Sunday, August 10, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 75



অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১৫

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৫.

ঈদের পরদিন হওয়া সত্ত্বেও হসপিটালে পেশেন্টের সংখ্যা সামান্যতম কমে নি। অসুখ বিসুখ তো আর কোনো বিশেষ দিন মেনে চলে না। তাই তো ঈদের এই সময়টাতেও ডাক্তার এবং রোগীরা চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে ব্যস্ত।

পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের সবথেকে সিনিয়র হেমাটোলজি অনকোলজিস্ট হলেন প্রফেসর মোহাম্মদ হায়াত। আজকে উনার ছুটিতে থাকার কথা থাকলেও আচমকা ইমারজেন্সি একটা কেসের কারণে উনার হসপিটালে আসতে হয়েছে। বয়স্ক হলেও ভদ্রলোকের হাঁটার গতি খুবই দ্রুত। উনার পায়ের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাশে হাঁটছেন আরো তিনজন ডক্টর। এদের মধ্যে সবথেকে জুনিয়র হলো ডক্টর ওয়াসিফ কায়সার মনন।

হাতে থাকা একজন পেশেন্টের রিপোর্ট হতে তার কেস নিয়ে সার্বিক তথ্য জানাতে জানাতে সিনিয়রদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছিল মনন। বোন এন্ড সফট টিস্যু ডিপার্টমেন্টের ওপিডি এরিয়া ক্রস করার সময় আচানকই তার চোখ পড়ে একটা বেঞ্চির দিকে। বেখেয়াল বশত চোখ ফিরিয়ে নিলেও সঙ্গে সঙ্গে সে আবার ঘুরে তাকায়। দেখে মোহকে। সঙ্গে বসে আছে একজন ভদ্রলোক। বয়স দেখে অনুমান করা যাচ্ছে লোকটা সম্ভবত সম্পর্কে মোহর বাবা হন।

মোহকে দেখার সময়টা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সিনিয়রের ডাকে মনন চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

__________

ঈদের পরদিন উপলক্ষে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে শুভ্রর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে মায়া। গায়ে জড়ানো বাবার কিনে দেওয়া নীল চুরিদার। একই রকম দেখতে লাল রঙের একটা চুরিদার বাবা মোহর জন্যও নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু মোহকে জোর করেও সেটা পরানো সম্ভব হয় নি। ঈদের দিনটা ঘরের পোশাক পরে, নিজের রুমে বন্দী থেকেই কাটিয়ে দিয়েছে মেয়েটা।

মায়া বুঝতে পারে মোহ নিজের বাহ্যিক রূপটাকে নিয়ে ইদানীং খুব হীনমন্যতায় ভুগে। বিশেষ করে চুল কেটে ফেলার পর থেকে। কিন্তু এই ব্যাপারটা তো ক্ষণস্থায়ী তাই না? মোহ সুস্থ হয়ে গেলেই তো আবার আগের রূপ ফিরে পাবে। চুল বড়ো হয়ে যাবে, গায়ের রঙটা ফিরে আসবে, মুখের লাবণ্যও আবার লক্ষণীয় হবে। ক’টা মাস কিংবা বছরেরই তো ব্যাপার!

কলেজ পড়ুয়া শুভ্রকে দেখা গেলো পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায়। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মায়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল। দূর হতে শুভ্রকে দেখতেই মায়া রিকশা থামিয়ে, ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরে। ফুটপাত ধরে এগিয়ে যায় শুভ্রর দিকে। দূর হতেই লক্ষ্য করে শুভ্রর গাল জুড়ে উঁকি দেওয়া ছোট ছোট দাঁড়িগুলোকে। মায়ার হাসি পায় খুব।

শুভ্রর মাথায় ইদানিং বড়ো সাজার ভূত চেপেছে খুব। একই বয়সী হওয়া সত্ত্বেও মায়ার মুখের আদলে ম্যাচিওর ভাবটা তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। কিন্তু শুভ্রকে সেই তুলনায় মায়ার পাশে বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়। এই সামান্যতম পার্থক্য মিটিয়ে নিজেকে মায়ার পাশে মানানসই দেখানোর জন্যই শুভ্রর এতো প্রয়াস!

মায়াকে খেয়াল করতেই শুভ্র চওড়া হাসে। এগিয়ে গিয়ে বলে,

“ ঈদ মোবারক দোস্ত। সুন্দর লাগতেসে তো তোরে! একদম ঈদের চাঁদের মতো! “

মায়া লাজুক হেসে বলে,

“ আচ্ছা। “

শুভ্র ভ্রু কুচকে বলে,

“ কিন্তু সামথিং ইজ মিসিং। “

মায়া ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো কি? শুভ্র উত্তর দেয় না। আশেপাশে তাকিয়ে চোখ বুলায় টিএসসি প্রাঙ্গন জুড়ে। মায়ার হাত ধরে রাস্তা পাড় করে চলে যায় অপর পাশটায়। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনে নেয় একটা বেলী ফুলের গাজরা। নিজ হাতে গাজরাটা পড়িয়ে দেয় মায়ার ডান হাতে। কিছুদূর যেতেই দেখে রাস্তার পাশে একজন বৃদ্ধা কাঁচের চুরি বিক্রি করছে। সেখান থেকে শুভ্র নীল রঙের এক ডজন কাঁচের চুড়ি কিনে মায়ার বাম হাতে পড়িয়ে দেয়।

মায়া ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“ আংকেলের টাকা উড়াচ্ছিস তুই? “

“ এহ! মোটেও না। এইসব টাকা আমি গতকাল সালামি পেয়েছি। টোটাল তিন হাজার সাতশো সামথিং আছে। আজকের ডেটের বাজেট এক হাজার। চলবে না? “

মায়া হেসে বলে,

“ চলবে মানে? দৌড়াবে। “

শুভ্র হেসে পকেট থেকে দুটো খাম বের করে মায়ার হাতে দিয়ে বলে,

“ এখন এইটা ব্যাগে রাখ। “

মায়া জানতে চায়,

“ খামে কি আছে? “

“ সালামি। লাল খামটা তোর। গোলাপিটা মোহর। ওকে দিয়ে দিবি। “

“ আরে! আমি তো গতকাল মজা করে সালামি চাচ্ছিলাম। তুই সিরিয়াসলি নিয়ে নিলি কেন! সালামি লাগবে না। চাকরি বাকরি যখন করবি তখন সালামি দিস। “

শুভ্র চোখ রাঙিয়ে বলে,

“ আপাতত চুপচাপ সালামি রাখ। চাকরি পাইলে তখন সালামি টালামি দিতে পারবো না। তখন তোর দেনমোহরের টাকা জমাবো। “

__________

সকাল থেকে বিভিন্ন টেস্ট করিয়ে, অত:পর ডক্টর দেখিয়ে, হসপিটালে ভর্তি হতে হতে প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছে মোহর। আপাতত সব টেস্টের রিপোর্ট ঠিক আছে। ডক্টর বলেছে আগামীকাল থেকে মোহর দ্বিতীয় সাইকেল কেমোটা শুরু করা যাবে। অবশ্য মোহর প্রত্যেকটা কেমোর সাইকেলই এমন ভাবে প্ল্যান করা হয়েছে। একুশ দিন পরপর প্রতি সাইকেল দিতে হবে। এই একুশ দিনের মাঝে মোহকে সকল নিয়ম মেনে নিজেকে যথাসম্ভব ফিট রাখতে হবে। কারণ কোনো একটা রিপোর্ট উপর নিচ হলেই তার কেমো পিছিয়ে যাবে।

এইবার মোহ যেই কেবিনটা পেয়েছে সেটা হলো তেরো তলায়। কেবিন নং এক তিন শূন্য সাত। মোহ কেবিনের বিশাল কাঁচের জানালাটা গলে বাইরের শহরটা দেখতে ব্যস্ত। তার অবশ্য কেবিনে মন টিকছে না। ইচ্ছে করছে একছুটে ছাদে গিয়ে বিকেলের শহরটা দেখতে। কিন্তু এই মুহুর্তে এইটা সম্ভব নয়। শিহান তার সাথেই রুমে উপস্থিত আছে।

মোহ সাথে সাথেই একটা ফন্দি আঁটে। নিজের বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ওহো! কেবিনে তো পানির বোতলই নেই। আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। “

শিহান সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ আমি পানির বোতল নিয়ে আসছি গিয়ে। “

মোহ সাথে সাথে বাঁধ সাধে।

“ তুমি কেনো যাবে? তুমি না কাজ করছিলে? আমাকে টাকা দিয়ে দাও। আমি গিয়ে নিচের ক্যান্টিন থেকে পানির বোতল নিয়ে আসছি। আমি সব চিনি। “

শিহান কপাল কুচকে বলে,

“ কোনো প্রয়োজন নেই। আমি যাচ্ছি। “

মোহ মুখ লটকে বলে,

“ আগামীকাল সকাল থেকে কেমো শুরু হবে। তখন তো সারাদিন শুয়ে বসেই কাটাতে হবে আমার। কেমোর আগের দিন এইটুকু স্বাধীনতা কি আমি পেতে পারি না? আমি জানি আমার এখনো আঠারো হয় নি। কিন্তু নিজে গিয়ে একটু পানির বোতল কিনে আনবো এইটুকু স্বাধীনতা পেতেও কি আমার আরো একবছর অপেক্ষা করতে হবে? “

শিহান নীরবে মেয়ের মুখটা দেখে। চুপচাপ পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ তাড়াতাড়ি আসবে। আর সাবধানে যাবে। মাস্ক পড়ে নাও। “

মোহর লটকে যাওয়া মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে প্রফুল্ল মনে দ্রুত মাস্ক পড়ে, ফোন আর ওয়ালেট হাতে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শিহান মৃদু হাসে। মোহর মুখ লটকে কথা বলার ধরণ দেখে তার খুব হাসি পাচ্ছিলো এতক্ষণ। খুব কষ্টে সেই হাসি চেপে রেখেছিল। হাসতে হাসতে ল্যাপটপ নিয়ে বসতেই শিহানের আচমকা মনে হয়, তার মেয়ের নিজের বাবার কাছে চাহিদার গন্ডি খুবই সামান্য। একা একা পানির বোতল কিনতে যাওয়ার স্বাধীনতা বাদে আর কি কি চাহিদা আছে মোহর নিজের বাবার কাছে?

__________

দুপুরে ইমারজেন্সি একটা কেস সামলানোর চক্করে লাঞ্চ করার সুযোগ হয়ে উঠে নি মননের। কেবিনে ফিরতেই পেন্ডিং পেশেন্টদের দেখে সবেমাত্র ফ্রি হয়ে ক্যান্টিনে এসেছে সে। ক্ষুধায় বুক জ্বলছে একদম। মনন খাবার নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই স্ক্রিনে ভাসমান নাম দেখে অবাক হলো। রিসিভ করে ফোন কানে চেপে ধরতেই অপর পাশ হতে চঞ্চল স্বর শোনা গেলো,

“ এই ডক্টর! হসপিটালে আছেন? “

মনন অবাক হলেও বাধ্যর মতো উত্তর দিলো,

“ হু, আছি। “

“ ব্যস্ত আপনি? পেশেন্ট দেখছেন? হাতে সময় হবে? “

“ ব্যস্ত না। পেশেন্ট দেখা শেষ হলো সবে। আপাতত হাতে চল্লিশ মিনিট ফ্রি টাইম আছে। “

মোহ এক অদৃশ্য অধিকারবোধ নিয়ে বলে উঠে,

“ আচ্ছা। তাহলে ছাদে চলে আসুন এখুনি। আর শুনেন, আসার সময় একটা পানির বোতল নিয়ে আসবেন ক্যান্টিন থেকে। তাড়াতাড়ি আসবেন। অপেক্ষা করছি। “

কলটা কেটে যায়। মনন কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে তো কিছুক্ষণ টেবিলে থাকা খাবারের দিকে। এটা ঠিক যে তার ক্ষিধে পেয়েছে খুব। আবার এটাও ধ্রুব সত্য যে সে চাইলেই ওই মেয়েটাকে উপেক্ষা করতে পারছে না। মনন আশ্চর্য হয়। নিজের মনের প্রতি চরম আশ্চর্য সে। তার মন এই মুহুর্তে তাকে বলছে,

“ মোহ অপেক্ষা করছে মনন। তোর শিগগিরই যাওয়া উচিত। ওই মেয়েটাকে অপেক্ষা করিয়ে এই মুহুর্তে খাওয়া দাওয়া করাটা চরম অনুচিত কাজ হবে। একবেলা না খেলে তুই মরে টরে যাবি না। “

মনের জোরের সামনে মননের মর্জি খাটে না। সে নীরবে টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে একটা পানির বোতল কিনে নেয়। অত:পর পা বাড়ায় ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এই কাজটা মনন কেন করছে তার জানা নেই। তার কেবল মনে হচ্ছে প্রতিদিন অন্তত চার ঘন্টা সময় ধরে ঘুমানো যেমন তার জন্য জরুরী, একইভাবে মোহর এরকম হুটহাট প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনীয় ডাকে সাড়া দেওয়াটাও খুব জরুরী।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১৪

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৪.

মোহর বাড়ি ফেরার ঠিক ছয়দিন পরের সন্ধ্যার ঘটনা। মোহ তখন গভীর ঘুমে তলিয়ে। আচমকা মায়া হুড়মুড়িয়ে তার রুমে ঢুকে গেলো। প্রবল উচ্ছাস নিয়ে মোহকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। মোহ বিরক্ত হয়। কপাল কুচকে উঠে বসে। আচমকা ডাকে ঘুম ভাঙায় মাথা কেমন চিনচিন করে ব্যথা করছে তার। বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ তোকে না এভাবে আমাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলতে নিষেধ করেছি? মাথা ব্যথা করছে এখন। উফ! “

বলেই মোহ আবার শুয়ে পরতে নেয়। মায়া বাধা দিয়ে দ্রুত বলে উঠে,

“ সরি, সরি। আর এভাবে ডাকবো না কখনো ঘুমের মাঝে। কিন্তু এখন নিচে চল তাড়াতাড়ি। সারপ্রাইজ আছে। দেখবি মাথা ব্যথা ফট করে গায়েব হয়ে যাবে। “

সারপ্রাইজের কথা শুনেও মোহর মাঝে তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ পেলো না। বরং সে নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করলো,

“ কি সারপ্রাইজ? বাবা গরু নিয়ে এসেছে হাঁট থেকে? এই তো? “

মায়া বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তুই কিভাবে বুঝলি? “

মোহ বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ দুইদিন পর ঈদ। প্রত্যেক বাসার বাবাদের এখন কুরবানির হাঁট থেকে গরু নিয়ে আসাটাই একটা সারপ্রাইজ তুল্য ব্যাপার। বেসিক কমন সেন্স এটা। এখন যা রুম থেকে। ঘুমাতে দে। “

মায়া যায় না। বরং মোহকে আলতো ভঙ্গিতেই টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,

“ চল না প্লিজ। বাবা কিছুক্ষণের জন্য গরুকে নিয়ে এসেছে। দূর থেকে শুধু দেখে চলে আসবি। কাছে যেতে হবে না। একবার নিয়ে গেলে কিন্তু আমরা পরে আর দেখার সুযোগ পাবো না। “

মায়ার জোরাজুরিতে অবশেষে বাধ্য হয়ে মোহ মাথায় স্কার্ফ পেঁচিয়ে নিচে নামে। দরজার কাছে যেতেই দেখতে পায় শায়লা আন্টিও দাঁড়ানো। শায়লা মোহকে দেখিয়ে বলে,

“ দেখো আম্মু। ওই-যে গরু। সুন্দর না? তোমার বাবা এবার তোমার পছন্দের রঙের গরু কিনেছে। তুমি না সবসময় বলো, লাল গরু বেশি সুন্দর হয়? “

মোহ দেখে দৃশ্যটা। সুন্দর করে সাজানো লাল গরুর পাশে দাঁড়ানো নিজের বাবাকেও দেখে। হাঁট ঘুরে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাওয়া শিহান আর ঘাম আর জীবাণু যুক্ত শরীরে মেয়ের কাছে যায় না। দূর থেকেই জিজ্ঞেস করে,

“ সুন্দর হয়েছে? “

মোহ আপ্লুত হলো কি-না বুঝা গেলো না। সে কেবল হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। অর্থাৎ সুন্দর হয়েছে।

__________

কায়সার পরিবারের তিন পুরুষকে আজ একত্রে খাবার টেবিলে দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকের গায়ে জড়ানো পরিপাটি নতুন পাঞ্জাবি। দেখে মনে হচ্ছে ভিন্ন তিন বয়সের ব্যাচেলর তিনজন। ঈদের সকালটায় পায়েশ দিয়ে মিষ্টি মুখ করে নিতে ব্যস্ত প্রত্যেকে। সবেমাত্র ঈদের নামাজ শেষ করে ফিরেছেন তারা। চটজলদি নাস্তা সেড়ে, পাঞ্জাবি বদলে তাদের নিচে যেতে হবে পশু কুরবানীর কাজটুকু সম্পন্ন করতে।

মননের খাওয়া শেষ হলো সবার আগে। পাঁচ চামচে সে সবটুকু পায়েস খেয়ে নিয়ে দ্রুত উঠে নিজ রুমে চলে যায়। আলী আকবর সাহেব নাতির প্রস্থানের পানে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

“ হতচ্ছাড়াটা বউয়ের কদর বুঝলো না! ঈদের মতো পবিত্র একটা দিনে কি-না ঘরে কোনো বউ নেই, যে গোস্ত ভাগ করে পাঠাতেই চুলায় রান্না বসাবে। আজকেও ওই টুনির মা’র হাতের রান্নাই খেতে হবে আমার। “

আরিফ কায়সার আড়চোখে নিজের পিতাকে দেখে নিয়ে বোকার ন্যায় বলে উঠে,

“ কিন্তু আব্বা টুনির মা’র হাতের রান্না তো খারাপ না। বেশ ভালোই তো রান্না করে! “

আলী আকবর সাহেব খেকিয়ে উঠে ছেলের উদ্দেশ্যে,

“ আহাম্মক! টুনির মা আর ঘরের বউ কি এক হলো? টুনির মা যে-ই রান্না করে দিয়ে যায় সেটা টাকার বিনিময়ে দায়বদ্ধতা থেকে। কিন্তু ঘরের বউ থাকলে সেই রান্নায় দায়বদ্ধতার স্বাদ থাকতো না। বরং সংসারের প্রতি পরম স্নেহ, মায়া, মমতা নিয়ে করা রান্নার স্বাদ পাওয়া যেতো। “

আরিফ কায়সার এবার কিছুটা মিইয়ে যায়। তবুও বলেন,

“ আব্বা, মননের বয়স তো এখনো কম। ওকে আপাতত বিয়ের প্রেশার দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? হসপিটালের প্রেশারেই ছেলেটা দম ফেলার সুযোগ পায় না। ও যেহেতু এখন চাচ্ছে না, সেহেতু আমরা অপেক্ষা করি। সঠিক সময় এলে অবশ্যই বিয়ে হবে। “

আলী আকবর সাহেব আর কথা বাড়ান না। নিজের ছেলে এবং নাতিকে ঘরে সংসারের জন্য একটা বউয়ের তাৎপর্য বুঝাতে বুঝাতে তিনি ক্লান্ত। আজ প্রায় এক দশকের অধিক সময় ধরে এই সংসারের হাল ধরার জন্য বাড়িতে কোনো নারী নেই। অথচ একটা সংসার এবং পরিবারকে বেঁধে রাখার কলাকাঠি থাকে ঘরের বউয়ের হাতে। আলী আকবর সাহেব এবার ক্লান্ত গলায় বলে উঠে,

“ যা ভালো মনে হয় করো তোমরা। কিন্তু মনে রেখো সময় কারো জন্য বসে থাকে না। দেখা গেলো এই ব্যস্ততার অযুহাত দিতে দিতে একটা সময় গিয়ে তোমার ছেলে বিয়ের জন্য আর ভালো পাত্রী খুঁজে পাবে না। “

__________

ধূসর রঙের টি শার্ট এবং কালো রঙের ট্রাউজার পরিহিত মননকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। নিজ রুমে প্রবেশ করেই দরজা চাপিয়ে এসি অন করে দেয় সে। আর দশটা সাধারণ বাঙালি ছেলের ন্যায় সকলের সাথে মিলে এতক্ষণ কসাইয়ের কাজ করেছে সে। যদিও গোস্ত কাটাকাটির কাজটা ফ্ল্যাটের পার্কিং এরিয়াতেই সম্পাদিত হয়েছে। তবে সরাসরি রোদের নিচে না থাকলেও, ভ্যাপসা গরমের উত্তাপে ঘেমে নেয়ে তার বিশ্রী অবস্থা হয়ে গিয়েছে।

মনন বিছানায় বসে চোখ থেকে চশমা খুলে সেটার গ্লাস পরিষ্কার করতে করতে জিড়িয়ে নিচ্ছিলো। গায়ের ঘামটা শুকিয়ে গেলেই সে আরেক দফা গোসলের জন্য যাবে। আচমকাই মননের কিছু একটা মনে পরলো। মনে পরতেই সে চমকালো।

ওই মেয়েটা, মোহ! মননের কি উচিত হবে মোহকে কল করে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো? এইটা সত্য যে মনন গুড ম্যানার্স মেনে চলা পুরুষ মানুষ। তবে ওই মেয়ের সাথে এই গুড ম্যানার্স পালন করার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি-না সেটা নিয়ে মনন দ্বিধাগ্রস্ত। সে চাইলেই পারে মোহকে ঈদ মোবারক জানানোর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে। কিন্তু মোহ যদি ওদিকে অপেক্ষা করে বসে থাকে?

ঈদের দিন একটা মানুষের অপেক্ষা দীর্ঘ করা অনুচিত বলে মনে হয় মননের। তাই সে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে কন্ট্যাক্ট লিস্টে যায়। মোহর ওদিন লিখে দিয়ে যাওয়া নাম্বারটা মনন অজানা কারণে নিজের ফোনে সেভ করে রেখেছে। ইংরেজিতে M O H O লেখা নাম্বারটাতে মনন কল করে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে।

বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর কলটা রিসিভ হয়। ঘুম জড়ানো একটা মেয়ে স্বর বলে উঠে,

“ ঈদ মোবারক ডক্টর। “

মনন চমকায়। মোহর কাছে তো তার নাম্বার নেই। তাহলে ওই মেয়ে কিভাবে বুঝলো যে মনন কল করেছে? মনন কিছু জানতে চাইবে তার পূর্বেই মোহ বলে উঠে,

“ আমার ব্যক্তিগত নাম্বার খালি তেরো জন মানুষের কাছে আছে। ওই তেরো জন বাদে আর কখনো কোথাও নিজের নাম্বার শেয়ার করা হয় নি। তাই আননোন নাম্বারটা যে আপনার এটা বুঝতে রকেট সাইন্সের প্রয়োজন পরে নি। “

মনন আর এই ব্যাপারে কথা বাড়ায় না। বরং যেই উদ্দেশ্যে কল দিয়েছিলো ছোট করে সেটা জানায়,

“ ঈদ মোবারক। আপনি ঘুমান তবে। আল্লাহ হাফেজ। “

“ আরে! আরে! আমি তো করার মতো কিছু পাচ্ছিলাম না দেখে রুমে মরার মতো পরেছিলাম। এখন তো আপনি আছেন। বলেন তারপর কি করলেন সকাল থেকে? “

মনন আরেকবার দ্বিধায় পরে যায়। সকাল থেকে সে কি কি করেছে সেসব জানানোর মতো সম্পর্ক তো তাদের মাঝে নেই। তাদের মাঝে অবশ্য কিছুই নেই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে এই মেয়ে এতো প্রশ্ন করছে? মনন উত্তর খুঁজে পায় না। নিজের মনের উত্তর খুঁজে পেতে অপারগ হয়ে সে মোহর প্রশ্নেরই উত্তর দেয় ধীর ভঙ্গিতে।

“ ঘুম থেকে উঠলাম, নামাজে গেলাম, বাড়ি ফিরে নাস্তা খেলাম, এতক্ষণ নিচে কুরবানির কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, মাত্র রুমে ফিরলাম। এই আরকি। “

মোহ আগ্রহী গলায় বলে,

“ ওয়াও! আপনিও কতকিছু করলেন সারাদিন। আমি জানেন কি করেছি? ঘুম থেকে উঠেছি, মশলা কম দিয়ে পাকানো ডিমের ঝুরা ভাজি দিয়ে রুটি খেয়েছি আর তারপর সোজা রুমে এসে দরজা লাগিয়ে শুয়ে আছি। নিচে আন্টি চুলায় মাংস বসিয়েছে। দরজা লাগিয়ে রাখা সত্ত্বেও মাংসের গন্ধে চারিদিক মৌ মৌ করছে। আমি এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কোনটা বেটার অপশন? পছন্দের খাবার না খেয়ে বেঁচে থাকা না-কি তৃপ্তি নিয়ে পছন্দের খাবার খেয়ে মরে যাওয়া? কারণ দিনশেষে তো সবারই মরতে হয়। “

মনন আঁতকে উঠে ব্যস্ত গলায় বলে,

“ ভুলেও না। মোহ লুকিয়ে ওসব খাবেন না ভুলেও। ক্ষতি হবে আপনার। প্লিজ রিমেম্বার, রেড মিট আপনার জন্য বিষ। “

মোহ মুখ ভেংচি কেটে বলে,

“ বিষ যদি মজার হয় সেটা কি আমার দোষ? মূলা, পটল, কাকড়ল এসব যদি বিষ হতো তাহলে আমার কোনো অসুবিধাই ছিলো না। খুশি খুশি আমি ওইসব সবজিকে তালাক দিয়ে দিতাম। কিন্তু গরুর গোস্তকেই কেন হানিকারক হতে হবে? এসব নিষ্ঠুর নিয়ম কে আবিষ্কার করেছে? “

“ যেই আবিষ্কার করুক না কেন সেটা জরুরী নয়। জরুরী হচ্ছে আপনার ডায়েটেশনের কথা মেনে চলা। ডু ইউ গেট দ্যাট? “

মোহ মুখ লটকে বলে,

“ আপনি আমাকে যা কিছু বলছেন এগুলো কি ফ্রি তে বিলানো জ্ঞান নাকি এর জন্য ফি রাখবেন আলাদা করে? ফি লাগলে আব্বুর সাথে যোগাযোগ করুন। আমি গরীব। টাকা পয়সা নেই। আর থাকলেও সেটা আপনার এমন অসহ্যকর জ্ঞানের পিছনে খরচ করতে রাজি না। “

মনন লজ্জায় পরে যায়। মাথা নেড়ে বলে উঠে,

“ আমি জাস্ট এভাবেই বলছিলাম। আপনার কথা ভেবে। ফি এর প্রয়োজন নেই। “

মোহ কথার প্রসঙ্গ বদলে বলে,

“ জানেন, আপনার ওই টোটোস্কোপ আছে না? ওটা আমি সামলে রেখেছি। কাউকে এখনো দেখাই নি। হাজারটা প্রশ্ন করবে। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে ওই টোটোস্কোপ নিয়ে গিয়ে দাদুর হার্টবিট চেক করি। এত্তো ইন্টারেস্টিং লাগে ব্যাপারটা! আপনি কি টোটোস্কোপ দিয়ে সবার হার্টবিট শুনতেই ডক্টর হয়েছেন? আমিও কি চাইলে হতে পারবো? আমি সব সাবজেক্টে খারাপ হলেও ইংরেজি আর আইসিটি ভালো পারি। ওই দুটো এনাফ হবে না? “

মনন কিছু বলতে নিবে ঠিক সেই মুহুর্তে তার রুমের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে আলী আকবর কায়সার। নাতিকে দেখে নাক মুখ কুচকে তিনি বলে উঠেন,

“ রুমে এসে গোসল না করে বসে আছো কেনো? গা থেকে গোবরের গন্ধ আসছে তোমার। ওয়াক! আমার পেট গুলিয়ে বমি পাচ্ছে। দেখতেও তো এলাকার গরু চোরের মতো লাগছে। তাড়াতাড়ি যাও। গোসল করে আসো। টুনির মা’য়ের রান্না প্রায় শেষ। একসঙ্গে খেতে বসবো। “

কথাটুকু বলেই আলী আকবর সাহেব ঠিক যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই হনহনিয়ে চলে যায়। মনন থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে। দাদুর এরকম বিব্রতকর কথাবার্তা শুনে সে অভ্যস্ত। কিন্তু দাদু কি একবারও খেয়াল করলো না যে মনন কানে ফোন চেপে রেখেছে? মোহ? ওই মেয়ে কি দাদুর বলা কথাগুলো শুনে নিলো? মনন আমতা আমতা করে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই ফোনের অপর পাশ হতে মোহ মুখ বিকৃত করে বলে,

“ ছিইইইইই! গোবর? আপনি গোসল না করে গোবরের গন্ধ গায়ে মেখে ঘুরছেন? এই হলো আপনার রিয়েলিটি? ডক্টররা এতো খাচ্চোরও হয়? “

মননের আর কিছু বলার থাকে না। পবিত্র ঈদের দুপুরে তার পবিত্র ইজ্জতের গায়ে চুনকালি মেখে দিয়ে গিয়েছে তার দাদু। আর এই নাক ছিটকানো মেয়েটা এখন ঢাকে ঢোলে বারি দিয়ে সেই চুনকালির খবর পারলে নিউজ চ্যানেলে টেলিকাস্ট করবে। মনন কলটা কাটার আগে কেবল দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ নাম্বার সেভ করার হলে ঠিকঠাক নাম লিখে সেভ করবেন। M O N O N ওকে? মদন কিংবা মরণ লিখবেন না। আর যদি এন এর জায়গায় ডি কিংবা আর বসানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে নাম্বারই সেভ করার প্রয়োজন নেই আপনার। “

কথাটুকু শেষ হতেই ফোনটা কেটে গেলো। মোহ বালিশ থেকে মাথা তুলে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আজব তো! লোকটা রেগে গেলো কেন? মোহ চুপচাপ নাম্বারটা সেভ করে ফোনটা ফেলে রাখে। মনন লিখে নি সে। মদনই লিখেছে। এই নামটাই ওই লোকের জন্য উপযুক্ত। মদনা কোথাকার!

__________

গোসল সেড়ে দুপুরের খাবার খেতে বসতে বসতে মননের প্রায় সাড়ে তিনটা বেজে গেলো। খাবার টেবিলে আলী আকবর কায়সার এবং আরিফ কায়সারও উপস্থিত আছেন। উনারা ইতিমধ্যে খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। খাওয়ার মাঝে মাঝে টুকটাক বিভিন্ন ব্যাপারে আলাপও সাড়ছেন।

মনন প্লেট নিয়ে টেবিলে বসতেই দেখলো ঈদের দিনের দুপুরের খাবার হিসেবে টুনির মা বেশ কিছু আইটেমই রেধে রেখে গিয়েছেন। যেমন – পোলাও, গরুর গোস্ত, গরুর কলিজা ভুনা, সালাদ, চিংড়ি মাছ ভুনা। মনন নিজের প্লেটে পোলাও এবং সালাদ তুলে নিয়ে যে-ই না গরুর গোস্ত নিতে নিবে ঠিক সেই মুহুর্তে তার মনে পরে যায় মোহর কথা। না চাইতেও তার মন ভেবে বসে ওই মেয়েটার বাসায়ও এসব কিছু রান্না হয়েছে আজ। খাবারগুলো মোহর পছন্দের। কিন্তু খেতে পারছে না। আর না কখনো খেতে পারবে। যতই বুঝ দেক না কেনো মনন, ওই মেয়ে নিশ্চয়ই মন খারাপ করে বসে আছে? এই সামান্য বিষয়টা মননেরও আচমকা মন খারাপ করে তুলে। হুট করেই তার মাংস দিয়ে পোলাও খাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেলো। সে চুপচাপ শুধু চিংড়ি তুলে নেয় নিজের প্লেটে। সেটা দিয়েই মেখে পুরোটা পোলাও খেয়ে নেয়। আরিফ কায়সার ব্যাপারটা লক্ষ্য করতেই ছেলেকে প্রশ্ন করে,

“ মাংস নিচ্ছো না কেন? “

মনন প্লেট হাতে উঠে যেতে যেতে জবাব দেয়,

“ ইচ্ছে করছে না খেতে। “

আলী আকবর কায়সার এবং আরিফ কায়সার দু’জনই চমকায়। কুরবানীর রান্না করা গোস্ত তো মনন খুব তৃপ্তি নিয়ে খায়। আজ হঠাৎ কি হলো?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১৩

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৩.

এতদিন বাদে ঘরের মেয়ের হসপিটাল হতে ঘরে ফেরা উপলক্ষে শায়লা সকাল থেকে এলাহি কান্ড লাগিয়ে দিয়েছে। মোহর রুমটার প্রতিটা কোণা নিজ হাতে ঝেড়ে পরিষ্কার করেছে। স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণু মুক্ত করেছে প্রতিটা জিনিস। বিছানার চাদর, রুমের পর্দা, কার্পেট থেকে শুরু করে সব বদলেছে।

এসব কাজে উনাকে সাহায্য করেছে মায়াও। মোহ বাড়ি ফিরতে রাজি হয়েছে শোনার পর থেকে খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে আছে তার মন। ঘরদোর গোছানো শেষে শায়লা আন্টির সাথে রান্নাঘরে বসে সব রান্না দেখতে ব্যস্ত সে। বারবার করে বলে দিচ্ছে, কোন খাবারটা মোহ খেতে পারবে। কোন খাবারে কতটুকু মশলা দেওয়া যাবে।

শিং মাছ ভুনা, লাল শাক ভাজি, অল্প মশলা দিয়ে দেশি কবুতরের বাচ্চা, ছোট চিংড়ি দিয়ে কলমি শাক রান্না শেষ করতে করতে দুপুর প্রায় দুটো বেজে গিয়েছে। বাড়ির আঙিনায় গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনতেই মায়া দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বের হলো। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো মোহকে। তার পিছু পিছু ব্যাগ হাতে এগিয়ে আসছে শিহান।

মায়া এগোতে নিলেই শিহান কিছুটা রাগী গলায় তাকে সতর্ক করে,

“ মাত্র হসপিটাল থেকে ফিরেছে। গোসল করে আগে ফ্রেশ হতে দাও ওকে। আর ওকে জড়িয়ে ধরবে না ভুলেও। চাপ লেগে পোর্টে সমস্যা হলে? “

মায়া সাথে সাথে বাধ্য মেয়ের মতো পিছিয়ে যায়। সত্যি বলতে এক মুহুর্তের জন্য সে ভুলে গিয়েছিলো এভাবে মোহকে জড়িয়ে ধরাটা ঠিক হবে না। বুকে চাপ লেগে ব্যথা পেলে অসুবিধা হতে পারে। শায়লাও ততক্ষণে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। মোহকে দেখে প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ কতদিন পর বাসায় এসেছে আমার আম্মু! “

মোহ কিছুটা ক্লান্ত বিধায় তেমন একটা কথা বলছে না। কেবল ক্ষীণ হাসে। শিহান তাড়া দিয়ে বলে,

“ শায়লা আপা, ওষুধের সময় হয়ে গিয়েছে ওর। আগে তাড়াতাড়ি গোসল সেড়ে এসে খেয়ে নিক। খেয়ে রেস্ট করার পর ওর সাথে গল্প করবেন। “

শায়লা এবং মায়া আর মোহকে আটকায় না। মোহ সরাসরি উপরে নিজের রুমে চলে যায়। শিহানও তার পিছু পিছু আসে। ব্যাগটা রুমের এককোনায় রেখে সে তাকায় মোহর দিকে। মোহ তখন নিজের রুম দেখতে ব্যস্ত৷ কি পরিপাটি করে গোছানো! যদিও বেশিক্ষণ রুমের নকশা এরকম থাকবে না। কয়েক ঘন্টার মাঝেই মোহ এই রুমের চিত্র বদলে দিবে অগোছালো করে। তবুও নিজের রুমে এতদিন পর ফিরে তার ভালো লাগা কাজ করছে খুব।

শিহান ব্যাগ থেকে ওষুধের বক্স, মেডিক্যাল ফাইল সহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বের করে দিতে দিতে বলে উঠে,

“ ব্যাগের কাপড়চোপড় ধরো না আর। ওগুলো ধুতে দেওয়া হবে সরাসরি। আর আমি পানি রেডি করে দিয়ে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি গোসল করে নিচে আসো। “

মোহ অবাক নয়নে দেখতে থাকে নিজের বাবাকে। শিহান একটা লিকুইড মেডিসিনের বোতল হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মোহও পা টিপে টিপে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়ায়। দেখে কিভাবে তার বাবা ধৈর্য্য সহকারে দাঁড়িয়ে বালতিতে দুই কল ছেড়ে ঠান্ডা এবং গরম পানি ভরার অপেক্ষা করছে। বালতি পানি ভর্তি হতেই শিহান মেডিসিনের বোতল হতে ঢাকনায় মেপে দুই ঢাকনা সমান ওষুধ মেশায় সেই পানিতে। এই জিনিসটা মোহর কেমোথেরাপির ডক্টর সাজেস্ট করেছে। ইনফেকশনের দায় এবং জীবাণু এড়ানোর জন্য এই মেডিসিন পানিতে মিশিয়ে গোসল করাটা বেশ কার্যকরী। মোহ একটুও বাঁধা দেয় না। গত কয়েক দিন ধরে বাবার এসব নীরব যত্ন সে খুব উপভোগ করছে। মনে হচ্ছে জীবনে প্রথমবারের মতো সে বাবার স্নেহ পাচ্ছে। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগে মোহর, বাবার এই স্নেহটা পাওয়ার জন্য কি মোহর অসুস্থ হওয়া খুব জরুরী ছিলো?

__________

দুপুরের খাবার সেড়ে ওষুধপত্র খেয়ে রুমে ফিরে এসি ছেড়ে বিছানায় চিত পটাং হয়ে শুয়ে পরেছে মোহ। শুয়ে শুয়ে দেখছিলো নিজের রুমটা। ঠিক সেই মুহুর্তে রুমে প্রবেশ করে মায়া। ভেজা চুল দেখে বোঝা যাচ্ছে সে-ও কেবল গোসল করে এলো। মোহর পাশের বালিশটা দখল করে শুয়ে পড়ে সে বলে উঠে,

“ কাহিল লাগছে তোর? ঘুমাবি? “

“ হু। ঘুমাবো। বিরক্ত না করে এখন যা তো। “

মায়া অন্যদিকে পাশ ফিরে হাই তুলতে তুলতে বলে,

“ ঘুমালে ঘুমা। কে বিরক্ত করছে তোকে? আমার নিজেরও ঘুম পেয়েছে খুব। “

মোহ বুঝতে পারে মায়ার ফন্দি। এতদিন পরে তার বাড়ি ফেরা উপলক্ষে মায়া এখন সারাদিন চুইংগামের মতো তার সাথে চিপকে থাকবে। উপরে উপরে বিরক্তি প্রকাশ করলেও মনে মনে মোহ উপভোগ করে বিষয়টা।

এসির হাওয়ায় ঠান্ডা লাগছিলো বিধায় সে গায়ে কাথা টেনে নিতে উঠে বসে। পায়ের প্লাজুটা কিছুটা উপরে উঠে যাওয়ায় মোহর চোখ গিয়ে স্থির হয় নিজের পায়ের দিকে। টিউমারের জানান দিতে কিছুটা ফুলে ওঠা পায়ের জায়গাটা দেখতে এখনো একই রকম দেখাচ্ছে। ফোলা কিছুটা কমেছে বলে মনে হচ্ছে না মোহর। অবশ্য তার কেবল একটা সাইকেল সম্পন্ন হয়েছে কেমোর। টিউমারের আকৃতি ছোট হয়ে আসতে খুব সম্ভবত আরো চার কিংবা পাঁচটা সাইকেল সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন।

মোহ প্লাজু ঠিক করে পা ঢেকে ফেলে নিজের। কাথা টেনে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তার মনে পরে যায় দু বছরের পুরনো একটি দিনের কথা। মোহ যখন কেবল ক্লাস টেনে। সন্ধ্যায় পড়তে বসেছিলো সে। আচমকা তার পায়ের হাঁটুর কিছুটা নিচে ব্যথা অনুভূত হয়। খুবই সূক্ষ্ণ এবং চিনচিনে সেই ব্যথা। মোহ প্রথমে সাময়িক ব্যথা ভেবে পাত্তা না দিলেও ধীরে ধীরে ব্যথার পরিমাণ এবং ভয়াবহতা বাড়তে শুরু করে। পুরোটা পায়ে বিষের মতো ছড়িয়ে পরতে শুরু করে সেই মরণ ব্যথা।

মোহ টেবিল ছেড়ে বিছানায় এসে শোয়। মনে মনে ভাবে হয়তো তার চঞ্চলতা, দৌড়ঝাঁপই এই ব্যথার আসল কারণ। তবে যখন ব্যথাটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় তখন সে না পেরে চিৎকার করে কান্না করে উঠে। পাশের রুম থেকে ছুটে এসেছিলো মায়া। বোনকে বিছানায় কুকড়ে পরে কাঁদতে দেখে ভীত হয়ে পরেছিলো সে। দ্রুত দৌড়ে ডেকে এনেছিলো শায়লা আন্টিকে।

শায়লাও এসে মোহর অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কল করে শিহানকে জানায় ব্যাপারটা। শিহান তখন শহরের বাহিরে একটা কাজে ব্যস্ত ছিলো। সবটা শুনে মেয়ের দস্যিপনাকে দায়ী করে বলেছিলো,

“ আরও আশকারা দিয়ে মাথায় তুলুন ওকে আপনারা। আমি সাইকেল কিনে দিতে রাজি ছিলাম না। আপনারা জোর করে বলেছিলেন বলে দিয়েছি। সাইকেল পাওয়ার পর থেকে দিন-রাত এলাকায় সাইকেলে চড়ে বেড়ায়। অতিরিক্ত সাইকেল চালানোর ফলে বোধহয় মাংস পেশিতে চাপ পড়েছে। ওকে কিছু খাইয়ে পেইনকিলার খাইয়ে দিন। ঠিক হয়ে যাবে। “

শিহানের রাগী গলায় বলা আদেশ মেনে শায়লা মোহকে জোর করে দুটো বিস্কুট খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলো সেদিন। তবে অমানবিক ব্যথাটা নিজের তান্ডব চালিয়ে যায় রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত। মধ্যরাতে হয়তো ওষুধের প্রভাবে ব্যথার প্রকোপটা যখন কমে এসেছিলো তখন অশ্রুসিক্ত ক্লান্ত মোহ ঘুমিয়ে পরেছিলো।

তারপর? তারপর বেশ ক’দিন মোহ সম্পূর্ণ ঠিক ছিলো। আর কোনো অসুবিধা হয় নি। বাবার দায়ী করা সাইকেলটাকেও লম্বা সময় সে ছুঁয়ে দেখে নি। মনে মনে সকলেই ধরে নিয়েছিলো মাংস পেশিতে চাপের ফলেই সেই ব্যথার সূত্রপাত ঘটেছিল।

কিন্তু সেই ব্যথাটা আবার ফিরে আসে। মোহর তখন পরীক্ষা ছিলো। সে কি অসহনীয় ব্যথা! সারারাত না পড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলো সে। কোনো প্রস্তুতি ছাড়া। পরীক্ষার হলেও দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করে মোটামুটি এন্সার করে বেরিয়ে আসে সে।

বাবা তাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। বিভিন্ন টেস্ট করেও ডক্টর কোনো সমস্যা খুঁজে পায় না। ভিটামিনের অভাবের উপর চাপিয়ে দেয় ব্যথাটাকে। কিছু ভিটামিন এর সাপ্লিমেন্ট এবং পেইন কিলার ধরিয়ে দেয় মোহকে। এরপর থেকে প্রায়ই এক দু মাস অন্তর অন্তর ব্যথাটা এসে উঁকি মারতো। যখন ব্যথা হতো মোহর মনে হতো এই ব্যথার থেকে ভয়ংকর ব্যথা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। দুনিয়ার সকল যন্ত্রণাকে এই ব্যথার সামনে অতি নগন্য মনে হতো তার। তবে তখন মোহর কাছে একটা হাতিয়ার ছিলো। ডক্টরের সাজেস্ট করা পেইনকিলার। ব্যথা উঠলেই সে পেইন কিলার খেয়ে নিতো। পাঁচ ছয় ঘন্টা পর ওষুধটা ব্যথা দমাতে সক্ষম হতো।

এভাবেই চলছিলো মোহর দিনগুলো। এর মাঝে আরো বেশ কয়েকবার ভিন্ন ভিন্ন হসপিটালে ডক্টর দেখানো হয়। তবে কেউ-ই কোনো সমস্যা খুঁজে পায় না মোহর রিপোর্টে। অবশেষে আসে সেই দিন। মাস দুইয়েক আগের ঘটনা। একদিন গোসল করতে গিয়ে মোহ লক্ষ্য করে তার পায়ের একটা অংশে কিছুটা ফোলা দেখা যাচ্ছে। ঠিক সেই জায়গাটাতে যেখান থেকে তার ব্যথা শুরু হতো। মোহ হাতে ছুঁয়ে দেখলে অনুভব করে ভেতরে শক্ত কিছু একটা আছে।

সেদিন আর মোহর গোসল সম্পূর্ণ হয় না। সাবান পানি গায়েই জামা গায়ে জড়িয়ে দৌড়ে বের হয় ওয়াশরুম থেকে। শায়লা আন্টিকে ডেকে পা দেখিয়ে সব বলতেই শায়লা আন্টি বিস্ময়ের সাথে বলে উঠে,

“ টিউমারের মতো মনে হচ্ছে! “

সতেরো বছরের জীবনে প্রথম এই শব্দটার নাম শুনেছিলো সেদিন মোহ। অর্থ বুঝে নি। কারণ আগে কখনো এরকম কিছুর নাম সে শুনে নি। তবে এরপর টেস্ট করানোর মাধ্যমে সে টিউমার হতে ক্যান্সার পর্যন্ত যাত্রার সাথে পরিচিত হয়। দু’দিন আগ পর্যন্তও জ্বর, ঠান্ডা, এলার্জির বাহিরে অন্য কোনো রোগের নাম না জানা মেয়েটা মেডিক্যাল জগতের সবথেকে কঠিন একটা রোগের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। জানতে পারে এর খুটিনাটি ব্যাপার।

মোহ মাঝেমধ্যে খুব ভাবে। তার এই ভয়াবহ রোগটা কেনো হলো? কিছু একটা ভুল তো সে অবশ্যই করেছে, যেই কারণে এই রোগের সৃষ্টি। এই ব্যাপারে সে ডক্টরকেও প্রশ্ন করেছিলো। ডক্টরের জবাব, নিজের ঘাটাঘাটি এবং উপলব্ধি থেকে মোহ নিজের উত্তর খুঁজে পায়। ক্যান্সার হতে কোনো কারণ লাগে না। এতে কারো দোষ নেই, কারো অবহেলা নেই। যাদের ভাগ্যে এই মরণব্যাধি লেখা আছে তাদের হবেই। ভাগ্যের লিখন বদলানোর সাধ্য কারই বা আছে?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১২

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১২.

সেকেন্ড ইয়ারের মিড টার্ম পরীক্ষার ঝামেলা চুকিয়ে মায়ার মুক্ত বাতাসে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু মায়ার মাঝে সেরকম কোনো ভাব লক্ষণীয় নয়। বরং সে বিষণ্ণ মনে নদীর ধারের নিরিবিলি একটা জায়গায় বাঁশের পাটাতনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। গায়ে কলেজ ইউনিফর্ম দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে সে কলেজ থেকে বাসায় না গিয়ে সোজা এখানে এসেছে। নদীর মুক্ত বাতাসে গলার আইডি কার্ডটা উড়ে অনেকটা নিজ জায়গা থেকে সরে গিয়েছে। সেদিকে মায়ার খেয়াল নেই অবশ্য। সে আপন জগতে ডুবে আছে উদাসীন হয়ে।

আচমকা তড়িঘড়ি করে কেউ এসে তার পাশের জায়গাটা দখল করে বসতেই তার ধ্যান ভাঙে। কলেজ ইউনিফর্ম পরিহিত ঘর্মাক্ত যুবক তখন বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,

“ সরি রে। ফাহিমরা আটকে ধরেছিল। কোনো মতে ওদের থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি। পরীক্ষা কেমন হইসে তোর? এম সি কিউ সব ঠিকঠাক দাগাইতে পারসিস? “

মায়া উদাস গলাতেই জবাব দেয়,

“ হু। খারাপ হয় নি। এম সি কিউ হয়তো আঠারোটা হবে। বাকিগুলো শিওর না। “

শুভ্র সূক্ষ্ণ চোখে তাকায় মায়ার মুখের দিকে। মন খারাপের আবহাওয়াটা আঁচ করতে পেরে প্রশ্ন করে,

“ মোহকে মিস করতেসিস দোস্ত? “

মায়া যেনো এই প্রশ্রয়টুকুর অপেক্ষাতেই ছিলো। মন খারাপের পাতা খুলে বসে বলতে শুরু করে,

“ পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। ঈদ সামনে। রোজার ঈদের সময়ও তো ও সুস্থ ছিলো। অথচ এখন… ঈদের আমেজ পাচ্ছি না আমি। “

শুভ্র এবার মায়ার হাতের উপর এক হাত রেখে বলে,

“ এই ঈদটায় ও অসুস্থ বলে কি হয়েছে? পরের ঈদে দেখবি, ও একদম সুস্থ ঘুরে বেড়াচ্ছে। “

মায়া যেনো আশ্বস্ত হয় না এতে। বলতে থাকে,

“ ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে। ও দেখাচ্ছে না সেটা। কিন্তু আমি তো অন্ধ না, তাই না? “

শুভ্র এবার আরেকটু দৃঢ় করে মায়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

“ আমি জানি তো, তুই বুঝিস। সবাইকে বুঝিস তুই। আংকেলকে, মোহকে, আমাকে। তুই বুঝিস বলেই আমাদের তিনটা মানুষের জীবন এতটা সহজ। ইন শা আল্লাহ মোহ সুস্থ হয়ে যাবে। ওর সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডিল আছে ভুলে গিয়েছিস? আমাদের বিয়ের গেটে ওর শালিগত হক আদায় করা বাকি আছে আমার। আমাদের বাচ্চা কাচ্চা ওর কাছে রেখে আমাদের ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যাওয়াও বাকি এখনো। এসব টু ডু লিস্ট পূরণ করার জন্য হলেও ওকে সুস্থ হতে হবে। তুই শুধু মোহকে মেন্টাল সাপোর্ট দে একটু। ওর সামনে ভেঙে পড়িস না। যখন মনে হবে ভেঙে যাচ্ছিস, তাড়াতাড়ি তখন আমার কাছে এসে পড়বি। সুপার গ্লু, ফেভিকল দিয়ে আবার জোড়া দিয়ে দিবো। “

শুভ্রর বলা বাক্যের শেষটুকু শুনে মায়া না চাইতেও হেসে ফেলে। সেই হাসি দেখে শুভ্রও হাসে। পকেট হতে একটা বাদামে ঠাসা ঠোঙ্গা বের করে মায়ার সামনে ধরে। মায়া হাসতে হাসতেই বাদাম নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুভ্র নিশ্চুপ দেখে সে-ই দৃশ্যটা। সে জানে এই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। ক্ষানিক বাদেই মায়া আবার বিষণ্ণ হয়ে যাবে। যার আপনজন মরণব্যাধিতে ভুগছে তার হাসিখুশি থাকাটা অনেকটা অমাবস্যার চাঁদের মতো ব্যাপার।

__________

আজ সকাল থেকেই শিহান এবং মোহর মাঝে তুমুল তর্কাতর্কি চলছে। তর্কের বিষয়বস্তু হলো মোহর বাড়ি ফেরা নিয়ে। শিহান চাইছে মোহকে বাড়ি নিয়ে যেতে। তার কাছে মোহর হসপিটালে থাকার জেদটা অহেতুক মনে হচ্ছে। ডক্টরের সঙ্গেও এই বিষয়ে শিহান কথা বলেছে। ডক্টরও বলেছে হসপিটালে এডমিট থাকার কোনো প্রয়োজন নেই মোহর। সে চাইলে বাসা থেকে আসা যাওয়া করেই ডক্টর দেখানো, টেস্টের কাজ গুলো সম্পন্ন করতে পারে। আর প্রত্যেক মাসের কেমোর সময়টাতে না-হয় ৫ দিন ভর্তি থাকলো।

কিন্তু মোহ মোটেও রাজি হচ্ছে না। তার একটাই কথা সে বাসায় ফিরবে না। শিহান স্বভাবসলুভ বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ সামনের সপ্তাহে ঈদ। ঈদের দিন কি তুমি হসপিটালে থাকতে চাইছো? ঈদের আমেজটা নষ্ট করতে চাইছো? “

মোহ কিছুটা বিক্ষিপ্ত স্বরে বলে,

“ জোর করছো কেনো তুমি? তুমি বুঝতে পারছো না আমি কেনো বাসায় যেতে চাই না? আমি অযথা তোমাদের ঘাড়ে ঝামেলা হতে চাচ্ছি না। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও না কেনো? তোমাদের সবার এই চব্বিশ ঘণ্টা বেবি সিটিং করাটা আমার একটুও পছন্দ হচ্ছে না। “

মোহ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। জোরে কথা গুলো বলে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। দু একদিন ধরে অল্প কথাতেই রেগে যাচ্ছে সে। মেজাজ খুব খিটমিটে থাকে। হাই ডোজের কেমো এবং মেডিসিনের প্রভাব। শিহান তা বুঝতে পারে। মোহকে উত্তেজিত হতে দেখে বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত করে।

এই মুহুর্তে তার শান্ত থাকতে হবে। ঠান্ডা মাথায় মেয়েকে সামলাতে হবে। মোহর এভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়াটা ঠিক নয়। তার হার্টের অবস্থা বর্তমানে খুব নাজুক। উত্তেজনার ফলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

শিহান নিজের জড়তা, রাগ, শাসন সব একপাশে রেখে মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে মোহর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় শান্ত করার জন্য। মোহ সময় নেয়। ধাতস্থ হয়। ঠান্ডা হতেই ফের বলে,

“ আমি হসপিটালেই থাকবো। “

শিহান এবার গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলে,

“ বাবা হিসেবে কখনো কিছু চাই নি। প্রথমবার চাইছি। ঈদের দিনটা আমি আমার পুরো পরিবারকে একসঙ্গে বাসায় চাই। সকালে নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে দুই মেয়েকেই একসঙ্গে দেখতে চাই। আশা করছি আমার চাওয়াটা রাখবে। “

মোহর চোখ থেকে জেদ উবে যায়। অদ্ভুৎ দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। শিহান অবশ্য অপেক্ষা করে না। চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় মোহকে ভাবার সময় দিতে। তার যা করণীয় ছিলো সে তা করে ফেলেছে। তার বিশ্বাস মোহ নরম হবে। মুখে মুখে যতই জেদ দেখাক, মনের দিক দিয়ে তো তার মেয়ে নরম। শিহান জানে তা।

__________

রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশটা দেখছে মোহ। বহুকষ্টে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এখানে এসেছে সে। বাবাকে বলে কয়ে সুপারশপে পাঠিয়েছে জিনিসপাতির লম্বা লিস্ট সহ। সেসব কিনে শিহানের ফিরতে আধ ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা সময় লাগবে। এর আগে ওই ডক্টর আসবে তো?

মোহর অবশ্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মননকে দেখা গেলো দরজা দিয়ে ছাদে প্রবেশ করতে। গায়ে হসপিটালের অন ডিউটি পোশাক জড়ানো। মনন দূর হতে এগিয়ে আসতে আসতে মোহকে লক্ষ্য করে। আচমকা তার মনে হয় একটা বিষন্ন রাজকুমারী রাতের আঁধারে ওই দূরটায় দাঁড়িয়ে আছে। মননের অপেক্ষায়। মনন বোধ করে অদৃশ্য কিছু একটা সে অনুভব করছে।

মনন কাছাকাছি আসতেই মোহ হেসে বলে,

“ আরে! লং টাইম নো সি। “

মনন দূরত্ব রেখে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,

“ কাল রাতেই তো দেখা হলো। “

“ সেটাতো অলমোস্ট চব্বিশ ঘণ্টা আগের ঘটনা। “

মনন আড়চোখে লক্ষ্য করে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ শরীর কেমন? “

“ আপনার সামনে যেহেতু জিন্দা দাঁড়িয়ে আছি তারমানে একদম ফিট এন্ড ফাইন। “

“ দাঁড়িয়ে আছেন কতক্ষণ ধরে? “

“ পনেরো মিনিট হবে হয়তো। “

“ পায়ে ব্যথা করছে না? “

মোহ এবার ভ্রু কুচকে মননের দিকে তাকায়। মনন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মোহ আরেক কদম এগিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে মননকে দেখতে থাকে। অস্বস্তিতে কাট হয়ে মনন প্রশ্ন করে,

“ কি? “

“ আপনার কি আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে? “

মনন অবাক হয়। পরমুহূর্তে দ্রুত উত্তর দেয়,

“ এজ এ হিউম্যান এন্ড ডক্টর। এর থেকে বেশি কিছু না। অন্য কিছু ভাববেন না। “

মোহ ভেংচি কেটে বলে,

“ অন্য কিছু ভাবিও নি আমি। আপনি অন্য কিছু ভাবার মতো ম্যাটেরিয়াল না। আপনি অনেকটা আংকেল টাইপ ম্যাটেরিয়াল। বাচ্চাদের আংকেল টাইপ, ইউ নো! “

মনন বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকায়। এসব কি হচ্ছে? এতদিন দাদু তার ইজ্জত নিলামে তুলতো, আর এখন এই মেয়েটা তার ইজ্জতের পাকোড়া ভাজছে। মননের রাগ উঠে খুব। বিরক্ত হয় সে। কিন্তু তা প্রকাশ করে না। তার প্রকাশিত রাগ কখনো দাদুর উপর তেমন একটা প্রভাব ফেলে নি। এই মেয়েটার উপরও ফেলবে না। তাই রাগ করাটা অহেতুক হবে।

মোহ আচমকা প্রবল আগ্রহ নিয়ে মননের দিকে এগিয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার ঘাড়ে ঝুলানো বস্তুটা একটানে নিজের হাতে নিয়ে প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ ওয়াও! টোটোস্কোপ! “

আকস্মিক ঘটনায় মনন যতটা না অবাক হয়, তার থেকে বেশি অবাক হয় মোহর ভুল উচ্চারণ শুনে। সঠিক করে দিয়ে বলে,

“ টোটোস্কোপ আবার কি জিনিস? স্টেথোস্কোপ হবে। আগে কখনো দেখেন নি? “

“ দেখেছি বহুবার। কিন্তু কখনো হাতে নেওয়ার সাহস পাই নি। এখন সুযোগ পাওয়ায় মনের অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করে নিলাম। আপনার টোটোস্কোপ কি কিউট! আপনারা এইটা কানে লাগিয়ে কি শুনেন বাই দ্যা ওয়ে? আদৌ কিছু শোনা যায়? “

বলতে বলতে মোহ আগ্রহ নিয়ে স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে নিজের বুকের বাম পাশে তা চেপে ধরতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে তার মনে পরে বুকের ভেতরে থাকা পোর্টের কথা। ভুলভাল কিছু যদি সে করে বসে? তাই মোহ সেটা আর নিজের বুকে চেপে না ধরে সাদা এপ্রোনের উপর দিয়ে মননের বুকের বাম পাশে ধরে।

মোহ আগ্রহ, মনযোগ দিয়ে শুনছে প্রতিটা স্পন্দন। ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ। প্রতিটা স্পন্দন তাকে আরো কৌতূহলী করে তুলছে। মজা পাচ্ছে সে। কি স্পষ্ট পরিষ্কার একটা মানুষের হৃৎস্পন্দনের ধ্বনি তার কানে বাজছে! যেই লোকটা সবার হৃৎস্পন্দনের গতি মেপে থাকে তার হৃৎস্পন্দনের গতিবিধি মোহ মাপছে। কি অদ্ভুৎ চমৎকার ব্যাপার!

প্রবল আগ্রহে ভেসে যাওয়া মোহ তাকালো না, খেয়াল করলো না ডক্টরের সঙ্গিন পরিস্থিতি। অদ্ভুৎ কারণে হাসফাস করছে মনন। নিঃশ্বাস যেনো গলার কাছে আটকে আছে। এই মেয়েটা নির্বোধ হতে পারে। কিন্তু মনন তো নয়। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এক কদম পিছিয়ে যায়। মোহ হেসে কান থেকে স্টেথোস্কোপ খুলে নিজের গলায় ঝুলিয়ে বলে,

“ শুনলাম। অবস্থা তো ভালো না আপনার। বুকের ভেতর বেবি শার্ক গান বাজছে। “

বলেই মোহ হাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে তার চোখের কোণে পানি জমে যায়। মনন কিছু বলে না। নীরব থেকে অজান্তেই মোহকে প্রশ্রয় দিচ্ছে সে। মোহ হাসি থামিয়ে বলে,

“ এই! আপনার এপ্রোণ পাঁচ মিনিটের জন্য ধার দেওয়া যাবে? জাস্ট ফাইভ মিনিটের জন্য। “

মনন কপাল কুচকে প্রশ্ন করে,

“ মতলব কি আপনার? “

“ আরে দেন না। “

মনন মিনিট খানেক মোহকে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের এপ্রোনটা খুলে এগিয়ে দিতেই মোহ তা লুফে নিয়ে গাউনের উপর দিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয়। অত:পর কিছু না বলেই মননের চশমাটা একটানে নিয়ে চোখে পড়ে ডক্টরদের মতো গলা কিছুটা ভার করে বলতে শুরু করে,

“ এক্সকিউজ মি। শুনুন, আপনার উচিত নিঃশ্বাস না নেওয়া। আপনার কোনো ধারণা আছে আপনি যেই অক্সিজেন গ্রহণ করছেন সেইটা কতটা পলিউটেড? “

মনন মোহকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে নিজের চশমাটা কেড়ে নিয়ে চোখে পড়তে পড়তে বলে,

“ এইটায় পাওয়ার আছে। “

মোহ ফের হেসে বলে,

“ আপনার পাওয়ারওয়ালা চশমা আপনাকে মোবারক। বাই দ্যা ওয়ে একটা সত্যি কথা বলি? এই চশমায় না আপনাকে একদম নোবিতা টাইপ লাগে। একদম নার্ড। “

মনন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়ের কাছে তাকে একটা স্বাভাবিক মানুষ বাদে সবই মনে হয়, সেটা মননের বুঝা হয়ে গিয়েছে। মোহ এবার হাসি থামিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার আসলেই পা ব্যথা করছিলো কিছুটা। তাই কিছু না ভেবে রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। মনন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“ করছেন কি? “

“ পা ব্যথা করছে। “

মনন নিজেও এবার দূরত্ব রেখে রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে। মোহর বসার ধরন দেখে বলে,

“ পা এভাবে সোজা করে রেখে বসবেন না। মেঝে শক্ত। টিউমারটাও হাড়ের পেছন অংশে। চাপ লাগবে। বসার গেসচার বদলান। “

মোহ মননের কথা শুনে। পা ভেঙে এবার দ আকৃতিতে বসে সে। মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আমি আগামীকাল বাসায় ফিরে যাবো। “

মনন অবাক হয় কিছুটা। তবে স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ বাহ। ভালো তো। অনেকদিন ধরে হসপিটালে আছেন। বাসার এনভায়রনমেন্টটা মিস করছিলেন অবশ্যই। “

মোহ বলে,

“ ঈদ সামনে। বাবা চাচ্ছিলো ঈদটা সবাই একসাথে বাসায় উদযাপন করি। ইউ নো? বাবা এই প্রথমবার কিছু চেয়েছে আমার কাছে। ফেরাতে পারি নি। “

“ ভালো করেছেন। “

মোহ মন খারাপ করে বলে

“ কিন্তু ঈদের দিন সারাদিন বিফ রান্না চলবে বাসায়। আপনি জানেন আমি বিফের কতো বড়ো ফ্যান? ডাল গোস্ত তো আমার সবথেকে প্রিয়। চোখের সামনে সারাদিন বিফ দেখে নিজেকে কন্ট্রোল কিভাবে করবো? আই হেইট দিজ ডায়েট চার্ট। “

মননের খারাপ লাগে। তবুও বলে,

“ এইটা তো মানতেই হবে। শুধু ট্রিটমেন্ট চলাকালীন সময়ের জন্য না, ফুল লাইফ টাইমের জন্য। রেড মিট, সুগার এসব থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে আপনার এট এনি কোস্ট। কতটা ভয়ংকর ইফেক্ট ফেলতে পারে এগুলো আপনার উপর ধারণা আছে? বডির ভেতর ব্লু সেল ডেভেলপ করতে ভূমিকা রাখে এসব। “

মোহ আর কিছু বলবে তার পূর্বেই তার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে বাবার নাম্বার দেখতেই সে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিয়ে বলে,

“ বাবা কল করছে। খুঁজছে হয়তো আমাকে। যেতে হবে এখন। “

বলেই মোহ উঠে দাঁড়ায়। মননও দাঁড়ায়। মোহ গায়ের এপ্রোনটা খোলার আগে নিজের ফোন বের করে ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে। হাসিমুখে নিজের একটা সেলফি তুলে নেয়। পাশে মননকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠে,

“ একচুয়্যালি আমার ডক্টরের কস্টিউমে কোনো ছবি টবি নেই তো। তাই ছবি তুলে নিলাম। আপনিও তুলবেন? “

মনন সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলে,

“ না। আমি ছবি তুলি না। পছন্দ না। “

মোহ এপ্রোনটা মননের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ বুঝতে পেরেছি। নিজের আউটলুক নিয়ে ইনসিকিউরিটিসে ভুগেন আপনি। কিন্তু এতোটাও খারাপ না আপনি দেখতে। আই মিন একটু মদন টাইপ। কিন্তু চলে। “

মনন চোয়াল শক্ত করে বলে,

“ আমি কি একবারও বলেছি আমি নিজের ফেস নিয়ে ইনসিকিউরিটিসে ভুগি? “

মোহ পাত্তা দেয় না। বরং সরল গলায় বলে,

“ আপনার হাতটা এগিয়ে দিন তো। “

মনন ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কেন? “

“ অতিরিক্ত প্রশ্ন করা কি আপনার ডক্টরগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত? দিতে বলেছি দেন না। আমি আপনার হাত চুরি করবো না। “

মনন অজান্তেই নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দেয়। এপ্রোনের বুকপকেটে থাকা কলমটা মোহর হাতে রয়ে গিয়েছিলো। সেটা দিয়ে মোহ দ্রুত মননের হাতের তালুতে একটা এগারো ডিজিটের নাম্বার লিখে ফেলে। অত:পর কলমটা মননের হাতে ধরিয়ে বলে,

“ ঈদের দিন পরিচিতদের শুভেচ্ছা জানানো একটা গুড ম্যানার্সের মধ্যে পরে। আমার বিশ্বাস আপনি অত্য ম্যানার্সপূর্ণ মানুষ। ঈদের দিন কসাইয়ের ডিউটি শেষে আমাকে ঈদ মোবারক জানাতে ভুলবেন না। ভয় পাবেন না। আমি সালামি চাইবো না আপনার থেকে। “

বলেই মোহ দ্রুত পায়ে হেঁটে মননের সামনে থেকে চলে যায়। মনন দেখে তা। বিস্ময়তা চিরে সতর্ক করতে পিছন থেকে ডাকে,

“ আস্তে হাঁটুন। হাঁপিয়ে যাবেন… “

মননের পুরো কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মোহ ছাদের দরজা পেরিয়ে চলে যায়। মননের কথা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। সে একবার মোহর যাওয়ার পানে তাকায় তো আরেকবার নিজের হাতে লেখা নাম্বারের পানে। আচমকা কিছু মনে পড়তেই সে বলে উঠে,

“ আমার টোটোস্কোপ! “

মোহ মননের স্টেথোস্কোপ নিয়ে যাওয়ায় মনন যতটা না অবাক হয়েছে, তার থেকেও অবাক হয়ে যায় সে নিজে স্টেথোস্কোপকে টোটোস্কোপ উচ্চারণ করে। লক্ষ্মণ ভালো না। আজকে স্টেথোস্কোপকে টোটোস্কোপ বলে বসছে সে, আগামীকাল দেখা যাবে কাউকে নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় মননের জায়গায় মরণ কিংবা মদন বলে বসবে সে। মনন বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ কারেক্ট ইউরসেল্ফ মনন।
কারেক্ট ইউরসেল্ফ… “

চলবে…

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১১

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১১.

হসপিটাল জীবনের আজ মোহর পনেরো তম দিন। ঘুমটা ভাঙতেই সে দেখলো এক সম্পূর্ণ নতুন দৃশ্য। সতেরো বছরের এই ছোট্ট জীবনে এরকম দৃশ্য মোহ আগে কখনো দেখে নি। বাবা বেডের একপাশে হাত রেখে তার উপর মাথা ঠেকিয়ে ঘুমোচ্ছে। বাবা কি সারারাত এই অবস্থায়ই মোহর শিয়রে বসেছিলো? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই মোহ কিছুটা আপ্লুত হয়। হয়তো বাবার কাছে তার চাওয়া এতটুকুই ছিলো। মা হারা মেয়েটার মনের কোণে ছোট্ট চাওয়া হিসেবে বাবার সান্নিধ্যটাই কাম্য ছিলো আজীবন।

মোহ এবার তাকায় নিজের দু’পাশে। দুটো বালিশ দিয়ে কি সুন্দর তাকে অনেকটা ঘেরাও দেওয়া হয়েছে দু’পাশ থেকে। মোহর কাছে এই ব্যাপারটাও ভাল্লাগে। এই কাজটাও নিশ্চিত তার বাবা করেছে? মোহ কিছুটা জড়তা এবং সংকোচ নিয়ে শিহানকে ডাকতে নেয়। কিন্তু ডাকতে পারে না। এভাবে ডেকে বাবাকে কখনো ঘুম থেকে তুলে নি সে। ওসব তো মায়ার কাজ। সবার আম্মা সেজে বেড়ানোর অদ্ভুৎ শখ লালন করে ওই মেয়ে।

মোহ এক হাত বাড়িয়ে আঙুল দিয়ে শিহানের বাহুতে একটা গুতা মারে। শিহান জাগে না। মোহ আরেকবার একই কাজ করে নিজের হাত গুটিয়ে নেয়। এবার শিহান জেগে যায়। কাঁচা ঘুম ভাঙায় কিছুটা বিরক্তির রেশ তার কপাল জুড়ে। কিন্তু চোখ তুলে মেয়েকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই অস্বস্তিতে কাঠ হয়ে যায়। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে একাই বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ ওওও! সকাল হয়ে গিয়েছে! আমার মর্নিং ওয়াক করতে হবে। হসপিটালে বসে থেকে পেট বেড়ে যাচ্ছে। ওজন কমাতে হবে। “

আপনমনে কথা গুলো বলতে বলতেই শিহান কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। মোহ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে বাবার যাওয়ার পানে। এই হসপিটালে মর্নিং ওয়াক কিভাবে করবে? এটা কি তাদের বাড়ির ফ্রন্ট ইয়ার্ড নাকি?

__________

বিকেল বেলা তখন। মোহ বসে ফোনে গ্রুপ চ্যাটিং পড়ছিলো। তাদের বন্ধুদের একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। সেই গ্রুপে মায়া এবং মোহও আছে। সবাই মূলত আজকের পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর মেলাতে ব্যস্ত। মোহর সেখানে বলার মতো কিছু নেই। তাই সে নীরবে কেবল দেখছে। গ্রুপে মায়াকেও মোটামুটি সরব দেখা যাচ্ছে। এম সি কিউর উত্তর মিলিয়ে দেখা গেলো মায়া ২৫ এর মধ্যে ২৩ টা এম সি কিউ ই সঠিক দাগিয়েছে।

গ্রুপের অন্যতম সদস্য জান্নাত আচমকা প্রশ্ন করে বসে,

“ মোহ, তোর কি অবস্থা? পরীক্ষার জন্য তোকে দেখতে আসতে পারছি না। এই ভিডিও কলে আয় না। অনেকদিন তোকে দেখি না। “

জান্নাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো কয়েকজন একই কথা বলতে থাকে। ফিহা তো সরাসরি গ্রুপে ভিডিও কল দিয়ে বসে। মোহ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দ্রুত ফোনের ওয়াই-ফাই অফ করে ফোনটা কিছুটা দূরে বিছানায় পায়ের কাছে ছুড়ে মারে। সে এদের কাউকে ফেস করতে চায় না। খুব ইনসিকিউরড ফিল করে সে। ওরা যদি মোহকে নিয়ে আড়ালে মজা করে? মোহকে দেখতে যে ভয়ংকর লাগছে এটা নিয়ে যদি ঠাট্টা করে? কিংবা এমন কিছু যদি বলে বসে যেটা শুনে মোহর মনে কষ্ট জাগবে? উহু। মোহ এরকম কিছু চায় না। তাই তো সে ইচ্ছে করেই এদের ইগনোর করছে।

মোহর এরকম ভাবনার মাঝেই শিহান একজন নার্স সহ কেবিনে প্রবেশ করে। হাসি মুখে ট্রে হাতে প্রবেশ করা নার্সটা বলে উঠে,

“ গুড আফটারনুন মেহনামা! ইঞ্জেকশন দিতে হবে তোমাকে একটা। আজকে আমরা পোর্টের মাধ্যমে ইঞ্জেকশন দিবো। “

বলেই নার্সটা শিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ স্যার, আপনি একটু কেবিনের বাহিরে যান কাইন্ডলি কিছুক্ষণের জন্য। “

শিহান একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ বাহিরে যাবো? ভয় পাবে না তো? কান্নাকাটি করবে? “

মোহ মুহুর্তেই নিজেকে গম্ভীর দেখিয়ে বলে,

“ সবাই তোমার মতো ভীতু না। তুমি তো সামান্য তেলাপোকা দেখলেও এখনো লাফাও। আমি তোমার মতো ভীতু হই নি। “

শিহানের মুখটা থমথমে হয়ে গিয়েছে। হাঁটুর বয়সী একটা নার্সের সামনে তার মেয়ে উল্টো তাকেই নাস্তানাবুদ করে দিলো। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো শিহানের আরো ব্যক্তিগত ভয়ের ব্যাপার গুলো তার মেয়ে ফাঁস করে দিবে। সেরকম কিছু ঘটার পূর্বেই শিহান দ্রুত কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

নার্স হাসতে হাসতে মোহকে বলে,

“ সোজা হয়ে শুয়ে পড়ো। “

মোহ তা-ই করে। মনে মনে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে ভয় না পেতে। কিন্তু তবুও ভয় করছে তার। পোর্টের মাধ্যমে ইঞ্জেকশন নেওয়ার অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম। নার্স এসে আগে মোহর হসপিটাল গাউনের গলার কাছের দুটো ফিতা খুলে ড্রেসিংটা দেখে নেয়। পরপর নিজের হাত ভালো করে পরিষ্কার করে নেয় সে। ততক্ষণে আরেকজন নার্স এসে উপস্থিত হয়েছে রুমে। উনার কাজ হলো এক এক করে সব মেডিসিন এবং ড্রেসিং এর সরঞ্জামের প্যাকেট গুলো খুলে দেওয়া।

মোহ চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলে। এসব প্রসেস সে দেখতে চায় না। মুহুর্তেই সে টের পায় তার বুকের এখানের ড্রেসিংটা ধীরে ধীরে খোলা হচ্ছে। ঠান্ডা জীবাণুনাশক তরল দিয়ে সম্ভবত জায়গাটা পরিষ্কার করছে নার্স। তারপর আচমকাই মোহ অনুভব করলো উক্ত জায়গায় কিছু একটার মাধ্যমে তাকে তরল মেডিসিন ইঞ্জেক্ট করা হচ্ছে। মোহ কিছু দেখলো না। তবে অনুভব করলো তার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেনো। বুকের ভেতর অনুপ্রবেশকারী মেডিসিনটার অস্তিত্ব সে টের পেলো। সাধারণ ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো নয় এই অনুভূতি। খুবই ভিন্ন। আরো বেশি যন্ত্রণাময়। তবে মোহ বিড়বিড়িয়ে আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে পুরোটা যন্ত্রণা হজম করলো। কারণ সে জানে কেবিনের দরজার ওপারেই তার বাবা আছে। ওই মানুষটা, যার সামনে মোহ পুরো জীবন নিজেকে শক্ত দেখিয়ে এসেছে। ওই মানুষটার সামনে দূর্বল হওয়া মোহকে সাজে না। তীব্র লজ্জা, অস্বস্তি এবং আড়ষ্টতা কাজ করে তার মাঝে।

__________

তেরো তলায় সর্বশেষ পেশেন্টকে ভিজিট করে কেবল বের হলো মনন। করিডোর হয়ে লিফটের দিকে অগ্রসর হতে হতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে নেয় সে। অনলাইনে যেতেই নোটিফিকেশন বারে এক এক করে বিভিন্ন নোটিফিকেশন ভীড় জমাতে থাকে। এতো নোটিফিকেশনের ভীড়ে একটি নোটিফিকেশনে গিয়ে মননের দৃষ্টি স্থির হয়। দাদু তাকে মেনশন করে কিছু একটা পোস্ট করেছে। সেই পোস্টটা কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে মনন লিফটে উঠে দাঁড়ায়।

লিফটের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সে ফেসবুকে প্রবেশ করে। মুহুর্তেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। দু বছরের মননের ছবি। সদ্য গোসল করে বের হওয়া দু বছরের মননের ভেজা চুল গুলো একপাশে বিলি কেটে আঁচড়ানো হয়েছে। কপালের এককোণে দেখা যাচ্ছে কাজল দিয়ে আঁকা বৃত্তাকার চাঁদ। পুরো শরীরটা একটা তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো। মনন অনেকটা বিদ্রোহ করে সেই প্যাঁচানো তোয়াল ছেড়ে বের হতে চাইছে। ঠিক এমন সময় হাচ্চি আসার ফলে তার নাকে সর্দি দেখা যাচ্ছে।

কি লজ্জাজনক এবং বিব্রতকর একটা ছবি! মননের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। বুড়োটা তাকে আর শান্তি দিবে না। মননকে হাড়ে জ্বালিয়ে এই লোক কি মজা পায় তা মননের জানা নেই। সে কঠিন দৃষ্টি বুলিয়ে একবার আলী আকবর সাহেবের লেখা ক্যাপশনটা পড়ে নেয়।

“ My dearest grandson Wasif Kaiser Monon. My one & only. A picture of his golden childhood. “

দুই ঘন্টা আগে আপলোড দেওয়া ছবিটাতে ইতিমধ্যে ৩০০ এর অধিক রিয়েক্ট এসে পড়েছে। কমেন্ট সংখ্যা দেখাচ্ছে ১২৭ টা। মননের আর ধৈর্য্য হয় না এসব দেখার। সোজা ফোনটা অফ করে সে পকেটে ভরে নেয়। তার ইজ্জতের নিহারি বানিয়ে বুড়োটা হয়তো এখন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে খুব। মননের ইচ্ছে করছে মার্ক জাকারবার্গের কাছে বিশেষ আবেদন করতে যেনো আলী আকবর কায়সারের ফেসবুক ব্যবহারের লাইসেন্স ক্যান্সেল করে দেয়। তাহলে যদি একটু মনন স্বস্তি ফিরে পায়!

লিফট নির্দিষ্ট ফ্লোরে এসে থামে। দরজা খুলে যেতেই রাগের মাথায় মনন লিফট থেকে নেমে পড়ে। দেখার প্রয়োজন বোধ করে না কোন ফ্লোরে নেমেছে সে। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দু চারটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতেই ডাক শুনে,

“ আরে! বাচ্চাদের ডক্টর আপনি? “

মনন চমকে পাশ ফিরে তাকায়। দেখে একটা বেঞ্চিতে বসে থাকা মোহকে। পরপর সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় লিফটের দরজার পাশে লেখা ফ্লোর নাম্বারে। দশম তলায় নেমে পড়েছে সে ভুলবশত!

মোহ আবার ডাকে,

“ কি হলো? আপনি কি হারিয়ে গিয়েছেন? রাস্তা ভুলে গিয়েছেন? “

মনন লিফটের বাটনে ক্লিক করে মোহর পাশে এক সিট সমান দূরত্ব রেখে বসে পড়ে। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কেমন আছেন এখন? “

“ খারাপ তো ছিলাম না কখনো। ভালোই আছি। আপনার কি অবস্থা? “

“ আলহামদুলিল্লাহ। “

বলে মনন আশেপাশে তাকায়। লিফটের এই এরিয়াটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। সামনের করিডরে দু একজন পেশেন্টকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে কেবল। মনন প্রশ্ন করে,

“ কেবিন ছেড়ে এখানে বসে আছেন কেনো? “

“ ডিনার করেছি একটু আগে। খাওয়ার পরে রুমে বসে থাকতে অস্থির লাগছিলো। তাই একটু হাঁটাহাঁটি করতে এসেছিলাম। “

“ একা কেন? ফ্যামিলি কোথায় আপনার? নার্সকে ডেকে নেন নি কেন? “

“ বাবা একটু বাহিরে সুপারশপে গিয়েছে। এখনই এসে পড়বে। নার্সও ছিলো এতক্ষণ সাথে। আমি কিছুক্ষণ বসবো বলায় কাউন্টারের ওদিকে গেলো। বাবা আসলেই রুমে চলে যাবো। “

মনন আর কিছু বলতে পারে না। দেখে লিফট প্রায় এসে পড়েছে। সে উঠে দাঁড়াতেই মোহ বুঝতে পারে ভদ্রলোক প্রস্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে তাড়া নিয়ে বলে,

“ আপনি ছাদে যান প্রতিদিন? “

মনন কিছুক্ষণ চুপ থাকে। কি বলবে সে? সত্যটা নাকি মিথ্যাটা? মোহ অবশ্য উত্তরের অপেক্ষা করে না। নিজেই আপনমনে বলে উঠে,

“ আমি ছাদে যাওয়া মিস করি। পুরো হসপিটালে ওই একটা জায়গাই আমার পছন্দের। মন খুলে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। “

আরে! কি মিল! মননের বলতে ইচ্ছে করে,

“ আমিও ওই জায়গাটায় স্বস্তি খুঁজে পাই। “

কিন্তু সে সেরকম কিছু বলে না। লিফট এসে হাজির ততক্ষণে। দরজা খুলে গিয়েছে। মনন ধীর গলায় বলে,

“ খেয়াল রাখবেন। আসি। “

মনন লিফটে উঠতেই নিবে এমন মুহুর্তে মোহ পিছন থেকে বলে উঠে,

“ কেবিনে বসে থেকে আমি বিরক্ত। আগামীকাল ছাদে যাবো। রাতের মুক্ত বাতাস খেতে। “

কথাগুলো মননের কানে পৌঁছায়। তবে সে আর পা থামায় না কিংবা পিছনে ফিরে তাকায় না। পিছনে ফিরে তাকানোর মতো কোনো কারণ নেই তার কাছে।

চলবে…

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১০

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১০.

রাত তখন আড়াইটা প্রায়। ক্লান্ত মনন সহকর্মীদের সঙ্গে হতাশ ভঙ্গিতে আই সি ইউ থেকে বেরিয়ে এলো মাত্র। প্রত্যেকের মুখের অবস্থা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে এতক্ষণ আই সি ইউর ভেতর ছোট্ট পেশেন্টকে বাঁচানোর যুদ্ধে তারা হেরে গিয়েছে। বাচ্চাটা সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে পাড়ি জমিয়েছে অনন্তকালের জগতে।

মননের সহকর্মীরা একে অপরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে নিজেদের শান্তনা দিচ্ছে। মনন আই সি ইউর বাহিরে এককোনায় একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। চোখের চশমাটা খুলে মাথা নুইয়ে চোখ বুজে রেখেছে। তায়েফ নামক সহকর্মী এসে তাকে ডাকতেই চোখ তুলে তাকায়।

“ বাসায় যাবে না ওয়াসিফ? ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে। ঘুম প্রয়োজন। সকালে আবার ওপিডি আছে তোমার। না ঘুমালে আগামীকাল সারাদিন মাথা ব্যথায় ভুগবে। ”

মনন কেবল ক্লান্ত গলায় বললো,

“ তোমরা যাও। আমি আর আজ রাত বাসায় ফিরবো না। হসপিটালেই রেস্টিং রুমে ঘুমিয়ে নিবো। “

তায়েফ আর ঘাটে না। একে একে আই সি ইউ এরিয়াটা আবার নির্জনতা এবং নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়তেই মনন আবার মাথা তুলে। কি ভেবে যেনো চশমাটা চোখে পড়ে উঠে দাঁড়ায়। এন আই সি ইউ এরিয়ার ওদিকটায় হেঁটে যায় ধীর পায়ে।

মধ্যরাত হওয়ায় এন আই সি ইউ রুমটা মৃদু আলোয় আলোকিত। প্রত্যেকটা পেশেন্ট তখন ঘুমে নিমগ্ন। বাচ্চাদের ডক্টরটা নার্সদের কাউন্টার সেকশনে গিয়ে স্বাভাবিক গলায় জানতে চায়,

“ মেহনামা ফেরদৌস মোহ। ফাইল নং সি আর সিক্স জিরো নাইন সেভেন। বেড নম্বর কত? “

উপস্থিত নার্স পেশেন্টের তালিকা চেক করে জানায়,

“ বেড নং ফোর, স্যার। “

__________

মনিটরের সূক্ষ্ণ বিপ বিপ শব্দে মোহর চোখ মুখ কুচকে এলো। চোখ মেলে তাকাতে চাইছে সে কিন্তু মনে হচ্ছে চোখের পাতার উপর কয়েক মণ ভারী বস্তু যেনো রেখে দেওয়া। বহু প্রচেষ্টার পর সে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। শুরুতে চোখের সামনে সবটা ঘোলাটে এবং অস্পষ্ট মনে হলেও, ধীরে ধীরে সামনের দৃশ্যপটটা তার কাছে পরিষ্কার হয়।

বেডের ডানপাশে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে ডক্টর বেশের পুরুষটা। মনযোগী দৃষ্টি মোহর ফাইলের পাতায় স্থির। মুখের অভিব্যক্তি অনেকটা নির্লিপ্ত। মোহ সজাগ হয়েছে টের পেতেই ফাইল ছেড়ে মোহর দিকে দৃষ্টিপাত করে। সহজ গলায় প্রশ্ন করে,

“ কেমন ফিল করছেন? “

মোহ কিছুটা বিস্ময় এবং অবাক হয়ে দেখছে মননকে। প্রথমে ধারণা করে পুরো দৃশ্যটা তার কল্পনা। খুব সম্ভবত এনেস্থিসিয়ার প্রভাবে এই লোকটাকে দেখছে সে। কিন্তু যখন মোহ বুঝতে পারলো যে কল্পনা নয়, বরং মনন সত্যি সত্যি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তখন লজ্জা, সংকোচ, আড়ষ্টতায় অস্থির হয়ে উঠে। আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে ব্যস্ত গলায় বলে উঠে,

“ আমার স্কার্ফ! স্কার্ফ কোথায়? আমার… আহ! “

কথাটা উচ্চারণ করতে নিয়েও মোহ ব্যথায় চোখ বুজে নেয়। মনন স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে,

“ গলার নিচে এবং বুকের এখানে কাঁচা ঘা এবং সেলাই। বেশি কথা বলবেন না। কষ্ট হবে। “

মনন ভুল বলে নি। আচমকা কথা বলে উঠায় এইমাত্র সেলাইয়ে ক্ষাণিকটা ব্যথা অনুভব করেছে মোহ। কিন্তু আপাতত সেটা তার ভাবনার বিষয় নয়। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। ওই লোকটা… ওই ডক্টরটা তাকে ন্যাড়া মাথায় দেখে নিলো? এই কুৎসিত অবস্থায় লোকটা মোহকে দেখে নিলো, ভাবতেই মোহর তীব্র অস্বস্তিতে কান্না পাচ্ছে।

মনন সম্ভবত আন্দাজ করতে পারে বিষয়টা। সে মোহকে সহজ করতে বলে,

“ ইনসিকিউরড ফিল করবেন না। হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্টকে এই অবস্থায় দেখে অভ্যস্ত আমি। এন্ড ট্রাস্ট মি আপনাকে মোটেও কুৎসিত লাগছে না। “

মোহ অবশ্য মননের কথাটা বিশ্বাস করলো না। ডক্টরদের কাজই মিথ্যা শান্তনা দেওয়া। মোহ শান্তনায় ভুলে যাওয়া মেয়ে নয়। তীব্র অস্বস্তি নিয়েই সে বাম হাতটা তুলে ধীরে ধীরে নিজের গলার কাছে নিয়ে যায়। আলতো করে ছুঁয়ে দেখে গলার কাছের ব্যান্ডেজটা। হসপিটাল গাউনের ভেতর বুকের কাছের ব্যান্ডেজটাও সে অনুভব করতে পারছে স্পষ্ট। গলা থেকে হাতটা সামান্য নামিয়ে বুকের ডান পাশে ব্যান্ডেজটার এখানে রাখে। এইতো, ঠিক এই জায়গাটাতেই ব্যান্ডেজের ভেতর তার পাতলা ত্বকের নিচে প্রায় গোলাকার ওই বস্তুটার কিছুটা ভার টের পাচ্ছে সে।

মোহ বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে। অদ্ভুৎ অনুভূতি কাজ করছে তার মধ্যে। যেই অনুভূতির কোনো স্পষ্ট নাম তার জানা নেই। চিত্ত জুড়ে অনুভূতিটাও অদ্ভুৎ। মনন ফাইলটা জায়গা মতো রেখে দিয়ে বলে,

“ চিন্তার কিছু নেই। মাইনর সার্জারি ছিলো। মধ্যরাত বলে আপনাকে এখন কেবিনে শিফট করা পসিবল না। আগামীকাল সকালে ডক্টর এসে সামান্য চেক আপ করে গেলেই কেবিনে শিফট করে দেওয়া হবে। আপনি রেস্ট করুন। এনেস্থিসিয়ার কারণে মাথা ভার মনে হতে পারে। ঘুমিয়ে পড়ুন। কিছুটা ফুরফুরে লাগবে তাহলে। “

মোহ নিশ্চুপ দেখে মননকে। লোকটার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে এই লোকটা তারই ডক্টর। মোহকে তাকিয়ে থাকতে দেহে মনন ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কিছু বলবেন? কোনো অসুবিধা হচ্ছে? “

মোহ কিছুটা ধীর গলায় এবার জবাব দেয়,

“ সার্জারির কারণে দুপুর থেকে কিছু খাই নি। কিন্তু এখন খিদে পেয়েছে। এখন কিছু খাওয়া কি পসিবল? “

শুকনো মুখে বলা কথাটুকু শুনে মননের খুব মায়া হলো বুঝি। সে একবার দেয়ালের ঘড়ি হতে সময় দেখে নিয়ে বলে,

“ আপাতত তো পসিবল না। আর দু তিনটা ঘন্টা কষ্ট করতে পারবেন? ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে আপনার মিল টাইম দেওয়া দেখলাম। পেইনকিলারও তখন দেয়া হবে। “

মোহ আর কিছু বললো না। মনন উদাস মুখটা দেখে নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তবে পানি খেতে পারবেন চাইলে? তেষ্টা পেয়েছে? পানি আনাবো? “

মোহর আসলেই তেষ্টা পেয়েছিলো। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। মনন সঙ্গে সঙ্গে ইশারায় একজন নার্সকে ডেকে পানি আনতে বলে। নার্সটা পানির বোতল নিয়ে আসতেই মনন তাকে বলে,

“ উনাকে হেল্প করুন একটু। “

নার্সটা বেডের একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে মোহর পিঠের নিচে একহাত দিয়ে এবং অপর হাতে মোহর একটা হাত ধরে তাকে কিছুটা উঠে বসতে সাহায্য করে। নার্সের সাহায্যে বসার জন্য মাথা তোলার চেষ্টা করতেই মোহ ব্যথায় আরো এক দফা চাপা আর্তনাদ করে উঠে। চোখ মুখ খিচে রেখেছে সে। বুক এবং গলার সেলাইয়ে একসঙ্গে টান অনুভব করছে সে। সেই ব্যথাটুকু দম খিচে সহ্য করে নিয়েই তার উঠে বসতে হয়। সাপোর্ট দেওয়ার জন্য নার্স তাকে হাতের সাহায্যে পিছন থেকে আগলে রেখেছে। মনন বোতলের ছিপিটা খুলে মোহর মুখের সামনে ধরতেই মোহ আড়চোখে লোকটাকে একবার দেখে নেয়। পরপর সামান্য চুমুক দিয়ে কিছুটা পানি খেয়ে আবার গা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। মনে মনে সে ভালোই টের পাচ্ছে এই সেলাই শুকানোর আগ পর্যন্ত তার শোয়া থেকে ওঠা বসা নিয়ে ভালোই ভোগান্তি পোহাতে হবে।

নার্স চলে যেতেই মনন ফের প্রশ্ন করে,

“ আর কিছু প্রয়োজন? “

মোহ এবার নিচু গলায় বললো,

“ এই মনিটরটার আওয়াজ বন্ধ করা যায় না? “

“ না। “

উত্তরটুকু দিয়ে কিছুক্ষণ থেমে মনন আরো একবার প্রশ্ন করে,

“ আর কিছু? “

মোহ কিছুক্ষণ মননকে দেখে। চোখে অজানা আবেগের রেশ। দূর্বল গলায় বলে,

“ আরেকটা কম্বলের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? এসির টেম্পারেচার খুব লো। ঠান্ডা লাগছে খুব। “

মনন কোমল গলায় বলে,

“ নার্সকে বলে দিচ্ছি। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি এখন যাই। ওকে? “

মোহ অবাক হয়। লোকটা কি এইমাত্র তার কাছে অনুমতি চাইলো? নাকি মোহরই এমনটা মনে হলো? কে জানে! হয়তো মোহই বেশি ভাবছে।

__________

মায়া বুঝদার মেয়ে। মোহ আর বাবার মাঝে স্থান করা নীরব দূরত্ব সম্পর্কে সে অবগত। সেই দূরত্ব দূর করতেই সে একটা ফন্দি এঁটেছে। ইচ্ছে করে পরীক্ষার উছিলা দিয়ে দু একদিন হসপিটালে যাবে না বলে ঠিক করেছে। অথবা গেলেও বেশিক্ষণ থাকবে না সেখানে। মোহর খেয়াল রাখার ব্যাপারটা ইনিয়েবিনিয়ে বাবার কাঁধে চাপিয়ে দিবে। এতে মোহ সাময়িক অস্বস্তিতে পরলেও অন্তত স্থায়ীভাবে দু’জনের মাঝের এই দূরত্ব তো মিটবে!

যে-ই ভাবনা, সেই অনুযায়ী কাজে লেগে পরলো মায়া। সকাল সকাল বাবাকে কল করে জানিয়ে দিলো তার পক্ষে আজ হসপিটাল যাওয়া সম্ভব হবে না। পদার্থবিজ্ঞান ২য় পত্র পরীক্ষার জন্য তার খুব পড়তে হবে। আজকে যেনো শিহান মোহর সাথেই থাকে সারাদিন।

শিহান কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়। প্রথমত এটা ভেবে যে মোহ কম্ফোর্ট ফিল করবে কি-না তার উপস্থিতিতে। দ্বিতীয়ত তার কিছু পেন্ডিং কাজও আছে। সেগুলো শেষ করাটাও তার জন্য জরুরী। মনে জড়তা কাজ করলেও শিহান আর মানা করে না। রাজি হয়ে যায় মোহর সাথে থাকতে।

__________

তখন দুপুর প্রায় ১ টা বাজে। মোহর লাঞ্চ কেবল দেওয়া হয়েছে। মোহ আড়চোখে একবার সোফায় বসে থাকা বাবাকে দেখে। শিহান তখন ল্যাপটপে কাজ করতে ব্যস্ত। অফিসের কাজ গুলো অনলাইনের মাধ্যমে নিজের তরফ থেকে যতটা সম্ভব কাভার করার চেষ্টা করছে সে।

মোহ বাবাকে বিরক্ত করে না। নিজেই একা একা উঠে বসে। এতে কিছুটা কষ্ট হয় তার, তবে নীরবে সয়ে নেয়। নিজেই আগ বাড়িয়ে ফোল্ডেবল টেবিলটা নিতে নিবে এমন সময় শিহান পাশ ফিরে তাকায়। ল্যাপটপটা কোল থেকে রেখে এগিয়ে এসে নিজে টেবিলটা হাতে নিয়ে নেয়। মোহর সামনে টেবিলে দুপুরের খাবার গুলো সাজিয়ে রাখে নিজ হাতে। সম্পূর্ণ কাজটাই সে নীরবে করে।

মোহও কিছু বলে না। শিহান গিয়ে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে। মোহ মুখ লটকে চামচ দিয়ে ভাত তরকারি নাড়াচাড়া করে মুখে দিতে থাকে। এই হসপিটালে তার সবথেকে অপ্রিয় জিনিসই হচ্ছে এখানকার খাবার। একটা তরকারিতেও মনে হয় মশলা দেওয়া হয় নি। কেমন সাদা সাদা দেখতে সব। যেনো শুধু সিদ্ধ করে সোজা মোহর সামনে পরিবেশন করা হয়েছে।

মোহ খেতে খেতে মুখ বিকৃত করে ফেলে। শিহানের দৃষ্টি এড়ায় না তা। সে চোখ কুচকে প্রশ্ন করে,

“ খাবার নিয়ে ঢং করছো কেন? “

মোহ অভিযোগের সুরে বলে,

“ এইটা কোনো খাবার হলো? কি বিশ্রী খেতে! এতো টাকা দেওয়া হয়, তবুও এরা এতো বাজে খাবার দেয়। “

“ বাজে খাবার কোথায় পেলে? হেলথি আর মানসম্মত খাবারই দেওয়া হয়। আমি নিজে পারমিশন নিয়ে হসপিটালের কিচেন এরিয়া ঘুরে দেখেছি। যথেষ্ট সচেতনতার সাথে রান্না করা হয়। চুপচাপ খাও। “

মোহ যেনো কিছুটা প্রশ্রয় পেলো। চটপটে স্বরে বলে,

“ না টেস্ট করে এরকম বড় বড় কথা সবাই বলতে পারে। সাহস থাকলে টেস্ট করে দেখো। তারপর দেখো আমি ঠিক নাকি ভুল। “

শিহান কিছুক্ষণ চোখ ছোট করে মোহকে দেখে উঠে আসে। মেয়ের মুখোমুখি বেডে বসে শক্ত মুখে একটা চামচ হাতে তুলে নেয়। ভাতের সঙ্গে কিছুটা লাউয়ের ঝোল মেখে চামচ দিয়ে তা মুখে ভরে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিহানের দৃঢ় মুখভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। কিছুটা মিইয়ে গেলো যেনো সে।

এ কেমন তরকারি? লাউয়ের স্বাদ কোথায়? মরিচ গুঁড়ো কোথায়? হলুদ গুড়ো কোথায়? শিহান এবার লাউ ছেড়ে সজনে দিয়ে রান্না করা ডাল কিছুটা চামচে তুলে মুখে দেয়। টক দিয়ে ডাল খেয়ে অভ্যস্ত শিহানের মুখে এই ডাল খুব পানসে মনে হলো। আর কিছু খেলো না শিহান। উঠে চুপচাপ গিয়ে আবার সোফায় ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বসে পড়লো।

মোহ নীরবে পুরো দৃশ্যটা দেখে। বাবার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে হঠাৎই খুব হাসি পেলো তার। বাকিটুকু খাবার সে তৃপ্তি নিয়ে না খেলেও, হাসিমুখেই খেলো।

__________

তখন প্রায় মধ্যরাত। ল্যাপটপের স্ক্রিনে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জোড়া লাল হয়ে গিয়েছে শিহানের। তবুও সে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসে। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আগামী তিন দিনের জরুরী কাজ যতটা সম্ভব সে আগাম সম্পন্ন করে রেখেছে।

ল্যাপটপ অফ করে উঠে দাঁড়াতেই শিহানের চোখ যায় বেডের দিকে। মোহ তখন ঘুমোচ্ছে। গায়ের কম্বলটা হাঁটু পর্যন্ত টানা। শিহান এগিয়ে গিয়ে সেই কম্বলটা আরেকটু টেনে দেয়। সারাদিন স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখা মাথাটা এখন উন্মুক্ত। শিহান নিষ্পলক কিছুক্ষণ মেয়ের মুখটা দেখে। চেহারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। হাই ডোজের কেমো এবং ওষুধের প্রভাবে যেনো চোখের পলকেই আরো কয়েক কেজি ওজন হ্রাস পেয়েছে মেয়েটার। চেহারাতেও লেপ্টে আছে অসুস্থতার ছাপ।

শিহানের আচমকা মনে পড়ে নিজ স্ত্রী’র কথা। বিথী খুব শখ করে মেয়ে দুটোর নাম রেখেছিলো মোহ এবং মায়া। জন্মলগ্ন থেকেই দুই বোনের মাঝে মোহ তুলনামূলক একটু দূর্বল এবং অসুস্থ ছিলো। বিথীর নিজের শারীরিক অবস্থাও তখন ভালো ছিলো না। তবুও সারাদিন দূর্বল মেয়েটাকে বুকে মিশিয়ে রাখতো। মৃত্যুর মুহুর্তেও এই মেয়েটাই বিথীর বুকে লেপ্টে ছিলো।

শিহানের আচমকা মনে হয় বিথী হয়তো আগে চলে যাওয়াতে ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে। না-হয় আজ নিজ চোখে নিজের মেয়েকে এই অবস্থায় দেখলে সে সহ্য করতে পারতো না কখনো। মায়েরা নরম মনের হয়। নিজ সন্তানের অসুস্থতায় তাদের কলিজা ছিড়ে আসে। বাবাদের কিছু হয় না সেই ধারণাটা অবশ্য ভুল। চোখের সামনে সুস্থ সন্তানকে অসুস্থ অবস্থায় দেখাটা কোনো বাবার জন্যও সহজ নয়। তবুও এই কঠিন ব্যাপারটা বাবারা সহ্য করে। কাঠিন্যতার আড়ালে নিজেদের উদ্বেগটা লুকিয়ে রাখে। কারণ বাবারা এমনই হয়। এরকমই হয়।

শিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফা থেকে নিজের আরো দুটো বালিশ এনে মোহর হাতের দু’পাশে কিছুটা চেপে রেখে দেয়। যেনো বালিশের চাপে মোহ ঘুমের মাঝে কাথ না হয়ে যায়। ডক্টর বলেছে আপাতত কয়েকদিন একটু বুঝে শুনে ঘুমাতে। ঘুমের মাঝে গলা কিংবা বুকের সেলাইয়ে টান কিংবা চাপ লাগলে অসুবিধা হবে।

বালিশ দেওয়ার পরও শিহানের মনে খচখচানি ভাব রয়ে যায়। তার মেয়ের ঘুমের ধরণ সম্পর্কে তার ধারণা আছে। দেখা গেলো বালিশ জড়িয়ে ধরে উল্টো কাথ হয়ে গেলো! খচখচানি ভাব নিয়ে এভাবেও শিহান ঘুমাতে পারবে না। তাই একটা টুল টেনে বেডের ধারে বসে পড়লো সে। আর কয়েকটা ঘন্টাই তো! একটা রাতেরই ব্যাপার! একটা রাত না ঘুমালে শিহানের বিরাট কোনো লস হবে না। সারা রাত জেগে কাজ করতে জানা শিহানের জন্য, একটা রাত মেয়ের জন্য নাইট গার্ডের ডিউটি পালন করা কোনো ব্যাপারই নয়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০৯

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৯.

পি আই সি সি করানোর জন্য নির্দিষ্ট রুমে প্রবেশের পূর্বে শেষ বারের মতো মুখ কালো করে বাবা এবং বোনের দিকে তাকায় মোহ। শিহানের মাঝে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা গেলো না। মায়া কেবল হেসে বোনকে ইশারায় বেস্ট অফ লাক বললো। মোহ তাতে গলে না। উল্টো রাগে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মাথায় বাচ্চামো ইচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার। মন চাচ্ছে নিজের বাপ আর বোনকে ধরে বেধে দুই ডোজ গ্রাফিল ইঞ্জেকশন দিতে।

নিজের অবান্তর ইচ্ছাকে বালি চাপা দিয়ে মোহ সুস্থ পায়ে হেঁটে নার্সের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে প্রবেশ করতেই মোহ দেখে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন ফিমেল ডক্টর। হাতে মোহর ফাইল। কম্পিউটার স্ক্রিনে মনযোগের সহিত কিছু একটা দেখছে। গায়ে সার্জিক্যাল পোশাক জড়ানো। মোহকে দেখেই তিনি মিষ্টি হেসে বলে,

“ হাই মেহনামা। আর ইউ রেডি? “

মোহ মাথা নেড়ে সত্যটাই বলে। সে প্রস্তুত নয়। ডক্টরটা খুব মিশুক। এগিয়ে এসে মোহকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

“ কেউই রেডি থাকে না। কিন্তু এটা তো জরুরী। তুমি চিন্তা করো না, আমরা অনেক সাবধানে পুরো কাজটা শেষ করবো। ব্যথা হবে না বলছি না, তবে আমরা যতটা সম্ভব ব্যথা কম দেওয়ার চেষ্টা করবো। “

মোহ মিষ্টি কথায় ভুললো না। আর না বিশ্বাস করলো। লাস্ট বার এরকম কথা সে শায়লা আন্টির মুখে শুনেছিলো। মোহ তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। শায়লা আন্টি একদিন তাকে ভুলিয়ে ফুসলিয়ে বলে কান ফোঁড়ানোর কথা। মোহ প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরে ভয় পাচ্ছিলো। কিন্তু আন্টি তাকে হেসে বলেছিলো,

“ একটুও ব্যথা পাবে না তুমি আম্মু। সামান্য পিঁপড়ের কামড়ের মতো লাগবে। টেরও পারে না। “

আন্টির কথায় মোহ রাজি তো হয়েছিলো, কিন্তু কানের লতিতে সুঁচ প্রবেশ করতেই তার চিৎকারে দু বাড়ির মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে মোহ এসব মিছে আশ্বাসে ভরসা করে না আর। এদের বলা পিঁপড়ের কামড়ের অর্থ যে কি তা মোহ ভালো করেই জানে।

__________

পি আই সি সি প্রসিডিওরের রুমটা দুটো স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তর পেরিয়ে ভেতরে মোহকে নিয়ে যায় ডক্টর। সেখানে উপস্থিত আছে আরো তিনজন নার্স। এই রুমটা তুলনামূলক আরেকটু বেশি ঠান্ডা। হয়তো এসির তাপমাত্রা বেশি কমানো বলেই। তাছাড়াও পুরো রুমটা মাত্রারিক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় মোড়ানো। ইনফেকশন এড়ানোর সকল ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ডক্টর মোহকে ইশারা করে পেশেন্টের উঁচু বেডটা দেখিয়ে দিয়ে বলে,

“ তুমি ওখানে উঠে বসো। আমি হাত স্যানিটাইজ করে গ্লাভস পরে নিচ্ছি। “

মোহ চুপচাপ ভঙ্গিতে বেডটায় উঠে বসে। নার্স গুলো বেডের কাছে একটা টেবিলের উপর ট্রে তে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম গুলো চেক করে নিতে ব্যস্ত। মোহ সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে দেখে ট্রে তে থাকা সরঞ্জাম গুলো। বিভিন্ন গেজের সূঁচ, ১০ মিলি সিরিঞ্জ, ডিলেটর, ছোট ব্লেড, সেলাই করার সরঞ্জমাদি, ড্রেসিং কিট এবং মূল উপাদান পি আই সি সি ক্যাথেটর। মোহ সঙ্গে সঙ্গে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে। তার চোখের সামনে ভাসছে পুরো দৃশ্যটা। ওই পাইপটাকে কি-না এরা হাতের বেসিলিক, ব্র্যাচিয়াল, সিফালিক অথবা মধ্য কিউবিটাল শিরা হয়ে মোহর হৃদয় পর্যন্ত ঠেলেঠুলে পাঠাবে? এর থেকে তো টুপ করে মরে যাওয়া সহজ।

ডক্টর এগিয়ে আসে। নিজ দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত তিনি। বেডের মাথার কাছটায় থাকা আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। মোহর দিকে তাকিয়ে তিনি হাসিমুখে বলেন,

“ আগে তোমার হাতের বাহুর পরিমাণ নিতে হবে আমাদের। যেনো হাতে সোয়েলিং হওয়ার আশংকা কতদূর আন্দাজ করতে পারি। “

মোহ কিছু বলে না। একে একে পি আই সি সি প্রসিডিওরের ধাপগুলোর সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হতে থাকে সে। প্রথমে তার হাতের পরিমাণ মেপে নেওয়া হয়। অত:পর লাইন বসানোর জন্য কোন শিরা এক্সেস করা হবে তা শনাক্ত করতে আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করা হয়। অত:পর একটা মার্কারের সাহায্যে দাগ টেনে তার হাতের একটা জায়গা চিহ্নিত করা হয়। মোহ সবটা দেখে শান্ত ভঙ্গিতে।

ঠিক যেই মুহুর্তে সুঁই নিয়ে ডক্টর এগোতে নিবে সেই মুহুর্তে মোহ চোখ খিচে বন্ধ করে চিৎকার শুরু করে। ডক্টর, নার্স সকলেই অবাক হয়। একজন নার্স মোহকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বলে,

“ আরে! ভয় পেও না। এখনো তো সুঁই ব্যবহারও করা হয় নি। আগেই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছো তুমি। শান্ত হও… শান্ত হও। “

ডক্টরও মোহকে বুঝিয়ে বলে,

“ মেহনামা, আগেই কান্নাকাটি শুরু করো না। একটু কো অপারেটিভ হও। আমাকে আমার কাজ করতে দাও। “

মোহ শুনলো না কারো কথা। চোখ বুজে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো। ডক্টর ধরে নেয় মোহ ভয় পাচ্ছে বিধায় এভাবে কান্নাকাটি করছে। তাই তিনি বাধ্য হয়ে নার্সদের ইশারা করেন মোহকে একটু ধরতে। একজন নার্স এগিয়ে মোহকে ধরার চেষ্টা করতেই মোহ এবার হাত পা মুচড়িয়ে কাঁদতে থাকে। যেনো সে কিছুতেই এই পি আই সি সি করতে দিবে না।

ডক্টর তবুও বেশ অনেকটা সময় চেষ্টা চালায়। শেষমেশ হার মেনে কিছুটা রাগ দেখিয়ে মোহকে সরাসরি প্রশ্ন করে,

“ তুমি কি এটা করাতে ইচ্ছুক নও? “

মোহ অশ্রুসিক্ত চোখ মেলে তাকায়। মাথা নেড়ে জানায় সে রাজি নয়। ডক্টর কিছুটা রাগ নিয়ে মোহর সাথে আসা নার্সের হাতে তার ফাইলটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ ওর এখন কি করতে হবে সেটা ওর ডক্টর ভালো বুঝবে। তুমি সাক্ষী রইলে যে আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যদি পেশেন্ট কো অপারেট না করে সেই দায় আমাদের না। “

__________

নিজ কেবিনে হাসিখুশি মেজাজে বসে টিভি দেখছে মোহ। মায়া ভ্রু কুচকে তাকে দেখছে। শিহান এতক্ষণ রাগারাগি করে এইমাত্রই কেবিনের বাহিরে গিয়েছে। কিন্তু শিহানের রাগ কিংবা ধমক কোনটাই যেনো মোহর গায়ে লাগে নি। উল্টো তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তার থেকে বেশি খুশি কেউ নেই।

মায়া সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,

“ তুই ইচ্ছে করে ওখানে কান্নাকাটির নাটক করেছিস, তাই না? “

মোহ জবাব দেয় না। উল্টো মন দিয়ে টিভিতে ওগি এন্ড দ্যা কোক্রোচেস দেখে হাসতে থাকে। মায়া এবার উঠে গিয়ে টিভির প্লাগ খুলে ফেলে। মোহ রাগ হয়। ফুঁসে উঠে বলে,

“ কি সমস্যা তোর? “

“ আমাকে এই প্রশ্ন করছিস? আগে বল তোর মাথায় কি পাকাচ্ছিস? পি আই সি সি করতে দিস নি কেন? “

“ যেটায় আমার মন সায় দিচ্ছে না সেটা আমি কেনো করাবো? আজাইরা জ্ঞান দিস না তো। বাসায় যা। হসপিটালে এসে সারাদিন পড়ে থাকবি না। আমি বিরক্ত হই। “

মায়া মোহর কথা গায়ে মাখে না। সে চিন্তিত। কপালে ভাজ পড়েছে। দুঃশ্চিন্তায় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। মনে প্রশ্ন জাগছে এখন কি হবে?

মোহ বোনের দুঃশ্চিন্তা বুঝতে পারে। বোনকে শান্তনা দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,

“ টেনশন লেকে কা নেহি, দেনে কা হে। চিল ব্রো। “

__________

অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্টের অনকোলজিস্ট প্রফেসর মতিউর আলম। মোহর সামনে গম্ভীর ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন। এই লোকটাই মূলত মোহর কেস হ্যান্ডেল করছেন। বোন এবং সফট টিস্যুর কেসগুলো নিয়ে উনার অভিজ্ঞতা খুব দীর্ঘ সময়ের। হসপিটালের অন্যতম সিনিয়র এবং অভিজ্ঞ ডক্টর তিনি।

শিহান ফেরদৌস পাশ থেকে বলে উঠে,

“ ও অবুঝ। ট্রিটমেন্ট প্রসিডিওরের গুরুত্ব বুঝতে পারছে না। আপনি চিন্তা করবেন না ওকে রাজি করিয়ে ফেলবো আমরা। “

মতিউর আলম থমথমে গলায় বলে,

“ আমাকে পেশেন্টের সঙ্গে আগে কথা বলতে দিন। “

শিহান ফেরদৌস চুপ হয়ে যায়। মতিউর আলম এবার মোহকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ তুমি কি পি আই সি সি করাতে চাও না মেহনামা? “

মোহ কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে বলে,

“ গতরাত থেকে আমি সবাইকে এটাই তো বলে আসছি। আমি পি আই সি সি করাবো না। আমাকে যেনো কেউ জোর না করে। “

“ আচ্ছা। পেশেন্টের মর্জির বিপরীতে কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ট্রিটমেন্ট জার্নিতে পেশেন্টের কনসেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটা পেশেন্ট কোঅপারেটিভ হলেই, ডক্টরের জন্য ট্রিটমেন্ট করাটা আরো সহজ হয়। তাই এখন আমি তোমাকে ঠান্ডা মাথায় আরেকটা অপশন এক্সপ্লেইন করবো। মন দিয়ে শুনবে। তারপর ডিসিশন নিয়ে আমাকে জানাবে। “

মোহকে কিছুটা মনযোগী দেখায়। মতিউর আলম বলতে শুরু করেন,

“ পি আই সি সি র বিকল্প হিসেবে পোর্ট আছে। পি আই সি সি যেমন পেশেন্টের সজ্ঞানে করা হয়, পোর্টে সেই ঝামেলা নেই। এনেস্থিসিয়া দিয়ে চেতনাহীন করে তারপর একটা মাইনর সার্জারির মাধ্যমে এটা সেটাপ করা হয়। বায়োপসির মতো পনেরো থেকে ত্রিশ মিনিটের একটা প্রসিডিওর এটা। একটুও টের পাবে না তুমি। পি আই সি সি তে যেই লাইনটা হাতের শিরা হয়ে হার্টে সেটাপ করা হয়, পোর্টে সেটা অন্যভাবে সেটাপ করা হয়। তোমার ঘাড়ের এখানে এবং ব্রেস্টের হাড়ের কিছুটা উপরে দুটো ছোট কাট করা হবে। সেখান দিয়ে তোমার ত্বকের নিচে ক্যাথেটার প্রবেশ করানো হবে। একবার পোর্টটা সেটাপ করা হয়ে গেলে সেলাই বা সার্জিক্যাল আঠার মাধ্যমে কাটা জায়গাটা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে ড্রেসিং করে দেওয়া হবে। কেবল ব্লাড, ইঞ্জেকশন অথবা কেমো দেওয়ার সময় সেই ড্রেসিং ওপেন করে সরাসরি পোর্টের মাধ্যমে তোমাকে সেসব দেওয়া হবে। “

মোহকে কিছুটা ভাবুক দেখা যায়। আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে,

“ ব্যথা করবে খুব? “

মতিউর আলম বলেন,

“ বায়োপসি টেস্টের পর তোমার পায়ে যেমন স্বাভাবিক কিছুটা ব্যথা অনুভব করেছিলে সেরকমই। চিকিৎসা শেষ হয়ে গেলো সেম একটা মাইনর সার্জারির মাধ্যমে পোর্টটা বের করে ফেলা হবে। “

শাহিন ফেরদৌস এবার প্রশ্ন করে,

“ পোর্ট সেটাপের ফলে কি কি অসুবিধা হতে পারে ডক্টর? “

“ দেখুন অসুবিধা বলতে ইনফেকশনের রিস্কটাই আছে আরকি। এই কারণেই সকল ডক্টর এবং নার্সরা এই ব্যাপারে অধিক সচেতন থাকে। আর তাছাড়া আজীবনের জন্য ছোট দুটো সেলাইয়ের দাগ আপনার মেয়ের গলার নিচটায় এবং বুকের এখানে রয়ে যাবে। “

শিহান ফেরদৌস এই দফায় আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না। অপেক্ষা করে মেয়ের উত্তরের। মোহ কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকে। যেনো খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। মতিউর রহমান ক্ষানিক বাদে প্রশ্ন করে,

“ পোর্ট ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি করাতে আপত্তি আছে তোমার? “

__________

রাত তখন প্রায় একটা বাজে। কানের পাশ হয়ে মাথার পিছনে নিয়ে সার্জিক্যাল মাস্কের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে ব্যস্ত পায়ে হাঁটছে মনন। এই মধ্যরাতে আচমকা গুরুত্বপূর্ণ কল পেয়ে হসপিটালে ছুটে এসেছে সে। দ্রুত নিজের জামা বদলে হসপিটালের পোশাক পরে দ্রুত কদমে এসে পৌঁছেছে সিক্সথ ফ্লোরে। সে একাই নয়, তার ডিপার্টমেন্টের আরো বেশ কিছু ডক্টরও এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। সকলের মাঝেই তাড়াহুড়ো এবং চিন্তার ভাব ফুটে উঠেছে।

আজকেই মাত্র বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সম্পন্ন করা একটা বাচ্চা পেশেন্টের মাঝে আচানক জটিলতা ধরা পড়েছে। বাচ্চাটার শারীরিক পরিস্থিতি খুব সিরিয়াস। আই সি ইউ তে শিফট করা হয়েছে ইতিমধ্যে। তা-ই তো এই মধ্যরাতে কল পেতেই বাচ্চাটার কেস সামলাতে হসপিটালে এসে হাজির হয়েছে বেশ কয়েকজন পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজিস্ট অনকোলজিস্ট।

মনন যখন দ্রুত পায়ে আই সি ইউ র দিকে যাচ্ছিলো আচানক তার পা জোড়া থেমে যায়। কি ভেবে যেনো ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায়। মুহুর্তেই সে বিস্মিত হয়। কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া সোজা হয়ে যায়। ভুলে বসে নিজের তাড়া। কিন্তু তাকে সেই তাড়া মনে করিয়ে দিতেই তার সহকর্মী তাকে ডাকে,

“ বি ফাস্ট ওয়াসিফ। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০৮

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৮.

বাড়ির তিন পুরুষ আজ বসার ঘরে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেছেন। এই বৈঠকের ডাকটা মূলত আলী আকবর কায়সারই দিয়েছেন। দেশের মাটিতে পা রেখেই বুড়ো খুব চটেছেন। জরুরী তলবে নিজ পুত্রকে কল করে আদেশ করেন,

“ হতচ্ছাড়া কোথাকার! এই মুহুর্তে বাসায় ফিরো। তোমার ছেলেকেও কল করে বাসায় ফিরতে বলো। “

আলী আকবরের এহেন কড়া তলবের কারণেই আরিফ কায়সার এবং ওয়াসিফ কায়সার এই মুহুর্তে উনার সামনে উপস্থিত। মনন চশমা ভেদ করে বিচক্ষণ দৃষ্টি মেলে দাদুর মেজাজ মাপতে ব্যস্ত। আলী আকবর সাহেব নিজের স্মার্টফোনে একটা যুবকের ছবি বের করে আরিফ এবং মননের দিকে ধরে শুধায়,

“ চিনতে পারছো এই ছেলেকে? “

মনন এবং আরিফ সাহেব সূক্ষ্ণ চোখে ছবির মানুষটাকে দেখে। পরপর একই সঙ্গে বলে উঠে,

“ এটা তো সাকিব। “

মনন মাথা নেড়ে বলে,

“ চিনবো না কেন? বাপ্পি আংকেলের ছেলে, করিম দাদুর নাতি ও। “

আলী আকবর সাহেব থমথমে গলায় বলেন,

“ দেশে ফিরতেই আমাকে করিম কল করেছে। নিজের নাতির বিয়ের দাওয়াত দিলো। আগামীকাল কার্ড দিতে বাসায় আসবে। “

আরিফ সাহেব হাসিমুখে বলে,

“ তা-ই নাকি? যাক আলহামদুলিল্লাহ। সাকিবের বিয়ে হচ্ছে এটা তো খুশির খবর। “

আলী আকবর সাহেব রেগে গরম গলায় বলে,

“ আহাম্মক কোথাকার! দাঁত বের করে কেলাচ্ছো কেন তুমি? এখানে খুশির কি পেলে তুমি? আমার তো লজ্জায় নাক কাটা যাচ্ছে। যে-ই করিম কি-না স্কুল, কলেজ লাইফে কখনো আমাকে টপকে প্রথম হতে পারে নি, আজ সেই করিম কি-না আমার আগে নিজের নাত বউয়ের মুখ দেখবে। আর আমি বসে বসে ঘাস কাটবো? “

আরিফ সাহেব এবং মনন এতক্ষণে বুঝতে পারে আসল সমস্যাটা কোথায়। মনন ভালো করেই জানে এই মুহুর্তে দাদুর এই প্যাঁচাল শুরু হলে থামার নাম নিবে না। তাই এর আগেই কেটে পড়ার জন্য সে ক্লান্ত গলায় বলে,

“ আমি খুব টায়ার্ড। গোসল করে একটু ঘুমাতে হবে। আমি যাচ্ছি। “

আলী আকবর চোখ রাঙিয়ে বলে,

“ কোথায় পালাচ্ছো? আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। লজ্জা করে না? তোমার থেকে দুই বছরের ছোট ছেলেটা বিয়ে করে ফেলছে। বলি এই বাসায় কি কোনো মেয়ে বউ হয়ে আসবে না সংসারটা সামলানোর জন্য? “

মনন ক্লান্ত দেহ নিয়ে রুমের দিকে যেতে যেতে বিনয়ী গলায়ই বলে,

“ ঘরে বউ আনার জন্য আমার বিয়ে করাটা বাধ্যতামূলক নয় দাদু। আব্বুকেও চাইলে বিয়ে করিয়ে দিতে পারো একটা। কিংবা তুমিও কিন্তু এখনো ব্যাচেলর আছো। দেখতেও আমার এবং আব্বুর থেকে বেশি হ্যান্ডসাম। সুযোগ হাতছাড়া করো না। “

আলী আকবর সাহেব পিছন থেকে রেগে খেকিয়ে উঠেন,

“ হতচ্ছাড়া কোথাকার! একদম বাপের মতো হয়েছে। নালায়েক। “

__________

সকাল তখন এগারোটা বাজে। থমথমে মুখে নিজ কেবিনে বসে আছে মোহ। তার সামনেই একটা সোফায় বসে আছে মায়া। মুখটা কাচুমাচু করে রেখেছে সে। শিহান ফেরদৌস কেবিনে প্রবেশ করে তাড়া দিলো মোহকে,

“ এখনো হসপিটালের পোশাক পড়ো নি কেন তুমি? একটু পরেই নার্স আসবে তোমাকে নিতে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। এই মায়া, তোমার বোনকে সাহায্য করো। আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি। “

মোহ প্রতিবাদ করে,

“ আমি রেডি হবো না। আমি কোথাও যাবো না ওই নার্সের সাথে। যা ইচ্ছে হয়ে যাক। “

শিহান ফেরদৌসের কপালে ভাজ দেখা যায়। কিছুটা শাসনের সুরে বলে,

“ একদম বাচ্চাদের মতো আচরণ করবে না। তোমার ভালোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তুমিও জানো এই মুহুর্তে আর কোনো অপশন নেই আমাদের কাছে। “

“ অপশন আছে কি না আই ডোন্ট কেয়ার। আর কোনো অপশন না থাকলে দরকারে আমি চিকিৎসা করাবো না। তবুও কখনো এই পি আই সি সির জন্য রাজি হবো না। আমি সারারাত এটা নিয়ে রিসার্চ করেছি। এর ভিডিও দেখেছি। খুব পেইনফুল একটা প্রসিডিওর। আমি এসবের মাঝে নেই। “

মায়া বসে অসহায় চোখে নিজের বাবা এবং বোনকে দেখছে। সে ভালো করেই জানে যে এই মুহুর্তে এখানে বাবা মেয়ের মাঝে কথা কাটাকাটি হবে। সেই ব্যাপারটাকে মায়ারই সামলাতে হবে। মোহর কথার পিঠে শিহান শাসায়,

“ চিকিৎসা করাবে না মানে কি? ছোটবেলার অভ্যাস বদলায় নি এখনো তোমার। সমস্যা দেখলেই সেটাকে ফেস না করে কেটে পড়তে চাও সবসময়। তোমাকে সুস্থ করার জন্য এতো চেষ্টা করছি আমরা, আর তুমি ভয়ে পালাতে চাচ্ছো। “

মায়া এবার উঠে দাঁড়ায়। বাবাকে গিয়ে থামিয়ে বলে,

“ তুমি রাগারাগি করো না এখন প্লিজ। বাহিরে গিয়ে ওয়েট করো। আমি কথা বলছি ওর সাথে। “

মায়ার কথায় আশ্বস্ত হয়ে শিহান বেরিয়ে যায়। তার এই মেয়েটা অত্যন্ত বুঝদার। মোহর মতো বেখেয়ালি নয়। যেকোনো সমস্যা সুন্দর করে সমাধান করার অসাধারণ প্রতিভা আছে তার মাঝে।

শিহান বেরিয়ে যেতেই মায়া এসে মোহর পাশে বসে। মোহ চোখ রাঙিয়ে আগেভাগে সতর্ক করে,

“ একদম বাবার হয়ে চামচামি করতে আসবি না। কোনো মোটিভেশনাল জ্ঞান তো ভুলেও দিবি না। কষ্টটা পুরোটা আমার সহ্য করতে হবে। শরীরটা যেহেতু আমার, সেহেতু আমার শরীর কোন ব্যথাটুকু সহ্য করতে প্রস্তুত সেটা আমি ভালো জানি। আমার ট্রিটমেন্ট জনিত যেকোনো ডিসিশন নেওয়ার অধিকার আমার আছে। “

মায়া মুখটা কালো করে তাকায় মোহর দিকে। কণ্ঠে অসহায়ত্ব ঢেলে দিয়ে বলে,

“ আই নো তোর অধিকার আছে। কিন্তু আমিও চাই আমার বোন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাক। আমার চাওয়াটা কি ভুল বল? ব্লাড টেস্টের জন্য কিংবা কেমো, ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য ভেইন পাওয়া কতটা জরুরী তুইও জানিস। এখন তোর ভেইন পাওয়া যাচ্ছে না বলেই তো ডক্টররা ট্রিটমেন্ট চলমান রাখার জন্য বিকল্প হিসেবে এই পি আই সি সি অথবা পোর্ট সার্জারির উপায়টা সাজেস্ট করেছে। একবার রাজি হয়ে যা প্লিজ। ট্রিটমেন্ট শেষ হয়ে গেলে তো এসব থেকেও তখন মুক্তি পেয়ে যাবি। “

মোহ নরম হলো কি-না বুঝা গেলো না। উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করে,

“ বিকল্প সাজেস্ট করেছে সেটা শুনতে পেরেছিস, কিন্তু সেই বিকল্প ওয়েটা কতটা পেইনফুল আর রিস্কি সেটা শুনিস নি? না শুনে থাকলে আমি আবার তোকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার সজ্ঞানে আমার বাম হাতের কনুইয়ের উপরের বাকের এখানে কিছুটা কেটে তারা একটা শিরা খুঁজবে আগে। সেই শিরার মাধ্যমে ওই ২৪ ইঞ্চির টিউবটা ধীরে ধীরে আমার হার্টে পৌঁছাবে। ক্যাথেটারের মাধ্যমে যখন পুরোটা সেটাপ করে ফেলবে তখন জাস্ট তারা সেই পি আই সি সি লাইনকে সেফ রাখতে আমার হাতে ড্রেসিং করে দিবে। এই পুরো প্রসিডিওরটা আমাকে সজ্ঞানে দেখতে হবে, অনুভব করতে হবে, তড়পাতে হবে। কি চমৎকার না? খুব ইজি! যতদিন এই চিকিৎসা শেষ না হবে ততদিন আমাকে নিজের শরীরের ভেতর একটা পাইপ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে হবে। “

মায়ার অসহায় মনে হয় নিজেকে। সে তো জানে ব্যাপারটা মোহর জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হবে। কিন্তু এছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তাদের কাছে? মায়া মোহকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বলে,

“ একটু কষ্ট সহ্য করে নে প্লিজ? একবার কাজটা কমপ্লিট হয়ে গেলে দেখবি তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর ট্রিটমেন্টে আর কোনো অসুবিধা হবে না। “

“ কে বলেছে হবে না? পি আই সি সির রিস্ক ভুলে গেলি? ইনফেকশনের হাই চান্স থাকবে তখন। সামান্যতম বিষয়ে ইনফেকশনের ভয় থাকবে আমার। তাছাড়া আমি ড্রেসিং করা হাত নিয়ে রাতে ঘুমাবো কি করে? “

মায়া আর কিছু বলতে নিবে তার আগেই মোহ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

“ তুই প্লিজ যা এখান থেকে। আমার অসহ্যকর লাগছে তোকে। রাগের মাথায় কিছু বলতে চাচ্ছি না। “

মায়া নীরবে উঠে যায়। দরজার কাছাকাছি গিয়ে সে ফিরে তাকায় মোহর দিকে। শেষ চেষ্টা চালাতে মলিন স্বরে বলে,

“ যা ভালো মনে হয় কর। ট্রিটমেন্ট মাঝ পথে থামিয়ে গিভ আপ করতে চাইলে কর। আমাকে নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না। মা, বাবা ছাড়া চলতে পারলে তোকে ছাড়াও চলতে পারবো আমি। আফটার অল আমাকে তো একাই চলতে হবে। “

বলেই মায়া কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। মোহ নিশ্চুপ বসে রয়। সে জানে মায়া কি বুঝিয়ে গিয়েছে এইমাত্র। সে না থাকলে মায়া পুরো একা হয়ে যাবে। ওই এতো বড়ো বাড়িটাতে কথা বলার মতো মানুষের খুব অভাব হবে মায়ার।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মোহ বেডের একপাশে রাখা হসপিটালের পোশাকের দিকে তাকায়। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায় গত রাতের ঘটনা। সে যখন ছাদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ঠিক সেই মুহুর্তে নার্স এসেছিলো তার কেবিনে ব্লাড টেস্টের জন্য। কিন্তু এবারও পরিস্থিতি একই দেখে নার্স বাধ্য হয়ে কল করে ডক্টরকে ব্যাপারটা জানায়। তারপর আর মোহ সুযোগই পেলো না। শিহান এবং মায়ার নজর এড়িয়ে ছাদে যাওয়াটা অসম্ভব ছিলো তার কাছে। তার উপর সে-ই মুহুর্তেই ডক্টর এসে নিজেও মোহর চেকাপ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। যখন দেখে স্পষ্ট শিরার অভাবে মোহর ব্লাড টেস্ট, ইঞ্জেকশন কিংবা কেমো দেওয়াটা অসম্ভব হয়ে পরেছে তখন তিনি বিকল্প হিসেবে পি আই সি সি সম্পর্কে জানান শিহানকে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিহানও রাজি হয়। তারপর… তারপর সারাটা রাত মোহর কিভাবে কেটেছে তা শুধু সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।

গত রাতের কথা ভাবতে গিয়ে মোহর মনে প্রশ্ন জাগে, ওই ডক্টর কি গত রাতে ছাদে গিয়েছিল? আর গেলে কি মোহর অপেক্ষা করেছিলো? আনমনে মস্তিষ্কে হানা দেওয়া প্রশ্নে মোহ নিজেই বিরক্ত হলো। ওই মরণ তার জন্য কেন অপেক্ষা করবে? হয়তো এসেছে, তারপর ঘুরে ফিরে চলে গিয়েছে। সেটাই তো হওয়ার কথা।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০৭

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭.

হসপিটালে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে লিফটে করে ছাদে পৌঁছাতে মননের সর্বোচ্চ পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মতো লেগেছে। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠা কদম গুলো ছাদের দরজার কাছাকাছি এসে ধীর হয়ে যায়। দরজাটা খোলা। অর্থাৎ মোহ হয়তো ছাদে আছে। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই মনন বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে ছাদে পা রাখে। যেনো এতক্ষণ সে প্রবল তাড়া নিয়ে ছাদে পৌঁছানোর জন্য মাঝপথ থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে আসে নি।

ছাদে পা রাখতেই মাতাল করা বাতাস এসে মননের শরীরে ধাক্কা খায়। মনন সেকেন্ড কয়েকের জন্য থামে। সামনের দিকে চোখ বুলায়। উঁহু, কেউ নেই। মোহ কি তবে আসে নি? নাকি এসে চলে গিয়েছে? প্রশ্নগুলো মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই ছাদের পিছনে বাম পাশ হতে একটা স্বর বলে উঠে,

“ হ্যালো ডক্টর, আমাকে খুঁজছেন? “

মনন সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় না। বুঝতে পারে ওই মেয়ে ছাদেই আছে। তা-ই সে পিছনে না ফিরেই রেলিঙের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জবাব দেয়,

“ আপনাকে খোঁজার কথা ছিলো না-কি? “

মোহ কোনো প্রতুত্তর করে না। মনন রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মোহর উত্তরের অপেক্ষা করে। তবে কোনো উত্তর না এলেও কয়েক সেকেন্ডের মাঝে মোহ নিজেই এসে তার পাশে দাঁড়ায়। দু’জনের মাঝে প্রায় তিন হাত সমান দূরত্ব। মনন এবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাকায়। অবলোকন করে কালো রঙের সুতি কাপড়ের একটা কুর্তি এবং প্লাজো পরিহিত মোহকে। মননের দৃষ্টি স্থির মোহর মাথায় প্যাঁচানো স্কার্ফটার দিকে। স্কার্ফের নিচে শক্ত মাথার আকৃতিটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। চুল কেটে ফেলেছে তার মানে। মনন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

মোহ এবার পাশ ফিরে তাকায়। সবসময় হসপিটালের পোশাক পড়ে থাকা লোকটা আজকে হালকা আকাশী রঙের শার্ট এবং কালো প্যান্ট পড়ে আছে। চোখ জোড়া স্বচ্ছ চশমার ফ্রেমের আড়ালে ঢাকা। মোহ অস্ফুটে বলে,

“ ভেবেছিলাম চলে গিয়েছেন। “

মনন শুনে তা। তবে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠে,

“ কানে কি অযথাই ইয়ারফোন গুজে রেখেছেন, নাকি গান শুনছেন? “

মোহকে উৎসাহী দেখা যায়। এক কানের ইয়ারফোন খুলে সে মননের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ গান শুনছিলাম। শুনবেন? “

মনন অনাগ্রহ দেখিয়ে বলে,

“ উহু, শুনবো না। আপনারও শোনা উচিত না। ওয়্যারড ইয়ারফোন রেডিয়েশন প্রডিউস করে। আপনার হেলথের জন্য সেটা ভালো না। উল্টো ক্ষতিকর। “

মোহ মুখ কালো করে ফেলে। কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বেরস মুখে বলে উঠে,

“ এতো রেস্ট্রিকশন? এক কাজ করি, নিঃশ্বাস নেওয়াও বন্ধ করে দেই। ঢাকার মতো পলিউশনে ভরপুর একটা শহরে নিঃশ্বাস নেওয়াটাও তো উচিত না। প্রতি নিঃশ্বাসে কত ক্ষতিকর জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে, তাই না? “

মনন ভ্রু কুচকে মোহর দিকে তাকায়। সব কথার জবাব এই মেয়ের ঠোঁটের আগায় প্রস্তুত থাকে। মননকে এভাবে কপাল কুচকে তাকাতে দেখে মোহ বলে উঠে,

“ আইডিয়াটা পছন্দ হয় নি? আমি তো আপনাদের ভাষাতেই কথা বললাম। ডক্টররা পারলে পেশেন্টদের নিঃশ্বাস নেওয়ার উপরেও রেস্ট্রিকশন বসিয়ে দেয়। “

“ ডক্টররা কোনো কিছু বারণ করলে সেটা পেশেন্টদের ভালোর জন্যই করে। নিয়মে বাঁধা জীবন কিছুটা কষ্টের হলেও তো বিনিময়ে সুস্থতা পাওয়া যাচ্ছে। সেটাই বড়ো ব্যাপার বলে আমি মনে করি। “

মননের সিরিয়াস কথাটাকে মোহ গায়ে মাখে না। উল্টো হেসে দিয়ে বলে,

“ প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের টিচারের মতো মোটিভেশনাল শোনাচ্ছে আপনার কথা। “

মনন বিরক্ত হয়। তার এতো দামী একটা কথাকে এই মেয়ে আমলে নিলো না টের পেতেই মুখটা করলার মতো রূপ ধারণ করে। প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি কাউকে জানিয়ে ছাদে এসেছেন? “

“ হ্যাঁ। নার্সকে বলে এসেছি। তাছাড়াও ডিনার করে চুপচাপ বসে থাকতে অস্বস্তি লাগছিলো। উনারা তা-ই আর মানা করে নি। “

“ আপনার ফ্যামিলি? উনাদের জানিয়ে আসেন নি? “

মোহ আনমনে বলে বসে,

“ ফ্যামিলির কেউ থাকলে তো বলবো! “

মনন কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়। মোহও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিজের কথার অর্থ বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে বলে উঠে,

“ আই মিন মায়া বাসায় গিয়েছে। ওর কালকে এক্সাম আছে। এক্সাম শেষে আসবে। “

“ আপনার আম্মু আব্বু? “

“ বাবা আপাতত দেশে নেই। আর মা তো পৃথিবীতেই নেই। “

মোহর অবলীলায় বলা কথাটা শুনে মনন নিশ্চুপ হয়ে যায়। বুঝে উঠতে পারে না তার কি বলা উচিত। কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় থাকে দুইজনের মাঝেই। মনন সেই নীরবতা ভেঙে বলে,

“ এভাবে গার্ডিয়ান ছাড়া একা থাকাটা তো আপনার অথবা আপনার বোনের জন্য সেফ না। বাচ্চা মানুষ দু’জনই। কোনো রিলেটিভ নেই? “

“ আছে তো। আমার মামা মামী আছে। উনারা কানাডায় স্থায়ী। তাছাড়া বাসায় দাদু আর আন্টি আছেন। আন্টি মূলত দাদুর খেয়াল রাখার দায়িত্বেই আছেন। দাদু একচুয়্যালি প্যারালাইজড তো। উনার পাশে সর্বক্ষণ একজনের থাকাটা জরুরী। আর আমি বাচ্চা নই। আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেল্ফ। কেউ আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা বেবি সিটিং করুক সেটা আমার পছন্দ না। “

মনন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“ আচ্ছা, মানলাম। আপনি বাচ্চা নন। খুশি? “

মোহ মননের কথা শুনে চোখ ছোট করে তাকায়। এই লোক কি এইমাত্র তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করলো? মোহ কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই মনন প্রশ্ন করে,

“ বাই দ্যা ওয়ে, আপনার তো কেমোর প্রথম সাইকেল শেষ। তাহলে হসপিটালে কি করছেন? আপনাকে কি আপনার ডক্টর হসপিটালে এডমিট থাকতে সাজেস্ট করেছেন? “

প্রশ্নের উত্তরটা মোহর কাছে আছে। তবে তা বলতে ইচ্ছে হলো না তার। সে তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে। আমি এখন যাই। টাটাহ। “

বলেই মোহ উল্টো পথ ধরে সেখান থেকে প্রস্থান করে। মনন নির্বিকার ভঙ্গিতে তা দেখে। বাঁধা দেয় না। পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই কিছু একটা মনে পড়ে তার। পকেট থেকে বের করে বেলী ফুলের সেই মালাটা। মুহুর্তেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সেই ফুলের ঘ্রাণ। মনন কিছুক্ষণ সেই মালাটা দেখে আবার পকেটে ভরে নেয়।

__________

নির্মল সকালটায় ফোলা ফোলা চোখ মেলে হসপিটালের বেডে বসে আছে মোহ। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে সে। কিন্তু ঘুমটা ভালো হয় নি তার। কেমোর প্রভাবে যদিও তার ঘোড়া বেঁচে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করে, কিন্তু হসপিটালের এই বেডটায় সে প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাতে পারে না। ছোটবেলা থেকে বিশাল বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে অভ্যস্ত মানুষের কি এই এক হাত সমান বিছানায় পোষায়? তার উপর ন্যাড়া মাথাটা বালিশে রাখলেই বারবার খোঁচা লাগছিলো তার। সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।

কেবিনের দরজা খোলার শব্দ পেতেই মোহ দ্রুত ভঙ্গিতে হাতের কাছের স্কার্ফটা টেনে মাথা ঢেকে নেয়। একজন ওয়ার্ড বয় এসেছে একটা ট্রে হাতে। ট্রে তে থাকা সকালের নাস্তাটা মোহকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি চলে যায়। মোহ গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর তীব্র অনিহা নিয়েই শুরু করে হসপিটালের সাদামাটা পুষ্টিসম্পন্ন নাস্তা খাওয়া।

নাস্তা শেষে ওষুধ খেয়ে মোহ বসে টিভি দেখছিলো। এই হসপিটালে সময় কাটাতে টিভি দেখা, ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলা, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা এবং নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরির সঙ্গে সময় ব্যয় করা ছাড়া সে করার মতো আর কিছু খুঁজে পায় না।

মোহ যখন টিভি দেখতে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহুর্তে একজন নার্স ব্লাড টেস্টের সরঞ্জামাদি পূর্ণ ট্রে হাতে কেবিনে প্রবেশ করে। মোহ দ্রুত স্কার্ফ নিতে চাইলে নার্সটি হেসে বলে,

“ রিলেক্স। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্টই ন্যাড়া মাথায় ঘুরে বেড়ায়। একবার জানো কি হয়েছিল? ক্লাস সেভেনে থাকতে আমার ভয়ংকর টাইফয়েড হয়েছিলো। মাথা ভর্তি সব চুল হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। কিন্তু এখন দেখো, কি সুন্দর লম্বা চুল হয়েছে না আমার? তোমারও হয়ে যাবে দেখে নিও। “

কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলা সুই প্রস্তুত করে মোহর হাতে তরতাজা রগ খুঁজতে থাকে। ডান হাতটা বেশ কিছুক্ষণ এপাড় ওপার করে খুঁজেও যখন কোনো রগ পায় না তখন তিনি বাম হাতটা ধরেন। লম্বা সময় ধরে খোঁজার পরে একটা আবছা রগ খুঁজে পান তিনি। মুষ্টিবদ্ধ হাতের উপর পিঠটা স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণু মুক্ত করে নিয়ে তিনি সুঁই ব্যবহার করেন।

কিঞ্চিৎ ব্যথায় মোহ চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। নার্সটা বেশ কিছুক্ষণ টিউব হাতে অপেক্ষা করেন। কিন্তু খুব সামান্য পরিমাণ রক্তই আসছে। এই সামান্য পরিমাণ রক্ত টেস্টের জন্য যথেষ্ট নয়। মোহ পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। দেখে নার্সের কপালের ভাজ। অত:পর দেখে সুঁইয়ের নিম্নভাগে লাগোয়া সরু স্বচ্ছ পাইপের মতো অংশটা। যার একভাগ সুঁইয়ের সঙ্গে জোড়া লাগানো এবং অপর অংশ দ্বারা টিউবে রক্ত নেওয়া হয়। খুবই সামান্য পরিমাণ রক্ত দেখে মোহ হতাশ হয়। ওই ডক্টর আবার গ্রাফিল টাফিল দিবে না তো?

নার্স কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে,

“ এরকম হলে তো চলবে না। ব্লাড টেস্টের জন্য তো সতেজ রগ দরকার। এভাবে তো টেস্ট করা সম্ভব নয়। “

মোহ চটপটে গলায় উত্তর দেয়,

“ আপনি আরেকটু খুঁজে দেখুন। আমি তো কথামতো সারাদিন পানি, আনারের শরবত, খেজুর এসব খেয়েছি। একটুও গাফলতি করি নি। “

নার্সটা মোহর কথায় কিছুটা নরম হয়ে বলে,

“ অসুবিধা নেই। আমি আবার সন্ধ্যায় ব্লাড নিতে আসবো। তুমি রেস্ট করো। “

বলেই নার্সটা ট্রে হাতে বেরিয়ে যায়। মোহ বসে বসে নিজের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বারবার রগ খুঁজতে থাকে। শুভ্র পাতলা ত্বকের নিচে তো রগ খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হওয়ার কথা। তাহলে মোহর বেলায় এমন হচ্ছে কেন? ভাবনাটা মাথায় উঁকি দিতেই মোহ দরজা খোলার শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকায়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে বিস্মিত হয়। ভুলে বসে সব কিছু। অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

“ বাবা। “

শিহান ফেরদৌস কিছুক্ষণ থম মেরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেয়ের মুখটা দেখে। পরপর ধীর পায়ে কেবিনে প্রবেশ করে। মোহ তৎক্ষণাৎ সম্বিত ফিরে পায়। স্কার্ফটা মাথায় নিয়ে চুপচাপ বসে রয়। শিহান ফেরদৌস অসচেতনের মতো আচরণ করেন না। সোজা তিনি আগে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসেন। কেবিনের টেবিলের উপর থাকা স্যানিটাইজার নিয়ে অত:পর দু-হাত পরিষ্কার করে নেন। মোহর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে একটা সোফায় বসে।

মোহ বাকা চোখে একবার বাবার থমথমে মুখটা দেখে নেয়। বাবা কখন দেশে ফিরলো? এইমাত্র নাকি গত রাতে? গত রাতে ফিরলে মায়া তাকে জানায় নি কেন? রাতেও তো সে দিব্যি মায়া এবং আন্টির সাথে কথা বলেছে। মোহর বিস্ময়তা চিরে শিহান প্রশ্ন করে,

“ শরীর কেমন তোমার? “

মোহ অপ্রস্তুত বোধ করে। অজানা কারণে তার মনে হচ্ছিলো এই বুঝি বাবা কিছু একটার জের ধরে তাকে বকবে। কিন্তু বাবা উল্টো জানতে চাইছে সে কেমন আছে। এই পরিবর্তনটা কি মোহ অসুস্থ বলেই? যদি তা-ই হয় তাহলে এই অসুস্থতা দীর্ঘস্থায়ী হলেও মোহ তা চুপচাপ সয়ে নিতে রাজি।

মোহর তরফ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে শিহান কিছুটা গলা ঝেড়ে বলে,

“ এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? “

মোহর বিস্ময়তা কাটে। তড়িঘড়ি করে জবাব দেয়,

“ জি? ঠিক আছি। “

আবারও অস্বস্তি পূর্ণ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় কেবিনটা। কেউই বুঝে উঠতে পারে না কি বলা উচিত তাদের। মোহর নিজের বাবার সাথে সম্পর্কটা খুব একটা সহজ নয়। কিছুটা সংকোচ, কিছুটা দ্বিধা এবং অসীম দূরত্ব দ্বারা সৃষ্ট এক জটিলতা তাদের সম্পর্কে বিরাজমান।

মোহর ধারণা এই জটিলতার মূল কারণ তাদের মায়ের মৃত্যু। মোহ এবং মায়ার জন্মের এগারো দিনের মাথায় তাদের মা মারা যান। মামা মামীর মুখে মোহ শুনেছে সেই দিনগুলোর কথা। তার বাবা খুব ভালোবাসতো তার মা’কে। স্ত্রী’র অকাল মৃত্যু শিহানের মাঝে পরিবর্তন নিয়ে আসে। লোক সমাগম এড়িয়ে গিয়ে একা থাকতে শুরু করে। কাজের সাগরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে শুরু করে। বাসায় যতক্ষণ থাকতো ততক্ষণ নিজের রুমেই থাকতো। স্ত্রী’র শোকে ডুবে থাকা শিহানের অজান্তেই তার সন্তানদের সাথে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। মায়া এবং মোহ কিছুটা বড়ো হওয়ার পর টের পায় তাদের বাবা নামক মানুষটার চারিদিকে একটা অদৃশ্য পর্দা রয়েছে। মায়া যদিও ধীরে ধীরে সেই পর্দার আড়ালে থাকা নরম মনের বাবার কাছে পৌঁছাতে পেরেছে, কিন্তু মোহ ব্যর্থ হয়েছে। সে নিজের জড়তা কাটিয়ে কখনোই আগ বাড়িয়ে বাবার সাথে মেশার আগ্রহ দেখায় নি। আর না শিহান নিজ থেকে কাঠিন্যতা ভুলে মোহকে স্নেহের ছায়ায় আগলে নিতে পেরেছে।

মোহ ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে শিহানের কথায়,

“ থাকো তবে। আমি গিয়ে তোমার ডাক্তারের সাথে দেখা করে আসি। কিছুর প্রয়োজন হলে কল দিও। “

মোহ কিছু বলতে পারে না। শিহান যেভাবে এসেছিলো, সেভাবেই উঠে চলে যায়। মোহ ভাবতে বসে বাস্তবিক অর্থে তার আসলে কি প্রয়োজন?

__________

ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে মননের ডিউটি আওয়ার শেষ এখন। হসপিটালের পোশাক বদলে নিয়ে সে শার্ট প্যান্ট পড়ে নেয়। কাধে ব্যাগটা চাপিয়ে নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে পা বাড়ায় লিফটের দিকে। পথিমধ্যে দেখা হয় এক সহকর্মীর সঙ্গে। তার সঙ্গে টুকটাক আলাপের ইতি ঘটে লিফট পঞ্চম ফ্লোরে থামার মধ্য দিয়ে। মননের সাথের সহকর্মী পঞ্চম তলায় নেমে গেলেও মনন নামে তা। তার উদ্দেশ্য চৌদ্দতম ফ্লোরে। ছাদে যেতে হবে যে তার!

আজ ছাদের দরজার কাছে এসে অবাক হলো মনন। দরজা খোলা নেই। তারমানে মোহ এখনো আসে নি। মনন তেমন একটা না ভেবে নিজেই দরজা খুলে ছাদে পা রাখে। একা একা মুক্ত বাতাসে পায়চারি করতে থাকে।

সময় গড়ায় আপন গতিতে। দশ মিনিট… বিশ মিনিট… ত্রিশ মিনিট। পায়চারি করতে করতে ক্লান্ত মনন রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। হাত ঘড়িটায় একদফা চোখ বুলায়। ঘড়ির কাটা নয়টা ছুঁই ছুঁই। মোহর আসার কোনো নাম গন্ধ নেই।

মননের শূন্য মস্তিষ্ক আচমকা একটা ধাক্কা খায়। সে মোহর জন্য অপেক্ষা কেন করছে? কিসের ভিত্তিতে সে ছাদে এসে অচেনা, অজানা ওই মেয়েটার জন্য সময় ব্যয় করছে? মোহ তো কখনো বলে নি যে সে প্রতিদিন এই সময়টাতে ছাদে আসবে। তাদের মধ্যে এরকম কোনো চুক্তি হয় নি। নাকি হয়েছে? নীরব চুক্তি বলে তাকে।

মনন আর অপেক্ষা করে না। ঠিক করে এই নীরব চুক্তির ইতি ঘটা দরকার। ভিন্ন দুটো জীবন, যার কোনো যোগসূত্র নেই, সেরকম দুটো মানুষের অহেতুক এই দেখাশোনাটা নেহাৎই অপ্রয়োজনীয়। অপ্রয়োজনীয় কিছু করাটা মননের উচিত নয়। ওইটুকু বাচ্চা মেয়ের সাথে প্রতিদিন ঘড়ি ধরে দেখা করার মতো দায়বদ্ধ সে নয়। কিংবা মোহও প্রতিদিন এই সময় ছাদে আসতে বাধ্য নয়।

মনন আরও কিছু ভাবার পূর্বেই তার মুঠোফোনটা বেজে উঠে। প্যান্টের পকেট হতে ফোনটা বের করে সে রিসিভ করে। কানে ধরতেই আরিফ কায়সার বলেন,

“ কোথায় তুমি? দাদু সে-ই কখন বাসায় এসে খবর আছে? দ্রুত বাসায় আসো। তোমার উপর রেগে আছে খুব। বোঝাপড়া করবেন আজ তিনি। “

মনন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলটা কেটে দেয়। ছাদ থেকে প্রস্থান করে। লিফটে উঠে সোজা গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটন চেপে দেয়। কিন্তু লিফটটা মধ্য পথে দশম তলায় এসে থামে। দরজা খুলে যায় দু’দিকে। দু’জন লোক লিফটে উঠে। মনন নীরবে দেখে তা। এই ফ্লোরটাতেই মোহ আছে। মনন মোহর খোঁজ করার আগ্রহ বোধ করে না। কিংবা বোধ করলেও তা মানতে আগ্রহ দেখায় না। সব আগ্রহকে পাত্তা দিতে নেই। সে আপন জায়গায় স্থির রয়। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দেখা হয় না আর দু’জনের।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-০৬

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬.

কায়সার পরিবারের খাবার টেবিলে বহু বছর ধরে একসঙ্গে বসে সকলের ভোজ হয় না। হবেই বা কিভাবে? ঘরে সদস্য সংখ্যা কেবল তিন। তিনজনই পুরুষ। সকাল সকাল একজন হেল্পিং হ্যান্ড এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে কেবল রাতের জন্য তরকারি আর ভাত রান্না করে দিয়ে যায়। দুপুরে যে যার কর্মস্থলে খাওয়া দাওয়া করে নেয়। আর সকালে যে যার সুযোগ সুবিধা মতো ঘর থেকে বের হওয়ার আগে পাউরুটিতে অরেঞ্জ জ্যাম কিংবা নিউটেলা মেখে নাস্তা সেড়ে নেয়। কর্ম ব্যস্ততায় কারো সঙ্গেই কারো রুটিন মিলে না।

আজকের সকালটাও সেরকমই। মনন সম্পূর্ণ রেডি হয়ে এসে নাস্তার টেবিলে বসেছে। আরিফ কায়সার একজন সনামধন্য প্রকৌশল। তিনি ইতিমধ্যে নাস্তা সেড়ে কাজে চলে গিয়েছেন। ফলস্বরূপ আজকের নাস্তাটাও মননের একাই করতে হচ্ছে। সে পাউরুটিতে কামড় বসিয়ে তা চিবুতে চিবুতে অপর হাতে ফোন তুলে নেয়। গণমাধ্যমের সবশেষ আপডেট পেতে প্রবেশ করে ফেসবুক এপে। অলস দৃষ্টি মেলে স্ক্রল করতে করতে আচানক তার আঙ্গুল থেমে যায়। চোখ কুচকে বিড়বিড়িয়ে পড়ে নেয় একটি ইংরেজি ক্যাপশন।

“ When life gives you lemon, make lemonade. Enjoying my sweet & sour era. “

ক্যাপশনের সঙ্গে পোস্টে যুক্ত করা হয়েছে একটি ছবি। ছবিটিতে একজন বয়স্ক লোককে রেস্টুরেন্টে লেবুর শরবতের গ্লাস হাতে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। লোকটি আর কেউ নয় বরং মননের দাদু আলী আকবর কায়সার। লোকটার বয়স হয়েছে তবে মন থেকে এখনো রঙের পরিমাণ কমে নি। প্রায়ই এরকম কচি খোকা সেজে অদ্ভুৎ সব ক্যাপশন দিয়ে নিজের ছবি আপ্লোড দেন তিনি। তা দেখে মনন খুব বিব্রতবোধ করে।

সেই বিব্রতবোধ থেকে সে একবার আলী আকবর কায়সারকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিলো। দু’দিনের মাঝে সে-ই ঘটনা টের পেতেই বুড়োর সে কি রাগ! খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করে গাল ফুলিয়ে বসে ছিলো। তার নাতির কাছে না-কি তার গুরুত্ব কমে গিয়েছে। তা-ই তো নিজের দাদুকে আনফ্রেন্ড করে দেওয়ার মতো এতো নিষ্ঠুর একটা কাজ করতে পারলো মনন!

বহুত কসরত করে সেইবার দাদুর রাগ ভাঙাতে হয়েছিলো মননের। তার কাছে মনে হয় দাদু খুব বড়ো একটা ড্রামাবাজ। কথায় কথায় ড্রামা করে। তবে সে-ই ড্রামা গুলো যে নেহাৎই এই নির্জীব ঘরটাকে উজ্জীবিত করে রাখারই উদ্দেশ্যে তা মনন ভালো করেই জানে। তাই সে-ও চুপচাপ এসব দেখে যায়।

ফোনটা টেবিলে রেখে আবার নাস্তায় মনযোগ দেয় মনন। এমন সময়ই তার ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনের পানে তাকাতেই দেখতে পায় দাদু কল করেছে। মনন খেতে খেতে কলটা রিসিভ করে ফোন কানে ধরতেই অপর পাশ হতে রাগী স্বরটা বলে উঠে,

“ দু ঘন্টা হয়েছে একটা ছবি আপলোড দিয়েছি। তুমি কিংবা তোমার বাপ কেউ এখনো আমার ছবিতে রিয়েক্ট কিংবা কমেন্ট করো নি। করছো টা কি তোমরা? খুব ব্যস্ত? আমি তোমাদের বাপ ছেলের চাকরি নট করে দিবো। তারপর সারাদিন ফুরসত পাবে আমার ছবিতে রিয়েক্ট, কমেন্ট করতে। “

মনন হতাশ গলায় বলে,

“ হয়েছে তোমার নাটক? “

“ আমি খুব সিরিয়াস। মোটেও নাটক করছি না। দ্রুত গিয়ে আমার ছবিতে রিয়েক্ট দাও। লাইক দিলে সোজা ব্লক করে দিবো বলে দিলাম। লাভ রিয়েক্ট দিবে। আর কমেন্টে লিখবে ‘মাই এভারগ্রিন বাডি’। বুঝতে পেরেছো? “

মনন প্রশ্ন করে,

“ তুমি আমার বাডি নও। দাদু হও। আমি বাডি কেনো লিখবো? “

“ এটাই সমস্যা তোমাদের জেনারেশনের। অযথা প্রশ্ন বেশি করো। যা বলা হয়েছে চুপচাপ তা করো। আমাকে আর বিরক্ত করবে না। আমি এখন ঘুমাবো। ঘুম থেকে উঠে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে। “

গমগমে স্বরে কথা গুলো বলেই আলী আকবর সাহেব কলটা কেটে দেয়। মনন হতবিহ্বল হয়ে কতক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। অত:পর কি ভেবে যেনো ফেসবুকে গিয়ে দাদূর আইডি সার্চ করে। একদম রিসেন্ট করা পোস্টটায় লাভ রিয়েক্টের বদলে লাইক দিয়ে সে অফলাইনে চলে যায়। এবার খুব মজা পাচ্ছে সে। বুড়োটা তাকে ব্লক করুক। হুহ, মননের তাতে কি আসে যায়?

__________

নিজ কেবিনের ওয়াশরুমের সিংকের সামনে একটা টুল টেনে বসে আছে মোহ। নির্বিকার ভঙ্গিতে ফোন চালাচ্ছে সে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মায়া। মনযোগের সহিত ট্রিমার হাতে মোহর মাথার চুলগুলো উচ্ছেদ করছে সে। মাথার ডান পাশটা ইতিমধ্যে কেশহীন হয়ে গিয়েছে।

চুল কাটার মাঝে মায়া আড়চোখে বারবার মোহকে দেখছে। মোহকে দেখতে অত্যন্ত স্বাভাবিকই লাগছে। যেনো এসব কিছুতে তার কিছুই আসে যায় না। মায়া নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাকি চুল গুলোও কেটে ফেলে।

অত:পর মোহকে বসিয়ে রেখে সে চলে যায় ওয়াশরুমের বাহিরে। এবার মোহ ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকায় আয়নার পানে। দেখে নিজেকে, নিজের নতুন রূপকে। অদ্ভুৎ লাগছে সবটা। গলার কাছে যন্ত্রণা নামক কিছু একটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছে সে। চোখ নামিয়ে টুলের নিচে বিছানো সাদা কাপড়টার দিকে তাকায় সে। গত রাতের ব্যথাটা আবার তড়পে উঠলো বুকের ভেতর।

নারীর সৌন্দর্যের ভূষণ হিসেবে গণ্য করা হয় তার কেশকে। বলা যায় একজন নারীর সৌন্দর্যতার পিছনে অনেকক্ষাণি অবদানই তার চুলের। তাইতো পৃথিবীর সকল মেয়েরা চুলের যত্ন এবং পরিচর্যার ব্যাপারে এতো সচেতন! মোহ সবসময় দেখে এসেছে মায়াও নিজের চুলের প্রতি অনেক যত্নশীল। কিন্তু মোহর মাঝে সেরকম কোনো তৎপরতা কখনো দেখা যায় নি। সে বরাবরই অলস কিসিমে’র মানুষ। চুলের যত্ন করার ব্যাপারে সে ছিলো খুব উদাসীন। এই আলসেমির কারণে সে কখনো চুল তেমন একটা বড়ো হতেও দিতো না। পিঠে নামার আগেই তা কেটে কাধের কাছে তুলে ফেলতো।

অথচ সে-ই মোহরই আজ ইচ্ছে করছে চুল হারানোর বেদনায় কেঁদে কেটে দুনিয়া ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু সে কাদবে না। সবাই তাহলে জেনে যাবে মোহ দূর্বল। মোহ নিজেকে দূর্বল প্রমাণ করে হাসির পাত্র হতে নারাজ। তাকে ড্যাম কেয়ার হিসেবে চিনে আসা সকলকে সে কখনোই নিজের দূর্বল রূপটা দেখাতে রাজি না। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ফোনের দিকে তাকায়।

__________

বিকেলের মিঠা আবহাওয়া তখন। মায়া সবেমাত্র বাড়িতে প্রবেশ করেছে। বাড়িটা কেমন জানি! নিষ্প্রাণ, জনমানবশূন্য মনে হয় তার কাছে। বিশাল বাড়িটার সদস্য সংখ্যা কেবল পাঁচ। শিহান ফেরদৌস, মোহ, মায়া, তাদের বৃদ্ধা দাদী এবং একজন আন্টি। শিহানকে ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই দেশের বাহিরে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। বাসায় থাকে না বললেই চলে। মোহটাও এখন হসপিটালে। বাসা থেকে আসা যাওয়া করে ট্রিটমেন্ট চালাতে ইচ্ছুক নয় সে। বাকি রইলো মায়ার দাদী। বৃদ্ধা শয্যাশায়ী অবস্থায় জীবন পাড় করছেন। ব্রেইনের একটা অপারেশনের পর থেকেই উনার পুরো শরীরটা প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। বেঁচে তো আছে, তবে তা মৃত্যুর সমতূল্য। মায়ার দাদীর দেখাশোনার জন্য একজন আন্টি সার্বক্ষণিক তার পাশে থাকে। বাসার রান্নাসহ যাবতীয় কাজ গুলোও তিনিই করেন। বিনিময়ে যে-ই মোটা অংকের বেতন পায় তা গ্রামে নিজের পরিবারের জন্য পাঠিয়ে দেন।

মায়া বাসায় ফিরতেই শায়লা আন্টি এসে জিজ্ঞেস করে,

“ মোহর কি অবস্থা মা? “

মায়া উদাস গলায় জবাব দেয়,

“ আছে, খারাপ না। “

“ ওকে এভাবে একা হসপিটালে রেখে আসাটা কি ঠিক? আমি হসপিটালে গিয়ে ওর সাথে থাকি? “

“ বাদ দাও আন্টি। অযথা রাগারাগি করবে। ভাববে আমরা সবাই মিলে ওর বেবি সিটার হতে চাইছি। তুমি বরং দাদুর কাছেই থাকো। আমি আগামীকাল পরীক্ষা শেষে হসপিটাল যাবো৷ “

কথাটুকু বলে নিজের রুমে প্রবেশ করতে নিয়েও থেমে যায় মায়া। কি মনে করে যেনো বলে,

“ আন্টি, কালকে একটু হালকা মশলা দিয়ে ভালো করে সিদ্ধ করে একটু দেশি মুরগী রান্না করবে? দুপুরে তাহলে আমি হসপিটালে যাওয়ার সময় মোহর জন্য নিয়ে যেতাম। ওর ডায়েট চার্টে পনেরো দিনে একবার দেশি মুরগী খাওয়ার অনুমতি দেওয়া আছে। হসপিটালের শাক সবজি বেচারি বাধ্য হয়ে গিলছে। “

শায়লা কিছুক্ষণ মায়াকে দেখে হেসে বলে,

“ তুমি একদম তোমার মা’য়ের মতো হয়েছো। তোমার মা-ও এরকম ছিলো। লক্ষী, বুঝদার, সংসারী। “

মায়া মিষ্টি করে হাসে। এ-ই কথাটা সে প্রায় অনেকের কাছেই শুনেছে। বাবাও একবার অজান্তে তাকে বলে ফেলেছিলো,

“ তুমি একদম বিথীর মতো হয়েছো। “

মায়ার তখন বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো,

“ আর মোহ একদম তোমার মতো হয়েছে বাবা। অশান্ত, একরোখা, জেদি। “

__________

গোধূলি লগ্নের সূচনা ক্ষণ তখন। মোহ সোফায় পা ভাজ করে ডায়েরি হাতে বসে। গভীর মনযোগ দিয়ে হাতের সাহায্যে ডায়েরির পাতায় কিছু একটা লিখছে সে। খাবারের টেবিলটায় কিছুক্ষণ আগে একজন স্টাফ এসে সন্ধ্যার নাস্তা হিসেবে ধোঁয়া উঠা গরম একটা ডালের স্যুপের বাটি রেখে দিয়ে গিয়েছে। মোহর মাঝে সেটা ছুঁয়ে দেখারও কোনো লক্ষ্মণ নেই। সে আপন কাজে মগ্ন।

হঠাৎ কিঞ্চিৎ শব্দ তুলে কেবিনের দরজা খুলে যেতেই মোহ চোখ তুলে তাকায়। নার্সকে দেখে দ্রুত ডায়েরিটা রেখে সোজা হয়ে বসে সে। নার্স মোহকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ হেই হিরোইন, নতুন লুকে সুন্দর লাগছে তোমাকে। “

মোহ প্রশংসাসূচক বাক্যটা খুব একটা গায়ে মাখে না। সে জানে তাকে দেখতে কেমন দেখাচ্ছে। তা-ই সে অন্যের অযথা কম্পলিমেন্টে বিশ্বাস করতে আগ্রহী নয়। উক্ত নার্স টেবিলে স্যুপের বাটি দেখে চিন্তিত গলায় বলে,

“ এখনো খাও নি কেনো? পছন্দ হয় নি? অন্য কোনো নাস্তা দিতে বলবো তোমাকে? “

মোহ অনাগ্রহ দেখিয়ে বলে,

“ খেতে ইচ্ছে করছে না। অযথা জোর করবেন না। খাবার নিয়ে আমাকে জোরাজুরি করলে আমার বমি হয়। “

নার্সটা এগিয়ে আসতে নিলেই মোহ বলে,

“ ট্রে হাতে এসেছেন। কি আছে ট্রে তে? কোনো মেডিসিন ইঞ্জেক্ট করবেন? “

“ না, না। মেডিসিন না। ব্লাড নিতে এসেছি। সিবিসি টেস্টের জন্য। “

মোহ চুপচাপ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বসে থাকে। নার্স এসে তার পাশে বসে ট্রে-টা রাখে। মোহর হাতটা ধরে নাড়াচাড়া করে কিছুক্ষণ রক্ত নেওয়ার জন্য একটা রগ খুঁজে। কিন্তু মোহর হাতে কোনো রগই স্পষ্ট ভেসে নেই। বহু কসরত করে যা একটা স্পষ্ট রগ পায়, সেটাতো সুঁই প্রবেশ করিয়ে দেখে কোনো রক্ত আসছে না। নার্সটা হতাশ গলায় বলে,

“ ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করো না, তাই না? কোনো রগই তো খুঁজে পাচ্ছি না। আমি আবার পরে আসবো ব্লাড নিতে। তুমি ভালো করে খাওয়া দাওয়া করো আর প্রচুর পানি খাও। রগ না পেলে কিন্তু অসুবিধা। “

বলেই নার্সটা ট্রে হাতে বেরিয়ে যায়। মোহ নিশ্চুপ কিছুক্ষণ নিজের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই দুই হাতের উপর দিয়ে বিগত দিন গুলোয় কি নির্মমতা কেটেছে তা একমাত্র মোহই ভালো জানে। কখনো ইঞ্জেকশন, কখনো ব্লাড টেস্ট, কখনো কেমো। সুঁইয়ের খোঁচায় খোঁচায় তার দুই হাত ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এই হাতে কি-না তারা দৃশ্যমান রগ খুঁজে বেরায়। ভ্যাম্পায়ারের দল কোথাকার!

__________

দীর্ঘ দিনের ডিউটির অবসান ঘটে রাত প্রায় সাড়ে আটটার দিকে। মনন ক্লান্ত ভঙ্গিতে হসপিটাল থেকে বেরিয়েছে কেবল। পার্কিং এরিয়ায় গিয়ে সোজা নিজের নীল রঙা গাড়িটায় উঠে বসে। স্টিয়ারিং এ হাত রাখতেই তার মনে হয় সে হয়তো কিছু একটা ভুলে যাচ্ছে। কি ভুলে যাচ্ছে?

মনন মনে করার চেষ্টা করে। উঁহু। মনে পড়ছে না। সব কাজই তো সে মিটিয়ে এসেছে আজকের জন্য। মনন ধরে নেয় হয়তো ক্লান্তির কারণে তার এমন মনে হচ্ছে। সে আর কিছু না ভেবে গাড়ি স্টার্ট দেয়। কিছুদূর যেতেই আটকা পড়ে ঢাকা শহরের সেই চিরচেনা জ্যামে। সকল যানবাহন যখন জ্যামে আটকে আছে, সেই দূর্বিষহ সময়টায় কিছু পথ বিক্রেতারা বিভিন্ন কিছু নিয়ে প্রত্যেক গাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর শুরু করে বিক্রির উদ্দেশ্যে।

মনন বসে নিজের ফোন ঘাটছিলো তখন। আচমকা তার গাড়ির জানালায় মৃদু আওয়াজ পেতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দেখতে পায় একটা পথ শিশুকে। বেলী ফুলের মালা বিক্রি করছে। মননের ফুলের মালা দেওয়ার কোনো মানুষ নেই। তবুও সে একটা ফুলের মালা কিনে নেয়। বাচ্চাটার হাতে চকচকা একটা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে জানালার কাঁচটা তুলে দেয় সে। বদ্ধ গাড়ির ভেতরটা মুহুর্তেই বেলী ফুলের মোহনীয় সুঘ্রাণে ভরে যায়। ফোন চালাতে ব্যস্ত মনন সেই সুঘ্রাণ টের পেতেই আচমকা তার মনে পড়ে যায় ভুলে যাওয়া ব্যাপারটা। চট করে সে উচ্চারণ করে,

“ মোহ। “

ওই মেয়েটা, ছাদে আছে নিশ্চয়ই? মননের অপেক্ষা করছে? মনন তো এই সময়টাই জানিয়েছিলো। মনন নিশ্চিত নয় মোহ আসলেই ছাদে আছে কি-না কিংবা মোহর অপেক্ষা করছে কি-না। অনিশ্চিত সে কোনোকিছু না ভেবেই বহু কসরত করে দ্রুত গাড়ি ঘুরায়।

চলবে…