Wednesday, August 13, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 76



অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০৫

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫.

আকাশটা আরো একবার গর্জন করে উঠতেই মননের হুশ ফিরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আবহাওয়ার আন্দাজ করে। দমকা হাওয়া ও বজ্রধ্বনি জানান দিচ্ছে যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। মনন ফের মোহর দিকে তাকায়। এখনো জবাবের অপেক্ষায় তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। মনন কোনো জবাব দেয় না। বরং বেশ সূক্ষ্ণ ভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে বলে,

“ বৃষ্টি শুরু হবে। দ্রুত চলুন। বৃষ্টিতে ভেজা আপনার জন্য ঠিক নয়। “

নিজের করা প্রশ্নের কোনো জবাব মিলবে না বুঝতে পেরে মোহ দৃষ্টি নামায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে বসে রয়। আবারও তার চোখ গড়িয়ে জল পরে। ভেতরটা হাসফাস করছে তার। মনন বুঝে তা। নিজের পকেট হাতড়ে একটা পরিষ্কার রুমাল বের করে। রুমালটা মূলত সে নিজের চশমার ফ্রেম মুছতে ব্যবহার করে প্রায়ই। মনন মার্জিত ভঙ্গিতে ছাদের মেঝেতে পড়ে থাকা কালো কেশগুচ্ছ নিজের রুমালে তুলে নেয়। মোহর হাতের মুঠোয়ও বেশ খানিক চুল ছিলো। মনন নিজেই সেগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে রুমালে তুলে রাখে। অত:পর রুমালটা ভাজ করে বেঁধে মোহর কাছে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ রেখে দিন। “

মোহ একবার রুমালটা দেখে। অত:পর মলিন গলায় বলে,

“ এগুলো দিয়ে কি করবো? ফেলে দিন। ঝরে যাওয়া জিনিসের কোনো মূল্য নেই। “

মনন আর জোর করে না। বরং রুমালটা নিজের পকেটে ভরে বলে,

“ আচ্ছা। ফেলে দিবো। এখন প্লিজ চলুন। আপনার ফ্যামিলি কোথায়? তাদের ইনফর্ম করে ছাদে এসেছেন? “

মোহ জবাব দেয় না। নির্লিপ্ত রয়। তার মাঝে কোনো হেলদোল না দেখে এবার মনন বাধ্য হয়ে তার বাম হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার খেয়াল ছিলো মোহর ডান হাতে ক্যানেলা লাগানো দেখেছিল সে, আবার সেই হাতেই ওদিন ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। তাই ইচ্ছাকৃতভাবেই বাম হাত ধরেছে সে। তবে তা-ও বেশ আলতো ভাবে।

মোহ বিরক্ত হয়। একটু কি শান্তিতে দুঃখবিলাসও তার কপালে নেই? মোহর বিরক্তি বুঝতে পেরে মনন নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। ব্যস্ত গলায় বলে,

“ এখন ফিরে যান। প্রতিদিন না-হয় ছাদে এসে আধ ঘন্টা কেঁদে দুঃখবিলাস করবেন। এখন অযথা বৃষ্টিতে ভিজে নিজের কেসটা আর জটিল করবেন না। “

মোহ প্রশ্ন করে বসে,

“ আপনি ছাদে থাকবেন? “

মনন অবাক হয়। পরপর পাল্টা প্রশ্ন করে,

“ আপনি চান আপনার দুঃখবিলাসের সময়টায় আমি ছাদে থাকি? আমার সামনে কান্নাকাটি করবেন? আপনার ইমেজ, প্রেস্টিজ চলে যাবে না? না-কি সেটা শুধু নিজের পরিবারের সামনেই ধরে রাখাটা জরুরী? “

মোহ জবাব দেয় না কোনো। তার মুখ ফস্কে প্রশ্নটা বেরিয়ে গিয়েছে। লোকটা কি ভাবছে? মোহ তার ব্যাপারে কিংবা তার সান্নিধ্যের প্রতি আগ্রহী? উহু। মোটেও না। মোহ কথা না বাড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। মনন তার পিছু আসতে আসতে বলে,

“ রাত আটটা কিংবা সাড়ে আটটা পর্যন্ত আমার ডিউটি থাকে। ডিউটি শেষে বাসায় ফেরার আগে ছাদে আসি কিছু সময়ের জন্য। রাতের মুক্ত আকাশ বাতাস দুটোই সারাদিনের স্ট্রেস রিলিফের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। “

মোহ শুনে সবটা। কোনো প্রতুত্তর না করে লিফটের দিকে এগিয়ে যায়। মননও তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে লিফটের অপেক্ষা করে। মনে মনে ভেবে রেখেছে মোহকে একদম তার কেবিন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তারপর বাসায় ফিরবে। দশ তলায় এসে লিফট থামতেই মোহ লিফট থেকে নেমে যায়। মননও নামে তার পিছু পিছু। মোহ পা থামিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনি আমার পিছু পিছু আসছেন কেন? “

“ আপনার পিছু পিছু আসছি কেনো মনে হলো? আমার পেশেন্ট এডমিট আছে এই ফ্লোরে। ওদের সাথে দেখা করতেও আসতে পারি। “

মোহ কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই একটা নারী স্বর চেঁচিয়ে উঠে,

“ মোহ! “

মোহ আর মনন সঙ্গে সঙ্গে পাশ ফিরে তাকায়। বিদ্যুৎ বেগে একটা মেয়ে ছুটে এসে মোহকে জড়িয়ে ধরে। উদ্বেগ মিশ্রিত স্বরে বলতে থাকে,

“ কোথায় গিয়েছিলি তুই না বলে? ফোনও সাথে করে নিস নি। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে টেনশন দিয়ে কি মজা পাস তুই? আমি এতক্ষণ ধরে খুঁজে তোকে না পেয়ে বাবাকেও কল করে ইনফর্ম করে দিয়েছি। “

মনন বিস্মিত নয়নে দেখছে মোহকে জড়িয়ে ধরে রাখা মেয়েটাকে। সালোয়ার কামিজ পরিহিত মার্জিত ধরনের মেয়েটি দেখতে অবিকল প্রায় মোহর মতো। একই নাক, একই চোখ। উপরওয়ালা যেনো একই চেহারার আরেকটা মানুষকে কপি পেস্ট করে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

মনন অবাক নয়নে ফের মোহর দিকে তাকায়। কিছু কি পার্থক্য আছে দু’জনের মাঝে? হ্যাঁ আছে। মোহর চুল গুলো খুব একটা লম্বা নয়। কাঁধের কিছুটা নিচ সমান। কিন্তু মোহ রূপী মেয়েটার চুলগুলো তুলনামূলক আরেকটু লম্বা। পিঠ সমান প্রায়।

মোহ বিরক্তি নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠে,

“ অনেক উপকার করেছিস। আমি কি মরে গিয়েছি? বাবাকে ইনফর্ম করতে কে বলসে তোকে? “

সামনের মেয়েটা কিছু বলবে তার আগেই সে মননকে খেয়াল করে। অবাক নয়নে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করে। মনে পড়তেই বলে,

“ আপনি ওই পাগল ছাগল লোকটা না? ওই যে ক্যান্টিনে আমাকে অযথা জ্ঞান দিয়ে গিয়েছিলেন? “

মোহ অবাক গলায় বলে,

“ এটাই ওই লোক? তোকে খাবার নিয়ে জ্ঞান ঝেড়েছিল যে? “

“ হ্যাঁ। আমি পুরোই বলদ হয়েছিলাম। তুই এই লোককে কিভাবে চিনিস? “

“ আরে এই লোক বাচ্চাদের ডক্টর। মানে পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের অনকোলজিস্ট। উনার নাম ডক্টর মরণ… থুক্কু মদন। ধ্যাৎ! কি যেনো নাম? এই আপনার নামটা যেনো কি? “

মনন এতক্ষণে নীরবে সবটা শুনছিলো। কি সুন্দর তাকে কখনো পাগল ছাগল বলছে, তো কখনো মরণ মদন। রাগে মননের গা জ্বলছে। নাম বিকৃত জিনিসটা তার খুব অপছন্দের। কোন কুক্ষণে যে সে মোহকে নিজের আসল নাম ছেড়ে নিজের ডাকনাম বলেছিল! মনন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ ডক্টর ওয়াসিফ কায়সার মনন। আপনারা বরং আমাকে ডক্টর ওয়াসিফই বলুন। “

কথাটুকু উচ্চারণ করে মনন সোজা অপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আই এম এক্সট্রিমলি সরি। আমি ওদিন আপনাকে দেখে মোহ ভেবেছিলাম। তাই ওসব বলেছিলাম। সরি ফর দ্যাট এগেইন। “

মেয়েটি বোকার মতো প্রশ্ন করে,

“ আপনি মোহকে কিভাবে চিনেন? আপনি না পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের? মোহ তো বাচ্চা না! “

মোহ মেয়েটিকে থামিয়ে দিয়ে মননকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ এটা আমার ছোট বোন মায়া। বয়সেও পাঁচ মিনিটের ছোট, বুদ্ধিতেও ছোট। আমার মতো এতো স্মার্ট না। “

মনন অনুভব করে তার মাথা সামান্য ব্যথা করছে। এখানে থাকলে তার মাথা ব্যথা কমার বদলে উল্টো আরো বেড়ে যাবে। তাই সে দ্রুত তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ আমার কাজ আছে। পরে দেখা হবে। টেক কেয়ার। আল্লাহ হাফেজ। “

__________

মলিন মুখ করে কাঁচের জানালাটার কাছে বসে আছে মোহ। দৃষ্টি বৃষ্টিস্নাত শহরের পানে নিবদ্ধ। সোফায় বসে ভিডিও কলে শিহান ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত মায়া। কথাগুলো স্পষ্ট মোহর কানে ভেসে আসছে। শিহান রাগী গলায় শুধায়,

“ কোথায় ও? ওকে ফোনটা দাও। আমি ওর সাথে কথা বলবো। “

মায়া চাপা স্বরে বলে,

“ রেগে আছো অযথা। এখন ওর সাথে কথা বলার জায়গায় উল্টো ধমকা ধমকি করবে তুমি। রাগ কমলে কল দিও। “

শিহান ফেরদৌস বলে,

“ রেগে যাওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? ও না জানিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে কেনো? ও কি কোনো বাচ্চা? চব্বিশ ঘণ্টা ওর আগে পিছে সবাইকে বেবি সিটিং করে বেড়াতে হবে সবার? “

মায়া নিজেও এবার রেগে যায়। রাগী গলায় বলে,

“ আমার তোমাকে কল করে জানানোটা ভুল হয়েছে। আর কল করবো না আমি। আমার বোনের জন্য আমি যথেষ্ট। তুমি তো অলরেডি আমাদের প্রয়োজনীয় খরচ প্রোভাইড করছো। এর থেকে বেশি কিছু এক্সপেক্ট করাটা আমাদের জন্য বোকামি। “

কথাটা বলেই মায়া কল কেটে দেয়। রাগে তার শরীর মৃদু কাঁপছে। মনে মনে বাবার প্রতি তীব্র ক্ষোভ পুষে রেখেছে সে। মা’য়ের খুব অভাব বোধ করছে। তাদের মা থাকলে নিশ্চয়ই আজ মোহর এই কঠিন সময়টায় মোহকে খুব আগলে রাখতো? মায়া চেষ্টা করে। ছোট হওয়া সত্ত্বেও মা-বাবার মতো মোহকে আগলে রাখার চেষ্টা করে। যদিও মোহ এতে বিরক্ত হয়, রাগ দেখায়। তবুও মায়া নিজের জায়গায় অনড় রয়।

ফোন রেখে চোখ তুলে মোহর দিকে তাকায় মায়া। প্রশ্ন করে,

“ এই? মুভি দেখবি? “

মোহ না তাকিয়ে উত্তর দেয়,

“ পরীক্ষা না চলে তোর? বাসায় যাস না কেন? পরীক্ষায় ফেল করে যাতে আমার নাম নিয়ে বেঁচে যেতে পারিস? “

“ আমার পরীক্ষা নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। আগামীকাল কোনো পরীক্ষা নেই। তাই চিল মুডে এখন আমরা মুভি দেখতে পারবো। কোনটা দেখবি বল। ল্যাপটপে ডাউনলোড দেই আমি। “

“ বেবিজ ডে আউট দেখা যায়। “

মায়া ল্যাপটপ নিয়ে বসে মুভি ডাউনলোড দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। মোহ আচমকা বলে উঠে,

“ আন্টিকে বলিস কালকে কাউকে দিয়ে ট্রিমার পাঠিয়ে দিতে। “

মায়া চমকায়। পরপর প্রশ্ন করে,

“ চুল কেটে ফেলবি? “

“ ধরে রাখার উপায় তো দেখছি না। “

মায়া কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে মোহকে দেখে। পরক্ষণে ল্যাপটপ সহ অন্যদিকে ঘুরে বসে। চোখ টলমল করছে তার। সে জানে মোহ যতটা সহজে কথাটা বলেছে, ততটা সহজ নয় সবকিছু। তার বোনের মাঝে কি ঝড় চলছে তা কিছুটা হলেও টের পাচ্ছে মায়া।

__________

সদ্য বাসায় ফিরেছে মনন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করে পকেট হতে ফোন, ওয়ালেট বের করতে থাকে সে। এক এক করে সব বের করে রাখতেই তার খেয়াল হয় রুমালটার কথা। রুমালটা বের করে হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে সে। বুঝতে পারছে না কি করা উচিত। বলেছিলো তো ফেলে দিবে সে। কিন্তু কেন যেনো ইচ্ছে করছে না।

অতর্কিত বৃষ্টির পানে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে মনন। রুমালের ভাজটা আর খুলে না। বরং সে-ই অবস্থাতেই টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেয়। সোজা চলে যায় গোসল করতে। গোসল সেড়ে বের হতেই দেখতে পায় তার টেবিলের উপর ধোঁয়া উঠা এক কাপ গরম কফি রাখা। মনন বুঝতে পারে কাজটা আর কারো নয় বরং তার আব্বু আরিফ কায়সারের।

মনন ভেজা চুল মুছে কফির কাপ হাতে বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টি ছিটে আসছে। মনন মনযোগ দিয়ে তা দেখছে। বৃষ্টির ঝমঝম ধ্বনি চিরে আচমকা একটা করুণ স্বর তার কানে ভেসে আসে।

“ আপনার কি মনে হয় ডক্টর? আমি বাঁচবো? রিপোর্টের সার্ভাইভাল রেট জানতে চাচ্ছি না, আপনার কি মনে হয় তা জানতে চাচ্ছি। “

মনন অবাক হয়। মনে পড়ে যায় মোহর জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের কথা। যে-ই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে নি সে। কি ভেবে যেনো মনন দ্রুত নিজের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। কফি মগটা হাত থেকে রেখে ল্যাপটপ খুলে বসে চেয়ারে। হসপিটালের ওয়েবসাইটে লগইন করে পেশেন্ট ডিটেইলস সাইটে চলে যায় সে। পেশেন্টের ফাইল নম্বর জরুরী তার হোম পেজে যেতে। মনন মনে করার চেষ্টা করে। কি ছিলো মোহর ফাইল নম্বর? বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর তার মনে পড়ে।

কি বোর্ড চেপে টাইপ করে সি আর সিক্স জিরো নাইন সেভেন। মোহর সম্পূর্ণ ডিটেইলস স্ক্রিনে ভেসে উঠে। মনন মনযোগ দিয়ে পুরোটা স্ক্রিনে চোখ বুলায়। মেহনামা ফেরদৌস মোহ। বয়স সতেরো বছর এগারো মাস। পিতার নাম শিহান ফেরদৌস। মাতার নাম বিথী আফরোজ।

মনন এবার কিছুটা নিচে গিয়ে রিপোর্টসে ক্লিক করে। সঙ্গে সঙ্গে মোহর সকল রিপোর্ট ক্রমানুসারে স্ক্রিনে ভেসে উঠে। মনন মনযোগ দিয়ে এক এক করে সবগুলো রিপোর্টস দেখে। বিশেষ করে এফএনএসি এবং বায়োপসি টেস্টের রিপোর্ট। জেনে নেয় ফিমার অস্থিতে বেড়ে উঠা টিউমারের আকার এবং আকৃতি সম্পর্কে।

টিউমারের অবস্থা অনুযায়ী রেকমেন্ডেশনে লেখা আছে যে কেমোথেরাপির মাধ্যমে আগে টিউমারটাকে নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। তারপর ডক্টররা মোহর পায়ে সার্জারি পারফর্ম করবে। উক্ত সার্জারিতে ফিমার নামক হাড়টা কেটে সেখানে ইম্পল্যান্টও প্রতিস্থাপন করা হতে পারে। তবে থার্ড স্টেজ হওয়ায় সার্জারি সফল হওয়ার চান্স খুব একটা হাই না। আর সৌভাগ্যক্রমে সার্জারি সফল হলে তাহলে বাকি চিকিৎসাটা কেমো এবং রেডিওথেরাপির মাধ্যমে বহাল থাকবে।

মনন নির্বিকার ভঙ্গিতে ল্যাপটপের মনিটর নামিয়ে ফেলে। এতক্ষণ শরীরে কাজ করা সতেজতাটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো তার। প্রশস্ত বুকটা ক্লান্তিতে উঠানামা করছে। চোখ আর মাথাও ব্যথা করছে। মনন আলতো হাতে চোখের চশমাটা খুলে ফেলে। ক্লান্ত মাথাটা পিছন দিকে এলিয়ে দেয়। মনে প্রশ্ন জাগে। মোহ কি জানে সবটা? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে উদয় হতেই বদ্ধ চোখের সামনে মোহর কান্নারত মুখটা ভেসে উঠে। চুল হারানোর যন্ত্রণায় যেই মেয়ে এতটা কাতর, সে নিজের শরীরের একটা আস্ত হাড় হারিয়ে শক্ত থাকতে পারবে তো? নাকি বিষাদ সাগরে হারিয়ে যাবে?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০৪

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪.

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে আজ সকাল থেকে। আবহাওয়াটায় কেমন শীতল ভাব বিরাজ করছে। গরম কফির মগে চুমুক দিয়ে পরবর্তী পেশেন্টের জন্য অপেক্ষা করছে মনন। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে নিজের মা বাবা সহ কেবিনে প্রবেশ করে। বাচ্চাটাকে দেখতেই মননের ঠোঁটের কোণে প্রসস্থ হাসি ফুঁটে উঠে। এক গাল হেসে শুধায়,

“ হ্যালো আয়েশা! কেমন আছো তুমি? “

আয়েশা নিজের মা বাবার সঙ্গে মননের মুখোমুখি বসে প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ অনেক ভালো। “

মনন হাসি মুখে বাচ্চাটাকে একবার ভালো করে দেখে নেয়। তার পোস্ট গ্রেজুয়েট লাইফের প্রথম পেশেন্ট এই মেয়েটা। এক বছরেরও অধিক সময় ধরে মেয়েটার ট্রিটমেন্ট চলেছে। পুরোটা জার্নি মনন নিজ চোখে দেখেছে। আজ যখন বাচ্চা মেয়েটা নিজের ভয়ংকর রোগটাকে হারিয়ে দিয়ে বিজয়িনীর বেশে তার সামনে এসে হাজির হয়েছে তখন গর্বে মননের নিজের বুকেই প্রশান্তির হাওয়া বইছে। সে শেষবারের মতো আয়েশার সকল রিপোর্ট গুলো দেখে নিয়ে বলে,

“ কংগ্রেচুলেশন। আয়েশা এখন পুরোপুরি সুস্থ। আর কোনো ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন নেই। রিপোর্ট গুলো আমি স্যারকে ফরোয়ার্ড করে দিয়েছিলাম। উনি লিভ দেওয়ার এপ্রুভাল দিয়েছেন। “

আয়েশার বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

“ এখন আর কোনো রিস্ক নেই তো, ডক্টর? “

মনন চশমাটা ঠিক করে বলে,

“ রিস্ক তো সবসময়ই থেকে যাবে স্যার। এজন্যই আয়েশার লাইফস্টাইলটা বিভিন্ন নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ওর ডায়েট চার্টটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই ব্যাপারে সবসময় কড়া নজর রাখতে হবে। তাছাড়া ওকে সবসময় একটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখাটাও জরুরী। ও সুস্থ হয়েছে, তবে ওর ইমিউনিটি সিস্টেম এখনো খুব দূর্বল। কেমোতে শুধুমাত্র আক্রান্ত কোষগুলো ধ্বংস হয় না। পাশাপাশি সুস্থ কোষও বিলীন হয়ে যায়। সেই সেল গুলো রিডেভেলোপ হতে যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। আর ওকে রেগুলার ফলোআপের মাঝে থাকতে হবে। জাস্ট টু মেক শিওর যে রোগটাকে যেনো আমরা মনিটরিং এর উপর রাখতে পারি। ট্রিটমেন্ট শেষে প্রথম ৫ বছর কিন্তু খুব সেন্সিটিভ একটা পিরিয়ড। এই সময়ের মাঝে রোগটার কামব্যাক করার হাই চান্স থাকে। আশা করি বুঝতে পারছেন। “

আয়েশার মা বাবার কপালে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। কি অদ্ভুৎ একটা রোগ! সুস্থ হয়েও একটা মানুষ পুরোপুরি আশংকা মুক্ত হতে পারে না। আবার তার ফিরে আসার ভয় মনে পুষে সেই অনুযায়ী চলতে হবে। মনন তাদের আশ্বস্ত করে বলে,

“ আয়েশা তো খুব ব্রেভ গার্ল। আপনারা চিন্তা করবেন না। ও সবসময় নিয়ম গুলো মেনে চলবে। তাই না আয়েশা? “

আয়েশা হেসে বলে,

“ হ্যাঁ। আমার তো অভ্যাস হয়ে গিয়েছে এখন। আমার অসুবিধা নেই। “

মনন হেসে কম্পিউটার স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থির করে দ্রুত হাতে কি বোর্ড ইউজ করতে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ কাজটা সম্পাদন করে আয়েশার মা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ হসপিটাল থেকে লিভ লেটার আমি লিখে দিয়েছি। আপনারা বাহিরে ওপিডি ডেস্ক থেকে লেটারটা কালেক্ট করে নিবেন। উনারা বলে দিবে কত নাম্বার রুম থেকে সিগনেচার নিতে হবে। “

বেরিয়ে যাওয়ার আগে আয়েশা দ্রুত নিজের হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা মননের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ এটা আপনার জন্য ডক্টর। “

মনন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“ এটা কি? “

আয়েশা কিছু না বলে হাসে। মনন ব্যাগ খুলতেই ভেতর থেকে একটা ফ্রেম করা বিভিন্ন রঙের সাহায্যে আঁকা থ্যাঙ্কিউ কার্ড বেরিয়ে আসে। সেই সঙ্গে এক বক্স চকলেট। আয়েশার মা বলে উঠে,

“ আয়েশা আপনাকে থ্যাঙ্কিউ বলতে চাইছিলো। তাই নিজ হাতে আপনার জন্য এই ড্রয়িংটা করেছে। “

মনন হেসে হাত বাড়িয়ে আয়েশাকে কাছে ডাকে। আয়েশা দৌড়ে তার কাছে আসতেই মনন ছোট বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ তুমি অলয়েজ আমার কাছে স্পেশাল থাকবে। ইউ নো দ্যাট? “

আয়েশা হেসে বলে,

“ আপনিও আমার কাছে স্পেশাল থাকবেন। আমিও বড়ো হয়ে আপনার মতো ডক্টর হবো। অনকোলজিস্ট হবো। “

“ ইন শা আল্লাহ। “

__________

মোহর প্রথম সাইকেল কেমোটা ছিলো ৫ দিনের। প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ ঘন্টা লম্বা সময় ধরে কেমোর ডোজ নিতে হয়েছে তার। ব্যাপারটা মোহর কাছে বিরক্তিকর হলেও সে তা খুব একটা প্রকাশ করে নি। এই পাঁচ দিন এক চাপে হাতে ক্যানেলা পড়ে থাকাটাও খুব বিরক্তিকর লেগেছে তার কাছে। রাতে ঘুমের মাঝে বারবার ক্যানেলার দিকে খেয়াল রাখতে হতো। ভুল করে ক্যানেলায় চাপ পড়লেই সুঁইয়ে লেগে হাত কেটে যাওয়ার আশংকা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এক প্রকার। তার উপর হসপিটাল বেডটায় ঘুমাতেও খুব অস্বস্তি লাগে তার।

ওই ডক্টরটা, কি যেনো নাম? মোহ মনে করার চেষ্টা করে। তবে মরণ কিংবা মদন ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ তার মনে পড়ে না। ওই ডক্টরটা ওদিন তাকে গ্রাফিলের ডোজ দিয়ে যাওয়ার পর সেদিন রাতে কি ভয়ংকর জ্বর এসেছিলো মোহর! সারারাত জ্বরে কাতরেছে সে। যদিও নার্সরা খুব ভালো খেয়াল রেখেছে তার। তবে আপন কারো সান্নিধ্য খুঁজছিলো তার অবচেতন মন। মোহ জানে সকলের পরিস্থিতি। বুঝতে পারে সে সব। তাই তো এই ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করে না সে। উল্টো ট্রিটমেন্ট চলাকালীন পুরোটা সময় নিজের মনের বিরুদ্ধেও হসপিটালে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেনো কারো অযথা তাকে নিয়ে কষ্ট না করতে হয়।

সদ্য ঘুম থেকে উঠে শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিলো মোহ। আজ সারা বিকেল ও সন্ধ্যা ঘুমিয়ে এই রাত নয়টার দিকে ঘুম ভেঙেছে তার। বেডের ডান পাশে বিশাল দেয়াল জুড়ে কাঁচের জানালাটা দিয়ে বাহিরের শহরটা দেখছে সে। কানে ভেসে আসছে ওয়াশরুম থেকে আগত পানির শব্দ। ওই মেয়ে এখনো বাসায় ফিরে নি? আজও হসপিটাল থাকবে না-কি?

মোহর তেষ্টা পায়। সে পানি খাওয়ার জন্য আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে বেড সাইড টেবিল হতে পানির বোতলটা নিতে নিলেই তার দৃষ্টি আটকায় আচমকা সফেদ রঙা বালিশের দিকে। মোহ বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষণ বালিশের দিকে তাকিয়ে রয়। পরপর দ্রুত পায়ে বেড ছেড়ে নেমে কাবার্ডের সাথে সংযুক্ত আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। দৃষ্টিতে পরিবর্তন আসে তার। বিস্ময়তা উবে গিয়ে মলিন ভাব উদয় হয়। মন চায় আয়নাটা ভেঙে ফেলতে। কিন্তু সে সেরকম কিছুই করে না। উল্টো এই আয়না থেকে দূরে পালাতে ওই অবস্থায়ই কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যায় সে।

__________

পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের সকল অনকোলজিস্টদের আজ রাত ৭ টা ৩০ থেকে একটা সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় দুই ঘন্টার এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে হসপিটালের অডিটোরিয়ামে। সেমিনার শেষ করে কেবল মাত্র বেরিয়েছে মনন। ক্লান্ত মস্তিষ্কটা কিছুক্ষণ মুক্ত আবহাওয়ার সান্নিধ্য চাইছে। তা-ই আর কেবিনের দিকে পা না বাড়িয়ে মনন সোজা লিফটে করে ১৪ তম তলায় চলে যায়। ১৪ তলায় পৌঁছে বাকি একটা ফ্লোর সে ইমারজেন্সি সিঁড়ি ধরে পায়ে হেঁটেই উঠে।

ছাদের দরজার কাছাকাছি যেতেই মনন অবাক হয়। ছাদের দরজা খোলা। কিন্তু সে ব্যতীত তেমন কেউ একটা তো কখনো ছাদের এদিকে আসে না। তাহলে? সিকিউরিটির কেউ এসেছে নাকি? মনে প্রশ্ন নিয়েই মনন ছাদে পা রাখে। সঙ্গে সঙ্গে তার কানে ভেসে আসে কারো ফোপাঁনোর শব্দ। কেউ কাঁদছে? মনন অপ্রত্যাশিত শব্দের উৎস খুঁজতে ছাদের বাম দিকে পা বাড়ায়। আলো আঁধারের মিলনমেলায় একটা নারী ছায়ামূর্তিকে সে ছাদের এককোণে বসে থাকতে দেখে। হাঁটুতে মুখ গুজে কাঁদছে। কান্নার দমকে তার পুরো শরীরটাও মৃদু কাঁপছে।

মনন বুঝতে পারে না তার কি করা উচিত। এগিয়ে গিয়ে মানুষটাকে শান্তনা দেওয়া উচিত? নাকি তার প্রাইভেসির প্রতি সম্মান রেখে এখান থেকে প্রস্থান করা উচিত? কিন্তু মনন এখান থেকে চলে গেলে যদি এই মানুষটা কষ্টের সাগরে গা ভাসিয়ে কোনো ভুলভাল স্টেপ নেয়? সেটাও তো আরেক ঝামেলা।

মনন নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশ লাইট অন করে। সেই আলো নারী ছায়ামূর্তিটার দিকে তাক করে ডাকে,

“ এক্সকিউজ মি? “

সঙ্গে সঙ্গে এক জোড়া অপ্রস্তুত নারী দৃষ্টি চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। অপ্রস্তুত মননও হয়, যখন সে দেখে সেই মেয়েটা মোহ। কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে,

“ আপনি? ছাদে একা কি করছেন? কাঁদছেন কেনো? “

মোহ উত্তর দেওয়াটা প্রয়োজনীয় মনে করে না। সে আবার হাঁটুতে মুখ গুজে। এহেন কাণ্ডে মনন অবাক হয়। পরিবেশটা কিছুটা স্বাভাবিক করতে সে হেসে বলে,

“ আপনি কি নিজের ইমেজ বাঁচাতে লোকচক্ষুর আড়ালে এসে কাঁদছেন? চিন্তা করবেন না। আমি কাউকে বলবো না। “

মোহ রাগী গলায় শুধায়,

“ গেট লস্ট। “

মননের হাসি উবে যায়। সে তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইছিলো। আর এই মেয়ে কি-না তার সাথেই বেয়াদবের মতো কথা বলছে। গেট লস্ট মানে কি? নিজের থেকে বয়সে বড়ো কারো সাথে কথা বলার আদব নেই নাকি এই মেয়ের মাঝে? মনন গলার স্বর গম্ভীর করে বিরক্তি নিয়ে শুধায়,

“ যাচ্ছি। কান্নাকাটি যা ইচ্ছা করুন, কিন্তু ভুলেও ছাদ থেকে লাফ দিবেন না। অযথা কারো সুইসাইড কেসে হেনস্থা হতে রাজি নই আমি। “

বলে মনন যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিয়েই হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ে। কি ভেবে যেনো ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা মোহর পায়ের কাছে মেঝের দিকে ধরে। মুহুর্তেই তার দৃষ্টি শীতল হয়। এগিয়ে যায় মোহর দিকে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মোহর সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে। আরেকটু মনযোগ দিয়ে মোহর পায়ের কাছে পড়ে থাকা বস্তুটা দেখে। পরপর কণ্ঠে যথাসম্ভব কোমলতা মিশিয়ে ডাকে,

“ মোহ? আপনি হেয়ার ফলের কারণে কাঁদছেন? “

মোহ যেনো আশকারা পেলো। নিজের ব্যক্তিসত্তা চিরে করে বসে এক নিষিদ্ধ কাজ। নিজের দুঃখটা মেলে ধরে অপরিচিত মানুষটার কাছে। ভুলে বসে নিজের তেজ। হাঁটু থেকে মুখ তুলে কান্না মিশ্রিত করুণ স্বরে বলে,

“ এইটা থামানোর কোনো উপায় নেই? “

বলতে বলতে মোহ নিজের হাত চুলের ভাজে বুলিয়ে সামনে এনে ধরে। মনন স্পষ্ট দেখে শুভ্র রঙা হাতের আজলে বেশ কিছু চুল এসে পড়েছে। কেমোথেরাপির অন্যতম সাইড ইফেক্ট এটা। যেই সাইড ইফেক্টটা সাধারণ দৃষ্টিতে একটা মেয়ের জন্য খুবই ভয়ংকর। মনন বেশ সাবলীল গলায় বলে,

“ উপায় নেই। “

সামান্য কিছু মাথার চুল হারানোর কষ্টে মোহ বয়ে গেলো। কাতর ভঙ্গিতে নিজের মাথায় বারবার হাত বুলিয়ে যাচ্ছে সে। প্রতিবারই তার হাতের মুঠোয় কালো চুল গুলো উঠে আসছে। তা দেখে মোহর কান্না আরও বেড়ে যায়। সে বলতে থাকে,

“ আর কি কি কেড়ে নেয় ক্যান্সার? আর কি কি হারাতে হবে? এতো ভয়ংকর কেনো? “

যন্ত্রণা কাতর মুখটা দেখে মননের মন আরো কোমল হয়ে আসে। সে হাতের ফোনটা মেঝেতে রেখে মোহর সামনে মেঝেতে বসে পড়ে। চুল হারানোর বিরহে মেয়েটা অবিরত কেঁদেই চলে। মনন নীরবে চেয়ে রয়। অযথা শান্তনা দিতে ইচ্ছে হয় না তার। শান্তনা কখনো দুঃখ ভুলানোর ওষুধ হতে পারে না। কিছু কিছু দুঃখ আছে যা শান্তনা বাক্যে বিন্দুমাত্র ঘুচে না, উল্টো তা দ্বারা সেই দুঃখটাকে আরো উপহাস করা হয়।

দক্ষিণের হাওয়া এসে ছুঁয়ে যায় মোহকে। ছুঁয়ে যায় তার মনের বিষণ্নতাকে। সেই বিষাদমাখা হাওয়া মননকেও ছুঁয়ে দেয়। মোহ তখনো বারবার নিজের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলো। মনন এবার না চাইতেও এগিয়ে গিয়ে মোহর দুই হাত ধরে তাকে থামায়। মৃদু গলায় বলে,

“ থামুন। “

মোহ শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকায় মননের দিকে। বলে,

“ আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই অবস্থায় মরে গেলে আমাকে দেখতে বিশ্রী লাগবে না। দু’দিন পর আমি দেখতে বিশ্রী হয়ে যাবো। আমি ওই অবস্থায় নিজেকে দেখতে চাই না। আমি ওই রূপটা নিয়ে কারো সামনে দাঁড়াতে চাই না। “

মনন একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলে,

“ যুদ্ধ দেখেছেন কখনো? যুদ্ধ করার সময় কিন্তু একজন যোদ্ধা নিজের বাহ্যিক রূপের কথা ভাবে না। তার গায়ে ময়লা লাগে, আঘাতে শরীর চিরে রক্ত বেরিয়ে আসে। তবুও তারা যুদ্ধ থামায় না, বরং চালিয়ে যায়। আপনিও সেরকম। একটা রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন। এতে আপনার বাহ্যিক রূপ নিয়ে আফসোস করে লাভ আছে বলুন? মাঝপথে পালাতে চাইলে সবাই আপনাকে ভীরু হিসেবে চিনবে। “

মোহ আনমনে বলে বসে,

“ নিজের চোখের সামনে নিজেকে নিঃশেষ হতে দেখবো তাই বলে? “

“ একবার নিঃশেষ হতে অসুবিধা কোথায়? নিজেকে ফিনিক্স পাখি ভাবুন। অগ্নিপাখির মতো ধ্বংসস্তুপ থেকে নতুন জীবনের সন্ধান করুন। একবার ক্যান্সারকে হারিয়ে দেখুন। আয়নার সামনে দাঁড়ালে তখন নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সাহসী নারী মনে হবে আপনার। “

নির্বাক, নীরব মোহ মননের মুখপানে তাকিয়ে রয়। সময় গড়ায় কিন্তু দৃষ্টি ফেরায় না। অজানা কারণে এই মুহুর্তে মননের অস্বস্তি লাগছে না। বরং সে-ও মোহর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার চোখে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। আচমকা নীরবতা ভেঙে মোহ প্রশ্ন করে,

“ আপনার কি মনে হয় ডক্টর? আমি বাঁচবো? রিপোর্টের সার্ভাইভাল রেট জানতে চাচ্ছি না, আপনার কি মনে হয় তা জানতে চাচ্ছি। “

আকস্মিক প্রশ্নে মনন ভড়কে যায়। কি উত্তর দিবে সে? নিজের মনকে প্রশ্ন করে। উত্তর খুঁজে পায় না কোনো। কালো আকাশ ফেটেও তখন বিদ্যুৎ চমকে উঠে। সেই আলোয় মনন নীরবে মোহর শান্ত অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। আচমকা তার বুক ধ্বক করে উঠে। তার সামনে বসে থাকা এই মেয়েটা মারা যেতে পারে। এই অদ্ভুৎ সত্যটা তাকে ক্ষণিকের জন্য নাড়িয়ে তুলে। কি কারণে কে জানে!

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০৩

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩.

রাত তখন প্রায় দশটা বাজে। চার শয়নকক্ষ বিশিষ্ট বিশাল এপার্টমেন্টে কেবল দুজন মানুষ এই মুহুর্তে অবস্থান করছে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আরিফ কায়সার ওভেনে খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে ছেলেকে ডাকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। করিডরের দ্বিতীয় রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রুমের দরজায় নক করে। ভেতর থেকে মনযোগ ভঙ্গ হওয়া পুরুষালি স্বরটা বলে উঠে,

“ এসো আব্বু। “

আরিফ কায়সার দরজার নব ঘুরিয়ে রুমে পা রাখতেই দেখতে পায় সাধারণ টি শার্ট এবং ট্রাউজার পরিহিত ছেলেকে। টেবিলে বসে চোখে পাওয়ারের চশমা এঁটে বইয়ে মুখ গুজে রেখেছে। কপালের মাঝে সূক্ষ্ণ চিন্তার ভাজ। আরিফ কায়সার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ বেশি ব্যস্ত তুমি? খাবার বেড়ে রুমে দিয়ে যাবো? “

মনন শুধায়,

“ তুমি খেয়ে নাও আব্বু। আমি পরে খেয়ে নিবো উঠে। “

ছেলের মলিন কণ্ঠ স্বর শুনে আরিফ কায়সার জানতে চায়,

“ মন খারাপ কোনো বিষয় নিয়ে? “

মনন এবার বই ছেড়ে মুখ তুলে নিজের আব্বুর দিকে তাকায়। অত:পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আজ একটা নতুন পেশেন্টের কেস এসেছে। চার মাসের একটা বাচ্চা মেয়ে। তার বাবা এবং দাদী তাকে নিয়ে এসেছে। বাচ্চাটার জন্মের এক সপ্তাহের মাথায় তার মা মারা যায়। ওর প্রাথমিক লক্ষ্মণ গুলো হলো জ্বর, শ্বাসকষ্ট, রাতে ঘেমে যাওয়া, শরীরে ছোট লাল লাল দাগ আরো ইত্যাদি। আমি বোন ম্যারো বায়োপসি সহ আরো জরুরী টেস্ট গুলো করতে দিয়েছি। যত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভবত রিপোর্ট দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু… “

“ কিন্তু কি? “

“ রিপোর্টে বাচ্চাটার লিউকেমিয়া ধরা পড়বে বলে আমি প্রায় নিশ্চিত। মনে মনে দোয়া করছি যেনো আমার ধারণা ভুল হয়। কিন্তু কিছুটা হলেও আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মনে হচ্ছে বাচ্চাটার শরীরে ভয়ংকর অসুখটা বাসা বেঁধেছে। আব্বু তুমি দেখলে বুঝতে পারতে… বাচ্চাটা অনেক ছোট। ওর আব্বু ওকে কোলে নিয়ে রেখেছিলো। মনে হচ্ছিলো হাতের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে এক্ষুণি পড়ে যাবে। অনেক নিষ্পাপ দেখতে। আমার… “

আরিফ কায়সার ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

“ তোমার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছি। আমিও দোয়া করবো যেনো রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। বাকিটা আল্লাহর মর্জি। ধরো যদি রিপোর্টে মেয়েটার লিউকেমিয়া ধরাও পড়ে, তাহলে তোমার হাতে করার মতো একটাই জিনিস আছে। নিজের জ্ঞান থেকে বাচ্চাটাকে একটা প্রোপার ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন দিয়ে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা। আল্লাহ হায়াত রাখলে বাচ্চাটা কোনো না কোনো উছিলায় ঠিকই সুস্থ হয়ে যাবে। দেখে নিও। “

মনন আর কিছু বলে না। তার বারবার ওই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটার মুখ মনে পড়ছে। হয়তো ওই নিষ্পাপ বাচ্চার এতো ভয়ংকর একটা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা তাকে ভীত এবং আবেগী করে তুলেছে। কিন্তু ব্যাপারটা মননের সাথে সাজে না। সে তো জেনে বুঝেই এই প্রফেশন বেছে নিয়েছে। সে তো সবসময়ই জানতো, সে যে-ই রোগীদের চিকিৎসা করবে তারা প্রত্যেকেই পৃথিবীর বুকে নিষ্পাপ ফুল। মনন আর কিছু বলতে পারে না। নিজের মন খারাপটা ভেতরে চেপে গিয়ে বলে,

“ আমি কিছুক্ষণ পরে আসছি। তুমি খেয়ে নাও। “

আরিফ কায়সার আর ছেলেকে বিরক্ত করে না। যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই প্রস্থান করে।

__________

এসি চালিত মিটিং রুমটায় গোল টেবিলে অফিশিয়াল বৈঠকে ব্যস্ত নয়-দশ জন বাংলাদেশি এবং চায়নিজ পুরুষ। গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস মিটিং এর ফাঁকে জ্বলজ্বল করা ফোনের স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টিপাত করেন সাতচল্লিশ বছরের শিহান ফেরদৌস। টেবিলের উপর সাইলেন্ট মুডে থাকা ফোনটায় আদরের মেয়ের হোয়াটসঅ্যাপে ইনকামিং কলটা উনার দৃষ্টি এড়ায় না। তবে এই মুহুর্তে কল রিসিভ করাটা সম্ভব নয় উনার পক্ষে। তাই ফের মিটিংয়ে মনযোগ দেয় তিনি।

চায়নিজ ক্লাইন্টদের সঙ্গে লম্বা মিটিংটার সমাপ্তি ঘটে আরো প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর। একে একে সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের বিদায় জানান শিহান ফেরদৌস। এইমাত্র শেষ হওয়া মিটিংয়ে একটা জ্যাকপটের ন্যায় ডিল ফাইনাল হওয়ার খুশিটা উনার মুখে স্পষ্ট। আচমকা শিহানের খেয়াল হয় মেয়ের কথা। সম্পূর্ণ রুমটা খালি হতেই উনি আরাম করে গিয়ে চেয়ারে বসেন। ফোনটা নিয়ে মেয়ের নাম্বার ডায়াল করেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলটা রিসিভ হয়। ফোনের অপর পাশে থাকা মেয়েলি স্বরটা সোজা বলে উঠে,

“ মোট বিশ বারের উপর কল করেছি। ইমারজেন্সি সিচুয়েশন ভেবে অন্তত একবার কলটা রিসিভ করলেও পারতে তুমি। তোমার কি এতটুকুও চিন্তা হয় নি, যে তোমার মেয়ে ঠিক আছে তো? “

শিহান ফেরদৌসের হাসি-হাসি মুখটা কাঠিন্য রূপ ধারণ করে। তিনি ভরাট গলায় বলে,

“ তুমি জানতে আমি মিটিংয়ে ছিলাম। মিটিংয়ের মাঝে বারবার কল করাটা কোন ধরনের অভদ্রতা? “

অপর পাশের মেয়েটা এবার কিছুটা রেগে গিয়ে বলে,

“ তুমি দেশের বাহিরে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছো সেটা আমার অজানা নয় বাবা। কিন্তু তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো যে তোমার মেয়ে হসপিটালে। দিন-রাত আমাকে এখানে তোমার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। একবার অন্তত দেশে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে গেলেও তো পারো। এইটুকু করার মতো সময়ও তোমার হবে না? আমি তোমার হয়ে তোমার দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছি না। তোমার পরিস্থিতিটা আমি জানি। কিন্তু তুমি একবার অন্তত হসপিটালে আসবে এটা এক্সপেক্ট করাটাও কি দোষের? “

“ তোমার কি মনে হয় আমি ইচ্ছে করে তোমাদের অবহেলা করছি? “

“ প্রশ্নটা নিজেকে করো। আমি শুধু তোমাকে এইটুকু জানাতে কল দিয়েছিলাম আমার আগামীকাল সকালে এক্সাম আছে। আজ রাতে হসপিটালে থাকা সম্ভব হবে না আমার। এখানের নার্সদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তবুও তুমি কথা বলে একটু স্পেশাল টেক কেয়ারের ব্যবস্থা করো। সারারাত যেনো অন্তত একজন পেশেন্ট এসিস্টের দায়িত্বে থাকে। আমি আগামীকাল কলেজ থেকে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার হসপিটাল আসবো। “

কথাটুকু বলেই সোজা কল কেটে দেয় মেয়েটা। শিহান ফেরদৌস নীরবে পিঠ এলিয়ে দেয় পিছনে। তার আদরের মেয়েটা ইদানিং আর বাবা খেয়েছে কি-না অথবা কেমন আছে এরকম কিছু জানতে চায় না। কণ্ঠে কেমন অভিমান মিশিয়ে কথা বলে।

শিহান বুঝতে পারে মেয়ের তার প্রতি অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু উনার কাছে কি-ই বা করার আছে? নিজের তরফ থেকে যা সম্ভব হচ্ছে তা-ই করছে উনি। দেশের সেরা ক্যান্সার স্পেশাল হসপিটালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। বেস্ট চিকিৎসাটাই তিনি নিশ্চিত করেছেন। আর কি-ই বা করবেন তিনি? চাইলেই কি এখন তার দেশে ফেরা সম্ভব নাকি? সদ্যই তিনি নিজের কোম্পানির একটা নতুন ব্র্যাঞ্চ চায়নায় খুলেছেন। তা নিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই। সকল কাজ ফেলে দেশে ফেরাটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয় এই মুহুর্তে।

__________

মননের প্রতিদিন হসপিটালে এসে সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে নিজ তালিকাভুক্ত পেশেন্টদের কেবিনে গিয়ে একবার রাউন্ড দিয়ে আসা এবং সারাদিন শেষে বাসায় ফেরার পূর্বেও তার ডিউটি হচ্ছে আরেকবার পেশেন্টদের শারীরিক অবস্থা পরখ করতে রাউন্ডে যাওয়া। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নিজ কেবিন থেকে বেরিয়ে সে সোজা চলে যায় লিফটের কাছে।

এক হাজার এগারো নম্বর রুমে আট বছরের ছেলে বাচ্চাটার সদ্য বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সম্পন্ন হয়েছে। মনন চশমার ফ্রেম গলে মনযোগ দিয়ে তার ফাইল দেখতে ব্যস্ত। বাচ্চাটার পাঁচ বছরের ছোট বোন নিজের মায়ের কোলে বসে ছিলো। সে চোখ পিটপিট করে মননকে দেখে প্রশ্ন করে,

“ ভাইয়া কবে বাসায় যাবে? “

মনন চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকায়। কিছুটা হেসে জবাব দেয়,

“ এইতো আর কয়েকটা সপ্তাহ। তোমার ভাইয়া সুস্থ হোক। তারপর বাসায় যাওয়ার পারমিশন দিয়ে দিবো আমরা। “

মেয়েটা এবার ঠোঁট উল্টে বলে,

“ ভাইয়া এখনো সুস্থ হয় নি? কিন্তু আম্মু তো বলেছিলো আমি ভাইয়াকে আমার থেকে একটু গ্লুকোজ গিফট করলে ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে। বাসায় গিয়ে আমার সাথে খেলতেও পারবে। “

মনন প্রশ্নসূচক দৃষ্টি মেলে তাকাতেই বাচ্চাটার মা বলে উঠে,

“ বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট শব্দটা ওর জন্য কঠিন ছিলো। তা-ই সহজ করে বুঝাতে গ্লুকোজ বলেছি। “

মনন একবার হসপিটাল বেডে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটাকে দেখে নেয়। অত:পর ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ভাইয়ার জন্য প্রে করো আল্লাহর কাছে। যেনো আল্লাহ তোমার ভাইয়াকেও তোমার মতো স্ট্রং করে দেয়। আল্লাহ ছোট বাচ্চাদের দোয়া দ্রুত কবুল করেন। “

বাচ্চাটা মনযোগ দিয়ে তা শুনে। মনন পেশেন্টের মা বাবার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত করে সব ঠিক আছে। চিন্তার কোনো বিষয় নেই। আগামীকাল সকালে সে আবার আসবে।

আজকের দিনের শেষ পেশেন্টটাকে দেখা শেষে মনন লিফটের দিকে যাওয়ার জন্য করিডর ধরে হাঁটছিলো। আচমকা এক হাজার চার নম্বর কেবিনের সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে কেবিনের ভেতর দিকে তাকায় সে। বেশ কিছু নার্সকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে কারো চেঁচামেচির শব্দ।

মনন সিচুয়েশন বুঝার জন্য কেবিনের ভেতর পা রাখে। ছয় সাতজন নার্সের ভীড় কেটে সে ভিতরে যেতে যেতে প্রশ্ন করে,

“ কি হচ্ছে এখানে? “

মূল দৃশ্যটা নিজ চোখে দেখতেই মনন আশ্চর্যে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। হালকা নীল রঙা হসপিটাল বেডে হাত পা গুটিসুটি মেরে চিৎকার করে কাঁদছে সপ্তদশী মেয়েটা। তার দু হাত পা চেপে ধরে রেখেছে তিনজন নার্স। সামান্যতম শরীর নড়াচড়া করার সুযোগটা দিতে রাজি নয় তারা। আরেকজন নার্স একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ হাতে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সপ্তদশী তখন যন্ত্রণায় পুরো শরীরটা কুঁকড়ে রেখেছে। দু চোখ খিচে বন্ধ করে রেখে কান্না করতে করতে আওড়াচ্ছে,

“ ইনজেকশন দিবো না আমি। দিবো না। প্লিজ। “

মনন প্রথম দর্শনেই চিনতে পারে মোহকে। আশেপাশে তাকিয়ে একটা নার্সকে প্রশ্ন করে,

“ কাঁদছে কেন? কিসের ইঞ্জেকশন? “

একজন নার্স বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয়,

“ স্যার, ডাব্লিউ বি সি কাউন্ট দেখে ডক্টর বলে গিয়েছে গ্রাফিল ইঞ্জেকশনের একটা ডোজ দিতে। কিন্তু পেশেন্ট দিতে চাইছে না। কান্নাকাটি করছে। জোর করে দিতে চাইলে হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে। এভাবে ইঞ্জেকশন কিভাবে দেই বলুন? “

মনন স্থির দৃষ্টি মেলে একবার মোহকে দেখে। পরপর এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর থাকা ফাইলটা হাতে নিয়ে ভেতরের পাতা গুলোয় চোখ বুলায়। মেহনামা ফেরদৌস মোহ। ফাইল নং সি আর সিক্স জিরো নাইন সেভেন। বোন এন্ড সফট টিস্যু ডিপার্টমেন্টের পেশেন্ট। ফিমার নামক অস্থিতে টিউমার রয়েছে। ফাইলে থাকা বায়োপসি রিপোর্ট অনুযায়ী টিউমারে স্টেজ থ্রি ক্যান্সারের জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে।

মনন ফাইলটা রেখে নার্সদের উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ছেড়ে দিন। জোর করে ধরেবেধে ইঞ্জেকশন দিতে চাওয়াটা রিস্কি। “

একজন নার্স দ্বিধা নিয়ে বলে,

“ কিন্তু স্যার, ইঞ্জেকশন…? “

মনন এগিয়ে গিয়ে মোহর পাশে দাঁড়িয়ে স্বভাবসলুভ নরম গলায় ডাকে,

“ মোহ? চোখ খুলুন। ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছে না। কান্নাকাটি, চেঁচামেচি থামান। টক টু মি। “

কিছুটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে মোহ পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। কান্না থামিয়ে কিছুক্ষণ ফোলা ফোলা চোখ মেলে মননকে দেখে। হুট করে যেনো সে খুব পরিচিত কাউকে পেয়ে গিয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এক লাফে উঠে বসে চটপটে গলায় বলে,

“ আপনি? কি নাম যেনো আপনার? ডক্টর মদন… নাকি মরণ? যা-ই হোক, প্লিজ এদের আমাকে ছাড়তে বলুন। আমি কোনো গ্রাফিল টাফিল নিবো না। এদের যেতে বলুন বাচ্চাদের ডক্টর। “

নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত নাম বিকৃতিতে মননের স্বাভাবিক মেজাজটা বিগড়ে যায়। মুহুর্তেই মুখটা কালো হয়ে যায়। এই তো, এইমাত্রও তার এই মেয়েটার জন্য এজ এ হিউম্যান খারাপ লাগছিলো। কিন্তু এখন তার সেই খারাপ লাগাটা বিরক্তিতে পরিণত হয়েছে। সে চোখ তুলে দেখে দু একজন নার্স ঠোঁট টিপে হাসছে। থমথমে গলায় মনন শুধায়,

“ মনন। এম ও এন ও এন। ঠিকঠাক উচ্চারণ করুন। “

মননের বলা কথাটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মোহ মরিয়া গলায় বলে,

“ আমি এতো কিছু জানি না। আমি শুধু জানি যে এই ইঞ্জেকশন অনেক পেইনফুল। এটা আমি নিবো না। জোর করলে ডিরেক্ট কেস করে দিবো বলে দিলাম। তখন টের পাবে আমি কে। “

শেষ বাক্যটা মোহ খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে। যেনো সে আসলেই খুব বড়ো কেউ। কিন্তু সেই সম্পর্কে জানার প্রয়োজন বোধ করে না মনন। একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করে,

“ পেশেন্টের অভিভাবক কোথায়? “

নার্স কিছু বলার পূর্বেই মোহ বলে উঠে,

“ অভিভাবক দিয়ে কি কাজ? আমি বলেছি না আমি ইঞ্জেকশন নিবো না? আমার ডিসিশনই ফাইনাল। “

মনন এবার বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ আপনি এখনো আঠারো বছরের হোন নি মিস। সুতরাং আপনার ব্যাপারে যেকোনো ডিসিশন নেওয়ার ক্ষেত্রে হসপিটাল অথরিটি আপনার ফ্যামিলির সঙ্গেই তা ডিসকাস করবে। আর বারবার ইঞ্জেকশন নিবেন না বলে চেঁচাচ্ছেন কেনো? আপনার ভালোর জন্যই গ্রাফিলের একটা ডোজ সাজেস্ট করেছে ডক্টর। চুপচাপ ইঞ্জেকশন নিয়ে নিন। “

“ না। ফাহিম আমাকে বলেছে এই ইঞ্জেকশন ভুলেও না নিতে। খুব ব্যথা হয়। এমনকি ব্যথায় জ্বর চলে আসে। আমি কখনোই এটা নিবো না। “

মনন আশ্চর্য গলায় প্রশ্ন করে,

“ ফাহিম কে? “

“ পাশের কেবিনের এগারো বছরের বাচ্চাটা। ও আমাকে বলেছে যে ডাব্লিউ বি সি কাউন্ট একটু উপর নিচ হলেই ডক্টররা এক ডোজ গ্রাফিল দিয়ে দেয়। এইটা কেমোর থেকেও বেশি পেইনফুল। ডক্টররা মিষ্টি করে হেসে বলবে এইটা কিছুই না। কিন্তু এইটা দিলে শরীরের প্রতিটা মাংসপেশিতে ভয়ংকর ব্যথা হয়। তাই পেশেন্টদের উচিত ডক্টরদের বিশ্বাস না করা। “

মনন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় তার বাচ্চা পেশেন্ট গুলোই বুঝি বেশি ভালো। এরকম হাতে পায়ে লম্বা তবে বাচ্চাদের মতো জেদ ধরা পেশেন্টের থেকে মননের বাচ্চা পেশেন্টদের সঙ্গে ডিল করাটাই অধিক সহজ। মনন নীরবে টেবিলের উপর থেকে একটা গ্লাভসের প্যাকেট খুলে দু’হাতে সফেদ রঙা মেডিক্যাল গ্লাভস পড়ে নেয়। অত:পর নার্সের হাত থেকে সিরিঞ্জটা নিয়ে নেয়। মোহর কাছে এগিয়ে যেতে নিলেই মোহ গুটিসুটি মেরে বেডের এক কোণে চলে যায়। মনন পেশেন্ট বশে আনতে জানে। সে সরাসরি মোহর চোখে দৃষ্টি স্থির করে। পানপাতা সরূপ মুখটায় ভয়ের ছাপ লেপ্টে আছে। মনন অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কেমো নিয়েছেন আপনি? “

মোহ মাথা নেড়ে বলে,

“ প্রথম সাইকেল চলছে। “

“ কেমো কেনো দেওয়া হচ্ছে জানেন? “

“ ট্রিটমেন্টের অংশ তাই। “

“ আপনার ফিমারে একটা টিউমার আছে মোহ। কেমো দেওয়া হচ্ছে সেই টিউমারটাকে যথাসম্ভব অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য। কারণ টিউমারকে অনুকূলে নিয়ে আসতে না পারলে সার্জারি পারফর্ম করা অসম্ভব। কিন্তু টিউমারকে অনুকূলে আনার জন্য শুধুমাত্র কেমো যথেষ্ট নয়। আরো অনেককিছু স্ট্যাবল থাকা জরুরী। আপনার মনে হতে পারে ডক্টররা অযথা হিমোগ্লোবিন, প্লাটিলেট, ডাব্লিউ বি সি, আর বি সি নিয়ে এতো সিরিয়াস থাকে। কিন্তু ট্রিটমেন্ট চলাকালীন সময়ে কম্পলিট ব্লাড কাউন্ট স্থিতিশীল পর্যায়ে না থাকলে আপনার ফিজিক্যালি অনেকটা ক্ষতি হবে। সেই ক্ষতিটাকে এড়াতে আপনার ডক্টরের সাথে কো অপারেট করতে হবে। আমি বলছি না এই পুরো প্রসিডিওরে আপনার একটুও কষ্ট হবে না। অনেক কষ্ট হবে, সাইড ইফেক্ট হবে, অসুবিধা হবে। কিন্তু সুস্থ হওয়ার জন্য এতটুকু সহ্য করে নিতে পারবেন না? “

মোহ মনযোগ দিয়ে মননের কথা গুলো শুনে। অত:পর মুখ কালো করে প্রশ্ন করে,

“ আর কোনো অপশন নেই? “

মনন মাথা নেড়ে বলে,

“ অন্য কোনো অপশন থাকলে আমি এই মুহুর্তে আপনাকে তা-ই সাজেস্ট করতাম, ট্রাস্ট মি। “

মোহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দেয়। মনন একজন নার্সকে ইশারা করে মোহর টি-শার্টের হাতাটা বাহুর দিকে উঁচু করে তুলতে। নার্স দ্রুত টি-শার্টের স্লিভটা উপরের দিকে তুলতেই মনন আগে কিছুটা তুলায় স্যানিটাইজার লাগিয়ে বাহুর চারিপাশটা জীবাণুমুক্ত করে পরিষ্কার করে নেয়। পরপর সিরিঞ্জটা নিয়ে দক্ষ হাতে পাতলা চামড়া ভেদ করে সূক্ষ্ণ সুঁচালো অংশটা ভেতরে প্রবেশ করিয়ে ইঞ্জেকশন পুশ করে। এতক্ষণ চোখ খিচে চুপ করে থাকলেও এই পর্যায়ে মোহ চিৎকার করে কান্না করে উঠে। সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে শীতল একটা মেডিসিন হাত থেকে ধীরে ধীরে যেনো তার শরীরের ভেতরে সর্বাংশে ছড়িয়ে পড়ছে। ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে প্রত্যেকটা মাংসপেশিকে এক বিষাক্ত কিছু কাঁমড়ে ধরেছে। ব্যথাটা সহ্য সীমার মধ্যে নেই মোটেও। মোহ কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠে,

“ আম্মু! আম্মু… আল্লাহ… না। “

মনন ততক্ষণে জরুরী কার্যসিদ্ধি করে সিরিঞ্জটা ফেলে দিয়ে কিছুটা তুলা হাতের ওই জায়গাটায় চেপে ধরে রাখে। নার্সকে ইশারা করে টি-শার্টের স্লিভটা নামিয়ে দিতে। নার্সরা যে যার ডিউটিতে ফিরে যায়। মোহ তখনো পুরো শরীর কুঁকড়ে কাঁদছে। মনন না চাইতেও আড়চোখে দৃষ্টিপাত করে সপ্তদশীর মুখপানে। চোখ বুজে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আর্তনাদ করে কখনো আল্লাহকে স্মরণ করছে তো কখনো নিজের মা কে। বদ্ধ চোখের কার্নিশ ঘেঁষে উত্তপ্ত জল গড়িয়ে পরছে গাল বেয়ে। কান্নার ফলস্বরূপ মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটা বিষণ্ণ। তবুও আশ্চর্য এক মুগ্ধতায় স্থবির হয়ে যায় মনন।

মুহুর্তেই নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সে। তুলাটা সরিয়ে হাতের ইঞ্জেকশন দেওয়া অংশটা একবার দেখে নেয়। হাত থেকে গ্লাভস খুলে মনন বলে,

“ হাতের এই জায়গাটায় ব্যথা থাকবে কয়েক ঘন্টা। রাতে সাবধানে ঘুমাবেন। ঘুমের মাঝে ডান পাশে ফিরবেন না। হাতে চাপ লাগলে কিন্তু ব্যথা বেড়ে যাবে। আর যদি দেখেন জায়গাটা ব্যথায় ফুলে শক্ত হয়ে গিয়েছে তাহলে নার্সকে বলবেন। আইস প্যাক ইউজ করলেই হবে। জ্বর আসছে মনে হলেও নার্সকে জানাবেন। গ্রাফিল দিলে টুকটাক জ্বর আসেই। ঘাবড়াবেন না, তেমন সিরিয়াস কিছু না এইটা। “

কথাগুলো বলে মনন বেরিয়ে যেতে নিলেই মোহ কান্না মিশ্রিত স্বরে পিছু ডাকে,

“ ডক্টর মরণ। “

মনন চোখ কুচকে পিছনে ফিরে তাকায়। মোহ হয়তো বুঝতে পারে। সে দ্রুত গলায় বলে,

“ সরি, আপনার নাম খেয়াল থাকে না। মরণ বা মদন শব্দটা ইজি বেশি। “

“ ডেকেছেন কেনো? “

“ আমি কান্নাকাটি করেছি এইটা যেনো কেউ না জানে। নার্সদের কাইন্ডলি মানা করে দিবেন আমার ফ্যামিলিকে বিষয়টা জানাতে? ওরা যদি জেনে যায় আমি বাচ্চাদের মতো ভয় পেয়ে কান্না করেছি তাহলে আমার প্রেস্টিজ আর ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে। “

মনন বিস্মিত হয়। ব্যথা করলে তো কান্নাকাটি করাটাই স্বাভাবিক। সেটার জন্যও ইমেজ নষ্ট হয় না-কি? কি অদ্ভুৎ!

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০২

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২.

তিন বছরের বাচ্চা ছেলেটা মায়ের আঁচলে মুখ গুজে রেখেছে। চোখ জোড়া ছলছল করছে তার। এইতো ঘন্টা খানেক আগে সিবিসি অর্থাৎ কম্পলিট ব্লাড কাউন্ট টেস্টের জন্য তার হাত থেকে সুঁচালো বস্তুটার মাধ্যমে এক শিশি রক্ত নেওয়া হয়েছে। ছোট্ট বাচ্চাটা তখন গলা ফাটিয়ে কান্না করছিলো ব্যথায়। সেই কান্নার ফলস্বরূপ এখনো মুখ জুড়ে লাল আভা ছড়িয়ে আছে।

মনন নিজের টেবিলে থাকা কম্পিউটারে বাচ্চাটার ফাইল নম্বর এন্টার করতেই তার লেটেস্ট রিপোর্টটা স্ক্রিনে দৃশ্যমান হয়ে ভেসে উঠে। এক এক করে রক্তের প্রতিটি উপাদানের কাউন্ট সে চেক করে। ডব্লিউবিসি, প্লাটিলেট সহ অন্যান্য উপাদানের কাউন্ট স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলেও হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৯ এ নেমে গিয়েছে। মনন তা দেখে চিন্তিত গলায় বলে,

“ হিমোগ্লোবিন দেখি লো হয়ে গিয়েছে। গত সপ্তাহেও তো হিমোগ্লোবিন ১১ এর ঘরে ছিলো। ৬ এর ঘরে নেমে গেলে কিন্তু ব্লাড দিতে হতে পারে। “

বাচ্চাটার মা’কে আতংকিত দেখালো। সে আতংকিত গলায় বলে,

“ এবারের কেমো দেওয়ার পর থেকে মুখের রুচি নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেলিমের। কিচ্ছু মুখে নিতে চায় না। জোর করে কিছু খাওয়ালেও তা বমি করে ফেলে দিচ্ছে। আমরা কি করবো ডক্টর? “

মনন মনযোগ দিয়ে শুনে সবটা। পরপর বলে,

“ ও একটা তিন বছরের বাচ্চা ম্যাডাম। কেমোতে মুখের টেস্ট বাড নষ্ট হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। ওর খাবার নিয়ে মর্জি করাটাও স্বাভাবিক। কেমোথেরাপির ফলে পেশেন্টের মেজাজ খিটখিটে থাকবেই। কিন্তু তা-ই বলে চেষ্টা না করে বসে থাকা যাবে না। ভুলিয়ে কিংবা যেভাবেই খেতে চায়, সেভাবেই খাওয়াবেন। বমি করলে কিছুক্ষণ ব্রেক নিয়ে আবার খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন ওর শরীরে যাওয়া কেমো, মেডিসিন, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এগুলো একমাত্র তখনই কাজ করবে যখন ওর ইমিউনিটি সিস্টেম স্ট্রং থাকবে। সেটার জন্য ডায়েট চার্ট মাফিক খাওয়াদাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। “

চোখের চশমাটা কিছুটা ঠিক করে নিয়ে মনন ফাইলে একটা নতুন পৃষ্ঠায় ডেট লিখে তার নিচে কিছু নির্দেশনা এবং নতুন একটা মেডিসিনের নাম লিখে দিয়ে বলে,

“ একটা ওরাল ট্যাবলেট লিখে দিয়েছি। মুখের রুচি বাড়াতে সাহায্য করবে। প্রতিদিন তিনবেলা খাওয়ার পরে এটা ওকে খেতে দিবেন। কিন্তু পানি দিয়ে নয়, চুষে ক্যান্ডির মতো খেতে বলবেন। “

ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে ফাইলটা হাতে নিতেই মনন উঠে দাঁড়ায়। মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে ডাকে,

“ সেলিম? বাবা? আংকেলের কাছে আসবে? “

ছোট্ট বাচ্চাটা মাথা কিছুটা তুলে ছলছল চোখে ডক্টরকে দেখে। মননকে হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে থাকতে দেখে সে-ও নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। মনন তাকে কোলে তুলে নিয়ে হেসে বলে,

“ মজার একটা ক্যান্ডি দিয়েছি। আম্মু প্রতিদিন খাওয়ার পর সেটা খেতে দিলে গুড বয়ের মতো খাবে, ওকে? চিন্তা করো না, ওটা তিতা না। “

সেলিম ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ মননের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বলা কথাগুলোকে উপেক্ষা করে হঠাৎই ছোট হাতে থাবা বসিয়ে মননের চোখের চশমাটা খুলে নিজের হাতে নিয়ে নেয় সে। সঙ্গে সঙ্গে গোলগাল লাল মুখটায় ফুটে উঠে হাসি। যেনো খুব বড়ো কিছু জয় করে ফেলেছে সে।

মনন বিব্রত হয়ে যায়। এটা তার জন্য নতুন কিছু না। তার কোলে ওঠা সকল বাচ্চারাই সুযোগ পেলে থাবা মেরে তার চোখের চশমা খুলে নেয়। যেনো এইটা খুব মজার কোনো খেলনা। সেলিমের আম্মু দ্রুত ছেলের হাত থেকে চশমা ছাড়াতে চাইলেই মনন ভদ্রতাসূচক স্বরে বলে,

“ সমস্যা নেই। বাচ্চা মানুষ। খেলুক। “

__________

হসপিটালের ক্যান্টিনটা বেশ পরিচ্ছন্নতা এবং নির্জনতায় ঘেরা। গুটি কয়েক পেশেন্ট, অভিভাবক এবং ডক্টরা দুপুরের খাবার খেতে একেক টেবিল দখল করে বসেছে। প্রত্যেকটা টেবিল থেকেই ভেসে আসছে মৃদু গুঞ্জনের স্বর।

অসামাজিক টাইটেল খ্যাত ডক্টর ওয়াসিফ কায়সার মনন ক্যান্টিনের এক কোণে একটা টেবিলে একা বসে আছে। মনযোগ তার টেবিলের উপর থাকা লাঞ্চ মেনুর প্রতি স্থির। নিজের চাপা ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবটার কারণে খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশতে তার বড্ড অস্বস্তি। পরশিকে নিজের মনের কথা জানাতে না পারার এটাও অন্যতম একটা কারণ।

লাইফ কেয়ার হসপিটালের খাবারের মান ভালো হলেও, হসপিটালের খাবারে বাসার স্বাদটা খুঁজে পায় না মনন। কেমন মেডিসিনের একটা গন্ধ সবসময় নাকে লাগে। তবে বিগত কয়েক বছর দিনের একটা লম্বা সময় হসপিটালে পাড় করার দরুণ এই গন্ধটা এখন তার সয়ে গিয়েছে। খুব একটা অসুবিধা হয় না।

খাওয়ার মাঝে আচানক ফোনটা বেজে উঠতেই মনন টেবিলের উপর থাকা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। পরিচিত নামটা দেখতেই সে ফোনটা টেবিলের কেচাপের বোতলের সাথে দাঁড় করিয়ে রেখে কানে ইয়ার বাড গুজে কলটা রিসিভ করে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠে একটা বৃদ্ধের মুখ। হাসি মুখে নিজের পিছনের দৃশ্যটা ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে বলে,

“ তোমার আগে আমি নায়াগ্রা দেখে ফেললাম। জীবন যুদ্ধে আমার থেকে আরো কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেলে তুমি। কষ্ট পেও না। আমার মতো বড়ো হও। তুমিও সুযোগ পাবে পৃথিবীটা ঘুরে দেখার। “

মনন চোখ জোড়া ছোট করে বলে,

“ তুমি আমার থেকে চল্লিশ বছরেরও বড়ো দাদু। জীবন যুদ্ধে আমার পিছিয়ে থাকাটা কি স্বাভাবিক না? আমার বয়সে তুমিও কিন্তু নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলে। “

মননের দাদু আলী আকবর কায়সার বলে উঠে,

“ আমার সাথে নিজের তুলনা দিও না। তোমার বয়সে কাজের পাশাপাশি একটা প্রেমিকাও সামলেছি আমি। পরবর্তীতে তাকে বিয়ে করেছি। তোমার বাপের বাপও হয়েছি। সে-ও বড়ো হয়ে তোমার বয়সে কাজের পাশাপাশি একটা প্রেমিকা সামলেছে। সেই মেয়েটা অর্থাৎ তোমার মা’কে বিয়ে করে তোমার বাপও হয়েছে। কিন্তু তোমার মাঝে সেরকম কোনো লক্ষ্মণ দেখছি না। বাপ, দাদার নাম ডুবাবে দেখছি। “

মনন দাদুর মশকরাকে পাত্তা না দিয়ে বলে,

“ পোস্ট গ্রেজুয়েশন এখনো শেষ হয় নি আমার। সারাদিন ল্যাব, ওয়ার্ড, কেবিনের চক্কর কাটছি তোমাদের এবং তোমার এই হসপিটালের মুখই উজ্জ্বল করতে। সেটা তোমাদের চোখে পড়ছে না? “

“ চক্করই কাটতে থাকো। বয়স পেরিয়ে যাবে, কিন্তু এই চক্কর কাটা আর শেষ হবে না তোমার। বুড়ো বয়সে আমার মতো নায়াগ্রা ঘুরতে আসার সুযোগ পাবে, কিন্তু তখন দেখবে তোমার সাথে কোনো সাথী নেই। “

মনন এবার কিছুটা হেসে দিয়ে বলে,

“ তোমারও কিন্তু সাথী নেই দাদু। একা একাই নায়গ্রার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হচ্ছে তোমাকে। আব্বুকে সাথে নিলেও পারতে। সিঙ্গেল দু’জন একে অপরকে কোম্পানি দিতে পারতে। “

“ এখন সাথী নেই। কিন্তু এককালে তো ঠিকই ছিলো। আমার জীবনে তোমার দাদী ছিলো, তোমার আব্বুর জীবনেও তোমার আম্মু ছিলো। মানুষ দুটো বেশি ভালো ছিলো দেখে তাদের তাড়াতাড়ি ডাক পড়ে গিয়েছে। এই আরকি। কিন্তু নিজেকে দেখো। আগে পিছে কেউ নেই তোমার। এরকম চলতে থাকলে আমার বংশের ফুল স্টপ হয়ে যাবে। ব্যাংকের এতো টাকা গুলো সব আমাদের তিন জনের মিলেই পরে শেষ করতে হবে। “

মনন হেসে আরো কিছু বলতে নিবে এমন সময় সে লক্ষ্য করে তার ডানপাশের সারির তৃতীয় টেবিলে বসে লাঞ্চ করতে ব্যস্ত মেয়েটাকে। গপাগপ বসে গরুর গোস্তো মেখে সাদা ভাত খাচ্ছে। মনন বিস্মিত নয়নে মেয়েটাকে দেখে। এটাই গত রাতের সে-ই মেয়েটা না? কি যেনো নাম? মোহ! হ্যাঁ, মোহ।

মেয়েটা না অসুস্থ? তাহলে এসব খাচ্ছে কেনো? এই মেয়েকে কি কেউ বলে নি, যে এই হসপিটালের প্রত্যেক পেশেন্টের জন্য রেড মিট হচ্ছে বিষ সরূপ? মননের দাদু ফোনে তখন কিছু বলছিলো। মনন দ্রুত গলায় বলে,

“ পরে কথা বলছি দাদু। “

বলেই কলটা কেটে দেয়। মননের খাওয়া প্রায় শেষ। সে চরম অস্বস্তি নিয়ে মোহ নামক মেয়েটাকে দেখছে। তার একবার ইচ্ছে করছে যে উঠে গিয়ে মেয়েটাকে এই খাবারটা খেতে নিষেধ করতে। পর মুহুর্তেই ভাবছে মেয়েটা যদি আবারও তার প্রতি ভুলভাল ধারণার ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করে? ক্যান্টিনে মননের ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র ডক্টরও বসে লাঞ্চ করছে। অযথা ইজ্জত যাবে। কিন্তু তা-ই বলে কি সে চোখের সামনে একটা পেশেন্টকে নিজের ক্ষতি করতে দেখেও চুপ করে থাকবে?

বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দ্বে কাটিয়ে মনন উঠে দাঁড়ায়। টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে এগিয়ে যায় সেই মেয়েটির টেবিলের কাছে। টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটা খাওয়া থামিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকায়। মনন অস্বস্তি কাটিয়ে ফটাফট বলে বসে,

“ এই হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্টের জন্য রেড মিট নিষিদ্ধ। বিষের মতো শরীরে বাসা বাঁধা রোগটাকে আরো শক্তিশালী করে তুলে। আপনি হয়তো বিষয়টা জানেন না, তাই জানিয়ে দিলাম। এসব খেলে আপনার ক্ষতি হবে। দ্রুত নিজের নিউট্রিশনের সঙ্গে দেখা করে নিজের ডায়েট চার্টটা বুঝে নিন। রেড মিট, কোল্ড ড্রিংকস, চিনি জাতীয় খাবার সহ আর যা যা নিষিদ্ধ তা এভয়েড করুন। আসি। আল্লাহ হাফেজ। “

প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বলা লম্বা পরামর্শের ইতি টেনে মনন ফটাফট সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। টেবিলে বসে থাকা মেয়েটাকে পাল্টা কিছু বলার সুযোগটুকুও দেয় না। নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরিহিতা ক্লান্ত মুখশ্রীর মেয়েটা লোকমা হাতে হা করে লোকটার যাওয়ার পানে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে,

“ পাগল নাকি? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০১

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১. ( অবতরণিকা )

প্রকৃতিতে কেবল নতুন ঋতুর আগমন ঘটেছে। শরতের প্রাণজুড়ানো হাওয়া বইছে চারিদিকে। রাতের আবহাওয়াটা নির্মল, শুদ্ধ হয়ে ধরা দিয়েছে যেনো। রাজধানীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পনেরো তলা বহুতল ভবনটা আধুনিকতা এবং পরিচ্ছন্নতায় মোড়ানো। ভবনের গায়ে উজ্জ্বল বড়ো বড়ো অক্ষর দ্বারা লেখা নামটা বেশ দূর থেকেও স্পষ্ট পড়তে পারবে যে-কেউ।

লাইফ কেয়ার হসপিটাল। বাংলাদেশের সনামধন্য প্রাইভেট হসপিটাল গুলোর মধ্যে একটি। সময় তখন রাত আটটা বেজে বত্রিশ মিনিট। হসপিটালের ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। চাঁদের রূপালি আলোয় তার কাটকাট মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টি তার জাদুর শহরের পানে নিবদ্ধ। বুক ভর্তি চাপা নিঃশ্বাস খুব নিভৃতে বেরিয়ে আসে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে নির্গত হয় নিষ্ঠুর হৃদয়ঘটিত পীড়াও।

পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফেসবুকে প্রবেশ করে সে। ফিডের সর্বপ্রথম পোস্টটা দেখতেই মিনিট খানিকের জন্য থমকায়। ছবিতে থাকা বিয়ের সাজে সজ্জিত লাল লেহেঙ্গা পরিহিত মেয়েটাকে দেখে বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করে। কিন্তু ছবিতে থাকা মেয়েটার মুখে কোনো কষ্টের লেশমাত্র নেই। সে পৃথিবীর সবথেকে সুখী বধূর হাসিটা মুখে নিয়েই পাশে বসে থাকা জীবনসঙ্গীর দিকে তাকিয়ে আছে।

ছবিটা দেখে শেষবারের মতো হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবকটি। ইশ! একবার যদি অন্তত নিজের মনের কথা জানানোর সাহসটা জোগাড় করতে পারতো সে! তাহলে কি আজ এই মেয়েটার পাশে সে থাকতে পারতো না? হয়তো, কে জানে!

আচমকা নিজের এমন ভাবনার প্রতি বিরক্ত হয় যুবকটি। পরশি এখন অন্য কারো স্ত্রী। অন্যের স্ত্রী’র পাশে নিজেকে ভাবাটাও এক ধরণের ছোটলকি রূপের বহিঃপ্রকাশ। এতো বছর ধরে যেহেতু সে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে চুপ ছিলো, আজ তাহলে আফসোস করছে কেন? আফসোস করলে কি বিধির লিখন বদলে যাবে?

যুবকটা ফট করে নিজের ফোনটা পকেটে ভরে নিয়ে মনে মনে আওড়ায়,

“ চির সুখী হ তুই পরশি। “

উন্মাদ বাতাস বইছে। যুবকটা দু’হাতে রেলিং শক্ত করে ধরে চোখ বুজে নেয়। মাথাটা কিছুটা বাইরের দিকে নুইয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালায়। আচমকাই নিস্তব্ধতা চিরে একটা চঞ্চল নারী স্বর বলে উঠে,

“ ওহ শিট! ওয়েট মিস্টার! সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। কিন্তু এখুনি ঝাঁপ দিবেন না প্লিজ। হুদাই আপনার সুইসাইড কেসে পরে সাক্ষী সরূপ আমার নাম এসে পড়বে। “

নির্জন হসপিটাল ছাদটায় আচমকা অনাকাঙ্ক্ষিত কারো গলার স্বর শুনে ভড়কে যায় যুবকটি। চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। ছাদের দরজার কাছে একটা নারী ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে থাকায় মুখটা অস্পষ্ট।

যুবকটা সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই এবার সেই ছায়ামূর্তিটা তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় তার মুখখানি। মেয়েটার মুখ দেখে আরো একদফা চমকায় যুবকটা। তার সূক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি জানান দিচ্ছে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির বয়স সতেরো থেকে আঠারোর ঘরে হবে খুব সম্ভবত। গায়ের কালো রঙের কুর্তিটার কারণে চাঁদের আলোয় শুভ্র মুখশ্রীটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে খুব। অবাধ্য উন্মুক্ত কেশ যার দৈর্ঘ্য কাধের কিছুটা নিচ পর্যন্ত তা বাতাসের তালে দুলছে।

যুবক কিছু বলার পূর্বেই মেয়েটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তার পাশ কেটে রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। নিচের দিকে উঁকি দিয়ে কিছু একটা ভেবে শুধায়,

“ এখান থেকে লাফ দিয়ে সুইসাইড করার আইডিয়াটা খুব বাজে। অনেক অসুবিধা আছে। প্রথমত হসপিটালের অথরিটিদের বিনা কারণে গণমাধ্যম ও পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হবে। দ্বিতীয়ত অযথা আপনার সুইসাইড কেসকে অনেকে মার্ডার কেস হিসেবে সাসপেক্ট করতে পারে। আর তৃতীয়ত আপনার ফিগার আর মুখের নকশা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে। আমি আপনাকে বেটার কোনো অপশন সাজেস্ট করতে পারি। ইফ ইউ ইনসিস্ট আরকি! এতে করে আপনি সুইসাইড করলেও অযথা কারো হয়রানির শিকার হতে হবে না আর আপনার সুন্দর ফেস আর বডির নকশাও ঠিক থাকবে। “

এতক্ষণ ধরে ভ্রু কুচকে মেয়েটার এই আউট অফ কনটেক্সট কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো যুবকটা। কথাগুলো বলে মেয়েটা হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে এমন একটা ভাব যেনো সে খুব বড়ো কোনো মানবসেবা করছে। মেয়েটার হাসি হাসি মুখটা দেখে যুবকটা বিরক্তবোধ করে। মুখ খুলে বলে,

“ থ্যাংকস ফর ইউর কনসার্ন। কিন্তু আমি সুইসাইড করার এটেম্পট করছিলাম না। “

মেয়েটা অবাক চোখে যুবকটাকে দেখে। হসপিটালের হালকা নীল রঙের জামা এবং পাজামা গায়ে। তার উপর পরে আছে সাদা রঙের একটা এপ্রোন। বাতাসের দমকে যার শেষাংশ কিছুটা উড়ছে। পায়ে বেশ সাধারণ একজোড়া হসপিটালে পরিধেয় যোগ্য স্যান্ডেল। গলায় ঝুলে আছে একটা স্টেথোস্কোপ। চোখ মুখে একধরণের হতাশার ছাপ লেপ্টে আছে।

মেয়েটাকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে যুবকটা অস্বস্তি বোধ করে। তার অস্বস্তি বাড়িয়ে দিতে মেয়েটা বলে উঠে,

“ আপনাকে দেখে তো পাক্কা ছ্যাঁকাখোর মনে হচ্ছে। আমার জায়গায় অন্য যে কেউ দেখলেও ভাবতো আপনি সুইসাইড করতেই এসেছেন। অথচ আপনি বলছেন আপনি না-কি সুইসাইড করতে আসেন নি। আপনার কি মুড সুইং হচ্ছে? কিন্তু মুড সুইং তো মেয়েদের হয় আমার জানামতে। ছেলেদের মুড সুইং হওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক বিষয়। “

যুবকটা বিরক্তি নিয়ে কিছুটা রাগী স্বরে শুধায়,

“ মিস, আপনি এখানে হাজির হওয়ার পর থেকে একের পর এক ভুলভাল আন্দাজ করেই চলেছেন আমার ব্যাপারে। লেট মি মেক ইট ক্লিয়ার। না আমি সুইসাইড করতে এসেছি আর না আমার মুড সুইং হচ্ছে। আমাকে নিয়ে ভুলভাল ধারণা ব্যাখ্যা করা বন্ধ করুন। আই এম নান অফ ইউর বিজনেস। “

মেয়েটার মুখ কালো হয়ে আসে। সে চুপচাপ সেখান থেকে সরে গিয়ে ছাদের চারিদিকটা ঘুরে দেখতে থাকে। যুবকটা তা দেখে নীরবে। উপলব্ধি করে এভাবে অপরিচিত একটা মেয়ের সঙ্গে রাগ দেখানোটা বোধহয় ঠিক হয় নি। সে কিছুটা নরম স্বরে এবার বলে,

“ এক্সকিউজ মি মিস। আই এম সরি। আমার আসলে এরকম রাগ দেখিয়ে কথা বলাটা ঠিক হয় নি। “

মেয়েটা স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ ইট’স ওকে। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কোনো ব্যাপারে ফ্রাস্ট্রেটেড। তাই আপনার কথায় আমি মাইন্ড করি নি। ইনফ্যাক্ট আমি কারো কথায়ই মাইন্ড করি না। সো টেক এ চিল পিল। “

যুবকটা আরো এক দফা হতাশ হয়। বিগত কিছুক্ষণে সে এই অপরিচিত মেয়ের ব্যাপারে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে। তা হলো মেয়েটা নিজের মতো করে সব বুঝে নিতে পছন্দ করে। আর একটু অতিরিক্ত কথা বলাও তার স্বভাব অন্তর্ভুক্ত বিষয়। যুবকটা তাই এই ব্যাপারে কথা না বাড়িয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে,

“ আপনি এইখানে ছাদে কি করছেন? “

মেয়েটা কৌতূহলী চোখে চারিদিকটা দেখতে দেখতে বলে,

“ ছাদটা ঘুরে দেখতে এসেছি। আই মাস্ট সে রুফটপটা আসলেই সুন্দর। কি জোস সিটি ভিউ পাওয়া যায় এখান থেকে! “

“ আপনি কি হসপিটালে ছাদ ঘুরে দেখতে এসেছেন? “

মেয়েটা হাঁটা থামিয়ে ঘুরে তাকায়। যুবকটার দিকে এগিয়ে এসে বিস্ময় নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যুবকটা আবারও অস্বস্তিতে পড়ে যায়। জড়তা নিয়ে পিছু হটে বলে,

“ আপনি প্লিজ বারবার এভাবে আমার মুখের দিকে তাকাবেন না। ব্যাপারটা খুব অস্বস্তিদায়ক। “

মেয়েটা ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি পরীক্ষায় চিটিং করে ডক্টর হয়েছেন? লজ্জা পাবেন না। আমাকে বলতে পারেন, আমি কাউকে বলবো না। “

“ অদ্ভুৎ তো! আপনার কেনো মনে হলো আমি পরীক্ষায় চিটিং করে এসেছি? “

“ তাহলে এরকম বলদের মতো আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেনো, হসপিটালে ছাদ ঘুরে দেখতে এসেছি কি-না? হসপিটালে মানুষ কেনো আসে আপনি জানেন না? “

যুবকের ঠোঁট যুগল নিজ শক্তিতে হা হয়ে গেলো। কিছু বলতে নিয়েও আর বললো না। মেয়েটা আবার তার কথায় ভুল ধরবে না-হয়। তার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে মেয়েটা ছাদের একপাশে চলে যায়। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের জিন্সের পকেট হতে ফোনটা বের করে ক্যামেরা অন করে। এই অত্যন্ত সুন্দর ভিউটা নিজের ক্যামেরায় বন্দী করতে সে প্রবল আগ্রহী।

যুবকটা দূর হতে তা দেখে। অত:পর সেখান থেকে প্রস্থানের জন্য দরজার দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু কি ভেবে যেনো থেমে যায়। ঘুরে আবার সে-ই মেয়েটার দিকে তাকায়। হাত উঁচু করে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। যুবকটা নিভৃতে মেয়েটার বাম হাতের কব্জির কাছে হসপিটালের আইডেন্টিটি বেইডটা লক্ষ্য করে। তার মানে এই মেয়েটা অসুস্থ? অসুস্থ হলে একা একা ছাদে কি করছে? অভিভাবক কোথায় মেয়েটির?

যুবকটা কিছুটা গলা উঁচু করে ডাকে,

“ এক্সকিউজ মি মিস। আপনি প্লিজ সেখান থেকে সরে আসুন। আমার যেতে হবে, আপনারও ছাদে একা থাকাটা ঠিক হবে না। “

মেয়েটা ফোন পকেটে ভরে তার দিকে এগিয়ে এসে আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি ভয় পাচ্ছেন যে আপনি চলে গেলে আমি ছাদ থেকে ঝাপ দিবো? “

মেয়েটা কাছে এসে দাঁড়ানোতে এবার তার হাতে পরিহিত রিস্ট বেইডটা আরো কাছ থেকে দেখতে পারে সে। সেখানে স্পষ্ট করে ইংরেজিতে একটা চার অক্ষরের নাম লেখা।

‘M O H O’

আর কিছু লক্ষ্য করার পূর্বেই মেয়েটা হেসে বলে উঠে,

“ চিন্তা করবেন না। আমার মরার প্ল্যান নেই এতো তাড়াতাড়ি। আমার তো এখনো… “

পুরো কথাটা শেষ করার পূর্বেই মোহর ফোন বেজে উঠে। সে পকেট থেকে ফোন বের করে কলটা রিসিভ করে। অপর পাশের মানুষটা কিছু বলতেই মোহ বলে উঠে,

“ হসপিটালেই আছি। ঘুরে দেখছিলাম একটু। এতো প্যানিক করার কি আছে? “

ফোনের অপর পাশ হতে আরো কিছু বলে। মোহ ‘আসছি’ বলে কলটা কেটে দেয়। যুবকের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

“ ইট ওয়াজ নাইস টু মিট ইউ। আমার এখন যেতে হবে। টাটাহ। “

বলেই মোহ দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে গিয়েই সে কিছু মনে পড়েছে ভঙ্গিতে থেমে যায়। পিছু ফিরে বলে,

“ ওহ শিট! আপনার নামটাই তো জানা হলো না। আপনার নাম কি? কোন ডিপার্টমেন্টের ডক্টর আপনি? “

যুবকটা এবার স্বাভাবিক গলায় জবাব দেয়,

“ মনন। পোস্ট গ্রেজুয়েট। পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট। “

মোহ হাসি চওড়া করে বলো,

“ ওওও! বাচ্চাদের ডক্টর। নাইস, ক্যারি অন। “

মোহ আর অপেক্ষা করে না। কল করা মানুষটা নাহয় তাকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসে পরবে। সে আর পিছু না ফিরে সেখান থেকে প্রস্থান করে। মনন দাঁড়িয়ে রয় আপন জায়গায়। মেয়েটার বলা ‘বাচ্চাদের ডক্টর’ কথাটা এখনো তার কানে বাজছে। বাচ্চাদের ডক্টর আবার কি জিনিস? ডক্টর তো ডক্টরই হয়।

পরমুহূর্তেই তার খেয়াল হয়, মেয়েটার হাতে থাকা সেই ব্রেসলেটটার কথা। মেয়েটা সত্যিই অসুস্থ? দেখে তো সেরকম কিছু মনে হচ্ছিলো না। এই হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্ট একই রোগে আক্রান্ত। তবে ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন। এই মেয়েটা কোন ডিপার্টমেন্টের কে জানে!

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

নারী নারীত্ব সতী সতীত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0

#নারী_নারীত্ব_সতী_সতীত্ব_ইত্যাদি_ইত্যাদি
#শেষ_পর্ব
#ইসরাত_ইতি

“এই তিহান, শোনো শোনো!”

বন্ধুদের মায়েরা স্কুলের মাঠ থেকে ছুটে এসে তিহানের পথ আগলে দাঁড়ালো। শিশু তিহান হকচকিয়ে উঠলো একইসাথে,এতজনের আক্রমণে।

“তোমার মা কেমন আছে? সে ভালো আছে? স্কুলে যায়?”

তিহান জবাব দিতে মুখ খুলবে ঠিক তখুনি সেলিনা গেট পেরিয়ে এসে ছো মেরে তিহানের হাত টেনে নিয়ে যায় ওখান থেকে। তার আচরণ বেশ অস্বাভাবিক, রুক্ষ। এতো পরিচিত মুখ গুলোকে যেন চিনেও চিনেন না, তিনি পালাতে চাইছে এখান থেকে নাতীকে নিয়ে।

তিন মাস। তিন মাস হয়ে গিয়েছে ঐ দূর্ঘটনার। একটা দূর্ঘটনা, সুস্মিতা যেখানে থেমে গিয়েছিল। গোটা দুনিয়া চলেছে,দৌড়েছে,ছুটেছে। সুস্মিতা নড়তেও পারেনি। চার দেয়ালের একটি কামরার মাঝে স্থির তার জীবন।

বাইরে কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে সুস্মিতা ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে সেলিনা তিহানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নতমস্তকে। সুস্মিতা নিষ্প্রাণ চোখে তার শাশুড়িকে দেখে। আগে একটু যা সুস্মিতাকে ফিরে দেখতো, এখন সুস্মিতার দিকে তাকাতেও তার বড্ড ঘেন্না। সুস্মিতার রান্না তিনি খাননা। তার শাশুড়ির ঘৃণা প্রকাশের ধরণ এ পর্যন্তই। কারণ যত যাই হোক, তিনি নাতীর খাতিরে ছেলের সাথে সুস্মিতার ছাড়াছাড়ি করাতে পারবেন না, পারবেন না সমাজে ধিক্কার শোনার ভয়েও।
এ সমাজ এখন বেশ উন্নত যে, ধর্ষিতাদের জন্য এই সমাজে আলাদাই সহানুভূতি। আড়ালে আবডালে হাসাহাসি করে মরছে মরুক। উপরে সবাই বেশ দরদ দেখিয়ে চলে।

হ্যা হাসছে সবাই। সুস্মিতা সবার চোখে উপহাসের হাসি দেখতে পায় তার জন্য। পাড়ার পরিচিত সবজি ওয়ালা থেকে শুরু করে তার স্কুলের পিয়ন চাচা, সবাই যখন সুস্মিতার দিকে তাকায়, ওর মনে হয় তাদের চোখ হাসছে। বাইরে তো তিন মাসেই যায়নি কোথাও ও।
শেষ বেরিয়েছিল স্কুলে রিজাইন লেটার জমা দিতে।

সেলিনা পাশ কাটিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে। তিহান মা’কে বলে,“দাদী আজ আমাকে কি করেছে জানো আম্মু?”

_কি করেছে?

_খামচি দিয়েছে হাতে।

_তা কেন?

_জানি না। আন্টিরা জানতে চাইলো তুমি কেমন আছো। আমি বলবো তার আগেই দাদী খামচি মেরে টেনে আনলো।

সুস্মিতার মুখটায় কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলো না। বরং সে হাঁটু ভেঙে বসলো ছেলের সামনে, নাভিশ্বাস ফেলে বললো,“আন্টিরা সবসময় আমার কথা জিজ্ঞেস করে?”

_হ্যা।

মুখে ম্লান হাসি টেনে সুস্মিতা বলে,“এরপর থেকে জিজ্ঞেস করলে বলবে আম্মু খুব ভালো আছে। সুন্দর করে বলবে। কেমন?”

তিহান মাথা নাড়ায়। সুস্মিতার কল বেজে ওঠে, মায়ের ফোন। কলটা রিসিভ না করে সুস্মিতা ফোনটা চুপচাপ রেখে দেয়। ও বাড়ির কল রিসিভ করা মানেই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হতে হবে সুস্মিতাকে, অসুস্থ হয়ে পরতে হবে। তাদের প্রশ্ন গুলো এমন হবে,সাইফ কেমন আচরণ করছে, সাইফ খারাপ ব্যবহার করছে কিনা, সাইফ ছাড়াছাড়ি করার কথা বলছে কিনা।

এসবের জবাব দিয়ে ইতিমধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছে সুস্মিতা। তাদের জানিয়েছে, সাইফ একটু মহাপুরুষ ধাঁচের মানুষ সম্ভবত। এই এতো গুলো দিন হয়ে গিয়েছে হাজী বাড়ির ছেলে সাইফুল ইসলাম সাইফের মান খোয়ানোর, এখন অবধি সুস্মিতার মতন এক অশুদ্ধ প্রাণীকে নিজ ঘরে, কামরায় মানছে। এখন অবধি এসে ঘাড় ধাক্কা দেয়নি।

সুস্মিতা ওসব ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসে,ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস।

“সাইফ আপনার কোয়ালিটি চেকার গুলো তিন লট মাল দেখেনি। আপনি এই ব্যাপারে খবর রেখেছেন?”

ডাইং ইনচার্জের কথায় সাইফ অন্যমনস্ক ভাব কাটিয়ে সাড়া দেয়। লোকটা সাইফের মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে অবাকের সুরে বলে,“আপনাকে এমন লাগছে কেন ? ইজ এভরিথিং ফাইন? খুব অ্যাবসেন্ড মাইন্ডেড আপনি!”

সাইফ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়াতেই লোকটা অপ্রতিভ গলায় বলে ওঠে,“আপনার মিসেস কেমন আছেন আ…আই মিন….”

এবার সাইফ ঠান্ডা গলায় বলে,“ভালো।”

জবাবটা ঠান্ডা হলেও শ্রুতিকটু ছিলো। সাইফের ভেতরটা চাপা ক্রোধে ফাটছে, বাইরে সেটা অপ্রকাশিত। লোকটাকে এক্সকিউজ মি বলে পাশ কাটিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে দুহাত মুষ্টিমেয় করে কপাল ঠেকিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। টেবিলের ওপর ঠান্ডা হচ্ছে তার লাঞ্চ, দুই তিনটা মাছি এসে খুব আয়েশ করে খাচ্ছে সুস্মিতার রাঁধা সজনে ডাঁটা দিয়ে কালবাউস মাছের তরকারি আর সাদা ভাত।

আচানক কলটা বেজে উঠে সাইফের ঝিমুনি ভঙ্গ করে। সেলিনার ফোন দেখতে পেয়ে সাইফ রিসিভ করে চুপ থাকে। ওপাশ থেকে সেলিনার থমথমে গলা শোনা যায়,“বীণার ছেলের মুসলমানির দাওয়াতে যাবি তুই?”

_বাড়ি এসে এই ব্যাপারে আলোচনা করি আম্মা? আমি ব্যস্ত!
সাইফ সামান্য বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে। সেলিনা গলার স্বর কিঞ্চিত খাদে নামিয়ে বলে,“না না, বাড়িতে এইসব আলোচনা কিভাবে করবি তুই? শোন, তোর বৌ নিয়া তুই গেলে আমি যাবো না বলে দিলাম। আমি হাঁপিয়ে উঠছি মানুষের কথায়, খোঁচাখুঁচিতে। আমি যাবো না।”

নাভিশ্বাস ছাড়ে সাইফ এইবার, মায়ের কথার পিঠে শান্ত গলায় বলে,“সুস্মিতা কোথাও যাবে না। তুমি যাও আজ রওনা করে,তিহানকে নিয়ে যাও।”

_আর তুই যাবি না?

_নাহ।

কল কেটে চেয়ার ঠেসে চুপচাপ বসে থাকে সাইফ। আর আধাঘণ্টা পরে ছুটি, অথচ তার হাত চলছে না। তার ইচ্ছে করছে সারারাত এখানে বসে কাজগুলো করতে। ভেতর থেকে বাড়িতে যাওয়ার মতো উদ্দীপনা কাজ করে না ইদানিং।

সন্ধ্যার পর থেকে সুস্মিতা বাড়িতে একা। তিহান ওর দাদীর সাথে বেড়াতে গিয়েছে ফুপির বাড়িতে। প্রায় তিন ঘন্টা ধরে একা সুস্মিতার কাছে মনে হচ্ছে তার মতো অসহায় এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। চারিদিক অন্ধকার লাগছে, পরিবেশটাও কেমন ভুতুড়ে।
হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে সুস্মিতা গুটিয়ে থাকে। ইদানিং ধরে তার একটা সমস্যা হয়েছে। একা নির্জনে তার কেমন হ্যালুসিনেশন হয়। এই সমস্যার কথা কাউকে বলেনি সে। সাইফকেও না।
রাত সাড়ে আটটা পেড়িয়ে গেলেও সাইফের কোনো হদিস না পেয়ে সুস্মিতা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। তবে কল করে না। ওর হাতের আঙ্গুল থিতিয়ে আসে, ওর গলা জড়িয়ে যায়। সেই কবে তাল কেটেছে ওদের, এখন সুস্মিতা সেধে সেধেও কল করতে পারে না। যদি সাইফের বিরক্ত গলা শুনে ফেলে? তাহলে সবকিছুর পেছনে সুস্মিতার অশুদ্ধ হওয়াকে দায় বানিয়ে সুস্মিতা মরমে মরে যাবে।

কলিং বেল বাজতেই সুস্মিতা হকচকিয়ে উঠে সোজা দাড়িয়ে যায়। চঞ্চল পায়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে দরজা খুলে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সাইফ। টানা চার ঘন্টা পরে নিজের জগতে একজন মানুষের অস্তিত্ব পেয়ে সুস্মিতা জাপটে ধরে সাইফকে।
সাইফ চমকায়, পর পর ধাতস্থ হয়ে বিরক্ত গলায় বলে, “ঘুমাওনি এখনো।”

সুস্মিতা মাথা তোলে, অবাক চোখে চেয়ে অস্ফুটে বলে,“রাত আটটা বাজে,এখনি কি ঘুমাবো? আমি ঘুমালে দরজা খুলতো কে?”

সাইফ জবাব না দিয়ে হাতের বাজারের ব্যাগটা রান্নাঘরে রেখে হনহন করে শোবার ঘরে ঢোকে। সুস্মিতা ওর পেছন পেছন গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সাইফকেই দেখতে থাকে নির্নিমেষ।
রাতের খাবারটা খায় দু’জন একসাথে বসে। সুস্মিতা টুকটাক সাইফের অফিসের কথা জানতে চায়, সাইফ সহজ তবে নিচু গলায় জবাবও দেয়। নিজে থেকে একটা কথা বলে না, বলার আগ্রহ পায়না।

এরপর যখন শুতে গেলো, সুস্মিতার পাশে শুয়ে সাইফ সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকলো। আর সুস্মিতা দেখতে থাকে মানুষটাকে। এতদিন, টানা তিন মাস তিহান ওর মস্তিষ্ক ব্যস্ত রাখতো বলে এ কথা মাথায়ও আসেনি ওর। আজ হুট করে মাথায় আসতেই সুস্মিতা উঠে বসলো। নিমিষেই হাঁসফাঁস করে উঠলো বক্ষপট, আপনা আপনি ওর হাত চলে যায় সেখানে। কম্পমান স্বরে সুস্মিতা ফিসফিসিয়ে বলে,“তুমি আমায় আদর করো না কেন?”

অন্যমনস্ক ভাব কেটে যায় সাইফের। সুস্মিতার অস্বাভাবিক মুখ চোখের ভঙ্গি দেখে সে উঠে বসে। সুস্মিতার কথার জবাবে কিছু বলতে যাবে তার আগে সুস্মিতা আবার বলে,“কেন আসো না তুমি আমার কাছে?”

নিরবে শ্বাস ফেলে সাইফ শীতল স্বরে বলল,“ঘুমাও প্লিজ।”

সুস্মিতা সাইফের “প্লিজ” শোনে না। ক্রমশ ওর মুখ চোখের ভঙ্গি এলোমেলো হয়, শরীর জুড়ে মৃগী রোগীর কাঁপন ওঠে, কন্ঠ জড়ায়,“না বলো কেনো তুমি আমাকে আদর করো না? আমি তো সুস্থ। তোমার চাহিদা জাগে না?”

সাইফ স্থির বসে আছে। সুস্মিতার কেমন পাগল পাগল লাগছে, হাঁটুতে ঘষে এগিয়ে গিয়ে সাইফের ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে সাইফের হাত দু’টো টেনে নিয়ে নিজের গাল চেপে ধরে আকুল হয়ে বলে,“এই দেখো। আমি তোমার সুস্মিতা। সে-ই আগের সুস্মিতাই। আমার গলার স্বর, আমার চোখ, আমার ঠোঁট দেখো। তুমি কেন আমার কাছে আসছো না?”

সাইফ ক্রন্দনরত সুস্মিতার দুই হাত আলতো করে সরিয়ে দিয়ে অবনত গলায় বলে,“থামবে তুমি? একটু ঘুমাতে দাও, তুমিও ঘুমাও!”

সুস্মিতা মুখ তুলে চায়, এক হাতে চোখের নোনাজল মুছে বলে,“তুমি কি ছাড়াছাড়ি চাও?”

_না।
সাইফ তৎক্ষণাৎ জবাব দেয় যান্ত্রিক মানবের মতন,কোনো ভাবাবেগ নেই গলাতে। ওর “না” তে কোনো জোর না পেয়ে সুস্মিতা কেমন দুলে ওঠে। অথচ সুস্মিতা আশা করেছিল সাইফের না টা হবে অন্যরকম। ঠিক সেদিনের মত শক্তিশালী, যখন পরিবারের সামনে সাইফ বলেছিল সুস্মিতাকে ছাড়া সাইফ আর কাউকে বিয়ে করবে না।

সেই একই সাইফ সুস্মিতার সামনে বসে আছে, কিন্তু একই নয়। এই সাইফের “না” বলার ধরণ শুনে সুস্মিতার মরে যেতে মন চাচ্ছে।

বুক ভরে দম ছেড়ে সুস্মিতা দু’হাতে নিজের গাল চেপে জল মোছে, ক্ষীণ আওয়াজে বলে,“তিহানের জন্য ডিভোর্স চাইছো না?”

কোনো কথা আসছে না সাইফের। যেন বোবা হয়েছে। সুস্মিতা অস্পষ্ট হেসে নিজেই আবার বলে,“অথচ আমাদের সম্পর্কের শুরুটা তিহানের জন্য হয়নি। তিহানের জন্য আমাদের সম্পর্ক হয়নি, আমাদের সম্পর্কের জন্য তিহান হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক টিকে থাকলে আমাদের জন্য থাকবে, তিহানের জন্য না। বলো তালাক চাও তুমি? তোমার কি গা ঘিন ঘিন করছে সংসার করতে আমার সাথে?”

বুকের ভেতরটা জ্বলছে সুস্মিতার, ও বেশ বুঝতে পারছে ওর সাথে খুব খারাপ কিছু একটা হবে। হয়তো ওর দম পরে যাবে। তবুও নিজেকে শান্ত করতে পারেনা সে।

কিন্তু হঠাৎ,একটা অকল্পনীয় কান্ড ঘটে গেলো ওর সাথে, যার কথা সুস্মিতা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
সাইফ চুলের মুঠি ধরলো ওর, পর পর তিন চারটা থাপ্পড় মেরে উগড়ে দিলো গত তিন মাসের,প্রতিটা দিনের হতাশা, চেঁচিয়ে উঠলো সুস্মিতার প্রতি জমে থাকা সমস্ত আক্রোশ নিয়ে,“কি দরকার ছিল? কি দরকার ছিল বলো! কেন আমার এমন দিন দেখতে হলো। একটুও দায় কি তোমার নেই সুস্মিতা? আসলেই কি নেই? একটা ছাপোষা গৃহিণী জীবন কাটালে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?”

সুস্মিতা, গত তিন মাস আগের ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া আঠাশের ভদ্রমহিলা নতুন করে আর ভাঙে না। শুধু এক জন্মের বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে সাইফকে, যে কিনা নিজের চুল টানছে উন্মাদের মতন।

সুস্মিতা জমে গিয়েছে,তবে গলা চলছে ওর, শ্বাস ফেলে বলে,“গৃহিনী মহিলাদের সাথে কখনো এসব হয়না বোলছো?”

টকটকে দু’টো লাল চোখ তুলে সাইফ বলে,“হয়তো তোমার সাথে হতো না! হ্যা হতো না।”

সাইফ কি বলছে সাইফ জানে না। সাইফ এটাও জানে না সাইফ সুস্মিতার সাথে কি করছে। সুস্মিতা সেদিন ভেঙেছিল শুধু, তবুও সুস্মিতা কই মাছের প্রাণ বিধায় বেঁচেছিল। আজ সুস্মিতাকে জানে মারার পাঁয়তারা করছে সাইফ নিজের হতাশা ঝাড়তে।

সুস্মিতা সাইফের শেষ কথাটা শুনে হাসে, বলে, “আমি চাকরি কেন করতাম না? পড়াশোনা কেন শেষ করেছিলাম তবে? আমার বাপ মা নেই? তাদের খাওয়াতে হতো না? তাদের ছেলে নেই….”

_তাদের ছেলে নেই সেই দায় আমার ছিল না তাইনা?

সাইফ যা বলছে তা সাইফ বলছে না, সাইফের মধ্যে এক পিশাচ ভর করেছে,সেই পিশাচ বলছে। সুস্মিতা নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয় এটা ভেবে। পরপর বলে,“আচ্ছা ওসব কথা বাদ। আসল কথায় আসি। আমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা যদি ঐ বাসে না হয়ে এই ঘরে হতো এর দায় কার ওপর চাপাতে তুমি? তোমরা?”

সাইফ জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পা মাথা তারও জ্বলছে, হাত নিশপিশ করছে। এবার গিয়ে দুম করে গাঁয়ে সমস্ত জোর খাটিয়ে দেয়ালে একটা ঘুষি মেরে দেয়, তবে ওখানেই থামে না সে, লাগাতার ঘুষিতে হাতটাই ভেঙে ফেলতে চায়। একটু চেষ্টা তার, এতে করে হলেও যাতে হতাশা কাটে। রোজ রোজ এক রেইপ ভিক্টিমের স্বামী হয়ে বাঁচার চরম হতাশা।

সুস্মিতা শান্ত দৃষ্টিতে তার সামনে অস্থির মানুষটাকে দেখছে। আট বছরের সংসারে মানুষটা তাকে ভালোবেসেছে, মাঝে সাঝে কথার আঘাতে কাঁদিয়েছে, রাগ দেখিয়েছে, আবার আদর করেছে। তবে কখনো সুস্মিতা সাইফের গলার কাঁটা হয়নি, আজ হলো, সাইফ না পারছে উগড়ে দিতে, না পারছে গিলতে। খুব অসহায় লাগছে সাইফকে। সকল জাগতিক অনুভূতি পাশে সরিয়ে সুস্মিতার এখন শুধু মায়া হচ্ছে সাইফের জন্য।

নাকের কাছটা কেমন ভেজা ঠেকল হঠাৎ, সুস্মিতা হাত ছুঁয়ে দেখলো রক্ত। সাইফের থাপ্পড়ে রক্ত ঝড়ছে। শাড়ির আঁচলে মুছে নিয়ে সুস্মিতা বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সাইফকে উদ্দেশ্য করে নির্লিপ্ত গলায় বলে,“এসো। থামো। ঘুমাও। প্লিজ।”

সাইফ থামলো হঠাৎ। যে বিধ্বংসী ঝড়টা তুলেছিল আচমকা, আচমকা থামিয়ে দিয়ে সুস্মিতার দিকে তাকাল‌। এতক্ষণে সাইফ হুঁশ ফিরে পেয়ে ছুটে এসে সুস্মিতাকে ধরলো, উদ্বিগ্ন গলায় বললো,“আমার মাথা ঠিক নেই সুস্মিতা। আমার সময় চাই। একটু সময় দাও।”

সুস্মিতা দশ মিনিট আগে মরে গিয়েছে। মৃত সুস্মিতা মলিন হেসে বললো,“অভক্তি কাটাতে সময় চাইছো? আচ্ছা। দিলাম।”

সাইফের দু’হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সুস্মিতা এলোমেলো পায়ে হেঁটে বেলকোনিতে বসে, বেলকোনির দরজা লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,“ঘুমাও তুমি। আমি পরে আসবো।”

এরপর দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, আঁচল ছড়িয়ে মেঝেতে বসে থাকে সুস্মিতা। বাইরের আকাশে ঝকঝকে এক চাঁদ, যেন পৃথিবী জুড়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সুস্মিতা চুপচাপ ঐ চাঁদ দেখে। টের পেলো বেঁচে থাকতে চাঁদটাকে যতটা ভালো লাগতো,এখন মরে যাওয়ার পরেও খারাপ লাগছে না।

“সমাপ্ত”

নারী নারীত্ব সতী সতীত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি পর্ব-০২

0

#নারী_নারীত্ব_সতী_সতীত্ব_ইত্যাদি_ইত্যাদি
#পর্ব_২
#ইসরাত_ইতি

মস্তিস্ক তখন নিশ্চল সাইফের। ও একটা বিশ্রী ঘোরের মধ্যে আছে, যেটা থেকে বেরুতে পারছে না কোনো মতেই। চোখের সামনে সবকিছু দেখছেও ওলটপালট। দেখছে তিহানকে নিয়ে ও আর সুস্মিতা শুক্রবার বিকেলে ফ্যান্টাসি কিংডম ঘুরতে এসেছে, ওরা আনন্দ করছে। সুস্মিতা সাইফের সাধ্যের মাঝে একটু আধটু আবদার করছে ঠোট ফুলিয়ে। কতটা চমৎকার সেই কাল্পনিক দৃশ্যটা। অথচ সামনের দৃশ্যটা কতখানি নির্মম, ভয়ংকর! সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জংলি ছাপার ইউনিফর্ম পরিহিত লোক গুলোকে সাইফের তার চেয়ে বেশি নির্মম মনে হচ্ছে যারা অকপটে বলাবলি করছে তার বৌয়ের ব্যাপারে। সাইফের একবার ইচ্ছা করলো ঐ লোক গুলোর মুখ বরাবর লাথি মারতে। ওদেরকে থামিয়ে দিতে।

“রিকভার হতে সময় লাগবে। আপাতত এতো খোঁচাখুঁচি করবেন না। একটু সময় দিন। এই ওষুধ গুলো আনুন।”

সুস্মিতার কথা জানতে গেলে ডাক্তারের ধমক খেয়ে গুটিয়ে যায় সাইফ। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেদিকে তার ভাবলেশহীন দৃষ্টি মেলে।
পাশ থেকে দু’জন নার্স হেঁটে যাচ্ছিল বলতে বলতে,“আরে ভয়াবহ ব্যাপার। কামড়ে কামড়ে কি অবস্থা করেছে। এবড়োথেবড়ো ভ্যাজাইনা। কি জানোয়ার। গলায় ফাঁসের দাগ আছে। সব কয়টা কম বয়সী ছেলে, একজন বাসের হেল্পার, একজন কন্ডাক্টর আর ড্রাইভার। ঝোঁকের মাথায় করে ফেলেছে তো, পরিণতি কি হতে পারে ভাবেনি। সাভার ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ায় আজ আর্মির টহল ছিল। ধরা খেয়ে গিয়েছে।”

“এবড়ো থেবড়ো ভ্যাজাইনা ”। সাইফ শব্দটা শোনা মাত্রই নার্সটির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থেকে সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সংযুক্ত বাথরুমে গিয়ে হরহর করে বমি করে। হঠাৎ খেয়াল এলো,আজ গোটা দিন শিপমেন্টের ঝামেলায় কিছু খাওয়া হয়নি তার।

আর্মির এক লোক গিয়ে সাইফকে ততক্ষণে শক্ত হাতে ধরে। কিছুটা সময় দেয় ওকে নিজেকে সামলাতে। তারপর এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,“আপনি বসবেন? বসুন।”

সাইফ বসে না। বমি করে হাপাচ্ছে, চোখ দু’টো এক নিমিষেই টকটকে লাল হলো। ঘুর্ণায়মান চোখের দৃষ্টি তখন আশপাশটা দেখছে, দেখছে কিছু কৌতুহলী ভাবাবেগ শূন্য দৃষ্টি তাকে খুব কৌতুহল নিয়ে দেখছে একজন রেইপ কেসের ভিকটিমের হাজবেন্ড হিসেবে। ওরা কি করুণার চোখে চাইছে?

ওপাশে পুলিশের লোক এসেছে, সাভার থানা থেকে। তারা কথা বলছে আর্মির লোকগুলোর সাথে। মাঝখানে সাইফ দাঁড়িয়ে আছে কাঠ পুতুলের মতন, একজন রেইপ কেসের ভিকটিমের হাসবেন্ডের মতন।

ধর্ষক তিনজনকে হাতেনাতেই ধরা হয়েছে। তারা পুলিশি হেফাজতে। সাইফ এখানে দলবল নিয়ে এদের আসার দরুণ প্রচন্ড বিরক্ত। ওর মন চাইলো পুলিশের লোকগুলোর মুখেও তিন চারটা লাথি মারতে।

“আপনি ঠিক আছেন?”

সাইফ দুলছে, এক কনস্টেবলের নজরে পরতেই সাইফ চোখমুখ কঠিন করে মাথা নাড়ায়। ওকে দেখাচ্ছে একটা শক্ত প্রস্তরখণ্ডের ন্যায়। গলার স্বরও তেমন। ওর সামনের পুরুষগুলোকে চমকে দিয়ে বলে ওঠে,“এসব আপনারা জানাজানি করবেন?”

লোকগুলো ভীষণ অবাক। একজন বললো,“বিষয়টা লুকিয়ে কি করবেন? কালপ্রিটদের শাস্তি পেতে হবে না?”

_না,ঐ বাইরের প্রেস বা জার্নালিস্ট…..

বেশি কিছু বলতে হয়নি, এক আর্মির লোক বলে ওঠে,“আমরা প্রেসের সামনে ইন্টারভিউ দিলে ভিকটিমের নাম পরিচয় উল্লেখ করি না। দুশ্চিন্তা করবেন না। ওনার জ্ঞান ফিরলে, একটু সুস্থ হলে ওনার একটা বয়ান নিতে আসবে সাভার থানা থেকে। আপনাদের ঝামেলা এ পর্যন্ত, আইনের ওপর ভরসা রাখুন।”

সাইফ আইনের ওপর ভরসা রাখবে কি না বোঝা গেলো না। আপাতত এই লোকগুলোর সামনে থেকে তার গিয়ে কোথাও লুকাতে ইচ্ছে করছে।
কোথাও,কোনো নির্জন জায়গায়।

“একি আপনি মেডিসিন গুলো আনলেন না? ইনজেকশন গুলো পুশ করতে হবে পেশেন্টকে, জলদি করুন।”

সুস্মিতার কেবিন থেকে একজন সিনিয়র নার্স মাথা বের করে গলা উঁচিয়ে বলতেই সাইফ নড়েচড়ে ওঠে। আরো একবার ফ্যাকাশে মুখে হাতের কাগজটা দেখে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যায় করিডোর ধরে।

ইনজেকশন দু’টো এনে নার্সের হাতে দিতেই ফোনটা বেজে ওঠে সাইফের। বড় বোন রিনার নাম্বার থেকে কল এসেছে । ওপাশে তিহানের কান্না মিশ্রিত গলার স্বর শুনে ছ্যাত করে ওঠে বুকটা।

“আব্বু আম্মু কই? দাদী আমাকে ফুপির বাসায় রেখে কোথায় গিয়েছে? তোমরা আসছো না কেন?”

ছেলের কথায় সাইফ জবাব দিতে পারে না। তার দৃষ্টি জরুরি বিভাগের সাত নাম্বার মহিলা কেবিনের দরজায় নিবদ্ধ। একজন নার্স হঠাৎ বলছে,“পেশেন্ট সেন্সে এখন। ফারজানা এর বাড়ির লোক কোথায়? ফারজানা?”

ফারজানা নামের নার্সটি নিজের ডেস্ক থেকে উঠে আশেপাশে তাকায়। সাইফকে চোখে পরতেই বলে ওঠে,“আপনি যান। আপনার ওয়াইফ সেন্সে আছে। বেশি কথা বলবেন না।”

সাইফ নার্সের দিকেও তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। তার নিজের বর্তমান অনুভূতি নিয়ে সে দ্বিধান্বিত। তার এখন আশপাশের পরিবেশটা কেমন অদ্ভুত লাগছে। সে যাবে ভেতরে? গিয়ে দাঁড়াবে সুস্মিতার সামনে? কি বলবে?

ভেবে পাচ্ছে না সাইফ। নার্স দু’জন প্রথম থেকেই সাইফের ওপর বিরক্ত বেশ। লোকটাকে তাদের আচরণে বোকা টাইপ মনে হচ্ছে। যেন কিছু জানে না, বোঝেনা, যেন নড়চড় নেই।

“কি হলো যান? ম্যাডাম একটু পর রাউন্ডে আসবে। দেখা করে আসেন তার আগে।”

বেডে সোজা করে শুইয়ে রাখা হয়েছে সুস্মিতাকে। পা থেকে গলা অবধি সাদা চাদরে আবৃত। ডান হাতটা,যেটাতে স্যালাইন চলছে সেটা তুলে রাখা হয়েছে সুস্মিতার পেটের ওপর।

কেবিনের দরজা ভেজিয়েই সাইফ ঘুরে তাকিয়ে সুস্মিতার পা মাথা দেখলো। কপালে গজ কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করেছে। তবে গালে খামছির দাগ স্পষ্ট।

সাইফ এগিয়ে যায় ধীর পায়ে। তারপর যখন সুস্মিতার পিটপিট করে তাকানো দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললো, সাইফ স্থির হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁয়।

সুস্মিতার চোখ জোড়া ছিল টকটকে লাল। যেন ওর চোখ থেকেও রক্ত নামছে শরীর অশুদ্ধির। সুস্মিতা পাথুরে চোখে তাকিয়ে আছে সাইফের দিকে। না কথা বলার মতো অবস্থা আছে,না নড়াচড়া করার মতো অবস্থা। আপাতত মনে হয়না কোমরের নিচ থেকে কোনো জোর পাবে ও।

দু’চোখে সুস্মিতার পানি নেই। সাইফকে দেখেও ও ভাঙে না কোনো অদ্ভুত কারণে। কেন জানি আর পাঁচটা মেয়ের মতো চিল্লিয়ে কাঁদতে পারছে না। ওর মস্তিষ্ক ওকে আপাতত বলছে,“সুস্মিতা তোর গলায় ফাঁস পরতে গিয়েও পরেনি। তুই বেঁচে আছিস। একটু ধৈর্য্য রাখ। একটু ব্যাথা টা গা সয়ে যাক। তারপর কাদিস।”

সুস্মিতার ভেতর থেকে কোনো এক সুস্মিতা বুঝি তাকে সান্ত্বনা দেয়। পর পর হাতের আঙুল নাড়িয়ে সাইফকে কিছু বলতে চায় সে।

সাইফ এগিয়ে গিয়ে বুঝতে চাইলো সুস্মিতাকে। অদ্ভুত ভঙ্গিতে বললো,“তিহানের কথা জানতে চাইছো? তিহান আছে। ওর বড় ফুপির কাছে। খেয়েছে।”

এই এতটুকুই সাইফ বলতে পারে। এরপর স্তম্ভিত হয়ে যায় তার সামনে শুয়ে থাকা সুস্মিতার হঠাৎ বাঁধভাঙা কান্নায়। এতক্ষণের সুস্মিতা ব্যর্থ নিজেকে ধরে রাখতে। শরীরি ব্যাথা, মানসিক যন্ত্রণা তার চোখের উষ্ণ জল হয়ে গড়িয়ে নামে। বুকটা হাঁপরের মতন ওঠানামা করে।

বাতাসের ঝাপটায় একটা তাসের ঘর যেমন হুরমুরিয়ে পরে যায়। আজ সুস্মিতার নারী সত্তাটা ঠিক ওভাবেই গড়িয়ে পরেছে। শুধু গড়িয়ে পরেনি, সুস্মিতার নারী সত্তাকে পিষে দেওয়া হয়েছে। এমন ভাবে চুরমার হয়েছে ও, আর গড়বে না সুস্মিতাখণ্ড গুলি।

আর এরপর? এরপর কি হবে?

সেলিনা বেগম সাইফের ছোটো বোন বীণাকে নিয়ে এসেছে। ভেতরে ঢুকতেই মাথায় হাত চেপে আহাজারি শুরু হলো ভদ্রমহিলার। সাইফ তখন কেবিন থেকে বেরিয়ে বাইরে, একপাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বীণা ছুটে এসে ভাইকে ধরে । গিয়ে একবার উঁকি দেয় ভেতরের কেবিনে। সুস্মিতাকে চোখ বুঁজে শুয়ে থাকতে দেখে বীণা পিছিয়ে এসে ভাইকে বলে,“এগুলা কিভাবে হইছে?”

সাইফ নির্লিপ্ত,মরা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে, অস্ফুটে বললো,“এগুলো কিভাবে হয়েছে তা দিয়ে কি করবি? এগুলো হয়েছে, এটাই তো! তাইনা?”

সেলিনা এবার মেঝেতে ধপ করে বসে পরে আহাজারি শুরু করে দেয়,“কোনো দরকার আছিলো? কোনো দরকার আছিলো চাকরি করতে যাওয়ার? ”

_আম্মা চুপ করো। এখন এসব ভাল্লাগছে না।

সাইফের নিষ্প্রাণ ধমকে থামলো না সেলিনা। কাঁদছে সে, বরং আগের থেকেও উচু গলায় আহাজারি করছে,“মানুষরে মুখ দেখানোর পথ আর থাকলো না রে। আর তিহান? তিহানের কি হবে? ও কি শুনে শুনে বড় হবে? হায় হায়, আল্লাহ কি পাপের শাস্তি দিতেছে এইগুলো!”

সেলিনা থামবে না এখন। সাইফ সেলিনাকে না থামিয়ে ঢুকে পরে সুস্মিতার কেবিনে। সুস্মিতা ততক্ষণে চোখ মেলেছে, শাশুড়ির কথাগুলো দিব্যি শুনেছে সে।
এতক্ষণ সুস্মিতা শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবেছিল। তার শাশুড়ি এসে মনে করিয়ে দিলো আসল কথাটা,তাইতো! মানুষ জনের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবে তার শাশুড়ি?

ধর্ষিতা হওয়া মারাত্মক একটি অপরাধ। কিন্তু সুস্মিতা সেধে সেধে এই অপরাধে জরায়নি তো! সে কি করে বুঝতো অত ছোটো ছোটো ছেলেগুলো তাকে নারী হিসেবে সম্মানের চোখে না দেখে একদলা মাংসপিণ্ড ভাববে শুধু!

তবে কি সত্যিই সুস্মিতার বাইরে বেরোনো উচিত হয়নি? কোনো না কোনো ভাবে হলেও দোষটা সুস্মিতারই?
ওর নাজুক মস্তিষ্ক এসব ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়। সাইফ এসে ওর হাতের স্যালাইনের সুইটা ঠিক করে দেয়। ঠিক তখন সুস্মিতা সাইফের মুখ দেখলো। এই সাইফ,তাকে বিয়ে করে বিয়ের প্রথম রাতে যখন বুঝেছিল সুস্মিতা অনাঘ্র। সুস্মিতাকে কত আদর মাখিয়ে দিয়েছিল গর্বে। ওকে কত আহ্লাদে বলেছিল,“আমার সুস্মি। সুস্মি সোনা আমার। আমি তোমাকে নিয়ে গর্ব করি।”

সুস্মিতা লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছিল সাইফের পাগলামি দেখে। ঐ পাগলামি কোনো নারীর প্রথম পুরুষ হবার গর্বের পাগলামি।
সুস্মিতা চাক্ষুষ দেখেছিলো নারী সতীত্ব নিয়ে তার বৈধ পুরুষের আবেগ। সাইফ শুদ্ধ পুরুষ ছিলো, এই জমানায় সুস্মিতার মতো একজন শুদ্ধ নারীকে পেয়ে তাই ভীষণ আবেগী হয়েছিল।
আর আজ,সাইফের আবেগ চুরমার হলো। সুস্মিতা অশুদ্ধ হলো। সাইফ বলবে না,“আমি মুখ দেখাবো কি করে?”

কখন বলবে?

চলমান……

[ আগামী পর্বে গল্পটি শেষ হবে! ]

নারী নারীত্ব সতী সতীত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি পর্ব-০১

0

নারী_নারীত্ব_সতী_সতীত্ব_ইত্যাদি_ইত্যাদি
#পর্ব_২
#ইসরাত_ইতি

“ভাই আবার বের করে দিছে ঐ মেয়েরে ঘর থেকে। ব্রাঞ্চ রোডে ভিড় জমছে। বুঝি না ওর বড় বোনটা কি বলদ নাকি?”

শাদ সিগারেটের শেষ টান টা দিয়ে টুকরোটা পায়ে পিষে ঘড়িতে সময় দেখে। রাত তখন সাড়ে এগারোটা প্রায়। কাঠপট্টির ওমাথার শেষ দোকানটির শাটার নামিয়ে ধীরেণ রায় নিজের বাইক চালু করে বাড়ির রাস্তা ধরে। দৃষ্টি এক ঝলক সেদিকে বুলিয়ে শান্ত গলায় ওমরকে বলে,“ওর কি আঠারো হয়েছে রে?”

_মিতুর কাছে শুনেছি হয়নি।

শাদ টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো। ও আসলে শ্বাস নয়,নিলো এক কঠিন সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তটা নিতে গিয়ে শাদ তালুকদারের ঘাম ছুটে গিয়েছে।

“চরকলোনির হুজুররে টাকা দিলে বিয়ে পড়িয়ে দেবে না?”

গুরুর কথায় এক নিমিষেই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা সাত আটটা চোয়াল হা হয়ে ঝুলে পরতে চায়। ওমর চাপা স্বরে চিল্লিয়ে বলে ওঠে,“বাল্য বিবাহ করবেন?”

পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকার পরিমাণ দেখছে শাদ। জবাব টা দেয় শান্ত গলায়,“মুসলিম বিবাহ করবো। আমার বয়স হয়েছে, ওরও বয়স হয়েছে। চেহারা দেখে তোদের মনে হয়না দুই একটা বাচ্চা অনায়াসে পালতে পারবে ঐ মেয়ে? হাবলি হলে হবে কি? হাট্টাগাট্টা আছে। মনে তো হয় সংসারী হবে?”

ওরা তখনও অবিশ্বাসের ঘোরে। ওমর বলে,“আর এতদিন যে বাস্তবতার কথা বলতেন? বাস্তবতা এই, বাস্তবতা সেই। ওসব?”

ওয়ালেট টা পকেটে ঢুকিয়ে নিজের বাইকে চেপে বসে এবারো শান্ত গলায় জবাবটা দেয় শাদ।

“বাস্তবতার গুষ্টি কিলাবো। আমার বৌ খাওয়ানোর গাটস আছে আমার। তুই কাজি আন। কাদতেছে নাকি রে?”

_তা দেখিনি।

_কতক্ষণ ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে?

_এই আড়াই ঘণ্টা তো হবেই।

এবার একটু মেজাজ উঠলো শাদের, আপনমনেই বিড়বিড় করলো,“ডেঙ্গুর সিজন। নিশ্চয়ই মশায় কামড়ে তামা তামা করে ফেলছে। যদি এমন কিছু হয়না? ওর বোন দুলাভাইকে আমি চিবিয়ে খাবো দেখিস,তাও লবণ ছাড়া।”

______________________________________

চলবে।

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ পর্ব-৫০ এবং শেষ পর্ব

0

#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ
#পর্বঃ৫০(১ম অংশ)
#লেখিকাঃমেহের_আফরোজ
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
[প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত]

“নির্জন কথাগুলো বলতে বলতেই নিধি চোখ জোড়া বন্ধ করে,নির্জনের বুকে ঢলে পড়লো।”

“নিধি এভাবে নির্জনের বুকে সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাওয়াতে,নির্জন নিধির পিঠে হাত দিয়ে শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে,পৈ**শাচিক হাসি দিয়ে,হাস্কি ভয়েসে বললো,

‘উফফ,এতো ভীতু হলে হবে?আমার বউ কে তো আমার মতো সাহসী হতে হবে।এরপর থেকে তোমাকে আরও ভালো করে ট্রেইনিং দিতে হবে,ডার্ক কুইন।’
বলেই পুরো রুমের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে,নিধিকে কোলে তুলে,রুম থেকে প্রস্থান করলো নির্জন।”

“নিধিকে রুমে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে,নিজের সেফটি স্যুট চেঞ্জ করে,নিধির সেফটি স্যুট চেঞ্জ করে দিলো।তারপর নিধির পাশে বসে,ওর ঘুমন্ত মুখস্রির দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে,ওর কপালে লেপ্টে থাকা চুল গুলো সরিয়ে,আলতো করে চুমু দিলো।অতঃপর ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

“প্রিয়তমা,যদি তুমি পাথর ভে**ঙে ফেলো ভুল পথে,
আমার শাসন হবে ভ**য়ংকর,তোমার চিন্তা করবে রাত।
তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ আমি গভীরভাবে লক্ষ্য রাখবো,
যদি তুমি পথে বাঁকাও,ভ**য়ংকর শাস্তি হবে তোমার প্রতিশ্রুতি।

তোমার দৃষ্টির দিকে কেউ যদি একটুও নজর রাখে,
আমার প্রতিশোধের আঁচ তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।
তোমার ভুলের জন্য আমি হবো অন্ধকারের গার্ড,
ভ**য়ংকর শাসনের আগুনে পুড়বে তোমার অহংকার।

আমার চোখের তীক্ষ্ণতা থাকবে সর্বদা,
যতক্ষণ তুমি আমার নিয়মে চলবে,ততদিন শান্তি।
প্রেমের নামে শাসন হবে কঠোর,অনুশাসন হবে অবিচল,
যদি তুমি ভুল করো,তুমি পাবে এক ভ**য়ংকর রাতের কল্লোল।”

~মেহের~
“কবিতা আবৃত্তি করে,কিছু একটা ভেবে ডেভিল হেসে রুম ত্যাগ করে,বাইরে চলে গেলো নির্জন।তারপর ৩-৪ ঘন্টা বাসার বাইরে এবং ঘরে কঠোর পরিশ্রম করে,সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নিধির পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।”

————–
“সকাল ৯টা বেজে ৪১ মিনিট।জানালার শুভ্র রঙা পর্দা ভেদ করে,সূর্যের তীর্যক রশ্মি নিধির চোখজোড়ার ওপর পড়তেই ঘুম ভে**ঙে গেলো নিধির।পিটপিট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো পাশে শুয়ে আছে নির্জন।
সাধারণত ঘুম থেকে উঠার পর মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনগুলো সাথে সাথেই কাজ করা শুরু করে,তবে সম্পূর্ণ কার্যক্ষমতায় পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগে।ঘুমের সময় মানুষের মস্তিষ্কের কিছু অংশ বিশ্রাম নেয় এবং ব্রেন ওয়েভ বা মস্তিষ্কের তরঙ্গ ধীর গতিতে চলে।ঘুম থেকে ওঠার পর, মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে আসে। এজন্য কিছু মানুষ ঘুম থেকে উঠার পর খানিকটা সময় ঘোরের মতো অবস্থায় থাকতে পারে,যাকে “sleep inertia” বলা হয়।”

“নিধির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।ও রাতে ঘটে যাওয়া কাহিনী গুলো ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথে মনে করতে পারলো না।আড়মোড়া ভে**ঙে বিছানা থেকে উঠতে নিলেই,দেখলো নির্জনের হাত ওর পেটের ওপর।নিধি
নির্জনের হাত সরানোর জন্য তার হাতের ওপর হাত রাখতেই,ধীরে ধীরে রাতের ভ**য়ংকর ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো।”

“সবকিছু মনে পড়তেই,নির্জনের দিকে একবার ভ**য়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে,নির্জনের হাত সরিয়ে মুহূর্তেই বিছানার এক কোণে গুটিসুটি হয়ে বসে,তীব্র স্বরে চি**ৎকার করে উঠলো নিধি।”

“নিধির এহেন চি**ৎকার শুনে,নির্জনের শান্তির ঘুম ভে**ঙে গেলো।ঘুমঘুম চোখে নিধির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘সকাল,সকাল এত জোরে চি**ৎকার করে উঠলে যে ডার্ক কুইন?কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছো নাকি?এসো, আমার বুকে এসো।
বলেই নিধির দিকে এগিয়ে ওর হাত ধরতে গেলেই,নিধি নির্জনের হাত ধা**ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে,চি**ৎকার করে বলতে থাকে,

‘আমাকে স্পর্শ করবেন না,আপনি খু**নি,আপনি পাপী।সরুন,সরুন..’
বলেই আরো গুটিসুটি হয়ে বসলো নিধি।ওর শরীর রীতিমতো থরথর করে কাঁপতে থাকল।”

“নিধির এহেন আচরণের কারণ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বুঝতে পেরে,বাঁকা হাসল নির্জন।কিছু একটা ভেবে,নিধির দিকে হিং**স্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শোয়া থেকে উঠে,নিধির কাছে এসে ওর হাত শক্ত করে ধরে বলতে থাকল,

‘বুঝেছি,রাতের ঘটনা মনে করে ভয় পাচ্ছো,হা হা হা..আরে এগুলো তো কিছুই না।আরও কাহিনী আছে,শুনবে?উমম..তুমি না শুনলেও জোর করে শোনাবো।নইলে তো আমার মতো সাহসী হতে পারবে না।’

“নির্জন এভাবে হাত ধরাতে ব্যথায় ‘উহ’ আর্তনাদ করে উঠলো নিধি।
চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

‘আপনার এই নি**কৃষ্ট হাত দিয়ে আমায় ধরবেন না,ছাড়ুন আমার হাত।অ*সভ্য,ইতর,ন**রপ*শু,খু**নি,প্রতারক।’

“নিধির বলা শেষ (প্রতারক) শব্দ টি শুনে,মেজাজ বিগড়ে গেলো নির্জনের।ঘাড় কাত করে নিধির দিকে র**ক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,ডান হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে,
ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলতে থাকল,

‘চুপ,চুপ..একদম চুপ..এই আমাকে প্রতারক বলার সাহস তোর হলো কি করে?কার সাথে প্রতারণা করেছি,হুম?তোর সাথে করেছি?নাকি অন্য কারো সাথে করেছি?আরে আমি তো তাদের শাস্তি দিয়েছি,যারা আমার সাথে প্রতারণা করেছে।ওই আলমিরাতে যেটাকে দেখলি,সেটাও তো ছলনাময়ী,আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড ইতি তো ছিলো মিথ্যাবাদী।আমাকে প্রপোজ করে,দুইদিন পর আরেকজন কে ওর মনে ধরেছে।তাই তো ওর হাত আর পায়ের আঙ্গুল গুলো ক্যা**চক্যা**চ করে কে**টে ফেলেছিলাম।আরেকজন আছে আমার অফিসের কলিগ,বর্ষা।ওই চরিত্রহীন নারীকে তো বিভিন্ন খাবারে বি**ষ দিয়ে,এসিড এবং আগুনে পুড়িয়ে মে**রেছি।আর সেই ছাইগুলো আমার ল্যাবরেটরী রুমের টেবিলে একটি বক্সে রেখেছি।
আরও শুনবি,কাকে কাকে মে**রেছি?হাহাহা..
তোর জন্যও মা**র্ডার করেছি।মনে আছে,রিমনের কথা?
দিগন্তের বিয়েতে ও তোর দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো,সেই সাথে তোকে ইঙ্গিত করে বাজে কথা বলেছিলো।ওকে তো আমি ওয়েটারদের চেঞ্জিং রুমে গিয়ে ক্ষ**তবিক্ষ**ত করেছি।নিউজে তো দেখেছিস,তাই না?এইবার ওর হ**ত্যাকারীকে নিজে চোখে দেখে নে।হ্যা,ওই খু**নি আমি,ভালো করে দেখ..ওই দেখ..দেখ..
আর শোন,নেক্সট টার্গেট হবে,মেহরাব।ওকে তো আমি টু**করো টু**করো করবো।’

“নিধি চোখজোড়া বন্ধ করে আছে।ভয়ে পুরো শরীর কাঁপছে।নির্জনের সেদিকে ধ্যান নেই।নির্জন ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ফেলে ঘাড় কাত করে আবারও বলতে শুরু করলো,

‘তারপর তোর বাবার বাড়ি থেকে আসার সময় বাসে একজন নে**শাখোর,চরিত্রহীন লোক তোর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো,সেই সাথে বাসে থাকা অন্য মেয়েগুলোকেও বা**জে ভাবে ছুঁয়েছে।ওকেও আমি কৌশলে পোড়াবাড়িতে নিয়ে ইচ্ছে মতো কা**টাকা**টি
করে,সেখানেই মাটি চাপা দিয়েছি।’
বলেই নির্জন কিভাবে লোকটিকে মে**রেছে,উ**ন্মা*দের ন্যায় তার বিবরণ দিতে থাকল।’

“এদিকে নির্জনের মুখে এতগুলো মা**র্ডারের নৃ**শংস বর্ণনা শুনে,নিধির মাথা ঘুরে উঠলো।ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়ে এলো।
সেদিকে হুঁশ নেই নির্জনের।সে তো কিভাবে মা**র্ডার গুলো করেছে,সেগুলোর মজা করে বর্ণনা দিচ্ছে।আর কিছুক্ষণ পর পর পৈ**শাচিক হাসি দিচ্ছে।”

“সবকিছু বলে নির্জন নিধির মুখ থেকে হাত সরাতেই, গড়গড় করে বমি করে দিলো নিধি।”

“নিধি এভাবে বমি করে দেওয়াতে নির্জনের পড়নের টি-শার্ট,প্যান্ট এবং বিছানার চাদর নষ্ট হয়ে গেলো।নির্জন চোখজোড়া বন্ধ করে,আবার খুললো।
অতঃপর নিধির পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে থাকল,

‘এই রোমান্টিক ওয়েদারে তোমার বমি হওয়ার কারণ কি অন্যকিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে,ডার্ক কুইন?’
বলেই বাঁকা হাসল নির্জন।”

“নির্জনের কথাগুলো নিধির কানে গেলো না।নিধি আবারও বমি করে দিলো বিছানায়।
নিধির এহেন পরিস্থিতি দেখে,নির্জন নিধিকে কোলে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো।তারপর নিধি কে ফ্রেশ করে দিয়ে,
ওকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।তারপর ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,

‘সকালে সূর্যের তেজ টা প্রখর ছিলো।কিন্তুু এখন ঠান্ডা মনে হচ্ছে।সেই সাথে তুমিও বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছো।সবকিছুই তো তোমাকে বললাম।এখন আমাকে একটা উপহার দাও।
এই রোমান্টিক ওয়েদারে একটা রোমান্টিক গান শোনাও,নিরু।ওই যে ওই গানটা,যেটা ফুলসজ্জার রাতে গেয়েছিলে..
“বাতাসে গুন গুন..
এসেছে ফাগুন..”
উফফ,ওটা যা গেয়েছিলে…ওটা শোনাও।”

“এই ভ**য়ংকর পরিস্থিতিতে নির্জনের এহেন আবদার শুনে,হতভম্ব হয়ে গেলো নিধি।দুর্বল শরীর নিয়ে,নড়েচড়ে বসে,নির্জনের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

‘নির্জন….

‘উহুম’ বুঝেছি,তোমার শরীর দুর্বল লাগছে।আচ্ছা,একটু পর শুনিও।আগে আমার টা শোনো।গান টা মনযোগ দিয়ে শুনবে।এটা কিন্তু আমার ভীষণ প্রিয় গান,হুম..।’
বলেই চোখজোড়া বন্ধ করে গাওয়া শুরু করলো নির্জন।

🎶”Na jaane koi, kaisi hai ye zindagani,
Humari adhuri kahani..”
ভেবে দেখেছো কি,তারাও কত আলোকবর্ষ দূরে..
আরও দূরে..
তুমি আর আমি ক্রমে ক্রমে যাবো সরে..”🎶

“কয়েক লাইন গেয়ে,নির্জন চোখজোড়া খুলতেই দেখলো,নিধির চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
সেটা দেখে নির্জন নিধির চোখের পানি মুছে বলে উঠলো,

‘আরে শেষের দুই লাইন শুনে কষ্ট পেলে নাকি?আরে বোকা বউ আমার..আমরা কখনোই দূরে সরে যাবো না।তুমি যেতে চাইলেও তোমাকে যেতে দেবো না।
আচ্ছা,আমি আগে আমার পোশাক এবং বিছানার চাদর পাল্টে নেই।তুমি এখানে বসে রেস্ট করো।তারপর আমরা আরও অনেক গল্প করবো,ওকে ডার্ক কুইন?’

বলেই নিধির ঠোঁট জোড়ায় আলতো করে চুমু দিয়ে,বিছানার চাদর উঠিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো নির্জন।”

“নির্জন ওয়াশরুমে যেতেই,নিধি সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,টেবিলে থাকা গ্লাসের পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।অতঃপর টেবিলের ওপর রাখা নির্জনের
মোবাইল,ওষুধের বক্স এবং প্রেসক্রিপশন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যখনই দরজা আটকাতে যাবে,তখনই নির্জন এসে দরজায় হাত দিয়ে নিধিকে আটকাতে চাইলো।”

“নিধি কোনো উপায় না পেয়ে,দরজা আরেকটু আটকাতেই নির্জনের হাতের তালুতে খুব জোরে চাপ লাগতেই,অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে নিচে বসে পড়লো নির্জন।

‘এই ফাঁকে নিধি,তড়িঘড়ি করে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।এলোমেলো পায়ে দৌঁড়াতে লাগল রাস্তা দিয়ে।রাস্তার মানুষগুলো এমন এলোকেশী নারীটিকে দেখে কি ভাবছে,সেদিকে মনোনিবেশ করার সময় নেই নিধির।বরং সে দৌঁড়ানোর সময় বারকয়েক পেছনে তাকিয়েছে।আর ভেবেছে,

‘এই বুঝি নির্জন চলে এলো।এখনই আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কঠোর শাস্তি দিবে।’

কথাগুলো ভাবতেই গায়ে কাঁপন শুরু হলো নিধির।দুর্বল শরীরে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মাথা ঘুরে উঠলো নিধির।আবারও বমি বমি ভাব হচ্ছে।এভাবে একসময় একটি গলিতে গিয়ে,একটি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেললো নিধি।তারপর নির্জনের মোবাইল থেকে
মাহিরের নাম্বার বের করে ফোন করলো।’

‘কয়েকবার রিং হওয়ার পর,মাহির ফোন রিসিভ করতেই,নিধি শুকনো ঢোক গিলে,ড.মায়ার ফোন নাম্বার চাইলো।’

“মাহির বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘আপু,আপনি ঠিক আছেন তো?নির্জন ভাইয়ার নাম্বার থেকে কল করলেন যে?আপনার ফোন কোথায়?’

“নিধি মাহিরের কথার বিপরীতে বলে উঠলো,

‘এইসব বিষয়ে পরে কথা বলবো,আগে মায়া আন্টির ফোন নাম্বার দিন প্লিজ।’

“মাহির কিছুটা চিন্তিত হয়ে,ফোন কে**টে ম্যাসেজ করে,ড.মায়ার নাম্বার দিলো।নিধি তৎক্ষনাৎ ড.মায়ার নাম্বারে কল দিলো।২বার পরিপূর্ণ রিং হয়ে কে**টে যাওয়ার পর,তিন বারের সময় রিসিভ করলেন ড.মায়া।”

“ফোন রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই,নিধি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,করুণ স্বরে ড.মায়াকে নির্জনের করা ঘটনা গুলো সব বললো।কিন্তু খু**নাখু**নির বিষয়টি বললো না।আপাতত ওর মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,

‘এতদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরেও,প্রতিদিন নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার পরেও,নির্জন কেনো সুস্থ হলো না?’

কথাগুলো ভেবে ড.মায়া কে কান্নামিশ্রিত স্বরে প্রশ্ন গুলো করলো।”

“ড.মায়া কিছুটা চিন্তিত হয়ে,নিধি কে বললেন,

‘আমার মনে হয়,এই বিষয়টি নিয়ে তুমি ড.আজাদের সাথে কথা বললে ভালো হবে।যেহেতু মেডিসিনগুলো তিনি দিয়েছেন।তুমি তাকে সবকিছু খুলে বলো।আশা করি,সঠিক পরামর্শ পাবে।’

“নিধি গলির আশেপাশে তাকিয়ে,করুণ স্বরে বললো,

‘এই মুহূর্তে আমার কাছে কোনো টাকা নেই।আমি তার কাছে কিভাবে পৌঁছাবো?আপনি যদি মেহরাব কে এখানে পাঠাতেন,তাহলে হয়তো আমি যেতে পারতাম।আমার খুব ভয় লাগছে আন্টি।’

“ফোনের অপর পাশ থেকে নিধির কান্নার শব্দ শুনে,ভীষণ মায়া হলো ড.মায়ার।তিনিও তো একদিন এভাবেই কেঁদেছিলেন।কিন্তু,তখন কেউ ছিলো না তার পাশে।নিজেকেই সংগ্রাম করতে হয়েছে।’
ভেবে,নিধিকে শান্ত করার জন্য ভরসার সহিত বললেন,

‘রিল্যাক্স নিধি।আমি মেহরাব কে পাঠাচ্ছি।ও তো ওখানেই জব করে।একটু অপেক্ষা করো।’

বলেই ফোন রেখে দিয়ে মেহরাব কে কল করে সব কিছু বললেন ড.মায়া।
মেহরাব সবকিছু শুনে,সিনিয়র অফিসার কে বলে,গাড়ি নিয়ে ড.মায়ার বলা ঠিকানায় চলে গেলো।”

“প্রায় ২০মিনিট পর নিধির দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছালো মেহরাব।গলি থেকে বেরিয়ে মেইন রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলো নিধি।এই সময়ের মধ্যে কতবার যে এদিক-ওদিক তাকিয়েছে ঠিক নেই।
মেহরাবের গাড়ি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসে,ড.আজাদের চেম্বারে নিয়ে যেতে বললো
নিধি।”

“নিধির ক্লান্ত মুখস্রির পানে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে,কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো মেহরাব।”

“প্রায় আধা ঘন্টা পর ড.আজাদের চেম্বারে পৌঁছাতেই,তার এ্যাসিস্ট্যান্টের কাছ থেকে জানতে পারলো,যে সে আজকে চেম্বারে বসবে না।”

“এ্যাসিস্ট্যান্টের এহেন কথা শুনে ক্লান্ত মুখমণ্ডল চুপসে গেলো নিধির।
নিধির দিকে তাকিয়ে মেহরাব ম্লান হেসে ভরসার সহিত বললো,

‘চিন্তা করো না,নিধি।ব্যাপারটা যেহেতু আর্জেন্ট,তাই আজাদ স্যারের বাসায় তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।স্যারের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক।আশা করি,তোমাকে দেখে তিনি কিছু মনে করবেন না।’

“মেহরাবের এহেন কথায় ধোঁয়াশার মাঝেও,মনে হয় আলোর দিশা পেলো নিধি।মলিন স্বরে বললো,

‘আপনি খুব ভালো মানুষ,মেহরাব।আমি চিরজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’

“নিধির কথা শুনে,অপরদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো মেহরাব।’

“তারপর নিধিকে নিয়ে রওনা হলো ড.আজাদের বাসায়।”

“ড.আজাদের বাসায় গিয়ে ২বার কলিংবেল বাজাতেই,তিনি দরজা খুলে নিধি এবং মেহরাব কে দেখে বিস্ময়কর চাহনি নিক্ষেপ করে বললেন,

‘আরে,তোমরা এখানে?হঠাৎ আমার বাসায় এসেছো যে?’

“মেহরাব এবং নিধি ড.আজাদের দিকে তাকিয়ে সালাম দিলো।মেহরাব সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে নিধির বলা কথাগুলো তাকে বুঝিয়ে বললো।
সবকিছু শুনে ড.আজাদের চেহারার ভাব পাল্টে গেলো।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে,মেহরাব এবং নিধিকে ঘরে প্রবেশ করতে বললো।”

“মেহরাব ঘরে প্রবেশ করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

‘স্যার,আমি একটা মিটিং ফেলে রেখে কিছু সময়ের জন্য চলে এসেছি।মিটিং টি এখনও চলমান।আমাকে এখন যেতে হবে।’

বলেই নিধির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘নিধি,তুমি স্যারের সাথে কথাগুলো বলো।আর আমার জন্য অপেক্ষা করো।আমি মিটিং টা শেষ করে,তোমাকে নিয়ে যাবো।’

বলেই মেহরাব ড.আজাদ কে সালাম দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।”

“এদিকে মেহরাবের যাওয়ার পানে তাকিয়ে,বাঁকা হাসল ড.আজাদ।”

“নিধিকে সোফায় বসতে বলে,তিনি চলে গেলেন কিচেনে।নিধির জন্য শরবত বানিয়ে এনে টি-টেবিলে রেখে,সোফায় বসে বললেন,

‘কি ভাবছো,এই বাসায় আমি একা কেনো?’

‘আসলে আমার স্ত্রী পরলোকগমন করেছে আরও ৬বছর আগে।আমার ২জন মেয়ে লন্ডনে সেটেল।আর আমি কাজের সুবাদে এখানেই থাকি।আচ্ছা,মেহরাবের থেকে তো সবকিছু শুনলাম।এইবার তুমি কি আমাকে আমার করা প্রেসক্রিপশন টা দিতে পারবে?সেটা কি সাথে এনেছো?’

“ড.আজাদ বলতেই,নিধি প্রেসক্রিপশন টা তার দিকে এগিয়ে দিলো।তিনি সেটা হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাঁকা হেসে বললেন,

‘আরে,তোমাকে দেখে তো বেশ অস্থির মনে হচ্ছে।এই ঠান্ডা শরবত টি খেয়ে নাও,আশা করি এই প্রখর গরমে স্বস্তি পাবে।’

“ড.আজাদের কথা মতো,নিধি গ্লাসে মুখ লাগিয়ে কিছুটা শরবত খেলো।তারপর ড.আজাদের দিকে তাকিয়ে নির্জনের এহেন পরিস্থিতির কথা জিজ্ঞেস করতেই,তিনি ডেভিল হেসে বলে উঠলেন,

‘যদি বলি,নির্জনের এই ভ**য়ংকর পরিণতি আমার দেওয়া ওষুধের কারণে হয়েছে,তাহলে কি তুমি বিশ্বাস করবে?’

“ড.আজাদের কথা শুনে ভড়কে গেলো নিধি।ভ্রকু**টি করে বিস্ময়ের স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘মানে?’

“ড.আজাদ পৈ**শাচিক হাসি দিয়ে বললেন,

‘আরে,আরে..রিল্যাক্স।এখনই এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।আগে তো পুরোটা শুনে নাও।অবশ্য একটু পর তুমিও শুকনো পাতার মতো ঝরে যাবে।তার আগে পুরো ঘটনাটা তোমাকে শোনাতে চাই,আফটার অল তুমি তারই স্ত্রী।’

বলেই বাঁকা হেসে বলতে শুরু করলো,

‘তোমার সৎ শাশুড়ির সাথে ছিলো আমার নিষিদ্ধ সম্পর্ক।তখন আমি এত বড় ডক্টর ছিলাম না।মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি।চোখে ছিলো অনেক স্বপ্ন।কিন্তু হাতে তেমন টাকা ছিলো না।তোমার শ্বশুর অসুস্থ হওয়ার পর,আমাদের হসপিটালে সায়রা বেগম তাকে দেখাতে নিয়ে আসে।আমার কেনো জানি,তার স্বামী কে দেখে খুব মায়া হয়েছিলো।সেই সাথে তাকে দেখেও।তোমার শ্বশুরের শারীরিক কন্ডিশন আগে থেকেই খারাপ ছিলো।চিকিৎসা করার পরেও তিনি হার্ট অ্যা**টাক করে মৃ**ত্যুবরণ করেন।আর আমাকে দিয়ে যায় সুবর্ণ সুযোগ।তারপর আমি নিজে থেকেই নির্জনদের বাসায় আসা-যাওয়া করতাম,খোঁজ-খবর নিতাম।তবে নির্জন যখন স্কুলে যেতো,তখন।
এক পর্যায়ে তোমার শ্বাশুড়ির সাথে আমার সম্পর্ক গভীর হয়।আর আমি তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেই এবং সে আমাকে এই সব সম্পত্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।কিন্তু সেখানে জটলা পাকায় ওই অ**সভ্য ছেলেটা,নির্জন।

একদিন ও আমাদেরকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে এবং আমি কোনোরকমে মুখ ঢেকে ওকে ধা**ক্কা দিয়ে, বাইরে চলে যাই।আর তারপর একসময় জানতে পারি,তোমার শ্বাশুড়ি নাকি শয্যাশায়ী।আমার এতদিনের সাজানো সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছিলো নির্জন।তারপর আমাকে এই পর্যায়ে আসতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।”

“যাইহোক,তখনই আমার কেনো জানি,সন্দেহ হয়েছিলো,যে তোমার শ্বাশুড়ির অসুস্থ হওয়ার পেছনে নির্জনের হাত নেই তো!

হ্যা,অবশেষে সন্দেহ টা সত্যি হলো তখন,যখন এতগুলো বছর পর নির্জন আমারই চেম্বারে আমার পেশেন্ট হয়ে এলো।ওকে এক পলক দেখেই আমি চিনে ফেলেছিলাম।
কিন্তু ও আমাকে চিনতে পারেনি।কারণ ও আমাকে এর আগে কখনো দেখেনি।
ব্যাস,মেঘ না চাইতেও বৃষ্টি পেয়ে গেলাম।আমার মধ্যে থাকা এতোদিনের জমানো প্রতিশোধ স্পৃহা হুড়হুড় করে জাগ্রত হয়ে উঠলো।
ড.মায়ার দেওয়া ভালো ওষুধ গুলো চেঞ্জ করে,যেই ওষুধ গুলোতে সাইড-ইফেক্ট হয়,সেগুলো লিখে দিলাম।আরও মজার বিষয় হলো,তুমি আমারই বলে দেওয়া ফার্মেসী থেকে ওষুধ গুলো কিনে নিলে,আর ওকে খাওয়ালে।তারপর বাকি কাহিনী তো নিজেই ভোগ করেছো,হা হা হা।
ওহ,কি কি ওষুধ দিয়েছি,আর সেগুলোতে কি কি সাইড ইফেক্ট আছে,সেটা শুনবে না?আচ্ছা,শোনো,

“১. সাইকোট্রিক্সিন(Psychotrixin):
এটি মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলোতে রিয়্যাকশন তৈরি করে এবং মানসিকভাবে স্থির থাকা কঠিন করে তোলে।

এর সাইড ইফেক্ট হলো,
ঘুমের তীব্র অভাব,মস্তিষ্কের মধ্যস্থ চিন্তা ও বোধশক্তি দুর্বল করে।এই ওষুধটি নির্জনকে দিনরাত জেগে থাকার এবং নানা অস্বাভাবিক চিন্তা ও ভ্রান্তির জগতে নিয়ে গিয়েছে।”

“২.ডিপ্রেসাড(Depressad):
এটি নির্জনের মনকে ধীরে ধীরে বিষণ্ণ করে তুলেছে।তার আত্মবিশ্বাস এবং ইচ্ছাশক্তি নষ্ট করে দিয়েছে।
সেই সাথে মানসিক অবসাদ,স্বপ্নভঙ্গ এবং আ**ত্মহ**ত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে দিয়েছে।এই ওষুধের কারণে নির্জন ক্রমাগতভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবতে থাকে।আশা করি,তুমি সেটা ভালো ভাবে উপলব্ধি করেছো।”

“৩. ইনসানিক্স(Insanix):
এটি নির্জনের ভেতরের অনুভূতিগুলোকে আরও গভীরভাবে জাগিয়ে তোলে এবং হিং**স্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে।সেই সাথে সহিংসতা ও ক্রোধের স্ফুরণ বৃদ্ধি করেছে।আর এই ওষুধটি নির্জনের ভেতরে আগ্রাসন সৃষ্টি করেছে এবং তাকে প্রতিদিন আরও হিং**স্র ও ভ**য়ংকর করে তুলেছে।যেন নিজের কিংবা অন্য কারো ক্ষতি করতে তার আর দ্বিধা না থাকে।”

“৪.হ্যালুসিনাজিন(Hallucinagin):
এটি নির্জনের মনে বি**কৃত চিন্তা এবং ভ্রান্তির সঞ্চার ঘটিয়েছে এবং বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছে।

ফলে তার তীব্র হ্যালুসিনেশন,ভ**য়ানক বিভ্রম এবং অতিরিক্ত অস্বস্তি অনুভব হয়েছে।এই ওষুধের কারণে নির্জন ঘরে বসেই অবাস্তব দৃশ্য দেখছে এবং সে ভ**য়ংকর দুঃস্বপ্নে আটকে পড়েছে।”

“৫. ইরেটোল(Iratol):
এটি মস্তিষ্কের রাগ এবং হতাশা সংক্রান্ত অংশগুলোতে কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে।তার স্থায়ী মানসিক অশান্তি সৃষ্টি করেছে এবং উদ্বেগ,মাথাব্যথা,এবং গায়ে অস্বাভাবিক অস্থিরতা তৈরি করেছে।এই ওষুধের কারণে নির্জনের ধৈর্য একেবারে শূন্য হয়ে গেছে,এবং সে ক্ষণে ক্ষণে রাগের মধ্যে ফেটে পড়ছে।”

“ড. আজাদ প্রতিটি ওষুধের বর্ণনা দিয়ে ভ**য়ানকভাবে হেসে উঠলো,এবং বললো,

“নিধি,তুমি কি বুঝতে পারছো না?এই ওষুধগুলো ওকে ধ্বং**স করার জন্যই বানানো হয়েছে।একদিন নির্জন এমন অবস্থায় পৌঁছাবে,যেখানে সে তার নিজের শরীর আর মনকে সহ্য করতে পারবে না।সে হয় নিজেই নিজেকে শেষ করবে,অথবা আমার মতো মানুষের হাতে বন্দী হয়ে থাকবে চিরকাল।”

“নিধি আতঙ্কিতভাবে ড. আজাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘৃণার স্বরে বললো,

‘ছিহঃ, একজন ডক্টর হয়ে পেশেন্টের ক্ষ**তি করতে আপনার বিবেকে বাঁধল না?আরে সে তো আপনার পেশেন্ট ছিলো।আর তার দ্বারা তো আপনার ক্ষ**তি হওয়ারও কোনো আশংকা ছিলো না।তবুও আপনি এই জ**ঘন্য কাজটা করতে পারলেন?ধি**ক্কার জানাই আপনার এই মন-মানসিকতাকে।’

বলেই নিধি সোফা থেকে উঠে গিয়ে যখনই সদর দরজার দিকে পা রাখতে যাবে,তখনই পেছন থেকে ড.আজাদ নিধির চুলের মুঠি ধরে রাগী স্বরে বলে উঠলেন,

‘আমার বয়স হলেও,এখনও শক্তি কমেনি।তোর কি মনে হয়,তোকে বাইরে গিয়ে ঘোষণা দেওয়ার জন্য এতক্ষণ এগুলো বলেছি?উহুম..তোকে তো এখানে মে**রে তারপর গুম করবো,তাই বলেছি।ওই শরবতে আমি হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি।ভাগ্যিস,তুই পুরোটা খাস নি।নইলে তো গল্প শোনার মধ্যেই ঘুমিয়ে যেতি।সমস্যা নেই,তোর ওই পা**গলা স্বামীকে নিয়ে এতো কষ্ট করতে হবে না।ও আরও পা**গল হবে।একসময় মা**রাও যাবে।তার আগে তোকে ওপারে পাঠাবো।’

বলেই নিধির চুলের মুঠি আরও শক্ত করে ধরে,টি-টেবিল থেকে গ্লাস এনে নিধির মুখে ধরতেই,
মুহূর্তেই কারও হাতের ধা**ক্কায় গ্লাসটি ফ্লোরে পড়ে ভে**ঙে কাচগুলো এদিক-সেদিক ছড়িয়ে গেলো।”

“আকস্মিক এহেন কান্ডে নিধি এবং ড.আজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো,নির্জন হাতে ধা**রালো ছু**রি নিয়ে ঘাড় কাত করে ড.আজাদের দিকে র**ক্তিম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।”

“নির্জনের আকস্মিক উপস্থিতিতে বিস্ময়ের শেষ চূড়ায় পৌঁছালো,ড.আজাদ এবং নিধি।ড.আজাদ নিধির চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে,কন্ঠে আ**তংক নিয়ে বললেন,

‘নির্জন,তুমি এখানে?’

“ড.আজাদের কথা শুনে,নির্জন হিং**স্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

‘হুমম,আমি এসেছি..আমার নিরু আমাকে আ**ঘাত করে,আমার ফোন নিয়ে বাসা ছেড়ে পালিয়ে
গিয়েছিলো।কিন্তু বেচারি জানে না যে,আমার ফোনের সাথে ল্যাপটপের ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক কানেক্ট করা।সেখান থেকেই তো লোকেশন ট্র্যাক করে,আমি ওর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারলাম।এরপর তোর এখানে এসে ভাবলাম,ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যাবো।না বুঝতে চাইলে এই ছু**রি টা দিয়ে ভয় দেখিয়ে নিয়ে যাবো।কিন্তু এখানে এসে সবকিছু শোনার পর,মনে হলো,ছু**রিটাকে সঠিক কাজে ব্যবহার করতে পারবো।থ্যাংকস রে..জানিস,আমার না ইদানীং খু**ন করার জন্য হাত টা কেমন নিশপিশ করে।আর তোকে দেখেতো,তোর পুরো শরীরটাই লুফে নিতে ইচ্ছে করছে।আচ্ছা,তাহলে অপারেশন শুরু করি,কি বলিস?তাছাড়া,তুই যেই পাপ করেছিস,তার জন্য এতটুকু শাস্তিও কম হবে।তবুও আমি তোকে যথাযথ শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করবো।’

বলেই মুহূর্তেই ড.আজাদের বুকে ছু**রি দিয়ে টান দিলো নির্জন।
ড.আজাদ চি**ৎকার করে ফ্লোরে পড়ে যেতেই,নির্জন নিধির দিকে তাকিয়ে,ওর হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের কাছে থাকা চেয়ারে বসিয়ে,পকেট থেকে রশি বের করে মুহূর্তেই ওর হাত-পা বেঁধে দিলো।তারপর কালো কাপড় দিয়ে ওর মুখ বেঁধে দিলো,যেন চি**ৎকার করতে না পারে।”

“নির্জনের এহেন কান্ডে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো নিধি।করুণ স্বরে ‘উম,উম’ শব্দ করতে যাবে,
ঠিক তখনই নির্জন নিধির গালে হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,

‘হিসসস..আরও সাহসী হতে হবে তোমাকে।এখন তোমাকে লাইভ মা**র্ডার দেখানো হবে,যেনো ভবিষ্যতে তোমার আমাকে হেল্প করতে সমস্যা না হয়।’

বলেই নিধির ঘামে ভেজা কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে, ডক্টর আজাদের দিকে ঘাড় কাত করে হিং**স্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো।ড. আজাদ অজ্ঞাতসারে তাকাচ্ছিলো নির্জনের দিকে।নির্জন হঠাৎ তীব্রভাবে ড. আজাদের বুকে লাথি দিলো,আর তারপর শুরু হলো ধ্বং**সাত্মক যুদ্ধ।নির্জন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ড.আজাদের হাত ধরে ফেলে এবং এক ঝটকায় ছু**রি দিয়ে ড. আজাদের ডান হাতের কব্জি লক্ষ্য করে আ**ঘাত করে।”

“ছু**রি একটানা টেনে নিয়ে ড. আজাদের হাত থেকে কব্জি সোজা কে**টে পড়ে।ফলে র**ক্তে ভিজে যায় পুরো ফ্লোর।ড. আজাদ তীব্র স্বরে চি**ৎকার করে ওঠে,কিন্তু নির্জন তার চি**ৎকারে আর কোনো সাড়া না দিয়ে,
ছু**রি নিয়ে ড. আজাদকে আরও একবার বুকে আ**ঘাত করে।ড.আজাদ তীব্র কষ্টে কুঁকড়ে ওঠে,কিন্তু নির্জন তার কা**টা বুক থেকে বের হওয়া তাজা র**ক্তের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দেয়।”

“তারপর নির্জন তাকে আরো নৃ**শং*সভাবে আ**ক্রমণ করে।তার পায়ের হাঁটুতে ছু**রি দিয়ে এমন ভাবে আ**ঘাত করে,এতে ফ্লোরে র**ক্তের ফোয়ারা বয়ে যায়।”

“আর নির্জনের এই আ**ঘাতের মধ্য দিয়ে,ড.আজাদ একেবারে নিঃশেষ হয়ে পড়ে।তার শরীরের র**ক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে ফ্লোরে।ড.আজাদ চোখ জোড়া বন্ধ করার আগমুহূর্তে নির্জন ছু**রি দিয়ে তার চক্ষুদ্বয়ের কোটর থেকে সন্তর্পণে মনি দুটো বের করে আনে।তারপর এলোপাথাড়ি ভাবে ছু**রি দিয়ে তার পুরো শরীরে আ**ঘাত করতে থাকে নির্জন।যেনো খুব দ্রতু গতিতে সে শশার স্লাইস করছে।এভাবে একের পর এক আ**ঘাত করতে করতে,নির্জনের পুরো শরীর লাল র**ক্তে মাখামাখি হয়ে যায়।এদিকে এহেন দৃশ্য দেখে কয়েক মিনিট আগেই নিধি সেন্সলেস হয়ে যায়।”

“নির্জন কপালের র**ক্ত মুছে,নিধির দিকে একবার তাকিয়ে,ড.আজাদের ওপর নিজের করা আ**ঘাতগুলো দেখে,ঘাড় কাত করে বলে উঠলো,

‘এবার তুমি আর কাউকে ধ্বং**স করতে পারবে না,আজাদ।কারণ,তোমার নামের মতোই তোমাকেও আমি মুক্ত করে দিয়েছি,আজাদ।আজ থেকে তোমাকে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে আজাদ(মুক্ত) করে দিলাম।হা হা হা…

‘একাধারে কথাগুলো বলেই ধীরে ধীরে নিধির দিকে এগিয়ে গেলো নির্জন।হাতে থাকা র**ক্তাক্ত ছু**রিটির দিকে তাকিয়ে,তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠলো,

‘কখনো ভাবিনি,তোর মাধ্যমে আমার প্রেয়সীর প্রাণও ঝরবে..’

#চলবে…

#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ
#পর্বঃ৫০(শেষ খন্ডের ১ম অংশ )
#লেখিকাঃমেহের_আফরোজ
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
[প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত]

[অনেক বড় পর্ব লিখেছি,তাই বাকিটা ১ঘন্টা পর দিবো]

“কখনো ভাবিনি,তোর মাধ্যমে আমার প্রেয়সীর প্রাণও ঝরবে..”
কথাগুলো বলেই নির্জন নিধির কাছে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে থাকা পানির গ্লাস থেকে হাতে পানি নিয়ে,নিধির চোখে কয়েকবার ছিটিয়ে দিতেই,ধীরে ধীরে নিধি চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো,চোখের সামনে র**ক্তমাখা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে নির্জন।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কিছুটা কপালে লেপ্টে আছে,কপালে ফোঁটা ফোঁটা র**ক্ত লেগে আছে,আর দুই গাল এবং চিবুকেও র**ক্তের ফোঁটা বিদ্যমান।”

“এগুলো দেখে রীতিমতো গায়ে কা**টা দিয়ে উঠলো নিধির।দুর্বল শরীর নিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে দেখলো,ওর হাত-পা বাঁধা।ফ্লোরে থাকা ড.আজাদের লা**শটির দিকে তাকিয়ে,শরীর গুলিয়ে আবারও বমি-বমি ভাব হলো নিধির।নির্জনের দিকে ঘৃণার নজরে তাকিয়ে,মুখ দিয়ে ‘উমম’ শব্দ করলো।”

“নিধির অস্বস্তি হচ্ছে বুঝতে পেরে,নির্জন বাঁকা হেসে নিধির মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে,হাতের ছু**রিটি নিধির চোখের দিকে তাক করে,গম্ভীর স্বরে বললো,

‘তোমাকে ছাড়তে পারি,তবে এক শর্তে।আগে বলো মানবে কিনা?যদি না মানো,তাহলে এখানেই তোমার মৃ**ত্যু নিশ্চিত,ডার্ক কুইন।’

“নির্জনের কথা শুনে চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো নিধির।বিস্ময়ের চাহনি নিক্ষেপ করে,নির্জনকে বললো,

‘নির্জন..আপনি অসুস্থ।ওই ডক্টর আপনাকে ভুল ওষুধ দিয়েছে।আ..আমার বাঁধন খুলে দিন প্লিজ।আপনি যে অন্যায়গুলো করেছেন,একটাও সুস্থ মস্তিষ্কে করেন নি।আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি।আ..আর আমার শরীর খুব দুর্বল লাগছে।প্লিজ.. আমাকে ছেড়ে দিন।’

“নিধির অশ্রুতে ভেজা চোখজোড়া দেখে মন বিগলিত হলো না নির্জনের।সে রুঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,পানির গ্লাস নিধির মুখের কাছে নিয়ে বললো,

‘হা করো,তোমার গলা শুকিয়ে গেছে।স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে পারছো না।আর ওই ন**রপ**শুকে মে**রে,এখন নিজেকে সম্পূর্ন সুস্থ মনে হচ্ছে।আগে পানি খাও,তারপর বাকি কথা হবে।’
বলেই নিধির ঠোঁটের কাছে পানির গ্লাস স্পর্শ
করতেই,তৃষ্ণার্ত নিধি ঢকঢক করে পানি খেলো।”

“নির্জন পানির গ্লাস টেবিলে রাখতেই,নিধি কাঁপা-কাঁপা স্বরে বললো,

‘নির্জন,এখানে আমার খুব ভয় লাগছে।প্লিজ,আমার বাঁধন খুলে দিন।’

“নিধির কথা উপেক্ষা করে,বাঁকা হাসল নির্জন।অতঃপর ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে,নিধির হাত ধরে মুচকি হেসে বললো,

‘জানো,ডার্ক কুইন,ভেবেছিলাম এই ছু**রিটা দিয়ে এখন তোমার প্রাণ কেড়ে নেবো।কারণ,আজ তুমি পালিয়ে গিয়ে ভ**য়াবহ অন্যায় করেছো।কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম,
এখনও একজন কে মা**র্ডার করা বাকি আছে।আর সে হলো মেহরাব।এক কাজ করো,তুমি ওর বাসার ঠিকানা টা দিয়ে আমাকে সাহায্য করো।বাকি কাজ আমি একাই করতে পারবো।’
খুব স্বাভাবিক স্বরে কথাগুলো বললো নির্জন।”

“নির্জনের এহেন কথায় ফের কেঁপে উঠলো নিধি।নির্জনের দৃষ্টিভঙ্গি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে,কিছু একটা ভেবে করুণ স্বরে বললো,

‘আচ্ছা,আমি মেহরাবের বাসার ঠিকানা দিবো এবং আপনার সাথে আমিও যাবো সেই বাসায়।আমিও আপনার সঙ্গী হবো,আপনাকে সাহায্য করবো।’

“নিধির এহেন কথা শুনে বেশ অবাক হলো নির্জন।মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,

‘সত্যি?সত্যি তুমি আমাকে সাহায্য করবে?এর মানে,তোমার সাহস হয়েছে,তাই না?দেখেছো,এইজন্যই তোমার সামনে লাইভ মা**র্ডার করলাম।নইলে তো ট্রেইনিং টা পাকাপোক্ত হবে না।আচ্ছা জানপাখি,তোমার বাঁধন খুলে দিচ্ছি।’
বলেই নির্জন নিচের দিকে তাকিয়ে নিধির হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে থাকল।
এদিকে নির্জনের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিধি।আজ যেন সে নিষ্প্রাণ।”

“নির্জন নিধির হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়ার পর,নিধি নির্জন কে ম্লান হেসে বললো,

‘থ্যাংক’স,নির্জন।এতক্ষণ আমার সত্যি খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো।এখন একটু শান্তি লাগছে।’

“নির্জন মুচকি হেসে,পরনের শার্ট খুলে ফেলে ফ্লোরে ছুঁড়ে মা**রলো।অতঃপর প্যান্টের পকেট থেকে শুভ্র রঙা রুমাল দিয়ে চেহারায় লেপ্টে থাকা র**ক্ত মুছে,সেটাও ফ্লোরে ছুঁড়ে দিয়ে,নিধিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,ওর কানের কাছে এসে হাস্কি ভয়েসে বললো,

‘এখন আমারও খুব শান্তি লাগছে নিরু।কত সময় পর এই বুকে এক চিলতে শান্তি পেলাম,বলোতো?আজ রাতের পর,আমরা অনেক দূরে চলে যাবো বুঝলে?যেখানে পরিচিত কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না।আমাদের মাঝে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির ছায়াও আসবে না।বলো,যাবে আমার সাথে?’

“নিধি নির্জনের ঘামে ভিজে থাকা বুকে মাথা ঠেকিয়ে,চোখজোড়া বন্ধ করে বললো,

‘হুম,অনেক দূরে চলে যাবো নির্জন।আপনি যা
বলবেন,তাই হবে।তার আগে এখান থেকে আমায় নিয়ে চলুন,নইলে যেকোনো সময় পুলিশ চলে আসতে পারে।’
বলেই চোখের পানি মুছলো নিধি।”

“নির্জন নিধির কপালে আলতো করে চুৃমু দিয়ে বললো,

‘বাহ!তোমার দেখছি বেশ বুদ্ধি হয়েছে।হুম,চলো জানপাখি।’
বলেই সদর দরজা পেরিয়ে আগে-আগে হাঁটতে থাকল নির্জন।
গাড়ির কাছে গিয়ে,গাড়ির দরজা খুলে,পেছনে তাকাতেই দেখলো,নিধি এলোমেলো পায়ে বিপরীত দিকে থাকা সরু একটি রাস্তা দিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে।”

“নিধির এহেন কান্ড দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো নির্জনের।গাড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবলো,

‘এই রাস্তা দিয়ে এই গাড়ি যাবে না।উফফ..কাজ টা তুৃৃমি ভালো করলে না,ডার্ক কুইন।অবশেষে নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই জড়িয়ে গেলে।আমার সাথে মিথ্যা নামক প্রতারণা করার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।আর সেটা হলো মৃ**ত্যু।আজ না হয় আমাদের জীবনের শেষ প্রতিযোগিতা হবে।’
ভেবেই নিধির পেছনে নির্জনও ছুটলো।”

“এদিকে সরু রাস্তা দিয়ে দৌঁড়ানোর পর,নিধি পাশে একটা জঙ্গলের মতো দেখতে পেলো।পেছনে একবার তাকিয়ে দেখলো,কেউ নেই।ভাবলো,

‘যেকোনো সময় নির্জন চলে আসতে পারে।আমাকে এই জঙ্গলেই লুকাতে হবে।’
ভেবেই গহীন একটি জঙ্গলের মধ্যে এলোমেলো পা ফেলে দৌঁড়াতে থাকল নিধি।চোখে-মুখে আ**তংকের ছাপ স্পষ্ট।এ যেনো নিধির দেখা সেই প্রথম স্বপ্নের কাহিনী বাস্তবায়ন হচ্ছে।দৌঁড়ানোর সময় বারংবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে নিধি।কিন্তুু বারবার একটা ধোঁয়াশা অবয়ব কে পেছনে দৌঁড়ে আসতে দেখছে।নিধি আরও জোরে দৌঁড়াতে থাকল।কিন্তুু কিছুতেই সে সামনে এগিয়ে যেতে পারছে না,হৃদস্পন্দন যেন ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।হঠাৎ কালো অবয়ব টি নিধির সামনে এসে,ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।অতঃপর ওর কোমল ওষ্ঠদ্বয় খুব সন্তর্পণে আঁকড়ে ধরলো।শত চেষ্টা করেও নিধি ছুটতে পারলো না।অবয়ব টি যেনো তার শীতল ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা তার শেষ তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত।নিজের তৃপ্তি মিটিয়ে,জঙ্গলের দা**নবাকৃতির গাছ ভেদ করে,জোছনার আবছা আলোতে কালো অবয়ব টি নিধি কে ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হলো।অবয়ব টি পুরোপুরি দৃশ্যমান হতেই,নিধি বিস্ময়কর স্বরে বলে উঠলো,

‘নির্জন আপনি?’

“অপরপাশ থেকে র**ক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে;উত্তেজিত স্বরে নির্জন বলে উঠলো,

‘কি ভেবেছিলে?তোমায় ধরতে পারবো না?হা হা হা..আবারও বিশ্বাস করে শেষ সুযোগ দিয়েছিলাম তোমায়।কিন্তুু তুমি কি করলে?আমার বিশ্বাস নিয়ে খেললে?আচ্ছা,ডার্ক কুইন তুমি কেনো আমার থেকে দূরে যেতে চাইছো?না না না..আর তোমাকে কষ্ট করে দূরে যেতে হবে না।আমরা এখনই অনির্দিষ্টকালের জন্য পরপারে চলে যাবো।আর ইউ রেডি মাই ডার্ক কুইন?’
বলেই নির্জন পেছন থেকে সেই চকচকে ধা**রালো ছু**রি বের করে যখনই নিধির পেটে তাক করবে,ঠিক তখনই নির্জন কে পেছন থেকে কেউ একজন নির্জনের মাথায় আ**ঘাত করলো।আর নির্জন তীব্র চি**ৎকার করে মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর পড়ে গেলো।ধীরে ধীরে তার চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেলো।
এদিকে জোছনা রাত হওয়ায় জঙ্গলের গাছের ফাঁক থেকে চাঁদের আলোতে সামনের অবয়ব টি আঁচ করতে কষ্ট হলো না নিধির।ঘন ঘন শ্বাস ফেলে,উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো,

‘মেহরাব,আপনি এখানে?’

“নিধি বলতেই,মেহরাব তার হাতে থাকা শুকনো,সরু ডাল টি ফেলে দিয়ে,নিধির কাছে এসে ভরসার স্বরে বললো,

‘নিধি,ডোন্ট ওয়ারি।ও আর তোমার কোনো ক্ষ**তি করতে পারবে না।আমি যখন স্যারের বাসায় ঢুকতে যাবো,ওই সময় দেখি নির্জন গাড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে,আর তুমি সরু পথ দিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছো।কিছুক্ষণ পর দেখলাম,নির্জন ও তোমার পেছনে ছুটে গেলো।তাই আমিও তোমাদের ফলো করি।আর ও তোমাকে আ**ঘাত করতে নিলে,আমি তৎক্ষনাৎ সামনে থাকা গাছের সরু ডাল দিয়ে ওর মাথায় আ**ঘাত করি।আজ আমি সঠিক সময়ে না পৌঁছালে হয়তো অঘটন হয়ে যেতো।আল্লাহ যে এখনও তোমায় ভালো রেখেছেন,তার জন্য শুকরিয়া।আর আমি পুলিশ কে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।’
বলেই ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ফেলে মাটিতে পড়ে থাকা নির্জনের ক্লান্ত মুখস্রির দিকে তাকালো মেহরাব।”

“এদিকে মাটিতে অচেতন হয়ে শুয়ে থাকা নির্জনের ঘুমন্ত মুখমণ্ডল দেখে,নিধি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।এক পর্যায়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে,নির্জনের বুকে হাত জোড়া রেখে গগনবিদারী চি**ৎকার দিয়ে উঠলো নিধি।
কিছুক্ষণ পর সেখানে পুলিশ এসে হাজির হলো এবং কয়েক ঘন্টা পর নিধির কাছ থেকে ড.আজাদ কে মা**র্ডার করার বিষয়ে স্বীকারোক্তি নিয়ে,নির্জন কে নিয়ে গেলো।”

———–
“কে**টে গেলো ১৭দিন।এই ১৭দিনে ঘটে গেছে অনেক কিছু।নির্জনের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে,তাকে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করা হয়।সেখানে তার আরও কিছু টেস্ট করার পর,তার মানসিক জটিলতার অবস্থা জানতে পেরে ডক্টররা বেশ অবাক হয়ে যায়।তারা ড.আজাদের এই কাজটিকে ‘বি**কৃত মস্তিষ্কের কাজ’ বলে আখ্যায়িত করেন।
টিভির নিউজ এবং পেপারেও এই খু**নের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে।”

“সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ছড়িয়ে পড়তেই,কেউ কমেন্ট করে,
‘ডক্টরের এমন মৃ**ত্যুই কাম্য ছিলো।’

কেউ কেউ আবার নির্জনের এই মা**র্ডারটির ভ**য়াবহতা সম্পর্কে নিজেদের অনুভূতি গুলো ব্যক্ত করে।”

“এদিকে নিধিকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে,নিধি কান্নারত অবস্থায় নির্জনের করা প্রতিটি খু**নের বিবরণ দেয়।কিন্তু,তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই।”

“পুলিশ ড.আজাদের মা**র্ডার ব্যতীত নির্জনের বিরুদ্ধে আর কোনো প্রমাণ খুঁজে পায় নি।”

” ১৫ দিন পর নির্জন কিছুটা স্বাভাবিক হলে,পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে রিমন হ**ত্যা থেকে শুরু করে,সবকিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলে,সে শুধু ড.আজাদের খু**নের ঘটনা স্বীকার করে।বাকি মা**র্ডার গুলো আত্মবিশ্বাসের সাথে অস্বীকার করে।”

“নির্জনের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য পুলিশ তাকে উত্তম-মধ্যম দেয়।কিন্তু সে তার কথায় অনড় থাকে।
এতে পুলিশও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়।কারণ,তাদের কাছেও কোনো প্রুভ নেই।তাছাড়া নিধির দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী পুলিশ নির্জনের বাসায় গিয়েও কোনো প্রমাণ না পেয়ে,হতাশ হয়ে ফিরে আসে।এক মুহূর্তের জন্য নিধিকেই তারা মানসিক রোগী ভেবে নেয়।”

“অবশেষে ১৭দিন পর,আদালতের কাঠগড়ায় দুইজন চিরচেনা মুখ একে-অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সাক্ষীর আসনে দাঁড়িয়ে,নিধি নির্জনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আর আসামীর আসনে দাঁড়িয়ে থেকে,নির্জন নিধির দিকে গভীর চাহনি নিক্ষেপ করে আছে।সেই দৃষ্টিতে যেন কোনো ঘৃণা বা ক্ষোভ নেই।আছে শুধু প্রিয়জনকে দীর্ঘ সময়ের জন্য হারানোর তুৃুমুল যন্ত্রণা।”

“আদালতে আসা সদস্যদের মধ্যে চেয়ারে বসে আছে নিধির মা তাহমিনা বেগম,দিগন্ত,নাদিয়া,মাহির,তোহা এবং মেহরাব।এই ১৭দিনে নির্জনের বিষয়টি নিয়ে ভেবে-ভেবে, তারাও যেন মানসিক অবসাদে ভুগেছে।তবুও নিধিকে সর্বোচ্চ দিয়ে সাপোর্ট করার জন্য তারা যেন অনড় ছিলো।
ইতোমধ্যে,আদালতের কাজ শুরু হয়ে গেছে।নিধি কাঁপা গলায় বিচারকের সামনে তার সাক্ষ্য দিচ্ছে।”

“নির্জনের পক্ষের সরকারি উকিল,নিধিকে উদ্দেশ্য করে,তার করা অভিযোগগুলো সম্পর্কে বর্ণনা দিতে বললো।”

“নিধি ফোলা চোখে একবার নির্জনের দিকে
তাকিয়ে,পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে,খু**নের বিবরণগুলো বলতে শুরু করলো।তারপর আবারও বললো,

‘আমি সব নিজের চোখে দেখেছি, সে খু**ন করেছে।তার শার্টে র**ক্তের দাগ… সবকিছু আমি দেখেছি।নিধি চি**ৎকার করে একই কথা বলতে থাকল,

‘আমাকে বিশ্বাস করুন,আমি সত্য বলছি।তার বাসায় ২টা ল্যাবরেটরী রুম আছে।সেখানে সব কিছু রাখা আছে।এমনকি সেই লা**শগুলোও কফিন এবং আলমিরাতে রাখা আছে।আমি নিজে চোখে দেখেছি।
আমি তাকে ভালোবাসলেও,তার অন্যায়গুলোকে কখনোই প্রশ্রয় দিবো না।’
বলেই চোখের পানি মুছলো নিধি।”

“নিধির কথাগুলো শুনে সরকারি উকিল ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বলে উঠলো,

‘বিচারক মহাশয়,আসুন আমরা সেই রুম দু’টির কথা বলি,যেখানে আমার মক্কেলের স্ত্রী দাবি করছেন খু**ন হয়েছে।মজার বিষয় হলো,মিসেস নিধির কথা শুনে তদন্ত কমিটি নির্জনের বাসায় সেই রুম দুটি তে গিয়ে সেখানে পুরনো কাপড়,ধুলা,আর মাকড়সার জাল ছাড়া আর কিছু পায়নি।মাকড়সার জাল দেখলেই বোঝা যায়,বহুদিন ধরে রুমটিতে কেউ যায়নি।এই নিন সেই রুম দু’টির কিছু ছবি।’
বলেই বিচারকের নিকট সেই ছবিগুলো দিলো।”

“এদিকে নিধি,উকিলের এহেন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো।ভাবলো,

‘এটা কিভাবে সম্ভব?আমার দেখা,ভুল হতেই পারে না।’
ভেবে মাথায় হাত দিলো নিধি।”

“জজ কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকলেন।নিধির চোখে জল জমে উঠেছে।সে বুঝতে পারলো,তার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না।রুমের সমস্ত প্রমাণ ধ্বং**স করা হয়েছে।নিধির মুখে চি**ৎকার আছে,কিন্তু তার প্রমাণ নেই।”

“এদিকে নিধির সেই স্তম্ভিত চেহারা দেখে,নির্জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাঁকা হাসি দিলো।চলে গেলো ফ্ল্যাশব্যাকে।”

“ফ্ল্যাশব্যাক-

“সেদিন রাতে নিধি নির্জনের বুকে সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাওয়ার পর,নিধিকে রুমে শুইয়ে দিয়ে,নির্জন ভাবলো,যদি নিধি কোনোদিন সব কিছু প্রমাণ সহ পুলিশের কাছে বলে দেয়,তাহলে নিধিকে সে সারাজীবনের জন্য হারাবে।তাই যে করেই হোক,এইসব প্রমাণ লোপাট করতে হবে।যেই ভাবা সেই কাজ।”

“নির্জন শুরু করে তার পরিকল্পনার প্রথম ধাপ।সে ভাবতে থাকে,
‘লা**শগুলোকে চিরতরে মুছে ফেলতে হবে,যেন কোনো চিহ্ন না থাকে।’

“সে রাতে,গাড়িতে এক এক করে ৫টি লা**শ গাড়ির ডিকি তে ভরে,১ঘন্টা জার্নি করে,চুপিসারে লা**শগুলো নিয়ে যায় নদীর ধারে।নদীর ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে সে ল্যাবরেটরী রুম থেকে আনা এ**সিডের বোতলগুলো খুলে লা**শগুলোতে ঢেলে দেয়।এ**সিডের গন্ধ,লা**শের পোড়া মাংসের ধোঁয়া মিশে যায় বাতাসে।এবং লা**শগুলোও একে একে বালির সাথে মিশে গিয়ে ধ্বং**স হয়ে যায়।আর সেগুলো দেখে তৃপ্তির হাসি দেয় নির্জন।কারণ তার সব প্ল্যান চলছে নিখুঁতভাবে।
অতঃপর রাতের নিস্তব্ধতা শেষ হতে না হতেই,নির্জন ফিরে আসে তার রুমে।”

“এইবার তার দ্বিতীয় কাজ হলো,রুম থেকে সমস্ত প্রমাণ মুছে ফেলা।
সে প্রথমেই খু**নের সরঞ্জামগুলো এক এক করে ভে**ঙে ফেলে।হ্যামার দিয়ে মা**রার পর যেসব অংশ ভে**ঙে গিয়েছে,সেগুলো প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে অনেক দূরে জঙ্গলে ফেলে আসে।
তারপর রুমের সবকিছু নতুনভাবে সাজায়।আলমিরাতে রেখে দেয় কিছু পুরনো আসবাবপত্র,কিছু পুরনো দিনের জামাকাপড়।যেন রুমটা দেখলেই মনে হয়,বহুদিন ধরে এটি ব্যবহার করা হয়নি।
সবশেষে,একটি ছোট্ট মেশিন ব্যবহার করে মাকড়সার জাল তৈরি করে দেয়।জালগুলো এমনভাবে বোনা,যেন সত্যিই বছরের পর বছর কেউ এই রুমে প্রবেশ করেনি।
রাতের কাজ শেষ করে নির্জন এক গ্লাস পানি খেয়ে,সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নিধির পাশে এসে শান্তির ঘুম দেয়।”

“অতীতের স্মৃতিচারণগুলো করে আবারও ডেভিল হাসল নির্জন।”

“এদিকে নিধির পক্ষের উকিল বিচারক কে নির্জনের নৃ**শংস খু**নের বিবরণ দিয়ে,তার ফাঁসির দাবি করছে।অপরদিকে,সরকারি উকিল নির্জনের মানসিক রোগের সমস্ত রিপোর্ট,এবং তার অতীত কাহিনী থেকে শুরু হওয়া এই পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সকল কাহিনী বিস্তারিত বর্ননা করলেন।”

“এদিকে নির্জনের অতীত কাহিনীগুলো শুনে আদালতে থাকা বিচারক থেকে শুরু করে,সকল সদস্যদের চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো।কিন্তু সবকিছুর পরেও নির্জন আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।যদিও সেটা অসুস্থতা বশত।কিন্তু আইনের চোখে সবাই সমান।কোনো অপরাধী আইনের বেড়াজাল থেকে ছাড় পাবে না।”

“আদালতের পরিবেশ থমথমে।সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে চূড়ান্ত রায়ের।কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে নির্জন,তার মাথা নত।তার সামনে নিধি দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখে দেখা যাচ্ছে অশ্রুর মেঘ।বিচারক একটু থেমে ঘোষণা করার চেষ্টা করছেন নির্জনের শাস্তি,কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু একটা ঘটে গেলো।”

” সবাইকে অবাক করে দিয়ে,নির্জন কাঠগড়া থেকে নেমে, সামনে থাকা একজন কনস্টেবলকে ধা**ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।তার এই আচরণে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলো।কিছুক্ষণের জন্য সবাই জমে গেলো,যেন কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না,কি হলো!”

“নির্জন তীব্র গতিতে নিধির দিকে এগিয়ে গিয়ে,তাকে হতবাক করে দিয়ে,নিধিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।তার ঠোঁট নিধির কানের কাছে নিয়ে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলো,

‘তুমি মাস্ক ছাড়া এসেছো কেনো?দেখছো না,বিচারক থেকে শুরু করে সবাই তোমার দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে?কতবার করে বলেছি,আমাকে ছাড়া এই মুখ তুৃমি কাউকে দেখাবে না।কবে তুমি আমার কথা শুনবে বলোতো?তোমার কি মনে হয়,ওই পঁচা বিচারক আমায় ফাঁসির আদেশ দিবে?দিক,কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তুু আমি বেঁচে থাকতে কেউ তোমায় দেখবে না,কেউ তোমায় ছুঁতে পারবে না।আমি আছি,আমি থাকবো,ডার্ক কুইন।’
বলেই নিধির কপালে আলতো করে চুম্বন দিয়ে।আবারও জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলতে থাকল,

‘কেউ দেখবে না,কেউ না..।আমি তোমাকে ঢেকে রাখার জন্য আছি তো।তোমার মায়াবী মুখস্রি ঢেকে রাখার জন্য আমার বুকই যথেষ্ট।’

“নির্জনের এহেন কান্ডে,নির্জনের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো নিধি।তার ভেতরের ভ**য়াবহ যন্ত্রণা যে সে চেয়েও বোঝাতে পারছে না।”

“এদিকে আদালতে শোরগোল শুরু হলো।বিচারক সবাই কে থেমে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।২জন কনস্টেবল নির্জন কে টেনে-হিঁচড়ে নিধির থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে,ওর হাত জোড়ায় হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিলো।কয়েক মিনিট চি**ৎকার করার পর নির্জন কিছুটা স্থির হতেই,
আদালতের পরিবেশ আবারও নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।সবাই অপেক্ষা করছে চূড়ান্ত রায়ের জন্য।কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে নির্জন,তার মুখে কোনো অনুশোচনার ছাপ নেই।ঠোঁটের কোণে হিং**স্র হাসি।চোখে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি,যেন সে যা করেছে তাতে তার কোনো অনুতাপ নেই।বিচারক তার জায়গায় বসে নীরবে চিন্তা করছেন।ড.আজাদের নৃ**শংস হ**ত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য মামলার আলোচনা শেষ।কিন্তু নিধির অভিযোগ এবং সব সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে একটি মাত্র খু**ন প্রমাণিত হয়েছে,ড. আজাদের খু**ন।”

“বিচারক কিছুক্ষণ নীরবে সব শুনে এবং মামলার নথি দেখে রায়ের জন্য কলম হাতে তুলে নিলেন।পুরো আদালত অপেক্ষায় আছে।সবার নিঃশ্বাস যেন আটকে আছে।সেই সাথে নিধির চোখ বেয়ে পড়ছে অনবরত পানি।”

“বিচারক টেবিলে হাতের মুষ্টি রেখে একটু ঝুঁকে বললেন,

‘আসামি নির্জন,তোমার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ পরীক্ষা করার পর,আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে,তুমি ড. আজাদকে নি**র্মমভাবে খু**ন করেছো।মামলায় অন্য হ**ত্যার অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়নি,কিন্তু ড.আজাদের মৃ**ত্যুর ঘটনায় সমস্ত প্রমাণ তোমার বিপক্ষে।”

“বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা ৩০২ মোতাবেক,ইচ্ছাকৃত খু**নের শাস্তি হিসাবে তোমার মৃ**ত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।কিন্তু,আসামি নির্জনের মানসিক অবস্থার বিশেষ বিবেচনায়,এবং তার অপরাধের ধরন দেখে আদালত এটিকে সাধারণ খু**ন হিসেবে না দেখে,সাইকোলোজিক্যাল কেস হিসেবে বিবেচনা করছে।ধারা ৮৪ অনুযায়ী,যে কোনো মানসিক অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার মানসিক অবস্থার বিচার করা হয়,এবং শাস্তির সিদ্ধান্ত সেভাবে নেওয়া হয়।’
বলেই বিচারক কিছুক্ষণ থামলেন,যেন সবার মনে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছেন।তারপর তর্জনী দিয়ে চশমা টা ঠিকঠাক করে,আবারও বললেন,

‘আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে,আসামি নির্জনকে প্রথম ৫ বছর মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে।চিকিৎসা শেষে,যদি চিকিৎসক দল তার মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল বলে ঘোষণা করে,তবে বাকি ৫ বছর তাকে কারাগারে রাখা হবে।যদি তার মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল না হয়,তবে চিকিৎসার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে।’

“অতঃপর বিচারক তার কণ্ঠকে আরও দৃঢ় করে বললেন,

‘আদালত বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা ৮৪, ৩০২ এবং ধারা ৩২৫ অনুযায়ী এই রায় ঘোষণা করছে।আসামি নির্জনকে মোট ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো।এর মধ্যে প্রথম ৫ বছর মানসিক হাসপাতাল এবং পরবর্তী ৫ বছর কারাগারে কা**টাতে হবে।’
বিচারকের হাতের কলম টেবিলে পড়ে গেলো।পুরো আদালত নীরব হয়ে গেলো।যেন শাস্তি ঘোষণার ওজন সবাই অনুভব করছে।নির্জন একটু মুচকি হাসল,যেন এই শাস্তি তার কোনো ভয় বা কষ্টের কারণ নয়।এগুলো তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়।”

“নির্জন নিধির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো,

‘হাসপাতাল হোক বা জেল,আমি সবকিছুই উপভোগ করবো।কিন্তু তুমি … তুমি তো আমার থেকে পালাতে পারবে না,ডার্ক কুইন।আমি ফিরে আসবো,আমি আবার তোমার কাছে আসবো।’

“আদালতের পরিবেশ একদম নীরব হয়ে গেছে।আকস্মিক,নির্জন নিধির দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

“আমার প্রেয়সী,তুমি যতই পালাতে চাও,আমি আছি তোমার ছায়ায়,তোমার ঘুমে,তোমার স্বপ্নে,
আমি থাকবো পাশে,সবসময়।
রাতের গভীর অন্ধকারে,তোমার মনে আমি চুপচাপ,
মনে মনে আমার হাতে,চিরকালই থাকবে তোমার প্রতিটি ধাপ।
তুমি ভাবো যতই তুমি দূরে চলে যাবে,
তোমার হৃদয়ে আমি আছিই,এ ছাড়া আর কিছু নেই।
ভালোবাসা নয়,এটা অভিশাপ,এক কঠিন শিকল,
তুমি চাইলে যতই পালাও,আমি ছেড়ে দেবো না তোমার বাঁধন।
স্বপ্নেও তুমি দেখবে আমাকে,আমি ছড়িয়ে যাবো তোমার মনে,
কখনও পারবে না তুমি ভুলতে,আমার ভালোবাসার শিখা,তুমি জানো না আমি কেমন….?”
~মেহের~

“নির্জনের এহেন কবিতা শুনে,নিধি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।তার চোখের কোণে পানি জমে গেছে।তার নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে গেলো।হয়তো নির্জনের প্রতিটি শব্দ তাকে আরও গভীরভাবে ঘিরে ধরছে।নির্জন আবার এক মুহূর্তের জন্য তার দিকে তাকিয়ে হাসলো।কারণ সে জানে,নিধির মুক্তি কখনও হবে না।
নিধির চোখে পানি জমে গেলো,সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।আদালতের কক্ষ ভরে উঠল কোলাহলে,কেবল নির্জনের কণ্ঠ সবার কানে পৌঁছালো।এক সময় সেই সময়টাও ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এলো।দীর্ঘ সময়ের জন্য দুটি দেহ একে-অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।আবারও কি এক হবে তারা?আবারও কি ফিরে আসবে সেই সুখময় দিন?যেখানে নিধি তার কল্পনার রাজ্যে এক সুন্দর স্বপ্ন সাজিয়েছিলো তার পা**গল প্রেমিক কে নিয়ে!”
*
*
*
———-
“সময়ের সাথে তাল মেলানো দায়,
স্বপ্নগুলো ঝরে যায় কাঁটার মতো,
বাঁচতে চাওয়ার লড়াইটা আজকাল বড়োই কঠিন হয়।
কে**টে গেলো ১০টি বছর।এই ১০টি বছরের একেকটি দিন,একেকটি রাত ছিলো নিধির কাছে তীব্র যন্ত্রণার।তারই সমপরিমাণ কষ্ট পেয়েছে নির্জনও।মাঝে মাঝে নির্জনের সাথে দেখা করতে গিয়েছে নিধি।প্রথমদিকে নির্জন অনেক পা**গলামি করলেও,চিকিৎসকদের সঠিক চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়েছে নির্জন।এখন আর নির্জন তার মন এবং হৃদয়ের সাথে কথা বলে না।সে যেন আর ৫জন স্বাভাবিক মানুষের মতই ব্যবহার করে।কিন্তু নিধির প্রতি পা**গলামি ভালোবাসা এখনও অবিচল,যদিও সেটা সবার আড়ালে।”

“নির্জন জেলে যাওয়ার পর নিধির পরিবারের পাশাপাশি,মেহরাবও নিধিকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিয়েছে।
অতঃপর মেহরাব মনোবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন যাওয়ার আগে,নিধিকে একটি চিঠি দিয়ে যায়।
নিধি সেই চিঠি পড়ে হতবাক হয়ে যায়।চিঠিতে লেখা ছিলো,

“প্রিয় নিধি,
তোমার কাছে একটি দীর্ঘ চিঠি রেখে যেতে যাচ্ছি,আর জানি না,এই চিঠি তুমি কখন পড়বে।কিন্তু যখন পড়বে,তখন হয়তো আমি এই দেশে থাকব না।কিছু কথা হয়তো তুমি জানো,আবার কিছু হয়তো জানো না।কিন্তু আজ,এই মুহূর্তে,তোমার কাছে আমি সব খুলে বলতে চাই।
অনেক আগে থেকেই আমি তোমায় ভালোবাসি,নিধি।যখন আমরা প্রতিবেশী ছিলাম,তখন আমি আমার মনটা তোমার কাছে খুলে দেওয়ার সাহস পাইনি।তবে এই যে সময় চলে গেলো,আমি উপলব্ধি করেছি,এখন কিছু কথা বলার,কিছু অনুভূতি প্রকাশ করার সময় এসেছে।তোমার পাশে থাকলে অনেক কিছুই বলার ইচ্ছে ছিলো,কিন্তু শঙ্কা ছিলো যেন না কখনো হারিয়ে ফেলি তোমাকে।কিন্তু মনে হয়,আমার অনুভূতিগুলো বলা জরুরি ছিলো,একবার হলেও।হয়তো কথাগুলো বললে,আজ তুমি পুরোপুরি আমার হতে।
জানো,তোমার বিয়ের খবরটা শুনে আমি খুব ভে**ঙে পড়েছিলাম।এটা এমন এক খবর ছিলো,যেটা আমি কোনোদিন কল্পনা করিনি।তুমি অন্য কারো হয়ে গেলে,এটা আমার হৃদয়ে এক অদ্ভুত ক্ষ**ত সৃষ্টি করেছিলো,যেটা কোনোদিন ভরতে পারবে না।আমি তোমার সুখের জন্য অবশ্যই খুশি,কিন্তু আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না।আমার পৃথিবী যেন এক মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।
তবে জানো,নিধি,ভালোবাসা কখনো একরকমের নয়।কিছু ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না,কিন্তু সেই অপূর্ণ ভালোবাসার মধ্যেই এক ধরনের শান্তি লুকিয়ে থাকে।আমি জানি তুমি ভালো থাকবে,আমি জানি তুমি সুখে থাকবে,আর তার মধ্যে আমি আমার ভালোবাসার শেষ দাগ রেখেই নিশ্চিন্ত হতে পারি।
তোমার জন্য কিছু ছন্দ লিখে যাচ্ছি,জানি না কখনো তুমি এগুলো পড়বে কিনা,

“তুমি,যেমন বৃষ্টি,মাটির স্নিগ্ধতা,
যেমন আলো,অন্ধকারের মাঝে এক আশার কণা।
তুমি,যেমন পাখি,আকাশে উড়ে চলে,
যেমন স্বপ্ন,কখনো জাগ্রত,কখনো হারিয়ে যায়।”

আর কিছু বলার নেই,নিধি।আমি জানি,তুমি কখনো বুঝবে না,কিন্তু এই চিঠির প্রতিটি শব্দই আমার হৃদয়ের গভীরতা থেকে উঠে এসেছে।
তোমার জন্য শেষবারের মতো একটাই বাক্য লিখছি,

“Some love remains incomplete,yet in that incompleteness,there lies a certain peace.”

আমি জানি,তুমি নিজেই একদিন এই শান্তির অর্থ বুঝবে।আমার কথা মনে রেখো,এবং যদি কখনো আমার সাহায্যের প্রয়োজন হয়,তুমি জানো আমি কোথায় আছি।

ইতি তোমার অজানা ভালোবাসা,
মেহরাব”

পুরো চিঠিটি পড়ে নিধিও কান্না করেছিলো।কিন্তু তার মন তো এক পুরুষেই আটকে আছে।”

————
“দীর্ঘ ১০বছর পর থানার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে নিধি,তাহমিনা বেগম,দিগন্ত,নাদিয়া এবং ওদের একমাত্র ছেলে-সীমান্ত ইসলাম নাভীন।ওর বয়স সাড়ে ৯বছর।
আর তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তোহা এবং মাহিরের একমাত্র ছেলে-মিহাদ ইসলাম তাহির।ওর বয়স ৮বছর ৬মাস।”

“থানার সব নিয়ম-নীতি মেনে নির্জনকে থানার বাইরে নিয়ে আসা হলেই,দিগন্ত ছুটে গিয়ে নির্জন কে জড়িয়ে ধরে।
নির্জনও বহুবছর পর প্রিয় বন্ধুটিকে খুশি মনে জড়িয়ে ধরে।
আজ এই স্পর্শে নির্জনের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে ভীষণ শান্তি পায় দিগন্ত।একে-একে সবার সাথে কথা বলে,নিধির সামনে এসে নির্জন মুচকি হেসে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,

‘সবারই দেখছি বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে।আমাদের টা কবে হবে,হুম?’

“এতদিন পর প্রথম সাক্ষাতে নির্জন যে এমন কথা বলবে,কল্পনা করেনি নিধি।মন খারাপ করে ভাবতে থাকল,১০ বছর আগে তার পেটেও তো একটি ভ্রুনের সৃষ্টি হয়েছিলো।কিন্তু অতিরিক্ত জার্নি এবং মানসিক অবসাদের কারণে,নির্জন জেলে যাওয়ার ১৫দিন পর,ভ্রুন টি নিঃশ্বেস হয়ে যায়।’
কথাগুলো ভাবতেই চোখের কোণে পানি জমে গেলো নিধির।”

“নিধি নির্জনের হাত ধরে মৃদুস্বরে সেই ভ্রুনটির কথা বললো।সবকিছু শুনে নির্জনের হাসি মুখ টা সেখানেই চুপসে গেলো।”

“নির্জন,নিধির হাত শক্ত করে ধরে বললো,

‘সব হবে।আবার নতুন করে আমাদের স্বপ্নের জগৎ গড়বো।সেখানে থাকবে শুধু সুখ আর সুখ..ডার্ক কুইন।’

#চলবে…

#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ
#পর্বঃ৫০(অন্তিম অংশ)
#লেখিকাঃমেহের_আফরোজ
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
[প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত]

‘সব হবে।আবার নতুন করে আমাদের স্বপ্নের জগৎ গড়বো।সেখানে থাকবে শুধু সুখ আর সুখ..ডার্ক কুইন।’

———-
“নির্জন জেল থেকে বের হওয়ার এক মাস পর নিধি ড.মায়ার সাথে দেখা করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।এবং তার চেম্বারে বসে গল্প জুড়ে দেয়।ঠিক সেই সময় পেছন থেকে একটি পুরুষালি গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

‘মায়া,তুমি এই পেশেন্টের সাথে এত গল্প জুড়ে দিয়েছো কেনো?তোমাকে তো বলেছি,প্রয়োজনের অধিক সময় কারো সাথে কথা বলবে না।তোমার মনের সব কথা শুধু আমার সাথে বলবে।’

“আকস্মিক এহেন কথায় নিধি পেছনে ফিরে তাকিয়ে বললো,

‘নিশাদ আঙ্কেল আপনি এখানে?’

“নিশাদ রহমান নিধির দিকে এক পলক বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে,পরক্ষণেই ড.মায়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘৫মিনিট সময় দিলাম।তাড়াতাড়ি বাইরে এসো।তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো।’
বলেই কেবিন থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।”

“এদিকে নিধি হতভম্ব চাহনি নিক্ষেপ করতেই,ড.মায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,

“তোমার আঙ্কেলও একজন মানসিক রোগী ছিলেন।সেও আমার সাথে নির্জনের মতই আচরণ করেছে।তবে কাউকে খু**ন করেনি।তার রোগের নাম হলো,
ওথেলো সিন্ড্রোম (Othello Syndrome)।এটি এক ধরণের মানসিক রোগ,যেখানে একজন ব্যক্তি তার সঙ্গীর প্রতি অবিরাম ও অবাস্তব হিংসা এবং সন্দেহ অনুভব করে।এই রোগের নামকরণ হয়েছে শেক্সপিয়রের বিখ্যাত চরিত্র ওথেলো এর নাম থেকে,যিনি তার স্ত্রী ডেসডিমোনার প্রতি অতিরিক্ত সন্দেহের কারণে তাকে হ**ত্যা করেন।”

“তোমার আঙ্কেল বিয়ের কিছুদিন পর আমাকে অবিরাম সন্দেহ,আমার ওপর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা,গোপন নজরদারি,হিং**স্র এবং আ**ক্রমণাত্মক আচরণ,অন্যের সঙ্গে মিশতে না দেওয়া,অযৌক্তিক প্রশ্ন,অন্যায় দোষারোপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাবে আমায় টর্চার করে।এমনকি মেহরাব বড় হওয়ার পর,ওর সাথেও কথা বলতে দিতো না।”

“অবশেষে অনেক কাহিনীর পর আমি মেন্টাল হসপিটালে যোগাযোগ করে,তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠাই।এবং তোমাদের পাশের বাসা টা ছেড়ে অন্য জায়গায় শিফট হই।
আর তোমার আঙ্কেলের ওথেলো সিন্ড্রোমের কারণ হলো,হীনমন্যতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব।
তার পরিবার থেকে দীর্ঘসময় প্রতারণার অভিজ্ঞতা এবং আ**ঘাত পেতে পেতে একসময় সে এমন হয়ে যায়,আর তার প্রভাব পড়ে আমার ওপর।অবশেষে দীর্ঘ
১৫ বছর পর তাকে আমি নিজের কাছে ফিরে পাই।এই রোগের চিকিৎসা দীর্ঘ মেয়াদি।কেউ ভালো হয়,কেউ আবার একই রকম থেকে যায়।কিন্তু আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া,তিনি আমায় নিরাশ করেন নি।”

“তবে কি জানো,প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটি সাইকো সত্তা লুকিয়ে থাকে,যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উন্মোচিত হতে পারে।চাপ,অতিরিক্ত সন্দেহ,বা মানসিক অস্থিরতার ফলে এই সত্তা প্রকাশ পায়।কিছু মানুষ এটি সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে,তবে অন্যরা অজান্তে এটি শাসন করতে শুরু করে।কখনো কখনো,মানুষের অজ্ঞাত সাইকোলজিক্যাল প্রবণতা তাদের আচরণকে একদম পরিবর্তন করে দেয়।এটি তাদের সম্পর্ক,আচরণ,এবং মনোভাবের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে,যা প্রায়ই সাইকোপ্যাথিক আচরণের দিকে ধাবিত করে।
আমার স্বামীও এইরকম।সে সুস্থ হলেও আমার প্রতি তার পজেসিভনেস একই রকম আছে।হয়তো সেটা কখনোই যাবে না।”

“আচ্ছা,অনেক কথা হলো।আরও দেরি করলে,আমার জনাব রেগে যাবে।আমি গেলাম।দোয়া করি,তোমার বাকিটা জীবন সুখময় হোক।”
বলেই ড.মায়া মিষ্টি করে হেসে বিদায় নিলেন।”

———-
তারপর…তারপর কে**টে গেলো আরও ৯মাস।এই ৯ মাসে ১০বছরের পুরনো স্মৃতি গুলো কে সুখে ভরিয়ে,মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে নির্জন।
নিধি আবারও অন্তস্বত্বা হলো।একজন গাইনী ডক্টরের পরামর্শে সব নিয়ম-কানুন মেনে চলতে থাকল।
৯মাস পর লেবার পেইন উঠে নরমাল ডেলিভারিতে কন্যা সন্তানের বাবা-মা হলো নিধি এবং নির্জন।”

“নির্জন এবং নিধি তাদের মেয়ের নাম রাখল,নিহারিকা ইসলাম নিহার।নিহারের গায়ের রং নিধির মতো ফর্সা হলেও,চেহারার গড়ন হয়েছে নির্জনের মতো।এ
যেন নির্জনের রাজকন্যা।”

“নিহার কে ঘুম পাড়িয়ে,নিধি বেলকনিতে গিয়ে আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ গুলোকে দেখতে থাকল।
নির্জন নিধির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।অতঃপর নিধির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখছো?’

“নিধি মুচকি হেসে বললো,

‘ধূসর রঙা মেঘ গুলো কে দেখছি।জানেন,আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ গুলো দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।এই মুহূর্তে বেশ ভালো লাগছে মেঘগুলোকে।মন
চাইছে,একবার যদি ছুঁয়ে দিতে পারতাম!’

“নিধির এহেন কথা শুনে,মনে মনে ভীষণ হিংসা হলো নির্জনের।মেঘের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে ভাবলো,

‘তোকে চ্যালেন্জ করলাম,আমি তোর থেকেও আমার ডার্ক কুইন কে অনেক দূরে নিয়ে যাবো।যেখানে তোর অবস্থান হবে নিচে।আর আমাদের অবস্থান হবে উপরে।ভূমি থেকে তোকে আর চাইলেও সে দেখতে পাবে না।’

ভেবে বাঁকা হেসে নিধির কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে,ওর গালে আলতো করে চুমু দিলো নির্জন।”

————
“এদিকে শীতের ছুটিতে মাহির,তোহা,দিগন্ত এবং নাদিয়া প্ল্যান করে তাদের সন্তান সহ সাজেক ভ্যালিতে ঘুরতে এসেছে।
শীতের সময় সাজেক ভ্যালি একেবারে অন্যরকম সুন্দর এবং স্বপ্নময় জায়গা হয়ে ওঠে।পাহাড়ি এলাকা,মেঘের ঘনঘটা এবং ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীতকালীন সাজেক ভ্যালি এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা দেয়।শীতের সময় এখানে তুষারপাতও হয়,যেটা জায়গাটিকে আরও মনোরম করে তোলে।রাস্তা দিয়ে চলার সময় পাহাড়ের মাঝে সূর্যের আলো এবং শীতের ঠাণ্ডা মিশে এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে।গ্রামের বাড়ি,সাদা তুষারের চাদর,এবং সবুজ পাহাড়ের সাথে মিলিয়ে সাজেক ভ্যালির শীতকাল একেবারে মনোমুগ্ধকর।”

“দিগন্ত এবং নাদিয়া,মাহির এবং তোহা সাজেক ভ্যালিতে “রিসোর্ট ৭৭” নামে একটি পরিচিত রিসোর্টে উঠেছে।এখানে তারা পাহাড়ের উঁচু জায়গায় বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছে,যেখানে চারপাশে শুধু পাহাড় আর মেঘের সমারোহ।এই রিসোর্টটি খুবই জনপ্রিয়,কারণ এটি সাজেকের সুন্দর প্রকৃতি এবং পাহাড়ি জীবনের সঙ্গে একীভূত হয়ে থাকে।রিসোর্টের শান্ত পরিবেশ এবং আধুনিক সুবিধা তাদেরকে এক আদর্শ অবকাশ যাপন করতে সাহায্য করছে।
বিষয়গুলো নিয়ে ওরা একে-অপরের সাথে কথা বলছে।ঠিক সেই সময় সেখানে এসে ইহান এবং আফরিন তাদের ৬ বছরের কন্যা,জাফরিন নাহার ইনায়াকে নিয়ে হাজির হতেই মুখোমুখি হয়ে যায় দিগন্ত এবং নাদিয়ার।
আফরিন তো দিগন্ত কে দেখে,তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে।এদিকে নাদিয়া আর ইহান একে-অপরের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।”

“আফরিন দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

‘বুঝলাম না,তুমি কি এখনো আমাকে ফলো করছো?আমরা এখানে ঘুরতে এসেছি,আর তুমিও…

“দিগন্ত ঝগড়ুটে সুরে বলে উঠলো,

‘হেই মিস আফরিন..এত বছর পর আপনার মাথায় কি ভূত চেপেছে?আমি আপনাকে ফলো করতে যাবো কেনো?এখানে আমি নয়,আমরা এসেছি পরিবার সহ।এত বছর পরেও দেখছি আপনার ঝগড়ুটে স্বভাব গেলো না,হুহ।’

“দিগন্তের এহেন কথা শুনে,আফরিন আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু বলতে যাবে,তখনই ইহান ওকে টেনে রিসোর্টের দিকে নিয়ে গিয়ে বললো,

‘পা**গল নাকি তুমি?সে তোমায় ফলো করবে কেনো?এনিওয়ে,গতকাল রাতে আমার কথা শোনো নি।এখন নাদিয়ার ছেলের সাথে আমার মেয়ে খেলা-ধুলা করুক,আর আমি তোমার সাথে।’
বলেই ইহান দুষ্টু হেসে,ইনায়া কে কোল থেকে নামিয়ে বাচ্চাদের সাথে খেলতে যেতে বললো।ইনায়া ও দৌঁড়ে চলে গেলো খেলতে।”

“আফরিন কটমটিয়ে ইহান কে বললো,

‘আরে,তুমি এটা কি করলে?আমার শত্রুর ছেলের সাথে ইনায়া কে খেলতে পাঠালে?

“ইহান চোখ টিপে বললো,

‘তোমার মাইন্ড ফ্রেশ করো।তাছাড়া দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয়,তাহলে দাগই ভালো।’
বলেই আফরিনের হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলো।
অতঃপর ইহান আফরিন কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।আফরিন আর কিছু বলতে পারলো না।সাজেকের ঠাণ্ডা বাতাসে দু’জনের শরীর যেন একাকার হয়ে যায়।আফরিনের নরম গাল ইহানের হাতের উষ্ণ স্পর্শে সজীব হয়ে উঠলো।দুজনের চোখে গভীর প্রেমের আভা ছড়িয়ে পড়লো।ইহান ধীরে ধীরে আফরিনের ঠোঁটে আলতো চুমু দিলো।ধীরে ধীরে একে-অপরের মধ্যে হারিয়ে গেলো দু’জন,তাদের মাঝে বয়ে গেলো শুধুই প্রেম,শুধুই মিলন।”

———
“এদিকে নাদিয়া নাভীন কে ইনায়ার সাথে খেলতে দিয়ে, দিগন্ত কে টেনে রুমে নিয়ে গিয়ে,দিগন্তের মুড চেঞ্জ করার জন্য জড়িয়ে ধরে বললো,

‘আমি এখন প্রেম করবো।’

“নাদিয়ার এহেন কথা শুনে দিগন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,

‘সূর্য কি আজ দক্ষিণ দিকে উঠলো নাকি?দাঁড়াও দেখে আসি।’
বলেই নাদিয়া কে ছাড়তে চাইলে,নাদিয়া দিগন্তের কলার টেনে বললো,

‘সূর্য ঠিক জায়গায় উঠেছে।এই কুল-কুল ওয়েদারে তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে জানু।বাইরে বাচ্চারা খেলছে।আর এটাই তো সুবর্ণ সুযোগ।’
বলেই লাজুক হাসল নাদিয়া।”

“দিগন্ত নাদিয়ার দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘এই,তুমি কি হানি নাটস খেয়েছো নাকি?’

“নাদিয়া মুখ ভেং**চি কে**টে বললো,

‘যাহ,দুষ্টু।ওটাতো নাভীন কে খাওয়াই।হানি নাটসে থাকা পেস্তাবাদাম,কাজুবাদাম,কিশমিস,মধু,জাফরান এগুলো ওর শরীরে হাড়ের ক্ষয়রোধে সহায়ক।
তুমি না..সবসময় নেগেটিভ চিন্তা করো।ধরু,ভাল্লাগে না।’

বলেই মুখ অন্যদিকে ঘুরাতেই,দিগন্ত ওর ঘাড়ে চুমু দিয়ে,নাদিয়া কে সামনে ফিরিয়ে ওর ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরলো।অতঃপর সাজেকের ঠাণ্ডা হাওয়ায় তাদের দেহ ধীরে ধীরে এক হয়ে গেলো।দিগন্ত নাদিয়ার চোখে গভীর ভালোবাসার দৃষ্টি ফেলে,আর নাদিয়া তার ঠোঁটে চুমু দিয়ে সাড়া দিলো।চারপাশের নীরবতা যেন তাদের অনুভূতির গভীরতা আরও বাড়িয়ে দিলো।ভেসে গেলো দু’জন গভীর ভালোবাসার সুখ সায়রে।”

———–
“এদিকে রিসোর্টের রুমের বেলকনিতে গায়ে গোলাপি রঙের শাল জড়িয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে তোহা।বাইরে তাহির,নাভীন,ইনায়া খেলছে..সেগুলো দেখছে,আর মিটিমিটি হাসছে।”

“হঠাৎ মাহির পেছন থেকে ‘স্বপ্নচারিনী’ বলে ডাক দিতেই তোহা পেছনে তাকিয়ে দেখলো,মাহির হাঁটু গেড়ে হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল নিয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।”

“তোহা অবাক হয়ে বললো,
‘হঠাৎ এগুলো এনেছেন যে?’

“মাহির মুচকি হেসে তোহার হাত ধরে চুমু দিয়ে বললো,
‘চুপ..একদম চুপ..আমি বলবো,তুমি শুনবে..

১. বাংলা: “স্বপ্নচারিনী,আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
২. ইংরেজি: “Dream Weaver, I love you.”
৩. হিন্দি:”ম্যায় তুমসে প্যায়ার কারতি হুঁ।”
৪.ফরাসি: “Dream Weaver, je t’aime.”
(উচ্চারণ:”স্বপ্নচারিনী,ঝে তেমে।”)
৫. স্প্যানিশ: ” Dream Weaver, te quiero.”
(উচ্চারণ: “স্বপ্নচারিনী, তে কিয়েরো।”)
৬.জার্মান: “Dream Weaver, ich liebe dich.”
(উচ্চারণ: “স্বপ্নচারিনী, ইখ লিবে দিখ।”)
৭. ইতালীয়: “Dream Weaver, ti amo.”
(উচ্চারণ: “স্বপ্নচারিনী, তি অ্যামো।”)
৮. আরবি: “توها، أنا أحبك.”
(উচ্চারণ: “তোহা, আনা আহাবুক।”)
৯. রাশিয়ান: “Dream Weaver, я тебя люблю.”
(উচ্চারণ: “স্বপ্নচারিনী, ইয়া তেব্যা ল্যুব্ল্যু।”)
১০. চীনা: “Dream Weaver, 我爱你。”
(উচ্চারণ: “স্বপ্নচারিনী, উও আয়ে নিও।”)

এভাবে মাহির ১০টি ভাষায় প্রপোজ করে,দাঁড়িয়ে তোহার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বললো,

‘স্বপ্নচারিনী,আজ আমি বলবো,আর তুমি শুনবে,অনেক ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও তোমায় খুব মিস করি।আগলে রাখতে চাই।কিন্তু ব্যস্ততা আমায় ঘিরে ধরে।তাইতো কিছু সময় তোমাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য এখানে আসা।এসো না,এত সুন্দর স্নিগ্ধ পরিবেশে দু’জন মধুর আবেশে হারিয়ে যাই।’
বলেই তোহার ঠোঁট জোড়ায় আলতো করে চুমু দিতেই,তোহা মাহির কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বললো,

‘আমি সত্যি খুব ভাগ্যবতী নারী,মাহির।আপনার মতো একজন আদর্শবান স্বামী পেয়ে,আমার নারী জীবন ধন্য মনে হয়।এতগুলো ভাষায় আমাকে প্রপোজ করে,আমায় পা**গল করে দিয়েছেন মাহির।আমি তো এগুলো পারি না।তবে গান শুনাতে পারি।শোনাবো?”

“মাহির মুচকি হেসে সায় জানাতেই,তোহা মাহিরের বুকে মাথা রেখে গেয়ে উঠলো,

“🎶ভালোবাসি, ভালোবাসি
এই সুরে কাছে-দূরে,জলে-স্থলে বাজায়…
বাজায় বাঁশি..ভালোবাসি, ভালোবাসি..

আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,
দিগন্তে কার কালো আঁখি,আঁখির জলে যায় ভাসি..ভালোবাসি..
সেই সুরে সাগরকূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে।
সেই সুরে বাজে মনে অকারণে
ভুলে-যাওয়া গানের বাণী, ভোলা দিনের কাঁদন-হাসি,ভালোবাসি….🎶

“তোহা গান শেষ করে মাহিরের দিকে তাকাতেই,মাহির তোহা কে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় গিয়ে শরীরে কম্ফোর্টার টেনে নিলো।
মাহির ধীরে ধীরে তোহার হাতে হাত রাখল,অতঃপর একে-অপরের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকল।মাহিরের নিঃশব্দে চুম্বনে তোহার ঠোঁটে আগুনের মতো উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লো।তোহাও নিজেকে মাহিরের কাছে সঁপে দিলো, দু’জনের ঠোঁট জোড়া এক মিষ্টি,অদৃশ্য প্রতিজ্ঞায় মিলিত হয়ে গেলো।আজ সময় থেমে গিয়েছিলো,সুখময় পৃথিবী শুধু তাদের ছিলো।”

———–
“৬মাস পর নির্জন,নিধি এবং তাদের মেয়ে নিহার কে নিয়ে চিরস্থায়ী হতে বাংলাদেশ থেকে বহুদূরের একটি দেশে এসেছে।যেখানে কখনোই বৃষ্টিপাত হয় না।”

“সত্যিই এমন এক গ্রাম আছে বিশ্বে যেখানে হয় না বৃষ্টি।এটি পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে কখনোই বৃষ্টি হয় না।তবে গ্রামের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে।সেখানে জনবসতি,স্কুল,মাদ্রাসা,মসজিদ সবই আছে।
আরও আছে নজরকাড়া প্রাচীন স্থাপনাসমূহ।প্রতিবছর প্রচুর পর্যটকেরও আগমন ঘটে সেখানে।আবার ক্ষেত-খামারও রয়েছে।
আর সেটি হলো ইয়েমেনে ছোট একটি গ্রাম ‘আল হুতাইব।’

“সেখানকার রাজধানী সানার প্রশাসনিক এলাকা জাবাল হারাজের পাহাড়ি অঞ্চলে গ্রামের অবস্থান।আর এই গ্রামে কখনো হয় না বৃষ্টি।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যখন বছরের বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টিপাত হয়,ঠিক তখন ‘আল হুতাইব’ গ্রাম থাকে শুকনো।এই গ্রামে যেহেতু কখনো বৃষ্টি হয় না,তাই সেখানকার আবহাওয়া বেশ শুকনো।
তবে কেনো এই গ্রামে বৃষ্টিপাত হয় না?এর কারণ হলো, ‘আল হুতাইব’ গ্রামটি অনেক উচ্চতায় অবস্থিত।সমতল থেকে প্রায় ৩২০০ মিটার উঁচুতে এই গ্রামের অবস্থান।আর এ কারণে সেখানে বৃষ্টিপাত হয় না।
সাধারণত বৃষ্টি মেঘ জমে সমতল থেকে ২০০০ মিটারের মধ্যে।তাই ‘আল হুতাইবের’ উপরে মেঘ জমে না।আর মেঘ না থাকলে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না।
বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এই গ্রামের পরিবেশ বেশ গরম।”

“শীতকালে সকালের পরিবেশ খুব ঠাণ্ডা থাকলেও সূর্য উঠলেই প্রচণ্ড খরতাপে পুড়ে সেখানকার মানুষরা।
তবে এই গ্রামের বাসিন্দাদের বৃষ্টি হওয়া বা না হওয়া নিয়ে তেমন কোনো দুশ্চিন্তা নেই।তারা সেখানকার শুকনো আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়েছেন।”

“বাংলাদেশে থাকাকালীন নির্জন, নিধির হাত ধরে করুণ স্বরে বলে,

‘এই মাটিতে তার জীবনের অনেকটা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে।তাই সে এখানে আর থাকতে চায় না।নিধিকে নিয়ে সে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে চায়।তবে মাঝে-মাঝে বাংলাদেশে এসে ঘুরে যাবে।’

“নিধিও নির্জনের কথা শুনে রাজি হয়ে যায়।দীর্ঘ ১০বছর পর প্রিয় মানুষটিকে কাছে পেয়েছে নিধি।তার জন্য তো এই আবদার রাখতেই হবে।”

“অবশেষে ইয়েমেনে এসে একটি প্রাচীন প্রাসাদে উঠলো নির্জন এবং নিধি।এটা শহরের বাইরের অংশে অবস্থিত।নিধি ঘুরে ঘুরে দেখলো,বাড়ির চারপাশে বালুকাময় শুষ্ক প্রান্তর,এবং দূরে কোনো গাছপালা বা জলাধার নেই।বাড়িটি এক ধরনের ক্লাসিক আরবীয় স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি,যেখানে উঁচু দেওয়াল,দরজা,এবং প্রাচীন সিলিং রয়েছে।
ঘরের অভ্যন্তর খুবই সাধারণ কিন্তু রহস্যময়।এটি দেয়ালের ওপর পুরনো আরবি নকশা,কাঠের ফার্নিচার এবং আলোর স্বল্পতা দ্বারা সজ্জিত।বাড়ির জানালাগুলোও বন্ধ,যেন বাইরের রুক্ষ পরিবেশকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে।”

“সবকিছু দেখে,নিধির মন টা কিছুটা খারাপ হয়ে গেলো।কারণ,আশে-পাশে তেমন জনমানব নেই।নিধি চাইলেও কারো সাথে মিশতে পারবে না।”

“নিধির বিষন্ন চেহারা দেখে,বাঁকা হাসল নির্জন।”

“নিধির মন পরিবর্তন করার জন্য বললো,

‘আমার ইউনিভার্সিটির এক ফ্রেন্ড এই শহরে থাকে।আমার কথা মতো সে এই বাড়িটির ব্যবস্থা করেছে।’

“নির্জনের কথা শুনে নিধি মুচকি হেসে বললো,

‘বাড়িটি তো খুবই সুন্দর।কিন্তুু এখানে আপনি কি কাজ করবেন?’

“নির্জন মুচকি হেসে বললো,

‘আল হুতাইব (Al-Hutaib) শহরটি ইয়েমেনের অন্যতম পরিচিত এবং ঐতিহাসিক শহর,যা মূলত তার উঁচু পাহাড়ি ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বিখ্যাত।এখানে বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যমগুলো হলো,চাষাবাদ ও কৃষিকাজ,গবাদি পশুপালন।এই অঞ্চলে গবাদি পশু,যেমন ছাগল ও ভেড়া পালন করা হয়। পশুপালন এখানকার অনেক পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস।
এছাড়াও আছে,হস্তশিল্প ও কারুশিল্প ঐতিহ্যবাহী ইয়েমেনি পোশাক,মৃৎশিল্প,এবং অন্যান্য হস্তশিল্পও এখানে জনপ্রিয়।
তারপর আছে,পর্যটন-
‘আল হুতাইব’ তার পাহাড়ি প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং ঐতিহাসিক স্থাপনার জন্য পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।পর্যটন থেকে উপার্জন এখানে একটি বড় উৎস।
আরও আছে,জাম্বিয়া (Jambia) ও ধাতব কাজ-ইয়েমেনের ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র জাম্বিয়া তৈরির কারুশিল্প অনেক জনপ্রিয়।
তারপর ব্যবসা ও বাণিজ্য-স্থানীয় বাজার এবং ছোটখাটো দোকানগুলো ব্যবসা পরিচালনা করে।এখানকার ব্যবসায়ীরা সাধারণত কফি,মসলা,এবং হস্তশিল্প সামগ্রী বিক্রি করেন।
অর্থাৎ,আল হুতাইবের মানুষের জীবিকা বেশিরভাগই কৃষি,পশুপালন,পর্যটন,এবং হস্তশিল্পের ওপর নির্ভরশীল।এগুলোর মধ্যে কোনো একটা করে নিবো।
তাছাড়া এতো বিলাসিতার দরকার নেই।তুমি-আমি,আর আমাদের রাজকন্যা.. এতেই শুকরিয়া আদায় করবো।কি বলো,ডার্ক কুইন?”

“নির্জনের এহেন কথা শুনে,হৃদয় বিগলিত হলো নিধির।মুহূর্তেই চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো।”

“নির্জন সেটা দেখে,বারান্দায় গিয়ে ভূমি থেকে কিছুটা দূরে ভেসে বেড়ানো মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবলো,

‘মনে আছে,চ্যালেন্জ করেছিলাম,তুই থাকবি আমার এবং ডার্ক কুইনের নিম্নে,আর আমাদের অবস্থান হবে তোর উপরে।
এখন আমায় সর্বোত্তম হিংসুটে বলে ব্যাঙ্গ করবি তো?করতে পারিস,কিন্তু আমার নিরুর জন্য আমি সর্বোচ্চ হিংসুটে হতে পারি।’
কথাগুলো ভাবতেই,পেছন থেকে দুটি কোমল হাতের ছোঁয়ায় নির্জনের বক্ষগহ্বর প্রশান্তিতে ভরে উঠলো।”

“এই প্রেয়সীর জন্যই তো তার এত কষ্ট করা।
নির্জন, নিধির দিকে ফিরে নিধির কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,

‘নিহার তো ঘুমিয়েছে,এখন কি করবে?মেঘবিলাস ও তো করতে পারবে না।কারণ,মেঘগুলো আমাদের নিম্নে অবস্থান করছে।’

“নিধি নির্জনের পা দুটো একটু উচু করে,নির্জনের কপালে চুমু দিয়ে,মুচকি হেসে বললো,

‘অনেক টা পথ জার্নি করে এসেছি।তাই এখন ফ্রেশ হবো,তারপর খাওয়া-দাওয়া করে,আপনার সাথে গল্প করবো।এছাড়া তো এখানে কেউ নেই।’

“নিধির এহেন কথা শুনে বিজয়ের হাসি দিলো নির্জন।
নিধিকে পাঁজাকোলে নিয়ে বললো,

‘আমার বয়স ৩৯ এর কোঠায়,আর তোমার ৩৩ এর কোঠায়।অথচ দেখো,আমাদের ভালোবাসা কিন্তু একইরকম আছে।বিন্দু পরিমাণ কমেনি।বরং প্রতিনিয়ত আরও বাড়ছে।’
কথাগুলো বলতে বলতে নিধিকে পাশের রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে,নিধির ঠোঁট জোড়া নিজ অধরে আবদ্ধ করে নিলো।কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে হাস্কি ভয়েসে বললো,

“তুমি কি জানো, প্রিয়া,এই ১০বছর,৩৬৫২ দিন কতটা তৃষ্ণায় কে**টেছে?
৮৭,৬৪৮ ঘণ্টা, প্রতিটি নিশ্বাসে শুধু তোমার গন্ধ খুঁজেছি,
৫,২৫,৮৮৮০ মিনিট,প্রতিটি মুহূর্তে তৃষ্ণার্ত ঠোঁট তোমার স্পর্শ চেয়েছে,
৩,১৫,৫৩,৮০০ সেকেন্ড, প্রতিটি কাঁপন তোমার ছোঁয়া পাওয়ার জন্য।
৩১,৫৩,৮০০,০০০,০০০ ন্যানো সেকেন্ড,
তোমার শরীরের উত্তাপে পুড়ে ম**রে যেতে চেয়েছি।
আজ,যখন এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে তোমাকে পেলাম,
গভীর এক চুম্বনে সেই সময়ের সব হিসাব মিটিয়ে দিলাম,
তোমার শরীরের প্রতিটি কোণে,প্রতিটি ভাঁজে,
আমি রেখে দিলাম আমার পুড়ে যাওয়া সমস্ত তৃষ্ণা।
তোমার ঠোঁটের স্বাদে এই দশ বছর,
এক মুহূর্তে গলে গেলো আমার ভিতরে,
তুমি আছো,আজও তুমি আছো আমার মাঝে,
আর আজ থেকে,প্রিয়তমা,
এই ৩১,৫৩,৮০০,০০০,০০০ ন্যানো সেকেন্ড হবে,
আমাদের প্রতিটি চুম্বনের প্রতিধ্বনি।” ~মেহের~

“নির্জনের এহেন কবিতা শুনে নিধির চোখজোড়ায় পানি চলে এলো।নির্জনের হাতে চুমু দিয়ে বললো,

“আপনি কি জানেন,প্রিয়,এই ৩৬৫২ দিন আমি কীভাবে কষ্ট পেয়েছি?
৮৭,৬৪৮ ঘণ্টা,আপনি যখন দূরে ছিলেন,আমি গভীর এক যন্ত্রণায় ডুবেছিলাম,
৫,২৫,৮৮৮০ মিনিট, প্রতি মুহূর্তে আপনার ছায়ায়,আপনার অভাবে,
আমার হৃদয় এক অন্ধকার গহ্বরে পড়েছিলো,যেখানে শুধু আপনার অসহায় চি**ৎকার ভেসে আসতো।
৩,১৫,৫৩,৮০০ সেকেন্ড,আপনার অভাবের যন্ত্রণা আর তৃষ্ণায়,
আমার আত্মা ক্ষ**তবিক্ষ**ত হয়ে গিয়েছিলো।
৩১,৫৩,৮০০,০০০,০০০ ন্যানো সেকেন্ড,
আপনার স্পর্শে,আপনার চুম্বনে,
এই দীর্ঘ সময়ের ব্যথা আর নৈরাশ্য মেটাতে চেয়েছি,
এবং যখন আমি আপনার সামনে এসে দাঁড়ালাম,
আপনার ঠোঁটে আমার তৃষ্ণা পূরণ হলো,
গভীর এক চুম্বনে,তীব্র যন্ত্রণার সঙ্গে,
আপনার শরীরের প্রতিটি কোণে আমার প্রতিশোধ রেখে দিলাম।
আপনি জানেন,প্রিয়,এই চুম্বন কেবল প্রেম নয়,
এটা সেই সমস্ত কষ্টের প্রতিশোধ,
যা আপনার অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া নিয়ে আমার দেহে ঢুকে গেছে,
আমার শিরায় শিরায় র**ক্তের প্রতিটি বিন্দু,
আমার প্রেমের গভীর অন্ধকারে মিশে যাবে,
যা এই দীর্ঘ যন্ত্রণা আর অপেক্ষার হিসাব মিলিয়ে দেবে।
আমরা এবার একসাথে সেই অন্ধকারে প্রবাহিত হবো,
যেখানে কষ্ট আর প্রেমের অশ্রু একাকার হয়ে যাবে।”
~মেহের~

বলেই নিধি নির্জনের বুকে মুখ গুজলো।দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পর ক্লান্ত শরীরেও একে-অপরের মাঝে সুখ খুঁজে নিতে ব্যস্ত হলো।অবশেষে দু’জনের মিষ্টি-মধুর সম্পর্ক আরও প্রগাঢ় হলো।”

“মধুর কিছু সময় কা**টিয়ে নির্জন টেবিল থেকে ব্যাগ এনে,চেইন খুলে ব্যাগের ভেতর থেকে একটি বই বের করে নিধির সামনে রেখে বললো,

‘বলোতো,আমার কথা রাখতে পেরেছি কিনা?একদিন বলেছিলাম,তোমাকে নিয়ে একটা বই লিখবো।আর বিয়ের আগে থেকেই বইটি লেখা শুরু করেছিলাম।মাঝখানে কে**টে গেলো ১০টি বছর।নিহার যখন তোমার পেটে ছিলো,তখন তুমি রাতে ঘুমিয়ে গেলে,আমি নতুন করে আমাদের জীবনের গল্প লেখা শুরু করি।কিছুদিন আগে এটা সম্পূর্ন করেছি।আর বইটির নাম কি দিয়েছি বলো তো?”

“নিধি বইয়ের দিকে তাকিয়ে,অবাক হয়ে বললো,

“#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ।”

“নিধি বলতেই নির্জন মুচকি হেসে নিধিকে কোলে তুলে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে,ভূমি থেকে অদূরে ভেসে বেড়ানো মেঘ দেখিয়ে বললো,এই বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় একটি কবিতা লিখেছি,শুনবে ডার্ক কুইন?”

“নিধি নিম্নে ভেসে বেড়ানো মেঘের দিকে তাকিয়ে,মুচকি হেসে বললো,

‘হুম,বলুন।’

“নির্জন নিধির কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে নিধির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘উহুম..ওই মেঘের দিকে নয়,আমার দিকে তাকাও।তাহলে বলবো।’

“নিধি ফের মুচকি হাসলো।অতঃপর নির্জনের চোখে-চোখ রাখতেই,নির্জন নিধির দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো,

“#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ”

তুমি মেঘের প্রশংসা করেছিলে একদিন,
সে মুহূর্তে যেন বেঁধেছিলো বিষের কাঁ**টা আমার হৃদয়ে।
তোমার মুখে অন্য কিছুর রূপের বন্দনা শুনে,
হিংসার আগুনে জ্বলেছি,আর
#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ হয়েছে গভীর সুরে।

আল-হুতাইবের এই আকাশে,মেঘ নামে নিচে,
আমি চাই,তুমি আর কোনো কিছুতে মুগ্ধ হবে না চোখে।
তোমার দৃষ্টি যেন শুধু আমায় ছোঁয়,
আমার ভালোবাসার হিংসা এমনই; সহ্য হয় না অন্যের প্রশংসা।

তুমি আমার নীল মেঘ,আমার স্বপ্নের আকাশ,
তোমার প্রশংসা যেন আর কোথাও না যায় উড়ে।
তোমার মুখে অন্য কিছুর প্রশংসা শুনলে,
আমার র**ক্তক্ষরণ হয় হৃদয়ের গভীরে,নিঃশব্দে।

#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ লিখেছি শুধুই তোমার নামে,
তোমার ভালোবাসা ছাড়া আমি কিছুই চাই না এই জীবনে।
তুমি যদি অন্য কিছু চাও,তোমার মুখে অন্যের নাম শুনি,
তবে আমার মনের অতল গহীনে #হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ হবে।”

~সমাপ্ত~

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ পর্ব-৪৯

0

#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ
#পর্বঃ৪৯ (বিশেষ পর্ব)
#লেখিকাঃমেহের_আফরোজল
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
[প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত]

“ওহ,ওহ,ওহ..মাই সুইটহার্ট,আরও ২টা স্পেশাল জিনিসের সাথে তোমায় পরিচয় করাবো।আশা করি,আমার মতো তোমারও ভালো লাগবে।’
বলেই মুচকি হাসল নির্জন।”

“অতঃপর নিধির হাত ধরে,নির্জনের রুমের দেয়ালের সাথে লাগানো আলমিরাটির সামনে নিয়ে গেলো।
তারপর আলমিরার সামনে গিয়ে,মুচকি হেসে স্বাভাবিক স্বরে বললো,

‘জানো,নিরু..এই আলমিরাটি একেবারে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে।এটি প্রায় ছয় ফুট উঁচু এবং তিন ফুট চওড়া।
এটি দেখতে যেমন বিশাল এবং শক্তপোক্ত,তেমনি এটিকে এক ধরনের সুরক্ষিত দেয়াল বলতে পারো।আলমিরার বাইরের অংশটি মেটালিক প্যানেল দ্বারা আবৃত,যেটি বাইরের দৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে।ভেতরের অংশটি টেম্পারেচার এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিশেষ প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত রয়েছে।এগুলো আমি বিশেষ ভাবে অর্ডার দিয়ে বানিয়েছি।’

“এই আলমিরাটির বাইরের অংশে অ্যান্টি-রফট এবং সুরক্ষার জন্য বিশেষ মেটাল প্যানেল ব্যবহৃত করা হয়েছে।এবং আলমিরার ভিতর প্রায় দীর্ঘকাল ধরে সংরক্ষণের জন্য উন্নত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে।এই কেমিক্যালগুলো দুর্গন্ধহীন এবং শোষক,যেটা ভিতরে থাকা জিনিসপত্রের অক্ষততা রক্ষা করে।আলমিরার দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলতে পারে,যাতে কোনো ধরনের শব্দ না হয় এবং ভিতরের পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে।দরজার কাঁচ স্বচ্ছ কিন্তু বিরল উপাদান দিয়ে তৈরি,যেটা ভিতরের দৃশ্য আড়াল করে।’
একাধারে কথাগুলো বলেই,নির্জন আলমিরাটি খুলতেই,সামনে থাকা নারী অবয়ব টি দেখে বিস্ময়ে চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো নিধির।তার হৃদ-স্পন্দন যেন তড়িৎ গতিতে বৃদ্ধি পেলো।”

“নিধি দেখলো,আলমিরার ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে,যে দেখতে ১৯ বছরের মতো হবে।মেয়েটির দেহ দেখলেই বোঝা যায়,কাপড়ে আবৃত দেহটি কেমিক্যাল দ্বারা সংরক্ষিত।তার শরীর নিখুঁত,কোন চিহ্ন ছাড়াই।মেয়েটির মুখে এক ধরনের স্থিরতা বিরাজ করছে।নিধি বুঝে গেলো,এই মেয়েটিও নির্জনের ভ**য়াবহতার সাক্ষী।
নিধি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলো,রাসায়নিক আলমিরার ভিতরে মেয়েটি যেন এক রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু তার শরীরের মাংসপেশি ও ত্বকে রাসায়নিকের প্রভাব স্পষ্ট।তার চোখজোড়া বন্ধ অবস্থায় আছে,কারণ সে দীর্ঘ দিন আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।”

“নিধির মনে আতঙ্ক নিয়ে নির্জনের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে ভাবতে থাকল,

‘নির্জন কতটা নিষ্ঠুর…’
ভেবে শুকনো ঢোক গিলে বললো,

‘কি কি করেছেন মেয়েটার সাথে?সে কি এমন করেছে?যে তাকে এখানে,এভাবে আটকে রেখেছেন?তাও এমন অবস্থায়?’

“নিধি বলতেই,নির্জন নিধির হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করলো,অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে বলতে শুরু করলো,

‘কলেজ লাইফের শেষের দিকে মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় হয়।আমি ক্লাসে বরাবরই নীরব ছিলাম।কিন্তু মেয়েটি ছিলো ভীষণ চঞ্চল।মাঝে মাঝে সে আমার সাথে কথা বলতে চাইতো।কিন্তু আমার তাকে বরাবরই বিরক্ত লাগত।তাই যথাসম্ভব ইগনোর করতাম।কিন্তু হঠাৎ একদিন সে ক্লাসের টিফিন পিরিয়ডের সময় একগুচ্ছ গোলাপ ফুল দিয়ে আমায় প্রপোজ করে,সেই সাথে ৮-১০টি চিঠিও আমার সামনে রেখে,আমার প্রতি তার ভালোবাসা ব্যক্ত করে।যেটা আমাকে বেশ অবাক করে।”

“তবুও আমি আমার অতীত কাহিনী ভেবে,মেয়েটিকে না করে দেই।কিন্তু,সে ছিলো ভীষণ জেদি স্বভাবের।অবশেষে তার এতটা রিকোয়েস্টে আমিও ‘হ্যা’ সূচক সায় জানাই।
যদিও সেই মুহূর্তে তার প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা অনুভব হয়নি।তবে ওর এতটা অনুরোধ আমার মনে কিছুটা মায়ার জন্ম দিয়েছিলো।তাই ‘হ্যা’ সূচক জবাব দিয়েছিলাম।”

“কিন্তু মজার ব্যাপার টা কি,জানো?পরের দিন ক্লাসে গিয়ে শুনি,মেয়েটা তার বান্ধবীদের কাছ থেকে ডেয়ার নিয়েছিলো।আর তারা তাকে ডেয়ার হিসেবে,আমাকে প্রপোজ করে বোকা বানাতে বলেছে।
হাহাহা..কি অদ্ভুত তাই না?ভালোবাসা নিয়ে ছলনা..তাও আবার আমার সাথে?হাহ..আচ্ছা,তুমি বলো,ভালোবাসা তো একটি গভীর শব্দ,যেটা মানুষ মুখের ভাষা দিয়েও পূর্ণাঙ্গ ভাবে প্রকাশ করতে পারবে না।এটি একটি পবিত্র জিনিস।সেখানে কেউ যদি তোমার সাথে,এই বিষয়টি কে নিয়ে মজা করে মিথ্যার আশ্রয় নেয়,সেটা কি আদৌ ঠিক?’
নাহ,ঠিক নয়।তোমার কাছে যেটা মজার,অন্যের কাছে সেটা সিরিয়াস হতে পারে।মানুষ যতভাবেই মজা করুক না কেনো,অন্তত এই ‘ভালোবাসা’ নামক বিষয়টি নিয়ে মিথ্যা প্রতারণা আমার আদালতে গ্রহণ যোগ্য নয়।ওর সেই নিখুঁত অভিনয় আমার মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিলো।ভাবলাম,
‘আমার আদালতে এই মিথ্যাবাদী,ছলনাময়ী নারীকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে।’

“তারপর ওকে আমি ৬ মাসের মধ্যেও কিছুই বলিনি।শুধু ওকে শাস্তি দেওয়ার জন্য সুন্দর একটি সুযোগ খুঁজেছি।আর পেয়েও গেছি।”

“একদিন টিফিন পিরিয়ডে,ও আমার কাছে কিছু নোটস চেয়েছিলো।আমিও ওকে বলেছি,যে নোটসগুলো আমার বাসায় আছে।ও চাইলে আমাদের বাসায় যেতে পারে।প্রথমে ও আমার বাসায় যেতে ইতস্তত বোধ করছিলো।তারপর আমি বলেছিলাম,আমার বাসায় আমার মা এবং গৃহপরিচারিকা আছে।সে নিশ্চিন্তে যেতে পারে।”

“জানো,বোকা মেয়েটা কিছু না ভেবেই আমার বাসায় যেতে রাজি হলো।
তারপর আমি ওকে বলে,কলেজ থেকে আগে বেরিয়ে গেলাম।যেন ওকে আর আমাকে একসাথে কেউ না দেখে।তাছাড়া আমাদের প্রতিবেশীদের বাড়িগুলো দূরত্বে থাকায়,ওই ভরদুপুরে ওকে আর আমাকে একসাথে পরিচিত কেউ দেখেনি।”

“আর তারপর..হাহাহাহা..তারপর আমি আমার কাজে সফল হলাম।মেয়েটা বাসায় আসতেই আমার ‘মা’ নামক ডাইনীর রুমে নিয়ে গিয়ে,ওকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।মায়ের এই অবস্থা দেখে ওরও খুব মায়া হলো।সেই সুযোগে আমি কিচেনে গিয়ে ওর জন্য কুুল-কুল লেমন জুস বানালাম।আর সেটাতে মিশিয়ে দিলাম ৭-৮টি ঘুমের ওষুধ।অতঃপর মেয়েটি কে শরবত দিতেই,সেটা সে তৃষ্ণার্ত গলায় ঢকঢক করে পান করলো।আহ!কি শান্তি।”

“তারপর আমার রুম থেকে নোটস গুলো নিয়ে ওকে দিলাম।আর নোটসের বিষয়ে কিছু কথা বলতে বলতেই দেখলাম,মেয়েটা ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।তৃপ্তির হাসি দিয়ে,বেশ যত্ন করে ওকে কোলে তুলে নিয়ে,এই বিশেষ রুমটিতে নিয়ে এলাম,যেটা মায়ের অসুস্থতার পর থেকেই আমি একটু একটু করে সাজিয়েছি।তখন অবশ্য এতটা ডিজিটাল ডিভাইস ছিলো না।”

“যাইহোক,তারপর হাতে গ্লাভস পরিধান করে,দুই হাত দিয়ে মেয়েটির গলায় এমন ভাবে চাপ প্রয়োগ করলাম,যেন গলার হাড় গুলো একে-অপরের সাথে গভীরভাবে মিশে যায়।গলায় সজোরে চাপ প্রয়োগ করতেই,মেয়েটার মুখ দিয়ে গড়গড় করে র**ক্ত বেরিয়ে এলো।যেটা দেখে বেশ তৃপ্তি পেয়েছিলাম।
যেহেতু ওকে এভাবে মা**র্ডার করার প্ল্যান টি আগে থেকেই ছিলো,তাই আগে থেকেই এই আলমিরাটি রুমটিতে তৈরি করার ব্যবস্থা করেছি।ওই যে অতিথি আসার আগে,মানুষ যেমন আপ্যায়ন করার ব্যবস্থা করে,আমিও তেমন আমার রুমটিতে প্রথম অতিথির আগমনের কথা ভেবে,৬মাস ধরে সুন্দর করে তার জন্য বাসস্থান টি সাজিয়েছি।
আচ্ছা,আলমিরাটি কেমন দেখতে?সুন্দর..তাই না?বলতেই হবে..তোমার হাসবেন্ডের রুচি সবসময় ইউনিক হয়।”

“আচ্ছা,তোমার মনে নিশ্চয়ই কৌতূহল জাগছে,যে মেয়েটার লা**শটিকে আমি কিভাবে সংরক্ষণ করলাম…

নির্জন কথা গুলো বলতে বলতেই দেখলো,নিধির হাত অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে,চেহারায় তীব্র ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।সেটা দেখে নির্জন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

‘আরে,আরে..এতো কাঁপছো কেনো?দেখেছো,আমি কত স্বাভাবিক!এরপর থেকে প্রতিটি খু**ন তুমি আর আমি মিলে করবো।তুমি প্ল্যান বানাবে,আর আমি মা**র্ডার করবো।তোমাকে ওদের গায়ে হাত দিতে হবে না,তাহলে আবার আমার হিংসা লাগবে।আর যদিও তুমি নতুন..ব্যাপার না..আমার সাথে থাকতে,থাকতে আরও বুদ্ধিমতী এবং সাহসী হয়ে যাবে।আর এইসব স্বাভাবিক বিষয় নিয়ে কাঁপা-কাঁপি বন্ধ করে,আমার কথা শোনো।’

বলেই আলমিরার দিকে ইশারা করে,নির্জন বলতে শুরু করলো,

“আলমিরার ভিতরে থাকা বাতাসকে স্টেরাইল রাখার জন্য, আমি বিশেষ একটি বিপরীত গ্যাস ব্যবহার করেছি।এই গ্যাসটি অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে দ্রুত বিক্রিয়া করে, যাতে ব্যাকটেরিয়া এবং পঁচনশীলতা প্রতিরোধ করা যায়।

আর,আলমিরার ভিতরে একটি উন্নত ডিহাইড্রেশন সিস্টেম রয়েছে,যেটা রূদ্ধি করে দেয়।এটি ভ্যাপরাইজেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প অপসারণ করে,ফলে লা**শটির পঁচন এবং ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।”

“এছাড়াও বিভিন্ন রাসায়নিক প্রিজারভেটিভ যেমন ফরমালডিহাইড,গ্লিটারালডিহাইড এবং অ্যাসিটিক অ্যাসিড ব্যবহার করেছি।এই রাসায়নিকগুলো সেলুলার স্তরে কাজ করে এবং কোষগুলোকে সুরক্ষিত করে।

আর,আলমিরার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি অটো ক্লাইমেট কন্ট্রোল সিস্টেম রয়েছে।এটি একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখে,যেটা পঁচন প্রক্রিয়া রোধ করে এবং লা**শটিকে অক্ষত রাখে।”
একাধারে কথাগুলো বলে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে নির্জন আবারও বলতে শুরু করলো,

“এই আলমিরাটি ভ্যাকুয়াম সিলিং পদ্ধতির মাধ্যমে সিল করা হয়েছে।এতে করে বাইরের বাতাস প্রবেশ করতে পারে না এবং সাপেক্ষের ক্ষতিকর প্রভাব কমে যায়।

আর একটি ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করেছি,যেটা আলমিরার ভিতরের অবস্থার তাপমাত্রা,আর্দ্রতা এবং গ্যাসের স্তর পরীক্ষা করে।এই সিস্টেমটি নিয়মিতভাবে তথ্য সংগ্রহ করে,যাতে আমি নিশ্চিত হতে পারি যে,সবকিছু সঠিকভাবে চলছে কিনা।”

“আর এই বিশেষ আলমিরাটি মেয়েটিকে দীর্ঘদিন ধরে অক্ষত রাখার জন্য নিখুঁত ব্যবস্থা করেছি।বুঝলে ডার্ক কুইন?’

বলেই নিধির দিকে তাকাতেই দেখলো,নিধি এক দৃষ্টিতে আলমিরায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে আছে।”

“নিধির এহেন কার্যে ভীষণ ক্ষিপ্ত হলো নির্জন।নিধির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

‘ওই ছলনাময়ী নারীর দিকে এত গভীর দৃষ্টিতে তাকানোর কি আছে?তুমি শুধু আমার দিকে এভাবে তাকাবে।নেক্সট টাইম যেন এমন ভুল না হয়,হুম…

এইবার আসো,তোমাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।যদিও ও তোমার-আমার মতো মানুষ নয়।তবে গেস করতে পারবে,সেটা কি?”

“নিধি হতভম্ব হয়ে নির্জনের মুখের পানে তাকিয়ে থাকল।ওর মাথা বারবার ঘুরে আসছে।মনে হয় এক্ষুনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়বে।
নির্জন সেই বিষয়টি উপেক্ষা করে,নিধিকে আরেকটি আলমিরার সামনে নিয়ে গিয়ে,আলমিরার দরজা খুলতেই,ভেতরে তাকিয়ে তীব্র ভয়ে চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে গেলো নিধির।”

“নির্জনের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাতেই,নির্জন ওকে আরেকটু ভয় দেখানোর জন্য বললো,

‘ফোঁস….
হাহাহাহা…কি হলো ভয় পেয়েছো?উহুম,তোমার মত সাহসী মেয়ের ভীতু দৃষ্টি মানায় না।শোনো,
এটা হলো রাসেলস ভাইপার সাপ।’

“এই সাপটিকে আমি ২দিন আগে,ঢাকা থেকে দূরত্বে একটি গ্রাম থেকে ধরে এনেছি।এটা আগে থেকে প্ল্যান ছিলো।যদিও এই বি**ষাক্ত সাপটিকে ধরার জন্য ইঁদুর এবং ব্যাঙ আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে।তবে আমার শত্রুদের ইউনিক স্টাইলে শাস্তি দেওয়ার জন্য রিস্ক নিয়ে এটাকে ধরেছি।জানো,এটার তেজ একদম আমার মতো।তাইতো ওর সাথে আমি ফ্রেন্ডশিপ করেছি।আর আমার বিশেষভাবে তৈরি করা লাঠিতে সাপটি ঢুকে পড়েছে।এবং নিজের অজান্তেই আমার আঁধার রাজ্যে বন্দী হয়েছে।আর এই লাঠিটি মোটামুটি ৫ ফুট লম্বা এবং ৮ ইঞ্চি ব্যাসের।এর বাইরে একটি শক্ত কাঠের তৈরি আবরণ আছে,যেটা সাপটির জন্য নিরাপদ এবং সুরক্ষিত স্থান প্রদান করে।”

“এই দেখো,লাঠির বাইরে একটি বন্ধনী দেওয়া আছে,যাতে সাপটি সহজে বাইরে আসতে না পারে।এই বন্ধনীর মধ্যে একটি বড় প্যাডলকের ব্যবস্থা রয়েছে,যেটা শুধুমাত্র আমি খুলতে পারবো।”

“এছাড়া,লাঠির সাইডে ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে,যেটা সাপটির জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে।এই ছিদ্রগুলো এত ছোট যে,সাপটি সহজে বাইরে বের হতে পারে না কিন্তু ভিতরে সে অস্বস্তি বোধ করে না।”

“আর দেখো,লাঠির অভ্যন্তরে একটি নরম স্তর রয়েছে,যেটা সাপটিকে আহত হতে বাঁধা দেয়।এই স্তরটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে,যাতে সাপটি সহজে সরে যেতে পারে এবং ভিতরে শান্তিতে থাকতে পারে।
আর এই লাঠিটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এটি সাউন্ড প্রুফ,ফলে বাইরের কোন শব্দ সাপটিকে বিরক্ত করতে পারে না।এর ফলে,সাপটি পুরোপুরি শান্তিতে থাকতে পারে।”

“আর আমি বিশেষ প্রয়োজনে সাপটিকে ব্যবহার করার জন্য বের করেছি।বিশেষ করে,এটা আমার শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য পারফেক্ট একটি প্রাণী।”

“ওহ,ওর মনে হয় ক্ষুধা লেগেছে।কি বলোতো,ও আবার ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা।’
বলেই নির্জন,লাঠিতে আবদ্ধ রাসেলস ভাইপারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

‘ওয়েট,বন্ধু..এখনই তোমার খাবারের ব্যবস্থা করছি।’

বলেই নিধির হাত ছেড়ে,আলমিরার পাশে থাকা ছোট ছোট ছিদ্রযুক্ত একটি খাঁচা,সাপটির সামনে আনল।
নিধি সেই খাঁচাটির দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।নির্জনের একের পর এক বিস্ময়কর কর্মকাণ্ড দেখে,তার ভাষাগুলো যেন অনায়াসে হারিয়ে যাচ্ছে।”

“খাঁচাটির ভেতর অনেকগুলো ব্যাঙ আর ইঁদুর এলোমেলো ভাবে ছোটাছুটি করছে।সেটা দেখে নির্জন পৈ**শাচিক হাসি দিয়ে বললো,

‘বুঝেছি,তোরাও মৃ**ত্যুর আগে একটু ইনজয় করে নিচ্ছিস।কিন্তু,এখন তো তোদের কে আমার বন্ধুর পেটে যেতে হবে।’

বলেই,লাঠিতে থাকা বিশেষ ধরণের ছিপি টা খুলে,লাঠিটি খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেই,রাসেলস ভাইপার তার প্রিয় খাদ্য গুলোকে পেয়ে,ভ**য়ংকর আওয়াজ (ফোঁসফোঁস) করার পর,তৃপ্তির সহিত ভক্ষণ করলো।’

‘সেটা দেখে নির্জনের মনও বেশ তৃপ্ত হলো এবং খাঁচা থেকে লাঠিটি সন্তর্পণে বের করে ঢাকনাটি লাগিয়ে,আবারও লাঠিতে থাকা সাপটিকে আলমিরাতে রেখে,হাত দিয়ে ইশারা করে ‘বাই..বাই’ বলে আলমিরার দরজা বন্ধ করে দিলো।”

“এদিকে ছোটবেলা থেকে যেই ‘সাপ’ নামক প্রাণী টিকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতো,সেটাকে আজ চোখের সামনে এমনভাবে দেখে,নিধি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে প্রায়,এমন সময় নির্জন নিধির কোমরে হাত দিয়ে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বললো,

‘কি হলো তোমার?এখনোও ভয় পাচ্ছো নাকি?আচ্ছা,আর ৫ মিনিট..
তোমার ভয় এখন পুরোপুরি দূর হয়ে যাবে।’

বলেই,নিধির দুর্বল হাতটি টেনে সেই কফিনগুলোর কাছে নিয়ে গেলো।
অতঃপর প্রথম কফিন টি খুললো,

‘প্রথম কফিনটি খুলতেই চোখের সামনে একটি যুবকের লা**শ দেখতেই,ভয়ে চি**ৎকার করতে গিয়েও গলায় স্বর আটকে গেলো নিধির।
নির্জন বিষয়টি উপেক্ষা করে বললো,

‘রিল্যাক্স,রিল্যাক্স…এগুলো আগে দেখো,তারপর না হয় তোমার মনের কথা গুলো স্বাধীন ভাবে বলবে।’

বলেই একে একে বাকি তিন টি কফিনও খুললো।”

“একে একে ৪জন যুবকের লা**শ দেখে,এইবার যেন নিজের শরীর কে সামলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে নিধির।প্রতিটি বাস্তবতা যেন তার কাছে দুঃস্বপ্নের মত লাগছে।”

“অতঃপর নিধির ভাবনার মাঝেই,ওর হাত ধরে টেনে নির্জন প্রথম কফিনের কাছে নিয়ে গিয়ে,র**ক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

‘মনে আছে,এই ৪জন বা**স্টার্ডগুলোর কথা?যারা তোমাকে,তোহা কে এবং নাদিয়া কে চলনবিলের নদীতে সম্ভ্রমহানি করতে চেয়েছিলো?ওদের চেহারাগুলো মনে পড়ে ডার্ক কুইন?
জানো,ওদের কে আমি আগে থেকেই চিনি।এর আগেও একবার চলনবিলে ঘুরতে গিয়ে দেখেছিলাম,কিছু মেয়ের সাথে ওরা খারাপ আচরণ করছিলো।
আর,তোমাদের সাথেও যেদিন এমন টা হলো,সেইদিনই বুঝেছি,এগুলো ওদের কাজ।”

“কিন্তু..কিন্তু যেখানে আমার ডার্ক কুইনের সাথে কেউ এমন আচরণ করবে..তাকে আমি বাঁচিয়ে রাখি কি করে?
যদিও তখন তোমাকে আমি ভালোবাসতাম না।কিন্তু যখন ভালোবেসেছি,তখন থেকেই আমার মনে প্রতিশোধের স্পৃহা জেগে উঠেছিলো।তাই তো আমি গ্রামের ক্ষেত থেকে আমার প্রিয় বন্ধুটিকে ধরে এনেছি,যেন ওদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতে পারি।গতকাল সন্ধ্যায় তোমাকে রুমে তালাবদ্ধ রেখে,আমি আমার বন্ধু রাসেলস ভাইপার কে নিয়ে, ৪ঘন্টা জার্নি করে সিরাজগঞ্জের চলনবিলে গিয়েছিলাম।সেখানের আশেপাশের কয়েকটি জায়গায় ওদের কে খুঁজেছি।ভেবেছিলাম,হতাশ হয়ে আমাকে বাসায় ফিরে আসতে হবে,কিন্তু অবশেষে যেই জঙ্গলটিতে তোমার আর আমার প্রথম শরীর এবং মনের সংঘর্ষ হয়েছিলো,সেখানেই ওদের কে পেয়েছি।”

“আমার মনে যে তখন প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিলো,নিরু।চলনবিলের পাশে সেই জঙ্গলেই আমার শত্রুরা মজার আসর বসিয়ে,টর্চলাইটের আলোতে তাস খেলছিলো আর ধূমপানের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছিলো চারদিকে।
আমি পা টিপে টিপে সন্তর্পণে হেঁটে গিয়ে,এক হাতে লাঠি আর তার মধ্যে থাকা রাসেলস ভাইপার নিয়ে ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।”

“যখন শুকনো পাতার খড়খড়ে আওয়াজে,পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ওরা ঘুরে তাকালো,তৎক্ষণাৎ ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই,আমি ওদের মাথার পেছনে ক্লোরোফর্মের গ্যাস স্প্রে করলাম।কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই,চারজনই মাটিতে ঢলে পড়লো,একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেলো।”

“আমি শান্তভাবে লাঠি থেকে সাপটি নামিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে দিলাম।রাসেলস ভাইপার সাপটি নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য সজাগ হয়ে তাদের শরীরে কা**মড় বসালো।বি**ষের তীব্রতা দ্রুত তাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।কিছুক্ষণেই তাদের হাত-পা অবশ হতে শুরু করলো।
অতঃপর তাদের নিষ্প্রাণ দেহগুলো গাড়িতে তুলে নিয়ে,আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
তারপর বাসায় এসে আমার প্রিয় রুমটিতে ঢুকে,তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এই কফিনগুলোতে ওদের
লা**শ গুলো রেখে,সুন্দর করে সংরক্ষণ করলাম,যেন তোমার শত্রুদের এহেন পরিস্থিতি দেখে তুমি আত্মতৃপ্তি পাও।”

“আর তুমি তো নিশ্চয়ই নিউজে শুনেছো যে,
রাসেলস ভাইপার সাধারণত একবারে একটি শিকারকে কা**মড়ে বি**ষ প্রয়োগ করে।তবে,যদি তার কাছে একাধিক শিকার থাকে এবং যদি সে প্রয়োজন বোধ করে,তাহলে সে পরপর একাধিক কা**মড়ের মাধ্যমে বি**ষ প্রয়োগ করতে পারে।সাপটির কা**মড়ে বি**ষাক্ততা এবং আ**ক্রমণের কারণ হিসেবে,এটি একসঙ্গে একাধিক মানুষের উপর বি**ষ প্রয়োগের জন্য সক্ষম হতে পারে।কিন্তু সেক্ষেত্রে তা অতি মাত্রায় কষ্টকর ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।”

“সাধারণত,রাসেলস ভাইপারের বি**ষ শক্তিশালী এবং মাত্রা অনুযায়ী এটি ১০০-২০০ মিলিগ্রাম বি**ষ একবারে প্রয়োগ করতে পারে,যেটা একাধিক ছোট প্রাণীকে মা**রতে যথেষ্ট।মানুষের জন্যও এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং প্রায়ই মা**রাত্মক হতে পারে।তবে একসঙ্গে একাধিক মানুষের ওপর তার বি**ষ প্রয়োগ করার জন্য বিশেষ কোন সক্ষমতা নেই;এটি প্রায়ই পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল।”

“সবকিছু ভেবেচিন্তে,আমি আমার বন্ধুটিকে দিয়ে ওদেরকে ভ**য়াবহ ভাবে শাস্তি দিয়েছি।
আর জানো,ওদের কে আমি কিভাবে সংরক্ষণ করেছি?
বলেই,প্রথম কফিনে থাকা লা**শটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুরু করলো,

“১.কালো বি**ষ (Black Venom)”-
এটি হলো ওই বখাটেদের দলের নেতার লা**শ।এই লা**শটি রাসেলস ভাইপারের বি**ষে শরীর কালো-নীল হয়ে ফুলে উঠেছে।মৃ**ত্যুর পর আমি এটি সংরক্ষণ করতে ফরমালডিহাইডের তীব্র দ্রবণে পুরো শরীর ডুবিয়ে রেখেছি।ফরমালডিহাইড লা**শের কোষগুলোকে জ্যান্ত রেখে,এই ভ**য়ঙ্কর মৃ**ত্যুর নিদর্শন যেন জীবন্ত রাখে,আর আমি এবং তুমি সেটা দেখে যেন তৃপ্তি পাই,তাই এভাবে সংরক্ষণ করেছি।”

“২.দ্বিতীয় কফিন,”বি**ষাক্ত হাসি (Poisoned Smile)”-
এই লা**শটি মৃ**ত্যুর আগেই বি**ষের তীব্র যন্ত্রনায় মুখ বি**কৃত হয়েছে।এই লা**শটির মুখমণ্ডল সিলিকন ওয়ার্নিশ দিয়ে আবৃত করে রেখেছি,যাতে বি**কৃত মুখটি স্থির থাকে।শরীরের বাকিটা পটাশিয়াম ডাইক্রোমেট দিয়ে সংরক্ষণ করেছি,যেটা লা**শটির ত্বকে ভ**য়ঙ্কর লালচে-বাদামি আভা এনে দিয়েছে।”

“নির্জনের কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই,নিধি কফিনের ভেতরের লাশের সেই বি**কৃত মুখটি দেখে শিউরে উঠলো।”

“নির্জন আবার বলতে শুরু করলো,

” ৩.তৃতীয় কফিন,”মৃ**ত্যুর ছায়া (Shadow of Death)”-
এই লা**শটি সরাসরি রাসেলস ভাইপারের বি**ষে সংক্রমিত হয়ে র**ক্তপাত বন্ধ হওয়ার ফলে সারা শরীর কালচে-লাল হয়ে রয়েছে।আমি এখানে লা**শটিকে ব্লিচ এবং মিথানলের সংমিশ্রণে সংরক্ষণ করেছি,যেটা লা**শের ত্বকে কালো ছায়া এনে দিয়েছে।”

বলেই মুচকি হেসে আবার ইশারা করলো,দেখো,

“৪.শেষের কফিন,”র**ক্তের ফোয়ারা (Fountain of Blood)”-
এই লা**শটি মৃ**ত্যুর পর র**ক্তপাত থামানো হয়নি,বরং আমি তাকে চিরস্থায়ী করতে ব্লাড ফিক্সেটিভ ব্যবহার করেছি।লা**শের শরীরকে পুরোপুরি সিল করেছি ভিনেগার ও প্রিজারভেটিভ সলিউশনের সংমিশ্রণে,যেটা লা**শের র**ক্তকে ঠাণ্ডা,থকথকে ফোয়ারার মতো লাগাচ্ছে।
আর এগুলো আমার পূর্বপরিকল্পিত ছিলো।তাই,কফিনটির নাম দিয়েছি ‘র**ক্তের ফোয়ারা’।”

“এদিকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রুমটিতে,নিধি তার দুর্বল শরীর নিয়ে একের পর এক অদ্ভুত জিনিসগুলোর সম্মুখীন হয়ে,আতঙ্কে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না।নিধির শরীর কাঁপতে থাকল,চোখ বেয়ে অনবরত নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।নিধি এক মনে ভাবতে থাকল,

‘নির্জনের এই ভ**য়ঙ্কর রাজ্য থেকে পালাবে কিভাবে?আদৌ কি পালানো সম্ভব?’

“এদিকে স্বচ্ছ হেলমেটের আড়ালে নিধির চোখের পানি দেখে,নির্জন একে একে কফিনগুলো বন্ধ করে দিয়ে,নিধির দুই বাহু ধরে,ঘাড় কাত করে,উত্তেজিত স্বরে বলতে থাকল,

‘কি হলো,নিরু?ওদের এমন শাস্তিতে তোমার মন ভরেনি,হ্যা?তুমি বললে,আমি ওদেরকে কু**চি কু**চি করে কে**টে তোমার সামনে রাখব।কি হলো,চুপ করে আছো কেনো,হুম?’

“নির্জন কথাগুলো বলতে বলতেই,নিধি চোখ জোড়া বন্ধ করে,নির্জনের বুকে ঢলে পড়লো।”

#চলবে…