Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 72



কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-১৭+১৮

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১৭
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

সময় দুপুর বেলা।ঘড়ির কাঁটা ঘুরে একটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে।চৌধুরী পরিবারের সবাই উপস্থিত হয়েছে শেখ বাড়িতে।আনন্দপুর থানার এসআই অমিত সাহাও জলিল শেখের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন।সবার মাঝে তিনিও উপস্থিত আছেন।মেহরিমা নিজের বাড়িতে আসতেই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।হৃদিত শান্ত চোখে সবটা দেখছে।চোখ মুখ মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না।মেহরিমা এখানে এসে যেন হৃদিত কে ভুলতেই বসেছে।বিশ মিনিটের মধ্যে একবারও হৃদিতের খোঁজ নেয় নি।

অবনী শেখ,মাধবী আর মেহরিমা নাস্তা নিয়ে আসে সকলের জন্য।অবনী শেখ কে দেখতেই আরিফ চৌধুরী কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।অতীতের ক্ষতটা তাজা হয়ে ওঠে।পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে নেয়।অন্য কারোর স্ত্রী কে নিয়ে ভাবতে মোটেও ইচ্ছুক নন তিনি।কিন্তু মন কি আর মস্তিষ্কের কথা শোনে!সে চলে তার নিজ ইচ্ছায়।শ্রেয়া চৌধুরী নিরব চোখে আরিফ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আছেন।এখানে এই বাড়িতে আসার একটুও ইচ্ছা ছিলো না ওনার।একপ্রকার বাধ্য হয়েই এসেছে এখানে।স্ত্রী হিসেবে খুব সহজেই স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পারে।নিজের করা ভুল গুলো প্রতিনিয়ত ওনাকে ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে।অবনী শেখ এইসবে নির্বিকার রয়েছে।মুচকি হেসে সকলের সাথে সালাম বিনিময় করে।ম্যানার্স রক্ষার্থে আরিফ চৌধুরীর সাথে ভালো মন্দ দুটো কথা বলে।শ্রেয়া চৌধুরীর সেটুকুও যেনো সহ্য হয় না।কিন্তু উনি অপারগ কিছুই করার নেই ওনার।নিজের একেকটা ভুলের শাস্তি তিলে তিলে পাচ্ছে এখন।শ্রেয়া চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।হৃদিত সবটা লক্ষ্য করতেই বাঁকা হাসে।

“আপনারা সবাই আজ এখানে থেকে যান।খুশি হবো আমরা।”

জলিল শেখের কথায় আরিফ চৌধুরী বলে,

“সেটা তো সম্ভব না ভাই।আয়াশ রাতে ঢাকা ব্যাক করবে।পনেরো মিনিটেরই তো রাস্তা।যখন মন চাই চলে আসা যাবে‌।”

“এমপি স্যারের বোধহয় আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষজনকে পছন্দ হয়েছে।আই মিন ওনাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছে।তাই এখানে বার বার আসতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই না স্যার?”

হৃদিতের যায়গা মতো মারা খোঁচা টা সবাই বুঝলো শুধু অবুঝের ন্যায় চেয়ে রইল অমিত সাহা,মাধবী, মেহরিমা‌।হৃদিতের কথায় চৌধুরী পরিবারের সকলের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।পরিবেশ কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে থমথমে হয়ে ওঠে।পরিবেশ ঠিক করার জন্য জলিল শেখ আলতো কেশে বলে,

“দুপুরের খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তো।অবনী খাবার সার্ভ করো।”

অবনী শেখ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে কিচেনে যেতে নিলেই আয়েশা চৌধুরী বলে,

“আপা আমি আর আতিয়া আপনাকে সাহায্য করি চলেন।একা হাতে এত কাজ সামলানো কষ্ট হয়ে যাবে।দয়া করে না করবেন না।আমরা আপনার বোনের মতোই।”

আয়েশা চৌধুরীর কথায় অবনী শেখের বুকের মাঝে কেঁপে ওঠে।মনে পড়ে যায় অতীতের কিছু সুখকর স্মৃতি।না করতে পারে না ওনাদের কে। আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরী কে সাথে নিয়েই কিচেনে চলে যায়।তিন জনে মিলে দ্রুত হাতে দশ মিনিটের মধ্যেই খাবার সার্ভ করে ফেলে।আগে পুরুষেরা খেয়ে নেবে তারপর মেয়েরা। এভাবেই খাওয়ার পর্ব শেষ হয়।

সময় বিকাল বেলা মেহরিমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় বড় বকুল গাছটার নিচে চেয়ার পেতে ছোট বড় সকলে আড্ডায় মশগুল।উপস্থিত নেই হৃদিত আর বাড়ির মহিলারা।মেহরিমা মাঝে মাঝে হৃদিতের করা কাজে,ব্যবহারে বড্ড অবাক হয়।রুমে একা বসে কি করছে কে জানে!খাওয়ার সময়ই কথা পাকাপাকি হয়েছে মেহরিমা আর হৃদিত কিছুদিন এখানে থাকবে।মেহরিমা সেই খুশিতেই নেচে বেড়াচ্ছে।তবে চোখ কান খোলা রেখেছে।চৌধুরী পরিবারের মধ্যে যে একটা গোলক ধাঁধা আছে সেটা খুব সহজেই বুঝে গেছে মেহরিমা।কোনো ক্লু পেলেও পেতে পারে।আয়েশা চৌধুরী,আতিয়া চৌধুরী,অবনী শেখ মিলে বিকালের হালকা পাতলা নাস্তা নিয়ে আসে।সবার অনুরোধে ওনারা তিনজন ও আড্ডায় সামিল হয়।

“জলিল ভাই সামনে বছর তো আবার ইলেকশন।আপনি ইলেকশন করবেন তো?”

আরিফ চৌধুরীর কথায় জলিল শেখ সময় নিয়ে বলে,

“না ভাই।আর ইচ্ছা নেই।অনেক তো করলাম অন্যের উপকার।বয়স হয়েছে,এখন নিজের পরিবার,নিজেকে একটু সময় দেই।হায়াতের তো আর বয়স নেই।কখন আল্লাহ ডাক দিয়ে দেবেন আর আমি আল্লাহর বান্দা তার ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবী ত্যাগ করবো।তাই আর যেই কয়টা দিন বেঁচে আছি কোনো ঝামেলা ছাড়া শান্তিতে কাটাতে চাই।”

জলিল শেখের কথায় উপস্থিত সবাই মৃ ত্যু র কথা স্মরণ করে।ইহজীবনের সদা কঠিন সত্যের কথা স্মরণ করতেই সকলের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। ছোট্ট এই জীবনে কতশত ভুলই করে থাকি আমরা!আজাদ চৌধুরী বলে,

“ঠিক বলেছেন ভাই।এটাই উত্তম সিদ্ধান্ত।”

জলিল শেখ মুচকি হাসেন।অমিত সাহা ক্ষণে ক্ষণে অবনী শেখের দিকে তাকায়।এই কঠিন সত্তার মানবীর মধ্যে আলাদা কিছু তো একটা আছেই।যা ওই মানবিকে হাজারও নারীর মধ্যে থেকেও আলাদা করে রাখে।হঠাৎ সকলের সম্মুখে আরিশা বলে ওঠে,

“অবনী আন্টি আপনি দেখতে মা শা আল্লাহ খুব সুন্দর।আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনার মতো সুন্দর মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখি নাই।”

আরিশার কথায় সবাই অবনী শেখের দিকে দৃষ্টিপাত করে।ফুল হাতার কামিজ পরিধান করা।লম্বায় হাঁটুর অনেকটা নিচ পর্যন্ত।ঢোলাঢালা সালোয়ার।ওড়না টা খুব সুন্দর করে মাথায় আটকানো।শুধু মাত্র উজ্জ্বল মুখমণ্ডল,চকচকে হাত দুটো আর পা দুটো দেখা যাচ্ছে।একদম মার্জিত বেশভূষা।সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে অবনী শেখ মুচকি হেসে বলে,

“আল্লাহর সৃষ্টি সবকিছুই সুন্দর।আমরা মানুষেরা মানুষ কে অসুন্দর বানাই,আল্লাহ না।”

অতি সাধারণ কথার মাঝেই অসাধারণ কিছু একটা ছিলো।সবাই মুগ্ধ হয় অবনী শেখের মার্জিত সুস্পষ্ট জবাবে।অমিত সাহা মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে কিয়ৎকাল।আরিশা এবার বুঝতে পারে মেহরিমা ঠিক অবনী শেখের মতোই হয়েছে।আয়াশ হাতঘড়ি যে চোখ বুলিয়ে বলে,

“এবার উঠতে হবে আমাদের কে।সন্ধ্যার পরপরই আমাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।”

আয়াশের কথায় সবাই সহমত জানিয়ে বিদায় নেয়।আরিফ চৌধুরী অবনী শেখের দিকে একপলক চেয়ে শেখ বাড়ি ত্যাগ করেন।চৌধুরী পরিবারের সকলে চলে গেলেও থেকে যায় অমিত সাহা।মেহরিমা আর মাধবী ততক্ষণে বাড়ির ভেতরে চলে গেছে।আঙ্গিনায় উপস্থিত আছে জলিল শেখ, অবনী শেখ আর অমিত সাহা।অবনী শেখ ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিয়েও থেমে যায়।

“মেয়েদের দিকে নজর দেওয়া পাপ।আর যদি সেই মেয়ে বিবাহিত হয় তাহলে তো তার দিকে নজর দেওয়া মহাপাপ।নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে শিখুন।বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করুন। আশাকরি আমার দ্বিতীয় রুপ আপনাকে দেখাতে হবে না।এই পর্যন্তই থেমে যাবেন।”

কথাগুলো বলে আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে অবনী শেখ বাড়ির ভেতরে চলে যায়।অমিত সাহা অবনী শেখের সুস্পষ্ট কথায় লজ্জা পেয়ে যান।জলিল শেখও ঘটনা কিছুটা আঁচ করতে পারে।

মেহরিমা দরজা খুলে নিজের রুমে প্রবেশ করতেই ভয় পেয়ে যায়।অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো রুম।জানালা গুলো বন্ধ করা।কোনো টু শব্দ নেই রুমের মধ্যে।শোনা যাচ্ছে শুধু ফ্যান চলার শোঁ শোঁ শব্দ।কেমন গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে রুমের মধ্যে।হঠাৎ শব্দ করে রুমের দরজা টা বন্ধ হয়ে যায়।মেহরিমা ভয়ে আঁতকে ওঠে দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করে।মনে পড়ে যায় সেই বিভৎস রাতের কথা।সেকেন্ডের ব্যবধানে ঠান্ডা একটা হাত শাড়ির আঁচল গলিয়ে উ ন্মু ক্ত কোমর স্পর্শ করে।কোমরে চাপ দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।স্পর্শটা চিনতে এক সেকেন্ড ও সময় লাগে না মেহরিমার। হঠাৎ কানের কাছে ভেসে আসে উদ্ভট একটা কন্ঠস্বর,

“তোর কাছে এই পৃথিবীতে কার প্রায়োরিটি সবচেয়ে বেশি?আমার নাকি অন্য কারোর?টাইম ইজ অনলি ফাইভ সেকেন্ডস।আন্সার মি কুইকলি।”

হিমশীতল তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার ছোট্ট বুকটা অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠে।এক ঝটকায় কোমর থেকে বলিষ্ঠ হাতটা ছুড়ে ফেলে।পেছনে ঘুরতেই তৎক্ষণাৎ একটা মোমবাতি জ্বলে ওঠে।অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমের মধ্যে সেই আবছা হলদে আলো হাড়হিম করা পরিবেশ তৈরি করেছে।মেহরিমার গা ছমছম করে ওঠে।মোমবাতির আবছা আলোয় সামনে উপস্থিত মানবের হিংস্র মুখমণ্ডল চক্ষু গোচর হতেই ভয়ে ওখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে যেতে নেয় মেহরিমা।তার আগেই বিদ্যুতের গতিতে দু’টো শক্ত পেশিবহুল হাত এগিয়ে এসে কোমর চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।

#চলবে_____

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১৮
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

মেহরিমা পিটপিট করে চোখজোড়া মেলে তাকায়। লাইটের তীব্র আলো সহ্য করতে না পেরে পরক্ষণেই চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।সময় নিয়ে আবারও চোখ মেলে তাকায়।দৃষ্টি ঝাপসা লাগছে।সেই ঝাপসা দৃষ্টি দিয়েই তাকিয়ে দেখে একপাশে হৃদিত বসে আছে ওর ডান হাত ধরে‌।অপর পাশে অবনী শেখ চিন্তিত মুখে বসে আছেন।ওনার পাশেই মাধবী,জলিল শেখ বসা।সবার চোখে মুখেই উদ্বেগের চিহ্ন।মেহরিমা কে সময় দেয় সকলে। কিছুক্ষণ অতিক্রম হওয়ার পরে মেহরিমা নিজে থেকেই বলে,

“আমি উঠে বসবো।”

মেহরিমা মুখ থেকে কথা টা বের করার সাথে সাথেই হৃদিত যত্ন সহকারে ওকে উঠিয়ে বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়।এবার অবনী শেখ মুখ খোলে,

“কি হয়েছিল নীলাক্ষী?এভাবে হঠাৎ সেন্সলেস হলি কিভাবে?”

অবনী শেখের কথায় মেহরিমার চোখের সামনে শেষ বিকালের সেই ভয়াবহ দৃশ্য ভেসে ওঠে।চোখ মুখে আঁধার নেমে আসে।চাহনিতে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। অবনী শেখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হৃদিতের দিকে তাকায়।হৃদিত স্বাভাবিক দৃষ্টি দিয়েই মেহরিমার দিকে তাকিয়ে আছে।মেহরিমা সাহস পাই যেন।বলতে শুরু করে।

“আমি বিকালে রুমে এসেছিলাম।রুমে এসে দেখি পুরো রুম অন্ধকারে ছেয়ে আছে।আ…আমি ভয় পেয়ে যায়।তখন রুমে হৃদিত ভাইয়ের উপস্থিতি অনুভব করি।তারপর একটা উদ্ভট কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হয়।লাল চোখের হিংস্র একটা মুখ দেখতেই আমি ভয়ে সেন্স হারিয়ে ফেলি।অন্ধকারে মুখটা স্পষ্ট দেখতে পারিনি আমি।তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।”

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কথাগুলো বলে শেষ করে মেহরিমা।হৃদিত সাইড টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি মেহরিমাকে সযত্নে খাইয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলে,

“আমি তো তোদের বাসার পিছনে বাগানে ছিলাম। ওখানে শিউলি ফুল গাছের নিচে বসে বসে গেইম খেলছিলাম।সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর ড্রয়িং রুমে বসে মা কে তোর কথা আস্ক করতেই বলে তুই রুমে আছিস।আর এখানে এসেই দেখি তুই সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিস।আই থিংক তুই কোনো কিছু নিয়ে টেনশড।তাই এরকম উদ্ভট চিন্তা ভাবনা আসছে তোর মাথায়।ইভেন আমি যখন রুমে আসি তখন রুমে লাইট জ্বালানো ছিলো।”

হৃদিতের কথা শুনে মেহরিমা ভাবনার অতলে হারিয়ে যায়।তবে সত্যিই ওগুলো ভাবনা ছিল? কিন্তু কন্ঠস্বর সেটা তো নিজের কানে শোনা! ওগুলো কিভাবে ভাবনা হতে পারে?মেহরিমা দো মনায় ভুগতে থাকে।হৃদিতের কথায় সহমত জানিয়ে অবনী শেখ বলেন,

“হ্যাঁ,হৃদিত তো রুমেই ছিলোনা।আচ্ছা তুই এখন রেস্ট নে।বেশি স্ট্রেস নিস না।এগুলো নিয়ে পরে কথা বলা যাবে।মিনাক্ষী আমার সাথে আয়।খাবার সার্ভ করতে হেল্প করবি।”

কথাগুলো বলে অবনী শেখ উঠে যেতে নিলেই হৃদিত বলে,

“মা,আমার আর ওর খাবার টা এখানেই দিয়ে যাবেন প্লিজ।ওর শরীর যথেষ্ট দূর্বল।ওর প্রোপার রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন।আগামীকাল হসপিটালে নিয়ে যাবো চেক আপের জন্য।”

অবনী শেখ মুচকি হেসে বলে,

“আচ্ছা বাবা।”

অবনী শেখ রুম ত্যাগ করতেই ওনার পিছন পিছন মাধবী ও রুম থেকে বের হয়ে যায়।জলিল শেখ এগিয়ে এসে মেহরিমার মাথায় হাত রেখে বলে,

“রেস্ট নেও আম্মা। শরীর ভালো লাগবে।রাতে না খেয়ে ঘুমাবে না কিন্তু।”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।জলিল শেখ হৃদিতের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আচ্ছা বাবা থাকো।যাই আমি।”

হৃদিত মুচকি হেসে সায় জানায়।জলিল শেখ ধীর পায়ে হেঁটে প্রস্থান করেন।কিছু সময় পরে মাধবী এসে দু’জনের জন্য খাবার দিয়ে যায়।হৃদিত হাত ধুয়ে এসে খাবার মেখে মেহরিমার মুখের সামনে ধরে,

“ক্ষুধা নেই।”

“তবুও খেতে হবে।”

“জোর করে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”

“তখন খুব ভয় পেয়েছিলিস?”

মেহরিমার যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিলো।

“আপনি বিশ্বাস করুন।ওগুলো মিথ্যা ছিলো না। আমার ভাবনা না ওগুলো।আমি সত্যিই দেখেছিলাম।একটা উদ্ভট কন্ঠ শুনেছিলাম।আপনার স্পর্শ অনুভব করেছিলাম।আপনার স্পর্শ চিনতে আমার কখনোই ভুল হতে পারে না।”

“আচ্ছা তুই কি শুনেছিলিস?”

“আমার লাইফে কার প্রায়োরিটি বেশি? আপনার নাকি অন্যকারোর এটা শুনেছিলাম।”

“তো ওটার আন্সার কি?”

মেহরিমা সময় নিয়ে জবাব দেয়,

“আমার পরিবার আর আপনি।মা বলেছে বিয়ের পরে হাসবেন্ডই মেয়েদের সব।তাই আমার প্রায়োরিটির লিস্টে সবার আগে আপনি আছেন।”

সুযোগে সৎ ব্যবহার করে হৃদিত।মেহরিমার জবাব শুনে হৃদিতের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে ওঠে।মেহরিমা দেখার আগেই সেটা মিলিয়ে যায়।

“তাহলে তোর কথা অনুযায়ী দাঁড়ায় আমি এই রুমে ছিলাম।আশ্চর্য!আমি কি জ্বিন,ভুত নাকি যে একসাথে দুই যায়গায় অবস্থান করবো।”

হৃদিতের এবারের বলা কথায় মেহরিমা চুপসে যায়।সত্যিই তো এটা তো ভেবে দেখেনি।আর হৃদিত যখন বলছে এখানে ছিল না তার মানে হয়তো সত্যিই ছিলো না। উনি তো আর মিথ্যা বলবে না। কিন্তু ওগুলো সব ভাবনা ছিল এটাও তো মন, মস্তিষ্ক মানতে চাইছে না।মেহরিমা সত্য, মিথ্যার বেড়াজালে পড়ে অস্থির হয়ে ওঠে।হৃদিত সবটাই লক্ষ্য করে।

“এক রাতেই আমার স্পর্শ এতোটা চিনে ফেললি? ভালোবাসা কি একটু বেশিই দিয়ে ফেলেছি?দিলেও মন্দ হয়নি কাজ টা।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা হকচকিয়ে যায়!নিজের বলা কথাতে নিজেই লজ্জা পেয়ে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলে।ফুলো ফুলো গাল দুটোতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে।পরক্ষণেই ঠোঁট কামড়ে থুতনি বুকে ঠেকিয়ে মাথা নামিয়ে রাখে।মেহরিমার লজ্জা মিশ্রিত রক্তিম গাল,পাতলা ঠোঁটখানা সেকেন্ডের ব্যবধানে হৃদিতকে এলোমেলো করে দেয়।হৃদিত নিজেকে খুব করে সামলায়।মনকে বুঝ দেয় ওর ছোট্ট বিড়াল ছানাটা অসুস্থ।এই অবস্থায় ওইসব কাজ ঠিক হবে না।মুচকি হেসে বলে,

“এখন চুপচাপ লক্ষী বউয়ের মতো খেয়ে নে তো সোনা।”

হৃদিতের নরম ভালোবাসাপূর্ণ কথায় মেহরিমা আহ্লাদে গদগদ হয়ে ওঠে।আহ্লাদি কন্ঠে বলে,

“আপনি খাইয়ে দিবেন?”

“হু।”

“কম করে খাবো কেমন?”

“আচ্ছা।”

“কাল সত্যিই হসপিটালে যেতে হবে আমাকে?”

“হুম।”

“ওই শাবলের মতো মোটা ছুঁচ ফোটাবে না তো?”

মেহরিমার প্রশ্নে হৃদিত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলে,

“সেটা আবার কি?”

“আরে ইনজেকশন,সেটাও চেনেন না?”

হৃদিত মেহরিমার চোখের আড়ালেই দুষ্টু হেসে বলে,

“হ্যাঁ ইনজেকশন ওটা দেবে তো।”

মেহরিমার মুখটা একটুখানি হয়ে যায়।ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে।মেহরিমার মুখটা দেখতে ছোট্ট বাচ্চার মতো লাগছে।হৃদিত মনে মনে খুব মজা পাই।তবে মুখটা সব সময়ের ন্যায় গম্ভীর।

“ক..কয়টা দেবে?”

“এই ধর পাঁচ,দশটা তো দেবেই।”

“অতগুলো কেনো দেবে?”

“আই ডোন্ট নো।মে বি যাদের মাথায় সমস্যা তাদের বেশি দেয়।”

“আমার মাথায় কোনো সমস্যা নেই তো!”

“তাহলে ওইসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা কেন করিস?”

“আর করবো না।”

“তবুও যেতে হবে।”

“আমি যাবো না।”

“যেতে হবে।”

“প্লিজ,আমি ওটাতে ভয় পাই।”

মেহরিমার কাঁদো কাঁদো কন্ঠ শুনে হৃদিত এদফায় থামে।কন্ঠে নিজের সবটুকু স্নেহ,ভালোবাসা মিশিয়ে বলে,

“আমি আছি তো জান।আমি থাকতে তোকে কখনো কোনো দুঃখ,কষ্ট ছুঁতে পারবে না।আই প্রমিজ।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা শান্ত হয়।পরক্ষণেই নিজের আটাশ পাটি দাঁত বের করে হেসে বলে,

“আমরা তো শহরে যাবো তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“অনেক শপিং করবো ওকে।”

“পুরো দোকানই কিনে দেবো।”

“স্ট্রিট ফুড খাবো।”

“ওগুলো আনহেলদি।”

“তাহলে শুধু ফুসকা।”

“নো।”

“প্লিইইইইইজজজজজ।”

“গান ধরেছিস কেনো?”

“আপনি আমার কথা শুনবেন না?একটুও ভালোবাসেন না আমায়।শুধু আমি একাই ভালোবাসি।”

“সাহস বেড়েছে তোর।”

“তাহমীদ হৃদিত চৌধুরীর ওয়াইফ মেহরিমা শেখ নীলাক্ষী।সাহস তো থাকবেই ব্রো।”

হৃদিৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।গতকাল ভালোবাসা পাওয়ার পর থেকে এই মেয়ের মাঝে তুমুল পরিবর্তন এসেছে।সাহস বেড়েছে বহুগুণ।হৃদিত কে রিতিমত নাচিয়ে ছাড়ছে।হৃদিত হার মেনে নেয়।

“আচ্ছা খেতে পারিস।”

“সত্যিই!”

“হুম।”

মেহরিমা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।চোখে মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে ওঠে।হৃদিতের সাথে শপিং করা,স্ট্রিট ফুড খাওয়া বহুদিনের স্বপ্ন ওর।আর সেটা পূরণ হতে চলেছে ভাবতেই খুশিতে গদগদ হয়ে পড়ে।হৃদিৎ ওর অ্যানাবেলা কে দু’চোখ ভোরে দেখে।এই মেয়েটা অল্পতেই কতো খুশি হয়ে যায়!মেহরিমার বকবকানির জন্য খাবার ঠান্ডা হয়ে যায়।হৃদিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে। তুই পাঁচ মিনিট বস আমি খাবার গরম করে নিয়ে আসি।”

“না,না তার দরকার নেই।আমি খেতে পারবো। আপনার বোধহয় সমস্যা হবে খেতে।মা কে ডেকে বলি আপনার টুকু গরম করে দিতে।”

“আমারও সমস্যা নেই।”

“সত্যি তো?”

“হু।”

মেহরিমা প্রাণবন্ত হাসে।হৃদিত ওর পাশে বসে ছোট ছোট লোকমা করে খাইয়ে দিতে থাকে।অবনী শেখ মুগ্ধ নয়নে দৃশ্য টুকু দেখে ওখান থেকে চলে যান।উনি খাবারের প্লেট নিতে এসেছিলেন।এসেই এই সুন্দর দৃশ্যর সম্মুখীন হন।অবনী শেখ নিজের ছলছল করা চোখজোড়া মুছে মনে মনে ভাবেন হৃদিতের হাতে মেহরিমা কে তুলে দিয়ে উনি মোটেও ভুল করেননি।চৌধুরী বাড়ির রক্ত খারাপ হলেও হৃদিত আর ছোট ছেলে দুটো ভিন্ন প্রকৃতির হয়েছে।অবনী শেখ চলে যেতেই হৃদিতের অধরে বক্র হাসি খেলে যায়।

#চলবে_____

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-১৫+১৬

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১৫
#ইসরাত_তন্বী

(গল্পের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে)

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

সময় মধ্যরাত।চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্য ড্রয়িং রুমে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে আরিফ হাসান চৌধুরীর জন্য।দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর পর আজ চৌধুরী বাড়িতে পা রাখবেন তিনি।তার নিজের জন্মস্থান ছাড়ার পিছনে রয়েছে এক কঠিন গল্প।আয়াশ হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়‌।রাত বারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আরিফ চৌধুরীর আসতে সর্বোচ্চ আর পাঁচ মিনিট সময় লাগতে পারে।ঘড়ি ধরে ঠিক তিন মিনিটের মাথায় গাড়ির শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায় চৌধুরী বাড়ির আঙ্গিনায়।সবাই ছুটে বাইরে চলে যায়।আরিফ হাসান চৌধুরী আর শ্রেয়া চৌধুরী গাড়ি থেকে নেমে আসে।বিয়ের পরে এই প্রথম শ্বশুর বাড়িতে পা রাখেন শ্রেয়া চৌধুরী। চৌধুরী বাড়ির মাটিতে পা রাখতেই আরিফ চৌধুরীর বুক কেঁপে ওঠে।সেই চিরচেনা নীড়।হাজারও স্মৃতি জমে আছে এই বাড়িকে ঘিরে,এই গ্রামকে ঘিরে,এই গ্রামের মানুষকে ঘিরে।আজাদ চৌধুরী এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন আরিফ চৌধুরী কে।আরিফ চৌধুরী আজাদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। উপস্থিত সকলের চোখে পানি।

“কেমন আছেন ভাইজান?”

“আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালো রেখেছে।তুই কেমন আছিস?আবরার আসবে না?”

“আমিও ভালো আছি ভাইজান। আবরার ছুটি নিতে চেয়েছে ভাইজান।ও নিশ্চয় আসবে।”

তারপর সবার সাথে ভালো মন্দ অনেক কথা বলে আরিফ চৌধুরী।কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই শ্রেয়া চৌধুরীর সাথে মিশে গেছে আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরী।যেনো নিজেদের আপন বোন। শ্রেয়া চৌধুরী দুজনের ব্যবহারে মুগ্ধ হন।দোতলা থেকে সবটাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখছে হৃদিত।ঠোঁটে বাঁকা হাসি।যেখান থেকে সব শুরু হয়েছিল সেখানেই শেষ করবে হৃদিত।হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপ নোটিফিকেশনে হাতে থাকা ফোন টা কেঁপে ওঠে।হৃদিত ফোনের স্ক্রিনে নজর রাখে।আনসেইভ নাম্বার থেকে টেক্সট এসেছে।

“নিজের ধ্বংস দেখতে নিশ্চয় কারোর ভালো লাগে না!আফসোস সেই দিন সন্নিকটে।”

টেক্সট টা পড়ে হৃদিত তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। নিজের ধ্বংস কেউ যদি নিজে ডেকে আনে তাহলে হৃদিতের আর কি করার!ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।হৃদিত জানালা থেকে সরে যেতেই আরিফ চৌধুরী নিজের দৃষ্টি নামিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।মেহরিমা কমফোর্টার মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে।গায়ে হৃদিতের সাদা শার্ট যেটা মেহরিমার হাঁটু ছুঁয়েছে।হৃদিত এক লাফে বিছানায় উঠে মেহরিমার কমফোর্টারের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।মেহরিমা একটু নড়েচড়ে উঠে হৃদিতের উন্মুক্ত বুকে মুখ গুজে আবারও গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে যায়।হৃদিত এক দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

_____

সময় সকাল আটটা বেজে পাঁচ মিনিট।মাধবী মন ভার করে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে।অবনী শেখ রান্না শেষ করে ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়ায়। জলিল শেখ ও বাইরে যাওয়ার জন্য একেবারে রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়।

“মাধু আম্মা তোমার কোচিং থেকে পিকনিকের অ্যারেঞ্জ করেছে শুনলাম।তুমি পিকনিকে অ্যাটেন্ড করবে না?”

“না বাবা।”

মাধবীর কথার পৃষ্ঠে জলিল শেখ প্রশ্ন করার আগেই অবনী শেখ জিজ্ঞাসা করে,

“কেনো?কোনো সমস্যা?”

মাধবী সময় নিয়ে জবাব দেয়,

“মা শিহাব ভাইয়ের করা ওই ঝামেলার পর থেকে কোচিংয়ের,গ্রামের সবাই কেমন একটা নজরে তাকায় আমার দিকে।আমার ভালো লাগে না একদম।ওদের নজর দেখে মনে হয় আমার গায়ে নোং রা লেগে আছে‌।”

কথাগুলো বলতে বলতে মাধবী ফুঁপিয়ে ওঠে। অবনী শেখ এগিয়ে এসে মাধবীর পাশে বসে। মাধবীর হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।

“তোর ইচ্ছে আছে পিকনিকে অ্যাটেন্ড করার?”

“হ্যাঁ মা। কিন্তু আমি অ্যাটেন্ড করবো না।ওরা আবার যদি উল্টা পাল্টা কিছু বলে বসে!”

“মানুষ কি বলবে তুই সেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিস?বোকা মেয়ে আমার।আজ তোকে কিছু কথা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবি ঠিক আছে?”

“আচ্ছা মা।”

“সাপোজ তুই এখন মারা গেলি।তুই মারা যাওয়া মাত্রই মানুষ তোর নামটাও আর মুখে নিবে না।বলবে,লা শ টা কে গোসল করাও,লা শ টা কে খাটিয়ায় তোলো,লা শ টা কবর দেও,অনেকে তো রাতে ভয় পাবে বলে তোর মৃ ত মুখ টাও দেখতে চাইবে না ব্যাস।আর এই ‘মানুষ কি বলবে’ভেবে তুই গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দিতে চাচ্ছিস?আশ্চর্য!জীবনটা তোর অন্যের না।তাই যতদিন বেঁচে থাকবি নিজের মতো করে বাঁচবি। সমালোচনাকারী তোর সমালোচনা করবেই সেটা তুই ভালো কাজ করলেও করবে খারাপ কাজ করলেও করবে।তাই নিজের আত্মতৃপ্তির কথা আগে ভাববি।এই জীবন টা খুব ছোট্ট রে মা।নিজের আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাঁচবি অলওয়েজ।”
কলমে~ ইসরাত তন্বী

অবনী শেখের কথাগুলো মাধবীর মস্তিষ্কে তড়িৎ গতিতে প্রভাব ফেলে।সেকেন্ডের ব্যবধানে মাধবীর চোখেমুখে কাঠিন্যের ছাপ ফুটে ওঠে। তেজস্বী কন্ঠে বলে,

“ঠিক বলেছো মা। জীবন টা আমার। তাই আমি নিজের মতো করে আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাঁচব।”

“এই তো আমার সোনা মা সহজেই বুঝে গেছে।”

অবনী শেখ মাধবী কে দু’হাতে বুকে আগলে নেয়। জলিল শেখ ওদের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে কিয়ৎকাল।এই মানুষ টার কথা জাদুর মতো কাজ করে সবসময়।ভাগ্যিস এই মানুষ টা কে জীবনে পেয়েছিল নাহলে এই ছোট্ট জীবন টা বোধহয় আর উপভোগ করা হতো না জলিল শেখের।এক পাক্ষিক ভাবে ভালোবেসে সেই স্বপ্নের রাজকুমারীর সাথে আজ সংসার করছে।তার দুটো কন্যা সন্তানের জনক হতে পেরেছে।একটা হাসিখুশি পরিবার পেয়েছে। জলিল শেখের জীবন পরিপূর্ণ।একজন মানুষের এর থেকে আর কিই বা চাওয়ার থাকে!

________

চৌধুরী পরিবারের সবাই নাস্তার টেবিলে বসে আছে।অপেক্ষা করছে হৃদিত আর মেহরিমার জন্য।আজ চৌধুরী বাড়ি যেনো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।সেই আগের মতই খুশিতে ছেয়ে গেছে বাড়ির চারিপাশ।সবার মুখে হাসি।বিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর হৃদিত আর মেহরিমা নিচে আসে।মেহরিমা গতকাল আয়াশ আর আরিশার সাথে পরিচিত হয়েছে।ইভেন আরিশার সাথে বেশ ভাব ও জমে গেছে মেহরিমার।আজ নাস্তার টেবিলে আরও দুটো অপরিচিত মুখ দেখতেই মেহরিমা ভাবুক হয়ে পড়ে।পরক্ষণেই হৃদিত আর আয়াশের সাথে ফেইসের মিল খুঁজে পেতেই মেহরিমা যা বোঝার বুঝে যায়।ওনাদের সাথে মিষ্টি কন্ঠে সালাম বিনিময় করে।আরিফ চৌধুরী মেহরিমার মুখের দিকে তাকাতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকায়!সেই চিরচেনা পরিচিত এক মায়াবী মুখ মানসপটে ভেসে ওঠে। মেহরিমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই এক প্রকার টেনে এনে নিজের পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেয় হৃদিত।হৃদিতের কাজে মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায় সাথে অবাক ও হয়!হৃদিত নিজের মা বাবাকে দেখেও যেন দেখলো না।হৃদিতের এহেন ব্যবহারে শ্রেয়া চৌধুরীর চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।মেহরিমা সহ সবাই সেটা লক্ষ্য করে।আরিফ হাসান চৌধুরী মলিন মুখে ঠাঁয় বসে রয়।কেউ আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে নাস্তা করতে শুরু করে।খাওয়ার শেষের দিকে আয়াশ আরিফ চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে,

“বাবা আগামীকাল আমাকে ঢাকা ব্যাক করতে হবে।এভাবে কাজ ফেলে এখানে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।আমার কাঁধে অনেক দায়িত্ব।নাস্তা শেষ করে বাইরে যাবো।চেয়ারম্যান জলিল আংকেলের সাথে দেখা করে গ্রামের সমস্যা গুলো জেনে সেগুলো ঠিক করার পরিকল্পনা করতে হবে।তুমি ও যাবে আমার সঙ্গে।”

“আচ্ছা ঠিকাছে।আরিশা মামনি আমাদের সাথে থাকুক কিছুদিন এখানে।”

“হ্যাঁ বাবা আরিশা এখানেই থাকবে।আমি একটু শান্তি চাই।”

আয়াশের শেষ কথাটা শুনে সবাই ওর দিকে দৃষ্টিপাত করে।আরিশা অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।সেটা লক্ষ্য করতেই আয়াশ আমতা আমতা করে বলে,

“আই মিন আরিশা এখানে থাকলে অনেক ভালো থাকবে।ওর তো গ্রাম খুব পছন্দ।আর ও শান্তিতে থাকলে আমিও শান্তিতেই থাকবো।”

আয়াশের কথা শুনে সবাই মুচকি হাসে।কেবল হৃদিত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে আয়াশের দিকে।

“এমপি স্যার নতুন বেয়াইয়ের সাথে দেখা করতে যাবেন।আই হোপ কিপটামো করে আমার সম্মান নষ্ট করবেন না।আপনাদের সম্মান না থাকলেও আমার সম্মান আছে।”

কথাগুলো বলে বেসিনে হাত ধুতে চলে যায় হৃদিত।হৃদিতের ব্যবহারে মেহরিমা সহ সবাই যেন অবাকের উপর অবাক হচ্ছে!আরিফ চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।এর শেষ কোথায় উনি নিজেও জানেন না।তবে উনি বুঝতে পারছেন ওনার ছেলে খেলার ছক পুরোপুরি উল্টে দিয়েছে।যার ফলস্বরূপ ওনাকে বার বার আবারও সেই বিভৎস অতীতের সম্মুখীন হতে হবে।

#চলবে______

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১৬
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

চৌধুরী পরিবারের ছোট সদস্যেরা সবাই একসাথে পুকুর পাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে।হৃদিত ওর বাগান বাড়িতে গেছে প্রায় দুই ঘন্টা হতে চলল।সূর্যি মামার অবস্থান ঠিক মাথার উপরে।ভ্যাপসা গরমে অস্থির হয়ে উঠেছে সকলে।রাতে ঠান্ডা আর দিনে গরম এভাবে মানুষের জীবন রিতিমত অসহনীয় হয়ে পড়েছে।মেহরিমা কে পেয়ে চৌধুরী পরিবারের সবার আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।আরিশা বড় বোনের মত হয়ে উঠেছে মাত্র দু’দিনেই।

“মেহু বাবার বাসায় যাবে না? বিয়ের পরে হাসবেন্ডের সাথে বাবার বাসায় যায় তো মেয়েরা ।”

আরিশার কথায় মেহরিমা মুখের হাসি বজায় রেখেই বলে,

“উনি গেলে যাবো।”

“এটা কেমন কথা মেহু!এগুলো বিয়ের রুলস।আর তোমাদের বিয়েটাও তো ঠিকভাবে হয়নি।বউভাত ও হবে না।অ্যাটলিস্ট এই রুলস গুলো তো মানতেই পারো।”

“ভাবী আমি ওনার সাথে কথা বলবো বিষয় টা নিয়ে।”

“এখানে কথা বলার কি আছে?আজব!তুমি যা বলবে হৃদিত শুনতে বাধ্য।তুমি কি মেরুদন্ডহীন মেয়ে নাকি?আচ্ছা সত্যি করে বলোতো হৃদিত কি সত্যিই তোমায় ভালোবেসে বিয়ে করেছে নাকি তোমার সম্মান রক্ষা করতে?আর শোনো বড়পু হিসেবে একটা কথা বলি সময় থাকতে হৃদিতরে শাড়ির আঁচলে বেঁধে ফেলো।ব্যাটা মানুষের মন কখন কোনদিকে চলে যায় বলা তো যায় না।”

আরিশার কথায় উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যায়!চোখ বড় বড় করে একবার মেহরিমার দিকে তাকায় আর একবার আরিশার দিকে তাকায়।আরিশার ঠোঁটের কোণে হাসি।মেহরিমার তাজা ক্ষত আরও তাজা করে দেওয়ার জন্য এই কথাগুলোই যথেষ্ট ছিলো।চোখে জলেরা এসে ভিড় জমায় পরক্ষণেই অবনী শেখের বলা কথাটা মনে পড়ে যায় ‘মেয়েদের আত্মসম্মান সবকিছুর ঊর্ধ্বে’।মেহরিমা গলায় আটকে আসা কান্না টুকো গিলে নেয়। চঞ্চল হাতে চোখমুখ মুছে কাঠিন্যতার সহিত বলে,

“উনি আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে নাকি অন্য কোনো রিজনের জন্য বিয়ে করেছে সেটা আমাদের পার্সোনাল ম্যাটার ভাবী।আর যে পাখি আমার তাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখলেও আমারই থাকবে,মুক্ত আকাশে উড়তে দিলেও দিনশেষে আমার কাছেই ফিরে আসবে।কারণ তার শেষ গন্তব্যস্থল শুধুই আমি।”

মেহরিমার জবাব শুনে আরিশার তোতা মুখ ভোঁতা হয়ে যায়।তৃধা,তাবান,তাইফের মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। নিস্তব্ধতার মাঝেই হৃদিতের গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,

“তৃধা মেহরিমা কে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যা।”

সবাই তৎক্ষণাৎ কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে সেদিকে দৃষ্টিপাত করে।হৃদিতের গায়ে থাকা সাদা শার্ট টা ভিজে শক্তপোক্ত শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে।ঘাড় ছুঁই ছুঁই বড় চুলগুলো কপালের উপর অযত্নে পড়ে আছে।পুরুষালি শাণিত চোয়াল আরও বেশি শাণিত লাগছে।মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে সোজা এখানেই এসেছে।হৃদিত বাগান বাড়িতে গেছিল হ্যানসেল আর হ্যারি কে সঙ্গে নিয়ে আসতে।এখন থেকে নিজের সাথেই রাখবে।হৃদিত বাসায় এসেছে পাঁচ মিনিট হতে চললো।দুই ঘন্টা যাবৎ অ্যানাবেলা কে না দেখতে পেয়ে হৃদিতের মনে অশান্তি শুরু হয়ে গেছিল।সেই অশান্তি কমাতেই দ্রুত ড্রাইভিং করে বাসায় এসেছে।দৌড়ে দোতলায় উঠে নিজের রুমে যেয়ে সেখানে মেহরিমা কে দেখতে না পেতেই মাথা খারাপ হয়ে যায় হৃদিতের।ঘরের জিনিসপত্র পুরো লন্ডভন্ড করে ফেলে।ব্যালকনিতে খোঁজার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই পুকুর পাড়ে মেহরিমা কে দেখতে পাই।তারপর এক ছুটে পুকুরপাড়ে উপস্থিত হয়।আর উপস্থিত হতেই আরিশা,মেহরিমার সব কথোপকথন শুনতে পাই।হৃদিতের কথায় সবাই উঠে চলে যেতে নিলেই হৃদিত বলে,

“ভাবী আপনাকে যেতে বলিনি।তৃধা মেহরিমাকে আমার রুমে দিয়ে আসবি।তাবান গাড়িতে হ্যানসেল,হ্যারি আছে।ওদের বের করে বাগানে নিয়ে আয়।”

নিজের কথা শেষ করে তাবানের দিকে গাড়ির সুইচ ছুড়ে মারে হৃদিত।তাবান সেটা নিয়ে তাইফের সাথে ওখান থেকে প্রস্থান করে।তৃধাও মেহরিমা কে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে যায়।মেহরিমা যাওয়ার আগে ছলছল চোখে হৃদিতের দিকে তাকায়।মেহরিমার চোখের পানি লক্ষ্য করতেই হৃদিতের বুকে আগুন জ্বলে ওঠে।আরিশার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,

“ইয়্যু নো আই হেইট স্লাট।আই ডোন্ট ওয়ানা টক টু ইয়্যু।আই জাস্ট ওয়ানা সে,স্টে এওয়ে ফ্রম মাই অ্যানাবেলা।”

তীব্র অপমানে আরিশার চোখমুখ শক্ত হয়ে ওঠে।ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে থাকে।তবুও মুখে হাসি টেনেই বলে,

“পারলে তোমার বউ কে আমার থেকে দূরে রাখো।”

“আমাদের মাঝে মেহরিমা কে নিজের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার মতো ভুল নিশ্চয় করবে না? ছয়মাস আগের কথা এতো সহজেই ভুলে গেলে?সংসার করার ইচ্ছা আছে তো নাকি?”

হৃদিতের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।আরিশা হৃদিতের কথায় কিংকর্তব্যবিমূড়!এই ছেলেকে হালকা ভাবে নেওয়া মানেই নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা‌। পরক্ষণেই ছয় মাস আগের কথা মনে পড়তেই আরিশার বুক কেঁপে ওঠে।হৃদিত আর কিছু না বলে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরতেই আরিশা উঁচু কন্ঠে বলে,

“ফুপিমনি আসবে নেক্সট উইকে।”

আরিশার কথায় হৃদিতের পা জোড়া থেমে যায়। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে।

“তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী ঠিক তোমার মতোই মাথামোটা।”

কথাটা বলেই সামনের দিকে হাঁটা ধরে হৃদিত।আরিশা চোখমুখ কুঁচকে হৃতিতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদিতের রুমের ব্যালকনি থেকে সবটাই দেখে মেহরিমা।ব্যস্ত পায়ে রুমে প্রবেশ করে।রুমের অগোছালো অবস্থা দেখে মেহরিমা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুক্ষণ আগে দৌড়ে ব্যালকনিতে যাওয়ার সময় কিছুই খেয়াল করেছিল না।তবে ওর খুব ভালো করে মনে আছে যখন রুম থেকে বের হয় তখন সব ঠিকঠাক ছিল। তাহলে এখন এরকম অবস্থা কি করে হলো?

______

রাত দশটা বেজে পাঁচ মিনিট।শেখ পরিবার রাতের খাওয়ার আয়োজন করছে।অবনী শেখ খাবার সার্ভ শেষ করে একটা চেয়ার টেনে বসে।নিজেও খেতে শুরু করে।জলিল শেখের চোখ মুখ কেমন শুকনো লাগছে।খাবারও খাচ্ছে না তেমন।অবনী শেখ সেটা লক্ষ্য করতেই বলে,

“কি হয়েছে তোমার?কোনো কিছু নিয়ে তুমি কি টেনশড?”

জলিল শেখ সময় নিয়ে জবাব দেয়,

“আগামীকাল চৌধুরী পরিবারের সবাই কে দাওয়াত করেছি।আজ সকালে আমার সাথে দেখা করেছে এমপি আরিফ হাসান চৌধুরী আর ওনার বড় ছেলে মন্ত্রী আয়াশ চৌধুরী।নতুন আত্মীয় আমার।ভদ্রতা বজায় রাখতে দাওয়াত করেছিলাম ওনারা গ্রহণ করেছে।”

জলিল শেখের কথায় অবনী শেখ মুচকি হেসে বলেন,

“হ্যাঁ তো এখানে টেনশন করার কি আছে?দাওয়াত দিয়েছো ভালো করেছো।এমনিতেও দাওয়াত দিতেই হতো ওনাদের।এই সুযোগে নীলাক্ষী আর হৃদিত ও এসে কিছুদিন এখানে থেকে যাবেনে।”

“তুমি এতো সহজেই সব ভুলে গেলে অবনী?”

“অতীত মনে রেখে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মতো মেয়ে আমি না।আর ওই পরিবারের সাথে আমার মেয়ে জড়িয়ে আছে এখন।এতটুকু তো করতেই হবে আমাদের।”

অবনী শেখের কথায় জলিল শেখের বুক থেকে পাথর নেমে যায়।এতো সহজেই যে সবটা মেনে নেবে সেটা জলিল শেখ ভাবতেও পারেনি। অবশ্য অবনী শেখের দ্বারা সব পসিবল।মাধবী নিরব দর্শক। মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে আর বাবা মায়ের কথোপকথন শুনছে।মেহরিমা আসবে শুনেই মাধবীর মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।

______

মেহরিমা ঠান্ডা ফিরফিরে বাতাসে ব্যালকনির দোলনায় বসে অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।মনটা হঠাৎ করেই কেমন বিষাদে ছেয়ে গেছে।মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন,চিন্তা ঘোরপাক খাচ্ছে।এই বাড়িতে এসে কেমন যেনো গোলক ধাঁধার মধ্যে আটকে পড়েছে!তখন দুপুরে হৃদিত রুমে এসে একাই সব পরিষ্কার করে গোছগাছ করে আবারও আগের মতো ঝকঝকে করে ফেলে রুম।মেহরিমা হেল্প করতে চাইলেও না করে দেয়।ইভেন ওই টপিকে প্রশ্ন করলেও হৃদিত বার বার ইগনোর করছে টপিক টা।মনের মাঝে বড্ড অশান্তি অনুভব হচ্ছে মেহরিমার।ইতোমধ্যে ফোনে তিনবার অবনী শেখের সাথে কথা বলেছে।তবুও শান্তি পাচ্ছে না।মায়ের কোলে মাথা রেখে শুতে পারলে বোধহয় একটু শান্তি অনুভব হতো।মেহরিমার ভাবনার মাঝেই ওর পাশে হৃদিত এসে বসে।মেহরিমা ধ্যান চ্যুত হয়।পাশে বসা হৃদিতের দিকে চোখ তুলে তাকায়।

“মন খারাপ?”

“উহু।”

“শরীর খারাপ?”

“উহু”

“পেইন কিলার নিয়েছিলিস?”

“হুম।”

“মায়ের কথা মনে পড়ছে?”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।হৃদিত মুচকি হেসে মেহরিমাকে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয়।হৃদিতের প্রশস্ত বুকে প্রশান্তিতে মাথা রাখে মেহরিমা।

“কাল নিয়ে যাবো।খুশি?”

মেহরিমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

“সত্যিই!”

“তিন সত্যি।”

“একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?”

“হু।”

“ওই দরজা টা কিসের?”

ব্যালকনির সাথে লাগোয়া কাঁচের একটা দরজা হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলে।হৃদিত মেহরিমার কপালে ছোট্ট করে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলে,

“আমার পার্সোনাল লাইব্রেরী,আর্টরুম ওটা।”

“আমি দেখতে চাই।”

“আচ্ছা দেখাবো।”

হৃদিত কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলতে শুরু করে,

“দুপুরে রুমে এসে তোকে না পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।তাই রাগের মাথায় ওরকম টা করে ফেলেছি।তোকে এক সেকেন্ড না দেখলে আমার অস্থির লাগে খুব।আই ওয়ানা স্পেন্ড মাই হোল লাইফ উইদ ইউ।”

মেহরিমা তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলে,

“ডোন্ট প্রমিজ জাস্ট প্রুভ।”

“অবভিয়াসলি আই উইল প্রুভ ইট।”

ওদের কথার মাঝেই হ্যানসেল আর হ্যারি ছুটে এসে ওদের সামনে বসে লেজ নাড়াতে থাকে।এই একদিনেই মেহরিমার ভক্ত হয়ে গেছে দুটো।

“ঘুমাবি না?”

“হ্যাঁ।”

কথা শেষ করার সাথে সাথেই নিজেকে শূন্যে অনুভব করে মেহরিমা।ভয়ে হৃদিতের গলা জড়িয়ে ধরে।হৃদিত রুমে এসে মেহরিমাকে শুইয়ে দেয় বেডে।রুমের দরজা,জানালা,লাইট সব অফ করে দিয়ে এসি অন করে দেয়।মেহরিমার গায়ে কমফোর্টার তুলে দিয়ে নিজেও ওটার মধ্যে ঢুকে পড়ে।মেহরিমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে দীর্ঘ ভালোবাসার পরশ দিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।মেহরিমা মুচকি হেঁসে হৃদিতের বুকে মাথা রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়।মূহুর্তের মধ্যেই কিছুক্ষণ আগের নিজের আকাশ পাতাল ভাবনা ভুলে যায়।

#চলবে_____

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-১৪

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১৪ [প্রথম অংশ]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

হৃদিতের ব্যালকনির চারি পাশ জুড়ে সুউচ্চ সারি সারি গাছ।শোঁ শোঁ শব্দে উঁচু সেই গাছের ছোট বড় পাতার ফাঁক ফোকড় দিয়ে বয়ে চলেছে হিমেল হাওয়া।মেঘের মতো করে উড়ে আসা শুভ্র শীতল সেই হাওয়ার পরশ মূহুর্তের মধ্যেই দেহের মনের সকল ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।একটু একটু করে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার।এখনই ধরনীর বুকে সন্ধ্যা নামবে।দিনের শেষ রেখায় দেখা মেলে নাম না জানা কতশত প্রজাতির পাখি আর কীটপতঙ্গের। শোনা যায় অচেনা পাখি ও ব্যাঙের ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার গুঞ্জন।যারা গ্রামে বসবাস করেন, সন্ধ্যা নামলে জোনাকি পোকার মিছিল,ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সঙ্গে তাদের সখ্যতা বেশ‌ দারুন। কেননা সন্ধ্যা নামলেই ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ সঙ্গীত আর জোনাকি পোকার মশাল আলোর মিছিল মানেই এক অন্যরকম অনুভুতি!

সময় সন্ধ্যা সাতটা।মেহরিমা মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে হৃদিতের ব্যালকনিতে বসে প্রকৃতির মন মাতানো সৌন্দর্য উপভোগ করছে।হৃদিতের ব্যালকনিটা একটু অন্যরকম।ছাদ বিহীন ব্যালকনিটা সুবিশাল অম্বরের নিচে অবস্থিত।ব্যালকনিতে আছে অনেক প্রজাতির ফুলের গাছ।আরও আছে ছোট্ট একটা আর্টিফিশিয়াল ফুলের দোলনা।বেলী ফুলের সুবাসে ভরে উঠেছে ব্যালকনির চারিপাশ।বলা চলে মেহরিমা এক প্রকার বাধ্য হয়েই ব্যালকনির দোলনায় বসে আছে।অবশ্য এটাতে মেহরিমার ভালোই হয়েছে।এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারছে।মেহরিমা মনে মনে ভেবে নেয় হৃদিতকে বড় করে একটা থ্যাংকস জানাবে।হৃদিত রুম লক করে কি করছে কে জানে?মেহরিমার জন্য নাকি কি একটা সারপ্রাইজ আছে এটাই বলেছে মেহরিমাকে।আজ একদিনেই হৃদিতের পাগলামীতে মেহরিমা আবিষ্ট হয়ে পড়েছে।একটা মানুষ কিভাবে এতোটা ভালোবাসতে পারে!মেহরিমার হঠাৎ করেই দুপুরের কথা মনে পড়ে যায়।মেহরিমা শাওয়ার নেওয়ার পরে উপলব্ধি করতে পারে ও টাওয়াল নিয়ে যায়নি ওয়াশ রুমে।দশ মিনিট মতো উশখুশ করেও অতিরিক্ত লজ্জায় পড়ে হৃদিতের থেকে টাওয়াল চাইতে পারেনা মেহরিমা।যখন ওড়না দিয়ে মাথা মোছার চিন্তা ভাবনা করে ঠিক তক্ষুনি ওয়াশ রুমের দরজায় নক করে ভদ্র ছেলের মতো মেহরিমা কে টাওয়াল টা দেয় হৃদিত।আর ছোট ছোট কেয়ারিং তো আছেই।এই এক দিনেই হৃদিতের প্রতি মেহরিমার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা অনেক গুণ বেড়ে গেছে।ব্যালকনির দরজা খোলার শব্দে মেহরিমা পেছনে ঘুরে তাকায়।হৃদিত একটা সফট কাপড় এনে মেহরিমার চোখ বেঁধে দেয়।মেহরিমা ভয়ে হৃদিতের হাত খা ম চে ধরে।

“চ.. চোখ বাঁধলেন কেনো?”

“তোকে এখান থেকে ফেলে দেবো বলে।”

মেহরিমা ভয় পেয়ে যায়।কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,

“আমাকে ফেলে দেবেন না প্লিজ।আমি বাঁচতে চাই।”

“কার সাথে?”

মেহরিমা সময় নিয়ে জবাব দেয়,

“আপনার সাথে।”

“শুধু আমার সাথেই?আমাদের বাচ্চার সাথে
না?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায়।হৃদিত আর কথা না বাড়িয়ে মেহরিমাকে রুমে নিয়ে আসে।

“শাড়ি পড়তে পারিস?”

“হু।”

“এই নে ওয়াশ রুম থেকে এই শাড়িটা পড়ে আয়।আ’ম ওয়েটিং।”

“কিন্তু আমার তো চোখ বাঁধা।”

“আমার সাথে চল।”

হৃদিত মেহরিমার হাত ধরে ওয়াশ রুমের দরজার সামনে নিয়ে যায়।মেহরিমার চোখজোড়া খুলে দেয়।

“আমি বাইরে থেকে লক করে দিচ্ছি।তুই ফাস্ট শাড়ি পড়ে আয়।কান্ট ওয়েট অ্যানিমোর।”

হৃদিতের কথামতো মেহরিমা বিশ মিনিট সময় নিয়ে শাড়ি পড়া শেষ করে ওয়াশ রুমের দরজায় নক করে।হৃদিত যেনো এই অপেক্ষাতেই ছিলো।চট করে দরজা খুলে দেয়।মেহরিমা ব্লাক কালারের একটা পাতলা জর্জেট শাড়ি পড়েছে।জর্জেট কাপড়ের ব্লাউজের হাতাটা কনুই পর্যন্ত লম্বা।পিছনের ফিতা দুটো বেঁধে অযত্নে পিঠের উপরে ফেলে রেখেছে।তাছাড়া পিঠে এক টুকরো কাপড়ও নেই।হাঁটু সমান ঘন কালো কেশ গুলো পিছনে মেলে দেওয়া।মেহরিমা লজ্জায় রাঙা মুখ নামিয়ে রেখেছে।ক্যান্ডেলের মৃদু আলোয় মেহরিমাকে বড্ড আবেদনময়ী লাগছে।হৃদিত মোহাবিষ্টের ন্যায় চেয়ে থাকে কিয়ৎকাল।আস্তে আস্তে মেহরিমার নিকট এগিয়ে যায়।ধীর অস্পষ্ট স্বরে বলে,

“আমাকে আর কত পা গ ল করবি?তোকে দেখলে আমি আর আমার মধ্যে থাকি না কেনো জান?আমার মন চুরি করার এতো বড় সাহস কোথায় পেলি মেহুপাখি?”

হৃদিতের ইনটক্সিকেটিং হাস্কি ভয়েস কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার শান্ত মন অশান্ত হয়ে পড়ে।ঠিক হৃদিতের মতোই।হৃৎপিণ্ড শব্দ তুলে ধ্বক ধ্বক করে চলেছে।মেহরিমা দৃষ্টি তুলে তাকায় হৃদিতের দিকে।মুহূর্তেই দুই জোড়া চোখের নিরব দৃষ্টি মিলে যায়।মেহরিমা সেকেন্ডের ব্যবধানে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।ওই নীল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির গভীরতা বোঝার ক্ষমতা মেহরিমার নেই।হৃদিত আরেকটু এগিয়ে যেতেই মেহরিমা দেওয়ালের সাথে মিশে যায়।হৃদিত মেহরিমার একদম কাছাকাছি যেয়ে দাঁড়ায়।মেহরিমার মুখের উপর হালকা ঝুঁকে ফুঁ দিতেই মেহরিমা পরম আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।হৃদিত মুচকি হেসে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়।মেহরিমার উ ন্মু ক্ত পে টে হাত রাখতেই মেহরিমা কেঁপে ওঠে।শির দাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।হৃদিত মেহরিমার নরম পে ট খা ম চে ধরে অ ধ র জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নেয়।সময় নিয়ে ছাড়ে মেহরিমাকে।পরক্ষণেই গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়।ছোট ছোট ভালোবাসার পরশে মেহরিমাকে ভরিয়ে দিতে থাকে।গলায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করে তবেই ক্ষান্ত হয় হৃদিত।মেহরিমা তখন দিশেহারা।বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে ব্যস্ত।হৃদিত মেহরিমার চোখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।অনায়াসেই নিজের প্রেয়সীর চোখের অব্যক্ত ভাষা বুঝে ফেলে।মেহরিমা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে চোখ নামিয়ে ফ্লোরে দৃষ্টিপাত করে।

“বউজান শুধু আমাকে দেখলেই হবে?পুরো রুমটা তো দেখবি একবার।তোর জন্যই তো এতো কিছু করলাম আমি।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা ফ্লোর থেকে নজর তুলে রুমের দিকে তাকায়।পুরো রুম পার্পল কালারের ফ্লাওয়ার্স দিয়ে ডেকোরেশন করা।ফেইরি লাইটের পরিমাণ আরও বেড়েছে।ছোট শত শত ক্যান্ডেল জ্বলছে রুমের মধ্যে।সেই আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রুমের চারিপাশের দেওয়ালে মেহরিমার শত শত ছবি টাঙানো।কয়েকটা জাস্ট ফটোশুট বাকি সবগুলোই আর্ট করা।মেহরিমা কিছুক্ষণের জন্য থমকায়!ছলছল চোখে হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদিতের ঠোঁটে ভুবন ভোলানো মিষ্টি হাসি।মেহরিমা হঠাৎ করেই দৌড়ে যেয়ে হৃদিতকে জাপটে জড়িয়ে ধরে।হৃদিত যেনো আগে থেকেই জানতো এমনটাই ঘটবে।শক্ত করে বুকের মধ্যিখানে জড়িয়ে নেয় নিজের অ্যানাবেলাকে।কিছু নির্জন সুখকর সময় পার হয়ে যায় একে অপরের উষ্ণ আলিঙ্গনে।হৃদিত মেহরিমাকে ছেড়ে দিয়ে রুমের লাইট অন করে।লাইটের তীব্র আলোয় মেহরিমা ঘুরে ঘুরে মুগ্ধ নয়নে নিজের ছবিগুলো দেখতে থাকে।কতোটা যত্ন,ভালোবাসা নিয়ে এঁকেছে একেকটা ছবি!কিছু ছবি দেখে লজ্জাও পেয়ে যায় মেহরিমা।কয়েকটা ছবিতে পোশাক বেশ খোলামেলা ভাবে এঁকেছে।তবে ততটাও না।মেহরিমা লাজুক হাসে।মনে মনে আওড়ায় এই ছেলে একটা বদ্ধ পাগল।হৃদিত মেহরিমার নিকট এগিয়ে এসে বলে,

“আমার লিটল কিটির কি পছন্দ হয়েছে সারপ্রাইজ?”

“আপনি খুউউব সুন্দর আর্ট করতে পারেন।”

“আই‌ নো।গিভ মি আন্সার।”

“খুব, খুব, খুব পছন্দ হয়েছে।আমার লাইফের বেস্ট সারপ্রাইজ ছিলো এটা।”

“চল ব্যালকনিতে যায়।আজ পূর্ণিমা।জোৎস্না বিলাস করি দু’জনে মিলে।”

“এই ছবিগুলো এভাবেই থাকবে?”

“হুম,কোনো সমস্যা?”

“এভাবে সবাই দেখলে কি ভাববে?আমার ওই ছবিগুলো তো…”

মেহরিমা লজ্জায় নিজের কথা শেষ করতে পারে না।হৃদিত মেহরিমার না বলা কথাটা চট করেই বুঝে ফেলে।

“আমার রুমে কারোর আসার পারমিশন নেই।নট অ্যালাও বুঝলি?ওগুলো তো জাস্ট পিকচার।তুই সারা দিন রাত ওভাবে থাকলেও কোনো সমস্যা হবে না।ট্রাস্ট না হলে একদিন ট্রাই করে দেখতে পারিস।”

কথাটা বলেই দুষ্টু হাসে হৃদিত।লজ্জায় মেহরিমার কান মুখ গরম হয়ে ওঠে।এক প্রকার পালিয়ে ব্যালকনিতে চলে যায়।হৃদিতও গিটার কাঁধে নিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে শিস বাজাতে বাজাতে ব্যালকনির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।আজ আর মেহরিমার মু ক্তি নেই।

#চলবে___

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব১৪ . [শেষ অংশ]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

দিন পেরিয়ে ধরণীর বুকে নেমে আসা একটি রজনীর অদ্ভুত সৌন্দর্য কে যদি বর্ণনা করা হয় তাহলে সবার প্রথমেই চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে পূর্ণিমা রাতের দৃশ্য।মানুষের মন কে মোহগ্রস্ত করে এক মায়াময় রজনীর সূচনা করে পূর্ণিমার চাঁদ।না আলো,না আঁধার এমন এক রহস্যের মায়াজালে মানব মনকে বন্দি করতে পারে শুধু ঐ দূর আকাশের থালার মতো বড় গোল চাঁদ টা। রাতের নিস্তব্ধতা গলিয়ে দূর থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক।হালকা ঠান্ডা ঝিরিঝিরি পবন বইছে।শীতের আগমনী বার্তা যেন!

মেহরিমা আর হৃদিত ব্যালকনির দোলনায় বসে আছে।জোৎস্না ভরা রাত।চাঁদ যেনো তার নিজের সবটুকু আলো পৃথিবীর বুকে ঢেলে দিয়ে পৃথিবীকে নতুন রুপে সাজিয়েছে!মেহরিমা হাঁটুর উপর মাথা রেখে পা জোড়া বুকে জড়িয়ে বসে আছে।নজর পাশে বসা নিজের ব্যক্তিগত সুদর্শন পুরুষটার দিকে।চাঁদের আলোয় নীল রঙের মণি জোড়া ঝলমল করছে।হৃদিত,মেহরিমার দু’জনের ঠোঁটেই মুচকি হাসি। হঠাৎ হৃদিতের গিটার থেকে ভেসে আসে আশিকি টু’র ‘তুম হি হো’ গানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক।এই জোৎস্না রাতের অপূর্ব সৌন্দর্যের সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক টা মিলেমিশে তৈরি করেছে মন মাতানো এক চমৎকার পরিবেশ।

হাম তেরে বিন আব রেহ নেহি সাকতে
তেরে বিনা কিয়া ওয়াজুদ মেরা‌।
হাম তেরে বিন আব রেহ নেহি সাকতে
তেরে বিনা কিয়া ওয়াজুদ মেরা‌
তুঝছে জুদা আগার হো জায়েঙ্গে
তো খুদ সে হি হো জায়েঙ্গে জুদা।
কিউকি তুম হি হো
আব তুম হি হো
জিন্দেগী আব তুম হি হো
চেইন ভি মেরা দার্দ ভি
মেরি আশিকি আব তুম হি হো।
তেরা মেরা রিশতা হে কেসা
ইক পাল দুর গাওয়ারা নেহি
তেরে লিয়ে হার রোজ হে জিতে
তুজ কো দিয়া মেরা ওয়াক্ত সাবি
কই লামহা মেরা না হো তেরে বিনা
হার সাস পে নাম তেরা।
কিউকি তুম হি হো
আব তুম হি হো
জিন্দেগী আব তুম হি হো
চেইন ভি মেরা দার্দ ভি
মেরি আশিকি আব তুম হি হো।
তুমি হি হো……
তুমি হি হো…..
তেরে লিয়ে হি জিয়া মে
খুদ কো জো ইয়্যু দে দিয়া হে
তেরি ওফা নে মুজকো সামহালা
সারে গামো কো দিল সে নিকালা
তেরে সাথ মেরা হে নাসিব জুড়া
তুঝে পাকে আধুরা না রাহা…হুম
কিউকি তুম হি হো
আব তুম হি হো
জিন্দেগী আব তুম হি হো
চেইন ভি মেরি দার্দ ভি
মেরি আশিকি আব তুম হি হো (২)

হৃদিত নিজের পুরুষালি সুমধুর কন্ঠে গান গেয়ে থামে।মেহরিমা চোখ বন্ধ করে অনুভব করে হৃদিতের গাওয়া গানের প্রতিটি লাইন।কি সুন্দর ভালোবাসা,মাধুর্য মিশিয়ে গাইলো গান টা!গানের মধ্যে দিয়ে নিজের অব্যক্ত কথাগুলো অনায়াসে প্রকাশ করে দিলো।গান থেমে যাওয়ার সাথে সাথেই চোখজোড়া খুলে হৃদিতের দিকে দৃষ্টিপাত করে মেহরিমা।হৃদিত মেহরিমার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মেহরিমা প্রফুল্ল কন্ঠে বলে,

“আপনার গানের গলা মারাত্মক!এই দিয়ে তিন দিন শুনলাম আপনার গান। আপনি কি সব পারেন?”

“সব বলতে?”

“এই ধরুন আপনি গান গাইতে পারেন,আর্ট করতে পারেন, ফুটবল ক্রিকেট খেলতে পারেন, পড়াশোনা তেও কত্ত ভালো!”

“আমার পড়াশোনা সম্পর্কে কতটুকু জানিস তুই?”

“সব জানি আমি।আপনি ঢাবি ম্যাথ ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছেন।”

“কিভাবে জানিস?”

“আরে আমিতো তৃধার থেকে সব সময় আপনার খোঁজ খবর নেই। আপনার বিষয়ে এ টু জেড সব জানি আমি।”

মুড নিয়ে বলে মেহরিমা।হৃদিত মৃদু হেসে বলে,

“দ্যাটস গুড।আই লাইক ইট। তুই শুধু আমাকে নিয়ে,আমার বিষয় নিয়েই চিন্তা ভাবনা করবি।তোর মন,মস্তিষ্ক সবটা জুড়ে যেনো শুধুমাত্র আমি থাকি।তোর পৃথিবী জুড়ে শুধু হৃদিত নামটাই থাকবে‌।আর কেউ না।”

মেহরিমা মুচকি হেসে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে।বোকা মেহরিমা কথাটার গভীর অর্থ বুঝেও যেনো বুঝলো না!

“তিন দিন গান কিভাবে শুনলি?আমিতো আজ দিয়ে দুই দিন তোকে গান শোনালাম।”

“একদিন চুরি করে শুনেছিলাম।আমি তখন ক্লাস টেনে পড়তাম।”

“স্টিলিং ইজ আ সিন।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,

“আই নো বাট ওটা তো ওরকম চুরি ছিলো না।”

“বি প্রিপেয়ারড ফর পানিশমেন্ট।”

মেহরিমা আঁতকে ওঠে বলে,

“কিসের পানিশমেন্ট?”

মেহরিমা নিজের কথা শেষ করার সাথে সাথে নিজেকে হৃদিতের উরুর উপর অনুভব করে।কিছু বুঝে ওঠার আগেই অধর জোড়া হৃদিতের আয়ত্তে চলে যায়।হৃদিত মেহরিমাকে ছেড়ে দিয়েই কোলে উঠিয়ে নেয়।দ্রুত কদমে রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে।

“আই কান্ট সোনা।প্রিপেয়ার ইউরসেল্ফ ফর টুনাইট।”

হৃদিত বিছানায় এক প্রকার ছুড়ে মারে মেহরিমাকে।শার্টের বাটনে দ্রুত হাত চালাতে থাকে।হৃদিতের এই নতুন রুপে মেহরিমা ভীত হয়ে পড়ে।ভয়ে শুকনো ঢোক গেলে।হঠাৎ করেই ভয়ে ওর ক্ষুধা পেয়ে যায়।হৃদিত এক মিনিটেই শার্ট আনবাটন করে ফেলে।মেহরিমার উপর উঠে পিঠে হাত রেখে ফিতা ধরতে নিলেই মেহরিমা চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে ,

“আমার ক্ষুধা পেয়েছে।খাবো।”

মেহরিমার তাৎক্ষণিক চিৎকারে হৃদিতের হাত জোড়া থেমে যায়।মেহরিমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

“হ্যাঁ সেটার প্রিপারেশন’ই তো নিচ্ছি।”

“ভাত খাবো।”

এই সময়ে মেহরিমার এহেন কথায় হৃদিত যেন আকাশ থেকে পড়ে!ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলে,

“আচ্ছা।দুই মিনিট ওয়েট কর।”

হৃদিত তাবানকে কল দিয়ে খাবার দিয়ে যেতে বলে।দুই মিনিটের মাথায় দরজায় নক করে তাবান।হৃদিত খাবার আনতে এগিয়ে যায়।দরজা খুলতেই তাবান হাসিমুখে খাবারের প্লেট এগিয়ে দেয়।হৃদিত খাবার নিয়ে দরজা লক করে দেয়।মেহরিমার নিকট এসে খাবার ধরিয়ে দেয় হাতে‌।

“সময় পনেরো মিনিট। ফাস্ট শেষ কর।এর এক সেকেন্ড ও বেশি সময় লাগলে তোর অবস্থা আরও খারাপ হবে।”

বিরিয়ানি দেখতেই মেহরিমা খুশি হয়ে যায়।দৌড়ে ওয়াশ রুম যেয়ে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে শুরু করে দেয়। কয়েক লোকমা মুখে দেওয়ার পর হৃদিতের কথা মনে পড়ে।মেহরিমা অসহায় চোখে হৃদিতের দিকে তাকায়।হৃদিত স্বাভাবিক চাহনি দিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

“আপনি খাবেন না?”

“আমার জন্য তুই আসিস।সময় আর মাত্র বারো মিনিট।”

এবার আর মেহরিমা কে পাই!দিন দুনিয়া ভুলে দশ মিনিটে বিরিয়ানি শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। পরক্ষণেই হৃদিতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে যায়‌।ফুলো গাল দুটো লালচে আভায় ছেয়ে যায়।

“শেষ?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি দিয়ে তাকায়।হৃদিত আবারও বলে,

“তোর সব কাজ শেষ?”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই তড়িৎ গতিতে ওকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে ওর উপর নিজের ভার ছেড়ে দেয় হৃদিত।অধর জোড়া নিজের অধর দিয়ে আঁকড়ে ধরে।মেহরিমা কিছুক্ষণ মোচড়া মুচড়ি করে করে শান্ত হয়ে যায়।নিজেও হৃদিতের ডাকে সাড়া দেয়।হৃদিত যেন এটারই অপেক্ষায় ছিল।ধৈর্যহীন হয়ে পুরো শরীরে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে লেগে পড়ে।মেহরিমা নরম কন্ঠে আস্তে করে বলে,

“লাইট টা বন্ধ করুন প্লিজ।”

“উমম!এভাবেই থাক।”

“প্লিজ!”

হৃদিত চোখ তুলে মেহরিমার দিকে তাকাতেই অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করা লজ্জায় আড়ষ্ট হওয়া মুখমণ্ডল চক্ষু গোচর হয়।হৃদিত হাত বাড়িয়ে লাইট অফ করে দিয়ে পুনরায় মেহরিমাতে ডুব দেয়।মেহরিমা হৃদিতের আরও নতুন একটা রুপের সাথে পরিচিত হয়।ছেলেটা সত্যিই পাগল! শুধু মেহরিমার জন্য পাগল!এই বদ্ধ পাগল টাকেই লাগবে মেহরিমার।বাইরে শনশন করে বাতাস বইছে।প্রকৃতির ঠান্ডা ফিরফিরে বাতাসে জানালার পর্দা ক্ষণে ক্ষণে উড়ে যেয়ে চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছে রুমে।বদ্ধ রুমে দু’জন নরনারীর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু।চাঁদের আলো মেহরিমার মুখে এসে পড়ছে বারংবার।চাঁদের আবছা হলদে আলোয় মেহরিমার লজ্জা রাঙা মুখখানি দেখতে রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার মতো লাগছে।অশ্রুসিক্ত নেত্র।ভেজা আঁখি পল্লব।হৃদিত ওই অশ্রুসিক্ত নেত্রের গভীরেই নিজের বি না শ,ম র ণ দেখতে পাই।নরম আদুরে স্বরে আওড়াই,

“আমার বিনাশিনী,আমার প্রাণনাশিনী,আমার অ্যানাবেলা।”

#চলবে____

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-১২+১৩

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১২
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

বিষ্ণু নদীতে শিহাবের লা শ পাওয়া গেছে।গ্রামের এক জেলে অতি ভোরে নদীতে মাছ ধরতে যেয়ে শিহাবের লা শ পেয়েছে।শিহাবের বিভৎস লাশ দেখে গ্রামের মানুষ প্রচন্ড ভয় পেয়েছে সাথে অবাক ও হয়েছে খুব!এতো বি ভ ৎ স ভাবে আদৌও কি কোনো মানুষ মারতে পারে?নাকি অন্যকিছুর কাজ এটা?গ্রামের সকলের মনে হাজারও প্রশ্ন খচখচ করছে।সবাই অতিদ্রুত লা শ দা ফ নে র কাজে লেগে পড়েছে।পুলিশ ইতোমধ্যে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে।

সময় সকাল আটটা।দিনটা শুক্রবার।আজ আর বৃষ্টি নামেনি ধরণীর বুকে।অন্য দিনের মতোই ঝলমলে একটা দিন।পূর্ব দিগন্তে সূর্য বেশ তেজ নিয়ে উঠেছে।মেহরিমা অন্যমনস্ক হয়ে ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে আছে।শিহাবের করুণ মৃত্যুর কথাটা শুনেছে মেহরিমা।হৃদিত এখনও ঘুমাচ্ছে। অবনী শেখ রান্না শেষ করে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মেহরিমার পাশে এসে বসে।আজ সকাল থেকেই ভ্যাপসা গরম পড়া শুরু হয়েছে।

“হৃদিত রাতে কখন এসেছে?”

অবনী শেখের কথায় মেহরিমা নড়েচড়ে বসে।সময় নিয়ে জবাব দেয়।

“মধ্যরাতে।”

“খেতে দিয়েছিলিস কিছু?”

“খেতে দিতে চেয়েছিলাম উনিই খাইনি।”

“ওও আচ্ছা।বেলা তো ভালোই হলো যা রুমে যেয়ে দেখ হৃদিত ওঠে কি না?”

“মা!”

অবনী শেখ মেহরিমার দিকে তাকিয়েই যেনো মেহরিমার মনের কথা বুঝে ফেলে। মুচকি হেসে বলে,

“সময় হলে সব জানতে পারবি।এখন এইসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে স্টাডি তে কনসেনট্রেশন দে।আজ হৃদিত তোকে চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে যাবে। এখন থেকে ওখানেই থাকবি।”

অবনী শেখের কথায় মেহরিমার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বলে,

“আমি যাবো না মা। তোমাদের ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।”

মেহরিমার কথায় অবনী শেখের মন হু হু করে কেঁদে ওঠে। চোখে জলেরা ভীড় জমায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে বলে,

“যেতে হবেই মা।এটাই প্রকৃতির নিয়ম।আমরা বাধ্য।”

“আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলে কেনো মা?”

“তোর ভালোর জন্যই। কেনো তুই খুশি না এই বিয়েতে?”

মেহরিমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। অবনী শেখ মেহরিমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন,

“আমার মেয়ে সাহসী।আমার মেয়েকে আমি কঠিন সত্তায় তৈরি করেছি।আমার মেয়ে যেনো অল্পতেই ভেঙে না পড়ে।সংসার জীবন যেমন কঠিন তেমন সহজও মা।সবটা তোর উপর ডিপেন্ড করবে।তুই যেরকম ভাবে হ্যান্ডেল করতে পারবি সেরকমই হবে সংসার জীবন।সবসময় নিজেকে মানিয়ে,গুছিয়ে চলতে হয়।তবে নিজের আত্মসম্মানের সাথে কখনো আপস করবি না।মনে রাখবি মেয়েদের আত্মসম্মান সবকিছুর ঊর্ধ্বে।কখনো অপাত্রে ভালোবাসা আর সম্মান দান করবি না।মানুষের ব্যবহার দিয়ে তাকে যাচাই বাছাই করবি।মনে থাকবে?”

মেহরিমা হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“মনে থাকবে।”

“আমার লক্ষী মা।আর অন্যের কোনো কথায় হৃদিতকে কখনো ভুল বুঝবি না।মনে রাখবি স্বচক্ষে দেখাতেও মিস্টেক হতে পারে‌।ঝগড়া,ঝামেলা এগুলো কখনো কোনো কিছুর সলিউশন হতে পারে না। নিজেদের মধ্যকার ঝামেলা নিজেরা ডিসকাশন করেই ঠিক করে নিবি।ঘরের কথা কখনো বাইরে বলে হাসির পাত্রী হবি না।আর এই বাড়ির দরজা সবসময় তোর জন্য খোলা।কখনো যদি ওই বাড়িতে নিজেকে বোঝা মনে হয় এক সেকেন্ড ও অপচয় না করে তোর মায়ের বুকে ফিরে আসবি।”

মেহরিমা ঠোঁটে হাসি চোখে পানি নিয়ে অবনী শেখের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই মানুষ টা এতো অদ্ভুত রকমের ভালো কেনো?মেহরিমাকে এতোটা বোঝে কিভাবে?সব মায়েরাই বোধহয় এমন হয়।

“অবনী খেতে দেও।নাস্তা করে বাইরে যাবো।”

জলিল শেখের কথায় অবনী শেখ মেহরিমার মাথায় ছোট্ট একটা চু মু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।মেহরিমার উদ্দেশ্যে বলে,

“রুমে যেয়ে হৃদিত কে উঠিয়ে ফ্রেশ হতে বল।”

“আচ্ছা।ও বাবা শিহাবের জা না জা কখন?”

“নয়টা পনেরো তে আম্মা।”

“তুমি জা না জা য় যাবে বাবা?”

“হুম।”

মেহরিমা আর কিছু না বলে গেস্ট রুমের উদ্দেশ্যে হাটা ধরে।মেহরিমা রুমে এসে দেখে হৃদিত উপুড় হয়ে ঠোঁট টা লাভ শেইপ করে বাচ্চাদের মতো করে ঘুমাচ্ছে।মেহরিমা গুটি গুটি পায়ে বিছানার নিকট এগিয়ে যায়।হৃদিত কে দেখতে নিষ্পাপ ছোট্ট একটা বাচ্চার মতো লাগছে।মেহরিমার খুব করে মন চাইলো একটু আদর করে দিতে।পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়।এই ছেলে সুবিধার না একদম।কিছু তো একটা আছেই এই ছেলের মাঝে!এই ছেলের কাছে আসলেই মেহরিমা কেমন যেনো বেশামাল হয়ে যায়।না জানি কবে কি অ ঘ ট ন ঘটিয়ে ফেলে!মেহরিমা নিজেকে খুব করে সামলায়। অতঃপর আস্তে আস্তে ডাক দেয়,

“এই শুনছেন?বেলা হয়েছে অনেক। উঠে পড়ুন।বাবা আপনার সাথে নাস্তা করার জন্য ওয়েট করছে।”

মেহরিমার কথা হৃদিত আদৌও শুনলো কি শুনলো না কে জানে! একটু নড়েচড়ে আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।মেহরিমা পড়েছে বিপাকে।এবার ডাকার জন্য গায়ে হাত দিতেই হৃদিত মেহরিমাকে একটানে নিজের নিচে নিয়ে ওর গায়ের উপর পা তুলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে।মেহরিমা লজ্জায়, আতংকে হাঁসফাঁস করতে থাকে।

“শ.. শুনুন দরজা খোলা। আপনি উঠে পড়ুন প্লিজ।”

হৃদিত ঘুম জড়ানো কন্ঠেই বলে,

“তাহলে তুই কি চাচ্ছিস আমি দরজা লক করে দিয়ে আসি?”

হৃদিতের এহেন কন্ঠস্বরে মেহরিমা থমকায়‌!বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ড টা আবারও শব্দ তুলে ধ্বক ধ্বক করে চলেছে।মেহরিমা জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলে,

“বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। এমন করবেন না প্লিজ।”

“হুশশশ!বউজান।স্টপ টকিং। তুই না আমার ভালো বউ? তাহলে এতো জ্বালাস কেনো? চুপচাপ থাক।”

মেহরিমা মোচড়া মুচড়ি করতে করতে এক সময় শান্ত হয়ে যায়।এই ছেলের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়।মেহরিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।হৃদিত চোখ বুজেই মুচকি হাসে।পাঁচ মিনিট পর নিজে থেকেই মেহরিমা কে ছেড়ে দিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়।মেহরিমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাত জান টাই বের হয়ে যেতো!পনেরো মিনিট সময় নিয়ে হৃদিত ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর সবাই মিলে একসাথে সকালের নাস্তা করে। জলিল শেখের সাথে হৃদিত ও শিহাবের জা না জা য় শরিক হতে যায়।মেহরিমা মনে মনে খুব খুশি হয়।ওর ভালোবাসার মানুষ টা কত্ত ভালো!একটা ন র প শু র জানাজায় শরিক হতে যাচ্ছে তাও যে কিনা মেহরিমার সম্মান নিয়ে খেলতে চেয়েছিল!কতো ভালো মনের মানুষ হৃদিত।কত সহজেই ক্ষমা করে দিয়েছে প শু টা কে।মেহরিমা মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে যে ও সঠিক মানুষকেই ভালোবেসেছে।যার মধ্যে নেই কোনো হিং স্র তা।আছে শুধু মায়া আর ভালোবাসা।নিজের ভাবনাই নিজেই মুচকি হাসে মেহরিমা।মেহরিমার হাসি দেখে মাধবী বলে,

“কি রে মেহু পাগল হলি নাকি? হঠাৎ হাসছিস কেনো?”

“কিছু না মাধুপু।ও মাধুপু চলো না আমার সাথে চৌধুরী বাড়িতে।আজ থাকবে আমার সাথে।”

“ধুর পাগলি তাই হয় নাকি?বাবা মা একা হয়ে যাবে না?আর তাতে কি এইতো দশ মিনিটের পথ। যখন মন চাইবে আমি চলে যাবো।আর ওখানে তৃধা আছে তো। সমস্যা হবে না বোন।”

ওদের কথার মাঝেই হৃদিত আর জলিল শেখ বাসায় আসেন।হৃদিত এসে ধপ করে মেহরিমার পাশে বসে মেহরিমার ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,

“বাইরে খুব গরম বুঝলি?যা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে দে।আর দশ মিনিটের মধ্যে লাগেজ গুছিয়ে নে।আমরা বের হবো।”

হৃদিতের কাজে মেহরিমা লজ্জা পেলেও আপাতত লজ্জা এক পাশে রেখে হৃদিতের কথামত সব কাজ করে।পাছে যদি রেগে যেয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে!

সময় দুপুর বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট।মেহরিমা অবনী শেখ আর মাধবীর সাহায্যে সব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিয়েছে। এখন ওরা বাড়ির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে। বিদায় বেলা বড়ই হৃদয়বিদারক।মেহরিমা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদেই চলেছে।হৃদিত রিতিমত বিরক্ত। তবুও চুপচাপ বকুল গাছের নিচে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত জোড়া ভাজ করে দাড়িয়ে আছে। জলিল শেখ হৃদিতের নিকট এগিয়ে যায়।হৃদিতের হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

“বাবা,মেহু আমাদের খুব আদরের।আমরা কখনো ওর গায়ে একটা ফুলের টোকা পর্যন্ত লাগতে দেই নি। কিন্তু গত পরশুদিন কিভাবে কি হয়ে গেলো!আমার প্রাণ তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি বাবা। কখনো যদি ও তোমার কাছে বিরক্তির কারণ অথবা বোঝা হয়ে যায় আমাকে শুধু একটাবার জানিও আমি যেয়ে ওকে নিয়ে আসবো কিন্তু তবুও ও কে কখনো কষ্ট দিও না বাবা।আমি বাবা হিসেবে ব্যর্থ আমার দায়িত্ব পালনে। তুমি হাসবেন্ড হিসেবে ব্যর্থ হয়ো না বাবা।”

কথাগুলো বলে জলিল শেখ ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেন।মেহরিমার কান্না আরও বেড়ে যায়। অবনী শেখ ছলছল চোখে জলিল শেখের দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদিত কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে যায়! ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি টেনে বলে,

“আজ থেকে ও কে ভালো রাখার সব দায়িত্ব আমার বাবা।আমি একজন বেস্ট হাসবেন্ড হয়ে দেখাবো।ও কে অভিযোগের জন্য কোনো সুযোগই দেবো না।আপনারা শুধু আমাদের জন্য দোয়া রাখবেন বাবা।”

হৃদিতের কথায় জলিল শেখ চোখের পানি মুছে সন্তুষ্টির হাসি হাসেন।মেহরিমা জলিল শেখ কে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থেকে একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।মাধবীর কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে।জলিল শেখ দুই হাতে মাধবী কে আগলে নেন।অবনী শেখ হৃদিতের নিকট এসে ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখেই বলে,

“নীলাক্ষীর প্রতি অনেক দায়িত্ব তোমার। আশাকরি যথাযথভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করবে। সামনে কিন্তু বড় ঝড় উঠতে চলেছে হৃদিত।সবদিক মাথায় রেখো।আমি কখনো ও বাড়িতে পা দেবো না।সো, তোমাকেই নীলাক্ষীকে সবদিক থেকে আগলে রাখতে হবে।আমার দোয়া সবসময় তোমাদের সাথে আছে।আর এদিকের সবকিছু আমি সামলে নেবো।সাবধানে থেকো।”

হৃদিতের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।

“আপনার বিশ্বাস কখনো ভাঙবে না মা।আরিফ হাসান চৌধুরী জীবনে বড্ড ভুল করেছেন। একপ্রকার হেরেছেন তিনি।”

“চৌধুরী রা অলওয়েজ ভুলই করে।ওরা কখনো জিততে পারে না।”

“আমি কিন্তু জিতেছি মা।”

হৃদিত কথাটা বলেই হেসে ওঠে।অবনী শেখের মুখের হাসিটাও চওড়া হয়।হৃদিত সকলের থেকে বিদায় নিয়ে চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।গাড়ির মধ্যে ভালোবেসে কাজ না হওয়ায় ধমকে ধামকে মেহরিমার কান্না থামিয়েছে হৃদিত।মেহরিমা এখন নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।দশ মিনিটের ব্যবধানে ওরা চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছে যায়।হৃদিতের গাড়ি চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করতেই সবাই ছুটে আসে ওদের নিকট।আজ চৌধুরী বাড়ির সবাই যেনো একটু বেশিই খুশি।হৃদিত এই খুশির কারণ সবটাই জানে শুধু অজানা মেহরিমার নিকট।মেহরিমা সবার খুশি দেখে নিজেও খুব খুশি হয়।মেহরিমার মুখে হাসি দেখে হৃদিত যেন দেহে প্রান ফিরে পাই।অ্যানাবেলার চোখের পানি হৃদিত একদমই মেনে নিতে পারে না।ভেতর থেকে তীব্র অশান্তি অনুভব হয়। নিজের ভাবনার মাঝেই হৃদিতের চোখ যায় চৌধুরী বাড়ির সদর দরজায়।হৃদিত কুটিল হেসে দরজার নিকট উপস্থিত মানুষ দু’টোর দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদিতের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অর্থ খুব করে বুঝতে পারে মানব দুটো।যেনো ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওদেরকে ইঙ্গিত করে বলছে,

“সবে তো সব কিছুর শুরু।জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি।”

#চলবে_____

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১৩
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

হৃদিত কে দেখে আয়াশ আর আরিশা সদর দরজা থেকে সামনে এগিয়ে আসে।

“কেমন আছিস?”

“আরে মন্ত্রী সাহেব যে!আর কতদিন এভাবে অন্যের চামচামি করবে বলোতো?”

“হৃদিত তুই কিন্তু একটা হাসিখুশি পরিবারের মাঝে দেয়াল তুলছিস।তাদের ভালো থাকাটা কেড়ে নিচ্ছিস।”

“বিশ্বাসঘাতক দের পরিবার আবার হাসিখুশিও হয় নাকি?বিশ্বাসঘাতকদের সাথে আবার কিসের ভালো থাকা মন্ত্রী সাহেব?”

“তোর জন্য বাবা মায়ের কিছু হয়ে গেলে আমি কিন্তু তোকে ছেড়ে কথা বলবো না।”

“উরে বাবা!খুব ভয় পেলাম।”

হৃদিতের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।হৃদিতের একরোখামি কথা বার্তায় আয়াশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“বাবা মা আসবে আজকে রাতে।”

“পঁয়ত্রিশ বছরের রেকর্ড ভাঙতে নাকি নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য?”

“তুই কিন্তু এবার বেশি বেশি বলছিস।”

“সত্যি কথা যায়গা মতোই লাগে।”

“আরে তোমরা থামো তো।তা হৃদিত ভাইয়্যু শেষ পর্যন্ত ওই চরিত্রহীন পরিবারের মেয়েকেই বিয়ে করলে?তাও আবার ভালোবেসে! নিশ্চয় মেয়েটাও ওর পরিবারের মতোই।”

আরিশার কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই তৎক্ষণাৎ হৃদিতের মুখমণ্ডল পরিবর্তন হয়ে যায়।

“মন্ত্রী সাহেব তোমার বিলভড ওয়াইফ কে বলে দেবে তার বাতাসের আগে চলা মুখটা যেনো বন্ধ রাখে। নাহলে দেখা যাচ্ছে তার বডি তে সব অর্গান আছে কিন্তু কথা বলার জন্য দুটো ঠোঁট আর জিহ্বা টা নেই। অ্যান্ড ইউ নো আমি কি কি করতে পারি।”

পুরুষালী থমথমে কন্ঠে কথাগুলো বলে হৃদিত সদর দরজার দিকে হাঁটা ধরে।ততক্ষণে মেহরিমাকে নিয়ে চৌধুরী পরিবার ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়েছে।

“দিলে তো হৃদিত কে রাগিয়ে।আরিশা দয়া করে তুমি তোমার মুখটা একটু বন্ধ রাখবে।আমি শান্তি চাই।সব সময় তো তোমার এতো কথা বলার প্রয়োজন দেখি না আমি।আ’ম টায়ার্ড।রুমে যাচ্ছি।”

“আশ্চর্য!ভুল কিছু তো বলিনি আমি।চরিত্রহীনকে তো চরিত্রহীনই বলবো তাই না?”

“তুমি সবটা জানো না।কোনো কিছু না জেনে কারোর দিকে আঙ্গুল তোলার কোনো রাইট নেই তোমার।”

“তাহলে আমাকে সব সত্যিটা বলো।”

“আমি বাধ্য নই।”

নিজের কথা শেষ করে বড় বড় কদম ফেলে ওখান থেকে প্রস্থান করে আয়াশ।আরিশা র ক্ত চক্ষু দিয়ে আয়াশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

“আমিও দেখবো আর কতদিন এই চৌধুরী পরিবার ফেরেস্তার মুকুট পরে থাকতে পারে!এখন তো আমি আর একা নই।চৌধুরীদের দূর্ভোগ অতি নিকটে।”

আরিশার ঠোঁটে কুটিল হাসি।মেহরিমা কে ঘিরে ধরেছে সবাই মিলে।সবার এত্ত এত্ত প্রশ্ন!মেহরিমা সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়ে রিতিমত হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে।হৃদিত দুই মিনিট মতো দাঁড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করে।

“মেহরিমা রুমে আয় ফাস্ট।”

এই প্রথম হৃদিতের মুখে নিজের নাম শুনে মেহরিমার অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়।তাও আবার পুরো নাম ধরে ডেকেছে।যে নামে সচরাচর কেউ ডাকে না।বলা চলে এই নাম শুনতে মেহরিমা মোটেও অভ্যস্ত না।মেহরিমা পিছন ফিরতেই দেখে হৃদিত হাওয়া।ততক্ষণে দোতলায় উঠে পড়েছে।চৌধুরী বাড়ি দেখাশোনা করে আবুল চাচা লাগেজ নিয়ে উপরে ছুটছে।উপস্থিত সবার মুখে চাঁপা হাসি।

“এই তৃধা মেহু মাকে হৃদিতের রুমে দিয়ে আয়। আমার ছেলেটার নিশ্চয় কোনো দরকার। আর ছোটু কিচেনে চল।আজ তুই আর আমি মিলে অনেক পদের রান্না করবো।কতগুলো বছর পর বড় ভাইয়া আর ভাবী আসবে।আমার তো খুশিতে কান্না পাচ্ছে।”

“হ্যাঁ আপা চলেন।হাতে অনেক কাজ।”

আতিয়া চৌধুরী আয়েশা চৌধুরীর কথায় সহমত পোষণ করে দু’জনে একসঙ্গে কিচেনে চলে যায়।ওনাদের সাহায্য করার জন্য রাবেয়া ফরিনা চাচিও কিচেনের দিকে যায়‌।থেকে যায় তাবান,তাইফ তৃধা আর মেহরিমা।

“ভাবী আপনার বয়স কতো?”

তাইফের ভাবী আর আপনি সম্বোধনে মেহরিমা খানিকটা লজ্জা পায়।মুচকি হেসে জবাব দেয়,

“উনিশ বছর পাঁচ মাস রানিং ভাইয়া।”

মেহরিমার কথায় তাইফ কিছু একটা ভেবে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে,

“উনিশ বছর পাঁচ মাস বয়সে আপনি মাত্র একাদশ শ্রেণীতে পড়েন ভাবী?”

মেহরিমার লজ্জা এবার আকাশ ছোঁয়া।মুখটা মলিন করে বলে,

“সেই কথা আর বলবেন না তাইফ ভাইয়া!সব মায়ের জন্য হয়েছে।প্লে, নার্সারি পড়িয়েও আবার ক্লাস ওয়ানে দুই বছর পড়িয়েছে।তাই তো এই অবস্থা আমার।”

মেহরিমার কথায় তাবান হেসে বলে,

“সমস্যা নেই ভাবী। আপনার সাথে ভাইয়ার বয়স একদম খাপে খাপ। আপনাদের দু’জন কে পাশাপাশি দাঁড়ালে যা লাগে না ভাবী!পুরাই রাজ জোটক।”

তাবানের কথায় মেহরিমার মুখে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে।

“তাবান ভাইয়া ওনার বয়স কতো?”

“সাতাশ রানিং।”

মেহরিমা মনে মনে হিসাব কষে।হৃদিত আর মেহরিমার এইজ ডিফারেন্স প্রায় সেভেন ইয়ার্স। ওদের কথার মাঝে আবারও হৃদিতের ডাক শোনা যায়।তৃধা দ্রুত মেহরিমা কে হৃদিতের রুমের সামনে দিয়ে আসে।মেহরিমা হৃদিতের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।কেমন এক অজানা ভয়, আবার ভালোলাগা মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে।মেহরিমা এই প্রথম হৃদিতের রুমে পা রাখবে তাও তার ওয়াইফ হিসেবে এজন্যই হয়তো এমন অনুভূতি!

“আর এক মিনিট ও যদি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নষ্ট করিস।আই সোয়্যার…”

হৃদিতের কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে দরজা টা আস্তে করে খুলে ভেতরে প্রবেশ করে মেহরিমা‌।ভেতরে প্রবেশ করতেই মেহরিমা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়!কিছুক্ষণের জন্য থমকায়!ওর মনে হচ্ছে ও ভুলে কোনো পার্পল ইউনিভার্সে চলে এসেছে।পুরো রুম পার্পল কালারে ডেকোরেশন করা।রুমের ওয়াল,বেডসিট থেকে শুরু করে ক্যাবিনেট সব পার্পল কালারের।রুমের অর্ধ শতাধিক অংশ অন্ধকার।জানালার পর্দা নামানো।পর্দার ফাঁকে ফাঁকে সামান্য আলো এসে উকি দিচ্ছে রুমটাতে‌‌।রুমের মধ্যে পার্পল কালারের ফেইরি লাইট গুলো মৃদু আলোয় জ্বলছে।চোখ ধাঁধানো সুন্দর এক পরিবেশ!মেহরিমা অবাক চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।হঠাৎ ঘাড়ে কারোর গরম নিঃশ্বাস অনুভব করতেই মেহরিমা আঁতকে উঠে ওখান থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রয়াস করতে চাইল।কিন্তু তার আগেই হৃদিত নিজের বলিষ্ঠ হাতজোড়া দিয়ে মেহরিমার নরম কোমর আঁকড়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।মেহরিমার উ ন্মু ক্ত ঘাড়ে থুতনি রেখে বলে,

“পছন্দ হয়েছে?”

মেহরিমা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দেয়,

“কিসের কথা বলছেন?”

“এই রুম,আমাদের রুম পছন্দ হয়েছে?”

“খুউউব।”

“আমার থেকেও বেশি?”

হৃদিত এতোটা নিকটে থাকায় মেহরিমার নাজেহাল অবস্থা।বুকটা লাগামহীনভাবে ধড়ফড় করেই চলেছে।হাত পা কেমন অবশ হয়ে আসছে।শরীরে শক্তি পাচ্ছে না একবিন্দুও।তারমধ্যে হৃদিতের হাস্কি ভয়েসের এমন প্রশ্নে মেহরিমা বেশামাল হয়ে পড়ার উপক্রম।তবুও নিজেকে সামলায়।জবাব দেয়,

“আপনার থেকে ইম্পর্ট্যান্ট আপাতত আমার লাইফে কিছু নেই।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত সন্তুষ্টির হাসি হাসে।মেহরিমার ঘাড়ে গুনে গুনে তিনটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে ছেড়ে দেয়।ফেইরি লাইট গুলো অফ করে দেয়। জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে ফেলে।মূহুর্তের মধ্যেই পুরো রুম প্রকৃতির আবছা আলোয় ঝলমল করে ওঠে।হৃদিতের রুম টা দোতলার একদম কোণায় হওয়ায় সম্পূর্ণ গাছপালায় আচ্ছাদিত।যার ফলস্বরূপ রুমে আলো সম্পূর্ণরূপে এসে পৌঁছাতে পারে না।গাছপালার ফাঁক ফোকড় দিয়ে প্রবেশ করে আলো।

“ক্যাবিনেটে তোর সকল ড্রেস আছে।ওয়াশ রুমে যেয়ে শাওয়ার নে।রিফ্রেশ লাগবে।”

মেহরিমা তখনও অনবরত কেঁপে চলেছে।এই প্রথম পাওয়া ঠোঁ টে র স্পর্শে মেহরিমার মনের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।ভেতরে ভেতরে কেমন ছটফট অনুভূত হচ্ছে।মেহরিমা নতুন সব অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে আজ।মেহরিমার উশখুশ অবস্থা দেখে হৃদিতের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি খেলে যায়।

“কাম ডাউন লিটল কিটি।জান ইউ নো ইটস আ নিউ ফিলিংস ফর আস।জাস্ট ফিল ইট।”

হৃদিতের এমন বে ফাঁ স কথায় মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।হৃদিতের সামনে থেকে তাড়াতাড়ি পালানোর জন্য বলে,

“আমার ড্রেস তো লাগেজে ছিলো?”

“ক্যাবিনেটে আমি রেখেছি।”

মেহরিমা আর কিছু না বলে ক্যাবিনেট থেকে একটা মেরুন কালারের থ্রি পিচ নিয়ে দ্রুত ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে টাওয়াল টা নিতেও ভুলে যায়।হৃদিত মেহরিমার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মুচকি হাসে।অতঃপর রুমের অসমাপ্ত কাজ গুলো গোছাতে লেগে পড়ে।তার অ্যানাবেলা কে এখনও অনেক সারপ্রাইজ দেওয়া বাকী।

#চলবে_______

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-১১

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১১
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

(পর্বটা একটু সেন্সিটিভ।)

সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যেয়ে ধরনীর বুকে রাত্রি নেমেছে।সকালের পর থেকে আর বৃষ্টি হয়নি।হঠাৎ এখন সুবিশাল অম্বরে কাদম্বিনী তার নিজস্ব শব্দে ক্ষণে ক্ষণে গর্জন তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।সাথে বইছে হালকা ঝিরিঝিরি মৃদু পবন।

সময় রাত এগারোটা বেজে সতেরো মিনিট।গতকালের পর থেকে হৃদিত লা পাত্তা।ফোন দিলে ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।মেহরিমা হৃদিতের কোনো খোঁজ না পাওয়ায় সারাদিন ছটফট ছটফট করেছে।সন্ধ্যার পরে এক প্রকার অধৈর্য হয়ে তৃধার কাছে কল দিয়ে হৃদিতের খোঁজ নিয়েছে মেহরিমা।আর তাতেই জানতে পেরেছে মেহরিমার মহামান্য হাসবেন্ড নিজের রুমের দরজা লক করে ভেতরেই আছে।জাস্ট খাওয়ার সময় নাকি ওনাকে নিচে খাবার টেবিলে দেখা গেছে।এখন দরজা লক করে রুমের মধ্যে কি করছে সেটা তো আর তৃধা জানে না!মেহরিমা সবটা শুনে স্বস্তি পায়। কিন্তু নারী সত্তাটা বড্ড অভিমান করে বসে।এতো রাতে মেহরিমা শুয়ে শুয়েই উশখুশ উশখুশ করছে‌।ঘুম আসছে না।আজও পাশে মাধবী শুয়েছে।মেহরিমা নিজের উপর বিরক্ত হয়েই বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে যায়।

ঘুটঘুটে অন্ধকার পরিত্যক্ত একটা রুম। রুমের মধ্যে শুধুমাত্র একটা মোমবাতি জ্বলছে নিভু নিভু আলোয়।ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে পড়ে আছে শিহাব।মুখটা বাঁধা থাকায় শুধুমাত্র গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।শিহাবের ঠিক সামনে একজোড়া নীলচে মণি জোড়া জ্বলজ্বল করছে। সামনে বসা মানবের থেকে কেমন ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ ভেসে আসছে।শব্দটার সাথে শিহাব পূর্বপরিচিত।এটা কোনো ধা রা ল অ স্ত্র ঘষার শব্দ।শিহাবের বুকের পানি শুকিয়ে যায়।অদূরেই তাবান,তাইফ দাঁড়িয়ে কাঁপছে।ওদের দুজনের হাতে থাকা দুটো বিদেশি কুকুর থেকে থেকে তার নিজস্ব শব্দে ডেকে উঠছে।এই পরিবেশের সাথে ডাকটা বড্ড ভয়ংকর শোনাচ্ছে!

“ওই শা লা শিহাব পটল তোলার আগেই মনে হচ্ছে তুই পটল তুলবি?এত কাঁপাকাপি করছিস কেনো?”

তাইফের কথায় তাবান ওর পিঠে এক চাপড় মেরে বলে,

“হাদা আমি কি একা একা কাঁপছি?তুইও তো কাঁপছিস।দেখ তোর পা জোড়া আমার থেকেও বেশি কাঁপছে।”

“সত্যিই কি আমি কাঁপছি?”

“না তো!তোর হ্যাবলাকান্ত শ্বশুর কাঁপছে?তুই কাঁপতে যাবি কেনো?”

“এই,এই তাবান।আমার সহজ সরল শ্বশুর টাকে নিয়ে কিছু বলবি না বলে দিলাম।”

ওদের কথার মাঝেই শিহাবের গগনবিদারী এক চিৎকার ভেসে আসে ওদের কানে।আর তাতেই দুজনের কাঁপাকাপি আরও বেড়ে যায়।হৃদিত শিহাবের ডান হাত কে টে ফেলেছে।সেটা অনাদরে পাশেই পড়ে আছে।হৃদিত এখন ওর সেই চিরচেনা সত্তায় ফিরে গেছে।দুই আঙ্গুলের সাহায্যে শিহাবের গালে চাপ প্রয়োগ করে মুখটা ওর নিকট এগিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,

“মা দা র ফা কা র তোর সাহস কি করে হয় আমার অ্যানাবেলা কে বাজেভাবে টাচ করার?হু আর ইয়্যু?ইউ নো শী ইজ মাই লাইফ।আ’ম নাথিং উইদাউট হার।আই কান্ট থিংক অ্যানিথিং উইদাউট হার।অলওয়েজ আমার ভাবনা,আমার মনের মাঝে থাকে আমার অ্যানাবেলা।নয় বছর ধরে ভালোবেসে এখনো একটুও বাজেভাবে ওকে টাচ করিনি আমি।এই নয়বছরে ওর চোখ থেকে কখনো এতোটা পানি পড়িনি।আমি পড়তে দেই নি।তুই আমার জানে হাত দিছোস শা লা।খুব করুণ মৃত্যু হবে তোর।আই উইল টেক ইয়্যু অন অ্যা জার্নি টু ব্লাডি হেল।জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি।”

হৃদিত কথাগুলো বলে গালে আরেকটু চাপ দিতেই কেমন কটমট শব্দ হয়!শিহাব ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে।হৃদিত শিহাবের গাল ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই শিহাব ওর একটা হাত দিয়ে হৃদিতের পা জোড়া চেপে ধরে ভা ঙ্গা মুখ নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে,

“আমার ভুল হয়ে গেছে।ক্ষমা করে দেন।”

কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই ওর বুক বরাবর লাথি মারে হৃদিত।শিহাব পিছলে দুই হাত দূরে গিয়ে পড়ে।হৃদিত পাশে থাকা একটা টেবিল থেকে হাতুড়ি আর না ই ফ নিয়ে পুনরায় শিহাবের নিকট এগিয়ে আসে।একাধারে বিড়বিড় করে চলেছে,

“বা স্টা র্ড!ইয়্যু হ্যাভ নোট রাইট টু টাচ মাই অ্যানাবেলা।”

হৃদিতকে ওগুলো নিয়ে এগিয়ে যেতে দেখতেই তাইফ চাপা স্বরে বলে ওঠে,

“এই ব্যাটার জীবন আজ শেষ। গ্রামে এতো মেয়ে থাকতে মেহরিমার দিকেই নজর দিতে হলো‌!ওপস ছরি ওই ব্যাটায় তো নিজেদের শত্রুতার বসে এমন করেছে।”

“নাম ধরে ডাকিস না।ভাবী বল ভাবী। নাহলে আজ আমাদের ও শেষদিন হবে।ভাই নিজের মধ্যে নেই।”

তাবানের কথায় তাইফ চুপসে যায়।হৃদিত শিহাবের নিকট এগিয়ে এসে ওর এক হাতের উপর পা রেখে হাতুড়ি দিয়ে শব্দ করে সবগুলো দাঁত ভা ঙ তে থাকে।শিহাব নিজেকে বাঁচানোর জন্য ছটফট ছটফট করছে।হৃদিত একে একে সবগুলো দাঁত ভে ঙে থামে। অতঃপর নিজের হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পড়ে নাইফ দিয়ে একটানে ঠোঁট জোড়া কে টে ফেলে।হৃদিত তাতেও ক্ষান্ত হয়না।শেষমেষ জিহ্বা টাও কে টে নেয়।শিহাবের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।

“ব্লাডি বিচ তোর ওখানে খুব জোর তাই না?”

কথাটা বলে হৃদিত আবারও বিড়বিড় করতে করতে টেবিলের নিকট যেয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ছোট কাঁচের বোতল নিয়ে আসে।শিহাবের নিকট এসে একটানে প্যান্টের জিপার খুলে ঢেলে দেয়।শিহাব চিল্লাতে না পারায় কা টা কবুতরের মতো লাফাতে থাকে।হৃদিত পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের কোণে হিংস্র হাসি দিয়ে শিহাবের সেই ছটফটানো এনজয় করতে থাকে।

“এই এই তাবান?ভাই ওটা কি ঢেলে দিলো রে?”

“এ সি ড। তুই থামবি? নাহলে তোরও যায়গা মত ঢেলে দেবে নে।”

তাবানের কথায় তাইফ অসহায় মুখ নিয়ে তাবানের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“তাবান,তাইফ হ্যানসেল আর হ্যারি কে ছেড়ে দে।”

হৃদিতের গম্ভীর শীতল কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই ওরা নিজের অজান্তেই রশি ছেড়ে দেয়।হ্যানসেল,হ্যারি এক ছুটে হৃদিতের নিকট এসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।যেন হৃদিতের হুকুমের অপেক্ষায়।

“বা ই ট হিম।”

হৃদিত বজ্রপাতের ন্যায় কথাটা বলতেই সাথে সাথে কুকুর দুটো শিহাবের উপর হামলে পড়ে।একদম র ক্তা ক্ত করে শরীরের মাংশ ছিন্ন বিছিন্ন করে থামে। পরক্ষণেই তাবান,তাইফ কে নির্দেশ দেয় হ্যানসেল আর হ্যারি কে ধরতে।হৃদিত শিহাবের নিকট এগিয়ে এসে ওর নাকের কাছে হাত নিয়ে চেক করতেই দেখে এখনো শ্বাস চলছে।হৃদিত পৈশাচিক হাসি দেয়।প্যান্টের পকেট হাতড়ে দুই ইঞ্চি সাইজের একটা পিন বের করে।সেটা দিয়ে ক্রমাগত শিহাবের চোখে আঘাত করতে থাকে।শিহাবের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত পেরেক দিয়ে চোখের মণি খোঁ চা তে থাকে হৃদিত।পরক্ষণেই হুংকার দিয়ে বলে,

“শুনে রাখো পৃথিবী,আমার অ্যানাবেলার দিকে যে নজর দেবে তার অবস্থা ঠিক এরকমই হবে।এই মা দা র ফা কা র তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী।”

আকাশের বজ্রপাতের শব্দের সাথে সেই হুংকারের শব্দ মিলেমিশে তৈরি করে হাড়হিম করা পরিবেশ।তাইফ ততক্ষণে সেন্স হারিয়েছে।তাবান অসহায় চোখে একবার তাইফের দিকে তাকায় আর একবার হৃদিতের দিকে তাকায়।

_______

সময় রাত তিনটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।ফোনের তুমুল শব্দে মেহরিমার ঘুম হালকা হয়ে যায়।ঘন্টা দুয়েক হলো ব্যালকনি থেকে রুমে এসে ঘুমিয়েছে।এতো রাতে আবার কে কল দেবে?মেহরিমা বিরক্তি তে নাকমুখ কুঁচকে কল কেটে দেয়।কল কাটার মিনিট দুয়েক পরে ঘুমের ঘোরেই হৃদিত নামক নামটা মস্তিষ্ক জানান দিতেই মেহরিমা তড়িৎ গতিতে উঠে বসে।চট করে ফোন হাতে নিয়ে কল লিস্ট চেক করে।যা ভেবেছিল তাই!মেহরিমা কল ব্যাক করতে যাবে ঠিক তখনই ফোনটা আবারো শব্দ তুলে বেজে ওঠে।মেহরিমা তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করে।

“তোদের মেইন গেইটের তালা খুলে দে ফাস্ট।আমি বাইরে ওয়েট করছি।”

ব্যস নিজের কথা শেষ করে কল কেটে দেয় হৃদিত।মেহরিমা কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে হৃদিতের কথাটা বুঝতে পারে।সারাদিনের অভিমান ভুলে গায়ে কোনোরকম ওড়না জড়িয়ে চাবি আর ছাতা হাতে বাইরে দৌড় লাগায় মেহরিমা।তিন মিনিটের ব্যবধানে গেট খুলে দিতেই হৃদিত গাড়ি নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ পড়ে।মেহরিমা গাড়ির দিকে এক পলক চেয়েই দরজা লক করে দেয়। পিছন ঘুরতেই শক্তপোক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খায়।মেহরিমা চোখ তুলে তাকাতেই হৃদিতের ক্লান্ত মুখটা চক্ষুগোচর হয়।মেহরিমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হৃদিত ওকে জাপটে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।মেহরিমার হাত থেকে ছাতা পড়ে যায়।দু’জনেই কাক ভেজা হয়ে যায়।মেহরিমা নিজের অজান্তেই হৃদিতের বুকে মাথা রাখে।অতঃপর রিনরিনিয়ে বলে,

“আপনাকে এতো ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেনো?”

“তুই কাছে ছিলি না তাই।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।হৃদিতের শক্তপোক্ত বুকে মুখ লুকায়।পাঁচ মিনিট এভাবেই কেটে যায়।

“আমাকে এভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখবি? শ্বশুর বাড়িতে এই প্রথম আসলাম।একটু খাতির যত্ন করবি তা না বাইরেই দাঁড় করিয়ে রেখেছিস।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমার টনক নড়ে।ও হৃদিতের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।তারপর দ্রুত হাতে ছাতা তুলে নিয়ে হৃদিতের হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটা ধরে।

মেহরিমার রুমে মাধবী থাকায় মেহরিমা হৃদিতকে গেস্ট রুমে নিয়ে আসে।আলমিরা থেকে নতুন টাওয়াল বের করে দেয়।

“আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।আমিও ফ্রেশ হয়ে আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থেকে দুষ্টু কন্ঠে বলে,

“ফ্রেশ হয়ে পরবো কি?দেখছিস ভিজে গেছি।নাকি আমাকে ড্রেসলেস রাখার পরিকল্পনা করছিস?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমার কান,মুখ গরম হয়ে ওঠে।সারা মুখে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ে।

“আরে,আরে!তোর সাথে তো এখনও কিছুই করলাম না। ইভেন তোকে ছুঁয়েও দেখিনি আমি।আর তাতেই তুই লজ্জায় লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি হয়ে যাচ্ছিস?আশ্চর্য!আমার মতো ভদ্র পোলা আর কোথাও পাবি তুই?”

হৃদিতের বে ফাঁ স কথায় মেহরিমা ল জ্জা য় হাঁসফাঁস করতে থাকে।কোনোরকমে বলে,

“বাবার শার্ট আর লুঙ্গি এনে দিচ্ছি।”

কথাটা বলেই মেহরিমা দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। হৃদিত পেছন থেকে উচ্চস্বরে বলে,

“লাগেজে আমার নিউ টি-শার্ট, ট্রাউজার আছে। ওগুলো জলদি নিয়ে আয়।আর আমি এখন কিছু খাবো না।খেয়ে এসেছি।”

মেহরিমা যাওয়ার সময় হৃদিতের সব কথাগুলোই শুনতে পায়।নিজে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে দশ মিনিট পর হৃদিতের জন্য টি-শার্ট, ট্রাউজার নিয়ে গেস্ট রুমে আসে মেহরিমা।ওয়াশ রুমের ভেতর থেকে পানি পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।দুই মিনিট পরে হৃদিত বের হয় ওয়াশ রুম থেকে।পুরুষালি শক্ত পেটানো কোমরে জাস্ট টাওয়াল বাঁধা।উপরের অংশ নেকেড।বুকে বিন্দু বিন্দু পানির কণা মুক্তোর মতো জ্বলছে।ঘাড় সমান চুল গুলো এলোমেলো ভাবে চোখের উপরে পড়ে আছে।চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে ঠোঁ টে র উপরে।সেই পানি জ-লাইন দিয়ে অ্যাডামস অ্যাপেল বেয়ে বুকে নেমে যাচ্ছে।নীল রঙের মণি জোড়া স্বচ্ছ দেখাচ্ছে।চোখ জোড়া যেনো গভীর এক সমুদ্র!যেই সমুদ্রের গভীরতা অসীম।মেহরিমা খুব সহজেই সেই গভীরতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে।হৃদিতের এহেন রুপ দেখে মেহরিমা শুকনো ঢোক গেলে।ইতোমধ্যে ওর বুকের মাঝে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করেছে।এক অবাধ্য টান অনুভব করছে হৃদিতের প্রতি।হৃদিত মেহরিমার বেহাল অবস্থা দেখে বাঁকা হাসে।সবে তো শুরু!এই নয় বছরে তো কম কষ্ট করেনি হৃদিত।এত সহজেই ধরা দেবে নাকি?

“ওগুলো কি নিজে পড়ার জন্য এনেছিস?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা আমতা আমতা করে বলে,

“আসলে না ইয়ে মানে আপনার জন্যই এনেছি।”

কথাটা বলে মেহরিমা কয়েক কদম এগিয়ে এসে হৃদিতের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।হৃদিত আলতো করে মেহরিমার হাত স্পর্শ করে।মেহরিমার শরীর উষ্ণ।হৃদিতের ঠান্ডা স্পর্শে কেঁপে ওঠে।হৃদিত মুচকি হেসে কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়।যাওয়ার আগে মেহরিমাকে ওয়ার্ন করে যায়।সে না আসা পর্যন্ত মেহরিমা যেনো রুমেই থাকে।পনেরো মিনিট পর হৃদিত ওয়াশ রুম থেকে বের হয়।মেহরিমার নিকট এগিয়ে এসে ওর হাতে টাওয়াল দিয়ে বলে,

“চুল মুছে দে।”

“আমি?”

মেহরিমার হতভম্ব কন্ঠস্বর।

“তুই ছাড়া আর এখানে কেউ আছে নাকি?চোখে তো দেখছি না।”

কথাটা বলে হৃদিত ভেতর থেকে দরজা লক করে এসে বিছানায় যেয়ে বসে।হৃদিতের কান্ডে মেহরিমা ভেতরে ভেতরে বড্ড ভয় পেয়ে যায়।মেহরিমা, নিজের তড়িৎ গতিতে ধ্বক ধ্বক করা হৃৎপিণ্ড টা নিয়েই গুটি গুটি পায়ে হৃদিতের নিকট এগিয়ে যায়।কাঁপা কাঁপা হাতে মাথা মুছিয়ে দিতে থাকে।মাথা মোছানোর শেষ পর্যায়ে হৃদিত মেহরিমার পাতলা কোমর নিজের শক্ত পোক্ত হাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়।সেকেন্ডের ব্যবধানে মেহরিমাকে নিজের উপর ফেলে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।মেহরিমা আঁতকে ওঠে!ওর কাঁপাকাপি বেড়ে যায়।হৃদিত আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।যেনো মেহরিমাকে নিজের বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়ার তীব্র প্রচেষ্টা করছে।অতঃপর কপালে গভীরভাবে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলে,

“আ’ম টায়ার্ড জান।একদম নড়াচড়া করবি না।আমি এখন একটু ঘুমাবো।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা শান্ত হয়ে যায়।পরম আবেশে হৃদিতের বুকে মাথা রেখে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।মেহরিমার দিকে এক পলক চেয়ে হৃদিত মুচকি হেসে বলে,

“দ্যাটস মাই গুড অ্যাঞ্জেলা।”

#চলবে______

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-১০

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১০ . [বিবাহ স্পেশাল]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

সুবিশাল অম্বর তার নিজের বর্ষণ থামিয়েছে প্রায় দশ মিনিট মতো হতে চলল।আনন্দপুর থানার এসআই এসেছে শেখ বাড়িতে। জলিল শেখ ভালো মন্দ টুকটাক কথা বলে ওনাদের কে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে মেহরিমার ঘরে আসে।

“অবনী এসআই অমিত সাহা এসেছে।”

“ওনাদের কে বসতে বলো আসছি আমি।”

জলিল শেখ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে ওখান থেকে চলে আসেন। ওনাদের নাস্তার ব্যবস্থা করেন।পাঁচ মিনিট পরে অবনী শেখ উপস্থিত হন ড্রয়িং রুমে।সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞাসা করে,

“আমরা তো আপনাকে ইনফরম করি নাই স্যার?”

“চৌধুরী বাড়ি থেকে আমাদের ইনফরম করা হয়েছে।আর গ্রামের মানুষের থেকে সবটা শুনেছি আমরা। এখন আপনার দুই মেয়ের মুখ থেকে সবটা শুনতে চাই।প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া তো আমরা কিছু করতে পারি না।”

“প্রথমত চৌধুরী বাড়ির কারোর সাহায্য আমাদের প্রয়োজন নেই স্যার।দ্বিতীয়ত আমার মেয়ে দুইটা মানসিক ভাবে ঠিক নেই এখন।তাই আমি চাই না ওদের কে আর মেন্টালি কোনো স্ট্রেস দিতে। তৃতীয়ত যদি প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েই থাকেন তাহলে কি ওই ছেলের ফাঁ সি হবে?”

“ফাঁ সি হয়তো হবে না।কারন ছেলেটা অনেক বেশি আঘাত পেয়েছে।আর এইরকম কেসে সচরাচর ওই সর্বোচ্চ দশ বারো বছর জেল হয়।”

“আর আমার মেয়ে যে আঘাত টা পেয়েছে সেটার কি হবে স্যার?আজ যদি ও নিজেকে রক্ষা করতে না পারতো।নিজের সর্বস্ব হারিয়ে ফেলতো তখন কি হতো?এই যে এখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে আমার মেয়েকে নিয়ে হাজারো বাজে কথা শোনা যাচ্ছে এর দায়ভার কে নেবে? যদিও এই সোসাইটির এইসব সো কলড রুলস কথা বার্তা আমি ডোন্ট কেয়ার করে চলি তবুও একটা নিষ্পাপ মেয়ে এতকিছুর দায়ভার কেনো নেবে?সব সময় মেয়েদের দিকেই কেনো আঙ্গুল উঠবে?”

অবনী শেখের কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে কিছুক্ষণ থমকে বসে থাকেন অমিত সাহা।বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর উনি বলেন,

“আপনার মেয়ে সাহসী।নিজেকে রক্ষা করেছে। ক্রি মি না ল কে শা স্তি ও দিয়েছে। আশাকরি ও এইসব কিছু খুব শিঘ্রই কাটিয়ে উঠতে পারবে।”

“না স্যার আমার মেয়ে সঠিক শান্তি দিতে পারেনি।ওর উচিত ছিলো বডি থেকে মাথা টা আলাদা করে দেওয়া।ওই জা নো য়া রে র ভাগ্য ভালো ও নিলাক্ষী শেখের হাতে পড়েছে।”

অবনী শেখের কথায় অমিত সাহা সহ ওনার সহযোগী পুলিশ হতভম্ব হয়ে যান!এ কি কঠিন সত্তা নারী জাতির!অমিত সাহা ওনার এত বছর চাকরির জীবনে এমন সুন্দর মুখশ্রীর কঠিন সত্তার নারী দেখেননি!উনি নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে বলেন,

“তাহলে আপনারা কোনো কেস ফাইল করতে চাচ্ছেন না?”

“আপতত না স্যার।প্রয়োজন পড়লে আমরা নিজেই আপনার দৌড় গড়ায় যাবো।”

তারপর আরও কিছু কথা বলে অমিত সাহা ওনার সহযোগী কে নিয়ে শেখ বাড়ি ত্যাগ করেন।অমিত সাহার খুব করে মন চাইলো পিছু ফিরে কঠিন সত্তার নারী মুখটা শেষ বারের মতো একটাবার দেখতে। কিন্তু উনি নিজের ইচ্ছায় এক বালতি পানি ঢেলে আর পিছু ফিরে তাকালেন না।

______

অমিত সাহা চলে যাওয়ার প্রায় দশ মিনিট পর ডক্টর সিয়াম এসে মেহরিমা,মাধবী কে চেক আপ করে প্রেসক্রিপশন দিয়ে যায়।মেহরিমার ক্ষত গুলোর জন্য মলম সাজেস্ট করেন।ডক্টর সিয়াম চলে যাওয়ার পরপরই জলিল শেখ তার পরিচিত একজন কে দিয়ে গ্রামের মোড়ের ফার্মেসি থেকে মেডিসিন সহ মলম আনিয়ে নেয়।অবনী শেখ দুই মেয়েকে জোর করে একটুখানি খাইয়ে দিয়ে মেডিসিন গুলো খাওয়াই।মাধবীর ঠান্ডা লেগেছে অতিরিক্ত তাছাড়া মোটামুটি সুস্থ।এদিকে মেহরিমার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। বিছানায় মায়ের কোলে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। অবনী শেখ মেহরিমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন।মাধবী গরম গরম আদা চা খাচ্ছে। জলিল শেখ অতিরিক্ত মাথা যন্ত্রণার জন্য নিজের ঘরে রেস্ট নিচ্ছেন।

জ্বরের মেডিসিন নেওয়ার সাথে জলপট্টি দেওয়ায় প্রায় আধাঘণ্টা পরে মেহরিমার জ্বর নেমে যায়। অবনী শেখ মেহরিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

“এখন কেমন লাগছে মা?”

“ভালো।”

“কিছু খেতে মন চাচ্ছে?”

“উহু।”

ওদের কথার মাঝেই ঘরের সামনে উপস্থিত হয় হৃদিত,তাবান,তাইফ, আয়েশা চৌধুরী,আতিয়া চৌধুরী, আজাদ চৌধুরী ও তৃধা।ওদের সাথে গ্রামের কাজী সাহেব কে দেখতেই অবনী শেখ ঘটনা যা বোঝার বুঝে যায়।হৃদিতের দিকে তাকিয়ে অবনী শেখ মুচকি হাসেন।তার বিপরীতে হৃদিতের ঠোঁটে ক্ষীণ বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।তৃধা দৌড়ে এসে মেহরিমার পাশে বসে।মেহরিমার সাথে টুকটাক কথা বলে।বাকিরাও এগিয়ে আসে।সবাই কে রুমে আসতে দেখে অবনী শেখ বেডের সাথে বালিশ রেখে মেহরিমা কে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়।মেহরিমা মলিন মুখেই সবার সাথে খুবই সীমিত কথা বলে।মেহরিমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ওকে কেউ আর ডিস্টার্ব না করে সবাই ড্রয়িং রুমে চলে যায়।মাধবীও অবনী শেখ কে কাজে সাহায্য করার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে যায়।থেকে যায় হৃদিত,তৃধা আর মেহরিমা।হৃদিত তৃধার দিকে তাকাতেই তৃধা ও রুম থেকে চলে যায়।মেহরিমা এইসবের কিছুই খেয়াল করেনি।চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে বসে আছে মেহরিমা।চৌধুরী পরিবারের সবাই কেনো এসেছে এই প্রশ্নটা মেহরিমার মাথায় একবারের জন্যও আসেনি।হৃদিত কয়েক কদম এগিয়ে যেয়ে মেহরিমার পাশে বসে।আলতো করে মেহরিমার হাত ধরতে নিতেই মেহরিমা এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে আঁতকে উঠে বলে,

“আমাকে ব্যাড টাচ করবেন না প্লিজ।”

মেহরিমার কথায় হৃদিতের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের সৃষ্টি হয়।চোখ দুটো ছোট ছোট করে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই ওর মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতে পারে ওর লিটল কিটি গতরাতের ঘটনা নিয়ে এখনো ট্রমার মধ্যে আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক।মেহরিমা ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে হৃদিত কে দেখতেই থতমত খেয়ে যায়। তাহলে কি হৃদিত ভাই? তৎক্ষণাৎ মেহরিমা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলে,

“আ..আসলে হৃদিতা ভাই আমি বুঝতে পারিনি।আ..আ আমি সব…”

মেহরিমার এলোমেলো কথা শেষ করার আগেই হৃদিত মুচকি হেসে শান্ত কন্ঠে আদর মিশিয়ে বলে,

“হাইপার হওয়ার কিছু নেই জান।আমি বুঝেছি সবটা।টেক ইট ইজি বেইবি।আমি মাধবী আর তৃধাকে তোর রুমে পাঠাচ্ছি।লাগেজের ভেতরে পার্পল কালারের একটা শাড়ি আছে সেটা পড়ে রেডি হয়ে নে।সময় বিশ মিনিট।আজ তোকে নিজের করে নিতে এসেছি।আজকের পর থেকে তোর সব দুঃখ কষ্ট আমারও।তারপর একসাথে মিলে না হয় তোর দুঃখ কষ্টের মোকাবেলা করবো।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,

“আ..আমি ক ল ঙ্কি ত হৃদিত ভাই। আমার সব কেড়ে নিয়েছে ওই পশু টা।”

মেহরিমার চোখের পানি হৃদিতের বক্ষ স্থলে তীরের মতো করে বিঁধে।হৃদিত হাত জোড়া মুঠো করে দু’চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে মেহরিমার আরেটু সন্নিকটে এগিয়ে যেয়ে বসে।মেহরিমা তখনও নিচের দিকে তাকিয়ে অনবরত কেঁদেই চলেছে।হৃদিত মেহরিমার থুতনি ধরে মুখটা সামান্য উঁচু করে গালে আলতো করে হাত রেখে চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলে,

“হুশশশ আর একটাও কথা না।তুই আমার অ্যানাবেলা, আমার সানসাইন, আমার স্নিগ্ধপরী। তুই আমার কাছে এখনও আগের মতোই পবিত্র আর স্নিগ্ধ সোনা।তোর পবিত্র আলোয় সবসময় আমাকে আলোকিত করে রাখিস তুই।পৃথিবীর চাঁদের গায়ে ক ল ঙ্ক থাকতে পারে কিন্তু আমার ব্যক্তিগত চাঁদের গায়ে কোনো ক ল ঙ্ক থাকবে না। আমার ভালোবাসায় সব মুছে বিলীন হয়ে যাবে অ্যাঞ্জেলা।শুধু সময়ের অপেক্ষা।ততদিন একটু মানিয়ে নে প্লিজ।”

হৃদিতের এহেন প্রথম স্পর্শে মেহরিমার তনু,মন কেঁপে ওঠে।পরক্ষণেই ওর মনে হয় এই অ্যানা বেলা,সানসাইন নামগুলোর সাথে ও পরিচিত। কিন্তু অসুস্থ শরীর আর ক্লান্ত মস্তিষ্ক নামগুলো পরিচিত লাগার কারণ টা ঠিক ধরতে পারে না।মেহরিমা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হৃদিত উঠে রুম থেকে বের হয়ে যায়। তারপর তৃধা আর মাধবী এসে অসুস্থ মেহরিমাকে জাস্ট শাড়ি টা পরিয়ে দেয়।হৃদিতের কথা মতো কাটায় কাটায় বিশ মিনিট পর মেহরিমা কে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসা হয়। জলিল শেখ হঠাৎ প্রশ্ন করে ওঠে,

“হৃদিত তোমার মা ,বাবা কোথায়? তাদের অনুপস্থিতিতে বিয়ে কিভাবে সম্ভব?”

“কেনো বাবা?আপনি আর মা তো আছেনই।আর আমার পুরো পরিবার এখানেই উপস্থিত।এর বাইরে জাস্ট ছোট কাকা আছে। তাছাড়া কেউ নেই।”

হৃদিতের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ আর কিছু বলে না।সব নিয়ম মেনে হৃদিত,মেহরিমার বিয়ে টা হয়ে যায়। তারপর সবাই মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চৌধুরী পরিবার চৌধুরী ভিলায় ফিরে যায়।হৃদিত অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে তাবান,তাইফ কে সঙ্গে নিয়ে।মেহরিমাও বিয়ের সব নিয়ম পালন করে তক্ষুনিই রুমে এসে শাড়ি পরিবর্তন করে শুয়ে পড়েছে। মেডিসিনের মধ্যে ঘুমের মেডিসিন থাকায় মেহরিমা শুয়ে পড়তেই ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়।

______

মেহরিমার রাত সাতটার সময় ঘুম ভাঙ্গে।মাঝে দুপুরে ওকে একবার তুলে দুপুরের খাবার খাইয়ে রেখে গেছেন অবনী শেখ।রাতে তিন ঘন্টা মতো জেগে থেকে একটু রাতের খাবার খেয়েই আবারও ঘুমিয়ে পড়ে মেহরিমা।আজ মাধবীও মেহরিমার সাথেই ঘুমিয়েছে।ফজরের আজানের শব্দে মেহরিমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে নামাজ পড়ার জন্য উঠে বসে। ঠিকঠাক ভাবে ঘুম হওয়াতে মেহরিমার মাথা টা এখন বেশ পাতলা লাগছে। হঠাৎ টিউবওয়েল চেপে পানি ওঠানোর শব্দ কর্ণগোচর হতেই মেহরিমা বিছানা থেকে নেমে ড্রয়িং রুমে আসে।এখন আর শব্দ টা শোনা যাচ্ছে না।দুই মিনিট পরে আবারও সেইম শব্দ শুনতে পাই মেহরিমা।মেহরিমা দরজা খুলতে নিলেই খেয়াল করে দরজা টা জাস্ট লক করা।মেহরিমা দরজার লক খুলে সিঁড়িতে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পাই অবনী শেখ র ক্তা ক্ত রা রাম দা ধুচ্ছে।মেহরিমা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না!চোখ দুটো বড় বড় করে অবনী শেখের দিকে তাকিয়ে থাকে।অবনী শেখ নিজের কাজ সম্পূর্ণ করে ওজু করে পিছন ফিরতেই মেহরিমা কে দেখে মুচকি হাসে। অতঃপর দা টা ওখানে রেখেই মেহরিমার নিকট এগিয়ে এসে বলে,

“শরীর ঠিক আছে মা?”

অবনী শেখের কথায় কোনো প্রত্যুত্তর না করে মেহরিমা পাল্টা প্রশ্ন করে,

“তুমি কোথায় গেছিলে মা আর ওটাতে র.. র ক্ত ইং বা কোথায় থেকে আসলো?”

“পৃথিবীর থেকে পাপ মুছে দিয়ে আসলাম।ওই পাপের সাথে সাথে তোর সব কলঙ্ক ও আমি মুছে দেবো।”

অবনী শেখের স্বাভাবিক কথাটা মেহরিমা একদম স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না।ও থরথর করে কেঁপে উঠে পড়ে যেতে নিলেই অবনী শেখ দু’হাতে মেহরিমাকে আগলে নেয়।

সকাল সাতটা বেজে দশ মিনিট।মেহরিমা চোখ খুলে নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করে। চোখজোড়া খুলে পাশে তাকাতেই মাধবীর বিবর্ণ মুখটা চক্ষুগোচর হয়।মেহরিমা মাধবী কে কিছু জিজ্ঞাসা করতে নিবে তার আগেই ওদের বাড়ির পাশের দশ বছরের মায়া নামের একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে মেহরিমার ঘরে প্রবেশ করে।মেহরিমার সাথে খুব মিল মেয়েটার।

“মেহুপু এখন ভালা আছনি?”

“আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালা আছি। গ্রামে কি ঘটে গেছে শুনবার পারিছো তোমরা?”

মেহরিমা ভ্র জোড়া কুঁচকে মায়ার দিকে তাকাতেই মায়া হড়বড়িয়ে বলতে শুরু করে,

“হাসপাতাল থেইকা তোমগোর চাচার সেই ছেলেডা লাপাত্তা হয়ে গেছে।নিজের শাস্তির ভয়ে বোধহয় জ্ঞান ফিরতেই পালিয়েছে।ধরা পইরা গেছে যে। আবার আইজ সক্কালে তোমার মেজো চাচিরে ওগো বাড়ির উঠানে বেহুঁশ অবস্থায় পাওন গেছে। শুধু কি তাই!তার কনুই থেইকা দুটো হাতই কেডায় কাইটা পাশে রাইখা গেছে গা। মাথাডাও ন্যাড়া করে রাইখা গেছে।হগ্গোলে বলতাছে জ্বিনেদের কাজ এইডা।ওরা ওগো বাড়িতে বড় কবিরাজ আইনাছে।”

মায়ার কথা শুনে মেহরিমা খুব অবাক হয় তবে কথাগুলো শুনে হঠাৎ ওর হৃদয় প্রশান্তি তে ছেয়ে যায়।একটা মানসিক শান্তি অনুভব করে।মেহরিমার ওর মায়ের বলা সেদিনের কথাটা মনে পড়ে যায়।

“তোকে কেউ কলুষিত করার আগেই সেই জ ঞ্জা ল ছেঁ টে পরিষ্কার করে দেবো আমি।এটা তোর মা অবনী শেখের ওয়াদা।”

পরক্ষণেই মেহরিমার মনে পড়ে যায় হৃদিত কে সেই গতকালের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে আর দেখেনি।আর না একটাবার কথা হয়েছে।সে কি ভুলে গেলো নাকি তার একটা বউ আছে?নাকি আমি নিজেই হৃদিত ভাইকে বেশি মিস করছি?কথাগুলো ভাবতেই মেহরিমার মুখে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে।

#চলবে_______

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০৯

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৯
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

ভোর ছয়টা বেজে সাত মিনিট।নিকষ কালো রজনী কেটে যেয়ে ধীরে ধীরে ধরনীর বুকে আলোরা হানা দিচ্ছে।রাত থেকে এখনো বৃষ্টি থামেনি।সে তার নিজ ধারায় বর্ষণ হয়েই চলেছে।বৃষ্টি প্রকৃতির এক অপূর্ব রহস্য। সকাল সকাল মেঘের গর্জন, বাতাসের ঝাপটা,ঠান্ডা বৃষ্টির ফোঁটা সব মিলিয়ে এক অপার সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।আশেপাশের ছোট ছোট ডোবা গুলো এখন পানিতে থৈ থৈ করছে।

মেহরিমাদের উঠানের ঠিক মাঝখানে একটা বড় বকুল ফুল গাছ আছে।মেহরিমা সেই বকুল ফুল গাছটার নিচে কর্দমাক্ত অবস্থায় থ মেরে বসে আছে!ওর একপাশে র ক্তা ক্ত রাম দা পড়ে আছে। এই বৃষ্টির পানিও যেনো ওই নি কৃ ষ্ট তাজা র ক্ত স্পর্শ করতে দ্বিধাবোধ করছে!আর অন্য পাশে মাধবী বসে বসে কান্না করছে।মেহরিমার চোখে এক বিন্দু পরিমাণ পানি নেই।দেহে প্রান থেকেও যেনো নেই।চোখদুটো ফুলে বালিশ হয়ে আছে।পরনের জামাটার দুই হাতাই ছেঁড়া।হাঁটু সমান দীঘল কালো কেশ গুলো অবহেলায় কাঁদার মধ্যে পড়ে আছে।গলা,গালে,হাতে কামড়ের দাগ নখের আঁচড়ের দাগ গুলো নীল বর্ণ ধারণ করেছে।ঠোঁট,কপাল ফেটে র ক্ত জমে গেছে।সেই মধ্যরাত থেকে এভাবেই বৃষ্টির বর্ষণে নিজেকে সঁপে দিয়ে মাটির দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে মেহরিমা।এই পৃথিবীর কোনো কিছুই যেনো ওর চোখে পড়ছে না!এই পৃথিবীতে থেকেও যেনো কোনো এক অজানা ভাবনার গহীনে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।বৃষ্টি নাকি মনের যত যন্ত্রণা,কষ্ট সব ধুয়ে মুছে নিজের সাথে নিয়ে যায় তাহলে আজ মেহরিমার সব যন্ত্রণা কেনো নিয়ে যাচ্ছে না?নাকি আজ মেহরিমার মতো বৃষ্টিও অপারগ!

মেহরিমার ঠিক দুই হাত দূরে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হৃদিত।হাজার হাজার বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় নিয়ে মেহরিমার দিকে নির্বিকার ভাবে চেয়ে আছে।মেহরিমা সেটাও খেয়াল করেনি।হৃদিতের মনের ভেতরে কি চলছে সেটা তার অতি সাধারণ দৃষ্টি দেখে বোঝার উপায় নেই।অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজার দরুন নীল রঙের মণি জোড়া দেখতে ফ্যাকাশে লাগছে।আজ পুরো হৃদিতটাই যেনো শান্ত হয়ে গেছে।ঠিক ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে যায়!হৃদিতের এই স্বাভাবিক রুপ দেখে তাবান,তাইফ শুকনো ঢোক গিলছে বারবার।হৃদিতের হিং স্র তা র সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচিত ওরা।শিহাব হসপিটালে অ্যাডমিট আছে।

তখন সেই মধ্যরাতে শিহাবের সাথে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মেহরিমা শান্ত হয়ে যায়।শিহাব তখন নিজের কার্য হাসিলে লেগে পড়ে।মিনিট দুয়েক পর শিহাব এক গগন বিরোধী চিৎকার দিয়ে নিজের চোখ ধরে মেহরিমার পাশেই পড়ে যায়। শিহাবের চোখ দিয়ে অনবরত র ক্ত ঝরছে।মেহরিমা নিজের মাথায় থাকা সরু চিকন ক্লিপ দিয়ে সুযোগ বুঝে শিহাবের চোখে আঘাত করেছে।মেহরিমা তখন চটজলদি উঠে পড়ে এক দৌড়ে কিচেন থেকে রাম দা এনে শিহাবের কাতরানো অবস্থায়ই ওর ডান বাহুতে কো প বসায়।পরপরই দুই পায়ের থাইয়ের উপর অনেক গুলো কো প বসায়। শিহাব একের পর এক চিৎকার দিয়ে নিজের প্রাণভিক্ষা চেয়েই চলেছে কিন্তু মেহরিমার থামার কোনো নাম ই নেই। মধ্যরাতের বৃষ্টির শব্দের সাথে সেই করুণ চিৎকারের শব্দ পরিবেশ ক্রমশ আরও ভারী করে তুলছে!মেহরিমার ভেতরে যেনো কোনো এক অদৃশ্য শক্তি ভর করেছে।মেহরিমার রুদ্রমূর্তি দেখে মাধবীও মেহরিমার নিকট আসার সাহস পাচ্ছে না।বুকে আরও কয়েক টা কো প বসাতেই ওখানেই সেন্সলেস হয়ে যায় শিহাব।ততক্ষণে শিহাবের চিৎকার শুনে শেখ বাড়ির মেইন গেইটের তালা ভেঙে আশেপাশের সবাই উপস্থিত হয়েছে।ঘরের মেইন ডোরে সবাই মিলে করাঘাত করেই চলেছে। মাধবী এবার অতিরিক্ত ভয় পেয়ে যায়।সাথে সাথে দৌড়ে এসে মেহরিমা কে জাপটে ধরে কান্না করতে করতে বলে,

“মেহু মায়ের ফোন বন্ধ।আমি অনেক বার চেষ্টা করেছি কিন্তু কল ঢোকেনি।বাবা তো ফোন ই নিয়ে যায়নি। পাড়ার সব মানুষ চলে এসেছে আমাদের বাড়ি।এখন কি হবে মেহু?এ..এ..এই শিহাব কি মা রা গেছে?”

মেহরিমা কোনো উত্তর না দিয়ে আলগোছে মাধবীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রাম দা হাতে নিয়েই বিধ্বস্ত অবস্থায় ড্রয়িং রুমের দরজা খুলে দেয়।পাড়া প্রতিবেশীরা মেহরিমার এহেন রুপ দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!মেহরিমা সবার দিকে এক পলক চেয়েই বাইরে বের হয়ে যায়।মেহরিমার হাতে রাম দা থাকায় কেউ আর কিছু বলার সাহস পাই না।মেহরিমার পিছন পিছন মাধবী ও এক ছুটে বের হয়ে যায় ঘর থেকে।তৎক্ষণাৎ সবাই ঘরে ঢুকে নিজেদের কানে শোনা সেই বি ভৎ স চিৎকারের উৎস খুঁজতে লেগে পড়ে।অচেতন অবস্থায় র ক্তা ক্ত শিহাব কে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখেই হৈচৈ পড়ে যায় সেকেন্ডের ব্যবধানে।কয়েকজন মিলে তক্ষুনি শিহাব কে শহরের হসপিটালে নিয়ে চলে যায়।

মেহরিমাদের ঘরের সামনে থাকা বাল্বের সাদা আলোয় বাড়ির আঙ্গিনা ঝলমল করছে।মেহরিমা বকুল গাছের নিচে এসে হাতে থাকা দা ফেলে দিয়ে ধপ করে ওখানেই বসে পরে।শিহাবের করুণ অবস্থার কথা শুনতেই মেহরিমার চাচি রা এক প্রকার ছুটে আসে শেখ বাড়িতে।আর চাচারা শহরের হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।শিহাবের মা তীব্র আক্রোশ নিয়ে মেহরিমার চুলের মুঠি ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে আর থাপড়াতে থাকে।শিহাবের ছোট চাচি মেহরিমা কে কাঁদায় ফেলে ইচ্ছেমতো লাথাতে থাকে।মেহরিমা একদম নিশ্চুপ।মাধবী হাতজোড় করে,সবার পায়ে পড়েও থামাতে পারে না।গ্রামের মানুষ তখন তামাশা দেখতে ব্যস্ত।অথচ সবার নিজেদের দুর্দিনের সঙ্গি জলিল শেখের দুটো প্রাণকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসে না।তখনই হঠাৎ হৃদিতের আগমন ঘটে শেখ বাড়িতে।শেখ বাড়িতে এই প্রথম পা দেয় হৃদিত।ওর পদধ্বনির শব্দে প্রতিটা মানুষের হৃদয় ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে।হৃদিত কে দেখতেই সকলের হৈচৈ থেমে যায়।মেহরিমার দুই চাচিও মেহরিমা কে ছেড়ে দেয়।হৃদিত ওদের দিকে এক পলক তাকাতেই ওরা ভয়ে কেমন জুবুথুব হয়ে তৎক্ষণাৎ শেখ বাড়ি ত্যাগ করে।সেই তখন থেকে এভাবেই বসে মেহরিমা।আর ওর ঠিক সামনে একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে হৃদিত।

অবনী শেখ আর জলিল শেখ দৌড়ে এসে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।রাতে ফোনে চার্জ না থাকায় অবনী শেখের ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছিল তাই এই সবের কিছুই জানতে পারেনি ওনারা।প্রায় ঘন্টা খানেক আগে হসপিটালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর থেকে সবটা শুনে তৎক্ষণাৎ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন ওনারা।হসপিটাল থেকে বাসায় আসতে আধাঘণ্টা মতো সময় লাগে।এতো সকালে কোনো ভ্যান না পাওয়ায় পায়ে হেঁটে আসতে ওনাদের প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতো লেগে গেছে। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতেই দুই মেয়েকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে পেয়েই ওদিকে ছুটে চলে যান অবনী শেখ। দুই মেয়েকে নিজ হাতে আগলে নিতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে মাধবী।অনেকক্ষণ ধরে একইভাবে বৃষ্টিতে ভিজে অতিরিক্ত কান্নার ফলে কথা বলতে পারছে না মাধবী।মেহরিমা তখনও নিশ্চুপ।ওর কোনো হেলদোল ই নেই।জলিল শেখ ধীর গতিতে এগিয়ে এসে কাদার মধ্যে বসে মেহরিমা কে আগলে নিতেই মেহরিমার শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা অনুভব করতে পারে। নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় দুটো ফুলের এতোটা করুণ অবস্থা দেখতেই বাবা নামক মানুষটার মন হু হু করে কেঁদে ওঠে। যাদের গায়ে কখনো একটা ফুলের টোকা ও লাগতে দেয়নি আজ এক রাতের ব্যবধানে তাদের এ কি অবস্থা!তবে কি নিজের দূর্বলতার শিকার নিজের ফুল দুটো হলো!জলিল শেখের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।অবনী শেখ রাগে থরথর করে কাঁপছে।রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিজের হাতে রক্তাক্ত রাম দা তুলে নিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,

“আমার আল্লাহর কসম এক মিনিটের মধ্যে আমার বাড়ি ফাঁকা না করলে সব কয়টার লা শ পড়ে যাবে এখানে।”

অবনী শেখের রাগ সম্পর্কে কম বেশি সবাই অবগত।তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি বাড়ি খালি করে দেয় সকলে।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বাড়ির আঙ্গিনা খালি হয়ে যায়।সবাই চলে গেলেও থেকে যায় হৃদিত,তাবান আর তাইফ। অবনী শেখ শব্দ করে মাটিতে দা ফেলে এগিয়ে আসে হৃদিতের নিকট।হৃদিতের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বলে,

“আমাকে দেওয়া তোমার কথা রাখার সময় এসেছে হৃদিত।আশাকরি তুমি চৌধুরী পরিবারের বাকিদের মতো কাপুরুষ নও।”

অবনী শেখের কথায় হৃদিত মেহরিমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অবনী শেখের দিকে দৃষ্টিপাত করে।হীম শীতল দৃষ্টি হৃদিতের।কয়েক সেকেন্ড মতো অবনী শেখের দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদিতের অধরে তখন বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছে।অবনী শেখের কথায় কোনো প্রত্যুত্তর না করেই তাবান,তাইফ কে হাতের ইশারায় ডেকে তৎক্ষণাৎ শেখ বাড়ি ত্যাগ করে হৃদিত।অবনী শেখ হৃদিতের বক্র হাসির কারণ টা ঠিক ধরতে পারলো না। তবে উনি আশাবাদী হৃদিত নিজের দেওয়া কথা রাখবে।অবনী শেখের কথায় জলিল শেখ তব্দা খেয়ে যান!মেহরিমা আর মাধবী কে জড়িয়ে ধরে বসে থেকেই চোখ বড় বড় করে অবনী শেখের দিকে তাকিয়ে আছেন। জলিল শেখের মনে তখন হাজারও প্রশ্ন।নতুন করে কি আবারও ধ্বংস খেলায় নামতে চাচ্ছে অবনী? তবে কি অতীতের আবারও পুনরাবৃত্তি হবে?কথাটা ভাবতেই জলিল শেখের আত্মার পানি শুকিয়ে যায়।

অবনী শেখ এগিয়ে এসে মেহরিমার মাথায় হাত রাখতেই এক গোছা চুল উঠে আছে অবনী শেখের হাতে। অবনী শেখ চুলগুলোর দিকে পলকহীন চেয়ে থেকে হাত জোড়া মুঠো করে ফেলে। চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।সময় নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে মেহরিমা আর মাধবী কে ঘরে নিয়ে যায়।মেহরিমা তখনও নিশ্চুপ। দুই মেয়েকে তাড়াতাড়ি গোসল করিয়ে দিয়ে অবনী শেখ নিজেও ফ্রেশ হয়ে নেয়।ততক্ষণে জলিল শেখ নিজেও ফ্রেশ হয়ে ডক্টরকে ইনফরম করেছে।ডক্টর সিয়ামের আসতে বিশ মিনিট মতো সময় লাগবে।মেহরিমা একদম পাথর বনে গেছে।কান্না টা পর্যন্ত করছে না।অবনী শেখ মেহরিমার জন্য ভেতরে ভেতরে চিন্তিত হলেও মেহরিমা কে সময় দিচ্ছেন উনি। তারপর না হয় সবটা জানা যাবে।অপরদিকে মাধবী কেঁদেই চলেছে।অবনী শেখের কোলের উপর মাথা রেখে মেহরিমা আর মাধবী কাঁথা গায়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।অবনী শেখ ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।হঠাৎ তখনই শেখ বাড়িতে পুলিশের আগমন ঘটে।

#চলবে______

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০৮

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৮
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

হৃদিত গাড়ি থামিয়ে গাড়ির ডোর ওপেন করে দিতেই মেহরিমা এক ছুটে হসপিটালের ভেতরে চলে যায়।ওর পিছন পিছন তৃধা ও দ্রুত পা চালায়। তখন মেহরিমা দৌড় দিয়ে আসতে যেয়ে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে।অতঃপর হৃদিত নিজের গাড়িতে করে নিয়ে এসেছে তৃধা আর মেহরিমা কে।মেহরিমা সারাটা রাস্তা কান্না করতে করতে এসেছে। রীতিমত সে হৃদিত নামক মানুষ টা কে ভুলতে বসেছে!এখন তার ধ্যানে জ্ঞানে সব যায়গা জুড়ে শুধুই তার বাবা নামক মানুষ টা।

হৃদিত গাড়ির ডোর অফ করে সিটে মাথা এলিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখে।মেহরিমার এই ইগনোর হৃদিত একদমই মেনে নিতে পারছে না।হৃদিতেরও তো হাত কেটে গেছে কৈ তখন তো কান্না করলো না!তাহলে এখন কেনো কান্না করছে?মেহরিমা কান্না করবে,হাসবে শুধুমাত্র হৃদিতের জন্য।একমাত্র হৃদিত ছাড়া আর কারোর জন্য মেহরিমার মনে একটুও ভালোবাসা,ফিলিংস থাকবে না।একটুও না।হৃদিতের চোখ মুখ কঠিন হয়ে ওঠে।পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে নেয়।এখন ওর নিজেকে কন্ট্রোল করতে হবে।একবার নিজের লিটল কিটিকে পেয়ে গেলেই তখন সব দেখা যাবে।একপ্রকার বাঁকা হিংস্র হাসি দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে হৃদিত।

মেহরিমা দৌড়ে এসে হসপিটালে পা রাখতেই করিডরেই অবনী শেখ আর মাধবী কে দেখতে পাই।ও দৌড়ে যেয়ে অবনী শেখ কে জড়িয়ে ধরে। অতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকি উঠে গেছে। ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছে না মেহরিমা।

“ব..ব..বাবা কেমন আছে মা?বাবা কে দে..দেখবো।”

“আরে বোকা মেয়ে এভাবে কান্না করছিস কেনো?তোর বাবা ঠিক আছে।মাথায় দুইটা সেলাই গেছে। এখন স্যালাইন চলছে।আজকে রাতে স্যালাইন টা শেষ হলে কালকে সকালেই আমরা বাসায় চলে যাবো।”

মেহরিমা তবুও শান্ত হয় না।কান্না করেই চলেছে। পাশেই মাধবী দাঁড়িয়ে ফুপাচ্ছে। অবনী শেখ সময় নিয়ে দুই মেয়েকে শান্ত করে।তারপর জলিল শেখ যেই ওয়ার্ডে অ্যাডমিট আছে সেখানে নিয়ে যায় মেহরিমা,মাধবী আর তৃধা কে।তৃধার সাথেও ভালো মন্দ অনেক কথা বলেন অবনী শেখ।সন্ধা হয়ে যাওয়ায় জলিল শেখ কে দেখে টুকটাক কথা বলে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে তৃধা বাইরে চলে আসে।এতক্ষণ সবকিছুই নিরব চোখে দেখছে হৃদিত।ওর ভেতরে এখন কি চলছে তা মুখ দেখে বোঝা মুশকিল!

“ভাইয়া বাসায় যাবো।”

“বাইরে তাবান,তাইফ দাঁড়িয়ে আছে ওদের সাথে চলে যা।”

তৃধা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে হৃদিতের দিকে এক পলক চেয়েই ওখান থেকে প্রস্থান করে।

সময় রাত আটটা। ইতোমধ্যে মেহরিমার একমাত্র মামা আর মামি হসপিটালে উপস্থিত হয়েছে। অবনী শেখের আপন বলতে ওনারা দু’জন ই আছে শুধু। নদীর ওপারে কুসুমপুরে বাড়ি ওনাদের।মেহরিমাদের বাসা থেকে মামার বাসায় ব্রিজ পার হয়ে যেতে মাত্র পনেরো মিনিট সময় লাগে।উনি জলিল শেখের সাথে পার্টনারশিপে ব্যবসায় কর্মরত আছেন।

মেহরিমা জলিল শেখের এক হাত ধরে নির্বিকার ভাবে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।

“ওও বাবা তোমার কি খুব খারাপ লাগছে?”

“না রে আম্মু।এখন বেশ ভালো লাগছে। বাসায় চলে যেতে পারলে আরও ভালো লাগতো।”

মেহরিমা মুচকি হেসে বলে,

“কালকে সকালেই তো বাসায় চলে যাবে বাবা। আজকে রাতটা একটু কষ্ট করে মানিয়ে নেও।আর কাল সকালে তোমার জন্য আমি তোমার পছন্দের গরুর মাংস আর খেচুরি রান্না করে রাখবো বাবা। বাসায় যেয়ে তখন মন ভরে খেও কেমন।”

“ওরে আমার পাকনি বুড়ি রে!”

জলিল শেখের কথায় মেহরিমা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।পাশে বসা মাধবী ও মুচকি হাসে।

“এই মিনাক্ষী, নীলাক্ষী শাহিন ভাই আর ভাবীর সাথে তোরাও বাসায় চলে যা।রাত বাড়ছে।সাবধানে থাকবি রাতে।মেইন ডোর ভালোভাবে লক করবি।আজ দুই বোন একসাথে থাকিস।কোনো সমস্যা হলেই আগে আমাকে কল করবি।”

অবনী শেখের কথায় মেহরিমা আর মাধবী হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায়।তারপর বাবা মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে মামা মামির সাথে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।মেহরিমা হসপিটাল থেকে বের হতেই ওর দৃষ্টি যায় ওদের অপোজিট সাইডে থাকা পরিচিত বিএমডব্লিউ টার দিকে।ল্যাম্পপোস্টের আবছা হলুদ নিয়ন আলোতে গাড়ির হুডের উপর বসা একটা অবয়ব দেখতে পাই।দুই আঙ্গুলের ভাঁজে জলন্ত সিগারেট রাখা।অবয়ব টা যে ওর কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সেটা মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতেই মেহরিমার বক্ষ স্থলে তীব্র ঝড় শুরু হয়!হৃদিত যে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে সেটাও খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে মেহরিমা।হঠাৎ ওর মনে পড়ে যায় বিকালের কথা।আর তাতেই মেহরিমার মুখটা আরও ফ্যাকাশে হয়ে যায়।হৃদিত ভাই কি রেগে আছেন?আজতো মাধুপু থাকবে কাছে তাই রাতেও কথা বলা যাবে না।হঠাৎ আকাশ ফেটে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়।মেহরিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত ভেনে উঠে বসে।

______

মেহরিমারা বাসায় এসেছে প্রায় তিন ঘন্টা হতে চললো।ওদেরকে নিজের বাসায় পৌঁছে দিয়েই শাহিন শেখ আর ওনার ওয়াইফ সাইমা শেখ নিজেদের বাসায় চলে গেছে।এখন রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট।বাইরে তুমুল বর্ষণ হচ্ছে।ক্ষণে ক্ষণে শব্দ তুলে মেঘ গর্জন করে উঠছে।দুই বোন রাতের খাওয়ার পর্ব সেরে পড়তে বসেছে।মেহরিমা ম্যাথ করছে।ওর পাশেই বিছানায় বসে বসে মাধবী ও অ্যাডমিশনের জন্য বায়োলজি বিচিত্রা পড়ছে। মাঝে মাঝে দুই বোন টুকটাক গল্পও করছে।

“এই মেহু ক্ষুধা লেগেছে। কিছু বানিয়ে দে।”

“কিছুক্ষণ আগেই না খেলে তুমি!এতো রাতে আবার কি খাবে?”

“নুডুলস! রান্না করে দে না বোন।”

“আচ্ছা তবে একটা শর্ত আছে।”

“কি?”

“আমাকে হেল্প করতে হবে।আমি একা পারবো না।”

“অবশ্যই সোনা।চল তাড়াতাড়ি।”

মেহরিমা মুচকি হেসে খাতা বন্ধ করে কিচেনের দিকে হাঁটা ধরে।মাধবী ও পিছু পিছু আসে।হঠাৎ ওদের কলিং বেল বেজে ওঠে।মাধবী আর মেহরিমা চমকে ওঠে।এতো রাতে কে আসবে?

“এই মাধুপু তুমি মেইন গেইটে তালা লাগাওনি?”

“লাগিয়েছি তো।”

“তাহলে এই বৃষ্টির মধ্যে এতো রাতে কেউ বাসার ভেতরে কি করে আসবে?”

ওদের কথার মাঝেই ওদের মেজ চাচা জিহাদের ছোট ছেলে শিহাবের কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে,

“এই মেহরিমা তাড়াতাড়ি দরজা খোল।ছোট আব্বুর অবস্থা ভালো না।তোদের কে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছোট আম্মু আমাকে পাঠিয়েছেন।”

বাবা নামক মানুষ টার কথা শুনতেই মেহরিমা নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেয়।কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,

“ভাইয়া,বাবার কি হয়েছে?সন্ধ্যায় ও তো সব ঠিকঠাক ছিল।তাড়াতাড়ি আমাদের কে বাবার কাছে নিয়ে চলুন।এই মাধুপু জলদি ছাতা নিয়ে এসো।”

মেহরিমা তাড়াতাড়ি করে ঘর থেকে বের হতে নিলেই শিহাব ওকে এক ধাক্কা দিয়ে ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে ফেলে দিয়ে তড়িৎ গতিতে ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নিজের সাথে কি ঘটে গেল সেটা মস্তিষ্ক জানান দিতেই মেহরিমার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে ওঠে।আজ তো মা নেই ও একা এই প শু টাকে কিভাবে সামলাবে।বাবার কথা শুনে সব কিভাবে ভুলে গেলো মেহরিমা! শিহাব ওর আটাশ পাটি দাঁত বের করে কুৎসিত হেসে বলে,

“আজ তোকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে মেহুপাখি?সেদিন তো তোর মায়ের জন্য ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছিলিস।আজ তো তোকে আমার হতেই হবে।”

কথাটা বলেই মেহরিমা কে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ দিয়ে গি লে খেতে থাকে। ঘৃ ণা য় মেহরিমার শরীর রি রি করে ওঠে।মাধবী ভয়ে ইতোমধ্যে কান্না করে দিয়েছে।ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।মেহরিমা চিৎকার করে তীব্র ক্ষোভের সাথে বলে,

“জা নো য়া র আমাদের থেকে দুরে থাক বলছি। নাহলে আমি কিন্তু চিৎকার করবো বলে দিলাম।”

“তো কর চিৎকার নিষেধ করছে কে?এই বৃষ্টির মধ্যে তোর চিৎকার কে শুনবে?আর চিৎকার শুনে যদি সবাই এসেও থাকে তাহলে তোদের কে এই অবস্থায় দেখে সবাই ছিঃ ছিঃ করবে।তোদের বাবা, মায়ের সম্মান মাটিতে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তুই বে শ্যা নামে নতুন রুপে পরিচিত হবি।আর তোর এই আবাল বোন তো নির্ঘাত সু ই সা ই ড করবে। যাইহোক তোর সাথে ওইটা ফ্রি।আগে তোর ব্যবস্থা করে নিই।”

কথাটা বলেই হো হো করে হেসে ওঠে শিহাব।মেহরিমার দিকে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে।মেহরিমা ফ্লোর থেকে উঠতে নিলেই ঝড়ের গতিতে ওকে আবারও ফেলে দিয়ে ওর কোমরের উপর উঠে বসে শিহাব।মেহরিমা ধস্তাধস্তি না করে মাধবী কে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করে।মাধবী আস্তে আস্তে ওখান থেকে সরে যায়।শিহাব একটানে মেহরিমার জামার হাতা ছিঁড়ে ফেলে।মেহরিমা তখনও নিশ্চুপ। হঠাৎ পিছন থেকে মাধবী ভাস্ক দিয়ে শিহাবের মাথায় আঘাত করতেই শিহাব মেহরিমাকে ছেড়ে ওর পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।মেহরিমা উঠে মাধবীর হাত ধরে দৌড় দেয় রুমের দিকে। রুমে ঢোকার আগ মূহূর্তেই মেহরিমার হাত ধরে ফেলে শিহাব।মেহরিমা নিজের হাত ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। মেহরিমা বুঝতে পারে এই প শু র হাত থেকে আজ আর ওর নিস্তার নেই। নিজের বোনকে বাঁচাতে মাধবীর হাত ছেড়ে দেয়।মাধবী ধাক্কা দিয়ে রুমের ভেতরে ফেলে দেয়।

“মাধুপু তোমার দোহাই লাগে দরজা ভেতর থেকে লক করে দেও। বিছানায় বালিশের পাশে আমার ফোন আছে। দরজা লক করে মায়ের কাছে কল দেও ফাস্ট। ততক্ষণে এই জানোয়ারকে আমি দেখছি।”

“মা গি র মা ই য়া তোর কল দেওয়া আমি বের করছি।”

কথাটা বলেই শিহাব মেহরিমার হাত ছেড়ে ওর চুলের খোঁপা শক্ত মুঠি বদ্ধ করে ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু তার আগেই মেহরিমা নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে শিহাবের গলা চেপে ধরে।মাধবী ফ্লোরে বসে শব্দ করে কান্না করছে।মেহরিমা মাধবীর উদ্দেশ্যে আবারো বলে,

“মাধুপু আমার কসম তুমি দরজা লাগাবে। নিজেকে রক্ষা করে মাকে কল দেও।তাহলে আমরা দুজনেই বেঁচে যাবো।নাহলে আমরা কেউ এই ন র প শু র হাত থেকে বাঁচতে পারবো না।আবেগ রেখে নিজের বুদ্ধি কাজে লাগাও।”

এবার মাধবী হয়তো মেহরিমার কথাটা বুঝতে পারলো। শিহাব মেহরিমা কে এক ধা ক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়।নিজের গলা ধরে কাশতে থাকে।মাধবী ততক্ষণে ভেতর থেকে দরজা লক করে দিয়েছে।সেকেন্ডের ব্যবধানে শিহাব উঠে দাঁড়িয়ে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মেহরিমার গালে থা প্প ড় বসায়।মেহরিমা ব্যালেন্স হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়।ওর ঠোঁ ট কেটে র ক্ত ঝরতে থাকে। শিহাব রাগে গজগজ করতে করতে মেহরিমাকে টেনে হিচড়ে পাশের রুমে নিয়ে যেয়ে বিছানায় এক প্রকার ছুড়ে ফেলে ওর উপরে হামলে পড়ে।মেহরিমা নিজেকে বাঁচাতে ধস্তাধস্তি শুরু করে দেয়।

“ভাইয়া আপনার পায়ে পড়ি আমার এতো বড় ক্ষতি করবেন না প্লিজ।আমি বাবাকে বলবো সব জমি,যায়গা আপনার বাবার নামে লিখে দিতে। তবুও আমার সাথে এমন করবেন না।আমাকে বাঁচতে দেন ভাইয়া।আমি এখনও দীর্ঘদিন বাঁচতে চাই ভাইয়া।আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মা কিন্তু আপনাকে টু ক রো টু ক রো করে কুকুর দিয়ে খাওয়াবে।”

মেহরিমার কোনো কথায় কানে নেয় না শিহাব। হিং স্র প শু র মতো মেহরিমার গা ল গ লা য় আঁ চ ড় দিতে থাকে।মেহরিমার দু’চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে চলেছে।ও চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়।এই ষাঁ ড়ে র মত পশুর শক্তির সাথে ওর পেরে ওঠা সম্ভব না।বুদ্ধি দিয়েই কিছু করতে হবে।বাইরে প্রকৃতি নিজস্ব রুপে কান্না করতে ব্যস্ত।নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে নিজের মন খারাপের কথা জানিয়ে চলেছে সকলকে।অপরদিকে বদ্ধ ঘরে এক তরুণী নিজের সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে অনবরত কান্না করে চলেছে।আজ প্রকৃতি মেহরিমার পক্ষে নাকি বিপক্ষে মেহরিমা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না!মেহরিমার চোখের সামনে নিজের মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে।মা তো কথা দিয়েছিল সব খারাপ পরিস্থিতিতে সবসময় পাশে থাকবে।তাহলে এখন কোথায় মা?মা তোমার মেহরিমা খুব কষ্ট পাচ্ছে।একটু কষ্ট কমিয়ে দেও না মা!তোমার মেহরিমা এই যন্ত্রনা আর সহ্য করতে পারছে না মা।ডুকরে কেঁদে ওঠে মেহরিমা।পরক্ষণেই ওর মানসপটে হৃদিতের গম্ভীর মুখটা ভেসে ওঠে।মন ও শরীরে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে ও মনে মনে আওড়ায়,

“এই জীবনে আর আপনাকে নিজের করে পাওয়া হলো না হৃদিত ভাই।”

#চলবে_______

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০৭

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৭
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

সময় বিকাল বেলা। সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিদিনের মতো আজও প্রকৃতি হাস্যোজ্জ্বল।মেহরিমা শুয়ে শুয়ে ছটফট করছে।আজ ইচ্ছে করেই বাহানা দিয়ে কলেজে যায়নি যার ফলে হৃদিতের সুদর্শন পুরুষালি গম্ভীর মুখটাও দর্শন করতে পারেনি।মেহরিমার মনটাও যেনো আজ কেমন অস্থির লাগছে।শান্তি পাচ্ছে না।মন চাচ্ছে এক ছুটে চৌধুরী বাড়িতে চলে যেতে।মেহরিমা নিজের মনের চাওয়া কে প্রশ্রয় দিলো।যেই ভাবা সেই কাজ। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে এসে নিজেকে পরিপাটি করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। উদ্দেশ্যে কিচেন।

“মা!”

অবনী শেখ রাতের রান্না বসিয়েছেন।মেহরিমার ডাকে পেছনে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন,

“বল মা।কোনো দরকার?”

“মা আগামীকাল ম্যাথ ক্লাস টেস্ট আছে।তৃধার কাছে যাওয়ার দরকার ছিলো একটু। আজকের ম্যাথ নোট কালেক্ট করতে হবে।”

চৌধুরী বাড়ির কথা শুনতেই অবনী শেখের মুখমণ্ডল শক্ত হয়ে যায়।উনি কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

“তোর ফোন কি হয়েছে?তৃধাকে নক দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে নিয়ে নে।”

“মা আজ তো ওয়াইফাই বন্ধ। লাইনে কি একটা সমস্যা হয়েছে।কালকের আগে আসবে বলে মনে হয় না।”

কথাটা শুনে অবনী শেখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকায়।ব্যস অমনিই মেহরিমার ভেতরের সাজানো সব কথা তালগোল পাকিয়ে যায়।

“শুধু কি ম্যাথ নোট কালেক্ট করতেই যাচ্ছিস?”

অবনী শেখের এমন কথাতে মেহরিমা থতমত খেয়ে যায়। অবনী শেখ তখন ও নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রয়েছে।মেহরিমা শুকনো ঢোক গিলে বলে,

“হুম মা।”

অবনী শেখ মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে বলে,

“আচ্ছা যা। সন্ধ্যার আগে বাসায় চলে আসবি। আমার ব্যাগের সাইডে টাকা আছে নিয়ে যা।ভ্যানে যাবি ভ্যানে আসবি।”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে তাড়াতাড়ি করে টাকা নিয়ে বের হয়ে পড়ে।খুশিতে মেহরিমার লুঙ্গি ডান্স দিতে মন চাচ্ছে।গোমড়া মুখো টা হঠাৎ মেহরিমা কে দেখলে হয়তো খুব অবাক হবে!সেই সুদর্শন মুখের অবাক চাহনি নিশ্চয় নজরকাড়া!
মেহরিমা বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেই অবনী শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মনে মনে আওড়াই।

“ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে সবাই।এর শেষ কোথায়?তোর সুখের কথা ভাবতে যেয়ে মায়ের মতো আমিও কোনো ভুল করে ফেলছি না তো নিলাক্ষী!”

তরকারি পোড়ার গন্ধ নাকে আসতেই অবনী শেখ নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি গ্যাস বন্ধ করে দেয়। অতঃপর রান্নায় মনোযোগী হয়।

_______

মেহরিমা ভ্যান থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গুটি গুটি পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে।দারোয়ান শামসুল চাচা মেহরিমা কে দেখতেই হাসিমুখে বলেন,

“আরে মেহু মা যে! কতদিন পর এই বাড়িতে আইলা।তা কেমন আছো মা?”

মেহরিমা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে,

“আলহামদুলিল্লাহ চাচা।আপনি,চাচি সবাই কেমন আছেন?”

“আমরা ভালা আছি মা।”

“চাচা ভেতরে যায় ।একটু পরেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। বাসায় ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।”

“আচ্ছা মা যাও।”

মেহরিমা এবার দ্রুত পা চালিয়ে চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করে।মেহরিমা এই বাড়ির ভেতরে ঢুকলেই কেমন যেন রাজপ্রাসাদের ফিল পাই!ও ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দেখতে পাই আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরী সোফায় বসে মুড়ি মাখানো খেতে খেতে গল্প করছে।চৌধুরী বাড়িতে আসলে এই দুই জনের মিল দেখে মেহরিমার মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।ওদের দেখে কখনো মনেই হবে না ওরা দু’জন একে অপরের জা!আপন বোনের মতো বন্ডিং দুজনের মধ্যে বিরাজমান।আতিয়া চৌধুরী গল্পের ফাঁকে সদর দরজার দিকে তাকাতেই মেহরিমা কে দেখতে পাই।আর তাতেই ওনার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। উনি এগিয়ে আসেন।

“আরে মেহু মা যে!আজকাল তো অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছো তুমি।মাসে একবারও এই বাড়িতে পায়ের ধুলো দেও না।”

মেহরিমা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে,

“আমার কথা বাদ দেন ছোট আন্টি।আমি তো ছয়মাস পরে একদিন হলেও এই বাড়িতে পা রাখি আপনাদের তো সেটুকু খবরও পাওয়া যায় না।”

মেহরিমার কথায় আয়েশা চৌধুরী এগিয়ে এসে বলেন,

“ঠিক বলেছিস মেহু মা।মায়েরা খোঁজ না নিলে মেয়ের খোঁজ কিভাবে পাবে?”

আয়েশা বেগমের কথা শুনে মেহরিমা উৎফুল্ল হয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে।

“ঠিক বলেছন আন্টি।আজ না আমি আড্ডা দিতে পারবো না।বড্ড তাড়া আমার। সন্ধ্যার আগে বাসায় চলে যেতে হবে।তৃধা কোথায় আন্টি?”

“ও আর কোথায় থাকবে?দেখ গিয়ে রুমের কোথাও ফোন নিয়ে মটকা মেরে পড়ে আছে।”

“আচ্ছা।”

কথাটা বলেই মেহরিমা দৌড় লাগায় তৃধার রুমের উদ্দেশ্যে।তৃধার রুম দোতলার একদম সামনের টাই।আর হৃদিতের টা একদম কোনার দিকে। নিজের অন্ধকার রুমে হঠাৎ লাইট জ্বলে উঠতেই তৃধা চরম বিরক্ত হয়।আয়েশা চৌধুরীকে ভেবে কিছু বলতে যাবে তার আগেই চোখ খুলে মেহরিমা কে দেখে তৃধা চমকে এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসে। কন্ঠে অবিশ্বাস্যতা মিশিয়ে বলে,

“আমি কি স্বপ্ন দেখছি!নাকি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে আমার?”

“আরে ভাই কিছুই হচ্ছে না তোর সাথে।আমি সত্যিই এসেছি। তাড়াতাড়ি আজকের ম্যাথ নোট দে।ফটাফট কয়টা ছবি তুলে নিই।”

তৃধা নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,

“মেহু বেইবি এতদিন পরে আসলি আমার বাসায়। কিছু তো খেতেই হবে। তারপর বাকি সব।”

“না রে,মা সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে বলেছে। মাগরিবের আজানের আর মাত্র আধাঘণ্টা বাকি আছে।”

অবনী শেখের কথা শুনতেই তৃধা দমে গেলো। স্টাডি টেবিলের সামনে এসে ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে মেহরিমাকে দেয়।মেহরিমা ছবি তুলতে নিলেই তৃধা বলে ওঠে,

“আরে আরে ছবি তুলোস কেন?কলেজে একটা ক্লাস মিস দিয়ে তোর জন্য আলাদা করে নোট করে রেখেছি আমি।খাতা সহ নিয়ে যা।”

মেহরিমা খুশি হয়ে তৃধাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে।অতঃপর তৃধাকে সঙ্গে করে আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরীর থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।মেহরিমার মনটা খারাপ হয়ে যায়।যার জন্য আসলো তার দেখাই পেলো না।হুদাই এতো কষ্ট করে আসা।বাড়ির সদর দরজা পার হতেই তৃধা মেহরিমার হাত থেকে পার্স আর খাতা নিয়ে নেয়।মেহরিমা জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই তৃধা বলে,

“তোর হ্যান্ডসাম বাড়ির পিছনে পুকুর পাড়ে আছে।যার জন্য এসেছিস তার সাথে দেখা না করেই চলে গেলে হবে বেইবি!আমি সামনের দোলনায় বসছি। চটজলদি নিজের কাজ সেরে আয় যা।”

তৃধার কথায় মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।তবে সুযোগ টা হাত ছাড়া করে না।গুটি গুটি পায়ে বাড়ির পেছনের দিকে হাটা ধরে।মেহরিমা প্রস্থান করতেই তৃধা উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।সেই হাসির শব্দ মেহরিমা নিজেও শুনতে পায়।

মেহরিমা বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে আসতেই দেখতে পাই চোখ ধাঁধানো এক সুন্দর দৃশ্য। সুদর্শন এক যুবক পুকুরের সিঁড়িতে তার নিজস্ব স্টাইলে বসে গিটারে দক্ষতার সাথে সুর তুলছে।সে যেনো নিজের মতো করে নিজস্ব এক দুনিয়ায় বিরাজ করছে!হৃদিতের একপাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।সন্ধ্যার লালাভ আলোতে ফর্সা মুখটা খুবই মোহনীয় লাগছে। চোখের লীল মণিতে লালাভ আবছা আলো পড়ে যেনো জ্বলজ্বল করছে!গান গাওয়ার তালে তালে অ্যাডামস অ্যাপেল ওটা নামা করছে।ব্যান্ডেজ করা হাতের লম্বা চওড়া আঙ্গুল গুলো দিয়ে সুনিপুণ ভাবে গিটারের তার নাড়িয়ে চলেছে।মেহরিমার কানে বেজে ওঠে এক সুমধুর কন্ঠস্বর থেকে ভেসে আসা গানের কিছু লাইন।

“দুরে কোথাও আছি বসে
হাত দুটো দাও বাড়িয়ে।
বিরহ ছুঁ তে চায় মনের দুয়ার
দু’চোখ নির্বাক আসো না ছুটে।
তুমি এলে রংধনু রং ঢেলে দেয়
তুমি এলে মেঘেরা বৃষ্টি ছড়ায়।
এ মনের আহ্লাদ আসো না ছুটে।
দুরে কোথাও আছি বসে
হাত দুটো দাও বাড়িয়ে।
বিরহ ছুঁ তে চায় মনের দুয়ার
দু’চোখ নির্বাক আসো না ছুটে।
(সংক্ষেপিত)

মেহরিমা দু’চোখ বন্ধ করে গানটা অনুভব করতে থাকে।হৃদিত মেহরিমার উপস্থিতি আগেই অনুভব করেছিল।হৃদিত যেন জানতো মেহরিমা আসবে!তাই তো এতো আবেগ ভালোবাসা মিশিয়ে গান গাইলো।হৃদিত মেহরিমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।অতঃপর মুখটা স্বভাবগত কঠিন করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“চুরি করা পাপ।”

হঠাৎ হৃদিতের গম্ভীর কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই মেহরিমা চমকে চোখজোড়া খুলে তাকায়।গানের মধ্যে এতোটাই মজে ছিলো যে গান কখন শেষ হয়ে গিয়েছে সেটাও টের পাইনি।মেহরিমা চোখ নামিয়ে নেয়।এভাবে চুরি করে গান শুনে ধরা পড়ে যাওয়াতে লজ্জার সাথে একরাশ অস্বস্তি এসে জেঁকে ধরে মেহরিমাকে।পরক্ষণে চোখ তুলে তাকাতেই মেহরিমার দৃষ্টি যেয়ে পড়ে হৃদিতের হাতের দিকে।মেহরিমা আঁতকে ওঠে!ও কোনোরকমে বলে,

“আ..আমি চুরি করিনা হৃদিত ভাই। আপনার হাতে কি হয়েছে হৃদিত ভাই?সেদিন ও না সব ঠিক ছিলো!”

“অনেক বড় কিছু চুরি করেছিস তুই।সেটার শাস্তিই এখনো দিতে পারলাম না তোকে।নতুন করে এখন তুই আমার পারমিশন ছাড়া চুরি করে গান শুনলি। আবার কানের কাছে কি এক ভাই ডাক লাগিয়ে রেখেছিস।তোর কোন জন্মের ভাই লাগি আমি? এতগুলো ভুলের জন্য তোকে কি শাস্তি দেওয়া উচিত বল?”

“আ.. আমার ভুল হয়ে গেছে।আর কখনো এমন হবে না।”

“উহু তা বললে তো চলবে না।তবে তোর শা স্তি কমানোর জন্য আমি একটু সাহায্য করতে পারি যদি তুই আমার কথা শুনিস।”

মেহরিমা যেন একটু আশার আলো দেখতে পাই।ওর চোখ মুখ ঝলমলিয়ে ওঠে।চোখে মুখে তীব্র আগ্রহ নিয়ে জানতে চাই ,

“কি করলে আমার শা স্তি কমবে?”

“চল বিয়ে করে ফেলি।তখন তুই আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবি।তোর সবকিছুই আমার হয়ে যাবে।সেই হিসেবে তোকে একটু কম শাস্তি দিয়ে সাহায্য করতেই পারি। অনেক বড় অফার। ভেবে দেখতে পারিস।লাভ ছাড়া লস নাই।”

হৃদিতের মুখে এমন কথা শুনে মেহরিমা তব্দা খেয়ে চোখগুলো রসগোল্লার মতো গোলগোল করে হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদিত কৌশলে হাতের কথাটা এড়িয়ে যায়।নিজের কথার জালে মেহরিমা কে আবদ্ধ করে রাখে।বোকা মেহরিমা আদৌও সেটা বুঝলো কি?হয়তো না!পাঁচ মিনিট মতো সময় নিয়ে মেহরিমা মনের ভেতরের জমানো কথাগুলো যখনই উজাড় করতে যাবে সেই মূহূর্তে তড়িৎ গতিতে ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে হাজির হয় তৃধা।

“মেহরিমা তোর চাচারা আঙ্কেল কে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আন্টি,মাধুপু আর গ্রামের কিছু মানুষ মিলে ওনাকে হসপিটালে নিয়ে গেছে। মাথা থেকে অনেক ব্লি ডিং হচ্ছে।মাধুপু তোকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে যেতে বললো।”

কথাটা শুনতেই মেহরিমার পুরো পৃথিবী দুলে ওঠে! ‘ব..বাবা’ অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেই নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওখান থেকে ছুটে চলে যায়। গন্তব্যস্থল হসপিটাল।

“আরে…আরে মেহু বেইবি তোর পার্স আমার কাছে।”

কথাটা বলে তৃধাও দৌড় দেয় মেহরিমার পিছন পিছন।হৃদিত গিটার কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মেহরিমার ইগনোর টা হৃদিত ঠিক মেনে নিতে পারলো না।হৃদিতের এতো ইম্পর্ট্যান্ট কথার উত্তর না দিয়েই ছুটে চলে গেলো!ওকে কি কোনোভাবে রিজেক্ট করে দিলো?মেহরিমা ওর থেকে অন্য কাউকে বেশি প্রায়োরিটি দেয় কথাটা মস্তিষ্ক জানান দিতেই হৃদিতের মুখমণ্ডল শক্ত হয়ে কঠিন রুপ ধারণ করে।হাতজোড়া মুঠো করে ফেলে।

#চলবে_______

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০৬

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৬
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

সময় বিকাল বেলা।সূর্যি মামা আজকের মতো বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।পুকুরের পানি মৃদু সূর্যের আলোয় ঝলমল ঝলমল করছে।ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।চৌধুরী বাড়ির ফুল বাগান থেকে ভেসে আসছে নাম না জানা ফুলের মিষ্টি সুবাস।

হৃদিত বাড়ির পিছনে একা একা বসে গিটারে সুর তুলে গান গাইছে।তাইফ আর তাবান খেলার মাঠে গেছে ফুটবল খেলতে।নাহলে এতক্ষণে হৃদিতকে বিরক্ত করে ছাড়তো!হৃদিতের গান গাওয়ার মাঝেই হঠাৎ ওর ফোনটা নিজ শব্দে বেজে ওঠে।হৃদিতের কোনো কাজের মাঝে ডিস্টার্ব একদম পছন্দ না।ওর মেজাজ বিগড়ে যায়।তবুও অনিচ্ছা নিয়েই প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা টা বের করে হাতে নেয়।ফোনের স্ক্রিনে নিজের বাবার আনসেইভ নাম্বার টা দেখতেই হৃদিত বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে কল রিসিভ করে,

“বলুন এমপি আরিফ হাসান চৌধুরী।কি দরকারে আমাকে স্মরণ করেছেন?”

“আমি কি শুধু প্রয়োজনেই তোমাকে কল দিই বাবা?”

“জ্বি এমপি স্যার।”

হৃদিতের কাঠখোট্টা জবাবে আরিফ হাসান মলিন হেসে বলেন,

“বাসায় আসবে কবে?তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছে না কিছু।তোমার মা কান্না করছে শুধু।তুমি কারোর কল ও রিসিভ করছো না!”

“কেনো আপনার বউ,ছেলে,বউমা আছে তো! আমাকে কেনো প্রয়োজন স্যার?আর তাছাড়া ঢাকাতে থাকলে আপনার রাজপ্রাসাদে আমি কয়দিন থাকি স্যার?আমাকে কাইন্ডলি একটু বলবেন প্লিজ।আপনার বউকে বলবেন এইসব কুমিরের কান্না যেন আমার জন্য না করে।”

“এভাবে কেনো বলছো?আমরা তোমার বাবা মা।”

“আমি মানি না।”

“তুমি মানো বা না মানো সত্য এটাই।আর সত্য সবসময় সত্যই থাকে।”

“ঠিক বলেছেন স্যার।সত্য সবসময় সত্যই থাকে।সত্য কখনো মুছে ফেলা সম্ভব না।”

কথাটা বলেই হৃদিত কল কেটে দেয়।হৃদিত কল কাটতেই আরিফ হাসানের চোখে জলেরা হানা দেয়।এই বিষাক্ত অতীত কবে পিছু ছাড়বে?এই অতীত যে আর টানা সম্ভব না।এর থেকে বরং মৃ ত্যু ই শ্রেয়! নিজের জানের টুকরো ছেলেকে আরিফ হাসান হারিয়ে ফেলেছে।সেই ছোট্ট হৃদিত আর এই হৃদিতের মাঝে যে আকাশ পাতাল পার্থক্য!
হঠাৎ কাঁধে কারোর স্পর্শ পেতেই পিছনে ফিরে তাকায় আরিফ হাসান।শ্রেয়া চৌধুরী কে দেখে চোখের জল লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করে।শ্রেয়া চৌধুরী মলিন হেসে বলেন,

“কান্না করো না।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“এটা কি আদৌও ঠিক হওয়ার মতো?মিথ্যা শান্তনা আর কতো দিবে শ্রেয়ু।”

“তোমার সাথে সাথে একই পাপ আমিও বয়ে বেরাচ্ছি আরিফ। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আমাদের ছেলে আমাদের কে একদিন ঠিক বুঝতে পারবে।”

“আমার পাপের কোনো ক্ষমা নেই শ্রেয়ু।আর না কখনো তোমাকে ক্ষমা করবো আমি।”

কথাটা বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে বাইরে চলে যায় আরিফ হাসান।শ্রেয়া চৌধুরী ছলছল চোখে ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
__________

হৃদিত তখন মেহরিমা কে ডক্টর দেখিয়ে মার্কেটে যেয়ে বোরকার সাথে প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে দিয়ে বাসায় রেখে গেছে।মেহরিমা বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়েছিল।অবনী শেখ তিনটার দিকে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে মেহরিমার হাতে ব্যান্ডেজ দেখতে পেয়েই পুলিশের মতো জেরা শুরু করেছিলেন।মেহরিমা সব পারলেও অবনী শেখের ঈগল দৃষ্টির সামনে মিথ্যা বলতে পারে না। তবুও আজ আগে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে রাখায় বেশ সাজিয়ে গুছিয়েই মিথ্যা বলেছিল।সবটা শুনে অবনী শেখ বিশ্বাস করেছিলেন কি কে জানে!তবে মেহরিমাকে আর প্রশ্ন করেন নি।মেহরিমা এখনো বোরকার ব্যাপার টা জানায়নি অবনী শেখ কে। একদিনে এতকিছু ঘটালে ওর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন মা অতি সহজেই সব বুঝে ফেলবেন।এমনিতেই অবনী শেখ চৌধুরী দের কেনো যেনো সহ্য করতে পারে না।মেহরিমাকে চৌধুরী ভিলাতে ও সহজে যেতে দেয় না।মেহরিমা বিষয় টা নিয়ে অতোটা মাথা ঘামায় না। কারণ ওর মা ওদের দুই বোন কে খুব প্রয়োজন ছাড়া কোথাও ই যেতে দেয় না। তবে চৌধুরী বাড়ির প্রতি একটু বেশিই করে এই যা!মেহরিমা ভেবে রেখেছে হাতের বাহানা দিয়ে এখন কয়দিন কলেজে যাবে না। তারপর ডক্টর দেখানোর নাম করে বাইরে যেয়ে বাসায় এসে বলবে বোরকা কিনে এনেছে। এখন ভালোই ভালোই প্লানিং মতো সবকিছু হলেই হলো।

“নীলাক্ষী মা আমার ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

মায়ের কন্ঠ শুনে মেহরিমা ওর সামনে রাখা বইতে মনোযোগ দেয়। অবনী শেখ আর মাধবী মেহরিমার ঘরে এসে খাটে বসে।মেহরিমা ওদের দিকে চেয়ার ঘুরিয়ে হাসিখুশি মুখে সামনাসামনি বসে।

“এতো রাত হয়ে গেলো এখনো পড়ার টেবিলে বসে আছিস কেনো?মাথা যন্ত্রণা করবে তো।সময় মতো সব কাজ করবি।”

অবনী শেখের কথায় মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।মাধবী বলে,

“মা তুমি এতো টাইমলি সব কাজ কিভাবে করো গো?”

“আমরা চাইলে সবই করতে পারি।শুধু ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন।এই দেখ যারা ডক্টর তাদের কে তো দিনের প্রায় অর্ধেক সময়ই হসপিটালে কাটাতে হয়।তারাও তো নিজেদের সংসার,বাচ্চা সব সামলিয়ে থাকে।তাই চাইলে সব সম্ভব।পানচুয়ালিটি আমাদের লাইফের খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা পার্ট।যে যতো বেশি পানচুয়াল সে ততো বেশি সাকসেসফুল।”

“তুমি কতো বোঝো মা!”

মেহরিমার বোকা কথায় অবনী শেখ মুচকি হেসে বলেন,

“সময় হোক তোরাও বুঝবি।মনে রাখবি সময় আর পরিস্থিতি মানুষ কে সবচেয়ে বেশি ম্যাচিউর করে তোলে।যে যত বাস্তবতার কবলে পড়বে জীবনে সে ততো বেশি শিখবে,ততো বেশি শক্ত হবে।তবে দোয়া করি আমার মতো এতো বাস্তবতার সম্মুখীন তোদের যেনো হতে না হয়।”

মেহরিমা বোঝ দ্বারের মতো মাথা নাড়ে।মেহরিমা অবনী শেখ কে ওনার বলা শেষ কথাটা নিয়ে যখনই প্রশ্ন করতে যাবে তখনই ওদের বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে।মেহরিমাদের এক তলা বিশিষ্ট ঘরটা বেশ পরিপাটি,মান সম্মত।অবনী শেখ দরজা খুলতে এগিয়ে যায়। পিছন পিছন মেহরিমা আর মাধবী ও আসে। অবনী শেখ দরজা খুলতেই জলিল শেখ কে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহরিমা আর মাধবী ওনার বুকের উপর হামলে পড়ে। জলিল শেখ দেহে যেন প্রাণ ফিরে পায়। কলিজার টুকরা মেয়ে দুটোকে ছাড়া জলিল শেখ এই কয়দিন একটুও শান্তিতে ছিলেন না। উনি মুচকি হেসে দুই মেয়েকে দুই হাতে আগলে নেন।

“মিনাক্ষী,নীলাক্ষী তোদের বাবা অনেক পথ জার্নি করে এসেছে। ওনাকে ফ্রেশ হতে দে।”

অবনী শেখের কথা শুনে মাধবী আর মেহরিমা জলিল শেখকে ছেড়ে দেয়।জলিল শেখ মেঝে থেকে ব্যাগটা তুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

“আমার আম্মারা কেমন আছে?”

মাধবী আর মেহরিমা মুচকি হেসে একসাথে বলে,

“আলহামদুলিল্লাহ বাবা।”

“মেহু মা তোমার হাতের ব্যথা কমেছে?”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে,

“বাবা তোমার আসতে এতো লেইট হলো কেনো?আমরা সবাই সেই সন্ধ্যা থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।গ্রামের মানুষ তো চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান করে বাড়ির মাটি রাখছিল না।”

জলিল শেখ মুচকি হেঁসে বলেন,

“একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যাওয়ায় দেরি হয়ে গেলো আসতে। গ্রামের মানুষের আস্থার যায়গা আমি আম্মা। তাই ওরা তো আসবেই আমার কাছে।”

“রাত এগারোটা বাজে।মিনাক্ষী,নীলাক্ষী নিজেদের ঘরে যেয়ে ঘুমিয়ে পড় অনেক রাত হয়েছে। কালকে ফজরের নামাজের সময় উঠতে যদি দু’জন একটুও বাহানা করিস। তাহলে একটা মার ও কিন্তু মাটিতে পড়বে না।”

অবনী শেখের কথায় ওরা দু’জন সুরসুর করে ওখান থেকে কেটে পড়ে। জলিল শেখ হাসতে হাসতে বলে,

“তুমি পারো বটে।”

“এভাবে না বললে আজ সারারাত তোমার সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিতো দু’জন।তিন দিনের গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসবে শুনে দেখো!আচ্ছা চলো ফ্রেশ হয়ে খেয়ে রেস্ট নিবে তুমি।”

“হ্যাঁ,চলো।”

মেহরিমা রুমে এসে দরজা লক করে শুয়ে পড়ে।কি মনে করে যেন ফোন টা হাতে নেয়।হৃদিতের নাম্বার থেকে ১০+ মিসড কল দেখতেই মেহরিমা আঁতকে ওঠে।দিক দিশা হারিয়ে তাড়াতাড়ি কল দেয় হৃদিতের নাম্বারে ।আর সাথে সাথেই কল রিসিভ হয়।হৃদিত বোধহয় মেহরিমার কলের অপেক্ষাতেই ছিলো।মেহরিমা ফোন কানে ধরে চুপচাপ বসে আছে।মুখ দিয়ে যেন কোন কথা বের হচ্ছে না।হৃদিত ও চুপচাপ আছে।ফোনের দুই পাশেই নিস্তব্ধতা।শুধু দুই জনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মিনিট দুই পেরিয়ে যাওয়ার পর হৃদিত হিসহিসিয়ে বলে,

“কল ধরলি না কেনো?”

হৃদিতের ভয়েস টা কেমন যেন শোনাই।মেহরিমা ভড়কে যায়। ভয়ে আমতা আমতা করে বলে,

“আ…আ..আমি বাইরে ছিলাম।ব…বাবা বাইরে বাসায় আসলো ম..ম…মাত্রই।”

“নেক্সট টাইম কল ধরতে এক সেকেন্ড ও লেইট হলে তোর অবস্থা খারাপ করে ছাড়বো আমি।”

মেহরিমা ভয়ে চুপসে যায়।ওপাশ থেকে হৃদিতের জোরে জোরে শ্বাস টানার শব্দ আসছে।হৃদিত দুই মিনিট সময় নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলে,

“কথা বলছিস না কেনো?তোর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনিয়ে আমাকে বেশামাল করার জন্য কল দিলি নাকি?”

অমনি মেহরিমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়,

“নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে মানুষ বেশামাল কিভাবে হয় হৃদিত ভাই?”

“এখন জানতে চাস না।সহ্য করতে পারবি না।”
বিয়ের পরে প্র্যাকটিক্যালি দেখিয়ে দেবো।”

হৃদিতের এমন লা গা ম ছা ড়া কথা শুনতেই মেহরিমার গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে।হৃদিত আবারও নরম স্বরে বলে,

“মাই লিটল কিটি!”

“হুম।”

“হাতের ব্যথা কমেছে?”

“হু।”

“ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করেছিস ?”

“উহু।”

“কেনো?”

“ভুলে গেছি।”

“পানিশমেন্ট দিলে সব মনে থাকবে।”

মেহরিমা শুকনো ঢোক গিলে বলে,

“কি পানিশমেন্ট দিবেন হৃদিত ভাই?”

“তুই তো বড্ড ছোট।আমার কোনো পানিশমেন্ট ই সহ্য করার ক্ষমতা নেই তোর।”

“আমি মোটেও ছোট না হৃদিত ভাই।”

“আমার বাচ্চার মা হওয়ার মতো বড় হয়েছিস কি?”

মেহরিমা এক মিনিট মতো সময় নিয়ে ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“না।”

“তাহলে আর বড় হলি কোথায়?”

কথাটা বলেই হৃদিত হেসে ওঠে।মেহরিমা পাঁচ সেকেন্ডের সেই হাসির শব্দতে যেন নিজের সর্ব সুখ খুঁজে পায়।মেহরিমা অবাক ও হয়!এই গোমড়া মুখো মানুষ টা হাসতেও জানে!হাসলে ঠিক কতোটা সুন্দর লাগবে?নিশ্চয় চোখ ধাঁধানো সুন্দর!হৃদিতের কথায় মেহরিমা ভাবনা থেকে বেরিয়ে নড়ে চড়ে বসে।

“মেডিসিন নিছোস?”

“হুম।”

“আচ্ছা তাহলে ঘুমিয়ে পড়। আল্লাহ হাফেজ।”

“এই না,না শুনুন।”

মেহরিমার কথায় হৃদিতের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।অতঃপর বলে,

“সামনে থাকলে তো কাঁপা কাঁপি শুরু করে দিস।আর ফোনে তো একদম তোতাপাখি হয়ে গেছোছ।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমার মনের মাঝে আবারও ভয়েরা উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করে।এতক্ষণ তো ও ভুলতেই বসেছিল যে ও ওর যমের সাথে কথা বলছে!হৃদিত স্বাভাবিক ভাবেই বলে,

“কি বলবি বল?”

“ক…কি করছেন আপনি?”

“আর্ট করি। ঝেড়ে কেশে বল কি বলবি?”

“আ…আমি কয়দিন কলেজে যেতে পারবো না।আজ হাত নিয়ে মা কে মিথ্যা বলেছি যে আমি রাস্তায় পড়ে যেয়ে ওখানে আবার ব্যথা পেয়েছি।মা বিশ্বাস করেছে কি না জানি না।তাই বোরকার কথা বলার সাহস পাই নি।একটু সময় লাগবে।”

হৃদিত কি বুঝলো কে জানে!ও ঠোঁ ট কামড়ে কিছু একটা চিন্তা করে বলে,

“আচ্ছা।”

হৃদিতের কথা শুনে মেহরিমার ঠোঁ ট দুটো আপনা আপনিই দুদিকে সরে মুখ টা হা হয়ে যায়!হৃদিত একবারেই কথাটা মেনে নিয়েছে এটা যেন মেহরিমা বিশ্বাস করতে পারছে না।

“ঘুমিয়ে পড়।”

কথাটা বলেই কল কেটে দেয় হৃদিত।এদিকে মেহরিমার মনে চলছে অস্থিরতা। উনি কি রেগে গেছেন? রেগে কল রেখে দিলেন নাকি? আমার কি ওনাকে একবার কল দেওয়া উচিত?কল দিলে যদি ঝাড়ি মারে!এভাবে পনেরো মিনিট মতো উশখুশ করে নিজের মনকে শান্তনা দেয় মেহরিমা।কাল যা হবে দেখা যাবে।শরীর অসুস্থ থাকায় আর সময় নষ্ট না তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে।পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুমের দেশে পাড়ি দেয় মেহরিমা।

________

তাইফ আর তাবান পারমিশন না নিয়ে হঠাৎ হৃদিতের ঘরে ঢুকতেই চমকে ওঠে।হৃদিতের রুমে ড্রেসিং টেবিল সহ কাঁচের যত জিনিস আছে সব ভেঙ্গে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।হৃদিতের ডান হাত ক্ষ ত বি ক্ষ ত হয়ে র ক্ত ঝরছে।সেই র ক্ত দিয়েই ক্যানভাসে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘মাই অ্যাঞ্জেলা, মাই গার্ল’।হৃদিতের এইসব দিকে কোনো খেয়ালই নেই।ও আরামছে ওই ক্ষ ত বি ক্ষ ত র ক্ত ঝ রা হাত নিয়েই বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঠোঁটে ওর মুচকি হাসি।তাবান আর তাইফ সাবধানতার সাথে দ্রুত ঘর পরিষ্কার করে ফেলে। তারপর কাউকে না জানিয়েই এতো রাতে ডক্টর ডেকে এনে হৃদিতের হাত ব্যান্ডেজ করে মেডিসিন লিখে নেয়।হৃদিত তখন ও নির্বিকার। ডক্টর চলে যেতেই হৃদিত বলে ওঠে,

“পারমিশন না নিয়ে এই রুমে আসার সাহস পেলি কোথায়?”

“ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া।ছরি।”

তাইফের কথায় হৃদিত বলে,

“নেক্সট টাইম যেনো আর এমন ভুল না হয়।এখন এই রুম থেকে যা।”

ওরা দু’জন মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।তাবান হঠাৎ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বল,

“ভাইয়া মেডিসিন…..”

তাবানের কথা শেষ করতে না দিয়েই হৃদিত গম্ভীর কন্ঠে হুংকার দিয়ে বলে,

“ওইসব ফা উ ল মেডিসিন তুই খা গা ধা। আমার মেডিসিন আমি পেয়ে গেছি।মাই অনলি মেডিসিন ইজ মাই অ্যাঞ্জেলা। নাউ গেট লস্ট।”

ওরা দু’জন খেয়াল করে হৃদিতের চোখ মুখের রং পরিবর্তন হয়ে কেমন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে!হঠাৎ হৃদিতের ভয়েস আর চেহারার এমন পরিবর্তন হতেই তাইফ,তাবান ভয় পেয়ে কোনোরকমে দরজা লক করে হাওয়ার বেগে ওখান থেকে ছুটে পালায়।হৃদিত চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলতে থাকে ,

“মাই অ্যাঞ্জেলা,মাই লিটল কিটি ইয়্যু আর অনলি মাইন।অনলি মাইন অ্যান্ড নো ওয়ান এলসে’জ।”

#চলবে_______