Thursday, August 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 73



কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০৫

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৫
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

চৌধুরী পরিবার।চৌধুরী নামটার সাথেই কেমন যেন একটা আধিপত্য মিশে আছে!আনন্দপুর গ্রামে যদি ধনী পরিবারের তালিকা করা হয় নিঃসন্দেহে চৌধুরী পরিবার সবার উপরে থাকবে।আর এইজন্য চৌধুরীদের গ্রামের কর্তা মানা হয়। চৌধুরীদের এক কথায় গ্রামের মানুষ ওঠে বসে।বলা বাহুল্য চৌধুরীদের এক প্রকার ভয় পেয়েই চলে তারা।

দুই তালা বিশিষ্ট চৌধুরী বাড়িটা বিশাল যায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে। বাড়ির প্রতিটা কোনায় যেন আভিজাত্যের ছোঁয়া মিশে আছে!চৌধুরী ভিলার পিছনে রয়েছে বড় বড় দুটো পুকুর যার চারি পাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ অনেক ধরনের ফলের গাছ।চৌধুরী ভিলা থেকে মেইন গেইট পর্যন্ত হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট মতো সময় লাগে। বাড়ির সামনে রয়েছে সুবিশাল যায়গা তার ঠিক মাঝ বরাবর রাস্তা। রাস্তার ডানপাশে নাম না জানা হাজারো ফুলের সমাহার।বাম পাশে রয়েছে শত শত নারিকেল ও সুপারি গাছ সাথে আরও একটা পুকুর। পুকুরের সামনে,গাছের নিচে বাঁশ দিয়ে বসার যায়গা ও করা আছে।

চৌধুরী বাড়ির কর্তা ছিলেন মৃত হান্নান চৌধুরী ।তার স্ত্রী ছিলেন মৃত রেণুবালা চৌধুরী।মৃত হান্নান চৌধুরী চার পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। প্রথম পুত্র এমপি আরিফ হাসান চৌধুরী ।যিনি পঁয়ত্রিশ বছর আগে এই চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন।আজও চৌধুরী বাড়িতে পায়ের ধুলো দেননি তিনি।ওনার অর্ধাঙ্গিনী শ্রেয়া চৌধুরী। যিনি বর্তমানে ঢাবিতে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রোফেসর পদে কর্মরত আছেন।বর্তমানে দুই পুত্র সন্তানের জনক আরিফ চৌধুরী। প্রথম সন্তান তথ্য মন্ত্রী আয়াশ চৌধুরী,যার স্ত্রী বানিজ্য মন্ত্রী মামুন তালুকদারের একমাত্র মেয়ে আরিশা তালুকদার।দ্বিতীয় সন্তান সবার বড্ড আদুরে তাহমীদ হৃদিত চৌধুরী।

দ্বিতীয় পুত্র বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আজাদ চৌধুরী। বর্তমান চৌধুরী পরিবারের সকল ব্যবসা ও কোম্পানির দায়িত্বে তিনিই আছেন।স্ত্রী আয়েশা চৌধুরী।আজাদ চৌধুরী দুই সন্তানের জনক। প্রথম সন্তান তাবান চৌধুরী। দ্বিতীয় সন্তান তৃধা চৌধুরী।মৃত হান্নান চৌধুরীর তৃতীয় পুত্র আয়মান চৌধুরী ছত্রিশ বছর আগে আ ত্ম হ ত্যা করে প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন। আদৌও সেটা আ ত্ম হ ত্যা ছিলো নাকি খু ন ছিলো !তা সময়ের আড়ালে চাঁপা পড়ে গেছে।

চতুর্থ পুত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবরার চৌধুরী। তিনি একজন আর্মি অফিসার। স্ত্রী আতিয়া চৌধুরী। ওনার একমাত্র পুত্র সন্তান তাইফ চৌধুরী।মৃত হান্নান চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে আয়রা চৌধুরী যে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।বর্তমানে তার বসবাস যুক্তরাষ্ট্রে।অলিভিয়া ও অ্যামেলিয়া দুই মেয়ে সন্তানের জননী আয়রা।

____________

মেহরিমা ক্লাসে বসে আছে।এখন বায়োলজি ক্লাস চলছে। কিন্তু মেহরিমার সেদিকে কোনো মনোযোগ নেই।সে ব্যস্ত তার গভীর চিন্তায়।

“এই মেহু কি হয়েছে তোর?”

মেহরিমাকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে কথাটা বলে তৃধা।মেহরিমা হুঁশে ফিরে।

“কিছু বলবি?”

“ক্লাস শেষ। পরবর্তী ক্লাস করবি তুই?”

“না,রে আজ ভালো লাগছে না। বাসায় যাবো।”

“ওকে।”

মেহরিমা আর তৃধা কলেজের মাঝ বরাবর রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে।

“মেহরিমা তুই কি গতকালের ঘটনা নিয়ে আপসেট?”

“উহু!”

“তাহলে কি পলাশের বি ভ ৎ স অবস্থার কথা শুনে?”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। কিছু একটা মনে পড়তেই বলে,

“হৃদিত ভাইয়া বিকালে কোথায় থাকে রে?”

মেহরিমার কথা শুনে তৃধা দুষ্টু হেসে বলে,

“কেনো রে? আমার ভাইকে দিয়ে তোর কি? আমার হ্যান্ডসাম, ড্যাসিং, সুচরিত্র ভাইয়ের সাথে প্রেম করার ফন্দি আটছিস নাকি?”

“সুনাম একটু বেশিই করে ফেললি না?যাই হোক বল‌ না হৃদিত ভাই বিকালে কোথায় থাকেন।”

“ভাইয়া আর কোথায় থাকবে!তার যা কাজ।নিজের রুমের ব্যালকনিতে বসে ছবি আঁকবে, নাহলে বাড়ির পিছনে পুকুরের সামনের বাগানে বসে গিটার বাজাবে।আর মাঝে মাঝে একটু বাইরে আসে।বিকালে বাসায় ই থাকে ভাইয়া।”

“ওওও আচ্ছা।”

ওরা কথা বলতে বলতে কলেজ গেইটের সামনে চলে আসে।এই অসময়ে রাস্তার ওপাশে চেনা পরিচিত গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই মেহরিমা অবাক হয় বেশ! তবে মনে মনে খুশি ও হয় খুব।মেহরিমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তৃধা মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,

“মেহু বেইবি তোর হ্যান্ডসাম ওয়েট করছে।যা মিট কর।আমি বাসায় যাই।”

কথাটা বলেই একটা ভ্যান ডেকে সেটাতে উঠে পড়ে তৃধা।মেহরিমাকে হাতের ইশারায় বাই জানায়। বেচারি মেহরিমা অসহায় চোখে তৃধার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।তৃধা গতকাল বাসায় যেয়ে যখন জানতে পারলো ওর মা ওকে ডাকেনি তখন ও তাইফ আর তাবানের পিছনে এক প্রকার কাঁঠালের আঠার মতো করে চিপকে থেকে সব সত্যিটা জেনেছে। আর তাতেই খুশিতে আত্মহারা তৃধা।মেহরিমা ওর ভাবী হবে ভাবতেই ওর মন টা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠছে!তৃধা মেহরিমার দিকে তাকিয়ে ওর ঝকঝকে সাদা দাঁত গুলো বের করে হাসতে থাকে।মেহরিমা মনে মনে ভেংচি কাটে।সময় মেহরিমার ও আসবে হু! হঠাৎ নিজের ব্যাগে থাকা ফোন টা ঝনঝনিয়ে বেজে উঠতেই মেহরিমার ভাবনায় ছেদ পড়ে।বাবা ফোন দিয়েছে ভেবে মেহরিমা তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে। অপরিচিত নাম্বার দেখতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফোনের স্ক্রিনে তাকায়।কেটে দেবে দেবে করেও কি যেন মনে করে কলটা রিসিভ করে আর সাথে সাথেই ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হয়।

“ইয়্যু হ্যাভ জাস্ট টু মিনিটস।আ’ম ওয়েটিং।এক সেকেন্ড ও লেইট করলে কো লে তুলে নিয়ে আসবো।”

কথাটা বলেই হৃদিত কল কেটে দেয়।মেহরিমা এমন লাগামহীন কথা শুনে ল জ্জা য় লাল হয়ে যায়।বিশ সেকেন্ড মতো ল জ্জা য় লাল হওয়া গাল নিয়ে মাথা নিচু করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়।তারপর হৃদিতের দেওয়া থ্রে টে র কথা মনে পড়তেই একপ্রকার দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গাড়ির নিকট আসে।মেহরিমা গাড়ির নিকট আসতেই দরজা টা খুলে যায়। আশেপাশে ভালোভাবে নজর বুলিয়ে তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠে বসে।হৃদিত গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়।সেদিনের মতো আজও জানালার গ্লাস ওঠানো।

“কাল থেকে বোরকা পরে,হিজাব করে কলেজে আসবি।মেয়েরা হাতে,পায়ে কি যেন পরে ওগুলো পরবি।চোখের উপর কি একটা কাপড় লাগায় সেটাও লাগাবি।মোট কথা তোর শরীরের একটা পশম ও যেন দেখা না যায়। ইভেন চোখ ও না।”

হুট করে হৃদিতের মুখে এমন কথা শুনতেই মেহরিমা যেন আকাশ থেকে পড়ে!মেহরিমা আজ নিয়ত করেই এসেছে হৃদিত কে একটুও ভয় পাবে না।উনি বাঘ নাকি ভাল্লুক যে ভয় পেতে হবে!কিন্তু এই যমের সামনে আসলে মেহরিমার সব হাওয়া বেরিয়ে যায়।তবুও মনে সাহস জুগিয়ে দৃঢ়তার সাথে আস্তে করে বলে,

“বাবা ব্যবসায়ের কাজে শহরে গেছে।মা স্কুল আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত।আজ বাসায় যেয়ে মা কে বলব।মা ফ্রি হয়ে কিনে এনে দেবে।”

“তোকে কি বললাম তোর কানে যায়নি? কালকে থেকে মানে কালকে থেকেই তোকে ওভাবে আসতে হবে। নাহলে তোর কলেজে আসার দরকার নেই। আমার ভালোবাসাতেই তোর সারাজীবন কেটে যাবে তাহলে তুই আবার চাকরি করবি কেনো?”

হৃদিতের ধমকে বলা কথাগুলো শুনে মেহরিমা ভয় পেয়ে যায়।ও জানালার দিকে চেপে যায়।মাথা নিচু করে ঠাঁয় বসে রয়।

“যা আরও এগিয়ে যা ওইদিকে।একেবারে গাড়ির ডোর ভেঙ্গে নিচে পড়ে যা।”

হৃদিতের এবারের বলা কথায় মেহরিমা আরও জড়সড় হয়ে বসে।ভয়ে ওর প্রাণ পাখিটা উড়ে যাওয়ার উপক্রম!

হঠাৎ হৃদিতের দৃষ্টি মেহরিমার রক্তজমা হাতের দিকে পড়তেই ওর মুখভঙ্গি পাল্টে যায়। নীল মণির চোখজোড়া লাল হয়ে ওঠে।হৃদিত ব্যাক ছিট তুলে পানি আর হ্যান্ড ওয়াশ বের করে।মেহরিমা তখনও নিজের অহেতুক ভাবনায় বিভোর হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। হঠাৎ ডান হাতে টান পড়তেই মেহরিমা চকিতে চোখ তুলে তাকায় হৃদিতের দিকে।হৃদিত ততক্ষণে মেহরিমার হাতের রক্তজমা স্থানে পানি ঢেলে দিয়েছে।সেই পানিতে গাড়ির সিট, মেহরিমার জামা,হৃদিতের শার্ট ভিজে একাকার। হঠাৎ হৃদিতের এমন কর্মকাণ্ড মেহরিমা ঠিক বুঝতে পারছে না!ও থমকে তাকিয়ে আছে হৃদিতের মুখের দিকে।ফর্সা লম্বাটে মুখ টা লাল টকটকে হয়ে আছে। শক্ত শানিত চোয়াল যেন আরও শক্ত হয়ে গেছে। কপালের নীল রগ গুলো ফুলে উঠেছে।নীল রঙের চোখজোড়া হঠাৎ ই কেমন ভয়ংকর বর্ণ ধারণ করেছে।মেহরিমা ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে।হঠাৎ করে হাতে ব্যথা আর জ্বলা অনুভব হতেই মেহরিমা আঁতকে ওঠে।হৃদিতের সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। ও বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে চলেছে আর হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে মেহরিমার হাত এমন ভাবে ডলে চলেছে যেনো হাতের চামরা টাই তুলে ফেলবে।মেহরিমা নিজের ব্যথা দাঁত চেপে সহ্য করে কান টা একটু এগিয়ে হৃদিতের কথা শোনার চেষ্টা করে।

“মাই লিটল কিটি,ইয়্যু আর অনলি মাইন।নো ওয়ান ক্যান টাচ ইয়্যু।”

এই কথাগুলোই হৃদিত বিড়বিড় করে বলে চলেছে। এবার আর ব্যথা,জ্বলা সহ্য করতে না পেরেই মেহরিমা শব্দ করে কান্না করে দেয়।মেহরিমার কান্নার শব্দ কর্ণগোচর হতেই হৃদিতের হাত জোড়া থেমে যায়‌।ও হুঁশে ফেরে।মেহরিমার সাথে এতক্ষণ ও কি করেছে সেটা ভাবতেই ওর চোখে মুখে অসহায়ত্বের ছাপ ফুটে ওঠে।হাতটার অবস্থা খুবই শোচনীয়।চামড়া ছিঁ ড়ে র ক্ত বের হওয়ার উপক্রম।মেহরিমা তখনও নিচের দিকে তাকিয়ে কান্না করে চলেছে।

“শীট!শীট!ড্যাম ইট!”

কথাটা বলেই হৃদিত হাত দিয়ে স্টিয়ারিংয়ে জোরে আঘাত করে।সেই শব্দে মেহরিমা কেঁপে ওঠে।তারপর দ্রুত টিস্যু দিয়ে মেহরিমার হাত মুছে দিতে দিতে বলে,

“আ’ম সরি লিটল কিটি। প্লিজ ফরগিভ মি।আই প্রমিজ নেক্সট টাইম আর কখনো তোকে এভাবে ব্যথা দিবো না। প্লিজ কান্না করিস না।এই দেখ কানে ধরছি।জান আমার এগেইন ছরি।”

হঠাৎ হৃদিতের কন্ঠস্বরের এমন পরিবর্তন দেখে মেহরিমার কান্না থেমে যায়।ও ফুলো ফুলো চোখ মুখ নিয়েই হৃদিতের দিকে চোখ তুলে তাকায়।হৃদিত বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে ইনোসেন্ট ফেইসে কানে হাত দিয়ে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে আছে।আজ হৃদিতের এই ব্যবহার,এই রুপ,এই সম্পূর্ণ হৃদিতটাকেই যেন নতুন লাগছে মেহরিমার কাছে!এমন কিউট লুক দেখে না চাইতেও মেহরিমা মুচকি হাসে।হৃদিত এবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আস্তে আস্তে চালাতে থাকে।পরক্ষণেই বলতে শুরু করে,

“সোনা,তুই তো জানিস আমি তোকে কতোটা ভালোবাসি!তোর উপর অধিকার শুধুমাত্র আমার।আর কারোর না।তোকে কেউ স্পর্শ করবে, দেখবে এটা আমি সহ্য করতে পারি না।তাই তো রাগের মাথায় এমনটা করে ফেলেছি ।আ’ম সরি সোনা।”

কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার বক্ষ স্থল প্রশান্তি তে ছেয়ে যায়। নিজের হাতের ব্যথা ভুলে ওর মাথার মধ্যে হৃদিতের বলা শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খেতে থাকে ‘তোর উপর অধিকার শুধুমাত্র আমার,আর কারোর না’।কিছুক্ষণ আগের হৃদিতের হিংস্র রুপটা যেনো অতি সহজেই ভুলে যায়! হয়তোবা কথায় বশীভূত হয়ে!তা নয়তো কি?মেহরিমা খুশি খুশি মনে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করে,

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”

“হসপিটালে।ডক্টর দেখিয়ে তোর হাত ব্যান্ডেজ করতে হবে।খুব ব্যথা করছে জান?জ্বলছে খুব?”

হৃদিত কথাটা বলেই মেহরিমার ডান হাতটা ধরে ফুঁ দিতে থাকে।মেহরিমা প্রশান্তির হাসি দিয়ে বলে,

“এতক্ষণ জ্বলছিল।এখন শান্তি অনুভব হচ্ছে।”

#চলবে_________

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০৪

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৪
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

(পর্বটাতে নৃ শং স খু নে র বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।ঘটনা প্রসঙ্গে,চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কিছু অসামাজিক ভাষা ব্যবহার করতে হয়েছে।আর হ্যাঁ এই পর্ব থেকেই গল্পের মূল প্লট শুরু।)

“মাধুপু গুনে গুনে চারটা থাপ্পড় মারো ওনার দুই গালে।”

মেহরিমার কথাটা কর্ণগোচর হতেই সাথে সাথে মাধবীর কান্না থেমে যায় ।ও চোখ বড় বড় করে মেহরিমার দিকে তাকায়।মাধবীর কোনো হেলদোল না দেখে পলাশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেহরিমা গুনে গুনে চারটা থাপ্পড় মেরে দেয় ওর গালে।থাপ্পড়ের শব্দে দোকানের সবাই হতভম্ব হয়ে মেহরিমাদের দিকে তাকায়।পলাশ ক্যারাম খেলছিল নিজের টিমের পোলাপানদের সাথে।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নিজের সাথে কি ঘটে গেছে সেটা বুঝতে পেরেই দাঁত কিড়মিড় করে আগুন চোখে মেহরিমার দিকে তাকায় পলাশ।

“মা গি র ঝি তোর এতো বড় সাহস!তোরে তো আজ…”

কথাটা বলেই মেহরিমার ডান হাতটা বেঁকিয়ে শক্ত করে ধরে।মেহরিমা ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে।

“নে এবার দেখা তোর কত তে জ।আমিও আজ দেখবো চেয়ারম্যানের মেয়ির এত তে জ কোথায় থেকে আসে?তোর তেজ কি শুধু মাঠেই নাকি
খা টে ও?”

কথাটা বলার সাথে সাথেই পলাশের ডান গালে শব্দ তুলে আরও একটা থাপ্পড় পড়ে।অবনী শেখ রাগে রিতিমত কাঁপছে। মাত্রই উনি এখানে এসে পৌঁছেছেন। উনি চিৎকার করে বলেন,

“জা নো য়া র তোর সাহস কি করে হয় আমার মেহরিমা কে নিয়ে এতো বাজে মন্তব্য করার।জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি।তোর অ্যাগেইনস্ট এ আমি লিগ্যাল অ্যাকশন নেবো।”

পলাশের কথাটা শুনতেই রাগে,ক্ষোভে,দুঃখে মেহরিমার চোখ বেঁয়ে পানি পড়তে থাকে।অবনী শেখ এক ঝটকা মেরে পলাশের হাত থেকে মেহরিমার হাত ছাড়িয়ে নেন।যেখানে জা নো য়া র টা ধরেছে একদম রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে!ততক্ষণে ঘটনাস্থলে শ’খানিক মানুষের ভীড়।ইতোমধ্যে সবাই ঘটনার মূল কাহিনী জেনে নিজেদের মাঝে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কেউ কেউ তো মেহরিমার মুখের উপরই বাজে বাজে কথা বলছে।আবার কেউ কেউ জলিল শেখের ক্ষমতার ভয়ে চুপ করে আছে।তবে মজা কম বেশি সবাই নিচ্ছে!মাধবী কেঁদেই চলেছে।মেহরিমা পাথর বনে গেছে একদম।

“নীলাক্ষী তোকে কোনো প শু র সামান্য কথার
আ ঘা তে ভে ঙ্গে পড়ার মতো করে গড়ে তুলি নাই আমি।যেখান থেকে আ ঘা ত পাবি সেখানেই ফিরতি আ ঘা ত করার মতো মনোবল থাকতে হবে।মনে রাখবি এরা মানুষ জাতি তোর কষ্টের কথা শুনবে,শান্তনা দেবে আবার এরাই তোর কষ্টে হাসবে।সুযোগ পেলে নিজেরা তোর কষ্ট আরও চারগুণ বাড়িয়ে দেবে।”

অবনী শেখ কথাগুলো বলে মেহরিমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।মেহরিমা মায়ের কথায় নিজের কঠিন সত্ত্বায় ফিরে আসে।তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলিয়ে চঞ্চল হাতে চোখের পানি মুছে ফেলে।অবনী শেখ দুই মেয়ে নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা ফেলতেই পলাশ পথ আটকায়।পলাশ আবারও বি শ্রি কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর দৃষ্টি যায় ভিড়ের মাঝে থাকা কালো মণির একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে।সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পেরেই পলাশের চেহারা টা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়।পলাশ সাথে সাথেই মেহরিমার পা জোড়া জড়িয়ে ধরে।

“আ…আ…. আমার ভুল হয়ে গেছে আপু। আমাকে ক্ষমা করে দেন।আর এরকম ভুল কখনো হবে না।চাইলে আপনি আমাকে আরও একশো টা থাপ্পড় মারতে পারেন। তবুও আমাকে ক্ষমা করে দেন।”

থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বলে পলাশ। সেকেন্ডের ব্যবধানে পলাশের এমন পরিবর্তনে সবাই হতবাক হয়ে যায়!অবনী শেখ তার ঈগল দৃষ্টি দিয়ে সবটাই খেয়াল করেন।আর তাতেই ওনার ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে ওঠে।মেহরিমা কিছু না বলেই নিজের পা জোড়া ছাড়িয়ে অবনী শেখ আর মাধবীর সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।

বাসায় এসে হাতে অনেক্ষণ বরফ ধরে যায়গাটা একটু স্বাভাবিক হতেই অবনী শেখ ওখানে মলম লাগিয়ে দেন।মেহরিমা দীর্ঘ তিন ঘন্টা সময় নিয়ে গোসল কমপ্লিট করেছে। তবুও নিজের মনের মাঝে তুমুল অশান্তি অনুভব হচ্ছে।মেহরিমার বার বার মনে হচ্ছে হৃদিত ওর নামের এইসব বাজে কথা শুনলে ও কে ভুল বুঝবে না তো!এই..এই হাতটা কি কেটে ফেলা উচিত?তাহলে কি হৃদিত আমাকে আগের মতোই কেয়ার করবে, ভালোবাসবে!হৃদিত ভুল বুঝলে নিজেকে একদমই সামলাতে পারবে না মেহরিমা।হঠাৎ মায়ের ডাকে নিজের ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে মেহরিমা।মায়ের হাতে চায়ের কাপ দেখে মুচকি হাসে ও।

“রাতে তো তেমন কিছুই খেলি না।চা টা খেয়ে নে।যত সময় নিয়ে গোসল কমপ্লিট করলি।নির্ঘাত গলা বসে যাবে তোর!”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নেয়। এমনিতেই ঠান্ডার ধাঁচ বেশি ওর।

“হৃদিত এসেছে গ্রামে?”

চা টা কেবলই মুখে দিয়েছে মেহরিমা হঠাৎ মায়ের এমন প্রশ্নে ওর কাশি উঠে যায়।

“আরেহ আরেহ সাবধানে খাবি তো!”

মেহরিমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কথাটা বলেন অবনী শেখ।মেহরিমা নিজেকে সামলিয়ে দুই মিনিট মতো সময় নিয়ে বলে,

“আমি তো জানি না মা।তৃধা ও এমন কিছুই বলেনি আমাকে।”

অবনী শেখ সন্দেহজনক দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলে,

“আচ্ছা তাহলে চা টা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়।”

“আচ্ছা মা।বাবা কবে আসবে?”

“আগামীকাল সন্ধ্যায়।”

“মা,সমাজ মেয়েদের কে এতো ছোট চোখে কেনো দেখে?দোষ তো ছিল পলাশের।তাহলে সবার খারাপ কথার বলিদান আমি কেনো হলাম?”

মলিন মুখে বলে মেহরিমা।মেহরিমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে অবনী শেখ বলেন,

“ওদের চিন্তাভাবনা ওদের মনের মতোই সংকীর্ণ মা।তুই আমার প্রিন্সেস।কেউ খারাপ বললেই খারাপ হয়ে যাবি নাকি!তুই কাঠগোলাপের মতো শুভ্র,স্নিগ্ধ। তোকে ক লু ষি ত করার আগেই সেই জ ঞ্জা ল ছেঁ টে পরিষ্কার করে দেবো আমি।এটা তোর মা অবনী শেখের ওয়াদা।”

কথাটা বলেই অবনী শেখ রুম থেকে বেরিয়ে যান।মেহরিমা অবনী শেখের যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।মেহরিমা সময় নিয়ে চা শেষ করে। তারপর রুমের দরজা লক করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে।নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে হৃদিতের ফেইসবুক আইডি তে যেয়ে ওর ছবি দেখতে থাকে।এই মানুষ টা কে ছাড়া মেহরিমার একটুও চলবে না!হোক না সে রাগী তাতে কি? কেয়ারিং ও তো কম না!

_______

সকাল সাতটায় মাধবীর ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে মেহরিমা। গতকাল রাতে হৃদিতের ছবি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল মেহরিমা বুঝতেই পারেনি।গতকালের সব কথা ভুলে মুচকি হেসে বিছানা ছাড়ে ও।দরজা খুলতেই মাধবীর ভীতু, উত্তেজিত মুখটা দেখে মেহরিমা বলে,

“কি হয়েছে মাধুপু। তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?”

“মেহু পলাশ ভাইকে অ র্ধ মৃ ত অবস্থায় ওদের বাড়ির গেইটের সামনে পাওয়া গেছে আজ সকালে।”

“কিহহহহহহহ!”

“হ্যাঁ ।বাম হাত টা নাকি ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে একদম থেঁ ত লে দিয়েছে।ডান হাত টার কোনো অংশই নেই!চোখ দুটো উ প ড়ে ফে লে ছে।পা আর বুকে
না ই ফ দিয়ে করা হাজারো আঁ চ ড়ে র দাগ।কপালে পে রে ক টাইপের কিছু একটা দিয়ে খু চি য়ে খু চি য়ে লেখা ‘মাই লিটল সানসাইন’।মাথার একাংশ থেঁ ত লে দেওয়া।মে ই ন পয়েন্টে আ ঘা ত করে র ক্তা ক্ত করা। জি হ্বা টাও নেই। দাঁত গুলোও ভে ঙ্গে দিয়েছে।আমাকে সামিয়া বললো।ওরা নাকি নিজের চোখে দেখেছে এমন বি ভ ৎ স দেহ!”

মাধবীর থেকে এমন ভ য় ঙ্ক র বর্ণনা শুনে মেহরিমা থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে।ওর মনে পড়ে যায় তিন মাস আগের কথা। মেহরিমা সবে কলেজে অ্যাডমিট হয়েছে তখন। একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় ও কে নিশান নামের একটা ছেলে খুব বাজে ভাষায় টিজ করেছিল।মেহরিমা প্রতিবাদ ও করেছিল কিন্তু বাসায় এসে সেই বাজে কথাগুলো শুধু কানের কাছে বাজতে থাকে।তাই ও নিজেকে সামলাতে না পেরে সেই রাতে খুব কান্না করেছিল।ঠিক এইভাবেই তার পরের দিন ছেলেটাকে অ র্ধ মৃ ত অবস্থায় তাদের বাড়ির পাশের নোং রা ডোবাতে পাওয়া যায়।তার গালেও খুঁ চি য়ে
খুঁ চি য়ে লেখা ছিল ‘মাই অ্যানাবেলা’।সেই ছেলেটা বেঁচে আছে তবে ওর থেকে ম রে যাওয়ায় বোধহয় শান্তির!ছেলেটা একদম বিছানাগত কথা বলতে পারেনা।একা একা নড়তে,চলতে কিছুই পারে না।ছেলেটা শহরে পড়তো।ড্রা গ নিতো। ব খা টে বে য়া দ ব ছিল।মে য়ে র প্রতি নে শা ছিলো।গ্রামের সবাই যেন জানতো ছেলেটার এমন পরিণতিই হবে!মেহরিমা আর ভাবতে পারছে না।মেহরিমা কেঁ পে উঠে পড়ে যেতে নিলেই অবনী শেখ দুই হাতে আগলে নেন নিজের মেয়েকে।মেহরিমা কোনোরকম কাঁ পা কাঁ পা গলায় বলে,

“প…পলাশ কো..কোথায় এখন?”

“সেই ভোরেই ওনাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে সবাই।এতক্ষণে পৌঁছে ট্রিটমেন্ট ও শুরু হয়ে গেছে বোধহয়। এখন আল্লাহ ভরসা।”

মাধবীর কথা শুনে মেহরিমা মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়ে।আর যাই হোক কারোর মৃত্যু চাই না মেহরিমা!

“নীলাক্ষী ভেঙে পড়লে চলবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।যা হয় ভালোর জন্যই হয়।আর প্রত্যেক মানুষকেই তার কৃতকর্মের শা স্তি পেতে হবে।সেটা আজ হোক বা কাল।”

নিজের মায়ের কথাটা শুনে মেহরিমা একটু শান্ত হয়।কিন্তু এতো নৃ শং স তার মাঝে ভালোর তো কিছুই চোখে পড়ছে না মেহরিমার! যদিও পলাশ মানুষ টা খুব খা রা প তাই বলে এতো ক ঠি ন শা স্তি!কে করছে এমন?আর কেনোই বা করছে? দু টো মানুষ কে এভাবে মৃ ত্যু র দো য়া রে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তি কি একজনই? হঠাৎ ই গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে যায় মেহরিমার!ও সাথে সাথেই নিজের মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকায়!
অবনী শেখ নিজের দিকে মেহরিমাকে ওভাবে তাকাতে দেখে মুচকি হাসেন।মেহরিমা মায়ের মুচকি হাসির কারণ টা ঠিক ধরতে পারলো না। তবে মেহরিমা জানে ওর মা একদম পবিত্র ঠিক ফুলে দের মতো!

মেহরিমা হাঁটতে হাঁটতে কলেজে যাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে হৃদিত ভাইয়ের সাথে একবার কথা বলা উচিত এই বিষয় নিয়ে।উনি তো এইসবের কিছুই জানেন না।সবটা জানলে উনি নিশ্চই ভালো কোন সলিউশন দেবে!কথাটা ভাবতেই মেহরিমা একটু স্বস্তি পায়।

#চলবে________

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০৩

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৩
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

গ্রামের নাম আনন্দপুর।আনন্দপুর নামটার মতোই গ্রামটাও আনন্দ,শান্তিতে ভরপুর।গ্রামের চারি পাশ সবুজে ঘেরা।চোখের দৃষ্টি যতদুর যায় ততদুর শুধু সবুজ আর সবুজে ভরপুর!প্রকৃতির এই সবুজ রুপ যেন চোখের প্রশান্তি বয়ে আনে!গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বিষ্ণু নদী। নদীর ওপারে আরেক গ্রাম। আনন্দপুর শুধু নাম মাত্রই গ্রাম।শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া পৌঁছে গেছে ইতোমধ্যেই।এমপি, মন্ত্রীর নিজের জন্মভূমি, নিজস্ব গ্রাম হওয়ায় উন্নয়নের দিকে অনেক এগিয়ে আনন্দপুর গ্রাম।প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ, হসপিটাল, মার্কেট সব রয়েছে এই গ্রামে।

মেহরিমার কলেজ থেকে পূর্ব দিকে পনেরো মিনিট মতো আসলেই দেখা মেলে এক মনোরম পরিবেশের।রাস্তার দুই ধারে সারি বেঁধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শত শত মেহগনি গাছ।মেহগনি গাছগুলোর শাখা প্রশাখার মধ্য দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সূর্যি মামা।রাস্তার দুই পাশে ফাঁকা যায়গা গুলোতে সবুজ ফসলে ভরপুর।থেকে থেকে ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।চোখ,মন জুড়িয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশ!হৃদিত মেহরিমাকে এই জায়গাটাতেই নিয়ে এসেছে।পাঁচ মিনিট ধরে একদৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে আছে হৃদিত।
মেহরিমা ভয়ে,অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছে।

উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রং।নাকটা শরু আর মাঝারি লম্বা।চোখ দু’টো টানা টানা তার মাঝে কুচকুচে কালো মণি টা জ্বলজ্বল করছে।চোখের পাপড়ি গুলোও তুলনামূলক বড় আর ঘন।কথা বলতে গেলেই থুতনিতে টোল পড়ে।আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে মেহরিমার চিকন পাতলা গোলাপী ঠোঁ টে র উপরের বাম সাইডের কালো তিল টা।এই তিলটা হৃদিত কে বড্ড টানে।সেকেন্ডের মাঝে ওকে এলোমেলো করে দেয়!দীর্ঘ আট মাস পর নিজের হৃদমোহিনী কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে যেয়ে,হৃদিত নিজের অজান্তেই অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে।

“মা শা আল্লাহ।”

এখানে পৌঁছেই গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিয়েছে হৃদিত।তাতে যেন মেহরিমা একটু স্বস্তি পায়।কিন্তু হৃদিতের ওই নীল চোখের নে শা লো দৃষ্টিটা মেহরিমা ঠিক হজম করতে পারছে না।মেহরিমার শরীরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে!ত ল পে টে ইতোমধ্যে প্রজাপতি রা উড়াউড়ি শুরু করে দিয়েছে।আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে!নিজের মাঝে সাহস জুগিয়ে মেহরিমা বলে,

“আ..আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাসায় যেতে হবে।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত নড়েচড়ে বসে।তারপর চোখ দিয়ে ওর উরু ইশারা করে বলে,

“ডান পা রাখ এখানে।”

মেহরিমা চমকে ওঠে!চোখ গুলো মার্বেলের মতো গোল গোল করে হৃদিতের দিকে তাকায়।

“ওভাবে কি দেখছিস পা রাখ এখানে।”

“আ.. আপনি বড় আমার থেকে।আমি পারবনা।”

ব্যস অমনিই হৃদিতের মেজাজ বিগড়ে যায়। রাগে গজগজ করতে করতে হাতে থাকা ভায়োডিন আর তুলা গাড়ির জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। সেকেন্ডের ব্যবধানে কি ঘটে গেল সেটা মেহরিমার মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতেই মেহরিমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ভায়োডিন আর তুলার দিকে।হৃদিত গাড়ি স্টার্ট দিতে নিলেই মেহরিমা আঁতকে উঠে বলে,

“আপনার দোহাই লাগে গাড়ি স্টার্ট দিবেন না।আমি পা রাখছি।”

কথাটা শুনতেই হৃদিত অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় মেহরিমার দিকে।হৃদিতের ওমন দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই মেহরিমার ছোট্ট হৃ ৎ পি ন্ড টা লাফিয়ে ওঠে।আজ আর বাঁচা হলো না!আজই বোধহয় জীবনের শেষদিন।মেহরিমার চোখের সামনে নিজের বাবা,মা,বড় বোন মাধবীর মুখটা ভেসে ওঠে।মনে মনে একনাগাড়ে দোয়া দরুদ পড়তে থাকে।হৃদিত কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়ির দরজা খুলে,নেমে যেয়ে ওগুলো উঠিয়ে আনে।এবার আর মেহরিমা কে কিছু বলতে হয় না।হৃদিত বসতেই মেহরিমা ওর ডান পা টা উঁচু করে হৃদিতের উরুর উপর হালকা ভাবে রাখে।হৃদিত গম্ভীর মুখেই ড্রেসিং করতে থাকে।ভায়োডিন লাগাতেই মেহরিমা আহ্ শব্দ করে ওঠে।হৃদিত ওর দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়।তারপর আস্তে আস্তে আঙ্গুলে ফুঁ দিতে থাকে।হৃদিতের মুখের ঠান্ডা বাতাসে মেহরিমার সারা শরীরে শীহরন বয়ে যায়। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।ও পরম আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।মেহরিমার দিকে তাকাতেই হৃদিতের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।ব্যান্ডেজ করা শেষ হতেই মেহরিমা সাথে সাথে নিজের পা টা নামিয়ে নেয়।হৃদিত নিজের মুখটা তুলনামূলক আরও বেশি গম্ভীর করেই গাড়ি স্টার্ট দেয়।গাম্ভীর্যে ভরপুর পুরুষ মুখটাতে পুরুষত্বের ছাপ স্পষ্ট।হৃদিত এবার আস্তে আস্তেই গাড়ি চালাতে থাকে।হৃদিত কে ওমন গোমড়া মুখে দেখতে মেহরিমার একদম ভালো লাগছে না।হৃদিতের সাথে কথা বলার জন্য ওর মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করছে।কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না।মেহরিমার অবস্থা দেখে হৃদিত মনে মনে হাসে।মুখটা গম্ভীর রেখেই বলে,

“কিছু বলবি?”

সুযোগ পেয়েছে মেহরিমা এতো সহজে হাত ছাড়া করবে নাকি!ও সাথে সাথেই বলে,

“আপনি এবার গ্রামে কতদিন থাকবেন?”

“অনেকদিন।”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার চোখ মুখ খুশিতে চিকচিক করে ওঠে।ও হাসিখুশি ভাবেই আবার জিজ্ঞাসা করে,

“আপনি আপনার গিটার, আর্টের সব সরঞ্জাম নিয়ে এসেছেন?”

মেহরিমার কথা শুনে হৃদিত কপালে ভাঁজ ফেলে এক ভ্রু উঁচু করে প্রশ্নাত্মক চাহনি দিয়ে বলে,

“তুই জেনে কি করবি?”

হৃদিতের এমন রিয়্যাকশন,চোখের এমন চাহনি তে মেহরিমা আরেকবার নতুন করে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নীল চোখের ওই অসীম গভীরতায়।আবারও ঠিক এই মুহূর্তেই নতুন করে হৃদিতের প্রেমে পড়ল মেহরিমা!ও কোনোরকমে বলে,

“এ…এ..এমনিতেই।”

“আমাকে একটা কথা ক্লিয়ারলি বলতো আমি কি ভুত নাকি অন্যকিছু যে তোর মতো সাহসী, প্রতিবাদি মেয়ে আমাকে দেখে কোনো কারণ ছাড়াই ভয় পাস?কথা বলতে গেলেই তোতলাতে থাকিস!রিজন টা কি? সবসময় ছুটে বেড়াস আর আমার সামনে আসলে পি করে দেওয়ার মতো সিচুয়েশন ক্রিয়েট করিস!প্রবলেম টা কি তোর?”

লাস্টের লাইন টা শুনে মেহরিমা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়।মাথা নিচু করেই ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“জা…. জানিনা আমি।”

হৃদিত বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। নিজের বাসার একটু দূরেই মেহরিমা হৃদিত কে গাড়ি থামাতে বলে।গাড়ি থামাতেই ও তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে যায়। কিন্তু তার আগেই হৃদিত ওর ডান হাত ধরে ভায়োডিন,তুলা ব্যান্ডেজের ব্যাগ টা ওর হাতে দিয়ে বলে,

“বাসায় যেয়ে পেইন কিলার নিবি।সকালে আর রাতে দুইবার করে ড্রেসিং করবি।কথার হেরফের হলে তোর কপালে দুঃখ আছে।এখন বাসায় যা।”

“আচ্ছা।”

কথাটা বলেই পায়ের দিকে খেয়াল না দিয়েই ওখান থেকে দৌড়ে দুই মিনিটেই বাসার মধ্যে ঢুকে পড়ে মেহরিমা।মেহরিমা বাসার মধ্যে চলে যেতেই হৃদিত দুই মিনিট মতো গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।

সময় বিকাল বেলা।মেহরিমা তখন বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে পায়ের ব্যথার জন্য হৃদিতের কথা মতো পেইন কিলার খেয়েই ঘুমিয়েছে। হঠাৎ মাধবীর কান্নার আওয়াজে মেহরিমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।ও চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। মাধবীর কান্নার শব্দের উৎস খুঁজে মায়ের ঘরে যায়।মাধবী মেহরিমার মাত্র দুই বছরের বড়।এবার অ্যাডমিশনের জন্য কোচিং করছে।মাধবী কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।মেহরিমার মা অবনী শেখ মাধবী কে জড়িয়ে ধরে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। অবনী শেখ পেশায় একজন টিচার। নিজেদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে হেড টিচার হিসেবেই কর্মরত আছেন।অবনী শেখ কঠিন সত্তার অধিকারী।মেহরিমাকেউ একদম নিজের মতো করেই গড়েছেন তিনি।

“মা কি হয়েছে?মাধুপু এভাবে কান্না করছে কেনো?”

“বখাটে পলাশ কে চিনিস?”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। অবনী শেখ সেটা লক্ষ্য করতেই বলে,

“মাধবী কে টিজ করেছে ইভেন ব্যাড টাচ ও করেছে।”

অবনী শেখের কঠিন কন্ঠের কথাটা কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার মুখভঙ্গি পাল্টে যায়।চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি ঝরতে থাকে!মেহরিমা তেজস্বী কঠিন গলায় বলে,

“মাধুপু চলো।পশুকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়ে আসি।”

মেহরিমার কথাটা শুনতেই মাধবী ভয় পেয়ে অবনী শেখের দিকে তাকায়। অবনী শেখ গর্বের সাথে মুচকি হেসে মাধবী কে যেতে ইশারা করে।মেহরিমা ততক্ষণে ওর হাঁটু সমান ভেজা চুল হাত খোঁপা করতে করতে ঘর ছেড়েছে। মাধবী আসতেই মেহরিমা মাধবীর এক হাত ধরে গ্রামের মোড়ের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।অবনী শেখ ও বোরকা পড়ে ওদের পিছন পিছন বাসা থেকে বের হয়ে আসে।

“ভাই,ভাই।ভাবি নির্ঘাত কোনো গন্ডগোল পাকাইবো।”

হৃদিত চৌধুরী বাড়ির সামনের বাগানের বড় একটা আম গাছের নিচে গাড়ির হুডের উপর বসে সিগারেট খাচ্ছে। সাথে অবশ্য তাবান আর তাইফ ও আছে।নিজের দলের এক সদস্য সাইম যে সবসময় মেহরিমার আপডেট দেয় তার মুখে এমন কথা শুনতেই প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় হৃদিত।

“ভাই মাধবী আপাকে পলাশ বাজে কথা বলেছে, আবার জোর পূর্বক হাত ও ধরেছে।সেটার প্রতিবাদ করতেই ভাবী,মাধবী আপু আর অবনী ম্যাডাম কে সাথে নিয়ে মোড়ের দিকে যাচ্ছে।”

হাঁপাতে হাঁপাতে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সাইম।ওর কথা শুনে তাবান বলে,

“ভাই তুমি যাবা না?যদি বড় কোন সমস্যা বেঁধে যায়!”

“উহু।আমি গেলে ও নিজের কাজ ঠিকভাবে করতে পারবে না। উল্টো কাঁপা কাঁপি শুরু করে দেবে।অবনী ম্যাম আছেন ও কে সামলে নেবে।সাইম তোর যেটা কাজ তুই সেটা কর।আর এমনিতেও মেহুর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই ওই বা স্টা র্ডে র।”

লাস্ট লাইন টা একটু চাপা স্বরে রহস্যময় হেসে বলে হৃদিত।হৃদিতের কথা শুনে সাইম দৌড় লাগায় গ্রামের চার রাস্তার মোড়ের উদ্দেশ্যে।তাইফ কিছু একটা ভেবে তৎক্ষণাৎ বলে,

“ভাবী,ভাইয়ের পোষা আদুরে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা তো।তাই ভাইয়া কে দেখলেই কাছে আসার জন্য ছটফট করতে থাকে।”

কথাটা শুনতেই তাবান উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।আর হৃদিত ভ্রু জোড়া কুঁচকে বাঁ দ র দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

#চলবে______

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০২

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০২
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

“পড়লি কিভাবে?”

হৃদিতের গম্ভীর কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার কান্না সাথে সাথে থেমে যায়।ব্যথা নিয়েই তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়ায়।পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নখ উ প ড়ে সেখান থেকে র ক্ত ঝরছে ওর।হৃদিত কপালে কয়েক টা ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেহরিমার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“মেহু সোনা পড়লি কিভাবে?”

তৃধার কথায় মেহরিমা ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“ইটে বেঁধে।”

“ইট বড় নাকি তুই বড়?”

হৃদিতের প্রশ্ন শুনে তাবান সাথে সাথে বলে,

“মেহরিমা তুমি বরঞ্চ ইটের সাথে নিজের উচ্চতা মেপে ভাইয়া কে হাতে না হাতে প্রমাণ দিয়ে দেও।”

হৃদিত বিরক্ত চোখে তাবানের দিকে তাকাতেই তাবান তাইফের হাত ধরে ওখান থেকে কেটে পড়ে। এমনিতেই এই মুখটা বেশি চলে সবসময়।উল্টা পাল্টা কিছু বলে ফেললে পাছে ভাইয়া যদি আর হাত খরচ না দেয় তখন!তাবান আর কিছু ভাবতে পারলো না।

“তুই আসলি ভালো কথা। আমাকে কেনো টেনে আনলি। ভাইয়ার সাথে ঘুরতাম একটু।”

তাইফ বিরক্তির সাথে বলে।

“আরে আরে রাগোস কেনো? ভাইয়ার ওভাবে তাকানোর মিনিং বুঝোছ?ওভাবে তাকানো মানে ভাইয়া প্রাইভেসি চাই গর্দভ!মেহরিমার সাথে একটু সময় কাটিয়েই চলে আসবে নে এখানে।চল তোকে একটা সিগারেট খাওয়াই।”

তাবানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাইফ আর কিছু বলে না।ওরা ওদের দলের কাছে চলে যায়।

“উত্তর দিচ্ছিস না কেনো?”

হৃদিতের হাড় হিম করা গম্ভীর কন্ঠে মেহরিমা চমকে উঠে হৃদিতের দিকে তাকায়।সেকেন্ডের ব্যবধানে আবার চোখ নামিয়েও নেয়।পাক্কা তিন মিনিট সময় নিয়ে মেহরিমা আস্তে করে জবাব দেয়,

“আমি।”

“তাহলে তুই এতো বড় মানুষটা ওই ছোট ইটের সাথে পা বেঁধে পড়লি কিভাবে?”

“হোঁচট খেয়ে।”

“চোখ,মন কোথায় থাকে?”

হৃদিতের এবারের করা প্রশ্নে মেহরিমার খুব করে বলতে মন চাইলো।চোখ আর মন দুটোই তো অলওয়েজ আপনার দিকে থাকে।অবুঝ আপনি কি তা বোঝেন?কিন্তু আফসোস এই কথা বলার মতো এতো বড় সাহস মেহরিমার নেই।এই কথা বললে দেখা যাচ্ছে মেহরিমার বডি আর মাথা দুটো দুদিকে পড়ে আছে।কি দরকার সেধে নিজের ক্ষতি করার! মুখে বলে,

“আমি খেয়াল করিনি।”

হৃদিত আর কথা বাড়ায় না।তৃধার উদ্দেশ্যে বলে,

“তোর বিলভড ফ্রেন্ড কে নিয়ে গাড়িতে ওঠ।”

হৃদিত বলার সাথে সাথে তৃধা মেহরিমা কে ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে গাড়ির দিকে যেতে থাকে।হৃদিতের সাথে ওর কাজিন মহলের সবাই খুব ফ্রি হলেও ওর কথা অমান্য করার সাহস কারোর নেই।
মেহরিমারা গাড়ির নিকট পৌঁছাতেই হৃদিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।হৃদিত গাড়ির কাছে এসে প্যান্ট থেকে চাবির রিং এর মতো ছোট্ট রিমোট বের করে সুইচ অন করে গাড়ির দরজা আনলক করে দেয়।

“ভেতরে যেয়ে বস।”

হৃদিতের কথাটা কানে আসতেই মেহরিমা আসে পাশে তাকিয়ে ভালোভাবে দেখে নেয়। দুপুর হওয়ার দরুন রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই।মেহরিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তৃধার সাথে আস্তে করে গাড়িতে উঠে বসে।ওরা গাড়িতে উঠে পড়তেই হৃদিত তাবানের কাছে কল দিয়ে কিছু একটা বলে। মিনিট চারেক পর তাবান আসে হৃদিতের কাছে। ওর হাতে ভায়োডিন,তুলা আর ব্যান্ডেজ।হৃদিত ওগুলো নিয়ে আর সময় ব্যয় না করে গাড়িতে উঠে বসে।

“তৃধু মেজো মা তোকে এক্ষুনি বাসায় যেতে বলেছে। খুব আর্জেন্ট দরকার।তাবানের সাথে বাসায় চলে যা।”

কথাটা শুনতেই মেহরিমা কয়েক মিনিটের মাঝেই দড়দড়িয়ে ঘেমে ওঠে।ভয়ে ও শুকনো ঢোক গিলে শক্ত করে তৃধার হাত ধরে থাকে।হৃদিত ভ্রু জোড়া কুঁচকে হাতের দিকে তাকাতেই মেহরিমা সাথে সাথেই তৃধার হাত ছেড়ে দেয়।তৃধা ও বোধহয় মেহরিমার ভয় টা বুঝতে পারলো।তাই কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই হৃদিত বলে,

“আমি ভুত না যে ওর ঘাড় মটকাবো।”

নিজের ভাইয়ের ত্যাড়া কথাটা খুব করে বুঝলো তৃধা।সাথে মায়ের জন্য ও চিন্তা হচ্ছে। হঠাৎ তলব করার কারণ টা ঠিক বুঝতে পারছে না!

“মেহু সোনা ভাইয়া তোকে সেইফলি বাসায় পৌঁছে দেবে।ভয় পাস না কেমন?আমি বাসায় যায়। মায়ের জন্য টেনশন হচ্ছে খুব।”

মেহরিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে তৃধা।তাবান তখন ও তৃধার জন্য ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।তৃধা বের হতেই ও কে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।কোথায় থেকে দৌড়ে এসে তাইফ ও ওদের সঙ্গে যোগ দেয়।তিন ভাইবোন খুনসুটি করতে করতে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে।

“আমি নিশ্চয় তোর পার্সোনাল ড্রাইভার নই?”

হৃদিত পেছনে তাকিয়ে বলে।হৃদিতের কথাটা কর্ণগোচর হতেই ওর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় মেহরিমা।

“সামনে এসে বস।”

হৃদিতের কথাটা শুনে হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে মেহরিমা। নিজের কান কেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না!তারপর নিজেকে সামলিয়ে মনের মাঝে হাজারো ভয় নিয়েই সামনের সিটে এসে বসে।নাহলে আজ আর ওর বাড়ির মুখ দেখা হবে না! হৃদিত আর মেহরিমার মধ্যে দুরত্ব মাত্র দুই,তিন হাত।এই প্রথম হৃদিতের এতোটা নিকটে মেহরিমা।মেহরিমার হার্ট টা তীব্র শব্দ তুলে দ্রিম দ্রিম করে বেজেই চলেছে।আর সাথে ওর কাঁপা কাঁপি তো আছেই!এই শব্দ নির্ঘাত হৃদিতের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে!ভয়ের সাথে একঝাঁক লজ্জা এসে হানা দেয় মেহরিমার মুখমণ্ডলে।

“মৃগিরোগীর মতো কাঁপছিস কেনো?কি সমস্যা?”

মেহরিমা ভয়ে কোনো উত্তর দিতে পারে না। অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপেই চলেছে ও। হঠাৎ করেই হৃদিত গাড়ির গ্লাস তুলে দেয়।এসি অন করে।মেহরিমার এবার ভয়ে মরি মরি অবস্থা।মুখের লাজুক আভা মুছে গিয়ে মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

“আর একটুও কাঁপা কাঁপি করলে আই সোয়্যার এক্ষুনি খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলবো।”

হৃদিত রাগে গর্জে ওঠে বলে।ব্যস!মেহরিমার কাঁপা কাঁপি সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে যায়।হৃদিত একবার আড়চোখে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। দুই মিনিট পার না হতেই মেহরিমা হঠাৎ খেয়াল করে গাড়িটা ওর বাসার দিকে না যেয়ে উল্টো দিকে অর্থাৎ ওর কলেজের দিকে যাচ্ছে।মেহরিমা আঁতকে ওঠে!মনে সাহস সঞ্চয় করে কোনোরকম তুতলিয়ে বলে,

“আ..আ…আপনি এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”

“জাহান্নামে! সঙ্গী হবি আমার?”

“অ..অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।সময় মতো বাসায় না ফিরলে বাবা টেনশন করবে।”

“তারমানে তুই আমার সাথে যেতে ইচ্ছুক না?”

হৃদিতের প্রশ্ন শুনে মেহরিমা কি বুঝলো কে জানে!ফ্যাকাশে মুখ নিয়েই মেহরিমা জানালার দিকে আরও চেপে বসে।তারপর এক ধ্যানে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।মেহরিমার দিকে এক পলক তাকিয়েই হৃদিত চোখ ফিরিয়ে নেয়। সেকেন্ডের ব্যবধানে গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দেয়।মেহরিমা ভয়ে তাড়াহুড়ো করে নিজের সিট বেল্ট বেঁধে ফেলে।ওর কর্মকাণ্ড দেখে হৃদিতের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে।কিন্তু আফসোস সেই হাসি বোকা মেহরিমার চোখে পড়ে না।নাহলে আবারও এই মুহূর্তে নতুন করে আরেকবার হৃদিতের প্রেমে পড়তো!

#চলবে_______

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০১

0

#সূচনা_পর্ব
#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#ইসরাত_তন্বী

দুপুর বেলায় অতিরিক্ত সূর্যের উত্তাপে সৃষ্টি হয়েছে ভ্যাপসা গরম। প্রকৃতির সবুজ গাছপালা গুলোও যেনো নিরব নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কোনো গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা বাধ্য হয়ে তীব্র সূর্যের অসহনীয় তাপদহ নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে।

এই প্রখর সূর্যের তাপ সহ্য করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে মেহরিমা আর ওর জানেজিগার বেস্টি তৃধা। মাত্রই কলেজের ক্লাস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ওরা।কিন্তু আজ পাঁচ মিনিট হাটতে যেয়েই হাঁপিয়ে উঠেছে দু’জন।ঘেমে খুবই বাজে অবস্থা।রাস্তায় একটা ভ্যানের ও দেখা নেই!মেহরিমার বাড়ি থেকে হেঁটে কলেজে আসতে বিশ মিনিট সময় লাগে আর তৃধার আসতে দশ মিনিট মতো সময় লাগে।আজ ছাতা না নিয়ে আসাতে নিজেকে নিজেই কয়েক দফা বকা দিয়ে নিল মেহরিমা।কিন্তু গতরাতে দীর্ঘ বর্ষণের পর এতটা প্রখর উত্তাপ নিয়ে সূর্য উঠবে কে জানতো!সকালেও তো প্রকৃতি ঠান্ডা ছিলো। দু’জন ক্লান্ত থাকায় আজ আর কেউ তেমন কথা বলে না।মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুলে দিব্বি হেঁটে চলেছে দু’জন।

আরও দুই মিনিট হেঁটে গ্রামের মোড়ে আসতেই ওদের থেকে পাঁচ/ছয় হাত দূরে কিছু একটা লক্ষ্য করতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মেহরিমা। দীর্ঘ আট মাস পর সেই চিরচেনা সাদা বিএমডব্লিউ টা চক্ষুগোচর হতেই মেহরিমার বক্ষ স্থলে ভয়,ভালো লাগার সংমিশ্রনে এক অদ্ভুত অনুভূতির শিহরণ বয়ে যায়।ওর মনে পড়ে যায় সেই পাঁচ বছর আগের কথা।

মেহরিমা তখন সবে ক্লাস সেভেনে উঠেছে।তৃধার জ্বর আসায় সেদিন স্কুলে আসতে পারেনি।তাই মেহরিমা একা একাই এসেছে স্কুলে।স্কুল ছুটির পরে ওদেরই পাড়ার এক ছেলে বন্ধু রাকিবের সাথে রাস্তায় হাসাহাসি করতে করতে বাড়ি ফিরছিল ছোট্ট মেহরিমা।ওদের স্কুল থেকে তিন মিনিট মতো হাঁটলেই একটা বড় বটগাছের দেখা পাওয়া যায় রাস্তার পাশে।সেটার পাশে দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎই একটা গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে কেঁপে ওঠে ছোট্ট মেহরিমার বক্ষ স্থল।মেহরিমা কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে পাশে তাকাতেই দেখতে পাই গ্রামের অনেক গুলো ছেলে একসাথে একজন কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের সাথে চৌধুরী বাড়ির দুই ছেলে তাবান আর তাইফ কে লক্ষ্য করতেই মেহরিমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।বিনিময়ে তাবান আর তাইফ ও মুচকি হাসে। কিন্তু গাড়ির হুডের উপর বসে থাকা ছেলেটার হালকা নীল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই মেহরিমার হাসি বন্ধ হয়ে যায়।ছেলেটাকে চিনতে একটুও সময় লাগেনি মেহরিমার। তাহমীদ হৃদিত চৌধুরী। এই ছেলেকে শুধু মেহরিমা কেনো গ্রামের প্রতিটা মানুষ হাড়ে হাড়ে চেনে!

“এই পুঁচকে মেয়ে এদিকে আয়।”

মেহরিমা ভয়ে ভয়ে পালিয়ে যেতে নিলেই এক ধমক লাগায় হৃদিত। ততক্ষণে রাকিব দৌড়ে পালিয়েছে।মেহরিমার এবার আরও বেশি ভয় লাগতে থাকে।মেহরিমা ভয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে হৃদিত ওর গম্ভীর কন্ঠস্বর হালকা নরম করে বলে,

“নাম কি?”

“মেহরিমা শেখ নীলাক্ষী।”

“টাকলু চেয়ারম্যান জলিল শেখের ছোট মেয়ে?”

হৃদিতের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।নিজের বাবাকে নিয়ে এমন কথা শুনে মেহরিমার মুখ টা মলিন হয়ে যায়। বাবাকে বড্ড ভালোবাসে কি না! তবুও মলিন মুখেই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।

“কোন ক্লাস?”

“সেভেন।”

“বড্ড ছোট।পাশের ছেলেটা কে ছিলো?”

“আপনাকে কেন বলবো?”

মেহরিমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ওর গালে পাঁচ টা আঙ্গুলের ছাপ বসে যায়।গালে হাত দিয়ে এবার বেশ শব্দ করেই কেঁদে দেয় মেহরিমা।

“আমার মুখে মুখে তর্ক করা একদম পছন্দ না।নেক্সট টাইম যেনো ওই ছেলের সাথে আর না দেখি।বাসায় যা।বরফ লাগিয়ে নিস গালে।”

হৃদিতের কথাগুলো মেহরিমা আদৌও শুনলো কি শুনলো না কে জানে!সেই থাপ্পড় খেয়ে দীর্ঘ এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগে ছিলো মেহরিমা।সেদিন থেকেই ওই মানুষটা কে যমের মতো ভয় পায় মেহরিমা।তবে সেই এক থাপ্পড়ে কাজ ও হয়েছিল বটে।তারপর থেকে মেহরিমা আর কোনো ছেলের সাথে কথা বলা তো দূরে থাক তাকাই ও না।তাকাবেই বা কি করে মনে যে শুধু এক জনেরই রাজত্ব চলে।থাপ্পড় খেয়ে প্রেমে পড়েছে এই কথা শুনলে মানুষ নির্ঘাত মেহরিমা কে পাগলী বলবে।তাতে মেহরিমার কী! কথাগুলো মনে করে মুচকি হাসে মেহরিমা।

“এই এই মেহু বেইবি এটা হৃদিত ভাইয়ার গাড়ি না?”

“জানি না।”

মেহরিমার উত্তর শুনে তৃধা ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।তারপর বেশ খুশি খুশি মনে মেহরিমার হাত ধরেই গাড়ির দিকে হেঁটে যায়।গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই গাড়ির ভেতরে কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয় তৃধা। কতদিন ভাইয়া কে দেখেনি তৃধা।ভাবলো এখন হঠাৎ দেখা হতেই সারপ্রাইজ দেবে ভাইয়াকে! কিন্তু ভাইয়া গেলো কোথায়?

মেহরিমা কি যেন মনে করে রাস্তার অপোজিট সাইডে থাকা চায়ের দোকানে তাকায়।আর সাথে সাথে সেই চেনা পরিচিত মুখ টা দর্শন হয়।হৃদিত দোকানে দাঁড়িয়ে আছে।ঠিক মেহরিমার সামনাসামনি ওর দিকেই মুখ দিয়ে।ও সিগারেট খেতে খেতে ধোঁয়া ছেড়ে শান্ত অথচ শানিত দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকায়।আর তক্ষুনি ওর নীল চোখের ধারাল দৃষ্টির সাথে মেহরিমার দৃষ্টি মিলে যায়।মেহরিমার হৃদপিন্ড টা যেন কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়! হার্ট বিট ফাস্ট হয়ে যায়!মেহরিমা সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নেয়।এখান থেকে তাড়াতাড়ি ও কে সরে পড়তে হবে।নাহলে নির্ঘাত হার্ট টা বের হয়ে মারা যাবে ও।এত লাফালাফি করার কি আছে আজব!ততক্ষণে তৃধা তার সবচেয়ে প্রিয় হৃদিত ভাইয়ের দিকে দৌড় লাগিয়েছে।

“ভাইয়াআআআআ! কেমন আছো তুমি?বড়মা,বড় বাবা,আয়াশ ভাইয়া আরিশা ভাবী সবাই কেমন আছে?এতো দিন পরে আমাদের কথা মনে পড়লো তোমার?জানো তোমাকে কত্ত মিস করেছি।”

তৃধার কথায় হৃদিত মুচকি হাসে।

“আস্তে আস্তে বল আমি তো আর হারিয়ে যাচ্ছি না।সবাই ভালো আছে।”

“এতো দিন আসলে না কেন তাই বলো আগে?”

“স্টাডি নিয়ে একটু বিজি ছিলাম।”

“তোমার না মাস্টার্স শেষ ভাইয়া?”

“উহু, এইবার শেষ হলো।কি খাবি?”

“আইসক্রিম।”

হৃদিত চকলেট ফ্লেভারের দশটা আইসক্রিম কিনে দেয় তৃধা কে। এত্তগুলো আইসক্রিম পেয়ে তৃধা তো মহাখুশি।

মেহরিমা জানে এই মেয়ে এখন ভাই পেয়েছে না! ভাইকে রেখে আর নড়বে না।তাই মেহরিমা দেরি না করে ছোট ছোট কদমে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। কিন্তু এভাবে হাঁটতে ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছে।ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে ওর দিকে কেউ একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।মেহরিমা খুব সতর্কতার সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়।না কেউ তো তাকিয়ে নেই!হয়তোবা নিজের মনের ভুল।মেহরিমা আনমনে হাঁটতে যেয়েই রাস্তায় পড়ে থাকা ছোট্ট ইটের টুকরার সাথে পা বেঁধে মুখ থুবড়ে রাস্তার পাশে থাকা কাঁদার মধ্যে পড়ে যায়।কয়েক সেকেন্ড অতিক্রম করে নিজের সাথে কি ঘটেছে সেটা মস্তিষ্ক জানান দিতেই ওভাবেই পড়ে থেকে ব্যথায়,লজ্জায় কেঁদে দেয় মেহরিমা।হঠাৎ রাস্তার পাশে মেহরিমাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখেই তৃধা সহ তাবান,তাইফ ও দৌড় লাগায় মেহরিমার দিকে।হৃদিত বিরক্তিতে চোখ,মুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়।হাতে থাকা সিগারেট টা একপ্রকার ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে।অতঃপর মেহরিমার দিকে হাঁটা ধরে।

#চলবে__________

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩০. ( উপসংহার )

চারিদিকে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। একটা ডায়েরি হাতে বিছানায় বসে আছে মোহ। অমনোযোগী দৃষ্টি টেবিলে রাখা পানির বোতলটার দিকে। একটা লম্বা সময় সেই বোতলটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। কলমের সাহায্যে ডায়েরিতে কিছু একটা লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

প্রথমে সে স্বাভাবিক থাকলেও ধীরে ধীরে তার মুখশ্রীতে করুণ বিষণ্ণতা এসে ভর করে। সেই বিষণ্ণতা সময়ের সঙ্গে নীরব কান্নায় রূপ নেয়। মোহর গাল গড়িয়ে নামা অশ্রুজলে ভিজে যায় শুভ্র কাগজের পাতাটা। সাক্ষী হয় সপ্তাদশীর বাঁধ ভাঙা আবেগের।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতেই মোহর হাত থেমে যায়। সে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে স্ক্রিনে মননের নামটা। মোহ আবারও ধ্যানে মগ্ন হয়। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই আবারও বেজে উঠে। এবার মোহ ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে সুইচ অফ করে দেয়।

অত:পর? অত:পর সে আবারও কাদলো। ডায়েরিতে মুখ গুজে লম্বা সময় পর্যন্ত কাদলো। এতটা হতভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে কেন এলো সে? কি হতো একটা মোহর অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে না জন্মালে? এই বিশাল পৃথিবীতে মোহর অবদান কি? কোন সুফলটা বয়ে এনেছে সে? কিছুই না। বরংচ আরো সকলের জীবনের একটা কষ্টের অধ্যায় হতে চলেছে সে। মোহ তো এমনটা চায় নি কখনো। তাহলে এরকমটা কেন হলো? আর কতগুলো মানুষকে সে কষ্ট দিবে?

__________

হুট করে মোহর ফোন বন্ধ পেয়ে মননের ভয়টা সত্যিতে রূপান্তর হয়। তার মানে সত্যিই সামহাও সে মোহকে হার্ট করেছে? কিন্তু কিভাবে? মনন ভাবে খুব। কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না।

অনেকটা অসহায়ের মতো যখন মনন বিছানায় বসে নিজের মাথার চুল টানছে ঠিক সেই মুহুর্তে রুমের বাহির থেকে চেঁচামেচির শব্দ পায় সে। আলী আকবর সাহেব চেঁচাচ্ছেন,

“ পানির বোতলটা কোথায়? এই আরিফ! বোতল কোথায় খুঁজে দেখো। “

বোতলটা খুঁজে না পেয়ে চেঁচামেচির পরিমাণ আরো কিছুটা বেড়ে যায়। মননের সবর ফুরিয়ে এতেই সে উঠে রুম থেকে বের হয়। শীতল স্বরে নিজের দাদু এবং আব্বুকে উদ্দেশ্য করে সরাসরি বলে,

“ আমি নিয়েছি বোতলটা। লুকিয়ে নিয়েছি। আর কিছু জানতে চাও তোমরা? “

আরিফ সাহেব ততক্ষণে আন্দাজ করে ফেলে ব্যাপারটা। কিন্তু আলী আকবর সাহেব বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

“ লুকিয়ে নিয়েছো মানে? লুকিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল কি? আমরা কি তোমাকে পানি খেতে নিষেধ করতাম? “

মনন এবার ক্লান্ত গলায় বলে,

“ আমার জন্য নেই নি দাদু৷ একটা অসুস্থ মেয়ের জন্য নিয়েছি। ওই অসুস্থ মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। সুস্থ দেখতে চাই ওকে। ওকে সুস্থ দেখার জন্য কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না আমি। “

আলী আকবর সাহেব অবাক হলেন। অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকলেন। নিজের বিস্ময়তা দমিয়ে কিছুটা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন,

“ অসুস্থ বলতে? কি অসুখ হয়েছে? “

“ ক্যান্সার। থার্ড স্টেজ। সারভাইভাল রেট ফিফটি ফাইভ পার্সেন্ট। “

আলী আকবর সাহেব বাকরুদ্ধ হলেন। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। নাতিকে কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারলেন না। অবশ্য উনার কিছু বলতেও হলো না। তার পূর্বেই মনন নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।

__________

আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। দিনটা আজ ২১ ই সেপ্টেম্বর। নিজের কেবিনে বসে পেশেন্ট দেখতে ব্যস্ত মননের টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। পেশেন্টের অভিভাবকদের এক মিনিটের জন্য এক্সকিউজ মি বলে মনন টেলিফোনটা তুলে কানে ধরে।

“ হ্যালো? “

“ ডক্টর ওয়াসিফ কায়সার মনন? “

“ জি বলুন। “

“ স্যার, আপনি একজন পেশেন্টের এডমিট হওয়ার আপডেট জানতে চেয়েছিলেন। পেশেন্টের নাম মেহনামা ফেরদৌস মোহ। আজকে এডমিট হয়েছে উনি। টেনথ ফ্লোর। রুম নং ওয়ান জিরো জিরো সেভেন। “

“ থ্যাঙ্কিউ ফর ইউর হেল্প। “

“ মাই প্লেজার। “

মনন টেলিফোনটা কান থেকে নামিয়ে আবার পেশেন্ট দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার মুখভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। দেখে মনেই হচ্ছে না যে গত ছয়টা দিন ধরে সে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারছে না। হৃদয় ব্যকুল হয়ে আছে কাউকে এক নজর দেখার জন্য। তার কণ্ঠ শোনার জন্য। গত ছয়টা দিনে মনন কতবার যে হসপিটালের ওয়েবসাইটে লগ ইন করে মোহর ফাইলের আপডেট চেক করেছে সেটারও হিসাব নেই। কিন্তু কোনো আপডেট পায় নি সে। অর্থাৎ এই ক’দিন মোহর ওপিডি, টেস্ট, কেমো কিছুই ছিলো না।

সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত মনন বসে সবগুলো পেশেন্টকে দেখা শেষ করে। একেবারে হাতের সব কাজ মিটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নেয়। পাঁচটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। মনন রওনা হয় একজনের মুখোমুখি হতে। যথেষ্ট হয়েছে! তার জানতে হবে মোহর সমস্যাটা কোথায়।

__________

মোহকে কেবিনে রেখে শিহান গিয়েছে হসপিটালের ডিসপেনসারিতে। মোহর কিছু ওষুধ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেগুলো নেওয়ার উদ্দেশ্যে। মোহ তখন কেবিনে একা। বিছানার এক ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকায়। দেখে একজন ওয়ার্ড বয় এসে হাজির হয়েছে। মোহর সামনে এগিয়ে এসে তার দিকে একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ স্যার দিতে বলেছে। “

মোহ চিরকুটটা নিতেই ছেলেটা চলে গেলো। মোহ অনুমান করতে পারে স্যার সম্বোধন করা ব্যক্তিটি কে হতে পারে। সে চিরকুটটা খুলতেই সেখানে চিরপরিচিত ডাক্তারদের মতো বিশ্রী হাতের লেখা দেখতে পায়।

“ চিরকুট দেওয়ার জন্য দুঃখিত নই। আপনিই আর কোনো যোগাযোগের উপায় রাখেন নি। ছাদে আসুন পাঁচ মিনিটের জন্য। আপনার আসতে ইচ্ছে না করলে অসুবিধা নেই, আমি তাহলে কেবিনে চলে আসবো। দেখুন আপনার যা মন চায়। “

মোহ বিস্মিত হয়ে চিরকুটটা কয়েকবার পড়ে। এই লোক মোহকে হুমকি দিলো? এতটা বেপরোয়া হয়ে পরেছে? কখন, কবে? মোহ আগে কেনো টের পায় নি?

শিহানের ফিরতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। তা-ই মোহ অপেক্ষা না করে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। চিরকুটটা হাতে নিয়েই রওনা হয় ছাদের উদ্দেশ্যে।

__________

বৃষ্টি বিরতি নিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। সন্ধ্যা নেমে আসা শহরটার কোণায় কোণায় কৃত্রিম আলো জ্বলে উঠছে। মোহ এলো ক্ষিপ্ত গতিতে। এসে মননের হাতে চিরকুটটা ধরিয়ে দিয়ে কিছুটা চেঁচিয়ে উঠলো,

“ এই মনন! ভয় নেই আপনার? হুমকি দেন আমাকে? “

মনন প্রতুত্তর করলো না। নীরবে দেখলো মোহকে। নীরবে শুনলো নিজের নাম। মোহর এই নীরবতা পছন্দ হলো না। জানতে চাইলো,

“ ডাক্তার না আপনি? আপনার কাজ নেই আর? আমার পিছনে কেনো পরলেন? “

“ ফোন বন্ধ করেছেন কেন? কিছু করেছি আমি? কষ্ট পেয়েছেন আপনি? “

মোহ উত্তর দিতে পারে না। কি বলবে সে? কেন মননের সঙ্গে দূরত্ব রাখতে চাইছে সে? মননের ভালোর জন্যই তো! মনন তো বুঝবে না এটা।

মনন আবার প্রশ্ন করে,

“ মোহ সমস্যা কোথায় সেটা বলুন প্লিজ। না বললে আমি বুঝতে পারছি না। আপনি বলুন, আমি সর্ট আউট করার চেষ্টা করছি। “

“ অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুতে জড়ানোর আগে লাগাম টানা উচিত আমাদের। আমি ইতিমধ্যে বাবা আর মায়ার কষ্টের কারণ হয়ে আছি। আমি চাচ্ছি না আপনারও কষ্টের কারণ হই। এই সামান্য… “

মোহ থেমে যায় হঠাৎ। চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রাখে। ঠিক ব্যান্ডেজটার উপর। মনন লক্ষ্য করে ব্যাপারটা। চেহারায় উদ্বিগ্নতা এসে ভীড় করলো। প্রশ্ন করলো,

“ কি হয়েছে? মোহ? আর ইউ অলরাইট। “

নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে মোহ বললো,

“ হ্যাঁ। কিছু হয় নি। আমি যাই। আপনি প্লিজ আর দেখা করতে চাইবেন না আমার সাথে। প্লিজ। “

মোহ যেনো তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে পালাতে চাইলো। মনন সুযোগ দিলো না। বাঁধা দিতে মোহর হাতটা ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে উঠলো। বিস্ময় নিয়ে বললো,

“ এই? এই? আপনার জ্বর। কখন থেকে? বলেন নি কেনো? “

মোহকে অস্থির দেখালো। এলোমেলো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আবারও হাতটা বুকের ডান পাশে ব্যান্ডেজের উপর রাখলো। মনন কণ্ঠে অস্থিরতা নিয়ে জানতে চাইলো,

“ ব্যথা হচ্ছে? বুকে ব্যথা হচ্ছে আপনার? কি হচ্ছে প্লিজ বলুন আমাকে। “

মোহ অস্ফুটে কেবল বলতে পারলো,

“ জ্বলছে। “

বলতেই তার শরীরটা টলে উঠলো। মনন দ্রুত সামলে নিলো। মুহুর্ত অপেক্ষা না করে পাজাকোলে তুলে নিলো মোহকে। মোহ জ্ঞান হারায় নি। তবে হুট করেই অস্বাভাবিক লাগছে তার। ব্যান্ডেজের ভেতরটা জ্বলছে খুব। মনে হচ্ছে একটা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড রাখা ওই ব্যান্ডেজের আড়ালে।

মোহকে নিয়ে কেবিনে পৌঁছাতে মননের সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট লাগলো। পথে সকলে অবাক হয়ে দেখছিলো একজন ডক্টর একটা রমণীকে কোলে তুলে হন্য হয়ে ছুটছে। মননকে দৌড়ে কেবিনের দিকে যেতে দেখে তার পিছে পিছে নার্সরাও ছুটে এলো। মনন চেঁচিয়ে বললো,

“ পোর্ট সার্জনকে খবর দাও। “

একজন নার্স ছুটে গেলো কাউন্টারে মোহর সার্জনকে ইনফর্ম করতে। মনন মোহকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই দ্রুত চিৎকার করে বলতে লাগলো,

“ গ্লাভস আর ক্লিনিং এইড কিট নিয়ে এসো। “

নার্সরা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। মনন কি করতে চাইছে বুঝতে পারছে না তারা। মননের আদেশ পালন করাও কতটুকু ঠিক হবে তা নিয়েও তারা সন্দিহান। কারণ হাজার হোক মনন এই পেশেন্টের ডক্টর নয়। তবে মননের ধমকের তোপে তারা বেশি কিছু ভাবার সময় পেলো না। একজন কিট আনতে ছুটে গেলো। আরেকজন দ্রুত গ্লাভস এনে মননের হাতে পড়িয়ে দিতে থাকলো। মনন মোহর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,

“ এই মোহ! কিছু হবে না। আপনি রিল্যাক্স থাকুন। “

মোহ রিল্যাক্স হতে পারলো না। জ্বর তো তার আগেও এসেছে। এরকম তো অনুভূতি হয় নি। ব্যান্ডেজের ভেতরে অনুভব করা উত্তাপটা মোহ মুখ ফুট বলতে পারলো না। ভয়ে তার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে।

মনন দ্রুত একজন নার্সকে বললো মোহর স্কার্ফটা সরাতে মাথা থেকে। ততক্ষণে আরো একজন নার্স নিজের হাত স্যানিটাইজ করে গ্লাভস পড়ে তৈরী। নার্সকে মোহর জামার গলাটা কিছুটা নিচে নামিয়ে ধরে রাখতে বলে মনন অতি সাবধানে দ্রুত ব্যান্ডেজটা খুললো। ব্যান্ডেজ উন্মুক্ত করতেই সে ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো। নার্সরাও ভীত হলো। মনন আবারও চেঁচিয়ে উঠে,

“ ডক্টর কোথায়? “

নার্স ইতিমধ্যে পোর্ট সার্জনকে কল করেছে। ডক্টর এক্ষুণি আসছে জানিয়েছে। তবে অশান্ত, ক্ষিপ্র মননকে সেটুকু বলারও সাহস পেলো না সে। মোহ চোখ মেলে নিজেও লক্ষ্য করলো তার বুকের ডান পাশের সেলাইয়ের জায়গাটা। দেখলো জায়গাটা লাল হয়ে কেমন ভয়ংকর দেখাচ্ছে। সেলাইয়ের জায়গাটায় পানি জমে ফুলে আছে। মোহ আর ঠিক থাকতে পারলো না। ভয়ে চিৎকার করে কান্না করে উঠলো।

মনন আরো অশান্ত হয়ে পড়ে। মোহর গাল ধরে বলে,

“ কিচ্ছু হয় নি। ইনফেকশন সম্ভবত। ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ শান্ত হন আপনি। শান্ত হন মোহ। “

ডক্টর আসার পূর্বে শিহান এসে উপস্থিত হলো। কেবিনের ভেতর অশান্ত নার্স এবং ডক্টরকে দেখে ভড়কালো। এগিয়ে এসে মোহর অবাক দেখতেই উনি নিথর হয়ে চেয়ে রইলেন। মোহ কান্নার মাঝে লক্ষ্য করলো শিহানকে। এই প্রথম যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সে মা’য়ের নাম ছেড়ে বাবাকে ডাকলো।

“ বাবা! বাবা! বাবা কি হচ্ছে আমার? বাবা প্লিজ কিছু করো। বাবা! “

শিহান পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। এগিয়ে যেতে পারলো না। মেয়ের ডাকে সাড়া দিতে পারলো না। মোহ চোখ খিচে বন্ধ করে আবার চিৎকার করতে থাকে। শিহান সম্বিত ফিরে পায়। দৌড়ে এগিয়ে যায় মেয়ের মাথার কাছটায়। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

“ কি হয়েছে মা? কি হচ্ছে তোমার? কোথায় ব্যথা হচ্ছে? বুকে ব্যথা হচ্ছে? “

প্রশ্নগুলো করতে করতে শিহান অনুভব করলো মোহর তীব্র জ্বর। এতটাই তীব্র যে মনে হচ্ছে শিহানের হাতের তালু সেই জ্বরের উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে। শিহান চেঁচালো। সবার উপর চেঁচালো।

“ কি হয়েছে আমার মেয়ের? ঠিক ছিলো ও। হঠাৎ কি হলো ওর?… “

শিহানের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় পেলো না কেউ। তন্মধ্যে ডক্টর এসে হাজির হলো। মোহর সার্বিক পরিস্থিতি দেখে উনি চিন্তিত হলেন। নার্সদের নির্দেশ দিলেন দ্রুত মোহকে নিয়ে প্রয়োজনীয় দু একটা টেস্ট করাতে। রিপোর্টটাও যেনো আর্জেন্ট পাঠানো হয় সেজন্য কল করে জানালেন নির্দিষ্ট অথরিটিকে।

মোহকে ধরে বেড থেকে নামিয়ে একটা হুইলচেয়ারে বসানো হলো। নার্স দু’জন ফাইল হাতে হুইলচেয়ার নিয়ে ছুটলো। তাদের সঙ্গে ছুটলো শিহানও। মনন পিছু যায় নি। বরং ডক্টরের সঙ্গে রইলো। একান্তে প্রশ্ন করলো,

“ ইনফেকশন হয়েছে বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক হয়ে যাবে তো? তাই না? “

ডক্টর জানালো,

“ বাহির থেকে দেখে তো অবস্থা ভয়ংকর মনে হচ্ছে। রিপোর্ট পেলে বিস্তারিত বুঝা যাবে। কিন্তু ইমিডিয়েট সার্জারি করতে হবে এটা নিশ্চিত। পানি জমে গিয়েছে। পোর্টে ইনফেকশন হওয়াটা কতটা রিস্কি আপনি তো জানেনই। “

বলেই ডক্টর সেখান থেকে প্রস্থান করলো। উনার হাতে ফুরসত নেই। এখনই নিজের টিম নিয়ে প্রস্তুত হতে হবে উনার। মোহর কেসটা নিয়ে আলোচনাও করতে হবে। মনন দেয়ালের সঙ্গে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের গ্লাভস খুললো। পকেট থেকে ফোন বের করে কল করলো আলী আকবর সাহেবকে। সরাসরি আবদার করে বলে,

“ আমি একটা সার্জারি এটেন্ড করতে চাই দাদু। ওটিতে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবো। কাউকে বিরক্ত করবো না। তুমি প্লিজ ব্যবস্থা করে দাও। আমি না শুনতে চাই না। “

__________

মোহর খবর পেয়ে মায়া ছুটে হসপিটালে এলো। রাত তখন আটটা বাজে প্রায়। মোহকে ওটিতে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। পড়নের জামা বদলে দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। মায়া ওটি এরিয়ার কাছে আসতেই শিহানকে দেখতে পেলো। ছুটে গিয়ে বাবাকে ধরে কাদতে কাদতে প্রশ্ন করে,

“ আমার বোন কোথায়? কি হয়েছে ওর? ওর সার্জারি কেন করবে? “

শিহান উত্তর দিতে পারলো না। তার আগেই দেখা গেলো মোহকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পেশেন্ট বেডটা ওটির ভেতর প্রবেশ করার পূর্বেই মায়া দৌড়ে গেলো। মোহর হাত ধরে বলে,

“ প্যারা নিবি না তুই। একদম ঠিক হয়ে যাবি। আমরা সবাই দোয়া করবো। “

কাদতে কাদতে মোহর গলা বসে গিয়েছে। সে ক্ষীণ স্বরে কিছু একটা বলে। মায়া স্পষ্ট কথাটা বুঝতে না পেরে মাথা নুইয়ে আনে। এবার মোহর কথাটা বুঝতে পারে সে। প্রতুত্তরে কিছু বলার সুযোগ পায় না। এর পূর্বেই মোহকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়।

মায়া একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে কাদতে থাকে। শিহান দূরে দাঁড়িয়ে দেখে তা। নিজেকে অসহায় মনে হয় তার। দুই মেয়ের এক মেয়েরও কষ্ট দূর করার ক্ষমতা নেই তার কাছে। এতটা জঘন্য কেন সে বাবা হিসেবে?

__________

ওটিতে ঢোকার আগ পর্যন্ত মোহর চোখ অজান্তেই বারবার একজনকে খুঁজে বেরাচ্ছিলো। কিন্তু না, মানুষটাকে কোথাও দেখতে পায় নি সে। লোকটাকে কি দেখার সুযোগও হবে না তার?

ওটি রুমের মধ্যিখানে সার্জারির জন্য নির্ধারিত বেডটায় মোহকে বসানো হয়। দুইজন নার্স তাকে একটা পর্দার মতো কাপড় দিয়ে আড়াল করে দেয়। আরেকজন নার্স তার হসপিটাল গাউনটা খুলতে সাহায্য করে। এতো যন্ত্রণার মাঝেও মোহর অস্বস্তি কাজ করছিলো। সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে নার্সদের সামনে বসে থাকতে তার জড়তা কাজ করছিলো। তার উপর ওটি ভর্তি ছয় সাতজন পুরুষ ডাক্তার। কিন্তু নার্সদের মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। এইটা তাদের নিত্যদিনের কাজ।

মোহ বেডে সোজা হয়ে শুতেই তার পুরো শরীর একটা সবুজ পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। এইবার নার্সরা পর্দা সরিয়ে নিলো। মোহ দেখলো না কিছু। সে ইতিমধ্যে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলেছে। জাগতিক সকল চিন্তা তার মস্তিষ্কে এসে ভীড় করেছে। একবার মায়ার কথা মনে পড়ছে। একবার বাবার। একবার…

“ ভয় পাবেন না। “

কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলা কথাটুকু শুনে মোহর ভাবনা উধাও হয়ে গেলো। সে চমকে চোখ মেলে তাকায়। তার পাশে দাঁড়ানো সার্জিক্যাল এপ্রোন, মাস্ক পড়া লোকটাকে চিনতে ভুল হলো না তার। চিনতে পেরে মোহ বুক পর্যন্ত টানা কাপড়টাকে টেনে গলা পর্যন্ত তুলতে চাইলো। মনন তাকে বাধা দিয়ে বলে,

“ ডক্টর হিসেবে আছি আমি। আমার দৃষ্টিতে আপনি শুধুমাত্র পেশেন্ট এখন। প্লিজ বি কম্ফোর্টেবল। “

মননের কথায় মোহ ভুললো না। সে জানে মনন ডাক্তার হিসেবে ওটিতে উপস্থিত নয়। সে মোহর জন্য এসেছে। মোহ তার কাছে শুধুমাত্র পেশেন্ট নয়। মোহ কোনোকালেই এই লোকটার পেশেন্ট ছিলো না।

মনন আরেকবার তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

“ ভয় নেই। এখনো আমি আছি। চোখ খুলেও আইসিইউতে সবার আগে আমাকেই দেখবেন। সুস্থ হোন আগে। বোঝাপড়া বাকি আছে আমাদের। “

মোহ উত্তর দিতে পারে না। না চাইতেও আরো একবার তার চোখ গড়িয়ে জল পড়তে থাকে। মনন নীরবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। একটুও নড়ে না। দু’জনেই তাকিয়ে থাকে একে অপরের দিকে। সেই ফাকে একজন ডক্টর এসে বহু খুঁজে শিরা বের করে মোহর হাতে ক্যানেলা পড়ায়। অত:পর সেটার সাহায্যে চেতনানাশক ওষুধ ইঞ্জেক্ট করে দেয়। ধীরে ধীরে মোহর মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। তবুও সে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা চালায়। যখন আর তাকিয়ে থাকতে পারে না তখন অস্ফুটে বলে,

“ আমি আর চোখ খুলবো না। আপনাকেও দেখবো না। আপনি অপেক্ষা করবেন না। “

মনন শুনলো সবটা। কিছু বললো না। মোহ ঘুমিয়ে পড়তেই ডক্টররা সার্জারি শুরু করতে এগিয়ে এলো। মনন তাদের বিরক্ত করে না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে ওটির একটা কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে। দূর হতে দেখতে থাকে মোহর বুকে চলমান কাটাছেঁড়া। মনন হঠাৎ অনুভব করলো তারও বুক জ্বলছে। কাটাছেঁড়া তারও বুকে চলছে। কেউ দেখছে না সেটা। মনন কাউকে দেখাতে পারবে না। তার বুকের এই কাটাছেঁড়া মোহ বাদে কেউ সাড়াতে পারবে না।

__________

মৃত্যুর সময় রাত নয়টা বেজে তিন মিনিট। ফাইলে ডেথ টাইমটা নোট করে নিয়ে ওটি থেকে বেরিয়ে গেলো একজন নার্স। তার পিছু পিছু ডাক্তাররাও বেরিয়ে যেতে নিলো। কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ওটির এককোণে মেঝেতে বসে থাকা বিধ্বস্ত মননকে। এক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বেডের উপর থাকা ডেডবডিটার দিকে। সবার মাঝে ফিসফিস শোনা যাচ্ছে। কানাঘুঁষা করছে পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের ডক্টর ওয়াসিফকে নিয়ে। সেই ডক্টর যে কি-না এক পেশেন্টের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখে কেমন দিশেহারার মতো সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো।

ডক্টররা সবাই বেরিয়ে যায় একে একে। মনন আপন জায়গায় সটান ভঙ্গিতে বসে রয়। অনেকটা পাথরের মতো। অনুভূতিশূন্য। একজন নার্স এগিয়ে এসে ডাকে,

“ ডক্টর? “

ওয়াসিফ শুনে না তা। জগতের কারো ডাকই তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। ব্যর্থ নার্স সরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মনন নিজেই উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় বেডটার কাছে। দেখে মোহর ফ্যাকাশে মুখটা। চোখের কার্নিশে এখনো পানি জমে আছে। মনন হাত বাড়ায় মুছে দিতে। কিন্তু হুট করেই হাত থেমে যায় তার। ছোঁয় না আর মোহকে। কেন ছুঁইবে? ওই মেয়েটা অপেক্ষা করেছে? করে নি। মননের সঙ্গে বৈধ সম্পর্কে জড়ানোর অপেক্ষাটুকু অবধি করে নি। তাহলে কোন অধিকারবোধ থেকে মনন ওই মেয়ের চোখের পানি মুছবে?

মন ব্যথায় ক্লান্ত মনন বেরিয়ে এলো ওটি থেকে। বাহিরে বেরিয়ে আসতেই দেখলো মোহকে। বেঞ্চিতে বসে বুক ভাসিয়ে কাদছে। মনন বেশ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। উপলব্ধি করলো এইটা মোহ না। মোহর বোন মায়া। বোন হারানোর ব্যথায় কাদছে। মনন আবার মাথা নুইয়ে হেঁটে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

শিহান মায়ার মাথায় হাত রাখে। মায়া তখনও হাউমাউ করে কাদছে। হঠাৎ মাথায় বাবার হাতের ছোঁয়া পেতেই সে আহাজারি করে বলে,

“ আমাকে তোমার খেয়াল রাখতে বলে গিয়েছে ও। ও তোমাকে অনেক ভালোবাসতো বাবা। অনেক… “

শিহানের মনের অবস্থা কেউ ব্যাখ্যা করতে পারলো না। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কখনো শব্দে ব্যাখ্যা করাও যায় না। কেবল যে হারায় সে অনুভব করতে পারে তা। শিহানের কেবল মনে হলো তার অর্ধেকটা কলিজা বোধহয় কেউ কেটে নিয়ে গেলো। বাকিটা জীবন তার এই অর্ধেক কলিজা নিয়েই চলতে হবে।

__________

কেবিন নং ওয়ান জিরো জিরো সেভেনটা পেশেন্টশূন্য পড়ে আছে। অথচ আজ দুপুরেও এই কেবিনে একজন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছিলো। সন্ধ্যা থেকে তার কেমো শুরু হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তা আর হলো কই? তার আগেই পেশেন্টটা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো।

হাহাকার করা বুক নিয়ে মনন বসে রইলো কেবিনের বেডটায়। যেই বেডটায় শুয়ে মোহ তড়পাচ্ছিল, সেই বেডটায়। চশমার আড়ালে ভেজা চোখ জোড়া জ্বলছে মননের। মোহ যে সম্পূর্ণ মননকে অসম্পূর্ণ রেখে গেলো, সেই দায় মোহ কিভাবে এড়াবে? এই-যে মননের সঙ্গে মোহর বোঝাপড়া অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো এই দায় কি শুধু এবং শুধুমাত্র মোহর না? মোহ যে মননের কত বড়ো সর্বনাশ করলো এই খবর কি পৃথিবী জানে? মননের যে একটা অপ্রেমের গল্প আছে সেটা কি পৃথিবী জানে?

বুক ব্যথা করার মতো একটা গল্পের কি এখানেই শেষ হলো? হয়তো না। কেবিন ক্লিন করতে আসা একজন স্টাফ হঠাৎ টেবিলের ড্রয়ারে একটা ডায়েরি খুঁজে পেলো। ডায়েরিটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল সে। কেবিনে উপস্থিত মননের দৃষ্টি এড়ায় না তা। ক্লান্ত স্বরে বলে,

“ কি ওটা? “

“ জানি না স্যার। পেশেন্টের জিনিস হয়তো। উনার পরিবারের মানুষরা হয়তো এটা নিতে ভুলে গিয়েছে। “

“ এখানে নিয়ে এসো। “

স্টাফ এসে ডায়েরিটা মননের হাতে দিয়ে চলে যায়। মনন বেশ কিছুক্ষণ ডায়েরিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অত:পর ধীর গতিতে ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় নীল কলমের কালি দ্বারা লেখা একটা নাম চোখে পড়ে তার।

“ মোহ। “

সমাপ্ত…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৯

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৯.

মোহ এবং মননের জীবনের দিন গুলো কেটে যেতে থাকলো হসপিটাল, ফোনালাপ আর বিভিন্ন জল্পনা কল্পনায় ডুবে। ক্যালেন্ডারের তারিখ আজ ১৪ ই সেপ্টেম্বর। সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে আজ। থামাথামির কোনো নাম গন্ধ নেই। তার উপর সকাল সকাল খুব কাছেই কোথাও জোরে বজ্রপাত হয়ে বাসার কারেন্ট নাই হয়ে গিয়েছে।

শীতল আবহাওয়ায় মোহর গায়ে কাটা দিচ্ছে। সেই ঠান্ডা ভাব দূর করতে এখন পর্যন্ত দু গ্লাস গরম দুধ খেয়ে ফেলেছে সে। এখন বসে বসে খেজুর খাচ্ছে। আজকে তার ব্লাড টেস্ট আছে। ব্লাড কাউন্ট নরমাল আসাটা জরুরী। না-হয় আবার তার কেমোর ডেট পিছানো হবে।

মেয়েকে নিজ গরজে এটা সেটা খেতে দেখে শিহান কিছুটা স্বস্তি পায়। এটাই তো চায় সে। মেয়ে দুটো ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করুক, সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক।

__________

আজকে মননের সকাল সকাল হসপিটালে যাওয়া হয় নি আর। হাফ ডে এর ছুটি নিয়েছে। এর পিছনে অবশ্য কারণও আছে। তার এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় আজ তাদের বাসায় আসবে বলে জানিয়েছেন। ভদ্রলোক সদ্য হজ্জ করে দেশে ফিরেছেন। দেশে ফিরে উনি একে একে সকল আত্মীয়র বাসাতেই যাচ্ছেন দেখা করতে।

কায়সার পরিবারের সকল পুরুষরাই তাই আজ বাসায় উপস্থিত। টুনির মা-ও সকাল থেকে অতিথির জন্য বিভিন্ন পদের রান্না সেড়ে রেখে গিয়েছেন। এখন কেবল অতিথির অপেক্ষা।

মেহমান এলেন দুপুর বারোটা নাগাদ। লিভিং রুমটা পুরুষদের আলাপে জমে উঠলো। মনন অবশ্য বড়োদের মাঝে নীরব শ্রোতা কেবল। তাকে শুধু যতটুকু প্রশ্ন করা হচ্ছে তার বিপরীতে জবাব দিচ্ছে সে। তবে এই চুপচাপ বসে থাকা মননের কান খাড়া হয় ভদ্রলোকের কথায়।

ভদ্রলোক একটা ব্যাগ মননের দাদুর হাতে তুলে দিয়ে বলে,

“ আংকেল, হজ্জ থেকে ফেরার সময় সবার জন্যই খুব সামান্য কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি আমি। এখানে আপনাদের জন্য জায়নামাজ, খেজুর এবং জমজম কূপের পানি রয়েছে। আপনি কবুল করলে খুশি হবো। “

মননের দাদু আলী আকবর সাহেব উপহার পেয়ে আপ্লুত হলেন। দোয়া করে দিলেন,

“ আল্লাহ তোমার হজ্জ কবুল করুক। “

মননের মনোযোগ আটকে রইলো কেবল ব্যাগের ভেতর থাকা জমজম কূপের পানির বোতলের প্রতি। এই খাস পানিতে বিশেষ রহমত আছে বলে জানে মনন। সুস্থতার নিয়ত করে এই পানি পান করলে আল্লাহ পাক বান্দার নিয়ত কবুলও করে নেন অনেকসময়। সুতরাং এই পানির তাদের থেকেও বেশি আরেকজনের প্রয়োজন। মনন সুযোগের অপেক্ষায় রইলো। সবাই যখন খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত মনন সে-ই সুযোগে ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা সকলের আড়ালে লুকিয়ে ফেললো।

__________

আজকে মোহ শায়লা আন্টির সঙ্গে হসপিটালে এসেছে। যদিও শিহানের আসার কথা ছিলো, কিন্তু একটা জরুরী মিটিং পড়ে যাওয়ায় তার আসা সম্ভব হয় নি। অপরদিকে মায়ারও পরীক্ষা সামনে, তা-ই তার পড়া আছে বলে বাসায় দাদুর কাছে রয়ে গিয়েছে।

সকল টেস্ট করিয়ে মোহ রিপোর্টের অপেক্ষায় আছে। রিপোর্ট এলে ডক্টরের কাছে যাবে সে। ততক্ষণ সে শায়লাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হসপিটালের বিভিন্ন জায়গা চেনাচ্ছে। এই প্রথম ক্যান্সার হসপিটালে এলো শায়লা। অবাক চোখে সে চারিদিকে তাকাচ্ছে। হসপিটাল নয় বরং এখানকার পেশেন্টদের দেখছে সে। প্রত্যেককে দেখতে তাদের মোহর মতো লাগছে। কি করুণ জীবনযুদ্ধের সাক্ষী এই হসপিটালটা ভাবতেই শায়লার মন খারাপ হয়। মনে মনে প্রার্থনা করে, রাব্বুল আল আমিন যেনো প্রত্যেককে এই যুদ্ধে জয়ী করে দেয়।

ঘুরতে ঘুরতে ক্যাফেটেরিয়াতে এসে বসে দু’জন। মোহ শায়লার জন্য কফি অর্ডার দিয়ে নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মননকে ম্যাসেজ দেয়,

“ কি করছেন? “

বেশ কিছুক্ষণ পরে রিপ্লাই আসে,

“ ওপিডিতে আছি। আপনি কি করছেন? রিপোর্ট দেখানো হয়েছে? “

“ উঁহু। কেবল টেস্ট করিয়ে আসলাম। রিপোর্ট পেতে আরো ঘন্টা খানেক লাগবে। আন্টি সাথে এসেছেন আজ। উনার সাথে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে আছি। “

মিনিট পাঁচেক পরে রিপ্লাই আসে,

“ মোহ? ছাদে আসতে পারবেন কিছুক্ষণের জন্য? আমি কিছুক্ষণের জন্য সময় বের করে নিচ্ছি। “

মোহকে ভাবুক দেখা গেলো। সে একবার আড়চোখে শায়লার দিকে তাকায়। শায়লা তখন কফি খেতে খেতে চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে। মোহ মননকে রিপ্লাই দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আন্টি আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি। তুমি এখানেই বসো। কোথাও যেও না। “

শায়লাও উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ আমিও তোমার সাথে যাবো। “

“ ওয়াশরুমে আমার সাথে গিয়ে কি করবে তুমি? আমি বড়ো হয়েছি তো! একা ওয়াশরুমে যেতে অসুবিধা নেই কোনো। তুমি এখানেই বসো। কফি খাও। “

বলে মোহ শায়লাকে বুঝ দিয়ে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে আসে। কোনো মতে লুকিয়ে লিফটের কাছে চলে যায়। মনে তার প্রশ্ন জাগে ডক্টর হঠাৎ দেখা করতে চাইলো কেনো?

__________

পরিবেশটা থমথমে, নিশ্চুপ। বৃষ্টি থেমেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। ছাদের মেঝেতে বৃষ্টির পানি জমে আছে। সেই পানির উপর ধীরে সুস্থে পা ফেলে হাঁটছে মনন। হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো মোহকে। হাসলো মনন। এগিয়ে গিয়ে বলে,

“ মা শা আল্লাহ। খুব খুশি মনে হচ্ছে আপনাকে। সামথিং হ্যাপেন্ড? “

মোহ বলতে আগ্রহী ছিলো। মনন প্রশ্ন করতেই সে সঙ্গে সঙ্গে বলা শুরু করে,

“ জানেন? লিফটে আছে না? আমার সামনে একটা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে ছিল। উনার কোলে একটা এত্তো কিউট ছেলে বাচ্চা ছিলো। হয়তো এক দু বছর বয়স হবে। আমার দিকে তাকিয়ে গাল ভেঙে হাসছিলো। পুরাই কুচিপুচিপু একটা! রসগোল্লার মতো খেয়ে ফেলতে মন চাচ্ছিলো আমার। “

মনন লক্ষ্য করলো কথা বলতে বলতে মোহও গাল ভেঙে হাসছে। মননের জানা নেই ওই বাচ্চাটার হাসি কেমন ছিলো দেখতে, তবে মোহর হাসির ধরণ দেখে সে ধারণা করে নিলো একটা। মনের কোণে একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলেকে কল্পনা করলো। যার হাসিটা হুবুহু একদম মোহর মতো। মোহ আর তার বিয়ে হলে তাদের ছেলেও কি দেখতে এরকম হবে? নিজের অবান্তর ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে মনন মৃদু হেসে প্রশ্ন করে,

“ বাচ্চা পছন্দ আপনার? “

“ না। খুব পছন্দও না আবার অপছন্দও না। কিন্তু সাধারণত বাচ্চারা আমার দিকে তাকিয়ে এভাবে হাসে না কখনো। তাই ব্যাপারটা খুব মজার লেগেছে। আমি ফেরত হাসার পরে ছেলেটা লজ্জা পেয়ে মায়ের কাধে মুখ গুজে আবার হাসতে থাকে। “

মোহর কণ্ঠে আনন্দে ঠিকরে পড়ছে। মনন না চাইতেও হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। আজকে অলরেডি সে দুপুরের পর থেকে শিফট শুরু করেছে। তার উপর এখন আবার কিছুক্ষণের জন্য ব্রেক নিয়ে এলো। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে এসব ব্যাপার সিনিয়রদের কানে পৌঁছাবে। সেটা হবে আরেক উটকো ঝামেলা। তাই মনন বেশি কথা না বাড়িয়ে সরাসরি নিজের হাতের পানির বোতলটা মোহর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ রাখুন। “

মোহ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়,

“ পানি দিয়ে কি করবো? “

“ জমজম কূপের পানি এটা। সুস্থতার নিয়ত করে বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে নিবেন। আমরা ডাক্তাররা তো শুধুমাত্র উছিলা, সুস্থতার নিশ্চয়তা সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। “

মোহ অবাক হলো। মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে এরকম কিছু সে আশা করে নি। অপ্রস্তুত গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমার জন্য? “

“ হ্যাঁ, আপনার জন্যই। “

মোহ কিছুক্ষণ থম মেরে মননের দিকে তাকিয়ে রইলো। বুঝে উঠতে পারলো না তার আর মননের মাঝে না থাকা সম্পর্কটা এতো গভীর কবে হলো? নিজের সতেরো বছরের এই জীবনে এতো চমৎকার কোনো উপহার কি মোহ কখনো পেয়েছিল? উঁহু। কেউ দেয় নি এরকম উপহার।

অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি এসে যেমন শহরটাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়, ঠিক সেরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই মোহ উপলব্ধি করলো এই লোকটার তার প্রতি শুধু মায়া নেই। আরও কিছু আছে এই লোকের মনে। গভীর কিছু, অদৃশ্য কিছু।

মনন মৃদুস্বরে ডাকে,

“ মোহ? “

মোহ হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিলো। অত:পর কিছু না বলে নীরবেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো। মনন অবাক হয়। পিছু ডাকে। মোহ ফিরে তাকায় না। মনন দ্বিধায় পড়ে যায়। সে কি ভুল কিছু করেছে? মোহ কি তার কোনো আচরণে কষ্ট পেলো? মনন বুঝতে পারে না সে কি করেছে। তবে মনে মনে দোয়া করে যেনো তার দ্বারা এই মেয়েটা কখনো কষ্ট না পাক।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৮

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৮.

বাসার কলিংবেলটা অবিরতভাবে বেজে চলেছে। আলী আকবর কায়সারের চোখে মুখে বিরক্তি ভাব স্পষ্ট। এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। গাধার বাচ্চার ঘরে একমাত্র বাচ্চাটা দরজা না খুলে কোথায় উধাও হয়ে গেলো হুট করে? আলী আকবর কায়সার দরজায় করাঘাত করতে নিবে ঠিক সে-সময় হাট করে দরজাটা খুলে যায়। মুখে চওড়া হাসি ঝুলিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মনন। দাদুকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আরে দাদু! তুমি? হসপিটাল থেকে আজকে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলে? কিছু ভুলে গিয়েছো? তোমার কষ্ট করে ভেতরে আসতে হবে না, আমাকে বলো আমি খুঁজে এনে দিচ্ছি। “

আলী আকবর কায়সার নিজের অভিজ্ঞ দৃষ্টি দিয়ে নাতিকে পরখ করেন। মনন নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে যায়। আলী আকবর সাহেবের সন্দেহজনক লাগে ব্যাপারটা। উনি মননকে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে করতে বলে,

“ অযথা ছাগলের মতো হাসছো কেন? “

মনন নিজের চুরি লুকাতে অতিশয় ব্যস্ত। সে না চাইতেও আরো একদফা হেসে বলে,

“ হাসছি? আমি কি হাসছি? ওহ! আমার মুখটাই আসলে হাসি-হাসি টাইপ। তাই তোমার মনে হচ্ছে আমি হাসছি। “

আলী আকবর কায়সার আবারও সূক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে নাতিকে পরখ করেন। তিনি এবার ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়িটা একবার দেখতে থাকেন। উনার মন বলছে মনন কিছু একটা লুকাচ্ছে উনার থেকে। দাদুকে এভাবে গোয়েন্দাদের মতো অনুসন্ধান করতে দেখে মননের কপাল থেকে ঘাম ছুটে যায়। শরীর অসাড় লাগে। ভয়ে মনে হচ্ছে আরো এক দফা জ্বর এসে পরবে।

মননের আতংক তীব্র হয় যখন আলী আকবর কায়সার তার রুমের দিকে পা বাড়ায়। মনন দৌড়ে গিয়ে নিজের রুমের বদ্ধ দরজার সামনে দু-হাত মেলে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আতংকিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমার রুমে তোমার কি কাজ? “

আলী আকবর সাহেবের মনে হয় উনি সঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছেন। মননের এই অস্বাভাবিক আচরণই প্রমাণ দেয় যে সে কিছু একটা লুকাচ্ছে। আলী আকবর সাহেবের ধারণা তিনি মননের রুমে প্রবেশ করলেই হাতেনাতে কিছু একটা ধরতে পারবেন। কি হতে পারে সেটা? বৃত্তের মাঝে ওই নাম না জানা মেয়েটার চুল আর কালো জাদুর আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র?

আলী আকবর সাহেব এবার গম্ভীর স্বরে সরাসরি প্রশ্ন করে,

“ কি লুকাচ্ছো তুমি? “

মনন বুঝে যায় আর দুই মিনিট সে সত্যিটা লুকানোর চেষ্টা করলে যেকোনো ভাবে ধরা পড়েই যাবে। তাই সেই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সে কথা ঘুরিয়ে এক অকল্পনীয় কাজ করে ফেলে। নিজের দাদুকে জড়িয়ে ধরে উনার রুমের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ দাদু তোমার এখন আগে গোসল করা উচিত। তোমার শরীর থেকে হসপিটালের গন্ধ আসছে। মেডিসিনের গন্ধে আমার মাথা ব্যথা করছে। তাড়াতাড়ি যাও তুমি। আগে গোসল করো, পরে সব কথা হবে। “

বলতে বলতে মনন আলী আকবর সাহেবেকে ঠেলে উনার রুমে পাঠিয়ে দ্রুত দরজা বাহির থেকে আটকে দেয়। সাথে সাথে ভেতর থেকে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে আলী আকবর সাহেব। চিল্লিয়ে বলতে থাকে,

“ মনন! অসভ্যের বাচ্চা কি লুকাচ্ছো তুমি? কোন মিথ্যা পর্দা দিয়ে ঢাকতে চাচ্ছো তুমি… “

আলী আকবর সাহেবের চেঁচামেচিকে খুব একটা পাত্তা দেয় না মনন। পরে না-হয় সে কিছু একটা বলে দাদুকে সামলে নিবে। আপাতত মোহকে নিয়ে বের হওয়াটা বেশি জরুরী।

মনন দ্রুত গিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলতেই দেখতে পায় বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মোহকে। রুমের ভেতর থেকে এতক্ষণ সে মননের সব মদন মার্কা কথাবার্তা শুনেছে। মননকে দেখতেই সে ফুঁসে উঠে বলে,

“ এতো থার্ড ক্লাস আর বাকওয়াস এক্টিং করেন আপনি! জীবনে কখনো মিথ্যা টিথ্যা বলেন নি? আপনার কথা শুনে তো একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও বুঝে যাবে যে ডাল মে কুছ কালা নেহি বরং পুরো ডালই কালা। “

মনন তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ এখন তাড়াতাড়ি চলুন। আপনাকে আগে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। বাসায় ফিরে আমার আরেক তুফান সামলাতে হবে। “

বলে মনন দ্রুত মোহর হাত ধরে টেনে রুম থেকে বের হয়। চোরের মতো তাড়াতাড়ি জুতো পড়ে দরজা লক করে লিফটের সামনে গিয়ে হাজির হতেই লিফটের দরজা খুলে যায়। মনন পা বাড়াতে নিয়েও হঠাৎ থেমে যায়। লিফটের ভেতর থেকে এক জোড়া বিস্ফোরিত দৃষ্টি তাকে দেখছে অবাক হয়ে। মনন অপ্রস্তুত বোধ করে। মনে মনে ভাবে আজ সকালে উঠে সর্বপ্রথম কার মুখ দেখেছিল সে? মননের মনে পড়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে সর্বপ্রথম টুনির মা’কে দেখেছিল। টুনির মা! ওই মহিলাটাই তাহলে কুফা! উনার কারণে আজ মননের দিনটা খারাপ যাচ্ছে এতো।

মননকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে মোহ তাড়া দেয়,

“ কি ব্যাপার? সমস্যা কি? খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে পড়েছেন কেনো? তাড়াতাড়ি চলুন। আপনার দাদু এনিটাইম দরজা ভেঙে বেরিয়ে যাবে। “

লিফটের ভেতর হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আরিফ সাহেব এবার ছেলের থেকে চোখ ফিরিয়ে মোহকে লক্ষ্য করে। লক্ষ্য করে মননের মোহর হাত ধরে রাখার ব্যাপারটাও। মনন কিছুটা অপরাধীর ন্যায় বলে,

“ আব্বু তুমি যা ভাবছো সেরকম কিছু না। উনি আমার পেশেন্ট। আমাদের মধ্যে কিছু নেই। “

আরিফ সাহেব লিফট থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে কেবল থমথমে গলায় বলে,

“ ওহ আচ্ছা। তুমি যে আজকাল বড়ো বাচ্চাদের উপরও ডাক্তারি করছো তা আমার জানা ছিলো না। হয়তো আমাকে বলতে ভুলে গিয়েছো। “

পুরো ব্যাপারটা বুঝতেই মোহ নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বিশ্লেষণ দেওয়ার মতো করে বলে উঠে,

“ আংকেল আসলেই আমাদের মাঝে কিছু নেই। আপনার ছেলের চেহারা দেখুন। আপনার মনে হয় এই কনফিডেন্স, আই-কিউ আর হিউমার নিয়ে উনার জীবনে প্রেম হবে? “

মনন নিজের ইজ্জত নিলামে উঠার আগেই মোহকে টেনে নিয়ে লিফটে উঠে পড়ে। দ্রুত গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটন চেপে দিয়ে নিজের আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আব্বু, আমি এসে তোমাকে সব বুঝাচ্ছি। আরেকটা কথা, প্লিজ দাদুকে এই ব্যাপারে কিছু বলো না। দাদুকে ক বললে দাদু চন্দ্র বিন্দু বুঝবে। “

লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আরিফ সাহেব আপন জায়গায় কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। অনুভব করলো উনি ঘামছেন। ছেলের এই নতুন রূপ উনার বোধহয় জ্বর এনে তবেই ক্ষান্ত হবে।

__________

মোহকে নিজ বাসায় পৌঁছে দিয়ে ঘন্টা খানিক পরে বাসায় ফিরলো মনন। তবে বাসার দরজার কাছে এসেই থেমে গেলো সে। ভেতরে প্রবেশ করার সাহস খুঁজে পাচ্ছে না সে। কি বলবে সে? ধ্যাৎ! মনন মনে মনে বিপদের যাবতীয় সকল দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে নিলো। নিজেকে শাসালো,

“ তুই একটা এডাল্ট মনন। এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ভয় পাওয়া তোকে মানায় না। বি এ ম্যান। ইউ ক্যান হ্যান্ডেল ইট। কাম ওন! “

মনে মনে নিজেকে সাহস জুগিয়ে মনন দরজার নব ঘুরালো। দরজা লক করা ছিলো না। তাই সে সহজেই প্রবেশ করতে পারলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বাসাটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই।

মননের মনে হলো এটাকেই বোধহয় ঝড়ের আগের নীরবতা বলে। সে পা টিপে টিপে একবার নিজের আব্বুর রুমে উঁকি দিলো। আব্বু রুমে নেই। বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। সম্ভবত গোসল করছেন। মনন এবার উঁকি দিলো নিজের দাদুর রুমের দিকে। দাদু থম মেরে বিছানায় বসে আছে।

মনন আরেক দফা বুকে ফুঁ দিয়ে রুমে পা রাখলো। আলী আকবর সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে নমনীয় স্বরে ডাকে,

“ দাদু। “

আলী আকবর সাহেব চোখ তুলে তাকায় না। মনন বুঝে উঠতে পারে না তার কি বলা উচিত। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে সে বলে,

“ দাদু আমি আসলে একজনের জন্য গিফট রেডি করছিলাম। রুমে ঢুকে পড়লে তুমি ওটা দেখে ফেলতে তাই ওরকম করেছি। আমি কোনো খারাপ কাজ করছিলাম না বিশ্বাস করো। “

আলী আকবর কায়সার এবার সরাসরি মননের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আমি কখন বললাম তুমি খারাপ কাজ করছিলে? “

মনন নিজের প্রতি বিরক্ত হয়। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস বাংক না করে মস্ত বড়ো ভুল করেছে সে। অন্তত মিথ্যেটা তাহলে আজ ঠিকঠাক বলতে পারতো। আলী আকবর সাহেব আর জবাবের অপেক্ষা করেও না। বরং ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ আমি আর এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করবো না। তবে এটা স্পষ্ট যে তুমি কিছু লুকাচ্ছো। আমি আশা করবো সেটা যা-ই হোক, তোমার জন্য যেনো মঙ্গলকর হয়। “

মনন এবার কিছুটা আনমনে বলে বসে,

“ ট্রাস্ট মি দাদু, যা লুকাচ্ছি তা নিজেই একদিন তোমাদের জানিয়ে দিবো। আর সেটা খুব চমৎকার কিছু। এর থেকে ভালো কিছু নেভার হ্যাপেন্ড টু মি। “

__________

দাদুর সঙ্গে ব্যাপারটা মিটমাট করে নিয়ে এবার আরিফ কায়সারের কাছে হাজির হয় মনন। ভদ্রলোক কেবল গোসল সেড়ে বেরিয়েছেন। ছেলেকে রুমে দেখেও না দেখার ভান করলেন তিনি। মনন সেধে কথা শুরু করে,

“ বাবা। সত্যিই ওর সাথে আমার কিছু নেই। ট্রাস্ট মি ও জাস্ট আমাকে একটা গিফট দিতে এসেছিলো। “

আরিফ সাহেব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে হেয়ার ব্রাশ চালাতে চালাতে জবাব দেয়,

“ তোমাদের মাঝে কিছু নেই এটা মেয়েটার কথা শুনেই আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি। ও বেশ কনফিডেন্টলি এটা স্বীকার করেছে। কিন্তু ওর প্রতি তোমার মনে কিছু নেই এই ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। আমি নিজেও তোমার আম্মুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। তুমি ওর হাত ঠিক সেভাবে ধরেছিলে যেভাবে এককালে আমি তোমার আম্মুর হাত ধরতাম। “

মনন জানে এই সব ব্যাপার সে তার ঘরের পুরুষদের থেকে বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তার বাপ, দাদা এসব ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞ। তাই সে নিজের দিকটা না লুকিয়ে স্বীকার করে,

“ অস্বীকার করবো না, আই রিয়েলি ডু হ্যাভ ফিলিংস ফর হার। “

আরিফ সাহেবের বুক হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে এই ভয়টাই কাজ করছিলো তার। ছেলের দিকে তাকিয়ে উনি প্রশ্ন করে,

“ ও কি অসুস্থ? “

“ হ্যাঁ। কিন্তু ও সুস্থ হয়ে যাবে। তোমার ধারণা নেই ও কতটা ব্রেভ। “

আরিফ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনের উপর কারো জোর নেই। মননেরও নেই। তবে উনি চায় না উনার ছেলে কষ্ট পাক। তাই এগিয়ে গিয়ে ছেলের কাধে হাত রেখে বলে,

“ ইউ হ্যাভ টু মেক শিওর ও যেনো সুস্থ হয়। ডু এভ্রিথিং টু কিপ হার এলাইভ। আমি আমার ছেলেকে কষ্ট পেতে দেখতে চাই না। “

মনন কিছুটা ভরসা খুঁজে পায়। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে,

“ ও সুস্থ হবে। অবশ্যই হবে। তোমাকে আর দাদুকে ওর বাসায়ও যেতে হবে। এই সংসারে কেউ আসুক তোমরা চাও না? মোহই আসবে। “

আরিফ সাহেব জবাব না দিয়ে কেবল হাসে। মননের মতো এতো আত্মবিশ্বাস উনার মাঝে নেই। ছেলে তার খুব সিরিয়াস মেয়েটার ব্যাপারে। কিন্তু মেয়েটার অসুস্থতাটা কোন পর্যায়ে আছে কে জানে! মনের ভয়টা ছেলের সামনে আর প্রকাশ করেন না তিনি।

__________

বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে বয়ে আসা বাতাসে রুমের সফেদ পর্দা গুলো উড়ছে। মনন রুমে প্রবেশ করতেই সেই শীতল বাতাস এসে তার গায়ে ধাক্কা খেলো। মনন এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে। তবে দরজা লাগাতে নয়, বরং বারান্দায় রাখা ছোট চারাগাছটা দেখতে।

বারান্দায় গিয়ে চারাগাছটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মনন। হাত বাড়িয়ে আলতো ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দেয় ছোট ছোট পাতা গুলোকে। মনে পড়ে যায় মোহকে দেওয়া ফুলের কথা। সে তো কেবল ফুল দিয়েছে, আর এই মেয়ে সোজা ফুলের গাছ দিয়ে গেলো তাকে।

ব্যাপারটা অবশ্য অর্থবহ লাগে মননের কাছে। গাছহীন ফুলের যত্ন নিলেও সেটা মরে যায়। কিন্তু ফুল গাছের যত্ন ঠিকঠাক ভাবে নিলে সেটা কখনো মরে না। বরং প্রতি বছর ঋতু এলে সেই যত্নের বিনিময়ে দেয় অজস্র ফুল।

মনন হেসে উঠে রুমে ফিরে আসে। মনে মনে ঠিক করে আজ বিকেলেই গিয়ে একটা নতুন টব কিনে নিয়ে আসবে সে চারাগাছটার জন্য। একটা সুন্দর টব। ভাবতে ভাবতে টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই মনন দেখে জুসের মগটা। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তখন সে এই মগটা সহ মোহকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

মনন এগিয়ে গিয়ে দেখে মগটা খালি। অর্থাৎ মোহ একা রুমে বসে জুসটুকু খেয়েছিল। মনন মগটা হাতে তুলে নিতেই দেখে সেটার নিচে একটা চিরকুট ভাজ করা। মনন কিছুটা অবাক হয়। চিরকুটটা হাতে তুলে নিয়ে ভাজ খুলতেই দেখে সেখানে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,

“ টেস্ট খারাপ না। রেটিংস ৭/১০। তিন পয়েন্ট কাটলাম কারণ আমার মাল্টা পছন্দ না। “

মনন চিরকুটটা পড়ে হেসে দেয়। অর্থাৎ সাত পয়েন্টটা একান্তই মননের। মগটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিয়েও আর বের হলো না সে। এই মগটা ক’দিন আগে ইতালি থেকে আসার সময় নিজের জন্য নিয়ে এসেছিল দাদু। এখনো যদিও এটা ব্যবহার করা হয় নি। তখন বেখায়েলিতে মনন এই মগেই জুস সার্ভ করে দেয় মোহকে। এখন এই মগটা ফেরত জায়গায় রেখে আসলে ক’দিনের মধ্যেই দাদু এটা ইউজ করা শুরু করবে। মননের ইচ্ছে হলো না মোহর ব্যবহার করা মগটা দাদুর জন্য তুলে রাখতে। তাই সে এটাকে ওয়াশরুমে নিয়ে ধুয়ে নিজের রুমেই গোপন বাক্সে পাচার করে দিলো। সেই সঙ্গে চিরকুটটাকেও।

__________

বাতাসে উড়তে থাকা চুলগুলোর প্রতি বিরক্ত হয়ে সেগুলোকে হাত খোপা করতে নিলো মোহ। কিন্তু হঠাৎ কারো বাঁধায় তার হাত থেমে যায়। কানের কাছে কেউ ফিসফিসিয়ে বলছে,

“ খবরদার চুল আটকাবে না। “

মোহর রাগ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রাগ হলো না। বরং চমৎকার করে হাসলো। তার পিছনে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার নৈকট্য বেশ উপভোগ করছে সে। মানুষটার চোখে মুখে প্রেমময় ঘোর লেপ্টে আছে। ঠোঁটের কোণে হাসি।

মোহ এবার পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায় মানুষটার দিকে। হেসে বলে,

“ চাঁদ দেখার নাম করে বারান্দায় ডেকে এনে অযথা দাঁড় করিয়ে রেখেছো। কোনো চাঁদ ফাঁদ দেখছো না তুমি। শুধু আমাকে বিরক্ত করছো। “

পুরুষটা ঘোর লাগা গলায় বলে,

“ কে বললো চাঁদ দেখছি না? “

কথার অর্থ বুঝতে পেয়ে মোহ লাজুক হাসলো। টের পেলো আরো নৈকট্যতা। মানুষটা যখন তার অধর ছুঁই ছুঁই পর্যায়ে ঠিক সেই সময় চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হয়ে গেলো। মোহ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ঘামছে সে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলছে। মননকে ঘিরে এমন একটা নির্লজ্জ স্বপ্ন দেখার অপরাধে লজ্জায় চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকলো বেশ কতক্ষণ। মনে মনে সবটুকু দোষ নিয়ে ফেললো কে ড্রামার উপর। ঘুমানোর পূর্বে একটা ড্রামা দেখছিল সে। সেই ড্রামায় নায়কের নায়িকাকে চুমু খাওয়ার দৃশ্যটার প্রভাবই বোধহয় তার মস্তিষ্কে পড়েছে। না-হয় এতো বাজে একটা স্বপ্ন কেউ দেখে না-কি? মোহ মনে মনে ঠিক করলো সে আর এসব ড্রামা ট্রামা দেখবে না। দিনদিন তার মস্তিষ্ক লাটে উঠছে খুব। ড্রামা না দেখার সিদ্ধান্তটা নিতেই মোহর মনে প্রশ্ন জাগলো, স্বপ্নের এরকম একটা পরিস্থিতিতে সে নিজেকে মননের সঙ্গেই কেন আবিষ্কার করলো?

চলবে…

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৭

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৭.

মননের চিন্তার অবসান ঘটে মধ্যরাতে। বন্ধ নাম্বারটা অন হতেই এবার কলটা পৌঁছায়। বেশ সময় নিয়েই কলটা রিসিভ হয়। নিদ্রাচ্ছন্ন মেয়েলি স্বরটা আওড়ায়,

“ হ্যালো। “

“ মোহ? ঠিক আছেন আপনি? সন্ধ্যা থেকে আপনার ফোন অফ কেন? “

মোহ ঘুম ঘুম স্বরেই জানায় বিকাল থেকে তাদের বাসায় কারেন্ট ছিলো না। জেনারেটরও অফ ছিলো। কারেন্টের কাজ করতে এসেছিলো কয়েকজন। কারেন্ট না থাকা অবস্থায় গেমস খেলে মোহ নিজের ফোনের চার্জ শেষ করে ফেলেছিল। তা-ই ফোনটা ফোনটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

মনন যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মনের আকাশ হতে দুঃশ্চিন্তা দূর হতেই নিশ্চিন্তে বলে,

“ আচ্ছা। অসুবিধা নেই। আপনি ঘুমান এখন। পরে কথা হবে। গুড নাইট। “

মোহও হাই তুলতে তুলতে শুভ রাত্রি জানিয়ে কলটা কেটে দেয়। মনন থম মেরে বিছানায় বসে থাকে। তার জ্বর পুরোপুরি কেটে গিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। তবে এতক্ষণ যে তার মস্তিষ্কে কত ধরনের দুঃশ্চিন্তা ঘুরপাক খেয়েছে তা শুধুমাত্র সে-ই জানে। এই দুঃশ্চিন্তার কি কোনো ইতি নেই?

__________

একটা লম্বা এবং গভীর ঘুম দিয়ে ওঠায় আজকে সকাল থেকেই মোহর শরীর অনেকটা ফুরফুরে লাগছে। নাস্তা সেড়ে সে আপন মনে পুরো ঘর ঘুরতে ঘুরতে উঠোনে বের হয়। দেখতে পায় শায়লা আন্টিকে। উঠোনের এক কোণায় বেশ কয়েকটি খালি টবে মাটি এবং সার ভরছেন। মোহ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে,

“ ফুল গাছের চারা এনেছো আন্টি? “

শায়লা মোহকে টবের পাশে রাখা চারা গাছগুলো দেখিয়ে বলে,

“ হ্যাঁ। শীতকাল আসছে সামনে। তাই শীতকালীন ফুলের চারা নিয়ে এসেছি নার্সারি থেকে। এখন সার দিয়ে যত্ন করলে বছর শেষে দেখবে টব ভর্তি ফুল থাকবে। “

“ কি কি ফুলের চারা আছে এখানে? “

“ সাদা আর হলুদ রঙের গোলাপের চারা আছে, সাদা রঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুলের চারা আছে, জিনিয়া আর কসমস ফুলেরও চারা আছে। “

মোহ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চারা গাছগুলো দেখে। মনে মনে কিছু একটা ভাবে সে। মায়া বা শিহান কেউ-ই এসময় বাসায় নেই। শিহানের বাড়ি ফিরতে হয়তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে আর মায়ারও বিকেলের আগে বাসায় ফেরার সুযোগ নেই। মোহ সুযোগটা কাজে লাগায়।

কিছু একটা ভেবে শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আন্টি, চন্দ্রমল্লিকা ফুলটা আমার জন্য আলাদা করে রেখো। “

শায়লা হেসে জিজ্ঞেস করে,

“ তোমার বারান্দায় লাগিয়ে দিবো ওটা? “

“ উঁহু। একজনকে উপহার দিবো। এখুনি রেডি হয়ে বের হবো। “

শায়লা অবাক হয়। জানতে চায়,

“ বের হবে মানে? কোথায় যাবে? তোমার বাবা জানে? “

“ বাবা আর মায়া বাসায় নেই। ওদের অযথা বিরক্ত করতে হবে না। আমি গিয়ে দুপুরের আগেই চলে আসবো। “

“ অসম্ভব। তোমার বাবা তোমাকে এক সেকেন্ডের জন্যও একা ছাড়তে নিষেধ করেছে। আমি অনুমতি দিতে পারবো না। “

মোহ কিছুটা আহ্লাদ করে শায়লার গলা জড়িয়ে দিয়ে বলে,

“ প্লিজ আন্টি! পারমিশন দাও না! বাবা অথবা মায়াকে জানানোর প্রয়োজন নেই। আমি উবার নিয়ে জাস্ট যাবো এন্ড আসবো। তোমাকে পাঁচ মিনিট পর পর কল দিয়ে নিজের আপডেট জানিয়ে দিবো। তোমরা সবাই যদি আমাকে এভাবে অসুস্থর মতো ট্রিট করে ঘর বন্দী করে রাখো তাহলে কখনোই সুস্থ হবো না আমি। এইটুকু স্বাধীনতা তো আমি ডিজার্ভ করি। আই প্রমিজ আমাকে যা খেতে দিবে আমি তা-ই খাবো। দিনে চার থেকে পাঁচ লিটার পানিও খাবো। “

মোহর জোরাজুরিতে বেশিক্ষণ কঠোর থাকতে পারে না শায়লা। শেষমেশ রাজি হয়। তবে মোহকে সতর্ক করে দেয়,

“ কথার বরখেলাপ করবে না কিন্তু। একটু পরপর কল করে আমাকে আপডেট জানাবে। আর তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে। “

“ ওকিই। “

__________

আজ বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে মনন। জ্বরের কারণে আজকের দিনটাও হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়েছে সে। জ্বরটা এখন না থাকলেও শরীর অনেকটা দূর্বল লাগছে তার। আলী আকবর সাহেব এবং আরিফ সাহেব ইতিমধ্যে যে যার কর্মস্থলে চলে গিয়েছে। বাসায় একা আছে কেবল মনন।

হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার টেবিলে বসে সে যখন পাউরুটিতে জ্যাম মাখাতে ব্যস্ত ঠিক সেইসময়ই তার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে মোহর নামটা দেখে মনন অবাক হয়। ওই ছাদের ঘটনার পর থেকে মোহ সাধারণত নিজ থেকে তাকে কখনো কল দেয় না বললেই চলে। হঠাৎ মননের মনে প্রশ্ন জাগে। সব ঠিক আছে তো? খাবার ফেলে মনন দ্রুত কল রিসিভ করে। সরাসরি প্রশ্ন করে,

“ ঠিক আছেন আপনি? “

মোহ কিছুটা অবাক হয়। পরমুহূর্তে জবাব দেয়,

“ হ্যাঁ। ঠিক আছি। আমার আবার কি হবে? “

“ হঠাৎ নিজ থেকে কল দিলেন তাই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। “

“ আপনি ব্যস্ত? হসপিটালে আছেন? “

“ না। বাসায় আমি। আজকে হসপিটাল থেকে ডে অফ নিয়েছি। “

“ কিছু মনে না করলে এখন দেখা করা সম্ভব হবে? “

মনন অপ্রস্তুত হলো। পরমুহূর্তে খুশি হলো। মোহ নিজ থেকে দেখা করতে চাইছে। ব্যাপারটা যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। মনন সামনে টেবিলে থাকা পাউরুটি এবং জ্যামকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে উঠে নিজের রুমে যেতে যেতে বলে,

“ হ্যাঁ। কোনো অসুবিধা নেই আমার। কোথায় দেখা করবেন? “

__________

পরিচিত নদীর ধারে বাঁশের পাটাতনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মোহ। ডান পাশে রাখা চন্দ্রমল্লিকা গাছের চারা। কানে ইয়ারফোন গুজে গান শুনতে শুনতে নদীর শীতল পানির ধারা পরখ করছে সে। মনন পৌঁছে দূর থেকেই লক্ষ্য করে মোহকে। হালকা জলপাই রঙের লং ফ্রক আর ন্যুড শেডের স্কার্ফ পড়েছে আজ। মননের ধারণা এই মেয়ের হয়তো হালকা রঙের প্রতি খুব ঝোক আছে। প্রায়ই যেসব জামা পড়ে সব হালকা রঙের হয়।

মননও আজ ফর্মাল গেটাপে আসে নি। বরং একটা সাধারণ সাদা টি শার্ট আর প্যান্ট পড়ে এসেছে। মোহর পাশে গিয়ে বসতেই মোহ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখলো। কোনো কথা না বলে এক কানের ইয়ারপ্লাগ খুলে মননের দিকে এগিয়ে দেয়। মনন নাকোচ করে না। নীরবে ইয়ার প্লাগটা নিজের কানে গুজে নদীর দিকে দৃষ্টি স্থির করে বসে থাকে।

ফোনে বাজছে ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইরুপশনের বিখ্যাত গান,

“ Gonna take a trip
To lonesome town,
Gonna stay at heartbreak hotel.
Oh, a fool such as I
( A fool such as I )
There never was
( Cry )
I cried a tear so well.
One way ticket,
One way ticket… “

গানটা মনন ইতিপূর্বে কখনো শুনে নি। তবে এই মুহুর্তে প্রতিটা লাইন গভীর মনযোগের সহিত শুনছে সে। অর্থবহ বেশ। মননের মনযোগে বিঘ্ন ঘটে মোহর প্রশ্নে,

“ কেনো দেখা করতে চেয়েছি জানতে চাইবেন না? “

মনন পাশ ফিরে তাকায়। ধীরেসুস্থে জবাব দেয়,

“ দেখা করতে চাওয়ার পিছনে কোনো কারণ আছে? বলুন তবে শুনি। অবশ্য কোনো কারণ না থাকলেও আমার অসুবিধা ছিলো না। “

মোহ কিছু একটা বলতে নেয়। তবে হুট করেই থেমে যায়। দ্রুত মাথা নুইয়ে অনেকটা মননের কাছাকাছি এসে নিজেকে লুকিয়ে নেয়। কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে,

“ শিট! শিট! শিট! “

মনন বিস্মিত হয়। প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে? “

“ মায়া আর শুভ্রর বাচ্চা এখানে কি করছে! এই দুই ছাগল প্রেম করার জন্য আর কোনো জায়গা পায় নি? আমাকে দেখে ফেললে আরেক কেলো হয়ে যাবে! “

“ আপনি বাসায় জানিয়ে আসেন নি? ”

“ উঁহু! শুধু আন্টিকে বলে এসেছি। বাবা আর মায়া জানলে জ্ঞানের আসর খুলে বসবে! “

বলতে বলতে মোহ মননের কাধের পাশ দিয়ে উঁকি মেরে মায়া আর শুভ্রর গতিবিধি লক্ষ্য করে। এদিকেই নদীর পাড় ধরে হাঁটছে দুটো। আর দুই মিনিট এখানে থাকলে মোহ নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবে! মোহর চোখে আতংক দেখে মনন বেশ মজা পেলো। মনে হচ্ছে যেনো প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে মোহ লুকোচুরি খেলছে। মনন নিজের অজান্তেই বলে বসে,

“ অন্য কোথাও চলবেন? যেখানে আপনি সেফ। ধরা পড়ার ভয় নেই। “

মোহর কণ্ঠে তাড়া,

“ হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি? ধরা খাওয়ার আগে দ্রুত চলুন এখান থেকে। “

__________

বসার ঘরে সোফায় সহজ ভঙ্গিতে বসে আছে মোহ। চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরে ঘুরে দেখছে গোছালো বাসাটা। রান্নাঘর থেকে মননকে দুটো মগ হাতে বেরিয়ে আসতে দেখেই সে চোখ নামিয়ে নেয়। মনন একটা মগ মোহর সামনে রেখে নিজে আরেকটা মগ হাতে সোফায় বসে পড়লো। মোহ তাকিয়ে দেখে মগ ভর্তি মাল্টার শরবত। সে ইতস্তত করে বলে,

“ ঝামেলা করার প্রয়োজন ছিল না কোনো। “

কথাটুকু বলেও মোহ মগটা ছুঁয়ে দেখে না। মনন লক্ষ্য করে তা। অত:পর হেসে বলে,

“ ভয় পাবেন না। জুসে কিছু মেশাই নি। সন্দেহ থাকলে আপনি জুসকে ইগনোর করুন। আমি কিছু মনে করবো না। “

মোহ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়,

“ সন্দেহ করছি না। আপনার চেহারা সন্দেহজনক না। উল্টো আপনাকে দেখে মনে হয় যে কেউ আপনাকে সহজে দশ বারো বার হাটে নিয়ে বেঁচে দিতে পারবে। “

মননের কপাল কুচকে আসে। মোহর দৃষ্টিতে তাকে দেখতে এতটা মদন মনে হয়? নিজের বেফাঁস কথায় মোহ নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মাথা নেড়ে বলে,

“ সরি… আমি আসলে ওভাবে মিন করি নি। আপনি দেখতে ঠিকঠাকই আছেন। কিন্তু ওইরকম ম্যানলি ব্যাপারটা নেই আরকি। “

আরো একবার স্টেশন ছেড়ে কথা বলে মোহ নিজের মুখ চেপে ধরে। অসভ্য মুখ একটা! সবসময় দশ হাত আগে চলে! মনন এবার হতাশ হয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। ইজ্জত জিনিসটা তার কোনোকালেই ছিলো না। না নিজের বাপ, দাদার কাছে। আর না মোহর কাছে।

মোহ কথা ঘোরাতে এবার সরাসরি চন্দ্রমল্লিকার চারা গাছটা মননের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ এটা দেওয়ার জন্য দেখা করতে চাইছিলাম। ওদিনের ওই ফুলের জন্য ধন্যবাদ। এই চারাগাছে যদিও ফুল নেই। কিন্তু রেগুলার পানি দিয়ে যত্ন নিলে শীতে চমৎকার ফুল ধরবে গাছে। সাদা চন্দ্রমল্লিকা ফুল দেখতে খুব সুন্দর হয়। “

বলেই মোহ উঠে দাঁড়ায়। এভাবে খালি বাসায় একজন পুরুষের সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকাটা তার জন্য অস্বস্তিকর ব্যাপার। মননও উঠে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,

“ চলে যাবেন? “

“ হ্যাঁ। বাসায় যেতে হবে তাড়াতাড়ি। আন্টি ইতিমধ্যে অনেকবার কল দিয়ে ফেলেছে… “

বলতে বলতে মোহ থেমে যায়। হঠাৎ সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে মননকে। চোখ মুখ অনেকটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। মোহ আগ্রহবশত প্রশ্ন করে,

“ বাই দ্যা ওয়ে, আপনি ঠিক আছেন? “

“ হ্যাঁ। ওই জাস্ট কালকে একটু জ্বর এসেছিলো। “

মননের কথার পিঠে মোহকে চিন্তিত দেখালো। এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে মননের কপাল ছুঁয়ে বলে,

“ দেখি… জ্বর আছে এখনো? “

মনন থমকায়। অজান্তেই হুটহাট এভাবে কাছে চলে আসাটা বোধহয় এই মেয়ের স্বভাব। কিন্তু এই মেয়ে কি জানে তার এই হুটহাট কাছে আসাতে বিপরীত মানুষের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার অবস্থা হয়? মোহ উদ্বেগ নিয়ে বলে,

“ এখনো হালকা গরম কপাল। ইউটিউব চিনেন না? ইউটিউব থেকে রেসিপি দেখে মশলা চা বানিয়ে খেয়ে নিলেই পারেন। “

মননের মনে হলো ডক্টর বোধহয় মোহই। মনন হলো তার রোগী। কথার মাঝে মননের চোখে চোখ পড়তেই মোহ স্থির হয়ে যায়। সরল মুখটা হুট করেই তাকে আকৃষ্ট করে। সেই আকর্ষণে সাড়া দিতে চলা মোহ হুট করেই নিজের হুশে ফিরে কলিংবেলের শব্দে। দ্রুত মননের কপাল থেকে নিজের হাত সরিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখে মুখে আবার আতংক খেলা করছে তার। মাথাটা বোধহয় গিয়েছে। এইমাত্র একটা ভুল করতে যাচ্ছিলো সে।

মনন এক মুহুর্তের জন্য মোহকে দেখে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। প্রশ্ন করে,

“ কে? “

“ আমি। তোমার দাদা। আলী আকবর কায়সার। “

মননের নির্ভীক মুখেও হঠাৎ ভয় ফুটে উঠে। আতংক নিয়ে মোহর দিকে তাকায়। দাদু এই সময় বাসায়! দাদু যদি মোহকে দেখে নেয় তাহলে কি হবে ভাবতেই মনন একটা ঢোক গিলে। তার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে বিশাল কোনো চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তটস্থ আসামীর ন্যায়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-২৬

0

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৬.

তারাখচিত আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে মোহ। নিজ রুমের জানালার ধারে বেতের সোফা পেতে বসে আছে সে। আজ বহুদিন পর আকাশে তারার দেখা মিললো। বিগত তিন চারদিন ধরে তো আকাশে জমা হওয়া মেঘের কারণে চাঁদের দেখাও মিলে নি। তবে আজকে সারাদিন বৃষ্টি না হওয়ায় আকাশটা বেশ পরিষ্কার দেখাচ্ছে।

মোহর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন এলোমেলো ভাবনা। যদি সে সুস্থ হয়? তারপর তার জীবনটা কেমন হবে? জীবনটা কি পুরোপুরি আবার আগের মতো হয়ে যাবে? মোহর বাহ্যিক রূপ, জীবন, স্বপ্ন সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে তো? নাকি কিছুই ফিরে পাবে না সে?

মোহ আকাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে আয়নার দিকে তাকায়। ভালো করে দেখে নিজেকে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয় নিজের গালটা। গায়ের রঙটা কেমন ময়লা হয়ে গিয়েছে। মাথার চুলের পাশাপাশি চোখের পাতা থেকে পাপড়ি এবং ভ্রু ও সব ঝরে পড়ে গিয়েছে। হাতে পায়ের শুভ্র নখ গুলোও কেমন কালো রঙ ধারণ করেছে।

মোহ জানে সবটাই কেমোর পার্শ প্রতিক্রিয়া। তবে ডক্টর তাকে আরেকটা সাইড ইফেক্ট সম্পর্কেও জানিয়েছিল। সেটা হচ্ছে কেমোর কারণে অনেক সময় ক্ষেত্র ভেদে অনেক নারীদের ঋতুস্রাব সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অনেক নারীদের স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। স্থায়ী ভাবে যাদের বন্ধ হয়ে যায়, সে-সকল মেয়েদের ভবিষ্যতে মা হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় চলে যায়।

মোহকে এই ক্ষেত্রে ভাগ্যবতী বলা যায়। এতো এতো সাইড ইফেক্টের মাঝে এই একটা সাইড ইফেক্ট থেকে সে রেহাই পেয়েছে। যদিও বাচ্চাদের প্রতি তার বিশেষ কোনো টান নেই, তবুও অদূর ভবিষ্যতে একটা বাচ্চা সকল মেয়েরই কাম্য। মোহও তার ব্যতিক্রম নয়। মায়ার জোরাজুরিতে মাস কয়েক আগে দুই বোন মিলে নিজেদের বাচ্চার নামও ঠিক করে রেখেছে। মোহ বহু ভেবে ঠিক করেছে তার কখনো ছেলে হলে নাম রাখবে মেসুত ওজিল। আর মেয়ে হলে নাম রাখবে শাকিরা। এরকম উদ্ভট নাম শুনে মায়া হতভম্ব হলেও মোহর মাঝে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা যায় নি কখনো। ছেলের নাম ভাবতে গিয়ে তার মাথায় সর্ব প্রথম মাদ্রিদের প্রাক্তন এই মুসলিম খেলোয়াড়ের কথাই মনে পড়েছিল। আর মেয়ের নাম ভাবতে গিয়ে তার ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ওয়াকা ওয়াকা গানের কথা মনে পড়েছিল।

মোহর অবান্তর ভাবনার ভীড়ে ভাটা পড়ে ফোনকলের কর্কশ শব্দে। মোহ ফোনের দিকে না তাকিয়েই বুঝে যায় কার কাছ থেকে কলটা আসছে। ইদানিং কল করে তার খোঁজ খবর নেওয়ার এক অদ্ভুৎ বাতিক রোগ হয়েছে ডক্টরের। মোহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অত:পর কলটা রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশ থেকে একটা খোশমেজাজ পুরুষ শুধালো,

“ কেমন আছেন? শরীর ভালো? এলার্জি জনিত কোনো সমস্যা হয় নি তো পরে? “

“ ভালো আছি। শরীরও ঠিকঠাক। উঁহু, কোনো অসুবিধা হয় নি। “

“ যাক আলহামদুলিল্লাহ! কি করছিলেন? খাওয়া দাওয়া করেছেন? ওষুধ খেয়েছেন? “

“ খেয়েছি। ওষুধও খেয়েছি। আপাতত বসে আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম। “

শেষ বাক্যে মোহর কণ্ঠে হতাশা ঠিকরে পড়ে। মনন স্পষ্ট টের পায় তা। নিশ্চয়ই এই মেয়ে আবারও নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে? মনন কথা ঘুরিয়ে বলে,

“ আজকে একটা বাচ্চা এসেছিল। বাচ্চাটা স্টেথোস্কোপকে কি বলছিলো জানেন? হরোস্কোপ। কি একটা অবস্থা! কেউ টোটোস্কোপ বলে তো কেউ হরোস্কোপ! “

বলে মনন হাসতে থাকে। মোহর কপাল কুচকে আসে। সন্দিহান গলায় জানতে চায়,

“ আপনি কি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন? “

“ উঁহু। মোটেও না। সত্যি বলতে টোটোস্কোপ শব্দটা বেশি কিউট! “

মোহ এবার আগ্রহী গলায় বলে,

“ জানেন? আমি ছোট বেলা থেকেই ভুলভাল উচ্চারণ করি। জানালা আছে না? ছোটবেলায় ওটাকে জালানা বলতাম আমি। আবার রিকশাকে রিশকা বলতাম। এমনকি একবার জেনারেল নলেজ এক্সামে বাংলাদেশের রাজধানী কি জানতে চাওয়ার পরে আমি কি উত্তর দিয়েছিলাম জানেন? কাকা! “

বলেই মোহ হাসিতে ফেটে পড়ে। হাসে মননও, তবে নীরবে। বলে,

“ অভ্যাসটা তাহলে ছোটবেলারই! “

“ হ্যাঁ। আবার কাচ্চি আছে না? ছোটবেলায় ওটাকে আমি হাচ্চি বলতাম। “

নিজের ভুলভাল উচ্চারণের চ্যাপ্টার খুলে বসা মোহ সাময়িকের জন্য ভুলে গেলো নিজের অসুস্থতা। ভুলে গেলো তার জীবনে কি চলছে। নিজের বর্তমানটাকে ভুলে গিয়ে ফিরে গেলো অতীতে। মননকে শোনাতে থাকলো নিজের শৈশব কথন। মননও কফির মগে চুমুক বসিয়ে নীরব শ্রোতার মতো শুনতে থাকলো মোহর কথা। কথায় কথায় মোহ বললো,

“ জানেন? আমার না পাইলট হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু এখন তো আর সম্ভব না। ফিজিক্যাল ফিটনেস টেস্টে আন্ডা পাবো আমি। আকাশে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছা আর পূরণ হবে না আমার। “

“ আকাশে ভ্রমণের জন্য পাইলট হওয়াটা জরুরী নয়। পেসেঞ্জার হয়েও আকাশের বুকে আপনি উড়তে পারবেন। আকাশ উপভোগ করতে পারবেন। “

মোহ হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে প্রশ্ন করে,

“ আপনার আমার জন্য মায়া হয় তাই না? আমার জন্য খারাপ লাগে আপনার। এই কারণে আপনি আমার এতো চিন্তা করেন, ঠিক বলেছি? “

মনন জবাব দিতে পারে না। মোহকে নিজের মনের খবর না জানানোর পিছনে এটাও একটা কারণ। এই মেয়ে ভেবে বসবে মননের মনে যা আছে তা কেবল দয়া মায়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। মননের অনুভূতির গভীরতা বোঝার মতো বোধ এখনো এই মেয়ের হয় নি। আর তাছাড়া মোহর সম্পূর্ণ মনযোগ এখন শুধুমাত্র কিভাবে সুস্থ হওয়া যায় এই ব্যাপারেই হওয়া উচিত বলে মনে করে মনন। এসব জটিল অনুভূতির ভার এই মুহুর্তে সে মোহর উপর চাপাতে চাইছে না।

“ এই, আছেন? “

মোহর ডাকে মননের ধ্যান ভাঙে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বলে,

“ জি। বলুন। আছি। “

মোহ আর ওই ব্যাপারে কথা আগায় না। কথা ঘুরিয়ে অন্য বিষয়ে চলে যায় সে।

__________

অদ্ভুৎ ভাবে হুট করেই গতরাত থেকে মননের প্রচুর জ্বর এসেছে। বাধ্য হয়ে সে হসপিটাল থেকে একটা দিনের ছুটিও নিয়ে নিয়েছে। নাওয়া খাওয়া দাওয়া সব কিছু বাদ দিয়ে সকাল থেকে জ্বরে কাবু হয়ে কেবল ঘুমোচ্ছে। ছেলের হঠাৎ জ্বরে আরিফ কায়সারও বেশ চিন্তিত। তার ছেলে ছোটবেলা থেকেই স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় খুব একটা অসুস্থ হয় না। তাই ছেলের আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়াতে উনি বিচলিত বোধ করে।

আলী আকবর কায়সার সকাল থেকে কয়েকবার নাতির রুমের চক্কর কেটে গিয়েছে। রাতারাতি জ্বরে কাবু হয়ে গিয়েছে তার আদরের দুলাল। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। দেখতেও কেমন রোগা-সোগা লাগছে।

শুক্রবার হওয়ায় আরিফ সাহেব এবং আলী আকবর সাহেব দু’জনেই আজ বাসায় আছে। মননের এরকম অবস্থা দেখে জীবনে প্রথম বারের মতো তার দাদু ডক্টরকে তলব না করে পরিচিত, বিশ্বস্ত এক হুজুরকে তলব করেন। বাসায় ডেকে এনে বলেন,

“ আমার নাতির উপর সম্ভবত কিছু একটা আছর করেছে হুজুর। ইদানিং ওর আচার-আচরণ কেমন বদলে গিয়েছে। একা একা হাসে। আপনি একটু ওকে দেখে বলুন তো আমার নাতির কি হয়েছে। “

আরিফ কায়সার পড়েছেন বিপাকে। না পারছে নিজের বাপের মুখের উপর কিছু বলতে আর না পারছে এসব সহ্য করতে। কে জানে মনন এসব দেখলে কেমন রিয়েক্ট করবে!

মননের রুমে যখন হুজুরকে নিয়ে প্রবেশ করে তার দাদু, তখন মনন অর্ধ ঘুমে নিমজ্জিত। তবে হুজুর বেশের একজনকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়। নম্র কণ্ঠে হুজুরকে সালাম দিয়ে বলে,

“ হুজুর? আপনি হঠাৎ? “

পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গি পরিহিত হুজুর ভদ্রলোক মননকে দেখে নিয়ে দোয়া পড়তে শুরু করে। মনন বোকার মতো তাকিয়ে থাকে কেবল। বেশ কতক্ষণ কুরআনের কালাম পড়ে মননকে ভালো মতো দেখে হুজুর আলী আকবর সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আপনার নাতি ঠিক আছে সম্পূর্ণ। খারাপ কিছুর ছায়া নেই ওর উপর। আপনি অযথা চিন্তা করছিলেন। “

মনন পুরো ঘটনা বুঝতে পেরে তপ্ত দৃষ্টি মেলে নিজের দাদুর দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করে আলী আকবর কায়সার দ্রুত হুজুরকে নিয়ে মননের রুম থেকে বিদায় হয়। মনে মনে বলতে থাকে,

“ সব যদি ঠিকই থেকে থাকে তাহলে এই ছেলের আচরণ কেমন সন্দেহজনক কেনো? “

__________

বিকালে হুজুরের সেই ঘটনার পর থেকে মননের সামনে আসছে না তার বাপ, দাদা কেউ-ই। মননও আর তেমন একটা রাগারাগি করে নি। দুপুরে ওষুধ খাওয়ার পর থেকে ঘাম ছেড়ে ধীরে ধীরে জ্বর কমে আসছে এতেই সন্তুষ্ট সে। রুমে শুয়ে বসে অসুস্থ সময় পাড় করা মনন সন্ধ্যার পরপরই মোহকে কল করলো। কিন্তু ফোনটা বন্ধ পেয়ে সে বেশ অবাক হলো।

মনন ধরে নেয় হয়তো ফোনে চার্জ নেই তাই ফোন বন্ধ। মনন আর ব্যাপারটাকে তেমন একটা ঘাটায় না। তবে তার চিন্তা বাড়ে রাতে। খাওয়ার পর মোহর নাম্বারে আরো একবার কল করে মনন। এবারও ফোনটা বন্ধ পেয়ে মননের চিন্তা হয়। অদ্ভুৎ তো! গতরাতেও তো তাদের কথা হলো! হুট করে মেয়েটার ফোন বন্ধ আসছে কেন? মোহ ঠিক আছে তো?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]