Sunday, August 3, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 70



কখনো কুর্চি পর্ব-০৬

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ৬)

পৃথিবীতে অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। কাকতালীয় ঘটনাও ঘটে। তারমধ্যে একটি হচ্ছে কুর্চির আরিয়ানের অফিসে চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে আসাটা।
কারণ আরিয়ান হচ্ছে সেই ছেলে যার মা আদিবা চাঁদনি চকে বাজার করতে গিয়ে কুর্চিকে এক দেখাতেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন ও ছেলের বৌ বানাতে হন্যে হয়ে গেছেন।
তবে কুর্চির রূপ দেখে মোহিত হবার চাইতে মায়ের সাথে কুর্চির কথোপকথন শুনে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে এমন বৌ তার চাই। কারণ নিজের ছেলের সাথেও তার এমনই মজার সম্পর্ক। কুর্চিকে যেমন মায়ের পিছে সারাক্ষণ লেগে থাকতে দেখলেন, আরিয়ানও তেমনি সবসময় তার পিছে লেগে থাকে। এমন এমন কথা বলে যে পেট ফেটে হাসি আসে। কে বলবে দুজনে মা ছেলে।

একটা উদাহরণ দেয়া যায়।
এক ছুটির দিনের সকালে নাস্তার টেবিলে তারা তিনজন নাস্তা খেতে খেতে গল্প করছিলেন, আদিবা হঠাত বলে উঠলেন
— ইশ, কতদিন ইলিশ পোলাও খাই না।
আরিয়ান একটু অবাকই হল। মা ইলিশের ভক্ত জানত না। কাঁটার ভয়ে এড়িয়ে চলে দেখে এসেছে।
— তুমি তো ইলিশ তেমন খাও না।
— খাই না তবে…
— তবে কী?
— সকালে পরাটা ভাজতে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল এক থালা গরম ধোঁয়া ওঠা ইলিশ পোলাওয়ের দৃশ্য। মা রান্না করত। আমরা ভাই বোনেরা সার দিয়ে বসে খেতাম দাদাবাড়িতে। মার বিখ্যাত রেসিপি।
— বাপ রে, মা! তুমি দেখি সেই লেভেলে পৌঁছে গেছ। আজকাল পরাটার মধ্যেও নির্বাক ছায়াছবি দেখছ। তোমার পা বাড়িয়ে দাও দেখি। সালাম করি!
— মারব থাপ্পড়।
আদিবা হেসে ফেলেছিলেন ছেলের দুষ্টুমিতে। কথাটা সেখানেই শেষ হয়ে গেছিল। আদিবার স্বামী ইমরান সাহেব খুব কম কথার মানুষ। তিনি নীরবে খেয়ে উঠে গেলেন।

কিন্তু দুপুর বারোটার দিকে বেশ বড় সাইজের ইলিশ বাসায় চলে এল। আদিবার চোখ কপালে উঠে গেল।
— এই ইলিশ তুমি কিনলে?
— কিনলাম।
ইমরান সাহেব অযথা কথা খরচ করবার মধ্যে নাই। খুব সম্ভব ইলিশ কিনেই তার রিসোর্স ফুরিয়ে গেছে।
— কেন কিনলে?
— তুমি ইলিশ পোলাও খেতে চেয়েছিলে!
পুরাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন আদিবা। সম্বিত ফিরতে ছুট লাগালেন রান্নাঘরের দিকে। তাজা ইলিশ, আজকেই রান্না করতে হবে।

ব্যপার দেখে আরিয়ান হেসে বাঁচে না। এক ফাঁকে মা’কে খোঁচাতে এল।
— ভদ্রলোককে এতখানি খাটাতে তোমার লজ্জা করল না? ছুটির দিনে কোথায় আরাম করবে, তা না বৌয়ের জন্য আকাশ বাতাস এক করে ইলিশ কিনতে দৌড় দিল। ছিঃ! কেমন বৌ তুমি?
— আমি বলেছি তাকে কিনতে?
— মুখে না বললেও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছ। ভদ্রলোক মোহাব্বতে পড়ে কিনে এনেছে।
চোখ পাকাল তাতে আদিবা।
— তা আমার বর আমাকে মোহাব্বাত করে, তোর এত জ্বলে কেন রে?
— বাহ! আমার জ্বলবে কেন? মোহাব্বাত ভালো জিনিস। একটাই মুশকিল, অনেক টাকা খরচ করায়। এনার্জিও!
— নিজের বৌয়ের জন্য টাকা এনার্জি খরচ করা কি খারাপ?
— আহা, তুমি শুরু থেকেই এমন ডিফেন্সিভ হচ্ছ কেন? আমি বলেছি খারাপ?
— না বললেও তোর গলার টোন তাই বলছে!
— গলার টোনের কথা বাদ দাও, মা। রেডিওতে চাকরি করি তো। গলার টোনে নানান ভ্যারিয়েশান আনতে হয়!
নীরবে কিছুক্ষণ হাড়ির পোলাও নাড়লেন আদিবা। তারপরে হাসতে হাসতে বললেন
— মুরোদ থাকে তো বিয়ে করে নিজের বৌকে যতখুশি মোহাব্বাত দেখা না! কে মানা করছে!
— মুরোদ নাই আপাতত। অল্প কয়টা টাকাই ভরসা। ইলিশ কিনতে হলে এখন আমাকে থালা নিয়ে রাস্তায় বসতে হবে।
— আহা। এখন নাই, পরে হবে। আগে থেকেই নেগেটিভ মন কেন? তোর বাবার এমন নেগেটিভ ভাবনা হলে বিয়ের সাহস করতে পারত? তার অবস্থাও তো তখন থালা হাতেই ছিল।

হাসাহাসি করলেও বিয়ের কথাটা তখনি মাথায় গেঁথে গেছিল আদিবার। আরিয়ানের বিয়ে দেবেন তিনি। টুকটুকে বৌ আসবে ঘরে, সারাদিন হাহাহিহি চলবে। সেজন্য হাসিখুশি মেয়ে চাই যে আরিয়ানের জোকগুলি বুঝবে। আর এজন্যই কুর্চিকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন।
সেদিন চাঁদনি চক থেকে বাড়ি ফিরেই আরিয়ানকে পাকড়াও করলেন তিনি।
— এই মেয়েটাকে দেখ।
আরিয়ান দেখল।
— কার ছবি এটা? কোথায় জায়গাটা?
— চাঁদনি চকে গেছিলাম, সেখানে মেয়েটাকে দেখলাম। ভালো লাগল। তোকে দেখাতে ছবি তুলে নিয়ে এলাম!
চক্ষু চড়ক গাছ হবার দশা আরিয়ানের।
— মা তুমি বাজারে গিয়ে র্যা নডম মেয়ের ছবি তুলে বেড়াচ্ছ? কোনদিন তোমাকে পুলিশে ধরবে। নাহ, আজ থেকে তোমার একলা বাইরে ঘোরাফেরা বন্ধ।
— শোন, এই মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দেব। যদি মেয়ে রাজি হয়। বেশ তেজি আছে!
তাতে আবার আঁতে ঘা লাগল আরিয়ানের।
— কেন রাজি না হবার কারণ কী? আমি কি ফেলনা নাকি?
— ফেলনা না হলেও কনের চাইতে যখন বরের চুলের বাহার বেশি হয়, তখন কনে বিয়েতে রাজি নাও হতে পারে।
নাক সিটকাল আরিয়ান
— তাহলে এমন হিংসুটি মেয়েকে বিয়ে করতে আমার দায় পড়েছে। ওর নজরে নজরেই আমার চুলগুলি ঝরে যেতে পারে। সেইটাই কি তুমি চাও?

মায়ের কথাকে তেমন পাত্তা দেয়নি আরিয়ান। মা’র মাথায় দিনরাত আজগুবি ভাবনা চলছে। এটাও তেমন একটা। দুদিনেই ভুলে যাবে।
তবে আদিবা ভুললেন না। জনে জনে দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন হবু বৌয়ের ছবি। তারমধ্যে তার বর ইমরান সাহেব ও বাসার সাহায্যকারিনী মুক্তার মা’ও ছিল। মুক্তার মা এতে খুব তাল দিলেও ইমরান সাহেব স্বভাবমতো নীরব রইলেন। কিন্তু একদিন আরিয়ানের রুমে এসে ছেলেকে ডাক দিলেন
— আরিয়ান, একটা কথা বলব ভাবছিলাম।
— বলো, বাবা।
— তোমার মা দেখলাম তোমার বিয়ে নিয়ে খুব এক্সাইটেড।
— বাবা, মা’র মাথায় একসাথে একশটা প্রজেক্ট চলে। এটা তারমধ্যে একটা।
— কিন্তু এটাতে তার ফোকাস বেশি। পড়াশোনা শেষ, চাকরি করছ, বিয়ের কথা ভাবতেই পারে সে। কিন্তু এখানে আমার একটা কথা আছে, আরিয়ান।
— বলো, বাবা।
— চাকরি করছ ঠিকই কিন্তু সলিড একটা চাকরি না হলে বিয়ে নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু ভেব না, বুঝলে?
— বাবা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। মা যতটা এক্সাইটেড, আমি তার কানাকড়িও না। এ অবস্থায় বিয়ের কথা মাথায়ই আনছি না।
ইমরান সাহেব কম কথার মানুষ, ছেলেকে যথেষ্ট জ্ঞানদান করা হয়েছে ভেবে প্রস্থান করলেন। আরিয়ানও বাবার কথাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। কাজেই কথাটাকে সে মাথায় গেঁথে নিল।

তবে দুদিন পরে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছেই দেখে এক দারুণ চমক অপেক্ষা করছে ওরজন্য। ফটোর সেই মেয়েটা জলজ্যান্ত রূপ ধরে বাসের অপেক্ষায় রয়েছে। তারপর থেকে বাসে যাওয়া আসা শুরু করল আরিয়ান, তখন প্রায়ই ওকে দেখত। কখনো একলা, কখনো বান্ধবীদের সাথে।
বাপ রে বাপ! মেয়েরা যে এত কথা বলতে পারে! টপিক ছাড়া বকবক করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। তবে মেয়েটার গলার স্বর মিষ্টি, উচ্চারণ স্পষ্ট। এজন্য শুনতে ভালো লাগত।
আরও দুইদিন যেতে মেয়েটা ওকে লক্ষ করল। তখন থেকে কালো চশমা পরে আসত আরিয়ান।
মা’কে বিশ্বাস নাই। হয়ত ওর ফটো এতদিনে ওদিকে চলে গেছে!
ওকে চিনতে পেরে যদি ভাবে পিছু নিয়েছে!
তবে বাসের ঘটনা ঘটার পরে বুঝল কুর্চির ওর সম্বন্ধে কোন আইডিয়া নাই, চেনবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না ওরমধ্যে।
তারপরে তো এল ওর অফিসে ইন্টার্ভিউ দিতে। সে আরেক মহাভারত।
আস্তে আস্তে আরিয়ানের ইন্টারেস্ট বাড়ছে। দেখা যাক সামনে কী হয়!
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-০৫

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ৫)

মিষ্টির বাক্স হাতে নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরে দন্ত বিকশিত করে মা’কে খবর দিল কুর্চি
— মা, রেডিওতে আমার চাকরি হয়ে গেছে।
— ওমা, তোকে আবার চাকরি দিল কে? কার খেয়ে দেয়ে কাজ নাই!
এর উত্তরে আর কী বলবে কুর্চি। ওর কপালটাই এমন। সবার মা একরকম, ওর মা’টাই সৃষ্টিছাড়া! ওর ধারণা হাসপাতালে নিশ্চয় আদল বদল হয়ে গেছিল। নাহলে এরকম হতে পারে না।
মা হবে সিনেমার মায়েদের মতো। ওর মা’কে কোনোমতেই সে কাতারে ফেলা সম্ভব না।
তবে বাবা খুব উৎসাহ দিলেন। সাথেসাথে বাক্স খুলে চট করে আস্ত এক মিষ্টি মুখে চালান করে দিয়ে বললেন
— বাহ! চমৎকার মিষ্টি।
— হতেই হবে। ৮০০ টাকা কেজি!
— তাহলে তো আরেকটা খেতেই হচ্ছে। খুব ভালো চাকরি পেয়েছিস রে, বিবলিন।
— ভালো চাকরি কিনা জানি না, তবে আমার স্বপ্নের চাকরি, বাবা।
— গুড। ভেরি গুড।

ওদিকে মা হাঁ হাঁ করে উঠেছে
— তুমি দুই দুইটা কোলবালিশ সাইজের মিষ্টি গপাগপ খেয়ে ফেললে? তোমার না খেতে মানা? সেদিনই তো ব্লাড টেস্ট করার পর ডাক্তার মানা করল।
সম্প্রতি কিছু শারীরিক অসুবিধা দেখা দেয়ায় নাসিম সাহেবকে ধরে বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন শিউলি রহমান। ডাক্তার সাহেব তখন দেড় মাইল লম্বা নানান টেস্টের এক ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তারমধ্যে থেকে বেরুল যে নাসিম সাহেবের সুগার লেভেল বর্ডারলাইনে ঝুলে রয়েছে, এই ক্রস করল বলে। সেটাকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে শিউলি রহমান তার খানা খাদ্যের ওপরে কঠোর বিধিনিষেধ জারি রেখেছেন। বলতে গেলে নাসিম সাহেব এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পছন্দের সব খাবারই তার জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু ফাঁক পেলে এটাসেটা অপকর্ম করে বসেন। এখন যেমন করলেন।

— ছোঃ। তাচ্ছিল্যের শব্দ করে কথাটাকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেন নাসিম সাহেব।— ডাক্তারে কী না বলে আর মোক্তারে কী না খায়।
— ডাক্তারে কী না বলে? বানিয়ে বানিয়ে বলেছে ডাক্তার?
— হুম। তোমার কাছ থেকে টাকা খেয়ে আবোল তাবোল বকেছে!
— আমি!
কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলেন না শিউলি রহমান।— আমি ডাক্তারকে টাকা খাইয়ে এসব বলিয়ে নিয়েছি। তাতে আমার লাভ?
শিউলি রহমানের গলার স্বর উত্তরোত্তর চড়ে যাচ্ছে দেখে বেগতিক বুঝে বাড়ি ছেড়ে পালালেন নাসিম সাহেব। বললেন বন্ধুর খুব বিপদ, তখুনি যেতে হবে।
কথাটা অবশ্য শিউলি রহমান একেবারেই বিশ্বাস করলেন না। পাকা গোয়েন্দার মতো জেরা করতে আরম্ভ করলেন
— কোন বন্ধু? নাম কী? কোথায় থাকে?
— ফিরে এসে বলব! বলে পত্রপাঠ ভেগে গেলেন নাসিম সাহেব। শিউলি রহমান তখন কুর্চিকে নিয়ে পড়লেন

— বললি না চাকরি কে দিল তোকে?
কুর্চি বিরক্ত
— আরে মহা জ্বালা দেখি। চাকরি আবার কে দিবে? আমি রীতিমতো কঠিন ইন্টার্ভিউ দিয়ে কত কষ্ট করে চাকরিটা জোগাড় করলাম, বলে কিনা কে দিল! আচ্ছা মানুষ তো তুমি। আমার দ্বারা কিছু হবে না, তাই মনে করো নাকি?
— মনে না করার মতো প্রমাণ এখনো পাইনি। যেদিন পাব, বিশ্বাস করব।
— কিসে প্রমাণ পাচ্ছ না তুমি, একটু খোলাসা করে বললে আমার জন্য ভালো হয়।
— তাহলে তো আমার মোটা ডায়রিটা আনতে হয়। সেখানে সব লেখা রয়েছে। দাড়া, একটা মনে পড়েছে। বাড়ির কোনো কাজ তোকে দিয়ে হয় না। উল্টে তোকেই ধরে বেধে তোয়াজ করে খাওয়াতে হয়।
— তারপর?
— তারপর ধর নিজের ঘরটাও পরিস্কার রাখতে পারিস না। একদিন মিনু কাজে না এলে চোখে সর্ষেফুল দেখিস। তারপরে ধর…
— আরো আছে নাকি?
— আসলটাই তো বলিনি।
— বলে ফেল। চান্স যখন পেয়েছ!
— তোকে বললাম সেদিন দোকানে যে মহিলার সাথে আলাপ হল, সে তার ছেলের জন্য তোকে খুব করে চাইছে, তো কানেই নিলি না।
— আশ্চর্য করলে, মা। খুপরি দোকানে পাওয়া বিয়ের প্রস্তাব আমি সিরিয়াসলি নিব, এখনো এতোটা ডাউনমার্কেট হইনি!
— খুপরি দোকান থেকে জামার কাপড় তো ঠিকই কিনতে চাইলি!
— তুমি যে কী না! জামার কাপড় কেনা আর জামাই বাছাই করা এক হল?
অবলীলাক্রমে শিউলি রহমান বললেন
— বিয়ে একবার হয়ে গেলে সবই সেম। তোর বাবা’কে দেখিস না?

ব্যপার হচ্ছে এই যে মাস দুয়েক আগে মা’কে সাথে নিয়ে কুর্চি গেছিল চাঁদনি চকের এক পরিচিত দোকানে। দোকান ঘুপচি হলেও কাপড় ভালো রাখে তারা। সেখানে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত মহিলা বলতে গেলে গায়ে পড়ে ওদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। কুর্চি আশ্চর্য হয়ে তাকাতে ওর হাতেধরা জামার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন
— সুন্দর রঙ।
কুর্চি কী বলবে ভেবে পেল না। ভদ্রতা করে বলেছিল
— জি, সুন্দর।
— তোমাকে খুব মানাবে।
এর উত্তরও কুর্চির কাছে নেই।
— জি।
ভদ্রমহিলা তখন শিউলি রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন
— আপনার মেয়ে বেশ সুন্দর। সবকিছুতেই মানাবে।
এসব ক্ষেত্রে মা’রা সাধারণত যা করে, শিউলি রহমানও তাই করলেন। তিনি গলে হালুয়া হয়ে গেলেন এবং কুর্চির সৌন্দর্যের পুরা ক্রেডিটটা নিজে নিয়ে নিতে চাইলেন
— ধন্যবাদ, আপা। সবাই বলে ও আমার মতো হয়েছে!

কুর্চি উঠে দাঁড়াল। চাঁদনি চকের খুপরি দোকানে বসে খাজুরে আলাপের মাজেজা বোঝা ওর কর্ম না। পাশের দোকানের দিকে যেতে যেতে বলল
— মা, আমি এই দোকানে যাচ্ছি।
পাঁচ মিনিটের মাথায় হাসিহাসি মুখে সেখানে শিউলি রহমানের আগমন ও তাকে বগলদাবা করে বাসার দিকে প্রস্থান!
কুর্চি যতোই বলে আগের দোকানে গিয়ে জামাটা ও কিনবে, শিউলি রহমান কানেই তুললেন না। তার মুখের হাসিরও কোনো হেরফের হল না।
পরে শুনল সেই দোকানের ছোট টুলে বসে দোকানীদের এক হাত দূরত্বে রেখে ভদ্রমহিলা নাকি নিজের ছেলের জন্য কুর্চিকে পছন্দ করেছেন, এখন বিয়ের কথা বলবার জন্য বাসায়ও আসতে চাইছেন।
বিয়েটা লেগে যায় কিনা, জানার জন্য দোকানীদের চোখও আগ্রহে ফেটে পড়বার উপক্রম হয়েছিল। তারা কাজকর্ম বাদ দিয়ে হাঁ করে প্রতিটি কথা গিলছিল।
শুনে কুর্চি শুধু বলেছে
— উনি যদি আসেন তো আমি বাড়ি ছেড়ে পালাব, বলে দিলাম কিন্তু। তখন আবার বলতে এসো না যে মেয়ের জন্য তোমার মান সম্মান গেছে।

কুর্চির কঠিন মুখ দেখে শিউলি রহমান ভদ্রমহিলাকে বাড়িতে ডাকতে সাহস করেননি, আবার সরাসরি না করেও দেননি। আগড়ুম বাগড়ুম কিছু একটা বলে ঠেকিয়ে রেখেছেন। তবে প্রায়ই এ প্রসঙ্গ তুলে কুর্চিকে ঠেস দেন।
কুর্চি যথাসম্ভব গায়ে না মাখার চেষ্টা করে। এবং ওর আবারও মনেহয় হাসপাতালে কিছু একটা ঘাপলা হয়েছিল নিশ্চয়। আসল মা হলে ভদ্রমহিলার কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিত। বলত
— আমার মেয়ে এখন বিয়ে করবে না, আপা। পড়াশুনা শেষ না হলে কিসের বিয়ে? তাছাড়া ওর স্বপ্ন আর জে হবার। আপনার চেনা পরিচিত কেউ থাকলে একটু বলবেন!
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-০৪

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ৪)

মনেমনে দোয়া দরূদ যা মনে পড়ছে, একবার পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে নিল কুর্চি। এবারে এসপার কী ওসপার। ভালোটাই ভাববে সে। খারাপ চিন্তা, পরাজিত মনোভাব মন থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করবার চেষ্টা করবে। ভেবে নাও তুমি উপস্থাপনা করতে গেছ কোথাও, গিয়ে শোনো যে গানের শিল্পী আসবে না বলে দিয়েছে। তখন তুমি কী করেছ? তোমার সাধ্যমতো কি সামাল দাওনি কখনো? নিজেকেই মোটিভেট করতে থাকল কুর্চি। মনের মধ্যে ক্ষীণ একটা ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইল। হয়ত একদিন ও মোটিভেশনাল স্পিকার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। কথাটা মনে আসতেই সেটাকে থাবড়া মেরে দমিয়ে দিল। এখন এসব ভাববার সময় না।
ফোকাস! ফোকাস করো, কুর্চি।
নড়েচড়ে গুছিয়ে বসে আত্মবিশ্বাসের হাসি হাসল। আরিয়ানকে বলল
— আমি রেডি।
জবাবে মাথা ঝাঁকাল আরিয়ান। তাতে ওর সিল্কি চুলগুলি দুলে উঠল। আজ মাথায় রাবার ব্যান্ড বেধে আসেনি আরিয়ান। ওর চুল দেখে মোহিত হয়ে গেল একেবারে কুর্চি। চুলে কী ব্যবহার করলে এত রেশমি, এত মোলায়েম, এত ঝরঝরে হয়?
একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে?

পরমুহূর্তেই ভাবনার গতিপথ রোধ করে দিল ও। কারণ দরজা খুলে ঢুকেছে নিরালা আকাশ।
— হাই, আমি নিড়ালা আকাশ। গ্ল্যাড টু মিঠ ইউ।
নিরালা আবার নিড়ালা হল কবে থেকে? কিন্তু এ প্রশ্ন কুর্চির মনেই রয়ে গেল। কারণ নিরালা আকাশকে দেখে ততক্ষণে ও ভিমরি খেয়েছে।
মহিলা দেখি চলন্ত জুয়েলারি শপ। রুবেল বলেছিল তার অনলাইন জুয়েলারি শপ রয়েছে। তাই বলে পুরা দোকান গায়ে চড়িয়ে আসতে হয়? ঝনঝন করছে হাঁটতে গেলে। উপরন্ত যে পরিমাণ মেকাপ করেছে, তাতে তাকে বাঙালি বলে আর চেনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ফেস পেইন্ট করা এক জাপানি গেইশা। মানে ল্যাহেঙ্গা পরা গেইশা!
বাপ রে বাপ! বিস্ময় সামলে নেবার চেষ্টা চালাল কুর্চি। আরিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল
— আমি আর জে আরিয়ান। আর ও আর জে কুর্চি।
তড়াক করে উঠে দাঁড়াল কুর্চি। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
— হাই, নিরালা আকাশ।

কুর্চিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ওকে পুরাই উপেক্ষা করল নিরালা আকাশ। আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল
— তোমার নাম শুনছি লুবনার কাছে। লুবনা কই?
মধুর হাসল আরিয়ান। এখন আপাদমস্তক বাটারিং না করলে উপায় নাই বুঝে বলল
— নিজেকে খুব সম্মানিত মনে করছি, নিরালা আকাশ। তবে দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে, লুবনা আজ থাকতে পারবে না। ওকে খুব জরুরী কাজে থাইল্যান্ড যেতে হয়েছে কাল গভীর রাতে। তবে কুর্চি থাকবে আমাদের সাথে। সে লুবনার চাইতে কম না।
অসন্তস্ট গলায় জবাব দিল নিরালা আকাশ
— কিন্তু আমি লুবনাকে এক্সপেক্ট করতেছিলাম। ওরসাথে কথা হইসে, আমরা কী নিয়ে আলোচনা করব, সেনিয়েও প্রস্তুতি নিসি। ধামাকা হবে, ধামাকা। এখন বলে লুবনা থাকব না। আমি এটা লাইক করতাসি না।
— তুমি প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করতে চাও? নাহলে আরেকদিন ডেট ফেলা যায়।

মনে হল আরিয়ানও এবারে দমে গেছে। ঠিক বুঝতে পারছে না কিভাবে নিরালা আকাশকে হ্যান্ডেল করবে। এতখানি রিস্ক নিয়ে সে ইন্টার্ভিউ শুরু করতে দ্বিধা করছে।
একটু ভাবল নিরালা আকাশ। তারপর বলল
— নাহ। রেডি যখন হইয়া আইস্যা পড়সি, তখন আর শুভ কাজে দের কিস বাত কা? হো জায়ে শুরু!
তারপর বসতে বসতে বলল
— পাঁচ লাখ দিয়া ল্যাহেঙ্গা কিনসি কি এমনি এমনি?
পাঁচ লাখ! কুর্চির মুখ ফসকে বের হয়ে গেল
— কিন্তু এটা তো রেডিও। এখানে কিছু দেখা যাবে না। শুধু শোনা যাবে।
স্তম্ভিত হয়ে গেল নিরালা আকাশ। তারপরে মাথায় থাপ্পড় মেরে বলল
— হায় রে হায়। আমি তো একদম ভুইল্যা গেসিলাম। মনে করসি টিভি ইন্টার্ভিউ হইব। হুদাই এত টাকা খরচ করলাম।
এ কথার জবাব আরিয়ান বা কুর্চি কেউ দিল না। তারা নিজেদের সমস্যায় বাঁচে না, নিরালা আকাশের ল্যাহেঙ্গাজনিত সমস্যার মধ্যে মাথা গলাতে চাইল না।
অন্য রুম থেকে রুবেল তাড়াতাড়ি বলল
— নিরালা আকাশ, তুমি এক কাজ করতে পার। এখন ছোট্ট একটা লাইভ করে তোমার ফলোয়ার্সদের জানিয়ে দিতে পার যে তুমি রেডিওতে ইন্টার্ভিউ দিচ্ছ। তাতে তোমার ভিউয়ার্সরা তোমাকে দেখতে পেল, তোমার পাঁচ লাখ টাকার ল্যাহেঙ্গা দেখল, আবার তোমার ইন্টার্ভিউ এর কথাও জানতে পারল।
— গুড আইডিয়া।
চট করে ফোন বের করে নিলারা আকাশ লাইভে চলে গেল। রুবেলের কথার অন্তর্নিহিত খোঁচা ধরতেই পারল না। আরিয়ান রুবেলের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে চোখ টিপল রুবেল।

অবশেষে সবাই গুছিয়ে বসতে আরিয়ান অন এয়ারে চলে গেল।
ধরি মাছ না ছুঁই পানি কায়দায় আরম্ভ করল।
— আজ আমাদের সাথে রয়েছেন জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার নিরালা আকাশ। আপনারা তো তাকে সবাই চেনেন। তাই আমি আর কী বলব। নিরালা আকাশকেই বলবার অনুরোধ করছি। আচ্ছা, নিরালা আকাশ, তোমার নিজের সম্বন্ধে, কাজের সম্বন্ধে লিসেনার্সদের একটু জানাবে?
— শিওর। হাই এভ্রিবডি। আমি নিড়ালা আকাশ। ইয়োর মোস্ট পপুলার ইনফ্রুয়েন্সার। সবাই আমাকে চেনে, আমার জুয়েলারি শপের কথা জানে। বাট আমি আজ জুয়েলারির কথা বলতে আসিনাই। আইসি অন্য একটা এনাউন্সমেন্ট দিবার লাইগা।
— ইয়ে, নিরালা আকাশ। তোমার জুয়েলারি শপের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক নাহয়।
— সেসব লিসেনার্সরা অনেক শুনসে। এক কথা কয়বার কপচামু। আমি এখন বলি আসল কথাটা।
হতাশ হয়ে আরিয়ান রুবেলের দিকে আবার তাকাল কাচের জানালা দিয়ে। রুবেল না দেখার ভান করে রইল।
— আচ্ছা বল।
— আমি আজ বলব প্রাক্তন তুই চায়া থাক নিয়া!

নিরালা আকাশকে কথা বলতে দিয়ে আরিয়ান সবে পানির বোতলের ছিপি খুলে এক ঢোঁক পানি খাচ্ছিল। একথা শুনে বিষম খেল। মুখ থেকে পানি ছিটকে গিয়ে পড়ল ওর মাইকের ওপরে। পুরা মাইক পানিতে সয়লাব।
আরিয়ান কাশতে থাকে। বহুকষ্টে কাশি দমন করে বলল
— কী নিয়ে কথা বলবে আজ ?
— প্রাক্তন তুই চায়া থাক!
বোকার মতো প্রশ্ন করল আরিয়ান
— তোমার গয়নার দোকানের নাম এটা?
ওদিক থেকে রুবেল দুইহাত তুলে প্রাণপণে আরিয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। সেদিকে তাকাতে রুবেল ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে ওর মাইক কাজ করছে না। খুব সম্ভব পানি পড়ে কিছু গোলমাল হয়েছে।
হতভম্বের মতো নিজের মাইক খানিক্ষণ নাড়াচাড়া করল আরিয়ান। কয়েকবার থাবড়া দিল। তারপর হতাশ হয়ে একবার রুবেল, একবার নিরালা আকাশের দিকে তাকাল। তারপর কুর্চিকে ইশারা করল চালিয়ে নিতে।

কুর্চির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এতক্ষণে সে শুধু একটাই কথা বলেছে
— নিরালা আকাশ, আপনি কেমন আছেন?
আর এখন পুরা ইন্টার্ভিউ ওকে চালিয়ে নিতে হবে? ভয়েভয়ে একবার রুবেলের দিকে তাকিয়ে দেখল। রুবেল দুইহাত মাথার ওপরে তুলে প্রাণপণে ইশারা করছে যাতে ডেড এয়ার না থাকে। নিরালা আকাশের দিকে তাকাল কুর্চি। সে তখন সবাইকে দেখছে, তারপর মেকাপে সয়লাব চোখ ঘুরিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করল। সামলে নিল নিজেকে কুর্চি। প্রশ্ন করল
— নিরালা আকাশ, আপনি কী নিয়ে কথা বলবেন আজকে, আবার একটু বলবেন?
— বললাম না, প্রাক্তন তুই চায়া থাক!
— প্রাক্তন তুই চায়া থাক?
— হ্যাঁ।
— কেন প্রাক্তন চায়া থাকবে?
— কারণ ইনকাম আমার মাসে বারো লাখ!
— বুঝলাম না, আপু।
বিরক্ত হল নিরালা আকাশ
— এতে না বোঝার কী আছে? মাসে বারো লাখ টাকা ইনকাম আমার!

— আচ্ছা! দ্বিধাগ্রস্থ হল কুর্চি। শুনে তো গহনা সম্পর্কিত কিছু বলে মনে হচ্ছে না। একবার আরিয়ানের দিকে তাকালো। আরিয়ান মাথা ঝাঁকিয়ে ওকে উৎসাহ দিল। আরিয়ানের উৎসাহ পেয়ে খানিকটা ধাতস্ত হল কুর্চি।
— এটা নিয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন কি? মানে নাম শুনে গয়না বলে মনে হচ্ছে না। নাকি এ আপনার নতুন গয়নার লাইন?
ঝকঝকে হাসি হাসল নিরালা আকাশ
— বলব বলেই তো আইলাম। এখানেই নিউজটা প্রথম বাইর হইব। তারপরে আমার পেজে খবর যাইব। প্রাক্তন তুই চায়া থাক আমার বই। আমার জীবনী।
— ওহ! বলে থেমে গেছিল কুর্চি। রেডিওতে আছে মনে পড়তে সাথেসাথে যোগ করল
— অভিনন্দন আপনাকে, নিরালা আকাশ। ইনফ্লুয়েন্সার ও রাইটার, এমন কম্বিনেশান আগে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। হলেও আপনাকে শুভেচ্ছা। এটা কি আপনার প্রথম বই?
— প্রথম বই এবং শেষ বই। আমার এত সময় আছে নাকি যে বইটই লিখুম? বই লিখব যাদের হাতে কাজকর্ম নাই, তারা! আমি এত ফেমাস, এত বিজি কিন্তু এ বই আমি লিখছি আমার মতো আরো শতশত নারীকে কী যেন বলে?… উদবুদ্ধ, হ্যাঁ উদবুদ্ধ করতে। তারা যেন প্রাক্তনের উস্টা খায়া নিজের জীবন বরবাদ না করে। দাঁতে দাঁত চাইপ্যা নিজেরে গুছাইয়া নেয়। একদিন সফলতা আইবই। তখন তারাও প্রাক্তন তুই চায়া থাকের মতো আরেকটা মাস্টারপিস লিখতে পারব।

মাস্টারপিস শুনে কুর্চি হাঁ!
— মাস্টারপিস? এ বইয়ে কী রয়েছে যাতে আপনি একে মাস্টারপিস বলছেন, নিরালা আকাশ?
— জীবনী হইলেও বইয়ে আমি জন্ম, বড় হওয়া নিয়ে কিছু বলিনাই। আমি শুধু ফোকাস করসি আমার জীবনের শয়তান ব্যাটাটার ওপরে। হের নাম আনামুল ইসলাম। ব্যাটা বদের বদ, শয়তানের লাঠি। প্রেম করার সময় কত মিষ্টি মিষ্টি কথা। এই করুম, সেই করুম। কিন্তু বিয়া করার সময় মা মইরা যাইতেসে, মায়ের কথামতো বিয়া করতে হইব এসব হাবিজাবি বলে ভাওতা দিসে আমারে!

শুনে কুর্চির চক্ষু চড়ক গাছ!
— তাহলে আপনি প্রতিশোধ নিতে এ বই লিখেছেন, নিরালা আকাশ?
— তা নয়ত কি? ব্যাটা সুখে শান্তিতে সংসার করব আর আমি চায়া চায়া দেখুম? আজ প্রি অর্ডার শুরু হইল। বই প্রকাশ পাইলে তার বউরে এক কপি পাঠামু। পইড়া বুঝব কার সাথে বিয়া হইসে হের। ব্যাটা ভন্ড!
কুর্চি একটু দম নিল, একবার আরিয়ানের দিকে তাকাল। নিরালা আকাশ কথা শেষ করে অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে। মনে হচ্ছে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এ লাইনে আরো প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি?
আরিয়ান সেটা বুঝতে পারল না। সে কুর্চিকে উৎসাহ দিতে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে ইশারা করল। তারমানে ইন্টার্ভিউ ভালো হচ্ছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাতে চাইল কুর্চি যেন চালিয়ে যায়। তাতে ওর চুল আবারো দুলে উঠল, সেদিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল কুর্চি।

হুশ ফিরতে একটু ভাবল, তারপর নতুন প্রশ্ন করল
— নিরালা আকাশ, ব্যপারটা কি একটু বেশি বেশি হয়ে গেল না? এভাবে সবার সামনে তাকে অপদস্থ না করে আপনি তাকে ধন্যবাদ জানাতে পারতেন। ঘটনা যাই হোক, তার জন্যই তো আপনি আজ এ অবস্থানে এসেছেন। আপনি এখন তাকে ধন্যবাদ জানাতে চান? অন এয়ারে?
— না! একরকম চিল্লায়ে উঠল নিরালা আকাশ। আচমকা খুবি খেপে গেল সে।
— এ বই নারী স্বাধীনতার বই। নারীদেরকে যুগ যুগ দমায়ে রাখলেও তারা একদিন তেড়েফুড়ে বাইর হইবই, আমি তার প্রমাণ। আনামুল ইসলামের মতো গুবরে পোকাগুলি আমার মতো শতশত নারীর জীবনে আইলেও আমাদের কেউ দমাইয়া রাখতে পারব না। এ কথাটা সব্বাইরে জানাইবার জন্যি আমি বইটা লিখসি।

কুর্চি খানিকটা কুঁকড়ে গেল। কথা খুঁজে পেল না, নিরালা আকাশ দেখি নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবার উপক্রম করছে। অসহায়ের মতো আরিয়ানের দিকে তাকাতে সে আবার ইঙ্গিত করল আরো প্রশ্ন করতে। কিন্তু কী প্রশ্ন করবে সেটাই বুঝে পেল না ও।
ওকে বাঁচিয়ে দিল রুবেল
— আমরা এবারে লিসেনার্সদের কাছ হতে কিছু কোয়েশ্চেন নিতে পারি। তাতে নিরালা আকাশের বই নিয়ে আরো খানিকটা জানতে পারব। প্রথম প্রশ্ন করবেন… আপনার নামটা বলবেন প্লিজ?
খরখরে এক পুরুষ গলা শোনা গেল। তারপরেই বাজ পড়ল যেন
— আমার নাম তো একটু আগেই হুনলেন। আনামুল ইসলাম। আমি হইলাম গিয়া আপনাদের নিরালা আকাশ না কী কয়, হের প্রাক্তন প্রেমিক। তয় তখন তার নাম নিরালা আকাশ আছিল না। কুলসুম বেগম ঢাকা শহরে আইয়া হইসে ইনফুলুয়েনসার! তার আগে মফস্বল শহরে দুজনের লগে আশনাই চালাইতেছিল, হেয় বলসে? এইজন্যই তো হেরে বিয়া করি নাই! এখন রেডিওতে আইসা আমারে হুমকি দেয়! দেইখ্যা নিমু তরে, কুলসুম। তুই একবার আয় আমাগো শহরে!

প্রশ্নের বহর শুনে সবার চোখ ছানাবড়া! চিৎকার করে উঠল নিরালা আকাশ
— হালার পুত আনাম, এত্ত বড় মিথ্যা কথা তুই আমার নামে কইলি? কইতে পারলি? আমার আশনাই আছিল নাকি তুই মায়ের কথায় ইন্দুরের মতো গর্তে লুকাইলি?
তারপরে আরো কী কী বলল, কুর্চি তার অর্ধেক কথাই বুঝতে পারল না। শুধু বুঝল কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর গালিগালাজও চলছে।
গালিগালাজ পর্ব শেষ হতে নিরালা আকাশ ভ্যা করে কেঁদে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। পিছনে সবাই হতবাক হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।
রুবেল অন্য রুম থেকে দরজা খুলে বের হয়ে এ রুমে ঢুকল। আরিয়ান মুখ লাল করে শুধু বলল
— লুবনাকে সামনে পেলে ওকে আমি খুন করে ফেলব!

নিঃস্পৃহভাবে জবাব দিল রুবেল। যেন এতক্ষণ যে নাটক চলছিল, সেটা খুব স্বাভাবিক ব্যপার।
— চিন্তার কিছু নাই। আমি বহু আগেই ব্রডকাস্টিং বন্ধ করে দিয়েছি। বলেছি টেকনিকাল ডিফিকালটিজ। এখন “বন্ধু, তুই লোকাল বাস!” গান শুনছে সবাই!
কুর্চি আর নিতে পারল না। প্রথমে হো হো করে হাসতে আরম্ভ করল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে হাসি হাউমাউ কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। ওর কাণ্ড দেখে বাকি দুজন আতংকিত হয়ে ওরদিকে তাকিয়ে রইল। এমন করছে কেন মেয়েটা?
আরিয়ান গাধার মতো রুবেলকে প্রশ্ন করল
— ও কাঁদছে কেন?
কাঁধ ঝাঁকাল রুবেল
— তার আমি কী জানি? কাঁদবার মতো কিছু হয়েছে নাকি? থামাও তো ওকে। আমি আর ড্রামা নিতে পারছি না। একদিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে।
— কেমন করে থামাব?
— কীজানি। জড়ায় ধরতে পারো।
ভীষণ অপ্রস্তুত হল আরিয়ান
— গবেট! জড়ায় ধরব কেন?
— কীজানি! মনে হল, তাই বললাম!
— ষ্টুপিড! যাও, ওরজন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো।

রুবেল পালাতে পেরে বেঁচে গেল যেন। ও বের হয়ে যেতে আরিয়ান সাবধানে কথা আরম্ভ করল
— ইয়ে কুর্চি, তুমি কাঁদছ কেন?
নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে কুর্চি জবাব দিল
— আজকেও আমার ইন্টার্ভিউ ভালো হয়নি। এখানে আমার চাকরি হবে না। অথচ আমার এত ইচ্ছা…
— কে বলেছে ইন্টার্ভিউ ভালো হয়নি? বিনা প্রিপারেশানে, কিছু না জেনে, কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও যা তুমি করেছ, আমি সত্যি ইম্প্রেসড, কুর্চি।
ওমনি কান্না বন্ধ হয়ে গেল কুর্চির।
— সত্যি বলছ?
টিস্যু বক্স থেকে ট্যিসু নিয়ে ওরদিকে এগিয়ে দিল আরিয়ান।
— নাও।
টিস্যু নিয়ে চোখ মুছল, নাক ঝাড়ল কুর্চি।
— দেখো, তোমার চিন্তার কোনো কারণ নাই। তুমি খুবি ভালো করেছ। এনিয়ে মনে কোনো সন্দেহ রেখো না। আজ বাড়ি যাও। কাল থেকে এসো। আমরা নতুন করে বসব। তোমার চাকরির টার্মস এন্ড কন্ডিশান্স নিয়ে কথা বলব।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল কুর্চির।
— সত্যি বলছ? আমার চাকরি হয়ে গেছে?
— হুম, হয়ে গেছে তো।
মৃদু হেসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল আরিয়ান। সামনে শুধু চাকরি না, আরো অনেককিছুই হতে পারে। এজন্য তো ও প্রতিদিন বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু কীভাবে আলাপ করবে বুঝতে পারছিল না। কেমন করে যেন কাকতালীয়ভাবে সব সুন্দরভাবে মিলে গেল!
একটা ক্লিপের কারণে এতকিছু হবে, কে জানত!
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-০৩

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ৩)

পরদিন।
সময়ের একটু আগে ইন্টার্ভিউ দিতে হাজির হয়ে গেল কুর্চি। উৎসাহ উদ্দীপনার চোটে গতরাতে ভালোমতো ঘুমই হয়নি।
সকালে উঠে রেডি হতে গিয়ে লাকি ক্লিপটার দিকে নজরে পড়তে একটু ভাবল ও। গতকালকে যা ঘটেছে তারপর সাহস করে ক্লিপটা আবার পরা ঠিক হবে কি?
কিন্তু এটা তো ওর লাকি ক্লিপ। কুর্চির স্থির বিশ্বাস এ ক্লিপের জোরেই ও ইন্টার্ভিউ এ ফেল করতে করতে বিশেষ বিবেচনায় আবারো সুযোগ পেয়েছে। শুধু তা না, আর জে আরিয়ানের সুনজরে পড়ে লিস্টের প্রথমদিকে জায়গা করে নিয়েছে।
তাহলে?
অনেক্ষণ ক্লিপটার দিকে তাকিয়ে রইল কুর্চি। তারপর ড্রয়ার খুলে চেন বের করল। তাতে ক্লিপ দুইটা লকেটের মতো সেট করে গলায় পরে নিল।
সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। অর্থাৎ ক্লিপটা চুলে পরা লাগল না, এদিকে সাথেও থাকল। দেখতে খারাপ লাগছে না, বরং ইউনিক কিছু মনে হচ্ছে।
যাক, এখন নিশ্চিন্তে ইন্টার্ভিউ এর জন্য রওনা দেয়া যায়।

পুরা রাস্তা নির্বিঘ্নে যেতে পারল কুর্চি। ভয়েভয়ে ছিল ও, কে জানে আবার কী হয়! কিন্তু না, আজ একেবারে সবকিছু নিয়মমাফিক ঘড়ি ধরে ঘটল।
যাক! সো ফার সো গুড।
গ্লাসডোর ঠেলে অফিসে পৌঁছে রিসেপশান ডেস্কে বসা মেয়েটিকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল
— আর জে আরিয়ান আমাকে আসতে বলেছে।
মেয়েটার চেহারায় কেমন দ্বিধা ফুটে উঠল। বলল
— আজকে আসতে বলেছে? আমাকে তো কিছু বলেনি।
বলে চোখের কোণ দিয়ে একবার তাকাল।
মেয়েটির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতে কুর্চিও আশ্চর্য হয়ে গেল।

কাচের দরজা দিয়ে সে ঘরের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে আরিয়ান হাত পা নেড়ে একজনের ওপরে খুব হম্বিতম্বি করছে। এক পর্যায়ে ছেলেটার কাঁধ চেপে ধরে তাকে ঝাঁকাতে দেখে কুর্চি যাকে বলে আঁতকে উঠল।
ওর আর জে হবার খুব শখ, একথা সত্য। আর জে আরিয়ানের সাথে কাজ করবার শখ খুব, একথাও সত্য। তাই বলে সেজন্য এমন ব্যবহার মেনে নেওয়া কি ঠিক হবে? মানে সবকিছুরই একটা লিমিট আছে। কাজ পছন্দ না হলে যদি দুই চারটা চড় চাপড় মেরে বসে?
কুর্চি নিজের বাবা মায়ের হাতেও যেখানে কখনো মার খায়নি সেখানে এমন এবিউজ সহ্য করা কি ওর পক্ষে সম্ভব হবে?

ঠিক সেসময়ে আরিয়ান মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই ওকে দেখতে পেল। সাথেসাথে ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে মাথা বের করে বলল
— তুমি এসেছ? ভেরি গুড!
কুর্চি ততক্ষণে খানিকটা দমে গেছে। এরমধ্যে গুডের কী হল আবার? ও তো ব্যাড ছাড়া কিছুই দেখছে না। উপরন্ত তুমি!
এটাই বা কখন থেকে হল!
হাত তুলে এবারে ইশারা করল আরিয়ান
— এসে পড়ো। আমাদের হাতে সময় একদম নাই। তোমাকে ব্রিফিং দিয়েই আমরা প্রোগ্রাম শুরু করে দিব।
দোনোমোনো ভাব নিয়ে আরিয়ানকে অনুসরণ করে রুমে গিয়ে ঢুকল কুর্চি। দেখা যাক কী হয়।

কুর্চি বসতে আরিয়ান প্রশ্ন করল
— রেডিওতে কখনো কাজ করেছ?
বিমুঢ় হল কুর্চি
— না তো। গতকালকেই তো বললাম। তবে আমি উপস্থাপনা করেছি প্রচুর। আবৃত্তিও করেছি।
— হুম। অন্যমনস্কের মতো টেবিলে আঙুল বাজাতে থাকে আরিয়ান। — কখনো কারো ইন্টার্ভিউ নিয়েছ? নার্ভ কেমন? শক্ত আছে?
ঠিক বুঝতে পারল না কুর্চি। ও যা ভেবেছিল, তার সাথে কিছু মিলছে না। প্রশ্নগুলিও কেমন খাপছাড়া। আরিয়ান কি ওরসাথে ঠাট্টা করছে? ফাজলামি করবার জন্য ডেকে এনেছে? গতকালকের ঘটনার প্রতিশোধ?
কেমন গোঁ চেপে গেল কুর্চির। সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। কিছুতেই বুঝতে দেবে না ও কতটা ঘাবড়ে গেছে। ঠান্ডা গলায় বলল
— নার্ভ একদম পাথরের মতো শক্ত। কোনোকিছু আমাকে বিচলিত করতে পারে না। ইন্টার্ভিউ কারো নেইনি তবে প্রয়োজন পড়লে নিতে পারব। আপনি পরীক্ষা করে দেখুন।

জবাবে ওরদিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আরিয়ান। তারপরে যে ছেলেটিকে ধরে ঝাঁকাচ্ছিল এতক্ষণ, তার সাথে চোখাচোখি করল। ছেলেটি বলল
— ট্রাই করা যায়।
— এতখানি রিস্ক নেয়াটা ঠিক হবে?
কাঁধ ঝাঁকাল ছেলেটি।
— এক ঘন্টা ধরে ডেড এয়ার থাকার চাইতে বেটার হবে। তাছাড়া নিরালা আকাশ কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে। তার ইন্টার্ভিউ না নিয়ে বিদায় করে দিলে কী না কী ফেসবুকে ছড়িয়ে দিবে, লোকজন তখন আমাদের মারতে না আসে।
চোখ গোলগোল করে ফেলল আরিয়ান
— নাম কী বললে? নিরালা আকাশ? কে সে? এ খবর কে দিল?
— এইমাত্র লুবনা আমার গোটা পঞ্চাশেক মেসেজের উত্তরে এক লাইন লিখে পাঠাল। বলেছে নিরালা আকাশ আজকের গেস্ট। আমরা যেন ব্যপারটা ট্যাকেল করি। তারপরেই ফেসবুক ছেড়ে উধাও হয়ে গেছে!

এক প্রস্থ গালাগাল বেরুল আরিয়ানের মুখ দিয়ে। দুহাতে চুল খামচে ধরে বলল
— কিন্তু নিরালা আকাশ জিনিসটা কী? মানুষ নাকি কোনো বস্তু? এভাবে এত রিস্ক নিয়ে কেউ অন এয়ারে যায়?
— মিলন সার্চ করছে। আশাকরি কিছু ইনফর্মেশান বের করতে পারবে সে আসার আগে। নাহলে আমন্ত্রিত অতিথিকেই প্রশ্ন করতে হবে- আপনি কে? কী করেন?
রাগে গরগর করে উঠল আরিয়ান
— লুবনা একবার ফিরে আসুক। ওকে আমি যে কী করব!
— আমার ব্যপারটা ভালো লাগেনি, আরিয়ান। তোমরা দুজনে একসাথে কাজ করো। কাকে ডাকছ, দুজনেরই জানা উচিত না?
— আরে আমি তো ছুটিতে গেছিলাম। এর মধ্যে লুবনা কাজ এগিয়ে রাখছে ভেবে খুশি হচ্ছিলাম। ফিরে এসে গতকালকে ওরসাথে এনিয়ে আলোচনা করব ভেবে রেখেছিলাম। আমাকে বলেছিল এমন একজনের সাথে কথা চলছে, যে খুব ফেমাস। কিন্তু কাজটা কনফার্ম না করা পর্যন্ত নাম গোপন রাখতে হবে। এই নিরালা আকাশের না কী, তারই নাকি বুদ্ধি এটা।
— তার বুদ্ধির চোটে তো আমরা এখন ডুবতে বসেছি। তিক্ত স্বরে বলল রুবেল।— দেখো, কেউ বিয়ে করলে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে হয়। লুবনা আমাদের এমন ফাঁসিয়ে দিয়েছে, মন থেকে দোয়া তো আসছেই না, ইচ্ছা করছে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাই। জংলি একটা! এভাবে কেউ ইলোপ করে? কতগুলি মানুষকে বিপদে ফেলে দিল! একটা বিবেচনা থাকবে না ইলোপ করার আগে?
— সেটাই তো। থাইল্যান্ডে ও কোথায় আছে এ মুহূর্তে জানলে গিয়ে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসতাম!

দরজা খুলে গেল। লম্বা শুকনা মিলন নামের ছেলে মাথা গলিয়ে বলল
— পেয়েছি, আরিয়ান। নিরালা আকাশ একজন ইনফ্লুয়েন্সার। তার বিশাল অনলাইন শপ রয়েছে। গয়নার।
— অ্যাঁ! আঁতকে উঠল আরিয়ান।— এখানে আমি কী কথা বলব? ব্যাকগ্রাউন্ডও জানি না যে দুই চারটা কথা বলে তাকে বলতে লাগিয়ে দিব। আজকের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দেবে, রুবেল? বলবে অনিবার্য কারণবশত আজকের সেশান স্থগিত, পুরানো কিছু দিয়ে চালিয়ে দেবে?
রুবেল কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই দরজা আবার খুলে গেল। এবারে রিসেপশনিস্ট মাথা গলাল
— আরিয়ান, নিরালা আকাশ নামে একজন এসেছে। বলছে আজকের অতিথি সে। আসতে বলব?
দুর্বল গলায় রুবেল বলল
— চলে এসেছে তো। এখন স্থগিত ঘোষণা দেব? এসব ইনফ্লুয়েন্সারদের পাওয়ার অনেক। কিভাবে নেবে, কে জানে!

ঝুলে পড়া মুখ নিয়ে পরাজিত সৈনিকের মতো বসে রইল খানিক আরিয়ান। এদিকে কুর্চির মাথায় কিছুই ঢুকছে না টেনশানে। হচ্ছেটা কী!
এক মিনিট গেল, দুই মিনিট গেল। নিশ্ছিদ্র নীরবতা বজায় রইল পুরো ঘরে। তারপরেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠল আরিয়ান। চোখে মুখে কঠিন সংকল্প। কুর্চির দিকে তাকিয়ে বলল
— হাতে সময় নাই, তাই খুব সংক্ষেপে জানাচ্ছি তোমাকে। আমি আর লুবনা দুজনে একসাথে কাজ করি রেডিওতে।
থামিয়ে দিল ওকে কুর্চি
— আর জে লুবনাকে চিনি তো। মানে প্রোগ্রাম শুনেছি।
— গুড গুড। কিন্তু আজ সকাল থেকে লুবনা মিসিং।
কুর্চি পুরাই হাঁ।
— মিসিং মানে? কিডন্যাপড?
— উফ, কথা বোলো না তো। পুরাটা শোনো আগে। গতকাল আমি ভ্যাকেশান থেকে ফিরে এসেছি। লুবনা গতকাল কাজে আসেনি। কোনো খবরও দেয়নি। আমরা ব্যপারটাকে পাত্তা দেইনি। কারণ রেকর্ডিং ছিল না। আজ সকালে আমাকে আর রুবেলকে মেসেজ দিয়ে জানিয়েছে সে ইলোপ করেছে, থাইল্যান্ডে চলে গেছে হানিমুন করতে। কেমনটা লাগে বল দেখি? এদিকে আমাদের মাথায় হাত। রেকর্ডিং রয়েছে। ভেবেছিলাম রেকর্ডিং শেষে দুজনে তোমার ইন্টার্ভিউ নিব। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসাতে এখন আমাদের অন্যকোনো উপায় নাই।

কুর্চি আবারও কনফিউশানে পড়ল। ও কি ঘড়ি ভুল দেখেছে? আগে চলে এসেছে?
— কী উপায় নাই?
— তোমাকে নিরালা আকাশের ইন্টার্ভিউ নিতে হবে।
আকাশ থেকে পড়ল কুর্চি
— আমি? আমি তো কখনো ইন্টার্ভিউ নেইনি। তাও নাহয় নিতাম। কিন্তু আমি এই নিরালা আকাশকে চিনিও না। কী প্রশ্ন করব? কিছু না জেনে সরাসরি অন এয়ারে?
— সেসব নিয়ে টেনশান কোরো না। আমি আছি। রুবেলও থাকবে অন্য সাইড থেকে। আমিই ম্যাক্সিমাম প্রশ্ন করব নাহয়। তুমি মাঝেমধ্যে দুই একটা প্রশ্ন কোরো যেমন আপনার হবি কী? কাজকর্ম কিভাবে শুরু করলেন— এসব হাবিজাবি।
রুবেলও সাহস দিল
— কোনো ভয় নাই তোমার। লিসেনার্সরা সবসময় একজন ছেলে একজন মেয়ে আর জে তে অভ্যস্ত বলেই বলছি। সামান্য দুই চারটা প্রশ্ন করলেই চলবে। আমরা তো আছিই। যদি ভুলভালও কিছু বলো, অসুবিধা নাই। আমরা সাথেসাথে সামলে নেব।
— পারবে? আরিয়ান একরাশ আশা নিয়ে প্রশ্ন করল।

দ্রুত ভেবে নিল কুর্চি। তারপর মাথা ঝাঁকাল
— পারব! আপনারা হেল্প করলে মনেহয় পারব।
জোর দিয়ে বলল কুর্চি। কোথা থেকে এমন জোর পেল, নিজেও জানে না।
পারতে ওকে হবেই। এটাকে ইন্টার্ভিউ হিসাবে ধরে নিয়ে আগাবে ও। ওরা একটা বিপদে পড়েছে। এসময়ে যদি মাথা ঠান্ডা রেখে ও ভালো কাজ দেখাতে পারে তো সেটা নিশ্চয় একটা প্লাস পয়েন্ট হিসাবে দেখবে এরা।
— ভেরি গুড! তবে একটা কথা।
— কী?
— এখানে সবাই সবাইকে তুমি বলে। বিশেষ করে অন এয়ারে। তুমিও আমাকে আর রুবেলকে তুমি বলবে। আমাদের টার্গেট মূলত ইয়াং জেনেরেশান। তারা তুমিতে অভ্যস্ত।
কী আর করা। বলবে নাহয় তুমি। নীরবে মাথা হেলিয়ে সায় দিল কুর্চি।

— গুড। ভেরি গুড!। নাও, এবারে একটু গুছিয়ে বসো। আমরা অন এয়ারে চলে যাই।
রুবেল এগিয়ে এসে ওর সামনে রাখা মাইক্রোফোনটা সেট করে দিল। তারপরে অন্য সাইডের দরজা খুলে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।
আরিয়ান ইঙ্গিত করতে রিসেপশানিস্ট গিয়ে নিরালা আকাশকে সাথে করে নিয়ে এল।
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-০২

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ২)

গন্তব্যে পৌঁছাতেই বাস থেকে নেমে পড়ল কুর্চি। কিছুদূর হেঁটে গেলে অফিসটা পড়বে। গ্লাসের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে টুলে ঢুলতে থাকা লোকটাকে প্রশ্ন করল
— বাথরুম কোনদিকে?
ওরদিকে সন্দেহের চোখে তাকাল লোকটা। স্বাভাবিক। নিশ্চয় পাগলিনীর মতো দেখাচ্ছে ওকে।
— ম্যাডাম। বাথরুম শুধু এখানকার ম্যাডামদের জন্য। বাইরের লোকদের জন্য না।
ঠিক পেছন থেকে ভরাট গলায় একজন বলল
— অসুবিধা নাই। ম্যাডামকে বাথরুমে নিয়ে দরজা খুলে দাও।
ঘুরে দাঁড়িয়ে কী বলবে ভেবে পেল না কুর্চি। সেই মতলববাজ লোকটা। এখানেও ওর পিছুপিছু এসেছে? নাকি এখানে ওর অফিস? বেশ জোর দিয়ে কথা বলল তো।
কথা শেষ করে ততক্ষণে লিফটে উঠে গেছে আরিয়ান।

ইন্টার্ভিউ শেষে মন খারাপ করে বেরিয়ে এল কুর্চি। ভালো হয়নি ইন্টার্ভিউ। এত ঝামেলা হল বাসে। সামলে নিতে না নিতেই ইন্টার্ভিউয়ের জন্য ডাক পড়ল। গিয়ে দেখে সেই মতলববাজ লোকটা ইন্টার্ভিউ প্যানেলে বসে রয়েছে।
কে জানত বাবা সে রেডিওতে কাজ করে! যদিও মনে সন্দেহ আসা স্বাভাবিক ছিল। যে চুলের বাহার!
প্রশ্ন যা জিজ্ঞেস করল কী উত্তর দিয়েছে এখন আর মনে করতে পারছে না।
একটা স্ক্রিপ্ট পড়তে দিল। কাঁপাকাঁপা গলায় পড়ল। এরচাইতে অনেক সুন্দর করে পড়তে পারে ও।
প্যানেলের সবার মুখ দেখে বুঝল ওদেরও পছন্দ হয়নি। বলল
— আচ্ছা, আমরা জানাব পরে।
পরে জানাবার অর্থ জানা আছে কুর্চির।
ধ্যুস! দিনটাই কুফা!

— শুনুন।
থেমে পড়ে ঘুরে দাঁড়াল কুর্চি। সেই লোকটা। আবার ওর পিছেপিছে চলে এসেছে? ওর দিন মাটি করে শখ মেটেনি?
পকেট হাতড়ে ক্লিপটা বের করল আরিয়ান। এগিয়ে দিয়ে বলল
— আপনার ক্লিপ। আমার চুলে আটকে গেছিল।
বাসের আপত্তিজনক অবস্থার কথা মনে পড়তেই গাল লাল হল কুর্চির। ছিঃ! ছিঃ! কী একটা অবস্থা!
হাত থেকে ক্লিপটা নিল। ধন্যবাদ আর জানালো না। এমন কাণ্ডে ধন্যবাদ দেয়া সম্ভব?
কী বলবে? আপনার বুকে জায়গা দেবার জন্য ধন্যবাদ?
— দেখুন, বুঝতে পারছি সকালের ঘটনায় আপনি স্ট্রেসড আউট ছিলেন। এজন্য ইন্টার্ভিউ ভালো হয়নি। কিন্তু আমি আপনার গলা শুনেছি, উচ্চারণ শুনেছি, কথা বলার স্টাইল খেয়াল করে দেখেছি।
— কখন দেখলেন এসব? সন্দেহের গলায় প্রশ্ন করল কুর্চি।
ব্যাটার মতলবখানা কী? মতলববাজ একটা!
— আপনি যখন বান্ধবীর সাথে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আবোল তাবোল বকতেন!
“আবোল তাবোল বকতেন” কথাটা নীরবে হজম করল কুর্চি! তারমানে ও ঠিকই ধরেছিল। লোকটা ওর দিকে আড়ে আড়ে চাইত।
— শুনুন, আজ বাসায় যান। গরম পানিতে লং ফেলে গার্গেল করুন। আদা চা খান। কাল আসুন। আপনার ইন্টার্ভিউ আমি নেব আবার।
— আপনি?
— হ্যাঁ, আমি। আমার সাথেই তো কাজ করবেন। আমিও আর জে। আমার নাম আরিয়ান।

হাঁ করে তাকিয়ে রইল কুর্চি। আর জে আরিয়ান। তাই তো! কখনো ভালোমতো তাকিয়েও দেখেনি লোকটার দিকে। সবসময় মতলববাজ মনে করে মুখ ফিরিয়ে রাখত।
— আপনি… আপনিই আর জে আরিয়ান?
হাসল আরিয়ান
— সেরকমই কিছু হবে। আমার শো যেহেতু, আমার কথার দাম আছে। আপনি কাল আসুন। শর্টলিস্টে আপনার নাম তুলে ফেলেছি আমি।
— সত্যি? আমার বহুদিনের স্বপ্ন…
আর বলতে পারল না কুর্চি। আর জে আরিয়ান খুব জনপ্রিয়। সেই যদি মনে করে ওর মধ্যে সম্ভবনা রয়েছে!
উফ!
মাঝরাস্তায় ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছা করল ওর। মুখ ফসকে বলে ফেলল
— আপনাকে যে কিভাবে ধন্যবাদ দিব!
মুচকি হাসল আরিয়ান।
— ধন্যবাদ দিতে হবে না। সামনে আমার চুল ছিঁড়বেন না, এই অনুরোধ রইল।

চলে যাচ্ছে আরিয়ান। যেতে যেতে মৃদু হাসল। কুর্চি কেমন বিহ্বল দৃষ্টিতে ওরদিকে তাকিয়েছিল। ভাবতে ভালো লাগছে। এতদিন ধরে ভেবে মরছিল কিভাবে ওরসাথে আলাপ শুরু করবে। আজ এমন এক কান্ড হল যে আলাপ তো আলাপ, যা-তা অবস্থা হল একটা। তারপরে একটার পর একটা চমক!
কুর্চি ওরই অফিসে এল ইন্টার্ভিউ দিতে!
ইন্টার্ভিউ ভালো হল না।
লাভ ওরই হল। তাতে কুর্চিকে আরেকটা সুযোগ দেবার কারণে ওর কৃতজ্ঞ দৃষ্টির গর্বিত মালিক হবার অভানীয় সুযোগ মিলল। সামনে হয়ত আবারো…
থামো তো! থামো! তুমি ওর বস। এভাবে গলে পড়বার কোনো মানেই হয় না!
নিজেকে বকতে বকতে কাজে ফিরে গেল আরিয়ান।

কুর্চির হাতে ধরা লাকি ফর্গেট মি নট ক্লিপটায় রোদ পড়ে ঝকঝক করছে।
আজ সত্যি ওর লাকি ডে।
আর জে আরিয়ানের সাথে ও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। উফ!
যদি একসাথে কাজ করতে করতে একদিন… যাঃ, কী ভাবছে ও! গাল লাল করে বাসায় ফিরে গেল কুর্চি।
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-০১

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ১)

মাস দুয়েক ধরে লোকটাকে নজরে রেখেছে কুর্চি।
রোজ সকালে বাস ধরতে যখন বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ায়, কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটাকেও দেখা যায়। কেদাদুরস্ত শ্যার্ট প্যান্ট, লম্বা চুল মাঝে সিঁথি করে ঘাড়ের কাছে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাধা, চৌকা মুখ, চোখে ডার্ক সানগ্লাস। সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু ডার্ক সানগ্লাসটাই যত সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে। কেন যেন ডার্ক সানগ্লাস চোখে দেয় যারা, তাদেরকে সুবিধার লোক বলে মনে করে না কুর্চি। মনে হয় মতলববাজ।
চোখ দেখতে পায় না বলেই হয়ত।
এ ব্যাটাকেও সন্দেহের তালিকায় তুলে দিয়েছে। নির্ঘাত ব্যাটা ও জিনিস চোখে ঠেসে ওরদিকে আড়চোখে চেয়ে থাকে। নাহলে ও এসে দাঁড়ালেই কুর্চি অস্বস্তিবোধ করে কেন? কেন মনে হয় কেউ ওকে লক্ষ করছে।
আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখেছে কুর্চি। কেউ তাকিয়ে নেই, সবাই নির্বিকারমুখে বাসের অপেক্ষায় রয়েছে। তারমানে ব্যটাই কালপ্রিট!
হুহ! দেখে নেবে কুর্চি। ওকে চেনে না! নরম সরম ললিত লবঙ্গলতা ও মোটেই না। কারাতে ব্রাউন বেল্ট।
এয়সা কারাতে প্যাঁচ কষবে যে বাপ বাপ করে পালাবে!

আজ শুক্রবার। ইউনিভারর্সিটিতে ক্লাস নাই। ও যাচ্ছে একটা ইন্টার্ভিউ দিতে। মিডিয়াতে কাজ করবার ওর অনেকদিনের শখ। ভয়েসও সুন্দর ওর। কোনোমতে একবার যদি রেডিওতে চান্স পায়, খুব ইচ্ছা আর জে হবে। নিজের প্রোগ্রাম থাকবে।

হাই লিসেনার্স, আমি আপনার আর জে কোকিলকন্ঠি কুর্চি। আজ আমরা কথা বলব …
হ্যাঁ, নিজেকে কোকিলকন্ঠি কুর্চি নামেই প্রতিষ্ঠিত করবার ইচ্ছা আছে। তাতে তাড়াতাড়ি পরিচিতি পাওয়া যায়। প্লেন কুর্চি শুনলে কেউ কি মনে রাখবে? অবশ্য কাকতাড়ুয়া কুর্চি হলে ব্যপারটা আরো শকিং হত কিন্তু নিজেকে খুব খেলো করা হয়ে যায় তাতে। ‘জংলি জুলির’ লেভেলে নিজেকে না নামানোই ভালো। টের পেলে মা ওকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নেবে তাহলে!
থাক, ধীরে সুস্থে আগানো যাক। ওর তো কিছুটা অভিজ্ঞতাও আছে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে সবসময় উপস্থাপনা করে এসেছে। কবিতা আবৃতি করেছে। সবাই ওর ভয়েসের অনেক প্রশংসা করে। সুযোগ পাওয়া কি এতটাই অসম্ভব হবে?
ইশ, যদি এ লাইনে পরিচিত কেউ থাকত তো কত ভালো হত।

কুর্চির কল্পনার জাল ফুঁড়ে অতিকায় বাসটা সামনে ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে হেল্পারের উচ্চস্বরে কলতান!
— এই ফারঙ্গে, ফারঙ্গে। শাহবাগ! সায়দাবাদ!
একটু ভাবল কুর্চি। ইউনিভভার্সিটিতে ও এরচাইতে উন্নতমানের বাসে চড়ে যায়। এসব মুড়ির টিনে কখনো ওঠে না। কিন্তু আজ শুক্রবার সকাল বলেই কি বাসের পরিমাণ কম? এতক্ষণে একটা বাস এল মাত্র। এটা ছেড়ে দিলে যদি পেতে দেরী হয়? যদি ইন্টার্ভিউ এ পৌঁছাতে দেরী হয়?

বাসটা চলতে আরম্ভ করবে করবে করছে, এক দৌড়ে গিয়ে কুর্চি বাসের সিঁড়িতে পা রাখল।
— এতক্ষণ ডাকতেসিলাম, ম্যাডাম। আপনে হুনেন নাই?
ইঁচড়ে পাকা হেল্পারটা সরে জায়গা দিতে দিতে অসন্তস্টি প্রকাশ করল। পাত্তা না দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল কুর্চি। ভালো ভিড়। বসতে পাবার আশা নাই। বাসের মাঝবরারবর গিয়ে থেমে গেল।
আরেহ! মতলববাজ লোকটা পেছনের দরজা দিয়ে উঠেছে দেখি, এখন ওরদিকেই এগিয়ে আসছে। সাথেসাথে থেমে গিয়ে সামনের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে গেল কুর্চি। ওকে পাত্তা দেবার কোনো মানে হয় না।
ভাবতে ভাবতেই ড্রাইভার এমন টান দিল। নিজেকে রাজপুত্র ভাবে খুব সম্ভব। বাসটা ওর পংখিরাজ ঘোড়া।
ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলল কুর্চি। ভয় পেয়ে চোখ বুজে ফেলল। আল্লাহ জানে বাসের মধ্যে পড়ে গেলে ওর কী দশা হবে। হাতে পায়ের নুনছাল উঠে যাবে, জামাকাপড়ও ছিঁড়তে পারে।

কিন্তু বাসের মেঝেতে পড়ে না গিয়ে পিছের জনের চওড়া বুকে আছড়ে পড়ল ও। চোখ বন্ধ করা অবস্থায়ই টের পেল যার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, সে নারী না, পুরুষ।
বাংলা সিনেমা হবার আর কিছু বাকি নাই। জঘন্য একটা ব্যপার হল। আবার মাথায় ঠোকাঠুকিও খেয়েছে!
ছিঃ! ছিঃ!
চোখ বন্ধ রেখেই কুর্চি কোনোমতে বলল
— সরি! সরি! এমন টান দিল। ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি।
বলেই সরে দাঁড়াতে চাইল। তখুনি ভয়ংকর ব্যপারটা যাকে বলে অনুধাবন করল।
লোকটার মাথার সাথে ওর মাথা কোনো কারণে আটকে গেছে! কিছুতেই আলাদা করা যাচ্ছে না। এদিকে ড্রাইভারও সমানে টেনে চলেছে। যারজন্য এখনো বলতে গেলে ও লোকটার বুকের মধ্যে লুটোপুটি খাচ্ছে!

এম্ব্যারাসমেন্টে মরে গেল কুর্চি। বাসের মধ্যে পিনপতন নিঃশব্দ।
ছিঃ ছিঃ। এটা কেমন ব্যপার হল। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য মাথা একবার ডানে একবার বায়ে এলোপাথারি নাড়াতে লাগল। তাতে চুল টুল ছিঁড়ে শেষ। এতক্ষণে একটা জিনিস বুঝতে পারল ও। খুব সম্ভব এমন অঘটনের জন্য সে নিজেই দায়ী!
মানে ও দায়ী না, ওর ক্লিপ দায়ী!
ওর লাকি ফর্গেট মি নট ক্লিপ!
যখনি ক্লিপ দুটো মাথায় দিয়ে কোনো জরুরি কাজে গেছে, সফল হয়েছে।
সে ভেবে আজও চুলে সাইড সিঁথি করে একপাশে দুইটা লাগিয়েছিল। ঘন চুল ওর, এক ক্লিপে সব চুল আঁটে না। ওর খুবি পছন্দের ক্লিপ। বয়সে বড়ো খালাতো বোন বাইরে থাকে, সেখান থেকে পাঠিয়েছিল। ক্লিপ দুটোতে মেটালিক তিনটা ফর্গেট মি নট ফুল রয়েছে। এত উজ্জ্বল নীল রঙ! খুবি ক্লাসি।
অথচ আজ লাকি ক্লিপই ওকে ডোবাল!

নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার বৃথা চেষ্টায় আরেকবার মাথাটা জোরে ঝাঁকাল কুর্চি। সাথেসাথে একদম কানের কাছে ভরাট গলা শুনতে পেল।
— এভাবে মাথা ঝাঁকাবেন না। আমাকে করতে দিন। আমি মনেহয় বুঝতে পেরেছি সমস্যাটা কোথায়।
একহাত ওর কাঁধে রেখে নিজের ব্যালান্স কোনোমতে ঠিক করল লোকটা। অন্যহাত দুজনের চুলে চালিয়ে দিয়ে অপরাধী ক্লিপ থেকে নিজের চুল ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল।
কুর্চি আর নিতে পারল না। এত মোলায়েমভাবে চুলে আঙুল চালালে ওরা সারাদিনই বাসের মধ্যে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকবে। অন্যান্যরা নিশ্চয় ঠোঁট টিপে সকাল সকাল ফ্রি সিনেমা দেখে নিচ্ছে।
জঘন্য! যা তা! ক্যাডাভেরাস অবস্থা একেবারে!
অন্ধের মতো লোকটার হাতে এক চাপড় মেরে হাত সরিয়ে দিল কুর্চি। তারপর বিশ্বাসঘাতক ক্লিপটাকে ধরে এমন হ্যাঁচকা টান দিল যে একদলা চুলসহ হাতে চলে এল সেটা।
লোকটা আর্তনাদ করে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করল কুর্চি।
তাও ভালো। দুজনের মাথা আলাদা হয়েছে এতক্ষণে। মাথা তুলল কুর্চি। তুলেই ভয়াবহভাবে চমকালো।

লোকটা আর কেউ না। সেই কালো চশমাধারী!
অবশ্য চশমা এখন বাঁকা হয়ে অর্ধেকটা কপালে উঠে গেছে। তাতে এক চোখ দেখা যাচ্ছে। অন্য চোখটা এখনো কালো চশমায় ঢাকা। অনেকটা পাইরেটস অফ দা ক্যারিবিয়ানের জ্যাক স্প্যারোর মতো লাগছে। আর তার চুলের পরিপাটি ঝুঁটির যা অবস্থা, কহতব্য নয়।
কুর্চি হাসতেও পারল না, বুঝল লোকটার চুলের অবিকল প্রতিফলন ওর নিজের চুলেও ঘটেছে। চুলের অবস্থা নিয়ে শোক করবে নাকি মাথা ফিরে পাওয়ায় শোকর করবে, বুঝতে পারল না।
লোকটা গরগর করে উঠল

— এসব জঘন্য জিনিস পরে বাসে উঠে পাবলিক হ্যাজার্ড তৈরী করেন কেন?
বারুদের মতো জ্বলে উঠল কুর্চি। লোকটার এক চোখের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল
— আপনিই বা আমার পিছে এসে দাঁড়াতে গেলেন কেন? মেঝেতে পড়ে যেতাম, এত ঝামেলা হত না!
অসহ্য রাগে জবাব দিতে পারল না আরিয়ান। মেয়েটাকে বাসের বদলোক থেকে রক্ষা করবার জন্যই ওর পিছে এসে দাঁড়িয়েছিল ও।
খুব ভালো হয়েছে। আর পরোপকার করতে যাবে কখনো?

কুর্চি সাথেসাথে ফিরে সামনের দিকে পাথর মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। যখনি স্টপ লাইটে বাস থামে, হাত দিয়ে যতটা পারছে চুল ঠিক করে নিচ্ছে। ইন্টার্ভিউএ ঢোকবার আগে আয়নার সামনে যাওয়া ফরজ কাজ এখন।
বদ্ধ উন্মাদ মেয়েকে তো আর কেউ চাকরি দেবে না!
চুল ঠিক করবার চেষ্টা করছে আরিয়ানও। রাবার ব্যান্ড থেকে অর্ধেক চুল বেরিয়ে গেছে। দুহাতে ঠিক করতে গিয়ে কী যেন হাতে ঠেকল। চুলে আটকে রয়েছে। ছাড়িয়ে নিয়ে না দেখেই পকেটে চালান করে দিল। নেমে দেখবে।
(চলবে)

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-৪৪ এবং শেষ পর্ব

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৪৪ (অন্তিম পর্ব)
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

গ্রামে জাঁকিয়ে শীত পড়তে শুরু করেছে। হাড়কাঁপানো শীতে অসাড় প্রকৃতি।হিম হিম ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। কুয়াশার আবরনে ঢাকা প্রকৃতি। নিস্তব্ধ পরিবেশ।রাতের নিস্তব্ধতা গলিয়ে ভেসে আসছে ক্ষুধার্ত কুকুরের হুংকার। চন্দ্রিমা বাঁশ বাগানের মাথার উপরে বসে নিজের রুপ প্রদর্শনে ব্যস্ত।জোৎস্নায় রাঙা গ্রামের মেঠোপথ।কবরস্থানের ল্যাম্পপোস্ট গুলো টিমটিম করে জ্বলছে।সদ্য হওয়া নতুন কবরটার উপর মাথা রেখে বসে আছে তাইফ।গুনগুনিয়ে কাঁদছে।দুহাতে শক্ত করে মাটি খামচে ধরে রেখেছে।

“মাধবীলতা তুমি আমারে কেন বললে না ?এই জীবনে ভালোবাসা যায় কিন্তু তাকে পাওয়ার স্বপ্নটা দেখা যায় না।তাহলে আমি কেবল ভালোই বাসতাম।তোমারে পাওয়ার স্বপ্নটা আমি দেখতাম না।যে চোখ দিয়ে তোমারে দেখেছি সেই চোখজোড়া যে চিরস্থায়ী ভাবে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তোমার মায়া কাটবে না।তুমি আমারে রেখে কেন চলে গেলে?এ কেমন ভালোবাসা তোমার? এই অভাগার জন্য একটুও কষ্ট হচ্ছে না তোমার?আমি যে এই ম র ণ য ন্ত্র ণা সহ্য করতে পারছি না।তুমি কি শুনতে পারছো আমার কথা?মাধবীলতা?”

কোনো উত্তর আসে না।অদূর থেকেই ভেসে আসে পাখিদের করুণ ডাক।তাইফ ডুকরে কেঁদে ওঠে।অস্ফুট স্বরে বলে,

“আমার আল্লাহর কসম।যারা আমার থেকে তোমাকে দূরে সরিয়েছে তাদের প্রত্যেকের গ র্দা ন কে টে তোমার পদতলে রাখবো আমি।আমার পবিত্র ভালোবাসার কসম মাধবীলতা।তোমার চেয়েও দ্বিগুণ কষ্ট দিয়ে তাদের মা র বো আমি‌।”

তাইফের কর্ণে ভেসে এক কিশোরীর খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ।তাইফ সেই হাসির শব্দ লক্ষ্য করে সেদিকে তাকায়। কবরস্থানের ফুলের সমাহারের মাঝে শুভ্রারঙা কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তাইফের মাধবীলতা।মাধবীকে দেখতেই তাইফের হৃদয়ে সদ্য জন্ম নেওয়া ফুলের কুঁড়ি গুলো ফুটে ওঠে।হৃদয়জুড়ে সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।মুচকি হাসে তাইফ।

“তুমি এসেছো মাধবীলতা?আমি জানতাম তুমি আসবে। আমাকে ছেড়ে আমার মাধবীলতা কখনও যেতে পারে না।”

মাধবী কিছু বলেনা। আবারও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।তাইফ মুগ্ধ চোখে সেই হাসি দেখে।হঠাৎ তাইফের সামনে থেকে মাধবীর অবয়ব টা অদৃশ্য হয়ে যায়।তাইফ চিৎকার করে ডাকতে থাকে,

“মাধবীলতা?কোথায় চলে গেলে তুমি?আমার সাথে লুকোচুরি খেলছো?”

তাইফের মনে হয় ওর মাধবীলতা কবরের মধ্যে থেকে মৃদু স্ব রে ওকে ডাকছে।

“তাইফ আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চল।এখানে এই অন্ধকারে একা থাকতে আমার খুব ভয় লাগছে।”

“তোমার কোনো ভয় নেই মাধবীলতা।আমি আছি তো।তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবো।এখানে একা রাখবো না তো তোমাকে।বোকা মেয়ে ভয় পায় না।”

তাইফ পাগলের মতো হাত দিয়ে কবরের মাটি সরাতে থাকে।মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

“আমার মাধবীলতা।এইতো আর একটু।ভয় পেও না তুমি।”

হৃদিত, আয়াশ কবরস্থানে এসে তাইফ কে এই অবস্থায় দেখতেই দ্রুত এগিয়ে আসে।তাইফকে জোর করে ওখান থেকে নিয়ে চলে আসে।তাইফ রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

“আমার মাধবীলতা কষ্ট পাচ্ছে।আমাকে ছাড়ো তোমরা।আমার মাধবীলতা আমার সঙ্গে যাবে। ছেড়ে দেও বলছি।”

হৃদিত আর আয়াশ তাইফকে গাড়িতে তুলে নেয়।হৃদিত ড্রাইভ করতে শুরু করে।আয়াশ তাইফকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে।ভাইয়ের ঘাড়ে মাথা দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে তাইফ।চোখজোড়া দিয়ে বর্ষণ নামে।
___

চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছেই তাইফ কে নিয়ে দোতলায় চলে যায় হৃদিত,আয়াশ।ওদের পিছু পিছু সবাই উপরে উঠে আসে।আরিফ চৌধুরী ডক্টরকে ইনফরম করে।তাইফের পাগলামি যেন কমবার নয়। মুখে শুধু একটাই শব্দ উচ্চারণ করে চলেছে
‘আমার মাধবীলতা।’ ছেলের কষ্ট দেখে হাউমাউ করে কান্না করে দেন আতিয়া চৌধুরী।সবাই আতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে নিচে চলে যায়।থেকে যায় হৃদিত,আয়াশ আর আরিফ চৌধুরী।তাইফকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করে হৃদিত।দশ মিনিটের ব্যবধানে ডক্টর এসে তাইফ কে চেক আপ করে ঘুমের ইনজেকশন দেয়। কিছু সময়ের ব্যবধানে ঘুমিয়ে পড়ে তাইফ। ডক্টর চিন্তিত মুখে বলে,

“তাইফের মেন্টাল কন্ডিশন ভালো না।আপনারা যত দ্রুত সম্ভব সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিন।এই অবস্থায় ম্যাক্সিমাম পেসেন্টের হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে। এরকম হতে থাকলে তাইফ মাধবীকে দেখতে পাবে।আর ওর টানে ওই কবরস্থানেই চলে যাবে।এটা তাইফের জন্য রিস্কি একটা ম্যাটার।”

ডক্টরের কথায় সায় জানায় আরিফ চৌধুরী। আগামীকাল’ই তাইফকে নিয়ে ঢাকাতে যাওয়ার প্ল্যান করে রাখে।ডক্টর চলে যেতেই তাইফকে ঠিকভাবে শুইয়ে দিয়ে ঘরের লাইট অন করে রেখে নিচে নেমে আসে সবাই।আজ রাতে আর তাইফের ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না।চৌধুরী বাড়ির প্রতিটা সদস্য ড্রয়িং রুমে উপস্থিত।আরিফ চৌধুরী এতক্ষণ ধরে নিজের চেপে রাখা রাগটা আর কন্ট্রোল করতে পারেন না।হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবার সম্মুখে শ্রেয়া চৌধুরীর গালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বসেন।থাপ্পড়ের শব্দে সবাই চমকে শ্রেয়া চৌধুরী আর আরিফ চৌধুরীর দিকে তাকায়। শ্রেয়া চৌধুরী গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে ছলছল চোখে আরিফ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আছেন। আকস্মিক এটার জন্য উনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। বাড়ির সবাই হতবাক হয়ে যায়!সিঁড়ির উপরেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হৃদিত।আরিফ চৌধুরী রাগে গর্জে উঠে বলেন,

“এই কাজ তোর তাই না?ছোট্ট নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে তুই মেরেছিস?জবাব দে।মানুষ হয়ে মানুষ মা র তে একটুও হাত কাঁপে না?ওহ হো আমি তো ভুলেই গেছি তুই তো মানুষের কাতারেই পড়িস না।তাইফের কিছু হয়ে গেলে তোকে মাটিতে জ্যা ন্ত পু তে রেখে দেবো আমি।থা র্ড ক্লাস মহিলা। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অ ভি শা প তুই।”

শ্রেয়া চৌধুরী কোনো প্রত্যুত্তর করেন না।কেবল হতভম্ব হয়েই তাকিয়ে থাকেন।ওনার বুকে কেউ যেন ছুরি চালিয়ে হৃদয়টা খ ন্ড বি খ ন্ড করে দিচ্ছে।যেই মানুষটার জন্য এতো গুলো পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন,নিজের গর্ভে জন্ম নেওয়া ছেলে দু’টোর জীবনটা পর্যন্ত ন ষ্ট করতে পিছপা হননি।আজ সেই মানুষটাই শেষ পর্যায়ে এসে হাত ছেড়ে দিল!তবে কি কারোর ক্ষতি করে কখনও ভালো থাকা যায় না?পঁয়ত্রিশ বছর আগে করা পাপের শা স্তি কি এখন পাচ্ছে?এটাই কি তবে প্রকৃতির বিচার?আরিফ চৌধুরী ওখান থেকে চলে যেতেই নিলে শ্রেয়া চৌধুরী হুশে ফেরেন।ধীর কন্ঠে বলেন,

“আমি খু ন করিনি।ওই নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়েটার সাথে তো আমার কোনো শ ত্রু তা নেই। তাহলে আমি কেন ওর জীবনটা শেষ করে দেবো?এতোটা নি ষ্ঠু র আমি না।”

আরিফ চৌধুরী কথাগুলো শুনেও যেন শুনলেন না।বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।হৃদিত নিচে নেমে আসে।ঠিক আয়রা চৌধুরীর সামনে দাঁড়ায়।হিসহিসিয়ে বলে,

“আমি যদি জানতে পারি এর পিছনে আপনার হাত আছে।আই সোয়্যার এই পৃথিবীতে জা হা ন্না ম দেখিয়ে দেবো।”

কথাটা বলেই হৃদিত বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। গন্তব্যস্থল শেখ বাড়ি।দীর্ঘক্ষণ অ্যানাবেলাকে দু’চোখ ভরে দেখতে পায়নি।বুকের মাঝে অশান্তির ঝড় বয়ে চলেছে।হৃদিতের বলা কথাটা শুনতেই আয়রা চৌধুরী দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করে। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল মুছে চটজলদি ওখান থেকে কেটে পড়তে নিলেই আয়াশ বলে ওঠে,

“ওটা কথার কথা ছিল ফুপি মণি।এতো ঘামবেন না।আর চোরের মতো পালিয়ে বেড়াবেন না।তাহলে কিন্তু সত্যিই আপনাকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হবে।”

আয়াশের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।অলিভিয়ার দিকে এক চোখ মেরেই হৃদিতের পিছু পিছুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।
___

রাত নয়টা বেজে পনেরো মিনিট।চৌধুরী বাড়ির সকলে শেখ বাড়িতে রাতের খাবার নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।শুধু ছেলের জন্য আসতে পারেননি আতিয়া চৌধুরী।একমাত্র ছেলের এই অবস্থায় উনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।স্বামী ছাড়া এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে যেয়ে মানুষটা যেন আরও বেশি ভে ঙে পড়েছে।সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। অবনী শেখের সাথে টুকিটাকি কথা বলে ওনাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সকলে মিলে।অবনী শেখ এখন বাইরে থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভেতরের খবর কে জানে?মেহরিমার ঘরের দরজাটা বন্ধ।সেই সন্ধ্যায় বন্ধ করেছে এখনও খোলেনি।হৃদিত স্লথ পায়ে হেঁটে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। কয়েকবার নক করে। দরজার ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না।হৃদিত ঘুরে চলে আসতে নিলেই দরজার লকটা শব্দ করে খুলে যায়।হৃদিত কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।এক অজানা ভয় চারিদিক থেকে জেঁকে ধরে।ধীর পায়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুমটা।একটা লাইটও জ্বালানো নেই।জানালা দিয়ে চাঁদের মৃদু আলো এসে ঘরে প্রবেশ করেছে।সেই মৃদু আলোয় যেন অন্ধকার আরও দ্বিগুন বেড়ে গেছে।হৃদিত আর রুমের লাইট অন করে না।শব্দহীন পায়ে হেঁটে মেহরিমার পাশে যেয়ে বসে।চাঁদের আবছা আলোয় মেহরিমাকে দেখতেই বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে।খাটের সাথে হেলান দিয়ে অগোছালো অবস্থায় নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে মেহরিমা।দেহে যেন প্রাণ নেই!দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ।এক দিনেই মেয়েটার শরীর ভেঙে গেছে।কেমন অসহায়ের মতো দেখাচ্ছে!মেহরিমার চোখদুটো রক্তের ন্যা য় লাল হয়ে ফুলে আছে। ঠোঁটের কাটা স্থান চিঁড়ে র ক্ত বেরিয়ে জমে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে জট বেঁধে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।পায়ে বাঁধা নতুন ব্যান্ডেজ টাও র ক্তা ক্ত হয়ে আছে। চাঁদের আলোয় হৃদিত স্পষ্ট দেখতে পায় ঘরের ফ্লোর জুড়ে পায়ের ছোপ ছোপ র ক্তে র দাগ লেগে আছে।হৃদিতের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।ফ্লোরে দৃষ্টি রেখেই মেহরিমা বলে,

“কাঁদছেন কেন?কান্না করার কথা তো আমার।সব হারিয়েছি আমি।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত নড়েচড়ে বসে।শক্ত খসখসে হাত দুটো দিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি গুলো দ্রুত মুছে ফেলে।ভাঙা গলায় বলে,

“জান তুই এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস কেনো?আমি তো আছি তোর পাশে।সবাই তোকে ছেড়ে গেলেও আমি কখনও ছেড়ে যাবো না।তোর থেকে সহস্র মাইল দূরে থাকলেও আমার ছায়া,বিশ্বস্ত দুটো হাত সবসময় তোর মাথার উপরে থাকবে অ্যানাবেলা।”

“আপনি আর আপনার পরিবার প্রতিনিয়ত যে মৃ ত্যু য ন্ত্র ণা দিয়ে চলেছেন সেগুলোর কাছে এই য ন্ত্র না খুবই তুচ্ছ হৃদিত চৌধুরী।এটাতো বাহ্যিক য ন্ত্র ণা তাই দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু আমার মনের গহীনে যে কষ্ট,ক্ষ ত লুকায়িত আছে সেগুলো তো কেউ দেখতে পায় না।আপনিও দেখতে পাচ্ছেন না।”

“আমি এই বিষয়ে কিছুই জানতাম না বিশ্বাস কর।আগে থেকে যদি ওদের প্লানিং এর একাংশও জানতে পারতাম তাহলে এমনটা কখনোই হতে দিতাম না।তুই তো আমায় বিশ্বাস করিস জান?আমি কথা দিচ্ছি মাধবীর শরীর থেকে ঝরা প্রতিটা র ক্তে র ফোঁটার হিসাব ওদেরকে দিতে হবে।”

“আপনার হিং স্র তা আমার থেকে সব কেড়ে নিল হৃদিত চৌধুরী।আমার বাবা, আমার নিষ্পাপ বোনটাকে কেড়ে নিলো।আপনি তো এটাই চেয়েছিলেন তাই না?আমাকে মুখ দেখাতে আপনার লজ্জা লাগছে না?বিশ্বাস করুন আপনার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃ ণা লাগছে।”

কথাগুলো বলেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে মেহরিমা। ও যেন হুশে নেই। মুখে যা আসছে তাই বলে চলেছে।মেহরিমার বলা একেকটা ধারালো কথা যে সামনে বসা মানুষটাকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে সেই দিকে ওর কোনো খেয়াল’ই নেই।মেহরিমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে হৃদিত। কিন্তু মুখনিঃসৃত কথাগুলো!মানুষ বলে শব্দতেই যত্ন,শব্দতেই বিচ্ছেদ।ভগ্নহৃদয়, ব্যথিত মন নিয়েই হৃদিত বলে,

“শা স্তি দিতে চাস?”

“আমার দু’চোখের সামনে আর কখনও আসবেন না।”

“আমার সীমানা পেরিয়ে কতদূর যেতে চাস?”

“যতদূর গেলে হৃদিত চৌধুরী আর তার সাথে কাটানো বি ষা ক্ত স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়াবে না।ঠিক ততটা দূর’ই যেতে চাই।”

“আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবি?”

“আপনার সাথে থেকেও তো আমি ভালো নেই।”

“তোকে ভালো রাখার আরেকটা সুযোগ কি আমি পেতে পারি না অ্যানাবেলা?”

“কেনো নয়? অবশ্যই পেতে পারেন।আমার হারানোর মতো আর কীই বা আছে?মা আর আমার কুট্টুস পাখিটা।ওদের দু’জনকে হারিয়ে স্বর্বহারা হওয়ার জন্য আপনাকে আমি আরেকটা সুযোগ দিতে চাই।”

মেহরিমার কথায় হৃদিতের বুকে র ক্ত ক্ষ র ণ হয়। নিজের অ্যানাবেলার চোখে এতোটা খারাপ কবে হয়ে গেল?ব্যথিত,অবিশ্বাস্য চাহনি দিয়ে মেহরিমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।যেই দৃষ্টি ফ্যাকাশে।নেই কোনো অর্থ।দৃষ্টিতে কেবল অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।নিরবতায় কেটে যায় কিয়ৎকাল।নিরবতা ভে ঙ্গে হৃদিত বলে,

“আমার হিং স্র তা দেখলি অথচ ভালোবাসাটা দেখলি না?”

“ভালোবাসা পবিত্র।এখানে হিং স্র তা র কোনো স্থান নেই হৃদিত চৌধুরী।”

“তবে কি তোকে আমি পেয়েও হারিয়ে ফেললাম অ্যানাবেলা?”

মেহরিমা কোনো প্রত্যুত্তর করে না। কাঁদতেই থাকে।ওদের দু’জনের কথার মাঝেই আয়েশা চৌধুরী এসে হৃদিতের কাছে মেহরিমার খাবার দিয়ে যায়।হৃদিত হাত ধুয়ে আসে।মেহরিমা ততক্ষণে টলমল পায়ে উঠে দাড়িয়েছে।হৃদিত খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে মেহরিমাকে বিছানায় বসতে বলে।মেহরিমা বসে না।ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়। মুখে বলে,

“ক্ষুধা নেই।খাবো না।”

“প্লিজ অ্যানাবেলা।জেদ করিস না। আজকের পর আর কখনও আমাকে তোর দু’চোখের সামনে দেখতে পাবি না।কিন্তু এখন আমাদের কুট্টুস পাখির জন্য হলেও খাবারটা খেয়ে নে।সারাদিন না খেয়ে আছিস।শরীর আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে জান।”

“ওই নামে আমাকে আর কখনও ডাকবেন না।আর আমাদের না ও শুধুমাত্র মেহরিমা শেখের সন্তান।ওর রক্ত পবিত্র।ওর রক্তে ওই বিশ্বাস ঘা ত ক চৌধুরীদের বি ষা ক্ত র ক্ত নেই। ”

“আচ্ছা ঠিক আছে।এবার তো খেয়ে নে।”

মেহরিমা এবার রাগে জেদে হৃদিতের হাত থেকে খাবারের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়।বিকট শব্দে প্লেট টা ভেঙ্গে ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। বাড়ির সকলে সেই শব্দে মেহরিমার রুমের দিকে ছুটে আসে।মেহরিমা মুখে হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতেই বলে,

“আপনাকে বললাম না আমার সামনে থেকে চলে যান। আপনি এতো নি র্ল জ্জ কেনো?আপনাকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে,রাগ হচ্ছে, ঘৃ ণা লাগছে।আপনার জন্য মাধুপুকে হারিয়েছি আমি। আমার বোন।আমার মাধুপু।আপনার ওই মুখ আর কখনও দেখতে চাই না আমি।চলে যান আপনি।দয়া করুন আমাকে।একটু বাঁচতে দেন আমাকে।”

মেহরিমার বলা কথাগুলো শুনে সবাই হকচকিয়ে যায়!মেহরিমা ঠিক আছে তো?হৃদিতের মতো করে আদৌও কি কেউ ভালোবাসতে পারে?বোনের শোকে মেয়েটা পাগল হয়ে গেল নাকি?হৃদিত কিছুক্ষণ নীরব থেকে মেহরিমার দিকে এগিয়ে যায়।ওর হাত দুটো আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

“তোকে অনেক কিছু বলার আছে অ্যানাবেলা।প্লিজ আমার সম্পূর্ণ কথাটা শোন।”

“হাত ছাড়ুন আমার। ছুঁবেন না আমাকে।”

হৃদিত আরও কিছু বলতে নিলেই মেহরিমা রাগের বশে থাপ্পড় মেরে দেয় হৃদিত কে। মূহুর্তেই ছোট খাটো একটা বজ্রপাত পড়ে শেখ বাড়িতে।অদূরেই যেন কোনো পাহাড় ধ্বসে পড়ে।সেই শব্দে কেঁপে ওঠে সকলের অন্তরাত্মা।উপস্থিত সবার চোখজোড়া অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অবনী শেখ যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।মেহরিমা নিজের হাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।এটা কী করে ফেললো!ও তো এমনটা করতে চায়নি।নিজের হাতটা এক্ষুনি ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে মন চায় মেহরিমার।অবনী শেখ হুং কা র দিয়ে ওঠেন,

“নীলাক্ষী তোর কী বোধশক্তি লোপ পেয়েছে?এটা কী করলি তুই? এক্ষুনি ক্ষমা চা হৃদিত বাবার থেকে।”

হৃদিত কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। পরক্ষণেই মেহরিমার দিকে তাকিয়ে মলিন মুখেই মৃদু হেসে বলে,

“বিচ্ছেদ চাস নাকি মুক্তি?”

মেহরিমা নিশ্চুপ।কোনো কথা বলে না। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।হৃদিতের বুক থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।মুখে বলে,

“ইয়্যু নো অ্যানাবেলা অপেক্ষা একটা মানসিক য ন্ত্র ণা। তবুও আমাদের অপেক্ষা করতে হয়।ওই যে নির্দিষ্ট একটা মানুষের কাছে আমরা সকলে অসহায় থাকি।আমাদের সবটুকু অপেক্ষা ওই জীবিত মানুষগুলোর জন্য।আমি আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তোর জন্য অপেক্ষা করবো।হোক না সেটা দীর্ঘ অপেক্ষা।যদি কখনও আমাকে মনে পড়ে চলে আসিস।আমার মনের,ঘরের দুটো দরজা’ই সবসময় তোর জন্য খোলা।তোকে নিজের করে পেয়েও পেলাম না আমি।তোকে জড়িয়ে ধরে আমি আমার অসহায়ত্বের কথাগুলো বলতে পারলাম না। তুই আমার সব বুঝলি কিন্তু এই আমিটাকেই বুঝলি না অ্যানাবেলা।এই একটাই আফসোস আমার আজীবন থেকে যাবে।এ য ন্ত্র ণা বয়ে বেড়াতে পারলে হয়তো বেঁচে থাকবো আর যদি না পারি এই পৃথিবী থেকে নিখোঁজ হয়ে চিরতরে হারিয়ে যাবো।তখন একটুও আফসোস করিস না আমার সানসাইন।ভুলে যাস তোর জীবনে হৃদিত নামের কেউ ছিল।কুট্টুস পাখিকে বলিস ওর পাপা মানুষ হিসেবে খা রা প হলেও একজন বাবা হিসেবে খা রা প নয়।ওর পাপা ওকে খুব ভালোবাসে।”

কম্পনরত কন্ঠস্বর হৃদিতের।হৃদিতের চোখের জলেরা বাঁধ মানে না।সাতাশ বছরের গড়া কঠিন সত্তাটা এক নিমিষেই ধ্বসে পড়ে।বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।কাঁদতে কাঁদতেই টলমলে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।আয়াশ হৃদিতের পিছু ছোটে।হৃদিত চলে যেতেই মেহরিমার ঘোর কাটে।হুশে ফেরে।এতক্ষণ ধরে কী করেছে সেটা ভাবতেই গলায় কান্নারা দলা পাকিয়ে আসে!এতো বড় শা স্তি ওই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মানুষটাকে কীভাবে দিল?দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মেহরিমা।ততক্ষণে হৃদিতের গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে শেখ বাড়ির আঙ্গিনা ত্যাগ করেছে।মেহরিমা দৌড়ে গাড়িটার পিছু পিছু যায়‌। চিৎকার করে বলতে থাকে,

“যাবেন না।আমাকে ছেড়ে যাবেন না দয়া করে।আমি ভুল করেছি।”

মেহরিমা দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তায় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে।এবার নাক মুখ দিয়ে গলগলিয়ে র ক্ত উঠে আসে। তবুও সেই র ক্তা ক্ত অবস্থায়’ই উঠে দাঁড়িয়ে আবারও দৌড় দেয়।কিন্তু ততক্ষণে চোখের সামনে থেকে হৃদিতের গাড়িটা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।তীব্র অন্ধকার যেন গাড়িটাকে গ্রাস করে নেয়।মেহরিমা রাস্তায় উপরেই বসে পড়ে। হাত পা ছড়ায়ে ছিটায়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।ডান হাতটা দিয়ে ক্রমশ আঘাত করতে থাকে রাস্তায়।কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই হাতটা ক্ষ ত বি ক্ষ ত হয়ে যায়।কিন্তু সেই আর্তনাদ কি আদৌও হৃদিত পর্যন্ত পৌঁছায়?হয়তো না!আমরা মানুষেরা বড়ই অভিনব প্রাণী!কেউ থাকতে মূল্য দেই না।অথচ ছেড়ে গেলে দেওয়ালে কপাল ঠুকে মরি।মেহরিমার বুকের মাঝে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে।বুকটা য ন্ত্র ণা য় ফেটে যাওয়ার উপক্রম।চারিদিক থেকে পৃথিবী ক্রমশ শূন্য হয়ে আসছে!কীসের এতো যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে? বিচ্ছেদের?হৃদিতের বলা শেষ কথাগুলো মেহরিমার মস্তিষ্কে কিলবিল করে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।এতো বড় ভুল মেহরিমা কীভাবে করতে পারল?শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে।ততক্ষণে সবাই দৌড়ে মেহরিমার নিকট এসেছে।অবনী শেখ মেয়েকে নিজের বুকে আগলিয়ে নেন।মেহরিমা মায়ের বুকে ঢলে পড়ে।অস্ফুট স্বরে বলে,

“আমি ওনাকে ভালোবাসি মা।ওনাকে ফিরে আসতে বলো না মা।আমি ওনাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না মা।”

#সমাপ্ত

(নোট: #কাঠগোলাপের_আসক্তি প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি টানলাম আজ।আমি যেভাবে প্লট সাজিয়েছি ঠিক সেভাবেই লিখেছি অ্যান্ড এন্ডিং টেনেছি।মাঝে এক দুটো দিন রেস্ট নিয়ে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দেওয়া শুরু করবো ইন শা আল্লাহ।প্রিয় পাঠক আজ সবাই রেসপন্স করবেন কেমন?প্রথম পরিচ্ছেদটা কেমন লেগেছে অবশ্যই মন্তব্য করে জানাবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।আজ সব ধরনের পাঠকদের রেসপন্স আশা করছি।)

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-৪৩

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৪৩
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

“আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?আমি আপনার সাথে কোথাও যেতে ইচ্ছুক নই।”

মেহরিমার কথায় হৃদিতের মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না।শক্ত পুরুষালী হাত দুটো সুকৌশলে ড্রাইভিংয়ে ব্যস্ত।হৃদিতের চোখমুখ শুকনো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।একটু আগেই আয়াশ ফোন দিয়ে সবটা জানিয়েছে। ডক্টরের সাথে কথা বলে তখনই মেহরিমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।মেহরিমার নিকট এখনও সবটা অজানা।মেহরিমা এবার খেকিয়ে ওঠে,

“কথা বলছেন না কেনো?আপনার ওই বাগান বাড়িতে আমি যাবো না।শুনেছেন আপনি?”

হৃদিত এ যাত্রায় ঘাড় ঘুরিয়ে মেহরিমার দিকে তাকায়।মলিন,ফ্যাকাশে মুখ নিয়েই ক্ষীণ স্বরে বলে,

“সকালে তুই আমাকে বলেছিলি না তোর বার্ধক্যের সূর্যাস্ত আমার সাথে দেখতে চাস।তোর ওই উইশটা পূরণ হবে কি না?আমার আন্সার শুনবি না সানসাইন?”

মেহরিমা এবার ভালোভাবে হৃদিতের দিকে দৃষ্টিপাত করে।চোখ, মুখের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারে খা রা প কিছু ঘটেছে।মনের য ন্ত্র ণা মনেই লুকিয়ে রেখে জবাব দেয়,

“বলুন।”

“যদি বলি না।কষ্ট পাবি?”

হৃদিতের প্রশ্নে মলিন হাসে মেহরিমা।মনের অব্যক্ত হাজারও কথা,অনুভূতি গুলো আর প্রকাশ করা হয় না।বুকের মাঝে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।সময় নিয়ে জবাব দেয়,

“না।”

একরোখা কন্ঠস্বর মেহরিমার।প্রেয়সীর একরোখামিতে মৃদু হাসে হৃদিত।

“ওটা তোর মুখের কথা। মনের কথা না। আমাদের একসাথে বাকি জীবনটা বোধহয় আর পাড়ি দেওয়া হবে না অ্যানাবেলা।তোর ভালো সময়গুলোতে তোর পাশে না থাকতে পারলেও তোর খারাপ সময়গুলোতে প্রতি ন্যানো সেকেন্ড তোর পাশে পাবি আমাকে।জানিস অ্যানাবেলা আমরা মানুষেরা বড়ই অদ্ভুত!কীসে আমাদের সুখ সেটা আমরা নিজেরাও জানি না।আমরা যেটাকে পাই সেটাকে আঁকড়ে না ধরে যেগুলো আমাদের দখল,সাধ্যের বাইরে সেগুলোকে পাওয়ার জন্য আমরণ চেষ্টা করি। দিনশেষে সেই খালি হাতেই ফিরতে হয়।”

মেহরিমা গভীর মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনে। তবে কী এতটুকুই ছিল দু’জনের গন্তব্য?চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।তবুও ঠায় নীরব রয়।হৃদিতের ব্যথিত ভগ্নহৃদয় থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
___

শোকাচ্ছন্ন প্রকৃতি। প্রকৃতি আজ নিজের সেই চিরচেনা রুপে সাজেনি। গাছ গুলো রু ক্ষ তা, তি ক্ত তা, বি ষা দে র প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।প্রকৃতিতে আজ তীব্র শোকের ছায়া ছড়িয়েছে।শেখ বাড়ির আঙ্গিনায় আজ আর বকুল ফুলের মন মাতানো ঘ্রাণ নেই।গাছে বসে থাকা পাখিগুলোর সুরেলা কণ্ঠ থেকে আজ আর কোনো গান ভেসে আসেনি।ভেসে এসেছে বিষাদের সুর।কীসের এতো শোক তাদের?তবে কী নিষ্পাপ মেয়েটার মৃ ত্যু তে ওই অবলা পাখিগুলোও শোকাহত?

মাধবীর প্রাণহীন,নিস্তব্ধ দেহ খানা সফেদ রঙা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো।যার একাংশ র ক্তে রাঙা হয়ে আছে।বেঁচে থাকতে আমাদের নিজেকে সাজাতে কতশত আয়োজন থাকে অথচ হাড় মাংসে গড়া দেহখানা থেকে প্রাণ পাখিটা উড়াল দিলেই কমদামি সফেদ রঙের কাপড়খানাই আমাদের শেষ সঙ্গী হয়। তবে ধন,সম্পদ নিয়ে কীসের এতো অ হং কা র আমাদের?শেষ সময়ে যদি সেগুলো আমাদের সঙ্গীই না হয়।বড়ই আফসোস!আমরা মানুষেরা সবটা বুঝেও অবুঝের ন্যায় আচরণ করি।

অবনী শেখ মাধবীর লা শে র ডান পাশে বসে একদৃষ্টিতে নিজের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।মাধবীর মুখের উজ্জলতা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।দেখতে কী স্নিগ্ধ লাগছে!কতোই না মায়াবী ওই মুখখানা!ওই মুখ দিয়ে আর কখনও ‘মা’ ডাক শোনা হবে না।আমরা পৃথিবীতে এসেছি একা।যেতেও হবে একা।তবে আমরা একাকীত্বকে কেনো এতো ভয় পাই?একাকীত্ব কেন মেনে নিতে পারি না?দুই দিনের পৃথিবীতে আমাদের মনে কেন এত মায়ার জন্ম দেয় আল্লাহ? আশেপাশের কোথাও থেকে কোনো উত্তর আসে না।অবনী শেখের প্রশ্ন গুলো হাওয়ায় মিশে যায়। ঠিক যেভাবে আর কিছুক্ষণের ব্যবধানে মাধবীকে নিয়ে ওনার সব স্বপ্ন,শখ,আহ্লাদ মাটির সাথে মিশে যাবে।অবনী শেখ যেন ইহজগতে নেই।গভীর ভাবনায় মগ্ন।চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়েই চলেছে। ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপছে।যেন বুকের মাঝে তোলপাড় করতে থাকা অসহনীয় য ন্ত্র ণা গুলো মুখ ফুটে প্রকাশ করতে চাচ্ছেন।কিন্তু পারছেন না।মাধবীর লাশের বাম পাশে তাইফ বসে আছে।তাইফের স্তব্ধ, নিশ্চল শরীর খানা আগলে রেখেছে তাবান আর তৃধা।তৃধা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অ্যাক্সিডেন্টের থেঁ ত লে যাওয়া লা শ বেশিক্ষণ রাখবে না।এমনিতেই কাফনের একাংশ র ক্তে ভিজে গেছে।সবাই অপেক্ষারত মেহরিমার জন্য।মেহরিমা আসলেই মাধবী কে কবরস্থানের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হবে।দীর্ঘক্ষণ পরে অধর জোড়া নাড়ায় তাইফ।বিড়বিড় করে বলে,

“এই পৃথিবীর সবকিছু পেয়ে গেলেও তোমাকে আর নিজের করে কোনো কালেই পাওয়া হবে না মাধবীলতা।এই একটা আফসোস নিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে থাকবো?এই একটা আফসোস যে আমারে আজীবন পোড়াবে।তোমাকে ছাড়া তোমার তাইফ বাঁচতে পারবে না মাধবীলতা।”

তাইফের অস্ফুট স্বরে বলা কথা গুলো শুনতেই তাবানের চোখের জলেরা আর বাঁধ মানে না। ভাইয়ের কষ্টে তৃধা ডুকরে কেঁদে ওঠে।
___

হৃদিত শেখ বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই মেহরিমা ভ্রু কুঁচকে তাকায় হৃদিতের দিকে।বাড়ির দিকে নজর পড়তেই বাড়ির সামনে,ভিতরে শতশত মানুষের আনাগোনা দেখে।বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। অজানা এক ভয়ে হৃদয় দু ম ড়ে মু চ ড়ে ওঠে।হৃদিত ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমেছে।হৃদিতকে দেখতেই আয়াশ,আরিফ চৌধুরী এগিয়ে আসেন।হৃদিত মেহরিমার পাশের দরজাটা খুলে দেয়।মেহরিমা একদমই হাঁটার মতো অবস্থায় নেই।হৃদিত মেহরিমাকে কোলে উঠিয়ে নিতে নিলেই মেহরিমা হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয়।চোখের সামনে প্রতিবেশী এক চাচী কে দেখতেই ডাক দেয়,

“চাচী একটু শুনুন।”

মহিলাটা মেহরিমার ডাক শুনতেই এগিয়ে আসে।

“চাচী বাড়িতে কী হয়েছে?এতো মানুষের ভীড় কেনো?”

মহিলাটা মুখে আঁচল গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,

“মাদুবী মা আর লাই।তুমি জানবার পারো লাই?একখান টিরাক আর একখান গাড়ি চাপা দিয়া গেছে মাদুবী মারে।”

কিছু সময়ের জন্য মেহরিমার মস্তিস্ক থমকে যায়। নিউরন গুলো ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যায়।শরীর অসাড় হয়ে আসে।শিরায় উপশিরায় র ক্ত চলাচলের পরিবর্তে যেন য ন্ত্র ণা চলাচল করতে শুরু করে।মেহরিমা অস্ফুট স্বরে বলে ‘আমার মাধুপু’।পরক্ষণেই হৃদিতকে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে ওই ক্ষ ত বি ক্ষ ত পা নিয়েই বাড়ির ভেতরে ছুট লাগায়।হাত খোঁপা করা চুলগুলো খুলে পিঠে ছড়িয়ে পড়ে।মিনিটের ব্যবধানে পা জোড়া র ক্তা ক্ত হয়ে যায়।শুভ্র রঙা ব্যান্ডেজ লাল র ক্তে গোসল করে গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করে।হৃদিত ধাক্কাটার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না বিধায় কয়েক পা পিছিয়ে যায়।মেহরিমার পিছু পিছু দ্রুত পায়ে শেখ বাড়িতে প্রবেশ করে।মেহরিমাকে দৌড়ে আসতে দেখেই সকলে সরে যেয়ে রাস্তা করে দেয়।মেহরিমা দৌড়ে এসে অবনী শেখের পাশে ধপাস করে বসে পড়ে।নিজের একমাত্র আদুরে বোনের থে ত লা নো শরীর দেখে শিউরে ওঠে!হতভম্ব হয়ে যায়!আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে কান্না করে ওঠে।মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দই বের হয়,”আমার মাধুপু।”

মেহরিমার গ গ ন বি দা রী আ র্ত না দে যেন ধরনী কেঁ পে ওঠে।বকুল গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে চলে যায়।অবনী শেখ হুশে ফেরেন।মেহরিমাকে নিজের বুকে আগলিয়ে নেন।মায়ের বুকের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই মেহরিমার কান্না আরও দ্বিগুন বেড়ে যায়।

“মা আমার মাধুপু। আমার মাধুপুকে ওরা কতটা ক ষ্ট দিয়ে মেরেছে মা।আমার কলিজার বোন।আমার মা..”

আর কিছু বলতে পারে না।শরীর অতিরিক্ত দুর্বল থাকায় সাথে এতো বড় স্ট্রেস না নিতে পেরে মায়ের বুকেই ঢলে পড়ে মেহরিমা।অবনী শেখ বুকের মাঝে মেয়েকে জড়িয়ে নেন।এখন বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল বুকের মাঝে গুটিয়ে থাকা বাচ্চা টা।মেহরিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন,

“এবার লড়াইটা তোর একার না নীলাক্ষী।তোর মা তোর সাথে আছে।”

অদূরেই দাঁড়িয়ে ব্যথিত আঁখি জোড়া,ব্যথিত হৃদয় নিয়ে সবটা নীরব দৃষ্টিতে দেখতে থাকে হৃদিত।অবনী শেখ হৃদিতকে ইশারা করতেই নিজের লাল টকটকে চোখজোড়া নিয়ে যন্ত্রের ন্যায় এগিয়ে আসে হৃদিত।মেহরিমাকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।সাইমা শেখ ও হৃদিতের পিছু পিছু যায়। চৌধুরীদের থেকে অনুমতি নিয়ে মাধবীর মুখের কাফনের কাপড়টা বেঁধে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন মুয়াজ্জিন সাহেব।বাঁধ সাধে তাইফ।সে তার মাধবীলতা কে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না।

“আপনি ছুঁবেন না আমার মাধবীলতাকে।ও এখানেই থাকবে আমার সাথে।কোত্থাও যাবে না।”

খাঁটিয়ার দুটো পায়া নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখে।আয়াশ এগিয়ে এসে তাইফকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

“ভাই আমার খাঁটিয়া ছেড়ে দে।এমন পাগলামি করিস না।”

“তুমি কে? আমাকে পাগল বলছো কেনো?দেখছো না আমার মাধবীলতা ঘুমিয়ে আছে।ও আমার সাথে ঘুরতে যাবে বলেছে।তোমরা ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছো কেনো?”

আয়াশের বুকটা কেঁপে ওঠে।ওর ছোট্ট ভাইটা কি তবে ভালোবেসে সব হারিয়ে ফেললো!তাইফের পাগলামিগুলো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন অবনী শেখ।মাধবী বেঁচে থাকলে নিঃসন্দেহে সুখী মেয়েদের মধ্যে একজন হতো।এই যুগে এসেও এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সবাই পায় নাকি?পরক্ষণেই ভাবে থাক না কিছু অপূর্ণতা।সব ভালোবাসা যে পূর্ণতা পেতে নেই। কিছু কিছু ভালোবাসা অপূর্ণাতাতেই সুন্দর।অবনী শেখ হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন।তাইফের পাশে বসেন। আস্তে করে বলেন,

“যেতে দেও বাবা। তুমি তো মিনাক্ষী কে ভালোবাসো।তোমাদের আবারও দেখা হবে।তুমি ওর সাথে আর দেখা করতে চাও না?এখন যেতে না দিলে যে তোমাদের আর দেখা হবে না।”

“চাই তো।সত্যিই আবারও আমাদের দেখা হবে?”

অবিশ্বাস্য কন্ঠস্বর তাইফের।অবনী শেখ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই তাইফ কী বুঝে কে জানে?খাটিয়া ছেড়ে দেয়। মুয়াজ্জিন চাচা মাধবীর মুখ বাধতে নিলেই অবনী শেখ উঠে দাঁড়ান। শেষ বারের মতো নিজের মেয়েকে স্পর্শ করেন।এই তো কয়েক বছর আগেই এই ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে অবনী শেখের সাথে খেলা করতো।এই ছোট্ট ছোট্ট পা দুটো দিয়ে গুটি গুটি করে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াতো!ওই মিষ্টি মুখখানা দিয়ে আধো আধো বুলিতে ডাকতো ‘আম…মা’।এতো তাড়াতাড়িই সেগুলো সব স্মৃতি হয়ে গেল!মেয়েটা কবে এতো বড় হলো যে তার পৃথিবী ছাড়ার সময় এসে গেল! অবনী শেখ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না।ধপ করে ওখানেই বসে পড়েন।সবাই এগিয়ে এসে ওনাকে ধরেন।মাধবী কে নিয়ে চলে যেতেই অবনী শেখ দূর্বল পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে চলে যান।ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দেন।মেহরিমার শেষ বারের মতো আর ওর মাধুপুকে দেখা হলো না।এতগুলো বছরের একসাথে কাটানো মুহূর্তগুলো শুধুমাত্র স্মৃতির পাতায় জমা রইল।
___

রাত আটটা বেজে পাঁচ মিনিট।গ্রামের পরিবেশ নিস্তব্ধ।শেখ বাড়িতে বিষাদের ছায়া লেপ্টে আছে।হৃদিত শেখ বাড়ির সামনে গাড়ির হুডের উপর বসে আছে।হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।পাশেই আয়াশ বসা।দুই ভাইয়ের মাঝে নিরবতা বিরাজমান।হৃদিতের দৃষ্টি দূর আকাশের জ্বলজ্বল করতে থাকা একটা নক্ষত্রের দিকে।আয়াশ বলে,

“মেহু,আন্টির কী অবস্থা এখন?”

“ভালো।”

“মেহু সব সত্যি জানে?”

“এতক্ষণে হয়তো জেনে গেছে।”

“মেহু যদি তোকে ভুল বুঝে?”

আয়াশের বোকা বোকা কথায় হৃদিত মলিন হাসে।

“মাধবী তো নিষ্পাপ বাচ্চা একটা মেয়ে ছিল ভাইয়া।ওর মুখের দিকে তাকালেই অদ্ভুত এক মায়া জন্মাত ওর প্রতি।ওকে কেনো এই খেলায় ব্যবহার করলো ওই বা স্টা র্ডে র দল?ওদের শ ত্রু তা আমার সাথে।আমাকেই মে রে দিতো।কিন্তু হাসিখুশি ছোট্ট এই পরিবারটাকে কেনো শেষ করে দিলো?এই প্রশ্নের উত্তর তো আমার নিজের কাছেই নেই ভাইয়া।তাহলে মেহরিমাকে কীভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিবো আমি?ভাইয়া আমি বাবা হতে চলেছি অথচ দেখো কেমন কেয়ারলেস বাবা আমি। নিজের আপকামিং বেবি,ওয়াইফ কাউকেই ভালো রাখতে পারছিনা।ওদের সব কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছি আমি। বিশ্বাস করো ভাইয়া আমি যদি না থাকতাম ওরা খুব ভালো থাকতো।সব ভুল আমার।মেহরিমাকে নিজের সাথে না জড়ালে হয়তো আজ এতো সুন্দর পরিবারটা শেষ হয়ে যেতো না। আমার মেহরিমা যদি নিজেকে ভালো রাখতে,আমাদের কুট্টুস পাখিকে ভালো রাখার জন্য বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আমি হাসিমুখে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।আমার কাছে ওর ভালো থাকাটা সবকিছুর ঊর্ধ্বে।ও ভালো থাকলে কোনো না কোনো ভাবে দিব্যি দিন কেটে যাবে আমার।কাছে এসে ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার না থাকলেও দূর হতে ওর ওই পবিত্র মুখখানা দেখে হৃদয়ে শীতলতা আনার অধিকার টুকু তো থাকবে।”

“তোকে ছাড়া মেহরিমা ভালো থাকতে পারবে?”

“আ’ম অ্যা কার্স টু দেম।ব্রো,আ’ম অ্যা ফেইলিওর অ্যাজ আ ফাদার অ্যান্ড হাসবেন্ড।আ’ম অ্যা কাওয়ার্ড।”

ভঙ্গুর অথচ শান্ত শিথিল কন্ঠস্বর হৃদিতের। নিজের একমাত্র ভাইয়ের কষ্টে আয়াশের বুক ভার হয়। আচ্ছা ভালোবাসা এতো কাঁদায় কেনো? নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে কী তবে সবাই সুখী হতে পারে না?মন থেকে উত্তর আসে,’অভাগা,সেটা তোর থেকে ভালো আর কে জানে?’আয়াশের মানসপটে ওর আর আরিশার খুনসুটির মুহূর্তগুলো ভেসে ওঠে।আয়াশ চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।তক্ষুনি আয়াশের ফোনে তাবানের নম্বর থেকে কল আসে।আয়াশ রিসিভ করে। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে তাবানের কান্নারত কন্ঠস্বর।

“ভাইয়া তাইফ কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবীদের ওখানে আছে কি?”

আয়াশের মাথায় আকাশ ভে ঙ্গে পড়ে‌।হৃদিতের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হয়।ফোন লাউড স্পিকারে থাকায় সবটাই শুনতে পায় হৃদিত।

“না,এখানে তো নেই।আচ্ছা আমি আর হৃদিত খুঁজে দেখছি।টেনশন করিস না।বাসার সবাইকে হাইপার হতে নিষেধ কর।”

কল কেটে দেয় আয়াশ। চিন্তিত মুখমণ্ডল আয়াশের।কিছু একটা ভাবতেই মৃদু হাসে হৃদিত। গাড়ির হুডের উপর থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামে।হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট টা ফেলে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।আয়াশকেও গাড়িতে উঠতে ইশারা করে।

#চলবে ।

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-৪১+৪২

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৪১
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

(পর্ব টা একটু সেন্সিটিভ।নোট বার্তা পড়বেন।)

রাত একটা বেজে পাঁচ মিনিট।মাধবী ব্ল্যাঙ্কেট গায়ে জড়িয়ে বিছানায় বসে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।পড়ার মাঝেই মাধবীর ফোনটা নিজস্ব শব্দে বেজে ওঠে। মাধবীর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। বিরক্ত সহিত ফোনটা হাতে নিতেই একটা আননোন নাম্বার চক্ষুগোচর হয়।কলটা কেটে দিবে দিবে করেও রিসিভ করে।ফোনের অপর পাশ থেকে কোনো শব্দ আসে না।মাধবীর বিরক্তি এবার আকাশ ছোঁয়া।কঠিন কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই ফোনের অপর পাশ থেকে পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

“এখনও জেগে আছো?”

এতো রাতে কল দিয়ে এমন বেহুদা কথা বলাতে মাধবীর মেজাজ বিগড়ে যায়।কটমট করে বলে,

“না,একটা শাকচুন্নী কথা বলছে আপনার সাথে।”

মাধবীর কথায় তাইফ শব্দ করে হেসে ওঠে।

“শেষমেষ একটা শাকচুন্নীর প্রেমে পড়লাম তাহলে?”

“আপনার পছন্দ খারাপ তাই শাকচুন্নীর প্রেমে পড়েছেন।”

“আমার পছন্দ ভালো খারাপ বুঝি না।আমার চোখে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী স্নিগ্ধ মায়াবতী তুমি।”

তাইফের বলা কথাটাতে মাধবীর হৃদয় গহীনে লুকিয়ে থাকা ভালবাসাটা আরও বেড়ে যায়।মনটা ভালোলাগায় ছেয়ে যায়।তবুও মিছে মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,

“আমাকে ঢপ দিয়েন না।বেটার অপশন পাইলে তখন আর এই মাধবীকে চিনবেন না।জানা আছে আমার।”

“তোমার অভাবে মারা গেলেও আর কখনও অন্য কাউকে ভালোবাসতে চাই না।মানুষ দুচোখ বন্ধ করলে স্বপ্ন দেখে আর আমি তোমায় দেখি।”

“গুগল থেকে মুখস্থ করেছেন?”

“উহু,আমার হৃদয়ে থাকা সুপ্ত অনুভূতি এগুলো। আচ্ছা তুমি এতো সহজেই সবটা মেনে নিলে? আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না!মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি।ঘুম ভাঙলেই আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।”

“এতো সহজে কোথায়?আপনি কী মনে করেন? এতো গুলো মাস ধরে আমাকে ফলো করা,আমার বাসার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করা,আমাকে দেখতে ভাইয়ার সাথে এ বাড়িতে আসা।এগুলো আমি লক্ষ্য করিনি?আর ভালোবাসা বোঝার জন্য মানুষের দুটো চোখ’ই এনাফ।মানুষের মন,মস্তিষ্ক মিথ্যা বললেও দুটো চোখ কখনও মিথ্যা বলে না। চোখের ভাষা সর্বদা সত্য।”

তাইফ মনোযোগ সহকারে মুগ্ধ হয়ে মাধবীর বলা কথাগুলো শোনে।ধরা পড়ে যাওয়ায় কিঞ্চিৎ লজ্জাও পায়।

“চলো কাল কোথাও ঘুরতে যায়।”

“সময় নেই।”

“প্লিজ মাধবীলতা।”

“বারোটা পঁয়তাল্লিশে কোচিংয়ের সামনে দাঁড়াবেন।”

কথাটা বলেই কল কেটে দেয় মাধবী।মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।এই ছেলে কয়েকদিনেই মাধবীকে পাগল করে ছাড়বে।তাইফের খুশিও আকাশ ছোঁয়া।এই প্রথম মাধবীর সাথে একাকী বসে নিজের মনের কথা গুলো বলতে পারবে।নতুন করে জীবনের একটা অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে।একটু স্পেশাল কিছু তো রাখতেই হয়।ইতোমধ্যে তাবানের সাথে কথা বলে সুন্দর একটা প্লানিংও করে ফেলেছে।
______

শব্দটা চলে যেতেই মেহরিমা মুখের উপর থেকে হাত নামিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়।ভয়ে তখনও ক্লান্ত শরীর টা কাঁপছে।হঠাৎ ফোনে মেসেজ নোটিফিকেশন আসে।মেহরিমা নোটিফিকেশনে ক্লিক করে।মেসেজ টা পড়তেই অধরে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে।মেহরিমা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়’ই আয়াশকে মেসেজ করে আননোন নাম্বারটা দিয়ে লোকেশন ট্র্যাক করতে বলেছিল।মেসেজের কোনো উত্তর না পেয়ে ভেবেছিল ভাইয়া হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।অপরিচিত ব্যক্তির অবস্থান জানতেই মেহরিমা মনের ভয় কাটিয়ে নিজের তেজস্বী সত্ত্বায় ফিরে আসে।

“বলুন এবার কোনদিকে যেতে হবে।”

কন্ঠে তেজস্বীয়তা বিদ্যমান।সেকেন্ডের ব্যবধানে মেহরিমার পরিবর্তনে ফোনের অপর পাশে থাকা ব্যক্তিটা চমকায়!

“হঠাৎ সাহস বেড়ে গেল যে মেয়ে!”

“আমার পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর,দক্ষিণ কোনো না কোনো একদিকে তো আপনি আছেন’ই।যেভাবে বুনো শেয়াল,সাপের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।সেভাবে অন্য প্রাণীর হাত থেকেও নিশ্চয় রক্ষা করবেন।”

“ইন্টেলিজেন্ট গার্ল।বাট ইয়্যু নো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার এই কঠিন রুপ ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। নিজের ভালোবাসাকে হেরে যেতে দেখতে নিশ্চয় তোমার ভালো লাগবে না?”

“মনে হচ্ছে আমার মন ভাঙার বড্ড তাড়া আপনার?”

“তোমার মন ভাঙলে একজন নিজের সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে মেয়ে।তার কষ্টতে যে আমি নিজের মনের প্রশান্তি খুঁজে পাই।তার দেওলিয়া রুপ দেখার বড়ই ইচ্ছা আমার।”

মেহরিমার বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয়। শরীরের ব্যথার চেয়েও মনের ব্যথাটাই বেশি পোড়াচ্ছে।মেহরিমা যেটা ভাবছে সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে হৃদিতকে আবারও আগের মতো ভালোবাসতে পারবে তো!মেহরিমার পবিত্র ভালবাসা তবে কী হৃদিতের হিং স্র তা র কাছে হেরে যাবে?নিজের ব্যথিত মন,ক্লান্ত শরীর নিয়েই অপরিচিত ব্যক্তির কথামতো আবারও হাঁটতে শুরু করে।অদূরেই জ্বলজ্বল করতে থাকা দুটো চোখে হাসি খেলে যায়।
_____

কাঠের রুমের দরজা টা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে খুলে যায়।ফ্লোরে পড়ে থাকা লোকটা সেই শব্দে নড়েচড়ে ওঠে।বাঁচার জন্য ছটফট করতে থাকে। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসে।হয়তো কিছু বলার চেষ্টা করছে।হৃদিত ঘরের ড্রিম লাইট টা জ্বালিয়ে দেয়। শব্দ করে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে। লোকটা সেই শব্দে কেঁপে ওঠে।হ্যানসেল আর হ্যারিকে একটা কাঠের খুঁটির সাথে বেঁধে লোকটার দিকে এগিয়ে যায় হৃদিত।চোখ,আর মুখের কাপড়টা খুলে দেয়। লাইটের আবছা আলোয় লোকটা নিজের সামনে উপস্থিত মানুষটার জ্বলজ্বল করতে থাকা হিং স্র চোখ দুটো দেখেই কাঁপতে শুরু করে দেয়।হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

“আমাকে ছেড়ে দাও।আমার কী অপরাধ?এ..একটু পানি।”

হৃদিত ক্ষীণ হেসে বলে,

“তোকে মুক্তি দিতেই তো আমি এসেছি।”

হৃদিতের কন্ঠস্বর শুনতেই লোকটা চমকায়! হতভম্বের সহিত বলে,

“ত.. তুমি?”

“হ্যাঁ তোর শুভাকাঙ্ক্ষী।পানি খাবি নাকি..?”

হৃদিতকে কথা শেষ করতে না দিয়েই লোকটা বলে,

“হ…হ্যাঁ খাবো।”

হৃদিত কোটের পকেট হাতড়ে একটা বোতল বের করে ছিপি খুলে লোকটার মুখের উপর ধরতেই লোকটা এক চুমুকেই সবটা শেষ করে ফেলে।সেকেন্ড পেরোতেই লোকটার গ গ ন বি দা রী চিৎ কা রে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।জিহ্বা,ঠোঁট দুটো গ লে পড়ে যায়।হৃদিত হাঁটু মুড়ে লোকটার সামনে বসে।

“এই মুখ দিয়েই আমার অ্যানাবেলাকে সুন্দরী বলেছিস তাই না?ওই চোখ দিয়ে ওকে কু ৎ সি ত নজরে দেখেছিস?আর,আর এই হাত দিয়ে ওকে স্পর্শ করেছিস তাই না? এখন যদি এগুলোর কিছুই না থাকে তাহলে কেমন হবে বল তো?”

কথাটা বলেই ভয়ংকর অট্টহাসিতে মেতে ওঠে হৃদিত।সেই হাসির শব্দে লোকটার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।হৃদিত হাসি থামিয়ে পরক্ষণেই কোটের পকেট থেকে সাঁ ড়া শি,চা পা তি,না ই ফ,লা ই টা র, হা তু ড়ি সহ আরও দুটো বোতল বের করে কাঠের ফ্লোরে রাখে।লোকটা যন্ত্রপাতিগুলো দেখতেই দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু হাত পা বাঁধা থাকায় নড়তে পারে না।চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।হৃদিত তা দেখে বাঁকা হাসে।সাঁ ড়া শি হাতে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়।কোনো কথা না বলেই মিনিটের ব্যবধানে চোখের মণি দুটো উ প ড়ে ফেলে।লোকটা কাঁ টা কবুতরের ন্যায় ঝাপটাতে থাকে।মুখ দিয়ে আ র্ত না দ বের হলেও হৃদিতের কর্ণে সেই আ র্ত না দ পৌঁছায় না।চা পা তি হাতে নিয়ে লোকটার হাতের পায়ের নখগুলো কে টে নেয়।একটা বোতলের ছিপি খুলে কাঁ টা আঙুলের ডগায় তরল পদার্থ লাগিয়ে দেয়।সাথে সাথে হাত পায়ের কা টা অংশগুলো ঝ ল সে যায়।হাতে হা তু ড়ি তুলে নিয়ে দাঁতসহ বুকের হা ড় গু লো খটখট শব্দ করে ভে ঙে ফেলে।লোকটা য ন্ত্র ণা য় কা ত রা তে থাকে।পরক্ষণেই কু ড়া ল উঠিয়ে নিয়ে হাত পা তিন খ ন্ড করে কেটে ফেলে।এক কো পে মাথাটা দ্বি খ ণ্ডি ত করে দেয়।মাথার মধ্যে থাকা তরল পদার্থ গুলো কি ল বি ল করে বেরিয়ে আসে। কাঠের ফ্লোর তাজা গাঢ় লাল র ক্তে ভেসে যায়।লোকটা কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে শান্ত হয়ে যায়।লোকটার শরীরে তখন প্রাণ নেই।কিন্তু হৃদিত তবুও থামে না।বুকের মাঝে তখনও হিং স্র তা বিদ্যমান!না ই ফ দিয়ে শরীরের মাং স কাটতে থাকে।পুরো শরীরের মাং শ কেটে তবেই ক্ষান্ত হয়।মাং শ গুলো হ্যানসেল,হ্যারির সামনে দিয়ে আসে।হ্যানসেল হ্যারি খুশিতে ঘেউ ঘেউ করে ডে কে উঠে খেতে শুরু করে দেয়।হৃদিত পুনরায় লোকটার লা শে র কাছে ফিরে আসে।সাঁ ড়া শি দিয়ে কলিজা টা টেনে বের করে আনে।সেটার দিকে কিয়ৎকাল তাকিয়ে থেকে হিসহিসিয়ে বলে,

“এটা তোর খুব বড় হয়ে গিয়েছিল তাই না?নাহলে হৃদিতের অ্যানাবেলাকে টাচ করার মতো সাহস কখনই দেখাতিস না।”

ক লি জা টাও হ্যানসেল,হ্যারিকে খেতে দিয়ে আসে।অবশিষ্ট থাকে শুধু মানব কঙ্কাল টা।কু ড়া ল দিয়ে সেটা ইচ্ছে মতো কো পা তে থাকে।হৃদিতের পুরো কোট তাজা র ক্তে ভিজে গেছে।উন্মুক্ত চোখদুটো থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে র ক্ত পড়ছে।নীল রঙের মণি জোড়া লাল র ক্তে র মাঝে দপদপ করে জ্বলছে।এ যেন রুপকথার গল্পের তথাকথিত সেই হিং স্র খলনায়ক!হাড়গুলো খ ন্ড খ ন্ড করে ঘরের কোনায় থাকা একটা বোতল এনে ছিপি খুলে হাড়গুলোর উপর পেট্রোল ছড়িয়ে দেয়।লাইটারে আগুন জ্বালিয়ে সেটা ছুড়ে মারে।মূহুর্তের মধ্যেই হাড়গুলোতে দাউদাউ করে আ গু ন জ্ব লে ওঠে।ক্রমশ কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে।মানুষ পো ড়া ভ্যা প সা গ ন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।হৃদিতের বুকটা প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়।এতক্ষণে বুকের মাঝে জ্ব ল তে থাকা আ গু ন নিভে।ওই জ্ব ল ন্ত আগুনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

“আমার পবিত্র অ্যানাবেলাকে অপবিত্র করার জন্য হাত বাড়ালেই তাকে করুণ মৃ ত্যু গ্রহণ করতে হবে।
তার চিহ্ন আমি এই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে ফেলবো।
পৃথিবীর সবটুকু সম্মান আমার অ্যানাবেলার হোক
এই পৃথিবীর সবটুকু ঘৃণা আমার প্রাপ্য,
আমার পবিত্র অ্যানাবেলা শুধুমাত্র সম্মানের যোগ্য।”

চোখের সামনে এমন বি ভৎ স দৃশ্য, নিজের ভালোবাসার মানুষটার হিং স্র রুপ দেখে মেহরিমা থমকে যায়!বুকে তীব্র র ক্ত ক্ষ র ণ শুরু হয়। তবে কী শেষ পর্যন্ত ওর পবিত্র ভালবাসা হেরে গেলো?হৃদিত কী এতদিন ভালো হয়ে যাওয়ার মুখোশ পরে ছিল?সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটা মেহরিমার হৃদিত হতেই পারে না।যেই মানুষটিকে মেহরিমা ভালোবেসেছে তার মধ্যে এমন প শু র মতো হিং স্র তা থাকতেই পারে না।কিন্তু নিজের চোখে দেখা সবটা মেহরিমা কীভাবে অস্বীকার করবে?মেহরিমা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,

“বি শ্বা স ঘা ত ক!”

আ গু নে র মতো জ্ব ল তে থাকা হৃদিতের চোখজোড়া নিভে যায়।ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়।দরজার নিকট মেহরিমাকে এলোমেলো অবস্থায় ছলছল চোখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হৃদিতের হৃদয় থমকে যায়।মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।মেহরিমাকে তো গভীর ঘুমে রেখে এসেছিল।রুমের দরজা সহ বাড়ির দরজা ইভেন মেইন গেইটও বাইরে থেকে লক করে এসেছিল।তাহলে মেহরিমা এতদূর পর্যন্ত কীভাবে এলো?এখানকার কিছুই তো চেনে না।তবে কী কারোর সহযোগীতা নিয়ে এসেছে?কিন্তু কার?মস্তিষ্ক জুড়ে এতো এতো প্রশ্নের আনাগোনা থাকলেও উত্তর জানা নেই হৃদিতের।চোখের হিং স্র তা বিলীন হয়ে অসহায়ত্ব ফুঁটে ওঠে।এতোক্ষণ কী তবে কোনো ঘোরের মধ্যে ছিল?মেহরিমার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই মেহরিমা গর্জে ওঠে,

“ওখানেই থামুন।এদিকে আর এক পা এগোলে আমি কিন্তু নিজেকে শে ষ করে দেবো।ঘৃ ণা হচ্ছে আমার নিজের উপর।চৌধুরীদের রক্ত খারাপ।সবাই বি শ্বা স ঘা ত ক।আমি নিজের হাতে আমার জীবনটা শেষ করে ফেললাম।”

ভঙ্গুর কন্ঠস্বর মেহরিমার।মেহরিমার বলা কথাগুলো শুনতেই হৃদিতের পা জোড়া থেমে যায় ।সামনে এগোনোর আর সাহস পায় না।হঠাৎ মেহরিমার নাকে ভ্যাপসা উদ্ভট গন্ধ এসে লাগে। এতোক্ষণ হয়তো নিজের ভাবনার জগতে ছিল বিধায় গন্ধটা নাসারন্ধ্র পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পারেনি।মেহরিমা গলগলিয়ে ব মি করে দেয়।চোখের সম্মুখে সবটা কেমন ধোঁয়াশা হয়ে ওঠে।পুরো পৃথিবী ঘুরতে থাকে।চোখের সামনে ক্রমশ অন্ধকার নেমে আসে।চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।মেহরিমা পড়ে যেতে নিলেই হৃদিত দৌড়ে এসে দুহাতে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।মেহরিমাকে বুকে জড়িয়েই ফ্লোরে বসে হাউমাউ কান্না করে দেয়।এই কান্না যেন নিজের অ্যানাবেলাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার কান্না।হৃদিতের কান্নার শব্দে অন্ধকার জঙ্গলের পরিবেশ আরও গম্ভীর হয়ে ওঠে।সেই করুণ কান্নার শব্দ শুনে মনে হয় কোনো অশরীরী নিজের সবটা হারিয়ে কাঁদছে।ছেলেরাও যে এতোটা কাঁদতে পারে সেটা হয়তো প্রকৃতি নিজেও জানতো না!নিশুতি রাতের ওই চন্দ্রিমা একজন পাগল প্রেমিক পুরুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়।ওদের একাকী সময় কাটাতে দিয়ে মেঘের আড়ালে নিজের সুন্দর মুখখানা লুকায়।একটা তমসাচ্ছন্ন রজনী সাক্ষী হয়ে থাকে স্বর্বহারা এক প্রেমিক পুরুষের হৃদয়বিদারক কান্নার।হৃদিতের বুকভাঙা কান্নায় জঙ্গলের গাছপালা গুলোও গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।পশুপাখি গুলো নিজস্ব শব্দে ডাকাডাকি করে হৃদিতের খারাপ সময়ের সঙ্গী হয়।ওরা যেন শান্তনা দিচ্ছে,

“কাঁদে না বোকা ছেলে।তোমার ভালোবাসা হারিয়ে যায়নি।ভালোবাসারা কখনও হারায় না।হারিয়ে যায় তো ভালোবাসার মানুষেরা।”

হৃদিত কাঁদতে কাঁদতেই বলে,

“এই অ্যানাবেলা কী হলো তোর?চোখ খোল আমার জান।তুই যা বলবি তাই করবো আমি।তুই বললে আর কখনও তোর দু’চোখের সামনে আসবো না আমি।এই অ্যানাবেলা তোর না বিশ্বাস ভেঙেছি আমি?আমাকে থা প্পর মার,মন চাইলে খু ন করে ফেল।তবুও এমন অভিমান করিস না প্লিজ।আমি বেঁচে থাকতে পারবো না।এই অ্যানাবেলা?”

মেহরিমা নিস্তব্ধ।কোনো সাড়াশব্দ নেই।নিথর শরীরখানা হৃদিতের বুকের সাথে লেপ্টে আছে।হৃদিত যেন নিজের ভেতরে নেই।পাগলের মতো বিলাপ করে কান্না করে চলেছে।হৃদিতের বিষন্ন মর্মভেদী কান্না,এই ভ ঙ্গু র রুপ কারোর মনে বসন্ত এনে দেয়।আপাতত তার কাজ শেষ।ক্রুর হেসে বলে,

“শিঘ্রই নতুন কোনো রুপে আবারও আমাদের দেখা হবে হৃদিত চৌধুরী।”

#চলবে__

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৪২
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

সকালের মিষ্টি রোদ এসে হাতছানি দিচ্ছে কেবিনে। প্রকৃতি কুয়াশার আবরনে ঢাকা।শুভ্ররঙা চাদরে মোড়ানো বিছানায় শুয়ে আছে মেহরিমা।গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।ডান হাতে ক্যানোলা ও মুখে অক্সিজেন মাস্ক পড়ানো।নিচের ঠোঁটের কা টা অংশে ড্রেসিং করে মেডিসিন লাগানো হয়েছে।পা জোড়া কে টে কু টে ছিঁ ড়ে একাকার।পা দুটোও ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করা‌।মেহরিমার বাম পাশেই একটা টুলে বসে আছে হৃদিত।মেহরিমার নরম তুলতুলে বাম হাতটা নিজের খসখসে দু’হাতের মুঠোয় পুরে।দৃষ্টি মেহরিমার ঘুমন্ত মুখমণ্ডলে।গতকাল শেষ রাতের দিকে হৃদিত নিজেই মেহরিমাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।ডক্টর জানিয়েছে টেনশনের কিছু নেই।টেক কেয়ার করলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। প্রেগন্যান্সির এই সময় টাতে যেন মেন্টালি স্ট্রেস কম নেয়।হৃদিত কেবল স্তব্ধ হয়ে সবটা শুনেছে কোনো প্রত্যুত্তর করেনি।

মেহরিমা নড়েচড়ে ওঠে।সময় নিয়ে পিটপিট করে আঁখিজোড়া খুলে তাকায়।হৃদিতের অধরে ক্ষীণ হাসির দেখা মেলে।মেহরিমা নিজের চোখ জোড়া মেলেই হৃদিতকে দেখতে পায়।হৃদিতের ভঙ্গুর অগোছালো রুপ দেখে বুকের ভেতর তীব্র য ন্ত্র ণা অনুভব হয়।চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে ফুলে আছে।মুখমণ্ডলে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে।অধরজোড়া শুস্ক দেখাচ্ছে।মাথার চুল গুলো এলোমেলো হয়ে কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।গায়ে থাকা ব্ল্যাক কালারের শার্ট টা যায়গায় যায়গায় কুঁচকে গেছে।বুকের কাছে শার্টের দুটো বাটন খোলা।মেহরিমা যেন আবারও নতুন করে এই অগোছালো হৃদিতের প্রেমে পড়ে।মেহরিমা কথা বলার জন্য ঠোঁটজোড়া ফাঁক করতেই হৃদিত বলে ওঠে,

“ওয়েট জান।ব্রিদিং প্রবলেম হচ্ছে?”

মেহরিমা হালকা করে না সূচক মাথা নাড়ায়।

“ওয়েট আ মিনিট।আমি অক্সিজেন মাস্ক টা খুলে দিচ্ছি।”

হৃদিত যত্ন সহকারে অক্সিজেন মাস্ক টা খুলে দেই।মেহরিমা মলিন চোখে কিছুক্ষণ হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে।ঠোঁটের ব্যাথায় আস্তে করে বলে,

“বাসায় যাবো।”

“দুপুরের আগে সম্ভব না।”

“নিজের বাসায় যাবো।”

“আচ্ছা।”

“কর্মফল খুব ভয়ানক জিনিস।আপনি আজ যা করবেন আগামীকাল ঠিক সেটাই ফিরে পাবেন।”

“গতকাল রাতে ওখানে কীভাবে গিয়েছিলিস?”

মেহরিমার কথায় কোনো প্রত্যুত্তর না করে পাল্টা প্রশ্ন করে হৃদিত।মেহরিমা ঘাড় ঘুরিয়ে হৃদিতের দিকে তাকায়।প্রথম থেকে সবটা খুলে বলে।সবটা শুনে হৃদিতের কপালে গুটি কয়েক ভাঁজের সৃষ্টি হয়।ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়।মেহরিমা প্রশ্ন করে,

“বুঝতে পারছেন কে?”

“আপাতত না‌।বাট শিঘ্রই জেনে যাবো।তবে তোর তো ওই ছেলেকে থ্যাংকস দেওয়া উচিত।তোর অনেক বড় উপকার করেছে কি না?”

“হ্যাঁ দিবো তো।ওনার দেখা পেলেই থ্যাংকস দিবো।”

হৃদিত আর কিছু বলে না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।মেহরিমাও কথা না বাড়িয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি স্থাপন করে। জানালার পাশেই একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ।সেখানেই একটা ডালে বসে আছে একজোড়া টিয়া পাখি।তাদের ভালোবাসার খুনসুটি দেখে মেহরিমার অধরে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।

“এই পা পীকে তুই খুব ঘৃ ণা করিস তাই না?”

শান্ত,কম্পিত কন্ঠস্বর হৃদিতের।দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ। নিজের ভালোবাসার মানুষটার চোখে চোখ রেখে ঘৃ ণা শব্দ টা কখনোই শুনতে পারবে না।মেহরিমা দৃষ্টি ঘুরিয়ে হৃদিতের মুখের দিকে তাকায়।

“যাকে একবার ভালোবাসা যায়।সে যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পা পীও হয় তবুও তাকে ঘৃ ণা করা সম্ভব নয়।আর মানুষটা যদি আমাকে হারানোর ভয়ে সারারাত বসে বসে বাচ্চাদের মতো কান্না করে। তাহলে তো তাকে হারিয়ে ফেলা মানে নিজের সাথেই সবচেয়ে বড় অন্যায় টা করা হবে।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত চমকে মেহরিমার দিকে তাকায়।বড্ড অবাক হয়!চোখে মুখে বিষ্ময় ফুটে ওঠে।তা দেখে মেহরিমা আবারও বলে,

“বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। গতকাল রাতে আপনার ওই হিং স্র তা দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারেনি।আপনার হাতে হাত রেখে আমি আমার বার্ধক্যের সূর্যাস্ত দেখতে চাই। আমার স্বপ্ন কি পূরণ হবে না?আপনি মানসিক ভাবে অসুস্থ।প্লিজ ডক্টর দেখিয়ে ট্রিটমেন্ট নেন।দেখবেন আপনি সুস্থ হয়ে উঠলে আমাদের সুন্দর একটা সংসার হবে।আমি…”

মানসিক অসুস্থতা,ট্রিটমেন্ট শব্দ দুটো শুনতেই হৃদিতের চোখমুখ কঠিন রুপ ধারণ করে।মেহরিমার মুখের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।হৃদিত শেষ করতে দেই না।গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।কোনো ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন নেই।”

“সেদিন মাকে আপনি নিজেই তো বললেন? আপনার আচরণ,রাগ আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত স্বাভাবিক না।বিশ্বাস করুন আমায়। আপনার এই হিং স্র তা একদিন আমাদের সবাইকে মৃ ত্যু র দিকে ঠেলে দিবে।অথচ আপনাকে নিয়ে হাজারও বছর বেঁচে থাকার স্বপ্ন আমার।”

“তখন ইমোশনাল হয়ে বলেছিলাম শ্রেয়া চৌধুরীকে।ওইসব রোগটোগ আমার নেই।আর আগে থাকলেও সেটার ট্রিটমেন্ট করিয়েছি আমি।এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।তাই আজাইরা কথা বলিস না জান।”

“আপনি একটা সাইকো।আমি থাকবো না আপনার সাথে।”

“তুই বাধ্য থাকতে।”

“ফোর্স করছেন আমায়?”

“উহু,তুই আমার ওয়াইফ।আমি তোর হাসবেন্ড। সেই অধিকারটাই দেখাচ্ছি।”

মেহরিমা রাগে কষ্টে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।হৃদিত এগিয়ে এসে গালে হাত রাখতে নিলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

“দূরে সরুন আমার থেকে।আমাকে ছুঁবেন না।”

“তাহলে ওই ছেলে এসে ছুঁবে তোকে?”

মেহরিমা হতভম্ব হয়ে যায়!একটু আগের হৃদিত আর এই হৃদিতের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ! মেহরিমা এবার শব্দ করে কান্না করে দেয়।

“আপনার এই হিং স্র তা র জন্য আপনার শ ত্রু বেড়েই চলেছে।আমি একটু শান্তি চাই।একটা শান্তিপূর্ণ জীবন চাই।আপনার পরিবার আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে।আমার খালামনিকে কেড়ে নিয়েছে।আমার মায়ের স ম্মা ন হা নি করেছে। আপনি ওদের মতো হবেন না প্লিজ।আমি তাহলে বেঁচে থেকেও ম রে যাবো।এমন হৃদিতকে তো আমি কখন’ই চাইনি।আমি যে হৃদিতকে ভালোবেসে ছিলাম সেই হৃদিত আপনি নন।আমার আগের হৃদিত হয়ে যাননা আপনি।আমরা খুব সুখে থাকবো।একটা সুন্দর সুখের ছোট্ট সংসারের খুব স্বপ্ন আমার।”

শেষের দিকের কথাগুলো বলতে যেয়ে মেহরিমার কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।হৃদিত কোনো কথা বলে না।কিছুক্ষণ থমকে মেহরিমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।অতঃপর ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।মেহরিমা চিল্লিয়ে বলে,

“আপনি আর কখনও আমাকে পাবেন না।সুযোগ দিয়েছিলাম আপনাকে আপনি গ্রহণ করেননি।”

মেহরিমার বলা কথাগুলো হৃদিত কি আদৌও শুনতে পায়?হয়তো পায় আবার হয়তো না!মেহরিমা ঠোঁটে টান দিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলায় আবারও কাঁ টা স্থান চিঁ ড়ে র ক্ত বের হয়ে আসে।রাগে দুহাতে নিজের চুল খামচে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলে,

“সব ক ষ্ট আমার কপালেই কেনো আল্লাহ?আমি ক্লান্ত।মুক্তি দেও আমাকে।ও বাবা তোমার মেহুমা একটুও ভালো নেই।নিয়ে যাওনা তোমার কাছে তোমার মেহুমাকে।”

____

তাইফ আজ নিজেকে বেশ সুন্দরভাবে পরিপাটি করে রুম থেকে বের হয়।তাইফ কে নতুন রুপে দেখতেই তৃধা চোখ বড়বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।মুখটা হাঁ হয়ে যায়।তৃধার পাশেই তাবান বসে আছে।তৃধাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাবানও ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে সেদিকে তাকায়।তাইফকে দেখতেই বলে,

“ব্রো ওদিকে সব ঠিকঠাক তো?তুই খবর নিয়েছিলিস?”

তাবানের কথায় তাইফ মুচকি হেসে বলে,

“হুঁ।”

“এ্যাই ভাইয়া তুমি এতো ভাব নিয়ে লুক চেঞ্জ করে কোথায় যাচ্ছো?মেয়ে পটাতে?আবার নতুন বউয়ের মতো এমন লজ্জা পাচ্ছো কেন?”

“আরে শাকচুন্নী রে!মেয়ে পটে গেছে।আজ ফার্স্ট ডেট ওদের তাই এতো ভাবসাব নিয়ে যাচ্ছে।”

তাবানের কথায় তৃধা অবাক হয়ে বলে,

“সত্যিই ভাইয়া!আমিও যাবো। ভাবীকে দেখবো।”

তাইফ ভ্রু কুঁচকে বলে,

“এখানে আবার ভাবী কোত্থেকে থেকে আসলো?”

“আরে তোমার ফিউচার ওয়াইফ তো আমার ভাবীই হচ্ছে তাই না?”

“এ্যাই তোর মাথায় পড়াশোনা ঢোকে না।ম্যাথ পারিস না। আবার এতো ভাবী বুঝিস কী করে?”

“তাবান ভাইয়া তুমি সবসময় আমাকে ইনসাল্ট করবে না।তোমার থেকে আমি হাজার গুন ভালো পড়াশোনায়।ওই ম্যাথটাই একটু কম বুঝি এই যা। কিন্তু তার জন্য তো আমার মেহু বেইবি আছেই।”

“তা আমার জানা আছে রে শা ক চু ন্নী।শা ক চু ন্নী রা কেমন পড়াশোনা পারে জানি আমি।তাই ভাব কম ল।”

“মাআআআ!দেখো,তোমার ফেল্টুস ছেলে আমার সাথে কেমন করে মেয়েদের মতো কোমর বেঁধে ঝগড়া করছে।”

“ভাই তোরা ঝগড়া থামা।আমি গেলাম ।আমার লেইট হয়ে যাচ্ছে।”

তাইফ গাড়ির দিকে ছুট লাগায়।পিছন থেকে তাবান,তৃধা সমস্বরে বলে,

“বেস্ট অফ লাক।”

“থ্যাংকস, থ্যাংকস।”

তাইফ দৌড়াতে দৌড়াতেই জবাব দেয়।তাইফের এক্সাইটমেন্ট দেখে তাবান,তৃধা হেসে ওঠে। অবশেষে ছেলেটার অগোছালো জীবনটা গুছিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ একজন আসলো।

____

মাধবী ক্লাস শেষ করে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। চোখ যেয়ে পড়ে রাস্তার অপরপাশে টং দোকানে বসে থাকা তাইফের দিকে।তাইফের হাতে চায়ের কাপ।দোকানদার চাচার সাথে আড্ডায় ব্যস্ত।গায়ে আকাশি রঙের একটা শার্ট জড়িয়েছে।শার্টের হাতাটা কনুই পর্যন্ত গোটানো।সাদা রঙের গ্যাবার্ডিন প্যান্টের সঙ্গে আকাশি রঙের শার্টে বড্ড মানিয়েছে।হালকা বাতাসে কপালের উপরে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়ছে।মাধবীর খুব করে মন চায় একটাবার ওই অবাধ্য চুল গুলোকে ছুঁয়ে দিতে।পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়।মাধবী মৃদু হাসে।এ যেন ওর কল্পনার সেই রাজপুত্র।মাধবী নিজেও আজ আকাশি রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পড়েছে।ওড়না টা সাদা। কাকতালীয় ভাবে ড্রেসের কালারটা মিলে যাওয়াতে মাধবী মনে মনে খুব খুশি হয়।তাইফ তখনও মাধবী কে খেয়াল করেনি।মাধবী তাইফ কে ডাকে না।নিজেই রাস্তা পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।রাস্তায় তখন যানবাহনের চাপ কম।চার রাস্তার মোড় হওয়ার দরুন সবসময় যানবাহনের আনাগোনা থাকে।মাধবী মুচকি মুচকি হেসে রাস্তা পার হতে থাকে।মনের মাঝে তখন নতুন প্রেমের এক অদ্ভুত অনুভূতি ।সাথে এক্সাইটমেন্ট তো আছেই।কতশত কথা বলার আছে চায়ের দোকানে বসা ওই ছেলেটাকে।সারারাত না ঘুমিয়ে সবটা ভেবেছে শুধু।এখন কাঁপাকাঁপি ছাড়া সবটা বলতে পারলেই হলো।রাস্তার মাঝখানে আসতেই হঠাৎ দ্রুতগামী একটা ট্রাক এসে মাধবীকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়।মাধবী চিৎকার করে ডেকে ওঠে,

“তাইফ!”

মাধবীর চিৎকার শুনতেই তাইফ রাস্তার দিকে তাকায়।রাস্তায় র ক্তা ক্ত অবস্থায় মাধবী কে পড়ে থাকতে দেখে মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়ে।মাধবী তাইফের দিকে কান্নারত চোখে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দুটো নড়ছে।যেন কিছু বলতে চায়।তাইফ দ্রুত উঠে ছুটে আসতে নিলেই আরেকটা দ্রুতগামী প্রাইভেট কার এসে মাধবীকে পি ষে দিয়ে চলে যায়!তাইফ ওখানেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।চোখের সামনে নিজের সব স্বপ্ন, নিজের ভালো থাকা, নিজের ভবিষ্যৎ,নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে শেষ হয়ে যেতে দেখে।সেকেন্ডের ব্যবধানে সবটা ওলটপালট হয়ে যায়।কী যেন মনে করে ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়িটার নম্বর প্লেট দেখে নেয়।মাধবীর নিস্তেজ, নিথর দেহখানা রাস্তায় পড়ে আছে।যে মনে কয়েক সেকেন্ড আগেও হাজারও কথা জমা ছিল সেই মনটা এখন নিস্তব্ধ।শেষ বারের মতো নিজের মনের কথাগুলো আর বলা হলো না মাধবীর।এই আফসোসটা কার রয়ে গেল?মাধবীর?নাকি তাইফের?তাইফ যে তার মাধবীলতার মনের ভিতরে জমানো কথার একাংশও জানতে পারলো না।ততক্ষণে রাস্তায় মানুষের জট বেঁধেছে।তাইফ ভীড় গলিয়ে মাধবীর দিকে এগিয়ে যায়।পা জোড়া চলার শক্তি পাচ্ছে না।একটু আগেই তো এই পা দিয়ে ছুটে আসলো অথচ এখন এতো ভারী কেন লাগছে!স্তব্ধ র ক্তা ক্ত দেহখানার পাশে যেয়ে বসে।আলতো হাতে মাধবীর পিষ্ট হয়ে যাওয়া মাথাটা নিজের কোলের উপর উঠিয়ে নেয়।কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে ডাকে,

“এই মাধবীলতা?এই শুনছো তুমি?তোমার তাইফ এসেছে।তুমি কথা বলবে না?ঝগড়া করবে না? অভিমান করেছো তুমি?”

কিন্তু তাইফের মাধবীলতা কথা বলে না।মৃত মানুষের কথা বলার মতো ক্ষমতা যে আল্লাহ তায়ালা দেননি।তাইফ হাউমাউ করে কান্না করে দেয়।মাধবীর থেঁ ত লে যাওয়া দেহটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।ততক্ষণে অবনী শেখ,চৌধুরী বাড়ির সকলে ঘটনা স্থলে উপস্থিত হয়েছে। অবনী শেখ কে দেখতেই সবাই সরে দাঁড়িয়ে রাস্তা করে দেয়।অবনী শেখ স্লথ পায়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়। ধপাস করে রাস্তার উপরেই বসে পড়ে। মাধবী তখনও তাইফের বুকে।তাবান দৌড়ে এসে নিজের ভাইকে বুকে জড়িয়ে নেয়।তাইফ তবুও মাধবীকে ছাড়েনা।অবনী শেখ যেন কথা বলতে ভুলে গেছে।একদৃষ্টিতে মাধবীর দিকে তাকিয়ে থাকে।মিনিট পাঁচেক পেরোতেই হেসে কুটিকুটি হয়ে বলে,

“আমার মেয়ে তোমার বুকে ঘুমিয়ে আছে তাই না তাইফ বাবা?ও আজ সকালে তোমার কথা বলেছে আমাকে।আমি বলেছি হৃদিত বাবা আর নীলাক্ষী ফিরে আসলে এই বিষয় নিয়ে কথা বলবো আমি।আমাকে আরও কী বলেছে জানো? সকালে আমাকে বললো,মা তোমার মেয়ের সব স্বপ্ন ওই ঢাবিকে ঘিরে।ইন শা আল্লাহ তোমার মেয়ে একজন ঢাবিয়ান হয়ে দেখাবে মা।তখন গর্বে আমার বুকটা ভরে উঠেছিল।মা শা আল্লাহ কী মায়াবী দেখতে লাগছে আমার মেয়েকে।তোমার সাথে বড্ড মানাবে আমার মেয়েটাকে।ওকে কিন্তু কখনও কষ্ট দিওনা।খুব আদুরে মেয়ে আমার।আমার মিনাক্ষীকে এখন ডেকো না বাবা।ওকে ঘুম থেকে ডেকে উঠিয়ে দিলে ওর খুব মাথা য ন্ত্র ণা হয়।তখন কান্না করে আমার মেয়েটা।মিনাক্ষী এমন করে রং মেখে আছে কেনো গো?কোচিংয়ে কোনো প্রোগ্রাম ছিল নাকি?আমাকে তো কিছুই বললো না সকালে।না,না বলেছে হয়তো আমি নিজেই ভুলে গেছি।বয়স হচ্ছে তো,সব কী আর অতো মনে থাকে।”

কথাগুলো বলেই আবারও হাসতে থাকে অবনী শেখ।অবনী শেখের কথায় সবাই হতভম্ব হয়ে যায়!এতো কঠিন মানুষটা এমন ভুলভাল বকছে কেনো? ওনাকে কী বিষয় টা জানানো হয়নি?পরক্ষণেই সবটা বুঝতেই সবার চোখে জলেরা হানা দেয়।ভীড়ের মাঝে দাঁড়ানো অমিত সাহা,আরিফ চৌধুরীর চোখেও পানি।এই কঠিন সত্তার নারীকে এই রুপে একদম মানাচ্ছে না।অবনী শেখকে সবসময় তেজস্বী রুপেই মানায়।তাইফ মাধবীকে বুকে জড়িয়েই কাঁদতে কাঁদতে অবনী শেখের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে!উপস্থিত সকলের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।হঠাৎ করেই অবনী শেখ নিজের হাসি থামান।পরক্ষণেই গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।এলোপাথাড়ি ভাবে নিজেকে থাপরাতে থাকেন।কাঁদতে কাঁদতেই বলেন,

“সব দো ষ আমার।সব দো ষ আমার এই পো ড়া কপালের।ওরা আমার নিষ্পাপ অবুঝ মেয়েটাকে বাঁ চ তে দিলো না।আল্লাহ!এই দিন দেখার আগে তুমি আমাকে কেন উঠিয়ে নিলে না?আমার সব শেষ।আমার নিষ্পাপ মেয়েটার কী দোষ ছিল?ওর আর ঢাবিয়ান হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না।আমার বুক খালি হয়ে গেল। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব?ও আল্লাহ এই কোন পাপের শা স্তি দিলে আমাকে?আমার মেয়ে।আমার মিনাক্ষী।ও আল্লাহ গো!এই কঠিন বোঝা মাথায় নিয়ে এই জীবন কী করে পার করবো আমি?”

আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরী দ্রুত এগিয়ে এসে অবনী শেখকে সামলানোর চেষ্টা করেন।এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে ওখানেই সেন্সলেস হয়ে আয়েশা চৌধুরীর গায়ের উপর ঢলে পড়েন অবনী শেখ।শ্রেয়া চৌধুরীর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।আয়াশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর দিকে তাকিয়ে থাকে।যার চোখে পানি অথচ অধরে ক্ষীণ বাঁকা হাসি ঝুলে আছে।

#চলবে___

কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-৩৯+৪০

0

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৯
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে চলেছে মাধবী।সূর্যের তাপদাহে পুড়ছে প্রকৃতি।গ্রামের রাস্তায় আজ মানুষের আনাগোনাও কম।এই অতিরিক্ত তাপমাত্রায় মাধবীর অবস্থা শোচনীয়।গন্তব্যস্থল ‘উচ্ছ্বাস কোচিং সেন্টার’।আর পাঁচ মিনিট হেঁটে গ্রামের মোড় পর্যন্ত যেতে পারলেই ভ্যান অথবা অটোরিকশা পেয়ে যাবে।কিন্তু সেই পাঁচ মিনিট হেঁটে যাওয়া মাধবীর জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।বাসায় একা থাকতে বড্ড বোরিং লাগছিল।পড়াশোনাটাও ঠিকমতো হচ্ছিল না।তাই অবনী শেখের কথায় আজ কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে মাধবী।এখন কিছুদিন ওখানে ক্লাস গুলো করলেও কিছুটা উপকৃত হবে।

সময় এগারোটা বেজে দশ মিনিট।ক্লাস সাড়ে এগারোটায়।আজ ছাতাটাও আনতে ভুলে গেছে।বেজায় বিরক্ত হয় মাধবী।মাধবীর ভাবনার মাঝেই কোথা থেকে উড়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ায় তাইফ। হঠাৎ কেউ এভাবে সামনে এসে দাড়ানোতে মাধবী ভড়কে যায়।পরক্ষণেই তাইফকে দেখতে গলায় আটকে রাখা শ্বাস টুকু ফেলে।

“কোথায় যাচ্ছো মাধবীলতা?”

মাধবীলতা নামটা শুনতেই মাধবী কিছুক্ষণের জন্য থমকায়।বুকের মাঝে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়।নতুন এক অনুভূতি জন্ম নেয়।কী এই অনুভূতির নাম?মাধবীর জানা নেই।তবে ‘মাধবীলতা’ নামটা শুনতেই মনের বিরক্ত ভাব কেটে মনটা ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। মাধবী সময় নিয়ে আস্তে করে জবাব দেয়,

“কোচিংয়ে।”

“হঠাৎ?মাঝে তো যেতে না।”

“বাসায় ভালো লাগছিল না।তাই আজ যাচ্ছি।”

“এখন প্রতিদিন’ই যাবে নাকি?”

“ঢাবির এক্সামের আগ পর্যন্ত রেগুলার যাবো।কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন আমি কোচিংয়ে যাই না?”

মাধবীর পাল্টা প্রশ্নে তাইফ থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণেই মুচকি হেসে বলে,

“ভাবী বলেছিল।”

“ওও আচ্ছা।পথ ছাড়ুন ভাইয়া। আমার লেইট হচ্ছে।”

“কী! তুমি আমায় ভাইয়া ডাকলে?”

“জি,তো?”

“প্রেজেন্ট ভাইয়া,
ফিউচার ছাইয়া।”

কথাটা বলেই লাজুক হাসে তাইফ। মাধবী হতবাক হয়ে যায়!এই ছেলেকে যতটা ইনোসেন্ট ভেবেছিল ততোটাও ইনোসেন্ট এই ছেলে না। মাধবী আর কিছু না বলে পাশ কাটি সামনের দিকে হাঁটা ধরে।তাইফ ও প্যান্টের পকেটে হাত গুজে পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।মাধবী পিছনে না তাকালেও সেটা অনুভব করতে পারে।আর তাতেই অধরে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে।

“চুমকি চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?
রাগ করোনা সুন্দরী গো
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো।”

হঠাৎ এমন আজগুবি গান শুনতেই মাধবীর পা জোড়া আপনাআপনিই থেমে যায়।পিছনে ঘুরে তাকায়।তাইফ নিজের আটাশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে।মাধবী কিয়ৎকাল মুগ্ধ চোখে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদয় থমকে যায়!এভাবে কয়েক মিনিট পেরোতেই মাধবী নিজের মনের মুগ্ধতা কাটিয়ে মিছে মিছে বিরক্তির ভাব ধরে বলে,

“আপনি কি আমায় টিজ করছেন?”

“উহু,আমি তো নিজের পছন্দের একটা গান গাচ্ছিলাম।”

মাধবী হতাশ হয়।কথা বললে আরও কথা বাড়বে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলা ঠিক না।গ্রামের মানুষ নিশ্চয় সেগুলো ভালো চোখে দেখবে না।দিন শেষে তখন সব দোষ মাধবীর হবে। চৌধুরীরা ধোঁয়া তুলসী পাতা কি না! মাধবী আর কথা বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।তাইফও বিষয়টা বুঝতে পারে।আর পিছু নেয় না।মোড়ে পৌঁছাতেই অটোরিকশার দেখা মেলে।মাধবী অটোরিকশায় উঠে বসে।আবারও আগের ন্যায় কোথায় থেকে উড়ে এসে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়ে তাইফ।ড্রাইভার চাচা তাইফকে দেখতেই খুশি হয়ে যান।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিজের চৌদ্দ গোষ্ঠীর গল্প শোনাতে শুরু করেন।তাইফও মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় সবটা শুনতে থাকে।মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দেয়।মাধবী না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে।মনে মনে বলে,”ভারী দুষ্টু ছেলে!”কোচিংয়ের নিকট আসতেই মাধবী নেমে পড়ে। ড্রাইভার চাচা ভাড়া নিতে না চাইলেও জোর করে ভাড়াটা হাতে ধরিয়ে দেয় মাধবী। অতঃপর নিজের ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরে।তাইফ ততক্ষণে নেমে দাঁড়িয়েছে। অটোরিকশাওয়ালা চাচা চলে যেতেই তাইফ ও কিছুটা সামনে এগিয়ে যায়।রোদের তাপমাত্রা থেকে বাঁচতে একটা জাম গাছের নিচে আশ্রয় নেয়। ঘেমে গায়ে থাকা শার্টটা শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে।মাধবী কিছু দূর যেয়েই থেমে যায়।পিছনে ফিরে তাকায়।তাইফের গভীর দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মিলে যায়। মাধবী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

“চুমকির সঙ্গী হলে দোষ নেই।চুমকিও রাগ করবে না।”

কথাটা বলেই এক ছুটে নিজের কোচিং রুমে ঢুকে পড়ে মাধবী।তাইফ যেন নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছে না!দুই মিনিট সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে।পরক্ষণেই জিতে যাওয়ার ভঙ্গিতে শব্দ করে বলে ওঠে,

“ইয়েস!”

তাইফ খুশি মনে আরও কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে।তারপর মুচকি একটা হাসি দিয়ে অবাধ্য চুলের ভাঁজে আঙ্গুল গলিয়ে দিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে উল্টো পথে হাঁটা ধরে।মাধবী জানালার পাশে লুকিয়ে সবটাই দেখে। বিড়বিড় করে বলে,

“পাগল একটা!”

পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে যায় বাবা তো সবসময় বলতো মাধবী ওর খালামনির হতো হয়েছে।ভাগ্যটা আবার খালামনির মতো হবে না তো!মাধবীর মুখে তমসা নেমে আসে।
____

সময় বিকালবেলা।গাছের নিচে একটা বড় পাথরের উপর বসে আছে মেহরিমা।আজ একটা পার্পল কালারের জর্জেট শাড়ি জড়িয়েছে শরীরে। হাঁটু সমান দীঘল কালো চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া।চোখে হালকা করে কাজল টেনেছে।ঠোঁটে নুড কালারের লিপস্টিক দিয়েছে।গলায়,কানে,হাতে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে হৃদিতের কিনে দেওয়া অর্নামেন্টসগুলো পরেছে।মেহরিমার সামনে বড় একটা নদী বয়ে চলেছে।মেহরিমা একদৃষ্টিতে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে।কী ভাবছে কে জানে!পাশেই হৃদিত বসে আছে।হৃদিতও আজ একটা পার্পল কালারের পাতলা শার্ট আর হোয়াইট কালারের গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পরেছে।চোখে সবসময়ের ন্যায় সানগ্লাসও আছে।এর জন্য বিশেষ কোনো কারণ নেই।হয়তোবা নিজের অদ্ভুত চোখদুটো লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে।নদীর ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাসে দু’জনের মন প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।পরম আবেশে পরিবেশটা উপভোগ করছে একজোড়া লাভ বার্ডস।দু’জনের মাঝে নিরবতা বিরাজমান।মেহরিমা নিরবতা ভেঙ্গে বলে,

“এই নদীর নাম কী?”

“আমি অ্যাকিউরেট নামটা জানি না।তবে এই এলাকাটা হচ্ছে খ্রিস্টানদের।ওরা এই নদীকে ‘ইচ্ছাপূরণ’ নদী নামেই ডাকে।এই নদীর কাছে কিছু চাইলে নাকি সেটা পাওয়া যায়।”

“ওও আচ্ছা। উদ্ভট চিন্তাভাবনা!”

“হুম।”

“আচ্ছা আপনি না থাকলে আপনার বাগান বাড়িতে আর কেউ থাকে না?”

“থাকে তো।কেয়ারটেকার চাচা।তুই আসবি বলে ওনাকে ছুটি দিয়েছি।আমাদের প্রাইভেট মোমেন্টস এ যেন একটুও ডিস্টার্ব না হয় সেজন্য।”

হৃদিতের বলা কথাটা শুনে মেহরিমা অবাক হয়ে যায়!পরক্ষণেই ভাবে ওর জামাইকে দিয়ে সব সম্ভব।মেহরিমা বেশ ব্যঙ্গ করেই বলে,

“খুউউব ভালো কাজ করেছেন আপনি।ডক্টর ইউনুস আপনাকে নোবেল দেওয়ার জন্য হ্যারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজছে।”

“আই নো আমি সবসময় ভালো কাজ’ই করি।”

বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে বলে হৃদিত।কিছু একটা ভেবে ভ্রু জোড়া কুঁচকে তৎক্ষণাৎ আবারও বলে,

“বাট নোবেল কী ডক্টর ইউনুসের নিজের সম্পত্তি? উনি আমায় কিভাবে দিবেন?”

“আমি কী জানি?মুখে ওনার নাম আসলো বলে দিলাম।ব্যস হয়ে গেলো।আপনাকে কেনো ওতো গভীরে যেয়ে ভাবতে হবে?আজব তো!সে যার সম্পত্তি হয় হবে।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।বউয়ের অনেক রুপ’ই তো দেখেছে এটা আবার কোন রুপ কে জানে!প্রতিদিন’ই তো নতুন নতুন রুপ দেখেই চলেছে।আর কতো রুপ যে দেখতে হবে আল্লাহ ভালো জানেন!

“আমাদের শেষ টা সুন্দর হবে তো?আমার সব অপ্রাপ্তির মাঝে একমাত্র প্রাপ্তি আপনি।আপনাকে আমি হারাতে চাই না।”

মেহরিমার প্রশ্নে হৃদিত চুপ হয়ে যায়।এর উত্তর হৃদিতের কাছে নেই।বুকের মাঝে যন্ত্রণা গুলো কিলবিল করে ওঠে।একদিকে নিজের ভালোবাসা অন্যদিকে নিজের জন্মদাত্রী মা।দু’জনকেই তো ভালোবাসে হৃদিত।মাকে কী কোনোদিন পরিবর্তন করতে পারবেনা হৃদিত!ছেলের শূন্যতা কী কখনও মা নামক মানুষটা অনুভব করতে পারবে না?মেহরিমা হৃদিতের মনের অবস্থা বুঝতে পারে।নিজের মনের কষ্ট,ক্ষত সবটা নিজের কাছেই রেখে কথা ঘুরিয়ে নেয়।দিন শেষে নিজের ক্ষত নিজেকেই সারতে হয়।মানুষ ওই মলম লাগিয়ে দেওয়া পর্যন্ত’ই ঠিক আছে।

“ওই পাহাড়ে যাবো।”

মেহরিমার কথায় হৃদিতের ধ্যান ভাঙে। মুখে মুচকি হাঁসি ফুটিয়ে বলে,

“কাল সকালে যাবো পাহাড়ে।তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

“সত্যিই!”

উৎফুল্ল কন্ঠস্বর মেহরিমার।হৃদিত মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।মেহরিমার অভিনয় টা খুব সহজেই বুঝে যায়।বুক থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।মুখে বলে,

“যে হাসি নীরবে নিজের সবটুকু ব্যথা লুকাতে জানে সেই হাসি বোঝার ক্ষমতা সবার থাকে না তাই না অ্যানাবেলা?কিন্তু বিশ্বাস কর তোর প্রতিটা শ্বাস প্রশ্বাস আমি বুঝি। আমার জীবনে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুই।তুই যতক্ষণ আছিস ততক্ষণ এই আমি আছি।তোর থেকেও আমি অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে।এই সম্পূর্ণ আমি টার থেকেও অনেক বেশি।”

মেহরিমার মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।বুকে প্রশান্তির হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে।ওরা দু’জন পুরো বিকাল জুড়ে আরও অনেক যায়গায় ঘোরাঘুরি করে।মেহরিমার মন খারাপ সবটুকু ভালো হয়ে যায়।সন্ধ্যায় শহরের মধ্যে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে যায় ওরা।রেস্টুরেন্ট টা বাইরে থেকে দেখতে অনেক বিলাসবহুল লাগে।মেহরিমা রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকেই অবাক চোখে সবটা দেখতে থাকে।রেস্টুরেন্টটা চোখ ধাঁধানো সুন্দর।হৃদিত মেহরিমার পছন্দ মতো কিছু খাবার অর্ডার করে।আধা ঘন্টার ব্যবধানে ওয়েটার এসে ওদের টেবিলে খাবার দিয়ে যায়।মেহরিমা হালকা পাতলা খায়।বেশি খেতে পারেনা।ওয়াশ রুমে যাওয়ার কথা বলতেই হৃদিত মেহরিমাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে যায়।নিজেও একটু দূরে থাকা বেসিংয়ের নিকট যেয়ে হাত টা ধুয়ে নেয়। হঠাৎ একটা ফোনকল আসায় হৃদিত ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা সামনেই এগিয়ে যায়।

পাঁচ মিনিট পরে মেহরিমা ওয়াশ রুমের দরজা খুলতেই একটা মধ্যবয়স্ক অপরিচিত লোককে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।ও ভয় পেয়ে যায়।লোকটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লা ল সা র চোখ দিয়ে মেহরিমাকে গিলে খাচ্ছে।মেহরিমা অত্যন্ত ঘাবড়ে যায়।চোখের সামনে সেই ভ য়ং ক র রাতের দৃশ্য ভেসে ওঠে।আশেপাশে তাকিয়ে হৃদিতকে খুঁজতে থাকে কিন্তু কোথাও হৃদিতের দেখা মেলে না।ওয়াশ রুমটা অফসাইডে হওয়ায় এদিকে মানুষের আনাগোনাও কম।এবার ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায় মেহরিমার।শুকনো ঢোক গিলে।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থেকেও দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করে।পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে এখান থেকে বাঁচার উপায় ভাবতে থাকে।লোকটা কুৎসিত হেসে বলে ওঠে,

“সুন্দরী রমনী ভয় পাচ্ছো নাকি?”

“আমার সামনে বাঘ,ভাল্লুক কিছুই তো দাঁড়িয়ে নেই।তাহলে ভয় কেনো পাবো আংকেল?সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।আমি বাইরে যাবো।”

কথাটা বলে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই লোকটা মেহরিমার ডান হাত চেপে ধরে।মেহরিমা কয়েক সেকেন্ড নিজের হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর হঠাৎ করে লোকটার মেইন পয়েন্টে জোরে লাথি মেরে বসে।লোকটা এমনটা একদম আশা করেনি।মেহরিমার হাত ছেড়ে দিয়ে ওখানেই বসে পড়ে।মেহরিমা এক দৌড়ে ওখান থেকে পালিয়ে যেতে নিলেই হৃদিতের সাথে ধাক্কা খায়।হৃদিত দুহাতে মেহরিমাকে আগলে নেয়।মেহরিমার র ক্ত শূ ন্য ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকাতেই হৃদিতের ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়। কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের সৃষ্টি হয়।একটু দূরে মধ্যবয়স্ক একটা লোককে বসে কাতরাতে দেখে ঘটনা যা বোঝার বুঝে যায় হৃদিত।এতেই যেন মাথায় আগুন উঠে যায়।হৃদিত বাইরে যেয়ে কয়েক মিনিট কথা বলার পরেই মেহরিমার কথা মনে পড়ে যায়।দ্রুত কল কেটে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা ধরে।ওর অ্যানাবেলা একা ভয় পাবে এই ভেবে।কিন্তু এখানে এসে এমন একটা দৃশ্য দেখবে কখনও কল্পনাও করেনি।হৃদিত হুংকার দিয়ে ওঠে,

“বা স্টা র্ড!”

লোকটা সেই হুংকারে কেঁপে ওঠে।ভয়ে আরও কুঁকড়ে যায়।হৃদিত রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাশের বেসিনে থাকা আয়নাটা খুলে লোকটার মাথায় মারে।সাথে সাথে লোকটা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। শুভ্র রঙা টাইলসের ফ্লোর তা জা লাল র ক্তে ভেসে যায়।ততক্ষণে রেস্টুরেন্টের সকল স্টাফ, ম্যানেজার উপস্থিত হয়েছে।মেহরিমা দৌড়ে এসে হৃদিতকে জড়িয়ে ধরে।হৃদিত মেহরিমাকে এক হাতে নিজের সাথে আগলিয়ে নেয়।উপস্থিত সবাই ঘটনা অনেকটাই আঁচ করতে পারে।কারণ লোকটার স্বভাব,চরিত্র সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানে। রেস্টুরেন্ট ওনারের নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ার দরুন কেউ কিছু বলতে পারে না।মুখবুজে সবটা সহ্য করে নেয়।ম্যানেজার এগিয়ে এসে বলে,

“অ্যানি প্রবলেম স্যার?”

হৃদিত বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে।মেহরিমার চোখে আর খা রা প হতে চায় না।

“চেক দ্য সিসিটিভি ফুটেজ।হোপ ইয়্যু আন্ডারস্ট্যান্ড এভরিথিং।আর পুলিশকে ইনফরম করার প্রয়োজন নেই।ওনার শা স্তি উনি পেয়ে গেছেন।বয়স্ক একটা মানুষ ওনার ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করুন।ওনাকে দ্রুত সুস্থ হতে হবে।”

হৃদিতের কথামতো সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হয়।রেস্টুরেন্টের ওনার ততক্ষণে রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হয়েছে।সিসিটিভি ফুটেজে সবটা দেখে সবাই খুব লজ্জিত বোধ করে।রেস্টুরেন্টের ওনার হৃদিতের কাছে বার বার ক্ষমা চেয়ে নেন। মন্ত্রীর ভাই আবার এমপির ছেলে বলে কথা!উনি সবদিকে নজর রাখবেন এরকম টা আর কখনও হবে না কথা দেন।হৃদিত গম্ভীর মুখেই কিছু কথা বলে লোকটার ট্রিটমেন্টের জন্য নিজের কার্ড থেকে রেস্টুরেন্টের ওনারের কার্ডে টাকা ট্রান্সফার করে দেয়।স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মেহরিমাকে এক হাতে আগলিয়ে নিয়েই গাড়ির দিকে হাঁটা ধরে।লোকটাকে ততক্ষণে বাইরে আনা হয়েছে।চেয়ারে বসে তখনও ব্যথায় কাতরাচ্ছে।হৃদিত যাওয়ার আগে লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।যেই দৃষ্টির ভাষা বোঝা দুঃসাধ্য।

____

মেহরিমা কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।গায়ে জ্বর জ্বর ভাব।সন্ধ্যার ব্যপারটা নিয়ে কেমন একটা ট্রমার মধ্যে চলে গেছিল।হৃদিতের সাহায্যে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সেটা এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।তবুও কেন যেন ভালো লাগছেনা।অস্থির অনুভব হচ্ছে!

রেস্টুরেন্টে মেহরিমা ঠিকমতো খেতে না পারায় ওর জন্য খাবার নিয়ে রুমে আসে হৃদিত।মেহরিমাকে শুয়ে থাকতে দেখে খাবারের প্লেটটা ডিভানের উপর রেখে ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।মেহরিমার মাথা থেকে কম্ফোর্টার টা সরাতেই মেহরিমা নিজের রক্তাভ চক্ষু জোড়া মেলে তাকায়।হৃদিতের সাহায্য নিয়ে আস্তে করে উঠে বসে।মেহরিমার করুণ দৃষ্টি সেকেন্ডের ব্যবধানে হৃদিতকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে তোলে।হৃদিত নিজের চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।দ্বিতীয়বারের মতো নিজেকে খুব অসহায় অনুভব করে।পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে আদুরে কন্ঠে বলে,

“সরি অ্যানাবেলা।আমি কল অ্যাটেন্ড না করলে আজ তোর সাথে..।”

হৃদিতকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে মেহরিমা নিজেই বলে,

“আপনি আছেন বলেই আমি নিরাপদ আছি।আর একটাও কথা না।যা হওয়ার হয়ে গেছে।আজ আপনার পরিবর্তন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার ভালোবাসার কত্তো পাওয়ার দেখেছেন? আপনাকে পরিবর্তন করেই ছেড়েছে। আপনার হিংস্রতা কমিয়ে এনেছে।”

“হুম জান।”

“আমার ক্ষুধা পেয়েছে।আজও খাইয়ে দিতে হবে কিন্তু!”

“যো হুকুম রানী সাহেবা।সামান্য প্রজা হয়ে রানীর আদেশ অমান্য করার সাধ্য আছে নাকি আমার?”

“উহু একদম নেই। তাহলে গ র্দা ন নিয়ে নেবো।”

কথাটা বলেই হেসে ওঠে মেহরিমা।এই মানুষটার সান্নিধ্যে আসলেই মনটা নিজের অজান্তেই ভালো হয়ে যায় মেহরিমার।মানুষটা কোনো যাদু টোনা জানে নাকি কে জানে!মেহরিমার হাসির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হৃদিত।সন্ধ্যা থেকে এই হাসিটা দেখার জন্যই ছটফট করছিল।ওই ব্লা ডি বি চ কে একদম ছাড়বে না।কলিজায় হাত দিয়েছে ওই জা নো য়া র।সবচেয়ে কঠিন মৃ ত্যু দিবে ওকে।আজ যদি অ্যানাবেলার কিছু হয়ে যেত!হৃদিত আর ভাবতে পারে না।হাতজোড়া মুঠো করে ফেলে।

#চলবে___

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৪০
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে বসে আছে মেহরিমা।হৃদিতকে বারবার খোঁচাচ্ছে তবুও উঠছে না।মেহরিমা দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল পাঁচটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট।সাড়ে ছয়টার আগে পাহাড়ে পৌঁছাতে হবে। কথাটা গতকাল রাতে হৃদিত নিজেই বলেছিল।অথচ ব্যাটা এখন কেমন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে।মেহরিমা এবার অধৈর্য হয়ে হৃদিতের গায়ের উপর থেকে কম্ফোর্টার সরিয়ে নেয়।হৃদিত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ গায়ে ঠান্ডা অনুভব হতেই আশেপাশে হাতড়াতে থাকে।কোথাও কম্ফোর্টার না পেয়ে চোখ জোড়া মেলে তাকায়।মেহরিমার দিকে নজর পড়তেই শুকনো ঢোক গিলে।মেহরিমার রণচণ্ডী রুপ দেখতেই বুজতে পারে এখন ওর আর নিস্তার নেই।

“ওহ শিট!বেইবি আ’ম সরি।জাস্ট গিভ মি ফাইভ মিনিটস।”

কথাটা বলেই মেহরিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ক্যাবিনেট থেকে শার্ট,প্যান্ট নিয়ে ওয়াশ রুমে দৌড় লাগায় হৃদিত।মেহরিমা না চাইতেও হেসে ওঠে।ঠিক দশ মিনিটের ব্যবধানে ফ্রেশ হয়ে বের হয় হৃদিত।এই প্রথম এতো কম সময়ে ফ্রেশ হয়েছে।লেদার জ্যাকেট,টুপি,মোজা পরিধান করেই মেহরিমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।মেহরিমাকে গিফটের মতো করে মোড়িয়ে এনেছে একদম।শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।

হৃদিতের বাগানবাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় গাছ হচ্ছে কাঠ গোলাপ গাছগুলো।মেইন গেইট থেকে ঘরের সদর দরজা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে লাইন দিয়ে কাঠগোলাপ গাছ গুলো বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মেহরিমা দিনের বেশিরভাগ সময় এই গাছগুলোর নিচেই কাটায়।বাড়িটার আশেপাশে গভীর জঙ্গল।জ ন্তু জা নো য়া রে র বসবাস সেথায়।তাই সেফটির জন্য উঁচু করে প্রাচীর নির্মাণ করা বাড়ির চারিপাশ ঘিরে।মেইন গেইটটাও স্ট্রং করে বানানো। বাড়ির সামনের জঙ্গল পেরিয়ে মেইন রোডে আসতে একঘন্টা বিশ মিনিট মতো সময় লাগে।ঠিক ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিটে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছায় ওরা।উঁচু নিচু রাস্তা হওয়ার দরুন গাড়ি আস্তে চালাতে হয়েছে।নাহলে বিশ মিনিটের রাস্তা।

মেহরিমা গাড়ি থেকে নামতেই মুগ্ধ চোখে চারিপাশটা দেখতে থাকে।পৌষের হাওয়া পাহাড় জুড়ে।মুক্ত দানার মতো স্বচ্ছ শিশিরের ফোঁটা।বেশ অনেক মানুষের আগমন এখানে।কেউ কেউ প্রকৃতির মাঝে মিশে গেছে আবার কেউ কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত।এ যেন কবিদের বর্ণনা দেওয়া সেই সবুজের সমাহার।চোখ যতদূর যায় সবুজে আচ্ছন্ন সবটা।একটা পাহাড়ের গায়ে হেলে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা পাহাড়।মাকড়সার জালে কুয়াশার স্বচ্ছ ফোঁটাগুলো দেখতে একদম মুক্তোর মালার মতো দেখাচ্ছে।পাহাড়ের গা কেটে কেটে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে।এতে পাহারপ্রেমীদের হয়রানি অনেকটাই কমে গেছে।অনায়াসেই উপরে উঠতে পারে।যদিও সকাল সকাল কুয়াশার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁটার জন্য সিঁড়ি গুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে।হৃদিত মেহরিমাকে কোলে উঠিয়ে নেয়।মেহরিমা আঁতকে ওঠে!

“এই কী করছেন আপনি?নামান আমাকে।”

“উহু,তুই চোখ দুটো বন্ধ কর জান।সারপ্রাইজ পেতে চাস না?”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।হৃদিত মুচকি হেসে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।অতঃপর সাবধানে উপরে উঠতে থাকে।আধা ঘন্টা তো লাগবেই উপরে উঠতে।পাঁচ মিনিট পেরোতেই মেহরিমা চোখজোড়া খুলে তাকায়।

“আর কতক্ষন?”

“আরেকটু।”

মেহরিমা আবার চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। এভাবে প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর চোখ খুলতে থাকে।হৃদিত একটুও বিরক্ত হয়না বরং মেহরিমার এক্সাইটমেন্ট দেখে মজা পায়। অবশেষে মেহরিমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ওরা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছায়।মেহরিমা চোখজোড়া বন্ধ করে আছে।হৃদিত আস্তে করে মেহরিমাকে নামিয়ে দেয়।মেহরিমার পিছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে,

“চোখ খুলতে পারিস জান।”

মেহরিমা নিজের আঁখি জোড়া খুলতেই বিস্ময়ে ওর ঠোঁট দুটো দুদিকে সরে যায়।এ যেন মায়াবীপুরীর অন্যদেশ!পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারপাশটা।পাখির কলকাকলি আর দিগন্ত মিশ্রিত সবুজ মিলে মিশে তৈরি করেছে এক মনোরম দৃশ্য।পেঁজা তুলোর ন্যায় সাদা মেঘের ভেলা পাশেই ছুটে চলেছে নিজেদের মতো।এ যেন মেঘেদের বাড়ি!মেহরিমা হাত বাড়িয়ে ছুঁতেই অদৃশ্য হয়ে যায়।পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে।এখানকার সূর্যোদয় কুয়াশার ধূম্রজালে মড়ানো।প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় গুলো।তার’ই ফাঁক ফোকড় দিয়ে দেখা মিলেছে সূর্যের।মেহরিমা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সবটা দেখতে থাকে।

“আমার জীবনের বেস্ট সকাল এটা।এতো সুন্দর একটা সকাল উপভোগ করানোর জন্য ভালোবাসা আমার কুট্টুসের বাবাকে।”

“আপনাকেও ভালোবাসা মহারানী। এবার চলুন।জলদি বাসায় ফিরতে হবে। আপনার ঠান্ডা লেগে গেলে সমস্যা।”

মেহরিমাও আর না করে না।আর পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে নেমে আসে। এবার মেহরিমা একাই আস্তে আস্তে হৃদিতের হাত ধরে অর্ধেক সিঁড়ি নামে।বাকি অর্ধেক সিঁড়ি কোলে চড়ে।বাসায় ফিরতেই হ্যানসেল হ্যারিকে দেখে মেহরিমা।খুশি দ্বিগুণ বেড়ে যায়।ওদের নিয়ে খুনসুটিতে মেতে ওঠে।বাগান বাড়িতে ওদের সময়গুলো স্বপ্নের মতোই কাটতে থাকে।
___

অন্ধকার ছোট্ট একটা কাঠের রুমে পড়ে আছে অ র্ধ মৃ ত এক মানব।চোখ, হাত,পা মুখ সবটাই বাঁধা। আশেপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে জীব জ ন্তু র হিং স্র গর্জন।শোনা যাচ্ছে নিশাচর পাখিদের ডাক।অদূর থেকেই ডেকে চলেছে জঙ্গলের মানুষ খে কো প্রাণীগুলো।সেই হাড়হীম করা ডাকে মানুষটার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়।ভয়ে ছটফট করতে থাকে।মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে গোঙানির আওয়াজ।

জঙ্গলের মাঝের অন্ধকার রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে হৃদিত।গায়ে হাঁটু সমান কালো কোট।মাথায় কালো হুডি তুলে দেওয়া।মুখে কালো মাস্ক।হাতে কালো গ্লাভস পরা।চাঁদের সোনালী আলোয় সর্ব কালোর মাঝে ওই নীল রঙের চোখ দুটো জলজল করছে।তারা যেন বহুদিনের ক্ষু ধা র্ত।এক হাতে হ্যানসেল আর হ্যারির রশি ধরা।অপর হাতে ছোট্ট একটা কুড়াল।হ্যানসেল আর হ্যারি ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠছে।নিস্তব্ধতার মাঝে সেই ডাক খুবই ভ য়ং ক র শোনাচ্ছে।

মেহরিমা গভীর ঘুমে মগ্ন।হঠাৎ ওর ফোনটা কর্কশ শব্দে বেজে ওঠে।মেহরিমা ঘুমের মধ্যেই বালিশের পাশে হাতরায়।ফোনটা পেয়েও যায়। নাম্বার না দেখেই রিসিভ করে বসে।

“টিং, টিং, টিং হৃদিতের অ্যানাবেলা তোমার ভালোবাসার মানুষটার আসল রুপ দেখবে না?”

মধ্যরাতে হঠাৎ অপরিচিত পুরুষালি কন্ঠ শুনতেই মেহরিমার ঘুম ঘুম ভাব কেটে যায়। তড়িৎ গতিতে উঠে বসে।

“ক..কে আপনি?”

“তোমার কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী হবো হয়তো।তোমার হৃদিত কোথায়? নিজের জামাইয়ের খবর একটুও রাখো না যে!মেয়ে ঘটিত কিছু করে বেড়ালেও তো টের পাবে না।”

কথাগুলো শুনে মেহরিমা হতভম্ব হয়ে যায়! তৎক্ষণাৎ উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়।হৃদিত কে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না। ওয়াশ রুম চেক করেও পায়না।দরজা খুলতে নিলেই বুঝতে পারে দরজা টা বাইরের থেকে লাগানো।মেহরিমা ঘাবড়ে যায়।মনের মাঝে হাজারো চিন্তা, প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে।তক্ষুনি শোনা যায় অপরপ্রান্তের মানুষটার অট্টহাসির শব্দ।

“খুঁজে পাবে না তো। তোমার হৃদিত তো ওখানে নেই। তাহলে কীভাবে পাবে মেয়ে?”

“হৃদিত কোথায়?ওর সাথে কী করেছেন আপনি?”

“আহা হাইপার হয়ো না মেয়ে।হৃদিতকে পেতে চাও তো নাকি?”

“হু…হ্যাঁ। কোথায় আমার হৃদিত?”

“আমার কথামতো সবটা করলেই হৃদিতকে পেয়ে যাবে।বোনাসসহ কিছু চমকও অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”

মেহরিমার মস্তিষ্ক এলোমেলো।হৃদিতের চিন্তায় ছটফটিয়ে ওঠে। ওনার সাথে খারাপ কিছু ঘটেনি তো!এদফায় মনে সাহস সঞ্চয় করে বলে,

“বলুন কী করতে হবে।”

“তোমার ব্যালকনিতে একটা দড়ি লাগানো আছে দেখো।ওটা বেয়ে নিচে নেমে এসো।তারপর আমার বলা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাবে।”

“ওকে।”

কথাটা বলেই মেহরিমা গায়ে একটা সাদা রঙের শাল জড়িয়ে নেয়।হাতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ফোনটা নিয়ে অপরিচিত ব্যক্তির কথামতোই ব্যালকনি দিয়ে দড়ি বেয়ে অনেক কষ্টে নিচে নেমে আসে।কাজটা মেহরিমার জন্য মোটেও সহজ ছিল না।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মনে দ্বিগুণ সাহস জুগিয়ে ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে অপরিচিত ব্যক্তির কথামতো হাঁটতে থাকে।মেইন গেইটের নিকট আসতেই মেহরিমা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে! দরজাটা খোলা।চোখের সামনে সব ধোঁয়াশা।মেহরিমা যত সামনে এগোচ্ছে ততই গা ছমছম করে উঠছে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রকৃতি।অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারিপাশ।মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় রাস্তাটাও অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।চাঁদের আবছা আলোয় জঙ্গলটা ভুতুড়ে রুপ ধারণ করেছে।গাছের উঁচু ডালে বসে মনের সুখে ডেকে চলেছে পেঁচা।গাছের পাতা থেকে টপ টপ করে কুয়াশা ঝরে পড়ছে।সেই শব্দে মেহরিমা কেঁপে উঠছে বারবার।হঠাৎ কাঁটা জাতীয় একটা গাছের সাথে মেহরিমার শালটা আটকে যায়।মেহরিমা জোর পূর্বক শালটা টানতেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে শালটা ছিঁড়ে যায়।নিস্তব্ধ পরিবেশে সেই শব্দে মেহরিমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি তখন নিরব।কয়েক সেকেন্ড পেরোতেই মেহরিমা আবারও অপরিচিত ব্যক্তির নির্দেশ মতো হাঁটতে শুরু করে।একসময় গহীন জঙ্গলের মিডল পয়েন্টে চলে আসে।অদূর হতেই কয়েক জোড়া চোখ জলজল করতে দেখে।ভয়ে মেহরিমার হাত,পা অবশ হয়ে আসে।বুঝতে আর বাকি নেই সামনের প্রাণীগুলো কী!পিছু ফিরে দৌড় দিতে নিলেই কিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।দু’হাতের উপর ভর দিয়ে পড়াতে পেটে কোনো ব্যথা পায় না।নিচের ঠোঁটের একাংশ চিঁ ড়ে গলগলিয়ে র ক্ত বের হয়ে আসে।মেহরিমা প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত উঠে ফোনটা হাতে নিয়েই ছুটতে থাকে।পেছনে বুনো শেয়াল গুলোও দৌড়াতে থাকে।হঠাৎ অন্ধকারের ডিঙিয়ে কয়েকটা তীর এসে লাগে শেয়ালগুলোর পায়ে।শেয়ালগুলো ওখানেই থেমে যায়।ব্যথায় কাতরাতে থাকে।মেহরিমা তখনও দৌড়াচ্ছে।পায়ের চটি জোড়া ততক্ষণে ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গেছে।মেহরিমা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে কিছু দেখতে না পেয়েই বড় একটা গাছের নিচে লুকিয়ে বসে পড়ে।ডুকরে কান্না করে ওঠে।ডান পাশ থেকে পাতার খসখস আওয়াজ শুনতে পেতেই মেহরিমা নড়েচড়ে বসে।বুঝতে পারে এটা কোন প্রাণী চলাচলের শব্দ।মেহরিমা নিজের মুখে হাত দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।তৎক্ষণাৎ ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে অস্পষ্ট কন্ঠস্বর,

“নড়াচড়া কোরো না মেয়ে।ওভাবেই বসে থাকো। ওদের রাস্তায় ওরা চলে যাবে।তোমায় কিছু করবে না ঠিক আমার মতোই।”

#চলবে___