Tuesday, July 1, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 80



প্রেমপরশ পর্ব-০৮

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৮

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

ঠিক তখনই ভেসে এলো গম্ভীর এক কণ্ঠস্বর,

“ওখানেই দাঁড়িয়ে যাও।”

আরোহী এবং তনয়া চমকালো। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মুহুর্তেই। মানিক স্যার এগিয়ে এলেন তাদের দুজনের পানে। চশমার ফাঁক থেকে তাকিয়ে শুধালেন,

“একে তো দেরী করে এসেছো। তার উপর আবার লুকিয়ে লুকিয়ে ঢুকছিলে?”

ঢোক গিললো দুজনেই। আরোহী আমতা আমতা করে বলল,

“না কি হয়েছে কি স্যার। রাস্তায়…”

বাকিটুকু আর শেষ করার সুযোগ হলো না মেয়েটার। তার আগেই মানিক স্যার ধমকে বলল,

“ক্লাসের বাইরে গিয়ে দাঁড়াও দুজনেই।”

স্যারের ধমকে চমকে উঠলো দুজনেই। মাথা নিচু করে ফেলল তৎক্ষণাৎ। তনয়া কিছুটা অনুনয়ের সাথে বলল,

“স্যরি স্যার। আর কখনও এমন হবে না।”

মানিক স্যার শুনলেন না কোনো কথা‌। গম্ভীর কণ্ঠে ফের বললেন,

“ক্লাসের বাইরে গিয়ে দাঁড়াও তাড়াতাড়ি।”

আরোহী এবং তনয়া আরও কিছুক্ষণ অনুনয় করলো। তবে শেষ পর্যন্ত গিয়ে ক্লাসের বাইরেই দাঁড়াতে হলো তাদের। স্যারটাও খবিশ বেশ। কোনো কথা শুনলো না। একটুই তো দেরী করেছে। কি হতো মাফ করে দিয়ে ক্লাসে বসতে দিলে? আরোহীর রাগ লাগলো ভীষণ। মনে মনে কিছু অভিশাপও দিয়ে ফেললো সে স্যার এবং স্যারের বউকে। তবে সবচেয়ে বেশি রাগ লাগলো তূর্ণের উপরে। ঐ লোকটার জন্যই তো সব হয়েছে। তখন যদি ঐ লোকটা তাদের পিছন থেকে না ডাকতো, দাঁড় করিয়ে উদ্ভট সব কথা বলে সময় নষ্ট না করতো তবে ঠিক সময়েই কলেজে পৌঁছাতে পারতো আরোহী আর তনয়া। শুধু শুধু লোকটা তাকে দাঁড় করিয়ে বিভ্রান্তিকর একটি পরিস্থিতিতেও ফেললো আর এখন ক্লাসের বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ক্লাসের সবার সম্মুখে কি এক লজ্জাজনক পরিস্থিতি এটা! সবাই নিশ্চয়ই তাদের নিয়ে মনে মনে হাসছে।

১১.
আকাশটা মেঘে ঢাকা। সূর্যের দেখা নেই আজ। গতকাল রাত থেকে যে এ বৃষ্টি শুরু হয়েছে তা কমেনি এখনও। টুপটাপ ধ্বনি তুলে অঝোর ধারায় ঝড়ছে ভূমিতে। আরোহী আজ কলেজে যায়নি। এই ভেজা বর্ষায় সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার কক্ষের সাথে লাগোয়া বারান্দায়, হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওড়ানো চা। বাহিরে বৃষ্টি, হাতে গরম চা। কি অদ্ভুত এক প্রশান্তি! আরোহী চায়ের কাপে চুমুক দিল। আবেশে বন্ধ করে নিল চোখ দুটো। পর মুহুর্তেই আবার চোখ দুটো খুলে ফের চুমুক বসালো চায়ের কাপে। বারান্দার মেঝেতে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এক হাত বাড়িয়ে দিল বাহিরের পানে। মুহুর্তেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিরা এসে ভিজিয়ে দিল তার কোমল হাতকে। শিরশির করে উঠলো শরীর খানা। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো মৃদু প্রশান্তির হাসি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ করেই আরোহীর স্মরণে এলো বেলী ফুলের কথা। এই ভেজা বর্ষায় এক গুচ্ছ শুভ্র রঙা বেলীদের দেখা পেলে মন্দ হয় না। সেদিন তূর্ণের ঘরের বারান্দায় যখন কিছু বেলী ফুলের চাড়া লাগাতে গিয়েছিল আরোহী তখন খেয়াল করেছিল বারান্দায় থাকা অন্যান্য বেলী গাছে বেশ সুন্দর ছোট ছোট কিছু কলি নিয়েছে। আজ তা ফুটে যাওয়ার কথা। আরোহী আর সময় নষ্ট করলো না। দ্রুত পায়ে এলো কক্ষের ভিতরে। চায়ের কাপটা টেবিলে উপরে রেখে একটা ছাতা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গৃহের বাইরে।

১২.
রাস্তাঘাটে ইতমধ্যে পানি জমে গেছে। ঢাকার এই একটা সমস্যা। একটু বৃষ্টি হলেই পথে ঘাটে পানি জমে যায়। ড্রেনগুলোও অপরিষ্কার, ময়লা আবর্জনায় ভরে রয়েছে। পানি নিষ্কাশনের ভালো কোনো উপায় নেই। আরোহী এক হাতে মাথায় ছাতা ধরে আর অন্য হাতে পাজামাটা একটু উপরে তুলে এক প্রকার লাফিয়ে লাফিয়েই পৌঁছালো তূর্ণদের বাড়ির দরজার সম্মুখে। বিশাল এক যুদ্ধ জয় করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন মেয়েটা। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে হাতের ছাতাটা বন্ধ করলো। অতঃপর দরজা ঠেলে ভিতরের দিকে পা দিতেই ধপাস করে মেঝেতে। আকস্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে উঠলো আরোহী। চেঁচিয়ে বলল,

“আল্লাহ গো!”

রান্নাঘরে কাজ করছিল পৃথা, ইসরাত এবং অনন্যা। আরোহীর চিৎকার শুনে তার পানে ছুটে এলো তারা। মেয়েটাকে মাটিতে বসে থাকতে দেখে তাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না এখানে কি হয়েছে। বাহির থেকে ভেজা পা নিয়ে এসে টাইলসের উপরে পাড়া দিতেই নির্ঘাত পিছলে পড়েছে। পৃথা, ইসরাত এবং অনন্যা আর সময় ব্যয় করলো না। দ্রুত এসে মেঝে থেকে টেনে উঠালো মেয়েটাকে। অস্থির হয়ে পৃথা শুধালো,

“ঠিক আছিস মা? কি হয়েছে?”

আরোহী কোনো মতে উঠে দাঁড়ালো। বোকা বোকা হেসে সে তাকালো সবার পানে। এই মুহূর্তে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার।‌ সারা পথে পানির মধ্যেও পড়লো না অথচ বাড়ির দরজায় এসেই ধপাস করে পড়লো! কি‌ এক লজ্জাজনক ঘটনা! ভাগ্যিস আর কেউ আসেনি। নয়তো মান ইজ্জত বলে আর কিছু থাকতো না। মেয়েটা ব্যথা তো পেয়েছে বেশ। কোমড় এবং এক পা বোধহয় ব্যথায় অবশ হয়ে গেছে ইতমধ্যে। তবুও লজ্জায় ব্যথা লুকালো সে। আমতা আমতা করে জবাব দিল,

“কোথাও ব্যথা পাইনি। কোথাও না।”

পরপর মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে পা বাড়ালো উপরের দিকে। যেতে যেতে বলল,

“তনায়ার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ওর কাছে যাই আগে।”

পৃথা, ইসরাত এবং অনন্যা কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আরোহীর চলে যাওয়ার পানে। অতঃপর যে যার নিজের কাজের উদ্দেশ্যে চলে গেল।

*****

আরোহী মুখে তনয়ার সাথে দেখা করার কথা বললেও সে তো মূলত এসেছিল তূর্ণের বারান্দা থেকে বেলী ফুল নিতে। পায়ে ব্যথা পেয়েছে বা কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে তাতে কি হয়েছে? তাই বলে কি সে বেলী ফুল নিবে না? অবশ্যই নিবে। কিন্তু এখন সমস্যা হলো তূর্য ঘরে আছে কিনা তা নিয়ে। ঐ বদ লোক ঘরে থাকলে বেলী ফুল নেওয়া তো দূরে থাক তাকে বেলী গাছের ধারে কাছেই ঘেঁষতে দিবে না। তখন নিচে বসে যে কাউকে তূর্যের কথা জিজ্ঞেস করবে তাও পারেনি। আছাড় খেয়ে লজ্জায় উপরে ছুটে এসেছে।

আরোহী আস্তে ধীরে উঁকি মা’র’লো তূর্ণের কক্ষের পানে। কক্ষের দরজাটা চাপানো তবে ভিতরে জনমানবের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কোনো। হয়তো ঘরে নেই। এই বৃষ্টিতেও বেড়িয়েছে। যাক ভালোই হলো। আরোহী পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ঢুকলো তূর্ণের কক্ষে। এদিক ওদিক তাকিয়ে চারপাশটা আরেকবার পর্যবেক্ষণ করে সোজা ছুটে গেল বারান্দায়। সত্যিই আজ অনেকগুলো বেলী ধরেছে গাছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে নিজের সুশ্রী শুভ্র রঙা রূপ নিয়ে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা, মোহিত সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। আরোহী চোখ বন্ধ করে নাক টেনে অনুভব করলো সে সুগন্ধ।‌ হাত ছুঁইয়ে দিল ফুলের গায়ে। তবে এ পুষ্প বিলাসে আর খুব বেশি সময় নষ্ট করলো না সে। বলা তো যায় না কখন আবার তূর্ণ ফিরে আসে। তারপর তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে এ কক্ষ থেকে। আরোহী একটু ঝুঁকে দ্রুত হাত চালিয়ে বেলীগুলো ছিঁড়ে নিতে শুরু করলো এক এক করে। ঠিক তখনই পিছন থেকে নিঃশব্দে একটা মাথা এগিয়ে এলো তার ঘাড়ের নিকট। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“কি করছিস এখানে?”

আরোহী চমকে উঠলো। কেঁপে উঠলো তার ছোট্ট দেহখানা। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল তীব্র ভয়ে। হাতের বেলী ফুলগুলোও ইতমধ্যে ছিটকে পড়েছে মেঝেতে। এ আবার কে এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে? এভাবে কথা বলছে কেন? মেয়েটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে তাকালো পাশ ফিরে। অমনি চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো তূর্ণের মুখ খানা। মেয়েটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তবে রাগও হলো ভীষণ। এভাবে কেউ ভুতের মতো আসে নাকি? আর একটু হলেই প্রাণটা বেড়িয়ে যেতো। আরোহী বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

“এভাবে কেউ আসে? আবার কিভাবে কথা বলছিলেন। আর একটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো।”

তূর্ণে আরোহীর নিকট থেকে একটু সরে দাঁড়ালো। মেয়েটার কথাগুলোকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

“আমার গাছের ফুল চু’রি করছিলি কেন তুই?”

থতমত খেয়ে গেল আরোহী। ভয়ের চোটে তো সে তার কর্মই ভুলে বসেছিল। ঢোক গিললো মেয়েটা। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,

“না মানে আসলে হয়েছে কি….”

আরোহী নিজের কথা শেষ করার আগেই মুখ খুললো তূর্ণ। নাক মুখ কুঁচকে বলল,

“ছিঃ ছিঃ আরোহী তোর এত অধঃপতন হয়েছে। শেষে কিনা তুই আমার বারান্দায় ফুল চু’রি করতে এসেছিস? চু’রি করবি তো করবি ভালো কিছু করতি। যা বিক্রি করেও সারাজীবন বসে খেয়ে যেতে পারবি।”

আরোহী ভীষণ অপমানিত বোধ করলো। একটু ফুলই তো নিতে এসেছিল তাই বলে এই লোক তাকে চো’র উপাধি দিবে? মেয়েটার মুখশ্রী থমথমে আকার ধারণ করলো। তূর্ণের বক্তব্যের ঘোর প্রতিবাদ করে সে বলল,

“মোটেই না তূর্ণ ভাই। আমি কোনো চু’রি করিনি। আপনার বারান্দার এ গাছগুলো আপনি আনলেও লাগিয়েছে আমি। সুতরাং এ গাছের ফুলের উপরে আমারও অধিকার আছে। সেই অধিকার থেকেই ফুল ছিড়ছিলাম আমি।”

তূর্ণের ওষ্ঠে হাসি ফুটে ফুটে উঠলো। তবে তা আরোহীর নজরে পড়ার আগেই গিলে ফেললো। থমথমে কণ্ঠে বলল,

“তারমানে তুই বলতে চাইছিস গাছ এক হলেও এ গাছের মালিক আমরা দুইজন?”

আরোহী উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো। কণ্ঠে জোর দিয়ে বলল,

“হ্যা তাই।”

“ভেবে বলছিস তো!”

“একদম।”

আরোহীর তৎক্ষণাৎ জবাব‌। ওষ্ঠ প্রসারিত করলো তূর্ণ। আরোহীর পানে একটু ঝুঁকে বলল,

“ভেবে বলছিস তো? ভবিষ্যতে এই গাছের সাথে সাথে আমি যখন অন্য কিছুর মালিকানা দিতে চাইবো তখন কিন্তু পিছপা হতে পারবি না। আমার গাছের মালিকানা নিতে হলে আর যা কিছুর মালিকানা দিতে চাইবো সব নিতে হবে।”

আরোহী অত কিছু ভাবলো না। আপাতত তার নিকট বেলী গাছ এবং তার ফুলই মূখ্য। ভবিষ্যতে যা হবে তা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে। মেয়েটা দৃঢ়তার সাথেই বলল,

“ঠিক আছে।”

“এই ভেজা বর্ষায় এক গুচ্ছ বেলীর উপস্থিততে তুই কিন্তু আমায় কথা দিলি। আমার নিকট দায়বদ্ধ হয়ে পড়লি।”

“আচ্ছা।”

তূর্ণের ওষ্ঠ প্রসারিত হলো আগের তুলনায়। নিজে থেকেই সে বেলী গাছগুলো থেকে ফুলগুলো তুললো এক এক করে। সে ফুলগুলো সে বাড়িয়ে দিল আরোহীর পানে। হাসিমুখে বলল,

“তোর অধিকার।”

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-০৭

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৭

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তূর্য আকাশের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে তূর্ণের পানে তাকালো। প্রশ্ন করলো,

“তুমি এই কথাগুলোর মানে বোঝো?”

তূর্ণ ডানে বামে মাথা ঝাঁকালো। অর্থাৎ সে বোঝে না তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তূর্য। বারান্দার মেঝেতে বসতে বসতে বলল,

“এর মানে তোমার মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই। তুমি তোমার পিতা মাতার মতামতকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য। তারা তোমার উপরে তাদের নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দিবে আর তোমার হাজার কষ্ট হলেও হাসিমুখে তা হজম করে নিতে হবে। তাছাড়া কিছু মাতা পিতা রয়েছে সন্তান তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলে তাদের মারধর করে, জনসম্মুখে অপমান করে। ফলস্বরূপ সন্তানের মধ্যে একটা জেদের সৃষ্টি হয়। পিতা মাতাকে নিজেদের শত্রু মনে করে। এক সময় এই জেদের বশেই তারা বিপথে চলে যায়। অথচ পিতা মাতা যদি ছোট বেলা থেকেই তার সন্তানের বন্ধু চেষ্টা করতো। সন্তানদের মতামতের গুরুত্ব দিতো, তাদের উপরে চড়াও না হয়ে, জনসম্মুখে তাকে অপমান না করে ঠান্ডা মাথায় বুঝাতো। সমাজের নিয়ম নীতি, ন্যায় অন্যায় সম্পর্কে ধারণা দিতো তবে সন্তান বিপথে হয়তো যেতো না।”

থামলো তূর্য। ইশারা করে তূর্ণকেও বসতে বলল পাশে। তূর্ণ পাশে বসতেই ফের বলতে শুরু করলো,

“আমি সেইসব পিতাদের মধ্যে নই যারা তাদের সন্তানদের উপরে নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়, মারধর করে কিংবা জনসম্মুখে অপমান করে। সন্তানের কাছে একজন পিতা হয়ে ওঠার পূর্বে একজন বন্ধু হয়ে ওঠা অধিক জরুরী। আমার কাছে আমার মতামতের মতোই তোমাদের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই মতামত অবশ্যই ন্যায়সংগত হতে হবে।”

তূর্ণ মাথা নুইয়ে নিল। তূর্য তাকালো তার পানে। ঠান্ডা কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

“মা’রা’মা’রি করেছো কেন? আমি কি তোমাকে মা’রা’মা’রি’র শিক্ষা দিয়েছিলাম?”

তূর্ণ এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। সে যে তূর্যকে ভয় পায় তেমন নয় তবে শ্রদ্ধা করে ভীষণ। তূর্ণ সময় নিল একটু। ঢোক গিলে বলল,

“মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।”

“মাথা গরম হয়ে গেলেই আঘাত করতে হবে? যেকোনো বিষয় দুইভাবে সমাধান করা যায়। প্রথমত শান্তিপূর্ণভাবে আর দ্বিতীয়ত মা’রা’মা’রি কিংবা ঝামেলায় জড়িয়ে। তুমি কি শান্তিপূর্ণভাবে তোমার সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলে?”

তূর্ণ তাকালো বাবার পানে। কণ্ঠটা একটু স্বাভাবিক করে বলল,

“করেছিলাম তো। প্রথমে আমি শান্তিপূর্ণভাবেই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরাই ঝামেলা শুরু করলো। হুট করেই ঘু’ষি বসালো আমার শরীরে। আমিও নিজের রাগটা ধরে রাখতে পারিনি। ব্যস বেঁধে গেল হাতাহাতি।”

তূর্য ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। গা ঝাড়া দিয়ে বলল,

“তাহলে ঠিক আছে। কেউ শান্তি না চাইলে তোমারও এত দায় পড়েনি শান্তি ধরে রাখার। কেউ একটা দিলে তাকে তিনটা দিয়ে আসবে। তবে প্রথমে অবশ্যই শান্তিপূর্ণভাবে সকল সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে নিবে, মুরুব্বিদের সাথে বেয়াদবি করবে না।”

তূর্ণ অবাক হলো। এতক্ষণ এতকিছু বুঝিয়ে শেষে কিনা এই বলল তার বাবা! তূর্ণ ভেবেছিল মা’রা’মা’রি’র বর্ণনা দেওয়ার পর তূর্য রেগে যাবে। গম্ভীর স্বরে বলবে,

“কুকুর তোমাকে কামড় দিলে কি তুমিও কামড় দিবে? তোমার মা’রা’মা’রি করা একদম উচিৎ হয়নি।”

কিন্তু তূর্য তো একদম উল্টো কথা বলল। আরও সাহস দিল তাকে। এই জন্যই তো বাবাকে এত ভালো লাগে তূর্ণের। ছেলেটা দুই হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো তূর্যকে। বলল,

“তোমার মতো বাবা পেয়ে সত্যিই আমি ধন্য।”

তূর্য হাসলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে চুপ থেকে হুট করেই প্রশ্ন করলো,

“ভালোবাসো আরোহীকে?”

তূর্ণ বাবাকে ছেড়ে দিল। সে যেমনই হোক না কেন এভাবে হুট করে বাবার সম্মুখে ভালোবাসার কথা বলতে কেমন লজ্জা লাগছে। তূর্য বুঝে নিল যা বোঝার। উঠে দাঁড়ালো সে। নিজ কক্ষে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তবে ফিরে যাওয়ার আগে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলে গেল,

“ভালোবাসলে আগলে রাখতে জানতে হয়। আগলে রেখো তাকে।”

৯.
দীর্ঘ এক রাতের অবসান ঘটিয়ে আকাশে স্থান করে নিয়েছে উজ্জ্বল এক সূর্য। চারদিকটা ভরে উঠেছে আলোয় আলোয়। আরোহী ঘুম থেকে উঠে পরিপাটি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো কলেজের উদ্দেশ্যে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে সোজা এলো তূর্ণদের বাড়ির সম্মুখে। তনায়াকে আগে থেকেই কল করে বলে রেখেছিল তৈরি হয়ে বাসার সামনে দাঁড়াতে। দুজন একসাথে কলেজে যাবে। তনয়াও তাই করেছে। দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির সামনেই। আরোহী আসতেই দেখেই হাত উঁচালো সে। গলা বাড়িয়ে বলল,

“এত দেরী করলি কেন? আমি সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তোর জন্য।”

আরোহী হাঁটার গতি বাড়ালো। লম্বা লম্বা পা ফেলে এলো তনায়ার সম্মুখে। কিছুটা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,

“খেতে খেতে দেরী হয়ে গিয়েছে একটু।”

তনায়া আর কথা বাড়ালো না। দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটা ধরলো সে। আরোহীকে তাড়া দিয়ে বলল,

“এখন আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি চল। আজ প্রথমেই ঐ টাকলু মানিক স্যারের ক্লাস। দেরী হলেই আবার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে।”

“তা যা বলেছিস।”

আরোহীও পা চালালো তনয়ার সাথে সাথে। ঠিক তখনই পিছন থেকে ডাক পড়লো। তনয়া আর আরোহী থমকে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে দেখলো তূর্ণ শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে তাদের পানেই এগিয়ে আসছে। কপাল কুঁচকালো দু’জনেই। তবে তনয়া নম্র কণ্ঠে বলল,

“কিছু বলবে ভাইয়া?”

তূর্ণের থমথমে মুখশ্রী। গম্ভীর কণ্ঠে কিছু বলবে তার আগেই ভেসে এলো আরোহীর কণ্ঠস্বর। মেয়টা বিরক্তি নিয়ে বলল,

“যা বলার তাড়াতাড়ি বলবেন। আমার কলেজ আছে।”

তূর্ণ কপাল কুঁচকালো। তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলল,

“একই স্থানে একই সাথে দাঁড়িয়ে রয়েছিস তোরা দুজন। একসাথে কলেজে যাচ্ছিস এবং আমি তোদের একসাথেই ডেকেছি। তনয়া কি সুন্দর নম্রভাবে আমাকে প্রশ্ন করলো আর তুই খচ্চরের মতো প্রশ্ন করলি কিসের জন্য?”

আরোহী তেতে উঠলো। কটমট করে বলল,

“আপনি আমাকে খচ্চর বললেন?”

“খচ্চরকে খচ্চর বলবো না তো কি বলবো?”

“ভাইয়া!”

আরোহী একটু উচ্চস্বরেই ডাকলো তূর্ণকে। সাথে সাথেই ছেলেটার কলিজাটা লাফ দিয়ে উঠলো। বুকে হাত দিয়ে বিরবিরিয়ে বলল,

“এমনিই তো সম্পর্কের দোহাই দিয়ে সারাদিন তূর্ণ ভাই তূর্ণ ভাই করে মেয়েটা হার্টে সমস্যা বাঁধিয়ে দিয়েছে। এখন আবার মাঝ রাস্তায় জোরে জোরে ভাইয়া ডেকে ভাই বোনের সম্পর্কের গভীরতা জাহির করতে চাইছে!”

পরপর গলা বাড়ালো তূর্ণ। কিঞ্চিৎ ধমকে আরোহীকে বলল,

“তোর মা আর আমার বাপ চাচাতো ভাই বোন জানি। তাই বলে মাঝ রাস্তায় এত জোরে ভাইয়া ডেকে আমার হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিতে চাইছিস নাকি?”

আরোহী কপাল কুঁচকালো। চোখ ছোট ছোট করে বলল,

“আপনি আমার ভাই তাই পৃথিবীর সকল স্থানে হোক তা মাঝ রাস্তায় ভাইয়াই ডাকবো। তা জোরে হোক কিংবা আস্তে। এতে হার্ট অ্যাটাকের কি আছে?”

তূর্ণ আশেপাশে তাকালো। একটু এগিয়ে দাঁড়ালো আরোহীর পাশে। কণ্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বলল,

“আজকাল শুনেছি মেয়েরা নাকি ছেলেদের প্রথমে ভাইয়া ডেকে পরে ছাইয়া বানাতে চায়। তুইও কি আমাকে তেমন কিছুই বানাতে চাইছিস আরোহী?”

আরোহী অবাক হলো। সে কি বলল আর এ লোক কোথায় নিয়ে গেল। সম্পর্কের খাতিরে তো সর্বদা ভাইয়া বলেই এ লোককে সম্বোধন করে আরোহী। আর আজ সেই ভাইয়া সম্বোধনকে টেনে হিচড়ে ছাইয়া পর্যন্ত নিয়ে গেল? আরোহী কপাল কুঁচকালো। বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলল,

“একদম আজেবাজে কথা বলবেন না তূর্ণ ভাই। আমি আপনাকে….”

এই টুকু বলতেই মেয়েটাকে থামিয়ে দিল তূর্ণ। আতঙ্কিত স্বরে বলল,

“আমি কিন্তু মোটেই তোর মতো একটা দজ্জ্বাল, ঝগরুটে মহিলার ছাইয়া হতে ইচ্ছুক নই। এসব চিন্তা বাদ দে আরোহী। আর একটু ভালো কিছু ভাব।”

আরোহীর বিরক্তি বাড়লো। কটমট করে সে তাকালো তূর্ণের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“পারবো না ভালো কিছু ভাবতে। আমি খারাপ কিছুই ভাববো আপনার কি?”

“তার মানে তুই স্বীকার করছিস যে তুই আমাকে নিয়ে আজে বাজে কথা চিন্তা করিস। আমাকে ছাইয়া বানাতে চাস।”

নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেল আরোহী। রাগের বশে কি বলতে কি বলে ফেললো এখন তা নিয়েও এই লোক কথা শুনাবে। অবশ্য আরোহী যা বলেছে তাতে এই অর্থই দাঁড়ায় যে সে খারাপ কিছু ভাবে। মেয়েটা বিব্রতবোধ করলো। আমতা আমতা করে বলল,

“তেমন কিছু নয় তূর্ণ ভাই। ওটা জাস্ট কথায় কথায় বলে ফেলেছি।”

তূর্ণ গায়ে মাখলো না আরোহীর কথা‌। তনয়ার পানে এক পলক তাকিয়ে মুখ নামালো আরোহীর কানের কাছে। ফিসফিসিয়ে বলল,

“ছিঃ ছিঃ আরোহী। এই ছিল তোর মনে? আচ্ছা মনে মনে তুই আমাকে নিয়ে কতদূর ভেবেছিস? মান ইজ্জত কিছু রেখেছিস আমার? নাকি তাও হরণ করে নিয়েছিস?”

আরোহীর কান গরম হলো। ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছে এই লোক। সে কি বলল আর সেই ছোট কথাটা কোথায় চলে গেল। লজ্জা, সংকোচে হাঁসফাঁস করে উঠলো মেয়েটা। এখানে আর দাঁড়াতে চাইলো না। এখানে যতক্ষণ দাঁড়াবে তূর্ণ ততক্ষণ এই কথাটা নিয়ে বিশ্লেষণ করবে। এর থেকে এখান থেকে কেটে পড়াই শ্রেয়। আরোহী অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে পা কলেজের পানে। তনায়াকে তাড়া দিয়ে বলল,

“কলেজে গেল চল। নয়তো দাঁড়িয়ে থাক।”

তনয়া এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলো তূর্ণ এবং আরোহীর কথোপকথন। এ দুজন যখনই সামনা সামনি আসে তখনই ঝগড়া বাঁধে। এ আর নতুন কিছু নয়। তাই আর আগ বাড়িয়ে এদের ঝগড়ায় ঢোকেনি সে। তবে এখন আরোহীর তাড়া শুনে সেও তাড়া লাগালো। ছুট লাগালো মেয়েটার পিছু পিছু। তূর্ণ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। সেও হাঁটা ধরলো ওদের পিছনে‌। গতকাল যখন থেকে শুনেছে আরোহীকে কেউ পটাতে চাইছে, প্রেম নিবেদন করেছে তখন থেকে আর শান্তি পাচ্ছে না ছেলেটা। একটাকে তো মে’রে ধরে শাসিয়ে এসেছে। কিন্তু এরপর যদি আর কেউ আবার মেয়েটার পিছু লাগে। আরোহীকে ছিনিয়ে নিতে চায় তার থেকে? না না এই মেয়েটাকে নিয়ে কোনো ধরণের ঝুঁকি নিতে চায় না তূর্ণ। তাই এখন থেকে মেয়েটাকে সর্বদা চোখে চোখে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।

১০.
কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই কলেজে পৌঁছালো আরোহী এবং তনয়া। ক্যাম্পাস ইতমধ্যে অনেকটাই জনশূন্য হয়ে পড়েছে। সকলের বোধহয় ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আরোহী এবং তনয়া ব্যস্ত পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো ক্লাসের নিকটে। জানালা থেকে দেখলো মানিক স্যার নামক মধ্যবয়স্ক অধ্যাপক অধ্যাপক ঘুরে ঘুরে পাঠদান করছেন। মাথার মধ্যভাগে তার তেল চকচকে টাকটা স্পষ্ট। এখন যদি সম্মুখের দরজা থেকে ক্লাসে ঢোকার চেষ্টা করে তবে নির্ঘাত লোকটা তাদের বকাবকি করে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে আর যদি না ঢুকে ক্লাস মিস দেয় তবে বাড়িতে নালিশ পাঠাবে। উভয় দিকে সংকট। এখন কোন দিকে যাবে তারা? আরোহী এবং তনয়া একে অপরের পানে তাকালো অতঃপর ঘুরে গেল ক্লাসের পিছনের দিকে। মাথা নিচু করে লুকিয়ে ঢুকতে নিল ক্লাসে। ঠিক তখনই ভেসে এলো গম্ভীর এক কণ্ঠস্বর,

“ওখানেই দাঁড়িয়ে যাও।”

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-০৬

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৬

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো আরোহী অতঃপর ফাস্ট এইড বক্সটা হাতে নিয়েই হাঁটা লাগালো তূর্ণের কক্ষের পানে।

কিছুটা সময়ের ব্যবধানেই কক্ষের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটা। দরজাটা চাপানো। আরোহী ভদ্রতা বজায় রেখে হাত উঁচিয়ে টোকা দিল দরজায়। গলার স্বর বাড়িয়ে ডাকলো,

“তূর্ণ ভাই! তূর্ণ ভাই।”

ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তবে কি তূর্ণ ভিতরে নেই? একটু আগেই তো সকলের সামনে থেকে কক্ষে এলো ছেলেটা। তাহলে এতটুকু সময়ের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেল? আরোহী আরও কিছুটা সময় নিয়ে ডাকলো তূর্ণকে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অধৈর্য হয়েই এবার কোনো অনুমতি না নিয়েই দরজা ঠেলে ঢুকলো কক্ষের ভিতরে। আশেপাশে তাকিয়ে তূর্ণকে খুঁজতে খুঁজতে কর্ণে ভেসে এলো ঝুমঝুম পানির আওয়াজ। আরোহী কান খাঁড়া করলো। ওয়াশ রুম থেকে আসছে আওয়াজটা। তূর্ণ বোধহয় ওয়াশ রুমে আছে তাহলে। যাক একদিকে থেকে ভালোই হয়েছে। এই সুযোগে এইড বক্সটা রেখে কেটে পড়া যাবে। পরে জিজ্ঞেস করলে না হয় বলে দিবে,

“আপনাকে রুমে পাইনি তাই ফাস্ট এইড বক্সটা রেখে চলে এসেছি।”

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আরোহী হাতের ফাস্ট এইড বক্সটা বিছানার উপরে রেখে পিছন ঘুরলো চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পিছন ঘুরতেই চমকে উঠলো মেয়েটা। তূর্ণ শুভ্র রঙা এক খানা তোয়ালে দ্বারা মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। সদ্য গোসল সেড়েছে বোধহয়। পড়নে তার একটা কালো রঙা ট্রাউজার মাত্র, নগ্ন দেহের উপরিভাগ। ফর্সা বক্ষে মুক্ত দানার ন্যায় বিন্দু বিন্দু পানি কনা স্পষ্ট, সাথে কিছু কাঁটা ছেঁড়ারও দাগ। আরোহীর হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো। উন্মুক্ত পুরুষদেহ উত্তাল করলো তার হৃদয়। এ কি হচ্ছে? এমন কেন হচ্ছে? আরোহীর এ বাড়িতে যাতায়াত ছোট বেলা থেকে। তূর্ণকে এভাবে উন্মুক্ত দেহে দেখেছে দুই একবার। কই তখন তো এমন হয়নি। আরোহী চেয়েও নিজের চোখ সরাতে পারছে না। বেহায়া, নির্লজ্জের ন্যায় চোখ দুটো বারবার তূর্ণের উন্মুক্ত শরীরেই আটকে যাচ্ছে। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে মেয়েটা তাকিয়ে রইলো তূর্ণের পানেই। অতঃপর হুট করেই হাত উঁচিয়ে নিজের চোখ চেপে ধরলো মেয়েটা। ব্যস্ত হয়ে বলল,

“আমি কিছু দেখিনি।”

তূর্ণ পাত্তা দিল না আরোহীর কথা। ভাবলেশহীভাবে এগিয়ে গেল আলমারির পানে। সেখান থেকে একটা টিশার্ট বের করতে করতে বলল,

“তোকে দেখতে বারণ করেছে কে?”

আরোহী অবাক হলো। চোখ থেকে হাত সরিয়ে প্রশ্ন করলো,

“মানে?”

“মানে এতক্ষণ তো আমার উন্মুক্ত দেহ তোর দুই চোখ দ্বারা গিলে খেয়ে নিলি দিব্যি। এখন আবার ঢং করে বলছিস কিছু দেখিসনি। নাটক করছিস আমার সাথে?”

আরোহী আড় চোখে তাকালো। একবার দেখে নিল তূর্ণের পা থেকে মাথা অব্দি। আমতা আমতা করে বলল,

“আমি আপনার আন্ডার ওয়্যারের কথা বলছিলাম তূর্ণ ভাই। ট্রাউজার একটু নিচে নেমে আপনার আন্ডার ওয়্যারের গোলাপী রঙা ফুল স্পষ্ট।”

থামলো আরোহী। ঠোঁট টিপে হেসে আবার বলল,

“আপনি যে ফুল পাখিওয়ালা আন্ডার ওয়্যার পড়তে পছন্দ করেন আগে জানা ছিল না তো তূর্ণ ভাই। দেহের উপরে তো বেশিরভাগ সময়ই সব এক রঙা শার্ট, প্যান্ট চোখে পড়ে। অথচ তার নিচে ফুল, পাখি উড়ে বেড়ায়। আহা কি প্রাকৃতি প্রেমিক পুরুষ আপনি! দেহের উপরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফুটিয়ে না তুলতে পারলেও নিচে ঠিকই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা রাখেন। আপনার মতো প্রাকৃতিক প্রেমিকই তো ঘরে ঘরে চাই।”

তূর্ণ অপ্রস্তুত হলো। চোখ নামিয়ে কোমড়ের পানে তাকাতেই চোখে পড়লো সত্যিই ট্রাউজার নিচে নেমে তার আন্ডার ওয়্যার দৃশ্যমান। সবচেয়ে লজ্জাজনক ব্যাপার হলো আন্ডার ওয়্যারের গোলাপী রঙা দুই চারটা ফুলও স্পষ্ট। ভিতরে ভিতরে লজ্জায় মুষড়ে পড়লো তূর্ণ। এই মেয়েটার সম্মুখেই এমন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটতে হলো? তবে নিজের এ লজ্জা প্রকাশ করলো না সে। দ্রুত ট্রাউজারটা টেনে উপরে তুললো, আলমারি থেকে একটা টিশার্ট বের করে জড়িয়ে নিল শরীরে। কণ্ঠ কিছুটা স্বাভাবিক রেখে বলল,

“ছিঃ আরোহী তুই তো দিন দিন লু’চ্চা মহিলাদের খাতায় নাম লেখাচ্ছিল।”

“আপনি আমাকে লু’চ্চা বললেন তূর্ণ ভাই?”

তূর্ণ এগিয়ে এলো আরোহীর পানে। হাত তুলে আঙ্গুল দ্বারা মেয়েটার কপালে একটা টোকা বসিয়ে বলল,

“তা বলবো না তো কি করবো? চোখ কোথায় কোথায় যায় তোর?”

আরোহী কপালে টোকা পড়া স্থানে হাত দিল। নাক মুখ কুঁচকে বলল,

“আমি কি ইচ্ছে করে দেখেছি নাকি? আপনার ট্রাউজার নিচে নেমে গিয়েছিল বলেই তো দেখেছি। এখানে আমার দোষ কোথায়?”

“তোর দোষ তুই দেখবি কেন?”

“তাহলে কি চোখ বন্ধ করে রাখবো নাকি? আশ্চর্য!”

“হ্যা ঠিক তাই। তোর চোখ বন্ধ করে রাখা উচিৎ ছিল।”

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো আরোহী। এই লোকের সাথে কথা বলে লাভ নেই কোনো। এর সাথে যাই বলবে তারই একটা পাল্টা অযৌক্তিক জবাব দিবে। আরোহী আর তেমন কথা বাড়ালো না। হাত দ্বারা ফাস্ট এইড বক্সটা দেখিয়ে বলল,

“ফাস্ট এইড বক্স রেখে গেলাম। ঔষধ লাগিয়ে নিবেন। আসছি আমি‌।”

কণ্ঠে তোলা বাক্যগুলোর সমাপ্তি ঘটিয়েই দরজার পানে পা বাড়ালো আরোহী। তূর্ণ কপাল কুঁচকালো অতঃপর বলল,

“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

আরোহী থমকে দাঁড়ালো। পিছন ঘুরে বলল,

“বাইরে। তাছাড়া বাড়িতে যেতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক।”

“তুই চলে গেলে আমার ঔষধ কে লাগিয়ে দিবে?”

আরোহী ভেংচি কাটলো। মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“নিজের কাজ নিজে করতে শিখুন তূর্ণ ভাই। অন্যের উপর নির্ভর হয়ে আর কতদিন বাঁচবেন?”

তূর্ণ বিছানায় উঠে বসলো। তিরস্কার করে বলল,

“ছিঃ ছিঃ আরোহী। তুই এত পাষাণ হলি কবে থেকে? দেখছিস একটা মানুষ অসুস্থ। কপাল কেটেছে, হাত পা ফেটেছে। অথচ তুই কিনা এখানেও নির্ভরতা খুঁজছিস?”

থামলো তূর্য। আবার বলল,

“মেয়ে তোকে তো আমি ভালো ভেবেছিলাম। কিন্তু তুই তো একটা আস্ত খচ্চর বের হলি।”

খচ্চর! এত বড় একটা কথা। আরোহী তেড়ে গেল তূর্ণের পানে। রেগেমেগে কিছু বলবে তার আগেই ফাস্ট এইড বক্স থেকে একটা মলম বের করে হাতে ধরিয়ে দিল মেয়েটার। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,

“লাগিয়ে দে তাড়াতাড়ি।”

আরোহী কটমট করলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“পারবো না আমি। মা’রা’মা’রি কে করতে বলেছে? কোনো ভদ্র ঘরের ছেলেদের কখনও শুনেছেন মা’রা’মা’রি করতে? কিসের জন্য মা’রা’মা’রি করেছেন আপনি?”

তূর্ণের দৃষ্টি শীতল হলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে সে তাকিয়ে রইলো আরোহীর পানে। অতঃপর আনমনেই বলল,

“তোর জন্য।”

আরোহী ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

“মানে?”

তূর্ণের ধ্যান ভাঙলো। অপ্রস্তুত হলো সে। কথা ঘুরিয়ে বলল,

“ঔষধ লাগিয়ে দিবি নাকি তোর মাকে ডাকবো?”

পরপর আবার হুমকির স্বরে বলল,

“দাঁড়া ডাকছি এক্ষুনি। মামনি! মামনি!”

কিছুটা হকচকালো আরোহী। তার মাকে ডাকলে এখানে আবার আরেক ঝামেলা। এমনি তূর্ণ বলতে অজ্ঞান সে। মেয়েটা হাতে ঔষধ নিল। আলতোভাবে তা তূর্ণের কপালে লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,

“এখানে আবার মাকে ডাকার কি আছে? আমাকে একটু সুন্দরভাবে বললেই হতো।”

“তোর মতো পেত্নীর জন্য আমার সুন্দর কথা আসে না।”

আরোহী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তূর্ণের পানে। তবে বলল না কিছুই। আস্তে ধীরে কপালে, গালে ঔষধ লাগিয়ে বলল,

“হয়ে গেছে।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তূর্ণ। টিশার্টের হাতাটা একটু উপরে তুলে বলল,

“এখানে লাগিয়ে দে।”

আরোহী তাকালো তূর্ণের হাতের পানে। কনুইয়ের উপরটায় মনে হচ্ছে কালো হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ফর্সা শরীরে সে কালো বর্ণটা যেন আরও বিদঘুটে আকার ধারণ করেছে। এতক্ষণ যাই বলুক এবার আরোহীর মায়া হলো। ইসস মা’রা’মা’রি করে নিজের কি হাল করেছে ছেলেটা। মেয়েটা বসলো তূর্ণের পাশে। ব্যথিত হৃদয় নিয়ে তার হাতের কালো অংশটাতে একটু স্পর্শ করতেই লাফিয়ে উঠলো তূর্ণ। মৃদু চিৎকারের সহীত বলল,

“মা’র’তে চাইছিস নাকি আমাকে? ওভাবে ধরেছিস কেন? আহ! ব্যথা।”

আরোহী তবুও হাতটা সরিয়ে নিল না। বরং তূর্ণের হাতটা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বলল,

“দেখছেন হাতটার কি অবস্থা করেছেন? আর কখনও মারামারি করবেন না।”

তূর্ণ আরোহীর কণ্ঠে বিষাদের ছোঁয়া টের পেল। এই বিষাদ কি তূর্ণের ব্যথা দেখে? ছেলেটার হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বইলো। মনে মনে বলল,

“তুই বললে আমি সব ছেড়ে দিতে পারি। আবার তোর উপরে কোনো আচ আসতে দেখলে তাকে মে’রে’ও দিতে পারি।”

৮.
রাত্রি কিছুটা গভীর। চারদিকটা নীরব নিস্তব্ধতায় ঢেকে গেছে ইতমধ্যে। জনমানবের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কোনো। এই নীরবতার বুক চিরেই হঠাৎ তূর্ণের কক্ষের দরজায় টোকা পড়লো। তূর্ণ ঘুমায়নি এখনও। মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করছিলো। রাত জাগার অভ্যাস তার। অবশ্য আজকালকার বেশিরভাগ তরুণ তরুণীর মধ্যেই এই অভ্যাসটা দেখা যায়। কেউ কেউ তো সারারাত ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউবসহ আরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেটে তারপর ভোরের দিকে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু এত রাতে আবার কে এসে দরজা ধাক্কা ধাক্কি করছে? বাড়ির সবাই তো ইতমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। তূর্ণ কপাল কুঁচকালো। বিছানা ছেড়ে এগিয়ে এলো দরজার পানে, খুললো দরজাটা। সাথে সাথে চোখের সম্মুখে দৃশ্যমান হলো তূর্য চৌধুরী। এত রাতে নিজ কক্ষের সম্মুখে বাবাকে দেখে বিস্মিত হলো তূর্ণ। অবাক সুরে বলল,

“বাবা তুমি?”

তূর্য হাসলো। অনুমতি চেয়ে বলল,

“ভিতরে আসতে পারি?”

তূর্ণ ভরকে গেল কিঞ্চিৎ। তার বাবা কক্ষের ভিতরে ঢোকার জন্য অনুমতি চাইছে? ছেলেটা দ্রুত সরে গেল দরজা থেকে। মেকি হেসে বলল,

“এসো, এসো।”

তূর্য ভিতরে ঢুকলো। আশপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে সোজা চলে গেল কক্ষের সাথে লাগোয়া ঝুল বারান্দায়। তূর্ণও গেল তার পিছু পিছু। তূর্য আকাশের পানে তাকালো। ওষ্ঠে হালকা হাসির রেখা বজায় রেখেই বলল,

“চাঁদটা সুন্দর না?”

তূর্ণ বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো আকাশের পানে। সত্যিই গোল থালার ন্যায় রূপালি এক খানা চাঁদ উঠেছে আজ আকাশ জুড়ে। স্নিগ্ধ সুন্দর জোৎস্নার আলোয় ছেয়ে গেছে শহরটা। ছেলেটা মাথা নাড়ালো। অসংখ্য সুরে বলল,

“হুম।”

“তুমি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছো আমি এই মাঝরাতে তোমার কক্ষে এসে চাঁদ কেন দেখাচ্ছি এটা ভেবে।”

থামলো তূর্য আবার বলল,

“আমাদের বর্তমান সমাজের চিন্তা চেতনা মোতাবেক এই স্নিগ্ধ চাঁদ দেখা, একত্রে সময় কাটানো প্রতিটিই ধরে রাখা হয় প্রেমিক যুগল কিংবা দম্পতির জন্য। সন্তান এবং পিতা মাতার সম্পর্কটাকে দেখা হয় ভীষণ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে। সমাজ নির্দিষ্ট করে রাখে সন্তান এবং পিতা মাতার সম্পর্কের মধ্যে থাকবে শুধুমাত্র গম্ভীরতা, শাসন এবং নিজের ইচ্ছে অন্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়া। জানো তো একটা বিষয় আমাদের সমাজে ভীষণভাবে প্রচলিত রয়েছে ‘সন্তান যখন পিতা মাতার অবাধ্য হয় বা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু করতে যায় তখন মানুষ বলে এ কেমন সন্তান যে পিতা-মাতার মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করছে না। অবশ্যই তাকে পিতা-মাতার মতামতই মেনে নিতে হবে। জন্ম দিয়েছে তারা। সুতরাং সন্তানের জীবনে তাদের কথাই হবে শেষ কথা।”

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-০৫

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৫

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

নিচু স্বরে বললেন,

“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে আজ। আমি যেন এই বুড়ো বয়সে এসেও আবার নতুন করে তোমার প্রেমে পড়লাম প্রিয়তমা।”

পৃথা লজ্জা পেল। এই লোকটা আর ভালো হলো না। আগেও ঠোঁটকাটা, নির্লজ্জ, লাগামহীন ছিল এখনও তাই আছে। মানুষের বয়স বাড়লে নাকি তার ভিতরে একটা ভার ভার্থিকতা চলে আসে কিন্তু এ লোক বুড়ো হওয়ার পরও শুধরালো না? পৃথা আড় চোখে একবার সবার পানে তাকিয়ে দেখলো কেউ তাদের কথা শুনেছে কিনা। নাহ বোধহয় শোনেনি। সবাই নিজের ভাবে খেতে শুরু করেছে। পৃথা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মুখ বাঁকিয়ে নিচু স্বরে বলল,

“বুড়ো বয়সে ভীমরতি।”

তূর্য ওষ্ঠ প্রসারিত করলো। মৃদু স্বরে গান ধরলো,

“চুল পাকিলেই লোকে হয় না বুড়ো, আসল প্রেমের বয়স এই শুরু।”

তূর্যদের অর্থাৎ বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠদের খাবার পালা শেষ হতেই বাড়ির ছোটদের পালা এলো। টেবিল দখল করে একপাশে বসলো আরোহী, তনায়া, তুলি এবং তানিয়া। আর অন্যপাশে বসলো তূর্ণ, তৌফিকের ছেলে নাহিয়ান, ইমনের দুই ছেলে ইমদাদ এবং ইনান। এদের মধ্যে তূর্ণ সবার বড়। নাহিয়ান এবং ইমদাদ পিঠোপিঠি হলেও ইনান এবং আরোহীদের তুলনায় বড়। পৃথা সবাইকে খাবার দিতে শুরু করলো। সবাইকে দিয়ে আরোহীর প্লেটে খাবার তুলে দিতেই চোখ বড় বড় করে ফেললো তূর্ণ। ব্যস্ত হয়ে বলল,

“ওকে একটু কম কম দাও মা। দিন দিন খেয়ে খেয়ে যে হারে মোটা হচ্ছে কয়দিন পর না ফেটে যায়। তখন আবার আমাকেই ঝামেলায় পড়তে হবে।”

আরোহী চোখ ছোট ছোট করে তাকালো তূর্ণের পানে। থমথমে কণ্ঠে শুধালো,

“আপনাকে ঝামেলায় পড়তে হবে কেন?”

“তুই ফেটে গেলে তোর বাপ মা তো কেঁদে কেটে জ্ঞান হারাবেন সাথে সাথে। আয়াশটাও ছোট কি করতে হবে না হবে ভেবেই কূলকিনারা করতে পারবে না। এ বাড়ির সবাইও তোর শোকে কাতর হয়ে ছিটকে পড়বে। তখন বাড়ির বড় ছেলে এবং তোর একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমাকেই শক্ত থাকতে হবে। তোর ফাটা দেহ কোলে তুলে, কাঁধে তুলে ছুটতে হবে হাসপাতালের অলিতে গলিতে।”

কি বেহুদা চিন্তাধারা। নাক মুখ কুঁচকালো আরোহী। নিজের প্লেটটা টেনে খাবার মুখে তুলতে তুলতে বলল,

“প্রথমত আমি মোটেও মোটা নই তূর্ণ ভাই। আর দ্বিতীয়ত আমি ফেটে গেলে আপনার আমাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হবে না। আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য আপনি ছাড়াও নাহিয়ান, ইমদাদুল ভাই আছে।”

“সবার হার্ট দূর্বল। ওরা তোর ফাটা দেহের পানে তাকিয়েই জ্ঞান হারাবে। আবার হাসপাতালে কখন নিবে?”

“তূর্ণ ভাই আপনি কিন্তু….”

এইটুকু বলতেই আরোহীকে থামিয়ে দিল ইমদাদুল। খেতে খেতে বলল,

“হ্যা যে আরোহী। সেদিন তোর পিছনে যে ছেলেটাকে দেখলাম ছেলেটা কে যে?”

প্রশ্নটা করার সাথে সাথে সকলের চোখ মুখ যেন চকচক করে উঠলো। তনয়া আর তুলি খাবার রেখেই তাকালো আরোহীর পানে। উৎসুক হয়ে শুধালো,

“কোন ছেলে রে?”

আরোহী ঢোক গিললো। সেদিন রাস্তায় হুট করেই কোথা থেকে একটা ছেলে এসে প্রেম নিবেদন করেছিল তাকে। কোথাকার ছেলে, কোন ছেলে কিছুই জানে না সে। শুধুমাত্র কয়েকদিন রাস্তা থেকে কলেজে যাতায়াতের সময় দেখেছিল তারপরই প্রেম নিবেদন। কিন্তু এরা সেই সামান্য ঘটনাটাও জেনে নিয়েছে? এদের যন্ত্রণায় দেখা যাচ্ছে কোথাও শান্তি নেই। এখানে যারা যারা উপস্থিত আছে বিশেষ করে তূর্ণ একবার যদি বাবা মায়ের কানে এ কথা তুলে দেয় তবে দেখা যাবে কাল থেকে সাথে বডিগার্ডের আবির্ভাব ঘটে গেছে। জোরপূর্বক হাসলো আরোহী। আমতা আমতা করে বলল,

“কোন ছেলে? আমি তো কোনো ছেলেকে চিনি না।”

ইমদাদুলের কপালে ভাঁজ পড়লো। সন্দিহান সুরে বলল,

“তাহলে আমার বন্ধু ফাহাদ কি আমাকে মিথ্যা বলল? ও নাকি দেখেছে তুই কোন ছেলের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলি। এবং তোদের দেখে নাকি ওর মনে হয়েছে ছেলেটা তোকে বিরক্ত করছে তাই আমাকে বলল।”

“ফাহাদ ভাই কি দেখতে কি দেখেছে। তুমিও তার কথা বিশ্বাস করে নিলে?”

“ছেলেটা কে ছিল?”

তূর্ণের শীতল কণ্ঠস্বর। খাওয়া থেমে গেছে তার আরও আগে। এতক্ষণ শুধুমাত্র আরোহীর মুখ পানে তাকিয়ে অপেক্ষা করছিল ছেলেটার পরিচয় জানার জন্য। কিন্তু মেয়েটা তো একের পর এক মিথ্যা বলেই যাচ্ছে। আরোহী ফাঁকা ঢোক গিললো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে আবার বলল,

“তোমারা কোন ছেলের কথা বলছো আমি তো তাই বুঝতে পারছি না।”

সাথে সাথে ধমকে উঠলো তূর্ণ। গলা বাড়িয়ে বলল,

“আমি সত্যিটা শুনতে চাইছি।”

তূর্ণের আকস্মিক ধমকে কেঁপে উঠলো আরোহী। চুপসে গেল উপস্থিত অন্যরাও। তূর্ণ যে ক্ষেপে গেছে তা বুঝতে বাকি রইলো না কারো। আরোহীও আমতা আমতা শুরু করলো। কিছুটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,

“আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি তা সাথে সাথেই প্রত্যাখ্যান করেছি।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই তূর্ণের চেহারার রং বদলালো। চোখ দুটোতে কেমন রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে, চোয়ালটাও শক্ত হয়ে উঠেছে। হুট করেই খাওয়া রেখে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটা। অবাক হলো সকলে। নাহিয়ান কিছুটা অবাক সুরেই শুধালো,

“কি হলো ভাই খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলে যে? খাবে না আর?”

তূর্ণ উল্টো ঘুরে পা চালালো। যেতে যেতে বেশ ভারী কণ্ঠে বলল,

“পেট ভরে গেছে আমার। তোরা খা।”

৬.
সন্ধ্যার সময়। সূর্যটা ডুবে গিয়ে চারদিকে আঁধারে ঢেকে গিয়েছে অনেকটাই। শহরের বুকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে কৃত্রিম সোডিয়ামের আলোর ঝলকানিতে। আরোহীরা এখনও বাড়ি ফিরেনি। বড় ছোট সবাই মিলে আসর জমিয়েছে বাড়ির বসার কক্ষে। পৃথা, ইসরাত, অনন্যা তিনজন মিলে ট্রেতে করে চা এনে রাখলো টি টেবিলে। একে একে চায়ের কাপ তুলে দিতে শুরু করলো সকলের হাতে। ঠিক তখনই বাড়ির সদর দরজা দিয়ে আবির্ভাব ঘটলো তূর্ণের। ছেলেটার পানে তাকিয়েই আঁতকে উঠলো সকলে। ধুলো মাখা জামা কাপড়, চুলগুলো এলোমেলো, কপালের কিছু অংশ কাটা। দেখেই মনে হচ্ছে কোথাও থেকে মা’রা’মা’রি করে ফিরেছে এ ছেলে। তবুও যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারলো না তূর্ণ মা’রা’মা’রি করে ফিরেছে। এমনি আরোহীর সম্মুখে যেমনই হোক না কেন এলাকা এবং পরিবারে ভদ্র ছেলে হিসেবে নাম ডাক রয়েছে বেশ। এসব মা’রা’মা’রি, ঝামেলা তার চরিত্রের সাথে যায় না কখনও। তাহলে আজ কি এমন হলো যে মা’রা’মা’রি করে ফিরতে হলো? ছেলের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে তার পানে ছুটে গেল পৃথা। হাত বাড়িয়ে ছেলেটার মুখে গালে বুলিয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে শুধালো,

“কি হয়েছে? এ অবস্থা কেন তোর? কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছে কি?”

“না মা’রা’মা’রি করেছি।”

তূর্ণের নির্লিপ্ত ভঙ্গিমা। চমকালো সকলে। যে কথাটা মাথায় এলেও বিশ্বাস করতে চায়নি কেউ তাই তবে সত্যি হলো। তূর্ণ শেষ পর্যন্ত নিজের ভদ্রতার খোলস ছেড়ে মা’রা’মা’রি করে ফিরেছে? এতক্ষণ ছেলের জন্য মায়া দেখালেও এবারে চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো পৃথার। ভারী কণ্ঠে বলল,

“বাইরে গিয়ে মা’রা’মা’রি করে ঘরে ফিরবে এই শিক্ষা দিয়েছিলাম আমি তোমাকে? দিন দিন অধঃপতন হচ্ছে তোমার।”

তূর্ণের চোখ মুখের কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। পূর্বের ন্যায়ই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সে বলল,

“কখনও কখনও প্রিয় কিছুর জন্য অধঃপতনও শ্রেয়।”

কথাটা বলে তূর্ণ পরপর তাকালো আরোহীর পানে। তবে তার এই ছোট্ট একটা বাক্যের গভীরতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি কেউই। পৃথা যেন পূর্বের তুলনায় আরও ক্ষীপ্ত হলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

“কি এমন প্রিয় বস্তু যার জন্য তুমি মা’রা’মা’রি করতে দ্বিধাবোধ করোনি। তোমার এই মা’রা’মা’রি’র জন্য তোমার বাবাকে, আমাদের প্রতিবেশীদের নিকট কতটা ছোট হতে হবে জানো তুমি?”

পৃথার কথা শেষ হতে না হতেই মুখ খুললো তূর্য। ছেলে মা’রা’মা’রি করে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়িতে ফিরলেও এতক্ষণ বেশ নির্লিপ্ত হয়ে চা পান করছিল সে। কিন্তু এ পর্যায়ে পৃথা তার নাম নিয়ে টানাটানি করায় আর চুপ থাকতে পারলো না। চা রেখে উঠে দাঁড়ালো। স্ত্রীর কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,

“আমি মোটেই ছোট হইনি আমার ছেলের মা’রা’মা’রি’তে বরং গর্ববোধ হচ্ছে। এতদিনে না একটা কাজের কাজ করেছে সে।”

পরপর তূর্ণের পানে ফিরে তাকালো তূর্য। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

“জিতে ফিরেছো তো? মা’রা’মা’রি’তে হারাটা কিন্তু আমার একদম পছন্দ নয়।”

পৃথা হতবাক হলো। সাথে মেজাজটাও বিগড়ে গেল। কোথায় ছেলে এত বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে এসেছে তাকে বকবে, বুঝাবে তা নয় আরও উস্কে দিচ্ছে। বাবা মায়ের এমন প্রশ্রয় দেওয়ার জন্যই তো আজকাল ছেলে মেয়েরা এত সাহস পাচ্ছে, বিগড়ে যাচ্ছে। ছেলে মেয়ে ভুল করলে প্রথমেই যদি বাবা মা তা শক্ত হাতে প্রতিরোধ করে, শাসন করে তবে ছেলে মেয়েরা পরবর্তীতে আর সেই কাজ করার সাহস করে না। পৃথা দাঁতে দাঁত চাপলো। কিছুটা রুক্ষ কণ্ঠে বলল,

“এই আপনার জন্যই ছেলেটা বিগড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।”

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাচ্ছে। মা’রা’মা’রি করে এসেছে তূর্ণ তবে ঝগড়া লাগার সম্ভাবনা রয়েছে তার বাবা মায়ের মধ্যে। অনন্যা এগিয়ে এলো তূর্ণের পানে। কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বলল,

“ছেলেটা মা’রা’মা’রি করে জখম হয়ে ঘরে ফিরেছে। আগে ওর দিকে আমাদের একটু তাকানো উচিৎ। তারপর না হয় কি হয়েছে, কেন হয়েছে জানা যাবে।”

ইসরাত, ইরা, আয়ুশ, তৌফিক এবং অন্যান্যরাও সায় জানালো অনন্যার কথায়। তৌফিক তূর্ণের পানে তাকিয়ে বলল,

“তুই কক্ষে যা। ফ্রেশ হ। আমি ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আসছি।”

প্রত্যুত্তরে তূর্ণ বলল না কিছুই। আরোহীর পানে শেষ একবার তাকিয়ে হাঁটা ধরলো সিঁড়ির পানে।

৭.
কিছুটা সময় গড়ালো। আরোহীরা আজ রাতে যতটুকু সময় এখানে কাটাবে বা হৈচৈ করবে বলে পরিকল্পনা করেছিল তাতে ভাটা পড়লো তূর্ণের মা’রা’মা’রি করে বাড়ি ফেরায়। বাড়ির ছোট সদস্যরা অর্থাৎ তনায়া, তুলি, ইমদাদ, নাহিয়ান, তানিয়া, ইনান সবাই যেন তূর্ণের শোকে দিশেহারা হয়ে উঠেছে। তারা একেকজন হয়তো কেঁদে দিতে পারলে শান্তি পেত। সকলের অবস্থা দেখে মনে মনে ভেংচি কাটলো আরোহী। একটু কপালই তো কেটেছে। তা নিয়ে সকলের কত আদিখ্যেতা। পুরো মাথাটা ফাটলে আরও ভালো হতো। তাও যদি লোকটার তার পিছনে লাগা বন্ধ হতো। এদের এত আদিখ্যেতা আর সহ্য হলো না মেয়েটার, উঠে দাঁড়ালো সে। অন্য দিকে পা চালাতেই পিছন থেকে ডাক পড়লো। তৌফিক ডেকে বলল,

“এই ফাস্ট এইড বক্সটা তূর্ণের ঘরে নিয়ে যা তো।”

আরোহী থমকে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাত উঁচিয়ে তর্জনী আঙ্গুলটা নিজের পানে তাক করে বলল,

“আমি?”

তৌফিক এগিয়ে গেল আরোহীর পানে। ফাস্ট এইড বক্সটা মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“হ্যা তুই নিয়ে যা। আমার হঠাৎই একটু কাজ পড়ে গেছে। সেখানে যেতে হবে আবার।”

“কিন্তু, আমি তো….”

আরোহীর কণ্ঠে তোলা বাক্যটা পুরোপুরি শেষ করতে দিল না তৌফিক। ব্যস্ত হয়ে বলল,

“তাড়াতাড়ি নিয়ে যা। ছেলেটা বোধহয় অপেক্ষা করছে।”

তৌফিক চলে গেল। হতাশ হলো আরোহী। যারে দেখতে পারে না। তার সম্মুখেই ঘুরে ফিরে যেতে হয় তাকে। কিন্তু কি আর করার। যেতে তো হবেই। বড়দের কথা ফেলা নিশ্চই কোনো ভালো মেয়ের কর্ম নয়। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো আরোহী অতঃপর ফাস্ট এইড বক্সটা হাতে নিয়েই হাঁটা লাগালো তূর্ণের কক্ষের পানে।

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-০৪

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৪

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

“না না আমি ভূত্তা বিজ্ঞানী হবো না। আমি হবো দিদুনের গল্পের ভূত্তা কুমার আর আলোপ্পি হবে ভূত্তা কুমারী। তারপর আমার ভূত্তা কুমারীকে রাক্ষস ধরে নিয়ে যাবে। আমিও এক সাহসী ভূত্তা কুমার হয়ে সাত সমুদ্রর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে ভূত্তা কুমারীকে উদ্ধার করে আনবো।”

তূর্ণের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। থমথমে কণ্ঠে সে বলল,

“এ তোর ভূট্টা কুমারী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এ আপাতত আলু কুমারীই ঠিক আছে।”

অনয় নাক মুখ কুঁচকালো। আঙ্গুল তুলে বলল,

“কিন্তু আমার আলোপ্পি তো ভূট্টা কুমারীর মতো সুন্দর।”

তূর্ণ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো অনয়ের পানে অতঃপর বলল,

“তুই কি বুঝিস সুন্দরের?”

“আমার ভূত্তা কুমারীকে।”

অনয় বেশ ভাব নিয়ে বলল কথাটা। অবাক হলো তূর্ণ। এই টুকু ছেলের কি উত্তর। আজকালকার বাচ্চাগুলো বয়সের তুলনায় অধিক বোঝে। এরা যেন পেট থেকেই পেকে বেরিয়ে আসে। তূর্ণ মুখ বাঁকালো। ভেংচি কেটে বলল,

“এসেছে আমার ভুট্টা কুমার। আরোহী তোর ভূট্টা কুমারী হবে না। অন্য কাউকে খুঁজে নে যা।”

অনয় যেন মানতে পারলো না তূর্ণের কথা। গুটি গুটি পায়ে এসে সে দাঁড়ালো আরোহীর পাশে। ছোট ছোট হাতে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটার কোমড়। কণ্ঠে জোর দিয়ে বলল,

“আলোপ্পিই আমার ভূত্তা কুমারী। আর কাউকে লাগবে না।”

কপালে ভাঁজ ফেললো তূর্ণ। একটু খানি পুঁচকে ছেলে। দুনিয়ায় পা রাখতে না রাখতেই তার জিনিসের দিকে নজর দেওয়া শুরু করেছে। ভাগ্যিস এই ছেলের জন্ম আরোহীরও অনেক পরে নয়তো আরোহীকে নিয়ে নির্ঘাত তার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটা বাঁধিয়ে দিতো। অবশ্য এখনই বা কম করছে কিসে? তূর্ণ কিঞ্চিৎ ধমকের স্বরে অনয়কে বলল,

“হপ! কোথা থেকে এসেছে আমার ভুট্টা কুমার। দূরে যা, আরোহীকে আমি তোকে দেব না।”

ব্যস হয়ে গেল। তূর্ণের এই টুকু ধমকেই নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেললো অনয়। চিৎকার করে কেঁদে উঠে দৌড় লাগালো তাহমিনা বেগমের কক্ষের পানে। যেতে যেতে কণ্ঠ উঁচিয়ে বলল,

“দাদী তূর্ণ ভাই আমাকে বকেছে। আবার ধমক দিয়েছে।”

তূর্ণ ওষ্ঠ বাঁকালো। ভেঙিয়ে বলল,

“দাদী তূর্ণ ভাই আমাকে বকেছে। আবার ধমক দিয়েছে। হাত পা এখনও পেটের মধ্যে এখনই এসেছে আমার শত্রুতা করতে। যত্তসব আজব পাবলিকে ভর্তি বাড়িঘর।”

তূর্ণের এহেন বাচ্চাদের ন্যায় আচরণে বিরক্ত হলো আরোহী। একটু খানি বাচ্চা ছেলে তার সাথেও ঝামেলা পাকাচ্ছে এ লোক। তূর্ণের ব্যবহার নিতান্তই ছেলেমানুষী এবং বাচ্চাদের বিরক্ত করা ব্যতীত আর কিছুই মনে হলো না আরোহীর নিকট। কপাল কুঁচকেই মেয়েটা বলল,

“ঐ টুকু ছেলের সাথেও আপনার ঝামেলা না করলে হয় না তূর্ণ ভাই? বুদ্ধি শুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে আপনার?”

তূর্ণ ঘুরে তাকালো আরোহীর পানে। চোখ বড় বড় করে বলল,

“প্রথমে আমাকে বদমাইশ বললি, তারপর আমাকে মিথ্যা বললি এখন আবার আমার বুদ্ধি নিয়ে তুই প্রশ্ন তুলছিস তুই?”

আরোহীর বিরক্তিবোধ বাড়লো। এক প্রকার তাকে বাসা থেকে জোরজবরদস্তি করে তুলে এনেছে লোকটা, এখানে এসে আবার ঝামেলা পাকালো অনয়ের সাথে। এখন আবার সে বলছে এক আর এ কথা ঘুরিয়ে নিতে চাইছে আরেক দিকে। আরোহী নিজের বিরক্তিবোধ নিয়েই পা বাড়ালো অন্যদিকে। অমনি পিছন থেকে খপ করে তার হাতটা ধরে ফেললো তূর্ণ। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,

“কোথায় যাচ্ছিস? তোর যে আমার থেকে এখনও অনেক শাস্তি পাওনা।”

এ পর্যায়ে আরোহীর হৃদয়ে কিঞ্চিৎ ভীত হলো। এই শাস্তির ব্যাপারটা সে তো ভুলেই বসেছিল। এখন আবার এই লোক তাকে কি না কি শাস্তি দেয় কে জানে! আরোহী ঢোক গিললো। ভীত স্বরে শুধালো,

“কি শাস্তি?”

তূর্ণ জবাব দিল না কোনো। মেয়েটার হাত টেনে নিয়ে গেল নিজের কক্ষের বারান্দায়। সেখানে কিছু বেলী ফুল গাছের চারা দেখিয়ে বলল,

“প্রথমে ফ্রেশ হবি। তারপর সুন্দর পরিপাটিভাবে বাগান থেকে মাটি এনে আমার এই বেলী ফুল গাছের চারাগুলো রোপণ করবি।”

থামলো তূর্ণ। দুই হাত তুলে হাই দিতে দিতে বলল,

“আমি এখন একটু ঘুমাবো। না গতকাল রাতে তোর যন্ত্রনায় একটু ঠিকভাবে ঘুমাতে পেরেছি আর না আজ সকালে পেরেছি। তুই তোর কাজ শুরু কর, আমি গেলাম।”

তূর্ণ চলে গেল। তবে বেলী ফুলের চারা রোপনের শাস্তি পেয়ে খুশিই হলো আরোহী। শাস্তি হলেও তার মনের মতো একটা কাজ পেয়েছে। পৃথিবীর বুকে বসবাসরত আমরা সবাই আলাদা আলাদা চিন্তাধারার অধিকারী, সবার পছন্দ অপছন্দ আলাদা। এই যেমন ফুলের ক্ষেত্রেই কারো পছন্দ গোলাপ, কারো পছন্দ বেলী, কেউ আবার ডেইজি পছন্দ করে, আবার কেউ টিউলিপ। সেক্ষেত্রে আরোহীর পছন্দ গোলাপ এবং বেলী। ছোট বেলা থেকেই কেমন যেন এই ফুল দুটোর প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করে আরোহী। কোথাও গিয়েছে আর এই ফুল দুটো চোখে পড়েছে কিন্তু সে এমন কখনও হয়নি। একটাকে রেখে সে কখনও অন্যটাকে বাছাই করতে পারে না। আরোহীর সর্বদাই মনে হয়,

“গোলাপ হলো ভালোবাসা, যা নিজের সৌন্দর্যকে ছড়িয়ে দিয়ে পুলকিত করে হৃদয়কে। আর বেলী হলো মায়া, যা নিজের সুভাস ছড়িয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে হৃদয়ে।”
-( কলমে : সাদিয়া শওকত বাবলি )

আর সেই ফুল দুটোর চারা দ্বারাই নিজের কক্ষের বারান্দা ভরে রেখেছে তূর্ণ। এ বাড়ির বাগানেই কিন্তু গোলাপ এবং বেলী দুটো গাছই রয়েছে তবুও তূর্ণ যে কেন আলাদাভাবে তার কক্ষের বারান্দা ভরে রাখে এ দুটো গাছে জানা নেই আরোহীর। কিন্তু বেলী গাছগুলোতে যখন ফুল ধরে আর মৃদু বাসাতে তার সুগন্ধ ভেসে আসে এ কক্ষে তখন পুরো কক্ষটা যেন স্বর্গীয় এক অনুভূতি অনুভব করায় মেয়েটাকে। ইচ্ছে হয় সারাদিন এ কক্ষে বসে থাকতে। তবে তূর্ণ তা কোনো কালেই হতে দেয় না। গোলাপ গাছে বা বেলী গাছে কুঁড়ি আসলেই এ কক্ষের আশেপাশে আর কাউকে আসতে দেয় না তূর্ণ, আরোহীকেও নয়।

৪.
সময় গড়ালো কিছুটা। দুপুর হয়ে এসেছে। আকাশের সূর্যটা ধীরে ধীরে ধরা দিতে শুরু করেছে উজ্জ্বল হয়ে। ঘন্টা দুয়েকের মতো ঘুমিয়ে তূর্ণের ঘুম ভাঙলো মাত্রই। একটু সময় নিয়ে সে উঠে বসলো বিছানায়। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে খুঁজলো আরোহীকে। মেয়েটা কি এ কক্ষে আছে এখনও নাকি বেরিয়ে গেছে? তূর্ণ বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গেল বারান্দার পানে। নাহ মেয়েটা নেই কোথাও। বেলী গাছের চারাগুলোও বেশ পরিপাটিভাবে রোপন করা। হয়তো নিজের কাজ শেষে বেরিয়ে গেছে এ কক্ষ থেকে। তূর্ণ আর বেশি ঘাটলো না। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ওয়াশরুমের পানে গেল ফ্রেশ হতে।

****

এই প্রায় দুপুরে বাড়ির বউরা অর্থাৎ তূর্য চৌধুরীর স্ত্রী পৃথা, তৌফিক চৌধুরীর স্ত্রী ইসরাত, তারেক চৌধুরীর স্ত্রী অনন্যা তিনজনই রান্নাঘরে। হাতে হাতে বেশ মুখরোচক খাবার তৈরিতে ব্যস্ত তারা‌। মাঝে মাঝেই সাপ্তাহিক ছুটির দিনই গৃহে এমন মুখরোচক খাবারের আয়োজনের হিড়িক লাগায় গৃহিণীরা। তাদের কর্তারাও এ হিড়িকে খুশি বেশ। বাড়ির বউদের রান্নার ব্যস্ততার এই ক্ষণেই আবার তাহমিনা বেগমের কক্ষে আড্ডা বসিয়েছে বাড়ির মেয়েরা। আড্ডার এক পর্যায়ে হুট করেই আরোহীর চুল টেনে ধরলেন তাহমিনা বেগম। চুলগুলো খুলে দিয়ে বললেন,

“চুলে তেল দিস না কতদিন ধরে বুড়ি? চুলগুলো কেমন রুক্ষ খসখসে হয়ে গেছে।”

তাহমিনা বেগমের কথা শেষ হতেই ওষ্ঠ প্রসারিত করলো তৌফিকের মেয়ে তনয়া। কেমন রসিকতার সুরে বলল,

“তূর্ণ ভাইয়ের যন্ত্রণায় মনে হয় চুলে তেল দেওয়ার কথাও ভুলে বসেছে আরোহী।”

তনয়ার কথায় সায় জানিয়ে হেসে উঠলো তূর্ণের ছোট বোন তুলি আর তৌফিকের আরেক মেয়ে তানিয়া। আরোহী আর তনয়া প্রায় সমবয়সী এবং এক শ্রেণীতেই পড়াশোনা তাদের। তবে তুলি আর তানিয়া আবার তাদের তুলনায় বয়সে কিছুটা ছোট। তারা দুজন এ বছর দশম শ্রেণীতে। তাহমিনা বেগম একটু উল্টে পাল্টে দেখলেন নাতনির রুক্ষ চুলগুলো। কপাল কুঁচকে বললেন,

“পৃথার থেকে চুলের আয়ুর্বেদিক তেলের বোতলটা নিয়ে আয় তো কেউ। মেয়েটা কি অবস্থা করেছে সুন্দর চুলগুলোর।”

তুলি উঠে দাঁড়ালো। বলল,

“আমি আনছি এক্ষুনি।”

আরোহীও উঠে দাঁড়ালো সাথে সাথে। তুলিকে বাঁধা দিয়ে বলল,

“আমি আনছি তোর যেতে হবে না। সাথে একটু এও দেখে আসি মামীরা আজ কি কি রান্না করছে।”

কথাটা বলেই পরপর খোলা চুলে দৌড়ে কক্ষে থেকে বেরিয়ে পড়লো মেয়েটা। তবে পথিমধ্যেই বাঁধলো বিপত্তি। বেখেয়ালীতে দৌড়াতে গিয়ে কারোর সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লো সে মেঝেতে। হকচকিয়ে উঠলো মেয়েটা, সাথে কিঞ্চিৎ ব্যথা পেল কোমড়েও। তৎক্ষণাৎ কোমড় চেপে ধরলো আরোহী। চোখ তুলে সম্মুখে তাকাকেই দেখা পেল তূর্ণের। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে। আরোহী কপাল কুঁচকালো। সব স্থানেই কেন এই লোক! কাল রাত থেকে যেন তূর্ণ তার কপালে শনি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি যা করার তা তো করেছেই এখন ধাক্কা খেল তাও এর সাথে। আরোহী উঠে দাঁড়ালো। বিরক্তি নিয়ে বলল,

“দেখে হাঁটতে পারেন না তূর্ণ ভাই? দিলেন তো আমাকে ফেলে।”

তূর্ণ কপাল কুঁচকালো। আরও কিছুটা সময় নিয়ে চেয়ে রইলো আরোহীর পানে। অতঃপর হুট করেই বুকে হাত দিয়ে বলল,

“তুই এভাবে দিনে দুপুরে চুল খোলা দিয়ে পেত্নীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল কেন আরোহী? আর একটু হলে তো আমি হার্ট অ্যাটাক করেই বসতাম।”

আরোহী কটমট করলো। এ লোক যে অভিনয় করছে তা বুঝতে বাকি নেই। একটা মানুষ কিভাবে যে এত অভিনয় করতে পারে তা ভেবে পায় না মেয়েটা। আরোহীর আর এই মুহূর্তে এই বদ লোকের সাথে কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো না। কত বড় সাহস এর তাকে পেত্নী বলেছে। যেখানে চুল খোলা দিলে অন্যরা তাকে বলে অপ্সরা লাগছে সেখানে এ বলছে পেত্নী লেগেছে। বদমাইশ লোক একটা। আরোহী রাগে গজগজ করতে করতে তূর্ণের পাশ কাটালো। কিছুটা দূরে গিয়ে আবার ফিরে তাকালো পিছনে। গলা বাড়িয়ে বলল,

“আমাকে পেত্নী বললেন না? দেখবেন আপনার বউ একটা পেত্নী হবে।”

তূর্ণ চোখ গরম করলো। তেড়ে গিয়ে বলল,

“কি বললি আবার বল তো।”

আরোহী দাঁড়ালো না আর এক মুহূর্তও। এক দৌড়ে সে চলে গেল রান্নাঘরে পানে। তূর্ণ হেসে ফেললো। মাথা চুলকে বলল,

“আসলেই আমার বউ একটা পেত্নী হবে।”

৫.
সূর্যটা মাথার উপরে। বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠ পুরুষেরা খাবার টেবিলে খেতে বসে পড়েছে ইতমধ্যে। টেবিল এখন তূর্য, তৌফিক, তারেক, আরুশ, ইমনের দখলে। আর দৌড় ঝাপ করে তাদের খাবার পরিবেশন করছে পৃথা, ইসরাত, অনন্যা, ইরা এবং ইমনের স্ত্রী লাবনী। সকলের শরীরেই আজ ভাঁজ ভাঙা নতুন শাড়ি জড়ানো। একটা উৎসব উৎসব ভাব ফুটিয়ে তুলতেই বোধহয় এই সাজসজ্জা। পৃথা সকলকে খাবার দিতে দিতে গিয়ে দাঁড়ালো তূর্যের পাশে। নম্র কণ্ঠে শুধালো,

“আপনাকে আর এক পিস মাছ দেই?”

তূর্য চোখে ইশারা করলো। পৃথা আশেপাশে তাকালো। এত মানুষের মধ্যে লোকটা আবার কানে কানে কি বলতে চাইছে? পৃথা একটু ইতস্তত করলো। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

“যা বলার পরে বলবেন।”

তূর্য মানলো না। চোখের ইশারায় তবুও নিচে ঝুঁকতে বলল। পৃথা আশেপাশে তাকালো অতঃপর সকলের চোখের আড়ালেই ঝুঁকলো একটু। তূর্য আশেপাশে চোখ বুলালো একবার। নিচু স্বরে বলল,

“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে আজ। আমি যেন এই বুড়ো বয়সে এসেও আবার নতুন করে তোমার প্রেমে পড়লাম প্রিয়তমা।”

চলবে….

প্রেমপরশ পর্ব-০৩

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

থামলো আরোহী। সাথে সাথে ওপাশ থেকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জবাব এলো,

“তুই নাকি আমাকে বদমাইশ বলেছিস?”

আরোহী থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠলো তার। এই টুকু সময়ে এই কথাও তূর্ণের কর্ণে পা’চা’র করে দেওয়া হয়ে গেছে। এটা তার ভাই নাকি শত্রু! তবে তাকে এই মুহূর্তে ভয় পেলে চলবে না। তূর্ণ কে হে যে তাকে ভয় পেতে হবে? ভয় পেলেই লোকটা মাথায় চড়ে বসবে। কাল কেমন ঠাস ঠাস দুটো থাপ্পর মে’রে গেল। গাল দুটো এখনও যেন অবশ হয়ে আছে। মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করলো আরোহী। জ্বীহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ ভিজিয়ে বলল,

“বদমাইশকে বদমাইশ বলবো না তো ভালো বলবো নাকি?”

তূর্ণ কপালে ভাঁজ ফেললো। রুক্ষ কণ্ঠে বলল,

“কি বললি আবার বল তো।”

“বদমাইশ বলেছি বদমাইশ।”

কথাটা বলে আরোহী একটা ছোট শ্বাসও ফেলতে পারলো না বোধহয়। তার আগেই কলটা কেটে গেল ওপাশ থেকে। অবাক হলো মেয়েটা। এক চোট ঝগড়া করার আগে তো কল কাঁটার ছেলে তূর্ণ নয়। সেখানে এত বড় একটা শব্দ “বদমাইশ” বলেছে তবুও কল কেটে দিয়েছে? আশ্চর্য তো! আরোহী আর তেমন ভাবলো না বিষয়টা নিয়ে। কেটেছে বেশ ভালোই হয়েছে। নয়তো এই সকাল সকাল আবার একটা তর্ক বিতর্কে জড়াতে হতো। মেয়েটা হাতের মোবাইলটা বিছানার পাশে রেখে আবারও চোখ বন্ধ করে নিল। যদিও এখন আর ঘুম আসবে না তবে কিছুক্ষণ মটকা মে’রে পড়ে থেকে যত রাজ্যের আজগুবি চিন্তাভাবনা তো করা যাবে।

কিছু মুহূর্তও গড়ালো না। এর মধ্যেই আরোহীর কক্ষের বন্ধ দরজায় শব্দ হলো ধুপ ধাপ। ধরফরিয়ে উঠে বসলো মেয়েটা। চোখ বড় বড় করে তাকালো দরজার পানে। এই ক্ষণে আবার কে এলো! আর এভাবে দরজাতেই বা আঘাত হানছে কেন? আয়াশ নয় তো? তখন দুই চার বাক্য শুধিয়ে ছেলেটাকে ভাগিয়ে দিয়েছিল। এখন আবার এসেছে নিশ্চই তাকে বিরক্ত করতে। কপাল কুঁচকানো আরোহী। এর যন্ত্রনায় এ গৃহেই যে তার বসবাস দায় হয়ে পড়েছে। তবে দরজায় পড়া আঘাত যে থামার নয়। মনে হচ্ছে দরজাটা ভেঙে ফেলবে এক্ষুনি। মেয়েটা দ্রুত নেমে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। ওড়নাটা ভালোভাবে শরীরে জড়িয়ে যত্রতত্র পায়ে এগিয়ে গিয়ে খুললো দরজাটা। অমনি আঁতকে উঠলো সে। একি! এ তো আয়াশ নয়। এ তো তূর্ণ। আরোহীর স্মরণে এলো একটু আগে তূর্ণের সাথে ফোনালাপের কথা, ভীত হলো তার হৃদয়। ঢোক গিলে আবারও দরজাটা আটকে দিতে উদ্যত হলে এক হাত তুলে আটকে দিল তূর্ণ। কি দানবীয় শক্তি এই পুরুষের শরীরে! তবুও আরোহী তার প্রচেষ্টা চালালো। কিছুটা সময় নিয়ে চেষ্টা করলো দরজাটা বন্ধ করে দিতে। কিন্তু পারলো না। তূর্ণ তার এক হস্ত দ্বারাই পরাস্ত করে দিল ছোট মেয়েটাকে। শক্তহাতে ধাক্কা মে’রে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো ভিতরে। এগিয়ে গিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বিছানায় বসে শুধালো,

“ফোনে যেন কি বলেছিলি? আমি যেন কি?”

আরোহী এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। পরপর ফাঁকা ঢোক গিলে জবাব দিল,

“কককই কিছু না তো। একদম কিছু না।”

“একটু আগে না তুই আমাকে বদমাইশ বলেছিলি। এর মধ্যে ভুলে গেলি?”

“ককই কখন? কিভাবে? আমি আপনাকে বদমাইশ বলবো কেন? আপনি তো আরও সব সময় বলি আপনি ভীষণ সৎ, আদর্শবান, সুশীল এবং ভদ্র পুরুষ।”

কি মিথ্যা! কি মিথ্যা! এই মেয়ে তো খাঁড়ার উপরে মিথ্যা বলছে। তূর্ণ বিছানা ছাড়লো। আরোহীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

“এত মিথ্যা কিভাবে বলছিস? তোর বুক কাঁপছে না? মামনি যে হায় হায় করে বলেছিল ‘মেয়েটা আমার বিগড়ে যাচ্ছে’ আজ তো দেখছি সত্যিই তুই বিগড়ে যাচ্ছিস।”

আরোহী আমতা আমতা করলো। এই ক্ষণেও নিজেকে বাঁচাতে সে আরও তর্কে জড়ালো। কণ্ঠে ধ্বনি তুলে বলল,

“প্রমাণ কি যে আমি মিথ্যা বলছি?”

তূর্ণ হতবাক হয়ে পড়লো। প্রথমে তাকে বদমাইশ বললো, তারপর মিথ্যা বললো, এখন আবার প্রমাণ চাইছে? মেয়েটা তো ইদানীং ধুরন্ধর হয়ে যাচ্ছে বেশ। নাহ একে এবার একটা শাস্তি না দিলেই নয়। নয়তো পরে যাবে ‘এতদিন আদর সোহাগে লালন করা গরু গোয়াল শূন্য করেই অন্যত্র ছুটতে চাইছে।’ তূর্ণ একবার সরু দৃষ্টিতে তাকালো আরোহীর পানে অতঃপর পকেট হাতরে নিজের ব্যক্তিগত মুঠোফোনটা হাতে তুলে নিল। তাতে একটু আগে আরোহীর আর তার কল রেকর্ডটা চালিয়ে দিল উচ্চশব্দে। সেখানে বেশ স্পষ্টভাবেই শোনা যাচ্ছে আরোহী তূর্ণকে বদমাইশ বলেছে। বিস্মিত হলো মেয়েটা। এই ছিল এই পাজী লোকের মনে? শেষে কিনা মিথ্যা বলেও বাঁচতে পারলো না! কে বলেছিল একে কল রেকর্ড চালু করে রাখতে? না না পরিবেশ বেশ গরম। এখন এই স্থান থেকে পালানোই উত্তম কর্ম। আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিজের পালানোর পথ খুঁজলো আরোহী। অতঃপর ছুটে পালাতে চাইলো দরজার বাহিরে। তবে তা আর হলো না। মেয়েটা দৌড় শুরু করতেই পিছন থেকে খপ করে তার হাতটা টেনে ধরলো তূর্ণ। বাঁকা হেসে বলল,

“এবার কোথায় পালাবি তুই? আমাকে বদমাইশ বলা! এবার তোকে দেখাচ্ছি মজা।”

“আমি আর কখনও আপনাকে বদমাইশ বলবো না তূর্ণ ভাই। আমার ভুল হয়ে গেছে, মাফ করে দিন।”

আরোহী হাত মোচড়ালো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল উক্ত কথাগুলো। তবুও তূর্ণ ছাড়লো না তার হাত। সকালের বাসী মুখেই হাত টেনে নিয়ে বেরুলো কক্ষের বাইরে। আরোহী নিজেকে মুক্ত করার আরও চেষ্টা চালালো। ব্যস্ত হয়ে বলল,

“আমি এখনও হাত মুখ ধুইনি তূর্ণ ভাই, ঘুম থেকে উঠে চুলটাতেও এখনও অব্দি চিরুনি করিনি। রাস্তার মানুষ দেখলে কি বলবে? মামা মামীই বা কি বলবে? আমি বরং হাত মুখ ধুয়ে একটু তৈরি হয়ে নেই তারপর আপনাদের বাড়িতে যাব।”

“নতুন নতুন শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছিস না যে তোকে তৈরি হয়ে যেতে হবে। এভাবেই চল আমাদের বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হবি।”

তূর্ণের কাঠ কাঠ কণ্ঠস্বর‌। মেয়েটাকে সে টেনে নিয়ে এলো সিঁড়ি থেকে। নিচে নামতেই সম্মুখে পড়লেন ইরা।তূর্ণকে দেখেই যেন আনন্দে গদগদ হয়ে পড়লেন তিনি। এক গাল হেসে বললেন,

“আরে তূর্ণ বাবা যে! কখন এলে?”

তূর্ণ একবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আরোহীর পানে। অতঃপর আবার ইরার পানে তাকিয়ে বেশ হাসি মুখেই বলল,

“এই তো একটু আগেই এসেছি মামনি। আর এসেই তোমার এই বলদী মেয়েটাকে টেনে হিচড়ে রুম থেকে বের করে আনতে হলো। মা যেতে বলেছে ওকে আর ওর কত বড় সাহস একবার ভেবে দেখো, মায়ের আদেশকে উপেক্ষা করে ঘরের দ্বার দিয়ে বসে ছিল।”

ইরা একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আরোহীর পানে। মেয়েকে এত বলে, এত বকে তবুও আদব কায়দা শিখাতে পারলেন না বোধহয়। পৃথা গুরুজন।‌ সে ডেকেছে অবশ্যই সে ডাককে গ্রহন করা তার মেয়ের কর্তব্য। তা না, গুরুজনের ডাককে উপেক্ষা করে দরজায় খিল বসিয়েছিল বাঁদর মেয়েটা। ইরার চোখ মুখ কিঞ্চিৎ রুক্ষ হলো। থমথমে কণ্ঠে বললেন,

“দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো তুমি। গুরুজনদের কথাও অমান্য করতে শিখেছো আজকাল। এই শিক্ষাই কি আমি তোমাকে দিয়েছিলাম?”

“মা, তুমি….”

কণ্ঠে তোলা বাক্যের সমাপ্তি ঘটার আগেই আরোহীকে থামিয়ে দিলেন ইরা। আদেশের সুরে বললেন,

“যাও গিয়ে দেখো তোমার বড় মামী ডেকেছে কেন। আর ফের গুরুজনদের কথা উপেক্ষা করার চেষ্টা করলে একদম চাপকে সিধে করে দেব বলে দিলাম।”

ইরা হতাশ হলো। বুঝলো এখানে কিছু বলে কোনো লাভ নেই। এও তূর্ণের পক্ষে। অবশ্য পক্ষে থাকবে নাই বা কেন? ইরার ভাইয়ের ছেলে তো তূর্ণ। একই বংশের রক্ত বইছে দুইজনের শরীরে। এই বাড়িতে আরোহীর ভাই শত্রু, মা শত্রু শুধু একটু ভালো আছে বাবা। সেই বাবাটা যে এই মুহূর্তে কোথায় গেল? মেয়েটা গলা উঁচিয়ে এদিক ওদিক দৃষ্টিপাত করে খুঁজলো বাবাকে। কিন্তু কোথাও দেখা পেল না তার। নিশ্চই শুক্রবার সকালে উঠেই বাজারে চলে গিয়েছেন। হতাশ হলো আরোহী। আর কি করার? তার কপালটাই খারাপ। এখন না চাইতেও এই বদমাইশ তূর্ণর সাথেই যেতে হবে। কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে না, কেউ না। ও বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আবার কি করবে কে জানে! চারদিকে শুধু হতাশা আর হতাশা।

৩.
চারদিকে ব্যস্ততা বেড়েছে। বৃক্ষ হীন শহরের বুকটায় সূর্যের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে অনেকটা। চৌধুরী বাড়ির সদর দরজা গলিয়ে আরোহীর হাত ধরে তূর্ণ ভিতরে প্রবেশ করতেই তাদের পানে ছুটে এলো ছোট অনয়। এ বাড়ির ছোট ছেলে অর্থাৎ তূর্ণের ছোট কাকা তারেকের ছেলে এই অনয়। বয়স আর কতই বা হবে। বড়জোর চার কিংবা সাড়ে চার বছর। এখনও অব্দি সব বুঝ ক্ষমতা তার না হলেও পাকা পাকা কথা আর, কথায় কথায় প্রশ্ন করায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে সে। অনয় ছুটে এসেই পথ আগলে দাঁড়ালো তূর্ণ এবং আরোহীর। ভ্রুদ্বয়ে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে শুধালো,

“আলোপ্পি তোমাকে এমন পাগলীর মতো দেখাচ্ছে কেন?”

আরোহী হতাশ হলো। শেষে কিনা তাকে দর্শনে ছোট অনয়ও পাগলীর সাথে তুলনা দিচ্ছে? অবশ্য দিবে নাই বা কেন? যেভাবে ঘুম থেকে তুলে গ’রু’র ন্যায় টেনে হিচড়ে নিয়ে এলো তূর্ণ। তাকে দেখে তো পাগলীর ন্যায়ই মনে হবে। রাস্তার লোকেরাও নিশ্চই তাকে দেখে এমনটাই ভেবেছে! এই লোকের অত্যাচারে এতদিন নিজ গৃহে কোনো মান সম্মান ছিল না আরোহীর। এখন দেখা যাচ্ছে গৃহের বাহিরেও থাকবে না। মেয়েটার হৃদয়ে যেন তূর্ণের প্রতি ক্রোধ নড়েচড়ে উঠলো। রুক্ষ দৃষ্টিতে সে তাকালো তূর্ণের পানে। তূর্ণ ভীষণ সাবলীলভাবে উপেক্ষা করলো সে দৃষ্টি। অনয়ের পানে তাকিয়ে শুধালো,

“কেন তোর আলোপ্পিকে আজ আলুর মতো লাগছে না আর?”

অনয় তার ছোট ছোট চোখ দ্বারা ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করলো আরোহীকে। অতঃপর বেশ বিচক্ষণতার সাথে জবাব দিল,

“নাহ, আজ আর আলুর মতো লাগছে না। দিদুন আমাদের বাড়ির ঐ পাশে কি যেন একতা গাছ লাগিয়েছে না ঐতার মতো লাগছে।”

অনয় ছোট বয়সেই সব কথা সুন্দর সাবলীলভাবে উচ্চারণ করতে পারলেও তার ‘ট’ এবং ‘ত’ এই দুটো অক্ষর উচ্চারণে বেজায় সমস্যা। আরোহী কপাল কুঁচকালো। এরা দুই ভাই মিলে আবার কোন সবজির সাথে তাকে মিলানোর চেষ্টা চালাচ্ছে? অনয় ছোট। তার কণ্ঠে আরোহী আপি/আপ্পি দুটো শব্দ উচ্চারণ না করতে পেরে সে তাকে আলোপ্পি বলেই ডাকে। যদিও মেয়েটার মনে হয় আলোপ্পির তুলনায় আরোহী আপি এটা সহজ, কোনো যুক্তবর্ণ নেই। বারবার অনয়কে এ ব্যাপারে বলার পরেও সে আলোপ্পিতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আর সেই আলোপ্পির আলো থেকে তূর্ণ বানিয়েছে “আলু।” এতদিন তো এই দুই ভাই মিলে আলু আলু করে তার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলেছিল কিন্তু এখন আবার নতুন কোন সবজির সাথে তাকে জড়াতে চাইছে? আরোহী কপাল কুঁচকে রেখেই অনয়কে প্রশ্ন করলো,

“তুই কোনটার কথা বলছিস?”

অনয় গালে হাত দিল। ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,

“ঐ যে বাড়ির ওপাশে দিদুন লাগিয়েছে। লম্বা, চারপাশে পাতা দিয়ে ঢাকা মাথায় আবার পাগলীর মতো চুল আছে। একদম ঠিক তোমার মতো।”

অনয়ের বর্ণনায় চিন্তায় পড়ে গেল তূর্ণ এবং আরোহী। কি এমন হতে পারে যেটা লম্বা, চারপাশ পাতা দিয়ে ঢাকা আবার মাথায় চুলের মতো? তূর্ণের দাদী অর্থাৎ তাহমিনা বেগম বাড়ির আশেপাশে তো বেশ অনেক গাছই লাগিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সের অবসর সময়ে এই করেই তার সময় কেটে যায়। এর মধ্যে কোন গাছটা? ভাবতে ভাবতে তূর্ণ হুট করেই বলল,

“ভূট্টা! তুই কি ভূট্টার কথা বলছিস অনয়?”

অনয়ের চোখ মুখ চকচক করে উঠলো। মাথা ঝাঁকিয়ে তৎক্ষণাৎ জবাব দিল,

“হ্যা হ্যা ভূত্তা ভূত্তা।”

তূর্ণের ওষ্ঠ প্রসারিত হলো। অনয়ের মাথায় হাত দিয়ে তার চুলগুলো এলোমেলো করে বলল,

“বাহ! বেশ ভালো বর্ণনা দিলি তো ভূট্টার। নির্ঘাত তুই একদিন ভুট্টা বিজ্ঞানী হবি।”

অনয়ের চোখে মুখে গম্ভীরতার ছাপ ফুটে উঠলো রাতারাতি। তূর্ণের বক্তাব্যের প্রতিবাদ করে সে বলে উঠলো,

“না না আমি ভূত্তা বিজ্ঞানী হবো না। আমি হবো দিদুনের গল্পের ভূত্তা কুমার আর আলোপ্পি হবে ভূত্তা কুমারী। তারপর আমার ভূত্তা কুমারীকে রাক্ষস ধরে নিয়ে যাবে। আমিও এক সাহসী ভূত্তা কুমার হয়ে সাত সমুদ্রর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে ভূত্তা কুমারীকে উদ্ধার করে আনবো।”

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-০২

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

কেঁপে উঠলো বেচারী। দ্রুত কানে হাত দিল। তুতলিয়ে জবাব দিল,

-“এএএই তো ধরেছি কান।”

তূর্ণ হাতের মোটা লাঠিটা নিয়ে দুইবার চক্কর কাটলো আরোহীর চারপাশে। অতঃপর বলল,

“এখন মুখে বল ‘আমার স্বামী ব্যতীত কাউকে আর কোনোদিন আমি লাভ ইয়্যু বলবো না।”

আরোহী মিনমিনে কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,

“আমার স্বামী ব্যতীত কাউকে….”

সাথে সাথে আবারও ধমকে উঠলো তূর্ণ। রুক্ষ কণ্ঠে বলল,

“মিনমিন করে কি বলছিস? জোরে বল বেয়াদব।”

তূর্ণের ধমকের কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো আরোহীর ছোট্ট কায়া। তৎক্ষণাৎ গলা বাড়িয়ে বইয়ের পড়া মুখস্থের ন্যায় আওড়ালো,

“আমার স্বামী ব্যতীত কাউকে আর কোনোদিন আমি লাভ ইয়্যু বলবো না। আমার স্বামী ব্যতীত কাউকে আর কোনোদিন আমি লাভ ইয়্যু বলবো না।”

ওষ্ঠে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ধরা দিল তূর্ণের। তবে আরোহী তার পানে তাকাতেই সে হাসি গিলে ফেললো দ্রুততার সাথে। পূর্বের ন্যায় মুখশ্রীতে থমথমে ভাব ধারণ করে বলল,

“কি সমস্যা? তোকে থামতে বলেছি আমি? তাহলে থামলি কেন?”

“আর কতক্ষণ এভাবে থাকতে হবে তূর্ণ ভাই? আমার যে ভীষণ পায়ে ব্যথা করছে।”

তূর্ণ কপালে ভাঁজ ফেললো। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“একদম বাপের মতো হয়েছিস। আমার বাবা যে তোর বাপকে কথায় কথায় মীর জাফরের বংশধর বলে আজ তার সত্যতা পেলাম। কান ধরে দাঁড়াতে বলেছি পাঁচ মিনিটও হলো না এর মধ্যে পা ব্যথা নামক মিথ্যা অজুহাত দিয়ে বাঁচতে চাইছিস? মীর জাফরের ন্যায় আমার বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পায়তারা করেছিস? তবে বলে রাখি, আমি তোর মতো কুচক্রী নারীর কথা বিশ্বাসই করি না আর তো করবি বিশ্বাসঘাতকতা। চুপচাপ কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক বেয়াদব মহিলা।”

আরোহী শুনলো তূর্ণর কণ্ঠ নিঃসৃত প্রতিটি বাক্য। দুই হাত দ্বারা কান ধরে রেখেই প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল,

“আমি মোটেই মহিলা নই তূর্ণ ভাই। আমার বয়স মাত্র ১৭ বছর। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী আমি এখনও শিশু।”

তূর্ণ ওষ্ঠ বাঁকালো। ভেংচি কেটে বলল,

“হ্যা তুই তো শিশুই, একদম বাচ্চা। এখনও বিছানায় মু’তি’স। তা একা একা বুঝি বিছানা নষ্ট করে হচ্ছিলো না তাই নাগর খুঁজতে বের হয়েছিলি?”

আরোহী নাক মুখ কুঁচকালো। কি বিশ্রী কথা বার্তা! বিছানায় মু’তি’স মানে কি? বড় ভাই হয়েছে বলে কি যা খুশি বলবে? তার কি কোনো মান সম্মান নেই নাকি! আরোহী আড়চোখে তাকালো তূর্ণের পানে। কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

“একদম বাজে কথা বলবেন না তূর্ণ ভাই। আমি মোটেও বিছানায় ওসব করি না।”

মেয়েটার পা থেকে মাথা অব্দি চোখ বুলালো একবার। ঠোঁট কামড়ে বলল,

“বিছানায় মো’তা ছেড়ে দিয়েছিস? তাহলে তো তোকে এখন বিয়ে দেওয়া দরকার। পাড়ার মোড়ের কুদ্দুস বয়াতির সাথে তোকে মানাবে বেশ। এমনিও লোকটা বহু বছর নিঃসঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তোর সাথে বিয়ে হলে তার জীবনের নিঃসঙ্গতা ঘুচবে একটু হলেও। আবার মাঝে মাঝে সে তার কোকিলের ন্যায় মিষ্টি সুরে তোকে গান শুনাবেন।”

থামলো তূর্ণ। একটু ভেবে কণ্ঠ বাড়িয়ে গান ধরলো,

“গিরি গিরি গিরি গিরি কে জানি কইলো উত্তর বাড়ির খালা আর দক্ষিণ বাড়ির খালা আরে তাড়াতাড়ি ওইঠা পালা।”

তূর্ণের পুরুষালী কণ্ঠে ধারণ করা “গিরি গিরি গিরি গিরি” এই চারটা শব্দের দাপটেই লাফিয়ে উঠলো আরোহী। বুক ধরফর করে উঠলো তৎক্ষণাৎ। এ আবার কেমন ভয়াবহ আতঙ্কের গান! এই রাতের আঁধারে চারদিকে শুনশান নীরবতায় আর একটু হলেই তো হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিতো আরোহীর। মেয়েটা জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল। সাথে সাথে তার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো পাড়ার মোড়ের কুদ্দুস বয়াতির চেহারাটা। লোকটা একটু পাগলা পাগলা ফকির ধাঁচের। শরীরে তার সর্বদা জোড়া তালি দেওয়া একখানা জুব্বার ন্যায় পোশাক থাকে, মাথার চুলগুলো বেশ অনেকদিন ধরে অযত্নে অবহেলায় লম্বা হয়ে ঝট বেঁধে গেছে, দাঁড়ি গোঁফেরও তেমনই অবস্থা। তবে লোকটার গানের গলা বেশ সুন্দর। রাস্তার ধারে একদিন গান গাইছিলো তা শুনেই আরোহী বলেছিল,

“বাহ লোকটা পাগলাটে ধাঁচের হলেও বেশ সুন্দর গান গায় তো।”

ব্যস ঐ বাক্যটাই যেন তার গলার ফাঁ’স হয়ে ধরনীর বক্ষে পদার্পণ করলো। কথাটা কিভাবে যেন তূর্ণের কর্ণে পৌঁছালো। আর তারপর থেকে এখন পর্যন্ত এই পুরুষ ঐ কুদ্দুস বয়াতির নাম নিয়ে জ্বালিয়ে মা’র’লো তাকে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো আরোহী। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

“এখন ছেড়ে দিন তূর্ণ ভাই। অনেক রাত হয়েছে। আমি ঘরে যাই ঘুম পাচ্ছে ভীষণ।”

“আমার ঘুমে আগুন লাগিয়ে তুই ঘুমাবি? তা তো আমি বেঁচে থাকতে হতে দেব না।”

আরোহী অবাক হলো। কি মিথ্যাবাদী লোক! সে কখন তূর্ণের ঘুমে আগুন লাগালো? আশ্চর্য! মেয়েটা পলক ঝাপটালো। হতবাক কণ্ঠে বলল,

“আমি আবার কখন আপনার ঘুমে আগুন লাগালাম? উল্টো আপনি আমার ঘুমে আগুন লাগিয়ে ধরে বেঁধে এখানে এনে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।”

“চুপ বেয়াদব। বড়দের মুখে মুখে আবার কথা বলছিস। চুপচাপ কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। নয়তো এখনই তোর বাপ মাকে ডাকবো আর সাথে তো এই মোটা লাঠি আছেই।”

তূর্ণের ফের ধমকে চুপসে গেল আরোহী। আর কোনো বাক্য ব্যয়ের সাহস করলো না মেয়েটা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কান ধরে।

একটু একটু করে সময় গড়ালো। চারদিকের জনমানবহীন নীরব রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধুমাত্র দুই নর নারী। একজন নিজেকে নিশ্চুপতার জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা নুইয়ে আর অন্যজন তার পানেই তাকিয়ে রয়েছে চোখে মুখে একরাশ মুগ্ধতা ফুটিয়ে। তূর্ণ আরও কিছুটা সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আরোহীর পানে। অতঃপর পাক্কা ত্রিশ মিনিটের সমাপ্তি ঘটিয়ে বলল,

“এখন ঘরে যা।”

আরোহী উৎফুল্ল হলো, এতক্ষণে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। যাক অবশেষে তার শাস্তির পাঠ চুকেছে। দ্রুততার সাথে কান ছাড়লো মেয়েটা। লাফিয়ে লাফিয়ে পা বাড়ালো গৃহের পানে। তবে দরজার নিকটে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো সে। আবারও ফিরে তাকালো পিছনে। তূর্ণ কপাল কুঁচকালো। গম্ভীর সুরে প্রশ্ন করলো,

“আবার কি?”

“আপনি সত্যিই বাবা মাকে কিছু বলবেন না তো?”

আরোহীর চোখ মুখে উৎকণ্ঠা। আড়ালে হাসলো তূর্ণ। তবে মুখশ্রীতে গম্ভীরতা এটে রেখেই ছোট করে জবাব দিল,

“না।”

“সত্যি করে বলুন। একদম তিন সত্যি।”

তূর্ণ বিরক্ত হলো। ধমকে বলল,

“তুই গেলি নাকি এখনই ডাকবো তোর মা বাপকে।”

আরোহী আর দাঁড়ালো না এক মুহূর্তও। ঝড়ের গতিতে সে ঢুকলো গৃহের ভিতরে। বলা তো যায় না সত্যি সত্যি যদি এই লোক আবার তার বাবা মাকে ডেকে বসে তবে আর আজ বাঁচতে হবে না। আরোহীকে ছুটতে দেখে এবার প্রকাশ্যেই ওষ্ঠ প্রসারিত করলো তূর্ণ। মেয়েটা যতক্ষণ না দরজা আটকালো ততক্ষণ চেয়ে রইলো ওভাবেই। দরজা আটকাতেই হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে ফেললো অদূরে। অতঃপর নিজেও পা বাড়ালো বাড়ির পানে।

২.
সকালের সূর্যটা উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। চারদিকটাকের ব্যস্ততাও বাড়তে শুরু করেছে একটু একটু করে। আরোহী এখনও এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে বিছানায়, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। এমন সুন্দর সুখকর ঘুমের মধ্যে হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ কর্ণে পৌঁছালো মেয়েটার। এ যেই সেই আওয়াজ নয়, মনে হচ্ছে যেন দরজাটা ভেঙে যাবে এক্ষুনি। সম্ভবত কোনো ভারী বস্তু দ্বারা কেউ দরজায় আঘাত হানছে লাগাতার। আরোহী ধরফরিয়ে উঠে বসলো বিছানায়। আকস্মিক ঘুম ভাঙায় গা হাত পা কাঁপছে থরথর। মস্তিষ্কটাও নিষ্ক্রিয় এই মুহূর্তে। একটু সময় নিয়ে পুরোপুরি ঠিক হলো আরোহী। একটু আগে কি ঘটেছে তা তার সচল মস্তিষ্ক ধারণ করতেই মেয়েটা ক্ষেপে উঠলো। এ কর্ম কার ধরতে সময় লাগলো না একটুও। ভেবেছিল আজ শুক্রবার একটু বেশি ঘুমাবে, গতকাল রাতে এমনিই তূর্ণ এসে জ্বালিয়ে গেছে। তবে সে স্বাদ আর পূর্ণ হলো কই? একটা ঘরের শত্রু বিভীষণ আছে না সেই তো জ্বালিয়ে খেল। আরোহী রেগেমেগে বিছানা ছাড়লো। তেড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই চোখের সম্মুখে দৃশ্যমান হলো তার একমাত্র আদরের ছোট ভাই আয়ুশ, এবার অষ্টম শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে সে। ছেলেটার হাতে একটা কাঠের চেয়ার। এই চেয়ার দ্বারাই নিশ্চয়ই এতক্ষণ দরজায় আঘাত করছিলো। আরোহীর মেজাজের পারদ বাড়লো ধপধপ করে। চেঁচিয়ে উঠে বলল,

“হতচ্ছাড়া বদমাইশ, ঘরের শত্রু বিভীষণ একটা। এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছিলি কেন? আমি কি ম’রে’ছি’লাম?”

বোনের এত হাঁক ডাক কিছুই গায়ে মাখলো না আয়ুশ। বরং সাবলীল কণ্ঠে বলল,

“যে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম তোর! প্রথমে তো আস্তে ধীরেই ডাকছিলাম উঠছিলি না তাই তূর্ণ ভাইয়ের বুদ্ধিতে এই পন্থা অবলম্বন করতে হলো।”

তূর্ণ! তূর্ণ! আর তূর্ণ। জীবনটা জ্বলিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিল ঐ লোকটা। রাতে জ্বালিয়ে হয়নি এখন সকালেও জ্বালানো শুরু করেছে। আরোহী দাঁতে দাঁত চাপলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

“এসেছে তূর্ণের চ্যালা। আমার চোখের সম্মুখ থেকে দূর হ বদমাইশ।”

কথাটা বলতে বলতেই রেগেমেগে দরজাটা আটকে দিল মেয়েটা। ব্যস্ত হলো আয়ুশ। দরজায় আবার কড়া ঘাত করে বলল,

“আরে দরজা আটকাচ্ছিস কেন? পুরো কথা তো শুনবি। তূর্ণ ভাইয়ের মা মানে বড় মামী আমাদের দাওয়াত করেছে যেতে বলেছে ও বাড়ি।”

তূর্ণদের বাড়িতে যাবে! কেন? কপালে যতটুকু শনি চড়ানো বাকি আছে সেটুকু চড়াতে! ও বাড়িতে গেলেই তো তূর্ণ আবার তার পিছনে লাগবে তারপর পুরো দিনটাই মাটি। ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো আরোহী। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

“কোথাও যাব না আমি। ঐ বদমাইশ তূর্ণের বাড়িতে তো নাই।”

আরোহী ফোঁস ফোঁস করতে করতে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তূর্ণের বাবা তূর্য চৌধুরী সম্পর্কে আরোহীর মা ইরার চাচাতো ভাই অর্থাৎ তার চাচাতো মামা। তবে তাদের দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক বেশ উন্নত। একদিকে চাচাতো ভাই বোনের সম্পর্ক তার উপরে আরোহীর মা ইরা আর তূর্ণের মা পৃথা বান্ধবী, আবার ওদিকে আরুশ এবং তূর্য ভাই ভাই। তূর্ণদের বাড়ির পাশেই ইরার আপন ভাই অর্থাৎ আরোহীর আপন মামা ইমন চৌধুরীর বাড়ি। সে বাড়িতেও তাদের অহরহ যাতায়াত তবুও যেন সখ্যতা তূর্যদের বাড়ির সাথেই বেশি। আরোহী নিজের ক্রোধ নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের গভীরতা একটু বাড়তেই বালিশের পাশে থাকা তার ছোট মুঠোফোনটা বেজে উঠলো কর্কশ ধ্বনিতে। মেয়েটা বিরক্ত হলো। এখন আবার কে? তার শান্তি কি এই পৃথিবীর কারো সহ্য হয় না? আরোহী কলটা ধরলো না। কানের উপরে একটা বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো আবারও। কিন্তু এ কল যে থামার কোনো নাম গন্ধ নিচ্ছে না। একের পর এক দিয়েই যাচ্ছে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকালো মেয়েটা। হাত বাড়িয়ে বালিশের পাশ থেকে মুঠোফোনটা হাতে নিল। নাম্বার ততটা ভালোভাবে খেয়াল না করেই রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো মুঠোফোনটা। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,

“হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম কে বলছেন?”

ও পাশ থেকে জবাব এলো না কোনো। শুধু ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আরোহী ভ্রু কুঁচকালো। তিরিক্ষি মেজাজে বলল,

“সমস্যা কি? কল দিয়ে চুপ করে আছেন কেন? মোবাইলে টাকা কি বেশি হয়ে গেছে নাকি?”

থামলো আরোহী। সাথে সাথে ওপাশ থেকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জবাব এলো,

“তুই নাকি আমাকে বদমাইশ বলেছিস?”

চলবে….

প্রেমপরশ পর্ব-০১

0

#প্রেমপরশ ( রোমান্টিক কমেডি )
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১ ( সূচনা পর্ব )

১.
“আই লাভ ইয়্যু পাশের বাড়ির চ্যাংরা পোলা।”

বান্ধবীদের ট্রুথ এন্ড ডেয়ার নামক ভ’য়ং’ক’র খেলার চক্করে পড়ে অবশেষে ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে এমন একটা পোস্টটা দিয়েই ফেললো আরোহী। কোন কুক্ষণে যে বান্ধবীদের সাথে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার নামক খেলাটা খেলতে গিয়েছিল কে জানে! জীবনের চড়ম ভুলটা বোধহয় এটাই করলো সে। তাও খেলেছিল বেশ ভালো কিন্তু ডেয়ার নিতে কে বলেছিল? সত্যি বলার ভয়ে ট্রুথ নেয়নি। এখন ডেয়ার নিয়ে তো ফাঁ’স’লো আরও। ভাগ্যিস আইডিতে পরিবারের কোনো সদস্য বা আত্মীয় স্বজন কাউকে রাখেনি নয়তো আজ যাচ্ছে তাই একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। যদিও তাদের বাড়ির আশেপাশের বাড়িতে তেমন কোনো ছেলে টেলে নেই। ডানপাশের বাড়িটায় দুটো মেয়ে একটা ছেলে। ছেলেটা ছোট, বয়স এই বছর দুই হবে হয়তো। আর বাম পাশের বাড়িটা তালাবদ্ধ। তবে এই বাম পাশে দুটো বাড়ি রেখে যে বাড়িটা রয়েছে তাতে এক ভয়ংকর পুরুষের বসবাস। সম্পর্কে সে পুরুষ আরোহীর মামাতো ভাই। তার বড় মামা তূর্য চৌধুরীর সুপুত্র তূর্ণ চৌধুরী। তূর্ণের থেকে আরোহী প্রায় বছর পাঁচেকের ছোট হলেও শৈশব থেকেই তাদের দা কুমড়ার সম্পর্ক। তূর্ণ বাকি সকলের সাথে সর্বদা বেশ মার্জিত ব্যবহার করে। কাজিন মহলের সকলের সাথে ভালো সম্পর্ক তার। শুধুমাত্র শত্রুতা আরোহীর সাথে। এই মেয়েটার সাথে যেন তার জন্ম জন্মান্তরের শত্রুতা। দেখা হলে এক চোট ঝগড়া না করে, দুটো ধমক না দিয়ে শান্তি পায় না। উঠতে বসতে সর্বদা তার পিছনে লেগেই থাকে ছেলেটা। আরোহীর মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা মতে সে এক বদমাইশ, ভয়ংকর, বদ, অভদ্র এবং বাজে পুরুষ। যাকে দেখলেই ভয়ে ঠকঠক করে কেঁপে ওঠে তার হৃদয়। মেয়েটার ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ তাদের বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠলো। আরোহী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো কক্ষের দেয়ালে ঝুলানো দেয়াল ঘড়ি টার পানে। রাত প্রায় বারোটা বেজেছে। বাবা মা এবং ছোট ভাইটা নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু এত রাতে আবার কে এলো? মেয়েটা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিছানার পাশে ফেলে রাখা ওড়নাটা তুলে ভালোভাবে জড়ালো শরীরে অতঃপর কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলো সদর দরজার পানে‌। কিন্তু এত রাতে একা একজন মেয়ে মানুষ হয়ে কি তার দরজা খোলাটা ঠিক হবে? যদি কোনো চো’র ডা’কা’ত বা গু’ন্ডা ব’দ’মা’ই”শ হয় তখন কি হবে? আরোহী ভীত হলো। দরজায় লাগানো দূরবীন/লুকিং গ্লাস থেকে তাকালো বাইরে। অমনি চমকে উঠলো মেয়েটা। একি বাইরে তো তূর্ণ দাঁড়িয়ে আছে। এই লোক এত রাতে এখানে কেন? তূর্ণ হাত উঁচিয়ে আবারও কলিং বেল চাপলো। আরোহী আর সময় ব্যয় করলো না। কলিং বেলের আওয়াজ শ্রবণে যদি তার মায়ের ঘুম ভেঙে যায় আর সে এসে দেখে তূর্ণ এসেছে অথচ আরোহী দরজা না খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তখন আবার এক চোট বকুনি দিবে। তার মায়ের আদরের ভাইপো কিনা। মেয়েটা হাত উঁচিয়ে দরজাটা খুললো। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,

“তূর্ণ ভাই আপনি…”

পুরো কথাটা শেষ করতে পারলো না আরোহী। তার আগেই তূর্ণের পুরুষালী হাতের বেশ শক্তপোক্ত একটা থাপ্পর এসে পড়লো মেয়েটার নরম গালে। মাথাটা যেন ঘুরে উঠলো সাথে সাথে। গালে হাত চলে গেল অজান্তেই। হতবাক চোখে তাকালো তূর্ণের পানে। অত্যন্ত গম্ভীর ক্রোধিত মুখশ্রী তার। সর্পের ন্যায় কেমন ফোঁস ফোঁস ধ্বনি তুললে কণ্ঠে। চক্ষু দুটোতেও রক্তিম আভা বিরাজমান। ঢোক গিললো আরোহী। আমতা আমতা করে বলল,

“আপনি আমাকে থাপ্পর কেন মা’র’লে’ন তূর্ণ ভাই?”

প্রশ্নটা কণ্ঠে ধারণ করতে যতক্ষণ তারপরই আবারও একটা থাপ্পর এসে পড়লো মেয়েটার আরেক গালে। কি ভয়ংকর শক্ত হাতের থাপ্পর রে বাবা! তাও আবার একটা নয় দুটো। ব্যথায় গাল টনটন করে উঠলো তার। আরেকটা হাত অন্য গালে দিয়েই ফুঁপিয়ে উঠলো মেয়েটা। নাক টেনে শুধালো,

“আমি কি করেছি তূর্ণ ভাই? এভাবে হুট করে বিরোধী দলের ন্যায় আচরণ করছেন কেন? দরজা খুলতেই থাপ্রা থাপ্রি লাগিয়ে দিয়েছেন ঐ ইটের মতো শক্ত হাত দিয়ে।”

তূর্ণের ক্রোধ যেন বাড়লো আরও। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল,

“আই লাভ ইউ পাশের বাড়ির চ্যাংরা পোলা! কোন ছেলেকে তুই আই লাভ ইয়্যু বলেছিস বেয়াদব? এত বড় সাহস তোকে কে দিয়েছে?”

দুই গালে দুই হাত রেখেই চমকে উঠলো আরোহী। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। এ কথা এই লোক জানলো কিভাবে? তার ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে তো এ নেই। প্রোফাইলও লক করা তাহলে এ কিভাবে জানলো? আরোহীর ভাবনার মধ্যেই আবারও মুখ খুললো তূর্ণ। হিসহিসিয়ে বলল,

“একটু খানি পুঁচকে মেয়ে। নাক টিপলে এখনও দুধ বের হয় এর মধ্যে নাগর জোটাতেও নেমে পড়েছে।”

আরোহী চোখ তুলে তাকালো তূর্ণের পানে। ঘোর প্রতিবাদ করে বলল,

“আমার নাক টিপলে কোনো কালেই দুধ বের হয়নি তূর্ণ ভাই বরং সর্দি বের হয়েছে। বিশ্বাস না হলে টিপে দেখুন। আপনার থাপ্পর খেয়ে কান্না করতে গিয়ে নাকে সর্দি জমেছে মাত্রই।”

আরোহী দুই গালে হাত রেখেই মাথাটা এগিয়ে দিল। তূর্য তাকালো মেয়েটার নাকের পানে। নাকের ডগাটা কেমন লাল হয়ে উঠেছে। মেয়েটা তার মায়ের মতো একটু বেশিই ফর্সা। একটু কান্নার বেগ আসলেই নাকটা লাল টমেটোর বর্ণ ধারণ করে। শীতল হলো তূর্ণের দৃষ্টি। তবে পরক্ষণেই আবার সর্দির কথা স্মরণে আসতে নাক মুখ কুঁচকালো। কটমট করে বলল,

“তুই কিন্তু বেশি বার বেড়েছিস আরোহী। আমার কথার উপরে আর একটা কথা বললে তোর নাকটাই কিন্তু আমি কেটে নেব।”

আরোহী ভীত হলো। দ্রুত নিজের নাকটা সরিয়ে নিল তূর্ণের সম্মুখ থেকে। এই পুরুষ যা ভয়ংকর তার নাকটা কেটে নিতেও পারে। তারপরে সে গন্ধ শুঁকবে কি দিয়ে? এই পৃথিবীর এত ভালো ভালো খাবার, সুন্দর সুন্দর ফুল শুধু চোখ দিয়ে দেখবে কিন্তু গন্ধ শুঁকতে পারবে না। কি মারাত্মক ব্যাপার স্যাপার। তার থেকে নিজের নাক নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়া ভালো। আরোহী একটু দূরে সরে গেল। পুরোনো ক্রোধ আবার জেগে উঠলো তূর্ণের ভিতরে। রু’দ্র’মূ’র্তি ধারণ করে বলল,

“তুই যে ইদানীং এসব করে বেড়াচ্ছিস, পাশের বাড়ির ছেলেদের ফেসবুকে পোস্ট করে আই লাভ ইয়্যু বলে বেড়াচ্ছিস এসব তোর ঐ হিটলার বাপ জানে? নাকি এখনও জানাসনি?”

থামলো তূর্ণ। পরপর আবার বলল,

“দাঁড়া ডাকছি তোর হিটলার বাপকে। মেয়েকে আদরে আদরে এতটাই বাদর বানিয়েছে যে সে এখন পাশের বাড়ির ছেলেদের ধরে ধরে লাভ ইয়্যু বলে।”

আঁতকে উঠলো আরোহী। এতক্ষণ রুক্ষ কণ্ঠে কথা বলা, থাপ্পর মা’রা যাই একটু মানা যায় কিন্তু বাবাকে বলা! ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো আরোহীর ছোট্ট দেহটা। বাবা মায়ের কানে কোনোভাবে এ কথা গেলে কেটে কুঁচি কুঁচি করে ফেলবে নির্ঘাত। মেয়েটা দিশেহারা হলো। তাড়াহুড়ো করে বলল,

“মা বাবাকে কিছু বলবেন না তূর্ণ ভাই। বান্ধবীদের সাথে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলতে গিয়ে ঐ পোস্টটা করেছিলাম ভাইয়া। নয়তো করতাম না।”

তূর্ণ তবুও দমলো না। ওষ্ঠদ্বার ফাঁকা করে উদ্যত হলো আরুশ শেখ এবং ইরাকে ডাকতে। আরোহী ভীত হলো আরও। কি করবে না করবে ভেবে পেল না। শেষে আর উপায় না পেয়ে হুট করেই সে বসে পড়লো তূর্ণের পায়ের কাছে। দুই হাতে তার পা জড়িয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,

“আব্বু আম্মুকে ডাকবেন না তূর্ণ ভাই। আমি সত্যিই বান্ধবীদের ট্রুথ এন্ড ডেয়ারের পাল্লায় পড়ে ঐ পোস্ট করেছিলাম। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন আমাদের বাড়ির আশেপাশে কোনো চ্যাংরা পোলা নেই। দুই বাড়ি পরে আপনাদের বাড়ি। কিন্তু সে বাড়ির সব পুরুষরা তো ভীষণ ভদ্র, সভ্য, সুশীল এবং মার্জিত যেমন আপনি।”

তূর্ণ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আরোহীর পানে। এই মেয়ের কণ্ঠে নিজের এত প্রশংসা তো জন্মে যুগে শোনেনি। আজ একদম প্রশংসার ফোয়ারা বইছে। এসব যে নিজেকে বাঁচানোর জন্য তা বেশ ভালোই জানে তূর্ণ। ছেলেটা হাত বাড়িয়ে আরোহীর বাহু ধরলো। টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,

“কোনো চ্যাংরা পোলা থাকুক বা না থাকুক। আর বান্ধবীদের ট্রুথ এন্ড ডেয়ারের পাল্লায় পড়ে হোক বা এমনি তুই আই লাভ ইয়্যু লিখেছিস তো। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে।”

আরোহী ডাগর ডাগর নয়নে তাকালো তূর্ণের পানে। কাঁচুমাচু করে প্রশ্ন করলো,

“কি শাস্তি?”

“বাইরে আয় তারপর বলছি।”

আরোহী দ্বিরুক্তি করলো। তূর্ণের প্রস্তাবকে নাকোচ করে বলল,

“আমি কোথাও যেতে পারবো না। যা শাস্তি দেওয়ার এখানেই দিন।”

“তাহলে আমি তোর বাবা মাকেই ডাকছি। কোন ছেলেকে ফেসবুকে প্রেম নিবেদন করেছিস সে উত্তর না হয় তাদের সম্মুখে দিস।”

আরোহী আতঙ্কিত হলো। তাড়াহুড়ো করে পা বাড়ালো বাইরের দিকে। মেকি হেসে বলল,

“কে বলেছে আমি যেতে পারবো না। এই যে যাচ্ছি, এখনই যাচ্ছি।”

তূর্ণ ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হাসলো অতঃপর নিজেও বেরিয়ে এলো আরোহীর পিছু পিছু। মেয়েটা সম্পূর্ণভাবে বাইরে বেরুতেই তূর্ণ আদেশ দিয়ে বলল,

“কান ধর।”

আরোহী চমকালো। এখন কিনা তাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান ধরতে হবে? হতে পারে এটা রাত আশেপাশে কেউ নেই কিংবা কেউ তাকে কান ধরে থাকতে দেখবে না। তবুও আত্মসম্মানের একটা ব্যাপার আছে। মেয়েটা এবার ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে, কিছুদিন পর এইচএসসি দিবে। যথেষ্ট বড় মেয়ে সে। সে কিছুতেই এই পুরুষের সম্মুখে কান ধরবে না। আরোহী তূর্ণের এ শাস্তি নিতে অস্বীকার করলো। নিচু কণ্ঠে বলল,

“অন্য শাস্তি দিন তূর্ণ ভাই। আমি কান ধরতে পারবো না।”

তূর্ণ চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজলো। অতঃপর রাস্তার পাশ থেকে একটা মোটা লাঠি তুলে এনে বলল,

“কান ধরবি নাকি এই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তোর পাশের বাড়ির চ্যাংরা পোলা বের করবো? আর তোর বাবা মাকে তো অবশ্যই পুরো ঘটনা বলে যাব।”

লাঠির পানে তাকিয়েই ঢোক গিললো আরোহী। এই লাঠির একটা বারি খেলে হাসপাতালের বিছানা ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলে যে সে জীবনের কত বড় ভুল করেছে তা সে বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। মেয়েটা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,

“এই জীবনে আর যাই হোক না কেন সে আর কোনোদিন ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলবে না। এই খেলার মতো ভয়ংকর এবং আতঙ্কের খেলা বোধহয় পৃথিবীতে আর দুটো নেই।”

আরোহীর ভাবনার মধ্যেই তাকে ধমকে উঠলো তূর্ণ। হাতের লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,

“কান ধরবি নাকি এটা দিয়ে লাগিয়ে দেব দুই ঘা।”

কেঁপে উঠলো বেচারী। দ্রুত কানে হাত দিল। তুতলিয়ে জবাব দিল,

-“এএএই তো ধরেছি কান।”

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

আজ শৈলীর বিয়ে পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0

#আজ_শৈলীর_বিয়ে
#অন্তিম_পর্ব
#সায়েদা_সানা

_________________
সত্য বলতে গেলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারাটা ততটা আঘাত করতে পারেনি শৈলীকে। কেন না তখন ওর মন মস্তিষ্ক জুড়ে একটি বিষয়েরই বিচরণ ছিল। রক্তিম। ছেলেটার সাথে তার বিয়ে তো হয়েই যাবে তাহলে আর ভেবে কি লাভ? পড়াশোনায় সময় দেয়নি বলেই তো পরীক্ষা খারাপ হয়েছিল তার। সময় দেবেই বা কি করে তার সময়টুকু তো বরাদ্দ রাখা ছিল তার মনের ঘরে একমাত্র অধিকারী রক্তিমের জন্য। রক্তিম নিশ্চয় এসব বিষয় নিয়ে তাকে ছোট করবে না।

ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে সেই রাতের কথা। রক্তিমের বলা কথাগুলো ভাবায় তাকে। মনে ভয় ঢোকে, চিন্তার বিষয় নেই বলে আশ্বাস দিলেও কোথাও একটা গিয়ে মনে হয় রক্তিম যদি সেদিনের মতোই কথা শোনায়। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য হলেও তার চিন্তা দূর হয়। শুধু রক্তিম নয় তার সাথে তার পরিবারও শৈলীকে শান্তনা দেয়। তাকে মন খারাপ করে থাকতে মানা করে। বলে এ তো মাত্র একটা একাডেমিক রেজাল্ট, এর দ্বারা আর যাই হোক কারো ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন হয় না। শিক্ষার মূল্যায়ন হয় না। প্রকৃত অর্থে শিক্ষা তো ভিন্ন অর্থ বহন করে। শুধু কিছু নিয়ম পড়ে আর মুখস্ত বিদ্যা খাতা ভরিয়ে এসে কেউ শিক্ষার পরিচয় দিতে সক্ষম নয়।

হ্যাঁ ওরা এমনটাই বলেছিল। এরপর বিয়ের জন্য তোড়জোড়ও শুরু করে দিল। কত যে যাওয়া আসা চললো তাদের এ বাড়ি ও বাড়ি। কেনা কাটাও হয়েছিল কিছু কিন্তু সময়ের সাথে মানুষ পরিবর্তনশীল। যারা একটা সময় শৈলীকে প্রকৃত শিক্ষার কথা বলে শান্তনা দিয়ে গেছিল তারাই রঙ পাল্টালো। বিশেষ রূপে রঙটা পাল্টে ফেলল রক্তিম। জানিয়ে দিলো ওর বন্ধুরা ওকে ছিঃ ছিৎকার করছে আর এই সুযোগটা ওদের করে দিয়েছে শৈলী। শৈলীর আজও মনে আছে রক্তিমের বলা কথাগুলো।

সে বলেছিল, “আমার সাথে তোমাকে ঠিক মানায় না শৈলী। আমার অর্জন বিদেশি ডিগ্রি আর তোমার সামান্যতম ডিগ্রিটুকুও নেই সেখানে আমার বরাবর আসতে পারা তো দিবাস্বপ্ন মাত্র। আমি তোমাকে নিয়ে আর এগিয়ে যেতে পারব না। বন্ধুমহলে এমনিতেই তোমার কারণে আমার নাক কাটা গেছে এরপর সারাজীবন ভর আমার এই দশা হোক আমি চাই না।”

“তুমিই তো বললে এসব ডিগ্রি দিয়ে মানুষকে বিচার করা বোকামি!”

“আবেগে ভেসে বলে দিয়েছি। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন মতাদর্শে চলমান আর সেই বাস্তবতায় বলে দেয় আমার যোগ্য তুমি নও। কখনো ছিলেই না।”

“আমি আজ তোমার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে রক্তিম।”

“তোমার এই ফ্যাচফ্যাচানি বন্ধ করো। আর কি বললে? আমার জন্য! আমি ঠিক কোথায় আটকেছি তোমায়? এই এতদূরে বসে তোমায় আটকাব আর তুমি স্থির থাকবে! না জানি কোথায় কোথায় সময় নষ্ট করে এসে এখন দোষারোপ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছো। তোমার ড্রামা আর নেওয়া যাচ্ছে না রাখছি আমি। আর হ্যাঁ আমাকে এবং আমার পরিবারকে নেক্সট টাইম আর বিরক্ত করবে না। করলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।”

বিয়ে ভাঙলো শৈলীর৷ এক প্রেম তার সময় জ্ঞান খেয়ে গেল অনায়াসে আর সেই প্রেমই তাকে ব্যর্থতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এক সময়ের সকলের চোখে বেস্ট একজন ছাত্রীকে সবাই কেমন কেমন একটা নজরে দেখতে শুরু করলো। ভেঙে গেল শৈলী। নিজেকে ঘর বন্দি করে রাখতে শুরু করল সে। আর রইলো তার পরিবার, তারা তার পাশেই ছিল সর্বদা তবে মাঝখানে বাইরের লোকের কথায় প্রভাবিত হয়েছিল তারাও। শৈলীকে উঠতে বসতে কথা শোনানো একটা রুটিনে পরিণত হয়েছিল তাদের নিকট। শৈলী বুঝেনি এসব বাইরে থেকে আসা কটুবাক্যের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মাত্র, সে তো জেনেছিল তাকে আর কেউ ভালোবাসে না। কেউ পছন্দ করে না। ডিপ্রেশনে ডুবে যেতে শুরু করেছিল মেয়েটি।

_________________
ডিপ্রেশনের অতলে তলিয়ে যাওয়া শৈলীকে উদ্ধার করতেই হয়তো আগমন ঘটেছিল প্রেফেসর সালমার। তিনি শৈলীকে দেখতে এসেছিলেন বলেই তো মেয়েটির অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ভুল কোন মানুষের দ্বারা হয় না? মানুষ কখনো ভুলের উর্ধে নয়৷ শৈলীর দ্বারাও ভুল হয়েছিল। অল্প বয়সে প্রেম, বিয়ের মতো একটা কমিটমেন্ট। স্বাভাবিক ভাবেই সেটাই একটি মেয়ের জীবনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে তাইতো আজ শৈলী হারিয়েছে সব। এমনকি তার ইচ্ছেশক্তিটুকুও হারিয়ে বসে আছে সে।

শৈলীর পরিবারকে বোঝানো এবং শৈলীকে হ্যান্ডেল করা। দুটো একা হাতে সামলে যাচ্ছিলেন প্রফেসর সালমা। সময় সাপেক্ষ ছিল সবটাই কিন্তু হার মেনে নেননি তিনি। অতি প্রিয়, কন্যা সমতুল্য ছাত্রীর সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে সময়ে সময়ে শৈলী ভেঙে পড়তে থাকে আর তিনি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে তাকে টেনে তুলে এগিয়ে নিতে থাকেন। যে কাজটি শৈলীর পিতা মাতার করার কথা ছিল সেটি তিনি করেছিলেন।

একটা সময় গিয়ে দেখলেন তিনি সফল। শৈলীর আর উঠে দাঁড়াতে কারো হাতের প্রয়োজন হচ্ছে না। সে হোঁচট খাচ্ছে কিন্তু দমে যাচ্ছে না। একা একাই সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে। মৃত শাখা প্রশাখা যেমন গোড়ায় পানির স্পর্শ পেলে সতেজ হয়ে ওঠে তেমনই শৈলীর ক্ষেত্রেও হয়েছিল। আর সেটি সম্ভব করে তুলেছিলেন প্রফেসর সালমা। একমাত্র তার প্রচেষ্টায় আজ শৈলী পড়াশোনায় এতোটা এগিয়ে যে কদিন বাদে তার নামের আগে ডাক্তার শব্দটি যুক্ত হবে।

________________
সবকিছু কত ভালো চলছিল এর মাঝে একদিন ফিরে আসে আবার সেই অতীত। সেদিন প্রফেসর সালমার ডাক পেয়ে বেরিয়েছিল শৈলী। ম্যাম তাকে আর্জেন্ট ডেকেছিলেন। বলতে চেয়েছিলেন কিছু কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি তার পূর্বেই রক্তিমের কন্ঠে থমকে যায় সবকিছু। সেদিন শৈলী বুঝেছিল আজও মানুষটা কোথাও না কোথাও তার মনের গোপন কোনো কোনে রয়ে গেছে। যাকে সরানো সম্ভব হয়নি শৈলীর পক্ষে।

________________
“উনি ফিরলেন আবার! কেন?”

“ক্ষমা চাইতে। আমাকে আবার তার জীবনে ফিরিয়ে নিতে। বলেছিল একটা সুযোগ চায় তার।”

“দিয়েছিলেন?”

“উত্তর দিইনি সেই সময়। স্তব্ধতা বজায় রেখে ফিরে এসেছিলাম বাড়িতে। ম্যামের সাথে আর কথা হয়নি। দুদিন পরে রক্তিম এসে হাজির হয় আমাদের বাড়িতে। তাকে দেখে সকলের অবস্থা এমন ছিল যেন সেখানেই জানে মে রে ফেলবে। আমি আটকেছিলাম তাদের। সেদিন রক্তিমকে প্রটেক্ট করেছিলাম বলে বাড়ির লোকেরা ভেবেই নিল আমি হয়তো ওকে মেনে নিতে চাইছি আরেকবার। আহত হয়েছিল সবাই আমি রক্তিমের ঢাল হয়েছিলাম বলে।”

“আপনি রাজি হয়েছিলেন?”

“উহু। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হই বা না হই সেটা পরের কথা। আসলে আমি চাইনি কেউ আমার আর ওর বোঝাপড়ার মাঝখানে ঢুকে পড়ুক। জবাবটা আমি দিতে চেয়েছিলাম তাকে। তার উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলেছিলাম আমি, আজ আমি সফল যা আগামীতে নাও থাকতে পারি। আমার গাট ফিলিং আমাকে বলে দিচ্ছে এমনটা হলে আমি আবারো তোমার সেই অহংকারী রূপটা দেখব। তুমি আসতে পারো।”

“ঠিক করেছেন। তবে আপনার জায়গায় আমি থাকলে তাকে দু’ঘা বসিয়ে দিতাম।”

মেয়েটির কথায় শব্দ করেই হেসে ফেলে শৈলী। মেয়েটি আরেকবার প্রশ্ন করে, “সবই বুঝলাম কিন্তু বিয়ে কাকে করতে যাচ্ছেন আপনি?”

“আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষীকে। যে আমার ডিপ্রেশনের সময়টাতে সাহস যুগিয়েছিল দূর থেকে। আমাদের সামনা সামনি কখনো দেখা হয়নি, আমি তাকে দেখিনি তবে তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি বহুবার। তার সাথে আমার আলাপটা আমার মাঝেই থাক। একান্ত আমার কিছু গুপ্ত স্মৃতি হয়েই থাক।”

“কিছুই জানতে পারব না?”

“আচ্ছা একটা কথা বলাই যায়। তার পরিচয়টা হচ্ছে সে কঠোর রৌদ্রতাপে আমাকে ছায়া প্রদানকারী সালমা ম্যামের একমাত্র পুত্র। অঙ্কন জোবায়ের নাম তার।
সেদিন রক্তিম এলো তখন জানতে পারি ম্যাম নিজের ছেলের জন্য আমাকে বাছাই করেছেন। এটা অবশ্য পূর্বের কথা। সেবারের প্রস্তাবটা তিনি দিয়েছিলেন দ্বিতীয়বারের মতো। প্রথমবারেরটা ছিল আমার আর রক্তিমের সম্পর্ক শুরু হবার পরে। যেটা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না ম্যাম তাই হয়তো প্রস্তাবটা রেখেছিলেন। পরে বাবা ভদ্রতার সাথে তা নাকোচ করলেও পরেবার আর নাকোচ করেননি। বলেছিলেন সবটা আমার উপর। আমি যা চাইব তাই হবে। ম্যামের ছেলের সাথে আমার তেমন আলাপ ছিল না। অপর পক্ষ থেকে আমাকে সাহস জোগানোর কাজটা চলমান থাকলেও আম্র তরফ থেকে কখনো কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি। এই বিয়েটা হচ্ছে শুধুমাত্র আমার ম্যামের জন্য। আমার মন বলল এমন একটা মা পেলে মন্দ হয় না শৈলী। রাজি হয়ে যা। একবার প্রেমিক পুরুষের মাকে গ্রহণ করে তো দেখলিই এবার না হয় মা সম ম্যামের ছেলেকে গ্রহণ করে দেখ। তোর সাথে আর খারাপটা হবে না।যেখানে ম্যামের মতো মানুষের বাস সেখানে খারাপের আনাগোনা অসম্ভব।”

মেয়েটি হাসে। মন ভরে দুয়া করে শৈলীর জীবন যেন ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে রয়। কিন্তু এতকিছুর মাঝে রক্তিমের আগমনের কারণটা সে বুঝে উঠতে পারে না। সে কী শুধুমাত্র তার বলা কথা সত্য করতে এসেছিল নাকি মনে অন্য কোনো মতলব ছিল!

__________________
মা সালমাকে অপেক্ষারত রেখে যথাসময়ে তার বৌমা রূপে শৈলীকে নিয়ে যেতে হাজির হয় অঙ্কন। সাথে তার কিছু নিকট আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব। হয়ে যায় বিবাহ সম্পূর্ণ। শৈলী ও তার নাম একে অপরের সাথে জুড়ে যায়। বন্ধুবান্ধব, শালা শালীদের হাসি মস্করায় কাটে সময়টা। একটা সময় ঘনিয়ে আসে বিদায় বেলা। শৈলীকে অঙ্কনের হাতে তুলে দেয় ওর বাবা। বিদায় দেওয়া হয় সারাজীবনের প্রিয় মাঝে কিছু সময়ের অপ্রিয় হয়ে ওঠা বিরক্তির কারণ, অসম্মানের কারণ সেই শৈলীকে। যে এখন শুধুমাত্র তাদের সম্মানের কারণ৷ আর এরজন্য তারা সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকবেন অঙ্কনের মা সালমার নিকট।

_________________
হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকা বাড়িটা নিস্তব্ধতার মাঝে ফেলে বিদায় নেয় শৈলী। এগোতে থাকে গাড়িটা। বাড়ির পরের গলিতে দাঁড়িয়ে শৈলীর বিদায় দেখে চোখের কোনে জল জমে রক্তিমের। মনে মনে বলে, “যে সুখের আশা আমার কাছে রেখেছিলে সেই সমস্ত সুখ তোমার নতুন সঙ্গী তোমার পায়ের তলায় বিছিয়ে দিক। ভালো থেকো আমার শৈলী, উহু আজ তুমি আর রক্তিমের শৈলী নও কখনো হবেও না। ভালো থেকো অঙ্কনের শৈলী।

রক্তিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে শৈলী। ও বোঝে রাতে কেন এসেছিল ছেলেটি। ওর তো অজানা নয় যে কোথাও না কোথাও মেয়েটি আজও তার নামে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে তাই শেষ আশা নিয়ে এসেছিল রাতে। ভেবেছিল শৈলী আবেগী হবে। হয়েছিল তো। আবেগী হয়েছিল শৈলী কিন্তু বাস্তবচিত্রটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি সে।

তার মনে পড়ে যায় অতীতটা। ওদের সম্পর্কের কথা জানাজানি হওয়ার পরে বাবা মাকে কতই না কথা শুনতে হয়েছিল সেদিন৷ ওরা তো ফুপি ও আপুকেও বাদ দেয়নি। তারপর যখন সব ঠিল হলো তখন কত অমায়িক সেই ব্যবহার। আবার শৈলীর অকৃতকার্য হওয়ায় তাদের শান্তনা বানী পরেই সেই শান্তনার জায়গায় রুষ্টতা। বাবা মায়ের অপমান। কিছুই ভোলেনি শৈলী। অপরদিকে শৈলীর ম্যাম বর্তমানের যিনি শৈলীর শাশুড়ী তিনি শৈলীর জন্য অন্ধকারে আলোর সমতুল্য। সেই শ্রদ্ধেয় মানুষটির সাথে জীবনের একটা লম্বা সময় কাটাতে শৈলী না হয় নতুন করে তার ছেলের প্রেমে পড়া শিখে নেবে। নতুন করে ভালোবাসতে শিখে নেবে। যা তাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু মানুষের সান্যিদ্ধে নিয়ে রাখবে।

সর্বপরী ভালোবাসা আছে তাই বলে সম্মান খুইয়ে তা পেতে হবে এর কোনো মানে হয় না। ভালোবাসা সম্মান দেয়, অসম্মান করে না। কখনো না।

শৈলীর ভাবনার মাঝে একটু শক্তপোক্ত হাত তার হাতটি আগলে নিল নিজের আয়ত্বে৷ শৈলী বুঝলো মানুষটা তার ভরসা হতে চাইছে। এমন মানুষকে উপেক্ষা করা যায়? যায় না। শৈলীও পারল না। সেই ভরসার হাতটি ধরে কষ্টগুলো ভাগিয়ে দিতে তৎপর হলো সে। সময় লাগবে কিন্তু সফলও হবে সে। এই বিশ্বাস নিয়েই পাশের মানুষটির সাথে সামনের পথে নিশ্চিন্তে পাড়ি জমালো শৈলী।

সমাপ্ত।

আজ শৈলীর বিয়ে পর্ব-০৪

0

#আজ_শৈলীর_বিয়ে
#পর্বঃ_৪
#সায়েদা_সানা

_______________
কাবিননামায় সাইন করার পরেও চেয়ে রইলো পাশের নামের দিকে। মনে মনে আওড়ে নিলো বার কয়েক। ‘অঙ্কন জোবায়ের’। নামটা ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত আওড়ে গেল যতক্ষণ সেই কাগজটি তার সামনে ছিল। যতক্ষণ নামটি তার চোখে ভাসছিল। এরপর ডান হাত মুঠো করে সামনে এনে মেলে ধরে সে। মাঝ বরাবর বরের নামের প্রথম অক্ষরটি দেখে সে। এই জায়গায় রক্তিমের নাম লিখা হয়েছিল রাতে। চোখ দু’টো বুজে আসে। গড়ায় এক ফোঁটা নোনাজল। মস্তিষ্ক স্মরণ করে রাতের শেষ ভাগের কিঞ্চিত পূর্বের সময়টা।

নিজের হাতের রক্তিমের নামের অক্ষরটি দেখে শৈলী। পরপর একটুখানি হেসে আরেকটি মেহেদির কোন তুলে নেয় হাতে। খুব সুন্দর ভাবে ‘R’ অক্ষরটির একপাশে গাঢ় করে দেয়। বাঁকানো মাঝের জায়গা কভার হয়ে ‘R’ হয়ে যায় ‘A’. মেয়েটি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রয় শৈলীর কাজটি দেখে। তার নজর বলে দেয় সেখানে রয়েছে অবাকতার বিশাল ছাপ সাথে একটি প্রশ্ন৷ এই যে শৈলী যেই কাজটি করলো তার অর্থ কী!

স্মৃতিপুস্তক আবার খুলে যায়। সেই সময়ে পৃষ্ঠাগুলো আরেকবার তাজা হয়ে ভাসে শৈলীর নেত্র সমীপে।

_______________
রক্তিমের যাওয়ার পরে কতকিছুই না ঘটলো এর মাঝে সবটাই ছিল ভালো আর ভালো। কোথাও খারাপটা ছুঁয়ে দিতে পারেনি। না ওদের দুজনকে আর না ওদের পরিবারকে। রক্তিমের মা যে কিনা শৈলীকে মানতে নারাজ ছিলেন তিনি সবথেকে বেশি আপন করে নিলেন মেয়েটিকে। আর শৈলী সে তো মহা খুশি। তার কাছে রক্তিম মানে এক আকাশ সমান খুশি। তার ভালোথাকার কারণ। সেই রক্তিমের পরিবার তো তার খুব ভালোবাসার জায়গায় স্থান পাবেই। তাই না! হয়েছিলও তাই। শৈলী তার বাবা মায়ের মতো করেই রক্তিমে বাবা মাকে দেখা শুরু করেছিল। ওর কাছে নিজের বাবা মায়ের চেয়েও বেশি প্রায়রিটিই তারা পেয়েছিলেন।

এসবের মাঝে দিনের অধিক সময়টা যেত রক্তিমের সাথে। রক্তিমের কলের অপেক্ষা করে কাটতো তার প্রতিটি প্রহর। নাওয় খাওয় বাদ দিয়ে, রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে, সবকিছু ভুলে রক্তিমকে প্রায়োরিটি দেওয়া শুরু করেছিল সে। এর জন্য কত যে বকা খেয়েছিল কলেজের ম্যামের কাছে।

তার কলেজে অনেক টিচার থাকলেও শৈলী পড়াকু হবার সুবাদে সবচেয়ে বেশি মন জয় করেছিল প্রফেসর সালমা সুলতানার। তাই তো শৈলীর অমনোযোগীতা টের পেয়ে সবার আগে শৈলীকে ডেকেছিলেন তিনি। কত বকাঝকাই না করেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন সময়টা একবার গেলে আর কখনো ফিরে আসবে না। কখনো না। সেদিন প্রফেসর সালমার একটা কথাও কানে তোলেনি মেয়েটা। সে যে বাস্তবের বাইরে অবস্থান করছিল। কল্পনায় তার সুখ সুখ স্বপ্নে রক্তিমকে নিয়ে ডুবে ছিল। বাস্তবতার ধারে কাছে ঘেঁষতে হলে তাকে ছাড়তে হতো কল্পলোকে সাজানো রক্তিম রাজ্যকে। যা শৈলীর কাছে একপ্রকার অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। এই তো, এখানেই ছিল শৈলীর ভুল। আবার বলা যায় শৈলীর বাস্তব শিক্ষা সফরের শুরু।

_______________
“কেমন আছে আমার শৈলী?”

“একটুও ভালো না।”

“আমায় মিস করছে বুঝি!”

“মজা করো না রক্তিম। আমি সিরিয়াস।”

“ওকে বাবা ওকে। মজা করছি না। কি হয়েছে খুলে বলো তো?”

“সকাল দশটায় আমার পরীক্ষা আর একটা ম্যাথও সলভ হচ্ছে না আনার দ্বারা।”

“টেস্টের সময় তো এমন বলো নি।”

“হ্যা কারণ সেই সময়ের গুলো খুব ইজি ছিল। আর এই গুলো খুব টাফ।”

“আগে দেখোনি?”

“না। এগুলো বোর্ড প্রশ্ন। টুকটাক কিছু ম্যাথ করে এইগুলো নিয়ে বসেছিলাম দেখি পারছি না কিছুই৷ এখন আমি কি করব রক্তিম!”

“কি করবে মান! তুমি কি করবে তা আমি কি করে জানব শৈলী। সারাবছর হেলায় পার করে এখন জানতে চায় কি করবে, নিজের সমস্যার সমাধান নিজে করো, কোথায় ভেবেছিলাম তোমার সাথে কথা বলে একটু রিফ্রেশমেন্ট হবে সেখানে এসব আদিখ্যেতা শুরু করলে তুমি।”

বিরক্ত হয়ে রক্তিম ফোন রেখে দেয়৷ শৈলী তখনো বিষ্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই সেই রক্তিম যে শৈলীর সাথে ঘণ্টার পর কথা না হলে পাগল হয়ে যেত। যার জন্য বাধ্য হয়ে নিজের অবসর সময়ের পরেও আরো অনেকটা সময় শৈলী নিজের থেকে চুরি করে বরাদ্দ রাখতো। এই কি সেই রক্তিম! শুরুতে যখন কথা বলা শুরু করলো তখন তো কত আবেগ নিয়ে ভালোবেসে বলছিল আর রাখার সময় এই এতো কথা! শৈলী যে আঘাত পেল সে বুঝেনি?

সারাটা রাত শৈলীর বাজেভাবে কাটলো। না পড়া হলো আর না ঘুম। পরীক্ষার খাতায় তেমন কিছুই লিখতে পারলো না। যতবার মাথা খাটাতে যায় পড়ার সময়ের স্মৃতিগুলো উধাও হয়ে রক্তিমের কথাগুলো ভাসে। কানের কাছে ভাসে। শৈলীর কলম আর চলতে চায় না। অসাড় হয়ে আসে শরীর।

_______________
“উনি এমন করেছিলেন আপনার সাথে!”

“অবাক হবার কিছু নেই আপু। মানুষ বদলায়, বদলায় মানুষের ভালোবাসাও।”

নিরবতায় কাটে কিছু প্রহর। তারপর মেয়েটি জানার আগ্রহ প্রকাশ করে।

“পরীক্ষার পরে কি হয়েছিল?”

শৈলী হাসে। চোখে জল, ঠোঁটে হাসি, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে কপালে বুড়ো আঙুল স্লাইড করে বলে, “পরীক্ষার পরে ফেইলিওরের ট্যাগ লেগেছিল এখানে। ইগো হার্ট হয়েছিল রক্তিম নামের ব্যক্তির। ছিন্ন করেছিল সম্পর্ক।”

“তাহলে বিয়ে কার সাথে হচ্ছে আপু? আর ওই ভাইয়াই বা এসেছিলেন কেন? আপনিই বা কেন তার হাত থেকে মেহেদি পরতে গেলেন?”

“আস্তে আস্তে। এতো প্রশ্ন তাও আবার একসাথে! দিচ্ছি তো উত্তর। বলব তো সব। শোনাব আমার গল্পটা। উহু আমাদের গল্পটা। শেষ না করে উঠছি না আজ। আমার যে বলতে হবে। বলতেই হবে।”

শৈলী বসে ছিল বিছার একটা সাইডে। মেঝেছে। সে পিছনের দিকে ঝুকে মাথাটা এলিয়ে দেয় বিছানায়। মেয়েটি অমনোযোগী হয় তার কাছে। তার যে আগ্রহ জেগেছে বাকি গল্পটা জানার।

চলমান।