Wednesday, July 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 79



ইরোরা পর্ব-০৩

0

( প্রাপ্ত বয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

#ইরোরা
#পর্ব_তিন
#কাওসার_আহমেদ

সারারাত কারো চোখে ঘুম নেই। ঘুম আসবেই বা কী করে! কারো মৃ*ত্যু হবে, আর সেটা মৃ*ত্যু*র আগের দিনই জানতে পারা, যেন ভবিষ্যত জানার মতোই ভ*য়*ঙ্ক*র। ডিবি পুলিশ ভালো করেই জানে যে সকালে তারা দুটো লা*শ পাবে। নাহিদ আর লিমনকে খুঁজতে অনেক চেষ্টা করলেও, তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। অবশেষে হার মানা ছাড়া উপায় নেই।

সকাল ঠিকই হলো, তবে অবাক করার মতো ঘটনা ঘটে গেল। দুটো লা*শে*র বদলে তি*ন*টা লা*শ পাওয়া গেল! নাহিদ ও লিমনের লা*শ ছাড়াও, তৃতীয় লা*শ*টি এক মহিলার। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। ঘটনাস্থল স্যামুয়েলের বাড়ির কাছেই হওয়ায়, সে আগে থেকেই সেখানে পৌঁছে যায়। একটা পরিত্যক্ত বাড়ির এক রুমে তিনটা লা*শ, র*ক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো রুম। খুনের পদ্ধতি একদম একই—ড্রিল মেশিন দিয়ে বুকের উপরে এমনভাবে ছিদ্র করা হয়েছে, যেন ছিদ্র দিয়ে অন্যপাশটা দেখা যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর আরমান, ইশিতা এবং ডক্টর মেহতাবের টিম এসে উপস্থিত হয়। ডক্টর মেহতাব স্যামুয়েলকে দেখে বললেন,
“তুমি এখানে?”

“একা একা ভালো লাগছিল না, তাই আপনাদের সাথে কাজ করতে চলে এলাম। চলুন, লাশের কাছে যাই,” স্যামুয়েল বলল।

“কাছে গিয়ে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। আগের চারজনের ক্ষেত্রেও তো কিছু খুঁজে পাইনি। মনে হচ্ছে, খুনি এমনভাবে কাজ করছে যে কোনো সূত্র বা প্রমাণ রেখে যাচ্ছে না। নিজের কাছে খারাপ লাগছে যে তোমাদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারছি না,” ডক্টর মেহতাব হতাশ সুরে বললেন।

“তবুও চলুন, একনজর দেখে আসি,” স্যামুয়েল বলল।

ঘটনাস্থল ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার পর তারা সবাই স্থান ত্যাগ করল।

পুলিশ স্টেশনে পৌঁছানোর পর, অমিত এসে জানালো যে ওই পাঁচজন বন্ধুর মধ্যে চারজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

“তোমাদের তো নজর রাখতে বলেছিলাম। তারপরও কীভাবে তারা নিখোঁজ হলো?” স্যামুয়েল ক্ষুব্ধভাবে জিজ্ঞাসা করল।

“বাকি একজন কোথায়?” এবার আরমান জানতে চাইল।

“ভিতরে আছে,” অমিত উত্তর দিল।

“সে কিছু বলেছে?” স্যামুয়েল জানতে চাইল।

“কারো সাথে বিজনেস মিটিং করার কথা বলেছিল। তার মতে, ভোরের দিকে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। কাল রাতে সবাই একসাথে ছিল,” অমিত জানাল।

“কোথায় বা কার সাথে দেখা করতে যাবে, এই বিষয়ে কিছু বলেছিল?” স্যামুয়েল আরও জানতে চাইল।

“না স্যার, কিছু বলেনি।”

“ওদের ফোন কোথায়? ফোন খুঁজে বের করো। ফোন থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে,” স্যামুয়েল নির্দেশ দিল।

“ওকে স্যার,” বলে অমিত তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে গেল।

এক ঘণ্টা পর, ইশিতা খুশিমুখে একটা ফাইল হাতে নিয়ে হাজির হলো। তখন আরমান নিখোঁজ চারজনকে খুঁজতে ব্যস্ত ছিল। ইশিতা ফাইলটা স্যামুয়েলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“একটা ক্লু পেয়েছি। আমার মনে হচ্ছে, এই সূত্র ধরেই আমরা খুনির কাছে পৌঁছাতে পারব। দেখো, ওই দশজন বন্ধু আর আজকে খুন হওয়া মহিলার মধ্যে একটা মিল আছে—সবাই সিমিরাতি কলেজের (কাল্পনিক নাম) প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী। আর ওই মহিলা এই কলেজের শিক্ষিকা ছিলেন।” ফাইলের মধ্যে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল ইশিতা।

স্যামুয়েল ফাইলটা ভালো করে দেখল এবং বলল, “ঘটনা তাহলে এখানে। র‍্যাগিং বা বুলিং কলেজে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ব্যাপার। হতে পারে, এরকম কিছু ঘটেছিল। চলো, কলেজে গিয়ে অনুসন্ধান করি।”

_______________
এক ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে ইশিতা এবং স্যামুয়েল পৌঁছাল সিমিরাতি কলেজে। খোঁজ নিয়ে তারা সরাসরি প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসে প্রবেশ করল। পরিচয় দেওয়ার পর প্রিন্সিপাল তাদের বসতে বললেন।

“বলুন, কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

প্রিন্সিপাল তখনও জানতেন না যে তার কলেজের এক শিক্ষিকার মৃত্যু হয়েছে। ইশিতা একটি ছবি বের করে দেখিয়ে বলল, “উনি আজ সকালে মা*রা গেছেন। মা*রা গেছেন বললে ভুল হবে, হ*ত্যা করা হয়েছে উনাকে।”

ইশিতার কথা শুনে প্রিন্সিপাল চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন এবং শোক প্রকাশ করলেন। চোখ মুছে বললেন, “উনার মৃ*ত্যু*র খবর শুনে আমি মর্মাহত। খুব ভালো শিক্ষিকা ছিলেন। গত বছর রিটায়ারমেন্ট নিয়েছেন। একটা ছোট এক্সিডেন্টে পায়ে সমস্যা হয়েছিল, তাই বাধ্য হয়ে অবসর নেন।”

স্যামুয়েল জানতে চাইলেন, “আপনি কতদিন ধরে এই কলেজে আছেন?”

“তিন বছর হলো,” প্রিন্সিপাল উত্তর দিলেন।

“পাঁচ-সাত বছর পুরনো কোনো শিক্ষক বা শিক্ষিকা থাকলে তাদের একটু ডাকবেন কি?” স্যামুয়েল বললেন।

প্রিন্সিপাল ফোন করে চারজন শিক্ষিকাকে ডাকলেন।

“উনারাই আট বছর ধরে আছেন। বাকিরা ট্রান্সফার হয়েছে বা রিটায়ার করেছেন। আপনারা তাদের সাথে কথা বলতে পারেন,” প্রিন্সিপাল জানালেন।

ইশিতা প্রিন্সিপালের রুম থেকে বেরিয়ে কলেজটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। এদিকে, স্যামুয়েল চারজন শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের এক প্রাক্তন শিক্ষিকাকে আজকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সন্দেহ করছি, এই ঘটনার সাথে এই কলেজের কোনো ছাত্র বা শিক্ষক জড়িত থাকতে পারে। গত পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে এই কলেজে কোনো শিক্ষার্থী বা শিক্ষক কোনো ধরণের অন্যায় করেছে কি না, সেটা আমাদের জানতে হবে। হয়তো কোনো টিচার্স কোনো স্টুডেন্টের সাথে অন্যায় করেছেন বা কয়েকজন স্টুডেন্ট একজন ছাত/ছাত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার, আচরণ করেছে।”

একজন শিক্ষিকা উত্তর দিলেন, “আমাদের কলেজের এমন কোনো রেকর্ড নেই।”

“ভালো করে ভাবুন,” স্যামুয়েল বলল। “হয়তো ছোট কিছু ঘটেছে যা আপনারা ভুলে গেছেন। র‍্যাগিং, বুলিং, কিছু হতে পারে।”

তখন অন্য একজন শিক্ষক বললেন, “হ্যাঁ, মনে পড়েছে! প্রায় ছয় বছর আগে রায়হান নামের একটি ছেলে এবং জুতি নামের একটি মেয়েকে কিছু ছাত্র বুলিং করেছিল। তাদের নাম ছিল রাইছা, লিমন, রাকিব, আর… বাকিদের নাম মনে পড়ছে না।”

“আপনার কাছে জুতি এবং রায়হানের ডিটেইলস আছে?” স্যামুয়েল জিজ্ঞেস করল। “এবং আপনার আগের প্রিন্সিপালের তথ্যও দরকার।”

প্রিন্সিপাল বললেন, “আমাকে একটু সময় দিন। অনেক আগের ঘটনা, তাই খুঁজে বের করতে কিছুটা সময় লাগবে।”

স্যামুয়েল সম্মতি জানাল।

ডিটেইলস পাওয়ার পর স্যামুয়েল প্রিন্সিপালকে ধন্যবাদ জানিয়ে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে এল এবং ইশিতাকে সব খুলে বলল।

“ওদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ?” ইশিতা জানতে চাইল।

“বড়লোকের ছেলে-মেয়ে ওরা। কলেজ কর্তৃপক্ষের সাহস ছিল না ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। জুতির বাড়ির লোকেশন হচ্ছে বি-৩৬, পুরান পড়া, ৭ নাম্বার বাড়ি। তুমি সেখানে যাও। আমি রায়হানের বাড়িতে যাচ্ছি, লোকেশনটা আবার দেখা নেই, সি-৮, নয়া পড়া, ১০ নাম্বার বাড়ি।” স্যামুয়েল বলল। (লোকেশনগুলো কাল্পনিক)

লোকেশন দুইটাই কাছাকাছি, তাই একসঙ্গে যাওয়াই সিদ্ধান্ত নিল তারা। স্যামুয়েল গাড়ি চালাচ্ছিল, কলেজ থেকে পঁচিশ মিনিটের দূরত্ব। সময় মতো পৌঁছে দুজন দুদিকে চলে গেল।

অনেকক্ষণ কলিং বেল বাজানোর পর অবশেষে দরজা খুলল দুজন। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তারা রায়হান বা জুতি কেউই নয়। চোখে এক ধরনের ঘুম-ঘুম ভাব ছিল তাদের। পরিচয় দেওয়ার পর দুজনকে ভেতরে আসতে বলল তারা।( দুই লোকেশনের কাহিনী একসাথে বলা হয়েছে)

_______________

“অমিত, তাদের ফোন থেকে কিছু জানতে পেরেছো?” স্যামুয়েল জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ স্যার। গত দশ দিন ধরে দুটি অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজের মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে,” অমিত জানাল।

“নাম্বার দুটি কার, তা জানতে পেরেছো?” স্যামুয়েল আবার জিজ্ঞেস করল।

“যাদের নামে নাম্বার দুটি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে, তারা আর বেঁচে নেই, স্যার,” অমিত উত্তর দিল।

“নাম্বার দু’টোর লোকেশন ট্র্যাক করতে পেরেছো?”

“হ্যাঁ স্যার, গত দশদিন ধরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় নাম্বারগুলো সচল ছিল,” অমিত বলল।

অমিত বিভিন্ন লোকেশনের তথ্য শেয়ার করতে শুরু করল। দুটি লোকেশন শুনে আরমান তাকে থামিয়ে নিজের ফোন বের করে স্যামুয়েলের দেওয়া লোকেশনের সাথে মিলিয়ে নিল। হ্যাঁ, লোকেশনগুলো মিলে গেছে।

“পেয়েছি! এই দুটি লোকেশনে বর্তমানে ইশিতা ও স্যামুয়েল অবস্থান করছে। আমাদেরও সেখানে যেতে হবে। ওই অপরিচিত নাম্বারগুলো যারা ব্যবহার করছিল, তাদের ধরতে পারলে আমরা খুনির কাছে পৌঁছাতে পারবো,” আরমান বলল।

অমিত একটি টিম নিয়ে স্যামুয়েলের অবস্থানের দিকে রওনা হলো, যা রায়হানের বাড়ির লোকেশন। আরমান নিজে ইশিতার অবস্থান যেখানে, সেখানে চলে গেল।

ইন্টারোগেশন টেবিলে দু’জনকে বসানো হয়েছে। যথাসময়ে আরমান এবং অমিত পৌঁছে তাদের গ্রেফতার করে আনা হয়। জুতির বাড়িতে যাকে পাওয়া গেছে, সে এখন স্যামুয়েলের সামনে বসে আছে। অন্যদিকে, রায়হানের বাড়ি থেকে যাকে পাওয়া গেছে, সে বসে আছে আরমানের সামনে।

“আপনি জুতি নন, জুতির সাথে আপনার সম্পর্ক কী?” স্যামুয়েল প্রশ্ন করল।

“জুতির বড় বোন আমি,” মহিলা শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন।

“জুতি এখন কোথায় আছে? কী করছে?”

“মারা গেছে তিন বছর আগে।”

“কীভাবে?”

“আ*ত্ম*হ*ত্যা করে।”

“আ*ত্ম*হ*ত্যা করার কারণ কী? আপনি কিছু জানেন?”

“কারণ তো একটাই-ছয় বছর আগের ঘটনা। ওরা আবার জুতিকে ব্ল‍্যাকমেইল করতে শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা আ*ত্ম*হ*ত্যা করতে বাধ্য হয়।”

“জুতির সাথে যা হয়েছে, তা অবশ্যই অন্যায় ছিল। কিন্তু আপনি হঠাৎ প্রতিশোধ নিতে গেলেন কেন? এত বছর পর কেন? ছয় বছর আগে বা জুতি আ*ত্ম*হ*ত্যা*র পরে নয় কেন?”

“মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমরা। বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। জুতির পাশে আমি ছাড়া কেউ ছিল না। ভেবেছিলাম সব ভুলে বোনকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করবো। তাই করলাম। হঠাৎ তিন বছর আগে একটা ঝড়ে সবকিছু শেষ হয়ে গেল। তবুও মনকে বুঝিয়ে রাখলাম- ওদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবো না। তাই এতদিন চুপ ছিলাম। হঠাৎ সুযোগ এসে গেল, সেটাকে কাজে লাগালাম।”

“কেমন সুযোগ? কী ধরনের সুযোগ?”

“কিছুদিন আগে একটা পার্সেল পেলাম। তাতে জুতির সাথে হওয়া অন্যায়ের কিছু লেখা ছিল এবং কিছু ছবি ছিল নির্যাতনের প্রমাণ হিসেবে। পার্সেল পাঠানো ব্যক্তি আমাকে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন থেকেই আমি প্রতিশোধের কাজে নেমে পড়ি।”

রায়হানের বাড়িতে রায়হানের বাবা ছিলেন। রায়হান পঙ্গু অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। রায়হানের বাবার বক্তব্যও জুতির বড় বোনের মতোই ছিল। তার কাছেও একটি পার্সেল এসেছিল। তাদের দুজনের মতে, তারা ওই চারজন বন্ধুর সাথে একটি ছোট্ট হোটেলে দেখা করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই লোকেশনে কোনো হোটেলই নেই। এর মানে সবকিছুই খুনির পূর্ব-পরিকল্পিত ফাঁদ ছিল।

তারা আরও বলেন, একজন মেয়ে ওয়েটার তাদের খাবার এনে দিয়েছিল। সেই খাবার খেয়ে তারা অজ্ঞান হয়ে যান। যখন তাদের জ্ঞান ফিরে, তখন নিজেদের বাড়ির সামনে পড়ে থাকতে দেখেন।

_________
শেষ চারজন বন্ধুর মধ্যে তিনজন মাটিতে নিথর পড়ে আছে, আর একজন মেয়ে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায়। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে খুনি, নিস্তব্ধ পরিবেশের ভেতরে কেবল তার শীতল দৃষ্টি তাদের দিকে নিবদ্ধ।

মেয়েটির জ্ঞান ফিরতেই খু*নিকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো।
“ওই দেখো নিহা, তোমার বাকি তিনজন বন্ধুকে। কীভাবে নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। দেখতে সুন্দর লাগছে না বলো?”

একটা শীতল হাসি দিল খু*নি, যে হাসিতে কোনো প্রাণ নেই, আছে শুধু হাড়কাঁপানো ভয়। নিহার ভয়ে মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।

খু*নি এবার একটা পলিথিন ব্যাগ হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে নিহার দিকে এগিয়ে আসছে, মুখে সেই ভয়ানক প্রাপ্তির হাসি।

চলবে,,,,,,

ইরোরা পর্ব-০২

0

( প্রাপ্ত বয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

#ইরোরা
#পর্ব_দুই
#কাওসার_আহমেদ

“শহরের উত্তর পাশে আরও দুটি লা*শ পাওয়া গেছে।”

ইশিতার কথা শুনে আরমান চমকে উঠল। সকালে দুটি লা*শ পাওয়া গিয়েছিল, আর এখন আরও দু’টো!

“চলো, যাই সেখানে।”

ঘটনাস্থলে পৌঁছে তারা ডক্টর মেহতাবকে আগে থেকেই অপেক্ষা করতে দেখল। আরমানকে দেখে তিনি তার দিকে এগিয়ে এলেন।

“নতুন কিছু পেলেন, ডক্টর?” আরমান জানতে চাইল।

“নতুন বলতে, খু*নের পদ্ধতি একই রকম। তবে এবার লোহার রডের বদলে লোহার বল ব্যবহার করা হয়েছে, যার আকার প্রায় ক্রিকেট বলের অর্ধেক।”

কথা বলতে বলতে তারা লাশের কাছে পৌঁছাল।

“দেখতে পাচ্ছো, প্রায় সম্পূর্ণ বলটাই শরীরের ভেতরে ঢুকে গেছে। পাশে চকলেট পাওয়া গেছে, আপেলের বদলে। তাছাড়া নতুন কিছু জানতে হলে ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে,” বললেন ডক্টর মেহতাব।

“আবারও একজন নারী ও একজন পুরুষকে খু*ন করা হয়েছে। খু*নি আসলে কী চাচ্ছে?” নিজের মনে বিরবির করে বলল আরমান।

কিছুক্ষণ পর তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করল।

দূর থেকে একজোড়া চোখ স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে ঘটনাস্থলের দিকে। সময় তখন প্রায় সন্ধ্যা।

একদিনে চারটি লা*শ পাওয়া গেছে—এমন ঘটনা শহরে গত এক বছরে হয়নি। আর খু*ন করার পদ্ধতি? সেটিও অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। আরমান এই নিয়ে ভাবছিল, খু*নে*র পদ্ধতি সম্পর্কে অনলাইন এবং পুরনো কেস ফাইলগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না, খু*নে*র কৌশলটি সম্পূর্ণ নতুন।

ইশিতার আগমনে তার ভাবনার মধ্যে ছেদ পড়ল।
“চারজন ভিকটিমের মধ্যে তিনজনের নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা রয়েছে এবং তারা বর্তমানে সেই ব্যবসা পরিচালনা করছিল। অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই তিনজন একে অপরের বন্ধু। চতুর্থ ভিকটিম একজন স্কুল শিক্ষক,” একটি ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলল ইশিতা।
“বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। তিনজন বন্ধুকে একসঙ্গে খু*ন, যার মধ্যে দুজন মেয়ে। আর একজন স্কুল শিক্ষক। খু*নি আসলে কী চায়? কেসটা যেন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আরও গভীরে তদন্ত করতে হবে।”
“ভিকটিমদের অতীত জীবন নিয়ে বাকিরা কাজ করছে, কিছুটা সময় লাগবে। তবে…” ইশিতা কথা শেষ করার আগেই আরমানের ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সে দেখল ডক্টর মেহতাবের কল। ইশারায় ইশিতাকে থামতে বলে সে ফোনটি রিসিভ করল। ডক্টর মেহতাব তাকে ল্যাবে আসতে বললেন।

“চারজন ভিকটিমের মধ্যে তিনজনের শরীরে ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে, এবং উভয়েই একই ধরনের ওষুধ সেবন করেছে। এছাড়া, তাদের শরীরে সামান্য পরিমাণে অ্যালকোহলও পাওয়া গেছে। চতুর্থ ভিকটিম বাকিদের থেকে আলাদা। আর হ্যাঁ, আপেল ও চকলেটের মধ্যেও সেই তিনজনের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে,” বললেন ডক্টর মেহতাব।

“ঘুমের ওষুধের মধ্যে কোনো বিশেষত্ব আছে? যেমন—অনেক শক্তিশালী বা সহজে পাওয়া যায় না এমন কিছু?” জানতে চাইল আরমান।

“শক্তিশালী তো বটেই, তবে সহজেই পাওয়া যায়। এ ধরনের ওষুধ সাধারণত তাদেরই দেওয়া হয়, যাদের বেশ কিছুদিন ধরে ঠিকমতো ঘুম হয় না।”

“ধন্যবাদ, ডক্টর।”

ফরেনসিক ল্যাব থেকে বের হয়ে তারা গন্তব্যের দিকে রওনা হলো। যাওয়ার সময় ইশিতা জিজ্ঞেস করল,
“এই চতুর্থ ভিকটিমের হিসাবটা বুঝতে পারছি না। খু*নি কি তাকে ভুল করে খু*ন করেছে?”

“খু*ন ইচ্ছে করেই করেছে। নিশ্চয়ই কোনো পাপ করেছে, কিন্তু খু*নে*র পদ্ধতিটা আলাদা। হয়তো খু*নি ইচ্ছে করেই আলাদা পদ্ধতিতে খু*ন করেছে যাতে আমরা তাকে নিয়ে ভাবতে সময় নষ্ট করি, আর সে অন্যদিকে সহজেই তার কাজ চালিয়ে যেতে পারে।”

কিছুক্ষণ পর তারা পুলিশ স্টেশনে পৌঁছালে অফিসার অমিত এসে জানায়…
“স্যার, পুরনো ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা ফাইল পেয়েছি। তিনজন ভিকটিমসহ মোট সাতজনের বিরুদ্ধে রাফিত নামের এক ছেলেকে মা*রা*র জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছিল।”
“কতদিন আগে এই মামলা করা হয়েছিল?” প্রশ্ন করল আরমান।
“প্রায় এক বছর আগে। তারা পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছিল, তখনই রাফিতকে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়,” উত্তর দিয়ে ইশিতার দিকে তাকিয়ে অমিত আবার বলতে শুরু করল, “ম্যাম, আপনি তিনজন ভিকটিমের বাকি বন্ধুদের খোঁজ নিতে বলেছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ওই সাতজন ছাড়া তাদের আরও তিনজন বন্ধু ছিল। তিনজন মা*রা গেছে, সাতজন এখনো বেঁচে আছে।”
“এক মিনিট, দশজন বন্ধুদের মধ্যে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল, তাহলে বাকি তিনজন?”
“বাকি তিনজন সেদিন পাহাড়ে যায়নি, তারা হোটেলেই ছিল। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, রাফিতের পরিবার মামলার রায় পেতে যাচ্ছিল। কিন্তু দুই মাস আগে হঠাৎ করে মামলা তুলে নেওয়া হয়।”

অমিতের শেষ কথা শুনে আরমান হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ইশিতার দিকে ঘুরে বলল,
“আমি রাফিতের পরিবারের সাথে দেখা করতে চাই। তুমি ওই সাতজন বন্ধুর খোঁজ নিয়ে তাদের এখানে নিয়ে আসো। খু*নি*র পরবর্তী টার্গেট হতে পারে ওই সাতজনের মধ্যে কেউ একজন, কিংবা দু’জনও হতে পারে।”
“ওকে, অমিত চলো আমরা কাজে লেগে পড়ি।”
____________________

রাত দশটা ছয় মিনিট। কলিং বেল বাজছে। ওয়াশরুমে থাকায় দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে দরজা খুলতেই পরিচিত এক মুখ, বললেন,
“কেতজি, কেতজি স্যামুয়েল!”
“স্যার! আপনি হঠাৎ?”
“এই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম দেখা করে যাই। দিনকাল কেমন যাচ্ছে?”
“ভালোই চলছে, স্যার।”
“ভালোই তো চলার কথা। শহরে যে চারটা খু*ন হয়েছে! ঘটনাস্থলে গিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, স্যার। গিয়েছিলাম।”
“কোনো কিছু জানতে পেরেছো?”
“সুখে থাকলে ভূতে কিলায়, একটা কথা আছে না স‌্যার? এদের ক্ষেত্রেও সেইম। টাকা থাকায় পাপ তাদের কিলাচ্ছে।”
“তাহলে এখন থেকে বাকিদের সঙ্গে মিশে কাজ শুরু করো।”
“এখন থেকে?” অবাক হয়ে বলল স্যামুয়েল।
“হ্যাঁ, কোনো সমস্যা?”
“না স্যার, কোনো সমস্যা নেই।”
“তাহলে আজ উঠি,” বলে চলে গেলেন।

উনার নাম আরিয়ান, উপর মহলের লোক। আমি একজন ডিবি অফিসার। আমার কাজ করার পদ্ধতি একটু আলাদা। অন্য এক কেসের জন্য শহরের সাম্প্রতিক খুনগুলোর ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। এখন স্যার যেহেতু বলেছেন সেগুলোর তদন্তে নিজেকে জড়াতে, তাহলে তো করতেই হবে।

_____________________

সাতজন বন্ধুর মধ্যে পাঁচজনকে পুলিশ স্টেশনে আনা হয়েছে, বাকী দুজন নিখোঁজ।
“কবে থেকে দুজন মিসিং?” আরমান জিজ্ঞাসা করল।
“যেদিন রিয়া, রাকিব আর রাইছার লা*শ পাওয়া যায়, তার আগের দিন থেকে,” একজন উত্তর দিলো।
“তোমরা সেদিন সবাই মিলে ম*দ খেয়েছিলে?”
“হালকা খেয়েছিলাম, স্যার।”
“অনেকদিন তো তোমাদের একসাথে দেখা হয়নি। হঠাৎ সেদিন দেখা করার কারণ কী?”
“বন্ধুদের সাথে দেখা করতে আবার কারণ লাগে নাকি?”
“কারণ তো লাগার কথা না। তবে তোমাদের অতীত তো বলে যে সেদিনের দেখা করার পেছনে কিছু ছিল। যাই হোক, সেটা বাদ দাও। এবার বলো, রাফিতের পরিবার হঠাৎ করে মামলা তুলে নিল কেন?”
“স্যার, বিশ্বাস করুন, আমরা কিছুই জানি না। এমনকি অতীতেও আমরা কিছু করিনি, যার জন্য আমাদের বন্ধুদের এত ভ*য়*ঙ্ক*র মৃ*ত্যু পেতে হবে।”

আরমান তাদের কথা শুনে হালকা হাসল, কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই পেছন থেকে কণ্ঠ ভেসে এল,
“পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাপ ভর্তি তোমাদের। এখনও সময় আছে, সত্যিটা বলো।”

আরমান পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে স্যামুয়েল দাঁড়িয়ে।
“কেতজি স্যামুয়েল! তুমি এখানে?”
“তোমাদের খোঁজ নিতে আসলাম,” স্যামুয়েল এবার ওই পাঁচজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা ম*র*লেও আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। কয়েক মাস তদন্ত করবো, যদি কোনো সমাধান না পাই, কেস বন্ধ করে দেবো। যা ক্ষতি হবে, তা তোমাদেরই। সময় থাকতে সত্যিটা বলো।”

পাঁচজন একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
“তোমাদের দুজন বন্ধু নিখোঁজ। কাল সকালে তাদের মৃ*ত*দে*হ পাওয়া যাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমরা আজীবন তোমাদের সিকিউরিটি দিতে পারবো না। বাড়ি যাও, ভালো করে ভেবে সত্যিটা জানিও।”

স্যামুয়েল আরমানকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। অফিসটা ভালো করে দেখছে স্যামুয়েল—অনেকদিন পর এখানে এসেছে। স্যামুয়েলকে দেখে বাকিরা তার দিকে তাকিয়ে আছে, অবশ্যই কারণ আছে। ইশিতা দৌড়ে এসে স্যামুয়েলকে অভিনন্দন জানালো ফিরে আসার জন্য।

“কাজে ফিরে যাই। প্রথমে রাফিতের বিষয়টা পরিষ্কার করি। রাফিতের একটা বোন আছে, যে দশম শ্রেণিতে পড়ে। রাকিব তার জীবন নষ্ট করে দেওয়ার হুমকি দেয়, যার ফলেই রাফিতের পরিবার মামলাটা তুলে নিতে বাধ্য হয়,” স্যামুয়েল একটু থামল। এরপর ল্যাপটপে পেনড্রাইভ কানেক্ট করে স্ক্রিনে একটা মেয়ের ছবি দেখিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “মেয়েটির নাম শাহানা। তাকে পাঁচ মাস আগে খু*ন করা হয়।” দ্বিতীয় ছবিতে একটা ছেলের ছবি দেখিয়ে বলল, “ছেলেটার নাম আফনান। তাকেও মেয়েটির মতো সাত মাস আগে মে*রে ফেলা হয়।” এরপর স্ক্রিনে একটা পুরুষ ও মহিলার ছবি দেখিয়ে স্যামুয়েল বলল, “এদের দশ মাস আগে খু*ন করা হয়। এরা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী, এবং তাদের একটা আঠারো বছরের ছেলেও আছে।”

“তাদের সবাইকে খু*ন করার কারণ হলো, তারা ওই দশজন বন্ধুর কুকর্মের বিষয়ে জেনে গিয়েছিল। সেই কুকর্মগুলো ছিল-ড্রা*গ*স বিক্রি করা, বিদেশে নারী পা*চা*র করা, এবং অনাথ বা পথশিশুদের শরীরের বিভিন্ন অ*ঙ্গ*প্র*ত্য*ঙ্গ বিক্রি করা।”

এইটুকু বলে স্যামুয়েল থামল।

স্যামুয়েলের কথা শুনে ইশিতা আরমানের দিকে তাকিয়ে বলল, “এদেরকে হ*ত্যা*র জন্য বেশ কয়েকজনের কাছে শক্ত কারণ আছে। যদি সবাই তাদের খু*ন করতে চায়, তাহলে খু*ন করার পদ্ধতি একরকম হলো কীভাবে?”

“হতে পারে অপরাধীরা চাইছে যেন মনে হয় খু*নি একজন। রিয়াকে হ*ত্যা*র পর যেভাবে তাকে মা*রা হয়েছে, বাকিরা সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে রাকিব ও রাইছাকে হ*ত্যা করেছে,” আরমান যুক্তি দিলো।

“হতে পারে,” ইশিতা সম্মত হলো।

“কিন্তু আসলে এমন কিছুই ঘটেনি,” তাদের কথার মধ্যে কেতজি হঠাৎ বলল। “প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম ওই দশজন বন্ধু একসাথে অপরাধ করেছে, কিন্তু না। রিয়া, যাকে আগেই হ*ত্যা করা হয়েছে সে, এবং যারা নিখোঁজ, তাদের মধ্যে নাহিদ কোনো অপরাধ করেনি। তা ছাড়া বাকী পাঁচজনেরও কোনো অপরাধ খুঁজে পাইনি। অপরাধ করেছে রাইছা, রাকিব এবং লিমন। লিমনও নিখোঁজ। রাইছা, রাকিব ও লিমন তাদের অপরাধ কে এমন ভাবে সাজিয়েছে যাতে দশজন বন্ধুকেই অপরাধী মনে হয়। প্রকৃত পক্ষে অপরাধী ছিল তিনজন। কিন্তু বাকীরাও কিছু না কিছু অপরাধ করেছে যা আমাদের চোখের সামনে আসছে না। আমি ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাপে ভর্তি’ বলেছি কারণ ওরা যাতে ওদের বন্ধুদের কুকর্ম স্বীকার করে নেয়।”

“তিনজন এত বড় বড় অপরাধ করল অথচ কেউ কিছু বুঝতেই

পারলো না,” ইশিতা অবাক হয়ে বলল।

“সবকিছুই কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে,” আরমান মাথা নাড়ল।

এমন সময় অফিসার অমিত এসে খবর দিলো, “স্যার, নাহিদ ও

লিমনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।”

“ঠিক আছে, তুমি যাও,” ইশিতা তাকে নির্দেশ দিলো।

“খু*নি কে এবং খু*নে*র কারণ কী, সেটা কীভাবে জানবো?” আরমান মাথায় হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল।

“খু*নি কে এবং খু*নের কারণ কী, সেটা আমাদের খু*নি নিজেই জানাবে, তার খু*নে*র মাধ্যমে। এটা শুধু সময়ের অপেক্ষা,” স্যামুয়েল নির্ভার কণ্ঠে উত্তর দিল।

স্যামুয়েলের কথা শুনে আরমান ও ইশিতা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

“এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সময় হলে সব ঠিক বুঝতে পারবে। তৈরি থেকো, সকালে আমাদের দুটো লা*শে*র সাথে দেখা করতে হবে,” স্যামুয়েল সতর্ক করে দিয়ে চলে গেল।

আরমান ও ইশিতা ভালো করেই জানে, সকালে তারা নাহিদ ও লিমনের লা*শ পাবে।

চলবে,,,,,,

ইরোরা পর্ব-০১

0

#ইরোরা
#পর্ব_এক
#কাওসার_আহমেদ

( ১৮+ এ্যালার্ট , প্রাপ্ত বয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

এক পিস আপেল মুখে দেওয়ার পর সে বুঝতে পারলো একটু আগে যাকে খু*ন করেছে তার র*ক্ত লেগেছিল আপেলে। যাকে খু*ন করল তার র*ক্ত খেয়েও মনে শান্তি নেই। এরচেয়ে ভ*য়*ঙ্ক*র কিছু করতে পারলে তার শান্তি লাগবে।

সে ধীরে ধীরে অন্য রুমের দিকে পা বাড়াল। ঘরের ভেতরে একটি মেয়ে চেয়ারে শক্ত করে বাঁধা ছিল, নিস্তব্ধতার মাঝে তার অসহায় শরীরটাও যেন ঘরের একাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগন্তুক মেয়েটির পিছনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়াল, যেন ছায়ার মতো উপস্থিতি। কিছুক্ষণ পর মেয়েটির জ্ঞান ফিরল। তার চোখ খুলতেই চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সে এক সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় আছে।

ঠিক তখনই আগন্তুক ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি আগন্তুককে দেখে হতবাক হয়ে গেল, তার চোখ ভয়ে বড় হয়ে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল, — “তু… তু… তুমি?”

একটা অদ্ভুত হাসি নিয়ে আগন্তুক উত্তর দিল, –“হ্যাঁ, আমি।”

মেয়েটির মুখে বিস্ময়ের ছাপ আরও গভীর হলো। –“তুমি কীভাবে? না, এটা সম্ভব নয়… র*ক্ত, র*ক্ত কেন তোমার জামায়?”

ঠাণ্ডা স্বরে আগন্তুক বলল, –“একজনকে খু*ন করে আসলাম। তার তাজা র*ক্ত লেগে আছে জামায়।”

মেয়েটি কাঁদো কাঁদো গলায় আকুতি করে বলল, –“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে মুক্তি দাও!”

মেয়েটির কথা শুনে আগন্তুকের মুখে বিকৃত এক অট্টহাসি ফুটে উঠল। সে পাগলের মতো জোরে শব্দ করে হাসতে লাগল, যেন মেয়েটির দুর্দশা তাকে অদ্ভুত আনন্দে ভরিয়ে তুলছে। হাসি থামিয়ে আগন্তুক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বাম দিকে ইশারা করে বলল, –“ওই যে, দেখছো? একটা আপেল দেখা যাচ্ছে। তুমি যদি সেটা আনতে পারো, তবে তোমার মুক্তি।”

মেয়েটির মুখে কিছুটা আশার ঝলক দেখা গেল। কিন্তু তার পা শিকল দিয়ে বাঁধা ছিল। আগন্তুক ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মেয়েটাকে চেয়ার থেকে মুক্ত করে দিল, তবে তার হাত এবং পা তখনও বাঁধা ছিল। হাঁটা সম্ভব, কিন্তু পুরোপুরি মুক্তি পায়নি সে। আপেলের দিকে তাকিয়ে সে এক মুহূর্ত দ্বিধায় ভুগল, তারপরই এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল।

ঠিক তখনই আগন্তুক হেসে বলল, –“তোমাকে দৌড়ে যেতে হবে, আবার দৌড়ে ফিরে আসতে হবে।”

আগ্রাসী কণ্ঠস্বর শুনে মেয়েটির হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকল। জীবন বাঁচানোর তাগিদে সে কোনোরকম দ্বিধা না করে দৌড় দিল। আপেলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই হঠাৎ পা আটকে মেয়েটি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। শিকলের অন্য প্রান্ত ঘরের এক পাশে শক্ত করে বাঁধা ছিল, আর সেই দূরত্ব আপেলের দূরত্বের চেয়ে কম ছিল। নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য সে কিছু না ভেবে দৌড় দিয়েছিল, কিন্তু শিকলের বাঁধা তাকে আরও অসহায় করে তুলল।

পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মেয়েটি তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। পায়ের গোড়ালিতে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে, যেন গোড়ালিটা ভেঙে গেছে। মেঝেতে শুয়ে অসহায়ভাবে কাতরাতে লাগল সে, আর আগন্তুক দূর থেকে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে বিকৃত আনন্দে মগ্ন হয়ে রইল।

ধীরে ধীরে আগন্তুক মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেল। সে মেয়েটির দিকে ঝুঁকে নিচু গলায় প্রশ্ন করল, –“আপেলটা এখনও তার জায়গাতেই রয়েছে। তুমি সেটা হাতে নিতে পারলে না কেন?”

মেয়েটি অসহায়ভাবে কাঁপতে কাঁপতে বলল, –“আমি আপেল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি। আমার পা শিকল দিয়ে বাঁধা, শিকলের দৈর্ঘ্য আপেল পর্যন্ত পৌঁছায় না।”

অপরিচিত আগন্তুক ঠাণ্ডা স্বরে উত্তর দিল, –“আমি সেটা জানি না, আর তোমার অজুহাত আমার একেবারেই পছন্দ নয়। তুমি কীভাবে আপেল আনবে, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি শুধু সেই আপেলটা তোমার হাতে দেখতে চাই।”

এই কথা বলতে বলতে সে হঠাৎ মেয়েটির পায়ের গোড়ালিতে পা দিয়ে আ*ঘা*ত করতে শুরু করল। একের পর এক আ*ঘা*তে মেয়েটির গোড়ালিতে ব্যথা আরও তীব্র হতে লাগল। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে অনুনয় করতে লাগল, –“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দাও! আমি আপেল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছি না। এটা আমার সাধ্যের বাইরে। দয়া করে, তুমি বুঝার চেষ্টা করো। আমাকে মুক্তি দাও, প্লিজ!”

কিন্তু আগন্তুকের মুখে কোনো দয়া দেখা গেল না। তার আঘাত অব্যাহত রইল, আর মেয়েটির কাতর কণ্ঠস্বর ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

আগন্তুক তার কাজ শান্তভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। ভেতরে প্রচণ্ড রাগ থাকলেও তা চেহারায় প্রকাশ না করে, সে সেই রাগ আ*ঘা*তে*র মাধ্যমে প্রকাশ করছে।

মেয়েটির আকুতি শোনার কোনো চেষ্টা না করে আগন্তুক শিকল ধরে টেনে মেয়েটাকে চেয়ারের কাছে নিয়ে এলো। ইশারায় তাকে চেয়ারে বসতে বলল। মেয়েটা অনেক কষ্টে চেয়ারে বসল, মুখে এখনও আ*ত*ঙ্ক আর আকুতির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু আগন্তুকের নজর সেদিকে নেই। ঘরজুড়ে এক অসম্ভব নিরবতা। সেই নীরবতা ভেঙে আগন্তুক হঠাৎ বলল,
–“কেমন হয় যদি তোমার ক*লি*জা*টা বে*র করে আনি?”

কথাগুলো শুনে মেয়েটির আ*ত্মা কেঁপে উঠল। আগন্তুকের মুখে নিষ্ঠুর এক হাসি ফুটল। এবার সে বলল,
–” নিজের কাপড় খুলে ফেলো।”

মেয়েটা আ*ত*ঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বলল, –“প্লিজ, এমন করো না। আমার পায়ে প্রচণ্ড ব্য*থা করছে, আমি খুব কষ্টে আছি।”

মেয়েটার কথা শেষ হতে না হতেই আগন্তুক গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে এক থাপ্পড় মারল। থাপ্পড়ের আঘাতে মেয়েটির নাক দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করল। এবার সে মেয়েটার গলায় হাত রেখে চাপ দিতে দিতে বলল,
–“আমি যা বলছি, তাই কর। এখানে তুমি আমার কথা শুনতে বাধ্য, আর আমি যা চাই, সেটাই হবে। আমার আদেশ অমান্য করলে ফল আরও ভ*য়*ঙ্ক*র হবে।”

গলা ছেড়ে দিয়ে মেয়েটাকে হাঁপাতে দিল সে। মেয়েটি কষ্টে, ব্যথায়, কাঁদতে কাঁদতে বলল, –“পানি… দয়া করে, একটু পানি দাও।”

কিন্তু আগন্তুক তার দিকে তাকিয়েও পানি দিল না। সে আবার ধীর কণ্ঠে বলল,
–“কিছু মনে পড়ছে, রিয়া?”

মেয়েটা এবার ভয়ে ঢোক গিলল, আ*ত*ঙ্কে স্তব্ধ হয়ে রইল।

মেয়েটার চেহারা দেখে আগন্তুক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বলল, –“নিজের অতীত মনে পড়ছে, রিয়া? একবার নিজেই ভেবে দেখো, তোমার জন্য কী শাস্তি প্রাপ্য। কেমন হয় যদি তোমাকে বি*ব*স্ত্র অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দিই, অচেতন করে ছেড়ে দিই যেন সবাই তোমাকে দেখুক?”

এই কথা বলেই আগন্তুক পাগলের মতো হাসতে লাগল। তার হাসি থামার নাম নেই। মেয়েটা কিছু না বললেও মনে মনে বুঝে গেছে, আগন্তুকের হাত থেকে তার আর রক্ষা নেই। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আগন্তুক হাসি থামিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“তুমি না একজন বিজনেস ম্যানের মেয়ে! তাহলে তোমাকে দিয়ে বিজনেস করলে কেমন হয়?”

মেয়েটা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, –“কেমন বিজনেস? তুমি কী করতে চাচ্ছো?”

আগন্তুক হেসে বলল, –“ভালো কিছু আশা করো না। অনেক কিছু করা যায়। শরীরের বিভিন্ন অ*ঙ্গ বিক্রি করা, তোমাকে দিয়ে দে*হ*ব্য*ব*সা চালানো—আরও কত কিছু!”

এই কথাগুলো বলেই আবারও আগন্তুক পাগলের মতো হাসিতে মেতে উঠল।

আগন্তুক এবার মেয়েটির পাশে বসে বলল, –“অনেক ব্যথা হচ্ছে, তাই না?”

মেয়েটি কষ্টের স্বরে বলল, –“হ্যাঁ, হু হু… খুব।”

আগন্তুক ঠাণ্ডা গলায় বলল, — “এগুলো কিছুই না, অন্তরের ব্যথার কাছে এগুলো কিছুই না।”

তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বলল, –“তোমাকে বলেছিলাম, যতটুকু পারো, কাপড় খুলে ফেলতে। কিন্তু তুমি তা করোনি। কেন? লজ্জা লাগছে? কিন্তু যখন তোমার বয়ফ্রেন্ডের কাছে নিজের শরীর বিলিয়ে দিয়েছিলে, তখন তো কোনো লজ্জা লাগেনি!”

এটা বলে আগন্তুক ঘরের এক কোণায় চলে গেল। মেয়েটির দু’পায়ে ও দু’হাতে শিকল বাঁধা। শিকল দিয়ে আটকানো থাকলেও মেয়েটি চাইলে আগন্তুককে আঘাত করতে পারত, কিন্তু তার শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই।

আগন্তুক এবার মেয়েটাকে শক্ত করে চেয়ারে আবার বেঁধে ফেলল, যাতে মেয়েটি নড়াচড়া করতে না পারে। তার পাশেই একটা ব্যাগ রাখল। ব্যাগটা দেখেই মেয়েটা আতঙ্কে ঢোক গিলে বলল,
— “তুমি যা বলবে তাই করব, প্লিজ ব্যাগটা সরিয়ে নাও। তুমি তো কাপড় খুলতে বলেছিলে, আমাকে সুযোগ দাও। আমি এখনই খুলছি।”

আগন্তুক মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে একবার হেঁসে বলল,
–“হাহ! কাপড়! সেটা আর খুলতে হবে না। আমি কাপড় খুলতে বলেছিলাম শুধু তোমার অতীতটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।”

এটা বলে, আগন্তুক ব্যাগ থেকে একটা ছোট লোহার রড বের করল। সঙ্গে আগুন জ্বালানোর যন্ত্রও বের করল। ধীরে ধীরে রডটা গরম করতে লাগল, আর মেয়েটার ভয়ের চাহনির দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা হাসি হাসল।

রডটা যখন গরম হয়ে লালচে রক্তবর্ণ ধারণ করল, ঠিক তখনই আগন্তুক সেটি মেয়েটার হাতে চেপে ধরল। মেয়েটা ব্যথায় চিৎকার করে উঠল, কিন্তু নিজেকে ছাড়াতে পারল না। আস্তে আস্তে আগন্তুক মেয়েটার দুই হাতে বেশ কয়েকটি জায়গায় আঘাত করল। মেয়েটার আত্নচিৎকার যেন আগন্তুকের জন্য নিখাদ আনন্দের উৎস হয়ে দাঁড়াল।

এক পর্যায়ে আগন্তুক নির্যাতন থামিয়ে দিল। মেয়েটা আধমরা অবস্থায় চেয়ারে পড়ে রইল, শরীরে কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই। আগন্তুক তার চেহারার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলল,
— “এই চেহারা নিয়ে তোমার তো অনেক অহংকার ছিল, তাই না? এখন যদি এই চেহারা খাবলে ছিঁড়ে ফেলি, কেমন হবে? কেমন হবে যদি প্রতিদিন এভাবেই তোমাকে আঘাত করতে থাকি?”

মেয়েটির শরীরে আর তেমন কোনো চেতনা অবশিষ্ট নেই, কিছু বলার শক্তি তার আর নেই। শুধু নিরুপায়ভাবে আগন্তুকের কথা শুনছে আর তার অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করছে। এবার আগন্তুক ব্যাগ থেকে একটি ড্রিল মেশিন বের করল। মেশিনটি চালু করে সেটি মেয়েটার বুক থেকে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি দূরত্বে ধরে রাখল। মেয়েটার মনে খুব ইচ্ছে করছিল বলতে, “প্লিজ, দয়া করো। আমি আর পারছি না। আজকের মতো ছেড়ে দাও।” কিন্তু সে কথা বলার শক্তিটুকুও তার নেই।

এক পর্যায়ে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ল।

_______________

–“বাড়িটা বছরখানেক ধরে বন্ধ।”
— “বাড়ি বন্ধ থাকলেও এখানে মানুষের আনাগোনা ছিল। হতে পারে একজন, দুজন, কিংবা একাধিকজন। তবে পুরো বাড়ির মধ্যে শুধুমাত্র দুই রুমেই আনাগোনা হয়েছে। দেখো, রুম দুটো কতটা পরিষ্কার।” –“নির্জন এলাকা। অপরাধী বেশ ভালো জায়গা বেছে নিয়েছে।”
–“তা তো বটেই। তুমি ওই কাজের লোকটাকে জিজ্ঞেস করো যে আমাদের খবর দিয়েছিল। আর হ্যাঁ, বাড়িওয়ালার ডিটেইলস চাই আমার সাথে ভিকটিমদের।”
–“ঠিক আছে।”

ইশিতা চলে গেল। আরমান ফরেনসিক টিমের দিকে এগোল। বেশ কিছুক্ষণ হলো ডিবি পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছে। একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে দুটি খু*ন হয়েছে। একজন পুরুষ ও অন্যজন মহিলা।

–“ডক্টর মেহতাব, কিছু পেলেন?” আরমান প্রশ্ন করল।
— “না ভাই, তেমন কিছু পাইনি। অপরাধী বেশ চতুরতার সঙ্গে কাজ করেছে। কোনো প্রমাণ ছেড়ে যায়নি। তবে দু’টি খু*ন আলাদাভাবে করা হয়েছে,” ফ্রেন্ডলি মেজাজে বললেন ডক্টর মেহতাব।
–“পুরুষ ভিকটিমকে গলায় ছু*রি দিয়ে আ*ঘা*ত করে হ*ত্যা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট ছু*রি*র আ*ঘা*ত করা হয়েছে, তারপর সেই ক্ষতস্থানে লবণ-মরিচ লাগানো হয়েছে। মহিলাকে হত্যা করার আগে তাকে ভয়ানকভাবে নি*র্যা*ত*ন করা হয়েছে। তার দু’পায়ের গোড়ালি ভেঙে গেছে, আর হাতগুলো গরম কিছু দিয়ে পোড়ানো হয়েছে। এরপর ড্রিল মেশিন দিয়ে তার বুকের বাঁ পাশে ছি*দ্র করা হয়েছে এবং ডান পাশে একটা ছোট গরম রড ঢু*কি*য়ে দেওয়া হয়েছে। ড্রিল মেশিন দিয়ে করা ছিদ্রটা লক্ষ্য করো, এত বড় যে দু’টো আঙুল সহজেই ঢুকে যাবে। এমনকি এপাশ থেকে ওপাশও দেখা যাচ্ছে। ডান পাশে এখনও রডটা গেঁথে রয়েছে। মুখের ওপর আঁচড়ের চিহ্ন রয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো জন্তুর নখ দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। রক্তের কথা তো বললামই না। ভাবছি, মেয়েটা যদি জীবিত থাকা অবস্থায় এসব করা হয়ে থাকে, তাহলে কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে।” আবারও বললেন ডক্টর মেহতাব।
–“খু*নি*র মনে এদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ছিল। আপেলটা, ওই আপেল থেকে কিছু জানতে পারলেন, ডক্টর?”
— “এখনো কিছু পাইনি। আপাতত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।”

জায়গাটি ভালোভাবে তদন্ত শেষে পুলিশ ও ফরেনসিক টিম স্থান ত্যাগ করল। তবে অজান্তেই, আড়াল থেকে কেউ একজন সমস্ত কিছু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল।
চলবে,,,,,

প্রেমপরশ পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৫ ( শেষ পর্ব )

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তূর্ণ উত্তর দিল না আরোহীর প্রশ্নের। বরং মেয়েটার হাতটা আরও জোরে মুচড়ে ধরে বলল,

“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে। এড়িয়ে চলছিস কেন আমাকে? সমস্যা কি তোর?”

আরোহী হাতের ব্যথায় দিশেহারা হয়ে উঠলো। আঁখি দ্বয় ভরে উঠলো মুহুর্তেই। নিজেকে তূর্ণের বাঁধন থেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেও পারলো না। শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নিল সব সত্যি বলে দিবে। তারপর যা হবার হবে। তূর্ণ রেগে গেলে না হয় ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যাবে তার কাছে। ভালোবাসা তো কোনো অপরাধ নয়। আর এই ভালোবাসার ক্ষেত্রে করো হাতও থাকে না। কখন কাকে কার ভালো লেগে যাবে কেউ জানে না। তাছাড়া এভাবে আত্মীয় এবং কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় তূর্ণের থেকে তার বেশিদিন লুকিয়ে থাকাও সম্ভব না। মেয়েটা নিজের চোখ বন্ধ করে নিল। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে ধাতস্থ করলো নিজেকে। অতঃপর বলল,

“আমি আপনাকে ভালোবাসি তূর্ণ ভাই।”

তূর্ণ চমকালো। হাতটা আলগা হয়ে এলো তার। সে কি সত্যি শুনছে নাকি ভুল? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না ছেলেটা। হতবাক স্বরে বলল,

“কি বললি আবার বল তো।”

আরোহী পিটপিটিয়ে খুললো চোখ জোড়া। আমতা আমতা করে বলল,

“আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাইনি তূর্ণ ভাই। তবুও কিভাবে কিভাবে যেন হয়ে গেল নিজেও জানি না।”

থামলো মেয়েটা। জ্বীহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ ভিজিয়ে ফের বলল,

“আমাকে মাফ করে দিন তূর্ণ ভাই। আমি জানি আমি ভুল করেছি। ছোট ছোটবেলা থেকে যাকে ভাই ভাই বলে মুখে র’ক্ত তুলেছি তাকে এভাবে ভালোবাসা নিশ্চই অপরাধ। তবে আমি চেষ্টা করছি আপনাকে ভোলার। তাই তো আপনার থেকে দূরে দূরে থাকছি, এড়িয়ে চলছি।”

তূর্ণ মন দিয়ে শুনলো আরোহীর বলা সব কথাগুলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে সে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার মুখ পানে। অতঃপর হুট করেই তার হাত টেনে পা বাড়লো নিচের দিকে। হকচকিয়ে উঠলো আরোহী। ভয় জাগলো হৃদয়ে। এই ছেলে তাকে টেনে নিয়ে নিচে যাচ্ছে কেন? এখন কি তূর্ণ তার এই ভালোবাসার কথা সবাইকে বলে দিবে? বাড়ির সবাই কথাটা জানতে পারলে নিশ্চই ঝামেলা হবে। তাকে খারাপ ভাববে সবাই। দুই পরিবারের মধ্যে একটা মনমালিন্যের সৃষ্টি হবে। আর ইরা এবং আরুশ! তারা তো তাকে মে’রে’ই ফেলবে। আরোহী ভীত হলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,

“আপনি কি সবাইকে এ কথা বলে দিবেন তূর্ণ ভাই? দয়া করে কাউকে কিছু বলিয়েন না। তাহলে যে ঝামেলা হয়ে যাবে অনেক।”

তূর্ণ যেন কিছুই শুনলো না। আগেই মতোই আরোহীর হাত টেনে ধুপধাপ পা ফেলে হাঁটছিলো। মেয়েটা দিশেহারা হয়ে উঠলো। নিজের উপর নিজের রাগ লাগলো ভীষণ। তাকে ভালো মানুষী করে সব সত্যি কে বলতে বলেছিল? এখন পড়লো তো বিপদে। আরোহীর কান্না পেল ভীষণ। ধুপ করে সে বসে পড়লো মেঝেতে। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,

“আমি আপনাকে আর ভালোবাসবো না তূর্ণ ভাই। তবুও দয়া করে বাড়ির কাউকে কিছু বলবেন না। মা জানতে পারলে নির্ঘাত মে’রে ফেলবে আমাকে।”

তূর্ণ পাশ পিছন ঘুরে তাকালো আরোহীর পানে। থমথমে কণ্ঠে বলল,

“কাকে কি বলবো না বলবো তা পরে দেখা যাবে। আগে নিচে চল।”

“আমি কোথাও যাব না। আমি এখানেই বসে থাকবো। আপনি বাড়িতে ফিরে যান।”

“কথা বাড়াস না আরোহী। উঠে নিচে চল বলছি।”

তূর্ণের শক্ত কণ্ঠস্বর। আরোহী তবুও উঠলো না। ঠাঁয় বসে থেকে বলল,

“আপনি এমন কেন করছেন তূর্ণ ভাই। বলছি তো আমি আপনাকে আর ভালোবাসবো না। নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করবো। আপনার থেকে সবসময় দূরে থাকবো।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো তূর্ণ। হুট করেই কোলে তুলে নিল মেয়েটাকে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,

“তোর যা বলার বলে দিয়েছিস। এরপর তুই আমার থেকে দূরে যাবি নাকি কাছে আসবি তা আমি ঠিক করবো তুই না।”

ইরা বসার কক্ষের সোফায় বসে টিভি দেখছিলো। হঠাৎ আরোহীকে তূর্ণর কোলে আসতে দেখে চমকালো সে। টিভি বন্ধ করে দ্রুত ছুটে গেল মেয়ের পানে। ব্যস্ত হয়ে শুধালো,

“কি হয়েছে ওর? তুই ওকে কোলে নিয়েছিস কেন? পড়ে ব্যথা ট্যাথা পেয়েছে নাকি?”

তূর্ণ আরোহীকে কোলে থেকে নামিয়ে দিল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“তোর কি হয়েছে তুই ই বল।”

আরোহী আমতা আমতা শুরু করলো। জোরপূর্বক হেসে বলল,

“কই কিছু না তো।”

ইরা ভ্রু কুঁচকালো। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো তূর্ণ। একটু সময় নিয়ে বলল,

“আমি আর আরোহী দুজন দুজনকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই।”

তূর্ণের কথায় চমকে উঠলো আরোহী এবং ইরা দুজনেই। এ ছেলে এসব কি বলছে? আরোহীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। শুধুমাত্র সেই নয় তূর্ণও ভালোবাসে তাকে? তাহলে সেদিন ঐ জ্বরের ঘোরে ভালোবাসি ভালোবাসি কথাটা তাকেই বলেছিল ছেলেটা। অথচ সে কি না কি ভেবে নিয়েছিল। আবার তূর্ণকে এড়িয়েও চলতে শুরু করেছিল। মাথাটা ঘুরে উঠলো ইরার। ভালোবাসি পর্যন্ত না হয় ঠিকই ছিল কিন্তু এ ছেলে তো বিয়ে পর্যন্ত চলে গেছে। তূর্ণকে তাদের পছন্দ নয় এমন নয়। ছেলেটাকে তারা ছোট থেকে দেখে আসছে। আজকালকার যুগে এমন ছেলে পাওয়া ভার। ইরা এবং আরুশ তো একবার ভেবেও ছিল যে তূর্যের নিকট তূর্ণকে জামাই হিসেবে চাইবে‌। কিন্তু সাহসের অভাবে কখনও বলতে পারেনি। আজ সেই সুযোগ তূর্ণের মাধ‌্যমে নিজেই দ্বরগোড়ায় এসে পৌঁছালো। তবে এভাবে তো আর বিয়ে হয় না। তূর্য পৃথার সাথে কথা বলতে হবে। আরুশও বাসায় নেই এই মুহূর্তে। ইরা ইতস্তত করলো। আমতা আমতা করে বলল,

“বিয়ে বললেই তো আর বিয়ে দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তোর মা বাবার সাথে কথা বলতে হবে। তারপর দুই পরিবার মিলে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে তবেই বিয়ে না হবে।”

তূর্ণ নির্বিকার ভঙ্গিতে একটু এগিয়ে গিয়ে বসলো সোফায়। গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

“তাদের কল করে এখানে আসতে বলো। যা হবার আজই হবে।”

ইরা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। কটমট করে তাকালো আরোহীর পানে। মেয়েটার দিকে একটু ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,

“এমনিতে তো আমাদের সামনে তূর্ণকে একদম দেখতে পারিস না। এখন এগুলো কি? আমাদের মান সম্মান আর কিছু রাখলি না।”

আরোহীর মুখশ্রী চুপসে গেল। মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে সে কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। সবচেয়ে বড় কথা কোথা থেকে কি হয়ে গেল তাই মাথায় ঢুকছে না তার। এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তূর্ণ তাকে চোটপাট দেখালো, সেও ভালো মানুষী করে ভালোবাসি বলে দিল। তূর্ণ তখন কোনো কথা বলল না এখানে এসে সরাসরি বলে দিল বিয়ে করবে? এ কথা ছাদে বললে কি এমন হতো?

২২.
রাত ১০ টার অধিক। ইরাদের বাড়িতেই মজলিস বসেছে তূর্ণ আর আরোহীর বিয়ের ব্যাপারে। দুই পরিবার যখন আগে থেকেই চেনাজানা তখন আর বিয়ের ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করেনি। তাছাড়া তূর্য তো আগে থেকেই সবটা জানতো। সেই সামলে নিল সবটা। তবে শেষ সময়ে এসে বাঁধ সাধলো আরুশ। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,

“আরোহী এখনও ছোট। সামনে এইচএসসি। পরীক্ষার পর বিয়েটা দিলে হতো না।”

তূর্য সাথে সাথে প্রতিবাদ করলো। আরুশের পানে তাকিয়ে বলল,

“পরীক্ষার জন্য কি এদের প্রেম আটকে রাখতে পারবি তুই? কাছাকাছি বাড়ি সারাদিন দেখা হবে, প্রেম চলবে। তুই আমি যতই আটকানোর চেষ্টা করি না কেন এরা ঠিকই নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ভালোবাসা বজায় রাখবে‌। তার থেকে বিয়ে দিয়ে দেই। প্রেম নামক হারাম সম্পর্কে না থেকে হালাল সম্পর্কে থাকুক।”

তূর্যের কথার উপরে আর কেউ কিছু বলার মতো পেল না। সে তো ভুল কিছু বলেনি। এখন পড়াশোনার ক্ষতি হবে, পরীক্ষা খারাপ হবে ভেবে বিয়ে দিবে না। কিন্তু তাই বলে তো আর এদের প্রেম আটকে থাকবে না। তা তারা ঠিকই চালিয়ে যাবে। তার থেকে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। তূর্যরা আর দেরী করলো না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজী সাহেবকে ডেকে বিয়েটা তূর্ণ আর আরোহীর চার হাত এক করে দিল।

২৩.
মধ্যরাত। চারদিকটা নীরব নিস্তব্ধয় ছেয়ে গেছে। আঁধারে ঢেকে গেছে ধরনীর বুকটা। তূর্ণ আর আরোহীর বিয়ের পর সকলে বাড়িতে চলে গেলেও তূর্ণ রয়ে গেছে এ বাড়িতেই। তূর্ণ আজ এখানেই থাকবে। সিদ্ধান্ত হয়েছে আরোহীর পরীক্ষার আগ পর্যন্ত সে বাবার বাড়িতেই থাকবে। পরীক্ষা শেষ হলে একসাথে ধুমধাম করে তুলে নিয়ে যাবে। তবে আজ যেহেতু তাদের বিয়ে হয়েছে তাই তূর্ণ প্রথম রাতটা এখানেই কাটাবে। আরোহীকে চটজলদি শুধুমাত্র একটা শাড়ি পড়িয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বাসরঘরে। মুখে কোনো সাজগোজের ছাপ নেই। বুকের মধ্যে কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। কোথা থেকে কি হয়ে গেল মস্তিষ্ক ধরতে পারছে কিছুই। এক হিসেবে একটু আগেই সে ভালোবাসি কথাটা স্বীকার করলো এর মধ্যে তার বউও হয়ে গেল। সম্পর্কটা কেমন এক পলকে বদলে গেল। আরোহীর ভাবনার মধ্যেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো তূর্ণ। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো আরোহী। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো তার। তূর্ণ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো বিছানার পানে। মেয়েটার হৃদয় ভীত হলো। ঢোক গিলে সে ঠাঁয় বসে রইলো সেখানেই। অমনি ধমকে উঠলো তূর্ণ। গম্ভীর স্বরে বলল,

“বাসর রাতে স্বামী কক্ষে এলে তাকে যে সালাম দিতে হয় জানিস না? সালাম কর বেয়াদব।”

আরোহী কেঁপে উঠলো। ফাঁকা ঢোক গিললো ফের। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে মিনমিনিয়ে বলল,

“আসসালামুয়ালাইকুম।”

“আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে বল।”

আরোহী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তূর্ণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

“আসসালামুয়ালাইকুম।”

তূর্ণ ওষ্ঠ প্রসারিত করলো। সালামের জবাব দিয়ে হুট করে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। মৃদু কণ্ঠে বলল,

“তোর বলা তখনকার কথাটার উত্তর শুনবি না?”

আরোহী কপালে ভাঁজ ফেললো। ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

“কোন কথাটার?”

“তখন ছাদে যে বললি আমাকে ভালোবাসিস।”

আরোহী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। তৎক্ষণাৎ মাথাটা নুইয়ে ফেললো সে। তূর্ণ আরও গাঢ় ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল মেয়েটাকে। তার চুলের ভাঁজে আলতোভাবে একটা চু’মু খেয়ে বলল,

“আমিও ভালোবাসি তোকে।”

( সমাপ্ত )

প্রেমপরশ পর্ব-১৪

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৪

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

আরোহী ঢোক গিললো। কণ্ঠটা একটু নরম করে অসুস্থের ন্যায় বলল,

“তূর্ণ ভাইকে বলে দাও আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। একটু শুয়েছি।

ইরার কপালে ভাঁজ পড়লো। ভ্রু কুঁচকে সে বলল,

“একটু আগেও তো তোকে একদম ঠিক দেখে গেলাম। আয়ুশের সাথে দুষ্টুমি করছিলি। কই তখন তো মাথা ব্যথা ছিল না।”

বিরক্ত হলো আরোহী। সে বলেছে মাথা ব্যথা করছে তার মাও সুন্দরভাবে মেনে নিবে তাই না। তা না পুলিশের মতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছে। আরোহী কপাল কুঁচকে বলল,

“মাথা ব্যথা কি বলে আসে যে ‘আমি একটু পর আসবো?’ আয়ুশের সাথে যখন দুষ্টুমি করেছি তখন মাথা ব্যথা ছিল না এখন হয়েছে।”

মেয়ের কথায় ইরা কিছুটা চিন্তিত হলো। একটু আগেও ঠিক থাকা মেয়েটার হঠাৎ মাথা ব্যথা কেন শুরু হলো? ইরা ফের দরজায় ধাক্কা দিল। চিন্তাত সুরে বলল,

“তোর কি বেশি মাথা ব্যথা করছে? দরজা খোল তো। দেখি তো কি হয়েছে?”

“একটু শুয়েছি। তুমি এখান থেকে যাও তো এখন। একটু একা থাকতে দাও আমাকে।”

ইরা তবুও মানলো না। হাজার হলেও মায়ের মন তো। সে ফের গলা উঁচিয়ে বলতে চাইলো কিছু এর মধ্যে তূর্ণও এসে উপস্থিত হলো সেই স্থানে। কপাল কুঁচকে শুধালো,

“কি হয়েছে? দরজা খুলছে না ও?”

“না, মাথা ব্যথা করছে নাকি।”

মাথা ব্যথা শুনে তূর্ণ আর বলল না কিছু। মায়া হলো আরোহীর প্রতি। থাক মেয়েটা যখন দরজা খুলতে চাইছে না তখন খুলতে হবে না। পরে মেয়েটা সুস্থ হলে তার সাথে এসে দেখা করে যাওয়া যাবে। তূর্ণ একবার তাকালো আরোহীর কক্ষের বন্ধ দরজার পানে অতঃপর ইরার পানে তাকিয়ে বলল,

“থাক আর ডাকাডাকি করতে হবে না ওকে। মাথা ব্যথা করছে যখন শুয়ে থাকুক একটু সময়। আমি না হয় পরে আবার আসবো।”

তূর্ণ চলে চলে গেল। ইরাও আর ডাকাডাকি না করে পা বাড়ালো নিজের কাজের উদ্দেশ্যে। আরোহী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তূর্ণের কণ্ঠস্বর কর্ণে পৌঁছাতেই সে ছুটে এসেছিল দরজার ধারে। দরজায় কান পেতে সে শুনছিলো ছেলেটা কি কি বলছে।

২০.
সকাল নেমেছে ধরনীর বুকে। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে চারিধার। আরোহী দাঁড়িয়ে রয়েছে তূর্ণদের বাড়ির সম্মুখে। তনয়াকে আগেই বলেছিল তৈরি হয়ে থাকতে। এখানে এসে আর দাঁড়াবে না। কলেজে যাবে দ্রুত। অথচ মেয়েটার দেখাই নেই কোনো। এখনও কি করছে কে জানে।

তূর্ণ দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির বাগানেই। অনয়ের সাথে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো বাগানের ফুল, ফল এবং সবজির গাছগুলো। তাহমিনা বেগম বৃদ্ধ বয়সের এই অবসর সময়টা কাটান এই বাগানেই। মহিলার হাতেও জাদু আছে বলতে হবে। যে গাছ রোপণ করে সেই গাছই ঝলমলিয়ে ফুল ফলে ভরে ওঠে। তূর্ণ আশেপাশে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখ পড়লো গেটের পানে। ওটা কে? আরোহী না? কিন্তু মেয়েটা গেটের বাইরে ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন? তনয়ার জন্য অপেক্ষা করছে ভালো কথা কিন্তু গেটের বাইরে অপেক্ষা না করে বাড়ির ভিতরেও তো আসতে পারতো। ভ্রু কুঁচকালো তূর্ণ। অনয়কে বাগানে রেখে পা বাড়ালো গেটের পানে।

তূর্ণকে গেটের দিকে আসতে দেখেই চমকালো আরোহী। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো তার। তূর্ণ আবার এদিকে আসছে কেন? এই ছেলে তার ভাবনা চিন্তা, জীবন, পরিকল্পনা, অনুভূতি সব তো ইতমধ্যে উল্টে পাল্টে দিয়েছে এখন কাছাকাছি এসে বাকিটুকুও শেষ করে দিবে নাকি? ঢোক গিললো আরোহী। উল্টো ঘুরে দ্রুত হাঁটা ধরলো সে। তূর্ণ তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে ডাকলো,

“আরোহী! আরোহী!”

মেয়েটা শুনেও না শোনার ভান ধরলো। ব্যস্ত পায়ে ছুটলো কলেজের পানে। তূর্ণের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরও কুঁচকে গেল। মেয়েটা কি তাকে কোনোভাবে এড়িয়ে চলছে? নয়তো এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। গতকাল কল করলো মেসেজ করলো একটারও উত্তর দেয়নি আরোহী। তারপর বাড়িতে গেল দেখা করতে তখনও মাথা ব্যথার দোহাই দিয়ে দরজা খুললো না। আর এখন তাকে দেখে এক প্রকার পালিয়ে যাচ্ছে। কাহিনী কি? সে তো এমন কিছু করেওনি যার দরুন মেয়েটা তাকে এড়িয়ে চলবে। না এবার ব্যাপারটা একটু খাতিয়ে দেখতে হচ্ছে।

২১.
দুপুরের সময়। আকাশের সূর্যটা তার উজ্জ্বলতা বাড়িয়েছে আগের তুলনায়। সাথে উত্তপ্ততাও ছড়িয়ে দিয়েছে বেশ। যদিও সূর্যের আশেপাশে কিছু সংখ্যক মেঘের দেখা মিলছে কিন্তু তাতে গরম কমছে না মোটেই। তূর্ণ দাঁড়িয়ে রয়েছে আরোহী এবং তনয়ার কলেজের সম্মুখে একটা চায়ের দোকানে। মেয়েটা সত্যি সত্যিই কি তাকে এড়িয়ে চলছে নাকি এটা তার মনের ভুল সেটা বুঝতে হবে আগে তারপর অন্যকিছু।

কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানেই কলেজ ছুটি হলো আরোহী এবং তনয়ার। তারা দুজনই বেরিয়ে এলো কলেজ থেকে। তূর্ণও হাতে একটা চায়ের কাপ নিয়ে এমন এক স্থানে দাঁড়ালো যাতে স্বল্পতেই আরোহীর নজরে পড়ে। মেয়েটা যদি তাকে সত্যিই এড়িয়ে চলে তাহলে তাকে দেখেই লুকিয়ে চুরিয়ে চলে যাবে, তনয়া তূর্ণের কাছে যেতে চাইলেও যেতে দিবে না। জোরপূর্বক নিয়ে কেটে পড়বে। আর যদি এড়িয়ে না চলে তাহলে আগে যেমন তাকে রাস্তায় দেখলেই ছুটে কাছে যেতো তেমনভাবে ছুটে যাবে‌। তূর্ণ যেন আরোহী তনয়াকে দেখতেই পায়নি এমনভাবে চায়ের কাপে চুমুক বসালো। কিন্তু কলেজের গেট থেকে বেরিয়ে আসতেই ছেলেটাকে চোখে পড়লো আরোহী এবং তনয়ার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আরোহী এত চায় যাতে তাকে তূর্ণের সম্মুখে পড়তে না কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাকে বারবার এই লোকের সম্মুখেই পড়তে হয়। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো মেয়েটা। তূর্ণের ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে সে লুকিয়ে পড়লো তনয়ার আড়ালে। কিন্তু কি আর থামে? ভাইকে দেখে উৎফুল্ল হলো সে। হাত উঁচিয়ে ডাক দিতে গেল তূর্ণকে। হকচকালো আরোহী। তৎক্ষণাৎ সে নিজের হাত দ্বারা টেনে ধরলো তনয়ার হাত। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“কি করছিস কি?”

“তূর্ণ ভাইকে ডাকছি।”

“উনাকে ডাকতে হবে না। বাড়িতে চল তাড়াতাড়ি।”

তনয়া তাকালো আরোহীর পানে। ভ্রু কুঁচকে শুধালো,

“কেন?”

আরোহী আমতা আমতা করলো। মেয়েটার টেনে নিয়ে সামনের দিকে যেতে যেতে বলল,

“বাড়িতে কাজ আছে আমার। উনাকে ডাকলেই এখন আবার হাঁসের মতো প্যাক প্যাক শুরু করবে। তারপর বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে।”

“কি এত কাজ বাড়িতে তোর?”

“আছে। অত কথা বলার সময় নেই এখন। বাড়িতে চল তো।”

তনয়াকে টেনে নিয়ে চলে গেল আরোহী। তূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়ালো এবার। কাঁপলে ফুটে উঠলো গুটি কয়েক ভাঁজ। একটু আগ পর্যন্ত তার হৃদয়ে সন্দেহ ছিল যে আরোহী তাকে এড়িয়ে চলছে এবার তা বিশ্বাসে পরিণত হলো। কিন্তু কথা হলো মেয়েটা হঠাৎ তাকে এড়িয়ে চলছে কেন? সে কি এমন করেছে? মেয়েটার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার বা খারাপ কিছু করেছে বলেও তো মনে পড়ছে না।

২১.
রাতের আঁধারে ছেয়ে গেছে চারপাশটা। চারদিকে শীতল হাওয়া বইছে। আকাশ জুড়ে এখনও মেঘের আনাগোনা। তবে আজ বোধহয় পূর্ণিমা। মাঝে মাঝে মেঘের আড়াল থেকে এক খানা গোল থালার ন্যায় রূপালি চাঁদ উঁকি ঝুঁকি মে’রে দেখা দিচ্ছে। যেন সে মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়েছে। ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাঁদ আর মেঘেদের লুকোচুরি খেলা দেখছিলো আরোহী। ঠিক তখনই তার কাঁধে এসে একটা শক্তপোক্ত পুরুষালী হাত থামলো। চমকে উঠলো মেয়েটা। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার। এই রাতে এখানে কে এসেছে? আবার ভুতের মতো কাঁধে হাত রাখছে। সত্যিকারে ভু’ত টু’থ নয় তো? আরোহীর ভয় হলো। পুরো ছাদে সে একা। যদিও আয়ুশ এসেছিল তার সাথে কিন্তু ওয়াশ রুমে যাবে বলে চলে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। আয়ুশও যদি ফিরে এসে থাকে তাহলেও এ হাত তার নয়। তার মতো একটা বাচ্চা ছেলের হাত এত বড় নয়। ভয় হলো আরোহীর। সৃষ্টিকর্তার নাম জপতে জপতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে পিছনে। অমনি চমকে উঠলো আরও। ধরফরিয়ে উঠলো কলিজাটা। একি! এ তো ভুতের চেয়েও বড় কেউ। তূর্ণ এখানে কি করছে? কখন এসেছে? কেন এসেছে? ঢোক গিললো মেয়েটা। আমতা আমতা করে বলল,

“আআআপনি! কখন এলেন?”

“কেন এখানে এসে তোর কোনো সমস্যা করলাম নাকি?”

তূর্ণের তীক্ষ্ম কণ্ঠস্বর। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো আরোহী। জোরপূর্বক হেসে জবাব দিল,

“না সমস্যা হবে কেন? হঠাৎ এলেন তো তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি?”

“হঠাৎ না এলে তো তোকে পেতাম না। আমার নাম শুনলেই তো হয় দরজা বন্ধ করতি নয়তো পালাতি‌।”

আরোহী ফাঁকা ঢোক গিললো। এ লোক কি সব ধরে ফেলেছে? সবচেয়ে বড় কথা তূর্ণ কি ধরে ফেলেছে যে সে তাকে এড়িয়ে চলছে? তাহলে তো মহাবিপদ। একে তো নিজের অনুভূতি নিয়ে পালিয়ে কূল পাচ্ছে না মেয়েটা। তার উপর আবার না এই এড়িয়ে চলার ধাক্কা সইতে না পেরে তূর্ণ তাকে একটা আছাড় মে’রে দেয়। আরোহী চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। এলোমেলো ভঙ্গিতে ছাদের দরজার পানে পা বাড়িয়ে বলল,

“চলুন নিচে গিয়ে কথা বলি। আপনি নাকি আগের দিনও আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন কিন্তু তখন আমার মাথা ব্যথা ছিল।”

তূর্ণ তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে হাত ধরে আটকে দিল আরোহীকে। তীক্ষ্ম স্বরে বলল,

“মাথা ব্যথা ছিল নাকি মাথা ব্যথার ভান ধরে ছিলি যাতে আমার সাথে দেখা করতে না হয়।”

ধরা পড়ে যাওয়ায় চো’রে’র ন্যায় এদিকে ওদিক তাকালো আরোহী। তবে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালালো সে। স্বপক্ষে সাফাই গাইতে বলল,

“ককই? আর আমি আপনার সাথে দেখা না করার জন্য মাথা ব্যথার ভান ধরবো কেন? সত্যিই আমার মাথা ব্যথা ছিল।”

তূর্ণ কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আরোহীর পানে। অতঃপর হুট করেই প্রশ্ন করলো,

“এড়িয়ে চলছিস কেন আমাকে?”

যে ভয়টা পাচ্ছিলো তাই হলো। তূর্ণ শেষ পর্যন্ত ধরেই ফেলেছে যে আরোহী তাকে এড়িয়ে চলছে। এরপর যে কি হবে আল্লাহই জানেন। মেয়েটা মোড়া মোড়ি শুরু করলো। নিজের হাতটা ছাড়াতে চাইলো তূর্ণের হাত থেকে। ক্রোধে রি রি করে উঠলো ছেলেটার শরীরটা। একে তো এই মেয়ে তাকে এড়িয়ে চলার মতো গুরুতর অপরাধ করেছে এখন আবার তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই পালাতে চাইছে। কই এত বছরে সে তো কখনও এড়িয়ে চলতে পরলো না আরোহীকে আর এই দুই দিনের পুঁচকে মেয়ে কিনা তাকে এড়িয়ে চলার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছে? চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো তূর্ণের। হ্যাঁচকা টানে আরোহীকে ফেললো নিজের বুকের উপর। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“বল কেন এড়িয়ে চলছিলি আমাকে।”

আরোহী দূরে সরে যেতে চাইলো তূর্ণের থেকে। হাত দ্বারা ছেলেটাকে বক্ষে বল প্রয়োগ করে বলল,

“কোথায়? আমি আপনাকে এড়িয়ে চলবো কেন? এটা নিশ্চয়ই আপনার ভুল ধারনা।”

তূর্ণ আরোহীর ধরে রাখা হাতটা পিছনে মুচড়ে ধরলো সাথে সাথে। হিসহিসিয়ে বলল,

“আবার মিথ্যা বলছিস এত সাহস তোর।”

হাতের ব্যথায় চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিল আরোহী। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল,

“হাত ছাড়ুন তূর্ণ ভাই। লাগছে আমার।”

“লাগুক। লাগার জন্যই তো ধরেছি।‌ কয়েকদিন ধরে তোকে দেখতে না পেয়ে আমারও লেগেছে ভীষণভাবে। তোর এড়িয়ে চলা যে আমাকে কষ্ট দেয় তা তুই বুঝিস না?”

আরোহী অবাক হলো। চোখ বড় বড় করে তাকালো তূর্ণের পানে। পলক ঝাপটে প্রশ্ন করলো,

“আমার এড়িয়ে চলা আপনাকে কষ্ট দেয়? কেন দেয়?”

তূর্ণ উত্তর দিল না আরোহীর প্রশ্নের। বরং মেয়েটার হাতটা আরও জোরে মুচড়ে ধরে বলল,

“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে। এড়িয়ে চলছিস কেন আমাকে? সমস্যা কি তোর?”

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-১৩

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১৩

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

ফের ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

“আমাকে ছেড়ে ঘুমান তূর্ণ ভাই।”

তূর্ণ ফের চোখ খুললো। নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকালো আরোহীর পানে। এখনও আরোহী এত কাছে যে! স্বপ্নটা কি শেষ হয়নি? ছেলেটা আবার চোখ বন্ধ করলো। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে চোখ খুলে আবার তাকালো। নাহ মেয়েটা এখনও তো তার সম্মুখ থেকে যাচ্ছে না। জ্বরের ঘোরে না হয় স্বপ্ন দেখছে তাই বলে বারবার এক স্বপ্ন আসবে? তূর্ণ নিজের চোখ জোড়া কিঞ্চিৎ বড় করলো। কপালে ভাঁজ ফেললো আরোহী। এবার কিছুটা রুক্ষ কণ্ঠেই বলল,

“আমাকে ছাড়ুন তূর্ণ ভাই। আমার দম আটকে আসছে।”

চমকালো তূর্ণ। এর মানে এটা স্বপ্ন নয়। এটা সত্যি! ধরফরিয়ে দূর্বল শরীর নিয়েই বিছানায় উঠে বসলো তূর্ণ। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

“তুই তাহলে আমার স্বপ্ন ছিলি না?”

তূর্ণের থেকে ছাড়া পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো মেয়েটা। তবে তার একটু আগের বলা কথায় ভ্রু কুঁচকে এলো। চোখ ছোট ছোট করে বলল,

“আমি আপনার স্বপ্ন হতে যাব কেন আশ্চর্য!”

“তাহলে তুই আমায় রুমে এভাবে আমার উপরে কি করছিস?”

কথাটা বলে একটু থামলো তূর্ণ। চোখ বড় বড় করে শুধালো,

“এই তুই আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে আমার দুধে ধোয়া তুলসী পাতার মতো ইজ্জতের উপরে দাগ লাগানোর চেষ্টা করছিলি না তো? নয়তো আমার বুকের উপরে এসে এভাবে গড়াগড়ি করছিলি কেন?”

আরোহী হতবাক হলো। লোকটা তার নামে কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছে। এই লোক তাকে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলো। সে ছাড়তে বলার পরও ছাড়লো না। এখন কিনা বলছে সে ইজ্জতে দাগ লাগানোর চেষ্টা করেছিল। নাক মুখ কুঁচকালো মেয়েটা। থমথমে কণ্ঠে বলল,

“একদম বাজে কথা বলবেন না তূর্ণ ভাই। আমি কিছু করিনি। আমি তো এসেছিলাম আপনার জ্বর দেখতে। কিন্তু আপনার কাছে আসতেই আপনি হুট করে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। কতবার বললাম ছাড়তে ছাড়লেনই না।”

“তুই যে সত্যি বলছিস তার প্রমাণ কি? তুই তো মিথ্যাও বলতে পারিস।”

“আপনাকে মিথ্যা বলে আমার লাভ কি? তাছাড়া আমার অত শখও নেই আপনার দুধে ধোয়া তুলসী পাতার ন্যায় পবিত্র ইজ্জতে দাগ লাগানোর।”

আরোহী উঠে দাঁড়ালো। কপাল কুঁচকে রেখেই বলল,

“যাই হোক আপনার সাথে এসব আছে বাজে কথা বলার সময় নেই আমার। নিচে যাচ্ছি। মা বোধহয় অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”

আরোহী দরজার দিকে পা বাড়ালো। তৎক্ষণাৎ তার পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো তূর্ণ। মেয়েটা দাড়িয়ে পড়লো। তূর্ণের পানে তাকিয়ে বলল,

“কিছু বলবেন?”

“আর একটু থাক না।”

থামলো তূর্ণ। কিছুটা ইতস্তত করে ফের বলল,

“না মানে একা একা ভালো লাগছিলো না তাই বললাম।”

আরোহীর হাঁসফাঁস লাগছে। বিশেষ করে যখন থেকে সে উপলব্ধি করতে পেরেছে সে তূর্ণকে ভালোবাসে তখন থেকে কেমন একটা একটা লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি তূর্ণ ধরে ফেললো তার মনের কথা। এই বুঝি ভালোবাসার অপরাধে তাকে ঠাঁটিয়ে দুটো চড় মা’র’লো, এই বুঝি সবাইকে বলে দিল সব। ঐ যে কথায় আছে না ‘চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।’ আরোহীর অবস্থাও হয়েছে অনেকটা তেমন। তূর্ণ কিছু বুঝুক বা না বুঝুক তার হৃদয় দিশেহারা হয়ে উঠছে। তবে ছেলেটার এমন আকুল আবদার ফেলতে পারলো না সে। হাঁসফাঁস লাগার সাথে সাথে তূর্ণের জন্য খারাপও লাগছে কিঞ্চিৎ। ছেলেটা অসুস্থ, একা একা আছে। তাকে একটু হলেও সঙ্গ দেওয়া উচিৎ তার। আরোহী নিঃশব্দে বসে পড়লো তূর্ণের পাশে।‌ হাসলো ছেলেটা। আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল,

“মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে তো। আমি ঘুমাবো আবার।”

আরোহী চোখ বড় বড় করলো। ইতস্তত করে তাকালো তূর্ণের পানে। এমনিই মেয়েটার হৃদয় তূর্ণের জন্য দিশেহারা। তার মধ্যে ছেলেটা আবার তাকে স্পর্শ করতে বলছে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো আরোহী। আমতা আমতা করে বলল,

“ঘুমান আপনি। এর জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে কেন?”

“কেমন ঘুম আসছে না এখন আর। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে হয়তো ঘুম চলে আসতো।”

“আমি পারবো না আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।”

তূর্ণ একটু এগিয়ে আরোহীর পাশ ঘেঁষলো। মেয়েটার হাতটা নিয়ে রাখলো নিজের মাথায়। অতঃপর বলল,

“আমার ঘুম যখন তুই ভাঙিয়েছিস তখন মাথায় হাত বুলিয়ে আবার তুই ই ঘুম পাড়িয়ে দিবি। তাড়াতাড়ি হাত বুলিয়ে দে।”

আরোহীর অস্বস্তি লাগছে ভীষণ। সে তূর্ণের মাথায় হাত বুলিয়ে না দিয়ে চুপচুপ বসে রইলো। অমনি ধমকে উঠলো ছেলেটা। রুক্ষ স্বরে বলল,

“কি হলো হাত বুলিয়ে দিচ্ছিস না কেন?”

আরোহী এবার ইতস্তত বোধ নিয়েই হাত বুলানো শুরু করলো তূর্ণের মাথায়। ছেলেটা চোখ বন্ধ করলো। কিঞ্চিৎ সময়ের মধ্যেই পাড়ি জমালো ঘুমের দেশে।

১৭.
রাত্রি গভীর। চারদিকটা কৃষ্ণ কালো আঁধারে ঢাকা পড়ে গেছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকায় এ আঁধারে যেন আরও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। চারদিকে বিরাজ করছে শুনশান নীরবতা। আরোহী বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। দুই চোখে তার ঘুম নেই মোটেই। বারবার শুধু তূর্ণের কথা মনে পড়ছে। তূর্ণকে সে ভালোবাসে কথাটা স্মরণে আসলে হৃদয় কেঁপে উঠছে। যে ছেলেকে সে ছোট বেলা থেকে ভাই মেনেছে তার প্রতি এমন অনুভূতি নিশ্চই বাঞ্ছনীয় নয়। আরোহীর কাছে এটা কোনো অনুভূতি নয় বরং পাপ মনে হচ্ছে পাপ। মেয়েটার এই মুহূর্তে নিজেকে ঘোর পাপী মনে হচ্ছে। সে কিভাবে এমন একটা কান্ড ঘটাতে পারলো? আরোহীর হৃদয় দিশেহারা হয়ে উঠলো। আবার খারাপও লাগছে তার। জ্বরের ঘোরে তূর্ণ বারবার ভালোবাসি ভালোবাসি বলছিলো। কাকে বলছিলো সে কথাটা? নিশ্চই তূর্ণ কোনো মেয়েকে ভালোবাসে।‌ নয়তো জ্বরের ঘোরে এতটা ব্যাকুল হয়ে সে ঐ কথা বলতো না। আরোহীর কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে তূর্ণ তাকে কেন ভালোবাসলো না। সে যেভাবে ভালোবাসে তূর্ণও তো তাকে সেভাবে ভালোবাসতে পারতো। কিশোরী বয়সে মেয়েটা প্রথম প্রেমে পড়লো তাও এমন একটা মানুষের যে কিনা অন্য একজনকে ভালোবাসে! আরোহীর কান্না পেল ভীষণ। সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে তার। বুকটা ভারী হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে যেন বুকের উপরে কেউ ১০০ মন ওজনের একটা পাথর চাপিয়ে দিয়েছে যা তার জন্য বহন করা দুস্কর। মেয়েটা জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল। নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। না না এসব সে কি ভাবছে? তূর্ণের সাথে তার কোনোদিনই কিছু সম্ভব না। উল্টো তার মনের কথা কেউ জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এখন থেকে নিজেকে তূর্ণের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে তাকে। ছেলেটার প্রতি তার মনে তৈরি হওয়া অনুভূতির নিঃশেষ ঘটাতে হবে। যে অনুভূতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই সেই অনুভূতির প্রসারন না ঘটানোই শ্রেয়।

১৮.
সময় প্রবাহমান। সময়ের এই প্রবাহমান গতিতে কেটে গেছে দিন তিনেক। তূর্ণের জ্বর কমে গেছে এর মধ্যে। তবে সর্দি কাশি রয়ে গেছে এখনও। সেদিনের পর আর তূর্ণের সাথে দেখা হয়নি আরোহীর। সেদিন যে মেয়েটা চলে গেল তারপর আর এ মুখো হলো না। তূর্ণও অসুস্থ থাকায় এ কয়দিন কল টল করেনি তাকে। কিন্তু আজ কল না করলেই নয়। ভিতরে ভিতরে কেমন অস্থির লাগছে তার। মনে হচ্ছে এক যুগ কেটে গেছে সে আরোহীর দেখা পেয়েছে। তূর্ণ অস্থির ভঙ্গিতেই নিজের মোবাইলটা হাতে তুলে নিল। কল‌ লাগালো আরোহীর নাম্বারে। কিন্তু মেয়েটা কল ধরছে না। রিং বেজে যাচ্ছে অথচ তার কোনো খোঁজ নেই।

আরোহী বসে ছিল মোবাইলের পাশেই। সে দেখেছে তূর্ণ কল করেছে। তূর্ণের নামটা দেখেই মেয়েটার মনটা আঁকুপাঁকু করে উঠেছিল কল ধরার জন্য কিছু নিজেকে সে নিয়ন্ত্রণ করেছে। না সে কিছুতেই কলটা ধরবে না। ঐ লোকটার সাথে কথা বললে দেখা যাবে সে আরও তার মায়ায় পড়ে গেছে। আর ভুলতে পারছে না। তার চেয়ে এর সাথে দেখা না করা কিংবা কথা না বলাই শ্রেয়। মোবাইলে কল বাজতে বাজতে থেমে গেল, পরপর আবার বাজলো, একের পর এক কল এলো তূর্ণের তবুও কলটা ধরলো না সে। শেষে বাধ্য হয়ে তূর্ণ একটা মেসেজ করলো,

“তুই হয়তো মোবাইলের কাছে নেই। কাছে এলে একটা মিস কল দিস।”

আরোহী দেখলো মেসেজটা তবে উত্তর দিল না কোনো।

১৯.
দিন গড়িয়ে রাতের দেখা মিলেছে। সূর্যের আলোয় আলোকিত হওয়া শহরটা এই মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সোডিয়ামের কৃত্রিম আলোয়। তূর্ণ হাতে মোবাইল নিয়ে বসে আছে। সেই বিকালে সে আরোহীকে কল করেছিল। তাও একটা দুইটা না পুরো ৭ টা। তখন না হয় মেয়েটা মোবাইলের কাছে ছিল না কিন্তু এখনও অব্দি কি সে এক বারের জন্যও মোবাইলের কাছাকাছি আসেনি? দেখেনি যে তাকে মিস কল দিতে বলা হয়েছে? আচ্ছা মেয়েটার আবার কিছু হয়নি তো? তার মতো জ্বরে পেয়েছে, কোনো বিপদ আপদ হয়েছে কিংবা মোবাইল চো’রে নিয়েছে! তূর্ণের হৃদয় অস্থির হলো। কোনো রকমে শরীরে একটা শার্ট চাপিয়ে সে বেড়িয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।

****

কিছুটা সময়ের ব্যবধানেই তূর্ণ এসে পৌঁছালো আরোহীদের বাড়িতে। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল ইরা। তূর্ণকে দেখে এক গাল হাসলো সে। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল,

“আরে তূর্ণ বাবা যে। আয় আয় ভিতরে আয়। জ্বর কমেছে তোর?”

কথাটা বলে আর তূর্ণের উত্তরের অপেক্ষা করলো না ইরা। নিজেই ছেলেটার কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা। জ্বর নেই দেখে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। স্বাভাবিক স্বরে বলল,

“বস এখানে। আমি বরং তোর জন্য কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি। কতদিন পর এলি আমাদের বাসায়। তার উপর অসুস্থ শরীর।”

তূর্ণ এদিক ওদিক তাকালো। চারদিকে নজর ঘুরিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে বলল,

“আরোহী আর আয়ুশ কোথায়? ওদের দেখছি না যে।”

“ঘরেই আছে।”

কথাটা বলে গলা উঁচালো ইরা। ডেকে বলল,

“আরোহী আয়ুশ কই তোরা? তূর্ণ এসেছে।”

তূর্ণ এসেছে শুনে আয়ুশ ছুটে এলেও আরোহী নিজ কক্ষের দরজা আটকালো তৎক্ষণাৎ। হৃদস্পন্দন বাড়লো তার। এই লোক এই সময়ে তাদের বাড়িতে এসেছে কেন? নিশ্চই সে কল ধরেনি তাই। না না সে কিছুতেই তূর্ণের সম্মুখে যাবে না। যতটা সম্ভব ঐ লোকটার থেকে এড়িয়ে চলতে হবে। একজন পুরুষ অন্য কাউকে ভালোবেসে এই সত্যটা জেনেও সে কিছুতেই তার দিকে পা বাড়াতে পারে না, কিছুতেই না। আরোহী এলো না তূর্ণের সম্মুখে। কপাল কুঁচকে এলো ছেলেটার। সন্দিহান স্বরে সে প্রশ্ন করলো,

“আরোহী ঠিক আছে তো? ওর কিছু হয়নি তো?”

“আরে না কি হবে? ঠিকই আছে। হয়তো আমার ডাক শুনতে পায়নি তাই আসছে না। তুই বস আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি ওকে।”

ইরা পা চালিয়ে গেল আরোহীর কক্ষের সম্মুখে। হাত উঁচিয়ে টোকা দিল বন্ধ দরজায়। ডেকে বলল,

“আরোহী! আরোহী! শুনছিস আমার কথা? তূর্ণ এসেছে। ডাকছে তোকে।”

আরোহী ঢোক গিললো। কণ্ঠটা একটু নরম করে অসুস্থের ন্যায় বলল,

“তূর্ণ ভাইকে বলে দাও আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। একটু শুয়েছি।

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-১২

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১২

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

তূর্ণের ভীষণ ইচ্ছে হলো আরোহীকে একটু ছুঁয়ে দিতে, ভালোবাসে অন্তত মেয়েটার ললাটের মধ্যভাগে একটা গাঢ় চুম্বন করতে। তবে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। নিজের পুরুষ তাত্বিক মনভাবকে দমন করতে মেয়েটার দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে নিল সে। সে আদেশ দিল,

“ভিতরে যা আরোহী।”

আরোহী গেল না। বরং হাত দুটো মেলে দিল বৃষ্টির মাঝে। ওষ্ঠে তার মন মাতানো হাসি। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা বিন্দুগুলোকে সে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল,

“আর একটু পরে যাই না।”

তূর্ণ আড় চোখে তাকালো মেয়েটার পানে। হৃদকম্পন বাড়লো আরও। প্রবল এই বর্ষনের মধ্যে মেয়েটার রূপ যেন স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে আরও। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা বিন্দু গায়ে মেখে উতলা করে তুলছে তূর্ণের হৃদয়। ঢোক গিললো বেচারা। ফের বলল,

“একটু পর না এখনই ভিতরে যা আরোহী।”

আরোহী তবুও গেল না। এবার হাতের সাথে একটা পা ও সে বাড়িয়ে দিল বৃষ্টির মধ্যে। মুহুর্তেই বৃষ্টি ফোঁটা ফোঁটা বিন্দুরা ভিজিয়ে দিতে শুরু করলো তার পা খানা। আরোহী পা দুলালো। ওষ্ঠে হাসির উপস্থিতি রেখেই বলল,

“পায়ে এখন আলতা আর নূপুর হলে দেখতে বেশি ভালো লাগতো।”

কথাটা বলার প্রায় সাথে সাথেই ধমকে উঠলো তূর্ণ। রুক্ষ স্বরে বলল,

“ভিতরে যাবি নাকি।”

আকস্মিক ধমকে কেঁপে উঠলো আরোহী। এতক্ষণ তো সব ভালোই ছিল। কি সুন্দর ব্যবহার করলো এই লোক তার সাথে। তাহলে হঠাৎ কি হলো যে এভাবে ধমকে উঠলো। মেয়েটা তাকালো তূর্ণের পানে। কপাল কুঁচকে শুধালো,

“কি হয়েছে তূর্ণ ভাই? হঠাৎ এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন?”

“কথা শুনছিস না কেন তাহলে? ভিতরে যেতে বলছি যাচ্ছিস না কেন?”

আরোহী চোখ ছোট ছোট করলো। ভেংচি কেটে বলল,

“যাব না আমি। কি সুন্দর বৃষ্টি! দেখতে ভালো লাগছে।”

তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তূর্ণ। মেয়েটা এখনও নিজের দিকে খেয়াল করেনি হয়তো। যদি খেয়াল করতো তবে এতক্ষণে লাজে মুষড়ে পড়তো। ছুটে পালাতো তূর্ণের সম্মুখ থেকে। একটু সময় নিল তূর্ণ। অতঃপর বলেই ফেললো,

“নিজের পা হতে মাথা অব্দি দেখ একবার। তারপর যদি তোর মনে হয় আমার সামনে থাকা উচিত তবে থাক নয়তো ভিতরে যা।”

আরোহী ভ্রু কুঁচকে তাকালো নিজের পানে। অমনি চমকে উঠলো। বৃষ্টির পানিতে ভিজে কি বিশ্রী দেখাচ্ছে তাকে। শরীরের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যেন। আর সে কিনা এভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল এই লোকের সম্মুখে! আবার তাকে ভিতরে বারবার ভিতরে যেতে বলার পরও সে যায়নি। লজ্জায় মুষড়ে পড়লো আরোহী। আর এক মুহূর্তও তূর্ণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেল না সে। এক দৌড়ে চলে গেল গৃহের ভিতরে। তূর্ণ হাসলো। ভেজা চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে সেও নেমে পড়লো বৃষ্টির মধ্যে। আজ রাতটা হোক না একটু বৃষ্টিময়, সুন্দর।

১৫.
বিকালের সময়। চারিদিকটায় এখনও সূর্যের উজ্জ্বল বিরাজমান। আজ বৃষ্টি নেই তেমন। তবে সূর্যের আশেপাশে কিছু মেঘের আনাগোনা লেগে রয়েছে। কখন আবার গগন কাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমে পড়ে কে জানে! আরোহী বসে রয়েছে নিজ কক্ষের বারান্দায়। নরম দৃষ্টিতে দেখছে চারপাশের প্রাকৃতি। তূর্ণের সাথে তার দেখা হয়েছে গোটা একটা দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে আরোহী আর ঐ পুরুষের মুখোমুখি হয়নি, কথাও বলেনি। তূর্ণও তার সামনে আসেনি কিংবা কল করেনি। যাক ভালোই হয়েছে তূর্ণ তার থেকে দূরে দূরে রয়েছে। সেদিন রাতে যা ঘটলো। মনে পড়লেও মেয়েটার ভিতরটা লজ্জায় শিউরে ওঠে। মেয়েটার ভাবনার মধ্যেই তার কক্ষে এলো ইরা। ডেকে বলল,

“আমি আর আয়ুশ একটু তূর্ণদের বাড়িতে যাচ্ছি। তুই যাবি?”

তূর্ণদের বাড়িতে! ও বাড়িতে যাওয়া মানেই তো তূর্ণের মুখোমুখি হওয়া। সেদিন রাতের ঐ লজ্জাজনক ঘটনার পর কোন মুখে আরোহী ঐ লোকের সম্মুখে দাঁড়াবে? না না ও বাড়িতে যাওয়া যাবে না এখন। মেয়েটা এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বলল,

“না না আমি যাব না। তোমরা যাও।”

ইরা আর সাধলো না মেয়েকে। স্বাভাবিক কণ্ঠ বলল,

“আচ্ছা আমরা যাচ্ছি তাহলে। সন্ধ্যার আগেই চলে আসবো। তুই দরজা আটকে ভিতরে থাকিস।”

কথাটা বলেই পিছন ঘুরলো ইরা। দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,

“যাই গিয়ে তূর্ণকে দেখে আসি একটু। জ্বরে ছেলেটা নাকি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে।”

আরোহী চমকালো।‌ কার জ্বর? তূর্ণের! সেদিন যা বৃষ্টিতে ভিজেছে তাতে জ্বর ওঠারই কথা। সকালে বৃষ্টিতে ফুটবল খেললো। আবার রাতে তার সাথে ভিজলো। কিন্তু তূর্ণের জ্বর তো ভয়ংকর। সহজে তার জ্বর ট্বর আসে না। তবে যখন আসে তখন ছেলেটাকে নাজেহাল করে তোলে। আরোহীর মায়া হলো। হৃদয়ে কেমন একটা খারাপ লাগা অনুভব করলো। তূর্ণকে নিয়ে চিন্তা হলো ভীষণ। ছেলেটা ঠিক আছে তো? কতটা জ্বর উঠেছে? মেয়েটা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো সাথে সাথে। মাকে পিছন থেকে ডেকে বলল,

“মা আমি যাব।”

ইরা দাঁড়ালো। পিছন ঘুরে ভ্রু কুঁচকে বলল,

“তুই না একটু আগে বললি যাবি না?”

জোরপূর্বক হাসলো আরোহী। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,

“বাসায় একা একা থেকে কি করবো? তাই ভাবলাম ও বাড়ি থেকেই ঘুরে আসি একটু।”

১৬.
কিঞ্চিৎ সময়ের বিলুপ্তি ঘটিয়েই তূর্ণদের বাড়িতে এসে পৌঁছালো ইরা, আয়ুশ এবং আরোহী। তাদের দেখেই এগিয়ে এলো পৃথা। ইরাকে এক হাতে আগলে নিয়ে বলল,

“তোমাকে তো দেখাই যায় না। আমাদের এদিকে একদম আসোই না।”

“সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকি। তাছাড়া কয়দিন ধরে যা বৃষ্টি তাই আসা হয় না।”

থামলো ইরা। ফের বলল,

“তূর্ণ কোথায়? শুনলাম ওর নাকি খুব জ্বর।”

“আর বলো না। কাল থেকে জ্বরে হুশই ছিল না ছেলেটার। ঔষধ টৌষধ খাওয়ানোর পর একটু কমেছে জ্বরটা। ঘুমাচ্ছে এখন।”

তূর্ণের ঘুমানোর কথা শুনে ইরা আর উপরে গেল না। পৃথার সাথেই খোশ গল্পে বসলো সে। আয়ুশও আর তূর্ণের কক্ষের পানে না গিয়ে অনয়ের সাথে দুষ্টুমিতে মাতলো। এমনিই জ্বর ছেলেটার তার মধ্যে আবার তার ঘুমে বিরক্ত করার দরকার কি? তবে আরোহী এই সুযোগটাই নিতে চাইলো। তূর্ণের ঘুমের মধ্যেই একবার তাকে দেখে আসতে চাইলো। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর ঐ পুরুষের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি এই মুহূর্তে মেয়েটার মধ্যে নেই। সেদিন রাতের কথা ভেবে এখনই কেমন ভিতরে ভিতরে লজ্জা, অস্বস্তি হচ্ছে। মুখোমুখি হলে তো আরও হবে। সকলের অগোচরে আরোহী ধীর পায়ে উপরে উঠলো। পা টিপে টিপে ঢুকলো তূর্ণের কক্ষে। কিন্তু একি! চারদিকটা অন্ধকারে ঘেরা। কক্ষের জানালা গুলোও সব বন্ধ আবার লাইটও নিভানো। মেয়েটা এদিক ওদিক হাতরে জানালার ফাঁকা থেকে আসা আবছা আলোয় কক্ষের বৈদ্যুতিক লাইটটা জ্বালালো। অতঃপর বিছানার পানে ফিরতেই চমকে উঠলো সে। হৃদস্পন্দন গাঢ় হলো পূর্বের তুলনায়। তূর্ণ উদম শরীরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। কোমড় অব্দি একটা কাঁথা টানা শুধুমাত্র। পিঠ জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি। ঢোক গিললো বেচারী। বুকের মধ্যটায় কেমন দ্রীম দ্রীম আওয়াজ হচ্ছে তার। আরোহী আর গেল না তূর্ণের নিকটে। উল্টো ঘুরে পা বাড়ালো দরজার পানে। তখনই তার কর্ণে ভেসে এলো অস্পষ্ট স্বরের কিছু শব্দ। মেয়েটা থমকে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে তাকালো বিছানার পানে। তূর্ণ ইতমধ্যে চিৎ হয়ে শুয়েছে, বিরবিরিয়ে বলছে কিছু। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সম্ভবত কোনো বাজে স্বপ্ন দেখছে বা কিছু। আরোহী আর বেরিয়ে গেল না কক্ষ থেকে। ফিরে গিয়ে দাঁড়ালো বিছানার নিকটে। একটু ঝুঁকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো তূর্ণ কি বলছে তা। কিন্তু কিছুই তো শোনা যাচ্ছে না স্পষ্ট। কি বলছে এই ছেলে? আরোহী আর একটু ঝুঁকলো। একদম তূর্ণের মূখের নিকট কর্ণ নিয়ে শোনার চেষ্টা করলো তার কথা। কিন্তু কিছু শোনার পূর্বেই তূর্ণ হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো আরোহীকে। শক্ত করে চেপে ধরলো নিজ বক্ষের সাথে। হকচকিয়ে উঠলো মেয়েটা। একজন পুরুষের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে শিউরে উঠলো তার দেহ খানা। বুকের ভিতরে অবস্থানরত ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠলো যেন দ্রুত বেগে। মেয়েটা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো তূর্ণের বাঁধন থেকে। কিন্তু পারলো না। ছেলেটা আরও শক্তভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল তাকে। চোখ দুটো বন্ধ রেখেই অস্থির হয়ে বলল,

“তুই আমার, শুধুমাত্র আমার।”

আরোহী অবাক হলো। তূর্ণ কার কথা বলছে? কাকে এতটা অস্থির হয়ে নিজের বলে জাহির করছে? মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো তূর্ণের মুখ পানে। কিঞ্চিৎ অবাক সুরেই বলল,

“কার কথা বলছেন আপনি তূর্ণ ভাই? কে আপনার?”

তূর্ণ জবাব দিল না আরোহীর প্রশ্নের। চোখ বন্ধ করে সে বারবার বলে যাচ্ছে,

“তুই আমার, শুধুমাত্র আমার। তোকে আমি হারাতে পারবো না। আমি ভালোবাসি তোকে, ভীষণ ভালোবাসি।”

আরোহী ভ্রু কুঁচকালো। তবে কি তার তূর্ণ ভাই কারো সাথে প্রেম করে বা কাউকে ভালোবেসে? মেয়েটার হঠাৎ বুক কাঁপলো। অদ্ভুত এক কষ্টদায়ক অনুভূতি ঘিরে ধরলো তাকে‌। বুকের মধ্যে যেন তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে তূর্ণ অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে না, কিছুতেই না। এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? তূর্ণ অন্য কাউকে ভালোবাসতেই পারে এতে তার ভিতরে তো এমন হওয়ার কথা নয়। তবে কি তার হৃদয়ে তূর্যের জন্য কোনো অনুভূতি রয়েছে? না এ হতে পারে না। তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা শুধুমাত্র ভাই বোনের সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ। ছোটবেলা থেকে তো তারা ভাই বোন হিসেবেই বড় হয়েছে। সেখানে হৃদয়ে এমন এক অনুভূতির স্থান দেওয়াও পাপ। তাছাড়া তার হৃদয়ে তূর্ণের জন্য এমন অনুভূতি রয়েছে জানাজানি হলে বাড়ির সবাই কি ভাববে? নিশ্চই তাদের দুই পরিবারের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যাবে। আর তূর্ণই বা কি ভাববে? নির্ঘাত ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পর লাগিয়ে দিবে তার দুই গালে। তারপর ধমকে বলবে,

“ছিঃ ছিঃ আরোহী শেষ পর্যন্ত এই ছিল তোর মনে? তুই এভাবে কলুষিত করলি আমাদের মধ্যকার ভাই বোনের সম্পর্ককে। এভাবে আমাদের দুই পরিবারের সম্পর্ককে নষ্ট করলি? তোকে যেন আমার আশেপাশে আর কখনও না দেখি।”

আরোহী ঢোক গিললো। নিজেকে তূর্ণের বাঁধন থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হলো ভীষণভাবে। কিন্তু সে ব্যর্থ। এত বড় শক্তপোক্ত এক পুরুষের সাথে তার মতো এক চুনোপুঁটির পারা কি সহজ নাকি? মেয়েটা শেষে আর উপায় না পেয়ে একটু জোরেই ডেকে উঠলো,

“তূর্ণ ভাই! তূর্ণ ভাই!”

এরপরেও কোনো হেলদোল দেখা গেল না তূর্ণের মধ্যে। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো মেয়েটা। দুই হাত তুলে সে ধাক্কা মারলো তূর্ণকে। ফের ডাকলো,

“তূর্ণ ভাই! তূর্ণ ভাই!”

তূর্ণ এ পর্যায়ে নড়েচড়ে উঠলো। নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকালো সে চোখ মেলে। আরোহীকে এত কাছে দেখে ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো তার। ভাবলো জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। তাই আর অতটা মাথা ঘামালো না সে বিষয়টা নিয়ে। আরোহীকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেই চোখ বন্ধ করলো আবারও। ভ্রু কুঁচকালো মেয়েটা। ফের ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

“আমাকে ছেড়ে ঘুমান তূর্ণ ভাই।”

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-১১

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১১

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

“একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”

“বলে ফেল।”

তনয়া একটু সময় নিল। ইতস্তত করে বলল,

“আজকে যা হয়েছে তাতে আরোহীর দোষ ছিল না কোনো। আর ঐ ছেলেগুলোও আমাদের ক্লাসমেট ছিল।”

তূর্ণ জানে আরোহীর দোষ ছিল না তবুও সে বলল,

“ক্লাসমেট ছিল বলে কি তাদের হাত থেকে ফুল নেওয়া যাবে নাকি?”

“না তা নয়। আসলে হয়েছে কি আজ কলেজে ঐ ছেলেগুলো কতগুলো কদম ফুল নিয়ে এসেছিল। এই ভেজা বর্ষায় ঐ সুন্দর সুন্দর কদম ফুল দেখে আমি আর আরোহী নিজেদের লোভ সামলাতে পারিনি। ওদের নিকট ফুলের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে মাঠের কাছের কদম গাছে নাকি অনেক ফুল ফুটেছে। আমরা তো আর গাছে উঠতে পারি না তাই ওদের নিয়ে মাঠের কাছের কদম গাছটার কাছে গিয়েছিলাম।”

“ক্লাসের সময় কেন গিয়েছিলি? ক্লাস বাদ দিয়ে কদম ফুল কিসের?”

“বৃষ্টির কারণে আজ ক্লাসে তেমন ছাত্র ছাত্রী আসেনি। তাই আমরাও ক্লাস না করেই চলে এসেছিলাম আর কি।”

তূর্ণের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। রুক্ষ কণ্ঠে সে বলল,

“চলেই যখন এসেছিলি তখন বাড়িতে আসতি। আমরা কি মরে গিয়েছিলাম? আমি ছিলাম, অন্যরা ছিল ওদের বলতি কদম ফুল এনে দেওয়ার জন্য। ক্লাস পালিয়ে অন্য ছেলেদের নিয়ে গেলি কেন?”

“না মানে…”

তূর্ণ কটমট করলো। ধমকের সুরে বলল,

“তোকে আর মানে মানে করতে হবে না। আপাতত চোখের সামনে থেকে সর। নয়তো একটাকে তো কানের নিচে দিয়েছি এবার তোকেও দেব।”

তনয়া ঢোক গিললো। আর কিছু বলার সাহস পেল না সে। বেশি কিছু বলতে গেলে দেখা যাবে থাপ্পড় খেয়ে গাল বেঁকে গেছে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো মেয়েটা। চুপচাপ বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।

১৪.
রাত বেড়েছে। চারদিকটা কেমন শুনশান নীরবতায় ছেয়ে গেছে। চারপাশের আঁধারটাও গাঢ় রূপ ধারণ করেছে ইতমধ্যে। বৃষ্টিটাও নেই। তূর্ণ নিজের মনের অপরাধবোধ এবং খারাপ লাগাকে দমাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। প্রথমে সে আরোহীর বাড়ির দিকে রওনা দিয়েও আবার উল্টো দিকে ঘুরলো। কিছুটা সময়ের ব্যবধানেই এসে পৌঁছালো মাঠের কাছের সেই কদম গাছটার নিচে। হলুদ আর সাদার সংমিশ্রণে ফুটে থাকা সুশ্রী কদমে ভরে রয়েছে গাছটা। এই রাতের আঁধারে কদমগুলো যেন আরও স্নিগ্ধ এবং সুন্দর রূপ ধারণ করেছে। তূর্ণ মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোয় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো কদমগুলো। এই ফুলের জন্যই তো আজ এত কিছু। মেয়েটার কদম ফুল এত পছন্দ তাকে বললেই পারতো তাহলে তো আর থাপ্পড় খেতে হতো না। অবশ্য আরোহীর সব ফুলই পছন্দ।‌ ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা বেশ ফুলপ্রেমী। কিন্তু এখন সমস্যা হলো এই কদমগুলো তূর্ণ পাড়বে কিভাবে? সব ফুল উপরের দিকে। নিচের দিকে কোনো ফুল নেই বললেই চলে। ছেলেমেয়েরা হয়তো নিচের দিকের সব ফুল ছিঁড়ে ফেলেছে। তূর্ণ কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে গাছের আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করলো। অতঃপর মোবাইলের আলোর সাহায্যেই গাছে চড়তে শুরু করলো। কিন্তু এখানেও সমস্যা। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গাছটা কেমন পিচ্ছিল হয়ে গেছে। হাতে মোবাইল নিয়ে এই পিচ্ছিল গাছে ওঠা কি এতটাও সহজ নাকি? তবুও হার মানলো না তূর্ণ। অনেক কষ্টে উঠলো সে গাছে। ইতমধ্যে গাছের বাকলের সাথে তার নরম চামড়ার ঘর্ষণে হাত পা ছুঁলে রক্তের দেখাও মিলেছে। তবুও থেমে থাকেনি ছেলেটা। গাছের ডগায় উঠে এক গুচ্ছ কদম ছিঁড়ে হাতে নিয়েই ক্ষান্ত হলো সে। অতঃপর ওষ্ঠে এক টুকরো বিশ্ব জয়ের হাসি ঝুলিয়ে নেমে এলো নিচে।

নিচে নেমে আর দেরী করলো না তূর্ণ। এক ছুটে এসে দাঁড়ালো আরোহীদের বাড়ির সম্মুখে। মোবাইল ঘেটে কল লাগালো মেয়েটার নাম্বারে। আরোহী ঘুমাচ্ছিল। গভীর ঘুমে নিমগ্ন সে। এর মধ্যেই হঠাৎ করে বালিশের পাশে রাখা তার মোবাইলটা বেজে উঠলো প্রবল ঝংকার তুলে। বিরক্ত হলো মেয়েটা। এত রাতে আবার কে কল করে ঘুম নষ্ট করছে কে জানে! আরোহী ঘুমঘুম চোখে মুখে মোবাইলটা হাতে নিল। নিভু নিভু দৃষ্টিতে স্ক্রীনে তূর্ণের নামটা দেখেই তার চোখের ঘুম উবে গেল। হৃদয়ে অভিমানেরা নড়েচড়ে উঠলো আবারও। একটু কিছু হলেই লোকটা তাকে থাপ্পড়ের উপরে রাখে। পরে আবার আদিখ্যেতা দেখাতে আসে। এ যেন ‘জুতা মে’রে গরু দান।’ এবারে তো মে’রে’ছে একদম শুধু শুধু। এখন আবার এসেছে ঢং দেখাতে। সেও এবার আর এর ঢং এ গলবে না। একদম কল ধরবে না ঐ লোকের। কিন্তু এ লোক তো থামছে না। একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। আরোহী একবার ভাবলো মোবাইলটা বন্ধ করে দিবে। পরক্ষণেই আবার ভাবলো কলটা একবার ধরে দেখা যাক লোকটা কি বলে। উল্টা পাল্টা কিছু বলা শুরু করলে না হয় কল কেটে মোবাইলটা বন্ধ করে দেওয়া যাবে। আরোহী কল রিসিভ করে মোবাইল কানের কাছে ধরলো। থমথমে কণ্ঠে বলল,

“আসসালামুয়ালাইকুম। এত রাতে কল করেছেন কেন?”

তূর্ণ সালামের উত্তর দিল। অতঃপর বেশি কথা না বাড়িয়ে বলল,

“নিচে আয়।”

আরোহী ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

“কেন?”

“আগে আয় তো নিচে তারপর দেখবি।”

কথাটা বলেই পরপর কল কাটলো তূর্ণ। আরোহী ভ্রু কুঁচকে রেখেই বিছানা ছাড়লো। লম্বা লম্বা পা ফেলে গিয়ে দাঁড়ালো জানালার নিকট। উঁকি দিয়ে দেখলো তূর্ণ সত্যিই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এত রাতে এ লোক এখানে কি করছে? সকালে থাপ্পড় মে’রে হয়নি এখন আবার এসেছে! মেয়েটা বিছানার পাশ থেকে ওড়না নিয়ে পরিপাটিভাবে গায়ে জড়িয়ে নেমে এলো নিচে। দরজা খুলে গিয়ে দাঁড়ালো তূর্ণের পিছনে। ভারী কণ্ঠে শুধালো,

“সমস্যা কি? এত রাতে আবার আমাদের বাড়িতে এসেছেন কেন?”

তূর্ণ পিছন ফিরে তাকালো। আরোহীর চোখ মুখ স্পষ্ট ক্রোধের ছাপ। মেয়েটা নিশ্চই তার উপরেই রেগে আছে। হাসলো তূর্ণ। তার হাতে ধরে থাকা কদমগুচ্ছ বাড়িয়ে দিল মেয়েটার পানে। মোহিত কণ্ঠে আওড়ালো,

এই ভেজা বর্ষায়,
এক গুচ্ছ কদম হাতে
আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি
তোমারই অভিমুখে ।
তুমি কি নিবে এ কদমগুচ্ছ?
নাকি ফিরিয়ে দিবে আমায়?
-( কলমে : সাদিয়া শওকত বাবলি )

তূর্ণের কণ্ঠে এমন বাক্য শ্রবণে চমকালো আরোহী। এই রাতে এখানে এসে এই লোক এমন প্রেমময় বাক্য আওড়াচ্ছে কেন? একে আবার ভুতে টুথে ধরলো নাকি? নাকি অন্যকিছু। আরোহীর হৃদয়ে বিভিন্ন প্রশ্নেরা হানা দিতে শুরু করলো। এতদিনের কাজিন সম্পর্কটা ভেঙে অন্য সম্পর্কের আভাস দিতে শুরু করলো তাকে। হৃদস্পন্দন বাড়লো তার। তবে তার এই আভাসের উপরে এক বালতি পানি ঢেলে খেকিয়ে উঠলো তূর্ণ। ধমকের সুরে বলল,

“কি হলো ফুলগুলো ধরবি নাকি ফেলে দেব?”

আরোহীর ভাবনা চিন্তায় ভাটা পড়লো। নিজের উপর নিজে বিরক্ত হলো ভীষণ। এসব সে কি ভাবছিলো? এই খবিশ লোক আর অন্য অনুভূতি? অসম্ভব। হতে পারে কোনো কবিতার লাইন এনে তার সম্মুখে ঝেড়ে দিয়েছে। এ ব্যতীত আর কিছুই নয়। আরোহী মুখ বাঁকালো। ভেংচি কেটে বলল,

“আপনার কদম আপনিই রাখুন। আমর লাগবে না।”

“তুই নিবি না এই ফুলগুলো?”

“না।”

“নিশ্চিত হয়ে বলছিস তো?”

“শতভাগ নিশ্চিত।”

হঠাৎই তূর্ণ ভোল বদলালো। এতক্ষণ শক্ত কণ্ঠে কথা বললেও এই পর্যায়ে এসে কণ্ঠ নরম করলো সে। হাত দুটো উল্টে পাল্টে দেখিয়ে বলল,

“তোর জন্য কদম আনতে গিয়ে দেখ হাত দুটোর কি অবস্থা হয়েছে। আর এখন তুই বলছিস নিবি না?”

আরোহী পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তূর্ণের হাতের পানে। সত্যিই হাতদুটো ছেঁলে ছুঁলে একাকার অবস্থা। ফর্সা হাত দুটোতে লাল রক্ত লেগে আছে। মায়া লাগলো মেয়েটার। এই কদমগুচ্ছ আর ফিরিয়ে দিতে পারলো না সে। হাত বাড়িয়ে নিল হাতে। থমথমে কণ্ঠে বলল,

“শুধুমাত্র আপনার হাতের অবস্থা দেখে মায়া লেগেছে বলে নিলাম নয়তো নিতাম না।”

তূর্ণ ওষ্ঠ প্রসারিত করলো। আরোহীর হাত টেনে বলল,

“চল একটু হেঁটে আসি।”

আরোহী দ্বিরুক্তি করলো না। থমথমে মুখশ্রী নিয়ে হাঁটা শুরু করলো তূর্ণের পাশে পাশে। দুজনের মধ্যেই নীরবতা বিরাজমান। কেউ কথা বলছে না কোনো। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নীরবতা ভাঙলো তূর্ণ। কিছুটা ইতস্তত করে বলল,

“সকালে তোকে থাপ্পড় মা’রা’র জন্য আমি মোটেই অনুতপ্ত নই। তবে এই বর্ষায় সবার আগে তোকে কদম দিতে না পারায় আমি সত্যিই অনুতপ্ত।”

আরোহী অবাক হলো। গোল গোল চোখে তূর্ণের পানে তাকিয়ে বলল,

“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আপনি আমাকে থাপ্পড় মে’রে ঠিক করেছেন?”

“অবশ্যই ঠিক করেছি। আরও দুটো থাপ্পড় মা’রা উচিৎ ছিল তোকে। একে তো ক্লাস না করে চলে এসেছিস তার মধ্যে আবার ছেলেদের নিয়ে গিয়েছিলি কদম পাড়তে।”

“এখানে দোষের কি আছে? শুধু কদম পাড়তেই তো গিয়েছিলাম আর তো কিছু নয়।”

“আর কিছু হলে তুই এখনও জীবিতও থাকতি না।”

আরোহী দাঁড়িয়ে পড়লো। ওষ্ঠ ফাঁকা করে বলতে চাইলো কিছু। এর মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। ভিজিয়ে দিতে শুরু করলো প্রাকৃতিকে। বর্ষার এই এক দোষ। বলা নেই কওয়া নেই যখন তখন গগণ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমে পড়ে। এমন হঠাৎ বৃষ্টিতে তূর্ণ এবং আরোহী দুজনেই চমকালো বেশ। তূর্ণ মেয়েটার হাত টেনে দৌড় শুরু করলো পিছন ঘুরে। এক দৌড়ে তারা এসে দাঁড়ালো আরোহীদের বাড়ির সম্মুখে। তবে এত তাড়াহুড়া করেও বৃষ্টির পানি থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারলো না তূর্ণ এবং আরোহী। দু’জনের শরীরই ভিজে একাকার। তূর্ণের বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে এলো। মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সে তাকালো আরোহীর পানে। অমনি থমকে গেল বেচারা। হৃদস্পন্দন গাঢ় হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। বৃষ্টিতে ভিজে মেয়েটার শরীরে থাকা টিশার্টটা লেপ্টে গেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মেয়েটার শরীরের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট তূর্ণের নিকট। বেচারা হাঁসফাঁস করে উঠলো। হৃদয়ে নিষিদ্ধ অনুভূতিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো মুহুর্তেই। হাজার হলেও সে পুরুষ মানুষ তো। তূর্ণের ভীষণ ইচ্ছে হলো আরোহীকে একটু ছুঁয়ে দিতে, ভালোবাসে অন্তত মেয়েটার ললাটের মধ্যভাগে একটা গাঢ় চুম্বন করতে।

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-১০

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১০

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

গলা উঁচিয়ে বলল,

“জোনাকি পেয়েছি তূর্ণ ভাই। জোনাকি পেয়েছি। এ প্রাণীর পা*ছা*য়*ও বাতি জ্বলে।”

তূর্ণ মাত্রই ঘুমিয়েছিল। এর মধ্যে হঠাৎ দরজা ধাক্কা এবং অনয়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ধরফরিয়ে উঠলো সে। তড়িঘড়ি করে বসলো বিছানায়। সম্পূর্ণ বিষয়টা মস্তিষ্কে ধারণ করতে সময় লাগলো একটু। অনয় এসেছে বুঝেই ব্যস্ত হয়ে বিছানা ছাড়লো সে। দরজা খুলে শুধালো,

“কি হয়েছে? এত রাতে এত চিৎকার চেঁচামেচি করছিস কেন?”

অনয় ঝটপট জবাব দিল,

“জোনাকি! বসার রুমে একটা বড় জোনাকি এসেছে।”

তূর্ণ অবাক হলো কিছুটা। এই বর্ষার দিনে জোনাকি এলো কোথা থেকে? এখনও বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির অস্তিত্ব রয়েছে। এই বৃষ্টির মধ্যে সচরাচর জোনাকি তো দেখা যায় না। তূর্ণ ছোট্ট অনয়ের কথাকে ততটা পাত্তা দিল না। কি দেখতে না কি দেখে ফেলেছে আর জোনাকি জোনাকি বলে ছুটে এসেছে এই রাতে। ছেলেটা কণ্ঠে বিরক্তি এটে বলল,

“কি দেখতে না কি দেখে জোনাকি জোনাকি বলে চিল্লিয়ে ম’র’ছি’স। যা ঘরে যা, ঘুমা গিয়ে।”

থামলো তূর্ণ কপালে ভাঁজ ফেলে আবার বলল,

“এই এত রাতে তুই বাইরে কি করছিস? ছোট কাকাই আর ছোট কাকি তো ঘুমিয়েছে বোধহয়। তুই নিশ্চই তাদের পাশ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে উঠে এসেছিস।”

অনয় কানে নিল না তূর্ণের শেষের বলা কথাগুলো। বরং তার প্রথম বলা কথাগুলোর ঘোর প্রতিবাদ করে বলল,

“না না ওতা জোনাকিই ছিল। তুমি বলেছিলে না জোনাকির পা*ছা*য় বাতি জ্বলে। এর পা*ছা*য়ও বাতি জ্বলছিলো। আমি স্পষ্ত দেখেছি।”

“কি রঙের বাতি জ্বলতে দেখেছিস এর পা*ছা*য়? নীল আলো, লাল আলো, সবুজ আলো নাকি সাদা আলো?”

অনয় চিন্তায় পড়ে গেল। মোবাইলের আলোর মতো ঐ আলোটাকে কি রং বলে? সাদাও তো বলা যায় না। অনয় কিঞ্চিৎ সময় নিয়েও আলোর রং খুঁজে পেল না। অতঃপর সে হাত বাড়িয়ে নিজের ছোট ছোট হাত দ্বারা ধরলো তূর্ণের হাত। টেনে সম্মুখের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

“চলো আমার সাথে। দেখে আসবে কি রঙের বাতি জ্বলে।”

তূর্ণ একবার ভাবলো যাবে না সে। পরক্ষণেই আবার ভাবনার পরিবর্তন করলো। একবার হলেও তার অনয়ের সাথে গিয়ে দেখা উচিৎ। না থাকুক জোনাকি তবুও যাওয়া উচিৎ।‌ নয়তো এই বিচ্ছুটা আজ রাতে তাকে আর ঘুমাতে দিবে না। একটু পর পর এসে জোনাকি জোনাকি বলে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে। তূর্ণ বিরক্তিভাব নিয়েই হেঁটে গেল অনয়ের পিছু পিছু। বসার কক্ষে যেতেই চোখে পড়লো তূর্যকে। ততক্ষণে সে দরজা আটকে হাতে মোবাইল নিয়ে নিজ কক্ষের পানে পা বাড়িয়েছিল। তবে হঠাৎ এত রাতে তূর্ণ এবং অনয়কে ঘুরঘুর করতে দেখে থমকে দাঁড়ালো সে। ভ্রু কুঁচকে শুদালো,

“তোমারা এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো?”

তূর্ণ অনয়ের পানে এক পলক তাকালো। অতঃপর জবাব দিল,

“ঐ একটু ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু অনয় আবার কি যেন দেখাবে করে তুলে নিয়ে এলো।”

অনয় অবশ্য তূর্য আর তূর্ণের কথার পানে খেয়াল করলো না। চোখ বুলিয়ে সে আশেপাশে খুঁজলো জোনাকিকে। কিন্তু জোনাকি কোথায়? এই টুকু সময়ে জোনাকি কোথায় চলে গেল? পা*ছা*য় বাতি জ্বলা তেমন কোনো প্রাণীকে তো চোখে পড়ছে না কোথাও। তবে কি চলে গেল জোনাকি? অনয় আশেপাশে নজর ঘুরাতে ঘুরাতেই বলল,

“এখানেই তো ছিল জোনাকি। এখন কোথায় গেল?”

“কোনো জোনাকি টোনাকি নেই। বৃষ্টির মধ্যে জোনাকিদের তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে ভিজে ভিজে তোকে দেখা দিতে আসবে। যা ঘরে গিয়ে ঘুমা।”

“না জোনাকি এসেছিল। আমি সত্যিই দেখেছি। আর তুমি যেমনতা বলেছিলে এর পা*…”

অনয়ের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত উঁচিয়ে তার মুখ চেপে ধরলো তূর্ণ। জোনাকির যে ঐতিহাসিক সংজ্ঞা সে দিয়েছে সে সংজ্ঞা তার বাবা শুনলে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করবে, আর মান ইজ্জত যা যাবার তা তো যাবেই। অনয় নিজের মুখ থেকে তূর্ণের হাত সরাতে চাইলো। কিন্তু তূর্ণ হাত সরালো না। আমতা আমতা করে বলল,

“তোর জোনাকি বোধহয় আমাদের এখানে আসতে আসতে উড়ে গেছে। কাল আমরা দু’জন মিলে জোনাকি খুঁজবো আবার। এখন ঘরে চল।”

পরপর তূর্ণ বাবার পানে তাকালো। বিদায় নিতে বলল,

“আমরা ঘুমাই গিয়ে। তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও।”

অনয়কে নিয়ে তূর্ণ তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। তূর্য আর ঘাটলো না বিষয়টা নিয়ে। এমনিও বাইরে থেকে এসেছে সে। এই মুহূর্তে তার ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া প্রয়োজন। ক্ষুধায় পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।

১৩.
বর্ষাকাল। এই সময়ে সূর্যের দেখা দেখা পাওয়াই যেন কঠিন হয়ে উঠেছে। সারাদিন আকাশে শুধু কালো মেঘের আনাগোনা আর ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টির আগমন। তূর্ণ এই বৃষ্টির মধ্যেই বন্ধু বান্ধবদের সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো ফুটবল খেলার উদ্দেশ্যে। বৃষ্টির মধ্যেই তো ফুটবল খেলার আসল মজা। বেশ কয়েকজন বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাড়ির কাছে পিঠেই এক মাঠে এলো ছেলেটা। সকলের পড়নেই হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট। তারা আর সময় ব্যয় করলো না খুব বেশি। নিজেদের মতো করে খেলা শুরু করলো স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই। বৃষ্টির কারণে আশেপাশে খেলা দেখার মতো তেমন দর্শক নেই বললেই চলে। তবে মাঠের একদম শেষ প্রান্তে কিছু ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকের মাথাতেই ছাতা থাকায় তেমন একটা মুখ দেখা যাচ্ছে না কারো। তূর্ণ সেদিকে বেশি খেয়াল করলো না। দৌড়ে ঝাঁপিয়ে শরীরে কাটামাটি মেখে খেলছে সে। কিন্তু মাঠের ঐ প্রান্ত থেকে তূর্ণের একজন বন্ধু সোহাগ দৌড়ে এলো তার পানে। ছাতা মাথায় দেওয়া ছেলে মেয়েগুলোর পানে ইশারা করে বলল,

“ওটা তোর বোন না?”

তূর্ণ বল নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে জবাব দিল,

“কোন বোন?”

“ঐ যেন নাম! হ্যা হ্যা তনয়া আর আরোহী।”

তূর্ণ থেমে গেল। কপালে ভাঁজ পড়লো তার। সকাল ১১ টা কিংবা সাড়ে এগারোটা বাজে কেবল। এখন তো তনয়া এবং আরোহীর কলেজে থাকার কথা‌। তারা এখানে কি করছে? তূর্ণ বল ফেলে রেখেই ছুটে গেল মাঠের শেষ প্রান্তে। সেখানেই গিয়েই চোখে পড়লো একটা ছেলে আরোহীকে কিছু কদম ফুল দিচ্ছে। আরোহীও উৎফুল্ল হয়ে সে কলমগুলো লুফে নিচ্ছে। তূর্ণের হৃদয়টা ধক করে উঠলো। মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। এ কি দৃশ্য দেখছে সে সম্মুখে। আরোহী অন্য কারো থেকে ফুল নিচ্ছে? কেন নিচ্ছে? এই ছেলের সাথে মেয়েটার সম্পর্ক কি? তবে কি তার অগোচরে আরোহী অন্যকারো সাথে সম্পর্ক গড়েছে? চিনচিনে ব্যাথার আবির্ভাব ঘটলো তূর্ণের হৃদয়ে। সাথে ক্রোধেও দিশেহারা হয়ে উঠলো। এর জন্য মেয়েটাকে সেই কিশোর বয়স থেকে আগলে রেখেছিল? এর জন্য এত বছর ধরে মেয়েটাকে চোখে চোখে রেখে নিজ হৃদয়ে অনুভূতির পাহাড় তৈরি করেছিল! তূর্ণ ক্রোধে দিক বেদিক হারিয়ে আর একটু এগিয়ে গেল আরোহীর পানে। ঠাস করে একটা থাপ্পর লাগিয়ে দিল মেয়েটার ফর্সা গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“কলেজের নাম করে এখানে বসে রঙ্গ তামাশা করছিস? এই বয়সেই পেকে গেছিস?”

আকস্মিক তূর্ণের কণ্ঠস্বর কর্ণে পৌঁছাতেই চমকে গেল আরোহী এবং তনয়া। আরোহী গালে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে তাকালো তূর্ণের পানে। তনয়াও গালে হাত দিল তৎক্ষণাৎ। আরোহীর গালে থাপ্পড় তো পড়ে গিয়েছেই এখন আবার তার গালেও পড়ে কিনা কে জানে। তূর্ণকে এই স্থানে হঠাৎ দেখে মেয়ে দুটোর হৃদয়ে ভয় জন্মেছে বেশ তবে আরোহী কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধও হচ্ছে। গালে হাত দিয়ে মেয়েটা এদিক ওদিক তাকালো। এখানে তূর্ণের বন্ধুরা তার বন্ধুরা কত মানুষ। সবার সম্মুখে তূর্ণ তাকে এভাবে মা’র’তে পারলো! তার কোনো অন্যায় হলে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বকতে পারতো বা মা’র’তে পারতো। এখন সে বড় হয়েছে। এত বড় মেয়েকে এভাবে জনসম্মুখে থাপ্পর মে’রে অপদস্থ করার মানে কি? আরোহীর চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হলো। আহত স্বরে বলল,

“আপনি আমাকে মা’র’লে’ন তূর্ণ ভাই?”

“হ্যা মে’রে’ছি। আরও দুইটা থাপ্পড় দেওয়া উচিৎ ছিল তোকে। কলেজ বাদ দিয়ে এখানে এই ছেলেদের সাথে তামাশা শুরু করেছিস?”

কথাগুলো বলতে বলতেই তূর্ণ আরোহীর হাত থেকে কদম ফুলগুলো কেড়ে নিল। কাদামাটির মধ্যে সে ফুলগুলো ফেললো ক্ষীপ্ত হয়ে। অতঃপর তা পা দ্বারা পিষে দিয়ে বলল,

“আবার ছেলেদের থেকে ফুল নিচ্ছিস? এই টুকু বয়স তার মধ্যে রাত বিরাতে ফেসবুকে পোস্ট করিস ‘আই লাভ ইয়্যু পাশের বাড়ির চ্যাংরা পোলা’ আবার কলেজ বাদ দিয়ে ছেলেদের সাথে আড্ডা দিস। মনে রং লেগেছে তোর? তোর মনের রং যদি আমি শেষ করে না দিতে পেরেছি তবে আমার নামও তূর্ণ না।”

আরোহী নজর ঘুরিয়ে আশেপাশের সবার দিকে তাকালো আরেকবার। সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার পানে। মেয়েটার হৃদয়ে অভিমানেরা হানা দিল। নাক ফুলিয়ে বলল,

“আপনি খুব খারাপ তূর্ণ ভাই। সব সময় আমাকে না মা’র’লে না বকলে আপনার পেটের ভাত হজম হয় না বোধহয়। আমিও চাই না আপনার পেটের ভাত হজম হোক। আপনি আমার সাথে আর কখনও কথা বলবেন না আর আমিও বলবো না।”

কথাগুলো বলে ঐ স্থানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না আরোহী। কান্নারা দলা পাকিয়ে শব্দ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার গলা থেকে, ফর্সা নাকের ডগাটাও লাল হয়ে গেছে ইতমধ্যে। কিন্তু এত মানুষের মধ্যে কাঁদতে চাইলো না মেয়েটা। এমনিই একটু আগে একটা থাপ্পড় খেয়েছে। এখন আবার এত বড় মেয়ে হয়ে জনসম্মুখে কেঁদে কেঁটে নিজের মান ইজ্জত হারানোর কোনো ইচ্ছা নেই‌ আরোহীর। তাই সে কিছুটা ব্যস্ত ভঙ্গিতেই দৌড় লাগালো বাড়ির পানে। তার পিছু পিছু তনয়া এবং বাকিরাও ছুট লাগালো।

আরোহী এবং তনয়া চলে যেতেই তূর্ণের কাঁধে হাত রাখলো সোহাগ। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

“একটু বেশি হয়ে গেল না? মেয়েটাকে থাপ্পড় মা’রা’টা কি ঠিক হয়েছে তোর?”

তূর্ণ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সোহাগের পানে। গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল,

“এটা শুধুমাত্র আমার আর ওর ব্যাপার।”

সোহাগ আর কথা বাড়ালো না। হয়তো সে বুঝে নিয়েছে কিছু একটা। তাছাড়া তূর্ণের চোখে মুখেও ক্রোধের আভাস। এই সময়ে এর সাথে কথা বাড়ানো মানে আবার একটা ঝামেলার সৃষ্টি। পরে দেখা যাবে আরোহীর রাগ সে এই মাঠের মধ্যেই ঝাড়বে। তাই সোহাগ খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই চাপড় লাগালো তূর্ণের কাঁধে। মাঠের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

“এত রাগ রাখলেও আবার হয় না। চল খেলাটা শেষ করি এখন।”

১৪.
রাত খুব বেশি নয়। ঘড়ির কাঁটায় টিক টিক ধ্বনি তুলে জানান দিচ্ছে রাত কেবল নয়টা। তূর্ণ বসে রয়েছে তার কক্ষে। সকালের পর আরোহীর সাথে আর দেখা হয়নি তার। তবে মেয়েটাকে থাপ্পড় মে’রে এখন নিজেরই খারাপ লাগছে। তখন আরোহী চলে যাওয়ার পর ঐ কদম ফুল দেওয়া ছেলেগুলোর সাথে কথা বলেছে তূর্ণ। ছেলেগুলো আরোহীর ক্লাসমেট ছিল এবং ঐ ফুল দেওয়া নেওয়ায় মেয়েটার দোষ ছিল না কোনো। শুধু শুধুই সে একটা থাপ্পড় মে’রে দিল মেয়েটাকে। তূর্ণের ভাবনার মধ্যেই তার কক্ষের দরজায় টোকা পড়লো। মিনমিনে কণ্ঠে তনয়া বলল,

“ভাইয়া ভিতরে আসবো?”

“আয়।”

তনয়া গুটি গুটি পায়ে ঢুকলো ভিতরে। দাঁড়ালো তূর্ণের মুখোমুখি। আমতা আমতা করে বলল,

“একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”

“বলে ফেল।”

চলবে…..

প্রেমপরশ পর্ব-০৯

0

#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৯

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

নিজে থেকেই সে বেলী গাছগুলো থেকে ফুলগুলো তুললো এক এক করে। সে ফুলগুলো সে বাড়িয়ে দিল আরোহীর পানে। হাসিমুখে বলল,

“তোর অধিকার।”

মেয়েটা খুশি হলো ভীষণ। উৎফুল্ল ভঙ্গিতে দুই হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল ফুল গুলো। ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,

“আপনাকে অনেকগুলো ধন্যবাদ।”

তূর্ণ আলতো হাসলো। আরোহী ফুলগুলো নিয়ে হাসি মুখেই পা বাড়ালো সম্মুখ পানে। অমনি ভ্রু কুঁচকে এলো তূর্ণের। পিছু ডেকে সে বলল,

“দাঁড়া।”

আরোহী দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছু ফিরে শুধালো,

“আবার কি হয়েছে?”

“তোর পায়ে কি হয়েছে? এভাবে পা টেনে টেনে হাঁটছিস কেন?”

আরোহী আমতা আমতা শুরু করলো। ইতস্তত করে জবাব দিল,

“পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি একটু।”

তূর্ণ হুট করেই চটে গেলো। মেজাজ বিগড়ালো তার। কিছুটা ধমকের সুরেই বলল,

“একটু ব্যথা পেয়েছিস নাকি বেশি তা তো হাঁটার গতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”

থামলো ছেলেটা। একটা নিঃশ্বাস টেনে ফের বলল,

“আর কিভাবে পড়ে গিয়েছিলি বল তো। এত বড় মেয়ে হয়েছিস এখনও ঠিকভাবে হাঁটতে পারিস না। এখানে ওখানে ঠাস ঠুস পড়ে গিয়ে ব্যথা পাস। তোকে কি এখন আমার ধরে ধরে হাঁটা শিখাতে হবে নাকি?”

“বৃষ্টির মধ্যে এসেছি তো। পায়ে পানি ছিল খেয়াল করিনি। ভেজা পায়ে টাইলসের উপর পাড়া দিতেই পিছলে পড়েছি।”

তূর্ণের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। রুক্ষ স্বরে সে বলল,

“হয়েছে আর অজুহাত দিতে হবে না। বিছানায় বস গিয়ে যা।”

আরোহী ইতি উতি করলো না। বাধ্য মেয়ের মতো বসলো বিছানায়। তূর্ণ এগিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে একটা ফাস্ট এইড বক্স বের করে আনলো। সেটা ঘেটে একটা ক্যাপসিকাম প্লাস্টার নিয়ে বসলো আরোহীর পায়ের কাছে। আদেশ দিয়ে বলল,

“পা টা দে।”

আরোহী পা দিল না বরং গুটিয়ে নিল আরও। মিনমিনিয়ে বলল,

“ওসব কিছু লাগাতে হবে না। এমনিই ব্যথা ঠিক হয়ে যাবে।”

তূর্ণ এক পলক তাকালো আরোহীর পানে। অতঃপর হাত বাড়িয়ে জোর করে সে নিজের দিকে টেনে নিল পা টা। উল্টে পাল্টে দেখতে শুরু করলো ব্যথার স্থাল। অমনি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো আরোহী। তূর্ণ কপাল কুঁচকালো অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে? পাগল হয়েছিস? ওভাবে হাসছিস কেন?”

আরোহী হাসতে হাসতেই জবাব দিল,

“সুরসুরি লাগছে পায়ে।”

তূর্ণ ততটা পাত্তা দিল না মেয়েটার কথায়। সে তার নিজের মতো করে যত্ন করে আরোহীর পায়ের ব্যথা স্থানে ক্যাপসিকাম প্লাস্টারটা লাগালো। মেয়েটাকে সাবধান করে বলল,

“একদম দৌড়াদৌড়ি করবি না। আস্তে আস্তে হাঁটবি।”

আরোহী মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বলল। অতঃপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পা টা একবার উল্টে পাল্টে দেখে পা বাড়ালো কক্ষের বাইরে। নাহ ছেলেটাকে যতটা খারাপ সে ভেবেছিল ততটাও খারাপ না। একটু আধটু ভালোও আছে।

আরোহী তূর্ণের কক্ষ থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলো নিচে। এ বাড়িতে তার যা নেওয়ার জন্য এই বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেও আসা তা তো নেওয়া হয়েই গেছে। এখন আর এখানে থেকে লাভ কি? তাই আর সে সময় ব্যয় না করে পা বাড়ালো বাড়ির সদর দরজার পানে। গলা উঁচিয়ে রান্নাঘরে রান্নার কাজে নিয়োজিত মামীদের উদ্দেশ্য করে বলল,

“মামী গেলাম আমি।”

কথাটা বলে সামনের দিকে আর দুই কদম যেতেই ছোট্ট অনয় দৌড়ে এসে পথ আগলে দাঁড়ালো তার। কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,

“কোথায় যাচ্ছো ভূত্তা কুমারী?”

আরোহী হাসলো। অনয়ের গাল টেনে দিয়ে বলল,

“বাড়িতে ফিরছি ভূত্তা কুমার। তুমি যাবে আমার সাথে?”

অনয় ডানে বামে মাথা ঝাঁকালো। আর একটু এগিয়ে এসে মেয়েটার ওড়নার এক কোনা টেনে ধরে বলল,

“তুমি যেতে পারবে না। আজকে আমার সাথে থাকবে।”

“তা কি করে হয়? আমি না গেলে আম্মু চিন্তা করবে তো। তার থেকে তুমি আমার সাথে চলো।”

আরোহীর কথার মধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হলো পৃথা। মেয়েটার বাড়িতে ফেরার কথা শুনেই রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছে সে। এসেই অনয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলল,

“তোর মাকে আমি কল করে দেব। সে আর চিন্তা করবে না। তুই আজ আমাদের বাড়িতে থেকে যা।”

“কিন্তু মামী…..”

“কোনো কিন্তু না। বাইরে কি বৃষ্টি দেখেছিস? এমনি আসার সময় একটা আছাড় খেয়েছিস।‌ আরেকটা খাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি? যা ঘরে যা, তনায়া ওদের সাথে গল্প গুজব কর। আজ আর বাড়িতে যেতে হবে না।”

পৃথা নিজের কথাগুলো বলে চলে গেল। আরোহীও আর মামীর কথার উপরে কিছু বলার খুঁজে পেল না। অগত্যা তাকে থেকে যেতে হলো এ বাড়িতেই। অনয় খুব খুশি হলো তার ভূত্তা কুমারীর থাকায়। মেয়েটাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল তনয়াদের কক্ষে। সেখানে তনয়া, তুলি আর তানিয়া আড্ডা দিচ্ছিলো। আরোহীকে দেখে খুশি হলো তারাও। তুলি এবং তানিয়া ছুটে এসে দুই দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো আরোহীকে। তুলি কিঞ্চিৎ উৎফুল্ল হয়েই শুধালো,

“তুমি কখন এসেছো আপু?”

“এই তো একটু আগেই।”

কথাটা বলেই আরোহী নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মেয়ে দুটোর বাহু বন্ধন থেকে, বসলো মেঝেতে। ওড়নার ভাঁজে রাখা বেলী ফুলগুলো সম্মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে বলল,

“সুঁই সুতার বাক্সটা দে তো মালা গাথি একটু।”

তানিয়া তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে সুঁই সুতার বাক্সটা নিয়ে এলো। আরোহী সুইয়ে সুতা গেথে শুভ্র রঙা ফুল গুলো তুলে মালা গাঁথতে শুরু করলো সুন্দরভাবে। তনয়া, তানিয়া, অনয় এবং তুলি গোল‌ করে বসলো মেয়েটার চারপাশে। তনয়া নিজের ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত করে শুনালো,

“বেলী ফুল পেলি কোথায়?”

“তূর্ণ ভাইয়ের বারান্দা থেকে এনেছি।”

আরোহীর উত্তরে অবাক হলো তনয়া, তানিয়া এবং তুলি। যে গাছের আশেপাশে তূর্ণ কাউকে ঘেঁষতে দেয় না, একটা পাতা পর্যন্ত ছিঁড়তে দেয় না। আজ সে গাছের এত ফুল সে আরোহীকে দিয়ে দিল? এটা কিভাবে সম্ভব? নাকি মেয়েটা চু’রি করে এনেছে। হ্যা তাই হবে হয়তো। নয়তো তূর্ণ তার গাছের একটা পাতা ছিঁড়তে দেওয়ারও ছেলে নয়। যদি সত্যিই আরোহী চু’রি করে এতগুলো ফুল ছিঁড়ে আনে তবে আজ তার কপালে নির্ঘাত দুঃখ আছে। তুলি কিছুটা ভয়ার্ত কণ্ঠেই শুধালো,

“তুমি কি এই ফুলগুলো চু’রি করে এনছো আপু?”

আরোহী তাকালো তুলির পানে। কপাল কুঁচকে জবাব দিল,

“চুরি করে আনবো কেন? তূর্ণ ভাই নিজে আমাকে এ ফুল দিয়েছে।”

সকলের অবাকের মাত্রা বাড়লো। তানিয়া অবাক স্বরেই শুধালো,

“তূর্ণ ভাই নিজে দিয়েছে!”

“না দিয়ে যাবে কোথায়? ঐ গাছে তার যতটা অধিকার আমারও ততটাই অধিকার। সে তো শুধুমাত্র বাজার থেকে গাছগুলো কিনে এনেছে কিন্তু লাগিয়েছি তো আমি। তারপর গাছের পরিচর্যাও তো ডেকে ডেকে আমাকে দিয়েই করায় সে।”

তবুও যেন আরোহীর কথা বিশ্বাস করতে পারলো না কেউ। সন্দিহান দৃষ্টিতে তারা তাকালো ফুলগুলোর পানে। তখনই কক্ষে প্রবেশ করলো তূর্ণ। অনয়ের পানে তাকিয়ে বলল,

“কিরে ভূট্টা কুমার কি করছিস?”

অনয় একবার তাকালো তূর্ণের পানে অতঃপর আবার বেলী ফুলগুলোর পানে দৃষ্টি দিয়ে জবাব দিল,

“আমার ভূত্তা কুমারীর মালা গাঁথা দেখি।”

তনয়া, তানিয়া এবং তুলি ভেবেছিল তূর্ণ এই ফুলগুলো এখানে দেখে ক্ষেপে যাবে, চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করবে কিন্তু তার কিছুই ঘটলো না। তাহলে কি আরোহী সত্যিই বলছিলো? তূর্ণ এতো গুলো ফুল সব দিয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে? তনয়া, তানিয়া এবং তুলি গোল গোল চোখে তাকালো একবার তূর্ণের পানে অতঃপর আবার আরোহীর পানে। তূর্ণ একটু উকি মে’রে দেখলো আরোহীর মালা গাঁথা অতঃপর আবার বলল,

“তা ভুট্টা কুমারের কি এখন ফুল কুমার হওয়ার ইচ্ছে জেগেছে নাকি? এদিকে আয় আমার কাছে।”

অনয় উঠে এলো। তূর্ণ বেশ আঁটসাট বেঁধে বসলো কক্ষের বিছানায়। ছেলেটাকে আরও কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,

“বল তো জোনাকি কাকে বলে।”

অনয় কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ভাবলো। তার ছোট মাথায় ধরলো না এত কিছু। বেচারা ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল,

“জানি না। তুমি বলো।”

তূর্ণ বুক ফুলালো। বেশ ভাবসাব নিয়ে বলল,

“যে প্রাণীর পা*ছা*য় রাতের আঁধারে বাতি জ্বলে তাকেই জোনাকি বলে।”

আরোহী নাক মুখ কুঁচকালো। বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইকে কি সব শিক্ষা দিচ্ছে। এইসব কারণেই তো আজকালকার ছেলেমেয়ে গুলো বয়সের তুলনায় পেকে যায় বেশি। দিন দিনে এক একটা বেয়াদব তৈরি হয়। তূর্ণ নিজে তো একটা বেয়াদবই এখন এই ছেলেটাকেও বেয়াদব বানাচ্ছে। অনয় চোখ বড় বড় করলো। আগ্রহ নিয়ে শুধালো,

“কোন প্রাণীর পা*ছা*য় বাতি জ্বলে?”

“জোনাকির।”

“জোনাকি কি?”

“বললাম তো যে প্রাণীর পা*ছা*য় রাতের আঁধারে বাতি জ্বলে তাকেই জোনাকি বলে।”

“কোন প্রাণীর পা*ছা*য় বাতি জ্বলে?”

নিজের করা প্রশ্নে নিজেই ফেঁসে গেল তূর্ণ। ছোট অনয়ের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্নে চর্কির মতো ঘুরে উঠলো বেচারার মাথাটা। শেষে আর উপায় না পেয়ে তূর্ণ বলল,

“তুই আজ থেকে খেয়াল রাখবি কোন প্রাণীর পা*ছা*য় বাতি জ্বলে। কোনো প্রাণীকে এমন দেখলেই দৌড়ে আমার কাছে আসবি। আমি তোকে একদম হাতে ধরে জোনাকি চিনিয়ে দেব।”

অনয় মাথা ঝাঁকালো। মুখে বলল,

“আচ্ছা।”

১২.
রাত গড়িয়েছে বেশ। চারিদিকটা কালো আঁধারে ছেয়ে গেছে। বাহিরে এখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টির অস্তিত্ব রয়েছে। জনমানবেরও সাড়াশব্দ নেই তেমন। সবাই ঘুমিয়েছে বোধহয়। চৌধুরী পরিবারের সকলেও ইতমধ্যে ঘুমে নিমজ্জিত। তবে ঘুম নেই অনয়ের চোখে। যদিও সন্ধ্যার সময়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে কিন্তু রাত্রির এই ক্ষণে এসে সে ঘুম ভেঙে গেছে। ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করলো, হাত পায়ের প্রতিকৃতি দেখলো। কিন্তু ঘুম যে কোনোভাবেই দুই চোখে ধরা দিচ্ছে না। অনয় আরও একটু সময় নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুষ্টুমি করলো। অতঃপর বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো। মায়ের মাথার কাছ থেকে টর্চাটা নিয়ে নীরবে নিঃশব্দে মা বাবার মাঝ খান থেকে উঠে গেল সে। পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে। হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে

“খোকাবাবু যায়, লাল জুতা পায়। বড় বড় দিদিরা সব উঁকি মে’রে চায়। থেমে গেল আড্ডা, কমে গেল ঠান্ডা।”

দেবের “সেদিন দেখা হয়েছিল” ছবিটার এই গানটা গুনগুন করতে করতে ছেলেটা এসে দাঁড়ালো বসার কক্ষে। ঠিক তখনই তূর্য বাড়িতে ফিরলো। অফিসের একটা কাজে গিয়ে বৃষ্টির দরুন আটকে পড়েছিল সে। তাই ফিরতে ফিরতে এতটা দেরী। তবে বাড়ির আরেকটা চাবি তার কাছে থাকায় ভিতরে ঢুকতে খুব একটা অসুবিধা পোহাতে হয়নি। কিন্তু এখন সমস্যা দাঁড়িয়েছে দরজা আটকানো নিয়ে। এক হাতে মোবাইলে ফ্ল্যাশ জ্বালানো অন্য হাতে ছাতা। এখন সে দরজাটা আটকাবে কিভাবে? ছাতাটা না হয় নিচে রাখা যাবে কিন্তু মোবাইলের ফ্ল্যাশ তো দরজা আটকাতে প্রয়োজন হবে। অন্ধকারে তো আর দরজা আটকানো সম্ভব নয়। তূর্য ছাতাটা নিচে রাখলো অতঃপর প্রথমে দাঁত দিয়ে মোবাইলটা কামড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা না করতে পেরে ফ্ল্যাশ জ্বালানো মোবাইলটা চেপে রাখলো দুই পায়ের মধ্যভাগে। পিছন থেকে হঠাৎ এ দৃশ্য দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল অনয়ের। অন্ধকারের মধ্যে তূর্যের এ দুই পায়ের মধ্যে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে রাখাটা দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন পা*ছা*য় বাতি জ্বলছে। অনয়ের হঠাৎ মনে পড়লো তূর্ণের কথা। সে তো বলেছিল জোনাকির পা*ছা*য় বাতি জ্বলে। আর এই ধরণের প্রাণী দেখলে তাকে ডেকে আনতে। অনয় দ্রুত ছুট লাগালো তূর্ণের কক্ষের পানে। গলা উঁচিয়ে বলল,

“জোনাকি পেয়েছি তূর্ণ ভাই। জোনাকি পেয়েছি। এ প্রাণীর পা*ছা*য়*ও বাতি জ্বলে।”

চলবে…..