Sunday, August 3, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 69



এক শহর প্রেম ২ পর্ব-০১

0

#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#সূচনা_পর্ব

#copyrightalert❌🚫
বর্ষার দিনে পায়ে হেঁটে ভার্সিটিতে যাচ্ছে আদিরা। রাস্তার কিনারাতে পানি জমে আছে। আদিরা পানি দেখে রিস্ক নিয়ে প্রায় রাস্তার মাঝে চলে যায়! হঠাৎই আদিরা পিঠে ধাক্কা অনুভব করে সেই পানিতেই উপুর হয়ে পড়ে যায়। এই পানি থেকে বাঁচতেই সে রাস্তার মাঝখানে গিয়েছিল। আর এখন সে সেই পানিতেই একদম নাজেহাল অবস্থা। আদিরা কিছু বুঝে উঠার আগেই, কিছুটা সামনে একটা বাইক ধুম করে উলটে যায়! বাইকের লোকটা ছিটকে রাস্তায় পড়েছে। বাইক অ্যাক*সিডেন্ট দেখে আদিরা তার রাগ-দুঃখ ভুলে তাড়াতাড়ি করে উঠে সেই বাইকটার কাছে যায়। গিয়ে দেখে একটা লোক হেলমেট পরা অবস্থায় রাস্তার মধ্যে পড়ে হাত ধরে কাঁতরাচ্ছে। আশেপাশে তিন চার জন লোক বাইক অ্যাকসিডেন্ট যেখানে হয়েছে সেখানে জড়ো হয়েছে। একজন বলছে,

“এই মাইয়া, তুমি রাস্তাঘাটে দেইখা চলতে পারো না? রাস্তার মাঝখানে কেন আইছো? তোমারে বাঁচাইতে গিয়া পোলাটার অ্যা*কসিডেন্ট হইলো!”

আরেকজন বলছে,
“বাইক থাকলে যেন মানুষ আসমানে উড়ে! দিক-বেদিকে তাকায় না! দেয় টান!”

আদিরা দুজনের কথাই শুনে। কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর করে না। এরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনার বিশ্লেষণ করছে, কিন্তু কেউ ছেলেটাকে ধরে উঠাচ্ছে না। অগ্যতা আদিরা ছেলেটার হাত ধরে উঠাতে চাইলে ছেলেটা ঝাড়া দিয়ে আদিরার হাত ছাড়িয়ে নেয়। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসে বাম হাত দিয়ে কোনো মতে মাথার হেলমেটটা খুলে আদিরের দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকায়। ছেলেটা হেলমেট খুলতেই আদিরা ছেলেটাকে চিনতে পারে। এই যে তার ভার্সিটির সিনিয়র মারসাদ ইশরাক! যাকে কী-না পুরো ভার্সিটি চিনে। চিনবেই না কেন? সে তো ভিপি পদের পার্থী! আর পুরো ভার্সিটির সবাই মারসাদকেই নতুন ভিপি হিসেবে চায়। তারউপর মেয়েরা তো..! কিন্তু আদিরা উনাকে ভয় পায়। সে এখন ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলো। মারসাদ আদিরাকে দেখে রাগে কটমটিয়ে বলে উঠে,

“এই তোমার সমস্যা কী? চো*খ কি হাতে নিয়ে হাঁটো?”

আদিরা ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে ডান হাতের নখ দিয়ে বাম হাতের নখ খুঁটছে। মারসাদের প্রশ্নে ভয়ে কেঁপে উঠে চুপ করে থাকে। মারসাদের হাঁটুর কাছে জিন্স ছিঁড়ে হাঁটু ছিঁ*লে গেছে। তবে পায়ের থেকে বেশি ব্যাথা পেয়েছে ডান হাতে। আদিরাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গিয়ে বেকায়দায়! আশেপাশের লোকজন মারসাদের বাইকটা সোজা করে উঠায়। মারসাদ বাইকের উপর হেলমেটটা রেখে খোঁরাতে খোঁড়াতে আদিরার কাছে এলো। আদিরা দৃষ্টি নিচু রেখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মারসাদ রুষ্ট স্বরে বলল,

“রাস্তার মধ্যে হাটার সময় চো*খ-কা*ন কি আসমানে তুলে হাঁটো? আমি যে দুইবার হর্ন দিলাম, শুনেছিলে? রাস্তার মাঝখানে কেন এসেছো?”

আদিরা দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘোরাতে গিয়ে মারশাদের হাঁটুর দিকে নজর যায়। আদিরা দেখে সেখানে র*ক্ত জমাট বেঁধে আছে। আদিরা সেখানে হাত দিতে নিলে মারসাদ বাম হাতে আদিরার হাত ধরে ফেলে। আর বলে,

“কী হয়েছে? তুমি আমার কথার জবাব দিচ্ছো না কেন? এখন কি চো*খ, কা*নের সাথে সাথে মুখের জবানটাও খুঁইয়ে বসেছ?

আদিরা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে,
“আসলে..মানে..”

“এই তোমার সমস্যা কী? তোমার মুখে কথা ফুটে না? আসলে, মানে এগুলা কী?”

আদিরা নিচু স্বরে বলল,
“ভাইয়া, রাস্তার ধারে পানি তো। তার জন্য আমি পানির থেকে বাঁচতে মাঝখানে চলে গিয়েছি।”

“রাস্তার কিনারায় পানি, আর রাস্তার মাঝখানে গাড়ি। তো কোনটা তোমার জন্য সেফ মনে হয়? এদিকে তোমার জন্য আমার অবস্থা..!”

মারসাদের কথাগুলো আদিরার খারাপ লাগলো। সে তো ইচ্ছে করে অ্যা*কসিডেন্ট করায়নি। আদিরা ফের বলল,
“সরি, ভাইয়া। আমি বুঝতে পারিনি যে এত কিছু হবে।”

মারসাদ বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে নিবে তখন আদিরার মুখখানা দেখে মায়া লাগে। তাই সে আর কিছু বলে না। আস্তে আস্তে নিজের বাইকের কাছে গিয়ে বাইকে বসে। তারপর হেলমেট পরে আদিরাকে ডাকে।

“বাইকে এসে বসো।”

মারসাদের ডাক শুনে আদিরা নিজের পিছনে একবার তাকায়। তা দেখে মারসাদ বিরক্তি নিয়ে বলে,
“আমি তোমাকেই বলছি। তুমি ছাড়া এখানে কে আছে? যাকে আমি বাইকে উঠতে বলবো!”

আদিরা মেকি হেসে বলে,
“সমস্যা নেই, ভাইয়া। আমি চলে যেতে পারব।”

“আমি কি বলেছি তুমি যেতে পারবে না? আমি জানি তুমি যেতে পারবে। এমনকি তুমি হেঁটে হেঁটেই যাবে! তোমার ক্লাস যেন কখন?”

আদিরার টনক নড়ে। সে তার ফোন সময় দেখতে ব্যাগে ফোন খুঁজে। কিন্তু ব্যাগে তার ফোন নেই। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখে পানির মধ্যে ফোনটা পড়ে আছে! আদিরা জলদি করে ফোনটা উঠিয়ে দেখে তা কাজ করছে না। মারসাদ বুঝতে পারলো, আদিরা সময় দেখতে চাইছে। তাই মারসাদ নিজেই বলে দিলো,

“আর দশ মিনিট বাকি! হেঁটে যেতে যেতে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”

আদিরা তার ফোনটার ব্যাটারি খুলে পানি মুছে, সেটাকে আবার লাগিয়ে চালু করার চেষ্টা করছে। মারসাদ এটা দেখে চোখ বন্ধ করে দুইবার বিরক্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে তাড়া দিয়ে বলে,
“তোমার আইফোন ফিফটিন প্রো ম্যাক্সকে সাইডে রেখে দয়া করে বাইকে উঠো।”

আদিরা ইতস্তত করছে। মারসাদ এবার ফের রেগে যায়। সে বলে,
“দেখো আমার পায়ে ও হাতে ব্যাথা। এখন আমাকে বাধ্য করো না তোমাকে টেনে আনতে। নিজের পায়ে হেঁটে বাইকে এসে বসো!”

আদিরা আর উপায়ন্তর না পেয়ে তাড়াতাড়ি করে বাইকে গিয়ে বসলো। তারপর মারসাদ ও নিজের মাঝে নিজের ব্যাগটা রাখলো। মারসাদ বলল,
“আমার বাম কাঁধে শক্ত ধরে বসো। ডান কাঁধে ধরবে না।”

আদিরা ইতস্তত করে ধিমি স্বরে বলল,
“ভাইয়া, বাইক একটু আস্তে চালিয়েন।”

“হুম।”

অতঃপর মারসাদ বাইক স্টার্ট করে। প্রায় ৫-৭ মিনিট পর ওরা ভার্সিটিতে এসে পৌঁছে। আদিরা বাইক থেকে নেমে মারসাদকে ধন্যবাদ বলে ছুট লাগালো ক্লাসরুমের দিকে। মারসাদ পিছু ডাকতে নিয়েও ডাকলো না। এদিকে মারসাদের ফ্রেন্ড সার্কেল মারসাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা মারসাদের বাইক আসতে দেখে খুশিও হয়েছিল। কিন্তু মারসাদের বাইকের পেছনে আদিরাকে দেখে অবাক হয়। তারপর মারসাদের কাছে এসে হাঁটুতে ক্ষ*ত এসব দেখে রিহান, আহনাফরা বিচলিত হয়ে পড়ে। রবিন নিজের হাঁটুতে হাত দিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে নিয়েছে। সুমি তা দেখে ওর পিঠে একটা লাগিয়ে বলে,

“গা*ধা! মারসাদের পা কে*টেছে! আর তুই নিজের পা ধরে বসে আছিস!”

রবিন পিঠ ডলতে ডলতে মুখ ছোটো করে নিলো। রিহান প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“তোর হাঁটু ছুঁ*লে গেলো কিভাবে?”

জবাবে মারসাদ চেহারায় বিরক্তি ফুটিয়ে বলে,
“বাইক অ্যাকসিডেন্টে।”

রিহান, মৃদুল, আহনাফরা সবাই ভয় পেয়ে যায়। মৃদুল মারসাদের ডান হাত ধরে বলে,
“আর কোথাও লেগেছে নাকি?”

সাথে সাথে মারসাদ আঁ করে উঠলো। মৃদুল তাতে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেয়। আহনাফ জিজ্ঞাসা করে,
“হাতেও লেগেছে। দেখি?”

“আরে ইয়ার! দুই হাতেই রাস্তার সাথে ঘষা খেয়েছি। তবে বেকায়দায় পড়ে ডান হাতটা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে।”

“তুই রাস্তায় একটু স্লো বাইক চালাতে পারিস না? আয় এখন। মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে ফার্স্টএইড করিয়ে আনি। একটু পর মিটিংও আছে। তোর বদলে নাহয় আমি এটেন্ড করে নিব।”

“চল।”

এরপর ওরা সবাই মেডিকেল সেন্টারের দিকে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে মৌমি প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা মারসাদ, তোর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তাহলে আদিরা তোর বাইকের পিছনে কী করছিল?”

“আরে ওর জন্যই তো…”

থেমে যায় মারসাদ। এবার মারসাদের বন্ধুমহল মারসাদকে ঘিরে ধরে। সুমি কপাল কুঁচকে বলে,
“এই পর্যন্ত, এই মেয়ের জন্য তোর কতবার বিপদ হলো! তাও তুই এই মেয়েকে তেমন কিছু বলিস না।”

সুমির সাথে রাত্রীও তাল মেলায়। আহনাফ বলে,
“আহ সুমি! আদিরা কি ইচ্ছে করে করে নাকি? চল এবার। মারসাদ, তুই চলতে চলতে ঘটনা বলতে থাক।”

তারপর মারসাদ ঘটনাটা বলতে থাকে।

চলবে?

এক শহর প্রেম সিজন-০১ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন।

কখনো কুর্চি পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0

কখনো কুর্চি (শেষ পর্ব)

ছাদের দরজায় পৌঁছে আঙুল দিয়ে ছাদ দেখিয়ে দিল রুবেল
— যাও, কথা বল।
বিমুঢ় কুর্চি প্রশ্ন করল
— মানে?
— মানে আন্টির আসল ছেলে ছাদে আছে। তোমার ভয়ে তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত যায়নি।
— কে সে? বাড়ি না গিয়ে ছাদে কী করছে? এ আবার কী নতুন ড্রামা?
— গিয়ে জিজ্ঞেস করো। ড্রামা কি তুমি একাই করবে নাকি? যাও কুর্চি, কথা না বাড়িয়ে যাও গিয়ে কথা বলো। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। মারামারি লাগলে যাতে তোমাদের ছাড়িয়ে নিতে পারি।

কুর্চি অন্ধকার ছাদে পা রাখল। কাউকেই দেখা গেল না, একটু এদিক ওদিক করতেই একপাশ থেকে জলদগম্ভীর স্বর ভেসে এলো
— আমি এখানে, কুর্চি।
সিঁড়ির অল্প আলোয় আরিয়ানকে দেখে পাথর হয়ে গেল কুর্চি
— আরিয়ান!
— হ্যাঁ, আমি।
— তুমি কেন? আন্টির ছেলে কই?
— আমিই তোমার আন্টির ছেলে!
— তুমি!
— হ্যাঁ, আমি। কেন হতে পারি না?
রেগে গেল কুর্চি
— সবকিছুই হতে পার। কিন্তু কেন এসেছে?
— তুমি কাউকে না বলে রেজিগনেশান দেবে, অফিসে না গিয়ে নীচে ডোরম্যানের কাছে কাপুরুষের মতো রেজিগনেশান লেটার রেখে পালিয়ে যাবে, তারপর আমি প্রশ্ন করলেও উত্তর দেবে না, আমাকে জানতে হবে না এসব কেন করছ? তোমার কোনো প্রবলেম হলে আমাকে এসে বলবে। রেজিগনেশান দেবার মতো ছেলেমানুষি কেন করলে? তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি, কুর্চি।

অন্যায় দোষারোপে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না কুর্চি। তারপরেই হিতাহিত জ্ঞান হারাল। আরিয়ানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর দামী শার্টের কলার চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান দিতে থাকল।
— আরে আরে, কর কী!
— কর কী! কর কী! বলতে লজ্জা করল না!
— শোনো, কথা শোনো, কুর্চি। তুমি মনেহয় পুরা ব্যপারটা ভুল বুঝেছ।
— ভুল বুঝেছি! আমি ভুল বুঝেছি! হ্যাঁ, আমিই তো ভুল বুঝেছি। তোমাকে ডিসেন্ট ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি আস্ত একটা শয়তান! তলেতলে সবদিকেই তাল দিতে ওস্তাদ!

রুবেল দৌড়ে এসে আরিয়ানকে কুর্চির হাত থেকে বাঁচাল। তারপর আরিয়ানের সামনে দুই বাহু মেলে দিয়ে একটা দেয়াল খাঁড়া করে বলল
— দেখো, আমার মতে তোমাদের মাঝে সবসময়ের জন্য দুইহাত দূরত্ব থাকা দরকার।
কুর্চি রুবেলের ওপর দিয়েই আরিয়ানকে আক্রমণের চেষ্টা চালাল। রুবেল ওর দুই বাহু চেপে ধরে ওকে থামাল। ছটফট করতে থাকল কুর্চি
— ছাড়ো, ছাড়ো আমাকে, রুবেল। ও আমাকে শুধু ব্যবহারই করে এসেছে। কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরালে পাজি। ইডিয়ট, স্টুপিড, ছোটোলোক একটা।
— দেখো, গালি দেবে না কুর্চি।
— আমাকেও নীচে গালি দিয়েছে, আরিয়ান। এর বিচার তুমি করবে। তোমার উপকার করতে গিয়ে শুধুশুধু গালি খেলাম।
হাঁপাতে হাঁপাতে কুর্চি বলল
— না, গালি দেবে না, কুর্চি। বিনা ট্রনিং এ নিজেদের চামড়া বাঁচাতে আমাকে অন এয়ারে বসিয়ে দেবে, দুনিয়ার খাটনি আমাকে দিয়ে করিয়ে নেবে কিন্তু যেই মালিকের মেয়ে ফিরে এল, ওমনি আমাকে আর লাগবে না। তখন দুজনে মিলে আমাকে মিলনের জায়গায় বসিয়ে দেবে। তোমাদের চা কফি আনানেয়া করার জন্য! আমি সবই শুনেছি, আরিয়ান। লুবনা বলেছে কুর্চিকে চলে যেতে হবে। একবারও তোমাকে শুনলাম না এর প্রতিবাদ করতে বা আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে।
রাগে দুঃখে কেঁদে ফেলল এবারে কুর্চি
— কিভাবে পারলে, আরিয়ান? আমি কম খেটেছি? জান দিয়ে দিয়েছি। এতখানি অবহেলা আমার প্রাপ্য না, আরিয়ান। তুমি কিভাবে পারলে লুবনার সাথে একজোট হয়ে আমার বিশ্বাস নষ্ট করতে?
— আমি তোমার বিশ্বাস নষ্ট করেছি? তোমার সাথে দেখা হবার পর থেকে আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি নিজেকে তোমার যোগ্য করে তুলতে।

কুর্চি কান্না বন্ধ করে হাঁ করে ওরদিকে তাকিয়ে রইল। রুবেল কুর্চিকে ছেড়ে দিয়ে বিব্রতভাবে বলল
— আচ্ছা তোমরা কথা বল। আমি চললাম। আরিয়ান, পরে কথা হবে।
রুবেল দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে উধাও হয়ে গেল।
বিহ্বল গলায় কুর্চি বলল
— কী বললে তুমি?
— সত্যি কথাই বলছি, কুর্চি।
— তুমি…তুমি আমাকে ভালোবাসো?
— মনে হয় তাই।
কাঙালের মতো প্রশ্ন করল কুর্চি
— এজন্য আমাকে কেক খাওয়ালে?
বিস্মিত আরিয়ান জবাব দিল
— এখনো তো খাওয়াইনি। তুমি চাইলে সে ব্যবস্থাও করা যাবে নাহয়।

— কিন্তু…কিন্তু…লুবনা!
— লুবনার কথা আপাতত থাক, কুর্চি। আগে আমার কথা শোনো। আমি তোমাকে শুরু থেকে কিছুই বলিনি। যারজন্য এতখানি ভুল বুঝলে আমাকে।

লুবনার কথা মনে করে কুর্চি আবারও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। এগিয়ে এসে আরিয়ান ওর দুইহাত নিজের হাতে নিয়ে বলল
— শোনো, কান্না বন্ধ করো। তোমার সাথে বাসে ঐ ঘটনা ঘটার আগে থেকেই তোমাকে চিনি আমি।
এবারে কান্না বন্ধ করল কুর্চি
— কী বলছ তুমি?
— হ্যাঁ। ঘটনা শুরু হয়েছিল যখন মা তোমাকে দেখে পছন্দ করে তোমার অজান্তে ফটো তুলে নিয়ে এসে আমাকে বাসায় দেখালো। আমি রাগ করলাম। অচেনা মেয়েকে না বলে, তার অনুমতি না নিয়ে ফটো তোলা কোনোমতেই সমর্থন করা যায় না। এজন্য মা’কে আমি খুব করে বকে দিয়েছি!
— আহা! তার মনে তো খারাপ কিছু ছিল না। তারপরে কী হল?
কুর্চি নিজের অজান্তেই এক পা এগিয়ে এল আরিয়ানের দিকে।
— তারপরে যা হল, সেটা নিছক কাকতালীয় বললেই চলে। বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ। সেদিন মোটরসাইকেল খারাপ ছিল বলে বাস নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু শুধু কৌতূহলের বশে আমি এরপর থেকে নিয়মিত বাসে চড়া আরম্ভ করলাম। শুধু তোমার জন্য, কুর্চি। এর আগে জীবনে বাসে চড়িনি, বাসায় গাড়ি, মটরসাইকেল সব রয়েছে! এমনকি সেদিন তোমাকে ভিড়ের মধ্যে যাতে কেউ ডিস্টার্ব না করে সেজন্য তোমার পিছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।
— সত্যি?
— হুম। তারপর তো যা-তা অবস্থা হল। অফিস পর্যন্ত গিয়ে আরেক চমক। তুমি এসেছ আমারি অফিসে ইন্টার্ভিউ দিতে। তারপর একে একে ঘটনা তো ঘটেই চলেছে। লুবনা উধাও হল, আমার মাইক নষ্ট হল, আমরা দুজনে জুটি হিসাবে সফল হলাম, দুজনের কাজ করার কেমিস্ট্রিটাও চমৎকার।
— কিন্তু একবারও বললে না কেন যে তোমার মা আমাকে পছন্দ করেছেন? আমি তো এদিকে যেভাবে পারছি উনার বাড়িতে আসা ঠেকিয়ে রাখছিলাম।
— কারণ মা বলেছিল তুমি তেজি মেয়ে, আমাকে তোমার পছন্দ নাও হতে পারে। তোমার বাবা মারও পছন্দ না হবার যথেষ্ট কারণ থাকার সম্ভবনা ছিল। আমার ইগোতে এটা লেগেছিল।
— কী কারণ? মা বলছিল তুমি ভালো ছেলে, ভালো ফ্যামিলি, ধনী ফ্যামিলি।
— সে তো আমার বাবামা ধনী, কুর্চি। আমি তো তেমনভাবে এখনো স্বাবলম্বী হইনি। কেবলি পাশ করার পর লুবনার সাথে ড্রিমজ রেডিওতে কাজ শুরু করলাম। কিন্তু একেবারে নতুন স্টেশান। রাকীব স্যার খুব ভালো, আমাকে খুব স্নেহ করেন সন্দেহ নাই কিন্তু এ চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি চিন্তিত। অন্তত এ নড়বড়ে চাকরির ওপরে ভরসা করে কখনো তোমাকে বলতে পারব না আমাকে বিয়ে করো।
— একবার জিজ্ঞেস করে দেখতে রাজি হতাম কী না!
— কেন করব? তোমার মান সম্মান আছে, আমার নাই? আমি তখনি তোমার সামনে দাঁড়াব যখন নিজেকে যোগ্য মনে করব। গত একমাসে আমি চারিদিকে চেষ্টা করেছি, বহু জায়গায় এপ্লিকেশান দিয়েছি, অপেক্ষা করছিলাম ডাকের জন্য। দুই এক জায়গায় অফারও পেয়েছি কিন্তু কিছুই মনের মতো পাচ্ছিলাম না। তারমধ্যে লুবনা পালিয়ে গেল, আবার ফিরে এসে নতুন ঝামেলা তৈরি করল। ও মনে করেছে যে জায়গাটা ও ফেলে রেখে গেছিল, সেটা ওরজন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। এদিকে রাকীব স্যার এতোদিন ধরে লুবনার উল্টা পাল্টা কাজ মেনে নিচ্ছিলেন। উনি নিজেও বোঝেন লুবনাকে তিনিই প্রশ্রয় দিয়ে এমনটা বানিয়েছেন। কিন্তু তার মানা সত্ত্বেও পালিয়ে বিয়ে করাতে উনি এবারে সত্যি কঠিন হয়েছেন। বুঝেছেন প্রতিবার এভাবে লুবনাকে উদ্ধার করে তিনি ওর ক্ষতিই করছেন। লুবনাকে তিনি সবধরণের সাহায্য করা বন্ধ করেছেন, এমনকি স্টুডিওতে আসতেও মানা করে দিয়েছেন। বলেছেন লুবনা ছাড়াই সবকিছু ভালোভাবে চলছে, কাজেই সে যেন গিয়ে নতুন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না করে।

কুন্ঠিতভাবে প্রশ্ন করল কুর্চি
— লুবনার সাথে তোমার সম্পর্ক কী, আরিয়ান? মানে সিঁথি বলছিল তোমরা ক্লাসমেট। কিন্তু আমার তার থেকে বেশিকিছু মনেহয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরিয়ান
— লুবনা আমার ক্লাসমেট ও বন্ধু। একসময়ে আমরা একই গ্রুপে ঘোরাফেরা করতাম। তারপর লুবনা ধীরেধীরে আমাদের গ্রুপ এভোয়েড করতে লাগল। নতুন নতুন বন্ধু জুটিয়ে নিল। যাদের দেখে আমার মনে সন্দেহ আসা স্বাভাবিক। তারপরেও হুটহাট দেখা হলে আমরা আগের মতোই আড্ডা দিতাম। আমার সবসময় ইচ্ছা ছিল মিডিয়া জগতে আসবার। লুবনা জানত। ও নিজেও খুব ক্রিয়েটিভ। শুধু জানে না মাত্রা কিভাবে রাখতে হয়। যাইহোক, আমাকে বিশ্বাস করত বলেই পাশ করার সাথেসাথে বলল চলো আমরা দুজনে মিলে কিছু শুরু করি। ওর বাবাকে বলে ড্রিমজ রেডিও আরম্ভ করল। এজন্য আমিও ওরপ্রতি একধরণের লয়াল্টি ফিল করি, একটা দায়িত্ববোধ। কিন্তু লুবনা বেশিদিন এক জিনিস নিয়ে পড়ে থাকবার মানুষ না। কোনোকিছুতে লেগে থাকতে জানে না। বাবার জোরে প্রতিবার ও পার পেয়ে যায়। কিন্তু এবারে রাকীব স্যারও হাত তুলে নিয়েছেন।
— তাহলে কী হবে?
— ড্রিমজ রেডিও খুব সম্ভব আর থাকবে না। মিলন চলে গেছে। রুবেল পুরাদমে চাকরি খুঁজছে। ওর আর লুবনার মধ্যে শুরু থেকেই বনেনি।
— তুমি তো রয়েছ।
— আমিও নাই, কুর্চি। বললাম না তোমাকে আমি চারিদিক খোঁজাখুঁজি করতে আরম্ভ করছিলাম। ফাইনালি খুব ভালো একটা অফার পেয়েছি।
— পেয়েছ? কোথায়?
— দোয়েল টিভি তো জানো, তাই না? খুব যে পুরানো বলব না কিন্তু ভালো নাম করেছে। ওরাই সকালের স্লটে দা টুডে শো ধরণের কিছু শুরু করতে চাইছে। একটু খবর, একটু ট্রাফিক, একটু ওয়েদার, একটা স্লটে গেস্টদের এনে রিলাক্সড ওয়েতে আড্ডা দেয়া। লেখক, গায়ক, রাধুনী, ইনফ্লুয়েন্সার, অভিনেতা— যখন যাকে পাওয়া যাবে। মোটমাটকথা একটা পজিটিভ ভাইব রাখতে হবে, সহ হোস্টের সাথে খুনসুটিও চলবে খুব। তারা অফার দিয়েছে। মাইনেও ভালো। আমি রাকীব স্যারকে বলে আজ রেজিগনেশান দিয়ে এলাম। তখন শুনলাম লুবনাও আর দেশে থাকবে না। ও ডিভোর্স নিতে চাইছে, তারপর রাকীব স্যার ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তারপরে নিজের ব্যবস্থা লুবনাকে নিজেই করে নিতে হবে। আশা করছি এবারে লুবনা জীবন নিয়ে সিরিয়াস হবে।

দুটো খবরের কোনটায় যে রিয়াক্ট করবে কুর্চি বুঝে পেল না। শেষে বলল
— কনগ্রাজুলেশান্স, আরিয়ান। আমার সবসময়ই মনে হয়েছে ড্রিমজ রেডিও তোমার জন্য না, তোমাকে আরো বড়ো কোনো জায়গায় মানায়।
— কিন্তু এখানেও তোমাকে আমার দরকার যে, কুর্চি। তুমি সাথে না থাকলে তো কিছু হবার নয়।
— আ…আমি?
কুর্চি আরো এক কদম এগিয়ে গেল, আরিয়ান এবারে দুহাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরল।
— তুমি ছাড়া তো কিছু হবার না, কুর্চি।
ফিসফিস করে প্রশ্ন করল কুর্চি
— কেন?
— কারণ ওরা শুধু আমাকে চায় না, আমাদেরকে চায়। আমাদের অন এয়ার কেমিস্ট্রি ওদের খুব পছন্দ হয়েছে। নতুন প্রোগ্রাম শুরু করবে প্ল্যান করতেই ওরা আশেপাশে কী হচ্ছে খেয়াল করছিল, কোন প্রোগ্রামের রেটিং কেমন এটাও লক্ষ করছিল। এরা নোটিস করেছে যে তুমি আসবার পরে আমাদের রেটিং ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। আমি তো আগেও ছিলাম লুবনার সাথে। তখনো রেটিং একেবারে খারাপ ছিল না। কিন্তু তুমি আসবার পরে ঝটপট বেড়ে গেছে। তোমাকে ওরা বলেছে “পাটাকা” মানে পটকা।
— মানে…মানে ওরা আমাদের দুজনকে কো-হোস্ট করবার অফার দিয়েছে টিভিতে?
কুর্চি নিজের কানকেও বিশ্বাস করবে কিনা বুঝল না।
— হুম, তাই তো। এজন্যই তোমাকে বলেছিলাম জরুরি কথা আছে। তা তুমি তো উত্তরই দিলে না।
একটু অভিমানী শোনাল আরিয়ানের গলা। কুর্চিও পালটা অভিমান করতে ছাড়ল না
— কেন উত্তর দিব? সেদিনের প্রোগ্রামের সব কাজ আমি করেছিলাম, এদিকে লাস্ট মোমেন্টে লুবনা উড়ে এসে জুড়ে বসল। আমার রাগ হবে না? তারপরে আবার তোমাদের দুজনকে জড়াজড়ি করতে দেখলাম মিটিং রুমে। লুবনার সে কী উথাল পাথাল কান্না!
দৃশ্যটা মনে পড়তেই আবার রাগ ধরল কুর্চির।
আরিয়ান কুর্চিকে ভালোমতো জড়িয়ে ধরে বলল
— নাও, এবার তোমাকেও জড়িয়ে ধরলাম, হোল তো? বাসেও জড়িয়ে ধরেছিলাম আগে। কাজেই তুমি ফার্স্ট, বুঝলে?
কুর্চি হেসে ফেলে আরিয়ানের কাঁধে এক ঘুষি দিল।

— কিন্তু আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না যে টিভিতে হোস্টিং এর সুযোগ পাচ্ছি। তুমি সত্যি সত্যি বলছ তো, আরিয়ান?
— সত্যি, বাবা। তোমার ধারণাও নাই তুমি কতটুকু ভালো। ওরা ঠিকই চিনেছে। দেখবে, একদিন তুমি অনেক দূরে যাবে।
— সত্যি?
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কুর্চি গলায় হাত রেখে প্রশ্নটা করতেই হাতে কীযেন ঠেকল। সাথেসাথে বুঝে ফেলল ও। ওর লাকি ফর্গেট মি নট ক্লিপটা। ওর লাকি চার্ম। আজ একসাথে ওকে শুধু এমন অভানীয় সুযোগ দিচ্ছে না, আরিয়ানকেও পাইয়ে দিচ্ছে। কুর্চি এখনো যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না।
— তাহলে, কুর্চি? তুমি রাজি তো?
— কিসে রাজি, আরিয়ান?
— আমার পার্টনার হতে? জীবনের পার্টনার, কাজেরও।
একটু ভাবল কুর্চি
— ৫০/৫০ পার্টনার হলে তো রাজি আছিই।
— তাহলে ডিল ফাইনাল করে ফেলি, কী বল?
পকেট থেকে আংটি বের করল আরিয়ান। কুর্চির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ওর আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বলল
— সিল হয়ে গেল কিন্তু। আর কথার নড়চড় করতে পারবে না।
— কে নড়চড় করতে চেয়েছে?
হাসল আরিয়ান। খোলাসা করে বলল না যে আদিবাই ওকে বুদ্ধি দিয়েছিল আংটি নিয়ে সরাসরি কুর্চির আঙুলে পরিয়ে দিতে। তাতে নাকি কুর্চি না বলতে পারবে না। আংটিটা আদিবার নিজের এঙ্গেজমেন্টের আংটি। আদিবার ধারণা খুব পয়মন্ত আঙটি এটা। পরিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে হবে।
এমন “গুহামানব” পদ্ধতি আরিয়ানের ঠিক পছন্দ না হলেও আসবার সময় আংটিটা সে পকেটে করেই নিয়ে এসেছিল। সুদূর কল্পনাতেও ছিল না সে সফল হবে। তারপরেও আশা নিয়েই তো মানুষ বাঁচে। সেজন্য রুবেলকে শেষ মুহূর্তে প্ল্যানে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
— চাও না?
— নাহ!
— তাহলে তো আরেকবার সিল করতে হচ্ছে!
খুব নরমভাবে কুর্চির ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করল আরিয়ান।
একটু পরে কুর্চি বলল
— আরিয়ান?
— হু?
— নীচে চল।
— যেতেই হবে?
— হু। আসবার আগে আমি নীচে এক কান্ড করে রেখে এসেছি। ওরা যেকোনো সময়ে ছাদে চলে আসতে পারে।
হাসল আরিয়ান
— মা’কে বলেছিলাম আজ তুমি একটা কান্ড করবে। শুনে মা খুব এক্সাইটেড। বলেছে এমন কান্ডওয়ালা বউয়ের অপেক্ষায়ই সে আছে। যে আমাকে উঠতে বসতে নাচাতে পারবে। মা বেশিরভাগ সময়ে আমার সাথে পেরে ওঠে না। এখন ছেলের বউকে নিজের দলে ভিড়িয়ে নেবার তাল করছে।
— সত্যি? কিন্তু তোমাকে দেখে তো সিরিয়াস মনেহয়। এজন্য আমি এতদিন একটু দূরে দুরেই থাকতাম।
— কারণ আমি এক মিশনে নেমেছিলাম, যেভাবে হোক নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার মিশন। যাতে তোমাকে পাই। এখন মিশন কমপ্লিট, আমার দুষ্টু অবতারের দেখা পাবে।
— ওয়াও। এ অবতারের দেখা তো আগে পাইনি।
— এখন দেখবে।
আরিয়ান কুর্চিকে কাছে টেনে নেবার উপক্রম করতেই কুর্চি হাসতে হাসতে সিঁড়ির দরজার দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করল
— সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি, আরিয়ান। ওরা এলো বোধহয়। জলদি চল।

মনে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে ড্রয়িং রুমে আর বসে থাকতে পারছিলেন না ওরা, তাই ছাদে এসে পড়ছিলেন। ছাদে পা দেবার আগে অবশ্য ইমরান সাহেব অর্থপূর্ণভাবে বারকতক কেশে নিয়ে হাঁক দিলেন
— আরিয়ান! আরিয়ান! তোমরা দুজনে ঠিক আছ তো?
— হ্যাঁ বাবা, তোমরা উঠে এলে কেন? এই তো আমরা নীচে নামছিলাম!
(সমাপ্ত)

কখনো কুর্চি পর্ব-১৪

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ১৪)

এরপর দুই সপ্তাহের মতো পার হয়ে গেছে। কুর্চি আর ফিরে যায়নি অফিসে। সেদি্নের ডিজাস্টারের পর অফিসের নীচে গিয়ে ডোরম্যানের হাতে রেজিগনেশান লেটার দিয়ে বলেছে
ড্রিমজ রেডিওতে পৌঁছে দিতে। আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে লেখা ওর রেজিগনেশান লেটার।

সেরাতে আরিয়ান ওকে টেক্সট করেছিল, উত্তর দেয়নি কুর্চি। তারপর আরো দুইবার মেসেজ দিয়েছিল জরুরী কথা আছে বলে। সেগুলি পড়ে কোনো জবাব না দিয়ে কুর্চি অনলাইনে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে।
দরকার নাই আরিয়ানের সাথে যোগাযোগ রাখার।
দরকার নাই আরিয়ানের কথা ভাবার।
দরকার নাই একসাথে কাজ করার স্মৃতি মনে করে কাঁদাকাটা করার।
ভুলে যাবার চেষ্টা করবে ও জীবনের এই অধ্যায়কে।
সামনে পড়ার চাপ বাড়ছে, মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।
শিউলি ওকে প্রশ্ন করেছেন কিছু হয়েছে কিনা, উত্তরে বলেছে পড়াশোনায় অসুবিধা হচ্ছিল, এজন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ও।
তাতে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেও কিছু বলেননি শিউলি।

আজ একমাস পার হবার পর শিউলি নতুনভাবে প্রসঙ্গটা ওঠালেন
— কুর্চি, আপাকে তো নানা কিছু বলে এতদিন ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন উনি ছেলেকে নিয়ে আসতে চাইছেন। আমি অজুহাত দেবার মতন কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। কী বলব?
ক্লান্ত গলায় কুর্চি উত্তর দিল
— আসতে বল।
— সত্যি বলব?
নিঃস্পৃহ গলায় কুর্চি বলল
— বলো। তবে শর্ত থাকবে পড়া শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একসাথে বিয়ে আর পড়ার ঝামেলা আমি নিতে পারব না।

শিউলি দৌড়ালেন আদিবাকে ফোন করতে। মেয়েটা কেমন শুকনা মুখে ঘুরে বেড়ায় ইদানিং। কিছু একটা হয়েছে তো বটেই যেটা ও নিজের মা’কেও বলতে পারছে না বা চাইছে না। এখন ওর মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া দরকার। হয়ত বিয়ের তালগোলে পড়ে মন ভালো হয়ে যাবে।

ফোন কেটে দিয়ে উৎফুল্ল গলায় আরিয়ানকে ডাকলেন আদিবা। নিজের রুম থেকে বের হল আরিয়ান
— ডাকছিলে, মা?
— হ্যাঁ, সেট হয়ে গেছে।
— কী সেট হয়ে গেছে?
— তোর বিয়ে। আপা দেখা করবার জন্য সামনের শুক্রবারে যেতে বলেছেন।
— এ আবার কোন মেয়ে?
— কোন মেয়ে আবার কী? একটাই তো মেয়ে। সেই যে চাঁদনি চকে দেখেছিলাম।
— কুর্চি?
— হ্যাঁ, কুর্চি।
তারপরেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে
— তুই ওর নাম জানলি কিভাবে? তোকে নাম বলেছি বলে তো মনে পড়ছে না।
— বলোনি। আমি কুর্চিকে চিনি, মা।
— চিনিস! এতদিন বলিসনি কেন?

কাঁধ ঝাকাল আরিয়ান, উত্তর দিল না।
— কিভাবে চিনিস। বল না!
— শোনো মা, এসবের দরকার নাই। কুর্চি আমাকে বিয়ে করবে না। ও আমাকে দেখতে পারে না দুচোখে।
ওমনি গরম হয়ে গেলেন আদিবা।
— কেন বিয়ে করবে না? এত তেজ কিসের? আমার ছেলেকে রিজেক্ট করে! এত সাহস!
— তুমিই তো সেদিন বলেছিলে তেজি মেয়ে, আমাকে বিয়ে নাও করতে পারে। বলোনি?
— বলেছি। কিন্তু সেটা তো কথার কথা। সত্যি সত্যি কি আর বলেছি নাকি?
— ওয়েল! তোমার কথার কথাই এখন ফলে গেল। ও আমাকে বিশ্বাস করে না। বিয়ে তো করবেই না।
চিন্তিত দেখাল আদিবাকে
— ব্যপারটা কী খুলে বল দেখি। এই মেয়ের সাথে পরিচয় হলই বা কেমন করে, এতটুকু সময়ের মধ্যে রিজেক্ট হলিই বা কেমন করে খুলে বল দেখি। আমার ছেলেকে রিজেক্ট করে, মেয়ের বুকের পাটা দেখি কম না!
আরিয়ান বাধ্য হয়ে খুলে বলল মা’কে। সব শুনে আদিবা দ্বিগুণ উৎসাহে লাফিয়ে উঠলেন
— এ মেয়েকে আমি বৌ করে এনেই ছাড়ব।
আরিয়ান কিছুতেই মায়ের উৎসাহ দমিয়ে রাখতে পারল না। শেষে হাল ছেড়ে দিল
— যা ভালো বোঝো করো। তবে কুর্চি ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের কথা ভুলেও ভাববে না, মা।

কুর্চিদের বাসায় দুপুরের পর থেকেই সাজসাজ রব পড়ে গেছে। শিউলি ছোটাছুটি করছেন নাস্তার ব্যবস্থা নিয়ে, ড্রয়িং রুমের ডেকোর নিয়ে। উল্টে পাল্টে ইতিমধ্যে ড্রয়িংরুম রিডেকোরেট করে ফেলা হয়েছে। নাসিম সাহেব পড়েছেন মহা মুশকিলে। পেপার পড়বেন বলে সোফায় বসতে গিয়েই ধমক খেলেন। বসলে নাকি সোফা ব্যাকের ভাঁজ নষ্ট হবে, তাই মেহমান না আসা পর্যন্ত সোফায় বসা চলবে না!
শুধু ড্রয়িংরুম না, আরো নানান ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে অবশেষে কন্যার ঘরেই আশ্রয় নিলেন। করুণ মুখে কুর্চির ঘরের পর্দা সরিয়ে প্রশ্ন করলেন
— তোর রুমের পড়ার টেবিলে বসলে কোনোকিছুর ভাঁজ নষ্ট হবে না তো?

মায়ের ছোটাছুটি আর হাঁকডাক সবই কুর্চির কানে যাচ্ছিল। উপেক্ষা করার নিস্ফল চেষ্টায় বিছানায় আধশোয়া হয়ে সে শুচির “প্রেম নেই জীবনে” পড়বার বৃথা চেষ্টা করছিল।
বাবার কথায় সোজা হয়ে বসল
— বাবা, তুমি আমার বিছানায় শুয়ে আরাম করে পেপার পড়ো। আমি ওপাশে সরে যাচ্ছি।

বিছানার কোণে সরে গিয়ে নাসিম সাহেবকে জায়গা করে দিল।
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আরামের নিঃশ্বাস ফেলে পেপার মুখের ওপরে ধরলেন তিনি
— তোর মা এত এক্সাইটেড কেন?
কুর্চির কিছুই ভালো লাগছিল না। জেদের বশে মা’কে তো হ্যাঁ বলে দিয়েছে কিন্তু যতোই ওদের আসবার সময় এগিয়ে আসছে, ততোই কুর্চীর মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। যদি পছন্দ করে ফেলে তো কী হবে। কুর্চির পক্ষে কি সম্ভব হবে অচেনা আজানা লোককে বিয়ে করতে?

— বাবা, এই ভদ্রমহিলা আমাকে চাঁদনী চকে দেখে পছন্দ করেছিলেন। তারপর থেকেই ছেলের সাথে বিয়ে দেবার জন্য পাগল হয়ে গেছেন।
— আচ্ছা বুঝলাম। তিনি নাহয় পাগল হয়েছেন, তোর মাও আধাপাগল হয়েছে। কিন্তু তোর কী অবস্থা? তুই রাজি?
— জানি না, বাবা। মা বলল ভালো ছেলে, ভালো ফ্যামিলি, ধনী ফ্যামিলি। আজ এলে সামনাসামনি দেখা হবে, কথা হবে।
— হুম। নাকের ওপর থেকে পেপারটা নামিয়ে একপলক কুর্চিকে দেখে নিয়ে আবার চোখের সামনে মেলে ধরলেন নাসিম সাহেব।— দেখ মা। বিয়েটা কোনো হেলাফেলার ব্যপার না যে জামাকাপড় বাছাবাছি করতে করতেই বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তোর গলার স্বরে, চেহারায় আমি এতটুকু উৎসাহ বা আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছি না। তোকে এমনভাবে মানুষ করাও হয়নি। যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়ে বড় করা হয়েছে। তোর কোনো পছন্দ থাকলে বল। আমরা কথা বলি। এসব কাপড়ের দোকানদারের সাথে বিয়ে বসার দরকার নাই। ধনী হলেই সব হয়ে গেল নাকি?
কুর্চি হাসতে বাধ্য হল
— কাপড়ের দোকানদার না, বাবা! কাপড়ের দোকানে ছেলের মা আমাকে দেখে পছন্দ করেছেন।
নাসিম সাহেব নির্বিকার
— ওই একই কথা। খারা বড়ি থোর আর থোর বড়ি খাড়া। টাকা দিয়ে সবকিছুর বিচার হয় না। আসল কথা হচ্ছে ছেলে কেমন, কী করে। আদৌ কাজকর্ম কিছু করে নাকি বাবার হোটেলের ভরসায় আছে? যাক গে সেসব কথা। এখন বল, আছে পছন্দ?
কুর্চি নিশ্চুপ।
— বল মা। তোর মা খুব চেষ্টা করছে এটা একটা ফ্রেন্ডলি ভিজিট দেখাতে। তেমন কিছু না, জাস্ট পাঁচ মিনিটের জন্য আসবে, তোর সাথে দেখা সাক্ষাত হবে টাইপ। কিন্তু তার এক্সাইটমেন্ট এমন আকাশচুম্বী হয়েছে যে আমি এখন নিজের ঘরেই জায়গা পাচ্ছি না। তারমানে সে যথেষ্ট সিরিয়াস। কিন্তু আমি সিরিয়াস না। এ ব্যাপারে তোর মতামতটা সবার আগে প্রাধান্য পাবে। এখন তোর কথাটা শুনি।
কুর্চি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল
— আছে, বাবা। কিন্তু সে আমাকে চায় না।
নাসিম সাহেব পেপার টেপার ফেলে তড়াক করে উঠে বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আগুন হলেন
— এত বড় সাহস! আমার মেয়েকে চায় না! কুলাঙ্গার একটা!

কথা ছিল সন্ধ্যার পরপরই তারা এসে পড়বেন। কথার এতটুকু এদিক ওদিক করলেন না আদিবা।
সন্ধ্যা পার হতেই ইমরান সাহেবকে বগলদাবা করে চলে এলেন কুর্চিদের বাসায়। দুই মহিলা পরস্পরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেন কতদিনের পরিচিত। নাসিম সাহেব অবশ্য ইমরান সাহেবকে জড়িয়ে ধরলেন না, শুধু ইমরান সাহেবের হাতে ধরা বড় মিষ্টির প্যাকেটটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন।
সবাই বসবার পরে শিউলি প্রশ্ন করলেন
— কই আপা, ছেলেকে দেখছি না।
— আসছে, আপা। গাড়ি পার্ক করছে। এসে পড়বে। কই, কুর্চি মা’কে দেখছি না তো।

শিউলি যথেষ্ট পরিমাণে ব্যস্ত হলেন
— কুর্চি! কুর্চি! রুমেই আছে, আপা। আমি যাই, নিয়ে আসি।
রুমে ঢুকে ডাকলেন
— কুর্চি।
আয়নার সামনে রেডি হচ্ছিল কুর্চি। মায়ের ডাকে ঘুরে দাঁড়াল। ওরদিকে এক পলক তাকালেন শিউলি। তারপর তাকিয়েই রইলেন
— তুই এ ছেলেকে বিয়ে করবি না, তাই না?
কুর্চি কেঁদে ফেলল
— না, মা। পারব না।
রুষ্ট ভঙ্গিমায় খানিক দাঁড়িয়ে রইলেন শিউলি। তারপর সহজভাবেই বললেন
— আচ্ছা, না পারলে না পারবি। পারতেই হবে, এমন জোরাজুরি তো নাই। কিন্তু একথাটা আমাকে আগে বললি না কেন? আমি কি তোর শত্রু?
শিউলিকে জড়িয়ে ধরল কুর্চি। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শিউলি প্রশ্ন করলেন
— কাকে পছন্দ তোর?
— কাউকে না।
— কাউকে তো বটেই। নাহলে চোখমুখের এমন অবস্থা হয়! বল কাকে পছন্দ, আমরা কথা বলি।
কুর্চি কাঁদতে কাঁদতে বলল
— বলে লাভ নাই, মা। সে আমাকে পছন্দ করে না।
বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন শিউলিও
— এত বড় সাহস! কে সে? নিয়ে চল আমাকে ওর কাছে।
কুর্চি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে
— আচ্ছা আচ্ছা, এখন আপাতত চল তো। উনাদের সামনে এক দেখা দিয়েই তুই ফিরে আসিস। আমি কিছু একটা ছুতা বের করে বলব যে ছেলে আমাদের পছন্দ হয়নি বা অন্যকিছু।
— মা! কিন্তু তুমি তো ছেলেকে পছন্দ করেছ!
— আমি পছন্দ করলে কী এসে যায়। সংসার তো করবি তুই। নে, মুখ ধুয়ে নে, একটু পাউডার দে। সব মুছে গিয়ে কী অবস্থা হয়েছে।

কুর্চিকে সাথে নিয়ে শিউলি ড্রয়িং রুমে ফিরে এলেন। সালাম বিনিময় হবার পর সবাই ঠাণ্ডা হয়ে বসতে না বসতেই দরজা দিয়ে ঢুকল এক যুবক। তাকে প্রথমে দেখলেন শিউলি। একটু কনফিউশানের সাথে বললেন
— আপা, এই আপনার ছেলে বুঝি?
এতদিন ধরে আদিবার সাথে কথা চলছে কিন্তু শিউলি মেয়ের বেঁকে বসা দেখে ছেলের ছবি বা সিভি কোনোদিন সাহস করে চাইতে পারেননি। চাইলে যদি আদিবা সেটাকে আগ্রহ বলে ধরে নেন! এখন তার আফসোস হচ্ছে। ছেলের একটা ফটো অন্তত দেখে রাখলে ভালো হত।
কিন্তু আপা জবাবও দিতে পারলেন না, তার আগেই কুর্চি লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল
— রুবেল!
রুবেল কুর্চির দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলবার চেষ্টা করল কিন্তু চান্স পেল না!
— রুবেল! তুমি জেনেবুঝে আমাকে দেখতে এসেছ! ছোটলোক, ইতর কোথাকার।
— আহ, গালি দিও না তো, কুর্চি! কথা শোনো।
— গালি তো অনেক কমই দিলাম। যেসব গালি দিতে ইচ্ছা করছে, সেগুলির কিছুই দিতে পারছি না। কোন সাহসে আমাকে দেখতে আসো? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? অসম্ভব! মা এ ছেলেকে বিয়ে করা অসম্ভব।
— ট্রাস্ট মি, কুর্চি। আমি তোমাকে দেখতে আসিনি। আন্টিকে জিজ্ঞেস করো।
কুর্চি তখন এতোই উত্তেজিত যে ভালোমতো শুনলও না
— আন্টি! মা’কে আন্টি বলো তুমি?

কুর্চির কান্ড দেখে শিউলি আর নাসিম সাহেব স্তম্ভিত হয়ে বসে ছিলেন। শিউলি আবার জিজ্ঞেস করলেন
— আপা, এ আপনার ছেলে?
কুর্চি আদিবাকে কথাই বলতে দিল না
— যার ছেলেই হোক, এ ছেলেকে বিয়ে করা অসম্ভব। পৃথিবীর শেষ ছেলে হলেও সম্ভব না।
রুবেল একটা কথা বলতে চাইছিল। কুর্চির কথা শুনে সেও তেরিয়া হয়ে গেল
— আমিই বা তোমাকে কোন বিয়ে করার জন্য নাচছি? আমার পক্ষেও অসম্ভব। তুমি পৃথিবীর শেষ মেয়ে হলেও সম্ভব না।
নাসিম সাহেব এতক্ষণে মুখ খুললেন
— তাহলে ত সমস্যার সমাধান হয়েই গেল। মানবজাতি বিলুপ্ত হলেও এরা বিয়ে করবে না!
রুবেল কপালে হাত দিয়ে অসহিষ্ণু ভঙ্গী করল
— কুর্চি, তোমার ড্রামা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করবে? জরুরী কথা ছিল। আলাদাভাবে বলতে হবে, সবার সামনে না।

শিউলি পুরা ব্যাপারটাই ভুল বুঝলেন। তিনি রুবেলকেই কুর্চির ভালোবাসার জন ভেবে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন
— গেস্টরুমে গিয়ে কথা বলতে পারো তোমরা।
কুর্চি তখনো হাঁপাচ্ছিল
— না! ওখানে কথা বলি আর তোমরা সবাই আড়িপেতে শোনো আরকি।
— বিশেষ করে আড়িপাতার অভ্যাস যখন তোমার খুবি আছে!
রুবেল খোঁচা মারতে ছাড়ল না।
কুর্চি কোনো কথা না বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল
— চলো ছাদে।
রুবেলের চেহারায় হুট করে হাসি দেখা গেল
— সেই ভালো। চল।

দুজনে বের হয়ে যাবার পর আদিবা কথা বলার চান্স পেলেন
— কিন্তু আপা, এ তো আমার ছেলে না।
— অ্যাঁয়! তাহলে কার ছেলে?
— জানি না, আপা। আমার না, এতটুকুই জানি। ভয়ের কিছু নাই। আপনার মেয়ে তাকে চেনে বলেই মনে হল।
( আগামী পর্বে সমাপ্য)

কখনো কুর্চি পর্ব-১৩

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ১৩)

একটা কথা কুর্চির জানতে খুব ইচ্ছা করল। জোড়া খুনের সাজা কি এক খুনের চাইতে বেশি হয়? যদি তেমন উনিশ বিশ নাহয় তবে ও আরিয়ান লুবনা দুজনকেই খুন করবে।
ফাজলামি হচ্ছে!
কাজ করবে সে আর “লুবনাও আমাদের সাথে থাকবে” করবে এরা!

আরিয়ানের কথার কোনো জবাব দিল না কুর্চি। উঠে দাঁড়িয়ে বলল
— শুচিকে নিয়ে আসতে হবে।
বলে আরিয়ানের অপেক্ষা না করেই ওয়েটিং এরিয়ায় বেরিয়ে এল। ওর পিছে কে এলো, কে এলো না, জানার দরকার নেই। এতোটাই রাগ লাগছে ওর। শুধু কি রাগ? আশাও কি ভঙ্গ হয়নি?
থামো! এনিয়ে আর একটা কথাও না। কেক খাওয়াখাওয়ির এখানেই শেষ। আর কখনো যেন না দেখি এসব। নিজেকে কঠিনভাবে বকল কুর্চি।

শুচি ওকে দেখে হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল। ও শুধু কুর্চিকে চেনে, ওকে দেখে হাসল, বাকি দুজনকে চেনেও না। কুর্চি পরিচয় করিয়ে দিল
— এ আমার সহ ইন্টার্ভিউয়ার, আরিয়ান। আর ও হচ্ছে লুবনা। সেও আমাদের সাথে থাকবে আজ।
ওর পরিচয় দেবার বহর শুনে বাকি দুজনের চোখ কপালে উঠে গেল। কুর্চি গ্রাহ্য করল না। আজ ও কাউকে ছাড়বে না। সব কয়টা বিশ্বাসঘাতককে একেবারে ধুয়ে দেবে।
তাতে ওর চাকরি থাকল কি গেল, ফিরেও দেখবে না।

সবাই রেকর্ডিং স্টুডিওতে গিয়ে গোল টেবিলে বসল। রুবেল ইঙ্গিত করল শুরু করতে।
ওপেনিং সাধারণত আরিয়ানই করে। আজকেও শুরু করল।
— হাই লিসেনার্স, আরিয়ান বলছি। আমার সাথে বরাবরের মতো রয়েছে আমার কোহোস্ট কুর্চি। সাথে আরেকজন সারপ্রাইজ হোস্ট রয়েছে। বলতে পারবে কার কথা বলছি? যে বলতে পারবে তাকে এক কপি “প্রেম নেই জীবনে” গিফট করা হবে। প্লিজ লিসেনার্স, তোমরা কমেন্ট করো।

কমেন্টের হিড়িক পড়ে গেল, অনেকে অনেক নাম লিখল কিন্তু লুবনার নাম কেউ লিখল না। কুর্চি আশ্চর্য হয়ে দেখল এ একমাসে সবাই লুবনার নাম ভুলেই গেছে। এদিকে নিজের নাম দেখতে না পেয়ে লুবনা মুখ কালো করে বসে রইল।
— হল না, লিসেনার্স, তোমাদের মধ্যে কেউ সঠিক উত্তরটা দিতে পারোনি। আজ আমাদের সাথে কো কোহোস্ট হিসাবে রয়েছে ড্রিমজ রেডিওর ড্রিমার আমাদের অতিপ্রিয় লুবনা। লিসেনার্স, ব্যক্তিগত কারণে লুবনা কিছুদিনের জন্য হোস্টিং থেকে দূরে সরে গেছিল। কিন্তু আর না, আমরা আজ থেকে আবারো ফিরে পাচ্ছি আমাদের প্রিয় লুবনাকে।

কুর্চি আর সহ্য করতে পারল না। পনের মিনিট পার হয়ে গেছে। আরিয়ানের লুবনা গাঁথা এখনো শেষই হল না।
মেকি হাসি হাসল কুর্চি। আরিয়ানের মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বলতে আরম্ভ করল
— আরিয়ান, লুবনাকে নিয়ে এতক্ষণ সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না হয়ত। আমাদের আসল গেস্টের সাথে এখনো সবাইকে পরিচয়ই করিয়ে দেয়া হল না। যারজন্য আমি, তুমি, আমাদের লিসেনার্স সবাই অধীর আগ্রহে বসে রয়েছি। তো শোনো লিসেনার্স, আজকের গেস্ট হচ্ছে আমারি ইউনিভার্সিটির একজন স্টুডেন্ট। তবে স্টুডেন্ট হলেও সে একজন লেখক। সম্প্রতি তার বই, “প্রেম নেই জীবনে” প্রকাশিত হয়েছে। শুধু প্রকাশিত বলছি কেন, তরুণ তরুণীর মাঝে ভালো সাড়া ফেলে দিয়েছে। তোমাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আজকের আসল গেস্টের সাথে— শুচি।
“আসল” কথাটার ওপরে জোর দিয়ে ওপেনিং স্টেটমেন্ট শেষ করে আরিয়ানের দিকে তাকালো কুর্চি। দেখে আরিয়ানের মুখ থমথমে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওরদিকে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাত করে যেন বুঝে ফেলল কিছু। কুর্চি বুঝে নিল আরিয়ান বুঝেছে কুর্চি ওদের সবকথা শুনেছে।
বুঝুক গে। ওর কিছু এসে যায় না।

এদিকে আরিয়ান আর কুর্চি পরস্পরের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে দেখে শুচি খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। ও কি কিছু বলবে নাকি বলবে না বুঝে পেল না।
হাল ধরল লুবনা
— হাই লিসেনার্স, লুবনা হিয়ার। আমার কথা নিশ্চয় ভুলে যাওনি সবাই? তবে আমি নিজের কথা না বলে আমাদের গেস্ট শুচির সাথে কথা আরম্ভ করি। আচ্ছা শুচি, তোমার বইটা নিয়ে একটু বলবে আমাদের?
শুচি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল
— নিশ্চয় বলব। আমার প্রেম নেই জীবনে বইটা মূলত খুব কাছে থেকে দেখা এক ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। এখানে নায়ক নায়িকা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ওদেরমাঝে একসময়ে ঘটে গেল প্রেম। কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাট প্রেম আর হল না কারণ মাঝখানে ঢুকে পড়ে আরেকজন নারী।

কুর্চি খোঁচা না মেরে থাকতে পারল না
— সে নারী নিশ্চয় বিবাহিত?
— না।
— নায়কের পূর্ব প্রেমিকা?
— না।
— নায়িকার শত্রু?

লুবনা কথার মাঝে ঢুকে গেল। শ্লেষের সাথে বলল
— শুচিকে বলবার চান্স দিলেই বোঝা যাবে সে কে? তাকে যদি কথা বলতেই না দেয়া হয়…
গোমড়ামুখে কুর্চি জবাব দিল
— এখানে বোঝার কি আছে? নায়ক নায়িকার মধ্যে যে ঢুকে পড়ে সে সাধারণত হয় বিবাহিত নাহয় নায়কের পূর্ব প্রেমিকাই হয়। এদের তো খেয়েদেয়ে আর কাজ নাই। অন্যের প্রেম ধ্বংস করা, অন্যের ক্যারিয়ার ধ্বংস করাই এদের জীবনের একমাত্র লক্ষ। এইম ইন লাইফ।
আরিয়ান হতবাক হয়ে ইন্টার্ভিউ এর গতিপথ দেখছিল। এবারে ধমকে উঠল
— তাদের এইম ইন লাইফ কী, সেটা নাহয় আমরা শুচির মুখ থেকেই শুনি। তুমি যেদিন বই বের করবে, সেদিন শুনব তোমার গল্প।

শুচি নিজেও এতক্ষণ হাঁ করে সবার কথা গিলছিল। মুখ দেখে মনে হয় ওর ইন্টার্ভিউ দেবার শখ শেষ হয়ে গেছে। তারপরেও খাঁটি প্রফেশনালের মতোই আচরণ করল
— আসলে তৃতীয় জন জীবনের এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। একসময়ে জড়িয়ে পড়ল নায়কের সাথে। তার আসলে দোষ ছিল না। পরিস্থিতির শিকার।
গায়ে গরম পানির ছিটা পড়ার মতো চিড়বিড়িয়ে উঠল কুর্চি
— হুহ! পরিস্থিতির শিকার! এসব সবাই বলে। এসব বলে যাখুশি তাই করার লাইসেন্স পেয়ে যায়।
এতে লুবনা খুবি অফেন্ডেড হল
— তুমি জানো তার জীবনে কী চলছে? হুট করে একটা জাজমেন্ট পাস করে দিলেই হল নাকি?
গোঁয়ারের মতো বলল কুর্চি
— খুব ভালো করেই জানি। সব নষ্টের গোড়া এরা। সবজায়গায় ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস সেজে সহানুভূতি কুড়ানোর জন্যই এদের জন্ম।

এবারে শুচি একটু শক্তভাবে নিজের দিকে এটেনশান ফিরিয়ে আনল
— আসলে সেকেন্ড যে নায়িকা তাকে আমি ড্যামসেল ইন ডিসট্রেস বানানোর চেষ্টা করিনি। চরিত্রের দিক দিয়ে সে বেশ মজবুত, শুধু পরিস্থিতি ওর আয়ত্তে নেই আরকি। নায়কও পড়েছে বিপাকে। সে মেইন নায়িকাকে সব খুলে বলতে পারছে না, এদিকে সেকেন্ড নায়িকার প্রতি একধরণের দায়িত্ববোধও ফিল করছে।
— তারমানে নায়কটা একটা লুচ্চা। দুই নায়িকাকে নাচাচ্ছে।

মুখ লাল হয়ে গেল আরিয়ানের। ভালুকের মতো গাঁকগাঁক করে উঠল
— মোটেই সে লুচ্চা না। মানুষের জীবনে এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে।
পাথর চোখ নিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল কুর্চি
— আচ্ছা আরিয়ান, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। তুমি তো ছেলে, তাই না?
— সন্দেহ আছে কোনো?
— সেটা প্রশ্নের উত্তরই বলে দিবে। আচ্ছা, তোমরা ছেলেরা নিজেদের কী ভাবো বলো তো? মেয়েদের জন্য একটা বিরাট কিছু? দুইটা মেয়েকে নাচাতে খুব ভালো লাগে, তাই না?
ভয়ংকর খেপল আরিয়ান। চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিল
— এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না কারণ প্রশ্নের সাথে আমাদের আজকের ইন্টার্ভিউয়ের কোনো সম্পর্ক নাই।
— অবশ্যই আছে। শুচি নিজেই বলেছে ওর নায়ক দুই নায়িকাকে নাচাচ্ছে।

— ইয়ে কুর্চি, আমি আসলে এমন কথা বলিনি। আমার বইয়ের নাম প্রেম নেই জীবনে দিয়েছি এক বিশেষ কারণে। সবার জীবনে প্রেম আসে না। এখানে তিনজনের মধ্যে একজনের জীবনে প্রেম আসেনি। তবে সেটা কে, আমি জানাবো না। তাহলে স্পয়লার হয়ে যাবে।
আজ কুর্চির মুখের জবাব একেবারে তৈরি, বুলেটের মতো বের হচ্ছে শুধু। বলল
— সে যে কে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। আসল নায়িকার জীবনে প্রেম নাই, সব প্রেম ঝরে ঝরে পড়ছে নায়কের জীবন থেকে!
আরিয়ান ক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল
— নায়কের জীবনে প্রেম না এলেই সবচাইতে ভালো কারণ প্রেমের মতো জঘন্য জিনিস আর নাই।
কুর্চির প্রতিউত্তরও রেডি ছিল
— মেইন নায়িকার জীবনেও দরকার নাই। বরং সব প্রেম সাইড নায়িকার জীবনেই আসুক। প্রেমের সাগরে ডুবে মরুক সে!
আতংকিত দেখালো শুচিকে
— প্লিজ, আমার বইয়ের স্পয়লার দিও না কেউ।

রুবেল এতক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে কথোপকথন শুনছিল। ধীরে ধীরে আসল ব্যপারটা ওর কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল। এখন শুচিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলল
— চিন্তার কোনো কারণ নেই, শুচি। তোমার বইয়ের সেল সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে এইমাত্র খবর পেলাম। আজকের প্রোগ্রাম শুনে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বইটা কিনতে।

কান থেকে হেডফোন খুলে টেবিলের ওপরে ছুঁড়ে ফেলল কুর্চি
— তাহলে তো উদ্দেশ্য সফল হয়েই গেল। অভিনন্দন তোমাকে, শুচি। আর এরসাথেই শেষ হল আজকের ইন্টার্ভিউ।
কুর্চি উঠে দাঁড়িয়ে গটগট করে হেঁটে বের হয়ে গেল অফিস থেকে।
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-১২

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ১২)

শুক্রবারে একটু আগেই গিয়ে পৌছাল কুর্চি। এ ওর অভ্যাস। সময়ের আগে গিয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়, স্টুডিওটাও ফিটফাট করে নেয়, তারপরে গেস্টের জন্য অপেক্ষা করে। এরমধ্যে আরিয়ান, রুবেল, মিলন এসে পড়ে, ওরা একসাথে চা খেতে খেতে কথা বলে। তারপর গেস্ট এলে ইন্টার্ভিউ শুরু করে দেয়।

আজকে গেস্ট হিসাবে আসবে শুচি। পদবী রাখেনি, শুচি নামেই লেখক হিসাবে পরিচিত হতে চায় ও। সেদিন ইউনিতে গিয়ে শুচির নাম্বার জোগাড় করে ওরসাথে কথা বলে নিয়েছিল কুর্চি। শুনে শুচিও খুব আগ্রহ দেখিয়েছে, তখুনি দেখা করতে চলে এসেছে, বইও উপহার দিয়েছে ওকে। ওর বইটার কয়েক পাতা পড়ে দেখেছে কুর্চি। বেশ সাবলীল লেখা, ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের নিয়ে লেখা, এজন্যই তরুণদের মাঝে সাড়া ফেলে দিয়েছে।
বইটা পড়ার সাথেসাথে কী কী প্রশ্ন করলে ইনটার্ভিউটা সুন্দর হয় সেটার একটা লিস্ট করে আরিয়ানকে পাঠিয়ে দিয়েছিল ও। আরিয়ান নিজেও কিছু প্রশ্ন সাজেস্ট করেছিল। দুটো মিলিয়ে ফাইনাল প্রশ্নের লিস্ট করে দুই কপি সাথে নিয়ে এনেছে। এসব আসলে মিলনের করার কথা। কিন্তু মিলন যেহেতু আর নাই তাই ও নিজেই করে এনেছে।

অফিসে ঢুকে একটু আশ্চর্য হল কুর্চি। খালি অফিস। রিসেপশান ডেস্কে সিঁথি নাই। ওয়েটিং এরিয়াও ফাঁকা। আজকে কি রাকীব স্যার আসেননি? যারজন্য ওয়েটিং এরিয়াতে কেউ অপেক্ষা করে নাই? উনি না এলেও সিঁথিই বা গেল কোথায়? অসুস্থ নাকি? কাজে আসেনি?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রেকর্ডিং স্টুডিওর দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজার নবে হাত দিবে, আশপাশের কোথাও গলার আওয়াজ শোনা গেল।
কেউ কথা বলছে? নাকি কাঁদছে?
কান খাড়া করল কুর্চি।
আজব তো। সত্যি মনেহয় কেউ কাঁদছে। শব্দটা ভেতর থেকেই আসছে।

রেকর্ডিং এ না ঢুকে কোরিডোর ধরে এগিয়ে গেল কুর্চি। কোরিডোরের শেষ মাথায় পরপর দুইটা রুম। শেষের রুমটা রাকীব স্যারের। তার আগের রুমটা মিটিং রুম হিসাবে উনি ব্যবহার করেন মাঝেমাঝে। এমনিতে ফাঁকাই পড়ে থাকে। সেখান থেকেই শব্দটা আসছে। কুর্চি দ্রুতপায়ে এগিয়ে যেতেই কানে এলো
— কুর্চিকে চলে যেতে হবে, আরিয়ান।
কুর্চি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
লুবনা!
কান্নামেশানো গলায় আরিয়ানের সাথে কথা বলছে।
— কী বলছ তুমি, লুবনা?

কুর্চি এমনই আশ্চর্য হয়েছে যে গলা দিয়ে অজান্তেই আর্তনাদ বেরিয়ে আসছিল। কোনোমতে মুখে হাত চাপা দিয়ে সেটা বন্ধ করল। একবার ভাবল ফিরে যায়। আড়িপাতা কোনো ভালো কাজ না। এতে ভালো কিছু শোনবার আশা নাই। কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলালো। ওকে শুনতে হবে। ও জানপ্রাণ দিয়ে খাটবে আর এরা তলেতলে ওকেই ফিনিশ করে দেবার মতলব করবে আর ও বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকবে, সেটি হচ্ছে না!
সাহস থাকলে সামনে আয়। দেখ লেঙ্গে!
শেষের কথাটি আরিয়ানের উদ্দেশ্যেই বলল অবশ্য।
আরিয়ান সারা সপ্তাহ ধরে ওকে গাধার খাটুনি খাটিয়েছে। নাকের ডগায় ফাইনাল নিয়ে কুর্চি আরিয়ানের কথামতো কাজ করতে গিয়ে মাথাকাটা মুর্গীর মতো চারিদিকে দৌড়ে বেড়িয়েছে। এখন এদিকে ন্যাকামি করে “কী বলছ তুমি, লুবনা!” করা হচ্ছে।

আচ্ছা, সেও দেখে নেবে!
যদি আর কোনোদিন ও স্বপ্নেও আরিয়ানের হাত থেকে কেক খেয়েছে তো নিজের নাম বদলে রাখবে।
কেক কেন, পেস্ট্রি, চকোলেট, একলেয়ার, পাই কিছুই খাবে না কখনো!
লাঠি বিস্কুটও না!
প্রেমও করবে না ওরসাথে!! কঠিন শপথ নিল কুর্চি।

করিডরের দিকের দেয়ালে কাচের জানালা রয়েছে, সেটার কোণে পাম ট্রি সাজানো ছিল। কুর্চি গিয়ে পাম ট্রির আড়ালে লুকিয়ে শুনতে থাকল।
লুবনা টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছল
— ঠিকই বলছি আমি, আরিয়ান। মিলন তো চলেই গেছে। ওর জায়গাটা ফাঁকা হয়েছে। যেটার জন্য কুর্চিকে আনা হয়েছিল। এখন কুর্চি তাই করবে।
— গতদিন রাকীব স্যারের সাথে আবার আমি কথা বলেছি, লুবনা। রাকীব স্যার…
— আমি কিছু শুনব না, আরিয়ান। ড্যাডি আমাকে স্টুডিওতেই আসতে মানা করে দিয়েছে।
— সেটা উনার রাগের কথা, লুবনা।
— না, ড্যাডিকে তুমি চেন না। আমাকে বারবার মানা করেছিল রাফাতকে বিয়ে না করতে। রাগ করে আমি পালিয়ে বিয়ে করলাম, সে এখন শোধ তুলছে।
— আরে পাগল নাকি? উনি তোমার বাবা, শোধ তুলবেন কেন?
— ড্যাডি এবারে সত্যি রাগ করেছে আমার ওপরে। তার কথা শুনিনি, তার অমতে পালিয়ে থাইল্যান্ড চলে গেলাম। কিন্তু এখন বুঝছি কেন বারবার এমন করে মানা করছিল।
— কেন?
— রাফাত একটা ভ্যাগাবন্ড। সপ্তাহখানেকের মধ্যে টের পেলাম ও ড্রাগ এডিক্টও। ও আমাকে সোনার ডিম পাড়া হাঁস ভেবে বিয়ে করেছে। চালচুলা কিছু নাই। আমাকে যা বলেছিল সব মিথ্যা।
— সে কি! তুমি টের পাওনি?
— কিছুই টের পাইনি, আরিয়ান। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু হয়ে গেছিল যে পরিস্কার মাথায় চিন্তাও করবার সুযোগ পাইনি। ড্যাডির সাথে জেদ করে বিয়েটা লুকিয়ে করলাম। রাফাত আমাকে ইম্প্রেস করতে এমন এমন সব খরচ করত, এত সারপ্রাইজ দিত, আমি পুরাই পাগলে গেছিলাম। বিয়ের পর জানতে পারলাম ধার করে করেছে এসব।
— তাহলে থাইল্যান্ড…
— সম্পূর্ণ সময় আমি খরচ করেছি। ওরকাছে ফুটা পয়সাও নাই। এনাফ ইজ এনাফ। এই জগদ্দল পাথরকে বয়ে বেড়ানোর কোনো ইচ্ছা আমার নাই। আমার জীবনের ওয়ার্স্ট ডিসিশান হচ্ছে রাফাত। ভুল করেছি আমি কিন্তু ভুল শুধরেও ফেলব।
— তুমি কি…
— হ্যাঁ আরিয়ান। ভুল করে অনর্থক মাশুল দেবার মতো মধ্যবিত্ত মেন্টালিটি আমার নাই। মাই ম্যারিজ ইজ নট ওয়ার্কিং আউট। এখন রাফাতকে ডিভোর্স দিব। দিয়ে আবার আগের মতোই ব্যস্ত হয়ে পড়ব। ড্যাডিকে বোঝাতে হবে আমাকে। তুমিও আমাকে হেল্প করো না প্লিজ।

আরিয়ানের দিকে জলভরা চোখ তুলে তাকালো লুবনা। ওর বড় বড় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
হঠাত করে রেগে গেল আরিয়ান। তিক্তস্বরে বলল
— তোমার এই এক অভ্যাস, লুবনা। বারবার ভুল করবে আর রাকীব স্যারের কাছে দৌড়াবে। ইউনিতেও এমন করেছিলে। মনে আছে সেই ছেলেটার কথা? আরেকটু হলে সে তোমাকে হয়ত কিডন্যাপই করে ফেলত। ভাগ্যিস তখন রাকীব স্যারের ড্রাইভার লোকজন জড়ো করে তাকে রাম ধোলাই দিয়েছিল। নাহলে সেদিন একটা যা তা ব্যপার হত।
এবারে তো কেউ জানতেও পারেনি। প্রতিবার তুমি ভুল করবে, বাবার কাছে দৌড়ে যাবে আর আশা করবে তিনি তোমাকে উদ্ধার করবেন। এভাবে জীবন চলে, লুবনা? তুমি একজাক্টলি কী চাও? কেন এভাবে নিজের জীবনটা বাজে খরচ করছ? রাকিব স্যার যে এবারে একদম বেঁকে বসেছেন, আমি তাকে খুব একটা দোষ দিতে পারছি না।
টেবিলের ওপর বসেছিল লুবনা, আরিয়ান সামনে দাঁড়িয়েছিল। এখন ওর কথার মাঝেই লুবনা লাফ দিয়ে টেবিল থেকে নেমে পড়ল। তারপর দুহাতে আরিয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল
—এখন ড্যাডিও আমার কথা শুনছে না, আরিয়ান। একমাত্র তুমিই আছ যে আমার কথা শুনবে। আমি সব আবার আগের মতো চাই। তুমি আমি একসাথে কাজ করব। কুর্চিকে সরিয়ে দাও। প্লিজ, প্লিজ আরিয়ান! হেল্প মি। দুজনে মিলে ড্যাডিকে বললে সে রাজি হয়ে যাবে। সে তোমার কথাকে আমার চাইতে বেশি ইম্পর্ট্যান্স দেয়।

কুর্চি এদের কথার মাঝে এমনভাবে ডুবে গেছিল যে কখন শরীরের পুরা ভর ছোট পাম গাছটার ওপরে দিয়ে ফেলেছিল, টেরও পায়নি। এখন পাম গাছটা ভার নিতে না পেরে সশব্দে টবশুদ্ধ উলটে পড়তেই প্যানিক করে ছুটে গিয়ে স্টুডিওতে ঢুকে পড়ল ও। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সিঁথি এসে খবর দিল যে শুচি এসেছে।
— আরিয়ানকে ডাকো।
কুর্চির থমথমে মুখ দেখে ভুরু উঠিয়ে সিঁথি জানতে চাইল কী হয়েছে। কুর্চি জবাব দিল না। দরজা দিয়ে ঢুকল রুবেল। তার কিছুক্ষণের মধ্যে সিঁথি আরিয়ানকে ডেকে আনল। সাথে লুবনা।
আরিয়ান টেবিলে বসতেই কুর্চি স্মরণ করিয়ে দিল
— শুচি এসে অপেক্ষা করছে কিন্তু।
— জানি। শোনো কুর্চি। কথা আছে তোমার সাথে।
পাথর মুখে জবাব দিল কুর্চি
— বলো।
— আজ আমাদের সাথে লুবনাও থাকবে, কেমন? মানে আমরা তিনজনে মিলে শুচির ইন্টার্ভিউ নিব!
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-১১

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ১১)

রাত্রে আরিয়ানের মেসেজ এল
— কুর্চি, নেক্সট কাকে গেস্ট হিসাবে আনা যায়, সেনিয়ে আলোচনা করা দরকার।
মেসেজ পেয়ে কুর্চি খুবি আশ্চর্য হয়েছিল। ওর ধারণা করে নিয়েছিল লুবনা আর আরিয়ানই হয়ত এখন থেকে ইন্টার্ভিউ এর কাজ করবে। রাকীব স্যারের রুম থেকে আরিয়ানের গনগনে মুখে বের হবার পর এমন ধারণা করা খুবি স্বাভাবিক। রুবেলও তো সেরকম আভাস দিয়েছিল সেদিন। উপরন্ত সিঁথির সাথে কথা বলে আরেক দিক শুনল। সিঁথি বলেছিল
— লুবনা কিন্তু খুব পজেসিভ। সেটা পছন্দের মানুষ হোক বা নিজের জায়গা হোক। তোমাকে তো মিলনের রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে আনার কথা হচ্ছিল। সেখানে তুমি লুবনারই জায়গা দখল করে নিলে। লুবনা তোমাকে ছাড়বে না, কুর্চি।
— সে কি! মিলন কেন? তাহলে মিলন কী করবে?
— জানো না বুঝি? মিলন তো বিদেশে পড়বার জন্য ট্রাই করছে। কিছুদিনের মধ্যে চলেও যাবে। ও রেজিগনেশান দিতে সে জায়গা পূরণ করবার জন্য তুমি ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছিলে।
— কিন্তু আমাকে তো স্ক্রিপ্ট পড়তেও দিয়েছিল। ভেবেছিলাম…
— কিজানি। হয়ত সামনে কখনো অন এয়ারে দিত। কিন্তু তোমার মেইন কাজ হত মিলনকে রিপ্লেস করা। তো লুবনা যখন উধাও হল, তখন আরিয়ান মিলনকে রিকোয়েস্ট করে আরো কিছুদিন থেকে যাবার জন্য বলেছিল।
একটু চুপ করে রইল সিঁথি। তারপরে চুপিচুপি বলল
— কাউকে বোলো না কিন্তু রুবেলও লুবনা ফিরে আসাতে বেশি খুশি না। সেও অন্য কোথাও কাজ খুঁজছে।

এর উত্তরে কিছু বলল না কুর্চি। সেদিন লুবনার ব্যবহারে রুবেলের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেয়েছিল কয়েকবার। লুবনা যেন ওকে কীট পতঙ্গের সমান মনে করছে, এমন ভাব। রুবেল যদি জব চেঞ্জ করতে চায় তো আশ্চর্য হবার কিছু নাই। কাজের ক্ষেত্রে সম্মান সবাই ডিজার্ভ করে। কাজের সময় রুবেল নিজেই আরিয়ানের চাইতে কোনো অংশে কম সিরিয়াস না।

যাই হোক, এসব বিবেচনা করে ও ভেবে নিয়েছিল যেকোনো সময় আরিয়ান বা রাকীব স্যার ওকে ডেকে নিয়ে পিঠ চাপড়ে বলবে
— এতোদিন তুমি খুব ভালো কাজ দেখিয়েছ। এজন্য তোমাকে কেয়া কসমেটিক্সের পক্ষ থেকে গিফট দেয়া হবে। আর হ্যাঁ শোনো, আজ থেকে মিলন আর আসবে না। তুমি ওর কাজগুলি একটু দেখে দিও।
এভাবেই ওকে ইন্টার্ভিউ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। তারপর লুবনা সেখানে একাই রাজত্ব করবে।
সেরকম যখন হবে, তখন কুর্চি কী করবে এখন পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারেনি। এমন না যে মিলনের কাজ করতে ওর আপত্তি আছে। সত্যি বলতে কী, শুরু থেকে সে মিলনের ওপরে নির্ভর না করে নিজেই ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্ক যথাসম্ভব করে এসেছে। কিন্তু লুবনা যদি আশা করে যে ও ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্কের সাথেসাথে ওদের চা কফিও পরিবেশন করবে তাহলে সেখানে আপত্তি রয়েছে কুর্চির। অফিসের প্রত্যেকের নিজস্ব হাত পা রয়েছে, তারা নিজেদের চা নিজেরাই বানিয়ে নিতে পারবে। কিচেন রয়েছে, সেখানে নিজের জন্য চা কফি বানিয়ে নেয়া এমন কঠিন কাজ কিছু না। যেখানে কুর্চি নিজের বাসায় নিজেরি চা ঢেলে খায় না, সেখানে অন্যদের বানিয়ে খাওয়াবে, এ আশা করা একটু বেশিবেশি হয়ে যাবে লুবনার পক্ষে।

বাকি থাকল ইন্টার্ভিউ এর ব্যপারটা। এনিয়ে ভেবে দেখেছে কুর্চি, কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। প্রথম দিন থেকে যদি মিলনের রিপ্লেসমেন্ট হত ও, তাহলে হয়ত ওরদিক থেকে আপত্তি হত না। কিন্তু এখন? একবার ইন্টার্ভিউ নিতে আরম্ভ করে ও এত মজা পেয়ে গেছে যে পুরা প্রসেসটাই ও অসম্ভব উপভোগ করে। গেস্ট নির্বাচন থেকে তাদের সাথে কথা বলে তাদেরকে রাজি করানো, তাদের সম্বন্ধে ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফো ঘাটা, তাদের কম্ফর্টেবল করা— সবকিছুই সে এঞ্জয় করে। এবং কাজটা সে ভালোমতোই পারে। লিসেনার্সরাও ওকে পছন্দ করে। এতটুকু কনফিডেন্স ওর হয়েছে। এখন হুট করে ইন্টার্ভিউ থেকে ওকে বাদ দিলে ওর মনের অবস্থা কেমন হবে? লুবনা পালিয়ে বিয়ে করেছে ভালো কথা, কিন্তু এতে ওর দোষ কি? ও লুবনাকে পালিয়ে যেতে বলেছিল?

সাত পাঁচ ভেবে আরিয়ানের মেসেজে সাবধানে উত্তর দিয়েছিল তাই
— আমার মতামত চাইছ?
— মানে? আগামী সপ্তাহে গেস্ট কে আসবে, এনিয়ে আলোচনা করতে হবে না?
একটু ভাবল কুর্চি। তারপর সরাসরিই লিখল
— আমি ভেবেছিলাম লুবনা ফিরে আসাতে এসব আলোচনা এখন থেকে ওরসাথেই করবে।
ওপাশ থেকে নিশ্চুপ রইল আরিয়ান। কুর্চি ভালোমতো টের পাচ্ছে আরিয়ান রাগে টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে।
হোক গে! ওর কী!
— অপ্রয়োজনীয় কাজে মাথাটা ব্যবহার না করে ভাবো কাকে আনা যায়। অলরেডি আজ রবিবার এসে গেছে। হাতে মাত্র কয়দিন আছে!
বারুদের মতো জ্বলে উঠতে গিয়েও নিজেকে থামালো কুর্চি। যাক, আরিয়ান অন্তত লুবনার মতো ওকে মশা মাছির মতো তাড়িয়ে দিতে চাইছে না। চক্ষুলজ্জা আছে তাহলে। হুহ! লিখল

— গায়ক, ইনফ্লুয়েন্সার সবই তো হল। এখন একজন লেখককে আনলে কেমন হয়?
— লেখক? মানে নিরালা আকাশ? আবার?
— না না, নিরালা আকাশ না। আমার ইউনিতে একটা মেয়ে ইদানিং লিখে খুব নাম করেছে। ইয়াং ক্রাউডের মধ্যে ক্রেজ যাকে বলে। ওরসাথে কথা বলে দেখতে পারি।
— দেখো তাহলে। নতুন কিছু করলে মন্দ হয় না। কাল ক্লাস আছে? কথা বলে আমাকে আপডেট দিতে পারবে? এদিকেও তো কাজ এগিয়ে নিতে হবে। পোস্টার তৈরী করা, ফেসবুকে পোস্ট করা। মিলন তো আগামী সপ্তাহ থেকে আর থাকবে না।
— আমি জানতাম না এটা মিলনের শেষ সপ্তাহ। জানলে ওর বিদায় উপলক্ষে কিছু করা যেত।
— কী করা যেত?
— ছোটখাট গিফট, একসাথে বাইরে কোথাও খাওয়া। এত ছোট অফিস, আমরা সবাই কাছাকাছি বয়সের, করাই যায়।
— হুম, যাব যাব করছিল মিলন। আমিই ওকে ধরে রেখেছিলাম। এইমাত্র আমাকে জানালো আর আসবে না সে। বাইরে পড়তে যাচ্ছে।

হাঁ হয়ে গেল কুর্চী। মিলন চলে যাচ্ছে, রুবেলও তাই ভাবছে, কুর্চী কী করবে ভেবে পাচ্ছে না, হয়ত সেও এমনকিছু ভাবতে বাধ্য হতে পারে। লুবনা দেখি এসেই চারিদিক পরিষ্কার করে ফেলল! তখন রেডিও চালাবে কারা? মনের এককোণ যে সন্তস্টিতে ফুলে উঠল না, হলফ করে বলতে পারবে না ও। বেশ হয়েছে, উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। আরো খানিক পালাও!
তাড়াতাড়ি নিজের ভাবনা বন্ধ করল। মিন মাইন্ডেড হওয়াটা ঠিক না।
— আচ্ছা, আমি তাহলে দেখি কাল ওকে পাওয়া যায় কিনা। তারপরে আপডেট জানাচ্ছি।
— ওকে, বাই।

মনটা কেমন খুশিখুশি হয়ে গেল। সারা সন্ধ্যার মন খারাপটা এক নিমেষে টুনটুনি পাখির মতো এক ফুঁয়ে উড়ে গেল। একথা সত্য, ও আর আরিয়ান একসাথে চমৎকার কাজ করতে পারে। আরিয়ানের অভিজ্ঞতা বেশি কিন্তু কুর্চিরও এসবে সহজাত একটা দক্ষতা রয়েছে। যারজন্য দুজনে সমানে সমানে কাজ করতে পারে।

কিন্তু তাই বলে কেক খাওয়াখাওয়ি?
সত্যি?
কুর্চি যে কী ভাববে বুঝে পেল না।
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-১০

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ১০)

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শিউলি রহমান আর নাসিম সাহেব, শিউলি জন্মদিনের কেক কাটছেন, কুর্চি ভিডিও করছে। দুজনের পরণে কুর্চির আনা ম্যাচিং শাড়ি আর পাঞ্জাবি। ম্যাচিং কাপড় দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়েছেন শিউলি, নিজের অনেকদিনের একটা শখ পূরণ করতে পারলেন। জানেন তিনি কিনে আনলে নাসিম সাহেব বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবেন, মেয়ে এনেছে তাই কিছু বলতে পারবেন না। যদিও ব্যপার দেখে তার চোখে আতংক ফুটে উঠেছিল। মনেমনে ভাগবার প্ল্যান করেও ফেলেছিলেন হয়ত, নেহাত আপত্যস্নেহে পড়ে গিয়ে প্ল্যানকে কাজে পরিণত করতে পারেনি।

নাসিম সাহেব মনে নতুন আতংক নিয়ে কেক কাটছেন। তার বিচ্ছু শালী, বকুলও আজ উপস্থিত রয়েছে। শশুরমশায়ের মাশাল্লাহ অনেকগুলি মেয়ে। একটার পর একটা মেয়ে জন্মেছে আর তিনি মনের আনন্দে ফুলের নামে তাদের নাম দিয়ে গেছেন পরপর। এখন টগর, চম্পা, চামেলী, জবা কেউ ঢাকা শহরের বাইরে, কেউ আবার একেবারে দেশেরই বাইরে। রয়ে গেছে সবচাইতে বিপজ্জনক শালিটা।
বকুল!
বকুলকে নিয়েই তার সবচাইতে বেশি চিন্তা। কুর্চি তো ভিডিও করে নেটে ছেড়ে দেবে, তারপরে এই বিচ্ছু বকুল কী কী যে কমেন্ট করবে, কতজনকে ডেকে ডেকে এনে দেখাবে, ভাবতেই তার টাক মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। সারাজীবন তিনি সিম্পল জামাকাপড় পরে এসেছেন, আজ মেয়ের কল্যাণে আস্ত কলাগাছ বুকে নিয়ে ভিডিও করছেন! শুধু তাই না, তার স্ত্রীর বুকেও অনুরূপ কদলী বৃক্ষ। অর্থাৎ দুজনেই কলা গাছ সেজে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছেন!
কোন জাতের কলা কে জানে? যদি চিনিচম্পা হয় তাহলেই শেষ। তিনি তার এভারেজ হাইট নিয়ে খুব স্পর্শকাতর। বকুল হয়ত সেইটাই হাইলাইট করবে! ওকে বিশ্বাস নাই!

কেক কাটা শেষ, সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। বকুল খালা চেঁচিয়ে উঠলেন
— নাসিম ভাই, আপুকে কেক খাইয়ে দাও।
এসবে খুবি বিব্রতবোধ করেন নাসিম সাহেব। কোনহাতে ছুরি ধরবেন, কোনহাতে কেক ধরবেন, কিভাবে খাওয়াবেন, কখনোই বুঝে উঠতে পারেন না। এসব করতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় ছু্রিটা হাত থেকে খসে গিয়ে শিউলির পায়ের ওপরে পড়বার উপক্রম হয়, শিউলি তখন অভিমানভরে বলে
— যাও, খাওয়াতে হবে না। মনে ইচ্ছাই নাই তোমার।
আসলে ইচ্ছার অভাব না, এসবে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না বলেই উল্টাপাল্টা হয়ে যায়।
আজ অবশ্য সফলভাবেই ছোট এক পিস কেক স্ত্রীর মুখে তুলে খাইয়ে দিতে পারলেন। যাক, শিউলির একটা শখ পূরণ করা গেল। বেচারির অনেক শখ। কোনোটাই তিনি শিউলির মনের মতো পূরণ করতে পারেন না। আজ কলাগাছ বুকে নিয়ে কেক খাইয়ে দিলেন, ভিডিওতে প্রমাণিত হয়ে থাকল যে স্বামী হিসাবে তিনি একেবারে ফেলে দেবার মতো না। দশে আট অন্তত পাবার আশা করাই যায়!

কুর্চি ভিডিও করছিল। বাবা আর মা দুজনকেই এত চমৎকার লাগছে। বাবার চেহারায় বিব্রত গর্বিতভাব, মায়ের চেহারায় লজ্জা লজ্জা ভাব, দুজনের ম্যাচিং শাড়ি পাঞ্জাবিটাও দুজনকে চমৎকার মানিয়েছে। কে জানত বাবা, ঐ ভয়াবহ দোকানের স্টকে এত ছিমছাম কাপড় থাকবে।
মা তো দেখে খুশিতে আটখানা হয়েছে। বাবাও আজ মায়ের কথামতো চলছে, তাতে এই জন্মদিন মায়ের সারাজীবন হয়ত মনে থাকবে।
অদ্ভুত আনন্দে মনটা ভরে গেল কুর্চির। ও ভিডিও করতে থাকল। আজ কী সুন্দর করে বাবা মা’কে কেকের পিসটা খাইয়ে দিচ্ছে।

হঠাত কুর্চির চোখ ঝাপসা হয়ে এল। নাকি ক্যামেরার লেন্সটার কিছু হয়েছে? পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে ঝাপসাভাবটা দূর করার চেষ্টা করল ও।
আরে! একী!
সামনে বাবামা দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে রয়েছে ও আর আরিয়ান। আরিয়ান ওকে কেকের পিস মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে, সেও লজ্জালজ্জা মুখ করে সেটা খাচ্ছে।
এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড।
চোখের ঝাপসাভাব দূর হয়ে গেল। কোথায় কী! ওই তো বাবামা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
স্তম্ভিত হয়ে গেল কুর্চী। এসবের মানে কী! কেন এমন দেখল ও? ওরপাশে আরিয়ানকেও বা কেন দেখল? ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
তবে কি… তবে কি… ও আরিয়ানকে নিজের পাশে মনেমনে কল্পনা করছে? আরিয়ানকে ভালোবেসে ফেলেছে?
একসাথে কাজ করতে করতে কখন মনেমনে এভাবে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে, ও জানেও না।
কিন্তু আরিয়ানের মধ্যে সেরকম লক্ষণ তো…
ভিডিও ক্যামেরা আরেকজনের হাতে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিল কুর্চি। ওর নির্ঘাত মাথাখারাপ হয়েছে।
আরিয়ান!
সত্যি কি ও আরিয়ানের প্রেমে পড়েছে?

মনে পড়ে গেল লুবনা ফিরে আসার পরে সিঁথির সাথে এনিয়ে আলাপ হচ্ছিল। সিঁথি ওকে জানিয়েছিল
— লুবনার জেদেই রাকীব স্যার স্টুডিওটা বানিয়ে দিয়েছিলেন। নাহলে এ অফিসটা রাকীব স্যার শুধুমাত্র নিজের কাজের জন্য ব্যবহার করতেন। লুবনা আবদার ধরল, লুবনার আবদার ফেলতে না পেরে স্যার পুরা অফিস রিডেকোরেট করলেন। রিসেপশান এরিয়া বসালেন, স্টুডিও বানালেন। সব কাজের আইডিয়া লুবনার ছিল।
— স্যার বুঝি লুবনার সব কথা শোনেন?
— হ্যাঁ, স্যার লুবনার কোনো কথা ফেলতে পারেন না। তবে এভাবে স্যারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করাতে স্যার আগের মতো আর লুবনার কথা শুনবেন কিনা কে জানে। স্যার ভালোমানুষ কিন্তু ঘাউরাও কম না। তার প্ল্যান হয়ত বিফলে চলে গেল লুবনা পালিয়ে বিয়ে করায়।
— প্ল্যান? স্যারের প্ল্যান ছিল লুবনার বিয়ে নিয়ে?
সাথেসাথে ঠোঁটে আঙুল ধরে চুপ থাকবার ইশারা করল সিঁথি
— এই, এসব কথা কাউকে বোলো না, প্লিজ। আমি আবোলতাবোল ভেবেছি, সত্যি কিনা জানি না। লুবনা বা স্যার শুনতে পেলে আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।
— না না, কাউকে বলব না। প্রমিজ।

সিঁথি তাও ইতস্তত করল খানিক। কিন্তু ওরও বলবার ইচ্ছা ষোল আনা। শেষে বলেই ফেলল
— তোমাকে তো বলেছি আরিয়ান আর লুবনা ক্লাসমেট। আরিয়ানকে লুবনাই এনেছে। তারপর তো আরিয়ান আর লুবনা জুটি হিট করে গেল। ওদের দুজনের কেমিস্ট্রিটা এত চমৎকার যে আমরা সবাই ধরেই নিয়েছিলাম যে ওরা কাপল।
তাই লুবনা যখন কাউকে কিছু না বলে ইলোপ করল, আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম। কখনো ভাবিনি লুবনা এমনকিছু করতে পারে। আরিয়ানও নিশ্চয় লুবনার এমন বিশ্বাসঘাতকতায় খুব ভেঙে পড়েছিল। শোয়েরও ভরাডুবি হতে চলেছিল। ভাগ্যিস তুমি এসেছিলে, কুর্চি।
সেকথায় কান না দিয়ে কুর্চি প্রশ্ন করল
— কিন্তু স্যারের প্ল্যান কী ছিল?
— কিছু না, মানে এটা সম্পূর্ণ আমি বানিয়েছি।
— কী বানিয়েছ, তাই বলো না।
— আমার ধারণা স্যার আরিয়ানকে জামাই বানাবার প্ল্যান করে রেখেছিলেন মনেমনে। আরিয়ান তো একেবারে ফেলে দেবার মতো ছেলেও না। স্যারও খুব পছন্দ করেন ওকে। হয়ত সামনে এমনকিছু হবে, মনেমনে ভেবে রেখেছিলেন স্যার। কিন্তু লুবনা পালিয়ে গিয়ে স্যারের প্ল্যান পুরাই পানিতে ফেলে দিল। যে ছেলেটার সাথে পালালো, তার সাথে বিয়ে দিতেও তো স্যার রাজি ছিলেন না। তারমানেই লাফাঙ্গা কেউ হবে। এখন লুবনা ফিরে এসে ভেবেছে আগের মতোই সবকিছু থাকবে। কে জানে কী হয়। স্যারকে যতটুকু দেখেছি আমি, তাতে স্যারকে খুব স্নেহশীল মনে হলেও বেশ কড়াও লাগে।

নিজের রুমে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে থাকে কুর্চি।
কী যে একটা ভ্যাজালে পড়ল ও, কিছু ভালো লাগে না!
কিন্তু আরিয়ান কেন ওকে কেক খাওয়াল!!!
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-০৯

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ৯)

কেকের ওপরে “শুভ জন্মদিন, শিউলি ও মা” লিখতে বলে দিয়ে মলে আনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কুর্চি। আজ মায়ের জন্মদিন। ভাবছে বাসায় ফিরে কেক কাটবে বাবাকে নিয়ে। বাবার তো এসব কখনোই মনে থাকে না। সেজন্য ফোন করে তাকে বেলুন আর কার্ড আনতে বলে দিয়েছে।
শিউলি বয়সের দিক দিয়ে একজন প্রমাণ সাইজের মেয়ের মা হওয়া সত্ত্বেও মনের দিক দিয়ে খানিকটা কাঁচাই রয়ে গেছেন। এসব কেক কাটাকাটি, বেলুন, কার্ড, চকোলেট উপহার পেলে ছেলেমানুষের মতো খুশি হন। সেজন্য কুর্চির ওপরে ভার থাকে যথাসময়ে বাবাকে দিনটি সম্পর্কে মনে করিয়ে দেবার। শিউলি খুব সম্ভব চাতুরীটুকু ঠিকই ধরতে পারেন কিন্তু শুধুশুধু সেটা প্রকাশ করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারেন না। কেক, বেলুন, কার্ড পেয়ে যথাযোগ্য বিস্ময় প্রকাশ করেন প্রতিবার। তারপর নাসিম সাহেবের চোরচোর মুখ দেখে মওকা বুঝে দামী গিফট আদায় করে নেন যথাসময়ে।

বিমনার মতো মলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কুর্চি। মনে করতে চেষ্টা করল ওর নিজের কিছু জরুরী কেনাকাটা আছে কিনা। কিছুই মনে পড়ল না।
আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল গত একমাসে ওর মলে ঘুরে বেড়ানো, এমনকি কেনাকাটা করা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। কিছুদিন আগে মাইনেও তো পেল। কিন্তু কিছু কেনেনি। এই এক কেক ছাড়া। কিছু কিনবে কি?
ভেবে দেখল কিছুই কিনতে ইচ্ছা করছে না। তাহলে মায়ের জন্মদিন উপলক্ষে কিছু কিনবে? প্রথম মাইনে পেলে নাকি বাবা মা’কে কিছু দিতে হয়, উপরন্ত আজ মায়ের তো জন্মদিন।

ভাবতে না ভাবতেই চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম হল কুর্চির। কারণ সামনে দিয়ে আপাদমস্তক রূপালি গহনা, সাথে সাদার ওপরে রূপার ঝিরিঝিরি ডিজাইনের ভয়াবহরকমের ঝিকিমিকি শাড়িতে লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে নিরালা আকাশ হেঁটে যাচ্ছে। ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং ওকে আশ্চর্য করে দিয়ে শাড়ির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঝকঝকে হাসি হাসল
— কেমন আছ?
নিরালা আকাশ ওকে মনে রেখেছে এ বিস্ময় কাটতেই তো আজ সারারাত যাবে! তাড়াতাড়ি মুখের অবাক ভাব দূর করে কুর্চি হাসল
— ভালো। তুমি?
ও এতোই আশ্চর্য হয়েছে যে গতবার আপনি করে সম্বোধন করেছিল, ভুলেই গেল।
— আমিও ভালো। এই দোকানের উদ্বোধন করতে আইসি। নতুন খুলসে, আমারে খুব ধরসে।
দোকানের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম হল কুর্চির। সব ঝিকিমিকি টুম্পা শাড়ি ডিসপ্লেতে। নিলারা আকশের পরণের শাড়িটিও দোকান থেকেই আসার সম্ভবনা খুব প্রবল। হয়ত তাদের শাড়ি পরে উদ্বোধন করতে হবে এমন শর্ত ছিল। দোকানের সামনে যারা ভীড় করে রয়েছে, তারাও কিছু কম যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
এ অবস্থায় কুর্চি কী আর বলবে। বলতে তো পারে না যে এমন দোকান উদ্বোধন না করে আগুন দিয়ে দিলে একটা জনহিতকর কাজ করা হয়! লোকজন ট্রমার হাত থেকে বাঁচে!

মুখে ফেক হাসি এনে বলতে বাধ্য হল
— বাহ! খুব ভালো।
— বাজার করতে আইসো?
— ন…নাহ। আজ আমার মায়ের জন্মদিন, কেকের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
— ওহ। মায়ের কথা শুনে কেমন মুষড়ে পড়ল যেন নিরালা আকাশ। চোখ দুটো কি ছলছল করছে নাকি শাড়ির রূপালি ঝিলিক চোখে রিফ্লেক্ট করছে? নাক টানল সে
— আমার মা আমার লগে কথা কয় না। ফোন করলে বোনকে ফোন ধরায় দেয়, হেয় কথা বলে না।
— সে কী! কেন?
নিরালা আকাশের চেহারায় অপরাধবোধের ছাপ পড়ল। আড়চোখে একবার সাথে লোকদের দেখে নিল। ওদের বলল
— তোরা যা। আমি হের সাথে কথা কইয়া আসতাসি। হেরে চিনোস?
কুর্চিকে চেনার ওদের কথাই না। তারা আকাশ পাতাল খুঁজেও চিনতে না পেরে হে হে হাসল
— হ্যাঁ হ্যাঁ। চিনসি তো!
— গুল মারিস না! হের সাথে আমারি হেইদিন পরিচয় হইল, তোরা চিনবি কি? যা তো, মিছা কথা কইস না, দোকানে যা। আমি আইতাসি।
লোকজন পালিয়ে বাঁচল!

নিরালা আকাশ সেধে ওরসাথে কথা বলার জন্য সাথের লোকজনকে ভাগিয়ে দিল! কুর্চি কি অজ্ঞান হয়ে যাবে? কিন্তু নিরালা আকাশ একটু লজ্জালজ্জা মুখ করে বলল
— সব বেডিরেই চিনি। হ্যাগো সামনে কইলে সাথেসাথে মা’র কানে চইল্যা যাইব, তারপরে আনামের কানেও। কিন্তু তোমারে আমি বিশ্বাস করি, তোমারে কওন জায়। তোমার জন্যই তো এত ঘটনা!
নিরালা আকাশকে লুকিয়ে নিজের হাতে চিমটি কাটল কুর্চি। নাহ, জেগে আছে তো। তবে কি ভুলভাল শোনবার রোগে ধরেছে ওকে?
— আ…আমার জন্য?
— হ। ঐদিন ইন্টার্ভিউ এর পর বাসায় ফিরা দেখি মায়ের ফুন। মা আমারে এই মারে তো সেই মারে। হেও সব শুনসে, বলে আমি নাকি তার ইজ্জত ধুলায় মিশাইসি। ঢাকা শহরে এসব চলতে পারে কিন্তু ছোট শহরে চেনা লোকদের সামনে তার মাথা কাটা যাইতাসে, লজ্জায় চোখ তুইল্যা তাকাবার পারতাসে না।
— কিন্তু কেন?
— প্রাক্তন তুই চায়া থাকের জন্য। আমার নাকি এমন খুললাম খুল্লা বই লেখা উচিত হয় নাইক্কা। আনামুলের সাথে আমার প্রেমটা গুপনেই হইতেছিল। এখন বই লিখ্যা, ইন্টার্ভিউ দিয়া আমি নাকি পরিবারের সুনাম নষ্ট করসি। এদিকে আনামুল নাকি শহরে চাউর কইরা দিসে আমার অনেক কয়টা প্রেম আসিলো। তাই হেয় আমারে বিয়া করে নাই। কইসে এমন মাইয়া কেডা বিয়া করব!

আতংকিত হয়ে তাকিয়ে রইল কুর্চি। এর মধ্যে ওর ভূমিকা কী, বুঝতে পারছে না। কিন্তু এত প্যাঁচালো জিনিসে ওর নামটা যদি জড়িয়ে যায় তবে ওরও নিরালা আকাশের মতোই অবস্থা হবে। শিউলিও ওরসাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবেন!
শুধু কথা বলা বন্ধ না, এ বয়সে মারধরও খেতে পারে ও।
— তুমি ঠিক কইসিলা। হেরে এত ইম্পট্যান্স দেওনের দরকার আসিলো না। তাছাড়া হের কারণেই তো আজ আমি সাফল্যের মুখ দেকতাসি। যাউজ্ঞা, বই বাইর হই গেসে, কিসু করার নাই। কিন্তু বই বাইর হইবার পর আমারে বহু জায়গা থিকা ইন্টার্ভিউ দিবার লগে ডাক পারসিলো, আমি যাইনাই। নিজের পরিশ্রমে আমি এদ্দুর আইসি, হুদাই হেরে প্রমোট করবার দরকার নাই।
এতক্ষণে খুশির হাসি হাসল কুর্চি
— শুনে খুব খুশি হলাম, নিরালা আকাশ। কিছুদিন যেতে যাও। দেখবে সবাই ভুলে যাবে বইয়ের কথা, মারও রাগ পড়ে যাবে, ঠিকই কথা শুরু করবে।
— হাছা কইতাছ?

আবারো মনে হল নিরালা আকাশের চোখটা যেন ছলছল করে উঠল। চোখে অতিরিক্ত মেকাপ থাকার কারণে কুর্চি ঠিক শিওর হতে পারল না।
— হ্যাঁ। আর যদি রাগ না পড়ে তো সরাসরি বাড়ি চলে যাবে। সামনাসামনি দেখলে উনি রাগ করে থাকতেই পারবেন না।
— এইডা একটা কথার মতো কথা বলসো। যামু আমি বাড়িত। কতক্ষণ রাগ কইরা থাকতে পারে দেখুমনে।
নিরালা আকাশের জন্য জেনুইনলি খুশি লাগছে কুর্চির। ফোনে সময় দেখে নিয়ে বলল
— আমি তাহলে আসি, নিরালা আকাশ। কেক রেডি হয়ে গেছে মনেহয়।
— যাইবা? মা’র লগে কী কিনসো?
— শুধু কেক।
— ছোঃ! তাচ্ছিল্যের শব্দ করল নিরালা আকাশ।— একটা গিপ্ট মিপ্ট দিবা না?
— ভাবছিলাম কিন্তু বুঝতে পারছি না কী দিব। সেদিন প্রথম মাইনেও পেলাম। দেয়া উচিত আমার।

খপ করে ওর হাত ধরে ফেলল নিরালা আকাশ।
— আমার লগে আসো। দোকান উদ্বোধন করি, তারপরে হেগো বলি তোমার লাইগ্যা শাড়ি দেখাইতে। হেরা কাপল সেটও বিক্রি করে।
কুর্চির চোখের ওপরে ভেসে উঠল ঝিলমিলি শাড়ি আর পাঞ্জাবী পরে ওর বাবামা কেক কাটছে! বকুল খালা হাসাহাসি করছে আর ছবি তুলছে, তারপর সেটা আপলোড করছে ফেসবুকে! মান সম্মানের আর কিছুই বাকি থাকবে না এ জিনিস বাড়ি নিয়ে গেলে। আতংকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল কুর্চি
— না না, নিরালা আকাশ। আমার মাবাবা একটু সাধাসিধা কাপড় পরে। মনে হচ্ছে না এখানে সেরকম কিছু পাওয়া যাবে।
কানেই নিল না সেকথা নিরালা আকাশ। ওকে টানতে টানতে দোকানের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল
— জানি তো। তোমারে চকরা বকরা জিনিস দিমু ভাবসো? এদের কাছে ভালো জিনিসও আসে। বিক্রি কম হয় বইল্যা সামনে রাখে না। দেইখো, ভালো লাগবেনে তোমার। ভালো ডিসকাউন্ট দিতে কমুনে।
দোয়া দরুদ যা মনে আছে, সব পড়তে পড়তে দোকানে গিয়ে ঢুকল কুর্চি।
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-০৮

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ৮)

কুর্চি মুখ তুলে তাকালো, তাকিয়েই মেয়েটাকে চিনতে পারল।
এ অফিসের ওয়েটিং এরিয়াতে বড় বড় পোস্টারে আরিয়ান আর ওর হাসিমুখের ছবি দেয়ালে সাঁটা রয়েছে।
আরিয়ান লুবনা জুটির লুবনা!

লুবনা ফিরে আসতে পারে, কুর্চি কখনো ভাবেনি। মানে এমন পরিস্থিতির কথা ও মাথাই আনেনি। ভেবেছে না বলে একদিন সকালে উধাও হয়ে গেছে, নিশ্চয় আর ফিরে আসবে না।
একে একে স্টুডিওর অন্য সবার মুখের দিকে একবার করে চোখ বুলিয়ে নিল কুর্চি।
ওর হাতের ডানদিকে বসা রুবেল, এমনিতে রুবেলের মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। এ মুহূর্তে ওর মুখটা হাসি নিয়েই পুরা ফ্রিজ হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে জোকারের মুখের হাসি।
সামনে বসা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল কুর্চি। আরিয়ানের চেহারা প্রথমে সাদা হয়ে গেছিল, তারপর ধীরে ধীরে ওর ফর্সা মুখটা লাল হতে আরম্ভ করল। দেখতে দেখতে টকটকে লাল হয়ে গেল।
কুর্চি বুঝল আরিয়ান প্রচন্ড রেগে গেছে।
আশ্চর্য ব্যপার। এই একমাসে আরিয়ানকে কখনো রাগতে দেখেনি কুর্চি। অথচ এখন রেগে আগুন হয়ে গেছে। রাগের উত্তাপ ও দুইহাত দূরে বসেও টের পাচ্ছে।

ঘরের ভিতরের তাপমাত্রা যেন আচমকা কমে গেল। এক ঠান্ডা শিরশিরে ভাব ভেসে বেড়াতে লাগল ঘরের বাতাস জুড়ে।
সবাইকে চুপ থাকতে দেখে লুবনাও থমকে গেল
— কী ব্যপার? খুশি না মনেহয় আমাকে দেখে তোমরা?
বহুকষ্টে রুবেল নিজের ফ্রিজ হয়ে যাওয়া চেহারা আনফ্রিজ করল। কাষ্ঠ হাসি হেসে প্রশ্ন করল
— কেমন আছ, লুবনা?
— ভালোই।
তাচ্ছিল্যভরে জবাব দিল লুবনা। যেন রুবেলকে ও গোণার মধ্যে ধরছে না। ওর দৃষ্টি এবারে কুর্চির ওপরে লেজারের মতো গিয়ে পড়ল।
— হু আর ইউ?
সৌজন্য হাসি হাসল কুর্চি
— আমি কুর্চি।
সৌজন্যের ধার ধারল না লুবনা। অভব্যের মতো প্রশ্ন করল
— এখানে কী করছ?
থতমত খেয়ে গেল কুর্চি
— ইন্টার্ভিউয়ের প্রিপারেশান নিচ্ছি।
— কেন?
এর আর কী জবাব হতে পারে?
— ইন্টার্ভিউ নিব বলে। আমি আর জে কুর্চি। তোমার প্রোগ্রাম শুনতাম আমি। অনেক বড় ফ্যান। নাইস টু মিট ইউ।
লুবনা সৌজন্যের ধার দিয়ে যাওয়া দূরে থাক, ওর কথাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না। বলল
— ওয়েল, আমি আর জে লুবনা। আই এম ব্যাক নাউ। নো নিড ফর ইউ।

ওর চোখ এবার গিয়ে পড়ল আরিয়ানের ওপরে
— হাই আরিয়ান। কেমন আছ?
এতক্ষণে মুখ খুলল আরিয়ান। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল
— নিজেকে তুমি কী মনে কর কি, লুবনা? ইচ্ছা হল গায়েব হয়ে যাবে, ইচ্ছা হল ফিরে আসবে?
শ্রাগ করল লুবনা
— গায়েব কই হলাম? বিয়ে করেছিলাম। বাবা বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না, ইলোপ করা ছাড়া উপায় ছিল না। এটুকু তো ব্যপার।
— এটুকু ব্যপার? তুমি জানো সেদিন তোমার এটুকু ব্যপার আমাদের কতখানি বিপদে ফেলে দিয়েছিল? নেহাত কুর্চি সেদিন সময়ের আগে এসে পড়েছিল, তাই রিস্ক মাথায় নিয়ে আমরা ওকে তোমার জায়গায় বসিয়েছিলাম।
আবারো শ্রাগ করল লুবনা
— ওয়েল, যা হয়েছে, হয়ে গেছে। আমি ফিরে এসেছি। ওকে আর দরকার নাই।
আরিয়ানের যেন কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে
— ওকে আর দরকার নাই? এত সেলফিশ কেন তুমি? প্রয়োজনে ব্যবহার করব, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বিদায় করে দিব, এ মটো নিয়ে হয়ত তুমি চলতে পারো, আমি না।

আরিয়ানের রাগ দেখে আপোষের সুর ধরল এবারে লুবনা। সামান্য হেসে বলল
— আহা, বিদায় করবার কথা কে বলছে? ও থাকুক না, অন্যকিছু করুক। ইন্টার্ভিউ তুমি আর আমি যেমন নিচ্ছিলাম, তেমনই নিব।
কঠিনমুখে আরিয়ান জবাব দিল
— এনিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তুমি রাকীব স্যারের সাথে এনিয়ে আলাপ কোরো। কুর্চি একয়দিনে ভালো কাজ করেছে। আমাদের রেটিং তুমি অনুপস্থিত থাকাতে কোনো হেরফের হয়নি। লিসেনার্সরা ওকে পছন্দ করে। এখন রাকীব স্যার যা বলবেন, আমি মেনে নেব। তবে আগে তুমি তার সাথে কথা বলে দেখো।
এবারে লুবনারও মুখটা লাল লাল দেখালো।
— ঠিক আছে। বলছি কথা তোমার রাকীব স্যারের সাথে।
মোজাইক করা মেঝেতে হাই হিলের খটাখট শব্দ তুলে লুবনা এগিয়ে গেল তার রুমের দিকে।

লুবনা চলে যেতে স্টুডিওর তাপমাত্রা আরো কয় ডিগ্রী নেমে গেল যেন। সবাই চুপ করে রইল, কেউ কোনো কথা বলল না।
কুর্চি হাতের কাগজপত্র অযথা নাড়াচাড়া করতে থাকল।
মিনিট পাঁচেক পর সিঁথি দরজা খুলে জানালো যে রাফি এসে পড়েছে। এখন রিসেপশানে অপেক্ষা করছে। আরিয়ান উঠে দাঁড়াল
— এসো কুর্চি, আমরা গিয়ে রাফিকে নিয়ে আসি। প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে।
দ্বিধা নিয়ে উঠে দাঁড়াল কুর্চি। রুবল উঠে গিয়ে কাচের ওদিকের বুথটায় চলে গেল।
ওয়েটিং এরিয়ায় এসে দেখল আরিয়ান নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। রাফির সাথে হাত মিলিয়ে সৌজন্য আলাপ করছে হাসিমুখে। কুর্চি এগিয়ে যেতেই রাফি হাসিমুখে বলল
— হাই কুর্চি। কেমন আছ?
— ভালো আছি। তুমি ভালো আছ?
— পার্ফেক্ট। আজকের ইন্টার্ভিউএর জন্য একদম তৈরী।
— আমরাও তৈরী। আশা করছি আজকে দারুণ এক ইন্টার্ভিউ নিতে পারব।
— গ্রেট।
— চলো রেকর্ডিং স্টুডিওতে যাই। হাতে সময় বেশি নাই।
আরিয়ান সবাইকে ইঙ্গিত করল স্টুডিওর দিকে রওনা দিতে।

ঝটপট ইন্টার্ভিউ শুরু করে দিল আরিয়ান। কুর্চি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল যে এই একমাসেই ও আরিয়ানকে খুব ভালো চিনে গেছে। আরিয়ান ইন্টার্ভিউ শুরু করেছে ঠিকই কিন্তু ওরমধ্যে একটা খুব সুক্ষন কাঠিণ্য চলে এসেছে। এসির মধ্যে বসেও ওর কপালে ঘামের আভাস চিত্তচাঞ্চল্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। বুঝে নিয়ে ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে নিজেই কথা আরম্ভ করল রাফির সাথে। রাফিও আগ্রহভরে উত্তর দিতে শুরু করতে বেশ সাবলীলভাবেই ইন্টার্ভিউ এগিয়ে যেতে লাগল। একসময়ে জমে উঠল দুজনের কথোপকথন। ওরকাছ থেকে স্কুপ পেতে ওকে ঘিরে এক নামকরা অভিনেত্রীর সাথে প্রেমের গুঞ্জনের ব্যপারে খেলাচ্ছলে প্রশ্ন করল কুর্চি। রাফির চোখ প্রথমে বড়োবড়ো হয়ে গেল, ঠোঁটে অভ্যাসমতো প্রতিবাদের জবাব তৈরি ছিল। কিন্তু কী ভেবে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে।
— সত্যি জানতে চাও?
— অবশ্যই। তবে সত্যিটাই জানাতে হবে কিন্তু। আমাদের লিসেনার্সরা সেটাই ডিজার্ভ করে।
— অবশ্যই সত্যিটা বলব।
— তাহলে জানাও প্লিজ লীরার সাথে তোমার সম্পর্কটা কি শুধুই বন্ধুত্ব নাকি বন্ধুত্ব ছাড়িয়ে অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিছুদিন আগে তোমাদের দুজনকে এক অভিজাত রেস্তোরায় অন্তরঙ্গভাবে ডিনার খেতে দেখা গেছে। এরপিছে আমরা কি অন্যকিছু ধরে নেব?

কথার ফাঁকে ফাঁকে আরিয়ানের ওপরে নজর রাখছিল কুর্চি। প্রশ্নের ধরণ শুনে আরিয়ান ঠোঁটে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও ও স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে আরিয়ান অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছে। ওর মনোযোগ ইন্টার্ভিউএর মধ্যে একেবারে নাই। হুট করে ওকে প্রশ্নের ভার দিলে ও খেই হারিয়ে ফেলবে।
কুর্চি মনেমনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। আজকের ইন্টার্ভিউ ভালো হতেই হবে। ও একাই চালিয়ে নেবে। রাফি খুব ভালো মুডে আছে। সব প্রশ্নের উত্তর দেবার মুডে আছে। এ ইন্টার্ভিউ অলরেডি জমে গেছে, এভাবে যদি ও চালিয়ে নিয়ে যায়, তবে আজকে ওরা চমৎকার রেটিং পাবে। ওদের পেতেই হবে। এর পিছে ও কম খাটুনি তো দেয়নি।
চেহারা হাসিহাসি করে নতুন প্রসঙ্গ টেনে আনল কুর্চি
— তারপরে রাফি, আগামীতে তোমার কী প্ল্যান আমরা জানতে কিন্তু খুবি আগ্রহী।

ইন্টার্ভিউ শেষ হয়ে গেল। ওরা দুজনেই উঠে রাফিকে মেইন দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। বিদায় নেবার সময় রাফি যেকোনো সময় যোগাযোগ করতে বলে ওদের অবাক করে দিল। এ তো অভাবনীয়। তারমানে সামনে আবার রাফি আসতে আগ্রহী। রাফিকে আনা মানেই ওদের ভালো পাবলিসিটি।

স্টুডিওতে ফিরে এসে টেবিলে বসলে রুবেলও ওদের সাথে জয়েন করল।
— একসেলেন্ট ওয়ার্ক, কুর্চি। ওয়েল ডান।
আরিয়ানের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত প্রশংসা পেয়ে কুর্চির মনে হল একরাশ বুদবুদের প্রজাপতি যেন ওর পেটে ওড়াওড়ি করছে। খুশিতে আটখানা হয়ে বলল
— থ্যাঙ্কস।
— আজকের ইন্টার্ভিউটা আমাদেরকে অনেকখানি এগিয়ে দিল, কুর্চি। তোমাদের দুজনের কথোপকথনও খুব সাবলীল ছিল, লিসেনার্সরা খুব এঞ্জয় করেছে, ওদের লাইভ প্রশ্ন শুনেই বোঝা গেছে।
রুবেল ফোন ঘাটতে ঘাটতে বলল
— আজকে সবচাইতে বেশি কমেন্ট এসেছে। আমি অর্ধেকই এখনো পড়তে পারিনি।
— মিলনকে বোলো সব কমেন্টের যেন উত্তর দেয়।
— অলরেডি বলে দিয়েছি।
— গুড, ভেরি গুড।

এই প্রথম আরিয়ানের ঠোঁটে সত্যিকারের হাসি দেখা দিল। কুর্চি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ওদের কাজের পরিবেশ, পরস্পরের সাথে কাজ করার ধরণ একদম রিলাক্সড ও বন্ধুত্বপূর্ণ। কেউ কারো ওপরে মাতব্বরি ফলায় না, সবাই নিজের নিজের কাজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত করে। সেখানে আজ আরিয়ানকে আড়ষ্ট দেখে ও খুব দমে গেছে।
সিঁথি দরজায় মাথা গলিয়ে জানালো
— আরিয়ান, তোমাকে রাকীব স্যার দেখা করতে বলেছেন।
সাথেসাথে আরিয়ানের মুখভাব পালটে গেল। চেহারায় তিক্ততা ফুটে উঠল। চোখ লাল করে সিঁথির দিকে তাকাল
— আমাকে?
— হ্যাঁ, তোমাকেই। আমাকে খুন করে লাভ নাই, আরিয়ান। আমি স্রেফ খবরটা দিতে এলাম।
অন্যসময় হলে এ জোকে আরিয়ান হাসত, পাল্টা জোক করত। আজ গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর ঝট করে উঠে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আরিয়ান উঠে যেতে রুবেল ও কুর্চি পরস্পরের দিকে তাকাল। অপ্রস্তুতভাব ঢাকতে রুবেল চিৎকার করে উঠল
— মিলন! মিলন!
দুই তিনবার চিৎকার করবার পর মিলন ছুটতে ছুটতে এল
— রুবেল ভাই, ডাকছ আমাকে?
— হ্যাঁ, আজকে যত কমেন্ট আসবে, সবগুলির উত্তর দিতে হবে কিন্তু।
বিস্ময় ফুটে উঠল মিলনের চোখে।
— একবার তো বললে। তোমার মেসেজ পেয়েছি আমি।
উঠে দাঁড়াল রুবেল।
— কয়টা স্পেশাল কমেন্ট আছে। এগুলি সাবধানে হ্যান্ডেল করতে হবে। এসো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
রুবেল কাচের পার্টিশানের ওপারে নিজের জায়গায় চলে গেল। কুর্চি চুপ করে বসে রইল। সাধারণত এসময়টা ও আর আরিয়ান, রুবেলের সাথে পরের গেস্ট কাকে নির্বাচন করা যায়, সেনিয়ে আলাপ করে। আজকেও মিটিং হবে কিনা বুঝতে পারছে না।

সজোরে দরজা খুলে গেল। আরিয়ান স্টুডিওতে ঢুকেই কোনো কথা না বলে নিজের ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে আবার দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। কাচের পাল্লা দিয়ে কুর্চি ওকে মেইন ডোর দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখল। আরিয়ানের চেহারা আবারও টকটকে লাল হয়ে ছিল। কুর্চি বুঝে নিল রাকীব স্যারের রুমে যা বলাবলি হয়েছে, তার কিছু আরিয়ানের পছন্দ হয়নি।
রুবেল ব্যাকপ্যাক হাতে স্টুডিওতে ঢুকে বলল
— চলো, বের হই।
কুর্চি কিছু একটা ভাবছিল। চমকে বলল
— কোথায়।
— দেখা যাক কোথায় যাওয়া যায়। আপাতত বের হই তো। আজ কারো কাজ করার মুড নাই। আরিয়ান তো চলে গেল। আমরাই বা বসে থেকে কী করব।
— সত্যি সত্যি চলে যাব?
— সত্যি না তো কি? মিলন ওদিকেই ছিল। বলল রাকীব স্যারের রুম থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ পেয়েছে। তারমানে লুবনা মহা গণ্ডগোল বাঁধিয়েছে স্যারের রুমে গিয়ে। ফলাফলে স্যার কিছু বলেছে যা আরিয়ানের পছন্দ হয়নি। দেখলে আরিয়ানের চেহারা কেমন হয়েছিল?
কুর্চী বলবার মতো কিছু খুঁজে পেল না। উঠে পড়ল।

বাইরে বেরোতেই কড়া রোদে চোখ ঝলসে যাবার মতো অবস্থা।
— চা চাই আমার।
— এই কড়া রোদে চা খাবে?
— হুম। কড়া রোদেই চা খেতে হয়। সাথে সদ্য কড়াই থেকে তেল ছেঁকে তোলা শিঙাড়া। চলো আজ তোমাকে ঢাকা শহরের বেস্ট শিঙাড়া খাওয়াই। নাক শিটকাতে পারবে না কিন্তু।
— নাক শিটকাবো কেন?
— তোমার স্ট্যান্ডার্ডের দোকান না, তাই।
হাসতে বাধ্য হল কুর্চি।
— আমার স্ট্যান্ডার্ড বলে আলাদা কিছু আছে নাকি? আমি যেকোনো জায়গা থেকে খেতে পারি। গরমাগরম চুলা থেকে নামলে অসুবিধা কি? তবে হ্যাঁ, কাপ পিরিচ নোংরা হলে অসুবিধা হয়। তেমন হলে নাহয় আরেকবার ধুয়ে দিতে বোলো।
— নোংরা না। খালাম্মা নিজেই খুব পরিষ্কার। তার দোকান ঝকঝক করে। শুধু পশ না।
— তাহলে তো কথাই নাই। খাব আমি ঢাকার বেস্ট শিঙাড়া। প্লিজ।

রুবেল দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার বোঝা গেল। দোকানের সামনে যে মাঝবয়সী মহিলা শিঙাড়া ভাজছিলেন, ওকে দেখে বহুপরিচিতের মতো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
— খবর সব ভালো?
— ভালো, খালাম্মা। আমার সহকর্মীকে নিয়ে এলাম ওকে ঢাকা শহরের বেস্ট শিঙাড়া খাওয়াব বলে। কড়া করে দুই কাপ চা আর চারটে শিঙাড়া পাঠিয়ে দেন লতিফের হাত দিয়ে।
— আচ্ছা।
খুব সাধারণ দোকান। কাঠের চেয়ার টেবিল। বসতে না বসতেই চা শিঙাড়া চলে এলো। আগুন গরম শিঙাড়ায় এক কামড় বসালো কুর্চী
— চমৎকার। সত্যি বেস্ট। বাসার জন্য নিয়ে যাব আমি।
— বললাম না ঢাকার বেস্ট শিঙাড়া? খালাম্মার হাতে জাদু আছে।

কিছুক্ষণ নীরবে দুজন খেতে থাকে। সকালের ঘটনায় কুর্চির মন এখনো ভারী হয়ে আছে। কিন্তু লুবনার কাছ থেকে এমন আচরণও মেনে নেয়া যায় না। কাউকে না বলে উধাও হয়ে যাওয়া চরম আনপ্রফেশনাল কাজ। ওর চাকরিই থাকবার কথা না। সেখানে উল্টে সেই বলছে ওকে সরিয়ে দিতে। আশ্চর্য! লুবনাকে ও চেনে না, শুধু ওর প্রোগ্রাম শুনেছে কিন্তু এমন ব্যবহার আশা করেনি।
রুবেল ওকে লক্ষ করছিল। এখন বলল
— মন খারাপ কোরো না, কুর্চি। এমনটা হয়ে থাকে। আরিয়ানেরও হাত বাধা। ও কিছুই করতে পারবে না।
অবাক হয়ে তাকাল কুর্চি
— বুঝলাম না আমি, রুবেল। কিসের কথা বলছ?
— সকালের কথা বলছি। লুবনা ফিরে এসেছে, এখন ও নিজের জায়গায় ফিরে যেতে চাইবেই। ইচ্ছা থাকলেও আরিয়ান কিছু করতে পারবে না।
কেমন বিদ্রোহী হয়ে উঠল কুর্চির মন। একমাস ধরে ও জানপ্রাণ দিয়ে খেটেছে। সেসবের কি কোনোই মূল্য নাই? আরিয়ান কি অন্ধ? বলেও ফেলল সেকথা
— আর আমি যে একমাস ধরে জান দিয়ে খাটলাম, প্রথমদিন এসেই অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও অন এয়ারে গেলাম, সেগুলি কিছু না? বুঝলাম লুবনা পরিচিত মুখ কিন্তু আমিও একমাসে কি একটা ভালো রেপুটেশান গড়ে তুলিনি? ইচ্ছা হল আর বিদায় করে দিল, এ কেমন ব্যপার?

চোখ সরু করে ওরদিকে খানিক তাকিয়ে রইল রুবেল।
— তুমি মনেহয় পুরা ব্যাপারটা জানো না।
— কী জানি না?
ঝাঁঝিয়ে উঠল কুর্চি। ওর সত্যি খুব রাগ ধরছে।
— সিঁথি তোমাকে বলেনি? দুজনে এত কথা বলো, একথা সিঁথি তোমাকে জানায়নি?
— উফ কী কথা সেটা বলবে তো?
চিন্তিতমুখে শিঙাড়ায় এক কামড় বসালো রুবেল, ধীরে ধীরে চিবুতে লাগল। এদিকে দমবন্ধ করে কুর্চী বসে রয়েছে। অবশেষে রুবেল জানালো
— লুবনা যে রাকীব স্যারের মেয়ে, একথা জানো না? এ স্টুডিও তো স্যার লুবনার কথাতেই বানিয়ে দিয়েছেন।
বাস! মুখভর্তি শিঙাড়া ক্যোঁৎ করে গিলে ফেলল কুর্চী। পেটে গিয়ে সেটা জগদ্দল পাথর হয়ে বসে রইল।
এতক্ষণ ধরে যে শিঙাড়া খুব মজা করে খাচ্ছিল সে শিঙাড়াই এখন বিষের মতো লাগছে।
কুর্চী বুঝল ওর এত সাধের চাকরিটা এখন খুব নাজুক সূতায় ঝুলে রয়েছে।
(চলবে)

কখনো কুর্চি পর্ব-০৭

0

কখনো কুর্চি (পর্ব ৭)

মাসখানেক পরের কথা। কুর্চি ওর চাকরিটা প্রচন্ড উপভোগ করছে। সারা সপ্তাহ ক্লাস করে শুক্র শনিবারে অফিসে চলে আসে। অবশ্য সপ্তাহের মাঝখানে কয়েকবার আরিয়ানের সাথে যোগাযোগ তো হয়ই। পরেরবার কোন অতিথি আসবে, কে এলে তাদের রেপুটেশান ভালো হয় সে নিয়ে আলোচনা হয়, কেমন প্রশ্ন করা যায় সেনিয়েও কথা হয়। অনেকসময় ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফো জোগাড়ের দায়িত্ব ওর ওপরেই চাপিয়ে দেয় আরিয়ান। কুর্চির তাতে আপত্তি দূরে থাক, সানন্দে অতিরিক্ত কাজটুকু করে দেয়। এতে ধীরে ধীরে ওর অভিজ্ঞতা বাড়ছে, আত্মবিশ্বাসের সাথে ইন্টার্ভিউ নিতে পারছে।
ওর ধারণা এ পর্যন্ত ওর কাজ নিয়ে আরিয়ান মোটামুটি খুশিই। সময়ে কাজ ডেলিভারি দেয়, কখনো কাজে দেরী করে আসে না, অন্যান্যদের সাথেও সহযোগীতাপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখে। কাজেই সন্তস্ট হবারই কথা আরিয়ানের।

যদিও আরিয়ানের মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না। প্রথমদিন যেমন সহজ স্বাভাবিক আচরণ করেছিল ওরসাথে, এখনো তাই। এরচাইতে এক কদম এগোয়নি, পিছায়ওনি। এতে কুর্চি মনে করেছে সে স্বভাবের দিক দিয়ে খানিকটা রিজার্ভড, পোলাইট কিন্তু বসসুলভ দূরত্ব বজায় রাখতে চায়। এমনকি কাজ নিয়েও যখন গভীর রাত পর্যন্ত চ্যাট করে, তখনও কাজের বাইরে কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে না, অপ্রাসঙ্গিক আলাপ করে না, গল্পগুজব তো দূরের কথা।
কুর্চিও এজন্য আরিয়ানের সাথে সহজ সম্পর্ক রাখলেও অতিরিক্ত কথাবার্তা একেবারেই বলে না। এই একমাসে আরিয়ানের চাইতে ও রুবেল, মিলন বা রিসেপশনিস্ট সিঁথির সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে। দিব্যি কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেদারসে গল্প চলে ওদের মধ্যে।

দ্বিতীয় দিন যখন কাজে গেছিল তখন আরিয়ান ওকে নিয়ে অফিসের এম ডি রাকীব সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। রাকীব সাহেব এ অফিসের মালিক। আরো অনেক বিজনেস রয়েছে তার। তবে এ অফিসটাতে তিনি বসেন। যারজন্য সবসময় অফিসটা গমগম করতে থাকে, অনেক লোক তারসাথে দেখা করতে আসে। রিসেপশনিস্টও রাখা হয়েছে সেজন্য। নাহলে ড্রিমজ রেডিওর বয়স বেশিদিন না। স্টুডিও এখানে বসাতে কর্মচারিরা সব তরুণ বয়সের। রিসেপশনিস্ট সিঁথি ওরই বয়সী, হাসিখুশি চটপটে একটা মেয়ে। পড়ছে , আবার চাকরিও করছে। রুবেলই ওকে এনেছে, বলল সিঁথি। রুবেল ওর ডিপার্মেন্টের ছেলে, তবে সিনিয়ার। এমনকি আরিয়ানও সবে পাশ করে বের হল। অফিসের সবচাইতে কমবয়সী ছেলে হচ্ছে মিলন। কেবল এইচ এস সি দিয়ে ইউনিতে ঢুকেছে।

সিঁথির কাছে শুনল এদের মধ্যে লুবনা আরিয়ানের ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড। সেই আরিয়ানকে এনেছিল। কাজকর্মও সেই বেশি করত কারণ তার চেনাজানা বেশি ছিল। গেস্টদের নির্বাচন, তাদের সাথে কথাবার্তা সেরে নেয়া, তাদের দেখভাল করা, এগুলি লুবনা খুব ভালো পারত। আরিয়ান মূলত ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্ক বেশি করত। তবে ইন্টার্ভিউএর সময় আরিয়ানই মূখ্য ভূমিকা নিত। লিসেনার্সরা আরিয়ান আর লুবনার কেমিস্ট্রিটা দারুণ এঞ্জয় করত। ওদের দুষ্টুমি, খুনসুটি লুফে নিত, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত। ওদের কান্ড দেখে গেস্টও চট করে সহজ হয়ে যেত, যারফলে ইন্টার্ভিউ উপভোগ্য হত। অল্প সময়ের মধ্যে ড্রিমজ রেডিও তরুণদের মধ্যে বেশ ভালোই সাড়া ফেলে দিয়েছে। তারমধ্যেই তো ঘটল এ ঘটনা। এক সকালে লুবনা উধায়। আগের রাত্রি সে কাউকে কিছু না বলে ইলোপ করেছে! সিঁথির ধারণা ঝোঁকের মাথায় কাজটা করেছে সে।
তারপরে তো কুর্চি এসে পড়ল। হয়ত ওকে কফি আনানেয়ার কাজ বা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করার কাজ দিত কিন্তু লুবনা ইলোপ করায় কুর্চি অভাবনীয় একটা সুযোগ পেয়ে গেল। সরাসরি ইন্টার্ভিউ নিতে শুরু করে দিল।

সত্যি বলতে কী, কাজটা ও যে খুব খারাপ করছে, তা মনে হচ্ছে না। প্রত্যেক ইন্টার্ভিউ এর শেষে রুবেলের মুখের হাসি দেখেই আন্দাজ করা যায়। মিলন তো ওকে প্রশংসা করতে করতে অস্থির। শুধু আরিয়ান তেমন কিছু বলে না। স্মিত হেসে সংক্ষিপ্তভাবে জানায়
— গুড ওয়ার্ক।
তাতেই কুর্চি যেন ফুলে ফেঁপে বাতাসে ভাসে সারাদিন। ওর সমস্ত মনোযোগ থাকে আরিয়ানের প্রশংসায়। আরিয়ান কেমন করে ইন্টার্ভিউ নেয়, ওর শব্দচয়ন, ওর স্টাইল সবকিছু কুর্চি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে। আর মনের গোপনে আশা পোষণ করে একদিন সেও আরিয়ানের মতো সহজ সাবলীলভাবে হেসেখেলে ইন্টার্ভিউ নিতে পারবে।

রাকীব স্যারও ওকে ওয়েলকাম জানিয়েছিলেন। আরিয়ান ওকে সাথে নিয়ে যখন স্যারের রুমে ঢুকল, স্যার তখন গম্ভীরমুখে একটা ফাইল পড়ছিলেন। আরিয়ান পরিচয় করিয়ে দিল
— স্যার, এ হচ্ছে কুর্চি। রেডিওতে নতুন জয়েন করেছে।
ফাইল থেকে মুখ তুলে চশমার ওপর দিয়ে একবার তাকালেন ওরদিকে। ভারী গলায় বললেন
— বসো।
দুজনে বসল।
— আজ থেকে জয়েন করেছ?
কুর্চি উত্তর দেবার আগে আরিয়ানই বলল
— গতকাল থেকেই শুরু করেছে, স্যার। যদিও গতকাল ওর ইন্টার্ভিউ ছিল কিন্তু ও আসামাত্র ইন্টার্ভিউ বাদ দিয়ে সরাসরি ব্রডকাস্টিং এ বসিয়ে দেয়া হয়েছিল।
সাথেসাথে মুখভাব গম্ভীর হয়ে গেল রাকীব স্যারের। কুর্চি ঠিক বুঝল না, শংকিত হয়ে পড়ল। ইন্টার্ভিউ নেয়নি বলে কি রাকীব স্যার রাগ করছেন? কিন্তু সে তো গতকাল বলতে গেলে ওদের বিরাট উপকার করেছে।
আরিয়ানের পরের কথাতেও তার প্রতিফলন পাওয়া গেল।
— একচুয়ালি স্যার, ও আসাতে আমরা বিরাট বাঁচা বেঁচে গেছিলাম। ও আসবার পরপরই গেস্ট এসে পড়েছিল। কুর্চিকে বিনা ট্রেনিং এ ইন্টার্ভিউ নিতে হয়েছিল, তারপরে একবার শুরু করতে আমার মাইক খারাপ হয়ে গেল। খুব বিপদে পড়েছিলাম বলা চলে। ও সবকিছু সুন্দরভাবে সামলে নিয়ে ইন্টার্ভিউ নিল এবং ভালোভাবে নিল।

কুর্চির দিকে তাকালেন রাকীব সাহেব
— শুনে খুশি হলাম। আগামীতেও এমন ভালো কাজ করবে আশা করি।
প্রশংসা করলেও কুর্চির মনে হল রাকীব স্যারের মুখে কে যেন একদলা কালি ঢেলে দিয়েছে। যেন এ খবরে তিনি খুশি না। কিন্তু খুশি না হবার কারণ কী হতে পারে? নাকি উনি এরকমই, খুশির খবরেও মুখ কালো করে ঘুরে বেড়ান? কে জানে বাবা!
কিছুটা কনফিউশান নিয়েই রাকীব স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এল কুর্চি। আরিয়ানও বেশ গম্ভীর। সেজন্য ওকেও কিছু জিজ্ঞেস করতে দ্বিধাবোধ করল কুর্চি।
আরিয়ান এরপরে ওকে মিলনের সাথে ভিড়িয়ে দিল। মিলন ওকে পুরা অফিস ঘুরিয়ে দেখাল, কোথায় কী আছে, কীভাবে কী কাজ করে, সেনিয়ে নিরন্তর কথা বলল। ফাঁকে ফাঁকে অফিসের সাথে কোনো সম্পর্ক নাই, এমন বিষয়েও প্রচুর কথা বলা বাদ দিল না। এত কথার মাঝে কুর্চি কিছুক্ষণ পরে ব্যপারটা ভুলেই গেল।

আজ ও কাজে এসেছে ফুরফুরে মন নিয়ে। কারণ আজ এক অসম্ভব ঘটনা ঘটেছে। মা ওর চুল, ওর জামাকাপড়, বেসিকালি ওরমধ্যে কোনো খুঁত খুঁজে তো পায়ইনি, উপরন্ত ওকে প্রশংসা করেছে। বলেছে কুর্চি সুন্দরভাবে জব, পড়াশোনা সামলে নিচ্ছে। বলতে গেলে বাতাসে ভেসেই কুর্চি অফিসে পৌঁছে গেছে।
আজকে ইন্টার্ভিউ আছে গুরুত্বপূর্ণ একজন গায়কের সাথে। সেজন্য একটু আগে আগেই পৌঁছেছে ও। আরিয়ানের সাথে বসে লাস্ট মোমেন্টে কিছু জিনিস ঝালিয়ে নিতে হবে। এতটুকু এদিক ওদিক হতে পারবে না আজ। গায়ক রাফি তরুণদের হার্টথ্রব, এজন্য আজ ওদের লিসেনার্সদের সংখ্যা নর্মালের চাইতে বেশি হবে আশা করছে সবাই। রাফিকে কমফর্টেবল ফিল করাতে হবে, ইন্টার্ভিউতে সে যেন গতানুগতিক কথার বাইরে স্কুপজাতীয় কিছু বলে, সেজন্য সাবধানে এগোতে হবে। সামনে রাফি যেন তাদেরকে আবার সময় দেয়, সে ব্যাপারেও কনফার্ম করতে হবে।

সবটুকুই নির্ভর করছে নিখুঁত প্ল্যানিং এর ওপরে। আর সেজন্যই আজ সাবধানে এগোতে হবে।
তবে দিনটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবে শেষ হল না। আরিয়ান আর ওর মিটিং এর মাঝেই এক মেয়ে ঝড়ের বেগে ওদের রেকর্ডিং রুমের দরজা খুলে বলল
— হাই গাইজ, আই এম ব্যাক!
(চলবে)