Thursday, July 31, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 63



তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-১৫+১৬

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১৫

“কোথায় গিয়েছিলি তুই প্রিয়তা?”
প্রিয়তার সামনে দুই জোড়া তীক্ষ্ণ চোখ। সে অসহায়বোধ করে। এদিকওদিক তাকিয়ে বাবাকে খোঁজে। কিন্তু কোথাও বাবাকে দেখতে পাচ্ছে না। আসলেই বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে। নিজেই বুঝতে পারেনি এতোটা দেরি কীভাবে করে ফেললো সে। বেশ আগে থেকেই অদ্ভুত একটা দোষ আছে তার। খুব মন খারাপ হলে নদীর পাড়ে চলে যায়। নদীর বিশালতার মাঝে নিজের কষ্টটুকু, মন খারাপ টুকু বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কখনোই এভাবে রাত করেনা। আজ কলেজ ছুটির পর ভীষণভাবে বিষাদ দখল করে নিয়েছিলো তার মনটা। কিছুই ভালো লাগছিলো না। আগপাছ কিছু না ভেবেই ছুটে গিয়েছিলো নদীর পাড়ে। কিন্তু কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে সে টেরও পায়নি। এখন বুঝতে পারছে কতোটা বড় ভুল করে ফেলেছে সে। পেখমটাকেও আশেপাশে দেখতে পাচ্ছে না। আর ওই রাগী লোকটা তাকে বাড়িতে ফেলেই কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেলো।
মার্জিয়া বেগম ধীর পায়ে এগিয়ে আসে প্রিয়তার দিকে। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,”তোর সারা শরীরে কাদামাটি কেনো? কোথায় ছিলি এতোক্ষণ তুই?”
মর্জিনা বেগম চিৎকার করে উঠে বললো,”এভাবে জিজ্ঞেস করলে ও কিচ্ছু বলবে না। চড় কষিয়ে দে দুই গালে দুইটা। কলেজে উঠে ডানা মেলেছে। ডানা ছেঁটে দিবো এবার।”
প্রিয়তা ঈষৎ কেঁপে খালার দিকে তাকায়।
মার্জিয়া বেগম হাত উঁচু করে আপাকে থামায়।
“আপা চিৎকার করোনা, আমি কথা বলছি।”
মার্জিয়া বেগমের চিৎকার চেচামেচিতেই অভ্যস্ত মেয়েরা। তার এমন শান্ত দৃষ্টিই ভিতরটা নাড়া দিয়ে দিচ্ছে প্রিয়তার।
প্রিয়তার গায়ের কাদা শুকিয়ে গেছে কিছু। মার্জিয়া বেগম হাত দিয়ে ঝেঁড়ে দেয় সেগুলো।
“কি হলো উত্তর দাও। শরীরে এতো কাদা লাগলো কীভাবে?”
প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয়,”মা রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।”
“ঘড়িতে এখন সময় প্রায় সাড়ে আটটা। তোমার কলেজ ছুটি হয় বিকাল চারটায়। আমার জানামতে আজ বাড়তি ক্লাসও ছিলো না। এই চার ঘণ্টা কোথায় ছিলে তুমি?”
প্রিয়তা কিছু বলার আগেই মার্জিয়া বেগম আবার থামায় তাকে।
“দয়া করে বলবে না তুমি কোনো বান্ধবীর বাড়িতে ছিলে। আমি তোমার সব বান্ধবীর বাড়িতে খোঁজ নিয়েছি। সাহস থাকলে সত্যটা বলো।”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে দাঁড়ায়। নিজেরই নিজেকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করছে। কীভাবে পারলো সে এতো বড় ভুল করতে? সে কি ভুলে গেছে, মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের ছোট একটা ভুলই পাপ হয়ে ধরা দিতে পারে?
“তুমি কোথায় এমন ছিলে যে উচ্ছ্বাস এতো দ্রুত তোমাকে খুঁজে পেলো? সে কি জানতো তুমি কোথায় থাকতে পারো?”
প্রিয়তা ফ্যাকাশে মুখে তাকায় মায়ের দিকে।
“মা তুমি আমার কথাটা শোনো…..”
প্রিয়তা কথা শেষ করার আগেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে মর্জিনা বেগম।
“ও আর কি বলবে? বলার মতো মুখ আছে ওর? বাপ মায়ের মুখে চুনকালি মিশিয়েই শান্ত হবে ও। বিয়ে দিয়ে আপদ বিদেয় কর।”
প্রিয়তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে এবার। শান্ত মেয়েটা ফুঁসে ওঠে হঠাৎ।
“খালা দয়া করে একটু চুপ করবেন আপনি? আমার পুরো কথাটা না শুনে তখন থেকে এতোগুলো কথা বলে যাচ্ছেন আপনি। আপনার সমস্যাটা কি?”
প্রিয়তা কথা শেষ করতে না করতেই একটা বলিষ্ঠ হাতের চড় এসে পড়ে তার মুখে। মুহুর্তের মধ্যে তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায় সে। হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই তার বিস্ময় বাঁধ ভাঙে।

“বাবা….”
“এক্ষুনি ক্ষমা চাও তোমার খালার কাছে।”
“বাবা তুমি আমাকে মারলে?”
“ক্ষমা চাইতে বলেছি তোমাকে।”
কবির শাহের অগ্নিমূর্তির সামনে হতবাক মার্জিয়া বেগমও। যে বাবা কখনো মেয়েদের শরীরে ফুলের টোকা ফেলতে দেয়নি, উঁচু গলায় ধমক পর্যন্ত দেয়নি সে কিনা আজ মেয়ের গায়ে হাত তুললো? বোঝাই যাচ্ছে কতোটা রাগ পুষে রেখেছে সে ভিতরে।
প্রিয়তা তখনও গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। সে কি এতো বড় শাস্তি পাওয়ার মতো ভুল করেছে?
“এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাদের আমি? নিজে অন্যায় করেছো, তার উপর বড়দের সাথে এভাবে কথা বলছো। যে কারণে আমি আজীবন গর্ব করেছি, আমার মেয়েদের আমি আমার আদর্শে বড় করেছি। আজ সেই তুমি কিনা আমার মাথাটা এভাবে নিচু করে দিলে?”
কবির শাহের কথা শেষ হওয়ার পরেও ঘর গমগম করতে থাকে। সারা ঘরে পিনপতন নীরবতা।

মর্জিনা বেগম মুখ টিপে হেসে মনে মনে বললো,’বেশ হয়েছে। খুব গর্ব মেয়েদের নিয়ে তাইনা? আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তোলার ফল এবার বুঝবে কবির।’

প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়ায়। এখনো তার দৃষ্টি বাবার দিকে নিবদ্ধ। সমস্ত বিস্ময় যেনো অতিক্রম করে ফেলেছে সে।
মর্জিনা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে। এরপর ভাঙা গলায় বিড়বিড় করে বললো,”খালা আমাকে ক্ষমা করে দিন, আর হবে না এমন।”
ঠোঁট উলটে মর্জিনা বেগম বললো,”হ্যা সেই আর কি। তোদের তো আবার অন্যরকম ব্যাপার। তোর বাবা তোদের পড়াশোনা করিয়ে জজ ব্যারিস্টার বানাবে, সেই সাথে বেয়াদব বানাবে। আমাদের মেয়েকে আমরা এতো পড়ালেখাও করাইনি, এতো অসভ্যও বানাইনি।”
কবির শাহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললো,”ও তো ক্ষমা চেয়েছে। তারপরও এতো কথা বলছেন কেনো? প্রিয়তা, তুমি তোমার ঘরে যাও। পরে তোমার সাথে কথা বলবো আমি।”
ফ্যালফ্যাল করে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তা। চোখের পানির বাঁধ মানছে না। নিজের সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার এমন নতুন রূপ পৃথিবীর কেউ সহ্য করতে পারেনা।
“কি হলো? তোমাকে যেতে বললাম না? ঘরে যেয়ে কাপড় পালটে নাও। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা বসে যাবে।”
প্রিয়তা আস্তে করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে ঘরে চলে যায়।

প্রিয়তা যেতেই কবির শাহ চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসে পড়ে। শুধুমাত্র সে জানে এতোক্ষণ তার মনের উপর দিয়ে, শরীরের উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গেছে। উন্মাদের মতো ছুটে বেরিয়েছে সে। একটা সময়ে মনে হচ্ছিলো, মেয়েকে এই মুহুর্তে খুঁজে না পেলে এক্ষুনি হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়ে যে তার শরীরেরই অংশ। এটা কীভাবে বোঝাবে সে?

“কবির বলছিলাম কি….”
কবির শাহ নির্লিপ্ত চোখে মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা আপনার গাড়ির ড্রাইভার আপনাকে খুঁজছিলো। রাত তো অনেক হলো।”
অপমানে মর্জিনা বেগমের মুখ কালো হয়ে ওঠে। তাহলে কি কবির তাকে চলে যেতে বলছে পরোক্ষভাবে? বিয়ের কথাটা তো তুলতেই পারলো না সেভাবে।

কোনো কথা না বলে মর্জিনা বেগম হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কবির শাহ মাথায় হাত চেপে হেলান দেয় চেয়ারে।

মার্জিয়া বেগম নি:শব্দে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ায়।
“মার্জিয়া।”
“বলো।”
“আমি বাবা হিসেবে কি ব্যর্থ হলাম? আসলেই কি তোমরা যা বলতে তাই সঠিক? আমি ওদের কখনো শাসন করিনি, ওদের মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে দিয়েছি খোলা আকাশে। এটাই কি আমার ভুল ছিলো? আমি শিক্ষক, সুশিক্ষিত মানুষ তৈরির কারিগর আমি। এই হাত দিয়ে কতোশত ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দিয়েছি, মানুষের মতো মানুষ করেছি। সেই আমি কিনা নিজের সন্তান মানুষ করতে ব্যর্থ হলাম?”
মার্জিয়া বেগম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”তুমি এমন করছো কেনো? মেয়ে একটা ভুল করে ফেলেছে। হয়তো সত্যিই কোনো বিপদে পড়েছিলো। পুরোটা না শুনে….”
মার্জিয়া বেগমকে থামিয়ে দেয় কবির শাহ। মেয়ে কোনো বিপদে পড়েনি, সে যে একটা কান্ডজ্ঞানহীন কাজ করেছে এটা সে খবর পেয়েছে। সেই সাথে আরো অনেক কিছু জেনেছে।
“আমাকে এক কাপ চা করে দিবে মার্জিয়া? মাথাটা আর চাপ নিতে পারছে না।”
স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মার্জিয়া বেগম চলে যায়।

রাত বাড়তে না বাড়তেই পুরো শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে উচ্ছ্বাসের। ক্ষণে ক্ষণেই কাঁপছে সে জ্বরের দাপটে। কোনো কিছুরই খেয়াল নেই। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। উঠে যেয়ে পানি খাওয়ার মতো শক্তি তার নেই।

খাবার টেবিলে মাথা নিচু করে বসে খাবার নাড়াচাড়া করছে কবির শাহ। টেবিলটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। প্রিয়তা বা উচ্ছ্বাস কেউ নেই টেবিলে। পেখম শুধু এক কোণায় বসে চুপচাপ খাচ্ছে।
“তুমি খাবার নিয়ে কোথায় যাচ্ছো মার্জিয়া?”
“মেয়েটা ভয়ে এখানে আসতে পারছে না। সারারাত কি না খেয়ে থাকবে?”
“খাবার রেখে দাও। ওকে বলো এখানে এসে খেতে।”
পেখম আস্তে আস্তে বললো,”বাবা আপা বলেছে সে আসবে না।”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”তাহলে ওর খাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
মার্জিয়া বেগম ভীষণ অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকায়। কি এমন জেনেছে সে? যে মেয়ে বলতে সে পাগল, মেয়েকে না খাইয়ে নিজে কখনো খায়না সে কিনা আজ এতো বড় কথা বলতে পারলো?

কিছুক্ষণ খাবার নাড়াচাড়া করে পাতেই হাত ধুয়ে উঠে পড়লো কবির শাহ।
মার্জিয়া বেগম কিছু বললো না। মেয়ের জন্য বাবার মনের অবস্থা ভালো করেই বুঝতে পারছে সে।

বালিশে মুখ গুঁজে ফোঁপাচ্ছে প্রিয়তা। কোনোদিন ভাবতে পারেনি তার বাবা তার সাথে এমন আচরণ করবে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে তার। কান্নার শক্তিও অবশিষ্ট নেই শরীরে আর।
“আপা কাঁদিস না। বাবা রেগে যেয়ে এমনটা করে ফেলেছে। রাগ কমলেই বাবা ঠিক নিজের ভুল বুঝতে পারবে তুই দেখিস। তখন নিজে তোর কাছে আসবে।”
প্রিয়তা লাল চোখে পেখমের দিকে তাকায়।
“আমি ভুল করেছি, বাবা একবার কেনো দশবার চড় দিক আমাকে। আমার কোনো আফসোস নেই। বাবা আমার পুরো কথাটা না শুনে খালার কাছে ক্ষমা চাইতে বললো, তারপর থেকে আমার মুখটাও দেখলো না। কষ্টটা তো এজন্যই পাচ্ছি আমি।”
পেখম মাথা নিচু করে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাইও তখন থেকে ঘরের দরজা আটকে রয়েছে। বাবা উনার খোঁজও করেনি একবারও।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”বাবা কি কিছু সন্দেহ করলো? কিন্তু বিশ্বাস কর, সবাই যা ভাবছে তা সত্যি না। আমাকে কিছু বলার সুযোগটা কেনো কেউ দিচ্ছে না?”
“আপা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বাবার সাথে কথা বল তুই। বড় খালা আজ আরেকটা সুযোগ পেয়ে গেলো। যদি সত্যি এবার তোর বিয়েটা দিয়ে দেয়?”
বালিশে হেলান দিয়ে আবারও শব্দ করে কেঁদে দেয় সে। সামান্য ভুল থেকে কতো বড় বিপদ আসতে চলেছে তার। এতোদিন বাবা ছিলো তার পাশে। শত বিপর্যয়ের মধ্যেও বাবা পাশে থাকলে কোনো ভয় থাকে না। আজ বাবাও তাকে ভুল বুঝলো। কি হবে এখন?

ভোরবেলা দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে মার্জিয়া বেগম কিছুটা বিরক্ত হয়। মানুষটা নিশ্চয়ই আজও হাঁটতে যাওয়ার সময় কিছু একটা ফেলে গেছে। কবির শাহ রোজ সকালে হাঁটতে যায়। ঠিক তার দুই মিনিট পরই আবার ফিরে এসে বলে কিছু একটা ফেলে গেছে।
রাগে গজগজ করতে করতে দরজা খুলতেই কিছুটা থমকে যায় মার্জিয়া বেগম। কথা সরে না মুখ দিয়ে।
“খালাম্মা ভালো আছেন?”
মার্জিয়া বেগম মিনমিন করে বললো,”বাবা তুমি এখানে?”
নিয়াজ মোর্শেদ এক গাল হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করে মার্জিয়া বেগমকে।
ইতস্তত করতে থাকে মার্জিয়া বেগম।
“এই তোরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ঝুড়িগুলো বাড়ির ভিতরে নিয়ে আয়।”
দুইটা ছেলে বড় বড় দুইটা ঝুড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। বাঁধা দেওয়ার অবকাশটুকুও পায়না মার্জিয়া বেগম।
“এসব কি হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এগুলো কি?”
“সব বলছি খালাম্মা। আগে যদি একটু পানি খাওয়াতেন।”
কথা বলতে বলতেই নিয়াজ ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে। এমনভাবে সে চলাফেরা করছে যেনো সে এ বাড়িরই লোক।

গ্লাসের পুরো পানিটা শেষ করে নিয়াজ আবারও হাসে।
“খালুজানকে দেখতে পাচ্ছি না, উনি কোথায়?”
“উনি সকালে হাঁটতে যান। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছি না আমি। একটু পরিষ্কার করে বলবে? আর সাথে এগুলো কি এনেছো?”
“কেনো খালাম্মা? মর্জিনা খালা যে আমাকে বললেন এ বাড়িতে আসার কথা। তাই তো আর দেরি করলাম না। সকাল সকাল চলে আসলাম। আর খালি হাতে কীভাবে আসি বলুন তো? তাই আপনাদের জন্য সামান্য উপহার নিয়ে এলাম।”
মার্জিয়া বেগম বুঝতে পারে এতোক্ষণে, এসব তার আপার কাজ। তার আপা পাঠিয়েছে নিয়াজকে। হয়তো ভেঙে যাওয়া সম্বন্ধটা আবার জোড়া লাগাতে চাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে মার্জিয়া বেগম দরজার দিকে তাকায়। মেয়েদের বাবা চলে এলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে।
“উপহারের কি দরকার ছিলো বাবা?”
“তেমন কিছুই না খালাম্মা। আগের দিন খালুজানকে দেখলাম বাজারে একটা ছোট মাছ কেনার জন্য দোকানদারের সাথে দরদাম করছে। তাই ভাবলাম ছোট একটা মাছ উপহার দিই উনাকে। সামান্যই কিছু জিনিস।”
ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে মুখ হা হয়ে যায় মার্জিয়া বেগমের। এটা নাকি ছোট মাছ! বিশাল আকারের মাছ, সাথে আরো অনেক বাজার এনে হাজির ছেলেটা। এই সামান্য বাজারই তাদের সারা মাসের বাজার।
মার্জিয়া বেগম রাগ হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পারেনা। অদ্ভুত একটা ভালো লাগা মন ছেয়ে যায় তার। নিশ্চয়ই আসার সময় এলাকার মানুষ সবাই দেখেছে নিয়াজকে। খুব কি ক্ষতি হবে ছেলেটার সাথে প্রিয়তার বিয়ে হলে? বয়সটা যা একটু বেশি, তাতে কি? পুরুষ মানুষের বয়স দিয়ে কি হবে? সারাজীবন সে যা কষ্ট করে এসেছে, মেয়েরাও তাই করবে নাকি? মধ্যবিত্ত মায়েদের মাঝে মাঝে সন্তানের সুখের জন্য লোভী হতে হয়। তার হতে দোষ কি?

মার্জিয়া বেগম মুখে হাসি টেনে বললো,”তুমি নাশতা করবে তো?”
“সে আপনি যদি আদেশ করেন, তবে তো করতেই হবে।”
“বেশ বেশ। তুমি একটু বিশ্রাম করো। তোমার খালুজান এলে আজ একসাথে নাশতা করেই যাবে।”
মার্জিয়া বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। ঘরে যা আছে তাই দিয়ে ভালো কিছু নাশতা বানাতে হবে। অস্থির অস্থির লাগে তার।

ঘরের চারপাশ ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে দেখে নিয়াজ। নিতান্তই মধ্যবিত্তের ছোঁয়া বাড়ির প্রতিটা কোণায়। ঠোঁটে অবজ্ঞার হাসি ফুটে ওঠে তার। সে দিব্বি বুঝতে পারছে কোথায় হাত করতে হবে। মেয়ের মা কিঞ্চিৎ লোভী আছে। এখানেই কলকব্জা নাড়তে হবে। এমন মায়ের মেয়েকে হাতের পুতুল বানানো সহজ।

হঠাৎ করেই ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে উচ্ছ্বাসের। শরীরটা বেশ হালকা হালকা লাগছে এখন। জ্বর নেমে গেলেও শীত শীত ভাবটা শরীর থেকে যাচ্ছে না। কালো একটা ভারী চাদর গায়ের উপর চাপিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। ঠোঁটের কোণায় সিগারেট ঝোলায়। এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
বসার ঘরে বসে থাকা নিপাট ভদ্রলোকের সামনে নিজেকে ভীষণ এলোমেলো লাগে তার। পিছন থেকে বোঝা যাচ্ছে না কে। এতো সকালে কে বা আসবে?

নিয়াজ মোর্শেদকে দেখে ভিতর ভিতর চমকে যায় সে। এতো সকালে এই লোক এখানে কি করে?
নিয়াজও অবাক হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। এমন সুদর্শন যুবক খুব কমই দেখেছে সে। এলোমেলো রুক্ষ চুল, নির্ঘুম লাল চোখ, খোঁচা খোঁচা দাড়িতেও যে কোনো পুরুষকে এতো সুন্দর লাগতে পারে তা ধারণা ছিলো না। গ্রীক পুরাণে দেবতাদের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, ঠিক তেমন। কিন্তু কথা হলো, যুবকটা কে? তার জানামতে কবির শাহের কোনো ছেলে নেই।
নিয়াজ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
উচ্ছ্বাস সেই হাতের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
কিছুটা অপমানিত বোধ করে নিয়াজ।
তবুও মুখে জোর করে হাসি টেনে ধরে নিয়াজ।
“শুভ সকাল। আমার নাম….”
উচ্ছ্বাস হাত উঁচু করে তাকে থামায়।
“আপনার পরিচয় আমি জানি। কিন্তু আপনি এখানে কেনো এসেছেন?”
মুখটা অন্ধকার হয়ে যায় নিয়াজের।
“ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা।”
উচ্ছ্বাস ঠোঁট থেকে সিগারেটটা নামিয়ে শান্ত গলায় বললো,”যতোদূর জানি আপনি এ বাড়ির মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর মেয়ের বাবা নিজেই বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলো। পুনরায় আপনি এখানে কি চান?”
অপমানে নিয়াজের মুখ কালো হয়ে যায়। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে সে কপালের। সরু চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। শান্ত লোকটাকে দেখে কেমন ভয় ভয় করছে নিয়াজের। শান্ত দেখালেও ভিতর ভিতর সিংহের মতো তেজ লোকটার সে বুঝতে পারে।
জিজ্ঞাসু চোখে উচ্ছ্বাস তাকায় নিয়াজের দিকে।
“আসলে আপনি ভুল বুঝছেন। এদিক থেকেই যাচ্ছিলাম আমি। যেহেতু এদিকে পরিচিত একটা বাড়ি আছে, তাই ভাবলাম ঘুরে যাই। আচ্ছা আমি নাহয় আরেকদিন আসবো আজ যাই।”
নিয়াজ কোনো এক অদ্ভুত কারণে সামনের মানুষটাকে ভয় পাচ্ছে। সে নিজেও জানেনা কেনো। তার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার তো করেনি।

নিয়াজ দরজার দিকে পা বাড়াতেই উচ্ছ্বাসের চোখে পড়ে সামনে রাখা দুইটা ঝুড়ির দিকে। ঝুড়িভর্তি বিভিন্ন বাজার।
“একটু দাঁড়ান।”
নিয়াজ যন্ত্রের মতো থেমে যায়।
“এগুলো কি আপনি এনেছেন?”
“জ্বি।”
“কেনো? আপনি কি যে বাড়িতেই মেয়ে দেখতে যান বিয়ে হোক বা না হোক সে বাড়িতেই বাজার নিয়ে যান?”
নিয়াজ উচ্ছ্বাস কৌতুক করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু তার মুখে কোনো কৌতুকের চিহ্ন নেই। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিয়াজের দিকে।
“এভাবে ভাববেন না। আসলে সেদিন খালুজানকে ছোট মাছ কিনতে দেখলাম দোকানে, আর তাই…..”
“আর তাই আপনার মনে হলো আপনার খালুজানের বাড়িতে মাছ কিনে দেওয়া আপনার নৈতিক দায়িত্ব? আরেহ বাহ! আমিও এমন খালুজান হতে চাই। বাজারে যেয়ে ছোট মাছ কিনবো, পরদিন বাড়িতে বড় মাছ চলে আসবে। বলছি, এমন খালুজান হতে কি করা লাগবে?”
নিয়াজ অবাক হয়ে দেখে চোখমুখ কঠিন রেখে একটা মানুষ কীভাবে এমন রসালো কথা বলতে পারে? সে কি আসলেই মজা করছে?
“আমি এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি, এক্ষুনি।”
“জ্বি, দুইটা ঝুড়ি নিজে মাথায় করে নিয়ে যাবেন। আপনার ভাগ্য ভালো আপনার সেই খালুজান এখন বাড়িতে নেই। উনি যদি দেখতেন তবে আপনার খবর ছিলো।”
নিয়াজ প্রমাদ গোণে। এই ছেলেটা আবার কে? বাপ রে, ছেলে তো নয় যেনো সাক্ষাৎ আগুন। সাধারণ কথার মধ্যে এতো তেজ থাকতে পারে এই ছেলেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।
কোনোরকমে ঝুড়িগুলো টানতে টানতে নিয়াজ বাইরে নিয়ে যায়।
উচ্ছ্বাস বুকে দুই হাত বেঁধে শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

নিয়াজ চলে যাওয়ার দুই মিনিট পর হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া যায়।
উচ্ছ্বাস সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বিরক্ত মুখে দরজা খুলতেই ভ্রু কুঁচকে যায় তার।

দরজায় অতি সজ্জিত এক রমনী দাঁড়িয়ে আছে মুখ হা করে। উচ্ছ্বাস ভালো করে দেখে চেনার চেষ্টা করে আগেও এই মেয়েকে এ বাড়ি দেখেছে কিনা। কিন্তু প্রসাধনীর পরতে চেনাই মুশকিল। উচ্ছ্বাস মুখ কুঁচকে ভাবে, এই মেয়ে আবার কে? এতো সকালে এভাবে সঙ সাজে কে?
এদিকে মেয়েটা হা করে উচ্ছ্বাসকে দেখেই চলেছে। পলকও পড়ছে না চোখের। সামনের মানুষটা এতো সুন্দর কেনো এটাই বুঝতে পারছে না সে। মাথা খারাপ লাগে তার।
“মুখটা বন্ধ করুন দয়া করে। এতো বড় হা করেছেন যে মুখের ভিতরের আলজিহ্বা দেখা যাচ্ছে। খুবই বিশ্রী লাগছে দেখতে।”
মেয়েটা সাথে সাথে মুখ বন্ধ করে। কিছুটা অপ্রস্তুতও হয়ে যায়। ইশ, কি ভীষণ সুন্দর করে কথা বলে লোকটা। একদম পুরুষালী গম্ভীর গলার আওয়াজ।
“কাকে চাই আপনার? মনে তো হচ্ছে ভুল ঠিকানায় এসেছেন। এখানে কারো বিয়ে হচ্ছে না।”
মেয়েটা অবাক হয়ে বললো,”কার বিয়ে হবে?”
উচ্ছ্বাস বিরস মুখে সিগারেটটা ফেলে দেয়।
“আপনার যে সাজসজ্জা, দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিয়েবাড়ি এসেছেন।”
নিয়াজের মতো একই সমস্যায় পড়ে মেয়েটা। এমন গম্ভীর মুখে কীভাবে এভাবে কথা বলছে? সে কি মজা করছে?
“বলছিলাম প্রিয়তা আছে? একসাথে কলেজে যেতাম আর কি।”
উচ্ছ্বাস ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়িতে সময় প্রায় সাতটা, আর প্রিয়তা কলেজে যায় নয়টায়। এই মেয়ের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে হয়তো।

“নীলু আপা, আপনি এখানে?”
উচ্ছ্বাস চমকে উঠে পিছনে তাকাতেই দেখে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে উচ্ছ্বাসের। মেয়েটা কি ঘুমায় নি সারারাত? এমন রুগ্ন লাগছে কেনো তাকে? সামনের চুলগুলো রুক্ষ হয়ে মাথার উপর উড়ছে। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে। আচ্ছা, ও কি সারারাত কেঁদেছে? তার মতোই তৃষ্ণার্ত রাত কেটেছে তার? তবুও কি ভীষণ মোহনীয় লাগছে তাকে। উচ্ছ্বাস চোখে নামিয়ে নেয়। সারা দুনিয়ার সামনে সুতীক্ষ্ণ চোখে তাকালেও, এই শ্যামসুষমার সামনে আজ সে কোনোভাবেই চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। গতরাতের অব্যক্ত অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলতে পারে, সেই ভয়ে।

সকাল সকাল উচ্ছ্বাস আর নীলুকে একসাথে দেখে বুক কেঁপে ওঠে প্রিয়তার। এই মেয়ে এখানে কেনো? একদম বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে। কি উদ্দেশ্য তার?
নীলু লাজুক মুখে হেসে বললো,”চলে এলাম রে প্রিয়তা। আজ একসাথে কলেজে যাবো।”
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। বুকের ভিতরটায় হঠাৎ একটা চাপা ব্যথা টের পায় সে। সুক্ষ্ম কিন্তু চিনচিনে ব্যথাটা পুরো শরীরেই মনে হয় ছড়িতে পড়বে।
সে হারাতে চায়না এই যুবকটাকে। মনের অজান্তেই সে প্রেমে পড়েছে এই লোকটার। ভিতরটা পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ার আগেই মানুষটার বরফমিশ্রিত প্রেম তার চাই, চাই-ই।

(চলবে…….)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব:১৬

প্রিয়তা বিস্ফারিত চোখে নীলুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে সোজা বাড়িতে চলে এসেছে? নীলুর সেদিকে মন নেই। সে উচ্ছ্বাসকে দেখতেই ব্যস্ত। উচ্ছ্বাস শুধু একদৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকানো।

ঠিক এমন সময় নাশতা নিয়ে ঘরে ঢোকে মার্জিয়া বেগম। ঢুকতেই পরিস্থিতি বুঝতে তার কিছুক্ষণ সময় লাগে। নিয়াজ কোথায়? আর নতুন মেয়েটাই বা কে?
মার্জিয়া বেগমকে দেখে নীলু এগিয়ে আসে হাসিমুখে।
“চাচী ভালো আছেন?”
মার্জিয়া বেগম জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
উচ্ছ্বাস মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনি যাকে খুঁজছেন সে চলে গেছে।”
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো,”চলে গেছে মানে? ওর তো যাওয়ার কথা না। কে বলেছে ওকে যেতে?”
প্রিয়তা একবার মায়ের দিকে আরেকবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। এখানে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কে এসেছিলো? আর কে বা চলে গেছে?
“আমি চলে যেতে বলেছি।”
মার্জিয়া বেগম হতবাক হয়ে বললো,”তুমি বলেছো মানে? তুমি কে বলার?”
“আমি বলার কেউ না মামি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো মামা এখন বাড়িতে নেই। একটা বাইরের লোক ঘরে থাকাটা আমার কাছে ভালো লাগেনি।”
রাগে ফোঁসফোঁস করে ওঠে মার্জিয়া বেগম। দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বললো,”দাঁড়াও তোমাকে দেখছি আমি।”
নীলুর দিকে তাকিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে মার্জিয়া বেগম বললো,”তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না মা।”
নীলু ঈষৎ হেসে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কি রে চাচীকে আমার পরিচয় দে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে দেখলো নীলু মেয়েটা মাথায় ইতোমধ্যে কাপড় টেনে দিয়েছে। নতুন বউয়ের মতো আচরণ করছে। সে কি নিজেকে বাড়ির বউ মনে করছে?
“মা উনি নীলু আপা। আমার কলেজের সিনিয়র। আমার নাচটাও উনি তুলে দিয়েছিলেন।”
মার্জিয়া বেগম একগাল হেসে বললো,”আগে বলবে তো, এসো। নাশতা করবে আজ আমাদের সাথে।”
প্রিয়তা হঠাৎ চেচিয়ে উঠলো,”কেনো কি দরকার?”
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো,”এটা কেমন অসভ্যতা প্রিয়তা? কি দরকার মানে?”
নীলু উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে লাজুক গলায় বললো,”কোনো সমস্যা নেই চাচী। ও আমার সাথে মজা করেছে। আমি কিছু মনে করিনি।”
“তা তুমি হঠাৎ কিছু না বলে এলে যে? কোনো দরকার প্রিয়তার সাথে তোমার?”
নীলু কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। এরপর হেসে বললো,”চাচী আজ তো প্রিয়তার জন্মদিন। তাই কলেজে ওর জন্য ছোট্ট একটা আয়োজন করেছি আমরা। আমি এসেছি ওকে নিতে।”
প্রিয়তা জিভ কামড়ায়। ছি ছি, এতোক্ষণ কতো কি ভেবেছে মেয়েটাকে নিয়ে। নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়।

মার্জিয়া বেগম আঁৎকে ওঠে। এতোসব ঝামেলার মধ্যে ভুলেই গিয়েছিলো আজ যে মেয়েটার জন্মদিন। মেয়ের বাবা অন্যবার কতো উচ্ছল থাকে এই দিনে। আজ সে-ও কিছু মনে করেনি।
মার্জিয়া বেগম জোর করে নীলুকে টেবিলে বসায়।
নীলু গাঢ় গলায় উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললো,”এইযে শুনছেন?”
উচ্ছ্বাস তখনও ঘোরের মধ্যে। আজ প্রিয়তার জন্মদিন? মেয়েটার জীবনের এক বিশেষ দিন। সে দিনেও মেয়েটার মুখটা এমন বিষাদে ছেয়ে আছে কেনো? কোন গ্রহণ লেগেছে চাঁদে আজ?
“এইযে শুনুন, আমি ডাকছি।”
বিরক্ত হয়ে উচ্ছ্বাস তাকায় নীলুর দিকে।
“বলছি আপনি খেতে বসবেন না?”
ঝাঁঝের সাথে উচ্ছ্বাস বললো,”জ্বি না, আপনি উদরপূর্তি করুন, তাতেই হবে।”
হনহন করে হেঁটে উচ্ছ্বাস বেরিয়ে যায়।
মার্জিয়া বেগম রাগান্বিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি কিছু মনে করোনা মা। ও একটু এমন রগচটা।”
“না না চাচী, কিছু মনে করিনি। কিছু মনে করতেই পারিনা আমি।”
নীলুর লাজুক কথাগুলো কাঁটার মতো গায়ে বিঁধে প্রিয়তার। মনে হচ্ছে গরম তাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে আছে সে। না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সহ্য করতে।

প্রিয়তা আজ শাড়ি পরে কলেজে যাবে। তার জন্মদিনে সবাই যে তার জন্য এতো সুন্দর করে আয়োজন করবে এটা তার কল্পনার বাইরে ছিলো।
পেখম মায়ের গাঢ় নীল সিল্কের শাড়িটা পরে। চুলগুলো আনাড়ি হাতে খোঁপা করে নেয়। পেখম ছুটে যেয়ে তার লাগানো গাছ থেকে কয়েকটা নীল অপরাজিতা ফুল এনে দেয় তার খোঁপায়। ছোট্ট একটা নীল টিপও পরিয়ে দেয় ভ্রুযুগলের মাঝে। আয়নায় নিজেকে দেখেই লজ্জা পেয়ে যায় প্রিয়তা।
নীলু আমতা আমতা করে বললো,”তোকে তো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে প্রিয়তা।”
প্রিয়তা ছোট্ট করে হাসে।

মার্জিয়া বেগমকে চুপচাপ থাকতে দেখে কবির শাহ এগিয়ে আসে তার কাছে।
“কি হলো মার্জিয়া? তোমাকে এমন লাগছে কেনো?”
মার্জিয়া বেগম ঝাঁঝ দেখিয়ে বললো,”কবে থেকে ওই বাইরের ছেলেটাকে ঘরের সদস্য বানিয়ে ফেলেছো তুমি বলো তো? যাওয়ার কথা বলে যাচ্ছে না কেনো ও?”
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে বললো,”আবার কি হয়েছে?”
“কিছু হয়নি, এবার হবে।”
“কি হবে?”
“আশ্রিত হয়ে নিজেকে বাড়ির মানুষ মনে করার উচিত শিক্ষা পাবে।”
“মার্জিয়া আমার কথা শোনো…..”
মার্জিয়া বেগম জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,”যাই হোক, আজ যে মেয়ের জন্মদিন তুমি কি ভুলে গিয়েছো?”
কবির শাহ কিছু না বলে চুপ করে যায়।
“কি হলো কথা বলছো না যে?”
“উনিশ বছর আগে এই দিনে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখটা পেয়েছিলাম। প্রথম বাবা হওয়ার সুখ। ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা গুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে যখন ও জানান দিচ্ছিলো পৃথিবীতে ওর উপস্থিতি। সেই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিলো সারাজীবন এই ফুটফুটে চেহারাটা দেখে কাটিয়ে দিতে পারবো, আর কিচ্ছু লাগবে না। সেই দিনটা আমি কীভাবে ভুলে যাই মার্জিয়া?”
কবির শাহের চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি জমে। মার্জিয়া বেগম কিছুটা নরম হয়ে স্বামীর কাঁধে হাত রাখে।
“তাহলে সকাল সকাল মেয়েটাকে ‘শুভ জন্মদিন’ টুকুও জানালে না কেনো? প্রতিবার তো এইদিনে তুমিই ওর ঘুম ভাঙাও। এখনো রাগ করে আছো মেয়েটার উপর?”
কবির শাহ ম্লান হাসে। মার্জিয়া বেগম মুগ্ধ হয়ে স্বামীর হাসি দেখে। পুরুষ মানুষের হাসিও এতো সুন্দর হয় বুঝি? বিয়ের এতোগুলা বছর পরেও মানুষটার হাসির প্রেমে পড়ছে সে বারবার।
“শোনো মার্জিয়া, বাবা মায়ের অভিমান হয় সন্তানের উপর, রাগ নয়। ও তো আমারই সন্তান, আমার র ক্ত, আমার শরীরের অংশ। কীভাবে ওর উপর রাগ করে থাকবো আমি? তবে সন্তান কোনো ভুল করলেও বাবা হিসেবে তাকে শুধরে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”
মার্জিয়া বেগম কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীলু এসে দাঁড়ায় সেখানে।
“চাচী দেখুন তো, প্রিয়তাকে কেমন লাগছে?”
মার্জিয়া বেগম আর কবির শাহ দুইজনই তাকায় একসাথে। তাকাতেই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় প্রিয়তার উপর। কিশোরী মেয়েরা হঠাৎ হঠাৎ শাড়ি পরলে বাবা মায়ের সামনে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যায় তারা।
প্রিয়তা মাথা নিচু করে শাড়ি কুঁচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। মূলত সে এখন মা বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারবে না।

মার্জিয়া বেগম মুচকি হেসে এগিয়ে যায় প্রিয়তার দিকে। তার চিবুক এক হাত দিয়ে তুলে অবাক হয়ে তাকায় মেয়েটার দিকে। তার বড় বোন মর্জিনা বেগম সবসময় বলে, মেয়ে কালো, অসুন্দর। কালো মেয়েদের নাকি সমাজে অসুন্দরই বলা হয়। কিন্তু কই? মর্জিনা আপা কি কখনো মেয়েটার আসল রূপ দেখার চেষ্টা করেছে? শ্যামবর্ণের যে আলাদা সৌন্দর্য আছে এটা কি সে জানে? যদি জানতো তবে সে বুঝতো এই চোখজোড়ার গভীরতায় কি মায়া আছে। লম্বা অক্ষিপল্লব, কুচকুচে কালো চোখের মণি কি যথেষ্ট নয় কোনো মেয়েকে অপরূপা করে তুলতে? আর এইযে, মেঘের মতো কালো কোমর ছাড়ানো চুল, গজদন্তের মিষ্টি হাসি, চাঁদের মতো মুখটা? সব সৌন্দর্য কি ম্লান গায়ের রঙের কাছে? গায়ের রঙ সব মোহনীয়তা ছাপিয়ে গেছে?
মার্জিয়া বেগমের চোখে পানি চিকচিক করে ওঠে।
ব্যস্ত হয়ে ওঠে প্রিয়তা।
“ওমা তুমি কাঁদছো কেনো?”
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মার্জিয়া বেগম বললো,”কই কাঁদছি না তো। চোখে কি যেনো পড়েছে।”
প্রিয়তাকে তার মা চোখের ইশারা করে বাবার কাছে যাওয়ার জন্য। কবির শাহ অন্য দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সে জানে, এখন মেয়ের দিকে তাকালে সে দূর্বল হয়ে পড়বে। আপাতত নিজের দূর্বলতা দেখাতে চাচ্ছে না সে। কিন্তু কতক্ষণ পারবে সে জানেনা।

প্রিয়তা ভীরু ভীরু পায়ে বাবার কাছে এসে দাঁড়ায়। ইচ্ছা করছে বাবার বুকে মাথা রেখে খুব কাঁদতে। কিন্তু একটা বাঁধা কাজ করছে।
প্রিয়তা আস্তে করে ডাক দেয়,”বাবা।”
“হুম বলো।”
“তাকাবে না আমার দিকে?”
কবির শাহের ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যেতে থাকে। এই ডাক অস্বীকার করার ক্ষমতা কেনো সৃষ্টিকর্তা তাকে দিলেন না?
“বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখেছি আমার জন্মদিনের সকালে তুমি আমার ঘুম ভাঙাও। তোমার মুখের মিষ্টি পবিত্র হাসি দেখে আমার ঘুম ভাঙে। আজ কেনো তা হলো না বাবা? এতোটাই রেগে আছো আমার উপর?”
কবির শাহ নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়।
“এখন তোমরা বড় হয়ে যাচ্ছো। নিজেদের ভালো নিজেরাই বুঝতে শিখেছো। এখন আর বাবার ভালোবাসা কি দরকার?”
প্রিয়তা নিজেকে সামলাতে পারেনা। ছুটে যেয়ে বাবার বুকের উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে। বাঁধ ভাঙে কবির শাহেরও। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে।
“আমি বড় হতে চাইনা বাবা, একটুও চাইনা। যে বড় হওয়াতে তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে হয়, সেই বড় হওয়া আমার জন্য অভিশাপ। তুমি আমাকে আরো মারো বাবা, তবুও আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিও না। আমি জীবনে সবকিছু ছাড়তে পারবো, কিন্তু তোমার ভালোবাসা না। আমি মরেই যাবো বাবা।”
কবির শাহ কাঁদতে কাঁদতে কথাই বলতে পারছে না। মার্জিয়া বেগম আঁচলে চোখে মুছে অন্যদিকে চলে যায়। এতো সুখের দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায়না, বুকে ব্যথা করে।

“খুব ব্যথা লেগেছিলো মা? বাবা অনেক ব্যথা দিয়ে ফেলেছে?”
“একদম না বাবা। আমার একটুও ব্যথা করেনি। শুধু তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো এই যন্ত্রণা আমাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। আমি যে তোমাকে ছাড়া অসহায় বাবা।”
কবির শাহ মেয়ের চোখের পানি মুছে দেয়।
“আজ আমার কাছ থেকে তুই কি উপহার চাস বল। আজ তুই যা চাইবি, আমি তোকে তাই দিবো।”
“বাবা তুমি আজ নিজে হাতে আমাকে খাইয়ে দিবে? সেই ছোটবেলার মতো।”
কবির শাহ কান্নার মধ্যেও হেসে দেয়। মেয়েটা এতো মিষ্টি কেনো তার? সে কীভাবে বোঝাবে গতকাল রাতটা তার জীবনের সবচাইতে কষ্টের রাত ছিলো। সে যে তার আদরের মেয়েটার গায়ে হাত তুলেছে। এরচেয়ে কষ্টের একটা বাবার কাছে আর কি হতে পারে? পুরো রাত কেটেছে তারও নির্ঘুম।

ছাদে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাস। ওঘর থেকে শুনেছে আজ প্রিয়তা শাড়ি পরবে। শত চেষ্টা করেও চোখের তৃষ্ণা মেটানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে পারেনি সে। মোহনীয় শ্যামসুষমা রূপটা দেখার জন্য উন্মাদের মতো ছুটে এসেছে সে ছাদে। কষ্টে ভরা জীবনটায় মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে কি সে বাঁচতে চাচ্ছে? ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচতে চায়।

বিরক্ত হয়ে চলেই যাচ্ছিলো, হঠাৎ তার শরীর থমকে দাঁড়ায়। একটা নীল প্রজাপতি যেনো উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। স্তব্ধ হয়ে যায় উচ্ছ্বাস সেদিকে তাকিয়ে। খোঁপায় গোঁজা নীল অপরাজিতার সৌন্দর্যও যেনো হার মানছে মেয়েটার কাছে। সত্যিই তবে কি প্রাচীর ভাঙলো তার? প্রেমে পড়লো সে অবশেষে?
নীলুর পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় একটা টান পড়ে প্রিয়তার। তার মস্তিষ্ক শূন্য লাগে। আবেগী মনটা বার বার বলছে, পিছনে ফিরে তাকা প্রিয়তা, একবার পিছনে ফিরে তাকা। হয়তো অপূর্ব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখতে পারবি। অসম্ভব সুদর্শন এক যুবক অপার মুগ্ধতা নিয়ে তার যাওয়ার পথে চেয়ে আছে। যার দুই চোখ জুড়ে অবাধ্য প্রেমের অবাধ বিচরণ।

প্রথমে নীলুই তাকায়। হতবাক হয়ে যায় সে।
“ইশ প্রিয়তা ছেলেটা আমার দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে পিছনে তাকিয়ে দেখ আবার। আমি তো প্রেমে পড়তে পড়তে পাগলই হয়ে যাবো।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কার কথা বলছেন নীলু আপা? কে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে?”
“পিছনে ফিরে দেখ তো একবার।”
প্রিয়তা ইতস্তত করে পিছনে তাকাতেই থমকে যায়। চোখাচোখি হয় দুইজনের। দূর থেকেই ভিতরকার সব বাঁধ ভেঙে যায় দুইজনের। ভিতরের সকল তৃষ্ণা মেটায় দুইজন।
“কি রে দেখেছিস?”
ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে প্রিয়তা। বিরক্ত হয়ে বললো,”আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে কেনো? উনি এই সময় এমনিতেই ছাদে থাকে।”
“তুই চুপ কর তো, হিংসুটে মেয়ে। আমার মতো সুন্দরী মেয়ে আগে দেখেছে উনি? এজন্যই তো দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। সোজা ছুটে এসেছে ছাদে।”
রাগে চোখে পানি চলে আসে প্রিয়তার। নীলুকে পিছে রেখেই হনহন করে হেঁটে চলে যায় সে। নীলু উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে প্রিয়তার পিছে দৌড়ায়।

উচ্ছ্বাস তখনও তাকিয়ে সেদিকে। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে ওঠে সে। পিছনে তাকাতেই দেখে কবির শাহ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ কিছুটা গম্ভীর।

উচ্ছ্বাস কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”মামা আপনি? কিছু বলবেন?”
“তুমি কি অসুস্থ উচ্ছ্বাস?”
“তেমন কিছু না মামা, ঠিক আছি আমি।”
“নিজের আবেগকে প্রকাশ করতে এতো কিসের আপত্তি তোমাদের বলতে পারো?”
উচ্ছ্বাস অবাক চোখে তাকায় কবির শাহের উপর। কথা সরে না মুখ দিয়ে।
“সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখো, নাহলে পরে অনুশোচনা করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যাবে।”
“মামা আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি।”
কবির শাহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ উচ্ছ্বাসের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমার মেয়ের সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে পারবে? কথা দিতে পারবে কখনো কোনো দু:খ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না?”
উচ্ছ্বাস বিস্ফারিত চোখে তাকায় কবির শাহের দিকে।
“মামা…..”
“আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও।”
উচ্ছ্বাস কথা বলতে পারেনা। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। এই মুহুর্তে কি বলা উচিত সে বুঝতে পারেনা।
“দেখো উচ্ছ্বাস, আমি শিক্ষক মানুষ। আমি যা বলি সোজাসুজি বলতে পছন্দ করি। তুমি হয়তো কোনোদিনও জানতে পারবে না আমি তোমাকে ঠিক কতোটা স্নেহ করি, ভালোবাসি। এর কারণ কি আমি তাও জানিনা। তোমার দিকে তাকিয়ে আমি নীলিমাকে দেখতে পাই, এটা একটা কারণ হতে পারে। তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। পুরো দুনিয়ার কাছে তুমি খারাপ, রগচটা হলেও আমি জানি তুমি কি। আমি বিশ্বাস করে আমার জীবনের সেরা সম্পদ তোমার হাতে তুলে দিতে পারি। যদি তুমি আমাকে কথা দাও তুমি আমার রত্নকে আমার চেয়েও বেশি যত্নে রাখবে, আমার রাজকন্যাকে রানী করে রাখবে তবে আমি নির্দ্বিধায় তোমার কাছে আমার কলিজার টুকরোকে তোমার হাতে তুলে দিবো।”
উচ্ছ্বাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষণ দূর্বল লাগে তার শরীর। মনে হচ্ছে জ্বরটা আবার আসবে। শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছে সে।

উচ্ছ্বাসের হাত থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিজের হাতে নেয় কবির শাহ। সেদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,”আর যদি সে সাহস না থাকে, এই সিগারেটের ধোঁয়ায় জীবন শেষ করে দিতে চাও, তবে আমার মেয়ের পথ থেকে সরে দাঁড়াও। তোমার ছায়া আমার মেয়ের জীবনে পড়তে দিও না। আমার মেয়েটা খুব আবেগী। ওর কোনো কষ্ট বাবা হয়ে আমি সহ্য করবো না। আর যদি ওর পাশে থাকতে চাও ওকে সময় দাও। ওর বয়স কাঁচা। ভালোমন্দ বোঝার বয়স হয়নি এখনো। আবেগে ভাসার বয়সে মহাপুরুষ হয়ে ওর কাছে ধরা দিও না।”
সিগারেটের প্যাকেটটা আবার ধরিয়ে দেয় উচ্ছ্বাসের হাতে।
“এটা তুমি রাখো। চাইলে আমি ছুড়ে ফেলে দিতে পারতাম এটা। কিন্তু দিবো না। জীবন তোমার, তুমি সিদ্ধান্ত নিবে এটা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবে নাকি আগুনের শিখার মতো উজ্জ্বল করবে।”
আর কথা বাড়ায় না কবির শাহ। হতবিহ্বল এক জোড়া চোখকে পিছনে ফেলে ছাদ থেকে নেমে যায় সে। ছাদের উপরই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে উচ্ছ্বাস। কি করবে সে এখন? নিজের আবেগকে গুরুত্ব দিবে? সে কি ভালোবেসে ফেলেনি ওই হরিণ চোখের মায়াবতীকে? নাকি বাবা মায়ের হয়ে প্রতিশোধ নিবে? এভাবেই ছেড়ে দিবে জানোয়ারগুলোকে? যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে পড়তে চায় তার। দুই হাতে চুল চেপে ধরে সে।

সিঁড়ির মুখেই ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো পেখম। উচ্ছ্বাসকে দেখেই দ্রুততার সাথে এগিয়ে আসে সে।
“উচ্ছ্বাস ভাই।”
রক্তলাল চোখে উচ্ছ্বাস তাকায় পেখমের দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায় পেখম।
“উচ্ছ্বাস ভাই আপনি ঠিক আছেন তো?”
গম্ভীর গলায় উচ্ছ্বাস বললো,”কিছু বলবে?”
পেখম এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,”আপা আপনাকে একটা কথা বলতে বলেছে উচ্ছ্বাস ভাই।”
“কি কথা?”
পেখম মাথা নিচু করে বললো,”আজ আপার জন্মদিন। আপার জীবনের বিশেষ একটা দিন। আজ আপার কলেজের ক্লাস শেষ হবে বিকাল চারটায়। আপা যদি আপনার মনে এতোটুকুও জায়গা দখল করে থাকে, তবে কলেজ ছুটির পর কলেজ গেটের সামনে থাকবেন আপনি। আর যদি না থাকেন আপা বুঝবে তার উপস্থিতি শুধুমাত্রই বিরক্তির কারণ আপনার কাছে। সে আর কোনোদিন আপনার সামনে আবেদনময়ী হয়ে ধরা দিবে না। আর কোনো অনুভূতি আপনার জন্য তার থাকবে না, অন্তত আপনার সামনে তা দেখাবে না। এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন আপনি কি করবেন।”
পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পেখমের কথাগুলো শোনে উচ্ছ্বাস। কি সিদ্ধান্ত নিবে সে? কি করা উচিত তার এখন? আর যাই হোক, গতকাল রাত তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে ওই চোখজোড়া ছাড়া সে থাকতে পারবে না। কিন্তু সে কি পারবে কবির শাহের কলিজার টুকরোকে সারাজীবন আগলে রাখতে?
“উচ্ছ্বাস ভাই…..”
পেখমের ডাকে ধাতস্থ হয় উচ্ছ্বাস।
“তুমি এখন যাও পেখম। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।”
“আপনি কি করতে চাচ্ছেন?”
ভয়ংকর শান্ত দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাস তাকায় পেখমের দিকে, পেখম চুপসে যায়। মানুষটাকে ভয় পায় সে ভীষণ। কোনো কথা না বলে চলে যায় সে সেখান থেকে। বারবার পিছন ঘুরে তাকায় সে। উচ্ছ্বাস নির্লিপ্ত।

বিকাল চারটা বেজে দশ মিনিট। এতোক্ষণ শাড়ি পরে থাকায় বেশ অস্বস্তি লাগছে প্রিয়তার। কলেজ গেটে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা উঁকি দিতে থাকে তার।
‘পেখম কি বলতে পারলো কথাগুলো উনাকে? কি করবে উনি? আসবে এখানে? নাকি সে বোকার স্বর্গেই বাস করছে? তার জন্য মানু্ষটার কোনো অনুভূতিই কখনো ছিলো না? কিন্তু আজ যদি উনি না আসে তবে তার কথা অনুযায়ী সে আর কোনোদিন উচ্ছ্বাসের সামনে যেতে পারবে না, নিজের কোনো আবেগ বা অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবে না।

কান্না পেতে থাকে প্রিয়তার। শাড়ির আঁচলটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়, সময় বেড়েই যাচ্ছে।
রুনা হঠাৎ প্রিয়তার কাছে এসে বললো,”তুই এখনো বাড়ি যাসনি কেনো প্রিয়তা? আজ তোর জন্মদিন। সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
প্রিয়তা উদাস গলায় অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”কেউ অপেক্ষা করবে না, কেউ বসে নেই আমার জন্য। কেউ ভালোবাসে না আমাকে।”
রুনা অবাক হয়ে বললো,”এসব কি বলছিস তুই?”
প্রিয়তা তার দিকে তাকিয়ে বিষাদ মাখা ঠোঁটে হাসে। রুনার খুব কষ্ট হয়ে সেই হাসি দেখে। কি এমন কষ্ট মেয়েটার মনে?

“এই প্রিয়তা।”
“বল।”
“জানিস তো, রাজপুত্রের মতো দেখতে একটা যুবক আমাদের এদিকে আসছে। নীল পাঞ্জাবিতে সাক্ষাৎ আগুন লাগছে। হাতে আবার গোলাপ। না জানি কোন ভাগ্যবতীর ভাগ্যে আছে গোলাপটা। এমন প্রেমিক পেলে তো আমি শুধু গোলাপ দিয়েই জীবন পার করে দিতে পারতাম। আর কিছুই লাগতো না।”
প্রিয়তা মুচকি হেসে বললো,”তোর স্বভাব আর পরিবর্তন হলো না।”
হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় সে। কি বললো রুনা? সুদর্শন যুবক, নীল পাঞ্জাবি আর হাতে গোলাপ?
বুকটা ধকধক করে ওঠে তার। পিছন ঘুরে তাকানোর সাহস হয়না। যদি পিছন ঘুরে দেখে সে যা ভাবছে তা না? কল্পনা করতেও ভয়ে করছে তার।

আচমকা উচ্ছ্বাস এসে দাঁড়ায় প্রিয়তার সামনে। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে প্রিয়তা।

হাতে থাকা গোলাপটা এগিয়ে দেয় তার দিকে।
“শুভ জন্মদিন। নীল গোলাপ খুঁজতে যেয়ে দেরি হয়ে গেলো। তবুও পেলাম না। পরে মনে হলো লাল গোলাপই মানাবে তোমার হাতে।”
রুনা চোখ বড় বড় করে একবার উচ্ছ্বাসের দিকে আরেকবার প্রিয়তার দিকে তাকায়।
প্রিয়তা নিশ্চিত সে স্বপ্ন দেখছে, অবশ্যই স্বপ্ন। এটা সত্যি হতে পারে না, কোনোভাবেই না।

(চলবে…….)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-১৩+১৪

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১৩

কাঁচাবাজারে ঢুকে মাথা খারাপ অবস্থা কবির শাহের। সবকিছুর দাম আকাশচুম্বী। তার মতো ছাপোষা চাকরিজীবীর জন্য বেশিরভাগ জিনিসই সাধ্যের বাইরে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট দেখে মাছ দোকানদারকে দেখিয়ে কবির শাহ বললো,”এটার দাম কতো রাখবে বাবা?”
দোকানদার কবির শাহের দিকে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে বললো,”এটার দাম আসে ছয়শো টাকা। আপনার জন্য পাঁচশো পঞ্চাশ টাকা রাখবো।”
কবির শাহ সুন্দর করে হাসে।
“আমার জন্য এতো ছাড় দেওয়ার কারণ কি বাবা?”
দোকানদার কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”আচ্ছা যান আরো পঞ্চাশ টাকা কম দিয়েন। একদাম পাঁচশো রাখবো।”
কবির শাহ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
“আমার জন্য কম করার দরকার নেই রে বাবা। এখনো দুইটা হাত, দুইটা পা সচল আছে। কিছু রোজগার করে খেতে পারি। কম যদি করতেই হয় যারা অত্যন্ত গরীব, টাকার অভাবে মাছ খাওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের জন্য করো। মাছটা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দাও। আমি তোমাকে ছয়শো টাকাই দিবো।”
দোকানদারের মুখ হাঁ হয়ে যায়। ব্যবসা করতে যেয়ে বহু অদ্ভুত মানুষ চোখে পড়েছে। কিন্তু এমন কিসিমের মানুষ এই প্রথম দেখলো সে। সে নিজে থেকে একশো টাকা কমাতে চাচ্ছে, আর উনি কিনা কমাবে না? দোকানদারের সন্দেহ হয়, লোকটা কি পাগল?
“কি হলো তোমার? এভাবে তাকিয়ে আছো যে? ভাবছো তো কেনো তুমি কম করতে চাইলেও আমি রাজি হলাম না?”
দোকানদার কথা না বলে চুপ করে থাকে। সে নিশ্চিত এই মানুষটা পাগল। এদের সাথে বেশি তর্ক করতে নেই।
“শোনো বাবা, তুমি আমাকে আসল দামটা বলতে পারতে, আমি হয়তো কিছু দামাদামি করতাম। কিন্তু তুমি আমার পোষাক দেখে আমাকে অত্যন্ত নিম্নশ্রেণীর কেউ ভেবেছো। এজন্যই আমার জন্য কমাতে চাইছো। কিছুক্ষণ আগেই আমি খেয়াল করেছি, একজন ক্রেতার কাছ থেকে তুমি এক টাকাও কমাওনি। তুমি হয়তো আমাকে সম্মান করতে চেয়েছো। তবে এই শিক্ষাটা তোমার আজীবন থাকবে। আজকের আমার এই একশো টাকা তুমি কোনো অথর্ব মানুষের কাছ থেকে কম রেখো, তাতেই হবে।”
দোকানদার মাথা নিচু করে থাকে। লোকটা ভুল বলেনি। সে সত্যিই করুণা করতে চেয়েছিলো মানুষটাকে। তবে তার কথা শুনে এখন নিজের মধ্যে অপরাধবোধ হচ্ছে।
“মন খারাপ করোনা। শিক্ষক মানুষ তো, সবাইকেই নিজের ছাত্র ভেবে ফেলি। দাও মাছটা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দাও।”
দোকানদার কোনো কথা না বলে মাছটা কবির শাহের ব্যাগে ঢোকাতে গেলেই একটা গম্ভীর গলার আওয়াজে থেমে যায় সে।

“এই শফিক, চাচার ব্যাগে সবচেয়ে বড় মাছটা দে।”
কবির শাহ আর শফিক দুইজনই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ভালো করে চশমাটা পরে কবির শাহ চেনার চেষ্টা করে ছেলেটাকে। খুব চেনা চেনা লাগছে মুখটা, কোথায় যেনো দেখেছে। বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তিও দূর্বল হয়ে যাচ্ছে মনে হয়।

“নিয়াজ সাহেব।”
“কথা কম বল শফিক, তোর দোকানের সবচেয়ে বড় মাছটা এই চাচার ব্যাগে ঢুকিয়ে দে।”
কবির শাহ মুচকি হেসে বললো,”তোমাকে খুব চেনা লাগছে। দু:খিত চিনতে পারছি না। কিন্তু আমার এতো বড় মাছ লাগবে না বাবা।”
“আহা চাচাজান আপনি এতো চিন্তা করবেন না তো। টাকার ভাবনা আপনার না, আমার। এই মাছটা আমার পক্ষ থেকে আপনাকে দিবো।”
কবির শাহ এবার কিছুটা কঠিন দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকায়। তার চোখ সরু।
“তুমি দিবে মানে? তুমি কেনো দিবে?”
নিয়াজ খোলা গলায় হেসে বললো,”মনে করুন আমি মাছটা আপনাকে উপহার দিচ্ছি।”
কবির শাহ চোখের চশমাটা ঠিক করে আবার তাকায় নিয়াজের দিকে।
“তুমি আমাকে মাছ উপহার দিবে মানে? তুমি কি চিনো আমাকে?”
নিয়াজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,”চিনতেও তো পারি।”
হঠাৎ করেই কবির শাহের মনে পড়ে যায়। এইতো সেই ছেলেটা, যে প্রিয়তাকে দেখতে এসেছিলো কিছুদিন আগে। সে মানা করে দিয়েছিলো এই বিয়েতে। এখন এই ছেলেটা তার কাছে কি চায়? মাছ-ই না উপহার দিতে চাচ্ছে কেনো?

“দেখো বাবা, আমার মনে হয় আমি তোমাকে চিনেছি। তবে আমি অত্যন্ত দু:খিত আমি তোমার কোনো উপহার নিতে পারবো না।”
নিয়াজ কিছু বলতে গেলে কবির শাহ ধীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। সেই চোখে কিছু একটা ছিলোই, নিয়াজ থেমে যায়। সে বুঝতে পারে এভাবে হবে না। এই লোক মারাত্মক ব্যক্তিত্ববান। সাধারণত এমন নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষগুলো এমনই হয়। এভাবে কাজ হবে না, অন্য কোনোভাবে চেষ্টা করতে হবে।

বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রিকশা থেকে নামতেই প্রিয়তাকে দেখে মনটা ভালো হয়ে যায় কবির শাহের। তার মেয়েটা বড্ড রূপবতী। শ্যামলা রঙেও যে মেয়েদের আলাদা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তা প্রিয়তাকে দেখলে বোঝা যায়। লম্বা চুলগুলো বেনী করে, ভ্রুযুগলের মাঝে ছোট্ট একটা কালো টিপ দিলে মেয়েটাকে অসামান্য সুন্দরী লাগে। মেয়ে গায়ের রঙ তার পেলেও চেহারার আদল পেয়েছে মায়ের মতো। মেয়েদের মা যুবতী বয়সে ভীষণ সুন্দরী ছিলো।
কবির শাহ চোখ নামিয়ে নেয় মেয়ের দিক থেকে। বাবা মায়ের নজর সন্তানের উপর বেশি পড়ে।

বাবাকে দেখেই ছুটে আসে প্রিয়তা। দরদর করে ঘাম পড়ছে বাবার কপাল থেকে। ব্যস্ত হয়ে যায় সে। নিজের ওড়নার কোণা দিয়ে বাবার কপাল মুছে দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,”বাবা তুমি তো ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছো। দাও বাজারের ব্যাগ আমার হাতে দাও।”
কবির শাহ টের পেলেন একটু আগে নিয়াজ নামক ছেলেটার উপর হওয়া রাগ আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে তার। মেয়েটা তার বড্ড বেশি মায়াবতী।
কবির শাহ মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”শান্ত হ মা। আমি ঠিক আছি।”
“তুমি চলো বাবা, তোমাকে লেবুর শরবত করে দিবো।”
হঠাৎ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে চোখে পানি চলে আসে কবির শাহের। নিজের মা কে হারিয়েছে সেই সতেরো বছর আগে। একমাত্র মা-ই এভাবে মায়া করতো তার জন্য। এই মেয়ে দু’টোকে তো সে তেমন কিছুই দিতে পারেনা। তবুও মেয়েগুলো তাকে এতো মায়া করে কেনো? কি উৎস এই মায়ার?
“প্রিয়তা মা।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় বাবার দিকে।
“আজ তোকে আমার কিছু দিতে ইচ্ছা করছে। কোনোদিন তো মুখ ফুটে কিছু চাস না তুই আমার কাছ। আজ তুই যা চাইবি তোকে তাই দিবো আমি। বল আমার কাছে কি চাস তুই?”
প্রিয়তা সুন্দর করে হাসে বাবার কথা শুনে। আচমকাই বাবাকে জড়িয়ে বাবার বুকের উপর মাথা রেখে বললো,”কে বলেছে তুমি আমাকে কিছু দাওনি? তুমি হলে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা। তুমি আমাকে যতোটা ভালোবাসা দিয়েছো, আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।”
কবির শাহ ঈষৎ কেঁপে ওঠে মেয়ের কথা শুনে। বাজারের ব্যাগটা পায়ের কাছে ফেলে কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়ের মাথায় হাত দেয়। তার মন বলছে মেয়েটার মনের ভিতর যে এক আকাশ সমান কষ্ট পুষে রেখেছে। চাপা স্বভাবের মেয়ে, মুখ ফুটে কিছু বলবেও না। মেয়ের সাথে কি খোলামেলা এই বিষয়ে কথা বলা উচিত? নাকি সে অপেক্ষা করবে মেয়েটা নিজে থেকে বলা পর্যন্ত?

দূর থেকে বাবা মেয়েকে এভাবে দেখে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মার্জিয়া বেগম। বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেলো মনে হচ্ছে। তার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো, গতকাল রাতে মেয়েকে এতো কথা জানানোর পর মেয়ে তার বাবাকে আগের মতো ভালোবাসতে বা শ্রদ্ধা করতে পারবে কিনা। কিন্তু সকাল হতে না হতেই বাপ মেয়ের এতো ভালোবাসা দেখে কিছুটা প্রশান্তি ভর করে তার মনে। ঠোঁটে ছোট্ট একটা হাসি ফুটে ওঠে তার।

কিছুক্ষণ আগেই ক্লাস শেষ হয়েছে প্রিয়তার। বাড়ি ফেরার জন্য একটাও রিকশা পাচ্ছে না সে কলেজ গেটের সামনে। এদিকে ঘেমে নেয়ে একাকার সে। কিছুটা মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এখনই রোদটা এমন প্রখর হতে হলো? প্রিয়তা ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে।
পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রিয়তা চমকে যায় কিছুটা। তাকাতেই দেখে নীলু আপা দাঁড়িয়ে আছে, মুখ টিপে হাসছে সে।
প্রিয়তা শুকনো মুখে হাসে।
“কি রে প্রিয়তা কেমন আছিস?”
“ভালো আছি নীলু আপা।” প্রিয়তা বেশি কথা বাড়ায় না।
“আচ্ছা তুই আমাদের জানাসনি কেনো বল তো এর আগে?”
“কিসের কথা বলছেন নীলু আপা?”
নীলু প্রিয়তার গাল টিপে দিয়ে বললো,”আহা কচি খুকি, কিচ্ছু বুঝেননা উনি।”
প্রিয়তা ভিতর ভিতর বিরক্ত হয়। কিন্তু মুখে প্রকাশ করেনা। মুখে জোর করে একটা হাসি টেনে প্রিয়তা বললো,”আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না নীলু আপা, কিসের কথা বলছেন আপনি?”
নীলু এদিক ওদিক তাকিয়ে নীচু গলায় বললো,”নিয়াজ মোর্শেদের মতো এমন নামীদামী একজনের বাগদত্তা তুই, এটা আগে আমাদের জানাসনি কেনো? জানালে বুঝি তোর হবু বরকে আমি নিয়ে নিতাম?”
প্রিয়তার শরীরটা কেমন রাগে ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। সে তীক্ষ্ণ চোখে নীলুর দিকে তাকায়। মেয়েটা এখনো কীভাবে হেসে যাচ্ছে। বয়সে বড় না হলে প্রিয়তা বুঝি একটা চড় মেরেই বসতো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে। তার রাগ সাংঘাতিক।
“দেখুন নীলু আপা….”
“আরে হয়েছে হয়েছে, আর থামিয়ে কি হবে? যা জানার গতকালের পর সবাই জেনে গেছে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কি জেনেছে আপা?”
নীলু শব্দ করে হেসে বললো,”কয়দিন পর নিজেই জানতে পারবি কি জেনেছে। কিন্তু তোকে আজ অন্য একটা কথা বলার জন্য এসেছি। তুই কথা দে আমাকে সাহায্য করবি।”
প্রিয়তার মুখ রাগে থমথম করছে। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছনা সে। এই অসভ্য লোকটা বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। সাথে লেগেছে এই গায়ে পড়া মেয়েটা। প্রিয়তা বুঝতে পারে সময় থাকতে কিছু না করলে পানি আরো গড়াবে। নাহ, যা করার তাকেই করতে হবে। প্রয়োজন হলে বড় খালাকে ডেকে শক্ত করে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে হবে।
“আমি সাহায্য করবো মানে? আমি আবার কি করবো?”
নীলুর মুখটা সাথে সাথে পালটে যায়। একটু আগে যে ফিচেল হাসি দিচ্ছিলো তার মুখটাই লজ্জায় লাল হয়ে যায়। লাজুক মুখে মাথা নিচু করে হাসতে থাকে সে।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি ব্যাপার বলুন তো নীলু আপা?”
নীলু গলা আরো নামিয়ে বললো,”বেশ কিছুদিন তোদের বাড়ির সামনে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। প্রায় দিনই কালো শার্ট পরে থাকে। কোনোদিকে না তাকিয়ে একমনে সিগারেট টানতে থাকে, আবার বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। আমার জানামতে তোর তো কোনো ভাই নেই, তবে উনি কে?”
প্রিয়তার বুকটা কেঁপে ওঠে। নীলু আপা কার কথা বলছে? উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথা নয় তো?
প্রিয়তা যন্ত্রের মতো বললো,”কার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না আপা।”
নীলু ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,”নাটক করিস না তো, ঠিকই বুঝতে পারছিস তুই।”
প্রিয়তা সামনের দিকে পা চালিয়ে বললো,”আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে নীলু আপা, আমাকে যেতে হবে।”
পিছন থেকে নীলু হাত টেনে ধরে প্রিয়তার। রাগী মুখে বললো,”যাবিই তো, তোকে আটকে রাখবো নাকি আমি? আগে উনার পরিচয়টা তো বলে যা।”
প্রিয়তা দাঁত কিড়মিড় করে বললো,”উনার নাম উচ্ছ্বাস, আমার দু:সম্পর্কের ফুপুর ছেলে উনি। উনার বাবা মা দুইজনই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ায় কিছুদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে এসেছেন। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো চলে যাবেন। এর বেশি আর কিছু জানিনা আপা উনার ব্যাপারে।”
নীলু আবারও মুচকি হাসে।
“শোন না প্রিয়তা, উনাকে আমার খুব মনে ধরেছে। আমাদের একটু পরিচয় করিয়ে দে না।”
আঁৎকে উঠে প্রিয়তা তাকায় নীলুর দিকে।
“এসব কি বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে আপনার? এটা সম্ভব না, কোনোদিনও সম্ভব না।”
প্রিয়তা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।
নীলু চোখমুখ কুঁচকে বললো,”কেনো সম্ভব না শুনি? উনার মতো একজন সুদর্শন পুরুষকে পছন্দ হওয়াটা কি অপরাধ? নাকি তোর হিংসা হচ্ছে আবার সত্যি করে বল তো।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে বললো,”আমার হিংসা হবে মানে? কি বলছেন আপনি?”
“হতেও পারে, এমন একজন রাজপুত্র। যে কোনো মেয়েরই স্বপ্নের পুরুষ হতে পারে।”
প্রিয়তা এবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় নীলুর দিকে। সামনে দাঁড়ানো এই যুবতীটাকে অসহ্য লাগছে তার এখন।
“দেখুন নীলু আপা, একটু বেশি বেশি করছেন আপনি এবার। কি জানেন উনার ব্যাপারে আপনি? পছন্দ হয়েছে তাতেই প্রেম করতে চান? অদ্ভুত মেয়ে তো আপনি।”
নীলু রাগে লাল হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কি ভেবেছিস তুই পরিচয় করিয়ে না দিলে আমি নিজে থেকে পারবো না পরিচিত হতে? আমি এই কলেজের সেরা সুন্দরী। আমি চাইলেই উনার সাথে প্রেম করতে পারবো। আর করে দেখাবো তোকে। তুই তখন দেখে নিস।”
নীলু কথা না বাড়িয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায়।
রাগে, কষ্টে, অভিমানে চোখে পানি চলে আসে প্রিয়তার। নীলু ভুল কিছু বলেনি। মেয়েটা আসলেই ভীষণ রূপবতী। আচ্ছা, সে তো নীলুর রূপের কাছে কিছুই না। উচ্ছ্বাস ভাই কি আবার উনাকে পছন্দ করে ফেলবে? এ কি বিপদ আবার?
প্রিয়তার মাথার উপর দিয়ে মনে হচ্ছে আগুন উঠছে। মাথা তাওয়ার মতো গরম হয়ে আছে। এই মুহুর্তে কয়েক কলস ঠান্ডা পানি মাথায় না ঢাললে শান্তি হবে না, কিছুতেই হবে না।

খাটের উপর শুয়ে গান শুনছিলো পেখম। টকটকে লাল মুখে ঝড়ের বেগে আপাকে ঢুকতে দেখে এক ঝটকায় শোয়া থেকে উঠে বসে সে। এই আপাটার আবার কি হলো? আজকাল বড্ড রেগে যাচ্ছে মেয়েটা কথায় কথায়। এর কারণও পেখম জানে। মেয়েরা নতুন নতুন প্রেমে পড়লে তাদের অনুভূতিগুলো প্রখর হতে থাকে আগের চেয়ে। সে শুনেছে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে।

প্রিয়তা ধপ করে বসে পড়ে খাটে। রাগে শরীর কাঁপছে তার। চোখ বন্ধ করে একশো থেকে উলটো দিক গুণতে থাকে সে।
পেখম ভয়ে ভয়ে বললো,”আপা কি হয়েছে তোর? রাগ করে আছিস কেনো?”
প্রিয়তা কিছুটা দমে যায়। আসলেই তো রাগ করছে কেনো সে? ওই মানুষটা তো তার প্রেমিক না। এমনকি প্রিয়তাকে পছন্দও করেনা সে। তার জন্য এভাবে রাগ করাটা কি ছেলেমানুষী না?
“আপা, এই আপা।”
প্রিয়তা ঝট করে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই কোথায়?”
“বাড়িতে নেই আপা।”
“কোথায় গিয়েছেন মহারাজ এখন? মেয়ে পটাতে বুঝি?”
পেখমের মুখ হা হয়ে যায়।
“এসব কি বলছিস আপা?”
প্রিয়তা উঠে দাঁড়ায়।
“শোন আমি মাথায় পানি ঢালতে যাচ্ছি, বরফ শীতল ঠান্ডা পানি। তোর উচ্ছ্বাস ভাই এলে আমাকে খবর দিস।”
প্রিয়তা যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলো, সেই বেগেই বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।
পেখম বিড়বিড় করে বললো,”আচ্ছা নতুন প্রেমে পড়লে কি মেয়েদের মাথাও কিছুটা খারাপ হয়ে যায়? এটা তো বান্ধবীদের কাছ থেকে শোনা হয়নি।”

প্রিয়তা ভেবেছিলো মানুষটার সামনে অনেক রাগ দেখাতে পারবে সে। কিন্তু কোথায় কি? তার ঘরের সামনে আসতেই বুকটা কেমন চুপসে গেছে তার। ঘর থেকে সিগারেটের তীব্র ধোঁয়া আর গন্ধ ভেসে আসছে।
প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে আস্তে বললো,”এইজন্য বুঝি বাড়ির বাইরে যেয়ে এতো সিগারেট খাওয়া তাইনা? সিগারেটের ধোঁয়া দেখিয়ে মেয়েদের প্রেমে ফেলানো। আর মেয়েদেরও বলিহারি। এসব দেখে কেউ প্রেমে পড়ে? ছি কি রুচি!”

“বাইরে দাঁড়িয়ে পেত্নীর মতো এভাবে বিড়বিড় না করে কি বলতে আসা হয়েছে বলে চলে গেলে ভালো হয়। এতো রাতে পেত্নী হোক বা পেত্নীর মতো দেখতে মানুষ কেউ বিরক্ত করুক, আমার পছন্দ না।”
প্রিয়তা শুকনো ঢোক চাপে। তার রাগের পারদ তরতর করে নিচে নামছিলো কিছুক্ষণ আগেই। হঠাৎ রাগটা আবার বেড়ে যায়। তাকে পেত্নী বলা? সে যদি পেত্নী হয় তবে সেই রূপসী পরীটা কে? ওই নীলু বুঝি?

প্রিয়তা পা টিপে টিপে উচ্ছ্বাসের ঘরে ঢোকে। ভীষণ অন্ধকার ঘরটা। অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই দেখে উচ্ছ্বাস স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি ব্যাপার? কি চাই এখানে?”
প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে হাতে রাখা ব্যাগটা এগিয়ে দেয় উচ্ছ্বাসের দিকে।
উচ্ছ্বাস দুই ভ্রু নাচায়।
প্রিয়তা শীতল গলায় বললো,”আপনাকে অত্যন্ত ধন্যবাদ এতো সুন্দর শাড়িটা আমাকে দেওয়ার জন্য। তবে শাড়িটা যেহেতু আপনার মায়ের, তাই এটাতে হয়তো অনেক স্মৃতি মিশে আছে। তাই এটা ফেরত দিতে এসেছি।”
প্রিয়তার মনে হয়েছিলো উচ্ছ্বাস এটা নিবে না, তাকে দিয়ে দিবে। মূলত সে উচ্ছ্বাসের সাথে কথা বলতে আসার একটা বাহানা খুঁজছিলো।
কিন্তু প্রিয়তাকে চরম অবাক করে দিয়ে উচ্ছ্বাস অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”খাটের উপর রেখে চলে যাও।”
প্রিয়তা চোখ বড় বড় করে তাকায়।
“শুনতে পাওনি মনে হয়। বলেছি শাড়িটা খাটের উপর রেখে দিয়ে চলে যাও।”
প্রিয়তা কিছুটা ধাতস্থ হয়ে শাড়িটা রেখে দেয়। বারবার বাঁকা চোখে উচ্ছ্বাসকে দেখতে থাকে সে। কিন্তু উচ্ছ্বাস এখনো অন্যদিকে তাকানো।

ধীর পায়ে হেঁটে দরজা পর্যন্ত যেয়ে কি মনে করে আবার ঘুরে তাকায় প্রিয়তা।
উচ্ছ্বাস নির্লিপ্ত চোখে তার দিকে তাকায়।
প্রিয়তা একটা লম্বা শ্বাস ফেলে, চোখ বন্ধ করে এক নি:শ্বাসে বলতে থাকে।
“দেখুন আপনি এতো সিগারেট খান আমার একদম পছন্দ না। তাও ভালো কথা, বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে খাওয়ার কি দরকার? আর কালো শার্ট পরে তো প্রশ্নই ওঠে না। আগামীকাল থেকে যেনো আর না দেখি।”
প্রিয়তা কথা শেষ করেও চোখ বন্ধ করে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বুঝতে পারে এক জোড়া অগ্নিকুন্ডলীর মতো চোখ তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। যেনো চোখ দিয়ে আগুন বের করেই তাকে ভস্ম করে দিবে। এ কি করলো সে? কথা ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় কি এখন?

উচ্ছ্বাস আস্তে আস্তে হেঁটে এসে প্রিয়তার সামনে দাঁড়ায়। মেয়েটা আজ শ্বেতশুভ্র একটা শাড়ি পরেছে। তরুণী মেয়েরা হঠাৎ হঠাৎ শাড়ি পরলে ভীষণ মোহনীয় লাগে দেখতে, চোখ সরানো যায়না। দুই ভ্রুয়ের মাঝে একটা ছোট্ট কালো টিপ। হাতভর্তি সাদা কালো কাচের চুড়ি। আচ্ছা, এতো রাতে মেয়েটা এমন মোহনীয় সাজে সেজেছে কেনো? সে কি কোনোভাবে উচ্ছ্বাসের দূর্বলতা বুঝে ফেলছে?
প্রিয়তার অনেকটা কাছে এসে দাঁড়ায় উচ্ছ্বাস। প্রিয়তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তার নি:শ্বাসের শব্দ।
“কি বললে তুমি? আবার বলো তো।”
প্রিয়তা ভয় পেয়ে ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। উচ্ছ্বাস পিছন থেকে তার হাত চেপে ধরে। দুই/তিনটা কাচের চুড়ি আলগোছে ভেঙে নিচে পড়ে যায়। প্রিয়তার বুকটা ধুকধুক করে ওঠে।

“উত্তর না দিয়ে পালাচ্ছো যে?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”কিছু বলিনি, কিছু বলিনি।”
“আমি যে শুনলাম তুমি বললে। আমাকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছো, কালো শার্ট পরতে নিষেধ করেছো।”
প্রিয়তা হাত মোচড়াতে থাকে।
অন্য হাতে থাকা সিগারেটটা দূরে ছুড়ে ফেলে দেয় উচ্ছ্বাস। এরপর হেঁচকা টান দিয়ে প্রিয়তাকে সামনে টেনে নিয়ে আসে। প্রিয়তার কপালের উপর তার কিছু অবাধ্য চুল এসে পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে ঘোর লাগে উচ্ছ্বাসের।
হঠাৎ হালকা ফুঁ দিতেই চুলগুলো উড়ে যেতে থাকে। প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে যায়। সে বুঝতে পারছে না এসব কি করছে মানুষটা। সে কি জানে কি করছে সে? নিজের মধ্যে সে কি আছে এখন? এই প্রথম তার এতোটা কাছে আসা। স্থাণুর মতো জমে গেছে সে। এক পা ও যেনো আর নড়তে পারবে না।
প্রিয়তা তোতলাতে তোতলাতে বললো,”আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি।”
উচ্ছ্বাস নেশাক্ত গলায় বললো,”তাহলে কি বলতে চেয়েছো শুনি?”
প্রিয়তা টের পায় তার পা দু’টো অবশ হয়ে যাচ্ছে।
উচ্ছ্বাস তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”শোনো মায়াবতী, আগুনের পাশে উড়তে থাকা পতঙ্গ হতে চেয়ো না। আগুনের টানে পতঙ্গ এক সময় ঝাঁপ দেয় লেলিহান শিখায়। এতে কিন্তু আগুনের কোনো ক্ষতি হয়না। কিন্তু পতঙ্গ জ্বলে অঙ্গার হয়ে যায়। অসহ্য রকম সুন্দর জীবনে খুঁত হিসেবে শুধু এই গজদন্তটাই থাকুক। যে খুঁত, হাজারও নিখুঁত বিন্যাসকে টেক্কা দিতে পারে। আর কোনো খুঁত জীবনে টেনে এনো না। পতঙ্গের মতো পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে, টেরও পাবে না। যখন টের পাবে, তখন বড্ড দেরি হয়ে যাবে। চারদিকে তাকিয়ে দেখবে শুধু ধোঁয়াশা আর ধোঁয়াশা।”
কথা শেষ করেই হাতের বাঁধন আলগা করে দেয় উচ্ছ্বাস। ছাড়া পেতেই ভেজা কপোতীর মতো কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।
উচ্ছ্বাস সেই তুলনায় শান্ত।
প্রিয়তা আস্তে আস্তে পা ফেলে দরজার দিকে এগোয়। কি হয়ে গেলো দুই মিনিটের মধ্যে। তার সত্ত্বা অনুভূতি শূণ্য হতে থাকে।

“এইযে নন্দিনী, একটা দিয়াশলাই দিতে পারবে?”
প্রিয়তা আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,”কি করবেন?”
উচ্ছ্বাস তার চোখের গভীরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”কালো শার্ট বাদে অন্য শার্ট গুলো পুড়িয়ে ফেলবো।”
প্রিয়তা হতাশ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

(চলবে….)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১৪

বসার ঘরে চিন্তিত মুখে বসে আছে কবির শাহ। তার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। পাশেই শরীর এলিয়ে বসে আছে মার্জিয়া বেগম। ক্ষণে ক্ষণে কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে সে। পেখম ভয়ে ভয়ে একবার বাবার দিকে তাকায়, আরেকবার মায়ের দিকে।
ঘটনা মোটেই সামান্য নয়। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে চললো, এখনো প্রিয়তা কলেজ থেকে বাড়ি ফেরেনি। সাধারণত এমন অবুঝের মতো কাজ সে কোনোদিন করেনা। কলেজ শেষ করেই সোজা বাড়ি চলে আসে। যদি কোনোদিন দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আগেই বাড়িতে জানিয়ে দেয়।

এক এক করে প্রিয়তার সব বান্ধবীদের কাছে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। কেউ জানেনা প্রিয়তা কোথায়। শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিলো কলেজ গেটের সামনেই। এরপর আর কেউ কিছু জানেনা।

মার্জিয়া বেগম ঠোঁট কামড়ে বললো,”আমার মেয়েকে এনে দাও, যেখান থেকে পারো আমার মেয়েকে আমার কাছে এনে দাও। আমার মেয়ের কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচবো না।”
কবির শাহ কিছুটা ইতস্তত করে স্ত্রীর মাথায় হাত রাখে। মার্জিয়া বেগম হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
“তুমি এতো ভাবছো কেনো? আমি দেখছি তো।”
মার্জিয়া বেগম চিৎকার করে বললো,”ভাববো না, চুপ করে বসে থাকবো? চারদিকের অবস্থা ভয়াবহ তুমি জানো না? কেউ যদি মেয়েটাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়?”
কবির শাহ আর পেখম একসাথে শিউরে উঠে তাকায় তার দিকে।
“এসব কি বলছো তুমি মার্জিয়া? মাথা ঠিক আছে তোমার? কে করবে এই কাজ? আমার প্রিয়তার সাথে কার শত্রুতা থাকতে পারে?”
মার্জিয়া বেগম মাথা চেপে ধরে বললো,”আমি কিচ্ছু জানিনা। তুমি যেখান থেকে পারো আমার মেয়েকে এনে দাও, এক্ষুনি।”
কবির শাহ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে উঠে দাঁড়ায়।

“পেখম।”
পেখম ধীর কণ্ঠে বললো,”জ্বি বাবা।”
“আমার পাঞ্জাবিটা এনে দে ভিতর থেকে, আমি বেরোবো।”
মার্জিয়া বেগম মাথা উঁচু করে বললো,”তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
“মেয়েটা তো আমার। আমাকে তো জানতেই হবে ও কোথায়। আমি থানায় যাচ্ছি।”
মার্জিয়া বেগম লাফ দিয়ে উঠে বললো,”আমিও যাবো তোমার সাথে।”
কবির শাহ কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শোনা যায়। সবাই চমকে উঠে তাকায়। পেখম দৌড়ে যায় দরজার দিকে।
মার্জিয়া বেগম চোখ মুছে বললো,”নিশ্চয়ই আমার প্রিয়তা এসেছে।”
কয়েক সেকেন্ড বাদেই অন্ধকার মুখে ঘরে ঢোকে পেখম।
“মা।”
“কোথায়, প্রিয়তা কোথায়?”
পেখম মাথা নিচু করে বললো,”আপা না মা, বড় খালা এসেছে।”
মার্জিয়া বেগম আবারও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।
মর্জিনা বেগম ঘরে ঢুকেই পরিস্থিতি এমন দেখে ঘাবড়ে যায়। দৌড়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো,”কি হয়েছে তোর? এভাবে কাঁদছিস কেনো? এই কবির কি হয়েছে ওর?”
কবির শাহের উত্তর দিতে হয়না।
মার্জিয়া বেগম ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,”আপা আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে, সব শেষ হয়ে গেছে আমার।”
“মানে কি? কি হয়েছে বলবি তো?”
“আপা আমার মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিয়তা বাড়ি ফেরেনি এখনো।”
“বাড়ি ফেরেনি মানে? এসব কি বলছিস তুই? কবির এসব কি শুনছি?”
কবির শাহ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।
মর্জিনা বেগম কপাল চাপড়ে বললো,”ঠিক এই কারণে আমি বলি, মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করানোর দরকার নেই। এখন যদি মেয়েটার নিয়াজের সাথে বিয়ে হতো, শ্বশুরবাড়িতে আরাম আয়েশে থাকতো। তোদের আর কোনো চিন্তাই থাকতো না। না তা হবে না। তোর বর তো বিদুষী বানাবে মেয়েদের। এখন দেখ কি হয়।”
মর্জিনা বেগমের কথা শুনে মার্জিয়া বেগম আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে। কবির শাহ বিরক্ত হয়ে তাকায় মর্জিনার দিকে। কিছু বলতে ইচ্ছা করেনা তার।
“এই মার্জিয়া তোর মেয়ের আবার কোনো গোপন প্রেমিক নেই তো? হতেও পারে তার সাথেই তোর মেয়ে পালিয়ে গেছে।”
কবির শাহ এবার চুপ থাকতে পারেনা।
তেজী গলায় মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”এবার মুখে একটু লাগাম টানুন আপা। বলতে বলতে কোথায় যেয়ে ঠেকেছেন ঠাওর করতে পারছেন না।”
ঝাঁঝিয়ে ওঠে মর্জিনা বেগমও।
“ভুলটা কি বললাম আমি? মিলিয়ে নিও আমার কথাই ঠিক হবে। এই বয়সের মেয়েরা হলো সাক্ষাৎ আগুন। এদেরকে বেশি মাথায় তুললে এদের শিখা বাড়তেই থাকে শুধু। যখন আমার কথা সত্যি হবে তখন এতো তেজ কোথায় যায় তোমার দেখবো।”
কবির শাহ ম্লান হেসে বললো,”আপনি খুশি হবেন এমনটা হলে? আমার মুখে চুনকালি মাখলে আপনার ভালো লাগবে তো? যদি না লাগে তাহলে দয়া করে চুপ করুন। আমি হাতজোড় করছি।”
মর্জিনা বেগম চুপ করে যায়।
এরপর কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে ভারী গলায় পেখমকে ডেকে বললো,”এই পেখম, তোদের বাড়ির ওই আশ্রিত ছেলেটা কোথায় রে?”
পেখম ভ্রু কুঁচকে বললো,”কার কথা বলছেন খালা?”
“ইশ বুঝতে পারছিস না যেনো। ওইযে তোর বাপ একটা এতীম ছেলেকে বাড়িতে টেনে এনে তুলেছে না? তার কথা বলছি।”
পেখম চাপা গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথা বলছেন? উনি তো বাড়িতে নেই। এই সময় উনি বাড়িতে থাকে না।”
মর্জিনা বেগমের মুখ সাথে সাথে জ্বলে উঠলো।
“এইতো বুঝেছি। দুইয়ে দুইয়ে চার হলো এবার। আমার সন্দেহই ঠিক।”
কবির শাহ অবাক হয়ে বললো,”কি বলতে চাচ্ছেন আপা?”
“বলতে চাচ্ছি না, বলছি। মার্জিয়া তোকে আগেই সাবধান করেছিলাম আমি, তোর মনে আছে? এইসব ছেলেদের বাড়ি থেকে বের করে দে। বাড়িতে এতো বড় বড় দুই মেয়ে। ঠিক হলো তো আমার কথা? নিশ্চয়ই ভুলভাল কিছু বুঝিয়ে তোর মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে ও।”
কবির শাহ হতভম্ব হয়ে তাকায় তার দিকে। মার্জিয়া বেগমও হতবাক।
“আপা আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?”
“না জানার কি হলো? প্রিয়তা কখনো এতো দেরি করেনা। ওই ছোকরাও এখন বাড়িতে নেই। তার মানে কি দাঁড়ালো?”
কেউ কিছু বলার আগে পেখম আস্তে আস্তে বললো,”খালা উচ্ছ্বাস ভাই তো প্রতিদিনই এই সময় বাড়িতে থাকেনা। আর তাছাড়া উনি এমন মানুষই নয়। আপনি ভুল বুঝছেন উনাকে।”
পেখমের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে মর্জিনা বেগম।
“চুপ কর তুই। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের চামচা এসেছে। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে তুই সব জানিস। সত্যি করে বল পেখম। এখনো সময় আছে।”
পেখম ভীত গলায় বললো,”কি বলছেন খালা? আমি কিছু জানিনা। ও বাবা সত্যিই আমি কিছু জানিনা।”

“আমার ব্যাপারে কিছু বলছিলেন?”
হঠাৎ একটা গম্ভীর গলার আওয়াজে সবাই থমকে যায় ওরা। দরজার দিকে তাকাতেই দেখে বুকে দুই হাত বেঁধে সুঠাম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। তার চোখের দৃষ্টি মর্জিনা বেগমের দিকে নিবদ্ধ। শান্ত দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই এমন কিছু ছিলো, মর্জিনা বেগম কিছু সময়ের জন্য চোখ নামিয়ে নেয়।
“কি হলো চুপ করে আছেন যে ম্যাডাম? খুব সম্ভবত আপনিই কিছু বলছিলেন কিছুক্ষণ আগে।”
মর্জিনা বেগম কিছু বলার আগেই কবির শাহ ছুটে যায় উচ্ছ্বাসের কাছে। হঠাৎ করেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে উচ্ছ্বাসকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দেয় সে।
অপ্রস্তুত হয়ে যায় উচ্ছ্বাস নিজেও। পুরুষ মানুষ খুব বেশি কষ্ট না পেলে কাঁদে না। এমন হাসিখুশি, ভালো একজন মানুষকে কাঁদতে দেখে উচ্ছ্বাসের বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে।
“মামা কি হয়েছে আমাকে একটু বলুন তো। কেনো কাঁদছেন এভাবে?”
“বাবা আমার মাথা কাজ করছে না। আমাকে তুমি একটু থানায় নিয়ে চলো। আমি হাঁটতে পারছি না আর এক কদমও। আমার মেয়েটা এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে কিছুই জানিনা। আমার শরীর আর চলছে না।”
উচ্ছ্বাসের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। মুহুর্তেই এক শ্যামবর্ণা কাজল চোখের তরুণীর গজদন্তের মিষ্টি হাসি ভেসে ওঠে। কি হয়েছে ওর? ওর কোনো বিপদ হয়নি তো?

বেরোনোর মুখে অন্ধকার মুখ করে পেখম দাঁড়িয়ে। তার চোখমুখ ছলছল করছে।
তাকে দেখেই থমকে দাঁড়ায় উচ্ছ্বাস।
কি একটা ভেবে মুচকি হেসে বললো,”চিন্তা করোনা পেখম। আপা ফিরে আসবে।”
“উচ্ছ্বাস ভাই।”
“বলো পেখম।”
“আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”
“বলো শুনছি।”
এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে পেখম বললো,”আপা আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাস মুহুর্তেই স্তব্ধ হয়ে পেখমের দিকে তাকায়। তার হাত-পা অনড় হয়ে যায়।
“তোমাকে এই কথা বলেছে তোমার আপা?”
পেখম না-সূচক মাথা নাড়ে।
“তবে কীভাবে জানলে?”
“আপনি যেদিন আপাকে বকা দেন, সেদিন রাতে আপা জেগে থাকে। একটুও ঘুমাতে পারেনা। গল্পের বইতে মুখ গুঁজে আপা নি:শব্দে শুধু কাঁদে। আনমনেই আপনার নামটা আপার বইখাতাতে লিখে। আর সেদিন তো ঘুমের ঘোরে….”
“কি হয়েছে ঘুমের ঘোরে?”
“কিছু না। আপনি আমাকে সত্যি করে বলুন তো, আপনি বুঝতে পারেননি?”
উচ্ছ্বাস ম্লান হাসে। বিষাদে মাখা সেই হাসিটা দেখে কষ্ট হয় পেখমের। মনে হয় এই মানুষটাও কোনো একটা কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে রেখেছে, ভয়ংকর এক কষ্ট।
“শোনো পেখম, তোমার আর তোমার আপার বয়সটা বড্ড কাঁচা। তোমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারোনা। পরিস্থিতি তোমাদের বুঝতে দেয়না। কিন্তু আমাদের মতো ছেলেদের, তোমার খালার ভাষায় আশ্রিত ছেলেদের অনেক কিছু বুঝতে হয়। তাই এসব আবেগে গা না ভাসিয়ে তোমার বাবার কথা চিন্তা করো। উনার অনেক স্বপ্ন তোমাদের ঘিরে।”
উচ্ছ্বাসের কথার মধ্যে কিছু তো একটা ছিলো। বয়সে কাঁচা হলেও পেখম ঠিক বুঝতে পারে, এই স্বরের মধ্যেও প্রেম আছে।
“ঘরে যাও পেখম। আমাকে বেরোতে হবে। তোমার আপাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
“আপনি তো তাকে শুধু কষ্টই দেন, তাহলে কেনো খুঁজে বের করতে চান তাকে?”
উচ্ছ্বাস সুন্দর করে হাসে।
“মনে করো দায়িত্ববোধ থেকে। তোমার বাবা আমার আশ্রয়দাতা। আমার খুব কঠিন একটা সময়ে তিনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। এতোটুকু দায়িত্ববোধ তো থাকেই আমার, তাইনা?”
“শুধুই দায়িত্ববোধ? আর কিছুই না?”
উচ্ছ্বাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”না আর কিছুই না।”
পেখম চুপ করে থাকে। উচ্ছ্বাস বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেখম আবার ডাক দেয় তাকে।
“আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই আমি।”
“পরে শুনবো পেখম, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“হয়তো উপকারেই আসবে আপনার।”
উচ্ছ্বাস থেমে যেয়ে তাকায় পেখমের দিকে।
“তুমি কি জানো তোমার আপা কোথায়?”
পেখম ফিসফিস করে বললো,”আমি নিশ্চিত নই। তবে আপার যখন খুব মন খারাপ থাকে, কোনোভাবেই মন ভালো হয়না তখন আপা ওর কলেজের পাশের একটা শান বাঁধানো নদীর ঘাঁট আছে, ওখানে চুপচাপ একা বসে থাকে। খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে তো, মন খারাপ হলে নিজের মধ্যেই সেটুকু শুষে নেওয়ার চেষ্টা করে।”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায়। পেখম দেওয়ালে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে। যে কোনো মুহুর্তে ঝড় ছাড়বে। উচ্ছ্বাস উন্মাদের মতো খুঁজছে প্রিয়তাকে। পেখমের কথামতো নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে সে। তীব্র বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে চোখমুখের উপর পড়ছে। ঝড়ো বাতাসে অজস্র ধুলো ওড়াউড়ি করছে। তবুও সে ছুটছে, তাকে খুঁজে বের করতেই হবে মেয়েটাকে। এখানে যদি না থাকে কোথায় যাবে সে?

হঠাৎই দূরে অন্ধকারের মধ্যে নীল ওড়না দেখে বুকটা ধকধক করে ওঠে উচ্ছ্বাসের। মনে হচ্ছে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে আসা কোনো বিষাদকুমারী খরস্রোতা পানির ঢেউ দেখায় ব্যস্ত। জগতের আর কোনো খেয়াল তার নেই।

উচ্ছ্বাস ধীর পায়ে হেঁটে প্রিয়তার অনেকটা কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। এখনও প্রিয়তা বুঝতেই পারেনি তার উপস্থিতি।
“তুমি যে বোকা তা জানতাম। তবে এতোটা জ্ঞানবুদ্ধিহীন একটা মেয়ে এটা জানা ছিলো না। ভাগ্যগুণে এটাও জানা হয়ে গেলো।”
ভয়াবহভাবে চমকে প্রিয়তা তাকায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে উচ্ছ্বাসের দিকে। এটা কি সত্যি নাকি কোনো ভ্রম?

প্রিয়তা তোতলাতে তোতলাতে বললো,”আপনি এখানে? এটা নিশ্চয়ই আমার কল্পনা।”
ধমকে ওঠে উচ্ছ্বাস।
“চুপ করো তুমি। লজ্জা করা দরকার তোমার। বাড়িতে বাবা মা তোমার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে, আর এখানে তুমি কল্পনার সাগরে ভাসছো? মাথায় কি সমস্যা আছে তোমার?”
কেঁপে ওঠে প্রিয়তা উচ্ছ্বাসের কথায়। এখনো সে ধাতস্থ হতে পারেনি। উচ্ছ্বাস কীভাবে জানবে সে এখানে আছে? এটা তো তার জানার কথা না।
“আপনি কীভাবে জানেন আমি এখানে?”
উচ্ছ্বাস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”স্বপ্নে দেখলাম। মহারানী রাজ্য ছেড়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায় সে মজা করছে কিনা বুঝতে। কিন্তু কোথাও মজার কোনো চিহ্ন নেই তার মুখে।

“বাড়িতে চলো, সবাই অপেক্ষা করছে।”
প্রিয়তা ম্লান গলায় বললো,”আপনি যান, আমি যাবো না। আমার মন ভালো না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়বো না।”
উচ্ছ্বাস গলার স্বর আরো চড়িয়ে বললো,”শেষ বারের মতো বলছি। তুমি আমার সাথে ফিরবে কি না?”
প্রিয়তা গাঢ় গলায় বললো,”না।”

আচমকা উচ্ছ্বাস প্রিয়তার বাম হাত শক্ত করে চেপে ধরে। প্রিয়তা হতবিহ্বল হয়ে যায়।
“কি করছেন আপনি? লাগছে আমার, ছাড়ুন।”
“অনুরোধ করেছিলাম, শোনোনি। এবার এভাবেই তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাবো।”
“আমার কথাটা শুনুন…..”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার হাত ধরে টানতে থাকে। ঘাঁট থেকে উঠতেই নদীর পাড়ের নরম কাদামাটি। প্রিয়তা নিজেকে আটকাতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তে কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
“উচ্ছ্বাস ভাই ছাড়ুন আমাকে….”
বলতে না বলতেই একটা পাথরের টুকরোর সাথে আঘাত লেগে উচ্ছ্বাস মাটিতে পড়ে যায়, সাথে সাথে প্রিয়তাও এসে পড়ে উচ্ছ্বাসের বুকের উপর।

ঠান্ডা ঝড়ো হাওয়া হুট করেই বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে। বলা নেই, কওয়া নেই অজস্র ফোঁটায় শীতল বারিধারা পড়তে থাকে। প্রকৃতিও হয়তো চাচ্ছে, দুই মানব মানবীর ভিতরকার সকল দূরত্ব ঘুচে যাক। তারা একে অন্যের অনেকটা কাছে চলে আসুক। এই খরস্রোতা নদী হোক তার সাক্ষী। শীতল বর্ষার জল হোক তাদের প্রণয়ের মিলনকারী।

প্রিয়তার চুল চুইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি এসে পড়ে উচ্ছ্বাসের মুখে। মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ ভেসে আসে উচ্ছ্বাসের নাকে। এটা কি কোনো প্রসাধনীর ঘ্রাণ নাকি তার শরীরের? উচ্ছ্বাস বুঝতে পারেনা।
পানিতে কাজল লেপ্টে যায় প্রিয়তার। এতে তার মাধুর্য আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। উচ্ছ্বাস সেই দৃষ্টির সামনে অসহায় বোধ করে। সে ভুলে যায় তার পরিচয়, তার উদ্দেশ্য, তার ভবিষ্যৎ। তার সামনে এখন শুধু এক মোহিনীর বাস। বাদবাকি আর সব কিছু ভুল, সব কিছু মেকি।

দূরের কোনো এক নৌকার মাঝি গান ধরেছে,’ওরে নীল দরিয়ে, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া। বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি হায় রে, কান্দে রইয়া রইয়া।’

প্রিয়তা ওঠার তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু কোনো এক অজানা শিকড় তাকে টেনে ধরে রাখে। সে জানে যে কোনো সময় তার তৃষ্ণার্ত চিত্ত, অধর বেঈমানী করবে তার সাথে। কোনো এক ভুলে আচ্ছাদিত হবে, যার মাসুল দিতে হবে সারাজীবন ধরে। তবুও কোনো যাদুবলে মানুষটা তাকে নিজের সাথে আটকে রেখেছে? সে নাহয় উঠতে পারছে না। তাই বলে উনিও কি উঠাবে না?
এই কম্পমান শীতল জলে শরীর কাঁপলেও ভিতর জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে দু’টো পিপাসার্ত কপোত-কপোতীর।
প্রিয়তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে তিরতির করে। এটা কি ঠান্ডায় নাকি কোনো ভুলের আগাম বার্তা সে বুঝতে পারেনা।
সেই ঠোঁটজোড়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রম জাগে উচ্ছ্বাসের। এখন সে উচ্ছ্বাস নয়। সে গ্রীক কোনো দেবতা, জিউস। আর তার সামনে স্বয়ং তার রানী ‘হেরা’। একটাই তো জীবন, ছোট্ট একটা ভুল করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?

মর্জিনা বেগম মার্জিয়া বেগমের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অনবরত। মার্জিয়া কেঁদেই চলেছে। ঘড়িতে সময় রাত আটটা বেজে পনেরো মিনিট। বৃষ্টির বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝড়ো বাতাসের বেগ। সেই সাথে দুশ্চিন্তার পারদও বাড়ছে মার্জিয়া বেগমের।
“ও আপা, এখনো তো ওর বাবা এলো না মেয়েকে নিয়ে। কি হবে এখন? কোথায় গেলো আমার মেয়ে?”
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”মেয়ে যদি প্রেমিকের সাথে পালায় তবে আর পাবি কীভাবে? নিজে থেকে দুইদিন পর ফিরে আসবে, অপেক্ষা কর।”
মার্জিয়া বেগম হালকা চিৎকার করে বললো,”দয়া করে এগুলো বলো না আপা। তুমি কি বুঝতে পারছো না আমার মনের অবস্থাটা? সান্ত্বনা দিতে না পারো, অন্তত খোঁচা দেওয়া কথাগুলো বন্ধ করো।”
কিছুটা দমে যায় মর্জিনা বেগম।
একটু থেমে আবার বললো,”শোন মার্জিয়া, একটা কথা বলে রাখি। এ যাত্রায় মেয়ে ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে এলে আর দেরি করিস না। নিয়াজ এখনো বিয়ে করেনি। তার নাকি প্রিয়তাকে খুবই মনে ধরেছে। বিয়ে করলে নাকি ওই মেয়েকেই করবে। তাই যতো দ্রুত সম্ভব, এসব কথা পাঁচ কান হওয়ার আগেই বিয়েটা পাকা করে ফেল। অনেক শুনেছিস কবিরের কথা, আর না। এবার নিজে একটু শক্ত হ।”

মার্জিয়া বেগম কান্নাভেজা লাল চোখে আপার দিকে তাকায়। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পায়না।

“মা মা, আপা ফিরেছে।”
পেখমের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শুনে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ে মর্জিনা আর মার্জিয়া। মার্জিয়া বেগম মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলেই পেখম ছুটে এসে মা কে ধরে।
“কোথায় আমার প্রিয়তা? কোথায় ও?”
ধীর পায়ে আস্তে আস্তে হেঁটে প্রিয়তা দাঁড়ায় বসার ঘরে। তার সারা শরীর কাঁদায় মাখামাখি। পানিতে ভিজে চুপসে আছে সে। একটা নীড়হারা পাখির মতো কাঁপছে সে থরথর করে। ভয়ে, উত্তেজনায় কিংবা ঠান্ডায়। অথবা সব মিশ্র অনুভূতিতে। লম্বা চুলগুলো খোলা, এলোমেলো। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে অনেক আগেই।
মার্জিয়া বেগম হতভম্ব হয়ে বললো,”এ কি অবস্থা তোর?”

বাড়ি ফিরেই সোজা ছাদে উঠেছে উচ্ছ্বাস। টিপটিপ বৃষ্টি এখনো ঝরে যাচ্ছে। তার মধ্যেই সিগারেট ধরিয়েছে সে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। না, সে কোনো ভুল করেনি। অধরজোড়া যখন খুব তৃষ্ণা নিয়ে অনেকটা কাছাকাছি, সে জোড়ার দূরত্ব মাত্র এক সেন্টিমিটার। ঠিক সেই সময় উচ্ছ্বাস ধাতস্থ হয়। এ কি করতে যাচ্ছিলো সে? এ যে পাপ, অন্যায়। তার কঠিন সময়ে যে দু’টো হাত সাহায্যের জন্য তার দিকে বাড়িয়েছে, সে কীভাবে বেঈমানী করবে তার সাথে?

ধাক্কা দিতেই প্রিয়তা ছিটকে যেয়ে কাদার মধ্যে পড়ে। উঠে দাঁড়ায় উচ্ছ্বাস সাথে সাথে। অন্যদিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলে,”আমি ওদিকে অপেক্ষা করছি, চলে এসো। আর রাতের এই নির্জনতাই শুধু সাক্ষী হোক। আর কেউ যেনো আজকের এই কথা না জানে।”
এক ব্যথায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া হৃদয়েশ্বরী কন্যার করুণ দৃষ্টি উপেক্ষা করে উচ্ছ্বাস চলে যায় সেখান থেকে।

তবুও কেনো এতো কান্না পাচ্ছে তার? মনে হচ্ছে অতি মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেললো সে বুকের বাঁ পাশ থেকে। কি হারালো? তবে কি সত্যিই সে এতোটা জায়গাজুড়ে ছিলো? নাহলে কেনো এতো বিষাদের ক্ষত হচ্ছে?
আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাস গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে বললো,”মা মা গো, তোমার ছেলেটার মনের অসুখ হয়েছে খুব। তুমি আমার মন ভালো করে দাও। মা তুমি শুনতে পাচ্ছো? তোমার ছেলের মনের জ্বর হয়েছে। তুমি বলে দাও আমি কি করবো?”

আচ্ছা, ঠিক তখন কি কোনো উজ্জ্বল তারকা হেসেছিলো তার দিকে তাকিয়ে? সে কথা উচ্ছ্বাস জানেনা। সে তখন তীব্র মাথা যন্ত্রণায় নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে তীব্র যন্ত্রণায়। বুকের ভিতরের এক সুবিশাল ক্ষতের যন্ত্রণায়।

(চলবে…….)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-১২

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১২

বৈশাখের প্রথম রাতেই কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। সারাদিনের অসহ্য গরমের পর একটু শান্তির ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া। প্রকৃতির বুকে নেমে এসেছে একরাশ প্রশান্তি।
শুধু স্বস্তি নেই প্রিয়তার মনে। পাশেই পেখম শুয়ে আছে। প্রিয়তা ঘরের বাতি নিভিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়েছে। অন্ধকার অসহ্য লাগছে এখন।

“আপা।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না।
পেখম উঠে বসে প্রিয়তার পাশে।
“আপা শুনছিস কি বলছি?”
প্রিয়তা যন্ত্রের মতো বললো,”এখনো ঘুমাসনি কেনো?”
পেখম মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বললো,”একটা কথা বলবো আপা? রাগ করবি না তো?”
প্রিয়তা নির্লিপ্ত চোখে পেখমের দিকে তাকায়।
“কি কথা?”
পেখম একটু থেমে বললো,”আজ উচ্ছ্বাস ভাই গিয়েছিলো তোর কলেজের অনুষ্ঠানে।”
এ কথা প্রিয়তা জানে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে পেখম আরো কিছু জানে।
“তোর প্রথম নাচ শেষ হওয়ার কিছু সময় পর উনাকে আমি দেখেছি। উনি ভীষণ রেগে ছিলেন। আর উনার হাতে অনেকগুলো গোলাপফুল ছিলো। ফুলগুলো উনি মাটিতে আছড়ে ফেলছিলেন। আমি যখন উনাকে জিজ্ঞেস করলাম উনি তোর নাচ দেখেছে কিনা। উনি কেনো যেনো খুব রেগে গেলেন। কি হয়েছে আপা উনার?”
প্রিয়তা পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। তার মাথা কাজ করছে না।
পেখম প্রিয়তার গায়ে হাত দিয়ে বললো,”আপা আমার একটা কথা রাখবি?”
প্রিয়তা চুপ করে থাকে।
“তুই একবার উনার সাথে কথা বল। উনি কেনো আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চান?”
প্রিয়তা বালিশে হেলান দিয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে।
“কি হলো আপা? শুয়ে পড়লি যে?”
প্রিয়তা কপালের উপর একটা হাত রেখে চোখ বন্ধ করে।
“মোমবাতিটা নিভিয়ে দে পেখম, বড্ড চোখে লাগছে আলোটা।”
পেখম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মোমের আলো এতোটাও প্রখর না যে চোখে লাগবে। সে বুঝতে পারে নিশ্চয়ই আপা আর উচ্ছ্বাস ভাইয়ের মধ্যে কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। দুইজনের চোখেই রাগের আড়ালে একটা চাপা কষ্ট দেখতে পেয়েছে সে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে পেখম।

বেশ কিছুক্ষণ উচ্ছ্বাসের ঘরের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। ইচ্ছা করছে ছুটে যেয়ে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরতে। এই দূরত্ব আর সহ্য হচ্ছে না তার। সবাই বলে এটা নাকি আবেগের বয়স। কিন্তু আবেগ হলে কি সত্যিই এতোটা কষ্ট হয়?
খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে জীবনটা ভালোবাসার মানুষটার সাথে কাটিয়ে দিলে? ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে জীবনটা কি সে গুছিয়ে দিতে পারবে না? জীবন তো একটাই। সময় গেলে যে সাধন হবে না।

“প্রিয়তা।”
মায়ের ডাকে চমকে ওঠে প্রিয়তা। মা কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে সে বুঝতেই পারেনি। এখন কি হবে? তাকে কি ভুল বুঝবে মা?
অতি সন্তর্পণে চোখের পানিটা মুছে ফেলার চেষ্টা করে প্রিয়তা। মার্জিয়া বেগম সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
“এখানে কি করছিস তুই?”
প্রিয়তা চাপা গলায় বললো,”পানি খেতে এসেছিলাম মা।”
বলার সময় গলাটা ঈষৎ কেঁপে ওঠে তার। যে চোখ এড়ায় না মার্জিয়া বেগমের।
একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে মার্জিয়া বেগম বললো,”তুই মনে হয় খেয়াল করিস নি, পানি তোর শোবার ঘরের মাথার কাছেই ছিলো।”
প্রিয়তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে।
“চল আমার সাথে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কোথায় যাবো মা?”
“আজ তুই আমার সাথে ঘুমাবি।”
প্রিয়তা আমতা আমতা করে বললো,”কিন্তু বাবা….”
“তোর বাবাকে আজ বসার ঘরে ঘুমাতে বলেছি। বলেছি আজ আমার বড় মেয়ের সাথে রাত জেগে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। তোর কোনো আপত্তি নেই তো?”
প্রিয়তা থতমত খেয়ে যায় মায়ের কথায়। কি বলবে বুঝতে পারেনা। মায়ের হঠাৎ এমন ব্যবহার অবাক করছে তাকে।
“কি রে চুপ করে আছিস কেনো? আগে তো মা কে ছাড়া ঘুমাতেই পারতিস না।”
এটা সত্যি, প্রিয়তা মা কে ছাড়া ঘুমাতেই চাইতো না আগে। কিন্তু তা অনেক বছর আগের কথা। প্রায় আট বছর সে আলাদা ঘুমায়।
মার্জিয়া বেগম কোমল হাতে মেয়ের হাত ধরে।
“কি রে চল।”
প্রিয়তাকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে তার হাত ধরে টেনে মার্জিয়া বেগম নিজের ঘরে নিয়ে যায়। প্রিয়তার ঘোর লাগে। সে বুঝতে পারছে না মায়ের এই ব্যবহারে তার ভালো লাগছে নাকি খারাপ।

মেয়ের মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মার্জিয়া বেগম। ঝড়-বৃষ্টি থামার পর বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। বাইরে একনাগাড়ে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। সেই ডাকে পরিবেশ রোমাঞ্চকর লাগে আরো।
“মনে আছে আগে রাত জেগে গল্প শোনাতে হতো তোকে। আমি যতো ক্লান্তই থাকি না কেনো, গল্প শোনাতে হবেই তোকে। কবে যে এতো বড় হয়ে গেলি তোরা।”
প্রিয়তার চোখে নোনাজল ভরে যায়। যে কোনো মুহুর্তে প্লাবন নামবে।
“আচ্ছা প্রিয়তা তোর কি খুব মন খারাপ হয়?”
প্রিয়তা আবারও চমকে ওঠে।
“কেনো মা?”
“এমনিতেই, তোর মতো বয়সটায় আমারও এমন হতো। হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ হতো, আবার হঠাৎ মন ভালো হয়ে যেতো। তোরও কি এমন কিছু হয়?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তার।
“শোন মা, তোরা হয়তো ভাবিস তোর বাবার সংসারে এসে আমি খুশি না। আমি তোর বাবাকে পছন্দ করিনা এটাই জানিস তোরা ছোট থেকে। কিন্তু এটা সত্যি না। মেয়েরা বড় হওয়ার পর মায়ের বন্ধু হয়ে যায়। তাই আজ আমার সব কথা তোকে বলবো। তুই কি শুনতে চাস?”
প্রিয়তা অস্ফুট শব্দে সম্মতি জানায়।
মার্জিয়া বেগম উদাস গলায় বললো,”তোর বাবাকে আমি অনেক ভালোবাসি, অনেক। হয়তো উনি আমাকে যতোটা ভালোবাসেন তার চেয়েও বেশি। তুই এখন বলবি, যদি তাই হয় বাবাকে কষ্ট দাও কেনো? বাবার সাথে সবসময় চিৎকার করো কেনো? এই উত্তর আসলে আমি দিতে পারবো না। একটা মেয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে একটা নতুন সংসারে আসে। তার স্বামী তাকে অনেক ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে। কিন্তু সে যখন বিয়ের পরই জানতে পারে তার স্বামীর একজন পূর্ব প্রেমিকা আছে তখন তার স্বপ্নগুলো কাঁচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। দূর থেকে স্ট্রিটের আলো জানালা গলে মায়ের মুখে এসে পড়ছে। মায়ের দুই গাল ভেজা। কি যে মায়াবতী লাগছে মা কে। প্রিয়তার অদ্ভুত কষ্ট হয় মায়ের জন্য। খুব ইচ্ছা করছে মা কে জড়িয়ে ধরতে।
“আমি জানিনা এটা তোকে আমার বলা উচিত হচ্ছে কিনা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এখন তোকে কথাগুলো জানানো দরকার। জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত গুলো অনেক ভেবেচিন্তে নিতে হয়। আর মা হিসেবে আমার দায়িত্ব তোকে ঠিক পথটা দেখানো।”
মার্জিয়া বেগম থামে, প্রিয়তা অধীর হয়ে অপেক্ষা করে মায়ের কথা শোনার জন্য।

“বিয়ের পর তোর বাবাকে আমি যতো আবিষ্কার করলাম, তত তাকে ভালোবাসতে শুরু করলাম। সত্যি বলতে প্রথমে আমার উনাকে ভালো লাগেনি। আমার সাথে বয়সেও মানানসই না, সামান্য ছাপোষা চাকরি। অনেকটা নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ঠিক এমন সময় তোর বড় খালার কি বিত্তশালী পরিবারে বিয়ে হয়েছে। মন খারাপও লাগতো। আমার বাবার উপর রাগ হতো। কেনো উনি আমাকে এমন একজনের সাথে বিয়ে দিলেন। কিন্তু বিয়ের কিছু মাস পর বুঝেছিলাম আমার বাবা ভুল করেননি। আমি একজন খাঁটি মানুষ পেয়েছি জীবনে। কতোদিন শুধু আলু ভর্তা খেয়ে দিন পার করেছি। তবুও আমি অভিযোগ করিনি। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমি একটা ভয়াবহ সত্যির মুখোমুখি হলাম, যা আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আমার সাজানো স্বপ্নগুলো বালুঝড়ের মতো উড়ে যেতে থাকে।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো মায়ের কথা শুনছিলো প্রিয়তা।
“কি সেই সত্যি মা?”
মার্জিয়া বেগম চোখের পানি মুছে ছোট্ট করে হাসে। কি বিষাদে মাখা সেই হাসি। প্রিয়তার অসম্ভব কষ্ট হতে থাকে মায়ের জন্য।
“তোর বাবা বিয়ের আগে অন্য একজনকে ভালোবাসতো। বলতে গেলে তার জন্য উন্মাদ ছিলো। যদিও আমাকে বিয়ের পর কিছুই বুঝতে দেয়নি সে। আমি জেনেছিলাম তার লেখা ডায়েরির কিছু অংশ পড়ে।”
প্রিয়তা ধড়ফড় করে উঠে বসে। মায়ের চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
“মা এসব কি বলছো তুমি?”
“আমি জানি এটা তোমার শুনতে ভালো লাগবে না। তবে সত্যি এটাই। তোমার বাবা তার দু:সম্পর্কের বোন নীলিমাকে ভালোবাসতো। অবশ্য ভালোবাসতো বলছি কেনো, হয়তো এখনো বাসে।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে বললো,”নীলিমা মানে?”
মার্জিয়া বেগম হালকা করে মাথা নেড়ে বললো,”তুমি যা সন্দেহ করেছো ঠিক তাই। উচ্ছ্বাসের মা নীলিমার সাথেই প্রেম ছিলো তোমার বাবার।”
মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে প্রিয়তার। কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চায়না সে এই কথা। এমন কিছুই কখনো মনে হয়নি তার বাবার কোনো ব্যবহারে।
“কলেজ জীবন থেকেই দুইজন দুইজনকে ভালোবাসতো। এরপর হঠাৎই নীলিমা হারিয়ে যায়। তোর বাবা খোঁজ নিয়ে দেখে উচ্চমাধ্যমিকের পরেই নীলিমাকে বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। তোর বাবাকে জানাতে পর্যন্ত পারেনি সে। তখন থেকেই মানুষটা একটা ভগ্ন হৃদয় নিয়ে বেঁচে ছিলো। এরপর অনেক বছর পর হঠাৎ করেই আবার যোগাযোগ হয় নীলিমার সাথে। এই শহরে নতুন এসে তোর বাবা দিশা পাচ্ছিলো না। এমন সময় নীলিমা আবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো। ওখানেই তোর বাবা ছিলো বেশ কয়েক মাস। এরপর চাকরি পাওয়ার পর ওই বাড়ি ছেড়ে দেয় সে। যদিও সে ও বাড়িতে কখনোই থাকতে চায়নি। কিন্তু তার কাছে আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। বৃদ্ধ বাবা মা অসুস্থতায় জর্জরিত গ্রামের বাড়িতে। ছোট তিন ভাইবোন। তারা সবাই বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে শহর থেকে কিছু পাঠাতে পারলেই খেতে পারবে। তাই বাধ্য হয়ে নীলিমার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয় তাকে।”
মার্জিয়া বেগম থামে। জোরে জোরে শ্বাস পড়তে থাকে তার। প্রিয়তা স্তম্ভিত হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তার এখন কি বলা উচিত সে বুঝতে পারছে না।
“মা।
মার্জিয়া বেগম হালকা হেসে মেয়ের দিকে তাকায়।
“তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”
মার্জিয়া বেগম দুই হাত মেলে দেয়। প্রিয়তা ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকের উপর। মায়ের বুকে মাথা দিয়ে যেনো তার ভিতরের কষ্ট টুকু টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে।
“তোমার কি খুব কষ্ট মা?”
মার্জিয়া বেগম শব্দ করে হেসে দেয়।
“কে বলেছে আমার কষ্ট? তোর বাবা আমাকে এই ভাঙা ঘরেও রানী করে রেখেছে। কখনো বুঝতে দেয়নি আমি তার জীবনের দ্বিতীয় নারী। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়েছে কোথাও যেনো সুরটা ঠিক নেই। পুরুষের প্রথম প্রেম হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ পুরুষ তার প্রথম প্রেমকে কোনোদিন ভুলতে পারেনা। তোর বাবাও হয়তো পারেনি। তাই তো, তাদের অবর্তমানে আমার নিষেধ সত্ত্বেও উচ্ছ্বাসকে নিজের কাছে এনে রেখেছে। হয়তো উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে সে নীলিমাকে দেখতে পায়।”
প্রিয়তা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মা কে। তার চোখের উষ্ণ পানি টের পায় মার্জিয়া বেগম তার বুকে।
“তোর বাবা একজন অসাধারণ মানুষ রে। আজকের পর যেনো তার উপর তোর সম্মান এতোটুকুও কমে না যায়, এই আদেশ আমার থাকবে। মানুষটা সারাটা জীবন অনেক কষ্ট করেছে। সংসারের কিছু অতিরিক্ত আয়ের জন্য স্কুল ছুটির পর টিউশন করেছে। তার দুই মেয়ে তার চোখের মণি।”
প্রিয়তার মায়ের উপর থাকা সব রাগ, সব অভিমান গলে যেতে থাকে। এক তিক্ত সত্যের মুখোমুখি আজ সে হয়েছে। হজম করতে পারছে না সে। আচ্ছা উচ্ছ্বাস ভাই কি এগুলো জানে?
“এই কথাগুলো তোদের আমি কোনোদিন জানাতে চাইনি। আজ কেনো জানালাম জানিস? আমি চাইনা আমার জীবনটা যেমন সঙ্কোচে কেটেছে। সবসময় মনে হয়েছে আমি আমার জীবনের প্রথম পুরুষের দ্বিতীয় নারী। আমি চাইনা আমার মেয়েদের জীবনটা এভাবে কেটে যাক। যে পুরুষটাই তোদের জীবনে আসুক না কেনো, তাদের জীবনে যেনো তোরাই প্রথম নারী হোস। জীবনের বড় সিদ্ধান্ত গুলো নেওয়ার আগে অনেক বার ভাবতে হবে। হয়তো-বা যে মানুষটাকে আপাত দৃষ্টিতে অসাধারণ কেউ মনে হচ্ছে, সে মানুষটা হতেও পারে তেমন না। তোর বয়সটা এমনই। এই বয়সে হেমলক নামক বিষটাও অমৃত মনে হয়। আমি তোর জীবনের সুখের বাঁধা হতে চাইনা। কিন্তু মা হিসেবে তোকে কিছু উপদেশ তো দিতে পারি, তাইনা?”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে ধরে। মা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে সে ভালো করেই বুঝতে পারে।
“কেউ যদি নিজে থেকে চলে যেতে চায়, তাকে যেতে দে। আটকে রাখার চেষ্টা করিস না। যদি নিজেকে প্রমাণ করতে পারে, তবে সে হবে তোর জন্য খাঁটি পুরুষ। মন খারাপ করে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে ভালোবাসা আটকে রাখা যায়?”
প্রিয়তা ছটফট করছে ভিতর ভিতর। অস্থির লাগছে তার পুরো শরীর জুড়ে।
“মারে, জীবনটা এটা নয় যে তুই যেটা সামনে দেখতে পাচ্ছিস। জীবনটা আরো অনেক বড়। আর নারীর মন? সে যে অনেক সাধনার বস্তু। এতোটাও সস্তা করে দিস না নিজেকে।”
প্রিয়তাকে চুপ থাকতে দেখে মার্জিয়া বেগম ম্লান হাসে। মেয়ের ভিতর এখন কি তাণ্ডব চলছে সে ভালো করেই বুঝতে পারছে। ভয়ংকর একটা সময় পার করছে মেয়ে। এখনই লাগাম না টানলে জোরেসোরে একটা ধাক্কা খাবে অচিরেই।
“ঘুম পেয়েছে নিশ্চয়ই অনেক? ঘুমিয়ে পড়। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মায়ের কাছে সব মন খারাপের ওষুধ আছে। দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে।”
প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো,”তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো মা।”

দুইজনই চুপচাপ শুয়ে পড়লো। কিন্তু কেউ জানলো না দুইজন অসমবয়সী নারী পাশাপাশি শুয়ে একটা নির্ঘুম রাত পার করলো। আবার হয়তো-বা তারা জানে তারা দুইজনই আজ জেগে। দূরে একটা রাত জাগা পাখি ডাকতে ডাকতে চলে যায়। ঝড়ে আটকে থাকা পাখি পরিবারের কাছে যেতে মরিয়া। পরিবার যে এক ভয়ংকর মায়ার জায়গা।

“ভাই এতো রাতে ডেকে পাঠালেন যে? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
উচ্ছ্বাস সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।
“ভাই আগে তো এভাবে সিগারেট খেতেন না। হঠাৎ এমন নেশা হয়ে গেলো এটা আপনার?”
উচ্ছ্বাস বিরক্ত হয়ে বললো,”সেসব তোমার না জানলেও হবে। তোমাকে যে কাজের জন্য বলেছি তার খবর জানাও।”
ছেলেটা ইতস্তত করে বললো,”আপনার মেজো চাচা রোজ রাত এগারোটায় ওদিকের মাছের বাজার সংলগ্ন রাস্তা হয়ে বাড়ি ফেরে। অতো রাতে তেমন মানুষ থাকে না ওখানে। বলতে গেলে ফাঁকাই থাকে রাস্তা।”
উচ্ছ্বাসের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।
“বাকিদের খবর বলো।”
“আপনার সেজো চাচার খবর সঠিক বলতে পারবো না এখনো। উনি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বাড়ি ফেরে। কখনো রাত দশটা আবার কখনো সন্ধ্যা সাতটা। কিন্তু আপনার ছোট চাচার ব্যাপারে দারুণ একটা খবর দিতে পারি।”
“কি?”
ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার আওয়াজ নামিয়ে বললো,”উনার নারীঘটিত অভ্যাস আছে। প্রায়ই একটা মহিলার সাথে একটা ফাঁকা ফ্লাটে যেতে দেখা যায় তাকে। আমার মনে হয় ওই সময়টাই আপনার জন্য সুবর্ণ সুযোগ হবে।”
উচ্ছ্বাস ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,”খুব ভালো, খুব ভালো।”
ছেলেটা মাথা নিচু করে বললো,”ভাই যদি বেয়াদবি না নেন একটা কথা বলি?”
“কি কথা?”
“আপনার মতো তুখোড় একজন ছাত্র, এভাবে জীবনটা শেষ করে দিবেন? আরেকটু ভাবলে হতো না? যারা যাওয়ার তারা তো চলেই গেছে। সম্পত্তি তো এখনো আপনার হাতেই আছে। আপনি চাইলেই ওদের ভোগদখল থেকে সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবেন…..”
উচ্ছ্বাস চোখ তুলে তাকাতেই ছেলেটা ভয়ে থেমে যায়।
“বেয়াদবি নিবেন না ভাই। আপনার জন্য আমার কষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কাছের ভাই আপনি আমার। আপনার মতো এমন উজ্জ্বল নক্ষত্র আমি কমই দেখেছি। আপনার জীবনটা এভাবে শেষ হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। কি চমৎকার গান করতেন আপনি অনুষ্ঠানগুলোয়। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আপনি সেবার লাল পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন পহেলা বৈশাখে। টিএসসিতে বসে আমাদের গান করে শুনিয়েছিলেন। মোর্ত্তজা স্যার বলেছিলেন, রাজপুত্র। সেই আপনি এভাবে ঝরে পড়ে যাচ্ছেন৷ তিলে তিলে আপনাকে শেষ হতে দেখতে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে আমার।”
উচ্ছ্বাস খোলা গলায় হাসে। ছেলেটার নাম মিথুন। উচ্ছ্বাস মিথুনের কাঁধে হাত রাখে।
“আমার জীবনটা আর আগের মতো নেই মিথুন। একটা কালবৈশাখী ঝড় এলোমেলো করে দিয়েছে সবকিছু। আমি আমার বুকের ভিতরটা কাউকে দেখাতে পারছি না। যতোদিন না পর্যন্ত আমি প্রতিশোধ নিতে না পারছি আমার র ক্ত ঠান্ডা হবে না। প্রতি রাতে আমার শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দুর তেজ আমাকে ঘুমাতে দেয়না। আর জীবনের কথা বলছো? জীবন তো সেদিনই আমার শেষ হয়ে গেছে, নতুন করে আর কি হবে?”
মিথুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
উচ্ছ্বাস রাস্তায় নেমে পড়ে। সিগারেট বের করেও ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। মুখটা কেমন তেতে আছে তার। কিছুই ভালো লাগছে না। এক রমনীর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা শান্তি খুঁজে পেয়েছিলো সে। অনেকটা অমাবস্যার রাতে দূরের কোনো তারা জ্বলজ্বল করে অন্ধকার কাটানোর বৃথা চেষ্টা করার পর। ডুবন্ত মানুষ কচুরিপানা আঁকড়ে হলেও বাঁচতে চায়। তার অবচেতন মন কোনোভাবে ওই কিশোরীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো। কিন্তু তা কি আর সম্ভব? কখনোই সম্ভব না।

ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। উচ্ছ্বাস ঠিক করে বাকিটা রাত সে রাস্তাতেই কাটাবে। রাতের সৌন্দর্য দেখবে। ঝড়ের পর শীতল আবহাওয়ায় হাঁটতে ভালো লাগছে তার।
যতোবার ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ততবার এক অষ্টাদশী কিশোরীর মুখ ভেসে আসছে তার চোখের সামনে। যে বন্যার মতো উত্তাল হয়ে ছুটে আসছে তার কাছে। কিংবা কখনো দীঘির টলটলে পানির মতো শান্ত। যার দুই চোখে সাতটা মহাদেশের মানচিত্র যেনো কেউ নিপুণ তুলির আঁচড়ে এঁকে দিয়েছে। যার গজদন্তের হাসি বারবার উচ্ছ্বাসের শক্ত প্রাচীর ভেঙে চলে অবিরত।

ভোরের আগেই দূর থেকে একটা চায়ের দোকান খোলা দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বাস যায় সেদিকে।
“এক বোতল পানি দাও।”
চায়ের দোকানদার কথা না বলে পানির বোতক এগিয়ে দেয়।
উচ্ছ্বাস ঢকঢক করে প্রায় সবটুকুই এক নি:শ্বাসে খেয়ে ফেলে। হৃদয়টা শুকনো মরুভূমির মতো খা খা করছে তার। কোনোভাবেই তৃষ্ণা মেটে না তার। বাকি পানিটুকু মাথায় ঢেলে দেয় সে। ভেজা চুলগুলো চুইয়ে পানি পড়তে থাকে।

উচ্ছ্বাস বোতল এগিয়ে দেয়।
“ফিরে যাও ভাগ্নে, ফিরে যাও।”
উচ্ছ্বাস এদিক ওদিক তাকিয়ে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমাকে বলছো?”
“তোমারেই বলতেছি ভাগ্নে। তার উপর রাগ করে থেকো না। মেয়েরা হলো এই মনে করো পদ্মফুলের মতো। যতো যত্ন করবা, তত পাপড়ি মেলতে থাকবো। যত্ন করবা না, শুকাইয়া মরে যাবো। তাই সময় থাকতেই ফিরে যাও। নিজেও কষ্ট পেয়ো না, তারেও কষ্ট দিও না। যাইয়া দেখো সে-ও রাইত জেগে বসে আছে তোমার জন্য।”
উচ্ছ্বাস হতভম্ব হয়ে বললো,”কি বলছেন আপনি এসব?”
দোকানদার হাসতে হাসতে বললো,”এই সময় সব প্রেমিকগুলোই আমার দোকানে আসে। আগের রাতে প্রেমিকার সাথে ঝামেলা করে, সারারাত রাত জেগে রাস্তায় হাঁটে। ভোরবেলা আমার দোকানে আইসা পানি খায়। আমি সবাইরে ফিরে যেতে বলি। নারীর মন, সে বড় অমূল্য ধন। পাইলে হাত ছাড়া কইরো না ভাগ্নে।”
উচ্ছ্বাস পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। দোকানদান জোরে গান ধরে,’তোমার বাড়ি রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কপ, বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না।’
অন্ধকার ভেদ করে তখন কেবলই আলো ফুটছে, এদিকে খোলা গলার গান। উচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে এক নতুন সূর্যোদয় দেখে।

(চলবে…..)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-১১

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১১

নাচ শেষ হতেই দর্শক সারির করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রিয়তা এতোক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলো। হাততালির শব্দে ধাতস্থ হয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকায় সে সামনের দিকে। আর দৃষ্টি দর্শক সারিতে থাকা উচ্ছ্বাসের উপর নিবদ্ধ। উচ্ছ্বাসও একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মার্জিয়া বেগমের চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। সে চাচ্ছে না নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে। কবির শাহ মুচকি হাসে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে।
“কেমন দেখলে মেয়ের নাচ?”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”বেশ ভালোই খেটেছে মেয়েটা।”
কবির শাহ হালকা হেসে বাকিদের দিকে তাকায়। সবাই তার মেয়েরই প্রশংসা করছে। গর্বে শরীরটা যেনো কেঁপে উঠছে তার বারবার।
“মার্জিয়া।”
মার্জিয়া বেগম চোখ মুছে স্বামীর দিকে তাকায়।
“এখন কি মনে হচ্ছে সন্তানদের তার স্বকীয়তা প্রকাশে উৎসাহিত করা উচিত?”
মার্জিয়া বেগম মাথা নাড়ে।
“আমাদের সেতারা কি সুন্দর গান করতো তোমার মনে আছে? ওর স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর গানে মুগ্ধ হলো শ্রোতারা সবাই। কিন্তু মর্জিনা আপা কি করলেন? ওর গান গাওয়া বন্ধ করে দিলেন। মেয়েটা মা কে এতো ভয় করতো, কোনোদিন মুখ ফুটে নিজের ইচ্ছাটা আর বলার সুযোগ পায়নি। তুমি কি জানো সেতারার তার মায়ের উপর একবুক ভরা অভিমান জমা হয়ে আছে? সে চাইলেও মা কে আপন করে কাছে টেনে নিতে পারেনা। তুমি কি চাও তোমার মেয়েদের সাথে তোমার সম্পর্কটা এমন হোক? মেয়েরা একসময় আমাদের কাছে আর থাকবে না। কে কোথায় চলে যাবে আমরা জানিনা। দূরে বসেও মেয়েরা তোমার কথা ভেবে বুকে অভিমান জমিয়ে রাখুক, এটা কি তুমি চাও?”
মার্জিয়া বেগম মুখ কঠিন করে বসে থাকলো। সে আজ মেয়েকে সাজানোর সময়ই বুঝেছে ইতোমধ্যেই মেয়েদের কাছ থেকে তার মনের দূরত্ব ঠিক কতোটা বেড়েছে। তবে কি সবাই ভাবে সে তার মেয়েদের খারাপ চায়? একজন মধ্যবিত্ত মা হিসেবে এটুকু কি খুব সাধারণ নয়?

ফড়িং এর মতো প্রিয়তা ছুটছে। তাকে এক্ষুনি মানুষটার কাছে পৌঁছাতে হবে, এক্ষুনি। তার মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তাকে মানুষটার কাছে না যেতে পারলে অনেক দেরী হয়ে যাবে।
মঞ্চের সিঁড়ির মুখেই উজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো রুনাসহ প্রিয়তার আরো কিছু বান্ধবী আর তাকে যারা নাচ শিখিয়েছে তারা। তাদের মধ্যে প্রিয়তার নীলু আপা ছিলো অন্যতম।

প্রিয়তা নেমে আসতেই ছুটে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে নীলু। তার কষ্ট করা স্বার্থক হয়েছে। মেয়েটার নাচের পিছনে অনেক শ্রম দিয়েছে সে। তার বিশ্বাস ছিলো, আর প্রিয়তা সেইটা করে দেখিয়েছে।
“উফ প্রিয়তা তুই তো মুগ্ধ করে দিয়েছিস। বিশ্বাস কর, আমরা কেউ এক মুহুর্তের জন্য পলক পর্যন্ত ফেলতে পারিনি। অসাধারণ প্রতিভা আছে তোর।”
প্রিয়তা শুকনো মুখে হাসে। তার চোখ বারবার ইতিউতি খুঁজছে।
“এদিক ওদিক কি দেখছিস? চল তো আমার সাথে।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”কোথায় যাবো নীলু আপা?”
নীলু মুখ টিপে হেসে বললো,”গেলেই দেখতে পারবি।”
প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় বললো,”আমি একটু বাদেই আসছি নীলু আপা। আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দিন।”
নীলু বিরক্ত গলায় বললো,”চুপ কর তো তুই। তোর জন্য একজন অপেক্ষা করে আছে। এক্ষুনি যেতে হবে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”আমার জন্য আবার কে অপেক্ষা করবে? এসব কি বলছেন?”
নীলু প্রিয়তার হাত টেনে ধরে বললো,”তুই আয় তো।”
প্রিয়তা আর কিছু বলার সুযোগ পায়না। হতভম্ব হয়ে অনুসরণ করতে থাকে নীলুকে। নীলু প্রিয়তার হাত ধরে টানতে টানতে কলেজের অন্য প্রান্তে নিয়ে যেতে থাকে। প্রিয়তা বারবার পিছনে ঘুরে উচ্ছ্বাসকে খুঁজতে থাকে।

“এখানে কেনো আনলেন আমাকে নীলু আপা?”
নীলু প্রিয়তার গাল টেনে বললো,”এতো বিখ্যাত একজন মানুষ যে তোর প্রেমিক আগে জানাসনি কেনো?”
প্রিয়তার মাথায় ঢোকে না কিছু। নীলু আপা এসব কি বলছে? উনি কি কোনোভাবে উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথা বলছে? কিন্তু উনি বিখ্যাত হবেন কেনো?
“এসব কি বলছেন নীলু আপা? আমার প্রেমিক মানে? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
“থাক থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। উনি আসছেন, এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছেন। মানুষটা একদম পাগল তোর জন্য।”
নীলু কুটকুট করে হাসতে থাকে। প্রিয়তা কথা আগামাথা কিছু বুঝতে পারেনা। নীলু আপা নিশ্চয়ই অন্য কারো সাথে তাকে মিলিয়ে ফেলেছে।

মিনিট পাঁচেকের মাথায় নীলু উজ্জ্বল মুখে হালকা চিৎকার দিয়ে বললো,”ওইতো উনি চলে এসেছেন।”
প্রিয়তা নীলুর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের উল্টোদিকে তাকাতেই ভয়াবহভাবে চমকে ওঠে। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। এই লোকটা এখানে কেনো? আবার দেখা হওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিলো উনার সাথে? কি চায় উনি প্রিয়তার কাছে?
পাথরের মূর্তির মতো অনড় দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তা।

নীলু ছুটে যায় সেদিকে।
“এইযে নিয়াজ সাহেব ওকে এনেছি। আমার দায়িত্ব শেষ। চারদিকে এতো শোরগোল, বুঝতেই পারছেন অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেরকম নিরিবিলি জায়গা বলতে এটাই আছে। আপনার প্রেমিকা তো লজ্জায় শেষ।”
নিয়াজ মোর্শেদ বাঁকা ঠোঁটে হাসে। প্রিয়তার শরীর জ্বলে যায় হাসি দেখে।

নীলু প্রিয়তার কাছে এসে চাপা গলায় বললো,”কথা শেষ করেই রিহার্সাল রুমে চলে আসিস। দলীয় নাচের জন্য শেষ সময়ের প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। প্রেমিককে পেয়ে আবার সব ভুলে যাস না।”
প্রিয়তা জোরালো গলায় নীলুর দিকে তাকিয়ে বললো,”খুব বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে নীলু আপা।”
নীলু মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়। প্রিয়তা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে এখন কোনো ঝামেলা চাচ্ছে না।

“তুমি এতো দারুণ নাচ করো, জানতাম না তো।”
প্রিয়তা লাল চোখে তাকায় নিয়াজের দিকে।
“আপনি আমাকে কেনো ডেকেছেন? আর নীলু আপার সামনে নিজেকে আমার প্রেমিক পরিচয়-ই বা দিয়েছেন কেনো?”
নিয়াজ শব্দ করে হাসে। লোকটার হাসি খুবই জঘন্য। কথায় আছে, একটা মানুষের চরিত্র তার হাসিতেই অনেকটা ফুটে ওঠে।
“দয়া করে উত্তরটা দিন। আমার জানামতে আমার বাড়ি থেকে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আপনার সাথে আমার আর কি সম্পর্ক থাকতে পারে? আপনি কেনো
আমাকে অনুসরণ করছেন?”
নিয়াজ মোর্শেদ বুকে দুই হাত বেঁধে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকে হাসিমুখে। যেনো খুব মজা পাচ্ছে সে মেয়েটার কথায়।
প্রিয়তা একরাশ বিরক্তি নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই নিয়াজ শক্ত করে তার বাম হাত চেপে ধরে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে যায় প্রিয়তা। অবাক হওয়ার মাত্রাও যেনো অতিক্রম করে ফেলেছে সে।
দাঁতে দাঁত চেপে প্রিয়তা নিয়াজের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনার এতো বড় সাহস? আপনি আমার হাত ধরেছেন?”
“হ্যা ধরে ফেললাম তো। এখন কি করবে? চিৎকার করে মানুষ ডাকবে? তা ডাকতে পারো। ইতোমধ্যেই হয়তো জেনেছো এই কলেজে আমার প্রতিপত্তি ঠিক কোন পর্যায়ের। কেউ আমাকে অসম্মান করে কথা বলা দূরের কথা, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস রাখেনা এখানে।”
প্রিয়তা ঘন ঘন শ্বাস ফেলে।
“সবাই কি জানে ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে ঠিক কেমন একজন মানুষ আপনি?”
নিয়াজ প্রিয়তার হাত ছেড়ে দিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
“সবাই জানুক তুমি আমার প্রেমিকা, এতে ক্ষতি তো নেই। বরং লাভ আছে তোমার। কলেজের সবাই তোমাকে বাড়তি খাতির করবে। কেউ কুনজরে দেখবে না তোমাকে।”
ঝাঁঝিয়ে ওঠে প্রিয়তা।
“আমার কোনো বাড়তি খাতিরের প্রয়োজন নেই। আর কীভাবে বোঝালে আপনি বুঝবেন আমি চাইনা আপনি আমার পিছনে এভাবে পড়ে থাকুন।”
“তোমার চাওয়া বা না চাওয়াতে কিছুই যায় আসে না। আমি সবসময় স্ত্রী হিসেবে তোমার মতো একটা মেয়ে চেয়েছি। যাকে চাবি দেওয়া পুতুলের মতো আমি ব্যবহার করতে পারবো। আমি যেভাবে বলবো সেভাবেই চলবে এমন মেয়ে। আমার মনে হয়েছে তুমি এমন ধরণেরই। আর মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের পরিবারও অনেকটাই রক্ষনশীল হয়। তারা মেয়ের বিয়ের পর আর কোনো ঝামেলা চায়না।”
প্রিয়তার অসহ্য লাগতে থাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মুখোশধারী লোকটার কথা। তার ইচ্ছা করছে চিৎকার করতে। কিন্তু মনে হচ্ছে না চিৎকার করে কোনো লাভ হবে।
“দেখো প্রিয়তা, একটা কথা যতো তাড়াতাড়ি মাথায় ঢুকিয়ে নিতে পারবে ততই তোমার জন্য ভালো হবে। আমি যখন ভেবেছি তোমাকে বিয়ে করবো, তবে করবোই। ও হ্যা, তোমার আবার কোনো প্রেমিক নেই তো? থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তোমাদের মতো মেয়েদের একজন বাউন্ডুলে, ভবঘুরে এবং বেকার প্রেমিক থাকে। যারা সারাজীবন স্বপ্ন দেখাতেই জানে, স্বপ্ন পূরণ করতে নয়। প্রেমিকার বিয়ের রাতে একটু পাগলামি করবে, কিছু নির্ঘুম রাত পার করবে। তারপরই সব ভালোবাসা শেষ। তোমার যদি এমন কেউ থাকে, তাতেও আমার কিছু যায় আসেনা। বিয়ের পর প্রেমিককে কীভাবে ভোলাতে হয় আমার জানা আছে।”
লোকটার স্পর্ধা দেখে হতবাক হয়ে যায় প্রিয়তা। দুই গালে সপাটে দুইটা থাপ্পড় মারতে পারলে বোধহয় শান্তি হতো এখন।

এদিকে হঠাৎই মঞ্চ থেকে প্রিয়তাকে ছুটে যেতে দেখে অবাক হয় উচ্ছ্বাস। মনে হচ্ছে এই ফুলগুলো বুঝি আজ ওই মেয়েটার জন্যই ফুটেছে। উচ্ছ্বাস জানে এ ধরণের অনুভূতি তার জন্য অন্যায়। তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। প্রিয়তা মধ্যবিত্ত বাবার একটা রাজকন্যা। তার কৃষ্ণগহ্বরের মতো অতিশয় কালো জীবনটার সাথে প্রিয়তার প্রজাপতির ডানার মতো রঙিন জীবনটা বড্ড বেমানান।
কিন্তু এই হৃদয়ের চেয়ে বড় আদালত কি দুনিয়ায় কিছু আছে? সে কি কোনো বাঁধন, বারণ মানে? সে নিজেও জানেনা এর পরিণাম কি? যে মানুষটা তার বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছে, সে কি তার ক্ষতি করতে পারে?

কলেজ আঙিনার প্রতিটা কোণায় উন্মাদের মতো প্রিয়তাকে খুঁজে চলেছে উচ্ছ্বাস। প্রখর রোদে মাথা ঝা ঝা করছে তার। দরদর করে ঘাম পড়ছে তার কপাল চুইয়ে। কোনো কোণা বাকি নেই তার খুঁজতে। মোটামুটি ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় সে। কোথায় গেলো মেয়েটা হুট করে?

হঠাৎই কিছুটা দূরে চোখ যাওয়ায় থমকে যায় সে। খুব ভালো করে দেখতে চোখ সরু করে তাকায়। আচমকাই বুকটা ঈষৎ কেঁপে ওঠে তার। প্রিয়তাই তো, কিন্তু তার পাশের মানুষটা কে? কার সাথে এভাবে কথা বলছে ও?

“আপনি কেনো এতোগুলো কথা বলার সাহস পাচ্ছেন জানেন? কারণ আমি আপনাকে সেই সুযোগটা দিচ্ছি। আর সুযোগটা দিচ্ছি কারণ, আমার বাবা আমাদের অসভ্যতা শেখায়নি। তবে এরপর আমাকে কিংবা আমার পরিবারকে অসম্মান করে আর একটা কথা বললে আমি আমার বাবার শিক্ষা ভুলে যাবো।”
নিয়াজ হাসিমুখে বললো,”কি করবে তুমি?”
প্রিয়তা রাগে গজগজ করতে করতে ছুটে চলে যায় সেখান থেকে। নিয়াজ বাম হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করতে করতে শিষ বাজিয়ে সুর ওঠায়।

স্থাণুর মতো জমে একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাস। মনে হচ্ছে বুকের পাঁজরগুলো কেউ খুব অযত্নে একটা একটা করে ভাঙছে। তার কেনো এমন লাগছে? সে তো মেয়েটাকে ভালোবাসে না, কখনো বাসতে চায়ওনি। মনের কোন কোণায় অনুভূতির জন্ম হলে এতোটা কষ্ট হতে পারে?
লোকটাকে উচ্ছ্বাস চিনতে পারে। এই লোকটাই তো প্রিয়তাকে দেখতে গিয়েছিলো। তবে কি প্রিয়তা পছন্দ করে ফেলেছে তাকে? আবারও যোগাযোগ হচ্ছে তাদের মধ্যে?

দুই হাঁটু সমানভাবে কাঁপতে থাকে উচ্ছ্বাসের। ব্যর্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার। একটু আগে দিনটাকে যেমন রঙিন লেগেছিলো, এখন ঠিক ততটাই ধূসর লাগছে সবকিছু। দুই চোখ ভীষণভাবে জ্বালা করতে থাকে তার। এক নারীর জন্য ধ্বংস হয়েছিলো ট্রয় নগরী। ঠিক তেমনই এক নারীর জন্যই মফস্বল শহরটা শেষ করে ফেলতে ইচ্ছা করছে উচ্ছ্বাসের।

বড় করে শ্বাস ফেলতে ফেলতে জোর কদমে হাঁটতে থাকে উচ্ছ্বাস। তার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকা ফুলগুলোকে আবর্জনা মনে হচ্ছে এখন। ফুলগুলোকে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিজের অস্থিরতা প্রকাশ করে।

“আরে উচ্ছ্বাস ভাই আপনি এখানে? কখন এসেছেন আপনি? আপা কতোবার খুঁজছিলো আপনাকে।”
পেখমের হাসি হাসি মুখের দিকে রক্তলাল চোখে তাকায় উচ্ছ্বাস। পেখম কিছুটা ভড়কে যায় সেই দৃষ্টি দেখে।
“কি হয়েছে উচ্ছ্বাস ভাই আপনার? এমন লাগছে কেনো আপনাকে? সব ঠিক আছে তো?”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না। এক উৎসহীন রাগ, অভিমানে যেনো বোবা হয়ে গেছে সে।
পেখমের এবার কিছুটা সন্দেহ হয়। উচ্ছ্বাসের পায়ের কাছে বেশ অনেকগুলো তাজা লাল গোলাপ পড়ে আছে। মাত্রই উচ্ছ্বাস পা দিয়ে মাড়িয়েছে সেগুলো।
পেখম উচ্ছ্বাসের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,”আপার সাথে দেখা হয়েছে আপনার? নাচ দেখেছেন৷ আপার?”
উচ্ছ্বাস চাপা রোষের সাথে বললো,”আমি কারো নাচ দেখতে এখানে আসিনি। কারো সাথে দেখা করতেও নয়। তোমার আপা এমন কিছুই হয়ে যায়নি যে আমার সময় নষ্ট করে তার নাচ দেখতে আসবো। আর একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো, আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। তোমাদের বাড়ি ছাড়বো। আর ততদিন তুমি বা তোমার আপা কেউ আমার সামনে আসবে না। আমি তোমাদের ছায়া দেখতে চাইনা। মনে থাকবে?”
কথাটা শেষ করে উচ্ছ্বাস জোরে জোরে দম ফেলতে থাকে। সমস্ত রাগ, অভিমান পেখমের উপর ঝাড়ে সে। নিজেও জানেনা এই মেয়েটাকে কেনো এতো কথা বললো সে। ওর কোনো দোষ নেই।

পেখম কাতর চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। তার মাথায় আসে না সে কি এমন করলো যে উচ্ছ্বাস ভাই এভাবে কথা বললো তার সাথে। কোনো খারাপ কথা তো বলেনি। আর তার মনে হয়েছিলো আপার সাথে হয়তো উনার সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। আপাকে এতো সুন্দর শাড়িটা উপহার দিলো। হঠাৎ করে কি হলো তাদের মধ্যে? পেখমের মাথায় আসেনা।

পহেলা বৈশাখের দিনটা কবির শাহের খুব পছন্দ। তার মধ্যবিত্ত পরিবারে সাধ্য অনুযায়ী আয়োজন করতে ভালোবাসে সে এই দিনটায়। যেহেতু আজ সারাদিনই প্রায় প্রিয়তার কলেজেই কাটিয়ে দিয়েছে তারা। তাই রাতের খাবারে আজ পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছের ব্যবস্থা করেছে মার্জিয়া বেগম। পেখম হাতে হাতে সাহায্য করছে মা কে।
প্রিয়তার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নিয়াজ মোর্শেদ তার মেজাজ খারাপ করে দিয়েছে। তারপর থেকে উচ্ছ্বাসকে অনেক খুঁজেও পায়নি। তখন থেকেই কেমন বেসামাল লাগছে তার। বিকেলের দলীয় নাচেও ভালো করে মন দিতে পারেনি সে। আলুথালু পায়ে ঘরের এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে আর বার বার উঁকি দিচ্ছে উচ্ছ্বাসের ঘরে। আসার পর থেকে তার ঘরের দরজা বন্ধ রেখেছে। কি হলো মানুষটার? মনে মনে অস্থির লাগে প্রিয়তার।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে আপাকে দেখছে পেখম। সকালের ঘটনাটা আপাকে বলার সুযোগ পায়নি সে এখনো। কি হয়েছে তাদের মধ্যে জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে সে। আপাকেও কেমন আনমনা দেখাচ্ছে। সকালের নাচের সময়ও কতো হাসিখুশি ছিলো। কি হলো হঠাৎ করে তার?

“মার্জিয়া।”
মার্জিয়া বেগম কাজ করতে করতে উত্তর দেয়,”বলো শুনছি।”
কবির শাহ ক্ষীণ গলায় বললো,”তোমাকে একটা অনুরোধ করবো, রাখবে?”
মার্জিয়া বেগম ছোট্ট একটা ফেলে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি জানি তুমি কি অনুরোধ করবে। আজ রাতে যেনো ওই ছেলেটা আমাদের সাথে একসাথে বসে খায়, এই কথাটা যেনো আমি নিজে যেয়ে ওকে বলি।”
কবির শাহ ম্লান হেসে স্ত্রীর দিকে তাকায়।
“বিশটা বছর সংসার করছি তোমার সাথে। তোমার মুখ দেখলেই আমি বুঝতে পারি তুমি কখন কি বলবে।”
কবির শাহ উত্তর দেয়না। মনে হয় মার্জিয়া বলবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মার্জিয়া বেগম বললো,”চিন্তা করোনা। তুমি মেয়েদের ডেকে বসে পড়ো। আমি হাতের কাজটা সেরেই ওকে ডাকতে যাবো।”
কবির শাহের মুখটা সাথে সাথেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মার্জিয়া বেগমের মুখ সেই তুলনায় নির্লিপ্ত।

কবির শাহ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,”প্রিয়তমা, আমি বার বার তোমার প্রেমে পড়ে যাই। মানুষ হিসেবে তুমি যে কতোটা দারুণ তুমি কি তা জানো?”
মার্জিয়া বেগম কিছু না বলে চোখ রাঙিয়ে তাকায় স্বামীর দিকে।

বেশ অনেকক্ষণ ধাক্কানোর পর ভিতর থেকে দরজা খোলার খুট করে একটা আওয়াজ হয়।
কিছুটা ইতস্তত করে ঘরে ঢুকতেই একটা ছোট্ট ধাক্কা খায় মার্জিয়া বেগম। সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে আছে ঘরটা। বিকট গন্ধে মার্জিয়া বেগম নাকে আঁচল চাপা দেয়।

উচ্ছ্বাস মার্জিয়াকে দেখে কিছুটা অবাক হয়। উনি সাধারণত এখানে আসেনা।
“এতো ধূমপান করো কেনো?”
উচ্ছ্বাস স্মিত হেসে বললো,”কেউ নিষেধ করে না তাই।”
বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায় মার্জিয়া বেগম। এমন উত্তর আশা করেনি সে।
“এসব কাব্যিক কথা বাস্তব জীবনের সাথে যায়না। কেউ নিষেধ না করলেও এটা তোমার জন্য কতোটা ভয়ানক হতে পারে এটা তো অন্তত জানো তুমি। জীবনের উপর এতো বিতৃষ্ণা কেনো এতোটুকু বয়সে? কি দেখেছো জীবনের?”
“হয়তো আমি যা দেখেছি কেউই তা দেখেনি।”
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো,”তার মানে?”
“তেমন কিছু না। আপনি মনে হয় কিছু বলতে এসেছিলেন।”
“প্রিয়তার বাবা চায় আজ রাতের খাবারটা সবাই একসাথে খাবে। তুমি যেহেতু আপাতত আছো এখানে, তুমিও আমাদের সাথেই খাবে আজকে। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে, আমরা অপেক্ষা করছি।”

মার্জিয়া বেগম কথা শেষ করে দরজার দিকে পা বাড়াতেই উচ্ছ্বাস পিছন থেকে থমথমে গলায় বললো,”ক্ষমা করবেন, আমার খিদে নেই। আপনারা আমার জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে নিন।”
মার্জিয়া বেগম কঠিন মুখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়।

“আমি উনাকে যেয়ে বলবো না তুমি আসবে না। তিনি আশা করে বসে আছেন। যে মানুষটা তোমার বিপদের দিনে তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিবারের বিরুদ্ধে যেয়ে তোমাকে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছে। তুমি নিশ্চয়ই তাকে কষ্ট দিতে চাইবে না।”
হালকা হেসে মার্জিয়া বেগম চলে যায়। খাটের উপর বসে দুই হাতে চাদর চেপে ধরে উচ্ছ্বাস। যন্ত্রণায় মাথার দুই পাশের শিরা দপদপ করছে তার।

প্রতিটা সেকেন্ড অস্থিরতায় কাটছে প্রিয়তার। বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁকা চোখে উচ্ছ্বাসের ঘরের দিকে তাকাচ্ছে সে। তার দিকে কঠিন দৃষ্টি রেখে বসে আছে মার্জিয়া বেগম।

“ও কি আসতে চাচ্ছে না মার্জিয়া? আমি কি একবার যাবো ওকে ডাকতে?”
“মনে হয়না লাভ হবে। কেউ যদি নিজে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায় তবে জোর করে পাঁচিল টপকে তার গন্ডির মধ্যে না ঢোকাই ভালো। তোমরা খেয়ে নাও, আমি ওর খাবারটা ওর ঘরে দিয়ে আসবো।”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই ছেলেটা ঠিক কি করতে চাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। এমন মেধাবী একটা ছেলেকে চোখের সামনে একটু একটু করে শুকনো ফুলের মতো ঝরে যেতে দেখতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তবে কি মার্জিয়ার কথাই সত্যি? সে কি জোর করে ছেলেটার চারপাশের অদৃশ্য শক্ত প্রাচীরের মধ্যে ঢুকতে চাচ্ছে?

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কবির শাহ খাবারে হাত দেওয়ার আগেই পেখম সহাস্যমুখে চিৎকার করে বললো,”ওইতো উচ্ছ্বাস ভাই।”
কবির শাহের বুকটা ভরে যায় খুশিতে। মার্জিয়া বেগম ছোট্ট করে হাসে মাথা নামিয়ে।

বুকটা ঢিপঢিপ করছে প্রিয়তার। তার মুখোমুখি একটা চেয়ারই শুধু খালি রয়েছে। সে কি ওখানে বসবে?

“বসো বাবা, আমার পাশে বসো।”
উচ্ছ্বাস দাঁড়িয়ে থাকে।
কবির শাহ আবার বললো,”কি হলো বাবা, বসো এখানে।”
উচ্ছ্বাস তীক্ষ্ণ গলায় বললো,”মামা আমি আসলে আপনাকে একটা কথা বলার জন্য এখানে এসেছি।”
“সব শুনবো বাবা, আগে খেয়ে নাও।”
উচ্ছ্বাস সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে তাকায়। প্রিয়তা আকুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছলছল করছে তার পদ্ম পাতার মতো চোখ দু’টো। উচ্ছ্বাস চোখ সরিয়ে নেয় তার উপর থেকে।

“মামা আপনি আর মামি অনেক করেছেন আমার জন্য। বাইরের অচেনা একটা ছেলেকে নিজের ছেলের মতো বাড়িতে এনে তুলেছেন তার বিপদের দিনে। আমি হয়তো সারাজীবন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও শেষ করতে পারবো না। আপনারা আমার কাছে অতি মূল্যবান দুইজন মানুষ।”
কবির শাহ অবাক হয়ে বললো,”হঠাৎ এসব কথা বলছো কেনো? তোমার মনটা কি খারাপ?”
কবির শাহ সরু চোখে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। সে কি তবে ওই ঘরে যেয়ে কটু কোনো কথা শোনালো ছেলেটাকে? কিন্তু মার্জিয়ার ভাব দেখে তো এমন কিছু মনে হচ্ছে না।

উচ্ছ্বাস চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস নেয়। অবাধ্য চোখজোড়া নিটোল তরুণীটির চোখে নিবদ্ধ হতে চায়। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে সে।

“মামা আমি অতি শীঘ্রই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাই। হতে পারে সেইটা আগামীকাল কিংবা হতে পারে আগামী পরশু।”

বসা থেকে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় কবির শাহ। বুকটা ধকধক করে ওঠে প্রিয়তার। দুই চোখ পানিতে ছাপিয়ে ওঠে তার সাথে সাথে।

(চলবে…..)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-১০

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১০

কোনোভাবেই সাজ পছন্দ হচ্ছে না প্রিয়তার। পেখমের ঘাম ছুটে যাচ্ছে আপাকে সাজাতে যেয়ে। তবুও কোথায় যেনো খুঁত থেকেই যাচ্ছে। এদিকে বৈশাখের শুরুতেই গরমও পড়েছে অসম্ভব। সকালটা হতে না হতেই সূর্যটা একদম প্রখর রোদ দেওয়া শুরু করেছে। প্রিয়তার চিবুক বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে। প্রিয়তা আয়নার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। তার গায়ের রঙ এমনিতে শ্যামলা, কিন্তু এভাবে ঘেমে যাওয়ায় বেশ কালো লাগছে তাকে।

রাগে, দু:খে শাড়ি অর্ধেক পরা অবস্থাতেই খাটের উপর বসে পড়ে প্রিয়তা। চোখে পানি চলে আসে তার অসম্ভব রাগে।
পেখম অবাক হয়ে আপার দিকে তাকিয়ে বললো,”এ কি রে আপা? বসে পড়লি কেনো তুই? কয়টা বাজে খেয়াল আছে? দশটা তো বেজেই গেলো। এগারোটায় তোর নাচ। এখনো সাজগোজ শেষই হলো না তোর। আর তুই কিনা এভাবে বসে পড়লি?”
প্রিয়তা টান দিয়ে বাকি অর্ধেকও খুলে ফেললো শাড়ির। চাপা গলায় বললো,”আমি যাবো না।”
পেখম আরো এক প্রস্থ অবাক হয়। সে ভেবেই পাচ্ছে না আপা এসব কি বলছে।
“আপা তুই কি মজা করছিস? সারা মাস রিহার্সাল করলি নাচের। আর এখন কিনা বলছিস যাবি না? আজ অনুষ্ঠানের একটা অন্যতম আকর্ষণ যে তোর নাচ, ভুলে গেছিস তুই?”
প্রিয়তা এবার সত্যি সত্যি কেঁদে দেয়। অন্যদিন চুলটা কি সুন্দর ঢেউয়ের মতো ফুলে থাকে। আর আজই কিনা চুলগুলো এমন নেতানো লাগতে হলো? তাকে দেখতে ভালো না লাগলে, কেউ দেখবে তার নাচ? আগে তো দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী।
প্রিয়তা মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,”আমি যাবো না, যাবো না, যাবো না। এই পেত্নীর মতো চেহারা নিয়ে আমি নাচবোই না।”
পেখমের অস্বস্তি হতে থাকে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকায় সে। এই পরিস্থিতিতে বাবাকেই দরকার ছিলো শুধু। কিন্তু বাবা সকাল সকাল তার স্কুলে চলে গেছে। ওখানের অনুষ্ঠানটায় কোনো রকম উপস্থিত হয়েই একবারে বাবা আপার কলেজে চলে যাবে।
পেখম প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”লক্ষী আপা আমার, এমন জিদ করিস না। আগে শাড়িটা পরিয়ে দিই সুন্দর করে তোকে। এরপর চুলে ফুল জড়িয়ে খোঁপা করে দিই। দেখবি কেমন সুন্দর লাগে তোকে।”
প্রিয়তা চিৎকার করে বললো,”কিচ্ছু ভালো লাগবে না আমাকে। তুই যা এখান থেকে। আমি আজ কলেজে যাবো না বলছি, তো যাবোই না।”
পেখম প্রমাদ গোণে। তার আপা শান্ত হলেও জেদী। আর এ ধরণের মানুষগুলো ভীষণ খুঁতখুঁতেও হয়।
বাড়িতে শুধু তাদের মা আর তারা দুই বোন। উচ্ছ্বাস ভাইটাও সকাল সকাল কোথায় যে বেরিয়ে গেলো। মা কে ডাকতে ভয় করে পেখমের। মার্জিয়া বেগম এসব নাচানাচি কোনোদিনই পছন্দ করে না।

“কি হচ্ছে এখানে?”
মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে পেখম শুকনো ঢোক চাপে। আপাকে আবার কথা না শোনায় মা। এমনিতেই মেজাজ তেতে আছে আপার। মায়ের বকা শুনে সত্যিই যদি কলেজে না যায়।

পেখম মুচকি হেসে বললো,”কিছু হয়নি মা। আপাকে তৈরি করছি আমি।”
মার্জিয়া বেগম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকায়।
“কি তৈরি করছিস শুনি? এগারোটায় অনুষ্ঠান শুরু, এখন বাজে দশটার বেশি। কিছুই তো হয়নি এখনো।”
পেখম ভয়ে ভয়ে বললো,”মা দেখো মা, আপা বলছে আপা নাকি যাবেই না আজ কলেজে।”
মার্জিয়া বেগম ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। মেঝে থেকে শাড়িটা তুলে হাতে নেয়।
পেখমের দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলো,”এই শাড়িটা কার? এটা তো আগে দেখিনি।”
পেখম আমতা আমতা করে আড় চোখে আপার দিকে তাকায়। প্রিয়তা এখনো ফুঁপিয়ে যাচ্ছে।
উত্তর না পেয়ে মার্জিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মেয়েগুলো দিন দিন তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই বয়সের মেয়েদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয় তাদের মা। কিন্তু তার বেলায় ঘটনা ভিন্ন। মেয়েরা বাপ ন্যাওটা। অবশ্য এসবের জন্য সে নিজেই দায়ী তা সে জানে। মেয়েদের ভালোর জন্যই ছোট থেকে অতিরিক্ত শাসনে রেখেছে সে। সে কি শাসনটা অতিরিক্ত করে ফেলেছে? মেয়েদের সাথে তার মনের এই যোজন যোজন দূরত্ব কি কাটানো সম্ভব?

“প্রিয়তা উঠে আয়।”
প্রিয়তা ঘাড় গুঁজে বসে থাকে।
“কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না? উঠে আসতে বললাম না?”
মায়ের গম্ভীর আওয়াজে মাথা তুলে তাকায় প্রিয়তা।
“আমি যাবো না মা। আমাকে একটুও ভালো লাগছে না আজ দেখতে। কি ভীষণ কালো লাগছে দেখো আমাকে আজ। আর চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে এক বোতল নারকেল তেল ঢেলেছি। এই সাজে আমাকে দেখলে কেউ আর ফিরেও তাকাবে না আমার নাচের দিকে।”
মার্জিয়া বেগম ছোট্ট করে হেসে এগিয়ে যায়। মেয়ের হাত ধরে টেনে তাকে খাট থেকে নামায়। মায়ের কোমল দৃষ্টির সামনে অসহায় বোধ করে প্রিয়তা। পেখমও অবাক হয়ে দেখে তাদের।

মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে মার্জিয়া বেগম ভীষণ সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেয় প্রিয়তাকে। গতানুগতিক শাড়ির ভাঁজের থেকে অন্যরকম করে। প্রিয়তা হতবাক হয়ে যায়। মা কীভাবে বুঝলো তার এখন কেমন পছন্দ? মাত্র এতোটুকু সময়ে কীভাবে সম্ভব হলো? আচ্ছা মায়েদের হাতে কি যাদু থাকে?
প্রিয়তার ইচ্ছা হয় শক্ত করে মা কে জড়িয়ে ধরতে। মনের মধ্যে হঠাৎ করেই হাজারটা প্রজাপতি উড়াউড়ি শুরু করেছে। সে ঠিক জানে মা কিছু একটা ব্যবস্থা করেই ফেলবে।

পেখম চোখ বড় বড় করে বললো,”মা তুমি কি অসাধারণ শাড়ি পরালে। আপাকে তো একদম একটা পরীর মতো লাগছে।”
প্রিয়তা লাজুক মুখে হাসে।

মার্জিয়া বেগম পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”ফুলগুলো নিয়ে আয় তো। চুলটা বেঁধে ফেলি।”
প্রিয়তা কাতর গলায় বললো,”কিন্তু মা….”
“চুপ থাক তুই। খুব বড় হয়ে গেছিস তাইনা? এই কয়দিন আগেও তো আমি সাজিয়ে, চুল বেঁধে দিতাম। এখন এতোটাই বড় হয়ে গেছিস যে মায়ের কাছে আসার প্রয়োজন মনে করিস না।”
প্রিয়তার চোখে পানি টলমল করে ওঠে। মায়ের উপর জমা হওয়া সব অভিমান এক নিমিষে উধাও হয়ে যায় তার।

মার্জিয়া বেগম কি করলো তা সেই জানে শুধু। নেতিয়ে যাওয়া চুলগুলোকে চিরুনি দিয়ে কারুকার্য করে সুন্দর করে ফুলিয়ে দিলো সে। একদম যেনো উত্তাল নদীর ঢেউ।
পেখম শুধু একদৃষ্টিতে দেখেই যাচ্ছে। সে মনে মনে ঠিক করে নেয়, এখন থেকে সব অনুষ্ঠানে সে মায়ের কাছ থেকেই সাজবে।

ফুলটা সুন্দর করে খোঁপার সাথে আটকে দিয়েই মার্জিয়া বেগম প্রিয়তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়ের থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা সামনে মেলে ধরেই একটা প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায় তার মনে। কে বলেছে তার এই মেয়েটা সুন্দরী নয়? হয়তোবা তথাকথিত সুন্দরী যাকে বলে, দুধে আলতা গায়ের রঙ, সুন্দর স্বাস্থ্য এগুলো তার নেই। কিন্তু তার যে সৌন্দর্য আছে, তা যদি কেউ মনের চোখ দিয়ে দেখে সে অভিভূত হতে বাধ্য এই মেয়ের রূপে। ভূবনভোলানো এক জোড়া টানা কাজল কালো চোখ, টানা নাক, পাতলা ঠোঁট, মাথায় ঘোর অমানিশার মতো একগুচ্ছ চুল। এই মেয়ে রূপবতী নয় তো কে রূপবতী?

“বাকি সাজটা আমি নিজে হাতে করে দিবো?”
প্রিয়তা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। মায়ের শরীরের গন্ধটা আজ কতো কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। প্রিয়তার অদ্ভুত একটা শান্তি হচ্ছে মনে। তার মনে হচ্ছে এই মনোবলটাই আজকের নাচের জন্য দরকার ছিলো তার। মনে মনে হাজারটা ধন্যবাদ দেয় সে মা কে।

সাজের মধ্যে তেমন কিছুই দিলো না মার্জিয়া বেগম। এই গরমে মেয়ে সারাদিন বাইরে থাকবে। সকালে একটা নাচ আবার বিকালে আরেকটা। ভারী সাজে মেয়েটা অস্বস্তি বোধ করবে।
সেই মতোই কাজলটা টেনে দিলো সে প্রিয়তার চোখে। টানা চোখ দু’টো তাতে আরো টানা লাগে। অতিরিক্ত ঘামের জন্য মুখে হালকা পাওডারের ছোঁয়া।
এতোটুকুই যেনো যথেষ্ট ছিলো প্রিয়তার সৌন্দর্য একরাশ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। মার্জিয়া বেগম মুগ্ধ হয়ে মেয়ের দিক্র তাকায়। সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নেয়। বাবা মায়ের নজর সন্তানের বেশি লাগে, সেই ভয়ে।

পেখম যন্ত্রের মতো প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা রে, আয়নার সামনে একবার আয়।”
প্রিয়তার ভীষণ লজ্জা করে হঠাৎ। পেখম তার হাত ধরে টেনে এনে আয়নার সামনে দাঁড় করায়।
সেদিকে এক নজর পড়তেই মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে যায় সে। সামান্য সাজে এতো অপূর্ব লাগে তাকে? এটা কি সত্যিই সে? নাকি ঝিলে থাকা একটা সদ্য ফোঁটা পদ্ম?
পেখম দুই হাত ভর্তি লাল চুড়ি পরিয়ে দেয় আপার হাতে। চুড়ির রুনঝুন শব্দে মুখর হয়ে ওঠে ওর ছোট্ট ঘরটা।

প্রিয়তা আস্তে করে হেঁটে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। মার্জিয়া বেগম আড়ালে চোখের পানি মোছে। কি স্নিগ্ধ, কি মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে তার। এটা যে তার সেই ছোট্ট মেয়েটা ভাবতেই অবাক লাগছে।
“মা।”
“বল শুনছি।”
“একটা অনুরোধ করবো মা, রাখবে তুমি?”
মার্জিয়া বেগম পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মেয়ের দিকে তাকায়। এমন আকুতি ভরা চোখে মেয়ে যা চাইবে সে তো তা উজাড় করে দিতে পারে। তার এই দূর্বলতা কি মেয়ে কোনোভাবে বুঝে ফেলেছে।
“কি বলবি বল।”
প্রিয়তা কিছুক্ষণ থেমে মাথা নিচু করে বললো,”তোমাকে ভয়ে বলতে পারিনি মা। হঠাৎ করে আমার পা’টা সেদিন মচকে গিয়েছিলো। ভীষণ যন্ত্রণা হয়েছিলো জানো? আমি তা সত্ত্বেও নাচের রিহার্সাল চালিয়ে গিয়েছি। হয়তো কলেজের গন্ডি পেরোনোর পর তুমি আমাকে আর নাচতে দিবে না। হতে পারে এটাই আমার জীবনের শেষ মঞ্চ নাচ। তাই আমি মন প্রাণ ঢেলে নাচটা শিখেছি। সবাই বলছে এবার আমার নাচেই সবাই মুগ্ধ হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম, তোমার মেয়েটার নাচ দেখতে যাবে তুমি আজ?”
মার্জিয়া বেগম ছলছল চোখে মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়ে স্কুলে থাকতে একবার নাচের পর এক বখাটে ছেলে শিষ দিয়েছিলো তাকে দেখে। তখন থেকেই মার্জিয়া বেগমের মাথায় আগুন ধরে যায়। প্রিয়তাকে নিষেধ করে নাচতে। কিন্তু জেদী মেয়েটা নিজের শখকে বিসর্জন দিতে চায়না। সেই রাগে মার্জিয়া বেগমও আর মেয়ের নাচ দেখতে যায়নি তারপর থেকে।

পেখম এসেও মায়ের এক হাত ধরে।
“ওমা চলো না, বাবাও যাবে।”
মার্জিয়া বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”বাবা গেলে মা কে আর দরকার কি? তোমরা তো বাবা পেয়ারী কন্যা। বাবা যাচ্ছে তাতেই হবে।”
প্রিয়তা হঠাৎ এসে মায়ের হাত চেপে ধরে বললো,”আমার যে দুইজনকেই চাই মা।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে সারাজীবন মেয়েদের সামনে নিজের রুদ্রমূর্তি দেখাতে চেয়েছে। যাতে করে মেয়েরা তাকে ভয় পায়। তাদের বাবা তো শাসন করবে না। তার ধারণা যে কোনো একজন কঠিন না হলে মেয়েরা বিগড়ে যাবে।
কিছুটা ইতস্তত করে মার্জিয়া বেগম অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”তোমাদের বাবা যে রাতে পান্তা-ইলিশ খেতে চেয়েছে। আমি বাড়িতে না থাকলে সেসবের যোগাড় করবে কে?”
প্রিয়তা মুখ টিপে হেসে বললো,”সে আমরা বাড়ি ফিরে তোমার হাতে হাতে সব করে দিবো মা।”
মার্জিয়া বেগম ঠোঁট উলটে বললো,”কি যে সাহায্য করবে তোমরা আমার জানা আছে।”
পেখম চিৎকার করে বললো,”তার মানে মা যাচ্ছে? কি মজা।”
দুই মেয়ের হইচইতে কান পাতা দায় হয়ে যায় মার্জিয়া বেগমের। আচমকা দুই মেয়েকে হাসতে দেখে কলিজাটা নাড়া দিয়ে ওঠে তার। আর ক’টা দিন পরেই ঘর অন্ধকার করে মেয়ে দু’টো চলে যাবে পরের ঘরে। আর এভাবে হৈহল্লা করবে না। সে কি শাসনের নামে একটু বেশি-ই কঠোর হয়ে গেলো তবে? এ দূরত্ব কি তবে কমবে না আর?

কলেজ গেটের সামনে অক্লান্ত পায়ে ছোটাছুটি করছে রুনা। একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার গেটের দিকে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার একদমই সময় নেই। শুরুতেই প্রিয়তার নাচ। আর এখনো পৌঁছাতে পারলো না ও? উত্তেজনায় ঘামতে থাকে সে।

গেট দিয়ে ঢোকার মুখেও ইতিউতি তাকাতে থাকে প্রিয়তা বারবার। তার মন বলছিলো উচ্ছ্বাস ভাই আসবে আজকে। সে যতো কঠিন মানবই হোক না কেনো, তার অনুরোধ সে ফেলতে পারবে না। কিন্তু না, কোথাও সে নেই। তার মনের কোনো এক কোণায় সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিলো, মানুষটা আসবেই।
পেখম আপার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে বললো,”কাউকে খুঁজছিস আপা?”
প্রিয়তা ম্লান হেসে পেখমের দিকে তাকায়। খুব কষ্ট হতে থাকে তার।

কবির শাহ আর মার্জিয়া বেগম পাশাপাশি বসেছে। নিতান্তই সাদামাটা, সাধারণ একরঙা একটা শাড়ি পরে এসেছে মার্জিয়া বেগম। তাতেই যেনো অসামান্য সুন্দর লাগছে তাকে কবির শাহের দিকে। সে বার বার আড়চোখে বউকে দেখছে।
ঘটনা বুঝতে পেরে মার্জিয়া বেগম চাপা গলায় বললো,”বুড়ো বয়সে হচ্ছেটা কি এসব? চারপাশে হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়ে। দেখে নিলে মান ইজ্জত থাকবে কিছু?”
কবির শাহ এক গাল হেসে বললো,”অন্যের বউকে দেখলে মান সম্মান থাকতো না হয়তো। বোঝোই তো শিক্ষক মানুষ আমি।”
“আচ্ছা তাই নাকি? শিক্ষক না হলে বুঝি দেখতে অন্যের বউকে?”
“ভেবে দেখতে দোষ কি?”
মার্জিয়া বেগম চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাতেই শব্দ করে হেসে দেয় কবির শাহ।
“একটা কথা বলবো মার্জিয়া?”
“বলো।”
“অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোমাকে আজ।”
মার্জিয়া বেগম লাজুক গলায় বললো,”বুড়ো বয়সে ভীমরতি শুরু হয়েছে।”
কবির শাহ উত্তর না দিয়ে হাতের মুঠোটা এগিয়ে দেয় মার্জিয়া বেগমের দিকে।
মার্জিয়া জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
“এটা খুলো, এর মধ্যে যা আছে তোমার।”
“কি আছে এতে?”
“খুলেই দেখো।”
খুশিতে চোখের কোণে পানি চিকচিক করে ওঠে মার্জিয়া বেগমের। মানুষটা তার জন্য বেলী ফুলের মালা এনেছে? তার যে বেলী ফুলের মালা পছন্দ মনে আছে তার?
“খোঁপায় পরো, আরো সুন্দর লাগবে তোমাকে।”
মার্জিয়া বেগম গাঢ় গলায় বললো,”পাগল হয়েছো তুমি? মানুষ কি বলবে? এসব কম বয়সী ছেলেমেয়েগুলোর অনুষ্ঠানে এক মাঝবয়েসী মহিলা খোঁপায় ফুল লাগিয়ে ঘুরছে।”
“মানুষের কথা দিয়ে কি এসে যায় মার্জিয়া? তুমি চাইলে আমি পরিয়ে দিতে পারি তোমার খোঁপায়।”
লজ্জায় লাল হয়ে যায় মার্জিয়া বেগম।
“অনেক হয়েছে, এবার থামো। হয়েছে কি তোমার আজ?”
কবির শাহ হাসি হাসি মুখে মালাটা এগিয়ে দেয়। দোমনা করে আশেপাশে তাকিয়ে মালাটা হাতে তুলে নেয় মার্জিয়া। বার বার সতর্ক হয় কেউ দেখে নিয়েছে কিনা। বিশেষ করে মেয়ে দু’টোর চোখে পড়লে শেষ! কি লজ্জা কি লজ্জা।
ঠিক এমন সময় মঞ্চে কে যেনো গেয়ে উঠলো,

প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে– বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও।

ভুলিব ভাবনা, পিছনে চাব না,– পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥

প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল, হৃদয় দুলিল, দুলিল দুলিল–

পাগল হে নাবিক, ভুলাও দিগ্‌বিদিক,– পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥

মার্জিয়া বেগমের হঠাৎ করে নিজেকে পৃথিবীর সবেচেয়ে সুখী মানুষটা মনে হতে থাকে। কে বলেছে সে ধনী নয়? যে নারীর কাছে তার স্বামীর এমন নি:স্বার্থ এক মহাকাশ পরিমাণ ভালোবাসা আছে, সে যে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী নারী। আর কি চাই? এইতো জীবন, এইতো জীবনের সৌন্দর্য। মাথা নিচু করে বসে থাকে মার্জিয়া। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। কবির শাহ শক্ত করে স্ত্রীর বাম হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে।

প্রিয়তার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে মঞ্চের দিকে এগোচ্ছে সে। তার চোখ দু’টো এখনো দর্শক সারির দিকে। এতো মানুষের ভীড়ে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না ওই চোখজোড়া। যে চোখজোড়া মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখলে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী হতে পারতো। তবে কি সে একটু বেশি চেয়ে ফেলেছে মানুষটার কাছে? বড় অন্যায় হয়ে গেছে। ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যায় প্রিয়তার।

দর্শক সারির সবাই তাকিয়ে দেখছে এক সুদর্শন যুবককে। কেউ অবাক হয়ে আবার কেউ বিরক্ত হয়ে। ভীড় ঠেলে হন্তদন্ত হয়ে যুবকটা সামনের দিকে যাচ্ছে। তার চোখমুখ অশান্ত হয়ে আছে।
“আরে কে আপনি? এভাবে ঠেলাঠেলি করছেন কেনো?”
উচ্ছ্বাস ফিরে তাকায় না। তার গন্তব্য সামনের দিকে। একদম সামনের সারিতে পৌঁছাতে হবে তাকে। জায়গা না পেলেও দাঁড়িয়ে থাকবে, তবুও সামনেই যেতে হবে তার। এক শ্যামবর্ণা ক্লিওপেট্রা তাকে অনুরোধ করেছে যে। পছন্দের কোনো মায়াবতীর অনুরোধ উপেক্ষা করার মতো ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা যে কোনো যুবককে দেননি। উচ্ছ্বাস কীভাবে প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যাবে?

তার হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ। সে জানেনা এগুলো সে কেনো কিনেছে। তার মা গোলাপ পছন্দ করতো খুব। পহেলা বৈশাখের দিনগুলোতে উচ্ছ্বাস তার মা কে একশো একটা তাজা গোলাপ দিতো। মায়ের মুখটা সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে যেতো। উচ্ছ্বাস প্রতিবারের মতো এবারও কিনেছে। এতোগুলো যোগাড় করতে দেরি হয়ে যাওয়ায় এভাবে ছুটছে সে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না নিজের এসব পাগলামির মানে। তার মা তো আর নেই। সে কাকে দিবে এগুলো?

নাচ শুরুর কয়েক সেকেন্ড আগে প্রিয়তার পা দু’টো হঠাৎ অনড় হয়ে যায়। এতো মানুষের মধ্যে যেনো আচমকাই এক জোড়া চোখে চোখে আটকে গেছে তার। যেই চোখজোড়ার গভীরতায় সে বারবার খেই হারিয়ে ফেলে। ঠোঁটজোড়া কাঁপতে থাকে তার তিরতির করে।
টকটকে লাল পাঞ্জাবিতে অত্যন্ত সুদর্শন সেই যুবকটার হাতে একগুচ্ছ গোলাপ। প্রিয়তার মাথা নষ্ট হওয়ার জন্য বোধহয় এটুকু যথেষ্ট ছিলো।

সামনে দাঁড়িয়ে দম ফেলে উচ্ছ্বাস। তার চোখ দু’টো মঞ্চে আটকে গেছে। কি একটা অপরূপা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে চাইলেও চোখ দু’টো সরাতে পারছেনা।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে উচ্ছ্বাসের দেহজুড়ে। অসহ্য সুখময় ব্যথা হচ্ছে ঠিক বুকের বাঁ পাশটায়। সে জানেনা এই অনুভূতির উৎস। কবিগুরু বুঝি এমন হৃদয়ের অধিকারীদের কথা চিন্তা করে লিখেছিলো,’চোখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা।’

শাড়িটায় এভাবে মেয়েটাকে মানিয়ে যাবে উচ্ছ্বাস ভাবতে পারেনি। সামান্য সাজে অষ্টাদশী তরুণীটিকে অসামান্য লাগছে। আর কোনো কিছুই তাকে আকর্ষিত করতে পারছে না।
উচ্ছ্বাস নিজের উপর জিদ করে গোলাপগুলো জোরে চেপে ধরে হাতের সাথে। হঠাৎ কাঁটাগুলো বিঁধে যায় তার মুঠোর মধ্যে। কাঁটাগুলোর আঘাতে জর্জরিত হয়ে ওঠে মুঠো তার। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে সে। ঠিক তখনই একটা প্রজাপতি মঞ্চে হাওয়ায় দুলে নাচছে।

সেখান থেকে ভেসে আসছে ‘ নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায় সম্বৃত অম্বর, হে গম্ভীর।’
চোখ তুলে সেদিকে তাকাতেই মোহনীয় তালে মুগ্ধ হয়ে যায় উচ্ছ্বাস। ঘোর লাগা চোখে একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে সে। দুই/এক ফোঁটা র ক্ত টপটপ করে হাত থেকে নিচে পড়ছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার।

(চলবে…..)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-০৯

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ৯

দূর থেকে উচ্ছ্বাসকে একদৃষ্টিতে দেখতে থাকে প্রিয়তা। সে ভালো করেই জানে এখন উনাকে কোথায় পাওয়া যাবে। সে এটাও জানে, এখানে আসায় তাকে কতোগুলো কথা শুনতে হবে উচ্ছ্বাসের কাছ থেকে। মা জানতে পারলে তো কথাই নেই। কিন্তু এতোটা সাহস কে আজ কীভাবে সঞ্চয় করেছে সে নিজেও জানেনা। সেই তাকে বিরক্ত করার জন্য খারাপ ছেলেগুলোকে মারার পর থেকে উচ্ছ্বাসের উপর তার মায়া বহুগুণে বেড়ে গেছে। যদিও অভিমান হয়েছে, বারবার সরে এসেছে সে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে। কিন্তু আজ তার মনে হয়েছে এই এলোমেলো, উড়নচণ্ডী মানুষটার ভিতরটা একদম অন্যরকম। আজ সকালে শাড়ি নিয়ে মন খারাপ করায়, ঠিক সে শাড়ি এনে রেখেছে তার জন্য। সে কীভাবে বুঝলো এই শাড়িটা আর এতো পছন্দ হবে?

প্রিয়তা পা টিপে টিপে উচ্ছ্বাসের পিছনে যেয়ে দাঁড়াতেই উচ্ছ্বাস পিছনে না ঘুরেই বললো,”আমি জানি তুমি এখানে কেনো এসেছো।”
প্রিয়তা কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এই মানুষটার অদ্ভুত একটা স্বভাব আছে। পিছন না ঘুরেই বুঝতে পারে কে দাঁড়িয়ে তার পিছে।
প্রিয়তা ধীর গলায় বললো,”কি জানেন আপনি?”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়। সে আজ ইচ্ছা করেই সিগারেট ধয়ায়নি। তবে কি তার মন বলছিলো প্রিয়তা আসবে? মেয়েটা সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না সে বুঝতে পেরেছে। মনের অজান্তেই কি সে মেয়েটার অসুবিধার কথা ভেবে নিজের কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সিগারেট না ধরিয়ে বসে ছিলো? নিজের এমন আচরণে উচ্ছ্বাস কিছুটা বিরক্ত হয়।

“তুমি আমাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছো শাড়িটার জন্য। আর এটাও বলতে এসেছো যে শাড়িটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
প্রিয়তা কি মনে করে ফিক করে হেসে দেয়। উচ্ছ্বাসের বুকে একটা ছোট্ট ধাক্কা লাগে। নিজেকে সামলাতে সে অন্য দিকে তাকায়।
“আপনি জ্যোতিষী হলে খুব ভালো হতো। আচ্ছা আমাকে দেখে আর কি কি বুঝতে পারেন আপনি? আমার চোখ দেখে কিছুই বুঝতে পারেননা?”
উচ্ছ্বাস স্মিত হেসে বললো,”আমি জ্যোতিষীও নই, চোখের ডাক্তারও নই। তোমার চোখে সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে যাও। ভারী ফ্রেমের চশমায় একদম হাইস্কুলের বয়স্ক ম্যাডামগুলোর মতো লাগবে তোমাকে।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নাহ, এই লোক শোধরাবার নয়। সে নিজেকে কিছুটা সংযত করে। এসেছে ভালো মন নিয়ে, কোনোভাবেই একটা ভাঙা মন নিয়ে ঘরে যেতে চায়না সে।
“শোনো মেয়ে, আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদ যদি দিতেই হতো তবে একজনকে দিতে পারতে। তবে আফসোস সে আর নেই।”
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসের কথা কিছু বুঝতে পারে না। শাড়ি এনে দিয়েছে উচ্ছ্বাস, আরেকজনকে কেনো ধন্যবাদ দিবে সে?
“কার কথা বলছেন?”
“এই শাড়িটা যার।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”এই শাড়িটা নতুন নয়?”
উচ্ছ্বাস গম্ভীর গলায় বললো,”কেনো নতুন না হলে পরবে না বুঝি? সেইটা তোমার ব্যাপার অবশ্য।”
“আমি তা বলিনি। কিন্তু শাড়িটা আসলে কার? আর সে নেই মানে? কোথায় গেছে সে?”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার নীরবতায় অস্বস্তি লাগে প্রিয়তার।
“কি হলো চুপ করে আছেন যে? উত্তরটা দিলেন না আমার?”
উচ্ছ্বাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”শাড়িটা আমার মায়ের।”
প্রিয়তা চমকে ওঠে হঠাৎ। উচ্ছ্বাসের মা কে সে দেখেছে অনেক ছোট থাকতে। ভালো করে মনেও নেই মুখের আদলটা। শুধু মনে আছে ভীষণ মিষ্টি একজন মানুষ ছিলেন। ছোটখাটো, গোলগাল আর খুব ফর্সা একজন ভদ্রমহিলা। ভিন্ন শহরে থাকায় সেভাবে আর দেখা হয়নি উনার সাথে। সে শুনেছে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে উনি আর উনার স্বামী। খুব কষ্ট পেয়েছিলো প্রিয়তা খবরটা শুনে।
“আপনার মায়ের শাড়ি?”
উচ্ছ্বাস আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
প্রিয়তা বুঝতে পারে উচ্ছ্বাসের মন ভার হয়ে আসছে।
সে পরিস্থিতি সামলাতে হেসে বললো,”এতো সুন্দর শাড়ি, বেশ রুচি ছিলো তো উনার। আমি একদমই বুঝতে পারিনি এটা পুরোনো। আমি ভেবেছি নতুন।”
উচ্ছ্বাস থমথমে মুখে প্রিয়তার দিকে তাকাতেই ও থেমে যায়।
“এই শাড়িটা প্রায় সাত বছর আগের। আমার মায়ের খুব প্রিয় ছিলো এটা। মা সবসময় এটা পরতো না। শুধুমাত্র বছরে একদিন পরতো, পহেলা বৈশাখে।”
প্রিয়তা বিস্মিত হয়ে বললো,”বাহ, উনি খুব রুচিশীল ছিলেন বোঝাই যাচ্ছে।”
উচ্ছ্বাস ছাদের একদম কিনারায় যেয়ে দাঁড়ায়। সেখান থেকেই খোলা গলায় বললো,”আমার মা বিয়ের আগে নাচতে ভালোবাসতো। ঠিক তোমার মতো। রবীন্দ্র সঙ্গীতেই বেশি নাচতো মা। অনেক পুরস্কারও ছিলো মায়ের। আমি বড় হয়ে দেখেছি।”
“বিয়ের আগে বলছেন কেনো? বিয়ের পর কি নাচ ছেড়ে দিয়েছিলেন উনি?”
“নিজে থেকে ছাড়েনি, ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আমার বাবা সৎ মায়ের ঘরে বড় হয়েছে। তার আপন মা, বাবা ছোট থাকতেই মারা যায়। যদিও আমার বাবা তার ওই মা কেই অনেক ভালোবাসতো। মায়ের বিয়ের পর বাবার ওই সৎমা মাকে নাচ ছাড়াতে বাধ্য করে। বাবা সামান্য প্রতিবাদ করেছিলো, কিন্তু মায়ের উপর কথা বলতে কোনোদিনই সে পার‍তো না। তার কয়েক বছর পরই আমার দাদী মারা যান। বাবা তখন মা কে আবারও নাচ চালিয়ে যেতে বলে। কিন্তু ততদিনে মা পুরোদস্তুর গৃহিণী। আমিও এসেছি মায়ের কোলে তখন। মা আর নাচতে চাননি। তবে আমি জানি, মায়ের মনে তখন অভিমানের স্তূপ জমা হয়েছে। সেই অভিমান থেকেই মা তার প্রিয় শখকে জলাঞ্জলী দিয়েছে। তবে শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখের দিনটায় মা হারিয়ে যেতো তার ফেলে আসা দিনগুলোয়। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে ঘরের মধ্যেই সেদিন নাচতো মা। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম মায়ের নাচ। সাত বছর আগে বাবা মায়ের জন্য এই শাড়িটা কিনে এনেছিলো। বয়স হয়ে যাওয়ায় আগের মতো আর নাচতো না মা। তবুও শাড়িটা এতোটাই পছন্দ হয়েছিলো যে প্রতি পহেলা বৈশাখে সে শাড়িটা পরতো। আবার সুন্দর করে ভাঁজ করে রেখে দিতো নতুনের মতো। বাড়ি ছাড়ার আগে স্মৃতি বলতে এই শাড়িটাই আমি সাথে এনেছিলাম। এখনো যে শাড়িটায় আমার মায়ের গায়ের গন্ধ লেগে আছে।”
উচ্ছ্বাস থামে। তার গলায় স্পষ্ট কান্না। প্রিয়তা হতবাক হয়ে দেখে এই কঠিন মানুষটার চোখ দিয়ে এভাবে দরদর করে পানি পড়ছে। প্রিয়তার নিজের চোখও ভিজে ওঠে। মানুষটার জন্য অদ্ভুত একটা মায়া টের পাচ্ছে সে ভিতরে। কি নাম এই মায়ার? কি অর্থ এই অনুভূতির?

“অনুমতি না নিয়েই আজ আমি রিহার্সাল রুমে লুকিয়ে তোমার নাচ দেখেছি। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি তোমার নাচ দেখে। সেই তাল, সেই মুদ্রা।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।
উচ্ছ্বাস চোখ মুছে প্রিয়তার দিকে তাকায়। হালকা হেসে বললো,”তোমার কি খুব অসুবিধা হবে পুরোনো শাড়ি পরে অনুষ্ঠানে নাচতে?”
প্রিয়তা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। সেই পরিচিত বাউন্ডুলে ছেলেটা কোথায় আজ? কে বলবে এই মায়াভরা মুখটা ওই ছন্নছাড়া যুবকটার, যে কথায় কথায় তাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে। আচ্ছা, মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ হয়না কেনো? যদি হতো তবে সে নিশ্চিত, সেই শব্দটা শুধু এই মানুষটার জন্যই হতো।
প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো,”আমি এই শাড়িটাই পরবো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”এখানে আবার শর্তের কি আছে?”
“আছে, আগে বলুন রাখবেন।”
উচ্ছ্বাস চোখমুখ কুঁচকে দাঁড়ায়। এই অষ্টাদশী কিশোরী গুলো ভীষণ ভয়ংকর হয়। এরা ঢংঢাং করে ঢেঁকি গেলানোর মতো কাজ করিয়ে নিতে চেষ্টা করে।
“কি শর্ত?”
প্রিয়তা লাজুক মুখে হেসে বললো,”অনুষ্ঠানে আপনাকে যেতে হবে। একদম প্রথম সারিতে বসে আমার নাচ দেখতে হবে। তবেই শাড়িটা পরবো আমি।”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে দেয়। প্রিয়তা মুগ্ধ হয়ে দেখে। একজন পুরুষের হাসি এতো সুন্দর হবে কেনো? তার হিংসা হচ্ছে খুব।
“হাসছেন যে?”
“না ভাবছি, যদি দেখো আমি অনুষ্ঠানে যাইনি। তবে কি শাড়িটা ওখানেই খুলে ফেলবে?”
প্রিয়তার কান লাল হয়ে যায় লজ্জায়। কি অসভ্য লোকটা। কথা বলাই ভুল হয়েছে এই বাজে লোকটার সাথে।

“আমি আসছি।”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না। তার সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। না না, ঠিক সিগারেট না। তার অদ্ভুত একটা তৃষ্ণা লাগছে কি হতে পারে সেটা? তবে কি তার অবচেতন মন চাচ্ছে এই মায়াবতীটা আর কিছুক্ষণ, না না আরো অনেকক্ষণ তার সামনে থাকুক? সে কেনো চাচ্ছে এমনটা? তার জীবন তো অনিশ্চিত এখন। সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এই ভবঘুরে অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গী সে কাউকে বানাবে না। আচ্ছা, মনের উপর কি এতো জুলুম চলে? মন, সে তো এক আজব কারখানা। সে না মানবে কারো বারণ না কোনো বাঁধা। শুধু অঝোর অনুভূতিতে প্লাবিত করবে।
উচ্ছ্বাস যন্ত্রের মতো মাথা নাড়ে। বোকা মেয়েটা ভেবেছে অসামান্য মানবীর চোখের ভাষা সে বুঝতে পারেনি। ভুল, সে ভুল।

প্রিয়তা যেতে যেতে আবার পিছন ঘুরে তাকায়। উচ্ছ্বাস এখনো ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কি অদ্ভুত, উনি এমন করছেন কেনো আজ? প্রিয়তার বুকটা কষ্টে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে কেনো মুখটা দেখে।

গুমোট গরম ছিলো আজ দুপুরের পর থেকে। সন্ধ্যার পর পশ্চিম আকাশে সাদা মেঘ জমেছে। উচ্ছ্বাসের মা সবসময় বলতো, ‘সাদা মেঘে বেশ বৃষ্টি হবে, খিচুড়ি খাবি নাকি বাবা?’
উচ্ছ্বাস ঠিক করে আজ সে বৃষ্টিতে ভিজবে। যতো রাতেই বৃষ্টি শুরু হোক না কেনো সে ছাদে বসে অপেক্ষা করবে। মাত্র তো কিছুদিন। এরপরেই হয়তো তাকে জেলখানার চার দেওয়ালে বন্দী হতে হবে। হয়তো ফাঁ সি হয়ে যাবে তার। জীবনের শেষ ক’টা দিন সে ইচ্ছা মতো জীবনটাকে উপভোগ করবে নিজের মতো করে, যা ইচ্ছা করবে।
মুখটা বিষিয়ে ওঠে তার। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায় সে। আজ পুরো প্যাকেট একসাথে শেষ করবে সে। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে, ছাদেই শুয়ে পড়বে। ইচ্ছা হলে চিৎকার করে কাঁদবে কিংবা হাসবে। মন আজ যা যা চায় সে করবে। সময় তো নেই আর বেশি।

“ঘুমিয়ে পড়েছিস মা?”
বাবার ডাক শুনে প্রিয়তা উঠে বসে। মাত্রই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসটা নিয়ে বসেছে। বইটা আজ রুনার কাছ থেকে ধার নিয়ে এসেছে। উপন্যাস পড়ার সময় ধ্যানজ্ঞান সব সেদিকেই থাকে প্রিয়তার।
বইটা বালিশের নিচে ঠেলে দিয়ে প্রিয়তা শব্দ করে বললো,”না না বাবা, তুমি এসো তো।”
কবির শাহ এক গাল হেসে ঘরে ঢোকে। ছোট্ট একটা লাইট জ্বলছে প্রিয়তার মাথার কাছে। কবির শাহ হাসে, সে বুঝতে পারে মেয়ে নির্ঘাত গল্পের বই পড়ছিলো।

“বিরক্ত করলাম নাকি তোকে?”
প্রিয়তা স্মিত হেসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে।
“বাবা তুমি আমার ঘরে আসায় যদি সেইটা বিরক্ত হয়, তবে আমি সারাজীবন এমন বিরক্ত হতে চাই।”
কবির শাহ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মেয়েটা সবসময় এতো মায়া করে কথা বলে যে কবির শাহের চোখে পানি এসে যায়।
“কি বই পড়ছিলি?”
প্রিয়তা আড়ালে জিভ কামড়ায়, ধরা পড়েই গেলো বাবার কাছে।
আস্তে আস্তে বইটা বাবার হাতে তুলে দেয় সে।
“বেশ বেশ, এটা আমারও ভীষণ প্রিয়। তবে সাবধানে, অল্প আলোতে বই পড়ে চোখটা নষ্ট করোনা অকালে।”
প্রিয়তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এইজন্য বাবাকে এতো ভালোবাসে সে। বাবা যেনো সবকিছু বুঝে যায় সহজে।

“তোর নাচের রিহার্সাল কেমন চলছে রে?”
প্রিয়তার মুখে যেনো আলো জ্বলে ওঠে।
“খুব ভালো হচ্ছে বাবা। একক নাচে আমি ‘হে গম্ভীর’ নাচটা করবো। সবাই অনেক প্রশংসা করছে জানো তো বাবা? সবাই বলছে এবারের অনুষ্ঠানের সেরা নাচ হবে আমারটা। ও বাবা, তুমি কিন্তু অবশ্যই আমার নাচ দেখতে যাবে।”
কবির শাহ আপন মনে হাসতে থাকে।
“বাবা হাসছো কেনো?”
কবির শাহ একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,”এই গানটার সাথে অনেক স্মৃতি মিশে আছে। তুই হয়তো জানিস না, উচ্ছ্বাসের মা নীলিমা অনেক সুন্দর নাচ করতো বিয়ের আগে। আমি আর ও একই কলেজে ছিলাম। ওর এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলাম আমি। সেবার পহেলা বৈশাখে ও ‘হে গম্ভীর’ গানে নেচেছিলো। কলেজের সবাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেই নাচ দেখে। ভেবেছিলাম নাচ দিয়েই অনেক দূরে যাবে ও। কিন্তু বিয়ের পরেই হঠাৎ নাচ আর পড়াশোনা দুইটাই বাদ দিয়ে দেয়। আমিও অন্য শহরে চলে যাই পড়াশোনার জন্য। বহু বছর আর যোগাযোগ ছিলো না আমাদের। আজ হঠাৎ এই গানটা শুনে ওর কথা খুব মনে পড়ছে।”
কবির শাহ চশমা খুলে পাঞ্জাবির কোণা দিয়ে কাঁচ মোছে।
প্রিয়তা বাবার কাঁধে হাত রেখে বললো,”সত্যি বলছো বাবা? উনিও এই গানে নাচ করেছিলেন?”
কবির শাহ মাথা নাড়ে।
“এই গানটা অনেক ভালোবাসতো ও।”
প্রিয়তার মুখ অন্ধকার দেখে কবির শাহ নিজেকে সামলে তার মাথায় হাত রাখে।
“আমি নিশ্চয়ই যাবো মা তোর নাচ দেখতে। তোর মা কেও নিয়ে যাবো জোর করে।”
প্রিয়তা মৃদু হাসে।
“কাল তোর রিহার্সালের পর তোকে নিয়ে একটু বেরোবো।”
প্রিয়তা কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”কোথায় যাবো বাবা?”
“তোরা তো জানিস আমার পছন্দ অতোটা ভালো না। তাই নিজে থেকে শাড়িটা কিনতে পারলাম না। তুই আমার সাথে যাবি, নিজের পছন্দ মতো একটা শাড়ি কিনবি।”
প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে। সে কি বাবাকে জানাবে উচ্ছ্বাস ভাই তাকে শাড়ি দিয়েছে, তাও আবার তার মায়ের? যদিও বাবা তার বন্ধুর মতো। তবুও কোথায় যেনো একটা বাঁধা কাজ করে।
“বাবা আমার শাড়ি লাগবে না।”
কবির শাহ হেসে মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললো,”রাগ করেছিস মায়ের উপর? রাগ করিস না মা আমার। তোর মা আসলে খুব ভালো একজন মানুষ। হয়তো তোদের একটু বকাবকি করে, রাগারাগি করে কিন্তু বিশ্বাস কর তার মতো খাঁটি মানুষ এ দুনিয়ায় খুব কম আছে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়। মা এই মানুষটাকে কতো কষ্ট দেয়। সবসময় খোঁটা দেয় কিছু দিতে না পারার জন্য। আর বাবা কিনা তারই এতো গুণগান করছে? তার বাবা আসলে এই পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধতম একজন মানুষ।
প্রিয়তা বাবার বুকে মাথা রেখে চাপা গলায় বললো,”বাবা তুমি মায়ের সব ভুলগুলো ক্ষমা করে দাও। আচ্ছা বাবা, আমিও যদি কখনো কোনো অন্যায় করে ফেলি তুমি ক্ষমা করে দিবে?”
কবির শাহ মেয়ের কথা শুনে চমকে যায়, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করেনা।
“তুই কখনো ভুল করতে পারবি না, কেনো জানিস?”
“কেনো বাবা?”
“কারণ তুই বুঝতেই পারছিস ওটা ভুল। কেউ যদি জানে যে সে ভুল করতে যাচ্ছে, সে শেষমেশ ভুলটা করতে পারেনা। ভুল তারাই করে যারা জানেনা সে ভুল করতে যাচ্ছে।”
প্রিয়তার বুকটা কেঁপে ওঠে বাবার কথা শুনে। ভীষণ কান্না পায়।
“এরপরেও যদি তুই কোনো ভুল করে থাকিস আমি তোকে ক্ষমা করে দিবো। আমি যে একজন বাবা। সন্তান ভুল করলে বাবারা অভিমান করে হয়তো, কিন্তু রাগ করে থাকতে পারে না।”
কবির শাহ টের পায় তার বুকের কাছ থেকে পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে। তার মানে তার মেয়েটা কাঁদছে? ঈষৎ কেঁপে ওঠে সে। কি এমন কষ্ট মেয়েটার? সে বাবা হয়ে জানতে পারেনি এখনো মেয়েটার মনের অবস্থা? সে কি জিজ্ঞেস করবে মেয়েকে? কিন্তু মেয়ে জীবনের এমন একটা পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে চাইলেও তার অনুভূতির প্রাচীর ভেদ করে ভিতরে ঢুকতে পারবে না, যতক্ষণ না মেয়ে নিজে চায়। এই বয়সটা ভুল করার বয়স। এই বয়সে মেয়েদের মনের হঠাৎ পরিবর্তন আসে। তারা কারণ ছাড়াই হাসে আবার কারণ ছাড়াই কাঁদে। মেয়ে কি সত্যিই কোনো ভুল করে ফেললো?
“আচ্ছা বাবা।”
“হ্যা মা বল।”
“কেনো হঠাৎ বড় হয়ে গেলাম বলো তো? সেই যে ছোটবেলায় তোমার কাঁধে চড়ে স্কুলে যেতাম, সেইদিন গুলো এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো কেনো?”
কবির শাহ মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”সে তুই এখনো আমার কাঁধে চড়তে পারবি। যে হাওয়াই মিঠাই এর মতো শরীর তোর। সেই তুলনায় আমি শক্ত আছি।”
প্রিয়তা কপট রাগ করে বললো,”ভালো হবে না কিন্তু বাবা।”
কবির শাহ শব্দ করে হাসতে থাকে, প্রিয়তাও কিছুক্ষণ রাগ করে থেকে খিলখিল করে হেসে দেয়। দূর থেকে বাবা-মেয়ের হাসাহাসির শব্দ শোনা যায়। কিছুক্ষণ আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। এবার গ্রীষ্মের আগেই চৈত্রে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে রাতের দিকে। তুমুল বৃষ্টির শব্দের সাথে এক অষ্টাদশী কিশোরীর হাসির শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ঠিক এমন সময় এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে এক ভগ্ন হৃদয়ের যুবক হাউমাউ করে কাঁদছে। মায়ের গায়ের গন্ধ পাওয়ার জন্য বুকটা খা খা করছে তার। বাবার সাথে বসে গল্প করার জন্য বুকটা ছটফট করছে তার। কেনো সব এমনটা হয়ে গেলো? কি এমন হতো সব ঠিক থাকলে? আচ্ছা, এটা কি কোনো দু:স্বপ্ন হতে পারে না? জেগে উঠলেই দেখবে সবটাই স্বপ্ন ছিলো, অতি জঘন্য কোনো স্বপ্ন।

গীটারটা হাতে তুলে নেয় উচ্ছ্বাস। বৃষ্টির অজস্র ফোঁটাগুলো টপটপ করে পড়তে থাকে চুল বেয়ে।
সেই অবস্থায় টুংটাং করে গীটারে সুর তোলে সে।

‘এই রুপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে
সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো
গোপন করে।
এই রুপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে
সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো
গোপন করে।

মনে রেখো তুমি
কত রাত কত দিন
শুনিয়েছি গান আমি, ক্লান্তিবিহীন
অধরে তোমার ফোঁটাতে হাসি
চলে গেছি শুধু
সুর থেকে কত সুরে।

এই রুপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে
সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো
গোপন করে।’

(চলবে…..)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-০৮

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ৮

উচ্ছ্বাস কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,”মামা আমি আসলে….”
কবির শাহ ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,”তোমার ঘরে এসো, কথা আছে।”
উচ্ছ্বাস কিছুটা ঘাবড়ে যায়। ভয় না ঠিক, কেমন অস্বস্তি হতে থাকে। কবির শাহও কি তবে মার্জিয়া বেগমের মতো ভুল বুঝবে তাকে? এ বাড়িতে থাকতে সে কখনোই চায়না। কবির শাহের জোরাজোরিতেই থাকা। যদি এখান থেকে চলে যেতেই হয়, কোনো অসম্মান নিয়ে যেনো এ বাড়ি ছাড়তে না হয়।

“দাঁড়িয়ে থেকো না, বসো আমার পাশে।”
উচ্ছ্বাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথার মধ্যে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। কবির শাহ তাকে ভুল বুঝেছে? সত্যিটা বললে বিশ্বাস করবে তো?
কবির শাহ কিছুক্ষণ থেমে আস্তে আস্তে বললো,”বাবা তুমি কি জানো তোমাকে আমি কতোটা স্নেহ করি?”
উচ্ছ্বাস মাথা তুলে তাকায় তার দিকে। এতো সুন্দর করে ‘বাবা’ তাকে দুইটা মানুষ ডাকতো। যে মানুষ দু’টো পৃথিবীতে নেই আজ। বুকটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে ওঠে তার।
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না।
“জানিনা বিশ্বাস করবে কিনা, তোমাকে আমি নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসি। প্রিয়তা, পেখমের চেয়ে আলাদা করে দেখিনা।”
উচ্ছ্বাস ধীর গলায় বললো,”জানি মামা, এজন্যই তো এভাবে পড়ে আছি এখানে।”
“এভাবে বলো না বাবা। আমি জানি প্রিয়তার মায়ের ব্যবহারে তুমি কষ্ট পাও। আমি লজ্জিত হই। তবে তুমি বিশ্বাস করো, ও আসলে এতোটা কঠোর না। ওর ভিতরটা একদম অন্যরকম। যেদিন ও তোমাকে ভালোবাসা শুরু করবে সেদিন তুমি ওর মধ্যে তোমার মাতৃছায়া দেখতে পারবে।”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে বললো,”আমি মামির ব্যবহারে কিছু মনে করিনা মামা। উনি যা করেন তা স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে যে কেউ এমনটা করবে। আর তাছাড়া আমি আমার জীবনের এমন একটা পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি, কারো ব্যবহারেই আমার আর মন খারাপ হয়না।”
কবির শাহ উঠে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাসের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”ওরা হন্যে হয়ে তোমাকে খুঁজছে। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী শুধু তুমি। ওরা টাকা দিয়ে কেসটা ধামাচাপা দিলেও তুমি একমাত্র আছো, যে নিজের চোখে সবটা দেখেছো। ওরা তোমাকেও শেষ করে দিতে চায়।”
উচ্ছ্বাসের মুখের শিরাগুলো শক্ত হয়ে ফুলে ওঠে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়ায়। এখনো জ্বলজ্বল করে সেই রাতটা। সেই রাতে মা গরম ভাতের সাথে বেগুন ভর্তা আর মরিচ পোড়া করেছিলো। মায়ের হাতের বেগুন ভর্তা অমৃত লাগতো উচ্ছ্বাসের। বাবার সাথে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলো ওরা। রাত তিনটার দিকে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। মা ডাকছে।
“খোকা একটু আয় তো এদিকে।”
মায়ের উৎকণ্ঠা দেখে উচ্ছ্বাস তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেয়।
“কি হয়েছে মা? এতো রাতে ডাকছো যে?”
“বাবা রে, আমার কেমন ভয় করছে। এতো রাতে তোর চাচারা এসেছে তোর বাবার কাছে। খুব ঝগড়া চলছে ওদের মধ্যে। তুই একটু যা তো বাবা।”
উচ্ছ্বাস হতবাক হয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত বাজে তিনটা দশ। এতো রাতে চাচাদের বাবার সাথে কি দরকার হতে পারে?
“আমাকে আগে ডাকবে না?”
এই বলে উচ্ছ্বাস ছুটে যায় বাইরের ঘরে। যেয়ে দেখে তার সেজো চাচা কলার করে রেখেছে তার বাবার। উচ্ছ্বাস হতভম্ব হয়ে যায় দেখে।
“কি হচ্ছে কি চাচা? আপনার এতো বড় সাহস, আপনার বড় ভাইয়ের কলারে হাত দিয়েছেন।”
“তুই চুপ কর। বাবাকে বাঁচাতে চাইলে এই দলিলে সই করে দিতে বল এক্ষুনি।”
উচ্ছ্বাস রাতে হতবিহ্বল হয়ে যায়। দৌড়ে এসে বাবাকে ছাড়াতে গেলেই বাকি দুই চাচা তাকে টেনে পিছিয়ে আনে।
“কি করছেন কি আপনারা? এসব কি হচ্ছে?”
উচ্ছ্বাসের বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”এই সম্পদ শুধুমাত্র আমার একার। আমি নিজের র ক্ত জল করে একটু একটু করে এগুলো বানিয়েছি। এগুলো আমাদের বাবার নয়। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করি তোমাদের সাহায্য করার জন্য। তাই বলে আমার এতো কষ্টের সম্পদ আমি তোমাদের দিবো না।”
উচ্ছ্বাস চাচাদের দিকে তাকিয়ে বললো,”এসব কি অন্যায় আবদার করছেন আপনারা? সম্পদের জন্য আপনার বড় ভাইয়ের গায়ে হাত দিবেন আপনারা? আর আমাকে এভাবে ধরে রেখেছেন কেনো? ছাড়ুন আমাকে, ছাড়ুন।”
তাদের মধ্যে একজন উচ্ছ্বাসের কথা পাত্তা না দিয়ে উচ্ছ্বাসের বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”ভাইজান আপনি শেষবারের মতো ভেবে বলুন। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হবে আমাদের।”
“কি ব্যবস্থা করবে তোমরা?”
হঠাৎ উচ্ছ্বাস দরজায় ছয়জনের ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। তাদের মধ্যে দুইজনের হাতে ধাতব অ স্ত্র। উচ্ছ্বাস নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। সাথে সাথে ওর মাথায় কেউ শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে। ও লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। উচ্ছ্বাসের না চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে। এক নারকীয় পরিবেশ তখন ঘরের মধ্যে। জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্তে উচ্ছ্বাস তার জীবনের সবচেয়ে নৃ শংস দৃশ্যটা দেখে।

উচ্ছ্বাস চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকে। কবির শাহ হঠাৎ ওকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়।
“বাবা ঠিক আছো তুমি?”
কবির শাহের হাতের ছোঁয়ায় ধাতস্থ হয়ে উচ্ছ্বাস। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে তার।
“মামা আমি ওদের ছাড়বো না, ছাড়বো না।”
কবির শাহ আঁৎকে উঠে বললো,”কাদের ছাড়বে না?”
“আমার সামনে যারা আমার বাবাকে, আমার মা কে শেষ করেছে আমি ওদের উচিত শাস্তি দিবো। আমি নিজে হাতে ওদের শাস্তি দিবো।”
টকটকে লাল হয়ে আছে উচ্ছ্বাসের চোখ। তার কণ্ঠ কাঁপছে রাগে, উত্তেজনায়।
“শান্ত হও বাবা। তুমি কি বলছো তুমি নিজেও জানো না।”
“আমি জানি মামা। আমি এটাও জানি আমাকে কি করতে হবে। আমি চুপ করে আছি মানে এটা নয় যে, আমি ভয় পেয়েছি। ওরা আমাকে সেদিন মারেনি। ওরা ভেবেছিলো আমি ভয় পেয়ে যাবো। তবে ওরা জানেনা ওরা সেদিন আমাকে না মেরে নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছে। আমি নিজেকে সময় দিচ্ছি। এই সময়ে আসলে আমি নিজেকে তৈরি করছি উপযুক্ত সময়ের জন্য। একেক করে আমি প্রতিশোধ নিবো, একেক করে।”
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে বললো,”উচ্ছ্বাস তোমাকে আমি আবারও বলছি মাথা ঠান্ডা করো। তুমি মেধাবী ছেলে। তোমার সামনে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এভাবে মাথা গরম করে সেইটা নষ্ট করে দিও না। আইনের উপর বিশ্বাস রাখো।”
উচ্ছ্বাস ম্লান হাসে। সেই হাসিতে একরাশ বিষাদ মাখা।
“ওদের অনেক টাকা মামা, অনেক। ওরা যেভাবেই হোক নিজেদের বাঁচাবে। আমি সেই সুযোগ ওদের দিবো না।”
“বাবা রে, জীবনটা এতো ঠুনকো নয়। জীবন আরো বড়, অনেক বড়। তোমার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি যা করতে চাচ্ছো, তা একেবারেই ভুল।”
উচ্ছ্বাস চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কবির শাহ উচ্ছ্বাসের কাঁধে হাত রেখে বললো,”ওরা এখনো জানেনা তুমি এখানে আছো। জানিনা কতোদিন তোমাকে লুকিয়ে রাখতে পারবো। সবসময় সাবধানে থাকবে।”
“অন্যায় করলো ওরা, আর লুকিয়ে থাকতে হবে আমাকে? এটাই দুনিয়ার বিচার মামা?”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। উত্তর দিতে পারে না।
“অনেক রাত হয়েছে মামা। আপনি ঘরে যান, নাহলে মামি দুশ্চিন্তা করবে।”
কবির শাহ ছোট্ট করে মাথা নাড়ে। সে উচ্ছ্বাসের মধ্যে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি দেখতে পাচ্ছে। আহত সিংহ কতোটা ভয়াবহ হতে পারে সে জানে। যে কোনো সময় ছেলেটা বিস্ফোরণ করবে। সেই দুশ্চিন্তাই তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। সে কি পারবে ছেলেটাকে রক্ষা করতে?
“ঘুমিয়ে পড়ো, রাত করোনা।”
উচ্ছ্বাস মাথা নাড়ে।
যেতে যেতে কবির শাহ আবার পিছনে ঘুরে তাকায়।
“একটা অনুরোধ করবো বাবা, রাখবে?”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে বললো,”অনুরোধ বলছেন কেনো মামা? অবশ্যই রাখবো।”
“আমার বড় মেয়েটা কুকুর ভয় পায় ভীষণ। পহেলা বৈশাখের আগের কিছুদিন ওর বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হবে আজকের মতো। জানো তো, মেয়েটা আমার দারুণ নাচে। সেই ছোটবেলা থেকে নাচতে ভালোবাসে ও। আমি ওকে সুযোগ দিয়েছি। ওর মা যদিও আপত্তি করে। আমি ভাবি, ও যদি পছন্দ করে কিছু করতে চায় ক্ষতি কি? কলেজের অনুষ্ঠানে ও নাচবে। রিহার্সাল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে এ কয়দিন। আমার আবার ওই সময় টিউশন থাকে। আমি চাইলেও ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারছি না। তুমি কি এই কয়দিন ওকে সন্ধ্যায় কলেজ থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারবে? যদি তোমার কোনো অসুবিধা না থাকে?”
উচ্ছ্বাসের ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট হাসি ফুটে ওঠে। সাথে সাথে হাসিটা মুছে বললো,”কিন্তু মামি?”
“ওকে নিয়ে ভেবো না, আমি বুঝিয়ে বলবো।”
“আমার সমস্যা নেই মামা।”
কবির শাহ স্মিত হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
উচ্ছ্বাস খাটের উপর বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার কি উচিত হবে একটা শুদ্ধতম মায়াবতীর মায়ায় জড়ানো? কখনোই না, কোনোদিন না।

সকাল সকাল মনটা ফুরফুরে হয়ে আছে প্রিয়তার। গত রাতের পর থেকে মনটা অস্বাভাবিক ভাবে ভালো হওয়া শুরু হয়েছে। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের এনে দেওয়া ওষুধ খাওয়ার পর ব্যথা বেশ কমে গেছে। ফোলাটা যদিও খুব বেশি কমেনি। তবে হাড় যে ভাঙেনি এটাই ভাগ্যের বিষয়।

“ইশ আজ এতো ভালো লাগছে কেনো? সকালটা কি অসাধারণ সুন্দর আজ, বল পেখম?”
পেখম মুখ টিপে হাসে। সে তো বুঝতে পারছে আপার কেনো এতো ভালো লাগছে।
“আপা তোকে দেখতেও আজ খুব সুন্দর লাগছে জানিস? কি ভীষণ স্নিগ্ধ যে লাগছে!”
প্রিয়তা লাজুক মুখে হাসে। তার মন বলছে সব কিছু ভালো হতে চলেছে। তার জীবনের সেরা নাচটা এবার নাচবে সে।

নাশতার টেবিলে মেয়েকে খুশি খুশি দেখে মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। আশেপাশে তাকিয়ে উচ্ছ্বাসকে খোঁজে সে। কোথাও দেখতে না পেয়ে কিছুটা স্বস্তি হয়।
“মা তোমার লাল পেড়ে সাদা জামদানী যে শাড়িটা আছে, ওটা আজ বের করে রোদে দিও মনে করে। রোদ না খাওয়ালে জামদানী শাড়িগুলো কেমন প্রাণহীন দেখতে মনে হয়।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”ওই শাড়ি দিয়ে কি করবি তুই?”
প্রিয়তা মিটমিট করে হেসে বললো,”মা তুমি তো জানোই না। এবার অনুষ্ঠানে আমি দুইটা নাচ করবো। একটা একক, আরেকটা দলীয়। দলীয় নাচে আমি আবার লিডে থাকবো। আমাকে সবচেয়ে সুন্দর ভাবে সাজতে হবে। নীলু আপা বলেছে এবার অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণই নাকি থাকবে আমার নাচ। আমাকে এতো সুন্দর করে শেখাচ্ছেন উনি। আর ওই শাড়িটাতেই আমাকে সবচেয়ে ভালো লাগে মা। পহেলা বৈশাখ বলে কথা, লাল সাদা তো পড়তেই হবে।”
প্রিয়তা এতোগুলো কথা কখনো একসাথে বলেনা। হড়বড় করে বলেই যাচ্ছ সে। কবির শাহ মনে মনে হাসে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটার মন আজ কতোটা ভালো। মেয়েটাকে প্রাণবন্ত দেখতেও ভালো লাগে। ছোট থেকেই নাচের অনুষ্ঠান গুলোর আগে এমন খুশিতে ছটফট করতো ও।
মার্জিয়া বেগম চুপ করে থাকে।
প্রিয়তা অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”ও মা শুনছো কি বলছি? আজ কলেজ থেকে এসে ওটা পরে দেখবো আবার। ভুলে যেও না কিন্তু রোদে মেলে দিতে।”
মার্জিয়া বেগম আমতা আমতা করে বললো,”তুই অন্য কোনো শাড়ি পরিস। ওটা পরা লাগবে না।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কি বলছো মা? পহেলা বৈশাখের দিন লাল সাদাই তো পরতে হয়। তোমার তো লাল সাদা আর কোনো শাড়ি নেই। ওটা পরতে কি সমস্যা?”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”ওটা তোর বড় খালা নিয়ে গেছে গতকাল। পহেলা বৈশাখে তার কোন প্রোগ্রাম আছে, ওখানে পরে যাবে।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায় খাওয়া ছেড়ে। কবির শাহ-ও দারুণ অবাক হয়।
“কি বলছো মা এসব? উনি চাইলো আর তুমি দিয়ে দিলে? উনার কি কম আছে?”
“এভাবে বলছিস কেনো তুই? শাড়িটা আপার পছন্দ হয়েছে, নিয়ে গেছে। তাছাড়া আমি জানতাম নাকি ওটা তোর লাগবে?”
প্রিয়তা কিছুটা গলা চড়িয়ে বললো,”উনি তো সারাদিন প্রচুর গল্প দেয় মা। উনার আলমারি ভর্তি এতো শাড়ি আছে যে উনি গুণেও শেষ করতে পারে না। এক শাড়ি নাকি উনি একদিনের বেশি দুইদিন পরে না। কথায় কথায় তোমাকে শোনায় তোমার ভালো কোনো শাড়ি নেই, বাবা তোমাকে কিছুই কিনে দিতে পারেনা। উনার কি এমন দরকার হলো যে, এতো গরীব বোনের পুরোনো শাড়ি পরে প্রোগ্রামে যেতে হবে? উনি নিজে একটা লাল সাদা শাড়ি কিনে নিতে পারেনি এতো বড়লোক হয়ে?”
কথা শেষ করে হাঁপাতে থাকে প্রিয়তা। মুহুর্তেই সুন্দর মনটা ভেঙে যায় তার। তার বাবার সামর্থ্য এতোটাও ভালো নয় যে, এখন একটা নতুন শাড়ি কিনে দিবে তাকে। আর বড় খালা যখন একবার নিয়েছে পহেলা বৈশাখের এক সপ্তাহ পর ছাড়া ওই শাড়ি পাওয়া যাবে না।”
মার্জিয়া বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”এ কি অসভ্যতা প্রিয়তা? উনি তোমাদের কোনোদিন কোনো সাহায্য করেনি? আজ একটা শাড়ি নিয়েছে বলে এভাবে বলবে তুমি? লজ্জা করছে না বলতে?”
রাগে দু:খে চোখে পানি চলে আসে প্রিয়তার। ইচ্ছা করছে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে। কতো আশা করেছিলো এবারের অনুষ্ঠানে সুন্দর করে সেজে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে। নাচের সাথে শাড়িটা কি যে সুন্দর লাগতো!
কবির শাহ উঠে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে।
“শান্ত হও মা আমার। আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি একদম ভেবো না।”
মার্জিয়া বেগম হালকা চিৎকার করে বললো,”দেখো আহ্লাদ দিয়ে কেমন বেয়াদব বানিয়েছো মেয়েকে। বড় খালা কতো কি করে ওদের জন্য। আর আজ সে একটা শাড়ি ধার নিয়েছে বলে কীভাবে কথা বলছে। দাও দাও আরো আহ্লাদ দাও।”
কবির শাহ মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হেসে বললো,”খাবারটা শেষ করে কলেজে বেরিয়ে যাও সোনা মা আমার। দেরি হয়ে যাবে।”
প্রিয়তা কাঁপা গলায় বললো,”আমার খিদে নেই, আমি বেরোলাম।”
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রিয়তা ছুটে চলে যায় সেখান থেকে। পেখমও কিছু না বলে আপার পিছনে চলে যায়।

কবির শাহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্ত্রীর দিকে তাকায়। মার্জিয়া বেগম এখনো রাগী চোখে তাকিয়ে আছে।
‘মার্জিয়া, আমি জানি বোনের জিনিস বোন নিবে এতে কোনো অসুবিধা নেই। প্রিয়তা যে শাড়িটা পরতে পারবে না এতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। ওটা না পরুক, অন্যটা পরবে। আমার মেয়ে যথেষ্ট মায়াবতী। ও যা পরেই নাচবে ওকে মোহনীয় লাগবে। কিন্তু কথা সেখানে নয়। তোমার বোন প্রতিনিয়ত তোমাকে খোঁটা দেয়, আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারিনা। আমার সংসারে এসে তুমি অসুখী। নতুন শাড়ি কিনেই তোমাকে দেখাতে ছুটে আসে। রসিয়ে বসিয়ে তোমাকে জানায় শাড়িটার কতো দাম, কতো সুন্দর। তোমার সারাদিন মন ভার হয়ে থাকে সেদিন। এটা যে তোমার স্বামীর জন্য কতোটা কষ্টের তুমি বোঝার চেষ্টা করোনা। আমি এটাও জানি, উনি ইচ্ছা করেই এমনটা করেন, যেনো তুমি সুখী থাকতে না পারো।”
মার্জিয়া বেগম আস্তে আস্তে বললো,”এতে আপার লাভ?”
“লাভ লোকসানের কিছু নেই। কিছু মানুষ আছে, যারা অন্যদের সুখী দেখতে পারে না। সে তার আপন মায়ের পেটের বোন হলেও না। সবসময় নিজে সুখী এটাই বোঝাতে চায়। এতেই তাদের শান্তি। তুমি কষ্ট পেয়ো না, তোমার বোন এই শ্রেনীর একজন মানুষ। উনার এতো থাকতেও উনি তোমার জিনিসটা নিতে এসেছে। এতে দোষের কিছু না, কিন্তু উনার প্রাচুর্যতা দেখে তোমার মন খারাপ হওয়াটা আমার কাছে খঞ্জরের আঘাতের চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক। একটা পুরুষ হলে বুঝতে, শখের নারীকে তার শখের জিনিসটা দিতে না পারার কি কষ্ট।”
মার্জিয়া বেগম মাথা নিচু করে বললো,”তাহলে কি আমি আপার কাছ থেকে চেয়ে আনবো শাড়িটা?”
কবির শাহ হাত ধুয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,”এতোটা ছোট তোমাকে হতে দিবো না আমি, এটা ভালো করেই জানো তুমি। মেয়েটা যখন আমার, আমি দেখি কি ব্যবস্থা করতে পারি।”
মার্জিয়া বেগম আর কিছু বলার সুযোগ পায়না। কবির শাহ বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। হতাশ মুখে মার্জিয়া বেগম তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে।
‘একটা পুরুষ হলে বুঝতে, শখের নারীকে তার শখের জিনিসটা দিতে না পারার কি কষ্ট।’ এই কথাটা আর বুকে যেয়ে লেগেছে। মনটা কেমন খচখচ করতে থাকে তার। সে কি মনের অজান্তে মানুষটাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে? কিন্তু তার কি দোষ? সে যখন দেখে, তার আপন বোনের আলমারি ভর্তি দামী শাড়ির বাহার, কোনোটার দামই পাঁচ/ছয় হাজারের কমে না, তখন সে না চাইতেও কষ্ট পায়। সে না চাইতেও মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলে। কিন্তু তার এতো থাকতেও, গরীব বোনের শাড়িই কিনা শেষমেশ দরকার হলো? বোনের উপর এই প্রথম কিছুটা রাগ ওঠে মার্জিয়া বেগমের।

কলেজ প্রাঙ্গনে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। এখনো রিহার্সাল শেষ হয়নি মহারানীর। এদিকে সিগারেটের তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এসেছে তার। কলেজে ধূমপান নিষেধ, তাই চাইলেও সিগারেট ধরাতে পারছে না। কপালে ঘাম জমতে থাকে উচ্ছ্বাসের। রাগে, বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আসে তার।

সে যেখানে দাঁড়িয়েছে তার পাশের একটা ঘর থেকেই ঘুঙুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে এখানেই হচ্ছে নাচের রিহার্সাল। উচ্ছ্বাস প্রথমে ভাবে এখান থেকে দূরে যেয়ে দাঁড়াবে।
হঠাৎ কি মনে করে দাঁড়িয়ে যায় সে। তার মন খুব টানছে ঘরটার দিকে। এখন কি ওই মেয়েটা নাচছে? সে কি জানালা দিয়ে উঁকি দিবে? খুব বেশি অন্যায় হয়ে যাবে?
কোনোভাবেই নিজের অবাধ্য মনটাকে আটকাতে পারে না সে। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভেবে জানালায় চোখ রাখতেই চোখ দু’টো শীতল হয়ে ওঠে তার।
সাদা কামিজ, সাদা চুড়িদার আর লাল ওড়না সুন্দর করে পেঁচানো শরীরে, লম্বা কোঁকড়া চুলগুলো বেণী হয়ে ছড়িয়ে আছে পিঠে। অবাধ্য কিছু চুল ঘামে লেপ্টে কপালে, ঘাড়ে মিশে আছে। কাজলটাও মুছে গেছে অনেকটা চোখ থেকে।
সামান্য এটুকুই কি যথেষ্ট একটা বাঙালি শ্যামবর্ণা তরুণীকে বহুগুণে মোহনীয় করে তোলার জন্য? এতোটা রূপবতী কেনো লাগছে তাকে? কেনো, কেনো, কেনো?

নীল- অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্‌বৃত অম্বর হে গম্ভীর!

বনলক্ষ্মীর কম্পিত কায়, চঞ্চল অন্তর–

ঝঙ্কৃত তার ঝিল্লির মঞ্জীর হে গম্ভীর॥

বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে,

কদম্ববন গভীর মগন আনন্দঘন গন্ধে–

নন্দিত তব উৎসবমন্দির হে গম্ভীর॥

দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা,

পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের অমৃতবারির বার্তা।

মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ, দিকে দিকে হল দীর্ণ–

নব অঙ্কুর-জয়পতাকায় ধরাতল সমাকীর্ণ–

ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর হে গম্ভীর॥

প্রিয়তা নাচছে গানের তালে তালে। মুগ্ধ হয়ে সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে উচ্ছ্বাস। এই গানে একক নৃত্য হবে প্রিয়তার। উপস্থিত সবাই মুগ্ধ প্রিয়তার নাচে। গানটা বোধহয় ওকেই শুধু মানায় নাচের জন্য। উচ্ছ্বাসের ভ্রম হতে থাকে প্রিয়তার মুদ্রা তাল দেখে।

ঘরে ফিরতেই প্রিয়তা ব্যাগটা ছুড়ে বিছানায় ফেলে। পেখম চুপ করে বসে আছে পড়ার টেবিলে।
“ইশ কি ঢং, আমাকে এগিয়ে আনতে গেছে আবার। আমি কি ছোট মানুষ, একা আসতে পারিনা আমি? উনি আগে আগে হাঁটছেন, আমি দৌড়াতে পারি উনার সাথে?”
পেখম হাসি চেপে বললো,”খুব বড় হয়েছিস তাইনা? গত রাতে তো দেখলাম, কেমন বড় হয়েছিস। কুকুরের দাবড়ানি খেয়ে অবস্থা কাহিল। উচ্ছ্বাস ভাই না থাকলে তো বারোটা বেজে যেতো। মানুষটাকে একটা ধন্যবাদ দিবি, তা না। বদনাম করে যাচ্ছিস তার।”
প্রিয়তা কপট রাগ করে পেখমকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই খাটের উপর একটা ব্যাগ দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যায়।
“এতে কি আছে রে পেখম?”
পেখম ইতিউতি তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললো,”নিজের দেখ কি আছে, ওটা তোর।”
প্রিয়তা চোখমুখ কুঁচকে পেখমের দিকে একবার তাকিয়ে ব্যাগটা হাতে নেয়।
খুলতেই চোখ কপালে ওঠে প্রিয়তার। এটা কোথা থেকে এলো? এতো সুন্দর শাড়ি তার ঘরে?
সাদা জমিনের উপর লাল কল্কা আঁকা একটা তাঁতের শাড়ি। পাড়টাতেও কি সুন্দর লাল নকশা করা। এতো সুন্দর একটা শাড়ি পরলে যে কাউকে তো একদম প্রজাপতির মতো লাগবে।
প্রিয়তা শাড়িটা গায়ের উপর ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনটা শতগুণে ভালো হয়ে যায়। একদম একটা জলপরীর মতো লাগছে তাকে। যদি সত্যি শাড়িটা তার হয়ে থাকে, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তো এটাই পরে যাবে। তাকেই দেখবে সবাই নিশ্চিত।
প্রিয়তার মুখটা হাসি হাসি হয়ে ওঠে।
“বাবা কিনেছে তাইনা রে পেখম? বাবার পছন্দ তো এতো ভালো ছিলো না। মায়ের কাছে সবসময় বাবা বকা খেতো নিজে নিজে পছন্দ করে হাবিজাবি শাড়ি আনার জন্য। মা দেখলে তো অবাক হয়ে যাবে এই শাড়িটা।”
পেখম ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বললো,”বাবা কিনেনি এটা।”
প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে বললো,”তাহলে কে কিনেছে? মা?”
পেখম উঠে এসে আপার পিছনে দাঁড়ায়। পিছন থেকে প্রিয়তাকে হালকা চেপে ধরে ওর কাঁধে থুতনি দিয়ে বললো,”সেই মানুষটা কিনেছে যে তোর পছন্দ খুব ভালো করে বুঝে গেছে।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে বললো,”কার কথা বলছিস?”
পেখম আপাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে নিজের মুখটা আপার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই তোর জন্য কিনে এনেছে এটা বিকেলে।”

(চলবে……)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-০৭

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ৭

কলেজ গেটে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো রুনা। গতকাল প্রিয়তা নিয়াজ মোর্শেদের সাথে কথা বলার পর ওভাবে ছুটে চলে যাওয়ার পর থেকে খুব দুশ্চিন্তায় আছে সে। সে-ও ছুটেছিলো প্রিয়তার পিছু পিছু। কিন্তু কিছুদূর যেয়েই হারিয়ে গেলো ও ভিড়ের মধ্যে। আর খুঁজে পেলো না মেয়েটাকে। নিয়াজ মোর্শেদ কি ওর পূর্ব পরিচিত? কি কথা হয়েছিলো ওদের মধ্যে কাল? আর প্রিয়তাই বা কেনো ওভাবে ছুটে চলে গেলো? উত্তরগুলো না পাওয়া পর্যন্ত শান্তিই হচ্ছে না রুনার।
মিনিট পাঁচেক পর প্রিয়তাকে দেখেই রুনা চমকে ওঠে। এভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে কেনো ও? এক নি:শ্বাসে ছুটে ওর সামনে যেয়ে দাঁড়ায় রুনা।
“কি হয়েছে তোর?”
প্রিয়তা শুষ্ক ঠোঁটে হাসে।
রুনা চোখ বড় বড় করে বললো,”পায়ে কি হয়েছে তোর? ইশ, পা টা ফুলেও তো গেছে বেশ অনেকটা।”
প্রিয়তা চাপা গলায় বললো,”তেমন কিছু হয়নি। চল ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
“তুই এই অবস্থায় ক্লাসে কেনো এলি? আমাকে বললে তো আমি ক্লাস লেকচারগুলো তোর বাড়িতে পৌঁছে দিতাম।”
প্রিয়তা ঈষৎ হেসে বললো,”আর আমার নাচের রিহার্সালের কি হতো? ওটাও বুঝি তুই আমার বাড়িতে যেয়ে শিখিয়ে দিয়ে আসতি?”
রুনা অবাক হয়ে বললো,”তুই পায়ের এই অবস্থায় নাচের রিহার্সাল করবি?”
প্রিয়তা রুনার হাত চেপে ধরে হাঁটতে থাকে ক্লাসের দিকে। রুনা প্রিয়তার ভাবগতিক কিছুই বুঝতে পারেনা।

“হেঁয়ালি না করে দয়া করে বলবি আমাকে সবটা?”
প্রিয়তা বেঞ্চে বসে দেয়ালে হেলান দেয়। অনেকটা হেঁটে আসায় পায়ের ব্যথাটা বেশ বেড়েছে তার।
রুনার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে প্রিয়তা বললো,”কি জানতে চাচ্ছিস?”
রুনা চারদিক ভালো করে দেখে গলা নামিয়ে বললো,”তুই নিয়াজ মোর্শেদকে চিনিস?”
প্রিয়তা ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে আস্তে করে মাথা নাড়ে।
রুনা আরো অবাক হয়ে বললো,”কীভাবে চিনিস?”
প্রিয়তা ব্যাগ থেকে বইখাতা বের করতে করতে বললো,”উনি আর উনার পরিবার আমাকে দেখতে গিয়েছিলো গত পরশুদিন। এজন্যই ওদিন আমি কলেজে আসতে পারিনি।”
রুনা হতবাক হয়ে বললো,”সে কি রে? উনি তোকে দেখতে গিয়েছিলো? বিয়েটা কি হচ্ছে তোদের?”
প্রিয়তা ম্লান হেসে বললো,”না হচ্ছে না।”
“তার মানে? তোকে উনাদের পছন্দ হয়নি?”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমাকে উনার পছন্দ হয়েছি নাকি অপছন্দ হয়েছে এটা আমার কাছে বড় কোনো ব্যাপার নয়। আমার উনাকে পছন্দ হয়নি, আমার বাবারও হয়নি। তাই আমাদের বাড়ি থেকে না করে দেওয়া হয়েছে এই বিয়েতে।”
রুনার মুখ ঝুলে গেছে। যেনো এমন আশ্চর্যজনক কথা সে আগে কখনো শোনেনি। মফস্বল শহরের একটা অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে, যে কিনা আহামরি সুন্দরীও নয় সে কিনা শহরের নামকরা ব্যবসায়ী নিয়াজ মোর্শেদকে ফিরিয়ে দিয়েছে? তাও কি কখনো সম্ভব?
“উনার মতো একজন ফেরেশতা তুল্য মানুষকে তোরা না করে দিলি?”
প্রিয়তা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুনার দিকে তাকায়।
“তোর কেনো মনে হলো উনি ফেরেশতা তুল্য একজন মানুষ?”
“কেনো মনে হবে না? আমাদের কলেজে উনি কতো ডোনেশন দেয় তোর কোনো ধারণা আছে? এছাড়াও বিনা স্বার্থে উনি অনেক মানুষকে সাহায্য করেন শুনেছি। দু:স্থ বাচ্চাদের জামাকাপড় দেয়, পড়াশোনার খরচ দেয়। তো এমন একজন মানুষকে ফেরেশতা তুল্য বলবো না তো কাকে বলবো?”
প্রিয়তা বই বন্ধ করে ধীর দৃষ্টিতে তাকায় রুনার দিকে। রুনার অবাক দৃষ্টি তার উপরে।
“উপর থেকে একজনকে বিচার করা কতোটুকু যুক্তিযুক্ত তোর কাছে? হ্যা বাইরে হয়তো উনি অনেক ভালো একজন মানুষ। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে উনি যে চরম অসভ্য কেউ হবে না এই নিশ্চয়তা দিতে পারবি তুই?”
রুনা কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। আসলেই তো, এমন একজন মানুষকে কেনো না করবে প্রিয়তার পরিবার? নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে।
“তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস…..”
রুনাকে থামিয়ে দিয়ে প্রিয়তা বললো,”আমি বলতে চাচ্ছি না, বলছি। উনার সাথে আমার খুবই অল্প কিছু সময় সাক্ষাৎ হয়েছে। উনি সামান্য কিছু কথা বলেছে আমাকে। আমি তাতেই বুঝতে পেরেছি উনি বা উনার পরিবার আসলে বউ হিসেবে কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, বরং চাবি ঘোরানো পুতুল চায়। যে বিয়ের পর থেকে নিজের জীবন শুধু তাদের জন্য উৎসর্গ করবে। তার নিজস্বতা বলে কিছু থাকবে না। তারা যখন যেভাবে নাচাবে, বউকেও সেভাবে নাচতে হবে। যদি কারো স্ত্রী হয়ে ভুলেই যেতে হয় যে, আমিও একজন মানুষ, আমারও নিজস্বতা বলে কিছু আছে তাহলে এতো প্রাচুর্যতা, টাকাপয়সা দিয়ে কি হবে? বাইরের মানুষ জানবে, এমন অসাধারণ একজন মানুষের স্ত্রী, অথচ শুধু ঘরের ভিতরের মানুষটাই জানবে একই ছাদের নিচে, চার দেওয়ালের মধ্যে কাকে নিয়ে বসবাস। আমি আমার বাবাকে দেখে শিখেছি, প্রাচুর্যতার থেকে ভালোবাসা বেশি প্রয়োজন জীবনে।”
প্রিয়তা থামে। তার পায়ের যন্ত্রণাটা বেশ বেড়েছে। কান্না পাচ্ছে তার ভীষণ। সে সত্যিই নাচতে পারবে তো?
রুনা কিছুক্ষণ প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”তাহলে তোর কি মনে হয়? ভালোবাসা কেমন? এইযে মিরাজ স্যারকে দেখার পর আমার মন, শরীর কেমন অস্থির হয়ে ওঠে, দিনে একবার দেখা না হলে জীবনটাই বরবাদ মনে হয়, যার হাসি দেখলে চিত্ত নেচে ওঠে এটাই কি ভালোবাসা? আমি কি ভালোবাসি মিরাজ স্যারকে?”
প্রিয়তা কুটকুট করে হাসে রুনার কথা শুনে। রুনা লাজুক মুখে মাথা নিচু করে। রুনা মেয়েটা মারাত্মক সুন্দরী। লজ্জা পেলে ফর্সা গাল দু’টো টমেটোর মতো লাল হয়ে যায়। বেশ দেখতে লাগে তখন ওকে।
“এখনো বলা যাচ্ছে না এটা ভালোবাসা কিনা। তুই এখন উনাকে রোজ দেখতে পাচ্ছিস, এজন্য হয়তো উনাকে তুই ভুলতে পারছিস না। কিন্তু যখন আর কয়েক মাস পর কলেজ ছেড়ে চলে যাবি, চোখের দেখাটুকুও দেখতে পারবি না৷ তখন বোঝা যাবে তুই উনাকে সত্যিই ভালোবাসিস কিনা।”
“সেইটা কীভাবে?”
“যদি দেখিস চোখের আড়াল হওয়ার সাথে সাথে মনের আড়ালও হয়ে গেছে, তবে মনে করবি ওটা কখনো ভালোবাসাই ছিলো না, ছিলো সাময়িক মোহ। কিন্তু সত্যিই যদি উনাকে দিনের পর দিন না দেখেও উনার কথা ভুলতে না পারিস, প্রতিনিয়ত তাকে দেখতে মন চায় তবে ধরে নিবি আসলেই তুই উনাকে ভালোবাসিস। কারণ ভালোবাসা মানে চোখের আড়াল হলেও, মনের আড়াল না হওয়া। সহস্র বছর পরেও মানুষটার জন্য একই অনুভূতি থাকা। যে অনুভূতি কখনো ফিকে হয়না, বরং দিন দিন আরো প্রখর হয়, রঙীন হয়।”
রুনা অবাক হয়ে প্রিয়তার কথা শোনে। মেয়েটা সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে এটা সে জানে। এতো সুন্দর করে কবিতা আবৃত্তি করে, শুনলেই নেশা ধরে যায়। প্রিয়তা তার বাবা কবির শাহের এই গুণটা ভালো ভাবেই আয়ত্ত্ব করেছে।
রুনা বাঁকা চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”এতো যে অনুভূতি তোর, প্রেমে পড়েছিস নাকি কারো?”
প্রিয়তা আনমনে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো। রুনার কথা শুনে বেশ চমকে ওঠে সে। রুনার দিকে তাকাতেই দেখে রুনা মিটমিট করে হেসেই যাচ্ছে।
“আরে না, এসব কি বলছিস?”
রুনা আরো কিছুক্ষণ চাপাচাপি করছিলো, এর মধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় ওখানেই তাদের আলোচনা থামাতে হলো। কিন্তু প্রিয়তার মনের ভিতরের খচখচানিটা কমেনা। সে কীভাবে অবলীলায় এই কথাগুলো বলে দিলো। তবে কি উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সাথে চোখের আড়াল হলে, তার মানুষটার জন্য আকুতিও কমে যাবে? তবে কি এটা শুধুই মোহ? নাকি সে-ও বছরের পর বছর চোখের দেখা না হলেও মানুষটার স্মৃতি বুকে চেপে রাখবে? সে কি মানুষটাকে ভালোবাসে আদৌ? এর উত্তর কে দিবে?

রিহার্সাল শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ সন্ধ্যা হয়ে যায় প্রিয়তার। বুকটা দুরুদুরু করছে তার। সে ভেবেছিলো সে বুঝি রিহার্সাল করতেই পারবে না পায়ের এই অবস্থায়। এবারের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে কলেজের ডিগ্রীতে পড়া ছেলেমেয়েগুলো। মেয়েদের নাচটা দেখছে কয়েকজন মেয়ে। গতবার অনুষ্ঠানে প্রিয়তার নাচ দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলো। তাই এবার সবার আগে নাচে ওর নামটাই লেখা হয়েছে। কিন্তু আজ নাচের ঘরে যেয়ে প্রিয়তা ভেবেছিলো মেয়েগুলো হয়তো তাকে তাড়িয়েই দিবে। এবার বোধহয় আর তার নাচা হবে না। কিন্তু অবাক বিষয়, মেয়েগুলো প্রিয়তাকে অনেক সাহায্য করেছে। খুব বেশি শিখতে না পারলেও কিছুটা নাচ সে সুন্দর তুলে ফেলেছে। এসব করতে করতে কখন যে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে ও খেয়ালই করেনি।
সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার পরও মেয়েরা বাড়ির বাইরে থাকবে এটা মার্জিয়া বেগমের পছন্দ না। ভয়ে কলিজাটা শুকিয়ে আসে প্রিয়তার। এমনিতেই তার মা এসব নাচ গান পছন্দ করেনা। বাবার অনুপ্রেরণায় এতোদূর এসেছে। কিন্তু আজ তো মনে হচ্ছে বাবাও তাকে বাঁচাতে পারবে না।

গলির মুখে আসতেই বুকটা ধক করে ওঠে প্রিয়তার। ফাঁকা গলির মুখে প্রায় আট/দশটা কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ছোটবেলা থেকে কুকুর খুব ভয় পায় প্রিয়তা। খুব ছোট থাকতে একবার কুকুরের কামড়ও খেয়েছে। তখন থেকেই দারুণ কুকুরভীতি ওর।
আশেপাশে তাকায় প্রিয়তা। সন্ধ্যার এই সময়ে এই গলি মোটামুটি ফাঁকা থাকে। পুরুষেরা বেশিরভাগ মসজিদে ঢোকে। কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে প্রিয়তার। তার চোখ কুকুরগুলোর উপর নিবদ্ধ।

কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়না। হঠাৎ করে দুইটা কুকুর ওকে দেখে ভয়ংকরভাবে ডাকা শুরু করে। দুইটা কুকুরের ডাক শুনে বাকিগুলোও তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। হতবিহ্বল হয়ে পড়ে প্রিয়তা। তার বাবা শিখিয়েছে কুকুর দেখলে না দৌড়াতে। স্থিরভাবে হেঁটে যেতে। তাছাড়া তার পায়ের যে অবস্থা সে চাইলেও দৌড়াতে পারবে না। কিন্তু ভয়ে তার পুরো শরীর কাঁপছে থরথর করে।
আচমকে তিনটা কুকুর তার দিকে এগিয়ে আসতেই প্রিয়তা সব ভুলে কাঁধের ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে এক নি:শ্বাসে দৌড়াতে থাকে। পায়ের যন্ত্রণায় চোখে দিয়ে পানি চলে আসে তার। কিন্তু সে থামতে পারে না, কারণ পিছন পিছন সবগুলো কুকুর একযোগে দৌঁড়াচ্ছে তার সাথে।
যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে পা চেপে বসে পড়ে সে। সামনেই দেখে আটটা কুকুর তার দিকে ক্ষিপ্রভাবে ছুটে আসছে। প্রিয়তা চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রিয়তার মনে হয়েছে সে শুন্যে ভাসছে। ভয়ে চোখ মেলে তাকাতেও ভয় করছে তার। এক চোখ বন্ধ রেখে এক চোখ খোলে সে কোনোমতে। তাকাতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার। উচ্ছ্বাস তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। সামনেই কুকুরগুলো গড়গড় করে শব্দ করছে।
উচ্ছ্বাস কয়েকটা বিস্কুটের প্যাকেট ছুঁড়ে দেয় ওদের দিকে। ওরা প্যাকেটগুলো টানাটানি করতে করতে দৌড়ে চলে যায় অন্যদিকে।
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই ওকে কোল থেকে ধপ করে নামিয়ে দেয়। প্রিয়তা কোনোরকমে টাল সামলে দাঁড়ায়।
“এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি? প্রতিবার তোমার বিপদের সময় তুমি আমার সামনে কেনো পড়ো? নাকি ইচ্ছা করে আমার সামনে এসে এসব করো?”
প্রিয়তা চোখ কটমট করে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। ভেবেছিলো গতকালের সবকিছু ভুলে এতো বড় উপকারের জন্য উচ্ছ্বাসকে একটা ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু কিসের কি? এই লোক শোধরাবার না।
প্রিয়তা কিছু বলতে যাবে তার আগেই উচ্ছ্বাস হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দেয়।
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আমি জানি তুমি এখন কি বলবে। আপনি আজ না থাকলে আমার যে কি হতো, আমি তো মরেই যেতাম। কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দিবো। এসব আমি জানি, মেয়েরা এমন সিনেমাটিক সংলাপ দিতে পছন্দ করে।”
প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”জ্বি না, আমি তেমন কিছুই বলবো না।”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে বললো,”বলবে না? তাহলে কি বলবে?”
প্রিয়তা কিছুটা ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
“নিজেকে ভাবেনটা কি আপনি? একটা মেয়েকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে নিজেকে মহাপুরুষ ভেবে নিয়েছেন নাকি? যদি ভেবে থাকেন, তাহলে শুনে রাখুন, আপনি কোনো মহাপুরুষ না। আর কি যেনো বললেন? আপনার সামনে নাকি আমি ইচ্ছা করে বিপদে পড়ি? আমার তো উল্টোটা মনে হচ্ছে। আপনিই হয়তো আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছেন, এজন্য আমার বিপদ আসলেই কোথা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করছেন, নিজেকে উচ্চমার্গের কেউ প্রমাণ করতে। পরের বার থেকে যদি দেখেনও আমাকে কোনো বিপদে পড়তে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় চলবেন।”
উচ্ছ্বাস হতবাক হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা এতো কথা বলতে জানে? কই দেখলে তো মনে হয়না।

প্রিয়তা কথা শেষ করে উল্টোদিক ফিরে হাঁটতে গেলেই পায়ের ভিতর যন্ত্রণা চিলিক দিয়ে ওঠে। প্রিয়তা থমকে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। সাথে সাথে তার চোখ যায় প্রিয়তার পায়ের দিকে। নিটোল পা’টা নীল হয়ে ফুলে আছে।
“পায়ে কি হয়েছে তোমার?”
প্রিয়তা রক্তলাল চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনার না জানলেও চলবে।”
পা টানতে টানতে প্রিয়তা চলে যায়। উচ্ছ্বাসের হঠাৎ খুব খারাপ লাগে মেয়েটার জন্য। বুকের কোথাও একটা ওই সরল শ্যামবর্ণা মেয়েটার জন্য একটা গভীর মায়া টের পায়। মায়াটা ক্ষতের মতো খচখচ করছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু উচ্ছ্বাস নিজের জীবনটা আর কোনো মায়ায় জড়াতে চায়না। এ জীবন যে ক্ষণস্থায়ী। কেনো মেয়েটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিবে সে? এ অধিকার তো নেই তার। উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে প্রিয়তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।

বাড়ির কাছে আসতেই বড় খালার গাড়ি দেখে আরো ভয় পেয়ে যায় প্রিয়তা। উনি আবার কেনো এসেছেন? ওদিনের ঘটনার পর প্রিয়তার মনে হয়েছিলো খালা বোধহয় বেশ কিছুদিন আর এ বাড়ি মুখো হবে না। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, যেখানেই বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়।
প্রিয়তা বুকে ফুঁ দিয়ে ঘরে ঢুকতেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে যায়। বসার ঘরে সবাই থমথমে মুখে বসে আছে। এমনকি বাবাও সেখানে উপস্থিত। তার মুখটাও গম্ভীর।
পেখম পর্দার ফাঁকা দিয়ে ভয়ে ভয়ে বাকিদের দিকে তাকাচ্ছে। মর্জিনা বেগম বাঁকা ঠোঁটে হেসে কবির শাহের দিকে তাকিয়ে আছে। আর মার্জিয়া বেগম চিন্তিত মুখে বসে আছে একপাশে।
“দেখেছিস মার্জিয়া, এই হলো তোর মেয়ের অবস্থা। তোর বর তো আবার মেয়েদের বিদ্বান বানাতে চায়। মুখে চুনকালি ঘষার আগে বিয়েটা দিতে বলেছিলাম। তাতেই আমাকে যেভাবে অপমান করা হলো। নেহাৎ মেয়েগুলোকে মায়া করি বলে রাগ করতে পারিনা। নাহলে তোর বরের ওদিনের ব্যবহারের পর পা রাখতাম না এ বাড়ি।”
কবির শাহ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,”আপা আমার মেয়েটা আগে বাড়ি ফিরুক, তারপর নাহয় ওর কাছ থেকেই শোনা যাবে ও কেনো দেরি করেছে। তাছাড়া সামনে পহেলা বৈশাখ। ওদের কলেজ থেকে প্রতি বছর এই দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মেয়েটা নাচতে পছন্দ করে। হয়তো ওখানেই দেরি হচ্ছে।”
মর্জিনা বেগম হায় হায় করে ওঠে।
“সে কি রে মার্জিয়া, এই বয়সেও মেয়েকে ধেইধেই করে নাচতে পাঠাচ্ছিস? তোকে আর মানুষ বানাতে পারলাম না আমি।”
কবির শাহ কিছু বলতে যাবে তার আগেই মার্জিয়া বেগম মাথা চেপে ধরে বললো,”তোমরা দুইজন চুপ করো দয়া করে। আমার মেয়েটা কখনো এতো দেরি করেনা। এখনো ফিরতে পারলো না, তোমরা ঝগড়া শুরু করে দিলে?”
মর্জিনা বেগম কিছুক্ষণ থেমে ভ্রু কুঁচকে ওদিক ওদিক তাকায়।
“হ্যা রে পেখম, তোদের বাড়িতে আশ্রিত থাকে যে ছেলেটা, ও কোথায়? বাড়িতে নেই নাকি?”
মার্জিয়া বেগম সাথে সাথে লাফ দিয়ে বসে।
“হ্যা তাই তো, ছেলেটাও তো বেরিয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। আচ্ছা ওরা আবার একসাথে নেই তো?”
কবির শাহ স্ত্রীর দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,”ছি ছি মার্জিয়া, এসব কি বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
মার্জিয়া বেগম উঁচু গলায় বললো,”একদম চুপ করো তুমি। যা কিছু হচ্ছে সব তোমার জন্য। তুমি মেয়ে দু’টোকে আহ্লাদ দিয়ে অসভ্য বানিয়েছো। সেই সাথে একটা রাস্তার ছেলেকে এনে তুলেছো বাড়িতে। তোমাকে একটা কথা বলে রাখি প্রিয়তার বাবা, আমার মেয়েদের কোনো সর্বনাশ হলে তোমাকে দেখে নিবো আমি।”
কবির শাহ চুপ করে যায়। এই সময়ে মার্জিয়াকে কিছুই বলা যাবে না। তার মাথা তেতে আছে এখন।

প্রিয়তা মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললো,”মা।”
বসার ঘরের সবাই একযোগে প্রিয়তার দিকে তাকায়। মাথা নিচু করে অপরাধী মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা সবার সামনে।

মুখটা বিষিয়ে আছে প্রিয়তার। আজ পায়ের উপর অনেক অত্যাচার গেছে। একে তো নাচের রিহার্সাল তার উপর কুকুর দেখে দৌড়ানো। এতো যন্ত্রণা হয়নি তখন। রাত বাড়ার সাথে পা’টা মনে হচ্ছে শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে যন্ত্রণায়।
পেখম ভয়ে ভয়ে আপার দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা মা কে জানানো উচিত না এবার? আমার তো মনে হচ্ছে তোর হাড় ভেঙেছে।”
প্রিয়তা চিঁচিঁ করে বললো,”তুই বরফ দিতে থাক, কথা কম বল।”
পেখম অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”না আপা, আমি চুপ থাকবো না। এই বরফ দিয়ে কিচ্ছু হবে না। মা কে না বলিস, অন্তত বাবাকে বলা উচিত না? ওষুধ না খেলে এ ব্যথা আরো বাড়বে।”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে তাকায় পেখমের দিকে। আজ সন্ধ্যায় তার উপর দিয়ে একচোট ঝড় গেছে। সে আদৌ জানেনা সে এবার নাচতে পারবে কিনা। পায়ের এই অবস্থা জানলে তো একদমই আটকে রাখবে ঘরে। কিন্তু ওষুধ না খেলেও তো আর চলছে না। পায়ে হাত দিয়ে প্রিয়তা ঝরঝর করে কেঁদে দেয় হঠাৎ। পেখম অস্থির চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে প্রিয়তা তাড়াতাড়ি চোখে মোছে। রাত বাজে বারোটা, এখন কে আসবে তাদের ঘরে? বাবা নাকি মা?
পেখম চাপা গলায় বললো,”কে?”
একটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে দরজার ওপাশ থেকে।
“পেখম, একটু বাইরে আসবে?”
প্রিয়তা আর পেখম চমকে উঠে একে অন্যের দিকে তাকায়। উচ্ছ্বাস এসেছে তাদের দরজায়? তাও আবার এতো রাতে?
“আপা কি করবো?”
প্রিয়তা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”সে আমি কি জানি তুই কি করবি। তোকে ডেকেছে তুই জানিস।”
পেখম কিছু বলার আগে আবারও দরজায় শব্দ হয়। প্রিয়তা মুক বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকায়। পেখম অসহায় চোখে তার দিকে আপার দিকে একবার তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে উঠে যায়।

“উচ্ছ্বাস ভাই আপনি?”
“দরজা খুলতেই তো রাত পার করে দিচ্ছো তোমরা? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে দরজা খুললেই মেরে ফেলবো তোমাদের?”
পেখম ফিক করে হেসে দেয়। মানুষটা কঠিন মুখে এমন হাসির কথা বলতে পারে।
“ভিতরে আসুননা উচ্ছ্বাস ভাই।”
কথাটা বলেই পেখম অস্বস্তি বোধ করে। সৌজন্যতার খাতিরে ভিতরে আসতে বলা। যদি সত্যি সত্যি ভিতরে ঢোকে উনি? মা জানলে তো তুলকালাম বাঁধাবে।
উচ্ছ্বাস বাঁকা ঠোঁটে হাসে।
“ভয়ে পেতে হবে না তোমাকে। আমি ভিতরে যাবো না। তোমাদের সাথে বসে গল্পে মশগুল হতেও আসিনি।”
পেখম কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রিয়তা কান খাঁড়া করে রাখে এদিকে। হঠাৎ এতো রাতে উনি এখানে কেনো?
হাতে থাকা একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয় উচ্ছ্বাস পেখমের দিকে।
“এটা ধরো।”
“এটা কি উচ্ছ্বাস ভাই?”
“কিছু ব্যথার ওষুধ আছে। তোমার বোনকে খেতে দিবে। কখন কোনটা খেতে হবে সব লেখা আছে। একদম যেনো বাদ দেওয়া না হয়। পায়ের যা অবস্থা উনার। চিকিৎসা না করলে সারাজীবন ঠ্যাং খোঁড়া অবস্থায় ঘরে বসে থাকতে হবে।”

অদ্ভুত একটা প্রশান্তিতে সারা শরীর তন্ময় হয়ে ওঠে প্রিয়তার। কি ভীষণ ভালো লাগছে তার হঠাৎ করে। মানুষটা তার এতো খেয়াল রাখে? সে কষ্ট পাচ্ছে বলে ওষুধ এনেছে তা জন্য? সব রাগ, অভিমান যেনো এক নিমিষেই ভুলে যায় সে।
পেখম অবাক হয়ে একবার ঘরের ভিতরে তাকায় আরেকবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়।
“আর তোমার অতি সাহসী এবং বীর আপাকে বলে দিও, একটা গাধাও জানে কুকুর আর পাগল দেখলে দৌড়াতে হয়না। একটা গাধা হয়ে যা জানে, তোমার মাথা সরু আপা তা জানেনা, আফসোস।”
পেখম উত্তর দেয়না। মুখ টিপে হাসতে থাকে। অন্য সময় হলে প্রিয়তার রাগ হতো, কিন্তু এখন হয়না। সবকিছু এতো সুন্দর, এতো রঙিন লাগছে কেনো?
“যাও এভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে, ওষুধ গুলো মাথা সরু মহারানীকে দিয়ে এসো। আর একটা কথা, উনাকে বলে দিবে শুধু নাচলেই হবে না। ওজনের দিকেও নজর রাখা দরকার।”
উচ্ছ্বাস পেখমকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায়। পেখম শেষ কথাটা বুঝতে পারেনা। তার রোগা পাতলা আপাটা আবার ওজন বাড়ালো কবে?
কিন্তু প্রিয়তা ঠিক বুঝে যায় উচ্ছ্বাসের কথা। লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় তার। কোলে তুলেছিলো বলে এই কথা বললো লোকটা? কি অসভ্য, কি বাজে!
প্রিয়তা মাথা নিচু করে হেসে দেয় শব্দ করে।

“কোথায় গিয়েছিলে ওদিকে?”
উচ্ছ্বাস চমকে উঠে তাকায়। সামনে কবির শাহ শ্রান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার অতি গম্ভীর কণ্ঠে উচ্ছ্বাস থমকে যায় সহসা।

(চলবে…)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-০৬

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব:৬

ছাত্ররা দুই দলে ভাগ হয়ে মারামারি করে ক্লাস বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছা করছে না প্রিয়তার। কলেজ ক্যান্টিনের পাশেই শান বাঁধানো গাছের বেদীর উপর বসে আছে সে ওর সবচেয়ে কাছের বান্ধবী রুনার সাথে।
তবে প্রিয়তা অন্যদিনের তুলনায় আরো বেশি চুপচাপ। রুনাই বেশি কথা বলে যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্রিয়তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রুনা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।
“তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস প্রিয়তা?”
প্রিয়তা আনমনে ছোট্ট করে ‘হুম’ বলে।
“কি হয়েছে তোর বল তো? এভাবে থম মেরে বসে আছিস কেনো?”
প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো,”তেমন কিছু হয়নি।”
“গতকাল কলেজে আসিসনি কেনো? মিরাজ স্যার ক্লাস নিয়েছেন। ইশ, কি যে সুন্দর লাগছিলো কাল তাকে। মেরুন শার্টে একদম নায়ক লাগছিলো।”
প্রিয়তা মুচকি হেসে রুনার দিকে তাকায়। রুনা নতুন আসা মিরাজ স্যারকে খুব পছন্দ করে। মিরাজ স্যার ওদের অ্যাকাউন্টিং ক্লাস নেন। প্রিয়তার হঠাৎ মনটা ভালো হতে থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই।
রুনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলেজের দুইজন নেতা গোছের ছেলে দৌড়ে আসে তাদের কাছে। ওরা ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ আগেই কলেজে ঝামেলা হয়েছে। এই ছেলেগুলো আবার তাদের লোক না তো?
ছেলেদের মধ্যে একজন কর্কশ গলায় বললো,”এই মেয়েরা তোমরা এখানে কি করছো?”
রুনা মিনমিন করে বললো,”কিছু না ভাইয়া। এক্ষুনি চলে যাচ্ছি আমরা।”
“যাবে মানে? এতোক্ষণ যখন যাওনি, তবে এখন যেতে পারবে না।”
প্রিয়তা আর রুনা দুইজনই ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।
“এই নাও, এই ফুলের তোড়া আর মালা হাতে রাখো। এক্ষুনি কলেজ গেট থেকে যে গাড়িটা আসবে, সেখান থেকে যে ভদ্রলোক নামবে তাকে এগুলো দিবে।”
প্রিয়তা কাঁপা গলায় বললো,”কে আসবে ভাইয়া?”
ছেলেটা বিরক্ত হয়ে চোখ কুঁচকে বললো,”কে আসবে তা দিয়ে তোমার কি কাজ? তবে মনে রেখো উনি বিশাল মাপের একজন মানুষ। এই কলেজের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ডোনেশন তিনিই দেন। কোনোরকম বেয়াদবি করবে না তার সাথে, মনে থাকবে?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। কিছুটা রাগ হয় তার। সে কি কারো সাথে বেয়াদবি করে?
হঠাৎ গেটের বাইরে গাড়ির হর্ণ শুনে ছেলে দু’টো হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে ছুটে যায়। যাওয়ার আগে প্রিয়তাদের দিকে একবার চোখ পাকিয়ে তাকায়। যার অর্থ, কোনো ভুল ত্রুটি যেনো না হয়।

মিনিট দুইয়েকের মধ্যে একটা সাদা পাজেরো এসে থামে ওদের কিছুটা সামনেই। রুনা ভয়ে ভয়ে প্রিয়তার কাছে এসে গলা নামিয়ে বললো,”আমার ভীষণ ভয় করছে রে প্রিয়তা।”
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে বললো,”ভয়ের কি আছে? উনি বাঘ না ভাল্লুক? ফুলটা উনার হাতে দিয়েই আমরা পগার পার হয়ে যাবো।”
রুনা শান্ত হতে পারে না, অল্পতেই অস্থির হয়ে যাওয়া মেয়ে সে। সেই তুলনায় প্রিয়তা শান্ত।

সাদা পাঞ্জাবি পরা মানুষটাকে দেখে প্রিয়তার শরীরে বিদুৎ খেলে যায়। শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে।
ছেলে দু’টো তাকে নিয়ে প্রিয়তাদের সামনে আসে।
“উনি নিয়াজ মোর্শেদ, আমাদের কলেজের জন্য ফেরেশতা বলা যায়।”
চোখের ইশারায় ওদের ফুলগুলো দিতে বলে। নিয়াজ নিজেও হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। সানগ্লাসটা খুলে তাকায় ওর চোখের দিকে।
রুনা কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দেয় নিয়াজের দিকে। নিয়াজ ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে ফুলটা হাতে নেয়।
“কি হলো আপনি মালাটা দিবেন না?”
প্রিয়তা হতাশ চোখে তাকায়।
নিয়াজ ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,”উনার মনে হয় আমাকে পছন্দ হয়নি বুঝলে তোমরা? সমস্যা নেই, আমার ফুলের মালা প্রয়োজন নেই।”
ছেলেগুলোর মধ্যে একজন নিয়াজের দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দেয়।
“না না স্যার, কি বলছেন এসব? সমস্যা থাকবে কেনো?”
প্রিয়তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই প্রিয়তা অন্যদিকে তাকিয়ে মালাটা নিয়াজের হাতে তুলে দেয়।
নিয়াজ মোর্শেদ আহত গলায় বললো,”মালা বুঝি কেউ হাতে দেয়? গলায় পরিয়ে দিতে হয়।”
ছেলে দু’টোও কিছুটা অস্বস্তিবোধ করে। মফস্বল শহরে কলেজ তাদের। একজন বাইরের মানুষকে মালা পরিয়ে দেওয়ার নিয়ম তাদের মেয়েদের নেই।
একজন কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”এই মেয়ে তুমি বরং মালাটা স্যারের গলায় পরিয়ে দাও।”
প্রিয়তা যেনো অবাক হওয়ার মাত্রাও অতিক্রম করে ফেলেছে। অসহায় চোখে একবার রুনার দিকে আরেকবার নিয়াজ মোর্শেদের দিকে তাকায়।
রুনা প্রিয়তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”চোখ বন্ধ করে মালাটা পরিয়ে দে প্রিয়তা। উনি শুনেছি আমাদের কলেজের জন্য অনেক ডোনেশন দেয়। যদি রাগ হয়ে বন্ধ করে দেন?”
প্রিয়তা বিস্মিত হয়ে তাকায় রুনার দিকে। কি অবাস্তব কথা এসব?
নিয়াজ হাসি মুখে তাকায় থাকে প্রিয়তার দিকে, যেনো খুব মজা পাচ্ছে।
প্রিয়তার রাগে হঠাৎ কান্না পেয়ে যায়। সে চোখ বন্ধ করে উল্টোদিক থেকে সংখ্যা পড়তে থাকে। কিন্তু রাগ কমে না। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে সে।
“এই কি হলো? স্যার আর কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন?”
প্রিয়তা কাঁপা হাতে মালাটা উপরে তুলে নেয়। তার ইচ্ছা করছে মালাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে। কিন্তু কলেজের এই ছেলেগুলো পরবর্তীতে অনেক ঝামেলা করবে। তার জন্য পুরো ক্লাসের উপর ঝামেলা আসতে পারে।

এখনো চোখ বন্ধ করে আছে প্রিয়তা। নিয়াজ মুচকি হাসে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে। তারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
“তোমরা সামনে এগিয়ে যাও, আমি আসছি।”
নিয়াজের কথায় ছেলেগুলো একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।
নিয়াজ অনেকটা কাছে চলে আসে প্রিয়তার। রাগে ফোঁসফোঁস করছে এখনো প্রিয়তা। রুনা অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকায়।
“শুনলাম তোমাদের বাড়ি থেকে নাকি বিয়ে ভেঙে দিয়েছে? এতোদিন আমি হাজারটা বিয়ে ভেঙেছি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছিলো। তোমার মতো একটা মেয়ে যাকে আমার হাতের পুতুল বানানো যাবে এমন একটা মেয়েই আমি খুঁজছিলাম। সেই তুমি কিনা আমাকে অপমান করলে?”
প্রিয়তা চোখ গোল গোল করে তাকায় নিয়াজের দিকে।
“ভেবো না, বিয়ে তো আমি তোমাকেই করবো। আজ মালাটা পরে নিলাম। তুমি শুধু অপেক্ষা করতে থাকো।”
ছোট্ট করে হেসে নিয়াজ চশমাটা চোখে পরে চলে যায় সেখান থেকে।
রুনা দৌড়ে এসে প্রিয়তার কাছে দাঁড়ায়।
“তোরা কি পূর্বপরিচিত? কি বললো উনি তোকে?”
প্রিয়তা কোনো কথা না বলে ঝড়ের বেগে কলেজ গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার।

রাস্তায় পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে প্রিয়তা। এই বয়সটা আবেগের বয়স। অল্পতেই মন অশান্ত হয়, আবার অল্প খুশিতেই মনটা ভরে ওঠে। সে বুঝতে পারছে নিয়াজ লোকটা এতো সহজে তাকে ছাড়বে না। এমনকি সে আজ জেনেও গেলো সে কোন কলেজে পড়ে। সেই কলেজেরই একজন নামকরা মানুষ সে। এর ফায়দা তো নিয়াজ তুলবেই।

হাবিজাবি অনেক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে সে খেয়ালই করেনি কখন সে বড় রাস্তার একদম মাঝ দিয়ে হাঁটছে। এই রাস্তা দিয়ে বড় বাস, ট্রাকগুলো যায়। কিন্তু প্রিয়তার সেদিকে একদমই মন নেই। তার মন পড়ে আছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনায়। কি কুক্ষণেই না সে ক্লাস না থাকা সত্ত্বেও বসে থাকতে গেলো।
প্রচন্ড দাবদাহে রাস্তা যেনো পুড়ছে। ফাল্গুন শেষ হয়ে চৈত্র পড়েছে কিছুদিন। তাতেই এমন গরম? প্রিয়তার গায়ের সাদা কামিজ ঘামে ভিজে জবজব করছে। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে পানিতে। সেদিকে খেয়াল নেই ওর। ওর শুধু ইচ্ছা করছে বরফশীতল পানি দিয়ে গোসল করতে।

হঠাৎ ট্রাকের হর্ণের শব্দ শুনে সম্বিত ফিরে পায় সে। আচমকা এতো কাছ থেকে শব্দ শুনে চকিতে তাকাতেই ভীষণ ভয় পেয়ে যায় সে। ট্রাক একদম কাছে চলে এসেছে। হয়তো মাত্র দুই হাতের দূরত্ব। স্থাণূর মতো জমে যায় সে। হিতাহিত জ্ঞানটুকুও যেনো লোপ পেয়েছে। তার সরে যাওয়ার উচিত, এক সেকেন্ডের মধ্যে পিছিয়ে আসা উচিত তার। কিন্তু তার মনে হচ্ছে চুম্বক দ্বারা আটকে রেকেছে কেউ তাকে রাস্তার সাথে। সে বিকট চিৎকার করে কানে হাত দেয়।

হঠাৎ একটা হেঁচকা টান আসে তার বাম বাহুতে। টাল সামলাতে না পেরে হুরমুর করে পড়ে রাস্তার অন্যপাশে। ডান পায়ে প্রচন্ড ব্যথা লাগে পড়ে যেতেই। মনে হয় মচকেই গেলো পা টা। তবে তাকে টান দিয়ে নিয়ে আসা মানুষটা এখনো তার বলশালী শক্ত দু’টো হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তার নি:শ্বাসের ঘন ঘন শব্দ পায় প্রিয়তা খুব কাছে। কিন্তু মাথা তুলে তাকানোর সাহস নেই তার। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সে। ভীত হরিণীর মতো কেঁপেই যাচ্ছে একনাগাড়ে। কি হতে যাচ্ছিলো? মানুষটা না এলে এতোক্ষণ কি হয়ে যেতো? ভাবতেই প্রিয়তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়।

ভয়ে ভয়ে একটা ঢোক চেপে আস্তে আস্তে চোখ দু’টো খুলে উপরের দিকে তাকাতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। এ কি দেখছে সে? এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি? না না, এটা সত্যি হতে পারে না। নির্ঘাৎ স্বপ্ন এটা। এটা একদমই অসম্ভব। এটা অন্য একজন মানুষ। তার অবচেতন মন হয়তো এখানে ওই মানুষটাকে চাচ্ছে, তাই অন্য একজনকেই ওই মানুষের জায়গায় দাঁড় করাচ্ছে। তবে কল্পনা এতো স্পষ্ট হয়?

উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে কঠিন লাল চোখে তাকিয়ে তার বাহু ছেড়ে দেয়। ওকে হালকা ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যায় ট্রাকটার দিকে।
“নামেন ট্রাক থেকে, নামেন বলছি।”
উচ্ছ্বাসের সাথে জড়ো হয়েছে আরো কয়েকজন মানুষ। আরেকটু হলে মেয়েটার একটা বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছিলো। বেশ কয়েকজন তামাশা দেখতে দাঁড়িয়ে যায়। মফস্বল শহরে তামাশার অভাব বড় শহরগুলোর মতো। তাই অল্পতেই তারা অতি আগ্রহী হয়ে পড়ে।
এতো মানুষের বহরে বাধ্য হয়ে ট্রাক ড্রাইভার নেমে আসতে বাধ্য হয়। তার চোখেমুখে কিছুটা ভয়।
উচ্ছ্বাস দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রাখে।
উচ্ছ্বাস উপস্থির মানুষগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে শান্তস্বরে বললো,”একটা মেয়ে ট্রাকের সামনে চলে এসেছে, আর আপনি ট্রাক থামাতে পারেননি? আমি এখানে সময়মতো না এলে কি হয়ে যেতো ভাবতে পারছেন?”
ড্রাইভার কিছু একটা বলতে গেলে উচ্ছ্বাস হাত উঁচু করে তাকে থামায়।
“মা’ল খেয়ে টাল হয়ে ট্রাক চালানোর শাস্তি কি হতে পারে জানেন আপনি?”
ড্রাইভার কিছুটা অবাক হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললো,”মুখ সামলে কথা বলুন। ওই আপা আপনি দূরে ক্যান? সামনে আসেন, বলেন উনারে। ওই আপা নিজে আমার ট্রাকের সামনে চলে এসেছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে হর্ণ বাজাচ্ছি। আপা কানেই শুনছে না। আপা মনে হয় নিজেই মরতে এসেছিলো।”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে দেখলো উপস্থিত লোকগুলো মুখ টিপে হাসছে ড্রাইভারের কথা শুনে। কেউ কেউ প্রতিবাদের গুঞ্জন তুলেছে, তবে তা খুবই ক্ষীণ।
উচ্ছ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকায়। ভয়ে, লজ্জায়, অপমানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ফোঁপাচ্ছে সে। হঠাৎই মেয়েটার জন্য একরাশ মায়া অনুভব করলো সে। মেয়েটাকে এমন বিধ্বস্ত লাগছে কেনো? কি কষ্ট মেয়েটার? সে কি ইচ্ছা করে ট্রাকের সামনে চলে এসেছিলো?

উচ্ছ্বাস ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। ড্রাইভার ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
উচ্ছ্বাস ড্রাইভারের কলারটা হালকা করে উঁচু করে ধরে বললো,”সাবধান হয়ে যাও। মেয়েদেরকে নোংরা কথা বলার আগে কয়েকবার ভাববে। ততটুকুই বলবে যতোটুকু তুমি তোমার মা বা বোনের জন্য শুনতে পারবে। যাও এখন।”
উচ্ছ্বাসের কন্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু উত্তপ্ত। ড্রাইভার আর বেশি কথা বলার সাহস পায়না। চুপচাপ নিজের ট্রাকে উঠে চলে যায় সে।

উচ্ছ্বাস বাকিদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,”তামাশা তো আর বাকি নেই। কি দেখছেন এভাবে দাঁড়িয়ে? মেয়েদের খোঁচা দিয়ে কেউ কথা বললে শুনতে ভালো লাগে তাইনা? যান এখান থেকে, যান বলছি।”
লোকগুলো শুকনো মুখে সেখান থেকে চলে যায়।
উচ্ছ্বাস সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ধীর পায়ে হেঁটে আসে প্রিয়তার কাছে।
প্রিয়তা মুখ খোলার আগেই উচ্ছ্বাস তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,”বিয়ে ভাঙার শোকে মরতে ইচ্ছা হয়েছিলো?”
প্রিয়তা ঝট করে মাথা তুলে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। বোঝার চেষ্টা করে সে মজা করছে কিনা। কিন্তু তার চোখেমুখে কোনো মজার চিহ্ন নেই।
“এসব কি বলছেন আপনি?”
উচ্ছ্বাস কিছুটা রেগে যায় এবার। প্রিয়তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে। প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে ফেলে সাথে সাথে।
“খুব বেশি মরতে ইচ্ছা করলে আজ রাতে বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিও। দিনেদুপুরে ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দেওয়া শুধুই লস প্রজেক্ট।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। চোখে পানি ভরে যায় তার।
“কে বাঁচাতে বলেছিলো তাহলে আমাকে? নিজেকে হিরো প্রমাণ করলেন?”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তাকে ছেড়ে দেয়। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে বললো,”তোমার জায়গায় যে কোনো মেয়ে থাকলেই এমনটা করতাম। নিজেকে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কিছু হয়নি। চোখের সামনে পড়েছে, বাঁচিয়েছি। চোখের সামনে পড়বে না, বাঁচানোর প্রয়োজনও মনে করবো না। আর হ্যা, সেদিন তোমার কলেজের সামনে থাকা বদমাশগুলোকেও আমি পিটিয়েছি। সেটা এই কারণে নয় যে, ওরা তোমাকে বিরক্ত করে। কারণটা এটাই ছিলো যে, ওরা শুধুমাত্র তোমাকেই এসব নোংরা কথা বলেনা। ওরা আরো অনেক মেয়েকেই এভাবে বাজে, অশালীন কথা বলে। চিরজীবনের মতো একটা উচিত শিক্ষা ওদের দিয়েছি। যাতে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত না পারে। তাই তোমাকে বলছি, আকাশকুসুম চিন্তা ভাবা বাদ দাও। দিবাস্বপ্ন যতো কম দেখা যায় ততই ভালো।”

উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে আর তাকায় না। ওভাবেই মাঝরাস্তায় ওকে একা ফেলে সে চলে যায়। প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নিজের অনুভুতিকে ভিতরে আটকে রাখে। এতোটা অপমানিত হওয়ার পরেও তার মনের কোনো এক কোণায় একটু হলেও আশা ছিলো উচ্ছ্বাস তাকে বাড়ি পৌঁছে দিবে। তার পা’টা মচকে গেছে। এই পা নিয়ে বাড়ি পৌঁছানো অসম্ভব মনে হচ্ছে তার। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেকে অসহায় মনে হয় তার ভীষণ। আচ্ছা, উচ্ছ্বাস কি একটা রিকশা ডেকেও দিতে পারতো না?
মিনিট পাঁচেক এমন ঘোরের মধ্যে থেকে প্রিয়তা পিঠ সোজা করে দাঁড়ায়।
‘এতো কিসের দেমাগ উনার? আমাদের বাড়িতেই পড়ে থেকে কিনা, আমার সাথেই এমন বাজে আচরণ? উনি নিজে মেয়েদের সাথে ভালো ব্যবহার করে? কে বলেছিলো সেদিন ওই বখাটেগুলোকে মারতে? আর কে বা বলেছিলো আজ আমাকে বাঁচাতে? আজ আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম, এই লোকের জন্য নিজের আর একবিন্দু চোখের পানি আমি নষ্ট করবো না। আমার অনুভূতিগুলো এতোটাও মূল্যহীন নয় যে, একটা অসভ্য ছেলের জন্য তা গলে পড়বে।’
কিছুক্ষণ ঠোঁট ফুলিয়ে আস্তে আস্তে এসব বিড়বিড় করতে থাকে সে। আশেপাশের মানুষগুলো বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখছে। রাস্তার মাঝখানে একটা কমবয়সী মেয়ে পায়ের ব্যথায় হাঁটতে পারছে না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে এই দৃশ্যটা যেনো তাদের কাছে খুব মজাদার। প্রিয়তা রাগী চোখে সেদিকে তাকিয়ে একটা রিকশা ডেকে অনেক কষ্টে বাড়ির দিকে রওনা হয়।

“একটা কথা বলবো প্রিয়তার বাবা?”
কবির শাহ ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। খাতা দেখার সময় সে নিরিবিলিতে থাকতে পছন্দ করে। মার্জিয়া বেগম সব জানে। সে কখনো স্বামীকে বিরক্ত করে না খাতা দেখার সময়। তবে আজ ঘটনা ভিন্ন।
কবির শাহ খাতা থেকে চোখ না তুলেই বললো,”কি বলতে চাও বলো।”
মার্জিয়া বেগম এক কাপ চা বাড়িয়ে দেয় কবির শাহের দিকে। কবির শাহ কিছুটা অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকায়। হঠাৎ এমন ভালো ব্যবহারের কারণ কি? মেয়ের জন্য আবার কোনো সম্বন্ধ আনেনি তো তার বড় বোন?
কবির শাহ খাতা বন্ধ করে চশমা খুলে রাখে। নির্লিপ্ত মুখে চায়ের কাপ হাতে নেয়।
মার্জিয়া বেগম স্বামীর অনেকটা কাছে এসে শান্ত গলায় বললো,”উচ্ছ্বাসের বাবা মা তো একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তাইনা?”
কবির শাহ চমকে উঠে তাকায় স্ত্রীর দিকে। হঠাৎ এতোদিন পর এই কথা জিজ্ঞেস করছে কেনো সে?
কবির শাহ নিজেকে সামলে অস্ফুট একটা শব্দ করে।
“শুনেছিলাম ওদের বাড়ির অবস্থাও বেশ স্বচ্ছল। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। সম্পত্তি তো সব ও পাবে তাইনা?”
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,”হঠাৎ এসব কথা বলছো কেনো?”
“বলছি কারণ, সবকিছু থাকা সত্ত্বেও সেসব ফেলে পরের বাড়িতে কেনো পড়ে আছে ও? দেখো ও যদি গরীব ঘরের সন্তান হতো, আমার ওকে করুণা করতে কোনো অসুবিধা ছিলো না। কিন্তু……”
কবির শাহ স্ত্রীর কথা শেষ করতে দেয়না। তার আগেই থামিয়ে দেয় তাকে।
“তোমাকে আগেও বলেছি মার্জিয়া, বাবা মা চলে যাওয়ার পর থেকে ও একটা মেন্টাল ট্রমার মধ্যে চলে গেছে। আপন বলতে ওর তেমন কেউই নেই। ও অনেকটাই মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলো তখন। ডাক্তার বলেছে ওকে একা না রেখে কোনো একটা পরিবারের সাথে রাখতে। এজন্যই ওকে এখানে এনেছি আমি। ও সুস্থ হলেই এখান থেকে চলে যাবে। আর পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ও এখানেই থাকবে। আর একটা কথা স্পষ্ট শুনে নাও তুমি। এটা ওর পরের বাড়ি না। তুমি ওকে করুণাও করছো না। গ্রাম থেকে যখন এই শহরে আসি, কেউ ছিলো না আমার পাশে। ভেসেই চলে যাচ্ছিলাম কালের গর্ভে। সেদিন ওর বাবা মা আমাকে টেনে ধরেছিলো। আমি খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছিলাম মানুষ দু’টোকে। আমাকেও ওরা পরম যত্নে ওদের বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিলো। আমি ওই মানুষ দু’টোর বাড়িতেই বছর তিনেক ছিলাম। তারা কেউ আমাকে কোনোদিন বুঝতে দেয়নি ওটা আমার পরের বাড়ি, ওরা আমার অনেক দু:সম্পর্কের আত্মীয়। ওরা কেউ আমাকে সেদিন করুণা করেনি, বরং ভালোবেসেছিলো। আজ তাদের একটা মাত্র কলিজার টুকরো সন্তান যদি আমার আশ্রয়ে কিছুদিন থাকে তাতে তোমার এতো আপত্তি কেনো মার্জিয়া? আমার ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই এই সংসারে? ও তো এখানে বছরের পর বছর পড়ে থাকবে না। এটুকু সহ্য কি আমার জন্য করতে পারছো না তুমি?”
কবির শাহ কথা শেষ করে থামে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। চা শেষ না করেই হনহন করে হেঁটে বারান্দায় চলে যায় সে। মার্জিয়া বেগম অসহিষ্ণু হয়ে মুখ ভোঁতা করে খাটের উপর বসে থাকে।

পেখম বরফের টুকরোগুলো পাতলা সুতি কাপড়ে মুড়ে প্রিয়তার ব্যথার জায়গায় চেপে ধরছে। আর প্রিয়তা সাথে সাথে যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠছে। আপার এমন কষ্টে পেখমেরই ভীষণ খারাপ লাগে। মনে হয় তারই যেনো ব্যথাটা হচ্ছে।
“আপা মা কে না জানানো কি ঠিক হচ্ছে? বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে গেলে? যদি হাড় ভেঙে যেয়ে থাকে? তাহলে তো মারাত্মক সমস্যা হবে।”
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে বললো,”যেটা করছিস ঠিকমতো কর। কথা বলিস না বেশি। কিচ্ছু হয়নি, একটু মচকে গেছে শুধু।”
পেখম হতাশ চোখে আপার দিকে তাকিয়ে নিজের কাজ চালিয়ে যায়।
প্রিয়তা গলার আওয়াজ কিছুটা নামিয়ে বললো,”ভুলেও যেনো মা কে এসব বলবি না। ঘূনাক্ষরেও যেনো মা টের না পায় কিছু।”
“কিন্তু মা কে জানালে কি হবে আপা? তুই তো ইচ্ছা করে এমনটা করিস নি যে মা তোকে বকবে।”
প্রিয়তা অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”সামনে পহেলা বৈশাখ। কলেজের অনুষ্ঠানে যে আমাকে নাচতে হবে সে কি ভুলে গিয়েছিস তুই? মা জানতে পারলে আমাকে রিহার্সালে যেতে দিবে?”
পেখম হতবাক হয়ে বললো,”তুই এই অবস্থাতেও রিহার্সাল করবি আপা? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
“কেনো এখানে মাথা খারাপের কি হলো? সারাবছর এই একটা অনুষ্ঠানের জন্য সেই ছোট্ট থেকে অপেক্ষা করে থাকি আমি। আগে স্কুলে আর এখন কলেজে। এ ছাড়া তো মা আর কোথাও নাচতেই দেয়না আমাকে। কলেজে ওঠার পরেও কি কম আপত্তি করলো গতবার? বাবা নেহাৎ এগিয়ে এসেছিলো বলে। নাহলে তো নাচ জিনিসটাই জীবন থেকে বাদ হয়ে যাচ্ছিলো আমার মা আর বড় খালার জন্য। এবারই কলেজে শেষ বছর। হয়তো জীবনে আর কোনোদিন এই সুযোগ পাবো না। শেষ সুযোগটা আর নষ্ট করতে চাইনা আমি। মা কে কোনোভাবেই জানতে দেওয়া যাবে না পায়ের কথা।”
কথা শেষ করতেই আবার দাঁতে দাঁত চেপে ধরে প্রিয়তা। যন্ত্রণায় চোখে পানি চলে আসছে তার মাঝে মাঝেই।
পেখম আহত গলায় বললো,”কিন্তু আপা পায়ের দিকে একবার তাকা। কীভাবে ফুলে নীল হয়ে আছে। মায়ের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখবি কীভাবে? আর তা যদি সম্ভব হয়-ও এই যন্ত্রণা নিয়ে প্রাকটিস করবি কীভাবে তুই?”
প্রিয়তা লম্বা চুলগুলো খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বললো,”এবার মায়ের লাল পেড়ে সাদা জামদানীটা পরবো বুঝলি। আচ্ছা চুলগুলো খোঁপা করবো নাকি ছেড়ে দিবো? কোনটায় আমাকে শাড়ির সাথে বেশি ভালো লাগবে?”
পেখম ক্লান্ত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। চোখমুখ খুশির ঝিলিকে চকচক করছে। তার পায়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পেখম। মনে হচ্ছে আগের চেয়ে আরো একটু বেশি ফুলেছে জায়গাটা।

(চলবে…..)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-০৫

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ৫

মার্জিয়া বেগম সরু চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার বুকটা অজানা আশঙ্কায় ধকধক করছে। শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
মার্জিয়া বেগম ধীর পায়ে হেঁটে প্রিয়তার কাছে এসে দাঁড়ায়।
“ভিজেছিস কেনো এভাবে?”
প্রিয়তা ঈষৎ কেঁপে ওঠে। মায়ের দিকে তাকাতেও ভয় করছে তার এখন।
“কি রে উত্তর দে, এভাবে ভিজেছিস কেনো?”
মার্জিয়া বেগমের কণ্ঠ অত্যন্ত শীতল। সে ধমকে কথা বলছে না। অথচ প্রিয়তার মনে হচ্ছে মা ধমক দিলেই বোধ হয় বেশি ভালো হতো।
“মা আসলে আমার খুব মন খারাপ লাগছিলো, তাই ছাদে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে বৃষ্টি এলো। তাই ইচ্ছা হলো বৃষ্টিতে ভিজি।”
মার্জিয়া বেগম ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের চোখের দিকে তাকায়। এই বয়সটা সে-ও পার করে এসেছে। মেয়ের অন্তরে ওঠা ঝড় তার চোখের তারায় স্পষ্ট সে তাও বুঝতে পারছে। কার জন্য এমন করছে সে? ওই ভবঘুরে বাউন্ডুলে ছেলেটার জন্য নয় তো আবার?
“ভিজে জামাকাপড় বেশিক্ষণ গায়ে দিয়ে রাখিস না। শাড়িটা মেলে দে, শুকিয়ে যাক।”
প্রিয়তা ঘাড় কাত করে চলে যাচ্ছিলো।
পিছন থেকে মার্জিয়া বেগম আবার ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”বিয়েটা আপাতত হচ্ছেনা তোর। এখন বোধহয় তোর মনটা ভালো হবে।”
প্রিয়তা বাঁকা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে। বিয়েটা ভাঙায় মা কি রেগে আছে খুব? তাকে দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না। অদ্ভুত রকম শান্ত ব্যবহার করছে সে। মায়ের এমন রূপের সাথে প্রিয়তা পরিচিত না। বেশ ভয় করতে থাকে প্রিয়তার।
“এখন যা নিজের ঘরে।”
প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে সেখান থেকে চলে যায়। মার্জিয়া বেগম একবার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে চলে যায়।

ঘরে ফিরেই উশখুশ করতে থাকে প্রিয়তা। সে যে চা চেয়েছে তার কাছে। এখন কীভাবে চা বানিয়ে ছাদে যাবে সে? মা তো ওখানেই খুঁটি পেতে আছে মনে হয়। রান্নাঘর থেকে চা বানিয়ে ছাদে গেলে তো নির্ঘাত সন্দেহ করবে। কিন্তু এই প্রথম মানুষটা মুখ ফুটে তার কাছে কিছু চেয়েছে। আর সে দিতে পারবে না?
খাটের উপর বসে ছটফট করতে থাকে প্রিয়তা।
পেখম কোথা থেকে দৌড়ে আসে। এসেই আপার গায়ের উপর আহ্লাদে ঢলে পড়ে। প্রিয়তা খানিকটা বিরক্ত হয়, কিছু বলেনা।
“আপা সুখবর পেয়েছিস তো? টাকলাকে আজীবনের মতো বিদায় দিয়েছে বাবা। বাবা একদম ফাটিয়ে দিয়েছে জানিস তো। আমাদের জন্য বাবা হলো সুপার ম্যান। যতোই বড় খালা হাঙ্গামা করুক না কেনো, শেষে বাবা ছক্কা মেরে জিতে গেলো।”
প্রিয়তা শুকনো ঠোঁটে হাসে। তার মন পড়ে আছে এখন ছাদে। এখনো নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছে তার চায়ের জন্য।
পেখম ভ্রু কুঁচকে আপার দিকে তাকায়।
“কি রে আপা? তুই মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেনো বল তো? তুই আবার মনে মনে ওই টাকলাকে পছন্দ করে ফেলিসনি তো? দেখ, আমি কিন্তু দুলাভাই হিসেবে ওই বেটাকে কোনোভাবে মানতে পারবো না, নেভার। আমার বান্ধবীরা আমাকে ক্ষেপাবে, তোর দুলাভাই টাক। আমি এসব মানতে পারবো না।”
প্রিয়তা ঝাঁঝের সাথে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”দয়া করে একটু চুপ করবি? এতো কথা কীভাবে বলতে পারিস তুই? মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিস একদম।”
পেখম কিছুটা দমে যায়। নিশ্চয়ই আপার কিছু হয়েছে। নাহলে এতো বড় একটা খুশির খবরেও এমন করছে কেনো?
পেখম প্রিয়তার হাতের উপর হাত রেখে নরম গলায় বললো,”কি হয়েছে আপা তোর? আমাকে বল। মা কিছু বলেছে?”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে না-সূচক মাথা নাড়ে।
পরক্ষণেই পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”একটা উপকার করতে পারবি?”
“কি উপকার আপা?”
“দৌড়ে যা তো, দেখে আয় মা কোথায়।”
“কিন্তু কেনো?”
প্রিয়তা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বললো,”যা বলছি তাই কর। কিন্তু সাবধান, এমন ভাবে যাবি যেনো মা বুঝতে না পারে তুই তাকে দেখতে গিয়েছিস। মায়ের কিন্তু অনেক বুদ্ধি।”
পেখম আপার কোনো কথা বুঝতে পারেনা। অগত্যা উঠে দাঁড়ায়।
পেখম ফিরে আসে মিনিট দুই পরেই। তাকে দেখেই প্রিয়তা উত্তেজিত হয়ে বললো,”মা কোথায়?”
পেখম ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,”ওদিকে তো কোথাও দেখলাম না। মনে হয় নিজের ঘরে।”
প্রিয়তা একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। এটাই সুযোগ, যা করতে হবে খুব দ্রুত আর খুব সাবধানে।
“আপা কোথায় যাচ্ছিস?”
প্রিয়তা গায়ের উপর ওড়না টেনে নেয়। পেখমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

মশার প্রকোপ বেশ বেড়েছে বৃষ্টি কমার পর। বেশ ঠান্ডাও লাগছে। গুমোট গরমের পর আরামদায়ক আবহাওয়া। উচ্ছ্বাসের ইচ্ছা করছে ছাদের উপরই শুয়ে পড়তে। উচ্ছ্বাস কখনো নিজের ইচ্ছাকে মাটিচাপা দেয়না। একটাই তো জীবন, তাও ছন্নছাড়া। কি হবে এতো নিয়ম কাননের বাঁধাজালে জীবন বেঁধে রেখে?
পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরায় সে। এরপর শুয়ে পড়ে ছাদের উপরই। পানিতে থইথই করছে ছাদ। পিঠের নিচে পানি পড়তেই ঠান্ডা অনুভূতি হয়। সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে উপরে। নিচে ঠান্ডা পানি, উপরে বিকট গন্ধের ধোঁয়া। বেশ ভালো লাগে উচ্ছ্বাসের।
নিজের উপর নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় সে। আস্তে আস্তে তবে চেইন স্মোকারই হয়ে গেলো সে? অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। নিতান্ত ভদ্র, চুপচাপ একটা তরুণ ছিলো সে। বন্ধুদের আড্ডায় কতো অনুরোধ করা হয়েছে একটা টান দিতে ধূম্রশলাকায়। কোনোদিন মনের ভুলেও এ কাজ করেনি সে। তার মা সবসময় বলতো,’ওসব বাজে ছেলেরা খায়। একদম যেনো ওসব কখনো না শুনি।’
উচ্ছ্বাস মিষ্টি করে হেসে বলতো,’মা আমি তো তোমার ভালো ছেলে।’
উচ্ছ্বাসের মা সুন্দর করে হেসে ছেলের কপালে চুমু এঁকে দিতো।
চোখ বন্ধ করে ফেলে উচ্ছ্বাস। যতোবার মায়ের মুখটা মনে পড়ে ততবার বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে তার।
সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটার দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে বললো,”মা গো, আজ সেই বাজে ছেলেটা হলাম আমি। এই শহরে আমার মতো বাজে কেউ নেই। তুমি চেয়েছিলে তোমার ছেলে যেনো বাজে না হয়। কিন্তু তোমার খু নের প্রতিশোধ নিতে আমি বাজে হবো মা, হবোই।”
কবির শাহ বাদে এ বাড়ির সবাই জানে উচ্ছ্বাসের বাবা মা একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। কিন্তু আসল সত্যটা এখনো কেউ জানেনা। কবির শাহ বলতে নিষেধ করেছে।
উচ্ছ্বাসের গলার রগ ফুলে ওঠে সাথে সাথে। ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে তার। ওই ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠলেই নিজেকে সংযত করতে পারে না সে। সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে বসে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছাদের উপর ঘু’ষি দিতে যাবে তার আগেই কারো মিষ্টি গলার স্বর শুনে থমকে যায় সে। নিজেকে সামলায় কষ্ট করে।

“আপনার চা।”
উচ্ছ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। প্রিয়তা ইতোমধ্যে শাড়ি পালটে ফেলেছে। হালকা নীল আর গোলাপির মিশেলে সুন্দর একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে। অনেক বেশি চিকন লাগছে তাকে এখন। কিন্তু কেনো যেনো একটু বেশি-ই মায়াবী লাগছে।
উচ্ছ্বাস চোখ ফিরিয়ে নেয় তার দিকে থেকে।
“আপনি চা চেয়েছিলেন।”
উচ্ছ্বাস থমথমে গলায় বললো,”চা লাগবে না, নিয়ে যাও।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কিন্তু আপনি যে একটু আগেই চাইলেন।”
উচ্ছ্বাস হালকা চিৎকার করে বললো,”বললাম না লাগবে না? নিয়ে যাও এক্ষুনি।”
উচ্ছ্বাসের চিৎকারে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় প্রিয়তা। কি হলো এতোটুকু সময়ের মধ্যে? মাত্রই তো কতো সুন্দর করে কথা বললো। আচ্ছা চা আনতে দেরি হয়েছে বলে কি এমন করছে?
প্রিয়তা মৃদু স্বরে বললো,”আসলে একটু দেরি হয়ে গেলো। ভেজা শাড়ি পালটে আসতে যেয়েই এমন দেরিটা হলো।”
উচ্ছ্বাস উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়তার চোখের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকায়। প্রিয়তা থতমত খেয়ে যায়।
“একদম আমার সামনে আসবে না তুমি। আমি মানুষটা ভালো না বুঝলে? আমি অত্যন্ত খারাপ একটা মানুষ। তোমরা অনেক ভালো একজন বাবার আদরের রাজকন্যা। তাই যতোদিন এই বাড়িতে আছি তুমি বা তোমার বোন কেউ আমার ছায়া মাড়াবে না, বোঝা গেছে?”
হাতের সিগারেটটা আবারও নিজের হাতের সাথে পিষে ফেলে উচ্ছ্বাস। প্রিয়তাকে একা রেখেই হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় সে।
হতভম্ব হয়ে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তা। কিছুটা রাগ তারও হচ্ছে। শান্ত মানুষের রাগ ভয়ংকর।
চায়ের কাপ থেকে পুরোটা চা প্রিয়তা ছাদে ঢেলে দেয়। অসম্ভব রাগ হলে প্রিয়তার কান্না পায়। কিন্তু এখন সে ঠিক করেছে সে কাঁদবে না।
“কি ভাবে কি উনি নিজেকে? কোন দেশের রাজপুত্র হয়েছেন উনি? অসভ্য লোক একটা। কেনো বললেন আমাকে চা বানিয়ে আনতে? সস্তা ভেবেছেন আমাকে? আমি এতোটাই সস্তা হয়ে পড়েছি? আমার নামও প্রিয়তা। দেখি কতোদিন এই জিদ আপনার থাকে।”
চা ফেলেও শান্তি হয়না প্রিয়তার। ইচ্ছা করছে কাপটাই ছুড়ে ফেলে ভেঙে দিতে। কিন্তু না, তার বাবা তাদের শিখিয়েছে জিনিসপত্র ভেঙে রাগ কমানোর মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। বরং চেষ্টা করতে হবে রাগ ভাঙানোর।
কবির শাহ সবসময় মেয়েদের বলেন,”একেকজনের রাগ ভাঙার উপায় একেকরকম। কেউ ব্লে’ড দিয়ে হাত-পা কেটে রাগ কমায়, কেউ জিনিসপত্র ভাঙচুর করে, আবার কেউ চিৎকার করে। তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে তোমার রাগ কিসে কমে। তবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে বা জিনিসপত্র নষ্ট করে রাগ কমানো ক্ষণস্থায়ী। তাই এমনভাবে রাগটা বশীকরণ করতে হবে যেনো সাপও না মরে, লাঠিও না ভাঙে।”
প্রিয়তার মাঝে মাঝে ভয়ানক রাগ ওঠে। ইচ্ছা হয় আশেপাশের সবকিছু ভেঙে ফেলতে। কিন্তু পরক্ষণেই তার বাবার কথা মনে পড়ে।
সে অনেকবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে,”বাবা আর কি উপায়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়?”
কবির শাহ মুচকি হেসে বলেছেন,”তোমার রাগ কিসে কমে তা তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে।”
প্রিয়তা অনেক খুঁজে পেয়েছে, সে যদি উল্টো করে সংখ্যা পড়তে থাকে তাহলে কাজে দেয়।
চোখ বন্ধ করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে প্রিয়তা পড়া শুরু করে,
নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই……
রাগ কমে না কোনোভাবেই। এতে কাজ হবে না। আজ সে ভীষণ রেগে গেছে বদরাগী ছেলেটার উপর। মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে, নাহলে শান্তি নেই।

ঘরে ঢুকতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো উচ্ছ্বাস। মার্জিয়া বেগম শান্তভাবে বসে আছে তার খাটের উপর। তার টেবিলে একটা ক্রিমি’নাল অফেন্সের বই। সেটাই উল্টেপাল্টে দেখছিলো মার্জিয়া বেগম।
উচ্ছ্বাসের শরীর ভেজা, চুলগুলো থেকে পানি পড়ছে টপটপ করে।
“তুমি এসেছো?”
মার্জিয়া বেগম ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে তার দিকে তাকায়।
উচ্ছ্বাস যন্ত্রের মতো বললো,”মামি কিছু বলবেন?”
মার্জিয়া বেগম বইটা রেখে উঠে দাঁড়ায়।
“খুব বই পড়ো মনে হচ্ছে? তবে এসব কি খু নীদের গল্প পড়ো? শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবি ঠাকুর উনাদের বই পড়বে। তোমাদের বয়সটাই তো ওসব পড়ার। এসব ছাঁইপাশ পড়ে কি হবে?”
উচ্ছ্বাস কিছুই বুঝতে পারেনা। এই ভদ্রমহিলা কখনোই তার সাথে এভাবে কথা বলেননি। সবসময় কটু কথা শুনিয়েছে, আজ হঠাৎ কি হলো?
“আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান মামি?”
“বলতে তো চাই। কিন্তু তুমি তো ভিজে চুপসে আছো একদম। মনে হয় খুব ভিজলে বৃষ্টিতে তাইনা?”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না।
“বেশ তুমি ভেজা কাপড় পালটে নাও, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। হয়ে গেলে আমাকে ডেকে নিও।”
উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে বললো,”তার প্রয়োজন হবে না মামি। আমাদের এটুকুতে কিছু হয়না। আপনি কি বলতে চান বলতে পারেন।”
মার্জিয়া বেগম আবার হাসে। উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে দেখে মা-মেয়ের হাসিতে কি মিল। দুইজনই হাসলে বাম গালে টোল পড়ে। পরক্ষণেই নিজের চিন্তায় নিজেই বিরক্ত হয়। কেনো সে বারবার ওই মেয়েটার চিন্তা করে? না চাইতেও মস্তিষ্ক কেনো ওই মুখশ্রীটা চোখের সামনে মেলে ধরে?
“এ ধরণের কথায় মেয়েরা খুব ভালো মুগ্ধ হয়ে যায় জানো? একদম বরশি গিলে ফেলার মতো।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না মামি।”
“খুব সাধারণ ভাবেই বলছি। মেয়ে পটানো যায় দুই ভাবে। প্রথমত খুব মিষ্টি করে কথা বলে, সারাক্ষণ তার রূপের প্রশংসা করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মেয়ে পটে যাওয়ার সম্ভাবনা অতোটাও বেশি নয়। দ্বিতীয় যে উপায়, তা হলো নিজেকে একটা শক্ত প্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ করার নাটক। মেয়েটা চাইলেও সেই প্রাচীরের মধ্যে ঢুকতে পারবে না। ছেলেটা এমন ভাব করবে যেনো সে মেয়েটাকে সহ্যই কর‍তে পারছে না, কিংবা তাকে খেয়ালই করছে না। এই প্রক্রিয়াটা খুবই কার্যকরী। শতকরা নব্বই ভাগ মেয়ে বিশেষ করে কিশোরী বা তরুণীরা এতে পটে যায়। তারা সেই পুরুষটিকে মহাপুরুষ ধরণের কিছু ভেবে বসে। ফলে সহজেই মেয়েটা ছেলেটার প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। ছেলেটাও ফায়দা নিতে থাকে।”
উচ্ছ্বাস একরকম হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মার্জিয়া বেগমের দিকে। প্রচন্ড বুদ্ধিমান উচ্ছ্বাস সহজেই বুঝে যায় মার্জিয়া বেগমের ইঙ্গিত। তবে কি সে তাকে দ্বিতীয় ক্যাটাগরির কেউ মনে করলো?

“কি ব্যাপার চুপ করে আছো যে?”
উচ্ছ্বাস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”কিছু বলার মতো ভাষা পাচ্ছিনা তাই চুপ করে আছি।”
মার্জিয়া বেগম হঠাৎ হাসি থামিয়ে চুপ করে যায়। কঠিন মুখে উচ্ছ্বাসের অনেকটা কাছে এসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”একটা কুমারী মেয়ের সাথে একা ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে লজ্জা করলো না একটুও?”
উচ্ছ্বাস হতবিহ্বল হয়ে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। কোনো কথা সরে না মুখ দিয়ে তার।
“যখনই শুনলে ওর বিয়েটা ভেঙে গেছে, তখনই ছাদে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চলে গেলে তাইনা? বোকা মেয়েটাকে তো ভালোই নিজের আয়ত্তে নিয়েছো।”
উচ্ছ্বাস মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,”মামি এসব কি বলছেন আপনি? আপনি যা ভাবছেন তা না।”
মার্জিয়া বেগম হাত তুলে থামিয়ে দেয় উচ্ছ্বাসকে।
“চুপ করো, একদম চুপ। আর একটা কথাও তুমি বলবে না।”
“আমাকে সুযোগটা তো দিন কিছু বলার।”
“তোমার কোনো কথা শোনার মতো ইচ্ছা বা ধৈর্য্য আমার নেই। শুধু কিছু কথা বলতে এসেছি। চুপচাপ শুনবে। যতো তাড়াতাড়ি কথাগুলো মাথায় ঢুকিয়ে নিবে ততই তোমার জন্য মঙ্গলের।”
উচ্ছ্বাস বুঝতে পারে তার রাগের পারদ তরতর করে উঠে যাচ্ছে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে সে, কোনোভাবেই পারে না।

রাগে ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢোকে প্রিয়তা। মুখ লাল টকটকে হয়ে আছে তার। ইচ্ছা করছে বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যেয়ে ঘুরে আসতে। যদিও সে বুঝতে পারছে এতো রাগ করার কিছু হয়নি। সে তো মেনেই নিয়েছিলো ওই মানুষটার এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার। তবে আজ কেনো এতো রাগ হচ্ছে তার?
তার একটাই কারণ, কেনো সন্ধ্যায় এতো ভালো ব্যবহার করলো সে তার সাথে? সে কি চেয়েছিলো এতো সহানুভূতি? কে বড় বড় লেকচার দিতে বলেছিলো তার মন খারাপের সময়? আবার চা খেতেও চাইলো প্রিয়তার হাতের। কিন্তু চা নিয়ে যাওয়ার পর আবার সেই কুৎসিত মানুষটা বেরিয়ে এলো তার ভিতর থেকে।
ঘরে ঢুকতেই বাবাকে দেখে একটু চমকে যায় প্রিয়তা। কবির শাহ হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“বাবা তুমি এখানে?”
“কেনো রে আমি তোর ঘরে আসতে পারিনা বুঝি?”
প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় বললো,”অবশ্যই পারো বাবা, একশ বার পারো।”
“তা তোর পড়াশোনা কেমন চলছে রে মা?”
“ভালো বাবা।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে আস্তে আস্তে তার রাগ কমে যাচ্ছে। বাবা মানুষটাই এমন। তার সাথে দুই মিনিট কথা বললে রাগ কমতে বাধ্য।
কবির শাহ এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। পরম শান্তিতে চোখ বুঁজে প্রিয়তা। বাবাদের হাতে এতো কি প্রশান্তি থাকে যে মাথায় রাখলেই সব কষ্ট, রাগ উধাও হয়ে যায়?
“মা রে, তোদের দুই বোনকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন রে। পেখমের জন্মের পর সবাই বলেছিলো কবিরের তো ছেলে হলো না। কি হবে ওর স্বপ্নের? ও যে সন্তানদের অনেক বড় পর্যায়ে নিতে চায়, মানুষের মতো মানুষ করতে চায়। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে শুধু হেসেছিলাম, কিচ্ছু বলিনি। আমি সেদিনই শপথ নিয়েছিলাম, আমার মেয়েদের আমি অনেক বড় করবো, মানুষের মতো মানুষ বানাবো। একটা ছেলেকে যে যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, আমি তোদের তাই দিবো। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবি তোরা একদিন সেই স্বপ্ন দেখি আমি। কেউ যেনো বলতে না পারে, ওরা মেয়ে তাই পারেনি। তোদের আমি শীর্ষে ওঠার সেই সুযোগটা দিতে চেয়েছি আজীবন। আর আমি খুশি, তোদের পড়ার উপর ঝোঁকও আছে। সবসময় ভালো ফলাফল করেছিস তোরা দুই বোন। তাই তোদের উপর কোনো ঝড় আমি কখনো আসতে দিবো না। যে তোদের ডানা ছেঁটে দিতে চাইবে, সে যে-ই হোক আমি রুখে দাঁড়াবোই। আমার মেয়েদের ভালো থাকার সাথে আমি কোনো আপোষ করবো না।”
প্রিয়তার হঠাৎ কেমন কান্না পেয়ে যায়। বাবার কথাগুলো একদম তীরের ফলার মতো বুকে যেয়ে লাগে তার। তার বাবা তাদের কতোটা ভালোবাসে। তারা কি পারবে বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে? ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে প্রিয়তা।

“আমি যে চাইনা তুমি এখানে থাকো, তুমি তা ভালো করেই বুঝতে পারছো। মধ্যবিত্ত সংসারে হুট করে একজন আগন্তুক এসে উপস্থিত হলে যে কেউ-ই মেনে নিতে পারবে না। তাও আবার আপন কেউ নও তুমি। প্রিয়তার বাবার বেশ দু:সম্পর্কের আত্মীয় তুমি। আমি না চাইতেও শুধুমাত্র প্রিয়তার বাবার জন্য তুমি এখানে থাকতে পারছো। আমি তাও মেনে নিয়েছিলাম কোনোমতে। কিন্তু ঘটনা যখন আমার মেয়েদের নিয়ে তখন তো আমি চুপ থাকতে পারিনা। আমার ঘরে দুইটা প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে। আর তাদের বয়সটাও ভুল করার। যদি ধরেও নিই, তুমি ধোয়া তুলসীপাতা তবুও আমি দুশ্চিন্তা করবো। কারণ আমার মেয়েরা তো অবুঝ। ভুল করার বয়সে ভুল করবেই তারা আর এটাই স্বাভাবিক।”
উচ্ছ্বাস মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। এসব কি ইঙ্গিত দিচ্ছেন উনি? এ কি কোনোদিনও সম্ভব?
“আসলে আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। আমি চাচ্ছিনা তুমি এখানে থাকো। মন থেকেই বলছি। বেশ কিছুদিনই তো হলো, এবার নিজের চিন্তাটা করো। যতোদূর জানি তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলে। তুমি মেধাবী, সেই সাথে বুদ্ধিমান। একটু চাইলেই ভালো একটা চাকরি পেয়ে যাবে। ততদিন পর্যন্ত তুমি এখানে থাকতে পারো। কিন্তু তাও খুব বেশিদিনের জন্য নয়। আর ততদিন আমার মেয়েদের থেকে শত হাত দূরে থাকবে তুমি। আমি চাইনা ওদের ছায়াটুকুও দেখো তুমি। ওরা নরম কাদার মতো এখন। ওদের যেভাবে গড়া হবে, ওরা সেভাবেই আকৃতি নিবে। আমি আমার মেয়েদের জীবন নষ্ট হতে দিবো না। তুমি প্রখর বুদ্ধিমান, তোমাকে নিশ্চয়ই এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে হবে না।”
উচ্ছ্বাস শুন্যের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে সে আসতে চায়নি। ওর নিজেরও প্রাণের ঝুঁকি ছিলো। তাই তার দু:সম্পর্কের মামা, যাকে কিনা তার বাবা মা এক সময় অনেক সাহায্য করেছিলো, সে তাকে সবার আড়ালে তার বাড়িতে এনে তুলেছে। তার বাবা মায়ের মৃ ত্যুর আসলে কারণও বাড়ির কাউকে জানায়নি।
তবে এবার উচ্ছ্বাসের মনে হচ্ছে আর নয়। এবার এখান থেকে চলে যেতেই হবে। নিজেকে আর অপমানিত করতে চায়না সে। এমনিতেই এক আকাশ সমান কষ্টে তার বুকটা পরিপূর্ণ হয়ে আছে। নতুন করে আর কোনো কষ্ট সে নিজেকে দিতে চায়না।

“তুমি নিজের ঘরেই খাওয়া দাওয়া করবে। তোমার মামা ডাকতে এলেও টেবিলে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি তোমার খাবারটা এখানেই দিয়ে যাচ্ছি।”
মার্জিয়া বেগম চলে যেতে যেতে আবার পিছন ঘুরে তাকায়।
“আমার কথাগুলো মনে রাখবে। কোনোরকম যেনো নড়চড় না হয়। আমি রেগে গেলে অন্য মানুষ হয়ে যাই, হয়তো এখনো জানো না তুমি।”
উচ্ছ্বাসকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মার্জিয়া বেগম বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। উচ্ছ্বাস টালমাটাল পায়ে হেঁটে ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়ে। অসহ্য যন্ত্রণা করছে মাথায়। ওই ঘটনার পর থেকে এমন মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তার। যখন যন্ত্রণাটা বাড়ে সে হতবিহ্বল হয়ে যায়। মনে হয় কেউ বুঝি ধারালো করাত দিয়ে তার মাথার শিরাগুলো কেটে দিচ্ছে।
দুই হাতে চুল চেপে ধরে উচ্ছ্বাস বসে থাকে। লাল হয়ে যায় তার ফর্সামুখটা।

(চলবে…..)