Saturday, August 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 74



অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৫

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৫.

সারারাত ধরে সোজা হয়ে শুয়ে কেমো পোর্টের মাধ্যমে এক ব্যাগ ব্লাড নেওয়ার পর থেকে মোহ দুই চোখে সব অন্ধকার দেখছে। সারারাত একটানে সোজা হয়ে শুয়ে থাকার কারণে কমোর আর পা ব্যথায় কামড়াচ্ছে। নির্ঘুম রাত্রি পাড় করার ফলস্বরূপ মাথাও ভার হয়ে আছে।

সেই যন্ত্রণা নিয়ে তাকে এখন আবার বিকেল থেকে দ্বিতীয় ব্যাগ ব্লাড নিতে হচ্ছে। এই ব্যাগ শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। তীব্র মাথা ব্যথার মাঝেও মোহর মনে প্রশ্ন জাগে আচ্ছা তার শরীরে যেই রক্তটা যাচ্ছে সেটা কার? কোনো ছেলের নাকি মেয়ের? মানুষটার ধর্ম কি? মুসলমান? হিন্দু? বৌদ্ধ? খ্রিষ্টান? নাকি ইহুদী?

মোহ জানে যে তার এসব ভাবনা গুলো নেহাৎই অবান্তর। রক্ত দেওয়া নেওয়ার সময় জাত, ধর্ম, গোত্র মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য হলো রক্তদাতার নিয়ত। একটা মানুষ নিজের শরীরের রক্ত দান করছে কারো জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সেটাই আসল।

শিহান বারবার ঘুরে ঘুরে ব্লাড ব্যাগটা চেক করছে। মোহ শুয়ে শুয়ে দেখছে নিজের উৎসাহী তবে চিন্তিত বাবাকে। শুকনো মুখে প্রশ্ন করে,

“ তোমার কি ইদানিং অফিসে কাজ থাকে না? “

শিহান অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে মেয়ের আচানক প্রশ্নে। বলতে পারে না যে সে অফিসের কাজগুলো এখন যথাসম্ভব হসপিটালে বসেই কাভার করার চেষ্টা করে। শিহান উত্তর না দিয়ে বরং গ্লাসে কিছুটা পানি ঢেলে নিয়ে বলে,

“ অনেকক্ষণ ধরে পানি খাওয়া হচ্ছে না তোমার। চলো উঠো। পানি খেয়ে নাও। “

মোহ সংকোচ নিয়ে শুয়ে থাকে। পোর্ট নিয়ে নড়াচড়া করতে তার খুব ভয়। মনে হয় এই বুঝি কিছু হয়ে গেলো! আর তাছাড়া এভাবে একা উঠে বসতেও তার অসুবিধা হয়। কারো সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে।

শিহান বোধহয় ব্যাপারটা ধরতে পারে। এগিয়ে এসে নিজেই মোহকে ধরে কিছুটা মাথা তুলে বসতে সাহায্য করে। একহাতে মোহকে আগলে রেখে আরেক হাতে পানির গ্লাসটা মোহর মুখের কাছে নিয়ে ধরে। কিছুটা পানি খেয়ে মোহ আবার গা ছেড়ে শুয়ে পড়ে সোজা হয়ে।

শিহানও গিয়ে সোফায় বসে একটা ছুরি এবং আপেল নিয়ে। এমন সময় হঠাৎ করে তার গুরুত্বপূর্ণ কল আসায় সে মোহকে বলে ফোন নিয়ে কেবিনের বাহিরে চলে যায়। মোহ একা শুয়ে জানালার বাহিরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে। এই সেপ্টেম্বর মাস পুরোটা বোধহয় বৃষ্টির সঙ্গেই কাটবে।

মোহর ভাবনার মাঝে আচমকাই কেবিনের দরজা খোলার শব্দ হয়। মোহ ফিরে তাকায় না। ধরে নেয় বাবা এসেছে। কিন্তু হঠাৎই তার শিয়রে এস্ব দাঁড়ানো মানুষটা বলে উঠে,

“ বৃষ্টি সুন্দর না? “

মোহ চমকে পাশ ফিরে তাকায়। দেখে মনন হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। মোহ দ্রুত আশেপাশে তাকায়। নিজের স্কার্ফ হাতের কাছে খুঁজে না পেয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠে,

“ আপনি এখানে কি করছেন? “

মনন হকচকিয়ে যায়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে সোফার পাশ থেকে মোহর স্কার্ফটা নিয়ে এসে তা মোহর কাছে রেখে বলে,

“ সরি। আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই। “

মোহ দ্রুত স্কার্ফটা দিয়ে মাথা ঢেকে নিয়ে বলে,

“ আপনি ইদানিং খুব দুঃসাহস দেখাচ্ছেন বলে মনে হয় না আপনার? “

মনন মৃদু হেসে বলে,

“ তা অবশ্য ঠিক। “

মনন ব্লাড ব্যাগটা একবার দেখে নিয়ে বলে,

“ বেশিক্ষণ লাগবে না, আর মাত্র তিন চার ঘন্টা লাগবে। “

মননের কথা শেষ হতে না হতেই কেবিনের দরজা খুলে শিহান প্রবেশ করে। মেয়ের শিয়রে অপরিচিত ডাক্তারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। মোহ এবং মননও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। শিহান এসে প্রশ্ন করে,

“ আপনি কে? “

মনন মিথ্যা বলতে অপটু। তবে তাকে বাঁচিয়ে দেয় মোহ। চঞ্চল গলায় বলে,

“ আরে উনি তো ডক্টর! সব কেবিনে গিয়ে নাকি রুটিন চেকাপ করছে। আমাকেও টুকটাক প্রশ্ন করলো। “

শিহান কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টি মেলে মননকে দেখে। মনন তখন ভয়ে ঘামছে। মোহকে দেখতে এসে এ কোন বিপদে পড়লো সে! এজন্যই বোধহয় বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। মনন যখন ভয়ে মনে মনে দোয়া পড়ছে ঠিক সেসময় হঠাৎ শিহান বলে উঠে,

“ তুমি ওয়াসিফ না? কায়সার সাহেবের নাতি? “

মনন চমকায়। পরপর মাথা নেড়ে বলে,

“ জি। আমি ওয়াসিফ। ওয়াসিফ কায়সার। “

শিহানের কপালের ভাজ মিলিয়ে যায়। বেশ হাসিমুখে বলে উঠে,

“ কায়সার সাহেবের সাথে আমার পরিচয় আছে। গতবছর ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার সময় ফ্লাইটে আমাদের সিট পাশাপাশি ছিল। পুরো পথ আড্ডা দিতে দিতে যাই আমরা। ফেসবুকে উনার সঙ্গে তোমার বেশ কয়েকটা ছবিই দেখেছি। কিন্তু হঠাৎ দেখা হওয়ায় চিনতে পারি নি। “

মনন যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে বিনয়ের সঙ্গে হেসে বলে,

“ অসুবিধা নেই স্যার। আমি আসলে এই হসপিটালেই জব করি। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। “

শিহান দ্রুত বলে,

“ আরে, আরে! স্যার বলছো কেন? ইউ ক্যান কল মি আংকেল। আমার মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হও। মেহনামা। “

মনন মোহকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ নাইস টু মিট ইউ মেহনামা। “

মোহ মনে মনে হাসে। মননকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো সে এইমাত্র মোহর নাম জানলো। ইতিপূর্বে মেহনামা নামের কাউকে সে চিনতোই না। মননের সঙ্গে শিহানের আলাপ আরো বেশ কতক্ষণ স্থায়ী হয়। পুরোটা সময় মোহ কেবল শুয়ে শুয়ে দেখে দু’জনকে। কথার ফাঁকে আড়চোখে মননকে এক দু’বার তাকাতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

__________

মনন আজ বাসায় ফিরে বেশ ফুরফুরে মেজাজে। সারাদিনের ক্লান্তির লেশমাত্র তার মাঝে সাদৃশ্য নয়। ঘরে প্রবেশ করতেই সবার আগে দাদুকে টিভির রুমে দেখতে পেয়ে বলে,

“ দাদু? শিহান ফেরদৌসকে চিনো তুমি? গত বছর ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার পথে ফ্লাইটে যার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছিল। “

আলী আকবর কায়সারের মনে পড়তেই তিনি বলেন,

“ শিহান, দ্যা বিজনেসম্যান? চিনি তো। উনার মেয়ে বর্তমানে আমাদের হসপিটালে ভর্তি। “

মনন বলে,

“ উনার সঙ্গে দেখা হলো আজ। বেশ অনেকক্ষণ কথাও হয়েছে। তোমাকে সালাম জানাতে বললো। “

বলেই মনন হাসিমুখে পানি খেতে থাকে। আলী আকবর সাহেব নাতিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে পরখ করে। শিহানের সঙ্গে দেখা হওয়াতে এতো খুশি হওয়ার কি আছে? নাকি অন্য কোনো বিষয়? আলী আকবর সাহেব অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে প্রশ্ন করে,

“ হঠাৎ এতো খুশি দেখাচ্ছে তোমাকে! ঘটনা কি? ওই মেয়েটা তোমার বশে এসে পড়েছে নাকি? “

মননের হাসি এবার গাঢ় হয়। গ্লাসটা রেখে দাদুর দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলে,

“ না। সে আমার বশে আসে নি। আমি তার বশে চলে গিয়েছি। “

বলেই মনন শিস বাজাতে বাজাতে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। আলী আকবর কায়সার বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। তার নাতি শিস বাজাচ্ছে? অসম্ভব ব্যাপার এটা! আলী আকবর সাহেব দ্রুত নিজের ছেলেকে কল করে বলেন,

“ গাধার বাচ্চা! দ্রুত একটা ভালো হুজুর খুঁজে বের করো। আমার ধারণামতে তোমার ছেলেকে বদ পেত্নী আছর করেছে। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৪

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৪.

সেপ্টেম্বরের শুরুটা হয়েছে শহরের বুকে নেমে আসা বর্ষণ দিয়ে। সুখ পাখি হয়ে নিজ নীড়ে উড়ে বেড়ানো মোহকে আজ আবার হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছে। তার তৃতীয় সাইকেল কেমোটা শুরু হওয়ার কথা ছিলো সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ অর্থাৎ আজ থেকে। কিন্তু ব্লাড টেস্টের রিপোর্টে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা হুট করেই ছয়ের ঘরের নিচে নেমে যাওয়ায় ডক্টররা আগে জরুরী ভিত্তিতে ব্লাড ট্রান্সফিউশানের কথা বলেছে। হসপিটালের ব্লাড ব্যাংক থেকে ইতিমধ্যে মোহর ব্লাড গ্রুপ অনুযায়ী তার জন্য ব্লাডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুই ব্যাগ ব্লাড তাকে দুই দিনে ধাপে ধাপে দেওয়া হবে।

এইবার মোহ বারো তলায় একটা প্রাইভেট কেবিন পেয়েছে। হসপিটালে এডমিট হওয়ার ফর্মালিটিস সম্পন্ন করে কেবিনে পা রাখতেই শিহান মেয়ের উপর রাগ ঝাড়তে শুরু করে।

“ খাবার না খেয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলে বা খাবো না বলে জেদ করলে তো হিমোগ্লোবিন লো হবেই। আরো নখড়া করো! কার কি? এখন শুধু শুধু কেমোর ডেটটা পিছিয়ে গেলো। ট্রিটমেন্ট শেষ হতে আরো দেরি হবে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার ইচ্ছে থাকলে তো খাওয়াদাওয়াটা ঠিকঠাক করতো! “

মোহ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নীরবে শুনে সবটা। বাবার রাগটা অযথা নয় সে জানে। কিন্তু তারও কি খুব দোষ আছে? সে কাউকে বুঝাতে পারে না যে সে ইচ্ছে করে খাবার নষ্ট করে না। তার কাছে সবকিছুই কেমন পানসে লাগে।

শিহানের কথার মাঝেই কেবিনে একজন নার্স প্রবেশ করে। মোহর প্রেশারটা মেপে ফাইলে তা নোট করে রাখে তিনি। যাওয়ার আগে জানিয়ে যায়, রাতে খাওয়ার পর মোহকে ব্লাড দেওয়া হবে। সারা রাতে এক ব্যাগ দেওয়ার পরিকল্পনা ডক্টরের। আরেক ব্যাগ আগামীকাল দেওয়া হবে।

মোহ আপত্তি করে না। খাওয়া দাওয়া করে একেবারে ফ্রেশ হয়ে শোয়ার পর ব্লাড নেওয়াটা তার কাছে বেটার অপশন মনে হয়। শিহান কিছুক্ষণ রাগারাগি করে ফোন বের করে সময়টা দেখে নেয়। তার ল্যাপটপটা সঙ্গে করে আনা হয় নি। তাছাড়া মোহর জন্যও কিছু ফলমূল কিনে আনতে হবে। ড্রাইভার ছুটিতে আছে বলে কাউকে নিয়েও আসতে বলতে পারছে না শিহান। মায়ারও পরীক্ষা সামনে। ওর মনযোগটা এখন পড়াশোনার দিকে থাকাই উত্তম।

শিহান উঠে দাঁড়িয়ে মোহকে বলে,

“ আমি একটু বাসায় যাচ্ছি। ল্যাপটপ আর দু একটা ফাইল নিয়ে আসতে হবে। আসার সময় তোমার জন্য ফল নিয়ে আসবো। তোমার কিছু লাগবে? কিছু নিয়ে আসবো? “

মোহ জানালা দিয়ে আবার বাহিরে তাকায়। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মোহর হঠাৎ করেই খুব খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে হলো। সে নরম গলায় বলে উঠে,

“ শায়লা আন্টিকে একটু খিচুড়ি রেঁধে দিতে বলবে? রাতে হসপিটালের খাবার খেতে চাচ্ছি না। আমার বমি পায়। “

শিহানের মনটা হঠাৎ নরম হয়ে আসে। প্রশ্ন করে,

“ খিচুড়ির সাথে কি খাবে? বেগুন ভাজা? তোমার তো এলার্জি আছে। “

“ শুধু পেয়াজ ছাড়া ডিম ভাজি হলেই চলবে। “

মেয়ের এই সামান্য আবদারে শিহান সন্তুষ্ট হলো না। ঠিক করলো বাসায় ফেরার সময় কবুতরের বাচ্চা কিনে নিয়ে যাবে। বাসায় গিয়ে শায়লা আপাকে বলবে তার মেয়ের জন্য যেনো খিচুড়ির সাথে কবুতরের মাংস আলু দিয়ে ভুনা করে দেয়। সাথে একটা ডিম ভাজি।

শিহান চলে যেতেই মোহ আবারও জানালার বাহিরে তাকায়। আজকের বৃষ্টিটা একটু বেশিই সুন্দর? নাকি তারই এরকমটা মনে হচ্ছে?

__________

গোধূলি লগ্ন তখন। শিহান গিয়েছে আধ ঘন্টা হবে বোধহয়। এর মধ্যে কয়েকবার কল করে মোহর খোঁজ নিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। মোহ বাধ্য মেয়ের মতো জানিয়েছে যে সে কেবিনেই আছে, শুয়ে ফোনে গেমস খেলছে। শিহান জানিয়েছে যে রান্না হতে আরো ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। মোহ যেনো ততক্ষণ নিজের খেয়াল রাখে। বাবার এই অহেতুক চিন্তায় মোহ বিরক্ত হয় না। বরং বেশ মজা পায়। বাবা ইদানিং তাকে নিয়ে যে চিন্তা করে সেটা বিভিন্ন কাজেই প্রকাশ করে ফেলে।

ভাবনায় বিভোর মোহর ধ্যান ভাঙে আরেক দফা রিংটোনের শব্দে। তাকিয়ে দেখে এবার বাবা নয় বরং আরেকজন পুরুষ তাকে কল করছে। যে-ই পুরুষটাও সম্ভবত মোহকে নিয়ে চিন্তা করে। সেদিন নদীর পাড় হতে ফেরার পর থেকে লোকটা প্রতিদিন তাকে সময় করে ম্যাসেজ দেয় হালচাল জানতে। মোহ নিজেও রিপ্লাই করে। যে যার রাস্তা মাপার ব্যাপারটায় আর অটল থাকতে পারে না সে। মনে হয় যেহেতু লোকটা নিজ থেকে যোগাযোগ করছে সেহেতু মোহর যেভাবে যা চলছে তা চলতে দেওয়া উচিত। সে তো অন্তত গায়ে পড়ে লোকটার সঙ্গে কথা বলছে না। এটাই যথেষ্ট তার জন্য।

ভাবনা থেকে বেরিয়ে মোহ কল রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশ হতে মনন প্রশ্ন করে,

“ কেমো চলছে? “

“ উঁহু। “

“ এখনো শুরু করে নি দেওয়া? “

“ কেমোর ডেট পিছিয়েছে। সিবিসি রিপোর্টে হিমোগ্লোবিন সিক্স পয়েন্টের নিচে এসেছে। এখন ব্লাড ট্রান্সফিউশান করাবে। “

মননের কণ্ঠে এবার চিন্তা প্রকাশ পেলো।

“ আল্লাহ! লাস্ট উইকের রিপোর্টেও তো হিমোগ্লোবিন কাউন্ট নরমাল ছিল বলেছিলেন। হুট করে ড্রপ করাটা তো চিন্তার বিষয়। “

“ প্যারা খাওয়া কিছু নেই। আজকে ওভার নাইট এক ব্যাগ ব্লাড নিবো আর কালকে আরেক ব্যাগ। কাউন্ট আবার নরমাল হয়ে যাবে। “

“ আপনি কি এখন কেবিনে? “

“ হু। “

“ ফ্যামিলি সাথে আছে? “

“ বাবা কিছুক্ষণের জন্য বাসায় গিয়েছে। রাতের খাবার নিয়ে আসতে। আপনাদের হসপিটালের খাবার একদম বাকওয়াস। “

মনন এবার কিছুটা সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ দেখা করা যাবে? “

মোহ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে,

“ বৃষ্টি হচ্ছে। ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়। “

“ কেবিনে আসতে পারবেন? “

মোহ কিছুক্ষণের জন্য ভাবনায় পড়ে যায়। আসলে সে-ও একা কেবিনে বসে থেকে বিরক্ত বোধ করছিলো। একা কেবিনে বসে থাকার থেকে একটু নিচ থেকে ঘুরে আসা উত্তম। মোহ বলে,

“ আচ্ছা। আসছি। “

“ শুনুন। “

“ বলুন। “

“ এসে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না। সরাসরি কেবিনে চলে আসবেন। আমি বাহিরে কাউন্টারে বলে রাখবো। “

মোহ কলটা কেটে উঠে বসে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে একজন নার্সকে জানিয়ে যায় সে একটু হাঁটাহাঁটি করতে বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে চলে আসবে।

__________

আজকের জন্য মননের রোগী দেখার সময় পেরিয়েছে আরো ঘন্টা খানেক আগে। সাতটার দিকে তার পেশেন্ট ভিজিটে যেতে হবে। ততক্ষণ সে ফ্রি আছে আপাতত। তা-ই মোহও ফ্রি আছে জানতে পেরে দেখা করতে চেয়েছে। ভাগ্যিস মোহ রাজি হয়েছে!

মনন কম্পিউটারে বসে একটা পেশেন্টের ফাইল দেখছিল। এরই মাঝে হঠাৎ কেবিনের দরজা ঠেলে মোহ ভিতরে উঁকি দিলো। ছোট করে প্রশ্ন করে,

“ আসবো? “

মনন সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ হ্যাঁ। প্লিজ, আসুন। “

মোহ নীরবে কেবিনে প্রবেশ করে প্রশ্ন করে,

“ ফ্রি এখন? “

“ হ্যাঁ। “

এতটুকু বলেই দু’জন চুপ হয়ে যায়। দু-জনের নীরবতাই অস্বস্তিতে ঘেরা। বুঝে উঠতে পারে না কি বলা উচিত তাদের। মোহর এভাবে চুপ থাকতে আরো বেশি অস্বস্তি হচ্ছিলো। তা-ই সে কেবিনটা ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ বলে উঠে,

“ বাহ! আপনি তাহলে একা থাকেন না এখানে। রুমে আপনার ফ্রেন্ডও হাজির আছে। “

মনন লক্ষ্য করে মোহ তার রুমের এক কোণায় থাকা কৃত্রিম কঙ্কালটাকে দেখিয়ে কথাটা বলছে। সে মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে মোহর পাশে দাঁড়ায়। কঙ্কালটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ হেই বনি। মিট হার। মেহনামা ফেরদৌস মোহ। “

অত:পর মোহর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ মোহ, মিট মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর নাম বনি। আমার ইন্টার্ন লাইফ থেকে হি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। “

মোহ সন্দিহান গলায় বলে,

“ ডক্টরদের মাথার তারে একটু সমস্যা থাকে শুনেছিলাম। কিন্তু আজ প্রমাণও পেলাম। লেস্কেটন কিভাবে কারো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়? “

মনন মাথা চুলকে হেসে বলে,

“ লেস্কেটন না, স্কেলেটন হবে উচ্চারণটা। আমি সহজে ফ্রেন্ড বানাতে পারতাম না। কারো সাথে নিজ থেকে কথা বলতে অস্বস্তি ফিল হতো। তাই দাদু আমাকে এই স্কেলেটন গিফট করে। বনি ইজ এ গুড ফ্রেন্ড। “

মোহ আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়,

“ আপনি এই লেস্কেটনকে বনি কেনো ডাকেন? “

মনন এবার সরাসরি মোহর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনি আমাকে মদন কিংবা মরণ কেনো ডাকেন? “

মোহ এবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। কথা ঘোরাতে আশেপাশে তাকায়। কিছু না পেয়ে বলে বসে,

“ আজকের বৃষ্টি সুন্দর। অসুস্থ না হলে আমি এতক্ষণে সাইকেল নিয়ে বাসার সামনে ঘুরতাম। আর বাসায় ফিরে মজার একটা জ্বর উপভোগ করতাম। “

মনন বুঝতে পারে মোহ কথা ঘুরিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। তা-ই সে-ও সঙ্গ দিয়ে বলে,

“ জ্বর কি করে মজার হয়? “

“ বৃষ্টিতে সাইক্লিং করতে গিয়ে জ্বর বাঁধালে সেটাকে আমি উপভোগ করি। মনে হয়, জ্বর এসেছে তো কি হয়েছে? আমার আত্মা তো তৃপ্ত। “

মনন কিছু একটা ভেবে বলে,

“ বৃষ্টি দেখতে যাবেন? “

মোহ অবাক হয়ে বলে,

“ সম্ভব না। বৃষ্টিতে ভিজে টিজে গেলে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ইনফেকশন হলে কি হবে? “

মনন হেসে বলে,

“ হবে না ইনফেকশন। আমি আছি। ইউ আর সেফ উইথ মি। “

__________

গাড়ির ব্যাক সিটে বসে শহর জুড়ে নামা বৃষ্টি মোহ দেখছে মুগ্ধ চোখে। আর গাড়ির রেয়ার ভিউ মিরর হতে তাকে দেখছে আরেক জোড়া মুগ্ধ দৃষ্টি। আচমকা মোহকে সামনে তাকাতে দেখেই মনন চোখ ফিরিয়ে নেয়। মনযোগের সহিত ড্রাইভ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মোহ পিছন থেকে কণ্ঠে উচ্ছ্বাস নিয়ে জানায়,

“ এদিকের রোড সাইড ভিউ চমৎকার। “

মনন হেসে বলে,

“ ভিউ চমৎকার। কিন্তু বৃষ্টির সময় প্রায়ই জ্যাম লেগে থাকে। “

বলতে বলতে মনন গাড়ির গতি ধীর করে। সামনেই জ্যাম লেগে আছে। মনন ঠিক করে এখান থেকে আর সামনে যাবে না, গাড়ি ঘুরিয়ে নিবে। মনন ইউ টার্ন নেওয়ার জন্য গিয়ার লিভারে হাত রাখতেই জানালায় কিছু একটার শব্দ শুনে। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে একটা ছয় বছরের বাচ্চা ছেলে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মনন গাড়ির কাঁচ নামাতেই বাচ্চাটা শুধায়,

“ ফুল নিবেন স্যার? “

মনন একবার মিররের মাধ্যমে সরাসরি মোহর দিকে তাকায়। মোহও তার দিকে তাকিয়ে ছিল। মননকে তাকাতে দেখেই সে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মনন বাচ্চাটাকে বলে,

“ দাও। “

“ কদম নিবেন নাকি দোলনচাঁপা? “

মনন নিশ্চিত হতে মোহকে জিজ্ঞেস করে,

“ আপনার কোনো ফুলে এলার্জি আছে? “

মোহ অবাক হয়। পরমুহূর্তে মাথা নেড়ে না জানায়। মনন ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে বাচ্চাটাকে দিয়ে বলে,

“ দুটোই দাও। “

বৃষ্টিতে ভেজা এক গুচ্ছ কদম এবং দোলনচাঁপা নিয়ে মনন তা নিজের পাশের সিটে রেখে দিয়ে গাড়ি হসপিটালের পথে ঘুরালো। মোহ নীরবে দেখে সবটা। অত:পর চোখ ফিরিয়ে সে বাহিরে তাকায়। হুট করেই তার মনে অভিমান চাপে। তার মন হয়তো ফুলগুলোকে নিজের জন্য আশা করছিল। কিন্তু মনন তার জন্য কেনো ফুল কিনবে? নিশ্চয়ই বিশেষ কারো জন্য নিয়েছে। মননের জীবনে কি সত্যিই বিশেষ কেউ আছে?

বাকিটা রাস্তা মোহ আর একটাও কথা বললো না। না দেখা গেলো তার মাঝে উচ্ছ্বাস। হুট করেই যেনো কেমন মিইয়ে গেলো। হসপিটালে পৌঁছাতেই মোহ দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়তে নিলো। কিন্তু মননের ডাকে সে থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রাইভিং সিটের দিকে তাকাতেই মনন তার দিকে কদম এবং দোলনচাঁপা গুলো এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ আপনার জন্য। “

মোহর চাপা অভিমান ফুঁস করেই হাওয়া হয়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো নিলো। অত:পর কি ভেবে যেনো কদম গুলো আলাদা করে মননের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ এগুলো আপনি রাখুন। “

মনন বারণ করে না। কদম গুলো নিয়ে কিছু বলতে নিবে এর পূর্বেই মোহ তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। একবারও ফিরে তাকালো না। গাড়ির ভেতর থেকে মনন কেবল দেখলো হালকা আকাশি রঙের জামা এবং সাদা রঙের স্কার্ফ মাথায় প্যাঁচানো মেয়েটা কিভাবে ফুল হাতে ছুটে হসপিটালের ভেতর চলে গেলো। মনন হঠাৎ আনমনে হেসে উঠে। কদম গুলো হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে। হুট করেই সব সুন্দর লাগছে তার। ঝুম বৃষ্টি, কদম, মোহ সবই অপার্থিব সুন্দর। ঠোঁটে হাসি নিয়েই মনন মনে মনে আওড়ায়,

“ আপনার বেঁচে থাকাটা জরুরী মোহ। আপনি প্লিজ সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকুন। সাইক্লিং নিষিদ্ধ হলেও আপনাকে আমি বৃষ্টি দেখাবো কথা দিচ্ছি। তবুও বেঁচে থাকুন। এরকম দোলনচাঁপা হাতে আপনাকে আমি আরো বহু বছর দেখতে চাই। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৩

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৩.

তারিখটা আজ আগস্ট মাসের ২৭ এর ঘরে। দিনের শুরুটা হলো মোহর নাস্তার টেবিলে বসতেই চোখ মুখ কুচকানো দিয়ে। অবশ্য প্রতিদিনই খেতে বসলে তার সুন্দর মুখটা বিরক্তিতে কুচকে আসে। প্লেটে থাকা অল্প মশলায় ভাজা আলু ভাজি, দুটো ডিম সিদ্ধ এবং সেদ্ধ আটার রুটি দেখে মোহর ইচ্ছে করছে উঠে একছুটে বমি করে আসতে। কিন্তু এরকমটা করলে টেবিলে বসে থাকা তার পিতা মহদয় তাকে দুই ঘন্টার লেকচার শোনানো শুরু করবে। সেটার থেকে জোর করে এসব ছাইপাঁশ গিলে নেওয়া উত্তম মনে হয় মোহর কাছে।

সিদ্ধ ডিমের সাদা অংশটা খুটে খেয়ে কুসুম দুটো ফেলে উঠে যাচ্ছিলো মোহ। শিহান ভারী গলায় ডাকে,

“ কুসুম কে খাবে? “

মোহ দাঁত বের করে হেসে বলে,

“ একটা তুমি খাও, আরেকটা মায়া খাবে। আমার পিছনে কতো দৌড়াও তোমরা! তোমাদের শক্তির প্রয়োজন বেশি। “

শিহান চুপচাপ চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকে মোহর দিকে। মোহ মুখ লটকে বলে,

“ আমি কেন খাবো? এতে আমার কি লাভ? আমি কি পাবো? “

শিহান ভ্রু কুচকে বলে,

“ শক্তি পাবে। শরীরে বল পাবে। আর কি চাও? “

মোহ এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলো। সুযোগ পেতেই সে লুফে নিয়ে বলে উঠে,

“ আমি একটু ঘুরতে বের হই? “

টেবিলে উপস্থিত মায়া এবং শিহানকে কিছুটা অবাক হতে দেখা গেলো। মায়া তবুও পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বলে,

“ ঘুরতে যাবি? সমস্যা নেই, আমিও সাথে যাবো। কোথায় যাবি বল। “

মোহ মুখ শক্ত করে বলে,

“ আমি একা বের হতে চাচ্ছি। “

“ অসম্ভব! “

শিহান সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়। মোহ ঠোঁট উল্টে কিছুটা ঢং করে বলে,

“ প্লিজ! একটু বের হই একা? ক’টা মাস ধরে আমি এই বেড়াজালে আটকা পড়ে আছি। পুরো ফেড আপ হয়ে গিয়েছি। একটু একা ঘুরি না বহুদিন! “

শিহান গলে না। মুখ শক্ত করে বসে থাকে। মোহও তার বাবার গুণই পেয়েছে। ঘাড়ত্যাড়ামি করে রাগ দেখিয়ে বলে,

“ ভালো! বেধে রাখো সবাই আমাকে হসপিটাল আর বাসার ভেতর। বেশি কিছু তো চাই নি। একদিন সামান্য ঘুরতে চেয়েছি শুধু। কিন্তু যেহেতু আমার এই আবদার কেউ মানবে না, সেহেতু আমিও আর কারো কথা শুনবো না। যাচ্ছি আমি। ওষুধও খাবো না আর রুম থেকেও বের হবো না। টাটাহ। “

বলেই মোহ একছুটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। মায়া পিছু ডাকে,

“ এই! দৌড়াচ্ছিস কেন? আস্তে মোহ! “

মোহ শুনে না সেসব। শিহান রাগে চেঁচিয়ে উঠে,

“ আমাকে ব্লেকমেইল করছে ও? আমার সাথে ঘাড়ত্যাড়ামি করছে? এতো সাহস? “

মায়া স্বাভাবিক মুখে জবাব দেয়,

“ তোমার মতই তো হয়েছে। এটা তুমিও ভালো করে জানো যে, ও যা বলে গিয়েছে তা-ই করবে। শুধু শুধু এই ব্যাপারটা না বাড়িয়ে পারমিশন দিয়ে দাও। এটা তো সত্যি যে ও অনেকদিন ধরে হসপিটাল টু বাসা ছাড়া আর কোথাও যাচ্ছে না। আজকে যেহেতু চাইছে, সেহেতু ড্রাইভার আংকেলকে দিয়ে যেখানে যেতে চায় যেতে দাও। “

মায়ার কথার কোনো প্রতুত্তর করে না শিহান। চুপচাপ বসে রয় কিছুক্ষণ। বাপকে ব্লেকমেইল করছে তার মেয়ে! শিহানও কম যায় না! মায়াকে বলে,

“ ওকে গিয়ে বলে দাও বিকালে ড্রাইভারের সঙ্গে যেতে পারবে। কিন্তু বিকালের আগ পর্যন্ত ওকে যা যা খেতে দেওয়া হবে তা চুপচাপ খেতে হবে। কোনো প্যাংছামি আমি শুনতে চাই না। “

মায়া হাসবে নাকি কাদবে বুঝতে পারে না। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় তার বাপ আর বোন দু’জনই পাগল। সারাদিন প্রতিযোগিতায় লেগে থাকে কে ঘাউড়ামিতে এগিয়ে থাকতে পারে।

__________

মননের দুপুরটা কাটে ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। চার মাসের একটা লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়। চার মাসের ওই নিষ্পাপ প্রাণটার নামটাও ঠিকঠাক শোনার সময় পায় না ডাক্তাররা। সকলে লেগে পড়ে বাচ্চাটার নিভু নিভু জীবন শিখাকে জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টায়।

ইমারজেন্সি ইউনিট থেকে বাচ্চাটাকে দ্রুত সময়ে আই সি ইউ তে শিফট করার প্রয়োজন পড়তেই মনন নিজে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে সিনিয়র ডক্টরদের পিছনে ছুটে। কিন্তু আই সি ইউ তে পৌঁছানোর পূর্বেই বাচ্চাটা মননের কোলেই দম ছেড়ে দেয়। সীমিত জীবন সন্ধির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে।

পুরো ঘটনাটা ঘটে মননের চোখের সামনে। তারই সংস্পর্শে। হতবুদ্ধির ন্যায় ঘন্টা কয়েক মনন আই সি ইউর সামনেই বসে থাকে। পুরো ব্যাপারটা হুট করেই যেনো তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে। নিষ্পাপ বাচ্চাটার মুখ তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠে। তার সিনিয়র পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে তাকে বলে,

“ ইট’স ওকে। উই ট্রাইড আওয়ার বেস্ট। আল্লাহর মর্জির থেকে তো আমাদের চেষ্টাটা বড়ো না। তোমার না বিকেলে ডে অফ নেওয়ার কথা? তুমি বরং এখনই বাসায় চলে যাও। তোমার শিফটটা ডক্টর মুবিন সামলে নিবে। “

মনন আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ হসপিটাল থেকে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায় নদীর পাড়ে। যেখানটায় মোহ বিকেলে দেখা করবে বলে জানিয়েছে। পুরো বিকেলটা মনন নদীর পাড়ে একটা বাঁশের পাটাতনে বসে কাটায়। ভয়ংকর অভিজ্ঞতাটা মস্তিষ্ক থেকে দূরই হচ্ছে না। বাচ্চাটার মা বাবার আহাজারি মনে পড়তেই তার পুরুষালি মনটা টলে উঠে। চোখ ঠিকরে অশ্রু বেরিয়ে আসতে চায়। তবে মনন সেই সুযোগ দেয় না। বিষাদমাখা অভিজ্ঞতাটার পীড়া গিলে নেয় নীরবে।

মোহ আসে বিকাল ৪ টা বেজে ২৭ মিনিটে। গায়ে জড়ানো হালকা বেগুনি রঙের টপস এবং সাদা প্যান্ট। মাথায় প্যাঁচানো স্কার্ফ। মুখটাও মাস্কের সাহায্যে ঢাকা। দূর হতেই মননকে লক্ষ্য করে সে। কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে! কাছাকাছি আসতেই টের পেলো লোকটা বোধহয় কাদছে। আরেকটু কাছে আসতেই স্পষ্ট হলো, কাদছে নয় তবে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। মোহ দূরত্ব রেখে পাশে বসতে বসতে বলে,

“ ঠিক আছেন? “

মননের ধ্যান ভাঙে। মোহকে দেখে বলে,

“ সরি। কখন এসেছেন? কেমন আছেন? “

“ মাত্র আসলাম। ঠিক আছি। কিন্তু আপনাকে ঠিক মনে হচ্ছে না। “

মনন কিছু বলতে নিয়েও বলে না। এসব ব্যাপার মোহর সঙ্গে শেয়ার করার মানে হয় না। অযথা ভয় পাবে মেয়েটা। তা-ই নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুটা হেসে বলে,

“ কিছু না। ঠিক আছি। রাতে ঘুম হয় নি ঠিকঠাক। সেজন্য ক্লান্ত দেখাচ্ছে হয়তো। “

মোহ বুঝতে পারে মনন এইমাত্র একটা ডাহা মিথ্যা কথা বলেছে। কিন্তু সে আর ব্যাপারটা ঘাটায় না। সে নিজের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে সে কিছুতেই নিজের সীমারেখা ভুলবে না। তা-ই সরাসরি প্রশ্ন করে,

“ দেখা কেন করতে চেয়েছেন? “

মনন আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। কথা হারিয়ে বসেছে সে। মনে পড়ছে না মোহকে কি বলতে চাইছিলো সে। মনে পড়লেও সাজিয়ে উঠতে পারছে না কথাগুলো। আবারও বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে যায় তার। চোখ আবার অশ্রুসিক্ত হয়। চশমার ফ্রেমটাও হঠাৎ ঘোলা হয়ে উঠে। মোহর চোখ এড়ায় না কিছু। এবার সে নিজের সীমারেখা ছেড়ে বের হয়। মননের চোখের চশমাটা খুলে নিয়ে নিজের স্কার্ফের এক কোণা দিয়ে কাঁচটা পরিষ্কার করে দেয়। স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ আমি আপনার সামনে কেঁদেছিলাম। আপনিও চাইলে কাঁদতে পারেন। কাউকে বলবো না, শোধবোধ। “

মনন না চাইতেও আশকারা পেয়ে বলে বসে,

“ একটা বাচ্চা… “

এতটুকু বলে মনন থেমে যায়। নিজেকে সংবরণ করে নেয় আবার। তবে এবার মোহ নিজ থেকেই আন্দাজ করে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ মারা গিয়েছে? “

মোহ অনেকটা সরল মনেই প্রশ্নটা করে। তবে মনন অবাক হয়। কিছুক্ষণ নিষ্পলক মোহকে দেখে কেবল হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। মোহ এবার জানতে চায়,

“ কতটুকু ছোট ছিলো? “

“ চার মাস… “

মোহ নিজেও এবার চুপ হয়ে যায়। মনে মনে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠে,

“ ওর জন্য আলাদা করে জান্নাত চাইছি না। নিষ্পাপ ফুল ছিলো। ওর গন্তব্য জান্নাতেই। “

মনন চশমা ছাড়াই নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। এদিকটায় মানুষ জন খুবই কম। শীতল বাতাস আছে। মোহ মননের চশমাটা ফেরত পড়িয়ে দেয়। মনন বাঁধা দেয় না অবশ্য। মোহকে সে শুরু থেকেই অজান্তে অনেক ব্যাপারেই ছাড় দিয়ে আসছে। হোক সেটা স্টেথোস্কোপ কিংবা এপ্রোণ কিংবা চশমা। মোহ শুকনো মুখে প্রশ্ন করে,

“ পেশেন্ট মারা গেলে কি সব ডক্টরদেরই কান্না পায়? “

মনন মোহর প্রশ্নের পিঠে কেবল তার দিকে তাকিয়ে রয়। কোনো উত্তর দেয় না। মোহ এবার নদীর দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় শুধায়,

“ আমার সার্ভাইবাল রেট জানেন? “

মনন ইচ্ছে করেই উত্তর দেয় না এবার। চোখ ফিরিয়ে নেয়। এমন ভান করে যেনো সে কিছু শুনতেই পায় নি। তবে মোহ বলে উঠে,

“ ৫৫%। রিপোর্টে এতো এসেছে। যদিও বেঁচে যাওয়ার পারসেন্টেজ কিছুটা বেশি, কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে আমার সার্জারি করাতে হবে। সার্জারিতে উনারা আমার হাড় কেটে ফেলে দিবেন। ইমপ্ল্যান্ট বসাবেন হাড়ের বদলে। পুরো জীবনের জন্য আমার দৌড়ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাবে। কখনো সাইকেলও চালাতে পারবো না। এর থেকে মরে যাওয়াটা সহজ মনে হয় আমার। “

মনন অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিলো। এই পর্যায়ে সে চোখ বুজে নেয়। তার এতদিনের দ্বিধার সমাধান হয় মোহর কথার সঙ্গে বুকটা কেঁপে উঠার মধ্য দিয়ে। উঁহু। এত বছর সে অনেক বড়ো একটা ভুল ধারণার মাঝে ছিলো। পরশির প্রতি সে যা অনুভব করতো তা ভালোবাসা ছিলো না। পরশিকে হারিয়েও এক মুহুর্তের জন্য তার কখনো মনে হয় নি সে হয়তো মরে যাবে। কিন্তু তার পাশে বসা এই মেয়েটা, মোহ। এই মেয়েটার মৃত্যু সম্ভাবনা শুনতেই তার নিঃশ্বাসে টান পড়ে। অনুভব করে সে হয়তো মারা যাচ্ছে। অদ্ভুৎ সেই অনুভূতি। মনন কাউকে দেখাতে পারে না। বলতেও পারে না।

মোহ হঠাৎ আনমনে বলে বসে,

“ ওদিন হসপিটালের ছাদ থেকে এসে আমার নিজেকে খুব গায়ে পড়া, সস্তা মেয়ে মানুষ মনে হচ্ছিলো। নিজের কাছেই নিজেকে বোঝা মনে হচ্ছিলো। আমি ওই সন্ধ্যায় নিজের মৃত্যু কামমা করেছি। এটাই সলিউশন মনে হয়েছে আমার। আমি অস্থির প্রকৃতির মেয়ে, এতো নিয়মশৃঙ্খলা মেনে বাঁচা আমার জন্য কষ্টের হবে। “

মনন চমকে তাকায় মোহর দিকে। বুক জুড়ে বিষব্যথা অনুভব করছে সে। মস্তিষ্ক বিদ্রোহ করে উঠলো।

“ তোর কারণে মনন। তোর কারণে মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে ওদিন। এতটাই কষ্ট পেয়েছে যে নিজের মৃত্যুকামনা করে বসেছে। “

মনন মস্তিষ্কে আলোড়িত কথাগুলো ভুলে ব্যথাতুর স্বরে আওড়ালো,

“ আপনি এতটা অবুঝ মোহ? অবুঝের মতো নিজের মৃত্যু চাইলেন? কারো কথা ভাবলেনও না? “

মোহ মলিন হেসে বলে,

“ সবার কথা ভেবেই চেয়েছি। মাছের কাঁটা চিনেন? আমাকে সবাই ভালোবাসলেও আমার আপাতত নিজের জীবনটা মাছের কাঁটার মতোই মনে হয়। না গিলে ফেলা যাচ্ছে, আর না উগড়ে দেওয়া যাচ্ছে। “

মনন টলমল করা চোখে মোহকে দেখতে দেখতে বলে উঠে,

“ কাঁটা নন আপনি। আপনিও ফুল। সবাই আপনাকে ফুটে থাকতে দেখতে চায়। আপনি প্লিজ ঝরে যাবেন না। প্লিজ মোহ। “

মোহ প্রশ্ন করে বসে,

“ আপনিও চান? “

“ হ্যাঁ। আমিও চাই। সুস্থ মোহকে দেখতে চাই। আপনাকে বাঁচতে দেখতে চাই। আপনি বেঁচে থাকুন প্লিজ। “

মোহ বুঝলো না অর্থ। চোখ ফিরিয়ে আবার নদীর দিকে তাকায় সে। ধরে নেয় ওই বাচ্চাটাকে মনন যেরকম বাঁচতে দেখতে চেয়েছিলো, মোহকেও একইভাবে বাঁচতে দেখতে চায়। অবুঝ মোহ বুঝলো না মননের কাছে তার জীবনের গুরুত্বটা। বুঝলো না তার অজান্তেই তার পাশে বসে থাকা পুরুষটার ভেতর কি দাবানলের খেলা চলছে। তার কাছে সবটা শান্ত মনে হলো। একদম এই শীতল নদীটার মতো।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২২

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২২.

মোহর দ্বিতীয় সাইকেল কেমো নেওয়ার এক সপ্তাহ পেরিয়েছে। আজ আবার হসপিটালের চক্কর কাটতে হবে তার। ব্লাড টেস্ট সহ যাবতীয় দু একটা টেস্ট করে একবার কেমোর ডক্টরকে দেখাতে হবে তারপর আবার সার্জারীর ডক্টর দেখাতে হবে। সব মিলিয়ে দিনের একটা লম্বা সময় আজ তার হসপিটালেই পাড় হবে।

শিহানের জরুরী কিছু কাজ থাকায় তাকে ঢাকার বাহিরে যেতে হয়েছে। তিনি শায়লাকে মোহর সঙ্গে হসপিটালে যেতে বলেছিল। কিন্তু মায়া জোরাজুরি করে শায়লার বদলে নিজেই মোহর সঙ্গে এসেছে। শুভ্রকেও কল করে জানিয়েছে যেনো হসপিটালে পৌঁছে যায়। এই কাজটা অবশ্য মোহর অনুমতি নিয়েই করেছে সে। মোহও আপত্তি জানায় নি কোনো।

মায়া আর মোহ হসপিটালে এসে আগে মোহর টেস্ট গুলো করিয়ে নেয়। ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট আসতে অন্তত এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লাগবে। রিপোর্ট আসলে তারপর ডক্টর দেখাতে হবে। তাই ততক্ষণের জন্য তারা ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে বসে। শুভ্রও এরই মাঝে এসে হাজির হয়ে যায়। হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে মায়ার মুখোমুখি বসে। মায়ার পাশের চেয়ারে বসা মোহ কপাল কুচকে প্রশ্ন করে,

“ তুই কি বাজার থেকে আসছোস? “

শুভ্র জবাব দেয়,

“ না দোস্ত! তোর ভাইয়ের এতো টাকা আছে? এসব তো আম্মুর ছাদে লাগানো গাছের ফলমূল। তোর জন্য নিয়া আসছি। একদম অরগানিক! বাজারের ফলমূল খাবি না একদম। শালারা ফরমালিন দিয়া ভরায় রাখে সব। “

মোহ সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ ডক্টর হওয়ার শখ জাগসে তোর? “

“ আরে না! ডাক্তারি পড়ে পাগলে। আমাকে কি তোর পাগল মনে হয়? “

“ তাহলে অরগানিক আর ফরমালিনের জ্ঞান ঝাড়তেসিস কেন? “

“ আমি তো তোর কথা ভেবেই বলছিলাম। “

“ উহু৷ আসল কাহিনী হচ্ছে মায়ার সাথে থাকতে থাকতে তুই ওর মতো হয়ে যাচ্ছিস। এই মেয়ে সারাদিন আমার আম্মা সেজে ঘুরে বেড়ায়, আর এখন তুই আসছিস আব্বা সাজতে। “

শুভ্র দাঁত বের করে হাসে। তিনজনই যখন আড্ডায় মশগুল তখন মোহ আলগোছে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। ম্যাসেজ নোটিফিকেশন চেক করতেই পরিচিত নাম্বার দেখে কৌতূহল বোধ করে সে। সোজা নোটিফিকেশন হতে ম্যাসেজে প্রবেশ করে।

“ টেস্ট ডান? “

হঠাৎ মননের ম্যাসেজ পেয়ে মোহ অবাক হয়। এই লোক কিভাবে জানলো আজ মোহর টেস্ট আছে? মোহ তো একবারও এই বিষয়ে কিছু বলে নি। এমনকি গত চার দিনে মনন কেবল চার বার তাকে ম্যাসেজ করেছিলো তার শারীরিক অবস্থা জানতে। প্রতিবারই মোহ জবাবে শুধু বলেছে,

“ ঠিক আছি। “

এর থেকে বেশি এক লাইনও কথা হয় নি তাদের। মোহ যখন কিছুটা বিস্ময় নিয়ে এসব ভাবছিলো তখনই আরো একটা ম্যাসেজ আসে মননের তরফ থেকে।

“ পিছনে তাকান। ডান পাশের সারির ফিফথ টেবিল। “

মোহ সাথে সাথে ঘুরে পিছনে তাকায়। দেখতে পায় মননকে। এক হাতে ফোন আর অন্য হাতে স্যান্ডউইচ নিয়ে বসে আছে। মোহকে দেখে সামান্য হাসে। মোহ সাথে সাথে আবার সামনে ফিরে বসে। ম্যাসেজের রিপ্লাই করে,

“ হু। ডান। “

“ ডক্টর দেখাবেন কখন? “

মননের আগ্রহ দেখে মোহ কিছুটা সংকোচে পড়ে। তবুও জবাব দেয়,

“ এক ঘন্টা পর। “

“ ওকে। আপনার সময় হবে? দেখা করতে পারবেন? বেশি সময় নিবো না আপনার। আই জাস্ট নিড টু টক টু ইউ। “

মোহ আরেক দফা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এই আগ বাড়িয়ে নিজ থেকে দেখা করতে চাওয়া মনন তাকে খুব অস্বস্তি দিচ্ছে। তবুও কি ভেবে যেনো রাজি হয়ে যায়। মনন ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে যেতেই মোহও ফোন ও ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ তোরা বসে গল্প কর। আমি আসছি। “

মায়া প্রশ্ন করে,

“ কোথায় যাচ্ছিস? “

মোহ বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয়,

“ ওয়াশরুমে যাচ্ছি। এখন কি তুই ওইখানেও আমার পিছুপিছু যাবি? তোর কি মনে হয় আমি পথ ভুলে যাবো? “

“ উঁহু। যা তুই। তাড়াতাড়ি আসবি। “

মোহ ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে না গিয়ে বরং লিফটের দিকে চলে যায়। মননের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী থার্ড ফ্লোরে পৌঁছে পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট এর ওপিডি এরিয়ায় চলে যায় সে। মননের কেবিনের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অত:পর কেবিনের বাহিরে থাকা এসিস্ট্যান্টকে বলে,

“ ডক্টর ভেতরে আছেন? “

“ জি, আছে। আপনার নাম? “

“ মেহনামা ফেরদৌস। “

“ ওহ, হ্যাঁ। ডক্টর আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনি যেতে পারেন। “

মোহ নির্বিকার ভঙ্গিতে দরজা ঠেলে কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে মননকে। টেবিলের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চার চোখ দিয়ে একটা ফাইল দেখছিল। মোহকে দেখতেই ফাইলটা হাত থেকে রেখে দিয়ে হেসে বলে,

“ হাই। প্লিজ হ্যাভ এ সিট। কেমন আছেন? “

মোহ চোখ সরু করে এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসতে বসতে জবাব দেয়,

“ ভালো। “

“ সরি। আপনাকে চা কফি অফার করতে পারছি না। উম্ম পানি খাবেন? “

মোহ প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি চা, কফি, পানি অফার করার জন্য দেখা করতে চেয়েছেন? “

“ উঁহু। আমি তো… “

“ ওহ। বুঝতে পেরেছি। টোটোস্কোপ ব্যাক চাই? ডোন্ট ওয়ারি। দিয়ে দিবো ফেরত আমি। “

মনন মোহর মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলে উঠে,

“ নাহ। ওইটা আপনার হয়ে গিয়েছে। আপনিই রাখুন। আমার কাছে নতুন টোটোস্কোপ আছে। সরি আই মিন স্টেথোস্কোপ আছে। আমি তো সব সর্ট আউট করার জন্য দেখা করতে চাইছিলাম। “

“ কি সর্ট আউট করতে চান? “

“ মোহ লুক আই এম সরি… “

“ ওয়েট! আপনার ওই সরির ভূত এখনো মাথা থেকে নামে নি? ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু বি সরি। ভুল কিছু তো বলেন নি আপনি। আমাকে রিয়েলিটি চেক দিয়েছেন শুধু। আমার এটার প্রয়োজন ছিল টু রিমেম্বার মাই বাউন্ডারিস। থ্যাংকস ফর দ্যাট। “

“ মোহ আই ওয়াজ টায়ার্ড দ্যাট ডে। “

“ আই এম এগেইন সরি ফর দ্যাট ডে। আমি এখানে দেখা করতে এসেছি শুধুমাত্র আপনাকে থ্যাংকস বলতে। ওদিন রাতে আমাকে হেল্প করার জন্য। “

বলতে বলতে মোহ নিজের ব্যাগে কিছু একটা খুঁজতে থাকে। মনন বলে,

“ থ্যাংকস বলতে হবে না। ইউ ক্যান কল মি এনিটাইম ইফ ইউ নিড এনি হেল্প। আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো… “

মননের সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মোহ একটা হলুদ রঙের স্ট্রেস রিলিফ বল বের করে মননের হাতে ধরিয়ে দেয়। মনন একবার হাতের বলটার দিকে তাকায় আরেকবার মোহর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। মোহ বলে উঠে,

“ থ্যাঙ্কিউ গিফট হিসেবে এটা বাদে আর কিছু পাই নি দেওয়ার মতো। ডক্টর আপনি, সারাদিন বিভিন্ন স্ট্রেসে থাকেন। ইট উইল হেল্প ইউ। এখন আই গেস সবকিছু সর্ট আউট করা হয়ে গিয়েছে আমাদের মাঝে। এখন থেকে আপনি আপনার রাস্তায় আর আমি আমার। টাটাহ। “

বলেই মোহ উঠে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। মনন বসে থাকে সম্পূর্ণ একা। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে হাতের স্মাইলি ইমুজির ডিজাইন করা স্ট্রেস রিলিফ বলটার দিকে। মোহর এই সর্ট আউটের নাম করে আলাদা আলাদা পথ মাপার ব্যাপারটায় বেজায় বিরক্ত এবং অসহ্যকর বোধ করছে সে। বেলাজ মনটা তাকে টিটকারি মেরে বলছে,

“ কি মদন? অসহ্যকর লাগছে না? দিজ ইজ সাইন। ইউ আর ইন লাভ উইথ হার ম্যান। একদিন না একদিন অবশ্যই স্বীকার করবি তুই। “

__________

রাতের খাবার টেবিলে বেশ অমনোযোগী দেখা যায় মননকে। ভাত মেখে শুধু নাড়াচাড়া করছে। খাবারের দিকে মনোযোগ নেই তার। উল্টো গভীর এক ভাবনায় বিভোর সে।

টেবিলে উপস্থিত আলী আকবর কায়সার এবং আরিফ কায়সারের চোখ এড়ায় না ব্যাপারটা। আলী আকবর সাহেব চোখের ইশারায় ছেলেকে কিছু একটা বলে। আরিফ সাহেব ইশারায় মাথা নেড়ে তাতে অসম্মতি জানায়। আলী আকবর সাহেব চোখ পাকিয়ে তাকাতেই আরিফ সাহেব ভয়ে নিজের ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ মনন, মেয়েটার নাম কি? “

মনন ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। কপাল কুচকে শুধায়,

“ হু? “

“ তোমার দাদু বলেছে তোমার রুমে একটা মেয়ের চুল পেয়েছে। মেয়েটার নাম, পরিচয় বলো আমাদের। আমরা প্রস্তাব নিয়ে যা-ই। তুমি চিন্তা করো না আমরা সবাইকে রাজি করিয়ে নিবো। কিন্তু কালোজাদু এসব করা কোনো সমাধান নয়। “

মনন বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে একবার নিজের আব্বুকে দেখে অত:পর নিজের দাদুকে। রাগে কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে,

“ সিরিয়াসলি? লাইক সিরিয়াসলি? আমাকে দেখে মনে হয়, আমি কুফরি কালাম করি? “

আরিফ সাহেব নিজের বাপ ও ছেলের মাঝে কাচুমাচু করে বলে,

“ তাহলে একটা মেয়ের চুল তোমার কাছে কি করছে? “

“ সেটা জেনে তোমাদের কি লাভ আব্বু? “

আলী আকবর কায়সার মুরগীর রানে কামড় বসিয়ে বলে উঠে,

“ তোমার বাপ প্রেমে পড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আমি তা ধরে ফেলেছিলাম। তোমার কি মনে হয় আমার চুলগুলো বাতাসে সাদা হয়েছে? অভিজ্ঞতা বলতেও একটা ব্যাপার আছে। তোমার আচার আচরণে একটা পরিবর্তন এসেছে যেটা বাসার সবাই দেখতে পাচ্ছি। প্রেমে পড়া ছেলেদের মতো আচরণ করছো তুমি। “

মনন বিরক্ত হয়ে খাবার ছেড়ে উঠে যেতে নিলে দাদু থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ খাবার নষ্ট করা মানুষদের আমি অপছন্দ করি। আমাদের কথা বিরক্তিকর লাগলে খাবার নিয়ে রুমে গিয়ে বসে খাও। তবুও যাতে একটা ভাতের দানা নষ্ট না হয়। “

মনন রাগ দেখিয়ে তা-ই করে। প্লেট নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে টেবিলে বসে। খাবার খেতে খেতেও তার রাগ কমে না। আশেপাশে তাকাতেই টেবিলের উপর মোহর দেওয়া ওই স্ট্রেস রিলিফ বলটা দেখতে পায়। সেটাকে বাম হাতে নিয়ে সে শক্ত করে চেপে ধরে। জিনিসটা আসলেই কাজের। দাদু আর আব্বু যেভাবে তার পিছনে হাত ধুয়ে পড়েছে, মননের এখন প্রায় প্রতিদিনই এটার প্রয়োজন পড়তে পারে। কিন্তু এটাকে এভাবে বাইরে ফেলে রাখা যাবে না। দাদু কিংবা আব্বু দেখে নিলে এই বলের পিছনেও গোয়েন্দাদের মতো হাত ধুয়ে উঠে পড়ে লাগবে।

__________

অঘটনটা ঘটলো ঠিক দু’দিন পর। মননের ধৈর্য্যের পারদ চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাতেই সে না পেরে মোহর নাম্বারে কল করে। বেশ কিছুক্ষণ পর কলটা রিসিভ হতেই মনন দ্রুত ভঙ্গিতে বলে,

“ মোহ দেখা করতে পারবেন আমার সাথে? রাইট নাও? ইট ইজ আর্জেন্ট। “

মোহ কিছু জবাব দেওয়ার আগেই মনন ফের বলে উঠে,

“ প্লিজ ডোন্ট সে নো। “

মোহ ইচ্ছে করে না চেনার অভিনয় করলো,

“ হ্যালো? কে আপনি? আমার সাথে দেখা করতে কেন চাইছেন? “

“ মোহ আই এম সিরিয়াস। “

“ সিরিয়াস তো আমিও। আমার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে আমি হাসছি? কে আপনি? “

“ ওয়াসিফ কায়সার মনন। “

“ ওহ! এই নামের একটা লোকের সাথে তো দুইদিন আগেই সব মিটমিট করে এলাম। আবার কেন কল দিয়েছেন তাহলে? “

“ কিছু মিটমাট হয় নি তাই। দেখা করতে পারবেন কি-না বলুন। ফ্রি আছেন আপনি? “

মোহ ফ্রি আছে। সে চাইলে এখন কিছু একটা বলে বাবাকে রাজি করিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হতেও পারবে। কিন্তু সে সেটা মননকে জানায় না। বরং বলে,

“ না। আগামী পাঁচ দিন আমি খুব ব্যস্ত। আমার প্রচুর রেস্ট দরকার। পাঁচ দিনের আগে কারো সাথে দেখা করা সম্ভব না আমার পক্ষে। পাঁচ দিন পর পারবো। “

যদিও মননের ধৈর্য্য কুলাচ্ছে না। তবুও সে রাজি হয়ে যায়। মোহকে বলে,

“ আচ্ছা। কোথায় আর কখন দেখা করতে চান আমাকে জানিয়ে দিবেন। টেক কেয়ার। “

কলটা কেটে কেবিনে থম মেরে বসে থাকে মনন। নিজেকে কিছুটা হ্যাংলা প্রকৃতির মানুষ মনে হচ্ছে তার। এভাবে কল করে ডেস্পারেট হয়ে দেখা করতে চাওয়াটা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। কিন্তু তবুও এই কাজটা সে করেছে। অবশ্য সে বহু কিছুই করেছে যা তার করার কথা ছিলো না। হয়তো সামনেও করবে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২১

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২১.

দরজা লক করে রুমের ভেতর বসে আছে মোহ। ওদিকে দরজায় জোরে করাঘাতের শুরু ভেসে আসছে। দরজার অপর পাশ হতে চেঁচাচ্ছে শিহান।

“ দরজা লাগিয়ে বসে থেকে পাড় পাবে না তুমি। এক্ষুণি দরজা খুলো। আমাকে রাগাবে না মোহ। দরজা খুলতে বলেছি তোমাকে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলো। “

মায়া নিজের বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করে জানতে চায়,

“ তুমি রেগে আছো কেন? কি হয়েছে? কি করেছে মোহ? “

শিহানের রাগে গমগমে স্বর,

“ কি হয়েছে জানতে চাও? তোমার বোনকে আমি ফল খেতে দিয়ে গিয়েছিলাম। ও লুকিয়ে জানালা দিয়ে সেই খাবার ফেলে দেয়। আমি ব্যাক ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম কলে। ওই ফল সব আমার মাথায় পড়েছে। শুধু ফল ফেলে ক্ষান্ত হয় নি ও। ফলের বাটিও আমার মাথায় ফেলে দেয়। ভাগ্যিস বাটিটা কাঁচের ছিলো না। নাহলে কি হতো বুঝতে পারছো? “

মেয়ের কাছে লম্বা অভিযোগ আর নালিশ সম্পন্ন করে শান্ত হয় শিহান। মায়া আর শায়লা এতক্ষণ গভীর মনযোগ দিয়ে শুনেছে সবটা। আর শোনা শেষে দু’জনেই না চাইতেও পেট চেপে ধরে অট্টহাসিতে ফেটে পরে। শিহান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। বুঝে উঠতে পারে না এখানে হাসির কি আছে?

দরজার ভেতরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবটা শুনছিলো মোহ। বাবার কথা শেষ হতেই সে নিজের সাফাই গেয়ে বলে উঠে,

“ এখানে আমার দোষটা কোথায়? এতো বড়ো বাসায় নিজের রুম, লিভিং রুম, ফ্রন্ট ইয়ার্ড, ছাদ, ওয়াশরুম সব ছেড়ে তোমাকে ব্যাক ইয়ার্ডে গিয়ে কথা বলতে হবে কেন? পুরো দোষটাই তো তোমার। “

মোহর কথা শুনে মায়ার হাসির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। শিহানের রাগের পারদের মাত্রা এবার বিপদ সীমা অতিক্রম করে। সে ভয়ংকর স্বরে ধমকে উঠে,

“ তোমার দোষ খুঁজে পাচ্ছো না তুমি? তুমি না খেয়ে খাবার জানালা দিয়ে ফেলে দাও। এটা দোষের না? “

এই পর্যায়ে মোহ ধমক শুনে ভয়ে সিটিয়ে যায়। আচমকা বজ্রকণ্ঠের ধমকে তার হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ে। ভয়ে সে দ্রুত বিছানায় বসে বুকের বা পাশটায় আলতো ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু শান্ত হতে পারে না। উল্টো মনে হয় হৃৎপিণ্ড বোধহয় এভাবে লাফাতে লাফাতে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে।

শিহানের ধমকের তোপে মায়া আর শায়লাও চুপ হয়ে যায়। মায়া কিছুটা ভয় পেলেও সে নিজেকে সামলে নিয়ে শিহানকে সেখান থেকে টেনে সরিয়ে বলে,

“ এতো ভয়ংকর ভাবে ধমক কেনো দিলে? ওর সামনে ডক্টর চিৎকার চেঁচামেচি করতে নিষেধ করেছে ভুলে গিয়েছো? ও না-হয় ভুল করেছে, কিন্তু তুমি কি ওর উপর রাগ দেখিয়ে ঠিক করছো? “

মুহুর্তেই শিহানের হুশ ফিরে। রাগের মাথায় আসলেই জোরে ধমক দিয়ে ফেলেছে সে। মোহর উপর এভাবে চিল্লানোটা উচিত হয় নি বোধ হতেই অপরাধ বোধ তাকে ঘিরে ধরে। মায়া নিজের বাবার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায় দরজার কাছে। ধীরে দরজায় নক করে প্রশ্ন করে,

“ এই মোহ? ঠিক আছিস? বেরিয়ে আয়। বাবা আর রাগবে না। খাওয়া নিয়েও আর জোর করবে না। “

ভয়ে তখন মোহর চোখ উপচে জল পড়ছে। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছে। সবটা অনুভব করতে পারছে সে। বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে তার সাথে। সে কি মারা যাচ্ছে? মোহ এই অবস্থায় বাবা, মায়া কারো সামনেই পরতে চায় না। তাই কোনো মতে উত্তর দেয়,

“ পরে আসছি… “

এতদূর বলেই সে বিছানার হেড সাইডে পিঠ এলিয়ে দেয়। চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হয়ে আসছে। কিন্তু মন বারবার বলছে, তাকে ঠিক থাকতে হবে। এভাবে মৃত্যু হতে পারে না। এই অবস্থায় তো ভুলেও না। বাবা দোষটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিবে না-হয়। ভাববে হয়তো উনার কারণেই মোহর ক্ষতি হয়েছে।

দরজার অপর পাশে আর কেউ নেই টের পেতেই মোহ হাতড়ে ফোনটা নেয়। কিছু না ভেবেই কল করে বসে মননকে। ওই লোকটা তো ডক্টর। নিশ্চয়ই একটা সমাধান দিতে পারবে? মোহ মনে মনে বারবার নিজের উদ্দেশ্যে আওড়াচ্ছে,

“ হোল্ড অন মোহ! ইউ হ্যাভ টু লিভ। বাবাকে গিল্ট ট্র্যাপে ফেলে মরলে ইউ উইল বি দ্যা ওরস্ট ডটার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড। “

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। রিং হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ করে মনন। স্বভাবসলুভ শান্ত গলায় বলে,

“ আমার দোষ কি সেটা জানাতে কল করেছেন? “

মোহ অক্সিজেন ইনহ্যাল এবং এক্সহ্যাল করতে করতে অস্ফুটে বলে উঠে,

“ হেল্প মি… “

মনন অবাক হয়। সে টিভির রুমে বসে খেলা দেখছিলো। কিছু বলবে এমন সময়ই দেখে তার দাদু টিভির রুমের দিকে আসছে। তাই সে সাথে সাথে উঠে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দেয়। উদ্বেগ নিয়ে জানতে চায়,

“ কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন? অসুবিধা হচ্ছে কোনো? “

“ পোর্ট যেখানে… বুকের বাম পাশে হার্ট অনেক জোরে জোরে বিট করছে। অস্বাভাবিক ভাবে। মনে হচ্ছে গলা দিয়ে এক লাফে বেরিয়ে আসবে। আমিও ঘামছি। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আমি… আমি বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে? এটা নরমাল? নাকি আমি মারা যাচ্ছি? “

মোহ কোনো মতে থেমে থেমে কথা গুলো বলে। মনন এক সেকেন্ডের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। কিন্তু সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চায়,

“ আপনি চিৎকার চেঁচামেচি করেছেন? এই মোহ? আপনি কি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছেন? “

মোহ কেবল দু’দিকে মাথা নাড়ে। মুখে উত্তর দিতে পারছে না সে। ভয়ে হুট করেই যেনো শব্দ হারিয়ে ফেলেছে। দু চোখ ছাপিয়ে কেবল মৃত্যু ভয়ে অশ্রু বইছে। নিজেকে মনে হচ্ছে সবথেকে অসহায়!

মনন কোনো উত্তর না পেয়ে নিজেই বলতে থাকে,

“ আচ্ছা! ইট’স ওকে। কিছু বলতে হবে না আপনার। আপনি আমার কথা শুনুন। যেই অবস্থায় আছেন ওভাবেই থাকুন। নড়বেন না মোটেও। নড়াচড়া করলে বুকে চাপ অনুভব করে শ্বাসরোধ অনুভব হতে পারে। তাই কষ্ট হলেও নড়বেন না। আর নিজেকে মেন্টালি স্ট্রং রাখুন। কিচ্ছু হয় নি। ইউ উইল বি ফাইন। বডি রিল্যাক্স রাখুন। মাইন্ড বডি কোনটাতেই প্রেশার দিবেন না। ওকে? আপনি কল কাটবেন না। লাইনে থাকুন। আমি এক্ষুণি পোর্ট স্পেশালিষ্টকে কল করছি। উনার ইন্সট্রাকশন জরুরী। একটু কলে থাকুন। ওকে? “

মোহ শুনে সবটা। জবাব দিতে পারে না। মনন মোহকে কলে রেখেই দ্রুত দৌড়ে রুম থেকে বের হয়। সামনে দাদুকে পেতেই দ্রুত উনার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয় হসপিটালে নিজের পরিচিত পোর্ট সার্জনকে কল করার উদ্দেশ্যে। আলী আকবর সাহেব চেঁচিয়ে উঠেন,

“ আরে! আমি লুডু ম্যাচ খেলছিলাম! “

মনন কেবল নিজের রুমের দিকে দৌড়ে যেতে যেতে জবাব দেয়,

“ তোমার ম্যাচ এর থেকে কারো জীবন আমার কাছে বেশি ম্যাটার করে। “

___________

মাথার উপরের দেওয়ালের মধ্যিখানে ফ্যানটা আপন গতিতে ঘুরে শীতল বাতাস বিলিয়ে দিচ্ছে। সেই শীতল বাতাস প্রাণ ভরে কুড়িয়ে নিচ্ছে মোহ। দু চোখের কার্ণিশে অশ্রু শুকিয়ে গেলেও তার অস্তিত্ব পুরোপুরি মুছে যায় নি এখনো। বুকের ভেতরের ভয়টাও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় নি এখনো।

এই তো কিছুক্ষণ আগেও মোহর মনে হচ্ছিলো হয়তো সে মারা যাচ্ছে। এই বুঝি সব ফুরিয়ে এলো। অথচ এখন সবটা শান্ত। হৃৎস্পন্দনের গতিও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মোহ সোজা হয়ে বিছানার মাঝটায় শুয়ে আছে। চোখ বুজে রেখে কানে ফোন চেপে ধরে রেখেছে এক হাতে। অপর হাতে এখনো বুকে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।

পুরোটা সময় মনন কলের অপর পাশে উপস্থিত ছিল। মাঝখানে মোহর ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাওয়ায় কলটা কেটে গিয়েছিল। তবে সাথে সাথেই মনন কল ব্যাক করেছে তাকে। চিন্তা মাথায় নিয়েও বেশ শান্ত গলায় মোহকে সকল ইন্সট্রাকশন বুঝিয়ে বলেছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে জুগিয়েছে আশ্বাস।

লম্বা সময় ধরে মোহকে স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিয়ে অত:পর মনন প্রশ্ন করে,

“ মোহ? এখন বেটার ফিল হচ্ছে? অসুবিধা হচ্ছে আর কোনো? “

মোহ ছোট করে উত্তর দেয়,

“ ঠিক আছি। “

মনন এইবার বলে উঠে,

“ আপনার ফ্যামিলি কোথায় থাকে মোহ? ইউ নিড কেয়ার। এরকম সিচুয়েশন গুলোতে উনাদের আপনার পাশে থাকা উচিত। “

“ না। আমি চাই না উনারা কখনো আমাকে এরকম অবস্থায় দেখুক। অলরেডি বাবা আর মায়া নিজেদের কাজ, পড়াশোনা ফেলে সারাদিন আমার পিছনে পড়ে থাকে। এরকমটা দেখলে উনারা এসব ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকবে ২৪ ঘন্টা। আমি চাই না আমার কারণে কারো জীবন থেমে যাক। “

মনন অজান্তে প্রশ্ন করে বসে,

“ আমার সামনে দূর্বলতা প্রকাশ করতে অসুবিধা নেই? “

মোহ এবার সামান্য হেসে বলে,

“ আমার কারণে আপনার জীবন থেমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। উনারা আমার পরিবার। আপনার সাথে তো কোনো সম্পর্ক নেই। “

মনন হঠাৎ নীরবতায় ডুব দিলো। মোহর বলা কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। আসলেই তো তাদের মাঝে সম্পর্ক নেই! নাকি আছি? জীবন মরণ পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই মানুষ সম্পর্কহীন কাউকে স্মরণ করে না? পরমুহূর্তেই মননের মস্তিষ্ক বলে উঠে,

“ মেয়েটা তোকে শুধুমাত্র এজ এ ডক্টর স্মরণ করেছে। “

কিন্তু মন মস্তিষ্ককে শাসিয়ে বলে,

“ পৃথিবীতে কি মননই একমাত্র ডক্টর? আরোও তো ডক্টর আছে! কিন্তু তবুও মোহ কলটা স্পেসেফিকলি মননকেই করেছে। “

মননের মন ও মস্তিষ্কের বাকবিতন্ডার মাঝে মোহর স্বর শোনা গেলো,

“ প্রথমত অসময়ে কল করার জন্য সরি। দ্বিতীয়ত আপনার মূল্যবান সময় চুরি করার জন্য সরি। আর তৃতীয়ত আপনার ফোনের ব্যালেন্স খরচ করার জন্য সরি। “

মনন এই পর্যায়ে বিরক্ত হয়। পর মুহুর্তেই মনে পড়ে যায় ওদিন মোহর সাথে হসপিটালের ছাদে করা আচরণটার কথা। ওই কারণেই বোধহয় এতো গুলো সরি বলে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। মনন বেশ শান্ত গলায় বললো,

“ আপনার অসুবিধা, খারাপ লাগা, দূর্বলতা গুলো চাইলে সম্পর্কহীন মানুষটার কাছে মেলে ধরতে পারেন মোহ। আপনার সমস্যা গুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে টুইয়েন্টি ফোর আওয়ারের জন্য এভেলেবল থাকবো। সেটার জন্য ফি কিংবা সরির প্রয়োজন নেই। আপনার এখন রেস্ট করা উচিত। আমি রাখছি, আচ্ছা? প্রয়োজন হলে কল দিবেন। মনে দ্বিধা রাখবেন না। “

বলেই কলটা কেটে বিছানায় বসলো মনন। দু’হাতে মুখ ঢেকে দীর্ঘ সময় বসে রইলো। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে মাশুকের বলা কথাটা। তার আর মোহর মাঝে কিছু নেই। অথচ তবুও তাদের মাঝে কিছু একটা আছে। খুব প্রখর সেটা। মনন টের পাচ্ছে তা। ফট করেই সে একা ঘরে নিজেকে প্রশ্ন করে বসলো,

“ ইউ লাভ হার মনন? “

প্রশ্নটা করে মনন নিজেই কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেলো। থমথমে হয়ে গেলো মুখটা। তার আর মোহর মাঝে থাকা কিছু একটাকে খুঁজে পেয়ে যেনো সে আরো দিশেহারা হয়ে পড়লো। অসম্ভব! মোহকে ভালোবাসা অসম্ভব একটা ব্যাপার! ও-ই টুকুন একটা বাচ্চা মেয়ে। মননের থেকে কম করে হলেও বছর দশেকের ছোট। ওই মেয়েটাকে মনন কখনোই ভালোবাসতে পারে না। সে একজন শিক্ষিত ডক্টর। এরকম আক্কেলহীন কাজ তার সঙ্গে সাজে না। আর তাছাড়াও সে তো পরশিকে… এতদূর ভাবতেই মনন আরেকদফা নিশ্চুপ হয়ে যায়। আরো নীরবতায় তলিয়ে যায়। বোধ করে গত এক মাসে পরশি নামক মেয়েটার কথা এক মুহুর্তের জন্যও সে মনে করে নি। এক মুহুর্তের জন্যও পরশি তার মন কিংবা মস্তিষ্কে হানা দেয় নি। কিন্তু কেন? এরকমটা কি করে সম্ভব? মননের মন এবং মস্তিষ্ক কখন পরশির পথ ভুলে মোহর পথে হাঁটা শুরু করলো? মননের হুট করেই নিজের মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মন চাইলো। এই মনটা আদৌ কখনো পরশির ছিলো? কোনটা সত্যি তার জীবনের? পরশি নাকি মোহ?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২০

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২০.

মনন হসপিটালে এসেছে ঘন্টা দুয়েক হবে। ওপিডিতে বেশ কয়েকজন পেশেন্টকে দেখে মাত্র উঠলো সে। এইমাত্র ইমারজেন্সি ইউনিট থেকে একটা কল এসেছে তার কাছে। তার একটা কেসের পেশেন্টকে ইমারজেন্সিতে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে। মননের গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে হবে।

দুই হাতে গ্লাভস এবং মুখে মাস্ক পড়ে নিয়ে মনন সরাসরি ইমারজেন্সি ইউনিটে চলে যায়। নার্সের থেকে সার্বিক পরিস্থিতি জেনে নিয়ে চলে যায় পেশেন্টের চেক আপ করতে। অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। মনন দ্রুত নার্সদের ডেকে বলে বাচ্চাটাকে সি সি ইউ তে শিফট করার ব্যবস্থা করতে। সেই সঙ্গে বেশ কিছু টেস্টও সম্পন্ন করতে। মনন ততক্ষণে সিনিয়রকে কেসের ব্যাপারে ইনফর্ম করে ফেলবে।

তড়িঘড়ি করে যখন মনন ইমারজেন্সি ইউনিট থেকে বের হতে নিবে আচমকা তার চোখ যায় বেড নং আটের দিকে। মননের চোখে মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠে। এগিয়ে যায় সেই পানে। বেডের কাছে গিয়ে একবার দেখে মানুষটাকে। ঘুমন্ত অবস্থায় যে শুয়ে আছে। তার পাশের টেবিলে থাকা ফাইলটা হাতে তুলে নিয়ে মনন দেখতে থাকে পেজ উল্টে পাল্টে। একজন নার্স এগিয়ে আসতেই চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ এডমিট হয়েছে কখন? “

“ ভোর রাতে ডক্টর। “

“ লাস্ট টেম্পারেচার কখন চেক করেছিলেন? “

নার্সটা ক্ষানিকটা অবাক হয় মননের আগ্রহ দেখে। মননকে তারা চিনে। ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ডক্টরের এই পেশেন্টের প্রতি আগ্রহর কারণ খুঁজে পায় না সে। তবুও জবাব দেয়,

“ আধঘন্টা আগে। মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। আশা করছি আর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে টেম্পারেচার কিছুটা কমবে। “

মনন কিছু বলতে নিয়েও আর বলে না। নার্সটা বলে উঠে,

“ ডক্টর? “

“ হু? আপনি যেতে পারেন। অসুবিধা নেই। “

নার্স চলে যেতেই মনন চোখ ফিরিয়ে তাকায় সাদা বিছানায় কাথ হয়ে শুয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা পেশেন্টের দিকে। এই ইমারজেন্সি ইউনিটে ভর্তি আর দশটা পেশেন্টের মতো নয় সে মননের কাছে। বরং হয়তো বিশেষ কেউ। যার প্রতি মননের চিন্তার পরিমাণটাও বেশি।

মনন লক্ষ্য করে মোহর ওজন বুঝি আরো অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে নিজের একহাতের গ্লাভস খুলে হাত রাখে তার কপালে। মেপে নেয় মোহর তাপমাত্রার পরিমাণ। একদম পুড়ে যাচ্ছে।

মনন হাত সরিয়ে নেবার পূর্বেই মোহ দূর্বল চোখ মেলে তাকায়। সাদা মাস্কের আড়ালে থাকা মানুষটার কেবল চশমা পরিহিত চোখ জোড়া উন্মুক্ত। মোহ হঠাৎ যেনো চিনতে পারে না। প্রশ্ন করে,

“ কে? “

ফ্যাকাশে মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে মনন জবাব দেয়,

“ আমি, মরণ। “

মোহ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে চোখ জোড়া নামিয়ে নেয়। তাকায় না আর ভুল করেও। পরক্ষণেই স্কার্ফটা হাতড়ে নিয়ে মুখ, ন্যাড়া মাথা দুটোই ঢেকে নেয়। মনন লক্ষ্য করে তা। মোহর সাথে বলার মতো অনেক কিছু থাকলেও এই মুহুর্তে তার হাতে সময় নেই। তাই হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে মোহকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ রাতে ম্যাসেজ করবো। কাইন্ডলি ফোনটা সুইচ অন করে তা দেখবেন। গেট ওয়েল স্যুন। আমার একটা ইমারজেন্সি কেস দেখতে হবে। এখন যাই, আচ্ছা? “

মোহ তবুও চোখ তুলে তাকায় না। যাওয়ার হলে যাক। মোহ কি কৈফিয়ত চেয়েছে? তাহলে এই লোক সেধে কেন তাকে কৈফিয়ত দিচ্ছে?

মনন চলে যায়। মোহ এবার চোখ তুলে তাকায়। হঠাৎই নিজে হাত বাড়িয়ে নিজের কপাল ছোঁয়। ওই ডাক্তার এখানেই ছুঁয়েছিল একটু আগে। মোহর হঠাৎই মনে হয় ওই হাতের ছোঁয়া বুঝি এখনো তার কপালে লেগে আছে। কি অদ্ভুৎ! এমন কেন মনে হচ্ছে?

__________

মনন বাসায় ফিরতেই দেখে দাদু সোফায় বসে টিভি দেখছে। আশেপাশে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে,

“ আব্বু এখনো ফিরে নি? “

“ না। কলিগদের সাথে ডিনার করবে জানিয়েছে। ফিরতে দেরি হবে। “

মনন কিছু না বলে রুমের দিকে যেতে নিলেই আলী আকবর সাহেব বলে উঠে,

“ ফ্রেশ হয়ে আসো। কথা আছে তোমার সাথে। “

মনন অবাক হয়। দাদুর গলা বেশ সিরিয়াস শোনাচ্ছে। রুমে এসে ফ্রেশ হতে হতে সে ভাবতে থাকে দাদুর হঠাৎ তার সাথে কি এমন জরুরী কথা আছে? দাদু কি আবার বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে কথা তুলবে? বিয়ের ভাবনাতেও মনন বিরক্ত হয়। মনে মনে কথা সাজাতে থাকে দাদুকে কি কি বলে এই ঝামেলার আলাপ ধামাচাপা দিবে।

গোসল সেড়ে মনন রুম থেকে বের বের হয়ে গিয়ে দাদুর পাশে সোফায় বসে। গা অনেকটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে রিমোট নিয়ে খেলার চ্যানেল দিয়ে ক্লান্ত গলায় শুধায়,

“ বলো, কি বলবে? “

আলী আকবর সাহেব নাতিকে লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে। অত:পর উঠে গিয়ে সোজা টিভির সুইচটা অফ করে দেয়। মনন তাতে অবাক হয়। তাকে আরও অবাক করে দিতে আলী আকবর সাহেব এসে নাতির চোখ থেকে চশমাটা খুলে নেয়। চশমা ছাড়া মননের কাছের জিনিস স্পষ্ট দেখতে অসুবিধা হয়। সে চোখ ডলতে ডলতে সোজা হয়ে বসে বলে,

“ চশমা কেনো নিলে? “

আলী আকবর সাহেব যত্নের সহিত নাতির চশমার গ্লাসটা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। তিনি মননের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বরং পাল্টা প্রশ্ন করে,

“ বিয়ে করতে না চাওয়ার পিছনে কি এমন কোনো কারণ আছে, যা আমি কিংবা তোমার আব্বু জানে না? “

মনন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। দাদুর প্রশ্নের অর্থ বুঝতে পারছে না সে। আলী আকবর কায়সার এবার পরিষ্কার চশমাটা মননের চোখে পড়িয়ে দিয়ে তার পাশে সোফায় বসে। আবারও প্রশ্ন করে,

“ কিছু লুকাচ্ছো তুমি আমাদের থেকে? “

মনন অবাক গলায় বলে,

“ আমি কি লুকাবো তোমাদের থেকে? “

“ তোমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে। “

মননের মনে পড়ে না সে নিজের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কখনো কিছু লুকিয়েছে কি-না দাদু এবং আব্বুর কাছে। সে জবাব দেয়,

“ না তো! “

আলী আকবর সাহেব এবার গলা ঝেড়ে বলতে থাকে,

“ সন্ধ্যায় আমি পেপার স্ট্যাপলার খুঁজছিলাম কিছু কাজে। আমার রুমে না পেয়ে আমি তোমার রুমে যাই। তখন তোমার টেবিলের ড্রয়ারে একটা অদ্ভুৎ জিনিস চোখে পড়ে। রুমালে প্যাঁচানো এক মুঠো চুল। আমার ধারণা মতে ওই লম্বা চুলগুলো একটা মেয়ের। “

মনন হঠাৎই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আলী আকবর সাহেবের দৃষ্টি এড়ায় না তা। তিনি সোজাসাপ্টা বলেন,

“ একটা মেয়ের চুল তোমার কাছে থাকার কোনো যুক্তিগত কারণ আছে তোমার কাছে? নাকি ব্যাপারটা এমন যে তুমি কাউকে পছন্দ করো, কিন্তু সে তোমার প্রতি আগ্রহী না। তাই তুমি তার উপর ব্ল্যাক ম্যাজিক করার প্ল্যান করছো? “

মনন চেঁচিয়ে উঠে,

“ নো ওয়ে! এরকম কিছুই না। তোমার কি করে মনে হলো এতো ফালতু একটা কাজ আমি করবো? “

“ তাহলে আমাকে এর যথাযথ কোনো কারণ বলো। “

মনন গম্ভীর স্বরে বলে,

“ কোনো কারণ নেই। “

বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করে সে। আলী আকবর সাহেব সন্দিহান দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। উনার মনে হচ্ছে মনন আসলেই তাদের থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছে। কি হতে পারে তা?

__________

মনন রুমে ফিরে সবার আগে একটা ছোট্ট স্টোরেজ বক্স খুঁজে বের করে। অত:পর সেটাতে মোহ সম্পর্কিত জিনিস গুলো তুলে রেখে তা বাক্সবন্দী করে। এই বক্স এভাবে যেখানে সেখানে ফেলে রাখাটা ঠিক হবে না মনে হয় তার। তাই সে সেটাকে সোজা আলমারিতে একটা লকার ড্রয়ারের ভেতর রেখে ক্ষান্ত হয়।

বিছানায় বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনন। আপাততর জন্য দাদু চুপ হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা যদি আব্বুর কান পর্যন্ত যায়? তখন দাদু আর আব্বু দু’জন যদি দুই দিক থেকে তাকে জেঁকে ধরে? ভয়ংকর একটা ব্যাপার হবে তা। মনন তখন কি জবাব দিবে? সে তো ঠিকঠাক বানিয়ে একটা মিথ্যা কথাও বলতে পারে না। মিথ্যা বলার পরে কেউ তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই তার হাসি পায়। আর হেসে মনন যায় ফেঁসে।

মনন কিছুক্ষণ স্থির বসে রয়। আচমকা তার কিছু একটা মনে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সে ফোন বের করে মোহর নাম্বারে একটা ম্যাসেজ করে। ম্যাসেজ পাঠানো শেষে মনন দুই হাতের ফিঙ্গার ক্রস করে মনে মনে বিড়বিড়াতে থাকে,

“ প্লিজ সুইচ অন ইউর ফোন মোহ! ফর গড সেক! “

__________

শেষ রাতে প্রকট রূপ ধারণ করা জ্বরটা মোহ হসপিটালে এডমিট হওয়ার পর দুপুরের আগেই নেমে যায়। তাই দুপুরেই বাবার সাথে মোহ আবার বাসায় ফিরে আসে। বাসায় ফিরে গোসল এবং খাওয়া দাওয়া করে এক ঘুম দিয়ে মাত্র উঠেছে সে। শরীরটা এখন কিছুটা চাঙ্গা লাগছে।

শিহান এইমাত্র এক বাটি আনার ছিলে এনে মোহকে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। কড়া গলায় বলেছে যেনো মোহ সবটুকু খায়। শিহানের ভাষ্যমতে সব রোগের মহা ওষুধ হলো ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করা। কিন্তু তার মেয়ে খাবার নিয়ে প্যাংছামি করাতেই মোহর শরীর ঠিক থাকছে না। তাই এখন থেকে মোহকে তিন বেলার জায়গায় সাত বেলা খেতে হবে। খেতে ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। আর যদি ভুলেও প্যাংছামি করেছে তাহলে শিহান তাকে সোজা ধরে বেঁধে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ডক্টরকে বলে দিবে, যেনো মোহকে গ্রাফিল ইঞ্জেকশন এর ডোজ দেওয়া হয়।

নিজের বাবার এমন চরম নিষ্ঠুরতায় মোহ বিরক্ত। আগের বাবা-ই তো ভালো ছিলো। সারাদিন কাজ নিয়ে পরে থাকতো। এই বাবা নং টু পয়েন্ট জিরো এডিশন মোহর হজম হচ্ছে না। কেমন ধমক, হুমকি, চোখ রাঙানোর উপর রেখে মোহকে শাসনে রাখছে সারাদিন।

মোহ একটা একটা করে আনারের দানা মুখে দিয়ে চিবুচ্ছে। পাশে কুশনের উপর রাখা ল্যাপটপে চলছে ডোরেমন মুভি। মোহ মনযোগ দিয়ে তা দেখছে। হঠাৎই মুভিতে নোবিতার করা বোকার মতো কাজের প্রতিক্রিয়ায় মোহ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,

“ শালা মদনা কোথাকার! “

বলতেই মোহর হঠাৎ মননের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় সকালে মননের বলা কথাটা,

“ রাতে ম্যাসেজ করবো। কাইন্ডলি ফোনটা সুইচ অন করে তা দেখবেন। “

মোহ আড়চোখে তাকায় নিজের ফোনের দিকে। ফোনটা হাতে নিয়েও আবার পাশে ফেলে দেয়। ভুলেও এই ফোন সে সুইচ অন করবে না। পরক্ষণেই আবার তার লোভী মন তাকে বলে,

“ অন কর। কি-ই বা হবে? শুধু ম্যাসেজটা দেখবি। রিপ্লাই দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তাহলেই হবে। “

লোভী মনকে জিতিয়ে দিয়ে মোহ ফোনটা অন করে। হাজারটা নোটিফিকেশনকে পুরোপুরি ইগ্নোর করে নিজের মনযোগ স্থির করে গতকাল ডিলিট করে দেওয়া নাম্বারটা হতে আগত ম্যাসেজের প্রতি।

“ মোহ, ভুল করে হলেও গতকাল আপনার কলটা আমার কাছে কেন এসেছে একবার ভেবে দেখেছেন? “

মোহ ম্যাসেজটা মনযোগ দিয়ে পড়ে। অত:পর চিন্তায় পড়ে যায়। যেনো বিরাট কোনো ইকুয়েশন সলভ করতে দেওয়া হয়েছে তাকে। সে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে রিপ্লাই দিয়ে বসে,

“ আমি কি জানি? “

রিপ্লাই দিতেই মোহর খেয়াল হয় সে ঠিক করেছিলো এই লোকের ম্যাসেজের কোনো রিপ্লাই সে দিবে না। মোহ বিরক্ত হয় নিজের প্রতি। মাথার আগে হাত কাজ করে তার! মোহ ভাবে তার উচিত আবার ফোনটা সুইচ অফ করে দেওয়া। কিন্তু সে ফোন সুইচ অফ করে দেওয়ার পূর্বেই তার ফোনে কল আসে। সেই একই নম্বর হতে। মোহ কিছুক্ষণ দ্বিধায় ভুগে। তার কি কলটা রিসিভ করা উচিত হবে? ভাবতে ভাবতে কলটা কেটে যাওয়ার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে সে রিসিভ করে। থমথমে গলায় শুধায়,

“ কি সমস্যা? “

“ কোনো সমস্যা নেই তো! “

“ তাহলে সেধে কথা বলার চেষ্টা করছেন কেন? এইবার কিন্তু আমি আপনাকে বিরক্ত করছি না। আপনি করছেন। “

“ আচ্ছা বিরক্ত করার জন্য সরি। একটু যেহেতু বিরক্ত করে ফেলেছি, তাহলে না-হয় আরেকটু করি। পরে আবার সরি বলে দিবো নি। “

“ মজা করছেন আমার সাথে? “

“ মোটেও না। মজা কেনো করবো? আপনার সাথে আমার মজা করার সম্পর্ক নেই। “

“ এক্স্যাক্টলি। ইভেন কোনো সম্পর্কই নেই। তাই অযথা আগ বাড়িয়ে কথা বলা বন্ধ করুন। “

মনন পাত্তা না দিয়ে বলে,

“ শরীর কেমন এখন? জ্বর কমেছে? বেটার ফিল হচ্ছে? “

“ তাতে আপনার কি? “

“ এজ এ ডক্টর পেশেন্টের হেলথ কন্ডিশন আমার কাছে মেটার করে। “

মোহর বিরক্ত লাগছে। এই আনারের দানা আর খেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু পুরোটা শেষ করে নি জানলে বাবা রাগ হবে। মোহ তাই কথা বলতে বলতে বাটি হাতে উঠে জানালার কাছে যায়। জানালা খুলে আনার গুলো ফেলে দিতে দিতে বলতে থাকে,

“ আমি আপনার পেশেন্ট না। আর না আপনি আমার ডক্টর। আপনার হেলথ কন্ডিশন চেক কিরার শখ থাকলে গিয়ে বাচ্চাদের চেকাপ করুন। আমার থেকে… “

এতদূর বলতেই মোহ থেমে যায়। নিচ থেকে কারো গলার স্বর শুনে থতমত খেয়ে যায়। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাত থেকে বাটিটাও জানালার বাহিরে পরে যায়। এবার নিচ থেকে ভেসে আসে শিহানের চেঁচানোর শব্দ। মোহ বিড়বিড়িয়ে উঠে,

“ শিট! শিট! শিট! “

কথায় আছে চোরের দশদিন গৃহস্থির একদিন। মোহর অবস্থা হয়েছে সেরকম। ওদিকে ফোনের অপর পাশ থেকে মননের গলা শোনা যাচ্ছে,

“ হ্যালো? মোহ, আর ইউ ওকে? কি হয়েছে? “

মোহ নিজের উপর অনুভব করা রাগটা মননের উপর ঝেড়ে বলে,

“ সব আপনার দোষ! “

বলেই ফট করে কলটা কেটে দেয়। মনন বোকার মতো ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে। সব তার দোষ মানে? সে তো কিছু করেই নি! তাহলে তার দোষটা কোথায়? চরম আশ্চর্য মনন বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ আশ্চর্য! মেয়েটা রেগে গেলো কেন? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১৯

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৯.

সকাল থেকে দু’বার বমি করে গা ভাসিয়েছে মোহ। গতকাল কেমো দিয়ে আসার পর থেকে মনে হচ্ছে মুখের রুচি যেনো পুরোপুরি মরে গিয়েছে। যা-ই খাচ্ছে তা পেটে সইছে না। ঠেলেঠুলে আবার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। উৎকৃষ্ট খাবারের অংশ মাখা জামা বদলে, পরিষ্কার একটা জামা পড়ে বিছানায় শুয়ে আছে মোহ। মন, মেজাজ দুটোই বিক্ষিপ্ত। শরীরটা দূর্বল। খিদে পাচ্ছে, কিন্তু খাবার দেখলে আবার খাওয়ার ইচ্ছে মরে যাচ্ছে। কি অদ্ভুৎ এক সমস্যা!

মোহর সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় ব্যস্ত শায়লা। বারবার এইটা সেইটা বানিয়ে নিয়ে আসছে মোহর জন্য। হয়তো একটা কিছু মেয়েটা একটু তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারবে। শিহান অফিসে গিয়েছে সকাল বেলায়। আর মায়া ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে। কাল বাদে পরশু কলেজ খোলা। কোচিং এরও বহু পড়া জমে আছে তার।

বিশাল ঘরটায় একা অনুভব করে মোহ বিছানা ছেড়ে নামে। একবার ভাবে মায়ার কাছে যাবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়, মায়াকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। শায়লা নিচে রান্নাঘরে আছে। ওখানে যেতেও ইচ্ছে হয় না মোহর। মশলার ধাগে কাশি আসে তার। তাই সে সরাসরি চলে যায় নিজের দাদুর রুমে।

পরিষ্কার বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছেন একজন সত্তর বছরের পৌঢ় নারী। অসুস্থতার ভারে চেহারায় তার ভাঙা ছাপ। খোলা চোখ জোড়া সিলিং এর দিকে নিবদ্ধ। বিগত বেশ অনেক গুলো বছর ধরেই বৃদ্ধার জীবনটা এই বিছানার মাঝেই সীমাবদ্ধ। প্রাণ থাকতেও এক নিষ্প্রাণ, অচল জীবন পাড় করতে করতে মৃত্যুর সময় গুণছেন তিনি।

মোহ সরাসরি বিছানায় উঠে দাদুর পাশে শুয়ে পড়ে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে তার দাদুকে। কিন্তু সে তা করে না। যদি দাদুর অস্বস্তি বা ব্যথা লাগে? মুখ ফুটে তো তা বলতে পারবে না দাদু। মোহ অনিচ্ছাকৃত ভাভেও কাউকে কষ্ট দিতে আগ্রহী নয়। তাই সে নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে,

“ আমার কিছু ভালো লাগে না কেন দাদু? “

বৃদ্ধার কানে পৌঁছায় নাতনির কথা। তবে তিনি জবাব দিতে অপারগ। তাই কেবল শুনে যায় নীরবে। মোহ বলতে থাকে,

“ আমি এখন তোমার পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছি। জীবন মৃত্যুর মাঝে ঝুলে থাকাটা খুব যন্ত্রণার হয়। আমরা দু’জন একই যন্ত্রণা পাচ্ছি। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি একটাই। হয় এপার, নাহয় ওপারে চলে যাওয়া। বাবা আমাকে এপারে ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ওপার থেকেও তো আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানছে। মাঝেমধ্যে কি মনে হয় জানো? এই দুই পাশের টানাটানিতে আমি হয়তো দুইভাগ হয়ে দু’দিকে চলে যাবো। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না তাই না? জানো? বাবা তোমাকেও ধরে রাখার সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এতো বছর ধরে। কারণটা কি জানো? তোমার ছেলে খুব ভীতু দাদু। সে আমাদের হারাতে হয়তো খুব ভয় পায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার থেকে তো পৃথিবীর কোনো মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট বড়ো নয়, তাই-না? যদি মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টই যথেষ্ট হতো তাহলে তো মা-ও আমাদের ছেড়ে যেতো না। কিন্তু আল্লাহর মর্জি ছিলো বলেই মা উনার কাছে চলে গিয়েছে। কে জানে? হয়তো তুমি, আমিও চলে যাবো। অবশ্য বাবাকে নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কিছু নেই। বাবার কাছে মায়া আছে। মায়া বাবাকে সামলাতে পারবে। মায়া অবশ্য সবাইকেই সামলাতে পারে। ও একদম তোমার আর মা-র মতো হয়েছে। আমি তোমাদের মতো হলাম না কেন? আমি তোমাদের মতো হলে কি বাবা আমাকেও ভালোবাসতো? “

এতদূর বলতেই থেমে যায় মোহ। চোখ ছলছল করছে তার। তাকিয়ে দেখে দাদুরও চোখের কোণায় পানি। মোহ হাত দিয়ে তা মুছে দিয়ে হেসে বলে,

“ কি মনে হয় তোমার? আমি টাইটানিক ২ এর কাহিনী লিখতে পারবো? দেখো, কি ইজিলি তোমাকে ইমোশনাল করে দিলাম। সেম টাইপ ডায়লগ লিখলে মুভির দর্শকদেরও কাঁদাতে পারবো। মুভি হিট, স্ক্রিপ্ট রাইটার হিট। জোস হবে না ব্যাপারটা? “

বলেই মোহ আরেক দফা হাসতে থাকে। সে নিছক মজা করেই এই কথাগুলো বলেছে। ঠিক সেই মুহুর্তে দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়া দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে। নিজের রুমে এসে দরজা লক করে বিছানায় বসে পড়ে সে। চোখ ছলছল করছে তার। দাদুকে বলা মোহর কথা সবটাই শুনেছে সে। আর শোনার পর থেকেই তার খুব কান্না পাচ্ছে। কান্নাটা ঠিক কি কারণে আসতে চাইছে তা মায়ার জানা নেই। সে কেবল জানে তার এখন হালকা হওয়ার জন্য কাঁদতে হবে।

মায়া যখন বাঁধহারা নীরব কান্নায় মগ্ন তখন আচমকাই তার ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে শুভ্রর নামটা ভেসে আছে। মায়া অপেক্ষা না করে ফোনটা তুলে। অপর পাশ হতে শুভ্র তার নাক টানার শব্দ শুনে জানতে চায়,

“ দোস্ত কি হইসে? সব ঠিক আছে? মোহ ঠিক আছে? “

মায়া উত্তর দিতে পারে না। তার কান্নার গতি বাড়ে। বাবার মতো তারও খুব ভয় হয়। কাউকে হারাতে চায় না সে। সে সবাইকে সুস্থভাবে নিজের জীবনে চায়।

__________

গভীর রাত তখন। জানালার পর্দার ফাঁক গলে পূর্ণ চাঁদের আলোয় রুমটা আলোকিত হয়ে আছে। বিছানায় গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকা রমণীর ঘুম ভাঙে আচানক। খুব অস্থির অনুভব করছে সে। চোখ খোলার চেষ্টা করতে নিয়ে টের পেলো চোখের পাতা খুব ভারী অনুভূত হচ্ছে। সেই সাথে জ্বালাও করছে।

একা রুমটায় মোহ উপলব্ধি করলো হুট করে বিনা নোটিশে জ্বর এসে হাজির হয়েছে। শরীরের প্রতিটা ভাজে সেই জ্বর নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কি এক মুশকিল! মোহ চেষ্টা করে একা উঠে বসার। কিন্তু শরীরে সামান্যতম বল খুঁজে পায় না সে।

মোহর আফসোস হয়। মায়া বারবার করে তার সঙ্গে থাকতে চাইছিলো। কিন্তু সে-ই ঠেলেঠুলে মায়াকে নিজের রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন কি করবে সে? অন্য কোনো উপায় না পেয়ে মোহ হাতড়ে ফোনটা খুঁজে বের করে বালিশের ভাজ থেকে। জোর করে চোখ মেলে তাকিয়ে ফোনটা সুইচ অন করে সে। গতকাল থেকে সে নিজের ফোন সুইচ অফ করে ফেলে রেখেছিল। কারণ হলো তার ক্লাসমেটরা। ওদের কৌতূহলী ম্যাসেজ এবং কল এড়ানোর জন্য এটাই সবথেকে সহজ উপায় মনে হয়েছে মোহর।

ফোন অন করতেই মিসড কলের নোটিফিকেশনে স্ক্রিন ফুল হয়ে যায়। মোহ সেসব উপেক্ষা করে কনট্যাক্ট লিস্টে চলে যায়। ঝাপসা, উত্তপ্ত চোখে কিছুটা স্ক্রল করে একটা নাম্বার ডায়াল করে। কানে ফোনটা চেপে ধরে ফের চোখ বুজে নেয় সে। এসির ভিতরেও মনে হচ্ছে সে পুড়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হয়। মোহ অপর পাশের মানুষের কিছু বলার অপেক্ষা না করে নিজেই দূর্বল গলায় বলে,

“ একটু রুমে আয় তো। কাউকে ডেকে বিরক্ত করিস না। জ্বর এসেছে মনে হয় সামান্য। সাথে করে একটু পানি নিয়ে আয়। মেডিসিন খেয়ে নিবো। “

বলেই মোহ চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ নীরবতা বজায় থাকে। অত:পর তাকে অবাক করে দিয়ে একটা পুরুষ স্বর বলে উঠে,

“ আমাকে আসতে বলছেন? “

মোহ জ্বরের ঘোরে চমকায়। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চোখের সামনে ধরে দেখে সে মায়ার জায়গায় ভুল করে অনাকাঙ্ক্ষিত নাম্বারে ডায়াল করে ফেলেছে। সাথে সাথে সে ফোন কানে চেপে ধরে বলে,

“ সরি। ভুলে। নাম্বার ডিলিট করে দিচ্ছি। ভুলেও আর কখনো কল যাবে না। এগেইন সরি… “

মোহর সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই অপর পাশের ব্যক্তিটি বলে উঠে,

“ আই এম সরি মোহ। ওদিনের জন্য সরি। হার্ট করার জন্য সরি। “

মোহ কিছু বলতে পারে না। বুঝে উঠতে পারছে না কিছু। কেবল টের পাচ্ছে তার ঘাড়ের নিচে বালিশের দিকটা শরীরের উত্তাপে গরম হয়ে গিয়েছে। মোহকে অবশ্য আর কিছু বলতেও হয় না। মনন নিজেই বলে উঠে,

“ কখন থেকে জ্বর আপনার? জ্বর মেপে দেখেছেন? “

মোহ এবারও নিরুত্তর রয়। মনন এবার গলার স্বর কিছুটা নরম করে প্রশ্ন করে,

“ কথা বলবেন না, মোহ? “

মোহ আসলেই আর কথা বলে না। বরং সোজা কলটা কেটে দেয়। কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে মননের নাম্বারটাও ডিলিট করে দেয়। মনে এসে ভীড় করে অভিমান। ভীড় জমানো অভিমান বুকে পুষে মোহ ঠিক করে সে কখনো এই লোকের সাথে কথা বলবে না। কেনো বলবে না সে জানে না। মোহর ভাবনার মাঝেই আরো একবার তার ফোন বেজে উঠে। এইবার সে সোজা ফোন সুইচ অফ করে ফেলে। কারো কল রিসিভ করবে না সে। কারো সাথে কথা বলবে না।

__________

মনন হতাশ ভঙ্গিতে ফোন হাতে বিছানায় বসে আছে। আচমকা কলের শব্দে ঘুম ভেঙে স্ক্রিনে মোহর নাম দেখে যেমন খুশি হয়েছিলো সে, এখন একই রকম শূন্যতা অনুভব করছে। মেয়েটা আসলেই তার সাথে আর কথা বলতে চায় না? দায় কি সম্পূর্ণ মননের?

মনন অন্ধকার রুমে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থেকে উপলব্ধি করে, বুকের ভেতর ক্রমাগত কিছু একটা ভেঙে চলেছে। ঠিক নদীর পাড় ভাঙার মতো। মনন টের পায় বুকের ওখানটায় বড়ো একটা গড়মিল ঘটে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু তা কি সেটা তার বুঝে আসছে না। মননের স্থির দৃষ্টিতে কোনো হেলদোল দেখা যায় না। কেবল বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটা লক্ষণীয় হয়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১৮

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৮.

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনটায় মুখোমুখি বসে আছে দু’জন যুবক। আজকে লাইফ কেয়ার হসপিটালে অনুষ্ঠিত সেমিনারে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দু’জনের সাক্ষাৎ হয়েছে। মননের সামনে বসে থাকা যুবকটা তার কলেজ লাইফের ক্লাসমেট। বর্তমানে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের পেশায় ডক্টর হিসেবে নিযুক্ত আছেন। নাম ডক্টর মাশুক মৃধা। হুট করে এতো বছর পর দেখা হওয়ায় দু’জনেই যেনো খুব খুশি। কথায় কথায় মনন জেনেছে মাশুক বর্তমানে বিবাহিত। স্ত্রী রয়েছে তার।

সেমিনার শেষে পেশেন্ট ভিজিটের জন্য মনন তেরো তলায় গিয়েছিলো। সঙ্গে ছিল মাশুক। ফেরার পথে আচমকা একটা নির্দিষ্ট কেবিনের সামনে এসে মনন অজান্তেই থেমে গিয়েছিলো। তাকিয়ে ছিল কেবিনের দরজার পানে। সেই ব্যাপারটা মাশুক লক্ষ্য করে জানতে চায় দাঁড়িয়ে পড়ার কারণ। মনন সেখানে আর কথা বাড়ায় নি। বরং মাশুককে নিজের কেবিনে কফির জন্য অফার করে। কফি খেতে খেতেই না-হয় মাশুকের প্রশ্নের জবাব দেওয়া যাবে সেই ভাবনা থেকে।

ধোঁয়া উঠা গরম কফির মগে একটা চুমুক বসিয়ে মনন বলে উঠে,

“ এক তিন শূন্য সাত নং কেবিনে একজন পেশেন্ট এডমিট আছে। একটা মেয়ে। আমি ওই মেয়েটাকে হার্ট করেছি। নিজের কথা দ্বারা। কখনো মনে হয় ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত, কখনো মনে হয় ওর মুখোমুখি আর না হওয়াই ভালো। “

মননের কলেজ লাইফের ক্লাসমেট, বর্তমানে ডক্টর মাশুক মৃধা নীরবে শুনে সবটা। সূক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করে মননের মুখের অভিব্যক্তি। অত:পর প্রশ্ন করে,

“ পেশেন্টের সিচুয়েশন কি? “

“ ফিমারে টিউমার। টিউমারে ক্যান্সারের জীবাণু রয়েছে। থার্ড স্টেজ ক্যান্সার। “

“ ফিমারে টিউমার? কিন্তু আমার জানামতে তো তুমি ব্লাড ক্যান্সারের পেশেন্টদের ডিল করো। বোন এন্ড সফট টিস্যু ডিপার্টমেন্ট এর পেশেন্টের সঙ্গে তোমার সূত্রটা মেলাতে পারছি না। “

মনন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ সে এক লম্বা ঘটনা। তোমাকে ছোট করে বলি। প্রথমে কাকতালীয়ভাবে তিনবার আমাদের দেখা হয়। তারপর থেকে সামহাও ব্যাপারটা আর কাকতালীয় থাকে না। ও মাঝেমধ্যে দেখা করতে চাইতো, হয়তো আমিও মনে মনে চাইতাম। ও দেখা করতে চাইলে কখনো নিষেধ করতে পারতাম না কেনো জানি। ও আমার আশেপাশে প্রশ্রয় খুঁজতো, না চাইতেও আমি কিভাবে কিভাবে যেনো ওকে প্রশ্রয় দিতে থাকি। ব্যাপারগুলো খুব কনফিউজিং। ওর সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই ভেবে নিলাম দূরত্ব বজিয়ে চলাটাই বেটার। “

মাশুক আনমনে হাসে। নীরবে হাসতে হাসতে কফির মগে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করে,

“ প্রথম কাকতালীয় দেখাটা কবে হয়েছে তোমাদের? “

মননের তরফ থেকে আসে সঙ্গে সঙ্গে জবাব,

“ ঠিক একমাস আগে। “

“ আচ্ছা। কি পরেছিলো সেদিন সে? “

“ কালো রঙের একটা জামা। “

মননের জবাবে এবারও কোনো জড়তা নেই। তবে জবাবটুকু দিয়েই সে অবাক হয়। মাশুককে প্রশ্ন করে,

“ এসব কেনো জানতে চাইছো? “

মাশুক জবাব দেয় না। বরং পাল্টা প্রশ্ন করে,

“ তুমি ওকে নিয়ে খুব কনফিউশানে ভুগছো, তাই না? “

মনন এবার কেবল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। মাশুক কিছুটা গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে। সরাসরি মননের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ কোনটার সমাধান আগে চাও? ওকে নিয়ে নিজের দ্বিধার নাকি ক্ষমা চাওয়াটা উচিত হবে নাকি অনুচিত সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত? “

মনন কিছুক্ষণ মাশুকের দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দেয়,

“ দ্বিতীয়টার। “

মাশুক কোনো ভনিতা না করে বলে,

“ আমার সাজেশন চাইলে আমি সাজেস্ট করবো, ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে ওর সিচুয়েশনটা। থার্ড স্টেজ ক্যান্সার আছে ওর। সার্ভাইভাল চান্সেস সম্পর্কে তোমার ধারণা আমার থেকেও বেশি। তাই বলবো সুযোগটা হাতছাড়া করো না। খুব বেশি দেরি হয়ে গেলে আজীবন আফসোস থেকে যাবে। আমি চাই না তুমি আফসোস করো। “

মনন আচমকাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় মোহর কেসের সার্ভাইভাল রেট সম্পর্কে। অনুভব করলো তার বুক কাঁপছে। অদ্ভুৎ অসহায়ত্ব যেনো তাকে গ্রাস করে ফেলছে। আবারও মনে পড়ে যায় মোহর মুখটা। ওই জ্বলজ্যান্ত মানুষটার না থাকার সম্ভাবনায় যে তার যায় আসছে তা তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠে। মাশুক লক্ষ্য করে সবটা। সে বলে উঠে,

“ এবার আসি তোমার মনে চলতে থাকা দ্বিধা দ্বন্দ্বের আলাপে। তুমি ইচ্ছা অনিচ্ছায় মেয়েটার সঙ্গে জড়িয়ে পরেছো। তুমি স্বীকার করো কিংবা না করো, দিজ ইজ ফ্যাক্ট। খালি চোখে দেখতে গেলে তোমাদের মাঝে কিছু নেই এইটা সত্য। কিন্তু দৃষ্টির আড়ালে তোমাদের মাঝে কিছু না থেকেও অনেক কিছু একটা আছে এইটাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তোমার দ্বিধা দ্বন্দ্বের সমাধান হিসেবে আমি শুধু এতটুকুই বলতে পারি। তোমাদের মাঝে থাকা সেই কিছু একটাকে এখন তোমারই খুঁজে বের করতে হবে। ইট ইজ টোটালি আপ টু ইউ। “

মনন শুনে সবটা। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বেই তাকে গভীর ভাবনায় ডুবতে দেখা যায়। মাশুক তা লক্ষ্য করতেই হঠাৎ তার মন খারাপ হয়ে যায়। তার সামনে বসা এই ছেলে যদি সেই কিছু একটাকে খুঁজে পায় তারপর কি হবে? কি হতে পারে তার পরিণতি? মেয়েটার জীবনের স্পষ্ট নিশ্চয়তা নেই কোনো। পরিণতিটা যদি করুণ হয়?

ভাবতে ভাবতেই মাশুক ধীর গলায় প্রশ্ন করে,

“ এক তিন শূন্য সাত নং কেবিনের পেশেন্টের নামটা কি বাই দ্যা ওয়ে? “

মনন ভাবনা থেকে বেরিয়ে জবাব দেয়,

“ মোহ। “

__________

মাশুককে বিদায় করেই মনন ব্যস্ত পায়ে দ্রুত লিফটের দিকে হাঁটা ধরে। দুটো লিফটেরই বাটন চেপে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। মস্তিষ্কে বারবার আলোড়িত হচ্ছে মাশুকের বলা কথাগুলো।

“ সুযোগটা হাতছাড়া করো না। খুব বেশি দেরি হয়ে গেলে আজীবন আফসোস থেকে যাবে। আমি চাই না তুমি আফসোস করো। “

হঠাৎই মনে ভয় হয় মননের। যদি… যদি দেরি হয়ে যায়? লিফট আসতে দেরি হচ্ছে দেখে অধৈর্য্য হয়ে যায় মনন। তাকিয়ে দেখে একটা লিফট এখনো বারো তলায় দাঁড়িয়ে আছে, অপরটা আট তলায়। ভিন্ন ভিন্ন ফ্লোরে থেমে লিফটের নামতে খুব সময় লাগবে। এতটা সময়ের তর সয় না মননের। সে কয়েক কদম পাশেই ইমারজেন্সি স্টেরওয়ের দিকে চলে যায়।

খালি সিঁড়ি বেয়ে একপ্রকার দৌড়ে উঠছে মনন। মাত্র সাত তলায় উঠেছে সে। এক চাপে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠার কারণে নিঃশ্বাসে টান পড়েছে তার। থেমে কিছুক্ষণ দম ফেলে সে আবার দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে।

তার পা জোড়া থামে একেবারে তেরো তলায় পৌঁছে। দ্রুত করিডর পেরিয়ে মোহর কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। মুহুর্তেই তীব্র অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। কেবিনের ভেতর থাকা মানুষ গুলোও অবাক হয়ে দেখছে তাকে। মনন আড়ষ্ট গলায় বলে,

“ সরি ফর ডিস্টার্বিং। “

কথাটুকু বলেই মনন কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। সোজা চলে যায় তেরো তলার নার্স কাউন্টার এরিয়াতে। গিয়ে একজনকে প্রশ্ন করে,

“ রুম নং ওয়ান থ্রি জিরো সেভেন এর পেশেন্ট কোথায়? “

কাউন্টারে বসে থাকা নার্স প্রশ্ন করে,

“ পেশেন্টের নাম? “

“ মেহনামা ফেরদৌস মোহ। “

নার্সটা কম্পিউটারে কিছু একটা চেক করে জানায়,

“ স্যার, উনি তো কেমো শেষ করে বিকেলেই ডিসচার্জ নিয়ে চলে গিয়েছেন। কোনো প্রয়োজন? “

মনন আর কিছু বলতে পারে না। নীরবে সেখান থেকে প্রস্থান করে সোজা ছাদে চলে যায়। ছাদে দমকা হাওয়া চলছে। মনন তোয়াক্কা করলো না, বরং কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে। দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে মোহর নাম্বারে কল করে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ফোনের অপর পাশ থেকে নারী কণ্ঠ বলে উঠে,

“ দ্যা নাম্বার ইউ আর ট্রায়িং টু কল ইট’স আনরিচেবল। প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার। “

মননের বুকের ভেতর অদ্ভুৎ এক সর্বনাশা ধ্বনি বাজতে থাকলো। মোহ চলে গিয়েছে। সে কি খুব দেরি করে ফেললো? সুযোগ কি হাতছাড়া হয়ে গেলো? অসহায়ত্ব বোধ ঘিরে ধরলো মননকে। অদ্ভুৎ অসহায়ত্ব বোধ। এই অসহায়ত্ব বোধ থেকে মুক্তি শুধুমাত্র মোহ তাকে দিতে পারবে। কিন্তু কোথায় পাবে সে মোহকে? কোথায় খুঁজবে?

চলবে…

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১৭

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৭.

সময় সকাল ছয়টা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। লিভিং রুমের সিঙ্গেল সোফাটায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন আলী আকবর সাহেব। এটা উনার নিত্যদিনের রুটিন। ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে ঘরময় পায়চারি করতে থাকেন। খবরের কাগজ এলে তাতে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে রুমে গিয়ে হসপিটালে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নেয়। অত:পর বেরিয়ে যাওয়ার আগে সোজা নাস্তা করে রওনা হোন তিনি। তবে আজ ভাবছেন হসপিটাল যাবেন না। বরং নাস্তা করে সোজা রুমে গিয়ে আরেক দফা ঘুমাবেন তিনি।

হঠাৎ টের পান কেউ একজন লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। আলী আকবর সাহেব টের পেয়েও চোখ তুলে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন না। বরং খবরের কাগজের প্রতিই মনযোগ স্থির রাখেন। উনার মনযোগ ভাঙ্গেন যখন কেউ একজন উনার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে নরম গলায় ডাকে,

“ দাদু? “

এই পর্যায়ে আলী আকবর কায়সার না চাইতেও খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে নাতির মুখপানে তাকায় সরাসরি। অবাক হোন তিনি। গতরাতের হসপিটাল ফেরত শার্ট, প্যান্ট গায়ে এখনো মননের। চশমা পড়ে না থাকায় সরাসরি দেখা যাচ্ছে অতিরিক্ত লাল চোখ দুটো। চুলগুলোও এলোমেলো।

গতরাতে রুমে যাওয়ার পর মনন আর রুম থেকে বের হয় নি। আলী আকবর সাহেব কিংবা আরিফ সাহেবও আর তাকে ডাকে নি। মননের প্রাইভেট লাইফ কি-না! এই মুহুর্তে নাতির এই অবস্থা দেখে আলী আকবর সাহেব উৎকণ্ঠা বোধ করেন। তবে তা প্রকাশ করে না, নীরব রয়।

মনন নিজ থেকেই নীরবতা ভেঙে বলে,

“ আই এম সরি দাদু। গতরাতে আমার ওভাবে কথা বলাটা ঠিক হয় নি। আই ওয়াজ নট ইন মাই মাইন্ড। “

“ তা তো বুঝাই যাচ্ছিলো। “

“ এগেইন সরি দাদু। কিন্তু এই বিয়ের টপিকটা বারবার আমার সামনে তুলো না। আই এম নট রেডি ফর এনি কমিটমেন্ট। “

“ অভিভাবক হিসেবে আমি এবং তোমার বাবা সর্বোচ্চ তোমাকে বিয়ের কথা বলতে পারি, পাত্রীর ছবিও দেখাতে পারি। কিন্তু কখনো জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবো না এতটুকু নিশ্চিত থাকতে পারো। কিন্তু আমাদের বলা কওয়া নিয়েও যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহলে সেটাও বাদ দিয়ে দিবো না-হয়। আফটার অল তুমি বড়ো হয়েছো। তোমার নিজের ব্যক্তিগত জীবন আছে। “

“ তোমাদের কিছু বলতে নিষেধ করি নি আমি। অবশ্যই তোমরা আমার ব্যাপারে কথা বলার অধিকার রাখো। কিন্তু দাদু সবকিছুর একটা সঠিক সময় থাকে। সঠিক সময় আসুক। তখন না-হয় এই টপিক নিয়ে কথা হবে আমাদের? “

আলী আকবর কায়সার না চাইতেও হঠাৎ গলে যান বরফের মতো। এই একটা সমস্যা তার! বেশিক্ষণ রাগ পুষে বসে থাকতে পারেন না তিনি। নোবিতার মতো দেখতে এই একমাত্র আদুরে নাতির বেলায় তো আরো না। তিনি কিছুটা মুখ ভার করে বলে,

“ এভাবে সরি চলবে না। আমার ইন্সটাগ্রামে ফলোয়ার বাড়ছে না। আমাকে ইন্সটায় ট্যাগ মেরে একটা পোস্ট বা স্টোরি দাও তো। “

মনন কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই শব্দ করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে জবাব দেয়,

“ আমার ইন্সটা একাউন্ট নেই দাদু। একটা ছিলো, কিন্তু ব্যবহার করা হতো না। তাই ডিলিট করে দিয়েছি। “

আলী আকবর কায়সারকে হতাশ দেখালো। উনি আফসোসের সুরে বলেন,

“ ওই দুইশো প্লাস ফলোয়ারের একাউন্টটা তুমি ডিলিট করে দিলে? আমাকে দিলেও তো পারতে! আমার একাউন্টে মাত্র সাতাশ জন ফলোয়ার। আগে বত্রিশ জন ছিলো। কিন্তু যারা যারা রিয়েক্ট দেয় না তাদের আনফ্রেন্ড করে দিয়েছি আমি। “

মনন হাসতে হাসতে বলে,

“ উঠো। চলো, আজকে আমি নাস্তা রেডি করবো। ফ্রেঞ্চ স্যান্ডউইচ। রাতে আমি খাই নি দেখে যে তুমি আর আব্বুও খাও নি তা আমার জানা আছে। খিদে পায়নি? “

আলী আকবর সাহেব নাক মুখ কুচকে বলে,

“ ভুলেও না। তোমার গা থেকে ঘাম আর হসপিটালের বাজে গন্ধ আসছে। তোমার হাতের খাবার খেলে আমাকে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে। তুমি গিয়ে গোছল করে নিজের এই গাঁজাখোরদের মতো হুলিয়া বদলাও। আমি গিয়ে তোমার বাপকে ডাকছি। ওর কাজ করা উচিত, দিনদিন ভুড়ি বেড়ে কি বিশ্রী দেখাচ্ছে। ওই বুড়োকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পাবো দু’দিন পর। “

বলতে বলতে আলী আকবর সাহেব পত্রিকা রেখে উঠে চলে যান। মনন হতাশ হয়ে দেখে নিজের দাদুকে। মিনিটের মধ্যে তার এবং তার আব্বুর ইজ্জতের রফাদফা করে দিলো এই বুড়ো!

__________

স্যালাইনের ড্রিপ হয়ে ধীর গতিতে বিন্দু বিন্দু স্বচ্ছ তরল নলার মতো চিকন বস্তুতে প্রবেশ করছে। সেই নলা একটা সুঁইয়ের মাধ্যমে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে কেমো পোর্টে। গত দুই ঘন্টা ধরে এভাবেই চলছে মোহর দ্বিতীয় সাইকেল কেমোর প্রথম দিনের ডোজটা। নার্সের ভাষ্যমতে আরো তিন থেকে চার ঘন্টা এভাবেই চলবে।

মোহর যেনো দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। সে সোজা হয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। নড়াচড়া করার কোনো উপায় নেই। কারণ কেমোটা হাতে করে ক্যানেলার মাধ্যমে নয় বরং বুকে সরাসরি কেমো পোর্টের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে মোহর মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে ভয়ংকর শাস্তি বোধহয় এটাই। আর কোনো যন্ত্রণা এর থেকে বড়ো হতে পারে না। রোগটা যতটা না ভয়ংকর, তার থেকেও এর চিকিৎসা প্রক্রিয়া আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক। মনে মনে বারবার আওড়াচ্ছে,

“ কেউ এই শাস্তি না পাক কখনো। আমার চরম শত্রুও না। কেউ ভোগ না করুক এই যন্ত্রণা কখনো। “

ভেতরে ভেতরে ঝড় বয়ে চললেও উপরে তার সিঁকি ভাগও প্রকাশ করছে না মোহ। বরং নীরবে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া ছিলো তার পাশেই। বারবার মোহকে জিজ্ঞেস করছে,

“ আপেল খাবি? কেটে দেই একটু? নাকি কমলা ছিলবো? একটু পানি খাবি? ডক্টর কিন্তু দিনে তোকে দুই থেকে তিন লিটার পানি খেতে বলেছে। যত বেশি পানি খাবি তত তাড়াতাড়ি ইউরিনের সাথে শরীরের এক্সেস মেডিসিন, জীবাণু সব বের হয়ে যাবে। “

মোহ শুনে সব। প্রতুত্তর করে না। মায়াকে সে বুঝাতে পারবে না। যে এই মুহুর্তে উঠে বসার চেষ্টা করলে তার বুকে কেমন অনুভূত হবে। না সে এটা বুঝাতে পারবে যে, তার কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। লোভনীয় সব খাবারের প্রতিও তার রুচি কাজ করছে না। বরং বিষ মনে হচ্ছে সেসবকে। অবশ্য যে ভোগ করছে সে বাদে কেউ কখনো বুঝবেও না এর জটিলতা। কেবলমাত্র শব্দ গুচ্ছ কম হয়ে যাবে কাউকে মোহর এই অনুভূতি গুলো বুঝাতে।

মোহর তরফ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মায়া হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ায়। ইমারজেন্সি নার্স কল করার ওয়্যারড রিমোটটা মোহর হাতের কাছে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ ওয়াশরুম থেকে আসছি আমি। খারাপ লাগলে রিমোট চেপে দিবি। সাথে সাথে নার্স এসে পরবে। আর তাছাড়া বাবাও দরজার ওপাশে আছে। বাবাকেও ডাকতে পারিস। “

মায়া ওয়াশরুমে চলে যেতেই মোহ আবার সিলিং এর দিকে দৃষ্টি স্থির করে। নিজেকে হুট করেই পৃথিবীর বুকে একটা উটকো ঝামেলা মনে হচ্ছে তার। ওই লোকটার সাথে কেনো এরকম গায়ে পড়া আচরণ করলো সে? কি কারণে? কি কারণে নিজেকে এতটা সস্তা হিসেবে তুলে ধরলো সে? লোকটার নিশ্চয়ই ধারণা হয়েছে, মোহ খুব ছ্যাচড়া স্বভাবের একটা গায়ে পড়া মেয়ে।

অথচ মোহ? তার মাথায় এতদিন এক মুহুর্তের জন্যও এমন চিন্তা আসে নি। সে শুধু জানতো, সে ওই লোকটার সঙ্গ উপভোগ করছে। অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। ক্ষণিকের কথা, ক্ষণিকের আলাপ সবটাই কেবল মোহর ভাল্লাগতো। কোথাও না কোথাও তার মন ধরে নিয়েছিলো ওই লোকটা বোধহয় তার যন্ত্রণাটা না বলা সত্ত্বেও বুঝতে পারবে। ডক্টর মানুষ তো! পেশেন্টদের উপর গভীর পড়াশোনা আছে তাদের। কোন রোগে রোগী কতটুকু কষ্ট পাচ্ছে ওই ধারণাটুকু নিশ্চয়ই উনাদের আছে?

কিন্তু গতকাল মোহ উপলব্ধি করেছে তার এবং ওই ডাক্তারের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। মোহর কাছে যা ছিলো উপভোগ তুল্য, ওই লোকের কাছে সেই একই বিষয় ছিলো বিরক্তির কারণ। তবে এইবার মোহর চোখ খুলে গিয়েছে। আর কারো বিরক্তির কারণ হবে না সে। তার কারণে সবার ব্যক্তিগত জীবনে অসুবিধা হচ্ছে। মোহ কারো অসুবিধার কারণ হতে চায় না। তাই আচমকাই সে মনে মনে একটা কিছুর কামনা করে বসে। এই কামনা কিংবা চাওয়া তার খুবই একান্ত আবদার সৃষ্টিকর্তার প্রতি। খুবই একান্ত।

__________

মননের রাগের বশে তার দাদু এবং আব্বুর সাথে করে ফেলা ব্যবহারটা নিয়ে তাদের সঙ্গে মিটমাট হয়ে গিয়েছে পরের দিন সকালেই। যদি কিছু অমীমাংসিত থেকে যায়, তাহলে সেটা হলো মোহ।

মোহকে ঘিরে মননের সবকিছুই কেমন যেনো অমীমাংসিত! কোনো কূল কিনারা খুঁজে পায় না সে। সেদিন বিকালে দেখা মোহর মুখটা হুটহাটই তার সামনে ভেসে উঠে। ওই তারার মতো জ্বলজ্বল করা মেয়েটার মুখখানি আঁধারে নিভে যাওয়ার দৃশ্যটা মননকে তাড়া করে। অবশ হয়ে আসে মস্তিষ্ক এবং চিত্ত।

অনুভব করে খুব বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছে সে। তার জন্য হয়তো মেয়েটার মন খারাপ হয়েছে। সেই মন খারাপের দায় সম্পূর্ণটাই মননের। পর মুহুর্তেই তার মনে হয়, সে অতিরিক্ত ভাবছে। মোহর জীবনে সে বিশেষ কেউ নয় যার কারণে মোহ দীর্ঘক্ষণ মন খারাপ দিবস পালন করবে।

কেবিনের টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে মোহকে ঘিরে মননের ভাবনা গুলো তার মন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকলো। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব আর মন ও মস্তিষ্কের মাঝে চলা যুদ্ধ নিয়ে মনন আর মোহমুখী হলো না। হয়তো বা আর হবেও না। ঝিম ধরা রবে কেটে যায় চার চারটা দিন। মনন ব্যস্ত হয়ে পরে নিজের কর্মজীবন নিয়ে পুরোপুরি। মোহর অবস্থা রয় অজানা। খুব আকস্মিকভাবে দেখা হওয়া মানুষ দুটোর পথ আলাদা হয়ে গেলো যেনো আরো আকস্মিকভাবে। আদৌ পথ আলাদা হয়েছে? কে জানে!

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১৬

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৬.

জাদুর শহরের বিকাল বেলাটা সাজে ভিন্ন রূপে। পরিষ্কার নীল আকাশের বুকে উঁড়ে বেড়াচ্ছে পেজা পেজা মেঘ। রাস্তায় সারি সারি গাড়ি আটকে আছে জ্যামে। ঢাকা শহরের খুব পরিচিত একটা দৃশ্য এটা। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের ফোনে সেসব দৃশ্যই ভিডিও করছিলো মোহ। ঘুরে ঘুরে চারিদিকটা রেকর্ড করতে করতে আচমকা দরজার দিকে ফোনটা ফেরাতেই সে থেমে যায়। ক্যামেরা থেকে চোখ তুলে তাকায় সরাসরি সামনে। মননের পানে।

মোহ ফোনটা অফ করে রেখে হেসে বলে,

“ এতো তাড়াতাড়ি এসে পরেছেন! আমি ভেবেছিলাম অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। “

মনন এগিয়ে এসে মোহর হাতে বোতলটা ধরিয়ে দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। অতি উঁচু দালানের ছাদে দাঁড়িয়ে শহরটা দেখতে দেখতে শুধায়,

“ আজকে কি ওপিডি ছিল আপনার? “

মোহ বোতল থেকে ঢকঢক করে কিছুটা পানি পান করে নিয়ে জবাব দেয়,

“ রুটিন চেকাপ টেস্ট আর ওপিডি এসব ছিল। ডক্টর দেখিয়ে সোজা এডমিট হয়ে গেলাম। আগামীকাল থেকে আবার কেমো শুরু হবে। তেরো তলায় কেবিন পেয়েছি। আগামী পাঁচ দিন হসপিটালে আমার দেখা পাবেন আপনি। “

মন মস্তিষ্কের টানাপোড়নে ডুব দেওয়া মনন প্রতুত্তর করে না। জানতে চায় না মোহ কেন প্রয়োজন অপ্রোয়জনে তার সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে চায়। মননকে ভাবনায় বিভোর দেখে মোহ প্রশ্ন করে বসে,

“ কি হয়েছে? কার কথা ভাবছেন? এই আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে? আচ্ছা ওয়েট। আপনার বলতে হবে না। আমি গেস করছি… “

মোহর কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মনন সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার আপনার ম্যাটার অফ কনসার্ন হওয়ার কথা নয় মোহ। “

মোহ আচমকা থেমে যায়। দেখে মননের শক্ত মুখটা। ব্যাপারটাকে খুব একটা গরু গম্ভীর কিছু না ভেবে ফের হেসে বলে,

“ এই! আপনি কি রেগে আছেন? গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে? “

মনন এবার আরো দৃঢ় গলায় চোখ মুখ শক্ত করে বলে,

“ দ্যাট ইজ নট ইউর বিজনেস মোহ। আপনি প্লিজ বারবার আমার ব্যক্তিগত লাইফ নিয়ে কথা বলাটা বন্ধ করুন। ব্যাপারটা আমাকে খুবই অস্বস্তি ফিল করাচ্ছে। আপনার সঙ্গে আমার সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই যেটার বেসিসে আপনি আমাকে যখন তখন কল দিয়ে দেখা করতে চাইতে পারেন। ইউ শুড একনলেজ দ্যা বাউন্ডারিস। “

মোহকে নীরব দেখালো। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মননের দিকে। পর মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর গলায় বলে,

“ সরি। “

এতটুকু বলেই মোহ দ্রুত প্রস্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েও থেমে যায়। শিহানের ওয়ালেট থেকে না দেখেই একটা নোট বের করে তা মননের এপ্রোনের বুকপকেটে গুজে দিয়ে বলে,

“ পানির বোতল নিয়ে আসার জন্য থ্যাঙ্কিউ। “

মোহ প্রস্থান করতেই মননের মুখভঙ্গি ধীরে ধীরে নমনীয় হয়ে আসে। দু-হাত দ্বারা রেলিঙে ভর দিয়ে বেশ অনেকক্ষণ চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে সে। নিজের প্রতি বিরক্ত সে। এইমাত্র সে মোহর সঙ্গে রুড বিহেভ করেছে। ব্যাপারটা উপলব্ধি করতেই সে নিজের প্রতি আরো বিরক্ত হয়।

ওই মেয়ের কি দোষ? দোষ হচ্ছে সব মননের। ছাদে আসার পর সে ইচ্ছে করেই মোহর দিকে তেমন একটা তাকায় নি। নিজের দৃষ্টিকে অন্য সকল বিষয় বস্তুর উপর স্থির করতে চাইছিলো সে। কিন্তু লাভ হয় নি। আড়ালে আবডালে দৃষ্টি ঘুরেফিরে ওই চঞ্চল মুখপানে গিয়েই ঠেকছিল তার। দেখছিলো কেমোর প্রভাবে মূর্ছে যাওয়া মুখশ্রীতে লেপ্টে থাকা হাস্যজ্বল ভাবটা। দেখছিলো ঘন চোখের পাপড়ি গুলো কেমন হালকা হয়ে এসেছে। দেখছিলো চঞ্চলতাকে ছাপিয়ে চেহারায় লুকিয়ে থাকা নিষ্পাপ ভাবটা।

এতকিছু লক্ষ্য করার সময় আচমকাই মননের মনে হচ্ছিলো সে চুরি করে একটা মানুষকে দেখছে। ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তি এবং লজ্জাজনক। মোহ আর এক মুহুর্ত তার সামনে থাকলে হয়তো তার এই চুরি করে দেখাটা ধরা পরে যাবে। হয়তো হুট করেই মোহ চোখ রাঙিয়ে বলে বসবে,

“ এই মরণ! আপনি হ্যাবলা কান্তের মতো চার চোখ নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন কেনো? আপনাকে একদম ছ্যাচড়া মনে হচ্ছে। “

মনন তখন কি জবাব দিতো? কেন দেখছে সে? উত্তর তো মননেরও জানা নেই। সারাদিনের কাজের চাপ, ক্ষুধা এবং মস্তিষ্কের টানাপোড়নে মনন হঠাৎই অসহায় বোধ করে। ঘুমালে বোধহয় কিছুটা আরাম পাবে সে। কিন্তু সে-ই সুযোগ মিলে না আর। এর পূর্বেই তার ফোন বেজে উঠে। সিনিয়রের জরুরি ডাক পরে। সিনিয়রের ডাক এড়ানো সম্ভব নয় মননের পক্ষে। তাই অগ্যতা তার ঘুমানোর ইচ্ছেকে বালি চাপা দিতেই হয়।

__________

ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একটু পরপরই মেয়েকে আড়চোখে পরখ করছে শিহান। ক্যান্টিন থেকে ফেরার পর থেকেই কেমন অন্যরকম লাগছে মোহকে। এক জায়গায় পাঁচ মিনিটও স্থির থাকতে না চাওয়া মেয়ে কি-না মাথা পর্যন্ত চাদর টেনে গত দুই ঘন্টা ধরে শুয়ে আছে।

কিছু কি হয়েছে? নাকি শরীর খারাপ লাগছে মোহর? শিহান বুঝতে পারে না। মেয়ের নীরবতার পিছনে কারণটা শরীর খারাপ লাগা কি-না তা নিশ্চিত হতে হলে তাকে মোহর সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিন্তু শিহান চাইলেও সহজ হতে পারছে না তেমন একটা। কোথাও একটা জড়তা রয়ে গিয়েছে।

বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধায় কাটিয়ে শিহান ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে মোহর বেডের পাশে থামে। ছোট করে ডাকে,

“ মোহ? “

উত্তর না পেয়ে শিহান ধরে নেয় হয়তো মোহ ঘুমাচ্ছে। তাই মুখের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে দিতে নেয়। কিন্তু চাদর সরাতে নিলেই মোহ চাদর খামচে ধরে রাখে শক্ত করে। অর্থাৎ সে সরাতে দিবে না। শিহান অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,

“ কি হয়েছে? “

“ কিছু না। আমি একা থাকবো। একা থাকতে দাও একটু। “

শিহান টের পায় মেয়ের ভাঙা গলা। কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে কান্না করছে। শিহান কিছুটা চিন্তিত হয়ে পরে। কান্না কেন করছে? বেশি খারাপ লাগছে নাকি? আবারও কি পা ব্যথা হচ্ছে? শিহান আবারও মুখ থেকে চাদর সরানোর চেষ্টা করে বলে উঠে,

“ শরীর খারাপ লাগছে তোমার? ব্যথা হচ্ছে? ডক্টর ডাকবো? “

মোহ আরও শক্ত করে চাদর ধরে রেখে চেচিয়ে উঠে,

“ আমি একা থাকবো। একা মানে একা। বিরক্ত করব না কেউ আমাকে। চলে যাও। আর তুমি না গেলে আমি চলে যাবো। “

রাগে ফেটে পরে মোহ। শিহান স্থির ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অত:পর নীরবে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। ফোন বের করে মায়াকে একটা কল দিয়ে হসপিটালে আসতে বলে। হয়তো মায়া মোহকে বুঝবে, সামলাতে পারবে। শিহান হুট করেই হতাশ হয় নিজের প্রতি। কি জঘন্য পিতা সে! বিজনেসের আগাগোড়া বুঝতে পারলেও নিজের মেয়ের সমস্যাটা কোথায় সেটাই সে বুঝতে পারছে না। বিথী থাকলে হয়তো সবটা সহজ হতো তার জন্য।

__________

সদ্য ঘরে ফিরেছে মনন। আজকের দিনটা যেনো খুব দীর্ঘ ছিল। শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছিলো না। বাসায় ফেরার পথেও জ্যামে বসে থাকতে হয়েছে প্রায় ঘন্টা খানেক। মনে হচ্ছে এক্ষুণি মাথা ব্যথায় ফেটে যাবে। চশমার আড়ালে চোখ দুটোও লাল হয়ে গিয়েছে নির্ঘুম থাকায়।

আলী আকবর সাহেব সন্ধ্যা বেলায়ই হসপিটাল থেকে ফিরেছে। আরিফ কায়সারও কর্মস্থল থেকে ফিরেছে বেশ অনেকক্ষণ আগে। দু’জনে মিলে অসময়ে চা পান করতে ব্যস্ত ছিলো। মননকে প্রবেশ করতে দেখে আরিফ সাহেব ডাকেন,

“ মনন? ফ্রেশ হয়ে এসে চা খাবে? বসাবো আমি? “

“ না আব্বু। “

বলেই মনন চলে যেতে নেয়। আলী আকবর সাহেব সে-ই মুহুর্তে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠে,

“ তোমার টেবিলের উপর একটা ফাইল রাখা আছে। সে-ই ফাইলে পাঁচটা মেয়ের ছবি এবং সিভি আছে। সময় করে দেখে নিও। যেটা পছন্দ হবে জানিয়ে দিও। তাহলে কথা আগাবো আমি। “

মননের সারাদিনের জমে থাকা ক্লান্তি, চাপ, মাথাব্যথা রাগ হয়ে প্রকাশ পায়। সে চেঁচিয়ে উঠে,

“ সমস্যা কি তোমাদের সবার? সবাই মিলে আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেন? কোথাও কি একটু শান্তি পাবো না আমি? চব্বিশ ঘণ্টা কানের কাছে বিয়ে, বিয়ে শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। ফর গড সেক তোমরা থামো। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। নিজেদের একাকিত্ব আর এক্সপেকটেশন এর বোঝা আমার উপর চাপানো বন্ধ করো। তোমাদের এই পারফেক্ট ফ্যামিলি এলবাম কম্পলিট করা বাদেও আমার লাইফে অনেক কাজ আছে। আমার অসহ্যকর লাগছে রোজ রোজ তোমাদের এই একই আলাপ… “

রাগে ফেটে পরে এতদূর বলতেই মনন থেমে যায়। হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে আসে সে। কাধ থেকে ব্যাগটা ফেলে এসি ছেড়ে দেয়। পুরো দুনিয়াটা তার অসহ্যকর লাগছে। কি হচ্ছে তার? সবাই তাকে বুঝতে অক্ষম নাকি সে নিজেই নিজেকে বুঝে উঠতে পারছে না? মননের কিচ্ছু জানা নেই। টেবিলের উপর চোখ পড়তেই সে দেখে ফাইলটা। মনের আক্রোশ মেটাতে সেই ফাইলটা হাতে নিয়ে কাচি দিয়ে কুটি কুটি করে কাটতে শুরু করে সে। একবার খুলে দেখারও প্রয়োজন বোধ করে না। এই ফাইলটার কোনো গুরুত্ব নেই তার কাছে। না ফাইলের ভেতর থাকা ওই মেয়েগুলোর ছবি কিংবা সিভি। এসবই অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় জিনিস মননের কাছে।

কাটতে কাটতে ফাইলটার হাজারটা টুকরো করতেই যেনো মনন কিছুটা শান্ত হলো। পকেট থেকে ফোন, ওয়ালেট সব বের করে রাখার সময় একটা পাঁচশো টাকার নোটও বেরিয়ে আসে। মনন সে-ই নোটটা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে পরে। বিকালে মোহর তার পকেটে গুজে দিয়ে যাওয়া নোট এটা। মনন বেশ কিছুক্ষণ নোটটার দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকাই মৃদু হাসে। ওই মেয়ের আই-কিউ লেভেল খুব বাজে। একটা বিশ টাকার পানির বোতলের বদলে পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। এই মেয়ে কখনো বাজার করতে গেলে তো এক কেজি আলু হাজার টাকায় কিনে নিয়ে আসবে।

ভাবতে ভাবতে মনন আরো একদফা হাসে। ফের আচমকাই তার হাসি মিলিয়ে যায়। বুক চিরে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। পাঁচশো টাকার নোটটা ড্রয়ারে রেখে দেয় সে। রুমালে মোড়ানো মোহর চুলগুলোর সাথেই। অত:পর মনে করে এইমাত্র দাদু এবং আব্বুর সাথে করে আসা দুর্ব্যবহারের দৃশ্যটা। মননের হুট করেই নিজেকে অসহায় মনে হয়। একই দিনে সে তিনটা মানুষকে হার্ট করে ফেললো। আব্বু আর দাদুকে তাও না-হয় সে সরি বলে ব্যাপারটা মিটমাট করে নিবে। কিন্তু মোহ?

মনন আর ভাবতে পারে না। এই মানসিক টানাপোড়েনের কষ্টের ভার বইতে না পেরে একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। বিরতি চাই তার একটু। ঘুম ছাড়া বিরতি পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। তাই দুনিয়ার থেকে সাময়িক বিরতি নিতে সে বেছে নেয় ঘুমকেই।

চলবে…