Saturday, August 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 65



তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-২৯+৩০

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৯(প্রথমাংশ)

সকাল সকাল দুই জা মিলে রাশার ব্যাপারে আলোচনা করতে বসেছে। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। মেয়েটা প্রতিদিন কোথায় যায়, কি করা, ফেরেও এতো দেরি করে। সারাদিন না জানি কোথায় কোথায় ঘোরে। ব্যাপারটা নিয়ে শাহিদার থেকে মাহফুজা বেশি চিন্তিত।

–খারাপ মানুষের খপ্পরে পরলে তো জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে ভাবি। মেয়েটার গায়ের রঙটাও কেমন মলিন হয়ে যাচ্ছে। না জানি কি দিয়ে কি করছে! বলে তো কোর্টে যায়, মিথ্যা সাক্ষী দেয়। আমার তো একদমই বিশ্বাস হয় না।

লিভিংরুমের বড় সোফায় দুই জা বসে এই আলোচনা করছে। আলোচনা কানে যাচ্ছে ডাইনিং টেবিলে বসা উষির আর উজানেরও। দুজনেই কান খাড়া করে শুনছে। মাহফুজার কথায় তাল মিলিয়ে শাহিদা বললো,

–বিশ্বাস যে আমারও হয়, তা না৷ তবে ভদ্র বাড়ির মেয়ে। খারাপ কিছু কিংবা উল্টাপাল্টা কিছু করবে না মনে হয়। আর ওই মেয়ের সাথে এই ব্যাপারে কথা কে বলবে? যে ত্যাড়া! একটা কথার ঠিকঠাক উত্তর দেয় না।

কথা সত্য। মাহিফুজা এক কথায় ব্যাপারটা স্বীকার করলো। স্বীকার করলো উজান, উষিরও। এরপর মাহফুজা বেশ উৎসাহিত হয়ে নিজের প্রস্তাব পেশ করলো,

–আমি তো বলি জিজ্ঞাসা করারই দরকার নেই। সরাসরি অফিসে বসার কথা বললেই হয়ে যায়। এখনকার প্রায় সব মেয়েই কিছু না কিছু করেই। নোঙরও অফিস জয়েন করলো। উষির তো অফিসের নামই নেয় না। ছেলে, ছেলের বউরা মিলেই কাজ করলে সবারই সুবিধা হবে। আর কারোর তো হাল ধরতে হবে। উজান একাই বা অতো বড় অফিস কিভাবে সামলাবে! সবাই মিলে হাতে হাত রেখে আগালে তবে না বড় করা যাবে।

উজানের মাথায় বজ্রপাত হলো বলে মনে হলো। চমকে উঠে মায়ের দিকে সরাসরি তাকালো। তারা নিজেদের গল্পে মশগুল। তাদের দিকে কেউ নজরই দিলো না। উজান আফসোসে মাথা নেড়ে বললো,

–এক নোঙরকে নিয়েই পারি না, আবার রাশা! আমি অফিসে যাওয়া বাদ দিয়ে দেবো।

উষির তাকে আশ্বস্ত করলো,

–কুল ব্রো! ও জীবনেও অফিসমুখো হবে না। নিশ্চিন্ত থাক।

উষিরের সাথে তাল মিলালো শাহিদা। সেও একদম নিশ্চিত হয়ে বললো,

–ওই মেয়ে অফিসে যাবে! জিজ্ঞাসা করে দেখো? জীবনেও যাবে না। আমি লিখে দিতে পারি।

রাশা বের হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে একদম রেডি হয়ে নিচে এসেছিলো৷ ভাগ্যগুণে শাহিদা আর মাহফুজার কথার মাঝে পরে গেলো। মাহফুজা তাকে দেখেই বেশ গম্ভীর গলায় বললো,

–রাশা, আমি আর ভাবি মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

রাশার পা থমকে গেলো। খাবার টেবিলে যাওয়ার আগে কথা শুনে যেতো চাইলো। তাই সেখানে দাঁড়িয়েই ভাবুক গলায় বললো,

–আচ্ছা! সিদ্ধান্তটা কি আমার জানা উচিৎ জন্য আমাকে বলছো আন্টি?

মাহফুজা আড় চোখে শাহিদার দিকে তাকালো। শাহিদা নির্লিপ্ত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মাহফুজাও চায়ের কাপ টেবিলে রেখে নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো,

–হ্যাঁ জানা উচিৎ। সিদ্ধান্তটা তোমাকে নিয়েই। তুমি আজ থেকে আমাদের অফিসে জয়েন করবে।

রাশা আতকে উঠল,

–অফিসে যাবো! আমি!

–হ্যাঁ তুমি। সারাদিন না জানি কই টইটই করে ঘুরে বেড়াও! বিজনেসে হাত লাগালে তাও বিজনেস আগাবে। বাড়ির মানুষই যদি বাড়ির ব্যবসার কাজে ইন্টারেস্ট না দেখায় তাহলে বাইরের মানুষ কি কাজ করবে! তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমি এখন থেকে অফিসে বসবে।

–সরি আন্টি৷ আমার বিজনেসে কোন আগ্রহ নেই। স্টিল, একটা কাজে আছি। সেটা তো হুট করে বাদ দেওয়া যায় না।

–কোর্টে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া একটা কাজ হলো! কেউ যখন আমাদের জিজ্ঞাসা করবে, তোমাদের বাড়ির বড় বউ কি কাজ করে তখন আমরা কি জবাব দেবো? না, আমাদের বাড়ির বড় বউ মামলায় মিথ্যা অ্যালিবি হয়। এসব বলবো?

ধমক দিলো মাহফুজা। উষির আফসোসে মাথা নাড়লো৷ হাতের স্যান্ডউইচ প্লেটে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

–ভাই, এই বউ শাশুড়ির ঝামেলাটা সত্যি ভীষণ ভয়ংকর হয়। সেই বউয়ের হাজবেন্ড হিসেবে তো আমার এখন ভয় লাগছে। না জানি কখন আমাকে নিয়ে শুরু হয়!

উজান আড় চোখে লিভিংরুমে চলা আলোচনায় নজর দিয়েছিলো। উষিরের আহাজারি শুনে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–ঝামেলাটা আমার মায়ের সাথে লেগেছে ষ্টুপিড। তুই বসে বসে জুস খা।

বলে সত্যি সত্যি জুসের গ্লাস উষিরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। তারপর চিন্তিত গলায় বললো,

–সত্যি সত্যি কি রাশা মিথ্যা অ্যালিবি হিসেবে কাজ করে?

–উহু, মিথ্যা অ্যালিবি জোগাড় করে তাদের দিয়ে কোর্টে কথা বলায়।

–মানে?

উজান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। উষির স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে বললো,

–মানে ও উকিল।

–কি!

উজানের দেওয়া চিৎকারটা জোরে ছিলো৷ সবাই তার দিকে অবাক চোখে তাকালো। যখন বুঝলো, তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা হচ্ছে তখন আবার নিজেদের আলোচনায় ফিরে গেলো। উজানের চিৎকারে উষির বেশ বিরক্ত হলো,

–চিৎকার দেওয়ার মতো কি বলেছি? কেউ কি উকিল হয় না নাকি?

–চিৎকার দেইনি, অবাক হয়েছি। রাশাকে দেখে উকিল উকিল মনে হয় না। কিন্তু ও কথাটা কোন কারনে লুকাচ্ছে নাকি ইচ্ছে করে বলছে না?

–কি জানি! কিছু কিছু মানুষের প্রফেশন লুকাতে ভালো লাগে। ওরও হয়তো সেম প্রবলেম আছে।

উষির কাধ নাচিয়ে বললে রাশার দিকে তাকালো৷ রাশার পরনে প্রতিদিনের মতো সাদা পোশাক, এক হাতে ব্রেসলেট, আরেক হাতে ঘড়ি। উষির মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। দীর্ঘক্ষণ তর্কবিতর্কের পর রাশা অনুরোধের সুরে বলো,

–আমার প্রবলেম আছে আন্টি। বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ? আমি একটা অ্যাগ্রিমেন্টে আছি। অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী আমি অন্য কারো হয়ে কাজ করতে পারবো না আর অন্য কোন কাজ করতে পারবো না। অ্যাগ্রিমেন্ট ভাঙলে এক বছরের জেল।

মাহফুজা সব শুনে শাহিদার দিকে তাকালো। শাহিদা কাঁধ নাচিয়ে হাত উঠালো। যেনো বলতে চাইছে, আমি আগেই বারণ করেছিলাম। এখন সামলাও! মাহফুজা এরপর আর একটা কথাও বললো না। থমথমে মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। রাশার মন খারাপ হয়ে গেলো। সত্যিটা সে বলতে চায় না আবার বিজনেসেও হাত লাগাতে চায় না। হাতে অনেক অপশন থাকলে সত্যিই ভীষণ বিপদে পরতে হয়। সব থেকে বড় বিপদ তো মানুষের মন রক্ষা করে চলা। কাজটা যেমন বিপদের, তেমনই কঠিনও। তার প্রফেশনে এমন করে চলতে হয় না। কিন্তু এই বিবাহিত জীবনে এটা খুবই জরুরি একটা কাজ বলেই বুঝলো সে। পরিশেষে মাহফুজাকে মন খারাপ করতে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো।

****
অনুষ্ঠানের আর খুব বেশি দেরি নেই। পুরো শপিং এখনও শেষ হয়নি। রাশা বুঝে পায় না, এক বেলার একটা অনুষ্ঠানে এতো শপিং করতে হবে কেন! অনুষ্ঠানের ড্রেস তো অর্ডার দেওয়াই আছে। শেষ! আর কি? এখন কি অনুষ্ঠানে মিনিটে মিনিটে ড্রেস চেঞ্জ করবে! একই অনুষ্ঠানে আবার শপিং করতে হবে৷ আর শপিংএ সাথে নিতে হবে নোঙরকে। প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা তার খুব খারাপ। আজকে ভয়ে ভয়ে তাকে নিতে এসেছে। অফিস ছুটির পর নোঙর আসলো মলিন মুখে। মুখ থেকে চিন্তার ভাজ কিছুতেই যাচ্ছে না। রাশা ভেবেছিলো, আজকে যদি ওমন ঘোরায় তাহলে ধমক দেবে তাকে। কিন্তু তার এমন মুখশ্রী দেখে নিজের ধমক হজম করে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো,

–কি হয়েছে নোঙর? এনি প্রবলেম?

নোঙর গাড়িতে বসে বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

–বিরাট বড় প্রবলেমে পরেছি আপু। একটু হেল্প করবে প্লিজ?

দীর্ঘশ্বাসের শব্দে রাশা হকচকিয়ে গেলো৷ একটু আমতা-আমতা করে বললো,

–আচ্ছা! কি প্রবলেম?

রাশাকে কথাবার্তা খুব সাবধানে বলতে হচ্ছে৷ আসল কথা হচ্ছে, নোঙরের ব্যবহারে সে প্রচন্ড ভয় পায়। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের মুখের উপর কথা বলা যায় না। তারা যা বলে তাই করতে হয়। রাশার জন্য নোঙরও তেমনই মানুষ। মেয়েটাকে কষ্ট দিতে মন চায় না। তাই যা বলে তাই মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। কথাবার্তাও বলতে হয় সাবধানে। না জানি কোন কথায় কি মনে করে ফেলে!

–অফিসের প্রবলেম।

–কেউ কিছু বলেছে? মারতে হবে কাউকে? নাকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে? ভাইয়াকে আমি বলবো সমস্যা নেই। শুধু বলো কে কি বলেছে?

বেশ উতলা হলো সে৷ নোঙর সেদিকে তাকিয়ে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। উদাস গলায় বললো,

–তোমার ভাইয়াই বলেছে মানে দিয়েছে। একটা প্রজেক্টের দ্বায়িত্ব দিয়েছে। আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। ফাইল খুললেই তার সব লেখা চোখের উপর ভাসছে।

রাশার উতলা ভাব চলে গিয়ে উত্তেজনা খানিক দমে গেলো,

–অফিসের প্রজেক্ট! আমি কি সাহায্য করতে পারবো!

নোঙর চটপট নিজের রুপে ফেরত আসলো৷ অতি উৎসাহিত হয়ে বললো,

–অবশ্যই পারবে। সেইজন্য আমি ফাইল সাথে করে নিয়েও এসেছি।

এরমাঝে একটা লুকানো কথা আছে। সেটা হলো, সারাটা দিন সে ফাইল হাতে অফিসের সবাইকে ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করেছিলো, কেউ কাজটা করে দিতে পারবে নাকি। কিন্তু অফিসের সবাই নাকচ করে দিয়েছে। উজানের কড়া আদেশ, কেউ নোঙরকে সাহায্য করবে না। তাই কেউ করলোই না। এখন রাশা শেষ ভরসা৷ তাই কথা শেষ করতে না করতেই ফাইল বের করে রাশার হাতে দিলো। রাশা চোখ মুখ গম্ভীর করে ফাইলের কাগজপত্র দেখতে লাগলো। একসময় মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,

–এটা তো অনেক ইজি। তোমাকে একটা ফুল প্ল্যান বানাতে হবে। তাহলেই হয়ে যাবে। এমবিএ তে তো এগুলো আছে। তুমি শেখোনি?

নোঙর ঠোঁট উলটে দায়সারা ভাবে বললো,

–নাহ! ক্লাসেই যাই না। শুধু শুধু ভর্তি হয়েছি। প্লেন মাস্টার্স করবো ভাবছি। ওইসব এমবিএ টেমবিএ আমার দ্ব্বারা সম্ভব হবে না।

রাশা উৎসাহ দিতে চাইলো,

–তুমি যেটাতে ভালো, তোমার সেটাই করা উচিৎ। মন যেখানে টানে সেখানেই যাও। তবে এমবিএ তে যখন ভর্তি হয়েছো তখন সার্টিফিকেটটা নিয়েই নাও। কখন কোনটা দরকার হয় বলা তো যায় না।

–ওটা তো এখনই দরকার ছিলো কিন্তু হচ্ছে তো না।

নোঙর উদাসভাবে বললো। রাশার উৎসাহ ধামাচাপা পরে গেলো। বুঝলো, পাশের মেয়েটিকে উৎসাহ দিয়ে কোন লাভ নেই। সে সেটাই করবে যেটা সে বুঝবে। তাই ওপথে আর পা বাড়ালো না। ফাইল নাড়াচাড়া করে বললো,

–আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি ভালো করে। মনে করো তুমি একটা গান সার্চ করবে। ইউটিউব, গুগোল বা আদার সাইট, যেখান থেকে সার্চ করবে সেখানে গানের একটু অংশ লিখে সার্চ করলেই কেমন চলে আসে রাইট? এটার পেছনে কিওয়ার্ড রিসার্চ এক্সপার্টরা কাজ করে। ওদের কাজ হচ্ছে, কেউ একটা ছোট বাক্য বা সিমিলার কিছু দিয়ে সার্চ করলেই যাতে ওই গানটা একদম প্রথমে চলে আসে। তোমার কাজও তাদের মতোই। যে কোম্পানির সাথে কাজ করছো, তাদের বিশ্বাস করাতে হবে যে, তোমাদের মেটারিয়াল ইউজে তাদের ব্যান্ডটা এমন টপে চলে আসবে। বুঝেছো?

নোঙর করুন চোখে মাথা নাড়লো৷ রাশা তপ্ত শ্বাস ফেলে বোতল থেকে পানি খেলো। এনার্জি ফিরে পাওয়ার পরেই আবার বলা শুরু করলো,

–তোমাদের মেটারিয়ালে তৈরি কাপড় ওদের ব্র‍্যান্ড ইউজ করবে। এখন ওদের যত ভালো কাপড় তোমরা দিতে করতে পারবে ওদের ড্রেস তত বেটার হবে। এখন তাদের এটা বিশ্বাস করাতে হবে যে তুমি ওদের বেস্ট কাপড় দিলে ওরা ওই কাপড়ে বেটার কোয়াটিলির ড্রেস বানাতে হবে আর সবাই খুব পছন্দ করবে। এখন এই পুরো প্রসেসটার ধাপ তোমাকে তৈরি করতে হবে৷ তুমি ওই কাপড়ে কি মেটারিয়াল ইউজ করবে, কেমন কালারের কাপড় তৈরি করবে এক্সেট্রা এক্সেট্রা তোমাকে ধাপে ধাপে প্লান তৈরি করতে হবে। দেন কোম্পানিকে সেটা প্রেজেন্ট করবে। ওরা অ্যাপ্রুভ করলে সেটা ওরা ওই কোম্পানিকে দেবে। ওরা অ্যাপ্রুভ করে ডিল ফাইনাল করবে। ব্যাস কাজ শেষ।

নোঙরের মাথা ভনভন করে ঘুড়তে লাগলো। রাশার সব উৎসাহে পানি ফেলে দিয়ে হতাশ গলায় বললো,

-আমার পক্ষে সম্ভব না। আই কুইট!

রাশা আরো হতাশ হলো। তবে সে নিজেকে ভালো টিচার হিসেবেই জানে। বৃষ্টি বন্যা তার বুঝিয়ে দেওয়া পড়া খুব ভালো করেই বোঝে। আবার জজ কিংবা ক্লায়েন্টকেও সে খুব ভালো ঘোল খাওয়াতে পারে৷ এইজন্যই দুই বছরের ইন্টার্নশিপ খুব সফলতার সাথে শেষ করতে যাচ্ছে। বুঝিয়ে দেওয়ার একটা টেকনিক আছে। সেটা হচ্ছে, যাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, সে কিভাবে বুঝালে বুঝবে সেটা ধরে ফেলা। রাশাও ধরে ফেলছে। তাই এর সমাধানও বের করে ফেললো,

–তো কে বলেছে তুমিই কাজটা কমপ্লিট করো? তোমার বর তো এসবে এক্সপার্ট। তাকেই বলো কমপ্লিট করে দিতে।

নোঙর আসলে কাজটা করতেই চায় না। আর যে করতে চায় না সে খামোখা বুঝবেই বা কেনো! কথাটা রাশা খুব ভালোমতো বুঝে ফেলেছে। তাই এর সুন্দর একটা সমাধান বলে দিলো। তার কথাটা নোঙরেরও মনে ধরলো। ভাবুক হলো৷ আসলেই ব্যাপারটা ভেবে দেখা যায়।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৯(শেষাংশ)

উষির মিছিল থেকে সরাসরি উজানের গাড়িতে চেপে বসলো। ক্লান্ত ঘর্মাক্ত দেহ সিটে এলিয়ে চোখ বুজে রইলো। বাড়ি থেকে কঠিন আদেশ এসেছে, বাড়ির দুই বউয়ের সাথে শপিংএ তাদেরও যেতে হবে। যতই কাজ থাকুক আর যাই থাকুক। এই আদেশে উজান বাধ্য হয়ে আসলেও উষির নিজের ইচ্ছায় এসেছে। তাকে ছুটি দিতে বাধ্য করেছে পার্টি অফিসের লোকদের। তার কাছে সব কাজ একদিকে আর তার বউ আরেকদিকে। দাঁড়িপাল্লায় রাশার ভাগের ওজন বেশিই পরে সবসময়। অন্যদিকে উজান বিপরীত। সবে সবে বড় একটা প্রজেক্টের কাজ হাতে নিয়েছে। এইসময় এইরকম ছুটিছাটা তার একদম পছন্দ হচ্ছে না। তার দাঁড়িপাল্লায় আবার কাজের ভারটা অতিরিক্ত বলা যায়।
গাড়িতে ছোট একটা পানির বোতলে অল্প একটু পানি ছিলো। উষির এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দিয়ে শরীর ঠান্ডা করলো। তারপর বোতলের অবশিষ্ট পানি গলায় ঢেলে আবার সিটে গা এলিয়ে দিলো৷ চোখ বুজে খুশি খুশি মনে বললো,

–মাঝে মাঝে বাড়ির লোকজন খুব সুন্দর সুন্দর কাজ দেয়। মনটা একদম প্রফুল্ল করে ফেলে।

উজান ড্রাইভ করছিলো। উষিরের কথা কানে যেতেই বিরক্ত নিয়ে বললো,

–এইটা তোর সুন্দর কাজ মনে হলো? কত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি৷ এইসময় এইসব কি সহ্য করা যায়! কত টাইম ওয়েস্ট হচ্ছে।

উষির তেঁতে উঠলো। হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,

–তোর কি মনে হয়, আমি বসে বসে খাই? আমার কাজ নাই? দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা খাটতে হয়। তবে গিয়ে মানুষের মন জয় করতে পারি। আর মানুষের মন জয় করলে তবেই ভোট পাবো।

উজান তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে অবজ্ঞার সুরে বললো,

–এতোদিনে বউয়ের মন জয় করতে পারলি না, আর মানুষের মন জয় করার চিন্তা করছিস? ব্রাভো ব্রো!

–এতোদিন কোথায়! কয়েকদিন হলোই তো মাত্র বিয়ে হয়েছে। একমাসও হয়নি! এক মিনিট, এক মিনিট! মআস বোধহয় হয়ে গেছে। কয় তারিখে যেনো বিয়ে করেছিলাম?

উষির বেশ চিন্তিত হলো। উজান আড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে আফসোসে মাথা নাড়লো। একেই বলে, যার বিয়ে তার হুশ নাই আর পাড়াপড়শির ঘুম নাই!

–সেকেন্ড অগস্ট। আর এটা ফিফটিন সেপ্টেম্বর! মাস শেষ অনেক আগে।

উষির বুকে হাত দিয়ে আহাজারি করে উঠলো,

–ইসস ভাই! বউকে একটা গিফট পর্যন্ত দিতে পারলাম না! ইসস রে!

উজান বাঁকা হাসলো। টিটকারি দেবার ভঙ্গিতে বললো,

–আমি তো আমার বউকে দিয়েছি৷ এক্সপেন্সিভ গিফট!

যেনো একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা হচ্ছে। উজানের চোখেমুখে শয়তানি হাসি ঝিলিক দিয়ে দিয়ে উঠছে। মিছিলে থাকার কারণে উষিরের সাদা পাঞ্চাবি খানিক ময়লা হয়ে গেছে৷ বিশেষ করে হাতের দিকের অংশ। হাতার ময়লা লাগা অংশটুকু গুটিয়ে ভাজ করতে করতে আনমনে বললো,

–আচ্ছা! কি দিলি?

উষিরের কন্ঠস্বর নির্লিপ্ত। বউকে কি গিফট দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন।

–ল্যাভেন্ডার স্যাফায়ারের পেন্ডেন্ট।

উষির বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকালো। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বললো,

–তুই একা একা তোর বউয়ের জন্য গিফট কিনে আনলি? আমার বউ কি বন্যায় ভেসে এসেছে? তুই আমাকে একবারও বললি না যে গিফট আনবি? তোর আগে আমি বিয়ে করেছি, ভুলে যাস না। গিফট আগে আমার দেওয়ার কথা। আর তুই আমাকে টপকে গিফট দিয়ে দিলি?

–এতোদিন দিস নাই কেন?

–গিফট যে দিতে হয় তাই তো জানতাম না।

হঠাৎই উদাস হয়ে পরলো সে। উজান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,

–জানতি না?

–মনে ছিলো না রে ভাই। বউকে মানাতে মানাতেই তো দিন যায়। অন্য চিন্তা কখন করবো!

উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভাইয়ের বউপাগলা রুপ দেখে বিরক্ত হলো উজান,

–আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। পঁচিশ লাখ দিয়ে আমার কাছ থেকে গিফটটা নিয়ে নিস।

–কত বললি?

টাকার অ্যামাউন্ট শুনে ভ্রু বেঁকিয়ে প্রশ্ন করলো উষির। উজান চুলে ব্র‍্যাক ব্রাশ করে স্টাইল করে বললো,

–পঁচিশ লাখ।

উষির দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,

–তোকে যদি গাড়ি থেকে বের করে ঠিক এই জায়গায়ই আমি আচ্ছামতো পিটানি দেই তাহলে কি বড় ভাই হিসেবে আমার কোন দোষ হবে? বেয়াদপ ছেলে। এতোদিন তোর পেছনে আমার যত টাকা গেছে সব টাকা দিয়ে অমন পঁচিশ লাখের স্যাফায়ার কতগুলা কেনা যাবে জানিস? দে তাড়াতাড়ি। বউকে গিফট না দেওয়া পর্যন্ত আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

ধমক দিলো উষির। ধমকে কাজ হলো৷ উজান মুখ ব্যাজার করে গাড়ির স্টোরেজ থেকে পেন্ডেন্ট বক্স বের করে দিলো। উষির বক্স উল্টেপাল্টে দেখে ভেতরের পেন্ডেন্টটাও চেক করে নিলো। তারপর পাঞ্চাবির পকেটে পুরে বললো,

–ভালো করে শুনে রাখ। রাশা আসলে তুই ড্রাইভ করবি আর তোর বউকে তোর পাশের সিটে বসাবি। আমি আর তোর ভাবি পেছন সিটে বসবো। আর নয়তো তুই আর নোঙর পেছন সিটে বসবি আর আমি আর রাশা সামনের সিটে৷ বুঝেছিস?

–পারবো না।

থমথমে মুখে উত্তর দিলো উজান। উষির তাচ্ছিল্যভরে হাসলো৷ দেখা যাবে, কে কি পারে!

****
রাশা আর নোঙর শপিংমলের বাইরে দাঁড়িয়ে উষির আর উজানের অপেক্ষা করছিলো। তারা আসলো, গাড়ি থেকে নামলোও বটে তবে তাদের কাছাকাছি আসার আগেই কয়েকটা মেয়েদের দল তাদের ঝেঁকে ধরলো। উজান আর উষিরের চেহারার গড়ন, উচ্চতা, ব্যবহার, সব প্রায় সেমই বলা চলে। সেইজন্য তাদের জমজ ভেবে অনেকে ভুল করে৷ মেয়েদের দলের সবাই তাই করলো। সেইজন্যই বোধহয়, উজান আর উষির তাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। একে একে দুইজনের সাথেই কথাবার্তা বলে ছবিও তুলতে লাগলো। আর এসব দেখে নোঙর রেগে আগুন। রাশাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–দেখেছো আপু, ছেলেদের আসলেই বিশ্বাস করতে হয় না৷ আমরা সাথে নেই আর সেই সুযোগে এরা এতোগুলা মেয়ের ভিড়ে বসে আছে। লেপ্টে লেপ্টে ছবিও তুলছে। জীবনে আমার সাথে হেসে কথা বললো না আর দেখো, মুখ থেকে হাসি সরছে না।

রাশা রোদ চশমার ফাঁকে তাদের দিকে তাকালো। এরপর বেশ বিরক্ত হয়ে বললো,

–ওরা তো ফ্যান গার্ল। এরা এমনই করে।

নোঙর অবাক হয়ে গেলো। তীব্র রোদের মাঝেও নিজের রোদ চশমা খুলে হাতে নিয়ে বিষ্ময়মাখা গলায় বললো,

–তোমার জেলাসি হচ্ছে না?

–তা কেনো হবে? এটা তো নরমাল ব্যাপার৷ পাবলিক ফিগার হলে এসব ফেস করতেই হবে। বি নরমাল নোঙর।

–নরমাল! এমন ঢেকেঢুকে আসার পরও মানুষ চিনবে কিভাবে? কোন ছেলে তো আসে নাই৷ সবগুলা মেয়ে৷

উষিরের মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ আর চোখে সানগ্লাস ছিলো। উষির সাথে থাকায় উজানও তেমনই মাস্ক, ক্যাপ আর সানগ্লাস পরেছিলো। তবুও মেয়েগুলো তাদের চিনে ফেলেছে। এই কথাটা রাশার মাথায় আসতেই ভাবুক হলো সে। চিন্তিত গলায় বললো,

–জেলাস হওয়া দরকার বলছো তাহলে?

–একশো পার্সেন্ট।

রাশা গম্ভীরমুখে মাথা ঝাকিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাদের দিকে তাকালো। মেয়েগুলো চলে যেতেই ওরা দুইজন তাদের দিকে আসলো। কাছাকাছি এসেই উষির পকেট থেকে রুমাল বের করে রাশার কপালের ঘাম মুছে বিচলিত গলায় বললো,

–শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে গিয়ে বসলেই তো হতো?

উষিরের বিচলিত মনোভাব দেখে নোঙর মুগ্ধ হয়ে বললো,

–আপনার মতো মানুষ ঘরে ঘরে জন্ম নিক ভাইয়া। কিছু কিছু মানুষ তো বউকে কষ্ট দিয়েই শান্তি পায়।

শেষের কথাটা উজানের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললো। উজান পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়েছিলো৷ এই কথায় ভ্রু কুঁচকে নোঙরের দিকে তাকালো। উষির হেসে ফেলে বললো,

–ছোটরা একটু ঘাড় ত্যাঁড়া হয় নোঙর। মনে নিও না কিছু। তুমিও বড় আর আমিও বড়। তাই দুইজনই দুইজনের কষ্ট বুঝতে পেরেছি৷ আর এরা দুইজনই ছোট। মানে বুঝতেই পারছো আমার আর তোমার অবস্থা!

নোঙর আফসোসে মাথা নেড়ে সায় জানালো। তারপর উজানের দিকে ভয়ংকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনে হাঁটা ধরলো। উষির চোখের ইশারায় উজানকেও তার সাথে যেতে বললো। উজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটা ধরলো। বউ পেয়ে ভাই যে নিজের ভাইকে ভুলে যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মিস্টার আদনান কায়সার। ব্যাপারটা দুঃখজনক!
ওরা চলে যেতে রাশা ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বললো,

–মেয়েগুলো সুন্দর ছিলো তাই না?

উষির রেগে তাকালো। তারপর আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বললো,

–খবরদার বলছি! আর একটা শব্দও মুখ থেকে বের করবে না।

বলেই সে গটগট করে সামনে হাঁটা ধরলো। এই ব্যাপারে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা খুব খারাপ৷ অন্তত এই ব্যাপারে বউকে তার একদম পছন্দ না! রাশা ঠোঁট উল্টে কাঁধ নাচিয়ে বিড়বিড় করলো,

–মনমতো কথাই বলতে চাচ্ছিলাম। আসলেই, সবার সবকিছু সহ্য হয় না!

***
শপিং করার পুরোটা সময় নোঙর মুখ ব্যাজার করে ছিলো। প্রতিটা জিনিসের প্রাইস দেখেছে আর আফসোস করে রেখে দিয়েছে। শান্তিতে কিছুই কিনতে পারেনি। তবে উজান কিনেছে। বলা ভালো, কিনে দিয়েছে। নোঙরকে কয়েক জোড়া হিল কিনে দিয়েছে যাতে আর কারো জুতা পরে অফিসে আসতে না হয়। নোঙর সেটা দেখে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলেছিলো শুধু। এরপর পুরোনো মামার বাড়ি আর নতুন শ্বশুরবাড়ির সবার জন্যেও শপিং করেছে৷ উজান কিনেছে জন্য উষিরকেও শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য শপিং করতে হলো। আবার বাড়ির সবার জন্যেও করতে হয়েছিলো। এই এতো এতো শপিং শেষে সবাই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে গেলো। আলাদা গাড়িতে সেগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে তারা নিজেরা উজানের গাড়ির কাছে আসলো। গাড়ির কাছাকাছি আসতেই উষির উজানকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিলো৷ রাশা আগেই উঠে বসেছিলো। নোঙর রাশার পাশে উঠতে নিতেই উজান তার হাত টেনে আটকালো। থমথমে গলায় বললো,

–সামনে বসো, কথা আছে৷

নোঙরের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো। বড় বড় চোখ দুটোতে বিষ্ময় খেলে গেলেও কিছু না বলে সামনেই বসে পরলো। উষির উজানের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে রাশার পাশে বসে পরলো। রাশা চোখ বুজে সিটে মাথা এলিয়ে বসে ছিলো৷ উষির পাশে বসতেই চোখ খুলে অবাক হয়ে গেলো৷ উষির ফিসফিস করে বললো,

–নতুন কাপলদের একটু প্রাইভেসি দিতে হয়। সবে সবে বিয়ে হয়েছে ওদের। তাই ওদের একটু প্রাইভেসির ব্যবস্থা করলাম। বড় ভাই হিসেবে তো এটা আমার কর্তব্য!

রাশা কিছু না বলে চোখ বুজে উষিরের কাধে মাথা দিলো৷ উষির আলতো হেসে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। প্রকৃতিতে আঁধার নেমে এসেছে অনেক আগে। গাড়ির ভেতর থেকে থেকে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পরছে। জ্যামে বসে সেই মৃদু মন্দ আলোতে নোঙরের দিকে তাকালো উজান। নোঙরের এনার্জির কমতি নেই। দুই আড়াই ঘন্টা শপিং করেও ক্লান্তির রেশমাত্র তার মধ্যে নেই। উলটে মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। বড় করে শ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো সে। মনটা কেমন কেমন করছে! হঠাৎ পেছন সিট থেকে উষির গলা উঁচিয়ে বললো,

–একটা মুভি দেখা যাক। এতে সময়টা অন্তত কাঁটবে।

নোঙর মোবাইল রেখে ভারি উৎসাহিত গলায় বললো,

–কি মুভি ভাইয়া?

রাশা জানালার কাঁচে মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে ছিলো৷ উষিরের কথাই চটপট তার কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বললো,

–ছোট ভাই-বউদের সামনে রোম্যান্টিক শব্দটা উচ্চারণ করবে না খবরদার? তোমার লজ্জা নাই থাকতে পারে, বাকিদের আছে।

মনে হলো, একজন লজ্জাবতী নারী একজন লজ্জাহীন পুরুষকে বলছে, লজ্জা করো! লজ্জা করো! লজ্জা যে কার নেই, সেটা তো সে ভালো করেই জানে। প্রথমবার কাছাকাছি আসার পর পুরো দুই ঘন্টা সে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলো। রাশার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারেনি। সেই মানুষকে লজ্জা শিখাচ্ছে! চরম হারে অপমান করে ফেললো তাকে। উষির ব্যাজার মুখে কুলুপ এটে বসে রইলো।৷ রাশা তার হয়ে বললো,

–কি মুভি দেখবে? হরর? কমেডি? অ্যাকশন?

–কুংফু পান্ডা দেখি? কলেজে একবার দেখেছিলাম। এত্তো কিউট ছিলো! আবার দেখতে ইচ্ছে করছে।

উচ্ছ্বসিত মুখে বলো নোঙর। মুভি দেখায় তার উৎসাহের সীমা রইলো না। উষির আফসোসে মাথা নাড়লো। উজানকে ছোট করে টেক্সট দিলো,

“উজান, তুই কখনও ভেবেছিলি, বউ নিয়ে কুংফু পান্ডা মুভি দেখবি?”

“মুভি যে দেখবো, তাই তো ভাবিনি। কত টাইম ওয়েস্ট হচ্ছে। কত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে পেয়েছিলাম। ধ্যাত!”

চটপট উত্তরও এলো। গাড়ির মনিটর স্ক্রিনে এখন কুংফু পান্ডা মুভি চলছে। নোঙর আর রাশা বেশ মনযোগ দিয়ে সেটা দেখছে। উষির এবারে রাশাকে টেক্সট করলো,

“বেগম জায়ায়ায়ায়ান? তোমার জন্য গিফট এনেছি সুদূর বিলেত থেকে।”

রাশা মেসেজের নোটিফিকেশন পেয়ে মেসে চেক করে কটমট করে উষিরের দিকে তাকালো। উষিরের নজর মুভির দিকে ছিলো। রাশা দ্রুত হাতে টাইপ করলো,

“বাই এনি চান্স, তুমি কি সৌরভের থেকে কোন ট্রেনিং নিয়েছো?”

“গিফট লাগবে নাকি সেটা বলো?”

খানিক রেগেই রিপ্লাই দিলো উষির। ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বেড়িয়ে বাস্তবে আসলো রাশা। হাত পেতে ইশারায় গিফট দিতে বললো। উষির মাথা নেড়ে মেসেজ টাইপ করলো,

“উহু, পরিয়ে দেবো। তুমি চোখ বন্ধ করে ঘুরে বসো?”

রাশা বিরক্ত হয়ে ঘুরে বসলো। উষির পকেট থেকে বক্স বের করে পেন্ডেন্ট হাতে দিলো। তারপর রাশার চুল সরিয়ে ঘাড়ের এক পাশে রেখে আলো-আঁধারিতেই সেটা পরিয়ে ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো। চকিতে ঘুরে বসলো রাশা। তার মেজাজ নেওয়ার জন্য উষির পুরোদমে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু রাশা কিছু না বলে শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,

–থ্যাঙ্কিউ!

****

টানা তিনদিনের প্রচেষ্টায় মোটামুটি একটা প্ন্যান দাঁড় করিয়েছে নোঙর। সেদিন শপিং শেষে উজানকে একটু সাহায্যের জন্য বলেছিলো৷ গম্ভীরমুখে এক কথায় মানা করে দিয়েছিলো। এতেই তার জেদ চেপে গিয়েছিলো৷ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, একা একাই সব চেয়ে বেস্ট প্ল্যান তৈরি করবে৷ প্লানমাফিক প্রজেক্ট তৈরি করে এখন উজানের কেবিনে গেলো৷ চেয়ার টেনে বসে উজানের দিকে তার এতো কষ্ট করে করা ফাইলটা এগিয়ে দিলো সে। উজান ফাইল চেক করতে লাগলো মনোযোগ দিয়ে। জীবনের প্রথম টাস্ক করে নোঙর ভীষণ উচ্ছ্বসিত। উৎফুল্ল মনে বললো,

–ডকুমেন্ট হারানোর কোন ভয় নেই। আমি অনেক জায়গায় কপি করে রেখেছি৷ ফোন মেমোরি, এসডিকার্ড, কম্পিউটারের ওয়ার্ড ফাইলে, গুগোল ডকুমেন্টে। ছবিও তুলে রেখেছি। আবার একটা ডিস্কেও রেখে দিয়েছি৷ একটা ক্রাশ করলেও আরেকটা থাকবে৷

উজান ফাইল চেক করা শেষে ধপ করে সেটা টেবিলের উপর রেখে বললো,

–আপনার এতো কষ্ট বৃথা গেলো মিসেস নোঙর খন্দকার। ফাইল রিজেক্টেড।

নোঙরের মুখের উজ্জ্বল্যভাব মূহুর্তেই চলে গিয়ে আঁধারে ঢেকে গেলো। এরপর একটা কথাও না বলে তক্ষুনি বাড়ি ফিরে গেলো৷ ছুটির আগে বাড়ি ফিরে যাওয়ায় উজান কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভেবেছিলো একবার। কিন্তু নোঙরের মলিন মুখ মনে পরায় সেটা আর করেনি। অন্যদিকে নোঙর বাড়ি ফিরেই বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে। উজানের সাথে সে কিছুতেই থাকবে না। মাকে কঠিন করে বলো,

–শোনো মা, আমার ওর কিছুই ভালো লাগে না৷ সংসার করবো কিভাবে? মগ ভর্তি করে কফি খায়। মগ ভর্তি করে কে কফি খায়? টেবিল এলোমেলো থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। সব সময় সব বিষয়ে খুঁতখুঁত করে। সব জিনিস নীট অ্যান্ড ক্লিন চাই। একটু নোংরা, একটু অগোছালো পছন্দ না। পুরো টেবিল সাফসুতরা চাই। চেয়ার এলোমেলো চলবে না। ফাইল অগোছালো থাকলে নিজেই নেমে পরে সব ঠিক করতে। উইকেন্ডে তো মাথায় গামছা বেঁধে অফিসের ঝুল পরিষ্কার করতে নেমে পরেছিলো। অফিসেই এমন করে তাহলে বাড়িতে কি করে চিন্তা করো একবার! পরিষ্কার করারও একটা লিমিট থাকে। পুরো পরিচ্ছন্নতাকর্মী একটা। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিৎ!

অফিসের ঝুল পরিষ্কার করার কথাটা সম্পূর্ণ বানোয়াট৷ পরিষ্কার সে করেনি। পরিষ্কার করার লোকগুলোই ওগুলো করেছে। আর তদারকি করেছে তাহের মিয়া। বাকিগুলো খানিক খানিক করে সত্যি৷ বড় কোন পদক্ষেপ নিতে গেলে এমন ছোটখাটো মিথ্যা বলতে হয়। সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। আর অপমান নয়, যথেষ্ট হয়েছে! এবার এর একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে!

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩০

রাশার রিসেপশন ড্রেসে মিসেস ফ্লোরা বাঙালীয়ানাকে খুব ভালোভাবে ধরে রেখেছেন। শাড়ির ডিজাইনও করেছেন নিজের মতো৷ হালকা গোলাপি রঙের সফট বেনারসি শাড়ির উপর সোনালি সুতার কাজ করা। এক দেখায় পছন্দ করার মতো শাড়ি। পছন্দ করলোও সবাই। রাশার সাজগোছও শুদ্ধ বাঙালিয়ানা স্টাইলের হলো। আটপৌরে পদ্ধতিতে শাড়ি পরে চুলগুলো খোপা করেছে। খোপা আবার জিপসি ফুল আর সাদা গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। গহনার মধ্যে চিকন লম্বা টিকলি, দুই হাতে চুর আর দুইটা পাতলা হার। সবশেষে শাড়ির সাথে মাচিং ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিয়েছে। ওড়নার এক কোনা হাতের সাথে বেধে দেওয়ায় এই হালকা সাজেও রাশাকে রানীর থেকে কম মনে হচ্ছে না। ছবিও আসলো দারুন দারুন৷
ম্যারেজ হলের লনে হচ্ছিলো এই অনুষ্ঠান। পায়ের নিচের নরম ঘাসে খালি পায়ে হাঁটার নিদারুন ইচ্ছেটা ধামাচাপা দিয়ে অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে স্টেজে বসে আছে রাশা। তার বাড়ি থেকে এখনও কেউ আসেনি। হয়তো রাস্তায় আছে৷ সে অবশ্য চাচ্ছে তারা রাস্তা থেকেই ফিরে যাক৷ কিন্তু জানে যে এমনটা হবে না৷ মাঝে মাঝে উষির এসে ঘুরে যাচ্ছে। তার পরনে ঘিয়ে রঙের পাঞ্চাবি৷ সেটাও মিসেস ফ্লোরাই ডিজাইন করেছে। মিসেস ফ্লোরাকে অবশ্য এখনও দেখা যাচ্ছে না। এসেছে নাকি, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। স্টেজে বসে বসে এসব দেখা ছাড়া রাশার আর কোন কাজ নেই। গালে হাত দিয়ে আড়াম করে যে বসবে, সে ভাগ্যও তার হচ্ছে না৷ সব থেকে বিরক্তিকর ব্যাপারটা হচ্ছে, সেকেন্ডে দুই তিনবার করে ক্যামেরার ক্লিকের আওয়াজ আসছে। একটা অনুষ্ঠানে একটা ক্যামেরাই যথেষ্ট। কিন্তু তার সামনেই তিন চারজন আছে। আসেপাশে ছড়িয়ে আছে আরো কয়েকজন। এর থেকে পুরো অনুষ্ঠানে সিসিক্যামেরা লাগালে বেশি ভালো হতো। খরচও কম আবার যখন যে মোমেন্টের প্রয়োজন, সেই মোমেন্ট ক্যাপচার করে রাখা যাবে। এইটুকু বুদ্ধিও কারো নেই! আফসোসে মাথা নাড়লো রাশা। কেউ অন্তত তার কাছে এসে পরামর্শ করতে পারতো। কতো আইডিয়া আছে তার কাছে।

সুবোধ বাবুর সাথে রাশার বাবার একটা অঘোষিত শত্রুতা আছে। রাশার বাবার ধারণা, সেই রাশার মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা ঢুকিয়েছে। এইসব বড় বড় ক্ষমতাধর মানুষের শত্রুতা ভয়ংকর হয়৷ তাই তিনি রিস্ক নিতে চাননি। নিয়ম রক্ষা করে এসেছেন, দেখা করেছেন, গিফট দিয়ে খেয়ে দেয়ে বিদায়ও নিয়েছে। অনুষ্ঠানের বাকি সদস্যরা নিজেদের মাঝে ব্যস্ত। নোঙরকে আনতে উষির পার্লারে চলে গেছে। তার সাজগোছ কমপ্লিট হয়েছে একটু দেরিতে। তাই পরিবারের সবাই চলে গেলেও সে যেতে পারেনি। উজান এসে তাকে পিক করলো৷ গাড়িতে বসেই নোঙর নিজের বরের দিকে নজর দিলো। ছাই রঙা পাঞ্চাবিতে তাকে ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছিলো। পাঞ্চাবি পরা এর আগেই দেখেছে৷ বিয়ের দিন। তখন পৃথিবীর সব থেকে খারাপ মানুষ মনে হলেও আজ সেই পাঞ্চাবিতেই তাকে পৃথিবীর সব থেকে হ্যান্ডসাম পুরুষ লাগছে। কি অদ্ভুত! মনের গোপন কথা গোপন না রেখে একসময় সেই অদ্ভুত কথাটা মুখেও প্রকাশ করলো,

–তোমাকে খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে।

যদিও কথাটা হিসাবমতে উজানেরই তার উদ্দেশ্যে বলার কথা ছিলো। কিন্তু হিসাবের গরমিল হলো। উজান আড়ালে মুচকি হাসলো৷ পরক্ষণেই চুলে আঙুল চালিয়ে বললো,

–আই নো। সবাই তাই বলে।

নোঙরের মুখ হা হয়ে গেলো। কি খারাপ মানুষ! একে তো সমাজের নিয়মের বাইরে গিয়ে তার প্রশংসা করেছে, উত্তরে কোথায় সে তার প্রশংসা করবে তা না করে অহংকার করছে তাও নিজের রুপ নিয়ে! মেকাপ করা মুখটা মূহুর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলো। থমথমে মুখে বাইরের দিকে দেখতে লাগলো। ঘুমিয়েও পরলো না আর কথাও বললো না। উজানের কাছে এটা নোঙরের ভদ্রতার লক্ষন। তাই জিজ্ঞাসা না করে পারলো না,

–আজ হঠাৎ এতো ভদ্র হয়ে গেলে কেন? এতো ভালো করে কথা বলছো!

–বোধহয় তোমাকে ইমপ্রেস করতে চাচ্ছি।

কথাটা মনে মনে বললেও মুখে কিছুই বললো না৷ মাথাটা যথাসম্ভব ঘুরিয়ে রাখলো৷ উজান আড় চোখে সেটা দেখলো। নোঙরকে সে দেখেছে৷ খুব ভালো করেই দেখেছে। পার্লারের গেট থেকে গাড়ির কাছে আসার আগ পর্যন্ত এক দৃষ্টিতে তাকে দেখেই গেছে। বেগুনি রঙের সিল্ক শাড়িতে অসাধারণ লাগছে। গলায় তার দেওয়া পেন্ডেন্ট। শাড়ির সাথে মিলেছে জন্য পেন্ডেন্ট পরেছে নাকি পেন্ডেন্টের সাথে মিলিয়ে শাড়ি পরেছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। এই একই মেয়েকে বিয়ের দিন তার আধ পাগল মনে হচ্ছিলো। এরপর প্রতিদিনই তাই। তারপর আর তেমন মনে হয়নি৷ প্রতিবারই প্রতিদিনের থেকে দ্বিগুণ ভালো লেগেছে। আর আজ তো বুকের ধুকপুকের আওয়াজে কথাই বলতে পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে, তার এই নার্ভাসনেস পাশের মেয়েটি জেনে যাবে। আর জেনে গেলেই তার ভয়ংকর অপমান হবে। সেটা করা যাবে না৷ তাই আড়চোখে তাকাতে লাগলো৷ এমন আড়চোখের খেলা খেলতে খেলতে ম্যারেজহলে পৌঁছে গেলো তারা৷ উজান নিজের গাড়ি নিজেই পার্ক করে। শখের গাড়ির ক্ষেত্রে অন্য কাউকে একটুও ভরসা করে না৷ তাই নোঙর নামলেও সে না নেমে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছিলো। নোঙর গাড়ি থেকে নেমে আবার ফিরে আসলো। তাকে ফিরে আসতে দেখেই মুচকি হেসে চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করলো। নোঙর একপলক পেছনে থাকা গার্ডের গাড়ির দিকে তাকিয়ে একটু ঝুকে জানালায় ঠকঠক করে আওয়াজ দিলো৷ উজান জানালা খুলতেই নোঙর বিচলিত গলায় প্রশ্ন করলো,

–আমার ক্রাশ কোথায়?

উজানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো,

–ক্রাশ?

–হ্যাঁ, ওই বডিগার্ডটা। সে কোথায়?

উজানের মুখ থমথমে হতে এক মূহুর্তকাল সময়ও লাগেনি। গম্ভীরমুখে বললো,

–তার চাকরি চলে গেছে।

নোঙর ভীষণ গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলো,

–কেনো?

–পরনারীর নজর পরেছিলো তার দিকে। তাই তার বউ এই চাকরি করতে দেয়নি।

বলেই সুইচ টিপে জানালা বন্ধ করে দিলো। নোঙরকে আর একটা কথাও বলতে না দিয়েই থমথকে মুখেই গাড়ি স্টার্ট করে সাঁই করে চলে গেলো। গেলো! এতোক্ষণের এতো ভালো লাগা মূহুর্তেই ধুলোয় মিশে একাকার হয়ে গেলো। আর সেটা আরো অনেক রাস্তা যাওয়ার পর উজানের বোধগম্য হলো। সব থেকে বেশি বোধগম্য হলো, সে গাড়ি পার্ক করার বদলে গাড়ি ছুটিয়ে না জানি কোথায় চলে যাচ্ছিলো!
নোঙর মনে মনে সাংঘাতিক শান্তি পেলো। তার প্রশংসা করার সময় মুখ দিয়ে কথা বের হয় না আর নিজের প্রশংসা শুনতে খুব ভালো লাগে! নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি আর পরের বেলায় চিমটি কাঁটি! এখন দেখো কেমন লাগে! হুহ!

প্রশংসার ব্যাপারটা উজান আর নোঙরের বেলায় শেষ হলেও রাশা আর উষিরের তো বাকিই ছিলো৷ আর সেটা বাকি থাকলে চলবে নাকি! উষির তো এটা একদম সহ্য করবে না। অনুষ্ঠানের ব্যস্ততার এক ফাঁকে কাপল ফটোশ্যুটের বাহানায় রাশার কাছে আসলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললো,

–ইউ’র লুকিং সো প্রিটি।

–থ্যাঙ্কিউ।

নোঙরের মতো উষির নিজের প্রশংসার প্রত্যাশা করেনি, তাই এমন কাটখোট্টা জবাবে আশাহত হলো না। উলটে আরো উৎসাহিত হয়ে বললো,

–তোমাকে দেখে একটা গান মনে আসলো।

–আচ্ছা! কি গান?

রাশা তার দিকে ফিরে ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলো। উষির মিষ্টি করে হেসে গলা খাঁকারি দিয়ে নিচু স্বরে গাইলো,

“তোর কাজল কালো চোখ, তোর ঝুমকো কানের দুল
ঢাকাই শাড়ী পড়ে তোকে লাগছে বিউটিফুল”

উষিরের গলার স্বর বেশ ভালো৷ কণ্ঠে মানালোও ভালো৷ রাশার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো৷ তারপর বেশ নাটকীয় সুরে বললো,

–পরের কলিটা বলো?

উষিরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো৷ আর একটা কথাও না বলে মূহুর্তেই পা ঘুরিয়ে অনুষ্ঠানে মিশে গেলো। একটু পর আবার আসলো সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে৷ তাদের দেখেই রাশা ফিসফিস করে বললো,

–এগুলো তোমার চ্যালা নাকি? চামচাদেরও চামচা আছে তাহলে।

উষির ভয়ংকর দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকালো। বউ হয়েছে তো কি হয়েছে! তার মানে এটা তো না যে তার পলিটিক্স সম্পর্কে যা খুশি বলবে! রেগে গেলেও সবার সামনে বউকে কিছু বললো না। আবার রেখে চলেও গেলো না। বিয়ের পর থেকে কোন পুরুষমানুষকেই তার বিশ্বাস হয় না। অবশ্য তার নিজের উপর খুব বিশ্বাস আছে৷ তাই বউকে কাছ ছাড়া করতে চায় না। থমথমে মুখে তার সঙ্গীদের মধু ঢালা কথা সহ্য করে তাদের নিয়ে তবেই সেখান থেকে চলে গেলো। রাশা আবার একা হয়ে গেলো। মাঝখানে নোঙর এসেছিলো। সাথে ছিলো অন্তু। অন্তুর হাতে কাবাবের প্লেট। রাশাকে দেখে গোলগাল মুখটা মূহুর্তেই লাল হয়ে উঠলো৷ ছবি ওঠার সময় লজ্জার কারনে মুখ তুলতে পারলো না। এরপর আবার একা!

উজান রিসেপশনের অনুষ্ঠানে ঢুকেই এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে নোঙরকে খুঁজতে লাগলো। পেছন থেকে উষির বলে উঠলো,

–বাড়িতে একটু বেশিই মশার আনাগোনা বেড়েছে দেখছি।

উজান মুখ বেঁকিয়ে পাল্টা জবাব দিলো,

–এখন তো তোমার ঘরেও মশার নিয়মিত যাতায়াত চলে।

–যে মানুষ চুমু আর মশার পার্থক্য বোঝে না তার পিছে ঘুরঘুর করতে বয়েই গেছে!

উষিরের কিছুক্ষণ আগের রাগগুলো মনে পরে গেলো। সেইসাথে বহু আগের রাগগুলোও৷ উজান শয়তানি হেসে দুই পা এগিয়ে গেলো,

–আয় তোকে একটা চুমু দেই। দেখি তুই বুঝিস নাকি।

–উজান!

উষির এক লাফে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ধমক দিলো৷ জায়গাটা মোটামুটি ফাঁকাই ছিলো। নাহলে দুইজনেরই মানসম্মান আজকে শেষ। উজান উচ্চশব্দে হেসে বললো,

–একটু কাছাকাছি থাক। তাহলে রাশা পার্থক্যটা বুঝে যাবে।

উজানের কথাটা উষিরের বেশ পছন্দ হলো৷ দ্বায়িত্ববান স্বামী হয়ে তার স্ত্রীকে এপর্যন্ত মশা আর চুমুর পার্থক্য বোঝাতে পারেনি, কথাটা মনে খুব আঘাত দেয়। পার্থক্য বোঝাতে কাছাকাছি থাকার থেকে উত্তম উপায় আর নেই। কিন্তু উষির বড়ই লাজুক ছেলে। সবার সামনে বউয়ের সাথে থাকতে তার লজ্জা করবে। তাই প্ল্যানটা আপাতত ক্যান্সেল করে পার্টি অফিসের লোকজনের ভিড়ে চলে গেলো। তার মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরঘুর করছে। মন্ত্রীর আসার কথা। মন্ত্রীর সাথে আবার তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের জমিজমা নিয়ে সমস্যা। ব্যাপারটা সে জানে। এদের মুখোমুখি করলে যে গো’লাগু’লি একটা হবেই হবে সেটা তো জানা কথা! সেই গো’লাগু’লি কিভাবে আটকানো যায়, চিন্তা এখন সেটাই।

নোঙর পুরো হলটা সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে ক্লান্ত হয়ে পরেছে৷ একসময় একটা ফাঁকা টেবিল খুঁজে চেয়ার টেনে বসে পরলো। হাতে সবুজ রঙের কোন একটা জুস। অনেক টেস্টি। দুই গ্লাস খাওয়ার পরেও মন ভরছে না৷ তাই আরেক গ্লাস এনেছে।

–এক্সকিউজ মি?

পেছন থেকে বলা কথায় নোঙরের আড়ামে ব্যাঘাত ঘটালো। বিরক্তি মুখে পেছনে ফিরলো। পেছনের বেঁটেখাটো মোটাসোটা ছেলেকে দেখে বিরক্তি মুখেই বললো,

–জ্বি?

–এখানে বসতে পারি?

ছেলেটি হেসে বললো৷ নোঙর খেয়াল করে দেখলো, ছেলেটির দাঁতে কালো কালো ছোপ। চোখও লাল লাল। ক্রমাগত নেশা করলে এমন হয়। গা শিউরে উঠলো তার। তারপরও মৃদু মাথা নেড়ে বললো,

–অবশ্যই।

অবশ্যই কথার সাথে সাথেই ছেলেটি তার পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো। নোঙরও তক্ষুনি উঠে পরলো৷ ছেলেটি বিষ্মিত হলো খুব,

–আপনি উঠছেন যে?

–আমার কি বসে থাকার কথা ছিলো?

বিষ্মিত হলো নোঙরও। ছেলেটি চটপট উঠে পরলো,

–না সেটা না। কিন্তু আমি তো অনুমতি নিয়েই বসলাম। আপনার যদি অসুবিধা থাকে তাহলে আমি যাচ্ছি।

–দেখুন, এটা তো আমার পারসোনাল প্রপার্টি না তাই এখানে যে কেউ বসতে পারবে। কিন্ত আমি যে সেখানেই বসে থাকবো সেটা তো বলিনি। আপনি বসেছেন, বসুন। আমার সময় শেষ, তারজন্য আমি যাচ্ছি।

এই লম্বা লেকচারের পরই পা ঘুরিয়ে চলে গেলো। মুখোমুখি পরলো উজানের। উজান দূর থেকে দুইজনকে একসাথে কথা বলতে দেখেছিলো। ছেলেটি আসলেই ভালো না। আত্মীয় জন্য বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছে। আর চলেও এসেছে। আর এসেই তার বউয়ের দিকে নজর! কি সাহস!
নোঙরের সাথে তার ছোটখাটো একটা ধাক্কা লেগেছিলো৷ ফলস্বরূপ জুস ছিটকে নোঙরের শাড়িতে পরেছে। দোষটা তারই ছিলো বেশি। কোনদিকে না তাকিয়ে প্রায় দৌড়েই জায়গা ত্যাগ করতে গেছিলো আর তাতেই এই কান্ড হলো৷ তবে নিজের দোষ স্বীকার করলে তো হয়েই গেলো! গাড়ির রাগ আর ছেলেটির উপর হওয়া রাগ উজানের উপরই ঝাড়লো,

–তোমার কি আমাকে দেখে হিংসা হচ্ছে?

উজান বিষ্মিত হলো আবার রেগেও গেলো। কোমড়ে হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে বললো,

–হিংসা! তাও তোমাকে দেখে? তোমাকে হিংসা করার একটা রিজন বলো শুনি?

–অনেক রিজন আছে। যেমন ধরো, আমাকে তোমার থেকে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। দেখো, সবাই কেমন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে আমার দিকে। হিংসা করবে না বুঝেছো। আমার মতো সুন্দর বউ পেয়ে তোমার আরো গর্ববোধ করা উচিৎ।

একেই বলে, নিজের ঢোল নিজেই পিটানো৷ বর হয়ে প্রশংসা করলো না তো কি এমন হয়ে গেলো! সে নিজের প্রশংসা নিজেই করে ফেললো। কথাটা বলে বুকের ভার মুক্ত করে গটগট করে চলে গেলো। উজান রাগতে গিয়েও হেসে ফেললো। মেহজাবিন হাসিটা দেখে ফেললো। তার বিয়ের খবর সে জানে না। উষির চলে গেলেও উজান আছে ভেবে নাচতে নাচতে তার কাছে এসে একবারে গায়ের উপর পরে গেলো। দৃশ্যটা দেখলো নোঙর৷ রাগের থেকে দুঃখ পেলো বেশি। কাজলরাঙা চোখ পানিতে ভরে গেলো। বার কয়েক নাক টেনে পানি আটকানোর চেষ্টা করেও যখন পারলো না তখন অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো। সাথে অপলা আর অন্তুকে নিতে ভুললো না।

রাশার বাড়ি থেকে লোকজন আসলো অনুষ্ঠানের শেষের দিকে। কয়েক গাড়ি ভর্তি শুধু মানুষই। যার তিন ভাগের দুই ভাগ গার্ড৷ সেই দুই ভাগের এক ভাগের হাতে ব’ন্দুক, আরেকভাগের হাতে ডালা সাজানো। বাড়ি থেকে কোন মেয়ে আসেনি৷ শুধু ছেলেরা এসেছে৷ তাও মাত্র চার পাঁচজন। তারা আসার পরপরই সমস্ত ক্যামেরা বন্ধ করিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিলো। ক্যামেরার প্রতিটি ক্লিক এখন তাদের অনুমতি নিয়ে হচ্ছে। উষিরের ভাগ্য ভালো ছিলো তাই মন্ত্রী আর সাংবাদিক, সকলেই তার শ্বশুরবাড়ির মানুষজন আসার আগেই চলে গেছে। নাহলে সত্যি সত্যি একটা হাঙ্গামা হওয়ার আশঙ্কা ছিলো। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসার পরপরই অবাক হয়ে দেখলো, ছটফট আর বিরক্ত নিয়ে চলা রাশা একদম চুপ করে গেলো। একটু সোজা করে বলতে গেলে, হুলো বিড়াল থেকে মেনি বিড়াল হয়ে গেলো। যে যা বলছে তাতেই মুচকি হেসে উত্তর দিচ্ছে। উষির অবাক হলেও হেসে ফেললো। রাশার এই রুপটা তার দারুন পছন্দ হয়েছে।
রাশার বাড়ির লোকজন যেই গতিতে এসেছিলো, সেই গতিতেই ফিরে গেলো। মাঝে থাকলো বড়জোর পনেরো মিনিট। কিছু খেলো না পর্যন্ত রেখে গেলো একটা লম্বা বিলাসবহুল গাড়ি। সকালে নব্য পতিপত্নীদের নিয়ে এই গাড়ির ফিরে যাবে নিয়ম রক্ষা করতে। আবসার সাহেব, শাহিদা আর মাহফুজা নতুন আত্মীয়র ব্যবহারে দারুন অপ্রস্তুত হয়েছিলো। তাদের আত্মীয়ের সামনে একেবারে নাক কেঁটে গেলো। অনুষ্ঠানের বাকি সময়টুকু তাদের কেমন গেলো, তা শুধু তারাই বলতে পারবে।

উষির আর রাশার জন্য বাসরঘর সাজানো হয়েছে কাঁচা রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুল দিয়ে। লেট করে হলেও সাজানো বাসরঘর থেকে বেশ উৎফুল্ল হলো উষির, আর বিরক্ত হলো রাশা। তার প্রচন্ড মাথা ধরেছে। এখন একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে একটা লম্বা ঘুম দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। সাজগোজ খুলে লম্বা শাওয়ার নিলো তো বটে কিন্তু ঘুমানোর আগেই উষির এসে হাজির৷ বেচারা বউকে একটু শান্তিতে দেখতে পর্যন্ত পারেনি। দেখার আশায়ই এসেছিলো৷ সাজগোছ খুলে ফেলেছে সেখে আশাহত হলো। বেশ হম্বিতম্বি করে বললো,

–তুমি চেঞ্জ করলে কেনো? জানো না, স্বামীকে না দেখানো পর্যন্ত সাজগোছ খুলতে হয় না।

–হাজারখানেক যে ছবি তোলা হলো, ওর মধ্যে থেকে একটা নিয়ে বসে বসে দেখো যাও।

প্রচন্ড এই মাথা ব্যাথায় কথা বলতেও বিরক্ত লাগছে। ঝগড়া করা তো দূরের কথা। উষির রাশার অবস্থা দেখে অসুস্থতার কথাটা আন্দাজ করলো৷ কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে মৃদু স্বরে বললো,

–মাথা ব্যাথা করছে?

রাশা চোখ বুজে মাথা নাড়লো। উষির দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাজানো গোছানো বাসরঘরের দিকে তাকালো। সুগন্ধি মোমের জন্য বেশি মাথা ব্যথা করছে মনে করে সেগুলো সরিয়ে ফেললো। রাশা ততক্ষণে শুয়ে পরেছে। উষির নিজের কাজ শেষে রাশার পাশ ঘেঁষে শুয়ে তার পাশ ফিরে রাখা মাথার উপর নিজের মাথা রেখে চোখ বুজলো। অল্প অল্প কষ্টও পাচ্ছে সে। সাজানো গোছানো বাসরে আজ তার বাসরই হলো না। বউ অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে। মাথায় চাপ লাগায় খানিক আড়াম পেলো রাশা। উষিরের হাতের উপর হাত রেখে মৃদুস্বরে বললো,

–ঘুমিয়ে পরো। কাল নর’কের ভেতর যেতে হবে।

উষির চমকে উঠে রাশার দিকে তাকালো। রাশার নিঃস্বাস ভারি হয়ে গেছে। অর্থাৎ সে ঘুমিয়ে পরেছে। নিজের বাড়িকে নরক বললো কেনো! একটু নাহয় রক্ষণশীল, নাহয় একটু বেশিই রক্ষণশীল। তাই বলে নিজের বাড়িকে নরক হয়! হয় হয়। উষির জানে সেটা। অনেক সময় নিজের বাড়িও নরক হয় যখন সেখানে জীবনের সব থেকে বেশি কষ্টটা পাওয়া হয়। তাহলে কত কষ্টই না সে পেয়েছে। মায়া হলো তার। রাশার নরম গালে কয়েকটা চুমু খেয়ে সিদ্ধান্ত নিলো, কোনদিন সে রাশাকে কষ্ট দেবে না। তার কষ্ট হলেও কষ্ট দেবে না।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-২৭+২৮

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৭

উষির তার বউকে ছাড়া থাকবে, সেটা তো হতেই পারে না৷ তাই বনে বাদারে ঘুরে সন্ন্যাসী হওয়া ক্যান্সেল করে রাত আটটার মধ্যে কাজ টাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আসলো। আর আসবে নাই বা কেন! বউয়ের টান বলেও তো একটা কথা আছে৷ ঘরে বউ রেখে কি আর বাইরে মন বসে!
উষির বউয়ের টানে ফিরলেও রাশা বরের টানে মোটেও তার মুখোমুখি হলো না। উষির ঘরে থাকলে রাশা লিভিংরুমে বসে শাশুড়িদের সাথে টিভি দেখে, আবার উষির সেখানে হাজির হলে সে উঠে যায় বন্যা বৃষ্টিকে পড়ায় সাহায্য করতে৷ এখন ছোট বোনদের মাঝে গিয়ে তো বউকে আনা যায় না৷ চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে। তাই মুখ গুজে নিজের ঘরেই পরে রইলো। ঘরে থেকেও চুপ করে রইলো না। একজন কর্তব্যপরায়ণ স্বামী হিসেবে বউকে রোম্যান্টিসিজম শেখানোটা তার মৌলিক দ্বায়িত্ব। তাই খুঁজে খুঁজে বলিউডের বেশ কয়েকটা নতুন পুরাতন রোম্যান্টিক মুভির লিস্ট তৈরি করলো। হলিউডের মুভি সেই লিস্টে জায়গা পায়নি৷ সে অতি লজ্জাশীল পুরুষ৷ বউয়ের সাথে হলিউডের মুভি দেখতে লজ্জা লাগবে৷ তাই ওটা ক্যান্সেল। মুভির লিস্ট তৈরি করার পর বেশ উৎসাহ নিয়ে রাশার অপেক্ষা করলো। ঘড়িতে তখন সারে দশটা বাজে। উষিরের মুভি দেখার আয়োজন করা শেষ। সুন্দর দেখে একটা পাতলা কম্ফোর্টার আর বেশ কয়েকটা রঙিন কুশন সোফাতে সাজিয়ে রেখেছে। কিছু আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার এলোমেলো ভাবে সোফা টেবিলের উপর রেখেছে। সব শেষে খাবার এনে ওখানে রাখবে। লিস্টের কোন মুভি আগে দেখবে সেটাও লিস্ট করে রেখেছে। রাশা আসলো রাতের খাওয়ার পর। এসে এসব সাজগোছ দেখে ভ্রু বেঁকিয়ে উষিরের দিকে তাকালো। উষিরের ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা থাকলেও বাইরে খুব গম্ভীর হয়ে রইলো। রাশার তাকানো দেখেও ভাবান্তর হলো না। আগের মতোই সোফার দুই পাশে দুই হাত উঁচু করে রেখে আর্টিফিশিয়াল ফুল রাখা টেবিলের উপর দুই পা তুলে বসে রইলো। রাশা শব্দ করে শ্বাস ফেলে উষিরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো,

–তোমার যদি লেট নাইট টিভি দেখার প্ল্যান থাকে তাহলে আগেই বলে দাও, আমি বন্যা বৃষ্টির রুমে যাচ্ছি।

উষির পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলো। শার্টের কলার ঠিক করে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

–ইতিহাস বলেছে, মিসেস আদনান একদম রোম্যান্টিক না। তাই তাকে রোম্যান্টিক বানানোর দ্বায়িত্ব মিস্টার আদনানের। সো, আজ সারারাত আমরা দুইজন রোম্যান্টিক মুভি দেখে তোমাকে রোম্যান্টিসিজম শেখাবো৷

রাশা ভ্রু বেঁকিয়ে তাকিয়ে হাত ভাজ করে বললো,

–তা এর মাঝে কোন কোন অ্যাডাল্ট মুভির জায়গা হয়েছে?

উষিরের মুখ রাঙা হয়ে উঠলেও প্রকাশ করলো না। ধমক দিয়ে বললো,

–মাথার মধ্যে সবসময় উল্টাপাল্টা চিন্তা ঘুরঘুর করে নাকি? আমি সুশীল, সামাজিক, ফ্যামিলি পার্সোন। আমার বউ আমার সম্পর্কে এমন ধারণা রাখে, সেটা বাইরের মানুষ জানলে কি ভাববে? কথাবার্তা, পরিস্থিতি, আচার-আচরণের মধ্যেও রোম্যান্টিসিজম আছে। সেটা ভুললে চলবে না। এই ভদ্র উষির তার বউয়ের সাথে বসে অ্যাডাল্ট মুভি দেখবে! ছি ছি ছি!

বেশ নাটকীয় ভাবে বললো উষির। রাশা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

–তাহলে কি একা একা দেখবে?

উষিরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। তারপর আগের থেকেও জোরে ধমক দিয়ে বললো,

–কিচেন থেকে স্ন্যাকস নিয়ে এসো। আমি এতো কাজ করে ক্লান্ত। বাকি কাজ তোমার।

রাশা হাই তুললো। অলস পায়ে উষিরের স্টাডি টেবিল পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে একটা মোটা বই হাতে নিয়ে আবার তার কাছে ফিরে বই বাড়িয়ে দিয়ে ধরলো। উষির ভ্রু কুঁচকে বইয়ের দিকে তাকালো। বইয়ের নাম,

“আইকিউ বাড়ানোর নিঞ্জা টেকনিক।”

উষির সাংঘাতিক রেগে গেলো। আবার! আবার সেই একই কাজ! তার অ্যাবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন! চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ক্রোধ মিশ্রিত স্বরে বললো,

–তুমি আমার রেজাল্ট জানো? সবসময় টপ করতাম আমি। গ্র‍্যাজুয়েশনেও কয়েক পয়েন্টের জন্য টপ করতে পারিনি। পুরো গোল্ডেন সার্টিফিকেট আমার।

রাশা মোটা বইটা উষিরের হাতে তুলে দিয়ে বললো,

–আউট নলেজ না থাকলে ওইসব সার্টিফিকেটের বড়াই করে লাভ নাই। প্রতিদিন দশ পৃষ্ঠা করে পড়বে।

উষির বইটা শক্ত হাতে ধরে চোখ মুখ লাল করে বললো,

–তুমি আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করছো রাশা?

ক্রোধে জর্জরিত ভয়ংকর কণ্ঠস্বর ছিলো তার। রাশা পাত্তাই দিলো না। হাই তুলে বললো,

–আরেকটা রিডল বলছি। দেখি পারো নাকি! এক বাড়িতে পাঁচটা বোন ছিলো। পাঁচ বোনের মধ্যে হিয়া রান্না করছিল, মনা ইস্ত্রি করছিল, টিয়া দাবা খেলছিল, প্রিয়া হোমওয়ার্ক করছিল, তাহলে শুভা কি করছিল?

উষির উত্তর দিলো না। থমথমে মুখে শক্ত হয়ে সোফায় বসে পরলো। রাশা ঠোঁট টিপে হাসলো। সারাদিন দৌড়ঝাঁপ পারায় প্রচন্ড ক্লান্ত সে। নরম বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিতেই শান্তিতে চোখ বুজে আসলো৷ উষিরের মনে হলো বইটা ছুড়ে ফেলে দিক। কিন্তু পরক্ষণেই বুকে জড়িয়ে ধরলো। বউয়ের থেকে পাওয়া প্রথম উপহার এটা। যা খুশি না হয় হোক, তাতে কিই বা যায় আসে। তবে রাশার শান্তি তার সহ্য হলো না। তাকে সেই সকাল থেকে অপমানের উপর অপমান করে এখন শান্তিতে শুয়ে পরেছে! একজন সফল নেতা হিসেবে বিরোধীদলীয় কাউকে শান্তিতে রাখলে সফল নেতার ঘুম কিছুতেই আসবে না। তাই গলা উঁচিয়ে বললো,

–তোমার সৌরভ তো এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত মুখ।

রাশা চট করে চোখ খুলে ধপ করে উঠে বসে তার দিকে তাকালো। চোখে বিষ্ময় আর প্রশ্ন একসাথে খেলা করছে। উষির শয়তানি হেসে ফোন আর বই হাতে রাশার পাশাপাশি বসে নিজের ফোন তার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। ফোনে নিউজটা দেখেই রাশার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো। শকিং নিউজটা হলো, সৌরভ এখন বিবাহিত। আর কিভাবে বিবাহিত হলো, সেটা আরো বড় শকিং নিউজ। শহরের ভদ্র একটা এলাকায় গোপনে একটা কুখ্যাত নাইটক্লাব তৈরি হয়েছিলো। কথাটা জানাজানি হওয়ায় সেখানকার ভদ্র এলাকাবাসীরা প্রচন্ড খেপে প্রতি জোড়ায় জোড়ায় বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, তাদের মধ্যে সৌরভও ছিলো।

নিউজ পরে বেশ রেগে গেলো রাশা। তেঁতে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–সৌরভ অনেক ভালো আর ভদ্র ছেলে৷ নাইট ক্লাব কি, ও তো কোনদিন কোন ক্লাবেও যায়নি। আর এই কাজটা! এমন কাজ কোন বিবেকবান কেউ করতেই পারে না। এসব আবার কি ধরনের কথা হলো! নাইটক্লাবে দেখলাম আর বিয়ে পরিয়ে দিলাম। মানে বিয়ে হলেই মানুষ ভদ্র হয়ে যায়! তারপর আর কিছুই করে না! এসব ইচ্ছে করে করা। দে যাস্ট ডিড ইট টু মেক আ জোক। রিডিকিউলাস!

উষির ভ্রু কুঁচকে রাগী গলায় বললো,

–জেলাসি হচ্ছে নাকি?

রাশা রেগে উষিরের দিকে তাকালো। কিছু বলতে চাইলো কিন্তু ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

–এসব তুমি করেছো তাই না? একজন মানুষের সম্মান কতটা ইম্পর্ট্যান্ট তা জানো তুমি? তুমি ওর সম্মান নিয়ে খেলেছো উষির। হ্যাভ ইউ এনি আইডিয়া, তুমি কি করেছো? হাউ কুড ইউ ডু দ্যাট উষির!

রাশা দুই হাত দিয়ে নিজের কপাল চেপে ধরলো। উষিরের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। নিজের চুলে হাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করে আড়াম করে বসে বললো,

–আর ও যে আমার সম্মানের দিকে হাত বাড়িয়েছিলো? আমার সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেললো, তার বেলা?

–তোমার কি সম্মান নিলো?

–আমার বউ নিতে চেয়েছিলো। বউ তো সম্মানই তাই না?

রাশা থমথমে মুখে উষিরের দিকে তাকালো। বইয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া উষিরকে দেখে মনে হলো, তার আর অন্য কোনদিনে নজর দেওয়ার সময় নেই। আর না দেবে৷ দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে ধাপ করে শুয়ে পরলো। কম্ফোর্টার দিকে মাথা ঢেকে শক্ত গলায় বললো,

–লাইট অফ করো?

উষির বইয়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই শান্ত গলায় বললো,

–পড়বো আমি। সো, লাইট জ্বলবে।

রাশা কম্ফোর্টার মাথা থেকে সরিয়ে চোখ গরম করে উষিরের দিকে তাকালো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে তার থেকে মনোযোগী স্টুডেন্ট আর একটাও নেই৷ রাশা বড় করে শ্বাস ফেলে ধমকের সুরে বললো,

–ওকে। বেস্ট উইসেস!

বলেই বেড সাইট ড্রয়ার থেকে স্লিপিং আই ক্যাপ বের করে চোখে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। উষির থমথমে মুখে সেদিকে তাকিয়ে বইটা ঠাস করে বন্ধ করে লাইট বন্ধ করলো। তার বেলায়, বিয়ে করে নিয়ে আসো আর সৌরভের বেলায়, বিয়ে করলো কেন! সাংঘাতিক হিপোক্রিট এই বউয়ের উপর সে প্রচন্ড রেগে আছে। গিজগিজ করতে করতে পণ করল, আজকে আসুক কাছে৷ একদম ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দেবে। কিন্তু উষির কি আর সেটা পারে! শুয়ে পরার ঘন্টাখানেক পর রাশাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজেও ঘুমিয়ে পরলো। উষিরের রাগ গেলো নদীতে পরে গেলো৷ একমাত্র এখানে এসেই যে তার রাগ নাই হয়ে যায়। কি এক সমস্যা!

*****
উজান আসলো আরো দুইদিন পর৷ ততদিনে নোঙরের হাল বেহাল। রুপচর্চা করতে মন চায় না, খেয়ে মন চায় না, কথা বলতে মন চায় না, সাজতে মন চায় না ইত্যাদি ইত্যাদি! এই এতোদিনে একটাবারের জন্যেও উজান তার খোঁজ নিলো না! কি পাষা’ণ, নি’ষ্ঠুর! মনে মনে রেগেও ছিলো এই নিয়ে। তবে তাকে অফিসে দেখেই মন প্রফুল্ল হয়ে গেলো। সেদিন পুর্বের সকল রেকর্ড ভেঙে সারে নয়টার মধ্যে অফিসে এসেছিলো সে। আর সেদিনই পরে এসেছিলো তার সব থেকে অপছন্দের ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের লং শার্ট। গলায় ছিলো সব থেকে অপছন্দের বাহারি রঙের স্কার্ফ। নিজের কাজের প্রতি নিজেই রেগে গেলো। কি দরকার ছিলো এমন পোশাক পরার৷ নিজের শোককে জাহির করার কি কোন দরকার আছে! কেউ কি আর তার শোক নিয়ে ভাবে!

উজান এসেই তাহেরকে দিয়ে নোঙরকে ফাইলসমেত ডেকে পাঠালো। সেখানে যাওয়ার আগে তার তো একটু ঠিকঠাক হওয়া দরকার। তাই তার সাতশো টাকার লেদারের হোবো হ্যান্ডব্যাগ থেকে প্রথমে আয়না তারপর লিপিস্টিক আর কমপ্যাক্ট পাউডার বের করলো। আয়না মুখের সামনে ধরেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আজ কতদিন হলো রুপচর্চা করে না! এই অবস্থায় এখন উজানের কাছে যাবে! তার সম্মান কই থাকবে! মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো। তবে নোঙর খন্দকারকে তো আর অসম্মান করা যায় না। তাই তাকে সম্মানিত করতে মুখে পাউডার মেখে একটু লিপস্টিক লাগালো। এমন ভাবে লাগালো যাতে বোঝা না যায়৷ তারপর কাজলের কথা মনে পরলো। ব্যাগ হাতরে কাজল না পেয়ে পাশের ডেস্কে বসা মমোর দিকে উঁকি দিলো। মমো তখন মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। কাজলের কথায় ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বললো,

–কাজল তো নেই৷ তুমি কি করবা?’

মনে মনে বিরক্ত হলো নোঙর৷ কাজল দিয়ে মানুষ করেটা কি!

–আঁকাবো। একটা ইম্পর্ট্যান্ট ড্রয়িং করছিলাম। কাজলের অভাবে কমপ্লিট হচ্ছে না।

–কি ড্রয়িং? দেখবো।

উঁকি দিতে চাইলো মমো। নোঙর দুই হাত দিয়ে টেবিল আড়াল করে বললো,

–কাজল দিয়ে কমপ্লিট করে তারপর দেখাবো। এখন না।

হতাশ হয়ে মাথা নাড়লো মমো। তারপর নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। অপরদিকে নোঙরের প্রচন্ড মন খারাপ হলো। কাজল ছাড়া আবার সাজ কমপ্লিট হয় নাকি! তার উপর ড্রেস! আজ বাড়িতে গিয়েই ড্রেসটা পুড়িয়ে ফেলবে!
ঝুঁটি করা চুলগুলো খুলে ব্যাগ খুঁজে ক্ল্যাচার বের করে অর্ধেক চুল বেঁধে ফেললো৷ তারপর সব জিনিস ব্যাগে পুরে বড় করে শ্বাস নিয়ে ফাইল হাতে চললো উজানের কেবিনে।
উজানকে দেখে নোঙরের চোখ জুরিয়ে গেলো। কালো ব্লেজারে কি অসাধারণই না দেখাচ্ছে৷ তার চোখে তো অসাধারণই লাগছে৷ বাকিদের খবর জেনে তার কি লাভ! ইচ্ছে হলো, একবার কেমন আছে জিজ্ঞাসা করুক। আমার মন বাঁধা দিলো। বললো, আগে সামনের জনকে বলতে দে। তারপর তুই বল।

উজান জমে থাকা ফাইল দেখছিলো। নোঙরের আগমন টের পেয়ে মাথা তুলে তাকালো। পাঁচটা ফাইল হাতে ভ্যাবলার মতো তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছোট ছোট চোখগুলো কুঁচকে বললো,

–হোয়াট হ্যাপেন্ড? এমন স্টাক হয়ে গেছো কেনো? আজ কি বসার জন্য ইনভিটেশন কার্ড পাঠাতে হবে?

অন্য সময় হলে নোঙর মুখের উপর জবাব দিয়ে বসতো। কিন্তু এখন সে তার তীব্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে৷ এমন সুখ সুখ অনুভূতির সময় কারো সাথে তর্কে জড়াতে ইচ্ছে হয় না৷ তাই চুপচাপ হজম করে নিলো। যদিও হজম করতে কষ্ট হয়েছে খুব, তাও হজম করে চেয়ার টেনে বসে পরলো। আর যেনো কষ্ট না হয় কিংবা আগের কষ্টটা খানিক লাঘব যাতে হয় তাই টেবিলের উপর ধপ করে ফাইল রেখে দিলো৷ উজান শব্দ শুনে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার ফাইলে মনোযোগ দিলো। নোঙরের ভারি মন খারাপ হলো৷ এতো কষ্ট করে সেজে গুজে এসেছে অথচ তার কয়েকদিনের পুরোনো বর একবারও চোখ তুলে তাকালো পর্যন্ত না! এখনও গা দিয়ে বিয়ে বিয়ে গন্ধ যায়নি। আর এই কয়েকদিনেই এতো বিতৃষ্ণা! সামনের দিনগুলো তো পরেই আছে! আহারে! বিবাহিত জীবন কি কষ্টের!

অনেকক্ষণ পরেও যখন উজান কিছু বললো না তখন নোঙর গলা খাঁকারি দিয়ে ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললো,

–এইযে তোমার গুপ্তধন। অনেক কষ্টে সব কমপ্লিট করেছি।

–আর ইউ সিওর এটা তোমারই কমপ্লিট করা?

ফাইলে চোখ রেখেই উজান প্রশ্ন করলো। নোঙর পুরো কনফিডেন্সের সাথে উত্তর দিলো,

–এক হাজার পার্সেন্ট সিওর। আকাশ বাতাস সাক্ষী।

–তোমার আকাশ বাতাস তোমার মতোই মিথ্যা কথা বলে। আই হ্যাভ এনাফ প্রুভ। তুমি এগুলো কমপ্লিট করোনি।

নোঙর নাকে কেঁদে বললো,

–মিথ্যা অভিযোগ দেবে না বলছি!

উজান কিছু না বলে স্থির দৃষ্টিতে নোঙরের দিকে তাকিয়ে টেবিলে রাখা মনটর তার দিকে ঘুরিয়ে দিলো। মনিটরে দৃষ্টি দিয়েই নোঙরের শরীর বেয়ে শিহরণ খেলে গেলো৷ তার মানে তার সাজগোছও দেখেছে! কি ভয়ংকর!

–তুমি আমাদের উপর নজর রাখো?

–তোমার মতো অফিসচোর থাকলে নজর তো রাখতেই হয়। কিছু করার নেই।

নোঙরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। উজান ঠোঁট টিপে হাসি আটকে অত্যান্ত সিরিয়াস ভাবে বললো,

–তুমি না চাকরি ছেড়ে দিলে?

ফুঁসে উঠলো নোঙর। পুরোনো ঘায়ে খোঁচা পরলে যে কেউ ফুঁসে উঠবে। এতে তার কোন দোষ নেই। সুখ সুখ অনুভূতিরা কোথায় যে মিলিয়ে গেলো! হয়তো ভয় পেলে পালিয়ে গেলো। হাজার হলেও নোঙর খন্দকারের ফার্স্ট প্রায়োরিটি প্রতিশোধ নেওয়া।

–তুমি…তুমি এক নম্বরের দুই নাম্বারি করা লোক। লোকের টাকা মেরে খাওয়া তোমার স্বভাব।

উজানের চোখ কপালে উঠে গেলো,

–এসব কথা কোথা থেকে শিখেছো?

–তোমার মাথা থেকে।

নোঙর ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলেই উঠে চলে গেলো৷ আজ এখানে তার কতো অপমান হলো! এতো অপমান সহ্য করা যায় নাকি! দুই পা যাওয়ার পর উজান পিছু ডাকলো৷ নোঙর অভিমানী চোখে পিছু ফিরলো। মনে মনে ভাবলো হয়তো বলবে, আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে নোঙর। কিন্তু তার আশার গুড়ে বালি পরতে সময় লাগল না৷ তার গায়ের জ্বালা আর অপমানের পারদ বাড়িয়ে উজান নিজের কপালের ডান সাইডে আঙুল দেখিয়ে বললো,

–এখানে পাউডার লেগে আছে। মুছে নাও৷

নোঙর এবারে কেঁদেই ফেললো। চোখের পানি গাল বেয়ে পরার সাথে সাথে চোখের পানি মুছে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যেতে যেতে কপালের পাউডার তো মুছলো। সাথে উজানকে হাজার কথা শুনাতে আর খট করে সর্ব শক্তি দিয়ে দরজা লাগাতে ভুললো না।

নোঙর আর উজানের আবার দেখা হলো অফিস ক্যাফেতে। নোঙর তার নিজের জন্য কফি বানাতে এসেছিলো। সে যাওয়ার পরপরই উজানও সেখানে আসলো৷ নোঙরের রাগ তখন একদম নেই। কোন এক অজানা অনুভূতি উজানের উপর হওয়া রাগ গ্রাস করে নিয়েছে। বরং তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হলো খুব।

–তুমি এখানে! কফি খেতে এসেছো নাকি?

উজান বিরক্ত হয়ে ব্যাজার মুখে বললো,

–না তোমাকে দেখতে এসেছি।

–আগে বলবে না? আজকে তো ফেসিয়ালও করিনি।

বলতে বলতে পিছন ঘুরে আয়নার মতো ঝকঝকে কিন্তু ঝাপসা টাইলসের দেওয়ালে নিজের চেহারা দেখতে লাগলো। মনে মনে বললো, কতদিন হলোই তো করি না!

–এমনিতেই তো বাদুরের মতো উড়ে উড়ে চলো। ওসব লাগালে তো প্যাঁচার মতো মুখ ভোতা করে বসে থাকতে।

উজানের কথায় না রেগে আরো খুশি মনে বললো,

–আচ্ছা যাই হোক, আজ আমার মুড অনেক ভালো। তাই ঝগড়া ঝাটিতে আমি যাচ্ছি না। কফি খাবে তো? আমি বানিয়ে দিচ্ছি।

–আমার এতো উপকার তোমাকে করতে হবে না। আমি নিজের কাজ নিজেই করতে পারি।

নোঙর সজোরে মাথা নেড়ে কাউন্টার আড়াল করে দাঁড়িয়ে পরলো,

–বললাম না আমি বানিয়ে দিচ্ছি। এমনিতেও আমি নিজের জন্য কফি বানাচ্ছিলাম।

উজান এগিয়ে যেতে নিয়েও থেমে গেলো। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললো,

–তোমার কফির জন্য পানি গরম করার কি দরকার? খাও তো সেই ঠান্ডা করেই। ঠান্ডা পানিতেই কফি গুলিয়ে খাও।

নোঙরের কপাল কুঁচকে গেলো। কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,

–আমার যতদূর মনে পরে, তোমার সামনে তো কখনোই চা কফি খাইনি। তাহলে তুমি কিভাবে জানলে, আমি ঠান্ডা করে কফি খাই?

–তোমার মতো উদ্ভট মানুষের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যায় না। কফি বানাতে আর কয় ঘন্টা লাগবে?

সে প্রথমটায় থতমত খেলেও কৌশলে নিজেকে বের করে আনলো। হাজার হলেও নোঙর খন্দকারকে তো আর বলা যায় না, মনিটরে তার গতিবিধির নজর খুব তীক্ষ্ণভাবেই রাখা হয়!

–পানি অলমোস্ট গরম হয়ে গেছে। আচ্ছা তুমি বেশি কফি খাও নাকি কম কফি? মানে অনেকে আছে, বড় মগে কফি খায়। আবার অনেকে দুই চুমুকে কফি শেষ, এমন কাপে খায়। তুমি কোন টাইপের মানুষ?

উজান কেবিনেট থেকে নিজের কফি কাপ বের করে নোঙরের সামনে শব্দ করে রাখল,

–এইটাতে।

নোঙর কাপ নাড়াচাড়া করে বললো,

–ওহ! বেশ বড়সড় আছে। ওকে তো স্ট্রং কফি খাও নাকি লাইট কফি খাও?

–এক্সপ্রেসো। কফিমেকারে বানায়। এটাতে হবে না।

নোঙর বিরক্তিকর শব্দ করে বললো,

–ওসব বিদেশি কফি বিদেশেই রেখে আসতে হয়৷ তোমাকে খাঁটি দেশি উপায়ে কফি বানিয়ে খাওয়াচ্ছি৷ একবার খাবে আর দশবার ঢেঁকুর তুলবে।

উজান কিছুই বললো না। হাত ভাজ করে কিচেন কাউন্টারে হেলান দিয়ে এক পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পানি গরম হলে নোঙর আমতা-আমতা করে বললো,

–আমি এক্সপ্রেসো বানাতে পারি না। শুধু গরম পানিতে কফি গুলিয়ে দিলে হবে না?

–হ্যাঁ হবে। একটু স্ট্রং বানাও। তাহলেই হবে।

উজানের কথা শুনে তার মন হালকা হয়ে গেলো। দ্বিগুণ উৎসাহে বললো,

–কেমন স্ট্রং? মানে এই কাপে কয় চামচ কফি দেবো? দুই নাকি তিন?

–তিন।

নোঙর ভাবুক গলায় ঠোঁট উলটে বললো,

–হুম,ভালোই স্টং কফি খাও তাইলে! দুধ কফি নাকি ব্ল্যাক কফি?

–তোমার বানাতে হবে না। সরো, আমি বানাচ্ছি।

উজান বিরক্ত হয়ে এগিয়ে আসছিলো। নোঙর দুই হাত আগলে দাঁড়ালো,

–না, আমি বানাবো। তুমি বলো?

উজান তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

–ব্ল্যাক কফি।

–চিনি খাও? নাকি পিওর ব্ল্যাক? মানে চিনির কোন ঝমেলা নাই?

–চিনি খাই না আমি।

উজান দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর করলো।

কফি বানানো শেষে উজানকে কাপ দিতে দিতে বললো,

–নাও হয়ে গেছে। খেয়ে বলো আমি কেমন শেফ?

উজান টিটকারি দেবার ভঙ্গিতে বললো,

–শেফ! পুরোটা আমি বলে দিয়েছি।

–সেটা না হয় বলেছো কিন্তু পানি গরম করার মধ্যেও টেকনিক আছে। বেশি গরম করলে কফি সিদ্ধ সিদ্ধ লাগে। আবার কম গরম করলে একদম ভালো লাগে না। পানি পারফেক্ট গরম করলে তবেই কফির আসল স্বাদ পাবে।

নোঙর মাথা নেড়ে প্রতি উত্তর করলো। তারপর বেশ মন খারাপের ভঙ্গিতে বললো,

–বলো না কেমন হয়েছে?

–হুম ভালো।

নোঙর দাঁত বের করে হাসলো। তারপর এগিয়ে এসে উজানের সামনে হাত পেতে বললো,

–তাহলে গিফট দাও।

উজানের কপাল কুঁচকে গেলো,

–কিসের গিফট?

–বিয়ের পর প্রথম রান্না করে খাওয়ালাম। তার গিফট।

–এটা রান্না ছিলো?

নোঙর মাথা উপর নিচ করে ঝাঁকিয়ে বললো,

–আগুনের তাপে যে খাবার জিনিসই তৈরি করা হয়, সেটাই রান্না।

উজাম নোঙরের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে কিছু না বলে চলে গেলো। নোঙর মুখ ভেঙচে বললো,

–অকৃতজ্ঞ মানুষ থাকেই আলাদা।

বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে উঠতেই উজান নোঙরের দিকে একটা গিফট বক্স এগিয়ে দিলো। মৃদুস্বরে বললো,

–তোমার গিফট।

উজানের কথা শুনে নোঙরের চোখ খুশিতে ঝকমক করে উঠলো। গিফট খুলে দেখলো, সিলভার কালার চেইনের সাথে ল্যাভেন্ডার স্যাফায়ারের একটা ছোট পেন্ডেন্ড। সাথে ম্যাচিং ছোট কানের দুল। খুশিতে নোঙরের চোখ চকচক করে উঠলো। উজান বলতে পারলো না, তার জন্যই স্পেশাল অর্ডার দিয়ে এই জুয়েলারি বানানো হয়েছে। আর এই ছোট জুয়েলারি বানানোর জন্যই তার ফিরতে এতো দেরি হলো।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৮

একবার কফি বানিয়েই নোঙরের কনফিডেন্স লেভেল এখন আকাশ চূড়ায়। বর্তমানে তার প্রধান ইচ্ছে, উজানকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে। আফটার অল, সে কত ভালো একজন শেফ! এতোদিন অন্য সবাইকে রান্না খাইয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এবারে বরের পালা! প্রশংসা তো আর এমনি এমনি আসে না। একটু কষ্ট করলে, একটু খাটনি করলে তবেই না সেটি পাওয়া যায়।
নোঙর বরাবরই নিজের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এবারে দিলো। সকালে উঠে বহুদিন পর মুখে শসা আর মধুর ফেসপ্যাক লাগালো। তারপর ঘুরে ঘুরে একে একে সবাইকে জানাতে লাগলো, আজ সে রান্না করবে। তবে সেটা সবার জন্য নয়। শুধুমাত্র উজানের জন্য। যদিও উজানের কথাটা শুধু মা আর বড় মাকে জানিয়েছে। বাকিদের বলেছে, আজ সে নিজে খাবার বানিয়ে সেই খাবার অফিসে নিয়ে যাবে। নোঙরের রান্নার খবরে সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিলো অন্তু। সেই তার রান্নার সব থেকে বড় ফ্যান। কিন্তু যখন শুনলো, রান্না করে কাউকে খেতে দেবে না, সবটা নিয়ে অফিসে যাবে তখন মুখ ফুলিয়ে হুলোর কাছে গিয়ে বসে রইলো। হুলো গোলগাল লম্বা চুলওয়ালা অন্তুর দিকে গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

নোঙরের আজকের মেন্যুতে খাবার একটাই। সুজির হালুয়া। তার পরিবারের ধারণা, যে একবার ওই হালুয়া খেয়েছে সে আর সেটার টেস্ট সহজে ভুলতে পারবে না। খারাপের দিক থেকে না, ভালোর দিক থেকে। এতোটাই অসাধারণ হালুয়া সে বানায়। বহুবার বানানোতে খুব ভালো এক্সপেরিয়েন্সও আছে। হাজার হলেও বরের জন্য দ্বিতীয়বার রান্না করছে। যেটাতে এক্সপার্ট, সেটাই তো করতে হবে। তাই হালুয়াই রান্না করতে চাইলো। নোঙরের যে কোন রান্নার ফুড টেস্টার হলো অপলা। রান্নার মাঝে দুধে চিনির পরিমাণ ঠিক আছে নাকি চেক করার জন্য চামচে অল্প দুধ নিয়ে তার কাছে গেলো। ভাগ্য খারাপ ছিলো তার। ঠিক ওই সময়ই তার বড় বাবা রান্নাঘরে আসলো। নোঙরের রান্না করা হালুয়া তারও সব থেকে বেশি পছন্দের। তাই একবার চেক করতে চাইলো। চামচে করে মুখে পুরতেই মুখ কুঁচকে ফেললেন তিনি। হালুয়ায় চিনি, লবন কিচ্ছু ঠিকঠাক হয়নি। তাই চামচ ভর্তি করে লবন আর চিনি দিয়ে দিলেন। নোঙরের রান্নার হাত যেমনই ভালো, তার বড় বাবার রান্নার হাত তেমনই খারাপ। যদিও তিনি সেটা মানতে নারাজ। তার রান্না কেউ খেতে পারে না সেটা তো তার দোষের না। যারা তার রান্না খেতে পারেনা তাদের সবার টেস্টবার নষ্ট। এমনটাই তার বক্তব্য। তিনি নিজের কাজে কোনদিন গাফিলতি করে না। আজও করলেন না৷ নিজ দ্বায়িত্বে ভাতিজির রান্না আরো সুস্বাদু করে বুক ফুলিয়ে চলে গেলেন তিনি। তিনি যাওয়ার পর অন্তুর আগমন ঘটলো। বাড়িতে নতুন কিছু রান্না হবে আর সে তা পাবে না, এটা তো হতেই পারে না। হালুয়া কিভাবে খাওয়া যায়, এটা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ হুলোর সাথে আলোচনা করে এরপর খাবার চুরি করতে এসেছে।
চুলার আঁচ বন্ধ ছিলো। অন্তু ভাবলো রান্না হয়ে গেছে। আবার টলটলে দুধ দেখে মনে করলো পাতলা হালুয়া রান্না হয়েছে। সুতরাং ওটা এখন খাওয়াই যায়। বড় তরকারির চামচে দুধ তুলে মুখে দিতেই থুথু করে ফেলে দিলো। এতো জঘন্য রান্না একমাত্র বড় বাবাই করতে পারে। তার বোন করেছে সেটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হলো। ভাবলো, ঠিক করতে হবে। খাওয়ার ভিডিওর মধ্যেও একদা এক ভিডিওতে সে দেখেছিলো তরকারিতে ঝাল বা লবন অতিরিক্ত হলে আলু কেঁটে দিলে ঠিক হয়ে যায়। সাজেশন ফলো করতে চাইলো। রান্নাঘর খুঁজে আলু বের করলো। গোল আলুর বদলে সবুজ সবুজ গাছ আলু গ্রেটারে গ্রেট করে দুধের সাথে মিশিয়ে দিলো। তারপর বড় বাবার মতোই বোনকে হেল্প করার গর্বে বুক ফুলিয়ে রান্নাঘর থেকে বিদায় নিলো৷ ঘন দুধের মাঝে আলুও সুন্দরমতো মিশে গেলো।

অপলাকে দিয়ে টেস্ট করিয়ে নোঙর বুঝলো লবন, চিনি সব কম হয়েছে। পানসে লাগছে খুব। এখন আবার লবন, চিনি দিয়ে জ্বাল দিতে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। ফেসপ্যাকটা আগে তুলতে হবে। তাই আগে ঘষে ঘষে আড়ামসে ফেসপ্যাক তুলে গোসল দিয়ে রান্নাঘরে গেলো। এরপর বন্ধ চুলা জ্বালিয়ে হাফ চামচ লবন, তিন চামচ চিনি দিয়ে সুজি দিয়ে তারপর চামচ হাতে তুলে নাড়াচাড়া শুরু করলো। রান্না শেষে নামানোর আগে কিসমিস দিয়ে নামিয়ে ফেললো৷ লবণ, চিনি আর আলুর কেরামতি একবারও নজরে পারলো না তার। এমনকি একবার টেস্ট করারও প্রয়োজন মনে করলো না। ওই যে, নোঙর খন্দকারের হাই লেভেলের কনফিডেন্স!

উজান যখন অফিসে পৌঁছালো তখন ঘড়িয়ে এগারোটা বেজে গেছে। তাকে এগারোটায় ঢুকতে দেখেই নোঙর মুখ ভেঙচে বিড়বিড় করে বললো,

–নিজে লেট করলে কিছুই না। আর অন্য কেউ লেট করলেই চাকরি খাওয়ার ভয় দেখায়। দুই নাম্বার মানুষ থাকেই আলাদা!

এইদিকে যে সে কত সকালে উঠে রান্না করে কত আগে এসে বসে আছে, সেইদিকে কারো কোন খেয়ালই নেই৷ “ফালতু মানুষ” বলে আবারও বিড়বিড় করে বললো সে৷ তারপর উজানের কেবিনে গেলো। সেখানে যেতেও আবার আরেক বাঁধা। তাহের মিয়া!

স্যার সবে এসেছে, এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ইত্যাদি বলে বলে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিলো। সেও তাহেরের দিকে একটু ঝুঁকে চোখ সরু করে শাসানি দিয়ে বললো,

–স্যারের মা আমার ফুপি হয়। স্যার আমার ফুপির ছেলে। একটা কল দেবো ফুপিকে৷ তারপর দেখবো আপনার চাকরি আপনার স্যার বাঁচাতে পারে নাকি।

তাহেরের মুখ ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। হম্বিতম্বি বন্ধ হলেও নিজের ইগো ধরে রেখে বললো,

–আগে স্যারের অনুমতি নিতে হবে। তারপর যেতে দেবো।

–তো যান।

বলেই রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ালো৷ তাহের মিয়ার যেতে যত সময় না লাগলো তার থেকেও তাড়াতাড়ি ফিরে এসে চোখ মুখ গম্ভীর করে বললো,

–যান।

নোঙর বিজয়ের হাসি হাসলো৷ তারপর বীরদর্পে কেবিনে প্রবেশ করলো। উজান তখন কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলো। তাকে দেখে ইশারায় বসতে বলে উঠে অন্যদিকে চলে গেলো। নোঙর চেয়ার টেনে বসে ব্যাগ থেকে হালুয়ার বাটি বের করলো। ততক্ষণে উজান কথা শেষ করে নিজের বরাদ্দ করা চেয়ারে এসে বসেছে। নোঙর উচ্ছ্বসিত চোখে বাটি আর চামচ তার দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,

–তোমার জন্য রান্না করেছি। নিজের হাতে৷

নিজের হাতে কথাটার উপর বেশ জোর দিলো। তারও তো জানা উচিৎ, তার বউয়ের কত্তো ট্যালেন্ট! আর সে কত ভালো রান্না করে সেটা খাবার খেলে এমনিতেই বুঝে যাবে। এটা আর বলার কি আছে! নোঙরের কথা শুনে একপলক তার দিকে তাকালো উজান৷ তার গলায় ল্যাভেন্ডার স্যাফায়ারের পেন্ডেন্ট জ্বলজ্বল করছে। মুচকি হেসে বাটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললো,

–কি রান্না করেছো?

–সুজির হালুয়া।

উত্তেজনায় নোঙরের গলার স্বর কেঁপে কেঁপে উঠছে। উজান আলতো হেসে বাটি থেকে এক চামচ হালুয়া নিয়ে মুখে পুরলো। সাথে সাথেই হাস্যজ্বল মুখটা বিকৃত করে টিস্যু হাতে নিলো। মুখের ওই অল্প সুজিটুকুও গলার মধ্যে গেলো না। টিস্যুর মধ্যে ফেলে পানি খেলো আগে৷ তারপর আরেকটা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,

–এতো বাজে রান্না কিভাবে করো? মুখ পুড়ে গেলো একদম।

নোঙর প্রথমটায় হতভম্ব হলো। তারপর ভাবলো উজান তার রান্না খাবে না জন্য এমন করছে। রেগে উঠলো। বাটি টেনে নিজের কাছে নিয়ে বললো,

–খেতে হবে না তোমার৷ জীবনেও আর তোমার জন্য রান্না করবো না।

শেষটায় কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো সে। উজানের মুখ এখনও সাংঘাতিক কুঁচকে আছে। ওভাবেই শক্ত গলায় বললো,

–করো না প্লিজ। এই রান্না দ্বিতীয়বার খেতে হলে আ’ত্মহ’নন ছাড়া আর পথ খোলা থাকবে না।

নোঙরর মুখ অপমানে থমথমে হয়ে গেলো। তার রান্নার এতো নিন্দা! এতোটা নিন্দা! অপমান সইতে না পেরে নাক টেনে সব গোছাতে লাগলো। উজান ভাবলো, নোঙর তাকে ইচ্ছে করে এমন খাবার খাইয়েছে। খাবারটা তারও খাওয়া উচিৎ। তাই বাঁধা দিয়ে বললো,

–কেমন রান্না করেছো সেটা আগে টেস্ট করো।

কথাটা মন্দ লাগলো না নোঙরের। রান্না টেস্ট করলেই না কথা শুনাতে ইজি হবে। নাহলে তো খোঁটা শুনতে শুনতে জীবন তামাতামা হয়ে যাবে। স্ব-গর্বে চামচ ভর্তি করে হালুয়া মুখে পুরলো সে। মিলি সেকেন্ডও গড়ালো না, তার আগেই বমির উপক্রম হলো তার। নোঙর এক কথায় রাজী হবে সেটা উজান ভাবেনি। খানিক অবাকই হয়েছিলো। এখন তার এই অবস্থা দেখে হাসি আটকে হাত দিয়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে বললো,

–ওয়াশরুম ওইদিকে।

নোঙর সেদিকে ফিরেও তাকালো না। বাটিতেই মুখের সুজি ফেলে দিলো। তারপর পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করলো। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো, উজান মিটিমিটি হাসছে। মূহুর্তেই মুখ শক্ত হয়ে গেলো। নিজের অপমান সহ্য করা যায় না। কিছু একটা দিয়ে ধামাচাপা দিতেই হবে। তাই নিজের ডান হাত বাড়িয়ে ধরলো। তারপর হাতের তালু দেখিয়ে বললো,

–ডান হাতের তালুতে তিল থাকলে নাকি রান্না ভালো হয়। আমার হাতেও ছিলো৷ যতদিন ছিলো ততদিন রান্না ভালো হতো৷ এখন আস্তে আস্তে তিল মুছে যাচ্ছে আর আস্তে আস্তে রান্নার কোয়ালিটিও খারাপ হচ্ছে।

তার কথায় উজানের হাসি আরো চওড়া হলো। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা মনে করে হুহা করে হেসে উঠলো। নোঙর রেগে বো’ম হয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর শক্তি দিয়ে চেয়ার সরাতে গিয়ে চেয়ার ফেলে দিলো। দরজাটাও ভাঙতে চেয়েছিলে, কিন্তু পারেনি। ব্যাগ, বাটি আর হাস্যরত উজানকে পিছনে ফেলে চলে গেলো কেবিন ত্যাগ করলো।

সেদিনের ঘটনা সেখানেই সমাপ্ত হয়নি। উজানের কেবিন থেকে বেরিয়ে বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু ব্যাগটা ওখানেই ফেলে এসেছে। এখন আবার গিয়ে ব্যাগ আনা মানে আবার অপমানের মুখোমুখি হওয়া। তাই নিজের ডেস্কে বসে লাঞ্চ ব্রেকের অপেক্ষা করতে লাগলো। তবে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সেখানে আসলো উজানের নোটিশ। ইমার্জেন্সি মিটিং হবে এখন। গোটা দশজনের নাম বলা হলো। সেখানে নোঙর, অমি, শামীম আর মমোর নামও ছিলো। যদিও নোঙরের মিনিংএ যাওয়ার এক ফোঁটা ইচ্ছাও ছিলো কিন্তু বাধ্য হয়ে যেতেই হলো।

সকালে হওয়া ছোট একটা মিনিংএ কোম্পানি একটা ছোট প্রজেক্ট পেয়েছে। উজান প্রজেক্টটা নিয়েছে নোঙরের জন্য। তাকে দিয়েই প্রজেক্ট কমপ্লিট করাবে। ইচ্ছেটা এমনই। তাই এই মিনিং ডেকেছে। কনফারেন্স রুমের ওই বদ্ধ ঘরে নোঙর চুপচাপ বসে রইলো। মন ভীষণ খারাপ। কারো দিকে না তাকিয়ে অভিমানে মাথা নিচু করে টেবিলে আঙুল খুঁটতে লাগলো৷ নাটকে সিনেমায় কত দেখায়, বউয়ের খারাপ রান্নাও হাজবেন্ড কি সুন্দর করে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নেয়। তার রান্না অমন করে খেলে কি এমন হতো! কি এমন খারাপ রান্নাই বা হয়েছে? একটু লবন বেশি হয়েছে আর কেমন একটা অদ্ভুত টেস্ট। আর লবনের জন্য চিনি বোঝা না গেলেও চিনি বোধহয় ঠিকি ছিলো। এতোটা খারাপ রান্নাও তো সে করেনি৷ ধুর! একটু কেয়ারও নেই তার উপর৷ সারাক্ষণ শুধু হৃদয়ভাঙা কাজ করতে থাকে!

মিটিং এ উজান এক দীর্ঘ বক্তৃতায় প্রজেক্টের কাজ বুঝিয়ে, গুরুত্ব বুঝিয়ে দ্বায়িত্ব দেওয়ার সময় নোঙরের দিকে তাকিয়ে বললো,

–আজকের প্রজেক্টের দ্বায়িত্ব নেবেন মিসেস নোঙর খন্দকার।

তারপর গভীর অথচ ক্রুর চোখে নোঙরের দিকে তাকালো উজান। চোখে চাপা শয়তানি হাসি। দ্বিতীয় হৃদয়ভাঙা ঘটনা ঘটার পর পর নোঙরের শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো৷ আড়চোখে অমির দিকে তাকালো। অমির ফ্লাটিং বেশ ইঞ্জয় করছিলো সে৷ সব ভেস্তে গেলো! সব! চোখ বুজে আফসোসে মাথা নাড়লো।
মিটিং শেষে মিসেস বলার রহস্য সমাধানে সবাই ঝেঁকে ধরলে আমতা-আমতা করে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলো সে। উজানের জন্য অপেক্ষাও করেনি। মিসেস বলার কি এমন দরকার ছিলো? সে কি সবাইকে বলে বলে বেরাচ্ছিলো নাকি যে তার সাথেই ওর বিয়ে হয়েছে। তাও মাত্র কয়েকদিন আগেই৷ চুপচাপই তো ছিলো। আসলে কারোর ভালো কেউ সহ্য করে না। তার ভালোও বদখত উজানের সহ্য হচ্ছে না। হুলোকে কানপড়া দিতে হবে আবার। দুই একবার দিলোও বটে। এনার্জি পেলো না বেশি। অনেকদিন হলো হেয়ারপ্যাক লাগায় না। তাই হয়তো এনার্জি পাচ্ছে না। হেয়ারপ্যাক লাগাতেও যখন উৎসাহ পেলো না তখন সব ছেড়ে ছুড়ে ঘুমিয়ে পরলো। তখন সত্যি সত্যি রাত নয়টা বেজেছিলো।

চলবে..

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-২৫+২৬

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৫

প্রতিদিনের মতোই দেরি করে অফিসে যাওয়ায় উজানের যাওয়ার কথাটা জানতে পারলো না নোঙর। উজান অফিস থেকে ইমার্জেন্সিতে বিদেশ যাত্রা করেছে। এতোদিন কষ্ট করে করা প্রেজেন্টেশন সাবমিট করার ডেট একদিন এগিয়ে এসেছিলো। উজান সবসময় সময়ের কাজ সময়ে শেষ করায় তার জন্য কোন সমস্যাই হলো না৷ অফিসে যাওয়ার পর প্রেজেন্টেশন প্রেজেন্ট করার মেইল পাওয়ার সাথে সাথে ওখান থেকেই এয়ারপোর্ট গেলো। নোঙরের সমস্ত রাগ, অভিমান, ক্ষোভ কাঁধে নিয়েই উড়াল দিলো। উজান চলে যাওয়ার প্রায় এক ঘন্টা পর নোঙর অফিসে ঢুকলো। উজানের দেওয়া ফাইলগুলো অমিকে দিয়ে কমপ্লিট করিয়েছিলো। সেগুলো তাড়াতাড়ি ওর থেকে ফেরত নিয়ে নিজের ডেস্কে রেখে দিলো। তারপর ফাইলের সামনে চেয়ার টেনে বসে উজানের অপেক্ষা করতে লাগলো।

তারপর শুধুই অপেক্ষা আর অপেক্ষা। ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা যেতে যেতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেলেও উজানের দেখা পাওয়া গেলো না৷ নোঙর এদিক ওদিক ঘুরঘুর করে, ফাইল নাড়াচাড়া করে একসময় অধৈর্য হয়ে উজানকে কল দিলো। কিন্তু ফোন বন্ধ। লজ্জার মাথা খেয়ে, আত্মসম্মানের বলিদান দিয়ে তাহেরকেও জিজ্ঞাসা করলো। উত্তরে কিছু ত্যাড়া কথা শুনে টেবিলে মুখ গুজে পরে রইলো। বোধহয়, ফ্লোরে এমন কেউ ছিলো না, যাকে উজানের না আসার কারণ জিজ্ঞাসা করেনি। কিন্তু কোথাও মন মতো উত্তর পেলো না।
লাঞ্চের পরেও যখন তার দেখা পেলো না তখন নোঙরের বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করলো। শেষমেশ মাহফুজাকে কল দিয়ে জানতে পারলো, উজান ব্যবসার কাজে কয়েকদিনের জন্য দেশের বাইরে গেছে। কথাটা শুনে নোঙরের চোখে পানি চলে আসলো। দেশের বাইরে যাবে কথাটা একবার তাকে জানালে কি সে বাঁধা দিতো নাকি! একবার বলতে তো পারতো৷ এতে কি এমনই বা হতো!

সেদিন রাতে নোঙর ভগ্ন হৃদয়ে হুলোকে গিয়ে বললো,

–তোর দুলাভাইকে বদ দুলাভাই বলে ডাকার দরকার নাই। তুই বরং দেখলে বলবি, পঁচা দুলাভাই।

বলে চোখের পানি মুছে নাক টানতে লাগলো। হুলো গভীর মনোযোগে নোঙরকে দেখে তার নিজস্ব ভাষায় ডেকে উঠলো। পাশ থেকে অপলা মিনমিন করে বললো,

–তুমি না দুলাভাইয়ের সাথে থাকবা না আপু?

নোঙর চোখে পানি নিয়ে তেঁতে উঠে বললো,

–থাকবো না জন্য বলবে না নাকি? একসাথে তিনটা রিলেশনশীপ মেইনটেইন করছি৷ এইটুকু তো ডিজার্ভ করি।’

নোঙরের রাগ দেখে আর কিছুই বললো না সে। এমনিতেই টাকা নিয়ে যা শুরু হয়েছিলো, ভেবেছিলো তার আয়ু আর বেশিদিন নেই। তবে মাঝখানে দুলাভাই হাওয়া হয়ে যাওয়ায় সে খুব ভালোমতো বেঁচে গেলো!
নোঙর ওড়নায় চোখের পানি মুছে বললো,

–জানিস, নিজে এতোগুলা গার্ড নিয়ে ঘোরে৷ আর আমার বেলায় হেঁটে হেঁটে একা একা অফিস যেতে হয়। রাস্তায় যদি কেউ গু’লি টুলি মেরে দেয় তাহলে তো তোর দুলাভাই বউ হারা হয়ে যাবে। পরে আমাকে মিস করলেও আমি কিছুই করতে পারবো না।’

অপলার মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো,

–তোমাকে কেউ রাস্তায় গু’লি করবে কেন?

–যে জন্য তোর দুলাভাই গার্ড নিয়ে ঘোরে, সেই জন্য। আমি তো তার একমাত্র বউ নাকি?

–কেউ তো বিয়ের খবর জানেই না।

–যারা শত্রু তারা ঠিকই জেনে যাবে। এতো ইনসিকিউরিটিতে থাকলে দেখিস একদিন গু’লি খেয়ে মরে পরে থাকবো। তোরা কেউ জানতেও পারবি না। পৃথিবী থেকে নোঙর খন্দকার নামটা যাস্ট মুছে যাবে। মনে রাখার মতো কোন কাজও এখনও করে উঠতে পারি নাই।

গু’লিবিদ্ধ হয়ে পরে থাকা নোঙরকে কল্পনা করেও অপলার গা শিউরে উঠলো৷ মনটা হুহু করে উঠলো৷ অতি আবেগে বলে উঠলো,

–আমি তোমাকে টাকা ফেরত দিয়ে দেবো আপু। কষ্ট পেও না অতো।

নোঙর আড় চোখে তাকিয়ে নাক টেনে বললো,

–অর্ধেক দে বাকি অর্ধেক নিজের কাছেই রাখিস।

বলেই চোখের কোন মুছে অপলাকে তাড়া দিয়ে বললো,

–তাড়াতাড়ি দে। অফিসে কত কাজ করতে হয় আমার। খুব টায়ার্ড আমি। ঘুমাবো এখন।

নোঙর রাত নয়টার সময় কোনদিনও ঘুমায় না। সেটা জেনেও অপলা কিছু বললো না। বোনটা আর কয়দিনই বা বাঁচবে! কয়েকদিন পর তো গু’লি খেয়ে রাস্তায় পরে থাকবে। এই কয়েকদিন একটু শান্তিতে থাকুক। আবার হুহু করে উঠলো তার বুকের ভেতরটা৷ ঘরে গিয়ে টাকা দেওয়ার সময় আরো হুহু করে উঠলো। আপুর গোছানো টাকার হদিস জানলে ভালো হতো৷ টাকাগুলো ফেরত পাওয়া যেতো।

***
উজানকে ছাড়া অফিসের দ্বিতীয়দিন নোঙরের কাছে আরো বেশি অসহায়ের মতো লাগতে লাগলো। একদম কলেজের প্রথমদিনের মতো অসহায় ভাব৷ সেদিন মনে হচ্ছিলো পরিচিত কেউ কোথাও নেই৷ সে একেবারে অথৈ জলে পরে গেছে৷ যেদিকে তাকায়, সেই দিকেই শুধু পানি আর পানি। আজকেও তেমনই লাগছে।
অফিসে অমি, শামীম আর মমো ছাড়াও আরো বেশকিছু মানুষ পরিচিত হয়েছে৷ উজান ছাড়া তাদেরও কেমন অপরিচিতদের মতো লাগতে লাগলো। নিজের ডেস্কে বসে কাপের পর কাপ চা কফি খাওয়ায় লাঞ্চের সময় কিছুই খেতে পারলো না। লাঞ্চের পর শেষ কাপ খাওয়ার সময় তাহের এসে তাকে ডাকলো।

–স্যারের বাড়ি থেকে লোক এসেছে৷ আপনাকে ডাকে।

নোঙরের ভ্রু কুঁচকে গেলো। কে আসতে পারে, বুঝলো না। জিজ্ঞাসা করায় উত্তরও এলো,

–আমি জানি না। নিজে গিয়ে দেখেন। ফোর্থ ফ্লোরে মিসেস ফ্লোরার কাছে বসে আছে।

লাঞ্চের পর অফিসে বেশি ব্যস্ততা বাড়ে। সবার ব্যস্ততা দেখে এমনিতেও তার দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছিলো। শুধু মনে হচ্ছিলো একটু ঘোরাফেরা করলে ভালো লাগলেও লাগতে পারে। এখন সুযোগ পাওয়ায় তা আর হাত ছাড়া করলো না। ব্যাগ কাঁধে সোজা ফোর্থ ফ্লোরে চলে গেলো।

মিসেস ফ্লোরার সামনে অত্যাধিক সুন্দরী একটা রমনী বসে তার সাথে কথা বলছিলো। লম্বা সাদা শার্ট আর কালো রঙের ঢোলা প্যান্ট পরা মেয়েটাকে নোঙর চেনে। বিয়ের দিন পরিচয় হয়েছিলো। সম্পর্কে তার বড় জা হয়। প্রথম দেখায় তেমন কথাবার্তা হয়নি। সেইজন্যই বোধহয় খানিক অস্বস্তি হলো। মিসেস ফ্লোরার কথায় ধীর পায়ে তার পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো। কথাবার্তা শুনে মনে হলো, কোন একটা ড্রেস ডিজাইনের কথা উঠেছে। নোঙরকে নীরব দেখে রাশা মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে বললো,

–রিসেপশন ড্রেস হিসেবে তোমার কোন পছন্দ আছে?

নোঙর হকচকিয়ে গেলো। তার দৃষ্টি মিসেস ফ্লোরার ডিজাইনের বইয়ে ছিলো। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে লাজুক হেসে মাথা নেড়ে বললো,

–না না আপু। আমার পছন্দ খুব বাজে। আপনারাই দেখুন না।

নোঙরের মনে পরেছে। তার বড় ভাসুর আর বড় জায়ের রিসেপশন হয়নি। ফুপি বলেছিলো, খুব শীগ্রই অনুষ্ঠান হবে। এইজন্যই হয়তো এসেছে।
মিসেস ফ্লোরা মৃদু হেসে বললো,

–রাশা, আগে তুমি ঠিক করো কি ড্রেস পরবে। শাড়ি, লেহেঙ্গা নাকি গাউন?

–আপনি লেহেঙ্গা বানান?

আচমকা নোঙরের বিষ্মিত স্বর শোনা গেলো। মিসেস ফ্লোরা তেঁতে উঠলেন,

–হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বানান? আমাকে কি তোমার লোকাল টেইলর মনে হচ্ছে?

নোঙর বিড়বিড় করলো,

–আধা-আধি তো টেইলারই।

রাশা থতমত খেয়ে গেছিলো। পরক্ষণেই পরিস্থিতি গরম দেখে নিজেকে সামলে নোঙরের হাতের উপর হাত রেখে নরম গলায় বললো,

–তুমি বলো নোঙর, কোনটা বেশি ভালো লাগবে? শাড়ি, লেহেঙ্গা নাকি গাউন?

নোঙর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। নতুন নতুন ভাবটা অনেকটা সামলে উঠেছে। নতুনদের সাথে খুব ভালো মিশে যায় সে। এবারেও তাই হলো। পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে বললো,

–এমনিতে তো শাড়িতেই নারী। তবে রিসেপশনের জন্য মনে হয় লেহেঙ্গা বেটার হবে।

–তোমার কোন আইডিয়া আছে, কেমন লেহেঙ্গা হলে ভালো হয়?

নোঙর রাশার দিকে ঘুরে বসলো,

–তার আগে দেখতে হবে, কেমন ধরনের লেহেঙ্গা চাই? মানে গর্জিয়াস নাকি সিম্পল?

মিসেস ফ্লোরা মাঝখান দিয়ে কথা বললেন,

–বিয়ের অনুষ্ঠানে অবশ্যই গর্জিয়াস হতে হবে।

–তাহলে দিপিকা পাড়ুকোনকে ফলো করতে পারেন। বিশেষ করে পদ্মাবতী লুকের লেহেঙ্গা। অসাম ডিজাইন ছিলো। বিশেষ করে আগুনে ঝাপ দেওয়ার সময়কার লুকটা! আর সিমপলের মধ্যে হলে আলিয়া ভাটের বিয়ের ড্রেসটা ট্রায় করতে পারেন। যদিও ওটা বোধহয় শাড়ি ছিলো।

মিসেস ফ্লোরা আবার রেগে গেলেন। এবারে বেশ ভালোই রাগলেন। রেগে টেবিলের উপর দুই হাত শব্দ করে রেখে ক্ষীপ্ত স্বরে বললেন,

–আমি কি ডিজাইন পারি না নাকি? আমার কাউকে কপি করতে হবে কেন? আমার ডিজাইনের কাছে সাব্যসাচিও ফেইল করবে বুঝেছো?

রাশা, নোঙর হকচকিয়ে তার দিকে তাকালো। নোঙর আমতা-আমতা করে বললো,

–রাগ করছেন কেনো ম্যাডাম? আমি কি আপনার মতো ক্রিয়েটিভ নাকি যে ডিজাইনের কথা উঠলেই নতুন নতুন ডিজাইন বলতে পারবো? আমি তো স্যাম্পল বললাম। বাকিটা আপনাদের দ্বায়িত্ব।

নেহায়েতই তেল মারা কথা। রাশা ঠোঁট টিপে হাসলো। নোঙরের কথায় কাজ হলো। মিসেস ফ্লোরার রাগ একদম চলে গেলো। নরম হয়ে বললেন,

–তাহলে কোনটা ফাইনাল করবো?

রাশা আড়চোখে নোঙরের দিকে তাকিয়ে বললো,

–ওইতো সিমপলের মধ্যে। লাইক আলিয়া ভাটের ব্রাইডাল ড্রেস। আর একদম লাইট কালার রাখবেন।

নোঙরের কথা শোনা হয়েছে। তার মুখে প্রসন্ন হাসি খেলে গেলো। রাশা এবারে নোঙরের দিকে তাকিয়ে বললো,

–এবারে তোমার ড্রেস অর্ডার দাও।

নোঙরের মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো,

–আমার ড্রেস?

–হ্যাঁ, বাড়ির সবার ড্রেস তো মিসেস ফ্লোরাই ডিজাইন করবে।

–আমরা নতুন নতুন ডিজাইনের ড্রেস ক্রিয়েট করি। যাস্ট লাইক, ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক।

কাঁধ নাচিয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে মিসেস ফ্লোরা জবাব দিলেন। যেনো নোঙরকে টেইলর আর তার মাঝের পার্থক্য বুঝিয়ে দিলেন। নোঙর ঠোঁট কামড়ে ভাবুক গলায় বললো,

–সেগুলো কি শুধু পেপারেই সীমাবদ্ধ?’

–তা হবে কেন? ড্রেস তো বানাতেই হয়। নাহলে বুঝবো কিভাবে, আমাদের ডিজাইন কেমন দেখা যাচ্ছে।

বেশ বিরক্ত হয়ে তিনি প্রতি উত্তর করলেন। নোঙর ভ্রু উঁচিয়ে টেবলে হাত রেখে আবার জিজ্ঞাসা করলো,

–টেইলরদের কাজ কি?

–ড্রেস বানানো।

–আপনারা কি তাহলে ঘুরে ফিরে টেইলরই হবেন না?

মিসেস ফ্লোরা রাগে ফুঁসে উঠলেন। নোঙর নিজের বাক্যে অটল। রাশা কপাল চাপড়ালো। সামনে দুইজন সমান তালে ঝগড়া করলে আর নিজে সেই ঝগড়ায় পৃষ্ঠ হলে যে এমন লাগে, সেটা আগে জানতো না। জজের কষ্টটা বুঝলো। আদালতে দুই উকিল এমন করেই তো ঝগড়াই। রাশা হাঁপ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

–আমাদের কাজ আছে নোঙর। তুমি দ্রুত তোমার ডিজাইন বলে দাও।

নোঙর শান্ত হলো। মিসেস ফ্লোরাও দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করলেন। নোঙর দাঁতে ঠোঁট কেঁটে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,

–হাম দিল দে চুকে সানাম ফিল্মে চান্দ ছুপা গানে ঐশ্বরিয়া যে ল্যাভেন্ডার কালারের লেহেঙ্গা পরেছিলো, আমাকে ওটা বানিয়ে দিতে হবে।

মিসেস ফ্লোরা ডিজাইন বুক বন্ধ করতে করতে বললেন,

–পসিবল না।

নোঙর অনুরোধের সুরে বললো,

–এমন করছেন কেন? প্লিজ বানিয়ে দেন। একই অফিসে আছি। এইটুকু কম্প্রোমাইজ তো করতেই পারেন। দুই দুইটা বানাবো তো। একটা ল্যাভেন্ডার কালার আর একটা সি গ্রীন কালার।

মধ্যবয়সী ফ্যাশন-সচেতন মিসেস ফ্লোরা নিজের বয়স খুব ভালোমতো ধরে রাখতে পেরেছেন। তাকে দেখে কেউ বয়স আন্দাজ করতে পারবে না। নোঙর রাশা কেউই পারছে না। বেশ অনেকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা চালালেও ত্রিশের উপর কিছুতেই উঠতে মন চাচ্ছে না। ভীষণ সুন্দরী ফ্যাশন ডিজাইনার মিসেস ফ্লোরা এখনও যদি মডেল হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তাহলে অনেক বড় বড় মডেলকে পিছনে ফেলে দেবেন, সেটা তারা এক বাক্যে স্বীকার করতে রাজী। নোঙর তো মনে মনে ভেবেও নিলো, সে একদিন না একদিন মিসেস ফ্লোরার বিউটি সিক্রেট জিজ্ঞাসা করবেই করবে৷ এমন এভারগ্রীন হওয়ার ইচ্ছা তারও আছে। যাতে উজান উঠতে বসতে তাকে মিস করতে পারে৷ হাজার হলেও আর কয়দিনই বাঁচবে! কবে না জানি গু’লি টু’লি খেয়ে রাস্তায় পরে থাকে!

মিসেস ফ্লোরা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভেবে বললেন,

–ওকে, বানিয়ে দিতে পারি বাট আগে হাফ পেমেন্ট করতে হবে।

–নো প্রবলেম। টোটাল বিল কত হবে?

নোঙর মহানন্দে জানতে চাইলো। সে ভেবেছে, তার বিল তার নিজেরই দিতে হবে। এই নিয়ে মনে মনে টাকার হিসাবও করে ফেলেছে

মিসেস ফ্লোরা গুরুগম্ভীর স্বরে বললো,

–অ্যারাউন্ড এইট্টি কে।

অ্যামাউন্ট শুনে নোঙর ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। অল্প হাসার চেষ্টা করে বললো,

–গোল্ডের থ্রেড দিয়ে বানাতে হবে না। নরমাল থ্রেড দিয়েই বানাবেন।

–আমার ফি-ই থার্টি কে পার ড্রেস। আর ড্রেস বানানোর অ্যাসেনশিয়াল ম্যাটেরিয়ালস মিলিয়ে টেন কে অনেক টেনে টুনে ফুলফিল করতে হবে। মোটমাট এই ড্রেস বানানোর পিছনে ফোরটি কে লাগবেই। দুইটা বানালে এইট্টি কে। তুমি কলিগ জন্য পার ড্রেস ফোরটি কে৷ নাহলে পার ড্রেস সেভেনটি কে-র নিচে কিছুতেই বানাতাম না।

বলতে বলতে নোটপ্যাডে ঘসঘস করে লিখে লিস্ট তৈরি করতে লাগলো। তারপর সেটা নোঙরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

–যদি মনে হয় টাকা বেশি নিচ্ছি তাহলে এইসব শপিং করে নিয়ে এসে জমা দিও৷ থার্টিতেই একটা তৈরি হয়ে যাবে।

লম্বা লিস্ট দেখে নোঙর শুকনা ঢোক গিললো৷ আমতা-আমতা করে বললো,

–তাহলে এক বছর পরে বানাচ্ছি ম্যাডাম। এতোদিন টাকা গোছাই।

বলেই রাশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

–এতো টাকা দিয়ে এখানে ড্রেস বানাতে হবে না আপু। আমার পরিচিত একটা টেইলার্স আছে। কাপড়, লেস কিনে দিলে হাজার টাকার মুজুরিতে সেম টু সেম ড্রেস বানিয়ে দেবে।

রাশাও নোঙরের মতো ফিসফিস করে বললো,

–টাকা তো আমাদের দিতে হবে না। অফিস পে করবে।

–সেগুলোও তো আমাদেরই টাকা।

মিসেস ফ্লোরা তাদের ফিসফিস করা দেখে কেশে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলেন। রাশা সোজা হয়ে বসে নোঙরের হাত থেকে লিস্ট নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। তারপর নোঙরকে অসন্তুষ্ট করে মিসেস ফ্লোরাকে বললো,

–তাহলে ডিজাইন করে ফেলুন। আর নোঙরের দুইটা লেহেঙ্গা সেম বানানোর চেষ্টা করবেন প্লিজ। উই নো, শখ!

মিসেস ফ্লোরা শক্ত মুখে মাথা নাড়লেন। নোঙরের হাজার বারণ সত্ত্বেও মাপ দিয়ে তাকে নিয়ে গাড়িয়ে উঠে বসলো রাশা। গাড়ি থামলো, শহরের বড় শপিং মলের সামনে। শপিংমল দেখেই নোঙরের মুখ কালো হয়ে গেলো। মন খারাপ নিয়ে বললো,

–এখানে গলা কাঁটা দাম নেয় আপু৷ অন্য জায়গায় চলুন। এর তিন ভাগের আধ ভাগ দিয়ে শপিং করা যাবে।

নোঙর এটা বলতে পারলো না, দরদাম না করলে সে শপিং করে মজা পায় না। তাই একটু ঘুরিয়েই বললো। রাশা আপনি বলাতে খুব বিরক্ত হলো,

–তোমার কি আমাকে দেখে বেশি বয়স্ক লাগে নোঙর?

নোঙর ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো,

–না তো। কেনো?

–তাহলে আপনি বলছো কেনো?

নোঙর বুঝতে পেরেছে, এমন ভঙ্গিতে হাসলো।

–আচ্ছা সরি। কিন্তু এখানে যাবো না। এখানে তো বারগেনিং করা যায় না। নিউমার্কেট চলো। এর থেকে তিন গুণ কম দামে শপিং করা যাবে।

নোঙর নিজের খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসলো। রাশা একবার বলতে চাইলো, ফেব্রিক তো আলাদা হবে। কিন্তু কিছু বললো না। নোঙর তাকে টেনে নিউমার্কেট চলে গেলো। নিউমার্কেট ঘুরে একটা জামা রাশার বেশ পছন্দ হলো। ফেব্রিকও বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। দাম জিজ্ঞাসা করায় দোকানদার দামও বললো,

–দুই হাজার।

–আমাদের কি আদরের দুলালি মনে হচ্ছে আপনার? নাকি দেখে বেকুব মনে হচ্ছে যে, যা দাম বলবেন আমরা সেই দামেই নিয়ে নেবো। এগুলা নাড়াচাড়া করেই এতোদূর এসেছি। এক দাম তিনশো।

নোঙর ফুঁসে উঠে বললো। নোঙরের বলা দাম শুনে রাশার মাথায় বজ্রপাত হলো। দুইপা সরে নোঙরের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো, যাতে দেখে মনে হয়, সে আলাদা এসেছে। নোঙরকে চেনেই না।
নোঙরের দাম শুনে লোকটা একটু নিভলো,

–আচ্ছা আপা, লসে দিচ্ছি। সতেরোশো।

নোঙর কিছু না বলে তীক্ষ্ণ চোখে লোকটার দিকে তাকাতেই লোকটা আরেকটু দাম কমালো,

–আচ্ছা নেন, বারোশো।

নোঙর ঠান্ডা গলায় বললো,

–সারে তিনশো।

–কেনাই তো হাজার টাকা আপা। লসেই দিচ্ছি। নয়শো টাকায় দেন।

–আর পঞ্চাশ আগাচ্ছি৷ এক দাম চারশো।

–নেন আপা, ছয়শো।

নোঙর আবার ঠান্ডা চোখে তাকালো। লোকটা শব্দ করে শ্বাস ফেলে জামা ভাজ করতে করতে বললো,

–না আপনার, না আমার। একেবারে লসে দিচ্ছি৷ সারে চারশোতে নেন। ম্যালা কমাইছি। আর না আপা। এখন নিলে নেন না নিলে থাকুক। এর থেকে কমে আর দিমু না।

রাশাকে চরম হারে অবাক করে দিয়ে লোকটা সারে চারশোতে কেমন রাজি হয়ে গেলো। একটা জামা কিনেই নোঙর ক্ষান্ত হলো না। অপলার দেওয়া আড়াই হাজারের পুরোটা দিয়ে হাবিজাবি শপিং করে আর রাশাকে এক গাদা শপিং করিয়ে দিয়ে তবেই থামলো। এমন ঘুরে ঘুরে শপিং করে রাশার পা ব্যাথা হয়ে গেলো। ব্যাগ গাড়িতে তুলে কোমরে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। গাড়িতে বসে একটু ধাতস্থ হতেই নোঙর প্রশ্ন করলো,

–শপিং তো শেষ। এখন কোথায় যাবে?

নোঙরের এনার্জি দেখে রাশা ঢোক গিললো। ভাবলো, আর ঘোরাঘুরি না। এবারে বসে থাকা কোন জায়গায় যাবে। তাই বললো,

–পার্লারে যেতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে আর একটু রুপচর্চাও করতে হবে।

রাশা চোখ টিপলো। নোঙর আহাজারি করে উঠলো,

–কি বলছো আপু! পার্লারে! সব জিনিস তো ভ্যাজালে ভরা৷ স্কিন খারাপ হয়ে যাবে। দশ টাকার স্কিন কেয়ার করলে একশ টাকার মেডিসিন খেতে হবে। চলো, তোমাকে অর্গ্যানিক জিনিস কিনে দিচ্ছি। বাড়ি ফিরে একটু মিক্স আপ করলেই প্যাক রেডি।

রাশা নিজের ডিপ ব্রাউন চুলে হাত বুলালো। চুলের কালার খানিক ফ্যাকাসে হয়েছে। কালার করাটা জরুরি হয়ে পরেছে। স্কিনটাও খসখসে হয়ে রয়েছে। নোঙরকে বলবে নাকি বুঝলো না।
নোঙরের উৎসাহে গাড়ি একটা লোকাল মার্কেটের সামনে দাঁড়ালো। ভেতরে গাড়ি যাবে না। সুতরাং আবার হাঁটতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে কোন এক কবিরাজের দোকানের সামনে গিয়ে তারা দাঁড়ালো। ভেতর থেকে নোঙরের অর্গ্যানিক মাল-মশলা কিনে আরেকটা দোকানে গেলো। এভাবে তিন চারটা দোকান ঘুরে কেনাকাটা করে তবেই গাড়িতে উঠলো। রাশার পা ব্যাথা করতে শুরু করেছে। ঘোরাঘুরির অভ্যাস তার নেই। নোঙর পুরোটা রাস্তা কোনটা কেমন ভাবে আর কি কি মিশিয়ে প্যাক তৈরি করতে হবে, সেটা বুঝালো। রাশার কাছে আইনের মোটা মোটা বইয়ের শক্ত শক্ত আইনও নোঙরের বলা প্যাকের উপকরণ মনে রাখার থেকে সোজা মনে হলো।

রাতে রাশা টেবিলে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে নাম মনে রাখার চেষ্টা চালালো। একদম এ বি সি ডি মুখস্ত করার মতো করে মুখস্ত করতে শুরু করলো,

–এটা মেথি, এটা নিম পাতার পাউডার, এটা রিঠা, এটা গোলাপের পাপড়ির পাউডার, এটা চিয়া সিড…

এর মাঝেই নোঙর রাশাকে ভিডিও কল দিলো। এরপর পরিমাণ বুঝিয়ে দিয়ে মিক্স করাও শিখিয়ে দিলো। রাশা মহা উৎসাহে কাজ করতে লাগলো। নোঙরের বলা ঘনত্ব আনতে আনতে পরিমাণে এতো বেশি হয়ে গেলো যে রাশা, ময়না, মাহফুজা, শাহিদা আর আবসার সাহেব লাগানোর পরেও খানিক বেঁচে গেলো। রাশার প্রথমে বিরক্ত লাগলেও এখন খুব ইঞ্জয় করছে। উষির বাড়ি ফিরে হতভম্ব হয়ে গেলো। রাত দশটার সময় বাড়ির সবই মিলে মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে লিভিংরুমে চুপচাপ বসে টিভি দেখছে। উষির এসেছে দেখে রাশা উচ্ছ্বাসিত হয়ে বেঁচে যাওয়া ফেসপ্যাকটুকু তাকে লাগিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো। এখন মোটামুটি, বৃষ্টি আর বন্যা ছাড়া সবাই ফেসপ্যাক লাগিয়ে লিভিংরুমে টিভি দেখতে লাগলো। ফেসপ্যাক পুরো আধা ঘন্টা লাগিয়ে রাখতে হবে। নোঙর বারবার করে সতর্ক করে দিয়েছে, একদম কথা বলা যাবে না।

চলবে..

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৬

রাশা এসেছে একটা কেসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। কেসটা পানির মতো সোজা। কিন্তু সুবোধ দত্তের ভাষ্যমতে, কেস প্রথমে জটিল করতে হবে তারপর সোজা ভাবে সলভ করতে হবে। এটাই নাকি তার রুল। এক কেস একদিনে সলভ হলে সেটা আবার কেস হলো নাকি! কেস আগে ঘোলাটে বানাতে হবে তারপর সেখান থেকে ক্লু বের করে করে সলভ করতে হবে। একদম সরল অংকের মতো। এসব কথা রাশা যখন প্রথম শোনে তখন ক্লাসরুম ভরা স্টুডেন্ট। নাহলে নির্ঘাত বলে বসতো, স্যার, কারা যেনো পানি ঘোলা করে খায়?
কথাটা বলা হয়ে ওঠেনি৷ আর যে কথাটা প্রথমে বলা হয়ে ওঠেনি, সেই কথাটা যে আর বলা হবে না সেটা তো জানার কথা। সুতরাং সেও সুবোধ দত্তের একনিষ্ঠ ছাত্রী হিসেবে তারই পথই অনুসরণ করছে৷

একটা লোক খু’ন হয়েছে। লোকটা বেশ বড়লোক। রিসেন্টলি স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কোর্টে অ্যাপ্লাইও করেছিলো। শর্ত ছিলো একটাই। একটা টাকাও স্ত্রীকে দেবে না। অথচ স্ত্রী টাকা নেবেই নেবে। শেষমেশ লোকটা খু’ন হলো। উইল অনুযায়ী সম্পত্তির মালিক এখন ওনার স্ত্রী৷ টাকা পয়সাওয়ালা মানুষদের একটা সমস্যা আছে। সাংবাদিক কখনও পিছু ছাড়ে না। খু’ন হয়েছে, সেটা তো পাবলিক জেনে গেছে। এখন সেটার তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকরা কিছুতেই পিছু ছাড়বে না। পুরো কেস সাজালে স্পষ্ট বোঝা যায়, খু’নটা তার স্ত্রীই করেছে। যথেষ্ট প্রমানও আছে। কিন্তু নাহ! সেটা হলে তো এটা সুবোধ বাবুর কেস হতোই না। এখন কাজ একটাই। খু’ন হওয়া লোকটার আশেপাশে থাকা মানুষজনের বয়ান রেকর্ড করা। আর সুবোধ দত্তের অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে রাশার কাজ হচ্ছে, নিজ দ্বায়িত্বে সেটা করা। সেইজন্যই এখন এই ভাঙা বাড়িতে এসে বসে আছে। সাথে আছে সুবোধ স্যারের আরেকজন স্টুডেন্ট।

জায়গাটা বস্তি টাইপ। দুইটা নোংরা গলি পাড় হয়ে এসে একটা ভাঙাচোরা একতলা বাড়ি পরে। ইটগুলো বহু কষ্টে দেয়ালে গেথে রয়েছে৷ তারা অনেক খুঁজে খুঁজে বাড়িটা বের করেছে। বাড়িটা খু’ন হওয়া লোকটার ড্রাইভারের। খু’নটা বাড়িতে হয়েছে কিন্তু বয়ান ড্রাইভারের লাগছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে রাশার সাথে আসা ছেলেটা অনেকক্ষণ গিজগিজ করলো। ছেলেটা রাশার জুনিয়র কিন্তু নতুন। আর এটাই তার প্রথম কেসের প্রথম দিন। তাই তাকে প্রথমদিনই ধমক দিয়ে চুপ করাতে ইচ্ছে হলো না রাশার। মূলত ছেলেটি সমস্যা নয়৷ সমস্যা হচ্ছে, ড্রাইভার বাড়ি নেই। বাড়ি ফিরছে, রাস্তায় আছে। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
অপেক্ষার মাঝে রাশার ফোনে মেসেজের নোটিফিকেশন আসায় চুপচাপ নিজের মোবাইলে নজর দিলো। উষির মেসেজ করেছে,

“বউ, কি করছো?”

রাশার মুখে রাগের আভাস আগে থেকেই ছিলো। মেসেজ দেখার পর সেটা আরো বেশি হলো। দ্রুত হাতে পালটা মেসেজ লিখলো,

“তোমার জন্য রান্না করছি।”

রাশার জবাব পেয়ে খানিক সময়ের জন্য উষিরের ধুকপুক করা বুকটা বিট করা মিস করে ফেললো। ঢোক গিলে আসেপাশে তাকালো। বড় মাঠের এক কোনে ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। মাঠটা বিল্ডিং বানানোর জন্য খোদাই করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন বাঁধা দিচ্ছিলো জন্য নিজে এসেছে। এই মূহুর্তে বউয়ের রান্না করা প্রথম খাবার খাওয়ার কথা মনে করে মুখের রাগী ভাবটা সরালে চলবে না। তাই রাশাকে রাগিয়ে দিতে চাইলো৷ আঙুলের দ্রুত চাপে আরেকটা মেসেজ টাইপ করলো,

“এখানে অনেক সুন্দরী মেয়েরা আছে।”

“পছন্দ হলে বিয়ে করে নিয়ে এসো।”

রাশার তেড়ছা জবাবে উষিরের মুখ হা হয়ে গেলো। হতভম্ব মুখে আবার মেসেজ টাইপ করলো,

“তোমার জেলাসি হচ্ছে না।”

“একদমই না।”

একদম স্পষ্ট বাংলা অক্ষরের স্পষ্ট মেসেজ৷ কাগজে লিখলে হয়তো কাটাছেড়াটা দেখলে মনের কথা বোঝা যেতো৷ এখানে সে উপায় নেই। বুকটা কেমন হুহু করে উঠলো। তার বউয়ের জেলাসি নেই! এ কেমন ভালোবাসা! অথচ সে ভালোবাসায় পরে কি না কি করে ফেললো! উষির মনে মনে দুঃখবিলাস করতে লাগলো। চোখ বুজে মাথা নিচু করে দুই দুইবার নিজের মাথা ডান বাম করে নাড়ালো। তারপর মাথা তুলতেই জৈনক সৈনিক হিসেবে খ্যাত তার সর্বদা সঙ্গীদের একজনকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। তার চোখ খোলার সাথে সাথেই সামনের ছেলেটি উশখুশ করে বললো,

–ভাই একটা কাজ ছিলো।

উষির রাগে হাত মুঠো করে ধমকে উঠলো,

–কাজ! এখানে আমি বউ নিয়ে সমস্যায় আছি আর তোদের কাজ মনে পরলো? জানিস জীবনে বউ কত দরকার?

তার ধমকে আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা বাকি সৈনিকরাও এসে জড়ো হলো এবং শেষ প্রশ্নের উত্তর হিসেবে সবাই একজোগে মাথা নেড়ে না বুঝালো। এরপর উষির দ্বায়িত্ববান নেতার মতো বউ এর উপকারীতা নিয়ে একটা লম্বা বক্তৃতা দিলো৷ ওখানে যারা সিঙ্গেল সোসাইটি ক্লাবের মেম্বার ছিলো, সবাই নিজেদের সিঙ্গেল জীবনের কথা চিন্তা করে আর বউ না থাকার কষ্টে বরই ব্যাথিত হলো।
উষিরের কষ্ট এই লম্বা বক্তৃতাতেও না কমায় ভাইকে কল দিলো। উজান এক লম্বা মিটিং শেষে হোটেল রুমে এসে বিশ্রাম করছিলো। উষিরের ফোন পেয়ে বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলো। রিসিভ করার সাথে সাথেই উষির তাকেও ধমক দিয়ে উঠলো,

–কি সমস্যা?

উজান বিষ্মিত হয়ে পালটা প্রশ্ন করলো,

–কিসের কি সমস্যা?

তোর ভাবির কি সমস্যা সেটা জিজ্ঞাসা করছি?

–সেটা আমাকে কেনো জিজ্ঞাসা করছিস?

–তোর তো পাতানো বোন হয়, তাই তোকেই জিজ্ঞাসা করছি। আমার সাথে রাগ করে আছে। আমার সাথে কথা বলছে না, কল ধরছে না।

উজান কপাল কুঁচকে ব্যাপারটা শুনলো। তারপর রাগ করতে নিয়েও করলো না। একজন বিবাহিত পুরুষ হয়ে অপর একজন বিবাহিত পুরুষের বিপদে তার পাশে দাঁড়ানো দ্বায়িত্বের মাঝে পরে। সেই দ্বায়িত্বটা সে ভালোভাবে পালন করতে চায়। তাই চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাসা করলো,

–কেনো?

–জানি না। তুই ফোন দিয়ে বল, আমার ফোন যেনো ধরে।

উজান তপ্ত শ্বাস ফেলে সময় দেখলো। বাংলাদেশের সময়ে এখন সকাল এগারোটা বাজে৷ এইসময় উষির ব্যস্ত থাকে। আর আজকে এইসময় রাশার রাগ নিয়ে কথা বলছে! কি অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে, বুঝলো না।

–আমার জানামতে তুই এই সময় খুব ব্যস্ত থাকিস।

–বউ রাগ করে থাকলে কাজে মন বসে নাকি? আমার সাথে সাথে টিমের বাকি সবারও মন খারাপ।

উষির বেশ মন খারাপ করেই কথাটা বললো। শেষের কথাটা অবশ্য একশো শতাংশ সত্যি৷ তার বক্তৃতার পর সিঙ্গেল সোসাইটি ক্লাবের সবাই ক্লাবটা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে৷ সেই সাথে নিজেদের সিঙ্গেল জীবন নিয়ে হা-হুতাশ করা শুরু করে দিয়েছে। সেসব আলোচনা অবশ্য গোপনে গোপনে আর মনে মনে চলছে।
উষিরের কথায় উজানও ভাইয়ের দুঃখে দুঃখী হলো। এখনই শুনবে বলে কল কেঁটে তক্ষুনি রাশাকে কল দিলো৷ রাশা তখন ড্রাইভারের সাথে কথা বলছিলো। ফোন আসায় ভীষণ বিরক্ত হলো। উজানের কল দেখে বাইরে এসে রিসিভ করলো। উজান বেশ চিন্তিত স্বরে তাকে প্রশ্ন করলো,

–তুমি উষিরের উপর কোন কারণে রাগ করে আছো?

–না তো। কেনো? কিছু হয়েছে?

রাশা কপাল কুঁচকে উত্তর দিলো। উজান আমতা-আমতা করতে লাগলো। কারো দাম্পত্য জীবনে ঢুকতে হয় না বলেই সে জানতো। এখনও ঢুকতো না যদি না উষির এতো করে তাকে বলতো। মনে মনে ভেবে নিলো, এই শেষ! আর এরুপ কাজ কদাপি নহে।

–উষির ফোন দিয়ে বললো, তুমি ওর ফোন ধরছো না৷ কথা বলছো না। রাগ করে আছো।

–আধ ঘন্টা আগেই তো কথা হলো। দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাচ্ছে। আমি অনুমতিও দিলাম।

উজানের মাথায় বজ্রপাত হলো বলে মনে হলো। এর উত্তর কি দেওয়া যায়, ভেবে না পেয়ে কল কেঁটে উষিরকে টেক্সট করলো,

“তুই দেশের হাল ধরতে চাস উষির। তোকে কি এসব মানায়? এমন বউ পাগলা হলি কিভাবে?”

পালটা উত্তর বেশ সাথে সাথেই আসলো,

“শোন শোন, এটা আমাদের বংশগত। তোর বাবা, কাকা, দাদা সবাই এইদিকেই ছিলো। বড় ছেলে হিসেবে বংশের গুণ রক্ষা করা আমার দ্বায়িত্ব। ছোট ছেলেরা তো অবাধ্য হয়। সেইজন্য আজ তোর এই হাল।”

রাশা একবার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো, ড্রাইভার ভেতরের ঘরে চলে গেছে। হয়তো খেতে গেছে। এমন কথাই ছিলো৷ তাই উষিরের সাথে কথা বলার চিন্তা করলো। ভাবনামতো কলও দিলো। উষির সাথে সাথে একদম রিসিভ করলো না। দুই তিনবার রিং বাজার পর রিসিভ করে ব্যস্ত স্বরে কথা বলতে লাগলো,

–কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো? আমার অনেক কাজ আছে। কাজের মাঝে এমন মেসেজ আর ফোন দিয়ে বিরক্ত করলে কি চলে? আমাকে তো খেটে খেতে হয়। তোমার মতো মিথ্যা সাক্ষী দিলেই আমাকে কেউ কাড়ি কাড়ি টাকা দেবে না।

একদমে বলে নিজের চেয়ারে বসলো উষির। ফ্যানের বাতাস সম্পূর্ণ তার গায়ে লাগছে। গা জুড়িয়ে যাচ্ছে একদম। রাশা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,

–ভাবলাম একটু প্রেমালাপ করি। কিন্তু তুমি তো ব্যস্ত। ঠিক আছে, রাখছি তাহলে।

উষির লাফ দিয়ে উঠলো। ব্যাজার মুখ করে বললো,

–একনিষ্ঠ স্বামী হিসেবে নাহয় একটু কাজের ক্ষতিই করলাম৷ তুমি তোমার প্রেমালাপ করো, আমি শুনছি।

রাশা শুনলো, বুঝলো। তারপর হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,

–একটা হাতির সামনে ১২টি কলা রাখা ছিলো। হাতিটা ১১টা কলা খেলো কিন্ত ১টা কলা খেল না। কেন?

উষির তজ্জব বনে গেলো,

–এটা প্রেমালাপ?

–প্রেমালাপের প্রথম ধাপ হলো আইকিউ টেস্ট। তারপর আইকিউ হিসেবে অনুপাত বুঝে প্রেমালাপ করতে হয়। আন্সার জানো নাকি সেটা বলো?

উষির আমতা-আমতা করলো,

–বোধহয় ওই কলাটা পঁচা ছিলো৷

–ভুল। ওটা প্লাস্টিকের কলা ছিলো। আবার বলো, একটা হাতির সামনে ১২টি কলা রাখা হলো, কিন্তু সে একটা কলাও খেল না কেন?

উত্তর শুনে বিষ্ময়ে তার চোয়াল ঝুলে পরেছিলো। কিন্তু একই সিলেবাসের একই প্রশ্ন একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে করায় পুরোনো কনফিডেন্স ফেরত পেলো। বেশ উৎসাহের সাথে বললো,

— কারন ১২টা কলাই প্লাস্টিকের ছিল!

–না হাতিটাই প্লাস্টিকের ছিল।

উষিরের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়ে মূহুর্তেই আষাঢ়ের মেঘের মতো কালো হয়ে গেলো। অন্যদিকে রাশা থেমে নেই। ঝুলি থেকে আরেকটা প্রশ্ন বের করেছে,

–এক লোক মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টি নামল। লোকটির কাছে ছাতা নেই আবার চার পাশে কোথাও এমন কিছু নেই, যার তলায় দাঁড়ানো যেতে পারে। লোকটি ভিজে চুপচুপে হয়ে বাড়ি ফিরল। কিন্তু তার একটি চুলও ভিজল না। কেন?

–কেনো?

থমথমে মুখে পালটা প্রশ্ন করলো উষির৷ এবারে উত্তর দেওয়ার জন্য এক ফোঁটাও চিন্তা করলো না।

–কারন লোকটা টাক ছিলো৷

উষিরের মনে হলো, ফোনটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলুক। এ জীবনে তার প্রেমালাপের শখ ঘুচে গেছে। রাগে মাথার তালু জ্বলে গেলো৷ শক্ত গলায় বললো,

–আজকে এমন ধাঁধা ধাঁধা খেলছো কেনো?

–পেপারে রাশিফল দেখছিলাম। সেখানেই দেখেছি, আজকে ধাঁধা ধাঁধা খেললে জীবনে খুব উন্নতি করবো।

উষির বুঝলো, রাশার সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। উত্তরে ত্যাড়া কথা ছাড়া আর কিছুই বলবে না৷ তাই আর কষ্টও করলো না৷ আর কোন কথা না বলে মুখের উপর কল কেঁটে দিলো। ওর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে পাশে থাকা ছেলেটি চিন্তিত গলায় বললো,

–কিছু হইছে ভাই?

উষির ছেলেটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রাশার করা প্রশ্নটা তাকে করলো,

–মনে কর, একটা হাতির সামনে ১২টি কলা রাখা হলো। হাতিটা ১১টা কলা খেলো, কিন্ত ১টা কলা খেল না। কেন?

ছেলেটি দাঁত বের করে হাসলো,

–এতো খুব সোজা ভাই। ওই কলা প্লাস্টিকের আছিলো।

উষির বিষ্ময়ে ছেলেটির দিকে তাকাতেই ছেলেটির হাসি চওড়া হলো।

–এগ্লা তো পুরাতন জোকস ভাই৷ আপনে শোনেন নাই? গুগলে তো ম্যাল্লা আছে।

উষির সত্যি সত্যি গুগল করলো আর সাথে সাথে পেয়েও গেলো। রাশার করা বাকি প্রশ্নগুলোও গুগলে সুন্দর করে উত্তর সহ দেওয়া ছিলো। নিজের চরম গাধামিতে বরই মর্মাহত হলো সে। সিদ্ধান্ত নিল, আজকে বাড়িই ফিরবে না। মাঠে, ঘাটে, রাস্তায়, যেখানে খুশি রাত কাঁটাবে কিন্তু বাড়ি সে ফিরবেই না।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-২৩+২৪

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৩

–আমার দুই লাখ টাকার ব্যাগ!

আর্তচিৎকার করে উঠলো পাখি। নোঙর টাকার অ্যামাউন্ড শুনে দ্বিগুণ আঁতকে উঠলো৷ তারপর নষ্ট হওয়া ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আফসোসে বললো,

–এই ব্যাগ এতো টাকা দিয়ে কিনতে হবে! আমাকে তো ফ্রীতে দিলেও নেবো না।

তারপর পাখিকে নিজের ব্রাউন লেদারের চিকন ফিতার হোবো হ্যান্ডব্যাগ দেখিয়ে বললো,

–গুলিস্তান থেকে সাতশো টাকায় কিনেছি৷ পনেরো-শো দাম চেয়েছিলো। আমার ট্যালেন্টের জোরে সাতশো টাকায় কিনেছি। ওই দুই লাখ টাকার ব্যাগ, এই সাতশো টাকার ব্যাগের কাছে কিছুই না।’

নোঙরের চোখে মুখে দরদাম জেতার দম্ভ ফুটে উঠেছে। মিসেস ফ্লোরা কপাল কুঁচকে নোঙরের ব্যাগ উলটে পালটে দেখতে লাগলেন। সেও মহা উৎসাহে নিজের ব্যাগ দেখাতে লাগলো। পাখি এসব দেখে আরো রেগে গেলো৷ আগুন চোখে নোঙরের দিকে তেড়ে আসতে নিতেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে পরে গেলো। নোঙর দ্বিতীয়বারের মতো আঁতকে উঠলো। এবারে আগেরটার থেকেও বেশি তীব্র ছিলো,

–আমার জুতা!

চিৎকার এতো জোরে ছিলো যে শুটিংএ থাকা সবাই পাখির দিকে না তাকিয়ে ড্যাবড্যাব করে নোঙরকে দেখতে লাগলো। নোঙরের তো কান্না করার মতো অবস্থা হয়ে গেলো। অপলার জুতা! না জানি তাকে কি দিয়ে কি করে ফেলে!
নোঙরের এমন জুতার আহাজারি শুনে খানিক বিষ্ময়ে, খানিক রেগে চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো উজান। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেও উজানের দিকে সে এক ফোঁটা নজরও দেয়নি। ফলস্বরুপ উজানের চোখ গরম সম্পূর্ণ বৃথা গেলো। নোঙর আফসোস নিয়ে বললো,

–হিলটা বোধহয় আর বাঁচানো গেলো না!

উজান চাপা গলায় মৃদু ধমকের সুরে বললো,

–এমন ছোটলোকের মতো বিহেভ করছো কেনো? সামান্য জুতাই তো। একটা মানুষ পরে গেছে, সেটাতে সামান্য রিগ্রেট নেই?

নোঙর চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

–তোমার পাখি পরেছে তাই তুমি দুঃখ করো। আমার পাখি পরলে আমিও দুঃখ করতাম। আমার জুতার যদি কিছু হচ্ছে, আমি কিন্তু একদম ওই পাখা ছাটা পাখিকে ছাড়বো না। শুধু তাই না, তোমার কোম্পানিকে বয়কট করবো। কোনদিন কোন ড্রেস কেনবো না৷ চাকরিও ছেড়ে দেবো। এই তিনদিনের হিসাব আমাকে বুঝিয়ে দেবে। এই তিনদিনের টাকা যদি আমাকে বুঝিয়ে না দিয়েছো তো টাকা মেরে দেওয়ার কেস করবো বলে দিলাম।

নোঙরের সতর্কবাণী আর হুম’কিকে উজান পাত্তাও দিলো না। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করতে করতে বললো,

–তিন হাজার তো? এখনই দিচ্ছি। কিন্তু তারপর আর দ্বিতীয়বার অফিসে মুখও দেখাবে না।’

অপমানে নোঙরের মুখ থমথম করে উঠলো৷ উজান তাকে তিন হাজারের বদলে পাঁচ হাজার দিলো৷ নোঙর থমথমে মুখেই টাকা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো৷ তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে মডেল পাখির চিৎকার চেঁচামেচি দেখতে লাগলো।

অপলার হিল সত্যি সত্যি ছিড়ে গেছে৷ পাখির ডান পা এমন বেকায়দায় পরেছিলো যে, সে একেবারে মুখ থুবড়ে মাটিতে শুয়ে পরেছিলো। সবুজ রঙের গাউনটা সম্পূর্ণ মাটি মাটি হয়ে নষ্ট হয়ে গেলো। তার উপর তার চিৎকারে সবার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে৷ জুতা খুলে যতক্ষণ না হসপিটালে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠলো ততক্ষণ পর্যন্ত হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে থেকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো নোঙর। গাড়িতে উঠতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। উজান নোঙরের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো৷ তীক্ষ্ণ চোখে তার পরবর্তী গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছিলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। নোঙর জুতার কাছে গিয়ে ছেড়া জুতা হাতে তুলে ছেড়া অংশটুকু পরিক্ষা করতে লাগলো।

–এটা নিয়ে আর কি করবে। ফেলে দাও এখানেই। আমি নতুন জুতা আনতে বলছি।

হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠলো নোঙর। উজানের উপস্থিতির কথা তার খেয়ালই ছিলো না। সম্পূর্ণ মনোযোগ ছিলো জুতার দিকে। বাড়ি ফিরে অপলাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে সেটাও ভেবে পাচ্ছিলো না।
এখন উজানের কথা আমলে না নিয়ে জুতার ভালো পাটিটাও হাতে তুলে নিলো। তার পায়ে ছিলো শুটিং স্পটে থাকা একটা আধা পুরাতন স্যান্ডেল। স্যান্ডেলটা যে বহু পা ঘুরে যে তার পায়ে উঠেছে, সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দুই পাটি জুতা বাম হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললো,

–ফেলে দেবো! সেলাই করে আড়ামসে পরা যাবে।

উজান কড়া গলায় আদেশের সুরে বললো,

–সেলাই করতে হবে না৷ ফেলে দাও বলছি।

নোঙর একটু কাচুমাচু করে বললো,

—দিতে পারবো না।

উজান কিছুক্ষণ নোঙরের দিকে তাকিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর নোঙরের হাত থেকে জুতা নিজের হাতে নিয়ে নিলো৷ নোঙর আঁতকে উঠে বললো,

–ফেলবে না প্লিজ। অপু মেরেই ফেলবে আমাকে৷ এটা ওর জুতা।

সহসাই ভ্রু দুটো কুঁচকে গেলো উজানের। হাতে ধরা কালো রঙের হিলের দিকে তাকিয়ে নোঙরের দিকে দৃষ্টি দিলো,

–তোমার জুতা নেই?

নোঙর উশখুশ করে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বললো,

–ছিলো কিন্তু এই জামার সাথে এটাই ভালো মানাচ্ছিলো।

বলতে বলতে নোঙর লজ্জিত হলো৷ জামাটা উজানের জন্য শখ করে পরেছিলো। উজান একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখবে, এই আশায় পুরোটা দিন বসে ছিলো।

–তুমি লজ্জা পাচ্ছো নাকি? ব্লাশ করছো মনে হচ্ছে।

নোঙরের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো উজান। নোঙর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,

–লজ্জা আর আমি! কিসব পাগলের প্রলাপ বকছো!

বলে আরেকটু লজ্জা পেলো সে। উজান দাঁড়িয়ে নোঙরের দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আঙুল উঁচিয়ে বললো,

–সেটা অবশ্য ঠিকি বলেছো কিন্তু এই চোখ.. তোমার বড় বড় চোখগুলো কেমন একটা হয়ে গেছে৷ তাকানোটা কেমন কেমন মনে হচ্ছে।

নোঙর চট করে নিজের চোখে হাত দিলো,

–কই, কিছু হয়নি তো৷ ভুল দেখেছো হয়তো।

উজাম মাথা নাড়লো,

–উহু, আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ না।

নোঙর চোখ বুজে ঠোঁট চেপে জবাব দেওয়ার জন্য কথা ভাবলো৷ অনেক ভেবেও কিছুই পেলো না৷ উজান হিল উঁচু করে ধরে বললো,

–এটা ফেলে দেই। অপলাকে নতুন জুতা কিনে দিচ্ছি।’

নোঙর প্রবলবেগে মাথা নাড়লো,

–এটা ও নিজে টাকা জমিয়ে কিনেছিলো। শুধু টাকা দেখলে হয় না৷ ইমোশনটাও ম্যাটার করে।’

উজানের গাড়ি বড় রাস্তায় পার্ক করা ছিলো। এখনও কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। সন্ধ্যাও পরে যাবে একটু পর। হাঁটা পুনরায় চালু করে উজান বললো,

–ইমোশন! তুমি কিছুক্ষণ আগে যে ব্যাগটা নষ্ট করলে, সেটাও কারো প্রিয় ব্যাগ ছিলো।

নোঙর মুখ ভেঙচে বিড়বিড় করে পাখি আর উজান, দুজনকেই আচ্ছামত বকলো। উজান নোঙরের বিড়বিড় বুঝতে পারলো। কিন্তু কি বললো সেটা বুঝলো না। এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই নোঙর উজানের শার্টের হাতা টেনে কানের কাছে মুখ এনে পিছনে আঙুল দেখিয়ে ফিসফিস করে বললো,

–এরা আমাদের পিছে আসছে কেন?

নোঙর শার্ট টানায় একটু ঝুঁকে এসেছিলো উজান। মুখ নোঙরের মাথার কাছে চলে এসেছিলো। এতোটা কাছে যে তার সাবধানি নিশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট পেলো। মূহুর্তেই হার্টবিট বিদ্রো’হ করে উঠে নিজের ইচ্ছামতো ছোটাছুটি করতে লাগলো। ঢোক গিললো উজান। মাথাটা আরেকটু নিচু করলেই নোঙরের মুখোমুখি হয়ে যাবে। হঠাৎই গলার কণ্ঠনালীর কাছে ওই উঁচু হাড়টা নড়ে উঠলো। ছোটাছুটি করা হার্টবিটের সাথে সাথে সেও বোধহয় বিদ্রোহ করে উঠলো। ইংরেজিতে অ্যাডামস অ্যাপেল আর বাংলাতে কণ্ঠমণি নাম হলেও আজ উজানের জন্য অন্য নামকরণের সূচনা তৈরি করছে সে। তার অলক্ষে, অবাধ্যে। নোঙরের আবার ডাকে টনক নড়লো তার। সোজা হয়ে গলা খাঁকারি দিলো। তারপর পিছনে এক পলক তাকিয়ে বললো,

–ওরা গার্ড, তাই আসছে।

নোঙরের চোখ কপালে উঠলো,

–তুমি গার্ড নিয়ে ঘোরো?

বলেই আবার পিছনে তাকালো। তাদের থেকে গার্ডদের দূরত্ব ফুট কয়েক দূরে। পাশাপাশি চলা পাঁচ ছয়টা গার্ড একই পোশাকে একই ভাবে হেঁটে আসছে। দুজনের হাতে আবার লম্বা নলওয়ালা বন্দু’কও আছে।

নোঙরের বারবার তাকানোতে বিরক্ত হলো উজান। কর্কশ গলায় বললো,

–এভাবে বারবার তাকাচ্ছো কেনো? বাজে দেখায়। সামনে তাকাও।

নোঙর সামনে তাকালো বটে কিন্তু থমকে দাঁড়ালো৷ আরেকবার পিছনে তাকিয়ে বললো,

–এদের তো আগে দেখিনি।’

উজান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–সারা রাস্তা ঘুমিয়ে কাঁটালে আর গাড়ি থেকে নেমে পিছন ফিরে না তাকালে দেখবে কিভাবে?

নোঙর আবার অবাক হলো। তাদের সাথে সাথে পিছনের গার্ডরাও দাঁড়িয়ে পরেছে৷ আবার তাকালো সেদিকে৷ তাজ্জব বনে যাওয়া মুখে বিষ্ময়ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে,

–শুরু থেকেই ছিলো?

রাগে মুখ থমথমে হয়ে গেলো উজানের৷ কঠিন গলায় দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

–জ্বি, অনেক আগে থেকেই ছিলো।

–বিয়ের দিনও?

নেহাতই বাচ্চাসুলভ প্রশ্ন। তাতেও উজানের রাগ উঠে গেলো। প্রায় ধমকে উঠে বললো,

–হ্যাঁ ছিলো। তাকে কি হয়েছে? এখন কি যাবে নাকি সারারাত এখানেই কাঁটানোর ইচ্ছা আছে?

নোঙর এপর্যন্ত উজানের রাগকে না এক ফোঁটা গুরুত্ব দিয়েছে, আর না ভয় পেয়েছে৷ উলটে আরো উৎফুল্ল হয়েছে। এবারেও তাই হলো। পিঠে লেপ্টে থাকা বিনুনি সামনে এনে একটু ভেবে বললো,

–কোথায় ছিলো?

–বাইরে ছিলো।

কপট রাগে উত্তর দিলো সাদী। হা-হুতাশ করে উঠলো শীতল,

–ইসস! আগে কেন দেখলাম না!

রাগে, বিরক্তিতে উজানের কপাল আগে থেকেই কুঁচকে ছিলো। আরো কুঁচকে গেলো। ছোট ছোট চোখগুলো আরো কুঁচকে যাওয়াতে মোটা ভ্রুর নিচে থাকা চোখগুলো প্রায় দেখাই গেলো না। সেভাবেই ঠান্ডা স্বরে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো,

–দেখলে কি হতো?

নোঙএ উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

–সালমান খানের বডিগার্ড ফিল্ম দেখেছো?

–না, আমি ফিল্ম দেখি না। টাইম ওয়েস্ট।

নোঙর মুখ ভেঙচে বললো,

–রসকষহীন মানুষ হলে যা হয় আরকি। যদি দেখতে তাহলে এইসব ছেড়েছুড়ে বডিগার্ড হতে চাইতে। আমার কত শখ ছিলো, সালমান খানের মতো বডিগার্ডকে বিয়ে করবো। তোমার বডিগার্ডের মধ্যে ওই মাঝেরটাকে আমার সেই লেগেছে। দেখতেও সালমান খানের কাছাকাছি বলা চলে। ও হলে সেই হতো৷ এখন আর কোন উপায় নেই না?

নোঙরের শেষের কথাগুলোতে ভীষণ আফসোস মেশানো ছিলো। উজানের চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। পিছনে তাকিয়ে অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললো,

–কোনটা?

–ওইতো, ডান থেকে দুই নাম্বারটা। ছোট চুল, কানে ব্লুটুথ ইয়ারফোনের মতো লম্বা কি জানি আছে। ড্রেসাপ চেঞ্জ করে স্যুট পরতে বলবে তো। এইরকম হাফ হাতার শার্টে কেমন লাগছে। স্যুট পরলে অস্থির লাগতো। ইসস! কত কাজ করাও এদের দিয়ে? রোদের তাপে চামড়া পু’ড়ে গেছে। টমেটোর একটা প্যাক আছে। আমি বানিয়ে দেবো। টানা কিছুদিন ব্যবহার করলেই ঠিক হয়ে যাবে।

মহা উৎসাহে বর্ণনা দিয়ে গল্প করলো নোঙর। উজান চিনলো তাকে। লম্বা চওড়া, স্বাস্থ্যবান গার্ডটির জয়েন তিন চারমাস আগেই হয়েছে৷ চাকরিতে বেশ সিনসিয়ারই বলা চলে। ছেলেটার একাগ্রতা বেশ পছন্দ করে সে। পছন্দের এই ছেলেটি অপছন্দের হয়ে উঠতে সময় নিলো না। উজানের মুখের রাগত ভাব সন্ধ্যার অন্ধকারে অনেকটাই ঢেকে গেছে। তবে মনে ঢাকলো না। সময়ের সাথে সাথে পারদ স্কেলে আরো বাড়তেই লাগলো।

উজান তড়িৎগতিতে নোঙরের হাত চেপে ধরলো। এক হাতে নোঙরের ছিড়ে যাওয়া হিল আরেক হাতে নোঙরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। উজানের এই ব্যবহারের সাথে নোঙর ভীষণ অপরিচিত। বিয়ের পর প্রথমবার নিজে থেকে হাত ধরলো সে। কোথায় মনে একটু অন্যরকম অনূভুতি লুটোপুটি খাবে, তা না। উলটো আরো হাত ব্যাথা করছে। সেটা নিয়েও মনে মনে এক প্রস্থ বকে নিলো।

পুরো রাস্তা প্রথমদিনের মতোই ঘুমিয়ে থাকলো নোঙর। বাড়ির কাছে পৌঁছে তাকে ডেকে দিতে চাইলো উজান। তবে ভালোভাবে ডাকলে তো আর সে নোঙর খন্দকারের অর্ধাঙ্গ হতো না।
উজান গাড়ির স্টোরেজ খুলে ভেতর থেকে সেফটি পিন হাতে নিলো। প্রথমদিন নোঙরই স্কার্ফের ঝুলের সাথে সেফটিপিনও গাড়িতে ফেলে গেছিলো। সেদিন জিম শেষে এটার সাথেই আচ্ছতো ঘা খেয়েছিলো সে। আজকে নোঙরের পালা। আর অপেক্ষা করালো না তাকে। নোঙরের কোলের উপর রাখা হাতে খুব সাবধানে সেফটিপিনের সূঁ’চা’লো অংশ দিয়ে খোঁচা দিলো। মূহুর্তেই ধরফরিয়ে উঠলো সে। উজানের কুটিল হাসি বুঝতে পেরে হাত ডলতে ডলতে ভ’ষ্ম করে দেওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে হড়বড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো৷ তবে গাড়ির দরজার সাথে নিজের শক্তিপরীক্ষা করতে ভুললো না। সশব্দে দরজা বন্ধ করে হনহনিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।

রাস্তায় জ্যামে বসে সিটের ফাঁকে নোঙরের রাবারব্যান্ড নজরে পরতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। গাড়ির স্টোরেজে সেটা রাখতে রাখতে ঝুলিতে রাখা ইংরেজি ভাষার ভদ্র সভ্য গালিগুলো নিজের উদ্দেশ্যেই ছুড়ে দিলো। ঠিক এইগুলো আর কতদিন চলবে কে জানে!

****
অপলা তার শখের হিল ছিড়ে যাওয়ার ধাক্কাটা পাওয়ার আগেই উজানের অফিস থেকে পাওয়া অফিসিয়াল মেইলের ধাক্কাটা পেয়েছিলো। জুতা ছিড়ে যাওয়ায় অফিসিয়ালি তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে তারা। সাথে ক্ষতিপূরণও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে পুরো পাঁচ হাজার টাকা। মেইলে টাকার নোটের নাম্বারগুলো পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। আবার ক্ষতিপূরণটা যে নোঙর খন্দকারের কাছেই দিয়েছে, সেটাও স্পেশাল ভাবে উল্লেখ করা আছে। একদম বড় বড় ফন্টে লেখা ছিলো,

“ক্ষতিপূরণের টাকা মিসেস নোঙর খন্দকারের কাছ থেকে বুঝে নেবেন।”

শেষে সাইন হিসেবে ছিলো কোম্পানির এমডি আজলান কায়সার এর সাইন।

উজানের পুরো নামটা সাবার জানা ছিলো। বাড়িতে উঠতে বসতে মাহফুজা আর তার পুরো পরিবারের নাম উচ্চারণ করা হয়। তাও প্রতিবারই পুরো নামটা উচ্চারণ করে। ফুপার নাম নেয় বাবা, কাকা আর দুলাভাইয়ের নাম নিচ্ছে তার সদ্য বিবাহিত বউ। মেইল পাওয়ার পর পরই পুরো বাড়ি জুতা ছেড়ার ঘটনা আর ক্ষতিপূরণের ঘটনা ছড়াতেও দেরি করলো না সে। দেরি করলে আবার যদি টাকা ফেরত না পায়!

নোঙর পৌঁছানোর আগেই অপলার মেইল এসে গিয়েছিলো। তাই নোঙর বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই অপলা ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিয়েছে,

–আমার টাকা ফেরত দাও আপু।

প্রথম দিকে তো নোঙর কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু ঘটনা জানতে পারার সাথে সাথেই মুখ থমথমে হয়ে গেছে৷ বরের দেওয়া প্রথম টাকা, উপহার যেটাই বলা হয়, সেটা হলো ওই পাঁচ হাজার টাকা। সেটা কিছুতেই সে হাতছাড়া করবে না।
এরমাঝে সব থেকে বেশি রাগ হলো উজানের প্রতি। নিজে যেচে টাকা দিয়ে আবার সেই টাকাকেই কি কৌশলে ব্যবহার করতে চাচ্ছে! একেই বলে ব্যবসায়ী! নোঙর খুব ভালো করে ব্যাপারটা শিখে নিলো। অন্য সময় কাজে লাগানো যাবে। তবে যাই হোক, টাকাটা তো হাত ছাড়া করা যাবেই না। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,

–আর একবার টাকার জন্য আসবি তো এই টাকা দিয়ে তোর চল্লিশা করবো।

অপলা যে কথাটাতে খুব ভয় পেয়েছিলো তেমনটা না। কিন্তু আর কিছু বলেওনি। আবার থেমেও থাকেনি। রাতে নোঙরের বাবা ফিরতেই অভিযোগের খাতা নিয়ে বসেছিলো সে। টাকা তার ফেরত চাই-ই চাই। তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে নোঙরকে বলে উঠেছিলো,

–তুমি যদি আমার টাকা ফেরত না দাও তাইলে কিন্তু আমি দুলাভাইকে কল করে বলবো, আমার টাকা তুমি মে’রে দিছো।

নোঙর দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলো,

–যা কর৷ তাও দেবো না।’

নোঙরের বাবা পাশ থেকে ধমকে উঠে বললেন,

–নোঙর, তুমি টাকা ফেরত দাও। খন্দকারদের একটা মানসম্মান আছে। এই ঘটনা ওরা জানতে পারলে কি হবে বুঝতে পারছো? মাহফুজার শ্বশুরবাড়ির সামনে আমাদের মুখ ছোট করতে পারবো না। ‘

নোঙর টাকা কিছুতেই ফেরত দেবে না। কিছুতেই না মানে কিছুতেই না। আবার বাবার কথা ফেলাও যায় না। তাই মিনমিন করে বললো,

–ওইটা আমার বেতনের টাকা ছিলো।’

এবারে কথা বললো নোঙরের মা। ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলেন,

–তুই কি দিনমজুরির কাজ করতিছিস নাকি যে ডেইলি বেজ টাকা দিয়েছে। তিনদিন অফিস করার টাকা কোন অফিস দেয়?

–শ্বশুরবাড়ির অফিসে হাজবেন্ড দেয়।

এবারেও নোঙর বেশ আস্তে করে বিড়বিড়িয়ে উত্তর দিলো। কথাটা নিহানের কানে গেলো৷ ভ্রু কুঁচকে ফিসফিস করে নোঙরকে জিজ্ঞাসা করলো,

–শ্বশুরবাড়ির অফিসে সব লিগ্যাল? মানে সব কাজ করা যায়? যা মন চায় সব?

কণ্ঠে তুমুল উত্তেজনা আর অবিশ্বাস। নোঙর আড় চোখে নিহানের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। ফিসফিস করে বললো,

–অফিসে কোন কাজ না করেও থাকা যায়৷ সারাদিন পুরো ফ্লোর ঘুরলেও কেউ কিছু বলে না। আবার দেরি করে গেলেও অফিসে ঢুকতে দেয়। কিচ্ছু বলে না। কোন কাজেই কারো টু শব্দ করার সাহস হয় না। যখন ইচ্ছা ঢোকা যায় আর বের হওয়া যায়।

সত্য মিথ্যা মিশিয়ে বেশ রসালো গল্প তৈরি করলো সে। মনে মনে ফুপির কথা মনে করে নিজেকে শান্তনা দিলো, নিজেদের অফিস। যখন ইচ্ছা যাবো যখন ইচ্ছা বের হবো!

–ওর টাকা ফেরত দিয়ে দাও। খন্দকারদের নাক কেঁটো না।

নোঙরের বাবা গম্ভীর গলায় বললেন। নোঙর তখন নিহানের সাথে কথা শেষ করে আপন মনে কিছু সত্য মিথ্যা কথা সাজাচ্ছিলো। বাবার কথায় বেশ রাগই করলো। মুখ কালো করে অপলাকে প্রশ্ন করলো,

–তোর হিলের দাম কত?

অপলা উশখুশ করে বললো,

–নয়শো। কিন্তু আমার ক্ষতিপূরণের পুরা টাকাটাই চাই। মেইলে টাকার নাম্বারগুলোও দিয়েছে।

রাগে নোঙরের মাথায় আগু’ন জ্ব’লে উঠলো। অ’গ্নি বর্ষণ করা চোখে তাকিয়ে বললো,

–ঘরে চল, দিচ্ছি।

অন্তু চেঁচিয়ে উঠে বললো,

–যেও না আপু৷ টাকা ফেরত কিন্তু পাবা না।

অপলা সজোরে মাথা নেড়ে অন্তুর কথায় স্বায় দিলো। ঘরে গেলে যে তার টাকা কত ফেরত পাবে, তা তার ভালো করেই জানা আছে! শীতলের অ’গ্নি দৃষ্টি উপেক্ষা করে স্পষ্ট গলায় বললো,

–এখানেই এনে দাও৷ আমি ঘরে যাবো না।’

নোঙর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

–জীবনে কি ঘরে ফিরবি না?

–নোঙর!

মা ধমকে উঠে বললেন। নোঙর মনে মনে জেঠা, জেঠিকে মিস করলো। তারা দুজনেই আজ বাড়িতে নেই। আর সেই সুযোগটা অপলা খুব ভালোমতো কাজে লাগিয়েছে।
থমথমে মুখে যখন টাকা ফেরত দিলো তখন অপলা অত্যান্ত অবিশ্বাসী মুখে টাকার নোটের নাম্বার মিলাতে লাগলো। মিলাতে না পেরে চিৎকার দিয়ে উঠে বললো,

–এইগুলা তো আমাকে দেওয়া টাকা না। তুমি আমার টাকা রেখে দিছো!

নোঙর কটমট করে তাকিয়ে বললো,

–টাকার মান তো বদলে যায় নাই। তাহলে সমস্যা কি?

–তোমার নীতির ঠিক নাই আপু। তোমাকে আর বিশ্বাস করবো না।

মাথা নেড়ে আফসোসে কথাটা বললো অপলা। তারপর টাকা নিয়ে নিজের ঘরে গেলো। নিহান মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বললো,

–খন্দকারদের নাক কেঁটে দিলি রে!

তারপর এক পিস মুরগী কেনার লোভে নিহান আর এলাকায় খোলা নতুন বার্গারের দোকানের বার্গার খাওয়ার লোভে অন্তু অপলার পিছু নিলো।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২৪

উষিরের জ্বর এক রাতেই সেরে গেলো। কিন্তু দুর্বলতার বাহানায় পরেরদিন বিছানা থেকে একফোঁটাও উঠলো না। খাওয়া নিয়েও ঝামেলা পাকালো। সেসব অবশ্য শাহিদাই সামলালো। পুরোটা দিন রাশা মুখ থমথমে রেখেছিলো। মা ছেলের এহেন ভালোবাসার নমুনা তার কাছে বহু পুরোনো। ছেলে খেতে চাইবে না আর মা খাবার নিয়ে পিছে পিছে ঘুরবে। তার বাড়িতে এসব নিত্যদিন চলতো৷
সারাদিন এমন বাহানা করার পর রাত্রেবেলা তেতো মুখের অযুহাতে কিচ্ছু খেলো না। উষিরের এমন নখরামি সারাদিন সহ্য হলেই রাত-বিরেতের নখরামি রাশার আর সহ্য হলো না। উষিরের ক্ষিদে পেয়েছে ভীষণ। ক্ষিদের জ্বালায় ঘুমোতে পারছে না। একটার সময় তাকে গভীর ঘুম থেকে জাগিয়ে বাহনা ধরেছে। এখন গরম গরম কিছু খেতেই হবে। অসুস্থ মানুষের উপর রাগতে হয় না। রাগটা সে গিলে ফেললো। মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখে উষিরকে জিজ্ঞাসা করলো,

–কি খাবে?

রাশা ফোনে রেস্টুরেন্ট খুঁজছিলো। সচরাচর এতো রাতে সব রেস্টুরেন্টই বন্ধ থাকে। আবার খোলা থাকলেও হোম ডেলিভারি দেয় না। এতো রাতে আদুরে বাচ্চাদের মতো বাচ্চাসুলভ ন্যাকামির অভ্যাস তার নেই। তাই জানেও না, কোন কোন রেস্টুরেন্ট রাতেও হোম ডেলিভারি দেয়। তবে তার বরের বোধহয় আছে। সেইজন্যই এতো রাতে গরম গরম খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। উষিরের ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হলো না। মোবাইল নেওয়া দেখেই শোয়া থেকে উঠে বসলো। কপালে ভাজ ফেলে জিজ্ঞাসা করলো,

–খাবার বাইরে থেকে অর্ডার করবে?

রাশার ভ্রু জোড়া কুঁচকে তির্যক মন্তব্য করলো,

–তা নয়তো কি করবো? এখন আন্টিদের জাগিয়ে তো রান্নার কথা বলতে পারি না। ময়নাকেও তো জাগানো ঠিক হবে না। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত সবাই। তাহলে রান্নাটা কে করবে?

–অসুস্থ মানুষের বাইরের খাবার খেতে হয় না। এক কাজ করো, তুমি রান্না করো।

উষির বেশ একটা সমাধানে আসলো। রাশার ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে গেলো। কপট বিষ্ময়ে নিজের দিকে আঙুল উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,

–তুমি আমার রান্না খাবে?

উষির বাবু দিয়ে বসে মাথা উপর নিচ করে গদগদ স্বরে বললো,

–গবেষণা বলে, বউয়ের হাতের রান্না খেলে বর সুস্থ হয়ে ওঠে। এখন ঝটপট আমার জন্য স্যুপ করে নিয়ে আসো।

রাশার চোখে মুখে এবারে দুষ্টুমি খেলা করলো। হাসি আটকে ভ্রু নাচিয়ে আবার প্রশ্ন করলো,

–আর ইউ সিওর?

উষির ফুল কনফিডেন্সে মাথা উপর নিচ করে ঝাকালো। আহ্লাদে রাশাকে একবার জড়িয়েও ধরতে চাইলো কিন্তু রাশা তো রাশাই। হাতের ফোন উষিরের মুখের উপর ছুড়ে ফেলে হনহন করে চলে গেলো। উষির নাকে আর কপালে ব্যাথা পেয়েছিলো। বউয়ের দেওয়া এই এই ব্যাথাটাও হাসিমুখে হজম করে দিলো।

রাশা প্রায় দের ঘন্টা পর ক্লান্ত, ঘামাক্ত শরীরে ঘরে ফিরলো। দেখে মনে হলো, রান্না কম করেছে, যুদ্ধ বেশি করেছে। উষিরের মায়া হলো খুব। ইসস! বউটা বোধহয় এর আগে রান্নাবান্না কিছু করেনি। আজকে কত ভালোবেসে তার জন্য রান্না করলো। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। রাশা ছোট ল্যাপটপ টেবিলটা উষিরের সামনে রেখে তার উপর স্যুপের বাটি রাখলো। টলটলে স্যুপ দেখে উষিরের মুখের হাসি হাওয়া হয়ে গেলো। বড়সর ঢোক গিলে প্রশ্ন করলো,

–এটা কি স্যুপ নাকি স্টু?

–স্যুপ।

রাশার গম্ভীর গলার উত্তর৷ উষির কি বলবে ভেবে পেলো না।

–কিসের স্যুপ এটা?

–মিট স্যুপ।

–কিসের মাংস?

–জানি না। ফ্রিজে যেটা সামনে পেয়েছি সেটাই নিয়েছি।

উষির ঢোক গিললো,

–ইন্সট্যান্ট স্যুপ বানিয়েছো তো?

রাশার মাথা ঘুরে উঠলো। মুখের ঘাম মোছা বাদ দিয়ে চোখ বড় বড় করে উষিরের দিকে তাকিয়ে বললো,

–রান্নাঘরে ইন্সট্যান্ট স্যুপ ছিলো? তাহলে আমি এতোক্ষণ এতো কষ্ট করলাম কেনো!

উষির হাল ছেড়ে দিলো। মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো। দেখতে যেমনই হোক, খেতে মজা হলেই হলো। ভয়ে ভয়ে এক চামচ মুখে তুলতেই মুখের রঙ গায়েব হয়ে গেলো। কোনমতে মুখের টুকু গিলে পুরো এক গ্লাস পানি খেলো। রাশার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,

–তুমি এর আগে কখনও রান্না করেছো?

রাশা কৌতুহলী দৃষ্টিতে উষিরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। খাওয়ার সময় তার মুখের অবস্থা দেখেই যা বোঝার বুঝে গেছে। রান্নার সময় এই ভয়েই সে টেস্ট করেনি।

–হ্যাঁ।

–সেগুলো খাওয়া গেছে?

–না।

রাশা নির্লিপ্ত স্বরে বলে উষিরকে হতভম্ব করে দিয়ে বিছানা ছাড়লো। ক্লোজেট থেকে জামাকাপড় নিয়ে গোসলে গেলো। এতোক্ষণ কষ্ট করে রান্না করেছে, গোসল না করলে হয় নাকি! উষির কি করবে ভেবে পেলো না। স্যুপের বাটি রান্নাঘরে রাখতে গেলো। রান্নাঘর দেখে মনে হলো, সত্যিই সেখানে একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে। এক স্যুপ বানাতে যে কয়টা হাড়ি ব্যবহার করেছে, তার ইয়াত্তা নেই। এক এক করে সবগুলো মশলাই যে ব্যবহার করা হয়েছে সেটা রান্নাঘর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো উষির। রাশা এসব ইচ্ছে করে করেছে নাকি অনিচ্ছাকৃত হয়ে গেছে, ঠিক বুঝলো না। কিন্তু এই অগোছালো রান্নাঘর দেখে মা, ছোট মা আর ময়নার উপর বেশ করুনা হলো। করুনা করেই হোক আর বউয়ের কীর্তি ঢাকতেই হোক, ঘন্টা নিয়ে সব পরিষ্কার করে তবেই ঘরে ফিরলো। রাশা ততক্ষণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমন্ত রাশাকে দেখে মুচকি হাসলো উষির। দরজা, লাইট বন্ধ করে রাশার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পরলো। এখনও প্রথমদিনের মতোই তার বউ ঘুমের ঘোরে অজান্তেই তার কাছে চলে আসে। তবে সে প্রথমদিনের মতো বিরক্ত হয় না। এমনকি এখন যে তার বউ তারই টি-শার্ট পরেছে, সেটা নিয়েও বিরক্ত হলো না। তবে উজান দেখলে হয়তো ভড়কে যেতো। এই টি-শার্ট জোড়া ধরে কেনা হয়েছিলো। একটা উজানের আর একটা তার। এবং পছন্দটা উজানেরই ছিলো। পছন্দের টি-শার্ট রাশাকে পরা দেখার পরের রিঅ্যাকশনটা ভেবেই হেসে ফেললো।

উষিরের আশংকা সত্যি হয়েছিলো। উজান রাশাকে দেখেই কাশতে কাশতে নাকে পানি উঠে গেছিলো। বেচারা খেতে বসেছিলো। খাওয়াটাও হয়ে উঠলো না। প্লেটে আধ খাওয়া রুটি অমনি পরে রইলো। শুধু কফিটা মন দিয়ে শেষ করতে লাগলো। রাশাকে দেখে শাহিদার গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পরলো। আবার রাগটাও পরেনি। তাই বৃষ্টি আর বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–অনুষ্ঠানের বেশি দেরি নেই। শপিং যা করার করে ফেল। কার কি লাগবে না লাগবে, তার লিস্ট করতে হবে। যার অনুষ্ঠান সে যেনো রিসেপশনের ড্রেস অর্ডার করে ফেলে। আর বাদ বাকি যা যা লাগবে তাও যেনো তাড়াতাড়ি কিনে ফেলে।

রাশা ভ্রু কুঁচকে শাহিদার দিকে তাকালো। কথাটা সরাসরি তাকে বললে বোধহয় সে কিছু মনে করতো না। এমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছে কেনো? কিছু কি হয়েছে নাকি?
মাহফুজা রাশার ভাবনার সুতা কাঁটলো। বৃষ্টি বন্যার পরীক্ষা চলছে। তারা খেতে বসে পরছে আর মাহফুজা খাইয়ে দিচ্ছে। তাদের খাওয়াতে খাওয়াতেই বললো,

–নোঙরকে নিয়ে শপিংএ যেও। দুই বউয়ের মধ্যে ভাবসাব হতে হবে তো। নাহলে শুরুতেই একে অপরকে হিংসা করা শুরু করবে। আজকালকার মেয়েদের বোঝা মুশকিল!

রাশা চোখ মুখ কুঁচকে এবারে মাহফুজার দিকে তাকালো। তার সাথে এসব হচ্ছেটা কি! মাথা নেড়ে কথাগুলো ঝেড়ে ফেললো। প্লেটে রুটি নিয়ে কি দিয়ে খাবে সেটা দেখতে দেখতেই উজানের কথা কানে আসলো,

–নো ওয়ে মা। এতো বারবার অফিস টাইমে ছুটি দিলে বাকি স্টাফদের মনে কি প্রভাব পরবে? সবাই তো এটাই ভাববে যে বসের ফ্যামিলি মেম্বার জন্য তাকে আলাদা ফ্যাসিলিটিস দেওয়া হচ্ছে, তার জন্য আলাদা রুল ক্রিয়েট করা হচ্ছে।

রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরা এমন ভাবে কথা বলছে যে মনে হচ্ছে কালকেই অনুষ্ঠান আর আজকেই সব শপিং শেষ করতে হবে। অন্যদিকে মেয়েদের খাওয়ানো রেখে মাহফুজা ক্ষোভ প্রকাশ করলো,

–তুইও তো অফিস টাইমেই বের হয়ে চলে আসিস। তখন কিছু হয় না?

–আমি বস আর ওরা এমপ্লয়ি। বোথ আর নট সেম। আর আমি কাজের জন্য বের হই। ওর মতো মন ইচ্ছা বের হই না। আত্মীয় জন্য যা খুশি করলে তখন বাকিরা একে একে অফিস থেকে চলে যাবে। কেউ কাজ করতে চাইবে না।

এবারে শাহিদা নিজের কাজ ফেলে রান্নাঘর থেকেই গলা তুলে পালটা জবাব দিলো,

–আত্মীয় তো ঘরের মানুষই তাই না?

রাশা চট করে শাহিদার দিকে তাকালো। ওপেন কিচেনের বদৌলতে ডাইনিং এড়িয়া থেকে কিচেনের সবটাই দেখা যায়। শাহিদাকে সরাসরিই দেখা গেলো। প্রতিবাদি হয়ে উঠলো রাশা। তেজি স্বরে বললো,

–একদমই না। এখন কি মেহজাবিনকে ঘরের মানুষ ভাবতে হবে নাকি?

রাশার প্রতি শাহিদার মন গলতে শুরু করেছিলো। এই কথায় এক লাফে আবার আগের অবস্থায় চলে আসলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে হাতের সবজি সর্বচ্চ শক্তিতে ঝুড়িতে রাখলো। মাহফুজা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঝটপট বললো,

–একদিনই তো আসবে। নিজেদের অফিস, যদি এইটুকু সুযোগ না পায় তাহলে নিজেদের অফিস হয়ে লাভ কি হলো!

সাথে কান্না ফ্রী ছিলো। বৃষ্টি আর বন্যার চোখ বইয়ে থাকলেও কান শপিং এর আলোচনায় ছিলো। আচমকা মায়ের কান্নায় তারা থতমত খেয়ে তাকালো। শাহিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

–উজান, মাকে কাঁদাচ্ছিস কেন?

–ওকে, যা ইচ্ছা করো।

বলেই উজান রেগে উঠে চলে গেলো। মাহফুজা চোখ মুছে আবার বৃষ্টি আর বন্যাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। শাহিদা রান্নাঘরে সবজি আলাদা করে রাখছিলো। হঠাৎ রাশার দিকে নজর পরতেই দেখে রাশা আড়চোখে মাহফুজার খাইয়ে দেওয়া দেখছিলো আর মুখে মলিন হাসি নিয়ে নিজের খাবার খাচ্ছিলো। শাহিদার বুকটা কেমন একটা করে উঠলো। সেও বাড়ির আদরের মেয়ে ছিলো। মায়ের আঁচলের তলায় থেকেই মানুষ। শ্বশুরবাড়ি এসেই পরিবারের দ্বায়িত্ব মাথায় চেপে বসে। একটা মেয়ে যে নিজের পরিবার থেকে অন্য একটা পরিবারে এসেছে, সেখানে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটা কেউ বুঝতেই চাইতো না। সবসময় পরপর করেই রেখেছিলো সবাই। মাহফুজাকে তিনি এই কষ্টটা বুঝতে দেয়নি। শ্বশুর শাশুড়ি তখন গত হয়েছেন। বড় সংসার ভেঙে ছোট হয়েছে। সেই ছোট সংসারের রাশ তখন তার হাতে। বড় বোনের মতো আগলে রেখেছিলো তাকে। নিজে যে কষ্টটা পেয়েছিলো সেটা আর কেউকে পেতে দিতে চায় না। রাশাও কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো মায়ের কথা খুব মনে পরছে। বাড়িতে হয়তো তার মা-ও এমন তুলে খাইয়ে দিতো৷ শাহিদার বুকটা হুহু করে উঠলো। মেয়েটার উপর রাগ করে আছে ঠিক আছে৷ কিন্তু তাকে এমন মানুষিক পিড়া দেওয়ার অধিকার তার নেই। রাশার বাড়ির খবর তিনি জানে না। কিন্তু তিনি রাশাকে দেখলো, কষ্ট পেলো। নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভাব বজায় রেখে ধমকেও উঠলো,

–কি পাখির মতো টুকুর টুকুর করে খাচ্ছো? ভালো করে খেতে পারো না?

রাশা থতমত খেয়ে শাহিদার দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলো। বন্যা পাশ থেকে আস্তে করে শিখিয়ে দিলো,

–বড় করে হা করে পুরো রুটিটা মুখে পুরে নাও।

রাশা ঢোক গিলে সায় জানালো। আচমকা ধমকে রাশা সত্যিই ভয় পেয়েছে। বুক এখনও কাঁপছে৷ শাহিদা নিজের কাজ ফেলে এগিয়ে এসে রাশার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। তারপর প্লেট থেকে এক টুকরো রুটি ছিড়তে ছিড়তে বকবক করতে লাগলো,

–বাড়ি থেকে কি শুধু ঝামেলা পাকানো শিখে এসেছো?

রাশা তাজ্জব বনে শাহিদার কর্মকান্ড দেখতে লাগলো। মুখের কাছে খাবার এলেও রাশা হকচকিয়ে বসে রইলো। তাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শাহিদা ধমকে উঠলো,

–তাড়াতাড়ি খাও। আমার অনেক কাজ আছে।

রাশাকে লাস্ট কবে কে খাইয়ে দিয়েছিলো, তার মনে নেই। বোধহয় হাত দিয়ে খাওয়া শেখার পর আর কেউ খাইয়ে দেয়নি। কোনদিন যে কেউ তাকে খাইয়ে দেবে সেটাও ভাবেনি। চোখ ভিজলো, গলা কেঁপে উঠলো। একসময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠে দুই হাতে শাহিদার কোমড় জড়িয়ে ধরলো।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-২১+২২

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২১

বৃষ্টিতে ভিজে উষিরের সর্দি ভাব এসেছে। মাথা চোখ ভার হয়ে আছে৷ সারাটা রাস্তা রাশার কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছিলো। রাশা বিরক্ত হয়েছে আবার উষিরের অসুস্থ মুখ দেখে মায়াও হয়েছে। সেইজন্যই বোধহয় টু শব্দটিও করেনি। তবে বেশি বিরক্ত হয়েছে দীর্ঘ জ্যামে বসে থেকে৷ দুই তিন ঘন্টার রাস্তা জ্যামের কারণে চার পাঁচ ঘন্টা লেগে গেলো। গাড়ি বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই পরিচিত দুই তিনটা গাড়ি তার নজরে পরলো। বাইরে কালো পোশাকধারী অনেক গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। তারাও পরিচিত। ভীত হলো রাশা। তটস্থ হয়ে দুরুদুরু বুকে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। যা ভেবেছিলো ঠিক তাই। লিভিংরুমের সোফায় তার বড় বাবা, বাবা আর ছোট কাকা বসে আছে। আবসার সাহেব অতি দ্রুত বিদেশ যাত্রা রেখে চলে এসেছেন। তিনিও তাদের সাথে বসে আছেন। উজান আর শাহিদা আরেকটা দিকে বসে আছে। শাহিদার মুখ থমথমে, রাগত ভাব। মাহফুজাকে আশেপাশে দেখা গেলো না।

রাশা আর উষিরকে দেখে হাসান চৌধুরী গদগদ হয়ে এগিয়ে আসলেন। নতুন জামাইয়ের সাথে মোলাকাত করে রাশার ভালোমন্দ শুনলেন। রাশা উপরে উপরে যতই হম্বিতম্বি করুক না কেনো, সে তার বাবা কাকাদের সাংঘাতিক ভয় পায়। তাই বেশ বিনয়ের সাথেই কথাবার্তা বললো। বাবা আর ছোট কাকা ও কথা বললো। যদিও রাশার বাবা শুধু মেয়ের জামাইয়ের সাথেই কথাবার্তা বলেছিলো। মেয়ের দিকে মুখ ফিরিয়েও তাকায়নি। জামাইয়ের সাথে কথা বলার সময় তার মুখ থেকে হাসি সরছিলো না। রাশা বাবার থেকে একটুও ভালো ব্যবহারের আশা করেছিলো না তবুও মনের কোনে একটু আশার প্রদীপ জ্বলজ্বল করে জ্বলছিলো। মুখ ফিরিয়ে আবার যখন তারা নিজেদের জায়গায় গিয়ে বসলো তখন আর সে এক মূহুর্তের জন্যেও সেখানে দাঁড়ায়নি। সোজা ঘরে চলে গিয়েছিলো। শাহিদা আর উষির ছাড়া পুরো ঘটনাটা আর কেউ খেয়াল করলো না।

নিচের লিভিংরুমে তখন উষির রাশাকে নিয়ে জমজমাট কাহিনী। ময়না ডাইনিংরুমের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা রেকর্ড করতে লাগলো। ইচ্ছা, নিজে আরো একবার এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুনবে আর রাশাকে শুনাবে। রাশা নিজেই তাকে ফোন দিয়ে এমনটা করতে বলেছে।

হাসান চৌধুরীর হাতে চায়ের কাপ। কাঁচের এই কাপগুলো বেশ সুন্দর দেখা যায়। তবে সেই সৌন্দর্য একমাত্র ঘরোয়া মেয়েদের চোখেই পরে। তিনি বাইরের জগতে দাপিয়ে বেরানো পুরুষ। ঘরোয়া সৌন্দর্য তার চোখে আটকায় না। তার চোখ আটকায়, সেখানে তার লাভ আছে সেখানে। গলায় মধু ঢেলে কারো কানে বিষ ঢুকানো তার অতি প্রিয় একটা কাজ। এখনও তিনি সেটাই করতে চাচ্ছেন। গলার স্বর যথাসম্ভব বিনয়ী রেখে বললেন,

–দেখুন, বাচ্চারা একটা ভুল করে ফেলেছে। ওদের বয়সটাই ভুল করার।

শাহিদা এর প্রতিবাদ করে উঠলো। তীব্র প্রতিবাদী গলায় বললো,

–ওরা কোন ভুল করেনি। ভুল বুঝেছিলেন আপনারা। নিজের সন্তানের উপর এইটুকু বিশ্বাস থাকা উচিৎ।

হাসান চৌধুরী অপমানিত হলেন। তার সামনে কেউ এইভাবে কথা বলে না। মহিলার সাহস আছে বলতে হবে। আর মহিলাদের এই অতিরিক্ত সাহস তার একদম পছন্দ না। আবার যে বাড়িতে বাড়ির মেয়ের বিয়ে দিয়েছে সেই বাড়িতে গলা তুলে কথা বলা ভালো দেখায় না। নিজেকে সবসময় নরম রাখতে হয়। চিন্তাভাবনা জোড়ালো করলেন তিনি। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

–তা ঠিকই বলেছেন বেয়াইন। ওই পরিস্থিতিতে আসলে কারোরই মাথা ঠিক থাকে না। আমরাও রাগের মাথায় কাজ করে ফেলেছি। এখন সবটা শোধরানোর সময় এসেছে।

উষির জোরে হাঁচি দিলো। হাতের টিস্যু দিয়ে নাক মুছে সামনে তাকিয়ে দেখলো, সবার দৃষ্টি তার দিকে। একটু অপ্রস্তুত হেসে বললো,

–সরি, একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।

হাসান চৌধুরী মাথা নেড়ে অল্প হেসে বললেন,

–ঔষধ খেয়ে নিও বাবা।

উষির মাথা নেড়ে উত্তর দিলো,

–জ্বি।

আদোতে তার এখানে থাকার এক ফোটা ইচ্ছাও নেই। কোন কথায় কানও নেই৷ নেহায়েতই বসে না থাকলেই নয় তাই বসে আছে। মন তো পরে আছে, দোতলার মাঝের রুমের মধ্যে থাকা তার বউয়ের কাছে। বউটা একা একা কি করছে কে জানে! সারাক্ষণ তো শয়তানি বুদ্ধি গিজগিজ করে। এখনও বোধহয় তাই-ই করছে।

হাসান চৌধুরী মুখ ঘুরিয়ে রাশার বাবার দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় বললেন,

–হামিদ, তুমি মেয়ের বাবা। তুমিই বাকি কথা বলো?

–জ্বি ভাই।

হামিদ চৌধুরী বিনয়ের সাথে ঘাড় নাড়লেন। তারপর আবসার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বেশ ভরাট গলায় বললেন,

–আমরা বিয়ের পরবর্তী অনুষ্ঠান ধুমধাম করে করতে চাচ্ছি। আপনারা সময়মতো একটা ডেট দিন।

–তার আগে আমার একটা প্রশ্ন ছিলো? বিয়ের কথা এইভাবে পাবলিক না হলে কি আপনারা অনুষ্ঠান করার কথা বলতেন?

শাহিদা হামিদ চৌধুরীর কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বললেন। রাশার বাড়ি থেকে আসা সবাই থতমত খেয়ে গেলো। সাথে অপ্রস্তুতও হলো। রগচটা খলিল চৌধুরী বিরক্ত গলায় বললো,

–কিছু মনে করবেন না বেয়াইন, আমরা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বাড়ির ছেলেরা মিলে করি। মেয়েরা কিছু বোঝে না সোঝে না। তাই এরমধ্যে তাদের না আসাই ভালো।

শাহিদার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। উষির রেগে কিছু বলতে চাইছিলো। উজান বাঁধা দিয়ে গলা উঁচিয়ে বললো,

–কিছু মনে করবেন না আংকেল, আমাদের বাড়ির নিয়মটা আপনাদের বাড়ি থেকে একটু আলাদা। আমরা ছোট বড় সব ধরনের কাজেই বাড়ির সবার পরামর্শ নেই, মতামত নেই৷ ছেলে, মেয়ে, বাচ্চা বিভেদ করি না।

সকলের মুখ আবার থমথমে হয়ে গেলো৷ পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। চারিদিকে ঝামেলার এক গন্ধ ছেয়ে গেলো। মনে হলো, কারো হাতে একটা দা থাকলে কা’টাকা’টি, খু’নোখু’নি হয়ে যেতো। এই গুমোট পরিস্থিতি থেকে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হাসান চৌধুরী উদ্ধার করলেন। মোলায়েম স্বরে বললেন,

–আপনারা একটা সময় দেন? আমরা মেয়ে মেয়ের জামাইকে ধুমধাম আয়োজনের সাথে স্ব-সম্মানে আমাদের বাড়ি নিতে চাই।

আবসার কায়সার কেশে গলা পরিষ্কার করলেন,

–এক সপ্তাহ পরের কোন একটা ডেট বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর এর মতে, তখন বৃষ্টি থাকবে না। শুক্রবার করে দিন করে নিলেই ভালো হয়। বাচ্চাদের ছুটিছাটাও দরকারী।

–জ্বি, জ্বি। তাহলে দ্বিতীয় শুক্রবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। আমরা হল বুকিং দিয়ে আপনাদের সব ডিটেইলস জানিয়ে দেবো।

রাশার পরিবার থেকে আসা এই মানুষগুলোকে শাহিদার একটুও পছন্দ হচ্ছে না। সব কথাবার্তা, ব্যবহারে একটা মেকি মেকি ভাব আছে। দেখে মনে হয়, যা করে সব লোক দেখানো। এখন আবার টাকার গরম দেখাচ্ছে। শাহিদা বেশ রেগেই বললো,

–আল্লাহর দয়ায় আমাদের আপনাদের মতো অতো না থাকলেও কিছু আছে। আমাদের ছেলের রিসেপশনের দ্বায়িত্ব আমরাই নিতে পারবো।

আবসার কায়সার সচকিত হয়ে শাহিদার দিকে তাকালেন। তার কাছে এটা একটু অপমানসূচক কথা হয়ে গেলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন,

–আপনারা রাশার বাড়ির মানুষ। আপনারা আয়োজন করলে ভালো দেখাবে না।

হাসান চৌধুরী নিরবে সায় দিলেন। দুই সপ্তাহ পর রিসেপশনের ডেট হলো। নিজেদের কাজ শেষে চলে যেতে চাইলেন। খাওয়ার কথা বলতেই বললেন, তাদের বাড়ির একটা নিয়ম আছে। মেয়ের বাড়ি গিয়ে তারা কিছুই খান না। কথাটা শুনে ময়না ভীষণ চটে গেলো। রান্নাঘরে চপ ভাজতে থাকা মাহফুজার কাছে গিয়ে বললো,

–আর রান্দার দরকার নাই ম্যাডাম। এনারা খাবি না। বলে নাকি, মাইয়্যার বাড়ি খাওয়া লাগে না। এইযে তিন কাপ চা খাইলো, এগুলা কি এগোর ভুত আইসা খাইলো?

রাগে ফুশতে লাগলো সে। মাহফুজা সব শুনে অসহায় চোখে তার রান্নাকরা বাহারি সব খাবার দাবারের দিকে তাকালো।
যাওয়ার সময় হাসান চৌধুরী দোয়া দিতে রাশার মাথায় হাত রাখলেন। রাশার মনে হলো, এক বিশাল বোঝা তার মাথায় চেপে বসেছে। স্থির চোখে বড় বাবার দিকে তাকালো। তিনি মুচকি হাসলেন। রাশা এই হাসি চেনে। যুদ্ধ জয়ের হাসি। তারা চলে যেতেই সে দ্রুত ঘরে গেলো। যাওয়ার সময়ও তার বাবা একটা কথা বলা তো দূর, ফিরেও তাকালো না। কিন্তু তার বড় বাবা কথা বলেছে। দোয়াও করেছে। ঘৃণা হলো রাশার। এতো জঘন্য পরিবারে তার জন্ম!

***
সন্ধ্যা থেকেই আকাশে মেঘ করেছিলো খুব। পলক ফেলতে না ফেলতেই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা মাটিতে আছড়ে পরলো। মূহুর্তকাল পরেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। বৃষ্টির তেজ বাড়তেই হুলোকে ঘরে নিয়ে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে সেখানে রাখা হলো। কাঁচ ঘেরা জানালার বাইরে পরা বৃষ্টি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে লাগলো সে।

নোঙরের ঘরে তখন ভাই বোনদের গোল মিটিং বসেছিলো৷ সাথে ছিলো বড় বাটির এক বাটি মুড়ি মাখা আর লম্বা লম্বা করে কাঁটা নারকেল। তাদের গোল মিটিং এর চুম্বক অংশ ছিলো অফিসে নোঙরের দেখা সেই ছোট ড্রেস পরা মেয়েটা। কিছুক্ষণ আগে তাএ ফোনে মেসেজ এসেছিলো। দেখতে ইচ্ছা হয়নি। আবার মেসেজ আসায় ফোন চেক করলো। অমি মেসেজ দিয়েছে।

“কেমন আছো নোঙর?”

“বাইরে খুব বৃষ্টি পরছে। চা খাচ্ছি। তুমি খাবে?”

“তোমার সাথে এই ওয়েদারে একসাথে বসে চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।”

পরপর তিনটে মেসেজ দেখে খিঁচে থাকা মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো৷ দ্রুত হাতে টাইপ করলো,
“আমি চা খাই না। চা খেলে ঘুম হবে না। আর ঘুম না হলে ডার্কসার্কেল পরে যাবে।”

অমি রিপ্লাই করলো, “তুমি না অফিসে দুই কাপ চা খেলে?”

নোঙরের মনে মনে ভয়ানক কিছু গালি দিয়ে ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিলো। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললো,

–রাস্তায়, গাড়িতে, বাড়িতে যেখানেই দেখা হবে, জোরে দুলাভাই বলে চিৎকার দিবি। যাতে আশেপাশের সবাই টের পায় উনি তোদের দুলাভাই।’

নিহান মুড়ি চিবুতে চিবুতে মাথা চুলকে বললো,

–কিন্তু তুই তো আমার থেকে ছোট। ছোট বোনের বরকে কি দুলাভাই বলে ডাকে?

নোঙর বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,

–ও তো তোমার থেকে বড় নাকি?

নিহান মাথা নাড়লো। তারপর ভাবুক দৃষ্টিতে পাখির খাঁচার দিকে তাকালো। নোঙর আশ্বাস দিয়ে বললো,

–আমার বেতনের টাকা দিয়ে আর দুটো মুরগী কিনে দেবো। সাতটা মুরগী দিয়ে তোর ফার্ম রমরমা চলবে।

অন্তু ফোঁড়ন কেঁটে বললো,

–অর্ডার দেওয়া মুরগী দুটো তো এখনও আসেনি। ওদুটোর কি হবে?

–ওদুটোর আশা বাদ দে। তিনমাস হলো অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এতোদিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে আবার ডিম দেওয়ার অবস্থা হয়ে যেতো।

নিহান রেগে কিছু বলছিলো কিন্তু তার আগেই অপলা ভাবুক দৃষ্টিতে নোঙরের দিকে তাকিয়ে বললো,

–দুলাভাই তো দুলাভাই বলে ডাকা পছন্দই করে না। ডাকলে যদি কিছু বলে? আর তুমি তো দুলাভাইয়ের সাথে থাকবা না বলছিলা। তাইলে?

নিহান অপলার মাথায় চাটি মেরে বললো,

–আরে গাধী, সম্পর্ক কি একটা নাকি? থাকতে না চাইলে আবার ভাই বোনে ফিরে যাবে। এতো চিন্তা কিসের?

নোঙর অগ্নী দৃষ্টিতে নিহানের দিকে তাকিয়ে বালিশ হাতে তুলে নিলো। মেজাজ দেখিয়ে বললো,

–বোনের বিয়ে ভেঙে দিতে চাচ্ছিস? কেমন বড় ভাই তুই? ভাই নামে কলঙ্ক।

নিহান আকাশ থেকে পড়লো এমন ভঙ্গিতে বললো,

–তুই-ই তো সবসময় বলিস, থাকবো না আমি। কিছুতেই থাকবো না। এই দুই দিনে হাজারবার এই একটা কথা শোনা হয়ে গেছে।

নোঙর মেজাজ দেখিয়ে বললো,

–তুই বলবি কেন? বলার হলে শুধু আমি বলবো।’

নিহান মাথা নেড়ে বললো,

–আচ্ছা যা আর বলবো না।

–হ্যাঁ বলবি না। এইযে একবার বলছিস, এরজন্য একটা মুরগী ক্যান্সেল। আর একবার কিছু বললে আরেকটাও ক্যান্সেল করে দেবো।

অন্তু দাঁত বের করে হেসে বললো,

–আপু, আমি কিন্তু কিছু বলি নাই৷ বেতন পেলে কিন্তু আমাকে একটা আইফোন কিনে দেবে।

অপলা বিষ্ময়ে বললো, ‘ত্রিশ হাজারে আইফোন!’

নোঙর অপলার কানে ফিসফিস করে বললো,

–আরে পাওয়া যায় না, খেলনার দোকানে। ওখান থেকেই কিনে দেবো।’

অন্তু বড় বড় চুলগুলো হাত দিয়ে কপাল থেকে সরিয়ে কপাল কুঁচকে বললো,

–কানে কানে কারা কথা বলে জানো তো? কিপটার বউ।’

নিহান পা ছড়িয়ে বসে মুড়ি হাতে নিয়েছিলো। অন্তুর কথায় চোখ উলটে কিছু ভেবে বললো,

–কান্টুর বউ না?

অন্তু সজোরে মাথা নেড়ে বললো, ‘উহু, দুলাভাই তো কিপটা। আইফোন ইউজ করে না। তাই কিপটার বউ।’

নিহান মাথা নাড়লো। উজান সত্যিই কিপটা। বিয়ের দিন থেকে তার সাথে দুইবার দেখা হলো। এই দুইবারে অন্তত একটা মুরগী দেওয়ার অফার তো করতেই পারতো। তাহলে তার ফার্মে আটটা মুরগী হয়ে যেতো। না সাতটা। একটা তো নোঙর ক্যান্সেল করে দিলো। নিহান আফসোস করে বললো,

–সত্যি রে। আমাকে একটা মুরগী দিতে চাইলে আমি নিতে চাইতাম নাকি? নেবো না জন্য কি একটু অফারও দেবে না! হয়তো প্রথমে একটু না না করতামই। জোর করে ধরিয়ে দিলে কি মানা করা যেতো নাকি!

অপলা সজোরে মাথা উপর নিচ করে ঝাঁকালো। আফসোসের সুরে বললো,

–গেট ধরলে ভালো হতো ভাইয়া। টাকা আদায় করা যেতো। এখন যা পরিস্থিতি দেখতিছি, আমাদের খন্দকারদের ভবিষ্যৎ খারাপ। ভালো হয়েছে আপু থাকবে না। সেকেন্ড টাইমে আমরা গেট ধরবো।

অন্তুও অপলাকে সমর্থন করে বললো,

–আইফোন ইউজারকে বিয়ে করবা আপু। আমরা গেটে অনেক টাকা পাবো।

অপলা উৎসাহের সাথে বললো,

–হাত ধোঁয়ানো আর শরবত খাওয়ানোতেও।

নিহান নারকেল মুখে পুরতে পুরতে বললো,

–হু, আব্বুর লাচ্চি নষ্ট করে ফেলছিলো। এমন ছেলের সাথে থাকাও উচিৎ না। সামান্য একটা মুরগী অফার করার সাহসও দেখাতে পারে না।

নোঙর অবাক হয়ে দেখলো, সব ভাই বোনরা মিলে তার দ্বিতীয় বিয়ের সব প্ল্যান রেডি করে ফেলছে। এখন শুধু একজন আইফোন ইউজারকে খুঁজে পেলেই হলো!

***
রাতে ফ্রী হতেই উজান আবসার কায়সারকে খুঁজতে লাগলো৷ তিনি স্টাডি রুমে এক গাদা ফাইল আর বইয়ের ভেতর বসে ল্যাপটপে নাটক দেখছিলেন। উজানের হাক-ডাকে বিরক্ত হলেন খুব। উঁচু গলায় ধমকে উঠলেন,

–এমন করে চেঁচাচ্ছিস কেনো? কেউ মরেছে নাকি?

উজান স্টাডি রুমে আসলো। একটা চেয়ার টেনে বসে বললো,

–যে অবস্থা দেখছি তাতে খুন শীগ্রই আমাদের কোম্পানির ডেথ সার্টিফিকেট বানাতে হবে।

আবসার সাহেব এবারে ল্যাপটপে নাটক পজ করে উজানের দিকে মনোযোগ দিলেন। আর যাই হোক, ব্যবসায়ী মানুষদের ব্যবসার দিকে নজর দিতেই হবে। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,

–কি হয়েছে? বড় কোন প্রজেক্ট হাত থেকে ছুটে গেছে? লস খেয়েছিস নাকি? অফিসে কেউ বিট্রে করছে?

উজান হাঁপ নিশ্বাস ছাড়লো৷ বিরক্ত গলায় বললো,

–অফিসে তোমাদের নোঙর বৌমাকে ঠিক কি কাজে রেখেছো? কি কাজ করাবো তাকে দিয়ে? আমাদের তো প্রেস কোম্পানি না যে কথা বললাম আর কাজ হয়ে গেলো৷ কথা বলা ছাড়া তো আর কিছুই সে পারে না।’

আবসার সাহেব ভারি বিরক্ত হলেন। তবে মাথা ঠান্ডা রেখে বুঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,

–ডিয়ার সান, আমাদের বাঙালীদের খেলার একটা নিয়ম আছে। খেলায় যদি কেউ অংশগ্রহণ করতে চায় কিন্তু যদি তাকে দলে নেওয়ার মতো না হয় তাহলে তাকে দুধভাত রাখা হয়। দুধভাত কখনই কাজে আসে না কিন্তু সে খেলতে পেরেই খুশি৷ তাকে খুশি করাই সবার কাজ৷ এবার তুই ভেবে দেখ বুঝিস নাকি?

–হুম, বুঝতে পেরেছি৷ তোমাদের বৌমাকে খুশি করাই আমাদের একমাত্র কাজ।

–গাধা, যা এখান থেকে।

ধমকে উঠলেন তিনি৷ উষিরের থেকে উজানের সাথে তার সম্পর্ক বেশি গভীর, বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ। উজান হাসলো, বড় বাবার গাল টিপে শিঁষ বাজাতে বাজাতে ঘরে গেলো৷ নোঙর খন্দকারের নোঙর করা জাহাজ ফুঁটো করার দারুন দারুন সব বুদ্ধি মাথায় কিলবিল করছে।

***
রাতে উষিরের জ্বর আসলো। টেম্পারেচার একশো দুইয়ের কাছাকাছি আসলেও রোগীর হালচাল দেখে দেখে মনে হলো একশো পাঁচ ছাড়িয়ে গেছে। রাশা রেগে বিড়বিড়ও করলো,

–ননীর পুতুল! হুহ!

উষির অনেক কষ্টে চোখ খুললো। রাশার ধরে রাখা হাত আরো শক্ত করে ধরে আবেগী স্বরে বললো,

–তোমাকে কালো ড্রেসে কি সুন্দর দেখাচ্ছে! একেবারে কালো পরী। আরেকটু একটু কাছে এসে বসো তো। বরের সেবা করো একটু৷ বরের সেবা করলে সুন্দরীদের সৌন্দর্য বেড়ে আরো যায়।

রাশা মুখ লুকিয়ে হাসলো,

–পাগল! এখন কি পেট কেঁটে পেটের মধ্যে ঢুকে যাবো?

উষির শুনলো না বোধহয়। উত্তপ্ত মুখ রাশার হাতে গুজে আবার চোখ বুজে আহা উহু করতে লাগলো৷ রাশা এবারে বিরক্ত হলো না। উজানের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। মুখে অকারণ লাজুক হাসি।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২২

ঘুম থেকে উঠেই নোঙরের ডিউটি শুরু হয়ে যায়। ডিউটির প্রথম এবং প্রধান দ্বায়িত্ব হচ্ছে, আজ কি দিয়ে রুপচর্চা করবে সেটার লিস্ট তৈরি করে প্রয়োজনী উপকরণ গোছানো৷ সব কিছু মোটামুটি বাড়িতেই থাকে৷ তাই খুব একটা ঝামেলা হয় না৷ কিন্তু আজকে ঝামেলা হয়ে গেলো৷ বাড়িতে দুধ নেই৷ অথচ আজকে দুধ আর হলুদের প্যাকটা লাগাতেই হবে। নিজেকে সুন্দর করে তবেই আজ অফিসে যাবে। মনে মনে পন করেছে, উজান যদি দ্বিতীয়বার তার দিকে ঘুরে না তাকায় তবে সেও নোঙর খন্দকার না!

অনেক কষ্টে দুধের ব্যবস্থা তো হয়ে গেলো। কিন্তু জামা নিয়ে সমস্যায় পরে গেলো। বেছে বেছে পছন্দের সি গ্রীন কালারের সালোয়ার সুট বের করেছিলো, কিন্তু ম্যাচিং জুতা আর কানেরদুল খুঁজে পাচ্ছে না। কানেরদুল তাও কোনমতে চলানো গেলেও জুতা! গোলাপি, লাল, এসব জুতা তো কিছুতেই মানাবে না। নজর তো পরে আছে অপলার কালো রঙের হিলের উপর। উপরে ছোট ছোট পাথরের চিকন ফিতা দেওয়া হিলটার দিকে এমন নজরে পরেছে যে তার কাছে থাকা কালো রঙের জুতাগুলোর দিকে ফিরেও তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অনেক বলে কয়ে যখন জুতার জোগাড়ও হয়ে গেলো, তখন ঘড়িতে নয়টা বেজে গেছে। অথচ তার অফিস যেতে দের ঘন্টার মতো সময় লাগে। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দেরি হলে হোক! ফুপি বলেছে, নিজেদের অফিসে যখন খুশি যাওয়া যায়। তাকে কিছু বলতে আসলে সেও ফুপির সাথে কথা বলিয়ে দেবে। হিসাব বরাবর!

নোঙর এসে পৌঁছালো এগারোটায়। অফিস তখন রমরমা চলছে৷ এসি জায়গামতো চলে এসেছে। সবাই খুশি, নোঙরও খুশি। খুশির খবরটা দিতেই শামীম টেবিলের উপর দিয়ে তার ডেস্কে উঁকি দিলো। দাঁড়ানো অবস্থায় ডেস্কের উচ্চতা বুক সমান। নোঙর মাথা উঁচু করে ভ্রু কুঁচকে বললো,

–কিছু বলবেন?

শামীম দাঁত বের করে হাসলো। তারপর আঙুল উঁচিয়ে এসির দিকে নির্দেশ করলো৷ ওপাশ থেকে মমো আর অমিও নিজেদের ডেস্ক ছেড়ে নোঙরের ডেস্কে উঁকি দিয়েছে। নোঙর অনেকটা হতভম্ব হয়েছে বলা চলে। মমো ডেস্কের কাঠের দেয়ালে হাত রেখে গালে হাত দিয়ে বললো,

–তোমারই তো সময় গো! কি সুন্দর দেরি করে আসছো৷ আবার এতো সুন্দর সেজেগুজে এসেছো। কেউ কিচ্ছু বলবে না৷ কি ভালো, তাই না? ইসস! আমার যদি এমন আত্মীয় থাকতো!

নোঙর ইতস্তত করে বলার মতো করে কিছু খুঁজলো৷ কিন্তু কি বলবে ভেবে পেলো না। ওপাশ থেকে অমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো,

–তোমাকে আজকে অনেক বিউটিফুল লাগছে নোঙর। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।’

নোঙর গম্ভীর গলায় কিছু বলতে চাইলো, মনে মনে কথা সাজিয়েও ফেললো। কিন্তু বলতে পারলো না। মুখ খোলার আগেই তাহের এসে হুংকার দিয়ে উঠলো,

–অফিসে কাজ বাদ দিয়ে এতো কিসের গল্প? স্যারকে ডাক দেবো?

বলেই নোঙরের দিকে কড়া চোখে তাকালো৷ তারপর বললো,

–আপনাকে স্যার ডাকে।

নোঙরের চোখ কপালে উঠে গেলো। যদি রুমে নিয়ে একা বকে তাহলে ঠিক আছে৷ কিন্তু যদি এই তাহেরের সামনে বকে তাহলে নোঙর খন্দকারের মানসম্মান সব ধুলিসাৎ হয়ে যাবে! ঢোক গিললো সে। ভয় পেলেও নিজের অ্যাটিটিউড ঠিক রাখলো৷ নাক চুলকে হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে তাহেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,

–স্যারের তো আবার আমাকে অনেক প্রয়োজন। আমাকে ছাড়া এক মূহুর্ত চলতে পারে না। আত্মীয়তা কি করছি, ফেঁসেই তো গেছি। শুনুন তাহের মিয়া, কোনদিন এমন আত্মীয়র অফিসে চাকরি করবেন না৷ আমার মতো বারবার বসের রুমে যাতায়াত করতে করতে পা ছিলে যাবে।

বলেই তাহেরের অগ্নি দৃষ্টি উপেক্ষা করে হিলের গটগট আওয়াজ তুলে উজানের রুমে গেলো।

উজান ল্যাপটপে নিজের কাজ করছিলো। নোঙরের হিলের খটখট আওয়াজ শুনেই ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। গলার টাই ঢিলা করে চেয়ারর হেলান দিয়ে তার দিকে তাকালো। ততক্ষণে সে চেয়ার টেনে বসে পরেছে৷ উজান মুখভঙ্গি গম্ভীর করে বললো,

–অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করা শিখবে কবে?

–যেদিন থেকে তুমি আমাকে নিজের মনে করবে।

বলতে বলতেই টেবিলে দুই হাত রেখে মুখ হাতের উপর রাখলো। চোখ পিটপিট করে রোম্যান্টিক দৃষ্টিতে উজানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। গতরাতে দেখা রোম্যান্টিক মুভিটা তার উপর ভালোমতো প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু উজান তো সেটা দেখেনি। তাই চোখ গরম করে ল্যাপটপের পাশে থাকা ফাইলের স্তুপ নোঙরের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,

–নিচের তিনটা ফাইল সেকেন্ড ফ্লোরে আকিব সাহেবকে দেবে। আকিব সাহেব সাইন করে অ্যাপ্রুভ করলে ফাইলগুলো কমপ্লিট করবে। আর বাকি দুটো ফাইল ফোর্থ ফ্লোরের মিসেস ফ্লোরাকে দেবে৷ উনি এটা নিয়ে আরো দুইটা ফাইল দেবেন৷ ওদুটো ফাইল আমার কাছ থেকে সাইন করে নিয়ে কমপ্লিট করবে৷ মানে টোটাল পাঁচটা ফাইল তোমাকে কমপ্লিট করতে হবে। কালকের মধ্যেই কমপ্লিট করে জমা দিতে হবে। আর লাঞ্চের পর মিস পাখিকে তার কস্টিউমগুলো দিতে হবে। ছয়টার দিকে ফটোশুট হবে। শুট শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার ছুটি নেই।

নোঙরের মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো৷ এতো কথা আর এতো কাজ হজম করতে সমস্যা হচ্ছে খুব। বড় বড় চোখ দুটো গোল গোল হয়ে আছে৷ তার অবস্থা দেখে উজান ফাইল শব্দ করে টেবিলের উপর রাখলো। নোঙর একপলক ফাইলের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে উজানের দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললো,

–এতো..এতো কাজ আমি করবো?

–ইয়েস। তোমার যেহেতু কাজের নিজস্ব সেক্টর নেই তাই সব সেক্টরেই তুমি কাজ করবে। আর হ্যাঁ, এটা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি, নট শ্বশুরবাড়ির অফিস। গট ইট?’

নোঙর ঠোঁট উলটে কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো,

–সেইটা তো নোঙর বুঝলো। কিন্তু এতো কাজ ও কিভাবে করবে সেটা তো বুঝতে পারছে না।’

–এই সিমপল কাজটা যদি করতে না পারো তাহলে করো না। এখান থেকে বেড়িয়ে সোজা বাইরের রাস্তা দেখবে। তারপর ওখান দিয়ে বাইরে গিয়ে একটা গাড়ি খুঁজে বাড়ি চলে যাবে।

–কিন্তু এতো কাজ!

নোঙরের কাজের কথা পাত্তা না দিয়ে উজান সতর্ক করে বললো,

–কাল যদি দশটার দশ সেকেন্ড পরেও আসো তো অফিসের দরজা তোমার জন্য বন্ধ। এবারে যাও।

নোঙর দাঁতে ঠোঁট কাঁটলো। এতো অপমান আর টর্চারের পর কিছু না বলে মুখ বুজে চলে গেলে খন্দকারদের অপমান হবে। এই অপমান নোঙর খন্দকার কিছুতেই সহ্য করবে না!

টেবিলে রাখা ফাইলগুলো গোছাতে গোছাতে বললো,

–আচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু তার আগে কিছু বলে যাই। ভালো কথাই বলবো। তোমার মতো জঘন্য কথা আমি বলতে পারি না।

এরপর একপলক উজানের শক্ত হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

–শোনো, বারবার এভাবে আমাকে ডাকবে না। আমার ডিস্টার্ব হয়। আর তাহের মিয়াও বাঁকা চোখে তাকায়। শুধু তাহের মিয়া না, অফিসের সবাই-ই বাঁকা চোখে তাকায়। ভাবে, তোমার আমাকে খুব প্রয়োজন। আর আমার পরামর্শ ছাড়া তুমি এক পাও চলতে পারো না। এসব কানাঘুষা হয় তো, শুনি সব৷ সবই কানে আসে।’

–কথা শেষ হলে বিদায় হও।

উজান দায়সারা ভাবে বলে হাতের ইশারায় দরজা দেখিয়ে বললো৷ নোঙর তেঁতে উঠলো,

–তুমি কি আমাকে বিদায় হও বলার জন্য ডাকো নাকি? কথা শুরুর আগেই বিদায় হও। ভদ্র মেয়ে জন্য ভদ্র ভাবে কথা বলছি। তোমার মতো অভদ্র হলে দেখাতাম মজা। হুহ!

বলেই ফাইল রেখেই চলে যেতে চাইলো। উজান পিছন থেকে ডেকে বললো,

–ফাইল রেখে যাচ্ছো কেনো? আবার আত্মীয়র ঘরে আসার ইচ্ছা আছে নাকি?

নোঙর তেড়ে এসে টেবিলে শব্দ করে দুই হাত রেখে উজানের দিকে ঝুঁকে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

–একদিন বৃষ্টি পরবে আর আমি সেইদিন এই সবগুলা ফাইল পানিতে ছুড়ে ফেলবক আর তারপর শান্তি পাবো।

বলেই ফাইল তুলে চেয়ারে লাথি দিয়ে দরজা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বন্ধ করলো। বলা চলে এক প্রকার প্রল’য়ংকরী ঘূ’র্ণিঝ’ড় তুলে তারপর গেলো।

*****
নিজের ডেস্কে বসে ফাইলের দিকে তাকিয়েই মাথা ঘুরে উঠলো নোঙরের। আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। গুগোলে সার্চ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু গুগোল কি উল্টাপাল্টা দেখিয়ে দিলো, মাথা আরো ঘুরে উঠলো৷ মাথা ঘোরানোর মাঝেই সাইন করার কথা মনে আসলো।

দোতলার আকিব সাহেব! তার কাছে কোন কোন ফাইল নিতে হবে ভুলে বসে আছে৷ তবে নোঙর খন্দকার বোকা না। সবগুলো ফাইল তুলেই দোতলা দোতলা জপতে জপতে নিচে না নেমে উপরের সিঁড়ি দিয়ে চারতলা চলে গেলো। চার তলা অনেকটা বুটিক হাউজের মতো দেখতে। চারিদিকে জামা কাপড় সুন্দর করে ঝুলিয়ে রেখেছে। আশেপাশে ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা টেবিলে অনেকগুলো কাগজ, পেন্সিল, কালার পেন্সিল নিয়ে কয়েকজন বসে কাজ করছে। আবার অনেকে সুই সুতা কিংবা টুকরো কাপড় নিয়েও কাজ করছে। এগুলোর কিছুটা সে বুঝলো আর কিছুটা বুঝলো না। চোখ পিটপিট করে যখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখছিলো তখন সামনে ভীষণ সুন্দরী একজন মহিলা এসে দাঁড়ালো। লম্বায় নোঙরের থেকে একটু বড়। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা টপস পরে আছে। চুলগুলো স্টাইল করে বাধা। পরনে নোঙরের থেকেও উঁচু হিল। নোঙরকে আপাদমস্তক দেখে সুন্দরী মহিলাটা বললো,

–ড্রেস কালার প্রিটি। বাট ডিজাইনটা অল্ড। এটা দিয়ে স্লিভলেস ফ্রক বানালে আর এর সাথে জিন্স আর একটু উঁচু সাদা হিল পরলে ভালো মানাতো। চুলগুলো অনেক বড় বাট সুন্দর আছে। ওগুলো বেঁধে না রেখে খুলে রাখলে আরো ভালো দেখাতো।’

নোঙর ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজের চুলে হাত দিলো৷ বিনুনি করা লম্বা চুলগুলো একটু নেড়ে চেড়ে বললো,

–আকিব সাহেব আছেন?

–নো। হি’জ অন দ্য সেকেন্ড ফ্লোর। দিস ইজ ফোর্থ ফ্লোর। অ্যান্ড আই অ্যাম মিসেস ফ্লোরা জেসমিন। নট ফ্লাওয়ার জেসমিন। ইট’স মি, হিউম্যান জেসমিন। খুশবুদার জেসমিন ফ্লাওয়ার দেখেছো কখনও?

ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলেন তিনি। নোঙর মাথা নেড়ে না বুঝিয়ে বললো,

–আপনার জন্যেও ফাইল আছে৷ আজলান স্যার পাঠিয়েছেন, সাইন নেওয়ার জন্য। কাইন্ডলি একটু দেখে দেবেন, কোনটা আপনার। আমি ভুলে গেছি।

–কোন ফাইলে সাইন নিতে এসেছো, সেটা কি আমার জানার কথা?

নোঙর হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে বিদায় নিলো। তারপর সিঁড়ি পেরিয়ে পুনরায় উজানের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ তাহের মিয়ার বাঁধায় ভেতরে যেতে পারলো না। নোঙর বড় বড় চোখে কড়া ভাবে তাকিয়ে বললো,

–দেখুন তাহের মিয়া, মাথা কিন্তু গরম আছে। আপনার স্যারকে ফাইলগুলো দিয়ে বলুন আলাদা করে দিতে।

তাহের ভ্রু কুঁচকে নোঙরকে দেখে ফাইল নিয়ে ভেতরে গেলো৷ কিছুসময় পরে দুই হাতে ফাইল আলাদা করে নিয়ে এসে তাকে ফেরত দিলো৷ সেগুলো নিয়ে সে আবার সফরে বের হলো।
ফাইল সাইন করিয়ে আসতে আসতেই লাঞ্চের ব্রেক পরে গেলো। এগুলো আবার উজানকে দিয়ে সাইন করাতে হবে৷ কিন্তু নোঙর ব্রেকটাইম নষ্ট করতে চাইলো না৷ ফাইল টেবিলে গুছিয়ে রেখে যখন অফিস ক্যান্টিন গেলো তখন অফিস স্টাফদের আড্ডা জমে উঠেছে। বিষয়বস্তু, মডেল পাখি ও উজান।

–উজান স্যার তো বোধহয় মডেল পাখিকে বিয়ে করবে৷ কালকেও কতক্ষণ একসাথে সময় কাঁটালো৷ আবার তাকে ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসেডরও বানিয়েছে। এসব কি কেউ এমনি এমনি করে নাকি?’

আজকের দুপুরের খাবার ড্রাইভার দিয়ে মাহফুজা পাঠিয়েছিলো নোঙরকে। একটা টেবিলে বসে সেটাই আনপ্যাক করছিলো আর সাথে সাথেই গরম সীসার মতো কথাটা কানে ঢুকে পরলো। টিফিন বক্সের ঢাকনাটা আর খোলা হলো না। টেবিলে কয়েকবার আঙুল দিয়ে খুটখুট আওয়াজ তুলে গলা উঁচিয়ে বললো,

–স্যার তো বিয়ে করেছে।

কথাটা বোমার মতো বি’স্ফো’রিত হলো৷ মূহুর্তেই নোঙরের টেবিল ভরে উঠলো৷ সিনহা নামের মেয়েটি চেয়ার টেনে বসে নোঙরের দিকে ঝুঁকে বললো,

–বিয়ে করেছে! কাকে? কবে? তুমি জানলে কিভাবে?

নোঙর কাঁধ নাচিয়ে টিফিন বক্সের ঢাকনা খুলতে খুলতে বললো,

–বিয়ে করেছে তিনমাসের মতো হয়েছে। আর বিয়ে করেছে একটা মেয়েকে। আর আমি জেনেছি কারন আমি নিজেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলাম।

শামীম অবাক হয়ে বললো,

–তুমি ছিলে?

টিফিনে ভাত, চিংড়ির মালাইকারী আর ফিশ কাটলেট ছিলো। পছন্দের খাবার দেখে জিভে জল চলে আসলো তার। কিন্তু এতো মানুষের মধ্যে খাওয়া যাবে না। পুনরায় ঢাকনা বন্ধ করে গালে হাত দিয়ে বললো,

–হ্যাঁ! আমি না থাকলে বিয়ে হবে নাকি?

মমো প্রায় নোঙরের গায়ের উপর পরে উত্তেজিত স্বরে বললো,

–তুমি না থাকলে বিয়ে হবে না কেন?

–আরে বাবা, আমি আত্মীয় হই তো৷ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়৷ আর বিয়েটা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নিয়েই হয়েছে।

অমি কপাল কুঁচকে ভাবুক গলায় বললো,

–তুমি কেমন আত্মীয়?’

–স্যার আমার ফুপুর ছেলে।

থেমে থেমে উত্তর দিলো নোঙর৷ এতোক্ষণ ইঞ্জয় করলেও এখন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে৷ মমো তাকে অস্বস্তি থেকে বের করলো। কিছুটা মন মরা হয়ে বললো,

–স্যারের ওয়াইফকে কেমন দেখা যায়?’

নোঙর বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বললো,

–অন্নেক কিউট। মানে এতো সুন্দর আর এতো ভালো বিহেভিয়ার! দেখলে পুরা পা’গল হয়ে যাবা।

অমি দ্বিধান্বিত আর খানিকটা কৌতুহলী স্বরে বললো,

–তুমিও কি বিয়ে করেছো? মানে ম্যারেড তুমি? বা কমিটেড?

নোঙর সজোরে মাথা নাড়লো,

–আমি পিওর সিঙ্গেল। কোন সন্দেহ নেই এতে।

উজানের বিয়ের কথায় শামীমের ভারী মন খারাপ হলো। স্যার তাদের নিজের মানুষ ভাবে না ভেবেই কষ্ট হচ্ছে খুব! বললো,

–আমাদের কেন বললো না বিয়ের কথা।

–ভাবি তো এখনও পড়াশোনা করছে। পড়াশোনা শেষে ভাবিকে শ্বশুরবাড়ি আনবে। এখনও বাবার বাড়িতেই আছে। জানো, জবও করে। সুন্দর না?

–চোখ পিটপিট করে সবার উদ্দেশ্যে বললো। মমো মুখ ভেঙচে চেয়ার টেনে বসে বললো,

–ছাই সুন্দর। এমন বর পেলে আমি এক মূহুর্তও বাবার বাড়ি থাকতাম না। পড়াশোনা, জব সব বাদ দিয়ে বরের দিকে নজর রাখতাম। আর বরের দিকে নজর দেওয়া সব ডাই’নিদের চো’খ উপরে ফেলতাম।’

নোঙর কেশে উঠলো। সেও তো আড়ালে আবডালে উজানের দিকে নজর রাখছে!

আলোচনা আরো কিছুক্ষণ চলতো কিন্তু পিছন থেকে ভারী গলায় বলায় উজান বলে উঠলো,

–এখানে কি বানর খেলা দেখানো হচ্ছে?

কথাটাতে ম্যাজিক ছিলো। মূহুর্তেই ভিড় ভেঙে গেলো। উজানকে দেখে চোখ পিটপিট করে নিরীহ চোখে তাকালো নোঙর। কতটা কি শুনেছে, সে জানে না। তবে উজান তার দিকেই কড়া চোখে তাকিয়ে আছে৷ ওভাবেই বললো,

–নিজের ডেস্কে আসুন, দ্রুত।

নোঙর ঠোঁট কামড়ে উঠে পরলো৷ উজান শুনলে পেলে শুনেছে। শোনাটা কোন বড় ব্যাপার না। শুধু বিয়ের সময়টা একটু বেশি বাড়িয়ে বলেছে। এটাও কোন বড় ব্যাপার না। বিয়ে তো হয়েছে। কবে হয়েছে সেটা কে দেখতে যাবে! আর তাছাড়া সে তো তার কথা রেখেছে। তার আর উজানের বিয়ের কথা মোটেও কাউকে জানায়নি। শুধু উজানের বিয়ের কথা জানিয়েছে। সে তো সিঙ্গেল। পিওর সিঙ্গেল!

উজান নোঙরের ডেস্কের সামনে এসে আঙুল উঁচিয়ে ডেস্ক দেখিয়ে বললো,

–এগুলো কি?

নোঙর উঁকি দিয়ে দেখলো, ডেস্কে লিপস্টিক, ফেস পাউডার, কাজল, রাবার ব্যান্ড সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাও আবার ফাইলের উপরে৷ উজান শ্বাস ফেলে বললো,

–এটা কি বিউটি পার্লার নাকি অফিস?

–যে যেটা বানায়, সেটাই।

নোঙর ঠোঁট উলটে কাঁধ নাচিয়ে বলল। উজান গরম করে তাকাতেই নোঙর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বললো,

–এখানে অফিস না বানালে এটা বিউটি পার্লারও তো হতে পারতো। হওয়াটা খুব একটা কঠিন ছিলো না।

–এসব আমার অফিসে চলবে না। দ্রুত এগুলো সরাও।

নোঙর গজগজ করতে করতে সেগুলো সরিয়ে ফেললো। সব সরিয়ে ক্লিন করার আগ পর্যন্ত উজান ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। গোছানো শেষ হতেই হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললো,

–চলো লাঞ্চ করে আসি। সময় বেশি নেই।

–আমি তো বাড়ির খাবার খাবো। শাশুড়িমা নিজের হাতে লাঞ্চবক্স রেডি করে আমাকে পাঠিয়েছেন। কারন তিনি জানেন, তার বৌমা বাইরের খাবার খায় না।

–বাইরের খাবার খায় না বলছো কেন? বলো পেটে সয় না। বদহজম হয়।

নোঙর ক্ষোভে ফেঁটে পরলো। আঙুল তুলে রাগী গলায় বললো,

–তুমি জানো কিছু?

–জানতে হয় না। এমনিতেই বোঝা যায়। যাও গিয়ে দেখো খাবার আছে নাকি। থাকলে খেতে পারবে।

বলেই বাঁকা হেসে চলে গেলো উজান। খাবার উজানের জন্যেও এসেছে। কিন্তু সেটা সে কিছুতেই শেয়ার করবে না। নোঙর ভ্রু কুঁচকে কথার কূলকিনারা না পেয়ে ক্যান্টিনে ফিরে গেলো। সত্যি সত্যি তার টিফিনবক্স খালি! নোঙরকে দেখে শামীম হাত চাটতে চাটতে বললো,

–তোমার খাবার অনেকটা স্যারের মা ম্যাডামের মতো। অনেক টেস্টি।

নোঙর উত্তর দিলো না৷ রাগ প্রকাশ না করায় মুখ থমথমে হয়ে গেলো৷ আর এভাবেই তার আর উজানের প্রথম ডেট আর তার দুপুরের খাবার বাতিল হয়ে গেলো। সেই রাগেই কি না কে জানে, সে আর দুপুরে খেলোই না। খালি পেটেই তাহেরের হাত দিয়ে উজানের থেকে ফাইলগুলো সাইন করিয়ে ব্যাগে রেখে মিস পাখির আসার অপেক্ষায় রইলো।

মিস পাখি আসলো তিনটার পরে। আসার পরপরই হম্বিতম্বি শুরু করে দিলো। তার আরেকটা শ্যুট আছে৷ দ্রুত কাজ করতে হবে। নোঙর দেখলো এই মেয়েটাই হলো কালকের সেই মেয়েটা। এখন এই মেয়েটার পিছে পিছে ড্রেস নিয়ে ঘুরতে হবে ভেবেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ ক্ষিদে পেটে আর কত সহ্য করা যায়! সেও পারছে না। একবার দোতলা, একবার তিনতলা, একবার চারতলা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে। ইচ্ছে হচ্ছে আজই রিজাইন করে চলে যাক। কিন্তু নোঙর খন্দকারের সম্মান আছে। সে হারবে না কিছুতেই।

মিসেস ফ্লোরা ফ্যাশন ডিজাইনার। মিস পাখিকে তিনিই ইন্সট্রাকশন দিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছিলেন। সাজানো শেষ হলেও জুতা নিয়ে সমস্যায় পরে গেছেন। কোন জুতাই পাখির পায়ে সুট করছে না। তারপর যখন তার নোঙরের পায়ের দিকে নজর পরে মুখে হাসি ফুটে উঠলো তখন নোঙরের আত্মা কেঁপে উঠলো। হিলের কিছু হলে অপলা ওকে যে কি করবে তার ইয়াত্তা নেই! ভয় থাকলেও জুতা ধরে রাখতে পারলো না। পাখির পায়ে অপলার শখের হিল দেখে রাগে শরীর জ্বলে উঠলো তার। মুখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেলো।

শ্যুটিং হবে আউটডোরে। অফিস থেকে মাইলখানেক দূরে একটা নদী আছে। ওই নদীর পাড়েই হবে কাঙ্খিত শ্যুটিং৷ জায়গাটা বেশ উঁচুনিচু৷ জুতা পরে ওই মডেল হাঁটতে পারবে নাকি এই ভয়েই নোঙরের অবস্থা খারাপ। অন্যদিকে প্রতিশোধও নিতে ইচ্ছা হচ্ছে৷ এই মিস পাখি গতকাল আর আজ কম জ্বালায়নি! একবার ভেবেছিলো ল্যাং মেরে ফেলে দিক৷ কিন্তু ফেলানো যাবে না। জুতা ম্যাটার করে। যত যাই হোক, অপলার হিলের কিছুই করা যাবে না। আবার প্রতিশোধ না নিলে শান্তিও পাবে না। তারপর নোঙরে বুদ্ধি বের হলো। শ্যুটিংস্পটে মডেলের খাওয়ার জন্য গ্রিলড হট ডগ আর দুই রকমের সস ছিলো টেবিলের উপর। বেছে বেছে টমেটো সস হাতে তুলে নিলো। পাশেই ছিলো মডেল পাখির ব্যাগ। এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাগের চেইন খুলে ভেতরে সস ঢালতে নিয়েছিলো। তার আগেই উজান হাত চেপে ধরলো। রাগী গলায় বললো,

–আমি অনেকক্ষণ হলোই তোমার চোরা চোখ খেয়াল করছিলাম। জানতাম এমন কিছুই হবে। এতো বদ বুদ্ধি পাও কোথা থেকে?

ধরা পরেও নোঙরের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। উলটে তেঁতে উঠে বললো,

–তোমার পাখি তো খুব ভালো। তা এতো ভালো পাখি ফুঁশ করে উড়ে যাবে না তো?

উজান বিরক্ত হলো খুব,

–কিসের মধ্যে কি বলছো?

হাত ঝাড়া দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো নোঙর। তারপর ব্যাগের ভেতর সস ফেলে সসের বোতল উজানের হাতে তুলে দিয়ে কণ্ঠে অবাক হওয়ার সুর তুলে বললো,

–এমা স্যার! মিস পাখির ব্যাগে সস ফেললেন কেনো?’

পিছনেই পাখি ছিলো। নোঙরের কথা স্পষ্ট শুনলো।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-১৯+২০

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৯ (প্রথমাংশ)

একদিনের মধ্যেই অদ্ভুত ভাবে উষির আর রাশার খবরটা ধামাচাপা পরে গেলো। মিথ্যা খবর প্রচারের জন্য সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে কেস করা হলো, সাংবাদিকের চাকরি গেলো। উষিরের বাড়ির সামনে থেকে সব সাংবাদিক উধাও হওয়ার পর পুলিশ প্রটেকশনও চলে গেলো। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সবাই৷ শুধু বাঁচলো না রাশা তাও উষিরের হাত থেকে। উষির তাকে নিয়ে এলাকা ঘুরতে বের হয়েছে। না জানি কোত্থেকে একটা প্যাডেল চালিত ভ্যান এনে তাতে রাশাকে নিয়ে সফর করতে বের হলো।

জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঢুকতেই উঁচু নিচু কাচা রাস্তায় হাল বেহাল হয়ে গেলো। তার উপর গতরাতের ঝুম বৃষ্টিতে চারিদিকে শুধু কাদা আর কাদা। রাশা কপালে হাত দিয়ে বিরক্ত নিয়ে ভ্যানে বসে ছিলো৷ পরনে সাদা কামিজে কাদার ছিটা লাগছে৷ সেদিকে তার ধ্যান নেই৷ বিরক্ত, চরম হারে বিরক্ত সে। কিসের কি, কোথাকার কি! একটা বিয়ে মানুষের জীবনে কি পরিমাণে পরিবর্তন করে তার নমুনা সে নিজে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, রাগ কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে, বিরক্ত হতে হতে বিরক্তের উপরও বিরক্ত হয়ে উঠেছে।
উষির রাশার সামনের সিটে বসেছিলো। ভ্যান থামতেই চট করে নেমে পরে রাশাকেও নামালো। তারা গ্রামের বাজারে এসেছে। লোকজন তেমন নেই। গ্রাম্য বাজারে সাধারণ সকালবেলা লোকের ভীড় বেশি থাকে। দিন যত গড়াতে থাকে, লোক তত কমতে থাকে। এখন দুপুরই বলা চলে। এইসময় এখানে কেনো এসেছে সেটা রাশা জানে না। জানতে চাইলো। জিজ্ঞাসাও করলো৷ উত্তরও পেলো।

–আজকের লাঞ্চ এখানে করবো। আমি রান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। তুমি তো আর রান্না করে খাওয়াও না।

স্পষ্ট ঠেস ছিলো। রাশার মুখ শক্ত হয়ে গেলো। রান্না কে করতে বলেছে? চলে গেলেই তো হয়ে গেলো! শুধু শুধু ঝামেলা করা। মনে মনে এইসব বলে আচ্ছামত বকলো তবুও মনের ঝাঁজ মিটলো না। বুঝলো, খু’ন টুন না করা পর্যন্ত এই ঝাঁজ মিটবে না। রক্তও মাঝে মাঝে কথা বলে। রাশা বড় বড় করে শ্বাস ফেললো।

বাজারের ঠিক মধ্যিখানে একটা ছোট ভাতের হোটেল আছে। তিনটে বড় টেবিল আর দুই পাশে কাঠের বেঞ্চ পাতা। তারা গিয়ে একটাতে বসতেই একটা লোক ছুটে এসে উষিরের সাথে কথা বলতে লাগলো। রাশা বুঝলো, লোকটার সাথে আগে থেকেই কথাবার্তা বলে রেখেছে। কথাবার্তা শেষে লোকটা চলে যেতেই রাশা গালে হাত দিয়ে বললো,

–এতো নাটক কি রাজনীতিতে আসার পরে শিখেছো নাকি নাটক শিখে তারপর রাজনীতিতে নেমেছো?

উষির কিছু বললো না, শুধু হাসলো। একের পর এক প্লেট এনে টেবিল ভরে ফেললো লোকটা আর তার একজন সহকারি। রাশা নিঃশব্দে সবটা দেখলো। মেন্যুতে আছে, নানা রকমের ভর্তা আর ভাত। রাশা বিষ্ময়ে বললো,

–শুধু ভর্তা?

উষির মাথা নেড়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,

–ইনি খুন ভালো ভর্তা বানায়। খেয়ে দেখো, মুখে এর স্বাদ লেগে থাকবে।

ভর্তা রাশার একদম পছন্দ না। অনেক মজা করে বানালেও কেমন কেমন লাগে। বিশেষ করে ভর্তা বানানোর প্রসেসটা। কিভাবে চটকে চটকে মাখে! দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে।

–আমি ভর্তা খাই না। অন্য কিছু অর্ডার দাও।

উষির অবাক হয়ে তাকালো,

–তাহলে কি খাবে?

প্রশ্নটা আচমকা মুখ থেকে বের হয়ে গেলো। রাশা ঝাঁজালো স্বরে বলল,

–সব প্ল্যান নিজে নিজে করলে এমনই হয়। আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলে?

–কেউ যে ভর্তাও খায় না সেটা আমি কিভাবে জানবো!

উষির কাঁধ নাচিয়ে বললো। তারপর চিন্তিত স্বরে লোকটাকে ডাকলো। লোকটা আসতেই কপালে ভাজ ফেলে জিজ্ঞাসা করলো,

–আপনার কাছে আর কিছু আছে?

–শৈল মাছের তরকারি আছে।

–নিয়ে আসুন।

রাশা আতকে ওঠা গলায় বললো,

–কি নিয়ে আসুন? আমি মাছ খাই না।

লোকটা সব শুনে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলো,

–আলু ভাইজা দিমু ভাবি?

–আলু না৷ আলুতে অনেক ক্যালরি।

–বেগুন?

রাশা মুখ কুঁচকে ফেললো,

–নাহ, বেগুন মানুষ খায় নাকি! জঘন্য টেস্ট।

–তাইলে কি খাইবেন ভাবি?

লোকটা হতাশ হলো। উষির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

–ডিম ভেজে আনুন।

রাশা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললো,

–হ্যাঁ, বেটার হবে। দুইটা ডিমের ওয়াটার পোচ করবেন। আর কুসুমও দেবেন না। দুইটা ডিম খেলে আর ভাত খেতে হবেন না।

রাশা ভাতের প্লেট ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো। লোকটা চিন্তিত হলো খুব। ডিমের ওয়াটার পোচের নাম তিনি শুনেছেন। কিন্তু কখনও যে বানাতেও হবে, সেটা তিনি জানতেন না। উষির খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে লোকটার উদ্দেশ্যে বললো,

–চলুন, আমি রান্না করে আনছি।

রাশা চোখ তুলে উষিরের দিকে তাকালো। মনে কেমন ভালো লাগা ছেয়ে গেলো৷ কিছু বললো না। উষির কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসলো৷ আটার রুটি আর ডিম একসাথে ভাজি করেছে৷ অনেকটা মোগলাইয়ের মতো হয়েছে। সাথে কিছু সবজি কুচি কুচি করে মিক্স করে দিয়েছে৷ খেতে খুব সুস্বাদু ছিলো৷ দুইটা রুটি এমন করে বানানো ছিলো। রাশা পেট পুরে গেলো৷ খাওয়া দাওয়া শেষে তারা হাঁটতে হাঁটতে বাজারের বাইরে চলে আসলো। ওখানে একটা টি-স্টল ছিলো। উজানের ভাষ্যমতে, সেখানে অনেক মজাদার দুধ চা পাওয়া যায়। সেটাই খাওয়া উদ্দেশ্য। উজানের পরিচিত একজনের সাথে দেখা হওয়ায় তার সাথে কিছু কথা বলছিলো। রাশা হেঁটে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো৷ সেখান থেকে নদী দেখা যায়৷ নদীর ওপারে বিশাল বড় চর। দেখতে খুব ভালো লাগছে৷ খুব যেতে ইচ্ছে করছে সেখানে।

-তোমাগোর দুইজনার চেহারায় কি মিল! তোমার ভাই নাকি?

রাশা নজর ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। পাশে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, তিনি পান খাওয়ায় সাংঘাতিক আসক্ত। রাশাকে চুপ দেখে মহিলাটা পুনরায় একই প্রশ্ন করলো,

–তোমার ভাই নাকি?

রাশার কেমন একটা লাগলো৷ তাকে দেখে কি উষিরের বউ বউ লাগে না! সাথে সাথে নজর ঘুরিয়ে উষিরের দিকে তাকালো। উষির কথা বলায় মশগুল। তাকে যে উষিরের বউ বউ লাগে না, ব্যাপারটা মনে হতেই কেমন মেজাজ গরম হলো। মুখ সাংঘাতিক কুঁচকে ফেললো। দেখে মনে হচ্ছে, ভুল করে নিম পাতা খেয়ে ফেলেছে৷ সেভাবেই বললো,

–এ আমার ভাই হলে আমি সেইদিনই সুই’সাই’ড করে ফেলতাম।

–তাইলে কেডা?

মহিলাটার গলায় চিন্তিত স্বর৷ মেয়েটাকে দেখে বিবাহিত মনে হচ্ছে না। সম্পর্ক নিয়ে বিরাট একটা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। রাশা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। তারপর দুষ্টু হেসে বললো,

–ভাই-ই কিন্তু কাজিন মানে কাকাতো ভাই।

কাকার ফ্রেন্ড কাকা হয়। সেই হিসেবে কাকার ছেলে কাকাতো ভাই হয়। রাশার হিসাব খুব সোজা। উষিরকে বর পরিচয় দেওয়ার থেকে এটাই তার কাছে সব থেকে বেশি সোজা লেগেছে। বৃদ্ধা তার পান খাওয়া মুখে হাসি আনলো। বেশ রসিয়ে কসিয়ে বসে কৌতুহলী গলায় বললো,

–ছাওয়ালের বিয়া হইছে?

রাশাও বেশ সিরিয়াস হলো। মুখভঙ্গী গম্ভীর করে মাথা নেড়ে বলল,

— এখনও হয়নি৷ পাত্রী খুঁজছি। ঘরোয়া, ভদ্র, শান্ত আর সুন্দরী পাত্রী চাই। আমাদের ছেলে খুব ভালো। সবার খুব খেয়াল রাখে। টাকা পয়সাও অনেক। কিন্তু কিছু করে টরে না। তবে পাত্র নেহায়েতই সুপাত্র।

টাকা পয়সার কথা আস্তে আস্তে বলতে হয়৷ রাশা সেই নিয়ম মানলো। সাথে ঘটকালির নিয়ম মেনে পাত্রের গুনগান গাইতে লাগলো। মহিলাটিও তাল মিলালো। উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো,

–আমার হাতে একখান মাইয়্যা আছে৷ আমার নাতনি৷ বহুত সুন্দুর। চাঁদের মতোন। দেখবা?

রাশা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লো। বললো,

–অবশ্যই। ছেলেকে সাথে নেওয়া যাবে?

–হা হা, আইসো আইসো। সামনেই বাড়ি। ওরে ডাইকা আনো। মাইয়্যার লগে মাইয়্যার ঘরবাড়িও তো দেখা লাগবো।

রাশা মাথা নেড়ে উষিরের কাছে গেলো৷ লোকটার সাথে তার কথা শেষ। এখন টি-স্টলের দোকানদারের সাথে কথা বলছে। রাশা গিয়ে তার পাশে দাঁড়াতেই নজর তুলে তার দিকে দেখলো। রাশা কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। কথা শেষ হতেই উষিরের হাত টেনে ধরে বললো,

–চলো।

–কোথায়?

–ঘুরতে এসে ঘুরবে না?

–ঘুরবো কিন্তু যাবো কোথায়?

–এই সামনেই। ওই বুড়ি দাদীর সাথে যাবো। যাবে কি না সেটা বলো?

উষির রাশার ইঙ্গিত করা মহিলাটির দিকে তাকালো। তারপর মাথা নেড়ে বললো,

–তোমাকে একা ছাড়া যাবে না। এক ফোঁটাও ভরসা করি না তোমাকে।

রাশা মুখ বাঁকালো। ভেঙচি কেঁটে বললো,

–আমি তো তোমাকে খুব বিশ্বাস করি!

বলেই সামনে গটগট করে হেঁটে গেলো৷ উষির পিছু নিলো। বৃদ্ধা তাদের নিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকলো। বাড়িটিতে মাটির মেঝের পরপর দুইটা ঘর। টিনগুলো জং ধরে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। ছোট উঠানের একপাশে একটা ভ্যান নীল পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা৷ রান্নাঘরটাও মাটির। রাশা এর আগে এমন বাড়িতে কখনও আসেনি। এসে বেশ মজা লাগছে। মাটির মেঝেতে সবাই কিভাবে চলাফেরা করে যেটা জানার ভীষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বললো না৷
একটা মাঝবয়েসী মহিলা এসে ছোট উঠানে দুটো কাঠের চেয়ার রেখে দিলো। বৃদ্ধা বিনয়ের সাথে তাদের বসতে বললো। রাশা আর উষির দুজনেই বসলো। উষিরের চোখে কৌতুহল আর রাশার চোখে উচ্ছ্বসিত ভাব।

–মেয়ে নিয়ে আসুন।

রাশার কথা শুনে উষির তড়িৎবেগে তার দিকে তাকালো৷ চোখ বড়বড় করে জিজ্ঞাসা করলো,

–কিসের মেয়ে?

রাশা আস্তে করে বললো,

–তোমার জন্য পাত্রী দেখতে এসেছি। চুপচাপ বসে থাকো। সিনক্রিয়েট করো না।

রাশার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। উষির শক্ত হয়ে বসে রইলো। অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলে রাখলো। একটা বাচ্চা ছেলে একটা প্লাস্টিকের টুল এনে তাদের সামনে রাখলো। এরপর দুইটা ছোট প্লেটে চানাচুর আর বিস্কুট এনে রাখলো। আবার ফিরে গিয়ে দুই গ্লাস পানি এনে রাখলো। রাশা একটা বিস্কুট নিয়ে হাসিমুখে খেলো। উষিরের গরম চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে খেতে বলার সাহস হলো না। মিনিট খানেকের মধ্যেই একটা মেয়েকে আনা হলো। পরনে লাল রঙের থ্রি-পিস। আরেকটা চেয়ার এনে সেই চেয়ারে তাকে বসিয়ে বৃদ্ধা নিজ উদ্যোগে মেয়েটির মাথা উঁচু করে রাশাকে দেখালো। রাশা মুগ্ধ হয়ে গেলো,

–মাশা-আল্লাহ! তোমার নাম কি?

–কবিতা খাতুন।

মেয়েটি অনেকবারই নিজে নাম বলেছিলো। কিন্তু এতো আস্তে বলেছিলো যে রাশা নামটাই শুনতে পায়নি। শেষ পর্যন্ত শুনে মাথা নেড়ে পরের প্রশ্ন করলো,

–পড়াশোনা করো?

মেয়েটি মাথা নেড়ে বললো,

–নাইনে পড়ি।

–নাইনে!

রাশা ছোটখাটো আর্তনাদ করে উঠলো। প্রচন্ড ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। বৃদ্ধার হাসি চওড়া হলো। বললো,

–মাইয়্যা সব কাম পারে। রান্নাবান্না, সেলাই সব। ম্যাল্লা খেতাও বানাইছে। ও কবিতার মা, যাইয়্যা নিয়া আসো খ্যাতাগুলান? দস্তরখানাও বানাইছে। নামাজ কালামও পড়ে। সব গুন আছে আমগোর মাইয়্যার।

রাশার গলা কেঁপে উঠলো। আড় চোখে উশিরের তীক্ষ্ণ ভষ্ম করে দেওয়া দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে নার্ভাস গলায় বললো,

–তোমার বয়স কতো?

–মাইয়্যারা তো দশ পারাইলেই বড় হয় যাই। সেই হিসাবে তোর বয়স কতো হইলো রে?

মেয়েটি আস্তে করে উত্তর দিলো,

–পনেরো।

রাশা পানি খেতে নিয়েছিলো। পানি নাকে মুখে উঠে কেঁশে উঠলো। উষির স্থির চোখে রাশাকে দেখছিলো। চোখে মুখে রাগের আভাস, চোয়াল শক্ত, কঠিন।
রাশা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো,

–এই বয়সে বিয়ে হলে তো বাল্যবিবাহ কেসে ফেঁসে যাবেন।

বৃদ্ধার সাথে সাথে মেয়েটি আর মেয়েটির মা-ও অবাক হলো। বৃদ্ধা বললো,

–ওমা! ফাসমু কেন? আমার তো ওর বয়সে তিনখান পোলা মাইয়্যা ছিলো। ওর মা-রেও তো এই বয়সেই বিয়া কইরা আনছিলাম।

রাশা বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো। উষির উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে সেখান থেকে হাজার টাকার দুই তিনটা নোট বের করে বৃদ্ধার হাতে দিয়ে বললো,

–আমরা এখন আসছি। মেয়ের এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। অন্তত আঠারো বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।

বলেই আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না। রাশা প্রায় ছুটতে ছুটতে বাইরে আসলো। উষির বাইরে ভ্যান দাঁড় করিয়ে তার অপেক্ষায়ই ছিলো৷ রাশা আসতেই ভ্যানে উঠে বসলো। রাশাও উঠে পরলো। জমিয়ে রাখা কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো,

–টাকা দিলে কেনো?

–নিজের সম্মান বাঁচাতে। মেয়ে দেখতে গেলে তাকে সম্মানসরুপ কিছু দেওয়ার নিয়ম প্রচলিত আছে। না দিলে তাকে ছোটলোক বলা হয়। আমি ওই অপবাদটা চাই না। এমনিতেই যথেষ্ট অপমান করে ফেলেছো।

উষির রেগে আছে। রাশা রাস্তায় কিছু বললো না। বাড়ির রাস্তায় যেতেই উষির নেমে পরলো। বাকিটা পথ হেঁটে যাবে। উষির হাঁটছিলো নাকি দৌঁড়াচ্ছিলো, বোঝা গেলো না। তবে তাকে ধরতে রাশার দৌঁড়াতে হলো। উঁচু লম্বা হিল পরে দৌড়ানো মুশকিল। তবুও অনেক কষ্টে দৌড়ে উষিরকে আটকালো। কোমড়ে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

–রাগ করছো কেনো? আমি তো মানুষের উপকার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এরা বাল্যবিবাহ দেবে সেটা আমি কিভাবে জানবো।

আকাশে মেঘ গুড়গুড় করছিলো। যে কোন সময় বর্ষন হয়ে ঝড়তে পারে৷ উষির সেদিকে তাকালো না। রাশার দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,

–বিয়ে নিয়ে সবাই তোমার মতো মজা করে না। এদের কাছে বিয়ে অনেক সেন্সিটিভ একটা ব্যাপার। ডোন্ট ডু দিস এগেইন।

রাশা বুঝলো, মাথা নেড়ে সম্মতিও দিলো৷ তারপর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে চিন্তিত স্বরে বললো,

–ওদের ব্যাপারটা বুঝানো উচিৎ। বাল্যবিবাহ মোটেও ভালো কাজ না।

উষির পকেট থেকে হাত বের করে পাশাপাশি চলা রাশার হাত ধরলো। তারপর নির্লিপ্ত স্বরে বললো,

–আমরা এখানে সমাজ সেবা করতে আসিনি। ছুটি কাঁটাতে এসেছি। সেটা করলেই বেশি ভালো হয়।

–তুমি না রাজনীতি করো? তোমাদের প্রথম কথাই তো সমাজসেবা।

–পাকনামি করার ইচ্ছা আমার নেই। আর আমার সাথে যখন এসেছো তখন তোমাকেও করতে দেবো না।

উষিরের কথা একদম সুস্পষ্ট। রাশা রাগলো। রুঢ় স্বরে বললো,

–তুমি খুব হার্টলেস। একটা মেয়ের জীবনের প্রশ্ন এখানে।

উষির থমকে দাঁড়ালো। রাশার দিকে ফিরে দুই হাত কাঁধে রেখে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো,

–একটা মেয়ে না, লক্ষ লক্ষ মেয়ে। কতজনকে ঠিক করবে তুমি? তোমার চোখের সামনে একটা আছে জন্য তুমি একটা জানো। কিন্তু রাশা, তুমি বাস্তবতা জানো না? তুমি তোমার পরিবারকে দোষ দাও কিন্তু তুমি জানো না, বাইরের সমস্ত বিপদ থেকে তারা তোমাকে রক্ষা করেছে। এসব কিছু তোমাকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। ওরা মেয়ে অপছন্দ করে এমন না। ওরা মেয়েদের ঘরে রেখে আগলে রাখায় বিশ্বাসী।

ছোট ছোট ফোঁটায় বৃষ্টি পরা শুরু করেছে৷ রাশার চোখেও ওমন বৃষ্টি পরতে পরতে পরলো না। কঠিন গলায় প্রশ্ন করলো,

–এসব তোমাকে কে বলেছে? সুবোধ স্যার?

রাশার গলার স্বরের সাথে মিলিয়ে আকাশে মেঘ গর্জে উঠলো। বৃষ্টির ফোঁটা এখন বড় আকাড় ধারণ করেছে৷ উষির চিন্তিত মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

–বৃষ্টি পরছে। তাড়াতাড়ি চলো, নাহলে ভিজে যাবো।

রাশা শুনলো না। ক্ষিপ্ত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

–তুমি কিচ্ছু জানো না? তুমি ব্যবহার দেখেছো, কথা শোনোনি। আমি শুনেছি, জেনেছি সব কিছু৷ দ্বিতীয়বার ওদের নিয়ে আমাকে আর কিচ্ছু বলবে না।

–আচ্ছা সরি, আর বলবো না। এবার চলো?

উষির রাশার হাত টান দিয়ে বললো। রাশা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে আবার চিৎকার করে উঠলো,

–আই হেইট ইউ আদনান কায়সার।

উষির হেসে ফেললো৷ বৃষ্টির বড় ফোটা মূহুর্তেই ঝুম বৃষ্টিতে রুপ নিয়েছে৷ উষির তার আদুরে হাত রাশার দুই গালে রেখে মায়াবি স্বরে বললো,

–তুমি আমার। তোমার পরিবার তোমাকে আমার হাতে দিয়েছে৷ এইজন্য আমি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ রাশা। এরজন্য তাদের সাত খু’ন মাফ। কিন্তু তুমি আমাদের প্রথম ডেট খারাপ করেছো৷ ইউ হ্যাভ পানিশড ফর দিস।

–পানিশমেন্ট!

রাশা রাগ ভুলে অবাক হলো। উষির রাশার হাতে নিজের হাতে গুজে সামনে এগোতে এগোতে বললো,

–হুম, এখন থেকে আমি রান্না করবো আর তুমি বাসন মাজবে। সাথে কাপড় ধুয়ে মেলে দেবে। আর ঘরও পরিষ্কার করবে।

রাশা ঝগড়ার প্রস্তুতি নিলো৷ বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকে মেজাজ দেখিয়ে বললো,

–ইচ্ছে হলে কাজ করো, আর না হলে ফেলে রাখো। আমি তোমার কাজ করতে বাধ্য না।

বলেই ভেতরে চল গেলো৷ উষির কোমড়ে হাত রেখে মুচকি হাসলো। তারপর কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে বড় করে শ্বাস টানলো।

চলবে..

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৯ (শেষাংশ)

নতুন শ্বশুরবাড়িতে উজানের দাওয়াত ছিলো৷ ইম্পর্টেন্ট একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। দিন রাত এক করে কাজ করতে হচ্ছে। অযথা সময় নষ্ট করার মতো কোন সময় তার হাতে নেই। কিন্তু মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে ল্যাপটপ বগলদাবা করে শ্বশুরবাড়ি গেলো। পরনে নীল রঙা পাঞ্জাবি। অনেক ভেবেচিন্তে, অনেক খুঁজে তারপর পাঞ্চাবির রঙ পছন্দ করেছে। এরপর মায়ের আদেশ অনুসারে এক গাদা মিষ্টি কিনে শ্বশুরবাড়ি গেলো৷ নতুন সম্পর্ক তৈরি হলে নাকি পুরোনো সম্পর্ক সবাই ভুলে যায়। উজান সেটা আজকে হারে হারে টের পেলো৷ নানাবাড়িতে মামাদের ভাগ্নে আদর পাওয়ার আগেই জামাই আদর পেয়ে গেলো৷ ব্যাপারটা খুব কষ্টের। বাড়িতে যাওয়ার পরপরই তাকে নিয়ে নোঙরের ঘরে বসানো হলো।

কিছুক্ষণ পর নোঙর এসে বিছানার এক কোনে বসলো৷ তারপর থেকে বাম হাতের নখের সাথে ডান হাতের নখের ঘর্ষণ করছে আর দাঁতে ঠোঁট কাঁটছে। রাগে তার মাথায় আগুন জ্বলছে। উজান আসার পর মা আর বড় মা মিলে তাকে শাড়ি পরিয়ে জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে৷ নোঙর ভাবতেও পারছে না, নীল পোশাক পরা কারো কাছে সে বসে আছে। বিরক্ত লাগছে খুব। তার নিজের ঘরে নিজের মতো করে থাকতে পারছে না। লোকটা বিছানায় হেলান দিয়ে কোলে ল্যাপটপ নিজে কাজ করছে৷ নতুন বউকে পাশে বসিয়ে রেখে অফিসের কাজ করছে! এমনিতে প্রেমালাপ করার কোন ইচ্ছা তার নেই। অন্তত নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তো আলোচনা করাই যেতো। কবে নাগাদ সেপারেট হবে কিংবা সেপারেশনের সময় ফ্যামিলিকে কি বলে সামলাবে, এসব। এই বিয়েতে সে থাকবে না সে ব্যাপারে তার দিক থেকে অন্তত সে সিওর। মিনমিন করে একবার বলেও বসলো,

–ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভেবেছো?’

উজান প্রতিউত্তর করেনি। উল্টে ভ্রুগুলো আরো কুঁচকে গেলো। সে দরকারী একটা প্রজেক্টে কাজ করছে৷ তাড়াতাড়ি সেটা কমপ্লিট করে ক্লায়েন্টকে দিতে হবে। নাহলে ক্লায়েন্ট হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। নোঙর সেটা জানলো না, বুঝলো না। উলটে মুখ রাগে অপমানে আরো লাল হয়ে গেলো। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলতে লাগলো।

–আজকে কেনো অফিসে যাওনি?

নোঙর ভষ্ম করে দেওয়া দৃষ্টিতে উজানের দিকে তাকালো। উজানের নজর তখন ল্যাপটপ স্ক্রিনে। ঝাঁজালো গলায় সে উত্তর দিলো,

–ফুপি ছুটি দিয়েছে।

–এসব আমার অফিসে আমি অ্যালাও করবো না। নেক্সট সিক্স মান্থ, আর একবারও অফিস মিস করলে রেজিগনেশন লেটার হাতে ধরিয়ে দেবো।

নোঙর রাগে পা দিয়ে খাটের পায়াতে বাড়ি দিলো। খাট কেঁপে উঠলো। উজানের তাতে কোন হেলদোল নেই। সে কি ইচ্ছা করে ছুটি নিয়েছে নাকি? সকালেই তো ফুপি ফোন দিয়ে বললো, আজ তার অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। আর এখন এতো কথা শুনতে হচ্ছে! হটাৎ চমকে উঠলো নোঙর। তার মানে আগামী ছয় মাসে তাদের সেপারেশনের কোন লক্ষণ নেই!

আহত হলো খুব। অতি কষ্টে তক্ষুনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার আগে উজানের বসার জায়গা হয়েছিলো ড্রয়িংরুমে। ডেকে এনেছিলো তার বড় মামা। যার উপর অভিমান করে তার মা এতোদিন তার বাবার বাড়ি ফেরেনি। আবার তার অসুস্থতার দোহাই দিয়েই মাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ সেই তিনিই এখন ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে ডেকচি সামনে নিয়ে বসে আছেন। হাতে ডাল ঘুটনি। মহা উৎসাহে টক দই ভর্তি ডেকচির মধ্যে ডাল ঘুটনি দিয়ে ঘুটে চলেছে৷ চারপাশে ছড়িয়ে আছে ড্রাই ফ্রুটসের বয়াম, জগ, গ্লাস, চিনির বয়াম ইত্যাদি ইত্যাদি। চোখ দিয়ে কাউকে ভষ্ম করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে উজান সর্বপ্রথম বড় মামাকেই ভষ্ম করে দিতো। তিনি নাকি অসুস্থ! এই তার নমুনা! তারজন্যই আজ তার এই পরিস্থিতি! এই বয়সে বিয়ের তকমা গলায় ঝুলিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।

বড় মামার পাশে সদ্য মুরগীর বিজনেসে হাত দেওয়া নিহান বসে আছে। মুখ কাচুমাচু। কিছুক্ষণ উশখুশ করে বললো,

–বাবা হচ্ছে না। ভালো করে ঘুটতে হবে। মিক্সারে ইজি হবে।

হুংকার দিলেন বড় মামা। বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠে ধমক দিয়ে বললেন,

–তুই লাচ্চি বানাতে পারিস? আমার থেকে বড় রাধুনি হয়ে গেছিস নাকি? মুরগীর ব্যবসায়ী আছিস, মুরগী নিয়েই থাক। এখানে নাক গলাবি না।

মিইয়ে গেলো নিহান। নতুন বোন জামাইয়ের সামনে ধমক খাওয়ায় মুখ ছোট হয়ে গেলো। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো, নতুন বোন জামাই মনোযোগ দিয়ে লাচ্চি বানানো দেখছে। ভ্রু দুটো কুঁচকানো, চোখে বিরক্তির ছাপ।

পুরো বাড়ি খাবারের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে৷ মেন্যুতে আছে তেহারি, হাড়ি কাবাব, ফিশ ফ্রাই আর কাটলেট। অন্তু প্রতিবার রান্নাঘরে যাচ্ছে আর কিছু না কিছু নিয়ে ফিরে এসে উজানের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। অনেকক্ষণ হলই সে তার সাথে কথা বলতে চাইছে। স্কুলে যায়নি আজ। বোনের বিয়ে উপলক্ষে তিনদিনের ছুটি নিয়েছে৷ আজ ছুটির দ্বিতীয়দিন। গোলুমোলু চেহারার অন্তুকে দেখলে যে কেউ গাল টিপে দেয়। আর নয়তো বড় বড় সিল্কি চুল ধরে টান দেয়। বিরক্ত লাগে অন্তুর। নতুন দুলাভাই যাতে এমন না করে তাই বোনের ঘর থেকে চুল বেঁধে এসেছে। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে লাফিয়ে লাফিয়ে উজানের কাছে এসে পাশ ঘেঁষে বসে বললো,

–আমি কিন্তু আপুর ভাই। একেবারে নিজের মায়ের পেটের ভাই।

উজানের কুঁচকানো ভ্রু অন্তুর দিকে এসে স্থির হলো। এই পিচ্চিকে বিয়ের দিনও দেখেছিলো। দূরে দূরে দেখলেও আজ একদম কাছে এসে বসে পরেছে। বিরক্ত হলো উজান। বিরক্তের উপর বিরক্ত! কোন উত্তর দিলো না। অন্তু মাথার ঝুঁটি নাড়িয়ে বললো,

–তুমি কি ফোন ইউজ করো দুলাভাই?

উজান অন্তুর দিকে আড় চোখে তাকালো। মাথায় ঝুঁটি, ঢোলা ঢালা টিশার্ট পরা ছেলেটার মুখ বেশ মায়া মায়া। তবে কথাগুলো একদম মায়া মায়া না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। না জানি আর কতদিন এদের টর্চার সহ্য করতে হবে! বিরক্তিকর শ্বাস ফেলে ছোট করে উত্তর দিলো,

–স্যামসাং।

–কোন মডেলের?

প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। পাল্টা প্রশ্ন করলো,

–তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

–সেভেনে।

মাথার ঝুঁটি নাচিয়ে উত্তর দিলো অন্তু৷ ঝুঁটি নাচানোতে বিরক্ত হলো উজান। এই চার পাঁচ ইঞ্চি চুলের এতো বাহার! মেয়ে হলে না জানি কি করতো!

–সতেরোর ঘরের নামতা বলোতো?

এবারে বিরক্ত হলো অন্তু৷ মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করে বললো,

–দুলাভাই, তুমি তোমার ফোনের মডেলের নাম জানো না?

রাগ গোপন করে উত্তর দিলো উজান,

–এস টুয়েন্টি ফোর।

–ইসসস!

আহাজারি করে উঠলো অন্তু। চোখে মুখে বিমর্ষ, আহত ভাব৷ চোখ বুজে মুখের ভাব এমন করলো, মনে হলো তার অতি প্রিয় জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। খানিক অবাক হলো উজান। বললো,

–কি হলো?

–তুমি আইফোন ইউজ করো না? এ আবার কেমন বড়লোক তুমি! কিপটা দুলাভাই।

আবারও ঝুঁটি নাচিয়ে মাথা ঘুরিয়ে বললো৷ উজান কড়া গলায় বললো,

–আমাকে দুলাভাই বলে ডাকবে না। ভাইয়া ডাকবে। বুঝেছো?

অন্তু উত্তর দিলো না। বিমর্ষ গলায় আফসোস মিশিয়ে মাথা নাড়লো,

–মনটাই খারাপ করে দিলে দুলাভাই।

বলেই উঠে চলে গেলো। ”নোঙরে ভাই!” মনে মনে বিড়বিড় করলো উজান। একটু পর সেখানে অপলার আগমন হলো। মুখের সামনে ট্রে ধরে বললো,

–দুলাভাই, আপনার জন্য শরবত এনেছি। একদম টাটকা বেলের শরবত।

উজান নিজেকে শান্ত করে হাসার চেষ্টা করে বললো,

–আমাকে ভাইয়া বলে ডেকো৷ দুলাভাই ডাকটা আমার পছন্দ না।

অপলা উজানের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বললো,

–আচ্ছা দুলাভাই। আপনি শরবত খান।

বলেই চলে গেলো৷ উজানের একবার মনে হলো ঠাস করে গ্লাস ফেলে দিক। আবার মনে হলো বড় মামার বানানো লাচ্চির মধ্যে পুরো শরবত ঢেলে দিক৷ তবে তার কিছুই করতে হলো না। অন্তু এসেছিলো লাচ্চি টেস্ট করতে। এক হাতে শরবতের গ্লাস, আরেক হাতে ফাঁকা একটা গ্লাস। ফাঁকা গ্লাসে লাচ্চি তুলতে নিয়ে হাতে থাকা শরবত ভর্তি গ্লাসের পুরো শরবত লাচ্চির মধ্যে পরে গেলো। আশেপাশে উজান ছাড়া আর কেউ ছিলো না। অন্তু একপলক উজানের দিকে ভিতু চোখে তাকিয়ে এক দৌড়ে তার কাছে চলে আসলো। তার হাত থেকে শরবতের গ্লাস নিয়ে ফাঁকা গ্লাস ধরিয়ে দিলো৷ হতভম্ব উজানকে আরো হতভম্ব করে দিয়ে চিৎকার করে করে বলতে লাগলো,

–দুলাভাই লাচ্চির মধ্যে শরবত ফেলে দিয়েছে।

উজান ঘটনা বোঝার সময়ও পেলো না। কোন একসময় লাচ্চিতে শরবত ঢেলে দিতে চেয়েছিলো, কল্পনা করেই লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে লাগলো। বড় মামা কিছুক্ষণ উশখুশ করলেন। ভাগ্নে হলেও সে এখন নতুন জামাই। কিছুই বলতে পারলেন না। খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর উজান আর এক মূহুর্ত দেরী করেনি। যেমন বোন তার তেমন ভাই, বলে বকতে বকতে বাড়ি ফিরে গেলো।

*****
মাঝরাতে রাশা চিৎকার করে উঠলো। উষির ঘুম ভেঙে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। ঘরে সে নেই। চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরের বাইরে বের হতেই রাশার সাথে জোরে ধাক্কা লাগল৷ ফলস্বরূপ দুইজন দুই দিকে পরে গেলো। লম্বায় রাশা উষিরের গলা সমান। যার ফলে উষির গলায় আর রাশা কপালে দারুন ব্যাথা পেলো। উষির খানিক সময়ের জন্য নিঃশ্বাস নিতে পারলো না। গলা ব্যাথার ঢোক গিলতেও কষ্ট হতে লাগলো। অন্যদিকে রাশার মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। উষির নিজেকে সামলে রুক্ষ স্বরে বললো,

–হয়েছে কি?

–ভ্য-ভ্যাম্পায়ার!

রাশা নিজেকে সামলে উষিরের দিকে গুটিয়ে বসে তোতলাতে তোতলাতে উত্তর দিলো। উষিরের ভ্রু কুঁচকে গেলো,

–ভ্যাম্পায়ার! কোথায়?

–বাই-বাইরে বাইরে। দুই চোখ জ্বলজ্বল করছে। আর কি ভয়ংকর স্বরে ডেকে ডেকে উঠছে। তাড়াতাড়ি চলো, সব দরজা আর জানালায় রসুন ঝুলাতে হবে। ওরা রসুনের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। আর আর..আগুন জ্বালাতে হবে। পুরো বাড়িতে লাইটও জ্বালাতে হবে। অন্ধকারে থাকা যাবে না।

–কি পাগলের প্রলাপ বকছো?

তক্ষুনি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা শিয়াল ডেকে উঠলো। রাশা চমকে উঠে উষিরের হাত খামচে ধরলো,

–ওইযে আবার ডেকে উঠলো?

উষির বিরক্তও হলো আবার হাসিও পেলো। গলার কাছটা এখনও ব্যাথা করছে৷ তার উপর রাশা হাত খামচে ধরেছে। বড় বড় নখ হয়তো হাতে বসেই গেছে৷ সেদিকে তাকিয়ে বললো,

–ওটা শিয়ালের ডাক। আগে শোনোনি?

রাশা শোনামাত্র হাত ছেড়ে দিলো। সত্যিই নখ বসে গেছে। উষির হাত মুখের সামনে ধরে আফসোসে মাথা নাড়লো। রাশা দাঁতে দাঁত চেপে তেজি সুরে বললো,

–আমি তো শিয়ালের সাথেই এতোদিন থেকেছি। ডাক কেনো শুনবো না?

শিয়াল পুনরায় ডেকে ওঠায় আবার চমকে উঠে উষিরের খামচি দেওয়া হাত আবার খামচে ধরলো। ভয়ার্ত গলায় বললো,

–শিয়াল এতো গভীরভাবে ডাকে? কাল তো শুনলাম না।

–এটা সাউন্ডপ্রুফ কাঁচ৷ আজ হয়তো কোন জানালা খোলা আছে তাই শব্দ আসছে।

বিরক্তভাবে বলে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলো। রাশা ছাড়লো না। দুই হাত দিয়ে উষিরের হাত জাপটে ধরে কাঁপা গলায় বললো,

–কি? কোথায়? জানালা বন্ধ করতে হবে। চলো তাড়াতাড়ি, খোলা জানালা খুঁজতে হবে।

রাশা উষিরকে আঁকড়ে ধরে জানালা খুঁজতে বের হলো। ওইদিকে ক্রমাগত শিয়াল ডেকে চলেছে। আর প্রতিটা ডাকে রাশা কেঁপে কেঁপে উঠছে। রান্নাঘরের জানালা খোলা ছিলো। সেটা বন্ধ করতেই হাপ ছেড়ে বাঁচলো। উষিরের থেকে কয়েক হাত দূরে সরে দাঁড়িয়ে আবার চিৎকার করে উঠলো,

–ওইতো দেখো? ভেতরে আসলো কিভাবে?

উষির কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাইরে তাকালো। বেশ কয়েকটা লাইট জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। শিয়ালের চোখ হয়তো। উষির সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট উলটে বললো,

–হয়তো কোন দেয়ালে গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। এখন সেখান দিয়েই এসেছে।

–কি ভয়ংকর!

রাশা আনমনেই বলে বসলো। উষির মজা করার লোভ ছাড়তে পারলো না। হাসি চেপে বললো,

–এখনই বাড়ি যাবে? গাড়ি আসতে বলবো?

রাশা ভয়ংকর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। উষির রাগ পাত্তা না দিয়ে দুষ্টু হেসে বললো,

–তো রাশা বাঘ, ভাল্লুক, সাপ, নরখাদক, ভুত কিচ্ছুতে ভয় পায় না। শুধু ভ্যাম্পায়ার আর শিয়াল দেখে ভয় পায়।

রাশা কথা ঘুরালো। মুখ ফুলিয়ে গমগমে গলায় বললো,

–তোমার সাথে আমার আর থাকা সম্ভব না। চব্বিশ ঘন্টা তোমাকে টলারেট করা সম্ভব হচ্ছে না! এই দুই দিনেই আমার অসহ্য হয়ে উঠেছো। তোমার সাথে আর কয়েকদিন টানা থাকলে আমাকে মানুষিক চিকিৎসা নিতে হতে পারে।

–আচ্ছা! আমার সাথে থাকা সম্ভব না কেনো?

উষির ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলো। মুখের হাসি গায়ের হয়ে গেছে। রাশা বিরক্তির ভাব এনে বললো,

–তুমি প্রচন্ড ইরিটেটিং আর অ্যানয়িং! খুবই চিপকু টাইপ মানুষ। সবাই তোমাকে কিভাবে পছন্দ করে বুঝি না!

উষিরকে স্থির তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো,

–হা করে তাকিয়ে কি দেখছো?

উষির নিজে রাগলো না, রাশাকে রাগিয়ে দিতে চাইলো। দুই পা এগিয়ে গিয়ে বললো,

–রাগলে তোমাকে দারুন লাগে। একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। শিয়ালের মতো।

–কথার গুরুত্ব বোঝো। কি বলছি সেটা বোঝো? আমার লাইফে আমি দ্বিতীয় কোন সৌরভ চাই না বুঝেছো?

ক্ষিপ্ত গলায় বললো রাশা। উষির থমকালো। রাগী গলায় স্বগোতক্তি করলো,

–আবার সৌরভ!

রাশা মাথা চেপে ধরলো। হাত পা নেড়ে বিরক্তিকর স্বরে বিড়বিড় করতে লাগলো,

–উফফ! আর সম্ভব না! আর সম্ভব না!

রাশা বিড়বিড় করতে করতে ঘরে গেলো। উষির দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

–সৌরভ না! দেখাচ্ছি মজা।

বলেই রান্নাঘরে গেলো। রান্নাঘরের কেবিনেটের ড্রয়ারে ফোন রেখেছে। ফোন বের করে কাউকে টেক্সট করলো। তারপর ড্রাইভারকে সকাল সকাল গাড়ি আনতে বলে লিভিংরুমের সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো। রাশার উপর রাগ করে ঘরে গেলো না। চোখ বুজে শুয়ে থাকার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশে রাশার অস্তিত্ব টের পেলো। উষির ঘুমিয়েছে ভেবে কাছাকাছি লম্বা একটা সোফায় শুয়ে পরলো। উষির মুচকি হেসে রাশার ঘুমের অপেক্ষা করলো৷ ঘুমিয়ে যেতেই আলগোছে তার পাশে এসে শুয়ে ঘুমন্ত রাশাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। ঘর থেকে তার কাছে না এসে যাবে কোথায়! সব কটা জানালা হাট করে খুলে দিয়েছে। মিনিটে মিনিটে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। নির্জন জায়গায় গভীর রাতে এই ভয়ংকর ডাককে উপেক্ষা করার সাধ্য কারই বা আছে!

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ২০

অফিস বিল্ডিং এর প্রথম তলার পুরোটা জুড়েই রিসেপশন ও ওয়েটিং এড়িয়া৷ রিসেপশনের ঠিক সামনে একটা বেশ বড় সোফা রাখা। ফ্লোর ডেকোরেশনের জন্য কিছু আর্টিফিশিয়াল ট্রি, ডিজাইনার পোষাক পরা ম্যানিকুইন রাখা আছে। এছাড়াও বিভিন্ন অ্যাচিভমেন্টের মোমেন্ট ক্যাপচার করে ফ্রেমে ভরে দেয়ালে টাঙানো আছে। বড় একটা সেল্ফে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড আর ফুলদানি সাজিয়ে রাখা রয়েছে৷ এই নিয়েই এক তলা সম্পূর্ণটা সাজানো। উপরতলা যাওয়ার জন্য লিফট এক কোনে পরে আছে। তার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে সিঁড়ি। পাঁচ তলার তৃতীয়তলাতে নোঙরের অফিস। সম্পূর্ণ বিপরীত দিকের সিঁড়িতে যাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। তাই লিফট দিয়েই অফিসে গেলো। অফিস ফ্লোর পুরোটাই কাঁচের দেয়ালে ঢাকা। দরজাটাও কাঁচের। বেশ আধুনিক ধাঁচের অফিস বলা চলে। অফিসে ঢুকতেই বড় হলরুম। সেখানেই প্রায় ত্রিশটার মতো ডেস্ক আছে। আশেপাশে ছড়িয়ে আছে চারটে কেবিন, একটা মিটিংরুম, আর একটা অফিস ক্যান্টিন। ক্যান্টিন ছাড়া সবগুলো রুমের দেয়ালই কাঁচের। ঝাঁপসা কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাইরে থেকে ভিতরটা মোটেও দেখা যায় না।

নোঙরের অফিসে যেতে যেতে এগারোটা বেজে গেলো। অফিস শুরু হয় দশটা নাগাদ। এক ঘন্টা লেট করে ঢুকেই দেখলো সবাই ব্যস্ত। কেউ ফাইলে মুখ গুজে আছে তো কেউ কম্পিউটার স্ক্রিনে মুখ গুজে আছে। তার ডেস্কটা মাঝের দিকে৷ আশেপাশের ডেস্কের মানুষজনকে সে প্রতিবেশী নাম দিয়েছে। ডান পাশের প্রতিবেশীর নাম মমো। বাম বাশের প্রতিবেশীর নাম অমি আর সামনের প্রতিবেশির নাম শামিম। আপাতত এই তিন প্রতিবেশির সাথেই প্রথমদিন পরিচয় হয়েছে৷ বাকিরা বসের আত্মীয় মেনে তাকে বেশ সমিহ করে চলে।
এখন অব্দি কোন কাজ তার কপালে এসে বসেনি। ডেস্কে থাকা কম্পিউটার সম্পূর্ণ অফিসের নিয়ন্ত্রাধীন। তাই অফিশিয়াল কিছু করা ছাড়া আর কিছুই করা যাবে না৷ তাছাড়া নোঙর খন্দকারের যথেষ্ট মানসম্মান আছে৷ এখন ইউটিউবে নাটক কিংবা ফিল্ম দেখলে সবাই বাঁকা চোখে তাকাবে। তাই ঘন্টা ধরে নিজের ডেস্কের এটা ওটা নাড়াচাড়া করে সময় কাঁটাচ্ছে। কখনও ড্রয়ার খুলে স্টিকি নোটস বের করে খুলে খুলে ডেস্কে লাগাচ্ছে। আবার কখনও কীবোর্ডের বাটন সংখ্যা গুনছে।

উজানের ডাক পরলো লাঞ্চের আগে। বিরক্ত হয়ে কেবিনে গেলো৷ কেবিন খুঁজে পেতে একটু জিজ্ঞাসা করতে হয়েছিলো অবশ্য কিন্তু খুব সহজেই পেয়ে গেলো। তার ডেস্কের নাক বরাবরই উজানের কেবিন দেখেই নোঙরের কপাল কুঁচকে গেলো। তার ডেস্ক পরার আর জায়গা পেলো না!
উজানের কেবিনের বাইরে তাহের নামের এক মাঝবয়েসী লোক টুল পেতে বসে থাকে। কেউ উজানের কেবিনে গেলে তিনি ভেতর থেকে অনুমতি নিয়ে এসে তারপর ভেতরে ঢুকতে দেয়। এই ব্যাপারটা নোঙরের জানা ছিলো না। ভেতরে যেতে বাঁধা পেতেই ভ্রু কুঁচকে তাহেরের দিকে তাকালো। ভ্রু নাচিয়ে যেতে না দেওয়ার কারন জানতে চাইলো। মধ্যবয়সী তাহেরের মেজাজ সবসময়ই খিটখিটে থাকে। অফিসের তার সম্মান অধিক। সবাই তাকে বেশ মান্যগণ্য করে চলে। কেউ তাকে বসের চাইতে কোন অংশে কম ভাবে না। কেউ কাজ ফাঁকি দিলে উজানের আগে তার মেজাজের সামনে পরতে হয়।

–আপনার কি স্যারের রুমে যাওয়ার পারমিশন আছে?

নোঙর কপাল কুঁচকে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,

–আপনার স্যার নিজে ডেকেছে আমাকে, নিজে।

শেষের শব্দটা ভর দিয়ে বললো সে। নিজের গুরুত্বটা বোঝাতে চাইলো। তাহের মাথা নাড়লো। বললো,

–স্যার নিজে ডাকলেও প্রয়োজন না শুনলে আপনাকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।

চটে গেলো নোঙর। বড় বড় হরিণী চোখ দুটো ছোট ছোট করে হাত নেড়ে নেড়ে বললো,

–আপনার স্যারের সাথে আমার কোন প্রয়োজন নাই। আমাকেই আপনার স্যারের প্রয়োজন। তাই আমাকে ডেকেছে।

তাহেরের সাথে অফিসের কেউ এভাবে কথা বলে না৷ তাই নতুন জয়েন করা মেয়েটার সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলো। ভাবলো, নিজের জায়গাটা তাকে বুঝাতে হবে। টুল থেকে সটান দাঁড়িয়ে বললো,

–একদিন হলো এসেছেন। এরমাঝেই বলছেন, বসের আপনাকে প্রয়োজন? নিজেকে ভাবেন কি আপনি? বসের আত্মীয় জন্য কি মাথা কিনে নিয়েছেন?

নোঙরের মাথায় আগুন ধরে গেলো। মূহুর্তেই ছোটখাটো গোলজোক বেঁধে গেলো। আশেপাশের সবাই কাজ ফেলে উৎসুক চোখে ঝগড়া দেখতে লাগলো। উজানের কেবিন সাউন্ডপ্রুফ৷ বাইরের কোন শব্দ ভেতরে যেতে কিংবা ভেতরের কোন শব্দ বাইরে বের হতে পারে না৷ তাই ঝগড়া তার কান অব্দি গেলো না। তবে অফিসের সিসিটিভি তার ল্যাপটপে সেট করা ছিলো জন্য ব্যাপারটা দেখলো। অবাক হলো, রেগে গেলো। তড়িৎগতিতে বাইরে বেরিয়ে আসলো। উজানকে আসতে দেখেই সবাই যে যার কাজে মনোযোগ দিলো। তাহের আর নোঙরের ঝগড়াও থেমে গেলো। উজান কড়া চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে নোঙরকে ভেতরে আসতে বললো। ঝগড়ায় তার জয় হয়েছে দেখে তাহেরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো নোঙর। তাহেরের ভয়ংকর দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে সোজা ভেতরে গিয়ে উজানের টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারগুলোর একটাতে বসে বলো। উজান নিজের চেয়ারে বসে স্থির দৃষ্টিতে নোঙরের দিকে তাকিয়ে রাগত গলায় বললো,

–কয়টা বাজে?

নোঙর এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুম দেখছিলো। উজানের কথায় দেয়াল ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো,

–বারোটা পঁচিশ। টাইম শোনার জন্য আমাকে ডেকেছো?

উজান দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

–অফিস শুরু হয় কয়টায়?

নোঙর নিরীহ মেয়ের মতো ঠোঁট উলটে বললো,

–দশটায়।

–এতো লেট হলো কেনো?

–এসেছি তো অনেক্ষন হলো। একটু দেরি অবশ্য হয়েছিলো। হুলোকে খাবার দিয়ে, নিজে খেয়ে, মুখে মধু আর মুলতানি মাটির ফেসপ্যাক লাগিয়ে, গোসল দিয়ে বের হতে হতে দেরি হয়ে গেলো। দেখো, চুলগুলো এখনও ভেজা।

হুলো নোঙরের পোষা কাকাতুয়ার নাম। উজানের সেটা জানার কথা না। জানতে ইচ্ছেও হলো না৷ একপলক নোঙরের পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া লম্বা কালো সিল্কি চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,

–মডেলিং করার আলাদা ডিপার্টমেন্ট আছে৷ এখানে সবাই মাথা খাটিয়ে অফিশিয়াল কাজ করে৷ মডেলিং করতে হলে চার তলাতে চলে যাও।

নোঙর ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,

–এতো হিংসা করতে হয় না। তোমার থেকে আমি দেখতে বেশি সুন্দর, সেটা তো আর আমার দোষ না। এই চেহারা মেইনটেইন করতে আমার কত পরিশ্রম করতে হয় জানো?

উজান উত্তর দিলো না৷ স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

–তোমার অনার্সের রেজাল্ট কি?

থতমত খেয়ে গেলো নোঙর। ওই কথার পিঠে এই প্রশ্ন একদমই আশা করেনি। মিনমিন করে বললো,

–সিক্স ফোর।

–সিক্স ফোর হোয়াট? টু অর থ্রি?

–টু।

নোঙর মিনমিন করে উত্তর দিলো। উজান ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,

–এই অফিসের সর্বনিম্ন সিজি কতো জানো? ফাইভ জিরো। তাও থ্রি, টু না।’

নোঙর চোখ ছোট ছোট করে কাঁধ ঝাকিয়ে বললো,

–আমি তো চাকরি চাইনি। তোমার বড় বাবাই তো যেচে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিলো। আমি থরি না বলছিলাম, আমি আপনাদের নিষ্ঠুর, বদমেজাজী, বদখত, উটকো ঝামেলাওয়ালা ছেলের অফিসে চাকরি করবো।

রাগে উজানের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,

–তো আছো কেনো? চলে যাও।

নোঙর মাছি উড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বাঁকা হেসে বললো,

–ইহ! আমাকে কি এতোই বোকা মনে হয়? ফ্রীতে পাওয়া চাকরি এভাবে ছেড়ে দেবো?

উজান অবজ্ঞার স্বরে বললো,

–নিজের কোয়ালিফিকেশনের দিকেও একটু নজর দাও। কোন এক্সপেরিয়েন্স নেই, ভালো সিজি নেই, কিচ্ছু না। যাস্ট নাথিং! বাকি কলিগদের সামনে যেতে তোমার লজ্জা করবে না?’

নোঙর টেবিলে হাতের কনুই রেখে রেখে আড়াম করে বসে হাত নেড়ে নেড়ে বললো,

–কেনো লজ্জা করবে? আমি আমার যোগ্যতায় এসেছি আর ওরা ওদের যোগ্যতায় এসেছে৷ আমার যোগ্যতা, আমি আমার শ্বশুর শাশুড়ীর বদখত ছেলের বউ। আর ওদের যোগ্যতা, ওরা এক্সপেরিয়েন্সড, ভালো সিজিওয়ালা। সিমপল।

উজান মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বললো,

–সেমলেস মানুষ দেখেছি আমি। লিটারেলি, তোমার মতো দেখিনি।

–এটা আপনার ব্যর্থতা।

নোঙর ঠোঁট উলটে নির্লিপ্তস্বরে বললো। উজান ক্ষিপ্ত স্বরে ধমকে উঠে বললো,

–এখানে বকবক করার জন্য তোমাকে ডাকা হয়নি। ইন্টারভিউ দিতে হবে। বসে বসে এমনি এমনি থার্টি থাউজেন্ট স্যালারি নেওয়া যাবে না।

ত্রিশ হাজার স্যালারি শুনে নোঙরের চোখ চকচক করে উঠলো৷ খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো,

–ত্রিশ হাজার টাকা বেতন! কত কিছু কেনার আছে আমার৷ আচ্ছা, স্যালারি কি অগ্রীম দেওয়ার নিয়ম নেই? এই এক মাস আমার চলতে হবে তো৷ পরিচিত জন্য কি একটু বেনিফিট পাবো না?’

শেষের কথাটা বেশ ইমোশন নিয়ে বললো সে৷ করুন গলার ইমোশনাল কথায় চিড়ে ভিজলো না। উজান হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,

–আগে ইন্টারভিউ, তারপর চাকরি আর তারপর বেতন। ইন্টারভিউ-এ না টিকলে চাকরির আজকেই শেষদিন।

নোঙরের মুখ ছোট হয়ে গেলো। মনে মনে নির্দয় উজান বলে বকতে ভুললো না। উজান অফিসের কড়া বস হয়ে নোঙরের ইন্টারভিউ শুরু করলো,

–তো নোঙর খন্দকার, ব্যবসা সম্পর্কে তোমার ধারনা কি?

নোঙর ঠোঁট উলটে কাধ নাচিয়ে বললো,

–ব্যবসা সম্পর্কে আবার কি ধারণা থাকবে? ব্যবসাতে একজন সেল করে আর একজন সেটা পারচেস করে। যে সেল করে যে যদি বুদ্ধিমান সেলার হয় তাহলে অল্প টাকায় ভালো লাভ করবে। আর যে পারচেস করবে সে যদি ভালো বারগেনার হয় তাহলে সেলারের ব্যবসায় রেড লাইট।

উজান ঠান্ডা চোখে নোঙরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নোঙরের দৃষ্টি টেবিলে রাখা কলমদানির দিকে৷ দেখে মনে হচ্ছে, এই মূহুর্তে কলমদানীর থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নয়। উজান নিজেকে সামলে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলো,

–তুমি কি জানো এটা কিসের কোম্পানি?’

–কিসের আবার, শ্বশুরবাড়ির কোম্পানি।

বলেই নোঙর জিভে কামড় দিলো। নজর কলমদানীর উপর থেকে সরিয়ে আড় চোখে উজানের দিকে তাকিয়ে দেখলো, উজান কলম শক্ত করে ধরে কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আসে। নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টায় আছে। নোঙর বিড়বিড় করলো,

–ছিঁচকে মেজাজের বাটি।

উজান আওয়াজ করে টেবিলের উপর দুই হাত ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো,

–এখান থেকে বিদায় হও।

নোঙর উঠলো না। চেয়ারে হেলা দিয়ে আড়াম করে বসে মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,

–একটু পর যাই। তোমার রুমের এসির বাতাসটা দারুন। আমাদের রুমের এসির বাতাস একদম ভালো না। একদিক থেকে এসি চলছে তো আরেকদিক দিয়ে ঘেমে যাচ্ছি। একমাত্র বৌ তোমার। এটুকু খেয়াল তো রাখতেই পারো।’

উজান এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। মূহুর্তেই গরম লাগতে লাগলো নোঙরের৷ দাঁতে দাঁত পিষে উঠে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় অবশ্য তাহেরের ফাঁকা টুলটা ফেলে দিতে ভুললো না। উজান তক্ষুনি সেক্রেটারিকে কল দিয়ে অফিসরুমের সবগুলো এসি খুলে ফেলতে বললো। এখন থেকে ওখানে শুধু ফ্যান চলবে।

মিনিট দশেকের মধ্যেই নোটিশ আসলো, এসি নষ্ট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ এসেছে। তাই নতুন এসি না আসা পর্যন্ত শুধু ফ্যান চলবে। নোটিশ শুনে সবাই অভিযোগ কে দিয়েছে, সেটা খুঁজতে লাগলো আর হা-হুতাশ করতে লাগলো। নোঙর চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলো। ক্ষমতা থাকলে এখনই সে আজলান কায়সারকে গদিচ্যুত করে ফেলতো।

লাঞ্চের ব্রেকের মিনিট পাঁচেক আগে নোঙর মাহফুজাকে ফোন দিলো। ফোন ধরতেই কাঁদোকাঁদো মুখে তার ছেলের নামে অভিযোগ তুললো,

–তোমার ছেলে অফিসের সব এসি খুলে ফেলেছে ফুপি। জানোই তো কেমন গরম পরেছে৷ এই গরমে এতো কাজ করা যায় বলো?

আহ্লাদে তার ঠোঁট ফুলে উঠলো। ফোনের ওপাশে মাহফুজা আবেগে হাহাকার করে উঠলো,

–ওর এতো সাহস বেড়ে গেছে? তুই চিন্তা করিস না৷ কালকে সকালের মধ্যে যদি এসি না লাগায় তাহলে ওর রুমের এসিও হাওয়া হয়ে যাবে। বাড়িরটাও আর অফিসেরটাও।

দাঁত বের করে হাসলো নোঙর। কাজ এখনও শেষ হয়নি। আবারও ঠোঁট উলটে আহ্লাদী স্বরে বললো,

–আজকে অনেক কাজ করেছি ফুপি। এই ছোট মেয়েটাকে দিয়ে যে তোমার ছেলে এতো কাজ করাচ্ছে! কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি৷ ছুটির এখনও কত্তো সময় আছে। আরো কাজ করতে হলে আমাকে হসপিটালে দেখতে এসো।

নোঙরের গলার স্বরে করুন ভাব। মাহফুজা মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বললো,

–তুই এতো চাপ নিস না৷ ইচ্ছা হলে কাজ করবি, ইচ্ছা না হলে করবি না। ইচ্ছা হলে অফিস করবি, ইচ্ছা না হলে চলে যাবি। নিজেদের অফিসে কেউ এতো চাপ নেয় নাকি!

আদুরে স্বরে বললেন তিনি৷ নোঙর উৎফুল্ল মনে বললো,

–থ্যাঙ্কিউ ফুপি। আমি তাহলে চলে যাচ্ছি এখন। তুমি তোমার ছেলেকে ফোন দিয়ে একটু বলে দাও আমাকে যেনো যেতে দেয়। প্লিজ!

নোঙরের অনুরোধে কাজ হয়েছিলো। খানিকক্ষণ পর থমথমে মুখে তাহের এসে নোঙরের ছুটির কথা জানিয়ে দিলো৷ কিন্তু নোঙরের লাঞ্চের সময় বাড়ি ফেরা হয়নি। কারনটা বেশ বড়সড়। যখন বাড়ি ফেরার জন্য নিজের ব্যাগ গোছাচ্ছিলো তখনই হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো হাট করে অফিসরুমের দরজাটা খুলে গেলো। কালো পোশাকধারী দুইজন গার্ড দরজার দুইপাশে দাঁড়িয়ে একজনকে আসার জায়গা করে দিলো। একজন গার্ডের হাতে এয়ারফ্রেশনার ছিলো। লেমন ফ্লেভারের এয়ারফ্রেশনার স্পে করার পরই খয়েরী ক্রপ টপের উপরে কালো লেদার জ্যাকেট আর মিনি স্কার্ট পরা একটা মেয়ে ভেতরে এসে সরাসরি উজানের কেবিনে ঢুকে গেলো। বাতাসে মেয়েটির কড়া দামী পারফিউমের সুগন্ধ এয়ারফ্রেশনারকে ছাড়িয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পরলো। নোঙর এসব দেখে প্রথমে অবাক হলো। পরে রাগে মাথায় আগুন ধরে গেলো। তার উপর তাহেরের মুখ মেয়েটাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে দেখে তার দিকে ভষ্ম করে দেওয়া চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। মিনিট পনেরো পর মেয়েটা সহ উজান হাস্যজ্বল মুখে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো। আগুন চোখে এসব দেখে আর উঠতে পারেনি সে৷ কলম কামড়াতে কামড়াতে উজানের আসার অপেক্ষা করছিলো।

অফিস ছুটির আধ ঘন্টা পরেও যখন উজান ফিরলো না তখন বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে গেলো সে। বাড়ি ফিরে সরাসরি হুলোর খাঁচার কাছে গেলো। উজানের ছবি তার মুখের সামনে ধরে নাক টেঁনে টেঁনে বললো,

–এর সামনে তোকে ছেড়ে দিকে একে ঠোকর দিতে পারবি না? এই লোকটা হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে জঘন্য লোক, বুঝেছিস। একে ঠোকর দিতেই হবে। দেখলেই বলবি উজান গাধা। বজ্জাত উজানও মানানসই। ছুঁকছুঁক করা উজান বোধহয় বেটার হবে। শর্ট ড্রেস পরা মেয়েদের দেখলে মাথা আউলায়া যায়।

বলতে বলতেই নোঙর কেঁদে দিলো। অফিসের দ্বিতীয়দিন তার একদম ভালো যায়নি। খুব খারাপ লাগছে তার। মনে হচ্ছে উজানের মাথার সবগুলো চুল টেনে ছিড়ে ফেলুক। নাহলে কিছু একটা করুক যাতে দুপুরের ঘটনাটা মাথা থেকে চলে যাক। মনে মনে কয়েকবার নিজেকে শান্তনার বানী শুনালো। লাভ হলো না। শেষপর্যন্ত ঘরের দরজা বন্ধ করে কান্না করতে লাগলো।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-১৭+১৮

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৭

সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর পরিবার সম্পর্কে জানার আগ্রহ সবারই প্রবল। যেখানে রাজনীতিবিদেরা নিজেদের আসন ধরে রাখতে পরিবারকে ক্যামেরার সামনে হাজির করে, সেখানে হাসান চৌধুরী নিজের পরিবারের সকল সদস্যদের সুকৌশলে ক্যামেরার আড়ালে রাখে৷ পারিবারিক ব্যবসা সেজো ভাই হামিদ চৌধুরি এবং ছোট ভাই খলিল চৌধুরি দেখভাল করলেও শোনা যায়, চৌধুরী পরিবারের আর কোন পুরুষ ব্যবসার কাজে যোগ দেয়নি। যদিও সব শোনা কথা। আসল ঘটনা শুধুমাত্র তাদের পরিবার ছাড়া বাইরের কেউ জানে না। চৌধুরী পরিবারের এক ছেলে শাহরিয়ার চৌধুরী বাবার পথ অনুসরণ করে রাজনীতিতে আসলেও তিনিও খুব একটা ক্যামেরার সামনে আসে না৷ আর বাকি তিন ছেলের খবর কেউ জানে না। মোট কথা, পুরো পরিবার নিজেদের আড়ালেই রেখেছে। সেই আড়ালে থাকা পরিবারের মেয়ের বিয়ে হয়েছে রাজনীতিবিদ আদনান কায়সারের সাথে৷ তাও প্রেমের বিয়ে। চৌধুরী পরিবারের সেই মেয়ে দিলওয়ারা জামানের প্রেমের বিয়ে তার পরিবার মেনে নেয়নি। পরিবারের অমতে বিয়ে করায় তার সাথে তারা সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। খবরটা চাউর হতেই লোকজন ফেঁটে পরলো। সব জায়গায় এটা নিয়ে আলোচনা হতে লাগলো৷ উষিরের বাড়ির সামনে মানুষের ঢল পরে গেলো। গার্ডরা অতি কষ্টে লোকদের আটকাতে লাগলো।

রাশা তখন ছিলো কোর্টের বাইরে এক আইসক্রিম পার্লারের সামনে। ম্যাঙ্গো ফ্লেভারের আইসক্রিমটা গলে গলে পরছে। বেশ আয়েশ করে খাচ্ছিলো সে। হঠাৎই ক্লিক করে ফ্ল্যাশ জ্বলার শব্দ পেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। দশ বারোজন সাংবাদিক ক্যামেরা তার দিকে তাক করে ধরে রেখেছে। আর বেশ কয়েকজন মাইকও নিয়ে এসেছে। রাশা এতো অবাক হলো যে কখন টুক করে আইসক্রিমটা সম্পূর্ণ গলে পরে গেলো, সেটা টেরও পেলো না। চোখের পলক ফেলতেই যেনো ভুলে গেলো। ধ্যান ভাঙলো, এক গাদা প্রশ্নের ভীড়ে। একজোগে সব সাংবাদিক প্রশ্ন করতে শুরু করলো,

“ম্যাম, আপনি কি সত্যি হামিদ চৌধুরীর মেয়ে?”
“পলিটিশিয়ান আদনান কায়সারের সাথে আপনার আলাপ হলো কিভাবে?”
“আপনার পরিবার আপনাদের বিয়ে কেনো মেনে নেয়নি?”
“আপনার পরিবার তো আড়ালে থাকে। তাহলে আপনি প্রকাশ্যে আসলেন কেনো?”
“আপনার বিয়ে নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরী কি বলছেন?”
“আপনাদের বর্তমান পরিস্থিতি কি?”
“আপনাকে কি সত্যি গুম করে রাখা হয়েছিলো? সেখান থেকে আদনান সাহেব আপনাকে উদ্ধার করেছে?”
“আপনার পরিবারই কি এই গুমের সাথে জড়িত?”
“আপনাকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো?”
“আপনার পরিবার কি সত্যিই আপনার উপর অত্যাচার করতো?”

নানান উদ্ভট প্রশ্ন শুনে রাশার মাথা ঘুরতে লাগলো। মুখ খুলতে চাইলো। কিন্তু খেয়াল করলো, তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগলো। উৎসুক জনতারাও ভীড় করলো। মিনিটের মধ্যে সেখানে বড় বড় তিনটা গাড়ি এসে হাজির হলো। সামনের গাড়ি এবং পেছনের গাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন কালো পোশাক পরা গার্ড এসে রাশাকে আড়াল করে দাঁড়ালো।

–ম্যাম, আপনি আমাদের সাথে চলুন। আমাদের উষির স্যার পাঠিয়েছেন।

রাশা শুনলো। গার্ডের আড়ালে নিজেকে ঢেকে মাঝের গাড়িতে গিয়ে বসলো। সামনে আর পেছনের গাড়ি ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হলো৷
গাড়িতে ওঠার পরপরই রাশার ফোনে উষিরের কল আসলো। গতরাতের ব্যবহারের পর উষিরের উপর প্রচন্ড রেগে আছে সে। তার অনুমতি ছাড়া তাকে ছোঁয়ার সাহস হলো কিভাবে! এখন আবার কল দিচ্ছে! রাগে লাল হয়ে গেলো রাশা। ফোন কেঁটে দিয়ে নাম্বার ব্লক করে দিলো। তারপর সামনে বসা গার্ডকে বললো,

–এতো জার্নালিস্ট এসেছে কেনো?

গার্ডদের সাথে রাশার ব্যবহার খুব স্বাভাবিক। সামনে বসা গার্ড মোবাইলে কিছু করছিলো। রাশার প্রশ্নে বিনয়ের সাথে জবাব দিলো,

–আপনার দেওয়া ইন্টারভিউ পাবলিশড হয়েছে। তাই সবাই আপনার সাথে সরাসরি কথা বলতে চাইছে।

রাশার ভ্রু কুঁচকে গেলো। ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। তারপর সপ্তাহ দুই আগে দেওয়া ইন্টারভিউয়ের কথা মনে পরে গেলো। সাথে সাথে মোবাইলে ইন্টারভিউ খুঁজতে লাগলো। খুঁজে পেতে একদমই কষ্ট করতে হলো না। নিউজপেপার তাদের তোলা সেই ছবি দিয়েই তাদের ওয়েবসাইট আর ফেসবুক পেজে বড় করে একটা আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। রাশার বলা কিছু কথা নিয়ে আর নিজেদের মাল-মশলা মিশিয়ে এক রসালো নিউজ বের করেছে। ক্যাপশন দিয়েছে, “হাসান চৌধুরীর ভাতিজির প্রেমের বিয়ে তার পরিবার মেনে নেয়নি।”
এই ক্যাপশন এখানেই শেষ। এই নিউজটাই সবাই বিভিন্ন ক্যাপশনে শেয়ার দিচ্ছে।
“তরুন পলিটিশিয়ান আদনান কায়সার ও সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর ভাতিজির সম্পর্ক মেনে নেয়নি তার পরিবার।”

“অবশেষে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর পরিবারের গোপন তথ্য ফাঁস করলেন তারই ভাজিতি দিলওয়ারা জামান চৌধুরী।”

“পরিবারের শত অত্যাচারেও সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর ভাতিজি দিলওয়ারা জামান চৌধুরী নিজের প্রেমের সম্পর্ক ভাঙেননি।”

“প্রেমের এক দৃষ্টান্ত উদাহরণ সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাসান চৌধুরীর ভাতিজি দিলওয়ারা জামান চৌধুরী।”

বাকি ক্যাপশনগুলো পড়ার ধৈর্য আর তার নেই। ভেতরের নিউজ আরো ভয়াবহ। তার বলা কথাগুলো অর্ধেক রেখে বাকি অর্ধেক নিজেরা যোগ করেছে।
–প্রেমের সম্পর্ক মেনে না নেওয়ার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। মেয়েকে আটকাতে তাকে কিছুদিনের জন্য গুম করে ফেলেন। উদ্ধার করেন তার বর্তমান স্বামী তরুন রাজনীতিবিদ আদনান কায়সার। এমনকি দিলওয়ারা জামানকে জোর করে অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়। সেখান থেকে স্বামীর হাত ধরে পালিয়ে আসেন। অতঃপর তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দিলওয়ারা জামান নিজের মুখে বলে বলেছেন, ওই কয়েকদিন তার উপর মানুষিক ও শারিরীক অত্যাচার করা হয়। এমনকি তাকে শাস্তি দিতে জানালাবিহীন এক বদ্ধ ঘরে কয়েকদিন বন্দী করে রাখা হয়। তিনি আরো বলেন, “আমি এখন অনেক সুখে আছি। আমার স্বামী এবং তার পরিবার আমাকে অনেক ভালোবাসে৷ সেদিন যদি না পালাতাম তাহলে জীবনে অনেক বড় একটা ভুল হতো।”

রাগে রাশার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। সবাই বলে, উকিলরা নাকি মিথ্যা বলে। তাদের তো সাংবাদিকদের দেখা উচিত। বদ সাংবাদিক! রাশা চিৎকার করে উঠলো,

–গাড়ি পুলিশ স্টেশনে নিন।

ড্রাইভার, গার্ড দুজনেই চমকে উঠলো। কিন্তু যাদের চাকরি করে তাদের মুখের উপর কিছু বলতে পারলো না। নিজের গতিতেই গাড়ি চলতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামতেই রাশা ভাবলো থানাতে চলে এসেছে। আশেপাশে নজর বুলাতে লাগলো। পরক্ষণেই পাশে এসে কেউ বসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, উষির পাশে এসে বসেছে। সামনের ড্রাইভার আর গার্ড নেমে পরেছে। রাশার পুরোনো মনে পরে গেলো। রেগে কিছু বলতে চাইলো। ততক্ষণে উষিরের হাতে রাশার ফোন চলে গেছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু করছে। ফোনে দৃষ্টিতে রেখেই মৃদু স্বরে বললো,

–হাজবেন্ডকে কেউ ব্লক করে নাকি?

রাশা তেঁতে উঠলো। পুরোনো রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই ফেঁটে পরলো। চেঁচিয়ে উঠে বললো,

–তোমার এখানে আসার সাহস কিভাবে হলো? কি চাও তুমি? কাল রাতে এতো বড় কাহিনী করেও লজ্জা হয়নি? নির্লজ্জের মতো আবার এখানে চলে এসেছো? হাউ কুড ইউ ডু দ্যাট? তুমি যে এখনও বেঁচে আছো, সেটা তোমার শত জনমের ভাগ্য মিস্টার আদনান কায়সার।

চিবিয়ে চিবিয়ে বললো রাশা। উষিরের কাজ শেষ। সিটের উপরিভাগে হাত রেখে মিটিমিটি হেসে রাশার কথা শুনছিলো৷ কাল রাত থেকে রাশার মুখ বন্ধ ছিলো। শত চেষ্টাতেও মুখ খোলেনি। আজ এই দুপুরের পর এসে তার গলার আওয়াজ শুনে উষিরের হৃদয় ঠান্ডা হলো।
উষির মৃদু হেসে রাশার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে লাগলো৷ ছিটকে হাত সরিয়ে দিতে চাইলো রাশা। উষিরের শক্তিশালী হাতের সামনে পেরে উঠলো না। নিজেই সরে বসলো। উষির চওড়া হাসলো৷ রাশার দিকে সরে বসে আলতো স্বরে বললো,

–স্বামী স্ত্রীর মাঝে ওসব ছোট বড় ম্যাটার করে না।

রাশা পালটা জবাব দিলো না৷ রাগে সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো,

–তুমি যাও এখান থেকে৷ তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি তোমার গার্ডদের সাথে এক্ষুনি বিদায় হবে। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। রাইট নাও।’

এই পরিস্থিতিতেও উষির মজা করার লোভ সামলালো না। হাসি চেপে বললো,

–ওরা তো আমার গার্ড না। ওরা তো তোমার গার্ড। শুরু থেকেই আছে।

রাশা জানতো, নিজের রাগ প্রকাশ করতে নেই। রাগ প্রকাশ করা দুর্বলতা। সামনের মানুষ সেই দুর্বলতা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে৷ সে ঠিক জানতো। আবার সেটার প্রমাণ পেলো৷ কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো৷ উষির পরিস্থিতি আন্দাজ করলো। ফোন বের করে ড্রাইভারকে কল দিয়ে গাড়িতে আসতে বললো। উষির আসার পরপরই গার্ডরা চলে গেছে। তাই ড্রাইভার শুধু উষির আর রাশাকে নিয়ে তাকে বলা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলো। রাশার ফোন উষির কোথায় রাখলো সেটা সেই জানে। যার ফোন সে নিজেই ফোন খুঁজলো না। মুখ ফুলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে লাগলো। এমনকি উষির যখন তার হাত নিজের হাতের মধ্যে রাখলো, তখনও কিছু বললো না। নিজের হাত ছাড়িয়ে পর্যন্ত নিলো না। উষির সবটা বুঝলো। আবারও রাশার রাগকে নিজের হাতিয়ার বানানো। এক হাতে রাশার কোমর চেপে কাঁধে মাথা রাখলো। আরেক হাত তার হাতের মাঝে বন্দী। রাশার মনে হলো, এক বাঁধন থেকে বের হওয়া খুব মুশকিল৷ বিয়ে করে সত্যিই ভুল হয়ে গেছে।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছালো, তখন আকাশ ফুঁড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। উষির জানে, রাশা গাড়ি চালাতে পারে। তাই গাড়ি রাখার রিস্ক নিলো না। নির্জন জায়গায় তাদের এই ফার্মহাউজ৷ চারিধারে বড় বড় গাছ আর একপাশে বড় একটা নদী। নদীর ওপারে গ্রাম শুরু৷ ফার্ম হাউজ থেকে বের হতে, হয় দীর্ঘ পথ হেঁটে মেইন রাস্তায় উঠতে হবে আর নাহলে নদী সাঁতরে গ্রামে যেতে হবে৷ কিন্তু এই তীব্র স্রোতের নদী সাঁতরে পার হওয়া কম কথা নয়। তবুও একমাত্র গ্রামবাসীর ভরসায় ড্রাইভারকে বিদায় দিলো। বড় একটা লাগেজ সমেত ফার্মফাউজে প্রবেশ করলো। রাশা চুপচাপ উষিরকে অনুসরণ করলো। অনুসরণ না করেও উপায় ছিলো না। এক মূহুর্তের জন্যেও তার হাত সে ছাড়েনি। হাত ছাড়াতে হয় কথা বলতে হতো আর নাহলে জোর জবরদস্তি করতে হতো। জোর করলে আবার কিছু না কিছু বলতে হতো আর নয়তো রাগ প্রকাশ করতে হতো। সেসবের কিচ্ছু সে চায় না। তাই চুপচাপ উষিরকে অনুসরণ করতে লাগলো।

এক তলার এই ফার্মহাউসটার মেঝে কাঠের। দেয়ালটার বেশিরভাগ অংশই কাঁচের৷ কাঁচের দেওয়াল দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখা যায়। বড় বড় দুটো ঘর আর বিশাল বড় লিভিংরুম। লিভিংরুমের সাথেই লাগোয়া ওপেন কিচেন৷ উষির এসে থেকে কিচেনেই কাজ করছে। আর রাশা বসে আছে লিভিংরুমে রাখা বড় গোল মতোন সোফাতে। এই এক সোফাতেই আট দশজন অনায়াসে বসতে পারবে। বোধহয় এখানে সবাই গল্প করতেই আসে।
সুর্য ডোবার সাথে সাথে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বাইরের আলো এখনও যায়নি। মেইন সুইচ অন করায় ঘরে অটোমেটিক লাইট জ্বলে উঠেছে।
উষির বৃষ্টির তেজ দেখে বাইরে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে উচ্ছ্বসিত স্বরে বললো,

–বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। চলো ভিজি।

রাশার কোলে হলুদ কভারের একটা কুশন ছিলো। কাজ না থাকায় মনোযোগ দিয়ে কুশনের কাপড়ের ডিজাইন দেখছিলো। উষিরের কথা শুনে কুশনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে গম্ভীরমুখে উত্তর দিলো,

–আমার এসব পছন্দ না।

উষির কপাল কুঁচকে রাশাকে দেখলো। তারপর আলতো হেসে ন্যাপকিনে হাত মুছে বললো,

–কোনদিন ভিজেছো?

–না।

উষির রাশার দিকে এগিয়ে আসলো। মূহুর্তের মধ্যে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে চোখে চোখ রেখে বললো,

–তাহলে কিভাবে মজা বুঝবে!

রাশা হকচকিয়ে গেলো। পলক ফেলতে না ফেলতেই মুখে বৃষ্টির ফোঁটা পরলো। চিৎকার করে উঠলো সে। উষির ছেড়ে দিতেই রাশা এক দৌড়ে ঘরে যেতে চাইলো। উষির ছাড়লো না। জাপটে নিজের সাথে ধরে রাখলো। কিছুক্ষণ জোরাজুরির পর হাল ছেড়ে দিলো৷ স্থির দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে কাকভেজা হওয়ার পর যখন উষির আচ্ছন্নের মতো রাশার কাছাকাছি আসলো তখন রাশা ধীর স্বরে বললো,

–বাড়ি ফিরবো কখন?

উষির রাশার ঘাড়ে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলো। নাকে নাক ঘষে আচ্ছন্নের মতো বললো,

–যখন তোমার রাগ কমবে।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৮

বৃষ্টি থামলো শেষ রাতের দিকে। সকালে প্রতিদিনের মতোই সূর্য তার তেজ ছড়িয়ে বৃষ্টির ভাব দূর করে দিলো৷ রাশা ঘুমিয়ে ছিলো। ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদারে কম্ফোর্টার গায়ে জড়িয়ে বেশ আড়াম করেই শুয়ে ছিলো। উষিরের আড়াম সহ্য হলো না। ভোর ভোর উঠেই কাঁচের দেয়ালের পর্দা সরিয়ে দিয়েছে৷ ফলস্বরূপ, সকালের আলো দিয়ে পুরো ঘর ভরে গেলো৷ অলস্য ভঙ্গিতে উঠে পরলো সে৷ নজর ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলো, উষির ঘরে নেই৷ পুরো ঘরে শুধু বেড, বেড সাইট টেবিল আর কাঠের ক্লোজেট ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। রাশা উঠলো বেশ কষ্ট করেই। মাথা ভার হয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস তার নেই। একদিন ভিজেই কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। লাগোয়া ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিলো। পুরো বাড়িতে উষির নেই। সেটা নিয়ে রাশার ভাবনাও ছিলো না। সে তো নিজের ফোন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ফোন যে উষির লুকিয়েছে সে ব্যাপারে সে একশো পার্সেন্ট সিওর। ফোন না পেলেও হতাশ হলো না। ফোন ছাড়াই সে ফিরে যাবে।

উষির ছিলো লনে। কোত্থেকে কাঠ জোগাড় করে সেগুলো কাঁটছে। খালি গায়ে থাকায় কাঠ কাঁটার সময় ফুলে ফুলে ওঠা পেশিগুলো বেশ ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। ঘামাক্ত শরীরটা বেশ আকর্ষনীয় লাগছে। অবস্থা দেখে রাশা নাক মুখ কুঁচকে ফেললো। ধীর পায়ে উষিরের পেছনে এসে হাত ভাজ করে দাঁড়ালো। উঁচু গলায় বললো,

–যাবে কখন?

ক্ষণকালের জন্য উষিরের হাত থামলো। তারপর কুড়াল দিয়ে কাঠে সজোরে একটা বাড়ি দিয়ে বললো,

–ম্যাডামের রাগ কমেছে?

রাশা কথা বললো না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মুখ ঘুরিয়ে থাকলো। উষির কাঠ কাঁটা থামিয়ে চেয়ারের উপর ফেলে রাখা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে বললো,

–সকালে রান্নার সময় দেখি গ্যাস শেষ। কাঠ ছাড়া উপায় নেই। এখন তুমি আমাকে এগুলো নিয়ে যেতে হেল্প করো।

রাশা তপ্ত শ্বাস ফেললো। সাহায্য না করে উলটে বললো,

–আমি এক্ষুনি ফিরবো।

–সাত দিনের আগে না।

উষির ঠোঁট টিপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বললো। রাশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–আমি একাই যাচ্ছি। তুমি তোমার হলিডে ইঞ্জয় করো।

বলেই হাঁটা শুরু করলো। উষির গলা উঁচিয়ে বললো,

–গাড়ি নেই।

–পায়ে হেঁটে যাবো।

–জঙ্গল কিন্তু।

–রাশা ভিতু না।

রাশা মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিলো। উষির ভ্রু উঁচিয়ে সাবধানি গলায় বললো,

–জঙ্গলে জোঁক আছে।

রাশা শুনলো না। সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। উষির পেঁছন থেকে চিল্লিয়ে উঠলো,

-সাপ, বাঘ, ভাল্লুক, উল্লুক, শিয়াল সব আছে।

রাশা মুখ ঘুরিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

–মানুষের থেকে বড় হিং’স্র প্রাণী আর একটাও নেই।

উষির খানিক থমকে ঠোঁট কামড়ে ভাবলো। তারপর বাঁকা হেসে আবার গলা উঁচিয়ে বললো,

–নর’খাদ’ক আছে।

কথা কাজে লাগলো৷ পা থমকে গেলো রাশার৷ তারপর দ্রুত পায়ে তার দিকে আসতে লাগলো৷ উষিরের মনে হলো, রাশা তেড়ে আসছে৷ প্যান্টে হাত মুছে জাপটে ধরার জন্য রেডি হয়ে থাকলো৷ রাশা ঠিক মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে দাঁড়ালো। বললো,

–বাইরে নর’খাদ’ক আছে আর ভেতরে নারী খাদ’ক আছে। আনফচুনেটলি আমি নর না, নারী। তাই নারী খাদ’কের থেকে বাঁচাই উত্তম।

উষির রাঙা হয়ে উঠলো। ফর্সা গালে লালচে আভা পরলো৷ লাজুক হেসে বললো,

–ছিহ বউ, এমন করে কেউ বলে নাকি!

রাশা লাজুক গলার আওয়াজে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর মাথা নেড়ে অবিশ্বাসের সুরে বললো,

–মাই গুডনেস!

বলে আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না৷ রাগে নাকি ভয়ে বোঝা গেলো না কিন্তু গটগট করে হেঁটে দ্রুত পায়ে চলে গেলো। উষির পাত্তা দিলো না। তার কেঁটে রাখা কাঠগুলো গুছিয়ে বাড়ির পেছনে রাখা মাটির চুলার রান্নাঘরে নিয়ে যেতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাশা ফিরে আসলো। রাগে রীতিমতো ফুঁসছে। বিরাট বড় লোহার গেইটে বিরাট বড় তালা ঝুলছে। উষির কাঠ রেখে ফিরে আসতেই রাশার মুখোমুখি হলো। রাশা বেগ রেগে আঙুল উঁচিয়ে বললো,

–যে পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়ে বিয়েছে তাতে আমি যদি হাসান চৌধুরীর পরিবারের অংশ আর হামিদ চৌধুরীর মেয়ে না হতাম তাহলে আমাকে কি মেনে নিতে?

উষিরের হাস্যজ্বল মুখ মূহুর্তের আঁধারে ঢেকে গেলো। তারপর বাঁকা হেসে একটু ঝুঁকে রাশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

–আমি আসার সময় আমার ব্রেইন রেখে আসিনি। সাথে নিয়েই এসেছি। আর আমার অনেক গুনের আর একটা গুন হলো, আমি রাগের মাথায় হুটহাট ডিসিশন নেই না।

বলেই কুটিল হেসে সামনে আগালো উষির। রাশা পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

–তুমি হাসান চৌধুরীর থেকে কিচ্ছু এক্সপেক্ট করো না৷ তার ভাতিজিকে বিয়ে করার জন্য তুমি ইজিলি তোমার ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাবে, এটা যদি ভেবে থাকো তাহলে খুব বড় ভুল করছো৷ আবারও ওয়ার্ন করছি৷ খুব বড় ভুল করছো তুমি।

উষির থমকালো, কথা ঘুরালো৷ গতকাল নিউজ প্রকাশের পর যে তার ক্যারিয়ারের অলরেডি চল্লিশ শতাংশ ডুবে গেছে এবং বাকি ষাট শতাংশ যে হাসান চৌধুরী নিজ দ্বায়িত্বে ডুবিয়ে দেবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এগিয়ে এসে রাশার হাত মুঠিয়ে বন্দি করে সামনে এগোতে এগোতে বললো,

–আমি একা কষ্ট করবো আর পার্টনার বসে থাকবে, এটা আমার সহ্য হবে না। চলো, কাঠ আনতে সাহায্য করবে।

রাশার লম্বা হালকা গোলাপি টপটা ভেজা কাঠ নেওয়াতে নষ্ট হয়ে গেলো। উষিরের উপর জমা সব রাগ কাঠের উপর ঝাড়তে লাগলো। রাগ কিছুতেই আয়ত্তে আসছে না। কতো উপায় ভেবেছে, কত ভাবে দেখেছে। কিচ্ছু কাজে আসছে না। এই রাগে রাগটা আরো বেড়ে যাচ্ছে।

***
ঘুম থেকে উঠেই নোঙর এক বিশাল অনশনে বসলো। বসার আগে অবশ্য খেয়ে নিতে ভোলেনি৷ অনশনে বসার মূল কারণ হলো চাকরি৷ বিয়ের একদিন পরেই তার মনে হলো একটা চাকরি তাকে করতেই হবে৷ বেকার থাকলে বিয়ের দিনের মতো প্রতিদিনই তার বর তাকে ছেড়ে চলে যাবে। তাই বিস্তর গবেষণা করে এবং দীর্ঘক্ষণ বান্ধবীদের সাথে আলোচনা করে এই অনশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
অনশনে বোধহয় কলা খেতে মানা নেই। অন্তু এক ছড়ি কলা এনে দিয়েছিলো৷ এখন আর চারটা বাকি আছে। নোঙরের অনশন দেখে কিছুক্ষণ উশখুশ করে নিহান এসে তার ফার্মে একটা চাকরি নিতে বললো। তিনটে মুরগী দিয়ে সবেই একটা ফার্ম দিয়েছে সে। এখনও দুটো মুরগী আসা বাকি আছে। টোটাল হবে পাঁচটা। শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো নোঙর৷ তার শখ করে ভর্তি হওয়া এমবিএ-র ডিগ্রী কি না মুরগী খাবে! মেনে নিতে পারল না কিছুতেই। বাকি কলা চারটে শেষ করে সোজা বিছানায় শুয়ে পরলো। অপলা এসে এক বোতল শরবত এনে দিলো। ছড়িয়ে পরলো, নোঙর তীব্র অনশনে অসুস্থ হয়ে শয্যা নিয়েছে৷ খবর চলে গেলো এতোদিনের পুরোনো ফুপুর বাড়ি আর সদ্য হওয়া শ্বশুরবাড়ি। ঘন্টাখানেক পরেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার চলে আসলো। সাথে নতুন কাকা শ্বশুরের সতর্ক বানী৷ নতুন বৌমাকে দুই ঘন্টার মধ্যে চাকরিতে জয়েন করতে হবে। দুই ঘন্টা পরে গেলে ইন্টারভিউ দিতে হবে। আর দুই ঘন্টার মধ্যে গেলে সরাসরি পাবে একটা গোছালো ডেস্ক।

কিছুক্ষণ তালবাহানা করে, গাঁইগুঁই করে রেডি হতে লাগলো সে। বেছে বেছে বের করলো সব থেকে পছন্দের একটা কুর্তি৷ সাদা, কালো আর হলুদ মিশেলের জামাটা কয়েকদিন আগে নিউমার্কেট থেকে অনেক দরদাম করে কিনেছিলো৷ এর আগে মাত্র একদিন পরেছে৷ অফিসের প্রথম দিনে এই জামার থেকে ভালো আর কোন জামা হয় না৷ চুল পনিটেল করে বেঁধে গলায় স্কার্ফ ঝুলিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিলো সম্পূর্ণরুপে তৈরি হয়ে গেলো।

বেরোনোর আগে পোষা কাকাতুয়া পাখির কাছে গেলো। সুন্দর ঝুঁটিওয়ালা, আকর্ষণীয় পালক আর বাঁকানো ঠোঁটের সাদা রঙের কাকাতুয়াটা নতুন কেনা হয়েছে। কথাবার্তা তেমন বলে না৷ বাচ্চা কাকাতুয়া পাখিটির চেনাপরিচয় এখনও তেমন একটা হয়নি। শুধু নোঙরকে দেখলে শান্ত থাকে। আর বাকিদের দেখলে রুক্ষ স্বরে ডেকে ওঠে, চেঁচামেচি করে৷ তাই তাকেই খাবার দিতে যেতে হয়। অফিস থেকে কখন ফেরে না ফেরে, তাই এখনই বেশি করে খাবার দিতে চাইলো। রান্নাঘর থেকে কিছু সূর্যমুখী বীজ নিয়ে খাঁচার কাছে গেলো৷ তখনই ফোন বেঁজে উঠলো। আননোন নাম্বার। রিসিভ করে ফোন কান আর কাঁধে দিয়ে আটকে খাঁচার দরজা খুলে খাবার দিতে দিতে ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে প্রশ্ন করলো,

–কে বলছেন? কাকে চাই?

–মিসেস নোঙরকে চাই।

ভ্রু কুঁচকে গেলো নোঙরের। তার মিস থেকে মিসেস হওয়ার খবর পরিবার ছাড়া বাইরে কোথাও যায়নি। ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি কিভাবে জানলো সেটা জানা দরকার। রুক্ষ স্বরে রাগী গলায় বললো,

–তাকে দিয়ে কি দরকার? ও বাড়ি নেই৷ ওর হাজবেন্ড আছে, কথা বলবেন?

–আমি ওর হাজবেন্ডই বলছি।

নোঙর থতমত খেয়ে গেলো। সেই সাথে একটা ঠান্ডা বাতাস শরীরে অনুভব করলো। হাজবেন্ড! এতো অধিকার! এতো জোড়! নিজেকে সামলালো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

–বলো, কি বলবে?

উজান তাড়াতাড়িই অফিসে এসেছে৷ কাজ জমে ছিলো অনেক। বিয়ের ব্যাপারটা মাথা থেকে একদম বেড়িয়ে গিয়েছিলো। একটু আগে যখন তার বড় বাবা আবসার কায়সার ফোন দিয়ে বললেন, নোঙরও আজ থেকে অফিসে আসবে তখন থেকেই তার হাসফাস লাগছে। এই বিয়ে ব্যাপারটা এখনও ঠিক হজম হচ্ছে না৷ বিয়ে জিনিসটা মানার আগেই নিউজ লিক করতে চায় না সে। সময় নিতে চাচ্ছে। ভাবতে চাচ্ছে। সম্পর্কটাতে থাকবে কি না সেটা নিয়েও কনফিউজড। বড় বাবাকে বললো সেটা। তিনি উত্তরও দিলেন। কিছুই আর করার নেই, তিনি বাধ্য। কথা শুনে প্রথমে রাগ উঠেছিলো। পরক্ষণেই মাথা ঠান্ডা করে নোঙরের সাথে সরাসরি কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো৷ সেই ভাবনায় ফোনও করে ফেলেছে৷ কল রিসিভ করায় আর একটুও সময় নিলো না উজান৷ প্রশ্ন করলো,

–চাকরি করতে চাইছো কেন?

–নোঙর খন্দকার কি তোমাকে বলে বলে চাকরি করবে?

নিতান্তই অভদ্রমার্কা উত্তর। রেগে গেলো উজান। দাঁতে দাঁত পিষলো। ক্রোধ মিশ্রিত স্বরে বললো,

–আমার অফিসেই তোমার সেই চাকরিটা নিতে হবে?

হতচকিত হলো নোঙর। এই খবরটা তার কাছে নতুন। শ্বশুরবাড়ির নিজস্ব অফিস মানে যে সেখানে উজান নামক হাজবেন্ডও থাকবে সেটা মাথাতেই আসেনি! রাজী হয়েছে, এখন মানাও করা যাবে না। নাক চুলকে কিছু ভাবলো৷ তারপর ক্রুর হেসে বললো,

–সেটা শ্বশুরবাড়ির ডিপার্টমেন্ট। আমার না৷ আমি যেচে চাকরি নেইনি। আমাকে যেচে দেওয়া হয়েছে, বাড়ি বয়ে এসে।

শেষের বাক্যটা বেশ জোরের সাথে বললো৷ উজান তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

–তুমি মানা করে দাও। বলো এখানে জব করবে না। আমি তোমাকে অন্য জায়গায় জব নিয়ে দিচ্ছি৷ ভালো বেতনের, ভালো চাকরি।

উজান মানা করছে মানে নোঙরকে চাকরিটা করতেই হবে। জেদ চেপে গেলো। মাথা নেড়ে বললো,

–উঁহু। শ্বশুরবাড়ির অফিসের মজাই আলাদা। আমি অন্য চাকরি করবোই না। এইটাই করবো।

নোঙরের জেদি সুরে বলা কথাগুলো শুনে রাগে টেবিলে কিল বসিয়ে দিলো উজান। টেবিলের কিছুই হলো না, কিন্তু হাতে ব্যাথা পেলো। হাত ঝাড়া দিতে দিতে বললো,

–ফাইন! তাহলে আমাদের বিয়ের কথা তুমি অফিসের কাউকে বলবে না। বুঝেছো?

উজান বুঝে গেছে, আর যাই হোক নোঙর এখানেই চাকরি করবে। তাই মনের কথাটাই বলে দিলো। ফোনের ওপাশ থেকে নোঙর ভেঙচি কাঁটলো৷ ঠোঁট বেঁকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বললো,

–তুমি কাউকে বলবে না।

অবাক হলো উজান। বিষ্মিত স্বরে বললো,

–আমি কেনো খামোখা কাউকে বলতে যাবো?

নোঙর রেগে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠে বললো,

–তাহলে আমিও কেনো খামোখা কাউকে বলতে যাবো? তোমার কি মনে হয়, আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য ম’রে যাচ্ছিলাম যে এখন জনে জনে ডেকে ডেকে বলবো, তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।

বিরক্ত হল উজান। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

–এমন অসভ্যের মতো কথা বলছো কেন? ভদ্র আচরণ করতে শেখোনি?

–ভদ্র আচরণ কেমন করে করে? শিখিয়ে দেবেন একটু?

নোঙর চোখ পিটপিট করে গলার স্বরে মাধুরী মিশিয়ে জবাব দিলো। ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি খেলা করছে।

–গো টু হেল। জাহান্নামে যাও!

রাগে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো উজান। বলেই ফোন রাখতে চাইলো৷ নোঙর ছাড়লো না।

–আমি গো টু হেলের বাংলা জানি। আপনাকে ট্রান্সলেট করতে হবে না। আর আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? আমি কি আপনাকে তুমি করে বলছি? আমাকে আপনি করে বলবেন।

–তুমি বয়সে আমার থেকে যথেষ্ট ছোট। আর..’

উজান বলতে চাইলো, সেও ওকে তুমি করেই বলছে। মাত্র দুই তিনটা বাক্য আপনি বলেছে। কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই ওপাশ থেকে কড়া গলায় বললো,

–আপনি যদি আমাকে আপনি করে না বলেন তাহলে আমিও আপনাকে তুই করে বলবো।

নোঙর একরোখা জবাব দিলো৷ ততক্ষণে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অটোতেও উঠে গেছে।

–তুই করে বলবে!

উজান মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো। বাক্যটা তার কাছে নতুন। নোঙর কপাল কুঁচকে মাথা নাড়লো। নির্লিপ্ত স্বরে বললো,

–হ্যাঁ, এই আজকে তুই কোন কালার ড্রেস পরে অফিসে যাবি? ব্লুটা একদম পরবি না। ওইটা পরলে তোকে একদম অফিসিয়াল জোকারদের মতো লাগে।

নোঙর উজানের সোশ্যাল সাইটও ভিজিট করেছিলো৷ কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টালে ছবিও দেখেছে৷ সেখানেই কোন একটা জায়গায় নীল স্যুট আর সাদা শার্টের উজানকে দেখে তার মাথা গরম হয়ে গেছে। নীল রঙ তার একদম পছন্দ হয় না৷ নোঙরের বিশ্বাস, নীল অশান্তি ছড়ায়। তাই সে নীল থেকে দূরেই থাকে।

উজান দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। চট করে নিজের পোশাকের দিকে তাকালো৷ গ্রে কালার শার্ট পরে আছে৷ সাথে ব্ল্যাক কালার স্যুট৷ নীল না পরায় রাগ গলো খুব। সাথে নোঙরের অভদ্র আচরণ। রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে বললো,

–অসভ্য!

নোঙরের বেশ মজা লাগতে লাগলো৷ মেইন রোড দিয়ে চলা গাড়িগুলো একটার পর একটা তাকে ক্রস করে চলে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে কণ্ঠ যথাসম্ভব সিরিয়াস করে বললো,

–তোকে আমি ইমপ্রেস করতে চাই না। তাহলে খামোখা তোর সামনে আমি ভদ্র সাজতে যাবো কেন?

–অসভ্য, অসহ্য, বেয়াদব মেয়ে!

রেগে কল কেঁটে দিলো উজান৷ নোঙরকে কল দেওয়ার জন্য মনে মনে নিজেকে বকতে লাগলো। চটপট নাম্বার ব্লক লিস্টে রেখে নিজেকে শান্তি দিতে ভুললো না৷ নিজেকে বোঝাতে চাইলো, পুরো কনভারসেশনটাই কল্পনা। বাস্তবে এমন কিছুই হয়নি। পরক্ষণেই মনে হলো, আপনি করে বলেই যদি এতো সম্মান দেয় তাহলে কোন সম্মোধন ছাড়া কথা বলাই ভালো।

***
প্রথমদিন নোঙরের কোন কাজ ছিলো না। আবসার কায়সারের সাথে ম্যানেজারের আগেই কথা হয়েছিলো। তবে নোঙরের আসল পরিচয়টা তাকে বলা হয়নি৷ তিনি শুধু জানতেন, নোঙর খন্দকার তার স্যারের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়। সবার সাথে সেভাবেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো৷ স্যারের আত্মীয় বলে সবাই আলাদা খাতির করলো। জ্যামের কারনে অফিসে আসতে আসতে প্রায় ছুটির সময়ই হয়ে এসেছিলো। তেমন পরিচয় হলো না কারো সাথে। সব থেকে খুশির ব্যাপার হলো, তাকে কোন ইন্টারভিউও দিতে হয়নি। এমনিতেই একটা সাজানো গোছানো ডেস্ক পেয়ে গেছে।

ছুটির পর উজান হন্যে হয়ে নোঙরকে খুঁজতে লাগলো। তাকে যেনো নিজ দ্বায়িত্বে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে, সেটা বলে মা, বড় মা, এমনকি বড় বাবাও বারংবার ফোন দিয়ে বলেছে। এই ফোনের চক্করে মিটিংটাও শান্তিতে করতে পারেনি। একটা ঝামেলা ঘাড়ে এসে জুটে গেছে। অসহ্য!

নোঙরকে পাওয়া গেলো গেটের মুখে। গ্যারেজের দারোয়ানের সাথে খোশগল্প করতে দেখা গেলো। উজানকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো। দেখেই শরীর জ্বলে উঠলো তার একটা কথাও বললো না। সোজা গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে নোঙরের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো৷ নোঙর দারোয়ানের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। আরামদায়ক সিটে পা তুলে বাবু দিয়ে বসলো। মূলত উজানকে জ্বালানোর জন্যই এমনটা করেছিলো। উজান দেখেও দেখলো না। বলা চলে পাত্তা দিলো না। ওই মেয়ের সাথে কথা বলা মানে নিজেই নিজের মাথায় বাড়ি দেওয়া। নিজেকে বুঝালো উজান। কোন কথা না বলে এক মনে গাড়ি চালিয়ে সোজা বাড়ির সামনে গাড়ি দাড় করালো৷ নোঙর ঘুমিয়ে পরেছিলো। জোরে হর্নের আওয়াজে ধরফরিয়ে উঠে পরলো। বাড়ি ফিরেছে দেখে গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো। ভ্রু কুঁচকে উজান বিড়বিড় করলো, ‘যেমন অভদ্র ব্যবহার, তেমন অভদ্র চালচলন! একবার বায় পর্যন্ত দিলো না! অসহ্য!’

গাড়ি চালানোর মূহুর্তে দেখলো সিটের উপর নোঙরের স্কার্ফের একটা ঝুল পরে আছে। ফেলে দিতে চাইলো সে। কি মনে করে সামনের স্টোরেজে রেখে গাড়ির মুখ ফেরালো। উদ্দেশ্য এখন বাড়ি।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-১৫+১৬

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৫

বিয়ে ভাগ্য উজান আর উষিরের প্রায় একই। বাবা অথবা মায়ের সাথে ঘুরতে যাও আর বিবাহিতের ট্যাগ লাগিয়ে বাড়ি ফেরো।
উষির আর রাশার রিসেপশন পার্টির আলোচনা চলছিলো৷ অনুষ্ঠানের বাহানায় পুরোনো ভাঙাচোরা আত্মীয়ের সাথে নিজেদের সম্পর্ক উন্নতি হয়। মাহফুজা আর আসিফ কায়সারের প্রেমের বিয়ে ছিলো। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন হওয়ায় মাহফুজার আদরটা একটু বেশিই ছিলো৷ অপরদিকে ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ায় তার বাড়িতে তুলকালাম বেঁধে গেলো। আসিফ কায়সার সম্পর্কে মাহফুজার ভাইয়ের বন্ধু ছিলো৷ ভাইয়েরা বোনকে কিছুতেই আসিফ কায়সারের সাথে দেবে না। তবে আদরের বোনের ভালোবাসার সামনে তা ধোপে টিকলো না৷ মাহফুজার অনুরোধে আর কান্নার তোড়ে বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হলেও কনে বিদায়ের সময় মাহফুজাকে তার বড় ভাই কঠিন গলায় বলেছিলো, সে যেনো আর কোনদিন ওই বাড়িতে না যায়। বোন তাদের জন্য মৃ’ত। তীব্র অভিমান হয়েছিলো তার। অভিমানে সত্যি সত্যি আর কোন যোগাযোগ করেনি। ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে ভাইদের আদরে মানুষ হওয়া বোন অভিমান ভাঙতে পারেনি। এতো বছর পর সম্পর্ক ঠিক করার উছিলায় আর অসু’স্থ ভাইয়ের অনুরোধে অভিমান ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো। তক্ষুনি তক্ষুনি কান্নাকাটি করে অফিস থেকে ছেলেকে বগলদাবা করে বাবার বাড়ি ছুটলেন।

মান অভিমানের পালা চুকে যেতেই সম্পর্ক মজবুত করতে উজানের সাথে ছোট মামার মেয়ের বিয়ের কথা উঠলো। তটস্থ হলো উজান। আবার খানিক ভরসাও পেলো। বাড়িতে দুটোই ছেলে। একজনের বিয়ে আচানক হলেও অপরজনের বিয়ে তো এমন আচানক হওয়ার প্রশ্ন আসে না। বিয়ে নিয়ে সবার কত শখ আহ্লাদ থাকে। তাছাড়া উজানের বয়সই বা কত! মাত্র আঠাশ চলছে। এই বয়সে কেউ বিয়ে করে নাকি! আর হলেও এভাবে নাকি!

উজানের সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবং সকল আশা পায়ে মাড়িয়ে বিয়েতে সবাই রাজি হলো। এমনকি তার বাড়ি থেকে শাহিদা আর ময়না রওনাও হয়ে গেলো।
মায়ের ইমোশনাল কান্নাকাটি নামক এক রোগ আছে। কথায় কথায় ইমোশনাল হয়ে যায়। মায়ের পরিবারেরও সেম রোগই আছে৷ বোনকে এতোদিন পর কাছে পেয়ে এক প্রস্ত, বোন জামাই বেঁ’চে না থাকায় এক প্রস্ত, বোনের ছেলেকে পেয়ে এক প্রস্ত এবং পরিশেষে বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে জন্য এক প্রস্ত করে কয়েক দফায় কান্নাকাটি হয়ে গেছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে উজান কিছুতেই বিয়েতে মানা করার সাহস পাচ্ছে না। ভাবলো, উষির আসলে তার সাথে গোপনে কোন না কোন আলোচনা করা যাবে।
শাহিদা আসলো ঘন্টা দুই তিনের মধ্যেই। সাথে করে নিয়ে আসলো এক গাদা মিষ্টি। উজানের সাথে দেখা করতেই উজান প্রশ্ন করলো,

–উষির আসবে না বড় মা?

–না, মিটিং পরে গেছে। বন্যা আর বৃষ্টি তো স্কুলে।

উজানের শেষ আশার পথটাও বন্ধ হয়ে গেলো। উজানকে কয়েকবার কল দিলেও ফোন বন্ধ পাওয়া গেলো৷ মিটিংএ সবসময় ফোন অফ করেই রাখে৷ উজানের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো৷ আর একটা ভরসা হলো রাশা। তাই এবারে রাশার কথা জিজ্ঞাসা করলো,

–আর রাশা?

মেহজাবিন সে রাতের ঘটনার পরেরদিন সকালেই চলে গেছিলো। সেই থেকে শাহিদা রাশার উপর রেগে আছে। তার ধারণা, রাশাই ওকে তাড়িয়ে ছেড়েছে৷ মেহজাবিন যাওয়ার পরপরই বেশ গম্ভীরমুখে একটা ডায়লগ বলেছিলো,

–বাড়ি আসা অতিথিকে অপমান করাকে প্রতিবাদ বলে না৷ তুমি যেটাকে প্রতিবাদ বলছো সেটাকে আমি অসভ্যতামো বলি।

আর এটাতেই রাশা হেসে ফেলেছিলো। ও ভেবেছিলো, শাশুড়ী মজা করে বলছে৷ কিন্তু এতেই শাহিদা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে। এখন সেই রাশার কথা উঠতেই গম্ভীরমুখে বললো,

–কোর্টে গেছে।

ব্যাস, এইটুকুই। বড় মায়ের এই গম্ভীরপনা দেখে নিজের বিয়ে নিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না। মেয়ে হলে তাও না হয় হাত পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি করে কিছু করা যেতো। ছেলে হয়ে কান্না করলে লোকে কি বলবে!

–বড় মা, বিয়েটা?

শাহিদা উজানের জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে। সেগুলোই গোছাচ্ছিলো। মাঝে উজানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো,

–হ্যাঁ, বিয়েটা কি?

–আম-আমার মতামত কেউ নিলে না?

উজান আমতা-আমতা করে উত্তর দিলো। শাহিদা খানিক থমকালো৷ তারপর হেসে ফেলে বললো,

— মতামত! আচ্ছা বল তোর মতামত কি?

–আমি বিয়ে করবো না?

উজান বেশ ইতস্তত করে বলার সাহস করলো। শাহিদা সব শুনে দায়সারা ভাবে বললো,

–কেনো? কোন পছন্দ আছে?

উজান সজোরে মাথা দুই দিকে নাড়লো। শাহিদা কপাল কুঁচকে পালটা প্রশ্ন করলো,

–তাহলে?

–আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই না।

–তোর বয়সে তোর বাবা আর বড় বাবা ছেলেদের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতো। আর তুই বলছিস এতো তাড়াতাড়ি! মেয়েকে দেখেছিস? একদম পরীর মতো দেখা যায়। আমার তো এক দেখায় পছন্দ হয়েছে। তোরও খুব পছন্দ হবে।

–তাই বলে এভাবে বিয়ে?

–বিয়ে আর কি? আল্লাহ যখন ভাগ্যে লিখে রাখেন তখনই হয়। তোর আর উষিরের ভাগ্যে যেমন বিয়ে লেখা ছিলো তেমন ভাবেই হচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই। বড় করে অনুষ্ঠান করে কনে বিদায় হবে। নোঙরের লাস্ট সেমিস্টার চলছে। শেষ হলেই অনুষ্ঠান হবে। ততদিন তোদের মধ্যে একটু চেনাপরিচিতিও হয়ে যাবে।

উজান শাহিদার কথার উপরে কোন কালেই কোন কথা বলতে পারে না। এবারেও বলতে পারলো না। তার বদলে নিজেকে বোঝাতে চাইলো। শাহিদা যাওয়ার খানিক পরে ময়না প্রায় উড়তে উড়তে উজানের কাছে আসলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,

–ভাই, নয়া ভাবিরে এত্তো সুন্দর দেহা যাই! ভাবিরে দেখছেন? দেখবেন? কথা কইবেন? ছবি তুইল্যা আনমু? আফনের ফোন দেন, ছবি তুইল্যা আনি? না নাম্বার আনমু? ফোন নাম্বার আনতাছি।

ময়নার পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। সেই সাথে লাল লিপস্টিক আর রাশার দেওয়া গহনা পরায় লাল টুকটুকে লাগছিলো৷ একমাত্র তাকে দেখেই মনে হচ্ছিলো, সে বিয়ে বাড়িতে এসেছে। উজান তার সাজ দেখে প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেলো৷ পরক্ষণেই কথাবার্তায় রেগে উঠলো। কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু ময়না শুনলে তো। যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিলো, সেভাবেই ঝড়ের গতিতে চলে গেলো।

বিয়ে হলো পরের আধঘন্টার মধ্যেই। তখন আবার কান্নার রোল পরে গেলো। মনে হলো বাড়িতে কোন শোক সভা চলছে। সদ্য সদ্যই কেউ মা’রা গেছে। উজানের এক ছুটে বাইরে চলে যেতে মন চাইলো। কিন্তু অদৃশ্য সুতায় হাত পা বাঁধা। অফিস থেকে পরে আসা স্যুট খুলে ধবধবে সাদা পায়জামা পাঞ্চাবি পরতে হয়েছে। সদ্য পরিচিত হওয়া বড় মামা এসে আতর লাগিয়ে দিয়ে গেছে। আতরের কড়া মিষ্টি ঘ্রাণে তার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগলো।

বিয়ে পরানোর পর বেশ লম্বা মোনাজাত করা হলো৷ এরপরই ভেতর বাড়ি থেকে লাল টুকটুকে বেনারসি পরা একটা মেয়েকে তার পাশে এসে বসানো হলো। কড়া আতরের ঘ্রাণের মাঝেও মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এসে নাকে বাড়ি খেলো। উজান শক্ত হয়ে বসে রইলো। কাছাকাছি বসানো হলেও নিজেকে এমন শক্ত করেছিলো যে স্পর্শ পর্যন্ত লাগেনি। এরপর নিয়ম অনুযায়ী একে অপরকে মিষ্টি খাওয়াতে হবে৷ উজানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আর যাই হোক, এই মেয়েকে কিছুতেই মিষ্টি খাওবে না। কিন্তু এবারেও তার সিদ্ধান্ত ধোপে টিকলো না। বাহারি রকমের মিষ্টান্ন সাজানো প্লেট সামনে এনে রাখা হলো। উজান ঠায় বসে রইলো। না নড়লো আর না টু শব্দ করলো। এবং হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলো, তার সামনে চামচে করে কেউ মিষ্টি ধরে আছে। হকচকিয়ে গেলো ভীষণ। স্বর্ণের নানান ডিজাইনের কয়েক গাছি চুড়ি পরা হাতে কেউ তার দিকে মিষ্টি বাড়িয়ে ধরেছে। হাতে মেহেদি নেই তবে আলতা দিয়ে সুন্দর করে হাত রাঙানো। উজান অস্বস্তি নিয়ে সামান্য একটু মিষ্টি খেলো। তাকে মিষ্টি খাওয়ানো হয়েছে মানে এখন তারও খাওয়াতে হবে৷ মনে আসা শত বাঁধা উপেক্ষা করে হাতটা নিজের কাজ করলো। প্লেট থেকে ছোট একটা মিষ্টি নিয়ে সাইড ঘুরতেই বিষ্ময়ে হাত কেঁপে উঠলো। সামনে বসা তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে, মিষ্টির সাথে উজান নামক মানুষটাকে মিশিয়ে দিলে বেশ আড়াম করে কড়মড় করে খেয়ে ফেলতো। উজান বারকয়েক চোখের পলক ফেলে দেখতে চাইলো, সে ভুল দেখছে নাকি ঠিক! যখন দেখলো, সামনের মেয়েটি সত্যি সত্যি তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে তখন সাংঘাতিক চটে গেলো। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি অফিসে পর্যন্ত তার পেছনে মেয়েদের লাইন লেগে যেতো আর এখানে একটা মেয়ে যে কিনা তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, সে তার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে! এতো সাহস! শাহিদা বলেছিলো, পরীর মতো মেয়ে। উজানের মনে হলো, এর থেকে অসভ্য মেয়ে আর দুটো হয় না। সম্মানে লাগলো খুব। সিদ্ধান্ত নিলো, এই মেয়ের সাথে কোন সংসার নয়। যেভাবে বিয়েটা হয়েছিলো, সেভাবেই বিয়েটা ভাঙতে হবে।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৬

হুটহাট বিয়ে হলেও মানিয়ে নিয়ে চললে সবই ভালো হয়। অন্তত প্রথম দেখা কিংবা প্রথম কথোপকথন তো ভালো হয়ই হয়। তবে উজান আর নোঙরের প্রথম দেখাতেই দা কুমড়ার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলো। বলা হয়, ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ লাস্ট ইম্প্রেশন। উজান সেটা মনে প্রাণে বিশ্বাসও করে। আরেকটা কথা আছে। যারে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা। এর একটা মিনিং হলো, যাকে পছন্দ হয় না তার কিছুই পছন্দ হয় না। উজানের ক্ষেত্রে সেটা খুব করে হচ্ছে। নোঙরের বাহ্যিক সৌন্দর্য সুন্দর, পরীর মতো বাকি সবার কাছে। কিন্তু উজানের চোখ সব কিছুর ধরা ছোয়ার বাইরে৷ সে পরে আছে সেই প্রথম দেখা নিয়ে। কি ভয়ংকর ভাবে কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো!
কিছুক্ষণ পর যখন তাকে নোঙরের সাথে কথা বলতে কিংবা সময় কাঁটাতে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো তখন উজান বেশ বিরক্ত হয়েছিলো৷ বিরক্ত ভাবটা কিছুতেই কমছে না। ফলস্বরূপ তাদের কথোপকথন শুরু হলো খুবই আজব বাক্য দিয়ে।

–ফ্লোর কি বসার জায়গা নাকি? ফ্লোরে বসে আছো কেনো?

কথাটা উজান নোঙরের উদ্দেশ্যে বলেছিলো। বিয়েটা এমন ভাবে হওয়ায় তার মাথা এমনিতেই প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। তার উপর নতুন বউয়ের ব্যবহার। আর তার উপর নানাবাড়ি প্রথমবার ঘুরতে এসে সম্পূর্ণ অচেনা একজন গলায় ঝুলে পরলো। বলা চলে, ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। বিরক্তিকর, অসহ্য, অভদ্র। শেষের শব্দটা নোঙরের জন্য ছিলো। গহনা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উজানের পায়ের নিচেও একটা চুড়ি পরেছিলো। সমস্ত রাগ চুড়ির উপর ঝাড়তে ফুটবলের মতো শট দিয়ে না জানি কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছে।

নোঙর এখনও ঠায় বসে আছে। দুই পা ভাজ করে হাত দুটো হাটুর উপর দিয়ে পদ্মাসনে বসে আছে। মনে হচ্ছে ধ্যান করছে। মাথার ওড়না, চুল, শাড়ি সব এলোমেলো। উজান চোখ ছোট ছোট করে গলায় আরো জোর বাড়িয়ে আরো রেগে বললো,

–কিছু জিজ্ঞাসা করেছি আমি?

নোঙর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর উজানের থেকেও দ্বিগুণ তেঁতে উঠে বললো,

–খন্দকার বাড়ির কেউ, কখনও কাউকে কৈফিয়ত দেয় না।

খন্দকার! হ্যাঁ, এসেছে থেকে এই খন্দকার শব্দটা অগুনতিবার শুনেছে। মায়ের থেকেও বহুবার শুনেছে। বলা চলে, শুনে শুনেই বড় হয়েছে। এটা বোধহয় তাদের পারিবারিক ডায়লগ! উজানের শরীর জ্বলে পুড়ে উঠলো। খন্দকার বাড়ির মানুষ এটা করে না, ওটা করে না, এরা এমন, তেমন এমন হাজার কথা তার প্রায় মুখস্ত। শুনতে শুনতে তার কান রীতিমতো পঁচে গেছে। এতোদিন মা একাই বলতো। এখন আরেকজন এসে জুটেছে। ভয়াবহ কিছু ধমক ঠোঁটের আগায় আসলেও গিলে হজম করে ফেললো। খন্দকার বাড়ির সবাই আর কি পারে না পারে সেটা সে জানে না। তবে এটা জেনে গেছে, এরা খুব ভালো কাঁদতে পারে। এই যেমন, বিয়ে পরানোর সময় ছোট থেকে বড়, এমন কেউ নেই যে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করেনি। বিশেষণটা উজান কলেজে শিখেছিলো। আজকের আগে তেমন কাজে লাগেনি। বাড়িতে একজনের কথায় কথায় ইমোশনাল কান্না দেখা আর পুরো বাড়ি মিলে সবার মরা কান্না দেখার মাঝে হিউজ ডিফারেন্স! উজান তপ্ত শ্বাস ফেললো৷ ঘরটা তার মায়ের পুরোনো ঘর৷ অর্থাৎ বিয়ের আগের ঘর। তার বর্তমান বউ নাকি অনেক বছর আগেই এটা দখল নিয়ে নিয়েছিলো। উজান আশেপাশে নজর ঘুরাতে ঘুরাতে বিছানার দিকে গেলো। বিছানায় ভারি মোটা মখমলের গোলাপি চাদর বিছানো আছে। দুটো বালিশ আর একটা পাশবালিশ। ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। এখনও কেউ পাশবালিশ ইউজ করে! বেডসাইট টেবিলে পানি ভর্তি জগ আর গ্লাস ভর্তি দুধ। উজান দুধ খায় না৷ অর্থাৎ যদি পানি খেতে চায় তো জগ ধরে পানি খেতে হবে! কি একটা অবস্থা! রিডিকিউলাস!

বিছানা থেকে নোঙরের একপাশ দেখা যাচ্ছে। এখনও সে সেভাবেই বসে আছে আর কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। ফর্সা মুখটা মেকাপের কারনে পুরো গোলাপি হয়ে গেছে। বড় বড় হরিণী চোখদুটো স্থির৷ দীর্ঘশ্বাস ফেললো উজান। সফল তরুন বিজনেসম্যান হিসেবে প্রায় প্রতিদিনই নানান ইন্টারভিউ তাকে দিতে হয়। আজকে সকালেও সাংবাদিকদের ইন্টারভিউ দিয়েছিলো। সেখানে বেশ ফলাও করে বলেছে, তার বিয়ের এখন অনেক দেরি আছে। আপাতত বিয়ে নিয়ে তার কোন প্ল্যান নেই।

উজানের আরেকবার মনে হলো, আঠাশে কেউ বিয়ে করে নাকি! লাইফ তো শুরুতেই শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া বিয়ের প্ল্যান তার কখনো ছিলোও না। পারিবারিক বিজনেস আরো বড় করাই তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো। এখনও আছে। সাথে আজ আরেকটা উদ্দেশ্য যোগ হলো। এই মেয়ের থেকে মুক্তি পাওয়া। এই মেয়ের থেকে পাওয়া জঘন্য ইম্প্রেশন নিয়ে দুইদিনও সে টিকতে পারবে না৷ নো নেভার!

নোঙর এখনও সব গহনা খোলেনি। দুই হাতে ডজনখানেক চুড়ি পরা ছিলো। এতোগুলা খোলার পর এখনও বোধহয় আধ ডজন আছেই৷ গহনা পরে তার সত্যি খুব বিরক্ত লাগছিলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো টান দিয়ে দিয়ে সব গহনা খুলে ঢিল দিয়ে ফেলে দিক। যদিও একটু আগে তাই করেছিলো। ইচ্ছেটাকে দমন করলো না। হাতের চুড়ি বালা সব এক এক করে খুলতে লাগলো আর চারদিকে ঢিল দিয়ে ছিটাতে লাগলো। চুড়ি শেষ করে কানের দুল, টিকলি, মালা। সবশেষে হাতের আংটি খুলে ফেললো। আংটির ঢিলটা সরাসরি উজানের কপালের ঠিক মাঝে গিয়ে লাগলো। উজান নোঙরের কর্মকান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে পরেছিলো। এতোগুলো গহনা কোন মানুষ পরে! তার উপর এমন ঢিল ছুড়ছে! সবশেষে আংটি উজানের কপালে লাগায় তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। হুঙ্কার দিয়ে উঠলো,

–এসব হচ্ছেটা কি?

নোঙর আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভয় পেলো না একফোঁটাও। কিন্তু বসেও থাকলো না। বিষ্মিত হলো উজান। পুরো অফিস, সাথে হাজার খানেক কর্মী যেখানে তার কথায় ওঠে বসে, সেখানে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী তার কথাকে পাত্তাই দিলো না! যাস্ট তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো!

নোঙর উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির কুচি অর্ধেকটা খুলে গেছে৷ হাঁটতে নিলে পায়ে বাজছে৷ ঠিক করলো না একটুও। সেভাবেই হেলতে দুলতে এসে উজানের ঠিক পাশে হাত পা ছেড়ে বসে পরলো। উজানের মনে হলো এখনই মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু অজ্ঞান হলো না। বিছানার দুই পাশে হাত দিয়ে শক্ত করে বিছানার চাদর খাঁমচে ধরলো। তারপর মাথা বাঁকা করে তার দিকে তাকিয়ে বললো,

–তোমার নাম কি?

উজান প্রথমটায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো৷ পরক্ষণেই রেগে গেলো৷ কোন উত্তর করলো না। যার সাথে কিছুক্ষণ আগে বিয়ে হলো, সে নাকি তার নিজের হাজবেন্ডের নামই জানে না! তার থেকেও বড় কথা, মেয়েটা উজানকে চেনেই না! যেখানে পুরো দেশ, এমনকি বাইরের দেশের মেয়েরা পর্যন্ত তার জন্য পাগল সেখানে তাকে সে চেনেই না! আত্মসম্মানে লাগলো খুব। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সরে বসলো। নোঙর ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর আবার বললো,

–নোঙরের কার সাথে বিয়ে হলো সেটা তো জানতে হবে।

উজান চোখ গরম করে রুষ্ট স্বরে বললো,

–বিয়ের সময় নাম শোনোনি?

নোঙর ঠোঁট উলটে বললো,

–মনে নাই।

উজানের চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো৷ তারপর ঝাঁজালো সুরে বললো,

–উজান

নোঙর মুখ বেঁকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বললো। অন্যদিকে মুখ থাকায় উজান সেটা দেখতে পারলো না। নোঙর আবার জানতে চাইলো,

–পুরো নাম?

উজান হাটুর উপর হাত রেখে কপাল ঘষতে লাগলো৷ রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে৷ চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে রীতিমতো।অত্যাধিক শান্ত স্বরে বললো,

–আজলান কায়সার।

–তাহলে উজান বললে কেনো?

উজান দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো,

–নিকনেম নামক ওয়ার্ডের সাথে কি পরিচয় নেই?

নোঙর ঠোঁট উল্টালো। পালটা জবাব না দিয়ে হিসাব করতে বসলো,

–হুম! আজলান কায়সার, হাজবেন্ড অফ নোঙর খন্দকার। ছ্যাঁহ! কি বিশ্রী শোনা যায়!’

নোঙরের মুখ করল্লা খাওয়ার পরের অবস্থার মতো হয়ে গেলো। উজান আর সহ্য করতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো। পাঞ্জাবির হাতা ভাজ করতে করতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো৷ আর নোঙর বিছানায় পা তুলে পাশ বালিশ আঁকড়ে সেভাবেই শুয়ে পরলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও গেলো। দরজা হাট করে খোলা রইলো।

রাশা বিয়ের খবরটা জানার পর আর কাজে মন বসাতে পারেনি। উষির, বৃষ্টি আর বন্যাকে নিয়ে উজানের সদ্য পরিচিত হওয়া নানাবাড়ি আর সদ্য হওয়া শ্বশুরবাড়ি চলে আসলো। রাশার পরনে ঢোলাঢালা কালো জিন্স আর সাদা কালো মিশেলের কুর্তি। কাঁধে ব্যাগ ঝুলছে। উষির বরাবরের মতোই সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। তবে মারাত্মক ড্রেসাপ ছিলো, বন্যা আর বৃষ্টির। স্কুলড্রেস পরে হয়তো এই প্রথম কোন বোনরা তার ভাইয়ের বিয়েতে আসলো। আর তারা আসার পরই আবার কান্নার রোল পরে গেলো। বন্যা আর বৃষ্টিকে আকড়ে ধরে যা একটা কান্না হলো, সেটা শোকবাড়িকেও ছাড়িয়ে যায়। তারা দুইজন হতভম্ব হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে পরিচিত কাউকে খুঁজলো। না পেয়ে হতাশ হলো খুব।
উজান বাইরের ঘরে আসতেই উষিরকে দেখল, সোফায় বসে তার মামাদের সাথে কথা বলছে। উজান গিয়ে সেখানে বসলো। দেখলো মামাদের চোখে হালকা পানি। কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো তার। খানিক উশখুশ করার পর যখন মামারা উঠে গেলো তখন উষির উজানকে টিটকারি দিতে ভুললো না। হাত দিয়ে উজানের পেটে মৃদু হাতে ঘুষি দিয়ে চোখ টিপে বললো,

–কংগ্রাচুলেশনস ভাই! মশা তো দেখি এখন তোর ঘরেও যাতায়াত করবে। বি কেয়ারফুল।

উজান তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। ক্ষিপ্ত হয়ে উষিরকে হামলা করার প্রস্তুতি নিতেই উষিরকে বাঁচাতে রাশা আসলো সেখানে। একদম নাচতে নাচতে এসে উজানের হাত ঝাঁকিয়ে বললো,

–কংগ্রাচুলেশনস ভাইয়া! নোঙরকে কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি চলো তো, দুজনকে একসাথে ছবি তুলবো।

উজান খানিক অবাক হয়ে বললো,

–ও না ঘুমালো?

–ওওও..

বেশ সুর ধরে উষির বললো। বলেই মুখ টিপে হাসলো। উজান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–এইরকম চিপ বিহেভ কিছু মেয়ে ফ্রেন্ড, ভাবি এরা করে। রাশা করলেও মানাতো। লজ্জা করে না, ভাসুর হয়ে এমন করিস?

–আমাকে বড় ভাই কে মানে?

উজান ভীষণ পস্তালো। নিজের ছোড়া তীর নিজের দিকেই ফিরে আসলো। সেখানে তখন অন্তুর আগমন ঘটলো। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলের নাদুস-নুদুস ছেলেটি নোঙরের ভাই হয়। এসেই বেশ লাজুক স্বরে মিটিমিটি হেসে রাশাকে বললো,

–আপনাকে ডাকে?

রাশা মিষ্টি করে হেসে অন্তর গাল টিপে দিলো। তাতে করে সে আরো লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। একদম হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিউয়ে যেচে চাইলো। উষির কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কর্কশ গলায় বললো,

–কে ডাকে?

অন্ত বিরক্ত হয়ে উষিরের দিকে তাকালো। উষিরকে সে চেনে। খুব ভালোমতোই চেনে। কিন্তু এখানে তাদের দুইজনের মাঝে কথা বলায় তার উপর খুব রাগ উঠলো। বড় মানুষের মতো গম্ভীর স্বরে বললো,

–ফুপ্পি ডাকে।

বলেই আবার লাজুক ভঙ্গিতে রাশার দিকে তাকিয়ে বললো,

–তাড়াতাড়ি চলুন।

উষিরের আর সহ্য হলো না। লাফিয়ে উঠে চোখ পাকিয়ে ধমক দিলো,

–এই পিচ্চি, এদিকে আসো?

উষিরের মেজাজ দেখেই অন্তু এক ছুটে ভেতরে চলে গেলো৷
বাড়ি ফেরার পর রাশার মুখে শুধু ওই বাড়ির কথাই ছিলো৷ বিশেষ করে নোঙরের কথা। রাতে ঘুমানোর সময় উষিরকে নানান কথা বলতে লাগলো। সাথে চললো, বেহিসাবি প্রশ্ন। আর সেও ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও সব কথা শুনতে থাকলো,

–নতুন বউকে কবে আনবে? উজান ভাইয়ার আজকে ওখানে থাকা উচিত ছিলো৷ দুইজনকে খুব সুন্দর মানাবে। তাই না? আন্টির ফ্যামিলি খুব ভালো। তাই না? রান্নাগুলো কিন্তু খুব টেস্টি ছিলো। আন্টির রান্নার হাত বোধহয় জেনেটিক্যালি এসেছে। অন্তুও খুব কিউট তাই না? একেবারে গুলুমুলু।

উষিরের ধৈর্য এখানেই সমাপ্ত হলো। এক লাফে রাশার হাত বিছানায় চেপে ধরলো। রাশা হকচকিয়ে গেলো। উজান আক্রোশ মেশানো গলায় বললো,

–ওই পিচ্চিটা তোমাকে দেখে লজ্জা কেনো পাচ্ছিলো সেটা বোঝো না? আর ও বাচ্চা? বৃষ্টি, বন্যার সমবয়সী।

রাশা চটজলদি নিজেকে সামলে ভ্রু নাচিয়ে বললো,

–তুমি এতো পজিসিভ হয়ে যাচ্ছো কেনো?

উষির থমকালো। তারপর ভ্রু দুটো কুঁচকে বাঁকা হেসে বললো,

–আমি পজিসিভ হলে তুমি মেহজাবিনের সাথে এমন বিহেভ করলে কেনো?

প্রথমবারের মতো রাশা উত্তর দিতে পারলো না। ময়নাকে যে ব্যাখা দিয়েছিলো, সেই ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া সম্ভব না। তাই কথা ঘুরালো,

–হাত ছাড়ো, ব্যাথা লাগছে।

উষির হাত ছাড়লো না৷ আর চোখ অন্য কিছু বলছে। রাশার হাত আরো শক্ত করে চেপে আরো কাছাকাছি গেলো। ফিসফিস করে বললো,

–লাগুক ব্যাথা। তুমিও তো আমাকে ব্যাথা দাও। তখন কিছু হয় না?

রাশা নার্ভাস হলো খুব। উষিরের এলোমেলো স্পর্শে রাশার অবস্থা নাজেহাল। নিস্তেজ গলায় বললো,

–আই হেইট ইউ!

উষির আরো কাছাকাছি আসলো। রাশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

–আই হেইট ইউ টু ডিয়ার ওয়াইফ।

রাশা চোখ বুজে ফেললো। চোখ খোলার সাধ্য আর তার নেই। মধুর রাতকে আরো মধুর করতে কোথা থেকে গান ভেসে আসলো,

এই মন জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে
এসো না গল্প করি৷
দেখৌ ঐ ঝিলিমিলি চাঁদ
সারারাত আকাশে শলমা জরি।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-১৩+১৪

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৩

উষিরের সামনে র’ক্তা’ক্ত দেহ নিয়ে একটা লোক পরে আছে। লোকটার জ্ঞান নেই কিছুক্ষণ হলোই। শেষবার যখন হাতের লাঠি দিয়ে সজোরে মাথায় বাড়ি দিয়েছিলো, লোকটা তখনই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরেছে৷ এখনও তার মাথা দিয়ে র’ক্ত ঝরছে। পা অস্বাভাবিক বাঁকানো। দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঁধন মাত্রই খোলা হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে অবদি বেশ চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি থাকলেও এখন পরিবেশ নীরব, শান্ত।
উষির হাতের লাঠি ফেলে দিলো৷ একটা ছেলে এক মগ পানি আর রুমাল নিয়ে এগিয়ে আসলো। হাতের গ্লাবস খুলে হাত বেশ করে পরিষ্কার করে ধুয়ে রুমাল দিয়ে হাত মুছলো সে। ঘাড় হালকা ম্যাসাজ করে বললো,

–আর কয়টার মুখ বন্ধ করতে হবে?

পাশে থাকা আরেকটা ছেলে এগিয়ে আসলো। ঠোঁটে কুটিল হাসি, মুখে প্রচ্ছন্নতা। রাতের আঁধার ল্যাম্পপোস্ট কিছুটা লাঘব করলেও পুরোটা করতে পারেনি।

–এইটাই শেষ ভাই৷ বাকিগুলারে আমরা দেখতিছি।

উষির ঘাড় নাড়লো। পাঞ্চাবিতে র’ক্তের দাগ লেগে আছে। কিছু র’ক্ত আবার জমাট বেঁধে চিপকে আছে। চেক করে বিরক্ত হলো সে৷ গাড়ির দিকে পা চালিয়ে পাশের ছেলেটিকে সাবধান করলো,

–কোন প্রমাণ যেনো না থাকে। সাবধান!

পাশের ছেলেটি সবিনয়ে ঘাড় নাড়লো। তটস্থ ভঙ্গিতে বুক টানটান করে বললো,

–জ্বি জ্বি ভাই। এটারে গুদামঘরে নিয়া যামু?

উষির একপলক পেছনে পরে থাকা লোকটার দিকে নজর দিলো। তারপর পকেট থেকে চাবি বের করে গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললো,

–না। এখানেই থাকুক। কুকুর বিড়াল এসে একটু টেস্ট করে যাক।

উষিরের বাম পাশে আরেকটা ছেলে ছিলো। ছেলেটা নতুন এসেছে। আপাতত তার ট্রায়াল ক্লাস চলছে৷ গভীরে যেতে এখনও অনেক দেরি। তবে আজকের এই ট্রায়াল ক্লাসেই ছেলেটার হাঁটু কাঁপা অবস্থা হয়ে গেছে। উষিরের দিকে তাকিয়ে বেশ কাঁপা গলায় বললো,

–ম’রে তো নাই ভাই।

উষির ছেলেটির দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে বাকা হাসলো। হাত দিয়ে তার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

–মাথার উপর শকুন উড়লে একাই ম’রে যাবে।

ছেলেটি বুঝতে পেরেছে, এমনভাবে মাথা নাড়লো। ভয়ে মুখ এখনও রক্তশূণ্য হয়ে আছে। উষির গাড়ির ভেতর রাখা ব্যাগ থেকে আরেকটা পাঞ্চাবি বের করে পরলো। গাড়ির লুকিং মিররের সামনে দাঁড়িয়ে পাঞ্চাবির বোতাম লাগিয়ে চুল ঠিক করতে লাগলো। ঘটনাস্থলে উষির সহ আরো চারজন ছেলে ছিলো। এতোক্ষণ নীরব থাকা ছেলেটি একটু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,

–ট্রেনের নিচে ফালাইলে ভালো হইবোনে। এক্কেরে খাল্লাছ!

উষির চুল ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পাঞ্চাবির হাতা ভাজ করতে করতে মাথা নেড়ে বললো,

–উহুম, ট্রেনের নিচে কাঁটা পরলে ময়নাতদন্ত হবে। ময়নাতদন্ত হলে ফাঁস হওয়ার চান্স আছে।

–মন্ত্রী সাহেব আছে তো ভাই।

ছেলেটির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো সে। চোয়াল শক্ত করে বললো,

–আমরা ফাঁসলে মন্ত্রীসাহেব কিচ্ছু করবে না। উলটো দল থেকে বহিষ্কার ঘোষণা করবে। যা বললাম সেটাই কর। এই রাস্তায় অনেক কুকুর ঘোরে। কুকুরের আ’ক্র’মণে মা’রা গেছে বলে চালানো যাবে। কেউ টেরও পাবে না। আর দড়ি, লাঠি, গ্লাবস পুড়িয়ে ফেলবি। গ্লাবস,দড়ি, লাঠি, কোনটাই ফেলে দিবি না। বুঝেছিস?

সবাই সজোরে মাথা নাড়লো। একজোগে বলে উঠলো,

–জ্বি ভাই।

উষিরের ব্যায়াম করা বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত হাতে পরা সিলভার রঙের ঘড়িতে রক্ত লেগে ছিলো। বিষয়টা সম্পূর্ণ তার দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলো৷ ফেলে রাখা পাঞ্চাবি আরেকটা ছেলের হাতে দিয়ে বললো,

–লাঠির সাথে এটাও পুড়িয়ে ফেলিস। কোন প্রমাণ যেনো না থাকে। আমি এখন যাচ্ছি। তোরা সব কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবি। বাড়ির মানুষ অপেক্ষা করে। বন্ধুদের জন্য সারাদিন আছে। রাতটা বাড়ির মানুষের সাথে কাঁটালে তারা আর তোদের কাজে বাঁধা দেবে না।

বলেই গাড়ির ডোর খুলে ড্রাইভিং সিটে বসে পরলো৷ নতুন ছেলেটা পাঞ্চাবি হাতে উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,

–কু*ত্তা যদি না আসে?

–ওদের আনার দ্বায়িত্ব তোদের৷ মাংসের লোভ সব মাংসাশীদেরই থাকে।

উষির কঠিন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো৷ যাওয়ার আগে আরেকবার সাবধান করলো,

–যেভাবে বললাম, সেভাবেই কাজ করিস৷ মনে রাখিস, এই ঘটনা ফাঁস হলে আমি কিন্তু ফাঁসবো না। ফাঁসবি তোরা। নিজেদের জীবনের ভার নিজেদেরই নিতে হয়।

উষির বাড়ি ফিরলো একটার দিকে। রাশা ঘুমিয়ে ছিলো। উষির ঘরে ফিরে লাইট জ্বালালো না। ড্রিম লাইটের আলোতে জামাকাপড় নিলো। লম্বা হট শাওয়ার নিয়ে তারপর বাথরুম থেকে বের হলো। তারপর ধীর পায়ে রাশার শিউরে বসে মাথায় হাত রাখলো। মাথায় হাত বুলিয়ে ধীর স্বরে বললো,

–পরিবারের প্রতি কেউ এতো বিদ্বেষ রাখে, বোকা মেয়ে!

উষির আজকে সুবোধ দত্তের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। সুবোধ বাবু অফিসরুমে কাজ করছিলেন। দরজা খুলে উষিরকে দেখেই হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। উষির কঠিন চোখেমুখে হেসে কোন ভণিতা ছাড়াই প্রশ্ন করেছিলো,

–রাশার সাথে আপনার কি সম্পর্ক আংকেল?

সুবোধ বাবু জানতেন, এমন কিছু হবেই হবে। উষির ঘটনার শেষ না জানা পর্যন্ত পেছন ছাড়বে না। দ্রুতই নিজেকে সামলে বললেন,

–সেটাই যেটা একজন টিচারের তার প্রিয় স্টুডেন্টের সাথে থাকে।

উষিরের শক্ত মুখ কিছুটা নরম হলো। সুবোধ বাবু দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে উষিরকে জায়গা দিলেন,

— ভেতরে এসে বসো উষির। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।

উষির স্ব-প্রশ্নক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। সুবোধ বাবু ঠান্ডা স্বরে বললেন,

–রাশার ব্যাপারে কিছু জানাতে চাই।

উষির ভ্রু কুঁচকে অস্ফুটে বললো,

–রাশার ব্যাপারে?

সুবোধ বাবু কিছু না বলে ভেতরে সোফায় গিয়ে বসলেন। উষির তার সামনা-সামনি একটা সোফায় বসলো। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে তার কথা শুরু করলেন,

–কথাগুলো একটু অদ্ভুত কিন্তু সত্যি। তোমাদের বিয়ে একটা অ্যা’ক্সিডে’ন্টে হয়েছে৷ তাই ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে তেমন কিছু জানো না৷ আর রাশাও যে নিজে থেকে কিছু জানাবে না সেটা আমি শিওর। ওর সমস্যাটা আমি তোমাকে শুরু থেকে বলছি।

উষির কিছু না বলে মনোযোগী শ্রোতার মতো সুবোধ বাবুর কথা শুনে গেলো।

–তুমি হয়তো জানো যে ওর বাবা কাকারা চার ভাই। রাশার বড় কাকার তিন ছেলে। মেজো কাকা অবিবাহিত আর ওর বাবার চার মেয়ে। মানে ওরা চার বোন। ছোট কাকার এক মেয়ে আর এক ছেলে। এটা বলার কারন আছে। ওর ফ্যামিলি পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষতান্ত্রিক দুই ধরনের হয়। এক ধরনের মধ্যে পরে, যেখানে গার্ডিয়ান পুরুষ থাকে। যেটা আর সাধারণ ফ্যামিলিতে হয় আর কি। আর দ্বিতীয় ধরনটা রাশার ফ্যামিলিতে হয়। ছেলেরাই যেখানে সর্বেসর্বা হয়। মেয়েরা অবহেলায়, অনাদরে থাকে। ওর বাড়ির মেয়েরা সবাই ক্ষমতা দেখেছে, টাকা দেখেছে। যা খুশি তাই করতে পেরেছে। আসলে ওদের দিকে কখনও কেউ নজরই দিতো না।

সুবোধ বাবু পায়ের উপর পা তুলে কথাগুলো বলে চললেন। খানিক থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাকি কথা বললেন,

–রাশা ওর বাবা মায়ের চতুর্থ সন্তান। মানে বুঝতেই পারছো ওর অবস্থাটা৷ বাকি মেয়েদের নিজেদের মতো মানুষ করলেও রাশাকে পারেনি। কি জানি কেনো, ও শুরু থেকেই খুব বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো। বড় তিন মেয়েকে ঘরোয়া আর নিজেদের মনের মতো বড় করলেও রাশার ক্ষেত্রে সেটা পারেনি। কয়েকদিন চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে ওকে নিজের মতো ছেড়ে দিয়েছে। ছোট থেকে অবহেলা আর ক্ষমতা দেখে দেখে ওর মনে প্রচন্ড ক্ষোভের জন্ম নেয়। এখন ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ, ওর ফ্যামিলির পরে থাকা মুখোশ টেনে খুলে ফেলা।

সুবোধ বাবু থামলে বোঝা গেলো, ঘর নিরবতায় ছেয়ে আছে৷ অতিথির আগমন বুঝতে পেরে কাজের লোক চা দিয়ে গেলো৷ উষির চায়ে চুমুক দিয়ে আবার মনোযোগ দিলো। সুবোধ বাবু নিজেও চায়ের কাপ তুলে মলিন গলায় বললেন,

–যতটুকু তোমাকে বললাম, ততটুকুই আমি জানি। তুমি এখন ভাবতেই পারো, আমি এসব ঘরোয়া খবর কিভাবে জানলাম। এগুলো রাশাই বলেছে। তবে আমাকে না, আমার স্ত্রীকে। আমার সাথে ও যতটা খোলামেলা, আমার স্ত্রীর সাথে তার থেকেও বেশি খোলামেলা। সেখান থেকেই আমি এসব জেনেছি। এরমাঝের কিছু কথা রাশার আর কিছু কথা আমার ধারণার। উষির, ও কখনও ভালোবাসা পায়নি। ভালোবাসা কি সেটা হয়তো জানেই না। তুমিই এখন ওর সুখ দুঃখের ভাগিদার। ওকে কখনও সুখ দিতে না পারলেও দুঃখ দিও না প্লিজ৷ শী ইজ অ্যান আমেজিং গার্ল৷ তুমি চাইলে ওর সাথে খুব সুখী হতে পারবে।

শেষ কথাগুলো তিনি উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন। এরমাঝে কিছু কথা লুকিয়েও গেলেন। যেগুলো তিনি আর রাশা ছাড়া রাশার পরিচিত আর কেউ জানে না। সেই গুপ্ত কথা বলার অধিকার একমাত্র রাশারই আছে।
উষির চায়ের কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে বললো,

–এখন আসছি আংকেল।

সুবোধ বাবু নিজেও উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে উষিরের সাথে হ্যান্ডশেক করে বললেন,

–এসব যে তোমাকে বললাম সেটা রাশাকে জানিও না। হুমকি দিয়েছে আমাকে। জানোই তো আমি খেতে কতটা ভালোবাসি। আর তোমার আন্টি আমার মুখের খাবার কেড়ে নিতে কতটা ভালোবাসে। এই সেনসিটিভ জিনিসটা নিয়েই রাশা হুমকি দিয়েছে।

উষিরের হাসি চওড়া হলো। বাঁকা হেসে বললো,

–ডোন্ট ওয়ারি আংকেল। রাশাকে বলবো না আমি।

–শুধু রাশা না। কাউকেই বলবে না।

–হ্যাঁ, যেভাবে আপনি কাউকে বলেননি সেভাবে আমিও কাউকে বলবো না। বায় আংকেল। হ্যাভ আ নাইস ডে।

সুবোধ বাবু পেছন থেকে কপাল চাপড়ালেন। উষির চলে যেতেই তিনি মনে মনে নিজেকে দুষলেন। বলে ভুল করলেন নাকি বুঝলেন না।

বর্তমানে, উষিরের নজর রাশার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে। তার মুখে হাসি বিদ্যমান। দেখে কেউ বলবে না, কয়েক ঘন্টা আগে একজনকে মা’রতে মা’রতে আধম’রা করে এসেছে। কি স্বাভাবিক, মোলায়েম ব্যবহার! তর্জনি দিয়ে রাশার গালে আলতো স্পর্শ আঁকলো। কিছুক্ষণ আঁকিবুঁকি একে গালে ঠোঁট ছোয়ালো।
উষির বাইরে থেকে কিছু খেয়ে আসেনি। বাড়ি ফিরতেই প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছিলো। জ্যামে আটকা পরে ফিরতে এতোটা লেট হয়েছে। সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। তাই রাশাকে ফেলে একাই রান্নাঘরে গেলো। খাওয়ার জন্য কিছু খুঁজলো।

–এতো রাতে তোমার শেফ হতে ইচ্ছে করছে নাকি?

রাশার গলার স্বর ছিলো। ঘুমন্ত অলসতায় ঘেরা। উষির ঘার ঘুরিয়ে মুচকি হাসলো,

–ঘুম ভাঙলো কিভাবে?

রাশা আড়মোড়া ভেঙে উষিরের দিকে এগিয়ে আসলো,

–এতো ভালো ঘুমিয়েছিলাম! তোমাদের এখানে এতো মশা। গালের উপর সুড়সুড়ি লাগছিলো৷ আবার একটু পর কাঁটা ফুটলো। তাতেই ঘুম ভেঙে গেলো। এতো জ্বালাতনে ঘুম ধরে নাকি! এর আগেও একদিন এমন ফিল হয়েছিলো। এতো মশার মধ্যে তোমরা থাকো কিভাবে?

উষির তাজ্জব বনে গেলো। হাতটা চট করে নিজের গালে চলে গেলো। আবার! আবার তার আদর করে দেওয়া চুমুটা মশার কামড় হয়ে গেলো! ও এতো খারাপ চুমু দেয়! এতোটা!

রাশা উষিরের উত্তরের অপেক্ষা করলো না। তাকে বাটিতে চামচ নাড়তে দেখে নিয়েছিলো। সেদিকে তাকিয়ে বললো,

–এই মাঝরাতে ঘুম ভাঙায় আমারও ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে৷ ঘুম ভাঙতেই দেখলাম তুমি রুম থেকে বের হচ্ছো। ইনভেস্টিগেট করতে এসেছিলাম। এসে দেখি অন্য কাহিনী। তা কি রান্না করছো?

–ব্রেড টোস্ট।

উষির ঢোক গিলে উত্তর দিলো। তার নেশাগ্রস্ত নজর, রাশার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে৷ রাশা আরো কাছে আসলো৷ একটু ঝুঁকে উপকরণ দেখতে লাগলো। উষিরের নাকে তার শ্যাম্পু করা চুলের সুগন্ধ এসে লাগলো। চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানলো। আচ্ছন্নের মতো ঝুঁকে রাশার চুলে নাক ডুবিয়ে দিলো৷

–উহুম উহুম, এখানে কি রোম্যান্স হচ্ছে? ভুল সময়ে এসে পরলাম নাকি?

উজান লেট নাইট পর্যন্ত অফিসের কাজ করছিলো। ক্ষিদে তারও প্রচুর পেয়েছে। ইচ্ছে ছিলো, এসে চট করে টু মিনিটস ম্যাগি রান্না করবে। কিন্তু রান্নাঘরে উষিরকে দেখে ভাবনা পালটে গেলো। আরেকটু এগিয়ে যেতেই রাশা আর উষিরকে কাছাকাছি দেখেই মুখ টিপে হেসে কেঁশে উঠলো। উষির চমকে উঠে ছিটকে এক হাত সরে গেলো। রাশা অবুঝের মতো উষিরের দিকে একপলক তাকিয়ে উজানের দিকে তাকালো। মিষ্টি হেসে বললো,

–এমপি মন্ত্রীদের চামচারা চামচামি ছাড়া আর শুধু রান্নাটা পারে। তোমার ভাই সেটাই করছে।

–চামচা! উষির?

উজানের মুখ হা হয়ে গেলো। রাশা মাথা নেড়ে গম্ভীরমুখে বললো,

–মন্ত্রীর পিছে পিছে ঘোরে। ওদের কাজ টাজ করে দেয়। এদের চামচা ছাড়া আর কি বলবে?

উজান মুখ লুকিয়ে হাসলো। মুখভঙ্গি গম্ভীর করে মাথা নেড়ে বললো,

–ভেরি ব্যাড উষির! তুই পলিটিক্সের নামে এসব করিস, তা তো জানতাম না!

রাশা ফোঁস করে শ্বাস ফেললো৷ উষির রাগে ফুসছিলো। কড়া চোখে উজানকে বারকয়েক শাসিয়েও দিলো। রান্নাঘরে শাসানোর কাজ সমাপ্ত হওয়ার আগেই সেখানে বো’মা ফেললো রাশা। উজানের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত স্বরে বললো,

–তোমাদের এখানে এতো মশা কেনো? আমাকে ঠিকমতো ঘুমাতেই দেয় না।

উজানের কপালে ভাজ পরলো,

–এখানে তো মশা নেই। মেডিসিন স্পে করা হয় তো।

–তাহলে প্রতিদিন আমাকে কামড়ায় কি? মশা না থাকলেও কোন পোকা আছে নাকি?

উষির খুকখুক করে কেঁশে উঠলো। উজান উষিরের দিকে তাকিয়ে মশার হদিস পেলো। বুঝতে পেরেই হাসতে নিয়ে কেশে উঠলো। নিজেকে সামলে হাসি থামিয়ে বললো,

–মেবি এই পোকা অনেক স্পেশাল পোকা। শুধু ম্যারেডদের কামড়ায়। আমি তো আবার চির সিঙ্গেল। তাই আমার থেকে দূরে দূরেই থাকে।

উষির আগুন চোখে তার দিকে তাকালো৷ উজান আমতা-আমতা করে কথা ঘুরিয়ে বললো,

–ভাই, আমার জন্যেও রান্না করিস। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।

উষির খেঁকিয়ে উঠলো,

–আমি শুধু মন্ত্রীদের চামচা। তোদের মতো ডাফার, ইডিয়ট আর থার্ডক্লাস পাবলিকদের চামচা না।

–আমাদের গালি দিলো রাশা!

উজান থমথমে গলায় রাশাকে অভিযোগ করলো। রাশা মনোযোগ দিয়ে পাউরুটিগুলো গুণে দেখছিলো৷ উজানের কথায় উত্তর দেওয়ার আগেই বৃষ্টি আর বন্যা হাত ধরাধরি করে সেখানে এসে হাজির হলো৷ উষিরকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–ভাইয়া, আমাদের জন্যেও রান্না করো। পড়তে পড়তে ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।

এক্সামের জন্য রাত করে পরতে হচ্ছে৷ যথারীতি রাত বেশি হওয়ায় ডিনারে খাওয়া সব খাবার হজম হয়ে ক্ষিদে পেয়ে গেছে। তারাও খাওয়ার জন্য রান্নাঘরে এসেছিলো। খাবার বানানোর আভাস পেয়েই নিজেদের আবদার করে বসলো। তাদের আবদার শুনে উষির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। ধমক দিয়ে বললো,

–বানিয়ে খা।

বৃষ্টি আর বন্যা থতমত খেয়ে গেলো। উষির চলে যেতে চাইলো। কিন্তু এতোজনের বাঁধা অতিক্রম করে যাওয়ার সাধ্য কারই বা আছে।
বৃষ্টি, বন্যা আর রাশা ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করতে লাগলো। উজান উষিরকে হেল্প করার একফাঁকে ফিসফিস করে বললো,

–ভাই সিঙ্গেলদের সামনে এতো খোলামেলা রোম্যান্স করে তাদের দিল জ্বলানোর কি মানে? ঘর আছে, দরজা আছে, সেটাতে আবার লকও আছে। ঘরে বসেই নাহয় এসব করলি। এতে তোরাও শান্তিতে থাকতে পারলি আর আমরাও।

উষির রেগে হাতে থাকা ডিম উজানের মাথায় ভাঙলো। সকালে বাড়িতে হইচই পরে গেলো। ফ্রিজে রাখা ডিম, পাউরুটি সব হাওয়া। তেলের জারে অর্ধেক তেল গায়েব। চিনিও অনেক কম। মধুর বয়াম প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। নিশ্চয়ই এটা জ্বিনের কারবার। মাহফুজা পুরো বাড়ি আয়াতুল কুরসি পরে ফুঁ দিলো। শাহিদা গিয়ে সাউন্ডবক্সে সুরা চালিয়ে দিলো। ময়না রসুন আর মরিচ নিয়ে পোড়াতে বসলো। সব কাজ পরে, আগে বাড়ি থেকে জ্বিন তাড়াতে হবে।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১৪

–এমন দুর্নীতি তো দুর্নীতিবাজও করে না খালাম্মা! আমার বেতন ভালোয় ভালোয় দিয়ে দাও বলছি। আমি অনেক বড় একটা লিস্ট করে রেখেছি৷ এখন টাকা দেবে আর এখনই আমি শপিংএ যাবো।

রাশা করুন গলায় শাহিদাকে কথাগুলো বললো। গলার স্বরে করুনা, অনুরোধ, হুম’কি সব ছিলো। শাহিদা জবাব না দিয়ে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে রাশার কথা শুনতে লাগলো। রাশার করুন গলার অভিযোগ শুনে সোজা হয়ে বসে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,

–বাড়ির বাইরে একটা আম গাছ আছে। দেখেছো?

শাহিদার বলা কথায় রাশা খানিক হকচকিয়ে গেলো। হচ্ছিলো কথা বেতন নিয়ে আর চলে গেলো আম গাছে! রাশা তপ্ত শ্বাস ফেলে দায়সারা ভাবে বলল,

–গেটের সাথে যে আছে ওটা?

–হুম ওটাই। ওখানে আম ধরে না।

–আম না ধরলে রেখেছো কেনো? কেঁটে ফেলে নতুন গাছ লাগাও।

রাশা কাঁধ নাচিয়ে ঠোঁট উলটে বললো। শাহিদা চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিলো,

–ওখানে তো আম ধরে না। টাকা ধরে। আমাদের যখন মন চায়, ওখান থেকে টাকা পেরে নিয়ে খরচ করি। তুমি যাও, যত টাকা দরকার তুলে নিয়ে আসো।

স্পষ্ট অপমান ছিলো। রাশা বুঝলো, হকচকালো। এক সপ্তাহ পার হয়েছে। তার এখন অগ্রিম বেতন চাই-ই চাই। এখানে যখন বেতন নিয়ে এতো ঝামেলা হয় তখন সে এই চাকরি করবেই না।

–তোমার কাজে আমি আজকেই ইস্তফা দিলাম। করবো না কাজ৷

মাহফুজা ফোঁড়ন কাটলো,

–কবে করেছো?

রাশা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে গাল ফুলিয়ে বললো,

–বিট্রেয়ার ফ্যামিলি। হুহ।

তারপর গটগট পায়ে চলে গেলো। রাশার চাকরির ইস্তফা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সকালের খাবার টেবিলে সাজানো হলো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই খেতে আসলো। আবসার সাহেব বাড়ি নেই। কিছুদিনের জন্য ঘুরতে গেছেন। নাহলে রাশার গাল ফুলানোর কোন না কোন ব্যবস্থা অবশ্যই হতো। সে এখন শোকে দুঃখে কিচেন কেবিনেটের উপর বসে বসে কলা খাচ্ছিলো। আজ এখানেই ব্রেকফাস্ট করার ইচ্ছা আছে৷ কল্পনায় অলরেডি ব্রেকফাস্ট শেষ। আর বাস্তবে তিনটে কলা আর দুইটা আপেল শেষ। পাশে এক প্যাকেট ড্রাই কেক রেখে দিয়েছে। কলা শেষে ড্রাই কেক খাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো। তবে সেটা পরিকল্পনায়ই থেকে গেলো৷ ভেস্তে গেলো কলিংবেলের আওয়াজে। কেউ একনাগাড়ে বেল বাজিয়ে যাচ্ছিলো।

কলিংবেলের ননস্টপ আওয়াজে ময়না দৌড়ে দরজা খুললো। বাইরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। পরনে সী গ্রিন কালারের লং ককটেল ড্রেস। দেখে মনে হচ্ছিলো, বলিউড থেকে উঠে আসা কোন নায়িকা। বড় একটা লাগেজ নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে৷ রাশার বেশ কৌতুহল হলো৷ এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করতে চাইলো। মেয়েটা সেই সময়ই দিলো না। হিল পায়ে দৌড়ে এসে উষিরের গলায় ঝুলে পরলো। নাক কুঁচকালো রাশা। কারো চেহারা বলিউড নাইকার মতো হলেই কি তাদের মতো কথায় কথায় গলায় ঝুলে পরতে হবে! বিরক্ত হলো ভীষণ। রান্নাঘরে যেতে যেতে মেয়েটির ন্যাকা গলায় বলা কথা কানে আসলো,

–ওহ হানি! আই মিসড ইউ সো মাচ! আর এইদিকে তুমি বিয়ে করে ফেললে! আমার কথাটা একবার মনে পরলো না?

রাশা পুরো কথা কান খাড়া করে শুনলো। ওপেন কিচেন হওয়ায় কিচেন থেকেই ডাইনিংরুমের কার্যকলাপ দেখা যায়। উষিরের পরবর্তী ধাপ দেখার জন্য বেশ উৎসুক হয়ে রইলো। সেও রাশার মনমতো কার্যক্রম করলো। গলা থেকে মেয়েটির হাত হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বিরক্তিকর সুরে বললো,

–দূরে থেকে কথা বলো মেহজাবিন। কথায় কথায় ঝাপটে ধরা আমার একদম পছন্দ না।

রাশা ভ্রু উঁচু করলো। ও আচ্ছা! মেয়েটির নাম মেহজাবিন! নামটা তো সুন্দর, তাহলে কাজকর্ম এমন কেনো!
মেহজাবিন আরো গলে গেলো। গলার স্বর নাকের মধ্যে নিয়ে এক অদ্ভুত আওয়াজে বললো,

–আগেও তো এমন হাজারবার কাছাকাছি এসেছি। টাইম স্পেন্ড করেছি, হোল ডেট টু নাইট। আমরা একসাথে থাকলে তো আমাদের টাইম সেন্সই থাকতো না।

–লায়ার!

উজান বিড়বিড় করে বললো। আজকে তার পছন্দের ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ হয়েছে৷ সেটাও ঠিকমতো খেতে পারছে না। রাশা ময়নাকে আস্তে করে বললো,

–মেয়েটার সাথে কিন্তু উষিরকে ভীষণ মানাবে। দুইজনকে সেট করতে আমাকে হেল্প করবে?

ময়না বিদ্যুৎবেগে রাশার দিকে তাকালো। চোখে অবিশ্বাস ঢেলে বললো,

–এডি কি কও তুমি! নিজের সংসারে কেউ এমুন আগুন লাগায়! এডি কিন্তু পত্তেকদিন আসে। সাড়াডি সময় ভাইগোর গলায় ঝুইল্যা থাকে। এইসব মাথায়ও আইনো না।

রাশা পরিকল্পনা বদলালো। ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। তারপর মুখভঙ্গি সিরিয়াস করে বললো,

— এইটা বোধহয় সেই গাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা পেত্নি। যে পথচারীকে পছন্দ হয় সেই পথচারীর গলায় ঝুলে পরে। কোন ব্যাপার না। আমিও মরিচ পোড়ার টোটকা জানি।

ময়না মুখ টিপে হাসলো। রাশা দ্রুত পায়ে উষিরের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাতের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলো। ভাগ্যিস এখানে বড়রা কেউ নেই৷ এইটুকু লাজলজ্জা তো তার আছে।
মেহজাবিন উষিরের কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিলো৷ রাশাকে উষিরের এতো কাছে দেখে রেগে গিয়ে বললো,

–হু আর ইউ?

–তোমার পথচারীর একমাত্র বউ।

রাশা মুখটা যথাসম্ভব ইনোসেন্ট করে উত্তর দিলো। মেহজাবিন নিজের চুলে হাত চালিয়ে একটু স্টাইল করে দাঁড়ালো৷ কোমড়ে হাত দিয়ে চুল মাথা ঝাঁকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

–ডু ইউ নো, হু আই অ্যাম?

রাশা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললো,

–হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। খাওয়ার পরে এঁটো হাত যে টিস্যুতে মুছে ফেলে দেওয়া হয়, তুমি হচ্ছো সেই টিস্যু।

–মেহজাবিন! তুই কখন আসলি? কার সাথে এসেছিস?

পেছন থেকে শাহিদার গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো৷ রাশা ছিটকে দুই হাত দূরে দাঁড়ালো। মুখ লাল হয়ে গেছে তার। মেহজাবিনের মুখ থেকে রাগের ছায়া সরে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রাশার শেষের কথাটার অতোটা গভীরে গেলো না। হাইহিলের উচ্চ আওয়াজ তুলে হেঁটে শাহিদাকে জড়িয়ে ধরলো,

–ডোন্ট বি ব্যাকডেটেড ফুপ্পি। আমি আমার সৌন্দর্য নিয়ে একাই এসেছি।

মেহজাবিন বেশ ভাব নিয়ে কথাটা বললো। শাহিদা হেসে মেহজাবিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো৷ উজান দ্রুত উঠে দাঁড়ালো৷ উষিরের পর এবারে মেহজাবিনের টার্গেট সে৷ চিন্তা করলো, আজকে ফিরবেই না৷ উষিরেরও একই পরিকল্পনা। যদিও ঘরে এখন বউ আছে কিন্তু বউ এখনও এতোটা আদুরে হয়নি যে বউয়ের টানে এই বিপদেও বাড়ি ফিরতে হবে।

উষির ভুল ছিলো৷ কাজ শেষে মোটেও আর ফালতু সময় নষ্ট করতে মন চাইলো না৷ বারবার রাশার তুলতুলে গালের কথা মাথায় আসলো৷ ভাবলো, আজকেও তাকে একটা মশার কামড় খাওয়াবে। ভাবনার পরে আর কিছুতেই বাইরে থাকতে পারলো না৷ অদৃশ্য এক সুতার টানে উজানকে ধরে বেঁধে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।

উজান রাগে রীতিমতো ফুঁসছিলো৷ উষির ছিলো নির্বিকার৷ মেহজাবিনের আবদারে কাজিনরা সবাই সোফায় গোল হয়ে বসে ছিলো৷ রাশা আর ময়নাকেও বাধ্য হয়ে রাখতে হয়েছিলো৷ মেহজাবিন কিছুক্ষণ নিজের গুণগান করার পর বললো,

–চলো গেম খেলি। ট্রুথ অর ডেয়ার।

সবাই একজোগে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রাশা ভ্যাবাচেকা খেয়ে পাশে বসা বৃষ্টিকে প্রশ্ন করলো,

–কি হয়েছে?

–এই গেমে মেহজাবিন আপুর একটা নিজস্ব রুল আছে। সবাইকে ডেয়ার নিতে হয়। সবাইকে ডেয়ার আপুই দেয়। আর সেটা ডান্স করার ডেয়ার। বেশিরভাগ সময়ই কেউ পারেনা। তখন আপু তার হয়ে প্রক্সি দেয়।

তার পাশে বসা বন্যা মাথা নাড়িয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বললো,

–মেহজাবিন আপু নাচতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু জঘন্য নাচে৷ ডান্সের নামে শুধু ভাইয়াদের গায়ে ঢলে ঢলে পরে৷

রাশা মাথা নেড়ে কুটিল হাসলো,

–আচ্ছা!

মেহজাবিনের বোতল তার দিকেই প্রথমে আসলো৷ খুশিতে লাফিয়ে উঠলো সে। এরপর নিজের বানানো নিয়ম অনুসারে ডেয়ার হিসেবে ডান্স নিলো। মিউজিক বক্সে বলিউডের এক রগরগে আইটেম সং সিলেক্ট করে নাচতে শুরু করলো। তার পরমে ছিলো শর্ট ফ্রক। ঝুল হাটুর উপরে। ফর্সা লম্বা পায়ের অনেকাংশই উন্মুক্ত। সেই সাথে গলা এবং হাতেরও অনেকটা উন্মুক্ত। হাতার জায়গায় শুধু দড়ির মতো দুটো ফিতা দেওয়া। গানের সাথে একদম মানানসই পোশাক পরিহিত মেহজাবিনের নাচের তাল শুধু উষির আর উজানের সামনেই ছিলো। কখনও উষির আর উজানের পেছনে গিয়ে তাদের গায়ে হাত দিয়ে নাচে তো কখনও সামনে এসে প্রায় গায়ের উপর উঠেপরে নাচে। বৃষ্টি, বন্যা অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গেলো। ময়না শুধু আস্তাগফিরুল্লাহ পরতে লাগলো৷ উষির উজান নিজেদের হাত অনেক কষ্টে সামলে রেখেছিলো। মামার আদরের মেয়েকে কিছু বললে চোদ্দগুষ্টি মিলে তাদের হাল বেহাল করতে দেরি করবে না। এইসবের মধ্যে একমাত্র রাশা নাচটা ভীষণ ইঞ্জয় করলো। শিস বাজাতে না পারে না জন্য আফসোস হল খুব। একসময় এই নাচ শেষ হলো। সবাই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে, এমনভাবে শ্বাস ফেলে হাত তালি দিলো। রাশা বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো,

–আমার বাড়িতে একটা বাইজিমহল আছে৷ সেখানে আগে বাইজিরা থাকতো। নাচ দেখার মন চাইলেই সবাই বাইজিমহলে চলে যেতো। যদিও এখন সেটা পরিত্যক্ত কিন্তু তুমি চাইলে সেটা আবার ওপেন হতে পারে। ওদের ভালো খোরপোশ দেওয়া হয়।

মেহজাবিন প্রথমটায় অপমান বুঝলো না। মুখ বেকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো,

–নাচ একটা আর্ট। সেটা যে পারে না সে এইসব বলে নিজেকে শান্তনা দেয়।

রাশা হাসলো। বিদ্রুপের হাসি। তারপর মুখ শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,

–আ’ম সরি বাট, শরীরের বাঁক দেখিয়ে সিডিউস করে কোমর দুলানোকে আমি বাইজি নাচ হিসেবেই জানি৷ নাচের বিভিন্ন ধরন আছে। তারমধ্যে সব থেকে খারাপ ধরনটা হলো খ্যামটা নাচ। সেটা বাইজিরা নাচে৷ সরি টু সে, নাচের সময় তোমার ব্যবহারটা ওমনই ছিলো৷ ঠিক রেড লাইট এরিয়ার বাইজি মেয়েদের মতো খ্যামটা নাচ।

অপমানের চূড়ান্ত ছিলো এটা৷ মেহজাবিন ক্রোধে ফেঁটে পরে তেড়ে মারতে আসলো। রাশা চোখ মুখ শক্ত করে মেহজাবিনের হাত পিছমোড়া করে ধরলো। উষির কিছু বলতে চাইলো। উজান বাঁধা দিয়ে বললো,

–ইতিহাস বলে, দুই মেয়ের ঝগড়ার মধ্যে একটা শিল্প থাকে৷ শিল্পটা ইঞ্জয় করতে দে।

–কোন ইতিহাস বলে?

উষির দাঁতে দাঁত চেপে পালটা প্রশ্ন করলো। উজান ঠোঁট উলটে কাধ নাচিয়ে বললো,

–ভবিষ্যতের ইতিহাস বলবে।

উষির চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো৷ রাশা মেহজাবিনের হাত আরো শক্ত করে চেপে কিড়মিড়িয়ে বললো,

–সরি ডিয়ার! আমার হাজবেন্ডের দিকে নজর দেওয়ার অপরাধে এমন একটা কেস গলায় ঝুলিয়ে দেবো যে বিশ বছরের আগে জেল থেকে ছাড়া পাবে না।

উষির উজানের বাঁধা মানলো না। এগিয়ে এসে রাশার হাতের শক্ত বাঁধন খুলতে চাইলো,

–ওর হাত ছাড়ো?

রাশা হাত ছাড়লো। রাগে ওর ফর্সা মুখ গোলাপি হয়ে উঠেছে। মেহজাবিন হাতের ব্যাথায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তারপর এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর পরিবেশ শান্ত হতেই মাঝে একবার ময়না ফিসফিস করে বললো,

–ভাবি, তুমি না কইলা এই বেডির লগে ভাইয়ের লাইন লাগায়া দিবা? এহন একে ধরেই তো মারতিছো।

রাশা আরো ফিসফিস করে বললো,

–এই মেয়ের সাথে উষিরের মিল করিয়ে আমি নিজের সম্মান খোয়াবো নাকি? সবাই কি বলবে, এই মেয়ের জন্য রাশার সংসারটা হলো না! ছিহ!

ময়না মুখ টিপে আসলো৷ এতোদিন এই মেয়ের অত্যাচার সহ্য করার পর আজ একটা উচিৎ শিক্ষা দেওয়া গেছে। এক্কেরে উচিৎ জবাব!
এরপর আবার সব চুপ। উষির প্রচন্ড রেগে গেছে। রাশার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,

–ঘরে চলো?

রাশা পাত্তা দিলো না৷ বন্যা আর বৃষ্টির হাত চেপে সামনে এগোতে এগোতে বললো,

–আজকে আমি ননদিনীদের সাথে গল্প করবো৷ একাই ঘুমাও।

উষির রাগী চোখে তাদের যাওয়া দেখলো৷ এখন ছোট ভাই বোনদের সামনে বউকে তো আর জোর করে ঘরে নেওয়া যায় না। বড়ই যদি এমন নির্লজ্জ কাজ করে তাহলে ছোটরা কি শিখবে! উজান পরিস্থিতি বুঝে মুখ টিপে হাসলো৷ এগিয়ে এসে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে বললো,

–রাগ করেছিস ভাই?

উষির দাঁত মুখ খিচিয়ে উঠলো,

–প্রে করি যাতে খুব তাড়াতাড়ি তোর কপালে এর থেকেও ড্যাঞ্জারাস কেউ জোটে।

উজান দাঁতে জিভ কেঁটে মাথা নাড়লো। ভাইয়ের হয়ে তওবা পড়লো হয়তো৷ তারপর বাঁকা হেসে বললো,

–তোর বউ এক পিসই আছে৷ তাই আমি নিশ্চিন্ত!

উজানের ধারণা যে কতটা ভুল ছিলো আর উষিরের দোয়া যে কত শীগ্র ফলে যাবে সেটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। যদি টের পেতো তাহলে হয়তো জীবনে আর মায়ের সাথে ঘুরতে যেতো না।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-১১+১২

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১১

লিভিংরুমের দেয়ালে বেশ কয়েকটা পেইন্টিং ঝুলানো আছে। রাশা সেগুলো বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। বৃষ্টি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। রাশা থামালো৷ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

— মেজো বাবার একেকটা ছবির দাম তো লাখের উপর। এগুলো তো অনেক এক্সপেন্সিভ। তার এই ছবিগুলো ফ্রীতে দিয়ে দিয়েছে?

বৃষ্টি ছবিগুলোতে চোখ বুলালো৷ তার হাতে একটা খোলা বিস্কুটের প্যাকেট। চোখে জিরো পাওয়ারের চশমা। চশমা চোখ থেকে একটু সরে এসেছিলো। বাম হাত দিয়ে চশমা ঠিক করে বললো,

–না না, ফ্রীতে কেনো দেবে? খাগড়াছড়িতে বড় আব্বুর একটা বড় রিসোর্ট ছিলো৷ সেটার বদলেই দিয়েছে। মানে আগে পেইন্টিং দিয়েছে তারপর বলেছে তার ওই রিসোর্ট চাই। এখন পেইন্টিং তো ফেরত দেওয়া যায় না৷ তাই বাধ্য হয়ে রিসোর্টটাই দিয়েছে৷

রাশা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। বৃষ্টির বিস্কুটে ভাগ বসিয়ে ব্যাঙ্গোক্তি করলো,

–তাই তো বলি! ফ্রেন্ডস অফ বেনেফিট। ওটা তাহলে তোমাদের রিসোর্ট! রিসোর্টটা বড় বাবার আদেশ অনুসারে মেজো বাবা নিয়েছে। এখন সেখান থেকে ডেইলি লাখ টাকা ইনকাম হয়। প্রতিটা জিনিসের মূল্য ধরা৷ রিসোর্টে নিঃশ্বাস নিলে সেটারও ভাড়া দিতে হয়। সোনা দিয়ে বানানো নাকি কে জানে!

রাশার কথায় বৃষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে মাস শেষে হওয়া লাভের পরিমাণটা হিসাব করলো। রাশা আরেকটা বিস্কুট মুখে পুড়লো। বিস্কুট নেওয়াতে কিছু মনে করলো না সে৷ তার এখনকার দুঃখ একটু বেশিই বড়৷ সেটাই রাশার সাথে শেয়ার করতে চাইলো। মুখ কালো করে বললো,

–জানো তো, ওই রিসোর্ট বড় আব্বুর অনেক পছন্দের। ড্রিম হাউজ বলতে পারো৷ বানানোর পর আমরা একদিনও যাইনি৷ তার আগেই হাতছাড়া হয়ে গেলো।

রাশা উত্তর করলো না। বৃষ্টি বলার পরপরই বিচলিত স্বরে বললো,

–এটা কাউকে বলো না প্লিজ? কেউ একথা জানে না। আমি লুকিয়ে শুনেছিলাম। আজ প্রথম তোমাকে বললাম।

রাশা ভ্রু কুঁচকালো৷ আরেকটা বিস্কুট মুখে পুরে চিবাতে চিবাতে সন্দেহী গলায় বললো,

–এতোদিন পর আমাকে কেনো বলছো?

বৃষ্টি হকচকিয়ে গেলো। ইতস্তত করে কাঁধ নাচিয়ে বললো,

— এমনি।

রাশা হাসলো। চোর ধরার মতো হাসি। বৃষ্টির গালে টোকা দিয়ে বললো,

–আমি কারনটা বলি। কারন তুমি চাচ্ছো, আমি যাতে ওই রিসোর্ট তোমাদের ফিরিয়ে দেই। তাই তো?

বৃষ্টির মুখ ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলো৷ রাশা হেসে ফেলে বললো,

–ভয় কেনো পাচ্ছো?

বৃষ্টি ভয়ার্ত গলায় বললো,

–তুমি..তুমি সত্যি খুব ড্যাঞ্জারাস।

বলেই এক ছুটে চলে গেলো। রাশা ফিক করে হেসে ফেললো। ঘাড় উঁচু করে একবার সিঁড়ির উপর নজর দিলো। ততক্ষণে বৃষ্টি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

ঘড়িতে সকাল সারে নয়টা দেখাচ্ছে। নিজের ভাগের সমস্ত কাজ মাত্র দশ মিনিটে সম্পন্ন করেছে রাশা। এখন এসেছে উষিরের সাথে গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনা করতে। উষির ল্যাপটপে কিছু করছে৷ সামনে টিভিতে নিউজ চলছে। সেদিকে তাকালো রাশা। টিভিতে কোন এক এমপির মা’র্ডার সম্পর্কে বলা হচ্ছে। অনেক পুরোনো নিউজ। ইউটিউব থেকে দেখছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে উষিরের পাশে গিয়ে বসলো। নজর তুলে রাশার দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত। নিজের কাজেই মগ্ন রইলো। রাশা কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

–কাল তোমার একটা কাজ করে দিয়েছিলাম। মনে আছে?

কি-বোর্ডে দ্রুততার সাথে হাত চলছে তার। ল্যাপটপ স্ক্রিনে নজর রেখেই গুরুগম্ভীর উত্তর দিলো,

–আমার স্মৃতি এতোটাও খারাপ না।

রাশা খানিক শান্তনা পেলো বলে মনে হলো। নিজের কাজ হাসিলের খানিক আশার আলো দেখতেই অনুরোধ করলো,

–ভেরি গুড৷ এখন আমার একটা উপকার করো প্লিজ?

ল্যাপটপ থেকে মুখ তুললো উষির। রাশার দিক তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো। রাশার মনটা কেমন জানি করে উঠলো। উষির সবে গোসল করে এসেছে। চুলের পানি গড়িয়ে পরছে। কপালের একাংশ ভিজে রয়েছে। ঢোক গিললো রাশা। একটু পিছিয়ে বসে বললো,

–আমার একটা ডকুমেন্টে তোমার একটা সাইন চাই। শুধু একটাই সাইন। আর তোমার এনআইডি কার্ডটা চাই। যাস্ট ফর নাম্বার।

উষির আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় বললো,

–এটা তো দুইটা কাজ হলো৷ একটা তো না।

–দুইটা জিনিসই একটা কাজেই লাগবে। তাই টেকনিকালি একটাই কাজ হলো।

রাশা বুঝানোর ভঙ্গিতে বললো। উষির বুঝেছে এমন ভাবে মাথা নেড়ে বললো,

–নিয়ে এসো।

এবারে রাশা একদম মিইয়ে গেলো। টুইস্টটা তো এখানেই। ফাইল সাইন করা যাবে কিন্ত দেখা যাবে না। এখন ল্যাপটপে মুখ গুজে থাকা মানুষটা সেটা মানবে নাকি সেটাই দেখার বিষয়। বেশ ইতস্তত করলো রাশা। দোনোমনা করে বললো,

–কিন্তু একটা কন্ডিশন আছে। তুমি ফাইলে শুধু সাইন করবে। কিছু পড়তে পারবে না।

উষির খানিক অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে রাশার দিকে একপলক তাকালো। তার কাজ শেষ। ল্যাপটপ বন্ধ করে রাশার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–না পড়ে সাইন করতে পারবো না। তার উপর এনআইডি কার্ড চাচ্ছো৷ ব্যাংক ডাকা’তি করে আমাকে ফাঁসিয়ে দিলে তখন!

রাশার মুখ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো,

–এনআইডির সাথে ব্যাংক ডাকাতির কি সম্পর্ক?

উষির কাঁধ নাচিয়ে ঠোঁট উলটে বললো,

–ফেক পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে গিয়ে ব্যাংক ডাকা’তি করা যায়। আবার সিম তুলে সেই সিম দিয়ে কিড’ন্যা’পিংও ইজিলি করা যায়। কত কিছুই তো করা যায়।

রাশার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। বিড়বিড় করে বললো,

–খুব এক্সপেরিয়েন্স আছে মনে হচ্ছে?

উষির কথাটা শুনতে পায়নি। সে এখনও ভ্রু কুঁচকে রাশার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে স্পষ্ট সন্দেহ। রাশা বড় করে শ্বাস নিয়ে পুনরায় বুঝাতে চাইলো,

–ওসব কিছুই না। ভালো কাজের জন্যই সাইন লাগবে। আমার একটা স্কলারশিপের জন্য অ্যাজ আ গার্ডিয়ান, তোমার সাইন আর একই কারনে এনআইডি নাম্বারও দরকার।

–আমি তো জানতাম তোমার স্টাডি শেষ। তাহলে এখন কিসের স্কলারশিপ?

রাশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে পালটা প্রশ্ন করলো,

–তুমি আমার স্টাডির ব্যাপারে আর কি কি জানো?

–নাথিং।

–তাহলে? পড়ার কোন বয়স হয় না বুঝেছো? আর এতো প্রশ্নই বা কেনো করছো? আমি কি তোমার লোন সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলাম? নতুন একটা কোম্পানি এতো টাকার লোন দিয়ে কি করবে? কিংবা সেটা কিসের কোম্পানি ছিলো? আমি একটাও কথা না বলে সাইন করিয়ে এনে দিয়েছিলাম।

উষির কপাল চুলকে দায়সারা ভাবে বললো,

–তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে। আমি বলিনি।

রাশা থতমত খেয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বললো,

–তাহলে আমাকে কেনো জিজ্ঞাসা করছো? একটাই তো সাইন। করে দাও, ঝামেলা চুকে বুকে যাবে। প্লিজ?

রাশা কাতর গলায় বললো। উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বার কয়েক চোখের পলক ফেলে বললো,

–নিয়ে এসো।

রাশা ভীষণ উচ্ছ্বসিত হলো। এক দৌড়ে ফাইল নিয়ে আসলো। নীল রঙের ফাইলের উপর সাদা পৃষ্ঠার একটা কাগজ দিয়ে সম্পূর্ণ লেখা ঢাকা। নিচের দিকে শুধু সাইন করার জায়গাটা ফাঁকা রয়েছে। একপলক রাশার দিকে তাকালো উষির। তারপর কলম চালিয়ে সাইন করে দিলো। রাশা এনআইডি কার্ডটা নিতেও ভুললো না। সব কিছু খুব সাবধানে ব্যাগে রেখে দিলো। উষিরের সামনে রাখলো না। সে বাইরে যেতেই খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখলো।

উষির, উজান দুজনেই সারে নয়টার মধ্যে বাড়ি থেকে বের হলো৷ রাশা এই অপেক্ষাতেই ছিলো। ওরা বেড়িয়ে যেতেই সেও তৈরি হয়ে নিলো। আগেরদিনের মতোই পোশাক-পরিচ্ছদ৷ সফেদ সালোয়ার সুট, পনিটেল করা চুল। বাম হাতে কালো ফিতার ঘড়ি আর ডান হাতে ব্রেসলেট। হাতের ব্রেসলেটটা সব পোশাকের সাথেই ভীষণ মানিয়ে যায়। প্রতিবারই তৈরি হওয়ার পরে ব্রেসলেটের দিকে তার নজর যাবেই যাবে। কিজন্য যায় আর কিজন্যই বা প্রতিবার দেখার পর মন ভরে ওঠে, সেটা বুঝতে পারে না। শুধু বোঝে, ব্রেসলেটটা হারানো যাবে না৷ তার কোটি টাকার গহনারগুলোও এই ব্রেসলেটের কাছে এসে মূল্যহীন হয়ে পরেছিলো।

সিঁড়ি ভেঙে লিভিংরুমে আসতেই শাহিদার সামনে পরলো সে। তাকে পরিপাটি পোশাকে আর ব্যাগ কাঁধে দেখেই কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,

–কোথায় যাচ্ছো?

রাশা চটপট উত্তর দিলো,

–বাইরে।

কুঁচকানো কপাল সোজা হলো শাহিদার। নরম গলায় বললো,

–অযথা বাইরে ঘোরাঘুরির কোন দরকার নেই।

রাশা এগিয়ে গেলো৷ শাহিদা ডাইনিংরুমে যাচ্ছিলো। রাশা তার পিছু পিছু যেতে যেতে বললো,

–কি বলছো তুমি খালাম্মা? অযথা কেনো হতে যাবে? আমি তো রিসেন্টলি ডেইলি ভ্লগ শুরু করেছি। তাই ভাবলাম বাইরেটা একটু এক্সপ্লোর করে আসি৷ বিশ হাজার বেতনের চাকরি করে তো সংসার চলবে না। একটা আউটসোর্সিং থাকলে বেশ ভালো হবে। ঘরে বসে ইনকাম।

পা থমকে গেলো তার। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রাশার দিকে দিরে ধমকে উঠলো,

–জাহান্নামে যাও।

বলেই হনহন করে সামনে এগিয়ে গেলো। প্রথমটায় রাশা মুখ টিপে হাসলো। পেছন লাগার লোভ সামলাতে পারলো না। দ্রুত পায়ে শাহিদার পিছু নিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো,

–ভালো দোয়াও তো করতে পারো। এরপর থেকে দোয়ার উপর ট্যাক্স বসাবো। প্রতি খারাপ দোয়াতে এক হাজার করে ট্যাক্স। আর ভালো দোয়াতে একশো৷ এই নিয়ে একটা অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার তৈরি করে রাখবো৷ এতে সবার সাইন চাই।

কথা বলতে বলতেই ডাইনিংরুমে পা ফেললো সে৷ আর সাথে সাথেই থমকে গেলো। আবসার সাহেব টেবিলে বসে খাচ্ছেন। রাশাকে দেখেই আলতো হেসে বললেন,

–তোমার কোথায় যেতে হবে আমাকে বলো৷ আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

রাশা নিজেকে চট করে সামলে নিলো। একগাল হেসে চেয়ার টেনে বসে বললো,

–কোর্টে যাবো আংকেল। তাড়াতাড়ি করো।

রান্নাঘর আর ডাইনিংস্পেস একদম সাথে। মাহফুজা রান্নাঘরে ছিলো। রাশার কথা শুনতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,

–প্রতিদিন কোর্টে যেতে হবে কেনো?

রাশা পানি খেয়ে গলা ভেজালো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে মাহফুজার দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হেসে বললো,
–টাকার বিনিময়ে সাক্ষী হিসেবে কাজ করি আন্টি। পার্ট টাইম জব বলতে পারো। ভালো ইনকাম হয়। লাইফে টাকা ভীষণ জরুরি৷ তোমাদের কারো এই চাকরির প্রয়োজন হলে আমার সাথে কন্ট্যাক করতে পারো। আমি কাজ জোগাড় করে দেবো।

ময়নার চোখ চকচক করে উঠলো৷ হাতের কাজ ফেলে এগিয়ে এসে বললো,

–কেমন টাকা পাওন যায় ভাবি?

রাশা ঠোঁট উল্টালো। তারপর কপাল কুঁচকে চিন্তা ভাবনা করে বললো,

–বেশ ভালোই ইনকাম হয়। প্রতি সাক্ষীতে দুই তিন হাজার। ডেইলি দশ বারো হাজার ইনকাম হয়ে যায়। তবে একটু রিস্কি আছে। ধরা পরলে সোজা হাজত। তারপর মাথায় গোটা কয়েক কেস ঝুলিয়ে দেবে।

দমে গেলো সে। মুখ গোমড়া করে বললো,

–তাইলে তুমি এরম কাম করো কেন?

–আমি একটা জজের কাছে একটা সাক্ষ্যই দেই। তারপর তার সাথে আগামী এক মাস আর দেখা করি না৷ জজ তো আর একটা না। তবুও যদি কথার মারপ্যাঁচে পরে যাই তাহলে চালাকি করে ছুটে আসি।

শাহিদা সোজা রান্নাঘরে ঢুকেছিলো। রাশার কথা শেষ হতে না হতেই হাতের চামচ নিয়েই তেড়ে এসে রাগী গলায় আবসার সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,

–এই মেয়েকে কোথা থেকে ধরে এনে আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছো?

আফসার সাহেব রাশার কথায় এমনিতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলো। স্ত্রীর কথায় আরো নার্ভাস হয়ে গেলো। রাশা তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে বললো,

–একটু ভুল হয়ে গেলো খালাম্মা। আংকেল আমাকে সিলেক্ট করেনি। আমিই আংকেল আর তোমার ছেলেকে সিলেক্ট করে ঝুলে পরেছি। ওইযে, কি জানি একটা গল্প টল্প আছে না? গাছে ভুত পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। নিচ দিয়ে যাওয়া পথচারীদের পছন্দ হলে লাফ দিয়ে গলায় ঝুলে পরে, ব্যাপারটা অনেকটা ওমন।

শাহিদা চামচ উঁচিয়ে রাশাকে শাসিয়ে বললো,

–তুমি সারাদিন বাড়ি ফিরবে না। প্রতিদিন সকালে বের হবে আর সন্ধ্যার পর ফিরবে। যদি এমন করো তাহলে তোমার বেতন ত্রিশ হাজার হবে। আর যদি সন্ধ্যার আগে ফেরো তাহলে বিশ হাজারের পাঁচ হাজার কাঁটা।

রাশা মাথা নেড়ে সায় জানালো। নড়ে চড়ে আড়াম করে বসে পা নাচিয়ে বললো,

–টাকার ব্যাপারে আমি খুব সেনসিটিভ। তোমার কথা আমার কাছে বেদবাক্য। তবে বেদবাক্যে আমার বিশ্বাস নেই। নতুন অ্যাগ্রিমেন্ট তৈরি না করা পর্যন্ত এটা কার্যকর করতে পারছি না। আজকে ফিরে এসে অ্যাগ্রিমেন্ট নিয়ে বসবো।

ওপাশ থেকে ময়না আবার প্রশ্ন করলো,

–ম্যাডাম? আমার জন্নে এমুন ব্যবস্তা নাই?

মাহফুজা আর শাহিদা দুজনেই চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো। দমে গেলো ময়না। দুই পা পিছিয়ে নিজের কাজে হাত লাগালো। রাশা আফসোস মেশানো গলায় বললো,

–তুমি বরাবরই এতো লেট কেনো করো ময়না? এরপর আমার সাথে আগে কথা বলবে৷ আমার মাথায় এর থেকেই বেটার বেটার আইডিয়া আছে।

মাহফুজা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–হ্যাঁ হ্যাঁ, কুবুদ্ধি দিয়ে মাথা ভরা। কোচিং সেন্টার খুলে ফেলো। এখানেও ভালো ইনকাম হবে।

রাশা মুগ্ধ হয়ে বললো,

–ওয়াও আন্টি! আমার সংস্পর্শে একসপ্তাহ থাকলে কি থাকলে না, আমার মতো বুদ্ধি পেয়ে গেলে! হ্যাটস অফ ইউ আন্টি! তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে পারো। ভালো স্যালারি দেবো।

মাহফুজা ধমকে উঠলো,

–তোমার দেরি হচ্ছে না?

রাশা ঠোঁট উলটে বললো,

–হচ্ছে তো। আংকেলের খাওয়াই তো শেষ হচ্ছে না।

শাহিদা থমথমে গলায় বললো,

–না খেয়ে বাইরে যাওয়া আমার একদম পছন্দ না।

কথাটা রাশার উদ্দেশ্যে বলা সেটা স্পষ্ট বোঝা গেলো। ময়না এসে রাশার সামনে খাবারের প্লেট রাখলো। রাশা নিজের চোখের পানি সামলাতে ঢোক গিললো। তাতেও কাজ না হওয়াতে পানি খেলো। ইসস! বারবার সে এতো ইমোশনাল কেনো হচ্ছে!

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ১২

মোড়ের রাস্তায় সাংঘাতিক মারামারি লেগেছে। তার তেজ সবজায়গায় বোঝা যাচ্ছে। রাস্তায় মানুষের ছুটাছুটি, চিৎকার, সব মিলিয়ে অবস্থা বেশ করুন। তবে তার তেজ কফিশপের মধ্যে আসছে না। এসির জন্য চারিদিকে বন্ধ করে রাখা রয়েছে। রাশা সেই কফিশপেই বসে আছে৷ সামনে বসে আছে মধ্যবয়সী মাঝারি আকৃতির এক ভদ্রলোক। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় টাক পরেছে। পেছনের দিকের চুলগুলো প্রায় সবগুলোই কাঁচা। পরনে স্যুট-বুট৷ বেশ অনেকক্ষণ হলোই তারা বসে আছে। নানান আলোচনা করেছে। আলোচনার শেষে এসে ভদ্রলোকটি নিজের কফিমগে এক চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলো,

–তুমি তোমার ডিসিশনে সিওর?

রাশা মুচকি হাসলো। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ বোঝা যাচ্ছে। গোছানো পনিটেল করা চুলগুলো হালকা এলোমেলো। কিছু চুল কানের পিঠে গুজে আলতো ভাবে বললো,

–ইয়েস স্যার। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন এটা। পিছু হাঁটার আর কোন ওয়ে নেই।

রাশার সামনে বসে থাকা লোকটার নাম সুবোধ দত্ত। পেশায় সিনিয়র আইনজীবী, রাশার শিক্ষক। মাঝবয়সী সুবোধ বাবু হাসিখুশি মানুষ। সিরিয়াস ব্যাপারেও একটু মজা না করে পারেন না। তবে আলোচনার এখন অব্দি বেশ শান্ত ভাবেই কথাবার্তা বলে চলেছেন।

–ইউ আর নিউলি ম্যারেড ব্রাইড। তোমার বিবাহিত জীবনে এর কোন প্রভাব পরবে না তো?

রাশার হাসিমুখে হালকা মলিনতার ছাপ ফুটে উঠলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। সামনে রাখা কফিমগে হালকা করে সিপ নিলো। ক্যাপাচিনো কফির কিছুটা ঠোঁট লেগে ছিলো। আলতো হাতে টিস্যু দিয়ে মুছে বললো,

–নো স্যার। আওয়ার ম্যারেজ ইজ আ অ্যাক্সি’ডেন্ট। আর অ্যাক্সি’ডেন্টের মেমোরি কেউ ধরে রাখতে চায় না। হি ইজ আ জেন্টালম্যান অ্যান্ড ভেরি ইন্টেলিজেন্ট। হোপ করছি, খুশি খুশি সবটা মেনে নেবে।

–তবুও একবার কথা বলে দেখতে।

সুবোধ বাবুর গলায় উদ্ধিগ্নতার ছাপ। রাশা হাসলো। চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস ফুঁটে উঠেছে। টেবিলে আঙুল দিয়ে দুই একবার টোকা দিলো। আনমনে, উদাসীন হয়ে। তারপর নিজেকে সামলে বললো,

–সেটা করতেই তো এসেছি স্যার। আপনার সাথে আলোচনা করাই এনাফ। এখন আমিই আমার ডিসিশন মেক করার স্বাধীনতা পেয়েছি। আ’ম এক্সট্রেমলি এঞ্জয়িং দিস চ্যাপ্টার।

সুবোধ বাবু খুব করে হাসলো। তার কফি শেষের পথে। চেয়ারে আড়াম করে বসে মাঝারি আকৃতির উঁচু পেটে হাত রেখে মৃদুস্বরে ব্যাঙ্গক্তি করলেন,

–তুমি যতটা ম্যাচিউর নিজেকে মনে করো ততটা ম্যাচিউর তুমি না।

রাশার আত্মবিশ্বাস প্রচুর। নিজের সিদ্ধান্তকে প্রচন্ড সম্মান করে। সেই বিশ্বাস থেকেই বললো,

–স্যার, ম্যাচিউর হলে মাঝপথেই কাজটা ছেড়েছুড়ে পালাতাম। ম্যারিউর মানুষরা স্বাভাবিক মানুষ হয়। আর স্বাভাবিক মানুষরা মৃ’ত্যুকে ভয় পায়।

–ফিলোসফিক্যাল কথাবার্তা বেশ ভালোই বলছো দেখছি।

রাশা বাঁকা হাসলো। বললো,

–যেটাই হোক স্যার, শেষপর্যন্ত জয় আমারই হয়।

সুবোধ বাবু সোজা হয়ে বসলো। অমায়িক হেসে বললেন,

-ইট’স ট্রু অ্যাকচুয়েলি!

তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

–ঠিক আছে, কাজের কথা থাক। এখন আমি তোমার পারসোনাল কথা শোনায় আগ্রহী।

–সবটাই তো জানেন স্যার। নতুন আর কিছুই নেই।

–নো রাশা, তোমার লাইফের এই নতুন চ্যাপ্টার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সেটাই জানতে চাই। তোমার হাজবেন্ড সম্পর্কে, তোমার শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে। আ’ম কিউরিয়াস!

রাশার বুকটা কেমন একটা করে উঠলো। ক্ষণকালের মধ্যে সেটা ঠিক হলেও রয়ে গেলো রেশ। ওয়েটার বিল নিয়ে এসেছে। সুবোধ বাবু বিল পেমেন্ট করলো। রাশা সেদিকে তাকিয়ে খানিক ইতস্তত করে বললো,

–আমার হাজবেন্ডের নাম আদনান কায়সার।

সুবোধ বাবুর হাত খানিক থামলো। তারপর কপাল কুঁচকে সন্দেহি গলায় প্রশ্ন করলো,

–ওয়েট আ মিনিট, পলিটিশিয়ান আদনান কায়সার?

রাশা মাথা নাড়লো,

–জ্বি স্যার।

সুবোধ বাবু বিল পেমেন্ট করে হেসে ফেললেন। ওয়েটার চলে যেতেই হাসতে হাসতেই নিজের ব্যাগ গোছাতে লাগলেন। রাশা বিহ্বল হলো। কিছু বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচেকা খাওয়া গলায় প্রশ্ন করলো,

–স্যার, আপনি হাসছেন?

–আ’ম সরি রাশা বাট তোমার ভাগ্যে পলিটিশিয়ান থাকবে সেটা আমি কল্পনাও করিনি। বাই দা ওয়ে, তোমার হাজবেন্ডকে আমি খুব ভালো করেই চিনি আর তোমার হাজবেন্ডও আমাকে ভালো করেই চেনে।

–ওকে চেনা অস্বাভাবিক না। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব অ্যাক্টিভ। আপনারই মতো। আবার পাবলিক ফিগারও। সেটাও আপনার সাথে খুব মেলে।

–হুম, দ্যাটস রাইট বাট আমি অন্যভাবে চিনি। আবসার কায়সার মানে তোমার শ্বশুর আমার ক্লায়েন্ট। রেগুলার কাস্টমার যাকে বলে।

কথা বলতে বলতে তারা কফিশপের বাইরে এসে দাঁড়ালো। কফিশপের বাইরেটা একদম সাদামাটা। কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে আসলেই রোড দেখা যায়। একপাশে গাড়ি পার্ক করার জায়গা ছাড়া অতিরিক্ত আর কোন জায়গা নেই। তারা বসেছিলো দরজার দিকের একটি টেবিলে। বের হতে খুব একটা সময় লাগেনি। তবে যতটুকু সময় লেগেছে ততটুকু সময়ই কৌতুহলী রাশার ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

–বাট স্যার, হাউ ইজ দিস পসিবল?

–হোয়াই নট? যাস্ট কনসালটেন্ট হিসেবে ওদের হয়ে কাজ করি। কাগজপত্রের যত কাজকর্ম থাকে সব আমার ওয়াইফ দেখে। ভরসা থেকেই কনসালটেন্ট হিসেবে ওদের অফিসে পার্ট টাইম জব করছি।

রাশা আফসোসে মাথা নাড়লো। একজন ক্রি’মি’লান ল’ইয়ার যদি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্ট হিসেবে যায় তাহলে ব্যবসা যে কিভাবে আর কতভাবে সোজাভাবে নিজের কাজ করবে সেটা আর তার বোঝার বাকি নেই।

–স্যার, একই অঙ্গে বহুরুপ কথাটা আপনার সাথে খুব যায়।

সুবোধ বাবু হাসলেন। বাঙালিদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করার এক আলাদা ট্যালেন্ট আছে। সেই ট্যালেন্টটা তারা দু’জন বেশ করে খাটাচ্ছেন।

-তুমি সুপর্ণাকে দিয়ে কিসের ফাইল সাইন করিয়েছো? দেখতে পর্যন্ত দাওনি। একেবারে বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছো।

সুবোধ বাবুর প্রশ্নে খানিক ইতস্তত করলো রাশা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললো,

–একটা লোন ফাইল স্যার। কিসের লোন সেটা বলতে পারবো না। শুধু জানি লোন ফাইল।

–পরে প্রবলেম হবে না তো?

রাশা হাসলো, বাঁকা হাসি। কোন বাচ্চা দুষ্টমি করার পর যেভাবে হাসে ঠিক তেমন হেসেই বললো,

–লোন অ্যাপ্রুভালের ফাইল আর প্রবলেম ফাইলের মধ্যে পার্থক্য আছে নাকি স্যার?

তারপর কি মনে হতেই মুখশ্রী গম্ভীর করে অনুরোধ করে বললো,

–স্যার, একটা রিকুয়েষ্ট ছিলো। আমার কাজ সম্পর্কে আমার শ্বশুরবাড়ির কাউকে কিছু জানাতে চাই না। মানে এখনই চাই না। সব আগে গুছিয়ে নেই তারপর জানাবো। এই রিকুয়েষ্টটা রাখবেন স্যার? প্লিজ?

–ওকে ওকে! এটাতে রিকুয়েষ্ট করে বলার মতো কিছুই হয়নি। আমি তো তোমাকে চিনিও না।

সুবোধ বাবু ভরসা দিলেন। কিন্তু রাশা ভরসা পেলো না। মুখমণ্ডল চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকলো। গোলমালের আওয়াজ এখন তাদের দিকে আসছে। সুবোধ বাবু চিন্তিত স্বরে বললেন,

–এতো আওয়াজ হচ্ছে কেন? কেউ মা’র্ডা’র হলো নাকি?

রাশা তপ্ত শ্বাস ফেললো। সুবোধ বাবুর কাছে কিছু হওয়া মানেই হয় মা’র্ডা’র হওয়া আর নয়তো বড় কোন ক্রা’ইম করা। এছাড়া তার মুখে চিন্তার অন্য কোন কারণ আজ পর্যন্ত সে দেখেনি।
অন্য কিছু রাশা দেখলো তবে সেটা সুবোধ বাবুর থেকে নয়। রাস্তায় এক পাল লোকের সাথে হেঁটে হেঁটে উষির আসছে। তার হাতে মোটা একটা লাঠি৷ ঘামে শরীর ভিজে উঠেছে। হাঁটার মধ্যে দাম্ভিকতা ফুটে উঠছে। মুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। এমন উষিরের সাথে রাশার পরিচয় ছিলো না। এই উষির কাজের প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাশীল আর সিরিয়াস। রাশার কেমন ঘোর লেগে আসলো। কানে আসলো সুবোধ বাবুর বিষ্মিত বাক্য,

–উষির! তোমার হাজবেন্ড এখানে কি করছে?

–ডোন্ট নো স্যার।

রাশা আচ্ছন্নের মতো উত্তর দিলো। সেকেন্ডের মধ্যে উষির লাঠি অন্যের কাছে হস্তান্তর করে ভিড় ছেড়ে তাদের কাছে আসলো। রাশার ঘোর তখনও কাঁটেনি। উষির হেঁটে হেঁটে আসলো, তার সামনে দাঁড়ালো, সবটাই কেমন একটা ঘোর লাগার মতো লাগলো তার কাছে। উষির ভ্রু বাঁকিয়ে দাম্ভিকতার সুরে রাশাকে প্রশ্ন করলো,

–তুমি এখানে কি করছো?

চমকে উঠলো সে। ঘোর কাঁটতেই আমতা-আমতা করলো। বললো,

–ক-কফি খেতে এসেছিলাম।

উষির রাশার মুখে একবার চোখ বুলালো। জহুরি নজরে কিছু পর্যবেক্ষণ করলো বোধহয়৷ তারপর নজর ঘুরিয়ে সুবোধ বাবুর দিকে তাকালো। মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

–সুবোধ আংকেল! আপনি এখানে?

সুবোধ বাবু হ্যান্ডশেক করলো। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য খানিক ভেবে উত্তর দিলো,

–হ্যাঁ, ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিলো। তোমাকে লাঠিসোঁটা হাতে দেখে এগিয়ে আসলাম। জানোই তো এসব আমি কত পছন্দ করি।

বলেই তিনি বোকার মতো হাসলেন। উকিলদের সবসময় সব প্রশ্নের উত্তর তৈরি থাকতে হয়। হয় সত্যি কিংবা মিথ্যা। তবে উত্তর তাকে করতেই হয়। উষির কিছু না বলে অল্প হাসলো। রাশার হাতের মধ্যে হাত রেখে টেনে নিজের পাশে দাঁড় করালো। তারপর হাতের বাঁধন শক্ত করে বললো,

–আংকেল, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আমার ওয়াইফ, দিলওয়ারা জামান চৌধুরী। আর রাশা, ইনি আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড প্লাস ফ্যামিলি ল’ইয়ার, সুবোধ দত্ত।

রাশা অপ্রস্তুত হাসলো। সুবোধ বাবু অমায়িক হেসে প্রশ্ন করলেন,

–হ্যালো গার্ল! হাউ অ্যাবাউট ইউ?

–ফাইন আংকেল। থ্যাঙ্কিউ!

–সো, ডু ইউ ওয়ার্ক? আমার আবার সবার কাজকর্ম জানতে বড়ই ইচ্ছে হয়।

রাশার মুখটা থমথমে হয়ে গেলো৷ রাশা বেশ জানতো, স্যার এমন কিছু অবশ্য অবশ্যই করবে। সেও ছাড় দিলো না। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললো,

–হাউজ হেল্পারের কাজ করি আংকেল। বিশ হাজার টাকা বেতনের। খুব ইজি কাজ৷ দশ মিনিটে ম্যাজিকের মতো কাজ শেষ হয়। আপনার বাড়িতে দরকার হলে বলবেন।

সুবোধ বাবু হকচকিয়ে গেলেন। উষির অপ্রস্তুত হয়ে রাশার হাতে খানিক চাপ দিলো। চোখের ইশারায় বললো, এসব কি উল্টাপাল্টা বলছো!
উষির পরিস্থিতি সামাল দিয়ে হেসে বললো,

–মজা করছে আংকেল। ও আবার মজা করতে খুব পছন্দ করে। বাদ দিন ওর কথা। আপনার ইনভিটেশন রইলো। বাড়িতে অবশ্যই আসবেন।

সুবোধ বাবুও হকচকানো ভাব সামাল দিয়ে উচ্চস্বরে হাসলেন। বললেন,

–সিওর সিওর। তোমাকেও খুব শীগ্রই আমার বাড়িতে ডিনারের ইনভাইট করবো। শুধু তোমার আন্টি বাড়ি ফিরুক। হলিডে-তে আবার ঘুরতে গেছে তার সিঙ্গেল ফ্রেন্ডদের সাথে।

–আপনারও যাওয়া উচিৎ ছিলো আংকেল। সিঙ্গেল বয় সোসাইটি থেকে খুব ভালো টুর প্ল্যান করেছে। আমিও যেতাম বাট আমাকে ওই ক্লাব থেকে বাতিল ঘোষণা করে দিয়েছে।

ভীষণ মজার কোন কথা শুনেছেন, এমন ভাবে সুবোধ বাবু আবারও উচ্চশব্দে হাসলেন। তারপর কি মনে করে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়েই তাড়াহুড়ো করে বললেন,

–আমার একটা কাজ আছে৷ আজকে আসছি৷ বায় বায় হ্যাপি কাপল।

উষির মুচকি হেসে মাথা হেলিয়ে সায় জানালো,

–বায় আংকেল।

সুবোধ বাবু চলে যেতেই রাশার হাতে টান পরলো। উষিরের হাসিখুশি মুখশ্রীতে আবার গাম্ভীর্য চলে এসেছে। সামনের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে থমথমে গলায় বললো,

–ভেতরে চলো।

রাশা নিজের ইচ্ছায় গেলো না। উষির একপ্রকার জোর করেই ভেতরের একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। সামনের চেয়ারে রাশা বসে আছে। একফাঁকে ফোন বের করে স্যারকে মেসেজ পাঠাতেও ভুললো না,

“আপনার নামটাই শুধু সুবোধ স্যার। আপনি কাজে মোটেও সুবোধ না। কাল যে দুই প্লেট বিরিয়ানি আর চিকেন কাবাব খেলেন, সাথে এক প্লেট গোলাপজাম। সবটা ভিডিও করে রেখেছি৷ ম্যামকে পাঠিয়ে দেবো। উইথ বিল। আপনিই তো বলেন স্যার, উকিলদের কিচ্ছু ভুলতে হয় না।”

ফিরতি মেসেজও প্রায় সাথে সাথেই আসলো,
“তোমার সকল ডকুমেন্টের কপি, আইডিকার্ড, কেস ফাইল, সবকিছু কুরিয়ার করে তোমার শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেবো।”

কি সাংঘাতিক, কি মারাত্মক! রাশার বিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে উষির প্রশ্ন ছুড়লো,

–তুমি আংকেলকে চেনো?

রাশা হকচকানো ভাব দমিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

–কেনো?

–একসাথে বসে কফি খাচ্ছিলে দেখলাম।

রাশা খানিক ভাবলো৷ তারপর হাসার চেষ্টা করে বললো,

–উনি একা বসে কফি খাচ্ছিলেন। আমিও একা বসে কফি খাচ্ছিলাম। আমাকে দেখে বললো তুমিও একা, আমিও একা। চলো একসাথে কফি খাই।

উষির অদ্ভুত দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকালো। রাশা কথা ঘুরানোর চেষ্টায় বললো,

–তুমি কিভাবে জানলে?

–বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যায়। সেটা খেয়াল রেখে বসা উচিৎ ছিলো।

রাশা চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে কফিশপের বাইরের দিকে তাকালো। আয়নার মতো সাদা ঝকঝকে গ্লাস দিয়ে দেয়াল বানানো। কাপলদের জন্য একদম উপযুক্ত নয় জায়গাটা। বিড়বিড় করলো সে,

–এইজন্যই কফিশপটা এতো ফাঁকা।

পরক্ষণেই আরেকটা প্রশ্ন করলো,

–তুমি এখানে কি করছো? মানে কেনো এসেছো?

–দুই দলের মারামারি লেগেছিলো। সেটা থামাতেই এসেছিলাম। গাড়ি এই কফিশপের পার্কিং এড়িয়াতেই রেখে গিয়েছিলাম।

রাশা ব্যাঙ্গ করে বললো,

–লাঠি হাতে মারামারি থামাতে এসেছো?

–তোমাকে মারতে লাঠি এনেছিলাম।

রাশা চমকে উঠলো। উষির নির্বিকার, নিস্প্রভ। রাশা নিজের চমকানো ভাব সরিয়ে কৌতুহলী গলায় বললো,

–আমাকে মারতে কেনো?

–কারো সাথে বসে কফি খাচ্ছিলে কেনো? সুবোধ আংকেলের জায়গায় অন্য কেউ হলে লাঠিটা আর ফেরত পাঠাতাম না।

রাশা বিস্ফোরিত নয়নে উষিরের দিকে তাকালো। উষির চেয়ারে সোজা হয়ে বসে তার দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাত ভাজ করে বুকের কাছে বাঁধা। রাশা উদ্ধিগ্ন স্বরে বললো,

–লুক অ্যাট ইউ উষির, এটা কি তোমার বাচ্চামো করার বয়স? বি ম্যাচিউর।

উষির স্থির গলায় বললো,

–তো কি এটা আমার মিথ্যা বলার বয়স?

রাশা হকচকিয়ে গেলো,

–মিথ্যা?

–একসাথে এক ঘন্টা বসে গল্পগুজব করার পর আমার সামনে অচেনার ভাণ করাটা মিথ্যা না?

রাশা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। উত্তর দিতে পারলো না। ওয়েটার আসলো অর্ডার নিতে। উষির মেন্যুকার্ড ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখলো না। রাশার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে টানটান গলায় বললো,

–এখানে যত রকমের কফি আছে সবগুলোই একটা করে আনুন।

রাশার মুখ হয়ে গেলো,

–এতো কফি কে খাবে?

–তুমি।

রাশা উত্তেজিত হলো,

–আমি? পাগল হয়েছো নাকি?

উষির উত্তর দিলো না। পালটা প্রশ্ন করলো,

–আংকেলের সাথে এতোক্ষণ কি কথা বললে?

রাশা দমে গেলো। থমথমে গলায় বললো,

–ইট’স গেটিং পারসোনাল।

উষির কিছুই বললো না। মুখ দেখে তার চিন্তাভাবনা বোঝার উপায় নেই। রাশা হাল ছেড়ে দিয়ে ফ্যাকাসে গলায় বললো,

–শুধু শুধু খাবার নষ্ট করো না প্লিজ। আমি কফি খেয়েছি। আর খেতে পারবো না।

উষির এবারেও কোন উত্তর দিলো না। রাশা হাঁপ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

–এখন যদি আমি সেট মেনু খেতাম তাহলে কি সব ধরনের সেট মেনু অর্ডার করতে?

উষির সোজা হয়ে হাত টেবিলের উপর রাখলো। একটু ঝুঁকে বললো,

–সেট মেনু খেতে ইচ্ছে করছে? ওয়েট!

রাশা না না করতে করতেই উষির ওয়েটারকে ডাক দিলো। ওয়েটার আসলো বড় ট্রে ভর্তি সাত আট মগ কফি নিয়ে। রাশা হা হয়ে গেলো। উষির সেদিকে ফিরেও তাকালো না। ওয়েটারকে বললো,

–আপনাদের এখানে সেট মেনু আছে?

ওয়েটার বিনীতভাবে উত্তর দিলো,

–সরি স্যার। আমাদের এখানে কোন সেট মেনু নেই। এখানে আপনি যাবতীয় সফট ড্রিংকস, চা, কফি পাবেন। আর কিছু চাই স্যার?

রাশা উত্তর দিলো৷ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–হ্যাঁ চাই। আরো দশ বারো রকমের কফি এখানে মিসিং। দ্রুত সেগুলোও অ্যাড করুন।

–সিওর ম্যাম। এনিথিং ইলস?

উষির চাপা হাসলো। ওয়েটার চলে যেতে রাশা বড় বড় শ্বাস ফেলে বললো,

–কফিশপে সেট মেন্যু কে খোঁজে?

–তুমিই তো বললে, আমি পাগল। পাগলরা সব পারে। বইয়ের দোকানে গিয়ে জামাকাপড়ও খুঁজতে পারে।

রাশা কপাল চাপড়ালো। বিড়বিড় করে বললো,

–আনবিলিভেবল!

রাশা বাড়ি ফিরলো, সাথে করে নিয়ে আসলো মাথা ভর্তি চিন্তা। চিন্তার শুরুটা উষিরকে দিয়েই শুরু আবার শেষটাও তাকে দিয়েই শেষ। উষির কি সন্দেহ করলো, তার কথা বিশ্বাস করেছে নাকি, তার পেছনে এখন ইনভেস্টিগ করবে নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। চিন্তা চিন্তাই ঘুমাতেও পারলো না ভালো করে। কিছুক্ষণ পর পর ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। উষির না পেরে কপালে হাত দিয়ে শান্ত করলো তাকে। কিছুটা শান্ত হলো আবার কিছুটা অশান্তি লেগেই থাকলো। সারারাত উষিরের ঘুম হলো না। শিউরে বসে রইলো। রাশার ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখশ্রী থেকে চোখ সরাতে পারলো না। ড্রিম লাইটের হালকা সবুজ আলোতে রাশার হালকা লালচে মুখের চিন্তিত ভাবটা তার নজরে পরলো।

–এই পিচ্চি মেয়েটার এতো কিসের চিন্তা!

পরক্ষণেই কথাব পালটে ফেললো,

–পিচ্চি তো না। উড়নচণ্ডী মেয়ে একটা! এক মূহুর্ত শান্ত থাকে না। তার আবার এতো কিসের চিন্তা থাকতে পারে?

চলবে…