Friday, August 1, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 64



তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-০৪

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব:৪

মুখ ভার করে স্ত্রী আর তার বড় বোনের কথা শুনছে কবির শাহ। এখনো নিজে থেকে কিছু বলা শুরু করেনি সে।

মার্জিয়া বেগম খুশিতে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। কথা বেঁধে যাচ্ছে মুখে। যদিও ছেলেকে তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। তার মেয়েটার সাথে একদমই মানায় না। তবুও কি হয়েছে? মেয়ের বাবা তো বয়সকালে অত্যন্ত সুদর্শন ছিলো। তাতে লাভটা কি হয়েছে? সারাজীবন অভাবের সাথে আপোষ করে চলতে হয়েছে।
মর্জিনা বেগম মুখে একটা পান দিয়ে বললো,”শোন মার্জিয়া, সোনার আঙটি বাঁকাও ভালো। ছেলে খুব একটা ভালো দেখতে না। কিন্তু একবার ভেবে দেখ, তোর মেয়েকে রানী বানিয়ে রাখবে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সোনায় মুড়িয়ে দিবে। যখন গাড়ি থেকে নেমে এসে তোকে জড়িয়ে ধরবে তখন বুঝবি সুখ কাকে বলে।”
মার্জিয়া বেগম স্মিত হেসে বললো,”পুরুষ মানুষের চেহারা দিয়ে কি হবে? টাকা থাকলেই হবে।”
কবির শাহ স্ত্রীর দিকে শান্ত চোখে তাকায়। মার্জিয়া বেগম তার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
“তা মার্জিয়া, এখন বল বিয়ের দিন কবে ঠিক করতে চাচ্ছিস?”
মার্জিয়া বেগম মাথা নিচু করে বললো,”আমি আর কি বলবো? ওদের বাবা যা ঠিক করবে তাই হবে।”
কবির শাহ মুচকি হেসে বললো,”তোমার তাহলে মনে আছে যে মেয়েদের বাবা এখনো বেঁচে আছে?”
ঝাঁঝিয়ে ওঠে মর্জিনা বেগম।
“কি বলতে চাচ্ছো তুমি পরিষ্কার করে বলো কবির। সবসময় আমার বোনটার সাথে এভাবে কথা বলো তুমি। কোনোদিন ওকে সুখ-শান্তি দিলে না।”
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। মার্জিয়া চোখের ইশারায় বোনকে চুপ করতে বলে।
কিন্তু মর্জিনা বেগম চুপ করে না।
“আমি চাই প্রিয়তার বিয়ে এখানেই হবে। আমি ওর জন্য এক সেট সোনার গহনা বানিয়ে রেখেছি। বাদবাকি যা খরচ প্রয়োজন হলে আমিই দিবো। তবুও এমন সম্বন্ধ হাত ছাড়া করা যাবে না।”
কবির শাহ এতোক্ষণ পর উঠে দাঁড়ায়। মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো,”আমার মেয়েকে আমি এখানে বিয়ে দিবো না। আপনার বোনের জিদের জন্য আমি রাজি হয়েছিলাম মেয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তার মানে এটা নয়, মেয়েকে আমি সারাজীবনের জন্য দাসী বানিয়ে রাখবো।”
মর্জিনা বেগম অবাক হয়ে বললো,”দাসী বানিয়ে রাখবে মানে?”
“আপনি নিজে কানে শুনলেন না, ওরা কি বললো? ওদের বাড়িতে মেয়েদের বেশি পড়াশোনার কালচার নেই। বিশেষ করে বাড়ির বউদের। তাদের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরেই কাটিয়ে দিতে হয়। দেখুন, আমি রান্না করা বা ঘরের কাজ করাটাকে ছোট করে দেখছি না। প্রত্যেকটা মেয়েই এটা কমবেশি করে। যদি আমার মেয়ে পড়াশোনা না করে ঘর গুছানোতেই মন দিতে চাইতো আমি কখনো মানা করতাম না। কিন্তু আমার মেয়ে পড়তে চায়। ও যতোদূর যেতে চায় পড়াশোনার জন্য, আমি ওকে যেতে দিবো। বাবা হিসেবে এটা আমার কর্তব্য।”
মার্জিয়া বেগম চুপ করে থাকে। সে জানে তার স্বামী সহজে রাগে না। আর একবার অতিরিক্ত রেগে গেলে তাকে থামানো যায়না কোনোভাবেই। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”বিদুষী বানাবে মেয়েকে? ঘরে বসিয়ে বুড়ি বানাবে?”
কবির শাহ দুই সেকেন্ড চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”যদি পড়াশোনা শেষ করতে করতে ওর বুড়ি হয়ে যেতে হয়, তবে তাই হবে।”
“মার্জিয়া ওকে বোঝা, ও ভুল করছে। মেয়েদের ভালো বিয়েটাই সব। এতো পড়াশোনা করে কোনো লাভ নেই।”
কবির শাহ ম্লান হেসে বললো,”তাই নাকি আপা? তাহলে সেতারার চোখের নিচে কালি কেনো? ওকে দেখলে সবসময় কেনো মনে হয় ও খুব কষ্টে আছে? কিসের কষ্ট ওর? বাড়ি, গাড়ি, প্রাচুর্যতা দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে ওর স্বামী ওকে। তবুও ওর সেই সৌন্দর্য হারিয়ে গেলো কেনো? আপনি মা হয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন কখনো?”
মার্জিয়া বেগম ভয়ে ভয়ে কবির শাহের হাত চেপে ধরে বললো,”তুমি চুপ করো।”
“চুপ করেই এতোদিন ছিলাম মার্জিয়া। শুধুমাত্র সংসারে শান্তি বজায় রাখার জন্য এতোদিন তোমার উপর কোনো কথা বলিনি। এই সংসারে কোনো সিদ্ধান্ত তুমি আমাকে নিতে দিয়েছো? মেয়েদের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপা। ওরা ওদের পছন্দ মতো কিছু কিনতে পর্যন্ত পারেনি কখনো। নেহাৎ আমার মেয়ে দু’টো শান্ত, কোনোদিন তোমার মুখের উপর কিছু বলার সাহস পায়নি বলে চুপচাপ তোমার কথা শুনেছে। আর তোমার কথাই বা বলছি কেনো? তোমাকে সব মন্ত্র তো উনি শিখিয়ে দেয়। তুমিও অক্ষরে অক্ষরে বোনের সব কথা পালন করো। তার একটাই কারণ, উনার অগাধ টাকা আছে। টাকা দিয়ে উনি তোমাকে কিনে রেখেছে৷ সেই সাথে আমার মেয়ে দু’টোকেও কিনতে চায়। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে তা কখনো হতে দিবো না। এতোদিন চুপ করে ছিলাম মানে এটা নয় যে, আমার মেয়ের জীবনের এতো বড় সর্বনাশের সময়ও আমি চুপ করে থাকবো।”
কবির শাহ এবার মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”কি যেনো বলছিলেন আপা কিছুক্ষণ আগে? মেয়ে যখন গাড়ি থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরবে তখন বুঝতে পারবো সুখ কি জিনিস? কিন্তু আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো আপা। গাড়ি থেকে নামা মেয়েটার চোখের নিচে যখন একরাশ কালি দেখতে পান, বিষাদে ছেয়ে যাওয়া মুখ খানা দেখতে পান, তখন সুখটা ঠিক ঠাওর করতে পারেন তো?”
মার্জিয়া বেগম কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো বিয়ে করা মানেই মেয়েদের সর্বনাশ হওয়া?”
“কখনোই না। জীবনটা যদি একটা সঠিক মানুষের সাথে মিলে যায়, তবে সেই জীবন সুখ ভরে ওঠে কানায় কানায়। টাকা কম থাক, তবুও মনে শান্তি থাক। আচ্ছা, মার্জিয়া তুমি কখনো বলতে পারবে আমি তোমাকে কোনোদিন কিছু নিয়ে জোর করেছি? বিয়ের আগে থেকেই গল্পের বই পড়ার ঝোঁক ছিলো তোমার প্রিয়তার মতো। এমন কতোদিন গেছে, গল্পের বই পড়তে পড়তে রান্না পুড়ে গেছে। আমি সেই পোড়া খাবার খেয়েছি হাসিমুখে। কোনোদিন তোমাকে রাগ করিনি, কেনো বই পড়েছো। বরং তোমাকে আমি বেতন পাওয়ার পর তোমার পছন্দের বই এনে দিয়েছি। আমি জানতাম, সংসারের চাপ বেড়ে যাওয়ার পর, সন্তান হওয়ার পর তুমি চাইলেও নিজের জন্য এটুকু সময় বের করতে পারবে না। এজন্য কোনোদিন তোমাকে তোমার শখ থেকে দূরে রাখিনি। কিন্তু যে ছেলে, বিয়ের আগেই আমার মেয়ের জীবনের শখ বিসর্জন দিতে বলে, তাকে রান্নাঘরে বন্দী হয়ে যেতে বলে সে কখনো আমার মেয়ের জন্য সঠিক নয়। আর সঠিক মানুষের সাথে জীবন না কাটাতে পারলে তাকে আমি সর্বনাশই বলবো।”
মার্জিয়া বেগম কোনো কথা বলতে পারেনা, চুপ করে যায়। তার স্বামী ভুল কিছু বলেনি। সেই কিশোর বয়স থেকেই গল্পের বইয়ের প্রতি তীব্র ঝোঁক তার। এই স্বভাবের জন্য কতো বকা খেয়েছে সে তার বাবা মায়ের কাছ থেকে। একটাই দোষ গল্পের বই পড়তে বসলে কোনোদিকে হুঁশ থাকতো না তার। এরপর বিয়ে হলো, কতোদিন রান্না পুড়িয়ে ফেলেছে সে গল্পের বই পড়তে যেয়ে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকতো, আবার তার স্বামী রাগ করে কিনা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, কবির শাহ কোনোদিন রাগ করতো না। বরং মিষ্টি করে হাসতো। আবার এই মানুষটাই বেতন পেয়ে তাকে নতুন গল্পের বই এনে দিতো। পরে প্রিয়তা জন্ম নিলো। আস্তে আস্তে দায়িত্ব বাড়লো। এখন সেই ইচ্ছাটাই আর নেই বই পড়ার। তবে তার বড় মেয়ে তার এই স্বভাবটা ভালোই আয়ত্ত করেছে। মায়ের মতোই নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে যায় সে। আর আজ নিয়াজ নিজেই বললো এসব অভ্যাস নাকি ত্যাগ করতে হবে তাকে।
মর্জিনা বেগম রাগে কাঁপতে থাকে। তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে।
“মার্জিয়া তুই কি ভাবছিস?”
স্ত্রী কিছু বলার আগেই কবির শাহ ছোট্ট করে হেসে বললো,”প্রিয়তার কথা ভাবার জন্য তার বাবা আছে, মা আছে। বাইরের একজনের এতো না ভাবলেও চলবে। এতোদিন ভেবেছেন এতেই আমরা কৃতজ্ঞ।”
মর্জিনা বেগম হতভম্ব হয়ে বললো,”কি বললে তুমি? আমি বাইরের লোক?”
“আমাকে ভুল বুঝবেন না। নিজের মেয়ের ভালো থাকার সাথে আর কোনো আপোষ করতে আমি রাজি নই।”
মার্জিয়া বেগম ফ্যালফ্যাল করে একবার স্বামীর দিকে আর একবার বড় বোনের দিকে তাকায়। কোনদিকে কথা বলা উচিত সে বুঝতে পারেনা।
মর্জিনা বেগম এবার চিৎকার করে ওঠে।
“যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। আজ আমি কিনা বাইরের মানুষ হয়ে গেলাম? বলি, আমি কি ওদের খারাপ চাই?”
“দেখুন আপা, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি সেভাবে বলতে চাইনি…”
“চুপ করো তুমি। তোমার সাথে কোনো কথাই বলতে চাইনা আমি।”
মর্জিনা বেগম কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো,”আজ আমাকে এভাবে অপমান করলে তো? যেদিন মেয়ে একটা কেলেংকারী বাঁধাবে সেদিন এসো আমার কাছে। মেয়েকে এভাবে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে মাথায় তোলার পরিণাম একদিন ঠিক বুঝবে তুমি কবির। সেদিন কারো সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। এই দাম্ভিকতা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। নিয়াজের মতো ছেলে দূরে থাক, মুচি মেথরও পাবে না মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য।”
মার্জিয়া বেগমের বুক কেঁপে ওঠে। ভর সন্ধ্যেবেলা আপা এসব কি বলছে? রাগে হতবিহ্বল হয়ে কি যা নয় তা বলে যাচ্ছে সে খেয়াল আছে তার?
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে বললো,”সেই শিক্ষা আমি আমার মেয়েদের দিইনি আপা। ওরা আমার আদর্শে বড় হয়েছে। আমার বিশ্বাস আছে ওদের উপর। এমন ভুল ওরা কোনোদিন করবে না।”
মর্জিনা বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,”আগুন আর বারুদ পাশাপাশি রাখলে বিস্ফোরণ হবেই কবির। আজ হোক বা কাল, তুমি বুঝতে পারবে। তোমার আদর্শ মাটিতে মিশে যাবে সেদিন, আমার কথা মিলিয়ে নিও। তোমার মেয়ে আগুন, আর বারুদ তুমি নিজে ঘরে ডেকে এনেছো। আমার সাবধান করে দেওয়ার দরকার ছিলো আমি করেছি।”
মর্জিনা বেগম প্রচন্ড রাগে আর কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনা। নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”চলে আয় সেতারা, এখানে দাঁড়িয়ে থাকার আর কোনো প্রয়োজন নেই।”
সেতারা কবির শাহের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এই কঠিন রণমুর্তি যদি তার বাবাও ধারণ করতো, আজ তার জীবনটা এমন হতোনা। একটা মেকি সুখের লেবাস পরে সবার সামনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তাকে ক্লান্ত হতে হতোনা। কবির শাহ যেনো বুঝতে পারে মেয়েটার হাসির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিষাদ।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের সাথে বেরিয়ে যায় সে। মার্জিয়া বেগম আটকাতে যেয়েও পারেনা।
কবির শাহ তাকায় স্ত্রীর দিকে। মার্জিয়া বেগম নির্লিপ্ত চোখে শুন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে না আছে রাগ, না আছে কষ্ট আর না আছে অনুতাপ। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু কষ্টই হয় কবির শাহের।

সারাদিনটাই গুমোট হয়ে ছিলো পরিবেশটা। বিকালের পর থেকে পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছে। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। মাঝে মাঝে বিজলী চমকে উঠছে। বাতাসে যেনো উড়িয়েই নিবে সবকিছু। প্রশান্তির ঠান্ডা বাতাস, তীব্র গরমের শেষে। সবার মনেই কিছুটা স্বস্তি আসে। শুধু স্বস্তি নেই প্রিয়তার মনে। পাত্রপক্ষের লোকগুলো চলে যেতেই দৌড়ে ছাদে এসেছে সে। বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে, কোনোভাবেই লম্বা শ্বাস নিতে পারছে না। বাবার সাথে তার মা আর বড় খালার কি কথা হচ্ছে সে জানেনা। সে জানে, বাবা একা কিছুই করতে পারবে না। সারাজীবন এমনটাই দেখে এসেছে। বাবা কিছু বলতে গেলেই তার মা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। বাবা বাধ্য হয়ে সব মেনে নিয়েছে। আজও নিশ্চয়ই তাই হবে। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে তার ওই লোকটার সাথে। যে তার স্বপ্নগুলোকে প্রতিনিয়ত গলা টিপে মেরে ফেলবে। তার ডানা ছেঁটে একটা খাঁচার মধ্যে বন্দী করে রাখবে।
প্রিয়তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কেউ যেনো শক্ত করে তার গলাটা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সে চাইলেও কাঁদতে পারছে না। বোবা কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে থাকে।

মিনিট বিশেক পরই যেনো আকাশের বাঁধ ভাঙে। মেঘ থেকে ভেঙেচুরে প্রবল বর্ষণ নামে। প্রথম বড় বড় ফোঁটায়, এরপর অজস্র জল ফোঁটা ছুঁয়ে দেয় এতোদিন অতৃপ্ত হয়ে থাকা প্রকৃতিকে। ভেসে যায় সব খরা। আকাশ যেনো চিৎকার করে মেঘকে বলছে,”যা মেঘ যা, দেখিয়ে দে তোর ক্ষমতা। পৃথিবীর বুকে একবুক পিপাসা নিয়ে অতৃপ্ত হয়ে থাকা প্রতিটা প্রাণকে তোর অস্তিত্ব জানিয়ে দে। তোকে নিঙড়িয়ে প্রতিটা বারিত বর্ষণ থেকে তৃষ্ণা মিটিয়ে দে ওদের। আজ তোর পরীক্ষার দিন।”
মেঘও সায় দিয়েছে আকাশের কথায়। সামান্য দূরের জিনিসও ঠাওর করা যায়না বৃষ্টির গতিতে।
সেই একই সাথে বাঁধ ভাঙে প্রিয়তারও। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে ছাদের উপর। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। তার পরনের নীল কাতান শাড়িটা ভিজে জবজবে হয়ে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। কোমর ছাড়ানো লম্বা কোঁকড়া চুলগুলো খোঁপা থেকে আলগা হয়ে নেমে এসেছে কোমর পর্যন্ত। এলোমেলো হয়ে ভেজা চুলগুলো প্রিয়তার ঘাড়, গলা, হাতের বাহু আঁকড়ে ধরেছে।
প্রিয়তা হয়তো কোনোদিন জানতে পারবে না, এই অবস্থায় কতোটা মোহনীয় লাগছে তাকে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বেঁচে থাকলে হয়তো বাঙালি মোনালিসা এঁকে ফেলতেন এই শ্যামবর্ণা বাঙালি তরুণীর মোহনীয় রূপ দেখে।

“এভাবে নিজেকে কষ্ট দিলে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?”
চমকে উঠে প্রিয়তা তাকায় পিছনের দিকে। দুই হাত বুকে বেঁধে উচ্ছ্বাস তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার চোখে, চিবুকে, ঠোঁটে। ঘন চাপদাড়ি থেকে যেনো সেই জলের ফোঁটা গুলো মুক্তোর মতো গড়িয়ে পড়ছে। গাঢ় নীল শার্টটা পরনে মানুষটাকে মনে হচ্ছে, এই রঙটা শুধু তার জন্যই বানানো হয়েছে। সুতীক্ষ্ণ চোখজোড়া এতো কাছ থেকে এভাবে কখনো দেখেনি প্রিয়তা।
তিরতির করে ঠোঁট কাঁপতে থাকে প্রিয়তার। তা শীতল বৃষ্টির পানিতে নাকি প্রিয় মানুষটাকে এভাবে দেখে তা সে জানেনা।
“এভাবে তাকিয়ে না থেকে যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। এভাবে ভিজছো কেনো?”
প্রিয়তা নির্লিপ্ত গলায় বললো,”আপনিও তো ভিজছেন।”
উচ্ছ্বাস খোলা গলায় হাসে। প্রিয়তা মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখে।
“আমাদের কিছু হয়না প্রিয়তা। তোমরা অনেক আদরের, অল্পতেই তোমাদের অসুখ বেঁধে যায়। নিচে চলো।”
প্রিয়তা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। আলুথালু চোখে তাকিয়ে থাকে উচ্ছ্বাসের দিকে।
“কি হলো, নিচে চলো।”
“আপনি যান উচ্ছ্বাস ভাই। আমি যাবো না।”
উচ্ছ্বাস আবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে প্রিয়তার দিকে তাকায়। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে মেয়েটাকে গ্রীক দেবী বলে ভ্রম হয়।
“বাস্তবতা থেকে পালানো যায়না প্রিয়তা। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। এই দুনিয়ায় কেউ কারো নয়। তোমার কাছে শুধুমাত্র তুমি-ই আছো। আর কেউ না।”
“এতো কঠিন কথা আমি বুঝিনা উচ্ছ্বাস ভাই। আমি সাধারণ একটা মেয়ে, আমার চিন্তাভাবনাও সাধারণ।”
“তুমি সাধারণ নও, তুমি অসাধারণ একটা মেয়ে। যার এক চোখে সমরেশ মজুমদারের আট কুঠুরি নয় দরজা, অন্য চোখে হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে সেই মেয়ে সাধারণ হতে পারেনা। যে মেয়ের মননে কাজী নজরুল ইসলামের সঞ্চিতা, যার হৃদয়ে রবী ঠাকুরের চোখের বালি, সেই মেয়ে অসাধারণ। তার চিত্তজুড়ে এক জলপরীর অবাধ বিচরণ।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই সেই মানুষটা? যে কথায় কথায় তাকে কষ্ট দেয়, রুক্ষভাষী হয়ে ওঠে তাকে দেখলেই। সেই মানুষটা এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে? কি আসল পরিচয় এই মানুষটার?
সে কিছুদিন পরই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে এজন্যই কি এতো সুন্দর ব্যবহার করছে? প্রিয়তার বুকটা হু হু করে ওঠে।
“আপনি কীভাবে জানেন আমি উপন্যাস পড়তে এতো ভালোবাসি? আর এগুলোই আমার প্রিয় উপন্যাস এটা কীভাবে বুঝলেন?”
“আজ যখন তোমার ঘরে গিয়েছিলাম গীটার নিতে তখন তোমার টেবিলে বইগুলো দেখেছি। আর এই উপন্যাসগুলোর বইয়ের ভিতর বুকমার্ক দেখেছি। বুঝেছি পুরোনো বইগুলোই নতুন করে পড়ছো আবার। পছন্দ বলেই পড়ছো আবার।”
প্রিয়তার অবাক হওয়ার মাত্রাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কি প্রখর দৃষ্টিশক্তি মানুষটার। একদিকে নিয়াজ তাকে বই পড়ার জন্য সূক্ষ্মভাবে অপমান করলো, আর অন্যদিকে উচ্ছ্বাস বই পড়াটাকে কতো মহানভাবে তুলে ধরলো।
প্রিয়তার চোখের পাতা চুইয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকে।
“নিচে যাও প্রিয়তা। সবাই খুঁজবে তোমাকে।”
“কেউ খুঁজবে না। আমি এভাবেই হারিয়ে যেতে চাই।”
“জীবনটা গল্পের বইয়ের পাতার মতো গোছানো নয় প্রিয়তা। এভাবে হারিয়ে যাওয়া যায়না। যদি যেতো, সবকিছু হারিয়ে আমি এভাবে বেঁচে থাকতে পারতাম না।”
প্রিয়তার ভীষণ কান্না পায় উচ্ছ্বাসের কথা শুনে।
“আর হ্যা, বিয়েটা আপাতত হচ্ছে না তোমার। বিয়ে না হওয়ায় আবার কষ্ট পেয়ো না।”
হতভম্ব হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায় প্রিয়তা। সে কি মজা করছে?
“কি বললেন আপনি? মজা করছেন আমার সাথে?”
“তোমার মতো বোকা মেয়ের সাথে মজা করাটা দোষের কিছু নয় যদিও। তবুও আমি মজা করছি না। তোমার বাবা বিয়েটা হতে দিচ্ছেন না। এতে যদি কষ্ট পেয়ে থাকো, বাবাকে যেয়ে বলো তুমি বিয়ে করতে চাও।”
প্রিয়তার ইচ্ছা করছে খুশিতে লাফ দিতে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা সে।
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো,”এই মেয়ে তোমার টিপটা সরে গেছে, ঠিক করো।”
প্রিয়তা হাত দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করে। কিন্তু আরো বেঁকে যায়। প্রিয়তার ইচ্ছা করে উচ্ছ্বাসকে বলতে,’আপনি ঠিক করে দিননা।”
তার মন বলছিলো উচ্ছ্বাস ঠিক করে দিবে। কিন্তু উচ্ছ্বাস সেদিকে তাকায় না। দুই পকেটে হাত দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

“জানেন আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আমি বিয়ে করতে চাইনি এখন।”
উচ্ছ্বাস তার দিকে তাকায়। হাত দিয়ে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,”অনেক রাত হয়েছে, নিচে যাও।”
“আপনি যাবেন না?”
“আমি আরো কিছুক্ষণ ভিজবো।”
প্রিয়তা কিছু সময় চুপ থেকে মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললো,”আপনি তো বললেন সমস্যা মোকাবিলা না করে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। আপনি নিজেই সেই কাজ করছেন?”
প্রিয়তা ভেবেছিলো উচ্ছ্বাস রেগে যাবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে উচ্ছ্বাস হেসে দেয়। এই প্রথম এভাবে হাসতে দেখলো সে মানুষটাকে। একটা পুরুষ মানুষের হাসি এতো সুন্দর কেনো হবে? কেনো কেনো কেনো?
“আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিও তো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চা খেতে ইচ্ছা করছে।”
প্রিয়তার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব খুশি তার মনে ভিড় করেছে। খুশিতে যদি বাচ্চাদের মতো একটা চিৎকার দিতে পারতো ভালো হতো।
“কি হলো যাও।”
হালকা ধমকে কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। আজ কি ভীষণ আনন্দ যে তার লাগছে। পুরো পৃথিবীর আনন্দ একদিকে আর তার বুকের ভিতরের আনন্দ আরেকদিকে। একটু আগ পর্যন্তও তার মনে হয়েছিলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী মানুষটা হলো সে। আসলেই বৃষ্টির পানির অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মানুষের মন ভালো করে দেওয়ার।

ফিরতে ফিরতে প্রিয়তা তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। দূর থেকে মনে হচ্ছে মানুষটাকে একটা পাহাড়ের মতো মনে হচ্ছে। যে পাহাড় এক নিমিষেই তার মনটা ভালো করে দিলো। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে তার উচ্ছ্বাসকে। পরক্ষণেই নিজের চিন্তায় নিজের কান লাল হয়ে যায়। এসব কি ভাবছে সে?
ঝুমঝুম নুপুরের শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে সে। ঘরে ঢোকার মুখেই মা কে দেখে কেমন ভয় লেগে যায় তার। শীতল চোখে মার্জিয়া বেগম তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। সেই চাহনী দেখে হঠাৎ ভয় পেয়ে যায় প্রিয়তা।

(চলবে……)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-০৩

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব:৩

পা টিপে টিপে ছাদে আসে প্রিয়তা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের হাতটাও দেখা যায়না। অন্যদিন হলে সে ভয় ছাদের সিঁড়ির কাছেও আসতো না। অন্ধকার ভীষণ ভয় পায় সে। কিন্তু আজ সে জানে, তার ভয় নেই। এক জোড়া বলিষ্ট হাত তাকে আগলে রাখবে।
ছাদে উঠে দক্ষিণের দিকে তাকাতেই মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে প্রিয়তার। দূর থেকে এক বিন্দু আগুন দেখতে পারছে সে। মানুষটা ধূমপানেই নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিয়েছে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়তা সেদিকে তাকিয়ে।

বেশ কিছুক্ষণ উচ্ছ্বাসের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ইচ্ছা করেই সাড়াশব্দ করেনা। উচ্ছ্বাস জানতে পারলেই আবার কঠোর গলায় গাদা গাদা কথা শোনাবে তাকে। তারচেয়ে যতক্ষণ দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়, ক্ষতি কি?
উচ্ছ্বাস হাতের আধখাওয়া সিগারেটটা কি মনে করে টান দিয়ে দূরে ফেলে দেয়। কেমন যেনো তেতে আছে মুখটা। কিছুই ভালো লাগছে না তার। সবকিছু বিবর্ণ লাগে।
পাশে থাকা গীটারটা তুলে নেয় সে। টুংটাং করে আওয়াজ তোলে। কিছুতেই তার মনমতো হয়না। ইচ্ছা করে টান দিয়ে তারগুলো ছিঁড়ে ফেলতে।
অল্পতেই মেজাজ হারিয়ে ফেলে উচ্ছ্বাস ইদানীং। খুব কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে সে নিজেকে।

‘কবিতা
তুমি স্বপ্নচারিনী হয়ে খবর নিও না।
কবিতা
এই নিশাচর আমায় ভেবো না সুখের মোহনা।’

প্রিয়তা স্থাণুর মতো জমে যায় উচ্ছ্বাসের গান শুনে। কতোটা আবেগ দিয়ে একটা মানুষ এতো সুন্দর গান করতে পারে? সে ভেবে পায়না। চোখ জোড়া কেমন জ্বালা করতে থাকে তার। সে কষ্ট পেতে চায়না, তবুও বার বার বেহায়া মনটা কেনো জোর করে তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে?

গান থামিয়ে উচ্ছ্বাস গীটারটার উপর মাথা রেখে বসে থাকে কিছুক্ষণ। প্রিয়তা অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিছন ঘুরে তাকায়। এখন এই মানুষটাকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করছে না তার।

“কেনো এসেছো এখানে?”
প্রিয়তার শরীরে বিদ্যুত খেলে যায়। তার মানে উনি জানতেন যে ও এখানে? এখন কি খুব রাগ করবে ওকে লুকিয়ে গান শোনার অপরাধে? পিছনে ঘুরে তাকাতে ভয় করে প্রিয়তার।
উচ্ছ্বাস ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে। প্রিয়তা সেদিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছে এক জোড়া রাগী লাল চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়।
“এদিকে ঘুরে তাকাও।”
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে ঘোরে। চোখ বন্ধ করে একদমে বলতে থাকে সে।
“বিশ্বাস করুন, আপনাকে বিরক্ত করতে আসিনি আমি। আপনার গান শুনতেও আসিনি। দয়া করে আমাকে বকা দিবেন না।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”তুমি চোখ বন্ধ করে আছো কেনো? রাতকানা নাকি তুমি?”
প্রিয়তা অবাক হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। সে কি মজা করলো তার সাথে? কিন্তু তার চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না মজা করেছে। শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। চোখজোড়া একটু বেশিই শান্ত লাগছে।
“এইতো চোখ খুলেছো। এবার বলো এখানে কেনো এসেছিলে?”
প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে আস্তে আস্তে বললো,”আপনাকে ধন্যবাদ দিতে।”
উচ্ছ্বাস ঝট করে তাকায় প্রিয়তার দিকে।
“ধন্যবাদ দিতে মানে? আমাকে কেনো ধন্যবাদ দিবে তুমি?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে লাজুক সুরে বললো,”আমাকে বিরক্ত করে দেখে আপনি ওই বদমাশগুলোকে মেরেছেন। আজ আমি অনেক অনেক খুশি। পৃথিবীর সকল শব্দ দিয়ে ধন্যবাদ জানালেও কম হয়ে যাবে।”
উচ্ছ্বাসের মুখটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায়। প্রিয়তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায় সে।
“এসব কথা কে বলেছে তোমাকে? আমি কেনো এসব করতে যাবো? অদ্ভুত তো, নিজেকে ভাবো কি তুমি? তোমাকে কে বিরক্ত করলো না করলো তাতে আমার কি?”
প্রিয়তা কিছুটা ঘাবড়ে যায়। এরপর তার হঠাৎ মনে হয় নিশ্চয়ই ধরা দিতে চাইছে না বলে এসব বলছে মানুষটা।
প্রিয়তা মুখ টিপে হেসে বললো,”সে আপনি যাই বলেন, আমি জানি এসব আপনিই করেছেন। সকালে বখাটে গুলো যখন আমাকে বাজে কথাগুলো বলছিলো, তখনই আপনার মাথা গরম হয়ে গেছে। আর তারপরই আপনি প্রতিশোধ নিতে খুব মেরেছেন ওদের।”
উচ্ছ্বাস হঠাৎ প্রিয়তার চোখের দিকে তাকায়। তার চোখ কিছুটা লাল হয়ে আছে, অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে ভয়ানক লাগে।
“একদম চুপ। এটা কোনো সিনেমা চলছে না। আমি কোনো প্রতিশোধ নিইনি বুঝেছো? আমার কোনো দায় পড়েনি তোমার জন্য মারামারি করার। এটা নিয়ে আর একটা কথাও তুমি আমার সামনে বলবে না।”
হতভম্ব অবস্থায় প্রিয়তাকে রেখে রাগে লাল হয়ে উচ্ছ্বাস নেমে যায় নিচে। মুখ কালো হয়ে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারের মধ্যে। তার মন বলছে এই কাজ উনিই করেছেন। কিন্তু এভাবে অস্বীকার কেনো করলেন উনি?

পাশে তাকাতেই প্রিয়তা দেখে উচ্ছ্বাস ভুলে তার গীটারটা ফেলে চলে গেছে। ধরবে না ধরবে না করেও কি মনে করে গীটারটা তুলে ধরে সে। গীটারের তারের জায়গাটায় নাক ডুবিয়ে দেয় কিছু না ভেবেই। এখনো তো মানুষটার আঙ্গুলের ঘ্রাণ লেগে আছে ওখানে। হয়তো কখনো ভাগ্য হবে না কাছ থেকে উনার ঘ্রাণ নেওয়ার। এটুকুতে ক্ষতি কি? প্রিয়তার বুকটা কেমন করে ওঠে। ও নিজেই বুঝতে পারে না ও কেনো এমন পাগলামি করছে? এটা কি তার কাঁচা বয়সের আবেগ নাকি সত্যিই সে মনে প্রাণে উচ্ছ্বাস নামক এক আজব যুবকের প্রেমে পড়ে গেছে? যদি তাই হয় কি হবে এই ভালোবাসার পরিণতি? এই রহস্যময় পৃথিবীতে কাকতালীয় কিছুই কি ঘটে না? যদি ঘটে যায়? যদি সে চিরজীবনের জন্য আপন করে পায় ওই পাগল করা দৃষ্টির সুদর্শন যুবকটাকে? এটা কি তার জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার হবে না?
প্রিয়তা আকাশের দিকে তাকায়। গুমোট গরম পড়েছে। অনেকদিন বৃষ্টি নেই, প্রকৃতি উত্তপ্ত হয়ে আছে। সেই সাথে উত্তপ্ত হয়ে আছে তার মনটাও। প্রকৃতি আর তার মন দুই জায়গাতেই এখন প্রবল বর্ষণ দরকার। সেই বর্ষণে সব খরা কেটে শীতল হয়ে যাবে সব, প্রশান্তি নামবে হৃদয়জুড়ে।

প্রিয়তা ঘরে ঢুকতেই পেখম হুড়মুড় করে ছুটে এসে ঘরে দরজা লাগিয়ে দেয় ভিতর থেকে। গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার দিকে।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
“কি হয়েছে পেখম? এভাবে দরজা বন্ধ করে দিলি যে?”
পেখম কিছু বলতে যাবে তার আগেই দেখে তার আপার হাতে গীটার। খুব বেশি ভুল না হলে গীটারটা উচ্ছ্বাস ভাইয়ের। ওই গীটার তার আপার হাতে কেনো?
“তুই এই গীটার কোথায় পেয়েছিস?”
“কোথাও পাইনি। দয়া করে এখন একটু চুপ থাক। আমার খুব মাথা যন্ত্রণা করছে, আমি ঘুমাবো।”
প্রিয়তা গীটারটা তার মাথার কাছে রাখে। পেখম কিছু বলতে যেয়েও বলেনা।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পেখম মুখ ভোঁতা করে বললো,”আপা বাবা মায়ের মধ্যে বেশ বড় একটা যুদ্ধ বেঁধে গেলো কিছুক্ষণ আগে। তুই ছিলি না বলে কিছুই জানতে পারলি না। বাবা খুব রেগে গিয়েছিলো মায়ের উপর। মা ও কম যায়না। দুইজন মিলে খুব ঝগড়া করলো অনেকক্ষণ। এখন দেখছিস না পরিবেশ কেমন শান্ত। দুইজনই ঝগড়া করে হাঁপিয়ে উঠেছে। এখন বিশ্রাম করছে। বিশ্রাম নেওয়া শেষ হলে হয়তো আবার দ্বিতীয় অধিবেশন বসবে ঝগড়ার।”
প্রিয়তা ধড়ফড় করে উঠে বসে। বাবা মায়ের ঝগড়া তাদের বাড়িতে নতুন কিছু না,প্রায়ই হয়। তবে বেশিরভাগ সময় মা একাই বলে যায় সবকিছু, বাবা চুপ করে থাকে। আর মুচকি মুচকি হাসে। তবে বাবা রেগে যাওয়া মানে মোটেই সাধারণ কিছু হতে পারেনা।
“কথাটা একটু কম বল পেখম। তুই অতিরিক্ত কথা বলিস যেটা আমার পছন্দ না। মূল কথাটা বল। কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে বাবা মায়ের?”
পেখম ঢোক চেপে ফিসফিস করে বললো,”তোর বিয়ে নিয়ে।”
চমকে ওঠে প্রিয়তা।
“কি বললি তুই? কার বিয়ে?”
“তোর বিয়ে রে আপা। বড় খালা কোন বড়লোক ব্যবসায়ী ছেলের সম্বন্ধ এনেছে তোর জন্য। আগামীকালই নাকি ছেলেপক্ষ তোকে দেখতে আসতে চায়। কিন্তু বাবা কোনোভাবেই তোকে এখন বিয়ে দিতে রাজি নয়। এসব নিয়েই ঝামেলা বেঁধেছে দুইজনের মধ্যে।”
প্রিয়তার সামনে পুরো দুনিয়া কেমন দুলে ওঠে। অন্ধকার হয়ে আসে সবকিছু।
“জানিস আপা, বড় খালা নাকি এটাও বলেছে যে পছন্দ হয়ে গেলে খুব বেশি দেরি করবে না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করবে তারা।”
প্রিয়তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। এই দুর্যোগের জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না কোনোভাবেই। এটা কি শুনলো সে?
পেখম প্রিয়তার বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,”এই আপা, শুনছিস আমি বলছি?”
প্রিয়তা যন্ত্রের মতো বললো,”শেষ পর্যন্ত কি সিদ্ধান্ত হলো?”
পেখম ইতস্তত করে বললো,”মায়ের জিদের কাছে বাবা আপাতত হার মেনেছে। আগামীকাল পাত্রপক্ষ আসবে তোকে দেখতে। তবে বাবা বলেছে যে, বাবা ওদের সাথে কথা বলবে। তোর পড়াশোনা শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় চাইবে। যদিও মা আর বড় খালা চায় এখনই সেরে ফেলতে বিয়ের কাজ। তবে তুই একদম চিন্তা করিস না। বাবা যখন বলেছে পড়াশোনা শেষ না হলে তোর বিয়ে হবে না, তাহলে কোনোভাবেই হবে না। তুই দেখিস….”
পেখমের কোনো কথা কানে যাচ্ছে না প্রিয়তার। কান দিয়ে গরম ঝাঁঝ বের হচ্ছে শুধু। মায়ের জিদ ভয়ানক। মা একবার জিদ করলে বাবা কিছুই করতে পারবে না। যদি সত্যিই আর কিছু করার না থাকে? সত্যি সত্যিই অন্য একজনকে বিয়ে করে নিতে হবে তাকে? কি হবে তার স্বপ্নের? কি করবে এখন সে? পালিয়ে যাবে দূরে কোথাও? কিন্তু কোথায় পালাবে? আর পালালেও কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? তার বাবা একজন সম্মানিত শিক্ষক। অর্থের অভাব থাকলেও এলাকা জুড়ে তার সম্মান কম নয়। মানুষ যদি শোনে কবির স্যারের বড় মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে, তার বাবা তো বাইরে মুখ দেখাতে পারবে না। মেয়ে হয়ে বাবার এতো বড় ক্ষতি কীভাবে করবে? এসব একগাদা ছাঁইপাশ চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে তার মাথায়।
পেখম প্রিয়তার কোল ঘেঁষে বসে।
“আপা কি ভাবছিস?”
প্রিয়তা পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”ঘুমিয়ে পড়, অনেক রাত হয়েছে।”
প্রিয়তার কণ্ঠের উত্তাপ টের পায় পেখম। কষ্ট হচ্ছে তার আপার জন্য। কিন্তু সে কি করবে? বড় খালা তাদের পরিবারের মাথা বলা যায়। সেই ছোট থেকেই ওরা দেখছে, জোর করে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করে বড় খালা তাদের সবকিছুতে খবরদারি করে। আজ পর্যন্ত ওরা দুইবোন নিজেদের পছন্দ মতো কিছুই করতে পারেনা। বড় খালা সব ঠিক করবে। অষ্টম শ্রেণি পাশের পর কোন বিভাগে তারা পড়াশোনা করবে, এটা থেকে শুরু করে ঈদে কোন রঙের জামা তারা পরবে সব সিদ্ধান্ত নিবে বড় খালা। তার বাবা প্রতিবাদ করতে চায়। সে চায়, তার মেয়েরা অল্প পাক, কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিক। তার মায়ের তাতে খুব আপত্তি। তার কাছে তার বড় বোন পীর, আর সে সেই পীরের মুরিদ। তাকে যা বোঝানো হয়, সে তাই বোঝে। কোনো কিছুই চিন্তাভাবনা না করে বোনের কথামতো তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে, চিৎকার চেচামেচি করে। কবির শাহ শান্তিপ্রিয় মানুষ। অনেকটা চাপে পড়েই, সংসারের শান্তি বজায় রাখতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্ত্রীর কথা মেনে নেয় সে। যেমন আজও নিতে হলো। পেখমের ভীষণ কান্না পায় তার আপাটার জন্য। সে তো ভালো করেই বুঝতে পেরেছে তার আপা উচ্ছ্বাস ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু এ যে অসম্ভব। একটা এতীম, বাউন্ডুলে ছেলের কাছে তার মা জীবনেও মেয়েকে বিয়ে দিবে না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেখম পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

শুধু ঘুম নেই প্রিয়তার চোখে। বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে থাকে সে সারাটা রাত। দুই চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে টপটপ করে। যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাওয়ার যোগাড়। সেদিকে খেয়াল নেই প্রিয়তার। গীটারটা ছুঁয়ে দেখে মাঝে মাঝে। তখনই চাপা কষ্ট বাড়তে থাকে। এভাবেই একটা নির্ঘুম রাত কেটে যায় তার প্রচন্ড অস্থিরতার সাথে।

ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে আসে প্রিয়তার। সকালের সূর্যের আলো জানালা গলে মুখে এসে পড়ে। সাথে সাথে হুড়মুড় করে উঠে বসে সে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ বেশ ফুলে গেছে তার। তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। সারারাত ঘুম না হওয়ায় মাথা ঝিমঝিম করছে, বুকে ব্যথা করছে।
পাশে তাকাতেই দেখে পেখম নেই। ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। নয়টা বেজে গেছে অথচ কেউ তাকে ডাকেনি। একটু পরেই যে তার কলেজের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায় প্রিয়তা। শরীরটা ভীষণ দূর্বল লাগছে তার।

“এ কি রে মা, তুই উঠে গেলি?”
প্রিয়তা কিছুটা অবাক হয়ে তাকাতেই দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে মিষ্টি করে হেসে। সকালের এই সময় তো তার মেজাজ তুঙ্গে থাকে। আজ হঠাৎ কি ব্যাপার?
“মা তুমি?”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে ছুটে এসে মেয়ের কপালে হাত দেয়।
“তোকে এমন লাগছে কেনো? তোর শরীরটা কি খারাপ? রাতে ঘুম হয়নি?”
প্রিয়তা মুচকি হাসে, উত্তর দেয়না।
মার্জিয়া বেগম কি মনে করে মেয়ের হাত ধরে তাকে খাটে বসায়।
“মা তুমি কি কিছু বলবে? কলেজ থেকে এসে তোমার কথা শুনি? দেরি হয়ে গেছে একদম।”
“আজ তোকে কলেজে যেতে হবে না। আজ তুই বাড়িতেই থাকবি। সারাদিন রূপচর্চা করবি। কাঁচা হলুদ বাটা মুখে লাগিয়ে গোসল করবি। বিকালের দিকে তোর সেতারা আপা আসবে। সে তোকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবে। আমার গাঢ় নীল জমিনের কাতান শাড়িটা তোর খুব পছন্দ না? ওটা পরলেও তোকে দারুণ লাগে। ওটা পরতে দিবো আজ তোকে। একদম পুতুলের মতো লাগবে আমার মেয়েটাকে আজ।”
মার্জিয়া বেগম মুখ টিপে হাসে।
প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। একদমে কথাগুলো বলে গেলো তার মা। প্রিয়তা কিছু বলার সুযোগই পেলো না।
“মা আমার কথাটা শোনো….”
“এই রে, রান্না বসিয়ে এসেছি চুলায়। পুড়ে যাবে তো। বুঝিস তো, এতোগুলো মেহমান আসবে। সব আমাকেই করতে হবে। তোর বড় খালার মতো দশটা কাজের লোক তো নেই আমার। তুই উঠে পড়, আমি আসছি।”
প্রিয়তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মার্জিয়া বেগম চলে যায়। প্রিয়তা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে খাটের উপর।

প্রিয়তাকে বেশ মনোযোগ দিয়ে সাজাচ্ছে সেতারা। সেতারা মর্জিনা বেগমের বড় মেয়ে। তারও বিয়ে হয়েছে খুব বড় বনেদি ঘরে, ছেলের বেশ কয়েকটা ব্যবসা। অল্প বয়সে বিবাহিত সেতারার আগের রূপ নেই। এককালের ডাকসাইটে সুন্দরী দুই বাচ্চার মা হয়েই কেমন যেনো বুড়িয়ে গেছে। পড়াশোনাটাও শেষ করেনি সে।
“প্রিয়তা এভাবে মূর্তির মতো বসে আছিস কেনো বল তো তুই? মুখটা এমন ভোঁতা করে রাখলে যতোই সাজাই দেখতে ভালো লাগবে না।”
প্রিয়তার ইচ্ছা হলো চিৎকার করে বলে,’ভালো না লাগুক তাই তো চাই।’
কিন্তু মুখে বলতে পারেনা। ম্লান হাসে শুধু।
সেতারা কি মনে করে প্রিয়তার দুই বাহু ধরে তাকে নিজের দিকে ফেরায়।
“এই সত্যি করে একটা কথা বল তো, তোর কোনো প্রেমিক আছে নাকি আবার?”
প্রিয়তা চমকে তাকায় সেতারার দিকে। তার গলা কেঁপে ওঠে।
“দেখ বোন, ওসব চিন্তা মাথাতেও আনিস না। যদি কেউ থাকেও, তাকে ভুলে যা। এই আমাকেই দেখ না, কলেজে থাকতে একটা ছেলে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। বয়সের আবেগে আমিও গা ভাসালাম। এক অজানা সুখে ভাসছি তখন আমি। হঠাৎ মা বিয়ে ঠিক করে ফেললো তোর দুলাভাইয়ের সাথে। না বলার সুযোগ পেলাম না। কোটি কোটি টাকা রয়েছে, আর কি চাই? বিয়েটা হয়ে গেলো। এখন ভাবি, ভাগ্যিস মায়ের কথাটা শুনেছিলাম। এখনও আমার সেই পূর্ব প্রেমিক একরকম বেকার ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে বিভিন্ন পত্রিকায় ছদ্মনামে প্রেমের কবিতা লেখে। এখন যদি আমি তাকে বিয়ে করতাম আমি কি সুখী হতে পারতাম?”
প্রিয়তা স্মিত হেসে বললো,”তুমি কি এখনো সুখী সেতারা আপা?”
সেতারা থতমত খেয়ে বললো,”সুখী হবো না কেনো? আমি অনেক সুখী। আমার বর দুই হাতে টাকা কামায়। আমি যা চাই তাই এনে দেয়। চোখে হারায় আমাকে। একটা মেয়ে সুখী হওয়ার জন্য আর কি দরকার?”
প্রিয়তা আবারও ছোট্ট করে হাসে।
“তাহলে তোমার চোখের নিচে কালি কেনো সেতারা আপা? এই বয়সেই কেমন ম্লান হয়ে গেছে তোমার সৌন্দর্য। এতো প্রাচুর্যতা তোমাকে সুন্দর রাখতে পারেনি? খুব বেশি বয়স তো তোমার হয়নি।”
সেতারা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অতি সাবধানে। ভিতরের বোবা কান্নাগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে।
“সোনা বোন আমার, এখন বুঝবি না পরে বুঝবি। সুখী হতে গেলে টাকার প্রয়োজন আছে। অভাব ঘরে ঢুকলে, ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। তখন বুঝবি কাজলে চোখ কালো করার চেয়ে, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে চোখের নিচে কালি ফেলানো ভালো।”
প্রিয়তা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজা ধাক্কানোর শব্দে সেদিকে তাকায় ওরা দুইজন।

“কে?”
উত্তর আসেনা ওপাশ থেকে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
মিনিট দুই পরেই পেখম কাকে যেনো টানতে টানতে ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করে। প্রিয়তা ঘোর লাগা চোখে সেদিকে তাকায়।
“আরে আসুন না উচ্ছ্বাস ভাই, ভিতরে আসুন।”
উচ্ছ্বাস কঠিন গলায় বললো,”এ কি তুমি এভাবে হাত ধরে টানছো কেনো? আমি ভিতরে যাবো না বললাম তো। আমার গীটারটা এনে দাও।”
“আরে আসুন তো। নিজের গীটার নিজেই নিয়ে যান।”
জোরপূর্বক উচ্ছ্বাসকে নিয়ে ঘরে ঢোকে পেখম। সেতারা অবাক হয়ে সেদিকে তাকায়।
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা চোখে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে যেনো তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করে বসিয়ে রাখে সে।

প্রিয়তার দিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই অদ্ভুত একটা নেশা তৈরি হয় উচ্ছ্বাসের বুকের মধ্যে। গাড় নীল রঙা শাড়িতে মেয়েটাকে একটা পরীর মতো লাগছে। চোখে টেনে কাজল দিয়েছে, যেটা তাকে আরো শতগুণে মোহনীয় করে তুলেছে। কোমর ছাঁড়ানো লম্বা চুলগুলো মেলে রেখেছে। কানে একটা ছোট্ট সাদা ফুল গোঁজা। সামান্য এতোটুকু সাজে প্রজাপতির মতো স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে অষ্টাদশী কিশোরীটাকে। উচ্ছ্বাস উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মেয়েটা এতো আবেদনময়ী সুন্দরী, আগে বুঝতে পারেনি কেনো সে কখনো?
সেতারা কিছু বুঝতে না পেরে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”কি রে পেখম, তোর কি কোনোদিন আক্কেল হবে না? দেখছিস ওকে সাজাচ্ছি আমি। এরমধ্যে বাইরের একটা ছেলেকে কোন বিবেকে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে এলি?”
প্রিয়তার ইচ্ছা করছে বলতে,’সেতারা আপা উনি বাইরের কেউ না। আমার কাছের, আমার অনেক কাছের।’
সেতারার কথায় ধাতস্থ হয় উচ্ছ্বাস। ছি ছি, এ কি করছে সে? এ যে অন্যায়। যে মানুষটা তাকে আশ্রয় দিয়েছে, তার ক্ষতি সে কোনোদিন করতে পারবে না। সে শুনেছে আজ মেয়েটাকে দেখতে আসবে, সব ঠিক থাকলে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে। এই সময় অন্য কোনো চিন্তা করা শুধু অন্যায় নয়, পাপ।

উচ্ছ্বাস মাথা নিচু করে স্বভাবত কঠিন গলায় বললো,”আমার গীটারটা কোথায়? ওটা ফিরিয়ে দাও।”
প্রিয়তার গীটার ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিলোনা। সারাজীবন ওটা তার কাছে রাখতে চায় সে। কিন্তু যার জিনিস তাকে ফেরত তো দিতেই হবে।
কাঁপা কাঁপা হাতে গীটারটা তুলে উচ্ছ্বাসের দিকে বাড়িয়ে ধরে। উচ্ছ্বাস এখনো অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। গীটারটা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। প্রিয়তা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মন বলছিলো উনি আর একবার ফিরে তাকাবে তার দিকে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে উচ্ছ্বাস ওভাবেই বেরিয়ে যায়। প্রিয়তা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্তোর্পণে।

বসার ঘরে তিনজন মহিলা আর চারজন পুরুষ বসে আছে। তাদের চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিবেশ পছন্দ হচ্ছে না তাদের। শুধুমাত্র মর্জিনা বেগমের জন্য তারা চুপ করে আছে।
কবির শাহ এক কোণায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেকে একটুও পছন্দ হয়নি তার। বয়স কম করে হলেও আটত্রিশ থেকে চল্লিশ হবে। মাথার সামনের দিকে হালকা টাক পড়েছে। উচ্চতাও বেশি নয়। তার এতো কম বয়সী মেয়ের সাথে একেবারেই বেমানান। কবির শাহ চুপ করে থাকে। এখনই কিছু বলার সময় নয়।
মর্জিনা বেগম খুশিতে ঝলমল করছে। এক এক করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে কবির শাহ আর মার্জিয়া বেগমকে।
“উনি হলো ছেলের বাবা, আর তার পাশে ছেলের চাচা আর ফুপা। মাঝে যে বসে আছে সে পাত্র। আর উনি ছেলের মা, ছেলের ফুপু আর তার পাশেই ছেলের চাচী।”
ছেলের মা রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললো,”আপা মেয়েকে আনুন। বেশিক্ষণ বসতে পারবো না। ছোট ঘরে বড্ড গরম।”
কবির শাহের কান গরম হয়ে যায়। স্ত্রীর দিকে তাকাতেই দেখে সে খুশিতে ডগমগ করছে। কোনো কথাই কানে যাচ্ছে না তার। খুশি হবে না কেনো? সে যা চায় তাই তো পাচ্ছে। দুই গাড়ি ভর্তি করে ছেলেরা এসেছে। এতো দামী গাড়ি দেখে এলাকার লোক ভীড় করেছে বাড়ির চারপাশে। মার্জিয়া বেগমের এতেই শান্তি।

মর্জিনা বেগম রাগী চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে।
“কোন আক্কেলে এমন নীল শাড়ি পরলি তুই? তোর গায়ের রঙের সাথে এই রঙের শাড়ি যায়?”
সেতারা পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে পাশে।
“তোর যা গায়ের রঙ, তাতে গোলাপী বা কমলা পরলেই ভালো হতো। এখন তো তোকে আরো কালো লাগছে।”
প্রিয়তা স্থির চোখে মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি তো কালোই খালাম্মা। তারা যদি এভাবে আমাকে দেখে পছন্দ না করে, না করবে। আমি তো পানিতে পড়ে যাইনি।”
“শোনো মেয়ের কথা। খুব তো মুখে মুখে কথা শিখেছিস। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, উনাদের সামনে কোনো বেয়াদবি করবি না।”
প্রিয়তা ছোট্ট করে হেসে বললো,”নিশ্চিন্তে থাকুন খালাম্মা, আমার বাবা আমাদের বেয়াদবির শিক্ষা দেয়নি। কোনোদিন যখন করিনি, আজও করবো না।”
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

বিশাল ব্যবসায়ী নিয়াজ মোর্শেদ। প্রিয়তার সাথে একান্তে কথা বলার অনুমতি চেয়েছে। কবির শাহ কিছু বলার আগেই মর্জিনা বেগম জোর করে তাকে নিয়ে এসেছে প্রিয়তার ঘরে। প্রচন্ড অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রিয়তা এসেছে পিছু পিছু।
নিয়াজ টেবিলে সাজানো প্রিয়তার গল্পের বইগুলো দেখছে গম্ভীর মুখে। প্রচুর গল্পের বই প্রিয়তার, বলতে গেলে সে গল্পের বইয়ের পোকা।

প্রিয়তা এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
নীরবতা ভঙ্গ করলো নিয়াজ।
“এই বইগুলো কার?”
প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় বললো,”জ্বি আমার।”
“খুব গল্পের বই পড়ো বুঝি।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। কেমন যেনো খুব বিরক্ত লাগছে তার।
নিয়াজ হঠাৎ বইগুলো টেবিলে রেখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। তার মুখ হাসি হাসি।
“গল্পের বই পড়ার অভ্যাস বাদ দাও।”
প্রিয়তা ভীষণভাবে চমকে উঠে নিয়াজের দিকে তাকায়। হজম করতে পারেনি সে কথাটা।
“এসব বাজে অভ্যাস আমার পছন্দ নয়। বাড়ির বউ সারাদিন বইতে মুখ গুঁজে গল্পের বই পড়বে এই দৃশ্য অত্যন্ত বিরক্তিকর। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও রান্নাঘরের কাজ বাড়ির বউরাই করে, আর এটাই নিয়ম আমাদের বাড়ির। তাই তোমাকেও তাই করতে হবে। তখন এসব আজেবাজে অভ্যাস চাইলেও ধরে রাখতে পারবে না। স্ত্রী যতো কম জ্ঞানী, ততই পরিবারে শান্তি।”
রাগে কাঁপতে থাকে প্রিয়তা। উত্তর দেওয়ার মতো ভাষাও যেনো নেই তার। ভদ্রতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই লোকটা একটা বদমাশ, সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।
“যে সংসারের ঘরনী কম বোঝে, সেই সংসারে শান্তি বেশি। বেশি বুঝলেই শান্তি নষ্ট।”
প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”আপনি ধরেই নিয়েছেন যে এই বিয়েটা হবে?”
নিয়াজ হাসে, এতো কুৎসিত হাসি আগে দেখেনি প্রিয়তা। রাগে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে সে।

নিয়াজ প্রিয়তার অনেকটা কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”প্রচুর টাকা আর বিত্ততার মধ্যে বড় হয়েছি আমি। ছোট থেকে যা চেয়েছি সব পেয়েছি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তাই তোমাকেই বিয়ে করবো আমি। সে তুমি চাও বা না চাও।”
প্রিয়তা ঝট করে তাকায় নিয়াজের দিকে। এখনো হেসে তাকিয়ে আছে সে। প্রিয়তার কঠিন রক্তিম দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নিয়াজ।

(চলবে……)

তুমি প্রেম হলে আমি প্রেমিক পর্ব-০২

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২

“অসম্ভব, আমার মেয়েকে আমি এখন বিয়ে দিবো না। মেয়ে পড়াশোনা শিখবে আগে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তারপর অন্য কথা চিন্তা করবো।”
মার্জিয়া বেগম স্বামীর কথায় বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকায়।
কবির শাহ নরম গলায় বললো,”আমার কথা শুনো প্রিয়তার মা। আমি একজন শিক্ষক। আমি অন্যদের শিক্ষা দিই, মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব। সেখানে আমার নিজের মেয়েকে যদি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিই, মানুষ কি বলবে?”
মার্জিয়া বেগম চোখ লাল করে বললো,”তার আগেই মেয়ে যদি কোনো কেলেংকারী করে বসে? সেই দায় কে নিবে? এরপর কি মেয়েকে আর বিয়ে দিতে পারবে?”
কবির শাহ হতবাক হয়ে বললো,”এসব কি বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার? কি কেলেংকারী করবে আমার মেয়ে?”
“আমার মাথা ঠিক আছে। ঘরে যে প্রাপ্তবয়স্কা দুইটা মেয়ে আছে সে খেয়াল তোমার নেই। বাইরের একটা ছেলেকে ঘরে এনে তুলেছো। ওদের বয়সটাই তো ভুল করার। যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় সেই দায়ভার কে নিবে? ওই ছেলে তো এতীম, ওর কোনো পিছুটান নেই। ও একটা অঘটন ঘটিয়ে কেটে পড়বে। কিন্তু আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে?”
কবির শাহ আরো অবাক হয়ে বললো,”তুমি কি উচ্ছ্বাসের কথা বলছো?”
মার্জিয়া বেগম দাঁত কিড়মিড় করে।
“উচ্ছ্বাস মোটেই এমন ছেলে নয় মার্জিয়া। এসব ভুলভাল চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও।”
মার্জিয়া বেগম এবার একটু চিৎকার করে ওঠে।
“বেশ তো, তোমার ওই মহাপুরুষ ভাবলাম ফেরেশতা পর্যায়ের মানুষ। কিন্তু আমার মেয়ে তো নয়।”
কবির শাহ চুপ করে যায়। আসলেই কিছু বলার নেই তার। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে, এই কথাগুলো নিজে থেকে মার্জিয়ার মাথায় আসেনি। কেউ তার মাথায় ঢুকিয়েছে। হয়তো তার বড় বোন মর্জিনা বেগম এসব বলেছে। এসব কারণেই সে তার স্ত্রীর বড় বোনকে খুব একটা পছন্দ করেনা। তার স্ত্রী একটু রাগী হলেও সহজ সরল। কিন্তু যতবার তার বড় বোন এ বাড়িতে এসেছে, ততবারই মার্জিয়াকে কোনো না কোনো বিষয়ে কানপড়া দিয়ে বিষিয়ে তুলেছে সংসারের প্রতি।
কবির শাহকে চুপ থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় মার্জিয়া।
“আমার মতো অসুখী আমি আমার মেয়েদের হতে দিবো না। টাকা ছাড়া সুখ নেই। মেয়ে যদি সুখী হয়, তাতেই আমার শান্তি।”
কবির শাহ মুচকি হেসে বললো,”তুমি আমার সাথে অসুখী?”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা দমে যায়।
“হয় মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করবে নাহয় ওই ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করবে। এখন দেখো তোমার কোনটা ভালো মনে হয়।”
হনহন করে হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে যায় মার্জিয়া। কবির শাহ হতাশ মুখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

গান থামিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে প্রিয়তা আর পেখমের দিকে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাস। প্রিয়তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে, পেখম সেই তুলনায় হাসিখুশি।
“উচ্ছ্বাস ভাই, আপনি কিন্তু দারুণ গান করেন। চেষ্টা করলে বড় গায়ক হতে পারবেন।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে পেখমের দিকে তাকায়।
প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো,”নিচে চল পেখম।”
“আরে আপা দাঁড়া তো। উচ্ছ্বাস ভাই আরেকটা গান করুন না।”
উচ্ছ্বাস একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,”এখানে এসেছো কেনো তোমরা?”
পেখম হাসিমুখে বললো,”আসা কি নিষেধ? জানতাম না তো উচ্ছ্বাস ভাই। জানলে আসতাম না।”
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে একবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায় আর একবার বোনের দিকে। উচ্ছ্বাস রাগী মুখে পেখমের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু পেখমের সেদিকে খেয়াল নেই।
“কান খুলে শুনে রাখো তোমরা দুইজনই। আমার আশেপাশে তোমাদের যেনো আর না দেখি। একদম আমাকে বিরক্ত করবে না তোমরা।”
পেখম চোখ কপালে তুলে বললো,”আমরা আপনাকে বিরক্ত করেছি? আমরা তো চুপ করে আপনার গান শুনছিলাম। একটা কথাও বলিনি।”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না। হাতের আধখাওয়া সিগারেটটা পিষে ফেলে হাতের মধ্যেই।
প্রিয়তা আঁৎকে উঠে বললো,”আরে কি করছেন? আপনার হাত পুড়ে যাবে তো।”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝড়ের বেগে চলে যায় ওদের সামনে থেকে। খানিক বাদেই সিঁড়িতে তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।

প্রিয়তা মুখ ভার করে বললো,”কি দরকার ছিলো উনাকে রাগানোর বল তো?”
পেখম মুখ টিপে হেসে বললো,”তুই থাম তো আপা। উনার দেমাগ আমি বের করবো। একটু ভালো চেহারা আর ভালো গান করে দেখে অহংকারে পা মাটিতে পড়ে না। মজা বুঝাবো আমার।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”তার মানে কি? কি করতে চাচ্ছিস তুই?”
“আরে তুই দেখ না।”
“দেখ পেখম উল্টাপাল্টা কিছু করিস না। উনার বোধহয় পছন্দ না আমরা উনার সামনে আসি। যার যেটা পছন্দ না, কি দরকার তবে? উনাকে উনার মতো ছেড়ে দে।”
“না রে আপা, আমার মনে হয় না এটা উনার আসল রূপ। আমার কি মনে হয় জানিস?”
“কি?”
“উনার মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর আর নির্মল একটা শিশুসুলভ মানুষ বাস করে। কোনো এক পরিস্থিতির চাপে পড়ে উনি এমন হয়ে গেছে বা ইচ্ছা করে এমন করছে।”
প্রিয়তা জোর করে হাসার চেষ্টা করে। হাসতে পারেনা ঠিক। তার বোনকে বিশ্বাস নেই। সে যখন বলেছে কিছু একটা করবে তো করেই ছাড়বে।

সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছে পেখম। প্রিয়তাও আজ পেখমের সাথে একসাথেই কলেজের উদ্দেশ্যে বের হবে। মার্জিয়া বেগম এক হাতে নাশতা আর ওদের টিফিন বানাচ্ছে। মেজাজ আজকেও চড়ে আছে তার।
কবির শাহ উচ্ছ্বাসের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে ঘর থেকে। ছেলেটা যে কেনো এমন চেইনস্মোকার হয়ে গেলো সে বুঝতে পারছে না। ও তো এমন ছিলো না। ঘরে ঢুকতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করে সে।
“মামা আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?”
কবির শাহ অপ্রস্তুত হয়ে হাসে।
“ভিতরে আসুন।”

“বাবা তোমার এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? কোনো কিছুর দরকার হলে সোজা আমাকে বলবে। একদম লজ্জা করবে না।”
উচ্ছ্বাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কবির শাহ উচ্ছ্বাসের মাথায় হাত রাখে, উচ্ছ্বাস কিছুটা কেঁপে ওঠে।
“তোমার মনটা কি খারাপ বাবা?”
“একটা কথা বলবো মামা?”
“হ্যা বলো।”
“আমি আসায় আপনাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। আমি বরং চলে যাই।”
কবির শাহর মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়।
“এমন কথা বলছো কেনো তুমি? কেউ কি তোমাকে কিছু বলেছে?”
কবির শাহ খুব ভালো করেই জানে মার্জিয়ার ব্যবহারেই উচ্ছ্বাস এমন কথা বলছে।
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না, ছোট্ট করে হাসে। এতো সুন্দর হাসি দেখেও কবির শাহের বুকটা কেমন হাহাকার করে ওঠে। বিষাদে মাখা হাসিটা দেখে তার এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো?
“কারো কথায় কিছু মনে করবে না তুমি। আমি যতদিন বেঁচে আছি তুমি আমার কাছেই থাকবে। কেউ না জানুক, আমি জানি আমার দু:সময়ে যখন কেউ ছিলো না আমার পাশে, পেট ভরে খেতে পর্যন্ত পারতাম না তখন তোমার বাবা মা-ই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি যে এতোটা অকৃতজ্ঞ হতে পারবো না বাবা।”
উচ্ছ্বাস কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়।
“চলো আজ থেকে তুমি আমাদের সাথে টেবিলে বসে খাবে।”
উচ্ছ্বাস নিচু গলায় বললো,”না মামা, আমি ঘরেই খাবো।”
কবির শাহ উচ্ছ্বাসের হাত ধরে টেনে টেবিলের কাছে নিয়ে আসে।

পেখম আর প্রিয়তা মাত্রই খেতে বসেছে৷ মার্জিয়া বেগম তাদের খাবার দিচ্ছে। উচ্ছ্বাসকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। এতোদিন সে নিজের ঘরে বসেই খেতো।
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”প্রিয়তার মা ওকে এখানেই খেতে দাও। আজ থেকে ও আমাদের সাথে বসে খাবে।”
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকায়। মনে মনে বলে,’মা দয়া করে কিছু বলো না উনাকে, তোমার দোহাই লাগে। উনাকে কষ্ট দিও না মা।’
মার্জিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”বসে পড়ো, খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো সবাই।”
কবির শাহের মনটা ভালো হয়ে যায়। তার স্ত্রী বাইরে যতোই কঠিন হোক, ভিতরে তার মধ্যেও একটা মমতাময়ী মা বাস করে। পেখম বাঁকা চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা মুগ্ধ চোখে একদৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। ধূসর রঙা শার্টে একজন যুবককে এতো সুন্দর লাগতে পারে?

“উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাস কঠিন চোখে পেখমের দিকে তাকায়।
“যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলবো?”
“কি কথা?”
“আপাকে একটু কলেজ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবেন?”
“কি বললে তুমি? আমি এগিয়ে দিয়ে আসবো?”
“আসলে হয়েছে কি উচ্ছ্বাস ভাই, আমার স্কুল তো কাছেই। আপার কলেজ আরো দূরে। আমি স্কুলে ঢুকে যাওয়ার পর আপাকে আরো অনেকটা রাস্তা একা যেতে হবে। তাই আপনি যদি……”
“তোমার আপা কি ছোট বাচ্চা? আর তোমাকে না বলেছি তোমরা দুই বোন আমার সামনে আসবে না অকারণে? তোমরা কি একটু কম বুঝো?”
প্রিয়তা আড়ালে দাঁড়িয়ে পেখমের জামা টানতে থাকে।
ফিসফিস করে বললো,”বাড়াবাড়ি করিস না পেখম, চল এখান থেকে।”
পেখম একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো,”আসলে পাড়ার মোড়ের কিছু বখাটে ছেলে আপাকে খুব বিরক্ত করে। এজন্যই আপনাকে বলেছিলাম।”
“তো আমি কি করবো? একদম বিরক্ত করবে না আমাকে।”
পেখম কিছুটা দমে যায়। তাহলে কি তার ভাবনা ভুল? এই মানুষটা আদতেই এমন রগচটা?
“চল রে আপা, কি আর করবি? বাবার তো বয়স হয়েছে। আমাদের বাড়িতে তো আর কোনো পুরুষও নেই। একটু নাহয় সহ্য করে নে।”
সে এটুকু বলে আড়চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। চোখমুখ একদম লাল হয়ে গেছে তার পেখমের খোঁচা দেওয়া কথা শুনে। মুখ টিপে হাসে পেখম

“কি দরকার ছিলো উনাকে এসব বলার? তোর সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। এগুলো আমার একদম পছন্দ না।”
প্রিয়তা রাগ করে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। তার চোখে পানি চলে আসছে বারবার। চোখজোড়া ভীষণ জ্বালা করছে তার। সে পেখমকে নিষেধ করলেও তার অবচেতন মন বলছিলো মানুষটা তার সাথে আসবে। কিন্তু তার মনটা ভেঙে গেছে একদম। পেখমও মুখ ভার করে হাঁটতে থাকে।

পেখম স্কুলের গেটে ঢুকতে যাবে ঠিক এমন সময় আচমকা স্তম্ভিত হয়ে যায় সে। প্রিয়তার শরীরে খোঁচা দেয় সে।
“আপা আমাকে একটা চিমটি কেটে দে তো।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।
“রাস্তার ওপাশে দেখ।”
প্রিয়তা পেখমের কথামতো সেদিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
বুকে দুই হাত বেঁধে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে তার মুখ থমথম করছে।
পেখম ঠোঁট কামড়ে হাসে। প্রিয়তার এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে। এটাও কি সম্ভব?
“যা আপা, দেরি করিস না। মানুষটা কতোক্ষণ অপেক্ষা করবে?”
প্রিয়তা ঘোর লাগা চোখে তাকায় বোনের দিকে। ছোট বাচ্চা মেয়ের মতো খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে তার। বহু কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রাখে সে।

প্রিয়তা দাঁড়ায় উচ্ছ্বাসের মুখোমুখি। এখনো পর্যন্ত একবারও উচ্ছ্বাস তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি এখানে দাঁড়িয়ে।
“একটা কথা কান খুলে শুনো এবং সেই সাথে মাথায় ঢুকিয়ে নাও। আহ্লাদী করা আমার পছন্দ নয়। আমার সামনে কেউ করুক তাও আমার ভালো লাগেনা। রাস্তায় এমন ভাবে হাঁটবে যেনো কেউ বুঝতে না পারে আমরা পরিচিত। তুমি সামনে সামনে হাঁটবে, আমি পিছনে। একবারও পিছন ঘুরে আমার দিকে তাকাবে না। মনে থাকবে?”
প্রিয়তা আস্তে আস্তে ঘাড় কাৎ করে। খুশিতে তার মনটা কানায় কানায় ভরে আছে। সে যে তাকে কলেজ পর্যন্ত এগিয়ে দিবে এটাই তো অনেক, আর কি চাই?

প্রিয়তা মনে মনে দোয়া করছে আজ যেনো কোনোভাবেই ওই বখাটে ছেলেগুলো চায়ের দোকানে আড্ডা না দেয়। উচ্ছ্বাসের সামনে যদি তারা প্রিয়তাকে নোংরা কথা বলে? কি লজ্জার একটা ব্যাপার হবে?
কিন্তু প্রিয়তার দোয়া কবুল হলোনা।
আজ আরো কয়েকজন বেশি ছেলে আজ বসে আছে ওদের সাথে। সবাই আগে থেকেই বিশ্রীভাবে হাসছিলো কিছু একটা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে করতে।
প্রিয়তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে যায় পিছনে উচ্ছ্বাস আছে কিনা। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে নিষেধাজ্ঞা। ব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ধরে আগাতে থাকে সে।
শেষ রক্ষা হয়না। ছেলেগুলো ততক্ষণে প্রিয়তাকে দেখে ফেলেছে।
কালো করে একটা ছেলে অন্য একজনকে খোঁচা দিয়ে বললো,”দেখ মা’লটা এসেছে। উফফ আজ একদম পরী লাগছে রে।”
প্রিয়তার কান গরম হয়ে ওঠে। বুক কাঁপতে থাকে তার। মনে হচ্ছে সে আর আগাতেই পারছে না। পা দু’টো অনড় হয়ে আছে তার।
“আরে এমন কালো বুঝি পরী হয়?”
“ব্লাক ডায়মন্ড রে। কালো তাতে কি? চেহারার আর্টটা দেখছিস? উফ!”
“এই চুপ সবাই, তোদের ভাবী হয় ও।”
“বন্ধু ভাবী বানাইলে আমাদেরও একটু দিস, চেখে দেখবো কেমন।”
এই বলে আরো বিশ্রীভাবে হাসতে থাকে ওরা। প্রিয়তাকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন নামে ডাকতেও থাকে ওরা। প্রিয়তা এক রকম দৌড়েই জায়গাটা পার করে। লজ্জায়, অপমানে চোখে পানি চলে আসে তার। হয়তো সে চেয়েছিলো উচ্ছ্বাস প্রতিবাদ করবে। কিন্তু কোনো কথাই সে বলেনা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে তার রাস্তার মধ্যেই।

কলেজ গেটে প্রিয়তা এসে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাস দাঁড়ায় তার কাছে এসে।
প্রিয়তা একটু ঝাঁঝের সাথে বললো,”অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এই পর্যন্ত আসার জন্য। না আসলেও হতো। পেখম অতিরিক্তই করে সবসময়। এটা তো আমার নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে গেছে। আর আমি সহ্য করেও নিয়েছি। আপনি কেনো আমার জন্য কিছু বলতে যাবেন তাদের? আমি আপনার কে? আপনি তো আবার আমাদের বাড়ির দুই দিনের অতিথি। আজ আছেন কাল নেই। আগামীকাল থেকে আমি একাই আসবো। কাউকেই আমার সাথে আসতে হবে না।”
একদম কথাগুলো শেষ করে প্রিয়তা। সে নিজেও জানেনা এসব কেনো বলছে সে। তার মনের কোনো একটা কোণায় হয়তো এমন বাসনা ছিলো, তার হয়ে মানুষটা কিছু বলবে, প্রতিবাদ করবে। মানুষের মন বড় অদ্ভুত এক জিনিস। অনেক সময় সেই মন মস্তিষ্কের চিন্তাধারাও বন্ধ করে দেয়।
উচ্ছ্বাস শান্ত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। হয়তো কাজল দিয়েছে মেয়েটা। কিছুটা লেপ্টে আছে চোখের পানিতে। আচ্ছা, এই কাজল কি শুধু শ্যামলা মেয়েদের জন্যই বানানো হয়েছে? সামান্য কালো রঙের কি এমন শক্তি যে একটা মেয়ের সৌন্দর্য এভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে?
প্রিয়তা আর কোনো কথা না বলে কলেজ গেটে ঢুকে যায়। সেদিকে তাকিয়ে একটা ক্রুর হাসি দেয় উচ্ছ্বাস।

বড় গাড়ি এসে থেমেছে প্রিয়তাদের ছোট্ট বাড়িটার সামনে। মর্জিনা বেগম নতুন গাড়ি কিনেছে। মূলত সেইটা দেখানোর জন্যই এসেছে সে। সাথে আরো কিছু বড়লোকি আলাপ। মার্জিয়া বেগম মুগ্ধ হয়ে গাড়িটা দেখছে। কি সুন্দর কচুয়া রঙের গাড়ি। সচারাচর দেখা যায়না এমন রঙের গাড়ি। মার্জিয়া বেগম ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে গাড়িটা।
“কি রে কেমন লাগলো?”
“খুব সুন্দর গাড়ি আপা। রঙটা এতো সুন্দর।”
“আর বলিস না, তোর দুলাভাইকে তো চিনিস। কবে একদিন বলেছিলাম এই রঙটা আমার ভীষণ প্রিয়। হঠাৎ এসে বললো চলো তোমার পছন্দের রঙের কিছু কিনে দিই। ভেবেছিলাম এই রঙের একটা শাড়ি কিনে দিবে। ওমা, সে যে এই রঙের গাড়ি কিনে আনবে তা কে জানতো?”
মর্জিনা বেগম খুব হাসতে থাকে এতোটুকু বলে। মার্জিয়া তার দিকে তাকায়। চোখজোড়া কড়কড় করে ওঠে তার। আজ কি তার জীবনটাও এমন হতে পারতো না? একই মায়ের পেটের দুই বোন। একজনের স্বামী গাড়ি উপহার দেয় আর একজনের স্বামীর দশ টাকা রিকশা ভাড়া বাঁচানোর জন্য হেঁটে বাড়ি ফেরে।

“মন খারাপ করে কি করবি বল? যার কপালে যেমন থাকে আর কি। তবে এখনো সবকিছু হাতছাড়া হয়ে যায়নি। যদি মেয়েদেরও এমন রাজকপাল দেখতে চাস, আমার কথা শোন। ছেলেপক্ষ খুব তাড়াতাড়ি মেয়েকে দেখতে আসতে চায়। কবিরকে জানিয়েছিস তো সব?”
মার্জিয়া মিনমিন করে বললো,”আসলে আপা, প্রিয়তার বাবা এখন রাজি হচ্ছে না। আমি সব বলেছি তাকে।”
মর্জিনা বেগমের মুখ কালো হয়ে সায় সাথে সাথে।
“তা রাজি হবে কেনো? সারাটা জীবন আমার বোনটাকে যেমন কষ্টে রেখেছে, মেয়েগুলোকেও তাই চায়।”
রাগে গজগজ করতে থাকে মর্জিনা বেগম। মার্জিয়ার মনটা খচখচ করতে থাকে। সে যা পায়নি, মেয়েদের পাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই সুখ পেতে চায় সে।
“বুঝেছি, তোকে দিয়ে কিছুই হবে না।আমি কথা বলবো কবিরের সাথে। সবকিছু ঠিক থাকলে, আগামী পরশুই মেয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করবো আমি।”
মার্জিয়া বেগম ক্ষীণ গলায় বললো,”আপা কিছুদিন দেরি করলে হয়না? মানে মেয়েটা অন্তুত উচ্চমাধ্যমিকটা পার করুক। বুঝতেই পারছো, একদমই কাঁচা বয়স।”
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”ছেলেপক্ষের তো খেয়ে কাজ নেই, তোর মেয়ের জন্য এতোদিন অপেক্ষা করতে যাবে। কতো মেয়ের বাবা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে জানিস? আহামরি কোনো রসগোল্লাও নয় তোর মেয়ে। রাজি হয়েছে তোর দুলাভাইয়ের বিজনেস পার্টনার এই সুবাদে।”
মার্জিয়া বেগম তবুও উশখুশ করতে থাকে। সে-ও চায় তার আপা মতো এমন রাজকপাল, এতো সুখ তার মেয়েদেরও হোক। এই সম্বন্ধ হাতছাড়া হয়ে গেলে কি এমন আর পাওয়া যাবে? মেয়ে আহামরি সুন্দরীও নয়। পেখমকে নিয়ে চিন্তা নেই, ও যথেষ্ট সুন্দরী। যতো দুশ্চিন্তা তার বড় মেয়েটাকে নিয়ে। তবুও তার ভয় হয়। তার মেয়েটা বোকা, বেশ বোকা। সবকিছু সামাল দিতে পারবে তো? মার্জিয়া বেগম কচুয়া রঙের গাড়িটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে এসব রাজ্যের চিন্তা করতে থাকে।

রাতের খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। প্রিয়তার খেতে ইচ্ছা করছিলো না। মূলত সে উচ্ছ্বাসের সামনে আসতে চায়নি। তার বাবা জোর করে তাকে ডেকে এনেছে। সে আবার তার বাবার অনুরোধ ফেলতে পারেনা। উচ্ছ্বাসের সেদিকে খেয়াল নেই। সে নিজের মতো চুপচাপ বসে আছে। পেখম একবার আপার দিকে, আরেকবার উচ্ছ্বাস ভাইয়ের দিকে তাকায়। বাড়ি ফেরার পর থেকে আপার মুখ ভার। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
মার্জিয়া বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,”কি হয়েছে তোমার? এতো খুশি লাগছে কেনো তোমাকে?”
কবির শাহ খেতে খেতে বললো,”যদিও খুশি হওয়া উচিত নয়, তবুও আজ যা ঘটেছে তাতে খুশি লাগছে আমার বটে।”
পেখম বললো,”কি হয়েছে বাবা?”
“আর বলিস না, আমাদের এলাকার হারুণ মিস্ত্রীর ছেলে মজিদ আছে না?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা চোখে তাকায় বাবার দিকে। মজিদ তো ওই ছেলেগুলোর মধ্যে একজন। সে আবার কি করেছে?
“ছেলেটা আমার ছাত্র ছিলো। কিন্তু কলেজে ওঠার পর থেকে একদম বখে গিয়েছিলো। পাড়ায় মোড়ে মোড়ে মেয়েদের বাজে ইঙ্গিত দিতো, নোংরা কথা বলতো। পাড়ার কোনো মুরুব্বিকেও মানতো না। আরো কিছু বন্ধু জুটিয়েছিলো ওর মতোই। আমি কতো নিষেধ করেছি, ওর বাবাকেও জানিয়েছি। কোনোভাবেই কাজ হয়নি। আমার নিজের চোখের সামনে একদিন দেখেছি স্কুল পড়ুয়া একটা মেয়েকে কতো বিশ্রী ভাষায় খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমি বাঁধা দিতে গিয়েছিলাম, শিক্ষক হিসেবে আমাকে একটু মানলো না। বরং আমাকেও কিছু কথা শুনিয়ে দিলো। শিক্ষক হিসেবে এটা যে আমার জন্য কতোটা লজ্জার। কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছিলো না ওদের দলটাকে। উপরন্তু দিন দিন বাড়ছিলো। এমন একটা অবস্থা যে মেয়েরা ওদের সামনে দিয়ে যেতেই ভয় পাচ্ছিলো।”
প্রিয়তার বুক ধকধক করতে থাকে। বাবা যদি জানতো ওই বদমাশটা তার মেয়ের পিছনেও লেগেছে তাহলে তো আরো রেগে যেতো।
মার্জিয়া বেগম বললো,”কি হয়েছে তাদের?”
“আর বলো না, কে বা কারা আজ সন্ধ্যায় ওদের খুব করে মেরে আমাদের পূবের খেলার মাঠটায় ফেলে রেখেছে। একদমই চেহারা চেনার মতো নেই, এমন অবস্থা। কারো নাক ফাটিয়েছো তো কারো হাত ভেঙেছে। পরে স্থানীয়রা দেখতে পেয়ে তাদের হাসপাতালে পাঠিয়েছে। যতোই হোক আমার ছাত্র তো ছিলো। আমার দায়িত্ববোধ থেকে আমি ওদের দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। খুবই ভয় পেয়ে আছে ওরা।”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে বললো,”কে করলো এই কাজ?”
“কি জানি, তবে এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিলো।”

প্রিয়তা খাওয়া থামিয়ে মুখ হা করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। পেখম হতবাক হয়ে তাকায় আপার দিকে। আপাকেও হতবিহ্বল মুখে দেখলো। তার মানে কি সে যা ভাবছে আপাও তাই ভাবছে? দুইজনই একসাথে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। তার এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একমনে খেয়ে যাচ্ছে সে। যেনো এতোগুলো কথা তার কানেই যায়নি।
প্রিয়তার বুক কাঁপছে, ধাতস্থ হতে পারছে না সে কোনোভাবেই। তার মন বলছে এই কাজ এই মানুষটা ছাড়া আর কারো নয়। প্রিয়তাকে খারাপ কথা বলেছে বলেই কি উচ্ছ্বাস এমন কাজ করলো?
সূক্ষ একটা হাসি ফুটে ওঠে প্রিয়তার ঠোঁটের কোণে। তবে কি তার মতো একই অনুভূতি বিপরীত দিকেও আছে?

(চলবে…..)

তুমি প্রেম হলে আমি প্রেমিক পর্ব-০১

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১

সকাল সকাল মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে মার্জিয়া বেগমের। তার একটা বদ অভ্যাস আছে, সকালে একবার মেজাজ কোনোভাবে খারাপ হয়ে গেলে সারাদিনে আর মেজাজ ভালো হয়না তার। যাকে সামনে পায় তার উপরই রাগ ঝাড়তে থাকে। তার এই অভ্যাসের কথা তার স্বামী আর দুই মেয়ে খুব ভালো করেই জানে। তাই সকালবেলাটায় তারা খুব সাবধানে থাকে, কোনোভাবেই মার্জিয়া বেগমকে রাগাতে চায়না তারা।
“আমার হয়েছে যতো জ্বালা। আমার স্বামী তো যেনোতেনো পুরুষ নয়, যেনো ফাদার তেরেসা।”
মার্জিয়া বেগমের ছোট মেয়ে পেখম। এইবারই নবম শ্রেণিতে উঠেছে। একটু চটপটে স্বভাবের মেয়ে। মায়ের মুখে ফাদার তেরেসা শুনে ভীষণ হাসি পাচ্ছে তার। কিন্তু হাসতে পারছে না। এখন তাকে হাসতে দেখলেই তার মা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে। সমস্ত রাগ তার উপরই ঝাড়বে পরে।
কাজের মেয়ে শেফালি আসতে দেরি করেছে আজ। ভয়ে ভয়ে সে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। আজকের রাগের কারণ কি তবে তার দেরিতে আসা? বুঝতে পারছে না সে।
ঝমঝম করে স্টিলের বাসনকোসনের শব্দ করে মার্জিয়া বেগম। যেনো কাউকে না পেয়ে এগুলোর উপরই মেজাজ দেখাবে সে।
শেফালি মুখ কাচুমাচু করে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”খালাম্মা কোনো সমস্যা হইছে?”
মার্জিয়া বেগম সেদিকে না তাকিয়েই নিজের মনে চিৎকার করতে থাকে।
“সমস্যা আর কি? এই সংসারে আমি নিজেই তো সমস্যা। আমার কথা এখানে কে শোনে?”
শেফালি কথা বাড়ায় না। সে বুঝতে পারে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যা বলার মার্জিয়া বেগম নিজেই বলবে।

“বলা নেই কওনা নেই, একটা হাড়হাভাতে ঘরের এতীম ছেলেকে বাড়ি এনে তুলছে। তার নাকি কোন জন্মের বোনের ছেলে। তাও নিজের বোন হলেও মানা যেতো। চেনা নেই জানা নেই, এসেই বললো আজ থেকে ও আমাদের সাথে থাকবে। অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম আমি এই সংসারে।”
স্ত্রীর চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হয়ে আসে কবির শাহ। পেশায় একজন হাইস্কুলের গণিতের শিক্ষক। অন্যান্য গণিতের শিক্ষকদের মতো মোটেই রাগী নয় সে, বরং খুব শান্ত মেজাজের।
“কি হচ্ছে কি প্রিয়তার মা? এভাবে চিৎকার করছো কেনো? ছেলেটা শুনতে পাবে তো।”
তেলেবেগুনে যেনো জ্বলে ওঠে মার্জিয়া বেগম। চোখ দিয়ে আগুন ঝরতে থাকে তার।
“শুনুক, শোনার জন্যই তো বলছি। দুই মাস হয়ে গেলো আপদ এনে জুটিয়েছো আমার ঘাড়ে। কবে বিদায় নিবে তার কোনো ঠিক নেই। কোনো চাকরিবাকরি খোঁজার ইচ্ছাও নেই। পরের কাঁধে বসে খেতে পারলে কে কষ্ট করে চাকরি খোঁজে?”
কবির শাহ হতভম্ব হয়ে যায় স্ত্রীর কথা শুনে। বার বার ও ঘরের দিকে তাকায়। ছেলেটা আবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে না তো এতো কিছু শুনে? সে বের হয়ে যাবেই বা কোথায়? তার তো যাওয়ার জায়গা নেই।
“প্রিয়তার মা, আমি হাতজোড় করছি তোমার সামনে। দয়া করে চিৎকার করোনা এভাবে। আর ও তো তোমাকে কোনোরকম বিরক্ত করছে না।”
মার্জিয়া বেগম চুপ করে থাকে। ভিতর ভিতর রাগে ফুঁসতে থাকে সে।
কবির শাহ আস্তে আস্তে হেঁটে মার্জিয়া বেগমের কাছে যেয়ে দাঁড়ায়।
নরম গলায় বললো,”কি হয়েছে প্রিয়তার মা? আমাকে বলো।”
“কি হবে তোমাকে বললে? কোনো সমাধান করতে পারবে তুমি?”
“তবুও বলো, চেষ্টা তো করতে পারি।”
“ঘরে কোনো সবজি ছিলো না। তাই ওকে যেয়ে বললাম কিছু সবজি এনে দিতে সামনের বাজার থেকে। কি এনেছে জানো? বাজারের সব পঁচা, নষ্ট সবজিগুলো ব্যাগ ভরে নিয়ে চলে এসেছে। টাকাগুলো সব জলে গেলো আমার।”
কবির শাহ অবাক হয়ে বললো,”তুমি ওকে দিয়ে বাজার করিয়েছো? কেনো আমাকে বলতে পারতে না?”
মার্জিয়া বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”কেনো ও কোন জমিদারের ছেলে? হাতে ফোস্কা পড়েছে ওর বাজার করতে? বলেছি বলে ইচ্ছা করে এমন বাজার করেছে, যাতে আর কোনোদিন ওকে না বলি।”
কবির শাহ মুখ কালো করে বললো,”তুমি জানো ও ওর বাবা মায়ের কতো আদরের সন্তান ছিলো? কোনোদিন গ্লাস থেকে পানি ঢেলে পর্যন্ত খেতে হয়নি তাকে। এগুলো ও শিখবে কীভাবে?”
“এটা ওর বাড়ি নয়, এটা আমার বাড়ি। এখানে থাকতে হলে কাজ করে খেতে হবে।”
মার্জিয়া বেগম কিছু বলতে যাবে তার আগে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ায় তাদের বড় মেয়ে প্রিয়তা। প্রিয়তার চোখ ঈষৎ ভেজা। মনে হচ্ছে কেঁদেছে কিছুক্ষণ আগে।
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি হয়েছে? এখানে কেনো তুই?”
“এক কাপ চা লাগবে।”
“তুই তো চা খাস না।”
কবির শাহ বিরক্ত হয়ে বললো,”এতো প্রশ্ন করছো কেনো? নাহয় আজ খেতে ইচ্ছা করছে ওর। আয় মা, তোকে আমি আজ চা বানিয়ে দিই। দেখবি কেমন মজা করে চা বানাই।”
প্রিয়তা কঠিন গলায় বললো,”প্রয়োজন নেই বাবা। আমি নিজেই বানাবো।”

কবির শাহ এক গাল হেসে তাকায় মেয়ের দিকে। দুই মেয়ে তার জগতের সবকিছু। পুরো পৃথিবী একদিকে আর তার মেয়েরা একদিকে।
মার্জিয়া বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকায়। আজকাল মেয়ের ভাবগতিক কিছুই ভালো লাগেনা তার। এমনিও ছোট থেকে মেয়েটা ভীষণ চুপচাপ, শান্ত। আর পেখম চঞ্চল। তবুও ইদানীং প্রিয়তাকে আরো বেশি বিষন্ন লাগে। মার্জিয়া বেগমের দুশ্চিন্তা হয়। অষ্টাদশী কিশোরী সে। এই বয়সটা ভয়ংকর। সে নিজেও এমন একটা বয়স পার করে এসেছে বলে বুঝতে পারে। এই বয়সে হেমলক বিষকেও অমৃত লাগে।

প্রিয়তা চায়ের কাপ নিয়ে বেরিয়ে যায়। মেয়েটাকে অতিরিক্ত সুন্দরী বলা যায়না। গায়ের রঙ নেহাৎ চাপা, তার বাবার মতো। এই সমাজ গায়ের রঙের উপর ভিত্তি করে সৌন্দর্য নির্ধারণ করে মেয়েদের। কিন্তু যদি কেউ খুব ভালো করে মেয়েটাকে লক্ষ্য করে সে মুগ্ধ হতে বাধ্য। চোখজোড়া একদম দীঘিতে ভাসতে থাকা ফুটন্ত পদ্মের মতো টানাটানা। দীর্ঘ অক্ষিপল্লবের পাপড়িগুলো যেনো ওর পুরো মুখের আদল আরো আবেদনময়ী করে তুলেছে। সুবিন্যস্ত দন্তপাটি মেলে যখন হাসে, তখন মার্জিয়া বেগম তাকাতে পারে না মেয়ের দিকে। বাবা মায়ের নজর বেশি লাগে কিনা! বাম গালের টোলটা তার হাসিকে আরো সুন্দর করে দিয়েছে। মার্জিয়া বেগম প্রায় মনে মনে বলে,’ইশ মেয়েটা যদি আরেকটু ফর্সা হতো!”
কবির শাহ মুচকি হেসে বললো,”মেয়েগুলো দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে তাইনা? কিছুদিন পরেই উচ্চমাধ্যমিক দিবে মেয়েটা। অথচ সেদিনই এতোটুকু ছিলো।”
মার্জিয়া বেগম ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,”মেয়েদের উপর থেকে টানটা এবার একটু কমাও। দুইদিন বাদে মেয়েরা পরের ঘরে যাবে, তখন নিজেই কষ্ট পাবে।”
কবির শাহ কিছু বলেনা, শুধু কুটকুট করে হাসতে থাকে।

বদ্ধ দরজার সামনে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। সে ভালো করেই জানে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ নয় এই ঘরের। একটু ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। তবুও সে ঢুকতে পারছে না। হাঁটু দু’টো অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে তার। মায়ের বলা কথাগুলো সে ঘর থেকে শুনতে পেয়েছে, নিশ্চয়ই ওই মানুষটাও শুনেছে। কান গরম হয়ে যাচ্ছিলো প্রিয়তার কথাগুলো শুনতে। চোখটা কেনো অকারণে ভিজে গেলো সে বুঝতেই পারেনি। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে তার ভিতরে, সে ধরতে পারছে না।
“দরজার বাইরে এভাবে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। কিছু বলতে হলে ভিতরে এসো।”
চমকে ওঠে প্রিয়তা। কাপ থেকে চা কিছুটা ছিলকে এসে পড়ে তার হাতের উপর। উনি কীভাবে জানলো প্রিয়তা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে?
দরজা ঠেলে ধীর পায়ে প্রিয়তা ঘরে ঢোকে। ঢুকতেই একরাশ ধোঁয়ায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। সিগারেটের গন্ধে শ্বাস নেওয়া দায়। একটা মানুষ এতো ধূমপান করে কেনো?
“আমাকে মহাপুরুষ ধরণের কিছু ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ ছিলো না। সেখান থেকে তোমার ওড়না দেখা যাচ্ছিলো।”
প্রিয়তা হাঁপ ছাড়ে, তবুও অস্বস্তি কমেনা তার।
“কি চাও এখানে?”
প্রিয়তার চোখটা আবার ভিজে ওঠে। এমনিতে সে খুব শক্ত মেয়ে, সহজে কাঁদে না। কিন্তু এই মানুষটার কঠোর আওয়াজ শুনলে তার কেমন কষ্ট হয়। আচ্ছা, উনি সবসময় এভাবে কেনো কথা বলে? একটু ভালো করে কথা বলা যায়না?
“অদ্ভুত তো, সমস্যা কি তোমার? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
প্রিয়তা পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। হঠাৎ করেই যেনো তার নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একটা পুরুষ এতো সুন্দর হবে কেনো? এতোটা সুন্দর হওয়ার কি দরকার যাতে চোখ ফেরানোই না যায়? মুখভর্তি দাড়িগোঁফের জঙ্গল থাকা সত্ত্বেও কাউকে এতো ভালো লাগতে পারে?
“এই মেয়ে, তোমার কানে সমস্যা নাকি? তখন থেকে এতোগুলো কথা বলছি। শুনতে পাচ্ছো না?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় উচ্ছ্বাসের দিকে।
“আপনার চা।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমি কি চা চেয়েছি তোমার কাছে?”
প্রিয়তার শরীরটা কেমন জমে ওঠে।
“কি হলো বলো? আমি কি চেয়েছি?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে বললো,”আমি খুব ভালো চা বানাই জানেন তো? সবাই খুব প্রশংসা করে। আমার বাবা বলে, আমার হাতের চা খেলে নাকি মন ভালো হয়ে যায়।”
উচ্ছ্বাস হঠাৎ মুচকি হাসে। আচমকা সেদিকে চোখ পড়তেই প্রিয়তার পা যেনো অবশ হয়ে আসে। এতো সুন্দর স্বর্গীয় হাসি একটা পুরুষের আছে, অথচ সে হাসে না।
“তো তোমার মনে হলো যে আমার মন খারাপ তাই চা দিয়ে আমার মন ভালো করতে এসেছো?”
প্রিয়তা বোকার মতো মাথা নেড়ে বললো,”না না….”
উচ্ছ্বাস থামিয়ে দেয় তাকে।
“আমার এতো সহজে মন খারাপ হয়না বুঝেছো? চোখের সামনে বাবা-মাকে একসাথে মারা যেতে দেখেছি। তারপর থেকে আর কিছুই আমার মন খারাপ করাতে পারেনা।”
প্রিয়তা হতাশ মুখে তাকিয়ে থাকে। সে শুনেছে উচ্ছ্বাসের বাবা মা একই সাথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। উচ্ছ্বাসও ছিলো তাদের সাথেই। কাকতালীয়ভাবে তার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
“যাই হোক, চা প্রয়োজন নেই আমার। এটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।”
প্রিয়তা আহত চোখে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। এতো কঠিন হতে পারে একজন মানুষ?
“আপনার জন্য বানিয়েছি, একটু খান।”
উচ্ছ্বাস শান্ত গলায় বললো,”বললাম তো খাবো না। এক কথা বার বার বলবে না। তোমাদের বাড়িতে আশ্রিত আছি মানে এটা নয় যে তোমাদের সব কথা শুনতে হবে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে তাকায়। এসব কি বলছে সে?
“আর একটা কথা, সময়ে অসময়ে এভাবে চা নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত হবে না। কিছুদিনের অতিথি আমি এখানে। হঠাৎ একদিন চলে যাবো। আর হ্যা, এখানে চোখের পানি ফেলবে না। কাঁদতে ইচ্ছা করলে ঘরে যেয়ে যতো খুশি কাঁদো।”
এতোটুকু বলে সে আরেকটা সিগারেট ধরায়।
লজ্জায়, অপমানে আর কষ্টে প্রিয়তার পা দু’টো অনড় হয়ে আছে। তার বাবা মধ্যবিত্ত হতে পারে, কিন্তু তারা দুই বোন সবসময় রাজকন্যার মতো বড় হয়েছে। কেউ তাদের সাথে কঠিন গলায় কথা বলেনি। এই লোকটার এতো দেমাগ কিসের? কোন রহস্যের দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছে নিজেকে?

ঘরে ফিরে মুখ অন্ধকার করে বসে আছে প্রিয়তা। নিজের উপর অসম্ভব রাগ হচ্ছে তার। কে বলেছিলো চা বানিয়ে নিয়ে দরদ দেখাতে? ইচ্ছা করছে নিজের গালে দুইটা থাপ্পড় মারতে।
“কি রে আপা? এভাবে মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস কেনো? মনে হচ্ছে কেউ তোকে মেরেছে।”
প্রিয়তা সরু চোখে তাকায় পেখমের দিকে। ঠোঁট টিপে হাসছে মেয়েটা। প্রিয়তার ইচ্ছা করছে নিজের উপরের রাগটা বোনের উপর ঝাড়তে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে।
পেখম পা তুলে খাটে বসে প্রিয়তার পাশে। পাশের টেবিলে চায়ের কাপ দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”সে কি রে আপা? চা বানিয়ে এনেছিস তো অনেকক্ষণ হলো। এখনো খাসনি? ওটা তো একদম ঠান্ডা হয়ে গেলো। আমাকে দে, আমি খাই।”
প্রিয়তা কঠিন গলায় বললো,”কেউ খাবি না ওই চা। ওটা আমি বাথরুমে ফেলে দিবো।”
“সে আবার কি কথা? তোর বানানো চা এতো মজা হয়, আর তুই সেইটা বাথরুমে ফেলে দিবি?”
“এখান থেকে যা পেখম। তোকে দেখলে আমার ভয়ংকর রাগ হচ্ছে।”
পেখম চোখ কপালে তুলে বললো,”আপা কি হয়েছে তোর? আমি কি করেছি?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। সে জানে এখন সে মুখ খুললেই কেঁদে দিবে। ছোট থেকেই তার ভয়ানক রাগ হলে চোখে পানি চলে আসে।
পেখম কিছুক্ষণ বিজ্ঞের মতো কিছু একটা ভাবে। এরপর প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা একটা কথা বলবো?”
প্রিয়তা চুপ করে থাকে, এখন কোনো কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না তার।
“আপা তুই কি কারো প্রেমে পড়েছিস?”
প্রিয়তা স্তম্ভিত হয়ে যায় পেখমের কথা শুনে।
“কি বললি তুই?”
“না মানে আমার বান্ধবীরা সেদিন বলাবলি করছিলো জানিস? ওরা নাকি নতুন নতুন প্রেমে পড়েছে। ওদের নাকি হঠাৎ হঠাৎ কান্না পায়, আবার হঠাৎই হাসি পায়, হঠাৎই রাগ হয় কোনো কারণ ছাড়া। কিছুদিন ধরে তোর মধ্যেও এমন দেখছি। সেদিন কোনো কারণ ছাড়াই কেমন মুচকি মুচকি হাসা শুরু করলি। আবার সেদিন রাতে দেখি একা একাই জানালার পাশে দাঁড়ায় কাঁদছিস।”
হতবিহ্বল মুখে প্রিয়তা তাকিয়ে থাকে পেখমের দিকে। সে নিজেও জানেনা এসব অনুভূতির কারণ কি, কেনোই বা এমন করছে সে। যদি সত্যিই এমনটা হয়ে থাকে তবে সে কার প্রেমে পড়েছে? ওই রগচটা আগন্তুক উচ্ছ্বাসের প্রেমে?
“আমাকে বলতে পারিস আপা। বিশ্বাস কর আমি কাউকে বলবো না, মা কেও না।”
প্রিয়তা কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললো,”স্কুল নেই তোর? যা আমার সামনে থেকে এখন। একদম বিরক্ত করবি না আমাকে।”
পেখম মুখ অন্ধকার করে উঠে চলে যায়। এই আপাটার হঠাৎ কি হলো সে বুঝতে পারেনা। এমনিতেও খুবই চুপচাপ সে, তবুও কিছুদিন হলো একদম যেনো কেমন হয়ে গেছে। আপার এই বদলে যাওয়াটা তার একদমই ভালো লাগছে না।

আজ দুপুরে প্রিয়তার বড় খালা মর্জিনা বেগম এসেছে তাদের বাড়িতে। মর্জিনা বেগম শহরের একজন বিশাল শিল্পপতির স্ত্রী। সেই তুলনায় মার্জিয়া কিছুই না। তাদের আর কোনো আত্নীয় এতো বড়লোক না। তাই মর্জিনা বেগমকে এ বাড়িতে বেশ ভক্তি করা হয়। সে-ই সিদ্ধান্ত নেয় প্রিয়তা, পেখমের সব ব্যাপারে।

মার্জিয়া বেগম ছোটাছুটি করছে বোনের সন্তুষ্টির জন্য। মর্জিনা বেগম আবার অল্পতেই খুঁত ধরতে থাকে সবকিছুতে। আর সবকিছু নিখুঁত হতে হবে।
মর্জিনা বেগম বিরক্ত মুখে বললো,”তোদের ফ্যানটা কি ভালোমতো ঘোরে না রে? একটা নতুন কিনলেই তো পারিস। ঘরমে সিদ্ধ হয়ে গেলাম।”
মার্জিয়া ছুটে এসে পাখা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে থাকে বোনকে।
“এই পেখম, দৌড়ে যা খালাম্মার জন্য ঠান্ডা শরবত নিয়ে আয়।”
পেখম বিরস মুখে উঠে চলে যায়।
“তুই বোস তো আমার পাশে। আমি এখানে শরবত খেতে আসিনি। তোর সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার। বলেই চলে যাবো।”
“সে কি কথা আপা? দুপুরে না খেয়েই চলে যাবে তুমি? তা হবে না বলে দিচ্ছি। আমি তোমার জন্য রান্না করছি।”
মর্জিনা বেগম চোখমুখ কুঁচকে বললো,”রাখ তো তোর রান্না, আমার সামনে এসে বোস।”
মার্জিয়া বেগম অনিচ্ছাসত্ত্বেও এসে বসে বোনের সামনে।
“বলো আপা।”
“আচ্ছা কবিরের আক্কেলটা কি বল তো?”
“কেনো সে আবার কি করলো?”
“কি করলো মানে? চেনা নেই জানা নেই একটা ছেলেকে ঘরে এনে উঠিয়েছে। দুই মাস হয়ে গেলো, এখনো যাচ্ছে না।”
মার্জিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”এই সংসারে আমার কোনো দাম আছে আপা? বাবা ঠিকই বড়লোক, ভালো পরিবার দেখে তোমাকে বিয়ে দিলো। আর আমার সাথে কি করলো? চেহারাছবি তো খারাপ ছিলো না আমার। তবুও একটা সামান্য বেতনের শিক্ষকের সাথে বিয়ে দিলো আমাকে। ছেলের চরিত্র এতোই ভালো যে বাবা আর হাতছাড়া করলেন না। এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমার কথা কে শোনে এ বাড়িতে?”
মার্জিয়া বেগমের চোখে পানি চলে আসে।
মর্জিনা বেগম হাত রাখে বোনের মাথায়।
“ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নেই রে। কিন্তু কবির আসলেই মানুষ হিসেবে ভালো। ও কেনো এই কাজটা করলো আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।”
মার্জিয়া বেগম চুপ করে থাকে।
“শোন মার্জিয়া, ছেলেটা প্রাপ্তবয়স্ক, তার উপর রূপবান। আর তোর মেয়েরাও বড় হচ্ছে। এই বয়সের মেয়েরা হলো আগুন, আর ছেলে হলো বারুদ। বারুদ আর আগুন পাশাপাশি থাকলে কি হয় বুঝিস তো?”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে তাকায় মর্জিনা বেগমের দিকে। এভাবে তো সে কখনো ভেবে দেখেনি।
“তুই তো আজীবনই বোকা থেকেই গেলি। এসব যে তোর মাথায় আসেনি আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। শোন, বয়সটা ভুল করার। এতে মেয়েদের দোষ নেই। এই বয়সে প্রেম জেঁকে ধরে। হাতের কাছে যদি এমন একজন সুদর্শন যুবক পায়, মেয়ে তো প্রেমে পড়তে বাধ্য।”

খালাকে শরবত দিতে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তার সব কথা শোনে পেখম। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তবে কি তার ধারণা ঠিক? আপা কি তবে উচ্ছ্বাস ভাইয়ের প্রেমে পড়েছে? এখন সে কি করবে?

“তাহলে আপা এখন কি করবো আমি? আমার তো হাত-পা কাঁপছে তোমার কথা শুনে।”
মর্জিনা বেগম বিরক্ত হয়ে বললো,”তোকে নিয়ে এই এক সমস্যা। কিছু হলেই চিন্তাভাবনা না করে কাঁপা-কাঁপি করতে থাকিস। আমার কথা শোন মন দিয়ে।”
মর্জিনা বেগম গলার স্বর নামিয়ে বললো,”প্রিয়তার জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ ঠিক করেছি। বড় ঘর, আদি ব্যবসা। তোর মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকবে। সচারাচর এমন সম্বন্ধ পাওয়া যায়না।”
মার্জিয়া বেগম আঁৎকে উঠে বললো,”এসব কি বলছো আপা? একটা বাইরের ছেলের ভয়ে এতোটুকু বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবো?”
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”তোর ঢং দেখে বাঁচিনা। মেয়েকে বিদুষী বানিয়ে ঘরে রেখে বুড়ি বানাবি? আমার তো আরো আগেই বিয়ে হয়েছিলো, স্কুল গন্ডিও পার হইনি তখন। আমি কি খারাপ আছি? তুই এতো পড়াশোনা করে কি করলি? ঠিকই তো এখন বাসন মাজা লাগে। বিয়ের জন্য এই বয়সটাই ঠিক আছে। তাছাড়া তোর মেয়ে আহামরি রূপবতীও না। তারা ছবি দেখে পছন্দ করেছে, এখন সামনাসামনি দেখতে চায়।”
“তুমি তাদের ছবিও দেখিয়েছো?”
“আমি কি তোর মেয়েদের খারাপ চাই?”
মার্জিয়া বেগম তবুও খুঁতখুঁত করতে থাকে। মেয়ে তো মাত্রই কলেজে পড়ে। এখনই সংসারের কি বুঝবে ও?
“কবিরকে বোঝা তুই। শিক্ষক মানুষ, অনেক ঝামেলা করবে। মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবে না। তুই ওই বাইরের ছেলেটার অযুহাত দিবি। এক ঢিলে দুই পাখি মারবি।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”আচ্ছা দেখি ওদের বাবার সাথে কথা বলে।”
“ওসব দেখাদেখি নেই। এমন বনেদি ঘর আর পাওয়া যাবে না। পরে তো আরেকটা মেয়ে আছে, সেদিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে নাকি? তুই কি চাস তোর মতো এমন কপাল তোর মেয়েদেরও হোক? এভাবে বাসন মেজে, রান্নাঘরেই দিন কাটিয়ে দিক? মধ্যবিত্ত একটা জীবন নিয়েই দুনিয়া ত্যাগ করুক?”
মার্জিয়া বেগম মাথা নিচু করে বললো,”আমি কিন্তু এই জীবনে অসুখী নই আপা। রাগের মাথায় অনেক কিছু বলি, কিন্তু আমি ওদের বাবার মতো মানুষকে পেয়ে অনেক সুখী।”
“তোর সিনেমার ডায়লগ বন্ধ কর। জীবন আবেগ দিয়ে চলবে না। যেভাবেই হোক কবিরকে রাজি করাবি তুই আজকের মধ্যে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়ে দেখাদেখির ব্যবস্থা করতে হবে।”
মার্জিয়া বেগমকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে মর্জিনা বেগম উঠে দাঁড়ায়।
“ওই ছোকরাটাকেও তাড়ানোর ব্যবস্থা করবো আমি যতো তাড়াতাড়ি পারা যায়।”
হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় সে। মার্জিয়া বেগম থম মেরে বসে থাকে খাটের উপর।

পড়ার টেবিলে বইতে মুখ গুঁজে বসে আছে প্রিয়তা। বারবার সকালের ঘটনাগুলো মনে পড়ছে তার। লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে বারবার নিজের মধ্যে। পড়ায় এক বিন্দুও মন নেই তার।
হঠাৎ গীটারের টুংটাং আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরে পায় সে। সে জানে কে বাজাচ্ছে। আগেও দুইদিন শুনেছে সে। অদ্ভুত সুন্দর গানের গলা তার। ইচ্ছা করে সারাদিন শুনতে। কিন্তু এমন রগচটা লোক, দুই মাসে মাত্র দুইবারই গান করেছে। একটু ভালো গলা বলে এতো দেমাগ হবে?
“আপা।”
চমকে ওঠে প্রিয়তা। পেখম কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে জানেনা।
“কি হয়েছে বল।”
“ছাদে যাবি?”
“হঠাৎ ছাদে যাবো কেনো?”
“অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নায় থইথই করছে একদম।”
“আমার এখন ভালো লাগছে না, তুই যা।”
পেখম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো,”ছাদে উচ্ছ্বাস ভাই আছে। গান করছে উনি।”
প্রিয়তা ঈষৎ কেঁপে ওঠে।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”আমার কি তাতে?”
পেখম প্রিয়তার হাত ধরে বললো,”চল গান শুনি উনার ওখানে যেয়ে।”
প্রিয়তা প্রতিবার করতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পেখমের দিকে।

(চলবে…..

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃশেষ_পর্ব

রাশা জানালার পাশের সিটে বসেছে৷ প্লেন টেক অফ করার পর সিট বেল্ট খুলে সিটের হাতলে হাত রেখে এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে মেঘেদের আনাগোনা দেখতে লাগলো। বুক চিড়ে কান্না আসছে তার। ঠোঁট কামড়ে কোনমতে কান্না আটকে অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। কিছু সময় পর পাশের সিট থেকে একজন তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিলো। বিরক্ত হলো সে। ও কি টিস্যু চেয়েছে নাকি! এমনিতেই মন মেজাজ ভালো নেই, তার উপর এইসব উটকো ঝামেলা। তবুও ভদ্রতার খাতিরে ছোট করে বললো,
–লাগবে না। ধন্যবাদ।

দৃষ্টি তার তখনও বাইরের দিকে। কে টিস্যু দিয়েছে তার দিকে ফিরেও তাকালো না৷ এই অপমান করার পরেও পাশের সিটের মানুষটার আক্কেল জ্ঞান কম আছে বলেই তার বোধ হলো৷ না বলার পরেও হ্যাংলার মতো এখনও হাত বাড়িয়েই আছে৷ উষিরের উপরের রাগটা পাশের সিটের মানুষটার ব্যবহারে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বড় বড় শ্বাস ফেলে কড়া কিছু কথা শুনানোর জন্য ঘুরতেই এক মূহুর্তের জন্য থমকালো। পাশের সিটের সেই বেয়াদপ মানুষটা উষিরই। তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। রাশার ঠোঁট ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠলো। তারপর উষিরের বুকে ঝাপিয়ে পরে কান্না শুরু করে দিলো। উষির মৃদু হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে চাইলো। কিছুক্ষণ পর আশেপাশের সবার অদ্ভুত নজর দেখে রাশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–সবাই কেমন নজরে তাকিয়ে আছে দেখেছো? ঠিক করে বসো।

রাশা কান্না করতে করতেই মাথা নাড়লো। উষির প্রশান্তির শ্বাস ফেলে মুচকি হেসে তার মাথায় চুমু দিয়ে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো। নিজেই এমন কাজ করেছে অথচ রাশাকে দোষ দিয়ে আফসোসের সাথে বললো,
–লজ্জায় আমার মাথা কাঁ’টা যাচ্ছে রাশা। কি না কি করাচ্ছো আমাকে দিয়ে!

রাশা উষিরের বুকে মুখ গুজে লাজুক হাসলো। তক্ষুনি একজন এয়ার হোস্টেস এসে বিনয়ী সুরে বললো,
–এনি প্রবলেম স্যার?

লজ্জায় উষিরের মাথা এবারে সত্যি সত্যি কাঁ’টা যাওয়ার জোগাড়। এয়ার হোস্টেসকে উত্তর দেওয়ার আগে একটু ঝুঁকে রাশাকে ফিসফিস করে বললো,
–ঠিক করে বসো রাশা। সবার প্রবলেম হচ্ছে৷

রাশা এবারেও মাথা নাড়লো। শুধু মাথা নেড়েই ক্ষান্ত হলো না। উষিরের বুকে এমন ভাবে মুখ গুজে রাখলো যে মনে হলো, বুকের ভেতরে অপা’রে’শন করে ঢোকা গেলে এই মূহুর্তে সে সেটাই করতো। উষির ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,
–সরি, আমার ওয়াইফ একটু সিক। প্রথমবার প্লেন জার্নি করছে তো। খুব ভয় পেয়েছে। বুঝতেই পারছেন।

কথার সাথে মাথায় আঙুল ঘুরিয়ে রাশার মেন্টাল হওয়ার সার্টিফিকেট দিতেও ভুললো না৷ সব শুনে এয়ার হোস্টেস মিটিমিটি হেসে মাথা নেড়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকার পর রাশা মিনমিন করে বললো,
–সরি উষির।

–উহু, মাফ হবে না।

রাশা ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা তুললো। তারপর ক্ষোভ মেশানো গলায় বললো,
–তুমি না আসলে আমি সোজা টেমস নদীতে ঝাঁপ দিতাম। তখন মাফ করতে?

উষির ভ্রু কুঁচকে রাগী চোখে তার দিকে তাকাতেই রাশা আবার বুকে মাথা রেখে বড় করে শ্বাস ফেলে কথা ঘুরিয়ে বললো,
–আমি এই ফ্লাইটে যাবো সেটা তুমি জানলে কিভাবে?

–ওয়েল, এটাতে একটু ক্ষমতা ঝাহির করতে হয়েছিলো।

নাটকীয় সুরে বলে দুজনেই হেসে ফেললো। তারপর বেশ সিরিয়াস হয়ে বললো,
–ফ্রেন্ডের সহায়তায় তোমার নাম খুঁজে বের করেছি। আর তারপর লাকিলি লাস্ট মোমেন্টে টিকিট পেয়েছি। অ্যান্ড দ্য এন্ড, তোমার পাশের জনকে আমার সিটে বসিয়ে আমি তোমার কাছে চলে এসেছি।

–আর কোথাও যাবে না তো?

রাশার গলায় অসহায়ত্বের সুর। উষির তাকে আস্বস্ত করে নাটকীয় সুরে গানের লাইনে নিজের উত্তর দিলো,
–তুমি যেখানে, আমি সেখানে।

বলেই আবার হেসে উঠলো। উষির নিজের কথা প্রতিটি ক্ষণে পালন করেছে৷ রাজনীতি ছেড়ে রাশার জন্য লন্ডনে সেটেল হয়ে গেলো। পরের দুই বছর রাশা নিজের ব্যারিস্টার পড়ার স্বপ্ন পূরণ করেছে। আর উষির তার আরেকটা স্বপ্ন পূরণে কালিনারি আর্টসের দুই বছরের কোর্স কমপ্লিট করে সেখানেই রেস্টুরেন্ট ওপেন করেছে৷ তাদের কোম্পানি লন্ডনে নতুন একটা ব্রাঞ্চ ওপেন করায় উজান আর নোঙরও তাদের কাছে চলে আসলো। এরপর নোঙরও উষিরের পথ অনুসরণ করে কালিনারি আর্টসের কোর্স বেশ সফলতার সাথে শেষ করে সেই রেস্টুরেন্টেই হেড শেফের অর্থাৎ উষিরের অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে জয়েন হয়েছে। এসবের পর কেঁটে গেছে আরো তিন বছর। মোটমাট এই পাঁচ বছরে উষির রাশার জীবনে নতুন দুই অতিথি এসেছে। তিন বছরের জমজ দুই মেয়ে, পর্শিয়া আর উর্শিয়া। মেয়েদের আগমনে সবাই খুশি হলেও নোঙর হসপিটালেই হাত পা ছড়িয়ে কান্না শুরু করেছিলো৷ তার অনেক শখ, রাশার ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দেবে। কিন্তু ছেলের বদলে তো মেয়ে হলো৷ এখন উপায়! কোন কিছুতেই তাকে যখন মানানো গেলো না তখন নোঙরের না হওয়া ছেলে যত ছোটই হোক, বিয়ে তাদের মেয়ের সাথেই দেওয়া হবে বলে চুপ করানো হয়েছিলো। কিন্তু এখন ছয় মাসের ছেলেকে কোলে নিয়ে প্রায় প্রায়ই পুরোনো কথাটা সবাইকে মনে করিয়ে দেয়।

উষির মেয়েদের ছাড়া রেস্টুরেন্টে একদমই যায় না৷ মেয়েদের সামনে না রাখলে নাকি তার হাত চলে না। রাশা সকালে তাদের ডে কেয়ারে রেখে আসে আর ছুটির পর উষির গিয়ে তাদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায়। লাঞ্চ সেখানে করার পর বিকালে রাশা আসলে একসাথে চারজন বাড়ি ফেরে।
নোঙর এখনও তার মাতৃত্বকালীন ছুটি কাঁটাচ্ছে। ছুটি কবে শেষ করবে তা একমাত্র সেই জানে। তার পরেও প্রায় প্রায়ই বেবি স্ট্রলারে তার ছেলে উষানকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট চলে আসে আর নানান রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে। কন্সিভ করার পর থেকে তার খাবারের টেস্ট একদম বদলে গেছে। নতুন টেস্ট অনুসারেই পুরোনো রান্নার নতুন স্বাদ তৈরির পরীক্ষা নিরিক্ষা চলে সর্বক্ষণ।

সময়টা এখন বিকাল। ছুটির দিন হলেও উজানের মিটিং থাকায় রেস্টুরেন্ট খোলা রাখা হয়েছে৷ তার মিটিং উষিরের রেস্টুরেন্টেই হয়। নোঙর এটাকে বিজনেস স্ট্র‍্যাটেজি নাম দিয়েছে।

–পাপা

মেয়ের আদো আদো বুলির ডাক শুনে উষিরের মন ভরে উঠলো। মেয়েকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে নরম গালে নিজের গাল ঠেকিয়ে বললো,
–ইয়েস পাপা?

–ওয়ান্ত ইউ মিত মাই বিএপ?

উষির চমকে উঠে মেয়ের দিকে তাকালো। আদো আদো বুলিতে ইংরেজি শিখেছে সবার আগে৷ বিদেশে থাকার এই এক কুফল৷ মেয়ে মাতৃভাষা শেখার আগে গড়গড় করে ইংরেজদের ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছে। সাথে তাদের কালচারও। নিজের দেশের এক সম্মানিত সাবেক নেতা হিসেবে ব্যাপারটা তার মোটেও ভালো লাগে না। নাহলে বাঙালি মেয়ে হয়ে বাবাকে বিএফ সম্পর্কে বলে! কি ভয়ংকর!

–সরি পাপা শুনতে পায়নি। আবার বলো?

মেয়ের ইংরেজি উত্তর তাকেও ইংরেজিতেই দিতে হয়। নাহলে এই আধা ইংরেজী ম্যাডাম বুঝতে পারেন না।

–বয়পেন্ত। পত্তি দানে।

–দানে আবার কি?

রাশা অফিস থেকে ফিরতেই তাদের দেখে সেখানে এসেছিলো। আর তখনই বাবা মেয়ের এই কথোপকথন শুনে বিচলিত গলায় প্রশ্নটা করলো। উষির মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে বেশ গর্বিত গলায় বললো,
–ও বলছে, পর্শি জানে। মেয়ের এইটুকু ভাষা বোঝো না?

–কি করে বুঝবো? আমি তো আর সাত বছর পর্যন্ত তোতলা ছিলাম না। কোন শব্দের অক্ষরও উল্টাপাল্টা বলতাম না। সেন্টেন্সেও ভুল হতো না।

রাশার মুখ বেঁকিয়ে বলা কথাটা শুনে উষিরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। ভিডিওকলে মাহফুজা একবার বলেছিলো, পর্শিয়া নির্ঘাত রাশার মতো হয়েছে৷ একদম স্পষ্ট করে কথা বলে। আর উর্শিয়া বাবার মতো। উষির নাকি সাত বছরের আগে স্পষ্ট করে কথাই বলেনি। কথা যেমন আটকে যেতো তেমনই উল্টাপাল্টা শব্দ ব্যবহার করতো৷ আর সেটা সবাই শুনে ফেলেছিলো। তারপর থেকে রাশার এক ডায়লগ।

স্ত্রীর কথার জবাব অন্য সময়ের জন্য তুলে রেখে ঝুঁকে মেয়ের গাল টেনে আদূরে গলায় বললো,
–পাপা, তুমি এখন অনেক ছোট। এই বয়সে এইসব করতে হয় না। আগে বড় হও তারপর বয়ফ্রেন্ড বানাবে।

–নো। মাই বপ্পেন্দ। তুমি না মারি, আমি কই বলবি না।

উর্শিয়া ফ্লোরে পা বাড়ি দিয়ে দুই হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে নিজের রাগ জাহির করলো। উষির বহু কৌশলে মেয়েদের বাংলা শেখাচ্ছিলো। আর এই হলো তার ফল! বড় মেয়েটা কি সুন্দর বাংলা বলে আর ছোট মেয়েটা বাংলা বলতে গেলেই কি দিয়ে কি বলে তা বোঝার সাধ্য উষিরের ছাড়া আর কারোর নেই। অথচ গড়গড় করে ইংরেজি বলে চলে৷ উষির মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আহত স্বরে বললো,
–পাপা বোঝেনি মা। তুমি ইংরেজদেরই ফলো করো।

যদিও কথাটা উষিরের জন্য লজ্জার তবুও বলতেই হয়, মাঝে মাঝে সেও ছোট মেয়ের কথা বুঝতে পারে না। বাবার কথায় উর্শিয়া ঠোঁট উলটে আহ্লাদী গলায় কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো৷ উষির অসহায় চোখে রাশার দিকে তাকাতেই রাশা তপ্ত শ্বাস ফেলে হাঁটু মুড়ে উর্শিয়ার সামনে বসলো। তারপর মেয়ের হাতে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বললো,
–আপুকে খুঁজে নিয়ে এসো। পিকনিকে যাওয়ার সময় হয়েছে তো৷ গো ফাস্ট বেবি।

পিকনকের কথায় উর্শিয়ার চোখ চকচক করে উঠলো। নতুন হওয়া বয়ফ্রেন্ডকে ভুলে এক দৌঁড়ে বোনের খোঁজে বের হলো। উর্শিয়া চলে যেতেই উষির রাশার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে বিচলিত গলায় বললো,
–মেয়ে আমাদের এই বয়সে বয়ফ্রেন্ড বানাচ্ছে! চিন্তা করতে পারো!

–এতে অস্বাভাবিক কি আছে? পশ্চিমা কালচারে এটা নরমাল।

–কিন্তু আমরা তো এখানকার না।

–এখানে তো আছি। বাচ্চারা যা দেখে তাই তো শেখে। আর তাছাড়া এখানে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড এতোটাও বোল্ড হিসেবে কেউ নেয়ই না। ইচ্ছে না হলে ছেড়ে দেবে সিমপল। এই সামান্য জিনিস নিয়ে এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই৷ তুমি এখানে ওকে হাজার বুঝাও, বাইরে গেলে যে কে সে-ই হয়ে যাবে। এমন করে তাকানোর কি আছে?

উষিরের তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে কথা বলতে বলতেই তেঁতে উঠলো রাশা। উষির গুরুগম্ভীর গলায় বললো,
–তোমারও বয়ফ্রেন্ড ছিলো তাই না?

–অবশ্যই ছিলো।

উষির হ্যাচকা টানে রাশার কোমড় চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–ডিড হি কিস ইউ?

উষিরের আচারণে রাশা হালকা বিরক্ত হলো। তার বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
–আমি যদি এখন হ্যাঁ বলি তাহলে রেগে যাবে, আর যদি না বলি তাহলে বিশ্বাস করবে না। সন্দেহ করবে। তাই এই চ্যাপ্টার ক্লোজ করাই ভালো।

–আন্সার দাও?

উষির হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে ধমক দিলো। রাশা তপ্ত শ্বাস ফেলে মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে না বুঝাতেই উষির বাঁকা হাসলো। তারপর আশেপাশে নজর বুলিয়ে ঝুঁকে রাশার ঠোঁটে হালকা করে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিলো। রাশা রাগার বদলে লজ্জা পেয়ে তার দিকে মারকুটে চোখে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করলো।

উর্ষিয়া ছোট ছোট পায়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে বোনকে খুঁজতে খুঁজতে উজানের মিটিং প্লেসে চলে আসলো। তার মিটিংটা একজন বাঙালির সাথেই হচ্ছিলো। কিউট বার্বি ডলের মতো দেখতে বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে তিনি হাতের ইশারায় কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,

–তোমার নাম কি মা?

–ওত্তিয়া দাবুন

লোকটি নামের আতাপাতা খুঁজে না পেয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলো। উজান ভাতিজিকে কোলে নিয়ে হেসে ফেলে বললো,
–উর্শিয়া জাবিন।

নাম শুনে লোকটি এক গাল হাসলো। তক্ষনি পর্শিয়াও বোনকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে উপস্থিত হলো। লোকটি একই বয়সী আরেকটি মেয়েকে দেখে তাকেও কাছে ডাকলো।
–আর তোমার নাম কি মা?

–পর্শিয়া জাবিন।

স্পষ্ট উত্তর। লোকটা আবার থতমত খেয়ে গেলো। তিন বছরের একটা বাচ্চার মুখে এতো স্পষ্ট শব্দ সাধারণ শোনা যায় না। উষির মৃদু হেসে ভাতিজিকে কোল থেকে নামিয়ে বললো,
–ওরা টুইন্স।

লোকটি এবারে চরম বিষ্মিত হল। জমজদের চেহারা একই রকম হয় বলে যাদের ধারণা, তাদের এই দুইজনকে দেখা উচিৎ। না তাদের চেহারার কোন মিল আছে আর না আচার-আচরণে। একদন উত্তর মেরু হলে আরেকজন দক্ষিণ মেরু। পর্শিয়া যেমন শান্ত, তেমনই ম্যাচিউর আর বুঝদার। উর্শিয়া ঠিক তার উলটো৷ আবার পর্শিয়া বাবার চেহারা পেলেও ব্যবহার পেয়েছে মায়ের। অন্যদিকে উর্শিয়ার চেহারা মায়ের মতো হলেও ব্যবহার পেয়েছে বাবার। তাদের এই কম্বিনেশন প্রথমবার খেয়াল করেছিলো আফসার সাহেব। তারপর থেকে উর্শিয়া কোন কান্ড ঘটালেই ফুল কনফিডেন্স নিয়ে বলেন,
–একেবারে বাপ কা বেটি। তার পাপাই এই কাজ করতো, সেখানে মেয়ে করবে না!

এই কথার আসল অর্থ ফাঁস হওয়ার পরে ছোট মেয়েকে বেশ চোখে চোখে রাখে উষির৷ না জানি কখন কি কান্ড করে, পরে ওর সাথে সাথে তার নামটাও জুড়ে যাবে। সবাই তখন এটাই বলবে যে, আরেহ! উষিরও এমনটাই করেছিলো নাকি! আরে বাবা, কেউ কি নতুন কিছু ঘটাতে পারে না নাকি! এই ক্ষেত্রে সে মেয়ের মতোই বাচ্চা হয়ে যায়। কারো নামের অভিযোগ যে নিজের নামের সাথে যোগ করবে না। সেটা নিজের মেয়ে হলেও না।

উর্শিয়ার ব্রেকাপ করানোর দ্বায়িত্ব গিয়ে পরলো নোঙরের উপর। সব শুনে তার মুখ হা হয়ে গেলো। অবাক বিষ্ময়ে উজানের দিকে তাকিয়ে বললো,
–তোমার না হওয়া ছেলের বউ দেখি এই পিচ্চি বয়সে বয়ফ্রেন্ড বানাচ্ছে! এই তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো?

নোঙর চট করে তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কোমড়ে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো। উজান মুখ খুলবে তার আগেই টেবিল থেকে কেক কাঁটার প্লাস্টিকের চা’কু তার দিকে বাড়িয়ে শাসিয়ে বললো,
–একবার খালি বলো, ছিলো। তারপর এই চা’কু যদি তোমার পেটে না ঢুকিয়েছি তাহলে আমিও নোঙর খন্দকার না।

উজান টেবিলের সাথে কোমড় ঠেকিয়ে হাত ভাজ করে বললো,
–জানতেও চাচ্ছো আবার মারতেও চাচ্ছো?

–মানে ছিলো? নাকি আছে?

নোঙর রেগে চাকু গলায় রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বললো৷ উজান হেসে ফেলে একটু কাছে গিয়ে ঝুঁকে আঙুল তার গালে বুলিয়ে মোহময় স্বরে বললো,
–উহু, বউ আছে।

নোঙর নরম হলো। চোখ মুদে লাজুক হাসলো। উর্শিয়াকে দেখে উজান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–উর্শিকে বোঝাও। তোমার উপর দ্বায়িত্ব পরেছে তো।

নোঙরের দ্বায়িত্বের কথা মনে পরতেই দাঁতে জিভ কাঁটলো। এরপর উর্শিয়াকে কোলে তুলে মোলায়েম স্বরে বললো,
–মামনি, এই বয়সে প্রেম করতে হয় না। তুমি আগে বড় হও তারপর বয়ফ্রেন্ডের কথা চিন্তা কোরো। আপাতত ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকো৷ আপাতত না। সবসময়ই ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকবে। যাকে তাকে তো আমি আমার ছেলে বানাতে পারবো না। এটা বুঝতে হবে তো। আমার ছেলেটা তোমার বড় হলে আমার এতো চিন্তাই থাকতো না।

নোঙরের আরেকটা প্ল্যানের মধ্যে এই প্ল্যানটাও সামিল হয়েছে৷ নেহাৎই বাইরে বিয়ে হলে যেই ছেলেকে নিজের ছেলে বানিয়ে নেবে। তাহলেই তো শখ পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু তার ছোট বড়-র আফসোস আর ফুরায় না!
নোঙরের শেষের কথা শুনে উজান রেগে উঠলো,
–পাগল হয়ে গেছো? বাচ্চা মানুষকে কিসব কানপড়া দিচ্ছো তুমি? মনে গেঁথে গেলে তখন কি করবে?

–আরে মনে রাখার জন্যই তো বলছি৷ তবে বড় হলেও কিন্তু সমস্যা নেই। এসব তো অহরহ হয়।

–মানি, বয়পেন্দ গুড। তুমি মিত্তা বলচি। আমরা কেলি না ফুটলবল, বাব্বি ডল, কিচেন কিচেন।

উর্শিয়া দুই ঝুটি নাড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে রাগী গলায় বললো৷
নোঙর হতাশার শ্বাস ফেলে উর্শিয়াকে তার কোল থেকে উজানের কোলে দিতে দিতে বললো,
–তুমিই বুঝাও ওকে। আমি তো ওর কথাই বুঝি না তার আবার বুঝাবো কি! তার থেকে ভালো আমি ভাইয়ার কাছে যাই। আমাদের নতুন রেসিপি কতদূর গেলো সেটা দেখতে হবে।

উজান কি করবে বুঝতে না পেরে উর্শিয়াকে ভাইকে পাহারায় বসিয়ে সেখান থেকে দ্রুত চলে গেলো। উর্শিয়া উষানের বেবি স্ট্রলারে ঝুঁকে তার নরম গালে নিজের ছোট ছোট আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। এই সুযোগে উষান আর ছোট ছোট নরম হাতের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য বোনের গলার পুতির মালা খপ করে ধরে খিলখিল করে হেসে উঠলো। পুতির মালাটা টিচারের সাহায্য দুইদিনের চেষ্টায় বানিয়েছিলো সে৷ এখন সেটার অন্তিম মূহুর্ত দেখে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো। তার গগনবিদারী কান্নার আওয়াজে সবাই হুরমুর করে সেখানে উপস্থিত হলো। কিন্তু ততক্ষণে মালার সব পুতি কিছু বেবি স্ট্রলারে আর কিছু মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে৷ উর্শিয়ার অবস্থা আরো করুন৷ সে মালার কষ্টে ফ্লোরে শুয়ে হাত পা নাচিয়ে, গড়িয়ে গড়িয়ে কান্না করছে। উর্শিয়া বাবার থেকে আরেকটা গুন বেশ ভালোমতো পেয়েছে৷ একবার কান্না শুরু করলে সহজে থামে না। এখন এই কান্না ঘুমানোর আগে থামবে বলে মনে হয় না। তাই কান্নারত মেয়েকে কোলে নিয়েই তারা ভ্রমণে বের হলো।

লন্ডনে তখন বসন্তকাল। ম্যাপল লিফের সময়। ম্যাপল ট্রির মাঝে সূর্য ডোবা দেখতে তারা হল্যান্ড পার্কে এসে উপস্থিত হলো। শত শত ম্যাপল ট্রির মধ্যে দিয়ে সন্ধ্যা হওয়া দেখার প্ল্যান সেই কবে থেকে তারা করে রেখেছে৷ অবশেষে সময় পেলো। বসন্তের মৃদু মন্দ বাতাদে মরা পাতা ঝির ঝির করে নিচে গড়িয়ে পরছে। মরা পাতা দেখতে যে এতো সুখ হয়, তা তারা এতোদিনে এসে বুঝলো। মরা পাতার সুখ তো সুখের সময়ই টের পাওয়া যায়।
একসময় আকাশ লাল করে সূর্য ডুবে গেলো। উর্শিয়া বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে অনেক আগেই৷ অপর পাশে পর্শিয়া মায়ের আঙুল আকড়ে সূর্য ডোবার পরের লাল মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। আর রাশা উষিরের কাঁধে মাথা রেখে সূর্য ডোবার পরের লাল আকাশ দেখতে লাগলো।
বেবি স্ট্রলারের ভেতরে পরা মরা ম্যাপল লিফ আকড়ে ধরে মুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে উষান। নোঙর মহা উৎসাহে সেটার ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। আর উজান স্ত্রী সন্তানের একান্ত মূহুর্ত নিজের ক্যামেরায় সাক্ষী করে রাখলো। এরপর দুই ফ্যামিলি একত্র হয়ে লম্বা রাস্তায় ম্যাপল লিফ পেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার আকাশের মেঘ দেখতে লাগলো। মনোমুগ্ধকর, সিগ্ধ আর ভালোবাসাময়। ঠিক তাদের জীবনের মতো।

সমাপ্ত

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৩৯+৪০

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৯

বিকালের দিকে রাশার ফোনে এক অতি পরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলো৷ কলার আইডি দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ফোন কানে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল মেজাজে বললো,
–কাজল কেমন আছে?

ওপাশে কাজল নামের মেয়েটির মুখেও মুচকি হাসি চলে আসলো। তারপর গাল ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে বললো,
–কাজল ভালো আছে কিন্তু রাশা আপুর উপর রেগে আছে। তুমি এতো টাকা দিয়েছো কেনো?

রাশা খিলখিল করে হেসে উঠলো৷ তারপর বেশ নাটকীয় স্বরে বলল,
–ডোনেশন দিয়েছি তো৷

–এতো টাকার ডোনেশন দিয়ে কি করবো? আমরা তো ডোনেশন নেই না। এটা আমাদের নিয়মবহির্ভূত কাজ।

রাশা হাসি থামিয়ে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
–তোমার যদি এতো টাকা থাকতো তাহলে তুমি কি করতে?

–আমি আমাদের আলোর দিশারিতেই খরচ করতাম।

–এইজন্যই তো আমি তোমাকে দিচ্ছি। গিফট হিসেবে দিচ্ছি তো। এখন যদি গিফট হিসেবে তোমাকে জোরে কয়েকটা চড়ও দেই তাহলেও তোমার সেটা হাসিমুখে মেনে নিতে হবে। বুঝেছো?

কাজল আবার হেসে ফেললো। রাশাও হেসে দিলো৷ বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সব প্রপার্টি সে বিক্রি করে দিয়েছে। তাও একেবারে জলের দরে। কয়েকশো কোটি টাকার প্রপার্টি দ্বন্দ্বের কারনে কোটিতে নেমে এসেছিলো। আর রাশা তার থেকেও কম দামে সব প্রপার্টি বিক্রি করেছে। তাও যে মন্ত্রীর সাথে তার বড় বাবার বিরোধ লেগেছিলো, সেই মন্ত্রীর কাছেই৷ আর সেই সব টাকা খাগড়াছড়ির সেই অরফানেজে ডোনেট করেছে। দুর্নীতির টাকা কোন তো ভালো কাজে লাগুক।

খবর বোধহয় ততক্ষণে পৌঁছে গেছে। তাই তো বাড়ির বড় ছেলে সুলতান চৌধুরীর কল আসলো। মূহুর্তেই রাশার হাসিখুশি মনটা বিস্বাদে ভরে গেলো। ওই বাড়ির সব থেকে বেশি রাগ যে মানুষটার উপর, সেই মানুষটা হলো এই সুলতান চৌধুরী। বাড়ির অন্যায়কে সহ্য করতে পারে না জন্য বাড়ি ছেড়েছে কিন্তু সাহস করে প্রতিবাদ করতে পারেনি। রাগটা ঠিক এই কারনেই।

–এমন করছিস কেনো রাশা? বাড়ির সবাই তোর উপর খুব রেগে আছে। বাবা যদি রাগের মাথায় তোর কোন ক্ষতি করে দেয় তখন?

ফোন ধরার সাথে সাথেই ফোনের ওপাশ থেকে সুলতান ভারি গলায় বেশ করুন করে কথাটা বললো। এপাশে রাশা তেঁতে উঠলো,
–তুমি যদি ওদের বিরুদ্ধে কোন স্টেপ না নাও তাহলে তোমার এই পোলাইটনেসের কোন দাম নেই।

ব্যাস! আর তারপরই দ্বিতীয় কোন কথা না বলে কল কেঁটে ফোন সুইচ অফ করে দিলো। তারপর বিগড়ে যাওয়া মুড ঠিক করতে নোঙরকে খুঁজতে কিচেনে আসলো৷ দিনের বেশিরভাগ সময়টা নোঙর এই কিচেনেই কাঁটিয়ে দেয়৷ বাড়ি ফেরার পরদিন থেকেই রান্নার দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে সে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন রেসিপি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়৷ যেমন আজকে কাবাব বানাচ্ছে৷ কিসের কাবাব তা সেই জানে। রাশার তো খাওয়া দিয়ে কথা।

রাশা কিচেনে গিয়ে বেশ আয়েশ করে কাবাবের প্লেট হাতে নিয়ে কেবিনেটের উপর পা তুলে বসে কাবাব খেতে লাগলো৷ একটা করে মুখে দিচ্ছে আর স্বাদে চোখ বুজে আসছে। তার থেকে কিছুটা দূরেই নোঙর কাবাব ভাজছে। রাশা তার দিকে ফিরে মুগ্ধ গলায় বললো,
–তোমার রান্না যে এতো টেস্টি! তোমার মতো মেয়ে ঘরে ঘরে থাকা দরকার।

নোঙর হেসে ফেলে বললো,
–প্র‍্যাকটিস করলে সব সম্ভব হয় আপু।

–মোটেও না। আমি হাজারবার রান্নাঘরে রান্না শিখতে গেছি। একবারও সফল হই নাই। বাড়ির এমন একটা মেয়ে নেই যে আমাকে রান্না শেখাতে আসেনি। সবাই শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। আমি আসলে পরিমাণটা বুঝতে পারি না। ওটাই তো মেইন। রান্না না একটা আর্ট বুঝেছো? এই আর্ট সবার মাঝে থাকে না। যেমন আমি!

এবারে রাশা বেশ উচ্চশব্দে হেসে উঠলো৷ নোঙর লাজুক হেসে রাশার প্লেটে আরো দুটো কাবাব তুলে দিয়ে মন খারাপের ভঙ্গিতে বললো,
–তোমার যেমন রান্না হয় না, আমার তেমন পড়াশোনা হয় না। কতো ট্যালেন্টেড তুমি। আর আমি কিছুই পারি না৷

–কে বলেছে, তুমি কিছু পারো না!

রাশা এক লাফে কেবিনেট থেকে নেমে বেশ সিরিয়াস মুখোভঙ্গী করে আবারও বললো,
–সবাই যেমন সব কিছু পারে না, তেমনই সবাই কোন না কোন ব্যাপারে এক্সপার্ট থাকে। যেমন তুমি কুকিংএ এক্সপার্ট। আর আমি আর্গুমেন্টে৷ আবার তুমি ট্যান পরলে কি লাগালে ট্যান রিমুভ হয় তা জানো, আর আমি সোজা পার্লারে চলে যাই। আমাকে যেগুলো শিখিয়েছিলে, আমি সে সব ভুলে বসে আছি। অথচ তোমার সব মনে থাকে। একজন মানুষের তাই করা উচিৎ, যাতে সে এক্সপার্ট। যেমন তুমি কুকিং এ এক্সপার্ট আর আমি..

রাশা ঠোঁট কামড়ে কথা আটকালো। নোঙর কৌতুহলী গলায় জানতে চাইলো,
–তুমি?

–আমি…আমি আর্গুমেন্টে, ঝগড়ায়।

রাশা কাঁধ নাচিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো। নোঙর হেসে ফেললে আবার কাবাব ভাজায় মনোযোগ দিলো। তারপর হঠাৎই হাত থামিয়ে বললো,
–আপু, তোমাকে সাজিয়ে দেই?

রাশা থতমত খেয়ে তাড়াহুড়ো করে নাকচ করলো,
–না না। আমি শুধু শুধু সেজে কি করবো? ওসব খুব ঝামেলার।

–কোন ঝামেলার না আপু৷ ভাইয়ার জন্য সাজবে। আমি এমন সুন্দর করে সাজিয়ে দেবো যে ভাইয়া নজর ফেরাতে পারবে না। যদিও এমনিতেও ফেরাতে পারে না।

বলেই কাঁধ দিয়ে রাশার কাঁধে ধাক্কা দিলো। রাশা হেসে ফেললো। সেই লাজুক হাসি যা হুটহাট দেখা যায়।

****
উষিরের বাইরে যাওয়ার এক ফোঁটা ইচ্ছাও ছিলো না। বেশ আড়ামে এসি রুমে পায়ের উপর পা তুলে বসে মোবাইল স্ক্রল করছিলো৷ কোন আপডেট জানা কিংবা তার পেজ পর্যবেক্ষণ করাও তার একটা দ্বায়িত্ব। এখন সেই দ্বায়িত্বই পালন করছে। এরমধ্যেই তার দলের এক ছেলে তার কাছে এসে বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
–ভাই, বাজারের বড় দোকানদার চাঁদা দিতে চাচ্ছে না।

উষিরের ভ্রু কুঁচকে গেলো। মোবাইল থেকে নজর সরিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
–চাঁদা তো আমার দ্বায়িত্বে না।

–মেয়র মেয়ের সাথে ছুটি কাটাতে বিদেশ গেছে। তাই মন্ত্রীসাহেব আপনার কথা কইলো।

উষির মোবাইল রেখে কপাল ঘষে বিরক্তি নিয়ে বললো,
–দোকানদারকে আমার কথা বলিসনি?

ছেলেটি এবারে বেশ কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো,
–বলছি ভাই, কাম হয় নাই।

উষির দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাঞ্চাবির কলার ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো,
–চল একটু মোলাকাত করে আসি।

উষির তার দলবল নিয়ে বড় বাজারের সেই দোকানে আসলো। বেশ বড় মুদির দোকান ছিলো সেটা। বেশ নামডাকও আছে। দোকানে মালিক একাই বসে ছিলো। কর্মচারী না দেখে সবাই সামান্য অবাক হলেও আমলে নিলো না। উষির ভেতরে দলবল নিয়ে ঢুকে সানগ্লাস খুলে হাতে নিলো। তারপর পাঞ্চাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে বেশ দাম্ভিক ভাবে বললো,
–হ্যাঁ ভাই, কি সমস্যা?

দলবল দেখে দোকানদার লোকটির গলা শুকিয়ে গেছে৷ উষিরের কথা শুনে পিলে চমকে ওঠার মতো ভয় পেয়ে নিজের আসন ছেড়ে উঠে ভয়ার্ত গলায় বললো,
–কিসের সমস্যা ভাই?

–চাঁদা দেও না কেন? জানের মায়া নাই? ফ্যামিলির চিন্তা নাই?

উষির একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে কথাটা বললো। লোকটা থতমত খেয়ে আর্ত গলায় বললো,
–জ-জ্বি ভাই। দিচ্ছি।

উষির বাঁকা হাসলো। তারপর বজ্রকণ্ঠে ডেকে উঠলো,
–মানিক?

মানিক নামের ছেলেটি তার পাসে দাঁড়িয়ে বিনীত গলায় বললো,
–জ্বি ভাই?

উষির আলগোছে পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
–শাটার নামিয়ে ফেল দ্রুত। আর লাইট দিবি না। রুম অন্ধকার চাই।

হুকুম করা মাত্র কাজ হয়ে গেলো। লাইট বন্ধ হতেই উষির ফোনের ক্যামেরা অন করে চারিদিকে ঘুরাতে লাগলো আর তখনই একটা সুক্ষ্ম নীল আলো তার নজর কাড়লো। মুখের হাসি আরো চওড়া হলো। দোকানদার লোকটির মাথায় বজ্রপাত ঘটিয়ে কাষ্ঠ হেসে ভারি গলায় বললো,
–আমার সাথে চালাকি? কাজটা কি ভালো হলো?

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হুকুম দিলো সবাইকে,
–দোকানে যেনো কোন মাল না থাকে৷ টাকায় হাত দিবি না, কিন্তু মাল ছাড়বি না। দেখে যেনো মনে হয়, দোকানদার বস্তা সমেত সব দান করে দিয়েছে। আর এই মালগুলা এতিমখানায় দিয়ে আসবি। বাজার দেওয়া, রান্না করা, খাওয়া সবটা ক্যাপচার করে সোশ্যালমিডিয়ায় পোস্ট দিবি। ক্যাপশন দিবি, উষির ভাইয়ের পক্ষ থেকে এতিমদের দাওয়াত।

–ভাই মন্ত্রীর নাম নিমু না?

যে ছেলেটি কথাটা বলেছে, উষির সেই ছেলেটির কাঁধ চাপড়ে বললো,
–আরে বাচ্চা, নিজেদের পকেটেও কিছু রাখতে হয়। সব কাজের পর ফলের ভাগ পুরোটা বিলাতে হয় না। নিজের কাছেও কিছু রাখতে হয়৷ তবেই উপরে ওঠা যায়। তোর এখনও এসব বোঝার সময় হয় নাই।

দোকানদার লোকটির হাত মুখ বাঁধা। চোখের সামনে তার সর্বস্ব লুট করা হচ্ছে তার সে কিছুই করতে পারছে না। চোখ দিয়ে টপাটপ পানি পরছে৷ এরমাঝেও উষিরের কথাটা কানে যেতেই মূহুর্তকালের জন্য বেদনা ভুলে হা হয়ে তাদের দিকে তাকালো। রাজনীতির আড়ালের এই খবর তার অজানা। চেয়েছিলো তো এই লুটরাজের বিরুদ্ধে কথা বলতে, কিন্তু হারাচ্ছে সবই। এইজন্যই হয়তো কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে না।
উষির অসহায় ভাবে কাঁদতে থাকা লোকটির দিকে তীক্ষ্ণ এক নজর নিক্ষেপ করে বাইরে এসে বসলো। তারপর চুলে আঙুল চালিয়ে মোবাইল পকেট থেকে বের করতে করতে আফসোসের সুরে পাশে দাঁড়ানো মানিকের উদ্দেশ্যে বললো,
–ইসস বউ! বউকে খুব মিস করছি বুঝলি। নতুন নতুন বিয়ে করছি তো। বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকতে ইচ্ছা করে। আমাদের আবার বউ পাগলা নামে বংশগত একটা রোগ আছে।

মানিক নামের ছেলেটির বুক হাহাকার করে উঠলো। তার গার্লফ্রেন্ডের সদ্যই বিয়ে হয়েছে। সেই কষ্টই এখনও ভুলতে পারেনি। এখন আবার নতুন করে কষ্ট পেলো। নাক টেনে কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে দুইজন ছেলে প্রায় মারামারি করতে করতে উষিরের কাছে এসে অভিযোগের খাতা খুলে বসলো,
–ভাই, এই কাজ্জুর বাচ্চা দোকান থাইকা টেকা মারছে। স্বীকারও করে না।

লম্বা চওড়া ছেলেটির অভিযোগের বিরুদ্ধে মারকুটে চেহারার আরেকটি ছেলে লম্বা ছেলেটিকে ঘুষি দেওয়ার জন্য হাত তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–মিছা কথা ভাই। ও মারছে।

–ভেরি গুড কাজ্জু। তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি আমি। তবে আর একটা টাকাও সরালে তার কঠিন বিচার হবে। বি কেয়ারফুল।

উষির ছেলেটির কাঁধ চাপড়ে শাসিয়ে বললো। ছেলেটি কাচুমাচু ভঙ্গিতে সরে গেলো। ওখানকার কাজ শেষে গাড়িতে উঠতেই রাশার কল আসলো৷ উষির মুচকি হেসে কল রিসিভ করতেই রাশার ক্লান্ত স্বর কানে আসলো,
–কখন আসবে?

–মিস করছো নাকি?

–হুম

উষির বেশ দুষ্টমি করে জিজ্ঞাসা করেছিলো। কিন্তু উত্তর শোনার পর হার্ট বিট করা মিস করলো বলে মনে হলো৷ সময় থমকে গেলো। কপালের ঘাম মুছে ঢোক গিললো সে। স্ত্রীর এমন কথা শুনে কোনো স্বামী এমন নার্ভাস হয় নাকি জানা নেই। তবে উষির হলো। শ্বাস চেপে আর কিছু না বলে কল কেঁটে দিলো। রাশার মন খারাপ হলো ভীষণ। ভাবলো, উষির আসবে না। নোঙরের যত্ন করে পরিয়ে দেওয়া শাড়িটা খুলে ফেললো৷ মাথার গাজরা, হাতের চুড়ি, কানের দুল, মালা সবগুলো খুলে বিছানায় ছড়িয়ে রাখলো। শুধু থাকলো ব্রেসলেট, নুপুর আর মেকাপ। মেকাপটা সে ইচ্ছে করেই তুললো না। উষির আসুক, এসে দেখুক, সে তারজন্য আজ সেজেগুজে বসেছিলো। কিন্তু সে দেরি করেছে।
উষির আসলো আধঘন্টা পর। রাশা তখন মন খারাপ করে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। উষির গিয়ে রাশার সামনে হাটু গেড়ে বসলো। গালে হাত ছুইয়ে আলতো স্বরে বললো,
–মন খারাপ?

রাশা ঠোঁট উলটে আহ্লাদী ভাবে মাথা উপর নিচ করে নাড়ালো। উষির হাসলো। রাশার গাল দুই হাতে আজলা ভরে তুলে মোলায়েম স্বরে বললো,
–ঘুরতে যাবে?

–কোথায়?

–বাইরে। আজ সারারাত ঘুরবো।

–হেঁটে হেঁটে ঘুরবো।

রাশা নিজের ইচ্ছে বলতেই উষির হেসে উঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–চলো?

উষির টি-শার্টের উপর কালো জ্যাকেট পরে রাশার হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হলো। মিনিট খানেকের মধ্যে আকাশ কালো করে অক্টোবরের শীত পরার বৃষ্টি শুরু হলো। অক্টোবরের প্রথম রেইন। উষির উৎফুল্ল মনে গুনগুন করে রাশার হাত ধরে রাখা হাতটা জ্যাকেটের পকেটে রাখলো। গরম আভাসে রাশার মন ভরে উঠলো। উষিরের হাত জড়িয়ে বাহুতে গাল রেখে আলতো স্বরে বললো,
–কি গাইছো?

উষির মিষ্টি করে হাসলো। তারপর গলা তুলে সুর ধরে গাইলো,
ইচ্ছে করে একটা ঘরে থাকবো দু’জনায়
গড়বো ভিটে খুশির ইটে, সঙ্গী হবি আয়

রাশার হাত ধরে ঘুরিয়ে বাকি লাইন গাইলো,

কলের পাড়ে জলের ধারা, ঘরের পরে তুই
চারটে হাতে খেলনা পাতে একজোড়া চড়ুই
সে ভাবনারা চোখ খোলে না..

রাশা খিলখল করে হেসে উঠতেই উষির হাতের আঙুল দিয়ে তার নাক ছুঁইয়ে মিটিমিটি হেসে গানের শব্দ পরিবর্তন করলো,

ও রাশা বোঝে না, বোঝে না, বোঝে না
রাশা বোঝে না, বোঝে না

কেনো বোঝো না বলোতো?

শেষের বাক্যটা ঝুঁকে রাশার কপালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে কেমন অসহায় স্বরে বললো। রাশা কিছু বললো না। অক্টোবর রেইন তাদের ঝিরিঝিরি করে ভিজিয়ে তুলছিলো৷ তাদের সাথে সাথে নোঙরের মনকেও পুলকিত করছিলো সেই রেইন।
উজান বিছানায় ফাইল ছড়িয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। নোঙর বাইরের ঝিরিঝিরি করে পরা বৃষ্টি থেকে নজর সরিয়ে বিছানায় বসা উজানের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল মেজাজে বললো,
–ফানা মুভি দেখেছো?

তার রাগ আজ অব্দি একদিনের বেশি টেকেনি। পালিয়ে যাওয়ার শখ পূরণ না করার রাগটাও কয়েক ঘন্টাই মাত্র টিকেছিলো৷ তার পরপরই পূর্বের নোঙরে ফিরে এসেছিলো।

–আমি মুভি দেখি না। টাইম ওয়েস্ট!

উজানের বলা কথাটা তার কানে গেলেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছালো না৷ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে বেশ হাসিখুশি মেজাজে বললো,
–ওখানে একটা ডায়লগ ছিলো। ওই ডায়লগটা তোমার জন্য মুখস্থ করেছি।

–আচ্ছা! বলো শুনি?

উজান ল্যাপটপ রেখে নোঙরের দিকে মনোযোগ দিলো। নোঙর গলা খাঁকারি দিয়ে বলা শুরু করলো,
–তেরে ইস্ক কে লিয়ে…

মাথা নাড়লো নোঙর। শুরুটা এমন ছিলো না। আবার চেষ্টা করলো,
–তেরে দিল মে মেরি জান..

হতাশ হলো। ঠোঁট উলটে বললো,
–ভুলে গেছি মনে হয়। মোবাইলে লিখে রেখেছি।

উজান ভ্রু কুঁচকে বললো,
–একটা সিমপল ডায়লগ মনে রাখতে পারো না!

নোঙর গাল ফুলিয়ে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখতে মনোযোগী হলো৷ মূহুর্তকাল পরেই পেছনে উজানের অস্তিত্ব অনুভব করে পেছন ঘুরতে চাইলেই উজান তার কোমড় টেনে নিজের বুকের সাথে তার পিঠ ঠেকিয়ে কাছে নিয়ে আসলো। নোঙর ধুকপুক করা বুক নিয়ে মাথা পেছনে ঘুরাতেই উজান তার গালে লেপ্টে থাকা বৃষ্টির ছাঁটে ভেজা চুল সরিয়ে মৃদুস্বরে বললো,

–তেরে দিল মে মেরি সাসোকো পানা মিল যায়ে, তেরে ইস্ক মে মেরি জান ফানা হো যায়ে।

নোঙরের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। বিষ্ময়ে বললো,
–তুমি জানতে এটা?

উজান নোঙরের নাকের সাথে নাক ঘষে মৃদু হেসে বললো,
–উহু! গুগোল থেকে জেনেছি৷

নোঙর নাক ফুলিয়ে দুই হাতে উজানের বুকে ধাক্কা দিতেই উজান হোহো করে হেসে উঠলো৷ তারপর বেশ শক্ত একটা চুমু দিয়ে কোলে তুলে নিলো। নোঙর হায় হায় করে উঠলো,
–পরে যাবো আমি। নামাও বলছি। পরে গেলে কিন্তু তোমার খবর আছে।

উজান তাকে নামালো বটে তবে তাকে ফেলে দেওয়া বললে বেশি ভালো হয়। বিছানা পর্যন্ত নিয়ে ঠাস করে ফেলে দিয়েছিলো৷ তারপর নোঙরের উপর আধশোয়া হয়ে চোখ টিপে বললো,
–ইস্ক ইস্ক করছো আর ইস্কের ডেফিনেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না?

নোঙর মারকুটে চেহারা নিয়ে তাকাতেই উজান তার নাকে আলতো করে কা’মড় দিলো। নোঙর আতকে উঠে নাকে হাত দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে উজানের হাতে কা’মড় দিলো। তারপর শাসিয়ে বললো,
–ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা আর কামড়ের বদলে কামড়।

উজান হাত ঝেড়ে উঠে বসে চোখ গরম করে বললো,
–ভালোবাসলে তো জীবনে ভালোবাসো না। তাহলে কা’মড়ে এমন বদলা কেনো?

নোঙর কিছু না বলে কম্ফোর্টার মাথার উপর জড়িয়ে শুয়ে পরলো। উজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাইল ল্যাপটপ সরিয়ে নোঙরের পাশ ঘেঁষে শুয়ে পরলো। তারপর কম্ফোর্টার জড়িয়ে শুয়ে থাকা নোঙরের কানের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–এরপর সবসময় একটা চাকু ক্যারি করবো। ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা না পেলে সোজা মা’র্ডা’র।

নোঙর কম্ফোর্টারের ভেতরে পেট চেপে হাসতে লাগলো। এরপর তাকে কা’মড় দিলে যে সে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা তো জানেই না৷ শীতকাল আসছে। মজা হবে বেশ ভেবে আরো হাসি পেলো।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৪০ (প্রথমাংশ)

সকালের ব্রেকফাস্টের সময় সেই ভয়ানক কান্ড ঘটে গেলো। টিভি সিরিয়ালে যেমন ফ্যামিলি মোমেন্টে ভয়ানক কান্ড হয়, তেমনই ভয়ানক কান্ড ছিলো সেটা। বাড়িতে পুলিশ এসেছে। আর পুলিশ এমনি এমনি কারো বাড়িতে যায় না। কিন্তু যখন যায় তখন কিছু না কিছু নিয়ে তবেই ফেরত যায়। এবারে নিতে গেছে উষিরকে। উষিরের নামে অভিযোগ উঠেছে। তার ভিত্তিতেই তাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। আধ খাওয়া খাবার রেখে সবাই যখন লিভিংরুমে হাজির হলো, তখনই উচ্চপদস্থ ফিটফাট একজন পুলিশ কর্মকর্তা উষিরের সামনে সটান দাঁড়িয়ে বো’মা ফাঁটানোর মতো করে কথাটা বললো,
–লু’টপা’ট আর খু’নের সন্দেহে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে মিস্টার আদনান কায়সার।

সবাই এতোই বিষ্মিত হয়েছে যে মিনিটখানেক হা করে কথাটা বোঝার চেষ্টা করলো। পরিস্থিতি বোঝার পর প্রথমে টনক নড়েলো রাশার। পুলিশের সামনে রুখে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
–আপনারা শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে কিভাবে অ্যারেস্ট করতে পারেন? আপনাদের কাছে কোন প্রুভ আছে? কোন উইটনেস, অ্যালিবি, কিছু কি আছে?

পুলিশ কর্মকর্তার হাতে হাতকড়া ছিলো। সেটাকেই আঙুলে ঘুরিয়ে বেশ কর্কশ গলায় বিদ্রুপের মতো করে বললো,
–আপনারা বরং উকিল নিয়ে থানায় আসুন। এইসব আইনের ব্যাপার স্যাপার আপনাদের মতো বেয়াইনি লোকজন বুঝবে না।

রাশা চাপা শ্বাস ফেলে বললো,
–অলরাইট! জাস্ট হোল্ড আ মিনিট। আ’ল কাম ফাস্ট।

বলেই এক দৌড়ে নিজের ঘরে গেলো। উজান সাইডে দাঁড়িয়ে উকিলকে কল দিলো৷ মাহফুজা ইতিমধ্যে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। শাহিদা যথেষ্ট বুদ্ধিমতি আর শক্ত। যে কোন পরিস্থিতিই শক্ত হাতে সামলানোর চেষ্টা করে। তবে আজকেও পুলিশ ছেলেকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে শুনে খুব অসহায় বোধ করছে। আফসার সাহেবও বাড়ি নেই। আর উপর মাহফুজার কান্নাকাটি। নিজেকে সামলে মাহফুজাকে সামলাতে চেষ্টা চালালো। অন্যদিকে নোঙর ময়নাকে আকড়ে ধরে ভয় কাঁটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তার চোখ দিয়েও টপাটপ পানি পরছে।

উষির নিজের মনে হিসাব চালানোর চেষ্টা চালালো৷ যে দুটো ঘটনার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে সেই দুটো ঘটনাতেই তার হাত দেওয়ার কথা ছিলো না। শেষ মূহুর্তে তার ডাক পরেছিলো। আর দুই মাস পর ভোট। এর আগে কোন নেতার নামে কোন স্ক্যান্ডেল বের হওয়া মানে তার ক্যারিয়ার শেষ। এই মূহুর্তে এমন অভিযোগ এর একটাই অর্থ। তুমি এখন পলিটিক্স থেকে বিদায় নাও! আর এই কাজটা যে তার জেঠা শ্বশুর বেশ নিশ্চিন্ত মনেই করিয়েছে সেটা একটা বাচ্চাও বুঝতে পারবে। তবে সেটা রাশা না বুঝলেই ভালো৷ এমনিতেও যা যা করেছে তাতে যথেষ্ট জল ঘোলা হয়েছে। আর দরকার নেই। তাকেই পরিস্থিতি সামলাতে হবে।
রাশা ফিরে আসলো একটা কার্ড হাতে। পুলিশের হাতে কার্ডটা দিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে,
–আমি…

একটু থেমে সবার দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস ফেললো। তারপর হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে নির্ভিক স্বরে বললো,
–আমি অ্যাডভোকেট দিলওয়ারা জামান চৌধুরী আপনাকে প্রশ্ন করছি, কোন আইনে আপনি শুধুমাত্র সন্দেহের বশে আমার ক্লায়েন্টকে অ্যারেস্ট করছেন? আইনের লোক হয়ে আইন ভঙ্গের শাস্তি জানেন না আপনি? উলটে আপনার নামে হ্যারেজমেন্টের কেস করে দিলে কি হবে বুঝতে পারছেন?

শেষেরদিকে রাশার গলায় বিদ্রুপের স্বর স্পষ্ট বোঝা গেলো। হম্বিতম্বি করা পুলিশের লোকটা বেশ নরম হলো। তাদের ইনফরমেশন মতে এই বাড়িতে কোন আইনের লোক নেই। ভেবেছিলো, উকিল আনতে আনতে এক চোট ধোলাই হয়েই যাবে। উপর মহলের আদেশ বলে কথা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নতুন করে প্ল্যান সাজাতে হবে। সেই সময়টা আর নেই। তাই মাথায় যা আসলো তাই বললো,
–আপনার কাছে আদনান স্যারের উকিল হওয়ার কোন অফিসিয়াল ডকুমেন্ট আছে?

–আপনার কাছে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে?

রাশা চোখে চোখ রেখে পালটা প্রশ্ন করলো। পুলিশের লোকটি হতাশ হয়ে বললো,
–দেখুন ম্যাডাম, আমরা অ্যারেস্ট করছি না। শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাচ্ছি।

–জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায়? আইনের ফাঁকফোকর খুঁজছেন স্যার? আপনি ভুলে গেছেন, আইনের ফাঁকফোকর আপনার থেকে আমি ভালো জানি। পাঁচ বছর মোটা মোটা আইনের বই আর দুই বছর হাইকোর্টে এমনি এমনি প্র‍্যাক্টিস করিনি। আপনি হাতখড়ি রেখে দেন আর অফিসিয়াল অনুমতি নিয়ে এসে ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিয়ে যান।

লোকটি বুঝলো, এখানে আর কিছুতেই কিছু করতে পারবে না। তাই দ্বিতীয় বাক্য ব্যয় না করে ফিরে গেলো। সবাই এতোক্ষণ দম বন্ধ করে ছিলো। ওরা দলবল নিয়ে চলে যেতেই চাপা স্বাস ফেললো সকলে। তারপর শাহিদা বিষ্মিত গলায় বললো,
–তুমি অ্যাডভোকেট?

রাশা মুখ কাচুমাচু করে বললো,
–আনফচুনেটলি খালাম্মা! দুইবার সরকারী জজের এক্সাম দিয়েছি। প্রথমবারে টিকিনি। এবারেও বোধহয় টিকবো না।

বাকি সব উকিলের মতো রাশারও জজ হওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে টেকেনি। ঠিক সেইজন্যই অ্যাডভোকেট হওয়ার কথাটা কাউকে বলতে চাইছিলো না। কিন্তু কি আর করবে! না বলেও উপায় ছিলো না। শেষ মূহুর্তে বলতেই হলো৷ আর এখন তীব্র অস্বস্তি নিয়ে ঠোঁট কামড়ে নখ খুঁটতে লাগলো৷ তার এই অস্বস্তি সকলেই বুঝতে পেরে তাকে আর কিছুই না বলে আধ খাওয়া খাবার শেষ করতে গেলো৷

খাওয়া দাওয়ার পর রাশা বাইরে গিয়েছিলো। ফিরেছিলো সন্ধ্যার পর। তার হাতে আর অল্প কিছু সময় আছে। এর মাঝেই সবাইকে সব সত্যি বলে দিতে হবে। সবার আগে বলতে হবে উষিরকে। সে এখনও বাড়ি ফেরেনি। ফেরার অপেক্ষা করতে করতে দশটা পেরিয়ে গেলো।
এগারোটার দিকে চিন্তিত মুখে উষির ফিরলো৷ যে ঝামেলায় জড়িয়েছে, সেই ঝামেলা থেকে বের হওয়া মুশকিল। হয় রাজনীতি ছেড়ে নাও নাহলে স্ক্যান্ডেলে জড়িয়ে পড়ো টাইপের অবস্থা হয়ে পরেছে।
ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে রাশাকে দেখেই মন ভরে উঠলো তার। রাশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি হিসেবে নাইট ক্রিম লাগাচ্ছিলো। উষির গিয়ে রাশাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আনমনে দাঁড়িয়ে থাকা রাশা চমকে উঠে আয়নার তাকালো। তারপর উষিরকে দেখে তার মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো। বিষন্ন মনেই উষিরের থেকে নিজেকে সরিয়ে ব্যাগ থেকে তার দেওয়া ক্রেডিট কার্ড নিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–তোমার ক্রেডিট কার্ড। আমার আর এটার প্রয়োজন নেই?

–কেনো? মোটা অংকের বেতনের জব পেয়েছো নাকি? তাহলে আমার দ্বায়িত্বও নাও। আমি হাউজ হাজবেন্ড হয়ে যাই আর তুমি ওয়ার্কিং ওয়াইফ।

উষির হাসতে হাসতে বললো৷ তার সাথে রাশাও হাসার চেষ্টা করলো। তাতে মন সায় না দেওয়ায় ঢোক গিলে মলিন মুখে বললো,
–আমি ইউকে যাচ্ছি। পরশুদিন আমার ফ্লাইট।

উষিরের পুরো মনোযোগ হাতঘড়ি খোলার দিকে থাকায় কথাটা ভালো শুনতে পায়নি। তাই পালটা প্রশ্ন করলো,
–কোথায় যাচ্ছো?

–ইউকে।

রাশা মাথা নিচু করে হাত কচলাচ্ছিলো। হাত ঘেমে উঠছে বারবার। উষির কথা বলতে বলতেই পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো। তারপর যাওয়ার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাশার দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিরস গলায় বললো,
–আগে বলতে আমাকে। আমিও সাথে যেতাম। যদিও একটু সমস্যা হতো কিন্তু ম্যানেজ করে নিতাম। আচ্ছা যাই হোক, কবে আসবে?

–পড়াশোনার জন্য যাচ্ছি। কবে আসবো জানি না।

–এখানে থেকে পড়া যায় না?

–না।

–তাহলে কয়েকমাস পরে যাও। দুইমাস পরে ইলেকশন। তারপর আমি ফ্রী৷ তখন যেও, সামার সেশনে।

রাশা ভেজা চোখ তুলে উষিরের চোখে চোখ রাখলো। প্রসঙ্গ পালটে শক্ত গলায় বললো,
–তোমার নামে যে অভিযোগগুলো এসেছে, তার সবগুলোই সত্যি। তাই না?

রাশার হঠাৎ পরিবর্তনে উষির হকচকিয়ে গেলো। রাশার গালে হাত রেখে বিচলিত স্বরে বললো,
–হঠাৎ এসব বলছো কেনো? কেউ কিছু বলেছে?

রাশা তীব্র আক্রোশে উষিরের হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলো,
–আমার প্রশ্নের আন্সার দাও। সবগুলোই সত্যি ছিলো?

–না।

উষির চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিলো। একদিন থেকে সে সত্যিই বলেছে। নিজের হাতে এই কাজগুলো সত্যিই করেনি। তবে নিজে করিয়েছে।

–তোমার ঘড়িতে র’ক্ত লেগেছিলো। আমি দেখেছি৷

মিথ্যা উত্তরে রাশা চিৎকার করে উঠলো৷ উষির বিরক্ত হলো। ক্লান্ত গলায় দুই পা এগিয়ে বললো,
–রাশা, বি নরমাল। এতো হাইপার হচ্ছো কেনো?

রাশা নিজের ব্যবহার বুঝতে পেরে চুপ করলো। সেকেন্ডের মাথায় আবার বললো,
–উষির, তুমি তোমার জীবনের সব থেকে বড় কোন জিনিসটা হারিয়েছো?

উষির এগিয়ে রাশার গাল আলতো হাতে ধরে মাথায় চুমু দিলো৷ তারপর মৃদু হেসে বললো,
–কিছু না।

–রাজনীতি তোমার স্বপ্ন রাইট?

আবার রাশার গম্ভীর কণ্ঠে উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এক হাতে রাশার হাত ধরলো। অপর হাত দিয়ে গাল ধরে ঝুঁকে তার মাথায় মাথা ঠেকিয়ে আকুল হয়ে বললো,
–হ্যাঁ কিন্তু এসব বলছো কেনো রাশা? প্লিজ যাওয়া ক্যান্সেল করে দাও। আমি তোমাকে ছাড়া এক মূহুর্তও থাকতে পারবো না। প্লিজ রাশা!

রাশা চোখ বুজে কিছুক্ষণ বড় বড় শ্বাস নিলো৷ তারপর বো’মা ফাঁটানোর মতো করে বললো,
–তোমার হাতে দুইটা অপশন আছে। আমি আর রাজনীতি। আমাকে পেতে হলে তোমার রাজনীতিকে হারাতে হবে। আর রাজনীতি পেতে হলে আমাকে হারাতে হবে। নাও চয়েস ইজ ইয়োর।

অবাক বিষ্ময়ে উষিরের হাত খসে পরলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে আর্তনাদের মতো করে ডেকে উঠলো,
–রাশা!

রাশা ছলছল চোখে উষিরের পাঞ্চাবির হাত মুঠো করে ধরে আহত গলায় বললো,
–বড় কিছু না হারিয়ে বড় কিছু পাওয়া যায় না। একটা বলিদান তোমাকে দিতেই হবে। সেটা আমি কিংবা পলিটিক্স।

উষির রেগে রাশার হাত পিছমোড়া করে ধরে আরেক হাতে তার গলা টিপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
–যে কথাটা আজকে ভেবেছো সেটা দ্বিতীয়বার ভাবার চেষ্টাও করো না। খু’ন করে ফেলবো একদম। তারপর না থাকবে তুমি আর না থাকবো আমি৷

কথা শেষ করার সাথে সাথে রাশাকে প্রায় ছিটকে ফেলে দিলো। তার চোখ দিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে রাশাও জ্বলে উঠলো৷ চোখের সামনে তার বাড়ির মেয়েদের অপমান আর চুপচাপ মার খাওয়ার ঘটনা মনে পরতেই তীবে আক্রোশে ফেঁটে পরলো। উষির তার গলা বেশ শক্ত করেই চেপে ধরেছিলো৷ এখনও ব্যথা করছে৷ কিন্তু সেদিকে তার নজরও গেলো না৷ খ্যাপা ষাড়ের মতো তেড়ে এসে উষিরের গালে সপাট এক চড় দিয়ে আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,
–ডোন্ট ইউ ডেয়ার দিস। আমাকে টর্চার মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে ভাবলে খুব ভুল ভেবেছো। এই কাজটা দ্বিতীয়বার করার সাহস দেখাবে না।

রাশার মনে হয়েছিলো, আজকের এই প্রতিবাদটা না করলে নিজেকে সে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবে না। সেও তার মা, বড় মায়ের দলে সামিল হবে। এটা তো সে কখনই চায় না।
উষির গালে হাত দিয়ে আগুন চোখে রাশার দিকে তাকালো। তারপর রাশার ঘাড় এক হাতে শক্ত করে ধরে নিজের দিকে টেনে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
–যতদিন না মাথা থেকে এই ভুত বের হয় ততদিন থাকো এই রুমে বন্দী হয়ে।

বলেই আবার ছিটকে ফেলে বাইরে বের হয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাশা বন্ধ দরজার ওপাড় থেকে চিৎকার করতে করতে দরজা ধাক্কাতে লাগলো,
–উষির ওপেন দ্য ডোর?

উষির দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা ভাজ করে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। হাত দুটো ভাজ করা। ক্লান্ত শরীর এতো ধকল মেনে নিতে পারছে না। যেমন মাথা ব্যথা করছে, তেমনই শরীর দুর্বল লাগছে। একটু আগেও তার কাছে আগামীকাল সকাল একটা নিশ্চিন্ত সকাল ছিলো৷ কারন সেই সকালে রাশা থাকতো তার কাছে। এখন তো পরের মূহুর্তও তার কাছে দুর্বিষহ!

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৪০ (শেষাংশ)

রাশার চিৎকার চেঁচামেচিতে পরিবারের সবাই দৌঁড়ে আসলো৷ আর দরজার সামনে এসে উষিরকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে থমকে গেলো। ভেতর থেকে রাশার ক্রমাগত চিৎকার ভেসে আসছে। শাহিদা পরিস্থিতি বুঝে রেগে বললো,
–দরজা খোল উষির।

–তুমি, তোমরা কেউ আমাদের মাঝে ঢুকবে না। এটা আমার আর রাশার প্রবলেম। আমাদেরই সলভ করতে দাও।

উষির রেগে কিড়মিড়িয়ে তেতে উঠে শাসিয়ে বললো। শাহিদা দ্বিগুণ রেগে বললো,
–নিজেদের সমস্যা হলে এমন ব্যবহার না করে তোরা একা একাই সামলে নিতি৷ এভাবে তুই রাশাকে অপমান করছি।

–তুমি জানো ও কি বলছে? আমার সাথে বিচ্ছেদের কথা বলছে। কত বড় সাহস ওর।

উষিরের গলার স্বরে অসহায়ত্ব ফুটে উঠলেও শেষের কথাটা বলে রেগে দরজায় সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লাথি দিলো। দরজার ওপাশে থাকা রাশা ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো।
উষিরের ব্যবহার দেখে তেজি স্বরে শাহিদা বললো,
–তো কি জোর করে রাখবি?

–দরকার হলে তাই থাকবে৷ যতদিন না মাথা থেকে ভুত নামে ততদিন এভাবেই বন্দী থাকবে।

–কেনো বন্দী থাকবে? ও কি পশু পাখি যে জোর করে আটকে রেখে পোষ মানাবি? নাকি পাখা কেঁটে উড়া আটকাবি? দরজা খোল আর ঠান্ডা মাথায় কথা বল। শুধু শুধু পরিস্থিতি বিগড়ে দিস না৷

উষির ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলেও রাগ কমাতে না পেরে রেগে দেয়ালে ঘুষি দিয়ে বললো,
–যা খুশি করো।

বলেই তীব্র বেগে বাইরে চলে গেলো। শাহিদা দরজা খুলতেই ভেতরে থাকা বিধ্বস্ত রাশা বেড়িয়ে আসতেই নোঙর গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। রাশা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিলেও কারো কোন প্রশ্নের জবাব সে দিলো না। শুধু জানিয়ে রাখলো, আর দুইদিন পর সে ইউকে চলে যাচ্ছে। এতোদিনে সবাই এতোটুকু তো বুঝেছে যে রাশা না চাইলে জীবনেও আর কিছুই বলবে না।তাই আর জিজ্ঞাসাও করলো না।

পরের পুরো একটা দিন উষিরের কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না। ফিরলো মাঝরাতে। ফেরার পর নিজের ঘরে না গিয়ে মায়ের ঘরে গেলো। শাহিদা বিধ্বস্ত ছেলেকে দেখে চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না। মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। উষির ঢোক গিলে আহত পাখির মতো নিজেকে গুটিয়ে মায়ের কোলে শুয়ে পরলো। তারপর কাঁপা গলায় বললো,
–আমি এখন কি করবো মা? কোনটা বেছে নেবো? রাশাকে হারানোর কথা মনে আসলে দম বন্ধ হয়ে আসে। আর রাজনীতি আমার স্বপ্ন। স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট কি বেশি বড়, মা?

শাহিদা ছেলের মাথায় আঙুল চালিয়ে বিলি কাঁটতে কাঁটতে ভাবুক হলো। রাশা নিজের শর্তের কথাটা সবাইকে পরেরদিন সকালে বলেছিলো৷ তাই উষিরের অবস্থা বোঝার জন্য খুব বেশি পরিশ্রম তাকে করতে হয়নি। অবস্থা বুঝে তার ঔষধ হিসেবে ছেলেকে বুঝাতে চাইলো শাহিদা। তাই উষিরের কপালে হাত রেখে মৃদু হেসে বললো,
–মানুষের জীবনে তো কত স্বপ্নই পূরণ হয় না বাবা। রাজনীতিতে যাওয়ার স্বপ্ন তো তোর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হয়েছে। আগে তো আরো কত স্বপ্ন ছিলো। সেগুলো তো পূরণ হয়নি। তোর তো অ্যাস্ট্রোনট হওয়ারও ইচ্ছে ছিলো। তোর ঘরটা আকাশের মতো রঙ করেছিলি৷ ঘরজুড়ে প্লেন, রকেটের খেলনা ছিলো। সেটা যখন পূরণ হলো না তখন নতুন স্বপ্ন খোঁজা শুরু করলি। প্রিয় মানুষের সুখের জন্য স্বপ্ন কুরবানী করা যায়, আমার স্বপ্নের জন্য প্রিয় মানুষকে কুরবানির করা যায়। যখন স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায় তখন একসময় গিয়ে মনে হয়, এর পেছনে ছুটে আমি সুখ পেলাম না। আবার প্রিয় মানুষটাকে পেয়ে গেলে একসময় মনে হয়, মানুষটার পেছনে ছুটে আমি আমাকে হারিয়ে ফেললাম।

উষির ভেজা চোখেই হেসে ফেললো,
–তুমি তো আমাকে আরো কনফিউজড করে দিচ্ছো মা? আমি তো তোমার কাছে সমাধান নিতে এসেছিলাম।

–উষির বাবা শোন, মন দিয়ে শুনবি। ছোট থেকে কারো একটা স্বপ্ন থাকে না। কেউ ডক্টর হওয়ার পাশাপাশি সিঙ্গারও হতে চায়। একসময় দেখা যায়, সাকসেসফুল ডক্টর হয়েও আফসোস থেকে যায়৷ এই আফসোসটা সবার নিত্যসঙ্গী। কেউ একটাতে সন্তুষ্ট হতে পারে না। যে যা পায় না, তার সেটারই আফসোস থেকে যায়। তুই রাজনীতি চুজ করলে রাশার জন্য আফসোস করবি আর রাশাকে চুজ করলে রাজনীতির জন্য আফসোস করবি। এখন সিদ্ধান্ত তোর, তুই স্বপ্নের খোঁজে বের হবি নাকি প্রিয় মানুষের খোঁজে।

–তুমি হলে কি করতে মা?

ছেলের প্রশ্নে শাহিদা এক মূহুর্তের জন্য থমকালো৷ তারপর উদাস গলায় বললো,
–আমি হলে প্রিয় মানুষকে চুজ করতাম।

–আর স্বপ্ন?

–রাজনীতি ক্যারিয়ারে তুই শেষ বয়সে এসেও ঢুকতে পারবি। কে জানে, তখন রাশার ভীতি দূর হয়ে গেলো। আমি রাশার পরিবার সম্পর্কে কিছু জানি না। কিন্তু এইটুকু বুঝেছি, ওর পরিবার সম্পর্কে ভাবলে ওর কষ্ট হয়। ওর কষ্টটা তোর দূর করতে হবে। তোদের সম্পর্কটাও কতদিনের বল! এই কয়েকদিনে ওর হয়তো ঠিক করে ভালোবাসাও হয়ে ওঠেনি। কে বলতে পারে, হয়তো একদিন ও নিজেই তোর পাশে এসে দাঁড়ালো। তাছাড়া, তোর আরেকটা স্বপ্নও তো পূরণ করা বাকি তাই না?

উষির মাথা ঝুকিয়ে হাসলো, উত্তরে কিছু বললো না। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো,
–তাহলে কি রাশাকে চুজ করবো?

–সেটা তোর সিদ্ধান্ত। তবে কোন এক্সপেকটেশন ছাড়া ওর কাছে যেতে হবে। এমনও হতে পারে, ও কখনও পলিটিক্স সাপোর্টই করলো না। তোকে আবার বাঁধা দিলো।

উষির আর পালটা প্রশ্ন করলো না। শাহিদার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে রইলো। তার কাছে পুরো রাত পরে আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, ভাবার জন্য। এখন একটু শান্তি চায়। শুধুই শান্তি। এই শান্তির খোঁজে উষির মনে মনে গেয়ে উঠলো,

Someone stole the moon tonight
Took my light
Everything is black and white
Who’s the fool who told you boys don’t cry?

বয়েস অলসো ক্রাই। কান্না ছেলে মেয়ে দেখে হয় না। কান্না তো কান্নাই৷ কষ্ট পেলে, ব্যাথা পেলে চোখে পানি আসবেই। তার চোখেও আসলো৷ চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি গড়িয়ে পরলো৷ তারপর মায়ের চোখের আড়ালে চোখ মুছে চোখ খিচে বন্ধ করে রইলো।

রাশা মলিন মুখে ব্যাগ গোছাচ্ছিলো৷ নোঙর কথা বলতে এসে নিজেও হাত লাগালো৷ অনেক সময় চুপ করে থাকলেও একসময় আর না পেরে হাতের কাপড় রেখে মুখে হাত চেপে ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
–প্লিজ আপু, যেও না। সবার মন খারাপ।

রাশা বিচলিত হয়ে নোঙরের গালে হাত রেখে চোখ মুছে দিয়ে বললো,
–কান্না করছো কেনো? কারো সামনে কান্না করা মানে নিজেকে দুর্বল ভাবা। বুঝেছো? কান্না করতে হয় একা একা।

–ভাইয়াকে ক্ষমা করে দাও আপু। প্লিজ?

রাশা নোঙরকে কিছু কিছু বলেছিলো৷ তাতেই সে বুঝেছে, উষিরের উপর রাগ করে রাশা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তাই এমন কথা বললো। রাশা তার কথা শুনে স্নান কণ্ঠে বললো,
–আমার একটা অযুহাতের প্রয়োজন ছিলো নোঙর। অযুহাত পেয়ে গেছি।

বলেই চোখ বুজে বড় করে শ্বাস ফেললো। নোঙরও নীরবে অশ্রু বিসর্জন ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না।

যাওয়ার সময় রাশা শাহিদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বললো,
–তোমাকে অনেক মিস করবো খালাম্মা। সময় নিয়ে ইউকে যাবে অবশ্যই৷ তোমারা গেলে আমার খুব ভালো লাগবে৷

শাহিদা কিছু না বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলো। ইমোশনাল ফুপু ও তার ইমোশনাল ভাতিজি রাশার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিলো। এয়ারপোর্টে তার সাথে গেলো উজান।
পুরোটা সময় বারবার করে চারিদিকে নজর বুলিয়েছিলো রাশা। একসময় বুঝতে পারলো, উষির নিজের ক্যারিয়ার চুজ করেছে৷ তারই মতো। মনে মনে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো সে৷ আসলেই দুনিয়ার সব মানুষই সেলফিস হয়। কেউ নিজেরটা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।
প্লেনে বসার আগ পর্যন্ত রাশার মনের কোনে আশার বাতি টিমটিম করে জ্বলছিলো। ইমিগ্রেশনের সময় বারবার পেছন ফিরে দেখছিলো উষির আসছে নাকি। একটা সময় তো মনেই হলো, আর একবার ডাকুক। কিছুতেই আর ফিরিয়ে দেবে না। শুধুমাত্র আর একবার ডাকুক!
বিচ্ছেদের অন্তিম মূহুর্তে তো এমনটাই হয়। পাশ থেকে ক্রমাগত ডাকলেও সারা দিতে ইচ্ছা করে না। আর যখন ওপাশের মানুষটা ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয় তখন মন বলে ওঠে, একবার ডাকুক। আর একবার৷ এইবার ফিরিয়ে দেবো না। অথচ এই ডাকটা তার পক্ষ থেকে আসলেও আসতে পারতো। কিন্তু জেদ বলেও একটা কথা আছে৷ জেদ, ইগো যে সবসময় ভালো বয়ে আনে তা তো না৷ যেমন এখন সেসবই তাদের বিচ্ছেদের কারন হলো। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে প্লেনে উঠে বসলো। এরপর রাশার এক বুক আশাকে নিরাশা বানিয়ে প্লেন উড়ে চললো তার নিজের গন্তব্যে।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৩৭+৩৮

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৭

উষির রাশার সম্পর্ক দিনদিন অবনতিই হচ্ছে। উষির যত কাছাকাছি যেতে চাইছে, রাশা তত পিছু হাঁটছে। উজান আর নোঙরের রিসেপশনের তিন চার দিন আগে থেকে তো উষিরও কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রাতেও ঠিকমতো বাড়িতে আসে না। আর যখন ফেরে তখন রাশা ঘুমিয়ে কাদা। তবে ঘরে ফেরার পর স্ত্রীর মুখটা দেখেই সে শান্তি পায়৷ স্ত্রী যতই অভিমান করুক, যাই করুক, শুধু তার কাছে থাকলেই হতো। এটাই তার থিউরি।
রাশা স্ত্রীসুলভ আচরণ করবে কিংবা তার খেয়াল রাখবে, এটা তো সে কখনও চিন্তাও করেনি। উষির নিজে নিজে ভালোবেসেই খুশি থাকে, আনন্দে থাকে। আর মন তো আছেই৷ সে সবসময় তাকে বোঝায়, রাশা যেটা প্রকাশ করে ও সেটা একদমই না। এটা তার লোক দেখানো ব্যবহার। নিজেকে এমনভাবে জাহির করেই সে আনন্দ পায়। আর যেটা যে ভেতরে রেখেছে, ওটা খুব ভাঙুর আর কষ্টে জর্জরিত। ভেতরের সত্তা অল্পতেই যখন ভেঙে পরে ঠিক তখনই বাইরের সত্তাটা জাগ্রত হয়। উষির রাশার কোন সত্তাকেই কষ্ট দিতে চায় না। ও যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক৷ তবুও তার থাকুক। তার এটুকুতেই চলবে। প্রতিটা মানুষই আলাদা হয়। রাশাও তেমনই আলাদা। আর ওকে সেভাবেই গ্রহণ করেছে সে। না বদলাতে চায় আর না ছাড়তে চায়৷ রাশার ব্যবহার যেমন মাঝে মাঝে কষ্ট দেয় তেমনই আনন্দও দেয়। একজন মানুষের শুধুমাত্র মন জুগিয়ে চলা তো সম্ভব নয়। ভালো খারাপ দুটোই তো মানুষের অংশ। তাহলে তার থেকে সারাক্ষণ ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। উষির বোঝে সব। আর বোঝে বলেই স্ত্রীর রাগ তার মনভুলানো হাসিতে উড়িয়ে দেয়৷

রিসেপশনের জন্য রাশা লাল রঙের জামদানি শাড়ি পরেছে। শাড়িটা উষির গিফট করেছে৷ কিনে এনে বিছানায় রেখে তার দিকে আড় চোখে একবার তাকিয়েছিলো শুধু৷ তারপর নিজের অ্যাক্টিং স্কিল জাহির করতে বলেছিলো,

–কি কান্ড দেখেছো! একজনের থেকে টাকা পেতাম। দুই বছর পর ফেরত দিলো তো দিলো, তাও কিভাবে দিলো? সেই টাকার বিনিময়ে শাড়ি হাতে ধরিয়ে দিলো। এখন এটা পরে পরে নষ্ট হবে শুধু। তার থেকে ভালো, শাড়িটা তুমিই ব্যবহার করো।

সব শুনে এবং সত্যিটা বুঝে মুখ লুকিয়ে হেসেছিলো রাশা। তারপর বুঝতে পারেনি এমনভাবে কৌতুহলী গলায় বলেছিলো,
–কত টাকা ধার নিয়েছিলো?

–দেখো রাশা, এইসব ছোটখাটো ব্যাপার আমার মনে রাখার কোন কারণ নেই৷ কত দ্বায়িত্ব আমার! এরমাঝে কে কত টাকা নিলো, দিলো সেই হিসাব আমি রেখে কি করবো৷ পেয়েছি, এনেছি। ব্যাস হয়ে গেলো।

–হয়ে গেলো?

রাশা গালে হাত দিয়ে কৌতুহলী গলায় প্রশ্ন করেছিলো। উত্তরে উষির কাঁধ নাচিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে শিষ বাজিয়ে গাছাড়া ভাবে ঘর থেকে চলে যায়। এতে রাশা উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। কোন এক কাজে উষিরকে নারায়নগঞ্জ যেতে হয়েছিলো। সেখান থেকেই এনেছে হয়তো। সরাসরি দিলেই হতো৷ সে কি না করতো নাকি! খানিক সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিলো রাশা৷ নিতো না হয়তো৷ নিলেও পরে সেটা কাউকে না কাউকে অবশ্যই দিয়ে দিতো। এখন তা দেবে না হয়তো। হয়তো কি! সে দেবেই না কাউকে। এটা তার কাছেই থাকবে৷ আর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর শাড়িটা আর পরা হয়নি। আজকে যখন সুযোগ এসেছে তখন পরার জন্য আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি।

শাড়ি পরার পর সাজার জন্য ড্রেসিং টেবিলে বসে মেকাপ নিয়ে টুকটাক সাজছিলো সে। উষির ধীর পায়ে এসে রাশার সামনে হাঁটু মুড়ে বাবু দিয়ে বসে তার একটা পা নিজের হাতে নিয়ে নিজের উরুর উপর রাখতেই চমকে উঠে রাশা। পা সরিয়ে নিতে চাইলেও উষির শক্ত হাতে ধরে আলতার কৌটা থেকে তুলির সাহায্য আলতা নিয়ে পায়ে পরিয়ে দিতে লাগলো। ঠান্ডায় আর সুরসুরিতে পা কেঁপে উঠলো সে। অস্বস্তি মাখানো স্বরে বললো,
–কি করছো তুমি? আমি কি আলতা পরিয়ে দিতে বলেছি নাকি পরতে চেয়েছি?

উষির কথা বললো না। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ আলতা পরানোর দিকে। মনোযোগ দিয়ে আলতা পরানো শেষে পকেট থেকে নুপুর বের করে পায়ে পরিয়ে দিলো। পরানো শেষে হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে নুপুরের স্লাইড করে মোলায়েম স্বরে বললো,
–এটা খুলবে না৷ আওয়াজ হয় না, তাই সমস্যা হবে না।

–হারিয়ে গেলে?

রাশা হাঁটুতে কনুই রেখে গালে দিয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করলো। উত্তরে উষিরও তার দিকে নির্নিমেষ চোখে চেয়ে লহু গলায় বললো,
–আবার কিনে দেবো।

–উষির।

রাশা খানিক রাগ করতে মেকি গলায় ডেকে উঠলো। উষির বুকে হাত দিয়ে হাঁসফাঁস করে বললো,
–ইসস রাশা! বুকের মধ্যে কেমন একটা করে উঠলো। আরেকবার ডাকো তো?

রাশা চোখ বুজে শ্বাস ফেললো। বোধহয় রাগতে চেয়েছিলো কিন্তু ভুলে হেসে ফেললো। এবং সেটা বোঝার সাথে সাথেই লজ্জা পেয়ে উষিরের কাছ থেকে পা সরিয়ে দ্রুত রুম ত্যাগ করলো। উষির হেসে ফেলে বিড়বিড় করলো,
–রাশা চৌধুরী তাহলে লজ্জাও পায়! সুন্দর তো!

অন্যদিকে ম্যারেজ হলের কাহিনী অনেকটা অন্যরকম। ক্যামেরাম্যান উজান আর নোঙরের ছবি তোলার অনেক কসরত করে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তিনি কিছুক্ষণ পর পর উজানের দিকে তাকিয়ে বলছেন,
–আপনি একটু ব্রাইডের দিকে রোম্যান্টিক চোখে তাকান।

উজান নোঙরের পেছনে দাঁড়িয়ে কোমড় চেপে একটু রোম্যান্টিকভাবে তাকানোর চেষ্টা করলো। নোঙরও পেছন থেকে মিটিমিটি হাসি নিয়ে তার দিকে তাকালো। তক্ষুনি আবার তিনি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন,
–হচ্ছে না তো। মনে হচ্ছে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। ভ্রু কুঁচকে আছে তো। সোজা করুন। কোমড়ে সুন্দর করে হাত রাখুন। সুন্দর ছবি আসবে।

নোঙর কুইক রিঅ্যাকশন দিলো। মুখ ভেঙচে বললো,
–উহু! উনি নাকি তাকাবেন রোম্যান্টিক চোখে! রোম্যান্সের আর ও জানে না। আসছে রোম্যান্টিক মানুষ সাজতে!

কুইক রিঅ্যাকশনের এই এক সমস্যা। রিঅ্যাকশন বোঝার চেষ্টা করতে করতেই ঘটনা ঘটে যায়। হলোও সেটা। উজান শুনে ফেলে চোখ গরম করে তাকালো। নোঙর কি হয়েছে জানতে ভ্রু নাচাতেই ক্যামেরাম্যান আবার বিরক্ত হলো,
–দুইজন দুইজনের দিকে এমন মারকুটে চোখে তাকিয়ে আছেন কেন? সবগুলো ছবিই তো এমন এসেছে। একটু সুন্দর করে তাকান। আজকের মেইন ফোকাস তো আপনারাই। আপনাদের ছবি ভালো না আসলে আমার এসে কি লাভ!

উজান বিরক্ত হলো। মহা মহা মহা বিরক্ত। সাথে রেগেও গেলো। সটান সোজা হয়ে হাত ঝেড়ে রাগত গলায় বললো,
–রিডিকিউলাস! আপনি বরং ব্রাইডের ছবি দিয়েই ক্যামেরার ফিল্ম ভরে ফেলুন। আ’ম নট ইন্টারেস্টেড।

বলেই দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো। ক্যামেরাম্যানকে কিছু বলার সুযোগটা পর্যন্ত দিলো না। নোঙর ফিক করে হাসতে নিয়েও হাসলো না। সুন্দর সুন্দর পোজের ছবি তুলতে লাগলো। মিসেস ফ্লোরা লেহেঙ্গাটা দারুন বানিয়েছে। ঐশ্বরিয়া রায়ের লেগেঙ্গার মতোই কিন্তু এতে নিজের মতো ছোঁয়া দিয়েছে। রঙ দিয়েছেন জলপাই রঙের। এটা কি জলপাই রঙ সেটা নিয়ে মতভেদ আছে। এক দল, যার মধ্যে আছে অন্তু নিহান। তাদের মতে এটা পাকা জলপাই৷ আর অপলা, নোঙরের মতে এটা সিদ্ধ জলপাই। মতভেদ যাই থাকুক, রঙটা তাকে খুব মানিয়েছে। আর পরিবর্তন এসেছে ওড়নায়। পাতলা ওড়নার বদলে ব্রাইডাল ভারি ওড়না ডিজাইন করেছিলেন। অপলার জন্য অবশ্য অন্যরকম ডিজাইন করেছেন। ওর লেহেঙ্গা স্কাই ব্লু রঙের। শুধু বদল বলতে এইটুকুই। বাদবাকি সব সমান। দুটো লেহেঙ্গাই অসাধারণ হয়েছে। যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি পরেও মানিয়েছে দারুন।
নোঙরের জুয়েলারি বলতে দুটো বড় কানের দুল আর নাকে ছোট টানা নথ। আর গলায় উজানের দেওয়া সেই লকেট। সেটা সে প্রায় মারামারি করেই তার থেকে ফেরত কম ছিনিয়ে নিয়েছে বেশি। সে যেভাবেই নিক, সেটা বিষয়বস্তু নয়। নিতে পেরেছে, এটাই যথেষ্ট।

অনুষ্ঠানের কোন এক ফাঁকে নোঙর উজানের হাত চেপে ধরে বললো,
–চলো পালাই।

উজান হতভম্ব হয়ে গেলো। একবার ধরে রাখা হাতের দিকে আর একবার নোঙরের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত স্বরে বললো,
–কোথায় যাবো?

নোঙর উজানের এক হাত চেপে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–তুমি যাব ইউ মেট ফিল্ম দেখোনি?

–না।

–রসকষহীন পুরুষ মানুষ কোথাকার!

বিড়বিড় করে বললো নোঙর। উজান তীক্ষ্ণ চোখে সেটা দেখলো। নোঙর উজানের চাহনি দেখে হাসার চেষ্টা করে দাঁড়িয়ে পরে বললো,
–ওখানে না কারিনা কাপুর আর শহীদ কাপুর পালিয়ে যায়। ট্রেনে করে পালায়। কি অ্যাডভেঞ্চারাস একটা মোমেন্ট! একদম ডিডিএলজে আর চেন্নাই এক্সপ্রেসের মতো দৌঁড়ে ট্রেনে উঠে ট্রেন যেখানে যায় আমরাও সেখানেই যাবো। আগে তুমি উঠবে আর পরে আমাকে হাত ধরে উঠাবে। ওই শাহরুখ খান যেমন দীপিকাকে তুলেছিলো, তেমন। তারপর যাব ইউ মেটের মতো আমরা যদি ট্রেন ফেল করি তো মজাই মজা।

বলতে বলতে চোখ চকচক করে উঠলো তার। উজান কি করবে আর কি ভাববে কিছুই বুঝতে পারলো না। হাঁটতে হাঁটতে তারা ততক্ষণে গেটের বাইরে চলে এলো। গেটের বাইরে অন্তু আর অপলা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো। তারা যেতেই উজানের হাতে ব্যাগ গুছিয়ে দিলো।

–শোনো, অনেক জামাকাপড় নিয়ে তো আর পালানো যাবে না৷ তাই এই ব্যাগ নিয়েছি। এই ব্যাগেই কিছু কিছু জিনিস তুলেছি। তোমারটাও তুলেছি৷ এখান থেকেই একটা শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে ওই গাড়ির মধ্যে থেকে চেঞ্জ করে আসো।

উজান একপলক নিজের ড্রেসের দিকে তাকালো। নোঙরের ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে ডিপ কালারের শেরওয়ানি, পায়জামা আর লং কটি পরা সে। সব ডিজাইন মিসেস ফ্লোরার করা। পরা সেট করতে আধ ঘন্টা লেগেছে। এখন আবার চেঞ্জ করতে হবে শুনেই চোখ কপালে তুলে বললো,
–চেঞ্জ করতে হবে কেন?

–তো কি এই শেরওয়ানি পরে পালাবে নাকি?

–তুমি কি এই লেহেঙ্গা পরে পালাবে নাকি?

ভ্রু উঁচিয়ে পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন করলো উজান। নোঙর দাঁত বের করে হেসে মাথা নেড়ে বললো,
–হ্যাঁ, নাহলে লেহেঙ্গা এক পাশে ধরে দৌঁড়াবো কিভাবে? লেহেঙ্গা একপাশে ধরে দৌঁড়ালে তবেই সিনেম্যাটিক ব্যাপারটা হবে।

উজান ডান ভ্রু উঁচিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
–আচ্ছা তো তোমার সিনেম্যাটিক ব্যাপার চাই!

নোঙর গম্ভীরমুখে মাথা নাড়লো। চোখেমুখে যথাসম্ভব সিরিয়াসনেস এনে বললো,
–দ্রুত চেঞ্জ করে এসো। হাতে সময় নেই। আমি ট্রেনের সময়সূচি দেখেছি৷ আর আধঘন্টা পর ট্রেন আসবে। আর ভাইয়া আর আপু আসছে না কেনো এখানে? ফোন দাও তো একটু।

–কোন ভাইয়া?

–উষির ভাইয়া আর রাশা আপু।

–ওরাও যাবে নাকি?

উজানের মুখে বিষ্ময় খেলে গেলো। বিয়ের পর প্রথম ঘুরতে যাচ্ছে ওরা। হিসাবমতে এটা ওদের হানিমুন। আর হানিমুনে কেউ ফ্যামিলি নিয়ে যায়!

–তোমার সাথে একা গিয়ে আমি বোর হতে পারবো না। সরি।

নোঙর নাক দিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো। উজান ঠোঁট চেপে নিজের কথাকে আটকে নোঙরের দেওয়া জামাকাপড় নিয়ে গাড়ির মধ্যে থেকে চেঞ্জ করে আসলো। ফিরে এসে দেখলো, উষির আর রাশা তো এসে গেছে কিন্তু নোঙর অন্তুর সাথে ঝগড়ায় ব্যস্ত। বিষয়বস্তু, জুতা।
নোঙর অন্তুকে অনুরোধ করে জুতা দিতে বলছে,
–আমি বলছি আমাকে দে। কিচ্ছু হবে না। যেখানে যাবো সেখানে নতুন জুতা কিনে এটা কুরিয়ার করে দেবো।’

অন্তু সজোরে মাথা নাড়লো,
–অপু আপুর জুতা তুমি ছিড়ে ফেলেছিলে। আমি আর তোমাকে বিশ্বাস করি না। একটুও না।

নোঙর আর অন্তুর কথায় উজান হেসে ফেললো।

–এইটা পরে পালাতে পারবো না তো। বুঝতে হবে তো। তাই তো এই স্নিকার্সটাই আমার লাগবেই লাগবে।

নোঙর কোমড়ে হাত দিয়ে অন্তুর থেকে জুতা নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে৷ কথায় না পেরে রাস্তায় বসে অন্তুর পা থেকে জুতা নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। অবশেষে যখন অন্তু নিজের জুতা দিলো তখন নোঙরের মোবাইল অন্তুর হাতে। নাক মুখ লাল করে সাবধানি স্বরে বললো,
–আমার ফোনের যদি কিছু হয় তাইলে পিঠে বস্তা বেঁধে রাখিস।

অন্তু দাঁত বের করে হাসলো৷ রাশা হাসি থামিয়ে বিচলিত গলায় বললো,
–কিন্তু তোমরা যাবে কোথায়?

–ওরা ঘুরতে যাবে। আর আমরা দুইজন ওদের ট্রেনে তুলে দিতে যাবো।

উষির নোঙরকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে নিজেই প্রশ্নের উত্তর দিলো। এর অর্থ স্পষ্ট, রাশা প্ল্যান সম্পর্কে কিছুই জানে না।

নোঙর ঠোঁট টিপে হেসে উজানকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললো,
–তোমার এই বডিগার্ডগুলো এভাবে পিছে পিছে থাকলে আমরা পালাবো কিভাবে?’

উজান পিছন ঘুরে ইশারায় সবাইকে চলে যেতে বললো। জায়গা ফাঁকা হতেই নোঙর এক হাত দিয়ে লেহেঙ্গা ধরে আরেক হাত দিয়ে উজানের হাত চেপে দৌঁড়াতে শুরু করলো।আচমকা এমন কান্ডে সবাই হকচকিয়ে গেলো। পেছনে উষিরও রাশার হাত ধরে দৌঁড়ানো শুরু করলো। রাশা থতমত খেয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই চেঁচিয়ে বললো,
–ওরা দৌঁড়াচ্ছো কেনো? আর আমরাই বা দৌঁড়াচ্ছি কেনো?

–ওরা দৌঁড়াচ্ছে কারন ওরা পালাচ্ছে। আর আমরা দৌঁড়াচ্ছি কারন ওদের সাথে আমরাও যাচ্ছি।

এবারে ঝটকা লাগলো রাশার। উষির হাত ধরে রাখায় অজানা কারনে সে থেমে গেলো না। শুধু সিএনজিতে ওঠার পর রাগে লাল হয়ে বললো,
–নিউলি ম্যারেড কাপলদের সাথে ঘুরতে যাওয়া কোন ধরনের আক্কেলের কাজ হয় বলতে পারো?

উষির বুক ফুলিয়ে বড় বড় করে শ্বাস ফেলে বললো,
–সমস্যা নেই তো। ওরা এক হোটেলে উঠবে, আমরা আরেক হোটেলে উঠবো।

উষিরের এই বুদ্ধিমান উত্তরে রাশা ঠোঁট চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে মুখ বন্ধ রাখলো। ম্যারেজ হল থেকে বড় রাস্তায় উঠার পর নোঙর উজানকে বললো,
–ফোন বন্ধ করে দাও৷ যাতে আমাদের ট্র‍্যাক করতে না পারে।

উজান হেসে ফোন বন্ধ করে ফেললো। উজানের ফোন যখন ব্যাগের মধ্যে বন্ধ হয়ে পরেছিলো তখন তাদের দুই সিএনজির পিছনে দুটো বড় গাড়ি পিছু নিয়েছে। নোঙর টের পেয়ে আঁতকে উঠলো,
–তোমার গার্ডদের ফোন দাও তাড়াতাড়ি। দুইটা গাড়ি আমাদের পিছু নিয়েছে।

উজান একপলক পিছনে তাকিয়ে পা টান করে সিটে হেলান দিয়ে বসে বললো,
–আসতে দাও। তোমার ভয়ে বেশিদূর আগাতে পারবে না।

প্লাটফর্মে যখন পৌঁছালো তখন ট্রেনে হুলসেল বেজে উঠেছে। আস্তে আস্তে চলতে শুরু করবে এখন। উজান নোঙরের হাত ধরে দৌঁড় দিলো। পেছনে উষিরও রাশার হাত ধরে দৌঁড়ালো।
নোঙর নিজের স্বপ্নের মতো লেহেঙ্গা এক হাত দিয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে উজানের হাত চেপে পিছন পিছন দৌঁড়াতে লাগলো। তারপর যখন উজান ব্যাগ কাঁধে ট্রেনে উঠে গেলো তখন হেসে নোঙরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। নোঙর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার পিছনে তাকিয়ে উজানের দিকে হাত বাড়িয়ে ধরে টান দিয়ে ট্রেনে তুললো। নোঙরকে ভেতরে ঢুকিয়ে উজান উষিরকে টেনে তুললো। উষির রাশার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো৷ ট্রেন আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে৷ রাশার এক পাও চলছে না। স্থীর দাঁড়িয়ে আছে। উষির তার থমথমে মুখ দেখে থমকে গেলো। হাস্যজ্বল মুখ মুহূর্তেই আঁধারে ঢেকে গেলো। মাথা নেড়ে রাশাকে আসতে বলতেই দুই দিকে মাথা নেড়ে না বুঝালো সে। উষিরের সাথে আর কোন পথ সে পাড়ি দেবে না। আর না কোন স্মৃতি তৈরি করবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো উষিরের। এমন মনে হচ্ছে, ট্রেন যত সামনে এগোচ্ছে, রাশার সাথে তার দূরত্ব ততই বেড়ে যাচ্ছে৷ বাড়ানো হাতটা আস্তে আস্তে নামিয়ে ফেললো। উষিরের পেছন থেকে উজান আর নোঙর একসাথে চেঁচিয়ে রাশাকে উঠতে বলছে। উষির না দরজা ছাড়ছে আর না উজানকে নামতে দিচ্ছে। একদম বরফের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

ট্রেনের গতি আরেকটু বাড়তেই পরিবারের সকলে এসে উপস্থিত হলো৷ রাশা তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। একদম কাঠ পুতুলের মতো। পরিবারের সকলেই রাশার এমন ব্যবহারে খুব অবাক হলো। তারাও চেঁচিয়ে উঠলো,
–দৌঁড়াও রাশা, দৌঁড়াও।

রাশা চমকে উঠে তাদের দিকে তাকালো। তার চোখে পানি টলমল করছে। বুক চিড়ে যাচ্ছে। তারপর তার কি হলো সে জানে না! শুধু দেখলো শাহিদা এগিয়ে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে দিয়ে দৌঁড়াতে বলছে। আর সেও সম্মোহনের মতো দৌঁড় দিলো। শাড়ি পরার অভ্যাস তার আছে। শাড়ি পরে দৌঁড়ানোর অভ্যাসও আছে। তাই কোন সমস্যাই হলো না। উষির পুনরায় হাত বাড়িয়ে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হাত আকড়েও ধরলো রাশা। এরপর সবার বুক দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস পরলো। রাশা উষিরের হাতের টানে ট্রেনে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে, কতকাল পর আজ তাদের দেখা হলো। কত জনমের দূরত্ব ঘুচে গেলো তাদের। ঘটনাটা ঘটতে মিনিটের মতোই লেগেছিলো। কিন্তু তাদের কাছে এটা ছিলো এক জনম পাড়ি দেওয়ার সমান।

নোঙরের পুরো সিন দেখে হাত তালি দিয়ে হেসে ফেলে বললো, –ফিল্মে তো এই ক্লাইমেক্সও থাকে তাই না? পালানোতে যদি থ্রিল না থাকে তাহলে সেটা পালানো হলো নাকি?

নিহান মলম বিক্রেতার কাছ থেকে মাইক এনে মাইকে জোরে জোরে বললো,
–যা সিমরান, জি লে আপনি জিন্দেগী।

নোঙর সহ সবাই হেসে ফেললো। তারপর হাতের ইশারায় সবাইকে বিদায় দিতে দিতেই ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দূরে চলে গেলো।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৮

টিকিট ছাড়া ট্রেন ভ্রমণের জন্য তাদের বেশ মোটা অংকের জরিমানা গুণতে হলো। কয়েক স্টেশন যাওয়ার পরেই তাদের পাকড়াও করা হলো৷ টিটি ভীষণ কড়া। কিছুতেই ছাড়বে না। পরিচয় দিলে আরো বেজ্জতি হবে জন্য পরিচয়ও দিতে পারলো না। পরের স্টেশনে নামার পর মাস্ক আর ক্যাপের জন্য স্টেশন মাস্টার তাদের স’ন্ত্রা’সী ভাবতে লাগলো। রেস্টরুমে দুই ঘন্টা বসিয়ে রেখে পুলিশ ডেকে কথাবার্তা বলে তবেই তারা ছাড়া পেলো। রাত তখন একটা। গন্তব্য তাদের এখনও ঠিক হয়নি তবে ট্রেন চলে গেছে। পরের ট্রেন কখন আসবে তারা জানে না। সেসব আলোচনার আগে উষিরের দুঃখ বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। সব জায়গায় প্রাধান্য পাওয়া ছেলেটিকে স্টেশন মাস্টার চিনলোই না। আর চিনলো না তো চিনলো না। সরাসরি স’ন্ত্রা’সী ভাবলো। মেয়ে ভাগিয়ে নেওয়া স’ন্ত্রা’সী। এই দুঃখ তার সহজে যাবার নয়।। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেকিং এর জন্য খুলে ফেলা মাস্ক পরতে পরতে বিষ্ময়ভরা স্বরে বললো,
–আজব! আমাকে চেনেনি!

–স্যোশাল মিডিয়ার পলিটিসিয়ানকে শুধু স্যোশাল মিডিয়ার মানুষই চেনে।

রাশার টিটকারি দিয়ে কথাটা কানে যেতেই উষির চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো। কথাটা যে এতো জোরে বলা হবে সেটা রাশা নিজেও বুঝতে পারেনি তাই হাসার চেষ্টা করে ঠোঁট চেপে অন্যদিকে মুখ নিলো। নোঙর ঘুমঘুম স্বরে বললো,
–আমরা কোথায় ঘুরতে যাবো?

–সিলেট, সেন্টমার্টিন, রাঙামাটি, নিঝুম দ্বীপ..

উষিরের লিস্ট লম্বা। তবে লিস্টের বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন পরলো না। তার আগেই উজান টিপ্পনি কেটে বললো,
–সুন্দরবন যাওয়া যায়। নোঙরের সঙ্গী সাথীদের সাথেও একটু মোলাকাত হয়ে যাবে।

রাগে নোঙরের চোখ জ্বলে উঠলো। রাশা তাকে সামলে নিয়ে বললো,
–খাগড়াছড়ি যাবো। আমটিলাতে একটা অরফানেজ আছে। আমার পরিচিত। সেখানেই আমরা থাকবো।

খাগড়াছড়ির কথা মনে হতেই উষিরের নিজেদের রিসোর্টের কথা মনে পরে গেলো। পাহাড়ের উপর বানানো সেই রিসোর্ট থেকে পুরো খাগড়াছড়ি দেখা যায়। সানসেট আর সানরাইজের মনোরম দৃশ্যও নজরকাড়ে। তৈরি হয়েছে তিন চার বছর হলো। রিসোর্টটা তৈরির সময় আফসার সাহেব পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছিলো। সেইজন্যই তার ওটার কথা মনে আছে। উজানকে জিজ্ঞাসাও করলো,
–ওখানে তো আমাদের একটা রিসোর্ট ছিলো।

–ছিলো কিন্তু..

উজান আমতা-আমতা করলো। রাশার ফ্যামিলি যে কিভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সেটা জলের দরে কিনে নিয়েছে সেটা তার সামনে বলতে অস্বস্তিতে পরে গেলো। তবে রাশা তাকে সেটা থেকে উদ্দ্বার করলো,
–ওটা এখন বুক। তাই ওখানে যাওয়া যাবে না।

–তুমি কিভাবে জানলে?

উষির ভ্রু বেকিয়ে জানতে চাইলো। রাশাও তেমনই তেড়ছা ভাবে বললো,
–আমি মোবাইলের জগতে থাকি না। তাই জানি।

উষির জোরে শ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে প্লাটফর্মে রাখা বেঞ্চিতে বসলো। নোঙরও বসে বসে ঝুমতে লাগলো। উজান তাদের দিক থেকে নজর সরিয়ে চিন্তিত গলায় চাপা স্বরে রাশাকে প্রশ্ন করলো,
–রাশা, ওটা তো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

–হয়েছিলো। বড় বাবা রিসোর্টটা আমার নামে লিখে দিয়েছিলো। আর আমি ওটা আংকেলকে ফেরত দিয়েছি। আংকেল জানে সেটা।

উজান কেমন থতমত খেয়ে গেলো। এসব কাহিনী হলো কবে? এতো বড় একটা ঘটনা বড় বাবা তাকে জানায়নি! এটা তাদের বেশ বড় আর লং টার্ম প্রজেক্ট ছিলো৷ দীর্ঘ সময় ধরে রিসোর্টটা তৈরি করা হয়েছে৷ লাভাংশ প্রায় কয়েক কোটি টাকা৷ সেটা ফিরে এসেছে অথচ সে জানেই না!

খাগড়াছড়ির ট্রেন সেখানে আসে না৷ এতো রাতে গাড়িও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই নিরব স্টেশনেই রাত কাঁটানোর সিদ্ধান্ত হলো। বসে থেকে অপেক্ষা করতে করতে একসময় নোঙর পেট চেপে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
–ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে৷ মনে হচ্ছে কতকাল হলো খাই না।

নোঙরের কথায় বাকিদেরও বেশ ক্ষিদে পেলো৷ পালানোর চক্করে তাদের কিছুই খাওয়া হয়নি। এসে পরেছে শহরের বাইরের কোন এক অপরিচিত এলাকায়। স্টেশনে একটা চায়ের দোকান ছাড়া আর কিছুই নেই। উষির আর উজান সেদিকেই গেলো। চায়ের খোলা দোকানের ভেতরে বেঞ্চির উপর চাদরমুড়ি দিয়ে একটা লোক ঘুমিয়ে আছে। তাকেই ডেকে তোলা হলো। তার কাছেও খাবার নেই৷ উপায় বাতলে দিলো নোঙর। তার ব্যাগে নুডলসের প্যাকেট আছে৷ সবাই বিষ্মিত হলো খুব। উজান হাত ভাজ করে কপাল কুঁচকে বললো,
–তুমি নুডলসের প্যাকেট নিয়ে ট্রাভেল করো?

–না না৷ এটা তো অপশনাল ছিলো। হঠাৎ যদি দরকার পরে, তাই এই ব্যবস্থা।

–তাহলে কেক, ব্রেড বা বিস্কিট আনতে। নুডলসের প্যাকেট নিয়ে এসে কি লাভ? রান্না করতে কোথায়?

–আমার তো ওগুলোর থেকে নুডলসই বেশি ভালো লাগে। তাই নুডলসই এনেছি। এটা এমনিতেই খাওয়া যায় আবার রান্না করেও খাওয়া যায়।

উজান কপাল চাপড়ে বেঞ্চিতে বসে পরলো। নোঙর কাধ নাচিয়ে ঠোঁট উলটে একে একে বারো প্যাকেটের ইন্সট্যান্ট নুডলস বের করলো।
–এতো নুডলস নিয়ে ট্রাভেল করতে?

রাশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো। নোঙর হাসার চেষ্টা করলো। সবার রিঅ্যাকশন দেখে মনে হচ্ছে, সবাই খুব অবাক হয়েছে৷ কিন্তু অবাক হওয়ার মতো কিছু হয়েছে বলে তার মনে হচ্ছে না৷ সে তো ভালো মনেই এনেছিলো৷ এখন তো অস্বস্তি হচ্ছে খুব।

রান্নার দ্বায়িত্ব নোঙর আর রাশা নিলো৷ রান্না হবে, চা বানানোর পাতিলে। চায়ের দোকানদার বেশ সাহায্য করতে লাগলো তাদের৷ উজান আর উষির রক্তশূণ্য মুখে বসে রান্না দেখতে লাগলো। উষির বেশ ভয়ার্ত গলায় বললো,
–কি যে রান্না করছে! আমাকে তো ধারের কাছেও ঘেঁষতে দিলো না।

উজানও দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
–নোঙরের রান্নায় আমার কোন ভরসা নেই।

উষির চমকে উঠে তার দিকে তাকালো৷ তারপর মাথা নেড়ে আফসোসের সুরে বললো,
–রাশার রান্নায়ও না। মনে হচ্ছে, আজকে না খেয়েই থাকতে হবে।

দুই ভাই-ই বেশ বড় আর গভীর শ্বাস নিলো৷ ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ লাস্ট ইম্প্রেশন। তাদের দুইজনেরই অর্ধাঙ্গিনীর হাতের রান্না খাওয়ার অভিজ্ঞতা এতোই খারাপ যে দ্বিতীয়বার টেস্ট করার কথা কল্পনাও করতে পারে না।
মিনিটখানেকের মধ্যেই নুডলস রান্না করে তারা ফিরে আসলো। বেঞ্চের মাঝখানে বাটি রাখতে রাখতে নোঙর উৎফুল্ল হয়ে বললো,
–নোঙর স্পেশাল গরম গরম নুডলস।

বেঞ্চের দুইদিকে দুই ভাই আর সামনে একটা বেঞ্চ এনে তাতে রাশা আর নোঙর বসলো। উজান আর উষির বাটির দিকে তাকিয়েই ঢোক গিললো। উজান রান্না খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে উষিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–বড় ভাইদের আগে টেস্ট করা উচিৎ। আগে তুই খা, তারপর আমি।

–ছোটদের রেখে বড়রা কীভাবে খাবে? একটা দ্বায়িত্ব আছে না?

উষির সেটা আবার তার দিয়ে বাড়িয়ে দিলো। উজান আবার তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দরাজ গলায় বললো,
–বড়রা আগে।

–বড়দের কথা শুনতে হয়। আগে ছোটরা খাবে।

তাদের এই লড়াই দীর্ঘক্ষণ চলতো। রাশা তাদের মাঝে সমঝোতা করে বললো,
–তোমাদের খেতে হবে না। আমি আগে খাচ্ছি।

বাটিটা চাওয়ালার টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি। স্টিলের চার বাটিওয়ালা টিফিন ক্যারিয়ারের দুটোতে তারা খাবার নিয়েছে আর একটাতে লোকটার সকালের হালকা খাবার হিসেবে রুটি রাখা৷ আর একটাতে তাকে নুডলস দেওয়া হয়েছে। চামচ হিসেবে চায়ে চিনি মেশানোর চামচ ব্যবহার করা হচ্ছে। নুডলস ছোট ছোট করে রান্না করায় খেতে কোন সমস্যাই হয়নি। রাশা একবার খেয়ে চোখ বুজে স্বাদ নিলো। তারপর বারবার করে খেতে লাগলো। প্রশংসা করতেও ভুললো না। নোঙর উজান আর উষিরের ব্যবহারে যে কষ্ট পেয়েছিলো, রাশার প্রশংসায় সেটা ভুলে গেলো।
তাদের খাওয়া দেখে দুই ভাই ভরসা পেলো। উষির এক চামচ মুখে তুলে চোখ বুজে স্বাদ নিলো। তারপর উৎফুল্ল মেজাজে বললো,
–ওয়াও নোঙর! এটা তো ভীষণ টেস্টি৷ কি দিয়ে রান্না করেছো?

–তেমন কিছুই না। পুরোটাই রান্নার কারিশমা।

নোঙর কানের পিঠে চুল গুজে লাজুক হেসে উত্তর দিলো৷ উষির আরেক চামচ মুখে তুলে বললো,
–আমাকে অবশ্যই শিখাবে৷ এটা অনেক টেস্টি৷ স্বাদে চোখ বুজে আসছে।

নোঙর লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে সায় জানালো। অন্যদিকে উজান কড়া চোখে তার দিকে তাকালো৷ তার মানে, ইচ্ছে করে তাকে বাজে রান্না খাওয়ানো হয়েছিলো! ভালো! খুব ভালো! তার জন্য আজ সবাইকে এতো অপদস্ত হতে হলো। সেটাও মেনে নিয়েছিলো সে৷ আর এখন এতো বড় একটা ঘটনা সামনে আসায় আর সহ্য হলো না। তার আর কোন মনমনানি সে সহ্য করবে না৷ যথেষ্ট হয়েছে। মনে মনে নোঙরকে ভুল বুঝে শক্ত সিদ্ধান্ত নিলো৷

খাওয়া দাওয়া শেষে রাশা আর নোঙর প্লাটফর্মেরই একটু দূরে ট্রেনে ওঠার রাস্তায় পা ঝুলিয়ে বসে প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখতে লাগলো আর গল্প করতে লাগলো। কিছুটা সময় যাওয়ার পর নোঙর খুশিতে লাফিয়ে উঠে রাশার হাত ঝাঁকিয়ে বললো,
–আপু দেখো তারা খসে পরছে। চলো, কিছু উইস করি।

–এসব কুসংস্কার নোঙর৷ তারা আদোতে তো পাথর৷ পৃথিবীর অ্যাটমোস্ফেয়ারে ঢোকার সময় একটা সংঘর্ষ হয়। সেটাই আলো ক্রিয়েট করে৷ আর এটাই তারা খসা নামে পরিচিত। বুঝেছো?

–বুঝেছি বুঝেছি।

নোঙর গাল ফুলিয়ে বললো। তারপর আবার উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললো,
–কুসংস্কার তো আমিও মানি না। কিন্তু এটা করতে আমার ভালো লাগে। বিশ্বাস করা আর ভালো লাগা তো এক না তাই না?

বলেই রাশার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর অনুরোধের সুরে বললো,
–প্লিজ আপু, মেক আ উইস।

নোঙরের জোড়াজুড়িতে রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো কি উইস করা যায়। মনের গহীন কোনে বলা কথাটা মাথায় আসলো। তারপর চোখ বুজে মনে মনে উইস করলো,
–একটু শান্তি।

মনে মনে বলা কথাটা উইস হিসেবে চাইতেই ঝট করে চোখ খুলে ফেললো। তক্ষুনি পেছন থেকে উষির বললো,

–হেই গার্লস, হোয়াট আর ইউ গাইস ডুয়িং?

দূর থেকে উষির আর উজান এসে দুইজনের পাশে বসলো। রাশার মুখে অজান্তেই হাসি চলে আসলো৷ পাশে বসা উষিরের হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখলো। তারপর চোখ বুজে একটা প্রশান্তির শ্বাস ফেলতেই উষির মুচকি হেসে রাশার মাথার উপর ঠোঁট ছুইয়ে মাথায় গাল ঠেকিয়ে চোখ বুজলো।

উজানের চোয়াল রাগে এখনও শক্ত হয়েই আছে৷ নোঙরের পাশে বসতেই নোঙর উচ্ছ্বসিত গলায় উজানের হাত চেপে বললো,
–এইমাত্র তারা খসে পরলো৷ উইস করো একটা। আমিও করেছি।

উজান শক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললো,
–তোমার মাথার সবগুলা তার জোরা লেগে যাক৷ আমিন।

নোঙর ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ক্ষোভের সাথে ঝটকা দিয়ে উজানের হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে পরলো৷ তারপর রাগে বড় বড় পা ফেলে হাঁটতে লাগলো৷ বাধ্য হয়ে উজানও তার পিছু নিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের গাড়ি চলে আসলো৷ উজান তখন তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো। গাড়ির ড্রাইভারকে সেই আসতে বলেছে। খাগড়াছড়ি তাদের যাওয়া হচ্ছে না। শুধু খাগড়াছড়ি কেনো, কোন জায়গায়ই যাওয়া হবে না। পেন্ডিংএ রাখা কাজ ফেলে তার পক্ষে ঘুরতে যাওয়া সম্ভব না। নোঙর অভিমানে আর একটা কথাও বললো না। চুপচাপ গাড়িতে বসে পরলো। রাশা আর উষির একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে উজানকে কিছু বলতে চাইলে উজান স্পষ্ট গলায় বললো,
–সরি উষির৷ তোরা ঘুরতে যা। আমি এখন যেতে পারবো না৷ পরে একদিন যাবো।

উষির রাগী গলায় বললো,
–তাহলে আসলি কেনো?

উত্তরে উজান কিছুক্ষণ নিরব থেকে গাড়িতে উঠে বসলো। রাশা নোঙরকে কিছু বলার আগেই নোঙর কান্নাভেজা গলায় তীব্র অভিমানী স্বরে বললো,
–আমার আর এখন যেতে ইচ্ছা করছে না আপু। তোমরা ঘুরতে যাও৷ আমি যাবো না।

নোঙরের গলার স্বরে রাশার প্রচন্ড মন খারাপ হলো৷ উজানের খারাপ লাগলেও সে নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল রইলো। অনেক বুঝানোর পরেও জেদি দুইজনের একজনও যখন রাজি হলো না তখন বাধ্য হয়ে উষির আর রাশাও গাড়িতে উঠে বসলো। ট্রেন যেমন তাদের নিয়ে অনেকদূর চলে এসেছিলো, তেমনই গাড়িও তাদের গন্তব্য পালটে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। মন খারাপ থাকা নোঙরের বঁধুবরণও সাদামাটা ভাবেই হলো৷ কেউ-ই প্রস্তুত ছিলো না৷ আর নোঙরেরও আনন্দ উচ্ছ্বাস চলে গিয়েছে৷ তাই ছবিগুলোও তার মন খারাপের সাক্ষী থাকলো।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৩৫+৩৬

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৫

উষিরকে সেইদিনই হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে দিয়েছিলো। সাথে পেয়েছিলো অফিস থেকে সাত দিনের ছুটি। সে তার সাতদিনের পুরো ছুটিটা স্ত্রী আর পরিবারের সাথে কাঁটাবে বলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে পরেছিলো৷ কিন্তু বাড়ি ফেরার পর থেকে রাশা তার ধারের কাছেও ঘেঁষেনি৷ সকালে কোর্টে যায় আর সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরে। তখন উষির ঘরে থাকলে সে লিভিংরুমে থাকে আর উষির লিভিংরুমে থাকলে সে চলে যায় বৃষ্টি বন্যার রুমে। সেখানে অন্তত উষিরের পক্ষে বউকে আনতে যাওয়া সম্ভব না। এভাবেই দুই তিনদিন যাওয়ার পর অবশেষে তার স্ত্রী তার কাছে আসলো৷ তাও একা না। সাথে করে একটা কাগজ এনেছে। সেখানে উষিরের সাইন লাগবে। সেটা তার সামনে ধরতেই তার কপালে চিন্তার ছাপ আসলো। রাশা নিজে থেকে আসাতে মন উৎফুল্ল হয়েছিলো তো বটে কিন্তু বর্তমানে তার চিন্তাভাবনা পড়তে পারলো না। তাই প্রশ্ন করলো,
–এটা কিসের পেপার?

–আগে সাইন করো তারপর বলছি।

রাশা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো। উষির তার এই স্বাভাবিক কথাবার্তায় হেসে ফেলে সাইন করে দিলো। রাশা সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখলো আগে। তারপর তার দিকে তাকালো। সে বেশ মুগ্ধ চোখে তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। রাশা আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে চাপা শ্বাস ফেলে বললো,
–এটা আমাদের ডিভোর্স অ্যাপ্লিকেশনের পেপার। আমি কাল জমা দিয়ে দেবো।

রাশা ভেবেছিলো, এটা শুনে উষির সাংঘাতিক রেগে কিছু একটা করে বসবে। হয়তো পেপারটাই ছিড়ে ফেলবে। কিন্তু এমন কিছুই না হওয়ায় খানিক অবাক হলো। উষিরের হাতে পাকোড়ার প্লেট ছিলো। সেখান থেকে একটা পাকোড়া মুখে পুরে শুনতে পায়নি এমন ভাবে আবার প্রশ্ন করলো,
–কিসের পেপার বললে?

রাশা কাগজটা শক্ত করে চেপে ধরে শ্বাস চেপে দম বন্ধ করে বললো,
–ডিভোর্সের অ্যাপ্লিকেশন। কোর্ট এটা অ্যাপ্রুভ করলে ডিভোর্স পেপার তৈরি করবে। চিন্তার কোন কারন নেই। আমার পরিচিত খুব ভালো একজন উকিল আছে। কোন ঝামেলা ছাড়াই তাড়াতাড়ি ডিভোর্স করিয়ে দেবে। কথা বলেছি আমি।

বলেই মনটা কেমন উদাস হয়ে গেলো। কয়েকদিন আগেই এই উকিলের কথাই তার বোনকে বলেছিলো। বোনের ডিভোর্স করিয়ে দিতে চেয়েছিলো সে। আর আজ সেই উকিলের থেকেই সে ডিভোর্স নিচ্ছে! ভাগ্যের কি করুন পরিণতি!
এরসাথে তার বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপছে৷ শুধু মনে হচ্ছে, উষিরকে এটার ব্যাপারে না বললেই ভালো হতো। এই কাগজ একবার নষ্ট হলে সাইন আর পাওয়া যাবে না।

উষির শান্ত, স্বাভাবিক ভাবে পাকোড়া চিবোতে চিবোতে রাশার কথা শুনছিলো। কথা শেষ হলে মাথা নেড়ে হাত টি-শার্টে মুছতে মুছতে বললো,
–আচ্ছা! ভেরি গুড। আমিও এই সম্পর্কে থাকতে থাকতে হাপিয়ে উঠেছি। খুব এক ঘেয়েমি এসে গেছে৷ দেখি পেপারটা? কোন কিছু ভুল হলে তো আমাকে আবার কষ্ট করে সাইন করতে হবে।

হাত বাড়িয়ে দিলো সে। রাশা কাগজটা আরো শক্ত করে ধরে আর্ত স্বরে বললো,
–কোন দরকার নেই। আমি ভালোভাবেই দেখেছি। সব ঠিক আছে।

–আরে দাও না দেখি?

বলেই কাগজটার এক কোনা খামচে ধরলো। রাশার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। উষির যেভাবে ধরেছে তাতে না দিলে নির্ঘাত ছিড়ে যাবে। আর দিলে এটা আর পাওয়া সম্ভব না। এখন তুমি যেদিকে যাও সেদিকেই বিপদ!
একসময় রাশার আশঙ্কা সত্যি করে বিপদ একটা ঘটে গেলো। এই টানাটানিতে উষিরের সাইন করা অংশটুকু তার হাতে চলে গেলো আর রাশার হাতে বাকি অংশটুকু রয়ে গেলো। মূহুর্তেই আর্তনাদ করে উঠলো সে,
–এমনটা কেনো করলে?

–কি করেছি? তুমিই তো দিতে চাইলে না। এখানে আমার কি দোষ৷ উলটে আমার আরো খাটনি করতে হবে। সাইন করা কতো কষ্টের জানো?

উষির কাঁধ নাচিয়ে ঠোঁট উলটে অবুঝের মতো বললো। রাশা ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,
–একটা ছিড়েছো তো কি হয়েছে? আমি খুব ভালো সাইন নকল করি। তোমারটাও করে দেবো।

–আমার কোন সমস্যা নেই৷ আমার কষ্ট একটু কমবে আর তোমার একটু বাড়বে।

রাশা বুঝতে না পেরে রাগী ভাবে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালে উষির ব্যাপারটা খোলসা করলো,
–আমার সাইন নকল করে আমার ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা উঠানোর জন্য তোমার নামে কেস করবো। সিমপল! ওইযে বলে না, ভালোবাসা না দাও প্রিয়, অন্তত একটা মামলা দিও। তারিখে তারিখে আমাদের দেখা তো হবে।

উষির বেশ নাটকীয় ঢঙে নিজের মতো সাজিয়ে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের উক্তি বলে গেলো। রাশার রাগী মুখ মুহূর্তের মধ্যে বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো৷ সে তারিখে তারিখে আসতে পারবে না। সম্ভব না সেটা। হয়তো তাদের আর কখনও দেখাই হবে না। কখনোই না!
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্ল্যান বি-তে কনভার্ট হলো রাশা। ক্লোজেট থেকে পুরোনো একটা অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার বের করে উষিরের হাতে ধরিয়ে দিলো। তার পাকোড়া খাওয়াতে এবারেও বাঁধা আসায় বিরক্ত নিয়ে বললো,
–আবার এটা কি?

রাশা নিজের বিষন্নতা আড়ালে রেখে কোমরে হাত রেখে শক্ত গলায় বললো,
–আমাদের অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার। পয়েন্টগুলো ভুলে গেছিলে না? মনে করে নাও ভালো করে।

উষির কপাল কুঁচকে কাগজটা হাতে নিয়ে পড়লো মনোযোগ দিয়ে৷ বিয়ের পর পর তাদের মধ্যে একটা অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছিলো। এটা সেটাই। যেখানে পয়েন্ট আকারে লেখা আছে,
১. অনুমতি ব্যতীত ঘরে প্রবেশ নিষেধ।
২. কেউ কারো কোন জিনিসে হাত দেবে না। এমনকি কেউ কারো ব্যাপারে কথাও বলবে না।
৩. ক্লোজেটের ডান পাশ রাশার এবং বাম পাশ উষিরের। এবং বেডের বাম পাশ রাশার এবং ডান পাশ উষিরের। এবং বাকি তৈজসপত্রও এভাবেই দুটি অংশে ভাগ করা থাকবে। এবং কেউ কারো অংশে দখলদারি করবে না।
৪. অ্যালকোহল সেবন করে ঘরে আসা যাবে না। এবং ঘরে স্মোক করা যাবে না।

তখনকার এই বাচ্চা বাচ্চা শর্ত পড়এ মনে মনে ভীষণ হাসলো উষির৷ তবে মুখোভঙ্গী শান্ত রাখলো। পড়ে বুঝলো, শেষের শর্তটা বাদে বাকি সবগুলো শর্তই তারা খুব সফলভাবে ভেঙেছে। আর তা এতোই স্বাভাবিক ছিলো যে, এই নিয়ে দুইজনের কেউ-ই একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। মনেই ছিলো না বলা চলে।
উষির সবটা পড়া শেষে কাগজটা এমন ভাবে রাশার হাতে দিলো, দেখে মনে হলো নোংরা কিছু ছুঁয়ে ফেলেছে। তারপর সেই হাত আবার টি-শার্টে মুছতে মুছতে বললো,
–আমি এক বক্তৃতার কাগজ দ্বিতীয়বার ছুঁই না আর তুমি আমাকে এইসব দেখাচ্ছো? ছিহ! আমার সম্মানটা আর ঠিক থাকতে দিলে না । আর তার থেকেও বড় কথা, আমার মতো রাজনীতিবিদকে তুমি নীতি শিখাচ্ছো! নীতি!

উষির যে অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেছে, সেটা তার শেষ কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রাশা বড় বড় করে শ্বাস ফেলে হাত মুঠো করে ক্ষিপ্ত পায়ে চলে যেতে লাগলো৷ পেছন থেকে উষির চেঁচিয়ে উঠলো,
—রাশায়ায়া, একটু সস এনে দাও প্লিজ। সস শেষ। আর সস ছাড়া পাকোড়া ভালো লাগে না।

রাশা পেছন ফিরে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
–র’ক্ত খাবে? র’ক্ত এনে দেবো? ওটাও তো লালই।

উষির লাজুক স্বরে বললো,
–তুমিও তো লাল। লজ্জায়, রাগে লালে লাল হয়ে যাও। চাইলে তুমি এসে পাশে বসতে পারো। লাল টুকটুকে বউয়ের উষ্ম আলিঙ্গনে সস ছাড়াই পাকোড়া খেয়ে ফেলতে পারবো। আর যদি একটু রোম্যান্টিক হতে চাও তাহলে…

রাশা এদিক ওদিক তাকিয়ে উষিরের দিকে ঢিল দেওয়ার জন্য কিছু খুঁজলো৷ কিছু না পেয়ে হাতে থাকা অ্যাগ্রিমেন্ট পেপার মুড়ে তার দিকে ছুড়ে মারলো। উষির দক্ষ হাতে সেটা ধরেও ফেললো। রাশার ঢিল ছোড়া দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করতেও ভুললো না,
–তোমার নিশানা তো দারুন! আ’ম ইম্প্রেস! এতো ইম্প্রেস করলে কি চলে বলো?

শেষ কথাটা বেশ নাটকীয় ঢঙে করুন করে বললো। রাশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–আই সয়্যার উষির! আগে আমি সৌরভকে খু’ন করবো তারপর তোমাকে।

এই প্রথমবার সৌরভের কথা ওঠায় তার খারাপ লাগলো না, রাগও উঠলো না। বরং আরো ভালো লাগলো। আর তারপর স্ত্রীকে আরো রাগিয়ে দিতে চোখ টিপে বললো,
–সৌরভকেই মে’রো শুধু। আমাকে মা’রলে তো অকালে বিধবা হবে। আর উষিরের বউকে কেউ বিয়েও করতে চাইবে না। নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে।

রাশা উষিরের দিকে জলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো। উষির হোহো করে হাসতে লাগলো।
ঠিক ওই সময়ই লিভিংরুমে উজানের সাথে তার মা আর বড় মায়ের গোল মিটিং চলছে৷ মাহফুজা কেঁদে কেটে এক-সার! নাক টেনে টেনে ছেলের নামে তার অভিযোগ শুনাচ্ছে,
–নোঙরের তিনদিন হলো জ্বর। তুই একটুও মেয়েটার খোঁজ নিলি না? এতো পাশান তুই!

উজান বিরক্তিকর শ্বাস ফেলে বললো,
–ওসব কিছুই না। সব অফিস না যাওয়ার বাহানা।

–হ্যাঁ আর সেইজন্যই ওকে স্যালাইন দিয়ে রাখতে হয়েছিলো। আর সেইজন্যই কাল রাতে শ্বাসকষ্ট ওঠায় অক্সিজেনও দিতে হয়েছিলো। তাই না?

কাঁদোকাঁদো গকায় চেঁচিয়ে উঠে বললো মাহফুজা। উজান চমকে উঠলো। এই খবব তার কাছে নতুন। শাহিদা বিচলিত হয়ে মাহফুজার মাথায় হাত রেখে বললো,
–মাহফুজা, শান্ত হও। ঠান্ডা মাথায় কথা বলো।

–কি করে শান্ত হবো ভাবি? শুধুমাত্র আমাদের পছন্দে বিয়ে করেছে জন্য মেয়েটাকে এতো অবহেলা করছে। এই এক মাসেই কি এমন করেছে যে নোঙর আর ওর সাথে থাকতেই চাচ্ছে না। ভাবির হাতে মার পর্যন্ত খেয়েছে, তাও বলছে ওর সাথে থাকবে না। কিজন্য থাকবে না সেটাও বলছে না। অফিসের সময়টুকুতেই শুধু ওরা দুইজন সামনাসামনি থাকে। এই সময়ে ও কি এমন করলো?

উজান রেগে বললো,
–আমি কিছুই করিনি। আমি তো থাকবো না বলিনি। তোমার ভাতিজিই বলেছে। এখানে আমার দোষ কোথায়? আর আমি অবহেলা করেছি? তোমার আদরের ভাতিজি আমার সাথে কবে ভালো ব্যবহার করলো যে ওর সাথে ভালো ব্যবহার করবো? অফিসের কোন নলেজ ওর নেই। কাজ শিখাতে চাইলেও শিখবে না। এটা নিয়ে কি কিছুই বলা যাবে না?

শাহিদা মা ছেলের মাঝে ঢুকে তাদের শান্ত করতে উজানকে বুঝানোর জন্য বললেন,
–উজান! বাবা, তুই তো অবুঝ না। কতো বুঝদার তুই। এটা তো বুঝিস, মানিয়ে নিয়ে চললে তবেই সংসার টেকে। তোরা দুইজন দুইভাবে মানুষ হয়েছিস। দুইজনের মতের মিল হবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। তার জন্য কেউ এমন করে? সব অপছন্দের দিক বাইরে রেখে একটু পছন্দ করার চেষ্টা তো করতে পারিস। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই অন্তত কর। বিয়ের কত বছর পরিবার থেকে দূরে থেকেছে৷ এখন যখন পরিবার ফিরে পেয়েছে তখন এই সম্পর্কের জের ধরে আবার হারাবে। একটু স্যাক্রিফাইস করলে সম্পর্ক নষ্ট হয় না বাবা।

উজান ক্লান্ত স্বরে বললো,
–আর একজন যদি সবসময় স্যাক্রিফাইস-ই করে যায়, তাহলে সম্পর্ক সুন্দর কিভাবে হয় বড় মা? এটা তো অন্যায়।

–স্যাক্রিফাইসের অনেক ধরন আছে বাবা। নিজের পছন্দ অপছন্দ অপরের জন্য বদলে ফেলাটা স্যাক্রিফাইস না। এমন করলে নিজের সাথে অন্যায় করা হবে। এটাতে সম্পর্ক সুন্দরের বদলে আরো খারাপ হয়ে যায়। তবে সেই পছন্দ অপছন্দ যদি খারাপ হয় তাহলে ব্যাপারটা চিন্তার৷ এর সমাধান আমার জানা নেই।

–তুমি সবসময় কনফিউজড করে দাও বড় মা। এটা ঠিক না।

উজান হেসে ফেলে বললো। শাহিদাও হেসে ফেলে আড় চোখে মাহফুজার দিকে তাকালো। মাহফুজা ক্ষোভ মেশানো চাহনিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। শাহিদা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
–একশো পার্সেন্ট ঠিক৷ কারন আমি ওই স্যাক্রিফাইসের কথা বলছি না। নিজের অপছন্দের জিনিস সামনের মানুষটার মধ্যে দেখেও সেটা অ্যাকসেপ্ট করে সামনের মানুষটার সাথে থাকাটাই হলো ভালোবাসার স্যাক্রিফাইস। এমন করলে তবেই সম্পর্ক সুন্দর হয়।

কথাটা উজানের উদ্দেশ্যে ছিলো কিন্তু মনে শুধু তার লাগলো না৷ একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাশার মনেও বাড়ি খেলো কথাটা। আর সাথে সাথেই বিবেক বিদ্রোহ করে উঠলো। বলে উঠলো, “তার পক্ষে আর সম্ভব না। ও তো কখনও চেষ্টাই করতে চায়নি। তাহলে এখন কেনো স্যাক্রিফাইস করার কথা মাথায় আনছে? এটা তো তার সাথে অন্যায় করা হবে।” এবং এরপর মন হেরে গেলো আর বিবেক জিতে গেলো।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৬

উজান শাহিদার কথামতো তৃতীয়বারের মতো শ্বশুরবাড়িতে পদার্পন করলো। আর তারপরেই তাকে তীব্র অস্বস্তি পেয়ে বসলো। বড় বড় বিজনেস ওনারদের সাথে লম্বা চওড়া মিটিংও আজকের নার্ভাসনেসকে ফেইল করিয়ে দিচ্ছে। সবার অলক্ষ্যে কপালের ঘাম মুছে বাইরের ঘরের সোফায় গিয়ে বসলো সে। ছোটবেলা থেকে যাতায়াত থাকলে হয়তো এই ফরমালিটির কোন জায়গাই থাকতো না। এসে সবার সাথে সরাসরি কথাবার্তা বলা যেতো, যেমন উষির নানাবাড়ি গেলে করে। তার ক্ষেত্রে নানাবাড়ি দেরিতে আসলেও আরেকটা সম্পর্কজুড়ে কেমন একটা উদ্ভট হয়ে পরেছে। কেমন অদ্ভুত আর অস্বস্তিকর।
সবার সাথে আলাপচারিতার পর উজানকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য নোঙরের ঘরে পাঠানো হলো৷ নোঙর তার আসার খবর জানে না। দ্রুত জানানোর মানুষগুলোর কেউ বাড়ি নেই৷ আর যারা আছে তারা সবাই জামাইকে আপ্যায়ন করতেই ব্যস্ত।

নোঙর দিনের বেলাতেও ঘরের পর্দা ফেলে ঘর অন্ধকার করে হাঁটুতে মুখ গুজে বসে ছিলো। জ্বরের দুর্বল, ক্লান্তি ভাব এখনও যায়নি। উজান যখন তার ঘরে আসলো তখন বাইরের আবছা আলোয় নোঙরকে কালো ছায়ার মতো লাগছিলো। আবছা আলোকে সঙ্গী করে জানালার ভারি পর্দা সরিয়ে দিতেই ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে গেলো৷ উদাস আর আনমনে বসে থাকা নোঙর চমকে উঠে সামনে তাকাতেই হকচকিয়ে সোজা হয়ে বসলো৷ তারপর দ্রুত হাত মুঠো করলো। এই হাত কিছুতেই খোলা যাবে না। মন ভালো করতে গতরাতে অপলা তার হাতে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে। সাথে লিখেছিলো উজানের নাম।
উজান তার হকচকানো ভাব দেখে নক করে না আসার জন্য আফসোস করলো। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কেশে গলা পরিষ্কার করে মৃদু স্বরে বললো,
–জ্বর সেরেছে?

নোঙর অভিমানি চোখে উজানকে দেখে মাথা ঘুরিয়ে নিলো। তারপর ঠোঁট ফুলিয়ে নাক টেনে বললো,
–জানি না।

উজান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বোধহয় ঠিকঠাক উত্তর দিলেই সে অবাক হতো৷ এটা তো তার কাছে নরমাল ব্যাপার।
শার্টের হাতা ফোল্ড করে নোঙরের কাছাকাছি গিয়ে হুট করে তার কপালে হাত ছোয়ালো। তারপর কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে তার শরীরের তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করলো। যখন বুঝতে পারলো জ্বর নেই তখন গম্ভীর গলায় বললো,
–জ্বর তো নেই৷ তাহলে অফিসে যাও না কেনো?

উজানের আচমকা ছোঁয়াতে নোঙর হকচকিয়ে তো গিয়েছিলো কিন্তু পরের কথায় রেগে গেলো। সে ম’রে গেলেও সামনের মানুষটার কিছু যায় আসে না। তখন তার কবরের কাছে গিয়ে বলতো,
–কি? কাজের ভয়ে ম’রে গেলে নাকি ভিতু নোঙর?

কথাটা চিন্তা করেই তার চোখ ফেঁটে কান্না আসলো৷ ঠোঁট নাক ফুলিয়ে গলার কাছে আসা কান্না অনেক কষ্টে আটকিয়ে বললো,
–যাবো না।

উজান মৃদু হেসে টিটকারি দিয়ে বললো,
–কেনো? কাজ দেখে ভয় পাচ্ছো নাকি?

নোঙর জানতো! সে ঠিক জানতো, উজান এমনটাই বলবে! এইতো বউয়ের প্রতি ভালোবাসা! ভালোবাসা কেনো বলছে? থোরাই না ভালোবাসে। নাহলে কেউ অসুস্থ মানুষকে কাজের কথা বলে! আরে বাবা, বউ হিসেবে না হোক মামার মেয়ে হিসেবে তো একটু চিন্তা করতো! একটু চিন্তা করলে তো আর তার ক্ষতি টতি হতো না।

–রিজাইন করবো। লেটার টাইপ করে প্রিন্ট আউটও করেছি৷ যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।

নোঙরের সিরিয়াসনেসে উজান চমকে উঠলেও নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অটল থেকে বললো,
–রিজাইন লেটার নিজে গিয়ে দিতে হয়। আর তার আগে দুই মাস আগে অফিসিয়ালি ম্যানেজারকে জানিয়ে দিতে হয়।

–মানে?

নোঙর হতবাক হয়ে গেলো। চাকরিতে জয়েন করেছে সবে এক মাস হয়েছে আর সেখানে নাকি দুই মাস আগে তাদের জানাতে হবে। পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি! আয় হায়! এখন তার কি হবে! পাগল মানুষ ডিভোর্স দিলে কি সেটা অ্যাপ্রুভ হয়? যদি না হয় তাহলে তো সারাটা জীবন তাকে পাগলের সাথে থাকতে হবে! সর্বনাশ! ভয়ে নোঙরের পিলে চমকে উঠলো। পাড়ার এক পাগল ছোটবেলায় ওকে কামড়ে দিয়েছিলো। সেই থেকে পাগল মানুষকে তার ভয়। এখন এই পাগলের সাথে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না।

উজান নোঙরের ভয়ার্ত মুখ দেখে হাসি আটকে পাশে বসে বললো,
–মানে জব থেকে রিজাইন করার অন্তত দুই মাস আগে থেকে জানিয়ে রাখতে হয়। সাইন করার আগে অ্যাগ্রিমেন্টগুলো পড়োনি?

–আমি আর ওখানে যাবো না৷ কিছুতেই না। করবো না আমি চাকরি।

নোঙর ঠোঁট উলটে ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে দিলো। উজান হতবাক হয়ে গেলো,
–এতে কান্না করার কি আছে? করতে না চাইলে করবে না। কেউ জোর তো করেনি।

নোঙর বলতে চাইলো, কেনো জোর করবে না? কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্যরকম। তাই কথাটা গিলে ফেলে চুপ করে মুখ ঘুরিয়ে চোখের কোনে আসা পানি হাত দিয়ে বারবার মুছতে লাগলো আর নাক টানতে লাগলো। উজান তার অভিমানি চোখের পানি দেখে অজান্তেই হাসলো৷ তারপর হাতের মেহেদীর দিকে নজর পরতেই হাসি চওড়া হলো। এই হাসির কোন কারন নেই। নোঙর তার এই হাসি না দেখতে পারলো আর না জানতে পারলো।
উজান কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকে দেখে বুঝলো, তার একটু প্রেম প্রেম পাচ্ছে। প্রজাপতিওয়ালা প্রেম। যাকে ইংরেজিতে বাটারফ্লাই ইন স্টমাক বলা হয়।
উজান নিজের অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রেমময় দৃষ্টিতে নোঙরের দিকে তাকিয়ে হাত টেনে কাছে টেনে নিলো। কপালের চুল সরিয়ে চুমু দিতে যাবে, এমন সময় হুলো জানালার পাশ থেকে বলে উঠলো,

–উজান মঞ্জু, উজান মঞ্জু, উজান মঞ্জু।

ভাঙা রেকর্ডের মতো এটা চলতেই থাকলো। উজান আসার পর থেকে তার নাম শুনে যাচ্ছে৷ সেইজন্যই বোধহয় পুরোনো পড়া মনে পরে মুখস্ত বলা শুরু করেছে। একসময় নোঙর খুব পরিশ্রম করেছিলো, আজ তার ফল পেলো। সাংঘাতিক, ভয়ংকর ফল। বেশ হকচকিয়ে গিয়ে উজানের দিকে আর্ত চোখে তাকালো। উজান কথার উৎস খুঁজে না পেয়ে কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করলো,

–এটা কে বলছে? আর মঞ্জুটা কে?

–এটা হুলো মানে আমার কাকাতুয়া পাখির গলা৷

–আর মঞ্জু?

নোঙর আমতা-আমতা করলো। বলাটা ঠিক হবে না করতে করতে ইতস্তত গলায় বললো,

–এই পাড়ায় একটা পাগল ছিলো। যাকে সামনে পেতো তাকেই কামড় দিতো।

–আর তার নাম মঞ্জু ছিলো?

উজান দাঁতে দাঁত চেপে চিড়বিড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলো। নোঙর উত্তরে বেশ অস্বস্তিতে মাথা নাড়লো। আহাম্মক বনে বসে রইলো উজান। তারপর শক্ত গলায় আবার প্রশ্ন করলো,
–আমার নামের সাথে এই নামটা ওই বেয়াদবকে তুমি শিখিয়েছো?

এবারেও নোঙর নীরব রইলো। মনে মনে হুলোকে বেয়াদব বলায় রাগ তো হলো কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে চুপ করে রইলো। উজান যা বোঝার বুঝে ভয়ংকর রেগে গেলো। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁজালো স্বরে বললো,
–অফিসে রিজাইন লেটার জমা দিয়ে চাকরি না ছাড়লে প্রতিদিনের অনুপস্থিতিতে জরিমানা হবে। পার ডে, ওয়ান থাউজেন্ট।

এরপর ক্ষিপ্ত পায়ে বেড়িয়ে গেলো। আর মিনিট দশেকের মধ্যে কাজের বাহানায় বাড়ি থেকেও চলে গেলো৷ নোঙর আবার উদাস হয়ে গেলো। মন খারাপ করে হুলোর উদ্দেশ্যে বললো,

–কাজটা কি ঠিক করলি হুলো? কোথায় কি বলতে হয় তা এখনও শিখলি না।

হুলো কিছুই শুনতে পারলো না৷ সে তারস্বরে চেঁচাতে ব্যস্ত। নোঙর বিরক্ত হয়ে টলমল পায়ে পর্দা টেনে দরজা আটকে শুয়ে পরলো।

****
পরেরদিন উজান অফিসে ঢুকতেই দেখলো নোঙর কমলা আর সবুজ রঙের মিশেলে তৈরি তাতের শাড়ি পরে বেশ সেজেগুজে অফিসে এসেছে। গতকালের এমন ভয়াবহ ঘটনার পর এভাবে সাজগোছ দেখে তার মেজাজ আবার চটে গেল। কোথায় হাসবেন্ডকে মানাবে তা না উলটো সেজেগুজে এসে সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছে! সেই আড্ডাটা আবার দিচ্ছে কাদের সাথে? মোটাকাটা অমি আর মাথামোটা শামিমের সাথে। সাথে আরো লোকজন থাকলেও উজানের নজরে ওই দুইজনই পরেছিলো কারন তাদের নজর নোঙরের দিক থেকে সরছিলোই না। বলা চলে, চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে একদম। এখন উজানের মেজাজ পারদ স্কেলে মাপলে থার্মোমিটার ফেঁটে যেতো। রাগে অগ্নিশর্মা হওয়া তার রাগ গিয়ে পরলো সবার উপর৷ বেশ হুংকার দিয়ে জটলা ভেঙে দিলো। একদম দুই বিড়াল ঝগড়া করলে মাঝে পানি দিলে তাদের যেমন হাল হয়, অমি আর শামিমেরও সেই হাল হয়েছে।

উজান রুমে বসে সর্বপ্রথম সেক্রেটারিকে ফোন দিয়ে ইমার্জেন্সিলি তার বাড়ি থেকে নিজের ব্লু পাঞ্চাবি আনতে পাঠালো। কারন ব্লু স্যুট তার নেই। থাকলে সেটাই পরতো। এর প্রধান কারণ, নোঙরের নীল রঙ একদম পছন্দ না। উজান জানে সেটা। আর তাই নিজের ড্রেসকোড নীল করার পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নিলো, আগামী সাতদিন সে ব্লু উইক ঘোষণা করবে। অফিসের সবাই এই সাতদিন ব্লু উইক পালন করতে ব্লু ড্রেস পরে আসবে। অফিসের প্রতিটা ফার্নিচারের রঙ হবে ব্লু। দেয়ালগুলোও ব্লু কালার করা হবে। এরমাঝে ভুলেই গেলো, আজই নোঙরের অফিসে শেষদিন।
উজান এগুলো শুধু ভেবেই ক্ষান্ত হলো না। নিজের ব্লু পাঞ্জাবি পরে নিজেই সব ব্যবস্থা করে ফেলতে লাগলো। নিজের সব মিটিং ক্যান্সেল করে দিলো। সেক্রেটারী শুকনো মুখে দুই একবার বললো,
–স্যার, মিটিংটা খুব ইমার্জেন্সি ছিলো।

তারপর উজানের বাজখাই গলার ধমকে মিইয়ে গেলো।
সব কাজের ফাঁকে উজান নোঙরের দিকে আড়চোখে তাকাতে লাগলো। নোঙর চোখ মুখ শক্ত করে কম্পিউটার স্কিনের দিকে বেহুদা তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে সাংঘাতিক রেগে আছে। কাজ তো সে এমনিতেও করে না। অথচ আজ দেখে মনে হচ্ছে তার থেকে বড় ব্যস্ত আর কেউ নেই। অথচ তার এখন নোঙরককে সামনে বসিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকতে খুব ইচ্ছে করছে। বউকে কেউ এভাবে আড়চোখে দেখে নাকি! উজানের তো একটা মানসম্মান আছে। ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে হুংকার দিয়ে নোঙরকে তার কেবিনে আসতে বললো। তারপর নিজের কেবিনে যেতে যেতে ভাবলো ব্লু উইকের মতো উইস ডে পালন করতে হবে। আজকেই সেই ডে পালন করার উপযুক্ত দিন। আজকের সব কাজ ক্যান্সেল। আজকে সবার ইচ্ছা পূরণ করতে হবে। তাকে দিয়েই শুরু হলো এই উইস ডে। এই ব্যাপারে সেক্রেটারির সাথে গভীর আলোচনা করতে হবে। অন্যদিকে সেক্রেটারী মিস্ত্রিদের রঙ করা দেখছে আর মাথা নাড়িয়ে বারবার বলছে,
–এতো টাকার গচ্চা গেলো! ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের টাকা ফেরত পেলে শান্তি পেতাম। কতো টাকা ঢেলে ডিজাইন করে দিয়েছিলো। আহা আহা!

নোঙর তার কেবিনে নক করলে উজান নিজের চুল, পাঞ্চাবির কলার ঠিকঠাক করে হাতা ফোল্ড করে ফিটফাট হয়ে তবেই তাকে আসার অনুমতি দিলো। নোঙর ধীর পায়ে হেঁটে তার টেবিলের সামনে এসে মুখ নিচু করে রিজাইন লেটার বাড়িয়ে দিলো। উজান সেদিকে ফিরেও দেখলো না। তার দৃষ্টি নোঙরের আনত মুখের দিকে৷ তার এখন অন্য কিছু করতে মন চাইছে৷ একদম অন্যকিছু, যেটা নিজের বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে করলে একদম অন্যায় হবে না। একদমই না। কলার ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে একদম নোঙরের কাছাকাছি দাঁড়ালো৷ তারপর কোমড়ে হাত দিয়ে এক ঝটকায় নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। নোঙরের মুখ নিচুই ছিলো। চোখে পানি টলমল করছে। সেটা সে উজানকে দেখাতে চায় না। কিন্তু তার এমন ব্যবহারে মাথা তুলেতাকাতে বাধ্য হলো। ফলস্বরূপ, টপ করে এক চোখ দিয়ে পানি গাড়িয়ে পরলো। উজান এক হাত দিয়ে সেটা মুছে গাল শক্ত করে ধরে ঠোঁটে এক গম্ভীর চুম্বন করে কালকের অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত করলো। উজানের এমন বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে নোঙরের হাত পা অসার হয়ে আসল। তাকে ছাড়তেই পা ভেঙে বসে পরে জোরে কান্না করে দিলো। উজান নোঙরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে গালে হাত ছুঁইয়ে বিচলিত গলায় বললো,
–কি হয়েছে? কানা করছো কেনো? মারিনি তো।

নোঙর ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,
–আমি থাকবো না এখানে। তোমার চাকরি আর কিছুতেই করবো না। খুব বাজে তুমি।

উজান হেসে ফেলে নোঙরের চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে আলতো চুমু দিলো। তারপর অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে হাত চেপে কেবিনের বাইরে এসে দাঁড়ালো। আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে শক্ত করে হাত চেপে ধরে উঁচু গলায় বলে উঠলো,
—হ্যালো এভ্রিওয়ান, অ্যাটেনশন প্লিজ৷ লেট মি অ্যানাউন্স সামথিং।

বলেই সবার দিকে নজর ঘুরালো। সবার নজর কাড়তে সামর্থ হয়েছে দেখে আবারও বলতে শুরু করলো।

–মিট মাই আনাদার আইডেন্টিটি৷ আই’ম হাজবেন্ড অফ মিসেস নোঙর খন্দকার৷

একটু থেমে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে থাকা নোঙরকে দেখে মৃদু হেস দৃষ্টি সামনের দিকে রেখে প্রফুল্ল গলায় বললো,
–ইয়েস! উই আর কাপল৷ অ্যান্ড ইউ অল আর ইনভাইটেড টু আওয়ার রিসেপশন পার্টি৷ খুব শীগ্রই আপনাদের ইনভিটেশন কার্ড দেওয়া হবে।

লজ্জায় মিইয়ে গেলো নোঙর। উজানের পাঞ্চাবির কোনা চেপে ধরে তার পেছনে গিয়ে লুকালো। রিসেপশনের কথাটা সে কাল রাতেই শুনেছে। এই ব্যাপারে উজানের সাথে ফেস টু ফেস কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই কিসব ঘটনা ঘটে গেলো! যাক গে সব! এখন ভালোয় ভালোয় এখান থেকে বের হতে পারলে বাঁচে!
অফিসের সবার মাথার উপর বজ্রপাত হলো বলে মনে হলেও স্যারের সামনে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করতে পারলো না। শুধু হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন জানালো। নোঙর এক মূহুর্তের জন্যেও উজানের পেছন থেকে বের হলো না। আর না সেখানে থাকলো। কোনমতে উজানকে টেনে সাথে নিয়ে অফিস থেকে বের হলো। তাহের মিয়া, অমি আর শামিমের কালো হওয়া মুখ পেছনে পরে রইলো।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৩৩+৩৪

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৩

নোঙর সব কাজে ফেল করার পর তার বস হয়ে গেলো মিসেস ফ্লোরা। সেখানে ট্রান্সফার হওয়ার পরে তাকে সর্বপ্রথম একটা গাউন ডিজাইনের টাস্ক করতে দেওয়া হলো। নোঙর ঠোঁট কামড়ে ভেবে চিন্তে সারাদিন সময় নিয়ে ডিজাইন কমপ্লিট করলো। মিসেস ফ্লোরা সেই ডিজাইন দেখার পর থমথমে মুখে একবার ডিজাইন, একবার নোঙরকে দেখলো। তারপর কাগজটা তার হাতে ধরিয়ে বললো,

–মিস্টার আজলানের থেকে এটার অ্যাপ্রুভাল নিয়ে এসো, যাও।

নোঙর ঠোঁট উলটে উজানের কেবিনে আসলো। উজান দীর্ঘক্ষণ ডিজাইনটা দেখে বোঝার চেষ্টা করলো, ওটা আসলে কিসের ডিজাইন। বুঝতে না পেরে টেবিলে ধপ করে কাগজটা রেখে বললো,

–এসব কি?

–একটা গাউন ডিজাইন করেছি। কেমন হয়েছে? সুন্দর না?

নোঙরকে বেশ উচ্ছ্বাসিত বলে মনে হলো। উজান তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,

–কেমন ডিজাইন করেছো সেটা দেখতেই পারছি!

উজানের মুখোভঙ্গী দেখে নোঙর দমে গেলো। খানিক মন খারাপ করে বললো,

–এভাবে বলছো কেন? কথা বলার ইচ্ছা না হলে না বলবে। তাও এভাবে কথা বলে মনে দুঃখ দেবে না প্লিজ। তুমি জানো, এই ডিজাইন করতে আমার কতোগুলো পেপার নষ্ট হয়েছে? চারটা পেন্সিল আর অর্ধেক ইরেজারও শেষ। দুটো শার্পনারও হারিয়েছে।’

কথা বলতে বলতে চেয়ার টেনে বসে পরলো সে। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যাথা হয়ে গেছে৷ উজান তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বললো,

–তার পরেও ভালো ডিজাইন হয়নি।

–আমি কি ডিজাইনার নাকি যে এসব পারবো?

নোঙর ক্ষোভ নিয়ে বলে টেবিলের উপর হাত রেখে উদাস হয়ে গেলো৷ উজান চোখ মুখ শক্ত করে ধমকের সুরে বললো,

–যদি ডিজাইন না পারো, অ্যাকাউন্টিন্স না পারো, ব্যবসায়ীক কোন জ্ঞান না থাকে তো এখানে কি করছো?

–জব করছি। আ’ম আ ওয়ার্কিং ওমেন।

নোঙর একজন গর্বিত চাকরিজীবী নারী। উজানের সামনে সেটাই জাহির করতে চাইলো। উজান ব্যাঙ্গ করে বললো,

–হ্যাঁ, সেটা তো দেখতেই পারছি।

নোঙর কিছু না বলে চোখ পিটপিট করে তার দিকে তাকালো। উজান সেদিকে ফিরেও দেখলো না। তার এতো কষ্ট করে করা আর্ট মুচড়ে ফেলে বললো,

–যেহেতু তুমি কোন কাজ পারো না আর শিখছোও না তাই কাল থেকে অফিসে আসার দরকার নেই।

নোঙর এবারে সোজা হয়ে বসে উজানের কথায় মনোযোগ দিলো,

–মানে?

–ইউ আর ফায়ার্ড।

–এক্সকিউজমি ডিয়ার হাজবেন্ড, অফিসটা আমার শ্বশুরবাড়ির। চাকরিটাও কাকা শ্বশুর দিয়েছেন। তাই তুমি আমাকে কিছুতেই ফায়ার করতে পারো না।

নোঙর এসব বলে বাঁকা হেসে হাত ভাজ করে আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। উজানকে আচ্ছামত শায়েস্তা করতে পেরে তার মন শান্তিতে ভরে উঠলো। উজান কপাল কুঁচকে কিছু ভেবে বললো,

–ওকে! ফায়ার করতে না পারি, পদ থেকে তো সরাতেই পারি।

–বলতে?

–বলতে তোমার ডিমশন হবে। এবার থেকে সবার জন্য চা কফি বানাবে তুমি।

–আমি চা কফি বানাবো!

বিষ্ময়ে নোঙরের চোয়াল ঝুলে পরলো। উজান বিরক্ত হয়ে রাগী গলায় বললো,

–তাছাড়া আর কি পদ দেবো তোমাকে?

–এমডি বানিয়ে দাও। ভালো সামলাতে পারবো।

–হ্যাঁ, এটাই বেস্ট ওয়ে। গলাবাজি তো ভালোই পারো।

–তাহলে স্বীকার করলে, তুমি গলাবাজি করেন।

নোঙর অজান্তেই কথাটা বলে ঠোঁট চেপে ধরলো। উজান কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

–আউট!

নোঙর রেগে উঠে দাঁড়ালো। যথেষ্ট হয়েছে অপমান। আর সে সহ্য করবে না। মুড়ে রাখা কাগজ হাতে নিয়ে তেজি গলায় বললো,

–হ্যাঁ যাচ্ছি। আমি নিজে আসিনি৷ আমাকে পাঠানো হয়েছিলো। নাহলে তোমার মুখ দেখার কোন শখ আমার নেই। আর রইলো তোমার চাকরি! ওটা তুমিই করো। রেজিগনেশন লেটার দিয়ে কালই চলে যাবো৷ তোমার চাকরি তুমিই খাও আর তোমার আদরের স্টাফদেরই খাওয়াও।

রাগ ঝেড়ে আর এক মূহুর্তও থাকলো না৷ হাতে ধরা মুড়ে রাখা কাগজটা দেয়ালে টাঙানো উজানের প্রাইজ ধরা ছবিতে ছুড়ে দিলো৷ ফ্রেম বাঁধানো ছবিতে বাড়ি খেয়ে নিচে পরে গেলো সেটা। সেদিকে নজরও দিলো না নোঙর। হনহন করে চলে গেলো। উজান তার বাচ্চামোতে বিরক্ত হলো খুব। তার উপর এখন কাজের প্রচুর প্রেসার পরেছে। এরমাঝে অন্যকিছু হ্যান্ডেল করার এনার্জি তার নাই৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে এক হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরলো। নোঙর রাগ করেছে৷ করলে করুক। দিনের মধ্যে চোদ্দবার এমনিতেই ফোঁস ফোঁস করে৷ এ আর নতুন কি!

নেটওয়ার্ক গোলযোগের কারনে অফিস তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। সমস্যা হলো, গোলযোগ হয়েছে বৃষ্টির কারনে। এখন যখন ছুটি হয়েছে তখন বাড়ি ফিরতে হবে। সমস্যা সেখানে না। সমস্যা বৃষ্টিই তবে সেটা অন্য কারনে। নোঙর ভুল করে বাবার পুরোনো ছেড়া ছাতা নিয়ে চলে এসেছে। ইগো দেখাতে গিয়ে উজানের সাথে কিছুতেই বাড়ি যাবে না। আবার ছেড়া ছাতা ফুঁটানোও যাবে না। ছাতা ছাড়া এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে বেরও হওয়া যাবে না৷ অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃষ্টি দেখতে লাগলো সে। একটু দূরেই উজান গাড়ির মধ্যে বসে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মুখে বিরক্তের ছাপ থাকলেও নোঙর কি করে দেখার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করে আছে। কিছু সময় পরে সেখানে অমি এসে পড়লো। সাথে একটা সিএনজি। অমিকে দেখেই উজানের মুখ শক্ত হয়ে গেলো। দ্রুত হাতে গাড়ি চালু করে সাঁই করে সেখান থেকে চলে গেলো। চমকে উঠলো নোঙর, অমি।

অমি জোরাজুরিতে তার সাথে নোঙর সিএনজিতে উঠতে নিতেই তিনজন গার্ড তাদের দিকে এগিয়ে আসলো। বিনীতভাবে বললো,

–ম্যাম, স্যার আপনাকে গাড়িতে যেতে বলেছেন।

নোঙর গার্ডদের দেখিয়ে দেওয়া গাড়ির দিকে তাকালো। উজানের গাড়ি না সেটা। কালো অ্যাম্বাসেডর গাড়িটা অমিরও অপরিচিত। কিন্তু গার্ডগুলো পরিচিত। উজানের আশেপাশে অহরহ দেখেছে। ভ্রু কুঁচকে একটু ইতস্তত করে বললো,

–আপনারা উজান স্যারের গার্ড না?

–ইয়েস।

তিনজন গার্ডের মধ্যে একজন মাথা নেড়ে উত্তর দিলো। তাদের মাঝে একটা রোবোটিক ভাব রয়েছে। অতিরিক্ত আর একটা কাজও তারা করে না। তাদের এই সংক্ষিপ্ত কাঠখোট্টা জবাবের বিপরীতে অমি কৌতুহল জরিত স্বরে বললো,

–বোনের জন্য কি দরদ! আজকাল তো মায়ের পেটের বোনেরও কেউ এতো খেয়াল রাখে না। বলছিলাম কি, আমাকেও কি লিফট দেওয়া যায়? তাহলে ভাড়া বেঁচে যেতো। মাসের শেষ তো। বুঝতেই তো পারছেন।

–সরি, স্যার কোন ভুড়িওয়ালা মানুষকে গাড়িতে তুলতে মানা করেছেন। ম্যাম বললেও না।

নোঙরের সামনে এমন বলায় অমি কেশে উঠলো। নোঙর ঠোঁট টিপে হাসি আটকালো। তারপর গার্ডদের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,

–আমি আপনাদের স্যারের দেওয়া গাড়িতে যাবো না। বুঝেছেন? বুঝলে এখন রাস্তা থেকে সরুন।

–সরি ম্যাম, স্যার বলেছেন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিলে তবেই আমাদের ছুটি। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে হসপিটালে যেতে হবে। ওখানে আমার ওয়াইফ রয়েছে।

এবারেও অতিরিক্ত কিছুই বলেনি। এসব কথা বলতে উজানই শিখিয়ে দিয়েছিলো। আবার মিথ্যাও বলেনি। যে গার্ড এটা বলেছে তার স্ত্রী একজন নার্স। আর নার্স তো হসপিটালেই থাকে। সুতরাং মিথ্যা একদমই হয়নি। নোঙর ইমোশনাল মানুষ। গার্ডের কথায় গলে গেলো। তারপর অমি সিএনজিতে চলে গেলো আর নোঙর গাড়িতে। দূরে উজান গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। স্ত্রী যেমনই হোক, তার উপর যত রাগই হোক, তার দ্বায়িত্ব পালন করা একজন স্বামীর কর্তব্য বলেই সে জানে এবং মানে।

****

প্রপার্টি দেখে রাশা তাচ্ছিল্যভরে হেসেছিলো তাকে সেইসব প্রপার্টি দেওয়া হয়েছে, যেগুলোতে নিজেরা কব্জা করতে পারেনি। দুই মালিকানায় ঝুলে রয়েছে। বক্র হেসে মনে মনে স্বগোতক্তি করলো রাশা,

–চালাক বড়বাবা! আপনি এখনও রাশাকে চেনেননি। দিলওয়ারা জামান চৌধুরীর শরীরে আপনার জিনও আছে। ভুলে কেনো যান বারবার!

দুপুরের আগেই রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ায় দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরপরই পুরো এক ট্রাক ভর্তি জিনিস নিয়ে বাড়ি ছাড়লো তারা। গাড়িতে বসার পর উষির গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

–আমাদের এতো অপমান না করলেও পারতে রাশা।

রাশার কপাল কুঁচকে গেলো,

–অপমান! কিসের অপমান করলাম?

–তোমাকে প্রপার্টি দাবী করতে কে বলেছে? আমরা কি কিছু চেয়েছিলাম? বাবা মা জানলে কতটা কষ্ট পাবে সেটা একবার ভেবেছো?

উষির রুষ্ঠ কণ্ঠে বললো। রাশা যেমন বিষ্মিত হলো তেমনই রেগেও গেলো,

–এক্সকিউজ মি মিস্টার উষির, তোমাদের জন্য প্রপার্টি নিয়েছি সেটা কে বলেছে? এটা আমার প্রপার্টি। শুধুই আমার৷

উষির দাঁতে দাঁত চেপে ধারালো স্বরে বললো,

–হ্যাঁ তোমার। আমরা তো চাইনি। তাহলে আমাদের নাম কেনো যুক্ত হলো?

–ট্রাস্ট মি, যেভাবে যুক্ত হয়েছে সেভাবে চলেও যাবে।

রাশা তাকে আস্বস্ত করে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো৷ উষির কিছুই বললো না। চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর নিরবতা ভেঙে বললো,

–তুমি হংকং ছিলে?

রাশা চোখ বুজে বড় করে শ্বাস ফেললো। রাত্রে উষির যে ডাইরি দেখেছিলো সেটা হংকং স্কুলের ডাইরি ছিলো। সেটা দেখার পর এমন প্রশ্ন যে করবে তা সে আন্দাজ করেছিলো। তাই অবাক না হয়ে ছোট করে উত্তর দিলো,

–হুম।

–পড়াশোনা?

–সব ওখানেই কমপ্লিট করেছিলাম।

–তাহলে এখানে চলে আসলে যে?

প্রশ্নটা তার জন্য অনেক কঠিন ছিলো। তাকে ল পড়ানোর ইচ্ছে তার বাবার ছিলো না। কিন্তু সে ল-তে ভর্তি হয়েছিলো। তার বাবা অত্যান্ত রেগে খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। রাশা ছোট একটা চাকরি নিয়ে খরচ চালানো শুরু করলে তার বাবা আরো রেগে ক্ষমতা খাটিয়ে বাংলাদেশের একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে তাকে ট্রান্সফার করিয়ে দেয়। যতক্ষণে সে জানতে পারে ততক্ষনে আর কিছুই করার ছিলো না। সেসব কথা বাইরের কারো সামনে প্রকাশ করতে চায় না। উষির তার কাছে এখনও বাইরের মানুষই৷ তাই সেটা প্রকাশ না করে মিথ্যা বললো,

–এমনিতেই, থাকতে ইচ্ছে হলো না। তাই ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড সেমিস্টারেই ট্রান্সফার হয়ে চলে এসেছিলাম।

উষির মৃদু হাসলো। রাশা মিথ্যে বলছে তা ওর ব্যথাতুর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ তাই আর সেটা নিয়ে কথা বাড়ালো না। কথা ঘুরিয়ে বললো,

–তোমার ফ্যামিলি তো খুব রেস্ট্রিকটেড। মেয়েকে এতোদূর যেতে দিলো?

রাশা মলিন হেসে বললো,

–মেজো বাবার খুব নেওটা ছিলাম। মেজো বাবাও আমার সব কথা মানতো৷ প্রাইমারি লেভেল শেষ করে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর দেখি ভাইয়ারা সবাই পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে। তাই দেখে আমারও শখ জেগেছিলো। তাই আমিও জেদ ধরেছিলাম। মেজো বাবা জেদ পূরণ করে নিজ দ্বায়িত্বে আমাকে হংকং নিয়ে গেলো। সেখানে এক বছর আমার সাথে থেকে আমাকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বোর্ডিং স্কুলে রেখে ফিরে এসেছিলো।

রাশা এবারেও মিথ্যা বললো। রাশা জেদ ধরেছিলো সত্যি তবে সেটা হংকং যাওয়ার না, হংকং থাকার। ঘটনাটা ওর প্রাইমারি স্কুল শেষেরই ছিলো। ওর মা তখন পঞ্চম সন্তান জন্ম দিয়েছিলো। তাদের চার বোনের এক ভাই ছিলো সে। দূর্ভাগ্যবশতঃ জন্মের পনেরো দিনের মাথায় শ্বাসকষ্টজনিত কারণে মা’রা যায়৷ শোকের ছায়ায় কেউ বুঝতেই পারেনি সদ্য সন্তান হারা মা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের স্বীকার হয়ে পরেছে। অন্য সকল ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক মাস এই রোগের স্থায়িত্বকাল থাকলেও রাশার মায়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ছিলো। পঞ্চম শিশুর জন্ম তার শরীরকে এমনিতেই অনেক দুর্বল করে ফেলেছিলো তার উপর শিশুর মৃ’ত্যু মায়ের মনে খুব খারাপ প্রভাব ফেলেছিলো। চার মেয়েদের বয়স প্রায় কাছাকাছি হলেও মায়ের বেশি কাছাকাছি ছিলো ছোট মেয়ে রাশা। মায়ের শারীরিক ও মানুষিক অবনতি ছোট রাশা বুঝতে পারেনি। বারবার শুধু মায়ের কাছে যেতে চেয়েছে আর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে এসেছে। মাঝে মাঝে মা নিজেই ডাকতো, তারপর কি যে হয়ে যেতো, হাতের কাছে যাই থাকতো তাই দিয়ে তাকে আঘাত করতো। শেষবারের আঘাত চূড়ান্ত ছিলো। রাশাকে কোলে তুলে দোতলার বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিলো। ভাগ্য ভালো থাকায় সোফার উপর পরেছিলো৷ এর জন্যেই বোধহয় মাথায় তেমন আঘাত লাগেনি৷ তবে মাথায় তেমন আঘাত না লাগলেও বেকায়দায় পরে হাত আর পায়ের হাড় ভেঙে যায়। পায়ের আর হাতের হার ভেঙে যাওয়ায় বেশ কয়েকদিন হসপিটালে অ্যাডমিট থাকতে হয়েছিলো৷ এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে হংকং নিয়ে যাওয়া হয়৷ তার মেজো বাবা ছাড়া বাকিদের এতো ফাঁকা সময় ছিলো না। স্পষ্ট করে সেটা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। যার ফলে তিনি বাধ্য হয়ে সেখানে ছিলেন। তবে তার লাভ হয়েছিলো প্রচুর। রাশা যতদিন ওখানে ছিলো ততদিন তিনি সেখানে নিজের আর্টের পসার জমিয়ে ফেলেছিলেন। সুস্থ হওয়ার পরেও যখন রাশা মায়ের ভয়ে ফিরতে চাইলো না তখন নিজের লাভের কারনেই তিনি বাড়ির সবাইকে রাজী করিয়ে সেখানেই তাকে ভর্তি করে দেয়। না বাড়ির সকলের রাশার উপর টান ছিলো আর না রাশার বাড়ির সকলের উপর টান ছিলো৷ তার মা-ও সুস্থ হয়ে ওঠার পর অসুস্থ থাকাকালীন করা সমস্থ ঘটনা ভুলে গেলো। এতোদিনের সাধনা করে পাওয়া ছেলে সন্তানের শোকের কাছে ছোট মেয়ের শোক ফিকে পরে হারিয়ে গেলো। তার মেয়ের সাথে কি হয়েছিলো, কেনো সে এভাবে দেশের বাইরে পরে রইলো তার কিছুই জানার আগ্রহ তার ছিলো না আর জানলোও না। অন্যদিকে রাশার মেজো বাবার কাজ শেষ হলে তার উড়ুউড়ু মন সেখানে আর থাকতে চাইলো না। বিলাসবহুল বাড়ির বিলাসিতা ভুলে তিনি ফিরে এলেন আর রাশাকে রেখে আসলেন বোর্ডিং স্কুলে।
উষিরের কাছ থেকে তার জীবনের এতো বড় ঘটনাটাও গোপন করে গেলো রাশা। যেটা বললো তার প্রেক্ষিতেই উষির হেসে বললো,

–তোমার মেজো বাবা তো তাহলে তোমাকে খুব ভালোবাসে।

রাশা বিদ্রুপ হাসি হাসলো৷ পরিবারের সকলের স্বার্থপরতা আর অভিনয়ের ভালোবাসা দেখতে দেখতে ভালবাসার উপর থেকে তার বিশ্বাস উঠে গেছে। মেজো বাবার থেকে দূরে থাকতে থাকতে তার স্বার্থের ভালোবাসাও বুঝে ফেলেছে। স্বার্থ ছাড়া যে মানুষ আর কিছুই বোঝে না সেটা সে জানে এবং মানে। এইযে উষির আর তার পরিবারের এতো কেয়ার, সেসব নিশ্চয় এমনি এমনি না। যেভাবে তাদের বিয়েটা হয়েছে সেভাবে এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। সম্পত্তির জন্য স্ত্রীকে বিয়ে করে সম্পত্তি হাতিয়ে স্ত্রীকে খুন করার বহু কেস সে স্টাডি করেছে৷ সেইজন্যই বিয়ের পরপরই তার গহনা সব ডোনেট করে দিয়েছে৷ এখন শুধু প্রপার্টি আছে৷ এই প্রপার্টি যখন নাই হয়ে যাবে তখন তার সাথেও নিশ্চয় এমনই করতে চাইবে। তবে সে সেটা হতে দেবে না। আগে থেকে সতর্ক হয়ে থাকবে।

শহরে ঢুকতে ঢুকতেই ঝুম বৃষ্টি থেমে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরতে লাগলো। বাড়ি পৌঁছাতে আরো দুই আড়াই ঘন্টা লাগবে। কিন্তু মাঝরাস্তায় রাশা গাড়ি থামিয়ে নেমে পরলো। উষিরও নেমে বিচলিত হয়ে বললো,

–কি হলো?

রাশা কোমড়ে হাত হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,

–এখানে তোমার চ্যালারা নেই?

–মানে?

–ছবি তুলতে হবে। সবাইকে দ্রুত আসতে বলো।

আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা উষিরের লোকবলের আসতে ঘন্টা দুয়েকের মত সময় লাগলো। ততক্ষণে চারিপাশ রাতের আঁধারে ঢেকে পরেছে। উষির আর রাশা তখন একটা দাতব্য সংস্থার ভেতর বসে আছে৷ সবাই চলে আসার পর রাশা তার কার্যক্রম শুরু করলো। উষির আর তার হাত দিয়ে বাড়ি থেকে আনা বই ছাড়া বাকি সব জিনিসপত্র একটা বড় দাতব্য সংস্থাতে দান করে দিলো। ঘটাঘট ছবিও উঠলো আর মূহুর্তে ভাইরালও হয়ে গেলো সেটা। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসার ঝড় উঠলো। উষিরের পেজের ফলোয়ার হুহু করে বাড়তে লাগলো। রাশা উষিরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললো,

–শ্বশুরবাড়ির জিনিসের ফায়দা এভাবেই নিতে হয় বুঝেছো?

উষির ক্লান্ত স্বরে বললো,

–এসব কেনো করছো রাশা? কি লাভ এতে? শুধু শুধু তোমার বড় বাবাকে রাগীয়ে দেওয়া।

রাশা চোখ ছোট ছোট করে কোমড়ে হাত রেখে বললো,

–একেই বলে, যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! শোনো, আনলিমিটেড আম খাচ্ছো খাও। কোথাকার আম সেটা জেনে কি লাভ? মজা যেটা আছে সেটাতে ইঞ্জয় করো। মজা পাবে।

উষির আফসোসে মাথা নাড়লো। এমন বউ ঘরে ঘরে থাকলে তো সব বাড়ির কপাল খুলে যাবে কিন্তু এমন মেয়ে সে ঘরে থাকবে সেই ঘরের সর্বনাশ কেউ আটকাতে পারবে না।

চলবে…

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩৪

উষিরের গু’লি লেগেছে কথাটা শুনেই রাশার হাত কেঁপে উঠলো৷ দাঁড়িয়ে থাকা দুস্কর হয়ে পরায় চেয়ারে বসেও পরলো৷ হার্টবিট খুব জোরে জোরে বাজছে। যে হাতে মোবাইল ধরেছিলো সেই হাত তো ঢিলা হয়েছেই, যে হাতে কাগজ ধরা ছিলো সেটাও আলগা হলো৷ কাগজটা ছিলো তার ভিসা অ্যাপ্রুভালের। মাত্রই সুবোধ বাবুর অফিস থেকে প্রিন্ট আউট করেছে৷ পড়ে দেখারও সুযোগ হয়নি, তার আগেই বাড়ি থেকে কল দিয়ে বলছে, উষিরের গু’লি লেগেছে। কোন এক আলোচনা সভায় গন্ডগোলের জের ধরে গো’লাগু’লি হয় আর সেখানেই তার গু’লি লাগে। টেবিলের উপর থেকে গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। তারপর কাগজ আর ফোন ব্যাগে তুলে সুবোধ বাবুকে না বলেই বেড়িয়ে পরলো। রাস্তায় আসতে আসতে নিজেকে আরো খানিকটা ধাতস্থ করলো। টিভি নিউজ, সোশ্যালমিডিয়াসহ সব জায়গায় বি’স্ফো’রণের মতো খবরটা ছড়িয়ে পরেছে। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ মিছিলের জন্য রাস্তায় জ্যামও হয়ে গেলো৷ রাশার কেমন একটা খটকা লাগলো৷ প্রায় জায়গায়ই “কে গু”লি করেছে” এর জায়গায় “বিরোধীদলের লোক গুলি করেছে” বলেই দেখাচ্ছে। সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনো দলের লোককে যেই জখম করুক, দোষ বিরোধীদলেরই হয়। তবুও রাশার মনে কেমন খটকা লাগছিলো৷ হসপিটালের সামনে পুলিশের গাড়ি দেখে মন কেমন আনচান করে উঠলো৷ দুশ্চিন্তাগুলো মনের মাঝে তিরতিরিয়ে উঠলো। শুধু মনে হতে লাগলো, বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে গেলো না তো! এই দুশ্চিন্তায় মনের মাঝে থাকা খটকা আড়াল হলো তবে সেটা সম্পূর্ণ দমে গেলো না।

হসপিটালের করিডরে দলের লোকে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে৷ এরমাঝে বাড়ির লোক তেমন দেখা যাচ্ছে না। রাশা খানিক সময়ের জন্য বিভ্রান্ত হলেও উষির কোন কেবিনে আছে, তা লোকগুলোর চলাফেরা দেখে আন্দাজ করে কেবিনে ঢুকলো আর পেয়েও গেলো।
অসারের তর্জন গর্জন সার বাগধারাটি উষিরের গুলি লাগার ঘটনার সাথে খুব ভালো যাচ্ছে। তার তেমন কিছুই হয়নি। গু’লির ব্যান্ডেজ বলতে পেশিবহুল বাহুতে শুধু একটা ফার্স্টএইড ব্যান্ডেজ লাগানো৷ ব্যাস! এতেই পুরো দেশ তোলপাড় হয়ে গেছে আর হসপিটালের করিডোর লোকে লোকারণ্য হয়ে পরেছে!
পুরো কেবিন আত্মীয়স্বজনে ভর্তি৷ বাড়ি থেকে সবাই এসেছে৷ আবার নোঙরের বাড়ি থেকেও সবাই এসেছে৷ উষিরের মামা বাড়ি থেকেও তারা আসতে চেয়েছিলো কিন্তু শহরের গরম গরম পরিবেশ আর উষিরের অল্প ইঞ্জুরির কথা শুনে প্ল্যান ক্যান্সেল করে দিয়েছে। তারা শুধু ফোনে যোগাযোগ করছে। মাহফুজা আর শাহিদা উষিরের পাশে বসে এখনও কান্নাকাটি করছে। আর রোগী তাদের শান্ত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বেডে হেলান দিয়ে কপালে হাত রেখে বসে আছে৷ রাশা এসে থেকে সবার এতো কাহিনী দেখে একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো৷ তার কপালে চিন্তার ভাজ। হসপিটাল অথোরিটি এতো মানুষকে হসপিটালে অ্যালাও করলো কিভাবে! আর ডক্টরই বা রোগীর রুমে এতো মানুষ একসাথে থাকতে দিলো কেনো!

কিছুক্ষণ পর সেখানে উজান উপস্থিত হলো। নোঙর রাশার মতোই এক কোনে দাঁড়িয়ে ছিলো। উজানকে একপলক দেখে অভিমানে চোখ ফিরিয়ে নিলো। উজানও তার দিকে তাকিয়েছিলো। তার চোখ ফেরানো দেখে কপাল কুঁচকে রাগের এই কারন খুঁজলো। নোঙর সাধারণ একদিনের রাগ আরেকদিন পুষে রাখে না৷ এই কয়েকদিনে এমনটাই তো সে দেখে এসেছে। সকালে রাগ করলে, সেই রাগ বিকাল পর্যন্ত আসে না আর বিকালে রাগ করলে পরেরদিন সব ঠিক। যদিও প্রতিদিনই কোন না কোন কারনে রাগ করতেই থাকে তবুও সেটা ক্ষনস্থায়ীই হয়৷ গতকাল সরকারি ছুটি ছিলো আর আজ অফিসিয়াল ছুটি৷ সেই দুই দিন আগের রাগ এই দুইদিনেও মেটেনি, এটা বিশ্বাস করতে একটু কষ্টই হচ্ছে। উজান এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আর সময় নষ্ট করতে চাইলো না। সবাইকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়া এখন তার দ্বায়িত্বের মধ্যে পরেছে। সেটাই করলো।
কেবিন থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় নোঙর উজানের পাশ ঘেঁষে নিরবে মাথা নিচু করে চলে গেলো। মুখ দেখে রাগ রাগ মনে হচ্ছে না। তার চাপা অভিমান বোঝার সাধ্য উজানের নেই। বুঝতে পারলোও না। শুধু কপাল কুঁচকে একবার চিন্তা করলো, নোঙরের ব্যবহার রাগের ছিলো নাকি ইচ্ছে করে তাকে এড়িয়ে গেলো! চিন্তার দৌড় এই পর্যন্তই ছিলো৷ ওখান থেকে সবাইকে নিয়ে হসপিটালের বাইরে এসে দেখলো, নোঙর আগেই গাড়িতে উঠে বসে আছে। আত্মীয়তার খাতিরে এগিয়ে এসে শ্বশুরবাড়ি আর মামার বাড়ির লোকের সাথে কথা বলার ফাঁকে একবার জানালার গ্লাস দিয়ে ভেতরে তাকিয়েছিলো৷ নোঙর থমথমে মুখে মাথা নিচু করে বসে আছে। নীরব, নিস্প্রভ ভঙ্গি তার। একসময় উজানের চরম বিরক্ত লাগলো৷ নোঙরের এই ব্যবহার-আচার একেকসময় বিরক্তির উর্ধ্বে চলে যায়। তার বাড়িতে এতো বড় একটা ক্রাইসিস গেলো আর ইনি এখন ড্রামা করতে ব্যস্ত! কাল আসুক অফিসে৷ তখন ভালোমতো ক্লাস নেওয়া যাবে।

সবাই চলে যাওয়ায় তাদের সাথে রাশাও চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু উষির তাকে দেখে ফেলায় আর যেতে পারেনি। তাই সবাই চলে যাওয়ার পর রাশা গিয়ে বেডের পাশের টুলে বসলো। উষির নিজে শহরের বড় প্রাইভেট হসপিটালের এসিরুমের কেবিনে বসে আড়াম করছে। আর তারজন্য সাধারণ মানুষ রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল করছে। রাশার খুব হাসি পেলো। এই হাসিটা আসলে কিসের জন্য লাগছে সেটা বড়ই রহস্যময়। তাচ্ছিল্যভরা এই হাসি আসলে কিসের জন্য? উষিরের ব্যবহারে, সাধারণ মানুষের বোকামিতে নাকি নিজের ভাগ্যে! ভাগ্য হবে হয়তো৷ যে ভাগ্য থেকে পালাতে সৌরভের মতো ছেলেকে জীবন থেকে তাড়ালো, সেই ভাগ্যের কবরেই আজ সে সায়িত!

রাশা বসতেই উষির তার হাত টেনে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাতের উল্টোপিঠে ঠোঁট ছুইয়ে বললো,

–আমি তো আরো ভাবলাম, তুমি আসবেই না।

রাশা হাত টেনে নিতে চাইলে শক্ত করে ধরলো উষির৷ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের শক্ত করে ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে তেছড়া ভাবে বললো,

–কেনো? তোমার সাথে কি আমার কোন শত্রুতা আছে নাকি যে আসবো না?

উষির ক্লান্ত স্বরে বললো,

–তুমি এমন ত্যাড়া কথা বলো কেনো বলোতো? একটু সুন্দর করে কথা বললে কি হয়?

রাশা উত্তর দিলো না। তার দৃষ্টি উষিরের ছোট ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজের দিকে। স্থীর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ চুপ করে দেখে এক টানে সেটা তুলে ফেললো। উষির ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো৷ রাশা একনজর আঘাতের দিকে তাকিয়ে তারপর ব্যান্ডেজের দিকে তাকালো। ব্যান্ডেজ হাতে তাচ্ছিল্যভরা সুরে বললো,

–এই সামান্য আঁচরে ব্যান্ডেজ! নাইস ওয়ার্ক!

উষির একবার হাতের কাঁটা জায়গায় দেখে আঙুল দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরলো। টান দিয়ে তোলায় সামান্য র’ক্ত গড়িয়ে পরছিলো। রাশা ব্যান্ডেজ মুড়ে ঝুড়ির দিকে ঢিল দিলো। পরলো না অবশ্য। নিশানা সামান্য বাঁকা হয়ে দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খেলো। সেদিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বললো,

–কিভাবে করলে এটা?

উষির কাঁটা জায়গায় আঙুল চেপে হেসে ফেললো। তারপর টিস্যুর সাহায্যে রক্ত মাখা আঙুল পরিষ্কার করে বললো,

–এগুলো তো সিমপল কাজ৷ আগে থেকেই লোক সেট করা ছিলো৷ তারা ইশারায় ফাঁকা গু’লি ছুড়েছে আর পাশ থেকে একজন ধারালো ব্লে’ড দিয়ে একটু আঁচর দিয়েছে। ব্যাস!

–ধরা পরলে?

রাশা কৌতুহলী হলো। উষির মৃদু হেসে বললো,

–এতোই সোজা নাকি? আর তাছাড়া কিছুক্ষণ পর প্রেস কনফারেন্সে বলে দেওয়া হবে, আমি আউট অফ ডেঞ্জার। গু’লি পাশ ঘেঁষে বের হয়ে গেছে।

–এতো প্রোটেকশন থাকতেও এমন ঘটনা ঘটলো, এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না?

উষির সজোরে মাথা নাড়লো,

–উহু! কেউ এসব চিন্তাই করবে না। এটাকে মাইন্ড গেম বলা হয়। বুঝেছো?

উষিরের গর্ব নিয়ে বলআ কথায় তার মধ্যে বড় বাবার ছায়া দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো রাশা৷

–মাইন্ড গেম! মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলে কি মজা পাও তোমরা? তাদের ইমোশনের কোন দাম নেই তোমাদের কাছে?

–তোমার কাছে আছে? আমার ইমোশনের দাম?

উষির আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো৷ রাশা রেগে গেলো৷ তার সামনে অসুস্থতার নাটক করে বসে থাকা মানুষটার সাধারণ মানুষের আবেগের কোন দাম নেই? এটা শুধুই একটা খেলা! এতো সস্তা সব কিছু!

–যে অন্য লোকের ইমোশন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, সে নিজের ইমোশনের দাম চাচ্ছে? সাউন্ড ইন্টারেস্টিং! তোমার হিরো হওয়া উচিত। অসাধারণ অ্যাক্টিং স্কিল। এটা কি বাই বর্ন নাকি প্র‍্যাক্টিস করে আর্ন করেছো?

উষিরের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। শক্ত গলায় বললো,

–তুমি এখন যাও রাশা। এই মূহুর্তে আমার তর্ক করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

রাশা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে উষিরকে দেখলো৷ তার মনে হলো, বর্তমানে তার সামনে দ্বিতীয় হাসান চৌধুরী বসে আছে। যাকে সে মনে প্রাণে ঘৃণা করে৷ উষিরের উপরও আসলো সেই ঘৃণা, রাগ৷ কোলের উপর রাখা ব্যাগ রাগের সাথে কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত পায়ে হসপিটাল ত্যাগ করলো। উষিরকে তার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপের উত্তির্ন হওয়ার সুখবরটা জানানো হলো না৷ সিদ্ধান্ত নিলো, জানাবেই না৷ যে সম্পর্কটাই টিকবে না, সেই সম্পর্কে এতো আলগা কথাবার্তার কোন মানেই হয় না৷ কোন মানে না!

***
নোঙর নিজের বিছানায় বসে উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখছিলো। অপলা, নিহান আর অন্তু তার মন খারাপ দেখে ছোট ছোট পায়ে এসে তাকে ঘিরে ধরলো। অপলা নোঙরকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

–তোমার কি মন খারাপ আপু?

নোঙরের চোখে পানি চলে আসলো। নাক টেনে বললো,

–কিছু হয়নি।

নিহান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আলতো স্বরে বললো,

–মিথ্যা বলছিস কেন? কেউ কি কিছু বলেছে?

ড্রিম লাইটের অল্প আলোতে নোঙরের গড়িয়ে পরা চোখের পানি দেখা গেলো না। সে ক্লান্ত। ভীষণ রকমের ক্লান্ত৷ উজানের ভালোবাসায় ক্লান্ত, তার অবহেলায়ও ক্লান্ত। এই ক্লান্তের মাঝে নিজেকে সে হারিয়ে বসেছে। কয়েকদিনেই হাল ছেড়ে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে মাথা নেড়ে বললো,

–আমাদের বাড়িতে দুইটা বড় ভুল হয়ে গেছে।

অন্তু কৌতুহলী হলো,

–কে কি ভুল করেছে আপু?

–প্রথম ভুল করেছে ফুপি ফুপাকে বিয়ে করে। আর দ্বিতীয় ভুল করেছে আমাদের পরিবার। ফুপার আপারক্লাস ছেলের সাথে তাদের মিডলক্লাস মেয়ের বিয়ে দিয়ে।

নোঙর উদাস গলায় উত্তর দিলো। অপলা বিচলিত হয়ে বললো,

–এসব কি বলছো আপু? ভাইয়া কত ভালো।

–সমস্যা তো সেটাই৷ আপারক্লাস মানুষ মিডলক্লাস মানুষদের আত্মীয় হিসেবে খুব ভালো হয়। কিন্তু জীবনসঙ্গী না।

–কেনো আপু? হলে কি হয়?

অন্তু কৌতুহলি গলায় প্রশ্ন করলো। তার কৌতুহল এতো পরিমাণে হলো যে, হাতের আইসক্রিম গলে গলে পরছে কিন্তু সেদিকে তার খেয়ালও গেলো না। নোঙর বিষন্ন হেসে বললো,

–ওরা অনেক উঁচু রে। তাকাতে হয় মাথা উঁচু করে৷ এতে আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু ওরা তো সামনে তাকাতে ভালোবাসে। আমাদের জন্য ঝুঁকবে কেন?

–তা ঠিক বলেছো৷ ভাইয়া সত্যি অনেক লম্বা।

অন্তু ঠোঁট উলটে বলে আইসক্রিমে কামড় দিলো৷ নোঙর অন্তুর কথায় তার দিকে তাকিয়ে নিস্প্রান হাসলো৷ অপলা আর নিহান দুই দিক থেকে দুইজন অন্তুর পিঠে কিল বসিয়ে দিলো। ব্যথায় উহু করে উঠল সে। অপলা ধমক দিলো,

–চুপ কর তুই। আপুকে বলতে দে।

নোঙর ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর আবার উদাস হয়ে বললো,

–জীবনসঙ্গী হতে হয় সমানে সমানে। আর তাছাড়া আমাদের কিচ্ছু মিল নেই। বিয়ের আগে আমাদের অন্তত একটু সময় দিলে ব্যাপারটা এতো খারাপ হতো না হয়তো। সম্পর্ক টেকাতে এমন হুটহাট বিয়ের কোন মানে হয় বল? বড়রা যদি বাচ্চামো করে তাহলে ছোটদের তো মন ভাঙবেই তাই না?

এই কথায় নোঙরের উদাসি মন খারাপ বাকি তিনজনের মধ্যেও ছেয়ে গেলো। বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই যদি এমন মনে হয় তাহলে সারাটা জীবন তো পরেই আছে। তখন কি করবে! সেপারেশন তো সমাধান না। মানিয়ে নিয়ে চলা বলেও তো একটা কথা আছে। এই কথাটা অপলা বোনকে বলতে চাইলো কিন্তু সাহস করে উঠলো না। থাকুক কিছুক্ষণ মন খারাপ। সকালে বোঝানোর চেষ্টা করবে।

চলবে…

তুমি সন্ধ্যার মেঘ পর্ব-৩১+৩২

0

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩১

বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে রাশার পরিপাটি সাজগোছ দেখে বাড়ির সকলে হা হয়ে গেলো। লম্বা ঢোলাঢালা কামিজ তো সে অনেক পরেছে, তবে এমন পরিপাটি ওড়না কোনকালেই নেয়নি। আজকে মাথায় খুব ভালো করে ঘোমটা টেনে একেবারে নতুন বউ সেজেছে৷ দুই হাতে দুইটা চিকন বালা পরতেও ভোলেনি৷ গলায় আর কানেও গহনা। তার সাজগোছ দেখে ময়না বিষ্ময়ে বলেই বসলো,

–ভাবি, তুমি বাপের বাড়িই যাবা তো?

রাশা উত্তর না দিয়ে থমথমে মুখে গাড়িতে গিয়ে বসলো৷ বড় লাগেজের পরিবর্তে ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে বসলো উজান৷ আর তারপরই বরাবরের মতোই রাশার হাত নিজের হাতের মাঝে আটকে নিলো। গাড়ি তো ড্রাইভার চালাচ্ছে। এখান বউয়ের সাথে সময় কাঁটানো ছাড়া তার আর কি কাজই বা আছে!

রাস্তায় উষির হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু বলছিলো৷ তক্ষুনি রাশার সম্পূর্ণ মনোযোগ তার ঘড়ির দিকে পরলো৷ আর সাথে সাথেই তীক্ষ্ণ চোখে স্ক্যান করে সন্দেহী গলায় প্রশ্ন করলো,

–তোমার ঘড়িতে কি লেগে আছে?

উষির একনজর রাশার বলা জায়গাটা দেখে ঘড়ি খুলে প্যান্টের পকেটে রাখতে রাখতে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,

–র’ক্ত।

এই ঘড়িটা সেই ঘড়িই৷ লোকটাকে মারার সব চিহ্ন মিটিয়ে ফেললেও ঘড়িতে চিহ্ন লেগেই আছে। এইজন্যই বোধহয় বলে, অপরাধ তার প্রমান রেখে যায়। উষির যত স্বাভাবিক স্বরে কথাটা বললো, রাশা ততটাই বিচলিত হলো। তার আঘাত লাগলো নাকি সেটা সব থেকে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো।

–রক্ত! তোমার কোথাও লেগেছে নাকি?

উষির দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷ রাশার তাকে নিয়ে এই বিচলিত ভাব অন্য কোনসময় হলে তার খুব ভালো লাগতো৷ কিন্তু এখন লাগছে না। মনটা বিষন্ন হয়ে রইলো। চোখ মুদে রাশার কাঁধে মাথা রেখে বললো,

–একজন অ্যা’ক্সিডে’ন্ট করেছিলো৷ তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো কোনভাবে লেগে গেছে।

–তোমার টিম এটা নিউজ করেনি কেনো? উষির কখন ঘুম থেকে উঠলো, কি খেলো, কি পরলো, এখন কোথায়, সবই তো নিউজ করে। তাহলে এতো বড় একটা ঘটনা সম্পর্কে কিছু বললো না! ইন্টারেস্টিং!

উষির কিছু বললো না। রাশার মজাটা তার কাছে তাচ্ছিল্য করা মনে হলো৷ চোখ জোর করে বন্ধ করে ঘুমানোর ভাণ ধরলো। এই প্রশ্নের থেকে রেহাই পাওয়ার এই একটা উপায়ই তার জানা আছে।

***
নোঙরের দ্বিতীয় টাস্ক অ্যাকাউন্টেন্স সম্পর্কিত ছিলো। ফাইল দেখেই তার মাথা ঘুরে উঠলো। উজানের সামনে বসে নিরীহ গলায় বললো,

–আমার গ্র‍্যাজুয়েট বিএ নিয়ে, বিবিএ নিয়ে না। এসব পারবো কিভাবে?

সামনে বসা মেয়েটির সামনে কিছু বলে কোন লাভ নেই, সেটা তার জানা আছে৷ তাই কিছু না বলে চুপচাপ ফাইলগুলো ফেরত নিলো৷ এরপর নোঙর নিশ্চিন্তে নিজের ডেস্কে ফেরত গেলো। ভাবলো, তার কাজ আপাতত শেষ।
বড় যে প্রজেক্টটা হাতে এসেছে, তার একটা শ্যুট ছিলো আজকে। শ্যুট সাধারণ অন্য একজনই করে তবে যে যে প্ল্যান উজানের করা থাকে, সেই সেই শ্যুটের দ্বায়িত্ব সেই নেয়। আজকের শ্যুটের প্ল্যান উজানের করা। সুতরাং সময় বাঁচাতে শহরের বাইরে যে আউটডোর শ্যুট হওয়ার কথা সেটা অফিসের কাছাকাছিই একটা ফাঁকা খোলা জায়গায় করা হবে। এখন সেখানে সেটারই সেটাপ করা হচ্ছে।

অফিসে নোঙরকে একা রাখার ভরসা উজানের নেই। তাই মিস পাখির সেক্রেটারি করেই তাকে রাখা হলো৷ আর এই মিস পাখিরই তো তার উপর ভয়ংকর রাগ আছে। রাগ ঝাড়লোও আচ্ছামতো। কথায় কথায় ঝাড়ি দেওয়া, তার মাঝে অন্যতম। এই কান্ডে মডেল পাখির উপর নোঙরের যতটা না রাগ হলো, তার থেকে দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি অভিমান হলো উজানের উপর।

ভীষণ রোদ ছিলো। রোদের তেজে তাকানো মুশকিল। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে একবার সুর্যের দিকে তাকালো নোঙর। তারপর হাতের আড়ালে চোখ রেখেই চোখ ছোট ছোট করে আরেক হাতে পানির বোতল আর ছোট একটা ব্রুজ ধরে শুটিংয়ের দিকে নজর দিলো। ব্রুজটা ড্রেসের সাথে খুবই দরকারী। বলা চলে, ড্রেসের মেইন আকর্ষণই সেটা। মডেল পাখি মেকাপ করার বাহানায় সেটা খুলে নোঙরের হাতে রেখে দিয়েছে। উজান বড় ছাতার নিচে চেয়ারে বসে শুটিংয়ের ডিরেকশন দিচ্ছিলো। নোঙরকে তীব্র রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছাতার নিচে বসতে বলার জন্য একজনকে পাঠালো। নোঙর ঝাঁঝালো কণ্ঠে নাকচ করে দিলো। উজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে একপলক জেদি নোঙরের দিকে তাকিয়ে উঠে পরলো। সাথে সাথেই আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা গার্ড সমবেত হয়ে তার পেছনে এসে দাঁড়ালো। উজান তপ্ত শ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে ছোট করে বললো,

–ছাতা?

সাথে সাথেই একজন গার্ড ছুটে গিয়ে ছাতা এনে তার হাতে দিলো। উজান ইশারায় গার্ডদের সেখানে থাকতে বলে ছাতা ফুটিয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে নোঙরের পাশে এসে দাঁড়ালো। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেখানেই তার মাথায় ছাতা ধরে শুটিংয়ের ডিরেকশন দিতে লাগলো। নোঙর কিছু বললো না৷ তার মন এখন অভিমানে পরিপূর্ণ। তাই সরে আসতে চাইলো৷ উজান শক্ত হাতে তার হাত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যাপারটা সকলেই দেখলো৷ বোন বলে আলোচনা বেশিদূর আগালো না। তার উপর দুজনেই বিবাহিত। তাদের স্যার আর যাই হোক, বিবাহবহির্ভূত কোন সম্পর্কে যে জড়াবে না সেই বিশ্বাস তাদের আছে। তবে চোখে পরলো মিস পাখির৷ শক্ত চোখে সবটা দেখলো। শ্যুটিং করার ইচ্ছেটাই তার মরে গেলো৷ কিন্তু কন্ট্যাক্ট মোতাবেক যদি অকারণ শ্যুটিং বন্ধ করে তাহলে তাকে ভারি জরিমানা দিতে হবে। যদিও তার কাছে হাজার অযুহাত আছে তবে সেগুলো উজানের কাছে টিকতে পারে না। এর আগে চেষ্টা করেছিলো দুই একবার। পরিনাম খুব একটা ভালো হয়নি৷ সামনে তার একটা সিনেমা করার কথা আছে। এই সময় কোন স্ক্যান্ডেল সে অ্যাফোর্ড করতে পারবে না। তাই চুপচাপ হজম করে নিলো।

নোঙরের হাতে ব্রুজ দেখে উজান কপাল কুঁচকে বিরক্তিকর স্বরে বললো,

–তোমার কাজ মিস পাখিকে অ্যাসিস্ট করা। তার জিনিসপত্র হাতে ধরে রাখা না। আর ব্রুজটা হাতে দিয়েছে কে? আমার কাছে দাও। হাতে থাকলে পরে যাবে।

নোঙর হাতের মুঠো শক্ত করে কঠিন স্বরে বললো,

–আমার হাত থেকে কখনও কিছু হারায় না।

উজান তাকে আর কিছুই বললো না৷ তবে বাকিদের ছাড়লো না। নোঙরকে এসব কাজ দেওয়ার জন্য একটা স্টাফকে বেশ জোরে ধমক দিলো। স্টাফটা কাচুমাচু ভঙ্গিতে বোতল আর ব্রুজ নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছিলো। নোঙর অবাক হয়ে দেখলো, তার হাতে বোতল থাকলেও ব্রুজটা নেই। সেটা নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নোঙর অস্বস্তিতে পরে গেলো। সহজ ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বললো,

–এমা! এটা এমন পিচ্ছিল কেনো? সাবধানে ধরে রাখবেন, নাহলে আপনার হাত থেকেও পরে যেতে পারে।

নিজের দোষ যে ঢাকতে চাচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। উজান নোঙরের বোকামিতে হাসি আটকে ইশারায় স্টাফকে চলে যেতে বললো৷ শ্যুটিং শুরু হলে নোঙরের খোঁজ পরলো৷ উজান দেখলো, সে নোঙরের ওড়নার উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চটজলদি সরে ওড়নার কোনা হাত দিয়ে ধরে বললো,

–তোমার ওড়নাতে তো..

ওড়নায় কাদা লেগে গেছিলো। উজান সেটা বলতেও পারলো না৷ নোঙর তার আগেই খপ করে ওড়না ধরলো,

–লজ্জা করে না তোমার? ইজ্জত লুটতে চাচ্ছো!

উজান কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো৷ তারপর কিছু না বলে ছাতা হাতেই চলে গেলো। আর নোঙর ছুটলো মডেল পাখির কাছে৷ এইমাত্র যে উজানকে অপমান করলো তার ধারণা বিন্দুমাত্র হলো না। নিজের অভিমান আর অপমান দেখতে গিয়ে সামনের জনের কথা বেমালুম ভুলে গেলো৷

মডেল পাখি স্থির দৃষ্টিতে নোঙরের পেন্ডেন্টের দিকে তাকিয়ে একসময় বলে উঠলো,

–হাউ মাচ ইজ ইয়োর স্যালারি?

ছাতার নিচে বসে মেকাপম্যান মডেল পাখির মেকাপ ঠিক করছিলো৷ নোঙর জুসের গ্লাস হাতে বিরক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো৷ তার কথায় কপাল কুঁচলে বিরক্তিকর শ্বাস ফেললো,

–অ্যাকোর্ডিং টু মাই রুল, স্যালারি কাউকে বলতে হয় না।

পাখি হাতের ইশারায় মেকাপ বন্ধ করতে বলে নোঙরের দিকে ঘুরে বসলো। পায়ের উপর পা তুলে বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে বললো,

–লেটমি গেস, টুয়েন্টি টু টুয়েন্টি ফাইভ কে। রাইট?

–আমি এখনও আমার আগের বাক্যে স্থির আছি।

নোঙরও নিজের অ্যাটিটিউড বজায় রেখে পাখির চোখে চোখ রেখে বললো। পাখি মাথা নিচু করে হালকা হাসলো৷ তারপর ঠোঁটের কোনে আঙুল রেখে ভাবুক গলায় বললো,

–ম্যারেড?

–ইয়েস।

ফুল কনফিডেন্স নিয়ে উত্তর দিলো। পাখি ভ্রু নাচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

–হাজবেন্ড কি করে?

–বিজনেস।

–ওহ! ছোটখাটো কোন গ্লোসারি স্টোর অর হকার হবে হয়তো। তোমরা তো নিজেদের অনেক বড় বড় বিজনেসম্যানদের সাথে কম্প্যায়ার করে খুব রিলিফ পাও। হোয়াট এভার! তুমি একটা শপের ওয়াইফ হয়ে আর একজন সামান্য স্টাফ হয়ে স্যাফায়ার পরছো! তাও ল্যাভেন্ডার স্যাফায়ার! আ’ম ইম্প্রেস! এতো টাকা পেলে কোথায়? চুরির জিনিস নয়তো?

ব্যাঙ্গ করে উত্তর দিলো পাখি৷ নোঙরের এই মেকাপ সুন্দরীকে আরো বেশি খারাপ মনে হলো। মনে মনে দোয়াও করলো,

–এ আজকে আবার আছাড় খাবে, আছাড় খেয়ে দাঁত পরে যাবে, নাক থেতলে যাবে, মুখের মধ্যে পোকা ঢুকবে, চোখের পাপড়িতে আঠা লেগে আটকে যাবে, আজকেই পেট খারাপ করে বাথরুমে বসে থাকবে..

এমন আরো হাজারখানেক বদদোয়া তার মনে ছিলো। সবগুলো একসাথে দিলো না। মানুষভেদে সেগুলো আলাদা আলাদা৷ এইসব বদ দোয়া নিজের পেন্ডেন্টে হাত দিয়েই করছিলো৷ বলা চলে সেটা পাখির নজর থেকে বাঁচানোর জন্যই করছিলো৷ সে তো এটাকে পাঁচ দশ হাজারের টোপাজ স্টোন ভেবেছিলো৷ এটা যে লাখ টাকার স্যাফায়ার, সেটা কে জানতো! স্যাফায়ার! সেতো অনেক দামী পাথর৷ তার থেকেও বড় কথা, তার সব সোনার গহনা এক জায়গায় আর উজানের দেওয়া এই গিফট আরেক জায়গায়৷ দুনিয়ার কোন কিছু দিয়েই এর মূল্য ধারণ করা যাবে না। আবার আরেকটা কথা মাথায় আসলো, তার নাহয় গহনার ব্যাপারে ধারণা কম। কিন্তু পাখির মতো চিল শকুন, চোরদের তো ধারণা আছে। তারা তো তাকে এই পেন্ডেন্টের জন্য কিডন্যাপ করতে পারতো। তারপর গলা কেঁ’টে…!
নোঙর মাথা নেড়ে খারাপ চিন্তা দূর করতে চাইলো৷ পাখির দিক থেকে ভয়ংকর দৃষ্টি সরিয়ে উজানের দিকে সেই দৃষ্টি দিলো। এর মনে তাহলে এই ছিলো! ম’রে গেলে তো ঝামেলা চুকে বুকে যাবে! এইজন্যই এমন চিন্তা করেছে! কি চালাক! গলার কাছে কান্নারা দলা পাকিয়ে রইলো। মনে হলো কেউ টু শব্দ করলেই সে কান্না করে দেবে। এতো জ্বালা যন্ত্রনা তার ভাগ্যেই থাকতে হলো! উজান দূর থেকে দেখে কিছই বুঝতে পারলো না। বাড়ি আসার পর গাড়ি থেকে নামার সময় নোঙর উজানের হাতে পেন্ডেন্ট গুজে দিয়ে আঙুল উঁচিয়ে তিরিক্ষি স্বরে বললো,

–নোঙর খন্দকারকে ফাঁদে ফেলা এতো সহজ না। তোমার সব চালাকি আমি ধরে ফেলেছি। সব এতো সোজা না বুঝেছো? আমি কালকেই থানায় জিডি করে রাখবো। আমি ম’রলে তোমাকে নিয়েই ম’র’বো, হুহ!

বলেই উজানকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে শরীরের সব শক্তি দিয়ে গাড়ির দরজা বন্ধ করে গটগট করে চলে গেলো।

চলবে..

#তুমি_সন্ধ্যার_মেঘ
#হুমায়রা
#পর্বঃ৩২

রাশার বাড়িতে ঢুকলে আধুনিক যুগের রঙিন আলো ধপ করে নিভে পুরোনো আমলের সাদাকালো আলো জ্বলে ওঠে। দেখে মনে হয়, বিংশ-শতাব্দীর কোন জমিদার বাড়িতে ঢোকা হয়েছে৷ উষির সেখানে এসেছিলো এক রাত্রের জন্য। জমকালো লাইটে সাজানো বাড়িতে কাটানো সেই এক রাত্রেই তার জীবনের মোড় পালটে যায়। আজ আবার এসেছে সেই পালটানো মোড়ের জের ধরে। রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানো সে এখন অস্বস্তিতে গাট হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর আশপাশ দিয়ে নতুন নতুন মুখ চলাফেরা করছে। আসলেই কোন বাড়িতে এতোজন মানুষই থাকে! কে কে যে আছে তার হিসাব নেই। তবে বলা যায়, অর্ধেক বাড়ির সদস্য আর অর্ধেক বাড়ির কর্মচারী।
নতুন জামাই হিসেবে আপ্যায়ন জোরদার চলছে। বিশাল বড় লিভিংরুম কম হলরুমের পুরোনো ডিজাইনের সোফায় বসে আছে উষির। সামনে বসে আছে হাসান চৌধুরী, হামিদ চৌধুরী আর খলিল চৌধুরী। দুই তিনজন লম্বা মোটাসোটা বলিষ্ঠ দেহধারী তাদের পেছনে বড় লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে৷ মুখে গামা পালোয়ানের মতো গোঁফ। উষির আড়চোখে বারবার সেদিকে তাকাচ্ছিলো৷ একসময় সেখানে রাশা আসলো। হাতে ট্রে ভর্তি শরবতের গ্লাস৷ মাথায় এক হাত ঘোমটা দেওয়া। তাকে দেখে উষিরের চোখে কপালে উঠে গেলো। রাশা নিজের হাতে শরবতের গ্লাস সবার হাতে তুলে দিলো। উষির অবাক চোখে তাকিয়ে বিবাহিত জীবনে প্রথমবারের মতো স্ত্রীর হাত থেকে শরবতের গ্লাস নিলো। রাশার পেছনে আরো তিনজন কাজের মহিলা এসেছিলো। তাদের হাতের ট্রে-তেও বিভিন্নরকমের খাবার ছিলো। হাসান চৌধুরী মৃদু হেসে রাশাকে বললেন,

–রাশা মা, ওগুলোও জামাইকে দাও। বাড়িতে এখন একটাই জামাই উপস্থিত আছে। আদরের কোন কমতি রাখবে না। মনে রাখবে, স্বামীই মেয়েদের জীবন।

বেশ জ্ঞানপূর্ণ কথা। রাশা বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে মৃদু স্বরে বললো,

–জ্বি।

উষিরের মনে হলো সে ভুল শুনছে৷ এটা তার বউয়ের গলা কিছুতেই হতে পারে না। সবসময় হম্বিতম্বি করা মেয়েটা এখন একেবারে ভেজা বিড়াল হয়ে গেলো! হাউ ইজ দিস পসিবল! রাশা আবার যখন তাকে মিষ্টির প্লেট দিতে নিলো তখন দুজনের চোখে চোখ পড়ল। উষিরের চোখে বিষ্ময় ছিলো আর রাশার চোখে বিরক্ত, রাগ। তার চোখে দেখা বিরক্ত দেখে সে খুব শান্তি পেলো। এতোক্ষণ পর বউয়ের পুরোনো রুপ দেখে তার নিজের নিজের মনে হলো। রাশা খাবার সার্ভ করা শেষে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলে আবার উষির একা হয়ে পরলো। খলিল চৌধুরী নিরবতা ভেঙে কথা বললেন,

–কতবছর হলো এই প্রফেশনে আছো?

–দুই বছর।

–দুই বছরে আর কি ইনকাম করতে পারলে! এর থেকে তো ভালো বাবার বিজনেসে হাত লাগাতে। নাহলে তোমার ওই চাচাতো ভাই সব দখল করে নেবে। ভবিষ্যতে সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে।

উষিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো,

–আমাদের এভাবে মানুষ করা হয়নি। আর প্রপার্টির উপর আমার আগ্রহও নেই।

উষির বলতে চেয়েছিলো, তাহলে কি আপনিও এমন কিছু করবেন? কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বললো না। হাসান চৌধুরী কাষ্ঠ হেসে বললেন,

–নিজের প্রপার্টির লোভ নেই অথচ শ্বশুরবাড়ির প্রপার্টি থেকে নজর সরছে না।

উষিরের চোখ টেবিলে রাখা শরবতের গ্লাসের উপর ছিলো৷ গুরুজনের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয় না বলেই সে জানতো। কিন্তু এই কথায় নজর না তুলে পারলো না। বিষ্ময়ে বলে উঠলো,

–সরি বুঝতে পারিনি, কিসের প্রপার্টি?

হাসান চৌধুরী দুইটা উত্তপ্ত মানুষকে শান্ত করতে হাত তুলে নিজের ভাইকে থামালেন। তারপর বললেন,

–ওসব পরে দেখা যাবে। কিন্তু বাবা তুমি যে কাজটা করেছো সেটা কি ঠিক হয়েছে?

উষির বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলো,

–কি কাজ?

–স্ত্রী হচ্ছে স্বামীর সম্মান। তাদের আড়ালে রাখা মানে নিজেদের সম্মান হেফাজতে রাখা। যেসব পলিটিশিয়ানরা নিজেদের পরিবারকে সামনে এনে ইলেকশন জিততে চায় তাদের আমি কাপুরুষ বলে মনে করি। আশা রাখি, তুমি আর রাশাকে নিয়ে সামনে আসবে না।

উষির রাগে হাত মুঠো করে ফেললো। চোয়াল শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,

–রাশা আমার স্ত্রী। আর আমার স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করতে আমি অ্যাবল।

হাসান চৌধুরী আর হামিদ চৌধুরী একে অপরের দিকে চোখাচোখি করলেন। গোপনে কোন বৈঠক হয়ে গেলো বলে মনে হলো। খলিল চৌধুরী হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর একজন কাজের লোককে ডেকে উষিরকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। হাসান চৌধুরী আর হামিদ চৌধুরীও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়াতে হলো উষিরকেও। হাসান চৌধুরী নিজের গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন,

–অনেক দূর থেকে এসেছো বাবা। ক্লান্ত নিশ্চয়? ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। বাকি কথা রাতে খাবারের পর বলা যাবে।

উষির গম্ভীরমুখে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে কাজের লোকের সাথে ঘরে গেলো।
রান্নাঘরে রাতের খাবারের প্রস্তুতি চলছিলো৷ রাশা বিরক্তিমুখে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পেয়ারা খাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর রাশার ফুপু রান্নাঘরে এসে তাকে দেখেই বলে উঠলো,

–তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে এসব কি কাপড় দিয়েছে রে রাশা? এসব জামা তো আমরা দান করি।

রাশা মুখ বেঁকিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,

–তাহলে তোমার শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিও। তারা পরবে।

তিনি ফুঁসে উঠলেন,

–এতো বড় কথা তুই বলতে পারলি?

–নিজের ইউজ করা ড্রেস পাঠাতে পারো আর যে ড্রেস তুমি দান করো তা পাঠাতে পারবে না? দিস ইজ নট ফেয়ার ফুপু!

রাশার ফুপুর নাম আঞ্জুয়ারা। রাশার থেকে খুব বেশি বড় নয় ৷ বড়জোর বছর দশেকের বড়। তবে তাদের বাড়ির নীতি মেনে তিনি বাড়ির কোন মেয়েকেই দেখতে পারেন না। বিশেষ করে রাশাকে তো একদমই না। এতোদিন পর তাকে দেখে কিসের ক্ষোভ ঝাড়বে বুঝতে না পেরে ড্রেস নিয়েই বলে উঠলো। তবে রাশার প্রতি-উত্তরে চিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,

–শোন রাশা, অতো দেমাগ ভালো না। তোর যে কান্ডে বিয়ে হয়েছে না, ওমন কান্ডে আমার বিয়ে হলে দ্বিতীয়বার এ বাড়ি মুখ দেখাতাম না।

রাশা টিটকারি দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,

–সেইজন্য বোধহয় শ্বশুরবাড়িতে যাও-ই না, তাই না?

মূহুর্তকালের জন্য থমকালো সে। তারপর তাচ্ছিল্যভরে হেসে বললো,

–শোন, অন্তত আমার বরের চরিত্র ভালো আছে। কারো ঘরে ঢুকে ধরা তো পরেনি।

রাশা ফিক করে হেসে দিয়ে বুকে হাত রেখে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,

–হায় ফুপু! কি কথা মনে করে দিলে! আমি প্রে করি, তেমনটা তোমার জীবনে কখনও না হোক। তুমি যেমন ফুলের মতো চরিত্রের অধিকারী, ফুপাও যেনো তেমনই ফুলের মতো চরিত্রেরই হয়৷

রাশার ফুপুর অতীতে পালিয়ে যাওয়ার একটা রেকর্ড আছে৷ ছয় দিন পর বয়ফ্রেন্ডসহ ধরে এনেছিলো। সেই ছেলেটির জীবন সেখানে সমাপ্ত হলেও তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তিনি ভাবলেন, তাকে সেটা নিয়েই কথা শুনানো হচ্ছে। আরো বেশি রেগে কিছু বলতে চাইলেই রাশার বড় মা ধমক দিয়ে উঠলেন,

–আহ! এসব কি হচ্ছে? আঞ্জু, তুমি কি বাচ্চা? আর রাশা, ফুপুর সাথে কেউ এসব কথা বলে? ক্ষমা চাও?

রাশা হাসি আটকে আবার বেশ নাটকীয় সুরে বললো,

–আ’ম সো সরি ফুপু৷ দোয়া করি, আমার মধুনিঃসৃত বানী তোমাকে আর শুনতে না হোক। আমিন বলো?

আঞ্জুমান মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলো,

–তোর এই দেমাগ একদিন এমন ভাবে ভাঙবে যে আর উঠে দাঁড়াতে পারবি না।

–সেম হেয়ার।

বিড়বিড় করে বলেছিলো রাশা৷ তবে ফুপু নিজের কথা শেষ করে চলে যাওয়ায় কথাটা শুনতে পায়নি। ফুপুর যাওয়ার দিক থেকে নজর সরিয়ে সোজা হলো৷ তারপর কিছুটা চিন্তিত স্বরে বললো,

–মেজো বাবা কোথায়?

তার উত্তর দিলো ছোট মা,

–জানি না। দুইদিন আগেই বাড়ি ছেড়েছে। বলে তো আর যায় না।

রাশার তাকে খুব দরকার ছিলো। আফসার সাহেবের সাথে গভীর বন্ধুত্ব করার কারণটা জানার খুব ইচ্ছে তার। তার জানামতে, স্বার্থ ছাড়া এরা কোন কাজ করে না। এই স্বার্থ শুধু সেই রিসোর্টই ছিলো নাকি অন্য কিছু তা জানা খুব দরকার।

–তুই নাকি সম্পত্তি চাচ্ছিস?

ছোট মায়ের কথায় চিন্তার জাল ছিন্ন হলো। এতোক্ষণ নিরব থাকা তার বড় বোন এবারে কথা বলে উঠলো,

–সম্পত্তি? কিসের সম্পত্তি?

রাশা বিরক্ত হলো। এতোক্ষণ তার লাভের কথা হচ্ছিলো না জন্য নিরবে শুধু শুনেই গেছে৷ আর যখনই সম্পত্তির কথা উঠেছে তখনই মুখে বুলি ফুটেছে। এরা যে কবে এসব থেকে বেড়িয়ে আসবে!

–আমার ভাগের সম্পত্তি।

রাশার বড়বোন প্রায় চিৎকার করে উঠলো,

–মেজোর সাথে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটনোর পরেও ওকে সম্পত্তি দেবে? শুধুমাত্র ওর জন্য মেজোকে এখানে আসতে দেয় না। উঠতে বসতে কথা শুনায়। তারপরও এসব চিন্তা করছো! একে তো ত্যাজ্য করার পরেও ওকে বাড়িতে এনেছো, তারপর আবার প্রপার্টি দেবে? ওকে যদি দাও তাহলে আমাকেও দিতে হবে। এক চুলও ছাড়বো না।

তার চিৎকারে এতোক্ষণ ধরে মাথা নিচু করে কাজ করতে থাকা কাজের মেয়েরা চমকে উঠে মাথা তুলে তাকে দেখলো। তারপর আবার নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। রাশার ফুপু আবার কি কারণে ফেরত এসেছিলো। প্রপার্টি ভাগের কথা উঠতেই সেও বলে উঠলো,

–আর আমি কি পানিতে ভেসে এসেছি নাকি? একমাত্র বোন আমি। আমার ভাগ তো আরো বেশি।

এসে গেছে আরেকজন! একজন কি কমতি পরেছিলো নাকি! বিরক্ত ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে মাথায় ওড়না টেনে রাশা বললো,

–তোমাদের এই কামড়াকামড়ি আমি খুব মিস করবো, সত্যি!

বলেই বাইরে যাওয়ার জন্য পা ফেললেও কোন কারণে দাঁড়িয়ে পরলো। তারপর ছোট মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

–দিয়া কোথা ছোট মা?

–বাড়ি নেই। নানাবাড়ি গেছে।

–শাহরিয়ার ভাই, সুলতান ভাই এরা নেই? বাকিদেরও তো দেখছি না।

–না, কেউ নেই।

রাশা তাচ্ছিল্যভরে হাসলো,

–মানে সবাইকে সরিয়ে তারপর আমাকে এনেছো?

–স্বাভাবিক। তোমার ছায়া ওদের উপর পরলে ওদের বিয়েও তোমার মতো করেই হবে। তাই দূরে দূরে থাকাই ভালো।

রাশা উত্তেজিত হয়ে বললো,

–তোমাদের ভদ্র বিয়েতেই বা কি সুখ পেলে? বড় দুলাভাই তো আরেকটা বিয়ে করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে। উঠতে বসতে আরেকটা বিয়ে করার ভয় দেখায়। কারন হিসেবে জানায়, পাঁচ বছরেও বাচ্চা হয়নি। এটা কোন কথা! বাচ্চা কি একজনের দোষে হয় না? আর বাচ্চা নাহলেই আরেকটা বিয়ে করতে হবে! হাউ ক্রিঞ্জ! আমি কতবার বললাম ডিভোর্সটা নিয়ে নে। কিছুতেই কানে তুলে না। এখনও বলছি তোকে, আমার পরিচিত বেস্ট ডিভোর্স ল’ইয়ার আছে। ডিভোর্সের সাথে দুলাভাইকে এমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে না! বেচারা আর…

জোরদার চড় রাশার গালে এসে পরলো। রাশা গালে হাত দিয়ে সেকেন্ডের জন্য থমকালেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। এইবাড়িতে এসব নিত্যদিনের ব্যাপার৷ সবারই মুখের থেকে হাত বেশি চলে। স্বামীরা বউকে মারে আর বড়রা ছোটদের। এই মার খু’ন পর্যন্ত যে যায়না এই অনেক!

–তোর যখন বাচ্চা হবে না তখন ওই উকিল দিয়েই ডিভোর্সটা করিয়ে নিস।

রাশার বড়বোন দাঁত কিড়মিড়িয়ে কথাটা বলেই নিজের কাজ ফেলে রান্নাঘর থেকে চলে গেলো। রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও ঘরে গেলো।
উষির রাশার ঘরে বেড ক্রাউনের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলো। হাতে ছিলো রাশার ডাইরি। নিজের রাগ থামাতে সেটা উল্টেপাল্টে দেখছিলো। রাশা এসে সর্বপ্রথম তার হাত থেকে ডাইরি ছিনিয়ে নিলো৷ তাকে দেখে উষিরের মন এতোক্ষণ পর একটু ভালো হলো। এক গাল হেসে বললো,

–ডাইরিতে সাংকেতিক ভাষায় এসব লিখে রেখেছো? সোজা ভাষায় কিছু লিখতে পারো না? শিখিয়ে দেবো?

রাশা উত্তর দিয়ে খেয়ে ফেলা নজরে তাকালো। উষির গলা খাঁকারি দিয়ে প্রসঙ্গ পালটে কৌতুহলী গলায় বললো,

–তোমার কি এমন মনে হচ্ছে না যে তুমি এখানে যেভাবে থাকো, সেভাবে অন্যরা শ্বশুরবাড়িতে থাকে।

রাশা এবারেও কিছু না বলে ঘরে থাকা বিশাল বইয়ের সেল্ফ থেকে বই নামিয়ে রাখতে লাগলো। উষির উঠে বসে বললো,

–রাগ করো না৷ কিন্তু দেখো, এখানে তুমি এক মূহুর্তের জন্যেও মাথা থেকে ঘোমটা সরাচ্ছো না আর ওখানে তুমি আমার টি-শার্ট পরে ঘোরাঘুরি করো। না, তোমার ড্রেসও পরো কিন্তু সেগুলোর সাথে এটা মানে টোটাল ডিফারেন্ট! আবার খাবার সার্ভ করছো! আমি আসলে তোমাকে সত্যিই চিনতে পারছি না। বাই এনি চান্স, তুমি কি এখানকার হাওয়া বাতাসে উলটে গেছো?

–এই বাড়ির সব মেয়েরা এভাবেই থাকে। আমি ছুটিতে যখন এখানে আসতাম তখন আমারও বাধ্য হয়ে এভাবেই থাকতে হতো। যেহেতু আমার পড়াশোনা বাইরে সেহেতু আমি নিজের মতো করেই চলাফেরা করেছি অ্যান্ড করি।

উষির হাসি আটকে গালে হাত রেখে বসে বললো,

–রাশাও বাধ্য হয় তাহলে! তুমি কি ভয় পাও? তোমার বড় বাবাকে?

রাশার হাতের বই শব্দ করে রেখে কটমট করে তাকালো৷ দরজায় কাজের মেয়ের নক পরায় রাগ গিলে তাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলো। মেয়েটি এক গাদা কার্টুন বক্স এনে ফ্লোরে রাখে চলে গেলো। রাশা সেগুলোর ভেতর নিজের জিনিসপত্র ভরতে লাগলো। তাকে একা কাজ করতে দেখে উষির হাত লাগালো৷ একসময় হাপিয়ে উঠে পুরো ঘরে নজর বুলালো। মোটামুটি পুরো ফ্লোর ভর্তি হয়ে গেছে৷ তাও অর্ধেক জিনিসও ভরা হয়নি। উষির বিষ্মিত হয়ে বললো,

–এই এতো জিনিস তোমার?

–হ্যাঁ তো ত্রিশ বছর ধরে জমানো জিনিস বলে কথা। এতো তো হবেই।

উষির চমকে উঠে রাশার দিকে তাকালো,

–ত্রিশ বছর! তোমার বয়স ত্রিশ?

রাশা কাজ ফেলে কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বললো,

–ত্রিশ! সেতো পার হয়ে এসেছি আরো আগে। আমার তো তেত্রিশ বছর বয়স!

–তেত্রিশ! তুমি তো মাত্রই ত্রিশ বললে?

–ছত্রিশ বলেছি। মন কই থাকে?

রাশা প্রায় ধমকের সুরে বললো। উষির রাশার ত্যাড়া কথা বুঝতে পেরে থমথমে মুখে চুপ করে গেলো। রাশা বুঝানোর ভঙ্গিতে বললো,

–আরে বাবা, বাইশ বছরের একটা তরুনিকে কেউ ত্রিশ বছরের মহিলা বানিয়ে দেয় নাকি?

রাশার বয়স ত্রিশ না। সেইজন্যই হয়তো গর্ব নিয়ে মহিলা বলতে পারলো। নাহলে কোন মেয়ে নিজেকে মহিলা বলে জাহির করবে, সেটা তো হতেই পারে না।

–বাইশ বছর!

উষির দাঁতে দাঁত চেপে বললো। রাশা খেঁকিয়ে উঠলো,

–কেমন মানুষ তুমি? মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করতে হয় না সেটা জানো না? আমি কি তোমার স্যালারি জিজ্ঞাসা করছি? আমি যখন রুল মেইনটেইন করছি তখন তোমারও করতে হবে। এখন বলো তোমার স্যালারি কত?

উষির থমথমে মুখে বসে রইলো। রাশা তেঁতে উঠলো,

–দেখেছো দেখেছো? নিজের স্যালারি বলতে প্রবলেম আর আমাকে বয়স জিজ্ঞাসা করছো? লজ্জা করে না?

উষির আর একটা কথাও বললো না। থম মেরে বসে রইল। আর রাশা কিছুক্ষণ গজগজ করে নিজের কাজ করতে লাগলো।

***
রাতে শোয়ার আগে রাশার ডাক পরলো বড় বাবার অফিস ঘরে৷ ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো তার। কাঁপা পায়ে সেখানে হাজির হয়ে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো৷ এইজীবনে বড় বাবার থেকে বেশি ভয় আর কাউকে পায় না সে। যতটা সম্ভব তার থেকে দূরে দূরেই থাকে৷

–তুমি নাকি প্রপার্টি চাচ্ছো?

হাসান চৌধুরীর গুরুগম্ভীর আওয়াজে রাশার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো। উত্তর দিতে পারলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। হাসান চৌধুরী কিছুক্ষণ তার অবনত মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

–এটা কি তোমার চাওয়া নাকি তোমার শ্বশুরবাড়ির চাওয়া?

রাশা এবারেও কিছু বললো না। ভয়ার্ত ঢোক গিলে ফ্লোরে নখ খুঁটতে লাগলো।

–ঠিক আছে৷ পেয়ে যাবে সবকিছু। তোমার বাকি বোনদেরও যথেষ্ট যৌতুক দেওয়া হয়েছে। তোমাকে তার বদলে প্রপার্টি দিচ্ছি৷ এরপর তোমার আর কোন দাবিদাবা থাকবে না। মনে থাকবে?

ঘাড় কাঁত করে সায় জানালো সে। তারপর মিনমিন করে বললো,

–খাগড়াছড়ির রিসোর্টটা..

–পেয়ে যাবে। কাল দুপুরের মধ্যে রেজিস্ট্রিও হয়ে যাবে। প্রপার্টি নিয়ে তারপর শ্বশুরবাড়ি যাবে। আমি চাইনা ওখানে আমাদের মুখ ছোট হোক।

রাশা ঘাড় কাত করে সায় জানালো শুধু। হাসান চৌধুরী কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,

–তুমি আমাদের বাড়ির কালচার জানার পরেও যেসব কাজ করে বেড়াও, সেটা কি ঠিক করো? আমাদের উপর তোমার রাগ আছে জানি, কিন্তু কারনটা জানি না। যদিও এই বংশের মেয়ে হয়ে তোমার গর্ববোধ করা উচিৎ। সে যাই হোক, সেসব সবার নিজস্ব ব্যাপার। তোমার এখন বিয়ে হয়েছে, তবুও এখনও যা করবে সেটার সাথে আমাদের পরিবারের নাম যুক্ত থাকবেই। তাই এরপর থেকে যা করবে সাবধানে করবে। সম্মানে আঘাত লাগলে আমি কিন্তু কাউকে ছাড়ি না। এখন যাও।

এতো বড় বড় জ্ঞানের বাক্য শোনার পর ত্যাক্ত বিরক্ত রাশা অবশেষে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে আর এক মূহুর্তও থাকলো না। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

চলবে…