_____________
আমাদের প্রেমটা খুব সুন্দর এগিয়ে যাচ্ছিলো। দু’জনে লুকিয়ে লুকিয়ে একে অপরের জন্য সময় বের কথা বলা। কখনো আপুর শ্বশুর বাড়ির দাওয়াতে লুকিয়ে একে অপরকে দেখা এইভাবে চলছিল। এরমাঝে একদিন হঠাৎ করে আমার ইচ্ছে হলো দেখা করব ওর সাথে। সেবার অনেকদিন দেখা হয়নি কিনা! তাই। রক্তিম রাজি ছিল না। কোনো মতেই ওকে রাজি করাতে পারছিলাম না জানেন। ও বললো শৈলী এইভাবে মিথ্যে বলে বাইরে দেখা করাটা খুব রিস্কের হয়ে যাবে। যদি কেউ জেনে যায়! তারচে বরং অপেক্ষা করি আমরা। সুযোগ আসবেই কখনো না কখনো।
আমি শুনলাম কিন্তু মানলাম না। জেদ ধরলাম, কাঁদলাম। আমার কান্নার সামনে ঝুঁকতে হয়েছিল ছেলেটাকে। সে এলো এবং আমাদের দেখা হবার কিছু পল, হয়তো পাঁচ মিনিটেরও কম সময় হবে; আমরা দেখলাম ওর বাবা দাঁড়িয়ে সামনে। ব্যস আর কী? জানাজানি হলো দুই বাড়িতে। রক্তিমের মা সবটা চাপিয়ে দিলেন আমার আপুর ঘাড়ে। বললেন আপু এসবের জন্য দায়ী। কথাটা ফুপি মেনে নিতে পারেননি। আর ফুপি থেকে বাবা, বাবা থেকে সমস্ত রাগ এসে পড়ে আমার উপর। পরিবারের সকলের আদরের এই আমি সেই দিনের সেই কয়েক ঘণ্টায় হয়ে গেলাম সবার থেকে দূরে।
_____________
“ভুলে যাও যা কিছু ছিল। তোমার আর ওই ছেলের মাঝে কিছুই হবার নয়।”
শৈলীর বাবা এই বাক্য আওড়ে বেরিয়ে গেলেন শৈলীর জন্য বরাদ্দ ঘর ছেড়ে। রইলেন ওর মা। মেয়ের মাথায় আলত হাত বুলিয়ে বললেন,
“ভুলে যা মা। সবকিছু একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা। তোর বাবাকে ভুল বুঝিস না। শুধুমাত্র তুই খুশি হবি বলেই উনি গিয়েছিলেন রক্তিমের বাবা মায়ের কাছে। ওরা তোর বাবাকে আর ফুপিকে যা নয় তা শুনিয়ে দিয়েছেন। আর এরপরে আবার তোর ফুপি ওনাকে শুনিয়ে গেল।”
শৈলী চুপ। ওকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললেন, “শোন আমার কথা, রক্তিম যদি তোকে চায় আমি নিজে তোর বাবাকে বোঝাব কিন্তু এখন নয়। বয়সটাই বা কত তোর? মাত্র ষোলো। এখন তোর পড়াশোনা করার বয়স। পড়াশোনায় মনোযোগী হ। তাড়াছাড়া ওরা বলছে এ তোর আবেগ মাত্র। তুই কিছুটা সময় নে। ভাব আসলে এটা কী? প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে এসব সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এটার মাঝে যেমন একে অপরের প্রতি যত্ন থাকে তেমনই থাকে সম্মান। দুইজন মানুষের একে অপরের জন্য সম্মান। তাদের পরিবারের একে অপরের প্রতি সম্মান। সেখানে তোর বাবা অসাম্মানিত হয়েই ফিরেছে। আবার যদি প্রয়োজন হয় তোর খুশির জন্য ঝুঁকতেও রাজি মানুষটা।
আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। তোর দেখা এতোবছরের তোর বাবা ঠিক কেমন। তোর কথা ভেবে কি কি করতে পারে সেসব ভেবেই না হয় অপেক্ষা কর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রূপে আসুক। হু?”
শৈলী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। এরপর কেটে যায় কয়েকটি মাস। হঠাৎ করে শৈলীদের দাওয়াত পড়ে ফুপাতো বোনের শ্বশুর বাড়িতে। শৈলী যেতে চায়নি কিন্তু যেতে বাধ্য হয়। সকলে যাচ্ছে ও যাবে না। এই নিয়ে অনেক তর্ক, মতবাদের পরেই ও তৈরি হয় যাওয়ার জন্য। গিয়ে সারপ্রাইজড হয়ে যায় ও।
_____________
মনমরা হয়ে একটা জায়গায় একা বসে শৈলী। তার পাশে এসে কেউ বসে। টের পেলেও কে বলেছে তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করে না মেয়েটা।
“কেমন আছো?”
পরিচিত গলা। ফিরে দেখে শৈলী। রক্তিমের মা বসে আছে তার পাশে। তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে সালাম জানায় তাকে। শৈলীর অবস্থা দেখে স্ফিত হাসেন তিনি। পরপর ওর হাত ধরে আবার পাশে বসিয়ে দেন কিন্তু হাতটা আর ছাড়েন না। অন্য হাতে থাকা একটা চিকন স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দেন তাকে। শৈলীর বিষ্ময় তখন সপ্তম আসমান ছুঁয়েছে। পরে অবশ্য জানতে পারে রক্তিমের জেদের কাছে হার মেনেই আজকের এই দিনে তারা একত্রিত হয়েছেন। এমনকি শৈলীর অগোচরে সপ্তাহ আগে তাদের একটা মিটিংও হয়েছিল। এসব জানার পরে শৈলী খোঁজে তার বাবাকে। দেখতেও পায়। পেয়ে দেখতে থাকে তাকে। আর দেখে বাবার খুশি খুশি মুখখান। যা তার সমস্ত দ্বিধা দূর করে দেয় নিমেষে। খুশি ছলকে পড়ে শৈলীর ঠোঁটে।
“তারপর?”
মেয়েটির কথায় আবারও স্মৃতি পুস্তক বন্ধ হয়। শৈলী চায় তার দিকে। বলে,
“সেদিনই আমি জনতে পারি রক্তিম দেশের বাইরে যাচ্ছে। আমার বয়স ষোলো বছর দশ মাস ছিল সেই সময়। সকলের মতে আমি ছোট তাই তখনি বিয়ের কথা ভাবেননি তারা। ঠিক হয় রক্তিম ফিরে এলে বিয়ে হবে আমাদের।”
“কখন ফিরলেন উনি?”
“এইতো মাস খানেক আগেই।”
কথা শেষ করে শৈলী খেয়াল করে ডান হাতের মেহেদি দেওয়া শেষ হয়ে গেছে। আর সেই ডিজাইনের মাঝখানে বড় করে ইংরেজি অক্ষর ‘R’ জ্বলজ্বল করছে।”
শৈলীকে অপলক এক দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি হাসে একটুখানি। হেসে বলে,
“নামটা তো আমি জেনেছিই তাই আর আপনার গল্পের মাঝে হস্তক্ষেপ করিনি। নিজেই লিখে দিয়েছি। কেমন হয়েছে?”
“খুব সুন্দর। ঠিক যেমন আমি কল্পনায় নিজের হাতে ওর নামের অক্ষর দেখেছিলাম তেমন।
______________
মাঝখানে কাঁচা ফুলের পর্দা। একপাশে বর অন্যপাশে কনে। কাজি সাহেব বসে আছেন কনের সাইডে তার সামনে। তার হাতে থাকা কাবিননামা এগিয়ে দিলেন শৈলীর দিকে। শৈলীর ফুপাতো বোন সেটি হাতে নিয়ে বোনের হাতে তুলে দেয়। সাথে দেয় কলম খানা। বিয়ে পড়ানো শেষ হয়েছে ইতমধ্যে। এখন শুধু সাইনটুকু বাকি। সই করার আগে বরের নামের জায়গায় চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। সেখানে স্পষ্ট লিখা আছে একটি নাম। ‘অঙ্কন জোবায়ের।’
_____________
মেহেদি আর্টিস্টের হাতে শৈলীর বা হাত। খুব দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ উনি। ডিজাইন দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। এই হাতে ব্রাইড আঁকা হবে। সেটাই করছেন তিনি। একেকটা ডিটেইলস খুব সুন্দরভাবে ফুঁটে উঠছে তার কাজে। শৈলীর মনোযোগ ছিল সেই ডিজাইনে তখন তার ধ্যান আকর্ষণ করে নেয় আর্টিস্ট আপুর একটি কথা।
“ভাইয়া খুব ভালোবাসেন আপনাকে।”
শৈলী চমকে তাকায়। দেখতে পায় আর্টিস্ট আপুর মুখে হাসি হাসি ভাব। তিনি চোখ তুলে শৈলীকে দেখেন তারপর আবার কাজে লেগে পড়েন। কথা কিন্তু বন্ধ হয় না, চলতে থাকে।
“কিছু মনে করবেন না আপু। আপনার ব্যক্তিগত বিষয় এইভাবে বলছি বলে। আসলে ভাইয়াকে দেখেছি আমি ব্যালকনি থেকে যখন লাফ দিলেন সেই সময়। আমি তখন আপনার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“কী বলছেন! আপুও তো ছিল সাথে। দেখে ফেলেনি তো!”
শৈলী আতঙ্কিত। বুঝতে পারে মেয়েটি। সে তাকে আস্বস্ত করে বলে দেয়।
“চিন্তা করবেন না। উনি দেখেননি কিছু। আমাকে রেখে উনি নিচে গিয়েছিলেন, কেউ ডেকেছিল উনাকে।”
“ওহ।”
“কালই তো বিয়ে তাই না?”
“উহু।”
“তাহলে!”
মেয়েটির কপালে ভাঁজ পড়ে। যা দেখে হাসে শৈলী। বলে,
“তারিখ পাল্টেছে আপু। সেই হিসেবে বিয়েটা আজ।”
এই কথার পরে দু’জনেই হেসে ওঠে। মেয়েটি বলে,
“কিছু ঘণ্টার বিষয়। ভাইয়া দেখছি আপনাকে চোখে হারাচ্ছেন।”
“হয়তো।”
আনমনে বলে ওঠে শৈলী৷ ডান হাতটা এগিয়ে দেখায় সে। মেহেদির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। বলে,
“ওর ইচ্ছে ছিল আমাদের বিয়ের মেহেদি সবার আগে ওই পরাবে। এই দেখুন ছুঁইয়ে দিয়ে গেল।”
“এ মা। আপু এইভাবে তো ডিজাইন নষ্ট হয়ে যাবে। কিছু মনে না করলে আমি এটা মুছে দিই। এইভাবেও ভাইয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েই গেছে।”
মেয়েটিকে অপেক্ষা করতে হলো না। নিজেই এক টুকরো টিস্যু নিয়ে মেহেদিটুকু মুছে ফেলল শৈলী।
“মেহেদি ওয়ালা ভাইয়ার নাম কি আপু?”
“রক্তিম।”
“নামটা সুন্দর আপু।”
“ধন্যবাদ।”
______________
এখনো ডান হাত এবং উভয় হাতের উল্টো পিঠে মেহেদি লাগানো বাকি অথচ ওদের দু’জনের চোখেই ঘুম। শৈলীকে ঢুলুঢুলু করতে দেখে মেয়েটির মায়া হলো। সে তো আর ইচ্ছে করে এমন পরিস্থিতি বানায়নি। তার পরিবারের এক সদস্য হঠাৎ হসপিটালাইজড হওয়ায় জানিয়েছিল আসতে পারবে না, অন্য আর্টিস্টের ব্যবস্থা করে দেবে সে। কিন্তু ইমার্জেন্সি কেউই রাজি না হওয়ায় তাকেই আসতে হবে বুঝতে পেরে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছিল সে। দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দিন পার করে রাত দশটায় গিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। এই যে এখন এই কাজটা শেষ হলে আবারও ছুঁটবে হসপিটালে।
“দুঃখিত আপু। আমার কথায় আমি অটল থাকতে পারিনি বলে আপনার ঘুম বিসর্জন দিতে হচ্ছে।”
“সমস্যা না। আপনি আপনার কাজ করুন।”
ডান হাতটায় মেহেদি চড়ানো শুরু করেছে মেয়েটি। ধীরে ধীরে রক্তিমের দেওয়া রঙটুকু ঢেকে গেল তার মাঝে। সেটা দেখে শৈলী বলল,
“একটা গল্প শুনবেন আপু? একটা প্রেমের গল্প। আমাদের গল্প। রক্তিম ও শৈলীর গল্প।”
মেয়েটি দেখে শৈলীকে। শৈলী একটুখানি হাসে তার চেহারার অভিব্যক্তি দেখে। অপেক্ষা করে না উত্তরের। শোনাতে শুরু করে গল্প। ওদের গল্প। ওর আর রক্তিমের গল্প।
_____________
রক্তিমের সাথে শৈলীর দেখা হয় ওর ফুফাতো বোনের শ্বশুর বাড়িতে। সম্পর্কে রক্তিম শৈলীর বোনের মামাতো দেওর। বউভাত অনুষ্ঠানে ভিড়ের মাঝে ধাক্কা লাগে ওদের। ছেলেটা ব্যস্ত ছিল, শৈলীকে না দেখেই স্যরি বলে দিয়ে চলে গিয়েছিল। ফিরেও চায়নি ওর দিকে। শৈলী ঠিক দেখতে কেমন সেটাও দেখেনি। কিন্তু শৈলী ওকে দেখেছিল। হ্যাংলা পাতলা ফর্সা দেখতে একটা ছেলে যার পরনের কাপড় ঘামে ভেজা, কপালে বিরক্তির রেখা। হয়তো ভাইয়ের বিয়েতে খেটেছিল খুব। কে জানে! জানার আগ্রহও দেখায়নি শৈলী। সেদিনকার মতো সেখানেই সমাপ্তি ঘটেছিল গল্পের।
এরপর কয়েক মাস পরের কথা। ফুপির বাসায় দাওয়াত ছিল ওদের। সেখানে দেখা হয় আবার। শৈলী নিজের মতো সবার সাথে ব্যস্ত থাকে। তার সেই ব্যস্ততা ছিল কারো নজর কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কেন না, শৈলী ব্যস্ত ছিল হাসিতে, মেতে ছিল গল্পে। তার সেই চোখের পলক ফেলা, অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করা আবার লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেওয়া। ভুল কিছু বলে ফেলায় চোখ ঢেকে নেওয়া আবার আঙুলের ফাঁক গলিয়ে সকলের মুখোভঙ্গি পরখ করা। ষোড়শীর সব কিছুই যেন কারো মনে ধরেছিল সেদিন। আর সেই কেওটা ছিল রক্তিম।
শৈলীর ফুপাতো বোনের কাছে জানতে চেয়েছিল, “মেয়েটা কে ভাবি?”
“কোন মেয়েটা?”
রক্তিম দেখিয়ে দেয় শৈলীকে। তারপর জানতে পারে শৈলী তার ভাবির কাজিন বোন। এইতো এই ছিল তাদের গল্পের পরবর্তী ধাপের আগের গল্প।
“আর তারপর?”
মেয়েটির কথায় স্মৃতিপুষ্কত বন্ধ হয়। ঘোর কাটে শৈলীর। বলে, “তারপর। তারপর প্রেম হয়েছিল। দু’জনে পাগলের মতো মজেছিলাম সেই প্রেমে।”
“তাই তো আজকের এই দিন।”
“উহু।”
“মানে?”
“আমরা সেই পাগল প্রেমিক-প্রেমিকা যেদিন ধরা খেলাম পরিবারের কাছে সেদিন দু’জনেরই পরিবার ছিল নারাজ। কেউই সম্পর্কটা মেনে নেয়নি।”
“তাহলে!
“আর কি পরিবারের মান ভাঙিয়ে লম্বা একটা সফর পার করে আজকের এই দিন।”
“বাহ! চমৎকার তো।”
“হু, চমৎকার বটে।”
হাসে শৈলী। আবারো ডুব দেয় সেই স্মৃতিপুস্তকে। পাতা উল্টে পৌছে যায় সেই দিন গুলোয় যেদিনগুলো কঠিন ছিল। যেন ক্ষরা ছিল ভূমিতে এরপর পরিবারের কিছু শীতল বাক্যের বর্ষণে কেটেছিল সেই ক্ষরা।
বিয়ে মানেই সেই বাড়ির কোনো কোনায় ব্যস্ততা, কোনো কোনায় আমেজ, কোনো কোনে শোকের ছায়া। ঠিক তেমনই শৈলীর বাড়িতে চলছে আয়োজন। বাড়ির আদরের দুলালি, সকল সদস্যের প্রিয়, ভালোবাসার শৈলীর বিয়ে বলে কথা। চলুন ঘুরে আসা যাক প্রতিটি কোনায় কোনায়। দেখা যাক বিয়ের আগের দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কিছু দৃশ্য।
বিকেল তখন সাড়ে চারটা। শৈলীর দুই চাচাতো ভাই ব্যস্ত বাড়ির আলোকসজ্জা নিয়ে। এতোটাই ব্যস্ত যে দুপুরের খাবারটুকুও খায়নি তারা। এখন কি আর খিদেকে প্রশ্রয় দিলে চলবে! ওদের আদরের ছোট্ট বোনটি শৈলী। কাজিনদের মধ্যে সকলের ছোট সে। তার বিয়েতে পাত্র পক্ষকে কোনো প্রকার অভিযোগের সুযোগ দেবে না এই পন করেছে ভাইয়েরা মিলে। দু’জন এখানে ব্যস্ত রইলো আরো তিন জনের কথা, তারা গিয়েছে শৈলীর হলুদ সন্ধ্যার কারুকার্য খচিত বোর্ডটি আনতে। সেটি না এলে হলুদ সন্ধ্যার ডেকোরেশন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বিয়ের এক টুকরো আনন্দ।
শৈলীর মা চাচীরা ব্যস্ত রান্না ঘরের দিকে। হলুদ সন্ধ্যার পায়েস, ফল, কেক সেগুলো সাজাতে ব্যস্ত তারা। এরপর শুরু হবে ছুলে রাখা আদা, রসুন পেস্ট করার কাজ। পিষতে হবে বাদাম সহ আরো নানান মশলা। ইতিমধ্যেই পেঁয়াজ গুলো ছুলে রাখার কাজে ব্যস্ত শৈলীর ফুফু। কেটে রাখা যাবে না তাই ছুলে কাজ এগিয়ে রাখছেন আজই।
শৈলীর বাবা- ফুফা- চাচারা ব্যস্ত বিয়ের প্যান্ডেল নিয়ে। বরের আসন নিয়ে। এসবের মাঝে একমাত্র নিরব এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা শৈলী। সকলের ব্যস্ততা দেখছে সে। উপভোগ করছে ব্যস্ততার মাঝে সকলের ঠোটে লেগে থাকা সেই খুশিটুকুন।
___________
রাত তখন বারোটা বাইশ হলুদ পর্ব শেষে ঘরে বসে আছে শৈলী। গায়ে কাঁচা হলুদের গন্ধ মাখা হলেও হাতে পরা হয়নি মেহেদি। রাঙানো হয়নি ওই মানুষটার নামে নিজের হাতদুখানা। ঘুম এসে ভীড় জমিয়েছে চোখে। শৈলী ব্যস্ত নিজেকে জাগিয়ে রাখতে। মেহেদি পরবে সে। তার বোনেরা পারে সুন্দর মেহেদি পরাতে কিন্তু হবু শাশুড়ি মায়ের আদেশ তার পাঠানো মেহেদি, তার ঠিক করা আর্টিস্ট এবং তার ঠিক করে দেওয়া ডিজাইন চড়ানো হবে শৈলীর হাতে। যার মাঝে জ্বল জ্বল করবে তার একমাত্র পুত্রের নামখানা। এক মায়ের শখ বলে কথা, তাই তো শৈলি এখনো অপেক্ষা করছে সেই আর্টিস্ট এর। শৈলী শুনেছিল মেয়েটি বিকেলে আসবে কিন্তু হঠাৎ বিপদের সম্মুখীন হয়ে সময় চেয়ে নিয়েছে সে।
হবু শাশুড়ির আবদারের কথা ভাবতে ভাবতে অপেক্ষায় ডুবে থাকা শৈলীর কানে আসে একটা শব্দ। শব্দটা আসছে ওর ঘরের বেলকনি হতে। অলস ভঙ্গিতে হেঁটে যায় সেইদিকে। ঘুমুঘুমু চোখ দুটো যখন মেলে তাকায় তখন সামনে ভেসে ওঠে চেনা এক অবয়ব। যার দর্শন মাত্র ঘুম পালিয়ে যায় বহু মাইল দূরে। ভীত কণ্ঠে শুধায়,
“তুমি এখানে?”
কথা বলে না সেই ব্যক্তি। এগিয়ে আসে, দাঁড়ায় শৈলীর মুখোমুখি। ওর ডান হাতটা নিজের দিকে টেনে তাতে ছুঁইয়ে দেয় একটু খানি মেহেদি। যার দিকে নিবন্ধিত হয় শৈলীর স্থির দৃষ্টি। স্মৃতিরা ভীড় জমায়। তাদের মাঝে থেকে একটি দৃশ্য ঢেলে সামনে ভাসে শৈলীর মনে। মস্তিষ্কে গুঞ্জন তুলে কিছু বাক্য বার বার আসতে থাকে সামনে। ভাসতে থাকে মনে।
“আজ সবার আগে মেহেদি নিয়ে বসেছ ঠিক আছে কিন্তু আমাদের যেদিন বিয়ে হবে সেদিন কনে শৈলীর হাতে প্রথম মেহেদি ছুঁয়ে দেব আমি।”
“সেদিন কেউ তোমাকে আমার কাছে আসতে দেবে?”
“দেবে না জানি। আমি লুকিয়ে আসব তোমার কাছে। শত বাধা পেরিয়ে শুধু তোমার হাতে মেহেদি ছোঁয়াতে আসব আমি। তুমি কিন্তু অপেক্ষা করবে আমার জন্য।”
স্মৃতির পাতা বন্ধ হতেই বন্ধ চোখের পাতা মেলে ধরলো শৈলী। শুনো কানের কাছে ফিসফিসে আওয়াজ,
“ভালোবাসি আমার শৈলী। বধূ বেশী শৈলীকে দেখার অপেক্ষায়।”
আশেপাশে চাইলো শৈলী। কেউ নেয় সেখানে। নজর বুলিয়ে দেখলো নিজের ডান হাত খানা। মেহেদি লেগে আছে সেই হাতে। যা দেখে চোখ ছাপিয়ে জল গড়ালো। বুকে হাতটা চেপে ধরে নিজেকে শুধালো,
“আমি কাঁদছি কেন? আমার তো কাঁদার কথা নয়।”
উত্তর মেলে না। তার আগেই কেউ ডাকে তাকে। মেহেদি আর্টিস্ট এসেছে তার ঘরে। সাথে আছে তার ফুফাতো বোন।
কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি টের পাইনি। রিয়ার ডাকে ঝট করে ঘুম ভাঙে। লাফ দিয়ে উঠি। ঘড়ির কাটায় তখন বাজে সকাল দশটা৷ তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে নাস্তা করতে যাই। রাইসা ও আছে কিচেনে। আমি রাইসার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। অপরাধবোধ কাজ করছে। রাইসা আমার দিকে না তাকিয়ে চলে গেল রুমে। আমি তড়িৎ গতিতে চেয়ার ছাড়লাম। রিয়া আমার হাত ধরলো। আমি রিয়াকে উপেক্ষা করে রাইসার রুমে গেলাম। আমাকে দেখামাত্র রাইসা হুদাই গুছানো কাপড় আবার গুছাতে লাগল।আমি পেছন থেকে তার হাত ধরে সামনে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “এমনভাবে এড়িয়ে চলছো কেন আমায়?”
সে শুনেও জবাব দিলো না। আমি তার চিবুক ধরে চোখের দিকে তাকালাম। চোখভর্তি পানি রাইসার৷ টলমল করছে। এটা দেখে আমার কলিজা হু হু করে উঠলো। আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে। সে আজ আর আমায় আটকায় নি। শক্ত করে ধরে রাখলো আরও বেশি করে। কান্নায় ভেঙে পড়ল। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। বললাম, “রাইসা এমন করছো কেন? প্লিজ শান্ত হও।”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহির! আমি ঠিক থাকতে পারছি না।”
” তুমি না বললে কি আমি বিয়ে করতাম। যদি চাও তো এখনি সব ঠিক করে দেবো।”
রাইসা চোখ মুছে। বলে, “না, না। এরকম কিছুই করবে না। দ্বিতীয় বিয়ে করা কোন খারাপ কিছুই না। তোমার বাচ্চা নেই করেছো, আমিও করিয়েছি। আমার কষ্ট লাগবে স্বাভাবিক। লাগার কথাই। এসব ঠিক হয়ে যাবে নতুবা হবে না। তবে রিকোয়েস্ট তোমার কাছে। আল্লাহকে ভয় পেয়ে তুমি রিয়া আর আমার সাথে সমান ব্যবহার করবে। সমান দায়িত্ব পালন করবে। কাউকে কম আসনে বসাবে না।
দেখো আমি এই কষ্ট থেকে রেহাইয়ের জন্য কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যেতে পারতাম। কিন্তু যাইনি। আমি তোমাকে এতটাই ভালোবাসি যে, আমি শুধু ইহকালে নয় পরকালেও তোমাকে চাই। তুমিও তোমার দায়িত্ব সমানভাবে পালন করো।”
রাইসার কথা যত শুনছি ততই আমি মুগ্ধ হচ্ছি। আশ্চর্য্য লাগছে। রাইসার জন্য খারাপ ও লাগছে খুব। নিজেকে স্বার্থপর মনে হলো, মনে হলো সে বলতেই কেন বিয়েটা করে ফেললাম। না করলেও পারতাম। মানুষটা কষ্ট পেতো না।
দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে। টের পাচ্ছি দিনদিন আমি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। রাইসার দেওয়া কথা রাখতে পারছি না। আমি রিয়াতে মজতে লাগলাম। রাতদিন রিয়ার সাথে বেড শেয়ার করছি। রাইসার কথা বললেই রিয়া অন্যরকম বিহেভ করে। কলাকৌশলে তার দিকে আকৃষ্ট করে।আর আমিও তার মধ্যেই ডুবি। রাইসা কেমন আছে, কেমন থাকে, খেলো কি না তার কোনটার খোঁজ রাখি না। রিয়াই পুরো আমিটাকে গ্রাস করে ফেলছে।
এক রাত দুপুরে রিয়া আর আমি একান্ত মুহুর্তে আছি। বাহিরে তুমুল বেগে বাতাস বইছে শাঁ শাঁ করে। জানলার ফাঁক দিয়ে বাতাস পৌঁছে রুমের পর্দা নাড়াচ্ছে এলোপাতাড়ি। এই হঠাৎ আসা খামখেয়ালি বাতাসের বেগ আমার শরীরে পৌঁছাতেই আমি শিউরে উঠলাম। বুকের বা পাশটা তুমুল ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। আমার রাইসার জন্য আজ এই মুহুর্তে মন কেমন করতে লাগলো। আমার সহ্য হলো না। জলদি করে উঠতে গেলেই রিয়া আটকালো। আগুন চোখে তাকাতেই সে ছেড়ে দিলো আমায়। আমি দ্রুত পায়ে রাইসার রুমে আসলাম। রুমের ভেতরে কোথাও রাইসাকে দেখলাম না। কান্না এসে জমাট বাধলো গলায়। আমি বেপরোয়া হয়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে পেছন দিকে গেলাম। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম রাইসাকে। আনমনে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাত দিয়ে আকাশপানে কি যেন গুনার চেষ্টা করছে। মন খারাপি দখিনা বাতাসে তার চুল নড়ছে এলোপাতাড়ি। শাড়ির আঁচল উড়ছে। দূর থেকে তাকিয়ে বিষাদীনি লাগছে তাকে। আমার ঠিক সাহস হচ্ছে না তার কাছে যেতে। তার প্রতি এত বেখেয়ালি আমি কি করে হলাম?
নিজেকে আর সামলাতে না পেরে কাছাকাছি গিয়ে তার এলো চুলে নাক ডুবালাম। সে মোটেও চমকালো না। আমার স্পর্শ তার চেনা। চোখ বন্ধ অবস্থায় ঘ্রাণ টানতে টানতে জিজ্ঞেস করলাম, “এত রাতে একলা এখানে কি করো?”
সে শান্ত ভঙ্গিতে বলে, “একলা কোথায়? এই যে রাতের আকাশ আমার সঙ্গী। আমি আজকাল রাতগুলো তারা গুনার বৃথা চেষ্টা করে কাটিয়ে দেই।”
“আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি রাইসা!”
সে ধমকায়, “আরে কীসের অন্যায়? কোন অন্যায় করো নি। আমি বহু আগ থেকেই জানি মানুষ এমনি। নতুন পেলে পাল্টে যায়। তবে এত তাড়াতাড়ি পাল্টায় সেটা জানতাম না।
তবু এতে তোমার কোন দোষ নেই। সব আমার কপালের দোষ।”
আমি অনুনয় করলাম, “প্লিজ রাইসা এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। কথা দিচ্ছি আর কখনও এমন হবে না।”
“ঠিকঠাক চললে তো ভালোই। ”
জানো একটা খুশির খবর আছে,এই বলে আমি তার পাশাপাশি দাড়ালাম গিয়ে। সে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, “কি?”
আমি অতি উৎসাহ নিয়ে বললাম, “রিয়া প্রেগন্যান্ট। আমি বাবা হতে চলেছি। আর তুমিও মা।”
সে চমকে উঠে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসে আমার দিকে, “অভিনন্দন মাহির। রিয়ার যত্ন রাখা দরকার এখন বেশি থেকে। ”
“তুমি খুশি তো?”
“খুশি মানে! খুব খুশি। ঘরে একটা বাবু আসবে। ঘর আলোকিত থাকবে। হৈ চৈ থাকবে। খেলবে। ইশ কত মজা হবে।”
সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগলো। রিয়া রাইসা দুজনের প্রতি আমি সমান দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। রিয়া তখন পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট। কি একটা সমস্যা হয়েছে তার। ভীষণ অসুস্থ সে। রাইসা তার কাছে যাওয়া মাত্রই রিয়া কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে, “আপনি আসবেন না আমার সামনে কয়েকদিন। মা বলছেন, বন্ধ্যা কাউকে এ সময় পাশে না রাখতে। তাতে বাচ্চার অমঙ্গল হয়।”
রিয়ার কথায় বড়সড় ধাক্কা খেলো রাইসা। অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকালো। বললো, কি বলছে কি মাহির? এসব তো কুসংস্কার!”
আমি বাচ্চার লোভে রিয়ার কথাকে গুরুত্ব দিলাম। রাইসাকে বললাম, “যা বলছে শুনে নাও না। যাও নিজের রুমে। সত্যি হয়তো কোন বিপদ হতে পারে।”
আমার কথাগুলো শুনে রাইসা এমনভাবে তাকালো আমার দিকে। মনে হলো, এর থেকে আশ্চর্য্যজনক কথা সে জীবনেও শুনেনি। ঝট করে সে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আমি রিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল হলো কিন্তু রাইসাকে দেখা গেলো না। না দেখতে পেয়ে খুজতে লাগলাম। পাইনি। অবাক হলাম বেশ। না বলে কোথায় যাবে? তার বাপের বাড়ি কল দিলাম সেখানে নেই। তারপর তার আর আমার পরিচিত সবার কাছে কল করলাম, না, সে কোথাও যায়নি। আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। হলো কি রাইসার? ড্রেসিং টেবিলে চোখ পড়তেই দেখি ছোট্ট একটা চিরকুট রাখা।আমি তাড়াতাড়ি খুলে পড়তে লাগলাম।
তাতে লেখা____ “আমার সব সুখ বিসর্জন দিয়ে তোমার সুখে তোমায় বিয়ে করিয়েছিলাম। কিন্তু কখনও কল্পনা ও করিনি, আমার মূল্য তোমার কাছে জিরো হয়ে যাবে। এতদিন কষ্ট পেলেও নীরবে সয়ে গেছি। কিন্তু আজ আর সম্ভব হয়নি। সহ্যের বাহিরে হয়ে গেছে। এমন ধাক্কা আমি জীবনেও খাইনি। তুমি রিয়ার সামনে আমাকে অপমান করেছো। আমার মূল্য শূন্য সেটা বুজিয়েছো। এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তুমি শিক্ষিত হয়েও এসব কুসংস্কার কথা কীভাবে এসব বিশ্বাস করো অবাক লাগে। যাই হোক, আমি বুজে গেছি তোমার জীবনে এখন আমার আর মূল্য নেই। তোমাদের সামনে আমার আর থাকা সম্ভব না।আমি চলে যাচ্ছি অনেকদূরে। খামাখা খুঁজো না। খুজলেও পাবে না।”
চিরকুট হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ি মেঝেতে। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন অবস্থা। রিয়া এসে আমাকে তুলে। বলে, “এতো আপসেট হওয়ার কিছু নেই।উনি চলে আসবেন দেইখো।”
প্রথমবার রিয়াকে আমার খুব ঘৃণা লাগলো। রিয়ার মনোভাব আর রাইসার মনোভাব সম্পূর্ণ আলাদা।
বহু খুজেও রাইসার কোনও খোঁজ পাইনি। ইতিমধ্যে আমার একটা মেয়ে হয়। তার নাম রাখি রাইসার নামের সাথে মিল রেখে ‘রাইমা’। রিয়াকে এখন অসহ্য লাগে আমার। তার কারণেই রাইসা আজ দূরে।কোথায় আছে, কেমন আছে সেটাও জানিনা।
এমন কোন দিন নেই, এমন একটা রাত নেই যে, রাইসার জন্য আমার মন কাঁদে না। মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের মতো কান্না করি। মনে প্রশ্ন জাগে, যে রাইসা আমাকে এতো ভালোবাসতো, সেই রাইসা কীভাবে এতদিন আমার থেকে দূরে আছে। নাকি যে ভালোবাসতে পারে, সে প্রয়োজনে সব করতে পারে!
আমার এখন একটিবার চিৎকার করে রাইসাকে বলতে ইচ্ছে করে, বাবা হওয়ার আনন্দের থেকে তোমার সাথে সারাজীবন একসাথে থাকার লোভ বেশি আমার। কিন্তু তুমি বুজোনি। হয়তোবা বুঝাতে পারিনি।
আমি অপেক্ষায় থাকব তোমার ফিরে আসার। অন্তত একবার আমার সামনে এসো রাইসা। তোমার অভাব যে এতটা যন্ত্রণার হবে, আমি কল্পনা করিনি। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ আমাদের। তাই বলে ভালোবাসার কোন কমতি নেই। বিয়ের প্রায় আট বছর হতে চলল। কিন্তু কোন সন্তান নেই আমাদের। সমস্যাটা রাইসার৷ রাইসা আমার স্ত্রী। আমি মাহির।
আমি যে বাবা হতে পারব না রাইসার মাধ্যমে, সেটা অনেক আগে থেকেই জানি। মা-বাবা নিকটাত্মীয় সবাই অনেক জোর করত দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য, আমি করিনি। রাইসা আমার ভালোবাসা। আমি তার মনে কষ্ট দিতে চাই না। আমার লাগবে না বাচ্চা। আমি রাইসাকে নিয়েই এই ছোট্ট জীবন দিব্যি কাটিয়ে দেবো।
মা কিছুদিন পরপর এত প্যারা দেন এ বিষয় নিয়ে। আজ সকালেও নাস্তা করার সময় কর্কশ কন্ঠে ঝাড়লেন আমায়। বললেন, “তুই কী এই বংশের শেষ বাতি হবি? বাচ্চা কাচ্চার দরকার নেই তোর? বুড়ো হলে দেখবে কে? এভাবে সবদিন চলবে না। এখনও সময় আছে। আমাদের কথা শুন। একটা বিয়ে কর। আল্লাহ হয়তো মুখ তুলে তাকাবেন।
আমি কান দিয়ে মায়ের কথাগুলো শুনছি আর চোখ দিয়ে রাইসাকে দেখছি। তার মুখ মলিন। রাইসার মলিন মুখ দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এমন কথা শুনলে কোন স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটারও কথা না। রাইসা চলে যায় রুমে। আমিও পিছু পিছু যাই। তার গা ঘেসে বসা মাত্রই সে আমার দিকে ঘুরলো। বলল, ” তোমার মায়ের রোজ রোজ এসব কথা আমি নিতে পারি না। আমার মাথা ধরে। তবে উনি ঠিক কথাই বলেন। একটা বাচ্চার দরকার তোমার। আর কতো অপেক্ষা করবা! ”
“তোমাকে রেখে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করব, পাগল হইছো!”
“পাগল হইনি। আমিই বলছি, তুমি আরেকটা বিয়ে করো। বাচ্চা হবে। তোমার শখ পূরণ হবে। বাবা ডাক শুনবে। আমারও শখ পূরণ হবে, মা ডাক শুনবো।”
আমি গম্ভীর হয়ে পড়লাম। কি বলছে কি রাইসা!
অফিস যাওয়ার সময় রাস্তায় দেখি, ছোট্ট একটা মেয়ে তার বাবার কোলে। বাবাকে হুদাই বারবার চুমু খাচ্ছে। বাবা হাসছে, মেয়েও হাসছে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখলাম। ভেতরে লাগলো আমার। মুখে হাসি ফুটলো। এই প্রথমবার মনে হলো, আমার একটা বাচ্চা থাকলে আমারও এরকম সুখের মুহুর্ত হতো। আমার হুট করে বাবা হওয়ার শখ জাগলো প্রবলভাবে। পরক্ষণেই চোখের সামনে ভাসলো রাইসার মুখ। আবার মনে পড়লো সকালের কথা। রাইসা তো বলছে, বিয়ে করতে। তবে কি করেই ফেলবো! করলেই বা কি! রাইসার প্রতি আমার ভালোবাসা এক বিন্দু ও কমবে না। যাকেই বিয়ে করি না কেন, রাইসার জায়গা কেউই নিতে পারবে না। কখনোই না।
বাসায় ফিরে রাইসার সম্মতি নিয়ে মাকে জানালাম, আমি বিয়ে করব। মা-বাবা অনেক খুশি। সাথে রাইসা ও। আমি তার মুখে হাসি দেখেছি। সে রাতে জানালো, মেয়ে দেখতে বাবা মা আর আমার সাথে সেও যাবে। আমি খুশি হলাম। বললাম, “এটা তো বেশ ভালো। আমার ভালো লাগবে তুমি গেলে। ফ্রেশ লাগবে নিজেকে।”
দুইদিন পর আমরা মেয়ে দেখতে গেলাম।উনিশ কুড়ি বছরের একটা মেয়ে। দেখতে বেশ সুন্দর। মা-বাবা কেউ নেই। আছে শুধু একটা বড় ভাই। বেশ গরীব ও। মায়ের পছন্দ হলো। তারাও রাজি হলো। মেয়েটার নাম রিয়া। রাইসা মেয়েটার সাথে বেশ হাসিমুখে কথা বলছে। আমি বারবার রাইসাকে দেখছি। সে হাসিখুশি থাকলে আমার ভালো লাগে। হাসিমুখ দেখলে মনে হয়, সে যেন সব মন থেকে মেনে নিচ্ছে। আমি ভেতর থেকে রিলাক্স ফিল করি।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। আমি গভীর রাতে রাইসার দু’হাত ধরি। বলি, “তোমার খারাপ লাগছে না?”
সে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফেরায়৷ বলে, “আমি অযোগ্য। আমার খারাপ লাগা মানায় না। আমি চাই তোমার মনের আশা পূরণ হোক। ঘর আলো করে একটা বাচ্চা আসুক। তোমার মুখে হাসি ফুটুক, তৃপ্তির হাসি।”
“তুমি কি খুশি এতে মন থেকে? ”
সে হাসে। বলে, “তোমার সুখেই আমার সুখ।”
আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে সে ধড়ফড় করে উঠে। বলে, “ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
রাইসাকে আমি এখন বুজতে পারি না। নাকি একটা বাচ্চার লোভে বুঝতে চাচ্ছি না। নিজেকে নিজের কাছে কেমন রহস্য লাগছে।
বিয়ের দিন আসে। আজ দ্বিতীয় বিয়ে আমার। ভাবতেই অদ্ভুত লাগে। রাইসা পরেছে নীল শাড়ি। খোঁপা করা বেলীফুলে দিয়ে। পরী লাগছে তাকে। আবার তার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে নতুন করে। আমাকে সে নিজ হাতে লাল শেরওয়ানী পরিয়ে দিলো। আমি বললাম, “তুমিও আজ লাল শাড়ি পরতে পারতে, ম্যাচ হতো।”
সে চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। বলল, “আরেকজন তো পরবে। তার সাথে ম্যাচ হলেই হলো।”
আমার রাগ হলো। তাকে ঝাপটে ধরে বুকের সাথে মিশালাম, “এমন করে কথা বলছো কেন?”
সে জেদ করলো, “উফ ছাড়ো। আমাকে এত জড়িয়ে ধরলে হবে? নতুনের জন্য অপেক্ষা করো।”
আমার আবারও রাগ হলো, “তুমি না চাইলে আমি এক্ষুনি না করে দেবো। বিয়ে হবে না।”
রাইসা খানিক হাসলো, “আমি চাই তুমি বিয়েটা করো। তোমার স্বপ্ন পূরণ হোক।”
“তাহলে এভাবে ট্যাশ মেরে কথা বলছো কেন?”
” অবাক হচ্ছো নাকি আমার কথায়? এতদিনের সংসার আমার। এত শখের তুমি৷ এতদিনের ভালোবাসা আমাদের। চোখের সামনে সবকিছুতে আরেকজন ভাগ বসাতে চলেছে। এমন কথা বলা স্বাভাবিক নয় কি? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো এতক্ষণে মানসিক হসপিটালে থাকতো। আমি তো ঠাই আছি। চোখের সামনে সব দেখছি। হাসিমুখে মেনে নিচ্ছি।
এত কথা বলার সময় আজ নয়। চলো তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“তুমি কিন্তু আমার পাশে বসবে। বসবে তো রাইসা?”
“বসব।”
দাড়াও বলে তার কপালে চুমু খেলাম। রাইসাকে বললাম, “শুভ কাজে যাচ্ছি। তুমিও একটা ভালোবাসার চিহ্ন একে দাওনা, হয় কপালে নয়তো ঠোঁটে।”
সে বলার সাথে সাথে চুমু খেলো। তবে এ চুমুর মধ্যে আমি কোন ভালোবাসা খুজে পেলাম না। নিতান্তই অনিচ্ছায় দিয়েছে, এমনটা মনে হয়েছে।
রাত বাড়ছে। হৈ চৈ কমে গেছে। সবাই ঘুম। রিয়া বউ সাজে বসে আছে বাসর ঘরে। তার জীবনে আজকের রাতটা ভীষণ স্পেশাল। সব মেয়েই তো এই বিশেষ রাতের স্বপ্ন দেখে। রিয়াও দেখেছে।
আমার জীবনে এই বিশেষ রাত অনেক আগেই এসেছে। বুক ধড়ফড় করছিলো সে রাতে। আরও কত কী! আজ দ্বিতীয় বাসর আমার। কত বিচিত্র এ জীবন! একটা সন্তান থাকলে এমন দু’টানার রাত দেখতে হতো না আমার। কি করব কিছুই বুঝতেছি না।
রাত দশটার পর থেকে রাইসাকে ও দেখিনি। জানিনা তার মনের অবস্থা এখন কেমন! আমি তো তাকে অন্য পুরুষের সঙ্গে একসাথে ভাবতেই পারি না। রুহ কেঁপে উঠে। না জানি তার কত কষ্ট হচ্ছে। যতই বাচ্চার শখ থাকুক না কেন, সে রাজি না হলে পারতো। সে রাজি না হলে, আমার বাচ্চার জন্য হাজারও ইচ্ছে থাকলেও দ্বিতীয় বিয়ে করতাম না।
আমি অসহায় হয়ে বারিন্দায় দাড়িয়ে এসব ভাবছি। নিঃশব্দে রাইসা এসে দাড়ালো পাশে। দূরে তাকিয়ে বলল, “রিয়া অপেক্ষা করছে তো। তাকে কোনও শাস্তি দেওয়ার মানে হয় না। এখনি যাও।”
আমি কিছু বললাম না। সে এক প্রকার জোর করে আমাকে রুমের কাছাকাছি দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেল।
চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বসে আছে রিয়া। এখনও বউয়ের সাজেই আছে। আমাকে দেখামাত্র উঠে দাড়ালো। মনে হলো এতক্ষণ সে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। আমি ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম। অস্বস্তি লাগছে ভীষণ। আড়চোখে এক পলক তাকালাম তার দিকে। মনকাড়া চেহারা। বুঝলাম, বারবার তাকে দেখলে আমি তার মধ্যেই ডুবে যাব। সে কথা বলল, “আজ আমাদের বিশেষ রাত। আপনি এভাবে চুপচাপ থাকলে খারাপ লাগবে আমার। ছোট থেকে মা বাবাহীন বড় হয়েছি। অনেক কষ্ট পেয়েছি। আপনি দূরে থেকে আমাকে আর কষ্ট দিবেন না দয়া করে। আমাকে আপন করে নিন।”
রিয়ার কথাগুলো আমার ভেতরে লাগলো। সত্যিই তো তাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার মানে হয় না। আমি সব অস্বস্তি কাটিয়ে রিয়ার কাছাকাছি গেলাম। চোখ আটকে গেলো তার সুন্দর ঠোঁটে। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। না, এই মুহুর্তে রাইসার কথা আমি আর ভাবছি না। আমি আচমকা ডুব দিলাম রিয়ার সুন্দর দুটি ঠোঁটে। রিয়াও তার দু’হাত দিয়ে আমাকে আরও কাছে টেনে নিলো।
এরপরের সময় বেশ দ্রুতই কাটলো। চোখের পলকে দু-মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। প্রত্যাশা আর নাওয়াস এখন চুটিয়ে প্রেম করছে। নাওয়াস আগের থেকেও দায়িত্ববান হয়ে উঠেচ্ছে। উঠবে না-ই-বা কেন। প্রত্যাশার কড়া শাসনে থাকে। দায়িত্ববান না হয়ে উপায় আছে? এদিকে প্রত্যাশার বিয়ে দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন পূর্ব ইমাম। আপাত্ত নিজের সকল দুশ্চিন্তাকে পাশে রেখে তিনি উৎফুল্ল চিত্তে ঘরে বসে আছেন। কেননা আজ ওনার ছোটো বেলার বন্ধু এসেছেন। যার সাথে এক যুগ পর সাক্ষাৎ হয়েছে। বিশ বছর আগে ওনার প্রিয় বন্ধু বিদেশ চলে গেছিলেন। প্রথম দিকে যোগাযোগ হলেও। কালের পরিক্রমায় পরবর্তীতে আর হয়নি। কয়দিন আগেই ওনার বন্ধু দেশে ফিরেছেন। এবং দেশে ফিরেই পূর্ব ইমামকে খুঁজে ওনার বাড়িতে এসেছেন। এখন দুই বন্ধু মিলে স্মৃতিচারণ করছে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই মিনা এসে ওনাদের নাস্তা পানি দিয়ে গেছেন। হুট করে আসায় তেমন আহামরি কিছু করতে না পারলেও কয়েক পদের মুখোরচক নাস্তা বানিয়েছেন মিনা।
“ভাবি এত সব কিছুর কী দরকার ছিলো?”
মিনা হালকা হেসে বলেন,
“এতো সামান্য ভাইয়া। আপনি কত বছরপর এলেন।”
উত্তরে পূর্ব ইমামের বন্ধু জামাল খান হাসলেন। মিনা নাস্তা করতে বলে চলে যায়। পূর্ব ইমামকে একটু চিন্তিত লাগে। তাই জামাল খান শুধান,
“কী ব্যাপার পূর্ব তোকে এমন চিন্তিত দেখাছে কেন? কত বছর পর আমাদের দেখা। সেই তুলনায়ই তোর চোখ মুখে উচ্ছ্বাস কম দেখছি। আমার আসাই কি তুই খুশি হসনি?”
বন্ধুর প্রশ্নে পূর্ব ইমাম তড়িৎ বললেন,
“কি যে বলিস না তুই? তোকে দেখে আমি খুশি হবো না?”
“তাহলে?”
“আসলে আমার মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তায় আছি।”
“কেন?”
পূর্ব ইমাম বুক ভরে ভারী শ্বাস ছেড়ে বললেন,
“মেয়ের বাবাদের যা চিন্তা হয়। বুঝছিস তো… মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও মেয়ের বিয়ে দিতে পারলাম না।”
“তুই তোর মেয়ের বিয়ে দিতে চাইচ্ছিস?”
“হুম!”
জামাল খান আগ্রহর সহিত বলেন,
“আমার ছেলের কথা তোর মনে আছে?”
“হুম আছে।”
“আমিও আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাইছি। কিন্তু মন মতো কোনো মেয়ে পাচ্ছি না। তুই যদি রাজি থাকিস,তাহলে তোর মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিতে পারি। এতে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কও গাঢ় হবে।”
জামাল খানের নিঃসৃত বাক্যে পূর্ব ইমামের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পরক্ষণে মুখশ্রী আঁধার হয়ে আছে। নিভে যাওয়া কণ্ঠে বললেন,
“আমার মেয়ে একটু অন্য রকম। মানে স্বাধীন চিন্তা ধারার। নিজের একটা ছোটো খাটো ব্যবসাও চালাই। আমার সাহায্য ছাড়ায় করেছে। ও চাই ওর এই স্বপ্ন নিয়ে জীবনে এগিয়ে যেতে। তোর ছেলেকে এমন কাউকে বিয়ে করতে চাইবে?”
জামাল খান এক গাল হেসে বলেন,
“আরে আমার ছেলে তো এমন মেয়েকেই বিয়ে করতে চাই। সে কারণেই তো ওর কাউকে পছন্দ হচ্ছে না।”
এবার যেন পূর্ব ইমাম আগ্রহ পেলেন। আগ্রহের সাথে প্রত্যাশার ব্যাপারে অনেক কিছু জানালেন বন্ধুকে। মোটা-মুটি ভাবে বিয়ে পাক্কা করে ফেললেন। আর ঠিক করলেন। এবার আগেই কাউকে কিছু বলবে না। তিনি খোলা খুলি ছেলের সাথে কথা বলবেন। পরে প্রত্যাশাকে জানাবেন। কেননা এর আগের যত সম্বোন্ধ ভেঙেছে। তার পিছে নিশ্চয়ই কারো হাত আছে। হয়তো কেউ চাই না প্রত্যাশার বিয়ে হোক। কেউ হিংসে করেই পাত্রপক্ষকে ভুল-ভাল বুঝিয়েছে। তাই এবার তিনি বিষয়টা গোপনে করার সিদ্ধান্ত নেন।
.
.
.
দিনটা শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। নাওয়াস আর প্রত্যাশার বিষয়ে নাওয়াসের বাড়ির সবাই জানে। কামাল মাহমুদ প্রত্যাশাকে দেখতে চেয়েছেন। তাই আজ প্রত্যাশাকে নাওয়াস নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। মনে মনে প্রত্যাশা ভিষণ নার্ভাস। প্রত্যাশা বাড়িতে বলেছে,আজ ও এক বন্ধুর বাড়ি যাবে। প্রত্যাশা রেডি হচ্ছিলো। সেই সময় পিউ আসে। ঘুরে ঘুরে তিক্ষ্ণ নজরে প্রত্যাশাকে অবলোকন করে একটু গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছো না-কি শ্বশুড় বাড়ি?”
পিউয়ের নিঃসৃত বাক্যে প্রত্যাশা থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে,
“ককী সব বলছিস? ততুই কিন্তু বেশি বুঝে গেছিস।”
“না মানে তুমি তো কখনও এমন করে সাজগোজ করো না। তাই বলাম আর-কি!”
“সাজি না। আজ সাজতে ইচ্ছে হয়েছে সেজেছি।”
“হুম! সাজো ভালো করে সাজো। যাতে এক দেখাতেই তোমার শ্বশুড় রাজি হয়ে যায়।”
প্রত্যাশা চমকে ওঠে। বলে,
“কী তখন থেকে শ্বশুড় শ্বশুড় করছিস? ততুই যা তো এখান থেকে…”
“তুমি নাওয়াস ভাইয়ার সাথে প্রেম করছো তাই না?”
পিউয়ের বাক্যে প্রত্যাশা হতবিহ্বল হয়। পিউয়ের দিকে বিস্মিত লচোনে চায়। প্রত্যাশার এহেন দৃষ্টিতে পিউ ফিক করে হেসে ফেলে। বলে,
“ভয় পেলে আপু? আমি কিন্তু জানি তুমি আর নাওয়াস ভাইয়া প্রেম করছো। নিহান বলেছে আমাকে।”
“তুমি যায় বলো, নাওয়াস ভাইয়া আর তোমার জুটি কিন্তু পুরো হিট জুটি।”
“পিউ আস্তে! কেউ শুনলে কী হবে বুঝতে পারচ্ছিস?”
পিউ সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে দেখলো। প্রত্যাশা রেডি হয়ে কাধে ব্যাগ তুলে নিলো। তারপর পিউকে এখনই বিষয়টা কাউকে জানাতে বারণ করে বেরিয়ে গেলো।
প্রত্যাশা নাওয়াসদের বাড়ির সামনে নামল। এর আগে একবার এই বাড়িতে এসেছিলো। তবে সেটা সাহায্য করতে। কিন্তু আজ… প্রত্যাশা জ্বিভের সাহায্যে নিজের শুষ্ক ওষ্ঠ জোড়া ভিজিয়ে নিলো। প্রত্যাশার প্রচুর নার্ভাস লাগছে। ধীরুজ কদমে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। কলিং বেল চাপতে নিয়েও চাপলো না। বরং উল্টো ঘুরে চলে যেতে নেয়। সেই সময় কট করে দরজা খুলে যায়। প্রত্যাশা চমকিত পিছে ফিরে। নজরে আসে নাওয়াসকে। যার পরনে সাদা টি-শার্ট আর টাওজার। এমন নরমাল লুকে প্রত্যাশা নাওয়াসকে আগে দেখেনি। ছেলেটার ওষ্ঠ ধারে লেপ্টে রয়েছে হাসি। প্রত্যাশা থমকায় কয়েক মুহূর্তের জন্য। নাওয়াস ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“আমাকে দেখা হলে ভিতরে এসো।”
নাওয়াসের কথায় প্রত্যাশা ধ্যান ছোটে। একেই নার্ভাস ছিলো। তার ওপর এরূপ বাক্য। প্রত্যাশা অপ্রস্তুত হয়। নাওয়াস বলে,
“কী হলো আসবে না? এক মিনিট তুমি কী ঘুরে যাচ্ছিলে?”
নাওয়াস কথা বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রত্যাশা এদিক ওদিক চোখ ঘুরায়। নাওয়াসের কপালে ভাঁজ পড়ে।
“ঘুরে কেন যাবো? একটু বাইরে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম নিহানের জন্য কিছু নিয়ে আসি তাই…”
প্রত্যাশার অগোচ্ছালো উত্তর। নাওয়াসের ভ্রু আরও গুটিয়ে আসে। বলে,
“আর ইয়্যু নার্ভাস!”
প্রত্যাশা নাওয়াস মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চাইল। প্রত্যাশার দৃষ্টিতেই নাওয়াসের যা বোঝার বুঝে যায়। হেসে বলে,
“নার্ভাস হওয়ার কী আছে? তোমার সাথে নার্ভাস বিষয়টা যায় না।”
“আমি তো আঙ্কেলের সাথে আগে কখনও দেখা করিনি। উনি যদি আমাকে পছন্দ না করেন?”
নাওয়াসের নিঃসৃত বাক্যে প্রত্যাশা নাওয়াসের চিত্ত পানে চাইল। নাওয়াসের এই একটা বাক্যে প্রত্যাশার মাঝের সকল ভয় দ্বিধা মুহূর্তেই কেটে যায়। প্রত্যাশা শুধায়,
“তুমি কী করে জানলে দরজার বাইরে আমি আছি?”
“ব্যালকুনি থেকে দেখতে পেয়েছিলাম। তাই তো আগে আগে দরজা খুললাম। তোমায় চমকে দিতে।”
প্রত্যাশা হাসে। নাওয়াস প্রত্যাশাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে যায়। প্রত্যাশাকে দেখে রিনা আর নিহান হাসি মুখে এগিয়ে আসে।
“কেমন আছো আপু উফসসস্ স্যরি ভাবি…”
নিহানের কথায় প্রত্যাশা বিবর্তবোধ করে। রিনা বিষয়টা বুঝে হেসে বলে,
“আসো! সেই সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। অবশেষে তুমি আসলে।”
প্রত্যাশা হাসে। বলে,
“আপনি কেমন আছেন আন্টি?”
“আলহামদুলিল্লাহ মা ভালো আছি। দেখেছো তোমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কথা বলছি।”
রিনা প্রত্যাশাকে হাত ধরে নিয়ে সোফায় বসায়। নাওয়াস প্রত্যাশার মুখো মুখি সোফায় বসে। নিহান, রিনা আর প্রত্যাশা গল্প করে। নাওয়াস ওদের গল্প শোনে। নিহান উঠে গিয়ে নাওয়াসের পাশে বসে বলে,
“ভাই ভাবিকে পেয়ে মা তো আর আমাদের পাত্তায় দিচ্ছে না।”
নিহানের কথায় নাওয়াস হাসে। সেই সময় বাড়িতে কামাল মাহমুদ প্রবেশ করেন। সদর দরজা খোলায় ছিলো। বসার ঘর থেকে কথার আওয়াজও পান। তিনি সরাসরি বসার ঘরেই যান। কামাল মাহমুদকে প্রথমে নিহান খেয়াল করে। বলে,
“বাবা! তুমি কখন এলে? আমরা তোমার অপেক্ষায় করছিলাম।”
নিহানের বাক্যে সবাই কামাল মাহমুদের দিকে তাকায়। প্রত্যাশাও চাইল। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। কামাল মাহমুদ সালামের জবাব দিয়ে এগিয়ে আসেন। কামাল মাহমুদের গুরুগম্ভীর মুখশ্রী দেখে প্রত্যাশার নার্ভাসনেস ফিরে আসে। ভারিক্কি স্বরে কামাল মাহমুদ প্রশ্ন করেন।
“তোমার সাথে নাওয়াসের সম্পর্ক আছে?”
প্রত্যাশার মাঝে একরাশ অস্বস্তি চলে আসে। মাথা নামিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,
“জ্বি!”
“তোমার নাম?”
“জ্বি প্রত্যাশা ইমাম!”
“তোমার বাবার নাম?”
প্রত্যাশা নার্ভাস বুঝে নাওয়াস বলে,
“বাবা তোমাকে আমি কাল রাতে বললাম না? ও ঔষধ ব্যবসায়ী পূর্ব ইমামের মেয়ে…”
নাওয়াসের কথায় কামাল মাহমুদ বললেন,
“আমি তোমার সাথে কথা বলছি না।”
নাওয়াস কিছু বলতে নিলেই রিনা ইশারায় চুপ করিয়ে দেন। প্রত্যাশা মাঝে এবার কিঞ্চিৎ ভয় কাজ করে। পূর্ব ইমাম নিজের কণ্ঠে আরও গাম্ভীর্য এনে প্রশ্ন করেন।
“তুমিই সেই মেয়ে যে আমার ছেলে কে থা’প্প’ড় মে’রে ছিলে?”
নাওয়াসের বাবার কথায় প্রত্যাশা হকচকায়। একরাশ অস্বস্তি, ভয় আর লজ্জা ওকে জেকে ধরে। এদিক ওদিক এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে। নতজানু হয়ে কোনো মতে কণ্ঠ হতে শব্দ বার করে, ধীম স্বরে বলে,
“জ্বি!”
“তোমার থা’প্প’ড়ে যদি ওর বখাটেগিরি দূর হয়। তাহলে নিয়ম করে রোজ দু-চারটে থা’প্প’ড় দেবে।”
প্রত্যাশা হতভম্ব হয়ে কামাল মাহমুদের আনন পানে চাইলো। নিহান তো শব্দ করে হেসে ওঠে। রিনাও মুখ টিপে হাসে। নাওয়াস নিজের বাবার এহেন বাক্য কিংকতর্ব্যবিমুঢ় হয়। প্রত্যাশা এখনও বিস্ময় ভাব কাটাতে পারেনি। তখন নাওয়াস বলে,
“তুমি কেমন বাবা? নিজের ছেলের বউকে শিখিয়ে দিচ্ছো ছেলেকে নিয়ম করে থা’প্প’ড় মা’রতে?”
“ওর থা’প্প’ড়েই তো তুমি সিধে হয়েছো। আমি তো তোমায় শাসণ করতে পারিনি। তাই শুরুতেই ওকে দায়িত্ব দিয়ে দিলাম। যাতে ভবিষ্যৎ আর তুমি বখে না যাও।”
কামাল মাহমুদের এই কথায় এবার প্রত্যাশার হাসি পায়। মুখ টিপে হাসেও। কামাল মাহমুদ প্রত্যাশার উদ্দেশ্যে বলল,
“তুমি আমার এই বাউণ্ডুলে ছেলেটার দায়িত্ব নিবে? আমাদের মেয়ে হয়ে আসবে? এই বাড়িতে না একটা মেয়ের বড্ড অভাব।”
প্রত্যাশার এতক্ষণের সকল নার্ভাসনেস কেটে যায়। কামাল মাহমুদ নিজেই ওকে নাওয়াসকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন। সেটাও বুঝতে পারে। বলল,
“আসবো আঙ্কেল!”
কামাল মাহমুদের কপালে ভাঁজ পড়ে। আবারও গম্ভীর স্বরে বলেন,
“আঙ্কেল কী? বাবা বলো মেয়ে। আজ থেকে আমিও তোমার বাবা হয়। ওই সব আঙ্কেল টাঙ্কেল চলবে না।”
এবার প্রত্যাশা গাল ভরে হাসে। বলে,
“তাহলে তোমারও আমাকে তুই করে বলতে হবে বাবা!”
উত্তরে কামাল মাহমুদ হাসেন। বলেন,
“ঠিক আছে বলবো!”
“বাহ্! ভাইয়ার বিয়ে না হতেই হবু ভাবি মেয়ে হয়ে গেলো। আর আমরা দুই ভাই পর। আমাদের চাঁন্দে চিনে না,সূর্যেও চিনে না। আমাদের তো দেখছি কানো কদরই নাই।”
নিহানের রঙ্গাত্মাক কণ্ঠ। সকলে উচ্চ শব্দে হাসে। প্রত্যাশার পুরোটা দিন নাওয়াসের পরিবারের সাথে দারুণ কাটে। বিশেষ করে নাওয়াসের বাবার সাথে। মানুষটা অনেক ফ্রি মাইন্ডের। প্রত্যাশা একটা জিনিস আবিষ্কার করে। কামাল মাহমুদ মেয়েদের অত্যন্ত ভালোবাসেন। এই কয়েক ঘণ্টা যতটা স্নেহ প্রত্যাশা কামাল মাহমুদের থেকে পেলো। তার এক শতাংশও পূর্ব ইমামের থেকে পাননি। পূর্ব ইমামের মাঝে কন্যা সন্তান নিয়ে কেমন একটা বিদ্বেষ কাজ করে। এই সব কথা ভেবে, প্রত্যাশার বুক থেকে ভারী শ্বাস নিগত হয়। বিকেলের নাওয়াস আর প্রত্যাশা এক সাথে আরও কিছুটা সময় কাটায়। বাইকে করে ঘুরে বেড়ায়। আর এই দৃশ্য অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পূর্ব ইমামের নজরে পড়ে।
প্রত্যাশাকে সেই দিন নাওয়াসের সাথে দেখে পূর্ব ইমামের সন্দেহ হয়। তিনি লোক লাগিয়ে খবর নেন। বিগত এক সপ্তাহ ফলো করার পর, ওনার লোক জানান প্রত্যাশা আর নাওয়াস সম্পর্কে আছে। বিষয়টা জানার পর পূর্ব ইমাম প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে যান। এটাও বুঝে যান প্রত্যাশার এতদিন ঠিক কী কারণে বিয়ে হয়নি। প্রত্যাশাই যে ইচ্ছাকৃত বিয়ে ভেঙেছে। সেটা বুঝতে পারেন। তাই তিনি মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। প্রত্যাশা এমনকি সবার অগোচরে প্রত্যাশার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তবে মিনা স্বামীর এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সবটা জানেন। কিন্তু কিছু বলেন না। কিই বা বলবে, প্রত্যাশার এই সম্পর্কে যাওয়ার দায় যে ওনার ওপর এসে পড়েছে। বলার মতো কিছুই পান না। এমন না বোঝাতে চাননি। বোঝাতে নিয়ে স্বামীর তিক্ত কটূক্তির স্বীকার হয়েছে। তাই চুপ চাপ সব মেনে নিয়েছে। আজ প্রত্যাশার বিয়ে সকাল থেকেই সব তোরজোড় শুরু হয়েছে। প্রত্যাশা সন্ধ্যের কিছু সময় আগে বাড়ি ফেরে। বাড়ি এরকম সাজানো দেখে প্রত্যাশার কপালে ভাঁজ পড়ে। মনে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। ভিতরে প্রবেশ মাত্র যা শোনে, তাতে প্রত্যাশার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে আসে।
“বাবা!আজ আপু বিয়ে আপু কী সেটা জানে?”
পূর্ব ইমাম পিউকে ধমক দিয়ে বলেন,
“তা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। যাও গিয়ে মায়ের সাহায্য করো।”
প্রত্যাশা হতবুদ্ধির ন্যায় সব শোনে। পরপর চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
“ও-কে না-হয় ধমকে চুপ করিয়ে দিলে… কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর তো তোমাকে দিতে হবে।”
পূর্ব ইমাম পিছনে ফিরে চাইল। একপলক প্রত্যাশাকে দেখল। তারপর আবারও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রত্যাশা এগিয়ে এসে বলল,
“এসব কিছুর মানে কী বাবা? তুমি সত্যিই আমার বিয়ে ঠিক করেছো?”
“হ্যাঁ করেছি।”
পূর্ব ইমামের গা ছাড়া উত্তর। প্রত্যাশা অবাক হয়। বলে,
“আমাকে না জানিয়ে তুমি এমনটা কী করে করতে পারো?”
“আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আমি তোমার বিয়ে দেবো।”
“তুমি আমায় বিয়ের জন্য সম্বোন্ধ দেখার কথা বলেছিলে। এখানে তো তুমি পুরো বিয়ের দিনক্ষণ পাক্কা করে তোরজোড় করে ফেলেছো…”
“বিষয়টা একই! তাছাড়া ছেলে ভালো। আমার বন্ধুর ছেলে। তুমি যেমন বলেছিলে,তোমার স্বপ্ন মেনেই ছেলে তোমাকে বিয়ে করবে। তাই মনে হয় না এই বিয়েতে তোমার কোনো আপত্তি থাকার কথা।”
প্রত্যাশা বলে,
“আমি এই বিয়ে করবো না!”
পূর্ব ইমাম ঠাণ্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন করেন,
“কেন?”
“কারণ আমি একজন কে ভালোবাসি! বিয়ে করলে তাকেই করবো।”
“সেই ছেলে কী বখাটে নাওয়াস আফফান?”
পূর্ব ইমামের প্রশ্নে প্রত্যাশা চমকায়। চমকিত স্বরে বলে,
“তুমি কী করে জানলে?”
পূর্ব ইমাম চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
“কী ভেবে ছিলে? আমি কিছু জানতে পারবো না?”
প্রত্যাশা নিজেকে সামলে নিলো। বলল,
“তুমি যখন আগে থেকেই সবটা জানো। তখন আমার বিয়ে কেন ঠিক করেছো?”
প্রত্যাশার ঠাণ্ড কণ্ঠে পূর্ব ইমাম অবাক হোন। বলেন,
“তো তুমি কী চাও? সব জেনে শুনে আমি ওই বখাটের সাথে তোমার বিয়ে দেবো?”
“বাবা ওকে বখাটে বলবে না। ও এখন শুধরে গেছে।”
“চুপ করো তুমি!”
পূর্ব ইমামের হুংকারে মিনা আর পিউ বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রত্যাশা আর পূর্ব ইমামের মুখ দেখে বুঝে যায়। এখানে কী ঘটেছে।
“লজ্জা করে না তোমার? একটা বখাটের সাথে সম্পর্কে জড়াতে? তুমি না খুব আত্মসন্মান দেখাও? এই তোমার আত্মসন্মানবোধ? শেষে কি-না একটা বখাটের সাথে… ছিহ্ আমার বলতেও ঘৃণা লাগছে। আমি ভাবতেও পারিনি তুমি এভাবে আমার মান-সন্মান নষ্ট করবে। মুখে চুনকালি মাখাবে।”
“হ্যাঁ সব জেনে শুনেই আমি নাওয়াসকে ভালোবাসি। আর বিয়ে করলে নাওয়াসকেই করবো।”
রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পূর্ব ইমাম প্রত্যাশাকে থা’প্প’ড় মেয়ে বসেন। মিনা চমকে ওঠেন। এগিয়ে আসতে চাইলে পূর্ব ইমাম হুংকার করে ওঠেন,
“খবরদার! আজ কেউ আসবে ওর আর আমার মাঝে।”
পূর্ব ইমামের হুংকারে মিনা থেমে যান। পূর্ব ইমাম রাগে হিসহিসিয়ে বলেন,
“ওই বখাটের সাথে তোমার বিয়ে আমি কখনো দেবো না। বিয়ে তোমাকে আমার দেখা পাত্রের সাথেই করতে হবে।”
পূর্ব ইমাম চলে যেতে নেয়। প্রত্যাশা বলে,
“তুমি আমার ওপর নিজের জোর খাটাতে পারবে না বাবা। আমি তোমার দেখা পাত্রের সাথে কখনই বিয়ে করবো না। প্রয়োজন পড়লে আমি এই বাড়ি ছেড়ে দেবো।”
প্রত্যাশা নিজের কথা শেষ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পূর্ব ইমামের মুখ দেখে মনে হয় উনি যেন বিষয়টা আগেই আন্দাজ করে ছিলেন। সেকারণেই অত্যন্ত শীতল স্বরে বলে,
“যে মুহূর্তে তুমি এই বাড়ির চৌকাঠ পেরুবে। সেই মুহূর্তে আমি তোমার মা আর বোন কেউ এই বাড়ি থেকে বের করে দেবো।”
পূর্ব ইমামের নিঃসৃত বাক্য প্রত্যাশার পা থেমে যায়। বিস্ময়ে কিংকতর্ব্যবিমুঢ় বনে যায়। পিছে ফিরে অবিশ্বাস্য স্বরে বলে,
“বাবা…”
“সিদ্ধান্ত তোমার বিয়ে করবে নাকি করবে না।”
পূর্ব ইমাম দাড়ান না। চলে যান। প্রত্যাশা এখনও বিহ্বল বনে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ব ইমামের এরূপ বাক্যে মিনাও পাথর বনে যান। ওনাদের দুজনের ধ্যান ভাঙে পিউয়ের কান্নায়।
“বা..বাবা এমন একটা কথা বলতে পারলো? বাবা আমাদের একটুও ভালোবাসে না। একটুও না। স্বার্থপর লোক একটা।”
“মা এখনও তুমি বাবার সাপোর্ট নিয়ে কথা বলছো? এতকিছুর পরও?”
“হ্যাঁ বলছি। কারণ উনি ঠিক। ওনার নেওয়া সিদ্ধান্তও ঠিক। কথা না বাড়িয়ে তৈরি হয়ে নে। তোর ঘরে তোর পোশাক রাখা আছে।”
মিনা চলে যেতে নিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“আশা করি তুই এমন কিছু করবি না। যার জন্য আমাদের মান-সন্মান ধূলিসাৎ হয়।”
মিনাও চলে যায়। মায়ের এরূপ ব্যবহারে পিউ প্রত্যাশা দুজনেই অবাক হয়। পিউ এগিয়ে এসে বলে,
“আপু এখন কী হবে? তুই কী স্যতিই এই বিয়েটা করবি?”
পিউয়ের প্রশ্নের উত্তরে প্রত্যাশা বলে,
“করবো!”
পিউ বিস্ফোরিত নেত্রে চায়। প্রত্যাশা মনে মনে বলে,
“আমিও তোমার মেয়ে বাবা। আমার জেদ সম্পর্কে তুমি জানো না। তুমি বললে না,এই বাড়ির বাইরে না বের হতে। হবো না বের। বিয়ে করেই এই বাড়ি ছাড়বো আমি।”
_____
কনে বেসে সোফায় বসে আছে প্রত্যাশা। সামনেই তার বাবা, মা, পিউ আর অপরিচিত আরও কিছু মুখ। তাদের মধ্যে একজন হুজুর আর একজন কাজী। প্রত্যাশা লাল টুকটুকে বউ সেজেছে। দেখতে ভারী মিষ্টি লাগচ্ছে। কাজী কাবিন নামা লিখছেন। কাবিন নামা লেখা শেষ হতে প্রত্যাশার উদ্দেশ্যে বলেন,
“পিতা:জামাল খান এবং মাতা:খাদিজা বেগমের একমাত্র পুত্র জাহিদ খানের সাথে বিবাহে আপনি কী রাজি? যদি রাজি থাকেন তাহলে বলুন কবুল!”
প্রত্যাশা চুপ রয়। কাজী আবারও কবুল বলতে বলে। সকলের উৎসুক দৃষ্টি প্রত্যাশার দিকে। প্রত্যাশা কাঠ পুতুলের ন্যায় বসে আছে। সেই সময় একটি আওয়াজ ভেসে আসে।
“বন্ধ করুন এই বিয়ে!”
আওয়াজের উৎস ধরে সকলে দরজার দিকে চাই। দরজার দিকে চাইতে পূর্ব ইমামের মুখের আদল বদলে যায়। নিরেট চোয়ালে গার্ডের ইশারা করেন। ওদের আটকাতে। গার্ডরা নাওয়াসের সামনে গিয়ে ওকে আটকায়। নাওয়াস একপলক গার্ডকে দেখে নিয়ে নাক বরাবর ঘুষি মা’রে। লোকটা ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়। আরও কয়েকজন এগিয়ে যায়। নাওয়াস তাদের চ’ড় থা’প্প’ড় মা’রে। পিয়াশ,তন্ময় আর মিন্টুকে ইশারা করে। নাওয়াস ইশারা করতে ওরা বাকিদের মা’রে। পিয়াশ বলে,
“ওকে চিনিস ও কে? ও হচ্ছে নাওয়াস আফফান।”
নাওয়াস আফফান নাম শোনা মাত্রই গার্ডরা বিস্মিত হয়। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়। বিয়ের সময় একটা অচেনা-অজানা ছেলের এভাবে বাধা দেওয়ায়। সবার অবাক হওয়ার কথা হলেও,কেউ অবাক হয় না। কেননা পূর্ব ইমাম আগেই এই বিষয়ে আন্দাজ করেছিলেন। এবং বন্ধুকেও জানিয়ে ছিলেন। তার বন্ধু তাকে পূর্ণসমর্থন করেছেন। উনিও মানেন মেয়ে ভুল করলে, বাবা মা তো আর তাকে ভুল করতে দিতে পারে না। সে কারণেই সব কিছুর জন্য উনি প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। নাওয়াস এগিয়ে আসে। একপলক প্রত্যাশার দিকে তাকায়। বধূবেশে প্রত্যাশাকে অসাধারণ লাগছে। নাওয়াস হালকা হাসে। সবাই কে এক লহমায় দেখে নিলো। পূর্ব ইমামের শক্ত চোয়ালের দিকে তাকাতে,নাওয়াসের চোয়ালও শক্ত হয়ে আসে। নাওয়াস বলে,
“সিংহ শিকার করা ছেড়ে দিয়েছে মানে এই না, শিকার করতে ভুলে গেছে। নাওয়াস আফফান ভালো হয়ে গেছে, তার মানে এটা না যে খারাপ হতে পারবে না। আপনি যে ক্ষমতা আমাকে দেখাতে চেয়ে ছিলেন।সেই ক্ষমতা আমি আমার ব্যাক পকেটে রাখি।”
পূর্ব ইমাম কোনো উত্তর করে না। চোখ মুখ শক্ত করে কাজীর উদ্দেশ্যে বলেন,
“কাজী সাহেব বিয়ে পড়ান।”
কাজী বিয়ে পড়াতে নিলে নাওয়াস বলে,
“আরে এতো তাড়া কিসের শ্বশুড় মশাই? মেয়ের এই বিয়েতে মত আছে না-কি সেটা তো আগে শুনুন।”
“ওর মত থাক বা না থাক এই বিয়ে হবে। কারণ এটা আমার সিদ্ধান্ত!”
“কাজী সাহেব মেয়ের অমতে ইসলামে কী বিয়ে জায়েজ আছে?”
“জ্বি না! নেই!”
নাওয়াস বাঁকা হাসে। নাওয়াসের বাবা কামাল মাহমুদ বলে,
“কন্যা সন্তান ঘরের রানী হয়। তাদের সাথে এমন রুক্ষ আচারণ করতে নেই। তাদের অমতে, জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত চাপাতে নেই।”
পূর্ব ইমাম ক্ষেপে গেলো। বলল,
“একদম জ্ঞান দেবেন না। নিজের ছেলেকে তো মানুষ করতে পারেননি। আপনার সামনে,আমার বাড়িতে এসে, আমার সামনেই বখাটেগিরি করছে। মা’রপিট করছে। বাবা হয়ে আপনি তাকে থামানোর বদলে উসকানি দিচ্ছেন? লজ্জা করে না আপনার?”
নাওয়াসের রাগ হয়। তবে নিজের রাগ গিলে বলে,
“মানলাম আমার বাবা আমাকে মানুষ করতে পারেনি। আমাকে উসকানি দিচ্ছে। তা আঙ্কেল আপনার প্রাণের বন্ধু তার ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছে তো?”
জামাল খান বলে,
“অ্যাই ছেলে! কি বলতে চাও তুমি?”
নাওয়াস বাঁকা হাসে। বলে,
“কেন আপনার গুণধর ছেলের গুনকীর্তন করতে চাই।”
জামাল খান ঘামতে শুরু করেন। নাওয়াস তা দেখে বলে,
“হবু শ্বশুড় আব্বা, আপনার বন্ধু কী আপনাকে জানিয়েছে? তার ছেলে বিবাহিত? বিদেশে থাকালীন সে বখে গেছিলো। একটা মেয়েকে টিজ করেছিলো। তার পরিবার কেস করাই, আপনার প্রাণের বন্ধু কেস তুলতে। সেই মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দিয়ে ছিলো। আপনি কী জানেন এগুলো?”
পূর্ব ইমাম তাচ্ছিল্য করে বলেন,
“তোমার কী মনে হয়? তুমি বলবে আর আমি মেনে নিবো? আমি তোমার মতো বখাটেদের বিশ্বাস করি না। তোমরা হলে এই সমাজের নোংরা।”
“আমার ছেলের সম্পর্কে ভদ্র ভাবে কথা বলবেন।”
রিনা রেগে বলল। মিনা বলল,
“তাহলে আপনার ছেলেকে তামাশা করতে মানা করুন। এটা একটা ভদ্র পরিবার। আপনার ছেলেকে নিয়ে
আমার মেয়ের জীবন থেকে আর এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।”
রিনা কিছু বলতে নিলেই নাওয়াস থামিয়ে দেয়। কামাল মাহমুদও ইশারায় শান্ত হতে বলে।
“আমি জানি আপনি আমায় বিশ্বাস করবেন না। তন্ময়!”
তন্ময় এগিয়ে আসে। নাওয়াসকে একটা খাম দেয়। নাওয়াস সেগুলো পূর্ব ইমামকে দিলো।
“এটা আপনার বন্ধুর ছেলের কাবিনের কপি! আর কেস কপিও আছে।”
পূর্ব ইমাম কাগজ গুলো দেখলেন। কাগজ গুলো আসল।সেটা বোঝা যাচ্ছে। পূর্ব ইমাম চমকিত চাইল বন্ধুর চিত্ত পানে। জামাল ধরা পড়েছে বুঝে বলেন,
“এগুলো মিথ্যে! আমার ছেলেকে ফাঁসানো হয়েছিলো। আমি বাধ্য হয়েই এই বিয়ে দিয়েছিলাম। মেয়েটা টাকার লোভে পড়ে আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে ছিলো। ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। মেয়েটা একদম ভালো ছিলো না…”
জামাল খান উত্তেজনায় নিজের মুখেই সব স্বীকার করলেন। সব শুনে পূর্ব ইমাম স্তব্ধ হয়ে যান। প্রিয় বন্ধুর থেকে এমন ধোঁকা তিনে মানতে না পেরে পাথর বনে দাঁড়িয়ে থাকেন। নাওয়াস তা দেখে হাসে।
দৃষ্টি ঘুরিয়ে বধূরূপে সোফায় বসা প্রত্যাশা দিকে চাইল। যার ঠোঁটে লেপ্টে আছে সূক্ষ্ম হাসি। নাওয়াস এগিয়ে যায়, একপাশে হেসে প্রত্যাশার পাশে বসে বলল,
“কাজী সাহেব নতুন কাবিন নামা লিখুন। বরের নামের জায়গার লিখুন নাওয়াস আফফান। মাতা: মৃত নাসরিন এবং
পিতা:কামাল মাহমুদ।”
“কিন্তু কন্যার বাবা…”
“চিন্তা করবেন না। উনি আর কিছু বলবেন না।”
জামাল বলে,
“পূর্ব তুই বিয়ে আটকাবি না? দেখ তোর মেয়ের সাথে একটা বখাটের বিয়ে হচ্ছে। ওর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।”
“ওর সাথে বিয়ে হলে কতটা জীবন নষ্ট হবে আমি জানি না। তবে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে হলে অবশ্যই ওর জীবন নষ্ট হবে।”
রিনার কথায় জামাল অবাক হয়ে বলেন,
“ভাবি!”
“হ্যাঁ! আমার মেয়ের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। ওর প্রতিটা সিদ্ধান্ত অর্থবহ এবং সঠিক হয়। ও মানুষ চিনতে জানে। নিজের জেদ বজায় রাখতে কিছু করে না…”
শেষোক্ত কথাটা যে পূর্ব ইমামের উদ্দেশ্যে ছিলো। সেটা পূর্ব ইমামের বুঝতে কষ্ট হয় না। যে আজ পর্যন্ত তার সিদ্ধান্তের বাইরে যায়নি। সেই স্ত্রীই আজ চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলো। তিনি ভুল। মিনা ফের বললেন,
“কাজী সাহেব আমি মেয়ের মা। আমি হুকুম দিচ্ছি আপনি বিয়ে পড়ান। মেয়ের পক্ষে আমি সাক্ষী দেবো।”
প্রত্যাশা নিজের মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের সাথে চোখা-চোখি হতে আলতো হাসে। মিনা ইশারায় ভরসা জোগায়। কাজী নতুন করে কাবিন নামা লেখে। তারপর কাজী বিয়ে পড়ায়। প্রত্যাশা এবার বিলম্বহীন কবুল বলে। নাওয়াস আর প্রত্যাশার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই নাওয়াস প্রত্যাশার হাত নিজের শক্ত হাতের মুঠোই বন্দি করে নিলো। উঠে দাঁড়িয়ে পূর্ব ইমামের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“এই যে পূর্ণ অধিকার নিয়ে ওর হাত ধরলাম। মৃ’ত্যু’র আগ পর্যন্ত আর এই হাত ছাড়বো না। আপনি নিঃশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ওকে আমার পরিবার, আমার বাবা-মা মাথায় করে রাখবে।”
প্রত্যাশা এক দৃষ্টিতে নাওয়াসের দিকে তাকিয়ে থাকে। কামাল মাহমুদ এগিয়ে আসে। প্রত্যাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“চল মা! বাড়ি চল।”
প্রত্যুত্তরে প্রত্যাশা মুচকি হাসে। মিনা মুগ্ধ হয়ে দেখেন। পূর্ব ইমাম এক দৃষ্টিতে প্রত্যাশার দিকে চেয়ে থাকে। মেয়েটার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি। কামাল মাহমুদের চোখে প্রত্যাশার জন্য স্নেহ, আর ওনার প্রতি প্রত্যাশার শ্রদ্ধা দুটোই অনুভব করেন। এই মুহূর্তে যেনো তিনি উপলব্ধ করতে পারেন। তিনি বাবা হিসেবে ব্যর্থ। প্রত্যাশা পূর্ব ইমামের সামনে এসে দাঁড়ায়। শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলে,
“নাওয়াসকে বখাটে বলে, একটু আগে ওকে সমাজের নোংরা বলেছিলে না? ওকে এই সমাজের নোংরা কারা বানিয়েছে জানো? তোমরা মতো কিছু নিম্ন মানুসিকতার মানুষ। যারা নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝে না। এমন কি সন্তান কেউ না… ওর মতো বখাটেরা এই সমাজে আছে বলেই রাস্তায় মেয়েরা এখনও নিরাপদ। আর এমন একজনকে ভালোবেসে আমি কোনো ভুল করিনি।”
প্রত্যাশা থামে। চুপ থেকে পুনরায় বলে,
“তুমি বলেছিলে বিয়ে ব্যতিত আমি এই বাড়ির চৌকাঠ পেরুলে,মা আর পিউকে বার করে দিবে। এই যে আমি বিয়ে করে এই চৌকাঠ পেরুবো। আর কখনও এই চৌকাঠ পেরিয়ে এই বাড়িতে আসবো না।”
প্রত্যাশা আর দাঁড়ায় না। পিউয়ের কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মাকে জড়িয়ে ধরে। নাওয়াস আর ওর পরিবারের সাথে এই বাড়ির চৌকাঠ পেরুল। এবং সেটা হাসি মুখে। এই দৃশ্য পূর্ব ইমাম এক দৃষ্টিতে দেখলেন। পিউ মিনাও প্রত্যাশার হাস্যজ্জ্বল আননের দিকে চেয়ে রইল।
.
.
.
নাওয়াস বাইক চালাচ্ছে প্রত্যাশা নাওয়াসের কোমড় জড়িয়ে পিছে বসে আছে। পরনে এখনও বিয়ের পোশাক। সবাই বাড়ি চলো গেলেও প্রত্যাশা নাওয়াসের বাইকে করে শহর ঘুরতে চাইল। অর্ধাঙ্গিনীর ইচ্ছে পূরণে নাওয়াস দ্বিমত করে না। ওকে নিয়ে শহর ঘুরতে বেরিয়ে পরে। রাতের শহর শুনশান রাস্তা। সাথে হিমেলা মৃদু বাতাবয়ান। সাথে প্রিয় রমনী। ব্যাপারটা খারাপ না। নাওয়াস বাইক একটা লেকের পাড়ে থামাল। প্রত্যাশা নেমে দাঁড়ায়। নাওয়াসও বাইক পার করে নামে। প্রত্যাশার ঠোঁটের কোণে লেপ্টে আছে হাসি। চোখ জোড়া নাওয়াসে নিবদ্ধ। নাওয়াস ভ্রু নাঁচিয়ে শুধাল,
“হাসছো কেন?”
“এমনি!”
“এমনি আবার কেউ হাসে?”
“আমি হাসি!”
নাওয়াস প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে থাকল। কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হলো। নাওয়াস কিছু একটা ভাবল। বাঁকা হেসে আকাশের দিকে চেয়ে দুঃখী ভাবে বলল,
“কেউ আমাকে ভালোবেসে অন্যের জন্য বউ সেজে বসে ছিলো। এই না-কি সে আমায় ভালোবাসে।”
“কারণ সেই কেউ জানতো, তার বিয়ে হবে না। একটা বখাটে তার বিয়ে হতে দেবে না। সময় মতো এসে তাকে নিয়ে যাবে।”
নাওয়াস ঠোঁট টিপে হাসল।
“তাই? যদি আসতে দেরী করতাম?”
প্রত্যাশা নাওয়াসের চোখে দিকে তাকাল। মন্থর স্বরে বলল,
“অপেক্ষা করতাম!”
“যদি কখনোই না আসতাম?”
“আসতে…”
নাওয়াস ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে। বলে,
“এত বিশ্বাস?”
“হুম!”
প্রত্যাশা ছোট্ট উত্তর। কিন্তু নাওয়াসের মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়। মেয়ে তাকে শুধু ভালোই বাসে না। বিশ্বাসও করে। তাই তো বিয়ে আগে তাকে কল করে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বলেছিলো,
“বাবা আমাদের বিষয়ে জেনে গেছে। আমাকে না জানিয়ে তার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। আমি চাইলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমি চাই তুমি এসে,সবার সামনে দিয়ে পূর্ণ অধিকারে আমাকে নিয়ে যাও।”
নাওয়াসকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রত্যাশা কল কেটে দিলো। প্রত্যাশার নিঃসৃত বাক্যে নাওয়াস হতবিহ্বল বনে যায়। পরপর মস্তিষ্কে প্রত্যাশা বলা কথা পৌঁছাতে রাগে মাথার তালু জ্বলে ওঠে। পরক্ষণে নিজেকে শান্ত করে। তন্ময়,পিয়াশ,মিন্টুকে ছেলের বিষয়ে খোঁজ নিতে পাঠায়। এই ভেবে যে ছেলেকে বিয়ের আগে গু’ম করে দিবে। তার ভালোবাসার দিকে হাত বাড়ানোর জন্য একটু শাস্তিও দেবো। কিন্তু খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারে ছেলের আগেও বিয়ে হয়েছে। এবং পুলিশের খাতায় নামও আছে। ব্যস নাওয়াসের বেশি কষ্ট করতে হলো না। সব প্ল্যান বাদ দিয়ে ছেলের কাবিন নামা জোগাড় করে। অল্প সময়ের মধ্যে এগুলো করতে পারতো না। যদি না তার বাবার হাত লম্বা হতো। ভাগিস্য তার বাবার বড়ো বড়ো রাঘব বোয়ালদের সাথে ওঠা বসা ছিলো।
“তুমি তো বউ সেজে বিয়ে করলে। কিন্তু আমি তো করতে পারলাম না।”
নাওয়াসের কথা কর্ণপাত হতে প্রত্যাশা নাওয়াসের দিকে চাইলো। পা থেকে মাথা অব্দি অবলোকন করল। পরনে ফর্মাল ড্রেস আপ। ছেলেটা যে অফিস থেকে ছুটে ছিলো তা বুঝতে পেরে প্রত্যাশা হাসল। বলল,
“সমস্যা কী? সবার মতো তোমার হতে হবে কেন? এমনিতেও তুমি সবার থেকে আলদা। বখাটে হয়েও খারাপ কাজ করো না। তেমনই বর না সেজেই বর হলে… ব্যাপারটা ইউনিক।”
নাওয়াস ছোটো ছোটো চোখে চাইল। বলল,
“তোমার মতো নির্লজ্জ কনে আমি একটাও দেখিনি।”
সহসাই প্রত্যাশা ভ্রু কু্চকায়।
“আমি নির্লোজ্জ?”
“তা নয়তো কী? তোমার বিয়ে হলো, কোথায় তুমি লজ্জায় রাঙা হয়ে চোখ নামিয়ে রাখবা। তা না তুমি বড়ো বড়ো চোখ করে ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকাছো। আবার আমার থেকেও ফাস্ট কবুল বলেছো। বিদায়ের সময় কান্নাটা অব্দি করোনি…”
“কান্না কেন করবো? আমি তো আমার প্রিয় পুরুষকেই বিয়ে করেছি। তাকে নিজের স্বামী রূপে পেয়েছি। এটা কোনো কান্না করার বিষয়?”
“আরে তুমি তো নিজের বাড়ি ছেড়ে আসলে। এই দুঃখেও তো কান্না করতে পারতে তাই না?”
“আমি এক বাড়ি ছেড়ে আমার আজীবনের বাড়িতে এসেছি। এতে দুঃখের কিছু নেই। হ্যাঁ মা আর পিউয়ের জন্য একটু খারাপ লেগেছে। তবে সেটা কান্না করার জন্য কম।”
নাওয়াস হতভম্ব হয়ে যায়। এই মেয়ে বলে কী?
“এই তুমি মানুষ তো? মানে এত স্বাভাবিক কেউ কী করে থাকে? তুমি যে পরিস্থিতির মধ্যে ছিলে। সেই পরিস্থিতির জন্যে হলেও তো কান্না করতে পারতে। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না করতো।”
“আমি কাঁদলে তোমার ভালো লাগতো?”
প্রত্যাশার কঠিন প্রশ্ন নাওয়াস থতমত খায় বলে,
“আরে না। কিন্তু তোমার এই ব্যক্তিত্ব আমাকে ভিষণ বিস্মিত করেছে। একটা মেয়ে এত শক্ত কী করে হয়?”
“শক্ত না হলে আজ তোমার সাথে আমার বিয়ে হতো না। শক্ত না হলে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম না। আমি শক্ত বলেই আমি সফল। আমার জীবনে অপ্রাপ্তির সংখ্যা কম…”
প্রত্যাশার উত্তরে নাওয়াস হাসে। মেয়েটার এই চিন্তা ধারায় ওকে সবার থেকে আলাদা করে। আর নাওয়াসকে ওর দিকে টানে। এই অসাধারণ রমনীটি আজ থেকে তার বউ। বউ শব্দটা আওড়াতেই নাওয়াসের শরীর ঝঁংকার দেয়। মনে এক ঝাঁক রঙিন প্রজাপ্রতি উঁড়ে। নাওয়াস প্রত্যাশার মুখশ্রী হাতের আঁজালে নিলো। প্রত্যাশার কপালে কপাল ঠেকিয়ে প্রেমময় স্বরে বলল,
“তুমি আমার জীবনে এক ঝড়ো হাওয়ার মতো। ঝড় এসে যেমন ঝড়ো হাওয়ায় সব তচ্ছনচ্ছ করে দেয়। তুমি তেমন চিরাচরিত আমি টাকে তচ্ছনচ্ছ করে দিলে। ধ্বংস করে নতুন আমিকে গড়লে। তুমি আমার জীবনের এক সুখকর ঝড়,যার ঝড়ো হাওয়ায় আমার অগোচ্ছালো জীবনের ছন্দপত ঘটে। বখাটে নাওয়াস আফফান থেকে জেন্টলম্যান নাওয়াস আফফান জন্ম নেয়…”
“আমার কিন্তু বখাটে, বাউণ্ডুলে নাওয়াস আফফানকেই বেশি পছন্দ।”
নাওয়াস দুষ্টুমি স্বরে বলে,
“বখাটে নাওয়াস কিন্তু ভালো না। সে কিন্তু নিজের বউয়ের পূর্ণ সুযোগ নেবে…”
নাওয়াসের কথার ইঙ্গিত ধরতে পেরে প্রত্যাশা গণ্ডযুগল র’ক্তিম আভা ধারণ করে। প্রত্যাশাকে লজ্জা পেতে দেখে নাওয়াস বলে,
পূর্ণতা পেলো আরও এক জোড়া ভালোবাসা। যাদের ভালোবাসা প্রমাণ করল। ঝড় সব সময় ধ্বংসী হয় না। আপাত দৃষ্টিতে ধ্বংস মনে হলেও, সেই ধ্বংসের পিছনে থাকে আল্লাহর পরিকল্পিত কোনো মঙ্গল। ঠিক যেমন প্রত্যাশা নামক #এক_ঝড়ো_হাওয়ায় নাওয়াসের মতো বখাটে,বাউণ্ডুলে ছেলে ধ্বংস হয়ে, নতুন এক নাওয়াসের জন্ম হয়। যে ভালোবাসতে জানে,ভালোবাসা প্রকাশ করতে জানে,প্রিয়জনদের আগলে রাখতে জানে…
নাওয়াস রিনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। রিনা নাওয়াসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নাওয়াস চোখ বন্ধ করে। চোখ বন্ধ করা মাত্রই প্রত্যাশার টলমলে আঁখিযুগল ভেসে ওঠে। নাওয়াস ধপ করে চোখ খুলে উঠে বসে। হঠাৎ নাওয়াসকে উঠতে দেখে রিনা অবাক হোন। চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“কী হয়েছে? এমন অস্থির কেন লাগছে?”
নাওয়াস রিনার দিকে তাকায়। কয়েক মিনিট গড়ায়। মন্থর কণ্ঠে বলে,
“তোমার প্রত্যাশার কথা মনে আছে?”
“হ্যাঁ! মনে কেন থাকবে না? ওমন মিষ্টি মেয়েকে ভুলা যায়? বিপদের সময় মেয়েটা যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। আজ কাল এমন কাউকে দেখায় যায় না।”
প্রত্যাশার বিষয়ে কথা বলার সময় রিনার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। নাওয়াস নিজের মায়ের মুখশ্রী অবলোকন করে।
“নিহানের থেকে শুনেছিলাম। ও না-কি তোর বন্ধু হয়। মেয়েটাকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আসিস তো। ভালো করে পরিচয় করা হয়নি।
“প্রত্যাশা আমাকে ভালোবাসে!”
রিনা থেমে যায়। নাওয়াসের আনন পানে চায়। নাওয়াস রিনার দিকে চেয়ে ছিলো। নাওয়াসের অশান্ত চোখের দিকে চেয়ে রিনা বলেন,
“সংশয়ের সূত্রপাত কী এখান থেকেই?”
নাওয়াস হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আমি ওকে বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না। কিন্তু পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টু বলছে আমি না-কি ভুল। প্রত্যাশা আমার বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু…”
“আমি তো তোকে জিজ্ঞেস করছি। তুই কী প্রত্যাশার জন্য কিছু অনুভব করিস। কি-না?”
নাওয়াস ত্রস্ত বলল,
“প্রত্যাশা আমার বন্ধু। অনেক ভালো বন্ধু।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। একটা কথা বলতো, তোর ওকে কেমন লাগে?”
নাওয়াস বিলম্বহীন বলে,
“নিঃসন্দেহ প্রত্যাশা খুব ভালো মেয়ে। সাহসী, আত্মনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন স্বাধীন চিন্তা ধারার একটা মেয়ে। যে ন্যায় কে ন্যায় আর অন্যায় কে অন্যায় বলার সৎসাহস রাখে। ওর ব্যক্তিত সবার থেকে আলাদা। একদম আলাদা। সি ইজ ইউনিক। আমি ওর মতো কাউকে আগে দেখিনি। জানো মা আমার সাথে ওর প্রথম সাক্ষাৎ এ ও আমায় থা’প্প’ড় মে’রে ছিলো। ওর চোখে মুখে সে কী তেজ। আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলেছিলো। আমি ভিষণ অবাক হয়েছিলাম। ওর চোখের তেজস্ক্রিয়তাই।”
রিনা আবারও শুধাল,
“আর ওর সঙ্গ?”
এবার নাওয়াসের মুখের আদল পরিবর্তন হয়। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হাসি হাসি আদলে বলে,
“ভিষণ ভালো লাগে। ওর সাথে থাকলে আমি একটা পসেটিভ ভাইব পায়। ওর ভিতরের পসেটিভিটি আমিও ফিল করতে পারি। ইন ফ্যাক্ট ওই তো আমার ভুল গুলো ভাঙিয়েছে। আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছে। ওর সান্নিধ্যে এসেই তো আমি তোমাদের সবাইকে উপলব্ধি করেছি। তোমাদের ভালোবাসা উপলব্ধি করেছি। সি হ্যাজ বি-কাম অ্যান এঞ্জেল ইন মাই লাইফ! সি ইজ ব্লেসিং ফর মি…”
“প্রত্যাশা যদি কখনও দূরে চলে যায়?”
নাওয়াস চমকিত রিনা দিকে চায়। ত্রাস স্বরে বলে,
“দূরে কেন চলে যাবে?”
রিনা কিঞ্চিৎ হাসলেন। বলেন,
“যার কথা উঠলেই তোর চোখে-মুখে খুশি খেলে যায়। যাকে নিয়ে কথা বলার সময় তোর ঠোঁট থেকে হাসি সরে না। যার সান্নিধ্যে তুই নিজেকে বদলে নিয়েছিস। যার দূরে যাওয়ার কথা শুনে তোর চোখে ভয় ভীড় করে। সে কী শুধুই তোর বন্ধু হতে পারে? একবার নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস কর।”
নাওয়াস ভাবুক হয়। রিনা ফের বলে,
“যখন আমাদের কারো সান্নিধ্য ভালো লাগে। তার আগমনে উৎফুল্লতা কাজ করে। এবং তার দূরে যাওয়ায় কষ্ট হয়। তখন সে শুধু আমার বন্ধু হয় না। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনই সারা জীবন বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না। তবে দুজন পার্টনার অবশ্যই ভালো বন্ধু হতে পারে। বন্ধুত্ব সম্পর্ক খুব পবিত্র। তার থেকেও পবিত্র হচ্ছে ভালোবাসা। প্রত্যাশার মনে যে অনুভূতি আছে। সেই অনুভূতি তোর মনেও আছে।”
নাওয়াস বিস্মিত লোচনে রিনার দিকে চাইল। বলল,
“আমার মনে প্রত্যাশাকে নিয়ে এমন কোনো অনুভূতি নেই। আমি ওকে শুধু নিজের বন্ধুই ভাবি।”
“এটা তোর মস্তিষ্কের ভাবনা। মনের না। বিশ্বাস না হলে নিজেই নিজের মন কে জিজ্ঞেস কর।”
নাওয়াস দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। নিজের মনেকে প্রশ্ন করে,
“সত্যিই কী প্রত্যাশা শুধু আমার বন্ধু? না-কি তার থেকেও বেশি কিছু?”
কেমন একটা ঘোলা উত্তর পায়। যা ওর বোধগম্য হয়না। রিনা হয়তো বোঝেন তাই বললেন,
“তোর মস্তিষ্কের ধারণা ও শুধুই তোর বন্ধু। বন্ধুর সম্পর্কে এমন অনুভূতি আসা অন্যায়। যার জন্য তুই তোর মনের কথা বুঝতে পারছিস না।”
“তাহলে তুমিই বলো কী করলে বুঝতে পারবো? আমার সংশয় কাটবে?”
নাওয়াসের বাচ্চাসুলভ কথায় রিনা মনে মনে হাসলেন। বললেন,
“ওর থেকে দূরে গিয়ে। তুই যদি ওর থেকে দূরে চলে যেতে পারিস। ওকে ভুলে যেতে পারিস। তাহলে বুঝবি ও শুধুই তোর বন্ধু। আর যদি তুই ওকে ভুলতে না পারিস জানবি,প্রত্যাশা শুধু মাত্র তোর বন্ধু না।”
রিনার নিঃসৃত বাক্যে নাওয়াস আতঁকে ওঠে। আতঙ্কিত হয়ে বলে,
“কী বলছো? ওর সাথে একদিন কথা না বললে আমার অস্থির লাগে। জানো বিগত সাতদিন প্রত্যাশা আমার সাথে কথা বলেনি। দেখা করেনি। এই সাতদিন আমার কত কষ্টে কেটেছে? আমার পক্ষে ওকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। প্রত্যাশা আমার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে।”
রিনা গাল ভরে হাসেন। নাওয়াস তা দেখে ভরকে যায় বলে,
“হাসছো কেন?”
রিনা নাওয়াসের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
“এখুনি কী বললি সেগুলো একটু ভাব। এগুলো তোর মনের কথা। একজন বন্ধুর জন্য কখনই এই ধরনের মনোভাব কাজ করে না।”
নাওয়াস থমকায়। নিজের কথাগুলো নিজ মনে আওড়ায়। রিনা বলে,
“উঁহু্! সেটা তোর মস্তিষ্কের কাছে। মনের কাছে নয়। তুই সব সময় মস্তিষ্কের কথা শুনিস। তাই মনের ভাষা বুঝতে পারচ্ছিস না। মনের কথা শোন বুঝতে চেষ্টা কর। সব সংশয় দূর হয়ে যাবে। তুই প্রত্যাশাকে ভালোবাসিস এটা স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
নাওয়াস চোখ বন্ধ করে নিলো। পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টুর,ওর মা সবার কথা মনে করলো। সর্বশেষ প্রত্যাশা ‘ভালোবাসি’ কথাটা মনে করে যা শুনে নাওয়াসের খারাপ লাগেনি। বরং মনের গহীনে কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করেছে। সেটা তখন উপলব্ধি না করলে এখন করছে। নাওয়াস নিজের মনকে প্রশ্ন করে এই অনুভূতির সূত্রপাত কবে হয়েছিলো। নাওয়াসের মানসপটে নিহানদের স্কুলের ফাংশনের ওই দিনের দৃশ্য ভেসে ওঠে। শাড়ি পরিহিত প্রত্যাশাকে দেখে নাওয়াসের হৃদস্পন্দনের থমকে যাওয়া। পরক্ষণে দ্রুতগতিতে লাফানো। সব কিছুর জানান দেয় নাওয়াস ওই দিন-ই এই অনুভূতির সূচনা হয়। যা ধীরে ধীরে ওর হৃদয়কে গ্রাস করে। আনমনে নাওয়াসের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোঁটে। মনে মনে কয়েক বার আওড়ায়,
“মা আমি একটা ভুল করেছি। নিজের মনের কথা না বুঝেই প্রত্যাশাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। ও যখন আমার ভালোবাসি বলেছিলো। আমি ওর অনুভূতিকে ভ্রম বলেছিলাম।”
নাওয়াসের করুণ কণ্ঠ। রিনা আস্বস্ত করে বললেন,
“কাল ওর সাথে দেখা করে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েনিস। সাথে নিজের অনুভূতির কথাও জানিয়ে দিস।”
“ও যদি না মানে? আমার জন্য ওর চোখে অশ্রু এসেছে। ভাবতে পারচ্ছো? ঠিক কতটা কষ্ট পেলে,ওর মতো শক্ত,কঠিন মেয়ের চোখে অশ্রু আসে?”
নাওয়াসের পা’গলামোতে আবারও হাসেন রিনা। বলেন,
“নারী যতই কঠিন হোক না-কেন, নিজের প্রিয় পুরুষের কাছে সে সকল সময় কাঁদা-মাটির মতো নরম হয়।”
নাওয়াস ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
“এত ভাবছিস না! আয় একটু ঘুমিয়ে নে।”
নাওয়াস শুয়ে পড়ে। তবে ঘুমায় না। বলা চলে ঘুম ওর চোখে ধরা দেয়না। একরাশ অস্থিরতা নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। মনের মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খায়। এই যেমন, প্রত্যাশা ওকে মেনে নিবে কি-না। আচ্ছা প্রত্যাশা আমার থেকে দূরে চলে যাবে না তো? নিজে নিজের ভাবনায় নিজেই আঁতকে ওঠে। আওড়ায়,
“না না প্রত্যাশা এমন মেয়ে না।”
রিনা নাওয়াসের মনের ভাব বুঝে রাতটা ও-কে সঙ্গ দিয়েই কাটান। মায়ের ভরসার হাত পেয়ে শেষ রাতের দিকে নাওয়াসের চোখ লেগে যায়।
_________
পরেরদিন নাওয়াস প্রত্যাশার বুটিকে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে বুটিকে তালা দেও। নাওয়াস চিন্তিত হয়। কেননা প্রত্যাশা বুটিকে নিজে না এলেও কখনও তালা ঝোলে না। ওর সহকর্মী মেয়েটা বুটিক খোলে। নাওয়াস প্রত্যাশাকে কল করে কিন্তু পায়না। নাওয়াস ভাবে প্রত্যাশা রাগ করে কল ধরছে না। তখনই নাওয়াসের পিউয়ের কথা স্মরণে আসে। পিউকে যদি পায় তবে কোনো ভাবে প্রত্যাশা অব্দি ওর কথা পৌঁছে দেওয়া যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। নাওয়াস হাত ঘড়িতে সময় দেখে। পিউদের স্কুল ছুটি হতে অনেক দেরী। তবে একটু পরে টিফিন দিবে। তখন দেখা করতে পারবে। নাওয়াস কাল বিলম্ব না করে স্কুলে ছোটে। নিহান নামাজ পড়ে বের হয়। নিহানদের স্কুলে নামাজের জন্য মসজিদ আছে। মসজিদ থেকে বের হয়ে গেটের কাছে নাওয়াসকে দেখতে পায়। হাসি মুখে সেই দিকে এগিয়ে যায়।
“ওদের গ্রামে জমি নিয়ে কি-সব ঝামেলা হয়েছে। সে-সব ঝামেলা মেটাতেই ওর বাড়ির সবার, আজকে সকালে গ্রামে যাওয়ার কথা। সেই জন্য কাল স্কুল থেকে সপ্তাহখানেকের ছুটিও নিয়েছে।”
নাওয়াস মনে মনে আওড়ায়,
“এর মানে প্রত্যাশাও সবার সাথে গেছে। আর তাই ও-কে পাচ্ছিনা। ধ্যাত! ওর আজই গ্রামে যেতে হলো?”
“কিন্তু তুমি পিউকে কেন খুঁজছিলে?”
নিহানের প্রশ্নে নাওয়াসের ভাবনায় ছেদ পড়ে। বলে,
“এমনি-ই! তুই ক্লাসে যা!”
নাওয়াস দাঁড়ায় না চলে যায়। নিহান বিহ্বল হয়ে নাওয়াসের প্রন্থান দেখে।
.
.
.
পরের দিন গুলো নাওয়াসের বিষাদে কাটে। গুনে গুনে দশ দিন পর নাওয়াস প্রত্যাশার দেখা পায়। তখন গোধূলি বিকেল ছিলো। প্রত্যাশা দুপুরেই গ্রাম থেকে ফিরেছে। বাড়ি না গিয়ে সোজা বুটিকে গেছিলো। বিকেলের দিকে বুটিক থেকে বাড়ি ফিরছিলো। নাওয়াস প্রত্যাশার খোঁজে নিয়ম করে কয়েক বেলা বুটিকে আসে। অনাকাঙ্খিত ভাবে আজ কাঙ্খিত রমনীর দেখা মিলে। নাওয়াসের মেঘাচ্ছন্ন আননে ঝমঝমিয়ে খুশির বৃষ্টি হয়। সময় ব্যয় না করে ঝড়ের বেগে প্রত্যাশার নিকট যায়। প্রত্যাশা গেটে তালা লাগিয়ে পিছে ফিরতেই নাওয়াস সোজার ওর সামনে বাইক থামায়। অকস্মাৎ এমন করে বাইক সামনে আসায় প্রত্যাশা চমকে ওঠে। প্রত্যাশা নিজেকে সামলানোর আগেই নাওয়াসের গমগমে ভারিক্কী আওয়াজ কর্ণপাত হয়,
নাওয়াসের কণ্ঠ স্বরে রাগের আভাস। প্রত্যাশা কিছু বলে না। বাইকে উঠে বসে। নাওয়াস প্রত্যাশাকে নিয়ে ওর প্রিয় জায়গা,ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের ওখানে নিয়ে আসে। জায়গাটা নিরিবিলি। মানুষের কোলাহল কম। আর তাই নাওয়াসের বেশ পছন্দের এই জায়গা। বাইক থামতেই প্রত্যাশা নেমে পড়ে। নাওয়াস বাইক স্ট্যান্ড করে। প্রত্যাশার মুখো-মুখি দাঁড়ায়।
“হঠাৎ এখানে নিয়ে আসলে?”
নাওয়াস চোখ-মুখ শক্ত করে বলে,
“এতদিন কোথায় ছিলে?”
প্রত্যাশা নিকট নাওয়াসকে অন্যরকম লাগে। এর আগে নাওয়াস কখনও এভাবে কথা বলেনি। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর করে।
“গ্রামে!”
“ফোন কেন ধরোনি?”
“গ্রামে নেটওয়ার্ক ছিলো না।”
“গ্রামে যাওয়ার আগে আমাকে জানাওনি কেন?”
“আমি নিজেও জানতাম না হুট করেই…”
প্রত্যাশাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে, নাওয়াস ক্ষিপ্ত গতিতে প্রত্যাশার বাহু আঁকড়ে ধরে। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
“তুমি জানতে না মানে কি? যখন জেনে ছিলে,তখন কেন জানাওনি? অন্য সময় তো বাড়ি থেকে এক পা বেরুলে আমাকে জানাও…”
প্রত্যাশা উত্তর করার আগে,নাওয়াস আবার বলে,
“তোমার একবারও মনে হয়নি যে আমি চিন্তা করতে পারি? না-কি ইচ্ছে করেই জানাওনি? তুমি জানো তোমাকে না পেয়ে আমার কী অবস্থা হয়েছিলো? তোমার খোঁজে আমি নিহানের স্কুলেও গেছিলাম। তখন জেনেছিলাম, তোমরা সপ্তাহ খানেকের জন্য লগ্রামে গেছো। তারপরও আমি রোজ তোমার বুটিকের কাছে আসতাম। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো। তবুও তোমার আসার কোনো খবর পায়নি। এই কটা দিন আমার কীভাবে কেটেছে,সে সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়া আছে?”
শেষোক্ত কথা নাওয়াস নরম কণ্ঠে বলে। প্রত্যাশা নাওয়াসকে অবলোকন করল। বলল,
“আমার অনুপস্থিতিতে কী তোমার জীবনে আদৌ কোনো প্রভাব পড়ে?”
নাওয়াস ভ্রু গুঁটিয়ে প্রত্যাশার দিকে চায়। সহসাই বলে,
“অবশ্যই পড়ে! তোমার অনুপস্থিতিতে আমার জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে।”
“আমি বরাবরই অগোছালো। ঠিক মতো কথাও বলতে জানি না। এমনকি নিজের মনের অনুভূতিও বুঝতে পারি না। আর তাই তো সেদিন তোমার অনুভূতিকে ভ্রম বলেছিলাম। বাট আই ওয়াজ রং! তোমার অনুভূতি ভ্রম না। ভ্রমের মধ্যে আমি ছিলাম। আমার অনুভূতি গুলোকে বন্ধুত্বরের জালে আটকে রেখে ছিলাম। সত্যিকার্থে তুমি কখনোই আমার বন্ধু ছিলে না। তোমার প্রতি আমার মনের কোণে একটা সুপ্ত অনুভূতি জন্মেছিলো। আমার অজান্তেই। তার ওপরে বন্ধুত্বের শীলমোহর পড়ায়, অন্য কোনো নাম আমার মস্তিষ্ক মানতে পারেনি। মনের কাছে কী আর মস্তিষ্কের জোর খাটে? খাটে না। আমার মস্তিষ্কও যুক্তি তর্কে হেরে গেছে, আমার অনুভূতির কাছে। এই দশটা দিন তোমার শূন্যতা আমার মস্তিষ্ককেও বুঝিয়ে দিয়েছি, তুমি শুধু আমার বন্ধু নও। তার থেকেও বেশি কিছু… এমন একজন যাকে ছাড়া আমার নিঃশ্বাসের সমাপ্তি ঘটতে পারে…”
প্রত্যাশা দৃষ্টিতে বিস্ময়,সংশয়,দ্বিধা। সাথে রয়েছে প্রশ্ন। নাওয়াস বলল,
“বখাটে,বাউণ্ডুলে নাওয়াস আফফানকে যেমন সোজা পথে এনেছো। এই অগোছালো নাওয়াস আফফানের জীবন গুচ্ছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে? সারা জীবনের জন্য এলোমেলো,অযত্নশীল আমিটার হবে? হয়তো খুব বেশি ভালোবাসতে পারবো না। তবে যতটুকু ভালোবাসলে পরকালে তোমায় পাবো,ততটুকু ভালো আমি ঠিকই বাসবো…”
“পারবো! এই অগোছালো, বাউণ্ডুলে তুমিটাকেই তো আমি চাই। যাকে আমি ভালোবেসে যত্নে গোছাবো, গড়বো নতুন ভাবে। তোমার আমায় ভালো না বাসলেও চলবে। শুধু সারা জীবন পাশে থেকো…”
নাওয়াসও প্রত্যাশাকে বাহুডোরে আগলে নিলো। দুজন ভালোবাসার মানুষের অন্তঃকরণের বয়তে থাকা ঝড়ো হাওয়ার সমাপ্তি ঘটল। তাদের এই প্রেমময় মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল কৃষ্ণচূড়া গাছ। এবং সেই গাছে বসা একযুগল পাখি। ওদের এই পূর্ণতায় যারা গেয়ে উঠল প্রেমের গান।
প্রত্যাশা একটা ক্যাফেতে বসে আছে। আজ সকালে যখন বুটিকে আসছিলো। তখনই পূর্ব ইমাম ওকে জানান। একটা ভালো পাত্রের খোঁজ পেয়েছেন। কিন্তু পাত্র আগে নিজে পাত্রীর সাথে কথা বলতে চাই। সেকারণেই পূর্ব ইমাম প্রত্যাশাকে ওই ছেলের সাথে দেখা করতে ক্যাফেতে পাঠায়। অনিচ্ছার শর্তেও প্রত্যাশা ক্যাফেতে আসে। ওই ছেলের জন্য। প্রত্যাশা বিগত এক ঘণ্টা যাবত্র ক্যাফেতে অপেক্ষা করছে। এভাবে সঙের মতো বসে থেকে প্রত্যাশা বিরক্ত হয়। উঠে চলে যেতে নিলে একজন সামনে এসে বসে। বলল,
“হাই আমি সমুদ্র! তুমি নিশ্চয়ই প্রত্যাশা? কখন এসছো?”
এমন হুড়মুড়িয়ে কথা বলায় প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকায়। বলে,
“আমি সময়ের অনেক পাক্কা। সময়েই এসেছি।”
ছেলেটা হেলার সহিত বলল,
“ওহ্ আচ্ছা!”
প্রত্যাশার ভিষণ রাগ হয়। একে তো এক ঘণ্টা দেরী করে এসেছে। তার জন্য কোথায় স্যরি বলবে। স্যরি তো দূরে থাক। চোখ মুখে নূন্যতম অনুতাপের ছাপ পর্যন্ত নেই। উল্টে এমন গাছাড়া ব্যবহার করছে। যাতে মনে হচ্ছে,এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করাটা যেন কোনো বিষয়ই না।
“কী নিবে চা না-কি কফি?”
“নো থ্যাংঙ্ক’স আমি অলরেডি দু কাপ কফি নিয়েছি।”
“ওকে দ্যান আমার জন্য অডার্র করি।”
প্রত্যাশার এই কথাতেও ছেলেটা বিশেষ প্রক্রিয়া দেখালো না। নিজের মতো ওয়েটার ডেকে কফি অডার্র করল। প্রত্যাশার বুঝতে বেগ পোহাতে হয়না ছেলেটা অত্যন্ত অ্যারোগেন্ট। প্রত্যাশার ইচ্ছে করল। এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যেতে। শুধু মাত্র ভদ্রতার খাতিরে সেটা করলো না।
“তোমার বাবা নিশ্চয়ই বলেছে, আমার বিষয়ে?”
সমুদ্র নামক ছেলেটার কথায় প্রত্যাশার ধ্যান ভাঙে। ছোটো করে বলে,
“হুম!”
সমুদ্র বলল,
“সরাসরি পয়েন্টে আসি তাহলে।”
প্রত্যাশা এপর্যায়ে নড়েচড়ে বসে।
“তোমার ব্যাপারে আমি সবটা খোঁজ নিয়েছি। তোমার তো একটা বুটিক আছে তাই না?”
“হুম আছে।”
“তা তুমি কেন নিজের বিজনেস করো? তোমার বাবার ফিন্যানসিয়াল কন্ডিশন যথেষ্ট ভালো। দেশের নামকরা ঔষধের ডিলার।”
“আমি নিজের জন্য কিছু করতে চাই। বাবার ওপর ডিপেন্ড হয়ে নিজের পুরো লাইফ লিড করতে চাই না।”
প্রত্যাশার কণ্ঠে দৃঢ়তা। ছেলেটা এমন টুকটাক আরও কথা জিজ্ঞেস করলো। প্রত্যাশার মনে হলো ও কোনো চাকরির ভাইভা দিচ্ছে। মনে মনে বিরক্ত হলেও, প্রত্যাশা চুপচাপ উত্তর করলো শুধু। ফিরতি কোনো প্রশ্নও করেনি। সব শেষে ছেলেটা বললল,
“ওয়েল আমার তোমাকে ভালো লেগেছে। বাট একটা প্রব্লেম আছে।”
সহসাই প্রত্যাশার ললাটে ভাঁজ পরে।
“বিয়ের পর তোমাকে তোমার বিজনেস ছাড়তে হবে। আমার ফ্যামিলিতে মেয়েদের বাইরে কাজ করার নিয়ম নেই। আর আমিও পছন্দ করি না। ইনকাম করার জন্য আমরা পুরুষ মানুষরা আছি। মেয়েদের কেনো করতে হবে? মেয়েরা শুধু সংসারের কাজ করবে।”
প্রত্যাশার মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“এটা শুধু মাত্র আমার বিজনেস নয়। এটা আমার স্বপ্নও।”
সমুদ্র অবজ্ঞা হাসি হেসে বলল,
“স্বপ্ন? এই সব স্বপ্ন দিয়ে কী হবে? মেয়েদের স্বপ্ন হওয়া উচিত ঘর সংসার নিয়ে।”
প্রত্যাশা বুঝল। ছেলেটা শুধু অ্যারোগেন্ট নয়। সাথে অত্যন্ত নিম্ন মানসিকতার। যে মেয়েদের সামান্যতম সন্মান করতে জানে না। প্রত্যাশা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সমুদ্র ভ্রু বাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“অ্যানি প্রব্লেম!”
“আমার মনে আমাদের আর কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। কারণ আমি আমার স্বপ্ন স্যাকরিফাইস করতে পারবো না।”
প্রত্যাশা সমুদ্রের উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে যায়। সমুদ্র প্রত্যাশার প্রন্থান পথে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে প্রত্যাশা জোরে জোরে শ্বাস নিলো। মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেছে। প্রত্যাশা ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। নাওয়াস কে কল করল। নাওয়াস মিটিং এ ছিলো। প্রত্যাশার কল দেখে বলল,
“এক্সকিউজ মি!”
নাওয়াস একটু সাইডে এসে কল রিসিভ করে।
“হ্যালো!”
“আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই এখুনি।”
নাওয়াসকে কোনো কথার বলার সুযোগ না দিয়েই, নিজ বাক্য ব্যয় করে কল কেটে দিলো। নাওয়াস কান থেকে ফোন সরিয়ে,সামনে ধরে বোকার মতো চেয়ে রইল।
.
.
.
নাওয়াস আর প্রত্যাশা পার্কে বসে আছে। প্রত্যাশা মাটির দিকে চেয়ে আছে। নাওয়াস প্রত্যাশাকে অবলোকন করে। নীরবতা কাটাতে নাওয়াস বলল,
“প্রত্যাশা?”
“একজন মানুষের মানসিকতা এতোটা নিচু কী করে হয়?”
প্রত্যাশার কথা নাওয়াসের মাথার উপর দিয়ে যায়। তাই নরম কণ্ঠে শুধাল,
“কী হয়েছে? তুমি যদি আমাকে সবটা না বলো। আমি বুঝবো কী ভাবে?”
প্রত্যাশা নাওয়াসকে সব খুলে বলল। সব শুনে নাওয়াসেরও প্রচুর রাগ হয়। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
“তোমার বাবা এই সব নমুনা গুলো কে কোথা থেকে ধরে আনে বলো তো? তোমাকে যখন ডমিনেন্ট করে কথা বলছিলো। দুটো থা’প্প’ড় লাগাতে পারলে না? কত বড়ো সাহস তোমায় কি-না তোমার স্বপ্ন ছাড়তে বলে? তোমার স্বপ্ন নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে? ইচ্ছে তো করছে শা’লা কে মে’রে মুখ ভেঙে দিই।”
“তো কী করবো? ওর সাহস কী করে হলো তোমার সাথে এভাবে বিহেভ করার?”
নাওয়াস থামে তারপর বলে,
“শুনো আজ তুমি তোমার বাবাকে জানিয়ে দিবে। তুমি এখন বিয়ে করবে না। উনি যেন আর এমন যাকে তাকে ধরে না নিয়ে আসেন। বুঝেছো?”
প্রত্যাশা মাথা নাড়ায়। প্রত্যাশার চোখে এখনও বিস্ময়। নাওয়াস প্রত্যাশার মন ভালো করতে ওকে বলে,
“ঘুরতে যাবে?”
“কোথায়?”
“গন্তব্যহীন!”
প্রত্যুত্তরে প্রত্যাশা হাসে। তারপর দুজনে চলে যায় উদ্দেশ্যেহীন পথে। নাওয়াসের সাথে ঘুরে প্রত্যাশার মন ভালো হয়ে যায়। প্রত্যাশা বাড়ি ফিরতেই পূর্ব ইমামের মুখোমুখি হয়। পূর্ব ইমামের গুরুগম্ভীর মুখ দেখেই প্রত্যাশা আন্দাজ করে উনি কী বলবেন। এবং প্রত্যাশার অনুমান সঠটিক করে পূর্ব ইমাম বললেন,
“তুমি সমুদ্রের সাথে খারাপ ব্যবহার কেন করেছো?”
প্রত্যাশার সহজ স্বীকারোক্তি।
“আমি শুধু মাত্র ওনাকে আমার মতামত জানিয়েছি। আর এটা যদি ওনার ভাষায় খারাপ ব্যবহার করা হয়। তবে হ্যাঁ আমি খারাপ ব্যবহার করেছি।”
“কেন করেছো?”
“কেন তুমি জানো না? তোমাকে জানায়নি? নাকি শুধু আমি খারাপ ব্যবহার করেছি সেটাই বলেছে।”
“সমুদ্র কী এমন বলেছিলো? যার জন্য তুমি না বলেছো?”
“আমাকে আমার স্বপ্ন ছাড়তে বলেছিলো। বলেছিলো বুটিকের কাজ ছেড়ে দিতে।”
“তার জন্য তুমি না বলেছো?”
“হ্যাঁ!”
পূর্ব ইমাম বিরক্তির সহিত বলল,
” এটা এমন কী বিষয়? ছেড়ে দিতে। একটা সামান্য বুটিকের জন্য তুমি এতো ভালো একটা ছেলেকে অপমান করলে?”
“তাহলে তুমিও শুনে রাখো। আমি আমার স্বপ্নের বিনিময়ে কোনো কাজ করবো না।”
প্রত্যাশা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। নিজের ঘরে চলে যায়। পূর্ব ইমাম হতবাক হয়ে প্রত্যাশার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিনা বললেন,
“ও যখন বিয়েতে রাজি হয়েছে, তখন এমন কারো সাথে বিয়ে দিন। যে ওর স্বপ্নসহ ওকে বিয়ে করবে।”
মিনা নিম্ন কণ্ঠে কথাটি বলেন। ভেবেছিলেন স্বামী হয়তো ধমকাবেন। কিন্তু এমন কিছু করেন না। বরং নীরবে চলে যান। এতে মিনা অবাক হয় বটে।
_______
প্রত্যাশা নতুন ড্রেসের জন্য কিছু ডিজাইন করছিলো। প্রত্যাশার অভেস্য আছে। ডিজাইন করতে করতে রেডিও শোনা। আজকেও তাই করছিলো। তখন রেডিও-তে একজন টপিক হিসেবে বলল, বন্ধুত্ব আর প্রেম। এটাই তাদের আজকের বিষয় বস্তুত। সেখানে একজন গল্প ই-মেইল করেছে। তাদের প্রেমের শুরুটা হয় বন্ধুত্ব দিয়ে। প্রথমে তারা একে অপরকে সহ্য করতে পারতো না। পরবর্তিতে কিছু ঘটনার মাধ্যমে বন্ধুত্বের শুরু হয়। এরপর প্রেম। এখন তারা বিবাহিত। এবং আজ তাদের বিশতম বিবাহ বার্ষিকী। প্রত্যাশা ভিষণ মনোযোগ সহকারে ওদের গল্প শুনলো। গল্পটা শোনার সময় প্রত্যাশার মানসপটে নাওয়াসের মুখশ্রী দৃশ্যমান হয়। প্রত্যাশা থমকে যায়। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে,
“আমি নাওয়াসের কথা কেন ভাবলাম? আমাদের বন্ধুত্বের শুরুটাও এমন বলে?”
প্রত্যাশা আর কোনো কিছু শোনে না। চুপচাপ শুয়ে পড়ে। ওর মাথায় অনেক কিছু ঘুরতে থাকে। এটা আজ প্রথম ঘুরছে এমন না। আরও আগে থেকেই ঘুরছে। প্রত্যাশা বোঝে তবুও নিজেকে বোঝায়। এই অনুভূতিটা ভুলও হতে পারে। তার এখন আবেগের বয়স নেই। আবেগে গা ভাসানো উচিত না। নিজের মনকে এমন সাত পাঁচ বুঝিয়ে প্রত্যাশা ঘুমিয়ে গেলো। তারপরের দিন গুলো প্রত্যাশার প্রচন্ড বিষণ্ণতায় কাটলো। কেননা নাওয়াস ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে গেছে। এখন ব্যবসার পুরো দায়িত্ব নাওয়াসের ওপর। সেকারণে নাওয়াস অনেক ব্যস্ত হয়ে পরেছে। দু-দন্ড প্রত্যাশার সাথে কথা বলতে পারছে না। প্রত্যাশা নাওয়াসকে কল করে। কয়েক বার রিং হয়ে কেটে যায়। প্রত্যাশা বলে এই শেষ তাই বলে কল করে। তখন কল রিসিভ হয় প্রত্যাশা উৎফুল্ল চিত্তে হ্যালো বলতে নিবে। তখন ফোনের ওপর পাশ থেকে রিনরিনে একটি মেয়েলী কণ্ঠ শোনা যায়। সহসাই প্রত্যাশার ভ্রু গুটিয়ে আসে।
“হ্যালো কে বলছেন?”
“আপনি কে বলছেন? এটা তো নাওয়াসের ফোন? আপনার কাছে কী করে এলো?”
প্রত্যাশার ফিরতি প্রশ্নে মেয়েটা বলে,
“জ্বি! উনিই আমাকে ফোনটা রাখতে দিয়েছেন। কাইন্ডলি আপনি কে বলবেন?”
“আপনি ফোনটা নাওয়াসকে দিন।”
“স্যরি উনি এখন বিজি আছেন। ওনাকে ফোন দেওয়া যাবে না। আপনার কী প্রয়োজন আমাকে বলুন। আমি ওনাকে বলে দিবো।”
মেয়েটির কথায় প্রত্যাশার রাগ হয়। বিনা বাক্যে কট করে কল কেটে দেয়। নাওয়াস মিটিং করে বের হয়ে আসে। নাওয়াসকে দেখে মেয়েটা বলল,
“স্যার আপনাকে একজন ফোন করেছিলো। অনেকবার কল করাই আমি বাধ্য হয়েই রিসিভ করি।”
নাওয়াস ফোনটা নিলো কল লিস্ট চেক করে দেখলো প্রত্যাশা কল করে। মেয়েটিকে চলে যেতে বলল। মেয়ে বিনাবাক্যে চলে যায়। মেয়েটি নাওয়াসের পিএ। নাওয়াস প্রত্যাশাকে কল করে। প্রত্যাশা কল রিসিভ করে।
“কল করেছিলে?”
“মেয়েটা কে ছিলো?”
প্রত্যাশার এহেন উত্তরে নাওয়াস ভরকে যায়। শুধায়,
“কোন মেয়ে?”
“যে তোমার ফোন ধরে ছিলো?”
“ওহ আচ্ছা! ওর নাম দিশা। আমার পিএ।”
নাওয়াসের কথায় প্রত্যাশার রাগ বাড়ে। বলল,
“তোমার পিএ একজন মেয়ে?”
“হ্যাঁ কেন?”
“ওর কাছে তোমার ফোন কী করছিলো?”
“আমি মিটিং এ ছিলাম। তাই ওর কাছে ফোনটা রেখেছিলাম।”
“আগে তো কখনও ওর কথা আমায় বলোনি।”
“এক সপ্তাহ আগেই জয়েন করেছে।”
“বাহ্! এক সপ্তাহ আগে জয়েন করেছে। আর তুমি তাকে ফোন দিয়ে দিলে?”
নাওয়াস প্রত্যাশার রুক্ষ আচারণে রিতীমত অবাক হয়। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
“এখানে মিটিংএ ফোন অ্যালাউ না। সেই জন্যই ওর কাছে রেখেছিলাম।”
“তুমি নিজের পিএ বদলাবে। আর একজন পুরুষ পিএ রাখবে।”
“কেন?”
নাওয়াসের বোকা প্রশ্নে প্রত্যাশা রেগে বলল,
“জানি না!”
বলেই প্রত্যাশা কল কেটে দিলো। নাওয়াস বিহ্বল হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করলো।
প্রত্যাশা সেদিন পর থেকে রাগ করে নাওয়াসের সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। নাওয়াস কল করলেও ও রিসিভ করেনি। এমন কী বুটিকেও যায়নি। নাওয়াস ভেবে পাচ্ছে না প্রত্যাশা হঠাৎ এমন কেন করছে? কোনো বিষয় নিয়ে কী রেগে আছে? নিহানের স্কুলেও গেছিলো। পিউকে প্রত্যাশার বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। পিউ জানায় প্রত্যাশা না-কি কারো সাথে ঠিক করে কথা বলছে না। কাজেও যাচ্ছে না। সব সময় দরজা আটকে বসে থাকে। নাওয়াস ভেবে পায়না প্রত্যাশার এহেন আচারণের পিছনে কারণ কী।
দিনটা শুক্রবার নাওয়াস, পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টু ব্যস্ততা বাদ দিয়ে আজ অনেক দিনপর আবার একত্রি হয়েছে। ঠিক করে সবাই আজ সারা দিন আড্ডা দিবে। নাওয়াসের তেমন ইচ্ছে না থাকলেও ওদের সাথে যায়। সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বাইক নিয়ে বসে সবাই আড্ডা দিতে থাকে। নাওয়াসকে উদাস দেখে পিয়াশ বলে,
“ভাই আপনার কী হয়েছে? আপনাকে কয়েকদিন থেকে অন্যমনস্ক লাগছে? আপনি কী কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”
নাওয়াস বিরস মুখে বলল,
“বিগত এক সপ্তাহ যাবত্র প্রত্যাশা আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করছে না।”
নাওয়াসের উত্তরে সবাই চমকিত একে অন্যের দিকে চায়। তন্ময় বলে,
“হয়তো উনি ব্যস্ত আছেন।”
পিয়াশ সায় দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ! শুনেছিলাম ডিজাইনারদের না-কি অনেক আর্ট-টাট করতে হয়। যার জন্য নাওয়া খাওয়া সব ভুলে যায়। প্রত্যাশাও তেমনই হয়তো কোনো আর্ট নিয়ে ব্যস্ত আছে।”
“উঁহু্! বিষয়টা এতো সহজ না।”
নাওয়াসের উত্তরে মিন্টু মুখ ফুঁলিয়ে বলল,
“ভাই আপনি অনেক বদলে গেছেন। ওই মাইডারে পাইয়া আপনি আমাদের আর পাত্তা দেন না। যত ব্যস্তই থাকেন না কেন,ওই আপনারে ডাকলে আপনি সব ফালাই থুইয়া ছুইটা চইলা যান। ঠিক যেমন প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য ছুটে যায়…”
মিন্টুর কথায় নাওয়াস চমকে ওঠে। পরক্ষণে ধমকে বলে,
“এই সব কী কথা? খবরদার আর কখনও এই ধরনের কথা বলবি না। তোরা যেমন আমার বন্ধু প্রত্যাশাও আমার বন্ধু। তোদের কিছু হলে যেমন আমি ছুটে আসি। ওর জন্যও যায়। বুঝেছিস?”
মিন্টু কাচুমাচু ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়।
প্রত্যাশা আজ সাতদিন পর চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে বের হলো। উদ্দেশ্যে নাওয়াসের কাছে যাওয়া। প্রত্যাশা জানে নাওয়াস কোথায় আছে। তাই রিঁকশা ওয়ালাকে সেখানে নিতে বলে। প্রত্যাশা এই সাতদিন নিজেকে ঘর বন্দি করে নিয়ে ছিলো। আর তাও নাওয়াসের কারণে। সেদিন নাওয়াসের ফোন একটি মেয়ে ধরায় প্রত্যাশার রাগ হয়। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে কেন তার এই রাগ? কেন সে সহ্য করতে পারছে না। মেয়েটা নাওয়াসের আশেপাশে থাকবে। কেন সে এই বিষয়টা মানতে পারছেনা? কেন?কেন?কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রত্যাশার মন বলেছিল,
“তুমি নাওয়াসের প্রেমে পড়েছো। তোমার নারী প্রেমিকা সত্তার ঈর্ষা হচ্ছে। আর তাই অন্য নারীকে নিজের, প্রিয় পুরুষের আশপাশেও মানতে পারছো না।”
প্রিয় পুরুষ শব্দটিতে প্রত্যাশা বিমূর্ত বনে যায়। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে নাওয়াস তার প্রিয় পুরুষ? সেকারণেই প্রত্যাশা ইচ্ছে করে নাওয়াসকে এড়িয়ে চলে। নিজের মনকে পরীক্ষা করতে। ভুলে যেতে পারে কি-না দেখেতে। ভুলা তো দূরের কথা আরও বেশি মনে পড়েছে। নাওয়াস ওর খোঁজে বুটিকে গেছিলো। সেকথাও প্রত্যাশার অজানা নয়। প্রত্যাশা নিজের মনকে নানা ভাবে পরীক্ষা করে। তখন পিউ এসে জানায় নাওয়াস না-কি পিউয়ের কাছে ওর খোঁজ করছিলো। সেই মুহূর্তে প্রত্যাশা প্রচুর খুশি হয়। প্রত্যাশা মনের সকল সংশয় দূর হয়ে যায়। ওতো আর বাচ্চা না। যে কোনটা কিসের অনুভূতি তা বুঝবে না। এটা যে পৃথীবির সবচেয়ে সিগ্ধ পবিত্র অনুভূতি। ভালোবাসার অনুভূতি। আর এই অনুভূতি সূচনা হয়েছিলো পিউয়ের স্কুলের ফাংশনের দিন। প্রত্যাশা রিঁকশায় বসে এই সব ভাবচ্ছিল। প্রত্যাশা ঠিক করে নাওয়াসকে নিজের অনুভূতির কথা জানিয়ে দিবে। প্রত্যাশা নাওয়াসের থেকে কিছুটা দূরে রিঁকশা থামায়। রিঁকশার ভাড়া মিটিয়ে ত্রস্ত পায়ে নাওয়াসের দিকে এগিয়ে আসে। প্রত্যাশাকে প্রথমে তন্ময় খেয়াল করে। নাওয়াসের উদ্দেশ্যে বলে,
“ভাই প্রত্যাশা!”
তড়িৎ নাওয়াস সামনে তাকায়। সামনে তাকিয়ে প্রত্যাশাকে দেখে নাওয়াস অন্তঃকরণে ঝড়োয়া হাওয়া থেমে যায়। এই সাতদিন মেয়েটা সাথে যোগাযোগ না হওয়াই, নাওয়াসের অভন্ত্যরে ঝড়ের সৃষ্টি হয়। প্রত্যাশাকে দেখে সেই ঝড় থেমে গেলেও। নাওয়াসের কঁপালে ভাঁজের সৃষ্টি হয়। সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকা মেয়েটাকে আজ ভিষণ অগোছালো লাগছে। চোখের নিচে কালচে দাগ। বা গালো একটা লাল ব্রণ। চুল গুলো ঠিক মতো আঁচড়ানো না। এমন এলোমেলো অবস্থাতেও মেয়েটার সৌন্দর্য চুল পরিমান কমেনি। বরং বেড়েছে কয়েকাংশে। প্রত্যাশা নাওয়াসের মুখো মুখি দাঁড়ায়। নাওয়াস প্রশ্ন করে,
“তুমি এতদিন কোথায় হারিয়ে ছিলে? কত কল করেছি তোমার খেয়াল আছে? এভাবে হুট করে গায়েব হয়ে যাওয়ার মানে কী?”
“আমি গায়েব হলে তোমার কী?”
নাওয়াসের ললাটে ভাঁজ পরে। সহসাই শুধাল,
“কী হয়েছে তোমার? তুমি সেদিনও ফোনে কেমন অদ্ভূত ব্যবহার করলে। কোনো প্রব্লেম হলে আমায় বলো।”
“যখন একটা মেয়ে একটা ছেলের একটুখানি দর্শন পাওয়ার জন্য, সারা শহর তাকে খোঁজে। সেই ছেলের আশেপাশে থাকতে তার দিকে বন্ধুত্বরের হাত বাড়ায়। তাকে নিয়ে ভাবতে থাকে। সেই ছেলের দুঃখে ব্যথিত হয়। তার ভালো মন্দ নিয়ে ভাবতে থাকে। একজন ছেলেকে বিশ্বাস করে, গন্তব্যহীন তার বাইকে করে শহর ঘুরে। নির্দ্বিধায় নিজের মনের সব কথা বলে। নিজের অন্তরের সকল সুখ-দুঃখ ভাগ করে। নিজেকে একদম খোলা বইয়ের মতো, তার সামনে মেলে ধরে। এগুলো একটা মেয়ে কখন করে জানো? যখন মেয়েটা নিজের মনকুটিরে ছেলেটার জন্য অনুভূতির বাসা বুনে।”
প্রত্যাশা থামে। নাওয়াসের দৃষ্টিতে বিভ্রম। অবাকতা। যা প্রত্যাশাতে নিবদ্ধ। প্রত্যাশা নাওয়াসের চোখো চোখ রেখে বলে,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি নাওয়াস। সত্যিই ভালোবাসি। আমি জানি না আমার মনে এই অনুভূতি কবে, কখন আর কীভাবে সৃষ্টি হলো। তবে এই অনুভূতির সূচনা হয়েছিলো, পিউয়ের স্কুলের ফাংশনের দিন।”
নাওয়াস চমকায়, থমকায়, বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে যায়। পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টুর চোখে একরাশ বিস্ময়। ফাঁটা নেত্রে ওরা প্রত্যাশাকে দেখতে থাকে। তাদের কাছে প্রত্যাশার এহেন কথা একবারে অপ্রত্যাশিত ছিলো। কসমিক কালেও যারা এই কথা ভাবেনি। আজ কিনা তা বাস্তবে,ওদের চোখের সামনে হচ্ছে? বিষয়টা ভাবতেই ওদের অক্ষিকটোর হতে বেরিয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়ার উপক্রম হয়। নাওয়াসের সম্বিৎ ফিরে। বিস্ময় ভাব কাটিয়ে অত্যন্ত ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
“দেখো প্রত্যাশা তুমি আমার বন্ধু। খুব ভালো একজন বন্ধু। যার জন্য আমি আমার জীবনের মূল্যবান অনেক কিছু ফিরে পেয়েছি। এটা যেমন আমি কখনোই অস্বীকার করতে পারবো না। তেমনই তোমাকে বন্ধু ছাড়া, অন্য কিছু ভাবতেও পারবো না।”
প্রত্যাশার বক্ষ ধ্বক করে ওঠে। রন্ধে রন্ধে বিষ ছড়িয়ে পরে। প্রত্যাশা ভেবেছিলো নাওয়াসও হয়তো ওকে নিয়ে কিছু ফিল করে। তাই তো ওর প্রতি এতো কেয়ার করে। ওকে নিয়ে চিন্তা করে। কিন্তু নাওয়াসের দৃঢ় কণ্ঠে প্রত্যাশার ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়। নাওয়াস ফের বলে,
“আমাদের বন্ধুত্বরের সম্পর্কটাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তোমাকে আমি নিজের বন্ধু ছাড়া,কখনও অন্য নজরে দেখিনি। আশা করবো। তোমার মনে তৈরি হওয়া এই ভ্রম,শীঘ্রই তুমি কাটিয়ে উঠবে। এবং এই ভ্রম কাটিয়ে আবার আগের মতো হয়ে যাবে।”
নাওয়াস নিঃসৃত ভ্রম শব্দে, প্রত্যাশার মনে হয় ওর কানে কেউ গরম শিশা ঢেলে দিচ্ছে। নিজের অনুভূতি এরূপ নাম সে মানতে পারে না। দাঁড়িয়ে থাকা শক্তি হারিয়ে ফেলে। কোনো মতে গলা হতে শব্দ টেনে এনে।
কম্পিত কণ্ঠে বলল,
“আই আ’ম স্যরি!”
প্রত্যাশা আর দাঁড়ায় না। প্রন্থান করে। প্রত্যাশার পুরো শরীর কাঁপছে। অক্ষিযুগলে টলমলে সমুদ্র। সব সময় শক্ত থাকা মেয়েটা নাওয়াসের প্রত্যাখ্যান মানতে পারে না। ভেঙে গুরিয়ে যায়। নিজের দূর্বলতা দেখাতে চাইনা। তাই সেখান থেকে দ্রুত চলে আসে। প্রত্যাশার টলমলে চোখ নাওয়াসের চোখের আড়াল হয়না। নাওয়াসের মনে প্রশ্ন জাগে,প্রত্যাশা কী কান্না করছে? পিয়াশ,তন্ময় মিন্টুও প্রত্যাশার অশ্রু সিক্ত আঁখিযুগল দেখেছে। কখনও প্রেম না করলেও। প্রত্যাশার অনুভূতি যে কোনো ভ্রম নয় তা ওদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এমনকি ওরাও এটায় ভাবতো নাওয়াস আর প্রত্যাশা একে অন্যকে ভালোবাসে। পিয়াশ বলল,
“প্রত্যাশার মন খারাপ হলে ওর মন ভালো করতে আপনি কেন মরিয়া হোন? কেন প্রত্যাশাকে কোনো ছেলে খারাপ কথা বলে আপনার রাগ হয়? আর কেনই বা প্রত্যাশার কথাতে আপনি পরিবর্তন হলেন? নিজের উগ্র জীবন ছেড়ে দিলেন?”
“কারণ ও আমার খুব ভালো বন্ধু হয়।”
“আমরাও তো আপনার বন্ধু হয়। আমরা যদি বলি ভাই আপনি বিয়ে করে নিন। আপনি কী শুনবেন আমাদের কথা?”
নাওয়াসের চোখ মুখ কঠিন হয়ে যায়। শক্ত স্বরে বলে,
“বিয়েটা কোনো মজার বিষয় না। এটা সারা জীবনের প্রশ্ন। এমন করে এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।”
“এটা সারা জীবনের প্রশ্ন বলে আপনি আমাদের কথা রাখতে পারলেন না। সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। কিন্তু প্রত্যাশার এক কথায়, আপনি নিজের গোটা জীবন পরিবর্তন করে ফেললেন। দায়িত্ববান হয়ে উঠলেন। একবারও ভাবার প্রয়োজনবোধ করেনি। এটা কী ভালোবাসা না?”
তন্ময় বলে,
“আপনি যদি প্রত্যাশাকে ভালো না বাসেন। তাহলে এই সাতদিন ওর সাথে কথা না হওয়াই এমন ছোটফোট কেন করছিলেন? এত উত্তলা কেন ছিলেন? কেন কোনো কাজে মন দিতে পারেননি? এমন কী প্রত্যাশা রাগ করেছে বলে,নিজের পিএ অব্দি পাল্টে দিলেন। কেন? এগুলোর কারণ কী শুধুই বন্ধুত্ব?”
এবার সাহস করে মিন্টুও বলল,
“আর সব কিছুতে প্রত্যাশাকে সবার আগে কেন রাখেন? ওর গুরুত্ব আপনার কাছে সব কিছুর উর্ধ্বে কেন। অফিসের জরুরি মিটিং এর মধ্যেও প্রত্যাশা কল করলে বিলম্বহীন কল ধরেন? গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রেখে প্রত্যাশার কাছে ছুটে যান? এগুলোর পিছনে কারণ কী?”
পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টুর প্রশ্নে নাওয়াস বাক্যহীন হয়ে যায়। ওদের প্রশ্নের উত্তর করতে পারে না। উল্টে নিজ মনে নিজেই প্রশ্ন করে,
“সত্যিই তো এগুলো আমি কেন করি? শুধুই কী প্রত্যাশা আমার খুব ভালো বন্ধু তাই? না-কি আমিও ও-কে…”
নাওয়াস কোনো উত্তর পায় না। নাওয়াসের সব কিছু এলোমেলো লাগে। নাওয়াস আর এক মুহূর্ত ওখানে থাকে না। বাইকে চেপে বসে।
.
.
.
রাতে নাওয়াস অন্যমনস্ক হয়ে খাবার খায়। কামাল মাহমুূদ ভাবেন অফিসের বিষয় নিয়ে চিন্তিত। তাই ঘাটান না। তবে রিনা মন বলে নাওয়াসের অন্য কিছু হয়েছে। সেই যে দুপুরের আগে ফিরল। তারপর আর কোথায়ও যায়নি। অফিসে জয়েন করার পর থেকে, শুক্রবারের দিনটা নাওয়াস বন্ধুদের জন্য বরাদ্দ রাখে। কিন্তু আজ যাওয়া ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই ফিরে আসে। নাওয়াস চোখ মুখ দেখেও ওনার ভালো লাগে না। মনের খচখচানি দূর করতে, নাওয়াসের কক্ষের সামনে আসে। দরজা হালকা ভেড়ানো ছিলো। সেই ফাঁক গলিয়ে লাইটের ক্ষীণ আলো বাইরে আসছে। যা দেখে রিনা বুঝলেন,ঘরে লাইট এখনও জ্বলছে। এর মানে নাওয়াস জেগে আছে। উনি আস্তে করে দরজা খুললেন। নাওয়াস রুমের মধ্যে একটা রোকিং চেয়ার আছে। সেখানে চোখ বন্ধ করে বসে আছে নাওয়াস। রিনা ভিতরে প্রবেশ করে। স্নেহের সহিত হাত নাওয়াসের মাথায় রাখে। অকস্মাৎ স্পর্শে নাওয়াস কিঞ্চিৎ চমকায়। চোখ মেলে রিনা কে দেখে সোজা হয়ে বসে।
নাওয়াস অবাক হয়। অবিশ্বাস্য নেত্রে রিনা দিকে চেয়ে বলল,
“তেমন কোনো ব্যাপার না। অফিসের বিষয়…”
“তুমি অফিসের বিষয় নিয়ে চিন্তিত নও,সেটা আমি জানি। তুমি যদি বলতে না চাও, তবে বলো না।”
নাওয়াস অবাক হয়। জিজ্ঞাস করে,
“আপনাকে কে বলল আমি অন্য বিষয়ে চিন্তিত?”
রিনা হালকা হাসেন। বললেন,
“মায়েরা সন্তারের মুখ দেখেই বুঝতে পারে তাদের মনে কী চলছে। তুমি কোনো বিষয় নিয়ে সংশয়ে ভুগচ্ছ। তবে সেই সংশয়ের কিনারা করতে পারচ্ছো না।”
রিনা থেমে আবার বলে,
“কিছু সংশয়ের সুরাহ একা একা করা যায় না। অন্যের সাহায্য লাগে।”
নাওয়াসের কানের কাছে রিনা বলা কথাটা বাজে, ‘মায়েরা সন্তারের মুখ দেখেই বুঝতে পারে তাদের মনে কী চলছে।’
পরপর নাওয়াসের মানসপটে প্রত্যাশার সেদিন হসপিটালে বলা কথাগুলো ভাসে। ‘উনি তোমায় পেটে ধারণ না করলেও, আত্মায় ধারণ করেছেন।’
রিনা চলে যেতে নিলে নাওয়াসের নিঃসৃত বাক্যে থমকে যায়।
“ছোটো বেলা যেমন তোমার কোলে মাথা নিয়ে হাত বুলিয়ে,ঘুম পাড়িয়ে দিতে তেমন করে আজ ঘুম পাড়িয়ে দিবে?”
রিনা চোখ ছলছল করে ওঠে। এই সম্বোধনটা শোনার জন্য কত অপেক্ষা করেছেন। আজ যেনো উনি মা হওয়ার আসল আনন্দ পেলেন। এক প্রকার ছুটে এসে নাওয়াসের চোখ মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,
“কী বললে ডাকলে? আবার বলো?”
“মা!”
রিনা হুঁহ করে কান্না করে দেন। নাওয়াস রিনাকে খাটে বসিয়ে রিনার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে সিক্ত কণ্ঠে বলল,
“আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই না? বিশ্বাস করো আমার তোমার প্রতি কখনও কোনো অভিযোগ ছিলো না। নিহানের প্রতিও না। আমি কারো মায়ার জড়াতে চাইনি। ভয় পেতাম তোমাদের কাছে গেলে, যদি তোমরাও হারিয়ে যাও। সেই কারণেই তোমাদের দূরে সরিয়ে রেখে ছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি খুব খারাপ ছেলে। এতদিন তোমার ভালোবাসাকে অবহেলা করেছি। কষ্ট দিয়েছি। খুব খারাপ আমি।”
নাওয়াসও কান্না করে।
“একদম আমার ছেলেকে খারাপ বলবি না। আমি জানি তুই আমাদের কতটা ভালোবাসিস। দূর থেকে সব সময় আমাদের আগলে রেখেছিস। তোর বাবাকে,আমাকে,নিহানকে আমাদের সবাইকে আগলে রেখেছিস। সবটা জানি আমি।”
রিনা থেমে আবার বলেন,
“নিহানের শরীর খারাপ হলে তুই সারারাত ওর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতি। আমি ঘুমিয়ে পড়লে ওর কাছে আসতি। বিজনেসের কারণে কতবার তোর বাবার ক্ষতি করতে চেয়েছে লোকে। তাদের থেকে তুই, তোর বাবাকে রক্ষা করেছিস। নিহান হওয়ার সময় যখন আমি অসুস্থ ছিলাম। তখন তুই আমার খেয়াল রাখতি। আমার সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখতি। সব সময় আড়াল থেকে আমাদের যত্ন নিয়েছিস।”
নাওয়াস বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“তুমি কী করে জানলে?”
“আমি যে মা হয়। আমি জানবো না আমার সন্তানকে?”
নাওয়াস রিনা কোলে মাথা গুজে। মা ছেলের এই মুধুময় মুহূর্তের নীরব সাক্ষি হয়ে থাকেন কামাল মাহমুদ আর নিহান। কামাল মাহমুদের চোখেও আজ খুশির অশ্রু চিক চিক করে। ঠোঁটে প্রশান্তি হাসি নিয়ে, মা-ছেলেকে নিজেদের মতো রেখে গেলেন। মনে মনে নিজের মৃ’তা স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ প্রকাশ করেন। তাকে ক্ষমা করার জন্য। এবং নাওয়াসের মতো একটা সন্তান দেওয়ার জন্য।
প্রত্যাশা বুটিক যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। আজ একটু সকাল সকাল যাবে। কয়েকদিন বুটিকে যাওয়া হয়নি। সেদিন পূর্ব ইমামের সাথে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর, প্রত্যাশার মন মেজাজ ভালো ছিলো না। মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিলো। মস্তিষ্ক বলছিলো, মা ঠিক বলেছে। বাবার কথা মেনে বিয়ে করা উচিত। আর মন বলছিলো, এখন বিয়ে না করতে। মন আর মস্তিষ্কের এই যুক্তি তর্কে। প্রত্যাশা মস্তিষ্কের কথায় শুনলো। মনস্থির করল, এবার সে আর বাবার অবাধ্য হবে না। এতদিন তো মনের কথায় শুনেছে। এই একটা কথা না হয় বাবার শুনুক। এটা তো ঠিক এক না একদিন, ওকে সত্যিই বিয়ে করতে হবে। বাবা যখন এখন চাইছে। এখনই করুক। তাদের মাঝে কম বিবাধ হয়নি। প্রত্যাশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। হ্যান্ড ব্যাগ কাধে নিয়ে ঘর থেকে বিরিয়ে আসল।
“মা আসছি!”
প্রত্যাশা সদর দরজা খুলতে নিবেন তখন পূর্ব ইমাম বললেন,
“কোথায় যাচ্ছো?”
পূর্ব ইমামের প্রশ্নে প্রত্যাশা পিছে ফিরলো। ছোটো করে বলল,
“বুটিকে!”
“আজকে বিকেলের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে।”
প্রত্যাশা স্বাভাবিক ভাবে শুধায়,
“কেন?”
“তোমাকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসবে। এর আগের বার জানায়নি, বলে অভিযোগ করেছিলে। এবার জানিয়ে দিলাম। আশা করি এবার আর আগের মতো দেরী করে ফিরবে না।”
পূর্ব ইমাম নিজ কথা সম্পূর্ণ করে যেমন এসেছিলেন,তেমনই চলে গেলেন। প্রত্যাশা মুখ গোল করে ভারি শ্বাস ছাড়লো। দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। প্রত্যাশা বিষণ্ণ মনে বুটিকে আসল। কাজ করতে লাগল। তবে কাজে বিশেষ মনোযোগ নেই। বুটিকে প্রত্যাশার একজন সহকারী আছে। নাম দিয়া। প্রত্যাশার অবর্তমানে ওই সব দেখে। প্রত্যাশা যখন কাজ করছিলো তখন দিয়া এসে বলে,
“আপু আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। আমি কী তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিবো?”
প্রত্যাশা আনমনে উত্তর করে,
“হুম!”
দিয়া চলে যায়। কিয়ৎক্ষণ পর একজন ভিতরে প্রবেশ করে। ভিতরে প্রবেশ করতেই মানবটি দেখে, প্রত্যাশা বিষণ্ণ চিত্তে পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে। মানবটি নিজের উপস্থিত জানান দিতে, হালকা কাশে। প্রত্যাশার ধ্যান ছুটে। কে এসছে দেখার জন্য মাথা তুলে। মাথা তুলতেই বড়ো সড়ো একটা ঝটকা খায়। সামনে দণ্ডায়মান নাওয়াসকে দেখে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“নাওয়াস তুমি?”
নাওয়াস এগিয়ে আসে। প্রত্যাশার অবাকতায় নাওয়াস কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়। তবে তা প্রকাশ করে না। নিজের অপ্রস্তুত ভাব সযত্নে লুকিয়ে বলল,
“হুম! একটু কথা ছিলো। সময় হবে?”
প্রত্যাশার বিস্ময় ভাব এখনো কাটেনি। সেভাবেই বলল,
“শিওর!”
“বসে কথা বলি?”
এবার প্রত্যাশার ধ্যান ছোটে। হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ইয়াহ! বসো!”
নাওয়াস বসলো। ইশারায় প্রত্যাশাকেও বসতে বলল। প্রত্যাশা বসল। নাওয়াস এসে তো পরেছে। কিন্তু কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারে না। প্রত্যাশা একপলক নাওয়াসকে অবলোকন করলো। হয়তো বুঝলো। নিজেই বলল,
“কী নিবে চা না কফি?”
পরপর প্রত্যাশা নিজেই বলল,
“চা বলি?”
প্রত্যাশা দিয়া কে ডাকলো। দু কাপ চা দিতে বলে গেলো। প্রত্যাশার কথা মতো দিয়া চা আনতে চলে গেলো। প্রত্যাশা শুধাল,
“আঙ্কেল এখন কেমন আছেন?”
নাওয়াস ছোটো করে বলল,
“ভালো!”
“আমি হসপিটালে গেছিলাম। কিন্তু হসপিটালে গিয়ে জানতে পারি, আঙ্কেল কে ডিসচার্জ করে দিয়েছে। তাই আর দেখা হয়নি।”
“হুম বাবার সেন্স আসার পর আর হসপিটালে থাকতে চাইনি। তাই আর কি…”
“ওহ আচ্ছা!”
ওদের কথার মধ্যে দিয়া চা দিয়ে যায়। চায়ের এক চুমুক দিয়ে প্রত্যাশা বলল,
“হুম! আমার তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ছিলো। সেদিন যদি তুমি সময় মতো বাবাকে হসপিটালে না নিতে…”
“এর জন্য তোমার আমাকে ধন্যবাদ জানাতে হবে না। আমি তোমার ধন্যবাদের জন্য কিছু করিনি।”
“তাহলে কীসের জন্য করেছো?”
“সাহায্য করতে কি কোনো কারণ লাগে?”
“সেটা না…”
নাওয়াস কিছু বলবে তার আগেই প্রত্যাশা বলে ওঠে,
“তুমি পিউকে কারণ ছাড়া একাধিকবার সাহায্য করেছো।”
নাওয়াস সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কী তার ঋণ শোধ করলে?”
“সেটা কেনো হবে? তুমি তো আমাকেও সাহায্য করেছিলে। যেখানে তুমি আমায় বিশেষ পছন্দ করো না।”
সহসাই নাওয়াসের ভ্রু কুঁচকে আসে। বলল,
“আমি তোমায় পছন্দ করি না, এটা তোমায় কে বলেছে? আমি?”
“উম্ম্ তা বলোনি!”
“তাহলে?”
“প্রথম সাক্ষাৎ কাউকে থা’প্প’ড় মা’রার পর, সে নিশ্চয়ই আমাকে পছন্দ করবে না। তাই না?”
নাওয়াস হকচকায়। প্রথম দিনের কথা মনে পরে। প্রত্যাশা পুনরায় বলে। এবং তাও অত্যন্ত নমনীয় স্বরে,
“সেদিনের জন্য আমি মন থেকে স্যরি নাওয়াস! রাগের মাথায় আমার তোমাকে হুট করে থা’প্প’ড় মা’রা উচিত হয়নি। আসলে সেদিন ওরা এত বাজে কথা বলেছিলো। তুমি যখন তোমার বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাইতে বললে। আমার মনে হয়েছিলো, তুমিও ওই রকম। তাই রাগের মাথায়…”
“ইট’স ওকে প্রত্যাশা! আমি কিছু মনে করিনি। সত্যি বলতে প্রথমে আমারও তোমার ওপর রাগ হয়। পরে বিষয়টা ভালো করে জানার পর বুঝি। এতে তোমার কোনো দোষ ছিলো না। তোমার রিয়াক্ট করাটা স্বাভাবিক।”
নাওয়াসের মুখে এই প্রথম নিজের নাম শুনলো প্রত্যাশা। এর আগে যতবার দেখা হয়েছে ততবার এই মেয়ে নয়তো তুমি। এর বাইরে কখনও অন্য কোনো সম্বোধন করেনি। নাওয়াস ফের বলল,
“বাট একটা কথা না বললেই না। তুমি খুব সাহসী। তোমার জায়গা অন্য কোনো মেয়ে হলে, লোক লজ্জার ভয়ে চুপচাপ সব মেনে নিতো। আর ঘরে দরজা দিয়ে কান্না-কাটি করতো। কিন্তু তুমি সেটা না করে প্রতিবাদ করেছিলে। এটা সবাই পারে না।”
প্রত্যাশা যেন আজ দফায় দফায় অবাক হচ্ছে। নাওয়াসের সাথে এপর্যন্ত যতবার সাক্ষাৎ হয়েছে। নাওয়াস খুব কম কথা বলেছে। প্রত্যাশা বুঝেই নিয়েছিলো নাওয়াস স্বল্পভাষী। কিন্তু আজ যেন অন্য নাওয়াসকে দেখছে। বলাবাহূল্য নাওয়াস অনেক সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছে। প্রত্যাশা মুগ্ধ হয় নাওয়াসের কথা বলার ভঙ্গিমায়।
“আমি নিজেকে নিজে সাহায্য করাই বিশ্বাস করি। এবং সেভাবেই নিজেকে তৈরি করেছি।”
প্রতাশার উত্তর নাওয়াস স্মিত হাসলো। এই প্রথম নাওয়াসকে হাসতে দেখে প্রত্যাশা বিস্মিত হলো। শ্যামবর্ণের এই পুরুষটার হাসি মারাত্মক সুন্দর। নাওয়াস বলল,
“নাইস থ্রট! তোমার চিন্তা ধারা বাকিদের থেকে আলাদা। আমার মনে হয়,প্রতিটা মেয়ের তোমার মতো হওয়া উচিত। আত্মনির্ভশীল, আত্মবিশ্বাসী, সাহসী। যারা নির্দ্বিধায় নিজের জন্য স্ট্যান্ড করতে পারবে। নিজের মত প্রকাশ করতে পারবে। সাবলম্বী হবে।”
“হ্যাঁ! তুমি সেদিন আমাকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলে। কিন্তু আমি গ্রহণ করিনি। আর আজ আমি তোমায় নিজে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি।”
নাওয়াস ডান হাত এগিয়ে দিয়ে শেষক্ত কথা বলল। প্রত্যাশার চোখে বিস্ময়। নাওয়াস আবার বলল,
“আমরা বন্ধু না হয়েও একে অপরের বিপদে পাশে থেকেচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি প্রকৃত বন্ধু সেই হয়। যে বিপদের সময় পাশে থাকে। পথ হারালে, পথ দেখায়। যেটা তুমি করেছো। তুমি শুধু আমার বিপদে এগিয়ে আসোনি। বরং আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছো। এতবছর ধরে যে ভুল পথে আমি হেঁটেছি। সেই পথ থেকে সঠিক সময় তুমি আমায় ফিরিয়ে এনেছো।”
নাওয়াসের নিঃসৃত বাক্যে প্রত্যাশা থমকায়। পরক্ষণে একরাশ ভালো লাগায় মন ভরে যায়। গাল ভরে হেসে নাওয়াসের বাড়িয়ে রাখা হাতে হাত মিলিয়ে, বন্ধুত্বের সূচনা করে। গ্রহণ করে নাওয়াসের বন্ধুত্ব। শুরু হয় দুই মেরুর মানুষের একত্রে পথ চলা। এই সূচনা কী বন্ধুত্বের না-কি অন্য কিছুর? ওদের বন্ধুত্বের পরিনতি কী হবে? তা আদৌও অজানা।
________
নাওয়াস আর প্রত্যাশা হাঁটছে। প্রত্যাশা নাওয়াসকে টুকিটাকি অনেক কথায় শেয়ার করলো। সাথে এটাও বলল আজ ওকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে।
“এর মানে শীঘ্রই তোমার বিয়ের দাওয়াত পাচ্ছি?”
নাওয়াস রসিকতা করেই বলে। উত্তরে প্রত্যাশা বলে,
“আমার বিয়ে শুনে তুমি খুব খুশি মনে হচ্ছে।”
“কেন খুশি না হওয়ার কী আছে?”
“ধুর! আমি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত না।”
“তাহলে করো না।”
“বাবা মানে না তো।”
“তোমার বাবাকে কেন মানাতে হবে? বিয়ে না করার জন্য পাত্রকে মানাও।”
“হ্যাঁ আমি বলবো আর পাত্র নাঁচতে নাঁচতে মেনে যাবে তাই না?”
“দারুণ আইডিয়া। এতে বিয়েও ভেঙে যাবে আমারও নাম হবে না…”
“হুম!”
বিকেলে প্রত্যাশাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। প্রত্যাশা ভদ্র মেয়ের মতো ওদের সামনে আসে। আলাদা কথা বলার জন্য ছাঁদে যায়। ছাঁদে যাওয়ার সময় প্রত্যাশা পিউকে ইশারা করে। ওরা ছাঁদে যেতেই পিউ কাজ শুরু করে। পাত্রকে ভয় দেখায়। পাত্ররা যে পুরোনো চিন্তা ধারার সে সম্পর্কে প্রত্যাশা অবজ্ঞাত ছিলো। আর তাই পাত্রের পরিবারকে জিনের ভয় দেখায়। ব্যস ওরা বিয়ে ভেঙে দেয়।
নাওয়াস আগেই পাত্রের পরিবার সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করে। সেটা প্রত্যাশাকে জানায়। সেই অনুযায়ী প্রত্যাশা বিয়ে ভাঙার প্ল্যান করে। এতে করে বিয়েও ভেঙে যায়। প্রত্যাশারও কোনো নাম হয় না। পূর্ব ইমাম হতাশ হয়। তিনি খুঁজে পাননা কেন এভাবে একের পর এক বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রত্যাশা মহা খুশি। নাওয়াস আর প্রত্যাশার সম্পর্ক অনেক মজবুত হয়েছে। নিঃসন্দেহ ওদের দেখলে যে কেউ বলবে, ওরা জন্মগত বেস্ট ফ্রেন্ড। পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টু প্রথমে নাওয়াস আর প্রত্যাশার বন্ধুত্বর বিষয়টা বিশ্বাস করেনি। প্রত্যাশার মিন্টুর কাছেও ক্ষমা চাই। মিন্টু এখন আর প্রত্যাশাকে ভয় পায়না। এভাবেই কেটে যায় দুমাস। প্রত্যাশার সাথে বন্ধুত্ব করার পর থেকে নাওয়াসের মাঝে পরিবর্তন এসেছে। নাওয়াস এখন অনেক দায়িত্ববান হয়ে উঠেছে। বাবার সাথে যেই মনোমালিন্য ছিলো তাও মিটিয়ে নিয়েছে। সপ্তাহখানেক হলো নাওয়াস অফিসের কাজে হাত লাগিয়েছে। নিজের সাথে নিজের বন্ধুদের কেউ দায়িত্ববান করে তুলেছে। নিজেদের কম্পানিতে ওদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দিয়েছে। অবশ্য এই বুদ্ধিটা প্রত্যাশার মস্তিষ্ক অভিভূত। নাওয়াসের এরূপ পরিবর্তনে সবাই অনেক অবাক হয়, সাথে খুশিও হয়। সব থেকে বেশি খুশি হয় নিহান। নাওয়াস অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো। নিহান এসে বলে,
“ভাইয়া একটা কথা বলবো?”
“হুম বলো!”
“অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিবে?”
নাওয়াস ছোটো করে বলল,
“রেডি হয়ে এসো।”
নিহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাওয়াস প্রশ্ন করল,
“কিছু বলবে?”
নিহান হ্যাঁ বোধক মাথা নাঁড়ায়।
“বলো!”
“আমি তোমার থেকে একটা জিনিস চাইবো দেবে?”
নাওয়াসের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হয়। সহসাই শুধাল,
“কী জিনিস?”
“আমাকে তুই করে ডাকবে? তুমি ডাকটা কেমন দূরের শোনায়। পর পর লাগে…”
নাওয়াস কিয়ৎক্ষণ নিহানের আনন পানে রয়। ছেলেটা সারাক্ষণ তার সানিধ্য পেতে চেষ্টা করে। নাওয়াসের উত্তর না পেয়ে নিহানের মুখটা মলিন হয়ে আসে। নিহানের ম্লান চেহারা দেখে নাওয়াসের বক্ষ ধ্বক করে ওঠে। নিহান চলে যেতে নিলে নাওয়াস নিঃসৃত বাক্যে থমকে যায়।
“আমার সাথে যেতে চাইলে, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়। আমার অফিসে জরুরি কাজ আছে। একমিনিট দেরী হলে,তোকে না নিয়েই চলে যাবো…”
কামাল মাহমুদ এখন পুরোপুরি বিপদ মুক্ত। ঔষুধের ফলে ঘুমাচ্ছেন। নাওয়াস ডাক্তারের সাথে অনুমতি নিয়ে কামাল মাহমুদ একবার দেখে আসে। আজ একমাস পর বাবাকে দেখছে। তাও কিনা এমন অবস্থায়? কামাল মাহমুদকে এভাবে দেখে নাওয়াসের বক্ষঃস্থলে র’ক্ত ক্ষরণ হয়। যতোই হোক মানুষটা তার বাবা হয়। নাওয়াস আর থাকতে পারে না। তুরন্ত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করে।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে আসে। একটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ায়। আঁখি হতে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কাধে কারো স্পর্শে নাওয়াস নিজের চোখের পানি মুছে ফেলে। সে চাইনা নিজের দূর্বলতা কাউকে দেখাতে। চোখ মুখ শক্ত করে পিছে ফিরে। নাওয়াস ভেবেছিলো পিয়াশ বা তন্ময় হবে। কিন্তু প্রত্যাশাকে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়। নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখে। আটটা বাজে। শীতের সময় আটটা মানে অনেক রাত। প্রত্যাশা এখনও হসপিটালে থাকায় নাওয়াস শুধায়,
“তুমি? বাড়ি যাওনি?”
“নাহ্!”
প্রত্যাশা কথা বলতে বলতে নাওয়াসের পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে। আকাশে চাঁদের অস্বস্তি না থাকলেও, অসংখ্য তাঁরা আকাশ জুড়ে নিজেদের বিস্তার লাভ করেছে।
“কেন?”
“এমনি!”
নাওয়াস আর কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিয়ৎক্ষণ পর নীরাবতা কাটিয়ে নাওয়াস তার চিরপরিচিত নিরেট স্বরে বলে,
“থ্যাংঙ্ক’স! তোমার কারণে আমার বাবা বড়ো বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন।”
প্রত্যাশা হালকা হাসে। তারপর বলে,
“উঁহু্! আমি শুধু মাধ্যম মাত্র। ওনাকে আল্লাহ রক্ষা করেছেন।”
আবারও দুজনের মাঝে নীরাবতা চলে। এবার প্রত্যাশা বলে,
“জানো মানুষের জন্মের আগেই তার মৃ’ত্যু লেখা হয়। কখন কোন মানুষ কোন রোগে অথবা অ্যাকসিডেন্টে মা’রা যাবে। এগুলো সব আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে।”
প্রত্যাশা থামে শ্বাস নিয়ে ফের বলে,
“জন্ম,মৃ’ত্যু’র মালিক আল্লাহ তায়ালা। এখানে মানুষের কোনো হাত থাকে না। এটা সম্পূর্ণ হায়াতের ব্যাপার। কারো মৃ’ত্যু’র জন্য নিজেকে কিংবা অন্য মানুষকে দায়ি করা, বোকামো ব্যতিত কিছু না।”
নাওয়াস ভ্রু কু্চকে প্রত্যাশার দিকে চাইলো। সহসাই শুধাল,
“কী বলতে চাইছো?”
“তোমার মায়ের মৃ’ত্যু সম্পূর্ণ আল্লাহ পদত্ত। ওনার হায়াত ও-তো টুকুই ছিলো। এখানে তোমার বাবার কোনো দোষ নেই। আল্লাহ চেয়েছিলেন বিধায় ওনার মৃ’ত্যু ঘটেছিলো।”
নাওয়াসের চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে। প্রত্যাশা পুনরায় বলে,
“আজ যদি তোমার বাবার হায়াত না থাকতো। ওনার যদি ভালো মন্দ কিছু হয়ে যেত। আর তার দায় যদি তোমাকে দেওয়া হতো তাহলে?”
নাওয়াস চমকায়। বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
“আমাকে?”
প্রত্যাশা স্মিত হাসে।
“তোমার বাবার ব্রেইন স্টোকের কারণ কী জানো?”
নাওয়াস চুপ থাকে।
“স্ট্রেস! তুমও বাড়ি ছাড়ার পর উনি মানুসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। দুশ্চিন্তা, হতাশায় ভোগেন। নিজেকে তোমার মায়ের মৃ’ত্যু’র জন্য দোষী মনে করেন। আর তার পরিনতি সরূপ ওনার মস্থিষ্কের স্নায়ুতে চাপ পড়ে।”
নাওয়াস স্তব্ধ, বিহ্বল। এতক্ষণ বিষয়টা সে ভাবেনি। মনে মনে আওড়াই,
“বাবা আমার জন্য স্টোক করেছে? বাবার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ি?”
প্রত্যাশা হয়তো নাওয়াসের মনের অবস্থা বোঝে। তাই বলে,
“তোমার বাবার এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ি নও। এটা ওনার ভাগ্যে লেখা ছিলো। ঠিক যেমন তোমার মায়ের ভাগ্যে ম’রণ ব্যাধি ক্যান্সার লেখা ছিলো। রোগ-ব্যাধি, বিপদ-আপদ সব কিছুই আল্লাহর তরফ থেকে আসে। ঠিক যেমন সুখ আসে। কিন্তু কী জানো তো?
আমরা মানুষরা বড্ড বোকা হয়। এটাই বুঝিনা দুঃখ আমাদের জীবনের পরীক্ষার জন্য আসে। আর সুখ সেই পরীক্ষার ফলাফল। আমরা দুঃখ আকঁড়ে সুখ গুলো হেলা করি…”
প্রত্যাশা এবার নাওয়াসের দিকে চাইল। নাওয়াস প্রত্যাশার দিকেই চেয়েছিলো। চোখে চোখ রেখে প্রত্যাশা বলে,
“দুঃখ গুলো আকঁড়ে না থেকে সুখ আকঁড়ে ধরো। তোমার একটা সুন্দর পরিবার আছে। বাবা আছে,ভাই আছে। একজন মা আছেন। যিনি তোমায় পেটে ধারণ না করলেও, নিজের আত্মায়, অস্বস্তিতে ধারণ করেছেন।
এখনও সময় আছে। তুমি একা নও নাওয়াস। তোমার সুখী পরিবার আছে। যেই সুখ তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তার হাত ধরো। বিশ্বাস করো, তোমার জীবনে কোনো আক্ষেপ থাকবে না। আল্লাহ কোনে শূন্যস্থান রাখেন না। তোমার জীবনেও রাখেননি। সময় থাকতে যদি না বোঝো। হেলা করো। তাহলে এই সুখ গুলো আর থাকবে না। তখন তুমি সত্যিই একা হয়ে যাবা। চাইলেও আর কাউকে পাবে না। তখন কিন্তু আফসোস করে কূল পাবে না…”
প্রত্যাশা নিজের কথা বলে সেখান থেকে প্রন্থান করে। নাওয়াস প্রত্যাশার বলা প্রতিটা কথা ভাবে। নাওয়াসের ভিতরের সত্তা হঠাৎ বলে ওঠে,
“দেরী হওয়ার আগে ফিরে এসো নাওয়াস। নিজের ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে দেখো। সত্যিই তুমি একা নও। তোমার সুন্দর একটা পরিবার আছে। যারা তোমাকে ভালোবাসে। যারা তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। তুমি ব্যতিত সেই পরিবার অসম্পূর্ণ…”
.
.
.
ঘড়ির কাটা যখন নয়টা পেরিয়েছে সেই সময় প্রত্যাশা বাড়িতে প্রবেশ করে। প্রত্যাশা বাড়ি ঢোকার সময় সদর দরজা খোলা পেয়ে, কিঞ্চিৎ অবাক হয়। প্রত্যাশার অবাকতার রেশ না কাটতেই পূর্ব ইমামের ভারিক্কি স্বরে ছোড়া প্রশ্ন কর্ণকুহরে প্রবেশ করে।
“কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়ে, এত রাত করে বাড়িতে ফেরে?”
সহসাই প্রত্যাশার ভ্রু সংকুচিত হয়। হাত ঘড়ি দেখে বলল,
“মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। ঢাকা শহরের এটা সন্ধ্যের সমান।”
“বাবা আমি কাজ করি। কাজের জন্য অনেক সময় লেট হয়। এর আগেও তো আমি আটটার পরে বাড়ি এসেছি। হ্যাঁ আজ আটটার বেশি বেজে গেছে। এতে এতো রিয়াক্ট করার কী আছে? আমি তো আর কোনে বাচ্চা নয়। যে রাতে রাস্তা হারিয়ে ফেলবো।”
“দিন দিন সভ্যতা, ভদ্রতা সব ভুলে যাচ্ছো।”
“এখানে অসভ্যতার কী আছে?”
প্রত্যাশার প্রশ্নে পূর্ব ইমাম আরও বেশি রেগে যান। বলেন,
“তোমার কারণে আজ আমার মাথা নিচু হয়ে গেলো।”
পূর্ব ইমামের নিঃসৃত বাক্যে প্রত্যাশা কিংকতর্ব্যবিমুঢ় হয়ে যায়।
“আমি কী করলাম?”
“তুমি যদি রাত করে বাড়ি না আসতে, তাহলে আমাকে পাত্র পক্ষের সামনে অপমানিত হতে হতো না।”
প্রত্যাশা চমকিত বলে,
“পাত্র পক্ষ মানে?”
“আজ তোমাকে দেখতে পাত্র পক্ষ এসেছিলো। কিন্তু তুমি কী করলে দেরী করে বাড়ি ফিরলে। তুমি জানো ওদের সামনে আমি কতটা অপমানিত হয়েছি?”
প্রত্যাশা বিস্মিয়ে কথা বলতে ভুলে যায়। পরপর চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে। কাঠ কণ্ঠে বলে,
“এখানে তো আমার কোনো ভুল নেই। তুমি আমাকে না জানিয়ে পাত্র পক্ষ এনেছিলে। যার সম্পর্কে আমি বিন্দু মাত্র অবগত ছিলাম না। তার দায় তুমি আমাকে দেবে না। এখানে সম্পূর্ণ তোমার ভুল। আর তাই তুমি অপমানিত হয়েছো।”
প্রত্যাশার কাঠ কণ্ঠে ছোড়া বানীতে পূর্ব ইমাম বিহ্বল বনে যায়।
“তুমি আমার দিকে আঙ্গুল তুলছো? তোমার এত বড়ো স্পর্ধা?”
প্রত্যাশাও এবার রেগে যায়। বলে,
“হ্যাঁ তুলছি। তুমি তুলতে বাধ্য করছো। আমি অবাক না হয়ে পারছি না। তুমি আমায় না জানিয়ে আমার বিয়ে জন্য ছেলে দেখছো? লাইক সিরিয়াসলি?”
“তোমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি।”
“তুমি আমার বিয়ের জন্য সম্বোন্ধ দেখছো। আর তুমি বলছো আমাকেই জানানোর প্রয়োজন বোধ করনি?”
“না করিনি! কারণ আমি তোমার বাবা হয়। তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে।”
“নাহ নেই। তুমি নিজের মতামত রাখতে পারো। কিন্তু তোমার কোনো সিদ্ধান্ত, তুমি আমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারো না।”
পূর্ব ইমান বিস্ময়ভূত হয়ে বললেন,
“কী বললে তুমি? তোমার জীবনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত, নেওয়া অধিকার আমার নেই? তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার বাবা হয়। তোমাকে জন্ম আমিই দিয়েছি।”
“জন্মদিয়েছো বলে তুমি আমার সাথে, যা খুশি করতে পারো না। আমি কোনো পুতুল নয়।”
পূর্ব ইমাম গলার স্বর দ্বিগুন চওড়া করে বললেন,
“পারি একশো বার পারি! সব সময় সবকিছুর ওপর তোমার জেদ চলবে না। এবার আমি যা বলবো তাই হবে। আমি তোমার বিয়ে দেবো। আর তোমাকেও বিয়ে করতে হবে। ব্যস, এটাই আমার শেষ কথা।”
প্রত্যাশা নিজেকে সামলায়। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ঠাণ্ডা স্বরে বলে,
“আমি তো বলছি না আমি বিয়ে করবো না। আমি বিয়ে করবো। কিন্তু এখন না। আমি এখন বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নয়।”
“এখন করবে না তো কখন করবে? নিজের বয়স দেখেছো? চব্বিশ পার করে গেছো। পঁচিশ পেরিয়ে গেলে তোমার আর বিয়ে হবে? তুমি যদি বিদেশে না যেতে। এতো দিনে তোমার সুন্দর একটা সংসার থাকতো। তা না করে তুমি বিদেশে গেলে। কী সব ডিজাইন কোর্স করলে। এগুলো সময় নষ্ট ছাড়া কিছু না। শুধু শুধু বিয়ের বয়স পার করলে।”
“বাবা তুমি এসব কী বলছো? শুধুমাত্র বিয়ে সংসার একটা মেয়ের জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে,তুমি এই ধরনের কথা বলছো?”
“তুমি আমাকে যুগ দেখাতে এসো না। মেয়ে হয়ে জন্মেছো। বিয়ে, সংসার করবে। তা না তুমি বাইরে কাজ করবে। আমি এতদিন তোমার জেদ মেনে নিয়েছি। কিন্তু আর না। তোমার এই উগ্রপন্থী জীবন আমি আর মানবো না। অতিস্বত্বর আমি তোমার বিয়ে দেবো।”
পূর্ব ইমাম নিজ বাক্য শেষ করে,চলে যান। প্রত্যাশা হতচেতন হয়ে পূর্ব ইমামের প্রন্থান পথে চেয়ে রয়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মা এসব কী? তুমি বাবাকে কিছু বলবে না?”
মিনা প্রত্যাশার নিকট এগিয়ে আসে। মাথা হাত বুলিয়ে মোলায়েম স্বরে বলেন,
“দেখ মা বিয়ে এক না একদিন করতেই হবে। তুই আর তোর বাবার অবাধ্য হোস না। মানুষটা তোকে নিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তায় থাকেন।”
“মা তুমিও এমন কথা বলছো? একবার আমার দিকটা ভেবে দেখছো না? আমি বিয়ের জন্য মানুসিক ভাবে প্রস্তুত নয়। আমার সময় প্রয়োজন। এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত আমি এভাবে হুট করে নিতে পারবো না।”
“তোর বাবা তোর জন্য পাত্র দেখছে। আর পাত্র দেখলেই বিয়ে হয়ে যায় না। ততোদিনে তুইও সময় পেয়ে যাবি। এই নিয়ে আর ঝামেলা করিস না। উনি তো তোর বাবা হন। উনি কী তোর খারাপ চাইবেন? কোনো বাবা-মা কী তার সন্তানের খারাপ চাই?”
“আমি সেটা বলিনি মা! কিন্তু…”
“আর কোনো কিন্তু না। তোর পছন্দ না হলে আমরা তো আর জোর করে বিয়ে দেবো না। এখন যা হাত মুখ ধুয়ে নে। আমি খাবার দিচ্ছি।”
মিনা চলেন যান প্রত্যাশা মনে মনে বলে,
“তুমি যায় বলো মা। আমি বাবাকে খুব ভালো করে চিনি। বাবার যদি ছেলে পছন্দ হয়। বাবা আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব দেবে না। জোর করে হলেও আমার বিয়ে দেবে।”