Saturday, August 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 66



তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৯+১০

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৯

“বাড়িতে ডা’কাত পরেছে৷” এটা ছিলো ঘটনার সূত্রপাত। দরজার ওই পাশের ব্যক্তিটিকে চরম বিরক্তিতে ফেলে রাশা বেশ কনফিডেন্সের সাথে ঘোষণা করলো,

–বাড়িতে ডা’কাত পরেছে। আমি স্পষ্ট শুনেছি।

রাত বাজে তিনটা৷ কলিংবেলের শব্দ সর্বপ্রথম রাশার কানে যায়। তারপর থেকেই ড্রয়িংরুমে এসে বসে আছে৷ একে একে সবাই এসে জড়ো হলেও সে কাউকে দরজা খুলতে দেয়নি। সবার মধ্যে একমাত্র বন্যাই রাশার কথায় অতিরিক্ত ভয় পেয়েছে। দুই বেনি করা চুলে হাত পেঁচিয়ে ভয়ার্থ গলায় বললো,

–বাড়িতে ডা’কাত কি কলিংবেল দিয়ে আসে?

রাশা মাথা হেলিয়ে সায় জানালো। দিলো এক ভয়ংকর তথ্য,

–আজকালকার স্মার্ট ডা’কাতরা কলিংবেল দিয়েই আসে৷ দরজা ভাঙার এনার্জি অন্যান্য কাজে লাগায়। আমাদের একটা মেড ছিলো। তার গ্রামে এমন ডা’কাতি হয়েছিলো। সবার হাত পা বেঁধে পুরো বাড়ির জিনিসপত্র ডাকাতি করেছিলো৷ ফার্নিচারগুলো খুলে খুলে ট্রাক ভর্তি করে ফেলেছিলো৷ রান্নাঘরের র‍্যাশন পর্যন্ত ছাড়েনি।

ময়না আতকে উঠলো৷ তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে৷ রাশার দেওয়া গহনাগুলোর কথা সর্বপ্রথম মাথায় আসলো। ওগুলো লুকাতে পারলে ভালো হতো। তবে গল্পটার শেষটাও জানা জরুরি। তাহলে ভালো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। তাই জিজ্ঞাসা করলো,

–কি সাংঘাতিক ডা’কাইত ভাবি!! তারফর কি হইলো?

রাশা কাঁধ নাচিয়ে ঠোঁট উলটে বললো,

–তারপর আর কি? সকালে দেখা গেলো, বাড়ির সবাই ফাঁকা ঘরে হাত পা বেঁধে পরে আছে। সে এক সাংঘাতিক ঘটনা!

সবার রিঅ্যাকশন জানা হলো না। তার আগেই উষির দ্রুত বেগে সিঁড়ি দিয়ে নামলো। লিভিংরুমে সবাইকে দেখে খানিক থমকালো। তারপর বিরক্ত নিয়ে বললো,

–সবাই এখানে মিটিং করছো আর কেউই দরজা খুলছো না? আবার ফোনও ধরছো না। উজান কখন থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ফোন করতে করতে শেষ! দরজা খোলা বাদ দিয়ে কি এখানে সিরিয়ালের রিহার্সাল করছো?

শাহিদা রাশার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রাগী গলায় বললো,

–যেখানে তোর বউ আছে সেখানে সিরিয়ালের রিহার্সাল না হয়ে উপায় আছে? তার বাবার বাড়ি থেকে পাঠানো ডা’কাত পরেছে বাড়িতে। দরজা খোলা মানা।

রাশা চোখ বড় বড় করে শাহিদার দিকে তাকালো। আফসোস করে বললো,

–কি মিথ্যা কথা খালাম্মা! এতো মিথ্যা বলতে আত্মা কাঁপলো না?

উষির আরো বিরক্ত হলো। দরজার কাছে যেতে যেতে মায়ের কথার প্রতিউত্তর করলো,

–ডা’কাত কলিংবেল দিয়ে আসে?

দরজা খুললো উষির৷ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা চওড়া এক সুদর্শন পুরুষ। স্কাই ব্লু রঙা শার্টের উপর নেভি ব্লু রঙের ওয়েস্ট কোট পরা। একই রঙের কোট আর প্যান্ট। ডান হাতে লাগেজ আর বাম হাতে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই লাগেজের উপর থেকে কোট তুলে হাতে নিলো৷ তারপর ভেতরে প্রবেশ করতেই রাশার প্রশ্নের মুখোমুখি হলো,

–তোমাকে কি আমি চিনি?

উজান থমকালো, হকচকালো। একপলক বাড়ির সকলের দিকে তাকিয়ে উষিরের দিকে তাকালো৷ তারপর আমতা-আমতা করে বললো,

–মেবি না।

রাশা উত্তরে যেনো বেশ শান্তি পেলো। পেছন ঘুরে বাড়ির সবার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে ভাষণ দেওয়ার মতো করে বললো,

–দেখেছো, বললাম না ডা’কাত পরেছে? অপরিচিত মানুষকে ডা’কাত বলবো না তো আর কি বলবো? পরিচয় তো জানি না। আর, এক তো তোমাদের বাড়ির কাজ কারবার! কেউ নিজের পরিচয় দিতেই চাও না। আরে বাবা, পরিচয় না দিলে আমি জানবো কিভাবে কে আমার কি হয়? এই যেমন ছোট কাকি। যদি ওনার পরিচয় আমার বুদ্ধি দিয়ে না বুঝতাম তাহলে তো আপু ডেকে বসতাম আর খালাম্মাকে বড় আপু ডাকতে হতো।

রাশার কথায় দুই শাশুড়িকে স্পষ্ট পটানোর চেষ্টা ছিলো৷ তবে কেউ-ই পটলো না। মাহফুজা ছেলের এহেন অবস্থা দেখে বেশ রেগে ছিলো। আরো রেগে বললো,

–নিজের গাধামিকে ঢাকতে আর কতগুলো গাধার মতো কথাবার্তা বলবে?

রাশা একটু থামলো। চোখ পিটপিট করে ইতিউতি তাকিয়ে নরম গলায় বললো,

–নিজের কনফেসে সব বলা যায়৷ বিশ্বাস করা না করা তোমাদের ব্যাপার।

তারপর সটান উজানের দিকে ঘুরলো। উজান তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। নিজের হকচকানো ভাবটা এখনও হজম হয়নি। তার উপর রাশা পুনরায় তাকে শাসিয়ে বললো,

–তোমার জন্যই আমাকে এতোগুলো কথা হজম করতে হচ্ছে৷ এখন নিজের পরিচয় আমাকে দেবে কি না সেইটা বলো?

উজান বেশ সময় নিয়ে বললো,

–আম-আমি আজলান কায়সার৷ উষিরের ছোট ভাই।

রাশা বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে শাহিদাকে বললো,

–তোমার আরেকটা ছেলে আছে আন্টি? একবারও বলার প্রয়োজন মনে করলে না? ছি ছি ছি! সেম অন ইউ! মনে বড্ড কষ্ট দিলে।

বেশ দুঃখী হলো সে। মুখটা করুন করে ফেললো। উজান ব্যাপারটা সমাধান করতে চাইলো,

–না না, আপনি ভুল বুঝছেন ভাবি। উনি আমার বড় মা। আমি উষিরের কাজিন হই, চাচাতো ভাই।

রাশা মুখ বিকৃত করে বললো,

–আপনি! ভাবি! ইসস! কি জঘন্য লাগছে শুনতে। ভাবি শব্দটা শুনলেই মাথায় সর্বপ্রথম একটা জিনিসই আসে। ফ্লার্টার দেবর!

উজান তাজ্জব বনে গেলো। বৃষ্টি আর বন্যা ইঁচড়ে পাকাদের মতো মুখ টিপে হাসলো। মাহফুজা অনেক্ষন সহ্য করে আর পারলো না। থমথমে গলায় উজানকে বললো,

–উজান, তুই ফ্রেশ হতে যা। আমি খাওয়ার জন্য কিছু বানাচ্ছি।

মাহফুজার কথা শুনে রাশা চোখ বড় বড় করে বিষ্ময়ে বললো,

–তোমার নাম উজান!

পরক্ষণেই ফিঁক করে হেসে ফেলে বললো,

–কার গাঙের উজান তুমি? কাকে ছ্যাঁকা দিয়ে ভাসিয়ে অন্য জায়গায় দিয়ে এসেছো?

উজান কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বের হলো,

–হ্যাঁ?

রাশা বুঝানোর মতো করে বললো,

–আরে একটা গান আছে না,

উজান গাঙে নাও ভাসাইয়া বন্ধু গেলা কই
দিয়া গেলা প্রানে ব্যাথা কেমন করে সই..

বৃষ্টির গানের গলা দারুন ছিলো। রাশার কবিতার তালে বলা লাইনগুলো বেশ রসিয়ে কষিয়ে সুর ধরে গাইতে লাগলো।
উষির অনেকক্ষণ এই মেলোড্রামা সহ্য করে উজানের কাঁধ চাপড়ে বললো,

–বেস্ট অফ লাক ভাই।

বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো৷ উষির চলে যেতেই এতোক্ষণ ধরে চলা আসরটা ভেঙে খানখান হয়ে গেলো৷ একে একে সবাই চলে যেতে লাগলো। রাশা অবাক হয়ে বললো,

–দেখেছো, বিপদে কিন্তু এই রাশাই সবার কাজে আসে। ছেলেটা না জানি কোথা থেকে এতোদিন পর বাড়ি ফিরলো আর কারো কোন গুরুত্বই নাই! তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি তোমার জন্য আজ রান্না করবো।

উজান নরম গলায় বললো,

–লাগবে না ভাবি। আমি ফ্লাইটে খেয়েছি৷ আর ক্ষিদে নেই।

রাশা বিরক্ত হলো। বললো,

–নো ভাবি টাবি! তোমার থেকে কত ছোট আমি! এই বয়সে আমি তোমার মতো হ্যান্ডসামের ভাবি হতে পারবো না। আমাদের চেয়ারার কি মিল দেখেছো? বোধহয় তুমি আমার বড় ভাই-ই হবে। আন্টি হয়তো তোমাকে চুরি করে এনেছে। অবশ্য ভালোই করেছে৷ আমাকেও চুরি করা উচিৎ ছিলো! যাই হোক, ইট’স মাই ব্যাড লাক!

উজান হেসে ফেললো। বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,

–থ্যাঙ্কিউ, আমার তিন নাম্বার বোন রাশা৷ আজকে আমাকে এতো স্পেশাল ভাবে ওয়েলকাম করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি এখন কিছুই খাবো না। এখন তুমি আমার বোন জামাইয়ের কাছে যেতে পারো।

রাশাও উজানের পথ অনুসরণ করে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে এক হাত বুকে রেখে একটু ঝুঁকে বললো,

–ইট’স মাই প্লেজার ভাইয়া। গুড নাইট।

চলে গেলো রাশা। উজান জ্বলজ্বলে চোখে রাশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো৷ মুখে এক চিলতে হাসি৷ এই প্রথমবার জার্নি করে এসে একটুও ক্লান্ত লাগছে না। মনটা এতো ভালো হয়েছে, যেটা বলার বাইরে!

***
প্রতিদিনের মতোই রাশার সকাল শুরু হলো অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভেঙে৷ উষির আজকে পাশে নেই। অনেক আগেই উঠে পরেছে৷ রাশা বেশ জানে, উষির ভোর ভোর উঠে এক্সারসাইজ করতে গেছে৷ সৌন্দর্য ধরে রাখতে হবে তো৷ নাহলে তো ভোট পাবে না৷ মুখ বাঁকালো রাশা। বিড়বিড় করে বললো,

–যেই আমার চেহারা, নাম তার পেয়ারা আলী!

বলেই ফিক করে হেসে উঠলো৷ পেয়ারা আলী নামটা বেশ সুন্দর৷ উষিরের সাথে একদম মানানসই। রাশা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, উষিরকে পেয়ারা আলী বলেই ডাকবে। সকাল সকাল এহেন সিদ্ধান্তে মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে গেলো৷ ফুরফুরে মেজাজেই রান্নাঘরে গেলো৷ এখন থেকে তার ডিউটি শুরু৷ আজকে প্লেটের সাথে একটা গ্লাস আর চামচও পরিষ্কার করলো৷ সময় নিয়ে আস্তে আস্তে শসাও কাঁটলো। তারপর শসা খেতে খেতে দুধও জ্বাল দিলো। সবশেষে ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে রান্নাঘর ঝাট দিলো৷ তারপর কাজ শেষ করে হাঁপ ছাড়লো।

রাশার কাজের বিহাইন্ড দ্যা সিনও আছে। ময়না থালাবাসন মাজছিলো। রাশা গিয়ে মাজা প্লেট, গ্লাস আর চামচ পুনরায় পানি দিয়ে ধুরে রাখলো৷ শসা স্লাইস করে কাঁটা ছিলো। সেই স্লাইসের মধ্যে দিয়ে আরেকবার ছুড়ি চালিয়ে আবার কাঁটলো সে। মাহফুজা দুধ জ্বাল দিচ্ছিলো। রাশা গিয়ে দুধে এক চামচ চিনি মিশিয়ে দুইবার চামচ নাড়লো। চিনি গললো নাকি বোঝা গেলো না৷ এরপর টেবিল মোছার পালা। টেবিলের এক কোনায় পানি পরে ছিলো একটু। সেটুকুই মুছলো সে। রান্নাঘরের ফ্লোরে পরে থাকা অল্প ময়লা ঝাটা দিয়ে ঝাট দিয়ে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দিলো।

সব কাজ শেষে টেবিলে চেয়ার টেনে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। গ্লাসে পানি ঢেলে বললো,

–কত কাজ করলাম আজকে! এতো কাজ ডেইলি করলে বাড়ি বাড়ি কাজ করার বিজনেসটা শুরু করে ফেলবো।

রাশার কাজের ধরনে রাগে ফুঁসছিলো শাহিদা। একসময় ঝাঁজালো স্বরে বললো,

–এসব আর কতদিন চলবে?

রাশা অবুঝের মতো বললো,

–কোনসব?

শাহিদা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–এই কাজের নাটক।

রাশা আফসোসে মাথা নাড়লো। বললো,

–আ’ম সরি খালাম্মা, বাট তোমার অ্যাগ্রিমেন্টে কাজের পরিমাণটা হাইলাইট করা উচিৎ ছিলো। আমি তোমাকে বলেছিলাম, কিছু লেখার হলে লিখে নাও। তুমি সুযোগ মিস করেছো। এখন কিছুই করার নাই।

–তোমার কিছুই করতে হবে না। এমনিতেই মাস শেষে বিশ হাজার দিয়ে দেবো।

–না না খালাম্মা। আমি আমার কথায় একদম পাক্কা। শুয়ে বসে টাকা ইনকাম করে নিজের সম্মান হারাতে চাই না।

ময়না ফিক করে হেসে ফেললো। মাহফুজা আর শাহিদার চোখ গরম উপেক্ষা করে বললো,

–ভাবি, আমারেও একখান ওই কাগজ দিয়েন। কাম করতে করতে মাথার ঘাম পায়ে পরে। তাও কাম শেষ হয় না। ওই কাগজ থাকলে কাম একটু কম করা লাগতো।

রাশা মাথা দুলিয়ে বিজ্ঞের মতো বললো,

— লাভ হবে বলে মনে হয় না। উল্টে আরো বেশি কাজ করা লাগতে পারে। রিস্কি হয়ে যাবে খুব।

আহত হলো ময়না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিলো। উজান আর উষির দুজনেই এক সাথে খেতে আসলো। দুজনেরই পরনে ঘরে পরার টি-শার্ট আর ট্রাইজার। তাদের দেখে চকিতে উঠে দাঁড়ালো রাশা। শাহিদা বিরক্ত হয়ে বললো,

–উঠলে কেনো? খাওয়া দাওয়া করা লাগবে না নাকি?

রাশা হকচকিয়ে গেলো। তার বাড়িতে ছেলে আর মেয়েদের একসাথে খাওয়া নিষেধ। আগে ছেলেরা খেয়ে উঠে গেলে তারপর মেয়েরা খায়। এই বাড়িতে আসার পরে শাহিদা, মাহফুজার সাথেই খেতে বসেছে। তাই ভেবেছে এখানকারও একই নিয়ম। একটু দোনোমনা করে বললো,

–একসাথেই খেতে বসবো?

–তা নয়তো কি? খাওয়া তো খাওয়াই৷ এতো বাছবিচার করার কি আছে?

উজান হাত টেনে রাশাকে নিজের পাশের চেয়ারে বসালো। বললো,

–তুমি বসো তো রাশা। দেখি আজকে কি কি রান্না হয়েছে।

রাশা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,

–আমিও রান্না করেছি ভাইয়া।

মাহফুজা রাগ নিয়ে বললো,

–বড় ভাইয়ের বউ তোর। নাম ধরে কেন ডাকছিস?

উজান ভ্রু বাঁকিয়ে জবাব দিলো,

–কে বড়? উষির? মাত্র তিন মাসের বড়। ওকেই ভাই বলি না আর ওর বউকে ভাবি ডাকবো? দেখো, আমাদের চেহারার কতো মিল? আমরা তো ভাই বোন হওয়ার যোগ্য।

মাহফুজা থমথমে গলায় রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে ছুটলেন। শাহিদাও রান্নাঘরে গেলো। এই দুইজন এক হলে তাদের মাথা খারাপ হতে বাধ্য, সেটা তারা বেশ বুঝেছে।
উজান কৌতুহল নিয়ে রাশাকে প্রশ্ন করলো,

–কি রান্না করেছো?

–দুধ জ্বাল দিয়েছি।

মাহফুজা পেছন থেকে ফোঁড়ন কাটলো,

–দুইবার হাত নেড়েছো। জ্বাল দাওনি।

রাশা ফোস করে শ্বাস ফেলে উজানের কাছে অভিযোগ করলো,

–এরা আমার কাজ এতো হিংসা করে ভাইয়া! কাজের কোন দামই দিতে চায় না।

উজান রাশাকে শান্তনা দিয়ে বললো,

–আমি এসেছি না? এখন সবাইকে ঠিক করে ফেলবো।

রাশা হিহি করে হেসে ফেলে। পরক্ষণেই তার ফোনে কল আসে। মুখশ্রী গম্ভীর হয়ে যায়। ফোন হাতে উঠে চলে যায়। তীক্ষ্ণ চোখে ব্যাপারটা দেখে উষির। আর উজানের দৃষ্টি থাকে উষিরের দিকে। রাশা ফিরতেই উষিরের দিকে তাকিয়ে বলে,

–তোমাদের এখানে কোর্ট কোথায়?

উষির সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো,

–কেনো?

রাশা রুটি ছিড়ে মুখে পুরলো। চিবোতে চিবোতে বললো,

–তোমার নামে হ্যারেজমেন্টের কেস করবো। তাই একটু খোঁজ দরকার। তারিখে তারিখে হাজিরা দিতে হবে তো।

উজানের বিষম উঠে গেলো। উষির দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–বলবো না। খুঁজে দিও।

রাশা বিরক্তিকর শব্দ করে বললো,

–কিসব বাচ্চাদের পাল্লায় যে পরলাম!

উজান হাসতে নিয়েও হাসলো না। উলটে রাশাকে ভরসা দিয়ে বললো,

–আমি নিয়ে যাবো। কোন সমস্যা নেই।

রাশা মাথা হেলিয়ে সায় জানালো। তার মুখ এখনও গম্ভীর, চিন্তিত। উষির গভীর চোখে দেখছে সেটা। উজান মিটিমিটি হেসে বিড়বিড় করলো,

–তুমি তো ফেঁসেছো ভাইজান। একেবারে ধপাস!

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১০

আলাদত চত্ত্বরে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। এই ভিড়ের মাঝে নির্দিষ্ট মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। উত্তপ্ত রোদেও সৌরভ ঠিকি রাশাকে খুঁজে নিলো। রাশা নিজের কাজ শেষে আদালতের ভেতর থেকে বের হচ্ছিলো। পরনে শুভ্র রঙা সালোয়ার সুট। কাঁধে কালো লেদারের হোবো ব্যাগ। চুলগুলো পনিটেল করে রাখা৷ হাতে নীল রঙা ফাইল নিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটছে। সৌরভ পিছু ডাকলো,

–রাশা!

রাশা থমকালো, হকচকালো। গলাটা পরিচিত ভীষণ। কপাল কুঁচকে পেছন ঘুরলো। সৌরভকে দেখে কুঁচকানো কপাল সোজা হলেও সেখানে বিরক্তি ফুটে উঠলো। সৌরভ মলিন এসে এগিয়ে আসলো। নিষ্প্রভ স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

–কেমন আছো?

রাশা গভীর শ্বাস ফেললো। ছেলেটা এখনও পিছু ছাড়েনি! কিছু কড়া কথা শুনাতে চাইলো। কিন্তু সৌরভ ভীষণ নরম মনের মানুষ। কিছু করে টরে বসলে আবার সমস্যা হয়ে যাবে। তাই হাসিমুখেই খোঁচা মারলো,

–খুব সুখে আছি। শান্তিতে সংসার করছি।

সৌরভ আহত হলো। নীরস গলায় বললো,

–তোমার কি একবারও আমার কথা মনে পরেনি?

–না।

রাশার কঠিন জবাবের সৌরভের তীর বিদ্ধ করার মতো কষ্ট হলো। চোখ বুজে নিজেকে সামলালো। বিষন্ন স্বরে বললো,

–তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি রাশা। তুমিও তো আমাকে ভালোবাসতে।

রাশা হাত ভাজ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ফাইল বুকের সাথে চেপে ধরে আছে। সৌরভের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললো,

–রং। তোমাকে আমি ভালোবাসতাম না। সেই কথা এর আগে অনেকবারই বলেছি। এটাও বলেছি যে, আই ডোন্ট বিলিভ ইন লাভ। এনি কাইন্ড অফ লাভ! অবশ্য এটা তোমার মাথায় ঢোকার কথাও না।

এনি কাইন্ড অফ লাভ বাক্যটা বেশ জোরের সাথে বললো রাশা। সৌরভ আরেকটু এগিয়ে রাশার হাত ধরতে চাইলো। রাশা দুই পা পিছিয়ে গেলো। লজ্জিত হলো সে৷ ভেজা স্বরে অনুরোধ করলো,

–ফিরে এসো প্লিজ। আমি জানি, তুমি ওইদিন ইচ্ছে করে ওসব করোনি। এর ভেতর কোন না কোন ঘটনা আছেই আছে। আই ট্রাস্ট ইউ। নিজের থেকেও বেশি ট্রাস্ট করি তোমাকে। ওই ওই ছেলেটা তোমাকে ফাঁসিয়েছে না? আমি জানি সব। ভেতরে ভেতরে তো এসব চক্রান্তই চলছিলো।

রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেললে বলো,

–চলো, বসে কথা বলি।

সৌরভের মুখ উজ্জ্বল হলো৷ পাশাপাশি হেঁটে আদালত চত্ত্বরে থাকা একটা টি-স্টলে বসলো। আশেপাশে অনেক উকিল, বাদী ঘোরাফেরা করছে। কিছু বসে আলোচনাও করছে। রাশা আর সৌরভ যে স্টলে গিয়ে বসলো, সেখানে আগে থেকেই দুইজন বসে ছিলো। তাদের বসতে দেখে উঠে চলে গেলো। রাশা সেদিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সৌরভকে প্রশ্ন করলো,

–তুমি এখানে কেনো এসেছো?

সৌরভের দৃষ্টি রাশার দিকে ছিলো। মুগ্ধ সেই দৃষ্টি মাঝে মাঝেই ঘোলা হয়ে উঠছে৷

–তোমার সাথে দেখা করতে। প্রতিদিনই আসি, জানো? আমি জানতাম, তুমি একদিন না একদিন এখানে অবশ্যই আসবে।

চকিতে সৌরভের দিকে তাকালো রাশা। সৌরভ দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। দুই কাপ চা এসে দিয়ে গেলো। দুজনের জন্যেই কড়া লিকারের আদা চা এসেছিলো। রাশা হাতে নিলো। প্লাস্টিকের কাপ ধরা মুশকিল। সৌরভ আর তার মাঝখানের ফাঁকা জায়গা কাপটার নতুন অবস্থান হলো। রাশা কাপের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে সৌরভকে বুঝাতে চাইলো,

–লিসেন সৌরভ, তোমাকে কিছু কথা বলি। মন দিয়ে শোনো। প্রতিটা মানুষের একটা পারসোনালিটি থাকা উচিৎ। নিজেকে নিজের সম্মান করা উচিৎ। নিজেকে নিজে সম্মান করলে তবেই অপরের থেকে সম্মান পাওয়া যায়। তুমি নিজেকে এক ফোঁটাও সম্মান করো না৷ তাই তোমাকে দেখলে আমার একটুও সম্মান আসে না। মায়ের আঁচলের তলায় আর বাপ ভাইয়ের ছায়ার তলায় ঢুকে আর কতদিন থাকবে? গ্রো আপ ম্যান। ইট’স ইয়োর লাইফ। নিজের লাইফে নিজের অধিকার তো থাকা উচিৎ।

রাশার কথায় মলিন হেসে সৌরভ বললো,

–তোমাকে ছাড়া লাইফটা আবার লাইফ হলো নাকি?

রাশা কপাল চাপড়ালো৷ অন্যদিকে ঘটে গেলো আরেক ঘটনা। বানিজ্যমন্ত্রীর সাথে উষিরের বেশ খাতিরদারি রয়েছে। তারই কোর্টে একটা দরকারী কাজ ছিলো। উষির নিজে সেই কাজ করার দ্বায়িত্ব নিলো। কারনটা অবশ্য অন্য। কোর্টে আসা তার জন্য ভীষণ দরকারী। রাশার কোর্টের কথাটা তার মাথায় ঘুরঘুর করছে। কিছুতেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না। নিজে এসে দেখতে চায়, রাশা এখানে কি কাজে এসেছে।
উষির বেশ শান্ত আর চিন্তিত মুখে আলাদত চত্ত্বরে আসলেও দূরে রাশাকে একটা ছেলের সাথে বসে থাকতে দেখে মুখ কঠিন হয়ে গেলো। ছেলেটা বেশ লম্বা, চওড়া ,সুদর্শন। পরিপাটি পোশাক, মাথার চুলগুলো দীর্ঘ সময় নিয়ে সেট করা হয়েছে। দেখেই সব বোঝা যাচ্ছে। এই ছেলের সাথে রাশার কি দরকার থাকতে পারে? খারাপ চিন্তা মাথায় আসতেই হাতের ফাইল খামচে ধরলো সে। ফিরতি পথ ধরতে পা ঘুরালো। তারপর কি মনে হতেই আর ফিরলো না। দ্রুত পায়ে রাশার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। শুনতে চাইলো তাদের কথা। কিন্তু আফসোস! কোন কথাই তার কানে গেলো না। তাদের চারপাশ এমনই ফাঁকা ছিলো যে চাইলেও কাছে গিয়ে কথা শুনতে পেতো না। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো উষিরের। রাশার কথা শেষ হওয়ার প্রতিক্ষা করতে লাগলো।

রাশা ভীষণ বিরক্ত নিয়ে বললো,

–এইসব সো কল্ড লাভ মানুষকে ভিখারি বানিয়ে দেয়। তুমি খুব ভালো একজন মানুষ৷ এসব বাদ দাও৷ প্লিজ! আই রিকুয়েস্টেড ইউ। ইট’স হাই টাইম টু ডু দ্যাট।

শেষ কথাগুলো রাশা মন থেকে অনুরোধ করে বললো। সৌরভ যেনো পণ করেছে, সে কোন কথা বুঝবে না। রাশার কথাও এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো। নত বদনে বললো,

–আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো রাশা। অনেক বছর পর্যন্ত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

রাশা রাগে ডান পা দিয়ে সজোরে মাটিতে বাড়ি দিলো। আক্রোশ মেশানো গলায় বললো,

–ঠিক এই কারনে, ঠিক এই কারনে তোমাকে আমার একটুও পছন্দ হয় না। তুমি তোমার ভালোবাসা নিয়েই পরে থাকো। বেস্ট অফ লাক ইউথ ইয়োর স্টুপিড লাভ।

সৌরভ ফ্যাকাসে গলায় বললো,

–তুমি যখন কাউকে ভালোবাসবে তখন আমাকে বুঝবে রাশা। এই দেখো, তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসবে মনে করে হৃদয় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। অন্য কাউকে ভালোবেসো না প্লিজ।

চোখ কুঁচকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সৌরভ। দেখে মনে হলো, হাজারটা ভিমরুলের কামড় খেয়েছে। রাশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–সো মাচ ইরিটেটিং! তুমি একটা কাজ করো, চিকিৎসা নাও। সময়মতো চিকিৎসা নিলে ভালো হয়ে যাবে।

সৌরভ মলিন হেসে বললো,

–আমার ডাক্তার তো তুমি।

রাশা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই ছেলেকে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে না পেয়ে বোধহয় সৃষ্টিকর্তার কাছে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলো। তারপর সৌরভের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,

–এইসব থার্ডক্লাস ফার্ট কার কাছ থেকে শিখেছো?

সৌরভ আবারও মলিন হাসলো,

–তোমার প্রেমে পরে শিখেছি।

রাশা থমথমে গলায় বললো,

–আমি বিবাহিত সৌরভ। কথাটা ভুলে কেনো যাচ্ছো?

–সেটাই তো সহ্য করতে পারছি না। তুমি আমার না, তুমি অন্য কারো! আমাকে মারতে এই একটা বাক্যই যথেষ্ট।

রাশা কপাল চাপড়ে উঠে পরলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

–যথেষ্ট হয়েছে! আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি তোমার দুঃখবিলাস করো। আমার অনেক কাজ আছে।

বলেই রাশা পথ চলতে শুরু করলো। সৌরভ পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

–রাশা, আই বেগ ইউ। প্লিজ, কাম ব্যাক। রাশা?

রাশা শুনলো না। নিজের গন্তব্যে ফিরে চললো। ওইদিকে চায়ের বিল দেওয়ার চক্করে রাশার পিছু নিতে না পেরে সৌরভ নিজের চুল নিজেই খামচে ধরলো।
মেইন রাস্তায় সিএনজি, রিক্সা থাকে। রাশার গন্তব্য সেদিকেই। কোর্টের এড়িয়া থেকে বেরোনোর আগেই হাতের টানে বাঁধা পেলো। রাশা ভাবলো সৌরভ হয়তো তার পিছু নিয়েছে। পেছন ঘুরে কড়া কিছু শোনাতে চাইলো। কিন্তু পেছন ঘুরতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। উষির রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাশা তাকাতেই তিরিক্ষি স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

–ছেলেটা কে?

রাশা প্রথমে চমকে উঠলো৷ পরক্ষণেই নিজের চমকানো ভাব দমিয়ে মুখে হাসি টেনে বললো,

–আরেহ! তুমি এখানে কি করছো?

উষির সে কথার জবাব দিলো না। গলার স্বর আরো কঠিন করে অধৈর্য গলায় আবার প্রশ্ন করলো,

–ছেলেটা কে?

রাশা নিজের হাত ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাত ভাজ করে উষিরকে কিছু মনে করানোর চেষ্টা চালালো,

–ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন মিস্টার উষির, অ্যাকোরডিং টু আওয়ার অ্যাগ্রিমেন্ট, আমরা কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলাবো না।

ফাইল আগেই ব্যাগে ঢুকানোর জন্য স্বস্তির শ্বাস ফেললো রাশা৷ উষির তীব্র রাগে রাশার কবজি চেপে হিসহিসিয়ে বললো,

–গো টু হেল উইথ ইউর অ্যাগ্রিমেন্ট! তুমি বলো ছেলেটা কে?

ব্যাথায় মুখ কুঁচকে গেলো রাশার। তবে ব্যাথা প্রকাশ করলো না। নিজের অনুভূতি প্রকাশে বরাবরই সে নীরব। নিজের অনূভুতি কারো কাছে প্রকাশ করলে নিজেকে ছোট করা হয়। এটাই তার রীতি। তাই এবারেও ব্যাথার অনুভূতি প্রকাশ করলো না। সম্পূর্ণ বিপরীত অনূভুতি প্রকাশ করলো। হেসে ফেলে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,

–হাউ রুড! ও সৌরভ। আনফরচুনেটলি আমার এক্স।

উষির হাত ছাড়লো না৷ উলটে আরো তীব্র হলো। বিরাট বড় বট গাছের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। তবুও রাশা ঘেমে উঠলো। ব্যাথায় চোখে পানি চলে আসছে। উষিরের ক্ষীপ্ত গলায় আবার প্রশ্ন করলো,

–কোর্টে এসেছো এক্সের সাথে দেখা করতে?

–আরে নাহ! বলেছিলাম তো তোমার নামে কেস করতে এসেছিলাম। মাঝখান থেকে পুরোনো সম্পর্কের একজনের সাথে দেখা হলো। কথাবার্তা না বললে খারাপ দেখায় তাই বললাম দুই এক কথা। তুমি বলো, তুমি এখানে কেনো এসেছো?

নরম হলো উষির। এতোক্ষণ ধরে করা রাগে নিজেই অবাক হলো। হাত ছেড়ে দুই পা পিছিয়ে দাঁড়ালো। এক হাতে রাখা ফাইল এখন আরেক হাতে ট্রান্সফার করলো৷ তারপর ফাঁকা হাত দিয়ে পাঞ্চাবির হাতার ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,

–তুমি আমার নামে কতগুলো কেস করলে, সেটা দেখতেই এসেছি।

রাশা কোমরে হাত রেখে ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,

–উহু! আমার সাথে চালাকি না। সত্যি সত্যি বলো?

উষির হাতের ফাইল উঁচিয়ে বললো,

–এটা জজের থেকে অ্যাপ্রুভ করাতে হবে। সেইজন্যই এসেছি।

–দেখি?

হাত বাড়িয়ে ফাইলটা চাইলো সে। উষির ফাইলটা তার হাতে দিতেই মনোযোগ দিয়ে পুরো ফাইল চেক করলো। তারপর বিষ্ময়ে বললো,

–এটা তো বড় অংকের লোন! অনেক বড় অংক! কোন কোম্পানির নামে নিতে চাচ্ছে। কার কোম্পানি এটা?

উষির দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো,

–মন্ত্রীর।

–কোন মন্ত্রীর?

উষির ভ্রু নাচিয়ে বললো,

–সেটা জেনে তোমার কি কাজ?

রাশা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো,

–ও মাই গড! তুমি! তুমি রাশার হাজবেন্ড হয়ে এমপি মন্ত্রীদের পেছনে ঘোরো! আর এই ঘোরাকে তুমি পলিটিক্স বলো! মাই গুডনেস! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! লিটারেলি তুমি এইসব করো?

–নতুন নতুন পলিটিক্স করতে গেলে কারো না কারো আশ্রয়ে যেতে হয়। তুমি এসব বুঝবে না।

রাশা প্রায় আহাজারি করে উঠলো,

–ওইদিকে আমি কাউকে আত্মসম্মানের জ্ঞান দিয়ে আসলাম আর এইদিকে আমার ঘরওয়ালারই মিনিমাম সেল্ফ রেসপেক্ট নাই!

রাশাকে দেখে মনে হলো, কষ্টে তার বুক ফেঁটে আসছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

–কোন জজের কাছে যাবে?

উষির তার প্রথম কথার কড়া জবাব দিতে নিয়েও চুপ হয়ে গেলো। পাবলিকপ্লেসে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা অনুচিত। তাই শেষের প্রশ্নটার উত্তর ঝটপট দিলো,

–যে থাকবে তার কাছেই যাবো।

–পরিচিত কেউ নেই?

–না।

–এসব কাজে পরিচিত কাউকে লাগে। অপরিচিত কেউ এতো রিস্ক কেনো নেবে?

–পরিচয় হওয়ার জন্য নামই যথেষ্ট।

উষির বেশ গর্বের সাথে উত্তর দিলো। রাশা মুখ ভেঙচে বললো,

–হাহ! আসছে আমার মন্ত্রীর চামচামি করতে!

তারপর সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো,

–ফলো মি।

উষির এবারেও তার কথার জবাব দিলো না। মনে মনে অপমানগুলো গুছিয়ে রাখলো। সব সুদে আসলে ফেরত দেবে।
রাশা আর উষির একটা বড় দোতলা বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়ালো। তারপর রাশা উষিরকে সেখানে রেখে একা ভেতরে চলে গেলো। খানিক পরে চিন্তিত উষিরকে নিশ্চিন্ত করে ফিরে আসলো। হাসিমুখে উষিরের সামনে ফাইল ধরে বললো,

–তোমার কাজ শেষ।

উষির ফাইল চেক করে সন্দেহী স্বরে প্রশ্ন করলো,

–তোমার পরিচিত জজ আছে নাকি?

রাশা চোখ টিপে বললো,

–আমি কোন ফ্যামিলির মেয়ে ভুলে গেলে চলবে না। তোমার ট্রিক অনুযায়ী নাম দিয়েই কাজ হাসিল। সাথে একটু হুমকি ধামকি।

উষির স্পষ্ট বুঝলো, রাশা মিথ্যা বলছে। বুঝেও কিছু বললো না। রাশাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেলো। ফিরলো রাতে। রাশা বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে চিপস খাচ্ছিলো আর টিভি দেখছিলো। উষিরকে দেখেই সব ছেড়ে ছুড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশ্ন করলো,

–কি গিফট পেলে?

উষির হাতঘড়ি খুলছিলো। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

–কিসের গিফট?

রাশার মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো,

–এতো টাকার লোনের অ্যাপ্রুভাল নিয়ে দেওয়া হলো আর তার বদলে গিফট দেবে না? এটা কেমন কথা। অ্যাটলিস্ট নিউলি ম্যারেড কাপলদের হানিমুনের ব্যবস্থা তো করে দিতে পারতো।

উষির পাঞ্চাবির বোতাম খুলছিলো। রাশার কথা শুনে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,

–হানিমুনের ইচ্ছে হচ্ছে নাকি?

রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলো। চোখ বুজে বললো,

–এতোক্ষণে তো আমি আর সৌরভ প্যারিসে থাকতাম। সেখান থেকে গ্রিসে যাওয়ার কথা ছিলো। পুরো এক মাসের প্ল্যান করা ছিলো আমাদের। তোমাকে হানিমুন ট্রিট দিলে প্যারিস আর গ্রিস ভ্রমণের কষ্টটা তাতে একটু লাঘব হতো।

উষিরের মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। এগিয়ে এসে রাশার মুখের উপর ঝুঁকে ক্রোধে জর্জরিত ভয়ংকর স্বরে শাসিয়ে বললো,

–আর একবার সৌরভের নাম মুখে আনলে সৌরভ নামক মানুষটার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আর থাকবে না। মাইন্ড ইট।

রাশা অবাক বিষ্ময়ে চোখ খুললো। উষির ক্ষিপ্ত পায়ে ক্লোজেট থেকে জামাকাপড় নিয়ে স্ব-শব্দে ক্লোজেট বন্ধ করলো। তারপর বাথরুমের দরজাও সর্বোচ্চ শক্তিতে বন্ধ করলো। রাশা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বিড়বিড় করলো,

–সৌরভকে গালি দিতে দিতে আরেকটা সৌরভ কপালে এসে জুটলো নাকি!

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৭+৮

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৭

বিয়ের কথা পাবলিক হতেই উষিরের উপর একটা ছোট ইন্টারভিউ দেওয়ার চাপ আসে। সাংবাদিককে অথোরিটিই পাঠাবে। শুধু তাকে কিছু প্রশ্নের সুন্দর ও ব্যাখ্যামূলক উত্তর দিতে হবে। উষিরের রাজি না হয়ে উপায় ছিলো না। সকাল সকাল সাংবাদিক আসার আগেই রাশাকে বেশ সাবধান করে বলে দিলো,

–তুমি একটাও কথা বলবে না। যা বলার সব আমি বলবো।

রাশাও শান্ত, ভদ্র আর বাধ্য মেয়ের মতো কাধ নাচিয়ে উত্তর দিলো,

–ওকে।

তবে তার শান্ত আর বাধ্যতা সেখানেই শেষ। সাংবাদিকের সামনে যেতেই নিজের ফর্মে ফেরত গেলো। সাংবাদিক কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই রাশা বলে উঠলো,

–ইন্টারভিউ এর আগে আমাদের কিছু শর্ত আছে।

উষির চকিতে তাকালো রাশার দিকে। চাপা গলায় বললো,

–সব কথাবার্তা আগেই হয়ে গেছে৷ এখন শুধু ছোট করে একটা ইন্টারভিউ দিতে হবে। প্লিজ চুপ করে থাকো।

রাশা মন দিয়ে উষিরের কথা শুনলো। তারপর মিষ্টি হেসে সাংবাদিককে আবার বললো,

–শুধু আমার কিছু শর্ত আছে। সেগুলো মানলেই আমি ইন্টারভিউ দেবো।

সাংবাদিকের জন্য এসব নতুন না। প্রায় মানুষই কথা বলার আগেই শর্ত রাখে। এখানেও যে এমন কিছু হবে, সে ব্যাপারে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর করলেন,

–শর্তগুলো বলুন? রাখার চেষ্টা করবো।

রাশা হাসলো। মিষ্টি হাসির পেছনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেই উষিরের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো।

–ইন্টারভিউ কোথায় প্রকাশ করবেন? টিভিতে, নিউজপেপারে নাকি অনলাইন নিউজ পোর্টালে?

–অনলাইন নিউজ পোর্টালে।

রাশার হাসি চওড়া হলো। উষিরের দেওয়া চাপা স্বরের ধমক উড়িয়ে দিয়ে আবার বললো,

–সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরির ভাতিজি আর শিল্পপতি হামিদ চৌধুরীর ছোট কন্যার বিয়ের নিউজ, অনলাইন নিউজ পোর্টালে দিলে ভালো হবে নাকি টিআরপি বাড়াতে টিভিতে দিলে ভালো হবে সেটা আপনারাই ভালো জানবেন।

সামনে আড়াম করে বসে থাকা সাংবাদিক বিষ্ময়ে সোজা হয়ে বসলো। বিষ্ময়ে খানিক বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। চৌধুরী পরিবারের মেয়েদের কখনই সামনে আনা হয়নি৷ বলা চলে, বেশ রাখঢাক রেখেই তারা চলাফেরা করে। ছেলেদের সবাইও যে সামনে এসেছে, তা না। চৌধুরী পরিবারের চার ছেলের মধ্যে শুধুমাত্র শাহরিয়ার চৌধুরী বাবার পথ অনুসরণ করে রাজনীতিতে এসেছে। বাকি তিন ছেলের খবর মিডিয়া জানে না। মাঝে তাদের পরিবারের এক ছেলেকে নিয়ে নিউজ বের হলেও স্পষ্ট ভুয়া নিউজ বলে পরেরদিনই তা সরিয়ে ফেলা হয়। বিত্তবান এই পরিবার সম্পর্কে সবার জ্ঞান অতি সীমিত। সেখানে একজন এসে সেই পরিবারের মেয়ে বলে নিজেকে দাবী করলেই তো বিশ্বাস করা যায় না। সাংবাদিক মহাশয়ও করলেন না। বিষ্ময়াভাব কাঁটতেই প্রশ্ন ছুড়লেন,

–আমি আপনার কথা কিভাবে বিশ্বাস করবো? আমার জানামতে চৌধুরী পরিবারের কোন মানুষ প্রকাশ্যে আসে না। তারা নিজেদের আড়ালে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন।

রাশা আলতো হেসে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। তারপর হাঁটুতে হাত রেখে বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে বললো,

–আপনাকে প্রমাণ দেওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই। বিশ্বাস করলে করুন না হলে না করুন। আমি তো শুধু আপনাদের উপকার করতে চাইছিলাম।

সাংবাদিক অধৈর্য হলো। উশখুশ করে বললো,

–প্লিজ ম্যাডাম, কিছু তো প্রমাণ দেন? আপনি বুঝতে পারছেন না, যদি আমি এইটা প্রকাশ করি তাহলে আমার ক্যারিয়ারের গ্রিন লাইট জ্বলে উঠবে। প্রমোশন পাক্কা!

উষির রেগে গেলো। কড়া গলায় বললো,

–আমরা আপনাকে কোন প্রমান দেবো না। যেটা করতে এসেছেন সেটাই করুন।

সাংবাদিক ফ্যাকাসে গলায় বললো,

–প্লিজ স্যার, এটা আমার বেতনের প্রশ্ন।

রাশা হেসে ফেললো। মাথা নেড়ে বললো,

–বেতন সব থেকে বেশি ইম্পর্টেন্ট। কিন্তু আমি আমার পরিচয়ের কোন প্রমাণ আপনাকে দেবো না। বলা চলে আপনার সুবিধার জন্যই দেবো না। কারন এটা আপনি প্রকাশ করলে আপনার চাকরি তো যাবেই সাথে আপনাদের অফিসও বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবারের কোন ঘটনা সামনে আসুক সেটা বড় বাবা চায় না। তাই আমি যেটা বলছি সেটাই করুন। লাভ আখেরে আপনারই হবে।

হাতে পেয়ে যাওয়া কোটি টাকার লটারির টিকিট নষ্ট হলে যেমন কষ্ট হয়, সাংবাদিক মহশয়েরও তেমনই কষ্ট হলো। আহত হলো খুব। বিমর্ষ স্বরে বললো,

–বলুন?

উষির উঠে দাঁড়ালো। চোয়াল শক্ত করে বললো,

–আপনারাই তাহলে কথা বলুন, আমি আসছি। আমার অপচয় করার মতো এতো সময় নেই।

সাংবাদিক আতকে উঠে উষিরকে আটকালো,

–প্লিজ স্যার, যে এক ঘন্টা সময় নিয়েছি সেই এক ঘন্টা একটু কনসিডার করুন। আমার চাকরির প্রশ্ন স্যার?

উষির কথা মানলেও রাগ ছাড়লো না। চুপচাপ বসে রাগে ফুঁসতে লাগলো। রাশা সতেজ গলায় বললো,

–ইন্টারভিউটা চেষ্টা করবেন নিউজপেপারে প্যারাগ্রাফ আকারে দিতে। সরাসরি কথোপকথন দেবেন না। তাহলেই আমার পরিচয় পেয়ে যাবেন। সাথে দেখবেন, আপনাদের অবস্থা হবে ধরি মাছ আর না ছুঁই পানি টাইপ হয়ে যাবে। দুই দিনে রিচ বেড়ে হাই হয়ে যাবে।

সাংবাদিক মহাশয় খুব একটা চালাকচতুর না। তাই রাশার কথার আক্ষরিক অর্থ বুঝতে পারলো না। কিছুটা দোনোমনা করে নিমরাজি হলেন। রাশা শুরু করলো তার কাহিনী,

–আমাদের প্রথম দেখা হয় হলুদ সন্ধ্যায়।

উষির চমকে উঠলো। এই মেয়েটা আবার সত্যি সত্যি সব বলে না দেয়! বেশ রাগত গলায় মৃদু শাসানি দিয়ে বললো,

–রাশা, বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

রাশা উষিরের থেকেও ফিসফিস করে বললো,

–বি কোয়াইট, জান!

জান শুনে তাজ্জব বনে গেলো উষির। মূহুর্তেই চোখ মুখ শক্ত করে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। ভাবখানা এমন, এখন যা খুশি হয়ে যায় সে একটা অক্ষরও বলবে না। রাশা উষিরের রাগ পাত্তা দিলো না। আবার বলা শুরু করলো,

–আমার মেজো চাচা আর বাবা মানে আমার শ্বশুরমশাই খুব ভালো ফ্রেন্ড। সেই সুবাদে তাদের এক মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের মেয়ের বিয়েতে তারা অতিথি ছিলেন। মেজো বাবার সাথে আমিও ছিলাম। আর বাবার সাথে উষির৷ সেখানেই এই লাজুক, কাটখোট্টা মানুষটার সাথে আমার পরিচয়। প্রথমে বন্ধুত্ব আর তারপর কখন প্রেম হয়ে গেলো, বুঝিই-নি৷ আমাদের বিয়েটা পূর্বপরিকল্পিত ছিলো না। আমার বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক হয়েছিলো৷ উষির সেটা শুনে একদম হিরোর মতো আমার বাড়িতে এন্ট্রি নিলো। আমার বাবার সামনে বুক টানটান করে বললো, আমাকে বিয়ে করতে চায়। বাড়ির কেউ এই বিয়েতে রাজী ছিলো না। জল অনেকদূর গড়ানোর পর বড় বাবা সবটা মেনে নিলেন। কিন্তু শর্ত রাখলেন, বিয়ের পর তাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না। প্রেমের টানে মেনেও নিলাম। ভাবলাম, এখন রেগে থাকলেও কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। যদিও বড় বাবা এক কথার মানুষ তবুও আশা আছে। দেখি ভবিষ্যতে কি হয়। যাই হোক, তারপর এখান থেকে বাবা আর উষির গেলো। ঘরোয়াভাবেই ওর সাথে আমার বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। এইতো কাহিনী৷ সংক্ষিপ্ত আকারে বললেও ব্যাপারটা সংক্ষিপ্ত হয়নি৷ অনেক চড়াই উৎরাই পেরোনোর পরই আমরা আজ একসাথে। অনেকেই বলবে, এটা একদম ঠিক হয়নি। পরিবারের অমতে গিয়ে বিয়ে করা একদম উচিৎ ছিলো না। কিন্তু উষির একজন পাবলিক ফিগার পরে, আগে সে একজন মানুষ। গভীর প্রেমে তো মানুষ নিজের অস্তিত্ব ভুলে বসে। উষির আর আমিও সেই কাতারেই পরেছি। আপনারা সবাই উষিরকে খুব ভালোভাবেই চেনেন। আপনারাই বিচার করবেন, আমি ঠিক কাজ করেছি নাকি ভুল।

উষিরের কথা বন্ধ ছিলো। কিন্তু সেটা রাগের জন্য নয়। রাশার নির্দ্বিধায় বলা এই মিথ্যে শুনে তার বাক্য অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। রাশার কথার মাঝে লাজুক হাসা, আবার মন খারাপের বাক্য শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলা, সবটাই কি নিঁখুত অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটে তুলছে! আর শেষের দিকে ছলছল চোখে উষিরের দিকে তাকিয়ে যখন চোখ মুখে লাজুক হেসে তার হাত দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো, তখন উষিরের মনে হলো, এই অভিনেত্রী এখনও অস্কার পায়নি কেনো!

সাংবাদিক সাহেব অত্যাধিক ইমোশনাল হয়ে পরেছেন। ভেজা স্বরে ছোট করে প্রশ্ন করলেন,

–জুয়েলারি দান করার ব্যাপারে কিছু বলুন?

রাশা আবার মিষ্টি হাসলো। বললো,

–ওগুলোর বেশিরভাগই আমার বিয়ের অর্নামেন্টস। আমার পরিবারের একটা রীতি আছে। বিয়ের পরেরদিন নববধূ গ্রামের সবার মাঝে দান সদকা করে। আমি সেই রীতিই অনুসরণ করেছি। বাড়ির দেওয়া ওই অর্নামেন্টস ছাড়া আর কিছুই আমার ছিলো না। তাই সেগুলোই দান করে রিচুয়াল মেইনটেইন করেছি। তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম, আমার অর্নামেন্টগুলো কোন একটা ভালো কাজে আসুক। আর সেটা এসেছেও। এতো আড়ালে থেকে চ্যারিটি করার পরও কিভাবে যে ব্যাপারটা পাবলিক হলো, কিছুই বুঝতে পারছি না। সব জায়গায় এখন এটাই চর্চা হচ্ছে। আ’ম সারপ্রাইজড!

–নারীদের গহনাই হলো তাদের জীবন। বিশেষ করে বিয়ের গহনা তারা সারাজীবন আগলে রাখে। আবার নারীরা তাদের গহনাকে বিপদের সঙ্গীও বলে। বিয়ের স্মৃতি রাখার জন্য একবারও মনে হয়নি, অন্তত কিছু একটা নিজের কাছে রাখবেন? কিংবা বিপদের সঙ্গী করে নিজের কাছে রাখবেন?

–বিয়ের স্মৃতি হিসেবে স্বামী মানুষটা পাশে থাকলেই হলো। আর আরেকটা প্রশ্নের উত্তর হলো, আমি বিশ্বাস করি, মানুষই মানুষের বিপদে এগিয়ে আসে। তাই আমি বিপদে পরলেও নিশ্চয় মানুষই এগিয়ে আসবে।

ইন্টারভিউ শেষ হয়ে যেতেই ফটোসেশান শুরু হলো। ডিপ অফ হোয়াইট সালোয়ার কামিজ পরে উষিরের পাশে দাঁড়ালো রাশা। উষির ম্যাচিং পাঞ্চাবি পরে আছে৷ এক হাত রাশার কোমড়ে আর রাশার এক হাত উষিরের কাঁধ আকড়ে আছে। ছবিটা দারুন হয়েছে৷ রাশা মুগ্ধ হয়ে বললো,

–আপনি তো দেখি দারুন ছবি তোলেন! আমাকে এক কপি পাঠাবেন প্লিজ।

সাংবাদিক সাহেব লাজুক হাসলো। রাশা ফের বললো,

–সুন্দর করে সাজিয়ে লিখবেন। আর স্পেশালি লিখবেন, উষিরের সাথে দেখা হয়নি। তার অনুমতি নিয়েই তার স্ত্রীর সাথে আপনার কথা হয়েছে। আর লিখবেন, তার স্ত্রীর পরিবার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতে রাজী হয়নি। আর উষির ইন্টারভিউ এর শেষের দিকে এসেছে। তারপরই ছবি তোলা হয়েছে। মনে থাকবে?

সাংবাদিক মহাশয় ঢোক গিলে মাথা হেলিয়ে সায় জানালেন। সাংবাদিক চলে যেতেই রাশা কোমড়ে হাত রেখে বেশ গর্বের সাথে উষিরকে বললো,

–দেখলে তো সব কেমন ইজিলি হয়ে গেলো৷ এতো সহজ ব্যাপারকে তোমরা এতো জটিল করো!

তারা তখন লনে ছিলো। পাশাপাশি হাঁটছিলো দুইজন। রাশা জুতা খুলে নরম ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটছে৷ উষির সেদিকে একপলক তাকিয়ে বললো,

–এতোগুল কথার মাঝে আবার বাবা আর তোমার কাকার ফ্রেন্ডশিপ ছাড়া আর একটা ওয়ার্ডও কি সত্যি বলেছো?

–কতগুলোই তো বললাম।

বলেই রাশা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। উষির চোখ ছোট ছোট করে বললো,

–কোনটা?

রাশা বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,

–আমি সত্যিই চেয়েছিলাম, গহনাগুলো কারো উপকারে লাগুক।

–ইউ আর যাস্ট ইম্পসিবল! তোমার মতো আর একজনও বোধহয় এই দুনিয়ায় আসেনি। আসলে আমার মতোই কারো লাইফ হেল থাকতো৷ তাতে যদি একটু শান্তনা পেতাম!

রাশা আবার হেসে ফেললো। উষির মুগ্ধ হতে হতে হলো না। রাশার এক হাত টেনে থামিয়ে বললো,

–কত টাকার শপিং করেছো জানো?

রাশা দাঁতে জিভ কেঁটে বললো,

–ছি ছি ছি! তুমি আমাকে টাকার খোঁটা দিচ্ছো? আমি কি শুধু আমার জন্য শপিং করেছি? সবার জন্যই তো করেছি৷ এমনকি তোমার জন্যেও করেছি। মন বড় করতে হয় বুঝেছো?

উষির বুঝলো নাকি বোঝা গেলো না। বললো,

–ক্রেডিটকার্ড ফেরত দেবে কখন?

রাশা আকাশ থেকে পরলো, এমন ভঙ্গিতে আহ্লাদী স্বরে বললো,

–বিয়ের পর একটাই জিনিস দিয়েছো। সেটাও ফেরত চাইছো?

উষির চোখ ছোট ছোট করে শাসিয়ে বললো,

–অ্যাকাউন্ড ক্লোজ করে দেবো কিন্তু?

রাশা কোমড়ে হাত রেখে দ্বিগুণ শাসিয়ে বললো,

–রাশাকে চেনার জন্য দুইদিনই যথেষ্ট। এই দুই দিনেও যখন চেনোনি তাখন তোমার বুদ্ধির পরিমাণ জানা হয়ে গেছে। বন্ধ করেই দেখো কি করি।

বলেই গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। উষির বিড়বিড় করলো,

–ইনক্রেডিবল! কোন গ্রহ থেকে এসেছে কে জানে!

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৮

ছবিগুলো উষির আর মেয়েটার বেশ অন্তরঙ্গ মূহুর্তের সাক্ষী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। বিয়ের তিন চার দিনের মাথায় নিজের স্বামীর এমন ছবি দেখা কোন মেয়েরই কাম্য নয়। কিন্তু সেখানে রাশা নির্লিপ্ত। সে বেশ মজা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। বিয়ের কথা জানাজানি হওয়ার পরেই এরকমটা শুরু হয়েছে৷ রাশা প্রায় সময়ই বিভিন্ন সাইট থেকে ছবি বের করে জুম করে করে দেখে। এখনও তাই করছে। উষির ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনি করছিলো আর আয়নার ভেতর থেকে রাশাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিলো। রাশার মিটিমিটি হাসিটা বেশ অসহ্য হয়ে উঠেছে উষিরের। একসময় আর না পেরে রাশার সামনে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বললো,

–এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখে এতো হাসছো?

রাশার চোখে মুখে ছেয়ে থাকা হাসির রেশ এবারে ঠোঁটের কোনে এসে গেলো। বেশ আগ্রহ নিয়ে উষিরের সামনে ফোন ধরে বললো,

–তোমার ছবিগুলো দেখছিলাম।

ছবিগুলো দেখে অপ্রস্তুত হলো উষির। পরক্ষণেই চোখ গরম করে রাশার মাথায় টোকা দিয়ে বললো,

–নির্লজ্জের এসব কি দেখছো? সব কিছু ফেক। এআই দিয়ে বানানো।

রাশার হাসি চওড়া হলো। প্রফুল্লচিত্তে বললো,

–সেটা তো একটা পাগল দেখলেও বুঝতে পারবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, মেয়েদের রুচি ঠিক কতটা খারাপ হলে তারা তোমাকে সিলেক্ট করে? নিজেই নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো। সুন্দর চেহারা ছাড়া আর কিছু কি নজরে পরে? পলিটিশিয়ান মানুষদের থাকতে হয় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। তোমার সব বুদ্ধি ওই লম্বা হাঁটুতে আটকে আছে। শুধু বডি দেখালে হয় না। যোগ্যতাও থাকতে হয়।

উষির প্রথম বাক্যটায় পরে রইলো। বাকি কথাগুলোতে কানও দিলো না। তার মানে রাশা বুঝতে পেরেছে, উষির তেমন ছেলে না। বুকে হাওয়া দোল খেয়ে গেলো। মন আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। কৌতুহলবশত বলে বসলো,

–তুমি কিভাবে বুঝলে?

রাশা ফোন রেখে উষিরের দিকে তাকালো। তারপর হাত নেড়ে বুঝানোর মতো করে বললো,

–তোমার নাকের ফুটো অত্যাধিক বড়। এই ছবিতে তেমনটা নাই। আবার তোমার ডান হাতে একটা বড় তিল আছে। এখানে একদম ফ্রেশ হাত। তোমার কান দুটো নরমাল হলেও ছবির কানদুটো তোমার নাকের ফুটোর অত্যাধিক বড়। আবার…

উষির রেগে গেলো। সে কি ভাবলো আর বলে বসলো কি! তার থেকে ভালো কিছু আশা করাটাই ভুল হয়েছে৷ বড্ড ভুল হয়ে গেছে। রাশাকে থামিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,

–যথেষ্ট হয়েছে। আর শুনতে চাই না।

রাশা দায়সারা ভাবে কাঁধ নাচিয়ে উষিরের রাগ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো। তারপর বললো,

–এসব ফেক হলেও তোমার ভার্জিনিটি সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ইউ নো হোয়াট, কোন পুরুষই শুদ্ধ পুরুষ না। মানে চরিত্রের দোষ সবারই আছে। তার উপর তুমি পাবলিক ফিগার। কিছু না কিছু তো অবশ্যই করে এসেছো। বলা যায় না, হয়তো এতোদূর আসতে নিজের দেহ বিসর্জন…

উষিরের কি হলো কে জানে! রাশার কথা শেষ হওয়ার আগেই একটু ঝুঁকে রাশার মাথার পেছনে হাত দিয়ে শক্ত হাতে তার মুখটা নিজের মুখোমুখি করলো। তারপর রাশাকে হতবাক করে দিয়ে তার ঠোঁটে একটা শক্ত চুমু খেয়ে বললো,

–মাই লিপস যাস্ট লস্ট দেয়ার ভার্জিনিটি।

রাশা ফ্যালফ্যাল করে উষিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। কাজটা করার পর উষির নিজেই কেমন একটা হয়ে গেলো। বুকে দোল খাওয়া ধুকপুক বেশি বেড়ে গেলো। বড় বড় দুটো ঢোক গিলে বাইরের দিকে হাঁটা ধরলো। অন্যদিকে রাশার ধাতস্থ হতে অনেকটা সময় লেগে গেলো। সজ্ঞানে ফিরতেই বিষ্মত হলো, রেগে গেলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

–হি কিসড মি! হাউ ডেয়ার হি ডু দ্যাট! উষিইইইইইইর!

চিৎকার করে উঠলো রাশা। নিচ থেকে তার চিৎকার শুনে উষিরের বিষম উঠলো। শাহিদা উষিরের পিঠ চাপড়ে চিন্তিত স্বরে বললো,

–আবার কিছু করেছিস নাকি?

উষির কাঁধ নাচিয়ে না জানার ভাণ ধরে বললো,

–জানি না তো। জানোই তো কেমন মেন্টাল। রাগ নাকের ডগায় উঠেই থাকে।

এবারে বন্যা চিন্তিত হলো। মুখের খাবার শেষ করে বললো,

–কিন্তু ভাইয়া, ভাবিকে তো আমি তেমন একটা রাগতে দেখিনি!

উষির ধমকে উঠলো,

–চুপচাপ খা। বড়দের মাঝখানে নাক গলাচ্ছিস কেন?

বন্যা বড় শ্বাস ফেলে চিন্তিত মুখেই খেতে লাগলো। তার মুখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারে, মাত্র হয়ে যাওয়া কথাটা নিয়ে সে সত্যিই ভীষণ চিন্তিত। শাহিদা বিরক্ত হয়ে ময়নাকে বললো,

–তোকে না রাশাকে ডেকে আনতে বললাম। এখনও যাসনি কেন?

কথাটা শুনেই উষির প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পরলো। তাড়াহুড়ো করে বললো,

–তিনটায় আমার ফিল্ডে কিছু কাজ আছে। ভুলেই গেছি। আসছি আমি।

বলেই কাউকে কিছু বলতে না দিয়েই চলে গেলো। মাহফুজা বিচলিত গলায় বললো,

–ছেলেটা যে কি বেছে নিলো ভাবি! পছন্দের রুই মাছটাও শান্তিতে খেতে পারলো না। তার থেকে বড় ভাই আর উজানের সাথে ব্যবসা দেখলে কত ভালো হতো।

শাহিদা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর ছেলের বলা কথাটাই রিপিট করলো,

–শখের দাম ষোল আনা।

কথাটা রাজনীতিতে ঢোকার আগে সবাই বাঁধা দেওয়াতে বলেছিলো উষির৷ মানে এটাই দাঁড়িয়েছিলো, যা কিছু হয়ে যাক তার পছন্দের কাজটাই সে করবে। সেটার মূল্যই তার কাছে সব থেকে বেশি। এরপর আর কেউ কিছুই বলেনি। এখনও কিছুই বলে না। তবে পান থেকে চুন খোসলে খোঁটা দিতেও ছাড়ে না।

দুপুরে ওমন বাজখাঁই চুমুর পর উষিরের কথা মনে হতেই কেমন ইতস্তত লাগে রাশার। সাথে রাগ তো ফ্রীতেই পাওয়া যাচ্ছিলো। উষির আসার আগ পর্যন্ত অনেক কথা মনে মনে গুছিয়েছে। উষির বাড়ি আসলো বেশ রাত করে। ভেবেছে, রাশা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ঢুকবে। কিন্তু হলো উলটো। রাশা তার জন্যেই জেগে বসে ছিলো। রুমে ঢুকতেই জাগ্রত রাশাকে দেখে তটস্থ হলো সে। মনকে অনেকবার বুঝিয়েছে, পরনারীকে তো স্পর্শ করেনি৷ যাকে করেছে, সে তার বিবাহিতা নারী৷ তাহলে এতো অস্বস্তি কেনো! তবুও মন মানেনি। কেমন একটা লাগতে শুরু করেছিলো।
রুমে ঢুকেই সোজা ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঘড়ি খোলার অযুহাতে আয়না দিয়ে বিছানায় শক্ত হয়ে বসে থাকা রাশাকে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। তবে সেটা আর করতে হলো না। রাশা এসে উষিরের পাশে এসে দাঁড়ালো। মুখ সোজা সামনের দিলে, উষিরের বিপরীত দিকে। আড় চোখে তাকিয়ে তার মুখ দেখা গেলেও সোজাসুজি দেখতে ঘাড় ঘুরাতেই হবে। উষির দ্বিতীয়টাই বেছে নিলো। ঘাড় ঘুড়িয়ে রাশার দিকে তাকালো। রাশা সামনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখশ্রী শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,

–দেখো, আর ওসব কিছু করবে না বলে দিচ্ছি। ভালো মানুষ পেয়ে যা খুশি করবে সেটা হবে না। বিয়ের আগে আমি রিচ ছিলাম। ইচ্ছামতো টাকা পয়সা খরচ করতাম। বিয়ের পর যতক্ষণ জুয়েলারিগুলো ছিলো ততক্ষণ রিচ ছিলাম। গহনার সাথে সাথে আমার রিচ জাতীয় সমস্যাও চলে গেছে। আমি এখন রিচ থেকে আছড়ে পরে পোওর হয়ে গেছি। মাত্র বিশ হাজার টাকা স্যালারির একটা চাকরি করি। প্রতি মাসে আমার নির্দিষ্ট কিছু খরচখরচা আছে৷ এরমধ্যে তোমার পলিটিক্সের পেছনে কনট্রিবিউট করার মতো উপায় আমার নেই৷ আমাকে কিডন্যাপ করেও লাভ হবে না। আর দুপুরে যেগুলো করলে সেগুলোর পর আমার কাছে টাকা থাকলেও আমি তোমাকে দিতাম না৷

বড় করে শ্বাস ফেললো রাশা। উষিরের দিকে আড় চোখে একবার তাকিয়ে আবার সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে কঠিন গলায় বললো,

–সব কথার শেষ কথা, এইরকম ফাউল মার্কা কাজ আর করবে না। নিজের ঠোঁট সংযত রাখো।

উষির তাজ্জব বনে গেলো। সাথে রাগও হলো৷ তার ওমন ভালবেসে দেওয়া প্রথম চুমুটাকে ঘুষ ভাবছে! ঘুষ! ভেট! গিফট! সুযোগ সন্ধানী কাজ কর্ম! ভারি অপমানিত হলো উষির। রেগে লাল হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠলো৷

রাতে শোয়ার পরে রাশা যখন আবার উষিরের বালিশে চলে আসলো তখন উষির ঘুরে রাশার মুখোমুখি হলো৷ তার আদর করে দেওয়া চুমুকে ঘুষ বলা! এখন সে আরো চুমু দেবে। সেও দেখতে চায়, রাশা ঠিক কত কি ঘুষ দিতে পারে। ভাবনামতো কাজও করলো। রাশার গালে, কপালে, ঠোঁটে, নাকে অনবরত চুমুর বন্যা বইয়ে দিলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও একসময় রাশা আর চুপ থাকলো না। চোখ মুখ কুঁচকে নিজের গালে নিজেই চড় বসালো৷ বিড়বিড় করে ঘুম জড়ানো গলায় বললো,

–উহুহু ক্যাকটাস মশা মশা মশা..

অর্ধ অসমাপ্ত কথাটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দ্বিতীয়বারের মতো উষিরকে হতবিহ্বল করে ঘুমের দেশে পারি জমালো সে। তার চুমু একেবারে ক্যাকটাস মশা হয়ে গেলো! অজান্তেই হাত নিজের গালে নিয়ে গেলো৷ এতো শখ করে রাখা চাপ দাড়িগুলো ক্যাকটাস মশা! এমন মশার অস্তিত্ব আদৌ কি পৃথিবীতে আছে!

চলবে..

তুমিবসন্ধ্যার মেঘ পর্ব-০৬

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৬

–এসব কি দেখছি রাশা। গহনা তোর কাছে এতো সস্তা? জানিস ওখানে কত টাকার গহনা আছে?

শপিংমলে ঢুকে কিছু ড্রেস দেখছিলো রাশা৷ তক্ষুনি মায়ের কল আসে। প্রথমটায় অবাক হলেও এখন বুঝতে পারছে, কেনো কল এসেছে৷ অনেক লোকের ভিডিও করা দেখেই রাশা বুঝেছিলো, ব্যাপারটা পাবলিক হতে আর সময় লাগবে না। সে মনে মনে এটাই চাইছিলো। আর হলোও তাই। ঘন্টা না পেরোতেই বাড়ি থেকে কল আসলো। রাশা মনে মনে হাসলেও অবাক হওয়ার ভাণ করলো। কণ্ঠে বিষ্ময় ঢেলে পালটা প্রশ্ন করলো,

— অনেক টাকার না?

রাশার গলার স্বরে না জানার ভাণ। ফোনের ওপাশে থাকা রাশার মা ফুঁসে উঠলো,

–তুই এই কাজ কিভাবে করতে পারলি? একটুও বুক কাঁপলো না?

ঘড়ির দোকানের সামনে দারোয়ানের সিটটা ফাঁকা ছিলো। রাশা সেখানেই বসলো। মনে হচ্ছে গল্প এখন অনেকক্ষণ চলবে।

–কেঁপেছিলো মা। যতক্ষণ ওগুলো আমার কাছে ছিল ততক্ষণ ভয়ে বুঁক কাঁপছিলো৷ মনে হচ্ছিলো এখনও আমি ওই বাড়ির নজরবন্দি। তবে এখন অনেক শান্তি লাগছে।

— তুই কি পাগল? এতো কিসের ক্ষোভ তোর? কিসের অভাব ছিলো? তোর কাজে সবাই কি পরিমাণ রেগে গেছে, জানিস?

রাশা মলিন হাসলো। তারপর উদাস কণ্ঠে বললো,

–রেগে আছে না? রাগতে দাও। আর তো সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না।

রাশার মা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–ওখানে আমাদের পারিবারিক গহনাও ছিলো।

খুশিয়ে লাফিয়ে উঠলো সে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললো,

–অপ্স মা! আনন্দ তো ডাবল করে দিলে। কি জানো তো, ভাবলাম তোমার শ্বশুরবাড়ির সম্পদ কোনদিন তো কোন ভালো কাজে আসে না। আমার মাধ্যমে একটু ভালো কাজে আসুক। এখন মনে হচ্ছে আমি একশো পার্সেন্ট সাকসেসফুল।

রাশার মা মেয়েকে বুঝানোর দ্বায়িত্ব থেকে অবসর নিলো। তাকে বুঝানো তার ক্ষমতার বাইরে৷ জোরে জোরে শ্বাস ফেলে শক্ত গলায় বললো,

–তুই ওগুলো কালকেই ফেরত পাঠাবি। কিভাবে করবি জানি না কিন্তু পাঠাবি।

রাশা কপাল কুঁচকে বিরক্তির সুরে বললো,

–ওই জুয়েলারিগুলো তো আমার ছিলো। আমার প্রপার্টি আমি তোমাদের কেন দেবো? ভালো কথা মনে করিয়েছো৷ তোমার শ্বশুরবাড়ির প্রপার্টিতে তো আমারও অংশ আছে। বাবাকে বলো প্লিজ, আমার অংশ যেনো আমাকে দিয়ে দেয়।

রাশার মা তেঁতে উঠলেন,

–কিসের সম্পত্তি? তোকে সবাই ত্যাগ করেছে৷ তোর বাবা তোকে ত্যাজ্য করেছে৷ ভুলে গেছিস?

রাশা হাসলো৷ এই কুটিল হাসি রাশার মা দেখলে হয়তো রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পরতো।

–মাই ডিয়ার মম, ত্যাজ্য আর ত্যাগ বলে কোন শব্দ আইনের খাতায় নেই৷ তুমি তো জানোই, আমি আমার কথা রাখতে ঠিক কতদুর যেতে পারি।

তিনি কেঁদে ফেলে অসহায় স্বরে বললেন,

–তোর মতো মেয়ে পেটে ধরে এখন আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

রাশার মুখ গরম হয়ে উঠলো৷ তীব্র রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো৷ সাথে মলিন কষ্টের নিঃশ্বাস। দম বন্ধ স্বরে বললো,

–আমার মতো মেয়েকে তো তুমি চাওনি মা৷ শুধু আমাকে কেনো, বড় আপা, মেজো আপা, ছোট আপা, দিয়া, কনিকা এদের কাউকেই তো তোমরা চাওনি। একমাত্র দাদাজানের ভয়ে তোমরা আমাকে পৃথিবীতে আনতে বাধ্য হয়েছো। তোমাদের কাছে তো একমাত্র ছেলেরাই মানুষ। তোমাদের বংশ প্রদীপ, উত্তরসূরী।

রাশার মা চোখের পানি মুছে ভৎসনা করে বললো,

–টাকা পয়সা দিয়ে পড়াশোনা করিয়ে এতো বড় করে আজকে আমাদের উপরই আঙুল তুলছিস? লজ্জা করে না?

–এটা তো আমার অধিকার ছিলো আর তোমাদের দ্বায়িত্ব। করতে তো হতোই। আরেকটা কথা মনে পরেছে। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্লক কে করেছে? খুলে দিতে বলবে। আর আমার ব্যাপারে দখলদারি করতে আসলে কিন্তু আমি চুপ থাকবো না। তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকদের বলে দিও, তারা মানুক বা না মানুক, ওদের জিনই আমি ক্যারি করছি। তাই ইট ছুড়লে পাটকেল খেতেই হবে।

রাশার মা চিৎকার করে উঠলো,

–আমাদের সম্মান নষ্ট করে এখন বড় বড় কথা বলছিস?

রাশা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,

–সম্মান! তোমাদের আদৌ সম্মান আছে তো? সাব্বির ভাইয়া যখন সিডনিতে একটা মেয়ের সাথে তিন বছর লিভ ইন এ ছিলো, আর যখন সেটা পাবলিক হয়ে গেছিলো, তখন তোমাদের সম্মান যায়নি? ঘরে বউ বাচ্চা রেখে যখন ছোট চাচা হোটেল রুমে ধরা পরলো তখন তোমাদের সম্মান যায়নি? আর বাবা…

ফোন ডিসকানেক্ট হয়ে গেলো। রাশা উঠে দাঁড়িয়ে ফোন ব্যাগে ঢুকালো। মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। খুব ভালো করেও জানতো, এই প্রসঙ্গ তুললে মা ফোন কেঁটে দেবে। মায়ের মুখের উপর ফোন কাঁটা ভালো দেখায় না। তার থেকে ওপাশ থেকে কল কাঁটলেই সব থেকে বেশি ভালো হয়।

****
উষিরের আনলিমিটেড ক্রেডিট কার্ডের বিলও আনলিমিটেডই হলো। ইয়া বড় একটা রিসিট বের হলো। সেগুলো নিয়েই ঘরে ফিরলো রাশা। অন্যদিকে উষির পার্টি অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংএ ছিলো৷ তিনটে মন্ত্রী আর কয়েকটা এমপির সাথে এই মিটিং৷ সব ঠিকঠাক থাকলে সামনের নির্বাচনে সংসদসভায় উষিরের জন্য একটা সিট বরাদ্দ থাকবে৷ সে হয় মন্ত্রী আসনে, নাহয় উপমন্ত্রী আসনে আর নাহলে এমপি তো হবেই হবে। তার নিচে সে নামতে চায় না। মেয়র, চেয়ারম্যানের মতো ছোটখাটো পদে বসে মাথার উপরে উঁচু মহলের ছুড়ি ঘোরানো দেখার মতো সহ্যশক্তি তার নেই। এইদিকে মিটিংএর মাঝেই তার ফোনে কলের উপর কল, মেসেজের উপর মেসেজ আসতে থাকে। সাথে আছে আনলিমিটেড ক্রেডিট কার্ডের কস্টবিল।
ফোন সাইলেন্ট ছিলো। তাই মিটিং চলাকালীন দেখতে পায়নি উষির। মিটিং শেষে ফোন হাতে নিতেই তার কপাল কুঁচকে গেলো। পরমুহূর্তেই কপাল সোজা হলেও চোখ বিষ্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো। মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো৷ প্রচন্ড রেগে তক্ষুনি বাড়ি ফিরলো।

একা একাই ঘুরে ঘুরে শপিং করে প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছিলো রাশার। ফিরেই খেতে বসলো। মেন্যুতে কাঁটাযুক্ত একটা মাছ ছিলো। রাশা মনোযোগ দিয়ে মাছের কাঁটা ছাড়াচ্ছিলো। উষির রাশাকে খাওয়া অবস্থায় দেখে আরো রেগে গেলো। তার এতো বড় ক্ষতি করে এখন তারই বাড়িতে বসে পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছে!
উষির রেগে রাশার সামনে রাখা ভাতের প্লেট হাতে তুলে ঢিল দিয়ে ফেলে দিলো। চমকে উঠে দাঁড়ালো রাশা। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়ির সদস্যরা দ্রুত পায়ে ডাইনিংরুমের বাইরে এসে জড়ো হলো। রাশা ঢোক গিলে উষিরের আগুন লাল চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। উষির রাশার ভয়কে দ্বিগুণ বাড়িয়ে কবজি শক্ত করে চেপে ধরলো৷ ব্যথায় চোখ বুজে ফেললো রাশা। উষির ভয়ংকর স্বরে বললো,

–তোমার এসব করার সাহস হয় কিভাবে? ভাবো কি নিজেকে? তুমি যা খুশি করবে আর আমি সবটা মেনে নেবো? হাতের পুতুল আমি? এক্ষুনি তুমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে৷ তোমাকে আর সহ্য করতে পারছি না।

চিৎকার করে উঠলো উষির। কেঁপে উঠলো রাশা। কিছু বলতে যাবে তার আগেই শাহিদা গমগমে স্বরে বললো,

–কি হয়েছে?

উষির রাশার হাত প্রায় ছিটকে ছেড়ে দিলো। পেশিতে টান লাগলো ভীষণ। হাতের জয়েন্টের কাছে এক হাত দিয়ে চেপে ধরলো সে। উষির মায়ের দিকে এগিয়ে চেঁচিয়ে তিরিক্ষ স্বরে বললো,

–কি করেনি সেটা বলো? বিয়ের কথা পাবলিক করে দিয়েছে। এখন ফোনের উপর ফোন আসছে। সবাইকে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। এতো ঝামেলার মধ্যে আরেকটা ঝামেলা বাজালো। এসব এখন সামলাবো কীভাবে?

শাহিদা থমথমে গলায় বললো,

–ও ভুল কি বলেছে? তোদের বিয়ে হয়নি? আর রাশার সাথে এমন ব্যবহার করার সাহস হয় কিভাবে? তোর বাবাকে কোনদিন আমার সাথে এমন করতে দেখেছিস? বাড়ির সবার সামনে ওকে অপমান কেনো করলি? মুখের গ্রাস কেঁড়ে নেওয়ার সাহস কে দিয়েছে তোকে? যদি সম্মান করতে না পারিস তাহলে অসম্মান করার সাহসও তোর নেই।

শাহিদার গলা দিয়ে রাগ বেরোচ্ছে৷ অত্যান্ত রুষ্ট দেখাচ্ছে তাকে। মাহফুজাও রেগে ছিলো৷ রুঢ় কণ্ঠে বললো,

–ভাবি ঠিক বলেছে উষির। তোমার কাকা যতদিন বেঁচে ছিলো ততদিন সবার সামনে আমার সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করতে দেখেছিলে? তোমার দুই বোন কি শিখবে বলোতো? যতই রেগে থাকো, তাই বলে কেউ খেতে বসলে তার মুখের সামনের খাবার এভাবে কেড়ে নেবে?

উষির আহত স্বরে বললো,

–ও আমার সম্মান নষ্ট করেনি, ছোট মা?

শাহিদা গমগমে স্বরে বললো,

–তোর সাথে ওর সম্মান নষ্ট হয়নি?

উষির রাগে জর্জরিত কণ্ঠে বললো,

–আজকে তো ওর কিছুই হয়নি। যা ক্ষতি হওয়ার সব আমার হয়েছে।

শাহিদা গম্ভীরমুখে বললো,

–তুই অবিবাহিত ছিলি জন্য সবাই তোকে সাপোর্ট করতো আর এখন বিবাহিত হয়ে গেছিস তাই কারো সাপোর্ট পাবি না। এই ভয় পাচ্ছিস?

উষির রাগ ভুলে থতমত খেয়ে বললো,

–আমি এসব কখন বললাম?

–তাহলে সমস্যা কোথায় হচ্ছে? কারো কাছে কমিটেড ছিলি? কাউকে বলেছিলি, তাকে না জানিয়ে বিয়ে করবি না? নাকি তোর পার্টি অফিসে কোন রুল আছে যে বিবাহিত কেউ রাজনীতি করতে পারবে না?

উষির হতাশ হলো। রাগ ছুটে পালিয়ে এখন মায়ের আদুরে বাচ্চার মতো ভেঙে পরলো,

–সেসব কিছুই না মা। তুমি বুঝতে পারছো না। এসব অনেক জটিল ব্যাপার। যখন যা খুশি তা করতে পারবো না। আমার সব ব্যাপারেই কৈফিয়ত দিতে হয়।

–কাকে কৈফিয়ত দিতে হয়? কথা বলা আমার সাথে। আমিও জানতে চাই, বিয়েতে তাদের কি এমন ক্ষতি হয়েছে যে শুভেচ্ছা না জানিয়ে কৈফিয়ত চাচ্ছে।

রাশার অজান্তেই তার চোখে পানি চলে আসলো। এই প্রথমবার তার সাথে এমনটা ঘটলো। কেউ তাকে সাপোর্ট করছে, তার হয়ে কথা বলছে! তার থেকেও বড় কথা, নিজের ছেলের বিপক্ষে গিয়ে কেউ বৌমার হয়ে কথা বলছে। তার বাড়িতেই অনেক মানুষ, অনেক বৌমা আর অনেক ছেলে আছে। কিন্তু কোনদিন এমনটা হয়নি। আর বোধহয় হবেও না কখনও।

উষির আর কোন কথা বললো না। যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিলো সেভাবেই ঝড়ের গতিতে চলে গেলো। সেই দুপুরে আর কারো খাওয়া হলো না। ময়না ফ্লোর পরিষ্কার করতে করতেই রাশা ঘরে চলে গেলো৷ তার খুব ঘুম পাচ্ছে। শাশুড়ি মায়ের অদ্ভুত ব্যবহার দেখে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে।

রাত দশটার পরে ক্ষিদের জ্বালায় নিচে আসলো রাশা। বাড়ির থমথমে পরিবেশে সবাই নিরবেই রাতের খাওয়া শেষ করেছিলো। রাশাকে ডাকলেও ক্ষিদে না থাকায় খেতে আসেনি। এখন খেতে এসেই এক অদ্ভুত দৃশ্যের মুখোমুখি হলো। আফসার সাহেব প্লেটে খাবার নিচ্ছিলেন। রাশার ধারণা মতে সবার খাওয়া হয়ে গেছে৷ তাই কৌতূহল মেটাতে আফসার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলো,

–কার জন্য খাবার নিচ্ছো আংকেল?

আফসার সাহেব আলতো হেসে বললো,

–তোমার শাশুড়ির জন্য। ছেলে না খেয়ে চলে গেছে, রাগ করে তিনিও না খেয়ে আছেন। দেখি রাগ ভাঙাতে পারি নাকি।

রাশা এতো পরিমাণে অবাক হলো, তা বলার বাইরে। বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে বললো,

–তুমি আন্টির জন্য খাবার নিচ্ছো? তুমি মানে..!

বিষ্ময়ে আর কথাই বলতে পারলো না। আফসার সাহেব হেসে ফেললেন।

–কেনো মানা আছে নাকি?

–তা নেই কিন্তু ব্যাপারটা আমার জন্য নতুন। বাট আই লাইক ইট।

মুগ্ধ হেসে বললো রাশা। আফসার সাহেব চওড়া হেসে বললেন,

–ক্ষিদে পেলে তোমার আন্টি খুব রেগে যায়। আর একটু দেরি হলে আমাকে ঘরেই ঢুকতে দেবে না।

রাশা মুগ্ধ হয়ে গেলো। তার বাড়িতে এই ব্যাপারটা আমাবস্যার চাঁদ। এই বাড়িতে আসার পর কত নতুন নতুন জিনিস দেখছে সে। দুইদিনও হয়নি আর আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য হচ্ছে। রাশার ক্ষিদে আবার চলে গেলো। শাশুড়ির পরে শ্বশুরের এমন অদ্ভুত চালচলনে ক্ষিদে মরে ভুত হয়ে গেলো৷ কিচেন কেবিনেট থেকে তিন প্যাকেট চিপস, এক প্যাকেট বিস্কুট আর আড়াইশো গ্রামের একটা জুসের বোতল নিয়ে ঘরে ফিরলো। ভাতের ক্ষিদে মরে গেলেও পেট তো ফাঁকা৷ সেটা তো ভরতে হবে। তার উপর ঘরে বিশাল বড় একটা টিভি আছে। সেখানে আবার নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রাইব করা। আড়াম করে সোফায় পা তুলে বসে পেট পূজা করতে করতে মুভি দেখতে লাগলো সে। হরর মুভি চলছিল তাই লাইট বন্ধ করার কথা কল্পনাতেও আনলো না।
উষির আসলো রাত একটার পর। পরনে শুভ্ররঙা পাঞ্চাবি ময়লা হয়ে রয়েছে। মাঝারি আকৃতির চুলগুলো এলোমেলো। ফর্সা সুন্দর মুখ মলিন হয়ে আছে। রাশা একপলক সেদিকে তাকিয়ে আবার টিভি দেখায় মনোযোগ দিলো। উষির বেশ খানিকক্ষণ উশখুশ করে রাশার পাশে এসে বললো,

–আ..আ’ম সরি।

রাশার ভ্রু কুঁচকে গেলো। মাথা তুলে উষিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

–সরি ফর হোয়াট?

উষির আমতা-আমতা করে বললো,

–ফর মাই বিহেভিয়ার।

বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে রাশা বললো,

–হুম..তাহলে তো খুব খারাপ করেছো। আমার রাগ করে থাকা উচিৎ। খালাম্মা রাগ করে রাতে খায়নি। আংকেল খাবার নিয়ে আন্টির রাগ ভাঙাতে গিয়েছে। তুমি আমার সাথে বাজে বিহেভ করেছো। তাহলে তোমারও রাগ ভাঙাতে হবে।

উষির তপ্ত শ্বাস ফেললো। লোকমুখে শুনেছে, স্বামীর বাম পাঁজরের হাড় থেকেই নাকি স্ত্রীকে তৈরি করা হয়। তার মতো সাদাসিধা মানুষের বাম পাঁজরের হাড় এতোটা বাঁকা হলো কিভাবে!
উষির বাবার পথ অনুসরণ করে রাশার জন্য খাবার নিয়ে আসলো। রাশা থতমত খেয়ে গেলো। এই ব্যাপারটাও তার জন্য নতুন। শাশুড়ি, শ্বশুর এরপর তাদের ছেলে! আজ বোধহয় তার খাওয়াই হবে না। অলস ভঙ্গিতে সোফার উপর শুয়ে পরলো। কুশনে মুখ গুজে বললো,

–খাবো না আমি। ক্ষিদে নেই।

উষির রাশার হাত টেনে উঠে বসালো। শাসিয়ে বললো,

–একটা ভাতও জেনো না থাকে।

রাশা ঢোক গিললো। কেনো যেনো আর মানা করতে পারলো না। উষির চেঞ্জ করার জন্য ক্লোজেট খুলেই হা হয়ে গেলো। ক্লোজেটের চার ভাগের সারে তিন ভাগই রাশার জামাকাপড় দিয়ে ভর্তি। মাত্র তিনতে তাকের মধ্যে তার জামাকাপড় রাখা রয়েছে। একটাতে তার টি-শার্ট আর ট্রাউজার, আরেকটা তাকে তার শার্ট আর প্যান্ট আর একটা তাকে তার পায়জামা পাঞ্চাবি। বিষ্মিত নয়নে রাশার দিকে তাকালো। তৃপ্তি করে খেতে থাকা রাশার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না। নিজের বাকি জামাকাপড়গুলোর কথাও আর জিজ্ঞাসা করতে পারলো না।
রাতে শোয়ার সময় রাশা যখন তার সাইড থেকে সরে উষিরের সাইডে এসে পরলো তখন সে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলো,

–আমার বাকি জামা কোথায় রেখেছো?

রাশা অলস ভঙ্গিতে হাই তুলে বললো,

–ময়না, বৃষ্টি আর বন্যার সাথে মিলে তোমার ডেইলি ইউজড ড্রেস বাইরে রেখে বাকিগুলো প্যাক করে রেখে দিয়েছি। আমার অতো বড়বড় লাগেজ ফাঁকাই পরে ছিলো। ওর মধ্যেই সুন্দর করে রাখা আছে

বলেই উষিরের দিকে পিঠ দিয়ে পেছন ঘুরলো। উষির দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার জীবনে পরিবর্তন হলো তো হলো, তাও এভাবে হলো!

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৪+৫

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৪

রাতের খাবার নিয়ে রাশা আর শাহিদার মধ্যে বড়সড় বাকবিতন্ডা হলো। এটাকে নিরব বাকবিতন্ডাও বলা যায়। রাশা রাতে খাবে চিকেন স্যুপ। কিন্তু শাহিদা কিছুতেই চিকেন স্যুপ বানাতে দেবেন না। এই মেয়ের কোন রকমের মন মনানিই তিনি আর সহ্য করবেন না। কিন্তু রাশা তো জানেই, হবে সেটাই যেটা সে চাইবে। আর এই বাকবিতন্ডায় যে সেই জিতবে সেটাও জানতো৷ আর হলোও তাই৷ একসময় শাহিদা আর না পেরে বললো,

–চিকেন স্যুপ কিভাবে বানায়, জানো তুমি?

রাশা স্ব-গর্বে মাথা নেড়ে বললো,

–অবশ্যই জানি।

শাহিদার কথাটা একদম বিশ্বাস হলো না। দুই হাত ভাজ করে বললো,

–আচ্ছা! বলো দেখি?

–চিকেন, ওয়াটার অ্যান্ড..অ্যান্ড স্পাইসেস।

উপকরণগুলোর নাম বেশ সময় নিয়ে ভেবে ভেবে বললো রাশা। আসেপাশের সবাই মিটিমিটি হাসতে লাগলো৷ শাহিদা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

–কি কি স্পাইসেস?

রাশা আবার ঢোক গিললো। দুই একটা মশলার নামই তার জানা আছে। সেগুলোতেই কাজ সারতে চাইলো,

–ওইতো, যেগুলো দিয়ে কুকিং হয় লাইক চিলি পাউডার, টারমারিক পাউডার, সল্ট..

–সল্ট স্পাইসেস?

বন্যা চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে উঠলো। রাশা ঠোঁট উলটে কাধ নাচিয়ে বললো,

–আরে বাবা হলেই তো হলো। দেয় নাকি সেটাই ম্যাটার করে।

শাহিদা মুখ টিপে হেসে বললো,

–আচ্ছা, তাহলে যাও আর রান্না করে খাও।

রাশা দাঁত বের করে হেসে বেশ গর্বের সাথে হেঁটে রান্নাঘরে যেতে যেতে বললো,

–অ্যাজ ইউ লাইক বেস্ট মাই ডিয়ার খালাম্মা।

শাহিদার রাগে শরীর জ্বলে উঠলো। রাশাকে অনেক কথা শুনানোর তীব্র ইচ্ছেকে দমিয়ে দরজা খুললো। কারন তখন কলিংবেল বেজে উঠেছে৷ দরজা খুলতেই উষিরের ক্লান্ত মুখশ্রী নজরে পরলো। শাহিদার বুকটা হাহাকার করে উঠলো৷ লিভিংরুমের সোফায় বসা পর্যন্ত ছেলেকে কাছ ছাড়া করলেন না। এমনকি বসার পরও ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ছেলের সাথে এতো বড় একটা কান্ড ঘটে গেলো, এখন নিশ্চয় ছেলেটা খুব ভেঙে পরেছে। তবে উষিরকে দেখে খুব একটা চিন্তিত মনে হলো না। স্বাভাবিক ভাবেই কাঁধের ব্যাগ সোফার পাশে রেখে সোফা টেবিলের উপর পা তুলে আড়াম করে বসলো। বৃষ্টির বোধহয় এই আড়ামটা সহ্য হলো না। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হেসে বলে উঠলো,

–ভাইয়ার তো আজকে বাসর রাত। ডেকোরেটরদের ফোন করে বাসরঘর সাজাতে বলবো বড়মা?

বড়মা শব্দটা বেশ টেনে লম্বা করে বলে মুখ টিপে হাসলো বৃষ্টি। উষির চমকে বৃষ্টির দিকে তাকালো। ক্ষণকালের জন্য তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। তারপর যখন মনে পরলো আজ সকালেই এক দূর্ঘটনার মধ্যে তার বিয়ে হয়েছে তক্ষুনি চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আজ তার সম্মান নিয়ে চূড়ান্ত এক ছেলেখেলা হয়েছে। সেটা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো কিভাবে! অবশ্য সারাদিন ঘুরে ফিরে টিম মেম্বারদের নিয়ে কাজ করে ভুলেই গেছিলো যে আজ এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। রাগে উষিরের দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছা হচ্ছে। বাবাকে মাঝরাস্তায় রেখে আসার সময় ভেবেছিলো, আর কোনদিন বাড়ি ফিরবে না। আর চব্বিশ ঘণ্টা না যেতেই কেমন ভ্যাবলার মতো বাড়ি ফিরে এসেছে। বাবা দেখলেই বলবে,

–খুব তো দেমাগ নিয়ে বললে, বাড়ি ফিরবো না। একদিনও বাপের ছায়া ছাড়া টিকতে পারলে না? এই নাকি তুমি আবার পলিটিক্স করবে! লজ্জার কথা!

আত্মসম্মানে আঘাত লেগে চট করে উঠে দাঁড়ালো উষির। নিজের ভুল ঢাকতে আমতা-আমতা করে বললো,

–আমি আমার জামাকাপড় নিতে এসেছি।

উষির আসার পরে বন্যা নিজ দ্বায়িত্বে আফসার সাহেবকে খবর দিয়েছে। আফসার সাহেব সেই যে দুপুরের পর বাড়ি ফিরে নিজের কাজের ঘরে ঢুকেছিলেন, তারপর আর বের হননি। পারিবারিক এই ঝামেলা থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই তার এই ব্যবহার। কিন্তু ঝামেলা থেকে মুক্তি চাইলেই কি আর মুক্তি পাওয়া যায়!
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই উষিরের শেষের বাক্য কানে গেলো। সাথে সাথেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসতে আসতে বললেন,

–জামাকাপড় নিয়ে কোথায় যাবে শুনি?

উষিরের দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। চোয়াল শক্ত, হাত মুঠো করা। স্থির, দৃঢ় গলায় বাবার প্রশ্নের উত্তর দিলো,

–আমার কি থাকার জায়গা অভাব আছে নাকি? ফ্ল্যাট আছে, ক্লাব আছে, পার্টি অফিস আছে।

আফসার সাহেব ছেলের কাছাকাছি এসে গমগমে স্বরে বললেন,

–তাহলে সাথে করে বউকেও নিয়ে যেও।

উষির দৃঢ় গলায় বললো,

–আমার কোন বউ টউ নেই।

–ঠাটিয়ে একটা চড় দেবো বেয়াদব ছেলে। বিয়ে করে বলছো বউ নেই? তোমার পার্টি অফিসে আর তোমার জনগনের মধ্যে কথাটা পাবলিশ করলে কি হবে বুঝতে পারছো?

আফসার সাহেব প্রচন্ড রেগে গেছেন। শাহিদা হালকা রাগ দেখিয়ে শক্ত গলায় বললো,

–কে বলবে?

আফসার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে পরিহাসের সুরে বললেন,

–সেই মহান দ্বায়িত্বটা আমিই পালন করবো।

নিজেদের কাজ ফেলে রাশা আর ময়না রান্নাঘর থেকেই লিভিংরুমে চলা বাকবিতন্ডা দেখতে লাগলো। নিজের প্রসঙ্গ আসায় রাশার কান খাঁড়া হয়ে উঠলো। নিজেকে আর আঁটকাতে না পেরে লিভিংরুমের দোরগোড়ায় হাজির হলো।
শাহিদার চোখে পানি চলে এসেছে। নাক টেনে অভিমানী গলায় বললো,

–তুমি বাবা নামে কলঙ্ক!

–ঠিক বলেছো শাহিদা। এই কলঙ্কিত বাবার ছেলে আজ একটা মেয়ের দ্বায়িত্ব নিয়েছে। এখন কলঙ্কিত বাবা হয়ে ছেলে সেই দ্বায়িত্ব পালন করছে নাকি সেটাও তো আমাকেই দেখতে হবে।

এরপর কঠিন গলায় বললো,

–তুমি তোমার ছেলেকে বলো রাশাকে নিয়ে বাইরে দাঁড়াতে। সম্মানের সাথে ছেলের বউকে বরণ করে ঘরে তুলবে তুমি।

উষির বাবার কথা না মেনে দুই পা ফেলে বললো,

–আমি চলে যাচ্ছি।

আফসার সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন,

–খবরদার বলছি উষির! এটা আমার আদেশ।

শাহিদা ভয়ে কেঁপে উঠলো। বাকিরা কানে আঙুল চাপা দিতে বাধ্য হলো। বাবার বাধ্য ছেলে হিসেবে পরিচিত উষির বাবার আদেশ ফেলতে পারলো না। গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালো। টি-শার্ট আর থি-কোয়াটার ট্রাউজার পরা রাশাও গিয়ে উষিরের পাশে দাঁড়ালো। ময়না চট করে ঘর থেকে রাশার বিয়ের ওড়না নিয়ে এসে রাশার মাথায় পরিয়ে দিলো। বিয়ের শাড়ি ময়নাকে দিলেও বিয়ের ওড়না নিজের কাছেই রেখেছিলো। কারণ ওড়নাটা রাশা নিজে পছন্দ করে কিনেছিলো। যদিও শাড়ির সাথে ম্যাচিং করেই তবুও কিনেছিলো তো রাশা নিজেই। ময়না দুইজনকে একসাথে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলো। কি মানিয়েছে দুজনকে! মনে মনে প্রাণ ভরে দোয়াও করে দিলো।
বন্যা আর বৃষ্টি বধূ বরণের ড্রেসাপের এই অড কম্বিনেশন দেখে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলো না। ক্যামেরায় ফটাফট ফটো ক্যাপচার করতে লাগলো।
গত রাতের রান্না করা পায়েস ফ্রিজে পরেছিলো। মাহফুজা সেটা এনেই শাহিদার হাতে তুলে দিলো। মুখ কালো করে সেই পায়েসই উষিরের মুখে আর রাশার মুখে দিলো। একবার খেয়েই রাশা মুগ্ধ হয়ে গেলো।

–ওয়াও খালাম্মা! কি টেস্টি পায়েস! পুরোটা খাই?

শাহিদা থমথমে মুখে পুরো বাটি রাশার হতে তুলে দিলো। রাশা আরেক চামচ মুখে তুলে চোখ বুজে স্বাদ অনুভব করলো। তারপর চোখ খুলে আনন্দিত গলায় বললো,

–কে রান্না করেছে?

বন্যা উচ্ছ্বাসিত স্বরে বললো,

–মা রান্না করেছে।

রাশা মিষ্টি হেসে মাহফুজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

–তুমি রান্না করেছো আন্টি? এতো টেস্টি রান্না করো? আসো তোমাকে একটা পাপ্পি দেই।

মাহফুজা ভয়ংকর দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আতংকিত দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকালো৷ তারপর কয়েক পা পিছিয়ে দূরত্ব বজায় রাখলো। তার এক মেয়ে তাকে বিপদে ফেললেও আরেক মেয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করলো। বৃষ্টি বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,

–পরের সেশন কিন্তু সালাম করা।

রাশা বৃষ্টির কথা শুনে আগে পুরো পায়েস শেষ করে মাথায় ভালো করে ঘোমটা টেনে নিলো। তারপর এগিয়ে এসে শাহিদার পা ছুঁইয়ে সালাম করতে চাইলো। সাথে সাথে শাহিদা দুই পা পিছিয়ে গেলো। রাশা হেসে ফেলে আবার দুই পা এগিয়ে গেলো। এভাবে বেশ কয়েকপা পেছানোর পর মাহফুজা এসে শাহিদাকে ধরলো। সাবধান করে বললো,

–সালাম না করা পর্যন্ত ছাড়বে না ভাবি। তার থেকে ভালো হবে এনার্জি খরচ না করে সালাম করতে দেওয়া।

রাশা দাঁত বের করে হেসে বললো,

–বুদ্ধিমতী আন্টি।

বলেই শাহিদা আর মাহফুজা দুইজনকেই সালাম করে উঠে দাঁড়ালো। শাহিদা ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলে কয়েকদিন আগে গড়া গোল্ড আর স্টোনের মিশেলে তৈরি চিকন চেইনের ব্রেসলেটটা উপহারস্বরুপ রাশার হাতে পরিয়ে দিলো। শাহিদার বুক হাহাকার করে উঠলো। আফসার সাহেব এটা না এনে দিলে কিছুতেই তিনি এই মেয়েকে ব্রেসলেটটা দিতেন না। কত শখ করে বানিয়েছে ছেলের বউএর জন্য। কিন্তু এমব বউকে দিতে হবে এটা কল্পনায় আসলেও বোধহয় ব্রেসলেটটা বানাতেন না।

পায়েস খাওয়ার পরই উষির হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেছিলো। খানিকপর বন্যার সাহায্যে রাশাও ঘরের সামনে গেলো। লাগেজগুলো এখনও ময়নার ঘরেই পরে আছে। কাল সকালে ওগুলো পাঠাবে বললো। তাই খালিহাতেই স্বামীর ঘরে প্রবেশ করলো রাশা।

উষির ক্লোজেট থেকে নিজের জামাকাপড় বের করছিলো। রাশা প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো। উষিরের কাছাকাছি গিয়ে বললো,

–দেখো, আমরা কিন্তু ম্যাচিউরিটির সাথে একটা অ্যাগ্রিমেন্টে আসতে পারি। লাইক, গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি। আমরা একসাথে যখন থাকবোই তখন দুই দিক থেকেই সমান এফোর্ট দিতে হবে। যেমন ধরো, আমাদের এই অ্যাগ্রিমেন্টে থাকবে, কেউ নক না করে ঘরে ঢুকতে পারবে না। আবার কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলাতে পারবে না। এই ধরনের একটা অ্যাগ্রিমেন্ট করলে কিন্তু ব্যাপারটা খুব ভালো হয় রাইট?

বেশ কয়েক চক্কর চলন্ত উষিরের পেছনে চলেও নিজের কথার উত্তর পেলো না রাশা৷ একসময় বিরক্ত হয়ে উষিরের হাত থেকে পোশাক টেনে নিয়ে বললো,

–কিছু বলছি আমি? কথা বলছো না কেনো?

উষির রেগে চিৎকার করে উঠলো,

–গো টু হেল।

–গেলে তোমার সাথেই যাবো বুঝেছো। আংকেল কি বললো মনে নেই? সব পাবলিক করে দেবে। সব মানে সব..

উষির রেগে রাশার হাত মুচড়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। তারপর হিসহিসিয়ে বললো,

–আমার সম্মান নিয়ে খেলেছো আজকে? তুমি জানতে, ওই ঘটনায় আমার কোন দোষ নেই। তারপরও তুমি কিছুই বলোনি। এখন এতো ঢং করছো, লজ্জা করছে না?

রাশা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলালো। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টার কোন কমতি রাখছে না৷ তাই উষিরের সামনেও ভেজা বেড়াল হলো না। হাসার চেষ্টা করলো,

–তোমার গায়ে এতো শক্তি! বাপরে বাপ!

উষির রাশাকে ছেড়ে দিতেই দুই কদম পিছিয়ে হাত ডলতে ডলটে রাশা বললো,

–ওই ঘটনার কথা বলছো তো? প্রথমত, সম্মানহানি শুধু তোমার না, আমারও হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সবাই সবটা জানে। শুধু কিছু একটা করা দরকার ছিলো জন্য করেছে। আর তৃতীয়ত, তোমার জন্য এটা নতুন কি ব্যাপার। দুইদিন পর পরই তো তোমাদের মতো পলিটিশিয়ানদের নতুন নতুন রিউমার ছড়ায়।

উষির ভয়ংকর দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকিয়ে লাগেজের চেইন আঁটকে বিছানা থেকে নামালো। রাশা আঁতকে উঠে উষিরের হাত টেনে বললো,

–আরে আরে, যাচ্ছো কেনো? আমাদের কথা তো শেষ হয়নি।

উষির নিজের হাত ছাড়িয়ে ঝুঁকে রাশার মুখের সামনে মুখ নিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

–আমাদের আর কোন কথা নেই। বুঝেছো?

শেষের শব্দটা চিৎকার করে বলেছিলো উষির। রাশা কেঁপে উঠলেও চুপ থাকলো না। উষিরের পেছনে ছুটতে ছুটতে বললো,

–আরে বাবা, ঘটনাটা তো শুনে যাও। প্লিজ?

আগে গিয়ে দরজার সামনে দুই হাত দুই দিকে দিয়ে দাঁড়িয়ে এক নিঃস্বাসে বললো,

–বিয়ে বাড়িতে তো অনেক লোকজন থাকে। তাই অতো লোকের ভিড়ে আমি ঘুমাতেই পারছিলাম না। না ঘুমালে তো বিয়েতে মজাই করতে পারতাম না। তাই ভাবলাম, নিলয় ভাইয়ার ঘর তো ফাঁকাই আছে। ওখানে গিয়েই ঘুমাই। আমি কি জানতাম নাকি যে ওই ঘরে তুমিও আছো। আমি তো জানতাম, নিলয় ভাইয়া নিজের ঘর কারো সাথে শেয়ার করে না তাই হয়তো ভাইয়ার রুমটা ফাঁকাই আছে। সত্যি জানলে কি নিজের এতো বড় ক্ষতি করতাম বলো? সৌরভকে আমি কত্তো ভালোবাসি। আমি তো নিজের ভালোবাসাকে হারালাম!

কোন কথাটা যে সত্যি আর কোন কথাটা যে বানানো তা হয়তো রাশা নিজেও বেমালুল ভুলে গেছে। আপাতত উষিরকে মানানোই তার এক মাত্র উদ্দেশ্য।
উষির রাগী গলার স্পষ্ট ভাবে বললো,

–আমি রাজি না।

রাশা এবারে হুমকির পথ বেছে নিলো,

–তুমি যদি রাজি না হও তাহলে আমি সু’ইসা’ইড করবো।

উষির বেশ মজা পেয়েছে, এমন ভাবে বললো,

–রিয়েলি?

–হুম।

–বড় বাঁচা বাঁচবো। গো অ্যাহেড। আ’ম সুপার এক্সাইটেড।

রাশা আড় চোখে উষিরের দিকে তাকিয়ে বললো,

–ম’রবো না। নিজের সুবিধামতোই সব করবো। আর তোমার নামে অ্যালিগেশন আনবো। তুমি বিয়ের পর থেকে আমাকে মেন্টালি আর ফিজিক্যালি টর্চার করছো। এরপর কি হবে জানো, তোমাকে তোমার পার্টি অফিসে ঢুকতেও দেবে না। ঘাড় ধরে বের করে দেবে। তোমার পলিটিক্স ক্যারিয়ার সেখানেই ফিনিশড!

উষির লাগেজ রেখে দুই তালি বাজিয়ে বললো,

–সুপার্ব আইডিয়া। আইডিয়াটা এক্সিকিউট করলেও করতে পারে। ক্যারি অন।

রাশা হতাশার সুরে বললো,

–তুমি এতো জেদি কেনো বলোতো? তোমার জায়গায় সৌরভ হলে এতোক্ষণে নাচতে নাচতে রাজি হয়ে যেতো।

উষির কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রাশাকে দেখতে লাগলো। খুব রাগ হলো রাশার। বিরক্তির সাথে বিড়বিড় করলো,

–কোন হেলদোল নেই! আশ্চর্য! এই মাথা নিয়ে করে পলিটক্স! ধ্যাত!

তারপর বড় করে শ্বাস ফেলে ঢোক গিলে উষিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। দুই হাত জরো করে অনুরোধ করলো,

–বাবা আমাকে ত্যাজ্য করে দিয়েছে। পরিবারের সবাই আমাকে ত্যাগ করেছে। আমার ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সব ব্লক করে রেখেছে। দুনিয়ার সব থেকে গরীব, দুঃখী আর অসহায় মেয়েটাকে একটু সাহায্য করো প্লিজ? তোমার এলাকায় এসেছি। আমি তো এখন তোমার ডাবল দ্বায়িত্ব। প্লিজ সাহায্য করো, প্লিইইইজ?

উষিরের মন গললো নাকি বোঝা গেলো না। শুধু নির্বিকার গলায় বললো,

-এখন কি করতে চাচ্ছো?

রাশা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বললো,

–তেমন কিছুই না। ঘরের বাইরে আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ আর ভেতরে আমরা নিজেরা নিজেদের মতো চলবো। আর একটা অ্যাগ্রিমেন্ট অনেক জরুরি। আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্য কিছু রুল তৈরি করবো আর সেটাই আমরা ফলো করবো। এতে তুমিও হ্যাপি আর আমিও হ্যাপি।

উষির হাপ নিঃশ্বাস ফেলে পেছন পথে হেঁটে বললো,

–ভেবে দেখবো।

রাশা উত্তেজিত হয়ে উঠলো,

–আরে ভাবাভাবির কি আছে? আমি এক্ষুনি অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার তৈরি করছি।

নিজের কথা শেষ করে খুঁজে খুঁজে খাতা কলম বের করে লিখতে শুরু করলো,

নিয়মসমূহ-

১. অনুমতি ব্যতীত ঘরে প্রবেশ নিষেধ।
২. কেউ কারো কোন জিনিসে হাত দেবে না। এমনকি কেউ কারো ব্যাপারে কথাও বলবে না।
৩. ক্লোজেটের ডান পাশ রাশার এবং বাম পাশ উষিরের। এবং বেডের বাম পাশ রাশার এবং ডান পাশ উষিরের। এবং বাকি তৈজসপত্রও এভাবেই দুটি অংশে ভাগ করা থাকবে। এবং কেউ কারো অংশে দখলদারি করবে না।
৪. অ্যালকোহল সেবন করে ঘরে আসা যাবে না। এবং ঘরে স্মোক করা যাবে না।

লেখা শেষে খাতা উষিরের হাতে দিয়ে বললো,

–আপাতত এইটুকুই পেরেছি। পরে মনে পরলে আস্তে আস্তে অ্যাড করে দেবো।

উষির বিছানায় বসে খাতা হাতে ভ্রু কুঁচকে বললো,

–এখানে অ্যালকোহলের ব্যাপার আসছে কেনো?

রাশা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

–খুব বিশ্রী গন্ধ আসে। একবার টেস্ট করেছিলাম। টানা দুইদিন ভাত খেতে পারিনি। তাই ওটা বাদ।

উষির মাথা নেড়ে মনোযোগ দিয়ে আবার পুরোটা পড়ে বললো,

–আরেকটা জিনিস অ্যাড করো। কেউ কারো টাকায় নজর দেবে না।

রাশা অত্যান্ত দুঃখী গলায় বললো,

–আজ গরীব হয়েছি জন্য এতো বড় অপমান করতে পারলে? টাকার তেজ দেখাচ্ছো আমাকে? মনে বড্ড আঘাত দিলে!

বলেই জোরে নাক টানলো। অর্থাৎ কান্না করতে চাচ্ছে। তবে এতে উষির একদম গললো না। রাশার হাত থেকে কলম ছিনিয়ে নিয়ে বললো,

— আমিই লিখছি।

পাঁচ নম্বর নিয়ম হিসেবে টাকার ব্যাপারটা লিখে কুটিল হেসে রাশার দিকে তাকালো উষির। তারপর নিয়মের খাতাটা যত্ন করে রেখে নিজের নির্ধারণ করা জায়গায় গিয়ে শুয়ে পরলো। রাশা হতাশ হয়ে নিজেও ঘুমালো। এবং পরেরদিন সকাল থেকে দুজনেই খুব দ্বায়িত্বের সাথে নিয়মগুলো ভঙ্গ করতে লাগলো।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৫

সকাল সারে সাতটা থেকে অ্যালার্ম বেজে চলেছিলো। প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর বাজা এই অ্যালার্মের শব্দে উষির মহা বিরক্ত। একসময় আর না পেরে দুম করে উঠে বসলো। রাশা নিজের বর্ডার ক্রস করে উষিরের বালিশে এসে শুয়ে পরেছে৷ আর উষির নিজের সাইডের, নিজের বালিশের একদম কর্নারের জায়গায় শুয়ে ছিলো। রাশার বালিশ তার পায়ের দিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ ব্ল্যাংকেটও অর্ধেক মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বাকি অর্ধেক রাশা নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। এসির পাওয়ার চব্বিশে দেওয়া। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো উষিরের। এসির পাওয়ার সাতাশের নিচে কোনদিনও দেয়নি সে৷ ঠান্ডা খুব একটা সহ্য করতে পারে না। এই মেয়ে কখন পাওয়ার কমালো আর কখন এইভাবে এসে শুয়ে পরলো, কিচ্ছু টের পায়নি! অবশ্য বিড়ালের মতো এমন গা ঘেঁষে শুয়ে থাকলে ঠান্ডা বুঝবেই বা কিভাবে!

আবার অ্যালার্ম বেজে উঠলো। রাগে কিড়মিড়িয়ে উঠলো উষির৷ ওপাশ থেকে মোবাইল নিয়ে রাশার কানের কাছে ধরলো। তবুও তার কোন হেলদোল নেই। শুধু একটু চোখ কুঁচকে বিরক্তির ভাব করে আবার ব্ল্যাংকেট মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। উষির হাল ছাড়লো না। এবারে রাশার ফোনের সাথে নিজের ফোনেও সেম টিউন অন করে দুই ফোন একসাথে ধরলো। কাজও হলো। ধরফর করে উঠে বসলো রাশা। চোখ ডলে চোখ খোলার চেষ্টা চালালো। না পেরে আবার শুয়ে পরতে চাইলো। উষির হাত শক্ত করে ধরে বসিয়ে রাখলো৷ তারপর বেড সাইড টেবিল থেকে পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে রাশার মুখে ছুড়ে মারলো। চমকে উঠলো রাশা। দিশা না পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে মুখের পানি মুছে অতি কষ্টে উষিরের দিকে তাকালো৷ উষির রাগে ফুঁসছিলো। রাশা রেগে বললো,

–পানি দিলে কেনো?

উষির দ্বিগুণ রেগে উঠলো,

–অ্যালার্ম দিয়ে আমার ঘুম নষ্ট করলে কেনো?

চকিতে হুশ ফিরলো রাশা। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো পৌনে আটটা বাজে। উষিরকে আর কিছুই বললো না। তড়িৎ উঠে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে ড্রিম লাইট অফ করে বাকি সব লাইট অন করে দিলো৷ সাথে এসির সুইচও অফ করে দিলো। রাশা উঠে যাওয়ায় উষির আবার শুয়ে পরেছিলো। কিন্তু এমন ব্যবহারে ভয়ংকর রেগে বিছানা ছেড়ে তেড়ে গেলো রাশার দিকে। রাশা নিজেকে সেফ করতে এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। উষির বাইরে থেকে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে বললো,

–এরপর আবার আমার সাথে ফাজলামো করতে আসলে দ্বিতীয়বার ভেবে আসবে। অন্তত আজকের দিনের কথা মাথায় রেখে আসবে, বুঝেছো?

রাশা তখন কিছুই বুঝলো না। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হওয়ার সময় আসল মানেটা বুঝলো। তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। উষির আবার ঘুমে কাত হয়ে পরে আছে। বেশ কয়েকবার ডেকেও লাভ হলো না। মেজাজ অত্যাধিক খারাপ হলেও কষ্ট পেলো খুব। ওয়াশরুমে ঢুকে এমন আটকে থাকতে হবে, সেটা কে জানতো!

ওয়াশরুমের দরজা খুললো দশটার পর। রাশা ওখানেই ঘুমিয়ে পরেছিলো। উষির দেয়াল ঘেঁষে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ঘুমন্ত রাশাকে দেখলো। তারপর আশেপাশে দেখলো। রাশা দুই পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। শাওয়ারটা একটু এদিক ওদিক ঘুরালে পানি সোজা রাশার উপর পরবে। বাঁকা হাসলো উষির। তারপর প্ল্যান মাফিক কাজ করে সফলতাও পেলো। হকচকিয়ে উঠে পরলো রাশা। ভিজে একাকার অবস্থা। ঘটনা বুঝতে পেরে আগুন চোখে উষিরের দিকে তাকালো। উষিরও স্থির দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা হুমকি দিয়ে চলে গেলো।

রাশা সকালে হওয়া ঘটনা বেমালুম চেপে গেলো। ড্রেস চেঞ্জ করে উষিরের একটা স্লিভলেস টি-শার্ট আর একটা শর্টস পরলো। টি-শার্ট তার হাঁটু পর্যন্ত চলে আসতে চাইছিলো আর শর্টস তার থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট হয়ে রইলো। উষির ভ্রু কুঁচকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখলো৷ রাশা সেটা পাত্তাও দিলো না৷

ভেজা চুলগুলো এখনও হালকা করে বাঁধা। আজকে চাকরির প্রথম দিন আর আজকেই লেট করে ফেললো। তাই আর দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব রান্নাঘরে হাজির হলো। ময়না থালাবাসন মাজছিলো আর মাহফুজা কিছু একটা রান্না করছিলো। শাহিদা ডাইনিং টেবিলে বসে মটরশুটির দানা আলাদা করছে। রাশাকে রেখেই তেঁতে উঠলো সে,

–আজ তো বাড়ির বউ হয়েই এসেছো। তাহলে আজকে এসব কি পরে এসেছো?

রাশা কোমড়ে হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাজ খুঁজছিলো। ওভাবেই বললো,

–সরি খালাম্মা, এখন আমি ডিউটিতে এসেছি। একটু দেরি হয়েছে কিন্তু আমি আমার কাজে ভীষণ সিনসিয়ার। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি, প্লিজ।

হকচকিয়ে গেলো শাহিদা। তাকে পুনরায় হকচকিয়ে দিয়ে পেটে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো রাশা। কাতরাতে কাতরাতে বললো,

–সেই কাল অল্প পায়েস খেয়েছি। ক্ষিদের জ্বালায় ম’রে গেলাম!

শাহিদা কপাল কুঁচকে কিছুটা গরম করেই বললো,

–তো খেতে মানা কে করেছে?

রান্নাঘর থেকে সোজা এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পরলো রাশা,

–খেতে দিচ্ছো আর কই? আমি কি কিছু চিনি নাকি যে নিজে নিয়ে খাবো!

শাহিদা ময়নাকে হাঁক দিয়ে ডেকে রাশাকে খাবার দিতে বললেন। ময়না তড়িঘড়ি করে হাত ধুরে রান্নাঘর থেকে পরোটা, ভাজি আর মিষ্টি দিয়ে গেলো৷ রাশার পরোটা একদম পছন্দ না। কিন্তু কিছু বললো না। সেটাই গোগ্রাসে গিলতে লাগলো৷ খাওয়া শেষে আবার রান্নাঘরে গেলো। ময়নার থালাবাসন মাজা শেষ। রাশা ঠোঁট কামড়ে কিছু চিন্তা করে তার খাওয়া প্লেট এনে সিঙ্কের উপর রাখলো। প্লেট উল্টেপাল্টে কিছু দেখে অল্প ডিসওয়াসিং লিকুইড প্লেটে দিয়ে হাত দিয়েই অল্প ছড়িয়ে সাথে সাথেই পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললো। তারপর এক চোখ বুজে প্লেট মুখের সামনে ধরলো। ঠোঁট কামড়ে পরিষ্কার কেমন হয়েছে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। প্লেট রাখার জায়গায় প্লেটটা রেখে এবারে রান্নার কাছে গেলো। মাহফুজার থেকে জোর করে হাতের চামচ নিয়ে একটু পাতিলে নাড়াচাড়া করলো। মাহফুজা মোরব্বা বানাচ্ছিলো। রাশার কান্ড দেখে খুব বিরক্ত হলো। চামচ ফিরিয়ে দিতেই একপ্রকার ছোঁ মেরে চামচ নিয়ে নিলো।
এরপর আসলো ঘর মোছা আর ঘর ঝাট দেওয়ার কাজ। ময়নার থেকে ঝাটা নিয়ে সবাইকে অবাক করে রান্নাঘরটা কোনমতে ঝাট দিলো৷ তারপর মপ চুপচুপ করে ভিজিয়ে এনে পুরো রান্নাঘর ভিজিয়ে ফেললো। এরপর রাশার মুখে হাসি ফুটে উঠলো৷ শাহিদার দিকে তাকিয়ে বললো,

–সব কাজ কিন্তু শেষ খালাম্মা। এবার আমার ছুটি চাই।

মাহফুজা অবাক হয়ে এতোক্ষণ দেখছিলো। এবারে বললো,

–এটা কেমন কাজ ছিলো? এই টুকু কাজের পেমেন্ট বিশ হাজার!

রাশা গম্ভীরমুখে বললো,

–অ্যাগ্রিমেন্টে কিন্তু শুধু কাজের কথা লেখা আছে। কতটুকু করবো তা লেখা নেই।

মাহফুজা তটস্থ ভঙ্গিতে বললো,

–তাহলে পরিমাণও অ্যাড করে দেই। এই কাজের জন্য বিশ হাজার নষ্ট করার কোন মানেই হয় না!

রাশা স্থির চোখে তাকিয়ে বললো,

–অ্যাকর্ডিং টু রুল, এটা পসিবল না।

–এই রুল কবে তৈরি হলো?

রাশা দাঁত বের করে হাসলো,

–আজ, এখনই।

শাহিদা চুপ করে নিজের কাজ করছিলো। এই একদিনে রাশার প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি খুব ভালো বুঝে গেছেন। তাই আর নিজের মাথা ব্যাথা বাড়াতে চাইলেন না। রাশার সেটা সহ্য হলো বলে মনে হলো না। খাতা আনতে লিভিংরুমে হাজির হলো। ময়না রাশার কথা শুনে মাহফুজাকে মিনমিন করে বললো,

–আমিও একখান ওইসব কাগজ তৈরি করমু ম্যাডাম?

মাহফুজা ভয়ংকর এক ধমক দিয়ে ময়নাকে থামিয়ে দিলো। এমন চলতে থাকলে তো বাড়িতে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। সবাই নিজেদের মন মরজি কাগজের অ্যাগ্রিমেন্টের দোহাই দিয়ে করিয়ে নেবে!

রাশা নিজের ছুটির দরখাস্ত শাহিদার দিকে ধরে কলম বাড়িয়ে দিলো৷ শাহিদা ভ্রু কুঁচকে দেখে বুঝলো, ওটা ছুটির দরখাস্ত ছিলো৷ তাকে কোন প্রশ্ন করতে হলো না। রাশা নিজে থেকেই বললো,

–আমি একটু শপিংএ যাবো। যেহেতু সব কাজ শেষ তাই নিয়মমাফিক আমাকে ছুটি দিতেই হবে।

শাহিদা থমথমে গলায় বললো,

–তোমার নিয়মের মধ্যে আর কি কি নিয়ম পরে?

রাশা সুন্দর করে হেসে বললো,

–সেটা পরিবেশ, পরিস্থিতি আর মানুষভেদে তৈরি হয়। আগে থেকে কিছু বলা সম্ভব হয় না।

শাহিদা আর কথা বাড়ালেন না। কলমের আঁচড় টেনে ছুটির দরখাস্ত অ্যাপ্রুভ করলেন।

রাশা দরখাস্ত পকেটে পুড়ে সোজা রুমে চলে গেলো। উষির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছিলো। হাতে এক গাদা জেল নিয়ে মাঝারি সাইজের চুলগুলোকে সাইজ করে দিচ্ছিলো। রাশা সরাসরি গিয়ে উষিরের সামনে দাঁড়ালো। বলাই বাহুল্য, অনুমতি নেওয়ার ধার দিয়েও সে যায়নি।
উষির ভ্রু কুঁচকে রাশার বাড়িয়ে ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

–সমস্যা কি?

–কিছুই না। শপিংএ যাবো। টাকা লাগবে।

–কাল রাতের অ্যাগ্রিমেন্টের কথা ভুলে গেছো নাকি?

–না, ভুলবো কেনো? আমি তো আজীবনের জন্য নিচ্ছি না। ধার চাচ্ছি।

উষির স্পষ্ট গলায় বললো,

–দেওয়া যাবে না।

–আচ্ছা মানুষ তো তুমি! কেউ ধার চাইলে এভাবে মানা করতে আছে নাকি? তুমি না পলিটিক্স করো। আর ধার দিতে পারছো না? এমন করলে কিন্তু ভোট দেবো না।

–তোমার ভোট আমার দরকারও নাই।

রাশা বুঝলো, এভাবে হবে না। অন্য পথ ধরতে হবে। গলার স্বর নরম করে বললো,

–আন্টি এইসব ড্রেস মানে তোমার না, আমার কাছে যেমন ড্রেস আছে ওইগুলো পরতে মানা করেছে। নতুন বউএর নাকি শ্বশুরবাড়িতে এইসব মানে ওইসব মানে টি-শার্ট, টপস এক্সেট্রা এক্সেট্রা পরতে হয় না। আমার কাছে তো বাড়তি কিছুই নাই। যা ছিলো সব তো সৌরভের কিনে দেওয়া। কথা ছিলো, বিয়ের পর আমি ওর দেওয়া ড্রেসই পরবো। কিন্তু বিয়ে তো হয়ইনি। এখন ওর দেওয়া ড্রেস পরলে তোমার কি ভালো লাগবে বলো?

উষির কাজে শেষ করে রাশার দিকে একপলক তাকিয়ে পারফিউম হাত নিলো। তারপর নির্লিপ্ত সুরে বললো,

— খুব লাগবে। তোমার পিছনে আমি এক টাকাও খরচ করবো না।

রাশা চুপ করে বড় করে শ্বাস নিলো। তারপর মুখে আরো মধু ঢেলে বললো,

–ওগুলো তো আনিনি। ভেবেছিলাম কারো ভালো লাগবে না, তাই রেখেই এসেছি।

–ভালো করেছো।
বলেই পারফিউম মেখে হাত ঘড়ি পরতে লাগলো। রাশা উৎকণ্ঠিত গলায় বললো,

–তোমাদের বাড়িতে কেউ আসলে যদি দেখে নিউ ব্রাইড শর্টস আর ক্রপ টপ পরে ঘুরছে, তাহলে কি কারো ভালো লাগবে?

উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুঝলো, টাকা না দেওয়া পর্যন্ত পিছু ছাড়বে না। তাই বললো,

–কবে ফেরত দেবে?

–কি?

–টাকা। ধার নিলে কবে ফেরত দেবে?

–বেতন পাওয়ার পর।

রাশা চোখ পিটপিট করে নিরীহ ভঙ্গিতে উত্তর দিলো। উষিরের তার কাজ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না। ভাবলো হয়তো আগে থেকেই কোন চাকরি করতো, সেটার কথাই বলছে৷
একটা কাগজ কলম নিয়ে আসলো৷ রাশার সামনে ধরে বললো,

–এখানে সবটা স্পষ্ট করে লিখে সাইন করে দাও।

রাশা হাসার চেষ্টা করলো,

–আবার এসব কেনো?

–তোমাকে প্রচন্ড পরিমাণে বিশ্বাস করি তো তাই এইসব। লেখো কত টাকা নিচ্ছো আর কবে ফেরত দেবে।

রাশা গম্ভীরমুখে লিখলো,

“বেতন পাইবার মূহুর্তে টাকা পরিশোধ করা হইবে।”

লিখে ডেট লিখে নিচে নিজের সাইন করে করুন মুখ করে কাগজটা উষিরের কাছে ফেরত দিলো। টাকার অ্যামাউন্ডের ব্যাপারে মাথা ঘামালো না উষির। নিজের ক্রেডিট কার্ড রাশার দিকে বাড়িয়ে দিলো। সাথে পাসওয়ার্ডও লিখে দিলো। রাশা কার্ড উলটে পালটে দেখে বললো,

–এটার লিমিট কত?

–আনলিমিটেড।

রাশা বেশ সময় নিয়ে মিটমিট করে হাসলো। তারপর টেনে টেনে বললো,

–আচ্ছা..ঠিক আছে ঠিক আছে। ধন্যবাদ। বর হলে এমনই হতে হয়। গুড হাজবেন্ড!

উষির কপাল কুঁচকে রাশার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। সকালে জরুরি মিটিং ছিলো তার। না খেয়েই চলে গেলো। রাশা ক্রেডিট কার্ড যত্ন করে রেখে আবার নিচে গেলো নিজের লাগেজ আনতে।
ময়না রাশার লাগেজের সাথে গহনার বক্স আর শাড়িও এনে দিলো। রাশা বিরক্ত হয়ে বললো,

–জুয়েলারি এনেছো কেনো? এটা তো তোমাকে দিয়েছি। দেওয়া জিনিস কেউ ফেরত নেয় নাকি?

ময়না কেঁদে ফেললো,

–সারাডি রাত ঘুমাইবার পারি নাই গো। এই জিনিস আমার হলি আমার জীবনডা শ্যাষ হয়ে যাবি। আমি আর পারমু না। তোমার জিনিস তুমিই নেও।

রাশা সজোরে ঘাড় নাড়লো। জুয়েলারি বক্স আর শাড়ি ময়নার হাতে জোর করে তুলে দিয়ে বললো,

–কখনোই না। কাউকে দেওয়া জিনিস আমি ফেরত নেই না। এগুলো তোমার মানে তোমারই।

ময়না এবারে শাহিদার কাছে ছুটলো। হুহু করে কেঁদে উঠে বললো,

–ম্যাডাম, আফনে কিছু কন? আমি গরীব মানুষ। এই গয়নার ভাড় নিবার পারমু না।

শাহিদা গম্ভীরমুখে মোটর দানা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন,

–ওর জিনিস ও ভালো মনে করেছে দিয়েছে। এখানে আমি কি বলবো?

মাহফুজারও একই কথা। ময়না পরলো অথৈ জলে। কূল না পেয়ে ফ্লোরে বসে কপাল চাপড়ে বিলাপ করতে লাগলো। রাশা হতভম্ব হয়ে গেলো। চোখ পিটপিট করে ময়নার কান্নার ধরন দেখতে লাগলো। কান্নার স্টাইলটা তার দারুন লাগলো। শিখে নিতে লাগলো ভালো করে। শাহিদা বিরক্ত হয়ে বললো,

–লকারে রেখে আয়, তাহলেই তো হলো।

–ও ম্যাডাম, তহন আরো চিন্তায় থাকমু। মনে হইবো, তালা ভাইঙ্গা কেউ নিয়া গেছে। এতো গয়না আমি কিছুতেই নিমু না। নিলে আমি বাঁচবার পারমু না।

রাশা বিরক্ত হয়ে দুইটা হার, এক সেট কানের দুল, দুটো চুরি আর একটা আংটি বের করে বললো,

–আচ্ছা তো শাড়িটা নাও। আর এইগুলো নাও?

জুয়েলারি বক্সে জুয়েলারি ছাড়াও আরো কিছু জুয়েলারি ছিলো৷ ময়না সেগুলো না নেওয়াতে রাশা সিদ্ধান্ত নিলো, রাস্তায় যেতে যেতে যত ভিক্ষারি দেখবে, সবাইকে একটা একটা করে দিয়ে দেবে। করলোও তাই। শপিং করতে যাওয়ার সময় সবাইকে একটা একটা করে জুয়েলারি দিয়ে দিলো। তারা যখন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো তখন রাশা মিষ্টি হেসে বলেছিলো,

–আমার বরের জন্য দোয়া করবেন। আপনাদের জন্যেই কাজ করে। সবসময় যেনো ভালো পথে আপনাদের সেবা করতে পারে, সেই দোয়াই করেন। সাথে তার সুস্থতার দোয়াও করবেন। সুস্থ না থাকলে তো আর কাজ করতে পারবে না।

ভিক্ষারিদের মধ্যেকার একজন বললো,

–তোমার বরের নাম কি মা?

–উষির৷ পুরো নাম আদনান কায়সার৷ আপনাদের সেবাতেই নিজেকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখে।

রাশার কর্মকান্ডে পথচারীরাও হতভম্ব ছিলো। কিছু কিছু অতি উৎসাহী পথচারী ছবিও তুলে রেখেছে। কিন্তু সবার পরিচিত উষিরের নাম শুনে প্রায় সকলেরই চক্ষু চরকগাছ। সবারই ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন, উষির বিয়ে করলো কবে?
আবার কিছু মানুষ ভাবলো, মেয়েটা মিথ্যা বলছে। এইরকম মেয়েদের তো অভাব নেই। কত মেয়েই নিজেদের কল্পনার জগতে থেকে এইসব কথাবার্তা ছড়ায়! তবে কথাটা ছড়াতে সময় লাগলো না। এলাকা থেকে শুরু করে স্যোশালমিডিয়াতেও উষিরের বিয়ের খবর আর রাশার দানশীলতার খবর ছড়িয়ে পরলো।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-২+৩

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০২

–এই বিয়ে আমি কিছুতেই মানি না। আমার ভালো মানুষ ছেলেকে ধোকা দিয়ে বিয়ে করানো হয়েছে। তোমার ফ্যামিলিকে আসতে বলো দ্রুত। এর ফয়সালা আজকেই হবে।

রাশা বড়সড় হাই তুললো। নব্য শাশুড়ি মাকে একদম ঠিক চিনে নিয়েছে। তার জহুরির চোখ! এতো সহজে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না।

–সেটা আর সম্ভব না আন্টি। তারা আমাকে চিরতরেই বিদায় দিয়েছে৷ বলেছে, এখন আর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তাই এখন আমিই আমার অবিভাবক। যা বলার আমাকেই বলুন।

শাহিদা চিৎকার করে উঠলো। মাথার উপর রাখা আইসব্যাগ ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে রাশার দিকে তেড়ে এসে বললো,

–আমার সাথে মশকরা হচ্ছে? চেনো আমাকে?

রাশা চোখ পিটপিট করে শাহিদাকে দেখলো৷ তারপর নিরীহ গলায় বললো,

–আপনিই তো আমার শাশুড়ি আম্মা। চিনবো না! আপনাকে কি তাই এতো বড় অপমান করতে পারি?

শাহিদা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলো৷ মাঝরাস্তায় থেমে পরা পা-টা আবার চালিয়ে রাশার দিকে তেড়ে গেলেন। আফসার সাহেব ধমক দিয়ে হাত টেনে ধরে আটকালেন,

–এসব কি শুরু করেছো তুমি? এখন কি মারামারি করবে নাকি?

শাহিদা দাঁতে দাঁত চেপে রাগী গলায় বললো,

–এই মেয়েকে আগে বিদায় করো, তারপর আমার সাথে কথা বলতে এসো। এই মেয়েকে আমার সহ্য হচ্ছে না।

আসফার সাহেব চড়া গলায় আবার ধমক দিলেন,

–পাগল হলে নাকি? আগে মাথা ঠান্ডা করো।

লিভিংরুমের সোফার কাছে এতোক্ষণ উষিরের চাচী মাহফুজা দাঁড়িয়ে ছিলো। আফসার সাহেবের কথায় সায় জানিয়ে তিনিও বললো,

–ভাবী আগে একটু ঠান্ডা হন। ওদের বিয়ে কিভাবে হলো সেটাও তো জানা জরুরি। বিয়ে তো ছেলেখেলা না।

মাহফুজার কথায় শাহেদার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগলো। ফুঁসে উঠে ঝটকা মেরে আফসার সাহেবের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর হিসহিসিয়ে বললো,

–ছেলেকে কোন কানপড়া দিয়ে বিয়েতে রাজী করালে?

রাশা চুপ থাকতে পারলো না। এতোক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখন অনেকটা এগিয়ে এসে বললো,

–কোন কানপরা দেওয়া হয় নাই আন্টি৷ একটু মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছিলো যাস্ট। তাতেই কখন যে বিয়ে হয়ে গেলো, টেরই পেলাম না।

আফসার সাহেব বিপদ আঁচ করতে পারলেন। সত্যিটা বললে যে কি ভয়ংকর পরিস্থিতি হবে, বুঝতে পেরে নিজেই তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন,

–সেরকম কিছুই হয়নি। লাস্ট মোমেন্টে বরপক্ষ বিয়েতে না করে দিয়েছিলো। উপায় না পেয়ে উষিরের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।

শাহেদা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–তোমায় এতো দিল দরদী হতে কে বলেছে শুনি?

রাশা হতাশার শ্বাস ফেলে বললো,

–আংকেল! সেখানে সত্যি বললে ঝামেলা কম সেখানে মিথ্যা বলে ঝামেলা বাড়ানোর কি দরকার বলুন? বরপক্ষ বিয়েতে মানা করেনি। মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা অন্য জায়গায় হয়েছে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি যে রুমে ঘুমিয়েছি তোমাদের ছেলেও একই রুমে ঘুমিয়ে আছে। আর একটু ডিটেইলসে বললে একই বেডে ঘুমিয়ে ছিলো মানে ছিলাম।

ঘরে ছোটখাটো ককটেল বিস্ফোরণ হলো। কিছুক্ষণ থমথমে পরিবেশ বজায় থেকে আচমকা শাহেদা কেঁদে উঠলো। কাছে থাকা সোফায় বসে কপাল চাপড়ে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে আহাজারি করতে লাগলো,

–তুমি এই চরিত্রহীন বাজে মেয়েকে আমার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে! ছি ছি ছি! লজ্জা করে না তোমার? কি সর্বনাশ করে ফেলে তুমি! হায় হায় রে!

রাশা রেগে গেলো। দু’কদম এগিয়ে শক্ত গলায় বললো,

–আমার চরিত্র নিয়ে কোন কথা বলবে না। সবাই যে অভিযোগ তুলেছে, তার পুরোটা মিথ্যা, ইলজিক্যাল! ছোট একটা মিস্টেকে এমনটা হয়েছে। এতে কারোরই কোন দোষ নেই। একটা সাধারণ ব্যাপারকে এতো প্যাঁচানোর কি আছে?

শাহেদা অগ্নিলাল চোখে চিড়বিড়িয়ে উঠলো,

–একটা বেয়াদব, লাজ লজ্জাহীন আর চরিত্রহীন মেয়ের মুখ থেকে আর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি। বের হও এক্ষুনি?

–আমার ক্যারেক্টার নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, প্রশ্ন কিন্তু তোমাদের ছেলের ক্যারেক্টারেও প্রশ্ন ওঠে৷ আর যদি তোমার ছেলে ইনোসেন্ট হয় তাহলে আমার বেলায় দোষ কেনো? ওই রুমে যখন আমি যাই তখন তোমার ছেলে কিছু বলে নাই কেনো?সারাবছর বন্ধ থাকা একটা ঘরে যে কেউ ঘুমিয়ে আছে সেটা তো আমার জানার কথা ছিলো না। তাহলে এখানে আমার কি দোষ!

মাহফুজা বললো,

–সেসব কথা আমাদের কেনো বলছো? তোমার ফ্যামিলির তোমাকে ভালো চেনার কথা৷ তারা যখন তোমাকে ত্যাগ করেছে তখন আমাদের আর কিছু বোঝার বাকি নেই। এখন তুমি সেখানে খুশি যেতে পারো। আমারও দুইটা মেয়ে আছে। তোমাকে এখানে রেখে তাদের ভবিষ্যত নষ্ট করতে চাই না। বড় ভাই যদি তোমাকে রাখে তাহলে বাধ্য হয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে আমার চলে যেতে হবে।

আফসার সাহেব চেঁচিয়ে ধমকে উঠলেন,

— কেউ কোত্থাও যাবে না। ছেলেখেলা হচ্ছে নাকি এখানে? রাশাও কোথাও যাবে না আর না তুমি মেয়েদের নিয়ে কোথাও যাবে।

শাহেদা চোখ মুখে মুছে উঠে দাঁড়ালো,

–হ্যাঁ, কারোর যাওয়ার দরকার নেই। আমিই চলে যাই এখান থেকে। তোমরা সবাই শান্তিতে থাকো।

আফসার সাহেব কঠিন গলায় বললেন,

–ওকে ছেলের বউ এর সম্মান দিয়ে ঘরে তোলো শাহিদা। তারপর যেখানে খুশি চলে যেও। আমার কথার নড়চড় যেনো না হয় বলছি।

–ওই মেয়েকে আমি বউ হিসেবে মানিই না। বরণ করে ঘরে তোলা তো দুঃস্বপ্ন!

রাশা তপ্ত শ্বাস ফেললো। ছোট সমাধান মাথায় এসেছে। সেটাই হাসিমুখে প্রকাশ করতে চাইলো,

–আচ্ছা ঠিক আছে। অনেক ঝামেলা হয়েছে। বউ হিসেবে না মানলে মানবে না। কোন চাপ নেই। কেউ জোর করছে না।

শাহেদা নাক টেনে আবার বসে পরলো। অনেকক্ষণ পর একটু শান্তি লাগছে। প্রসন্ন মুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,

–দেখেছো, তোমার নিয়ে আসা মেয়েটাও একই কথা বলছে। নিজেই নিজের যোগ্যতাটা বুঝে গেছে।

আফসার সাহেব হতাশ হয়ে স্ত্রীর পাশের সিটে বসে পরলেন। রাশাও মুখের হাসি চওড়া করে আরেকটা সোফায় বসে পরলো। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যাথা হয়ে গেছে। পায়ের হিল জুতা খুলে ক্লান্ত পা জোড়া ঠান্ডা মেঝেতে রেখে বললো,

–একদম ঠিক কথা বলেছো। এখন তাহলে আমি এই বাড়ির অতিথি। তোমাদের দেখে খুব অতিথি পরায়ণ মনে হচ্ছে। সকাল থেকে কফি খাইনি। এককাপ কফি দাও আগে। মাথা হ্যাং হয়ে আছে। কফি খেয়ে বাকি আলোচনা করছি।

ঘরের সবাই তব্দা খেয়ে গেলো। মাহফুজার দুই জমজ মেয়ে বন্যা আর বৃষ্টির রাশার প্রতি আগ্রহ ব্যাপক। এই আগ্রহের বশেই বন্যা বললো,

–তুমি অতিথি হলে কেমন করে?

রাশা ঠোঁট উঠে বললো,

–বা…রে! বউও না আবার অতিথিও না, এটা তো মানা যায় না। একটা তো মানতেই হবে।

শাহিদা রেগে উঠে দাঁড়ালো। হাত উঁচিয়ে দরজা নির্দেশ করে বললো,

–তুমি এই বাড়ির কেউ না। এক্ষুনি চলে যাবে তুমি। গেট আউট!

রাশা পাত্তা না নিয়ে সোফায় পিঠ এলিয়ে আড়াম করে বসলো,

–আহ! কি যে বলো তুমি আন্টি! আমি তো এখান থেকে বের হলে সোজা পুলিশ স্টেশনে যাবো। তখন আমাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য থাকবে। যেভাবেই হোক, বিয়ে তো হয়েছে। অস্বীকার তো কেউ করতে পারবে না। আই হ্যাভ এনাফ প্রুফ। তার থেকে বেটার হয় যে কোন একটা চুজ করা। হয় বউ হিসেবে মেনে নিতে হবে আর নাহলে গেস্ট হিসেবে মেনে নিতে হবে। অবশ্য বউ হিসেবে মেনে নিলে একটা সমস্যা আছে। ছেলে তো আগেই পগারপার হয়ে বসে আছে। ছেলেকে ধরে বেঁধে আনতে হবে আগে। তারপর আমাকে মেনে নিয়ে সারাজীবন চলতে হবে।

বৃষ্টি অনেকক্ষণ হলো কিছু চিন্তা করছিলো। সারাদিন বড় মা অর্থাৎ শাহিদার সাথে সিরিয়াল আর সিনেমা দেখতে দেখতে নিজেরও এমন কিছুই করতে মন চাইলো। তাই এগিয়ে এসে শাহিদার কানে কানে কিছু বলতেই কুটিল হেসে উঠলো শাহিদা,

–ওকে তোমার শর্ত মানলাম। তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। তবে তুমি বউ বা গেস্ট হিসেবে না, মেড হিসেবে থাকবে। বাড়ির সমস্ত কাজ করতে হবে তোমাকে।

রাশা আগ পিছ চিন্তা না করেই বললো,

–আমি রাজী।

আফসার সাহেবের নিজেকে পুতুলের মতো মনে হচ্ছে। বাড়ির কর্তা হয়েও কেউ তার কথা না শুনছে আর না পাত্তা দিচ্ছে। ভেতরে ভেতরে সাংঘাতিক চটে যাচ্ছে আর ভাবছে আর একটু বাড়াবাড়ি করলেই নিজের আরেকটা রুপ দেখিয়ে দেবে।
ময়না এতোক্ষণ সব কাজ ফেলে ঘরোয়া ড্রামা দেখছিলো। শেষেরদিকে দেখলো তার নিজের পেটেই এখন লাথি পরতে চলেছে। তাই আর চুপ থাকতে পারলো না। ডাইনিংরুমের দেয়ালের আড়াল থেকে বের হয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো,

–আমার কি হইবে ম্যাডাম? আমার চাকরি গেলে খামু কি?

বৃষ্টি ময়নাকে আশ্বাস দিলো,

–তোমার কেনো চাকরি যাবে? তোমরা দুজনই থাকবে।

ময়না হাসিমুখে ধন্যবাদ দেওয়ার আগেই রাশা ফস করে তাকে বলে উঠলো,

–তোমার বেতন কত?

ময়না হকচকিয়ে গেলেও সামনে উঠে দ্বিধান্বিত স্বরে বললো,

–পনেরো হাজার।

রাশা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু ভাবলো। তারপর শাহিদার দিকে তাকিয়ে বললো,

–ওকে, আমি তাহলে বিশ হাজারে ডান করছি।

শাহিদা বেগম বিষ্মিত হলেন,

–বিশ হাজার!

রাশা দায়সারা ভাবে বললো,

–আমার বেতন। রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, বাসন মাজা, ঘর মোছা সব কাজ করবো। শুধু বাজারটা পারবো না। রোদে ঘুরলে ট্যান পরে যাবে। আর জামাকাপড় ধুতে পারবো না। ওটা আমার একদম ভালো লাগে না।

ময়না দেখলো, আবারও তার পেটে লাথি পরতে চলেছে। তাই আবারও কথার মাঝে ফোড়ন কাটলো,

–নতুন বউয়ের বেতন বিশ হাজার হলে আমি কিন্তু পনেরোতে কাজ করমু না। আমারেও বিশ হাজার বেতর দেওয়া লাগবে।

আফসার সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। রাগী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

–তোমাদের নাটক আর কতক্ষণ চলবে?

রাশা শান্তনা দিয়ে বললো,

–আর একটুখানি আছে আংকেল। আপনি আমার একমাত্র সাক্ষী। একমাত্র আপনাকেই ভরসা করতে পারি। একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ।

তারপর শাহিদার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–হ্যাঁ তো আন্টি, আমি তাহলে ডিল ডান করছি?

শাহিদা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–মগের মুল্লুক পেয়েছো? কোন বেতন পাবে না।

–এটা তো আইন বিরুদ্ধ আন্টি। চাকরি করবো আর বেতন পাবো না, এমনটা তো হতেই পারে না। এখন তো আপনার কাছে তিনটা অপশন আছে। ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিয়ে বধূবরণ করে সসম্মানে ঘরে তুলবেন। অথবা অতিথি হিসেবে অতিথিপরায়ণতা করবেন। আর না হলে চাকরি দেবেন। বেতন বিশ হাজারের এক টাকাও কম না। বেশি হলে আমার সমস্যা নেই কিন্তু একদম কম না।

মাহফুজা শাহিদাকে শান্ত করতে চাইলো। না মানার মতো চরম সত্যটা অবশেষে প্রকাশ করলো,

–ভাবী, এই মেয়ের সাথে পারবেন না। শেষে সম্মান নিয়ে টানাটানি পরে যাবে৷

রাশা এক গাল হেসে মাহফুজার দিকে তাকিয়ে বললো,

–হাউ সুইট আন্টি। তোমার পরিচয় কি?

মাহফুজা গম্ভীরমুখে বললো,

–তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। ভাই আর ভাবির সাথেই কথা শেষ করো।

রাশা কাঁধ নাচিয়ে বললো,

–ওকে

শাহিদা উঠে দাঁড়াতে চাইলো৷ ক্লান্ত স্বরে বললো,

–আমার মাথা ঘুরছে। ঘরে যাচ্ছি আমি।

রাশা তড়িঘড়ি করে বললো,

–আন্টি, অ্যাগ্রিমেন্টে সাইন করে তারপর যাও।

উঠতে নিয়ে আবার ধপ করে বসে পরলো শাহিদা,

–আবার কিসের অ্যাগ্রিমেন্ট?

–কিসের আবার? চাকরি করবো আর কিছু শর্ত রাখবো না? তোমার কিছু শর্ত থাকবে, আমার কিছু থাকবে। এসব নিয়েই না চুক্তিপত্র তৈরি হয়। আমি আবার মুখের কথায় একদম বিশ্বাসী না।

নিজের কথা শেষে সোফা টেবিলের উপর রাখা বন্যার খাতা আর কলম তুলে খাতার একটা ফাঁকা পেজ খুললো৷ তারপর কলমের আঁচড় টেনে লিখতে শুরু করলো,

শর্তসমূহঃ

১. ছয় মাসের আগে চাকরিচ্যুত করা যাবে না৷ যদি করা হয় তাহলে যুক্তিপূর্ণ কারন দেখাতে হবে।

২. কাজের সময়, সকাল আটটা হতে রাত আটটা পর্যন্ত। এর অতিরিক্ত সময় চাকরির অভার টাইম হিসেবেন গণ্য হবে এবং সে মোতাবেক বেতনের টাকা যুক্ত হবে।

৩. মাসের এক থেকে তিন তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় কর্মী যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

৪. কাজের লিস্ট – রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা, বাসন মাজা আর ঘর মোছা। এর অতিরিক্ত কাজ হলে অতিরিক্ত বেতন গুণতে হবে।

এই চারটা শর্ত লিখে কাগজ শাহিদার দিকে এগিয়ে দিলো। হাসিমুখে বললো,

–এবারে তোমাদের শর্ত লেখো।

শর্তগুলো পরে শাহিদা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো৷ চোখ গোল গোল করে একবার রাশার দিকে তো একবার কাগজের দিকে দেখতে লাগলো। বিষ্ময়ের পরিমাণ এতো ছিলো যে নিজের শর্তের কথা বেমালুম ভুলে আচ্ছন্নের মতো সাইন করে দিলো। রাশা হাসিমুখে কাগজ নিয়ে নিজেও সাইন করে সাক্ষী হিসেবে ময়না আর আবসার সাহেবের সাইন নিলো। তারপর কাগজটার গোটা কয়েক ছবি তুলে আবসার সাহেবের কাছে গচ্ছিত রাখলো। ময়না সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের বেতনের কথা মুখেও আনতে পারলো না। ভগ্ন মন নিয়ে রাশাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। যদিও সেটা এখন রাশার সাথে ভাগ করে থাকতে হবে।

চলবে..

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৩

ঘরটা বেশ ছোট। তাও রাশা বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো সবটা। ছোট সিঙ্গেল বেড, একটা কাপর রাখার আলনা, একটা মাঝারি সাইজের আয়না আর একটা টেবিল আছে শুধু। টেবিলে জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই। রাশা বড় করে শ্বাস ফেলে নিজের লাগেজের দিকে তাকালো। লার্জ সাইজের তিন তিনটে লাগেজ যে এখানে কোথায় আটাবে বুঝতে পারছে না। চিন্তায় চিন্তায় মাথা চুলকাতে চাইলো। মাথায় হাত দেওয়ার পর বুঝলো, এখনও সে বধূবেশেই আছে। চেঞ্জ করা দরকার। আয়নার সামনে গিয়ে একে একে গহনাগুলো খুলতে লাগলো। ময়না ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে ছিলো। মুগ্ধ চোখে রাশার গহনা খোলা দেখছিলো। গহনার বহর শেষ হয় না দেখে অবাক বিষ্ময়ে বললো,

–এতো গয়না আফনার! সব সোনার?

ময়নার অবাক হওয়া গলার স্বরে রাশা হেসে ফেললো।

–সব সোনার না। ডায়মন্ডেরও আছে। আর কিছু স্টোনেরও আছে।

ডায়মন্ডের কথায় ময়নার মুখ হা হয়ে গেলো।

–আফনে তো দেহি হেব্বি বড়লুক! বাপরে!

রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসলো। গহনাগুলো গোছাতে গোছাতে বললো,

–কোথায় আর বড়লোক হলাম! বাবা তো ত্যাজ্য করে দিয়েছে। এখন আমি দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ গরীর। না আছে বাড়ি আর না আছে পরিবার। শুধু আছে একটা চাকরি। তাও জোর করে পাওয়া।

রাশা মোটেও মন খারাপ করে কথাটা বলেনি৷ কিন্তু ময়নার খুব মন খারাপ হলো। সম্পর্কছেদের ব্যাথায় মন হুহু করে উঠলো। চোখের পানি সামলে রাশাকে শান্তনা দিলো,

–মন খারাপ কইরেন না৷ বাপ মায়ের রাগ দুই মিনিটের। দুই মিনিট পরে সব ঠিক হয় যাবি।

রাশার মন হঠাৎ করে খুব ভালো হয়ে উঠলো। মনে হলো, তার দুঃখেও তাহলে কেউ দুখী হয়! উৎফুল্ল মন নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

–তোমার নাম কি?

–ময়না।

রাশা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ময়নার কাছে গেলো। তারপর হাত টেনে হ্যান্ডশেক করে বললো,

–আমার নাম রাশা। তোমার সহকর্মী৷ আপনি ডাকটা আমার একদম পছন্দ না৷ আমাকে একদম আপনি বলবে না।

ময়না হকচকিয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বললো,

–আচ্ছা। তুম-তুমি সত্যি কাম করবা?

রাশা আবার আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চুলে হাত দিলো। পার্লারের মেয়েরা চুলে এক গাদা ক্লিপ দিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছে। বিয়েতে গন্ডগোল হলেও বড় চাচা কিছুই নষ্ট হতে দেননি। পার্লারে অগ্রিম বুকিং দেওয়ায় দুপুরের বদলে ভোরবেলাতেই তাদের নিয়ে আসা হয়েছিলো। ঠিক যেমন সাজানোর কথা ছিলো, ঠিক তেমনই সাজিয়ে দিয়েছে। শুধু খাবারে মুশকিল হয়েছিলো। বড় চাচা বুদ্ধিমান মানুষ। ম্যারেজ হলের বুকিং নিয়েও কোন না কোন প্ল্যান নিশ্চয় করে ফেলেছেন। রাশার ধারণা, তিনি তার পার্টির লোকজনকে দিয়ে ম্যারেজ হল ভর্তি করেছেন আর বাড়তি খাবার গরীব দুঃখীদের দিয়ে নিজের স্ট্যাটাসের আরেকটু উপরে উঠে গিয়েছে। বলা যায় না, হয়তো এতোক্ষণে খবরের কাগজে কিংবা সোশ্যালমিডিয়াতে তার দানশীলতা ছড়েও পরেছে। এসব তো ওনার ওয়ান টু-র ব্যাপার।

ক্লিপ চুলে আটকে বসে আসে৷ জোরে খোলার চেষ্টা করতেই চুলে টান লাগলো। চোখ কুঁচকে জোরে টান দিলো রাশা। ক্লিপের সাথে গোলাপ ফুল আর কিছু চুলও উঠে এসেছে। অবহেলায় সেটা ফেলে দিলো৷ তারপর আড়াম করে বসে ময়নার প্রশ্নের উত্তর দিলো,

–হ্যাঁ, পেট চালাতে হবে তো। মাসে বিশ হাজার এমনি এমনি আসবে নাকি?

তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলো, এখানে এটাচ বাথরুম নেই৷ চেঞ্জ করা অতি জরুরি হয়ে পরেছে। শাড়িটা প্রচন্ড ভারি৷ ইন্ডিয়া থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনা হয়েছে৷ হাত দিয়ে শাড়ির সেপটি পিন খুলতে লাগলো৷ গায়ের জোরে খুলতে নিয়ে শাড়িও ছিড়ে গেলো। ছিড়ুক শাড়ি। সৌরভ নিজে গিয়ে শাড়ি পছন্দ করে নিয়ে এসেছে৷ তাই এটা পুড়িয়ে ফেললেও রাশার কিচ্ছু যায় আসবে না।

–তোমার ঘরের দরজা তো একটাই। তাহলে ওয়াশরুম কোথায়?

সুন্দর শাড়ি আর চুলের বেহাল অবস্থা দেখে ময়নার খুব আফসোস হলো৷ কেউ চেয়েও পায় না আর কেউ হেলায় ফেলে দেয়!

–বাইরে বাগানের দিকে। রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়া যায়।

এই প্রথমবার রাশা অবাক হলো,

–এতোদূর! কাছে কোন ওয়াশরুম বা চেঞ্জিং রুম নেই?

ময়না দীর্ঘশ্বাস ফেললো। উদাস মনে বললো,

–মাথার উপর ছাদ আছে এই অনেক। আমার নিজের বাড়িত তো টয়লেটও নাই। চার পাঁচ ঘর মিলায়া একখান টয়লেট।

রাশা কেমন করে একটা হাসলো। তারপর বললো,

–এইজন্যই বলে, দুনিয়া দেখতে হলে ঘরের বাইরে বের হতে হয়।

ময়নার দেখানো পথে গিয়ে আরেক ধফায় অবাক হলো। পাশাপাশি দুটো ছোট ঘর৷ একটা টয়লেট আর একটা গোসলখানা৷ গোসলখানায় একটা ট্যাপ আর একটা লাল বালতি, লাল মগ করেছে৷ সাবান রাখার জায়গাটাও কেমন নোংরা। আবার জামা কাপড় রাখার জন্য দড়ি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। আর কি ভীষণ দুর্গন্ধ! রাশা নাকে কাপড় চেপে কোনরমকে চেঞ্জ করে বাইরে বের হয়ে বাঁচলো। বড় করে শ্বাস ফেলে নিজেই নিজেকে বললো,

–রিলিফ! শান্তির জীবনে ওয়েলকাম রাশা।

নিজেই নিজেকে তাচ্ছিল্য করলো। তারপর দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরে গেলো৷ হাতের ভারি শাড়ি বিছানায় ফেলে দিলো আগে৷ ভারি শাড়িটা এতোক্ষণ হাতে ধরে রাখায় হাত ব্যাথা হয়ে আছে। রাশার পরনে টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়াটার ট্রাউজার। ফর্সা পায়ের অনেকাংশই উন্মুক্ত। শরীরে আর কোন গহনাও নেই। বিয়ের চিহ্নস্বরূপ রয়েছে শুধু হাতের মেহেদী। সেটাও যদি না থাকতো তাহলে নিশ্চিন্তে নিজেকে অবিবাহিত দাবি করা যেতো। সৌরভের নাম হাতে কিছুতেই লেখতে দেয়নি। এটা বেশ বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে।

রাশার প্রায় ছুড়ে ফেলা শাড়ি দেখে ময়না আঁতকে উঠলো,

–এতো সুন্দর শাড়ি এমনে ফেলাইলা? আমার হলে তো আমি মাথায় করে রাখতাম।

রাশা ময়নার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বিছানা থেকে শাড়ি গুছিয়ে ময়নার হাতে দিয়ে বললো,

–তুমিই নাও তাহলে। আমার এটার কোন দরকার নেই।

শাড়ির ভারে ময়নার হাত ঝুঁকে পরলো। অবাক দৃষ্টিতে রাশাকে দেখে তোতলাতে তোতলাতে বললো,

–তুমি…তুমি..

রাশা তাকে আরেক দফায় অবাক করে গহনাগুলোও গুছিয়ে বিছানায় সুন্দর করে সাজিয়ে রাখলো,

–তুমি এই জুয়েলারিগুলোও নাও। এগুলোরও কোন দরকার নেই।

ময়নার মাথা ঘুরতে লাগলো। রাশা তার সাহায্যে শাড়ি সুন্দর করে ভাজ করে রাখলো। তারপর লাগেজ থেকে জুয়েলারি বক্স বের করে সব জুয়েলারি সুন্দর করে গুছিয়ে ময়নার হাতে তুলে দিলো। ময়না বিষ্ময়ে কথা বলতেই ভুলে গেছে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রাশা চুটকি দিয়ে ময়নার ধ্যান ভেঙে বললো,

–জুয়েলারিগুলো এভাবে ফেলে রাখবে না। লকারে রাখতে পারো। চুরি হওয়ার ভয় থাকবে না। অথবা সেল করে দিতে পারো। আমার কাছে বিল আছে। সেল করতে সুবিধা হবে। সেই টাকা দিয়ে বিজনেস স্টার্ট করতে পারো। আই হ্যাভ হিউজ আইডিয়া। একে একে সব বলবো। আপাতত এখন একটু শান্ত হও আর আমাকে তুমি এখানকার ঠিকানাটা বলো। আমি কিছু জিনিস অর্ডার করবো।

ময়না ঢোক গিলে চোখ পিটপিট করে বললো,

–কি অডার করবা?

–বেশি কিছু না৷ এখানে থাকার জন্য যেসব জিনিস জরুরি, সেসব আনতে হবে। যেমন, এসি, ম্যাট্রেস, ড্রেসিং টেবিল, ক্লোজেট এটসেট্রা এটসেট্রা।

ময়নার চোয়াল আবার ঝুলে পরলো,

–এসি আনবা!

–হুম, গরম আমার একদম সহ্য হয় না। এখানে একটা মাত্র ফ্যান আছে। তাও ঘটঘট করে বিশ্রী আওয়াজ করে। আর তোমার বেড তো অনেক শক্ত। ঘুম তো নাইটমেয়ার হয়ে যাবে। তুমি ঘুমাও কিভাবে?

ময়না ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,

–তুমি অনেক আদরে মানুষ হইছো, তাই না?

রাশা ময়নার দিকে ঝুঁকে চোখ টিপে বললো,

–আমি ক্ষমতার প্রাচুর্যে মানুষ হয়েছি। পাওয়ারও বলতে পারো।

ময়না আর্তনাদ করে উঠলো,

–পাওয়ার! তোমরা কি জ্বিন পরী?

যে নির্দ্বিধায় নিজের দামী গহনা আর শাড়ি দিয়ে দিতে পারে, সে যে মানুষ হতেই পারে না সে ব্যাপারে ময়না একশো পার্সেন্ট সিওর। তাই কথাটা বলে ফেলেছে। রাশা হাসিতে ফেটে পরলো৷ অনেক কষ্টে হাসি আটকে বললো,

–তুমি ঠিকানাটা দাও আগে। এগজ্যাক্ট লোকেশন চাই।

–আমি তো জানি না। আপারা জানে। আমি লিখে নিয়ে আসি।

–যাও তাড়াতাড়ি। গরমে আমার নাজেহাল অবস্থা।

এক দৌড়ে চলে গেলো ময়না। ফিরেও এলো দ্রুত। উৎফুল্ল মুখে বললো,

–এইযে ঠিকানা নাও। একেবারে ঠিকঠাক লিখা আনছি। আপারা তো তোমার লিস্ট শুনে হা হয়ে গেছে।

বলেই আবার হেসে ফেললো। রাশা ঠিকানার কাগজ হাতে তুলে ট্রাউজারের পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বললো,

–ঠিকানা নিয়ে আর লাভ নেই ময়না। আমার অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিয়েছে।

ময়না বুঝতে না পেরে বললো,

–মানে?

রাশা হেসে ফেললো। মজা করে সুর ধরে বললো,

–মানে আমি পার্মানেন্টলি তোমার মতো বাথরুম ছাড়া গরীব হয়ে গেছি।

ময়নার মুখ ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলো৷ একপলক রাশার দেওয়া জিনিসগুলোর দিকে তাকালো। ভাবলো, হয়তো এগুলো নিয়ে নেবে। মন খারাপ হলেও সামলে নিলো দ্রুত। সে তো এগুলোর লোভ করেনি। যেভাবে এসেছিলো, সেভাবেই চলে যাবে। এতে তারই বা কি করার আছে। কিন্তু রাশার অবস্থায় খুব কষ্ট পেলো। এইটুকু সময়ে এটা তো বুঝেছে, রাশা মোটেও তার মতো করে মানুষ হয়নি। এই পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে না জানি কি কষ্টই না হবে!

— কষ্টে এতো হাসতিছো তাই না? কষ্ট পাইও না। সব ঠিক হয়ে যাবি।

রাশা কোন উত্তর দিলো না। মাথা সাংঘাতিক চুলকাচ্ছে৷ সবে অর্ধেক খোলা হয়েছে৷ বাকি অর্ধেক তাড়াতাড়ি খুলতে হবে। তাই ময়নাকে সাহায্য করতে বললো,

–তুমি আমাকে চুল খুলতে হেল্প করো একটু। মাথা ব্যাথায় মাথা ফেটে যাচ্ছে।

ময়না তাড়াতাড়ি রাশাকে সাহায্য করতে ছুটে আসলো। আলতো হাতে ক্লিপ খুলতে খুলতে বললো,

–তুমি যে বললা, ওইভাবেই কি তোমাদের বিয়ে হইছে?

রাশা মাথা ঘুরিয়ে ময়নার দিকে মুখ করে আস্তে আস্তে বললো,

–তোমাকে একটা সিক্রেট বলি। আমি না বিয়েটা করতাম না। পালিয়ে যেতে নিয়েছিলাম। আর দেখি বড় চাচা করিডরে পাইচারি করছে। আমার তো ভয়ে মাথা খারাপ। যেজন্য রাত তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম তাও যদি পালাতে না পারি তাহলে তো মুশকিল। তাই করলাম কি, পাশে থাকা একটা রুমে ঢুকে গেলাম। নিলয় ভাইয়ার রুম ছিলো ওটা। ভাইয়া তো দেশেই থাকে না। যখন আসে তখন ওটা তার রুম হয়ে যায়। আর ভাইয়া তো বিয়েতে আসেইনি। তাই নিশ্চিন্তে ভেতরে ঢুকে পরেছিলাম। তারপর দেখি বড় চাচা রুমের সামনে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো ভয়ে এক লাফে খাটে উঠে ব্ল্যাংকেট দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পরেছিলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়েছি, টেরই পাইনি। এবারে বলো, এখানে আমার দোষ কোথায়?

ময়না অনাক বিষ্ময়ে বললো,

–তুমি পালাইতে চাইছিলা কেন?

–কেনো আবার! বিয়ে করবো না তাই। ওই ছেলেকে বিয়ে করা যায় নাকি? এতো গায়ে পরা আর এতো বিরক্তিকর। উফফ!

ময়না সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে খোশমেজাজে বললো,

–উষির ভাই কিন্তু হেব্বি সুইট৷ তোমরা অনেক হ্যাপ্পি হবে। তোমারে অনেক ভালোও বাসবে। এখন একটু রেগে আছে মনে হয়। কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবি।

উষিরের কথা ওঠায় রাশার আরেকটা ব্যাপার মনে আসলো। সেটাও খোলসা করা জরুরি,

–উষিরের কি কোন পছন্দ টছন্দ ছিলো?

ময়না তড়িৎ মাথা দুইদিকে নেড়ে বললো,

–না না, ভাই একদম সলিড।

রাশা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রাগত গলায় বললো,

–আমি জানতাম! চেহারা ছাড়া ওর আর কোন গুনই নাই। ধ্যাত!

ময়না হকচকিয়ে গেলো,

–বরের আগের কোন চক্কর না থাকলে বউ খুশি হয় আর তুমি রাগলা!

রাশা উদাস হয়ে গেলো,

–তুমি বুঝবে না।

চুল খোলা শেষ হতেই রাশার স্টাইল করে কাটা ডিপ ব্রাউন চুলগুলো পিঠে এলিয়ে পরলো। ময়না তুলোর মতো চুলে হাত বুলিয়ে মুগ্ধ হয়ে বললো,

–তোমার চুলগুলা পুরা হাওয়াই মিঠাই। কি সুন্দর!

রাশা হেসে ফেললো৷ হাসির আওয়াজ ঘন্টার আওয়াজে ঢাকা পরে গেলো। ময়লা লাফিয়ে উঠে বললো,

–তাড়াতাড়ি চলো, ডাকতিছে আমাদের।

রাশা বিরক্ত হয়ে গেলো। এই ঘন্টা দিয়ে সে এতোদিন শুধু ডেকেই গেছে। এর আওয়াজ যে এতোটা বাজে, তা কে জানতো!

–এটার আওয়াজ এতো বিদঘুটে কেনো!

ময়না রাশার কথা শোনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো না। দ্রুত পায়ে চলে গেলো৷ বাধ্য হয়ে রাশাকেও ছুটতে হলো।
লিভিংরুমের সোফায় শাহিদা আর মাহফুজা বসে আছে। মুখ গম্ভীর, থমথমে। রাশা আর ময়না গিয়ে দাঁড়াতেই শাহিদা গম্ভীরমুখে রাশার দিকে তাকিয়েই চোখ বড় বড় করে ফেললো। তারপর ধমকে উঠে বললো,

–এসব কি পরেছো? নতুন বউ বিয়ের দিন এইসব পরে? বাড়ি থেকে এইসব শিখে এসেছো?

রাশা অবাক হওয়ার ভান করে বললো,

–আমি কোন বাড়ির নতুন বউ?

মাহফুজা রাগী গলার বললো,

–মজা করার জায়গা পাও নাই? জানো না কিছু?

–জানি জন্যেই তো বলছি আন্টি৷ যদি আমি নতুন বউ হই তাহলে তো আমি কোন একটা বাড়ির কোন একটা ছেলের নতুন বউ। নতুন বউ তো আর একা একা হওয়া যায় না।

শাহিদা রাগে গিজগিজ করতে লাগলো,

–বেয়াদপ মেয়ে একটা। বাড়িতে এসে একেবারে ঘাটি গেঁড়ে বসে পরেছে।

বলেই আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা করলো না। উঠে চলে যেতে নিতেই রাশা পথ আটকে দিলো,

–আরে আন্টি যাচ্ছো কেনো? ডেকেছো কেনো সেটা তো বলে যাও?

শাহিদা আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো,

–আমাকে আন্টি ডাকবে না, খবরদার।

–তো কি ডাকবো? শাশুড়িমা? শাশুড়ি আম্মা? মা? ম্যাডাম?

একনাগাড়ে বলে চললো রাশা। শাহিদা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। রাশা উপায় না পেয়ে মাহফুজার দিকে তাকিয়ে বললো,

–আন্টির নাম কি?

মাহফুজা থতমত খেয়ে গেলো,

–শাহিদা।

রাশা এরপর চিৎকার করে বলে উঠলো,

–শাহিদা খালাম্মা?

শাহিদা এক মূহুর্ত থমকে দাঁড়িয়ে রাশার দিকে তেড়ে আসলো,

–কি ডাকলে?

রাশা এক দৌড়ে সোফার পেছনের নিরাপদ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর দাঁত বের করে হেসে বললো,

–পছন্দ হয়েছে না? ডাকটা আমারও দারুন লেগেছে। এই ডাকেই ডাকবো তোমায়। কেমন?

শাহিদা হুংকার দিয়ে উঠলো,

–বেয়াদব..

রাশা কানে আঙুল চেপে বিরক্তিকর সুরে বললো,

–আর কতবার বলবে আন্টি? এতোবার ডাকলে তো শব্দটার উপর অভক্তি চলে আসবে। ট্রাই নিউ সামথিং, প্লিজ। ইউ ক্যাম ডু ইট।

শাহিদা আর কিছুই বললো না। তার এই মেয়ের সাথে কথা বলাই ভুল হয়েছে। বলে নিজেই নিজেকে ধমক দিলো। তারপর হনহনিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। মাহফুজার কোন এক অজানা কারণে রাশাকে খুন ভয় লাগে। সেও আর এক মূহুর্ত থাকলো না। পেছন থেকে রাশা অবশ্য অনেকবার ডেকেছিলো কিন্তু কে শোনে কার কথা। নিজেকে বাঁচানো জরুরি।

চলবে..

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-০১

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ০১

বিয়ের কনের জন্য বিয়ের দিনের সকালটা অনেক স্পেশাল হয়। রাশার জন্য একটু বেশিই স্পেশাল হয়ে গেলো। সকালে সবার চিৎকার চেঁচামেচিতে উঠে নিজেকে অন্য এক পুরুষের পাশে আবিষ্কার করলে স্পেশাল তো হওয়ারই কথা। আর তারপর যদি দেখে সামনে পরিবারের সবাই সহ আত্মীয় স্বজন সবাই ছিঃ ছিঃ করছে, তাহলে সকালটা বাস্তবিকই স্পেশাল হয়ে যায়। ভীষণ ভীষণ স্পেশাল হয়ে যায়।

পাশে থাকা ছেলেটি এতো চেঁচামেচিতেও অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাশা তাকে এক থেকে দুইবার দেখেছিলো। শুধু জানে মেজো চাচার বন্ধুর ছেলে।
দিলওয়ারা জামান নামটা দাদুর দেওয়া। তার জন্মের আগেই নাম ঠিক করে গেছেন তিনি। বড্ড সেকেলে নাম। এই নাম থেকে রাশাকে তার মেজো চাচা উদ্ধার করেছে। সবাই এখন তাকে মেজো চাচার দেওয়া নাম রাশা হিসেবেই চেনে। রাশা অর্থ বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা। তবে তার জন্ম বৃষ্টিতে হয়নি। ঘন কুয়াশায় যখন দেশ ঢেকে ছিলো, তখনই তার জন্ম হয়েছে। মেজো চাচা পেশায় একজন আর্টিস্ট। তাই তার দেওয়া নামটাও এমন আর্টস্টিক হয়েছে।
আর্টিস্ট হওয়ার কারনে তিনি দেশের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ান আর নতুন নতুন থিমে ছবি আঁকেন। তেমনই একটা জায়গায় গিয়ে পরিচয় হয় আফসার সাহেবের সাথে। অল্প আলাপ থেকে গভীর বন্ধুত্ব। ভাতিজির বিয়ে উপলক্ষে স্বপরিবারে নিমন্ত্রিত ছিলেন তারা। পুরো পরিবার না আসলেও তিনি তার ছেলেকে নিয়ে ঠিকই এসেছিলেন। মূলত রাশার বড় চাচা একজন সনামধন্য রাজনীতিবিদ। আফসার সাহেবের ছেলে উষিরেরও রাজনীতিতে ব্যাপক আগ্রহ। সেইজন্যেই ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন বড় চাচা সাথে আলাপ করাতে।

উষিরের সাথে ররাতে গায়ে হলুদের সময় অল্প পরিচয় হয়েছিলো রাশার। আদনান কায়সার হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। বলেছিলো, নিজ এলাকায় নাকি খুবই জনপ্রিয় সে। শুনে রাশা একবার জনপ্রিয় আদনান কায়সারের দিকে তাকিয়েছিলো। বুক টানটান করে চোখ নিচু করে তাকিয়ে ছিলো সে। রাশার মনে হয়েছিলো, সুঠাম দেহের এই সুদর্শন পুরুষটি তার রুপের জন্যই এতো জনপ্রিয়। গুন টুন কিচ্ছু নেই। সুন্দর মানুষদের সৌন্দর্যই তাদের গুন। বাকি গুনগুলো সব সৌন্দর্যের আড়ালে ঢাকা পরে যায়। কখনও প্রকাশও পায় না।

এখন সেই গুনহীন সুন্দর ছেলেটিকে নিজের পাশে আবিষ্কার করে শরীর হিম হয়ে আসলো তার। কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি, সে ব্যাপারে রাশা নিশ্চিত। কিন্তু কোন ছেলের সাথে একই ঘরে রাত কাঁটালেই মেয়ে কলঙ্কিনী হয়ে যায়৷ সেখানে সে তো একই বিছানায় রাত কাঁটিয়েছে!

বিছানা বসেই হতবিহ্বল রাশার মাথায় হাত পরলো,

–আমি..আমি এখানে! তোমরা সবাই এখানে! আমি এখানে এলাম কিভাবে?

রাশার ছোট চাচী এগিয়ে আসলেন। হাত টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে হাত শক্ত করে ধরে চিৎকার করে বলে উঠলেন,

–শয়তান মেয়ে! তোর লজ্জা করলো না রে? বিয়ে না করলে আগেই বলে দিতি৷ আমাদের মুখ কেন পোড়ালি? এসব করার আগে তোর বোনের কথা মাথায় আসলো না? নিজের মায়ের পেটের বোন তোর৷ ওর এখন কি হবে? ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কি ওকে ছেড়ে দেবে? অপমানের প্রতিশোধ নেবে না?

রাশা শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,

–বিশ্বাস করো চাচী আম্মা, আমি এসবের কিচ্ছু জানি না। এসব কখন কিভাবে হলো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আর আমিই বা এখানে এলাম কিভাবে? আমি তো নিজের ঘরে শুয়েছিলাম। এটা তো আমার ঘরই না।

হা-হুতাশ করতে লাগলো রাশা। কেউ তার কোন কথা শুনলো না। মা ঘরে দরজা দিয়ে কান্না করছেন। বাবা শুরুতেই বলে দিয়েছেন, দিলওয়ারা জামান নামের মেয়েটিকে তিনি ত্যাজ্য করলেন। ছেলেটির আর ছেলেটির বাবার খবর রাশা জানতে না। অন্য একটা ঘরে তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

এটা ঠিক যে রাশা সৌরভকে একদম বিয়ে করতে চায়নি। কেমন গায়ে পরা ছেলে! পৃথিবীতে ও একমাত্র ছেলে হলেও তাকে রাশা বিয়ে করতো না। প্ল্যান ছিলো, রাতেই বাড়ি থেকে পালাবে। চকিতে রাশার মনে পরে গেলো! কাল রাতে পালাতেই তো চেয়েছিলো। পরে দেখলো বড় চাচা করিডরে পায়চারি করছেন। তার থেকে লুকাতেই অন্য একটা ঘরে ঢুকে পরেছিলো। তারপর কখন ঘুমের তাড়নায় বিছানায় উঠে ঘুমিয়ে পরেছিলো, কে জানে! আর এরমধ্যেই কি সর্বনাশটাই না হলো! এখন যদি ধরে বেঁধে ওই ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়! শিউরে উঠলো রাশা। এমন অশুভ কথা মনে আনার জন্য মনে মনে তওবাও পরে নিলো। ছেলেটি তো আগাগোড়া কিছুই জানে না। বিয়েতে রাজী হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এতোটাও নিচ নিশ্চয় না। অবশ্য কিছু মানুষের বিয়েতে ছুঁকছুঁক অভ্যাস আছে। এরা শুধু বিয়ের চান্স খোঁজে। কার সাথে হচ্ছে বা কিভাবে হচ্ছে তা দেখে না। তার নিজের বাড়িতেই এমন একজন আছে। ছোট চাচার মেয়ে দিয়া। রাশা সিওর ছিলো, ও পালিয়ে যাওয়ার পরে বিনা দ্বিধায় দিয়া বিয়ে করতে রাজী হয়ে যেতো। কিন্তু এখন কি থেকে কি জানি একটা হয়ে গেলো! সব প্ল্যান জলে ভেসে গেলো!

রাশার সমস্ত আশংকা সত্যি করে উষিরের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেলো। পাশাপাশি বসে না, পাশাপাশি ঘরে বসে তাদের বিয়ে হলো। টেনশনে রাশার মাথা ঘুরতে লাগলো। সকাল সাতটায় তার ট্রেন ছিলো। সাতটা বাজতে আর বিশ মিনিট আছে। এখন বের হলেও ট্রেন ধরা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। সাতশো টাকার এসি কামড়া নিয়েছিলো। সব গেলো! এতো ভোরে কেউ বিয়ে করে! আর এক দুই ঘন্টা দেরি করে বিরে পরালে না ট্রেন মিস হতো আর না বিয়ের শিকল পায়ে পরতো। রাশার ভাগ্যটা ইদানিং খুব একটা সাথ দিচ্ছে না।

***
বিয়ের পর আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করেনি উষির। তাদের সাথে করে আনা গাড়িতে উঠে নিজেই ড্রাইভ করে গাড়ি চালাতে লাগলো। সামনে রাশার সদ্য হওয়া সম্পর্কের শ্বশুর আর বর বসে আছে। আর পেছনে নিজে বসে বসে হাই তুলছে।
আচমকা জোরে ব্রেক কষায় রাশা পরতে পরতে বেঁচে গেলো। তারপর অবাক চোখে দেখলো, যেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে সেটা তার বহুল কাঙ্খিত রেলস্টেশন।

আফসার সাহেব অবাক হয়ে একবার বাইরের দিকে আর একবার ছেলের দিকে তাকালেন। বিষ্ময়ে মুখ দিয়ে কথাও বের হলো না। উষির স্টেয়ারিং এ দুই হাত শক্ত করে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। নিজেকে একটু শান্ত করে দরজা খুলে বের হলো। তার দেখাদেখি আফসার সাহেবও বের হলেন। রাশা কি করবে বুঝতে না পেরে জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে কথা শুনতে চাইলো।

–আমি যাচ্ছি। তোমার ব্যবস্থা তুমি করে নাও।
উষির কঠিন, রাগী মুখে কথাটা বলেই গাড়ির ডিকি থেকে নিজের ব্যাগটা বের করে কাঁধে নিলো। আফসার সাহেব বিচলিত হলেন খুব। ছেলে চলে গেলে বাকি রাস্তাটুকু নতুন বউ নিয়ে কিভাবে বাড়ি ফিরবেন তিনি!
ছেলেকে শান্ত করতে হালকা করে বললেন,

–আমি গাড়ি চালাতে পারি নাকি?

–বিয়ের সিদ্ধান্ত তোমার ছিলো, এখন গাড়ি কিভাবে চালাবে সেই সিদ্ধান্তও তুমিই নাও। এসব দেখার বিষয় আমার না বাবা, সরি!

আফসার সাহেব রেগে গেলেন।

–আরে ছাগল..

তার কথা শেষ করার আগেই উষির বাবার পা ছুঁইয়ে সালাম করে বড় করে শ্বাস ফেলে বললো,

–ভালো থেকো বাবা।

উষিরের যাওয়ার কথা শুনে রাশাও গাড়ি থেকে নেমে পরেছিলো৷ ট্রেনের হুইলসেল দিয়ে দিয়েছে। ছেড়ে দেবে ছেড়ে দেবে করছে। তাই সেও উষিরের পদ অনুসরণ করে শ্বশুরের পা ছুঁইয়ে সালাম করলো,

–আমিও যাচ্ছি আংকেল। ভালো থাকবে। আর এতোক্ষণ আমার খেয়াল রাখার জন্য ধন্যবাদ।

তারপর আফসার সাহেবকে অবাক করে রাশা উষিরের পেছন পেছন ছুটতে লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো,

–আরে দাঁড়াও? আমাকে গাড়িতে তুলুন। আমিও যাবো…

রাশার আওয়াজ শুনে অনেকেই অবাক চোখে তাকে দেখছিলো। টকটকে লাল বেনারসি আর গা ভর্তি গহনা পরে একজন চলন্ত ট্রেনের পেছন পেছন ছুটছে। সবাই দেখলেও দেখলো না শুধু উষির। একবারও পেছন ফিরে দেখার প্রয়োজনও মনে করলো না। সোজা একটা ফাঁকা সিটে বসে পরেছে।

রাশা অনেক কষ্টে অনেক দৌঁড়ানোর পরেও ট্রেন ধরতে পারলো না। প্ল্যাটফর্মেই হাত পা ছড়িয়ে বসে পরলো। হাঁপাতে হাঁপাতে আফসোসের সুরে বললো,

–আমার থেকে টিকিট নিলে তাও জরিমানা দিতে হতো না। বউয়ের দেওয়া ফ্রী টিকিটে এসিতে আড়াম করে বসে যেতে পারতো। বদ দোয়া দিলাম, টিটি ধরে জেলে পুড়ে দিক। সাত দিন রিমান্ডে রেখে আচ্ছামত শায়েস্তা করুক। তারপর জাহান্নামে যাক!

আরো অনেক বদ দোয়া দিতে দিতে হতভম্ব হওয়া শ্বশুরের কাছে এসে বললো,

–চলো আংকেল, আমি ড্রাইভ করে তোমাকে নিয়ে যাই।

–তুমি চালাতে পারো মা?

আফসার সাহেব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন। রাশা লাজুক হেসে বললো,
–কি যে বলো! এই রাশা পারেনা এমন কোন কাজ তৈরিই হয়নি।

তারপর দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র আক্রোশে বললো,

–এমন অকর্মণ্য ছেলে তোমারই তো? ডিএনএ টেস্ট ভালো করে করেছিলে তো? শাশুড়ি আম্মার অন্য জায়গায় কোন চক্কর টক্কর ছিলো না তো আবার? তোমাদের চেহারাতেও কিন্তু কোন মিল নাই। শাশুড়িকে কিন্তু সন্দেহ করতে পারো।

রাশার কথাবার্তায় আফসার সাহেব কেশে উঠলেন। রাশা গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলতেই লাগলো,

–এমন বিট্রেয়ারকে আর রাখা যায় না আংকেল। আজকেই ত্যাজ্য করে দাও। কি দরকার এই ছেলের! বাপ আর বউকে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যায়! বেয়াদপ ছেলে একটা। একে তো উল্টা ঝোলায়া রাম ধোলাই দেওয়া উচিৎ।

আফসার সাহেব নিশ্চুপ হয়ে রাশার কথা শুনতে লাগলেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। রাশাকে বলা হলো না, ট্রেন ধরতে পারলে সে নিজেও একই পথের পথিক হতো। তখন গাড়ি নিয়ে তাকে অথৈ জলে পরতে হতো।

দ্বিতীয় ঝড় উঠলো বাড়িতে গিয়ে। তার সাথে বধূবেশে রাশাকে দেখেই তার স্ত্রী হায় হায় করে উঠলো,

–আমার কি সর্বনাশ হয়ে গেলো গো! এই বুড়া বয়েসে তোমার বিয়ের শখ জাগছিলো? ছেলেও তো সাথে ছিলো। ছেলের মুখের দিকে তাকায়া অন্তত এই কাজ করতা না। ছি ছি ছি! লোক লজ্জার ভয় নাই তোমার?

আফসার সাহেব স্ত্রীর কথার চাপে কোন কথাই বলতে পারছেন না। তবে রাশা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠে বললো,

–কে তুমি? পাগলের মতো একাই বকবক করে যাচ্ছো। আংকেলকে কিছু বলতে কেনো দিচ্ছো না? আর আমার বিয়ে আংকেলের ছেলের সাথে হয়েছে৷ আর সেই ছেলে বিয়ে করে মাঝরাস্তায় বউ রেখে ভেগে গেছে৷

পুরো বাড়িতে আচানক হওয়া এই বজ্রপাতে সবাই হতবিহ্বল হয়ে পরলো। হতবাক হয়ে সবাই একবার রাশা তো একবার আফসার সাহেবের দিকে দেখতে লাগলো। মনে হতে লাগলো, আফসার সাহেব নিজে বিয়ে করলেও কেউ এতোটা শক পেতো না!

চলবে…

এক শহর প্রেম_২ পর্ব-৪৮ এবং শেষ পর্ব

0

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৮
নতুন বউ নিয়ে কুমিল্লায় পৌঁছাতেই রাত প্রায় এগারোটা! সবাই খুব ক্লান্ত। মারসাদের ফুফি-মামিরা আদিরাকে দেখার পর মিসেস মীরা আর দেরি না করে মারসাদ ও আদিরাকে ওদের রুমে পাঠিয়ে দেন। তারপর মাহিকে দিয়ে ওদের জন্য খাবার ঘরেই পাঠিয়ে দেন। মারসাদের রুমটা ফুলে ফুলে সজ্জিত। গোলাপ ও রজনীগন্ধার ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে পুরো রুম জুড়ে। মারসাদ প্রথমে ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর আদিরাকে ফ্রেশ হতে পাঠায়। আদিরা ভারি শাড়ি বদলে একটা সুতি লাল রঙের থ্রিপিস পরে আসে। মারসাদ ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

“এসো, খেয়ে নাও।”

“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“একটু খাও। এতোটা পথ জার্নি করে এসেছ। না খেয়ে ঘুমালে এখন তোমার শরীর খারাপ করবে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

মারসাদ ও-কে খাইয়ে দিবে কথাটা শুনে আদিরা অবাক হয়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে মারসাদ ওর হাত ধরে এনে সোফায় বসায়। তারপর খাবারের লোকমা তুলে খাইয়ে দেয় সাথে নিজেও খায়। মারসাদ বলে,
“আমি এর আগে মাহি ছাড়া আর কাউকে খাইয়ে দেইনি। মাহি ছোটো থাকতে আমার হাতে খাবে বলে বায়না করতো। ও কলেজে যাওয়া অবধি হাতে গোনা হয়তো কয়েকবার শুধু নিজের হাতে খেয়েছে। আর বাকি সবদিন দাদি, মা-বাবা, আপিলি ও আমি খাইয়ে দিতাম। তারপর আমি চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার পর আর সেই সুযোগ হয়নি। আজ এত বছর পর আমি কাউকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছি।”

আদিরা মৃদু হাসে। অতঃপর ওরা খাওয়াদাওয়া শেষ করে ব্যালকনির দোলনায় গিয়ে বসে। দুজনে একসাথে আঁধার আকাশে শুভ্র চাঁদটাকে দেখছে। মারসাদ মোবাইলে সময় দেখে। বারোটা বাজতে আর ছয় মিনিট বাকি। মারসাদ বলে,
“একটু বসো। আসছি আমি।”

তারপর মারসাদ উঠে রুমে চলে গেলো। আদিরা আকাশের দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে। আজ তার ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে। মারসাদ তার কাছে চাঁদের মতো। ছোটোবেলায় শুনেছে, সবাই চাঁদ ছোঁয়ার ক্ষমতা রাখে না। চাঁদ দূর আকাশেই সুন্দর। সৌভাগ্যবানেরাই চাঁদের সান্নিধ্য পায়। কিন্তু আদিরার এখন মনে হচ্ছে, সে সেই সৌভাগ্যবতীদের মধ্যেই একজন।
মিনিট খানেক পর মারসাদ এসে হাজির। তার হাত পেছনে আড়াল করা। হুট করে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। আদিরা অবাক হয়ে যায়। মারসাদ হাতটা সামনে এনে বক্সটা খুলে। সেখানে একটা পাতলা চেইনের গোল্ড ফ্লোরাল ব্রেসলেট। মারসাদ বলে,

“ভালোবাসা দিবস ও বসন্তের শুভেচ্ছা, মিসেস আদিরা। আমার জীবনে অনাগত সব বসন্তে আমি শুধু তোমাকেই চাই। তোমার সাথে আমি বৃদ্ধ হতে চাই। ভালোবাসি।”

আদিরা লাজুক হেসে মারসাদের সামনে দুই হাঁটু গেড়ে বসলো। তারপর মারসাদকে অবাক করে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে রিনরিন স্বরে বলল,
“আমিও ভালোবাসি।”

মারসাদের ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি৷ সে আদিরার কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে ও-কে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর চট করে আদিরাকে কোলে তুলে রুমের দিকে হাঁটা ধরে। আদিরার নাকে নাক ছুঁইয়ে বলে,
“সুন্দর রাতটাকে আরও সুন্দর করি?”

আদিরা লজ্জায় মারসাদের বুকে মুখ লুকায়। অতঃপর বসন্তের প্রথম রাজন ভালোবাসায় আচ্ছন্ন।

——-
ছয় বছর পর,
আদিরা এখন একটা কলেজে ক্যামিস্ট্রির লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে। সবে এক মাস হলো সে জয়েন করেছে। অনার্সের পরপরই বিসিএস দিয়েছে। দুইবার বিসিএস দিয়ে দ্বিতীয়বার সে শিক্ষা ক্যাডারে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। এরইমধ্যে সে মাস্টার্সও শেষ করেছে। সবকিছুতে মারসাদ ও তার দুই পরিবারের সাপোর্ট ছিল। সবার সাপোর্টে ও নিজ যোগ্যতায় সে এতো দূর আসতে পেরেছে। কলেজে জয়েন করার পর আদিরা তার বাবা-মা, ভাইকে কুমিল্লায় নিয়ে এসেছে। একটা ফ্লাট ভাড়া করে সে নিজের খরচে নিজের বাবা-মা ও ভাইকে রাখছে।

আজ মারসাদ ও আদিরার ষষ্ঠী বিবাহবার্ষিকী। বছরের প্রথম বসন্তের বিকেল। বাড়ির লনে আদিরা, মিসেস মীরা, মিলি ও মাহি, বসে চা খেতে খেতে গল্প করছে। আদিরার দৃষ্টি বারবার গেইটের দিকে। মারসাদ আসছে কী না তা দেখছে। আদিরার এই অস্থিরতা কারও নজরকে ফাঁকি দিতে পারেনি। মাহি বলে,

“আদু, তুই যেভাবে দাভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিস, দেখে মনে হচ্ছে তোদের নতুন বিয়ে হয়েছে। নতুন বউ তার স্বামীর জন্য অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে আছে!”

আদিরা হাসে। মিলি মাহির মাথায় একটা টো*কা দিয়ে বলে,
“অথচ তোর উচিত আহনাফের জন্য এভাবে অপেক্ষা করা! মাত্র দেড় মাস হলো তোদের বিয়ের।”

মাহি মাথা ড*লতে ড*লতে বলে,
“উনার সাথে আমি রাগ করেছি। আমাকে আইসক্রিম খেতে দিচ্ছে না। বিয়ের আগেই এই লোক ভালো ছিল। এখন আমার পছন্দের খাবারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।”

মাহির কথা শুনে সবাই হেসে উঠে। তখন গেইট দিয়ে মারসাদের গাড়ি ঢোকে। মাহি বলে,
“এই নাও। বলতে বলতে দুই বন্ধু চলে এসেছে।”

গাড়ি থেকে মারসাদ ও আহনাফ নামতেই দুটো বাচ্চা দৌঁড়ে যায় ওদের দিকে। মিলির সাত বছরের ছেলে মাহির ও মারসাদ-আদিরার তিন বছরের মেয়ে মাদিহা। মাদিহা ছুটে সবার আগে তার বাবার কোলে উঠে। মারসাদও মেয়েকে পরম আদরে আগলে নেয়। মাদিহা আধো স্বরে বলে,

“বাবা, চক্কেত(চকলেট)?”

মারসাদ মেয়ের গালে আদুরে চু’মু এঁকে হাতে থাকা প্যাকেট থেকে চকলেট বের করে মেয়েকে ও মাহিরকে দেয়। আহনাফও ওদের দুজনকে চকলেট দেয়। তারপর মারসাদ মাদিহাকে কোলে নিয়ে ও আহনাফ মাহিরের হাত ধরে মাহি, আদিরাদের দিকে যায়। আহনাফকে দেখে মাহি মুখ ভে*ঙচি দিয়ে অন্যদিকে ফিরে। আহনাফ তা দেখে হেসে পকেট থেকে ডেইরিমিল্ক সিল্কের সবচেয়ে বড়ো সাইজের চকলেটটা বের করে মাহির সামনে রাখে। চকলেট দেখে মাহি মনে মনে বেশ খুশি হলেও রাগ করে থাকার ভান করে চকলেটটা নিয়ে চুপ করে থাকে। মিসেস মীরা মেয়েকে বলেন,

“আহনাফ তোর জন্য চকলেট আনলো, তারপরও এভাবে আছিস? যা ও-কে নিয়ে রুমে যা। ওর কী লাগবে দেখ।”

“তুমি মেয়ের থেকে জামাইয়ের বেশি কেয়ার করো! ভাল্লাগে না!”

বলেই মাহি উঠে গেলো। সবাই ওর কথা শুনে আবারও হেসে উঠলো। আহনাফ শাশুড়িকে সালাম দিয়ে বউয়ের পেছন পেছন গেলো।

এদিকে মারসাদ রুমে গিয়ে ঘড়ি, বেল্ট খুলে শার্টের বোতাম খুলছে তখন আদিরা ফ্লাস্ত থেকে গরমপানি নিয়ে চটপট কফি বানিয়ে মারসাদকে নিয়ে দেয়। মারসাদ কফির মগ রেখে আদিরার হাত ধরে নিজের বুকের সাথে আগলে নেয়। তারপর বিছানার উপর রাখা প্যাকেটটা থেকে একটা গোলাপ বের করে বলে,

“হ্যাপি এনিভার্সেরি, মিসেস।”

বলতে বলতে কানের পিঠে ফুলটা গুঁজে দেয়। আদিরা শক্ত করে মারসাদকে জড়িয়ে ধরে প্রত্যুত্তরে বলে,
“হ্যাপি এনিভার্সেরি, মিস্টার হাজবেন্ড। আাপনি আমার মনের শহরেে প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। আপনিই আমার পূর্ণতা।”

তখনি রুমে মাদিহার আগমন ঘটে। বাবা-মাকে একসাথে দেখে মাদিহা মুখে হাত দিয়ে হাসছে। মারসাদ মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। মাদিহার খিলখিল হাসিতে মারসাদ আদিরাও হাসে। অতঃপর দুজনে মেয়েকে দুই পাশ থেকে একসাথে চু’মু খা’য়।

সবার মনের শহরে এক শহর প্রেম পূর্ণতা পাক। ভালো থাকুক সবাই।
সমাপ্ত

আসসালামু আলাইকুম। অবশেষে গল্পটা শেষ করতে পেরেছি। আগের সিজনে মারসাদ-আদিরার বেবির সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তাদের জন্য মাদিহা।🥹
যারা গল্পটা ধৈর্য নিয়ে পড়েছেন, সবার জন্য ভালোবাসা।

ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

এক শহর প্রেম_২ পর্ব-৪৭

0

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৭ (বিবাহ স্পেশাল)
দেখতে দেখতে ফেব্রুয়ারি মাস। প্রকৃতিতে এখনও শীতের আবহ থাকলেও মাঘ মাসের আজই শেষ দিন। আদিরার আজ গায়ে হলুদ। সাবিহা, রিন্তি, সুমি, মৌমি, রাত্রিরা আজকে সকালেই আদিরার গ্রামে এসে পৌঁছেছে। ওরা এখন আদিরার রুমে বিশ্রাম করছে। বিকেল হতেই আত্মীয়-স্বজনরা আসছে। গ্রাম্য পরিবেশে আদিরাদের আশেপাশের বাড়ির মহিলারা হলুদ, মেহেদী বাটছে। সেই সাথে সন্ধ্যায় সবার জন্য খিচুড়ি রান্নার প্রস্তুতি চলছে। মুরগী গো*শত ও সবজি দিয়ে এই খিচুড়ি রান্না হবে। খিচুড়িতে মাখা মাখা একটা ভাব থাকবে। শীতের বিকেল, নিতান্ত ছোটোই হয়। দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছে। মৌমি আদিরার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবার তোড়জোড় দেখছে। সে গ্রামের বিয়ের পরিবেশ আগে কখোনো দেখেনি। রিন্তি এসে মৌমির পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

“কতো সুন্দর লাগছে, তাই না আপু?”

“হ্যাঁ৷ আমার এর আগে গ্রামে কোনো বিয়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। তবে আম্মুর কাছে শুনেছি অনেক সুন্দর হয়। আশেপাশের বাড়ি ঘরের মানুষজন এসে স্বেচ্ছায় কাজে হাত লাগায়।”

“আমি আমার আব্বুর খালাতো ভাইয়ের বিয়ে খেয়েছি গ্রামে। তখন সাত বছরের ছিলাম। সন্ধ্যা হলেই দেখবে সবাই কিভাবে মেহেদী ও হলুদ নিয়ে বসে। আমরা কিন্তু আদিরার হাতে ডিজাইন করে মেহেদী দিব বলে চট্টগ্রাম থেকেই সব প্রিপারেশন নিয়ে এসেছি।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। আন্টিকে বলেছ?”

“বলেছি। আন্টি রাজিও হয়েছে। আন্টি বলেছেন, রাত নয়টার পর আন্টি আর কাউকে আদিরার রুমে হলুদ লাগাতে ঢুকতে দেবেন না। তখন আমরা মেহেদী দিতে বসব।”

“আচ্ছা। তাহলে ভালোই হয়।”

কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান হতেই রিন্তি ও মৌমি ঘরের ভেতরে যেতে নিলে, একটা মেয়ে ওদেরকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে আদিরার ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। রিন্তি ও মৌমি অবাক হয়ে তাকালেও মেয়েটি পাত্তা না দিয়ে আদিরার সামনে গিয়ে রূঢ় স্বরে বলতে শুরু করে,

“শেষে শহরের ছেলে পটাইলা!”

মেয়েটির কথার প্রত্যুত্তরে আদিরা কিছু বলার আগেই সাবিহা বলে উঠে,
“সরি! আপনি কে? আর এসব কেন বলছেন?”

আদিরা সাবিহাকে উত্তরটা দেয়।
“আমার খালার ননদের মেয়ে। ডালিয়া।”

ডালিয়া আদিরার কথা শুনে ফের বলে উঠে,
“এইটাও বলো যে আমার ভাইয়ের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হইছিল।”

রুমে উপস্থিত সকলের ভ্রুঁ কুঁচকে উঠে। সুমি বসা থেকে উঠে বলতে শুরু করে,
“আমার মা আমাকে বলেছিল, গ্রামে কিছু এমন প্রজাতির মা*নুষ আছে যারা কারও ভালো ঘরে বিয়ে হতে দেখলে বিয়ের আগের দিন ও বিয়ের দিন বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে বা ঝামেলা বাধায়। তুমিও মনে হয় সেই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত! এদেরকে বলে কর্ডাটা পর্বের ভার্টিব্রাটা উপপর্বের রে*পটিলা শ্রেণীর এক বি*ষধর প্রা*ণী!”

সুমির কথা শুনে ডালিয়া ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে তাকালে সুমি ওর চারদিকে একবার ঘুরে এসে ফের বলতে শুরু করে,
“আমরা সব জানি। তোমাকে নতুন করে জানাতে হবে না। আসলে কি বলতো?….”

কথাটা বলে সুমি মেয়েটির কানের কাছে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“লাভ ম্যারেজ বলে কথা! আমাদের বন্ধু তো আদিরার জন্য পুরো দিওয়ানা। যেই ছেলের জন্য পুরো ক্যাম্পাসের মেয়েরা দিওয়ানা, সেই মারসাদ শুধু আদিরার জন্য দিওয়ানা। কাল বিয়ে খেতে এসে আদিরার বরটাকে দেখো! কেমন?”

ডালিয়া ফুঁসতে ফুঁসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ও যেতে সবাই হেসে উঠলো। রাত্রি বলে,
“মাহিটাকে মিস করছিলাম। কিন্তু সুমির জবাব শুনে এখন মনে হচ্ছে মাহি তার আ*ত্মাটা সুমিকে দিয়ে দিয়েছে!”

সবাই ফের হেসে উঠে। আদিরা বসা থেকে উঠে বলে,
“নামাজ পড়ো। আজান হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর এই রুমে বসার জায়গাও থাকবে না।”

তারপর আদিরা অজু করতে কলপাড়ে যায়।

———

মারসাদদের পুরো বাড়ি আলোয় সজ্জিত। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ মরিচবাতি দিয়ে দালান ও গার্ডেন ডেকোরেশন করা হয়েছে। আত্মীয় স্বজনরাও সবাই চলে এসেছে। রাত একটার পর সবাই আদিরাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। বিয়ের সাঁজানো এসবে মারসাদকেই দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। আহনাফ, রাফিন, মৃদুল, রবিনরাও মারসাদকে সাহায্য করছে। মারসাদের কাজিনমহল খুব বেশি বড়ো না। আর তাতে বোনদের সংখ্যাই বেশি। ভাই সব ছোটো ছোটো। মারসাদের মামা, ফুফারাও অনেক দিক সামলাচ্ছে তবে মিলির স্বামী রাকিব রুমের ভেতর একদম নিরব বসা। মিলি কয়েকবার বলেছেও যেন সবার সাথে মিলেঝুলে থাকে৷ কিন্তু রাকিব নারাজ। সে আসতেও চায়নি। মিলি হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ে। রাকিবের পরিবারের কেউ বিয়েতে আসবে না। উনারা মিলি ও রাকিবকেও নিষেধ করেছিল। কিন্তু ভাইয়ের বিয়ে বিধায় মিলি নিষেধাজ্ঞা মানেনি।

রাত বারোটা বাজতে আর দুই মিনিট বাকি। মাহির হাতের মেহেদী প্রায় শুকিয়ে গেছে। সে তার বোনদের মাঝ থেকে উঠে ছাদে যায়। কিছুক্ষণ আগেই আহনাফ তাকে ছাদে আসতে বলেছে। ছাদে গিয়ে মাহি অবাক। গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে ছাদের ফ্লোরে মাহির নাম লেখা। সাথে মাটির প্রদীপ দিয়েও সাঁজানো। মাহির চেহারায় খুশির উজ্জ্বলতা ফুটে উঠে। সে বুঝে যায় এটা কার কাজ। তখনি ছাদের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দরজা বন্ধের শব্দে মাহি পেছনে ঘুরলে দেখে আহনাফ হাঁটু গেড়ে একটা গেলাপ হাতে বসে আছে। আহনাফ বলে উঠে,

“হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে, মাই এংড়িবার্ড!”

মাহি চোখ ছোটো করে তাকালে আহনাফ হেসে ফেলে। তারপর বলে,
“সরি! একজনকে এংড়িবার্ড বললে তো আবার মুখ ফুলিয়ে ফেলে।”

অতঃপর মাহিও হেসে ফেলে।
“আপনি আমাকে এই পর্যন্ত যে কতো নামে ডেকেছেন! তারমধ্যে এংড়িবার্ড নামটা কিউট কিন্তু আমি তো রাগ করি না। কতো ক্লাম, সুইট, কিউট আমি।”

“ওহ তাই?”

“হু হু।”

মাহি চাপা হেসে ফুলটা নেয়। তারপর আহনাফকে নিজের মেহেদী দেখিয়ে বলে,
“আপনার নাম খুঁজুন তো।”

“নাম লিখেছ? ওয়াও! দেখি কোথায়…”

আহনাফ বেশ আগ্রহ নিয়ে মাহির হাতে নিজের নাম খুঁজছে। হুট করে ছাদের দরজা খুলে রাফিন, মৃদুল, রবিন আসে। ওরা তিনজন কিছু দেখেনি এমন একটা ভাব করে। মৃদুল বলতে থাকে,

“ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে কাপলদের দেখতে দেখতে আমি হতাশ! কিছুক্ষণ পর আরেক কাপলের বিয়ের জন্য রওনা হতে হবে। আর আমি এখনও সিঙ্গেল!”

রাফিন বলে,
“আমার জন তো তার বান্ধবীর কাছে। তাই আমিও এখন সিঙ্গেল।”

রবিন বোকার মতো বলে,
“আমি জন্মগত সিঙ্গেল!”

“আরে ব*ল*দ! সবার জন্ম সিঙ্গেল হয়েই হয়!”

ওদের কথোপকথন শুনে মাহি ঠোঁট চেপে হেসে তাড়াতাড়ি করে নিচে চলে যায়। আহনাফ তার তিন বন্ধুর মাথায় চা*টা মে*রে বলে,
“ওর হাতের মেহেদীই দেখছিলাম! আরেকটু পর আসলে কী হতো?”

“ঘড়িতে সময় দেখ। সোয়া বারোটা বাজে। একটা বাজে বের হওয়ার কথা। আমার তো মনে হচ্ছে ২-৩টা বাজবেই। ৬-৭ ঘণ্টা তো লাগবেই সাতক্ষীরা শহরে যেতে। তারপর তো আরও ভেতরে।”

আহনাফ চিন্তায় পড়ে যায়।
“তাও ঠিক। কিন্তু তিনটা বাজলেও সমস্যা নেই। বিয়ে তো যোহরের পর পড়ানো হবে। ফেরার সময় ঝামেলাটা হবে। কখন না কখন ফিরব!”

——–

আদিরার দুই হাত ভর্তি করে মেহেদী দেওয়া শেষে সবাই বসে বসে গানের কলি খেলছে। আহাদ ইতোমধ্যে আদিরার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। রাত্রি আহাদকে আস্তে করে উঠিয়ে একটা বালিশে শুইয়ে দিয়ে বলে,

“আদিরা, তোমার হাতের মেহেদী প্রায় শুকিয়ে গেছে। তুমি এখন শুয়ে পড়ো। কালকে সারাদিন তো ঘুমাতে পারবেই না। তারউপর জার্নি করেই ক্লান্ত হয়ে যাবে।”

আদিরা মাথা নাড়িয়ে ফোনটা হাতে নেয়। ফোন যে কখন সাইলেন্ট হয়ে আছে তা সে টেরও পায়নি। মারসাদের দুইটা মিসডকল আর একটা মেসেজ এসেছে। আদিরা মেসেজটা দেখে।

“সবার মাঝে আছো? তাহলে আর কল করলাম না। জলদি ঘুমিয়ে পড়ো। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে, মাই লাভ। আমাদের একসাথে এজ অ্যা কাপল এটাই প্রথম বসন্ত। আর দেখো, প্রথম বসন্তেই তুমি আমার বউ হতে চলেছ। টু বি মিসেস আদিরা, আই লাভ ইউ!”

মেসেজটা পড়ে আদিরা লাজুক হাসে। তারপর ফিরতি মেসেজ লিখতে নিয়েও থেমে যায়। একেবারে কালকে মারসাদকে জবাব দিবে ভেবে ফের লাজুক হেসে ফোন রেখে শুয়ে পড়ে।

——-
বরযাত্রী আদিরাদের গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বেলা ১১টা বেজে গেছে। মারসাদের মা, খালা, ফুফি, মামিরা কেউ আসেনি। উনারা কুমিল্লায় নতুন বউ বরণ করার অপেক্ষায় আছেন। কাশেম আলী ও আশা বেগম ফাঁকা ঘরটাতে সবাইকে অ্যাপ্যায়ন করছেন। গ্রামের মুরুব্বিরাও সেখানে বসেছে। সবার মাঝে মারসাদের অস্বস্তি হচ্ছে। ওর বন্ধুরাও সব মুরুব্বিদের মাঝে পুতুলের মতো বসে আছে। আশেপাশে মাহি ও কাজিন বোনেরাও নেই যে এখান থেকে উঠার ব্যবস্থা করবে। মাহি ও তার কাজিন বোনেরা এসেই গহনা নিয়ে আদিরার রুমে চলে গেছে। আদিরা তখনও সাঁজ শুরুই করেনি! সবে গোসল শেষে চুল শুকাচ্ছে। মাহি তা দেখে বলে,

“তুই এখনও রেডি হসনি? মেকাপ এসব কখন করবি?”

সাবিহা হতাশ কণ্ঠে জবাব দেয়,
“সে নাকি মেকাপ করবে না! এতো পথ জার্নি করতে হবে বলে মেকাপই করবে না।”

সাবিহার কথা শুনে মাহি বিরোধ করে,
“মেকাপ করবে না মানে কি? একটু তো করতে হবে। বিয়ে কি বারবার করবে নাকি! উঠ আদু, আমি তোকে হালকা করে মেকাপ করে দিব।”

“মাহি, অনেক জার্নি করতে হবে। আমার আনইজি লাগে।”

আদিরার অসহায় কণ্ঠ শুনে মাহি ওর দুই গালে হাত রেখে বলে,
“হালকা করে করব। আমি জানি, গ্রামের পার্লারে খুব ভারি করে বেস করে। আমি তেমনটা করব না। তাছাড়া তুই তো মা শা আল্লাহ, এমনিতেই সুন্দর। কিন্তু বিয়েতে একটু মেকাপ না করলে ভালো লাগবে না।”

এবার মৌমি, সুমি, সাবিহারাও মাহির সাথে একমত পোষণ করে। তারপর মাহি আদিরার মেকাপ করা শুরু করে।

এদিকে আশা বেগম রান্নার দিকটা তদারকি করার সময় তার বোনের ননদ ও তার মেয়ে ডালিয়া সেখানে আসে। ডালিয়ার মা ইনিয়েবিনিয়ে আশা বেগমকে বলেন,

“তোমার মাইয়ার জামাইটা তো বেশ সুন্দর। আর বড়ো ঘরের। আমার মাইয়ার জন্যও একটা ছেলে খুঁইজো তো। তোমার মাইয়ার জামাইয়ের বন্ধুগুলাও দেখতে ভালো ঘরের লাগে।”

আশা বেগম কৃত্রিম হাসেন। উনার বদলে আসাদ এসে মজার ছলে বলে,
“খালা, দুলাভাইয়ের বন্ধুগো গালফ্রেন্ড(গার্লফ্রেন্ড) গুলাও অনেক সুন্দর। ডালিয়া আপা তো হেগো কাছে কিছুই না!”

ছেলের কথা শুনে আশা বেগম তাড়াহুড়ো করে ছেলের মুখ চেপে ধরলেন। তারপর জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলেন,
“ওয় ছোটো মানুষ, আপা। কিছু মনে কইরেন না।”

এদিকে ডালিয়া ও ডালিয়ার মা ফুঁসছে। ডালিয়া ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
“ছোটো না! বলেন অতিরিক্ত পাকনা! চলো তো মা,…”

তারপর ডালিয়া তার মাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আশা বেগম ছেলেকে শাসন করতে গিয়েও ছেলের হাসি দেখে হেসে ফেলেন।

যোহর নামাজের পর কাশেম আলী মৌলবি নিয়ে আদিরার ঘরে আসে। মৌলবি নাম, ঠিকানা সব বলার পর আদিরাকে কবুল বলতে বললে আদিরা জলে ভরা নয়নে তার বাবার দিকে তাকায়। কাশেম আলী মেয়ের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছেন। আদিরার চোখ থেকে টুপ করে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। মৃদু স্বরে সে তিনবার কবুল বলে দেয়। তারপর কাজি মারসাদের কাছে গিয়ে কবুল বলায়। সকলে আলহামদুলিল্লাহ বলে। অতঃপর দুজনে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

দুপুর সাড়ে তিনটার পর আদিরাকে নিয়ে মারসাদরা কুমিল্লার উদ্দেশ্য রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত। অনেক দূর যেতে হবে বলে বেশি দেরি করছে না। বিদায়ের সময় আদিরা খুব কাঁদছে। নিজের বাবা-মা ও ভাইকে ছেড়ে সে যেতেই চাইছে না। কেঁদেকেটে চোখ-মুখে লাল করে ফেলেছে। তারপর মাহি, রিন্তি ওরা আদিরাকে খুব বুঝিয়ে গাড়িতে বসায়। মারসাদ গাড়িতে বসে ক্রন্দনরত আদিরা হাত ধরে ওর মাথা নিজের কাঁধে এলিয়ে দেয়। অতঃপর ওদের গাড়ি ছুটে চলে নতুন ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

এক শহর প্রেম_২ পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৪
মারসাদ তার বাবার সাথে বাড়ির লনে বসে আছে। এখন সন্ধ্যা। অফিস করেই সেখান থেকে বাইকে করে কুমিল্লা চলে গেছে সে। আরশাদ খান বলে,
“কী বলতে তুমি ছুটে এসেছে? যা ফোনে বলা যায় না!”

মারসাদ হাসে৷ তারপর টেবিল থেকে কফির মগ তুলে নিয়ে বলল,
“বলছি৷ সময় তো আছেই।”

ছেলেকে এতো শান্ত কণ্ঠে কথা বলতে শুনে আরশাদ খান চিন্তিত হলেন। তিনি শুধালেন,
“তুমি হেয়ালি করছো মানে তুমি খুব ফুরফুরে মেজাজে আছো।”

“অ্যাবসুলেটলি রাইট, বাবা। তুমি সবসময় আমাকে একদম সঠিক বুঝো। ইয়াং এইজে তুমি আমার মতোই ছিলে কী না! কিন্তু এখন অনেক বদলে গেছো। আমার মধ্যে নিজের রিফ্লেকশনই তোমার পছন্দ হচ্ছে না।”

আরশাদ খান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন,
“বাবা হলে বুঝবে।”

“আমার বুঝতে হবে না। বরং তুমি বুঝো! সামিরাকে তো তুমি খুব ভালো মেয়ে মনে করো। সেই ভালো মেয়ের কীর্তিকলাপ জানবে না?”

ভ্রঁ কুঁচকে এলো আরশাদ খানের।
“কী বলতে চাইছ?”

তারপর মারসাদ কল রেকর্ড শোনায়। নাম্বারটা যে সামিরার নামে রেজিস্ট্রেশন করা, সেটাও দেখায়। সব দেখে ও শুনে আরশাদ খান হতবাক। তিনি বাকরুদ্ধ। মারসাদ বলে,
“আমি পু*লিশের কাছে এগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করে এসেছি। এতক্ষণে হয়তো পু*লিশ সামিরাদের বাড়িতে চলেও গেছে!”

আরশাদ খান কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। মারসাদও উঠে বাড়ির ভেতরে যায়। মিসেস মীরা মারসাদকে দেখা মাত্রই ছুটো এলেন। তিনি এতক্ষণ বাবা-ছেলের কথোপকথন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিলেন। এখন উৎকণ্ঠিত হয়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন,

“কী কথা বললি তোর বাবার সাথে? আর তোর বাবা এত শান্তভাবে রুমে চলে গেলেন যে।”

মারসাদ তার মাকে সোফাতে বসিয়ে বলে,
“একটু পর তোমার বোনের ফোন তোমার কাছে আসবে। সো বি প্রিপেয়ার।”

বলেই মারসাদ চলে যাচ্ছে। মিসেস মীরা ডাকলেন,
“অন্তত খেয়ে যা।”

“তোমার মেয়ে তো ওখানে একা। তাছাড়া আমার যাওয়াটা জরুরী।”

“কী হয়েছে বল না? তোর আন্টি কল দিবে কেন?”

মিসেস মীরা মারসাদকে এই প্রশ্ন করতে করতেই উনার ফোন বেজে উঠলো। সামিরার মা কল করেছে। মিসেস মীরা কল রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশে সামিরার মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

“মীরা, তোর ছেলেকে বল আমার মেয়ের নামে কে*স তুলে নিতে। ও-কে পু*লিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে।”

মিসেস মীরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি মারসাদের দিকে তাকালেন। মারসাদ বাঁকা হাসছে। ফোনের অপরপাশ থেকে সামিরার চিৎকার ও ভাঙচুরের শব্দও আসছে। মিসেস মীরা শুধালেন,
“পুলিশ কেন সামিরাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে? কী করেছে ও?”

“আমার মেয়ে যা করেছে তোর ছেলেকে ভালোবেসে করেছে। ওর দোষ ছিল কিন্তু ও বুঝতে পারেনি। খুব জেদি মেয়ে আমার। জেদ, রাগের বশে করে ফেলেছে। আমার মেয়ের হয়ে আমি কথা দিচ্ছি, ও আর কখনো তোর ছেলের আশেপাশেও আসবে না। শুধু কে*সটা তুলে নিতে বল। ও-কে আমরা অনেক দূরে পাঠিয়ে দেবো।”

মিসেস মীরা কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। মারসাদ তার মায়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সামিরার মাকে বলল,
“আন্টি, আপনার স্বামীর তো অনেক টাকা। আপনার মেয়ে সেই টাকার অপব্যবহার করে অন্যের ক্ষতি করতে চেয়েছে। তাহলে সেই টাকা দিয়েই না হয় আপনার মেয়েকে ছাড়িয়ে আনুন।”

সামিরার মা এবার মারসাদের কাছে আকুতি-মিনতি করছেন।
“মারসাদ প্লিজ। তোমার আন্টির উপর দয়া করো প্লিজ। সামিরার আব্বু দেশে নেই। তার উপর তিনি যদি জানতে পারেন, তাহলে মেয়েকে তিনি মে*রেই ফেলবেন।”

মারসাদ খানিক ভাবে। তারপর বলে,
“কিন্তু আন্টি, আমি তো আংকেলকে সব মেইল করে দিয়েছি। আর সেটা অনেকক্ষণ আগেই করেছি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই দেখে ফেলেছেন।”

সামিরার মা আঁৎকে উঠলেন। মারসাদ আরও বলল,
“আমি অবাক হচ্ছি, আপনি এখনো আপনার মেয়ের হয়ে ডিফেন্ড করছেন? আপনার মেয়ে টাকা ছড়িয়ে আরেকটা মেয়ের সবচেয়ে বড় সর্ব*না*শ করতে চেয়েছে। সেই সত্য যাতে ফাঁস যাতে না হয় তার জন্য সে ক্রি*মিনা*লদের জামিনও করিয়েছে। তাহলে কি আপনি আপনার মেয়ের এসব কাজে সাপোর্ট করছেন?”

সামিরার মা কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলেন,
“না, বাবা। আমি আমার মেয়ের এসব কাজ সাপোর্ট করছি না। কিন্তু কী করবো বলো? আমার একমাত্র মেয়ে।”

“আপনারাই ও-কে বেশি আদর দিয়ে বিগড়ে দিয়েছেন। সি নিডস ট্রিটমেন্ট। পু*লিশকে পু*লিশের কাজ করতে দিন। তারপর নাহয় টাকা দিয়ে জামিন করাবেন! কিন্তু আমি কে*স উইথড্র করব না। রাখছি।”

মারসাদ কল কেটে মিসেস মীরার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

——–
পরদিন ভার্সিটিতে সবাই সামিরাকে নিয়ে চর্চা করছে। আদিরা খবরটা শুনে মাহিকে জিজ্ঞাসা করে। এরপর মাহি আদিরাকে সব বলে ও কল রেকর্ড শোনায়। আদিরা যখন সামিরার কল রেকর্ড শুনেছে, আদিরা পুরো থমকে গেছে। মাহি, সাবিহা, রিন্তি ও-কে সাহস দিচ্ছে। মাহি বলে,
“সামিরা আপু এতো জঘন্য কাজ করতে পারে সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। এরপরও শাহানা আন্টি আমাকে বারবার ফোন করছে, যেন আমি দাভাই ও তোকে বুঝাই!”

কিছুক্ষণ পর আদিরা ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মলিন স্বরে বলে,
“টাকা দিয়েই তবে নিজের মেয়েকে মুক্ত করুক। আমি এইবার তাকে ক্ষমা করতে পারব না। কোনোভাবেই না।”

তারপর সে সেখান থেকে চলে যাচ্ছে। রিন্তি ও-কে ডাকলে মাহি বাধা দেয়। তারপর হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ডাকিস না। ও কে একটু একা থাকতে দে। ও নিজেকে সামলে নিবে।”

তারপর রিন্তি আর আদিরাকে ডাকে না।

আদিরা থানায় যায়। সেখানে গিয়ে সামিরার সাথে দেখা করে। সামিরা আদিরাকে দেখেই রেগে যায়। আদিরা কিয়ৎক্ষণ সামিরাকে পর্যবেক্ষণ করে তাচ্ছিল্য হাসে। আর বলে,

“এতো রাগ? একটা মা’নুষ আরেকটা মানু’ষকে এতোটা অপছন্দ করে যে তাকে নিয়ে এরকম জঘন্য প্ল্যানিং করে! মেয়ে তো তুমিও। মেয়েদের সম্মান মেয়েদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তোমার সাথে এমনটা হলে কী করতে?”

সামিরা উচ্চস্বরে হেসে উঠে। তারপর জে*লের গ্রিল শক্ত করে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,
“তাহলে সরে যেতি তো আমাদের জীবন থেকে। তোকে সহ্য করতে হতো না। তোর মতো মেয়ের আবার সম্মান আছে নাকি? তোরা পারিস বড়ো ঘরের ছেলেদের নিজেদের ফে’ক ন্যা*কা-মোতে ফাঁসাতে। তোকে দেখলেই আমার ঘৃ-ণা হয়৷ রা-গ লাগে। মনে হয় নিজ হাতে খু*ন ক’রি।”

আদিরা নির্নিমেষ চেয়ে রইল। সামিরা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফ্লোরে বসলো। আদিরা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল,
“আমাদের বিয়ের খবরটা আমি ও মারসাদ নিজে এসে তোমাকে দিয়ে যাব!”

সামিরা চমকায়। সে চট করে উঠে দাঁড়ায়৷ আবার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
“তুই! তুই! আমার মারসাদ বেবিকে বিয়ে করতে পারবি না। আমাদের এনগেজমেন্ট হবে কিছুদিন পর।”

আদিরা নির্বিকার৷ সে আবারও বলে,
“আর যদি তুমি জা*মিনে ছাড়া পেয়ে যাও তবে তোমার বাড়িতে গিয়ে বলে আসব বা ফোনেই বলব। ততোদিন তুমি অপেক্ষা করো। আর নিজের মানসিক অবস্থার ট্রিটমেন্ট করাও।”

সামিরা এসব সহ্য করতে পারছে না। সে পা’*গলের মতো করছে। আদিরা আর কালক্ষেপণ না করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৫
মাসখানেক পেরিয়ে গেছে। সামিরার বাবা দেশে এসে সামিরার জামিন করান। তারপর মেয়েকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান। এখন সামিরা চুপচাপ থাকে। নিজের রুমে একা সারাক্ষণ ঘুম ও বারান্দায় বসে থাকা এভাবেই দিন কাটছে। আরশাদ খান ও মিসেস মীরা এসে সামিরাকে দেখে গেছেন। সামিরার বাবা-মা উনাদের কাছে মাফও চেয়েছেন। এখন উনারা আদিরার কাছে মাফ চাইতে চান।

এদিকে আদিরা নিয়মিত ক্লাস করে। ক্যাম্পাসে এখন কেউ তাকে কটু কথা শোনায় না। তার মনে হচ্ছে এতোদিন পর ক্যাম্পাসটা তার জন্য সুন্দর হয়েছে। আজ বিকেলে মারসাদের বাবা-মায়ের সাথে তার দেখা করার কথা। আদিরা খুব নার্ভাস। কাল আবার তার বাবা-মা চট্টগ্রামে আসবেন। দুই পরিবারের মধ্যে কথা হবে। সবকিছু যেন খুব দ্রুত হচ্ছে। আজকে যে আদিরা মারসাদের বাবা-মায়ের সাথে দেখা করবে, সেটা মারসাদ জানে না। তাই আদিরা আরও বেশি চিন্তিত। সকাল থেকে ক্যাম্পাসে আদিরা কেমন উঁশখুশ করছে। মাহি, সাবিহাদের সাথে বসেও যেন তার মন নেই। এদিকে মারসাদের আজ ওভারটাইম পড়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিউটি। তার আগেই সে মারসাদের বাবা-মায়ের সাথে দেখা করবে। আদিরা জানে মারসাদের বাবা আদিরাকে তেমন পছন্দ করেন না। এখন উনি কী বলবেন, তা নিয়ে আদিরা চিন্তিত। মাহি, সাবিহা, রিন্তি অনেকক্ষণ যাবত আদিরাকে লক্ষ্য করছে। মেয়েটার খাওয়াতেও মন নেই। সাবিহা জিজ্ঞাসা করে,

“এতো কি চিন্তা করছিসরে, আদু?”

আদিরা হাসার চেষ্টা করলো। অতঃপর বলল,
“তেমন কিছু না।”

মাহি টেবিলে দুই হাতের কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল,
“যতোই বলিস তুই কিছু চিন্তা করছিস না। কিন্তু আমি জানি, সকাল থেকে তুই বাবাকে নিয়েই চিন্তা করে ম*রছিস! যে বাবা কি বলবেন? বাবা রেগে যাবে কি না?”

আদিরার মুখপা চুপসে গেলো। মাহি ওর দুই গাল হালকা করে টেনে দিয়ে বলে,
“রিল্যাক্স। আমার বাবা ভি*লেন না। মাঝ দিয়ে একটু আরকি… তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তাছাড়া সামিরা আপুর সাথে দাভাইয়ের বিয়ের কথা আরও আগে থেকেই চলছিল। বাবা তো আর জানতো না, সামিরা আপু এরকম! তাই এতো ভাবিস না। কালকে আঙ্কেল-আন্টির সাথে দেখা করার আগে বাবা তোর সাথে কথা বলতে চায়।”

আদিরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“এমনও হতে পারে আঙ্কেলের সত্যি সত্যি আমাকে পছন্দ না!”

“এমন কিছুই না।”

“আমার ভয় করছে।”

মাহি এবার উঠে দাঁড়ালো। তারপর বলল,
“আচ্ছা ভয় পেতে থাক। চারটার দিকে আমাকে কল করবি, একসাথে বাসায় যাব। বায়!”

এই বলে মাহি হাঁটা ধরলো। সাবিহা ও রিন্তি অবাক হয়ে গেল তাতে। রিন্তি শুধায়,
“তুই কই যাচ্ছিস এখন?”

“আহনাফের কাছে৷ উনার থেকে ট্রিট পাই আমি। টাটা।”

তারপর মাহি চলে গেলো। সাবিহা হতাশ হয়ে বলল,
“ট্রিট যেহেতু পায়, আমাদেরকে নিয়ে গেলে কি হতো? কিন্তু তা না করে এই ডিপ্রেসড আদুকেও আমাদের কাছে দিয়ে গেল!”

আদিরা রাগ করে বলে,
“তাহলে তোরা থাক। আমি লাইব্রেরিতে যাচ্ছি।”

আদিরা উঠতে নিলে সাবিহা ও রিন্তি ওর হাত চেপে ধরে। আর বলে,
“থাক। আমরাও যাব চল।”

তারপর ওরা ওর সাথে লাইব্রেরির দিকে যায়।

——–

আরশাদ খান ও মিসেস মীরার সামনে বসে আছে আদিরা। বেশ কাচুমাচু অবস্থা তার। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মাহিও এখানে নেই। আরশাদ খান আদিরার চোখমুখ দেখে বুঝলেন কিছু। তিনি নিজেই পানির গ্লাসটা আদিরার দিকে এগিয়ে দিলেন। আদিরা জোরপূর্বক হেসে সামান্য পানি পান করলো। তারপর আরশাদ খান বললেন,
“মারসাদ যখন যা করেছে আমি সব সময় ও-কে সবকিছুতে সাপোর্ট করেছি। একমাত্র তোমার বেলায় আমি ওর বিপক্ষে ছিলাম। কারণটা তুমিও জানো। মারসাদের অ্যাকসিডেন্ট, মা*রামা*রি, জে*লে যাওয়া, হসপিটালে ভর্তি হওয়া। সবকিছুর পেছনে কারণ তোমাকে বাঁচানো ও তোমার জন্য প্রতিবাদ করা। বিষয়টাকে আরো জটিল করেছে সামিরা। ও আমাদেরকে সবসময় এসব বিষয়ে আগে ইনফর্ম করতো। বাবা হিসেবে ছেলেকে বারবার বিপদে পড়তে দেখতে তো আমারও সহ্য হয় না। একমাত্র ছেলে আমার। তাই আমি চাইনি মারসাদ তোমার সাথে সম্পর্কে জড়াক। কিন্তু যখন আসল সত্য সামনে আসলো, তখন আমার ধারণা বদলেছে। আমি জানি, মানুষ যাকে ভালোবাসে তার জন্য জীবন দিতেও দ্বিধা করে না। এটা আমি নিজেও মানি কিন্তু বাবার মন তো মানে না। মারসাদের মধ্যে আমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখি। বরং তার চেয়েও বেশি। আই হোপ তুমি যদি আমার কোনো কথা ও কাজে কষ্ট পেয়ে থাকো তবে মেয়ে হিসেবে আমাকে বাবা ভেবে মাফ করে দিবে।”

আদিরা চমকে তাকালো। সে হড়বড়িয়ে বলে উঠলো,
“না আঙ্কেল, আমি আপনাকে ভুল বুঝিনি। আপনি আপনার জায়গায় সঠিক। কোন বাবা-মা তার ছেলে-মেয়েকে বিপদের দিকে যেতে দেখতে পারে না। আমি নিজেও উনাকে বলেছিলাম, যেন দূরে থাকে আমার থেকে।”

আরশাদ খান ফের বললেন,
“আমাদের ভুল ভেঙেছে। দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে। আমরা তোমাকে আলাদা করে এখানে আসতে বলেছি কারণ তোমার কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়াটা উচিত। আমি আমার বড়ো মেয়েকে শ*ত্রুদের ডেরায় বিয়ে দিয়েছি, সেটা আমি ওর বিয়ের পর বুঝতে পেরেছি৷ তাই ছেলেকে ও ছোটো মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তিত। এই চিন্তার কারণে আমার ছেলের সাথেও এরকম কিছুই করতে যাচ্ছিলাম। এখন আমি ছেলের পছন্দের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। তুমি মীরার মতোই শান্ত ও ধৈর্যশীল। আমাকে যেমন তোমার আন্টি সামলিয়ে রাখে, আশা করব তুমিও মারসাদের হুটহাট রেগে যাওয়া কন্ট্রোল করতে পারবে।”

আদিরার এবার লজ্জা লাগছে। সে নতমুখে চুপ করে আছে। আরশাদ খান উঠে আদিরার মাথায় হাত রেখে সেখান থেকে চলে গেলেন। মিসেস মীরা আদিরার পাশে এসে বসেন। আদিরার গালে হাত দিয়ে হালকা হেসে বলেন,
“তোমাকে আমার ছবি দেখে মাহির মুখে তোমার কথা শুনেই ভালো লেগে গিয়েছিল। আমার ছেলের পছন্দ মা শা আল্লাহ। কতো মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি। তোমরা দুজন সবসময় একসাথে ভালো থাকো, সুখে থাকো।”

আদিরা লাজুক হাসলো। মিসেস মীরা তারপর মাহিকে ডাকলেন। মাহি আসতেই তিনি বললেন,
“আদিরাকে ওর হোস্টেল অবধি গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিয়ে আয়৷ আর তোর দাভাইকে আদিরার এখানে আসার কথা বলার দরকার নেই৷ কালকে আদিরার বাবা-মা আসবেন, তখন বাকি কথা হবে।”

মাহি আপেলে কা*মড় বসিয়ে বলে,
“ফিকার নট৷ তোমাদের মধ্যে সব যখন ক্লিয়ার তখন আমার কোনো দরকারই নেই দাভাইয়ের কানে এসব তোলার।”

মিসেস মীরা ও আদিরা হাসলো। তারপর মাহি আদিরাকে নিয়ে বের হলো। আদিরা ও মাহি বেরিয়ে যেতেই আরশাদ খান এসে মিসেস মীরার পাশে দাঁড়ালেন। তিনি নিজ স্ত্রীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
“আমাকে সামলে নেওয়া, সাহস দেওয়ার জন্য তোমাকে আমি সবসময় চাই। আমাদের ছেলেও তোমার মতো কাউকে পেতে চলেছে।”

মিসেস মীরা হালকা হেসে স্বামীর কাঁধে মাথা রাখলেন। সূর্য তার দিসের শেষ আলো ছড়াচ্ছে। গোধূলিতে রক্তিম আভা সকল দুঃসময় কেটে যাওয়ার আহ্বান।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৬
সন্ধ্যায় আদিরার বাবা-মা ও ভাই চট্টগ্রাম এসেছেন। মারসাদ নিজে উনাদের বাস স্ট্যান্ড থেকে রিসিভ করে এনেছে। উনাদেরকে ফ্লাটে পৌঁছে দিয়ে মারসাদ ভার্সিটিতে গেছে একটা কাজে। কাশেম আলী ও আশা বেগম দুজনেই খুব ইতস্তত করছেন। শহুরে পরিবেশে উনারা অভ্যস্ত নয়। মিসেস মীরা চা-নাস্তা এনে টেবিলে রাখেন। আরশাদ খান দুপুরে কুমিল্লা গিয়েছে, একটু পরই চলে আসবেন। মিসেস মীরা দেখলেন আদিরার বাবা-মা লজ্জা পাচ্ছে। তিনি মৃদু হেসে বললেন,

“আপা, ভাইজান, আপনারা নাস্তা নিন৷ অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছেন তো। ক্লান্ত অনেক। নাস্তা খেয়ে রেস্ট করবেন।”

আশা বেগম হাসার চেষ্টা করে বলেন,
“আপনে ব্যস্ত হইয়েন না, আপা। আমরা ক্লান্ত না।”

“তা মুখে বললে তো হবে না। বাচ্চা ছেলেটার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আপনারা নিচ্ছেন না বলে ও নিচ্ছে না। নিন না।”

আশা বেগম ক্ষীরের বাটি উঠিয়ে নেয়। মায়ের দেখাদেখি আহাদ চিকেন রোল উঠিয়ে নেয়। মিসেস মীরা বসে বলেন,
“মারসাদের বাবা আজ দুপুরে কুমিল্লা গেলেন। এখনি চলে আসবে। ফোন করেছিলাম। আর্জেন্ট হওয়াতেই যেতে হয়েছিল। আপনারা কিছু মনে করবেন না। ততক্ষণে আপনারা মারসাদের রুমে গিয়ে রেস্ট করুন। আজকে আপনারা মারসাদের রুমেই থাকবেন।”

আশা বেগম আবার বললেন,
“সমস্যা নাই, আপা। আমরা ঠিক আছি। ভাইজান আসুক।”

মিসেস মীরা আর কিছু বললেন না। তিনি উঠে গিয়ে নিজের স্বামীকে কল করলেন।

আদিরা মাহির সাথে মাহির ঘরে বসে আছে। বাবা-মা আসার পর দেখা করে বুঝেছে, তার বাবা গম্ভীর হয়ে আছে। শেষবার গ্রাম থেকে আসার সময় তিনি আদিরাকে যা বলেছিলেন, সেসব ওর বারবার মনে পড়ছে। আদিরা মাহিকে বলে,

“আব্বা মনে হয় খুশি না। সেদিন আমাকে বলেছিলেন যেন ঠিকমতো পড়াশোনা করি। নিজেকে সামলে চলি। আজকে উনার শক্ত মুখ দেখে আমার ভয় করছে।”

মাহি চিপস খেতে খেতে ল্যাপটপে কার্টুন দেখছিল। আদিরার কথা শুনে কার্টুন পস করে বলে,
“তুই ভয়টা কবে পাস না!”

আদিরা কপাল কুঁচকে তাকালে মাহি ফের বলে,
“তোকে তো আমি সবসময়ই ভয়ই পেতে দেখি! তুই ভয়টা কবে পাস না, শুধু সেটা আমাকে বল। ভয় পেতে পেতেই তোর প্রেম হলো! এখন বিয়ের কথা চলছে। সামনে বিয়েও হবে। সো চি*ল বেব!”

তারপর মাহি আবার কার্টুন দেখা শুরু করলো। আদিরা হতাশ হয়ে বসে রইল।

——-
আরশাদ খান চট্টগ্রামের ফ্লাটে ফিরতেই কাশেম আলী ও তার স্ত্রীর সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেন। আরশাদ খানের নম্র ও সুন্দর ব্যবহার কাশেম আলীর মনের দোটানা কমালো। কাশেম আলী বললেন,

“ভাইসাহেব, আমরা গরিব মানুষ। গ্রামে থাকি। শহরের ভাবসাব বুঝি না। মাইয়া শহরের ভার্সিটিতে চান্স পাইছে তাই পড়তে দিছি। শহরে আইসা যে মাইয়া এসবে জড়াইব তা আমাগো ধারণাতেও আছিল না। গ্রামের মানুষজন কইছিল মাইয়া হাতের বাইরে যাইব গা। এহন কী করমু কন!”

আরশাদ খান হাসলেন। অতঃপর বললেন,
“ছেলেমেয়েদের একে-অপরকে পছন্দ হয়েছে। এখন আমাদের কাজ আমরা দেখেশুনে ওদের বিয়ে দিব। আপনার মেয়ে খুব ভদ্র ও নম্র স্বভাবের মেয়ে। যে-কারও নিজের ছেলের জন্য পছন্দ হবে। আজকাল তো এতো নরম স্বভাবের মেয়ে খোঁজাও মুশকিল। সেখানে ছেলে যখন খুঁজে এনেছে। আমরা রাজি না হয়ে কীভাবে থাকি?”

কাশেম আলীর মন থেকে একটা বড়ো বোঝা নেমে গেলো। তিনি বললেন,
“আপনারা যা বলেন। আমাগো কোনো সমস্যা নাই। আর বিয়ার জন্য কী কী লাগব আর আপনাগো কী কী দিতে হইব…..”

কাশেম আলী তার কথা শেষ করার আগেই আরশান খান বাধা দিলেন। আর বললেন,
“কিছু লাগবে না। আর আপনারা কেন দিবেন? যৌতুক প্রথা আমরা সাপোর্ট করি না। ইসলামে দেনমোহর দেওয়ার নিয়ম। যৌতুক প্রথা একটা কুপ্রথা। যেটার জন্য অনেক মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যায়। কতো বাবা-মা সবকিছু হারিয়ে বসে। কারণ আপনি কাউকে দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। দিলেই চাইবে। কিন্তু দেনমোহর বিয়ের সময় নির্ধারণ করা হয়। যা সাথে সাথে পরিশোধ করা উচিত। দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার। দেনমোহর অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। ইসলামে শরিয়তের বিধান, দেনমোহর সর্বনিম্ন ১০ দিরহাম। ১০ দিরহামের কম পরিমানে স্ত্রী রাজি হলেও সেটা বৈধ না। সর্বোচ্চ দেনমোহরেরও কোনো বাউন্ডারি নেই। নবীজির স্ত্রী উম্মে হাবিবার দেনমোহর ছিল ৪০০০ দিরহাম।”

কাশেম আলীর যেন অবাক হওয়া বাকি। এর আগে তিনি যেখানেই মেয়ের বিয়ের কথা তুলেছেন, সেখানেই যৌতুকে তার থেকে বাইক, ফ্রিজ, টিভি, খাট, আলমারি এসব তো চেয়েছেই। এখানে আসার পূর্বে কাশেম আলীর আরো একটা ভয় ছিল যৌতুকে কী চাইবে? বড়োলোক ঘর। হয়তো বেশি কিছু চাইবে। কিন্তু উনার ধারণা বদলে গেছে আরশাদ খানের কথা শুনে। তিনি অশ্রুসিক্ত হাসলেন। ফের বললেন,

“আপনারা বড়ো মনের মানুষ। এজস আর আমার ভয় নাই। আমার মাইয়া ভালোই থাকবো আপনাগো বাড়িত।”

আরশাদ খান হাসলেন। অতঃপর দুই পরিবার রাজি। দুই পরিবারের মধ্যে মিষ্টিমুখ হলো। মিসেস মীরা মারসাদকে কল করে আসতে বললেন। বিয়ের দিন তারিখ পহেলা ফাগুন ঠিক হলো। এখনও তিন মাসের কম বাকি। মিসেস মীরা আদিরার হাতে আংটি পরিয়ে দিলেন। আদিরা মাথায় বড়ো করে ওড়না দিয়ে লজ্জায় নতমুখে বসে আছে। মাহি ওর পাশে দাঁড়িয়ে সবার আড়ালে ওর হাতে চি*মটি কাটে। কানে কানে বলে,

“ওয়েলকাম ভাবি!”

আদিরা লাজুক হাসে। কাশেম আলী নিজের আঙুল থেকে আংটি খুলে মারসাদকে পরাতে চাইলে মারসাদ বাধা দেয়৷ বলে,
“না আঙ্কেল। আমাকে আংটি পরাতে হবে না। আমি আংটি এমনিও পরি না। ছোটো থেকে কখোনোই পরিনি। তাই প্লিজ।”

মারসাদের সাথে আরশাদ খানও তাল মেলালেন। তিনি বললেন,
“ছেলে আমার ছোটো থেকে এসব সহ্য করতে পারে না। বাচ্চাদের গলায় স্বর্ণের চেইন যখন দেওয়া হতো, তখনও ও কে পরানো যায়নি৷ ওর দাদি পরাতে চাইলেই কান্নাকাটি করে অবস্থা খারাপ করে ফেলতো। তাছাড়া পুরুষদের জন্য স্বর্ণ পরা হারাম।”

কাশেম আলী মৃদু হাসলেন৷ আংটিটা আশা বেগমের কাছে দিয়ে দিলেন।
——

পরেরদিন দুপুরের পর আদিরার বাবা-মা গ্রামে যেতে রওনা হলেন। আদিরা ও মারসাদ উনাদেরকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাস ছাড়ার আগে আহাদ জানালা দিয়ে হাত নাড়িয়ে টাটা দিচ্ছে। আদিরা চোখ মুছে নিজেও বিদায় জানায়। তারপর বাস ছেড়ে দিলে আদিরা মারসাদকে বলে,

“আপনি এখানে একটু দাঁড়ান৷ আমি আসছি।”.

এই বলে আদিরা একদিকে যাচ্ছে তখন মারসাদ ওর হাত ধরে আটকে প্রশ্ন ছুঁড়ে
“দাঁড়াব মানে? কোথায় যাচ্ছ?”

“দাঁড়ান তো। আমাকে ফলো করবেন না। একটু দাঁড়ান।”

তারপর আদিরা চলে গেলো। প্রায় পনেরো মিনিট পর সে ফিরে আসে। মারসাদ শুধায়,
“কোথায় গিয়েছিলে?”

“পরে বলব। চলুন পতেঙ্গাতে যাই।”

“এখন?”

“হুম চলুন।”

আদিরার হঠাৎ স্বভাববিরুদ্ধ কাজে মারসাদ হতবাক। তারপর মারসাদ একটা সিএনজি ঠিক করে। সিএনজি করে দুজনে রওনা করে।

পতেঙ্গাতে পৌঁছে দুজনে সাগরের পাড়ে দাঁড়ায়। পশ্চিম আকাশ রক্তিম আভায় আচ্ছন্ন। গোধূলির সময়। আদিরা ব্যাগ থেকে একটা ঘড়ির বক্স বের করে মারসাদকে দিয়ে বলে,

“এটা আপনার জন্য।”

মারসাদ বক্সটা নিয়ে বলে,
“ঘড়ি কেন কিনেছ?”

“মা বলেছে। আপনি ঘড়ি তো পরেন। তাই মা আমাকে বলেছে যেন আপনাকে ঘড়ি কিনে দেই। মাহি বলেছিল আপনি কোন কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরেন। তারপর কিনে আনলাম।”

“অযথা টাকা খরচ করেছ। আমার ঘড়ির কালেকশন এতো যে ওখানের সবগুলোই এখনও পরা হয়নি।”

আদিরা মারসাদের হাত শক্ত করে ধরে চোখে চোখ রেখে বলে,
“এটা পরবেন। আমি জানি, আপনি এটা প্রায় প্রায় পরবেন।”

মারসাদ হাসে। প্রত্যুত্তরে আদিরাও হাসে। তারপর দুজনে সমুদ্রের দিকে চেয়ে সূর্যের সমুদ্র গর্ভে বিলীন হওয়া দেখছে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

এক শহর প্রেম_২ পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪১
মেলায় মেয়েরা সবাই চুড়ির দোকানের কাছে এসে দাঁড়ায়। রং-বেরঙের কাঁচের চুরি। কাঁচের রেশমি চুড়িতে ভরপুর দোকানগুলো থেকে যেন মেয়েদের নজর সরছেই না। আদিরা নীল রেশমি চুড়ি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। মারসাদ ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর কানের কাছে ঝুঁকে ধিমি স্বরে শুধালো,

“পছন্দ হয়েছে?”

নিজের এতো কাছে কারও ধিমি স্বরে আদিরা কেঁপে উঠলো। হাত থেকে চুড়িগুলো পড়ে যেতে নিলে মারসাদ ধরে ফেলে। তারপর পেছন থেকে আদিরার হাতে আস্তে আস্তে চুড়ি গুলো পরিয়ে দিতে থাকে। চুড়ি পরানোর সময় আদিরা বারবার নড়াচড়া করছে। আশেপাশে গ্রামের কেউ দেখছে কী না তা দেখছে। মারসাদ বলে উঠে,

“হাত এতো নড়াচ্ছো কেন? চুড়ি ভেঙে হাত যদি কে*টে যায়?”

আদিরা স্থির হলো। মারসাদ যত্ন সহকারে এবার চুড়ি পরাচ্ছে। মাহি, সুমিরা এই দৃশ্য দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। তখন আহনাফ মাহির কাছে গিয়ে ওর হাত থেকে চুড়িগুলো নিয়ে পরিয়ে দিচ্ছে। মাহি ভ্রঁ নাঁচিয়ে বলে,

“দাভাইয়ের থেকে ইন্সপেরেশেন হয়ে বুঝে চুড়ি পরিয়ে দিতে এলেন?”

আহনাফ চুড়ি পরানোর দিকে মনোযোগ দিয়েই মৃদু হাসলো। তারপর বলল,
“আমার কারো ইন্সপেরেশন লাগে না।”

“ওহ আচ্ছা!”

মাহি তারপর আহনাফের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। এদিকে রিন্তি বারবার লাজুক লাজুক দৃষ্টিতে রাফিনকে দেখছে। রাফিনের ক্ষেত্রেও তাই। রাফিনের পাশ থেকে মৃদুল বলে উঠে,

“ইয়ার! যা। আমার পাশে দাঁড়িয়ে এই লাজুক লাজুক নজরে রিন্তুকে দেখাটা বন্ধ কর! ওর কাছে গিয়ে তোর যা মন চায় বল। চুড়ি পরাতে মন চাইলে পরা। তাও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার সিঙ্গেল মনকে কষ্ট দিস না!”

তারপর মৃদুল রাফিনকে একটা ধাক্কা দিলে, রাফিন মাথা চুলকে লাজুক হেসে রিন্তির কাছে যায়। সুমি, মৌমি, রাত্রি, সাবিহা এই তিন জুটিকে দেখে একসাথে আফসোসের স্বরে চুড়ি পরতে পরতে বলে উঠে,

“আজ আমাদেরকে চুড়ি পরিয়ে দেওয়ার মত কেউ নেই বলে, নিজেরাই নিজেদের হাতে চুড়ি পরছি!”

মাহি হেসে উঠে। রিন্তি ও আদিরাও লাজুক হাসে।

চুড়ি পরানোর পর মারসাদ আদিরার দুই হাত দেখছে। অতঃপর বলে,
“নীল চুড়ি তোমার হাতে বেশ মানিয়েছে।”

আদিরা লাজুক স্বরে বলে,
“চুড়ি গুলো খুব সুন্দর।”

“না। চুড়ির সৌন্দর্য তাকে পরা হাতের উপর নির্ভর করে।”

আদিরা মারসাদের চোখের দিকে তাকায়। এই চোখ দুটো সবসময় তার মাঝেই মুগ্ধতা খোঁজে। আদিরা বলে,
“আল্লাহর সৃষ্টি সবাই সুন্দর। আপনিই তো বলেছিলেন।”

মারসাদ বুঝতে পারলো না, সে কি ভুল কিছু বলল! আদিরা মারসাদকে চিন্তায় ফেলে সুমিদের কাছে গেলো।

———
জুম্মার নামাজ পড়ে মারসাদ ও তার বন্ধুরা আদিরার বাবার সাথে একসাথে বাসায় আসে। তারপর সবাই একসাথে খেতে বসে। আদিরা তার বাবাকে বলে,

“আব্বা, আমরা কালকে চট্টগ্রাম চলে যাব।”

আদিরার কথা শুনে আশা বেগম প্রশ্ন করে বসেন,
“তুই না বললি তুই রবিবার পর্যন্ত থাকবি। সোমবার সকালে রওনা দিবি। তাইলে এহন কালকেই যাবি গা কেন?”

আদিরা আমতা আমতা করে সবার দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“স্টুডেন্টের মা কল করেছিল।”

“কয়টাদিন ছুটি দিলে কী হয়? আমারে ফোন লাগায় দিস। আমি কথা কমু।”

“না না। আসলে আন্টির দেবররা এই মাসের শেষের দিকে আসবে। তাদের সাথে গ্রামে যাবে। এজন্য আমাকে বলেছে যেন কয়দিন আগে আগে পড়িয়ে দেই। ডিসেম্বরে তো ফাইনাল পরীক্ষা। ও-কে কয়েকবার পড়াতে হয়।”

আশা বেগম হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর শুধালেন,
“তাইলে কি কালকে সকাল সকাল যাবি গা?”

আদিরা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লেন। কাশেম আলী বললেন,
“তাইলে আমি এহনি বড়ো বাজারে যামু। বড়ো একটা ইলিশ মাছ আনমু। গো*শত তো সবসময়ই খাস। বড়ো ইলিশ মাছ তো সবসময় পাওয়া যায় না। বরফের তলে রাইখা দেয়। দেহি পাই কী না।”

তারপর সবাই আর কথা না বলে খাওয়া শেষ করতে থাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কাশেম আলী আগে মাছ কিনতে যান। বড়ো একটা দেড় কেজির ইলিশ, দুই কেজি বাটা মাছ (সঠিক নাম এটা কি না জানিনা) কিনে তার দোকানের ছেলেকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। দোকানের ছেলেকে মাছ দিয়ে পাঠানোর পর পাশের দোকানের একজন এসে জিজ্ঞাসা করে,

“কাশেম ভাই, আপনের বাড়িতে শুনলাম মেহমান আসছে?”

“হ। চট্টগ্রাম থিকা আসছে। মাইয়ার লগে পড়ে।”

“শুনলাম কয়ডা পোলাও নাকি আইছে?”

কাশেম আলী এবার থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি বিব্রত স্বরে জবাব দিলেন,
“মাইয়ার বান্ধবীর ভাই ওরা। এত দূরে মাইয়াগুলারে একা ছাড়বো, এজন্য আইছে।”

“আসলেই ভাই তো? আজকালকার পোলা মাইয়ারা তো কত মিছা কথাই কয়! না*গররে ভাই বানায় চালায় দেয়!”

কাশেম আলী প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারলেন। তারও প্রথমে এতোগুলো ছেলে আসা নিয়ে আপত্তি ছিলো। নিজ স্ত্রীকে তিনি বলেছেনও। তারপর মাহির ভাই এবং মারসাদ ও তার বন্ধুরা আদিরাকে কিভাবে বাঁচিয়েছে শুনে মনকে শান্ত করেছেন। যদি সেদিন এই ছেলেগুলো তার মেয়েকে না বাঁচাতো, তাহলে তার মেয়ের কী অবস্থা হতো! এটা ভেবেই তার গায়ে কাঁপন ধরলো। তিনি কথা কাটানোর জন্য বললেন,

“সবাই তো আর খারাপ হয় না, ভাই। এহনো দুনিয়াতে কিছু মানুষ ভালা বাঁইচা আছে বইলাই দুনিয়াডা এহনো মাইয়াগো জন্যে থাকনের মতো আছে।”

লোকটাও আর কিছু বলল না। সে তার দোকানের কাজে মগ্ন হয়ে পড়লো। কাশেম আলী চিন্তিত হয়ে বেঁচাকেনায় মন দিলেন।

——–

মাছ আনার পর আদিরা, সুমি, রাত্রি ও আশা বেগম মাছ কা*টতে বসেছেন। মৌমি, সাবিহা, মাহি, রিন্তি একটু দূরে বসে মাছ কা*টা দেখছে। সুমি বলে,

“মৌমিরে, তুই যে এখন হাত গুটায়ে বসে আছিস, বিয়ের পর তো তোরও মাছ কা*টতে হবে।”

মৌমি বলে,
“আমি আশিককে বলব, বাজার থেকে মাছ কে*টে আনতে। আমি মুরগি কা*টতে পারি এটাই তো অনেক!”

আশা বেগম হাসতে হাসতে বলেন,
“মা গো, মাইয়া মানুষের সব কাম জানতে হয়। পরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়া তুমি সেটা করো বা না করো। কিন্তু যাতে কেউ খোঁটা দিতে না পারে যে, মা-চাচিরা তো কিছু শিখায় নাই!

“কিন্তু আন্টি আমি মাছের আঁশ ছাড়াতে গিয়ে মাছের চা*মড়াই ছিলে ফেলি! আর কতো নরম। কা*টাও হয় না।”

“আস্তে আস্তে শিইখা যাইবা। এখন দেখতে থাকো, তারপরে একদিন নিজের চেষ্টা করবা।”

মৌমি সম্মতিসূচক হাসে। মাহি বলে,
“তোমরা তাও তো রান্না-বান্না পারো। আমাকে যে বিয়ে করবে তাকে বিদেশি কিছু ডিশ খেয়েই বাঁচতে হবে!”

কথাটা বলতে বলতে মাহি আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ মাথা নুইয়ে হাসে। মারসাদ তো গভীর মনোযোগ দিয়ে আদিরার মাছ কা*টা দেখছে। খুব যত্ন করে কা*টছে ও। মারসাদ ফোন বের করে ছবিও তুলে নিলো।

রাতে সবাই সাথে খেতে বসেছে। সবার পাতে ভাজা ইলিশ মাছের পিস ও একটা করে বাটা মাছ ভাজা। সাথে গরম গরম ভাত ও শুকনো মরিচ৷ কাশেম আলী খেতে খেতে আদিরাকে বলেন,

“এবার থিকা খুব সাবধানে থাকবা। চোখ-কান খোলা রাখবা। আর তোমার এই বোকা বোকা স্বভাবটা এইবার বাদ দাও।”

কাশেম আলীর কথার প্রত্যুত্তরে মাহি বলে উঠে,
“এটাই তো, আঙ্কেল। আদু যে এতো বোকা! কেউ ও-কে হাজারটা কথা শুনিয়ে গেলেও মেয়ে চুপ করে থাকে! আমি আর দাভাই তো ওর এই চুপচাপ সহ্য করা স্বভাবে খুবই বিরক্ত।”

“শহরের সবার লগে তাল মিলাইতে পারে না তো। ঠিক হইয়া যাইব৷ ওরে নিয়া আমার অনেক চিন্তা হয়। ”

মৃদুল বলে উঠে,
“আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, আঙ্কেল। আমরা আছি তো। ওর চারটা ভাই আছে।”

আহাদ মৃদুলের কথার মাঝে বলে,
“পাঁচটা। আপনেরা তো পাঁচজন। তাইলে চারটা ভাই কন কেন?”

মারসাদ কেঁশে উঠলো। রাফিন আহাদকে বলল,
“তুমিই ঠিক, বাবু! ও অংকে কাঁচা তো!”

“আমার কিন্তু অংক অনেক ভালো লাগে। আমি এবার অংকে হায়েস্ট নাম্বর পাইছি। স্যারে কইছে….”

আশা বেগম ছেলেকে মৃদু ধ*মক দিয়ে খেতে বললেন।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪২
পরদিন সকালবেলা। সবাই ব্যাগপত্র নিয়ে প্রস্তুত। আদিরার বাবা-মা ও ভাই সবাইকে বিদায় দিচ্ছেন। তখন মারসাদ আদিরার বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আর বলল,
“আঙ্কেল-আন্টি, আমি আপনাদেরকে কিছু ইম্পর্টেন্ট কথা বলতে চাই। জানিনা আপনারা বিষয়টা কীভাবে নিবেন। ”

মারসাদের কথা শুনে আদিরা ঘাবড়ে গেলো৷ সে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“কাল থেকে লোকটাকে এতো করে বুঝাচ্ছি, বুঝতেই চাইলো না! উনার কথা মতো একদিন আগে ফিরে যাচ্ছি। তারপরও!”

পাশ থেকে সাবিহা ও-কে জিজ্ঞেস করে,
“কী বিড়বিড় করছিস?”

“উনি তো কালকে আমাকে বলেছিলেন, যদি আমি উনার সাথে ফিরতে রাজি হই তবে আব্বা-মা কে কিছু বলবেন না। এখন দেখ!”

সাবিহা হাসি চেপে বলল,
“তোর কি সত্যিই বিশ্বাস হয়েছিল? যে ভাইয়া আঙ্কেল-আন্টিকে বলবেন না।”

আদিরা অসহায় চাহনি দেয়। এদিকে কাশেম আলী ও আশা বেগম কিছুটা চিন্তিত। কাশেম আলী বলেন,

“কী কথা, বাজান? কিছু কি হইছে?”

“আসলে আঙ্কেল…”

“তুমি নিশ্চিন্তে কও।”

মারসাদ এবার পরিপূর্ণ সাহস সঞ্চার করে বলে,
“আমি আদিরাকে পছন্দ করি। ইনফেক্ট ভালোবাসি। আদিরাও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু ও বলতে ভয় পায়।”

মারসাদ খানিক থামে। কাশেম আলীর মুখ থমথমে। আশা বেগমও ভয় পাচ্ছেন। তিনি যদিও আগে থেকে আন্দাজ করেছিলেন। আদিরা নিজেকে সাবিহার পেছনে আড়াল করে নিয়েছে। তার বাবার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছে না, যে রেগে আছে নাকি নেই। কাশেম আলীর নিরব হয়ে আছেন। মারসাদ আবার বলে,

“আমি ও-কে বিয়ে করতে চাই।”

কাশেম আলী এবার বললেন,
“মাইয়া শহরে গেছে তহনি লাগাম ছুইটা গেছে। এহন তার আমাগো পছন্দ ভালা লাগতো না। সে যদি সঠিক মানুষ খুঁইজা পায়, তয় আমার তো বাধা দেওনের কিছু থাকে না। মাইয়া ভালো থাকব, এইডাই তো চাই। তুমি আর তোমার বন্ধুরা আমার মাইয়ার চরম ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে ঝাঁপায় পড়ছো। নিজের জানের তোয়াক্কা করো নাই। তোমাগো ধন্যবাদ দিতে ভাষা নাই আমার। তয় বাজান, বিয়া তো কোনো খেলা না। বিয়া দুইটা পরিবারের মধ্য সুসম্পর্কও। এহন খালি আমরা রাজি হইলেই তো হইব না। তোমার বাপ-মায়েরেও রাজি থাকন লাগবো। তোমার বাপ-মা রাজি না থাকলে আমরাও রাজি না। শ্বশুর-শাশুড়ির মন না পাইলে সংসার অশান্তির হইয়া যায়।”

মারসাদ চিন্তায় পড়ে গেলো। তার বাবা রাজি না। এটা বললে আদিরার বাবা বেঁকে বসবেন। কী বলবে এটা ভাবার মাঝেই মাহি বলে উঠে,

“সবাই রাজি, আঙ্কেল! আপনি চাইলে আম্মু, আপুর সাথে কথা বলিয়ে দেই? আসলে আঙ্কেল, আপনি তো জানেনই আদিরার সাথে কী হয়েছিল। দাভাই চায় আদিরাকে প্রটেক্ট করতে। আদিরার তো সবে ফার্স্ট ইয়ার শেষ হলো। আরও তিন বছর তো বাকিই। দাভাই ও-কে প্রটেক্ট করতে চাইলেও আদিরা চায় না ভাইয়া ওর জন্য বিপদে পড়ুক। তাই দাভাই আপনাদের অনুমতি নিতে এসেছে।”

“সবই বুঝলাম, মা। আমাগো তেমন কোনো আপত্তি নাই। এখন আল্লাহ চাইলে আরকি।”

মাহি, মারসাদ ও তার বন্ধুরা স্বস্তি পেলো। আশা বেগম আদিরাকে একটু ঘরে ডাকলেন। আদিরা মায়ের সাথে যায়। কাশেম আলীও ঘরের দিকে গেলেন। সুমি বলে,

“আমাদের মাহি তো খুব ব্রিলিয়ান্ট! এতো সুন্দর করে শান্ত ভাবে সব হ্যান্ডেল করলো।”

মাহি কিছুটা ভাব নেওয়ার মতো করে বলল,
“আমি সবসময়ই ব্রিলিয়ান্ট।”

রিন্তি চিন্তিত সুরে বলে উঠে,
“কিন্তু আঙ্কেল-আন্টি আদুকে ভেতরের ঘরে কেন নিয়ে গেল?”

“রিল্যাক্স। ও-কে আসতে দে।”

ভেতরের ঘরে গিয়ে কাশেম আলী আদিরাকে জিজ্ঞাসা করেন,
“তুমি ওই পোলারে পছন্দ করো?”

আদিরা ভয়ে জড়োসড়ো। তার বাবা কি তাকে আট*কে ফেলবেন? এই ভয় পাচ্ছে। আশা বেগমও জিজ্ঞাসা করেন,
“বল। পছন্দ করোস মারসাদরে?”

আদিরা মাথা উপর নিচে হেলায়। কাশেম আলী বলেন,
“যাই করো, আমাগো মান-সম্মান খুওয়াইও না। আমরা গরীব মানুষ কিন্তু আত্মসম্মান আছে। পোলাটা ভালো আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু বড়লোক ঘরের পোলা। এইজন্য ভয়ও হয়। তুমি শহরে গেছো, পড়াশোনা করবা। নিজের খেয়াল রাখবা। এটুকুই। এহন যাও।”

আদিরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর ওরা সবাই আদিরার বাবা-মা ও ভাইকে বিদায় জানিয়ে রওনা করে।

——-

সামিরা জে*লে সাগরের সাথে দেখা করতে গেছে। সাগরই পু*লিশের মোবাইল দিয়ে সামিরাকে কল করেছে। সামিরা মুখ ঢেকে থানায় গেছে। তারপর সাগরের সাথে দেখা করে। সামিরা বলে,

“আমাকে কেন ডেকেছো?”

সাগর শ*য়তানি হেসে বলে,
“তুমি যদি আমাদেরকে জেল থেকে বের না করো, তাহলে কিন্তু আমরা তোমার নাম পু*লিশের কাছে বলে দেব। দ্রুত আমাদের জামিনের ব্যবস্থা করো।”

সামিরা কিছুটা ভয় পায়। সে তোঁতলানো স্বরে শুধায়,
“কী বলে দিবে? আমি কিছুই করিনি।”

তখন দেলোয়ার পাশ থেকে বলে,
“আফা, আপনে যে আমার নাম্বারে কল করছিলেন, হেইডা কিন্তু আমি জাইনা গেছি। আপনে কইছিলেন আদিরারে রে*প করতে। তাইলে আপনে আমারে দুই লক্ষ টাকা দিবেন।”

“আমি বলেছি মানে? এই মিথ্যা বলছো কেন তোমরা?”

“শুনো সামিরা, দেলোয়ার এখনো পু*লিশের কাছে বলেনি যে কেউ ও-কে বলেছে আদিরাকে রে*প করতে। কিন্তু আদিরাকে কিডন্যাপের দিন, তুমি আমার কাছে এসেছিলে। আমার ফোনের সাথে কিছু করেছ এটা আমার বিশ্বস্ত জুনিয়র রনি দেখেছে। কী করেছিলে তুমি? রনি দেলোয়ারের ফোন থেকে তোমার নাম্বার পেয়েছে। দেলোয়ারের ফোনটা ওই গুদামঘরে পড়ে ছিল। রনিকে পু*লিশ ধরেনি৷ কারণ রনি সেদিনই তার গ্রামে চলে গিয়েছিল। দুইদিন হলো এসেছে। এসেই দেখা করেছে। পু*লিশকে আমরা বলেছি রনি এসবের ভিতরে নেই। তারপর দেলোয়ারের থেকে সেই ফোন কলের কথা শুনে রনিকে ফোন খুঁজতে পাঠিয়েছি।”

সামিরা আমতা আমতা করে বলে,
“নাম্বার পেলেই কি আমি আদিরার রে*প করতে বলেছি নাকি! নিজেদের কুকর্ম আমার নাম দিয়ে ঢাকতে চাইছ!”

সাগর বাঁকা হাসে। তারপর বলে,
“তাই নাকি! আমাদেরকে কি তোমার মূর্খ মনে হয়? চট্টগ্রাম ভার্সিটির সিএসসি ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের তোমার মূর্খ লাগে? কল রেকর্ডও বের করা হয়ে গেছে। পু*লিশের কাছে এটা দেওয়া হবে।”

সামিরার অস্থির লাগছে। সে এখন নিজের কাজে নিজেই পস্তাচ্ছে। সামিরা হড়বড়িয়ে বলে,
“আমি তোমাদের জামিনের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু প্লিজ, পু*লিশের কাছে যেন এটা না যায়।”

“তুমি আমাদের সাহায্য করলে আমরা তোমার ক্ষতি কেন করব? আমাকে যদি পু*লিশ গ্রে*ফতার করতে পারে এই কারণে যে আমি দেলোয়ারকে বলেছি আদিরাকে বিয়ে করে নিতে। তাহলে তুমি তো আমার থেকেও ভয়ংকর ক্রি*মি*নাল! মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের…..! এজন্যই বলে, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু হয়।”

“বেশি কথা বলবে না। আমি তোমাদের জামিনের ব্যবস্থা করছি।”

তারপর সামিরা দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৩
চট্টগ্রাম ফিরেই মারসাদের কানে একটা ভয়ানক খবর এলো। দেলোয়ার, সাগররা জামিনে ছাড়া পেয়েছে। দেলোয়ার গা ঢাকা দিয়েছে। রুহুল আমিনও জামিনে ছাড়া পেয়ে অন্য শহরে আছে এখন। কিন্তু সাগর পালায়নি। এখন সাগর ও মারসাদ মুখোমুখি বসে আছে। সাগর মারসাদের চোখে চোখ রেখে বলে,

“দেখ মারসাদ, তুই যেই কারণে আমাকে জেলে ভরেছিস, এখানে কিন্তু আমার দোষ ছিল না। দেলোয়ার আমার কাছে এসে বুদ্ধি চেয়েছে, আমি শুধু বলেছি আদিরাকে কি*ডন্যা*প করে বিয়ে করে ফেলতে। কিন্তু নিজে করাইনি। আর এতে হেল্পও করিনি। আমি ফ্লো ফ্লো তে বলেছি, দেলোয়ার যে সত্যি সত্যি করবে বুঝতে পারিনি।”

মারসাদ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করে রেখেছে। চোখ-মুখের অবস্থা তার কঠোর। সে বলে,
“তুই বুঝতে পারিসনি?”

“আরে তোর চোখ থাকতেও কা*না নাকি! পুলিশ তো আদিরার কে*সে আমার কোনো ইনভলবমেন্ট খুঁজে পায়নি। তুই আমার নামে কম*প্লেন করছিস। দেলোয়ারকে রুহুল আমিন সাহায্য করেছে। রুহুল আমিনের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। দেলোয়ার রুহুল আমিনকে চিনেছে আমার মাধ্যমে। কিন্তু ওই কি*ডন্যাপিং এসবে আমি ও আমার গ্রুপ ছিলাম না। তোর ও আমার মধ্যকার ঝামেলা এই ভার্সিটির ভিপির পদ নিয়ে। ভার্সিটিতে কার বেশি দাপট সেটা নিয়ে। প্রথম যখন দেলোয়ার আদিরাকে ডিস্টার্ব করেছিল, তখন তো আমি দেলওয়ারকে চিনতাম না। তোর সাথে মা*রামা*রি হওয়ার পরেই আমি দেলোয়ারকে চিনেছি। দেলোয়ার যা যা করেছে সব নিজের মর্জিতে। আমি চেয়েছিলাম ও-কে তোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে। কিন্তু সেই সুযোগটাই আমি পাইনি। কিন্তু রুহুল আমিন সেটা ব্যবহার করেছে।”

মারসাদ এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে,
“তোর এই রচনা মূলক বক্তব্য আমার শোনার ইচ্ছে নেই। হ্যাঁ, তোর সাথে আমার ঝামেলা ভার্সিটিতে কার দাপট বেশি সেটা নিয়ে। ও ভিপির পদ নিয়ে। কিন্তু তুই রুহুল আমিনের সাথে হাত মিলিয়েছিস। এখানকার খবর রুহুল আমিনকে জানিয়েছিস। দেলোয়ারকে আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে রুহুল আমিনের সাথে পরিচয় করিয়েছিস। আদিরার কি*ডন্যা*পিং এর বুদ্ধি দিয়েছিস। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও তুই পরোক্ষ ভাবে দোষী। তোর জামিন কে করিয়েছে, সেটাও আমি দুই দিনের মধ্যে জেনে যাব। উ*কিলকে দ্বিগুণ টাকা ঢাললে উ*কিল বলে দিবে।”

মারসাদ রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন সাগর মাসাদকে পিছু ডাকে। আর বলে,
“শুধু শুধু উ*কিলের পেছনে কেন টাকা ঢালবি? আমিই তোকে বলে দিচ্ছি কে জামিন করিয়েছে!”

সাগরের কথার মর্ম মারসাদ ঠিক বুঝলো না। সে শুধালো,
“কি বলতে চাইছিস? আর তুই আমাকে কেন বলবি? তোর কীসের স্বার্থ? আবার কিছু নিয়ে ডিল করতে চাইছিস?”

সাগর হাসে. তারপর মারসাদের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“একদম তাই। কে জামিন করিয়েছে আমি তোকে সেই নামটা বলবো। তুই শুধু পুলিশের কাছে আমার নামের কে*সটা উইথড্র করে নিবি।”

মারসাদ ক্ষেপে সাগরের কলার চেপে ধরলে সাগর বলে,
“পুরো কথা শোন। আগে থেকেই এরকম মা*রামা*রিতে যাস না। তোর সাথে আমি আর কোনো ঝামেলা করব না। আমি এই দেশ ছেড়েই চলে যাব। আমার দুলাভাই অলরেডি আমার জন্য ইটালির ভিসা এপ্লাই করেছেন। সে আগে থেকেই আমাকে তার কাছে নিতে চাইছিল। তুই আমাকে কিছু ফ্যাকাল্টির রিকমেন্ডেশন আনিয়ে দিবি।”

“আর এসব আমি কেন করব?”

“করবি। কারণ আমি এখন যা সত্য ফাঁস করতে চলেছি, তার সাথে তোর জীবনও জড়িয়ে আছে।”

মারসাদ দৃষ্টি ক্রমশ তীক্ষ্ণ হচ্ছে। সে সন্দিহান হয়ে শুধায়,
“কার কথা?”

এরপর সাগর সেই কল রেকর্ডটা মারসাদকে শোনায়। কল রেকর্ডটা শুনে মারসাদের রাগ যেন আকাশচুম্বী! সাগর ফের বলে,
“এর আগেও সামিরা আমার কাছে এসেছিল, আদিরার ক্ষতি যেন করি। আমার একচুয়ালি ইচ্ছে হয়নি। বা বলতে পারিস তোর সাথে আদিরার প্রেমটা গভীর হওয়ার পর কিছু করতাম। কারন আমার শত্রুতা সম্পূর্ণটাই তোকে নিয়ে ছিল।”

মারসাদ চিন্তা করতে থাকে। শত্রুতা শেষ করার এই একটা উপায়। কারণ সাগর জে*ল থেকে বের হবেই।

“ঠিক আছে। রেকর্ডটা আমাকে দে। কিন্তু তোকে ফ্যাকাল্টির রিকমেন্ডেশন আমি আনিয়ে দিতে পারবো না। তোরটা তুই ব্যবস্থা করে নিবি। কিন্তু দেলোয়ারকে আমি মুক্ত করছি না। দেলোয়ার ও রুহুল আমিন দুজনেই শাস্তি পাবে। তোকেও শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এই কেসে তোর ইনভলবমেন্ট পু*লিশও যেহেতু পায়নি, অযথা হয়রানি করব না। সবশেষে বলব, সঠিক পথে ফিরে আয়।”

তারপর মারসাদ সাগরের থেকে রেকর্ডটা নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। মারসাদ চলে যাওয়ার পর সাগরও সেখান থেকে চলে যায়। জামিনে মুক্ত হয়েই সে জানতে পেরেছে, তাকে পু*লবশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার বাবা স্ট্রো*ক করেছে। এখন তাই সে তার বাড়িতে যাবে।

——–

“তুই কি পাগ*ল হয়ে গেছিস, মারসাদ? তুই সাগরকে বিশ্বাস করে ও-কে ছেড়ে দিয়েছিস! লাইক সিরিয়াসলি!”

রাফিন প্রচণ্ড রেগে আছে। আহনাফ ও মৃদুল বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে চলেছে। রবিন বলে উঠে,
“কু*কুরের লে*জ সোজা হয় না। বোতলে ভরে রাখলেও হয় না।”

মারসাদ হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“এই শত্রুতা আমার আর ভালো লাগে না। সাগরকে তো আর পু*লিশ সারাজীবন জে*লে বন্দি করে রাখবে না! একসময় না একসময় সে ছাড়া পাবে, তারপর এর থেকেও বেশি প্র*তিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠবে। তাছাড়া ও আমাকে একটা হেল্প করেছে এখন। সামিরার মুখোশ খুলে দিয়েছে। এতদিন ভাবতাম সামিরা হয়তো আদিরাকে পছন্দ করে না। কিন্তু ওর মনের মধ্যে এতো নোং*রা চিন্তা-ভাবনা!”

মৃদুল বলে,
“সাগর কি ভালো হবে? পরবর্তীতে পল্টিও মা-রতে পারে।”

আহনাফ বলে,
“খবর শুনেছি ওর বাবা স্ট্রোক করেছেন। যদি নিজেকে শোধরায়। দেখি কী হয়। সাগর তো ভার্সিটি ছেড়ে দিবে।”

“আমার সাগর ও সাগরের গ্রুপকে বিশ্বাসই হয় না।”

রাফিনের কথার আর কোনো প্রত্যুত্তর মারসাদ করলো না। সে রেকর্ডটা ঠিক জায়গায় কাজে লাগাবে তাই অপেক্ষা করছে।

——
শুক্রবার। আদিরা সকালের টিউশনি পড়িয়ে হোস্টেলে এসেছে। এসেই দেখে সেখানে আগে থেকে মাহি এসে বসে আছে। মাহি আদিরাকে দেখে বলে,
“এত সময় লাগলো আসতে?”

“তুই এখানে কিভাবে আসলি?”

মাহি তারপর আদিরাকে ইশারায় রুমমেটকে দেখায়। আদিরা ব্যাগটা রেখে বলে,
“আর কি বুদ্ধি করে এসেছিস?”

মাহি আহ্লাদ করে আদিরার পাশে বসে বলে,
“আমার সাথে বাসায় চল।”

আদিরা কপাল কুঁচকে শুধায়,
“কেন?”

“সুমিপু, রাত্রিপু, মৌমিপু, সাবু, রিন্তি সবাইকে আসতে বলেছি। আমরা সবাই মিলে পিকনিক করব।”

“ঘরের ভেতর পিকনিক?”

“হ্যাঁ ছোটোবেলায় খেলতাম। কলোনির বাচ্চারা মিলে। সবার বাড়ি থেকে তেল, চাল, ডাল আর যা যা লাগে। তা এনে। ঝোলাপাতি বলে।”

আদিরা বিষয়টা পাত্তা দিলো না। বলল,
“আমার ঘুম আসছে।”

“ঘুম আসবে না। আমরা খিচুড়ি করব আর ঝাল দিয়ে মুরগি রান্না করব। শুধু দুপুরে খেতে। সবার থেকে ৬০টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। বাজার করার পর টাকা বাঁচলে তা দিয়ে কিছু একটা করা হবে দেখি।”

আদিরা রাজি হচ্ছিলোই না। কিন্তু মাহি টেনে জোর করে ও-কে নিয়েই গেছে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,