অবশ্যই। প্লিজ শিখিয়ে দাও আমায়। ”
“কিসের ঘ্রাণ নিতে চাও? ”
“পাহাড়ের। ”
“ওকে, চোখ বন্ধ করো। ”
“করলাম। ”
“প্রথমে অনুভব করো তুমি একা একটা পাহাড়ে আছো এখন। সবুজ পাহাড়টা রাতের নিস্তব্ধতায় নীরব হয়ে আছে। তোমার সাথে যেন পাহাড় টা মিশে যেতে চাইছে। শান্ত বাতাস তোমার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। অনুভব করো তুমি। ”
“করছি। ”
“এবার ধীরে ধীরে শ্বাস নাও। অনুভব করতে পারবে পাহাড়ের এই অন্যরকম ঘ্রাণ। ”
অথৈ ধীরে ধীরে শ্বাস নেয়। অনুভব করে একটা শীতল ঘ্রাণ।
“কিছু অনুভব করলে তুমি? ”
নিবিড় দেখলো অথৈ এর চোখ ভর্তি পানি।
“নিজেকে আজ অনেক টা হালকা লাগছে নিবিড় জানো? সত্যি তুমি দারুণ একটা মানুষ। তোমার জন্য আমি এত কাছে থেকে প্রকৃতি কে অনুভব করতে পারছি। আগে কখনো কেউ আমাকে এমন ভাবে বলেনি। ”
“তুমি পাহাড়ের ভাষা বুঝতে পারো? ”
“পাহাড়ের ভাষা ও আছে নাকি! ”
“পাহাড়ের ও একটা নীরব ভাষা আছে। ”
“তাহলে আমি বুঝতে পারছি না কেন? ”
“আবার চোখ বন্ধ করো। মনটা কে শান্ত করো। এই নীরব পাহাড় কে অনুভব করো গভীর ভাবে। ”
অথৈ চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে থাকে। একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সারা শরীর শির শির করতে লাগলো।
নিবিড় খেয়াল করলো অথৈ এর গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরছে। অজানা এক অনুভূতি হচ্ছে। ওর চোখের পানি দেখে নিবিড়ের বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখের পানি মুছে দেয় আলতো করে।
“পৃথিবীতে এত সুখ কেন? বেশি সুখ পেলে আমার চোখে আনন্দে পানি চলে আসে। পাহাড় এভাবে আমাকে তার কাছে টানছে কেন বলো তো? ”
“তুমি সবার থেকে আলাদা এজন্য। ”
নিবিড় আচমকা অথৈ এর হাত ধরে কাছে টেনে নেয়। দুজন দুজনের দিকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
~ অথৈ, তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে গাঢ় এক চুম্বন একে দিয়ে কানে কানে ফিসফিসিয়ে যদি বলি, ভালোবাসি? তুমি কি আনন্দে চোখ দিয়ে নোনা জল ফেলবে? নাকি দূরে ঠেলে দেবে আমায়? ~
আকষ্মিক এই কথা শুনে অথৈ এর শরীর কেঁপে ওঠে। বাকহারা হয়ে যায়। নিবিড় কি ওকে ভালোবাসে সেটা বলল? ওর গলা শুকিয়ে আসছে হঠাৎ করেই। পা অবস হয়ে আসছে। এখনই বোধহয় ঢোলে পড়ে যাবে নিচে।
এই কথাই তো সে কবে থেকে শুনতে চাইছিল। এতদিনে বলার সময় হলো? কিছুটা অভিমান, ভালো লাগা মিশিয়ে অথৈ চুপ করেই থাকে।
নিবিড় কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে রেখে লাইটার জ্বালিয়ে আগুন ধরায়। সিগারেটে কয়েকটা টান দেয়। অথৈ পেছন থেকে শুধু দেখে যাচ্ছে। কি বলা উচিত এখন তার? নিবিড় একবার অথৈ এর দিকে ঘুরে তাকায়। ও দেখল নিবিড়ের চোখ লালচে হয়ে আছে। আচ্ছা, নিবিড়ের কি কষ্ট হচ্ছে? বুক জ্বালাপোড়া করছে?
অথৈ ধীর পায়ে নিবিড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর ঠোঁটে থাকা সিগারেট টা নিয়ে নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে আগুন নিভিয়ে দেয়। চোখে চোখ রেখে ঘোর লাগা কন্ঠে একটা অন্যায় আবদার করে ফেলে।
“নিবিড়, তোমার এই সিগারেটে পোড়া ঠোঁট দিয়ে আমাকে একটা চুমু খাবে প্লিজ? ”
নিবিড় ভেজা চোখে তাকায় পূর্ণ দৃষ্টিতে। সুখে চোখ বুজে আসতে চাইছে। তবুও তাকিয়ে থাকে। শান্ত কন্ঠে উত্তর দেয়।
“কলঙ্ক লেগে যাবে তোমার পবিত্র শরীরে।
“লাগুক না একটু কলঙ্ক। চাঁদের ও তো কলঙ্ক আছে। আমার হলে ক্ষতি কি? ”
“ক্ষতি আছে তো। তুমি চাদের থেকে ও বিশেষ কিছু আমার কাছে। ”
“আমিও তো আবদার টা আমার বিশেষ মানুষের কাছেই করলাম নিবিড়। ”
“তুমি যেমন পবিত্র। আমার ভালোবাসা তার থেকে ও পবিত্র অথৈ। ”
“শুধু একবার। ”
নিবিড়ের নিঃশ্বাস আটকে যায়। স্থির হয়ে যায় চাহনি। কয়েক বার ঢোক চাপে। তারপর____তারপর কেটে যায় অনেকক্ষণ। নিবিড় নিজের ওষ্ঠ দিয়ে অথৈ এর আরেক জোড়া ওষ্ঠ নিজের করে নেয়। পাগলের মতো শুষে নিতে থাকে সেই জ্বালাময়ী অমৃত। তারপর আচমকা ওকে ছেড়ে দিয়ে অন্য পাশে ঘুরে দাঁড়ায়।
“চলো বাসায় ফিরে যাই অথৈ। ”
“আর কিছু সময় থাকি। ”
নিবিড় আর কিছু বলে না। কি বলা উচিত ওর এই মুহূর্তে সেটা জানা ও নেই। দুজন হাত ধরে হাঁটতে থাকে সামনের দিকে।
_____
বাসায় কেউ নেই আজ। অথৈ একা আজ। ওর কানের কাছে কিছু আওয়াজ আসছে ভেসে ভেসে। অনেক্ষণ ধরেই এমন হচ্ছিল। তবে হালকা। এখন আবার বেড়েছে সেই শব্দ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কথা গুলো। দুজন মানুষ ঝগড়া করছে কিছু একটা নিয়ে। ঝগড়ার কথা অনুযায়ী বোঝা যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী তারা। এক পর্যায়ে মহিলা চিল্লাতে থাকে জোরে।
কিন্তু এই শব্দের উৎসটা ঠিক কোথায়। সেটা অথৈ বুঝতে পারছে না। বাসায় এখন কেউ নেই। আশেপাশে ও কোন বাসা নেই। টিভি ও অফ করে রাখা। তবে?
নাহ! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। শব্দগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কানের পর্দা ফেটে কথা বেড়িয়ে আসছে মনে হচ্ছে। অথৈ কান চেপে ধরে থাকে।
শেষের কথা গুলো শুনে ও আরও অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এখন একজন পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসছে।
সে জোরে জোরে বলছে,
“অথৈ তুই অপয়া। তুই মেরেছিস। তোর জন্য সব শেষ হয়ে গেছে। হ্যাঁ, তুই-ই। সব তোর দোষ। কেন করলি এমন? কেন করলি? তুই খু*ন করেছিস। মরে যা তুই। এখনো বেঁচে আছিস কেন? লজ্জা লাগে না তোর? ছিঃ! ”
অথৈ জোরে চিৎকার করে ওঠে কান চেপে ধরে।
“আমি কিছু করিনি। তুমি ভুল বুঝছো। কেন এত জ্বালাও আমায়? আমি কিছু জানি না। আমি খু*ন করিনি। আমাকে শান্তি দাও। বাঁচতে দাও আমায়। ”
তবুও থামছে না। এখনো সেই শব্দ গুলো জোরে জোরে শোনা যাচ্ছে। অথৈ ফোন খুঁজতে থাকে। অসহ্য যন্ত্রণায় হাতের কাছে যা পাচ্ছে সব ছুঁড়ে ফেলছে। টমি অথৈ এর এমন অবস্থা দেখে মিউ মিউ করে ওর চারপাশে ঘুরছে। অথৈ সহ্য করতে না পেরে টমি কে তুলে ছুঁড়ে ফেলে বিছানার আরেক পাশে। টমি ছিঁটকে পড়ে বিছানার পাশে। দেয়ালে মাথা লেগে কুকিয়ে ওঠে মিউ মিউ করতে করতে এক সময় নিশ্চুপ হয়ে যায়।
যেই টমি কে ও এত ভালোবাসে। সেই টমি কে এভাবে আঘাত করেও ওর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। যেন মানসিক ভাবে শেষ হয়ে গেছে। নিবিড় কে কল করে দ্রুত। নিবিড় ওপাশ থেকে “হ্যালো, হ্যালো” করতে থাকে।
তখনই অথৈ লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে।
টমি চোখ মেলে তাকায় হালকা ভাবে। অথৈ কে ওভাবে পড়ে যেতে দেখে ওমনি বিছানা থেকে খুঁড়িয়ে নামে নিচে। টমির মাথায় আঘাত লেগে হালকা রক্ত আসছে। সেদিকে ওর খেয়াল নেই। অথৈ কে পড়ে থাকতে দেখে বুকের উপর যেয়ে পা দিয়ে খামচি দিচ্ছে। জিভ দিয়ে গাল চেটে দিচ্ছে। অথৈ এর জামা ধরে টানতে থাকে। জোরে মিউ মিউ করে।
পোষা প্রাণীটা ও বুঝতে পেরেছে মেয়েটা অসুস্থ হয়ে গেছে। নয়তো ওকে এভাবে মারবে কেন? টমি ছটফট করছে ওখানেই। চারপাশে দৌড়াচ্ছে। আবার ছুটে যাচ্ছে অথৈ এর কাছে। আবার জামা ধরে টানতে থাকে। এভাবেই ছুটোছুটি করতে থাকে টমি।
____
চলবে
১৫
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
অথৈ এর যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখতে পায় ও ক্লিনিকে। বেডে শুয়ে আছে। উঠে বসতে যাবে তখনই মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। নিবিড় একটু বাইরে গিয়েছিল। অথৈ কে উঠে বসতে দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে ওকে আবার শুয়ে দেই। বিছানার এক পাশে টমি ঝিম মেরে বসে আছে। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ করা। অথৈ হঠাৎ ওকে এই অবস্থায় দেখে চমকে যায়। নিবিড় কে জিজ্ঞেস করে এসব কিভাবে হলো।
নিবিড় নিজেও জানে না এসব কিভাবে হয়েছে। ও নিজেই তো বাসায় ফিরে দেখে অথৈ অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। পাশেই টমি মিউ মিউ করছে। ওর ও মাথা থেকে হালকা রক্ত আসছে। পা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তখনই ওদের দুজন কে নিয়ে আসে ডক্টরের কাছে।
তবে ডক্টর সেলিম রানা যা বললেন সেটা নিবিড়ের ও সঠিক মনে হচ্ছে। তার ধারণা অথৈ এর মানসিক কিছু সমস্যা আছে। তাই নিবিড় যেন দ্রুত কোন সাইকোথেরাপিস্ট কে দেখায়।
সেদিন বিকেলেই ওরা বাসায় ফিরে যায়। কাব্য, নীল, রিদ সবাই ওকে দেখতে আসে। নিবিড়ের মা মিসেস রেহেনা সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসে। অথৈ কে যত্ন করে স্যুপ খাইয়ে দেয়। নবনী এসে ওর মাথার কাছে বসে। মজার মজার কথা বলে ওর মন ভালো করার চেষ্টা করতে থাকে।
কাব্য ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি শেষ করে অথৈ এর নাক টেনে দেয়। ও চোখ পাকিয়ে তাকায়।
“উফ! ভাইয়া, এমনিই আমার নাকটা পাকিস্তানিদের মতো লম্বা। তুমি টেনে আরও লম্বা বানিয়ে দিও না। ”
ওর এই কথা শুনে সবাই জোরে হেসে ওঠে।
“বলিস কি! তোর নাকটাই তো সুন্দর। এখনকার মেয়েরা কি করে জানিস? বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট এর মাধ্যমে নিচু নাক সরু বানিয়ে ফেলে। বুঝছিস? ”
অথৈ আড়চোখে কাব্যর দিকে তাকিয়ে থাকে। কাব্য ঠোঁট টিপে হাসে। নীল এসে জানতে চায়।
“এই তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? চাইলে বলো কিছু বানিয়ে দেই অথবা কিনে নিয়ে আসি? ”
“আমি এখন কিচ্ছু খাব না ভাইয়া। ”
“আচ্ছা, সমস্যা নেই। ”
“তোমরা এমন করছো কেন হুঁ? আমি তো সুস্থ। ”
নিবিড় এগিয়ে এসে অথৈ এর পাশে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“তুমি সুস্থ সেটা আমরা সবাই জানি অথৈ। তবুও আগামী কাল একবার ডক্টরের সাথে দেখা করে আসতে হবে। মাথায় বেশি চোট লেগে থাকলে তো পরে সমস্যা হবে তাই না? তুমি তো সব বোঝো। ”
অথৈ বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। তার মানে আগামী কাল ডক্টরের কাছে যাওয়া নিয়ে ওর কোন আপত্তি নেই।
_____
মেডিকেল রোড, কাজলশাহ, সিলেটে একজন ব্রেইন-মাইন্ড স্পেশালিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্ট আছেন। ডঃ রাশিদ চৌধুরী। তিনি চেম্বারে থাকেন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
নিবিড় অথৈ কে নিয়ে ৫ টার দিকে বেড়িয়ে যায়। ডক্টর কে দেখানো হলো। তিনি অথৈ এর সাথে প্রায় ৫০ মিনিট সুন্দর ভাবে কথা বললেন। সহজ ভাবে কিছু প্রশ্ন করলেন। যখন অথৈ স্বস্তি বোধ করা শুরু করল তখন ওর যতটুকু মনে আছে নিজেই ডক্টর কে সব বলল।
কিছুক্ষণ পর ডক্টর নিবিড় কে একা ডাকলেন।
“মিঃ নিবিড় বসুন এখানে। ”
“ডক্টর কি বুঝলেন কথা বলে? ”
“আমি যা বুঝলাম, পেশেন্ট মেন্টাল ডিসঅর্ডারে ভুগছে। সেটা কিছুদিনের নয় কিন্তু। প্রায় ১১-১২ বছর ধরে। কাজেই এটা এখন আর সামান্য কোন পর্যায়ে নেই। ভয়ানক ভাবে ওকে এই মানসিক রোগটা ঘিরে ধরেছে। এটা মারাত্মক চিন্তার বিষয় কিন্তু। ”
“অথৈ আমাদের সাথে বেশ অনেক দিন ধরে আছে। সেটা আমি আপনাকে আগেই জানিয়েছি। কিন্তু এর মাঝে এমন কোন অস্বাভাবিক কিছু বোঝা যায়নি। মনে হয়েছে একদম সুস্থ একটা প্রাণোচ্ছল মেয়ে। ”
“হ্যাঁ, ও মাঝে মাঝে সুস্থ থাকবে। হঠাৎ করেই আবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে যাবে। আর সেটা তখনই হবে যখন ও একা থাকবে কোথাও। আপনি তো বললেন বেশ কিছু দিন আগে হঠাৎ করেই অথৈ লাপাত্তা হয়ে যায়। তারপর ওকে আপনারা মণিপুরীদের বাসস্থানে পেয়েছেন। ও কিন্তু এমনি এমনি বাসা থেকে চলে যায়নি। ওর প্রধান সমস্যা কানে আওয়াজ আসা। ওর কানে এমন কিছু শব্দ আসে যা ওকে স্থির রাখতে দেয় না। চলে যায় যেকোন জায়গায়। এমন কি ওর মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে অনেক বেশি। এমন কিছু শব্দ ওর কানে আসবে যা এক সময় সহ্য করতে না পেরে ও সুই*সাইডের চেষ্টা করবে।
এমন কি গতকাল ও অথৈ এর কানে কিছু অপ্রকাশিত শব্দ অথবা কথা এসেছিল। যেটা সহ্য করতে না পেরে সেন্সলেস হয়ে যায়।
যেমন ধরুন আপনি বললেন প্রথম দেখেছিলেন বউ সাঁজে ট্রেনে। তারপর আপনি আপনার সাথে নিয়ে এসেছেন আপনার বাসায়। আপনাকে অথৈ যেই গল্প টা শুনিয়েছে সেটা সত্যি নয়। এর পেছনে অন্য কিছু একটা আছে। কি কারণে ও চলে এসেছে বাসা থেকে সেটা আপনার খোঁজ করা উচিত। ওর পরিবার কোথায়? জলজ্যান্ত একটা মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। অথচ ওর বাবা-মা কোন খোঁজ করবে না? আদৌ কি ওর বাবা-মা আছে?
আরেকটা কথা। আপনি বললেন অথৈ কে খুঁজে না পেয়ে আপনি ওর ফোনের কল লিস্ট চেক করেছেন। কিন্তু কোন নাম্বার পাননি। অথচ আপনি আগে শুনেছেন সে তার মায়ের সাথে কলে কথা বলতো। এখানে আমার অভিজ্ঞতা যা বলে সেটা হচ্ছে, মেয়েটা কারোর সাথেই কথা বলতো না। ওর মায়ের সাথে ও না। কিন্তু ও মনে মনে এটা ভেবে নিয়েছিল নিজের অজান্তেই। এই মানসিক সমস্যায় এমন হয়। কল্পনা শক্তি তাদের বেড়ে যায়। নিজের মনের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা গন্ডি বানিয়ে ফেলে। ওরা যা ভাবে সেটাকেই সঠিক মনে করে। আশা করি আপনি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন।
আর এই রোগের সাথে ওর অতীতের কোন সংযোগ আছে। আপনি ভালো করে খোঁজনিন। তারপর আমাকে জানাবেন। আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি আপাতত সেই অনুযায়ী ঔষধ খাওয়াবেন। ট্রিটমেন্ট চলতে থাকুক। সাধারণত শুরুর দিকে হলে কাউন্সিলিং এর মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু ওর কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে কিছুই হবে না। রোগটা বেড়ে গেছে অনেক। মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে এটাই শুকরিয়া। ওকে কখনো একা রাখবেন না। চোখে চোখে রাখুন। বুঝতে দেবেন না সে অসুস্থ। আপনারা আগের মতোই ওর সাথে কথা বলুন, মিশুন, ঘুরতে যান। হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করুন। ইন শা আল্লাহ ঠিক মতো ট্রিটমেন্ট চললে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। ”
নিবিড় অথৈ কে নিয়ে বাসায় ফিরে যায়। ডক্টরের কথা শোনার পর থেকে ওর মনটা অশান্ত হয়ে আছে। এতদিনে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এই মেয়েটার মাঝে এত বড় রোগ বাসা বেঁধে আছে। কি এমন হয়েছিল অতীতে? জানতে তো হবেই তাকে।
আজ থেকে রাতে মিসেস রেহেনা থাকবে অথৈ এর সাথে। ওকে একা রুমে রাখার সাহস কারোর হচ্ছে না। অথৈ কে অবশ্য এগুলো বুঝতেও দিচ্ছে না। মিসেস রেহেনা ওর সাথে থাকবে শুনে সে মহাখুশি। রাতে তিনি ওকে গল্প বলে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিলেন
_____
মেঘ ডাকছে প্রচন্ড জোরে। এখনই বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে।অথৈ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। মেঘের ডাক শুনে মনের ভেতর আকুপাকু শুরু করে দিয়েছে। বৃষ্টি নামলে ভিজতে যাবে কি না দ্বিধায় আছে। নিবিড় দেখলে বকবে। সেই ভয়েই আছে। চুপিচুপি নিবিড়ের রুমে উঁকি দেয়। তখনই নিবিড় দরজা ঠেলে বেড়িয়ে আসে। দুজনের জোরে একটা ধাক্কা লাগে। “আউচ” বলে চিল্লিয়ে অথৈ উল্টে যাচ্ছিল। নিবিড় দ্রুত ওর হাত ধরে ফেলে।
অথৈ এর বাহু ধরে দাঁড় করায়। হাতটা চেপে ধরে। তখনই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হয়। হাতটা ছেড়ে দেয়। গভীর দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
“অথৈ যদি বলি, চলো ভিজি আজ বৃষ্টি তে।
ধরবে কি তুমি আমার হাত?
ভিজবে কি তুমি আমার সাথে? ”
নিবিড়ের কথা শেষ করার আগেই ওর গলা জড়িয়ে ধরে।
“উম্ম, ভিজবো। চলো যাই। ”
নিবিড় একটা স্নিগ্ধ হাসি ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে ওকে নিয়ে চলে যায় ছাদে। অথৈ নিবিড়ের পায়ের উপর উঠে দাঁড়ায়। নিবিড়ের গলা জড়িয়ে ধরে। নিবিড় ওর কোমর ধরে থাকে যেন পড়ে না যায়। তারপর বৃষ্টির মাঝে এভাবেই ছাদে ওকে পায়ের উপর নিয়ে হাঁটতে থাকে। নিবিড় ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। অথৈ কেঁপে ওঠে। চোখ নামিয়ে নেয়।
একটু পর ওর পায়ের উপর থেকে নামে। ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে পাখির ডানার মতো দু হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টির প্রতিটা কণা ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম বৃষ্টির পানি কে নিবিড়ের হিংসে হচ্ছে।
অথৈ পেছনে ঘুরে তাকায়। নিবিড় কে ডাকে। নিবিড় ওর কাছে গেলে ওকেও ওই ভাবে দুদিকে হাত মেলে দাঁড়াতে বলে। দুজনেই দাঁড়ায় এক রকম ভাবে।
বেঁচে থাকা অনেক সুন্দর অনেক। যদি ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকে এভাবে। একটা আকড়ে ধরার মানুষ থাকলে আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছে যারা তাদের ভালোবাসার মানুষের সাথে এক জীবন পার করেছে। এই শহরে তো শুধু মন ভাঙ্গার গল্প লেখা হয়। মন গড়ার গল্প খুব কমই হয়। ওই অল্প সংখ্যক মানুষের মাঝে ওরাও হলে মন্দ কি তবে?
অথৈ ঘুরে দাঁড়ায়। নিবিড় কে ডাকে।
“এই শোনো ? ”
“বলো। ”
“আমি তো আহামরি কেউ না। তবে আমাকে এত ভালোবাসলে কেন তুমি? ”
“তুমি আমার কাছে অন্যরকম। আমার ভালোবাসা। আমি জানি, সহজে কারোর প্রেমে পড়ব না। কিন্তু একবার পড়ে গেলে আর উঠতে পারব না। এইযে, প্রেমে পড়ব না পড়ব না করেও গভীর ভাবে প্রেমে পড়লাম। কিন্তু মেয়েটা অনেক জ্বালায় আমায়। ”
অথৈ ঠোঁট টিপে হেসে ওকে জিজ্ঞেস করে,
“শুধু জ্বালায়? ”
নিবিড় আরেকটু আহ্লাদ করে বলল,
“নাহ। ভালো ও বাসে। ”
অথৈ এক বুক প্রশান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ওকে আবার জিজ্ঞেস করে,
“ভালোবাসা এত সুন্দর কেন বলো তো? ”
নিবিড় শান্ত চোখে তাকায়। এর উত্তর ওর কাছে আছে। চট করে সেই উত্তর দিয়ে দেয়।
“তুমি সুন্দর তাই। ”
“ইশ! বলে কি এই লোক। ”
“ভুল বললাম বুঝি? ”
“কি জানি। ”
“সত্যি টা কি তবে? ”
“তুমি যা বলবে তাই পরম সত্য নিবিড়। ”
“আমার মাঝেও মিথ্যা আছে অথৈ। ”
“ওই এতটুকু মিথ্যা সবার মাঝেই থাকে। ”
নিবিড় ওকে জড়িয়ে ধরে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয়।
এইযে জড়িয়ে নিল। আর কখনো আলাদা হতে দেবে না। এই মেয়েটার কোন ক্ষতি ও হতে দেবেই না। ওকে সুস্থ করার পুরো দায়িত্ব নিবিড়ের। বাকি ১০টা মেয়ের মতো স্বভাবিক করে তুলবেই।
_____
নিবিড় ঢাকা গিয়েছে আজ। অথৈ এর পরিবার কে খোঁজার চেষ্টা করছে। সাথে আছে রিদ। বিকেল হয়ে আসছে প্রায়। একটা রেস্তোরাঁয় বসে কিছু খেয়ে নেয়। আজকের রাতটা থাকার জন্য একটা ভালো হোটেল বুক করে। বাসায় ওর মা আর নবনী কে বার বার করে বলে এসেছে অথৈ কে যেন কেউ চোখের আড়াল না করে। শিঘ্রই ফিরে আসবে কাজ শেষে।
নিবিড়ের পরিচিত অনেকেই ছিল ঢাকায়। তাদের ও খোঁজ করতে বলেছে। আর পরিচিত কয়েক জন পুলিশ কে ও কাজে লাগিয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে যেভাবেই হোক সব জানার চেষ্টা করবে।
রাত ১১ টায় নিবিড়ের একটা কাজিন কল করে জানায় অথৈ এর পরিবারের কাউকে খুঁজে পায়নি। তবে ওর মামার ঠিকানা পেয়েছে। নিবিড়ের মনে আশার আলো চলে আসে। আগামীকাল জানা যাবে বাকিটা।
____
চলবে
১২
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
৯ টায় ওরা বেরিয়ে পড়ে মণিপুরীদের থেকে বিদায় নিয়ে। শ্রীমঙ্গলটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে থাকলেও নিবিড় রাজি হচ্ছে না। নবনী আর অথৈ জেদ ধরেছে ওরা ঘুরবেই।
নীল এসে নবনীর গাল চেপে ধরে কটমট করে বলে,
“তুই না এতদিন চট্টগ্রাম ঘুরে আসলি? তবুও ঘোরা হয়নি তোর? ”
নবনী ভেংচি কাটে। নিবিড়ের কাছে বিচার দেয়।
“ভাইয়া, নীল ভাইয়া আর একবার আমার গাল চেপে ধরলে কিন্তু আমি হাতে কামড়ে দিব বলে দিলাম। ”
“এহ! আমি বুঝি চুপ থাকব? আমিও তোর মুখে পানি দিয়ে মেকআপ নষ্ট করে দেব। ”
“আমি মেকআপ করি না তুমি জানোই। ”
“মেকআপ দিলেও কি আমাদের বলবি? ”
ওদের ঝগড়া দেখে সবাই হেসে ফেলে। কাব্য এসে সবার মাঝে দাঁড়িয়ে এর সমাধান দেয়।
“শোন সবাই, আমরা শ্রীমঙ্গল এসেছি অল্প সময় নিয়ে। তাই ঘুরে দেখার ইচ্ছে থাকলেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু অথৈ আর নবনী যেহেতু এত করে চাইছে। সেহেতু আমরা চাইলে ওদের হাম হাম ঝর্ণা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতেই পারি। আর টমি ও তো আসেনি। তাই সমস্যা ও হবে না আপাতত। কি বলিস তোরা? ”
নিবিড় রাজি হয়। নবনী অথৈ খুশিতে দুজন দুজন কে জড়িয়ে ধরে। অথৈ গিয়ে কাব্য কে জড়িয়ে ধরে।
“মানে কি অথৈ? আমি আর রিদ কি দোষ করলাম বলতো। তোমার জন্য কত কি করি। আর তুমি আমাদের পাত্তাই দিলে না। ”
অথৈ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়।
“ভাইয়া, একদম ন্যাকামি করবে না। আমি সবাই কেই ভালোবাসি। ”
কাব্য সুযোগ বুঝে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“আর নিবিড় কে? ”
নিবিড়ের নাম শুনে অথৈ খানিকটা লজ্জা পায়। কথা এড়িয়ে যায় সুক্ষ্ম ভাবে। নিবিড় বুঝতে পারে সেটা।
_____
প্রথমে ওরা শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে যায়। তারপর সেখানে থেকে একটা জীপ ভাড়া করে নেয়। জীপ নিয়ে যেতে হবে কলাবাগান পর্যন্ত। রিদ একটা জীপ ভাড়া করে। তারপর সবাই কলাবাগানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
সবাই হাসি-ঠাট্টা, হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকে পুরোটা সময়।
এরপর ওরা কলাবাগান পৌঁছে যায়। অনেকেই কলাবাগানে এসে গাইড ঠিক করে নেয়। কারণ, ঝর্ণাটির কাছে যাওয়ার জন্য এখনও সরকারি ভাবে কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। তাই সাধারণত স্থানীয় অধিবাসীদের থেকে কাউকে গাইড বা পথপ্রদর্শক নির্ধারণ করে পর্যটকরা ঝর্ণা ভ্রমণ করেন।
কিন্তু কাব্যরা এর আগেও অনেক বার এখানে ঘুরতে এসেছিল বিধায় ওদের সব চেনা জানা আছে। তাই কেউ আর গাইড নেয়নি।
হামহাম বা চিতা ঝর্ণা, বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত এই প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝর্ণা।
অথৈ নিবিড় কে এই জলপ্রপাত নিয়ে অনেক প্রশ্ন করে। ওর আগ্রহের যেন শেষ নেই। আশেপাশে যা দেখছে তাতেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। অজানা জিনিসগুলো জানার আগ্রহ দেখাচ্ছে। নিবিড়ের ওর এই ব্যাপার গুলো ভালো লাগছে। সব কিছুতেই আগ্রহ থাকা ভালো। বিশেষ করে প্রকৃতি নিয়ে। কয়জন মানুষই বা এখন প্রকৃতি কে এতটা ভালোবাসে।
নিবিড় ওকে এই জলপ্রপাত নিয়ে আরও অনেক তথ্য জানায়। এই জলপ্রপাত এর নামকরণ কেন এটা হলো। কে এই পর্যটন কেন্দ্র আবিষ্কার করলেন। আরও বিভিন্ন ধরনের কথা।
“জানো অথৈ? জলপ্রপাতটি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের শেষাংশে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সাথে দুর্গম জঙ্গলে ঘোরা একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। দুর্গম গভীর জঙ্গলে এই ঝর্ণাটি ১৩৫ মতান্তরে ১৪৭ কিংবা ১৭০ ফুট উঁচু। কেউ কেউ ঝর্ণার সাথে গোসলের সম্পর্ক তুলনা করেন।
“হাম্মাম” (গোসলখানা) শব্দটি থেকে “হাম হাম” হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, সিলেটি উপভাষায় “আ-ম আ-ম” বলে বোঝানো হয় পানির তীব্র শব্দ, আর ঝর্ণা যেহেতু সেরকমই শব্দ করে। তাই সেখান থেকেই শহুরে পর্যটকদের ভাষান্তরে তা “হাম হাম” হিসেবে প্রসিদ্ধি পায়। তবে স্থানীয়দের কাছে এটি “চিতা ঝর্ণা” হিসেবে পরিচিত। কেননা একসময় এ জঙ্গলে নাকি চিতাবাঘ পাওয়া যেত। ”
চিতাবাঘের কথা শুনে অথৈ চমকে তাকায়। ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে যায়।
“কি বলছো তুমি! চিতাবাঘ আছে আগে বলবে না? তবে আমি ভুলেও এখানে আসতে রাজি হতাম না। ”
নিবিড় হাসতে থাকে ওর কথা শুনে।
“আরে এখন নেই। এগুলো আগে মানুষ বলতো তখন নাকি ছিল। এখন কই পাবে এখানে। ”
অথৈ স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় এবার।
হাম হাম যাবার পথ এবং হাম হাম সংলগ্ন রাজকান্দি বনাঞ্চলে রয়েছে সারি সারি কলাগাছ, জারুল, চিকরাশি কদম গাছ। এর ফাঁকে ফাঁকে উড়তে থাকে রং-বেরঙের প্রজাপতি। ডুমুর গাছের শাখা আর বেত বাগানে দেখা মিলবে অসংখ্য চশমাপড়া হনুমানের। এছাড়াও রয়েছে ডলু, মুলি, মির্তিঙ্গা, কালি ইত্যাদি বিচিত্র নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ।
ঝর্ণার যৌবন হলো বর্ষাকাল। বর্ষাকালে প্রচন্ড ব্যাপ্তিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ে। শীতে তা মিইয়ে মাত্র একটি ঝর্ণাধারায় এসে ঠেকে। ঝর্ণার ঝরে পড়া পানি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছড়া তৈরি করে বয়ে চলেছে। এরকমই বিভিন্ন ছোট-বড় ছড়া পেরিয়ে জঙ্গলের বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই ঝর্ণার কাছে পৌঁছতে হয়। তাছাড়া ঝর্ণাকে ঘিরে তৈরি হয়নি কোনো সরকারি অবকাঠামোও।
ঝর্ণায় যেতে হলে কুড়মা বন বিটের চম্পারায় চা বাগান হয়ে যেতে হয়। চম্পারায় চা-বাগান থেকে ঝর্ণার দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। পথে অত্যন্ত খাড়া মোকাম টিলা পাড়ি দিতে হয় এবং অনেক ঝিরিপথ ও ছড়ার কাদামাটি দিয়ে পথ চলতে হয়। ঝিরিপথে কদাচিৎ চোরাবালুও তৈরি হয়। কিন্তু সে সকল স্থানে পর্যটকদের জন্য কোনো নির্দেশিকা দেখা যায় না। এছাড়া গভীর জঙ্গলে বানর, সাপ, মশা এবং জোঁকের অত্যাচার সহ্য করে পথ চলতে হয়।
জঙ্গলের মধ্যে এসে অথৈ শুনলো এখানে সাপ আর জোঁক আছে অনেক। এই কথা শুনে সেখানে দাঁড়িয়েই কান্না শুরু করে দিয়েছে। কান্না কারার আগেই চোখ দিয়ে উপচে পড়ছে পানি। নবনীর কেন যেন মজা লাগছে এই ব্যাপার গুলো।
ও এসে সাহস দেয়।
“আরে অথৈ আপু, একদম ভয় পেয়ো না। জোঁক তোমায় ধরবেই না। ভয় পাওয়ার ও কিছু নেই। আমি কিন্তু ভয় পাই না। ”
তবুও অথৈ এর ভয় কাটে না। নিবিড় জানে এই মেয়ের ছিঁচকাদুনে স্বভাব আছে। আর ভীতু ও অনেক। নিবিড় এসে ওর হাত চেপে ধরে। ওর চোখে চোখ রাখে।
“তাকাও আমার দিকে। ”
অথৈ বাধ্য মেয়ের মতো ওর দিকে তাকায়।
“কিচ্ছু হবে না। আমি আছি না? ভয় কিসের তোমার? সেই শুরু থেকেই সব কিছু থেকে তোমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছি আমি। তোমাকে আমি কষ্ট পেতে দেব বুঝি? এভাবে কাঁদতে হয় না। চলো। ”
আচমকা নিবিড়ের কথা শুনে ওর কান্না থেমে যায়। নিবিড়ের হাত চেপে ধরে হাঁটতে থাকে। এই সামান্য কথাতেই যেন ও মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। মনে মনে ভাবতে থাকে, নিবিড় কি ম্যাজিক জানে? কি সুন্দর ওকে সব সময় সামলে নেয়।
ভাবতে ভাবতেই নাবনীর চিৎকারে সবাই থমকে দাঁড়ায়। ওর পায়ের আঙ্গুলে একটা জোঁক ধরেছে। যদিও নবনী ভয় পায় না। তবে আচমকা পায়ের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেছে। রিদ এসে নবনীর পায়ের কাছে বসে জোঁকটা টেনে ছাড়িয়ে নেয়। কিছুটা রক্ত গড়িয়ে পরে ওর পা থেকে।
নিবিড় এগিয়ে আসে,
“ব্যথা লাগছে তোর? হাঁটতে পারবি কি? নাকি কোলে নিয়ে যাব তোকে। ”
“সমস্যা নেই ভাইয়া। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে না। আমি যেতে পারব। ”
“না না ব্যথা লাগলে বল। রক্ত আসছে তো। ”
কাব্যর পকেটে রুমাল ছিল একটা। সেটা ছিঁড়ে নবনীর পায়ের আঙ্গুলে বেঁধে দেয়। এখন আর রক্ত পরছে না।
নবনী হেঁটেই যাবে তবুও। কিন্তু অথৈ এবার চিল্লানো শুরু করেছে। সে আর এক পা ও নড়বে না কোনভাবেই। নবনীর পায়ে জোঁক ধরা দেখে ভয় আরও বেড়েছে।
নিবিড় অথৈ এর কানের কাছে এসে আস্তে করে বলে,
“আপনার কি আমার গলা জড়িয়ে ধরে কোলে ওঠার শখ হয়েছে ম্যাম? কোলে নেব? ”
অথৈ লজ্জা পায় খানিকটা। গাল লাল হয়ে যায়। কান দিয়ে গরম ভাব বের হচ্ছে যেন। মুখটা নিচে নামিয়ে নেয়।
নিবিড় ঠোঁট টিপে হাসে। তারপর অথৈ কে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে আবার।
অথৈ তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের মুখের দিকে। নিবিড় ও তাকায়।
“এইযে, তোমার কি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে? ”
“লাগে তো। ”
“কেন ভালো লাগে? ”
“সুদর্শন পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে যে কারোরই ভালো লাগবে। ”
“আচ্ছা তাই? ”
“সন্দেহ আছে কোন? ”
“যেহেতু তুমি বলেছো। তাই আর সন্দেহ নেই। ”
নিবিড় ওর সাথে দুষ্টুমি করে ও সেটা বুঝতে পারে। কিছু বলে না। নিবিড়ের সাথে আজকাল কথা বলতে অন্য রকম ভালো লাগে। কেমন যেন একটা প্রশান্তি আছে ওর মাঝে। সারাক্ষণ ওর সাথেই গল্প করে কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
ওদের কে এক সাথে এভাবে দেখে নবনী কাব্যর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“এই ভাইয়া, অথৈ আপু আর নিবিড় ভাইয়ার মধ্যে কি কিছু চলছে? ”
“এখনো কিছু চলছে না। তবে শীঘ্রই প্রেম হয়ে যাবে বোধহয় বুঝলি? ”
“ইশ! বলো কি। আমার তো দারুণ লাগছে। ওদের দুজন কে এক সাথে কি সুন্দর মানায় তাই না বলো? ”
কাব্য ওর মাথায় একটা গাট্টা দেয়।
“গাধী, ওদের নিয়ে তোর এত ভাবা লাগবে না। তোর পায়ে আরেকটা জোঁক ধরেছে নিচে তাকিয়ে দেখ। ”
নবনী তাকিয়ে দেখে বাম পায়ের এক পাশে জোঁক ঝুঁলছে। এটা দেখে ওর হাসি পেয়ে যায়। কাব্য অবাক হয়।
“হ্যাঁ রে নবনী, তোর কি কিছুতেই ভয় লাগে না? জোঁক ঝুঁলছে তোর পায়ে আর তুই হাসছিস? ”
নবনী আরও হাসে। শরীর কাঁপিয়ে হাসতেই থাকে। ওর পাগলামি দেখে কাব্য ও আর কিছু বলে না। এবার ও জোঁক টা টান দিয়ে ছাড়িয়ে রুমালের আরেক অংশ দিয়ে ওই পা ও বেঁধে দেয়।
অবশেষে ওরা চলে আসে ওদের গন্তব্যে।
বর্ষাকালে হাম হামে যাবার কিছু আগে পথে দেখা পাওয়া যায় আরেকটি অনুচ্চ ছোট ঝর্ণার। কিন্তু এখন তো বর্ষাকাল নেই। হাম হামের রয়েছে দুটো ধাপ, সর্বোচ্চ ধাপটি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাঝখানের ধাপে, এবং সেখান থেকে আবার পানি পড়ছে নিচের অগভীর খাদে।
অথৈ এখনো নিবিড়ের কোলে। নিবিড় ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে যায় আবার ও।
“আপনি কি নামবেন ম্যাম? নাকি কোলে নিয়েই ঝর্নার নিচে চলে যাব? ”
অথৈ ও নিবিড়ের সাথে দুষ্টুমি ভরা চাহনি নিয়ে ওভাবেই কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আপনি চাইলে আমাকে সারাদিন কোলে নিয়েও ঘুরতে পারেন জনাব। আমি একটু ও বারণ করব না। ”
“বাপরে! কি আবদার। যাই তবে ঝর্নার নিচে? ”
“চলো। ”
“এভাবে কোলে নিয়েই ভিজবো? ”
“হ্যাঁ, এভাবেই। পারবে না? ”
“সন্দেহ আছে? ”
অথৈ এই কথার উত্তরে কিছু বলে না। চোখ বুজে ফেলে। নিবিড়ের ঘাড়ের পাশে মুখ লুকিয়ে নেয়। দুপুরের তপ্ত রোদে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে।
নিবিড় ধীর পায়ে পানি পেরিয়ে এগিয়ে যায় ঝর্নার নিচে।
ঝর্নার জলরাশি উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একটা সুদর্শন পুরুষের কোলে উঠে বুকে মুখ লুকিয়ে একটা উঠতি বয়সী রমণী ঝর্নার পানিতে ভিজছে। এই দৃশ্যটা দেখা কেউ মিস করে কি? আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে ওদের দিকেই।
কাব্য, নীল, রিদ এবং নবনী ৪ জনেই জোরে উল্লাস করে ওঠে। তারপর সবাই মিলে ছুটে যায় ঝর্নার নিচে।
____
চলব
১৩
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
নবনী নীল কে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়। নীল ও পাল্টা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয় ওকে। কাব্য আর রিদ গেছে অন্য পাশে ওরা ঝর্ণার নিচে একটা পাথরের উপর বসে গল্প করছে।
নিবিড় এখনো অথৈ কে কোলে নিয়ে ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
নিবিড় ওকে নিচে নামিয়ে দেয়। কিন্তু অথৈ ওকে ছাড়েনি। গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিবিড় এক হাত ওর কোমরে রাখে। অবিরাম গতিতে পানির ধারা বইছে। ঝুমঝুম পানিতে ওরা ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেছে। চুল গড়িয়ে পানি পরছে। নিবিড় তাকিয়ে আছে এক ভাবে। অথৈ যেন এখন ততটা ও লজ্জা পাচ্ছে না। দুজনই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিবিড়ের কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। শরীর ঝিম ধরে আসছে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে পরছে ধীরে ধীরে।
“অথৈ শোনো। ”
“বলো। ”
“আফিমের চাইতেও ভয়ানক নেশা বোধহয় তোমার মাঝেই আছে। নয়তো আমার এমন নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো লাগছে কেন? ”
“নেশায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছো বুঝি? ”
“হয়ে গেলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে কি? ”
অথৈ লাজুক হাসে। নিবিড় জোরে কয়েক বার শ্বাস নেয়। তারপর আচমকা ওকে ছেড়ে দিয়ে খানিক দূরুত্বে গিয়ে দাঁড়ায়। অথৈ ও কিছু বলে না। ও জানে নিবিড়ের মনের সাথে বুঝতে সময় প্রয়োজন। ওকে সময় দেওয়া উচিত।
_____
রাত ২ টা বাজে। নিবিড়ের ডাকে অথৈ এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে বসে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। অথৈ কিছুক্ষণ চোখ কচলায়। নিবিড় রুমের কোথাও নেই। কিন্তু একটু আগেই ও স্পষ্ট শুনেছে নিবিড় ছাদে যাওয়ার জন্য ডাকছিল।
মনে মনে ভাবে, নিবিড় হয়তো ডাক দিয়ে চলে গেছে আগেই।
অথৈ টমির দিকে তাকায়। বিছানায় গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওর শরীরে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। টমি নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। টমির জন্য রাখা ছোট কম্বলটা ওর উপর হালকা ভাবে ছড়িয়ে দেয়। তারপর উঠে যায় বিছানা থেকে। পা টিপে টিপে ছাদে চলে যায়।
ছাদে গিয়ে অবাক হয়ে যায়। নিবিড় নেই। ভালো করে পুরো ছাদে খুঁজে দেখে। কোথাও নেই। অথৈ বেকুব হয়ে যায় যেন। মনে মনে নিবিড় কে বকতে থাকে। ওকে আসতে বলে সে নিজেই আসেনি। এটা কোন কথা? মাঝরাতে এমন ফাজলামি করার কোন মানে হয়?
কিছুক্ষণ বিষন্ন হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। যেহেতু এখন ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আপাতত আর ঘুম হবে না এখনই। তাই চুপচাপ দূরের পাহাড় দেখে। গুনগুন করে একটু গান গায়। শীত এখন আর নেই। তবুও বাইরের শোঁ শোঁ বাতাসে হালকা শীত লাগছে। রুম থেকে চাদর টা নিয়ে আসলে বোধহয় ভালো হতো।
ঠিক সেই সময় নিবিড়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ওর ঘুম ভাঙ্গলে যত রাতই হোক না কেন এক কাপ চা অথবা কফি বানিয়ে নিয়ে ছাদে চলে যায়। মাঝরাতে ছাদে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে একাকিত্ব ভীষণ সুন্দর মন হয় ওর। ঝটপট এক কাপ চা বানিয়ে ফেলে। দ্রুত চলে যায় ছাদে। ছাদের দরজায় পা রাখতেই হঠাৎ চমকে যায়। নিবিড় ভাবে, এত রাতে কে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে? ভুত বলতে কিছু নেই সেটা ও জানে। ভুতে বিশ্বাস ও করে না। কিন্তু এই মাঝরাতে কে এমন চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এভাবে?
নিবিড় পা টিপে টিপে আরেকটু কাছে যায়। ট্যাঙ্কির পাশে গিয়ে উঁকি দেয়। তখনই অথৈ পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়।
আচমকা দুজনের চোখাচোখি হতেই অথৈ ভয়ে একটা চিৎকার দেয়। ওর চিৎকার শুনে নিবিড় ও ভয়ে কেঁপে ওঠে। চা ছলকে কাপ থেকে অল্প পড়ে গিয়ে নিবিড়ের শার্ট ভিজে যায়। গরম চা ছিল তাই কিছুটা বুকে লেগে জ্বালাপোড়া শুরু করে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
“এই অথৈ, সমস্যা কি তোমার? এত রাতে ভুতের মতো ছাদে কি করো তুমি? এসেছো ভালো কথা। এভাবে আমাকে দেখে চিৎকার করতে বলেছে কে তোমায় হু? ”
“আরে থামো। আমাকেও একটু বলতে দাও। ”
“বলো। ”
“তুমি নিজেই আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললে ছাদে আসতে। তোমার কথা শুনে আমি চলে আসলাম। এসে দেখি তুমি নেই। আর এখন জিজ্ঞেস করছো আমি এত রাতে ছাদে কি করি? ”
“আজব কথা বার্তা তো! আমি কেন এত রাতে তোমায় ছাদে আসতে বলব? ”
“তুমি না বললে কি আমি একা আসব? ”
“আমার ও তো সেম কথা। আমি কেনই বা এত রাতে তোমায় ছাদে আসতে বলব। আমি তো তোমার ঘরে যাইনি। মাত্র ঘুম ভাঙ্গলো আমার। ”
অথৈ খানিকক্ষণ কিছু একটা ভাবে। তারপর নিবিড়ের দিকে তাকায়।
“আচ্ছা, আমারই বোঝার ভুল। ঘুমের মাঝে কোন স্বপ্নে দেখে হয়তো ভেবেছি তুমি ডাকছো। ”
“হ্যাঁ, তাই হবে। ”
“যাক গে সেসব কথা। তোমার জন্য শুধু চা নিয়ে আসলে? ”
“হ্যাঁ, আমি তো জানতাম না ভুত ও আমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করছে। ”
“এই একদম মজা করবে না বলে দিলাম। ”
“ইশ! একটু ও মজা করছি না আমি। যাইহোক, চা টা তুমিই নাও। ”
“আমি একা কেন খাব? ”
নিবিড় দুষ্টু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
“তবে কি এক কাপ চা’য়ে দুজনে চুমুক দিতে চাও? ”
অথৈ গলার স্বর টা একটু নিচু করে বলে,
“এমন হলে কি মন্দ হবে জনাব? ”
“উম্ম, একদমই না। ”
চা’য়ে প্রথম চুমুক টা অথৈ দেয়। তারপর নিবিড়। দুজনে মিলে চা শেষ করে। অথৈ আবদার করে ছাদের রেলিং এ বসবে। নিবিড় যদিও বারণ করে অনেক বার। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। রেলিং এ সে বসবেই। অগত্যা নিবিড়ের রাজি হতে হয়। অথৈ কে কোমর ধরে উঁচু করে বসিয়ে দেয় রেলিং এর উপর। যেন পড়ে না যায় সেই জন্য নিবিড় ওর কোমর জড়িয়ে রাখে।
অথৈ নিবিড়ের চোখের দিকে তাকায়। ওই চোখে তাকিয়ে কি যেন একটা খোঁজে। তারপর একটা প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা, তুমি কি কখনো কাউকে ভালোবেসে ছিলে? ”
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন? ”
“এমনিই। বলো না। ”
“হ্যাঁ, সেই ছোটবেলায়। স্কুলে একবার একটা মেয়ের সাথে রিলেশন ছিল। কয়েক মাস একটু চোখাচোখি, তারপর প্রপোজ করলাম। দুইমাস লুকিয়ে প্রেম করতে না করতেই ওর বাবা-মা জেনে গেল। তারপর ওকে নিয়ে ওদের পরিবার ঢাকা শিফট হলো। তখন তো ফোন ও ছিল না আমাদের। যোগাযোগ করার কোন উপায় ও ছিল না। কিছুদিন বিষন্ন ছিলাম। তারপর সব ভুলে গেলাম। কবেই সেসব ভুলে গেছি। তুমি এখন জিজ্ঞেস করলে দেখে মনে পড়ল। ”
কথা শেষ করে নিবিড় মৃদু হাসে। সেই হাসির দিকে অথৈ তাকিয়ে থাকে কিভাবে যেন।
“এই তোমার কি হলো শুনি? ”
“কই, কিছু না তো। ”
“তুমি কি প্রেম-টেম করেছিলে কখনো? ”
“আরে ধুর। আমি হলাম বাচ্চা মানুষ। এগুলো কখন করব। ”
“আমিও তো বাচ্চা কালেই প্রেম করেছিলাম। ”
নিবিড় আবার ও হাসে। এখন ওর সাথে অথৈ ও হেসে ফেলে।
“নিবিড় শোনো না। ”
“বলো না। ”
নিবিড়ের “বলো না” কথাটা শুনে অথৈ জোরে হেসে ওঠে। কেমন একটা সুর টেনে কথাটা বলে।
“একি! হাসছো কেন এভাবে? ”
“তোমার কথা শুনে। ”
“আমি কি ফানি কিছু বলেছি? ”
“আরে না। বাদ দাও। আরেকটা কথা। ”
“কি কথা? ”
“এখন কাউকে ভালোবাসো কি? ”
“উম্ম, কঠিন প্রশ্ন। ”
“বলো প্লিজ। ”
“এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেও জানি না অথৈ। ”
“ধরো কোন মেয়ে তোমাকে মনে মনে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু সে কোন এক অজানা কারণে বলতে পারছে না। সেক্ষেত্রে মেয়েটার কি করা উচিত বলে তোমার মনে হয়? ”
“বলে দেওয়া উচিত। ভালোবাসা কখনো ভেতরে চেপে রাখতে নেই। চেপে রাখলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভালোবাসা কে দ্রুত নিজের করে নেওয়া উচিত। বুঝলেন ম্যাম? ”
“জ্বি, জনাব। বুঝলাম। ”
“অনেক সময় ধরে তুমি রেলিং এ বসে আছো। এবার নামো। ”
“নামিয়ে দাও আমায়। ”
নিবিড় ওকে নিচে নামায়। অথৈ দূরের পাহাড় দেখে। আনমনেই বলে দেয়।
“দূরের ওই পাহাড় ছুঁতে চাই। ”
“কোনটা? ”
“ওইযে সামনের উঁচু পাহাড় টা। ”
“যাবে এখন? ”
“কি বলো! এত রাতে? ”
“যদি তুমি চাও তবে কোন অসম্ভব আবদার ও আমি অপূর্ণ রাখব না। আর এটা তো মামুলি ব্যাপার। ”
অথৈ এর চোখে হঠাৎ পানি জমে। এত সুন্দর কথা বোধহয় আগে কোনদিন শোনেনি কোথাও। এভাবে ও কেউ বলতে পারে? ওর সব আবদার রাখবে এমন মানুষ যে পৃথিবীতে আছে সেটা ভুলেই গিয়েছিল সেই কবে।
নিবিড় অথৈ এর দুই বাহুতে হাত রাখে।
“এই মেয়ে, কাঁদছো কেন শুনি? ”
“আমি যদি তোমায় একবার জড়িয়ে ধরি। তবে কি রেগে যাবে? ”
“বোকা মেয়ে। বললাম না তোমার কোন আবদার আমি অপূর্ণ রাখব না। ”
অথৈ পা উঁচু করে নিবিড়ের গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। নিবিড় ও আলতো ভাবে ওর কোমর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেভাবেই। নিবিড়ের কাঁধে চোখের পানি পড়ে শার্ট ভিজে যাচ্ছে।
“করছো কি অথৈ? শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছো একেবারে। এভাবে কেউ কাঁদে? ”
অথৈ কান্নার দমকে নাক টেনে টেনে কথা বলে,
“হ্যাঁ, আমি এভাবে কাঁদি। কথা বলবে না তুমি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। ”
“তখন ও কিন্তু তোমার চিৎকারে গরম চা পড়ে আমার পেট হালকা পুড়ে গেছে। ”
“যাক পুড়ে। তুমি ভুতের মতো পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? ”
“ইশ! একটু ও মায়া নেই মেয়েটার। ”
“উঁহু, নেই। ”
“পঁচা মেয়ে একটা। ”
“যা মন চায় বলো। ”
“নাহ। লক্ষী একটা মেয়ে তুমি। ”
অথৈ ওকে ছেড়ে দেয়। নাক দিয়ে পানি আসছে। নিবিড়ের শার্ট টেনে ওর নাক মুছে নেয়। নিবিড় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।
“কি করলে এটা! আমার শার্টে আর কিছু ফেলার আর মোছার বাকি আছে তোমার? ”
“আবার মুছবো? ”
“পুরো শার্ট টাই খুলে দেই? ”
অথৈ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
“চলো বাসার ভেতর চলে যাই। রাত পেরিয়ে ভোর হতে চলল। ”
“চলো যাই। ”
অথৈ রুমে ঢুকতে যাবে তখনই নিবিড় ওর হাত টেনে ধরে।
“কিছু বলবে? ”
“হ্যাঁ, ”
“জলদি বলো। ”
“ভালোবাসলে কেন মুখে বলেই প্রকাশ করতে হবে অথৈ? ভালোবাসি না বলেও তো ভালোবাসা যায়। পুরুষ মানুষের ভালোবাসা অদ্ভুত বুঝলে? পুরুষ তার শখের নারীর অসুস্থতায় যেভাবে যত্ন করে। ঠিক ওই যত্নটার মাঝেও ভালোবাসা থাকে।
প্রিয় মানুষটা নিখোঁজ হয়ে গেলে পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে যেভাবে খুঁজতে থাকে। ওই দিশেহারা হবার মাঝেও ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।
মেয়েটা এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হলে চিন্তায় অস্থির হয়ে যেভাবে বার বার কল দেয়। ওই কল দেওয়ার মাঝে সেই অস্থিরতাই আসলে ভালোবাসা।
বন্ধুদের মাঝে ব্যস্ততার সময়ে ও প্রিয় মানুষের জন্য এক মগ কফি বানিয়ে দেওয়ার সময় কফিতে কয় চামচ চিনি মেশালে মেয়েটা তৃপ্তি পাবে সেই ধারণা রাখাটাই ভালোবাসা।
আমি না হয় আমার ভালোবাসা টা অন্য ভাবেই প্রকাশ করলাম। তাতে ক্ষতি কি বলো? ”
অথৈ আর কিছু বলতে পারে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের মুখের দিকে। ও বুঝে যায় কোন কারণে নিবিড়ের কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। কিন্তু কিছু বলতে পারে না।
নিবিড় ওর গালে আলতো করে হাত রাখে।
“অনেক রাত অথৈ। রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কোন দরকার হলে আমায় ডেকো। আমি আছি। ”
এইযে সে বলল “আমি আছি”। এই কথাটাই তো সব। কয়জন পুরুষ এভাবে বলতে পারে সে পাশে আছে?
____
চলবে
১০
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
____
নিবিড় চমকে অথৈ এর দিকে তাকায়। অথৈ ও তাকিয়ে আছে। আশেপাশের লোকজন ফিসফিস করে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। ধীনেশ মল্লিক ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
নিবিড় অথৈ এর দিকে আরেকটু এগিয়ে আসে। গালে হাত দিতেই আবার অথৈ ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়। কাব্য এগিয়ে আসে। হাত চেপে ধরে।
“এই অথৈ তুই আমাদের চিনতে পারছিস না? আমি তোর কাব্য ভাইয়া। আর ও নিবিড়। চিনছিস না তুই? আমাদের না ট্যুরে যাবার কথা ছিল? ”
অথৈ কিছু না বলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ওর মাথা ঝিম ঝিম করছে বেশ কিছুদিন ধরে। জ্ঞান ফেরার পর এখানে কিভাবে আসলো। এরা কারা কোথায় ও। কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। কিন্তু কিছু মনেও করতে পারছিল না। এখন আচমকা এতগুলো ছেলে কে এক সাথে এভাবে কাছে আসতে দেখে আরও ভয় পেয়ে যাচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করছে ভীষণ ভাবে।
নীল রিদ সবাই মিলে ওকে রিল্যাক্সে ভাবতে বলছে। নীল ওর ফোনের ছবিগুলো দেখাল।
পাশে থেকে একজন লোক কয়েকটা মোড়া এনে বসতে দিলেন সবাই কে। নিবিড় মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। অবচেতন মন বলছে, ওর কি স্মৃতি হারিয়ে গেছে? কিন্তু এভাবে কি আদৌ স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যায়?
নিবিড় পুলিশে কল করল। জানানো হলো অথৈ কে পাওয়া গেছে। ধীনেশ মল্লিকের সাথে ও বেশ খানিকক্ষণ এই বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনা করলো।
অথৈ এর কিছু মনে পরছে না এখনো। কিন্তু চুপচাপ শান্ত হয়ে ওদের পাশেই বসে আছে। কিছু বলছে না।
রিদ গিয়ে মণিপুরীদের সবাই কে ধন্যবাদ জানালো। ওদের মধ্যে বিষ্ণু নামের এক লোক আর দুটো মহিলা বেশ জোড়া জুড়ি করল আপ্যায়নের জন্য। যেন আজ রাতটা ওখানেই থাকে। নিবিড় কোন ভাবেই রাজি না। ওকে ডক্টর দেখানো জরুরী ভিত্তিতে দরকার।
কিন্তু ওরাও নাছোড়বান্দা। এভাবে খালি মুখে কোন ভাবেই বের হতে দেবে না। আর দুদিন পর ওদের রাসপূর্ণিমা উৎসব। কার্তিকের পূর্নিমা তিথিতে ওরা রাসপূর্ণিমা উৎসব পালন করে। এই সময়ে কেউ আসলে তাকে ফেরত পাঠানো ওদের কাছে অমঙ্গলের দেখায়।
আর যেহেতু এটা ওদের সব চেয়ে বড় উৎসব তাই অনেক বড় করেই পালন করা হবে। ওদের ধারণা অনুযায়ী অথৈ কে দেবতারা কল্যাণকর হিসেবে ওদের কাছে নিয়ে এসেছে। নয়তো বিপদে পড়া একটা মেয়ে ওদের সন্ধানেই কেন আসবে? নিশ্চয় ওদের দেবতা চায় এই উৎসবে এই মেয়েটা ওদের সাথেই উপস্থিত থাকুক। তবেই সবার মঙ্গল।
ধীনেশ মল্লিক কে মণিপুরীদের একজন তাদের এই ধারণা টা জানালো। তিনি আবার কাব্য কে ডেকে নিয়ে অনুরোধ করলেন উৎসব পর্যন্ত একটু কষ্ট করে ওদের সাথে থেকে যেতে। অগত্যা ওরা সবাই রাজি হলো উৎসবে থাকার। কিন্তু এই দুদিন এখানে থাকা সম্ভব নয়। আজকে ওরা ফিরে যাবে। আগামীকাল বিকেলে সবাই মিলে এক সাথে আসবে।
তারপর এক সাথে উৎসবে আনন্দ উপভোগ করবে।
মণিপুরীদের ওদের এই কথার বিপরীতে আর কিছু বলার রইল না। ওরাও মেনে নিল। উৎসবে উপস্থিত থাকলেই হবে। এতেই বাকিরা খুশি।
____
কেউ কেউ গল্পে মশগুল। নিবিড় এক ভাবে অথৈ এর দিকে তাকিয়েই আছে। রিদ অথৈ এর সাথে অনেক গল্প জমিয়ে ফেলেছে। দুই তিন জন মেয়ে একটু পর আসলো বিভিন্ন রকমের খাবার আর পিঠে নিয়ে। ওরা সবাই খেলো। খাওয়া শেষে আরও কিছু সময় বসে থাকলো সেখানেই। তারপর সবার কাছে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে গেল বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে।
নিবিড় গাড়ি ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে রিদ, পেছনে নীল আর কাব্য। কাব্যর কাঁধে মাথা রেখে অথৈ ঘুমিয়ে গেছে। জানালা খোলা ছিল। সাঁই সাঁই করে বাতাস আসছিল। জানালা লাগিয়ে দিল। পাহাড়ের আঁকে বাঁকে রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে তার আপন গতিতে।
বাসার কাছে আসতেই অথৈ এর ঘুম ভেঙে যায়। গাড়ি থেকে নেমে ড্রয়িং রুমে সোফায় ক্লান্তি নিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। নিবিড় কফি বানাতে যায়। সবার জন্য কফি নিয়ে আসে। এক মগ অথৈ এর দিকে এগিয়ে দেয়।
বাকিরা কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর অথৈ এর সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করছে।
নিবিড় বলল, আগামীকাল ওকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবে। এই কথা শুনে অথৈ মুখ তুলে চাইলো।
“কি বললে তুমি? ডক্টরের কাছে কেন নিয়ে যাবে আমায়? ”
“কারণ, তুমি আমাদের কাউকে চিনতে পারছ না। নিশ্চয় মাথায় ভীষণ চোট পেয়েছিলে। ”
“আমি একদম ঠিক আছি। এতটাও চোট লাগেনি। আমি ডক্টরের কাছে যাব না। নেহাত তোমাদের সাথে আমার ছবি ছিল। নিশ্চয় আমরা পরিচিত সেজন্য তোমাদের সাথে আসতে রাজি হয়েছি। নয়তো আমি কখনোই আসতাম না। ”
রিদ আরেকটু বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“সেটাই তো অথৈ। তুমি আমাদের ভুলে গেছো। এজন্য ডক্টরের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। কেন ভুলে গেলে সেটা তো আমাদের জানতে হবে নাকি? ”
অথৈ চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। মাথা যন্ত্রণা করছে। কিন্তু কিছু বলছে না।
“আমি ডক্টরের কাছে যাব না বললাম তো। ”
“কেন যাবে না? এমন জেদ করছো কেন তুমি? ”
নিবিড়ের কথা শুনে অথৈ এর মাঝে কি হয় ওর বুঝে আসে না। রাগে কফির মগটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। আশেপাশে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেলছে। আচমকা ওর এই আচরণে সবাই ভয় পেয়ে যায়।
কাব্য অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের দিকে। এই ছেলেটা কেমন ভাবে ভালোবাসে অথৈ কে ওর বোঝার আর বাকি নেই। ভেতরে ওর রক্তক্ষরণ হয়ে যাচ্ছে। সেটাও ও বুঝতে পারছে।
অথৈ আরও কিছু জিনিস ভাঙ্গে। তারপর চিল্লাচিল্লি করতে থাকে।
“আমি বলেছি ডক্টরের কাছে যাব না। মানে যাব না। জোর করলে আমি আবার যেখানে মন চায় চলে যাব। বুঝেছো তোমরা? ”
অথৈ চিল্লাচিল্লি করে একটা রুমে চলে যায়।
ওরা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। নীল আফসোস করতে থাকে।
“এই হাসি খুশি মেয়েটার হঠাৎ কি হয়ে গেল বলতো? এবার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে আমার। ”
রিদ আর কাব্য মিলে রুমের ভাঙ্গা সব কাঁচ আর জিনিস গুলো তুলে ফেলে দিয়ে আসে।
রাতে সবাই চিন্তায় চিন্তায় জেগে থেকে ভোরের দিকে সোফাতেই ঘুমিয়ে যায়।
_____
অথৈ এর ঘুম ভাঙ্গে সকাল ৯টায়। উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙ্গে। হাই তুলে পাশে তাকিয়ে দেখে টমি পিট পিট করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
ওকে কোলে তুলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা চুমু খায়। তারপর ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। নিবিড় আর রিদ রান্নায় ব্যস্ত। কাব্য সোফায় এখনো ঝিমাচ্ছে। নীল বসে বসে কি সব ভাবছে। অথৈ এসেই একদম স্বাভাবিক ভাবে সবাই কে গুড মর্নিং জানায়।
সবাই হকচকিয়ে যায় এমন স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে। ওদের কে আরেক দফা চমকে দিয়ে অথৈ সোফায় ধপাস করে বসে নিবিড় কে চিল্লিয়ে ডাকে।
“নিবিড় এক কাপ চা দিয়ে যেও প্লিজ। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে আমার। ”
নিবিড় আর রিদ এই কথা শুনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসে।
“এই অথৈ, তোমার সব কিছু মনে পড়ে গেছে? আমাদের চিনতে পারছো তুমি? ”
অথৈ যেন ওদের কথা শুনে আকাশ থেকে পরলো।
“চিনতে পারছি মানে কি? এমন অদ্ভুত কথা বলছো কেন? ”
কাব্যর ঘুম ছুটে গেছে। ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
“আশ্চর্য! কাব্য ভাইয়া, তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? তোমাদের মাথা কি খারাপ হয়ে গেল? ”
“মানে কি? গতকালকের কথা তোর মনে নেই? তুই রাতে ভাঙ্গচুড় করলি কিচ্ছু মনে নেই? এটা কিভাবে সম্ভব? ”
অথৈ খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে।
“তোমাদের সবারই কি হয়েছে বলো তো। কি সব বলে যাচ্ছো আবোল-তাবোল। আমাদের না ট্যুরে যাওয়ার কথা ছিল? কবে যাবে শুনি? ”
ওর এমন স্বাভাবিক আচরণ দেখে নিবিড় সবাই কে এই টপিক বাদ দিতে বলে। সবাই এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যায় আপাতত। অথৈ ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আদৌ কি গতকাল এমন কিছু হয়েছিল? কই, ওর তো মনে পড়ছে না কিছু?
কাব্য এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“এখন কেমন আছিস তুই? ”
“অনেক ভালো আছি ভাইয়া। কিন্তু হঠাৎ এভাবে বলছো যে? ”
কাব্য কিছু বলে না। শান্ত দৃষ্টি তে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসে। অথৈ ও আর কিছু বলে না।
রিদ এসে জিজ্ঞেস করে,
“এই অথৈ, তোমার কি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? ইচ্ছে হলে বলো আমি ঝটপট এখনি বানিয়ে দেব। ”
রিদের কথা শুনে অথৈ খুশি হয় ভীষণ। খুশিতে চোখ মুখ চিকচিক করে ওঠে।
নিবিড়ের এবার শান্তি লাগছে অনেক টা। মনে হচ্ছে কলিজাটা ফিরে আসলো। অথৈ এখন আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছে। এটা ভালো দিক। তবুও একদিন ওকে রাজি করিয়ে ডক্টর দেখানো দরকার। সমস্যা টা আসলে কি সেটা জানা প্রয়োজন। আর অথৈ রোজ ওর মায়ের সাথে কথা বললেও ফোনে কোনো নাম্বার কেন ছিল না। এই রহস্যটা জানা প্রয়োজন।
____
চলবে
১১
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
ভোরের দিকেই নিবিড়ের মা মিসেস রেহেনা এবং ওর ছোট বোন নবনী চলে আসে বাসায়। অনেক দিন পর মনে হচ্ছে বাসাটা একটু ভর্তি ভর্তি। নিবিড়ের মা আর বোনের সাথে রোজই ভিডিও কলে অথৈ এর কথা হতো।
বেশ ভালো সম্পর্ক ওর সবার সাথেই। মিসেস রেহেনা কে অথৈ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।
নবনী তো অথৈ কে কাছে পেয়ে ভীষণ খুশি। ওদের গল্পের ভান্ডার শেষ হচ্ছে না কোন ভাবেই। নিবিড়ের ও সবাই কে এতদিন পর কাছে পেয়ে ভালো লাগছে।
মিসেস রেহেনা ছেলে কে জড়িয়ে ধরে থাকলেন কিছুক্ষণ। কপালে চুমু খেলেন আলতো করে।
ওর মা হাসলেন ছেলের কথা শুনে। নবনী এসে ভাই কে বলল,
“এই ভাইয়া, তোরা নাকি মণিপুরীদের রাস উৎসবে যাবি? ”
“যাব তো। তুই খুশি হচ্ছিস কেন? তোকে তো নেব না। ”
“মানে কি ভাইয়া? আমাকে নিবি না কেন? ”
নিবিড় হাসতে থাকে। নবনী আরও রেগে যায়।
“এই অথৈ আপু, দেখো ভাইয়া কি বলে। আমাকে নাকি নেবে না তোমাদের সাথে। ”
“তোমার ভাইয়ের কথা শুনছে কে শুনি? আমরা সবাই যাব। তোমার ভাইয়াকেই নেব না। ”
এগুলো নিয়েই ওরা অনেক্ষণ মজা করে সময় পাড় করে দেয়।
_____
কাব্যরা সবাই বিকেলের দিকে চলে আসে নিবিড়দের বাসায়। নীল আসার সময় নবনী আর অথৈ এর জন্য দুটো মণিপুরী শাড়ি ও কিনে নিয়ে এসেছে। শাড়ি পেয়ে তো ওরা দুজন ভীষণ খুশি। রেহেনা ওদের দুজন কে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেয়। শাড়ি পরা শেষে দুজন কে একদম মণিপুরীদের মতো করে সাজিয়ে দেন তিনি। রুম থেকে ওরা দুজন নিচে নেমে আসে। কাব্য, নীল, রিদ সবাই অনেক প্রশংসা করলো। এত প্রশংসা পেয়ে তো নবনী আর অথৈ আইসক্রিমের মতো গলে যাচ্ছে।
নবনী নিবিড়ের দিকে এগিয়ে যায়। ওর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।
“এই ভাইয়া বল তো আমাকে কেমন লাগছে? ”
নিবিড় বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সুন্দর করে হেসে উত্তরে বলল,
“চাঁদ কিন্তু একদম তোর মতো সুন্দর। ”
নবনী এই কথায় এত খুশি হয় যা বলার মতো না। ওর ভাইটা আসলেই সবার থেকে আলাদা। কি সুন্দর করে সব সময় প্রশংসা করে। নিবিড় জানে তার বোনের কিসে আনন্দ। এত সুন্দর কথা শুনে নবনীর আনন্দে শেষই হচ্ছে না।
তবুও সে বাকিদের সামনে গিয়ে ও বলে,
“এই ভাইয়া তোমরা বলতো আমাকে সুন্দর লাগছে
না? ”
রিদ ওর মাথায় দুম করে একটা মেরে দেয়।
“কখন থেকে বলছি তোকে সুন্দর লাগে। তবুও আবার জিজ্ঞেস করছিস। কি ন্যাকা রে তুই নবনী। ”
নবনী খিলখিলিয়ে হাসে। বাকিরা ও হাসে। নিবিড় সবার অগোচরে অথৈ এর দিকে তাকায়। কি সুন্দর মেয়েটা! অথৈ ও যেন আজ একটু অন্যদিনের তুলনায় লাজুক ভাবে তাকিয়ে আছে। বেশি কথা বলছে না। আগের সেই চটপটে স্বভাব টা আজকে ঠিক নেই। সারা মুখ জুড়ে লজ্জা লজ্জা একটা আভা ছড়িয়ে আছে। সবার সাথেই সে হাসি মুখে কথা বললেও নিবিড়ের দিকে ঠিক ভাবে তাকাচ্ছে না।
এই বিষয়টা কাব্য ও খেয়াল করে। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে ওর ঠোঁটে ও একটা হাসির রেখা দেখা দেয়।
সবাই মিলে বেড়িয়ে পড়ে বাসা থেকে।
রাসলীলা উৎসবের দুটি পর্ব। দিনের বেলায় রাখালরাস আর রাতে মহারাস। ওরা ভেবেছিল সকালে যাবে। কিন্তু সকালে আর যাওয়া হয়নি। তাই রাতের মহারাস দেখার জন্য বিকেলে বের হয় সবাই মিলে।
রাখালরাস উৎসবে মূলত, কৃষ্ণের বাল্যকালে মাঠে মাঠে বাঁশি বাজিয়ে ধেনু চড়াবার মুহূর্তগুলো অনুকরণ করা হয়। গোষ্ঠলীলাকে ‘রাখালনৃত্য’ বা ‘রাখালরাস’ বলা হয়ে থাকে। রাখালরাসের শুরুতে বালক কৃষ্ণ, বলরাম আর সখাদের গোচারণে যাবার অনুমতি দিতে গিয়ে মায়েদের অশ্রুমাখা বিলাপ গীত-মুদ্রায় রূপায়িত হয়।
রাসলীলার বিভিন্ন আঙ্গিক ও মুদ্রা সমন্বয়ে নৃত্যে ব্যাপকতা ও সাবলীলতা থাকে। এ নৃত্যে পোশাকের মধ্যে তেমন কোনো বাহুল্য থাকে না। গোপীরাও শ্রীরাধার পোশাক, মাথায় চূড়ার ওপর ‘ককনাম’, মুখে পাতলা সাদা কাপড়ের ঢাকনা ‘মেইকুম’, গায়ে রেশমি ব্লাউজের ওপর জড়ানো সাদা লংকথ ‘থারেং’ ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া ছোটখাট বিভিন্ন সামগ্রীর ব্যবহার বিশেষ করে চন্দন, ধূতিসহ পায়ে নূপুর ব্যবহার নৃত্যকে কমনীয়, আকৃষ্ট ও মোহাবিষ্ট করে তোলে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাঝে মাঝে স্বর্ণালংকারও ব্যবহার করা হয়।
মাধবপুর ও আদমপুরে রাসমেলার আয়োজকরা জানান,
“মহারাস লীলার মূল উপস্থাপনা শুরু হবে সকাল ১১টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালক বেলাকে উপস্থাপন করা হবে। এতে থাকবে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। রাসনৃত্য ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত চলবে। রাসনৃত্যে গোপিনীদের সাথে কৃষ্ণের মধুরলীলার কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তুলবেন শিল্পীরা। ”
ওরা সবাই সেখানে পৌঁছাতেই মণিপুরীদের এক দল ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসলো। ওরা এসেছে দেখে সবাই খুব খুশি। দুটো ছেলে ছুটে গিয়ে মোড়া নিয়ে আসলো। ওদের কে বসতে দিল। ৩-৪ জন মেয়ে ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই হরেক রকমের পিঠা সাজিয়ে নিয়ে এসে ওদের সামনে দিল। আপ্যায়ন এর কোনো ত্রুটি তারা রাখছে না। অথৈ আর নবনীর এই ব্যাপার গুলো অনেক ভালো লাগছে।
একটু পর পরই অথৈ নীল কে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে। নীল সুন্দর করে সব কিছু ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
রাতের দিকে শুরু হলো রাসনৃত্য। অনেক কিশোরীরা দল বেঁধে সুন্দর করে নৃত্য করছে। বাকিরা দেখছে। আশেপাশেই খাবারের দোকান বসেছে বেশ কিছু। শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসা আশেপাশের অনেক পর্যটকরা এই উৎসব দেখতে চলে এসেছে এখানে। সবাই বেশ ভালোই মজা করছে। সুন্দর মূহুর্তটা উপভোগ করছে।
তিনটা মেয়ে এসে অথৈ আর নবনী কে ওদের সাথে টেনে নিয়ে গেছে নৃত্য করার জন্য। সুন্দর ভাবে সবাই হাতে হাত ধরে, মাঝে মাঝে আরও অন্য রকম ভাবে নৃত্য করছে। দেখতে চমৎকার লাগছে। এখানকার মেয়ে না হয়েও অথৈ নিজেকে সব সময় সব কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে। ওর এই স্বভাবটাই বাকিদের মুগ্ধ করে ফেলে।
নিবিড় পুরো সময়টুকু শুধু অথৈ এর দিকেই তাকিয়ে আছে। অথৈ ও কখন বেখেয়ালি হয়ে নৃত্য করতে করতে এক সময় সবার মাঝে থেকে এসে নিবিড়ের এক হাত চেপে ধরে রেখেছে ওর খেয়াল নেই সেটা।
কাব্য নিবিড়ের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
“দোস্ত, তুই কিন্তু প্রেমে উল্টে পরেছিস সেটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। এবার প্রপোজটা করে ফেল ঝটপট। বেশি সময় নিস না। ”
কথা শেষ করেই কাব্য মুখ টিপে হেসে অন্য পাশে চলে গেল ফোন টিপতে টিপতে। নিবিড় অবাক হয়ে কাব্য কে দেখে। এই ছেলেটা কিভাবে যে ওকে এতটা বোঝে নিবিড়ের মাথায় আসে না। পরক্ষণেই কাব্যর কথা গুলো সে ভাবে। আসলেই কি ওর বলে দেওয়া উচিত এবার?
_____
কাব্য কল রিসিভ করেই ধমকে ওঠে,
“পৃথা, সমস্যা কি তোমার? বার বার কল দিয়ে এত বিরক্ত করো কেন আমায়? ”
“তোমার খোঁজ নিতেই কল দেই। একটু ভালো করে কথা বললে কি হয় বলো তো। সব সময় এমন কেন করো আমার সাথে তুমি? ”
“কেন এমন করি সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। আমি আগেও বলেছি এখন ও বলছি আমি কখনো বিয়ে করব না। আমার বিয়ে করার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে কখনোই হয়নি। আর যদি আমি বিয়েই না করি। তবে তোমার সাথে এমনি প্রেম করে আমার লাভটা কি? আমি এসব টাইম পাসের মতো স্টুপিড কাজে নেই। ”
“কাব্য, আমি তো তোমাকে বলিনি আমায় বিয়ে করতে। টাইপ পাস ও করতে বলছি না। আমাকে শুধু একটু সময় দিও মাঝে মাঝে। তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে আমার। নিঃসঙ্গ মুহূর্ত গুলো আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। প্লিজ আমায় এতটা অবহেলা করো না তুমি। ”
“আমি চাইছি না তোমাকে কষ্ট দিতে। তাই ভালো হয় যদি শুরুতেই তুমি আমাকে ভুলে যাও। বোঝার চেষ্টা করো পৃথা। ”
“আমাকে নিয়ে তোমায় ভাবতে বলিনি আমি। ভালোবাসতে ও বলিনি। শুধু একটু সময় চাই। মাঝে মাঝে কল দিলে ৫ মিনিট কথা বলবে। এতটুকুই তো। বেশি কিছু তো চাইছি না। ”
কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নারী সঙ্গ তার কখনোই পছন্দ ছিল না। প্রেম থেকে সব সময় দূরে থেকেছে। অনেক মেয়েরাই তাকে চাইলেও কখনো সে পাত্তা দেয়নি। তবে পৃথা মেয়েটা বাকিদের থেকে আলাদা। ওর কোন চাওয়া পাওয়া নেই। চাওয়া বলতে একটু সময়। তাতেই সে সন্তুষ্ট। এমন মেয়েদের আসলে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না। পুতুলের মতো সাঁজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাব্যর ঠিক সেই অনুভূতি টা কাজ করে না। আর অনুভূতি ছাড়া কখনো কোন সম্পর্কে জড়ানো ও যায় না। জোর করে গেলানোর মতো অবস্থা।
_____
ওদের জন্য আবার রাতে খাবারের আয়োজন করে কয়েকজন। এত মানুষ আর উৎসবের মধ্যে ও ওদের কথা যে এরা মনে রেখেছে সেটা ভাবতেই অথৈ এর ভালো লাগছে। সব ব্যস্ততার মাঝেও আপ্যায়ন এর কমতি রাখছে না। মণিপুরীদের এই আতিথেয়তা বেশ চমৎকার।
কাব্যরা এগুলো সম্পর্কে জানলেও অথৈ এর এসব জানা নেই। তাই ও একটু বেশিই অবাক হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আনন্দ ও লাগছে অনেক।
চাকমাদের মতো মণিপুরীরাও খাবারে তেল ও মশলার ব্যবহার করে না বললেই চলে। প্রাত্যাহিক জীবনে মণিপুরীরা আঠালো ভাতের সঙ্গে সেদ্ধ সবজি এবং বিভিন্ন রকমের ডাল দিয়ে তৈরি ‘খার’ খায়। খার তৈরিতে ডালের সঙ্গে আদা পাতা, হলুদ পাতা, লেবু পাতা দেওয়া হয়। এরপর তাতে কলাগাছ পুড়িয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে ছাই দেওয়া হয়, যা খারে ব্যতিক্রমধর্মী এক ফ্লেভার যোগ করে। তাদের প্রতিবেলা ভাতের সঙ্গে থাকা আরেকটি সবজি তরকারি হচ্ছে ‘পালটৈ’।
মণিপুরীদের খাদ্য তালিকায় মাংস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল।
পরবর্তীতে চৈতন্যের আদর্শে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণের পর থেকে তারা তা পরিহার করে। মণিপুরীদের যেকোনো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই খাওয়া-দাওয়ার একটি পর্ব থাকে। যাকে ‘বান্দারা’ বলে। বান্দারায় মণিপুরীদের বিশেষ সালাদ ‘চিনচু’ বেশ সমাদৃত। এছাড়াও ভর্তা ও ডাল জাতীয় খাবার এদের বিশেষ পছন্দের। বিভিন্ন উৎসবে মণিপুরীরা এক বিশেষ মাছের তরকারি রান্না করে, যা ‘নাগা’ বলে পরিচিত।
নীল অথৈ কে জিজ্ঞেস করে,
“খাবার মুখে দিয়ে বলতো কেমন মজা? ”
অথৈ অল্প ভাতের সাথে এক টুকরো মাছ মুখে নেয়। ধীরে চিবিয়ে সুন্দর করে ওইটুকু শেষ করে। তারপর সেদ্ধ সবজি আর ডাল দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে নেয়। এরপর মিষ্টি মুখ করে। সব একটু একটু করে খেয়ে একদম মুখের ভাবভঙ্গি সুন্দর ভাবে প্রকাশ করে। এর মানে সবাই বুঝে যায়। খাবার টা ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
ওরা রাতের খাবার শেষ করে দেখতে পায় আরও কিছু ভিন্ন রকমের উৎসবের আমেজ। এগুলো করতে করতে রাত প্রায় শেষের দিকে। তখন একজন আসলো নিবিড়দের আজকের রাতটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। পরেরদিন সকালে উঠে ওরা এখানে থেকে চলে যাবে।
একটা ঘরে নবনী আর অথৈ। আরেক ঘরে ছেলেরা।
ওরা দুজন তো গল্পে মশগুল হয়ে গেছে। সারাদিনে কত মজা করলো। এই নৃগোষ্ঠীদের উৎসব আয়োজন সব মিলিয়ে গল্প যেন শেষই হচ্ছে না ওদের। রাত পেরিয়ে কখন ভোর হয়ে যায় কারোর খেয়ালই নেই।
____
চলবে
৯
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
______
আজ ৫ দিন ধরে অথৈ নিখোঁজ। নিবিড়ের অবস্থা ভয়াবহ রকমের খারাপ। কাউকে সহ্য করতে পারে না। কেউ সামনে আসলেই চিল্লাতে থাকে। আর রাত বাড়লেই খুঁজতে খুঁজতে না পাওয়ার পর মেয়েদের মতো হু হু করে কেঁদে ওঠে। মনের মধ্যে সব সময় খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আশার আলো না থাকা সত্ত্বেও আশা ছাড়তে কেউ পারছে না।
আজকে পুলিশ জানিয়েছে শ্রীমঙ্গলের ওই দিকে অথৈ এর খোঁজ পাওয়া গেছে কিছুটা। এখন সেখানে পৌঁছাতে পারলেই বাকি খবর জানা যাবে। নিবিড় সবাই কে রেখেই বেড়িয়ে পরেছিল। পরে নীল, কাব্য আর রিদ ওর পিছু নিয়ে ওর সাথে যাচ্ছে আবার। পাগলের মতো গাড়ি ড্রাইভ করছিল। এই অবস্থা দেখে কাব্য ওকে সরিয়ে নিজে ড্রাইভ করতে থাকে।
নিবিড় চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে যাচ্ছে আজকে যেন ওকে নিরাশ হয়ে কোন ভাবেই না ফিরতে হয়।
মনের সকল খারাপ চিন্তা দূরে রেখে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কি হবে ভেবে পাচ্ছে না কেউ।
_____
দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ শ্রীমঙ্গল। চা শিল্পের জন্য শ্রীমঙ্গলের সুনাম ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপি। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২শ’ কি.মি. দূরত্বে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রকৃতির আদুরেকন্যা, সুবিশাল পাহাড়ের পাদদেশে আর হাইল-হাওরের পিঠে ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভাসহ উপজেলা শ্রীমঙ্গলের অবস্থান। চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলের আয়তন ৪২৫.১৫ বর্গকিলোমিটার। পাহাড়, অরণ্য, হাওর আর সবুজ চা বাগান ঘেরা নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীমঙ্গল। প্রকৃতির সুরম্য নিকেতন শ্রীমঙ্গলে দেখার আছে চা বাগানের পর চা বাগান, চা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, লাউয়াছড়া রেইনফরেস্ট, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ, চা গবেষণা কেন্দ্র, লাউয়াছড়া ইন্সপেকশন বাংলো, খাসিয়াপুঞ্জি, মণিপুরীপাড়া, ডিনস্টন সিমেট্রি, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান নির্মাই শিববাড়ি, টি-রিসোর্ট, ভাড়াউড়া লেক, পাহাড়ি ঝর্ণা, চারদিকে প্রকৃতির নজরকাড়া সৌন্দর্য আর হাজারো প্রজাতির গাছ-গাছালি। শ্রীমঙ্গলের পাদদেশে অবস্থিত এককালে বৃহত্তর সিলেটের মৎস্যভান্ডার বলে খ্যাত ‘হাইল-হাওর’ এবং শীতের শুরুতে সাত-সমুদ্র-তেরো-নদী পার হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে আসা শীতের পাখি।
শ্রীমঙ্গলের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত স্বতন্ত্র স্বত্বার উপজাতি জনগোষ্ঠী খাসিয়া, মণিপুরী, ত্রিপুরা ও গারোদের জীবনাচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কারণেও এ অঞ্চলের নাম অনেকের কাছে সুপরিচিত। তাছাড়াও চা, রাবার, লেবু, পান, আনারস ও মূল্যবান কাঠ ইত্যাদি নানা কারণে শ্রীমঙ্গলের প্রসিদ্ধি রয়েছে সর্বত্র। প্রকৃতিই শ্রীমঙ্গলের প্রাণ। ভ্রমণবিলাসীদের কাছে এ এলাকাটি যেন তীর্থস্থান – প্রকৃতিপ্রেমীদের আপন নীড়। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদভারে বছরের প্রতিটি দিন মুখরিত থাকে শ্রীমঙ্গল। আর এ কারণে শ্রীমঙ্গলে গড়ে ওঠেছে অনেক আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরা। সরকারি, আধা-সরকারি সংস্থার একাধিক রেস্টহাউজ ও চা বোর্ড পরিচালিত একটি ‘টি রিসোর্ট’। এ জনপদের সঙ্গে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে সারাদেশের। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীমঙ্গল আকৃষ্ট করেছে অগণিত পর্যটককে।
দেশের পাহারী ও ঘন বনাঞ্চল এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয় আর শ্রীমঙ্গলে পাহাড় ও ঘন বনাঞ্চল থাকায় এখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ও শীত পড়ে। আর চা চাষ উপযোগী অন্যান্য উপাদানের সাথে প্রধান এ উপাদান গুলোর জন্য দেশের সবচেয়ে বেশি চা বাগান গড়ে উঠেছে মৌলভীবাজার জেলায়। দেশের ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে এ জেলায় পড়েছে ৯১ টি চা বাগান।
শ্রীমঙ্গল জায়গাটা ওদের সবার এত পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও আজকে কারোর দৃষ্টি এই প্রকৃতি তে নিবন্ধ হচ্ছে না। এই প্রকৃতি আজকে ওদের মুগ্ধ করতে পারছে না কোন ভাবেই।
গাড়িটা মল্লিক বাড়ির সামনে এসে থামলো। ভেতর থেকে একজন লোক এসে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল কাকে চাই?
কাব্য এসে কথা বলে,
“ধীনেশ মল্লিক কি বাসায় আছেন? আমরা ওনার সাথে দেখা করতে এসেছি। ”
“আজ্ঞে, কত্তা মশাই ঘরেই আছেন। আপনেগো আসার অপেক্ষাতেই তিনি বইসা আছে। ভেতরে আসেন। ”
ওরা সবাই ভেতরে চলে যায়। বারান্দায় একজন ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক লোক বসে আছেন। ওরাও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। ধীনেশ মল্লিক সামনের চেয়ার দেখিয়ে ওদের বসতে বললেন। গৃহকর্মী কে বললেন চা দিয়ে আসতে। ওরা মানা করা সত্ত্বেও তিনি শুনলেন না।
“বাবা, তোমরাও তো সিলেটেরই মানুষ। জানোই তো আমরা আপ্যায়ন করতে ভালোবাসি। প্রথম আসছো। বসো, চায়ে চুমুক দিতে দিতে মূল কথায় আসা যাক। ”
চা নিয়ে আসলো। ধীনেশ মল্লিক চা এগিয়ে দিলেন। তারপর কথা শুরু করলেন।
“গত পরশু খবরের কাগজ খুলে তোমাদের ওই বিজ্ঞপ্তি টা চোখে পরলো বুঝলে? তো মেয়েটার ছবি দেখতেই আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল। অনেক্ষণ ভাবলাম কোথায় যেন দেখেছি। পরে মনে পরলো, আমি প্রায়ই পাহাড়ের ওই দিকে যেখানে খাসিয়া, মণিপুরীরা থাকে সেখানে যাই। ওদের সাথে গল্প সল্প করি। আমাকে আবার ওরা খুব সম্মান করে তো এই জন্য। বয়স্ক মানুষ। তাই ওদের সঙ্গ পেলে আমারও খুব ভালো লাগে। ওই সেদিন যখন গেলাম। কিছু মণিপুরী মেয়েদের সাথে আমি আরেকটা মেয়েকে দেখেছি। মণিপুরীদের মতো পোশাক পড়াই ছিল। কিন্তু তবুও এক ঝলক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মেয়েটা ওদের জাতের কেউ না। খুব ভদ্র, শান্ত একটা সুন্দর মুখশ্রী। এক নজরেই বোঝা যাচ্ছিল শহরের কোন মেয়ে।
তাই ওদের আমি জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটা কে। কিন্তু ওরা কোন উত্তর দিল না। মেয়েগুলো এক নজর তাকিয়ে ওকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। পরে আরেকজন কে জিজ্ঞেস করতেই বলল, মেয়েটা নাকি অজ্ঞান হয়ে পাহাড়ের ঢালু তে পড়েছিল কিছুদিন আগে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চোট পেয়েছিল। পরে ওরা নিয়ে এসে ওদের বিভিন্ন জড়িবটি দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছে। দুদিন কোন হুশ ছিল না। আর জ্ঞান ফেরার পর ও কিছু বলছে না। ওদের বললাম পুলিশে জানাতে হবে। কিন্তু কেউ রাজি হলো না সেদিন।
আর পরশুদিন খবরের কাগজ খুলতেই তোমাদের বিজ্ঞপ্তি দেখে বুঝলাম এই সেই মেয়ে। তাই সেখানে দেওয়া নাম্বারে কল করলাম। কল দিয়ে তোমাদের না পেয়ে পুলিশে জানালাম। ”
ধীনেশ মল্লিক কথা শেষ করতেই নিবিড় গিয়ে ওনার হাত চেপে ধরেন। উত্তেজনায় অনেক্ষণ কথাই বলতে পারলো না। চোখের পানি তার হাতের উপর পরলো। মাথাটা তুলে ওনার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দাদু, আপনি আমার কত বড় উপকার করলেন ভাবতেও পারছেন না। এভাবে অচেনা হয়েও আমার প্রাণটা ফিরিয়ে দিয়েছেন আপনি। আমি আমৃত্যু আপনার কাছে ঋণী থাকব। ”
ধীনেশ মল্লিক নিবিড় কে ধরে দাঁড় করালেন। কাধ চাপড়ালেন।
“আরে পাগল, দাদু ডেকেছ না? তবে আর ঋণ কিসের? এটা তো আমার দায়িত্ব ছিল। একটা মেয়ে হারিয়ে গেছে। তাকে দেখে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব না? সেটা কখনো হয়? এখন আমার সাথে চলো। তোমাদের ওদের ওখানে নিয়ে যাই। ”
ওরা সবাই বের হলো। পাহাড়ের এই দিকে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই হেঁটেই যাচ্ছিল। আর তিনি বললেন বেশি দূরে ও না। নিবিড়ের এখনো উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে।
তারপর আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে ওরা মণিপুরীদের বাসস্থানে চলে আসলো। ধীনেশ মল্লিক একজন কে ডাকলেন। ডেকে বললেন মেয়েটা কে বাইরে নিয়ে আসতে। সেই লোকটা এক নজর ওদের সবাই কে দেখল। তারপর ভেতরে গিয়ে একজন কে বলে আসলো মেয়েটা কে নিয়ে আসতে।
নিবিড় চোখ বন্ধ করে আছে। আবার মনের মধ্যে কু ডাকছে। এটা ওর অথৈ যদি না হয়? কি হবে তখন?
অতঃপর দেখলো, ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো মণিপুরীদের শাড়ি পরা মণিপুরীদের সাঁজের একটা মেয়ে। একটা মিষ্টি পুতুলের মতো দেখতে। নিবিড়ের হার্টবিট কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল। গলা শুকিয়ে আসলো।
ওর হঠাৎ কি হয়ে গেল জানা নেই। ছুটে গিয়ে অথৈ কে বুকের মধ্যে চেপে জড়িয়ে ধরে। যেন একটু আলগা হলেই ওকে আবার হারিয়ে ফেলবে।
বাকিরা ওদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এমন দৃশ্য কোনদিন দেখা হয়নি।
ছোট ছোট বাচ্চারা ওদের চারপাশে ভীড় জমিয়েছে। এখানে কি হচ্ছে সেটা দেখতে। উঠতি বয়সের কিছু রমণী এই ভাবে জড়িয়ে ধরা দেখে মুখ চেপে হাসছে।
কাব্যদের ও কলিজায় যেন পানি আসলো এতক্ষণে।
কিন্তু! অথৈ আচমকা নিবিড় কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো,
“কে আপনি? ”
এই প্রশ্নে উপস্থিত সবাই হতবিহ্বল হয়ে গেল।
____
চলবে
৮
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
সকালে নিবিড়ের ঘুম ভাঙ্গে নীলের ফোন কলে। ঝটপট ওঠে পরে। আজকে ওদের ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হবার কথা। কোথায় কোথায় ঘুরবে সেটা গতরাতেই সব ঠিক করে রেখেছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়। অথৈ এর রুমের দরজার কাছে যেয়ে বাইরে থেকে কয়েক বার ডাক দিয়ে ওকে উঠতে বলে। তারপর চলে যায় বাদ বাকি সব গোছাতে।
১ ঘন্টা পর রিদ, নীল, কাব্য চলে আসে। সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। রিদ অথৈ কে দেখতে না পেয়ে ওকে ডাকতে থাকে।
“এই নিবিড় অথৈ কি ঘুম থেকে ওঠেনি নাকি। ডাকছি সাড়া দিচ্ছে না। ”
“ঘুমাচ্ছে হয়তো এখনো। আমিও ডাকলাম। এক্সাইটমেন্টে কাল সারারাত ঘুমায়নি। আমার রুমে ঘুর ঘুর করেছে অনেক্ষণ। তার জন্য হয়তো ঘুম ভাঙ্গেনি। ”
“কিন্তু বের হতে হবে তো। নয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। ”
কাব্য উঠে দাঁড়ায়। অথৈ কে ডাকতে উপরে যায়। দরজায় বেশ অনেক্ষণ নক করে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই।
“এই অথৈ, কিভাবে ঘুমাচ্ছিস। ওঠ না এবার। আজকে কিন্তু আর যেতে পারবি না দেরি করলে। ”
তবুও কোন সাড়া নেই। দরজা খোলাই ছিল। কাব্য দরজা টা খুলে ভেতরে যায়। বিছানা এলোমেলো। কিন্তু অথৈ নেই। ভাবলো হয়তো ওয়াশরুমে আছে। কিন্তু ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে দেখে বাইরে থেকে লাগিয়ে দেওয়া। তার মানে এখানে নেই। ও নিবিড় কে জিজ্ঞেস করে আবার।
“অথৈ তো রুমে নেই। কোথায় গেল? ”
“ওয়াশরুমে হয়তো গেছে। ”
“সেখানে ও তো নেই। বাইরে থেকে দরজা লাগানো। ”
“উফ! এই মেয়েটা কে নিয়ে আর পারি না। দেখ নিশ্চয় ছাদে গিয়ে বসে আছে। ”
কাব্য ছাদে যায়। কিন্তু সেখানে ও অথৈ কে দেখতে পায় না। নিচে নেমে আসে।
“নিবিড়, অথৈ ছাদেও নেই। ”
এবার নিবিড়ের খটকা লাগে। এভাবে সকাল সকাল কোথায় যাবে। না বলে তো কোথাও যায় না। আর কাব্যরা আসলেই যেখানে থাকুন না কেন অথৈ ছুটে চলে আসে। আজকে সাড়াশব্দই নেই।
“এই তোরা একটু বাকি রুম গুলো তে খুঁজে দেখ তো। আমি বাইরে দেখে আসি। ”
রিদ, নীল, কাব্য ভেতরে সব জায়গায় খুঁজতে থাকে। আর নিবিড় বাইরে যায়। বাসার আশেপাশে একবার ঘুরে দেখে। কিন্তু পায় না। তারপর চা বাগানের দিকে নেমে যায়। সেখানে ও খোঁজ করে। আবার কাব্য কে ফোন দিয়ে শোনে ভেতরে আছে কি না।
কিন্তু আশানুরুপ কোন খবর নেই। নিবিড়ের চিন্তা বাড়ছে। এখানে আসার পর একা একা কোথাও অথৈ এই পর্যন্ত যায়নি। তাই তেমন কিছু চেনেও না। আজকে কোথায় চলে গেল এভাবে না বলে। নাকি ওর বাবা খুঁজে পেয়ে নিয়ে গেছে কিন্তু এমন কিছু হলেও তো ও জানতো। আশেপাশে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করে। একে ওকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে রাস্তায় দেখেছে কি না।
বাকিরা ও বাইরে আসে। ৪ জন দুটো গাড়ি নিয়ে দুই জায়গায় ভাগ হয়ে আলাদা ভাবে খোঁজা শুরু করে। অথৈ এর ফোন ও বিছানায় ফেলে চলে গেছে। যার ফলে কল দিয়েও লাভ নেই। নিবিড়ের শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। এত চিন্তা শেষ কবে করেছিল ওর মনে নেই। এমন লাগছে যেন, খুব কাছের কেউ হারিয়ে গেছে। যাকে না পেলে ও নিঃস্ব হয়ে যাবে।
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে মাথাটা পেছনের ছিটে হেলিয়ে দেয়। নীল বুঝতে পেরে নিবিড় কে ওর পাশে রেখে ও ড্রাইভ করতে থাকে। নিবিড়ের চোখ বেয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পরে। আশেপাশের সব জায়গায় খুঁজেও আর পায় না।
সকাল পেরিয়ে দুপুর, তারপর সন্ধ্যা। সবাই ভয়ে আছে। না জানি ওর কি বিপদ হলো।
রিদ শেষে ওদের কে পুলিশে ডায়েরি করিয়ে রাখার পরামর্শ দেয়। আপাতত এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তারপর ওরা সবাই মিলে পুলিশ স্টেশনে যায়। সেখানে গিয়ে ডায়েরি করিয়ে চলে আসে বাসায়।
৪ জনই অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছে।
“তোদের কি মনে হয় অথৈ কোথায় যেতে পারে? ”
নীলের কথা শুনে কাব্য ঘুরে তাকায়।
“কিভাবে বলি বলতো? যদি ওর বাসায় চলে যাওয়ারই থাকে। তবুও তো বলে যেত। এমন তো না এখানে ওকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল আর ও সুযোগ পেয়ে চলে গেছে। আর সব থেকে বড় কথা টমি কে রেখে গেছে। যেই টমি কে ছাড়া অথৈ কিছুই বোঝে না। ”
টমি বোধহয় ওর নাম শুনে ঘার এদিক সেদিক ঘুরায়। মিউ মিউ করে। যতক্ষণ বাসায় ছিল টমি এদিক সেদিক অথৈ কে খুঁজেছে। এখন রিদের কোলের মধ্যে বসে আছে।
রাত বাড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এবার কি করবে মাথা কাজ করছে না। ওই রাতেই আবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। যেহেতু বড় গাড়ি নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। সব রাস্তায় ঢুকানো যায় না। তাই বাইক সব থেকে ভালো। টমি কে ঘরে আটকে রেখেছে। নয়তো ওদের যেতে দেখলে পিছু নেবে। আর এই বৃষ্টি তে ও ভিজলে অসুস্থ হয়ে পরবে। কাজেই চার জন বেরিয়ে পড়ে।
রাতের আধারে ঘুটঘুটে অন্ধকারেও প্রতিটা ওলিতে গলিতে খুঁজতে থাকে। বৃষ্টি তে ভিজে সবার যুবুথুবু অবস্থা। ওরা অথৈ কে নাম ধরে বার বার ডাকতে থাকে। সারারাত কোথাও না পেয়ে ভোরের দিকে বাসায় চলে আসে।
_____
ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে রোদ উঠে যাচ্ছে। এখনো কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশরা ও কোন তথ্য পায়নি। আশেপাশের যত বাজে ছেলেদের গ্যাং আছে। যারা নেশা করে সবাই কে পুলিশ ধরে নিয়ে এসে অথৈ এর কথা জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু ওরা কেউ কিচ্ছু জানে না। মূলত, কেউ ওকে চেনেই না।
নিবিড়ের মাথা ঘুরতে থাকে। চোখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কি করবে, কি বলবে ভেবে পায় না। তখনই চট করে মনে পড়ে অথৈ তো কলে ওর আম্মুর সাথে কথা বলতো। ফোন তো রেখেই গেছে। কল লিস্টে ওর আম্মুর নাম্বার থাকার কথা। সেখানে ফোন দিলেও তো জানা যাবে।
অথৈ এর ফোন টা নীলের কাছে ছিল। নীলের কাছে গিয়ে ফোন টা চায়।
“ওর ফোনটা দে তো নীল। ”
“কি করবি। ”
“দরকার আছে দে। ”
ওর ফোন নিয়ে দ্রুত ওর কল লিস্টে যায়। কিন্তু আশ্চর্য জনক হলেও অথৈ এর ফোনে ওর আম্মুর নাম্বার তো দূর কোন নাম্বারই নেই। শুধু কি সব হাবিজাবি সংখ্যা তুলে কল দেওয়া হয়েছে এই ফোন থেকে। কিন্তু এগুলো কারোর নাম্বার না। ছোট বাচ্চাদের হাতে ফোন দিলে যেভাবে এমনি একটা চাপতে চাপতে কল চলে যায় ঠিক সেই রকম।
কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? অথৈ তো প্রায়ই কলে ওর আম্মুর সাথে কথা বলতো। কলে হাসাহাসি করতো। এগুলো তাহলে কি? কার সাথে কথা বলতো ও? নাকি কথা বলা শেষে সব নাম্বার ডিলিট করে দিত। কি এক রহস্য লাগছে সব কিছু। নিবিড়ের মাথা আউলে যাচ্ছে। অথৈ তবে কার সাথে কলে বকবক করতো। এমন তো হবার কথা নয়? চিন্তা টা এবার দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
নিবিড় এই কথা আর কাউকে বলে না। চুপ করে বসে থাকে। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। জ্বর আসবে মনে হচ্ছে। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজেছে। অলরেডি রিদের জ্বরে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। নীলের সর্দি লেগে গেছে। একটু পর পর নাকের পানি মুছতে হচ্ছে। কাব্য আরেক বার পুলিশের কাছে ফোন করে। জানতে চায় কোন খোঁজ পেলো কি না। কিন্তু তারা ও কিছু বলতে পারছে না এখনো।
নিবিড় হুট করে রেগে যায়। চিল্লাচিল্লি করতে থাকে।
“পুলিশরা কোন বাল করছে তাহলে? এতজন মিলেও এখনো একটা মেয়ে কে বের করতে পারছে না। তারা কিসের নিরাপত্তা দিতে ডিউটি করে? বাল ফালাইতে? ”
ওরা সবাই নিবিড়ের এমন আচরণে চমকে যায়। কারণ, সে কখনো রাগে না। আর রেগে গেলেও নিজেকে যথেষ্ট সামলে রাখে। বাজে কোন শব্দ এই পর্যন্ত কেউ নিবিড়ের মুখ থেকে শোনেনি। কিন্তু আজ যেন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে।
কাব্য এগিয়ে আসে।
“শান্ত হ ভাই। রেগে গেলে কোন কাজ হবে না। চল আজকে আশেপাশের সব পর্যটক কেন্দ্র গুলো তে খুঁজে দেখে আসি। হতেও তো পারে ওকে আমরা খুঁজে পেলাম। ”
“আর যদি না পাই? ”
নিবিড়ের এই কথাটা কেমন যেন শোনালো। অনুভূতি শূন্য মানুষের মতো। কাব্যর বুকের মাঝে খচ করে কামড়ে উঠলো। এই একটা কথাতেই ও বুঝে যায় নিবিড় অথৈ কে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এতটা ভালোবাসে এটা বোঝেনি। কাব্য নিবিড় কে জড়িয়ে ধরে। পিঠ চাপড়ে বলে।
“ইন শা আল্লাহ খুঁজে পাবোই। চল তো এখন। ”
ওরা আবার বেরিয়ে পরে নতুন ভাবে। আবার খোঁজ শুরু হয়। এখানে ওখানে। আদৌ কি ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে? এ কেমন চিন্তায় ফেলে গেল মেয়েটা!
কাব্যের ফোন বাজছে। ফোনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই মেয়ে সব সময় এমনি এক সময়েই কল দিয়ে কাব্যর মন মেজাজ খারাপ করে দেবে। কল কেটে দিলে আবার ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আর কারোর কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে না। আপাতত মাথায় অথৈ এর চিন্তা ঘুরছে। ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। খুব দ্রুত।
____
চলবে
৭
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
____
অথৈ কলে ওর মায়ের সাথে কথা বলছে। এক ভাবে বকবক করেই যাচ্ছে। নিবিড় রুমের সামনে দিয়ে যাবার সময় একবার উঁকি দেয়। তারপর আবার চলে যায় সেখানে থেকে। নুডুলস বানিয়ে নিয়ে এসে অথৈর সামনে রাখে। টমি কে নিয়ে আবার চলে যায়।
অথৈ কথা শেষ করে চলে আসে নিচে।
রিদ কে কল করে।
“রিদ ভাইয়া, ”
“হ্যাঁ, অথৈ বলো। ”
“তোমরা না বললে আমি সুস্থ হয়ে গেলে আমায় নিয়ে ঘুরতে যাবে? ”
“হ্যাঁ, যাব তো। ”
“আমি সুস্থ এখন। চলো যাই সবাই। ”
রিদ কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে,
“আচ্ছা শুনো, আমি ওদের থেকে জেনে নেই। দেখি ওরা কবে যেতে চায়। সবারই তো ফ্রি হতে হবে তাই না? ”
“হ্যাঁ, তো। তুমি ওদের কে বলো এখনি। আমি তো নিবিড় কে ভয়ে কিছু বলতেই পারছি না। বলতে গেলেই যেভাবে তাকায়। ভয়ে আমার শরীর জমে যায় একদম। ”
অথৈ এর কথা শুনে রিদ হু হা করে হাসতে থাকে।
“নিবিড় কে এত ভয় পাও কেন তুমি? বেচারা কত কেয়ার করে তোমার। ”
অথৈ ঠোঁট উল্টায়। ভাবতে থাকে কেন সে নিবিড় কে ভয় পায়। তারপর কল কেটে ধুপ ধাপ পা ফেলে নিবিড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
নিবিড় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে।
“কি হলো, হুট করে এখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? ”
“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। ”
“বলো। ”
“আমি কিন্তু তোমাকে আর ভয় পাই না। ”
“ভয় পেলে আবার কবে? ”
নিবিড় চলে যাচ্ছিল বাইরে। অথৈ আহাম্মক হয়ে যায় যেন। ও নিবিড় কে ভয় পেতো মাঝে মাঝে এটা নিবিড় জানেই না। সেই ভেবে ওর আফসোস হচ্ছে। অবশ্য এটা ভাবার কোন বিষয়ই না। নিবিড় যেতে যেতে আবার কিছু একটা ভেবে ঘুরে আসে। অথৈ ও তখন সামনে যাচ্ছিল। আচমকা ধাক্কা লাগে দুজনের।
অথৈ চিল্লিয়ে ওঠে।
“জিম করে শরীর কি পাথর বানিয়েছো নাকি গো? এত শক্ত কেন? ”
কথাটা বলেই অথৈ নিবিড়ের হাতের পেশিতে চাপ দিয়ে পরিক্ষা করতে থাকে আসলেই এটা শরীর নাকি পাথর। নিবিড় তাকিয়ে থেকে ওর এই দুষ্টুমি গুলো দেখছে।
“দেখা শেষ তোমার? ”
অথৈ মাথা তুলে তাকায়। মাথা দু দিকে ঝাঁকায়। আবার হাতের পেশিতে চাপ দেয়। নিবিড় এবার ও কিছু বলে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,
“নুডলস বানিয়ে রুমে রেখে এসেছিলাম। খেয়েছিলে কি? ”
এই কথা শুনে ও মাথায় হাত দিয়ে এক দৌড়ে উপরের রুমে চলে যায়। নিচে থেকে নিবিড় ডাকছে।
“অথৈ, এতক্ষণে নুডলস ঠান্ডা হয়ে গেছে ওইটা আর খেতে হবে না। চলে আসো। ”
অথৈ রুম থেকে মাথা বের করে তাকিয়ে থাকে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ একজন ওর মাথা কে*টে দেয়ালে বাঁধিয়ে রেখেছে।
নিবিড়ের কথা শুনে আবার লাফিয়ে নিচে নেমে আসে।
“আমি তো ভাবলাম তুমি বকবে। ”
“বকবোই তো। এত ছোটাছুটি, লাফালাফি কিসের শুনি? ধীরেসুস্থে যেতে পারো না? সেদিনই না পরে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেলে? এমন করলে আর ঘুরতে যাওয়া হবে না বলে দিলাম কিন্তু। ”
অথৈ মুখ ভেংচি দিয়ে চলে যায়। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয়, তুমি না নিয়ে গেলেও কাব্য ভাইয়া আমাকে নেবেই। হুহ!
_____
কাব্য পরের দিন সকালে অথৈ কে ডাকতে থাকে। ও নিচে নেমে আসে।
“চল শপিং এ যেতে হবে। ”
“কেন? ”
“তোর কি কি কেনাকাটা আছে করে নিবি। ”
“আমার তো সব কিছুই আছে। ”
“গা*ধী, ঘুরতে যাব আমরা ২ দিন পর। তাই আরও কিছু কিনবি। ”
“কিহ! সত্যি আমরা ঘুরতে যাচ্ছি? ”
“হ্যাঁ, চল এবার। ”
অথৈ গাড়িতে উঠে পরে।
“নিবিড় কে বললে না যে। যদি বকে? ”
“বলতে হবে না। ও জানে তুই আমার সাথে আছিস। ”
“আমরা কোথায় ঘুরতে যাব? ”
“সেটা পরে বলব। আগে সিলেটের আশেপাশের জায়গা গুলো তে তোকে ঘুরতে নিয়ে যাব। পরে এক সময় বাইরে কোথাও আমরা সবাই মিলে যাব। ”
অথৈ আঁতকে ওঠে প্রথমে। তারপর খুশিতে হাত-পা ছুড়ে নাচতে শুরু করে গাড়ির মধ্যেই। ওর নাচানাচি দেখে টমি ও গাড়ির মধ্যে লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করে দেয়। কাব্য হেসে ওঠে।
“থাম রে এবার। নয়তো তোর এই লাফ ঝাঁপের চক্করে এক্সিডেন্ট করে ফেলব। ”
অথৈ থেমে যায়।
“এই ভাইয়া আমার হাতে চিমটি কাটো তো একটা। ”
“কেন তোর কি বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি। ”
“উহু, হচ্ছে না তো। ”
“সত্যি সত্যি যাচ্ছি ইন শা আল্লাহ। ”
“ইয়েএএএ! দারুন মজা হবে কিন্তু। ”
“তুই দেখলে একদম অবাক হয়ে যাবি। এত সুন্দর জায়গা। ”
“আসলেই? ”
“হ্যাঁ, ”
“এমনিতেই তো তোমাদের সিলেট শহরটা অনেক সুন্দর। ”
“সিলেটের সব সুন্দর জায়গা তোকে দেখাবো। একদম পাগল হয়ে যাবি। ”
অথৈ আরও খুশি হয়। আনন্দ গুলো প্রকাশ করবে কিভাবে ভাবতে পারে না।
_____
অথৈ নিবিড়ের সব পোশাক ভাজ করে ব্যাগে রাখা দেখছে দাঁড়িয়ে। কি সুন্দর করে শার্ট ভাজ করে। অথচ ও সব জামা কাপড় একদম দলাই মলাই করে রেখে দেয়। আজকে অবশ্য নিবিড় ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে। এই শীতে ও নিবিড় ঘেমে যাচ্ছে। টি-শার্ট অর্ধেক ভেজা। অথৈ এর মনে হচ্ছে চোখ দুটো নিবিড়ের দিকে টানছে।
“এভাবে তাকিয়ে কি দেখো? ”
“কই কিছু না তো। ”
নিবিড় ওর দিকে এগিয়ে আসে। দুষ্টমি করে বলে,
“পুরুষ মানুষ কি আগে কখনো দেখনি তুমি? ”
অথৈ ও বা কম যাবে কেন? সে ও চোখ টিপে আরেক দফা দুষ্টুমি করে।
“পুরুষ মানুষ তো অনেক দেখেছি জনাব। কিন্তু এমন সুদর্শন পুরুষ তো আর কোনদিন দেখিনি। ”
নিবিড় জোরে হেসে ফেলে।
“ফাজলামি রাখো। যাও গিয়ে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো। গলা শুকিয়ে গেছে। ”
“এই শীতে কারোর গলা শুকায়? ”
“দেখছো না ঘামে ভিজে গেছি? ”
অথৈ গ্লাসে পানি ঢালে। কি মনে করে যেন ওই গ্লাস থেকে অল্প পানি খেয়ে নিবিড়ের জন্য নিয়ে যায়। নিবিড় ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পানি শেষ করে। পানি খাওয়ার সময় যখন নিবিড়ের কণ্ঠনালী উঠানামা করছিল। তখন সেই দৃশ্য দেখে অথৈর আবার গলা শুকিয়ে যায়।
বার বার ভাবতে থাকে, নিবিড় কে দেখে ওর এমন কেন লাগে। প্রেমে পরে যাচ্ছে নাকি। কি সর্বনাশ!
নিবিড় বুঝার চেষ্টা করে অথৈ এর মনের অবস্থা। ওর ভেতর কি চলছে সেটা। আদৌ কি অথৈ ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছে? নাকি নিবিড়ের ভ্রান্ত ধারণা সবটা।
কে জানে?
অথৈ নিবিড়ের বিছানায় বসে থাকে। পা নাচায়। ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকে। নিবিড় শুধু আড়চোখে অথৈ এর এই কান্ড কারখানা দেখছে। টমি আসে। বিছানায় গড়াগড়ি খায়।
“নিবিড়, কত কিছু নিচ্ছো তুমি? ”
“আমি সব দরকারি জিনিস নিচ্ছি বুঝলে? ”
অথৈ আর কথা বাড়ায় না। নিবিড়ের বুকশেলফ থেকে একটা বই বের করে। কিন্তু পড়তে মন চায় না। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আবার আগের মতো রেখে দেয়।
নিবিড় বুঝতে পারছে অথৈ ঘুরতে যাওয়ার জন্য কতটা এক্সাইটেড হয়ে আছে। ওর এই আনন্দ টুকু দেখতে ভালো লাগছে। এখানে নবনী থাকলে বেশ ভালো হতো। বাড়িটা মাথায় তুলে ফেলতো আজ। কবে যে ফিরবে ওরা। আবার কল দিতে হবে।
____
চলবে
৬
#অথৈ_মহল
#নুরে_হাফসা_অথৈ
_____
অথৈ ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙ্গে। নিবিড় অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। হাত ঘড়িটা পরতে পরতে আয়নায় ভেতর বিছানার দিকে তাকায়। অথৈ চোখ পিটপিট করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। নিবিড় ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
নিবিড় ভ্রু কুঁচকায়।
“তুমি যেয়ে কি করবে? ”
“আমি বসে থাকব তোমার কাছে। ”
“সারাদিন? ”
“হ্যাঁ, ”
“জলদি রেডি হয়ে নাও তবে। আমার সময় নেই কিন্তু। ”
নিবিড়ের পারমিশন পেয়ে এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামে। দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। ফ্রেশ হয়ে আরেক দৌড়ে যায় জামা বের করতে। নিবিড় ওর দৌড়াদৌড়ি দেখে চিল্লাতে থাকে।
“এই অথৈ আস্তে। পরে গেলে কিন্তু কোমরটা যাবে। ”
বলতে না বলতেই অথৈ ধপাস। জোরে চিৎকার করে ওঠে। নিবিড় দৌড়ে যায় ওর কাছে।
“বললাম না পড়ে যাবে? বেশি ছটফট করো তুমি। এবার ঠিক হয়েছে একদম। আরও লাফাও। ”
অথৈ ছলছল চোখে তাকায়।
“নিবিড়, আমি ব্যথা পেলাম। তুমি কোথায় হিরোর মতো আমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গিয়ে কোমরে ম্যাসাজ করে দিবে। তা না করে দাঁড়িয়ে থেকে উপদেশ বানী শোনাচ্ছ? ”
নিবিড় এবারও ভিমড়ি খায় ওর কথায়। এত বড় মেয়ের কোমরে নাকি সে হাত দেবে। ভাবতেই তো ওর হাসফাস লাগা শুরু হয়ে যায়।
“দেখি আমার হাত ধরো। ”
নিবিড় ওকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দেয়। অথৈ মুখ কাচুমাচু করে তাকিয়ে আছে।
“কি? ওভাবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। তোমাকে আজকে নিয়ে যাচ্ছি না। রেস্ট নাও তুমি। বেশি ব্যথা লেগেছে? ডক্টর ডাকব? ”
“লাগবে না। ”
“এইযে দেখ, আবার মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। ”
নিবিড় চলেই যাচ্ছিল। অথৈ আবার পিছু ডাকে।
“নিবিড় শোন। ”
“বলো। ”
“কোলে নাও আমায়। ”
কি নিঃসংকোচ একটা আবদার। কিন্তু নিবিড় বার বার বিপাকে পরে যাচ্ছে। এই মাথা পাগল মেয়ে কে নিয়ে সে করবে টা কি? অগত্যা ওর কাছে যায়। অথৈ হাত বাড়িয়ে রেখেছে। নিবিড় গিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয়। অথৈ ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে। নিবিড় ওর চোখের দিকে তাকায়।
“এবার হয়েছে? তুমি শুয়ে থাক। আমি অফিসে যাই? দেরি হয়ে যাচ্ছে বাবা। খাবার ও দিয়ে যাচ্ছি। ”
অথৈ আবার ঠোঁট ফোলায়। গলা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
“তুমি কোথাও যাবে না। ”
“অফিসে যাব না? ”
ও মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করে।
“আমার কাজগুলো কে করে দেবে শুনি? ”
“তোমার ম্যানেজার করে দেবে। ”
“সবারই আলাদা কাজ আছে গো। ”
“এত কিছু আমি বুঝি না। তুমি যাবে না ব্যস। ”
“আচ্ছা। তাহলে এখন আমি কি করব মহারাণী? ”
অথৈ খিলখিলিয়ে হাসে।
“আমাকে কোলে নিয়ে পুরো বাসা ঘুরে বেড়াবে এখন। ”
“বাপরে! কি আবদার। ”
“জিম করে এত সুন্দর বডি বানিয়েছ। আর আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে পাড়বে না? ”
“হাহ! তোমার যে স্বাস্থ্য। তোমাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরতে পাড়ব। ”
“আচ্ছা তাই? ”
“হ্যাঁ তো। ”
“তাহলে চলো। ”
নিবিড় ওকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। অথৈ পুরো সময় টা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন ওর চেহারা টা মুখস্থ করে রাখছে। নিবিড় ব্যপার টা বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসে। একটু দুষ্টুমি করে বলে,
“কি হচ্ছে শুনি? এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছো যে? আমি পুরুষ বলে কি আমার লজ্জা টজ্জা নেই নাকি হুঁ? ”
এই কথা শুনে অথৈ লজ্জায় একদম নিবিড়ের গলায় মুখ গুজে দেয়। এবার বোধহয় নিবিড় নিজের কথার প্যাচে নিজেই ফেসে গেল। এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়? শেষে না পেরে ওর দিকে তাকায়।
“এইযে মেয়ে, এভাবে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে টালমাটাল করে দিয়েন না। তার থেকে বরং আপনি আমাকে মুখস্থ করতে থাকুন। সেটাই ভালো। ”
অথৈ এই কথা শুনে আরও লজ্জা পায়। মুখ তুলে ওর দিকে তাকায় তবুও। আরও একটা আবদার করে।
নিবিড় ওর কথা মত বাইরে নিয়ে যায়। কোলে নিয়েই হাঁটছে এখনো। দূরে দেখা যাচ্ছে সাদা রঙের গাড়িটা এদিকেই আসছে। গাড়িটা ওদের সামনে এসে থামে। অথৈ গাড়ি দেখেই চিল্লাতে থাকে।
“ইয়েএএএএ! নীল ভাইয়াআআ। ”
অবশেষে গাড়ি থেকে শুধু নীল না। কাব্য আর রিদ ও বের হয়ে আসে। কাব্য এসে অথৈ এর মাথায় চাটি মা*রে।
“কি রে, কি এমন অকাজ করলি যে তোকে এই সাত সকালে নিবিড়ের কোলে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে? ”
রিদ সামনে চলে আসে।
“নিশ্চয় পড়ে গিয়ে হাত-পা মচকে ফেলেছে। কি অথৈ? ঠিক বললাম তো? ”
নিবিড় অথৈর দিকে তাকায়।
“দেখেছ? তুমি যে কি কি অকাজ করো সেটা সবাই বুঝে গেছে। ”
নীল হো হো করে হেসে ওঠে। অথৈ এর কাছে গিয়ে বলে,
“এই অথৈ, এদের কথা কানে দিও না তো। তোমার যখন খুশি লাফাবে, ঝাঁপাবে। পরে গিয়ে হাত-পা ভাঙ্গবে। বাকিটা আমি দেখে নেব চাপ নিও না তুমি। ”
অথৈ হেসে নিবিড়ের দিকে তাকায়। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয়, “দেখলে তো আমার টিমেও একজন আছে। ”
নিবিড় নীল কে আরও এক ধাপ বকাবকি করে।
“তুই ওকে এমন বানিয়েছিস। এখন আরও অকাজ শেখাতে থাক। শেষে আমাকেই ওকে নিয়ে ঘুরতে হবে। ফাজিল একটা। ”
সবাই হেসে ওঠে। তারপর এক সাথে সকলে বাসার ভেতর চলে যায়। অথৈ কে সোফায় বসিয়ে দেয়। দুই পা সে কাব্যর পায়ের উপর তুলে রাখে। নিবিড় খাবার নিয়ে এসে খাওয়াচ্ছে। নীল অথৈ কে দুনিয়ার সব অকাজ শেখাচ্ছে।
রিদ দ্রুত ফোন বের করে এই সুন্দর মুহূর্তটা ক্যাপচার করে ফেলে।
কিছু সুন্দর মুহূর্ত গুলো বাঁধাই করে রেখে দিতে হয়। তবেই না পরবর্তীতে এগুলো স্মৃতি হয়ে থাকবে। এমন কিছু মানুষ যাদের জীবনে আছে তারাই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে,
“সুখ শান্তি গুলো তারাই উপভোগ করছে ভীষণ ভাবে। ”
রিদ প্রশান্তির শ্বাস নেয়। ওদের ৪ জনের মধ্যে ছোট বোন বলতে শুধু নিবিড়ের আছে। ওদের তিন জনের বোন নেই। নবনী কে ওরা ছোট বোনের মতোই ভালোবাসে। এবার নতুন করে যোগ হয়েছে এই মেয়েটা। রিদ ওকে ছোট বোনের মতোই ভালোবেসে ফেলেছে। এমন মায়া মায়া আদুরে মুখটা দেখলে কার না শান্তি লাগবে।
_____
অথৈর মাথা খারাপ করতে নীল এবার ভয়ানক আইডিয়া দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। মুখ খুলতেই যাবে সেই মুহূর্তে নিবিড় ওকে শাসায়।
“নীল, একটা কথা ও মুখ দিয়ে বের করবি না। তোর খবর আছে কিন্তু। ”
নীল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। অথৈ চোখ কান খাড়া করে থাকে। কখন নীল পেটে চেপে রাখা কথা টা বলবে সেই অপেক্ষা করে। কাব্য তুলো নিয়ে এসে অথৈ এর কানে গুজে দেয়। অথৈ কাব্যর দিকে তাকায়।
“ভাইয়া, এইটা কি হলো? কানে তুলো গুজলে কেন? ”
“কানে তুলে গুজে দিলাম এই কারণে। যেন তুই নীলের কোন কথা শুনতে না পাস। ”
অথৈ শুনতে না পেয়ে কাব্যর দিকে আরেকটু কান এগিয়ে দেয়। কাব্য ওর মাথায় একটা গাট্টা মা*রে।
“সর ওই দিকে। ”
ও চুপ করে বসে থাকে। রিদ নিবিড়ের সাথে কথা বলে,
“অনেক দিন থেকে ট্যুরে যাওয়া হয় না। তাই ভেবেছিলাম এবার একটু ট্যুরে যাব। সেই প্ল্যান করতেই এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখি এই মেয়ে কোমড়ে ব্যথা পেয়ে বসে আছে। তাই আপাতত এই টপিক বাদ দিচ্ছি। ”
কাব্য অথৈ এর কানে তুলো গুজলে কি হবে? নীল সবার চোখ এড়িয়ে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ঠিক সময় ওর কান থেকে তুলো খুলে নিয়েছে। যার ফলস্বরূপ, অথৈ পুরো কথা শুনে ফেলেছে। রিদের কথা শেষ হতেই ও চিল্লিয়ে ওঠে।
“রিদ ভাইয়াআআ! তোমরা ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করতে এসেছিলে? ইশ! আগে জানলে কি আমি এমন ঝাঁপাঝাঁপি করতাম? ”
কাব্য বুঝতে পারলো তুলো খুলে দিয়েছে নীল। রুমের মধ্যেই ওকে এক প্রকার দৌড়ানি দেয়। টমি মিউ মিউ করে অথৈর কোলে গিয়ে বসে। নিবিড় অথৈর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়।
“এইযে মহারাণী, এই ছোট মাথায় কি সব বুদ্ধি আটছেন বলুন তো? কোন ভাবেই ট্যুরে যাওয়া যাবে না। ভুলেও নীলের সাথে তালে তাল মেলাবেন না। বোঝা গেছে? ”
অথৈ মুখ ভেংচিয়ে অন্য দিকে তাকায়। ভাবখানা এমন।
যেন সে বলছে, “তোমার কথা শুনতে আমার বয়েই গেছে। ”
কাব্য আর নীল হাপিয়ে গিয়ে এসে আবার সোফায় বসে পরে।
অথৈ মন খারাপ করে বসে থাকে। নিবিড় বুঝে ও কিছু বলছে না। বেশ অনেক্ষণ চুপ করে থাকার পর ও নিজেই কথা বলে।
“নিবিড়, চলো না কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আমি বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি একদম। ”
“সেদিন না নীল তোমাকে নিয়ে ঘুরে আসলো? ”
“একবারে কোনদিন হলো? তাও তো নীল ভাইয়া রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে। দূরে কোথাও ঘুরে আসি প্লিজ। আমি কখনো এভাবে ট্যুরে যাইনি। আব্বু-আম্মুর সাথে যেই কয়বার গিয়েছি। ওদের সাথে সাথেই থাকতে হয়েছে। কোন মজা আছে বলো? ”
নীল ও সায় দেয়।
“অথৈ তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। এরা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে। তোমার তো তেমন কিছু হয়নি। তাই না বলো? ”
অথৈ ও উঠে দাঁড়ায়। সুস্থ হবার ভান ধরে।
“দেখ, আমি দাঁড়িয়েছি। একদম সুস্থ আমি। চলো না যাই প্লিজ। ”
কাব্য নীল কে আরও কিছু বলতে যেয়ে ও থেমে যায়। অথৈ কে বোঝাতে থাকে।
“শোন, জেদ করিস না। কোমরে বেশ ব্যথা পেয়েছিস। কয়টা দিন রেস্ট নিয়ে সুস্থ হ। তারপর এক সাথে সবাই হৈহৈ করতে করতে যাব। শেষে এই অবস্থায় গিয়ে যদি আবার অসুস্থ হয়ে যাস? ঘুরতেই পারবি না। আনন্দ ও করতে পারবি না। মাথায় কিছু ঢুকল কি? ”
অথৈ মাথা নাড়ায়। বিজ্ঞদের মতো একটা ভাব নেয়। যেন সে বুঝে একদম উদ্ধার করে ফেলেছে।