Tuesday, August 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 71



কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-৩৭+৩৮

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৭
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

সময় মধ্যাহ্ন।প্রকৃতি তার তীব্র রোদের প্রখরতায় হাঁসফাঁস করে তুলছে জনজীবন।সকালের ঠান্ডা আবহাওয়া কাটিয়ে এই অসহনীয় তাপমাত্রায় সকলের অবস্থায় শোচনীয়।চৌধুরী বাড়ির পরিবেশ আজ তাপমাত্রার মতোই গরম।সকাল থেকে একের পর একেক চমক পেয়েই চলেছে সকলে।হৃদিত,মেহরিমার সকালে বেরোনোর কথা থাকলেও সময় পরিবর্তন করে রাতে ফিক্সড করা হয়েছে।আয়াশ সেই তখন ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি।শ্রেয়া চৌধুরীর জ্ঞান ফিরেছে বারোটা পঁয়তাল্লিশ নাগাদ।প্রায় ত্রিশ মিনিট সেন্সলেস অবস্থায় ছিলেন।অতিরিক্ত টেনশন প্লাস স্ট্রেস নেওয়ায় সেন্স হারিয়েছিলেন।আরিফ চৌধুরী একবারের জন্যও ওনার রুমে যাননি ওনাকে দেখতে।বলা বাহুল্য আরিফ চৌধুরী আলাদা রুমে থাকেন।ঘন্টা খানেক হতে চললো আব্রাহাম তালুকদার হসপিটাল থেকে বাসায় এসেছেন।

চৌধুরী বাড়িতে আজ দ্বিতীয় বারের মতো পুলিশের আগমন।প্রথম বার এসেছিল কয়েক যুগ আগে।সবাই এক বুক অস্থিরতা নিয়ে ড্রয়িং রুমে দাড়িয়ে আছে।হৃদিত এসআই এর পাশের সোফায় আরামসে বসে কারোর সাথে টেক্সট এ কথা বলছে।

“হঠাৎ আপনি এখানে?”

আরিফ চৌধুরীর কথায় অমিত সাহা সোজা সাপটা জবাব দেয়,

“আপনার বোন-জামাই আব্রাহাম তালুকদার ব্যক্তিগত আক্রোশের জের ধরে মৃত জলিল শেখকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়েছে।শুধু তাই নয় উনি নিজেই কোম্পানি থেকে এক কোটি টাকা সরিয়েছেন ওনার সহযোগীর সাহায্যে। যিনি বর্তমানে কোম্পানির সিইও পদে কর্মরত আছেন।এই যে দেখুন আপনার বোন-জামাই নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন সবটা।আর হ্যাঁ উনি ড্রা গ বিজনেসের সাথেও যুক্ত।বাইরের দেশ থেকে ড্রা গ এনে তরুনদের মাঝে বিলিয়ে দেন।ওনাকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই স্যার।”

কথাগুলো বলেই নিজের ফোন থেকে একটা ভিডিও অন করে দেয় অমিত সাহা।যেখানে আব্রাহাম তালুকদার হসপিটালের বেডে বসে দাপটের সাথে নিজের করা খা রা প কাজ গুলো বলে চলেছেন।হৃদিতের ঠোঁটে ক্ষীণ বক্র হাসির রেখা ফুটে ওঠে।আরিফ চৌধুরী সেটা খেয়াল করতেই মনে মনে হাসেন।সবাই সবটা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়!আয়রা চৌধুরী হায় হায় করতে করতে বলেন,

“এগুলো সব মিথ্যে।অলিভিয়ার বাবাকে দিয়ে জোর করে এগুলো বলানো হয়েছে।ও এরকম কিছুই করেনি।ও নি র্দো ষ।আমার সোনার মতো সংসারের দিকে কোন শ কু নে র নজর পড়লো আল্লাহ!”

“সেটা আদালতে যেয়ে বলবেন।এছাড়াও ওনার ড্রা গ বিজনেসের মেইন ইনফর্মেশন গুলো আমাদের কাছে আছে।উনি এখন কোথায়?”

আয়রা চৌধুরী কিছু বলার আগেই আরিফ চৌধুরী বলেন,

“স্ট্রেট যেয়ে তিন নম্বর রুমে পাবেন।নিয়ে যান আপনাদের সাথে।”

আরিফ চৌধুরীর কথামতো অমিত সাহা দু’জন কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে আব্রাহাম চৌধুরীর ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরেন।খুঁজে পেয়েও যান।আব্রাহাম তালুকদার বিছানায় শুয়ে আছেন।অমিত সাহাকে দেখতে নিজেই উঠে এসে হাত দুইটা বাড়িয়ে দেন।একজন কনস্টেবল হাতকড়া পরিয়ে দেয়।অতঃপর সঙ্গে করে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে।আয়রা চৌধুরী,অ্যামেলিয়া,অলিভিয়া আহাজারি করছে।তারা আব্রাহাম তালুকদারকে কিছুতেই নিয়ে যেতে দিবে না। কিন্তু পুলিশদের শক্তির কাছে ওদের শক্তি কিছুই না। অ্যামেলিয়া, অলিভিয়া আজ নিজের বাবার জন্য কান্না করছে।অথচ কিছুদিন আগেই ওদের মতোই কারোর বাবাকে মৃ ত্যু র দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিল!নিয়তি কখন কাকে কোথায় দাড় করিয়ে দেয় বোঝা মুশকিল।বাড়ির সকলে নীরব দর্শক।আজ তারা যেন সত্যের পক্ষে।এইসব কিছু দেখেও দেখছে না।আয়রা চৌধুরী কোনো উপায় না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আরিফ চৌধুরীর নিকট এগিয়ে যান,

“ভাইজান আপনি কিছু করবেন না?ওকে তো নিয়ে যাচ্ছে।”

“এখানে আমার কী করার আছে?পা প করলে শা স্তি পেতেই হবে।সেটা তুই করলেও পাবি।”

কথাটা বলেই আরিফ চৌধুরী ওখান থেকে চলে যান।ওনার পিছু পিছু আজাদ চৌধুরীও যান। ভাইজানের কথায় হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আয়রা চৌধুরী!এটা তার ভাইজান হতেই পারে না।যে ভাইজান সবার আগে নিজের বোনের সুখের কথা ভেবেছে আর আজ!তবে কী খারাপ সময়ে কাউকে পাশে পাবে না?কীসের শা স্তি দিচ্ছে আল্লাহ!পরক্ষণেই নিজের পা পে র খাতাটা মানসপটে ভেসে ওঠে।অমিত সাহা আব্রাহাম তালুকদারকে নিয়ে চলে যান।আব্রাহাম তালুকদার যাওয়ার আগে হৃদিতের দিকে হিং স্র চাহনি দিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকেন।যার অর্থ উনি ফিরবে শিঘ্রই।তখন এর হিসাব মেটাবে।আয়রা চৌধুরী ফ্লোরে বসেই কান্না জুড়ে দেয়।সাথে ওনার দুই মেয়ে তো আছেই।বাড়ির দুই বউ ওনাদেরকে শান্তনা বাণী শোনাতে এগিয়ে যান।দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে সবটা শান্ত চোখে দেখেন শ্রেয়া চৌধুরী।উনি বুঝতে পারেন এবার ওনার পালা।আর তাতেই তাচ্ছিল্যের হাসি দেন।যে পৃথিবীর মানুষের হিং স্র তা থেকে বাঁচতে নিজেকে খারাপ বানিয়েছেন সেই পৃথিবীর মানুষ কী বিচার করবে?এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একটু ভালোবাসা পাওয়ার আশা করা,একটু ভালো থাকায় আশা করাও বুঝি পাপ!শ্রেয়া চৌধুরী নিজের রুমে চলে যান।এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরেও মেহরিমার ঠোঁটে মুচকি হাসি।যারা বাবাকে কেড়ে নিয়েছে তাদের শা স্তি তো ও নিজে হাতে দেবে। প্রতি সেকেন্ড মৃ ত্যু য ন্ত্র ণা অনুভব করিয়ে তবেই মারবে।হৃদিতের দেওয়া সারপ্রাইজ টা মেহরিমার মনে প্রশান্তি এনে দেয়। এখনও খালামনির মৃ ত্যু র রহস্য উন্মোচন করা বাকি।মাত্রই তো সবকিছুর শুরু।

_____

“ভাইয়া দরজা খোলো?”

ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারও ডাকে হৃদিত।

“ভাইয়া….”

হৃদিত নিজের কথা সম্পূর্ণ করার আগেই ওপাশ থেকে দরজার লকটা খুলে যায়।হৃদিত দরজাটা হালকা সরিয়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে।পুরো রুম অন্ধকারে ডুবে আছে।জানালা বন্ধ করে পর্দা টানা।পর্দা গলিয়ে মাঝে মধ্যে ল্যাম্পপোস্টের আবছা হলুদ আলো প্রবেশ করছে।ভেতরে সিগারেটের ধোঁয়া আর তীব্র গন্ধে কেমন একটা ভ্যাপসা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সম্পূর্ণ রুম জুড়ে গভীর নিরবতা বিরাজমান।এতো অন্ধকারের মাঝেও আয়াশের অবস্থান ঠিকই বুঝে যায় হৃদিত।দরজাটা লক করে ধীর পায়ে আলমিরার দিকে এগিয়ে যায়।আয়াশের পাশে ফ্লোরেই হাঁটু জোড়া ভাজ করে বসে।আয়াশের দিকে গভীর ভাবে তাকাতেই আবছা আলোয় বুঝতে পারে চোখজোড়া লাল হয়ে ফুলে আছে।দীর্ঘক্ষণ কান্না করার ফল।ভালোবাসার মানুষ হারালে কঠিন মনের ছেলেরাও বুঝি কান্না করে!

“আজব!ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে যাওয়া মানুষের মতো বিহেব কেনো করছো তুমি?”

আয়াশ নিরুত্তর।ওর এই নীরবতা যেন অনেক কথার সাক্ষী।মনের গহীনে লুকানো ব্যথা,চার দেওয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনি হওয়া এক মিষ্টি কন্ঠস্বরের সাক্ষী।হৃদিত কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলে,

“আমরা মানুষেরা একটু স্যাক্রিফাইস একটু কম্প্রোমাইজ করলেই কিন্তু সব সম্পর্ক গুলো আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।সম্পর্কে বিচ্ছেদ শব্দটা আর আসে না।তবুও আমরা একটু স্যাক্রিফাইস, একটু কম্প্রোমাইজ করতে দ্বিধাবোধ করি।এর কারণটা কী জানোতো?আমরা মানুষেরা সবসময় নিজের টা বুঝি অন্যেরটা না।মানুষ স্বভাবগত ভাবেই স্বার্থপর।”

“দুঃখের দিন ফুরিয়ে যাওয়ার আগে আমি নিজেই শেষ হয়ে যাবো‌।আমি নিজেই নিজের কাছে এক ভ য়ং ক র যন্ত্রণা।”

ভাঙা কন্ঠস্বর আয়াশের।হৃদিতের বুকে সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হয়।হাসিখুশি ভাইটার এ কী অবস্থা!তবে আয়াশকে কথা বলাতে পেরে হৃদিত মনে মনে বেশ খুশি হয়।মুখে গম্ভীর ভাব লেপ্টে রেখেই বলে,

“হারিয়ে যাওয়া কী এতই সহজ?তোমার মতো আমিও ওইসব কথা হাজার বার ভেবেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো প্রতিবার কোনো না কোনো পিছুটান আমাকে পিছন থেকে আঁকড়ে ধরে নিজের সাথে রেখে দিয়েছে।”

“আমার তো কোনো পিছুটান নেই।”

“পিছুটান থাকা লাগে না।হয়ে যায়। তোমার কাঁধে একটা দেশের জনগনের দায়িত্ব।এটাই তো সবচেয়ে বড় পিছুটান। আচ্ছা শোনো অবনী মা তোমার সাথে একটু কথা বলবে।ওনার সাথে কথা বললে আশাকরি তোমার ভালো লাগবে।তোমার মা আর ওনার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ।”

আয়াশ না করেনা।হৃদিত কল দেয়।কয়েক সেকেন্ড পেরোতেই কল রিসিভ হয়।আয়াশ নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়।ওপাশ থেকে ভেসে আসে অবনী শেখের স্নেহপূর্ণ কন্ঠস্বর,

“আসসালামুয়ালাইকুম।আয়াশ বাবা?”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম আন্টি।জি আমি আয়াশ বলছি।”

“কেমন আছো বাবা?”

“আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহ রেখেছে ভালো।”

“আমি সবটা শুনেছি।ওই টপিক নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না বাবা। আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।আমি শুধু চাই আমাদের আগের আয়াশ টা যেন বেঁচে থাকে।অবহেলিত আয়াশের মাঝে হাসিখুশি আয়াশটা যেন হারিয়ে না যায়। তুমি যতক্ষণ হাসবে ততক্ষন তোমার সাথে পুরো পৃথিবী হাসবে।এই পৃথিবী কাউকে কিচ্ছু দেয় না।বুদ্ধি,হাসি আর পরিশ্রম দিয়ে সবটা জয় করে নিতে হয়।”

অবনী শেখের কথায় আয়াশ মৃদু হাসে।এইতো জ খ ম মনে একটু শান্তি মিলছে।অবনী শেখের যায়গায় নিজের মা হলেও কী মনটাতে এভাবেই শান্তি মিলতো?মনে প্রশ্নটা জাগলেও আশপাশ হাতড়ে কোনো উত্তর মেলে না।প্রশ্নটা কী এতোটাই কঠিন?নাকি উত্তরটা?আয়াশ জবাবে বলে,

“হাসিখুশি আয়াশকে হারাতে দেবো না আন্টি।”

“সোনা ছেলে আমার।খেয়েছো কিছু?”

“না আন্টি।”

“এটা কিন্তু ঠিক না বাবা।এক্ষুনি খাবে তুমি।আমার কথা রাখবে তো বাবা?”

অবনী শেখের মাতৃসুলভ আচরণে ওনার কথা ফেলতে পারে না আয়াশ।কথাটা রাখে।

“আচ্ছা আন্টি এক্ষুনি খেয়ে নেবো।”

“বাবা স্বপ্ন,শখ,আহ্লাদ সব ভেঙে যাক।নিজেকে কখনও একবিন্দু পরিমাণও ভাঙতে দিও না।ওই অন্ধকার কবরে কতশত মানুষ এক বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে শুয়ে আছে।জীবনের উর্ধ্বে কিছুই না।হায়াত যতদিন আছে কোনো না কোনোভাবে দিন ঠিকই কেটে যাবে। নিজেকে শক্ত রাখো।”

অবনী শেখের বলা কথাগুলো আয়াশকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে তোলে।আজ সারাদিনে নিজের সাথে করা অ ন্যা য় গুলো উপলব্ধি করতে পারে।নিজের মনের কোথাও একটা বেঁচে থাকার শক্তি,জোর খুঁজে পায়।মায়েরা তো এমনই হয়।তাহলে শ্রেয়া চৌধুরী কেন এমন না?সারাটাদিনের মধ্যে একটাবারও ছেলের নিকট কেনো এলেন না।তার ছেলেটা যে অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষারত ছিল।তার কোলে মাথা রেখে জীবন নিয়ে অনেক অভিযোগ করার ছিল।মায়ের হাতের স্নেহের স্পর্শ অনুভব করার ছিল।কিন্তু এমন কিছুই তো হলো না।তবে কী মা সত্যিই পরিবর্তন হয়ে গেছে!অবনী শেখ আরও কিছু কথা বলে কল কেটে দেন।আয়াশ দুহাতে হৃদিত কে আঁকড়ে ধরে।

“তোর মতো একটা ভাই সকলের হোক হৃদিত।”

আয়াশের কথার পরিপ্রেক্ষিতে হৃদিত শুধু হাসে।ভাইকে দুহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়।

____

মেহরিমা,হৃদিত সব ঝামেলা মিটিয়ে অবশেষে একটু ক্ষণস্থায়ী সুখের আশায় চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।এখন ওরা দু’জন একজোড়া মুক্ত পাখির ন্যায় আকাশে উড়বে।গন্তব্যস্থল অজানা হলেও জীবনটা প্রশান্তিময় হবে।হোক না সেটা ক্ষণস্থায়ী।

আয়াশকে নিয়ে মেহরিমা,হৃদিত কিছুটা দুশ্চিন্তা মুক্ত এখন।আসার সময় আয়াশকে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থাতেই পেয়েছে।শেখ বাড়িতে যেয়েও অবনী শেখ,মাধবীর সাথে দেখা করে এসেছে।মেহরিমা এক ঘন্টা যাবৎ গাড়িতে বসে আছে।হৃদিত ড্রাইভ করছে।মেহরিমার কাছে হার মেনে আজও গাড়ির জানালা খোলা রাখতে হয়েছে।পরিবেশ শান্ত,থমথমে,অন্ধকারাচ্ছন্ন। নিস্তব্ধতায় ঘেরা চারিপাশ।মেহরিমার দৃষ্টি জানালার বাইরে।রাস্তার দুইধারে সুউচ্চ সারি সারি গাছ পালা।তার মাঝে দিয়ে শ শ করে ওদের গাড়িটা ছুটে চলেছে।জানালা দিয়ে ঠান্ডা মৃদু হাওয়া এসে লাগছে তনু মনে।সকালের দিকে মনটা খারাপ থাকলেও এখন বেশ ফুরফুরে একটা মেজাজে আছে মেহরিমা।

“তোকে দেখে খুব খুশি মনে হচ্ছে!”

হৃদিতের কথা শুনে মেহরিমা ঘাড় ঘুরিয়ে হৃদিতের দিকে দৃষ্টিপাত করে। মুখে হাসি টেনেই বলে,

“কেনো বলুন তো?”

“এই যে আজ একটু বেশিই হাসছিস তাই।”

“আমাদের জীবনটা খুব সীমিত।হতাশা,দুশ্চিন্তায় মগ্ন হয়ে জীবনটা পার করে দেবো নাকি? শুনুন আপনি সব সময় এমন গোমড়া মুখো হয়ে থাকবেন না।নিজে হাসবেন অন্যকেও হাসাবেন। ছোট্ট এই জীবনটা উপভোগ করুন।নয়তো পরে আফসোস হবে।”

“আমার কাছে জীবন,জীবনের অর্থ মানেই শুধু তুই।তুই হাসলেই আমার জীবন পরিপূর্ণ।বিশ্বাস কর আমার একটুও আফসোস হবে না।”

নিজের কথার পরিপ্রেক্ষিতে এরকম উত্তর একদমই আশা করেনি মেহরিমা। অতিরিক্ত ভালোবাসা পেয়ে যাওয়ার খুশিতে চোখে পানি চলে আসে।সেই ছলছল চোখ নিয়েই একদৃষ্টিতে হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই মানুষটাকে মেহরিমা খুব ভালোবাসে।এই মানুষটার মতো করে কেউ মেহরিমাকে আগলে রাখতে পারবেনা।ভালোবাসা দিয়ে মানুষটার সব পাপ মুছে পবিত্র করে তুলবে মেহরিমা।

“এভাবে তাকিয়ে থেকে আমায় নজর লাগিয়ে দিবি নাকি?”

হৃদিতের কথা শুনে মেহরিমা ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলে।পরক্ষণেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।হৃদিত মুচকি হাসে।সারাদিনের সব কষ্টের মাঝে ভালো থাকার একমাত্র মেডিসিন অ্যানাবেলা।

#চলবে___

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৮
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

মেহরিমা পিটপিট করে চোখজোড়া মেলে তাকায়। নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে।সুসজ্জিত একটা রুমে শুয়ে আছে।ওর তো এখন গাড়িতে থাকার কথা ছিল তাহলে এখানে কীভাবে এলো? কিডন্যাপ হয়ে গেল নাকি?হৃদিত কোথায়?মেহরিমা ভয় পেয়ে যায়।এক লাফে বিছানা থেকে নেমে পড়ে।দৌড়ে দরজার নিকট যেতেই শক্ত কিছু একটার সাথে ধাক্কা খায়।ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই শক্তপোক্ত একটা হাত এসে মেহরিমার কোমর জড়িয়ে নিজের বুকের উপর ফেলে‌।মেহরিমা ততক্ষণে ভয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলেছে।

“এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন?পড়ে গেলে কী হতো?”

হৃদিতের কন্ঠস্বর কর্ণধার হতেই মেহরিমা চট করে চোখজোড়া খুলে তাকায়।হৃদিতকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।হৃদিত ঘটনা যা বোঝার বুঝে যায়।মেহরিমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলিস তাই আর জাগায়নি।এটা আমার বাগানবাড়ি।আমরা দুটো দিন এখানে থাকবো।”

মেহরিমা নিজেকে ধাতস্থ করে জড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই বলে,

“আপনি কোথায় ছিলেন?

“কিচেনে।তোর জন্য বিরিয়ানি রান্না করছিলাম।”

“আপনি রান্না পারেন!”

অবিশ্বাস্য কন্ঠস্বর মেহরিমার!হৃদিত মৃদু হেসে বলে,

“তোর জামাই সব পারে।”

“এখন কয়টা বাজে?”

“মধ্যরাত,বারোটা বাজে।আমি নিচে যাচ্ছি তুই এখানে বসে রেস্ট নে।আমি খাবার নিয়েই চলে আসবো।”

“নাআআআ।আমিও যাবো আপনার সাথে।”

একপ্রকার আঁতকে উঠে বলে মেহরিমা।হৃদিত মুচকি হাসে।ইশারায় পিছু পিছু আসতে বলে।হৃদিতের শার্টের একাংশ ধরে পিছু পিছু হাঁটতে থাকে মেহরিমা।নিচ তলায় নেমে ড্রয়িং রুমে দাড়িয়ে অবাক চোখে পুরো বাড়িটা দেখতে থাকে।একটা ছোট খাটো ডুপ্লেক্স বাড়ি এটা।ঘরের ওয়াল,সোফা সেট থেকে শুরু করে সবকিছুই ব্ল্যাক কালারের।ড্রয়িংরুমের প্রতিটা ফার্নিচার কাঁচের তৈরি।সবকিছুতেই আধিপত্যের ছোঁয়া লেপ্টে আছে।কী সুন্দর বাড়িটা!হৃদিত ততক্ষণে খাবারের প্লেট নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।মেহরিমাকে আবারও ইশারা করে রুমের দিকে হাঁটা ধরে।মেহরিমা আগের মতোই শার্টের একাংশ ধরে হৃদিতের পিছু পিছু রুমে হাজির হয়।

“ফ্রেশ হয়ে আয় জান।”

হৃদিতের কথামতো মেহরিমা ফ্রেশ হতে চলে যায়।দশ মিনিটের ব্যবধানে ফ্রেশ হয়ে আসে।হৃদিত আগেই ফ্রেশ হয়েছে।

“এখানে এসে বস সানসাইন।আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোকে।”

মেহরিমা লক্ষী মেয়ের মতো যেয়ে হৃদিতের পাশেই ডিভানে বসে।হৃদিত যত্ন সহকারে খাইয়ে দিতে থাকে।মেহরিমা পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।এই ঘরেরও বেডশিট থেকে শুরু করে সব ব্ল্যাক কালারের।ঘরের ফার্নিচার গুলোও ড্রয়িং রুমের মতোই কাঁচের তৈরি।ঘরে ফার্নিচার বলতে একটা ওয়াল আলমিরা,একটা ডিভান,একটা ক্যাবিনেট,একটা ড্রেসিং টেবিল আর একটা বেড ব্যস।অতিরিক্ত কিছুই নেয়।মেহরিমা ধারণা করে নেয় পুরো বাড়ির ডেকোরেশনও বোধহয় এমনই।মেহরিমা পেটে কথা চেপে রাখতে না পেরে বলে,

“আপনার কী ব্ল্যাক আর পার্পল কালার ফেভারিট?”

“হুঁ।হোয়াই?”

“চৌধুরী বাড়িতে আপনার রুমের ডেকোরেশন পার্পল আর এখানে ব্ল্যাক তাই বললাম।”

“পার্পল কালার আমার কাছে স্পেশাল।আর ব্ল্যাক কালার ফেভারিট।”

“পার্পল কালার স্পেশাল কেন?”

“আমার জীবনে প্রথম বসন্ত এনেছিল একটা পার্পল ফেইরি।শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ধোঁয়াশা দেখেছিলাম তাকে।”

“আপনারও ভালোবাসার মানুষ ছিল?”

“হুঁ,ইভেন এখনও আছে।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমার মুখটা মলিন হয়ে যায়।হৃদিত মেহরিমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসত,আবার এখনও ভালোবাসে কথাটা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে মেহরিমার।হৃদিত মেহরিমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে।সেই হাসিতে মেহরিমার গা জ্বলে ওঠে।কিড়মিড়িয়ে বলে,

“আপনার সেই সো কলড ভালোবাসার মানুষটা কে শুনি?”

“আমার অ্যানাবেলা।”

“কী!আমি?”

কম্পনরত কন্ঠস্বর মেহরিমার।হৃদিত মুখের হাসি প্রসারিত করে বলে,

“হুম।তখন তুই ক্লাস থ্রিতে পড়তিস।আমার রুমের জানালা দিয়ে এক কুয়াশামাখা ভোরে সেই প্রথম আবছা দেখেছিলাম তোকে।তোর মতো পুঁচকে একটা মেয়েকে দেখে আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছিল।কিছু সময়ের জন্য থমকে গেছিল আমার হৃদয়।তাহলে ভাব তোর কত ক্ষমতা!ওতটুকু বয়সে হৃদিত চৌধুরীর মনে ভালোবাসার জাল বুনেছিস।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমার মুখের মলিনতা কেটে উজ্জলতায় ছেয়ে যায় গাল দুটো।চোখে মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে ওঠে।উৎফুল্ল কন্ঠে প্রথম বারের মতো বলে বসে,

“খুউউউব ভালোবাসি আপনাকে।আমার এই বদ্ধ পাগল হৃদিতকেই লাগবে।সবসময় এমনই থাকবেন কেমন?”

“হুম।আর কোনো কথা না।চুপচাপ খেয়ে নে।”

“আপনি তো কিছু বললেন না?”

“কি বলবো?”

“কিছু না।”

“মনের কথা বোঝার জন্য আমার চোখের ভাষা, আমার করা পাগলামি গুলোই কি যথেষ্ট নয়?”

“যথেষ্ট।আপনার চোখের ওই অতল গভীরতায় নিজেকে হারিয়ে বসেছি আমি।।”

হৃদিত মুচকি হাসে কোনো প্রত্যুত্তর করে না।চুপচাপ খাইয়ে দিতে থাকে।কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই বলে,

“বিনা প্রকাশে তোকে নিজের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসি আমি।”

হৃদিতের বলা এক লাইনের কথাটা মেহরিমার মন কুঠুরিতে বসন্তের দোলা দিয়ে যায়।মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে।এই মানুষটার সাথে এক জনম কেন সাত জনমও অনায়াসেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে।কিন্তু মেহরিমা তো ওতোটাও ভাগ্যবতী না!

মেহরিমা চুপচাপ খেতে থাকে।তবে চুপ থাকার মতো মেয়ে মেহরিমা না।আর সামনের মানুষটা যদি হৃদিত হয় তাহলে তো চুপ থাকতেই পারবে না।বকবক করে হৃদিতের মাথা খাওয়ার অভ্যাস কি না!দুই মিনিটের মাথায় অধৈর্য হয়ে আবারও প্রশ্ন করে,

“আপনার বাসা টা এমন নির্জন,ভুতুড়ে কেন? কেমন একটা ভ্যাম্পায়ার ভাইব দিচ্ছে সবকিছুতেই।”

“তোর জামাই ভ্যাম্পায়ার তাই তার সবকিছুতে ভ্যাম্পায়ার ভাইব দিচ্ছে।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমার মুখে থাকা খাবার গলায় আটকে যায়।হৃদিত দ্রুত পানি খাইয়ে দেয়। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মেহরিমা নিজেকে সামলিয়ে বলে,

“আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন কেন?”

“ভয় কখন দেখালাম?তোর প্রশ্নেরই তো উত্তর দিলাম জাস্ট।”

মেহরিমা জানে এখন এই টপিক নিয়ে কথা বললেই হৃদিত ঘাড়ত্যাড়ামো করবে।তাই চুপ থাকাই শ্রেয়।হৃদিত মেহরিমাকে খাইয়ে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেও খেয়ে নেয়।দু’জন ক্লান্ত থাকায় আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে।হৃদিত মেহরিমার কম্ফোর্টারের মধ্যে ঢুকে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়।মেহরিমা মৃদু হাসে।

____

মেহরিমার কাছে আজকের সকালটা একটু বেশিই মনোমুগ্ধকর।হৃদিতের ব্যালকনিতে কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে ডিভানে বসে শীতের সকালের পরিবেশ উপভোগ করছে।প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে মোড়ানো।একটু দূরের কিচ্ছু দেখার উপায় নেই।বাড়িটার চারি পাশে সুউচ্চ গাছের সারি।গাছের ডালপালার ফাঁক ফোকড় দিয়েও দিবাকরের দেখা পাওয়া মুশকিল। আশেপাশের কোথাও থেকে ভেসে আসছে পানির কলকল ধ্বনি।নিস্তব্ধ পরিবেশে সেই ধ্বনি বড়ই মনোরম শোনাচ্ছে।নিশ্চয় পাশেই নদী অথবা লেক জাতীয় কিছু আছে।ভেসে আসছে কতশত পাখির ডাক।অদূর হতেই একটা পাহাড় হাত ছানি দিয়ে মেহরিমাকে ডাকছে। ব্যালকনির সামনেই বড় একটা ছাতিম গাছ আর কাঠগোলাপ গাছ।একটু দূরেই লাইন দিয়ে আরও অনেকগুলো কাঠ গোলাপ গাছ লাগানো।শীতকাল হওয়ার দরুন কাঠগোলাপ গাছ ফাকা।একটা ফুলও নেই।তবুও গাছগুলো দেখতে মেহরিমার বড্ড ভালো লাগছে।সবুজে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায় মেহরিমা।ভুলে বসে নিজের মনের ব্যথা,কষ্ট সব।হয়তো প্রকৃতি মেহরিমার ব্যথাগুলো কিছু সময়ের জন্য গিলে নেয়।প্রশান্তি এনে দেয় প্রকৃতিপ্রেমী এক কিশোরীর মনে।হঠাৎ কম্ফোর্টারের মধ্যে কারোর উপস্থিতি অনুভব করতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায় মেহরিমা।হৃদিতের ঘুমু ঘুমু ফেইস দেখতেই মুচকি হাসে।হৃদিত ঘুমু ঘুমু কন্ঠেই বলে,

“এত ঠান্ডায় এখানে কী করছিস?”

“প্রকৃতি দেখছি।আমি কিন্তু কম্ফোর্টার নিয়ে এসেছি।”

“গুড গার্ল।”

“আশে পাশে কোথাও নদী আছে?”

“হুম বড় একটা নদী আছে।”

“আজ ওখানে ঘুরতে যাবো।”

“আচ্ছা।”

“ওই যে পাহাড় টা দেখছেন না?ওখানেও যাবো।”

“আচ্ছা।”

“আপনি এখানে এসেও ঘুমাচ্ছেন?”

“উহু। রুমে চল ঘুম পাচ্ছে।”

“আপনি যান।আমি এখানেই থাকবো।”

হৃদিত আর কোনো কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।মেহরিমাকে কোলে উঠিয়ে নেয়।হৃদিতের কান্ডে মেহরিমা হতভম্ব হয়ে যায়!হৃদিত ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে বিছানার নিকট এগিয়ে আসে।মেহরিমাকে শুইয়ে দিয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।মেহরিমা কটমট করে বলে,

“এটা কী হলো?”

“কিছুই না। চুপচাপ ঘুমা।”

“পারবো না।আমি সকালের পরিবেশ দেখবো।”

“বাইরে ঠান্ডা জান।আমাদের কুট্টুস পাখির জন্য হলেও এখন একটু মেনে চল।এই হৃদিত থেকে শুরু করে হৃদিতের সবকিছু শুধুই তোর।তোর যখন মন চাইবে তখনই এখানে আসতে পারবি সমস্যা নেই তো।”

মেহরিমা আর কিছু না বলে চুপচাপ মুখ ফুলিয়ে শুয়ে থাকে।হৃদিত হতাশ হয়।পরক্ষণেই কিছু একটা ভাবতেই বাঁকা হাসে।হঠাৎ হৃদিতের হাতের অবাধ্য বিচরণ অনুভব করতেই মেহরিমা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।হৃদিত মেহরিমার কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ করে নেয়।অধরে অধর মিলিয়ে দেয়।মেহরিমা আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।হৃদিতের উন্মুক্ত পিঠ খামচে ধরে। কিছুক্ষণ পর হৃদিত মেহরিমাকে ছেড়ে দিয়ে কপালে উষ্ণ ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।

“আর একটুও মুখ গোমড়া করে থাকলে আই সোয়্যার তোকে এখন ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে হবে।”

ব্যস মেহরিমাকে আর কে পায়!ঠান্ডা পানি,গোসল কথাটা ভাবতেই মেহরিমার রুহ কেঁপে ওঠে! তৎক্ষণাৎ মুখে হাসি টেনে ঘুমের ভান ধরে।মুখে বলে,

“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।আপনার সাথে পরে কথা বলবো কেমন?আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন।”

মেহরিমার কান্ডে হৃদিত শব্দ করে হেসে ওঠে।মেহরিমা নিজের একচোখ একটুখানি খুলে হৃদিতের দিকে তাকায়।ওর নজরকাড়া হাসি দেখে নিজেও মুচকি হাসে।অতঃপর দু’জন ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়।

#চলবে___

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-৩৫+৩৬

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৫
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

তমসাচ্ছন্ন প্রকৃতি।অম্বরের নক্ষত্রেরা শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধরনীর দিকে।অম্বরে দেখা মিলেছে এক ফালি চন্দ্রের।সেই চন্দ্রের নেই নিজস্ব আলো ছড়ানোর ক্ষমতা।আছে শুধু এক বুক ব্যথা গিলে নীরবে সবটা সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা।বাঁশের পাতার কড়মড় শব্দ শোনা যাচ্ছে।অদূরেই ডেকে চলেছে শেয়ালের দল।ভেসে আসছে দূরের কোনো গাছে বসে ডাকতে থাকা পেঁচার ডাক।পরিবেশ থমথমে।বইছে শীতের উত্তরের হিমেল ঠান্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়া।যা ক্ষণে ক্ষণে মন প্রাণকে সতেজ করে তুলছে।

বিষ্ণু নদীর তীরে গাড়ির হুডের উপর বসে আছে হৃদিত।হাতে জ ল ন্ত সিগারেট।যা কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বারংবার পি ষে চলেছে দু’ঠোটের মাঝে।সময় মধ্যরাত। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে।সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে আর বাড়ি মুখো হয়নি।সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরেছে।ঘন্টাখানেক হলো নদীর পাড়ে এসে বসেছে। কঠিন মানুষটা হঠাৎ করেই কীভাবে ওতোটা নরম হয়ে গেলো সেটাই ভেবে পাচ্ছে না হৃদিত। তার উপর মেহরিমাকে হারানোর ভয় জেঁকে ধরেছে।এখন তো মেহরিমা সব সত্য জানে।যদি হৃদিতকে ছেড়ে চলে যায়!বাসায় গেলেই যদি ডিভোর্সের কথা বলে বসে!একটা আধ পাগলের সাথে সংসার করতে কেই বা চায়!সেই ভয়েই আরও বাসায় যায়নি হৃদিত।নিজের আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই হৃদিতের ফোনটা ঝংকার তুলে বেজে ওঠে।নিস্তব্ধ পরিবেশে সেই শব্দ বড্ড বী ভৎ স শোনায়।হৃদিত পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে।ফোনের স্ক্রিনে জলজল করছে ‘অ্যানাবেলা’ নামটা।এতো দুঃখ,হতাশার মাঝেও হৃদিতের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।কল রিসিভ করে।আর সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে মেহরিমার বাজখাঁই গলা।

“এই আপনি কোথায়?রাত কতো হলো খেয়াল আছে?সকাল থেকে কতবার কল,মেসেজ দিয়েছি আমি?আমাকে মানুষ মনে হয়না?নাকি এই কয়দিনেই পুরোনো হয়ে গেলাম?তখন ওভাবে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন।কোথায় আছেন,কী করছেন একটা খোঁজ খবর নেই আপনার।এভাবে চলতে থাকলে আমি কিন্তু খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলবো।”

মেহরিমার কথায় হৃদিতের মুখের হাসি আরও প্রসারিত হয়। জবাবে ছোট্ট করে বলে,

“পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোর কাছে সমর্পণ করতে আসছি অ্যানাবেলা।”

হৃদিত কল কেটে দেয়।ঝড়ের গতিতে ড্রাইভ করে একদম চার মিনিট চল্লিশ সেকেন্ডে বাড়ির ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়।ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই রাগে রক্তিম হয়ে ওঠা মেহরিমার চাঁদের ন্যায় মুখখানা চক্ষুগোচর হয়।হৃদিতের বুকের মাঝে তোলপাড় করতে থাকা ঝড় কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে শান্ত হয়ে যায়।এক বুক প্রশান্তি মেলে।হৃদিত ঠোঁট টিপে হাসে।মেহরিমা সোফায় বসে আছে।মুখ দিয়ে হৃদিতের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে চলেছে।হৃদিত ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।ধপাস করে মেহরিমার কোলে মাথা রেখে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ে।বাড়ির সবাই তখন নিজেদের রুমে।হঠাৎ হৃদিতের এহেন কান্ডে মেহরিমা চমকে ওঠে!পরক্ষণেই হৃদিতকে দেখতে বুকে থু থু দেয়।মুখটা গোমরা করে দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে বসে থাকে।

“রাগ করেছিস জান?”

মেহরিমা নিরুত্তর।হৃদিত মেহরিমার ডান হাতটা নিজের পুরুষালি খসখসে হাতের মুঠোয় পুরে নেয়।গুনে গুনে দশটা চু মু দেয়।মেহরিমা তখনও নিশ্চুপ।

“আরো ভালোবাসা লাগবে জান?স্পিক আপ অ্যানাবেলা।”

মেহরিমার কোনো নড়চড় না দেখে হৃদিত হতাশ হয়।আজ অভিমানটা বোধহয় একটু বেশিই করেছে!হৃদিতের’ই বা কী করার!ও তো খেয়াল’ই করে নাই কখন কখন ওতো গুলো কল মেসেজ দিয়েছে।ফোনটা গাড়ির ব্যাক সিটে পড়ে ছিল।

“এ্যাই মেয়ে আমার লেজটা যদি তোর মতো এমন অভিমানিনী হয় তাহলে তোর খবর আছে বলে দিলাম।আমি এতো..”

হৃদিতের কথা শেষ না হতেই মেহরিমা ফিক করে হেসে ওঠে।হৃদিত সেই হাসি দেখে মুচকি হাসে।অ্যানাবেলার মুখের এই হাসিটাই হৃদিতের ভালো থাকার কারণ।

“এতক্ষণ তো কথায় বলছিলিস না।এখন আবার হাসছিস কেনো?”

“আমার ইচ্ছা।”

“সব তোর ইচ্ছা তাই না?ওয়েট আ মিনিট।”

কথাটা বলেই হৃদিত মেহরিমার ঘাড়ের পিছনে হাত দিয়ে মাথাটা একটু নামিয়ে অধরে অধর মিলিয়ে দেয়।মেহরিমা হতবাক হয়ে যায়!পরক্ষণেই মুচকি হাসে।

“বাড়িতে তিনটা বেডরুম ফাঁকা আছে।কেউ চাইলে সেখানে যেতে পারে।”

হঠাৎ আয়াশের আকস্মিক কন্ঠস্বরে মেহরিমা সিটকে দূরে চলে যায়।লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মুখটা নামিয়ে রাখে।হৃদিত নির্বিকার সেসবে।আয়াশ বাড়ির সামনে বাগানে ছিল।নিজের কাজ ফেলে গ্রামে বসে আছে।দায়িত্ব নিজের পিএ এর উপর দিয়ে এসেছে।সেটাই ঠিকঠাক মতো হচ্ছে কী না খোঁজখবর নিচ্ছিল।সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে আবারও বলে,

“ক্যারি অন।সরি টু ডিস্টার্ব।”

“তুমি রুমে যাও আগে।রাত শেষ হতে চললো। আগামীকালকেই না ডিভোর্স দিবা?”

হৃদিতের কথার মানে বুঝতেই মুচকি হাসে আয়াশ। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে হৃদিতের দিকে তাকায়।

“এখনও চান্স আছে ব্রো।সবে রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ।”

“তোমার মায়ের কী অবস্থা?খেয়েছে কিছু?”

হৃদিতের কথায় আয়াশের মুখে মলিন হাসি ফুটে ওঠে।মা হয়ে এতকিছু করার পরেও হৃদিত তার খোঁজ নিচ্ছে।সন্তান বুঝি এমনই হয়!আয়াশের চোখের সামনে হৃদিত আর শ্রেয়া চৌধুরীর খুনসুটির মুহূর্তগুলো ভেসে ওঠে।কতোই না সুন্দর ছিল সেইদিন গুলো!আমরা মানুষেরা এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়!অন্যদেরকে ঠকাতে তাদের কী একটুও বুক কাঁপে না?আয়াশ বলে,

“খেয়েছে।আমি জোর করিয়ে রাতে একটুখানি খাইয়েছি।মা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে।হয়তোবা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।”

“উনি মা অথচ দুইটা ছেলেকেই নিজের সুখের জন্য ব লি দা ন দিয়েছেন।তোমার মা শুধরানোর মানুষ না।আরিশাকে সুযোগ দিও আরেকটা।”

“ওর আর কোনো সুযোগ নেই।যে ভালো হওয়ার সে এক সুযোগেই ভালো হয়ে যায়।তিনটা সুযোগের প্রয়োজন পড়ে না।”

কথাটা বলেই আয়াশ উপরে উঠে চলে যায়।মেহরিমা অবাক চোখে আয়াশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।ভালোবাসার মানুষকে নিজের হাতে কিভাবে ত্যাগ করবে এই মানুষটা?আরিশার প্রতি আয়াশের গভীর ভালোবাসা মেহরিমা নিজের চোখে দেখেছে।

“ভালোবাসার মানুষকেও বুঝি ত্যাগ করা যায়?”

“হয়তোবা!”

“মনের টান থাকলে বিচ্ছেদ কিভাবে সম্ভব?”

“মনের টান হাহ্!সেটাতো দু’জনের দিক থেকেই থাকতে হয়।”

এই প্রথম আয়াশের জন্য হৃদিতের বুক ভার হয়। মানুষটা এতো ভালোবেসেও তার বিনিময়ে একটুও ভালোবাসা পেলো না।ভালোবাসা দিয়ে নাকি সবকিছু পরিবর্তন করা যায়।তাহলে আয়াশ কেনো ব্যর্থ হলো?তবে কী এই কথাটা মিথ্যা!আরিশার সাথে থাকলে আয়াশ কখনও ভালো থাকতে পারবে না।যে অন্যের কথায় বশীভূত হয়ে নিজের স্বামীর ক্ষতি করতে চায় আর যাই হোক সে কখনও একজন ভালো স্ত্রী হতে পারেনা। ভালোবাসলে একে অপরকে হারানোর ভয় থাকে হৃদয়ে।যেই ভয়টা আরিশার মধ্যে নেই।কিছু সময় ভালো থাকার জন্য হলেও ভালোবাসার মানুষকে ত্যাগ করতে হয়।প্রথমে কষ্ট হলেও একসময় সয়ে যায়।আমরা মানুষ দুঃখ কষ্ট ভুলতে না পারলেও সেগুলো সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে।

“আমরা মানুষেরা বারবার ভুল মানুষকে কেনো ভালোবাসি?”

“এটার উত্তর আমার থেকেও তুই ভালো জানিস।এইযে যেমন তুই ভালোবেসেছিস আমাকে।এটা দুর্ভাগ্য তোর।”

“কে বলেছে আমার দুর্ভাগ্য? আমার তো বড় সৌভাগ্য। আপনার মতো করে এই পৃথিবীতে কয়জন ভালোবাসতে পারে?দুর্ভাগ্য তো সেই ভাগ্য, যেই ভাগ্যে একটা হৃদিত লেখা নেই।স্বার্থের এই দুনিয়াতে সবাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পায়না।আর যারা পায় তারা ভাগ্যবতী।যেমন আমি।”

হৃদিত মুগ্ধ চোখে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে।ও কী ভেবেছিল আর কী হচ্ছে!ওর অ্যানাবেলা সবার থেকে আলাদা।সম্পূর্ণ আলাদা।মেহরিমা মুচকি হেসে বলে,

“আমি খাবার গরম করতে যাচ্ছি।আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত কিছুক্ষণ থ মেরে বসে থেকে ফ্রেশ হতে চলে যায়।পনেরো মিনিটের ব্যবধানে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে।মেহরিমা তখন খাবার সার্ভ করে টেবিলে বসে আছে।টেবিলে দুটো প্লেট দেখতেই ভ্রু কুঁচকায় হৃদিত।

“তুই খাস নি?”

“না।”

“তোকে নিষেধ করেছিলাম…”

হৃদিতের মুখের কথা শেষ করতে না দিয়েই মেহরিমা জবাব দেয়,

“এটা আপনার ঘাড় ত্যা ড়া মো র পা নি শ মে ন্ট।এরপর থেকে এটাই হবে আপনার জন্য বেস্ট পা নি শ মে ন্ট।আর একটাও কথা না বলে জলদি খেতে বসুন।আমি জানি আপনি সারাটা দিন না খেয়ে আছেন।”

আজ আর হৃদিত তর্কাতর্কি করার সাহস পায় না। বউটা এমনিতেই রেগে আছে।বেশি বাড়াবাড়ি করলে দেখা যাচ্ছে বোম ব্লাস্ট হয়ে গেছে।তাই কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো খেতে বসে পড়ে।মেহরিমা মনে মনে হেসে গড়াগড়ি খায়। অতঃপর দু’জনে একসাথে ডিনার কমপ্লিট করে।

_____

সময় রাত একটা বেজে চল্লিশ মিনিট।মেহরিমা বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে।ঘুম আসছে না।মনে বড্ড অশান্তি অনুভব হচ্ছে।মাথার উপর ওতো গুলো টাকার টেনশন নিয়ে কার’ই বা ঘুম আসে?আসল সত্য আদৌও কী কারোর সামনে আসবে? মাথায় হাজারও টেনশন দৌড়ে বেড়াচ্ছে।হৃদিত মেহরিমার কোমরে হাতে রেখে নিজের কাছে টেনে নেয়।আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।মেহরিমা হৃদিতের বুকে মাথা রাখে।

“শরীর খারাপ লাগছে জান?”

“উহু।”

“তাহলে?সকালের বিষয়টা নিয়ে টেনশড?”

“এতো গুলো টাকা আমরা কিভাবে দেবো?আমাকে,মাকে,মাধুপুকে বিক্রি করলেও তো এতগুলো টাকা হবে না।”

“হুশশ,আর একটাও বাজে কথা না।আমি আছি তো।”

“কিন্তু আমার বাবাকে যে মিথ্যা অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলো। আমার বাবা নির্দোষ। আমার বাবা কখনও কারোর কোনোকিছু দেখে লোভ করেনি।আর আজ তাকে…”

মেহরিমা নিজের কথা শেষ করতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।হৃদিত সযত্নে মেহরিমার চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।কপালে শিক্ত ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।কৌশলে টপিক চেঞ্জ করে বলে,

“আমরা কালকে যাচ্ছি।”

“কোথায়?”

“ঘুরতে।”

“আমার ইচ্ছা নেই।এমন অবস্থায় কে ঘুরতে যায়?”

“কে যায় না যায় ইটস ডাজন্ট ম্যাটার।আমরা যাবো মানে যাবো।”

“এই অবস্থায় মাকে একা ফেলে গেলে মা কষ্ট পাবে।”

“উহু পাবেনা।মা নিজেই বলেছে আমাকে।কাল সকালে আমরা ও বাড়িতে যেয়ে মা আর মাধবীর সাথে দেখা করে রওনা দেবো।”

“তাহলে এদিকের কী হবে?”

“তোর জন্য সকালে একটা সারপ্রাইজ আছে।এই বিষয় নিয়ে আর একটাও কথা না।”

“থাকবো কয়দিন?”

“তোর যতদিন ইচ্ছা।”

“আপনার বাগান বাড়িতে দু’দিন থাকবো।”

“যথা আজ্ঞা মহারানী।”

“আপনার আর্টরুম দেখবো।”

“এখনই?”

“হুম।”

“এখন না জান। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়।”

“না এখন’ই।”

হৃদিতের আর কী করার!খাটের পাশে থাকা বক্সের উপর থেকে রুমের দরজার সুইচটা হাতে নিয়ে মেহরিমাকে কোলে উঠিয়ে নেয়।ব্যালকনিতে এসে মেহরিমাকে নামিয়ে দেয়।সুইচ দিয়ে দরজা ওপেন করতেই মেহরিমা ভেতরে প্রবেশ করে।মেহরিমার পিছু পিছু হৃদিত আসে।রুমের সবগুলো লাইট অন করে।আলোর তীব্রতায় মেহরিমা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।পরক্ষণেই‌ আস্তে আস্তে চোখজোড়া মেলে তাকায়।পুরো রুমের সৌন্দর্য দেখতেই মেহরিমার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে যায়!রুমের এক পাশের দেওয়াল জুড়ে কাঠের তৈরি বইয়ের বড় একটা ওয়াল বুক সেলফ।যেখানে রাখা আছে হাজার হাজার বই।অপর পাশে দেওয়ালটা পুরোই কাঁচের তৈরি।যার সামনে একটা ডিভান রাখা।আরেকটা দেওয়ালে ওয়াল সেলফ তৈরি করে আর্টের ইনস্ট্রুমেন্ট রাখা।দরজার সাথে থাকা দেওয়ালে তিনটা গিটার রাখা।পুরো ঘরে এক্সট্রা বলতে জাস্ট একটা ডিভান রাখা আছে আর কিচ্ছু না।ঘরটা অত্যধিক পরিপাটি করে রাখা।ঘরের ডেকোরেশন সাধারণের মাঝেও অসাধারণ।মেহরিমা বুক ভরে শ্বাস নেয়।ঘরটার মাঝে যেন স্বস্তি মিলে।মেহরিমা কাঁচের দেওয়ালটার নিকট ধীর পায়ে এগিয়ে যায়।এখান থেকে চৌধুরী বাড়ির পিছনের পুকুর,বাগান সব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। দিনের আলোয় হয়তো দেখাও যাবে।তবে মেহরিমার যত টুকু মনে পড়ে ও নিচে থেকে অনেকবার এদিকে তাকিয়েছে কিন্তু এই দেয়ালটা দেখা যায়নি।বাইরে প্রকৃতি অন্ধকারাচ্ছন্ন।অন্ধকার গলিয়ে ভেসে আসছে নাম না জানা কতশত পোকা মাকড়ের ডাক।মেহরিমার গা ছমছম করে ওঠে।তখনই কোমরে হৃদিতের হাতের গাঢ় স্পর্শ অনুভব করে।ঘাড়ে উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে।শুনতে পায় হৃদিতের নরম শীতল কন্ঠস্বর,

“এই পৃথিবীর সবাই আমার হিংস্র রুপটা দেখেছে।এক কঠিন হৃদিতকে দেখেছে।আমার দুঃখ, কষ্টগুলো কেউ কখনও উপলব্ধি করেনি ইভেন বোঝেও নি। আমার দুঃখ,কষ্ট গুলো বোঝার জন্য হলেও আমার হয়ে থেকে যাস।অন্যদের মতো আমারও একটা আশ্রয় প্রয়োজন।যেখানে আমি নিজের দুঃখ কষ্ট অনায়াসেই প্রকাশ করতে পারবো।হতে পারবি না আমার আশ্রয়?তুই না বলিস মানুষের আসল সৌন্দর্য তার মনে?আমার অবুঝ মনটা একটাবার পড়ার চেষ্টা করিস মায়াবতী।হিংস্রতার মাঝে রয়ে গেছে অনেক অব্যক্ত অনুভূতি।”

#চলবে__

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৬ [রহস্যের খন্ডাংশ.৩]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

“আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল কৌশিক।তুই তো চিনিস ওরে।আমি তখন বাবার সাথে সবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি।তখনই ওর সাথে পরিচয় হয় আমার।মামুন তালুকদারের একমাত্র আদরের ছেলে ছিল কৌশিক তালুকদার।বাবার সাথে বানিজ্য মন্ত্রী মামুন তালুকদারের সম্পর্ক সবসময়ই খুব ভালো ছিল।সেই সম্পর্কের জের ধরেই আমার আর কৌশিকের সম্পর্কটাও বন্ধু থেকে প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হয়। আমাদের বন্ধুত্বের দুই বছরের মাথায় কৌশিকের লা শ পাওয়া যায় বাবার পার্টি অফিসের সামনে।তখন আমি আর কৌশিক দু’জনেই রাজনীতির মাঠে ধূর্ত খেলোয়াড়।সবে মন্ত্রীত্ব পেয়েছি আমি।ওই সময়টাতে মামুন তালুকদার আর বাবার মাঝেও কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা চলছিল।বাবার ডান হাত আমি ছিলাম।তাই সবাই ভেবে নেয় খু ন টা আমিই করেছি।কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় কেউ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনা। মামুন তালুকদার অবশ্য আমাকে ফাঁ সা নো র চেষ্টা করেছিলেন বাট পারেনি।এরপর কেটে যায় একটা বছর।হঠাৎ বর্ষার একদিনে বৃষ্টির মধ্যে আমার গাড়ি জ্যামে আটকা পড়ে।সেদিন দেখা মিলেছিল এক শুভ্র পরীর।তাকে দেখে আমার হৃদয় কিছু সময়ের জন্য থমকে ছিল।মেয়েটার অনুমতি ব্যতীত’ই সেদিন ওর পিক তুলেছিলাম।বাসায় এসে মেয়েটার সব ডিলেইলস কালেক্ট করি।জানতে পারি মামুন তালুকদারের একমাত্র মেয়ে আরিশা তালুকদার।এইসব কালো জগৎ থেকে নিজের মেয়েকে সরিয়ে রেখেছিলেন উনি।তাই আমি চিনতাম না আরিশাকে।নিজের মনে জন্ম নেওয়া এক টুকরো অনুভূতি ওই বদ্ধ ঘরের মধ্যেই মাটি চাপা দিলাম।তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে মেয়েটা নিজে থেকেই আমার সাথে কথা বলতে আসে।আমি সেদিন অবাকের সপ্তম পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম! তারপর নিজেদের মাঝে টুকিটাকি কথা বলা,নিয়ম করে দেখা করা শুরু হয়।একসময় নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলি আরিশাকে। নিজের অনুভূতি বোঝার জন্য আমি আরও কিছুদিন সময় নিই। দিনশেষে সেই একই ফলাফল।তাই আমি কোনো ভনিতা না করেই আরিশাকে মনের কথা জানায়।ভেতরে ভেতরে আপসেট ছিলাম প্রত্যখানের ভয়ে কিন্তু এমন কিছুই ঘটেনি। ওকে প্রোপোজাল দিয়ে জানতে পারি ও নিজেও আমাকে ভালোবাসে।ব্যস আর কীসের অপেক্ষা? বাবাকে জানায়।বাবা মামুন তালুকদারের নাম শুনে নাকচ করে দেন।আমি সবটা আরিশাকে জানাতে আরিশা আমাকে বলে,’ও সবটা ম্যানেজ করে নিবে।’ ঠিক তার পরেরদিন মামুন তালুকদারের সঙ্গে আরিশা আমাদের বাসায় আসে তাও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। মামুন তালুকদার আর বাবার সম্পর্কটাও ঠিক হয়ে যায়।ধুমধাম করে আমাদের বিয়ে হয়।”

একাধারে কথাগুলো বলে থামে আয়াশ।সময় সকাল ছয়টা।চারি পাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু।ঠিক আয়াশের ভবিষ্যতের মতো।হৃদিত আর আয়াশ চৌধুরী বাড়ির ফুলের বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।শীতকালীন ফুলের সুবাসে ভরে উঠেছে বাড়ির আঙ্গিনা।দুই ভাইয়ের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে হাজারও ফুলের মাঝে।আয়াশের জন্য আজকের সকালটা একটু অন্যরকম।ক্ষণে ক্ষণে বুকটা অযথাই ভার হয়ে উঠছে।

“এগুলো তো জানি নতুন কিছু বলো।”

হৃদিতের কথায় আয়াশ হাসে।

“তো বিয়ে ঠিকঠাক ভাবেই হয়।বিয়ের রাতে জানতে পারি আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে বিয়ে করেছে তার প্র তি শো ধ নেওয়ার জন্য।তার ভাইয়ের মৃ ত্যু র প্রতিশোধ নিতে।এতদিনের ভালোবাসাবাসি সবটাই ছিল তার অভিনয়। ওইসময় একদম ভেঙ্গে পড়েছিলাম।পরক্ষণেই নিজেকে নিজেই সামলিয়ে কৌশিকের মৃ ত্যু র রহস্য উন্মোচনের কাজে লেগে পড়ি।তিনমাস সময় নিয়ে সব সত্য জানতে পারি।সত্য জেনে আমি অবাক কম ব্যথিত হয়েছিলাম বেশি। মামুন চৌধুরী নিজের স্বার্থের জন্য নিজের ছেলেকে খু ন করিয়েছেন।যাতে আমাকে খু নি বানিয়ে আমার ক্যারিয়ার ন ষ্ট করতে পারে।কিন্তু এমন কিছুই তো হয়নি।কৌশিকের প্রাণ ছিল আরিশা।ওরা ভাই, বোন কম বন্ধু ছিল বেশি।তাই ওই জা নো য়া র নিজের মেয়েকে কাজে লাগায়।আরিশাকে মিথ্যে বলে ওর মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে আমাকে, আমাদের চৌধুরী বংশকে ধ্বং স করতে পাঠায়।কিন্তু আফসোস ওই জা নো য়া র জানে না ভালোবাসার কাছে এইসব প্র তি শো ধ বড়ই তুচ্ছ।”

“তাহলে স্বীকার করছো?”

“কী?”

“তুমি এখনও আরিশাকে ভালোবাসো।”

“ভালোবাসা তো পাপ না।ভালোবাসা কী আর ভালো খারাপ দেখে হয়?কতই তো নিজেকে আটকাতে চেষ্টা করলাম। শেষ রক্ষা আর হলো কোথায়? বরং আগের থেকেও এখন বেশি ভালোবাসি।”

আয়াশের কথায় হৃদিতের দু’চোখের পাতায় মেহরিমার মুখটা ভেসে ওঠে।এই জন্যই বোধহয় মেহরিমা হৃদিতকে নিজের অজান্তেই এতোটা ভালোবেসে ফেলেছে।

“আরিশাকে সত্যিটা বলছো না কেনো?”

“ও বিশ্বাস করবে না।আর বিশ্বাস করলেও এত বড় সত্যি ও কখনও মেনে নিতে পারবে না। বাবা ভক্ত মেয়ে কি না!”

“সত্যিটা জানাও।আরেকটা সুযোগ দেও।এতগুলো বছর একসাথে কাটালে। ওকে ছাড়া হয়তো তুমি ভালো থাকতে পারবে না ।”

হৃদিতের কথায় আয়াশের বুক থেকে ভারী দীর্ঘশ্বাস বের হয়।ম্লান হেসে বলে,

“ভালো থাকা হাহ্!যে যেতে দেয় একমাত্র সেই জানে কতটুকু চেষ্টার পরেও একটা মানুষ হাল ছেড়ে দিয়ে তার ভালোবাসার মানুষটাকে যেতে দেয়।”

“যেতে দিচ্ছো কেনো? নিজের করে রেখে দেও।সে তো যেতে চাচ্ছে না। তুমি জোর করছো।”

“যে আমার দুঃখ কষ্টগুলো বোঝে না,সে আমারে কী বুঝবে?আর আমারে না বুঝলে সেখানে ভালোবাসা রইলো কোথায়?ভালোবাসা ছাড়া একটা সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো মোটেও সহজ নয়। একতরফা ভালোবাসায় সব হয়না।”

আয়াশের কথায় হৃদিত সুক্ষ্ম হেসে বলে,

“বিশ্বস্ত আর বিশ্বাসঘাতক দুইটা কিন্তু খুব কাছের মানুষেরাই হয়। তোমার চোখ,কান,মুখ আরও খোলা রাখা উচিৎ মন্ত্রী সাহেব।আর হ্যাঁ আরিশা আমার ক্লাসমেট ছিল।”

হৃদিতের কথায় আয়াশের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হয়।তবে কী ওর জানার এখনও বাকি আছে!হৃদিত ততক্ষণে সদর দরজার দিকে হাঁটা ধরেছে।ওর কাজ শেষ।কিছুটা দূরেই আরিশা দাঁড়িয়ে আছে।সবটা শুনে বুক ফেটে কান্না আসছে।বাবা এতোটা নিচে কীভাবে নামতে পারলো?নিজের ক্যারিয়ারের জন্য ভাইয়া কে বলিদান দিয়ে দিল?মানুষের জীবন এদের কাছে কী এতোটাই তুচ্ছ!পরক্ষণেই আয়াশের বলা কথাগুলো মনে পড়ে।মানুষটাকে তিনটা বছর অযথাই কষ্ট দিলো!একটা সুন্দর জীবন নষ্ট করে দিলো! নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয় আরিশার।ভাগ্যিস হৃদিত ওকে এখানে নিয়ে এসেছিল।নাহলে সত্যটা তো কখনোই জানা হতো না আরিশার।

_____

সময় দশটা। চৌধুরী বাড়ির সকলে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়েছে।হৃদিত ব্যতীত সবার চোখে পানি।অ্যাডভোকেট এসেছে আয়াশ আরিশার ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে।আয়াশের হাতে কলম।হাতটা থরথর করে কাঁপছে। তিনবার চেষ্টা করেও সাইন করতে পারেনি। হঠাৎ করেই কলমটা শব্দ করে টেবিলে রেখে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।মাথাটা সোফায় এলিয়ে দেয়।আরিশা মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে আয়াশ ডিভোর্স দেবে না। সকাল সাতটার সময় যখন আয়াশের মুখ থেকে শুনেছিল আজ দশটাই ওদের ডিভোর্স হবে তখন থেকেই বুকে চাপা কষ্ট অনুভব হচ্ছে আরিশার।এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ও বুঝে গেছে ওর মনের কোথাও একটু ভালোবাসার জন্ম হয়েছে আয়াশের জন্য।আর এটা সম্পূর্ণ নিজের অজান্তেই হয়েছে।তাইতো এতদিন বুঝতে পারেনি। কিন্তু শেষ সময় সেটা বুঝে আদৌও কী কিছু করার আছে!

অদূরেই দাঁড়িয়ে নিরব চোখে সবটা দেখছে হৃদিত।দেখছে ভালোবেসে ব্যর্থ হওয়া একটা ছেলের জীবন শেষ।আয়াশ নিজের লালচে চোখজোড়া খুলে তাকায়।সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাইন করে দেয়।অতঃপর আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে দোতলায় উঠে চলে যায়।আরিশা অনুভূতিশূন্য চোখে আয়াশের যাওয়া দেখতে থাকে।উপস্থিত সকলের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।আরিশাকে সাইন করতে বলা হলে ও হাউমাউ করে কান্না করে দেয়।ডিভোর্স দিতে পারবে না।দৌড়ে উপরে চলে আসে।জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে থাকে।আয়াশের কোনো সাড়াশব্দ নেই।আরিশা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“আমাকে আরেকটা সুযোগ দেও আয়াশ।তোমাকে ভালোবাসি আমি।আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারবোনা আয়াশ। আমার হাত দিয়ে ওই সাইন হবে না।”

তৎক্ষণাৎ দরজাটা খুলে যায়। দরজায় বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে আয়াশ।চোখে পানি নিয়েই মুচকি হাসে।

“তোমার মন থেকে বলা ভালোবাসি কথাটা শোনার খুব ইচ্ছা ছিল আমার।সেই ইচ্ছা আজ পূরণ হলো। আমাকে করুণা করার জন্য ধন্যবাদ।সাইন টা করে দিও। আমার ড্রাইভার তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

“আমাদের এতো স্মৃতি তুমি ভুলে ভালো থাকতে পারবে?”

“একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কিছু খারাপ স্মৃতি থাকা প্রয়োজন।”

“এমনটা করোনা আয়াশ।আমি বাঁচতে পারবো না।”

“পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্য কি জানো?”

আরিশা চোখে জল নিয়েই না বোধক মাথা নাড়ায়।তা দেখে আয়াশ হাসে।মেয়েটা সত্যিই বোকা।

“চেনা মানুষের অচেনা রুপ।”

আয়াশ মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়।যেটার অর্থ বহন করে আরিশার জন্য আয়াশের জীবনের দরজাটা সারাজীবনের জন্য ঠিক এভাবেই বন্ধ। মস্তিষ্ক কথাটা উপলব্ধি করতেই ওখানেই ধপ করে বসে পড়ে আরিশা।সেকেন্ড পেরোয়,মিনিট পেরোয়, ঘন্টা পেরোয় আরিশা একইভাবে বসে থাকে।ভেতর থেকে আয়াশের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।কী করছে কে জানে! অ্যাডভোকেট ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলার সাহস নেই।দুই ঘন্টা পেরোতেই আরিশা অগোছালো ভাবে উঠে দাঁড়ায়।এটা ওর করা পাপের শা স্তি।আর এটা ওর প্রাপ্য।নিচে নেমে এসে কাঁপা কাঁপা হাতেই সাইন টা করে দেয়।সেকেন্ডের ব্যবধানে একটা সাইন দুটো জীবনের গন্তব্য পরিবর্তন করে দেয়।আরিশা উঠে দাঁড়ায়।আজ আর পা টা যেন চলছে না।ভেঙে আসছে বারংবার। তবুও শরীরের সাথে জোর করে সকলের নিকট যেয়ে ক্ষমা চায়।মেহরিমার কাছে যেতেই মেহরিমা বলে,

“আপনার যখন মন চাইবে তখনই চলে আসবেন আপি।এই বাড়ির দরজা সবসময় আপনার জন্য খোলা।আমরা সবসময় একটা পরিবার ছিলাম,আছি,থাকবো।কখনো আমাদের পর ভাববেন না।”

মেহরিমার কথায় আরিশা শব্দ করে কান্না করে দিয়ে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“তুমি খুব ভালো মেহু।তোমার কতো ক্ষতি করতে চাইলাম আমি আর তুমি কি না আমাকে এখনও আপি ডাকছো!আল্লাহ তোমায় খুব ভালো রাখবে। আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে।”

মেহরিমাকে ছেড়ে দিয়ে শ্রেয়া চৌধুরীর নিকট আসে।মলিন হেসে আস্তে করে বলে,

“নিজে হাতে আপনার দুটো ছেলের জীবন নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন আপনি।একটার জীবন তো শেষ পর্যন্ত ন ষ্ট করেই দিলেন।মা নামের ক ল ঙ্ক আপনি।আয়াশ সত্যটা জানলে আপনাকে মা বলে কখনও পরিচয় দেবে না।তবে ভয় পাবেন না আমি কিচ্ছু বলবো না।আপনার ছেলে যথেষ্ট বুদ্ধিমান।নিজেই সব সত্য খুঁজে বের করে নিবে।”

কথাগুলো বলেই কাঁপা কাঁপা পায়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আরিশা। ড্রাইভার সাহায্য করতে চাইলে না করে দেয়।দোতলার একটা রুমের জানালা থেকে সিক্ত দুটো চোখ একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আরিশার প্রস্থানের দিকে।বুকে তার তীব্র রক্তক্ষরণ হচ্ছে।আহ্ পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা বোধহয় একেই বলে।আরিশা মেইন গেইটের সামনে এসে থামে।গাড় ঘুরিয়ে শেষ বারের মতো চৌধুরী বাড়িটাকে দেখে নেয়। দৃষ্টি যেয়ে আটকায় নির্দিষ্ট একটা ঘরের দিকে।পরিচিত দুটো চোখের সাথে দৃষ্টি মেলে যায়।বুকটা কেঁপে ওঠে!মলিন হেসে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে।অতঃপর সোজা রাস্তা বরাবর হাঁটা ধরে।গন্তব্যস্থল অজানা।আরিশা শুধু এটুকু জানে ও আর কখনও হাওলাদার বাড়িতে ফিরবে না।

শ্রেয়া চৌধুরী পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মস্তিষ্কে বারবার আরিশার বলা কথাগুলো পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে।চোখের সামনে নিজের করা পাপ গুলো ভেসে উঠছে।কানের কাছে কিছু অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে।আশেপাশের সবকিছু ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকে।হঠাৎ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতেই সবাই সেদিকে তাকায়।শ্রেয়া চৌধুরী ফ্লোরে পড়ে আছেন।সবাই সেদিকে ছুটে যায়।আরিফ চৌধুরী সেসবে নির্বিকার।হাঁটা ধরে বাড়ির বাইরের দিকে।দুদিনের এই জীবন এত অদ্ভুত কেনো!এত বিচ্ছেদের সুর কেন চারিদিকে?কেন মানুষ চেনা যায় না?শ্রেয়া চৌধুরী সজ্ঞানে থেকে যদি সবটা দেখত তাহলে নিশ্চয় বুঝতো সবার ক্ষতি করে কখনোই নির্দিষ্ট একজনের ভালোবাসা পাওয়া যায়না।অথচ মানুষটা সেই ভুলটাই করেছে।যেই মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য সবার কাছে খারাপ হলো আজ সেই মানুষটাই তার খারাপ সময়ে পাশে নেই।প্রকৃতি সবকিছু দ্বিগুণ রুপে ফিরিয়ে দিতে পছন্দ করে।হোক সেটা ভালোবাসা অথবা একাকিত্ব।

#চলবে____

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-৩৩+৩৪

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৩.[সারপ্রাইজ পর্ব]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

সময় বিকালবেলা।হৃদিত,মেহরিমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে এসেছে।ডক্টরের অ্যাপোয়েনমেন্ট আগে থেকেই নেওয়া ছিল।অবশ্য মেহরিমা একা না ওদের সাঙ্গপাঙ্গরাও সাথে এসেছে।মেহরিমা,মাধবী, আর তৃধা হৃদিতের গাড়িতে এসেছে।তাবান,তাইফ হৃদিতের বাইক নিয়ে এসেছে।মেহরিমা আর হৃদিত ডক্টরের কেবিনে আছে।বাকি ওরা চারজন হসপিটালের করিডোরে বসে আছে।সবাই নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত।মাঝে মাঝে একটু নিজেদের মধ্যে ফুসুরফুসুর করছে।

“মাধবী তোমার অ্যাডমিশন টেস্টের প্রিপারেশন কেমন?”

তাইফের প্রশ্নে মাধবীর ফোনের স্ক্রিনে চলা হাতটা থেমে যায়।এই প্রথম তাইফের সাথে কথা বলা হবে।এতদিন দুই এক বার চোখে চোখ পড়লেও কেউ মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।

“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া।”

“এক্সাম ডেইট কবে?”

“এইতো আর পনেরো দিন পরে।”

“ঢাকাতে কে কে যাবে?”

“আমি আর মা।”

“থাকবে কোথায়?”

“মামানির বোনের বাসায়।”

“বলো কি!ওখানে কেনো থাকবে? ভাইয়ার নিজের বাসা আই মিন বড় চাচ্চুর বাসা আছে তো ঢাকাতে।”

“এইসব আমি জানি না।মা জানে।”

“এই ভাইয়া তুমি যে মাধুপুর পড়াশোনার এত্তো খোঁজ নিচ্ছো তা তোমার পড়াশোনার কি খবর?হুদাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হলে।ঢাকাতেও তো যাও না?তোমার আর তাবান ভাইয়ার উচিত ছিল মাঠে বসে ঘাস কাটা।”

তৃধার কথা শেষ হতেই ওর পিঠে দুম করে এক কিল বসিয়ে দেয় তাবান।তাইফ মনে মনে শান্তি পায়।এই কিল টা বসানোর জন্য এতক্ষণ ওর হাত নিশপিশ করছিল।নেহাতই এখানে মাধবী আছে নাহলে এতো ভদ্র থাকার ছেলে নাকি তাইফ হুহ্!তাবান বলে,

“শাকচুন্নী কথা কম ক।ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের দুই ভাইয়ের রেজাল্ট থ্রি পয়েন্ট।ভাবতে পারছিস? অবশ্য তোর মতো মাথা মোটা এটা বুঝবে কিভাবে?”

“ভাইয়া খবরদার আমাকে মাথামোটা বলবে না। তোমাদের মতো ফেল্টুস না আমি।আর তোমাদের ওগুলো তো ঘুষ দেওয়া পয়েন্ট।”

ওদের কান্ড কারখানা দেখে মিটিমিটি হাসে মাধবী। হঠাৎ তাইফের চোখে চোখ পড়তেই মাধবীর হাসি বন্ধ হয়ে যায়।তাইফ মুচকি হাসে।মাধবী চোখ নামিয়ে নেয়। দু’জনের এই লুকোচুরি দেখে তৃধা,তাবান ঠোঁট টিপে হাসে।

“এই তোমলা একানে কী কচ্ছো?”

একটা বাচ্চা কন্ঠ শুনতেই সবাই সেদিকে তাকায়।দেখে ছোট্ট একটা কিউট গুলুমলু বাচ্চা ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।তাবান চারপাটি দাঁত বের করে হেসে বলে,

“আড্ডা দেই।তুমি দেবে?”

“মাম্মা,পাপ্পা বকা দিবে তো।আমি একানে পালিয়ে এছেতি।ইটত থিকলেট।”

বাচ্চাটার কথা বলার ধরণ দেখে সবাই হেসে ওঠে।তৃধা এগিয়ে এসে কোলে উঠিয়ে নেয়।গালে টপাস টপাস করে কয়েক টা চুমু বসিয়ে দেয়।

“উপপপপপ!তোমলা শুদু আমার গালে তুমু খাও কেনো?আমি ডিস্তার্ব হই।”

ছোট্ট একটা বাচ্চার মুখে এমন কথা শুনে সবার চোখজোড়া মার্বেলের মতো গোল গোল হয়ে যায়। তক্ষুনি সেখানে উপস্থিত হয় বাচ্চার মা,বাবা। নিজের ছেলেকে দেখে বাচ্চার মা দ্রুত এগিয়ে আসে।

“অদৃজ বাবা তুমি এখানে কী করছো?তোমাকে কত খুঁজেছি জানো?একটুর জন্য আমার প্রাণটাই বের হয়ে যাচ্ছিলো।”

“থলি মাম্মা।আল হবে না।”

কথাটা বলেই মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে চলে যায় অদৃজ।ঘাড়ে মাথা রাখে লক্ষী বাচ্চার মতো।

“ও আপনাদের নিশ্চয় খুব জ্বালিয়েছে।আসলে আমরা ডক্টরের কেবিনে ছিলাম।ও খেলছিল ওখানেই।আমরা ডক্টরের সাথে একটু কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।ও সেই সুযোগে বাইরে চলে এসেছে।আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

“না ভাইয়া ও মোটেও দুষ্টুমি করেনি।খুব মিষ্টি একটা বাচ্চা।মা শা আল্লাহ।”

তাবানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে অদৃজের বাবা,মা মুচকি হাসে।ততক্ষণে ডক্টর দেখিয়ে করিডরে হৃদিত আর মেহরিমা উপস্থিত হয়েছে। খুব পরিচিত একটা মুখ দেখতেই হৃদিত মৃদু হেসে সামনে এগিয়ে আসে।

“আরে এমপি তিহান এহসান ব্রো যে?সাথে তরু ভাবী আর অদৃজ বাবাটাও আছে দেখছি?”

হৃদিতের কথা শুনে ওর দিকে তাকায় তিহান,তরু। তিহান মুচকি হেসে বলে,

“হ্যাঁ,ডক্টরের কাছে এসেছিলাম তোমার ভাবীকে নিয়ে।তুমি এখানে যে?গ্রামে থাকো নাকি?পাশের টা কে?ওয়াইফ?”

“হুম ব্রো আপাতত গ্রামেই আছি।শি ইজ মাই ওয়াইফ মেহরিমা শেখ।আপনারা এখানে হঠাৎ?”

“বাবার ফ্রেন্ডের বাসায় এসেছিলাম।এখানে এসে তোমার ভাবী একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই ডক্টরের কাছে আসা।”

“ব্রো আমাদের সাথে যেতে হচ্ছে কিন্তু।”

“আজ তো যাওয়া হচ্ছে না।আগামীকাল সকালে ব্যাক করতে হবে খুলনাতে।আয়াশ কেমন আছে?ও কোথায় এখন?”

“আপনার ফ্রেন্ড গ্রামেই আছে।”

“এই মিত্তি আন্তি তোমাল ছাতে যাবো আমি।নিবে আমাকে?”

অদৃজের কথায় মেহরিমা হেসে উঠে দুহাত বাড়িয়ে দেয়।অদৃজ কোলে চলে আসে।মেহরিমা অদৃজের গালে চু মু দিতে নিলেই দৃষ্টি মিলে যায় হৃদিতের দৃষ্টির সাথে।সেই দৃষ্টিতে মেহরিমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।আর সাহস হয়না চু মু দেওয়ার।মেহরিমা মুখের হাসি বজায় রেখেই বলে,

“তুমিও খুব মিষ্টি একটা বাচ্চা বাবা।তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো আমি।”

“আমি মোতেও বাত্তা নই মিত্তি আন্টি।”

“শুধু পাকা পাকা কথা।বাসায় ব্যাক করতে হবে বাবা।চলে আসো।”

কথা বলেই তিহান অদৃজকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়।তরু মুখে হাসি টেনে প্রাণোচ্ছল কন্ঠে বলে,

“মেহরিমা খুলনাতে সময় সুযোগ করে একবার এসো কেমন? তুমি সত্যিই খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার বাচ্চাটা সবাই কে পছন্দ করে না।তোমাকে পছন্দ করেছে মানে ওর ভালো লেগেছে।”

“ইন শা আল্লাহ ভাবী যাবো।এখানে আর কখনও আসা হলে অবশ্যই গ্রামে যাবেন কিন্তু।”

“ইন শা আল্লাহ।হৃদিত বাসার সবাই কে নিয়ে একদিন আমাদের বাসার এসো।এই পিচ্চি বাচ্চা গুলো তোমরাও এসো আমাদের বাসায়।”

“আচ্ছা ভাবী।”

সবাই একসাথে জবাব দেয়।তরুর মুখের হাসি আরও প্রসারিত হয়।

“টেক কেয়ার হৃদিত।আই হোপ উই মিট এগেইন সুন।”

তিহান কথাটা বলেই মুচকি হেসে হৃদিতের দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়।হৃদিত ও মুচকি হেসে ডান হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে।দু’জনের ঠোঁটেই রহস্যময় হাসি।সকলের সাথে আরও কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলে তিহান,তরু চলে যায়।

“ভাইয়া এই তিহান ভাইয়ার ওয়াইফ’ই তো এসপি ছিল তাই না?”

তাবানের কথায় হৃদিত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।তিহান,তরু চলে যেতেই মেহরিমার মুখে আঁধার নেমে আসে।তৃধা বিস্মিত হয়ে বলে,

“দেখে তো মনেই হলো না।কি মিষ্টি মিশুক একটা মেয়ে!আর ব্যবহার তো অমায়িক ভালো।”

তৃধার কথায় ওর মাথায় গাট্টা মারে তাইফ।
অতঃপর ইশারায় চুপ থাকতে বলে।তাবান মৃদু হেসে বলে,

“তৃধু তোরে একদিন তরু ভাবীর পাস্ট শোনাবনি।তখন সব শুনে বলিস ভাবী কেমন?দেখতে সাধারণ হলেও তরু ভাবী অসাধারণ একজন মানুষ।”
_____

রাতের খাওয়ার পর্ব শেষ করে নিজের রুমের ব্যলকনিতে বিষন্ন মন নিয়ে বসে আছে মেহরিমা।হৃদিত ছাদে গেছে স্মোকিং করতে।চারি পাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন।অদূরেই শেয়াল ডেকে চলেছে।রাতের ঝিরিঝিরি বাতাসের সাথে ভেসে আসছে শিউলি ফুলের মন মাতানো সুঘ্রাণ।মেহরিমা বুক ভরে শ্বাস নেয়।তবুও আজ বুকের ভারটা কমে না।

“মন খারাপ?”

মায়ের কথায় মেহরিমা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায়। মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,

“না তো মা। এমনিতেই বসে আছি এখানে।”

“কার থেকে কথা লুকাচ্ছিস তুই?আমি তোর মা নীলাক্ষী।”

“মা এই কয়দিনেই তোমার চেহারার এই অবস্থা কেনো? ঠিকমতো শরীরের যত্ন নিচ্ছো না?”

“মানুষের মন মরে গেলে দেহের চিন্তা করে না।কথা ঘুরাচ্ছিস কেনো?”

মায়ের কথায় মেহরিমার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।এই মানুষটা ছাড়া ওকে ঠিক করে কেউ বোঝে না।পৃথিবীতে মায়ের মতো কেউ হতে পারে না।মেহরিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।অবনী শেখ দু’হাতে মেয়েকে আগলে নেন।কপালে স্নেহের চুমু এঁকে দেন।

“আমার আর কোনো কিছু ভালো লাগছে না মা। জীবনের সবকিছু কেমন বিষাদে ভরে গেছে।”

“আমাদের জীবন টা খুব সীমিত।এই জীবনের প্রতিটা পর্বে ওঠা নামা থাকবে।মানুষের ভাগ্য সব সময় এক থাকে না। ভাগ্য পরিবর্তনশীল।মনে রাখবি যাদের মস্তিষ্কে রাগের পাহাড়,তাদের মস্তিষ্কেই ভালোবাসার ভান্ডার।রাগী মানুষগুলো সবসময় বেশি কেয়ারিং হয়।তোকে বাইরের কারোর কথায় কান দিতে নিষেধ করেছিলাম আমি।”

“মা আমার আশে পাশের মানুষ গুলো সবাই মুখোশধারী।আমি ওদের চিনতে অপারগ।”

“তাদের থেকে দূরে থাকবি যারা ছোট্ট করে মিথ্যা বলে তোকে ব্যবহার করে।তোকে অসম্মান করে। মানুষ চেনা খুব কঠিন আবার খুব সহজও।”

“আমি ক্লান্ত মা।কুট্টুস পাখি কী আদৌও একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পাবে মা?ওর বাবা-মা কী ওকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারবে?”

“জীবন যুদ্ধে এতো তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়লে বাকি জীবন পাড়ি দিতে পারবি না।জীবন এতো সহজ না।একদিন হসপিটালে,ফুটপাতে যারা থাকে তাদের সাথে কথা বলে দেখিস।ওই হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা মানুষটা জানে জীবনের কী মূল্য। ফুটপাতে রাত কাটানো বাচ্চাটা জানে এই জীবন মানেই প্রতি সেকেন্ড,প্রতি মিনিট সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা।”

“তুমি এতো কিছু জেনেও তো জীবনের কাছে হেরে গেলে মা।এই জীবন তোমায় কী দিল?”

“তোর বাবাকে দিয়েছে,তোকে দিয়েছে,মাধবীকে দিয়েছে।একটা সুন্দর পরিবার দিয়েছে।আমি পরিপূর্ণ।”

“তুমিও অন্যদের মতো মুখোশধারী মা।তোমাকে আমি আজও ঠিকভাবে না চিনতে পারলাম আর না বুঝতে পারলাম।”

অবনী শেখ মেহরিমার কথাটা শুনেও যেন শুনলো না।

“এই বাড়িতে থাকলে তোর মনটা অলওয়েজ খারাপ’ই থাকবে।হৃদিতের সাথে কোথাও কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যা।আমি হৃদিতের সাথে কথা বলবো এটা নিয়ে।”

নিজের কথা শেষ করে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে ওখান থেকে চলে যান অবনী শেখ।মেহরিমা নিজের ভাবনার সাগরে ডুব দেয়।আজ সন্ধ্যায় ওরা চৌধুরী বাড়িতে ছিল এক ঘন্টার জন্য।সেখানেও মেহরিমা একটা চিরকুট পায় যেখানে লেখা ছিল।’হৃদিত মানসিক ভাবে অসুস্থ।আর ওর এই অসুস্থতা শুধু মাত্র মেহরিমাকে ঘিরে।’ মেহরিমা এগুলো বিশ্বাস করতে না চাইলেও মস্তিষ্ক বারবার ওই কথাগুলোই জপে চলেছে।আজ বিকালে হৃদিতের করা ব্যবহার মেহরিমার মোটেও ঠিক লাগেনি।ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ে জেলাস নিশ্চয় কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হবে না!যন্ত্রণায় মেহরিমার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।দুহাতে চুল খামচে ধরে চুপচাপ বসে থাকে।

অবনী শেখ নিজের রুমে এসে আলগোছে দরজাটা বন্ধ করে দেন।টেবিলের নিকট এগিয়ে এসে ড্রয়ার খুলে জলিল শেখের ডায়েরি টা বের করেন।ওটা নিয়েই ফ্লোরে বসে পড়েন।ডায়েরিটা খুলে প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখে পড়ে ‘আমার অবনীমালা’ লেখাটা।ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে ধরেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন।সবার সামনে কঠিন সত্তায় থাকা মানুষটাও ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে প্রতিক্ষণ।সেই খবর কি কেউ রাখে?আমরা মানুষেরা তো একজনের বাইরের দিকটা দেখেই তাকে জাজ করি।ভেতরটা পড়ার ক্ষমতা কয় জনের থাকে আর কয়জনই বা ভেতরটা পড়তে চেষ্টা করে! অবনী শেখ কাঁদতে কাঁদতেই বিড়বিড় করে বলেন,

“এই পৃথিবী আমায় কিচ্ছু দেই নি।শুধু কেড়ে নিয়েছে।এই পৃথিবী নিষ্ঠুর।এই পৃথিবী আমায় একটুও ভালো থাকতে দেয়নি।”
_____

হৃদিত দু’আঙ্গুলের ভাঁজে জলন্ত সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত।জীবনের শেষ পরিণতির কথা কল্পনা করতেই তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় হৃদিত।একটু ভালো থাকা তো ওর ও কাম্য ছিল।কিন্তু বিষধর সাপের মাঝে থেকে সেটা আশা করা নেহাতই বোকামি।যেখানে নিজের জন্মদাত্রী মা’ই নিজের শত্রু।সেখানে পরাজয় নিশ্চিত।তাই ভালো থাকা,সেটা তো একটুও আশা করে না হৃদিত। হঠাৎ পাশে কারোর উপস্থিতি অনুভব করতেই মুচকি হাসে হৃদিত।সামনের অন্ধকারেই দৃষ্টি রেখে বলে,

“এতো ঠান্ডায় ছাদে আসলি কেনো?”

“আপনি রুমে যাচ্ছেন না কেনো?কখন থেকে এখানেই আছেন।”

“ইন ফিউচার তো একাই থাকা লাগবে তোকে।অভ্যাস করে নে।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমার বুক কেঁপে ওঠে।এমন কিছু ও কখনও ভুলেও ভাবতে পারে না।এই মানুষ টাকে ছাড়া বেঁচে থাকা সেটা তো মৃত্যুর সমতূল্য!

“এমন কথা আর কখনও বলবেন না। আপনাকে ছাড়া আমার একটুও চলবে না।”

“তাহলে আজ সামান্য একটা চিরকুট পড়ে নিজেকে,আমাদের কুট্টুস পাখি টাকে কষ্ট কেনো দিচ্ছিস?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা চমকে ওঠে!এই চিরকুটের কথা হৃদিত জানলো কিভাবে!মেহরিমার হতভম্ব ভাব দেখে হৃদিত ক্ষীণ হেসে বলে,

“চিরকুটের কথাটা হয়তোবা সত্য।হতে পারে অ্যাট লাস্ট এটাই তোকে হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”

“আপনি খু ন,মারামারি এগুলো ছেড়ে দেন।আমি পর্দা করবো।কেউ আমাকে দেখতে পারবে না।আর আমিও কারোর দিকে তাকাবো না।ভালোবাসায় থাকে কোমলতা।সেখানে হিংস্রতার কোনো যায়গা নেই।অথচ আপনি সেটাই করে চলেছেন।”

“চেষ্টা করবো।”

“চেষ্টা নয় আপনাকে ছাড়তে হবে।আমাদের কুট্টুস পাখির জন্য হলেও আপনাকে ছাড়তে হবে।”

হৃদিত নিজের হাতে থাকা সিগারেট টা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অতঃপর মেহরিমার নিকট এগিয়ে এসে ওর দু গালে হাত রেখে বলে,

“ভালোবাসি তোকে।মৃ ত্যু ব্যতীত এর চেয়ে কঠিন সত্য আমার জীবনে আর দুটো নেই।তোর বলা কথাটা আমি রাখার চেষ্টা করবো অ্যানাবেলা।আই ক্যান ডু এভ্রিথিং ফর ইয়্যু জান।”

মেহরিমা কিছুক্ষণ ছলছল চোখে হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।অতঃপর শক্ত করে হৃদিতকে জড়িয়ে ধরে।যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।মেহরিমার কাজে হৃদিত মুচকি হেসে নিজের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ করে জড়িয়ে নেয়।খুব ব্যক্তিগত ভালোবাসা এঁকে দেয়।

#চলবে___

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৪
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

আজ শুক্রবার।শেখ পরিবারের সকলে খাবার টেবিলে বসে আছে।ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘরে। অবনী শেখ খাবার সার্ভ করছেন।

“হৃদিত তুমি কি ফ্রি আছো এখন?”

অবনী শেখের কথায় হৃদিত জানালার বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলে,

“জি মা।”

“নীলাক্ষীকে নিয়ে কিছুদিন অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসো।ওর মাইন্ড রিফ্রেশের দরকার।”

“আচ্ছা মা। তাহলে আগামীকালই রওনা দেই?”

অবনী শেখ মুচকি হেসে মাথা নাড়ান।অবনী শেখের খাবার সার্ভ করা শেষ হতেই সকলে একসাথে খেতে শুরু করে।ওদের খাওয়ার মাঝেই ঘরের কলিং বেল বেজে ওঠে।অবনী শেখ দরজা খুলতে এগিয়ে যান।দরজা খুলতেই অপরিচিত তিন জন মধ্যবয়স্ক পুরুষের মুখ চক্ষুগোচর হয়।অবনী শেখ কোনো ভাব ভণিতা ছাড়াই ওনাদের ঘরের ভিতরে আসতে বলেন।যেনো ওনারা আসবে এটা অবনী শেখ আগে থেকেই জানতেন।ওনারা তিনজন একটু অবাক হলেও স্বাভাবিক ভাবেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। অপরিচিত তিনজন পুরুষকে দেখতেই মেহরিমা আর মাধবী একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে।হৃদিত নির্বিকার ভাবে খেতে ব্যস্ত।যেনো এখানে ও ছাড়া আর কারোর উপস্থিতি নেই।

“জি ভাই বলুন।আপনাদের অভিযোগ কী?”

লোকগুলোর মধ্যে ফর্সা করে একজন বলে,

“আপনার হাসবেন্ড কোম্পানি থেকে এক কোটি টাকা সরিয়েছে এটা কি আপনি জানেন?”

লোকটার আকস্মিক এহেন কথা ড্রয়িং রুমে ছোট খাটো একটা বজ্রপাত ফেলে।মেহরিমার মুখে থাকা খাবার গলায় আটকে যায়।হৃদিত দ্রুত যত্ন সহকারে পানি খাইয়ে দেয়।মাধবী অবিশ্বাস্য চোখে ওনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।অবনী শেখ স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দেন,

“এটা তো আমার হাসবেন্ড নিজেই জানতো না। তাহলে আমি কিভাবে জানবো?সো রিডিকিউলাস।”

অবনী শেখের কথায় ওনারা তিনজন থতমত খেয়ে যান।সেই লোকটা আবারও বলে,

“আপনার হাসবেন্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এবং প্রমাণ সহ।আমরা একসাথে বসে আপোষে এটা মিমাংসা করতে চাই।”

“আমার হাসবেন্ড কে টাকা সরাতে দেখেছেন আপনারা? উইদাউট অ্যানি স্ট্রং প্রুফ আপনারা একজনের নামে চুরির অভিযোগ কিভাবে দিতে পারেন?”

“টাকা সরাতে দেখতে কেনো হবে?আপনার হাসবেন্ডের হিসাব থেকেই এক কোটি টাকা মিসিং।তাহলে এর দায়ভার কে নেবে?কোম্পানি?নেভার।”

“আমার বাবা এমন টা কখনও করতে পারে না আংকেল। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।”

মেহরিমার কথায় বেটে করে একজন বলে,

“প্রমাণ আছে বিধায় আমরা বলছি।তোমার বাবা একজন চোর।আর এটা তোমাদের মানতেই হবে। টাকার তো আর পা নেই।এতো গুলো টাকা না সরালে নিশ্চয় হাওয়া হয়ে যাবে না?”

লোকটার বলা ‘চোর’ কথাটা কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার মুখমণ্ডল কঠিন রুপ ধারণ করে। অবনী শেখ আগুন দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকেন।মেহরিমা রেগে যেয়ে উঁচু স্বরে বলে,

“একদম মিথ্যা কথা বলবেন না।প্রমাণ কোথায় দেখান আগে।একজন মৃত মানুষের নামে মিথ্যা অভিযোগ দিতে আপনাদের লজ্জা করছে না?এর পেছনে কার হাত আছে বলেন?”

“এই মেয়ে আওয়াজ নিচে।চোরের মেয়ের বড় গলা।এতগুলো টাকা গি লে আবার বড় বড় কথা আসে কোথা থেকে?”

লোকটা নিজের কথা শেষ করার সাথে সাথেই নাকের উপর ভারি কিছু অনুভব করে।চোখে মুখে ঝাপসা দেখতে থাকে।নাক দিয়ে তরল র ক্ত গড়িয়ে পড়ে।হৃদিতের হাত তখনও মুষ্টি বদ্ধ করা।গর্জে উঠে বলে,

“এ্যাই চোখ আর আওয়াজ নিচে।নাহলে চোখগুলো তুলে লুডু খেলবো আমি।শি ইজ মাই ওয়াইফ।তোর সাহস কী করে হয় ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে উঁচু গলায় কথা বলার?ইয়্যু ব্লাডি বিচ।ওর দিকে কারোর তাকানোর সাহস নেই আর তুই!”

কথাটা বলে নাকের উপর আবারও পাঞ্চ মারতে নিলে মেহরিমা হৃদিতকে আটকায়।বেচারা নাকের যন্ত্রণায় ছটফটাতে থাকে। তবুও জোর দেখিয়ে বলে,

“এই তুই কে?তোর সাহস কী…”

লোকটাকে নিজের কথা শেষ করতে না দিয়েই হৃদিত আগের থেকে দ্বিগুণ গর্জে বলে,

“গেট আউট অফ হেয়ার ইন ফাইভ সেকেন্ডস। পাঁচ সেকেন্ডের এক সেকেন্ডও বেশি দাঁড়ালে আই সোয়্যার একটাও বেঁচে ফিরতে পারবি না।”

হৃদিতের ভ য়ং ক র কন্ঠস্বরের সাথে হিং স্র মুখমণ্ডল লক্ষ্য করতেই ওনারা তিনজন ভয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান।মেহরিমা সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। মাধবীর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।অবনী শেখ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।হৃদিতের এই রুপ দেখে উনি শিহরিত!হৃদিত মেহরিমার দিকে এক পলক তাকায়।কয়েকবার জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে।

“ব্রেকফাস্ট পুরোটা শেষ চাই।তারপর যা মন চায় করিস।বাবাই সোনাকে একটুও কষ্ট দিলে তোর অবস্থাও খারাপ হবে।”

কথাগুলো বলেই গটগট পায়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় হৃদিত।মেহরিমা বুঝতে পারে বড় ঝড় আসতে চলেছে।

____

চৌধুরী বাড়িতে ইতোমধ্যে সকালের নাস্তার পর্ব শেষ হয়েছে।বাড়ির পুরুষেরা ড্রয়িং রুমে বসে আছে। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে।বাড়ির মহিলারা রান্না ঘরে নিজেদের হাতের কাজ সারছে।হৃদিত হনহনিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে।মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে আছে। নীল মণির চোখজোড়া লাল হয়ে ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে।শানিত চোয়াল আরও তীক্ষ্ণ দেখাচ্ছে।হৃদিত হাঁটতে হাঁটতেই টেবিল থেকে ফ্লাওয়ার ভেজ উঠিয়ে নেয়।অতঃপর এগিয়ে এসে সোফায় বসা আব্রাহাম তালুকদারের মাথার উপর ভেজ দিয়ে জোরে আঘাত করে।সাথে সাথে বিকট শব্দে ভেজটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়।আব্রাহাম তালুকদারের করুণ আর্তনাদে বাড়ির সকলে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়।আরিফ চৌধুরী, আজাদ চৌধুরী,আয়াশ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে!কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারে না।আয়রা চৌধুরী হায় হায় করতে করতে দৌড়ে স্বামীর কাছে আসেন।পুরো মাথা র ক্তা ক্ত হয়ে গেছে।

“এই জানোয়ারকে আমি আজ মেরেই ফেলবো।ওর সাহস কি করে হয় বাবাকে মিথ্যা জালে ফাঁসানোর?আই সোয়্যার তুই যদি টাকাগুলো কোম্পানিতে জমা দিয়ে নিজের ভুল স্বীকার না করিস তাহলে তোকে আমি নিজে হাতে পু ত বো বা স্টা র্ড।”

কথাটা বলে মারার জন্য সামনে অগ্রসর হতে নিলেই আয়াশ পথ আটকায়।

“কী হয়েছে?খুলে বল?”

“তোমরা নিজেদের মধ্যে কথা পরে বইলো আগে ওনাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে চলো। আমার কি বড় ক্ষতি হয়ে গেল আল্লাহ!”

আয়রা চৌধুরীর আহাজারি যেন শুনেও শোনে না হৃদিত।

“এখানেই থাকবে এই জা নো য়া র।যে এক পা এগোবে তার খবর আছে।আর একটা কথা সবাই কান খুলে শুনে রাখুন শেখ পরিবারের দিকে হাত বাড়ালে তার হাত আমি ভে ঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবো।এই বাড়ির বাকি দুটো পুরুষের মতো কাপুরুষ নই আমি।ওইসব পুলিশ বা ল ছাল দেখে ভয় পাই না আমি।”

ব্যস আর কেউ ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়ার সাহস পায় না। আব্রাহাম তালুকদার ব্যথায় কাতরাতে থাকে।আয়রা চৌধুরী মরা কান্না জুড়ে দেয়।আরিশা ভয়ে ভয়ে কেটে পড়তে নিলেই হৃদিত হুংকার দিয়ে ওঠে।

“এই তুই কোথায় যাচ্ছিস?সবসময় আমাদের ফলো করে,আমার বউয়ের কাছে চিরকুট দিয়ে নিজেকে খুব জ্ঞানী ভাবিস?অন্যের চামচামি আর কত করবি?নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর মিথ্যা ইস্যু নিয়ে তোর মতো বস্তির মেয়েরাই হাসবেন্ড কে নিয়ে খেলতে পারে আমার মেহরিমা না।সবাই কে তোর মতো নোং রা মস্তিষ্কের ভাবিস নাকি?আই ওয়ার্ন ইয়্যু ফর দ্য লাস্ট টাইম।স্টে এওয়ে ফ্রম হার।এরপর থেকে কিন্তু আমার হাত চলবে,মুখ না।”

হৃদিতের কথায় আরিশা হতবাক হয়ে যায়!নিজের উদ্দেশ্যের কথা হৃদিত কিভাবে জানলো?এটা তো আয়াশ আর নিজের বাবা ছাড়া কেউ জানে না।প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সাথে এক বুক ভয় জন্মে।এক বছর আগে নিজের চোখে দেখা হৃদিতের সেই নৃ শং স হ ত্যা কা ণ্ড মানসপটে ভেসে ওঠে।হৃদিতের কথার মানে বুঝতে আয়াশের খুব একটা সময় লাগে না।যেটা ভেবেছিল ঠিক সেটাই ঘটিয়েছে আরিশা।আয়াশ রাগে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবার সামনে সজোরে থাপ্পড় মারে আরিশার গালে।বাড়ির সবাই হতভম্ব হয়ে যায়!আরিশার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।গালের থেকে যেন মনে বেশি ব্যথা পেয়েছে।গালে হাত দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!

“এই তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা।তোর কাছে আগামীকালকেই ডিভোর্স পেপার পৌঁছে যাবে।এখান থেকে দ্রুত সর।আই সোয়্যার আমার হাত দিয়ে কিন্তু আজ খারাপ কিছু ঘটে যাবে।”

আয়াশ রাগে থরথরিয়ে কাঁপছে।হৃদিত আরিশার দিকে তাকিয়ে সবার আড়ালে বাঁকা হাসে।যেই হাসির অর্থ আরিশার ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝতে ব্যর্থ।তবে ওর সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে এটা খুব করে বুঝতে পারে।আরিশা চোখে পানি নিয়ে রাগে হনহন করে নিজের রুমে চলে যায়।এতক্ষণ সবকিছু নিরব চোখে দেখলেও এবার আর চুপ থাকতে পারেন না আরিফ চৌধুরী।

“হৃদিত বাবা আমার,কী হয়েছে সবটা একটু ক্লিয়ারলি বলো?”

“আপনার বোন-জামাইয়ের থেকে সবটা ভালোভাবে শুনে নেবেন এমপি সাহেব।ওই জা নো য়া রে র হাতে জাস্ট দুইদিন সময় আছে।যদি দুইদিনে সবটা মিটমাট করে নিতে না পারে তাহলে ওর আর শান্তিতে থাকা হবে না।সারাজীবন জেলে পচিয়ে মারবো।এতো কাঁচা খেলোয়াড় হৃদিত চৌধুরী না।”

কথাগুলো বলে হৃদিত বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই চোখ যেয়ে পড়ে শ্রেয়া চৌধুরীর দিকে।হৃদিত এদফায় একটু নরম হয়।মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলে,

“আমি তো তোমার নিজের ছেলে মা।অন্যদের মতো তুমিও কেনো আমার ভালো থাকাটা সহ্য করতে পারছো না?পাপ করেছো তুমি আর বাবা।সেই পাপের শাস্তি আমাকে কেনো দিচ্ছো?আরিশাকে আর খারাপ বানিও না।এই পর্যন্তই থেমে যাও।নাহলে তোমার আর শেষ রক্ষা হবে না।ছোট্ট বেলায় আমাকে আমার এক ফ্রেন্ড বলেছিল ‘নো পাওয়ার ইজ গ্রেটার দ্যান আ মাদার প্রেয়ার।’ আমি কী এতোটাই অভাগা মা?যে তোমার দোয়াটাও আমার ভাগ্যে নেই।মেহরিমা,অবনী মায়ের তো কোনো দোষ নেই।সব দোষ তোমাদের।অবনী মা তো নিজের সব হারিয়েছে আর কী কেড়ে নিতে চাও ওনার থেকে?তোমার ছেলে বাইনোপোলার ডিসঅর্ডারে অ্যাফেক্টেড।আর তুমি কি না তোমার ছেলের অসুস্থতা নিয়ে তার সংসার ভাঙতে চাচ্ছো?মা তো কখনও এতোটা নির্দয় হতে পারে না!একজন সন্তানের কাছে শেষ আশ্রয়স্থল তার প্যারেন্টস।তাহলে আমার তো আর কোনো শেষ আশ্রয়স্থল রইল না মা।তুমি মানুষটা আমার কাছে এতোটা অপরিচিত হয়ে গেলে কেনো মা?তুমিও অন্যদের মতো আমায় বুঝলে না।তাহলে আমায় বুঝবে টা কে?আমি কি এতোটাই কঠিন মানুষ মা?কেউ আমায় কেনো বোঝে না? দিনশেষে আমিও একজন মানুষ মা।আমি বাবা হতে চলেছি মা।আমি একজন ভালো বাবা হতে চাই।একটা সুন্দর জীবন চাই।আমাকে একটু শান্তি দেও মা।নিজের নোং রা খেলা বন্ধ করো।আমার মেহরিমার কিছু হয়ে গেলে আই সোয়্যার তোমাদের সবকিছু আমি জ্বালিয়ে ধ্বং স করে দেবো।মেহরিমা ছাড়া আমার কোনো পিছুটান নেই।ভাগ্যের কঠিন কাঠগড়ায় আমাকে দাড় করিও না।তোমার’ই ছেলে আমি।”

শীতল ভঙ্গুর কন্ঠস্বর হৃদিতের।শেষ কবে মায়ের সাথে এভাবে কথা বলেছিল হৃদিতের ঠিক মনে পড়ে না।সম্পর্কে ফাটল ধরেছে সে তো অনেক গুলো বছর হলো।পরিচর্যা ছাড়া সেই ফাটল প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।পরিচর্যা ছাড়া একটা গাছ ও ধীরে ধীরে মৃ ত্যু র দিকে ঢলে পড়ে।আর সেখানে এটা তো একটা সম্পর্ক!হৃদিত বাবার দিকে এক নজর তাকায়।বাবার ব্যথিত দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মিলে যায়।হৃদিত আর কিছু না বলে সদর দরজার দিকে তাকাতেই মেহরিমার মলিন মুখখানা দেখতে পায়।মেহরিমার পাশেই মাধবী দাঁড়িয়ে আছে।হৃদিত হতাশার শ্বাস ফেলে।মেহরিমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এলোমেলো পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।ছেলের এক বুক আর্তনাদ মেশানো কথাগুলোতে শ্রেয়া চৌধুরীর বুকটা ভার হয়ে ওঠে।ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে যান।কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পুরো বাড়িটা অগোছালো হয়ে যায়।চৌধুরী বাড়ির একটা সদস্যও আজ পর্যন্ত হৃদিতকে এতোটা নরম হতে দেখেনি।তবে কী ছেলেটা ভেতর থেকে একদম ভে ঙে চু র মা র হয়ে গেছে!নিজেদের মস্তিষ্ক সচল করতে কয়েক মিনিট সময় লেগে যায় সকলের।আর সময় নষ্ট না করে আয়রা চৌধুরী এবং আজাদ চৌধুরী দু’জনে মিলে দ্রুত আব্রাহাম তালুকদারকে হসপিটালের উদ্দেশ্যে নিয়ে চলে যায়।সাথে অবশ্য অলিভিয়া,অ্যামেলিয়াও যায়।আরিফ চৌধুরী শান্ত চোখে সবটা শুধু দেখতেই থাকেন।নিজের করা একটা ভুলের জন্য আজ সবশেষ।এই জন্যই হয়তোবা মানুষ বলে, ‘ভুল মানুষকে বিশ্বাস করলে আজীবন পস্তাতে হয়।’ এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন আরিফ চৌধুরী।

#চলবে

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-৩১+৩২

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩১. [রহস্যের খন্ডাংশ.২]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

মাঝে কেটে গেছে দুটো দিন।শেখ বাড়ির পরিবেশ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক।আত্মীয়-স্বজন সবাই নিজের নীড়ে ফিরে গেছে।ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া অবনী শেখ হঠাৎ করেই আগের রুপে ফিরে এসেছেন।গ্রামের মানুষ এটা নিয়েও কম কানাঘুষা করেনি।এমনকি এখনও করে চলেছে।অবনী শেখের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।দুটো সন্তান বুকে নিয়ে তিনি তার নিজের জগতে আছেন।মেয়ে দুটো তার একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে সেই নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই।

আজ সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বর্ষণ শুরু হয়েছে।সাথে মৃদু বাতাস বইছে।দুপুরের দিকে অম্বরে সূর্যের দেখা মিললেও বিকাল থেকে আগের মতোই বর্ষণ নেমেছে ধরনীর বুকে।এখন সন্ধ্যাবেলা।মেহরিমা মাগরিবের নামাজ আদায় করে বিছানায় শুয়ে আছে।শরীর টা আজ একটু বেশিই খারাপ লাগছে।গত পরশুদিন ডাক্তার কনফার্ম করেছেন মেহরিমা কনসিভ করেছে থ্রি উইক।এজন্য অবশ্য মেহরিমার এক্সট্রা কেয়ার নেওয়া হচ্ছে।এই কয়দিনে হৃদিত মেহরিমার পাশে থেকে একটুও নড়েনি।কুট্টুস পাখির আগমনের খুশিটা ঠিকমতো কেউই উপভোগ করতে পারেনি।হৃদিত একটা ট্রে তে বেদানার জুস আর ফল কেটে নিয়ে আসে।মেহরিমাকে শুয়ে থাকতে দেখে খাটের নিকট এগিয়ে আসে।আলতো করে কপালে হাত রাখতেই মেহরিমা চোখজোড়া খুলে তাকায়।দৃষ্টি উদাসীন।মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে।মেহরিমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে হৃদিত।

“শরীর খারাপ লাগছে জান?”

“উহু।”

“তাহলে?”

“ভালো লাগছে না।”

“সব ঠিক হয়ে যাবে অ্যানাবেলা।শুধু সময়ের অপেক্ষা।একটু কষ্ট করে উঠে এগুলো খেয়ে নে।”

মেহরিমা জানে ও না বললেও হৃদিত ওকে খাইয়েই ছাড়বে।তাই কোনো তাল বাহানা না করে উঠে বসে।হৃদিত যত্ন সহকারে ওকে খাইয়ে দিতে থাকে।মেহরিমা খেতে খেতেই বলে,

“ভালোবাসেন আমায়?”

“প্রমাণ লাগবে?”

“চাইলে দিবেন?”

“প্রাণ টা চাইলেও হাসতে হাসতে দিয়ে দেবো।”

“আপনার প্রাণ চাইলে আমি আর কুট্টুস পাখি কাকে নিয়ে থাকবো?ছোট্ট একটা প্রমাণ চাই। দিবেন তো?”

“হুম।”

“বাবা মায়ের সাথে আর কখনও খারাপ ব্যবহার করিয়েন না কেমন?”

হৃদিত কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায়।পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।মেহরিমা সন্তুষ্ট হয়।বাবা-মা যে কতটা মধুর জিনিস এখন খুব করে বুঝতে পারছে মেহরিমা।বাবা-মা ছাড়া জীবন টা বড়ই বেরঙিন।
______

সময় রাত এগারোটা টা বেজে পনেরো মিনিট।অবনী শেখ দুই মেয়েকে দুহাতে জড়িয়ে ব্যলকনিতে বসে আছেন।আকাশে মেঘ গর্জন করে চলেছে।মেহরিমা চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছে।মাধবীর দৃষ্টি বাইরে।মেহরিমা চোখজোড়া বুজেই বলে,

“মা আমাদের সাথে এমনটা কেন হলো?”

“আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।”

“বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।বাবারও নিশ্চয় ওখানে একা থাকতে কষ্ট হচ্ছে।”

“ওটাই আমাদের আসল আর শেষ ঠিকানা। ওখানে সবাইকেই যেতে হবে।”

মায়ের কথায় মেহরিমা গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে যায়।মাধবী নিরবে সবটা শুনতে থাকে। কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।

“আজ তোদের আমার আর আপার জীবনের গল্পগুলো শোনাবো।এই সমাজের কাছে হেরে যাওয়া অসহায় এক মেয়ের গল্প শুনবি তোরা?”

“বলো মা।”

মেহরিমার কথায় মলিন হেসে অবনী শেখ বলতে শুরু করেন।

“আমি আর হৃদিতের ফুপি আয়রা চৌধুরী ছিলাম বেস্ট ফ্রেন্ড। তোদের বাবা বলেছিল না একবার ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম আমি।তারপর হঠাৎ একদিন ও আমার সাথে কথা বলতে আসে।সেদিন থেকেই ওর সাথে আমার ভাব জমে যাই।আয়রার সাথে মাঝে মাঝেই চৌধুরী বাড়িতে যাওয়া হতো আমার।আমার সাথে একদিন আপাও চৌধুরী বাড়িতে যান।তার একমাস পরে তোদের নানুর কাছে আপার হাত চায় আয়রার বাবা হান্নান চৌধুরী ওনার তৃতীয় পুত্র আয়মান চৌধুরীর জন্য। আপাকে দেখে আয়মান চৌধুরীর নাকি খুব পছন্দ হয়েছে।কখন কিভাবে আপাকে দেখেছিল আপা নিজেও জানতো না।আমার আপা ছিল চোখ ধাঁধানো সুন্দরী।তোদের নানু তো এক পায়ে খাড়া আপাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য।প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।বাড়ির সবাই তোদের নানুর সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকলেও বিপক্ষে ছিল শুধু তোদের বাবা।তোদের বাবার সাথে যোগ দিয়ে তোদের দাদাও ঘাড় ত্যাড়ামো শুরু করে।কিন্তু বাবা সবার কথা অগ্রাহ্য করে ধুমধাম করে বিয়ে দেয় আপার।চৌধুরী বাড়ির বাকি তিন ছেলের তখনও বিয়ে হয়নি।বড় দুটো ভাই রেখে আয়মান চৌধুরী আগে বিয়ে করেন।আয়মান চৌধুরী দেখতে সুদর্শন ছিলেন অনেকটা হৃদিতের মতো।গ্রামের সকলের মুখে মুখে তখন এক কথা,’অতশীর রুপের মতো ওর ভাগ্যটাও সুন্দর।তাইতো এমন রাজপুত্রের মতো জামাই পেয়েছে।’ কিন্তু কে জানত ওই সুন্দর ভাগ্যের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক নির্মম পরিহাস!বিয়ের এক বছর পরেই আমরা সবাই জানতে পারি আয়মান চৌধুরীর দ্বিতীয় ওয়াইফ আপা।ওনার বউ বাচ্চা সব আছে।শহরে একটা বিয়ে করে বউ পালছেন।এটা উনি ছাড়া কেউ জানতো না।গ্রামে এসে আপাকে দেখে পছন্দ হয়ে যাওয়ায় বিয়ে করে ফেলেছেন।আপা ছিল নরম মনের মানুষ।সবটা জেনে খুব ভে ঙে পড়ে তখন।হান্নান চৌধুরী নিজের ছেলের কর্মে লজ্জিত হয়ে বারবার ক্ষমা চান আপার কাছে।সবাই মিলে আপাকে বোঝানো হয় তখন।আয়মান চৌধুরীও ক্ষমা চান আপার কাছে।কথা দেন আপাকে কখনও অবহেলা করবেন না।আপাকে তার ন্যায্য অধিকার দেবে।আপাকে শহরে নিয়ে যায় নিজের সাথে।অল্পতেই খুশি হওয়া মেয়েটা সবটা মেনে নিয়ে নিজের সংসারে মনোযোগ দেয়।তারপর সব ঠিকঠাক।তার ছয়মাস পরে হঠাৎ একদিন জানা যায় আয়মান চৌধুরী ড্রা গ অ্যাডিক্টেড।এটা তোদের বাবা জানতো বলেই বিয়েতে ঘাড় বেঁকিয়ে বসেছিল।তোদের নানুকে সবটা জানিয়েছিল।কিন্তু বিশ্বাস করেনি।আপাকে শহরে নিয়ে যেয়ে রিতিমত মারধর করতো ওই জা নো য়া র।আমার নরম আপা ছয়টা মাস দিনের পর দিন সব মুখ বুঁজে সহ্য করে গেছে। নিজের ছেলের এই অধঃপতনে ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন হান্নান চৌধুরী।নিজে দায়িত্ব নিয়ে ঠিকভাবে আপাকে আমাদের বাসায় দিয়ে যান।আপা তখন তিন মাসের গর্ভবতী।নিজের ছেলের সব কীর্তি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য গ্রামে ছড়িয়ে দেন আপা গর্ভবতী বলে এখানেই থাকবেন।ওনার ছেলের কাজের ব্যস্ততা অনেক তাই মাঝে মাঝে গ্রামে এসে দেখে যাবেন আপাকে।গ্রামের মানুষ তখন ভেতরের খবর কিছুই জানতো না।সহজেই সবটা বিশ্বাস করে নেয়।আপার শরীরে তখনও মারের দাগ স্পষ্ট।আপা পর্দা করতো বিধায় সেগুলো কখনো কারোর চোখে পড়েনি।”

একাধারে কথাগুলো বলে অবনী শেখ থামেন।মেহরিমা,মাধবী মায়ের মুখের দিকে উচ্ছুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।অবনী শেখ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলা শুরু করেন।

“মাঝে কেটেছে চার মাস।আপা তখন সাত মাসের গর্ভবতী।আয়মান চৌধুরী একদিনের জন্যও আপার খোঁজ নেয় নি।গ্রামে শুরু হয় আপাকে নিয়ে নানা ধরনের কানাঘুষা।একসময় দেখা যায় আপাকে দেখলেই সবাই মুখ কালো করে ফেলতো। ঠিকমতো কথা বলতো না।সবার ধারণা আপার চরিত্রের সমস্যা।বাচ্চা টা অন্যজনের বলে আয়মান চৌধুরী আপার খোঁজ খবর নেয় না।আপা নিজেও সবটা বুঝতে পেরে নিজেকে ঘরবন্দি করে নেয়।আমি মা জোর করেও ঠিক মতো আপাকে খাওয়াতে পারতাম না।আমি আপার বিষয় নিয়ে বাবার সাথে কথা বলি।বাবা সেদিন কঠিন এক সত্য জানায় আমাকে।আপা নাকি বাবার নিজের মেয়ে না।শহরে ব্যবসার কাজ শেষ করে রাতে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামের মাঠের মধ্যে আপাকে পেয়েছিল বাবা।এই কথা শুনে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়।বাবা সাথে এটাও জানান আপাকে নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এভাবেই চলছে চলুক।স্বামী ছাড়া মেয়েদের জীবনের কোনো দাম নেই।তাই উনি ডিভোর্সের পক্ষে না।সেদিন বাবার উপর চাপা অভিমান জন্মে আমার।সবথেকে কষ্ট পেয়েছিলাম তখন,যখন দেখেছিলাম আমার আপা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।সেই দৃষ্টিতে কি নিদারুণ যন্ত্রণা!তারপর থেকে আমার আপা আরো চুপ হয়ে যায়।একদিন হঠাৎ করেই আপা হারিয়ে যান।কোথায় চলে যান আমরা কেউ জানি না।কোথাও খুঁজে পাই না আপাকে।আপা আর কখনও ফিরে আসেনি।আপা আমাকে একটা চিঠি লিখে যান।আপা আমাকে ভালোবেসে শিউলিফুল ডাকতো।আমাকে নাকি আপার কাছে শিউলি ফুলের মতো লাগতো।আমি নাকি শিউলি ফুলের মতো সুবাস ছড়ায় সবখানে।”

কথাগুলো বলে অবনী শেখ এলোমেলো ভাবে উঠে দাঁড়ান।ঘরের মধ্যে যেয়ে পুরনো একটা কাগজ নিয়ে ফিরে আসেন।মেয়েদের মাঝে কিছুক্ষণ থ মেরে বসে থাকেন।অতঃপর ধীরে ধীরে কাগজটা পড়ে শোনাতে শুরু করেন।

প্রিয় শিউলি ফুল,

প্রাণের চেয়ে প্রিয় বোন আমার।এই পৃথিবীতে আমাকে নিয়ে ভাবার মতো একমাত্র তুই আছিস।তাই তোকেই আমার মনের কিছু কথা বলতে চাই। নাহলে হয়তো আর কোনোদিন বলা হবে না।মনের অতৃপ্তি নিয়েই হারিয়ে যেতে হবে আমাকে।জানিস শিউলিফুল আজ একটা জিনিস খুব করে অনুভব করলাম।মানুষের চেহারা সুন্দর হওয়ার চেয়ে ভাগ্য টা সুন্দর হওয়া খুব বেশি প্রয়োজন।এ কেমন ভাগ্য আমার!না পেলাম স্বামী সোহাগ আর না পেলাম বাবার ভালোবাসা।ওইদিন বাবার সামনে না পড়ে কোনো প্রাণীর সামনে পড়লেও তো পারতাম।আমাকে ছিঁড়ে ছুড়ে খেয়ে ফেলতো‌।তবুও এমন জাহান্নামের মতো জীবন তো পেতে হতো না।বাবার কোন দোষ নেই।দোষ আমার জন্মদাতা বাবা,মায়ের।সন্তান পালতে না পারলে নিয়েছিল কেনো? আচ্ছা শিউলিফুল আমি কারোর জা র জ সন্তান না তো?আল্লাহ!জানিস এটা ভাবতেই আমার বুক কাঁপছে,নিজের প্রতি ঘৃণা লাগছে।বাবা,মায়ের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ আমাকে ছোট থেকে আগলে বড় করার জন্য।পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য।তোর কাছে আমি চিরঋণী থাকবো।তোর মতো করে আমায় কেউ কখনো বুঝেনি শিউলিফুল।আল্লাহ যেন তোর মতো বোন সবাইকে দেয়।আর ছোটাছুটি করিস না লক্ষ্মী বোন আমার। যাকে তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছি তাকে ডিভোর্স দিতে পারবো না আমি।এতো কঠিন মন যে আমার না!তবে হ্যাঁ এই পৃথিবীর বুক থেকে নিজেকে হারানোর আগে তাকে তার পাপের শাস্তি দিয়ে যাবো আমি।ওকে আমি শেষ বারের মতো বলেছিলাম,’জীবন তো খুব একটা বড় না।ছোট্ট একটা জীবন। কাটিয়ে দেওনা আমার সাথে।এতে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে তোমার?’ওর উত্তর কি ছিল জানিস? বলেছিল,’তুমি আমার ক্ষণিকের মোহ ছিলে ভালোবাসা না।’ আচ্ছা ভালোবাসা কি খুব কঠিন জিনিস?আমি তো না চাইতেও ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাহলে ও কেন আমায় ভালোবাসতে পারলো না?ও চাইলে তো আমাদেরও সুন্দর একটা জীবন হতো।সুন্দর একটা সংসার হতো।কিন্তু ও তো চাইনি তাই কিছুই হয়নি।শিউলিফুল সবসময় মনে রাখবি,’প্রতিবাদ না করলেই অপবাদ বাড়বে।চুপ থাকা ভালো কিন্তু সবসময় না।’ আজ আমি চুপ আছি বলে সবাই আমার গর্ভের নিষ্পাপ বাচ্চাকে জা র জ বলতেও দু’বার ভাবছে না। তাহলে আমার বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসলে ওর কি হবে ভাবতে পারছিস? আমার শিউলিফুল তোর জন্য মন ঢালা দোয়া ও ভালোবাসা রইল।আল্লাহ যেন তোর জীবনে সত্যিকারের একজন রাজপুত্রকে পাঠায়।যে তোকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবে।আমার মতো ভাগ্য যেন তোর না হয়।তোর মতো ফুলেরা বাগানে মানায়।আর আমার মতো ফুলেরা আঁস্তাকুড়ে।

ইতি,
বড় আপা।

চিঠি খানা পড়া শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অবনী শেখ।মেহরিমা মাধবীর চোখে পানি।এ কেমন ভাগ্য একটা মেয়ের!

“আপা হারিয়ে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় আয়মান চৌধুরীর মৃত দেহ পাওয়া যায় ওনার নিজের বাড়িতেই।ওনার ওয়াইফ ওইদিন বাবার বাসায় ছিলেন।আয়মান চৌধুরীর লা শ গ্রামে এনে দাফনের কাজ সম্পন্ন করা হয়।দাফনের দিনে ওনার ওয়াইফও এসেছিলেন গ্রামে।আয়মান চৌধুরী মারা যাওয়ার দুই’দিন পর আপার লাশ পাওয়া যায় এই বিষ্ণু নদীতে।আমার আপা সাঁতার জানতো না।”

অবনী শেখ এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।সময় নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে কয়েক বার টানা নিঃশ্বাস ফেলেন।মা’কে এই দিয়ে দুইবার এভাবে কাঁদতে দেখে মেহরিমা,মাধবী।খালামনিকে মা কতোটা ভালোবাসে সহজেই বুঝে যায়।খালামনিকে নিজের চোখে না দেখলেও বুকে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হয় দু’জনের।

“আপার মৃত্যুতে গ্রামের সবাই কমবেশি শোকাহত হয়।হান্নান শেখ নিজেই নিজের ছেলে কৃতকর্ম প্রকাশ করে প্রকাশ্যে সবার নিকট ক্ষমা চান। আপাকে নির্দোষ প্রমাণ করেন।কিন্তু তাতে কি আমার আপাকে আমি ফিরে পেয়েছি?পাইনি তো।এটা আগে করলে হয়তো আমার আপা বেঁচে থাকতো।বাবার উপর চাপা অভিমান নিয়ে আমি একাই আপার ডিভোর্স পেপার রেডি করার জন্য ছোটাছুটি করতে থাকি সেই সময়।তখন আমাকে সাহায্য করেছিলেন চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে আরিফ হাসান চৌধুরী।বয়সের ব্যবধান থাকলেও আমরা দু’জন বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। দু’জনেই আদরের ভাই বোন হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলাম।আয়মান কে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই ভালো বাসতেন আরিফ চৌধুরী।এতকিছুর পরেও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট ছিল।ঢাবিতে পরিক্ষা দিতে যেতে আমাদের আরিফ চৌধুরীই সাহায্য করেছিলেন।ওনার বর্তমান ওয়াইফ শ্রেয়া চৌধুরীর মেসে থেকে আমি পরিক্ষা দিয়েছিলাম।বাবা ছিলেন আরিফ চৌধুরীর মেসে।তারপর এভাবে আরও সাত আট মাস কেটে যায়। হঠাৎ একদিন আরিফ চৌধুরী নিজে প্রস্তাব রাখেন বাবার কাছে। আমাকে নাকি বিয়ে করতে চান।বাবা আমার মতামত জানতে চাইলে আমি হ্যাঁ বলে দিই। আপার সাথে এতকিছু ঘটার পরেও কেনো যেন আরিফ চৌধুরীকে আমি ঘৃণা করতে পারতাম না।আমার মনে হতো হাতের পাঁচটা আঙুল তো সমান হয় না। উনি বন্ধু হিসেবে যেমন অমায়িক,হাসবেন্ড হিসেবেও নিশ্চয় তেমনই হবেন।বিয়ের দিন,তারিখ ঠিক হয়ে যায়। নির্দিষ্ট দিনে আমিও আর পাঁচটা মেয়ের মত একটা সুন্দর সংসারের আশায় বউ সাজি।কিন্তু বিয়ের দিন আরিফ চৌধুরী কোথায় যেন চলে যান।আমার স্বপ্ন আর পূরণ হয়না।গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে অবনীর চরিত্রে সমস্যা।তাই ওকে বিয়ে করার ভয়ে বর পালিয়েছে।আমার মতো চ রি ত্র হী ন মেয়েকে নাকি কেউ কখনও বিয়েই করবে না।অথচ ওনারা জানতো না আমি ছিলাম কারোর স্বপ্নের শখের নারী।ওই অবস্থায় আমি একদম ভেঙে পড়ি।আমার বারবার মনে হতে থাকে বোধহয় আপার মতোই কিছু হতে চলেছে আমার সাথেও!আমার বিয়ে পাকাপোক্ত হওয়ার দিনই তোদের দাদা তোদের বাবাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।তখন চিঠি যেতে সপ্তাহ খানেক সময় তো লাগতোই। তোদের বাবা আমার বিয়ের খবর পেয়ে ছুটে আসেন।আমাকে বিয়ে করে ক ল ঙ্কে র হাত থেকে রক্ষা করেন।তিনমাস পর আরিফ চৌধুরী বউসহ গ্রামে আসলে হান্নান চৌধুরী গ্রামের মোড় থেকেই ওনাকে তাড়িয়ে দেন।বাড়িতে পা টাও রাখতে দেন না।তারপর আরিফ চৌধুরী আর কখনও গ্রামে আসেননি।”

“উনি তোমার সাথে প্রতারণা করে শ্রেয়া চৌধুরী কে কেনো বিয়ে করেছিলেন মা?”

মেহরিমার কন্ঠে ক্রোধ স্পষ্ট। মেয়ের কথায় অবনী শেখ মুচকি হাসেন।

“সেটা যে করেছে সেই ভালো জানবে মা ।যাই হোক একটা কথা কি জানিস মা?আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।তুই কিছু বছর পর পিছু ফিরে তাকাবি।দেখবি তোর সাথে যা যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।আমার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই।তোর বাবার মতো কখনো কেউ হতে পারবে না।ওকে পেয়ে আমি পরিপূর্ণ ছিলাম।আমার আর কিছু চাওয়ার ছিল না জীবনে।”

“তোমার প্রথম ভালোবাসা কি তবে আরিফ চৌধুরী ছিলেন মা?”

মাধবীর কথায় অবনী শেখ হেসে ওঠেন।

“আমার পাগলি মেয়ে তা কেনো হতে যাবে? আরিফ চৌধুরী কেবল আমার একজন ভালো বন্ধুই ছিলেন।ওনার জন্য কখনো ওমন কোনোকিছু অনুভব করিনি আমি।শুধু প্রতারণার স্বীকার হয়েছিলাম বলে তোর বাবাকে ভালোবাসতে একটু সময় লেগে গেছিল।এই যা তাছাড়া ওমন কিছু না। আমার প্রথম ভালোবাসা তোর বাবা।”

মায়ের কথাগুলো শুনে মেহরিমা নিজের ভাবনার জগতে চলে যায়।কি এতো ভাবছে?মন,মস্তিষ্কে কি চলছে কে জানে?হয়তো ওর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়!মুখে বলে,

“মা এই জন্যই কি উনি ওনার পরিবারের কাউকে সহ্য করতে পারেন না?”

“হৃদিতের কথা বলছিস?”

“হুম।”

“হয়তোবা।তোর বাবার মৃত্যু হার্ট অ্যাটাকে হয়েছে জানিস?”

“কিহ্!বাবার না অপারেশন করা হলো মা?”

“হ্যাঁ।তোর বাবা অতিরিক্ত টেনশড ছিল বিজনেস নিয়ে।তাই দ্বিতীয় বার বড়সড় হার্ট অ্যাটাক হয় ওর।হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ওর পালস রেট কমে আসে।পাঁচ মিনিট পর নার্স এসে বলে তোর বাবা আর নেই।”

“বাবা বিজনেস নিয়ে টেনশড ছিল তুমি আমাকে আগে জানাও নি কেন মা?”

“আমিই গতকাল জেনেছি তোর বাবার ডায়েরি পড়ে।রিজন টা কি ছিল সেটা তুইও সময় হলে জানতে পারবি।শুধু এতটুকুই বলবো ওই চৌধুরী বাড়ির পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে।তোকে শক্ত থেকে সবটা মোকাবেলা করতে হবে নীলাক্ষী।”

“আই সোয়্যার মা।বাবার মৃত্যুর পিছনে যদি চৌধুরী বাড়ির কারোর হাত থাকে।তাকে আমি নিজে হাতে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করাবো।এমনিতেও আমার সহজ সরল খালামনিকে বাঁচতে দেয়নি ওরা।তোমাকে কষ্ট দিয়েছে ওরা।আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি সবটা বলোনি মা।কোথাও একটা কিন্তু রেখে দিয়েছো!”

মেহরিমার চোখে মুখে আলাদা তেজ ফুটে উঠেছে।অবনী শেখ মুগ্ধ চোখে নিজের মেয়েকে দেখেন।এ যেন ওনারই প্রতিচ্ছবি।অবনী শেখের কথাগুলো শুনে দরজার নিকট দাঁড়ানো হৃদিত কিছুক্ষণের জন্য থমকায়।তবে কি ওর ধারণায় সঠিক!যেটা ভেবেছিল ঠিক সেটাই হয়েছে!নিজের পাপের শা স্তি এবার সবাইকেই পেতে হবে।হৃদিত নিজে হাতে দেবে শা স্তি।

#চলবে

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩২ [১১১+ এলার্ট]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

অমানিশা নিজের মুখ লুকিয়েছে ধরনীর বুকে। জ্যোতির দেখা মিলেছে।নতুন একটা দিনের সূচনা।চারিপাশে কুয়াশার ধূম্রজাল।শেখ বাড়ির আঙ্গিনা শিউলি ফুলের সুগন্ধে ম-ম করছে।বাড়ির উঠান শিউলির সাজে সেজেছে।ভূমি ধূসর রুপ ধারণ করেছে।চোখ ধাঁধানো সুন্দর এক সকালের আগমন!কুয়াশার ধূম্রজাল চিরে পূর্ব আকাশে দিবাকর নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে ব্যস্ত।

জলিল শেখের মৃত্যুর আজ চারদিন।গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ফিল্ডে বড় করে মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে।শহর থেকে বড় মাওলানা আনা হচ্ছে।চৌধুরী বাড়ির পুরুষেরা সকাল থেকে সেখানেই নজরদারি করে চলেছে। মিলাদের রান্নার আয়োজন হচ্ছে সেখানেই।মিলাদ শুরু হবে মাগরিবের নামাজ পরে।মেহরিমার চাচারা জলিল শেখের লা শ মাটি দিয়ে আসার পরে আর শেখ বাড়ি মুখো হয়নি।মামা,মামি এসেছে আজ সকালে।মামাও অবশ্য স্কুলের ফিল্ডেই আছে তদারকির কাজে।মেহরিমার একটা মামাতো ভাই আছে।সে ঢাকা সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত।ছুটি না পাওয়ায় একমাত্র ফুফাকেও শেষ বারের মতো দেখতে আসতে পারেনি।

সময় দুপুর বেলা।মেহরিমা দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় বসে আছে।বেশ রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন। রোদের তাপ ইতোমধ্যে সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়েছে।বেলা এগারোটা নাগাদ চৌধুরী বাড়ির সকলে শেখ বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে।ঘর্মাক্ত অবস্থায় তড়িঘড়ি করে রুমে আসে হৃদিত।টাওয়াল নিতে যেয়ে মেহরিমাকে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে চোখ দুটো ছোট ছোট করে মেহরিমার দিকে তাকায়।

“কী হয়েছে আমার মহারানীর?গাল দুটো এভাবে টমেটোর মতো করে রেখেছে কেনো?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা কোনো প্রত্যুত্তর করে না। চুপচাপ বসে থাকে। হঠাৎ মেহরিমার এহেন ব্যাবহারের কারণ হৃদিতের মাথার তিন হাত উপর দিয়ে যায়।এগিয়ে আসে সামনে।মেহরিমার গালে হাত রেখে কিছু বলতে নিলেই মেহরিমা ছ্যাত করে ওঠে।

“আমাকে ছুবেন না একদম।দূরে থাকুন আমার থেকে।”

মেহরিমার কথায় হৃদিতের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হয়।ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে,

“কেনো?আমি আবার কি করলাম?”

“জানি না।”

“মহা মুশকিল!না বললে জানবো কিভাবে?”

“বলবো না।”

“কেন বলবি না?”

“আমার ইচ্ছা।”

“আজব!হঠাৎ এমন বিহেভ কেনো করছিস জান?টেল মি দ্য রিজন।”

“এইসব জান,টান আমায় ডাকবেন না।আপনার তো এইসব ডাকার জন্য অনেক মানুষ আছে।তাদের গিয়ে ডাকেন যান।”

“কে আছে?”

“কে আবার?আপনার ওই শাকচুন্নী ফুফাতো বোন অলিভিয়া।”

“অলিভিয়া কি কিছু করেছে তোর সাথে?”

“আমার সাথে আবার কী করবে?যা করার আপনার সাথে করেছে।আপনাকে গি লে খেয়েছে।”

মেহরিমার আজগুবি কথায় হৃদিতের মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে।নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,

“জান আর ইয়্যু ওকে?আমাকে গি লে খেলে আমি এখানে কি করে থাকবো?এতক্ষণে তো ওর পেটের মধ্যে থাকার কথা ছিল তাই না?”

“আরে এই গি লে খাওয়া সেই গি লে খাওয়া না।এটা হচ্ছে চোখ দিয়ে গি লে খাওয়া।তখন আপনার দিকে কিভাবে তাকিয়ে ছিল!এখন থেকে আপনার কপালে কালো টিকা দিয়ে রাখবো।সুদর্শন জামাই পাওয়ার এই এক জ্বালা বাপু।”

“আর ইয়্যু জেলাস অ্যানাবেলা?”

“জামাই আমার তাহলে আমি জেলাস হবো না তো অন্য কেউ হবে?”

“এখন কী করতে মন চাইছে?”

“ওই শা ক চু ন্নী কে পানিতে চোবাতে।চোখ দুটো তুলে লুডু খেলতে।কত বড় সাহস আমার জামাইয়ের দিকে ওভাবে তাকায়।”

“আর তাকাবেনা।”

“সত্যিই তো?”

“তিন সত্যি।”

কথাটা বলে মেহরিমার কপালে আলতো করে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায় হৃদিত।মেহরিমা মুচকি হেসে বিছানায় মাথা এলিয়ে দেয়।মিনিট দুয়েক পর গায়ে কিছুর টোকা অনুভব করতেই মেহরিমা চোখজোড়া মেলে তাকায়।কোলের উপরে একটা কাগজের টুকরো দেখতেই মেহরিমার কপালে ভাঁজ পড়ে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায় না।কাগজ মেলে দেখে ছোট্ট একটা বার্তা লেখা।

‘তুমি বড্ড বোকা মেয়ে।অলিভিয়াকে তুমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছো।এবার ওকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।তোমার করা একটা ভুলের জন্য আজ অন্য কারোর জীবন সংকটে।”

মেহরিমা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চিরকুট টার দিকে তাকিয়ে থাকে।চিরকুটে লেখা কথাটার অর্থ মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতেই মেহরিমার বুক কেঁপে ওঠে।সেই প্রথম দিনের চিরকুটের মতোই লেখাটা।চিরকুটদাতা তাহলে একজনই।এর মানে সেই মানুষটা সবসময় ওদের উপর নজর রাখছে। চিরকুটদাতা যে কাছের কেউ সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে মেহরিমা।নাহলে এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নজর রাখা বাইরের কারোর পক্ষে সম্ভব না।মেহরিমার সন্দেহের তীর যেয়ে পড়ে খুব কাছের একজনের উপর।মেহরিমা শিওর এই চিরকুটদাতাকে ধরতে পারলে চৌধুরী বাড়ির রহস্যের গভীরে যাওয়া যাবে।মনে মনে পণ করে চিরকুটদাতাকে খুঁজে বের করেই ছাড়বে।আর এ কাজে সাহায্য করতে পারে একমাত্র হৃদিত। নিজের ভাবনায় ইতি টেনে মেহরিমা কাগজ টা আলমিরাতে লুকিয়ে রেখে রুমের বাইরে চলে আসে।তৎক্ষণাৎ জানালার নিকট থেকে একটা মানব ছায়া সরে যায়।

_____

সময় সন্ধ্যাবেলা।গ্রামের প্রায় সবাই মিলাদে এসেছে।মহিলা,পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।ইতোমধ্যে চৌধুরী ও শেখ বাড়ির সকলে ফিল্ডে উপস্থিত হয়েছে।হৃদিত মেহরিমাকে যত্ন করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়।গায়ে পরিধান করা গরম কাপড়ের উপর সুন্দর করে একটা শাল জড়িয়ে দেয়।

“বাইরে খুব ঠান্ডা।তোকে নিষেধ করলাম তবুও এসেই ছাড়লি।সাবধানে থাকবি।খোলা যায়গায় আর নিচে বসবি না।চেয়ারে বসবি।মহিলাদের ওইদিকে তো আমি যেতে পারবো না।নাহলে আমার সাথেই রাখতাম তোকে।আচ্ছা এখান থেকে তো সবটাই শোনা যাচ্ছে।ইভেন দেখাও যাচ্ছে।আমি একটা চেয়ার এনে দেই।এখানেই বসে শোন। তাহলে আমিও তোর পাশে থাকতে পারবো।”

হৃদিতের বাচ্চামো কথাবার্তায় সকলে ঠোঁট টিপে হাসে।আতিয়া চৌধুরী বলেন,

“তোর বউকে যত্ন করার জন্য তোর মায়েরা আছে বাবা।এতো চিন্তা কিসের?বউ তো আর হারিয়ে যাচ্ছে না।এইতো কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার।এতটুকু সময় একা থাকতে পারবি না?আর ওর ঠান্ডা লাগবে টা কিভাবে?শরীরের মধ্যে মুখটা ছাড়া আর কোনো যায়গা কি ফাঁকা আছে?হাতে পায়েও মোজা পরিয়ে এনেছিস।”

আতিয়া চৌধুরী নিজের কথা শেষ করে হৃদিত কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেহরিমার হাত ধরে গটগট করে সামনে এগিয়ে যায়।মেহরিমার যাওয়ার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে হৃদিত।মেহরিমা একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে হৃদিত কে আশ্বাস দেয় ও নিজের খেয়াল রাখবে। তবুও হৃদিতের মন মানে না।ভেবে রাখে আগামীকালকেই আবার ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে অ্যানাবেলাকে।

মিলাদ শেষ হয় রাত নয়টায়।মিলাদের সকল কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যায়।শেখ বাড়িতেই রাতের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।হৃদিত ফ্রেশ হয়ে এসে ক্লান্ত শরীর টা সোফায় এলিয়ে দিয়েছে।ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায় সাথে অতিরিক্ত মাথা যন্ত্রণার ফলে চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে।মেহরিমা নিজের ঘরে আছে।ফ্রেশ হচ্ছে।অলিভিয়া এসে হৃদিতের পাশেই গাঁ ঘেঁষে বসে পড়ে।

“মাথা যন্ত্রণা করছে তোমার?টিপে দেবো?”

হৃদিত নিজের রক্তের ন্যায় লাল চক্ষুজোড়া মেলে তাকায়।অলিভিয়ার শরীর ভয়ে শিউরে ওঠে।সাথে সাথে লাফিয়ে দুই হাত দূরে গিয়ে বসে।

“তুই কে ভাই?সবসময় এভাবে আমার পিছনে লেগে থাকিস কেনো?তোরে না সেদিন বললাম আমার থেকে দূরে থাকবি?”

“আমি তোমায় ভালোবাসি হৃদিত।এতো সহজেই সবটা ভুলে কিভাবে তোমার থেকে দূরে থাকবো?”

“এখন এগুলো বলে কোনো লাভ আছে আপাই?আপনার ভালোবাসার মানুষটা তো এখন সেকেন্ড হ্যান্ড হয়ে গেছে।আমার নামে বুকড।আর কয়েক মাস পর দেখবেন একটা লেজও থাকবে সাথে। সবসময় পাপ্পা,পাপ্পা বলে ওনার পিছনে দৌড়ে বেড়াবে।আপনার তো রুচি ভালো না দেখছি।লেজ ওয়ালা ছেলেদের কেউ আবার পছন্দ করে নাকি?”

মেহরিমার কথায় হৃদিত হো হো করে হেসে ওঠে। হাসির সেই শব্দে বাসার সবাই হৃদিতের দিকে দৃষ্টিপাত করে।সবাই মুগ্ধ চোখে হৃদিতের হাসি দেখে।অনেকে তো এই প্রথম হৃদিতকে হাসতে দেখে।হাসলে মানুষটাকে কত্তো সুন্দর লাগে অথচ মানুষটা হাসেই না।হৃদিতের হাসি দেখা আর অমাবস্যার চাঁদ দেখা একই বিষয়।হঠাৎ মেহরিমার এমন কথায় অলিভিয়া থতমত খেয়ে যায়।এই মেয়েটা তো এখানে ছিল না।আসলো টা কখন? অলিভিয়া দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।

“এবার বেশি বাড়াবাড়ি করলে হ্যানসেল,হ্যারিকে পিছে লাগিয়ে দেবো একদম।তখন বাবা ডেকেও কুল পাবি না।অ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি।স্টে এওয়ে ফ্রম আস্।”

হৃদিতের করা তীব্র অপমানে অলিভিয়ার মুখটা থমথমে হয়ে ওঠে।দ্রুত ওখান থেকে সরে পড়ে।তবে মনের মধ্যে জেদ ঠিকই থাকে।

রাতে খাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে।সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।সবার কথার মাঝে অলিভিয়া বলে ওঠে,

“এই মেহু তুমি তো নিজেই এখনও একটা বাচ্চা।আবার আরেক বাচ্চা নিয়ে বসে আছো।কয়েক বছর পরে নিলেও তো পারতে বাচ্চা টা?তোমার সামান্য হেয়ারের যত্নই তুমি একা নিতে পারো না।একটা বাচ্চার যত্ন কিভাবে নিবে?এই দেখো আমার কি সুন্দর হেয়ার অ্যান্ড এটার যত্ন আমি একাই নিই।অথচ আমি এখনও বিয়েই করলাম না।তাছাড়া আরিশা ভাবীও তো এখনও বাচ্চা নেয়নি।ওনাদের তো বিয়ের থ্রি ইয়ার্স রানিং।”

“আজব তো!তুমি তোমার কথার মাঝে আমাকে কেনো টানছো?অন্যের পার্সোনাল ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করা বন্ধ করো।”

আরিশা কথাটা বলে আয়াশের দিকে একপলক তাকিয়ে ওখান থেকে উঠে বাইরে চলে যায়।আয়াশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সকলের সামনে এমন প্রশ্নে মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।সাথে অপমানবোধও করে।অলিভিয়ার ঠোঁটে কুটিল হাসি। সুযোগ পেয়েছে এতো সহজে ছেড়ে দিবে নাকি।মেহরিমা কিছু বলার আগেই হৃদিত নিজের গম্ভীর তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,

“বাচ্চা পালবে আমার ওয়াইফ।তোর এতো টেনশন কিসের?নাকি নিজের নোং রা মি করার চান্স হারিয়েছিস বলে মাথায় কাজ করছে না?আর তোর মতো মেয়েকে বিয়েটা কে করবে শুনি?কোটি টাকা দিয়েও কারোর গলায় ঝুলাতে পারবে না তোকে।”

“হৃদিত অলিভিয়া তো ঠিক কথায় বলেছে।তুমি সব সময় এভাবে আমাদের অপমান করতে পারো না।”

“নিজের মেয়েকে ভদ্রতা শেখান এমপির বোন।আপনাদের পরিবারের কারোর মধ্যেই ম্যানারস নেই।মেহরিমা রুমে চল।রাত হয়েছে অনেক।তোর ঘুমের সময় হয়ে গেছে।”

হৃদিত মেহরিমাকে নিয়ে রুমে চলে যায়।অবনী শেখ আয়রা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন।আর তাতেই আয়রা চৌধুরী তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন।

______

সকাল সকাল তাবান,তাইফ আর তৃধা হাজির হয়েছে মেহরিমাদের বাসায়।সবার মুখে চাঁপা হাসি।মেহরিমা রুম থেকে বেরিয়ে আসে।হৃদিত এখনও গভীর ঘুমে মগ্ন।

“মেহু বেই..না না শুধু মেহু তাড়াতাড়ি এদিকে আয়।একটা হেব্বি কথা আছে তোর সাথে।”

মেহরিমা এগিয়ে এসে সোফায় বসে।

“বল।”

“জানিস অলিভিয়া পেত্নীর কি হয়েছে?”

“না বললে জানবো কিভাবে?”

“ওও তাইতো।তাহলে শোন।পেত্নী পুরো টাক হয়ে গেছে। মাথায় আর একটা চুল ও নেই।হাতের পায়ের সুন্দর নখ গুলো নেই।বোচা হয়ে গেছে।চোখের উপর ভ্রু নেই।দেখতে পুরাই সার্কাসের মতো লাগছে।আবার মাথার টাকের উপর পুকুরের নোংরা পানি আর শেওলা লেগে আছে।পেত্নীর পুরো রুমে পুকুরের কর্দমাক্ত শেওলা পড়ে আছে।ছিহ্ কি দুর্গন্ধ!”

নাকমুখ সিঁটকায়ে কথাগুলো বলে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে তৃধা।সাথে তাবান তাইফ ও যোগ দেয়।সবটা মেহরিমার মাথার উপর দিয়ে যায়।

“হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ?”

“তা জানি না।সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই নিজের ওমন সার্কাস চেহারা আর রুমের ওই অবস্থা দেখে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে পেত্নী।মা মেয়ে মিলে কান্না জুড়ে দিয়েছে।”

আচ্ছা তোরা বস আমি দুই মিনিট আসছি।মেহরিমা দ্রুত পায়ে রুমে এসে হৃদিতকে ডাকে।

“এ্যাই শুনছেন?”

হৃদিতের কোনো নড়চড় না দেখে গায়ে হালকা ধাক্কা দেয়।

“এই শুনুন না।”

হৃদিত নড়েচড়ে উঠে ঘুমু ঘুমু কন্ঠেই বলে,

“হুমম জান।”

“আমি ঘুমানোর পরে আপনি গতরাতে বাইরে গেছিলেন?”

“উহু।হোয়াই?”

“না,এমনিতেই।আপনি ঘুমান।”

মেহরিমা আর কিছু না বলে রুমের বাইরে চলে আসে।ঠোঁটের কোণে মুচকি হাঁসির দেখা মেলে।মেহরিমা রুমের বাইরে যেতেই হৃদিতের ঠোঁটে ক্ষীণ বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।আরামছে আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

#চলবে

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-২৯+৩০

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৯ [ছোট্ট ধামাকা]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

মেহরিমা সাজুগুজু করে হৃদিতের অপেক্ষায় বসে আছে।আজ কালো রঙের একটা জর্জেট শাড়ি জড়িয়েছে শরীরে।হৃদিত বিকালে এসে শাড়ি সহ অর্নামেন্টস দিয়ে গেছে।সেগুলো দিয়েই নিজেকে সাজিয়েছে। ইতোমধ্যে বিয়ের একমাস পেরিয়েছে।বিয়ের পরে আজ দ্বিতীয় বারের মতো শাড়ি পরেছে মেহরিমা।

“নীলাক্ষী বাসায় ফিরবি আজকে?”

মায়ের কথায় মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।লাজুক হেসে বলে,

“না মা।কাল সকালে ফিরবো।”

“আচ্ছা সাবধানে থাকিস।”

“ঠিক আছে মা।”

অবনী শেখ ঘর থেকে চলে যেতেই হৃদিতের কল আসে।মেহরিমা দ্রুত রিসিভ করে।

“বাইরে আয়।আ’ম ওয়েটিং।”

“পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন।বাবার সাথে দেখা করেই চলে আসছি।”

“ওকে।”

হৃদিত কল কেটে দিতেই মেহরিমা বাবার রুমে যায়।জলিল শেখ বসে ফল খাচ্ছেন।মেহরিমা কে দেখতেই মুচকি হাসেন।সেই চিরচেনা মধুর কন্ঠে আম্মা ডাকেন।আজ বাবার আম্মা ডাকটা শুনে মেহরিমার বুকের মাঝে কেমন একটা করে ওঠে।

“বাবা সাবধানে থাকবে।রাতের খাবার খেয়ে ঠিকমতো মেডিসিন গুলো খাবে।একা একা হাঁটবে না।ওয়াশ রুমে মায়ের সাথে যাবে।একা ভালো না লাগলে মাধুপুকে ডেকে আড্ডা দেবে নাহলে আমাকে কল করবে মনে থাকবে?”

মেয়ের আদুরে শাসনে জলিল শেখ হো হো করে হেঁসে ওঠেন।অনেক দিন পর বাবার মুখে সেই পুরোনো হাসি দেখতেই মেহরিমার মনটা ভালো হয়ে যায়।

“আচ্ছা আমার আম্মা আপনার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবো।”

মেহরিমা বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসতেই জলিল শেখ ডেকে ওঠেন।

“আম্মা!”

মেহরিমা পিছু ফিরে চায়।জলিল মুচকি হেসে কিছুক্ষণ মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। অতঃপর বলেন,

“সাবধানে যেও আম্মা।”

মেহরিমার হঠাৎ কি হয় কে জানে!দৌড়ে এসে বাবাকে ঝাপটে ধরে।জলিল শেখ ব্যথা পেলেও সহ্য করে নেন।মিনিট দুয়েক ওভাবেই বাবার বুকে থাকে মেহরিমা।জলিল শেখ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।তারপর ধীর কন্ঠে বলেন,

“হৃদিত বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে আম্মা।ওই বাড়ির সবাই মুখোশধারী হলেও হৃদিত বাবা নির্ভেজাল আম্মা।মন দিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করবে।কখনো কারোর কথায় কান দেবে না।মনে রাখবে মানুষ যখন কথায় পারে না তখন তার অতীত টেনে কথা বলে।নিজের অতীত ভুলে বর্তমান,ভবিষ্যৎ নিয়ে বাঁচতে শেখো।তোমার বর্তমান ভবিষ্যৎ সবটা হৃদিত বাবা।পড়াশোনা টা মনোযোগ দিয়ে করবে ঠিক আছে আম্মা?অনেক বড় হতে হবে তোমায়।বিয়ে হয়ে গেছে বলে গিভ আপ করবে না।তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আমার।তোমার মায়ের জীবনটা খুব কষ্টের আম্মা।কখনও তোমার মাকে কষ্ট পেতে দিওনা কেমন?”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।আবারও হৃদিতের কল আসতেই বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে চলে আসে মেহরিমা।কেনো যেনো আজ বাবাকে ছেড়ে আসতে মন চাইছে না।গাড়ির নিকট আসতেই দরজা টা একাই খুলে যায়।মেহরিমা গাড়িতে উঠে বসে।সিটবেল্ট বাঁধতেই হৃদিত গাড়ি স্টার্ট দেয়।মেহরিমার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধটুকু করে না।কিছুক্ষণ ড্রাইভিং করার পর প্রশ্ন করে,

“এতো দেরি হলো কেনো আসতে?”

“বাবার সাথে কথা বলছিলাম। আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

“গেলেই দেখতে পাবি।”

মেহরিমা বুঝতে পারে হৃদিত ওর উপর খেপে আছে তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপ হয়ে যায়। দুইঘন্টা ড্রাইভিং করে হৃদিত একটা লেকের কাছে এসে গাড়ি থামায়।মাঝে একবার গাড়ি থামিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার কমপ্লিট করে এসেছে।হৃদিত নিজে নেমে মেহরিমাকে কোলে উঠিয়ে নেয়।চারিদিকে শূনসান নিরবতা।মানুষের একটা চিহ্ন ও নেই।শুধু পাশেই একটা কটেজ দেখতে পাচ্ছে মেহরিমা।শীতের রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।অদূরেই কোথাও শেয়াল নিজস্ব কন্ঠে ডেকে চলেছে।মেহরিমা লেকের চারপাশটা তাকিয়ে দেখতে থাকে।লেকের চারিপাশে পার্পল কালারের ছোট ছোট লাইট দিয়ে ডেকোরেশন করা।সেই আলো খুব মৃদু।তাছাড়া এক্সট্রা কোনো লাইট অর ল্যাম্পপোস্ট নেই।এমন ভুতুড়ে পরিবেশে মেহরিমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।চারি পাশে সারি সারি সুউচ্চ গাছপালা।শীতের ঠান্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়া এসে তনু মনে লাগতেই মেহরিমা শিউরে উঠে হৃদিতের বুকের সাথে লেপ্টে যায়।হৃদিত মুচকি হাসে।লেকের সামনে আসা মাত্রই মেহরিমার চোখজোড়া কপালে উঠে যায়!লেকের পানিতে শত শত ক্যান্ডেল জালানো।লেকের ঠিক সামনেই লাল, সাদা গোলাপের পাপড়ির কম্বিনেশনে লাভ শেপ করা।তার মাঝে বড় করে লেখা ‘মাই অ্যানাবেলা।’ তার একটু নিচে ছোট্ট করে লেখা ‘ডু ইয়্যু রিমেম্বার দিস নিকনেইম সানসাইন?’।হৃদিত এগিয়ে যেয়ে মেহরিমাকে লাভ শেপের মধ্যে নামিয়ে দেয়।পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে কাঁধে থুতনি রেখে দাড়ায়।আর সাথে সাথেই উপর থেকে গোলাপের পাপড়ির বর্ষণ শুরু হয়।মেহরিমা হতভম্ব হয়ে যায়!ওর কাছে সবটা স্বপ্ন মনে হয়।খুশিতে আঁখি জোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠে।মেহরিমা দুদিকে দু’হাত মেলে দেয়।দশ মিনিট ধরে গোলাপের পাপড়ির বর্ষণ শেষে মেহরিমা হৃদিতের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ জোড়া বুজে নেয়।ভালো লাগা খারাপ লাগা সব মিলিয়ে বক্ষস্থলে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়।হৃদিত ওর কাঁধে ছোট্ট ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।

“সারপ্রাইজ ভালো লেগেছে?”

“বেস্ট সারপ্রাইজ এভার।”

“শীতে গরম কাপড় পরিসনি কেনো?”

“ভুলে গেছি।”

“আচ্ছা এখানে দুই মিনিট বস।আমি গাড়ি থেকে তোর জন্য গরম কাপড় নিয়ে আসি।”

“না,না আমিও যাবো আপনার সাথে।”

মেহরিমা ভয় পাচ্ছে হৃদিত সেটা বুঝতে পেরেই ওর নরম হাত নিজের শক্ত খসখসে হাতের মুঠোয় পুরে নেয়।

“ভয় কিসের?আমি আছি তো।”

ব্যস অমনিই মেহরিমার সাহস বেড়ে যায়।ছোট্ট একটা বাক্য অথচ কতো শক্তিশালী!হৃদিত মেহরিমাকে সাথে করে গরম কাপড় আর চাদর নিয়ে আসে।মেহরিমাকে গরম কাপড় পরিয়ে দিয়ে দু’জনে লেকের পাশে এক চাদরের মধ্যে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে।হৃদিতের বুকে মাথা রাখে মেহরিমা।মেহরিমার দৃষ্টি নিবদ্ধ লেকের পানিতে।হৃদিতের দৃষ্টি নিবদ্ধ অ্যানাবেলার সুশ্রী মুখমন্ডলে।পার্পল কালারের মৃদু আলোয় নিজের প্রেয়সীকে দেখতে বড্ড আদুরে লাগছে।আঁখি জোড়ায় চিকন করে কাজলরেখা টানা।ঠোঁটে নুড কালারের লিপস্টিক দেওয়া।অতোটা বোঝা যাচ্ছে না।নাকফুল টা জ্বলজ্বল করছে।হৃদিত নাকফুলের উপর ছোট্ট একটা চু মু খায়।

“আমাদের জীবনের সেরা দিন গুলোর মধ্যে এই দিনটাও যুক্ত হলো।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত হেসে বলে,

“তাই নাকি?”

“হুম।

“আজকাল তোকে হারানোর ভয়টা একটু বেশিই পাই আমি।তোর সাথে কিছু সুন্দর স্মরণীয় মূহুর্ত কাটাতে চাই।তোর সাথে আমি না থাকলেও আমার এই স্মৃতি গুলো সবসময় থাকবে।এগুলো নিয়ে দিব্যি একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে।”

“চন্দ্রের মতো আলো দিয়ে আমার জীবন টা সুন্দর করে সাজিয়ে অগ্নিকাণ্ডে নিক্ষেপের কি খুব প্রয়োজন ছিল?নিজের আসল চেহারা বিয়ের আগে কেনো প্রকাশ করলেন না?”

“আমার সব মিথ্যের মাঝেও চিরন্তন সত্য হচ্ছে তুই,আমার ভালোবাসা।”

“ওই ভালোবাসার কাছেই হেরেছি আমি।”একটু থেমে আবার বলে,”নিশান,পলাশ,শিহাব কে আপনিই মেরেছেন?”

“হৃদিতের অ্যানাবেলাকে টাচ করার সাহস দেখালে সে অক্ষত অবস্থায় থাকবে নাকি?”

“মানুষ হ ত্যা পা প।”

“কিন্তু ওরা তো ম রে নি।”

“শিহাব কে তো মে রে দিয়েছেন।”

“প শু হ ত্যা পাপ নয়।আর আমি না মা র লে ও কেউ একজন মে রে দিতো।”

“কে মে রে দিতো?”

হৃদিত জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।মনের মাঝে কি চলছে কে জানে?ঠোঁটে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি।নিজের এতটুকু সত্য প্রকাশ না করলে অ্যানাবেলা নির্ঘাত ভুল বুঝতো।পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতো।সকাল থেকে যেভাবে সত্যি জানতে উঠে পড়ে লেগেছিল!এতটুকু একটা মেয়ে পারেও বটে।সেদিনের রাতে পানি দেওয়ার ঘটনা নিয়ে তাবান,তাইফ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে!মেহরিমা নিজে থেকেও আর কোনো কথা বলে না।এতো এতো রহস্য,এতো এতো সত্য সব মিলিয়ে মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হওয়ার উপক্রম।মেহরিমার মায়ের বলা একটা কথা মনে খুব মনে পড়ে।’আমাদের সবার ভালোবাসা একরকম নয়।ঠিক তেমনভাবেই আমাদের সকলের ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ টাও একরকম না।এই পৃথিবীতে একেক জন একেক ভাবে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করে।কেউ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে প্রকাশ করে,কেউ রাগ দেখিয়ে,কেউ অভিমান করে আরও অনেক ভাবে একেকজন একেকজনের ভালোবাসা প্রকাশ করে‌ থাকে।ভালোবেসে কেউ হয় প্রেমিক আবার কেউ হয় খলনায়ক।ভালোবাসার মানুষ কে নিয়ে কয়েকজন আবার অত্যধিক পজেসিভ মাইন্ডের হয়।তারা নিজেদের ভালোবাসার জন্য পৃথিবী ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে‌।ভালো খারাপ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।তাদের কে একমাত্র ভালোবাসা দিয়েই সঠিক পথে আনা যায় বুঝলি নীলাক্ষী।’ মায়ের কথামতো দাঁড়ায় হৃদিত অত্যধিক পজেসিভ মাইন্ডের একজন মানুষ।স্পেশালি মেহরিমাকে নিয়ে।মেহরিমা তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে হৃদিতকে পরিবর্তন করবে।খুব করে বোঝাবে।আর এভাবে অন্যায় কোনো কাজ করতে দেবে না।দুটো মানুষ নিজেদের আলাদা আলাদা ভাবনায় বিভোর থাকে।এভাবেই সেকেন্ড পেরোয়,মিনিট পেরোয়,ঘন্টা পেরোয়। দু’জনের মাঝে বিরাজ করে এক নিবিড় নিরবতা।হৃদিত নিরবতা ভেঙে বলে,

“তোর কাছে কিছু একটা চাই দিবি আমায়?”

“সাধ্য থাকলে অবশ্যই দেবো।”

“তোর বাচ্চার বাবা হতে চাই।”

মেহরিমা সবটা ভুলে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে হৃদিতের শক্তপোক্ত সুদৃঢ় বক্ষস্থলে মুখ লুকায়।কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু কন্ঠে বলে,

“আই থিংক ইটস অলরেডি ডান।”

“ওহ দ্যাটস গুড নিউজ।”

জবাব দেয় হৃদিত।পরক্ষণেই কথাটার অর্থ মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতেই চোখে এক আকাশ সমান বিষ্ময় নিয়ে মেহরিমার দিকে তাকায়!উৎফুল্ল কন্ঠে বলে,

“আর ইয়্যু শিওর জান?”

“নোপ বাট মে বি।”

“কালকেই টেস্ট করবি বাটারফ্লাই।”

“আচ্ছা।”

হৃদিত মেহরিমা কে কোলে উঠিয়ে নিয়ে কটেজের দিকে হাঁটা ধরে।হঠাৎ হৃদিতের এমন কান্ডে মেহরিমা ভয়ে হৃদিতের গলা জড়িয়ে ধরে।

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

“কটেজে।বাইরে ঠান্ডা বাড়ছে।এখানে তোর থাকা ঠিক হবে না জান।”

কটেজের দরজার সামনে মেহরিমাকে নামিয়ে দেয়।দরজা খুলে দু’জনে ভেতরে প্রবেশ করে।
হৃদিত লাইট জ্বালিয়ে দেয়।মেহরিমা ঘুরে ঘুরে কাঠের তৈরি সুন্দর ঘরটা দেখতে থাকে।কি সুন্দর কারুকাজ খচিত তৈরি ঘরের প্রতিটা আসবাবপত্র!মেহরিমা মুগ্ধ নয়নে সবটা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে।হৃদিত দরজা লক করে এসে মেহরিমার পিছনে দাঁড়ায়।শাড়ি গলিয়ে উন্মুক্ত কোমরে হাত রাখে।মেহরিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“অ্যানাবেলা আর ইয়্যু রেডি ফর টুনাইট?”

লজ্জায় মেহরিমা কুঁকড়ে ওঠে।গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে।হৃদিত মেহরিমা কে কোলে উঠিয়ে নেয়।যত্ন সহকারে বিছানায় শুইয়ে দেয়।মেহরিমা লজ্জায় হাঁসফাঁস করতে থাকে।

_____

সকাল সাতটা বেজে পনেরো মিনিট।শীতের সকাল সাতটা মানেই চারিপাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকা।পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছে প্রভাকর।কটেজের চারিপাশ কুয়াশায় ঘেরা।দূরের কিচ্ছু দেখার উপায় নেই।শোনা যাচ্ছে নাম না জানা কতশত পাখির ডাক।মেহরিমা ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে।ভেজা চুল দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।হৃদিত মেহরিমার জন্য এক্সট্রা ড্রেস নিয়ে এসেছিল সেটাই পড়েছে মেহরিমা।ব্যালকনির সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে মাঝারি আকারের লেক টা।মেহরিমা যখন মুগ্ধ চোখে শীতের সকালের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত সেইসময় হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে ওঠে।এতো সকালে আবার কে কল দেবে?কথাটা ভাবতে ভাবতেই মেহরিমা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে নাম্বার না দেখেই কল রিসিভ করে।ওপাশ থেকে ভেসে আসে মাধবীর কান্নারত কন্ঠস্বর।

“মে..মেহু আমাদের বাবা আর নেই।”

মাধবীর কথাটা মেহরিমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে বজ্রপাত ফেলে।মাথায় উপর যেন পুরো আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।পৃথিবীটা দুলে ওঠে।ক্রমশ সামনের সবকিছু অস্পষ্ট হতে থাকে।অস্ফুট স্বরে ‘বাবা’ ডেকে দু’চোখ বন্ধ করে নেয় মেহরিমা।কিছু পড়ে যাওয়ার বিকট শব্দে হৃদিত শোয়া থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসে।মেহরিমার সাথে গোসল সেরে মাত্রই চোখজোড়া বন্ধ করেছিল।হৃদিত দৌড়ে ব্যালকনিতে আসে।মেহরিমাকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়ে।

#চলবে__

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩০
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

জলিল শেখের প্রাণহীন নিথর দেহ খানা খাটিয়াই পড়ে আছে।চারি পাশে হাজার হাজার মানুষের সমাগম।শেখ বাড়িতে তিল পরিমাণ জায়গাও ফাঁকা নেই।গ্রামের প্রায় সকলেই উপস্থিত হয়েছে।তাছাড়া শহরের পরিচিত অনেকেই এসেছেন। স্বনামধন্য একজন ব্যক্তি ছিল কি না!শেখ বাড়িসহ পুরো গ্রামেই হাহাকার বিরাজমান।তাদের সকলের দুঃখের সঙ্গি ছিল এই মানুষটা।জলিল শেখের খাটিয়ার একপাশে মাধবী চিৎকার করে কান্না করে চলেছে।ওকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন অবনী শেখ।উনি প্রথমে কান্না করলেও এখন পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে গেছেন।অপর পাশে পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে মেহরিমা।সকাল থেকে এখনও পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি আর না করেছে একটুও কান্না। বাবার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট।কেউ জোর করেও বাবার পাশে থেকে সরাতে পারেনি। জলিল শেখকে ধোয়াতে নিয়ে যাওয়ার সময়ও একই যায়গায় ঠাঁয় বসে ছিল।মেহরিমা কে জড়িয়ে ধরে আছেন আয়েশা চৌধুরী।হৃদিত অদূরেই দাঁড়িয়ে ব্যথিত হৃদয় নিয়ে একদম ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া প্রেয়সীর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করা ছেলেটাও আজ কেমন যেনো সবকিছুতেই তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।

তখন সকালে মেহরিমা কে ওই অবস্থায় দেখে হৃদিতের দেহে প্রাণ ছিল না।পাঁচ মিনিট ধরে ডেকে যখন সেন্স ফিরছিল না তখন ডক্টরকে ইনফরম করে।ততক্ষণে জলিল শেখের মৃত্যুর সংবাদ হৃদিতের নিকট পৌঁছে গেছে।ডক্টর এসে চেক আপ করে জানায় এত বড় স্ট্রেস নিতে না পারায় সেন্স হারিয়েছে। পুরো একঘন্টা সময় নিয়ে সেন্স ফিরে মেহরিমার। তারপর আর ওকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি।হৃদিতও অসুস্থ মেহরিমাকে নিয়েই শেখ বাড়িতে ছুটেছে।

সময় দুপুর বেলা।ঘড়ির কাঁটা এখন দুটো বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিটে।জানাজা অনুষ্ঠিত হবে ঠিক তিনটা বেজে পনেরো মিনিটে।মেহরিমার এই নিস্তব্ধতা কেউ মেনে নিতে পারছে না। অনেকেই কথা বলানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাত বড় কোনো সমস্যা হয়ে যাবে।জীবনে এই প্রথম হৃদিতের নিজেকে খুব অসহায় লাগে।চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তক্ষুনি কাঁধে কারোর স্পর্শ অনুভব করে।ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায়।আরিফ চৌধুরীর মলিন মুখখানা চক্ষু গোচর হয়।হৃদিতের আজ আর খারাপ ব্যবহার করতে মন টানে না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।বাবা ছেলের মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতা চলে।

“ভেঙে পড়ো না বাবা।তোমাকে শক্ত থাকতে হবে।এখন এই পরিবারের একমাত্র ভরসার স্থল, একমাত্র খুঁটি শুধু মাত্র তুমি বাবা।”

আরিফ চৌধুরীর কথায় হৃদিতের মনে কোথাও একটু মনোবল বাড়ে।ওনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছুই বলা যেতো তবুও হৃদিত কোনো প্রত্যুত্তর করে না।সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।ছেলের এই ব্যবহার নতুন কিছু না।তবুও বাবার মনটা আজ ব্যথিত হয়। ছেলের ব্যবহারে নাকি অন্য কোনো কারণে উনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।আশেপাশের ভিড় গলিয়ে ওনার দৃষ্টি যেয়ে থমকায়,কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে পাথর বনে যাওয়া স্বর্বহারা এক নারীতে।যার এই পৃথিবীতে সব থেকেও আর কিছুই নেই।এতোটা করুণ পরিণতি উনি তো কখনোই চাননি।কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে তৎক্ষণাৎ ওখান থেকে প্রস্থান করেন।নিজের মনের মতো এই গ্রামের বাতাসও যেন আজ ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে।বাবার প্রস্থানের দিকে নিরশ চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হৃদিত।

সময় দুপুর দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।গ্রামের বড় মসজিদের মুয়াজ্জিন আসেন কাফন বাধতে। লাশ এক্ষুনি কবরস্থানে নিয়ে যেতে হবে।শেষ বারের মতো সবাই দেখে নেয় জলিল শেখের নিষ্পাপ মুখখানা।মাধবী হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে বাবাকে ঝাপটে ধরে।বাবাকে সে কিছুতেই নিয়ে যেতে দিবে না।

সাইমা শেখ সহ গ্রামের কিছু মহিলা এগিয়ে এসে মাধবী কে জলিল শেখের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। অবনী শেখ যন্ত্রের ন্যায় এগিয়ে আসেন। জলিল শেখের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেন,

“অনেকগুলো বছর আমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছো।সারাটা জীবন আমার মুখে ‘ভালোবাসি’ কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করলে।এবার ওপারে যেয়েও আমার জন্য অপেক্ষা কোরো কেমন?আমি শিঘ্রই তোমার কাছে চলে আসবো। এবার আর বেশি অপেক্ষা করাবো না।তুমি তো জানো তোমার অবনীমালা কথা দিলে তা রাখে।”

অবনী বেগম কথা গুলো বলে যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন সেভাবেই দুই কদম পিছিয়ে যেয়ে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়েন। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।গ্রামের মহিলারা এগিয়ে এসে ওনাকে ধরেন।শেষ বারের মতো দু’চোখ ভোরে নিজের বাবাকে দেখে নেয় মেহরিমা। হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক উপলব্ধি করে বাবাকে ওর কাছে থেকে কেড়ে নিতে চাচ্ছে সবাই।সাথে সাথে দুহাতে খাটিয়া আঁকড়ে ধরে।

“আমার বাবার মুখ বাধলেন কেনো চাচা? দেখছেন না আমার বাবা ঘুমাচ্ছে। বাবার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে তো।তাড়াতাড়ি খুলে দিন।”

কথাটা বলে নিজেই হাত বাড়ায় বাবার মুখের কাফন খোলার উদ্দেশ্যে।আয়েশা চৌধুরী,আতিয়া চৌধুরী,তৃধা মেহরিমাকে ঝাপটে ধরে আটকায়।মেহরিমার কথায় উপস্থিত সবার বুকটা কেঁপে ওঠে।গ্রামের সবাই কমবেশি জানে মেহরিমা খুব বাবা ভক্ত ছিল।জলিল শেখের জানের টুকরো ছিল দু’টো মেয়ে।পাশ‌ থেকে এক মহিলা বলেন,

“তুমার আব্বার আর কষ্ট হইতো না মা।হেই তো না ফিরার দ্যাশে চইলা গ্যাছে।তোমগোর বাবা আর লাই মা।”

মহিলার কথাটা বিদ্যুতের গতিতে মেহরিমার মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।সেই মধুর কন্ঠে আর কখনও আম্মা ডাক শুনতে পাবে না ভাবতেই মেহরিমার বুক কেঁপে ওঠে। চোখে জলেরা ভীড় জমায়। জানাজায় দেরি হয়ে যাবে দেখে মুয়াজ্জিন চাচা জলিল শেখের হয়ে সবার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেন।উপস্থিত সবার চোখে পানি।হৃদিত,শাহিন শেখ আর মেহরিমার দুই চাচা দ্রুত জলিল শেখের খাটিয়া কাঁধে তুলে নেয়।তক্ষুনি মেহরিমা নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবাইকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে ওর মামা শাহিন শেখের পা জোড়া জড়িয়ে ধরে।চিৎকার করে বলতে থাকে,

“আমার বাবাকে নিও না তোমরা।আমার বাবা ওখানে একা থাকতে পারবে না।আমার বাবা অন্ধকারে ভয় পায়।আমার বাবার ঠান্ডা সহ্য হয় না।”

মেহরিমাকে সবাই ঝাপটে ধরে রাখে।আজ সবাই মিলেও ওকে সামলিয়ে রাখতে পারছে না।ওর গায়ে যেন কোনো অশরীরী ভর করেছে।মেহরিমার কষ্টে হৃদিতের বুকে তীব্র রক্তক্ষরণ শুরু হয়।এই পৃথিবীর সবকিছুই কেমন অসহ্য লাগে ওর কাছে।কাঁধে শ্বশুর নামক আরেক বাবার লাশটা আজ যেন খুব ভারী ঠেকছে।চোখের সামনে গতকালের আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি গুলো ভেসে উঠছে বারংবার।কি সুন্দর করে হাসছিল মানুষটা অথচ আজ!পা জোড়া চলার জন্য কোনো শক্তি পাচ্ছে না।এ কেমন যন্ত্রণা!পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সত্য মেনে নিতে আমাদের অবুঝ মন এতো তাল বাহানা কেনো করে!

“বাবা!তুমি না বলেছিলে সবসময় আমার পাশে থাকবে।তাহলে আজ কেনো ছেড়ে যাচ্ছো? তোমাকে আমার প্রয়োজন বাবা।তোমার মতো করে আমায় আম্মা কে ডাকবে বাবা?আমার বাবাকে তোমরা নিয়ে যেও না।বাবা ওখানে একা থাকতে পারবে না।বাবার ভয় করবে।”

মেহরিমার আর্তনাদে কেঁপে ওঠে আকাশ,বাতাস সহ ভূমি।কেঁপে ওঠে উপস্থিত সকলের অন্তরাত্মা। সবাই সাক্ষী হয় বাবা হারা এক এতিমের আর্তনাদের।চোখের সামনে থেকে ক্রমশ বাবার শেষ চিহ্ন বিলীন হয়ে যেতেই মেহরিমা নিজের চোখজোড়া বুজে নেয়।অবনী শেখ সেভাবেই পাথর হয়ে বসে আছেন।দৃষ্টি নিবদ্ধ মাটিতে।দেহে প্রাণ আছে কি না বোঝা মুশকিল।মাধবী মাটিতে হাত পা ছড়ায়ে ছিটায়ে চিৎকার করে কান্না করছে।মেহরিমা জ্ঞান হারাতেই শেখ বাড়িতে দ্বিগুণ হৈচৈ পড়ে যায়।কয়েক জন দৌড়ে পানি আনতে চলে যায়।

#চলবে____

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-২৭+২৮

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৭. [রহস্যের খন্ডাংশ.১]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

মাঝে কেটে গেছে পনেরো দিন।তিনদিন হলো মেহরিমারা গ্রামে এসেছে।নিজের বাড়িতে এসে সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।চৌধুরী পরিবারের সবাই অপারেশনের পরের দিনই চলে এসেছিলেন। আরিফ চৌধুরী,আয়াশ থাকায় মেহরিমাদের ওতোটা সমস্যা হয়নি।তাছাড়া প্রতিবেলা শ্রেয়া চৌধুরী রান্না করে খাবার পাঠাতেন।সময় পেলে নিজেও এসে দেখে যেতেন।জলিল শেখ এখন মোটামুটি অনেকটা সুস্থ।তবে কোনো এক কারণে উনি সবসময় মনমরা হয়ে থাকেন।দেখে মনে হয় কোনো এক গভীর চিন্তায় মগ্ন।কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছেন।এই কয়েকদিনেই মুখে বয়সের ছাপ পড়ে গেছে।বাবার নিরবতা মেহরিমাকে ভেতরে ভেতরে দিশেহারা করে তুলেছে।হঠাৎ এই নিরবতা ঠিক মেনে নিতে পারছে না।জলিল শেখের পরিবর্তন নিয়ে অবনী শেখও বেশ চিন্তিত।

গতকাল চৌধুরী পরিবারের সবাই এসে দেখে গেছে জলিল শেখকে।মেহরিমা শেখ বাড়িতেই আছে।ভেবে রেখেছে বাবা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এ বাড়িতেই থাকবে।হৃদিত আজ আর শেখ বাড়িতে আসবে না। নিজের বাগান বাড়িতে গেছে।সময় রাত দশটা।জলিল শেখ বেডের হেড বোর্ডের সাথে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসে আছেন।মেহরিমা নিজের হাতে বাবাকে খাইয়ে দিয়ে মেডিসিন খাওয়াচ্ছে।অবনী শেখ রাতের টুকিটাকি কাজ শেষ করে রুমে আসেন।সামনের মাসে ঢাবির অ্যাডমিশন টেস্টের ডেইট দিয়েছে।এই কয়দিন ঢাকাতে থাকায় একটুও পড়াশোনা করা হয়নি মাধবীর।তাই পড়ার জন্য নিজের রুমে গেছে পাঁচ মিনিট হতে চললো।

“ও বাবা তোমার এখন কেমন লাগছে?”

“ভালো আম্মা।তুমি কি এখন কিছু করবা?”

“না বাবা।”

“আসো তোমার সাথে গল্প করি।”

পনেরো দিন পরে বাবাকে আগের মতো কথা বলতে দেখে মেহরিমার বুকে প্রশান্তির হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে।ও উৎফুল্ল হয়ে বাবার পাশে বসে।বাবার ডান হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

“বলো বাবা।আজ তোমার সাথে অনেক গল্প করবো।তোমার সব কথা শুনবো।”

মেয়ের কথায় জলিল শেখ মৃদু হেঁসে বলেন,

“আজ তোমাকে আমার ভালোবাসার গল্প শোনাবো।শুনবে তো?”

“অবশ্যই বাবা।বলো তুমি।”

“আমি আর তোমার মা কাজিন সেটাতো জানো আম্মা?”

“হ্যাঁ বাবা।”

“আচ্ছা শোনো তাহলে।তোমার মা আমার বেশ অনেক বছরের ছোট। আমাদের বকুল গাছ আছে না?ওখানে আগে আমাদের বাড়ি ছিলো।আর আমার ছোট চাচা মানে তোমার নানু ভাইয়ের বাসা ছিল আমাদের শিউলি ফুলের গাছ আছে না? ওখানে।”

“বাবা আমার নানুর বাসাও এই গ্রামেই ছিলো!”

অবিশ্বাস্য কন্ঠস্বর মেহরিমার!মেয়ের কথায় মুচকি হাসেন জলিল শেখ।

“হ্যাঁ মা। তারপর শোনো।তোমার মা ছোট বেলা থেকেই খুব চঞ্চল ছিল।অতশী ছিল ওর পুরোই উল্টো।নম্র,ভদ্র,নরম মনের নির্ভেজাল একজন মানুষ।আর শাহিন তো ছোটবেলা থেকেই খুব শান্ত।ব্যতিক্রম ছিল শুধু তোমার মা।অবনীর নামে প্রতিদিন পাড়া প্রতিবেশীদের থেকে বিচার আসতো।একদিন কারোর মাথা ফাটিয়ে দিতো তো,অন্যদিন কারও চুল ছিঁড়ে দিতো।এভাবেই বড় হতে থাকে অবনী।মূলত ওর চঞ্চলতার জন্যই ওর প্রেমে পড়েছিলাম আমি।আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি আর অবনী ফোরে।সেদিন স্কুলে মারপিট করে আমার কাছে এসেছে।ছোটমার ভয়ে বাড়ি যেতে পারছে না।ছোটমার হাত থেকে নাকি ও কে বাঁচাতে হবে।বাঁচিয়েও ছিলাম।বলা বাহুল্য ছোটকাকা অবনী কে মাত্রারিক্ত ভালোবাসতো।তাই অবনী শুধু মাত্র ভয় পেতো ছোটমাকে।বাড়িতে ও কে বাঁচিয়ে দিলেও সেবার ওর শেষ রক্ষা হয়েছিল না।সেদিন স্কুলের পুরো ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে।এক মেয়ের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে কিনা!কারণটা হচ্ছে সে অবনীকে দাঁত বুকড়ি বলে রাগিয়েছে।সেইবার চৌধুরীরা বিচার পর্যন্ত বসিয়েছিল।কারণ মেয়েটা ছিল আয়রা চৌধুরী।তাহলে ভাবতে পারছো তোমার মা কোন লেভেলের দুষ্টু ছিল।তবে হ্যাঁ তোমার মায়ের একটা ভালো গুণও ছিল,কোনো অন্যায় মেনে নিতো না।খুব প্রতিবাদি ছিল ঠিক এখনকার মতই।”

“বাবা তাহলে মানুষ তো ঠিকই বলে।আমি মায়ের মতো হয়েছি।”

“হ্যাঁ আম্মা তুমি পুরোটাই তোমার মায়ের মতো হয়েছো।আর মাধবী আম্মা অতশীর মতো।তোমার মা আমার এক পাক্ষিক ভালোবাসা ছিলো।যখন থেকে আমি আমার অনুভূতি বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই অবনী আমার ভালোবাসা ছিল।সালটা ১৯৮৬।একদিন খুব ধুমধাম করে অতশীর বিয়ে হয়ে যায়।আমিও ওটার অপেক্ষাতেই ছিলাম।ছোট কাকার কাছে যেয়ে নিজের জন্য অবনীর হাত চাই।কিন্তু আফসোস তিনি আমার মতো বেকার ছেলের হাতে মেয়ে দিবেন না।আমি যতই ভাইপো হই না কেনো।ছোট মেয়ের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বড়ই দায়িত্বশীল।অতশীর প্রতি অতোটা দায়িত্বশীল কখনোই ছিলেন না।অতশীর প্রতি যদি আরেকটুও দায়িত্বশীল হতেন তাহলে হয়তো অতশীর জীবনটা অন্যরকম হতো।কথাটা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জলিল শেখ।

যাইহোক ততদিনে ঢাবি থেকে আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়েছে।তোমার মা তখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে।তবে ছোট কাকা আমাকে কথা দিয়েছিলেন চাকরি পেলে অবনী কে আমার হাতেই তুলে দিবেন।আমার চাকরি পাওয়া পর্যন্ত উনি অপেক্ষা করবেন।তখন আমি টগবগে যুবক।রক্ত গরম আমার।অবনী কে পাওয়ার জন্য জেদ ধরেই আবারও ঢাকায় ফিরে গেলাম।চাকরির জন্য ছুটোছুটি করতে লাগলাম।এভাবে ঢাকা শহরে চাকরি খুঁজতে যেয়ে জড়িয়ে পড়লাম ছাত্ররাজনীতিতে।তবুও চাকরির জন্য কমবেশি চেষ্টা করতাম।এভাবেই কেটে গেলো তিনটা বছর। ১৯৮৮ সালের জুলাই মাস।অবনীর ঢাবিতে বাংলা ডিপার্টমেন্টে পড়ার সুযোগ হয়ে যায়।ও যে ঢাকাতে যেয়ে ঢাবিতে পরিক্ষা দিয়ে এসেছে সেটাও আমি জানতাম না।গ্রামে তখন হাতে গোনা কয়েকজন ইউনিভার্সিটি তে পড়তো।বাকি সবাই স্কুলের গন্ডি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল।কেউ কেউ কলেজ পর্যন্ত পড়তো এই যা।অবনী প্রথম সেমিস্টার গ্রামে থেকেই পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল।জাস্ট পরিক্ষার সময় যেয়ে পরিক্ষা দিয়ে আসবে।আমি ওর জন্য যাবতীয় সব বই কিনে এনে গ্রামে দিয়ে যাই।তারপর মাঝে ছয়মাস আর কোনো খোঁজখবর পাইনি ওর।তখন তো ফোনের যুগ ছিল না।তখন ছিল চিঠির যুগ।যাই হোক ঠিক ছয়মাস পরে ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রাম থেকে বাবার দেওয়া একটা চিঠি পাই আমি।বাবার দেওয়া চিঠিটা আমি যখন পড়ি তখন ধরনীর বুকে তমসা নেমেছে।চিঠিটা পড়ে শেষ করতেই আমার পৃথিবী থমকে যায়।আমি এক কাপড়েই বের হয়ে আসি গ্রামের উদ্দেশ্যে।বুকের মাঝে তখন ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিয়ে উঠছে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়।সেইসময় আমি টিউশন করে নিজে চলতাম।বাবার থেকে ইচ্ছে করেই টাকা নিতাম না।মাসের শেষের দিকে হওয়ায় হাতে টাকাও ছিল না।আমার এক বন্ধুর থেকে টাকা ধার নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসি।কপাল ভালো থাকায় ওই রাতের শেষ বাসটা পেয়ে যাই।গ্রামে এসে পৌঁছায় রাত বারোটার সময়।অন্যদিন ওই সময়ে পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে থাকে।কিন্তু ওইদিন গ্রামের প্রতিটা কোণায় চলছিল চাঁপা কানাঘুষা।বাড়ির পরিবেশ তখন থমথমে।বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতেই দেখি বধুবেশে চোখের কাজল লেপ্টে চোখ মুখ ফুলিয়ে শাকচুন্নী সেজে মাটিতে বসে আছে অবনী।শাড়ির বড় আঁচল মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।সেদিন চাঁদের ভরা পূর্ণিমার আলোয় অবনীর ওই রুপে আবারও নতুন করে প্রেমে পড়ি।ছোটকাকা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি পার পাননি।সেদিন রাতেই আমার সাথে অবনীর বিয়ে হয়।বাধ্য হয়ে আমার মতো বেকারের হাতেই অবনীকে তুলে দেন।তার ঠিক দুই দিন পরেই ছোট কাকা স্ট্রোক করে মারা যান।ছোট কাকা মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পরেই ছোট চাচি শাহিন কে নিয়ে নদীর ওপারে কুসুমপুরে উঠে যান নিজের বাবার ভিটেতে।অবনীকে নিয়ে আমিও ঢাকাতে পাড়ি জমায়।সেখানে শুরু হয় আমাদের দু’জনের জীবনযুদ্ধ।নতুন করে একটা দুই রুমের বাসা নিই।তোমার মায়ের কাছে তখনও আমি স্বামীর মর্যাদা পাইনি।আলাদা রুমে থাকবে সে।সুযোগ থাকলে ও কখনোই আমাকে বিয়ে করতো না।কাউকে ভালো না বাসলে বিয়ে করা যায় নাকি!১৯৯২ সালের কথা আমরা তখনও আলাদা ঘরেই থাকতাম।তবে ততদিনে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের মতো হয়ে গেছিল।অবনী টিউশন আর আমি ছোট্ট একটা চাকরি করে দিব্যি ভবিষ্যৎহীন একটা সম্পর্ক টেনে বেড়াচ্ছিলাম।যেই সম্পর্কের শেষে কি আছে আমরা কেউই জানতাম না।আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে এমনও সিদ্ধান্ত অবনী নিয়েছিল।আমি ওর মতের সাথে সহমত প্রকাশ করলেও কখনোই ডিভোর্স দিতাম না।শখের নারীকে পেয়ে ছেড়ে দেওয়ার মতো বোকামি কেউ করে নাকি!কথাগুলো বলে কিছুক্ষণের জন্য থামেন জলিল শেখ।মুখমণ্ডলে ফুটে ওঠে তীব্র বেদনার ছাপ।

একই ছাদের নিচে বসবাস করতে করতে আমরা দুজন কখন যে একে অপরের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম সেটা আমরা বুঝতে পারেনি।বিষয়টা উপলব্ধি করতেই আমরা দু’জনে একসাথেই বাকিটা জীবন পার করার সিদ্ধান্ত নিলাম।একটা সুন্দর মিষ্টি সংসারের স্বপ্ন দেখলাম।অবনী মাস্টার্স শেষ করার এক বছর পরেই ওর স্কুলের চাকরি টা হয়ে যায়।পোস্টিং পড়ে পাশের জেলার শেরপুর গ্রামে।তোমার মা শেরপুর থাকতো আর আমি ঢাকাতে।সেখান থেকে আনন্দপুরে ট্রান্সফার করতে দুই বছর সময় লেগে যায়।তারপর দু’জনে একসাথে এই গ্রামেই ফিরে আসি।যেই মেয়েটা নিজের মুখ লুকিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল,ঠিক সেই মেয়েটাই সেদিন বুক ফুলিয়ে গ্রামের গর্ব হয়ে ফিরে আসে।দীর্ঘ দশ বছর পরে গ্রামে পা দিয়ে আমরা আগের মতো আর কোনো কিছুই পাইনি।আমরা গ্রামে আসার এক বছরের মাথায় তোমার নানিমনি মারা যান।তার দুই বছর পরে বাবা মারা যান আর মাধবী হওয়ার এক বছর আগে আম্মাও মারা যান।ভাইগুলো সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা করে আমাকে একা করে দেয়।এই জগৎ সংসারে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ি।ততদিনে আমি পাকা রাজনীতিবিদ হয়ে গেছি।বাবা রিটায়ার্ডের পর একটা ছোট্ট ব্যবসা শুরু করেছিল।সেটার হাল ধরি আমি।তারপর আস্তে আস্তে সবটা সামলিয়ে উঠে এই সুখের মুখ দেখেছি।”

মাঝে থেমে থেমে প্রায় দুই ঘন্টা সময় নিয়ে সবটা বলে শেষ করেন জলিল শেখ।বাবা মায়ের কষ্টের কাহিনী শুনে মেহরিমা ততক্ষণে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে।কাঁদতে কাঁদতেই বেডের পাশে রাখা টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খাইয়ে দেয় বাবাকে।অতঃপর নিজেকে সামলিয়ে মনের মধ্যে ঘুরপাক করতে থাকা প্রশ্ন গুলো করে ফেলে।

“বাবা তুমি মাঝে অনেক কথা বললে না যে! খালামনির কার সাথে কোথায় বিয়ে হয়েছিল?দাদু চিঠিতে কি এমন লিখেছিল যে তুমি গ্রামে ছুটে আসো?তখন কি খালামনি কে দেখতে পাওনি তুমি?মায়ের সাথে কি ঘটেছিল বাবা?নানুভাই খালামনির প্রতি কম দায়িত্বশীল কেনো ছিল?তোমার….”

মেহরিমাকে নিজের কথা শেষ করতে না দিয়েই জলিল শেখ বলেন,

“বাকিটা তোমার মায়ের থেকে শুনে নিও।আমার ঘুম পাচ্ছে।ঘুমাবো আম্মা।”

বাবার মুখে ঘুমের কথা শুনতেই মেহরিমা আর কথা বাড়ায় না।বাবা তো অসুস্থ।তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া উচিত।পাশে বসে থাকা মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে।ঘর থেকে বের হতেই সামনে পড়ে মাধবী।ছলছল চোখজোড়া নিয়ে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে আছে।মেহরিমা মাধবীকে আগলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।অবনী শেখ আজ না জানা অনেক সত্যের মুখোমুখি হন।এই মানুষ টা দীর্ঘদিন ধরে ভালোবেসে গেছে অথচ উনি টেরই পাননি।সেই দিনগুলোতে কতশত খারাপ ব্যবহারই না করেছেন।আর এই মানুষটা সব মুখ বুজে সহ্য করে গেছে।অতীতের কথা ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে ওঠে।

“আমি ভেবেছিলাম সেদিন তুমি নিজের দায়বদ্ধতা থেকে,আমায় কলঙ্কিত হওয়া থেকে বাঁচাতে বিয়ে করেছিলে।”

“আমি কথাগুলো বলার আগ পর্যন্তও তো তুমি এটাই ভাবতে।”

“কখনো তো সত্যটা বলনি আমায়।”

“তুমিও তো কখনো সত্যটা জানতে চাওনি।”

অবনী শেখ চুপ হয়ে যান।আর কোনো কথা না বলে জলিল শেখকে শুইয়ে দিয়ে ঘরের লাইট অফ করে নিজেও শুয়ে পড়েন। কিন্তু দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন না।বুকের মাঝে চাপা কষ্ট জমা হয়।

“তোমাকে পেয়ে আমি পরিপূর্ণ।ভাগ্যিস সেদিন আমার সাথে দূর্ঘটনা ঘটেছিল নাহলে আমার এই জীবনটা এতো সুন্দর করে কখনোই কাটানো হতো না।আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া।আমার দুই সন্তানের বাবা অনেক ভালোবাসি তোমায়।তুমি ছাড়া আমার তীর হারা জীবনটা কখনোই এতো সুন্দর হতো না।ওইদিন তো এক মূহুর্তের জন্য জীবন কি জিনিস,এই জীবনের কি অর্থ সবটা ভুলতে বসেছিলাম।তুমিই আমায় নতুন করে জীবনের মানে,জীবনের মূল্য বুঝিয়েছো‌।নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছো।”

অবনী শেখের হঠাৎ করে কি হয়ে যায় উনি নিজেও বুঝে উঠতে পারেন না।নিজের বলা কথাগুলোতে নিজেই হতবাক হয়ে যান!এতো বছর না বলা কথাগুলো আজ কিভাবে বলে ফেললেন!জলিল শেখের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে।পঁয়ত্রিশ বছরের সংসার জীবনে এই কথাটা শুনতে উনি কতোই না মরিয়া হয়ে ছিলেন।আজ সেই স্বপ পূরন হলো।এখন মরলেও আর কোনো আফসোস থাকবে না।

“আমার ড্রয়ারে একটা ডায়েরি আছে অবনীমালা।যখন আমি থাকবো না ওটা তোমার সঙ্গী হবে।”

অবনীমালা ডাকটা অবনী শেখকে শৈশবের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।জলিল শেখ আগে এই নামেই ডাকতো।বিয়ের পরে আর কোনোদিন এই নামটা ওনার মুখে শোনেননি।অবনী শেখ ছলছল চোখে জলিল শেখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।জলিল শেখের অধরে ক্ষীণ হাসির রেখার দেখা মেলে।

#চলবে____

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৮
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

মেহরিমা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।পাশেই ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে বায়োলজি বিচিত্রা পড়ছে মাধবী।হঠাৎ মেহরিমার ফোনটা নিজস্ব কর্কশ শব্দে বেজে ওঠে।মাধবী ভ্রু কুঁচকে তাকায় মেহরিমার দিকে।ফোনটা বেজেই চলেছে কিন্তু মেহরিমার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই।সে গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে আছে।কলটা কেটে যেতেই মাধবী পুনরায় পড়াতে মনোযোগ দেয়।সেকেন্ড পেরোতেই আবারও ঝংকার তুলে ফোনটা বেজে ওঠে। মাধবী এবার বেজায় বিরক্ত হয়।

“এই মেহু,শুনছিস?তোকে কখন থেকে কে যেনো কল দিয়েই যাচ্ছে।রিসিভ কর।”

মাধবীর কথায় মেহরিমা নড়েচড়ে উঠে আবারও তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।ওর ঘুম যেনো ইদানিং বেড়ে গেছে।মাধবী তীব্র বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নেয়।ফোনের স্ক্রিনে হৃদিতের নাম দেখতেই শুকনো ঢোক গেলে।এই মানুষ টাকে মাধবী সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।হৃদিত মাধবীর সাথে রেগে কথা বলেছে কিংবা খারাপ ব্যবহার করেছে এমনটা না।অকারণেই ভয় পায়।আসলে হৃদিতের শানিত চোয়াল,গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর,নীল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মাধবী কে ভেতর থেকে নাড়িয়ে তোলে।কথা বলতে গেলেই হাঁটু কেঁপে ওঠে।মাধবী মাঝে মাঝে ভেবে পায় না মেহরিমা ওমন কঠিন একটা মানুষের সাথে সংসার কিভাবে করছে!মাধবীর ভাবনার মাঝেই কল কেটে যেয়ে তৃতীয় বারের মতো ফোনটা বেজে ওঠে।মেহরিমার কোনো হেলদোল না দেখে তীব্র ভয় নিয়ে কল রিসিভ করে মাধবী।

“ঘুমিয়ে পড়েছিস জান?আই মিস ইয়্যু আ লট।আ’ম ওয়েটিং।পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাইরে আসবি।”

হৃদিতের মুখে এমন কথা শুনে মাধবী বেশ লজ্জা পায়।নিজের মনের মাঝে থাকা প্রশ্নের উত্তর গুলো খুব সহজেই পেয়ে যায়।এই জন্যই তার ছোট্ট বোনটা হৃদিত ভাইয়া বলতে পাগল।মাধবী মুচকি হাসে।

“ভাইয়া আমি মাধবী বলছি।মেহু ঘুমিয়ে আছে। অনেকবার ডেকেছি তবুও উঠলো না।”

কল মাধবী রিসিভ করাতে হৃদিতের মাঝে কোনো বিচলিত ভাব দেখা গেল না।সবসময়ের মতো গম্ভীর তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর।

“ওর শরীর ঠিক আছে?রাতে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেছে?”

“ভাইয়া ও ঠিক আছে।রাতেও ঠিকমতো খেয়েছে।হয়তোবা একটু টায়ার্ড থাকায় ঘুমাচ্ছে।”

“ওকে।তুমি একটু কষ্ট করে এসে মেইন গেইট টা খুলে দেও।”

“আচ্ছা ভাইয়া।”

মাধবীর জবাব শুনেই কল কেটে দেয় হৃদিত। মাধবী যেয়ে মেইন গেইট খুলে দেয়।হৃদিত গাড়ি নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।অতঃপর গেইট ঠিকঠাক ভাবে লক করে নিজের রুমে চলে যায় মাধবী।মেহরিমার রুমে যেয়ে ওর আর কোনো কাজ নেই।হৃদিত মেহরিমার রুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয়।অ্যাট ফার্স্ট ওয়াশ রুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।দরজা খোলাই রাখে।ওয়াশ রুমের পানি পড়ার শব্দে মেহরিমার ঘুম হালকা হয়ে যায়।হাতড়ে পাশে থাকা বালিশ টা দিয়ে কান চেপে ধরে‌।কিন্তু তবুও শব্দের হাত থেকে বাঁচতে পারে না।শেষমেষ বিরক্ত হয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,

“ও মাধুপু তুমি আমার সাথে এমন কেনো করছো? ওয়াশ রুমের দরজা টা বন্ধ করে দেওনা প্লিজ।আমি ঘুমাতে পারছি না।”

তখনই হৃদিত ফ্রেশ হয়ে বের হয়।মেহরিমার কথাগুলো শুনতেই অধরে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। ছোট্ট এই বিড়াল ছানাকে ছাড়া একদমই চলছিল না।মনের মধ্যে হাঁসফাঁস লাগছিল।একটুও শান্তি পাচ্ছিল না।হৃদিত কোনো কথা না বলে রুমের লাইট অফ করে দেয়।মেহরিমার পাশে শুয়ে ওর ব্লাংকেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে‌।মেহরিমার কোমর আকড়ে ধরে নিজের সাথে ঘনিষ্ঠ করে গলায় মুখ ডুবিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।আকস্মিক ঠান্ডা হাত,ঠান্ডা ঠোঁ টে র আক্রমনে মেহরিমার তন্দ্রা ছুটে যায়।ভয়ে আত্মাটা লাফিয়ে ওঠে।পরক্ষণেই অতি পরিচিত ম্যানলি পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে আসতেই মেহরিমা শান্ত হয়।হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

“আপনি কখন আসলেন?আমি যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তখন তো আপনি ছিলেন না!”

“উমম!কথা কম বলে ঘুমা জান।তোর তো আজকাল ঘুম বেড়েছে।ঘুমিয়ে পড় আর আমাকেও ঘুমাতে দে।”

“আপনাকে কে বললো আমার ঘুম বেড়েছে?”

“কাউকে বলতে হবে কেনো? আমার কি চোখ নেই?”

“না সেটা বলিনি তো আমি।”

“আর একটাও কথা না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়।নাহলে কিন্তু আজ রাতে আর ঘুমাতে পারবিনা।”

ব্যস মেহরিমা চুপ হয়ে যায়।ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো হৃদিতের বুকে জড়সড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।মেহরিমার কাজে হৃদিত মুচকি হাসে।কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।
_____

সকালের নাস্তার পর্ব সেরে মেহরিমা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে।মাধবী পড়াশোনায় ব্যস্ত।অবনী শেখ স্কুলে গেছেন।হৃদিত জলিল শেখের সাথে কথা বলছে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে মেহরিমা হাতের কাজ ফেলে এসে ঘরের দরজা খুলে দেয়।আর অমনিই তাবান, তাইফ,তৃধা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।ওদের সকল কে দেখতেই মেহরিমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।তৃধা মেহরিমাকে জড়িয়ে ধরে।তাবান,তাইফ সোফায় বসে।

“তোরে খুব মিস করছি মেহু বেইবি।তোরে ছাড়া আমাদের বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে।”

“ভাবী তৃধু কিন্তু ঠিক কথা বলেছে।আপনাকে ছাড়া আমাদের আড্ডা জমে না একদম।”

তাবানের কথায় মেহরিমা মুচকি হেসে বলে,

“বাবা আরেটু সুস্থ হলেই আমি ও বাড়িতে চলে যাবো ভাইয়া।আজ রাতটা এখানেই থেকে যান।সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া যাবে।”

“আচ্ছা ভেবে দেখবনি।ভাবী আপনার বোনটা কোথায়?ওরে দেখছি না তো?বাড়িতে নেই নাকি?”

তাইফের কথা শুনে ওর মাথায় গাট্টা মারে তাবান। ফিসফিসিয়ে বলে,

“তুই ওরে দেখার জন্যই এসেছিস তাই না?সত্যি করে বল কিন্তু।”

তাইফ তাবানের মতোই ফিসফিস করে বলে,

“হ্যাঁ রে‌।এই কয়দিন তো কোচিংয়ে যাচ্ছে না।তাই এ বাড়িতে আসার সুযোগ খুঁজছিলাম। কিন্তু এখনতো মনে হচ্ছে সব বৃথা যাবে।”

“ধান্দাবাজ ভাই আমার।”

“এই ভাইয়া তোমরা দু’জন কি ফুসুরফুসুর করছো বলোতো?একটু জোরে বলো আমরা দুজনও একটু শুনি।”

“শাকচুন্নীর মাথায় কয়টা চুল থাকে সেটার হিসাব করছিলাম দু’জনে মিলে।”

তাবানের কথা শুনে তৃধা রাগে কিড়মিড় করে ওঠে।ভাই বোনের মাঝে বড়সড় ঝামেলা বাঁধার আগেই মেহরিমা পরিস্থিতি ঠিক করতে বলে,

“সামনে আপুর অ্যাডমিশন টেস্ট তো তাই রুমে বসে পড়ছে।”

তাবান,তাইফ সমস্বরে বলে,

“ওওও আচ্ছা ভাবী।”

ভাইয়া আপনারা একটু বসুন আমি আসছি।এক মিনিটের ব্যবধানেই তৃধার রাগ পড়ে যায়।আগের ন্যায় মুখটা হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ওঠে।মেহরিমার পিছন পিছন কিচেনে চলে যায়।হাতে হাতে নাস্তা গুছিয়ে দু’জনে একসাথে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসে।একথা,সেকথা বলতে বলতে বসে যায় আড্ডার আসর।ড্রয়িংরুমে অনেকগুলো মানুষের কথার শব্দ পেয়ে ঘরের বাইরে আসে মাধবী।সবার জোরাজুরিতে আড্ডায় সামিল হয়।তাইফের ইচ্ছাটাও পূর্ণ হয়ে যায়।সকলের হাসির শব্দ শুনে হৃদিত ততক্ষণে দরজার নিকট এসে দাঁড়িয়েছে।মেহরিমাকে সকলের সামনে খিলখিল করে হাসতে দেখে ভালো,ফুরফুরে মেজাজটা সেকেন্ডের ব্যবধানে বিগড়ে যায়।এই মেয়েটা একটা কথাও শোনে না।কতো করে বলেছে যে শুধুমাত্র হৃদিতের সামনে হাসবে।ওর এই সুন্দর হাসি যেনো আর কেউ না দেখে।এটা দেখার অধিকার শুধুমাত্র হৃদিতের।কিন্তু এই মেয়ে শুনলে তো!

“মেহু বেইবি ক্লাসে অ্যাটেন্ড করবি না আর?”

তৃধার কথাটা আগুনে ঘি ঢেলার মতো কাজ করে।মেহরিমা কে অ্যানাবেলা,লিটল কিটি, সানসাইন, বাটারফ্লাই,অ্যাঞ্জেলা,বেইবি,জান,সোনা,মনা,পাখি,হানি যত নিকনেইম আছে সেগুলো ডাকার অধিকার শুধুমাত্র হৃদিতের।আর কারোর না।হৃদিত
সামনে এগিয়ে আসে।হৃদিতকে দেখতেই তৎক্ষণাৎ সবার হাসি থেমে যায়।চুপ হয়ে যায় সকলে।

“ওর নাম কি তৃধু?”

হৃদিত,মেহরিমার দিকে তাকিয়ে বলে কথাটা।হৃদিতের অতীব গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর।হঠাৎ এমন আজগুবি প্রশ্নে সবার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।মেহরিমার নাম জানতে চাইছে তাও আবার হৃদিত!হৃদিতের তীক্ষ্ণ চাহনির স্বীকার হয়ে তৃধা আমতা আমতা করে বলে,

“মেহু।”

“টেল মি হার ফুল নেইম।”

“মেহরিমা শেখ নীলাক্ষী।”

“সবাই ওরে কি নামে ডাকে?”

“মেহু,শুধু আন্টি ডাকে নীলাক্ষী।”

“তুই কি ডাকিস?”

এ পর্যায়ে এসে তৃধা চুপ হয়ে যায়। ইতস্তত বোধ করে।সময় নিয়ে জবাব দেয়।

“মেহু বেইবি।”

“ওর নাম কি ওইটা?”

“না ভাইয়া।”

“তাহলে ওই নামে কেনো ডাকিস?”

“আর ডাকবো না ভাইয়া।”

“গুড গার্ল।”

হৃদিতের ব্যবহারে মেহরিমা হতভম্ব হয়ে যায়!আজ যেনো হৃদিতের এই ব্যবহার মোটেও স্বাভাবিক লাগে না।বাকিরা হৃদিতের জেলাসি লেভেল দেখে মুচকি মুচকি হাসে।তাবান,তাইফ উপরে উপরে হাসলেও ভেতরে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে আছে।তৃধার মুখেও মুচকি হাসি।মেহরিমার হঠাৎ’ই সেদিনের রাতের কথা মনে পড়ে যায়।ইশশ!কাজের চাপে সবটা ভুলে গেছিল।বিয়ের পরে হৃদিতের ঘটানো সব অস্বাভাবিক ঘটনা গুলো মেহরিমার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।সব কিছু কেমন যেনো একসূত্রে গাঁথা মনে হয় ওর কাছে।

“আমি সন্ধ্যায় আসবো।রেডি হয়ে থাকিস।তোকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো।”

মেহরিমা হতভম্ব অবস্থায়’ই হ্যাঁ সূচক মাথা দোলায়।মন মস্তিষ্ক পড়ে আছে অন্যদিকে।হৃদিত,তাবান আর তাইফ কে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।হৃদিত ওদের নিয়ে চলে যেতেই তৃধা মেহরিমাকে এটা ওটা বলে নাড়তে শুরু করে।মেহরিমা সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বললেও মস্তিষ্ক হাতড়ে বেড়াচ্ছে অজানা এক সত্য উদঘাটনে।

______

সকাল সকাল রেডি হয়ে বসে আছে আরিশা। শ্রেয়া চৌধুরী ইউনিভার্সিটিতে গেছেন‌।উনি রেজাইন লেটার জমা দিবেন।সরকারি চাকরি ছাড়ার মূলত একমাস আগে রেজাইন লেটার জমা দিয়ে থাকে সকলে।যাতে কোনো টাকা না লাগে।কিন্তু শ্রেয়া চৌধুরী এক সপ্তাহের মধ্যেই চাকরি থেকে অবসর নেবেন।টাকার তো আর অভাব নেই।দেশের একমাত্র তথ্য মন্ত্রীর মা বলে কথা।ক্ষমতা,টাকা এ দুটো জিনিস থাকলে আর কি লাগে!আয়াশ মায়ের সাথে সহমত।বয়স হয়েছে এখন ঘুরে ফিরেই বাকিটা জীবন কাটাক।তাহলে মন,মস্তিষ্ক দুটোতেই স্বস্তি মিলবে।আয়াশ নিজেকে পরিপাটি করতে করতে আরিশার দিকে আড়চোখে তাকায়।

“এমন সংয়ের মতো সেজে বসে আছো কেনো?”

“গ্রামে যাবো।”

“কিহ্!কে নিয়ে যাবে তোমাকে?”

“তুমি তো আর নিয়ে যাবে না।তাই ড্রাইভারের সাথে যাবো।”

“ড্রাইভারের সাথে সত্যিই গ্রামে যাবে?নাকি অন্য কোথাও?”

“আজব!অন্য কোথায় যাবো?”

“যেখানে ইচ্ছা যাও কিন্তু তোমার জন্য যদি আর কারোর জীবনে এক বিন্দু পরিমাণও সমস্যা দেখা দেয় তাহলে সেদিন’ই আমার জীবনে তোমার শেষ দিন।”

“আমাকে থ্রেট দিচ্ছো তুমি?”

“হ্যাঁ,কথা না শুনলে কাজেও করে দেখাবো।”

“কিসের এতো অহংকার তোমার? টাকার? ভুলে যেওনা আমার বাবারও কম টাকা নেই।এই দেশের বানিজ্য মন্ত্রী আমার বাবা।”

“ওরে বাবা তাই নাকি!তুমি না বললে তো জানতামই না তোমার বাবা ওতো বড় একজন মানুষ।ওনার সাথে একবার দেখা করতে হয় দেখছি।”

“মজা করবে না একদম।তোমাদের থেকে কোনো অংশে কম না আমার বাবা।”

“হ্যাঁ আমিও তো সেটাই বলছি।”

“বললে না তো কিসের এতো দাপট তোমার?এই সুদর্শন চেহারার?”

“মনের মধ্যে ভালোবাসা থাকলে সৌন্দর্যের প্রয়োজন পড়ে না সোনা।তবুও একটু বলি ওকে?আমি রাস্তায় বেরোলে মেয়েরা আমার দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে।নেহাতই একটা বিয়ে করে ফেলেছিলাম।আর আমার অহংকার হচ্ছে,আমার নিঃস্বার্থ ভালবাসা।যেটা তোমার আর তোমার সো কলড বাবার মধ্যে নেই।তোমাদের নেশা মানুষ ঠকানো।টাকা দিয়ে সবকিছু হয়না আরু।”

আয়াশের কথায় আরিশার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।গলায় কান্না আটকে বলে,

“তুমি কি এখনও আমাকে আগের মতোই মনে করো?”

“তুমি তো আগের মতোই আছো।এখানে মনে করার কি আছে?আ’ম অলরেডি লেইট।সাবধানে যেও।”

আয়াশ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।ওর যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরিশা।চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। অস্পষ্ট স্বরে বলে,

“ভালোবাসা কি জোর করে হওয়ার জিনিস?আমিও তো তোমায় ভালোবাসতে চাই।কিন্তু অতীত সেটাতো আমার পিছু ছাড়েনা।তোমার প্রতি দেহের টা ন অনুভব করলেও মনের টা ন অনুভব করতে পারিনা।তোমাদের ধ্বং স করতে এসে তোমার পবিত্র ভালোবাসাতে আমি নিজেই ধ্বং স হচ্ছি প্রতিনিয়ত।নিজের উদ্দেশ্যে’ই ভুলতে বসেছি আমি।ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়!”

#চলবে

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-২৫+২৬

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৫
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

হসপিটালের করিডোরে পেতে রাখা একটা চেয়ারে বসে আছে মেহরিমা।দৃষ্টি নিবদ্ধ ফ্লোরে।পাশের চেয়ারে বসে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে চলেছে মাধবী।সকালের প্রথম প্রহরে হার্ট অ্যাটাক করেছেন জলিল শেখ।সেই সকালেই শহরের হসপিটালে নেওয়া হয় ওনাকে।শহরের ডক্টরেরা নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করতেই তৎক্ষণাৎ ওনাকে নিয়ে চৌধুরী পরিবার আর শেখ পরিবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।বড় একটা প্রাইভেট হসপিটালে অ্যাডমিট করানো হয় জলিল শেখকে।এখন অপারেশন চলছে ওনার।

গতকাল রাত থেকে হৃদিতের উপরে একটা চাপা রাগ জমে আছে মেহরিমার।কোটি কোটি টাকা,গাড়ি,বাড়ি সব আছে বলেই যে রাগ উঠলেই ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করতে হবে এ কেমন কথা?এই বিষয়ে গতরাতে দু’জনের মাঝে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে।হৃদিত হার মেনে নিয়েছে।গতকাল রাত থেকে সহস্র বার ছরিও বলে ফেলেছে ইতোমধ্যে।তবুও মেহরিমার রাগ কমেনি। আসলে সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেওয়া পোলাপান টাকার মর্ম বুঝবে কিভাবে?বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা মূলত এই টাকার জন্যই উচ্ছন্নে যায়।মেহরিমার মনের মাঝে হাজারও প্রশ্ন জমা হয়েছে। কিন্তু এর উত্তর কোথায় পাবে?কে দেবে?কে এই মনের ভার কমাবে?হৃদিতের সমস্যা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে মেহরিমা।এই নিয়ে যে তাবান,তাইফের সাথে একটু কথা বলবে সেই সুযোগও হয়ে ওঠেনি। সারারাত না ঘুমিয়ে ভেবেছিল সকালে এই বিষয়ে কথা বলবে কিন্তু তার আগেই ঢাকায় ছুটতে হয়েছে।সকালে কোরআন শরিফ পড়ার সময় বাবার হার্ট অ্যাটাকের খবর পেতেই মেহরিমার পুরো পৃথিবী থমকে যায়।সেই এক কাপড়েই চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করে শেখ বাড়িতে উপস্থিত হয়। বাবার জন্য বুক ফেটে কান্না আসছে।খুব কষ্টে গলায় আঁটকে থাকা কান্নাটা গিলে ঠাঁয় বসে আছে মেহরিমা।মেয়েদের যে এতো সহজে ভেঙে পড়তে নেই।এই কয়দিনে খুব করে এটা বুঝে গেছে মেহরিমা‌।নিজের ভাবনার মাঝেই চোখের সামনে একটা পানির বোতল ধরা দেখতেই হাতের মালিকের দিকে দৃষ্টিপাত করে।হৃদিতের মলিন মুখমণ্ডল।মেহরিমার খুব মায়া হয়।কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।মূলত এই জগৎ সংসারের প্যাঁচে পড়ে মন, মস্তিষ্ক,শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।এজন্যই বোধহয় মা বলত ‘আমরা মানুষেরা কল্পনাতেই সুখী।বাস্তবতা বড়ই কঠিন।’

“কি ভাবছিস এতো?এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বি তো।”

“হুম?”

হৃদিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তার মানে অ্যানাবেলা কিছুই শোনেনি।

“আমার উপর রাগ,অভিমান যত মন চাই কর। তবে এটার জের ধরে নিজের প্রতি অবহেলা, অযত্ন করিস না প্লিজ।নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগে আমার।আমাকে একটু সময় দে তোর রাগ ,অভিমান সব ভাঙিয়ে দেবো। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো।অথচ এখনো কিছুই মুখে দিলি না।এ কেমন অভিমান তোর?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা হতবাক হয়ে যায়!হৃদিতের উপর করা রাগ থেকে ও তো কিছুই করেনি।মন ভালো না থাকায় খাবার খাইনি।খেতে মন না চাইলে খাবেটা কিভাবে?আর এই মানুষটা কতদূর পর্যন্ত ভেবে নিয়েছে।কিন্তু ক্লান্ত মস্তিষ্ক সত্যটা বলতে একটুও ইচ্ছে প্রকাশ করলো না।

“বাবার অপারেশন ঠিকঠাক ভাবে শেষ হোক। তারপর খাবো।আপাতত খেতে ইচ্ছে করছেনা।”

“পানিটা নিয়ে মাধবীর সাথে ওয়াশ রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।ভালো লাগবে।আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলে পানির বোতল মেহরিমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে ওখান থেকে প্রস্থান করে হৃদিত।মেহরিমা হৃদিতের একরোখামিতে না চাইতেও মুচকি হাসে।ভালোবাসা বোধহয় এই ছোট ছোট কেয়ার গুলোর মধ্যেই লুকায়িত থাকে।এই দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে মেহরিমা অনেক ভাগ্যবতী।মেহরিমা ঘাড় ঘুরিয়ে মাধবীর দিকে তাকায়।সেই সকাল থেকে কেঁদেকুটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।

“এভাবে আর কতো কাঁদবে?কান্না করলেই কি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে?”

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মেহু।বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?”

“কান্না না করে আল্লাহর কাছে দোয়া করো।দোয়া ইউনুস পড়তে থাকো।আল্লাহ যেনো এই বিপদ থেকে শিঘ্রই আমাদেরকে মুক্তি দেন।বাবাকে সুস্থ করে দেন।”

মাধবী কাঁদতে কাঁদতে মেহরিমাকে জড়িয়ে ধরে।

“আর কাঁদে না মাধুপু।ওয়াশ রুমে চলো হিজাব খুলে চোখে মুখে ভালো করে পানি দেবে।আমিও হিজাব ঠিক করবো।তখন তাড়াহুড়োতে হিজাবটাও ঠিকভাবে মারতে পারেনি।”

ওরা দু’বোন ওয়াশ রুমে চলে যায়।সেদিকে তাকিয়ে অবনী শেখ মলিন, বিষন্ন মুখেই হাসেন। ছোট্ট মেহরিমাটা এতো তাড়াতাড়ি এভাবে বড় হয়ে যাবে উনি কি তা কখনো ভেবেছিলেন।যেখানে মাধবীর শক্ত থাকার কথা সেখানে মেহরিমা শক্ত হয়ে বড়বোন কে আগলে রাখছে।দৃশ্যটা খুবই মনোমুগ্ধকর লাগে ওনার কাছে।মন জুড়িয়ে যায়।এজন্যই বোধহয় মানুষ বলে ‘সময় আর দায়িত্ব মানুষ কে সবচেয়ে বেশি ম্যাচিউর করে তোলে।বয়স!সে তো দুটো সংখ্যা মাত্র।”

মেহরিমা,মাধবী ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে হৃদিত খাবার হাতে দাড়িয়ে আছে। ওদের দেখতেই সামনে এগিয়ে আসে।

“এই করিডরের লাস্টেই খাওয়ার জন্য আলাদা একটা হলরুম আছে।ওখানে যেয়ে তোরা দু’জন খেয়ে নে।আমি বাকিদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি।”

“আপনি খেয়েছেন?”

“হ্যাঁ।তোরা তাড়াতাড়ি খেয়ে আয় যা।”

হৃদিতের কথাটা মেহরিমার ঠিক বিশ্বাস হয়না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে।হৃদিত আবারও তাড়া দিতেই তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে খাবার গুলো হাতে করে হলরুমের উদ্দেশ্যে চলে যায় মেহরিমা,মাধবী।হৃদিত অবনী শেখের কাছে আসে।অবনী শেখ,আয়েশা চৌধুরী,আতিয়া চৌধুরী একসাথে বসে আছেন।তৃধা,তাবান,তাইফ বাইরে খেতে গেছে।হসপিটালে বসে খেতে পারবে না সেজন্য।আজাদ চৌধুরী আরিফ চৌধুরীর সাথে কি একটা কাজে বাইরে গেছেন।আয়াশ,আরিশা কে নিয়ে ওর বাবার বাসায় গেছে।ওদের সাথে আয়রা চৌধুরীর পুরো পরিবারও আছে।হসপিটালে থাকতে যেয়ে নাকি ওনাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে।ঢাকাতে এসেছে সবে এক ঘন্টা।এসেই নিজেদের ঢং শুরু করে দিয়েছে।আয়াশ এক প্রকার বিরক্ত হয়ে ওনাদেরকে রেখে আসতে গেছে।আর এমনিতেও প্রয়োজন ছাড়া হসপিটালে ভিড় না জমানোই বেটার।শ্রেয়া চৌধুরী নিজেদের বাসায় গেছে।কেনো গেছে সেটা অবশ্য সকলের নিকট অজানা।

“মা,মেজোমা,ছোটমা তোমরা খাবে না?হসপিটালে পেশেন্টের পাশে থাকে সুস্থ সবল মানুষ।”

“আমরা ঠিক আছি বাবা।”

অবনী শেখের কথায় হৃদিত মলিন হেসে বলে,

“এখন নাহয় ঠিক আছেন মা।এভাবে না খেয়ে থাকলে কতক্ষন ঠিক থাকতে পারবেন?বাবার কাছে কিন্তু আমি অসুস্থ কাউকে অ্যালাও করবো না।”

হৃদিতের কথা বলার ধরন দেখে উপস্থিত তিন মায়েরই মুখে হাসি ফুটে ওঠে।আয়েশা চৌধুরী হৃদিতের হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে দেন।

“পাগল ছেলে আমার।সবাই কে যে এতো খাওয়ানোর চেষ্টা করছিস,তা তুই খেয়েছিস কিছু?”

হৃদিত অকপটেই মিথ্যা বলে।

“হ্যাঁ আমি খেয়েই মেহরিমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসলাম।তোমরা বসো আমি খাবার নিয়ে আসি।”

হৃদিত উঠতে নিলেই সেখানে উপস্থিত হয় শ্রেয়া চৌধুরী।ওনার সাথে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশ/একুশ বছরের মেয়ে।মেয়েটার হাতে খাবারের বড় একটা ব্যাগ।

“খাবার আনতে যেতে হবে না বাবা।আমি রান্না করে এনেছি।বাইরের তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার দরকার নেই তোমাদের।অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।”

“আপনাকে রান্না করতে কে বলেছে?এখানে কেউ খেতে চেয়েছে আপনার হাতের রান্না?”

মূহুর্তেই শ্রেয়া চৌধুরীর মুখে আঁধার নেমে আসে।ছলছল চোখে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

“আহা হৃদিত বাবা আমার,রাগ করেনা।আপা তো ভালোই করেছে।আপা আপনি এদিকে আসুন।ওর কথায় কিছু মনে কইরেন না।বোকা ছেলেটা আমার
কখন কোথায় কি যে বলে তার ঠিক নেই।”

আয়েশা চৌধুরীর বলা কথাটা তীরের মতো বিঁধে শ্রেয়া চৌধুরীর বুকে।শ্রেয়া চৌধুরী তখনও ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।ওনার দৃষ্টি যেনো চিৎকার করে বলছে।’আমি জন্মদাত্রী মা হয়েও তোমার কাছে এতোটা পর হয়ে গেলাম বাবা?আমার থেকে অন্যদেরই তোমার উপর বেশি অধিকার হয়ে গেলো?এ কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ তুমি আমায়?’হৃদিত নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।মায়ের করুণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা ওর নেই।যতই হোক মা তো!এক সময় এই মানুষটাই ওর পৃথিবী ছিলো।তাই এই দৃষ্টিতে এখনও বুক কাঁপে।বুকটা ভার হয়ে ওঠে।মা তো পবিত্র,নিষ্পাপ হয় তাহলে ওর মা কেনো পাপী হলো?মা ছেলের মাঝে এমন আকাশ ছোঁয়া প্রাচীর কেনো উঠল?হৃদিতের দিকে তাকিয়ে অবনী শেখ মুচকি হাসেন।ছেলেটাকে বড্ড অদ্ভুত লাগে ওনার কাছে। ভেতরে এক আর বাইরে এক।শক্ত খোলসে মোড়ানো মানুষ গুলোই বোধহয় এমন।সবাই মিলে এক প্রকার জোর করে অবনী শেখকে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যান।অবনী শেখ হৃদিতের কথা ফেলতে না পেরে অনিচ্ছা নিয়েই ওনাদের সাথে যান।হৃদিত ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।শ্রেয়া চৌধুরী ধীর পায়ে হেঁটে এসে দুরত্ব রেখে হৃদিতের পাশের চেয়ারে বসে।হাতে থাকা খাবারের বক্স টা দু’জনের মাঝের চেয়ারটাতে রাখে।

“আমি জানি তুমি এখনও কিছুই খাওনি।তোমার পছন্দের কাচ্চি রান্না করে এনেছি। তুমি আমার হাতের রান্না খাবেনা বলে শেফালিকে দিয়ে রান্না করিয়েছি।আমার কথাটা রাখো প্লিজ।খেয়ে নেও বাবা।”

হৃদিত ফ্লোরে দৃষ্টি রেখেই জবাব দেয়।

“ক্ষুধা নেই।”

“আমি খাইয়ে দিই?”

“প্রয়োজন নেই।”

কথাটা বলেই হৃদিত উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে মেহরিমা, মাধবী উপস্থিত হয়েছে।

“এখানেই থাকিস।ডক্টর,নার্সদের কখন কি দরকার হয় না হয় বলা তো যায় না।কোনোকিছু দরকার পড়লেই আমাকে কল করবি।আমি কাছেই আছি।”

মেহরিমাকে জবাব টুকু দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই ওখান থেকে দ্রুত কদম ফেলে চলে যায় হৃদিত। পিছনে ফেলে যায় এক জোড়া ছলছল চোখের ব্যথিত হৃদয়ের জননীকে।যে মানুষটার বুকের মাঝে বয়ে চলেছে ঘূর্ণিঝড়।শ্রেয়া চৌধুরী চোখে জল মুখে মলিন হাসি দিয়ে নিজের প্রাণের টুকরো ছেলের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে।আহ্ জীবন!এই জীবন যেন নাটকের চেয়েও নাটকীয়।যাদের জন্য সব ভুলে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলো।আজ যেনো এক নিমিষেই সবটা মিথ্যা হয়ে গেলো।শ্রেয়া চৌধুরী এই মূহুর্তে উপলব্ধি করলেন এই জীবনের আর কোনো মূল্য নেই।

“আমার বাবাটা সকাল থেকে এখনও কিছু খাইনি বউমা।ওর না খেয়ে থাকার অভ্যাস নেই।না খেয়ে থাকলে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে।ওকে জোর করে হলেও খাইয়ে দিও।”

ভাঙা গলায় কথাগুলো বলেই ওখান থেকে চলে যান শ্রেয়া চৌধুরী।মেহরিমা শ্রেয়া চৌধুরীর যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।পরক্ষণেই অযত্নে পড়ে থাকা খাবারের বক্সটার দিকে চোখ পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

#চলবে___

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৬
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

গোধূলি লগ্নে আকাশে ছুটে চলেছে কালো মেঘের ভেলা।বৈরী বাতাসে গাছপালার সাথে সাথে যেনো সুউচ্চ বিল্ডিং গুলোও দুলে উঠছে।প্রকৃতি তমসাচ্ছন্ন।সময় বিকালের শেষ ভাগ হলেও প্রকৃতি দেখে তা বোঝার উপায় নেই।দেখে মনে হচ্ছে মধ্যরাত।হঠাৎ আকাশ ফেটে ঝিরিঝিরি বর্ষণ শুরু হয়।বর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে সবাই দ্রুত পায়ে ছুটে চলেছে এদিকে ওদিকে।শীতের আগমন কে দ্বিগুণরুপে অনুভব করানোর জন্যই ধরনীর বুকে এই বর্ষণ।

হৃদিত রাস্তার পাশে একটা ছাতিম গাছের নিচে একমনে দাঁড়িয়ে আছে।হাতের দু’আঙুলের ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট।অর্ধেকটা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।মনের ভেতরটাও ঠিক এভাবেই পুড়ে চলেছে অনিমেষ।হাহ্!সেই খবর কি কেউ রাখে?সবাই তো শুধু কঠিন,গম্ভীর হৃদিত টাকেই দেখতে পাই।হৃদিত সিগারেটে একটান দিয়ে দৃষ্টিপাত করে মাথার উপরে থাকা গাছটার শুভ্র রঙা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলগুলোর দিকে।

শীতের শুরুতেই ফোটে ছাতিম ফুল। স্থানীয়ভাবে কোনো কোনো যায়গায় ছাতিয়ান,ছাত্তিয়ান নামেও পরিচিত এই গাছ।গোধূলি বেলা থেকে সারা রাত ঝাপটা বাতাসে সুন্দর মধুমাখা মাদকতাময় সুগন্ধ ছড়িয়ে থাকে এই ফুল।হৃদিত গাছের নামটা মনে করার চেষ্টা করে।পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে যায় গাছটার নাম ‘ডেভিলস ট্রি’।ওর বাগান বাড়িতেও দুটো এই গাছ লাগানো আছে।একটা ওর দোলতার বেডরুমের ব্যালকনি বরাবর আরেকটা মেইন গেইটের সামনে।শুভ্র রঙা ফুল গুলো দেখতে হৃদিতের খুব ভালো লাগে।প্রকৃতির নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যৈর বাহার দেখে মনটা হালকা হয়। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়তেই চোখদুটো ছলছল করে ওঠে।ততক্ষণে জোরালো বর্ষণ শুরু হয়েছে।যার ফলে অনায়াসেই চোখের পানি লুকিয়ে ফেলতে পারে।হৃদিতের গায়ে থাকা সফেদ রঙা শার্টটা ভিজে চুপচুপে হয়ে শক্ত পোক্ত সুঠাম পুরুষালি দেহের সাথে লেপ্টে আছে।বৃষ্টির ফোঁটা সুদর্শন মুখখানার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

“রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের সৌন্দর্য দেখিয়ে মেয়ে পটাচ্ছেন?এই কয়দিনেই বুঝি পুরোনো হয়ে গেলাম?”

মেহরিমার কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। নিজের প্রেয়সীর অভিমানী কন্ঠ শুনতেই মুচকি হাসে হৃদিত।ঘাড় ঘুরিয়ে মেহরিমার দিকে দৃষ্টিপাত করে।একটা পার্পল কালারের ছাতা নিয়ে মুখটা ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।শরীরে জড়ানো ডিপ মেরুন কালারের থ্রি পিচ।তীব্র বৃষ্টির ফলে মাথার উপর ছাতা থাকা সত্ত্বেও অনেকটা ভিজে গেছে।দেখতে মোহনীয় লাগছে।হৃদিত ঠোঁট কামড়ে আবারও মুচকি হাসে।মুখে বলে,

“তাই বুঝি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“বৃষ্টির মধ্যে আসতে গেলি কেনো?কল‌ দিলেই পারতিস।”

“আপনার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। অনেক বার ট্রাই করেছি।”

হৃদিত পকেট হাতড়ে ফোন বের করে। সত্যিই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে।

“সরি জান। চার্জ শেষ।আমি খেয়াল করি নাই।”

মেহরিমা এগিয়ে এসে হৃদিতের মাথার উপর ছাতাটা ধরার চেষ্টা করে।অনেক কষ্টে দু’পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে ছাতা ধরতে সফল হয়।মেহরিমার কান্ড দেখে এ পর্যায়ে হৃদিত হেসে ওঠে।মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।দু’জনের মাঝে এক ইঞ্চি ব্যবধান।

“আমি মাঝে মাঝে অবাক হই!এতটুকু একটা মেয়ে আমাকে দিব্যি হাতের ইশারায় নাচিয়ে চলেছে।”

কথাটা বলে হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট টা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মাটিতে।মেহরিমার নরম কোমর আকড়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।বৃষ্টির ঝাপটায় ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় চারিপাশটা অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।আশেপাশে মানুষের কোনো চিহ্ন নেই।হঠাৎ হৃদিতের ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে ওঠে মেহরিমা।কোনোরকমে বলে,

“কেউ দেখে ফেলবে ছাড়ুন।”

“এখানে কেউ আছে নাকি?আর থাকলেও হু কেয়ারস?”

মেহরিমা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ন্যানো সেকেন্ডের ব্যবধানে উঁচু করে তুলে গাছের সাথে চেপে ধরে।হাতে থাকা ছাতাটা রাস্তার দিকে ধরে নিজেদের আড়াল করে অধরে অধর মিশিয়ে দেয়।মেহরিমা ছটফটিয়ে ওঠে।শক্ত পোক্ত শরীরের মাঝে থেকে ছাড়া পেতে অনবরত মোচড়া মুচড়ি করতে থাকে।কিন্তু হৃদিতের সুঠাম পুরুষালি দেহের কাছে ও নেহাতই একটা মশা।এভাবে হুদাই মোচড়া মুচড়ি করে কোনো কাজ হবে না বুঝতে পেরেই একসময় নিজে থেকেই শান্ত হয়ে যায়।হৃদিতের অবাধ্য হাতের বিচরণ ও থেমে যায়।সময় নিয়ে ছাড়ে মেহরিমাকে।মেহরিমা লজ্জায় চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে।হৃদিতের ঠোঁটে আত্মতৃপ্তির হাসি।

“তোর ভালোবাসা ছাড়া এতক্ষণ নিজেকে অসম্পূর্ণ লাগছিল।নাউ আ’ম ফুলফিল।”

“সিগারেট খেয়ে চু মু খেতে আসবেন না।আই হেইট সিগারেট।ওটার গন্ধ আমার সহ্য হয়না।”

“তাহলে কি খেয়ে চু মু খেতে আসবো? হুইস্কি খেয়ে?ওটা বুঝি ভালো লাগে তোর?”

“দেখুন…”

মেহরিমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হৃদিত বলে,

“উইল ইয়্যু শো আপ হেয়ার?আ’ম…”

মেহরিমা দ্রুত হৃদিতের মুখ চেপে ধরে।হৃদিতের কথা অসম্পূর্ণই থেকে যায়।

“আর একটাও উল্টাপাল্টা কথা না।আপনি আমায় একটুও ভালোবাসেন না তাই না?এজন্যই আমার কথা শুনতে চাচ্ছেন না।”

“আ’ম সরি লিটল কিটি।আর হবে না।”

হৃদিতের অসহায় চাহনি।সেটা দেখতেই মেহরিমা ফিক করে হেসে ওঠে।গতকাল রাতের পর থেকে এই প্রথম একটু হাসে মেহরিমা।হৃদিতের বক্ষস্থলে প্রশান্তি অনুভূত হয়।মেহরিমা হাসি থামিয়ে নিজে থেকেই বলে,

“জানেন,আল্লাহর রহমতে বাবার অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।ডক্টর আঙ্কেল জানিয়েছেন দুই,এক ঘন্টার মাঝেই বাবার সেন্স ফিরে আসবে।”

“ভালো তো।”

“ভালো কি হু?বলুন আলহামদুলিল্লাহ।”

হৃদিত মৃদু হেসে আলহামদুলিল্লাহ বলে।মেহরিমা চুপচাপ হৃদিতের হাত ধরে সামনে হাঁটতে থাকে।হৃদিত ও চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো মেহরিমার সাথে তাল মিলিয়ে হাটে।লিফটে উঠে সাত তলার বাটন চেপে হৃদিতের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মেহরিমা।

“আমাকে মিথ্যা কেনো বলেছেন?”

মেহরিমার কথায় হৃদিত ভ্র যুগল কুঁচকে ফেলে।

“কিসের মিথ্যা?”

“আপনি আজ সারাদিন না খেয়ে আছেন কেনো?”

“ইচ্ছে হয়নি তাই।”

“আমিও না খেয়ে আছি।”

কথাটা শুনতেই হৃদিতের ভ্রু জোড়া শিথিল হয়ে যায়।অবাক কন্ঠে বলে,

“তখন তুই খাস নি?”

“না।”

“কিন্তু কেনো।”

“ইচ্ছে নেই তাই।”

হৃদিতের কন্ঠে এবার অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।এগিয়ে এসে মেহরিমার মুখটা দু হাতের মাঝে নিয়ে বলে,

“তাই বলে তুই সারাটা দিন না খেয়ে থাকবি জান?সব ভুল আমার।তোর দিকে আরও ভালোভাবে খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।আমায় ক্ষমা করে দে।খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না সোনা?”

হৃদিতের এতো ভালোবাসা পেয়ে মেহরিমা আপ্লুত হয়ে পড়ে।চোখের কোণায় জলেরা চিকচিক করে ওঠে।অভিমানী কন্ঠে বলে,

“আরেকজন ও তো না খেয়ে আছে সেই বেলায় কিছু না তাই না?তাকে বলে দিবেন তিনি না খেলে এই মেহুও খাবে না হু।সে কি শুধু একাই ভালোবাসতে জানে নাকি!”

মেহরিমার বাচ্চামিতে হৃদিত না চাইতেও হেসে ওঠে।চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।

“মহারানী,আমার বড় ভুল হয়ে গেছে।এখন কি ভুলের জন্য এই অধমের গর্দানটা নিয়ে নিবেন? আপনি চাইলে নিতে পারেন।”

“এইবার প্রথম ভুল সেজন্য ক্ষমা করা হলো। পরবর্তীতে কিন্তু আর ক্ষমা পাবেন না।সত্যিই গর্দান নিয়ে নেবো।”

“যথা আজ্ঞা মহারানী।”

দু’জন দু’জনের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই হেসে ওঠে। নিজেদের ফ্লোরে পৌঁছাতেই ওরা লিফট থেকে বের হয়ে আসে।মেহরিমা হৃদিতকে নিজের পিছু পিছু আসতে বলে সোজা হলরুমের দিকে চলে যায়।

দু’জন কে অর্ধভিজে অবস্থাতে দেখতেই করিডোরে উপস্থিত বাড়ির সবাই চাঁপা হাসে।জলিল শেখের অপারেশনটা ঠিকঠাক ভাবে হওয়াতে সবাই অনেকটা টেনশন ফ্রি এখন।মেহরিমা হাত ধুয়ে আসে।হৃদিত ততক্ষণে মেহরিমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।ওর ওড়না নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলে,

“খেয়ে আমার সাথে বাসায় যাবি। ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে।এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে তোর ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“আর নিজের যে ইতোমধ্যে নাকমুখ লাল হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল আছে?”

“এইতো এখন তুই খেয়াল করলি।তুই আর আমি তো একই হলাম তাই না?”

“থাক আর ঢং করতে হবে না।জলদি খেয়ে নিন‌।”

কয়েক সেকেন্ড পেরোতেই হৃদিত হাঁচি দিতে শুরু করে।মুখমণ্ডল লাল টকটকে হয়ে ওঠে।মেহরিমা হৃদিতের কপালে হাত দিয়ে দেখে তাপমাত্রা তুলনামূলক অনেকটা বেশি।মেহরিমার রাগে কষ্টে কান্না পায়।

“বৃষ্টির পানি যখন সহ্য হয়না তখন ভিজতে যান কেনো?এক ঝামেলার মধ্যে আরেক ঝামেলা না বাধালে আপনার ভালো লাগে না তাই না?”

“বৃষ্টির পানির সাথে নিজের মনের সব ক্ষত,বিষাদ ধুয়ে নিঃশেষ করে দিতে।দেহের জ্বর হলে কেয়ার করার জন্য তুই আছিস,আরও কতশত মেডিসিন আছে।কিন্তু মনের ক্ষত!সেটা ঠিক করার জন্য তো কেউ নেই,কোনো মেডিসিন নেই।সেটা তো দিনশেষে আমাকেই সারতে হবে জান।”

মেহরিমা অবাক হয়ে সবটা শোনে।ঠোঁটে হাসি টেনে বলে,

“ক্ষত সারতে চাইলে বারবার সেটাকে স্পর্শ করা বন্ধ করুন।আমাদের জীবন মায়ায় আটকে যাওয়া এক অবরুদ্ধ কারাগার।আর কথা যখন মা বাবা পরিবার কে নিয়ে তখন সেই মায়া অসীম। চেষ্টা করুন আপনিও ক্ষত সেরে উঠতে পারবেন। আপনাদের ভেতরের কোনো কিছুই আমি জানিনা তবে সব সময় আপনার পাশে আমাকে পাবেন।”

“আমার জীবনের গল্পটা ভূমিকাহীন অ্যাঞ্জেলা।তুই খুব সহজেই সবটা পড়তে পারবি কিন্তু বুঝে উঠতে পারবিনা।”

“আপনাকে বোঝার জন্য জানার জন্য আমার সারাটা জীবন পড়ে আছে।প্রতিদিন একটু একটু করে জানবো,বুঝবো তাহলে তো হবে?”

প্রত্যুত্তরে হৃদিত মুচকি হাসে।মেহরিমা আর কথা না বাড়িয়ে শ্রেয়া চৌধুরীর আনা বক্স থেকে খাবার তুলে হৃদিতের মুখের সামনে ধরে।আর অমনিই হৃদিতের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।

“এটা ওনার আনা খাবার তাই না?”

“কার?”অবুঝের ন্যায় বলে মেহরিমা।

“শ্রেয়া চৌধুরীর।”

“খাবার তো খাবারই।এখানে কি কোথাও মায়ের নাম লেখা আছে?কথা কম বলে খেয়ে নিন তো। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।”

হৃদিত কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই মেহরিমা ওর মুখে খাবার পুরে দেয়।হৃদিতের হাবভাব দেখে তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে,

“খাবার ফেলে দিলে কিন্তু আমি আর খাবো না।”

ব্যস অমনিই অগত্যা হৃদিতকে অনিচ্ছা নিয়েই খেতে হয়।মেহরিমা মনে মনে হাসে।এই ছেলেকে সোজা করা ওর বাম হাতের ব্যপার।

“বাবার সেন্স আসলে তারপর বাসায় যাই প্লিজ।”

“নো।তোকে নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে পারবো না জান।এখান থেকে এমপির বাসা মাত্র দশ মিনিটের রাস্তা।”

“কিন্তু ওখানে যেয়ে আমি পরবো টা কি?”

“ওয়েল লিভ ইট।ইয়্যু ডোন্ট হ্যাভ টু অয়্যার অ্যানিথিং।এমনিতেও একটু আগেই তো তুই বললি..”

মেহরিমা কটমট করে তাকায়।হৃদিত চুপ হয়ে যায়।ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।

জানালার নিকট দাঁড়িয়ে থাকা শ্রেয়া চৌধুরীর মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে।ওদের কথা শুনতে না পারলেও নিজের হাতে রান্না করা খাবার ছেলেকে খাওয়াতে পেরে মনে মনে মেহরিমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।হৃদিত মায়ের হাতের খাবারের স্বাদ খুব সহজেই বুঝে যায়।তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে জানালার দিকে তাকায়।

“ভেবো না এসব করে নিজের পাপকে মুছতে পারবে।মেহুমা অতীত জানে না বিধায় এগুলো করছে।জানলে তোমার প্রাপ্য শাস্তি ও নিজেই দেবে।”

নিজের স্বামীর কথায় শ্রেয়া চৌধুরী হেসে উঠে বলেন,

“আমার সাথে তুমিও তো সমান দোষী।সমস্যা নেই দু’জনে একসাথে মিলে শাস্তি ভোগ করবো কেমন?”

আরিফ চৌধুরীর মুখটা থমথমে হয়ে যায়।রক্তচক্ষু দিয়ে শ্রেয়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে থাকেন।শ্রেয়া চৌধুরীর মুখে কুটিল হাসি।

#চলবে___

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-২৩+২৪

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৩
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

অম্বরে কালো মেঘের ভেলা ছুটে চলেছে এদিকে ওদিকে।মেঘের আড়ালে নিজের সুন্দর মুখখানা লুকিয়েছে শশী।বইছে বৈরী পবন।সুবিশাল অম্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে ক্ষণে ক্ষণে ডেকে চলেছে কাদম্বিনীর দল।চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।থেকে থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক।শীতের কুয়াশামাখা রাত।আশেপাশে সবটা কুয়াশায় আচ্ছন্ন।ছাদে দোলনায় বসে আছে মেহরিমা।ধ্যান, জ্ঞান কোথায় পড়ে আছে বোঝা মুশকিল।মেহরিমার দৃষ্টি যেয়ে থেমেছে চৌধুরী বাড়ির ডান পাশের জঙ্গলে। যেথায় মনের আনন্দে ছুটে চলেছে একঝাঁক জোনাকি।ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে হৃদিত।দৃষ্টি অ্যানাবেলার মুখমণ্ডলে।তখন মেহরিমার প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় নি হৃদিত।মেহরিমার হাত ধরে নিয়ে এসে দোলনায় বসিয়ে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে।আর কোনো টুঁশব্দ করেনি।মেহরিমাও আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি।এভাবে নিরবতায় কেটেছে বেশ কিছুক্ষণ।

“আমায় বিশ্বাস করিস?”

মেহরিমার ধ্যান ভাঙে।হৃদিতের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে।সময় নিয়ে জবাব দেয়।

“নিজের থেকেও বেশি।”

“তাহলে আমার উপর ভরসা রাখ।খুব শিঘ্রই সবটা ঠিক হয়ে যাবে।আমাদেরও সুন্দর একটা সংসার হবে।”

“আচ্ছা রাখলাম ভরসা।”

“তুই সবচেয়ে বেশি কাদের ঘৃণা করিস?”

“বিশ্বাসঘাতক,পাপী দের।”

“যদি আমিও তাদের মধ্যে একজন হয়ে থাকি?”

মেহরিমা চুপ হয়ে যায়।আবারও নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় চারিপাশ।আকাশ চিরে আলোর ঝলকানি রেখা ফুটে ওঠে।মেহরিমা আঁখিযুগল বন্ধ করে নেয়।সেভাবেই মৃদু কন্ঠে উত্তর দেয়।

“আমার কাছে সব পাপীরা সমান।”

“যদি কখনও আমাকে তোর পাপী মনে হয়।ডিরেক্ট বুকে ছু রি চালিয়ে দিবি।কখনো বিচ্ছেদ চাইবি না।বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আমি সইতে পারবো না।তোর হাতে
ম র তে সদা প্রস্তুত আমি।তবুও একান্ত তোর হয়েই
ম র তে চাই।”

“পাপীকে একবারেই মে রে ফেলাতে কোনো শান্তি নেই।প্রতি সেকেন্ড,প্রতি মিনিট,রোজ নিয়ম করে
মা রা তে আলাদা শান্তি আছে।”

হৃদিতের হৃদয় কিছু সময়ের জন্য থমকায়। অবিশ্বাস্য চাহনি দিয়ে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে।এই মেহরিমা তো হৃদিতের মেহরিমা না। সম্পূর্ণ নতুন ভিন্ন এক মেহরিমা।মেহরিমা মুচকি হাসে।

“আপনি তো আর বিশ্বাসঘাতক,পাপী নন।আপনি আমার ভালোবাসার পবিত্র একজন মানুষ। আপনার ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ হই প্রতিক্ষণ। আপনার ভালোবাসা আমার হৃদয়ে ছড়ায় ফুলের সুবাস।আল্লাহর দেওয়া সেরা উপহার আপনি।”

“আমার দ্বারা কখনো কোনো ভুল হলে একবার সুযোগ দিস।যেভাবেই হোক নিজের করে রেখে দিস।জীবন তো একটাই।পুনর্জন্ম তো আর হবে না তোকে আবার নিজের করে পাওয়ার জন্য,তোকে দু’চোখ ভরে দেখার জন্য।”

মেহরিমা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।হৃদিত নিজেকে সামলায়।মেহরিমার ডানহাত দুহাতের মুঠোয় নিয়ে টপাটপ চু মু বসিয়ে দেয়।মেহরিমাকে হারানোর ভয় চারিদিক থেকে জেঁকে ধরে।ভেতরে ভেতরে দিশেহারা হয়ে পড়ে।

“আপনার সেজো বাবা আয়মান চৌধুরী কিভাবে মারা গেছিল?”

“খু ন করা হয়েছে ওনাকে।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমার ঠোঁট দুটো নিজে থেকেই দুদিকে সরে যায়।নিজের হতভম্ব ভাব কাটাতে কয়েক মিনিট সময় লাগে মেহরিমার।

“কে করেছে খু ন? আপনাদের মতো শক্তিশালী মানুষেরা তাকে শাস্তি না দিয়ে যুগ যুগ ধরে ঘটনা লুকিয়ে রেখেছেন কেনো?”

“সময় হলে জানতে পারবি।তাড়াহুড়ো করে জানাতে স্বস্তি পাবি না।সময় নিয়ে সবটা জানলে তবেই স্বস্তি পাবি।মনের আগুন নিভাতে পারবি।তুই যেটা জানতে চাচ্ছিস সেটা তো ঘটনার মধ্যস্থান।আর খু ন সেটা তোর খুব কাছের একজন করেছে।আয়মান চৌধুরী ওনার প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছেন।”

মেহরিমার চোখদুটো অক্ষীকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।ওদের কথার মাঝেই অম্বর চিঁড়ে ধরনীর বুকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে।ততক্ষণে দু’জনে উঠে দাঁড়িয়েছে।সেকেন্ডের ব্যবধানে দু’জনে কাকভেজা হয়ে যায়।মেহরিমার গায়ে থাকা শুভ্ররঙা কামিজ বাঁকানো তনুর সাথে লেপ্টে গেছে।মুখে বৃষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা লেগে আছে।বিদ্যুতের ঝলকানির আলোয় চারিপাশ আলোকিত হয়ে ওঠে।সেই আলোয় মেহরিমাকে দেখতে বড্ড আবেদনময়ী লাগে।মুখে লেগে থাকা বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু কণা গুলো ঝলমল করছে।মায়ের দেওয়া ছোট্ট নাকফুলটা মুক্তোর দানার মতো চকচক করে উঠছে।সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।বৃষ্টির কণাগুলোর উপর হৃদিতের খুব হিং সা হয়।কেমন নির্লজ্জের মতো অ্যানাবেলাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রতিক্ষণ।ক্ষমতা থাকলে এক্ষুনি এই বৃষ্টির কণাগুলোকে কে টে কুচি কুচি করতো।হৃদিত কয়েক কদম এগিয়ে এসে মেহরিমার গা ঘেঁষে সামনাসামনি দাঁড়ায়।মেহরিমা কিছু বলতে নিলেই ওর কামিজ গলিয়ে আলতো হাতে নরম কোমর খামচে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় হৃদিত।মেহরিমা চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে।নিজের ভার ছেড়ে দেয় হৃদিতের উপর।হৃদিত মেহরিমার ঠোঁটে থাম্ব দিয়ে আলতো করে স্লাইড করতে করতে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আমার স্নিগ্ধ পবিত্র কাঠগোলাপ।
মায়াবতী শুভ্র রঙা বেলি ফুলের মায়া ছেড়েছি সেদিন,
স্নিগ্ধ পবিত্র কাঠগোলাপের আসক্তি আমায় নিঃস্ব করেছে যেদিন।”
কলমে~ইসরাত তন্বী

মেহরিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কোলে তুলে নেয়।মেহরিমা লজ্জায় হৃদিতের সুদৃঢ় বক্ষস্থলে মুখ লুকায়।সিঁড়ির দরজার নিকট থেকে একটা মানব ছায়া দ্রত কদমে সরে যায়।মুখে তার কুৎসিত হাসি।খেলার ছক উল্টিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার পেয়ে গেছে কি না!এবার জয় তার হবেই।

________

সকাল সকাল চৌধুরী বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে আয়াশ।মূলত আয়রা চৌধুরীদের সাথে দেখা করতে এসেছে।থাকবে দিন দুই মতো।বাড়ির সামনে পুকুরের পাড়ে বানানো বেঞ্চ গুলোতে বসে ছোটরা আড্ডা দিচ্ছে।হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে আড্ডার আসর।হঠাৎ সেখানে আরিফ চৌধুরী উপস্থিত হন।

“আয়াশ শহরের *** হসপিটালে যেতে হবে। আমার বেস্টফ্রেন্ড লিয়াকত হাওলাদারের একমাত্র মেয়ের উপর অ্যাসিড অ্যাটাক হয়েছিল জানো তো তুমি।ঐশী মায়ের অবস্থা শোচনীয়।আজ দুপুর দু’টোই ওদের ফ্লাইট।লন্ডন নিয়ে যাবে ট্রিটমেন্টের জন্য।”

“এখনই যাবে তুমি?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা বসো আমি রেডি হয়ে আসছি। থানায় যেতে হবে একটু।শপিং কমপ্লেক্সের অ্যাসিড অ্যাটাক টা নিয়ে এসআই এর সাথে কিছু আলোচনা করতে হবে।এতো বড় একটা ক্রা ই মে র কোনো ক্লু পাওয়া যাবে না এটা কোনো কথা হলো!”

আয়াশ বাড়ির ভেতরে চলে যায়।আরিফ চৌধুরীর দৃষ্টি যেয়ে পড়ে মেহরিমার উপর।কোনো এক অদৃশ্য বেদনায় বুকটা চিনচিন করে ওঠে।মেহরিমা সবটা নিরব হয়ে শোনে।আয়াশ,আরিফ চৌধুরীর কথোপকথন শুনে সেদিন শপিং কমপ্লেক্সে দেখা হওয়া মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায়।ওই মেয়েটাও তো বলেছিল উনি বাবার বেস্ট ফ্রেন্ডের মেয়ে।তবে কি ওই মেয়েটাই ঐশী?মেহরিমা দুইদিন আগে হৃদিতের থেকে জেনেছে ওই শপিং কমপ্লেক্সটা হৃদিতদের।

“মেহুমা সেদিন শপিং কমপ্লেক্সে তোমাদের সাথে কারোর কোনো ঝামেলা হয়েছিল কি?”

মেহরিমা সময় নিয়ে আস্তে ধীরে সেদিন ওদের সাথে ঘটে যাওয়া সবটা খুলে বলে।মূলত ও যতটুকু জানে ততটুকুই বলে।সন্দেহের মতো কেউ কিছুই খুঁজে পাই না।সবটা শুনতেই আরিফ চৌধুরীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।যেটা মেহরিমার চোখ এড়ায় না।আয়াশ ও ততক্ষণে হাজির হয়েছে।অতঃপর বাবা ছেলে মিলে নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।ওদের সামনে পিছনে গার্ডসহ পুলিশের আরও দুটো গাড়ি বের হয় চৌধুরী বাড়ি থেকে।আড্ডাটাও ভেঙে যায়।যে যার মতো নিজেদের ঘরের দিকে হাঁটা ধরে।নিজের রুমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সবটা লক্ষ্য করে হৃদিত।ঠোঁটে বাঁকা হাসি।পকেট থেকে ফোন বের করে কল লাগায় আনসেইভ এক নম্বরে।অ্যানাবেলার চোখে ভালো হওয়ার জন্য,অ্যানাবেলাকে সারাজীবন নিজের করে রাখার জন্য সব করতে প্রস্তুত হৃদিত।কিন্তু আমরা চাইলেই কি আর সব হয়?কে জানে হৃদিতের পরিকল্পনা কতটুকু সফল হবে!মেহরিমা সদর দরজায় পা রাখতেই ওর পিঠে কিছু একটা এসে পড়ে।ও পিছু ফিরে চায়।নিচে তাকাতেই একটা কাগজের খন্ডাংশ দেখতে পাই।কাগজ টা উঠিয়ে নেয় মেহরিমা।আশেপাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পাই না।ওটা খুলতেই চক্ষুগোচর হয় ছোট ছোট অক্ষরে লেখা ক্ষুদ্র বার্তা।

“ভালোবেসে বিশ্বাস করা ভালো তবে অন্ধবিশ্বাস না।দেইখো শেষ পর্যন্ত যেন তোমাকে ঠকে যেতে না হয়!মানুষ বাইরে যেমন দেখায় আসলে কিন্তু তেমন না।”

লেখাটুকু পড়ে মেহরিমা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝতে মস্তিষ্ক কিলবিল করে ওঠে।

#চলবে___

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৪
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

মেহরিমা উদাসীন হয়ে ব্যালকনির দোলনায় বসে আছে।নিজের জীবনের হিসাব মেলাতে বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কয়েকদিনের ব্যবধানেই জীবনটা এতো জটিল হয়ে পড়বে মেহরিমা কি তা কষ্মিনকালেও ভেবেছিল!মেহরিমার আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই ওখানে হৃদিত উপস্থিত হয়।

“এখানে একা বসে কি করছিস?”

মেহরিমা ধ্যান চ্যুত হয়।রয়ে সয়ে জবাব দেয়,

“কিছু না।”

“মন খারাপ?”

“উহু।”

“তাহলে?”

“আপনি কখনো আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে দিবেন না তো?”

“এমনটা মনে হওয়ায় কারণ?”

“জানি না।তবে অজানা এক ভয় আমাকে চারিদিক থেকে জেঁকে ধরেছে।”

“একটা সম্পর্কে রাগ,অভিমান,জেদ, ভালোবাসা, কষ্ট সবটা থাকে লিটল কিটি।যেই সম্পর্কে এইসব কোনো কিছু নেই শুধু ভালোবাসা আছে ওগুলো লোক দেখানো সম্পর্ক।আর একটা সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস।যখনই কোনো তৃতীয় পক্ষ প্রবেশ করবে একটা সম্পর্কে,তখনই সম্পর্ক ভাঙতে শুরু করবে।অ্যাক্চুয়ালি আমি বোঝাতে চাচ্ছি তুই কোনো তৃতীয় পক্ষের কথায় নাচিস না। আমাকে নিয়ে যত অভিযোগ সেটা আমার কাছেই করবি।এই দেয়ালের বাইরে যেনো না যায় সেই অভিযোগ।তোকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি নিয়েছি কোনো তৃতীয় পক্ষ না।”

মেহরিমা নির্বিকার চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। কথাগুলো খুব করে মস্তিষ্কে গেঁথে নেয়।হৃদিত কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে আসে।মেহরিমার মুখোমুখি হয়ে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে।মেহরিমার ঠান্ডা কনকনে হাত দুটো নিজের উষ্ণ হাতের মুঠোয় পুরে নেয়।

“ঠিকমতো নিজের যত্ন নিচ্ছিস না কেনো?”

“তার জন্য আপনি আছেন তো।”

“ঠান্ডায় কোনো গরম কাপড় পরিসনি যে?”

“ঠান্ডা লাগছে না তো।”

“আমার তো লাগছে।”

“ঘরে যেয়ে গরম কাপড় পরে আসুন।”

“ওই কাপড়ে হবে না।তোকে লাগবে।তুই না হট? মাত্রই তো বললি!”

মেহরিমা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।এটা আবার কখন বললো?হৃদিতের কথার উদ্দেশ্যে বুঝতেই মূহুর্তেই মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।এই মানুষ টা আজকাল একটু বেশিই লজ্জা দেয় যেন।কোন কথা কোথায় নিয়ে গেছে ভাবা যায়!মেহরিমার মুখের দিকে তাকিয়ে সুক্ষ্ম হাসে হৃদিত।মেহরিমার হাতে অধর ছুঁয়ে দিয়ে নরম কন্ঠে বলে,

“আমাকে কখনো ছেড়ে যাবি না তো?”

“কাউকে ভালোবাসলে ছেড়ে যাওয়া যায় নাকি?”

“ভালোবাসিস আমায়?”

“মন তো বলে বাসে।”

“কতটুকু?”

“জানিনা।তবে যতটুকু ভালোবাসলে আপনাকে জান্নাতেও পাবো ঠিক ততটুকুই ভালোবাসতে চাই।”

“ইহজীবনেই আমার সাথে নিজের সব শখ আহ্লাদ মিটিয়ে নে।ওই জীবনে আমাকে নিজের সঙ্গী হিসেবে পাবি না।তুই পবিত্র,স্নিগ্ধ।অথচ আমি,নি..”

হৃদিতের অধর জোড়া আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে মেহরিমা।হৃদিতকে নিজের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে,

“আপনি ভালো খারাপ যেমনই হন না কেনো। ইহকাল,পরকাল সব কালেই আপনাকেই লাগবে আমার।আর এমন কথা কক্ষনো বলবেন না।”

হৃদিত মেহরিমা কে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।মেহরিমার বোকামিতে,সরলতায় মুচকি হেসে ওকে বুকে জড়িয়ে নেয়।

“আচ্ছা বলবো না।মধুচন্দ্রিমা কোথায় করতে চাস? বাংলাদেশ?নাকি অ্যাব্রোড?তোর যেখানে ইচ্ছা।”

“মধুচন্দ্রিমা শব্দটা কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার মনে বসন্তের দোলা দিয়ে ওঠে।ছড়িয়ে পড়ে ফুলের সুবাস।কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়।লজ্জায় হৃদিতের শক্তপোক্ত বুকে মুখ লুকায়।”

“লজ্জা পেলে ছোট্ট মেহরিমা আসবে কিভাবে?আমি অ্যাট ফাস্ট বাবা হতে চাই।”

মেহরিমা এবার লজ্জায় মিইয়ে যায়।হৃদিত হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করে।

“সমুদ্র পছন্দ নাকি পাহাড়?”

“বোথ।এমন যায়গায় যেতে চাই যেখানে পাহাড়, সমুদ্র একে অপরের সাথে মিলে মিশে একাকার। নিজেদের সুখ দুঃখের কথা অনায়াসে বলতে পারে একে অপরকে।সাথে জঙ্গল হলে মন্দ হয়না!”

মিনমিনে কন্ঠস্বর মেহরিমার।হৃদিত হেসে ওঠে।

“যথা আজ্ঞা মহারানী।আপনি যা বলবেন।ওয়ান উইক টাইম লাগবে সব অ্যারেঞ্জ করতে।”

“কোথায় যাবো আমরা?”

“ইটস সারপ্রাইজ।”

মেহরিমার মনটা হঠাৎই খুশিতে ভরে ওঠে। হয়তোবা খুব কাছে থেকে প্রকৃতি কে ছুঁয়ে দিতে পারবে বলে এই খুশি।নিজের বুকের মাঝে থাকা লিটল কিটির খুশি অনুভব করতে পেরেই হৃদিতের মুখের হাসি প্রসারিত হয়।এই ছোট্ট অ্যানাবেলা অল্পতেই কতো খুশি হয়ে যায়!হৃদিত মুখটা নামিয়ে কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“ওখানে শুধু তুই আর আমি থাকবো।আমাদের ডিস্টার্ব করার মতো কেউ থাকবে না। আমাকে একদম নিজের করে পাবি।এই জন্যই কি তোর এতো খুশি?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা লজ্জা পেয়ে হৃদিতকে এক ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে ওখান থেকে দৌড়ে রুমে চলে আসে।মূহুর্তেই হৃদিতের মুখমণ্ডল পরিবর্তন হয়ে যায়।মুখটা হিংস্র হয়ে ওঠে। উত্তর না দিয়ে ধাক্কা দেওয়া টা নিজের ইগোতে লাগে।তবে কি মেহরিমার আর হৃদিতের ভালোবাসা ভালো লাগে না?হৃদিত এই কয়দিনেই পুরনো হয়ে গেলো?বড় বড় পা ফেলে রুমে উপস্থিত হয় হৃদিত।মেহরিমা ততক্ষণে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়েছে।মেহরিমাকে আঘাত করার মতো বোকামি হৃদিত কখনোই করবে না।অত্যধিক ভালোবাসে কি না!রাগগুলো যেয়ে পড়ে ঘরের নিরপরাধ জিনিসগুলোর উপর।একে একে সব ভাঙতে শুরু করে। হঠাৎ জিনিস পত্র ভাঙচুরের শব্দ কানে আসতেই মেহরিমা দ্রুত ওয়াশ রুম থেকে বের হয়।কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই ঘরের লন্ড ভন্ড অবস্থা দেখতেই মেহরিমা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তার থেকে বেশি ভয় পায় হৃদিতের আচরণ,রাগ কে।সব তো ঠিকই ছিল। হঠাৎ করে কি এমন হয়ে গেলো?এতো রেগেই বা গেলো কেনো?মেহরিমার মাথায় কিছুই ঢোকে না। ততক্ষণে শব্দ শুনে নিচে থেকে সবাই দৌড়ে উপরে উপস্থিত হয়েছেন।তাবান,তাইফ দ্রুত হাতে দরজা ধাক্কাতে থাকে।

“ভাবী,ভাবী আপনি ঠিক আছেন? দরজা খুলুন তাড়াতাড়ি।”

তাবানের কন্ঠস্বর শুনতেই মেহরিমা কাঁপা কাঁপা পায়ে দরজার নিকট এগিয়ে যায়। দরজাটা হালকা খুলতেই তাবান দ্রুত এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় মেহরিমার দিকে।ভাবী ভাইয়াকে পানিটা খাওয়ান। শান্ত করুন।মেহরিমা ভয়ে ভয়ে হৃদিতের দিকে তাকায়।দিন দুনিয়া ভুলে ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করতে ব্যস্ত।মুখ দিয়ে একাধারে কিছু বলেই চলেছে।হৃদিতের হিংস্রতা দেখে মেহরিমা শুকনো ঢোক গেলে।

“উনি রেগে আছেন।আমি পারবোনা।”

“ভয় পাবেন না। আপনাকে কিছুই করবে না। তাড়াতাড়ি যান পানি টা দেন ভাইয়া কে।”

মেহরিমা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থেকে বুকে সাহস জমিয়ে ধীর পায়ে হৃদিতের দিকে এগিয়ে যায়।তাবান দরজা বন্ধ করে পিছনে ঘুরতেই বাড়ির সকলের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টির সম্মুখীন হয়। মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,

“ভাই একটু রেগে আছেন।তাই হয়তো কিছু ভাংচুর করছে। ভাবী কল দিয়ে পানি চাইল সেটা দিতেই এসেছিলাম।টেনশন করো না তোমরা।তেমন বড় কোনো ঝামেলা না।”

হৃদিতের রাগ সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানে।তাই সবাই খুব সহজেই সবটা বিশ্বাস করে নিলো।সহসায় প্রস্থান করলো।থেকে গেলো শুধু আয়াশ আর আরিফ চৌধুরী। দু’জনে কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রস্থান করে।তাবান,তাইফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।দৌড়ে নিজেদের ঘরে চলে যায়।

মেহরিমা এগিয়ে যেয়ে ধীর কন্ঠে ডেকে ওঠে,

“শুনছেন?একটু শান্ত হোন।”

হৃদিত পিছনে ফিরে তাকায়।মেহরিমা কাঁপা কাঁপা হাতে পানি টা এগিয়ে দেয়।মেহরিমা কিছু বলার আগেই হৃদিত গ্লাস উঠিয়ে এক ঢোকেই সবটা শেষ করে।বড্ড পানির পিপাসা পেয়েছিল কি না!মেহরিমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে দশ মিনিটের ব্যবধানে হৃদিত একদম শান্ত হয়ে যায়।মেহরিমা কে হাজার বার ছরি বলে ফেলেছে ইতোমধ্যে ।আধা ঘন্টার মধ্যে নিজেই রুম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলে।মেহরিমা কেবল অবাক চোখে সবটা দেখেই চলেছে।মনের মাঝে হাজারও প্রশ্ন খচখচ করতে থাকে।মস্তিষ্কে আসন্ন কথাটা উপলব্ধি করতে পেরেই বুকটা কেঁপে ওঠে।
______

আরিফ চৌধুরী,আয়াশ বাড়ির সামনে মেইন গেইট বরাবর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।শীতের রাতের ঠান্ডা বাতাসে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে দুটো পুরুষালি শরীর।দু’জনেই নিশ্চুপ।আয়াশ নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে,

“মানুষ এক ভুল কতবার করে বাবা?”

নিজের ছেলের কথায় ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করে আরিফ চৌধুরী।মুখে হাসি।কথাটা কোনদিক মিন করে বলেছে খুব করেই বোঝেন উনি। এমপি তো আর মুখ দেখে হননি।

“যতদিন না তার শক্তপোক্ত একটা শিক্ষা হয় ততদিন।”

“তবে কি মায়ের এখনও শিক্ষা হয়নি বাবা?”

“অন্যকে নিচে নামানোর প্রতিযোগিতায় নামলে মানুষ নিজের বিবেক,জ্ঞান সব হারিয়ে ফেলে।”

“বড় কোনো সমস্যা বাঁধার আগেই মাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে চলো।হৃদিত কে একটা সুন্দর,সুস্থ জীবন কাটাতে দেও।”

“এবার যে পাপিকে তার শাস্তি পেতেই হবে।”

“মেহু কে তোমরা যেমন ভাবছো ও কিন্তু তেমন না।অবনী আন্টির সেকেন্ড ভার্শন মেহু।ও সব সত্যি জানলে,না আমরা রক্ষা পাবো আর না হৃদিত।”

“মেহুমা হৃদিতকে ভালোবাসে।কখনো বিচ্ছেদ চাইবে না এটা শিওর থাকো।আর আমার?পাপের বোঝা বয়ে বেড়ানোর চেয়ে শাস্তি পাওয়া শ্রেয়।”

“একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে একটুও বুক কাঁপেনি বাবা?তোমার নেওয়া একটা ভুল সিদ্ধান্তে এই ভরা সমাজে একটা মেয়েকে কলঙ্কিত হতে হয়েছে।পাল্টেছে সময়,পাল্টেছে সবকিছু।কিন্তু মনের ক্ষত সেটা কি একটুও পাল্টেছে?একটুও কমেছে?”

“আয়মানের মৃত্যুর সত্যিটা আমার মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।সত্য মিথ্যা যাচাই করার অবস্থায় ছিলাম না।”

“মানুষ কিভাবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারে সেটা তোমাকে না দেখলে কখনো জানতেই পারতাম না বাবা।বড্ড আফসোস হয় তোমার জন্য।অবশ্য মায়ের বুদ্ধির কাছে তুমি নেহাতই একটা চুনোপুঁটি।”

“তুমিও তো ভালোবেসে ঠকে গেছো আয়াশ।”

“আমি চাইলে এক্ষুনি ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি।”

“তাহলে ছুঁড়ে ফেলছো না কেনো?”

“আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এটার ইফেক্ট পড়বে।”

“সত্যিই কি তাই?”

বাবার কথায় আয়াশ চুপ হয়ে যায়। আহ্ আয়াশের ভালোবাসা সেটা যে এতোটাও ঠুনকো না।সেটা তো গভীর ভালোবাসা।চাইলেও ছুঁড়ে ফেলা সম্ভব না।বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায় নিরবতায়।

“ভালোবেসে ঠকে যাওয়ার মাঝেও শান্তি আছে বাবা।কিন্তু ভালোবেসে ঠকানোর মাঝে কোনো শান্তি নেই।আছে শুধু আক্ষেপ,এক বুক ভরা কষ্ট।যেটা না কাউকে বলা যায় আর না নিজের কাঁধে বয়ে বেড়ানো যায়।”

আয়াশের কথায় আরিফ চৌধুরী আঁখি জোড়া বন্ধ করে ফেলে।চোখের পাতায় ভেসে ওঠে সুন্দর অতীত।এক কিশোরীর মায়াবী মুখাবয়ব।কি সুন্দর তার হাসি!এখনও এই হৃদয়,এই কানে ঝংকার তোলে সেই হাসি।এক পাক্ষিক ভাবে এতোটা ভালোবেসেও নিজের করা একটি ভুলে নিজের ভালোবাসা,নিজের ভালো থাকা সব হারিয়েছে এক নিমিষেই।কাউকে ঠকালে বিধাতা বোধহয় তার ভাগ্যেও ভালো থাকাটা আর লেখে না। ভালোবাসার কাছে হেরে যাওয়া দু’জন পুরুষের কষ্টে খুশিতে মেতে ওঠে এক নারী মন।পৈশাচিক হাসি দিয়ে পরক্ষণেই গুনগুনিয়ে কেঁদে ওঠে বলে,

“এই চৌধুরী বাড়ির কেউ কখনো ভালোবেসে সুখী হতে পারবে না।আমার মতোই বুকে ভালোবাসার আগুন নিয়ে সবাই কে জ্বলতে হবে,পুড়তে হবে।”

#চলবে___

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-২১+২২

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২১
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে।গ্রামের মানুষের কাছে রাত দশটা মানেই মধ্যরাত।অথচ ইট পাথরে তৈরি যান্ত্রিক শহরের মানুষের নিকট রাত দশটা মানে রাতের প্রথম প্রহর।এই সময়ে গ্রামের অর্ধেক মানুষ তন্দ্রায় বিভোর।ইতোমধ্যে মেহরিমাদের রাতের খাবার পর্ব শেষ হয়েছে‌।মেহরিমা বাবা মায়ের রুমে বসে ওনাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।হৃদিত মেহরিমার রুমেই আছে।মাধবী পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।দরজায় কড়া নাড়ছে ওর অ্যাডমিশন এক্সাম।

“এই নীলাক্ষী তুই নোজপিন পরিস না কেনো?”

“মা এখন কেউ নোজপিন পরে নাকি!”

“আমি তো ভুলেই গেছি আমার মেয়ে এখন বড় হয়ে গেছে।সে আপডেটেড।নোজপিন পরে না।”

মায়ের কন্ঠে সুক্ষ্ম অভিমানের আঁচ পেতেই মেহরিমার মুখে আঁধার নেমে আসে।মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আচ্ছা মা আমি ওনাকে বলবো একটা সুন্দর নোজপিন কিনে এনে দিতে।”

“আমাকে ছাড়।আলমিরার ডান সাইডের ড্রয়ারে দেখ একটা ছোট বক্স আছে।ওটা নিয়ে আয় যা।”

অবনী শেখের কথায় মেহরিমা চঞ্চল পায়ে আলমিরার নিকট এগিয়ে যায়। দ্রুত হাতে আলমিরার ড্রয়ার খুলতেই একটা সাদাকালো ছবি চক্ষু গোচর হয়।ছবিতে দু’জন কিশোরী মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে।একটা অবনী শেখ অনায়াসেই বুঝতে পারে মেহরিমা।পাশের মেয়েটার চেহারা টা অবনী শেখ আর শাহীন শেখের সাথে অনেকাংশে মিলে যায়।মেহরিমা ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।হঠাৎ করেই নিজের একমাত্র খালামনি অতশী শেখের কথা মাথায় আসে মেহরিমার।কিন্তু মা যে বলেছিলো খালামণির কোনো ছবি নেই নিজের কাছে।অনেক বছর আগে মারা গেছে অতশী শেখ কিন্তু কিভাবে মারা গেছে সেটা মেহরিমার অজানা।এই বিষয়ে কথা তুললেই অবনী শেখ সুকৌশলে এড়িয়ে যায় বিষয়টা।

“কিরে কি করছিস ওখানে?এতো সময় লাগছে কেনো?”

“হু? হ্যাঁ আসছি মা।”

মেহরিমা বক্সের সাথে ছবিটাও নিয়ে আসে। অবনী শেখের সামনে ছবিটা মেলে ধরে।

“এটা খালামনি মা?”

অবনী শেখ অপলক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে।হঠাৎ করেই ব্যথিত হয়ে ওঠে হৃদয়টা।

“হ্যাঁ।”

ম্লান কন্ঠস্বর অবনী শেখের।জলিল শেখ নিরস চাহনি দিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে।অবনী শেখের ব্যথিত মুখমণ্ডল দেখতেই মেহরিমার মনটা খারাপ হয়ে যায়।তবুও সেই প্রতিবারের মতোই পুরোনো কথা তোলে।আজ যেনো জানার পণ করেছে!

“মা খালামনি কিভাবে মারা গেছিল?তুমি এই কথাটা কেনো লুকিয়ে রেখেছো আমাদের থেকে?আর এই ছবি কোথা থেকে আসলো?তুমি না বলেছিলে খালামনির কোনো ছবি নেই তোমার কাছে।”

কথাটা শুনতেই অবনী শেখের মুখমণ্ডল শক্ত হয়ে যায়।তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরে বলে,

“সময় হলে সব জানতে পারবি।তোকে সত্য খুঁজে বের করতে হবে না।সত্যই তোকে খুঁজে বের করে নেবে।তবে নিজেকে সর্বদা প্রস্তুত রাখিস কঠিন সত্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।তোর অস্তিত্ব যাদের সাথে মিশেছে তারা প্রতারক।”

“মা আমি কখনও কারোর ক্ষতির কারণ হবো না তো?”

“তুই আমার প্রিন্সেস।আমার বাগানের নিজের হাতে গড়ে তোলা সবচেয়ে আকর্ষণীয় গোলাপ হচ্ছে তুই।ঘ্রাণ বিহীন অথচ সৌন্দর্যের রাণী। তোকে ভালোবাসলে তুই তার হৃদয়ে সুঘ্রাণ ছড়ানোর ক্ষমতা রাখিস।আর যে তোকে আঘাত করার ইচ্ছা পোষণ করে তোর কাঁটার আঘাতে সে নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।”

“মা আমি গোলক ধাঁধায় আটকে গেছি।ওই চৌধুরী বাড়ির কিছু একটা ঠিক নেই।আমার মনে হয় ওই বাড়ির ইট পাথরগুলো আমাকে ডেকে বলে তুই রহস্যের বেড়াজালে আটকে গেছিস মেহরিমা।এর থেকে তোর মুক্তি নেই।”

মেহরিমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে অবনী শেখ মুচকি হাসেন।

“হু রহস্যের বেড়াজালে আটকে পড়েছিস।সময় হলে গোলক ধাঁধা নিজে থেকেই খুলে যাবে।হৃদিত বাবা একা রুমে আছে।এই বক্সটা নিয়ে রুমে যা।ওকে পরিয়ে দিতে বলিস।”

মেহরিমা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছবিটা বিছানায় রেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।মেহরিমা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই অবনী শেখ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। জলিল শেখ নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেন প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীকে।অবনী শেখের বলা প্রতিটা কথা মেহরিমার মাথার মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছে।মায়ের বলা কথা গুলোর সাথে কোনোভাবে কি চৌধুরী বাড়ির যোগসূত্র আছে? নিজের মনে হাজারও প্রশ্ন নিয়ে রুমে প্রবেশ করে মেহরিমা‌।ঘরে সবুজ রঙের ড্রিম লাইট মৃদু আলোয় জ্বলছে।রুমের মধ্যে শুনশান নিরবতা।দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস ক্ষণে ক্ষণে প্রবেশ করছে রুমের মধ্যে।ব্যালকনি থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসতেই মেহরিমা মুচকি হেসে সেদিকে পা বাড়ায়।

একডুব দিয়ে সুবিশাল অম্বরে গোল থালার মতো বড় রুপালি চন্দ্র দেখা দিয়েছে।নিজের আলোয় ধরনী আলোকিত করে গৌরবে বুক ফুলিয়ে অম্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে চন্দ্রমা।হৃদিত ব্যলকনিতে চেয়ারে বসে এক ধ্যানে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।

“সুন্দরী চন্দ্রমা যতই নিজের রুপ দেখিয়ে আমায় বশ করতে চাও না কেনো আমি ধরা দিচ্ছি না। আমার ব্যক্তিগত চাঁদের সৌন্দর্যের কাছে তুমি কিচ্ছু না।ওর স্নিগ্ধ নিষ্পাপ মুখের কাছে পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ।আমার উপরে রাগ করলে সুন্দরী চন্দ্রমা?”

পরক্ষণেই গেয়ে ওঠে।

“আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি
আর মুগ্ধ এচোখে চেয়ে থেকেছি
বাজে কিনকিনী রিনিঝিনি
তোমারে যে চিনি চিনি
মনে মনে কত ছবি এঁকেছি
আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি
আর মুগ্ধ এচোখে চেয়ে থেকেছি।”

মেহরিমা স্লথ পায়ে এগিয়ে আসে।হৃদিতের ঠিক পিছনে দাঁড়ায়।মেহরিমার উপস্থিতি অনুভব করতেই হৃদিতের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

“সামনে আয়।”

মেহরিমা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে হৃদিতের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।রিনরিনি কন্ঠে বলে,

“আমার উপস্থিতি কিভাবে বুঝতে পারলেন?”

“নিজের সত্ত্বার উপস্থিতিই যদি বুঝতে না পারি তাহলে আর কেমন ভালোবাসলাম তোরে!”

“আপনার গানটা খুব সুন্দর হয়েছে।আমার খুব পছন্দের একটা গান।আমার জামাই পুরাই একটা রাজপুত্তুর।কত্ত গুণ তার!”

“এগেইন?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা আলাভোলা হাসি দেয়।

“ইয়ে মানে আমি ইচ্ছা করে শুনিনি তো।এখানে আসতে আসতে শুনে ফেলেছি।এটা আমার কানের দোষ।”

হৃদিত মেহরিমার হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে নিজের কোলের উপর বসিয়ে নেয়।আলতো হাতে কাঁধের উপর থেকে চুল সরিয়ে দেয়।হৃদিতের স্পর্শে মেহরিমা কেঁপে ওঠে।

“কাঁপছিস কেনো?”

মেহরিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়।ছোট ছোট ভালোবাসায় মেহরিমাকে ভরিয়ে দিতে থাকে।মেহরিমা যেন সুখের অনুভুতির জোয়ারে ভেসে যায়।কয়েক মিনিট পেরোতেই মেহরিমা তড়িৎ গতিতে পেছনে ঘুরে হৃদিতের অধরজোড়া নিজের অধর দিয়ে চেপে ধরে।সেকেন্ডের ব্যবধানেই নিজেকে শূন্যে অনুভব করে মেহরিমা‌।দু’জন নরনারীর উষ্ণ শ্বাস প্রশ্বাসে ক্রমস ভারি হয়ে ওঠে বদ্ধ ঘরের চারিপাশ।লজ্জায় মেঘের আড়ালে নিজের মুখ লুকায় সুন্দরী চন্দ্রমা।লজ্জায় নাকি মেহরিমার উপর হিংসায়?হৃদিতের ভালোবাসার পাগলামিতে আরও একটা সুন্দর রজনী পার করে মেহরিমা।মায়ের দেওয়া বক্সটা অযত্নেই পড়ে থাকে বিছানার এক কোণায়।

#চলবে

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২২
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

ইতোমধ্যে কেটে গেছে পাঁচদিন।মেহরিমা আর হৃদিত আজ চৌধুরী বাড়িতে এসেছে।এ বাড়িতে পা রাখতেই মেহরিমা নতুন চমক পেয়েছে!চৌধুরী বাড়ির মেয়ে অর্থাৎ হৃদিতের একমাত্র ফুপিমনি আয়রা চৌধুরী আমেরিকা থেকে পুরো পরিবার নিয়ে স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন চৌধুরী বাড়িতে।ওনারা গতকাল রাতেই এসেছেন।অথচ মেহরিমা এইসবের কিছুই জানে না।আয়রা চৌধুরীর সাথে পরিচিত হয়ে মেহরিমার বেশ ভালো লেগেছে। খুবই হাস্যোজ্জ্বল, মিশুক প্রকৃতির মানুষ তিনি। তবে ওনার দুই মেয়ে অলিভিয়া, অ্যামেলিয়া কে মেহরিমার একটুও ভালো লাগেনি। মানুষ হিসেবে অতিরিক্ত অহংকারী আর পোশাকের অবস্থা নাজেহাল।হৃদিত এসবে নির্বিকার রয়েছে।চোখ তুলে একবার তাকায় ও নি ওনাদের দিকে আর কথা বলা তো দূরের বিষয়!

সময় রাত দশটা।সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়েছে।হৃদিতের একপাশে মেহরিমা বসেছে অপর পাশের চেয়ারটা খালি পড়ে আছে তৃধার জন্য।বেচারি লজ্জায় আজ সারাদিন হৃদিতের মুখোমুখি হয়নি।যেই মেয়ে সবার আগে খাবার টেবিলে উপস্থিত থাকে আর আজ তার কোনো খবরই নেই।আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরী দ্রুত হাতে খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।শ্রেয়া চৌধুরীও ওনাদের কাজে টুকটাক সাহায্য করছেন।

“আমার মেয়েটার হঠাৎ করে কি যে হলো!আজ সকাল থেকে কেমন ঘরকুনো হয়ে গেছে। সারাদিনে একটা বারের জন্যও ঘর থেকে বের হয়নি।ও মেহুমা একটু কষ্ট করে তৃধুকে ডেকে এনে দিবে গো।”

আয়েশা চৌধুরীর কথায় মেহরিমা মুচকি হেসে বলে,

“এভাবে বলছেন কেনো মেজোমা?আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”

মেহরিমা তৃধাকে ডাকতে চলে যায়।হাঁটার ধপধপ শব্দ কর্ণগোচর হতেই সবাই শিড়ির দিকে তাকায়। অলিভিয়া আর অ্যামেলিয়া দোতলা থেকে নামছে। দুই বোনের পরনে ছোট্ট একটা টপস।যেটা উচ্চতায় হাঁটুর অনেকটা উপরে।ফর্সা কাঁধ,পা সবটাই উন্মুক্ত।আরিফ চৌধুরী,আজাদ চৌধুরী দ্রুত নিজেদের চোখ নামিয়ে নেন।হৃদিতের দৃষ্টি নিজের ফোনে স্থির।অলিভিয়া,অ্যামেলিয়া এসে কোনো অনুমতি ছাড়াই হৃদিতের দু’পাশের চেয়ারে দু’জন বসে পড়ে।হৃদিত ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আয়রা চৌধুরীর দিকে দৃষ্টিপাত করে।

“বিদায় হচ্ছেন কবে?”

হৃদিতের এহেন কথায় উপস্থিত সবার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায়।গোল গোল চোখ করে অবিশ্বাস্য চোখে হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।আয়রা চৌধুরী মলিন হাসেন।

“মাত্রই গতকাল আসলাম বাবা।এবারে অনেক দিনের জন্য এসেছি।পুরো শীত কাটিয়ে তারপর যাবো।বহুবছর গ্রামের শীতের পরিবেশ উপভোগ করা হয়নি।”

হৃদিতের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।

“শীত কাটাতে এসেছেন?খুব ভালো।আমি ভেবেছিলাম বোধহয় আগের বারের মতোই ভাইবউকে নিজের সঙ্গি বানিয়ে ভাইয়ের মাথা চিবোতে এসেছেন।”

শেষ কথাটা শ্রেয়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে।শ্রেয়া চৌধুরী দৃষ্টি নামিয়ে নেন।কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলে,

“তবুও একটা ওয়ার্নিং দিয়ে রাখি আমার বউ কিন্তু সুবিধার না। সাবধানে থাকবেন।নিজের সব সঙ্গিদেরও সাবধানে রাখবেন।মেহরিমা আপনাদের মতো মানুষ কে ঘৃণা করে।”

“হৃদিত!”

গর্জে ওঠেন আরিফ চৌধুরী।নিজের একমাত্র আদরের বোনকে অপমান করেছে কিনা!উপস্থিত ছোট বড় সবার সামনে এমন কঠিন অপমানে ফুঁপিয়ে ওঠেন আয়রা চৌধুরী।আয়রা চৌধুরীর হাসবেন্ড আব্রাহাম তালুকদার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন হৃদিতের দিকে।হৃদিত সেদিকে পাত্তাই দিলো না।ভাবটা এমন যে কিছুই হয়নি।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

“আর এইযে তোরা দু’জন একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ।নেক্সট টাইম যদি আমার আশেপাশেও তোদের দু’জন কে দেখেছি তাহলে পা দুটো কেটে হাতে ধরিয়ে দেবো।মাইন্ড ইট।”

হৃদিতের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো।অলিভিয়া, অ্যামেলিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে তড়িৎ গতিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।হৃদিত দোতলার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

“নিজেকে তুমি কি মনে করো?”

আরিফ চৌধুরী উচ্চস্বরে বলে ওঠেন।হৃদিতের চরণ যুগল থেমে যায়।পেছনে ঘুরে তাকায়।প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে আয়েশি ভঙ্গিতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়ায়।

“আপাতত নিজেকে কিছু মনে করছি না।”

“তোমার ব্যবহার দিনকে দিন প শু র মতো হয়ে যাচ্ছে।”

“আপনারই তো র ক্ত বইছে আমার শরীরে।”

হৃদিতের খাপছাড়া জবাবে আরিফ চৌধুরীর রাগ তিরতির করে বেড়ে যায়। উনি আবারও গর্জে ওঠেন,

“আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও তুমি। তোমাকে এমন শিক্ষা দিয়ে বড় করিনি আমি।এ কেমন ব্যবহার তোমার?আমাদের সাথে যেটা করো সেটা মেনে নিয়েছি।কিন্তু তোমার একমাত্র ফুপিমনির সাথে কিভাবে এই জঘন্য ব্যবহার করো?”

“আপনার মতোই হয়েছি আমি।আর আপনার চোখের সামনে কে থাকতে চাই?হু?আমার পিছনে পড়ে আপনি নিজেই এখানে এসেছেন।ভুলে কেনো যাচ্ছেন?যে যেমন ব্যবহারের যোগ্য তার সাথে তো আমি তেমন ব্যবহারই করবো।”

সবসময়ের ন্যায় গম্ভীর কন্ঠস্বর হৃদিতের।ছেলের একরোখামিতে আরিফ চৌধুরী রিতিমত রাগে কাঁপছেন।আজাদ চৌধুরী এগিয়ে আসেন।

“ভাইজান শান্ত হোন।”

শ্রেয়া চৌধুরী এগিয়ে এসে এক গ্লাস পানি দেন। রাগান্বিত আরিফ চৌধুরীর সাথে কথা বলার মতো সাহস ওনার নেই।আরিফ চৌধুরী এক ঢোকেই সবটা শেষ করেন।

“আপনাদের নাটক শেষ?আমি কি যেতে পারি?ছোটো মা আমার আর মেহরিমার খাবার রুমে পাঠিয়ে দেবেন।”

“আমার কথা শেষ হয়নি এখনও।”

হৃদিত কপালে গুটি কয়েক ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে।আরিফ চৌধুরী বলেন,

“তোমার লজ্জা করেনা?ওই বাড়ির মেয়েকে তুমি কিভাবে বিয়ে করলে?তুমিতো সবটা জানতে হৃদিত।কেনো এই ধ্বংস খেলায় নামলে?আমাকে আর কত শাস্তি দেবে?”

শেষের দিকে ওনার কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।

“যেভাবে আপনার ভাই বিয়ে করেছিল সেভাবেই করেছি।আপনাদের ভুলের শাস্তি আমি কেনো পেতে যাবো?ভালোবাসি আমি মেহরিমাকে।আর আপনার শাস্তি হাহ্!সেটা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ দিতে পারবে না।”

“অতীত পুনরাবৃত্তি করতে চাইছো?”

“উহু।মেহরিমার গায়ে একটা আঁচড় দেওয়ার আগে তাকে আমার মুখোমুখি হতে হবে।সবাইকে নিজের আর নিজের ভাইয়ের মতো কেনো ভাবেন বলুন তো?সবাই কি আপনার মতো বিশ্বাসঘাতক, কাপুরুষ নাকি?”

এদফায় দমে যান আরিফ চৌধুরী।সব রাগ এবার গিয়ে পড়ে শ্রেয়া চৌধুরীর উপরে।শ্রেয়া চৌধুরীর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বাড়ির বাইরে চলে যান।শ্রেয়া চৌধুরী শব্দ করে কেঁদে ওঠেন।বাড়ির সকলে হতভম্ব হয়ে গেছে।কি থেকে কি হয়ে গেল!কেউই বুঝতে পারছে না।হৃদিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছনে ঘুরতেই মেহরিমার ভেজা চক্ষু যুগল,রক্তিম মুখমণ্ডল চক্ষু গোচর হয়।আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে মেহরিমা ওখান থেকে এক দৌড়ে ছাদে চলে যায়।এতক্ষণ ধরে কথোপকথনের সবটাই শুনেছে অবনী শেখ।মেহরিমা তখন তৃধা কে ডেকে নিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে অবনী শেখ কল দেন।মেহরিমা রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করে।হঠাৎ আরিফ চৌধুরীর চিৎকার শুনে ওরা দু’জন দ্রুত পায়ে দোতলার সিঁড়ির নিকট এসে দাঁড়ায়। তাড়াহুড়োতে কলটা কাটতেই ভুলে যায়। অবনী শেখের অধরে বাঁকা হাসি।ধীরকন্ঠে আওড়াই,

“সময় সবকিছু দ্বিগুণ রুপে ফিরিয়ে দেয়।প্রকৃতির বিচার বড়ই কঠিন।”

মেহরিমার পিছন পিছন হৃদিত ও দৌড়ে ছাদে আসে। চৌধুরী বাড়ির ছাদটা অপরূপ সৌন্দর্যে মোড়ানো।ছাদের অর্ধেক যায়গা জুড়ে ছাদবাগান করা। যেখানে আছে নাম না শত শত দেশি-বিদেশি ফুলের জাত। চাঁদের আলোয় চারি পাশ ঝলমল করছে।ছাদে পা রাখতেই একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়া বয়ে যায়।মেহরিমার ক্ষীণ তনু মন শিরশির করে ওঠে।নাসারন্ধ্রে ভেসে আসে শিউলি,বেলি ফুলের সুবাস।মেহরিমা বড় একটা শ্বাস নিয়ে স্লথ পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।একদম ছাদের রেলিং ঘেসে দাঁড়ায়।চোখ চলে দূরে,বহুদূরে।গ্রামের ছোট ছোট ঘরবাড়ি,গাছপালা সবমিলিয়ে দেখতে বেশ ভালো লাগছে মেহরিমার।চাঁদের আলোয় সবকিছু বড়ই মনোরম লাগছে।কিছুক্ষণ আগের মনের ব্যথাটা কিছুটা কমে আসে।প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে প্রকৃতিই যেনো শান্তির নীড়।তাইতো কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই মেহরিমার অসহনীয় বুক ব্যথাটা গিলে নিলো প্রকৃতি।হৃদিত এগিয়ে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে মেহরিমাকে।উন্মুক্ত স্কন্ধে থুতনি রাখে। কিছুক্ষণ নিরবতা চলে দু’জনের মাঝে।একে অপরের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে ব্যস্ত।হঠাৎ মেহরিমার চোখে জলে ওঠে অগ্নিশিখা। নিরবতা ভেঙে তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরে বলে,

“অতীতে চৌধুরী পরিবারের সাথে শেখ পরিবারের কি ঘটেছিলো?একে অপরের প্রতি এতো ভয়, সংকোচ,ঘৃণা কেনো?কিসের ধ্বংস খেলায় নেমেছেন সবাই? আপনাদের খেলায় আমায় কেনো দাবার গুটি বানালেন?”

#চলবে___

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-১৯+২০

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১৯
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন।বইছে ঠান্ডা ঝিরিঝিরি পবন।হৃদিত মেহরিমা বেরিয়েছে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।মেহরিমার জেদের কাছে একরকম হেরে গাড়ির জানালা খোলা রেখেছে হৃদিত।মেহরিমা জানালা ঘেসে বসে আছে।চোখজোড়া জানালার বাইরে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত।ঠান্ডা বাতাস জানালা দিয়ে প্রবেশ করে ক্ষণে ক্ষণে মেহরিমার তনু মন জুড়িয়ে দিচ্ছে।মেহরিমা আবেশে চক্ষুযুগল বন্ধ করে নেয়।গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দেয়।এভাবেই কেটে যায় কিছুক্ষণ।হৃদিত ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত।

“শরীর খারাপ লাগছে?”

হৃদিতের কন্ঠস্বর শুনতেই মেহরিমা চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে হৃদিতের দিকে তাকায়।জবাব দেয়,

“উহু।”

“তাহলে?”

“কিছু না।”

“তোর বিয়ে করার এখনো বয়স হয়নি।একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করে বড্ড বিপদে পড়েছি আমি।”

হৃদিতের কথা শুনে মেহরিমা চোখ দুটো ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকায়।অতঃপর অ্যাটিটিউড নিয়ে বলে,

“আ’ম ১৯+। অবভিয়াসলি আমার বিয়ের বয়স হয়েছে।”

“উহু হয়নি।”

“তাহলে বিয়ে কেনো করেছেন?”

“তোকে হালাল ভাবে চাই তাই।ইয়্যু নো জান হালাল ইজ অলওয়েজ বেস্ট।”

হৃদিতের কথা শুনে মেহরিমা না চাইতেও ওর মনটা ভালো হয়ে যায়।গতকালের ঘটনার পর থেকে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে মেহরিমার।না চাইতেও ওই ঘটনাটাই চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে বারংবার।মেহরিমা মুচকি হাসে।

“আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া আপনি।”

“তুই আমার ভালোবাসার আদুরে ধ্বংসবতী।সবার জীবনে আসে মায়াবতী।আর আমার জীবনে এসেছে ধ্বংসবতী।তোকে ভালোবেসে বার বার,শতবার, সহস্র বার ধ্বংস হতে রাজি আমি।”

হৃদিতের বলা কথাগুলো মেহরিমার মাথার একহাত উপর দিয়ে যায়।কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

“ধ্বংসবতী কে আবার কে ভালোবাসে?নিজের ধ্বংস স্বচক্ষে দেখার এমন ইচ্ছাও আবার কারো হয় নাকি!”

“আমি ভালোবাসি আমার ধ্বংসবতী কে।তোকে ভালোবেসে শুধু নিজের ধ্বংস কেনো নিজের মৃ ত্যু ও স্বচক্ষে দেখতে রাজি আমি।”

হৃদিতের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারে না মেহরিমা।তবে কথাগুলো শুনতেই হঠাৎ’ই বুকের মাঝে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয়।সত্যিই কি এই মানুষটার ধ্বংসের কারণ হবো আমি?ওনাকে ধ্বংস করার আগেই আমার মৃত্যু হোক তবুও আমার দ্বারা এমন কোনো কাজ না হোক।মেহরিমাকে ঠিকমতো কষ্টটা উপলব্ধি করতে না দিয়েই ওর ফোনটা নিজস্ব শব্দে ঝংকার দিয়ে ওঠে।মেহরিমা পার্স থেকে ফোন বের করে।ফোনের স্ক্রিনে নজর রাখতেই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘শাকচুন্নী’ শব্দটা।মেহরিমা তৎক্ষণাৎ কল কেটে দেয়।কল রিসিভ করলেই এই মেয়ে নির্ঘাত উল্টাপাল্টা বকা শুরু করবে।

“কে ছিলো?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা ভাবনা চ্যুত হয়।

“তৃধা।”

শাকচুন্নীর নাম নিতেই আবারও ফোনটা বেজে ওঠে।মেহরিমা পূর্বের ন্যায় কল কাটতে নিলেই শুনতে পাই হৃদিতের কন্ঠস্বর।

“রিসিভ কর ফাস্ট। লাউড স্পিকার অন কর।”

হৃদিতের কথামতোই সবটা করে মেহরিমা।কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে তৃধার ক্যাট ক্যাটে কন্ঠস্বর।

“কিরে সমবয়সী ভাবী!আমার ভাইকে পেয়ে আমাকেই ভুলে গেলি?গতকাল থেকে কল দিয়েই যাচ্ছি রিসিভ করছিস না।সে যাই হোক তোর বাসর রাত কেমন কাটলো?কিছু মিছু কি হয়েছে তোদের মাঝে?অ্যাই শোন একদম মিথ্যা কথা বলবি না কিন্তু। যদিও ভাইয়াকে নিয়ে আমার বিশ্বাস নেই।কি রে চুপ করে গেলি কেনো?”

“এই থাম‌।আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিয়েছিস তুই?”

তৃধার কথায় মেহরিমা অত্যধিক লজ্জা পেয়ে যায়।হৃদিত মুচকি মুচকি হাসছে।হৃদিতের হাসি দেখে মেহরিমার মাটি ফাঁক করে ভিতরে ঢুকে যেতে মন চাইছে।মেহরিমার কথায় তৃধা দম নেয়।বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে।পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়তেই বলে,

“ভাইয়া কোথায়?”

“আমার পাশে।”

“কল কি কোনোভাবে লাউড স্পিকারে দে..”

তৃধার কথা শেষ করতে না দিয়েই মেহরিমা জবাব দেয়,

“হুম।”

ব্যস অমনিই সাথে সাথে অপর পাশ থেকে কল ডিসকানেক্ট হয়ে যায়।তৃধা কল কেটে শুকনো ঢোক গেলে।মেহরিমা কল রিসিভ না করায় এক প্রকার রেগে ওকে লজ্জায় ফেলানোর জন্যই ইচ্ছে করে কথাগুলো বলেছে তৃধা।এখন নিজের বুদ্ধিতে নিজেই বাঁশ খেয়ে গেছে।ভাইয়া কি ভাবলো! নিজের ইনোসেন্ট বোনটার এই রুপ মেনে নিতে নিশ্চয় খুব কষ্ট হচ্ছে ভাইয়ার।তৃধার বুক ফেটে কান্না আসে।ধপাস করে ফ্লোরে বসে হাত পা ছড়ায়ে ছিটায়ে শব্দ করে কান্না করতে থাকে।তৃধার কান্নার শব্দে চৌধুরী পরিবারের সকলে উপস্থিত হয় ওর রুমে।তৃধা কল কাটতেই মেহরিমা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।আর সাথে সাথেই চোখ ধাঁধানো সেই সুন্দর টোল পড়ে থুতনি তে।হৃদিত মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে ওর অ্যানাবেলার দিকে।মেহরিমার হাসির শব্দ হৃদিতের শ্রবণেন্দ্রিয়ে ঝংকার তোলে।

“তোর মুখটা একটু এদিকে এগিয়ে নিয়ে আয় লিটল কিটি।”

মেহরিমা হাসতে হাসতে মুখটা হৃদিতের দিকে এগিয়ে দেয়।হৃদিত সাথে সাথে থুতনি তে টুপটাপ কয়েটকা চু মু খেয়ে বসে।তৎক্ষণাৎ মেহরিমার হাসি থেমে যায়।চোখ বড় বড় করে হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“সিলমোহর মেরে দিলাম।তোর ওই সুন্দর গর্ত ওয়ালা থুতনির একমাত্র মালিক আমি।কখনো কারোর সামনে হাসবি না ঠিক আছে?তোর এই সুন্দর নজর কাড়া হাসি দেখার অধিকার শুধুমাত্র তাহমীদ হৃদিত চৌধুরীর।”

মেহরিমা হতভম্ব অবস্থায়’ই বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়।যার অর্থ ঠিক আছে।আরও এক ঘন্টা জার্নি করার পর ওরা হসপিটালে পৌঁছায়।মেহরিমাকে ডক্টর দেখিয়ে প্রেসক্রিপশন নিয়ে একেবারে মেডিসিন কিনে সব ঠিকঠাক করে দু’জনে বড় একটা শপিং কমপ্লেক্সে আসে।দুহাত ভরে শপিং করেছে মেহরিমা।অবশ্য হৃদিতের পছন্দে,হৃদিতের ইচ্ছাতেই সব কিনতে হয়েছে।ছয়টা শাড়ি,সাতটা থ্রি পিচ,পাঁচটা ওয়াশ পিচ,পাঁচটা রেডিমেড প্যান্ট কাটিং সালোয়ার,ছয়টা হিল শু কিনেছে।সাথে কসমেটিকস,অর্নামেন্টস তো আছেই।এতকিছু কিনেছে ভাবতে যেয়েই মেহরিমা রিতিমত হাঁফিয়ে উঠছে।

“আমার কেনা শেষ।আর লাগবে না।”

“তুই না গতরাতে বললি অনেক শপিং করবি? এখনও তো কিছুই হয়নি কেনা।”

সেই সেইম আন্সার।প্রায় একঘণ্টা ধরে মেহরিমা এই এক কথা বলেই চলেছে আর হৃদিত ও সেইম আন্সার দিয়েই চলেছে।মেহরিমার রাগে দুঃখে কান্না পায়।কেনো যে গতকাল রাতে ওটা বলতে গিয়েছিলো!

“বিশ্বাস করুন‌‌। আমার খুব কেনা হয়েছে।শখ মিটেছে।এবার চলুন প্লিজ।আ’ম টায়ার্ড।”

মেহরিমার মুখের দিকে দুই সেকেন্ড মতো তাকিয়ে হৃদিত বলে,

“সত্যিই তো?”

“তিন সত্যি।”

“আচ্ছা চল।”

মেহরিমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। অতঃপর দু’জনে গাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।শপিং কমপ্লেক্সের একজন স্টাফ ওদের শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। ওতো গুলো ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে যেয়ে আনফরচুনেটলি একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগে স্টাফের। সবগুলো ব্যাগ নিচে পড়ে যায়।মেয়েটার নিজের হাতে থাকা কোল্ড ড্রিঙ্কস নিজের ড্রেসের উপরেই পড়ে।

“মূর্খের বাচ্চা দেখে চলতে পারিস না।দিলি তো আমার ড্রেস টা নষ্ট করে।উফফ এই ছোট লোকগুলো কে নিয়ে আর পারি না।জানিস এটা আমার পাপা আমেরিকা থেকে এনে দিয়েছিল।”

“ছরি ম্যাম।”

“কিসের ছরি হু?তোকে তো আমি দেখে নেবো।তুই জানিস এই শপিং মলের ওনার আমার বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড।এক মিনিটেই তোর চাকরি কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখি আমি।”

“প্লিজ ম্যাম এমন করবেন না।এটার উপর দিয়েই আমার সংসার চলে।আমার বাবা নেই।আমার ছোট্ট একটা বোন আছে।”

ততক্ষণে হৃদিত মেহরিমা পেছন ঘুরে দাঁড়িয়েছে।মেহরিমা মেয়েটার দিকে দৃষ্টিপাত করে।হোয়াইট কালারের একটা লেডিস শার্ট আর লেডিস জিন্স পরা।হালকা বাদামী রঙের চুল গুলো কাঁধ ছুঁয়েছে।গায়ের রং ফর্সা।মেয়েটা কটমট করে আরও কিছু বলতে নিলেই মেহরিমা এগিয়ে এসে বলে,

“আপি ওনার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দেন প্লিজ।আর এরকম কখনো হবে না।”

“হু আর ইয়্যু?দেখে তো মনে হচ্ছে গ্রামের কোনো ছোট পরিবার থেকে উঠে এসেছিস।বস্তি একটা।এইসব ড্রেসের ভ্যালু বুঝিস তুই?যা সর এখান থেকে।”

মেয়েটার কথায় মেহরিমার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।তীব্র অপমানে উজ্জ্বল মুখমণ্ডল থমথমে ভাব ধারণ করে।হৃদিতের শানিত চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।মেহরিমা কে এহেন কথা বলায় স্টাফ টা ভয় পেয়ে হৃদিতের দিকে তাকায়।মেহরিমা আর কথা না বাড়িয়ে ওখান থেকে প্রস্থান করে।হৃদিতের নিকট এসে বলে,

“ভাইয়ার চাকরিটা বাঁচিয়ে দেবেন প্লিজ।শপিং মলের ওনার তো আপনার পরিচিত।কথা বলে দেখুন একটু।নিশ্চয় আপনার কথা শুনবে।আর আমি বাসায় যাবো।”

মেহরিমার কাঁদো কাঁদো কন্ঠস্বর।কোনোমতে কথাগুলো বের করে কন্ঠনালী দিয়ে।হৃদিত নিজেকে কিছুটা নরম করে বলে,

“তোর ফেভারিট ফুসকা খাবি না?”

“না।”

“আচ্ছা চল।”

হৃদিত মেহরিমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে দেয়।মেহরিমার ফোনের সাথে কানেক্ট করে দেয়।

“তুই গান অথবা যেটা ভালো লাগে সেটা শোন।আমি ওই ছেলের বিষয়টা একটু দেখে আসি।”

“আচ্ছা তাড়াতাড়ি আসবেন।”

হৃদিত যেতে যেয়েও ফিরে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে গানের প্লে লিস্ট অন করে দিয়ে যায়।মেহরিমা তীব্র মন খারাপ নিয়েই ছিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।হৃদিত চলে যেতেই মেহরিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।মেহরিমার কাছে থেকে সরে আসতেই হৃদিতের মুখমণ্ডল পরিবর্তন হয়ে যায়।কারো কাছে টেক্সট করতেই পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে শপিং মলের সামনে একটা বাইক এসে থামে।তৎক্ষণাৎ কোথাও একটা কল দেয় হৃদিত আর সাথে সাথে পুরো শপিং মলের সিসিটিভি ক্যামেরা অফ হয়ে যায়।সেই মেয়েটা তখনও কথা কাটাকাটি করছে স্টাফ টার সাথে।হৃদিত উপস্থিত হয় সেখানে। মেয়েটার দিকে টাকার বান্ডিল এগিয়ে দেয়।

“আই হোপ এই টাকা দিয়ে আপনার এটার থেকেও এক্সপেন্সিভ ভালো ড্রেস কেনা হয়ে যাবে।আর আপনার জানতে একটু মিস্টেক আছে।এই শপিং কমপ্লেক্সের এস্টাব্লিশার আপনার বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড হলেও ওনার তাহমীদ হৃদিত চৌধুরী।এখন আসতে পারেন।রাহাত আমার গাড়ির ব্যাক ছিটে এগুলো রেখে আস যা।”

বিশ/একুশ বছরের ছেলেটা কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে ব্যাগ গুলো তুলে ওখান থেকে চলে যায়।মেয়েটা কিছু বলার জন্য হৃদিতের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকায়!হৃদিতের চোখে সানগ্লাস পরা।পুরুষালি সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কিছু বলতে চেয়েও মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারে না।হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নেয় শুধুমাত্র ওগুলোতে হৃদিতের স্পর্শ লেগে থাকায়।হৃদিত উল্টো পথে হাঁটা ধরে।মেয়েটা কিছুক্ষণ হৃদিতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর কিছু একটা ভাবতেই মুচকি হেসে গাড়ির পার্কিং প্লেসে চলে যায়।নিজের গাড়িতে উঠে বসতেই হঠাৎ মেয়েটার মুখে তরল কিছু উড়ে এসে পড়ে।এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে গাড়ি থেকে ছিটকে দূরে পড়ে যায়।দুপুরের সময় হওয়ার দরুন আশেপাশে মানুষের আনাগোনা কম।তবুও মেয়েটার করুণ চিৎকারে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মানুষের ঢল নেমে যায় পার্কিং প্লেসে।মেয়েটার পুরো মুখ ঝলসে গেছে।সেন্সলেস হয়ে নিচে পড়ে আছে।সাথে সাথে কয়েকজন মিলে ঠান্ডা পানি দিতে থাকে মেয়েটার মুখে।অতঃপর সময় ব্যয় না করে ওখান থেকে হসপিটালে নিয়ে চলে যায়।হৃদিত দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে।ঠোঁটে হিংস্র হাসি।এতক্ষণে বুকের মাঝের আগুন নিভে শান্তি অনুভব হচ্ছে।অ্যানাবেলার চোখের পানি এই শক্তপোক্ত বুকে আগুন ধরিয়ে দেয়।মেহরিমার কথা মনে পড়তেই দ্রুত কদমে গাড়ির নিকট এগিয়ে যায় হৃদিত।গাড়ির ডোর ওপেন করতেই মেহরিমার ঘুমন্ত মুখখানি চক্ষুগোচর হয়।হৃদিত মুচকি হেসে মেহরিমার কপালে ছোট্ট করে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।ছিট টা আরেকটু হেলিয়ে শোয়ার জন্য কম্ফর্টেবল করে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

#চলবে_______

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২০
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

একটা বড় রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামায় হৃদিত।মেহরিমা এখনো গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন।হৃদিত হ্যান্ড ওয়াচে চোখ বুলায়।ঘড়ির কাঁটা দুটোর ঘরে প্রবেশ করেছে।সেই সকাল আটটায় খেয়ে বেরিয়েছে ওরা।মেহরিমা কে বারবার খাওয়ার কথা বললেও নাকোচ করে দিয়েছে।আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। নাহলে অ্যানাবেলা সিক হয়ে পড়বে।কিন্তু ঘুমটাও ভাঙাতে ইচ্ছে করছে না হৃদিতের।ও অপারগ কি আর করার!আস্তে করে ধীরস্বরে ডাকে,

“জান!”

মেহরিমার কোনো নড়চড় নেই।গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে আছে।হৃদিত আরেকটু এগিয়ে যেয়ে মেহরিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“জান!একটু উঠবি প্লিজ।”

গলায় কানে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করতেই মেহরিমা নড়েচড়ে ওঠে।সময় নিয়ে পিটপিট করে বন্ধ চক্ষু যুগল মেলে তাকায়। নিজের এতোটা কাছে কোনো পুরুষের উপস্থিতি অনুভব করতেই চমকে দূরে সরে যায়।জানালা ঘেসে বসে পড়ে। ঘুমঘুম ভাব কেটে যেতেই হৃদিতের দিকে ভালোভাবে তাকায়।মেহরিমার করা কাজে হৃদিতের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের সৃষ্টি হয়।পরক্ষণেই কিছু একটা বুঝতে পেরে মুচকি হাসে।

“লিটল কিটি ইটস মি।ইউর পার্সোনাল ম্যান।ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড।”

মেহরিমা নিজেকে ধাতস্থ করে।ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,

“আ’ম ছরি।আসলে ঘুমের ঘোরে বুঝে উঠতে পারেনি।”

“ইটস্ ওকে। এখন ফাস্ট দুই মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নে।খেতে হবে।”

হৃদিত একটা ওয়াটার বটল আর টিস্যু বক্স ধরিয়ে দেয় মেহরিমার হাতে।জানালার গ্লাস নামিয়ে দেয়।মেহরিমা ফ্রেশ হয়ে নেয়।অতঃপর দু’জনে মিলে রেস্টুরেন্টের ভিতরে যায়।হৃদিত মেনুকার্ড মেহরিমার হাতে দেয়।

“অর্ডার কর।”

মেহরিমা অস্বস্তিতে পড়ে যায়।হৃদিত খুব সহজেই সেটা বুঝে ফেলে।

“আমার কাছে পাস কর ওটা।”

মেহরিমা হাতে থাকা মেনুকার্ড হৃদিতের দিকে এগিয়ে দেয়।

“কি খাবি?”

“আপনার যেটা ভালো লাগে।”

“আমার তো তোকে ভালো লাগে।”

মেহরিমা ভড়কে যায়!হৃদিতের কথার মিনিং বুঝতে পেরেই কান দুটো গরম হয়ে ওঠে।লজ্জায় মুখটা নামিয়ে নেয়।হৃদিত মুচকি হাসে।কাচ্চি উইদ চিকেন রোস্ট,বোরহানি,জালি কাবাব,বিফ রেজালা,চাটনি,কোল্ড ড্রিঙ্কস অর্ডার করে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে খাবার ও এসে যায়।খাবার দেখে মেহরিমার মাথা ঘুরে যায়।এতো খাবার কে খাবে!হৃদিত জোর করিয়ে খাওয়ায় মেহরিমা কে। খাবার পর্ব শেষ করে ওরা বেরিয়ে আসে রেস্টুরেন্ট থেকে।মেহরিমার দু’হাতে দুটো আইসক্রিম।একটা থেকে একটু একটু করে খাচ্ছে।হৃদিত মেহরিমাকে যত্ন সহকারে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

“তুই শিওর ফুসকা খাবি না?”

“হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।এখন ফুসকা খেতে গেলে মরেই যাবো।”

“হুশশ এই কথা নেক্সট টাইম যেনো আর না শুনি। আমার হাত থেকে এতো সহজে তোর মুক্তি নেই।”

“আচ্ছা বলবনা।”

হৃদিত আর কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভিং এ ফোকাস দেয়।মেহরিমা আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত।নিজের খাওয়া শেষ করে অন্য হাতের টা হৃদিতের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

“আপনার টা।”

“আমাদের মাঝে আবার আমার,তোর ও আছে নাকি?”

মেহরিমা থতমত খেয়ে যায়।

“আসলে আমি ওভাবে বলি নাই।”

“তাহলে কিভাবে বলেছিস?”

“আমি বোঝাতে চেয়েছি আমি তো একটা খেলাম। তাহলে এটা আপনার ভাগের হচ্ছে।”

“খাইয়ে দে।”

মেহরিমা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।

“আমি!”

“তুই ছাড়া আর কেউ আছে নাকি এখানে?”

মেহরিমা ইতস্তত করে হাতটা বাড়িয়ে দেয় হৃদিতের দিকে।হৃদিত ড্রাইভিং করতে করতে খেতে থাকে।মেহরিমা যত্ন সহকারে খাইয়ে দিতে থাকে হৃদিতকে।মেহরিমার চোখের আড়ালেই মুচকি হাসে হৃদিত।
_________

নিজের রুমে সকলের উপস্থিতি টের পেতেই তৃধার কান্না থেমে যায়। নিজের করা আরেকবারের বোকামিতে নিজেই বিরক্ত হয়। আয়েশা চৌধুরী দৌড়ে এসে মেয়েকে ঝাপটে ধরে।

“কি হয়েছে মা? এভাবে কাঁদছিস কেনো?”

আরেকপাশেই আতিয়া চৌধুরী এসে বসে। মুখে বলে,

“কি হয়েছে আমাদের তৃধুরাণীর? এভাবে কান্না করছিস কেনো মা?”

মা ছোটমায়ের কথায় বোকা হাসে তৃধা। দু’জন কে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,

“কান্নার রিহার্সাল করছিলাম।মেহুর সাথে প্রাঙ্ক করবো তো তাই।হিহিহি।তোমরা ভয় পেয়ে গেছো?”

মেয়ের কথায় আয়েশা চৌধুরী রেগে যান।তৃধার পিঠে ধুম করে কিল বসিয়ে দিয়ে বলে,

“এভাবে কেউ রিহার্সাল করে?জান টাই বের হয়ে গেছিল আমার।”

আয়েশা চৌধুরীর সাথে তাল মিলিয়ে আতিয়া চৌধুরী বলে,

“এমন আর কখনো করবি না সোনা।এগুলো ঠিক না।আমরা সবাই কত ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস তুই?”

“ছরি।”

“আচ্ছা ঠিকাছে।দুপুরের খাবার খেতে আয়।”

কথাটা বলে আয়েশা চৌধুরী চলে যান।ওনার পিছু পিছু আতিয়া চৌধুরীও নিচে চলে যান।এতক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো শ্রেয়া চৌধুরী আর আরিশা।আয়েশা চৌধুরী,আতিয়া চৌধুরী চলে যেতেই ওনারা দু’জন ও প্রস্থান করেনা।বড়রা চলে যেতেই তাবান,তাইফ এগিয়ে আসে।

“সত্যি করে বল কিন্তু কান্না করছিলি কেনো?তোর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুই মিথ্যে বলেছিস।”

তাবানের কথা শুনে তাইফ বলে,

“তৃধুচুন্নী কারোর সাথে লাইন মেরে ছ্যাঁকা খাইছিস নাকি?”

“এই ভাইয়া তোমরা থামবে।আমি সত্যিই বলেছি। মিথ্যে কেনো বলতে যাবো।আজব!”

তৃধার কথা শুনে তাবান নিজের আটাশ পাটি দাঁত বের করে বলে,

“হয়তোবা!তোর মতো চুন্নীকে আবার কে পছন্দ করবে?”

কথাটা বলেই তাবান হো হো করে হেসে ওঠে।ওকে সঙ্গ দেয় তাইফ।তৃধা রেগে কটমটিয়ে বলে,

“তোমাদের বিয়ে হবে না দেখে নিও।আর বিয়ে হলেও তোমাদের বউ হবে চুন্নীদের প্রধান।দাঁত গুলো ইয়া বড় বড় হবে।হাতের নখ হবে এই দোতলা থেকে নিচতলা পর্যন্ত।দেখতে হবে কুচকুচে কালো।মাথায় কয়েকটা চুল থাকবে সুতোর মতো।”

“এমন দোয়া দিস না বইন।তখন তুই নিজেই ভয় পেয়ে ঘর থেকে বের হতে পারবি নানে।তুই যে ভীতুর ডিম।”

তাইফের কথায় সুর মিলিয়ে তাবান বলে,

“ঠিক বলেছিস ব্রো।”

পুরো রুম জুড়ে আবারও হাসির রোল পড়ে যায়।

“তো..তোমরা একটা যাচ্ছে তাই।”

কথাগুলো বলেই রেগে গটগট পায়ে নিচে চলে যায় তৃধা।তৃধা চলে যেতেই দুই ভাই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।বোনটাকে জ্বালাতে বড্ড ভালো লাগে কি না!

#চলবে