Wednesday, July 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 62



মেমসাহেব পর্ব-৫+৬

0

🔴মেমসাহেব (পর্ব :৫, ৬)🔴
– নিমাই ভট্টাচার্য

আমি দিল্লী ফিরে এসেছি, কিন্তু কদিন এমন অপ্ৰত্যাশিত ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটালাম যে, কিছুতেই তোমাকে চিঠি লেখার সময় পাইনি। তাছাড়া ইতিমধ্যে দু’দিনের জন্য তোমাদের বন্ধু মাধুরী চ্যাটার্জি আর তাঁর স্বামী এসেছিলেন। মাধুরীকে মনে পড়ছে তোমার? প্রেসিডেন্সীতে ফিলসফি নিয়ে পড়ত। পার্কসার্কাস-বেগবাগানের মোড়ে থাকত।

দিল্লীতে আসার পর নিত্য-নৈমিত্তিক পরিচিত আধা-পরিচিত অনেকেই আসেন আমার আস্তানায়। কেউ ইণ্টারভিউ দিতে, কেউ অফিসের কাজে, কেউ বা আবার ডেরাডুন-মূসৌরী-হরিদ্বারের পথে লালকেল্লা-কুতুবমিনার আর রাজঘাট-শাস্তিবনা দেখার অভিপ্ৰায়ে। মাধুরী চালাৰু মেয়ে। হাজার হোক তোমাদেরই বন্ধু তো! স্বামী এসেছিলেন অফিসের কাজে; আর উনি এসেছিলেন স্বামীকে অনুপ্রেরণা দিতে। এখনও সেই আগের মতনই হৈ-হুল্লোড় করে। স্বামীকে সকাল বেলায় অফিসে রওনা করিয়ে দিয়ে সারা দিন নিজে হৈ-হৈ করে চক্কর কেটে বেড়াত আমার সঙ্গে। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। কিন্তু মাধুরী হতো না। বিকেল বেলায় স্বামী এলে আমাদের সেকেণ্ড ইনিংস শুরু হতো।

যাই হোক বেশ কাটল দু’টো দিন। মাধুরীর কাছে তোমার একটা শাড়ী আর পেটুক খোকনদার জন্য খানিকটা শোনহালুয়া পাঠিয়েছি। শাড়ীটা তোমার পছন্দ হলো কিনা জানিও।

এদিকে আমার মনের ওপর দিয়ে নীলিমার ঝড় বয়ে যাবার পর পরই হঠাৎ সাংবাদিকতা শুরু করলাম। আমার জীবনের সে এক মাহেন্দ্ৰক্ষণ। জীবনের সমস্ত হিসাব-নিকাশ। ওলট-পালট হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত বাঙালী ঘরের ছেলে। ম্যাট্রিক পাশ করে আই-এ পড়ে, আই-এ পাশ করে বি-এ পড়ে। তারপর ইউনিভার্সিটির দেওয়া পাশপোর্ট নিয়ে চোদ্দ আনা ছেলে নেমে পড়ত জীবনযুদ্ধের পাওয়ার লীগ খেলতে। বাকি দু’ আন আরো এগিয়ে যেত। তাদের মধ্যে কেউ ফাস্ট ডিভিশনে, কেউ আই-এফএ শীল্ডে বা রোভার্স খেলত। কেউ কেউ আবার আরো এগিয়ে যেত।

আমি পাওয়ার লীগে খেলবার জন্যই জন্মেছিলাম ও তারই প্ৰস্তুতি করছিলাম। মাঝে মাঝে অবশ্য স্বপ্ন দেখতাম ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবো। অথবা অধ্যাপক হয়ে কেঁচা দুলিয়ে কলেজে আসব, মেয়েদের পড়াব, ছেলেদের পড়াব। ছাত্রীদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পাবার জন্য মন আকুল ব্যাকুল হলেও আমি কিছুতেই তার প্রকাশ করব না। কিন্তু তবু ছাত্রীরা আমার কাছে ছুটে আসবে নানা কারণে, নানা প্ৰয়োজনে। ইলোরাদের বাড়ি একদিন চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করায় অনেক সরস কাহিনী ছড়াবে সমগ্ৰ নারীজগতের মধ্যে। তারপর ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি আর কি!

আমাদের আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে কেউ কোনদিন খবরের কাগজে চাকরি করা তো দূরের কথা, খবরের কাগজের অফিসে পৰ্যন্ত যান নি। তাইতো কেউ কল্পনা করেন নি তাদের বংশের এই কুলাঙ্গার খবরের কাগজে চাকরি করবে। দেশটা দুটুকরো। হবার আগে আমাদের সমাজজীবন কয়েকটা পরিচিত ধারায় বয়ে গেছে। পরিচিত সীমানার বাইরে যাবার প্রয়োজন বা তাগিদ। বিশেষ কেউই বোধ করেন নি। দেশটা স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গেই অতীত দিনের সে সব রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন প্রয়োজন কোথায় যেন তলিয়ে গেল। এই শান্ত-ম্বিন্ধ পৃথিবীটা যেন কোটি কোটি বছর পেছিয়ে অগ্নি-বলয়ে পরিণত হলো। জৈব প্রয়োজনটা চরম নগ্নভাবে প্ৰকাশ করল। ইতিহাসের বলি হয়ে মানুষগুলো বাঁচবার প্রয়োজনে উন্মাদের মত ছুটে বেড়াল চারদিকে। সেদিনের সে অগ্নি-বলয় পৃথিবীর যে যেখানে পারল আস্তানা করে নিল। লক্ষপতির ছেলে কলেজ ষ্ট্রীটে হকার হলো, আমার-তোমার চাইতেও বনেদী ঘরের অনেক মেয়ে-বৌ বৌবাজার আর লিণ্ডসে স্ট্রীটের ম্যাসেজ-বাথে গিয়ে দেহ বিক্রয় করতে বাধ্য হলো।

বৌবাজারের রথের মেলায় বা বিজয়া দশমীর দিন কুমুরটুলীর ঘাটে লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট বাচ্চাদের দেখেছি? দেখেছি কেমন হাউ হাউ করে কঁদে? লক্ষ্য করেছি বাবা-মা’কে হারিয়ে অসহায় হয়ে, ব্যাকুল হয়ে অর্থহীন ভাষায় সবার দিকেই কেমন তাকায়? আমিও সেদিন এমনি করে অর্থহীন ভাষায় চারদিকে তাকাচ্ছিলাম একটু ভবিষ্যতের আশায়। কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ, কোনটা সহজ, কোনটা কঠিন-ত ভাববার সময় বা ক্ষমতা কোনটাই সেদিন আমার ছিল না। তাইতো অপ্ৰত্যাশিতভাবে খবরের কাগজের রিপোর্টার হবার সুযোগ পেয়ে আমি আর দ্বিধা না করে এগিয়ে গেলাম।

রামায়ণে পড়েছি সতীত্বের প্রমাণ দেবার জন্য সীতাকে অগ্নি-পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। অগ্নি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও স্বামীর পাশে সীতার স্থান হয় নি। রাজরাজেশ্বরী সন্তানসম্ভবা সীতাকে প্রিয়হীন বন্ধুহীন নিঃস্ব হয়ে গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। জান দোলাবৌদি, আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় সীতার গর্ভেই বোধহয় বাঙালীর পূর্বপুরুষদের জন্ম। তা না হলে সমগ্ৰ বাঙালী জাতটা এমন অভিশাপগ্ৰস্ত কেন হলো? স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য চরম অগ্নি-পরীক্ষা দেবার পরও কেন তার রাহুমুক্তি হলো না? স্বাধীন সার্বভৌম ভারতবর্ষের নাগরিক হয়েও কেন তাদের চোখের জল পড়া বন্ধ হলো না?

সত্যি দোলাবৌদি, সেদিনের কথা মনে হলে আজও শরীরটা শিউরে ওঠে, মাথাটা ঘুরে যায়, দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়। সেই দুর্দিনের মধ্যেই আমি নতুন পথে যাত্রা শুরু করলাম। সকালবেলার টিউশানি দু’টো ছাড়লাম না; কিন্তু বিকেলের ছাত্র পড়ান বন্ধ করলাম। দুপুরে কলেজ করে সাড়ে তিনটে কি চারটে বাজতে বাজতেই নোট-বই পেন্সিল নিয়ে চলে যেতম সভাসমিতি বা কোন প্রেস কনফারেন্সে। তারপর অফিস। রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত রোজই কাজ করতে হতো। কোন কোনদিন আবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত তিনটে-চারটেও হয়ে যেত।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এমনি করে চালিয়েছি। বিনিময়ে কি পেয়েছি? প্ৰথম বছর একটি পয়সাও পাইনি। নিজের টিউশানির রোজগার দিয়ে ট্রাম-বাসের খরচ চালিয়েছি। পরের বছর থেকে মাসিক দশ-টাকা রোজগার শুরু করলাম। ইতিমধ্যে বিজ্ঞান সাধনার প্রথম পর্ব শেষ করলাম। পিতৃদেব ফতোয় জারী করলেন, সাংবাদিকতার খেলা শেষ করে একটা রাস্ত ধর। সত্যি তখন অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক পরিস্থিতি এমনসঙ্কটাপন্ন ছিল যে, কিছু একটানা করলে চলছিল না। আমার বন্ধু-বান্ধবরাও এই একই সমস্যার সম্মুখীন হলো। সবাই উপলব্ধি করছিল। কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে-তা কেউই জানত না। ডাক্তারী-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মত রসদ কারুরই ছিল না। তাই ওদিকে আর কেউ পা বাড়াল না। আমি রিক্রুটিং অফিস থেকে শুরু করে খিদিরপুর বারাকপুরের সমস্ত কল-কারখানার দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ালাম একটা পঞ্চাশ টাকার অ্যাপ্রেনিটিসশিপের জন্য। জুটল না। তাই এবার বিজ্ঞান সাধনায় ইস্তফা দিয়ে সাহিত্যসাধনা আর সাংবাদিকতা নিয়েই পরবর্তী অধ্যায় শুরু করলাম।

তোমাকে এত কথা লিখতাম না। তাছাড়া হয়ত কিছু কিছু তুমি শুনেছি বা জেনেছি। কিন্তু এই জন্যই এসব জানাচ্ছি যে, আমার জীবনের কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে মেমসাহেবকে পেয়েছিলাম, তা না জানালে তুমি ঠিক গুরুত্বটা উপলব্ধি করবে না।

যৌবনে প্ৰায় সব ছেলেমেয়েই প্রেমে পড়ে। এটা তাদের ধর্ম, কর্ম। প্ৰয়োজনও বটে কিছুটা। তাছাড়া শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে পূর্ণতা লাভ করার এটা সব চাইতে বড় প্ৰমাণ। কলেজের কমনরুমে বা থিয়েটারের গ্ৰীনরুমে অনেক প্রেমের কাহিনীরই আদি-পৰ্ব রচিত হয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার মেয়াদ ক্ষণস্থায়ী। সামান্য একটু হাসি, সামান্য একটু গল্প, একটু মেলামেশার পর অনেক ছেলেমেয়েই প্রেমের নেশায় মশগুল হয়ে ওঠে। জীবনকে উপলব্ধি না করে, ঘাত-প্ৰতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের অগ্নি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়ে যারা প্ৰেম করে বলে দাবী করে, তারা হয় বোকা, নয় মিথ্যাবাদী। দুটি মন, দুটি প্ৰাণ, দুটি ধারা, দুটি অপরিচিত মানুষ একই সঙ্গে কোরাস গাইবে অথচ তার পরিবেশ থাকবে না, প্ৰস্তুতি থাকবে না, তা হতে পারে না। এই পরিবেশ আর প্রস্তুতি থাকে না বলেই আমাদের দেশের কলেজ রেস্তোরাঁর প্ৰেম প্রায়ই ব্যর্থ হয়। দুধ জমিয়ে ভাল মিষ্টি দই খেতে হলে অনেক তদ্বির, তদারক ও প্ৰস্তুতির প্রয়োজন। একটু হিসাব-নিকাশ বা তদ্বিার-তদারকের গণ্ডগোলে হয়। দই জমে না, অথবা জমলেও দইট টক হয়ে যায়।আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার

দুটি নারীপুরুষকে নিয়ে একটা সুন্দর ছন্দোবদ্ধ জীবন গড়ে তুলতে হলে শুধু চোখের নেশা আর দেহের ক্ষুধাই যথেষ্ট নয়। আরো অনেক কিছু চাই। তাছাড়া জীবনে এই পরম চাওয়া চাইবারও একটা সময় আছে। কিছু পেতে হলেও সে পাওয়ার অধিকার অর্জন করতে হয়।

বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ও পরিবেশে অনেককেই অনেক সময় ভাল লাগে। হাসপাতালে হাসিখুশি ভরা নার্সদের কত আপন, কত প্রিয় মনে হয়। কিন্তু হাসপাতালের বাইরে? সমাজ জীবনের বৃহত্তর পরিবেশে? ক’জন পারে তাদের আপনি জ্ঞানে সমাদর করতে?

আমার জীবনটা যদি সুন্দর, স্বাভাবিক ও ছন্দময় হয়ে এগিয়ে যেত তাহলে হয়ত যে কোন মেয়েকে দিয়েই আমার জীবনের প্রয়োজন মিটত। কিন্তু আমি জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের জন্য তিলে তিলে দগ্ধ হচ্ছিলাম। একটু সম্রামের সঙ্গে বাঁচবার জন্যে অসংখ্য মানুষের স্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরেও কোন ফল হয় নি। মাত্র একশ পঁচিশ টাকার একটা সামান্য রিপোর্টারের চাকরির জন্য কতজনকে যে দিনের পর দিন তৈল-মৰ্দন করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। তবুও বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দের যোগ্য বংশধরদের মন গলে নি।

কেন, আত্মীয়-বন্ধুর দল? পাঁচশ বা পঞ্চাশ টাকা মাইনের রিপোর্টারের সঙ্গে আবার আত্মীয়তা কিসের? নিতান্ত দু’চারজন মুৰ্থ বন্ধু ছাড়া আর সবার কাছেই আমি অস্পৃশ্য হয়ে গেলাম।

দোলাবৌদি, আমার সে চরম দুর্দিনের ইতিহাস তোমাকে আর বেশী লিখব না। তুমি দুঃখ পাবে। তবে জেনে রাখা তোমাদের ঐ কলকাতার রাজপথে আমি দীর্ঘদিন ধরে উন্মাদের মত ঘুরে বেড়িয়েছি, একটি পয়সার অভাবে সেকেণ্ড ক্লাশ ট্রামে পৰ্যন্ত চড়তে পারিনি। দু’চারজন নিকট আত্মীয়ের প্রতি কর্তব্য পালন করে বহুদিন নিজের অদৃষ্ট দুবেল অন্ন জোটাতেও পারিনি। কিন্তু কি আশ্চর্ষ। বিধাতাপুরুষ যত নিষ্ঠুর হয়েছেন আমার প্রতিজ্ঞাও তত প্ৰবল হয়েছে। বিধাতার কাছে কিছুতেই হার মানতে চায় নি আমার মন।

এমনি করে বিধাতাপুরুষের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে প্রায় সাত-আট বছর কেটে গেল। তবুও কোন কুল-কিনারা নজরে পড়ল না। এই সাত-আট বছরে আমার দৃষ্টিভঙ্গীর অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। সাত-আট বছর আগে শুধু বেঁচে থাকবার জন্য আমি কর্মজীবন শুরু করেছিলাম, কিন্তু সাত-আট বছর পরে আমি শুধু বাঁচতে; চাইনি। লক্ষ লক্ষ মানুষের অরণ্যের মধ্যে আমি হারিয়ে যেতে চাইনি। চাইনি শুধু অন্ন-বস্ত্ৰ-বাসস্থানের সমস্যার সমাধান করতে। মনে মনে আরো কিছু আশা কয়ছিলাম।

কিন্তু আশা করলেই তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না। তাছাড়া শুধু আশা করে আর কতদিন নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্ৰাম করা যায়? আমি হঁাপিয়ে উঠলাম। মনের শক্তি, দেহের তেজ যেন আস্তে আস্তে হারাতে শুরু করলাম। হাজার হোক ধৈর্ষেরও তো একটা সীমা আছে।

কাজকর্মে ফাঁকি দিতে শুরু করলাম। ঘুরে-ফিরে নিত্য-নতুন খবর যোগাড় করার চাইতে নিউজ ডিপার্টমেণ্টে সাব-এডিটরদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াই আমার কাছে বেশী আর্কষণীয় হলো। শুধু আমাদের অফিসে নয়, আরো অনেক আড্ডাখানায় যাতায়াত শুরু করলাম। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কেমন যেন দার্শনিকসুলভ ঔদাসীন্য দেখা দিল। মোদ্দা-কথায় আমি বেশ পাল্টাতে শুরু করলাম।

বেশীদিন নয়, আর কিছুকাল এমনি করে চললে আমি নিশ্চয়ই চিরকালের মত চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতাম। ঠিক এমনি এক চরম মুহুর্তে ঘটে গেল সেই অঘটন।

শান্তিনিকেতন থেকে ফিরছিলাম। কলকাতা। বোলপুর স্টেশনে দানাপুর প্যাসেঞ্জারে আমার কামরায় আরো অনেকে উঠলেন। ভিড়ের মধ্যে কোনমতে এক পাশে জায়গা করে আমি বসে। পড়লাম। জানলার পাশে মাথাটা রেখে আনমনা হয়ে কিছুক্ষণ কি যে দেখছিলাম। দু’চারটে স্টেশনও পার হয়ে গেল। বীরভূমের লালমাটি আর তালগাছ কখন যে পিছনে ফেলে এসেছি, তাও খেয়াল করলাম না। বাইরে অন্ধকার নেমে এলো। উদাস। দৃষ্টিটাকে ঘুরিয়ে কামরার মধ্যে নিয়ে এলাম। ভাবছিলাম। কামরাটাকে একটু ভাল করে দেখে নেব। কিন্তু পারলাম না। বৃষ্টিটি। সামনের দিকে এগুতে গিয়েই আটকে পড়ল। এমন বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জল গাভীয় ঘনকালো টানা-টানা দুটি চোখ আগে কখনও দেখিনি। একবার নয়, দুবার নয়, বার বার দেখলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে আবার দেখলাম। আপাদ-মস্তক ভাল করে দেখলাম। অসত্যের মত, হাংলার মত আমি শুধু ঐ দিকেই চেয়ে রইলাম।

আমি যদি খোকনদার মত সাহিত্যের ভাল ছাত্র হতাম ও সংস্কৃত সাহিত্য পড়া থাকত, তাহলে হয়ত কালিদাসের মেঘদূতের উত্তরমেঘ থেকে কোট করে বলতাম-তম্বী শুষ্ঠামা শিখরিদশনা পাকবিশ্বাধরোষ্ঠী, মধ্যে ক্ষমা চকিতহরিণীপ্ৰেক্ষণা নিন্মনাভিঃ। কালিদাসের মত আমি আর এগিয়ে যেতে পারিনি। এইখানেই আটকে গেলাম। তাছাড়া দানাপুর প্যাসেঞ্জারের ঐ কামরায় অতগুলো প্যাসেনঞ্জারের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে এর চাইতে বেশী কি এগুতে পারা যায়?

পরে অবশ্য মেমসাহেবকে আমি আমার সেদিনের মনের ইচ্ছার কথা বলেছিলাম। ক’মাস পর আমি আর মেমসাহেব দানাপুর প্যাসেঞ্জারেই শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা ফিরছিলাম। বর্ধমানে এসে কামরাটা প্ৰায় খালি হয়ে গেল। ও পাশের বেঞ্চিতে শুধু এক বৃদ্ধি-বৃদ্ধ ছাড়া আর কোন যাত্রী ছিল না। মেমসাহেব আমার হাতের পর মুখটা রেখে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। আমিও যেন কি ভাবছিলাম। হঠাৎ মেমসাহেব আমাকে একটু নাড়া দিয়ে বলল, শোন।

আমি ঠিক খেয়াল করিনি। মেমসাহেব। আবার আমাকে ডাক দিল, শোন না।

কিছু বলছ?

মেমসাহেব হাত দিয়ে আমার মুখটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। আঙুল দিয়ে আমার কপালের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল। দু’চার মিনিট শুধু চেয়ে রইল আমার দিকে। একটু হাসল। সলজ দৃষ্টিটা একটু ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে।

এবার আমি ওর মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম আমার দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কিছু বলবে?

আমার দিকে তাকাতে পারল না। ট্রেনের কামরার ঐ স্বল্প আলোয় ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মনে হলো যেন লজ্জায় ওর মুখটা লাল হয়ে গেছে। দেখতে বেশ লাগছিল। দু’চার মিনিট আমি ওকে প্রাণভরে দেখে নিলাম। তারপর কানে কানে ফিসফিস করে বললাম, লজ্জা করছে?

মেমসাহেব জবাব দিল না। শুধু হাসল। একটু পরে আমার কানে কানে বলল, একটা কথা বলবো?

বল।

প্ৰথম যেদিন তুমি আমাকে এমনি ট্রেনে যাবার সময় দেখেছিলে, সেদিন আমাকে তোমার ভাল লেগেছিল?

মনে হয়েছিল–
তম্বী শ্যামা শিখরিদশনা পাকবিম্বাধরোষ্ঠী,
মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণী প্ৰেক্ষণ নিম্ননাভিঃ।
শ্রোণীতারাদলসগমনা স্তোকনম্রা স্তনাভ্যাং,
যা তত্ৰ স্যাদযুবতিবিষয়ে সৃষ্টিরাদ্যেব ধাতুঃ।।।

মেমসাহেব ঠাস করে আমার গালে একটা চড় মেরে বলল, অসভ্য কোথাকার।

ছি, ছি, মেমসাহেব, তুমি আমাকে অসভ্য বললে। অসভ্য বলতে হলে কালিদাসকে অসভ্য বলো।

আমি একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি রামায়ণ পড়েছ?

কেন? এবার বুঝি রামায়ণের একটা কোটেশন শোনাবো?

আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

পড়েছি।

মূল রামায়ণ বা তার অনুবাদ পড়েছ?

মূল সংস্কৃত রামায়ণ পড়িনি, কিন্তু অনুবাদ পড়েছি।

ভেরী গুড়। দণ্ডকারণ্যে সীতাকে প্ৰথম দেখার পর রাবণ কি বলেছিলেন জান?

সীতার রূপের তারিফ করেছিলেন, কিন্তু ঠিক কি বলেছিলেন, তা মনে নেই।

বেশ তো আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। রাবণ সীতাকে বলেছিলেন–

মেমসাহেব বাধা দিয়ে বললে, তোমার আর শোনাতে হবে না। ঠিক লাইনগুলো মনে না থাকলেও আমি জানি রাবণ কি ধরনের সংঘাতিক বর্ণনা করেছিলেন।

একটু থেমে দৃষ্টিটা একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আমার মুখের কাছে মুখটা এনে বলল, তুমিও তো আর এক রাবণ। ডাকাত কোথাকার! দিনে দুপুরে কলকাতা শহরের মধ্যে আমাকে চুরি করলে।

যাকগে সেসব কথা। সেদিন শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছিলাম। চুরি করে দেখতে দেখতে একবার ধরা পড়লাম। চোখে চোখ পড়তেই আমি দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিলাম। কিন্তু মিনিটখানেক পরেই আবার চেয়েছি। আবার ধরা পড়েছি। আবার চেয়েছি, আবার ধরা পড়েছি।

মসাহেবের আর দুটি বন্ধু কিছু ধরতে না পারলেও হাওড়া স্টেশনে পৌঁছবার পর কামরা থেকে বেরুবার সময় আমার মনটা যে খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তা ও বেশ বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু কি করা যাবে? দুজনের কেউই কিছু বলতে পারিনি। জীবনের বর্ষণমুখর পথ চলতে গিয়ে এমনি একটু-আধটু বিদ্যুতের চমকানি তো সবার জীবনেই দেখা দিতে পারে। তাতে আশ্চৰ্য হবার কিছু নেই। অস্বাভাবিকতাও কিছু নেই।

ওরা তিন ও বন্ধু কামরা থেকে নামবার বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি নোমলাম। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলছিলাম গেটের দিকে। আরেকবার তাকিয়ে নিলাম ওর দিকে। মনে মনে ভাবছিলাম, এইত এক্ষুনি গেট পার হলেই দুজনে হারিয়ে যাব। কলকাতা শহরের জনারণ্যের মধ্যে। আর হয়ত জীবনেও কোনদিন দেখা হবে না। হয়ত কেন? নিশ্চয়ই কোনদিন দেখা হবে না। হঠাৎ গেটের দিকে তাকাতে নজর পড়ল, মেমসাহেব একবার মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল। আমি দূর থেকে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানালাম।

কেউ বুঝল না, কেউ জানল না, কি ঘটে গেল। এমন কি আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি। কি হয়ে গেল। আমি তো এর আগে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে অমন করে দেখিনি, কোন মেয়েও তো। অমন করে আমাকে মাতাল করে তোলে নি। কেন এমন হলো? শুধু বুঝেছিলাম, বিধাতাপুরুষের নিশ্চয়ই কোন ইঙ্গিত আছে। আর মনে মনে জেনেছিলাম, দেখা আমাদের হবেই।

বিশ্বাস কর দোলাবৌদি, শুধু আমার চোখের নেশা নয়, শুধু মেমসাহেবের দেহের আকর্ষণও নয়, আরো কি যেন একটা আশ্চৰ্য টান অনুভব করেছিলাম মনের মধ্যে। মনে মনে বেশ উপলব্ধি করলাম যে, আমার জীবনযুদ্ধের নতুন সেনাপতি হাজির! এই নতুন সেনাপতি আমাকে সহজে পরাজয় বরণ করতে দেবে না, আমাকে পিছিয়ে যেতে দেবে না। আমাকে হারিয়ে যেতে দেবে না। ভবিষ্যতের অন্ধকারে।

অদৃষ্ট যে মানুষকে কোথায় নিয়ে য়েতে পারে, কি আশ্চৰ্যভাবে দুটি অপরিচিত মানুষকে নিবিড় করে এক সূত্রে বেঁধে দেয়, তা ভাবলে চমকে উঠি।

পরের দিন বেশ দেরি করে অফিসে গেলাম। চীফ রিপোর্টার আশা করেন নি। আমি অফিসে আসব। তাই ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মিটিং আর গোটা তিনেক প্রেস কনফারেন্স কভার করার ব্যবস্থা দেখে আশ্চৰ্য হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার?

তুমি দৌড়ে একবার পার্ক স্বীট আৰ্ট ইন ইণ্ডাষ্ট্ৰতে গিয়ে যামিনী রায়ের একজিবিশনটা দেখে এসো। আজই শেষ দিন। ওর একটা রিভিউ না বেরুলে দোতলায় উঠতে পারছি না।

বুঝলাম উপরওয়ালারা বার বার বলা সত্ত্বেও একজিবিশনটার রিভিউ ছাপা হয় নি এবং এডিটর সাহেব বেশ অসন্তুষ্ট।

কলকাতার অন্যান্য রিপোর্টারদের মত আমিও নৃত্য-গীত বা শিল্পকলা বুঝতাম না, কিন্তু প্ৰয়োজনবোধে কলমের পর কলম রিপোর্ট লিখতে পারতাম ওসব নিয়ে। কেন তানসেন-সাদারঙও তো কভার করেছি। বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব গাইবার আগে স্টেজের পাশে ব্ল্যাকবোর্ডে রাগ ইত্যাদি লিখে দিত। আমার মত সঙ্গীতবিশারদ রিপোর্টারের দল সেই ফমূল ভাঙিয়েই বেশ এক প্যারা লিখে দিতাম। শেষে আবার বাহাদুরী করে হয়ত মন্তব্য লিখতাম, গতবারের চাইতেও এবারের খ্যা সাহেবের গান অনেক বেশী মেজাজী হয়েছিল। অথবা লিখেছি, রাগ রাগেশ্বরীতে সেতার বাজিয়ে মুগ্ধ করলেন রবিশঙ্কর। অনেক ভিন্নমত পোষণ করলেও আমার মনে হয় রাগ রাগেশ্বরীতেই রবিশঙ্কর তাঁর শিল্পীসত্তাকে সব চাইতে বেশী প্ৰকাশ করতে পারেন।

কেন মহাজাতি সদনের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে? রোজ অন্তত এক কলম লিখতেই হতো। লিখেছি, আজকের অধিবেশনের সব চাইতে উল্লেখযোগ্য শিল্পী ছিলেন। দ্বিজেন মুখার্জি। বিশেষ করে তাঁর শেষ গানখানি ভরা থাক ভরা থাক স্মৃতি-সুধায় বিদায়ের পাত্ৰখানি বহুদিন ভুলতে পারব না। গত বছরের সম্মেলনে এই গানখানিই আর এক’জন খ্যাতনামা শিল্পী গেয়েছিলেন। ভালই গেয়েছিলেন। কিন্তু তবুও যেন এত ভাল লাগে নি। বোধ করি দরদের অভাব ছিল। তাছাড়া কিছু কিছু গান আছে যা বিশেষ বিশেষ শিল্পীর কাছেই ভাল লাগে। চৈত্র দিনের ঝরা পাতার পুখে অনেকেই গাইতে পারেন, কিন্তু পঙ্কজ মল্লিকের মত কি আর কেউ গাইতে পারবেন? কেন সায়গলের গাওয়া আমি তোমায় যত’ বা কানন দেবীর সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে?–

এমনি করে কিছুটা কমনসেন্স আর কলমের জোরে রিপোর্টারের দল বেশ কাজ চালিয়ে যান। খবরের কাগজের রিপোর্টাররা অনেকটা মফঃস্বলের ডাক্তারবাবুদের মত। কিছুতেই বিশেষজ্ঞ নন, অথচ সব কিছু রোগেরই চিকিৎসা করেন। প্রয়োজনবোধে ছুরি-কঁচি নিয়ে একটা ছেড়া অ্যাপ্রন গায় চাপিয়ে পঞ্চানন চাটুজ্যে বা মুরারী মুখার্জির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেও দ্বিধা করেন না।

সুতরাং আমিও দ্বিধা না করে চলে গেলাম যামিনী রায়ের একজিবিশন রিভিউ করতে।

একেই একজিবিশনের শেষ দিন, তারপর আর্ট ইন ইণ্ডাস্ট্রির ছোট্ট ঘর। বেশ ভিড় হয়েছিল। তবুও আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে কিছু কিছু নোট নিচ্ছিলাম। একটা হলের দেখা শেষ করে। পাশের হলটায় যাবার মুখে অকস্মাৎ দেখা পেলাম মেমসাহেবের। ভাবলে আশ্চর্য লাগে, কিন্তু হাজার হোক Truth is stranger than fiction.

প্ৰায় দুজনেই একসঙ্গে বললাম, আরে আপনি?

আপনি বুঝি যামিনী রায়ের ভক্ত?–আমাকে প্রশ্ন করে মেমসাহেব।

পঞ্চাশ টাকা মাইনের রিপোর্টারী করি বলে এই আধ-ঘণ্টার জন্য ভক্ত হয়েছি।

আপনি বুঝি রিপোর্টার?

নির্লজ্জ আর বেহায়াপনা দেখে এখনও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে?

ছি, ছি, ওকথা কেন বলছেন? পাশের পেন্টিংটা এক নজর দেখে মেমসাহেব মন্তব্য করল, রিপোর্টারদের তো ভারী মজা।

আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস…

শেষ করতে হয় না। তার আগেই বলল, আপনি দেখছি রবীন্দ্ৰনাথেরও ভক্ত।

হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর একটু পরে দেখবেন আমি আপনারও ভক্ত।

লোকের ভিড়ের মধ্যে আর কথা হলো না। এই দু’এক মিনিটের মধ্যেই কিছু কিছু কলারসিক বেশ এক ঝলক আমাদের দেখে নিলেন।

পাশের হলটা চটপট ঘুরে দেখে নিয়ে আমরা দুজনেই একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম।

এখন রাত প্ৰায় দেড়টা বাজে। তাই আজ আর লিখছি না। কালকে সকাল সকাল উঠতে হবে। নটার সময় প্ৰাইমমিনিস্টারের মান্থলি প্রেস কনফারেন্স। সুতরাং তুমি বেশ বুঝতে পারিছ কাল সকালে আমার কি দুর্ভোগ আছে।

কাল তো তোমাদের দুজনেরই ছুটি। তোমরা নিশ্চয়ই এখনও ঘুমোওনি। বেশ কল্পনা করতে পারছি খোকনদা তোমার কোলের পর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আর তুমি তোমার ঐ বিখ্যাত বেসুরে গলায় তাঁকে একটা পচা প্রেমের গান শোনাচ্ছি। তাই না?

পর্ব ৫ শেষ📌

🔴পর্ব :৬🔴

তুমি যেদিন প্ৰথম খোকনদার দেখা পেয়েছিলে, সেদিন খোকনদা তোমাকে কি বলে সম্বোধন করেছিল, কি ভাষায় কথা বলেছিল, কি সে বলেছিল, আমি সেসব কিছুই জানি না। সেদিন তুমি কিভাবে ওকে গ্ৰহণ করেছিলে, তাও জানি না। তবে বেশ কল্পনা করে নিতে পারি তুমিই আগে খোকনদার মাথাটা খেয়েছ। কিছু কবচ-মাদুলী ধারণ করেছিলে কিনা জানি না; তবে কিছু না কিছু একটা নিশ্চয়ই করেছিলো। নয়ত খোকনদার মত ছেলে…

তুমি রাগ করছ? রাগ করে না। তবে তোমাদের ব্যাপারটার ঐ রহস্যভরা আদি পর্বটা জানা থাকলে আমার অনেক সুবিধে হতো। তাইতো সেদিন আর্ট ইন ইণ্ডাষ্টি থেকে বেরুবার পর কি বলব, কি করব কোথায় যাব, কিছুই তেবে পাচ্ছিলাম না। পার্ক স্ট্রট ছেড়ে চৌরঙ্গী ধরে এসপ্ল্যানেডের দিকে এগুতে এগুতে শুধু বলেছিলাম, আমি জানতাম আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে।

সত্যি?

সত্যি।

আজই দেখা হবে, একথা জানতেন?

‘না, তা জানতাম না। তবে জানতাম দেখা হবেই।

মেমসাহেব থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে ফিরে বেশ একটু আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল, কি করে জানতেন যে আমাদের দেখা হবেই?।

আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি, আপনার বাবা কি লিগ্যাল প্ৰাক্‌টিশনার?

‘হঠাৎ একথা জিজ্ঞাসা করছেন? সন্দেহের রেখা ফুটে উঠল মেমসাহেবের কপালে।

ভয় পাবেন না, আমি দস্যু মোহন বা ডিটেকটিভ কিরীটী রায় নই।

কিড্‌ স্ট্রট পার হলাম। বেশ বুঝতে পারলাম মেমসাহেবের মন থেকে সন্দেহের মেঘ কেটে যায় নি। তাইতো বললাম, আপনি যে ল পড়েন নি, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে যেভাবে জেরা করতে শুরু করেছিলেন, তাতেই মনে হলো, আপনি বোধহয় ল-ইয়ায়ের-মেয়ে।

মেমসাহেব এবার হেসে ফেললো। বোধহয় মনটাও একটু হালকা হলো।

মিনিট কয়েক দুজনেই চুপচাপ। মিউজিয়াম পার হয়ে এলাম, ওয়াই-এম-সি-এ পিছনে ফেললাম। লিণ্ডসে স্ট্রীটের মোড়ে এসে পড়লাম। আরো এগিয়ে গেলাম। ফিরপো পার হয়ে আর সোজা না গিয়ে রক্সীর দিকে ঘুরলাম। মৌনতা ভাঙলাম আমি, চা খাবেন?

চা? বিশেষ খাই না, তবে চলুন খাওয়া যাক।

পাশের রেস্তোরাঁর একটা কেবিনে বসলাম। বেয়ারা এলো। হাতের তোয়ালে দিয়ে পরিষ্কার টেবিলটা আর একবার মুছে দিল। নোংরা মেনু কার্ডটা আমার সামনে দিয়ে এক নজর দেখে নিল

মেমসাহেবকে।

দু’টো ফিস ফ্রাই, দু’টো চা।

বেয়ারা বিদায় নিল। কিছু বলব বলব ভাবতেই ক মিনিট কেটে গেল। ইতিমধ্যে বেয়ারা দু’টো ফর্ক আর দু’টো ছুরি এনে আমাদের দুজনের সামনে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল। আবার ভাবছি কিছু বলব। কিন্তু বলা হলো না। বেয়ারাটা আবার এলো। এক শিশি সস আর দু গেলাস জল দিয়ে গেল। বুঝলাম, বেয়ারাটা বুঝেছে নতুন জুড়ী এবং সেজন্য ইন্‌ষ্টলমেণ্টে, কাজ করছে। ফিস ফ্রাইএর প্লেট দু’টো নিয়ে বেয়ারাটা আসবার আগেই জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু ভাবছেন?

আঁচলটা টেনে নিয়ে মেমসাহেব বলল, না, তেমন কিছু না।

তেমন কিছু না ঝলেও কিছু তো ভাবছেন?

ফিস ফ্রাই এসে গেল। আমি একটা টুকরো মুখে পুরলাম কিন্তু ফর্কটা হাতে নিয়ে মেমসাহেব কি যেন ভাবছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলবেন?

একটা কথা বলবেন?

নিশ্চয়ই।।

আমাদের দেখা হবে, একথা। আপনি জানলেন কি করে?

কি করে জানলাম তা জানি না, তবে মনের মধ্যে স্থির বিশ্বাস ছিল যে আপনার সঙ্গে দেখা হবেই।

শুধু মনের বিশ্বাস?

হ্যাঁ।

সেদিন একে প্ৰথম সাক্ষাৎকার তারপর ঐ ছোকরা বেয়ারাটার অতিরিক্ত কর্তব্যপরায়ণতার জন্য আর বিশেষ কথা হলো না। তবে ঐ কেবিন থেকে বেরুবার আগে আমার নোটবই-এর একটা পাতা ছিড়ে অফিসের টেলিফোন নম্বরটা লিখে দিলাম। শুধু বলেছিলাম, সম্ভব হলে টেলিফোন করবেন।

কিছুটা লজ্জায় আর কিছুটা ইচ্ছা করেই আমি ওর নাম-ধাম ঠিকানা কিছুই জানতে চাইলাম না। মনে মনে অনেক কিছু ইচ্ছা! করছিল। ইচ্ছা করছিল বলি, তুম মুখাতিব ভী হো, করিব ভী হো, তুমকো দেখু, কী তুমসে বাত করু।–তুমি আমার কাছে বসে আছ, কথা বলছি। তুমিই বল, তোমাকে দেখব, না তোমার সঙ্গে কথা বলব।

আবার ভাবছিলাম, না, না। তার চাইতে বরং প্রশ্ন করি, আঁখো মে হি রহে হো, দিলসে নেহি গ্যায়ে হে, হয়রান হাঃ সঙ্কনী আঁই তুষে কঁহাসে?–সব সময় তুমি আমার চোখে, তুমি আমার হৃদয়ে রয়েছ। ভাবতে পারি না কি ভাবে তুমি আমার হৃদয়-মাঝে এমন তবে নিজের আসন বিছিয়ে নিলে।

সত্যি বলছি দোলাবৌদি, ওকে কাছে পেয়ে, পাশে দেখে বেশ অনুভব করছিলাম, এ তে সেই, যার দেখা পাবার জন্য আমি এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছি, এত দীর্ঘদিন সংগ্ৰাম করেছি। মনে মনে বেশ অনুভব করছিলাম। এবার আমার দিন আগত ঐ।

আরো অনেক অনেক কিছু ভেবেছিলাম। সে সব কথা আজ আর লিখে এই চিঠি অযথা দীর্ঘ করব না। তবে শুধু জেনে রাখ, মেমসাহেব এক এবং অদ্বিতীয়া। এই পৃথিবীতে আরো অসংখ্য কোটি কোটি মেয়ে আছেন, তাঁদের প্ৰেম-ভালবাসায় কোটি কোটি পুরুষের জীবন ধন্য হয়েছে। তাঁদের স্পর্শে অনেকেরই ঘুম ভেঙেছে। আমি তাদের সবার উদ্দেশে আমার শ্রদ্ধা জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি জানি আমার কালো মেমসাহেবের চাইতে অনেক মেয়েই সুন্দরী, অনেকেই ওর চাইতে অনেক বেশী শিক্ষিতা। তবে একথাও জানি আমার জন্য এই পৃথিবীতে একটিমাত্র মেয়েই এসেছে এবং সে আমার ঐ মেমসাহেব। মেমসাহেব ছাড়া আর কেউ পারত না আমাকে এমন করে গড়ে খুলতে। মাটি দিয়ে তো সব শিল্পীই পুতুল গড়ে। কিন্তু সব শিল্পীর শিল্প-নৈপুণ্য কি সমান? মেমসাহেব আমার সেই অনন্য জীবন-শিল্পী যে কাদামাটি দিয়ে আমার থেকে আজ একটা প্ৰাণবন্ত পুতুল গড়ে তুলেছে। তুমি শুনলে অবাক হবে। আমি সেদিন ওর বাসে পর্যন্ত ওঠার অপেক্ষা করলাম না। আমি আগেই একটা বাসে চড়ে অফিসে চলে এলাম। মনে মনে তাবলাম, আমি তো ওর জন্য অনেক তেবেছি, ভাবছি। এবার না-হয় রেকর্ডের উণ্টে দিকটা দেখা যাক। দেখা যাক না ও আমার জন্য ভাবে কিনা!

রাত্রে অফিসে ফিরেই দেখি বেশ চাঞ্চল্য। সন্ধ্যার পরই টেলিপ্রিস্টারে নিউজ এজেন্সীর খবর এসেছে পূর্ব-পাকিস্থানের বাগেরহাটে খুব গণ্ডগোল হয়েছে। কি ধরনের গণ্ডগোল হলো এবং কলকাতায় কি প্ৰতিক্রিয়া দেখা দেয়, সেই চিন্তায় সবাই। উৎকষ্ঠিত। পরের দিন আমার ডিউটি পড়ল। শিয়ালদহ স্টেশনে। পূর্ব-পাকিস্থানের ট্রেনের যাত্রীদের সঙ্গে দেখা করে সেখানকার পরিস্থিতি জানতে হবে। রিপোর্ট করতে হবে। পরের দিন খুলনার ট্রেনটি এসেছিল, তবে অনেক দেরি করে। প্ল্যাটফর্ম থেকে আজে-বাজে লোক আগে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিছু সরকারী কর্মচারীও উপস্থিত ছিলেন। বাগেরহাটের পরিস্থিতি জানিবার পর ওরা সবাই আগত যাত্রীদের হুশিয়ার করে দিলেন, অযথা বা মিথ্যা গুজব ছড়াবেন না।

যাত্রীদের কথাবার্তা শুনে বেশ বুঝতে পারলাম অবস্থা বেশ গুরুতর। কোথা থেকে কিভাবে যে গণ্ডগোল হলো, সেকথা কেউ বলতে পারলেন না। তবে যাত্ৰাপুরের এক ভদ্রলোক জানালেন যে, বাগেরহাটের এক জনসভায় পশ্চিম-পাকিস্থানের এক নেতা বক্তৃতা দেবার পরই ওখানে প্ৰথমে কিছু লুটপাট শুরু হয়। দু-তিন দিন পরে ছুরির খেলা শুরু হলো। গুণ্ডাদের হাতে প্ৰথম দিনেই প্ৰাণ দিলেন লুৎফর রহমান।

শিয়ালদহ স্টেশনের বুকিং অফিসের সামনে দু’টো ট্রাঙ্কের পর বসে আমরা দুজনে কথা বলছিলাম। কথা বলছিলাম নয়, কথা শুনছিলাম। ভদ্রলোক আগে একটা ছোট্ট স্কুলে মাস্টারী করতেন।

অনেকদিন মাস্টারী করেছেন ঐ একই স্কুলে। বাগেরহাটের সবাই ওঁকে চিনতেন, ভালবাসতেন। অধিকাংশ ছাত্ৰই মুসলমান ছিল কিন্তু তা হোক। ওরাও ওকে বেশ শ্রদ্ধা করত। লুৎফর সাহেব যখন ঐ স্কুলের সেক্রেটারী ছিলেন, তখন স্কুলবাড়ি দোতলা হলো, ছেলেদের ভলিবল খেলার ব্যবস্থা হলো, দশ-পনের টাকা করে মাস্টার মশাইদের মাইনেও বাড়ল। কি জানি কি কারণে পরের বছর সরকার স্কুল-কমিটি বাতিল করে দিলেন। ক’ মাস পরে স্কুলের তহবিল তছরূপের অভিযোগে লুৎফর সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু কোর্টে সেসব কিছুই প্ৰমাণিত হলো না।

ইতিমধ্যে স্কুলের নতুন কর্তৃপক্ষ ভদ্রলোকের চাকরি খতম করে দিলেন অযোগ্যতার অভিযোগে। অনন্যোপায় হয়ে একটা দোকান খুললেন। প্ৰথম প্ৰথম বিশ্ৰী লাগত দোকানদারী করতে। কিন্তু কি করবেন? পরে অবশ্য মন লেগেছিল ব্যবসায়ে। ব্যবসাটাও বেশ জমে উঠেছিল। পোড়া কপালে তাও টিকল না। এবারের গণ্ডগোলে দোকানটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

এসব কাহিনী আমার না জানলেও চলত, কিন্তু কি করব। আর এমন কোন যাত্রী পেলাম না। যার কথায় ভরসা করে রিপোর্ট লেখা যায়। তাই চুপচাপ বসে শুনছিলাম। তবে এতক্ষণ ধৈৰ্য ধরে এত কথা শোনার পুরস্কার পেলাম পরে।

লুৎফর সাহেব ছাত্রজীবনে ছাত্ৰ-কংগ্ৰেসে ছিলেন। পরে ওকালতি করার সময় রাজনীতি প্ৰায় ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু পূৰ্বপাকিস্থানের রাজনৈতিক আবহাওয়া জটিল হবার সঙ্গে সঙ্গে লুৎফর সাহেব। আবার রাজনীতি শুরু করলেন। সারা খুলনা জেলা লুৎফর সাহেবের কথায় উঠত, বসত। সারা জেলার মধ্যে কোন অন্যায় অবিচারের কথা শুনলেই গর্জে উঠেছেন। খুলনা ডকের কয়েক হাজার বাঙালী মুসলমান শ্ৰমিক অনেক দিনের অনেক অত্যাচার আর অপমানের বিরুদ্ধে প্ৰথম গর্জে উঠেছিল লুৎফর সাহেবেরই নেতৃত্বে।

পূর্ব-পাকিস্থানের মসনদ থেকে ফজলুল হক সাহেবকে অপসারিত করে ইস্কান্দার মির্জা পূর্ব বাংলাকে শায়েস্তা করবার জন্য ঢাকায় আসার কিছুকালের মধ্যেই লুৎফর সাহেবকে ডেকে পাঠান লুৎফর সাহেব লাটসাহেবের নেমস্তন্ন খেতে ঢাকা গিয়েছিলেন। তবে একবেলা বুড়ীগঙ্গার ইলিশ খাইয়েই সে নেমস্তন্ন খাওয়া শেষ। হয় নি। দুটি বছর ঢাকা সেন্টাল জেলে বিশ্রাম নেবার পর লুৎফর সাহেব খুলনা আসার অনুমতি পান।

খুলনা ফেরার পর লুৎফর সাহেব আরো বেশী রুখে দাঁড়ালেন।

আমার অফিসে ফিরে রিপোর্ট লিখতে হবে। এত দীর্ঘ কাহিনী শোনার অবসর ছিল না। তাই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, লুৎফর সাহেব আজকাল কি করেন?

—লুৎফর সাহেব আর নেই। এই দাঙ্গায় বাগেরহাটের প্রথম বলি হলেন লুৎফর।

সে কি বলছেন?

আমাদেরও তো ঐ একই প্রশ্ন।

তবুও কি মনে হয়?

বাগেরহাটের লাহোর কটন মিলে অনেকদিন ধরেই শ্রমিক ধর্মঘট চলছে। লুৎফর সাহেব ওদের লীডার। কিছুদিন ধরেই আমরা শুনছিলাম। লুৎফর সাহেবকে শায়েস্তা করার জন্য শহরে নাকি বাইরের অনেক গুণ্ড এসেছে। আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি।; কারণ-বাগেরহাট শহরে লুৎফর সাহেবের গায় হাত দেবার সাহস স্বয়ং ইস্কান্দার মির্জারও হয় নি। কিন্তু এরই মধ্যে সর্বনাশা দাঙ্গা শুরু হলো বুধবার সন্ধ্যার দিকে। পরের দিন বাড়ির থেকে বাইরে যাইনি। শুক্রবার সকালে দোকানটা দেখতে গিয়ে শুনি লুৎফর সাহেব শেষ।

আমি বেশ বুঝতে পারলাম। লুৎফর সাহেবকে সরাবার জন্যই লাহোর কটন মিলের মালিকদের চক্রান্তে বাগেরহাটে গণ্ডগোল বাধানো হয়েছে। কেননা, শহরের অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে লুৎফর সাহেবকে শেষ করা যেত না।

অফিসে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো। বেশ ক্লান্ত বোধ করছিলাম। তবুও চটপট করে বাগেরহাটের দাঙ্গার নেপথ্য কাহিনী লিখে ফেললাম।

তাই সারাদিন মেমসাহেবের কথা ভাববার ঠিক সময় পেলাম না।

পরের দিন আমার উইকলি অফ ছিল। অফিসে গেলাম না। তার পরের দিন আমার টেলিফোন ডিউটি ছিল। তাই একটু দেরি করেই অফিসে গেলাম।

এখনকার মত তখন ডায়াল ঘুরালেই নম্বর পাওয়া যেত না। অপারেটরের ওপর নির্ভর করতে হতো। খবরের কাগজের রিপোর্টারের নাইট-টেলিফোন ডিউটি একটা বিচিত্র ব্যাপার। পুলিস, হাসপাতাল, এ্যাম্বুলেন্স, ডক, রেল-পুলিস, রেল স্টেশন, দমদম এয়ারপোর্ট ইত্যাদি জায়গার থেকে দৈনন্দিন টুকটাক লোক্যাল নিউজ পাবার জন্যে প্ৰায় শতখানেক টেলিফোন করতে হতো। আমাদের কাগজের পাড়াতে এবং একই টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আরো চার-পাচটি কাগজের অফিস ছিল। এক্সচেঞ্জের অপারেটররা প্ৰতি রাত্রে এই লাইন দিতে দিতে প্ৰায় রিপোর্টার হয়ে উঠেছিলেন। নাম্বার বলবার প্রয়োজনও হতো না; শুধু বললেই হতো, রিভার পুলিস দেবেন নাকি?

উত্তর আসত, রিভার পুলিস এনগেজ। টাইমস অফ ইণ্ডিয়া কথা বলছে।

এখনকার মত তখন এরারপোর্ট রিপোর্টার বলে কিছু ছিল না। তাই সাধারণ ছোটখাটো খবরের জন্য এয়ারপোর্ট পুলিস-সিকিউরিটিতে রোজ রাত্তিরে ফোন করতে হতো। তাইতো রিভার পুলিস না পেয়ে বলতাম, এয়ারপোর্ট দিন।

অপারেটর সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিতেন, সিকিমের মহারাজার এ্যারাইভাল ছাড়া আর কিছু নেই।

সঙ্গে সঙ্গেই আবার হয়ত বলতেন, এবার নীলরতনের সঙ্গে কথা বলুন। কি একটা সিরিয়াস অ্যাকসিডেণ্টের খবর আছে।

সব অপারেটরই যে এইরকম সাহায্য করতেন, তা নয়। তবে অধিকাংশ মেয়েই খুব সহযোগিতা করতেন। রাত্রে টেলিফোন ডিউটি করতে করতে বহু অপারেটরের সঙ্গে অনেক রিপোর্টারেরই বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নানা অবস্থায় রিপোর্টাররাও যেমন অপারেটরদের সাহায্য করতেন, তেমনি অপারেটররাও রিপোর্টারদের যথেষ্ট উপকার করতেন।

কোন কোনদিন খবরের চাপ বিশেষ না থাকলে অনেক সময় আমরা নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলতাম। এইরকম কথাবার্তা বলতে বলতেই আমরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অনেক কাহিনী শুনেছিলাম। জানতে পেরেছিলাম। অনেক অফিসারের আনটোল্ড স্টোরি। কিছু কিছু কাগজে ছাপিয়ে ফাস করেও দেওয়া হয়েছিল। অপারেটরদের উপর অনেক অফিসারের খাম-খেয়ালিপনা বন্ধ হয়েছিল।

অপারেটররাও আমাদের কম উপকার করতেন না। কৈলাশনাথ কাটজু তখন পশ্চিম বাংলার গভর্নর। আর ডাঃ রায় মুখ্যমন্ত্রী। কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দুজনের মধ্যে তীব্ৰ মত-বিরোধ দেখা দিয়েছে বলে নানা মহলে গুজব শোনা গিয়েছিল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও মত-বিরোধের সঠিক কারণগুলো কেউই জানতে পারছিলাম না। শেষে একদিন অকস্মাৎ এক টেলিফোন অপারেটর জানালেন, জানেন, আজ একটু আগে টেলিফোনে গভর্নরের সঙ্গে চীফ মিনিস্টারের খুব একচোট…

দুদিন বাদে এই ঝগড়ার কাহিনীই আমাদের কাগজের ব্যানার স্টোরি হলো। মোটা মোটা অক্ষরে চার-কলম সামারিতে লেখা হলো, রাজভবনের সহিত সংশ্লিষ্ট অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য মহলের নিকট হইতে জানা গিয়াছে যে রাজ্য পরিচালনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে রাজ্যপালের সহিত মুখ্যমন্ত্রীর মত-বিরোধ দেখা দিয়াছে।–

শুধু বাংলা দেশের জনসাধারণ বা রাইটার্স বিল্ডিংস-এর কিছু অফিসার নয়, স্বয়ং ডাঃ রায় ও কাটজু সাহেব পৰ্যন্ত চমকে গিয়েছিলেন এই খবরে। অনেক তদন্ত করেও ওঁরা জানতে পারেন নি। কি করে এই চরম গোপনীয় খবর ফাঁস হয়ে গেল।।

আমরা অফিসে বসে শুধু হেসেছিলাম। আর ভাবছিলাম ইচ্ছা করলে আরো কত কি আমরা ছাপতে পারতাম। কিন্তু ছাপিনি।

এইরকম আরো অনেক চমকপ্ৰদ খবর পেতাম। আমাদের অপারেটর বান্ধবীদেৱঃ মারফত ও মাঝে মাঝেই বাজার গরম করে তোলা হতো। মন্ত্রী আর অফিসারের দল কানামাছি ভেঁ-ভেঁা করে মিছেই হাতড়ে বেড়াতেন, আর আমরা মুচকি হাসতে হাসতে ঐ মন্ত্রী ও অফিসারদের ঘরে বসে। ওদের পয়সায় কফি খেয়ে বেড়াতাম।

সেদিন রাত্রে অফিসে এসে যথারীতি টেলিফোনটা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, কে কথা বলছেন?

কণ্ঠস্বর অপরিচিত নয়। তাই উত্তর আসে, আমি গার্গী।

এক মুহুর্ত পরেই আমাকে প্রশ্ন করেন মিস গার্গী চক্রবর্তী, অনেকদিন পর আজ আপনার টেলিফোন ডিউটি পড়ল, তাই না?

উত্তর দিই, না। অনেকদিন কোথায়…

গার্গী মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জানতে চায়, কাল আর পরশু। আপনি অফিসে আসেন নি?

কেন বলুন তো।

আগে বলুন কোথায় ছিলেন দুদিন।

কোথায় আবার থাকবে, কলকাতাতেই ছিলাম। তবে। কালকে আমার অফ ছিল। আর পরশু অনেক রাত্রে অফিসে এসেছিলাম।’

তাই বুঝি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

গার্গী চক্রবর্তী টেলিফোন ছাড়ে না। ইনিয়ে-বিনিয়ে দু’চারটে আলতু-ফালতু কথার পর জিজ্ঞাসা করল, তারপর আপনি কেমন আছেন?

হঠাৎ আজ পঞ্চাশ টাকা মাইনের রিপোর্টারের এত খবর নিচ্ছেন, কি ব্যাপার?

যাস্ট এ মিনিট বলে গার্গী অন্য কাউকে লাইন দিতে গেল। আমি টেলিফোন ধরে রইলাম। একটু পরেই ফিরে এলে আমার লাইনে। বলল, কাল-পরশু আপনার অনেক টেলিফোন এসেছিল।

আমি গার্গীকে দেখতে পাই না। কিন্তু বেশ অনুভব করতে পারছিলাম ওর হাসিখুশী ভরা মুখখানা। আমি এবার একটু ঠাট্টা করে বললাম, আমি তো মিস গার্গী চক্রবর্তী নই যে আমার অনেক টেলিফোন আসবে।

তাই বুঝি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

গলার স্বরে একটু অভিনবত্ব এনে গার্গী বলে, অনেকে না হোক এক’জনও তো অনেকবার টেলিফোন করতে পারে-যাস্ট এ মিনিট…

গার্গী আবার লাইন দিতে চলে যায়।

আমি ভাবি কে আমাকে অনেকবার টেলিফোন করতে পারে। মেমসাহেব হয়ত একবার টেলিফোন করতে পারে। কিন্তু অনেকবার কে করল?

গার্গী এবার ফিরে এসে বলল, সত্যি বলছি। এক’জন আপনাকে অনেকবার…

কিন্তু তাতে আপনাকে এত ইণ্টারেস্ট!

কিছুই না। তবে এতদিন আপনার এই ধরনের টেলিফোন আসত না বলেই আর কি…

এবার আমার মনে সন্দেহ দেখা দিল। তবে কি মেমসাহেবই?

গার্গী বলল, ধরুন, আমি তাঁর সঙ্গে কানেকশন কয়ে দিচ্ছি।

আপনি বুঝি নাম্বারটাও জেনে নিয়েছেন?

ওদিক থেকে গার্গীর গলার স্বর শুনতে পেলাম না। একটু পরেই বলল, নিন, স্পীক হিয়ার।

আমি বেশ সংযত হয়ে শুধু সম্বোধন করলাম, নমস্কার।

নমস্কার। কি খবর বলুন?

কি আর খবর। আপনারই তো দুদিন পাত্তা নেই।

মেমসাহেব দুদিন ধরে আমাকে খোজ করেছে জেনে বেশ সুখী হলাম। তবুও ন্যাকামি করে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি টেলিফোন করেছিলেন?

কি আশ্চৰ্য। আপনাকে কেউ বলেন নি?

আমাদের অফিস আর হরি ঘোষের গোয়ালের মধ্যে যে কোন পার্থক্য নেই সেকথা মেমসাহেবকে কি করে বোঝাই। তাই বললাম, খবরের কাগজের অফিসে এত টেলিফোন আসে যে কারুর পক্ষেই মনে রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া রোজই তো ডিউটি বদলে যাচ্ছে।

মেমসাহেব সঙ্গে সঙ্গে বলল, কেন। ঐ অপারেটর ভদ্রমহিলা আপনাকে বলেন নি?

গার্গী হঠাৎ আমাদের দুজনের লাইনে এসে বলে গেল, বলেছি। মেমসাহেব চমকে গেল। আমি কিন্তু জানতাম গার্গী আমাদের লাইন ছেড়ে পালাবার পাত্রী নয়।

মেমসাহেব ঘাবড়ে প্রশ্ন করল, কে উনি?

মিস গার্গী চক্রবর্তী।

হাজার হোক মেয়ে তো! গার্গীর নাম শুনেই মেমসাহেবের মনটা সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। হয়ত বা ঈর্ষাও। তাই হেঁয়ালি করে জানতে চায়, আপনার সঙ্গে বুঝি মিস চক্রবর্তীর বিশেষ পরিচয় আছে?

আমি আপন মনেই একটু হেসে নিই। আর বলি, অধিকাংশ অপারেটরের সঙ্গেই আমাদের প্রায় সব রিপোর্টারদেরই যথেষ্ট পরিচয় আছে।

আমি আবার টিল্পানী কেটে জিজ্ঞাসা করি, কোন ছোট প্রেমের গল্পের প্লট এলো নাকি আপনার মাথায়?

বোধ করি মেমসাহেব বুঝেছিল, গার্গীর বিষয়ে আর প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই। বললে, কালকে আপনার সঙ্গে দেখা করে প্লটটা ঠিক করব।

আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করি, কাল দেখা হবে?

বিকেলের দিকে হতে পারে।

বিকেল পাঁচটায় লিণ্ডসে স্ট্রীটের মোড়ে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আসবেন।

হ্যাঁ, আসব।

দোলাবৌদি, তুমি তো জানি কলকাতার শহরে মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের একটু প্ৰেম করা কি দুরূহ ব্যাপার। প্রেম করা ত্বে দূরের কথা, একটা গোপন কথা কইবার পর্যন্ত জায়গা নেই কলকাতায়। আমাদের শৈশবে লেকে গিয়ে প্ৰেম করার প্রথা চালু ছিল, কিন্তু পরে লেকের জলে এতগুলো ব্যর্থ প্রেমিক-প্ৰেমিকা আত্মহত্যা করল যে লেকে গিয়ে প্রেম করা তো দূরের কথা, একটু বেড়ানও অসম্ভব হলো।

এমন একটা আশ্চর্য শহর তুমি দুনিয়াতে কোথাও পাবে না। শুধু কলকাতা বাদ দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত শহরে-নগরে কত সুন্দর সুন্দর বেড়াবার জায়গা আছে। নিত্যনতুন আরো সুন্দর সুন্দর বেড়াবার জায়গা তৈরি হচ্ছে কিন্তু আমাদের কলকাতা? সেই জব চার্নক আর ক্লাইভ সাহেবের ওভারসিয়ারবাবুরা যা করে গেছেন, আমাদের আমলে তাও টিকল না। কলকাতার মানুষগুলোকে যেন একটা অন্ধকূপের মধ্যে ভরে দিয়ে চাবুক লাগান হচ্ছে অথচ তাদের চোখের জল ফেলার একটু সুযোগ বা অবকাশ নেই।

সমস্ত যুগে সমস্ত দেশের মানুষই যৌবনে প্ৰেম করেছে ও করবে। যৌবনের সেই রঙীন দিনগুলোতে তারা সবার থেকে একটু দূরে থাকবে, একটু আড়াল দিয়ে চলবে। কিন্তু কলকাতায় তা কি সম্ভব? নতুন বিয়ে করার পর স্বামী-স্ত্রীতে একটু নিভৃতে মনের কথা কইবার জায়গা কোথায়? মাতৃহারা শিশু বা সন্তানহারা পিতামাতা গলা ফাটিয়ে প্ৰাণ ছেড়ে কাঁদতে পারে না। কলকাতায়। এর চাইতে আর কি বড় ট্র্যাজেডী থাকতে পারে মানুষের জীবনে?

কেতাবে পড়েছি ও নেতাদের বক্তৃতায় শুনেছি বাঙালী নাকি সৌন্দর্যের পূজারী, কালচারের ম্যানেজিং এজেন্টস। রুচিবোধ নাকি শুধু বাঙালীরই আছে। কিন্তু হলপ করে বলতে পারি কোন নিরপেক্ষ বিচারক কলকাতা শহর দেখে বাঙালীকে এ অপবাদ নিশ্চয়ই দেবেন না। রবীন্দ্রনাথ যে কিতাবে চিৎপুর-জোড়ার্সাকোয় বসে কবিতা লিখলেন, তা ভেবে কুলকিনারা পাই না। শেক্সপিয়র বা বায়রন বা অধুনাকালের টি এস ইলিয়টকে চিৎপুরে ছেড়ে দিলে কাব্য করা তো দূরের কথা একটা পোস্টকার্ড লিখতে পারতেন না।

আশ্চৰ্য, তবুও বাঙালীর ছেলেমেয়েরা আজো প্ৰেম করে, কাব্যচর্চা করে, শিল্প-সাধনা করে। যেখানে একটা কৃষ্ণচুড়ার গাছ নেই, যেখানে একটা কোকিলের ডাক শোনা যায় না, দিগন্তের দিকে তাকালে যেখানে শুধু পাটকলের চিমনি আর ধোয়া চোখে পড়ে, সেই বিশ্বকর্মার তীর্থক্ষেত্রে আমি আর মেমসাহেবও নতুন জীবন করলাম।

চলবে।

মেমসাহেব পর্ব-১+২+৩+৪

0

🔴মেমসাহেব (পর্ব :১, ২, ৩, ৪)🔴
– নিমাই ভট্টাচার্য

ওয়েস্টার্ণ কোর্ট
জনপদ
নিউদিল্লী

দোলাবৌদি,

তোমার চিঠি পেলাম। অশেষ ধন্যবাদ। তুমি আমাকে ভালবাস, স্নেহ করা। তাইতো স্বপ্ন দেখ আমি ঘর বাঁধি, সুখী হই। একটা রাঙা টুকটুকে বৌ আসুক আমার ঘরে। আমাকে দেখাশুনা করুক, একটু ভালবাসুক, আমার জীবনের একটা অবলম্বন হোক। তাই না? ভাবতে বেশ লাগে। আমার এই ছন্নছাড়া জীবনে একটা জুনিয়র দোলা এসে দোলা দিলে মন্দ হতো না! হয়ত তাঁর আবির্ভাব হলে নিজের জীবনটাকে নিয়ে এমন জুয়া খেলতাম না, ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি করতাম না। হয়তো তাঁর ছোঁয়া পেলে বুকের ব্যথাটা সেরে যেত, হয়ত নিকট ভবিষ্যতে মূসৌরী বা নৈনীতালের কোন নার্সিংহোমে যাবারও প্রয়োজন হতো না। হয়ত আরো অনেক কিছু হতো। নিজের কাছ থেকে নিজেকে এমনভাবে লুকিয়ে রেখে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম না। তাই না দোলাবৌদি?

সত্যি কথা বলতে কি, বিয়ে করতে আমার সম্মতি না থাকলেও যদি কোন মেয়ে আমাকে বিয়ে করে তাতে আমার বিশেষ অসম্মতি নেই। বরং বেশ আগ্রহই আছে। আর তাছাড়া আগ্ৰহ না থাকার কি কারণ থাকতে পারে?

তুমি তো নিজেই আঠারো কি উনিশ বছর বয়স থেকে খোকনদাকে দোলা দিতে শুরু করেছিলো। ইউনিভার্সিটির দুই গেট দিয়ে দুজনে বেরুতে। তুমি ইউনিভার্সিটির দোরগোড়া থেকে ২-বি বাসে চাপতে আর খোকনদা মেডিক্যাল কলেজের পিছন থেকে ননম্বর বাসে চাপত। দুজনে দুটি বাসে চাপলে কি হয়। দুজনেই তো নেমে পড়তে লিণ্ডসে স্ট্রটএর মোড়ে। ডিসেম্বরের হাড়কঁপানো শীতে ফাঁকা দাৰ্জিলিং উপভোগ করেছ তোমরা দুজনে। এসব আমি জানি। আরো জানি তুমি নিজের হাতের কঙ্কণ আর গলার মোটা হারটা বিক্ৰী করেছিলে বলেই খোকনদা অত দিন ধরে রিসার্চ করে পি-এইচ-ডি হতে পারল। এমনি করে দোলা দিতে দিতে একদিন অকস্মাৎ নিজের দোলনায় তুলে নিলে খোকনদাকে।

এসবই তো নিজের চোখে দেখা। আরো অনেককেই তো দেখলাম। মঞ্জরী, লিপি, কণিকারাই কি কম খেল দেখাল। আমার প্রথম যৌবনের সেই সবুজ কাঁচ দিনগুলিতে তোমরা সবাই আমাকে যথেষ্ট ইনফ্লুয়েন্স করেছিলো। হয়ত আজো সে ইনফ্লুয়েন্স শেষ হয় নি। আর ঐ অনুরাধা? কত বড় বড় কথা, কত লেকচার, কত তর্ক-বিতর্ক। বিয়ে? সরি! শেষ পৰ্যন্ত একটা পুরুষের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য আমাকে শিকার করবে? নেভার, নেতার, নেতার!

মনে পড়ে দোলাবৌদি? অনুরাধা শেষকালে চীৎকার করে হেনরি ফিল্ডিংকে কোট্‌ করে বলত, His designs were strictly honourable, as the saying is : that to rob a lady of her fortune by way of marriage.’

আমাদের সেই অনুরাধাও একদিন বর্ধমানের নীতীশের গলায় মালা পরাল। আমি দিল্লীতে ছিলাম না। তাই অনুরাধার আমন্ত্রণ পেতে একটু দেরী হওয়ায় সে দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার হয় নি। কিন্তু তার বৌভাত-ফুলশয্যার দিন আমি বর্ধমান না গিয়ে পারিনি। প্ৰাচীন কাব্যে আছে অনন্তযৌবন উর্বশীর ক্যাবারে ডান্সের ঠেলায় স্বৰ্গরাজ্যের ম্যানেজিং ডাইরেকটরদের সব কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল। কিন্তু মুনি-ঋষিদের নাচে উর্ষণীয় ধ্যানভঙ্গ? না, পড়িনি। তবে দেখলাম অনুরাধার বেলায়। একটা ভাঙা জীপগাড়ি, দু’টো কনেস্টবল আর একটা পেটমোটা সাব-ইন্সপেকটরের ঘাড়ে চড়ে আই-পি–এস নীতীশ এমন নাচই নাচল যে, অনুরাধাও ক্লিন বোল্ড হয়ে গেল।

ঐ উৎসবের বাড়িতেই লোকজনের ভিড় একটু পাতলা হলে আমি কানে-কানে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, অনু, এ কি হলো? ছিঃ ছিঃ। শেষ পর্যন্ত পুরুষের তৃষ্ণা মেটাবার শিকার হলে?

তুমি তো অনুরাধাকে ভালভাবেই জান। ও ভাঙবে কিন্তু মাচকাবে না। তাই শেকসপিয়ারের অ্যান্টনি অ্যাণ্ড ক্লিওপেট্ৰ থেকে কোট করে বলল, My salad days when I was green in judgement.’

চমৎকার! তোমাদের এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে আমার বিয়ে করার ইচ্ছা হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? মাঝে মাঝেই ভাবি আমিও যদি খোকনদা বা নীতীশের মত…।

যাকগে ওসব। আচ্ছা দোলাবৌদি, তাছাড়া পাত্র হিসেবে কি আমি খুব খারাপ? বোধ হয় না, তাই না? লেখাপড়া না শিখলেও কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে গেছি কবছর। খবরের কাগজের স্পেশ্যাল করাসপেনডেণ্টের চাকরিটাও নেহাত মন্দ নয়। বেশ চটক আছে। মাইনেও নেহাত কম পাই না। বাড়ি না। থাকলেও গাড়ি আছে, নায়েব না থাকলেও স্টেনে তো আছে। তাছাড়া শুনেছি আজকালকার মেয়েরা বিলেত-ফেরত দুষ্ট ছেলেদের বেশ পছন্দ করে। মেয়েদের বাপ-মা স্মার্ট-সফিসটিকেটেড বলে। ঐসব দুষ্ট ছেলেদের জামাই করতে আপত্তি করেন না। সেদিক থেকে আমি ওভার-কোয়ালিফায়েড! একবার নয়, বহুবার গেছি। বিলেত। লোকে বলে দুষ্টুমিও নাকি করেছি।

আরো একটা ব্যাপার আছে। পটলডাঙার গোবিন্দ বিলেতফেরত বলে বিয়েতে ফিল্মস্টারদের মত ইনক্যাম ট্যাকস ফ্রি দশ হাজার টাকা ব্ল্যাকমানি পেয়েছিল। সুতরাং আমার ভবিষ্যতও বেশ উজ্জল মনে হয়। আর তাছাড়া তোমার মত হাই ফাস্টক্লাশ পাওয়া এজেণ্ট যখন আছে। পয়সাওয়ালা বোকা বোকা লোকের একটা উদ্ভুত উড়ু, মেয়ে শিকার করা অধ্যাপিকা দােলা সরকারের পক্ষে নিশ্চয়ই খুব কষ্টকর নয়।

তবে তার আগে মেমসাহেব উপাখ্যানটা তোমাদের সবার জেনে নেওয়া দরকার। আমার ঐ কালো মেমসাহেবকে নিয়ে তোমরা অনেকদিন হাসি-ঠাট্টা করেছ। হয়ত কিছু ধারণাও করেছ মনে মনে। শুধু তুমি কেন, অনেকের মনেই আমার মেমসাহেবকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন। কেউ-কেউ ভাবে মেমসাহেব বলে কেউ নেই। পুরোটাই গুল, ফোরটোয়েন্ট। আবার কেউ-কেউ ভাবেন মেমসাহেবকে আমি শুধু ভালবাসিনি, বিয়েও করেছি। নানা ধরনের নানা লোকজনের কাছ থেকে মেমসাহেব সম্পর্কে চিঠিপত্রও কম পাই না।

যার সঙ্গেই নতুন আলাপ হয়, তিনিই প্রশ্ন করেন, মেমসাহেব কে? ছেলেমেয়ে বুড়ো-বুড়ী সবারই ঐ এক প্রশ্ন। এইত কদিন আগে দিল্লী ইউনিভার্সিটির এক তথ্বী-শ্যামার সঙ্গে আলাপ হলো। বাড়িতে নিয়ে গেলেন। দু’টো থিন-এরারুট বিস্কুট, একটা প্যাড়া সন্দেশ আর এক কাপ চা দিয়েই মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, মা জানতে চাইছিলেন মেমসাহেবের আসল নাম কি?

বছরখানেক আগে সিউড়ি থেকে এক বৃদ্ধ পার্শেল করে একটা লাল টুকটুকে সিল্কের শাড়ী পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি ছিল। লিখেছিলেন, তোমার মেমবৌকে এই শাড়ীটা আশীৰ্বাদী পাঠাচ্ছি। বিদেশী মেমকে এই শাড়ীটা পরলে ভালই লাগবে। মাতৃতুল্য স্নেহাতুর বৃদ্ধাকে আমি লিখেছিলাম, মা, শাড়ীটা আপনি সাবধানে রেখে দিন। সময় মত আপনার মেমবৌকে নিয়ে ওখানে গিয়েই শাড়ীটা গ্ৰহণ করব।

মেমসাহেবকে নিয়ে আরো কত কি কাণ্ডই হয়। তাইতো এবার ভেবেছি তোমাদের সঙ্গে এমন করে আর লুকোচুরি না খেলে পুরো ব্যাপারটাই খুলে বলব। তাছাড়া আমার জীবনের এইসব ইতিহাস না জানলে তোমার পক্ষে ঘটকালি করারও অসুবিধা হতে পারে। তোমাকে সব কিছু লেখার আগে নৈতিক দিক থেকে মেমসাহেবের একটা অনুমতি নেওয়া দরকার। কিন্তু আজ সে এতদূরে চলে গেছে যে, তার অনুমতি যোগাড় করা প্ৰায় অসম্ভব। আর হ্যাঁ, তাছাড়া ঠিকানাটাও ঠিক আমার জানা নেই।

পর্ব ১ শেষ 📌

🔴পর্ব :২🔴

মনে হলো তুমি আমার চিঠি পড়ে ঘাবড়ে গেছ। গত চিঠিতে বিশেষ কিছুই লিখি নি, এমন কি গৌরচন্দ্রিকাও পূর্ণ হয় নি। সুতরাং এখনই নার্ভাস হবার কি আছে? তাছাড়া তুমি না মেয়ে? অন্যের প্রেমের ব্যাপারে তোমাদের তো আগ্রহের শেষ নেই। শিক্ষিতাই হোক, আর অশিক্ষিতাই হোক, প্ৰেমপত্র সেন্সর করতে মেয়েরা তো শিরোমণি! ইউনিভার্সিটির জীবনে তো দেখেছি লেকচার শোনা, কফিহাউসে আড্ডা দেবার মত অন্যদের প্ৰেমপত্ৰ হাত করাও প্ৰায় সব মেয়েদের নিত্যকার কাজ ছিল। গণ্ডগ্রামে যাও, সেখানেও দেখবে পারুল-বৌদির চিঠি অন্নপূর্ণ-ঠাকুরঝি না পড়ে কিছুতেই ছাড়বে না। শুনেছি স্কুল-কলেজে মেয়েদের চিঠি এলে দিদিমণিরা একবার চোখ না বুলিয়ে ছাড়েন না। ছাত্রীদের অভিভাবকত্ব করবার অছিলায় চুরি করে প্রেমপত্র পড়াকে কিছুটা আইনসম্মত করা যেতে পারে মাত্র; কিন্তু তার বেশী কিছু নয়।

তাছাড়া প্রেমের কাহিনী জানতে মেয়েদের অরুচি? কলিকালে না জানি আরো কত কি দেখব, শুনব। মেয়ের বিয়ে হলে মা পৰ্যন্ত জানতে চান, হ্যারে খুকী, জামাই আদর-টোব্দর করেছিল তো? হাজার হোক মা তো! ঠিক খোলাখুলিভাবে সব কথা জিজ্ঞাসা করতে পারেন না। তাই ঘুরিয়ে আদর-টাব্দর করার খবর নেন। বাসরঘর তো মাসি-খুড়ি থেকে দিদিদের ভিড়ে গিজ-গিজ করে।

আর সেই সতী-সাবিত্রী সীতা-দময়ন্তী থেকে শুরু করে। আমাদের মা-মাসিরা যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধ্বজ বহন করে এনেছেন, শত বাধা-বিপত্তি অগ্ৰাহ্য করে যে ঐতিহ্যের ধারা অম্লান রেখেছেন, আজ তুমি সেই মহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে, আমি ভাবতে পারিনি।

সর্বোপরি আমি যখন নিজে স্বেচ্ছায় তোমাকে সব কথা বলছি, তখন তোমার লজ বা সঙ্কোচের কি কারণ থাকতে পারে? আর তোমাকে ছাড়া আমার এই ইতিহাস কাকে জানাব বলতে পারো? তুমি আমার থেকে মাত্র এক বছরের সিনিয়র হলেও তোমাকে। আমি সেই প্ৰথম পরিচয়ের দিন থেকেই ভালবেসেছি, শ্ৰদ্ধা করেছি। খোকনদার প্রতি তোমার শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা যেদিন থেকে আবিষ্কার করেছি। সেইদিন থেকেই তুমি আমার দোলাবৌদি; হয়েছ। ছাত্রজীবনের সেই শেষ দিনগুলিতে আর আমার কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায়ে তুমি আর খোকনদা যেভাবে আমাকে সাহায্য করেছ, সহানুভূতি জানিয়েছ, তার তুলনা হয় না। তাইতো জীবনের সমস্ত সুখে-দুঃখে প্ৰথমেই মনে পড়ে তোমাদের।

মেমসাহেবের ব্যাপারটা ইচ্ছা করেই জানাই নি। তোমরা অবশু-কিছু কিছু আঁচ করেছিলে কিন্তু খুব বেশী জানতে পার নি। ভগবানের দয়ায় আমি দিল্লী চলে আসায় নাটকটা আরো বেশী জমে উঠেছিল। আমি ভেবেছিলাম, তোমাকে আর খোকনদাকে একটা সারপ্রাইজ দেব। তাই কিছু জানাই নি। কিন্তু আর দেরি করা ঠিক হবে না। তুমি যখন আমার বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছ। তখন সব কিছু না জানান অন্যায় হবে।

আর শুধু মেমসাহেবের কথাই নয়, আমার জীবনে যেসব মেয়েরা এসেছে, তাদের সবার কথাই তোমাকে লিখব। সব কিছু তোমাকে জানাব। কিছু লুকাব না। আর কিছু না হোক, তোমাকে হলপ করে এইটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি যে, আমার এই কাহিনী তোমার খুব খারাপ লাগবে না। যদি ভাষাটাকে একটু এডিটু করে, তাহলে হয়ত ছাপা হয়ে বই বেরুতে পারে।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

সুতরাং হে আমার দোলাবৌদি। ধৈৰ্য ধরা! হে আমার খোকনদার প্রাণের প্রিয় দোলে দোদুল দোলে দোলনা দোলা। তোমার ভ্রাতৃসম লক্ষ্মণ-দেবরের প্রতি কৃপা করি, তার ইচ্ছা পূৰ্ণ কর!

পর্ব ২ শেষ 📌

🔴পর্ব :৩🔴

সেদিন কি তিথি, কি নক্ষত্র, কি লগ্ন ছিল, তা আমি জানি না। জীবন-নদীতে এত দীর্ঘদিন উজান বইবার পর বেশ বুঝতে পারছি যে সেদিন বিশেষ শুভলগ্নে আমি পৃথিবীর প্রথম আলো দেখিনি। এই পৃথিবীর বিরাট স্টেজে বিচিত্র পরিবেশে অভিনয় করার জন্য আমার প্রবেশের কিছুকালের মধ্যেই মাতৃদেবী প্ৰস্থান করলেন। একমাত্র দিদিও আমার জীবন-নাট্যের প্রথম অঙ্কেই জামাইবাবুর হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি কেটে পড়ল। আমার জীবনের সেই প্ৰাগৈতিহাসিক তিনটে কপিও পাওয়া গিয়েছিল। নিয়মিত বাসাবাদলের দৌলতে দু’টি কপি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তৃতীয় কপিট দিদির সংসারে ক্ষুধার্ত উইপোকার উদরের জ্বালা মেটাচ্ছে। মানুষের জীবনে প্ৰথম ও প্ৰধান নারী হচ্ছে মা। তাঁর স্নেহ, তার ভালবাসা, তাঁর চরিত্র, আদর্শ প্রতি পুত্রের জীবনেই প্রথম ও প্রধান সম্পদ। আমি সেই স্নেহস্পৰ্শ, ভালবাসা ও সম্পদ থেকে চিরবঞ্চিত থেকে গেছি।–তাইতো আমার জীবনে নারীর প্রয়োজন ও গুরুত্ব উপলব্ধিতে অনেক সময় লেগেছে।

ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে ও আশপাশে কোন বোন বা অন্য কোন নারীচরিত্র না থাকায় মেয়েদের সম্পর্কে আমার শঙ্কা ও সঙ্কোচ, বহুদিন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় নি। আমার কৈশোরের সেই সেদিনের কথা মনে হলে আজও হাসি পায়।…

তখন ক্লাশ নাইন থেকে টেনএ উঠেছি। সবে পাখনা গজান শুরু হয়েছে। হাফ প্যাণ্ট ছেড়ে মালকেঁচা দিয়ে ধুতি পরা ধরেছি। ফুলহাতা শার্টের হাত না গুটিয়ে পরলে বোকা বোকা মনে হয়।, শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল পেটাতে বেশ আত্মসম্মানে লাগে। বিকেলবেলার একমাত্ৰ রিক্রিয়েশন দু’চারজন বন্ধু মিলে পাড়ার এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে আডা দেওয়া। মণ্টু দার বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল, হৃদ্যতা ছিল। দু’একবার পৌষসংক্রান্তির দিন মণ্টুদার মা আমাকে আদর করে পিঠে-পায়েসও খাইয়েছেন। শুনেছি দিদির বিয়ের সময় মন্টুদাদের বাড়ির সবাই খুব সাহায্য করেছিলেন। ঐ বাড়ির সবার সঙ্গেই আমার পরিচয় ছিল,–ওদের পরিবারের অনেক খবরই আমি জানতাম। জানতাম না। শুধু নন্দিনীর কথা। ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে মন্ট দ্বার এই চঞ্চল। কিশোরী ভাইঝি কবে আকস্মাৎ মহানগরীতে আবিভূতি। হয়েছিলেন, সে খবর আমি রাখিনি। তিনিও যে নাইন থেকে টেনএ উঠে মীর্জাপুরের বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়কে ধন্য করার জন্য কলকাতা এসেছেন, তাও জানতাম না। জানতাম না আরো অনেক কিছু। জানতে পারিনি যে চোদ্দ বছর বয়সেই তিনি তার জীবন-নাট্যের নায়ক খুঁজতে বেরিয়েছেন। এসব কিছুই আমি জানতাম না।

একদিন মণ্টুদাদের বাড়ি থেকে দু একটা গল্পের বই নিয়ে। বেরুবার সময় মাথার ওপর একটা কাগজের প্যাকেট এসে পড়ায় চমকে গেলাম। কুড়িয়ে নিয়ে দেখলাম একটা খাম। নাম ঠিকানা কিছুই লেখা ছিল না। শুধু লেখা ছিল, তোমার চিঠি। তোমার চিঠি। মানে আমার চিঠি! মুহুর্তের জন্য ঘাবড়ে গেলাম। দু’এক মিনিট বোধহয়। থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর একটু হলেই চীৎকার করে মণ্টুদাকে ডাক দিতাম। কিন্তু হঠাৎ যেন কে আমার মাথায় বুদ্ধি জোগাল। চারপাশটা একনজরে দেখে নিলাম। শুধু বুড়ো কাকাতুয়া পাখীটা ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না। খামটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলাম। উপরের লেখাটা বারিকয়েক পড়লাম, তোমার চিঠি। তারপর দৃষ্টিটা দোতলার দিকে ঘুরিয়ে নিতেই কোনার ঘরের জানলায় হাসিখুশিভরা একটা সুন্দরী কিশোরীকে দেখলাম।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

অনেকদিন আগেকার কথা সবকিছু ঠিক মনে নেই। তবে আবছা আবছা মনে পড়ে কি যেন একটা ইশারা করে নন্দিনী লুকিয়েছিল। নারী চরিত্র সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি চিঠিটি নন্দিনীরই লেখা।

প্ৰায় ছুটতে ছুটতে বাসায় এলাম। ঘরের খিল বন্ধ করে চিঠিটা একবার নয়, অনেক বার পড়লাম। চিঠির ভাষাটা আজ আর মনে নেই। কিন্তু ভাবটা একটু একটু মনে পড়ে। কিছুটা উচ্ছ্বাস, কিছুটা আবেগ ছিল চপলা, কিশোরী নন্দিনীর ঐ চিঠিতে। চিঠিটা পেয়ে তালও লেগেছিল, ভয়ও লেগেছিল। তার চাইতে আরো বেশী লেগেছিল অবাক। ধনীর দুলালীর জীবন-উৎসবে আমার আমন্ত্রণ! আমার মত একটা ভাঙা ডিঙ্গি নৌকা চড়ে, নন্দিনী জীবন-সাগর পাড়ি দেবে? আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

নন্দিনী চিঠির উত্তর চেয়েছিল কিন্তু আমার সাহস হয় নি। উৎসাহও আসে নি। উত্তর দিইনি, তবুও আবার চিঠি পেয়েছিলাম। ইঙ্গিত পেয়েছিলাম, আমি নাকি তার মানসরাজ্যের রাজপুত্র। পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে নন্দিনীকে নিয়ে অভিষিক্ত করব আমার জীবন-সঙ্গিনীরূপে। আরো অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। সে। জীবন যার প্রাচুর্যে ভরা, বিলাসিত করা যার স্বভাব, তার পক্ষে এমন অহেতুক স্বপ্ন দেখা হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মত দৈন্যভরা কিশোরের পক্ষে এমন স্বপ্ন দেখা সম্ভব ছিল না। তাইতো তার সে আমন্ত্রণ আমি গ্ৰহণ করতে পারিনি। সে আমন্ত্রণ গ্ৰহণ করার ক্ষমতা বা সাহসও আমার ছিল না।

নন্দিনীকে আমি ভালবাসিনি। কিন্তু প্ৰাণচঞ্চল এই কিশোরীকে ভুলব না কোনদিন। সে আমার জীবনযজ্ঞের উদ্বোধনসঙ্গীত গেয়েছিল। এই কিশোরী আমার জীবন-নাট্যমঞ্চে শুধু একটু উকি দিয়েই সরে গিয়েছিল, বিশেষ কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করার অবকাশ পায় নি, কিন্তু তবু তার এক অনন্য ভূমিকা রয়ে গেছে আমার কাছে। বি-এ বা এম-এ পাশ করার পর জীবনের বৃহত্তর পটভূমিকায় অতীতের অনেক স্মৃতি হারিয়ে যায়, কিন্তু হারিয়ে যায় না পাঠশালার গুরুমশায়ের স্মৃতি। নন্দিনী আমার তেমনি একটি অমূল্য স্মৃতি। সে আমার তোরের আকাশের একটি তারা। সে তারার জ্যোতিতে আমি আমার জীবন-পথ চলতে পারিনি বা তার প্রয়োজন হয় নি। তা না হোক। তবুও সে আমার জীবন দিগদর্শনে সাহায্য করেছিল। সর্বোপরি সে আমাকে আমার আমিত্ব আবিষ্কারে সাহায্য করেছিল।

ভালবাসা কি এবং তার কি প্রয়োজন, সেদিন আমি বুঝিনি, জানিনি। নন্দিনী কেন আমাকে ভালবেসেছিল, কি সে চেয়েছিল,, কি পেয়েছিল–কিছুই আমি জানি না। শুধু এইটুকুই জানি আমার সুখে সে সুখী হতো, আমার দুঃখে সে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জলও ফেলেছে। ছন্দোবদ্ধভাবে এইসব অনুভূতির প্রকাশ করবার সুযোগ কোনদিনই সে পায় নি। কিন্তু যখনই সে সুযোগ এসেছে, নন্দিনী তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে।

সরস্বতী পূজার আগের ক’দিন মরবার অবকাশ থাকত না। খাওয়া-দাওয়া তো দূরের কথা ঘুমুবার পর্যন্ত সময় পেতাম না। সারা দিন-রাত্তিরই রিপন স্কুলে কাটাতাম। নন্দিনী ঠিক জানত আমি কোন গরম জামা নিয়ে যাই নি। সন্ধ্যার পর এক ফাঁকে। একটা আলোয়ান নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দিয়ে আসত। বলত, তোমার কি ঠাণ্ডাও লাগে না? যদি জ্বরে পড়, তাহলে কি হবে বল তো!

একবার সত্যি সত্যিই আমি খুব অসুস্থ হয়েছিলাম। নটা বাজতে না বাজতেই বাবা বিদায় নিতেন। ফিরতে ফিরতে সেই রাত দশটা! অখিল মিস্ত্রী লেনের ঐ বিখ্যাত ভাঙা বাড়িটার অন্ধকার কক্ষে আমি একলা থেকেছি। মণ্টুদাদের বাড়ি থেকে আমার পথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা হয়েছিল নন্দিনীর আগ্রহেই। দুবেল স্কুলে যাতায়াতের পথে নন্দিনী আমাকে দেখে যেত। হয়ত একটু সেবা-যত্নও করত।

এসব অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। শুধু আমার জন্য এক’জন পথ চেয়ে বসে থাকবে, আমাকে ভালবেসে, সেবা করে, যত্ন করে, কেউ মনে মনে তৃপ্তি পাবে, আমি ভাবতে পারতাম না। নন্দিনী আমার জীবনে সেই অভাবিত অধ্যায়ের সূচনা করে।

ম্যাট্রিক পাশ করার পরই নন্দিনী বোম্বে চলে গেল। আমার জীবনের সেই ক্ষণস্থায়ী অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু তবুও সে আমার জীবন থেকে একেবারে বিদায় নিল না। চিঠিপত্ৰ নিয়মিত আসত। আর আসত আমার জন্মদিনে একটা শুভেচ্ছা। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা নেতাজী নই। আমার মত সাধারণ মানুষের জন্মদিনে যে কোন উৎসব বা অনুষ্ঠান হতে পারে, তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। আমার জন্মদিনে বাবা ধান-দূর্বা দিয়ে আশীৰ্বাদ করেই অফিসে দৌড় দিতেন। সেবারেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় নি। বিকেলবেলায় নন্দিনী টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে আমার জন্য সামান্য কিছু উপহার এনে চমকে দিয়েছিল।

নন্দিনী আজ অনেক দূরে চলে গেছে। সুখে-শাস্তিতে স্বামীপুত্র নিয়ে ঘরসংসার করছে। তার আজ কত কাজ, কত দায়িত্ব। কিন্তু তবুও একটা গ্ৰীটিংস টেলিগ্রাম পাঠাতে ভোলে না। আমার জন্মদিনে।

কলকাতা থেকে বিদায় নেবার পর আমার সঙ্গে নন্দিনীর আর দেখা হয় নি। এম-এ পড়বার সময় ওর বিয়ে হলো এক আই-এ–এস পাত্রের সঙ্গে। নিমন্ত্রণাপত্রের সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত অনুরোধপত্রও এসেছিল। কিন্তু আমার পক্ষে তখন বোম্বে যাওয়া আদৌ সম্ভব ছিল না। টিউশানির টাকা আগাম নিয়ে পনের টাকা দামের একটা তাঁদের শাড়ী পাঠিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে আমি আমার জীবন-যুদ্ধে এমন মেতে উঠেছিলাম যে নন্দিনীকে মনে করার পর্যন্ত ফুরসত পেতাম না।

প্ৰায় বছর দশেক পরে আমি গ্যাংটক গিয়েছিলাম কি একটা কাজে। তিন-চারদিন পরে কলকাতার পথে শিলিগুড়ি ফিরছিলাম। পথে আটকে পড়লাম। সেবক ব্রীজের কাছে কিছুটা ধ্বস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়েছিল। কুলি-মজুরের দল রাস্তা পরিষ্কারে ব্যস্ত। আমার মত অনেকেই প্ৰকৃতির এই খামখেয়ালীপনায় বিরক্ত হয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিলেন। রাস্তা পরিষ্কার হতে আরো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। এই দীর্ঘ অবসরে অনেকের সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় হলো। কার্শিয়াং-এর তরুণ এস-ডি-ওর সঙ্গেও বেশ ভাব হয়ে গেল।

মাসিকয়েক পর আবার কর্মব্যাপদেশে দাৰ্জিলিং যাচ্ছিলাম। পথে কার্শিয়াং পড়বে। মনে মনে ঠিক করেছিলাম। এস-ডি-ও সাহেবের সঙ্গে দেখা করব। শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং এলাম। হঠাৎ অফিসে গিয়ে হাজির হওয়ায় এস-ডি-ও সাহেব চমকে গেলেন। পরপর দুকাপ কফি গিলেই পালাবার উপক্রম করছিলাম কিন্তু এস-ডি-ও সাহেব বললেন, তা কি হয়। আমার কোয়ার্টারে যাবেন, লাঞ্চ খাবেন। তারপর বিকেলের দিকে দাৰ্জিলিং যাবেন।

আমার কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই এস-ডি-ও সাহেব কোয়ার্টারে টেলিফোনে স্ত্রীকে জানালেন, নন্দা, আমার এক বন্ধু এসেছেন কলকাতা থেকে। লাঞ্চে নিয়ে আসছি। তুমি একটু ব্যবস্থা করো।

গোটা বারো নাগাদ এস-ডি-ও সাহেব আমাকে নিয়ে কোয়ার্টারে গেলেন। ড্রইংরুমে আমাকে বসিয়ে রেখে স্নান করবার জন্য বিদায় নিলেন। মিনিট কয়েক পরে আর কেউ নয়, স্বয়ং নন্দিনী কফির কাপ হাতে নিয়ে আমার সামনে হাজির হলো। দুজনেই একসঙ্গে বলেছিলাম, তুমি?

সেদিন কার্শিয়াং পাহাড়ের সমস্ত কুয়াশা ভেদ করেও নন্দিনীর চোখেমুখে যে উজ্জ্বলতা, যে আনন্দ দেখেছিলাম, তা কোনদিন ভুলব না। এস-ডি-ও সাহেবকে বলেছিলাম, আপনি যে মণ্টুদাদের বাড়ির জামাই, তা তো জানতাম না। সংক্ষেপে জানালাম ওর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতার কথা। গোপন করিনি যে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছোটবেলায় খেলাধুলা করেছি।

এস-ডি-ও আমাকে শ্বশুরবাড়ির দূত মনে করে আনন্দে মেতে উঠলেন। লাঞ্চের টেবিলে এক গেলাস স্কোয়াস হাতে নিয়ে আমার হেলথ এর জন্য প্রপোজ করতে গিয়ে ঘোষণা করলেন, মিস্টার জার্নালিস্ট আজ রাত্রে এক স্পেশ্যাল ডিনারে চীফ গেস্ট হবেন এবং কাশিয়াংএ রাত্রিবাস করবেন।

আমি বললাম, তা কি হয়।

এস-ডি-ও সাহেব বললেন, ভুলে যাবেন না। আমি শুধু অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন চালাই তা নয়, বিচারও করি। আমি কার্শিয়াংএর চীফ জাস্টিস কাম প্ৰাইম মিনিস্টার।

নন্দিনী বলল, এতদিন পর যখন দেখা হলো, একটা দিন থাকলে কি তোমার খুব ক্ষতি বা কষ্ট হবে?

সত্যি খুব আনন্দ করে সেই দিনটি কাটিয়েছিলাম। নন্দিনী ঠিক এতটা আদর-যত্ন করবে, ভাবতে পারিনি।

কর্মজীবনের পাকচক্ৰে আমি ছিটকে পড়েছি বহুদূরে। নন্দিনীর সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নি, ভবিষ্যতে কোনদিন দেখা হবে। কিনা, তাও জানি না। তবে ভুলব না তার স্মৃতি।

জান দোলাবৌদি, আমি কার্শিয়াং ত্যাগের আগে নন্দিনী বলেছিল, একটা অনুরোধ করব?

আমি বলেছিলাম, তার জন্য কি অনুমতির প্রয়োজন?

না তা নয়। তবে বলো আমার অনুরোধটা রাখবে।

বিদায় নেবার প্রাক্কালে মনটা নরম হয়েছিল। কোনকিছু তর্ক করার প্রবৃত্তি ছিল না। বললাম, নিশ্চয়ই রাখব।

তোমার পুত্রবধূর নাম রেখে নন্দিতা। রাখবে তো? আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম ওর ঐ বিচিত্ৰ অনুরোধ করার জন্য। ঠোঁটটা কামড়াতে কামড়াতে কথা বলতে পারিনি। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম।

এই চিঠি আর দীর্ঘ করব না। তাছাড়া তুমি তো আমার চিঠি। একবার পড়ে ক্ষান্ত হও না। আর যাই কর আমার এসব চিঠি তুমি কলেজে নিয়ে ক্লাশে বসে পড়ে না। তিন-চারদিনের জন্য এলাহাবাদে যাচ্ছি। ফিরে এসে আবার চিঠি দেব।

পর্ব ৩ শেষ 📌

🔴পর্ব :৪🔴

ভেবেছিলাম তিন-চার দিনের মধ্যেই এলাহাবাদ-বাস শেষ হবে। আশা করেছিলাম। এই কদিনের মধ্যেই ভারতবর্ষের ভাষা সমস্যার একটা হিল্পে হবে। দেশটা এমন একটা স্তরে এসে পৌচেছে যে আমাদের কোন আশাই যেন আর কোনদিন পূর্ণ হবে বলে মনে হয় না। ভাষা নিয়েও তাই আমাদের আশা পূর্ণ হলো না এবং আমার এলাহাবাদ ত্যাগ করাও সম্ভব হয় নি। আমি আজও এলাহাবাদে আছি; আগামী কাল ও পরশুও আছি। হয়ত আরো অনেক দিন থাকতে পারি।

ক’দিন শুধু টাইপরাইটার খট্‌খটু করে প্রায় অ্যালার্জি হবার উপক্রম হয়েছে। তাইতো একটু মুখ পাণ্টে নেবার জন্য তোমাকে আমার মেমসাহেব কাহিনী আবার লিখতে শুরু করলাম।

নন্দিনীর বিদায়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবন সংগ্ৰাম শুরু হলো। তুমি তো জান বাংলাদেশটা দুটুকরো। হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মত লক্ষ লক্ষ বাঙালী যুবক-যুবতীদের অদৃষ্টও টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে এমন করে কালবৈশাখী দেখা দেবে। ভাবিনি। জীবনের সমস্ত দিগন্ত এমনভাবে অন্ধকারে ভরে যাবে।

রিপন স্কুল ত্যাগ করে রিপন কলেজে ভর্তি হলাম। সবার মুখেই শুনছিলাম আর্টস পড়লে কোন ভবিষ্যত নেই; সায়েন্স না। পড়লে দেশ ও দেশের যুবকদের মুক্তির কোন উপায় নেই। বাপ-ঠাকুর্দার সঙ্গে জ্ঞানের পরিচয় থাকলেও চোদপুরুষের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তবুও আমি বিজ্ঞান সাধনা শুরু করলাম। তবে দেশের অবস্থা এমন অদ্ভুত জটিল হয়েছিল যে শুধু বিজ্ঞান সাধনা করেই দিন কাটান সম্ভব ছিল না, লক্ষ্মীর সাধনাও শুরু করলাম।

কলেজে গিয়ে লেখাপড় করা মুখ্য হলেও সকাল-সন্ধ্যায় টিউশানি করে রসদ যোগাড় করার কাজটাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এই দেটিানার মধ্যে প্ৰাণান্ত হবার উপক্রম হয়েছিল। নিজেয় দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পাচ্ছিলাম না। ছোটবেলায় কলেজ জীবন সম্পর্কে অনেক রূপকথার কাহিনী শুনতাম। স্কুলে পড়বার সময় তাই অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্ন দেখতাম, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে খাতা দোলাতে দোলাতে কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মাস্টার মশাইদের মত প্রফেসাররা অযথা ছাত্রদের বকাবিকি করছেন না, ক্লাশ ফাঁকি দেবার অবাধ স্বাধীনতা এবং আরো অনেক কিছু। আশা করেছিলাম কলেজ জীবন সাফল্যপূর্ণ বৃহত্তর জীবনের পাশপোর্ট তুলে দেবে আমার হাতে। এই ক’বছরের শিক্ষা-দীক্ষা ও সৰ্বোপরি অভিজ্ঞতা আমার চোখে নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা এনে দেবে, সম্ভব করে তুলবে তাদের বাস্তব রূপায়ণ। লুকিয়ে লুকিয়ে মনে মনে হয়ত এ আশাও করেছিলাম আমি সার্থক, সাফল্যপূর্ণ ও পুর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে সগৰ্বে এগিয়ে যাব আগামী দিনের দিকে।

সেদিন জানতাম না বাংলা দেশের সব যুবকই কলেজ জীবনের শুরুতে এমনি অনেক স্বপ্ন দেখে এবং সে স্বপ্ন চিরকাল শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। বোধহয় একজনের জীবনেও এসব স্বপ্ন বাস্তব হয়ে দেখা দেয় নি। তবুও বাঙালীর ছেলে স্বপ্ন দেখে; স্বপ্ন দেখে হাসিতে গানে ভরে উঠবে তার জীবন। জীবন পথের চড়াই উতরাই পার করতে সাহায্য করবে। আদর্শবতী জীবন-সঙ্গিনী এবং আরো অনেক কিছু।

লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বাঙালী যুবকদের মত হয়ত আমিও এমনি স্বপ্ন দেখেছিলাম কোন দুর্বল মুহুর্তে। অতীতের ব্যর্থতার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিইনি, পূর্বসূরীদের অভিজ্ঞতা আমাকে শাসন করতে পারে নি, সংযত করতে পারে নি।

তবে আমি আমার কল্পনার উড়োজাহাজ উড়িয়ে বেশিদূর উড়ে যাই নি। রিপন কলেজের এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করার পরপরই ক্রাশ ল্যাণ্ড করে সন্বিত ফিরে পেয়েছিলাম।

একদিকে অর্থ চিন্তা ও অন্যদিকে ভবিষ্যতের চিন্তায় আমি এমন প্ৰমত্ত থাকতাম যে আশপাশে কোন ভ্ৰমর আমার মধু খাবার জন্য উড়ছে কিনা, সে খেয়াল করার সুযোগ পেতাম না। জীবনটার সঙ্গে সঙ্গে মনটাও কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল। আমার সীমিত জীবনের মধ্যে যে ক’টি নারী-পুরুষের আনাগোনা ছিল তাদের দিকে ফিরে তাকাবারও কোন আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না।

কিন্তু কি আশ্চৰ্য, কিছুকাল পর হঠাৎ আবিষ্কার করলাম কে যেন আমার মনোবীণার তারে মাঝে মাঝে ঝঙ্কায় দিচ্ছে। চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন একটু রঙীন মনে হলো। ক’দিন আগে পর্যন্ত যে আমার মুহুর্তের ফুরসত ছিল না নিজের দিকে তাকাবার, সেই আমি নিজের দিকে ফিরে তাকান শুরু করলাম। আরো একটা গেরুয়া পাঞ্জাবি তৈরী করলাম। কায়দা করে ধুতি পরাও ধরলাম। পাড়ার সেলুনে চুল কাটা আর রুচিসম্মত মনে হলো না। পরের মাসে টিউশানির মাইনে পাবার পর একজোড়া হাল ফ্যাশানের কোলাপুরী চটিও কিনলাম।

এমনি আরো অনেক ছোটখাটো পরিবর্তন এলে আমার দৈনন্দিন জীবনে। আগে দু’টো একটা বই আর খাতা নিয়ে কলেজে যেতাম। এখন বই হাতে করে কলেজে যেতে আত্মসম্মানে বাধতে লাগল। বই নেওয়া ত্যাগ করে শুধু খাত হাতে করে কলেজ যাওয়ার নিয়মটা পাকাপাকি করে নিলাম। মোদ্দা কথা আমি এক নতুন ধর্মে দীক্ষিত হলাম। বাসাংসি জীর্ণানি করে আমি এক নতুন আমি হলাম।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

অদৃষ্ট নেহাতই তাল। বেশিদূর এগুতে হলো না। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। আজ আত্মজীবনীর সেই রঙীন দিনগুলোর কথা মনে হলে হাসি পায়। সেদিন। কিন্তু হাসি পায় নি। মরীচিকাকেই সেদিন জীবনের চরম সত্য বলে মনে করে। ছুটেছিলাম। ঘটনাটা নেহাতই সামান্য।

বারাকপুর-টিটাগড় বা খিদিরপুরের বড় বড় কলকারখানার মত তখন আমাদের কলেজও তিন শিফটএ হতো। সকালে মেয়েদের, দুপুরে ছেলেদের, রাত্ৰিতে প্ৰৌঢ়দের ক্লাশ হতো। বেথুন বা লেভী ব্ৰাবোর্মের ছাত্রীদের মধ্যে যুবতী কুমারীদের মেজরিটি থাকলেও আমাদের কলেজের মর্নিং সেকসনের চেহারা ছিল আলাদা। নীলিমা সরকারের মত সদ্য প্ৰস্ফুটিত গোলাপের সংখ্যা খুব বেশী ছিল না। দেশটা স্বাধীন হবার পর অনেকের সংসারেই আগুন লাগল। এক টুকরো বস্ত্ৰ আর এক মুষ্টি অন্নের জন্য, রুগ্ন শিশুর একটু পথ্যের জন্য, জীবনধারণের নিতান্ত প্ৰয়োজনীয় দাবী মেটাবার জন্য বাংলা দেশের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ গৃহস্থ বধুদের ডালহৌসী স্কোয়ারের রঙ্গমঞ্চে নামতে হলো। তাইতো এই ডালহৌসী রঙ্গমঞ্চে আসবার পাশপোর্ট যোগাড় করার জন্য অনেক বৌদি আর ছোট মাসিমারাই আবার কলেজে পড়া শুরু করলেন। তাছাড়া আর একদল মেয়েরা নতুন করে উচ্চ শিক্ষা নিতে সে সময় শুরু করলেন। দেশটা স্বাধীন হবার পর অনেক অন্ধকার ঘরেই হঠাৎ বিংশ শতাব্দীর আলো ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের কলেজের বীণামাসির মত যারা কোন অন্যায় না করেও স্বামী ও শ্বশুর-বাড়ির অকথ্য অত্যাচার দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সহ করেছেন, যারা বিবাহিতা হয়েও স্ত্রীর মর্যাদা পাননি, স্বামীর ভালবাসা পাননি, সন্তানের জননী হয়েও যাঁরা মা হবার গৌরব থেকে বঞ্চিতা হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই বন্দীশালার অন্ধকূপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলেন। অজানা, অজ্ঞাত, ভবিষ্যতের সঙ্গে মোকাবিলা করবার জন্য এদের অনেকেই আবার কলেজে ভর্তি হলেন। আমাদের কলেজেও অনেকে ভৰ্তি হয়েছিলেন।

দিনের বেলায় হাফ আদর্শবাদী, হাফ ভাবুক, হাফ পলিটাসিয়ান, হাফ অভিনেতা, হাফ গায়ক, হাফ খেলোয়াড়দেরই সংখ্যা ছিল বেশী। সন্ধ্যার পর যারা আসতেন। তাঁদের অধিকাংশই ডালহৌসী-ক্যানিং স্ট্রট-ক্লাইভ স্ট্রট থেকে অধমৃত অবস্থায় ছুটতে ছুটিতে কলেজে আসতেন।

সওয়া দশটায় মেয়েদের ক্লাশ শেষ হতো আর ছেলেদের ক্লাশ শুরু হতো। আমার ক্লাশ কোনদিন সওয়া দশটায়, কোনদিন এগারটায় শুরু হতো। সওয়া দশটায় ক্লাশ থাকলে ছেলেরা কোনদিন লেট করত না। বরং দশটা বাজতে বাজতেই কমনরুম ছেড়ে দোতলা-তিনতলার দিকে পা বাড়াত। সওয়া দশটার সন্ধিলয়ের প্রতি অন্যান্য ছাত্রদের মত আমারও আকর্ষণ ছিল। কিন্তু সকালবেলায় দুদু’টো টিউশানি করে কলেজে আসতে আসতে প্ৰায় সাড়ে দশটা হয়ে যেত। তাইতো সওয়া দশটার ক্ষণিক বসন্তের হাওয়া আমার উপভোগ করার সুযোগ নিয়মিত হতো না।

বীণামাসির সঙ্গে প্রায়ই পূরবী সিনেমার কাছাকাছি দেখা হতো। বীণামাসি বিবাহিত যুবতী। কিন্তু সিঁদুর পরত না। বীণামাসি বলত, বিয়ে করেও যখন স্বামীকে পেলাম না, শ্বশুরবাড়িতেও স্থান পেলাম না, তখন সিন্দুর পরব। কার জন্য? কিসের জন্য? ফুটপাথের এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা দু’চার মিনিট কথাবার্তা বলতাম। কলেজের ছোকরা অধ্যাপক ও ছাত্রদের কেউ কেউ পাশ দিয়ে যাবার সময় একটু সরস দৃষ্টি দিয়ে চাইতেন। বীণামাসি ও আমি দুজনেই তা লক্ষ্য করতাম। কিন্তু গ্ৰাহ করতাম না।

পর পর ক’দিন বীণামাসির সঙ্গে দেখা হলো না। প্ৰথম ক’দিন বিশেষ কিছু ভাবিনি। পুরো একটা সপ্তাহ দেখা না হবার পর একটু চিন্তিত না হয়ে পারলাম না। অথচ বীণামাসিদের বাড়ি গিয়ে খোজ করব সে সময়ও হয় না। কলেজ শেষ হতে না হতেই আবার টিউশানি করতে ছুটতে হয়।

সেদিনও কলেজে আসবার পথে বীণামসির দেখা পেলাম না। কিন্তু ঐ পূরবী সিনেমার কাছাকাছিই হঠাৎ একটা জীবন্ত বারুদের ভূপ আমার সামনে থমকে দাঁড়াল। বললো, শুনুন। বীণাদির খুব অসুখ। আপনাকে যেতে বলেছেন।

সকাল সাড়ে দশটার সময় হ্যারিসন রোডের পর পূরবী সিনেমার পাশে এমনভাবে এক’জন সুন্দরী আমাকে বীণামাসির সমন জারী করবে, কল্পনাও করতে পারিনি। মুহুর্তের জন্য ভড়কে চমকে গিয়েছিলাম। একটু সামলে নেবার পর অনেক প্রশ্ন মনে এসেছিল। কিন্তু গলা দিয়ে সেসব প্রশ্ন বেরুতে সাহস পায় নি। শুধু বলেছিলাম, আপনি জানলেন কি করে?

–আমি বীণাদির বাড়ি গিয়েছিলাম।

সেই দিনই বিকেলবেলা বীণামাসিকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমি যেতেই বীণামাসি আমাকে প্রশ্ন করল, নীলিমার কাছে খবর পেয়েছিস বুঝি?

আমি বললাম, কোন নীলিমা?

ঐ যে আমাদের সঙ্গে পড়ে নীলিমা সরকার…

তা জানিনে, তবে আজ সকালেই পূরবীর কাছে একটা সুন্দর ধরনের মেয়ে…

বীণামাসি আর এগুতে দিল না। বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ ঐ তো নীলিমা।

আমি বললাম, তাই বুঝি?

বীণামাসির কাছে আমি আমার চিত্তচাঞ্চল্যের বিন্দুমাত্ৰ আভাস দিলাম না। নিজেকে সংযত করে নিলাম। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে সেদিনের মত বিদায় নেবার আগে বীণামাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কলেজ থেকে কেউ তোমাকে দেখতে আসেন না।

হ্যাঁ, অনেকেই আসে।

তিন-চারদিন পরে আবার বীণামাসিকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি সেদিনের সেই নীলিমা সরকারও বসে আছেন। নমস্কার বিনিময় করে আম পাশের মোড়াটায় বসলাম। বীণামাসি চাদরটা গলা পর্যন্ত টেনে নিয়ে পাশ ফিরে বললে, জনিস নীলিমা, বাচ্চা আগে আমাদের পাড়াতেই থাকত। আমাদের এই পাড়ায় থাকবাযর সময়ই ওর মা মারা যান…

নীলিমা বললো, তাই নাকি?

আমি বললাম, আমার জীবন কাহিনী শোনার অনেক অবকাশ পাবেন, আজ থাক। যদি লিখতে পারত তবে বীণা মাসি আমার জীবন নিয়ে একটা রামায়ণ লিখত। ভাগ্য ভাল বীণামাসির কলম চলে না, শুধু মুখ চলে। কিন্তু তার ঠেলাতেই আমি অস্থির।

নীলিমার সঙ্গে সেই আমার প্রথম আলাপ-পরিচয় হলো। দশ-বারে দিন পরে বীণামসির ওখানেই আমাদের আবার দেখা। সেদিন দুজনেই একসঙ্গে বেরুলাম। তারপর কলেজ স্কোয়ার পর্যন্ত একসঙ্গে হেঁটে গিয়ে দুজনে দুদিকে চলে গেলাম।

ঐ সামান্য আলাপ-পরিচয়তেই আমি যেন কেমন পালটে গেলাম। সকালবেলার টিউশানিতে একটু একটু ফাঁকি দিয়ে ও স্নানআহারের পর্ব কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত করে দৌড়ে দৌড়ে সওয়া দশটার আগেই কলেজে আসা শুরু করলাম। কোনদিন দেখা হয়, কোনদিন হয় না; কোনদিন কথা হয়, কোনদিন হয় না। কোনদিন আবার দূর থেকে একটু তিৰ্যক দৃষ্টি আর মুচকি হাসি-বিনিময়। তার বেশী আর কিছু নয়। কিন্তু তবুও আমি কেমন স্বপ্নাতুর হয়ে পড়লাম। নীলিমাকে কো-পাইলট করে আমি আমার কল্পনার উড়ো-জাহাজ নিয়ে টেক অফ করলাম। ভাব-সমুদ্রে ভেসে বেড়ালাম।

ঐ শুধু একটু মুচকি হাসি ও ক্ষণিকের দৃষ্টি-বিনিময়কে মূলধন করে আমি অনেক, অনেক দূর এগিয়ে গেলাম। টোপর মাথায় দিয়ে নীলিমার গলায় মালা পরিয়েছিলাম, পাশে বসে বাসর জেগেছিলাম। বৌভাত-ফুলশয্যার দিন গভীর রাত্রে অতিথিদের বিদায় জানিয়ে আমি নীলিমার ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করলাম। নীলিমার পাশে বসে একটু আদর করলাম। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে সুইচটি অফ করতে গিয়েই দারুণ শক লাগল। আমার কল্পনার জাহাজ ক্রোশ ল্যাণ্ড করল। কো-পাইলট নীলিমাকে আর কোথাও খুজে পেলাম না।

সাহস করে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। মহা উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল। নীলিমা-বিহীন জীবন প্ৰায় অসহ্য হয়ে উঠিল। বৈরাগ্যের ভাব মনের মধ্যে মাঝে মাঝেই উকি দিতে লাগল। আর কয়েক দিনের মধ্যে খবর না পেলে হয়ত কেদার বদ্রীর পথেই পা বাড়াতাম। ভগবান করুণাময়। তাই সে যাত্রায় আর সংসার ত্যাগ করতে হলো না, নীলিমার দেখা পেয়ে গেলাম।

দেখা পেলাম বীণামাসির বাড়িতেই। নীলিমার কপালে অতি বড় একটা সি দুরের টিপ দেখে বেশ আঘাত পেয়েছিলাম মনে মনে। প্ৰথমে ঠিক সহজ হয়ে কথাবার্তাও বলতে পারিনি। নীলিমা বোধহয় আমার মানসিক দ্বন্দ্বের ভাষা বুঝেছিল। তাই সে নিজেই বেশ সহজ সরল হয়েছিল আমার সঙ্গে।

জান দোলাবৌদি, নীলিমার বিয়ে হবার পরই আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব হলো। কোন কাজে-কর্মে সাউথে গেলেই কালীঘাটে নীলিমার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। নীলিমার স্বামী সন্তোষবাবু আজ আমার অন্যতম বিশেষ বন্ধু ও শুভাকাজক্ষী। ওরা এখন আমেদাবাদে আছেন। সন্তোষবাবু একটা বিরাট টেকসটাইল মিলের চীফ অ্যাকাউন্ট্যাণ্ট। এক গাদা টাকা মাইনে পান। নীলিমা আমেদাবাদ টেগোর সোসাইটির সেক্রেটারী। তোমার বোধহয় মনে আছে সেবার গোয়া অপারেশনস কভার করে দিল্লী ফেরার পথে দমন গিয়েছিলাম এবং আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। গত্যন্তর না পেয়ে সন্তোষবাবুকেই একটা আর্জেণ্ট টেলিগ্রাম পাঠাই। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছুটে এসেছিলেন আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। দু-সপ্তাহ ওদের সেবা-যত্নে আমি সুস্থ হবার পর নীলিমা মেমসাহেবকে আমেদাবাদ আনিয়েছিল। দু’সপ্তাহ অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও কোন খবর না দেবার জন্য মেমসাহেব ভীষণ রেগে গিয়েছিল। আমি কিছু জবাব দিতে পারিনি। নীলিমা ওর দুটি হাত ধরে বলেছিল, তোমার সেবা পাবার মত অসুখ হলে নিশ্চয়ই খবর দিতাম। ডক্টর মৈত্রকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম। উনি বললেন, তাড়াহুড়ো করে ওকে আনাবার কোন কারণ দেখি না। একটু সুস্থ হলেই খবর দেবেন।

একটু থেমে দু’হাত দিয়ে মেমসাহেবের মুখটি তুলে ধরে নীলিমা বলেছিল, তাছাড়া ভাই, আমি বা তোমার দাদাও বাচ্চা কে ভালবাসি। তোমার অভাব আমাদের দ্বারা না মিটলেও ওর সেবাযত্নের কোন ত্রুটি করিনি। আমরা।

মেমসাহেব তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে হাসিতে ভরিয়ে তুললো নিজের মুখটা। বললো, নীলিমাদি, আমি তো আপনাদের দুঃখ দিতে চাইনি। তবে আগে এলে হয়ত নিজে মনে মনে একটু শান্তি পেতাম, তাই আর কি…

নীলিমা আর এগুতে দেয় নি। ঐ অধ্যায়ের ঐখানেই সমাপ্তি হলো।

তারপর আরো এক সপ্তাহ ছিলাম। আমেদাবাদে। কাকারিয়ার লেকের ধারে রোজ বেড়িয়েছি আমরা। কত আনন্দ, কত হৈ-চৈ করেছি। আমরা। যাকগে সেসব কথা।

নন্দিনী যখন আমার জীবনে উকি দিয়েছিল, তখন আমি চমকে গিয়েছিলাম। ভাবতে পারিনি, ভাববার সাহস হয় নি যে একটি মেয়ে আমার জীবনে আসতে পারে বা আমাকে কোন মেয়ে তার জীবনরথের সারথী করতে পারে। যেদিন নীলিমার দেখা পেলাম, সেদিন কি করে এই সংশয়ের মেঘ কেটে গেল জানি না। তবে একথা সত্য যে রূপকথার রাজকুমারীর মত নীলিমার ছোয়ায় আমার ঘুম ভেঙেছিল, আমি কৈশোর থেকে সত্যি সত্যিই যৌবনের সিংহদ্বারে এসে উপস্থিত হলাম।

নীলিমার কথা আজ পর্যন্ত কাউকে জানাই নি। এসব জানাবার নয়। এ আমার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। এমন কি নীলিমাও জানে না, হয়ত ভবিষ্যতেও জানতে পারবে না।

তবে মেমসাহেবকে বলেছিলাম। মেমসাহেব কি বলেছিল। জান? বলেছিল, সুন্দরী মেয়ে দেখলে যে তোমার মাথাটা ঘুরে যায়, তা আমি জানি। আমার মত কালো কুচ্ছিৎ মেয়েকে যে তোমার পছন্দ হয় না, সে কথাটা অত ঘুরিয়ে বলার কি দরকার?

আমি শুধু বলেছিলাম :
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস–
তোমার চোখে দেখেছিলাম। আমার সর্বনাশ।
এ সংসারের নিত্য খেলায় প্ৰতিদিনের প্রাণের মেলায়
বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস–
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ।”

একটা চাপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছিলাম, তোমার পোড়া কপাল। কি করবে বল। যদি পার পালটে নেবার চেষ্টা কর।

আলোচনা আর দীর্ঘ না করে মেমসাহেব মুচকি হেসে জিভ ভেংচি কেটে পালিয়ে যেত।

চলবে।

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ৩০ (অন্তিম পর্ব)

মাঝরাতে কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় মর্জিনা বেগম। সাধারণত এতো রাতে তার বাড়িতে কেউ আসেনা। মেয়েটা অনেকদিন যাবৎ বলছে জামাই নাকি তাকে খুব অত্যা’চার করছে ইদানীং, ও আর সহ্য করতে পারছে না। মর্জিনা বেগম কিছু বলতে পারেনি। তার স্বামী রফিকুলের কথা, মেয়ে বউ হয়ে ও বাড়িতে গেছে, যদি আসতে হয় মৃত লা’শ হয়ে আসতে হবে। মা হয়ে মেয়ের কষ্টে পাশে থাকতে না পারার যে কষ্ট মর্জিনা বেগম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অনুশোচনায় এতোটুকু হয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে পড়ছে সে। আজ কবির শাহের মনে কতো আনন্দ, মার্জিয়ার মনেও অহংকার। আজ বাদে কাল তাদের মেয়ে ডাক্তার হবে। অথচ এককালে তাদেরই টাকা কম বলে কতোই না খোঁটা দিয়েছে সে। আজ তারা কম টাকার মধ্যেও অসম্ভব সুখী আর সে নিজে বিশাল বিত্ততার মাঝেও চরম অসুখী। পাপের শাস্তি বোধহয় একেই বলে।

মেয়ের বিপদের আশঙ্কায় বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে তার। কোনো বিপদ হয়েছে ওর? খারাপ কিছু হয়েছে? পা দু’টো যেনো আর চলছে না দরজা পর্যন্ত। দরজা খুলে কি দেখবে সে? কি খবর শুনবে? আদৌ তার মেয়েটা বেঁচে আছে তো? নিজের ভাবনায় নিজেই শিউরে ওঠে মর্জিনা বেগম। আলুথালু পায়ে ছোটার চেষ্টা করে।

“তুমি এতো রাতে?”
সেতারা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। ঈষৎ কাঁপছে সে একটু পর পর। বাচ্চা দু’টো কোলেই ঘুমিয়ে গেছে। তাদের সোফায় শুইয়ে দেয় সেতারা আস্তে করে।
“কি হলো কথা বলছো না কেনো? রাত বাজে আড়াইটা। এ সময়ের কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়ে বা ভদ্র বাড়ির বউ রাস্তায় নামে?”
সেতারা এবার একটু হাসে, শব্দ করেই।
“এতো রাতে বুঝি ভদ্র বাড়ির ছেলে স্ত্রীকে মেরে লা’শ বানিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে বাবা?”
সেতারা মুখ তুলে তাকায়। সাথে সাথেই শিউরে ওঠে মর্জিনা বেগম। মেয়ের কপাল চুঁইয়ে র’ক্ত পড়ছে, সারা মুখে অসংখ্য দাগ। কে বলবে এই সেই চাপা ফুলের মতো রূপবতী মেয়েটা তার? এ কি অবস্থা হয়েছে ওর?
হাহাকার করতে করতে মর্জিনা ছুটে যায় মেয়ের কাছে। সেতারার মাথাটা বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় সে।
“মা রে এ কি হয়ে গেলো তোর? আমাকে ক্ষমা করে দে মা, আমি তোর ব্যর্থ মা। অপদার্থ আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না তোর জন্য। নিজেও ভালো ভাবে পড়াশোনা করলাম না, তোকেও করাতে পারলাম না। মা হয়ে আমি মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলাম। আমাকে তুই শাস্তি দে মা, ভয়ংকর শাস্তি দে।”
সেতারা ম্লান হেসে বললো,”শাস্তি তো তুমি পেয়েছো মা। ছোট খালাকে তুমি বলতে সবসময়, মেয়ে যখন গাড়ি থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরবে, লক্ষ লক্ষ টাকার সোনার গহনা গায়ে থাকবে সেদিন বুঝবি সুখ কাকে বলে। মা দেখো, আজ আমিও গাড়িতে এসেছি। আমাকে তাড়ানোর জন্য ওদের এতো ব্যস্ততা ছিলো যে, এতো রাতে কোনো গাড়ি পাবো না রাস্তায় তাই নিজেদের গাড়িটাই দিয়ে দিয়েছে আসার জন্য। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে দেয়নি। দেখো মা, আমার শরীরে এখনো দামী শাড়ি, গহনা। এগুলো কিচ্ছু রেখে দেয়নি ওরা। এদিক থেকে ওরা অনেক ভালো মা। আমাকে তাড়ানোর ব্যস্ততায় এগুলো নেওয়ার সময় পায়নি আমার কাছ থেকে। এইযে আমি গাড়ি থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরলাম তোমাকে। তোমার সুখ হচ্ছে না মা? শান্তি পাচ্ছো না?”
মর্জিনা বেগম উত্তর দেয়না। সেতারার একটা কথাও তো মিথ্যা না। আসলেই সে এগুলো করেছে, বলেছে। কিন্তু সে এই মুহুর্তে বুঝতে পারছে একটা অসহায় মায়ের কাছে এ দৃশ্য কতোটা কষ্টের, কতোটা যন্ত্রণার। নিজেকে এই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে দু:খী মানুষটা মনে হচ্ছে।

রফিকুল বিরক্ত হয়ে এসব দেখছিলো এতোক্ষণ। পাশে তাকাতেই দেখে বিশাল এক স্যুটকেস সেতারার পায়ের কাছে।
রফিকুল ভ্রু কুঁচকে বললো,”তুমি কি অনেকদিন থাকবে ভাবছো?”
মর্জিনা হতবাক হয়ে বললো,”ও কি বললো তুমি শুনতে পাও নি? ওর অবস্থা দেখতে পারছো না? মেরে তোমার মেয়েটাকে আধমরা বানিয়ে দিয়েছে পাষণ্ডগুলো। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে। এরপরও তুমি বাবা হয়ে কীভাবে বলছো এই কথা?”
“আমি এতো কিছু জানিনা। অনেক টাকা খরচ করে বড় বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। সংসার জীবনে অনেক কিছুই হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। তার জন্য সংসার ছাড়তে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাছাড়া এখন বাচ্চা আছে ওর দু’টো। এই অবস্থায় ফিরে আসলে মানুষ কি বলবে? কোন সোসাইটির সাথে আমার ওঠাবসা তুমি জানো না?”
মর্জিনা বেগম যেনো অবাক হওয়ার মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে তার। শ্বাসকষ্ট হতে থাকে তার।
“তুমি কি ওর নিজের বাবা? নিজের সোসাইটির কথা ভাবছো, মানুষ কি বলবে ভাবছো। একটাবার নিজের মেয়ের কথা ভাবছো না?”
“তোমার সাথে আমার ঝামেলা হয়নি? তার জন্য তুমি কি চলে গেছো? ঠিকই মাটি কামড়ে এ বাড়িতে পড়ে আছো। তাহলে ওর ওখানে থাকতে সমস্যা কি? ওটা ওর নিজের বাড়ি, ওখানেই ওর ঘর-সংসার।”
“আমি যেতে পারিনি কারণ আমাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো কেউ ছিলোনা। একটা ছোট বোন, আমি গেলে মাথায় করে রাখে। কিন্তু তাদেরই আর্থিক কষ্ট, আমি যেয়ে কীভাবে থাকি? কিন্তু সেতারা? ওর তো মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে। শুধু ঠাঁই বলছি কেনো, শিল্পপতি রফিকুল চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে সে। কোনোকিছুরই অভাব নেই। সে কেনো স্বামীর সংসারে অত্যাচারিত হয়েও সেখানে পড়ে থাকবে? আমি মা হয়ে এটা কোনোভাবেই মানবো না।”
“তুমি মানতে পারবে কি পারবে না আমি জানতে চাইনা। না মানতে পারলে দরজা খোলা আছে। তোমাকে কোনোদিন আটকে রাখিনি আমি, আজও রাখবো না।”
মর্জিনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেতারা চিৎকার করে তাকে থামায়।
“মা অনেক হয়েছে, এবার তোমরা থামো। এতোক্ষণ তোমরা বলেছো আমি শুনেছি। এবার আমি বলবো তোমরা শুনবে। কেউ একটা কথাও বলবে না।”
রফিকুল অবাক হয়ে তাকায়। মেয়ে তো এভাবে চিৎকার করে কথা বলার সাহস পায়নি আগে, এখন কীভাবে এ সাহস পেলো? কে দিচ্ছে তাকে এই সাহস?
সেতারা ধীর পায়ে হেঁটে রফিকুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুচকি হাসে বাবার দিকে তাকিয়ে।

“মা কি যেনো বলছিলে তুমি? আমি বাবার একমাত্র মেয়ে? কেনো মা তুমি জানো না, বাবার রক্ষি’তার ঘরে যে আরো দুইটা সন্তান আছে? যাদের দায়িত্ব বাবার উপর, শুধু সমাজে তাদের স্বীকৃতি দিতে পারেনা?”
রফিকুল চিৎকার করে সেতারার দিকে রক্তচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে হাত ওঠাতে যায়। সেতারা শান্ত চোখে তাকায় বাবার দিকে। কিন্তু সেই শান্ত চোখেও এমন কিছু ছিলো রফিকুল থমকে যায়। মর্জিনা বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
“কি হলো বাবা থামলে যে? সত্য সবসময় তিতা হয় বাবা। তিতা কথা কেউ হজম করতে পারেনা।”
রফিকুল রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে৷
“শোনো বাবা, আমি তোমার এই সুবিশাল অট্টালিকায় থাকতে আসিনি। সাথে আনা ব্যাগ দেখে এতো ভয়ে পেয়ো না। তোমার সোসাইটি কিচ্ছু জানবে না। এতো বড় ঘটনা যখন তুমি চাপা দিতে পেরেছো, এই সামান্য ঘটনাও পারবে।”
মর্জিনা মেয়ের বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো,”এখানে থাকবি না তো কোথায় যাবি? ওই নরকের মধ্যে তোকে আর যেতে দিবো না আমি।”
“মা কে বললো আমি ও বাড়িতে ফিরে যাবো? আমি ওখান থেকে বের হয়েছি ফিরে যাওয়ার জন্য না।”
“তাহলে কোথায় যাবি তুই? কি বলছিস এসব?”
রফিকুল রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,”নিজেকে বিক্রি করবে তুমি এখন?”
মর্জিনা রাগান্বিত হয়ে কিছু বলতে গেলেই সেতারা আবার থামায় দেয় তাকে। সে ভীষণ শান্ত, শীতল হয়ে আছে আজ।
“বলতে দাও মা। যার চরিত্র যেমন, সে অন্যকে তেমনই ভাববে। বাবাদের কতো রূপ হয়। উনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। ছোট খালুও পুরুষ, উনিও পুরুষ। অথচ দুইজনের মধ্যে কতো যোজন যোজন ফারাক। এক লেখকের লেখায় পড়েছিলাম, পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। কিন্তু না, সেই লেখা ভুল। আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পারছি সেই লেখায় চরম ভুল। এই দুনিয়ায় অসংখ্য খারাপ বাবা-ও আছে। তার মধ্যে এইযে উনি একজন।”
সেতারা থামে। রফিকুল থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মতো বিশাল শিল্পপতির সঙ্গে কিনা একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষকের তুলনা করা হচ্ছে? এটাও তাকে সহ্য করতে হবে?

“তোমাকে আমার বাবা বলে স্বীকার করতেও ঘৃণা হচ্ছে বাবা।”
“দয়া করে স্বীকার করোনা। যাও তোমার অতি প্রিয় খালু, কবির শাহ-কে বাবা বলে স্বীকার করো।”
“যদি সেইটা পারতাম না বাবা? তাহলে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা হতাম। সত্যিই যদি প্রিয়তা আর পেখমের মতো আমিও ওরকম একটা বটবৃক্ষের ছায়ায় নিজেকে আশ্রয় দিতে পারতাম, আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার থাকতো না বাবা। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলোনা। বাবা, তুমি ভীষণ গরীব জানো তো? তোমার কাছে টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই।”
রফিকুল উত্তর দেয়না। চরম অপমানিত বোধ করতে থাকে।

মর্জিনা আবারও সেতারার হাত ধরে এসে।
“তুই একটু বোস মা, কীভাবে র’ক্ত পড়ছে কপাল থেকে। একটু ওষুধ লাগিয়ে দিই। কিছু তো মনে হয় খাওয়াও হয়নি, কিছু খাইয়ে দিই আমি?”
“না মা, এখানে বসতে বা খেতে আসিনি আমি। তোমরা আমার বাবা মা। আমার দায়িত্ব তোমাদের জানানো তাই জানাতে এসেছি। আমি একটা চাকরি পেয়েছি মা।”
মর্জিনা বেগম হতভম্ব হয়ে যায়, অবাক হয় রফিকুলও। সেতারার পড়াশোনা বেশি না, ও কীভাবে চাকরি পাবে?
“তুই চাকরি পেয়েছিস মানে?”
“হ্যা মা, আমি একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছি। চাকরিটা আমাকে ছোট খালু ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেই সাথে কিছু বাচ্চাদের টিউশনেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে উনি।”
“কবির তোকে চাকরি খুঁজে দিয়েছে?”
“হ্যা মা। আমি-ই উনাকে কাউকে কিছু বলতে মানা করেছিলাম। আমি অনেক আগে থেকেই উনার সাথে যোগাযোগ করছি। ওখানে থাকা আমার জন্য অসম্ভব হয়ে উঠছিলো দিনদিন। আমি একটা সাবলেট বাসাও খুঁজেছি। খালু-ই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জানো মা, আমি আবারও পড়াশোনা শুরু করবো। খালু আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবে বলেছে। একটু কষ্ট হবে মা, অনেকদিন পড়াশোনা থেকে দূরে আছি। তবে মা আমি পারবো জানো তো? খালু সব রকম সাহায্য করবেন আমাকে।”
রফিকুল আর চুপ থাকতে পারেনা। উন্মাদের মতো চেচিয়ে বললো,”নিজের মেয়েদের ন’ষ্টামি শিখিয়ে ক্ষান্ত হয়নি অসভ্যটা? এখন আমার মেয়ের পিছে পড়ে তার সংসার ভাঙার পায়তারা করছে? ওকে আমি দেখে নিবো।”
সেতারা ম্লান হেসে বললো,”কেউ আমার সংসার ভাঙার পায়তারা করেনি বাবা। যে সংসারটা ভাঙাই ছিলো, তা অন্য কেউ কীভাবে আবার ভাঙবে? খালু তার মেয়েদের কোনো ন’ষ্টামি শেখায়নি, বরং এই সমাজে অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে মাথা উঁচু বাঁচতে শিখিয়েছে। আমি খুব গর্ববোধ করছি আমি দেরিতে হলেও তার সান্নিধ্যে যেতে পেরেছি। আর কি বললে বাবা, তোমার মেয়ে? যে বাবা মেয়েকে জোর করে নরকে ঠেলে দেয়, নোংরা কথা বলতে দুইবার ভাবে না, সে বাবা? বাবা তুমি আমার?”
রফিকুল মাথা নিচু করে জোরে জোরে তপ্ত শ্বাস ফেলতে থাকে।
মর্জিনা স্তম্ভিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এ কি তার সেই শান্ত মেয়েটা? সত্যি সে নতুন করে সব শুরু করতে যাচ্ছে? সত্যি এমন কিছু হবে?

“আমি যাচ্ছি মা। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। তবে ওই মানুষটার সাথে যেনো আর দেখা না হয়। এই চাওয়া টুকু সৃষ্টিকর্তা যেনো পূরণ করেন আমার।”
রফিকুল চিৎকার করে বললো,”যাও যাও, বাইরে যেয়ে দেখো জীবন কেমন। সবকিছু এতো সহজ না। যখন বিপদে পড়বে, কোনো মামা কোনো খালু বাঁচাতে আসবে না।”
সেতারা স্মিত হেসে বললো,”সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়? আমাকে নাহয় বিপদে পড়েই শিখতে দাও বাবা। তবে ভয় নেই, বিপদে পড়ে তোমার কাছে আর ফিরে আসবো না।”
অপমানে জর্জরিত মুখে রফিকুল মেয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

সেতারা বাচ্চাদের কোলে তুলে নেয়। ব্যাগটাও হাতে নেয়। মর্জিনা বেগম অবাক হয়ে এক যোদ্ধাকে দেখে। যে সন্তানের জন্য, নিজের জন্য ভয়াবহ এক যুদ্ধে নেমেছে।
“আসি মা।”
মর্জিনার দিকে তাকিয়ে একটা সুন্দর হাসি দেয় সেতারা। কি ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে এখন মেয়েটাকে তার।
সেতারা দরজা পর্যন্ত যেতেই মর্জিনা পিছন থেকে ডাক দেয়।
“সেতারা একটু দাঁড়া।”
সেতারা দাঁড়ায়।
“আমিও যাবো তোর সাথে।”
সেতারা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। রফিকুল হতভম্ব হয়ে বললো,”তুমি যাবে মানে? তুমি কোথায় যাবে?”
“যে মেয়েকে গর্ভে ধারণ করে আমি মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছি, যে মেয়ের মুখে মা ডাক শুনে আমি পৃথিবীর সব সুখ পেয়েছি, তাকে একা ছেড়ে দিবো না আমি। আমাকে এখন দরকার ওর পাশে৷ ওর যুদ্ধে ওর মা ওর পাশে থাকবে।”
সেতারার দুই গাল বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। এতোক্ষণ শক্ত থাকতে পারলেও এখন আর পারেনা।
“মা……”
“যে কাজটা আমার আরো কয়েক বছর আগে করা উচিত ছিলো সেই কাজটা আমি আজ করবো। বেটার লেট দ্যান নেভার, তাইনা?”
রফিকুল দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”চলচ্চিত্র চলছে? পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি? একবার এই বাড়ি থেকে বের হলে তোমার আর তোমার মেয়ের জন্য এই বাড়ির দরজা বন্ধ, আর কোনোদিন খুলবে না।”
“একটা দরজা বন্ধ হলে হাজারটা দরজা খুলবে। তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি চাইলেও আমি আর আসবো না এ বাড়িতে।”
“কবির শাহের বাতাস লেগেছে মা-মেয়ের গায়ে? বুঝবে একদিন, টাকা না থাকলে দুনিয়া অন্ধকার।”
“অন্ধকারের পরেই আলো আসে।”
মর্জিনা এগিয়ে এসে সেতারার হাত থেকে একটা বাচ্চাকে নিজের কোলে তুলে নেয়।
“চল মা।”
“মা তোমার কষ্ট হবে, তুমি পারবে না।”
“মেয়েকে কষ্টে রেখে আমি খুব আরামে থাকবো এখানে তাইনা? ব্যর্থ মা হিসেবে কম তো অনুশোচনায় পুড়িনি। আজ নাহয় তার প্রায়শ্চিত্ত করবো। আমাদের দুইজনের মধ্যেই অসম্ভব মিল আছে রে মা, আমরা দুইজনই আজ থেকে যোদ্ধা মা। চল যাওয়া যাক।”
হতভম্ব রফিকুলকে পিছনে রেখে দুই মা হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। রাতের ফাঁকা রাস্তাটা আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। চাঁদের আলো যেনো ঠিকরে পড়ছে। সেতারা তাকায় মায়ের দিকে। মা’কে এতো সুন্দর লাগছে কেনো আজ হঠাৎ? ছায়াটা কি দীর্ঘ পড়েছে মায়ের। মনে হচ্ছে এই ছায়াতলেই সে আজীবন শান্তিতে থাকতে পারবে। তার মা তার পাশে আছে, আর কি ভয়?

মাছ কাটছে আর ঘন ঘন চোখের পানি মুছছে মার্জিয়া। চোখটা বারবার ঝাপসা হয়ে উঠছে তার। ভালো করে কাটতেই পারছে না মাছটা। ইচ্ছা করছে কিশোরীদের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে, কিন্তু পারছে না। আজ যে তার কোথায় এমন সুখ হচ্ছে সে বোঝাতে পারছে না। এতো আনন্দ কেনো তার এই ছোট্ট ঘরটায়? এই ঘর ছেড়ে, এই ভালোবাসার সংসার ছেড়ে, এই মায়ার দুনিয়া ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে একা এটা ভাবতেই কান্না আটকাতে পারছে না সে।

“চোখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা।”
কবির শাহের গলার আওয়াজ পেয়ে কোনোরকমে চোখ মোছে মার্জিয়া, মাছ কাটতে মন দেয়।
কবির শাহ একটা পিঁড়ি টেনে মার্জিয়ার সামনে বসে। তার স্ত্রীকে চন্দ্রের মতো সুন্দর লাগছে। ফোলা চোখ, হালকা লাল আভা সারামুখ জুড়ে, পরনে সাধারণ সুতি শাড়ি। তাতেই কোনো নারীকে এমন অসামান্য সুন্দরী লাগতে পারে, মার্জিয়াকে না দেখলে কবির শাহ হয়তো বুঝতেই পারতো না।
“কি হলো এখানে এসে বসলে যে?”
“আমার বউটা একা একা কষ্ট করবে, আমি ঘরে আরাম করবো?”
মার্জিয়া লজ্জায় লাল হয়ে বললো,”আজ বাদে কাল মেয়ের বিয়ে হবে, আর তোমার ঢংঢাং কমেনা।”
“কমলে তুমি খুশি হবে?”
“এই তুমি যাও তো, আমাকে আমার কাজ করতে দাও।”
“মার্জিয়া আমার এখন মিষ্টির দোকানে যেতে ইচ্ছা করছে। শহরের সমস্ত মিষ্টি কিনে নিয়ে আসতে ইচ্ছা করছে। একটা মিষ্টির দোকানও যেনো বাদ না যায়। আজ আমার এতো আনন্দ হচ্ছে যে নিজেকে সামলাতে পারছিনা।”
“হ্যা এতো রাতে মিষ্টির দোকানদারদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তোমার জন্য দোকান খুলে বসে থাকবে।”
“থাকবে মার্জিয়া থাকবে। কারণ আজ এক পাগলাটে বর আর স্নেহময় বাবা তার পরিবারের জন্য মিষ্টি কিনবে। প্রকৃতিই ব্যবস্থা করে দিবে মার্জিয়া।”
“রক্ষা করো, আর জ্বালাতন করোনা আমাকে। একে তো তোমার ভাগ্নে এতো বছর পর এই রাতে কোথা থেকে মাছ নিয়ে উদয় হলো, কথা নেই বার্তা নেই মামি মাছ ভাজেন। যতোসব পাগল নিয়ে আমার সংসার।”
কবির শাহ গভীর মমতায় মার্জিয়ার দিকে তাকায়। মার্জিয়া মুখে বললো ঠিকই, কিন্তু এটুকু বলতে তার চোখেমুখে যে আনন্দটুকু বয়ে গেলো, তাতে মনে হচ্ছে সে এই পাগলদের পাগলামি দেখে বাকি জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবে, আর কিচ্ছু লাগবে না।

“মার্জিয়া।”
“বলো।”
“তোমার আজ কেমন লাগছে?”
“কীভাবে বুঝাই?”
“যেভাবে ইচ্ছা হয় বুঝাও, বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
“আমি আজ এতোটাই খুশি যে, আমি যদি কোনোদিন বেহেশতে যাই আর আল্লাহপাক আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, মার্জিয়া তোর কি লাগবে? আমি বলবো, পৃথিবীতে আজকের মতো একটা রাত যেনো আমি ওখানে পাই, প্রতিনিয়ত পাই। কারণ এরচেয়ে সুখের রাত আমার জীবনে আর কোনোদিন আসেনি। মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা যদি থামিয়ে দিয়ে, সময়টা মুঠোবন্দি করতে পারতাম তাহলে কতোই না ভালো হতো। আমার স্বামীর মুখে আনন্দের ছাপ, মেয়ের মুখে পরিতৃপ্তি আর শান্তির বৃষ্টির ধারা আমার আর কি চাই বলো? এক জীবনে একজন নারীর আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?”
মার্জিয়া শব্দ করে কেঁদে দেয়। কবির শাহ তাকে থামায় না, কাঁদতে দেয়।
আচমকাই মার্জিয়ার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে আলতো করে।
“কি করছো? তোমার গায়ে ময়লা লেগে যাবে তো, মাছ কাটছি।”
“লাগবে না, কিচ্ছু হবেনা। এ শরীর অপবিত্র হলে তুমি আবার পবিত্র করে দিও।”
মার্জিয়া কান্নার মাঝেই মুখ টিপে হাসে।
“আচ্ছা তুমি বললে না তো, তোমার কেমন লাগছে।”
“আমার? আমি যদি বলি পৃথিবীর সব সুখ একদিকে, আর আজকের এই রাতটার সুখ একদিকে। তুমি কি বিশ্বাস করবে?”
“তোমাকে তো অবিশ্বাস করিনি কখনো।”
“সে সুযোগও তোমাকে কখনো দিবো না।”

“ওমা, তোমার হলো? ইলিশ মাছের গন্ধে তো খিদে পেয়ে গেলো আবার। এখনই ভাজা না হলে কিন্তু কাঁচাই খেয়ে নিবো।”
বলতে বলতে রান্নাঘরে ঢুকতেই চমকে ওঠে পেখম। বাবা মায়ের মাথাটা বুকে চেপে কান্নাকাটি করে যাচ্ছে দুইজন মিলে। পেখমকে দেখেই মার্জিয়া লজ্জা পেয়ে ঝট করে মাথা তুলে নেয়। তাড়াতাড়ি হাত চালায় আবার মাছ কাটতে।

“এ বাবা, এসব কি হচ্ছে চারদিকে? আর তো পারা গেলো না।”
মার্জিয়া ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো,”কি হয়েছে তোর?”
“চারদিকে প্রেমের গন্ধ, শুধু আমার সর্দিতে নাক বন্ধ।”
মার্জিয়া কপট রেগে কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”দেখলে তুমি, মেয়েটা কেমন দুষ্টু হয়েছে। বাবা মায়ের সাথেও ফাজলামি।”
কবির শাহ মেয়ের কথায় খুব মজা পায়, হা হা করে হাসতে থাকে।
“আয় মা এদিকে আয়, আমার পাশে এসে বোস।”
পেখম বাবার পাশে আরেকটা পিঁড়ি টেনে বসে।
“শোনো মার্জিয়া, সন্তান বড় হলে বাবা মায়ের বন্ধু হয়ে যায়।”
মার্জিয়া মুচকি হাসে, কিছু বলেনা।
“বাবা আমার এসব সহ্য হচ্ছেনা। সবাই প্রেমে ব্যস্ত, এদিকে আমার যে কেউ নেই, আমার যে এসব সহ্য হচ্ছেনা সেদিকে তোমাদের কোনো খেয়ালই নেই।”
“এই পেখম বাবার সামনে এসব কি কথা?”
কবির শাহ রাগ করেনা, বরং আরো মজা পায় মেয়ের কথায়। মেয়ের মাথাটা কোলের উপর রাখে নিজের। মেয়েগুলো এতো বড় হয়ে যাচ্ছে কেনো? আহা! তার কি সাধের দুই কন্যা, তার দুই রাজকুমারী। এ সুখের বাড়ি কোথায়?

চিলেকোঠার দেয়ালে হেলান দিয়ে দুই হাত বুকে বেঁধে উচ্ছ্বাস একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার ঠোঁটটা কেমন নীলচে হয়ে গেছে, একটু পর পর তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট জোড়া। এখনো সে ধাতস্থ হতে পারেনি। অসম্ভব লজ্জা লাগছে তার। ঠিকমতো তাকাতে পারছে না উচ্ছ্বাসের দিকে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না এতো লজ্জা লাগছে কেনো। অবশ্য পাঁচটা বছর তো কম সময় না। কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েরা যেনো গোলাপের কুঁড়ি থেকে মাত্রই পাপড়ি মেলা শুরু করে। এই সময় তাদের রূপ বহুগুণে বেড়ে যায়। উচ্ছ্বাস একরাশ অপার মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে, কোনোভাবে পলক ফেলতে পারছে না। শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে, রূপোর মতো জ্যোৎস্না থইথই করছে ছাদে। সেই আলোর একাংশ এসে পড়েছে প্রিয়তার চোখেমুখে। তার ভেজা-ভেজা গালটা চকচক করছে সেই আলোয়। মৃদু বাতাসে কোমর সমান লম্বা চুলগুলো ঈষৎ উড়ছে। উচ্ছ্বাসের মনে হচ্ছে স্বপ্নের কাছাকাছি কোনো জগতে বাস করছে সে। এটা কোনো ভাবে বাস্তব জীবন হতে পারেনা।

“প্রিয়তা।”
প্রিয়তা মৃদু কেঁপে ওঠে, তবুও তাকায় না উচ্ছ্বাসের দিকে।
“আমার দিকে তাকাও, অন্য দিকে তাকিয়ে আছো কেনো? ওদিকে তোমার কোনো প্রেমিক নেই।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না তবুও। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে।

“আমার বিরানভূমিতে তোমার কোমল ছোঁয়া,
জাগ্রত করেছে কোলাহল।
তোমার পবিত্র চোখের চাহনি ভুলিয়ে দেয় আমার কষ্টকে।
আমি অস্তিত্বে আছো শুধুই তুমি।
আমার অস্তিত্ব জুড়ে ওই জলপরীর অবাধ বিচরণ, আমি চাইলেও দূরে থাকতে পারলাম না।”
উচ্ছ্বাসের গমগমে আওয়াজ শুনে প্রিয়তা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। এই মানুষটাকে এতো সুন্দর লাগছে কেনো? একটা পুরুষ এতো সুন্দর হবে কেনো? জ্বলজ্বল করছে যেনো মুখাবয়বটা। শক্ত প্রাচীরের মতো চোয়ালের মাঝে পুরু ওষ্ঠদ্বয়ের কোণে ফিনকি হাসিটা এতো নজরকাড়াই বা হতে হবে কেনো?

“তাহলে চেয়েছিলেন দূরে থাকতে?”
উচ্ছ্বাস বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
“ইশ এতো বছর পর শুকনো মরুভূমিতে প্রবল বর্ষণের আনাগোনা শুরু হলো। খাঁ খাঁ করছিলো যেনো বুকটা। আপনার কণ্ঠের সুধা পেয়ে অমৃত পেলো যেনো হৃদয়টা।”
“জীবনটা এতো কাব্যিক না উচ্ছ্বাস ভাই। আপনি কীভাবে পারলেন? মানুষ আপনি?”
“মানুষ বলেই তো অপেক্ষা করছি সর্বোচ্চ ভালোবাসার জন্য। আর কোনো প্রাণী হলে তো অপেক্ষাটুকুও করতাম না……”
উচ্ছ্বাসের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল হয়ে যায় প্রিয়তা। মুখ টিপে হাসে উচ্ছ্বাস।

আচমকা প্রিয়তা একের পর এক ঘুষি দিতে দিতে থাকে উচ্ছ্বাসের বুকে। পাঁচ বছরের সকল রাগ যেনো আজকেই উপড়ে ফেলবে সে। কোনোভাবেই থামে না রাগ। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও উচ্ছ্বাস কিছু বলেনা। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটাবারও থামায় না প্রিয়তাকে।

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে যাওয়ার পর প্রিয়তা থামে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। এতোদিন যতো কষ্ট, যতো রাগ, যতো অভিমান জমা ছিলো ভিতরে সব বের করে দিবে, সব।
“ক্লান্ত হয়ে গেলে এতোটুকুতেই? আমি তো আরো সহ্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।”
“জীবনটা কোনো নাটকের অংশ না উচ্ছ্বাস ভাই। জীবন সরলরেখায় চলেনা, কেনো এতো হেলাফেলা করেন সেই জীবনটা নিয়ে?”
“ভীষণ এলোমেলো আমি-কে তুমি নাহয় গুছিয়ে নিও নিজের মতো করে। সব দায়িত্ব দিয়ে দিবো তোমাকে।”
“আমি সত্যিই বোকা ছিলাম। আপনি আমাকে মাথামোটা বলতেন না? একদম ঠিক বলতেন। আর বোকা ছিলাম বলেই এতো অপেক্ষার পরেও পাগলের মতো ভালোবেসেছি আপনাকে, কোনোদিন অন্য কিছু ভাবিনি।”
“তোমাকে অন্য কিছু ভাবতে দিতামও না নন্দিনী। আমি তোমার চারপাশে একটা অদৃশ্য প্রাচীর বানিয়ে রেখেছিলাম, তুমি টেরও পাওনি। তবে হ্যা, তুমি কিন্তু এখনো কিঞ্চিৎ মাথামোটাই আছো।” উচ্ছ্বাসের ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি।
প্রিয়তার রাগ হয়, সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উচ্ছ্বাস খপ করে পিছন থেকে তার হাত ধরে। পুরো শরীরে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বয়ে যায় যেনো প্রিয়তার। বরফশীতল একতা হাতের স্পর্শে রাগের পারদ তরতর করে নামতে থাকে তার। তার বদলে শরীর জুড়ে ভিড় করে অদ্ভুত এক অনুভূতি। ভালোবাসা, ভয়, হৃদয় নিংড়ানো প্রেম সবকিছু মিলিয়ে হওয়া সেই অনুভূতির নাম প্রিয়তা জানেনা।

এক ঝটকা দিয়ে উচ্ছ্বাস কাছে টেনে দেয় প্রিয়তাকে। এই মুহুর্তে উচ্ছ্বাসের প্রতিটা নি:শ্বাসের শব্দ, প্রতিটা হৃৎকম্পনের শব্দ যেনো শুনতে পাচ্ছে সে। প্রিয়তার কানের কাছে মুখ এনে উচ্ছ্বাস ফিসফিস করে বললো,”এই মাথামোটা বোকা মেয়েটার প্রেমেই তো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছি, সে পালটে গেলে তো কষ্ট পেতাম।”
উচ্ছ্বাসের কণ্ঠে কি মাদকতা ছিলো, প্রিয়তার সারা শরীর শিরশির করে ওঠে।
“এখনো সিগারেট খান?”
“তোমার নেশা ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যাওয়ার পর অন্য নেশা ছেড়ে দিয়েছি। দেখো।”
প্রিয়তা দেখেনা, অন্যদিকে তাকায়।

প্রিয়তার এক হাত টেনে এনে উচ্ছ্বাস নিজের বুকের বাম পাশে রাখে।
“দেখেন তো ডাক্তার ম্যাডাম, কি রোগ হয়েছে আমার।”
“মানে? কি হয়েছে বুকে?”
“কঠিন অসুখ হয়েছে ম্যাডাম। প্রতিটা নি:শ্বাসে শুধু এক মায়াবতীর নাম জপে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। এতো করে বলি আমার খাবি, আমার মধ্যে থাকবি অথচ নাম নিবি আরেকজনের। আপনি ওষুধ দিন তো।”
“যদি তাই হয় এতোদিন একবারও মনে করেননি কেনো?”
“ভুলতেই তো পারিনি দু’দণ্ডের জন্য।”
“হাসাবেন না।”
“কেনো কি বললাম?”
“তাহলে কেনো একটাবারও দেখা দিলেন না? কেনো কোনো খবর নিলেন না? জানেন কীভাবে পাগলের মতো খুঁজেছি আপনাকে? কীভাবে কেটেছে আমার এই পাঁচটা বছর, জানেন কি?”
“যদি বলি জানি?”
“মানে?”
“আমি দূরে ছিলাম না প্রিয়তা। আমি তোমার খুব কাছাকাছি ছিলাম। সবসময় তোমার খবর নিয়েছি। আমি নিজেও এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। তোমাকে আমি সময় দিয়েছিলাম। আমার জন্য যেনো তোমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা না আসে। আমাকে নিয়েই যেনো পূর্ণ হও তুমি।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। মানুষটার মুখে আগের মতো খোঁচা খোঁচা দাড়ি নেই, তার বদলে একরাশ ঘন কালো দাড়ি। কি যে অপূর্ব লাগছে তাকে।
“আমি নিজেকেও গুছিয়ে নিয়েছি। এক বাবার রাজকন্যাকে রানী বানাতে হলে তো তার জন্য রাজ্য বানাতেই হতো আমাকে।”
“আমার কোনো রাজ্য চাইনা উচ্ছ্বাস ভাই। আমি খুব সাধারণ একটা জীবন চাই। শুধু সেই জীবনে কোনো কষ্ট না আসুক?”
উচ্ছ্বাস ঘোর লাগা দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কোনোই কষ্ট না? যে কষ্টে শান্তি লাগে তাও না?”
“উফফ আপনি…..”
জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় প্রিয়তা। এই মানুষ শোধরানোর নয়, শোধরাবেও না কোনোকালে।
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে বললো,”আমি কি?”
“আপনি একটা অসভ্য।”
“বেশ মেনে নিলাম।”
প্রিয়তা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। উচ্ছ্বাস গলা থেকে মাফলার খুলে চুল মুছতে থাকে, বেশ ঘেমে গেছে সে। প্রিয়তা নেশাভরা চোখে সেদিকে তাকায়। বেহায়া চোখটা কোনোভাবে ভালো হচ্ছে না যেনো আজকে, একটুও শুনছে না ব্যক্তি প্রিয়তার বারণ।

“কি দেখো?”
প্রিয়তা গাঢ় গলায় বললো,”আমার স্বর্গ।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু উঁচু করে চোখ বড় করে তাকায়। এ কি তার সেই ছোট্ট মাথামোটা প্রিয়তা? কবে শিখলো এতো কথা?

কি মনে করে উচ্ছ্বাস মাফলারটা দিয়ে টেনে প্রিয়তাকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে। প্রিয়তা অপ্রস্তুত বোধ করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু অমন বলিষ্ঠ বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বিশেষ লাভ হয়না তার।
“সুযোগ দিলে স্বর্গ দেখিয়ে আনতে পারি।”
প্রিয়তার কান লাল হয়ে যায়।
“আপনি কি নিচে যাবেন নাকি এখানেই থাকবেন সারারাত?”
“তুমি থাকলে তো আমি গভীর জঙ্গলেও রাত কাটিয়ে দিতে রাজি।”
“কিন্তু তার জন্য তো অপেক্ষা করতে হবে মশাই। নারীর মন তো বহু সাধনার বস্তু। এতো সহজেই পেয়ে যেতে চান?”
“অধিকাংশটা তো পেয়েই গিয়েছি, বাকিটুকুও পেয়ে যাবো। রাজকন্যাকে চেয়ে নিবো তার বাবার থেকে। আমার রাজকুটিরে বন্দি করে নিয়ে যাবো। এরপর পুতুলের মতো সাজিয়ে অপলক দেখবো সেই হরিণ চোখের বন্দিনীকে।”
প্রিয়তা ঠান্ডা গলায় বললো,”আর কতোদিন?”
“তোমার চেয়ে তো আমার তাড়া বেশি, খুব তাড়াতাড়ি-ই।”
“আপনার তাড়া বেশি কেনো?”
“বাহ, স্বর্গ দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে না?”
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ির কাছে চলে যায়।

“কোথায় যাচ্ছো? আরেকটু থাকো।”
প্রিয়তা মুচকি হেসে বললো,”আসছি এক্ষুনি।”

মিনিট পাঁচেক পর প্রিয়তা ফিরে আসে, হাতে উচ্ছ্বাসের সেই গীটারটা। এতোগুলা বছর আগলে রেখেছে প্রিয়তা ওটাকে।
উচ্ছ্বাস হতবাক হয়ে যায়। গীটারটা প্রিয়তার হাত থেকে নিয়ে হাজারটা চুমু খেতে থাকে তাতে। এটা ওকে ওর মা উপহার দিয়েছিলো। কতো বছর এটাকে দেখেনা। পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে ওটাকে। প্রিয়তা হাসিমুখে তাকিয়ে দেখে।

উচ্ছ্বাস প্রিয়তার হাত ধরে। কার্নিশের দিকে এগিয়ে যায় দুইজন। উচ্ছ্বাস পা ছড়িয়ে বসে। পাশেই প্রিয়তা রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় তার দিকে তাকিয়ে।

“ভ্রমর কইয়ো গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে…
অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর
কইয়ো গিয়া

ও ভ্রমর রে, ও ভ্রমর
কইয়ো কইয়ো কইয়ো রে ভ্রমর
কৃষ্ণরে বুঝাইয়া
কইয়ো কইয়ো কইয়োরে ভ্রমর
কৃষ্ণরে বুঝাইয়া
মুই রাধা মইরা যাইমু
কৃষ্ণ হারা হইয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া

ভ্রমর কইয়ো গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে
অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর
কইয়ো গিয়া

ও ভ্রমর রে
আগে যদি জানতাম রে ভ্রমর
যাইবা রে ছাড়িয়া
মাথার কেশর দুই ভাগ কইরা
তোরে বান্ধা রাখতাম রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া

ভ্রমর কইয়ো গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে
অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া

ও ভ্রমর রে
ভাইবে রাধারমণ বলে
“শোনো রে কালিয়া”
ভাইবে রাধারমণ বলে
“শোনো রে কালিয়া
নিভা ছিলো মনের আগুন রে
কে দিলা জ্বালাইয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া”

ভ্রমর কইয়ো গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে
ও ভ্রমর
অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া
ভ্রমর কইয়ো গিয়া
ভ্রমর কইয়ো গিয়া।”

উচ্ছ্বাস থামে। প্রিয়তা থমকে যায় এতো দরদমাখা সুরে। পুরো পরিবেশটা আবেশিত হয়ে যায় যেনো। উচ্ছ্বাসের দুই গাল ভেজা। চিবুক বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু নামতে থাকে।

নিজেদের ঘর থেকে গানটা চুপ করে বসে শোনে কবির শাহ আর মার্জিয়া। মার্জিয়ার মাথা কবির শাহের কাঁধে। সে পরম যত্নে স্ত্রীর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মার্জিয়া বুঝতে পারছে ছেলেটা কোন জাদুবলে তার শান্তশিষ্ট মেয়েটাকে পাগল করেছে। এতো মায়াভরা এক সুপুরুষকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারে?
“মার্জিয়া কি ভাবছো?”
“কিছু না, কিচ্ছু না।”
চোখ মুছে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে মার্জিয়া।

প্রিয়তা ধীর পায়ে হেঁটে উচ্ছ্বাসের পাশে এসে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাস প্রিয়তার বাঁ হাতটা নিজের গালে চেপে ধরে। তার গালের উষ্ণ পানি ভিজিয়ে দেয় প্রিয়তার হাত।

“ভালোবাসি প্রিয়তমা, নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি। এতো পর্যন্ত যতো কষ্ট দিয়েছি, যে কয়টা দিন পৃথিবীতে আছি তা পুষিয়ে দিবো, এই ওয়াদা থাকলো তোমার কাছে তোমার পাগল প্রেমিকের।”
প্রিয়তা মোহ ভরা কণ্ঠে বললো,”আমিও আপনাকে ভালোবাসি, হৃদয়ের সর্বোচ্চ অনুভূতি নিংড়ে আপনাকে ভালোবেসেছি। পুরো দুনিয়া সাক্ষী, আমি আপনাকে উন্মাদের মতো ভালোবেসেছি।”
“নন্দিনী, তুমি যদি প্রেমের নাম হও তাহলেই কেবলমাত্র আমি প্রেমিক। পৃথিবী অবাক হয়ে দেখবে এক প্রেমিক তার প্রেমের জন্য কি করতে পারে।”
প্রিয়তা বরফের মতো আচ্ছাদিত হয়ে যায়। উচ্ছ্বাস চোখ বন্ধ করে হাতটা আরো জোরে চেপে ধরে।
চাঁদটা যেনো ঠিক সেই মুহুর্তে কিরণটা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। সে যে গ্রহের উপগ্রহ, সেই গ্রহেরই এক পাগল প্রেমিক তার প্রিয়তমাকে ভালোবাসা উৎসর্গ করছে, এতোটুকু দায়িত্ব তো চাঁদকে পালন করতেই হতো, তাইনা?

(সমাপ্ত)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-২৮+২৯

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২৮

প্রিয়তা বরফ শীতল গলায় বললো,”কি করছেন উচ্ছ্বাস ভাই? আপনি পায়ের কাছে বসে আছেন কেনো?”
পেখম অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। পাশেই একটা মসজিদ, এশার নামাজ শুরু হয়ে গেছে সেখানে। নামাজ শেষে সবাই বের হবে। এমন অবস্থায় দেখলে কি না কি ভাববে সবাই। ছোট শহরে বিনোদনের ভীষণ অভাব, এমন বিনোদন পেলে কেউ আর নড়তে চাইবে না এখান থেকে।

উচ্ছ্বাসের কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে চিৎকার করে কাঁদছে। সে জানেনা সে কেনো কাঁদছে। সারাজীবন নিজের কষ্ট চেপে নিজেকে একটা শক্ত আবরণের মধ্যে বন্দী করে রেখেছে সে। আর সেই প্রাচীর আরো শক্ত হয়েছে চোখের সামনে বাবা-মায়ের খু’নের হতে দেখার পর। আজ অনেক অনেক দিন পর এভাবে মন খুলে কাঁদছে সে। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে বড় একটা পাথর নেমে যাচ্ছে তার প্রতিটা পানির ফোঁটায় একটু একটু করে।

প্রিয়তা নিজেও বসে পড়ে, নিজের হাঁটুর থেকে উচ্ছ্বাসের হাত ছাড়ায়। পুরো মুখ তার চোখের পানিতে ভিজে জবজব করছে। প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে কাঁপা হাতে পানিটা মুছে দেয়।
“কি করছেন আপনি এসব উচ্ছ্বাস ভাই? এমন পাগলামির মানে কি?”
উচ্ছ্বাস মুখ হাঁ করে কিছুক্ষণ শ্বাস নেয়, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। প্রিয়তা সেই সময়টুকু দেয় উচ্ছ্বাসকে। পেখম শুধু ইতিউতি দেখেই যাচ্ছে। ভীষণ ভয় করছে তার।

বেশ কিছুক্ষণ পর উচ্ছ্বাস দুই হাতে নিজের চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়তাও উঠে দাঁড়ায় তার সামনে।

“তোমরা এখানে কেনো এসেছো প্রিয়তা? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তোমরা আমার সামনে।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে বললো,”আমরা আপনার কাছেই এসেছি উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাদ কিছুটা অবাক হয়। ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমার কাছে এসেছো মানে? তোমরা কীভাবে জানো আমি এখানে থাকি? কে দিয়েছে তোমাদের এই ঠিকানা?”
“সেসব বলার মতো সময় নেই উচ্ছ্বাস ভাই। আপনার সামনে অনেক বিপদ। অনেক বড় একটা ট্র‍্যাপে আপনাকে ফেলা হয়েছে। এখন যেভাবে হোক এই ট্র‍্যাপ থেকে আপনাকে বের হতে হবে।”
উচ্ছ্বাস গম্ভীর গলায় বললো,”ট্র‍্যাপে তো তুমি আমাকে ফেলেছো প্রিয়তা। নাহলে আমার মতো একটা রগচটা ছেলে কারো প্রেমে এমন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যেতে পারে?”
প্রিয়তা অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”এখন মজা করার সময় না উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাস দুই হাত বুকের সাথে বেঁধে সটান হয়ে দাঁড়ায় শান্ত মুখে। সে বুঝতে পারছে প্রিয়তা কোনো ভয়, দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনার মধ্যে আছে। একটু পর পর ঠোঁট কাঁপছে তার। শান্ত মেয়েগুলো ভীষণ ভয় পেয়ে গেলে কেমন অশান্ত হয়ে যায়। তার মা-ও এমন ছিলো বলে সে বুঝতে পারছে।

“উচ্ছ্বাস ভাই আমি জানি এই খু’নগুলো আপনি করেননি।”
উচ্ছ্বাস কিছু বলেনা, ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়তাকে তার কথা শেষ করার সময় দেয়।
“আর এটাও জানি এগুলো কে করেছে।”
বেশ অনেকটাই অবাক হয়ে যায় উচ্ছ্বাস। এসব খু’নের ব্যাপারে প্রিয়তা কিছু জানতে পারে এটা তার কল্পনাতেও আসেনি কখনো। এটা কীভাবে সম্ভব?

“প্রিয়তা তুমি কি বলছো তুমি জানো?”
“আমি জানি উচ্ছ্বাস ভাই। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বুঝতে পারছি। কিন্তু দেখুন আমি কীভাবে তাহলে আপনার গোপন ঠিকানার খোঁজ পেলাম?”
উচ্ছ্বাসের মনে খটকা লাগে৷ এখন মনে হচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অষ্টাদশী তরুণীকে মোটেই হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক হচ্ছে না।

প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই আজ নীলু আপা এসেছিলো আমার বাড়িতে।”
“নীলু আপাটা আবার কে?”
“কেনো ভুলে গেলেন? ওইযে আমার কলেজের সেই আপাটা, আমাদের বাড়িতেও দেখা হয়েছিলো আপনার সাথে। আপনি কলেজেও উনাকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে।”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে।
“তো উনি এসেছিলো তাতে আমি কি করবো?”
“উনি আমাকে সব তথ্য দিয়েছে। আপনার ঠিকানাও উনি দিলো, তাছাড়া এগুলোর সাথে কে জড়িত তা-ও আমাকে বলেছে।”
“বিলু আপা এগুলো কীভাবে জানলো?”
প্রিয়তা হতাশ গলায় বললো,”বিলু না নীলু।”
“ওই হলো একটা। উনি কি বাই এনি চান্স সিআইডির গোপন এজেন্ট?”
প্রিয়তা এবার কিছুটা রাগান্বিত গলায় বললো,”আপনি কিন্তু এখনো মজা করছেন।”
“আচ্ছা আচ্ছা, কিছু বলছি না। শেষ করো।”
প্রিয়তা এদিক ওদিক তাকায়। পেখম ভরসার দৃষ্টিতে তাকে বুঝায় তুমি নিশ্চিন্তে কথা বলো, আমি এদিকটা দেখছি।

ঝিম ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে উচ্ছ্বাস। প্রিয়তার বলা কথাগুলো অস্বীকার বা অবিশ্বাস করার উপায় নেই। কারণ এগুলোর একটা কথাও মিথ্যা নয়। সত্যিই তার চাচাদের বড় বিজনেস আছে। প্রিয়তা বা নীলুর এগুলো জানার কথা না। নিশ্চয়ই এখানে অন্য কারো হাত আছে।

“এই কথাগুলো তোমার নীলু আপাকে কে জানিয়েছে বললে? তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া সেই নিয়াজ মোর্শেদ?”
প্রিয়তা হতাশ গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই….”
উচ্ছ্বাস আচমকা শব্দ করে হেসে দেয়। প্রিয়তা অবাক হয়ে তাকায়। এখানে হাসির কি হলো?

“প্রিয়তা তুমি বোকা, ভীষণ বোকা।”
“আমি বোকা?”
“শুধু বোকা নও। তোমার ফাঁপা মাথায় গ্যাস ভর্তি। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় এতো গ্যাসের চাপে কবে না তুমি গ্যাস বেলুনের মতো ফুঁস করে উড়ে যাও।”
প্রিয়তা অপমানিত বোধ করে। অদ্ভুত লোক তো, উনারই উপকার করতে এসে অপমানিত হতে হলো উনার কাছেই? উনি কি কোনোদিন শোধরাবে না?

“চলো আমার সাথে।”
“কোথায়?”
“তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিই। মামা মামি দুশ্চিন্তা করছে।”
“পৌঁছে দিতে হবে না, আমরা নিজেরা চলে যেতে পারবো।”
উচ্ছ্বাস নির্লিপ্ত চোখে তাকায় প্রিয়তার দিকে, প্রিয়তা চুপ করে যায় সাথে সাথে।

“তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আমার অন্য কাজ আছে?”
“অন্য কাজ মানে? কোথায় যাবেন আপনি? পুলিশের কাছে ধরা দিবেন?”
উচ্ছ্বাস ঘোর লাগা চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।

“তুমি বললে তো ফাঁ’সির দড়ির সামনেও হাসতে হাসতে পৌঁছে যেতে পারি। তবে এখন যাচ্ছি অন্য হিসাব চুকাতে।”
“কি হিসাব?”
“তোমার সেই মেইন কালপ্রিট, শিল্পপতি চাচাকে হালকার উপর ঝাপসা বার্নিশ করে আসি।”

প্রিয়তা অপমানিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে একটা মানুষ কি সবসময় এমন তেড়া কথা বলতে পছন্দ করে?

“চলো পেখম, আমি তোমাদের পৌঁছে দিই।”
পেখম কান্নাজড়িত ক্ষীণ গলায় বললো,”আমাদের আবার কবে দেখা হবে উচ্ছ্বাস ভাই?”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”যেদিন তোমার আপার বউ সাজতে ইচ্ছা করবে।”
লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় প্রিয়তার। পেখম কষ্টের মধ্যেও হেসে দেয়।
“জায়গাটা ভালো না, বেরিয়ে পড়তে হবে। আমার অন্য কাজও আছে।”
প্রিয়তা এগোয় না, পেখম বুঝতে পারে সে উচ্ছ্বাসকে গোপনে কিছু বলতে চায়।

“আপা তুই আস্তে আস্তে আয়। আমি এগিয়ে গলির মুখে দাঁড়াচ্ছি।”
প্রিয়তা ম্লান হেসে তাকায় বোনের দিকে, পেখমও বিনিময়ে কিছুটা হেসে বেরিয়ে যায়।
“কি হলো চলো?”
“উচ্ছ্বাস ভাই?”
“হুম বলো।”
প্রিয়তা কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। নিজেই নিজের উপর রাগ দেখায়। ছিহ, এতোটা নির্লজ্জ হলো কবে থেকে সে?

উচ্ছ্বাস ঠোঁট কামড়ে হাসে প্রিয়তার অবস্থা দেখে।
“এ কি আপনি হাসছেন কেনো শুধু শুধু?”
উচ্ছ্বাস ভিতরের টি শার্টটা রেখে চাদরের নিচ থেকে নিজের শার্টটা খুলে প্রিয়তার হাতে দেয়। প্রিয়তা কিছু না বুঝে তাকায় তার দিকে।

“আমি জানি তুমি চাচ্ছো এখন। আমি যেনো তোমাকে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরি।”
প্রিয়তা লজ্জায় মাথা নিচু করে। লোকটার লজ্জা শরম আসলেই কিঞ্চিৎ কম, কিঞ্চিৎ না ভালোই কম। কিন্তু সে বুঝলো কীভাবে প্রিয়তা এটাই চাচ্ছিলো? তাহলে সে নিজেও কি সামান্য বেহায়া হয়ে উঠেছে এই মানুষটার সামনে?

“তবে তোমার ইচ্ছা এখন আমি পূরণ করবো না। কিছু ইচ্ছা অপূর্ণ থাক। সব ইচ্ছা পূরণ হয়ে গেলে তুমি যে আমার অপেক্ষায় থাকবে না আর।”
প্রিয়তা সজল চোখে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে, উচ্ছ্বাস চোখ নামিয়ে নেয়। এই মুহুর্তে এই চোখজোড়া দেখার সাহস তার নেই। সে যতো বীরপুরুষই হোক না কেনো, এই সাহস কোনো পুরুষেরই নেই।

“তবে তার বদলে এই শার্টটা রাখো। তোমরা মেয়েরা আবার শার্টের গন্ধ শুকতে পছন্দ করো। আমি তো ঘামের গন্ধ ছাড়া আর কিছুই পাইনা।”
প্রিয়তা কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ হেসে দেয়। উচ্ছ্বাসও হাসে। প্রিয়তা শার্টটা নিজের মুখের সাথে চেপে ধরে।

“আমাদের আবার কবে দেখা হবে উচ্ছ্বাস ভাই?”
“যেদিন তুমি আমার নামের শেষে আর ভাই যোগ করবে না, সেদিনই দেখা হবে।”
“আপনি আর শোধরাবেন না তাইনা?”
“শোধরালে কি এখনের মতোই ভালোবাসবে? যদি ভালোবাসা আরেকটু বাড়িয়ে দাও, তাহলে ভেবে দেখতে পারি শোধরানো যায় কিনা।”
প্রিয়তার ইচ্ছা করছে না মানুষটাকে ছাড়তে। তার মনে হচ্ছে এখন ছেড়ে দিলে আর কোনোদিন দেখা হবে না তাদের। এমন কেনো মনে হচ্ছে তার? বুকটা কেমন ছটফট করছে। সময়টা এখানেই আরো কিছু সময় থেমে থাকলে কি প্রকৃতির খুব বেশি অসুবিধা হয়ে যাবে?
আজ এতো মায়া মায়া করেই বা কথা বলছে কেনো উনি? পেখম তাহলে ঠিকই বলতো। এই রগচটা, রাগী মানুষটার মুখোশের আড়ালে একটা অসাধারণ মানুষের বসবাস। সে আসলেই বোকা, সে বুঝতে পারেনি। উচ্ছ্বাস শেষ বারের মতো স্মিত একটা হাসি দেয় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে। ভিতরটা ভেঙেচুরে যাওয়ার উপক্রম হয় প্রিয়তার সেই হাসি দেখে। একটা পুরুষ মানুষের হাসি এতো মায়াকাড়া হবে কেনো? আচ্ছা, মায়াবতীর পুরুষবাচক কেনো শব্দ হয়না কেনো? পুরুষদের কি মায়া থাকে না?

“তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?”
বাড়ি ঢোকার মুখেই বাবাকে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে দুই বোনই থমকে দাঁড়ায়। বাবার গলার স্বর যদিও শান্ত, কিন্তু কোথায় যেনো একটা ভীতিকর সুর টের পায় দুইজন।

“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো, উত্তর দাও।”
ওরা উত্তর দেওয়ার আগেই মার্জিয়া বেগম ছুটে এসে বললো,”ওদের আগে ঘরে ঢুকতে তো দাও। আসতে না আসতেই কি শুরু করলে?”
প্রিয়তা, পেখম দুইজনই অবাক হয়৷ এ চিত্র যে উলটো তাদের বাড়ি। সবসময় মা বকাঝকা করে আর বাবা তাদের বাঁচায়। কি হলো আজ?

“মার্জিয়া আমি যখন আমার মেয়েদের সাথে কথা বলবো তুমি মাঝে থাকবে না।”
মার্জিয়া বেগম কিছু বলতে যেয়েও চুপ করে যায়।
প্রিয়তাই মুখ খোলে প্রথম।
“বাবা, মা বলেনি তোমাকে?”
“হ্যা বলেছে, তোমার মুখেই শুনি।”
প্রিয়তা একবার পেখমের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলার সাহস তার কোনোদিনই হবে না।

“বাবা আমরা তো রুনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। রুনাকে চিনেছো তো?”
“হ্যা তোমার বান্ধবী।”
“আসলে অনেক দিন কলেজে যাওয়া হয়নি তো। সামনেই পরীক্ষা, তাই ভাবলাম……”
“তাই ভাবলে এই রাতেই সব পড়া শেষ করে আসবে নাকি?”
প্রিয়তা চুপ করে যায়। বাবার কথা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বাবা এভাবে খুব একটা কথা বলে না তাদের সাথে, বাবা কি টের পেলো কিছু? ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় প্রিয়তা।
পেখম হালকা হেসে বললো,”বাবা আমরা বেরিয়েছিলাম তো সেই সন্ধ্যার আগেই। ফিরতে ফিরতে দেরি হলো। আসলে রুনা আপার মা আমাদের নাশতা না করিয়ে ছাড়লেনই না।”
“নাশতা করে এসেছো?”
পেখম আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।”
“তবে যাই হোক, তোমাদের একটা ভুল হয়েছে।”
“কি ভুল বাবা?”
“নাশতা করার সময় রুনাকে বলে দিলেই পারতে তোমাদের বাবা ফোন দিলে যেনো মিথ্যা না বলে সত্যটাই বলে যে তোমরা ওখানে আছো।”
দুই বোনের মুখ ঝুলে যায়। তার মানে বাবা রুনাকে ফোন দিয়েছিলো? ইশ, কি ভুলটাই না হয়েছে রুনাকে আগে থেকে সবটা না জানিয়ে। এমন ভুল কেউ করে? উচ্ছ্বাস ভাই ঠিকই বলে, সে বোকা। শুধু বোকা না, বোকার হদ্দ।

“কি হলো? রুনা আমাকে মিথ্যা বললো কেনো যে তোমরা ওখানে যাওনি?”
প্রিয়তা আর পেখম আচমকাই বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়ে। চিৎকার করে কেঁদে দেয় দুই বোনই। কবির শাহ বাঁধা দেয়না৷ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঠাঁয়।
“বাবা আমাদের ক্ষমা করে দাও, আর কখনো এমন হবে না।”
“কখনো এমন হবে কি হবে না জানতে চাচ্ছিনা। তোমরা আজ আমাকে নিজের কাছেই ছোট করে দিয়েছো। আমি যে অহংকার সবসময় করেছি, তা হলো তোমাদের নিয়ে, তোমাদের শিক্ষা নিয়ে। তোমাদের আমি সর্বশুদ্ধ মানুষ করার প্রত্যয় নিয়েছিলাম। সবার বিরুদ্ধে যেতেও দুইবার ভাবিনি তোমাদের স্বার্থে। আর যাই হোক, আমার দুই মেয়ে মানুষ হিসেবে খাঁটি হবে এটাই আমার প্রত্যাশা ছিলো। আমি কোনোদিন ভাবিনি তোমরা আমার সামনে মিথ্যা কথা বলবে। পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করায় আমি কোনোদিন তোমাদের রাগ করিনি। তোমার মা করলেও আমি বাঁধা দিয়েছি। মানুষ তৈরির পরীক্ষায় যেনো কখনো খারাপ ফলাফল না দেখি এটাই চেয়েছি সারাজীবন। স্কুল ছুটির পর ক্লান্তিতে হাত-পা অবশ হয়ে আসলেও, আরো কয়টা টিউশন বেশি করিয়ে বাড়ি ফিরেছি। দু’টো টাকা বেশি আসলে যেনো আমি আমার মেয়েদের জন্য কিছু করতে পারি। আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছি তোমাদের মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সব ভুল ছিলো, আমি ব্যর্থ একজন বাবা হিসেবে। আমার সব কষ্ট ব্যর্থ।”
মার্জিয়া বেগম থাকতে না পেরে কবির শাহের কাঁধে এসে হাত রাখে।
“তুমি কি লঘু পাপে ওদের গুরুদণ্ড দিচ্ছো না? আগে শোনো ওরা কই গিয়েছে, কেনো মিথ্যা বললো। তুমি জানো তোমাকে মেয়েরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ হিসেবে জানে, ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি। ওদের এতো কঠিন কথা কেনো শোনাচ্ছো?”
“ওদের কথা শোনাচ্ছি না মার্জিয়া। বরং ওরা প্রমাণ করে দিলো আমি একজন ব্যর্থ বাবা। আর কি বললে লঘু পাপে গুরুদণ্ড? তুমি যদি বুঝতে পারতে আজ কতোটা কষ্ট পেয়েছি আমি, তাহলে উল্টোটাই বলতে।”
“বাবা আমাদের ক্ষমা করে দাও। বললাম তো আর কোনোদিন এই ভুল হবে না। তুমি যে শাস্তি দিবে তাই আমরা খুশি মনে মেনে নিবো বাবা। তাও আমাদের সাথে এভাবে কথা বলোনা তুমি।”
“পায়ের কাছ থেকে উঠে এসো। তোমাদের মাথা সর্বদা সমুন্নত দেখতে চেয়েছি, এরকম নিচু না।”
“না বাবা তুমি আমাদের ক্ষমা না করলে আমরা উঠবো না। আগে শাস্তি দাও।”
“শাস্তি চাও তোমরা? বেশ উঠে এসো, শাস্তি দিবো।”
প্রিয়তা আর পেখম হাত ধরাধরি করে উঠে দাঁড়ায়, দুইজনের হাতই বরফের মতো ঠান্ডা।

“দেখো তোমরা অনেক বড় হয়ে গিয়েছো। এতোটাই বড় হয়ে গেলে যে আজকাল নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেওয়া শুরু করেছো। তাই শাস্তিটাও তেমন হওয়া উচিত তাইনা?”
প্রিয়তা নাক টানতে টানতে বললো,”বাবা তুমি আমাদের মারো।”
“গায়ে হাত তোলা আমার পছন্দ না। তবুও হয়তো রাগে দুই একবার করেছি আমি, আমার ভুল ছিলো আমি রাগ সামলাতে পারিনি। তবে আজ তোমাদের মারবো না।”
কবির শাহ সবার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।

“যতক্ষণ তোমরা না বলছো তোমরা কোথায় গিয়েছিলে, মিথ্যা বলার-ই বা কি প্রয়োজন হলো। ততক্ষণ তোমরা আমাকে বাবা বলে ডাকবে না। কথাও বলবে না আমার সাথে।”
“বাবা……”
“সময়টা যদি কয়েকদিন বা কয়েক মাসও হয়ে যায় তবুও না। আর যাই হোক, মিথ্যা বলা আমার পছন্দ না। আর আমার মনে হয় এরচেয়ে বড় শাস্তি তোমাদের জন্য আর কিছু না।”
মার্জিয়া দৌড়ে এসে প্রিয়তার হাত ধরে বললো,”বলে দে না বাবাকে, কোথায় গিয়েছিলি।”
প্রিয়তা সজল চোখে তাকায় মায়ের দিকে।
“মার্জিয়া জোর করোনা। ওরা নিজে থেকে যখন বলতে চাইবে তখনই বলুক। এ নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইনা। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, আমি ঘরে যাচ্ছি।”
কবির শাহ একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায়। মার্জিয়া বেগমও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।
প্রিয়তা আর পেখম স্তম্ভিত হয়ে দুইজন দুইজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

গেটে কোনো গার্ড না দেখে উচ্ছ্বাস কিছুটা অবাক হয় কিন্তু বিব্রত হয়না। বাঘের গর্তে হাত দেওয়ার আগে যে তাকেও সেইমতোই শক্তিশালী হতে হবে সে জানে। আর তার শক্তি হলো মনোবল। মনোবল ছাড়া এখন তার আর কোনো শক্তি নেই।

বাড়ির সামনের দরজাও খোলা, হালকা আলো আছে সিঁড়ির কাছে। উচ্ছ্বাসের একবার মনে হচ্ছে মানুষটা জানে সে আসবে। আর তাই এভাবে তাকে স্বাগতম জানাচ্ছে। ঠোঁটের কোণায় একটা হাসি ফুটে ওঠে তার।
বিশাল ড্রয়িংরুমটার মধ্যে উচ্ছ্বাস একা দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে নিকষ কালো আঁধার না হলেও তেমন কিছু দেখাও যাচ্ছেনা। অন্ধকারটা চোখ সয়ে নিতে বেশ সময় লাগে।

“উচ্ছ্বাস তুমি এসেছো? আমি জানতাম তুমি আসবে। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি।”
উচ্ছ্বাস কিছুটা চমকে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজে শব্দের উৎস। সে বুঝতে পারে অন্ধকারের মধ্যে মানুষটা বসে আছে।
“আপনি জানতেন?”
“জানতাম, জানতাম। প্রিয়তা বোকা, কিন্তু তুমি নও।”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হাসে। হঠাৎ হেসে হঠাৎই থামিয়ে দেয়।
“সেই বোকা মেয়েটার পিছে পড়েছেন কেনো এভাবে?”
“দেখো প্রিয়তাকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। সে এমন কোনো আগুনসুন্দরীও নয় যে তাকে না পেলে মারাই যাবো। আসলে তার পিছে পড়ে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য তুমি।”
“আমি?”
“হ্যা তুমি। আমি সেদিনই বুঝতে পেরেছি, যেদিন ওদের বাড়ি তোমাকে প্রথম দেখেছি। তুমি-ই আমার বিজনেস পার্টনারদের ভাইয়ের ছেলে, যার বাবা-মাকে ওরা খু’ন করেছে। আমার অনেকদিনের নজর ছিলো তোমার উপর। কবির শাহ তোমাকে আশ্রয় না দিলে অনেক আগেই খুঁজে পেতাম। আমি এটাও জানতাম তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও।”
“এতোসবের মধ্যে প্রিয়তাকে ব্যবহার করলেন কেনো?”
“ওইযে বললাম ও বোকা, সহজেই আমার ফাঁদে পা দিয়েছে। আমার প্রেডিকশন ছিলো দুইটা। এক তুমি আমার কাছে আসবে নাহয় সত্যিই পুলিশের কাছে ধরা দিবে। তবে তুমি বুদ্ধিমান, তুমি বুঝে গিয়েছো সেই বিজনেস পার্টনার, শিল্পপতি আসলে কে।”
“নীলুকে ব্যবহার করেছেন এজন্যই?”
“নীলু আমার সাথে প্রতারণা করেছে। অসভ্য মেয়েটা আমার সাথে ভালোমানুষির নাটক করেছে তবে বেশি কিছু করার সাহস পায়নি। প্রিয়তাকে বলেনি আমার নাম। তবে ঠিকই কিছু প্রমাণ যোগাড় করেছে আমার বিরুদ্ধে। বোকা মেয়েটা ভেবেছিলো ও কোর্টে প্রমাণ নিয়ে হাজির হবে, আর আমি কিছুই জানতে পারবো না।”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে বললো,”কোর্টে ও পৌঁছানোর আগেই ওকে আপনি আটকাতেন যেভাবেই হোক আমি জানি। এতে আপনার দুইটা লাভ হতো, আমার উপর সব দায় দিয়ে আমাকে ফাঁ’সির দড়িতে ঝুলাতেন, আপনার কোনো শাস্তি হতো না। আর দ্বিতীয়ত, প্রিয়তাকে পেয়ে যেতেন। ওর বড় ভাই নেই, মাথার উপর ছায়া বলতে বৃদ্ধ বাবা। মেয়ে পাচারের ব্যবসাটা তো ভালোই চলছে, তাইনা?”
শব্দ করে হাসির আওয়াজ আসে। আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে হাসার আওয়াজ। উচ্ছ্বাস বিন্দুমাত্র বিভ্রান্ত হয়না, সে জানে তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

“তুমি আসলে অসম্ভব বুদ্ধিমান একজন মানুষ, আমাকে বলতেই হচ্ছে। সুদর্শন রূপের চেয়ে একটা পুরুষ মানুষের যে দিকটা মেয়েরা পছন্দ করে তা হলো তার ক্ষুরধার বুদ্ধি। প্রিয়তা এবং সেই সাথে নীলুও শুধু শুধু তোমার প্রেমে পড়েনি বুঝতে পারছি। তোমার বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছে তারা। আই মাস্ট সে, আমি মেয়ে হলে আমিও বোধহয় তোমার প্রেমে পড়তাম।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”আপনি পুরুষ?”
“তার মানে?”
“আমার তো মনে হয় আপনিও মেয়ে। দূর্বল পুরুষ মানুষকে আমার ঠিক পুরুষ মনে হয়না। হতে পারে পুরুষ বা মহিলার মাঝামাঝি কিছু। খাঁটি বাংলা ভাষায় যাদের বলে নপুংসক।”
“হাউ ডেয়ার ইউ।”
বাজখাঁই চিৎকারে মনে হলো পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠছে। কিন্তু উচ্ছ্বাস একবিন্দুও ভীত হয়না, বরং ভীষণ শান্ত থাকে।
“আপনার খেলা শেষ নিয়াজ মোর্শেদ। অনেক তো খেললেন, এবার ব্যাটিংটা আমি-ই করি।”
“এই তুই কি করবি? এক্ষুনি আমার লোকেরা তোকে শেষ করে দিতে পারে তুই জানিস? তুই বাড়িতে ঢোকার সাথেই পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছে ওরা। হয় লা’শ হয়ে বের হবি নাহয় জীবিত অবস্থায় বের হয়ে জেলে ঢুকবি। কয়দিন পরই ফাঁ’সি হয়ে যাবে তোর। কে বাঁচাবে তোকে? সব প্রমাণও তোর বিরুদ্ধে।”
“চিৎকার করলেই পুরুষ হওয়া যায়না রে পাগলা। পুরুষের সাথে লড়তে পুরুষই হওয়া লাগে। আমার তো লজ্জা লাগছে তোর মতো একটা নপুংসকের সাথে লড়তে। এটা আমারই অপমান।”
“আমি কিন্তু এবার আমার লোকদের ডাকবো।”
“ডাক, ডাক না। দেখি কয়জনকে রেখেছিস আমার একার জন্য। তোর আমার পার্থক্যটা দেখলি তো? তুই আমাকে মারতে পুরো বাড়ি ঘিরে রেখেছিস মানুষে, আর আমি তোর স্থানে এসেছি, আর একা এসেছি। ডাক না তাদের, তোর মতো কয়টা হাফ লেডিসের জন্য উচ্ছ্বাস একাই যথেষ্ট।”
হালকা আলোয় মুখোমুখি নিয়াজ-উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাসের মুখে রহস্যময় হাসি। নিয়াজ কিছুটা পিছিয়ে যায়। তার মনে ভয় ঢুকেছে। উচ্ছ্বাস দাঁত বের করে হাসে। নিয়াজ আরো ভয় পেয়ে যায়। গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হতে থাকে মুখ দিয়ে। উচ্ছ্বাস জানে তাকে এখন কি করতে হবে।

“বাবা আসবো?”
কবির শাহ দরজার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয়,”এসো।”
মার্জিয়া কবির শাহের মাথার কাছে বসে ছিলো, মেয়েদের দেখে উঠে দাঁড়ায়।
“তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।”
“মার্জিয়া আমি পৃথিবীতে এমন কোনো গোপন কথা কারো সাথে বলবো না যেখানে তোমার উপস্থিতি থাকতে পারেনা। তুমিও থাকো।”
মার্জিয়া চুপ করে দাঁড়ায়।
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে ঢোক চাপে। পেখমের মুখও ফ্যাকাশে।

“যদি কিছু বলতে এসে থাকো, বলে চলে যেতে পারো। আমি বিশ্রাম করবো। সারাদিন অনেক ধকল গেছে।”
প্রিয়তা আর পেখম হঠাৎ ছুটে আসে। বাবার বুকের উপর আছড়ে পড়ে দুই বোন। তাদের কান্নার শব্দে মার্জিয়াও চোখের পানি মোছে।
“বাবা তুমি আমাদের এমন শাস্তি কেনো দিলে? আমাদের মেরে ফেলো তারচেয়ে, তবুও এই শাস্তি আমাদের দিও না।”
“তোমরা অনেক বড় হয়েছো মায়েরা। এতোটাই বড় হয়েছো যে আমি তোমাদের এরচেয়ে কম শাস্তি দিতে পারলাম না।”
“আমরা বড় হইনি বাবা, আমরা একদম বড় হইনি।”
“নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিচ্ছো, বাবাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছো না। এখনো ছোট আছো বলছো?”
প্রিয়তা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,”তুমি জানলে খুব রাগ করতে বাবা। তাই তোমাকে বলার সাহস পাইনি।”
“সৎপথে থাকলে কাউকে ভয় পেতে নেই এই শিক্ষা কি তোমাদের দিইনি আমি? তাহলে কি তোমরা অসৎ কোনো কাজ করেছো?”
পেখম হতাশ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমার তাই মনে হয় বাবা? আমরা এমন কিছু করতে পারি?”
“মনে হয়না। এজন্যই আশা করেছিলাম আমাকে জানাবে তোমরা, ভয় পাবে না।”
পেখম প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা একটা লম্বা শ্বাস ফেলে। সে ঠিক করে সে বাবাকে সব বলবে। এখন আর লুকিয়ে কি হবে?

কবির শাহ বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে বসে আছে। মার্জিয়া হতবাক হয়ে একবার প্রিয়তার দিকে আরেকবার কবির শাহের দিকে তাকায়। সবকিছু কেমন অস্বাভাবিক লাগছে তার। মনে হচ্ছে সব ঠিক নেই, কিছু তো গন্ডগোল আছেই।
“আর তোমরা এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে ওই মেয়ের কথা শুনে?”
প্রিয়তা মৃদু গলায় বললো,”বাবা আমার আর কিছু করার ছিলোনা।”
“উচ্ছ্বাস এখন কোথায়? পুলিশের কাছে ধরা দিতে গেছে?”
“জানিনা বাবা। আমরা আর কিচ্ছু জানিনা উনি এখন কোথায়।”
কবির শাহ কম্পিত গলায় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো,”এটা তোমরা কি করলে? কি সর্বনাশ করলে তোমরা? উচ্ছ্বাস, আমার উচ্ছ্বাস।”
কবির শাহ বুকে হাত চেপে বসে পড়ে। মার্জিয়া ছুটে আসে তার কাছে। প্রিয়তা আর পেখম ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ আসলেই কি কোনো অন্যায় করে ফেললো তারা? কি করবে এখন?

(চলবে……)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২৯

চাপা উত্তেজনায় সারারাত ঘুম হয়নি প্রিয়তার। ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। কিন্তু সেই ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই ঘুমটা আবার ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙতেই লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। প্রতিটা রেজাল্টের আগেই তার এমন অনুভূতি হয়। শরীর কাঁপে, অবসাদ লাগে সবকিছুতে। এতোগুলো বছরে এতো কিছু বদলে গেলেও এই জিনিসটাই বদলাতে পারলো না এখনো। এখনো রেজাল্টের সময় আসতেই বুক কাঁপতে থাকে তার ধকধক করে। তার বাবা এতো করে বুঝায় তাকে যে যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে, এতো দুশ্চিন্তা করে কি হবে? কিন্তু মন মানতে চায়না কিছুতেই।

তবে আজকের রেজাল্ট মোটেই সামান্য হয়। তার মেডিকেল লাইফের সর্বশেষ প্রফের রেজাল্ট। এতোগুলো বছরের কতোশত রাত জাগা, অসম্ভব পরিশ্রম, চোখের নিচের কালো দাগ সবকিছুর ফলাফল আজ। পাঁচ বছর সে নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার, বাবার মুখ উজ্জ্বল করার আর একটা মানুষকে একদম নিজের করে পাওয়ার। আজকের দিনটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আজ পাশ করলে আপাতত কিছুটা চিন্তামুক্ত। এরপর এক বছরের ইন্টার্নশিপ তার পরেই সে ডাক্তার। হ্যা, সে ডাক্তার হবে। এরচেয়ে শান্তির আর কি হতে পারে? তার বাবা তাদের নিয়ে যে অহংকার করতো, সে তার মর্যাদা রাখতে যাচ্ছে। মেয়ে হিসেবে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই।

“কি রে এতো সকালে উঠে পড়েছিস যে?”
“মা কলেজে যাবো, তৈরি হতে হবে।”
মার্জিয়া কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”তোর মাথা ঠিক আছে? মাত্র সাতটা বাজে। রেজাল্ট দিবে সেই এগারোটায়। এতো তাড়াতাড়ি কলেজে যেয়ে কি করবি তুই?”
ঘড়ির দিকে তাকাতেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় প্রিয়তার। আজ সময়টা যাচ্ছেই না কোনোভাবে। আধা ঘন্টা ধরে মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা সেই সাতটা দশের ঘরেই পড়ে আছে।
মার্জিয়া হালকা হেসে প্রিয়তার মাথায় হাত রাখে।
“নরম করে পরোটা ভেজেছি, তোর খুব পছন্দ তো। একটু খাইয়ে দিই?”
প্রিয়তা হতাশ মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”মা এখন আমার গলা দিয়ে একটা শস্যদানাও নামবে না।”
“প্রতিটা রেজাল্টের আগে তোর এই দুশ্চিন্তাগুলো দেখলে মনে হয় দুনিয়ায় ভালো রেজাল্টের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। সবসময় এতো দুশ্চিন্তা করলে সামনে এগোবি কীভাবে?”
প্রিয়তা কথা বাড়ায় না। এখন তার কারো কোনো কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না। চুপচাপ দরজা খুলে বাগানে এসে বসে। ইদানীং কবির শাহের শখ হয়েছে বাগান করার। স্কুল থেকে ফেরার পথে রোজই কোনো না কোনো গাছ কিনে আনছে আর মহাসমারোহে সেই গাছ লাগানো হচ্ছে বাড়ির সামনের ছোট্ট জায়গাটায়। কিন্তু এতো গাছ এতোটুকু জায়গায় আর ধরছে না। পেখম তো বলে তার বাবা নাকি বাগান করতে যেয়ে জঙ্গল বানিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়তার যদিও খারাপ লাগে। সে ঠিক করেছে সে যখন বড় ডাক্তার হবে, বাবাকে বড় এক খণ্ড জমি কিনে দিবে বাড়ির পাশেই। বাবা সেখানে ইচ্ছামতো গাছ লাগাবে, বাগান করবে। বাবার ইচ্ছাগুলো তারা পূরণ করবে না তো কে করবে?

বাগানে আসতেই মনটা ভালো হয়ে যায় প্রিয়তার। বেশ অনেক ফুল ফুটেছে গাছে। সবচেয়ে বেশি যেটা নজর কাড়ছে তা হলো হলুদ রঙা জবাটা। এই রঙের জবা খুব বেশি দেখা যায়না সচারাচর। তবে তার বাবা কোথা থেকে যেনো যোগাড় করে এনেছে। যেদিন এই ফুল ফোটে সেদিন কবির শাহ যতোটুকু সময় বাড়ি থাকে, একটু পর পর বাগানে উঁকি দেয়। তার ধারণা এই হলুদ জবাটা তার বড় মেয়ে, প্রিয়তা।

“এ কি রে মা, এতো সকালে তুই?”
এটা সত্যি, মেডিকেলে ভর্তির পর থেকে প্রিয়তা সকালে খুব বেশি উঠতে পারেনা। প্রায় রোজই সারারাত জেগে পড়াশোনা করে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যায়। তারপর উঠেই তড়িঘড়ি করে নাশতা করেই কলেজের উদ্দেশ্যে দৌড়। এভাবেই চলেছে তার বিগত পাঁচটা বছর।

প্রিয়তা সুন্দর করে হাসে বাবার দিকে তাকিয়ে। তার বাবা সকাল সকাল বাগানে চলে এসেছে। আগাছা কাটবে, গাছে পানি দিবে অনেক কাজ তার।
“ভাবতেই অবাক লাগছে রে মা, আমি একজন ডাক্তারের বাবা। কিছু বছর পর, সবাই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে, ওইযে দেখো এতো বড় ডাক্তার প্রিয়তার বাবা উনি। এই এক জীবনে আর কি চাওয়ার আছে আমার?”
প্রিয়তা ম্লান হাসে। সময় যাচ্ছে আর দুশ্চিন্তাও সমানুপাতিক হারে বাড়তেই আছে তার। বাবার কথাগুলো শুনে ভয় আরো বেড়ে যায়। আজ যদি সে পাশ করতে না পারে? অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেমন ধড়ফড় করে ওঠে।

“কি রে মা, তুই কি দুশ্চিন্তা করছিস কিছু নিয়ে?”
প্রিয়তা কান্নাভেজা গলায় বললো,”বাবা আমি যদি পাশ করতে না পারি? তাহলে তো সবাই তোমাকে বলবে ফেল্টুস প্রিয়তার বাবা যাচ্ছে দেখো।”
প্রিয়তা কথা শেষ করতেই কেঁদে দেয়। কবির শাহ হো হো করে খানিকক্ষণ হাসে।
“তুই এতো বড় হয়ে গেলি, আজ বাদে কাল ডাক্তার হয়ে যাবি এখনো তোর এই ছিঁচকাঁদুনে স্বভাবটা গেলো না।”
“বাবা সত্যিই আমার খুব ভয় করছে।”
কবির শাহ মিনিট খানিক কি যেনো চিন্তা করে চুপচাপ।

“নদীর ঘাটে যাবি?”
“এখন?”
“চল তো, স্কুলে যাওয়ার আগেই চলে আসবো।”
প্রিয়তা না করতে পারেনা। নদীর ঘাট অসম্ভব প্রিয় জায়গা তার। তার উপর বাবার সাথে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার মতো আনন্দ আর হতেই পারে না। প্রিয়তা রাজি হয়ে যায়। অন্তত কিছু সময় তো সব চিন্তা ভুলে থাকা যাবে।

শীত শীত আবহাওয়া, প্রিয়তার ভীষণ ভালো লাগছে এই ঠান্ডা আবহাওয়াটা। নদীর শীতল বাতাস আসছে। প্রিয়তা পাতলা একটা জামা পরেই চলে এসেছে। ওড়নাটা পেচিয়ে নিয়েছিলো ঠান্ডায়। কবির শাহ তাই দেখে নিজের চাদরের মধ্যে মেয়েকে নিয়ে এসেছে। প্রিয়তাও বাবার বুকের কাছে এসে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। এতো ভালো লাগছে ওর। ঠিক যেনো সেই ছোট্ট প্রিয়তা আর কমবয়সী কবির শাহ। এভাবেই শীতের দিনে নিজের চাদরের মধ্যে পেচিয়ে রাখতো মেয়েকে। অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যেতো বাবার শরীর থেকে। প্রিয়তা এখনো সেই গন্ধটা পাচ্ছে। একটু পাল্টায়নি যেনো। কিসের গন্ধ কে জানে!

“প্রিয়তা।”
“বলো বাবা।”
“তুই কি আমার উপর রেগে আছিস?”
“বাবা, তুমি কীভাবে ভাবতে পারো আমি তোমার উপর রাগতে পারি? তুমি তো আমার জীবনের সবটাই বাবা। কেনো রাগ করবো তোমার উপর?”
প্রিয়তার কথায় চোখটা ভিজে আসে কবির শাহের। মেয়েটা এতো মায়া মায়া করে কথা বলে সবসময়।

“আমি উচ্ছ্বাসের কাছে সময় চেয়েছিলাম। আমি ওকে বলেছিলাম তোকে সময় দিতে। তুই আজ যে পর্যন্ত এসেছিস, কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে এ পর্যন্ত আসতে পারতিস কিনা আমি জানিনা। বাবা হিসেবে এটুকু করা কি অন্যায় হয়েছে আমার?”
প্রিয়তা কিছুটা অপ্রস্তুত পড়ে। মাথা নিচু করে গাঢ় গলায় বলে,”বাবা তুমি যা করেছো ঠিকই করেছো। সত্যিই আমি সেসময় আবেগকে প্রশ্রয় দিলে এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। আমার পড়াশোনায়ও ভাটা পড়েছিলো। উচ্চ মাধ্যমিকেও আশানুরূপ ফলাফল করতে পারিনি আমি সেসময়ের হাজারটা টানাপোড়েনের মধ্যে। পরবর্তী সময়টাও এভাবে কেটে গেলে আজকের এই অবস্থায় আমি আসতে পারতাম না বাবা।”
“কিন্তু উচ্ছ্বাস যে তার পর থেকে একটা বারও এলো না, খোঁজ নিলো না আমাদের। ও কি অনেক বেশি রেগে আছে আমার উপর? আমার সিদ্ধান্তে কি ও খুশি হতে পারেনি?”
প্রিয়তার চোখ জ্বালা করে ওঠে। সে ভেবেছিলো উচ্ছ্বাস ভাই তার সেই কম বয়সের আবেগ। যাকে হয়তো কিছুদিন চোখের সামনে না দেখলে ভুলে যাবে, প্রেম আর থাকবে না। কিন্তু না, সে ভুল। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের ভাষায় যাকে বলে মাথামোটা, সে তাই। উচ্ছ্বাস ভাই তার কাছে কোনো আবেগের নাম ছিলো না। সে ছিলো তার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা কিংবা প্রিয়তা নামক অতি সাধারণ মেয়েটার অসাধারণ হৃদয়ের একচ্ছত্র অধিপতি। এই পাঁচটা বছরে এমন কোনো দিন যায়নি, এমন কোনো রাত যায়নি সে উচ্ছ্বাস ভাইকে স্মরণ করেনি। অ্যানাটমি কিংবা ফরেনসিক মেডিসিন বইয়ের মধ্যে রাত দু’টো কিংবা তিনটায় যখন বুঁদ সে, হঠাৎ করেই ওই উজ্জ্বল ফর্সা বরণের পুরুষটার মুখাবয়ব ভেসে উঠতো তার চোখের সামনে, যার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় জ্বলন্ত সিগারেট। সে চাইলেও, শত চেষ্টা করেও সরাতে পারতো না মুখটা। এক মগ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে রাত চারটায় যখন মাইক্রোবায়োলজি পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে জানালার পাশে দাঁড়াতো, তখন ঠিক মনে হতো উচ্ছ্বাস ভাই হয়তো হঠাৎ করে এসে হাজির হবে জানালায়। তাকে নিয়ে ওই রাতেই হাঁটতে যেতে চাইবে সুনসান, নীরব, জনমানবহীন রাস্তায়। কিন্তু না, এই পাঁচ বছরে একটা বারের জন্যও মানুষটা আসেনি তার সামনে। কর্পূরের মতো একরকম যেনো উবে গেছে মানুষটা। শুধু মাত্র কবির শাহের কথায়? নাকি সত্যিই প্রিয়তার জন্য তার মনে কোনো জায়গা তৈরি হয়নি? সবই ছিলো কম বয়সী মেয়েটাকে প্রেমে ফেলার ফাঁদ? সে উত্তর আজও পায়না প্রিয়তা। আজও অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে আছে সে। যদি আসে, যদি আসে। একরাশ অভিমান কি তার বুকেও জমেনি? জমেছে, জমেছে। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। অনেক প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছে মেডিকেল কলেজে। কাউকে মনে ধরেনি, ভুলেও কাউকে সম্মতি জানাতে ইচ্ছা করেনি। মনের কোণায় কখনো আসেনি এই মনের জমিনে অন্য কোনো পুরুষকে ঠাঁই দিতে। কিন্তু উচ্ছ্বাস? সে কি তবে অন্য কাউকে খুঁজে পেয়েছে? যার মায়ার জালে আটকা পড়ে ভুলেই গেছে তাকে? প্রিয়তা শিউরে ওঠে, আর কিছু ভাবতে পারেনা সে। ভাবলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার।

“প্রিয়তা।”
বাবার ডাকে ধাতস্থ হয় প্রিয়তা।
“বলো বাবা।”
“উচ্ছ্বাস কি রাগ করেছে আমার উপর? আমি তো তোদের ভালো চেয়েছি। বাবা হিসেবে এই চাওয়া কি আমার অন্যায় ছিলো?”
“তোমরা কেউ কোনো অন্যায় করোনি বাবা। যদি কোনো অন্যায় করে থাকি, সে আমি। শাস্তি পেলে আমিই পাবো।”
“এসব কি বলছিস তুই? তুই কোনো অন্যায় করতেই পারিস না।”
প্রিয়তা বিষাদমাখা মুখে ম্লান হাসে। কবির শাহের অসম্ভব কষ্ট হয় হাসি দেখে।
“যদি উনি কোনোদিন ফিরে আসে তাহলে মনে করবো আমি ঠিক ছিলাম, আমি ভুল মানুষকে বিশ্বাস করিনি। আর যদি ফিরে না আসে……”
প্রিয়তার গলা ধরে আসে, আর কিছু বলতে পারেনা। চোখের পানি লুকাতে অন্য দিকে তাকায়।
কবির শাহ একরাশ কষ্ট নিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। আজ প্রথম বারের মতো নিজের কোনো সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে পারছে না সে। কিন্তু এ ছাড়া আর কি করার ছিলো? আর কি করতে পারতো সে বাবা হয়ে? কম বয়সী দুইটা ছেলেমেয়ের আবেগকে প্রশ্রয় দিতে ওদেরই ক্ষতি করে ফেলতো? সে তো শুধু একটু সময় চেয়েছিলো, আর কিছু না।

সেই পাঁচ বছর আগের এক মধ্য রাতে রক্তাক্ত অবস্থায় উচ্ছ্বাস যখন হাজির হয় তাদের বাড়িতে, কবির শাহ যেনো উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলো। নিয়াজ মোর্শেদের লোক মারতে মারতে ছেলেটাকে আধমরা করে দিয়েছিলো। উচ্ছ্বাস একা ছিলো, কেউ আসেনি তাকে বাঁচাতে। সিংহের মতো একাই লড়ে কোনোরকমে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে আসতে পেরেছিলো উচ্ছ্বাস। কিন্তু সে রাতেই তাকে গ্রেফতার করা হয় কবির শাহের বাড়ি থেকে। কবির শাহ, মার্জিয়া, প্রিয়তা পুলিশের পা ধরেছিলো অন্তত তাকে চিকিৎসা টুকু করাতে দিতে। পুলিশ দেয়নি, ধরে নিয়ে যায় তাকে। এরপর বহু কাঠখড় পোড়ে, সহজ ছিলো না তাকে নির্দোষ প্রমাণ করা। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসে নীলু, হ্যা সেই প্রিয়তার নীলু আপা। তার দেওয়া প্রমাণে নিয়াজ মোর্শেদ ফেঁসে যায়। যদিও এ যাত্রা মোটেই সহজ ছিলো না তার জন্য। নিয়াজ অনেক অত্যা’চারও করেছে তাকে যেনো কোনোভাবেই কোর্টে কিছু না বলে। কিন্তু সত্য হয়তো এমনই, কোনোদিন চাপা থাকে না। ফাঁ’সিকাষ্ঠের অনেক কাছ থেকে মুক্ত হয় উচ্ছ্বাস।

এতোদিনের সেসব কাহিনী মনে করে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবির শাহ। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনো বুকটা কেঁপে ওঠে তার। কি দুর্বিষহ কেটেছে দিনগুলো। তারমধ্যেই ছিলো প্রিয়তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। এতোসবের মধ্যে কবির শাহ তো ভেবেছিলো পাশ করতেই পারবে না মেয়েটা। কিন্তু প্রিয়তা পাশ করে, ভালো ফল করতে না পারলেও পাশ করে। কবির শাহ ভয় পেয়ে যায়। এমন চলতে থাকলে মেয়ে তো নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে না। মেধাবী মেয়েটা হারিয়ে যাবে একসময়। বাবা হয়ে কীভাবে পারতো সে এটা হতে দিতে? শেষ মুহূর্তে ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হয়, ওদেরই ভালোর জন্য। উচ্ছ্বাসের কাছে কিছুটা সময় চায় সে। উচ্ছ্বাসও আর কোনো বাক্যব্যয় করেনি, একবাক্যে মেনে নেয় কবির শাহের কথা। সেই পাঁচ বছর যাবৎ কোনো খোঁজ নেই তার। যে ইচ্ছা করে হারাতে চায়, তাকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়না। কিন্তু এই পাঁচ বছরের প্রতিটা দিন মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারেনি সে ঠিক করে। বারবার অপরাধবোধে কুঁকড়ে গেছে সে। মনে হয়েছে বাবা হিসেবে আসলেই সে বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। মেয়ের ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে যেয়ে কি বাবা হয়ে মেয়ের হাসিটুকুই কেড়ে নিয়েছে সে আজীবনের জন্য? কিন্তু যদি তাই হয়, উচ্ছ্বাস কি সত্যি ভালোবেসেছে তবে প্রিয়তাকে? যদি ভালোবাসতোই, কেনো এখনো এলো না একটা বারের জন্যও? তবে কি একপাক্ষিক ভালোবাসায় তার মেয়েটাই হেরে গেলো? বাবা হয়ে মেয়ের এই কষ্ট সহ্য করবে কীভাবে সে? বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে কবির শাহের।

কলেজের কোণার এক শান বাঁধানো ঘাটে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে প্রিয়তা। কান্নার দমকে বারবার শরীর কেঁপে উঠছে তার। মুখ লাল হয়ে গেছে মুহুর্তেই।

“প্রিয়তা।”
প্রিয়তা চোখ মেলে তাকায় দেখে মেডিকেলের কলেজেরই এক বান্ধবী তিথি দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
“প্রিয়তা তুমি ফেইল করেছো? এটা কীভাবে সম্ভব? তোমার মতো মেধাবী ছাত্রী আমাদের ক্লাসে কয়টা আছে? তুমি কীভাবে ফেইল করলে? না না আমরা এগুলো নিয়ে প্রতিবাদ করবো। সব কিছু স্যারদের ইচ্ছামতো হবে নাকি?”
প্রিয়তা বেশ অবাক হয়ে তিথির দিকে তাকায়। এই মেয়েটা অতিরিক্ত বেশি কথা বলে। দাঁড়িকমা ছাড়াই বলে যায়, ওর ডিকশনারিতে দাঁড়িকমা বলে কোনো শব্দ নেই হয়তো।
“ফেইল করেছো বলে কাঁদছো এভাবে? আসলে কাঁদারই কথা। তোমার বাবা মা বোধহয় অনেক বকবে তোমাকে। আমার বাবা মা হলেও বকতো। কি করবে বলো, আবার নাহয় পরীক্ষা দিও। আচ্ছা পাশ না করলে কি তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে? এজন্যই কাঁদছো?”
প্রিয়তা অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এই মেয়েটা কি বলছে এসব? আগা নেই মাথা নেই।
“তুমি কি বলছো আমি কিছু বুঝতে পারছি না তিথি।”
“থাক মন খারাপ করোনা। বিয়ে করাও খারাপ না। আমিও ইন্টার্নের পরই বিয়ে করে নিবো। তুমি নাহয় একটু আগেই করলে।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমার জীবনে আমি যতোগুলো বন্ধু পেয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কথা বলো তুমি। সীমান্ত এক্সপ্রেসের মতো ছুটতেই আছো। আমি ফেইল করবো কেনো? আমি পাশ করেছি তো।”
তিথি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,”পাশ করলে এভাবে কাঁদছো কেনো?”
“আমি আনন্দে কাঁদছি তিথি। আজ আমার অদ্ভুত একটা আনন্দ হচ্ছে। আমার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিলো আমাদের দুই বোনকে নিয়ে। তার স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে আজ আমি। এই আনন্দেই এভাবে কাঁদছি আমি, বুঝেছো?”
তিথি সুন্দর করে হেসে দেয়, প্রিয়তাও কান্নার মধ্যে হেসে দেয়৷ সত্যি আজ তাদের বড্ড আনন্দের দিন। ডাক্তার হওয়ার যুদ্ধে আর মাত্র এক ধাপ বাকি, ইন্টার্নশিপ। তারপরেই তারা ডাক্তার, অনেক অনেক রাত জাগা কষ্টের ফসল এই দিনটা তাদের। আজ তারা হাসবে, কাঁদবে যা ইচ্ছা করবে। আজ দিনটা শুধুই তাদের।

মর্জিনা বেগম হতাশ মুখে বসে আছে কবির শাহের সামনে। খুব আফসোস হচ্ছে আজ তার প্রিয়তাকে দেখে। তার মেয়েটাও মেধাবী ছিলো, তার ইচ্ছা ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, বড় চাকরি করবে। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আজ কোথায় সেতারা আর কোথায় প্রিয়তা। আর বছর খানিক পরই প্রিয়তা ডাক্তার হয়ে যাবে, সবাই এক নামে চিনবে তাকে। আর তার সেতারা? স্বামী-শ্বশুরবাড়ির অত্যা’চারে কাটিয়ে দিবে বাকি জীবনটা। বাহ্যিকভাবে সে কতো সুখী। ভরি ভরি স্বর্ণের গহনা, দামী দামী শাড়ি। কিন্তু সেসব গহনার নিচে চওড়া কালশিটে দাগ কি কেউ দেখতে পায়? তবে আজ তার সত্যি আফসোস হচ্ছে, মেয়ের বাবার বিরুদ্ধে যেয়ে যদি একটা বার শক্ত হতে পারতো কবিরের মতো। তাহলে আজও তার মেয়েটা খুব ভালো কিছু কর‍তে পারতো। মেয়ের কথা ভাবতেই চোখটা বারবার ভিজে যাচ্ছে তার।

“তাহলে কবির তুমি জিতেই গেলে বলো শেষমেশ?”
কবির শাহ সুন্দর করে হাসে। হাসিটা মর্জিনা বেগমের বুকে যেয়ে বিঁধে, অপমানিত বোধ করে সে।
“সেতারাকে আমি নিজের মেয়ে ব্যতীত আর কিছু কোনোদিন মনে করিনি আপা। আমার এক মেয়ের সফলতা দেখে আরেক মেয়েকে ভুলে যাই কীভাবে? তার কষ্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি জিতি কীভাবে?”
মর্জিনা বেগম শব্দ করে কেঁদে দেয়। কবির শাহ অপ্রস্তুত বোধ করে। মার্জিয়া দৌড়ে এসে আপাকে জড়িয়ে ধরে।
“মার্জিয়া রে, আমি তোর কাছে সারাজীবন ধরে ক্ষমা চাইলেও মনে হয়না ক্ষমা পাবো।”
“আপা এসব কথা কেনো বারবার বলে নিজে কষ্ট পাও আর আমাকে কষ্ট দাও? আমরা সেসব কথা কিছু মনে রাখিনি।”
“ওই নিয়াজ যে এতো বড় বদমাশ আমি জানতে পারিনি মার্জিয়া। আজ যদি আমার কথা শুনে ওর মতো একটা অসভ্যের সাথে তোরা প্রিয়তাকে বিয়ে দিতি তাহলে ওর জীবনটা এতো সুন্দর হতো না, কষ্টে কেটে যেতো। এ আমি কি করতে যাচ্ছিলাম।”
মার্জিয়া মিষ্টি করে হেসে কবির শাহের দিকে তাকায়, কবিরও তাকায়।
“এমনটা হতোই না আপা। আমি বোকা ছিলাম কিন্তু মেয়েদের যে এক জোড়া শক্ত হাত সর্বদা আগলে রেখেছে। এমন কীভাবেই বা হবে? তাকে দেখতে খুব সরল, সাধারণ একজন মানুষ মনে হলেও তার মেয়েদের জন্য সে একজন অগ্নিপুরুষ। আমি ভুল করতে চাইলেও সে যে ভুল করতে দিতো না।”
কবির শাহ অপার মুগ্ধতা নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকায়। বিয়ের পঁচিশ বছর পেরিয়ে ছাব্বিশ হতে যাচ্ছে, তবুও দিনদিন এই নারীটির উপর প্রেম বেড়েই যাচ্ছে কেনো তার? উত্তর পায়না কবির। মাথা নিচু করে মিটমিট করে হাসতে থাকে শুধু। মনে মনে বলে,’শুধু কি মেয়েদের আগলে রেখেছি? তোমাকে না?’

“আপা।”
কফির নেশাটা ইদানীং বেশ জোড়ালো ভাবে ধরেছে প্রিয়তাকে। চাইলেও কাটাতে পারছে না। কতোভাবে আর খাবে না কিন্তু রাত বাড়তেই কফির নেশায় গলা শুকিয়ে যায় তার।
এক মগ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা, তার দৃষ্টি এলোমেলো। দূর থেকে ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ আসছে। রাত যতো বাড়ে ঝিঁঝির আওয়াজও তত বাড়ে।
“বল।”
“তোর কি মনে হয় উচ্ছ্বাস ভাই আর ফিরে আসবে?”
“আমি কীভাবে জানবো?”
“তোর ভালোবাসার উপর কোনোও বিশ্বাস নেই তোর?”
প্রিয়তা স্মিত হাসে। পেখম আপার হাসি দেখে। তার বোনটা দিন দিন অসম্ভব সুন্দর হয়ে উঠছে। চুলগুলো কোমর ছাড়িয়েছে, গায়ের রঙটাও বেশ খুলেছে আগের চেয়ে, মাঝে মধ্যে চোখে কাজল দিলে উপন্যাসের নায়িকাদের মতো মনে হয়।

“আমার ভালোবাসার উপর আমার বিশ্বাস আছে, এজন্যই আমি এতোগুলো বছর পরেও ওই মানুষটা ছাড়া আর কারো কথা ভাবতে পারিনা। তবে…..”
“তবে কি আপা?”
“না কিছু না।”
“আমার কি মনে হয় জানিস আপা? উচ্ছ্বাস ভাই ফিরবে, খুব তাড়াতাড়ি।”
প্রিয়তা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে পেখমের দিকে তাকায়।
“কেনো এমন মনে হয় তোর?”
পেখম উঠে এসে আপার কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়ায়। আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের আলো গলে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে প্রিয়তার মুখে পড়েছে। সেই আলোয় প্রিয়তাকে দেবীর মতো সুন্দর লাগছে। মাখনের মতো নরম গালে মুক্তোর মতো অশ্রুফোঁটা গুলো চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে।

“আপা একটা গান করবি?”
“এখন কি গান করার সময়?”
“সময় দিয়ে কি হয় আপা? দুনিয়ার যা কিছু সুন্দর ঘটনা সব হঠাৎ করেই হয়েছে, সময়ের তোয়াক্কা না করেই।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বোনের দিকে তাকায়। কি ভীষণ সুন্দর একটা কথা বললো মেয়েটা। কতো বয়স হবে ওর? এইটুকু বয়সে এতো সুন্দর কথা শিখলো কোথা থেকে?

“গান কি তুই একাই শুনবি পেখম? আমরা শুনবো না?”
প্রিয়তা আর পেখম চমকে উঠে তাকাতেই দেখে মার্জিয়া বেগম দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। তার হাতে এক থালা গরম তেলে ভাজা।
“চল ছাদে যাই, একসাথে জ্যোৎস্না বিলাশ চলবে, সাথে প্রিয়তার গান আর গরম গরম তেলে ভাজা।”
পেখম বললো,”আজ সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠেছিলো রে আপা?”
“সে তোরা যাই বলিস, আজ আমার আনন্দের দিন। আজ হোক একটু সীমাছাড়া আনন্দ। কি রে প্রিয়তা যাবি নাকি ছাদে? তোর বাবা-ও আছে।”
প্রিয়তার মন টানছিলো না, কিন্তু বাবা, মা খুশি হবে ভেবে না করতে পারলো না। হালকা হেসে সম্মতি জানায়, পেখম খুশি হয়ে আপাকে জড়িয়ে ধরে।

প্রিয়তার গান শেষ হওয়ার পর পেখমও গান ধরে। প্রিয়তার চেয়ে পেখম ভালো গান করে, প্রিয়তা ভালো নাচে। দুই মেয়ের প্রতিভায় কবির শাহ মুগ্ধ। মার্জিয়া বেগম আঁচলে চোখ মুছে বারবার।

‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে
উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।
উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।’

পেখমের দরদমাখা গলা শুনে সবার চোখেই পানি জমে। প্রিয়তা কাঠের মতো বসে থাকে শূন্যের দিকে তাকিয়ে। বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। এতো সব আনন্দের কিছুই যেনো তাকে স্পর্শ করতে পারছে না।
মার্জিয়া প্রিয়তার কাঁধে হাত রাখতেই কেঁপে ওঠে সে।
“মা।”
“প্রিয়তা চুপ কেনো তুই?”
“কই না তো।”
“কিছু তো খাচ্ছিস না।”
“কই মা খাচ্ছি তো।”
মার্জিয়া কবির শাহের দিকে তাকায়। কবির শাহ উদাস হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। মেয়ের দিকে তাকালেই অপরাধবোধ তাকে জেঁকে ধরছে বারবার। এটা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না তার এই কথাটা দিয়েও নিজেকে স্বান্তনা দিতে পারছে না সে।

মার্জিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”মা রে, জীবন তো এতো ঠুনকো না। জীবনটা অনেকটা একটা বটগাছের মতো। মাটির নিচে শিঁকড় বিস্তৃত থাকে অনেকটা। বাইরের ঝড় যতোই গাছকে উপড়ে ফেলতে চাক না কেনো, শিকড়গুলো ঠিক শক্ত করে ধরে রাখে তাকে। তুই কি জানিস আমাদের জীবনে সেই শিকড়গুলো কি?”
প্রিয়তা নির্লিপ্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়।
“সেই শিকড় হলো বিশ্বাস, ভরসা। যদি কাউকে ভালোবাসিস মন থেকে, তাকে ভালোবাসার আগে বিশ্বাস করবি। এই বিশ্বাসই তোকে ওই গাছের শিকড়গুলোর মতো আঁকড়ে রাখবে শক্ত করে তোর অবস্থানের সাথে। শুনতে খুব সহজ মনে হলেও এটা খুব কঠিন একটা কাজ। আর এই কাজটাই তোকে সারাজীবন সাধনা করে করতে হবে, করে যেতে হবে। বিশ্বাস আটকে রাখা সহজ কাজ নয় রে মা, এ ভারী কঠিন কাজ।”
কবির শাহ মার্জিয়ার ডান হাত চেপে ধরে আলতো করে। প্রিয়তা আর পেখম মায়ের কোলে মাথা রেখে ছাদেই শুয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে চাঁদটা থেকে এক টুকরো নেমে তাদের মধ্যে নূর ছড়িয়ে দিয়ে গেলো।

মাঝরাতে দরজার করাঘাত শুনে কবির শাহ আর মার্জিয়া দুইজনই লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। ঘর থেকে সেই আওয়াজ শুনতে পায় প্রিয়তা আর পেখমও। এই অসময়ে কে এলো তাদের বাড়িতে? কোনো বিপদ আপদ নয় তো?
প্রিয়তা ছুটে বসার ঘরে আসতেই দেখে কবির শাহ ইতোমধ্যে সেখানে।
“আমি দেখছি, তোমরা ঘরে যাও।”
“না বাবা তুমি একা দেখবে না। আগে জিজ্ঞেস করো কে এসেছে।”
করাঘাত আরো বাড়তে থাকে। কবির শাহ চোখে চশমাটা পরেই দরজাটা খুলে দেয়। আর সাথে সাথেই ভয়াবহ চমকে ওঠে সে। আচ্ছা সে স্বপ্ন দেখছে না তো?
সবাইকে উপেক্ষা করেই উচ্ছ্বাস ঢোকে ঘরে। তার মুখে একরাশ বিরক্তি। যেনো কিছুই হয়নি, কতো আসা যাওয়া তার এ বাড়িতে!

প্রিয়তা মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলেই পেখম তার হাত ধরে। মার্জিয়া বেগম চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, সে নিশ্চিত সে স্বপ্ন দেখছে।
পেখম বিস্মিত হয়ে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই।”
কবির শাহ কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”বাবা রে তুমি এসেছো? তুমি এসেছো বাবা?”
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে কবির শাহ, মার্জিয়া ছুটে যেয়ে তাকে ধরে। তার হাত কাঁপছে থরথর করে।
“আচ্ছা কান্নাকাটি পরে করলেও চলবে। মামি মাছটা নেন তো, পুরোটা ভাজবেন। ভীষণ খিদা লেগেছে। পারবেন না?”
মার্জিয়া এতোক্ষণ পর অবাক হয়ে দেখে উচ্ছ্বাসের হাতে বিশাল একটা ইলিশ মাছ।

“আর পেখম ডাক্তার ম্যাডামকে একটু ছাদে পাঠাও তো, মাছ ভাজতে ভাজতে কিছু চিকিৎসা নিবো তার কাছ থেকে। আমার ভীষণ অসুখ করেছে।”
প্রিয়তা বরফের মতো জমে দাঁড়িয়ে থাকে, এক পা নড়ার ক্ষমতা নেই তার। সে শতভাগ নিশ্চিত সে স্বপ্ন দেখছে, তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নটা। যদি তাই হয়, এই স্বপ্ন যেনো শেষ না হয়।
পেখম মুখ টিপে হেসে প্রিয়তার কানে কানে এসে বললো,”মনে হচ্ছে একটুও বদলায়নি, আরো বেশি দুষ্টু হয়েছে।”
প্রিয়তার কানে তখন কোনো কথা ঢুকছে না। সে একদৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। গ্রীক দেবতা জিউসের মতো লাগছে তাকে, পুরুষ মানুষ কি বয়সের সাথে সমানুপাতিক হারে সৌন্দর্য লাভ করতে থাকে? তাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না সে অসুস্থ, তবে কি অসুখটা তার অন্য কোথাও?

(চলবে, আগামী পর্বে সমাপ্ত)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-২৬+২৭

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব ২৬:

প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু সে কোনো কথা বলছে না তারপর থেকে, কাঁদছেও না। তার মস্তিষ্ক অনুভূতি শূণ্য মনে হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে কোনো দু:স্বপ্ন দেখছে, ভয়ংকর একটা দু:স্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পেখম। তার চোখ দিয়েও অঝোরে পানি পড়ছে। পাশেই চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে কবির শাহ একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মার্জিয়া বেগম তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার মনটাও অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে। তার বিশ্বাস ছিলো উচ্ছ্বাস এমন কিছু করবে না, করতে পারেনা।
“প্রিয়তার বাবা।”
কবির শাহ অস্ফুটে সাড়া দেয়।
“তুমি কি এভাবেই চুপচাপ বসে থাকবে?”
কবির শাহ নির্লিপ্ত গলায় বললো,”আমাকে এখন কি করতে বলছো মার্জিয়া?”
“ছেলেটার আমাদের ছাড়া কে আছে? বাবা মা নেই, কাছের লোক বলতে তো আমরাই। আজ ওর এতো বড় বিপদের দিনে তোমার কিছুই করার নেই বলছো?”
কবির শাহ উঠে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে হেঁটে জানালার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। মানুষটাকে দেখে বুকটা ধক করে ওঠে মার্জিয়ার। এমনিতেই সে অসুস্থ, ক্ষত এখনো পুরোপুরি শোকায়নি। সকাল সকাল এমন একটা খবর, মনে হচ্ছে মানুষটার বয়স এক ধাক্কায় কয়েক বছর বেড়ে গেছে। কেমন জবুথবু হয়ে হাঁটছে। উচ্ছ্বাসকে নিজের ছেলের মতোই তো ভালোবাসতো সে।

“যে নিজে থেকে নিজের বিপদ ডেকে আনতে চায়, তাকে কীভাবে আটকাবো মার্জিয়া? আমি কি আমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রেখেছিলাম? আমার বাড়িতে এনে একরকম লুকিয়ে রেখেছিলাম ছেলেটাকে। যাতে কেউ ওর কোনো ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু ওর চোখে যে আমি ভয়ংকর প্রতিশোধের আগুন দেখেছিলাম। সেই আগুন নেভানোর ক্ষমতা আমার কি ছিলো?”
মার্জিয়া বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ওঠে শব্দ করে।
“কেঁদো না মার্জিয়া, কেঁদে কি হবে? এটা হয়তো হওয়ারই ছিলো।”
“আজ আমার জন্য এতোকিছু হলো, আমি দায়ী সবকিছুর জন্য। আমি যদি ছেলেটার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করতাম, তাহলে হয়তো ও আমাদের বাড়ি ছেড়ে যেতো না। এই অন্যায়টা ও করতো না তাহলে।”
“এসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দিও না এখন।”
“তাই বলে তুমি কিচ্ছু করবে না? চুপচাপ সব দেখবো আমরা?”
“কি করবো আমরা মার্জিয়া? সব প্রমাণ ওর বিরুদ্ধে, তাছাড়া ও পলাতক। কোথায় খুঁজবো ওকে আমরা?”
পেখম ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কবির শাহ পরম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। নিজেও ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। ছোট থেকে পেখমের একটা আফসোস ছিলো। তার কেনো একটা বড় ভাই নেই। থাকলে কতো আবদার মেটাতো ছোট বোনের। উচ্ছ্বাসকে পেয়ে সে ভেবেছিলো একটা বড় ভাই পেয়েছে। তার এতো বড় বিপদে মেয়েটা নিজেকে সামলাতে পারছে না।
“বাবা উচ্ছ্বাস ভাই এটা করেনি, বিশ্বাস করো উনি এটা করতেই পারেনা। আমি জানি উনি যতোই প্রতিশোধ নিতে চাইতো না কেনো, মানুষ খু’ন করার মতো ছেলে উচ্ছ্বাস ভাই নয়।”
“কিন্তু মা সব প্রমাণ তো ওর বিরুদ্ধে। প্রতিটা স্পটে ওর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনটা খু’নের সময়ই কোনো না কোনোভাবে তার উপস্থিতি ছিলো। এমনকি ও পালিয়ে গেছে এরপর। ও যদি সত্যি এগুলো না করতো তাহলে পালিয়ে গেলো কেনো?”
“হয়তো ভয়ে।”
মার্জিয়া বেগম অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”তুমি বিশ্বাস করো উচ্ছ্বাস এটা করতে পারে? ছেলেটা একটু রগচটা, তাই বলে খু’ন?”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”আমি বিশ্বাস করতে চাইনা মার্জিয়া। আমি এখনো কোনো মীরাক্কলের অপেক্ষা করছি। হয়তো সত্যি প্রমাণ হয়ে যাবে উচ্ছ্বাস এগুলো করেনি। কিন্তু বাস্তবে এমন মীরাক্কল কাঁহাতক হয়?”
মার্জিয়া বেগম আবার কাঁদে। বুকটা কেমন ভার হয়ে আসছে তার। আজকের সকালটা এমন বিষাদময় কেনো?
“সব আমার জন্য হয়েছে সব।”

“তোমার জন্য নয় মা, যা হয়েছে সব কিছুর জন্য দায়ী আমি। আমার জন্যই এতোকিছু হয়েছে। নাহলে ওই মানুষটা কখনোই এটা করতো না।”
সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকায়। এতোক্ষণ পর সে কথা বলছে। কিন্তু তার কণ্ঠ একদম নির্জীব। কেউ যেনো জোর করে তাকে কথা বলতে বাধ্য করছে।
কবির শাহ ছুটে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। নিজের মেয়েটার জন্যও উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি খুব কষ্ট হচ্ছে তার। অষ্টাদশীর প্রথম প্রেম ভয়ংকর হয়, এটাকে হেলাফেলা করা উচিত নয়।
“তুই এখন এসব কেনো বলছিস মা? তোর শরীর দূর্বল, তুই বিশ্রাম কর।”
“না বাবা, যা সত্যি তাতো সত্যিই। আজ আমার জন্যই এতো কিছু হয়েছে। হাসপাতালে আমি যদি উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার না করতাম, উনি হয়তো আবার ফিরে আসতো আমাদের বাড়ি। উনি সবকিছু ভুলে আবারও নতুন করে সব শুরু করতে চেয়েছিলো হয়তো। ঠিক এমন সময় তাকে খুব কঠিন কিছু কথা আমি শুনিয়েছি। আমি ভুল করেছি বাবা।”
কবির শাহ আর মার্জিয়া হতভম্ব হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকায়। এমন কিছু শুনতে হবে ভাবতেই পারেনি তারা। পেখম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কবির শাহ কঠিন গলায় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি উচ্ছ্বাসের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো?”
মার্জিয়া রাগান্বিত হয়ে মেয়ের কাছে এসে বললো,”কতোটা নিমকহারাম মেয়ে তুমি প্রিয়তা। যে মানুষটা তোমার বাবার এমন অবস্থায় সবার আগে ছুটে এসেছে। দুই হাতে আগলে রেখেছে আমাদের পরিবারকে অমন কঠিন সময়ে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো তুমি? এই শিক্ষা এতোদিন দিয়েছে তোমার বাবা?”
মার্জিয়া রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে। ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে মেরে আধমরা করে দিতে। কীভাবে এতোটা অসভ্য হতে পারলো? আজ উচ্ছ্বাস না থাকলে, কি হয়ে যেতো সেদিন? হয়তো বাঁচানোই যেতো না মানুষটাকে। কতো আপনজনই তো ছিলো, কেউ তো আসেনি সেদিন।

“মার্জিয়া আমি কথা বলছি তো। ওকে আমার কাছে বলতেই হবে কেনো ও এই কাজ করেছিলো। তুমি জানো আমি যেমন ভালোবাসতে জানি তেমনই শাসন করতেও জানি।”
প্রিয়তা নির্লিপ্ত গলায় বললো,”ভুল যখন আমি করেছি, এর প্রায়শ্চিত্তও আমিই করবো।”
“কি করতে চাচ্ছো তুমি?”
প্রিয়তা বাবার দিকে তাকায়। মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছেনা, চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে।
“উনার কিছু হলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো বাবা।”
মার্জিয়া বেগম রাগে ফেটে পড়ে। দৌড়ে এসে মেয়ের গায়ে হাত ওঠাতে গেলেই কবির শাহ তাকে থামায়।
“কতো বড় অসভ্য একবার ভাবো, কতোটা নির্লজ্জ মেয়ের জন্ম দিয়েছো। এতো বড় অন্যায় করেছে তার উপর বাবা মায়ের সামনে কীভাবে বেহায়ার মতো কথা বলছে। ও নিজেকে কি শেষ করবে? আমারই তো ওকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে।”
“মার্জিয়া শোনো, আমি বাবা হওয়ার পাশাপাশি একজন শিক্ষক এ কথা ভুলে যেওনা। আমি আমার সন্তানকে কখনো এমন শিক্ষা দিবো না যে এভাবে কথা বলার সাহস সে পাবে বাবা মায়ের সামনে। তবে সবকিছু বলার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। মেয়েটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ও স্বাভাবিক হোক, আমি নিজে ওকে শাস্তি দিবো।”
প্রিয়তা হঠাৎ চিৎকার করে বললো,”আমাকে এখনই শাস্তি দাও বাবা। আমার জন্য একটা ফুলের মতো মানুষের জীবন ধ্বংস হয়ে গেলো। আমাকে এখনই শাস্তি দাও তুমি।”
কবির শাহ শীতল গলায় বললো,”হয়তো নিজেকে তুমি যতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছো ওর কাছে, ততটা নয়। হয়তো তোমার কোনো কথায় না, নিজে থেকেই ও এই কাজটা করেছে। নিজের দিকে কেনো টেনে নিচ্ছো? তবে এটা ঠিক ওর সাথে হাসপাতালে খারাপ ব্যবহার করে তুমি চরম অন্যায় করেছো। এই শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।”
প্রিয়তা চিৎকার করে কাঁদতে চায়, পারেনা। অদৃশ্য কেউ ওর গলাটা টিপে ধরে আছে যেনো।

কবির শাহ হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপাতে চাপাতে বের হতে গেলেই মার্জিয়া ডাকে পেছন থেকে।
“এখন আবার কোথায় যাচ্ছো তুমি? শরীর তো ভীষণ দূর্বল তোমার।”
কবির শাহ মেয়ের দিকে একবার কঠিন দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে মার্জিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
“যে আমার জীবন বাঁচাতে সবার আগে ছুটে এসেছে, আমি একজন বাবা হয়ে ঘরে বসে থাকি কীভাবে মার্জিয়া?”
“তুমি এখন কোথায় খুঁজবে ওকে? খবরের কাগজে যে দেখলাম ও পলাতক।”
“শান্ত হয়ে ঘরে বসে না থেকে কিছু তো করা উচিত। নাহলে ওপাড়ে যদি ওর বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়ে যায় আমার। কি জবাব দিবো তাদের মার্জিয়া? ওরা যে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, আমার কলিজার টুকরোটাকে বাঁচাতে পারলে না?”
প্রিয়তা তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়ায়।
“বাবা আমিও যাবো, আমাকে নাও।”
কবির শাহ স্মিত হেসে বললো,”প্রয়োজন নেই।”
কাউকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে কবির শাহ হনহন করে বেরিয়ে যায়। মার্জিয়া বেগমও বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। সে ঠিক করেছে সে জায়নামাজে বসবে। উচ্ছ্বাসের বিপদ না কাটা পর্যন্ত জায়নামাজ থেকে উঠবে না সে। একজন মায়ের আকুল চাওয়া সৃষ্টিকর্তা কীভাবে ফেরান তাই দেখবে সে।

সবাই চলে যাওয়ার পর কাঁপা কাঁপা পায়ে প্রিয়তা এসে বসে খাটের উপর। পেখম কিছুটা ইতস্তত করে বোনের কাঁধে হাত রাখে। আচমকাই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে প্রিয়তা। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করতে থাকে সে। পেখম তাকে থামায় না। সে চায় প্রিয়তা কাঁদুক, ভিতরের কষ্টটা বের করে মিশিয়ে দিক বাতাসে। তাতে যদি একটু হালকা হয় সে।

“ভাই।”
“হু।”
“আজ সব খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে আপনার ছবি।”
“আরে বাপ রে, হিরো হয়ে গেলাম নাকি?”
রাসেল অবাক হয়ে বললো,”ভাই আপনি এখনো মজা করছেন?”
“কেনো মজা না করার মতো কি কিছু হয়েছে?”
“ভাই পুলিশ হন্যে হয়ে আপনাকে খুঁজছে। তিন তিনটা মার্ডা’র কেসের আসা’মী আপনি।”
“পুলিশের কাজ পুলিশ করছে। এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে?”
“আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি কি বলছেন?”
উচ্ছ্বাস ছোট্ট করে হেসে রাসেলের কাঁধে হাত রাখে। রাসেল অবাক হয়ে দেখে এতোসবের মধ্যেও এই ছেলেটা এতো সুন্দর করে হাসছে কেনো? আর একজন পুরুষ মানুষের হাসি এতো সুন্দর হবে কেনো?
“দেখ রাসেল, আমি জানি আমি এগুলো কিছু করিনি। তাই আমার কোনো ভয় নেই।”
“যদি তাই হবে তাহলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেনো?”
“কোথায় পালিয়েছি? আমি আমার জায়গাতেই আছি। পুলিশ যদি খুঁজে পায়, পাবে।”
রাসেল অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”ভাই জীবনটা কোনো থ্রিলার মুভি না আর আপনিও লিওনার্দো ক্যাপ্রিও না। যেসব জায়গায় তিনটা খু’ন হয়েছে সব জায়গায় আপনি গিয়েছেন এবং প্রমাণও ফেলে এসেছেন। কোথাও পায়ের ছাপ তো কোথাও নিজের শার্টের ছেঁড়া অংশ। আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন যে এগুলো আপনি করেননি? শুধুমাত্র তাদের ভয় দিতে গিয়েছিলেন?”
উচ্ছ্বাস এদিক ওদিক তাকায়। কেমন অস্বস্তি তার চোখেমুখে।
“এখন আবার কি খুঁজছেন?”
“সিগারেটের তৃষ্ণা হচ্ছে। শালা সবগুলো শেষ হয়ে গেছে।”
“একটু আগেই তো একটা খেলেন। এখনই তৃষ্ণা পেয়ে গেলো?”
“যেদিন নন্দিনীর সুধা পান করে তৃষ্ণা মিটবে সেদিন থেকে আর খাবো না যা, কথা দিলাম।”
রাসেলের কান লাল হয়ে যায়। লোকটা ভীষণ ঠোঁটকাটা। ছেলে হয়ে রাসেলেরই লজ্জা লাগে।

“কি রে তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেনো? তুই কি নন্দিনী নাকি?”
এমন সময়ও কেউ এমন মজা করতে পারে? হাসবে না হাসবে না করেও হেসে দেয় রাসেল, উচ্ছ্বাসও হাসে।

“কিন্তু রাসেল আমি একটা জিনিস এখনো বুঝতে পারছি না।”
“কি ভাই?”
উচ্ছ্বাস চিন্তিত গলায় বললো,”ওই তিন জানো’য়ারের সাথে আর কার শত্রুতা থাকতে পারে? আমি বাদে কে ওদের শেষ করে দিতে চায়?”
রাসেল উত্তর দেয়না, এটা সে-ও ভেবেছে।
“তবে সে যে-ই হোক, আমার উপর তার কড়া নজরদারি আছে এখনো।”
“আপনি কীভাবে বুঝলেন?”
“আমি ঠিক যেদিন যেদিন ওই তিনজনকে ভয় দেখাতে গিয়েছি ঠিক সেদিনেই ওদের খু’ন হয়। তিন ক্ষেত্রেই আমি যাওয়ার আগেই ওরা খু’ন হয়ে ছিলো। যে সত্যিই এই কাজ করেছে, সে কীভাবে জানলো আমি ওদিনই যাবো। আমি না চাইতেও আমার উপস্থিতির প্রমাণ খুব সূক্ষ্মভাবে ওখানে রাখা হয়েছে। কারণ সে জানতো আমি যাবো, আর আমার কাছে মার্ডা’র মোটিভ ছিলো। এই জিনিসটাই সে কাজে লাগিয়েছে।”
রাসেল চিন্তিত মুখে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। আসলেই তো, এটা তো সে ভেবে দেখেনি।

“আমার মনে হয় দূরের কেউ না, আমার খুব কাছের কেউ এটা করছে। আমার প্রতিটা গতিবিধি নজরে রাখছে।”
রাসেল কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে। কারণ দলে উচ্ছ্বাস বাদে যে তিনজন আছে তাদের মধ্যে সে-ও একজন।
উচ্ছ্বাস আচমকা শব্দ করে হেসে দেয়। বুকটা ধকধক করে ওঠে রাসেলের। তবে কি উচ্ছ্বাস তাকে সন্দেহ করছে?
উচ্ছ্বাস হঠাৎ হাসি থামিয়ে ক্রুর চোখে রাসেলের দিকে তাকায়। ডেরার আধো আলোয় সেই দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে যায় রাসেল।
“তুই ভয় পাচ্ছিস কেনো রাসেল? কাজটা তুই করিসনি তো?”
রাসেল থতমত খেয়ে বললো,”ভাই……”
“এখন সামনে থেকে দূর হয়ে যা। আর হ্যা, গা টা ম্যাজম্যাজ করছে। সিগারেট এনে দে। পকেট থেকে টাকা নিয়ে যা।”
রাসেল কাঁপা কাঁপা পায়ে বেরিয়ে যায়। উচ্ছ্বাস হাসে সেদিকে তাকিয়ে।

এরপর বুকপকেট থেকে একটা ছোট্ট সাদাকালো ছবি বের করে উচ্ছ্বাস। মুচকি হাসে সেদিকে তাকিয়ে।
“প্রিয়তমা খুব কাঁদছো বুঝি? কাঁদো, খুব কাঁদো। আমি মানুষটা ভালো না। আমি প্রতিশোধ নিতে ভালোবাসি। আমার মনের মৃ’ত্যু ঘটাতে চেয়েছো তুমি, তোমাকে যে এই শাস্তিটুকু পেতেই হবে। তবে হ্যা, ভালোবাসায় প্রতিশোধ চলে না। তাই বেশিদিন না, অচিরেই তোমার কান্না বন্ধ হবে। ততদিন একটু কষ্ট করো নন্দিনী।”
ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে উচ্ছ্বাস। নেশাটা মারাত্মকভাবে চেপে ধরেছে তাকে। সিগারেট না পেলে গলা শুকিয়ে আসবে আরো। শরীরে নারকীয় এক যন্ত্রণা ভর করে। এই নেশা সে কাটাতে চায়, সে জানে এই নেশা কীভাবে কাটবে। ছবিটা আরেকবার চোখের সামনে তুলে ধরে উচ্ছ্বাস।

সারারাত তীব্র মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করেছে প্রিয়তা। ভোরের দিকে ব্যথা চলে গেছে। ভীষণ খিদা লেগেছিলো তখন। গরম ভাতে চিকন করে ভাজা আলু দিয়ে খেতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু খেতে বসে একবারও ভাত মুখে নিতে পারেনি, গলা দিয়েই নামেনি। এক অসহ্য যন্ত্রণা পুরো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছিলো, খেতে দেয়নি তাকে একটুও।

সকালের নরম আলোয় মূর্তির মতো মেঝেতে দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে প্রিয়তা। চোখে পানি নেই, তবুও শরীর কাঁপছে কিছুক্ষণ পর পরই গতকালের পর থেকে কবির শাহ বা মার্জিয়া কেউ বড় মেয়ের সাথে কোনো কথা বলেনি। উন্মাদের মতো লাগছে নিজেকে।

“আপা।”
প্রিয়তা তাকায় না পেখমের দিকে।
“আপা একজন দেখা করতে এসেছে তোর সাথে।”
প্রিয়তা আলতো করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখে পেখমের পিছনে নীলু দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে ভয় কিংবা হতাশার চিহ্ন।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় নীলুর দিকে। ও এখানে এখন কি চায়? কি বলতে এসেছে?

“প্রিয়তা।”
“আপনি এখানে?”
নীলু মাথা নিচু করে পেখমকে বললো,”পেখম ওর সাথে আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে।”
পেখম বুঝতে পেরে একবার প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে চলে যায় ঘর ছেড়ে। প্রিয়তা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে নীলুর দিকে। তার সাথে এই মেয়ের কি ব্যক্তিগত কথা থাকতে পারে? কি চায় সে?

পেখম যেতেই নীলু ধীর পায়ে এসে প্রিয়তার পাশেই মেঝেতে বসে পড়ে। প্রিয়তা কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে।

“প্রিয়তা আমি জানি তোরা কতোটা পেরেশানিতে আছিস। আমি গতকালের খবরের কাগজ পড়েছি।”
প্রিয়তার এখন একদম ইচ্ছা করছে না নীলুর সাথে কোনো কথা বলতে। অসম্ভব বিরক্ত লাগছে মেয়েটাকে তার। কি বলতে চায় সে? যদি জানেই তারা পেরেশানিতে আছে, তবে কেনো এসেছে?

“নীলু আপা আমি বুঝতে পারছি না আপনি কেনো এসেছেন এখানে? আমার সাথে কি ব্যক্তিগত কথা থাকতে পারে আপনার?”
নীলু এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় ফিসফিস করে বললো,”আমাকে আসলে এখানে নিয়াজ মোর্শেদ পাঠিয়েছে।”
প্রিয়তা ভয়ংকরভাবে চমকে নীলুর দিকে তাকায়। প্রিয়তার দৃষ্টি দেখে ভড়কে যায় নীলু। মুখটা মুহুর্তেই লাল হয়ে উঠেছে প্রিয়তার।

“প্রিয়তা আমার কথা শোন……”
“আপনি বেরিয়ে যান নীলু আপা।”
“প্রিয়তা…”
“শুনতে পাননি আমি কি বলছি? আপনি যদি এখনই বেরিয়ে না যান তাহলে আমি ভুলে যাবো আপনি আমার বড়। আমার মাথা এখন ঠিক নেই। আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। নিজের সম্মান নষ্ট করতে না চাইলে ভালোয় ভালোয় আমার সামনে থেকে চলে যান আপনি, এখনই।”
“প্রিয়তা পুরো কথা না শুনেই এমন করছিস কেনো? আগে আমার কথাটা শোন।”
“আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা নীলু আপা। ওই অসভ্য লোকটা এখনো কেনো আমার পিছে পড়ে আছে? আর আপনি এসেছেন তার হয়ে আমার কাছে বার্তাবহন করতে। আপনি কি ডাকপিয়ন নাকি?”
নীলু হতাশ মুখে তাকায়। প্রিয়তার এখন ইচ্ছা করছে এই মেয়েটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। নর্দমার কীটের মতো লাগছে এখন মেয়েটাকে তার কাছে। মনে হচ্ছে একটা কালো কীট কিলবিল করছে তার সামনে। সহ্য হচ্ছেনা তার একবিন্দু।

“কি হলো এখনো গেলেন না?”
প্রিয়তার গলার উত্তাপ টের পেয়ে উঠে দাঁড়ায় নীলু। কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই কি মনে করে আবার ফিরে আসে সে।
“আপনি আবার এসেছেন? বললাম না আমার ভালো লাগছে না এখন কথা বলতে?”
নীলু কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”প্রিয়তা আমি যদি তোর মনটা এ মুহুর্তে ভালো করে দিই? আমি জানি আমাকে এসময় যতোটা অসহ্য লাগছে তোর, তখন ততটা লাগবে না।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”তার মানে?”
নীলু ম্লান হেসে প্রিয়তার পাশে এসে বসে আবার। প্রিয়তা কোনোভাবেই এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যাকে নিয়াজ মোর্শেদের মতো অসভ্য একটা লোক তার কাছে পাঠিয়েছে তার নিশ্চয়ই কোনো অভিসন্ধি আছে।

“নীলু আপা কি বলবেন আপনি?”
“তুই এই মুহুর্তে যা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিস, আমি সেই দুশ্চিন্তা কমিয়ে দিতে পারি।”
“আপনি কীভাবে জানেন আমি কি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি?”
নীলু হাসে, প্রিয়তা এবার নড়েচড়ে বসে। তার সত্যি এবার মনে হচ্ছে নীলু শুধু শুধু এখানে আসেনি। কোনো একটা উদ্দেশ্য আছে তার।

“তুই কি উচ্ছ্বাস ভাইকে প্রচন্ড ভালোবাসিস সেইটা আমি জানি।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না।
“এই মুহুর্তে তোর ভালোবাসার মানুষটাকে পুলিশ খুঁজছে এটাই যে তোর দুশ্চিন্তার কারণ এটাও আমি জানি।”
“আপনি সেই দুশ্চিন্তা কীভাবে কমাবেন?”
“যদি বলি আমি জানি তোর উচ্ছ্বাস ভাই কোথায় আছে?”
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় প্রিয়তা। তার শরীর অসম্ভব কাঁপছে। মনে হচ্ছে যে কোনো সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কোনোমতে নিজেকে সামলায় সে।

“নীলু আপা……”
নীলু দরজার দিকে তাকিয়ে প্রিয়তাকে বললো,”আস্তে কথা বল, সবাই শুনবে তো।”
“সবাই শুনলে কি হবে নীলু আপা? আমার বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তায় আছে। সবাই খুব খুশি হবে।”
প্রিয়তা হড়বড় করে কথা বলে যায়। খুশিতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার, যা চোখ এড়ায় না নীলুর।

“তোকে আমি আরেকটা সুখবর দিবো।”
“আপনি আমার জন্য অনেক বড় একটা সুখবর এনেছেন নীলু আপা। এরচেয়ে বড় সুখবর আমার কাছে আর নেই এই মুহুর্তে।”
নীলু উঠে এসে প্রিয়তার পাশে দাঁড়ায়, হাত ধরে তার। নীলু টের পায় প্রিয়তা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে।

“আছে প্রিয়তা আছে, এরচেয়েও বড় সুখবর আছে।”
প্রিয়তা অস্থির চোখে তাকায় নীলুর দিকে।
“উচ্ছ্বাস ভাই এই খু’নগুলো করেনি।”
হতবাক হয়ে প্রিয়তা নীলুর দিকে তাকায়। নীলু হাসে তার দিকে তাকিয়ে।

“নীলু আপা আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?”
“আমি জানি প্রিয়তা। জানি বলেই এখানে এসেছি।”
প্রিয়তা টালমাটাল পায়ে দূরে ছিটকে আসে কিছুটা। বুকের উপর কয়েক মণের পাথর দীর্ঘক্ষণ চাপা থাকলে হঠাৎ তা সরে গেলে শরীরটা যেমন হালকা লাগে, প্রিয়তারও তাই লাগছে। শরীর ছেড়ে দিয়েছে তার। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তেই মাটিতে পড়ে যাবে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে। হৃৎপিণ্ডটা এতোক্ষণে বুঝি একটু শান্তি দিচ্ছে বুকের কোটরটাকে। সে জানেনা নীলু সত্যি বলছে না মিথ্যা। তবে এই সময় যে তার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে নীলু যা বলছে সব সত্যি, একবিন্দু মিথ্যা না।

“তাহলে কে করেছে নীলু আপা? কে করেছে এই কাজ?”
নীলু রহস্যময় একটা হাসি দেয় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে।

(চলবে…….)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব : ২৭

প্রিয়তা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীলুর দিকে। গভীরভাবে অবলোকন করছে তাকে। বিশ্বাস করবে কি করবে না ভাবছে। অতীতের স্মৃতিগুলো নীলুকে বিশ্বাস করতে বাঁধা দিচ্ছে প্রিয়তাকে। তার উপর নিয়াজ নাকি তাকে পাঠিয়েছে। নিয়াজ লোকটাকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায়না, কিন্তু তার পাঠানো নীলুকে কি যায়?

“আমি জানি প্রিয়তা তুই কি ভাবছিস।”
“আমি কি ভাবছি তা জানা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয় নীলু আপা।”
নীলু হাসে, তবে হাসিটা এবার অতোটা খারাপ লাগেনা প্রিয়তার।

“নীলু আপা আপনি সত্যি জানেন উচ্ছ্বাস ভাই কোথায় আছে?”
নীলু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো,”জানি।”
“কীভাবে জানেন?”
“তার জন্য তোকে ধৈর্য্য ধরে আমার পুরো কথাটা শুনতে হবে। আর বিশ্বাস রাখতে হবে আমি তোর খারাপ চাইবো না।”
প্রিয়তা স্মিত হেসে বললো,”কেনো এই বিশ্বাসটা করবো আপনাকে নীলু আপা?”
“অবিশ্বাসই বা কেনো করবি?”
নীলুর কথায় কিছুটা থতমত খেয়ে যায় নীলু, আসলেই তো অবিশ্বাস করবে কেনো? শুরু থেকে নীলুর আসলেই কি কোনো দোষ ছিলো? নীলু তো জানতো না সে উচ্ছ্বাস ভাইকে পছন্দ করে। না জেনেই একজন সুদর্শন যুবকের প্রেমে পড়া কি খুব অস্বাভাবিক কিছু? আর বাকি রইলো নিয়াজের কথা। সেই পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তাকে নিয়াজের কাছে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে আর যাই হোক, নিয়াজ সেভাবেই নিজেকে পরিচয় দিয়েছে নীলুর কাছে। নীলু কিছু বোকামি করেছে, তাই বলে একেবারেই অবিশ্বাস করার মতো সে?

“শোন প্রিয়তা, ছোট্ট একটা মফস্বল শহর আমাদের, তার মধ্যে নিতান্তই ছোট একটা কলেজ আমাদের। এখানে কিছু হলে গোপন থাকে না, সবাই সব জানতে পারে। তোর উচ্ছ্বাস ভাই তোর জন্য যে পাগলামি করেছে, কেউ কিছু বুঝতে পারেনি ভেবেছিস? আমরা সবাই আছি তোদের পাশে।”
প্রিয়তা অবিশ্বাসী চোখে নীলুর দিকে তাকায়।
“সবাই মানে?”
“সবাই মানে সবাই। এতো কিছু এখন বলতে পারছি না। তোকে যা বলার জন্য এসেছি, বলে চলে যাবো। বাকিটা তোকে করতে হবে।”
“কি করতে হবে নীলু আপা?”
“প্রথমেই তোকে বলবো নিয়াজ মোর্শেদ আমাকে এখানে কেনো পাঠিয়েছে।”
নীলু কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়তা অধৈর্য্য হয়ে যায়।

“নিয়াজ জানে এই খু’নগুলো কে করেছে।”
“কি বলছেন নীলু আপা?”
“ওর চাচাতো ভাই, যে কিনা একজন সিরিয়াল কিলা’র তাকে দিয়ে একজন বড় শিল্পপতি এই কাজ করিয়েছে।”
প্রিয়তা আঁৎকে উঠে বললো,”তার সাথে উচ্ছ্বাস ভাইয়ের চাচাদের কি সম্পর্ক?”
“তারা বিজনেস পার্টনার ছিলো। টাকা নিয়ে কিছু একটা সমস্যা চলছিলো। অনেকদিন থেকেই তাদের মারার প্লান করছিলো। কিন্তু যেহেতু তারা বিজনেস পার্টনার ছিলো তাই সব সন্দেহ তার উপরই পড়বে। তাই সে সুযোগ খুঁজছিলো, আর পেয়েও গেলো। উচ্ছ্বাস ভাইকে ব্যবহার করলো দাবার গুটি হিসেবে।”
“নীলু আপা এসব কি বলছেন? উচ্ছ্বাস ভাই এসব কর‍তেই পারেনা। উনার রাগ বেশি, তবে বিশ্বাস করুন উনি মানুষটা মোটেই এমন না। উনাকে কেনো কেউ দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে?”
“খুব স্বাভাবিক, যাতে দায়টা তার উপর যেয়ে পড়ে। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের বাবা মা’কে খু’ন করা হলে যেনো বিনা মেঘেই বৃষ্টিপাত হয় ওই লোকের। সেই সময় থেকে পুরোটা সময় তার নজর ছিলো উচ্ছ্বাস ভাইয়ের উপর। তার এই বাড়িতে আসা, এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়া সবকিছুতে নজরদারি রেখেছে ওই লোক। তোকে ভালোবাসার পর উচ্ছ্বাস ভাই চেয়েছিলো সবকিছু ছেড়েছুড়ে নতুন করে বাঁচবে। কিন্তু এটা হলে তো ওই লোকের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাই উচ্ছ্বাস ভাইয়েরই এক কাছের লোককে দিয়ে প্রতিনিয়ত উষ্কে দিয়েছে তাকে। তবুও উচ্ছ্বাস ভাই রাজি হয়নি খু’ন করতে। সে চেয়েছিলো শুধু ভয় দেখাবে তার চাচাদের। কিন্তু তার দলেরই সেই ছেলেটা উচ্ছ্বাস ভাইয়ের পাশে থাকার নাম করে তাকে ফাঁসিয়েছে। তার পায়ের ছাপ, শার্টের ছেঁড়া অংশ সবকিছু ওই ছেলেটা অতি সাবধানে ঘটনাস্থলে রেখে এসেছে। যাতে সব সন্দেহ উচ্ছ্বাস ভাইয়ের উপর যায়। আর সে এই পরিকল্পনায় সফল। পুলিশ এখন হন্যে হয়ে উচ্ছ্বাস ভাইকে খুঁজছে। তবে সত্যিই উনি নির্দোষ রে প্রিয়তা।”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা পায়ে খাটের উপর ধপ করে বসে। মাথাটা ভীষণ ঘুরছে তার। উচ্ছ্বাস ভাই বুঝতেই পারলো না কতো বড় একটা ট্র‍্যাপে ফেলানো হয়েছে তাকে। অজান্তেই তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন সে কি করবে? কীভাবে বাঁচাবে উচ্ছ্বাস ভাইকে?

“উচ্ছ্বাস ভাই অল্পে রেগে যায়, তাকে রাগিয়ে দেওয়া সহজ। আর তার দূর্বলতাকেই ব্যবহার করেছে তারই কাছের কেউ।”
প্রিয়তা ছুটে এসে নীলুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। নীলু একহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে।

“শান্ত হ প্রিয়তা।”
“আমি এখন উচ্ছ্বাস ভাইকে বাঁচাবো কীভাবে নীলু আপা?”
“এখনো সবকিছু সাধ্যের বাইরে চলে যায়নি। আমাদেরকে পারতেই হবে প্রিয়তা। আমরা সবাই আছি তোর সাথে।”
প্রিয়তা কান্নাভেজা লাল চোখে তাকায় নীলুর দিকে।

“কিন্তু এতো কথা আপনি কীভাবে জানলেন?”
“আজ আমাকে নিয়াজ মোর্শেদ ডেকেছিলো। আমাকে সে একটা প্রস্তাব দিয়েছে। তখনই এগুলো জানতে পারি আমি তার কাছে। যেহেতু ওই শিল্পপতি খু’নী হিসেবে ব্যবহার করেছে নিয়াজের চাচাতো ভাইকে।”
“কিন্তু কি প্রস্তাব নীলু আপা?”
“বলবো, তবে শোনার পর তুই আমাকে ভুল বুঝবি না। এজন্যই এই কথা আমি আগে বলিনি। তাহলে তুই আমাকে ভুল বুঝে বাকি কথাটা হয়তো শুনতে চাইতি না।”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে নীলুর দিকে তাকিয়ে থাকে।

নীলু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”নিয়াজ চায় তুই ওকে বিয়ে করিস। বিনিময়ে সে প্রমাণ করবে উচ্ছ্বাস ভাই নির্দোষ।”
চিৎকার করে ছিটকে দূরে যেয়ে দাঁড়ায় প্রিয়তা। নিয়াজ লোকটার প্র‍তি ঘৃণায় দমবন্ধ হয়ে আসে প্রিয়তার। কতোটা নির্লজ্জ হতে পারে ওই অসভ্যটা। একজন মানুষ নির্দোষ জানা সত্ত্বেও তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার স্বার্থে শর্ত দিয়েছে। অসভ্য নর্দমার কীট একটা।

“নীলু আপা, অসভ্যটা আমার পিছু ছাড়ছে না কেনো? কি পেয়েছে আমার মধ্যে? আমি তো আহামরি সুন্দরীও নই, না আছে আমার বাবার অগাধ টাকা। কেনো আমার পিছনে এভাবে পড়ে আছে সেই শুরু থেকে? একজন মানুষ নির্দোষ, সে যখন জানেই তবে তা প্রমাণ করার জন্য আমাকে বিয়ে করার শর্ত দিয়েছে।”
নীলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”নিয়াজ মানুষটা ভালো না, আমি শুনেছি আমার বাবার কাছে। শুধুমাত্র তোর পিছে না, অনেক মেয়ের পিছেই নাকি এভাবে পড়েছিলো। অনেক মেয়ের সর্বনাশও করেছে অসভ্যটা। নারীপিপাসু লোভী একটা মানুষ। এটা জানার পরেই আমি ঠিক করেছি, যেভাবে হোক আমি তোকে বাঁচাবো ওর হাত থেকে, সেই সাথে উচ্ছ্বাস ভাইকেও।”

প্রিয়তা গভীর মমতায় নীলুর দিকে তাকায়। এই মুহুর্তে এই মেয়েটাকে তার নিজের বড় বোন মনে হচ্ছে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে এতোক্ষণ তাকে ভুল বুঝে এতোগুলা খারাপ কথা বলার জন্য।

“নীলু আপা।”
“বল প্রিয়তা।”
“আমাকে ক্ষমা করে দিন আপা, আমি খুব খারাপ কাজ করেছি, আপনাকে অসম্মান করেছি। আমাকে শাস্তি দিন।”
“ধুর পাগল! তোর জায়গায় আমি থাকলে আমিও এটাই করতাম। এগুলো নিয়ে এখন ভাবার সময় না। তোকে এখন অনেক দায়িত্ব নিতে হবে, উচ্ছ্বাস ভাইকে বাঁচাতে হবে।”
প্রিয়তা চোখ মুছে নীলুর দিকে তাকায় উদগ্রীব হয়ে।
“আমি কি পারবো নীলু আপা? কি কর‍তে হবে আমাকে?”
“তোকে আমি একটা ঠিকানা দিবো, সেখানে যাবি। তবে সবকিছু কর‍তে হবে খুব সাবধানে। দরকার হয় ছদ্মবেশে যাবি।”
“কোথায় যাবো ছদ্মবেশে?”
“উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কাছে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”ছদ্মবেশে যাবো কেনো?”
“এখনো আসল অপরাধী শকুনের মতো দৃষ্টি রেখেছে উচ্ছ্বাস ভাইয়ের উপর। তোকে যেতে দেখলে সন্দেহ করবে। আর খালুজান যেনো কোনোভাবেই না যায়। পারলে একাই যাবি তুই।”
“আমি একা যাবো?”
“পারলে তাই যাবি।”
“কিন্তু আমি কি করবো ওখানে যেয়ে?”
“উচ্ছ্বাস ভাইকে বলবি পুলিশের কাছে ধরা দিতে।”
প্রিয়তা আঁৎকে ওঠে নীলুর কথায়।

“ধরা দিতে বলবো?”
“ধরা না দিলে নির্দোষ প্রমাণ হবে কীভাবে? কোর্টে আমি প্রমাণ করবো উনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আসল দোষী কে তা আমি প্রমাণ করবো। আমার কাছে প্রমাণ আছে।”
“কি প্রমাণ?”
“সেসব তোকে না জানলেও চলবে। ভুলে যাস না আমি নিয়াজের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিছু প্রমাণ তো সাথে এনেছি।”
প্রিয়তার কেমন অবিশ্বাস্য লাগতে থাকে সবকিছু। যদি নীলু আপা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ না দেয়? তাহলে তো উচ্ছ্বাস ভাইয়ের ফাঁ’সি হয়ে যাবে। না না এটা কীভাবে সম্ভব?

“শোন প্রিয়তা তুই আমাকে এই মুহুর্তে বিশ্বাস করতে পারছিস না আমি জানি। এমনিও উনি এই ছোট্ট শহরে খুব বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারবে না, ধরা উনাকে পড়তেই হবে। তাছাড়া আসল অপরাধী জানেই উনার ঠিকানা। সে চাইলেই ধরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সে কোনো ঝুঁকি নিতে চায়না। সে চায়না কোনো দোষ নিজের উপর আসুক। তাই সে অপেক্ষা করছে পুলিশ কবে উচ্ছ্বাস ভাইকে নিজে থেকে ধরবে।”
প্রিয়তা কি করবে বুঝতে পারেনা। বাবা কে না জানিয়ে সে কি বড় ভুল করবে? কিন্তু বাবাকে জানালে কি সে তাকে একা যেতে দিবে? ছোট্ট মস্তিষ্ক এতো চাপ আর নিতে পারছে না।

“তাহলে কি ঠিকানাটা দিবো আমি তোকে?”
প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় বললো,”দিন।”
নীলুর মুখে হাসি ফোটে।
“আমি জানতাম তুই পারবি।”

“ভাই।”
উচ্ছ্বাস সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,”বল।”
রাসেল ভয়ে ভয়ে বললো,”আপনি কি আমাকে ভুল বুঝছেন? আমি এমনটা করতে পারি? কখনোই এমন করবো না আমি। আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না? আমি……..”
উচ্ছ্বাস হাত উঁচু করে থামায় তাকে।
“করলে করেছিস, তাতে কি হয়েছে? টাকার কাছে তো আমরা সবাই গোলাম।”
“কিন্তু ভাই আমি তো করিনি এমন কিছু।”
উচ্ছ্বাস রাসেলের কথার উত্তর না দিয়ে গুণগুণ করে গান ধরে। গীটারটা রয়ে গেছে ও বাড়িতে। গীটারকে খুব মনে পড়ছে।

‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ, বায়োস্কোপের নেশা আমার ছাড়েনা।’

হঠাৎ গান থামিয়ে উচ্ছ্বাস বললো,”এই রাসেল।”
“জ্বি ভাই আদেশ করুন।”
“গা কুটকুট করছে। সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে। যা একটা সাবান কিনে আন। নিজের হাতের শেষ গোসল করে নিই, হয়তো এর পরের গোসলটা করতে হবে পরের হাতে। এরপর অনন্ত কালের যাত্রা। তার আগে সাবান দিয়ে ময়লা সব ফেলে দিই শরীরের, কি বলিস?”
রাসেল আঁৎকে উঠে বললো,”এসব কি বলছেন ভাই? আপনি কিছু করেননি, তাহলে কেনো আপনার শাস্তি হবে?”
উচ্ছ্বাস হাই তোলে। তার মুখে দুশ্চিন্তার কোনো রেশ নেই। সে আবারও গুণগুণ করে ওঠে।

‘এইযে দুনিয়া, কিসেরও লাগিয়া। এতো যত্নে বানাইয়েছেন সাঁই।’
খুব সুন্দর একটা টান দেয় উচ্ছ্বাস। রাসেল মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। তার চোখ হঠাৎ ঝাপসা হয়ে ওঠে। শার্টের হাতায় চোখ মোছে সে। এই মানুষটাকে কোনোভাবেই সে শাস্তি পেতে দিবে না। দরকার হয় সব দোষ নিজের কাঁধে নিবে, তাও এই মানুষটার যেনো কোনো শাস্তি না হয়। সবকিছু হারিয়ে এক নন্দিনীকে অসম্ভব ভালোবেসে বসে আছে। সে জীবনটা গুছিয়ে নিক, সে কেনো কিছু না করেও শাস্তি পাবে?

“পুরুষ মানুষের কাঁদতে হয়না রে বেটা, এটা একটা অলিখিত সংবিধান। পুরুষ মানুষের কান্না হলো তার দূর্বলতার প্রতীক। যা কিছু হবে শুধু হাসবি। দুনিয়ার সবচেয়ে বিশ্রী দৃশ্য হলো পুরুষ মানুষের কান্নার দৃশ্য। ফাঁ’সির দড়ি সামনে রেখেও হাসা যায় যদি দিল পরিষ্কার থাকে।”
“এতো কঠিন কথা আমি বুঝিনা ভাই। আমার কাছে এই দুনিয়াটাই সব। এই দুনিয়ার পর আর ফিরে আসবে না এই জীবন। আমি আপনাকে কোনো শাস্তি পেতে দিবো না।”
উচ্ছ্বাস উঠে দাঁড়ায়। অনেকদিন বাইরের বাতাস গায়ে লাগানো হয়না।

“আপনি এখন কই যাচ্ছেন?”
“বাইরে যাই, সাবান কিনে আনি।”
“আপনাকে আমি কোথাও যেতে দিবো না। আমি এনে দিচ্ছি।”
“আমি-ই যাবো। অপরাধী হাসিমুখে ঘুরে বেড়াবে আর আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকবো সেই মানুষ তো আমি নই। আমি কোনো অন্যায় করিনি। আর যদি একান্তই আমাকে লোহার শিকের মধ্যে আটকে রাখে আমি কোনো কষ্ট পাবোনা। চিড়িয়াখানায় দেখিস নি, সিংহ থাকে খাচার মধ্যে, বিড়াল-কুকুর থাকে বাইরে। কারণ মানুষ সিংকে ভয় পায়, বিড়ালকে না।”
“ভাই জীবনটা কোনো উপন্যাস না, বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে অনেক পার্থক্য। দোষ না করেই শাস্তি পেতে চান?”
“এই মুহুর্তে তোর এতো প্যাচাল শোনার চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই। আমি বাইরে যাচ্ছি, কপালে থাকলে দেখা হবে আবার। নাহলে একবারে ওপারে।”
“ভাই…..”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হাসে। কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। হতাশ মুখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে রাসেল। এই মানুষটা পাগল, অবশ্যই পাগল।

“দ্রুত পা চালা না পেখম, তোকে আনাই আমার ভুল হয়েছে। এতো আস্তে কেউ হাঁটে?”
পেখম অসহায় গলায় বললো,”এমন উঁচুনিচু ভাঙা রাস্তায় তাড়াতাড়ি হাঁটা যায় নাকি আপা? তুই আস্তে হাঁট না, পড়ে যাবি তো।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। বরং পায়ের জোর আরেকটু বাড়িয়ে দেয়।

প্রিয়তা একা আসতে পারেনি। নীলুর সব কথা পেখম দরজার বাইরে আড়ি পেতে শুনে ফেলে। নীলু চলে যাওয়ার পরেই পেখম প্রিয়তাকে জানায় সে কোনোভাবেই আপাকে একা যেতে দিবে না। যা হয় হবে, সে সাথে যাবেই। বাধ্য হয়ে প্রিয়তা পেখমকে সাথে নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে বেশ আগে। ভালোই রাত নেমেছে। তাছাড়া রাস্তাটাও বেশ নির্জন। পেখম ভয়ে ভয়ে প্রিয়তার হাত ধরে।

“আপা নীলু আপাকে বিশ্বাস করে বাবাকে না জানিয়ে কি ভুল করলাম? পরে যদি বাবা জানতে পারে খুব রেগে যাবে।”
“কথা বলিস না তো পেখম।”
অস্বস্তি প্রিয়তারও হচ্ছে, কিন্তু সে স্বীকার করছে না। মনোবল হারাতে চায়না সে কোনোভাবেই।
এক ফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। হালকা আলোয় প্রিয়তা আবার কাগজটা বের করে ঠিকানাটা পড়ে। কাছেই চলে এসেছে, আর সামান্যই দূর।

‘বাড়ি নাম্বার ১৯’
“অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছি পেখম, এটা বাড়ি নাম্বার ১৬। আর দুইটা বাড়ির পরেই ১৯ নাম্বার।”
একটা বড় করে শ্বাস ফেলে প্রিয়তা। ভয়ে হৃৎপিণ্ডটা বুকের কাছে এসে ধকধক করতে থাকে তার। একদিকে দু্‌শ্চিন্তা, অন্যদিকে ভয় আর আরেকদিকে প্রিয় মানুষটাকে এতোগুলো দিন পর সামনে থেকে এক নজর দেখা। একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে প্রিয়তার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। পেখমের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা, দরদর করে ঘামছে সে।

“আচ্ছা আপা যেয়ে যদি দেখি উচ্ছ্বাস ভাই ওখানে নেই? নীলু আপা যদি মিথ্যা কথা বলে?”
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে তাকায় পেখমের দিকে। পেখম চুপ করে যায়। প্রিয়তার মোটেই ভালো লাগছে না এখন। মনে হচ্ছে ফিরে চলে যেতে। এতোক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো সে। কিন্তু শেষ সময়ে এসে মনে হচ্ছে আসলেই বড় ভুল করে ফেলেছে সে, বাবা কে জানানোটা আসলেই দরকার ছিলো। আসলেই সবাই ঠিক বলে, তার মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই, গোবরে ঠাসা।
তার আবেগ বলছে, যা প্রিয়তা যা। তোর প্রিয় মানুষটাকে একবার চোখের দেখা দেখে আয় আর কিছু না হলেও। কিন্তু তার বিবেক বলছে না, এখন আবেগ দেখানোর সময় না। সময়টা ভালো না, যা কিছু ঘটে যেতে পারে। আবেগ আর বিবেকের মধ্যে ঝুলে আছে সে।

ঠিক সতেরো নাম্বার বাড়ি পেরিয়ে আঠারো নাম্বারের কাছে আসতেই বাঁধে বড় বিপত্তিটা৷ ল্যাম্পপোস্টের নিচে গোল হয়ে প্রায় দশ থেকে বারোটা কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ছোট থেকেই প্রিয়তার কুকুরে ভীষণ ভয়। তার কলিজার পানি শুকিয়ে আসে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই তেমন।
ছদ্মবেশ বলতে বোরকা পরে এসেছে দুইবোন। এখন যদি এই অবস্থায় সে তারা দৌড় দেয় কুকুর তো ধাওয়া করবেই। কুকুর না করলেও মানুষ তো ধরবেই চোর ভেবে। ঢোক চাপে প্রিয়তা, পেখম ভয়ে ভয়ে তাকায় আপার দিকে।

“আপা চল ফিরে যাই।”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করে। সামনে যাবে নাকি ফিরে যাবে?
“আপা কোনোভাবেই দৌড় দিস না আপা, তোর দোহাই লাগে।”
প্রিয়তা মনে মনে ঠিক করে ফেলে সে দৌড় দিবে না, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আচমকা প্রিয়তা পেখমের হাত চেপে ধরে উন্মাদের মতো দৌড়াতে থাকে সামনের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় পেখম। বুঝতে পারেনা কিছুক্ষণ কি হচ্ছে তার সাথে এটা? ধাতস্থ হতেই টের পায় তার আপা ভোঁ দৌড় দিচ্ছে তার হাত ধরে। পেখম যেনো ভাসছে তুলার মতো।

ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকাতেই পেখমের কলিজার শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে যায়। ঠিক যা ভয় করেছিলো তাই। সবগুলো কুকুর একত্রে ধাওয়া করা শুরু করেছে তাদের। একেকটার দাঁত দেখে মনে হচ্ছে, আজকেই ছিঁড়ে ফেলবে ওদের দু’জনকে। রাগে, ভয়ে পেখম যেনো বোবা হয়ে যায়।

কতক্ষণ এভাবে গেছে পেখম জানেনা। চোখ বন্ধ করে শুধু দৌড়াতেই থাকে দিকবিদিকশুন্য হয়ে। ঠিক তখনই আচমকাই প্রিয়তার হাতে টান পড়ে। লোহার মতো শক্ত হাতের কেউ হাতটা চেপে ধরে তাদের এক গলির মধ্যে ঢুকিয়ে নেয় কুকুরগুলো বুঝে ওঠার আগেই। ডাকতে ডাকতে কুকুরগুলো সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে যায়। ওদের না পেয়ে আবার দল বেঁধে যেখানে শুয়ে ছিলো সেখানে শুয়ে পড়ে।

কিয়ৎক্ষণের জন্য জ্ঞানশুন্য হয়ে যায় প্রিয়তা আর পেখম দুইজনই। কি হতে যাচ্ছিলো এটা? আজ তো এখানেই মৃত্যু হয়ে যেতো, কেউ জানতেও পারতো না। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরাতে থাকে ওদের।

“এই আপনারা কি পাগল নাকি অন্য কিছু? কুকুর দেখে দৌড়াতে হয়না এটা তো একটা ছোট বাচ্চাও জানে। মাথায় কি সাবানের ফেনা ভর্তি হয়ে আছে? কোথা থেকে আমদানি হয়েছে এই নমুনা দু’টো? এই আবার চোরটোর নয় তো?”

ভয়াবহভাবে চমকে প্রিয়তা আর পেখম দুইজনই তাকায় সামনের দিকে। এই গলার আওয়াজ তো অপরিচিত নয়, বরং অনেক দিনের পরিচিত। এই গলার স্বর শোনার জন্য প্রিয়তার উন্মুখ হয়ে থেকেছে কতো দিন, নির্ঘুম কেটেছে কতো রাত। এটা কি সত্যি নাকি বিভ্রম?
হালকা চাঁদের আলো এসে পড়েছে গলির উপর। সেই হালকা আলোয় এক গ্রীক দেবতার মতো রূপবান পুরুষ দৃষ্টিসীমার সামনে আসতেই বরফের মতো জমে যায় দুই বোন। এইতো সেই পুরুষ, সেই তেজী চোখজোড়া যা গভীর কিন্তু জ্বলজ্বলে। সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় জ্বলন্ত সিগারেট এই অসম্ভব গরমেও কালো চাদরে আবৃত বিশাল প্রশস্ত বুকের সামনে স্বস্তি পায় ওরা দুইজনই। এখনো ভীত হরিণীর মতো কেঁপে যাচ্ছে দুই বোন।

“কথা বলছেন না কেনো? কোন বাড়িতে এসেছেন? এভাবে দৌড়াচ্ছিলেন কেনো?”
পেখম বিস্মিত গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাস শান্ত দিঘীর মতো শীতল হয়ে যায়। তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। এবার তার চমকানোর পালা। ঠোঁট থেকে সিগারেট আলগোছে নিচে পড়ে যায়, সে টেরও পায়না। ভালো করে তাকায় সে দুইজনের দিকে।

প্রথমে প্রিয়তা এরপর পেখম আস্তে আস্তে নিকাবটা টেনে তোলে উপরে। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে উচ্ছ্বাস। তার কল্পনাতেই কখনো আসেনি এমন দিন কখনো আসতে পারে। কথার খেই হারিয়ে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ সে। এরপর আচমকাই প্রিয়তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে উচ্ছ্বাস। দুইবোনকে চরম অবাক করে দিয়ে প্রিয়তার হাঁটু জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় সে। প্রথমে আস্তে এরপর ভীষণ জোরে শব্দ করে। সে ভুলে যায় কিছুক্ষণ আগে নিজেই রাসেলকে বলা কথাটা,
‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী দৃশ্য হলো পুরুষ মানুষের কান্নার দৃশ্য।’ সে নিজেও জানে সে কি করছে।

প্রিয়তা স্থাণুর মতো জমে দাঁড়িয়ে থাকে। যেনো সে হাজারটা কাচের টুকরোর উপর দাঁড়িয়ে আছে, একটু নড়লেই কাঁচ বিঁধে যাবে শরীরে, রক্তাক্ত করে দিবে মুহুর্তের মধ্যে।

“মার্জিয়া, মেয়েরা কোথায়?”
উচ্ছ্বাসের যাওয়ার সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে বেরিয়েছে আজ কবির শাহ। অসুস্থ শরীর নিয়ে চষে বেরিয়েছে যেনো। উচ্ছ্বাসের ভীষণ দু:সম্পর্কের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বাকি রাখেনি সে৷ ক্লান্ত শরীরের বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যার পর। এসেই এক গ্লাস পানি খেয়ে বুঁদ হয়ে বসে থাকে চেয়ারের উপর৷ ছেলেটা কি শহর ছেড়েছে? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। অসম্ভব কান্না পাচ্ছে তার।

মার্জিয়া নির্লিপ্ত গলায় বললো,”রুনার বাড়িতে গিয়েছে প্রিয়তা, সামনেই পরীক্ষা। অনেকদিন কলেজে যায়না, তাই খাতা আনতে গেছে। সাথে পেখমও গেলো। এতো রাতে প্রিয়তা একা যেতে পারবে না তাই।”
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। যে প্রিয়তা সকালেও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিলো না, রাত হতেই রুনার বাড়ি ছুটলো খাতা আনতে? রাতেই কেনো? সকালেও তো যেতে পারতো।

“মার্জিয়া টেলিফোনটা আর আমার ডায়রিটা এনে দাও তো।”
“এখন আবার কাকে ফোন করবে? উচ্ছ্বাসের কোনো খবর পেয়েছো?”
মার্জিয়া উদগ্রীব হয়ে তাকায় কবির শাহের দিকে।

“না।”
“তাহলে কাকে ফোন করবে এখন আবার?”
“প্রিয়তার বান্ধবী রুনার বাড়িতে ফোন করবো।”
“সে কি, কেনো?”
“ওরা ঠিকমতো পৌঁছালো কিনা শুনি৷ দরকার হয় আমি ওদের এগিয়ে নিয়ে আসবো।”
মার্জিয়া কিছু না বুঝে টেলিফোন এনে দেয়। মেয়েরা বড় হলে নাকি মায়েরা বন্ধু হয়। কিন্তু এ বাড়িতে উলটো। মেয়েদের সবচেয়ে ভালো চিনে তাদের বাবা। কোন মেয়ে কখন কি করতে পারে তার ভালো করেই জানা আছে।

(চলবে……)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-২৪+২৫

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২৪

“কি হয়েছে পেখম?”
প্রিয়তা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে পেখমের দিকে। উচ্ছ্বাস মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে কোনো খারাপ সংবাদ শুনতে চায়না। এই পরিবারটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে সে।
“আপা, আপা।”
পেখমের কাঁধ চেপে ধরে তাকে ঝাঁকাতে থাকে প্রিয়তা।
“কি হয়েছে বল, চুপ করে আছিস কেনো? বাবা ভালো আছে তো?”
পেখম হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,”আপা, বাবার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। কথা বলতে পারছে না। তোকে খুঁজছে, বারবার ইশারা করে তোকে ডাকছে তোকে।”
শরীরের সব শক্তি যেনো ফুরিয়ে যায় প্রিয়তার। মাটিতে বসে পড়ে সাথে সাথে। পেখম আপাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।

উচ্ছ্বাসের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। পরম মমতায় দুই বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এতো সুন্দর দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায়না। চোখে পানি চলে আসে।
“কান্নাকাটি পরে করলেও হবে। এখন যাও দুইজন, বাবার কাছে যাও।”
পেখম চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।
“উচ্ছ্বাস ভাই।”
“বলো পেখম।”
“আজ যা হয়েছে আপনার জন্য হয়েছে। আমরা আপনাকে যতোই ধন্যবাদ দিই সেইটা কম হয়ে যাবে। আপনি ফেরেশতার মতো এসে আজ আমাদের এই বিপদ থেকে বাঁচালেন।”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা এখনো ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
বাঁকা ঠোঁটে হেসে উচ্ছ্বাস বললো,”এসব কথা বলতে নেই পেখম। আমরা মানুষ, ফেরেশতা নই। আমাদের ক্ষমতা সামান্য, অতি সামান্য। তবে আমরা চাইলেই আমাদের এই সামান্য ক্ষমতাটা কাজে লাগিয়ে অসামান্য কাজ করতে পারি।”
প্রিয়তা ঘাড় ঘুরিয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। উচ্ছ্বাস দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে উদাসভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে মাত্রই। আকাশে দুই’একটা তারা জ্বলে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। উচ্ছ্বাস হয়তো সেই তারাদের মধ্যে নিজের বাবা মা কে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

“যাও পেখম, তোমাদের বাবা তোমাদের অপেক্ষায় বসে আছে।”
“আপনি যাবেন না উচ্ছ্বাস ভাই?”
“কেউ আমার অপেক্ষায় নেই পেখম। আমি আমার এই নষ্ট জীবনে আর বাঁধা পড়তে চাইনা, তোমরা যাও।”
প্রিয়তা উঠে দাঁড়ায়। ভ্রু কুঁচকে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে।
পেখম আস্তে আস্তে বললো,”আমাদের পরিবারটাকে নিজের ভাবতে পারেননা উচ্ছ্বাস ভাই? মা তার ভুল আজ বুঝতে পেরেছে, সে তার ব্যবহারের জন্য কষ্টও পেয়েছে। খুব ক্ষতি হয় আমাদের আপন ভাবতে?”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হাসে।
“তোমরা ভালো থেকো, আবার দেখা হবে।”
পেখম প্রিয়তার বাহু চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,”তাকিয়ে দেখছিস কি আপা? উচ্ছ্বাস ভাই চলে যাচ্ছে, আটকাবি না তাকে?”
প্রিয়তা ম্লান হেসে বললো,”যে চলে যেতে চায় তাকে কি আটকানো যায়?”
উচ্ছ্বাস পিছন ঘুরে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে হাসে। প্রিয়তার পুরো সত্ত্বা কেঁপে ওঠে। সেই হাসি, যে হাসির জন্য সে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। কেনো আটকাতে পারছে না সে মানুষটাকে?

“আটকানোর ক্ষমতা আমি সবাইকে দিই নি, কিন্তু যাকে দিয়েছি সে চাইলেই আমাকে আটকাতে পারে। কারণ তার জন্য আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে।”
হতভম্ব দুই বোনকে পিছনে রেখে উচ্ছ্বাস চলে যায়। তার অবয়বটা ঝাপসা হয়ে ওঠে প্রিয়তার চোখের পানিতে।

বাবার দুই পাশে দাঁড়িয়ে নি:শব্দে চোখের পানি ফেলছে দুই বোন। পায়ের কাছে নির্লিপ্তভাবে বসে আছে মার্জিয়া বেগম। কবির শাহকে আরো কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। ক্ষত শোকাতে অনেকটা সময় লাগবে। এখন তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। যন্ত্রণাটা তীব্র হচ্ছিলো সময়ের সাথে।

“মা।”
পেখমের ডাকে মার্জিয়া বেগম চোখ তুলে তাকায়।
“খালাকে তো খবর পাঠালে, একবারও এলো না। আমাদের খোঁজটুকুও নিলো না। কেমন আপন মানুষ আমাদের? অথচ এই মানুষটার জন্য তুমি কম অশান্তি করোনি বাবার সাথে। ছোট থেকে দেখে আসছি, খালা যেদিন বাড়িতে আসতো তুমি বাবার সাথে সেদিনই কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করছো। এখন বুঝলে তো মা, রক্তের সম্পর্ক থাকলেই কেউ আপন হয়না?”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।

প্রিয়তা পেখমের হাত ধরে টেনে বললো,”হচ্ছেটা কি পেখম? এখন কি এসব বলার সময়? মায়ের মনের অবস্থাটা বুঝবি না?”
“কি বুঝবো আপা? ওই ভদ্রমহিলা আমাদ্রর জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিয়েছিলো। আমাদের মায়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে কম অশান্তি করেনি আমাদের সংসারে। অথচ আজ দেখ, আমাদের এমন ভয়ংকর বিপদের সময় সে অনুপস্থিত। ওই মহিলার জন্যই তো মা উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে দিনের পর দিন, তার উষ্কানিতেই। চলে গেলো মানুষটা আমাদের বাড়ি ছেড়ে। অথচ আজ উনি না থাকলে আমাদের কি অবস্থা হতো একবার ভেবেছিস? থানা-পুলিশ কিছুই বুঝতাম না আমরা। মানুষটা আজীবন আমাদের কাছে সুপারম্যান হয়ে থাকবে আজকের দিনটার জন্য।”
প্রিয়তা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

কেবিন থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় প্রিয়তা। আকাশে যেনো হাজারটা তারা উঠেছে আজ। প্রিয়তা খোঁপা থেকে চুলগুলো আলগা করে দেয়। মাথা চেপে ছিলো যেনো খোঁপাটা। একটু শান্তি লাগছে চুল খুলে দেওয়ায়।

“আপনার নাম প্রিয়তা?”
কারো ডাকে চমকে উঠে তাকায় প্রিয়তা। বিরক্তমুখে একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
“জ্বি আমি প্রিয়তা।”
“কোথায় ছিলেন বলুন তো এতোক্ষণ? এটা নিয়ে কতোক্ষণ অপেক্ষা করছি।”
নার্সটা একটা ব্যাগ তুলে ধরে।
“ঠিক বুঝলাম না। এটা কি?”
নার্সটা দ্বিগুণ বিরক্ত হয়ে বললো,”আপনাদের সাথে যে কমবয়সী ছেলেটা এসেছিলো সে এটা আপনাকে দিতে বলেছে।”
ব্যাগটা প্রিয়তার হাতে দিয়েই বিদায় হয় সে।
হতবাক হয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তা। উচ্ছ্বাস ভাই কি দিয়েছে তার জন্য?

তড়িঘড়ি করে ব্যাগটা খুলতেই ভীষণ অবাক হয়ে যায় প্রিয়তা। ব্যাগভর্তি খাবার। এতোসব কাণ্ডের মধ্যে ওর খেয়ালই নেই সারাদিনে তেমন খাওয়া হয়নি ওদের কারোই। বাবার এই খবর শুনে ক্ষুধার বোধটাও ছিলো না কারো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খাবারটা ভীষণ দরকার ছিলো। শরীরে একবিন্দু শক্তি নেই কারোই।

খাবারের সাথে ছোট্ট একটা সাদা কাগজ দেখে হাতে তুলে নেয় প্রিয়তা ওটা।

‘নন্দিনী,
এ এযাবৎকাল আমি কাউকে আমার সাথে উদ্ধত আচরণ করার সাহস দিইনি। কেউ আমার উপর রাগ দেখাক, আমি পছন্দ করিনি। এই অধিকার ছিলো শুধুমাত্র আমার মায়ের। মায়ের পরে এই রগচটা ছেলেটা কাউকেই সেই অধিকার দেয়নি। তবে আজ তুমি যখন আমার সাথে রাগ দেখিয়েছো, বিশ্বাস করো আমি তোমাকে আটকাতে পারিনি। খুব ইচ্ছা করছিলো, কেউ আমার উপর রাগ দেখাক, অভিমান করুক। আমার অবচেতন মনটা যেনো ভেবেই নিয়েছে তোমার অধিকার আছে আমার উপর রাগ দেখানোর। জানিনা কেনো কিছু বলতে পারলাম না আমি। তবে সেদিন আমি ওদের মেরেছিলাম তোমার কথা ভেবে নয়। আমি শুনেছিলাম কলেজে থাকতে আমার মা কে কিছু বখাটে উত্যক্ত করায় তোমার বাবা তাদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলো। মা আমাকে ছোট থেকে শিখিয়েছে, মেয়েদের কেউ লাঞ্চিত করলে সাথে সাথে প্রতিবাদ করতে। আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। তবে তুমি নিশ্চিত থাকো, আজকের পর ওদের সাহস হবে না তোমাদের পরিবারের ক্ষতি করা দূরে থাক, তোমাদের দিকে চোখে তুলে তাকানোর। তুমি বরং অভিমানটুকু জমা করে রেখে দাও, আমার তৃষ্ণার্ত বুকটা কারো একরাশ অভিমান ভাঙানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।

খাবারের উপর রাগ করোনা। আমি জানি তুমি না খেয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারোনা। এখন তোমার সুস্থ থাকা যে খুব দরকার। তোমার বাবা মায়ের পাশে তোমাকে থাকতে হবে। তাই ছোট্ট অনুরোধ, খেয়ে নিও।

ইতি,
সম্বোধনের জায়গাটা ফাঁকা থাক। তুমি ইচ্ছামতো কিছু লিখে দিও এখানে।

চিঠিটা ছয়বার পড়লো প্রিয়তা। পড়তে পড়তে মুখস্ত হয়ে গেলো। তবুও যেনো প্রতিবার পড়ার সময় নতুন লাগছে তার। নিজের ব্যবহারের জন্য নিজের উপরই চরম ঘৃণা হচ্ছে তার। বাবার এই অবস্থায় মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। যতো রাগ সব ওই মানুষটার উপর দেখিয়েছে। নিজের উপর রাগে নিজের চুলগুলো চেপে ধরে সে।
চিঠিটা বুকের উপর রাখতেই কাঁধে কারো স্পর্শে চমকে উঠে তাকায় প্রিয়তা।

মার্জিয়া বেগম শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে।
“মা তুমি এখানে?”
প্রিয়তা চিঠিটা হাতের মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে।

“এখানে একা দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
“ও কিছু নয় মা। তুমি খুব ক্লান্ত মা, খাবারটুকু খেয়ে নাও।”
মার্জিয়া বেগম খাবারের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বললো,”এতো খাবার কে এনেছে?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই দিয়েছে মা।”
মার্জিয়া বেগম কথা বলেনা। কিছুদূর এগিয়ে যায়। বেশ কিছু সময় নিস্তব্ধতায় কাটে সময়।

“ছেলেটা কি আমাকে ক্ষমা করতে পারেনি?”
“এমন কেনো বলছো মা?”
“কেনো চলে গেলো এভাবে? ওর ঋণটুকু কীভাবে শোধ করবো আমি?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

“তুই কি জানিস ও কোথায় আছে?”
প্রিয়তা ঝট করে চোখ তুলে বললো,”আমি কীভাবে জানবো মা?”
মার্জিয়া বেগম স্মিত হেসে বললো,”আমি আসলে নীলিমাকে হিংসা করতাম। এটাই সত্যি। উচ্ছ্বাসের মধ্যে আমি সবসময় ওর মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারতাম। আমি একটা মা হয়ে কীভাবে ওকে ওর জীবনের একটা কঠিন সময়ে ওর সাথে এতো দুর্ব্যবহার করতে পারলাম? আমি কোনোদিন ক্ষমা পাবো না এই অন্যায়ের।”
প্রিয়তা মায়ের কাঁধে হাত রাখে।
“মা সব ভুলে যাও। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব ভেবে নিজের মনকে পেরেশানিতে ফেলোনা।”
মার্জিয়া বেগম প্রিয়তার হাতটা চেপে ধরে।
“প্রিয়তা, ও আবার আসবে তো? ওকে আমি এবার অনেক ভালোবাসবো। একদম ওর মা যেভাবে ওকে ভালোবাসতো, ঠিক তেমন।”
প্রিয়তা মায়ের বুকে মাথা রাখে। চোখ বন্ধ করতেই উচ্ছ্বাসের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

“আসবে মা, উনাকে আসতেই হবে।” প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো।

লোহার চেয়ারের উপর শান্তভাবে বসে আছে উচ্ছ্বাস। তার সামনে তিনটা যুবককে বেঁধে রাখা হয়েছে। তারা কাঁপছে ভয়ে।
“ভাই আমাদের অপরাধ কি?”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হাসে।
“অপরাধ? তোরা জানিস না কি তোদের অপরাধ?”
ছেলেগুলো একে অন্যের দিকে তাকায়।
“কবির শাহকে ছুরির আঘাত করেছিস কে?”
ছেলেগুলো সাথে সাথে বাঁধা অবস্থায় উচ্ছ্বাসের পায়ের কাছে এসে পড়ে। উচ্ছ্বাস পা ছাড়িয়ে নেয়।
“ভুল হয়ে গেছে বড় ভাই। আর কোনোদিন হবেনা। এখন থেকে উনারে দেখলে সালাম দিবো আমরা।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু নাচিয়ে বললো,”তাই নাকি? কীভাবে বিশ্বাস করবো আমি এই কথা?”
“বিশ্বাস করুন বড় ভাই আমাদের। আর এই ভুল হবে না।”
উচ্ছ্বাস ধীর পায়ে হেঁটে যায় একজনের কাছে। হাঁটু গেড়ে তাদের সামনে বসে।
হঠাৎ একজনের চুলগুলো চেপে ধরে তার চোখে চোখ রাখে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে ছেলেটা।
“গতবার তোদের সাবধান করে দিয়েছিলাম প্রিয়তার দিকে চোখ তুলে তাকাবি না। আজ তোরা ওর বাবার গায়ে হাত তুলেছিস। তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিস। তোদের শত্রুতা আমার সাথে, উনাকে কেনো ছুরি আঘাত করলি?”
“মাফ করে দিন এবারের মতো।”
চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে দূরে ফেলে দেয় ছেলেটাকে উচ্ছ্বাস।
“তোদের মেরে হাত নষ্ট করবো না আমি। তোদের শায়েস্তা করার জন্য আমার ছোট ভাইগুলোই যথেষ্ট।”

“এই রাসেল।”
রাসেল ছুটে আসে উচ্ছ্বাসের কাছে।
“জ্বি ভাই।”
“বলে দেওয়া লাগবে কি করতে হবে?”
রাসেল দাঁত বের করে হেসে বললো,”না ভাই।”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে চলে যায়। রাসেল হাসতে হাসতে তাকায় ছেলেগুলোর দিকে।

সকাল হতে না হতেই মর্জিনা বেগম এসে হাজির হাসপাতালে। এসেই চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করেছে। মার্জিয়া বেগম একটাবারও তাকায়নি বোনের দিকে। প্রিয়তা আর পেখম দুইজন বাবার পাশে বসে আছে।
কবির শাহ আস্তে আস্তে বললো,”উনি কাঁদছেন কেনো এভাবে?”
পেখম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”নাটক করছে বাবা।”
কবির শাহের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও চোখ কটমট করে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”এগুলো কেমন ধরণের কথা? এসব শিক্ষা দিয়েছি তোমাদের আমি?”
পেখম মুখ ভেংচি দেয়।

“প্রিয়তা।
“জ্বি বাবা।”
“উনাকে কাঁদতে নিষেধ কর এভাবে। হাসপাতালে আরো রোগী আছে। উনার চিৎকারে তারা অস্বস্তি বোধ করবে।”

“কবির, তোমার এ কি অবস্থা। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি কাল। এ কি হয়ে গেলো?”
কবির শাহ হালকা হেসে বললো,”বেঁচে আছি আপা। হয়তো আপনি আশা করেননি এটা।”
মর্জিনা বেগম কান্না থামিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,”কি বললে তুমি?”
“তেমন কিছু না আপা। কান্নাকাটি করে আর কি হবে, শান্ত হোন। আমি ভালো আছি।”
প্রিয়তা এতোক্ষণ চুপ করে বসে ছিলো।
খালার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বললো,”খালা, আপনি সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাহলে গতকাল কেনো খোঁজ নিলেননা আমাদের? আমরা কীভাবে আছি, কোন অবস্থায় আছি। একটাবার জানার প্রয়োজন মনে করেননি।”
মর্জিনা বেগম অপ্রস্তুত ভাবে হাসার চেষ্টা করে।
মার্জিয়া বেগম হঠাৎ বোনের সামনে এসে দাঁড়ায়।
“কেনো এসেছো আপা?”
“কি বললি মার্জিয়া?”
“বলছি কেনো এসেছো? মানুষটা মারা গেছে কিনা এটা দেখতে এসেছো?”
উঠে দাঁড়ায় মর্জিনা বেগম
“এসব কি বলছিস তুই মার্জিয়া? মাথা ঠিক আছে তোর?”
আচমকা চিৎকার করে ওঠে মার্জিয়া বেগম।
“তুমি আমার বোন নও আপা, হতেই পারোনা। আমি সারাটা জীবন বোকার স্বর্গে বাস করে গেলাম। তোমার শেখানো বুলি আওড়িয়ে মানুষটার সাথে ঝগড়া করে গেলাম। সংসারে অশান্তি করে গেলাম। অথচ আজ আমার এই দু:সময়ে তোমাকে পাশে পেলাম না। এই তোমার ভালোবাসা আপা? তুমি এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে, এক্ষুনি।”
কথা শেষ করতে পারেনা মার্জিয়া। তার আগেই মাথাটা ঘুরে ওঠে তার। বসে পড়তেই কবির শাহ এক হাত দিয়ে ধরে বসে তাকে।

পেখম মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”খালা আপনি চলে যান, আর দাঁড়াবেন না এখানে। মা অসুস্থ হয়ে পড়ুক তা নিশ্চয়ই আপনি চাননা।”
রাগে, অপমানে মুখটা লাল হয়ে ওঠে মর্জিনা বেগমের। কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায় সে। হনহন করে হেঁটে কেবিন থেকে বের হয়ে যায় মর্জিনা বেগম।

কবির শাহ ঈষৎ হেসে দুই মেয়ের দিকে তাকায়।
“হ্যা রে আমার কন্যারা, তোর মায়ের এমন রণমুর্তি আগে কখনো দেখেছিস তোরা?”
প্রিয়তা আর পেখম দুইজনই হেসে মাথা নাড়ে।
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,”শোন তোরা, প্রিয় মানুষের দু:সময়ে মানুষের মধ্যে অদ্ভুত এক শক্তি ভর করে। খুব সাধারণ, শান্ত মানুষটাও অশান্ত হয়ে ওঠে। তোরাও এক সময় বুঝবি।”
প্রিয়তা আনমনা হয়ে যায়। উচ্ছ্বাসের মুখটা চোখের সামনে ঘুরপাক খেতে থাকে বারবার। তাকে একটাবার দেখার তৃষ্ণা পাগল করে দিচ্ছে তাকে।

তখনই কবির শাহের মুষ্টির ভিতর পরম মমতায় হাতটা দিয়ে ভরসার আশ্রয় খুঁজছে মার্জিয়া বেগম। দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে তার।

(চলবে…..)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২৫ (নতুন পর্ব)

কবির শাহকে বাড়িতে আনা হয়েছে আটদিন হাসপাতালে থাকার পর। এই আটদিনে পৃথিবীটাকে নতুন করে চিনেছে মার্জিয়া বেগম, প্রিয়তা আর পেখম। মার্জিয়া বেগম কোনোদিন ভাবতে পারেনি স্বামীর অবর্তমানে দুনিয়াটা এতো কঠিন হবে। এই ক’দিন সে দিনরাত এক করে স্বামীর সেবা করেছে, বেডের পাশেই মেঝেতে বিছানা করে ঘুমিয়েছে, প্রিয়তা জোর করে কিছু খাওয়ালে খেয়েছে নাহলে না। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কবির শাহ দেখেছে মার্জিয়া জায়নামাজে বসে কাঁদছে। সে একনাগাড়ে স্বামীর সুস্থতা চেয়েছে আর এ পর্যন্ত বাইরের মানুষের কুমন্ত্রণায় মানুষটার উপর যে মানসিক অত্যা’চার করেছে তার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। সে এই কয়দিনেই বুঝতে পেরেছে একটা বয়সে এসে মেয়েদের কাছে স্বামী-সন্তানের চেয়ে আপন আর কেউ হতে পারেনা, কেউ-ই না।

“মার্জিয়া।”
কবির শাহের ডাকে মার্জিয়া ছুটে আসে তার কাছে। এখন তার সর্বক্ষণ কাটে স্বামীর কোথায় অসুবিধা হচ্ছে সেসব চিন্তা করে। এতোদিন পর বাড়িতে এসে দেখে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে, সেই সাথে কবির শাহের জন্য আলাদা রান্নাবান্না। মার্জিয়া বেগম চোখে অন্ধকার দেখে। প্রিয়তা আর পেখম অবশ্য আজ কলেজ বা স্কুলে যায়নি। আজ সারাদিন তারা মা’কে সাহায্য করবে ঠিক করেছে।

“কি হয়েছে? তোমার কিছু লাগবে?”
কবির শাহ মুচকি হেসে ঘাড় নাড়ে।
“তাহলে ডাকলে যে? শরীর খারাপ লাগছে আবার? ডাক্তারকে ফোন করবো একটা?”
“কিছুই হয়নি মার্জিয়া, তুমি আমার কাছে এসে একটু বসবে?”
মার্জিয়া বেগম ঈষৎ কেঁপে ওঠে। ধীর পায়ে হেঁটে কবির শাহের মাথার কাছে বসে।
“তোমার হাতটা একটু ধরি মার্জিয়া?”
মার্জিয়া অবাক হয়ে কবির শাহের দিকে তাকায়, কিছু বলেনা। কবির শাহ পরম যত্নে স্ত্রীর হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয়। হাত বুলিয়ে দেয় হাতে।

“আমি কোনোদিন চাইনি এই নরম হাতটা জীবনের যাঁতাকলে পিষে শক্ত হয়ে যাক। আমার টাকা কম থাকতে পারে, হয়তো অনেকগুলো কাজের লোক রেখে দিতে পারিনি তোমার সাহায্যের জন্য কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি স্কুল থেকে ফিরেই তোমার হাতে হাতে কিছুটা কাজ আগায় দেওয়ায় জন্য যাতে তোমার কষ্ট না হয়। জানিনা কতোটুকু পেরেছি, তবুও আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। কিন্তু আমি জানি তুমি আমার সাথে সুখী হতে পারোনি। তোমাকে দামী শাড়ি বা গহনায় মুড়ে দিতে পারিনি, দামী গাড়ি উপহার দিতে পারিনি বিবাহবার্ষিকীতে। আমি স্বামী হিসেবে ব্যর্থ মার্জিয়া। তোমার সব অভিযোগ মাথা পেতে নিয়ে আমি দুনিয়া ছাড়তে চাই, আমার এতোটুকুও আফসোস নেই।”

কবির শাহের কথায় চিৎকার করে ওঠে মার্জিয়া। তার খুব অসহায় লাগতে থাকে।
“এসব কি বলছো তুমি? কোথায় খারাপ লাগছে তোমার আমার বলো? প্রিয়তা আর পেখমকে ডাকি?”
“শরীরে তো কোথাও খারাপ লাগছে না মার্জিয়া, খারাপ লাগছে মনে। পারবে ডাক্তার এই রোগ সারাতে?”
“মনে খারাপ লাগার কারণ কি?”
“এই কয়দিনে আমি এক অন্য মার্জিয়াকে আবিষ্কার করেছি। এই মার্জিয়ার চোখে আমার জন্য একরাশ ভালোবাসা দেখেছি, দেখেছি আমার জন্য নির্ঘুম রাত কাটিয়ে চোখের নিচে হওয়া কালো দাগ। তুমি রাত জেগে জায়নামাজে বসে আমার জন্য কেঁদেছো, তুমি জানতে পারোনি আমিও তোমার কান্না দেখে কেঁদেছি। এতোসবের মধ্যে আমার মনে হয়েছে আমি কি এই নিখাঁদ ভালোবাসার যোগ্য? আমার মতো অযোগ্য একটা লোক, যে তার স্ত্রীকে কখনো ভালো রাখতেই পারেনি তার জন্য তার স্ত্রী এতো কিছু করবে? আমি নিজের কাছে ছোট হয়েছি মার্জিয়া।”
মার্জিয়া বেগম আচমকা স্বামীর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে। কবির শাহ আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

“তুমি এসব কেনো বলছো? আমার কোনো ব্যবহারে কি তুমি কষ্ট পেয়েছো? পেয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দাও কিংবা শাস্তি দাও। কিন্তু এভাবে কথা বলোনা দয়া করে। আমি সহ্য করতে পারছি না।”
“মার্জিয়া বিশ্বাস করো নিলীমা আমার জীবনে নেহাৎ একটা আবেগের নাম ছিলো, আর কিছু না। কিন্তু ভালোবাসার নারী বলতে যা বোঝায় তুমি তাই। যেদিন তোমাকে বিয়ে করে এ বাড়িতে নিয়ে আসি সেদিন থেকে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে তোমাকেই ভালোবেসেছি। তুমি আমার কাছে সেই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটাই আছো যেমনটা বিশ বছর আগে ছিলে।”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না, এখনো ফোঁপাতে থাকে।
“উচ্ছ্বাসকে এ বাড়িতে আনার পিছনে কখনোই ওর মায়ের প্রতি আমার পুরোনো আবেগটা কারণ ছিলোনা। আর তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো।”
মার্জিয়া বেগম মাথা উঁচু করে বললো,”উচ্ছ্বাস আর ফিরে আসবে না আমাদের কাছে?”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”আমি জানিনা মার্জিয়া। যে ভয়ে ওকে এ বাড়িতে এনেছিলাম সম্ভবত তাই সত্য হবে।”
“কি ভয়?”
“তোমাদের জানিয়েছিলাম ওর বাবা মা একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কারণ আমি জানতাম আসল ঘটনা বললে তুমি কোনোভাবেই ওকে বাড়িতে থাকতে দিতে না।”
“কি সেই ঘটনা?”
কবির শাহ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, মার্জিয়া অধীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

“ওর বাবা মা কোনো দুর্ঘটনায় মারা যায়নি, ওদেরকে মেরে ফেলা হয়েছে।”
মার্জিয়া বেগম আঁৎকে ওঠে।
“এসব কি বলছো?”
“ওর তিন চাচা মিলে ওর বাবার অগাধ সম্পত্তির জন্য ওর বাবা মা দুইজনকেই খু’ন করেছে। উচ্ছ্বাসকেও মারতো কিন্তু ততক্ষণে প্রতিবেশীরা কিছু আন্দাজ করতে পেরে এগিয়ে আসায় ওরা পালিয়ে যায়। উচ্ছ্বাস নিজে চোখে ওর বাবা মা’কে খু’ন হতে দেখেছে।”
কবির শাহ থামার পর সারাঘরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। মার্জিয়া বেগম স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। এমন কিছু শুনতে হতে পারে কখনো সে ভাবতেও পারেনি। একটা বাবা-মা হারা ছেলে যে কিনা নিজের চোখে বাবা -মা’কে খু’ন হতে দেখেছে তার সাথে সে কি নোংরা ব্যবহারটা করেছে দিনের পর দিন। আর সেই ছেলেই কিনা তাদের বিপদে সবার আগে ছুটে এসেছে, যেখানে নিজের লোকেরাই আসেনি। লজ্জায়, কষ্টে মার্জিয়ার ভিতরটা ভেঙেচুরে যায়। একটা মা হয়ে কীভাবে পারলো সে এই কাজটা করতে?

“কি ভাবছো মার্জিয়া?”
মার্জিয়া বেগম কথা বলতে পারেনা। ছেলেটার জন্য একরাশ মায়া অনুভব করে সে। যদি আরেকটু ভালো ব্যবহার করতো, যদি পছন্দের খাবার গুলো নিজে পাশে বসিয়ে খাওয়াতে পারতো, আরেকটু ভালো ব্যবহার করলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? এটা কি করলো সে? কীভাবে এই ভুলের মাশুল দিবে সে?
“কষ্ট পেয়ো না মার্জিয়া, তোমার দিক থেকে তুমি ঠিক। আমি তোমাকে কোনোভাবেই দোষ দিই না।”
“কিন্তু আমি যে পাপ করেছি প্রিয়তার বাবা, অনেক বড় পাপ। আচ্ছা ও কি আর ফিরে আসবে কখনো আমাদের কাছে? আমি দরকার হয় ওর কাছে ক্ষমা চাইবো অনেক করে? ও ক্ষমা করবে না আমাকে?”
কবির শাহ শূণ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি জানিনা ও কি করবে, আদৌ আর ফিরে আসবে কিনা।”
“এমন বলছো কেনো?”
“ওর চোখে আমি প্রতিশোধের আগুন দেখেছি মার্জিয়া। ওর র’ক্ত গরম হয়ে আছে। প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত সেই র’ক্ত ঠান্ডা হবে না।”
মার্জিয়া ভয়ার্ত গলায় বললো,”ও কি করতে চাচ্ছে?”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”খু’নের বদলে খু’ন।”
ভয়াবহভাবে চমকে মার্জিয়া তাকায় কবির শাহের দিকে, কবির শাহ নির্লিপ্ত।
“ও সত্যি এমন কাজ করবে? কখনো না, কোনোদিন না।”
“আমার এখানে থাকলে হয়তো আমি করতে দিতাম না এমনটা, যেভাবে হোক ওকে আটকাতাম। কিন্তু এখন তো আমি জানিই না ও কোথায় আছে, কীভাবে আছে। এটা যদি হয় আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না মার্জিয়া। ওর বাবা মা আমার জন্য অনেক করেছে, অনেক। কিন্তু আমি পারলাম না ওদের কলিজার টুকরো, একমাত্র সন্তানকে আগলে রাখতে। আমি ব্যর্থ মার্জিয়া।”
কবির শাহ চোখ থেকে আসা দুই ফোঁটা পানি তৎক্ষনাৎ মুছে ফেলে।
মার্জিয়া বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”আমার বিশ্বাস ও এমন কিছু করবে না।”
“এতোটা নিশ্চিত কীভাবে বলতে পারছো?”
“কারণ ওর চোখে আমি ভালোবাসা দেখেছি। যে পুরুষ মন থেকে কাউকে অসম্ভব ভালোবাসে, সে বাঁচতে চায়। কারণ ভালোবাসা নিয়ে বাঁচার মতো সুখ পৃথিবীতে আর দুইটা হয়না।”
কবির শাহ হতভম্ব হয়ে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“আমি মা হয়ে বুঝতে পেরেছি ও প্রিয়তাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছে। এই ভালোবাসার টান ও ছিঁড়তে পারবে না। ও কোনো অন্যায় কাজে জড়াবে না। কারণ ওকে ফিরতে হবে, প্রিয়তার কাছে ওকে ফিরতেই হবে।”
“তুমি সত্যি বলছো মার্জিয়া? ও ফিরে আসলে তুমি ওকে মেনে নিবে?”
মার্জিয়া স্মিত হাসে।
“প্রকৃতি যা চায় তার বাইরে যাওয়ার সাধ্যি আমার কোথায় মাষ্টারমশাই? আমি যে অতি ক্ষুদ্র একজন মানুষ ব্যতীত আর কিছুই নয় প্রকৃতির কাছে।”
কবির শাহ স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে। তার নিজেরও এখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে মার্জিয়ার কথাই সত্য হবে, যদি তাই হয় তারচেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছু হবে তার কাছে।

দরজায় অনেকক্ষণ ধরে করাঘাতের আওয়াজ শুনে প্রিয়তা দরজা খুলে দেয়। আর তারপরই বেশ অবাক হয়ে যায় সে। দরজার বাইরে তার বড় খালা দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হওয়ার কারণ মর্জিনা বেগম এসেছে সেইটা নয়, তার চোখমুখ অসম্ভব ফোলা। চোখ লাল হয়ে আছে, মনে হচ্ছে অনেক কেঁদেছে সারারাত জেগে। প্রসাধনীর ছিঁটেফোঁটাও নেই মুখে। তার বদলে যেনো একরাশ কষ্ট আর যন্ত্রণায় ছেয়ে আছে মুখটা। বড় খালার এমন রূপের সাথে ও পরিচিত নয়। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখেছে ভীষণ হাসিখুশি, প্রফুল্ল একটা মুখ তার। সবসময় চওড়া প্রসাধনীতে আবৃত সেই মুখ। হঠাৎ তার কি এমন হলো?

“খালা।”
প্রিয়তাকে দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে মর্জিনা বেগম।
“ভিতরে আসতে বলবি না রে প্রিয়তা?”
প্রিয়তা ইতস্তত করে বললো,”কেনো বলবো না? আসুন না খালা। বাবাকে আজকেই বাড়িতে আনা হয়েছে।”
মর্জিনা বেগম কাঁপা কাঁপা পায়ে ঘরের ভিতর ঢোকে।

“কে এসেছে রে প্রিয়তা?”
মার্জিয়া বেগম কবির শাহের পাশেই বসে ছিলো। আচমকাই ঘরের বাইরে নিজের বড় বোনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে যায়। এই মানুষটাকে সে আর একবিন্দুও সহ্য করতে পারছে না।
মার্জিয়া বোনের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,”আপা তুমি এখানে? তুমি কেনো এসেছো এখানে? আবার নতুন শাড়ি না গহনা কিনলে? বিশ্বাস করো আপা তোমার শাড়ি, গহনা দেখার একটুও ইচ্ছা নেই আমার।”
কবির শাহ কিছুটা বিরক্ত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,”এসব কি হচ্ছে মার্জিয়া?”
মার্জিয়া চিৎকার করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় কবির শাহ।

“আপা আপনি বসুন না।”
মর্জিনা বেগমের কান্নাজড়িত চেহারা চোখ এড়ায় না দুইজনের কারোই। কিন্তু নিজে থেকে কেউ কিছু বলেনা।
মর্জিনা বেগম বোনের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বললো,”আমার উপর তোর অনেক রাগ তাইনা রে মার্জিয়া?”
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হঠাৎ এভাবে কেনো কথা বলছে সে? এমনভাবে তো কোনো সময় কথা বলে না তার বোন।

“আপা আমার না এখন সত্যি এতো অতিরিক্ত সময় নেই বাইরের কারো উপর রাগ করার। এখন আমি অনেক ব্যস্ত। সারাটাজীবন তোমার কথা শুনে এই সংসারটা আপন করতে পারিনি, এই মানুষটাকে ভুল বুঝেছি। এখন সেই ভুল সংশোধনের সময় এসেছে। আমি ঠিক করেছি যে কয়টা দিন বেঁচে থাকবো শুধু এই সংসারে মন দিবো, আগলে রাখবো দুই হাতে। এখন আমার অনেক দায়িত্ব আপা। কারো উপর রাগ হওয়ার কোনো সময়ই নেই আমার, বিশ্বাস করো।”
কবির শাহ হৃষ্টচিত্তে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এমন একটা দিনের অপেক্ষাতেই সে ছিলো এতো বছর। আজ নিজেকে স্বার্থক মনে হচ্ছে।

হঠাৎ দুইজনকে চরম অবাক করে দিয়ে মর্জিনা বেগম শব্দ করে কেঁদে দেয়। প্রথমে আস্তে আস্তে হলেও আচমকা তা হাউমাউ করে কান্নায় রূপ নেয়। হতভম্ব হয়ে যায় কবির শাহ আর মার্জিয়া।

“মার্জিয়া তুমি বসে আছো কেনো এভাবে? দেখো আপার কি হলো? আপা এভাবে কাঁদছে কেনো?”
মার্জিয়া বেগম অপ্রস্তুত হয়। তবে কি একটু বেশি কঠিন আচরণ করে ফেললো বোনের সাথে? এটাই কি স্বাভাবিক ছিলোনা সে যা করেছে? কিন্তু এটুকু কারণে আপা এভাবে কাঁদবে? সে তো এভাবে কখনো কাঁদে না।
“মার্জিয়া আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি ভুল করেছি, পাপ করেছি। তোরা আমাকে ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। কবির আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমার দুই মেয়েকে ডাকো, তাদের কাছেও ক্ষমা চাইবো আমি।”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে মার্জিয়া বেগম ছুটে আসে বোনের কাছে। হাত রাখে তার পিঠে। দূর্বল শরীর নিয়ে কবির শাহ-ও এগিয়ে আসার চেষ্টা করে। মর্জিনা বেগমের এমন রূপের সাথে কেউ পরিচিত না ওরা। নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিছু হয়েছে।
“আপা তোমার কি হয়েছে একটু বলবে? এভাবে কাঁদছো কেনো তুমি?”
“মার্জিয়া আমাকে কিছুদিন এখানে থাকতে দিবি? আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি তোদের কাছে একটু বুক ভরে নি:শ্বাস নিতে চাই। কবির তুমি থাকতে দিবে আমাকে কিছুদিন এখানে?”
কবির শাহ কিছু না বুঝে মার্জিয়ার দিকে তাকায়। ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে দুইজনেরই।

“কিন্তু তোমার ওই আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি ছেড়ে আমার এই ছোট্ট ভাঙা বাড়িতে তোমার থাকতে কষ্ট হবে না আপা?”
কবির শাহ শীতল চোখে মার্জিয়ার দিকে তাকাতেই সে চুপ করে যায়।

“হ্যা আজ তোর বলার দিন, তুই বল মার্জিয়া। বিশ বছর ধরে আমি বলেছি, তুই শুনেছিস। আজ তুই বলবি আমি শুনবো। কিন্তু তারপরেও আমি বেহায়ার মতো কিছুদিন এই বাড়িতেই আশ্রয় নিবো।”
“কোনো সমস্যা নেই আপা। আপনার যতোদিন ইচ্ছা এখানে থাকবেন। আর আশ্রয় বলেছেন কেনো? এটা আপনার বোনের বাড়ি। আপনি থাকতেই পারেন এখানে। মার্জিয়া, প্রিয়তাকে বলো উচ্ছ্বাস যে ঘরে থাকতো ভালো করে ঘরটা গুছিয়ে দিতে। আপার যা যা লাগে ব্যবস্থা করো। আলমারিতে টাকা রাখা আছে কিছু। উনার কাছ থেকে শুনে কি কি উনার প্রয়োজন এনে দাও।”
মর্জিনা বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠে।
“আমাকে আর লজ্জা দিও না কবির। আমি তোমাকে কারণে অকারণে অনেক অপমান করেছি, অশান্তি সৃষ্টি করেছি তোমার সংসারে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি এগুলো ইচ্ছা করে করিনি। আমি তোমাদের হিংসা করতাম। না চাইতেও তোমাদের হিংসা করেছি আমি মনের অজান্তে। আমার অবচেতন মন তোমাদের সুখ দেখে বড্ড হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতো।”
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমাদের কেনো হিংসা করবেন আপা? আপনার তুলনায় আমাদের তো কিছুই নেই। দামী শাড়ি গহনা, বিলাসবহুল আবাস, দামী গাড়ি কিছুই আমি আপনার বোনকে দিতে পারিনি। একবুক ভালোবাসা ছাড়া এই সংসারে আমার দেওয়ার মতো কিছুই ছিলোনা। তবুও কেনো আমাদের হিংসা করতেন আপনি?”
মর্জিনা বেগম ধরা গলায় বললো,”ওই ভালোবাসার অভাবেই তোমাদের হিংসা করতাম কবির।”
মার্জিয়া বেগম বেশ অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকায়। মর্জিনা বেগম উঠে দাঁড়ায় বসা থেকে। হাঁটতে হাঁটতে জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। বাইরের একফালি উঠোনে কবির শাহ বেশ কিছু ফুল আর সবজির গাছ লাগিয়েছে। দুপুরের আগের রোদে এতো সুন্দর লাগছে দেখতে। মর্জিনা বেগমের চোখ ছাপিয়ে ওঠে আবারও পানিতে।

“মার্জিয়া আজ একটা সত্য কথা বলবো তোদের। যে সত্য তোরা কেউ জানিস না।”
“কি সত্য আপা?
“আমি সুখে নেই মার্জিয়া। মিথ্যা সুখের অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমি ভয়ংকর এক কষ্টের যাঁতাকলে পিষে মরেছি আজীবন। যন্ত্রণার ছাপ মুছতে ব্যবহার করেছি প্রসাধনীর প্রলেপ। মানুষের সাথে কুৎসিত ব্যবহার করে নিজের মধ্যকার যন্ত্রণাটা কমানোর চেষ্টা করে আজীবন। কিন্তু আমি এখন ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত আমি। আমি আর পারছি না এই মিথ্যা অভিনয় কর‍তে।”
এমন অত্যাশ্চর্য কথা আগে কোনোদিন শোনেনি ওরা কেউ। মনে হচ্ছে কোনো স্বপ্ন দেখছে, এ-ও সম্ভব? মার্জিয়া কিছু বলতে গেলে কবির শাহ ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। মর্জিনা বেগম নিজে থেকে সব বলুক।

“তোর দুলাভাই আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি মার্জিয়া। তার দরকার ছিলো বাড়িতে একটা রূপবতী স্ত্রী,ব্যস। এ বাদে আমার প্রতি স্ত্রী হিসেবে তার কোনো টান ছিলোনা।”
“আপা এসব কি বলছো?”
“এটাই সত্যি মার্জিয়া। তার অন্য কোথাও প্রেম ছিলো, বেশিরভাগ দিনেই সে ওই মেয়ের কাছেই থাকতো। আর ঠিক সেসব দিনেই আমি খুব সুন্দর করে সেজেগুজে, দামী শাড়ি গহনা পরে, দামী গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়তাম। আমি যে কতোটা সুখী এটা মানুষকে জানাতে।”
মার্জিয়া বেগম হতভম্ব চোখে কবির শাহের দিকে তাকায়। কবির শাহ মাথা নিচু করে বসে থাকে। সে এসব কথা আগে থেকেই জানে, খবর এসেছে আগেই তার কানে। কিন্তু স্ত্রী কষ্ট পাবে তাই কখনো কিছু বলেনি।
“আমার মেয়েটাও আমার মতোই কষ্টে আছে রে মার্জিয়া। ওর বাবা জোর করে নিজের বিজনেস পার্টনারের ছেলের সাথে ওকে বিয়ে দিয়েছে। মা মেয়ের কপাল একই রকম। টাকাপয়সা, সোনাদানার অভাব নেই। কিন্তু যেটার অভাব ছিলো তা হলো ভালোবাসা। যা আমরা কেউ পাইনি।”
“আপা তুমি যে বলতে তুমি অনেক সুখী। টাকা ছাড়া সুখ কেনা যায়না। আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে তুমি দেখিয়েছো তুমি কতোটা সুখী আর আমি কতোটা যন্ত্রণায় আছি। আর বোকা আমি তোমার ওসব কথায় প্ররোচিত হয়ে উদাসীন থেকেছি আমার সংসারে, স্বামীর সাথে রুক্ষ ব্যবহার করেছি একই সাথে দূরত্ব বাড়িয়েছি মেয়ে দু’টোর সাথে। কেনো করলে আপা এমন?”
মর্জিনা বেগম হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুই বলার নেই তার, কি বলবে? মার্জিয়ার একটা কথাও যে মিথ্যা নয়।
“কিন্তু আপা দোষ তোমার না, কোনোভাবেই তোমাকে দোষ দিয়ে দায় নিশ্চিত হতে পারিনা আমি। আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী, আমি কেনো তোমার কথায় প্ররোচিত হবো? আমি তো বাচ্চা ছিলাম না।”
কবির শাহ স্ত্রীর হাতে হাত রাখতেই মার্জিয়া বেগম ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করে।
“তোমাদের কারো এখানে দোষ নেই মার্জিয়া। না আপার না তোমার। তোমরা দুইজনই যেটা করেছো তা মানব স্বভাবসুলভ আচরণ। সৃষ্টির শুরু থেকে এমনটা হয়ে আসছে। তোমরা অস্বীকার করবে কীভাবে? দুলাভাইয়ের ব্যাপারে সবকিছু আমি জানতাম, কিন্তু কোনোদিন কাউকে বলিনি। এমনকি সেতারার বিয়েতে আমি এজন্যই উপস্থিত ছিলাম না। আমি জানতাম ওর যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে ভালো নয়। বিয়ে আটকানোর চেষ্টা করায় দুলাভাই আমার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেছিলো।”
মার্জিয়া অসহায় গলায় বললো,”আমাকে এগুলো আগে বলোনি কেনো তুমি?”
“ইচ্ছা হয়নি, জোর করে তোমাকে আমার দিকে, এই সংসারের দিকে আকৃষ্ট করতে চাইনি। আমি চেয়েছি তুমি যেনো নিজে থেকে, নিজের চিন্তাধারা থেকেই এই সংসারে আবদ্ধ হও। দেখো আজ আমি সফল। তুমি নিজে থেকে ধরা দিয়েছো আমার কাছে। আমি আজ অনেক খুশি।”
মার্জিয়া বেগম একবার স্বামীর দিকে আরেকবার বোনের দিকে তাকায়। এই প্রথম নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবতী নারী মনে হচ্ছে নিজেকে। একইসাথে বড়বোনের কষ্টে জর্জরিত মুখটা দেখে মায়া অনুভবও করছে। সত্যি এই দুনিয়া বড়ই অদ্ভুত!

পেখমের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। পেখমের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নিজের মতো কাপড়ে কি যেনো সেলাই করছে। পেখমের এই অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করছে প্রিয়তা বেশ কিছুদিন। সে কোনো এক অজানা কারণে প্রিয়তাকে এড়িয়ে চলছে। কথাও বলছে না খুব বেশি। ও তো এমন ছিলোনা। অল্পতেই কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিতো প্রিয়তার।
“পেখম।”
পেখম অস্ফুট স্বরে সাড়া দেয়।
“আমার দিকে তাকা পেখম।”
“দেখছোই তো একটা কাজ করছি আপা।”
“আমার কথাটা আগে গুরুত্বপূর্ণ। রাখ তোর কাজ।”
“রাখতে পারবো না, যা বলার বলো।”
প্রিয়তা হঠাৎ জোর করে পেখমের হাত থেকে কাপড়টা কেড়ে দেয়। পেখম বিরক্ত হয়ে বোনের দিকে তাকায়।
“কি হয়েছে আপা? এসবের মানে কি?”
“তোর কি হয়েছে?”
“কি হবে?”
“আমার সাথে কথা বলছিস না কেনো তুই কিছুদিন ধরে? আমি কি করেছি?”
পেখম স্মিত হেসে বললো,”বলছি তো।”
প্রিয়তা অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”বাবা হাসপাতালে থাকা সময় থেকেই আমি খেয়াল করছি তুই আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিস না, বললেও খুব কম। তুই তো এমন ছিলিনা।”
“বললাম তো কিছু হয়নি আপা। কেনো এক কথা বারবার বলছিস?”
প্রিয়তা কান্নাভেজা চোখে বোনের দিকে তাকায়। ছোট থেকে দুই বোনের খুব মিল। কেউ কাউকে ছেড়ে এক দণ্ড থাকতে পারেনা। হঠাৎ বোনের এমন ব্যবহার খুব পোড়াচ্ছে প্রিয়তাকে।
আপার চোখে পানি দেখে পেখমের মন কিছুটা গলে, কিন্তু পুরোপুরি না।
“কাপড়টা দে আপা।”
“তুই আমার সাথে ঠিকমতো কথা না বলা পর্যন্ত আমি কিন্তু খাওয়াদাওয়াই করবো না বলে দিলাম।”
“এসব পাগলামির মানে কি আপা?”
“বেশ তোর কথা বলা লাগবে না, গেলাম আমি। আমার জিদ তুই জানিস।”
প্রিয়তা উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেখম পিছন থেকে তার হাত চেপে ধরে।

“আপা উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সাথে তুই খুব খারাপ আচরণ করেছিস। যেটা আমার একদম পছন্দ হয়নি। সে আমাদের জন্য যা করেছে, তুই নিজের গায়ে সব র’ক্ত ঢেলে দিলেও তার শোধ দিতে পারবি? ওই সময় যদি মানুষটা এগিয়ে না আসতো আজ কি হতো একবার ভেবেছিস? কিন্তু তুই কি করলি? এমন একজন মানুষের সাথে হাসপাতালে দাঁড়িয়ে এতো খারাপ ব্যবহার করলি। যে তোকে এতোটা ভালোবাসে, তার সাথে কীভাবে এমন করলি তুই?”
প্রিয়তা কাঠের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। পেখমকে সে কীভাবে বোঝাবে সেদিনের পর থেকে সে নিজেও ভালো নেই। অস্থির মনটা বারবার খুঁজে ফিরেছে ওই মানুষটাকে। কিন্তু কোথাও কোনো হদিস নেই। কর্পূরের মতো উবে গেলো একরাশ অভিমান বুকে নিয়ে। পেখম কি জানে সেদিনের পর থেকে প্রিয়তা একটা রাতও ঘুমাতে পারেনি। বারবার উচ্ছ্বাসের কথা ভেবেছে। অনুতপ্ত হয়েছে কিন্তু বাবার এমন অবস্থায় কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি।
“কেনো করলি এমন?”
“আমার মাথা ঠিক ছিলোনা। কি করেছি, কি বলেছি আমি নিজেও জানিনা।”
“তোর এই না জানার দায়ভার কে নিবে আপা? আমাদের কাছে আর ফিরে আসবে না মানুষটা। খুব ভালো লাগছে এবার? নিজের ভালোবাসাকে নিজে দূরে ঠেলে দিলি, খুব ভালো লাগছে এবার তাইনা?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা শরীরে ধপ করে বসে পড়ে পেখমের কাছে। ম্লান গলায় বললো,”উনি আর ফিরে আসবে না পেখম?”
“জানিনা আপা। না আসাটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
প্রিয়তা দুই হাঁটু জড়ো করে মুখ ঠেকায় সেখানে। শরীরটা অসম্ভব কাঁপছে তার, মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। অনুশোচনার আগুনের তাপে দগ্ধ হয়ে পুড়ছে সে প্রতিনিয়ত। এই জ্বর তো কিছুই না তার কাছে।

সকালে নাশতার টেবিলে কবির শাহ পত্রিকা নিয়ে বসেছে। অনেকদিন পর প্রিয়তা কলেজে যাবে আজ। খিদা না থাকলেও মায়ের জোরাজোরিতে খাবার নিয়ে বসেছে বাবার পাশে।
হঠাৎ কবির শাহের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিচে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মার্জিয়া বেগম ছুটে আসে শব্দ শুনেই। প্রিয়তা বাবার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,”বাবা সব ঠিক আছে? এমন লাগছে কেনো তোমাকে?”
কবির শাহ কোনো কথা বলতে পারেনা। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে থাকে শুধু। একদৃষ্টিতে পত্রিকার দিকে তাকিয়ে আছে সে। তার দৃষ্টিতে ভয়।
প্রিয়তা কিছু না বুঝে পত্রিকাটা নিজের হাতে তুলে নিতেই ছিটকে পড়ে দূরে। ফ্রন্ট পেজে বড় করে উচ্ছ্বাসের ছবি ছাপা। কলিজাটা ধকধক করে ওঠে তার।

শিরোনামে ছিলো:
‘প্রতিহিংসার বলি হলো তিন চাচা, খু’ন করলো আপন ভাতিজা।’
খবরের কাগজটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারায় প্রিয়তা।

(চলবে……)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-২২+২৩

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২২

বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে প্রিয়তা আর পেখম। ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। দুই বোনের কারো চোখে ঘুম নেই।

“আপা ঘুমিয়েছিস?”
প্রিয়তা অস্ফুট স্বরে উত্তর দেয়,”না।”
“তোর কি খুব বেশি মন খারাপ?”
“না তো, মন খারাপ হবে কেনো?”
পেখম উঠে বসে, আধশোয়া অবস্থাত কাত হয়ে আপার দিকে তাকায়।
“আচ্ছা আপা উচ্ছ্বাস ভাই যদি ফিরে আসে কখনো? যদি এসে বলে উনিও তোকে খুব ভালোবাসে। তাহলে কি করবি তুই?”
প্রিয়তার বুকটা ঈষৎ কেঁপে ওঠে। সে জানে এটা কোনোদিনও সম্ভব না। মানুষটা আসলেই তাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। যদি বাসতো এভাবে তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতো না কাপুরুষের মতো। মিথ্যা আশাও দিতো না।
“কি রে আপা চুপ করে আছিস কেনো? কিছু বল।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় পেখমের দিকে।
“সকালে তোর স্কুল আছে না? দয়া করে চুপ করে ঘুমানোর চেষ্টা কর।”
প্রিয়তা পাশ ফিরে শোয়। তার চোখের কোণা থেকে দুই ফোঁটা পানি এসে পড়ে বালিশের উপর। সে যতো চেষ্টা করছে সব কিছু ভুলে যেতে, অনুভূতিগুলো যেনো তত বেশি জোরালো হচ্ছে তার। এ যেনো তার আবেগ আর মস্তিষ্কের এক কঠিন খেলা।

ঠিক কতোটা সময় পেরিয়েছে জানা নেই, হঠাৎ পেখম লাফ দিয়ে উঠে বসে।
প্রিয়তা কিছুটা বিরক্ত হয়ে পিছন ঘুরে বললো,”কি সমস্যা?”
পেখম ভয়ার্ত গলায় বললো,”আপা কোথায় যেনো একটা শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে জানালায় কেউ টোকা দিচ্ছে।”
প্রিয়তা রাগী গলায় বললো,”কে আবার টোকা দিবে? পাশের নারকেল গাছটায় যে বিশাল দাঁতওয়ালা ভূতটা থাকে ওটা মনে হয় তোকে খুঁজতে এসেছে। তোকে ভারী পছন্দ করে কিনা!”
বলা বাহুল্য, পেখমের ভূতের ভয় সাংঘাতিক। প্রিয়তা এরজন্য ওকে প্রায়ই খোঁচা দেয়।
পেখম কান্নারত গলায় বললো,”আপা আমি সত্যি বলছি। তুই ভালো করে কান পেতে শোন।”
প্রিয়তা শোয়া থেকে উঠে বসে।
“শোন পেখম আমার সকালে কলেজ যেতে হবে। এতো রাতে তোর উদ্ভট কথা শোনার সময় নেই এখন আমার। আর তাছাড়া…..”

প্রিয়তার কথার মাঝেই আবার শব্দ শোনা যায় জানালায়। এবার বেশ জোরালো। কেউ যেনো মহাবিরক্ত হয়ে জানালায় টোকা দিচ্ছে।
শব্দটা এবার প্রিয়তার কানেও যায়। চোখ বড় বড় করে তাকায় সে সেদিকে। পেখম জাপটে ধরে আপাকে।
“এবার বিশ্বাস হলো তো তোর?”
প্রিয়তা ঠোঁটের কাছে আঙ্গুল নিয়ে শসসসস শব্দ করে।
“আস্তে কথা বল। আমার মনে হয় চোর এসেছে। টোকা দিয়ে নিশ্চিত হচ্ছে আমরা জেগে আছি কিনা।”
পেখম ঢোক চেপে বললো,”কি বললি আপা? চোর? এখন কি হবে?”
“আমি দেখছি, শান্ত হ তুই। এতো বড় সাহস আমাদের জানালায় টোকা দেয়?”
“তোকে কোথাও যেতে দিবো না আমি। বাবাকে ডাকতে হবে।”
প্রিয়তা চোখ কুঁচকে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”এতো রাতে বাবাকে ডেকে তার ঘুমটা না ভাঙালেই তোর হচ্ছে না? আমরা বড় হয়েছি না?”
পেখম ভয়ে ভয়ে একবার আপার দিকে আরেকবার জানালার দিকে তাকায়। শব্দটা ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলেছে।

প্রিয়তা এক লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়। ইতিউতি খুঁজে কিছু না পেয়ে পড়ার টেবিল থেকে কাঠের স্কেলটা হাতে তুলে নেয়।
“আজকে ওই চোরের একদিন কি আমার একদিন।”
“আপা আমার মনে হচ্ছে না ওটা চোর। তুই কি বোকা? চোর কি শব্দ করে সবাইকে জানিয়ে চুরি করতে আসে?”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে।
“কথাটা মন্দ বলিস নি তুই।”
“হ্যা আপা সেজন্যই তো বলছি বাবাকে ডাকি।”
প্রিয়তা স্কেলটা হাতে চেপে ধরে বললো,”আমাদের তো আর জানালা ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে না কেউ। আগে দেখি ঘটনা কি, পরে বাবাকে জানানো যাবে। তুই চুপ করে আমার পিছু পিছু আয়।”
পেখম ইতস্তত করতে থাকে। তার আপাটা এতো জেদী কেনো এটাই বুঝতে পারে না সে। নরম মনের মেয়েগুলো এমনই জেদী হয়।

পা টিপ টিপে প্রিয়তা জানালার পাশে দাঁড়ায়। অগত্যা পেখমকেও আসতে হয়।
প্রিয়তা চাপা গলায় ফিসফিস করে বললো,”শোন পেখম, একদম চিৎকার করবি না। জানালাটা খুলেই স্কেল দিয়ে আচ্ছামতো মারবো যে-ই থাকুক। বদমাশটাকে উচিত শিক্ষা দিবো। এতো রাতে মেয়েদের ঘরের জানালায় টোকা দেওয়ার সাহস যেনো আর না করে।”
পেখম ফ্যাকাশে মুখে তাকায় আপার দিকে।

আস্তে আস্তে জানালাটা খুলতে থাকে প্রিয়তা, পেখম পিছন থেকে আপার জামা চেপে ধরে। ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

জানালাটা খুলতেই হালকা আলোয় চাদরে পেঁচানো এক মুর্তিমান যুবককে দেখে চোখমুখ শক্ত হয়ে ওঠে প্রিয়তার। হাতের স্কেলটা জানালার শিকের ভিতর দিয়ে বাইরে বের করে দেয়। কেউ কিছু বোঝার আগেই যুবকের কাঁধে পিঠে বেশ কয়েকবার স্কেলের আঘাত বসিয়ে দেয়। শব্দও হয় বেশ সেদিক থেকে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যুবকটা বিন্দুমাত্র নড়ছে না। বরং চাদরের মধ্যে দুইটা চোখ যেনো অতি বিস্ময়ে জ্বলজ্বল করছে তার।

প্রিয়তা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,”এই কে তুই? এতো বড় সাহস আমাদের ঘরের জানালায় টোকা দিস।”
পেখম প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা ওটা নড়ে না কেনো রে? আদৌ মানুষ তো নাকি অন্য কিছু?”
প্রিয়তা বিজয়ীর হাসি হেসে বললো,”আরে মার খেয়ে নড়াচড়া করতে পারছে না বুঝিস নাই? ভাবতেই পারেনি মনে হয় এমন কিছু হবে।”

আচমকা যুবকটার গম্ভীর গলার আওয়াজ ভেসে আসে।
“হ্যা আসলেই ভাবতে পারিনি এমন কিছু হবে।”
ঝট করে সেদিকে ঘুরে তাকায় দুইবোন। প্রিয়তার হাত থেকে স্কেলটা মাটিতে পড়ে যায়। কাঠের স্কেল ঠনঠন করে শব্দ করে ওঠে।

পেখম চাপা গলায় চিৎকার করে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই?”
প্রিয়তা যেনো কথা বলতেই ভুলে গেছে। মুখটা হা হয়ে আছে তার। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি ভূত দেখলেও এতোটা চমকাতো না সে।

উচ্ছ্বাস চাদরটা মাথা থেকে খুলে গায়ে পেঁচিয়ে নেয়। চাঁদের হালকা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় সেই চিরচেনা রাজপুত্রের মুখখানা। চোখজোড়া ঈষৎ লাল, সারামুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল আর ভ্রু জোড়া কোঁচকানো। অবাক বিস্ময়ে লাল চোখজোড়া প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রিয়তা তোতলাতে তোতলাতে বললো,”আপনি? এটা সত্যি আপনি?”
উচ্ছ্বাস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”হ্যা সত্যি আমি, যাকে তুমি একটু আগে কাঠের স্কেল দিয়ে পিটিয়েছো। এই, মাথামোটা মেয়ে আগে দেখবে তো কে এসেছে। দেখে তো মনে হয় গায়ে একবিন্দু শক্তি নেই। পাটকাঠির মতো হাতে এতো জোর? ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানো না এমন একটা ভাব ধরে থাকো। অথচ….”
উচ্ছ্বাস নিজের ঘাড়ে হাত বোলায়।

প্রিয়তা এখনো হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেখম একবার উচ্ছ্বাসের দিকের আরেকবার নিজের আপার দিকে তাকায়। তার মনটা বেশ ভালো লাগছে এখন। উচ্ছ্বাস ভাই ফিরে এসেছে, তার আপা নিশ্চয়ই আবার হাসিখুশি হবে আগের মতো।

প্রিয়তা মাথা চুলকে বললো,”আপনিই বা চোরের মতো জানালায় টোকা দিচ্ছেন কেনো? আমি তো ভেবেছি চোর এসেছে।”
উচ্ছ্বাস হতবাক হয়ে বললো,”তোমাকে ক্ষীণ বুদ্ধির মেয়ে ভেবেছিলাম, আসলে তোমার মাথায় যে গোবরটুকুও নেই সেইটা তো বুঝিনি। এই মেয়ে, চোর এলে কি জানালায় টোকা দিয়ে শব্দ করে সবাইকে জাগিয়ে ঘরে ঢোকে?”
প্রিয়তা মাথা চুলকিয়ে বললো,”আসলেই তো, এটা আমাদ মাথায় আসেনি কেনো?”
“কারণ তোমার মাথায় উৎকৃষ্ট মানের ছাগলের লাদি ঠাসা।”
পেখম শব্দ করে হেসে দেয়। প্রিয়তা তার দিকে তাকিয়ে রাগ করতে যেয়েও করেনা। তার মনটা অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন।

“বলছিলাম যে আপনি কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন? ওষুধ এনে দিই?”
উচ্ছ্বাস মুচকি হাসে।
“ওষুধ নিতেই এসেছি।”
“তার মানে?”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ থেমে ভারী গলায় বললো,”বের হবে প্রিয়তা?”
প্রিয়ত হতভম্ব হয়ে যায়, মুখ ঝুলে যায় তার।
“কি বললেন বুঝতে পারিনি।”
উচ্ছ্বাস ক্লান্ত গলায় বললো,”গভীর রাতের রাস্তা দেখেছো কখনো? কীভাবে চাঁদ উঁকি দেয় মেঘপুঞ্জের মধ্য থেকে, কীভাবে রাস্তার কালো পিচগুলো জ্যোৎস্নায় রূপালী বর্ণ ধারণ করে চিকচিক করে, কীভাবে রাতজাগা পাখি তারস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে পালায়৷ দেখেছো কখনো?”
প্রিয়তা বুঝতে পারেনা কি করবে সে। ফ্যাকাশে মুখে পেখমের দিকে তাকায়। পেখমও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে বললো,”ভয় পাচ্ছো? তবে থাক।”
প্রিয়তা মিনমিন করে বললো,”না না ভয় পাবো কেনো?”
“বিশ্বাস রাখতে পারো আমার উপর। তোমার বাবার রাজকন্যাকে আগলে রাখতে উচ্ছ্বাস মৃত্যুমুখে পড়তে দুইবার ভাববে না।”
প্রিয়তার শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগে। পেখমের দিকে তাকাতেই পেখম চোখ টিপে তাকে আশ্বস্ত করে।
“আপা যা, আমি এদিকটা সামলে নিবো। তবে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।”
প্রিয়তা পেখমের হাতের উপর হাত রাখে। তার হাত বরফের মতো ঠান্ডা। এমন দু:সাহস করার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু অদ্ভুত এক নেশা তাকে টানছে বাইরে। ভিতর থেকে কেউ বলছে, সব শেকল ভেঙে যা প্রিয়তা, এটাই সুযোগ।

প্রিয়তা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বাইরে। উচ্ছ্বাস এখনো দরাজ চোখে তার দিকে তাকানো। তার প্রতিটা নি:শ্বাস যেনো তাকে ভরসার মায়াজালে টানছে। চোখ বন্ধ করে বড় একটা নি:শ্বাস ছাড়ে প্রিয়তা।

কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যোৎস্না থইথই করছে চারপাশে। সেই মায়াভরা আলোয় দুই মানব-মানবী পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। দুইজনের মনেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা অপরজনের হাতটা চেপে ধরার। কিন্তু কোনো এক বাঁধায় দুইজনই সামলে রেখেছে নিজেদের।

“এখনও কি একটুও স্বাভাবিক হতে পারছো না?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে বললো,”হয়েছি।”
“তাহলে চুপ করে আছো কেনো?”
“ভয় করছে।”
“কিসের?”
“জানিনা।”
আবারও নীরবতা। মফস্বলি রাস্তা রাত হতে না হতেই ফাঁকা হয়ে যায়। কদাচিত দুই/একটা রিকশা চলছে। এর বাইরে আর কোনো মানুষ নেই।

“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“করো।”
“এতোদিন কোথায় ছিলেন? কাউকে কিছু না বলে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য আছে? একটাবারও কি মনে হয়নি কেউ আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করবে, অস্থির হয়ে যাবে?”
উচ্ছ্বাস জোরে জোরে হাসে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।
“খুব হাসির কোনো কথা বললাম নাকি?”
উচ্ছ্বাস হাসি থামিয়ে শূন্যের দিকে তাকায়।
“কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে না প্রিয়তা, কেউ আমার জন্য দুশ্চিন্তা করবে না। আমি একজন বাঁধনহারা, নীড়হারা পাখি। আমার কোনো পিছুটান নেই।”
প্রিয়তা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখে বিন্দু বিন্দু জল জমা হয়। চাঁদের আলোয় সেই জল রূপার টুকরোর মতো চিকচিক করে ওঠে। উচ্ছ্বাসও থেমে যায়। প্রিয়তার দিকে তাকাতেই তার বুকে ঈষৎ ধাক্কা লাগে। এক স্বর্গীয় মায়ায় ডুবে আছে তার সামনে দাঁড়ানো তরুণীর মুখটা। এই মায়ার উৎস কি?

“দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো?”
“আমি বাড়ি ফিরে যাবো, এক্ষুনি।”
“কেনো ভালো লাগছে না হাঁটতে?”
প্রিয়তা কিছুক্ষণ থেমে ঘনঘন শ্বাস নেয়। উচ্ছ্বাস বুঝতে পারে প্রিয়তা কিছু বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। সে বুকে হাত বেঁধে অপেক্ষা করতে থাকে।

“নিজেকে ভাবেনটা কি আপনি? মহাপুরুষ হয়ে গিয়েছেন আপনি? যা ইচ্ছা করবেন, মায়া লাগাবেন এরপর ভবঘুরে জীবন কাটাবেন? মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা করতে খুব ভালো লাগে আপনার, তাইনা? যদি আপনার মনে হয়েই থাকে কেউ আপনার জন্য অপেক্ষা করবে না, কেউ দুশ্চিন্তা করবে না তবে কেনো এসেছেন আমার কাছে? কেনো আমাকে বারবার মিথ্যা আশা দিয়েছেন? কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন। একটা বারও মনে হলো না আমার কতোটা কষ্ট হতে পারে। আমার দমবন্ধ হয়ে আসতো মাঝে মাঝে। এরকম অনুভূতি কখনো হয়নি আমার। আপনি তো অবুঝ নন। কেনো করলেন তবে আমার সাথে এমনটা?”
উচ্ছ্বাস ঠোঁট কামড়ে হাসে। নরম মেয়েগুলো রেগে গেলে অদ্ভুত আচরণ করে। রাগে ফোঁসফোঁস করা মেয়েটার নাকের ডগা লাল হয়ে আছে, চোখ বেয়ে অবাধ্য জলকণা গুলো বিরতিহীন ভাবে পড়ছে। মেয়েটা কি কোনোদিন জানতে পারবে ওকে এই অবস্থায় কতোটা মায়াবতী লাগছে?
উচ্ছ্বাসের হাসি দেখে প্রিয়তা আরো রেগে যায়। হঠাৎ করেই উল্টোদিক ফিরে হনহন করে হেঁটে যেতে গেলেই উচ্ছ্বাস তার হাত চেপে ধরে পিছন থেকে। প্রিয়তা পাথরের মূর্তির মতো থেমে যায়। বুকটা ধকধক করে ওঠে তার।

আচমকাই উচ্ছ্বাস তাকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের দিকে ফেরায়। নিজের অনেকটা কাছে টেনে এনে প্রিয়তার উত্তাপটুকু নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করে। প্রিয়তা স্তম্ভিত হয়ে যায়। মাথা নিচু করে রাখে, মুখ তোলার সাহস নেই তার।

উচ্ছ্বাস ঘোরলাগা গলায় বললো,”একটু আগে যে কথাগুলো বললে এখন আবার বলো।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। সত্যিই তার এখন সাহস নেই কথাগুলো আবার বলার। সে এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে উচ্ছ্বাসের হৃৎস্পন্দনগুলো।

“কি হলো বলবে না?”
প্রিয়তা নিজের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে উচ্ছ্বাসের বাহুডোর থেকে।
“ছাড়ুন আমাকে, ফিরতে হবে।”
“আজ না ফিরলে হয়না?”
প্রিয়তা ঝট করে চোখ তুলে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। তাকানোর পর মনে হয় না তাকালেই বুঝি ভালো হতো। কীভাবে এখন সে এই চোখজোড়ার মায়া থেকে নিজেকে উদ্ধার করবে? এই মায়া কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ কি আদৌ আছে খোলা?

“একটু আগে কি যেনো বললে তুমি? আমি মায়া লাগিয়েছি? কাকে মায়া লাগালাম?”
প্রিয়তা গাঢ় গলায় বললো,”কাউকে না, কাউকে না।”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে চাপা গলায় ফিসফিস করে বললো,”কিন্তু আমি তো আরেকজনের মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেলাম। এখন আমার কি গতি হবে?”
প্রিয়তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে তিরতির করে।
“কার মায়ায়?”
“এক নন্দিনী, যার দৃষ্টিতে আমি বারবার খেই হারিয়ে ফেলি। যার গজদন্তের হাসিতে দুই/একটা হৃৎস্পন্দন হুটহাট হারিয়ে ফেলি। চাঁদের চেয়েও সুন্দর সেই প্রিয়তমার মায়ায় আটকে গিয়েছি তো আমি। তার অনুপস্থিতি আমাকে নরক সমান যন্ত্রণা দেয়, সে কি বুঝবে কখনো?”
প্রিয়তা মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছে। তার বুকটা ক্রমাগত হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে। তার মানে এই মানুষটাও তাকে ভালোবাসে? সত্যিই কি এতোটা ভাগ্য তার আছে?

“প্রিয়তা।”
প্রিয়তা অস্ফুট স্বরে বললো,”বলুন।”
“যদি কখনো জানতে পারো আমার অতীতের মতো আমার ভবিষ্যতটাও অন্ধকার হতে পারে, তবে কি তোমার অনুভূতিগুলো এখনো এতোটাই জ্বলজ্বলে থাকবে?”
প্রিয়তা কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ে।
“ভেবে বলো নন্দিনী। সামান্যতম ভুল জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে।”
প্রিয়তা আস্তে আস্তে বললো,”সেই ভুলের সাথে যদি আপনি মিশে থাকেন তবে, আমি সেই ভুল বারবার করতেও রাজি। যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকতো, আমি সেই জন্মেও এই ভুল করতে চাইতাম।”
উচ্ছ্বাস ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।
নিজের মুখটা প্রিয়তার কানের কাছে এনে বললো,”পরজন্ম লাগবে না নন্দিনী, এ জন্মেই তোমার সবটুকু অনুভূতির দায়িত্ব আমি নিলাম। কথা দিলাম, তোমাকে আর একবিন্দুও কষ্ট পেতে দিবো না।”
প্রিয়তা আকুল হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাতেই আচমকা উচ্ছ্বাস তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হেসে তার নিটোল বাঁ পায়ের পাতাটা নিজের উরুর উপর রাখে। প্রিয়তা যেনো অবাক হওয়ার পালাও অতিক্রম করে ফেলেছে।

পকেট থেকে একটা নূপুর বের করে উচ্ছ্বাস পরিয়ে তার প্রিয়তার পায়ে। রূপারঙা নুপুরটা চাঁদের আলোয় ঝকমক করে ওঠে। প্রিয়তা নিশ্চিত সে স্বপ্ন দেখছে, অবশ্যই স্বপ্ন। এতো সুখ বাস্তবে হতে পারে না, কখনোই না।

“নন্দিনী, আজ থেকে তোমাকে ভালোবাসার ভার নিলাম। যদি কখনো মৃত্যু আসে, তবে ক্ষমা করে দিও। কিন্তু যতোদিন আমার শ্বাস চলবে, ততদিন প্রিয়তার উপর থেকে প্রিয়তার নিজের অধিকার সরিয়ে আমার অধিকার রেখে যাবো। নন্দিনী কি রাজি হবে? পারবে আমার জন্য অপেক্ষা করতে?”
প্রিয়তা ঘোরলাগা চোখে উচ্ছ্বাসের চোখের দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টিতে না আছে কোনো কপটতা, না আছে লোভ আর না আছে বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্রয়। কিছু একটা তো আছেই চোখজোড়ায়৷ যে অনুভূতি একেবারেই নতুন, এক্কেবারে নতুন।
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটার উপর নিজের কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখে। তার বরফশীতল হাতের ছোঁয়ায় উচ্ছ্বাসের সব উত্তপ্ততা নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে যায়।

প্রজাপতির মতো যেনো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রিয়তা সকাল সকাল। কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে আর মাঝে মাঝেই গুণগুণ করে গান গেয়ে উঠছে নিজের মনেই। মার্জিয়া বেগম নিজের কাজ করতে করতে আড়চোখে তাকায় মেয়ের দিকে। মেয়েটা অনেকদিন মনমরা হয়ে পড়েছিলো। গতকাল আবার জ্বরও হলো। হঠাৎ করে কি এমন হলো আজ তার।

“মা খুব খিদে পেয়েছে, খেতে দাও।”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”তোর খিদে পেয়েছে? সূর্য আজ কোনদিক থেকে উঠলো? যে মেয়ে খাবার দেখলে একশো হাত দূরে থাকে, আজ সকাল সকাল খিদে পেয়ে গেলো তার?”
কবির শাহও ততক্ষণে হাজির হয়েছে।
মার্জিয়া বেগম কথা না বলে সবাইকে খেতে দেয়। মেয়েটা খুব আরাম করে খাচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া হয় তার। গতকাল সেতারা আর তার স্বামীর কীর্তি দেখে খুব ভয় করছে তার। বুকটা কেঁপে ওঠে তার সহসাই। সেতারার জায়গায় নিজের মেয়ের মুখটা বসাতেই ভয় পেয়ে যায় সে। গাড়ি-বাড়ি, সম্পদ এগুলোর লোভে পড়ে সে মেয়েদের ক্ষতি করতে যাচ্ছিলো নাতো?
“মা তুমি কি কিছু বলবে আমাকে? ওভাবে তাকিয়ে আছো যে?”
মার্জিয়া বেগম নিজেকে সামলে বললো,”না ও কিছু না। তুই কি কলেজে যাবি? তোর শরীরটা ভাল না।”
“হ্যা মা, সামনেই পরীক্ষা। এখন একদম বাড়ি বসে থাকা যাবে না। তাছাড়া আমি এখন একদম সুস্থ।”
পেখম আপার দিকে তাকিয়ে কুটকুট করে হাসে, প্রিয়তা লাজুক মুখে মাথা নিচু করে বসে থাকে।
কবির শাহ খেতে খেতে বললো,”যেতে চায় যাক না। শরীর খারাপ লাগলে নাহয় ছুটি নিয়ে চলে আসবে। তুমি আর বাঁধা দিও না।”
মার্জিয়া বেগম কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে যায়। মেয়েটার মুখে যে কারণেই হোক অনেকদিন পর হাসি দেখে দিয়েছে। সে এই হাসি হারিয়ে যাওয়ার কারণ হতে চায়না।

প্রিয়তা বের হওয়ার মুখেই দরজায় বড় খালাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে যায়। এতো সকাল সকাল এই মহিলা কেনো এসেছে?
মর্জিনা বেগম ভ্রু কুঁচকে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কোথায় যাচ্ছিস?”
“কলেজে যাচ্ছি খালা।”
“তোর মা বারণ করেনি যেতে?”
প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”মা বারণ করবে কেনো খালা?”
মর্জিনা বেগম কথা না বলে ফুঁসতে থাকে।
প্রিয়তা আস্তে আস্তে বললো,”আমি আসি খালা? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মর্জিনা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই একরকম উড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়ে প্রিয়তা। মনে মনে বলে,’উফ খুব বাঁচা বেঁচে গেলাম আজ।’

“তোর সমস্যা কি মার্জিয়া?”
মার্জিয়া বেগম বাঁকা চোখে একবার বোনের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। নিজের কাজগুলো করতে করতে উত্তর দেয়,”কিসের সমস্যা আপা?”
মর্জিনা বেগম যেনো রাগে ফেটে পড়ে।
“এতো কিছু বলার পরেও মেয়েকে কলেজে পাঠিয়ে দিলি? একটা কেলেঙ্কারি না হওয়া পর্যন্ত শোধরাবি না তাইনা?”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না। সকালের এই সময়টা অনেক ব্যস্ত থাকে সে। কথা বলার বা শোনার সময় খুব কম।
তাকে চুপ থাকতে দেখে আরো রেগে যায় মর্জিনা বেগম।
“দেখ মার্জিয়া, নিয়াজের বাড়ি থেকে চায়না তাদের বাড়ির বউ পড়াশোনা করুক, তাছাড়া……”
মর্জিনা বেগমের কথার মাঝেই তার দিকে তাকায় মার্জিয়া বেগম। তার শীতল চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় মর্জিনা বেগম আচমকা।

“আপা মেয়েটা আমার, নিয়াজের পরিবারের না। ও পড়াশোনা করবে কি করবে না ঠিক করবো আমি আর ওর বাবা। কোনো নিয়াজ কিংবা বাইরের কেউ না।”
মর্জিনা বেগম হতবাক হয়ে যায়। এভাবে কেনো কথা বলছে তার বোন তার সাথে?
“তুই কি পরোক্ষভাবে আমাকে বাইরের লোক বললি?”
মার্জিয়া বেগম ঈষৎ হেসে বললো,”পরোক্ষভাবে না আপা প্রত্যক্ষভাবেই বললাম।”
মর্জিনা বেগম চিৎকার করে ওঠে।
“মার্জিয়া মুখে লাগাম টান। ভুলে যাস না তোর মেয়েদের জন্য আমি কতো কিছু করেছি এ পর্যন্ত।”
“একদম ভুলে যাইনি আপা। আমি কৃতজ্ঞ তার জন্য তোমার কাছে। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে আমার মেয়েদের সুখ বলি দেওয়ার কারণ তোমাকে হতে দিবো আমি। আমি বেঁচে থাকতে এ অধিকার কাউকে দিবো না আমি।”
মর্জিনা বেগম অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় বোনের দিকে। কি হলো কি তার হঠাৎ করে?

“আমি তোর মেয়েদের সুখের বলির কারণ? তোর মতো অবস্থা যেনো ওদের না হয়, এজন্য আমি…..”
রক্তচক্ষু মেলে তাকায় বোনের দিকে মার্জিয়া বেগম।
“আমি মা হিসেবে চাই, আমার মেয়েদের অবস্থা যেনো আমার মতোই হয়। ওদের বাবার মতো একজন খাঁটি মানুষ ওদের জীবনে আসুক। যে আর কিছু দিতে না পারলেও সম্মানটুকু দিবে সংসারে।”
মার্জিয়া বেগমের কঠোর কণ্ঠের মুখে থতমত খেয়ে যায় মর্জিনা বেগম। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। একদিনের মধ্যে কি হয়ে গেলো বোনটার তার? কে ব্রেইনওয়াশ করলো তার?
“তুই কি ভেবে বলছিস?”
“একশোবার ভেবে বলছি। আমার মেয়েদের চিন্তা না করে নিজের মেয়েটার দিকে এবার একটু তাকাও আপা। অন্যের সুখ চাইতে যেয়ে তোমার নিজের মেয়েটার কতো বড় সর্বনাশ করেছো একটু দেখো এবার।”
“আমি আমার মেয়ের সর্বনাশ করেছি? জানিস ওর বরের কতো টাকা? টাকায় মুড়িয়ে রাখে মেয়েটাকে।”
মার্জিয়া বেগম শব্দ করে হেসে বললো,”টাকার থেকে অনেক ঊর্ধ্বে রয়েছে সম্মান। পৃথিবীর সব টাকা একত্র করেও সম্মান কিনতে পাওয়া যায়না সংসারে। মেয়েটার চোখের নিচের কালির কারণ খোঁজার চেষ্টা করো আপা একদিন। সেদিন সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।”
মর্জিনা বেগম জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে।
“আমি যে ভুলের সাগরে ডুবে ছিলাম, আমি অনুতপ্ত তার জন্য। আমি চিৎকার করে এখন বলতে পারি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী একজন মেয়ে। কারণ আমার পাশে আমার বটবৃক্ষের মতো স্বামী আছে। যে আমাকে সমস্ত প্রতিকূলতা থেকে এক হাতে সামলাতে জানে। কোটি টাকার খাটে শুয়ে চোখের পানি ফেলার চাইতে, ভাঙা ঘরে শুয়ে সুখের জোয়ারে ভাসা হাজার গুণে ভালো। যেটা হয়তো তুমি কোনোদিন বুঝতে পারবে না।”
চিৎকার করে মর্জিনা বেগম উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,”তোর মেয়েদের আর কোনো ভালোমন্দতে আমি নেই। যা খুশি কর তোরা।”
দরজাতেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলো কবির শাহ। সাইকেলের চাবি ফেলে যাওয়াতে ফিরে এসেছিলো সে। এসেই দুই বোনের কথার মাঝে পড়ে যায়। কাউকে বুঝতে না দিয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো সে তার স্ত্রীর কথা শোনার জন্য। বুকটা আনন্দে ভরে গেছে তার।

“ধন্যবাদ আপা।”
মর্জিনা বেগম কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”ধন্যবাদ কিসের?”
“এইযে আপনি শেষ যে কথাটা বললেন, তার জন্য।”
“অসভ্য কোথাকার।”
হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় মর্জিনা বেগম। গালভরে হাসে কবির শাহ।

হঠাৎ পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরতেই মার্জিয়া বেগম হকচকিয়ে যায়।
“এ কি, তুমি এখানে কেনো? যাও নি এখনো?”
“ভাগ্যিস আজ সাইকেলের চাবিটা ভুলে বাড়িতেই ফেলে গিয়েছিলাম। নাহলে কীভাবে জানতাম আমার বউটা আমাকে এতো ভালোবাসে।”
মার্জিয়া বেগম লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
“বুড়ো বয়সে এসব কি শুরু করেছো তুমি?”
“মেয়েরা কিন্তু বাড়িতে নেই।”
কবির শাহ হাসে, মার্জিয়া বেগমও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসে।
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের হাতের উপর হাত রেখে বললো,”তুমি একদম ঠিক বলেছো। আমার মেয়েদের জন্য একদম খাঁটি মানুষ লাগবে। যারা আমাদের রাজকন্যাদের রানী বানিয়ে রাখবে।হোক ভাঙা ঘর, অভাব থাকুক। তবে ভালোবাসার অভাবটা যেনো কোনোদিন না হয়।”
মার্জিয়া বেগম স্বামীর হাতের উপর আলতো চাপ দিয়ে বললো,”ঠিক আমাদের মতো।”
কবির শাহ স্বপ্নালু চোখ স্ত্রীর দিকে তাকায়। তার বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে যায় নিমিষেই।

(চলবে……)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২৩

ক্লাস শেষে প্রিয়তা রুনার সাথে সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো। সিঁড়ির মুখেই নীলুকে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুনা থেমে যায়, প্রিয়তা তাকায় না সেদিকে।

“কি রে দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো? বাড়িতে যাবি না?”
রুনা ফিসফিস করে বললো,”প্রিয়তা, নীলু আপা মনে হয় তোকে কিছু বলতে চায়।”
“আমার উনার সাথে কোনো কথা নেই। তোর এতো দরকার হলে তুই কথা বল, আমি গেলাম।”
প্রিয়তা কিছুটা ঝাঁঝের সাথে সামনে এগোতে গেলেই নীলু ঝট করে তার বাহু চেপে ধরে।
“ওদিকে চল প্রিয়তা, তোর সাথে আমার কথা আছে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”এখানেই বলুন না, ওদিকে কেনো যেতে হবে?”
নীলু প্রিয়তার কথা শোনে না। প্রিয়তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় কিছুটা নির্জন জায়গায়।

“কি হয়েছে কি নীলু আপা? আমার কাছে কি চান আপনি?”
নীলুর চোখমুখ লাল হয়ে আছে, মনে হয় সে কেঁদেছে কিছুক্ষণ আগেই।
“প্রিয়তা আমি সত্যিই অসহায় হয়ে তোর কাছে এসেছি। তুই আমাকে ফিরিয়ে দিস না। আমি জানিনা আমি কি করবো। আমার অসহ্য লাগছে সবকিছু।”
প্রিয়তা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নীলুর দিকে। বোঝার চেষ্টা করে নীলুর কথা।
“দয়া কর প্রিয়তা, এখন তুই ছাড়া আমি কাউকে পাচ্ছি না যে আমাকে এই চোরাবালি থেকে টেনে তুলবে।”
নীলুর কান্নাজড়িত মুখটা দেখে খুব মায়া হয় প্রিয়তার। তার মুখের কঠিন রেখাগুলো কিছুটা সহজ হয়ে আসে।
যথাসম্ভব নরম গলায় প্রিয়তা বললো,”কি হয়েছে নীলু আপা? আমাকে সবটা খুলে বলুন।”
নীলু নাক টানে, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। প্রিয়তা অপেক্ষা করে নীলুর দিকে তাকিয়ে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নীলু মুখ খোলে।

“সারাজীবন রূপের অহংকার ছিলো আমার মধ্যে। আমি মনে করতাম আমি যাকে পছন্দ করবো, সে-ই আমার হবে। কতো ছেলেদের মন নিয়ে খেলেছি আমি। কিন্তু সত্যি বলতে কখনো প্রেম কি আমি বুঝিনি। সত্যিকারের ভালোবাসা কি বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে আমি প্রেমে পড়েছি। খুব বিশ্রীভাবে একজনের প্রেমে পড়ে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। আমাকে বলে দে আমি কি করবো।”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”কার প্রেমে পড়েছেন নীলু আপা?”
প্রিয়তা নি:শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে নীলু কার নাম বলতে চলেছে, তবুও সে শুনতে চায়।
নীলু ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। প্রিয়তা ইতস্তত করতে থাকে।
“প্রিয়তা আমি তোর উচ্ছ্বাস ভাইয়ের প্রেমে পড়েছি। আমি মানুষটাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছি। কতোগুলো দিন হয়ে যায় আমি উনাকে দেখতে পারছি না। এই বিরহ যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। হয় তুই আমাকে উনার ঠিকানা দে, নাহয় আমাকে শেষ করে দে একেবারে।”
প্রিয়তার কান গরম হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগেই যার জন্য এতো মায়া লাগছিলো, তাকেই বিষের মতো লাগে প্রিয়তার। নীলুর নির্লজ্জতা দেখে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে যেনো সে।
আচমকা নীলু প্রিয়তার হাত চেপে ধরে। প্রিয়তার কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
“তুই আমাকে ফিরিয়ে দিবি না প্রিয়তা, এটা আমি জানি। তুই বল উনি কোথায় আছে। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোর কাছে।”
তড়িৎগতিতে হাত সরিয়ে নেয় প্রিয়তা। রাগে নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তার।
“আপনি আসলে কি চান নীলু আপা? এসব পাগলামির মানে কি? আপনি কি ষোড়শী কিশোরী? এভাবে কাউকে দেখেই প্রেম হয়ে যায়? কতোটুকু জানেন আপনি উনার ব্যাপারে? খোঁজ রাখেন তার সম্পর্কে? কি তার পরিচয়, কি তার পূর্ব জীবন আর কোথায় তার পরিবার? কিছুই না জেনে এভাবে প্রেমে পড়ার বয়স কি আপনার আছে?”
কান্নাভেজা চোখে নীলু তাকায় প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা এখনো রাগে কাঁপছে, ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে তার।

“উনার পরিবার বলতে কেউ নেই, বলতে পারেন অনাথ একজন মানুষ সে। বাবা-মা সবাইকে হারিয়ে যখন সে পাগলপ্রায়, তখন আমার বাবা তাকে আমাদের বাড়িতে এনে তোলে। আপনার বাবা এই এলাকার একজন নামীদামী মানুষ। তিনি কি এমন একজন ছেলে যার পরিবার বলে কিছুই নেই তার কাছে মেয়েকে তুলে দিবেন? নাকি আপনি যাবেন এমন কারো কাছে?”
নীলু বিস্ফারিত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন কিছু শুনতে হবে সে কোনোদিন ভাবতে পারেনি। ঠোঁট কাঁপতে থাকে তার তিরতির করে।
প্রিয়তা নিজেকে কিছুটা সামলে নরম গলায় বললো,”নীলু আপা, আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। আপনি যেটাকে ভালোবাসা বলছেন, সেটা নেহাৎই ভালো লাগা, আর কিছুই নয়। সারাজীবন আপনি এটাই দেখে এসেছেন যে, আপনি যাকে প্রেম নিবেদন করেছেন সে নিজেই প্রেমিক পুরুষ হয়ে আপনার কাছে ধরা দিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম এমন একজনকে আপনি দেখেছেন, যে আপনার ভালোবাসাকে পাত্তাই দেয়নি। আপনি তার এই ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছেন। এমন সুদর্শন ব্যক্তিত্ববান একজন মানুষকে চট করে ভালো লেগে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন তার কালো অতীতকে একইভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না, তখন বুঝতে পারবেন এটা ভালোবাসা নয়, ভালোলাগা।”
প্রিয়তা থামে, সে নিজেও জানেনা এতোগুলো কথা সে কীভাবে একনাগাড়ে বলে গেলো। কেউ তাকে এগুলো শিখিয়ে দেয়নি, এগুলো প্রতিটা তার মনের কথা। সে তো নিজেই উচ্ছ্বাসের সবকিছু মেনে নিয়ে তাকে ভালোবেসেছে।
নীলু আহত গলায় বললো,”তুই এগুলো মিথ্যা বলছিস তাইনা? আমি জানি সব মিথ্যা, সব।”
রাগে, ক্ষোভে প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে তাকায় নীলুর দিকে। এই মুহুর্তে এই লজ্জাহীনা মেয়েটার দিকে তাকালেই অস্বস্তি লাগছে তার।
“বেশ আমি মিথ্যা বলছি, তবে আপনি নিজেই খোঁজ নিয়ে দেখুন। দয়া করে আমাকে এসব বলতে আসবেন না।”
প্রিয়তার আরো কিছু শোনানোর ইচ্ছা ছিলো নীলুকে। কিন্তু অতিরিক্ত রাগে সে কোনো কথা বলতে পারেনা। নীলুকে ওই অবস্থায় রেখেই হনহন করে হেঁটে চলে যায় সেখান থেকে। স্থাণুর মতো জমে নীলু দাঁড়িয়ে থাকে শূণ্যের দিকে দৃষ্টি ফেলে।

বাড়ির কাছে আসতেই প্রিয়তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। তার মনে হয় সবকিছু ঠিক নেই, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। বাড়ির সদর দরজায় বড় একটা তালা ঝুলছে। সাধারণত এই সময় এরকমটা হওয়ার কথা না। তাছাড়া তার মা মার্জিয়া বেগম জানে সে এখন কলেজ থেকে ফিরবে। এই সময়ে দরজা বন্ধ থাকার কোনো কারণই নেই।

প্রিয়তা ছুটে এসে তালাটা উল্টেপাল্টে দেখে। ভীষণ অসহায় লাগে তার। তাকে না জানিয়ে কোথাও যাওয়ার কথা না তার মায়ের। সে অনেকবার চিৎকার করে পেখমকে ডাকে, তার বাবাকে ডাকে। তার বাবা এই সময় বাড়িতে থাকে না। স্কুল শেষে সে টিউশন পড়ায় কয়েকজন ছাত্রকে।
টিউশনের কথা মনে পড়তেই তার মাথায় আসে তার বাবা তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই পড়ায়। প্রিয়তা ঠিক করে সে সেখানে যাবে।
ঠিক এমন সময় পাশের বাড়ির একজন ভদ্রমহিলা ছুটে আসে প্রিয়তার কাছে।

“মা গো, তুমি ফিরেছো?”
“কি হয়েছে চাচী? এমন লাগছে কেনো আপনাকে?”
মহিলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। প্রিয়তা অস্থির হয়ে তার কাঁধে হাত রেখে চিৎকার করে বললো,”চাচী দয়া করে বলুন কি হয়েছে। আপনি জানেন আমার মা কোথায়?”
মহিলাকে চুপ থাকতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় প্রিয়তা। অজানা আশঙ্কায় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার। সে নিশ্চিত কোনো বিপদ হয়েছে, অনেক বড় কোনো বিপদ।

নিজের ডেরায় বসে পা ছড়িয়ে সিগারেট টানছিলো উচ্ছ্বাস। মন না চাইতেও প্রিয়তার মুখটা বারবার ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। কতোশত রূপবতী মেয়ে চোখে পড়ে, কখনো তো প্রিয়তার মতো ভালো লাগেনি তাকে। কি আছে ওই শ্যামবর্ণা মায়াবতীটার মধ্যে? উচ্ছ্বাস মনের অজান্তেই হেসে দেয়।
ঠিক এমন সময় রাসেল এসে বললো,”ভাই আপনি এখানে? অনেক বড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে তাকায় রাসেলের দিকে।
“কি হয়েছে রাসেল? সব ঠিক আছে তো?”
ছেলেটা আমতা আমতা করতে থাকে।
উচ্ছ্বাস সিগারেট ফেলে দিয়ে রাসেলের কাঁধে হাত রেখে বললো,”এই রাসেল আমার দিকে তাকা, কি হয়েছে বল। প্রিয়তা, প্রিয়তা ঠিক আছে তো?”
রাসেল মাথা নাড়ে।
কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাস। তার কাছে এখন প্রিয়তার ভালো থাকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই।
“তাহলে কি হয়েছে? শয়তানগুলোর মধ্যে একটাও কি মরেছে?”
রাসেল মাথা নিচু করে বললো,”আপনার মামাকে কে বা কারা যেনো ছুড়ি আঘাত করেছে। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে।”
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় উচ্ছ্বাস। হতভম্ব হয়ে যায় সে রাসেলের কথা শুনে।
“তুই কার কথা বলছিস? এক মিনিট, তুই কোনোভাবে প্রিয়তার বাবার কথা বলছিস না তো?”
রাসেল মাথা নিচু করে বললো,”স্কুল শেষে টিউশন পড়াতে যাওয়ার সময় কবির শাহকে কারা যেনো ছুড়ি আঘাত করেছে। অবস্থা খুবই শোচনীয়। উনার স্ত্রী উনাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। তবে যতোটা শুনলাম, অবস্থা ভালো না।”

উচ্ছ্বাস চিৎকার করে ছিটকে যায় দূরে। এই মানুষটাকে সে নিজের বাবার মতো ভালোবেসে ফেলেছে। মাঝে মাঝে নিজেকে ওই মানুষটার সন্তান ভেবে ফেলেছে সে বারবার। তার কিছু হয়ে গেলে উচ্ছ্বাস আবারও কাছের মানুষ হারানোর মতো কষ্ট পাবে।
হঠাৎ প্রিয়তার কথা মনে পড়তেই তার চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে।
“রাসেল।”
“জ্বি ভাই বলেন।”
“উনি এখন কোন হাসপাতালে আছে?”
রাসেল চোখ বড় বড় করে বললো,”আপনি যাবেন?”
রাসেলের চোখে চোখ রেখে উচ্ছ্বাস বললো,”কথা কম। এখন ওদের আমাকে দরকার, বুঝতে পেরেছিস?”

মায়ের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে শুণ্যের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। তার মনে হচ্ছে কোনো একটা দু:স্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তারা, ভয়ংকর একটা দু:স্বপ্ন। ঘুমটা ভেঙে গেলেই স্বপ্নটাও ভেঙে যাবে। তখন আবার দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। বাবা হাসিমুখে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে, আর মা অল্পতেই রেগে বাবার সাথে চিৎকার করছে। মা যতো রাগ করছে, বাবা তত মিটমিট করে হাসছে। এই মুহূর্তটা সত্যি হতে পারেনা, কোনোভাবেই না। এটা অবশ্যই একটা দু:স্বপ্ন, তাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে বাজে দু:স্বপ্ন।

মার্জিয়া বেগমের জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছিলো সে। পেখম মায়ের মুখে পানি ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়েছে। প্রিয়তা ঠিক তখনই এসে পৌঁছায়।
এই মুহুর্তে মার্জিয়া বেগম কাঁদছে না। প্রিয়তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে নির্লিপ্ত চোখে বসে আছে। প্রিয়তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি এসে পড়ে মার্জিয়া বেগমের হাতের উপর।

“মানুষটা তার জীবনে কাউকে কোনোদিন ছোট করে কথা বলেনি। কাউকে কষ্ট দেয়নি। সবাইকে শুধু ভালোবাসা বিলিয়েই গেলো। কে তার শত্রু হতে পারে? কে করতে পারে এই কাজ? আজীবন সহজ সরল থাকা মানুষটাকে এতো বড় শাস্তি কে দিলো?”
মার্জিয়া বেগম আবারও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
প্রিয়তা মায়ের মাথাটা আরো শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,”শান্ত হও মা, শান্ত হও। আমার বাবার শত্রু কেউ হতে পারে না।”
“সারাজীবন মানুষটাকে ভুল বুঝে গেলাম। এই প্রথম আমার মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে আমি একা। ওই মানুষটা ছাড়া আমার আর কেউ নেই এই দুনিয়ায়। আমি অন্ধ ওকে ছাড়া। কেনো এই দিন দেখতে হলো আমাকে?”
পেখম ফুঁপিয়েই যাচ্ছে মায়ের পাশে বসে। বাবা ছাড়া আসলেই তারা অন্ধ। খারাপ কিছু এখন ভাবতেও পারছে না তারা কেউ।

“আপা।”
প্রিয়তা লাল ভেজা চোখে পেখমের দিকে তাকায়।
“আমার সাথে একটু ওদিকে চল। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আছে তোর সাথে।”
প্রিয়তা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”এখানেই বল, মায়ের এই অবস্থায় মাকে ফেলে যাবো কীভাবে?”
“এখানে বলা যাবে না আপা। তবে তোকে এখনই কথাটা বলতে হবে আমাকে।”
প্রিয়তা মার্জিয়া বেগমের মাথাটা চেয়ারে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তার শরীরও ক্লান্তি আর অবসাদে ভেঙে পড়ছে। বাবার ভালো কোনো খবর না পাওয়া পর্যন্ত অস্থির হয়ে আছে মনটা।

প্রিয়তাকে টানতে টানতে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসে পেখম। কিছুটা ইতস্তত করে আস্তে আস্তে সে বললো,”আপা কারা এই কাজ করেছে এটা মনে হয় আমি জানি।”
প্রিয়তা চমকে উঠে বললো,”কি বলছিস তুই? যদি জানিস তাহলে এতোক্ষণ চুপ করে আছিস কেনো? কে করেছে এই কাজ?”
পেখম চাপা গলায় বললো,”আমার এক বন্ধু স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখেছিলো কয়েকটা ছেলের সাথে বাবার তর্কবিতর্ক হচ্ছিলো। তারা বলছিলো, বাবা নাকি একজন গুন্ডা দিয়ে তাদের মার খাইয়েছে। সম্ভবত ওরা তারাই ছিলো, যারা তোকে কলেজ থেকে ফেরার পথে বিরক্ত করতো। আর উচ্ছ্বাস ভাই যাদের খুব মেরেছিলো। হতে পারে ওরাই এভাবে প্রতিশোধ নিলো বাবার উপর।”
পেখমের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় প্রিয়তা। তার মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা বুঝি গলার কাছে এসে ধকধক করে কাঁপছে। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলেই পেখম তাকে চেপে ধরে।
“আপা তুই ঠিক আছিস?”
প্রিয়তা পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়ে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে তার। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে জ্ঞান হারাবে।

“দেখুন আপনাদের সব কথাই বুঝতে পারছি আমরা। তবে আমাদের ব্যাপারটাও তো আপনাদের বুঝতে হবে। এটা একটা পুলিশ কেস। এভাবে আমরা হুট করে চিকিৎসা শুরু করে দিতে পারিনা। যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়, আমাদেরই সমস্যা হবে। কেনো বুঝতে চাচ্ছেন না আপনারা? তাছাড়া এমন ক্রিটিকাল চিকিৎসার জন্য এককালীন আপনাদের বেশ কিছু টাকা জমা করতে হবে। নাহলে আমরা কোনোভাবেই উনার চিকিৎসা শুরু করতে পারবো না।”
মার্জিয়া বেগম হাতজোড় করে ডাক্তারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,”আমার দুইটা মাত্র মেয়ে, ওরা এখনো অনেক ছোট। এসব থানাপুলিশ ওরা কিছুই বোঝে না। কাছের আত্মীয় বলতে আমার একজন বোন আছে। আমি তাকে খবর পাঠিয়েছি অনেকক্ষণ হলো। সে আসলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি দয়া করে এভাবে চিকিৎসা বন্ধ করে দিবেন না, মানুষটা মরে যাবে।”
মার্জিয়া বেগম চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। হাসপাতাল ভারী হয়ে ওঠে মার্জিয়া বেগমের কান্নায়।
“দেখুন আপনাদের পারিবারিক সমস্যা বুঝতে যেয়ে তো আমরা বিপদে পড়তে পারিনা। নিয়মের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। আগে জিডি করবেন এরপর টাকা জমা দিবেন। তারপর আমরা আমাদের কাজ শুরু করবো। এর আগে আমরা রোগীর শরীর স্পর্শ করতে পারবো না।”

“সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে ডাক্তার সাহেব, আপনি আপনার কাজ শুরু করুন।”
গম্ভীর পুরুষালি গলার আওয়াজ শুনে সবাই চমকে উঠে তাকায়। আওয়াজের দিকে ঘুরে তাকাতেই থমকে যায় সবাই।
বুকে হাত বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। তার চোখে কালো সানগ্লাস পরে থাকায় সে কোনদিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যাচ্ছেনা।

মার্জিয়া বেগম হতভম্ব গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস, তুমি?”
পেখম হেসে দেয় কষ্টের মাঝেও। শুধু প্রিয়তার মুখে হাসি নেই। সে অবিশ্বাস্য চোখে শুধু তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে।

ডাক্তার এগিয়ে যায় উচ্ছ্বাসের কাছে।
“আপনি কে? আপনার পরিচয় কি?”
উচ্ছ্বাস চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে বললো,”আমি কে এই মুহুর্তে আপনার না জানলেও চলবে। আপনি যে কারণে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি করছেন আমি সেগুলো ইতোমধ্যেই কাউন্টারে জমা করে দিয়েছি, চাইলে দেখে নিবেন। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব উনার চিকিৎসা শুরু করুন।”
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে।
“আপনারা ডাক্তার, কসাই না। সবকিছুর উপরে আপনাদের কাছে রোগীর জীবন বাঁচানোটাই মুখ্য হওয়া উচিত। এখন এভাবে তাকিয়ে না থেকে আপনার কাজে যান। রোগীকে সুস্থ না করে আমি হাসপাতাল ছাড়বো না। আপনার যা কিছু দরকার আমাকে এসে বলবেন। উনাদের কিছু বলে তাদের মানসিক অবস্থাটা আরো দূর্বল করে দিবেন না।”
ডাক্তার মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। মার্জিয়া বেগম আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
ডাক্তার চলে যেতেই পেখম ছুটে আসে উচ্ছ্বাসের কাছে।

“উচ্ছ্বাস ভাই।”
শব্দ করে কেঁদে দেয় সে। উচ্ছ্বাস হালকা হেসে পেখমের মাথায় হাত রেখে বললো,”কেঁদো না পেখম। তোমার বাবা আর যাই হোক, তার দুই রাজকন্যার চোখের পানি সহ্য করতে পারতো না। চোখ মুছে মায়ের পাশে বসো। কোনো ভয় নেই, আমি আছি। যে কোনো দরকারে আমাকে পাশে পাবে।”
উচ্ছ্বাস কথা শেষ করে প্রিয়তার দিকে তাকায়। মাত্র কয়েক ঘন্টায় মেয়েটাকে চেনাই যাচ্ছেনা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে তার। লাল পদ্মের মতো লাগছে তার চোখ দু’টো। উচ্ছ্বাসের ইচ্ছা করে খুব যত্নে তার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বলতে,’ভয়ের কি আছে? আমি আছি তো পাশে।’
প্রিয়তা অনড় দাঁড়িয়ে আছে। উচ্ছ্বাস আসায় সে খুশি নাকি অখুশি বোঝা যাচ্ছেনা। তার ব্যবহারে উচ্ছ্বাস কিছুটা অবাক হয়। পরক্ষণেই ভাবে হয়তো বাবার এমন অবস্থায় সে কোনো অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না।

মার্জিয়া বেগম ধীর পায়ে হেঁটে উচ্ছ্বাসের সামনে এসে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাস ম্লান হেসে বললো,”মামী ভয় পাবেন না। উনার মতো ফেরেশতা তুল্য একজন মানুষের জীবন এভাবে চলে যেতে পারেনা। উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন, দেখে নিবেন আপনি।”
মার্জিয়া বেগম উচ্ছ্বাসের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”কেনো তুমি আমাদের জন্য এতোকিছু করছো? তোমার সাথে তো আমি অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। আমার জন্য তুমি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছো। তবে আজ হঠাৎ…..”
“ওই মানুষটা আমার জন্য যা করেছে, আমার আমার জীবনের প্রতিটা রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তার ঋণ শোধ করতে পারবো না। এটা তার কাছে কিছুই না।”
“তবে কি তুমি ঋণ শোধ করতে চাচ্ছো?”
“কিছু কিছু মানুষের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে চাইনা। তাদের কাছে আজীবন আম ঋণী থাকতে চাই। কবির শাহ নামক মানুষটা আমার জীবনে একটি বটবৃক্ষ। তার কাছে আমি আজীবন ঋণী থাকতে চাই। এটা শুধুমাত্র আপনাদের থেকে পাওয়া ভালোবাসার ছোট্ট একটা বহিঃপ্রকাশ, আর কিচ্ছু না।”
মার্জিয়া বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ওঠে।
“আমার নিজের লোকেরা পর্যন্ত আমার এই বিপদে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। অথচ তাদের কথা শুনে আমি আমার পরিবারে কতো অশান্তি করেছি, মানুষটাকে ছোট করেছি।”
উচ্ছ্বাস পকেট থেকে রুমাল বের করে মার্জিয়া বেগমের দিকে তুলে ধরে।
“কাঁদবেন না মামী। আমার মা নেই, মায়ের মতো কারো চোখে আমি পানি সহ্য করতে পারিনা। এ ক্ষমতা আমাকে সৃষ্টিকর্তা দেয়নি।”
মার্জিয়া বেগম কাঁপা কাঁপা হাতে রুমালটা হাতে তুলে নেয়। একদৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায় সে। ছেলেটাকে আজ এতো আপন লাগছে কেনো? মনে হচ্ছে ছেলেটার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে। অনেক অন্যায় করেছে সে এই ছেলেটার সাথে। বাবা-মাকে হারিয়ে অসহায় অবস্থায় তাদের কাছে এসেছিলো। সে কি পারতো না একটু স্নেহের পরশে ছেলেটাকে আগলে রাখতে? খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? অনুশোচনায় আড়ষ্ট হয়ে আসে মার্জিয়া বেগম।

“মহান সাজা কি আপনার স্বভাবেই আছে?”
হাসপাতাল থেকে বাইরে এসে উচ্ছ্বাস সিগারেট ধরিয়েছিলো, কারণ ভিতরে ধূমপান নিষেধ।
প্রিয়তাকে দেখেই উচ্ছ্বাস সিগারেট ফেলে দেয়।
“তুমি এখানে?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না, কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে।
“আমি আসায় মনে হচ্ছে তুমি খুশি হও নি।”
“আজ যদি আপনি আমাদের জীবনে না আসতেন, তবে হয়তো এই দিনটাই আমাদের দেখতে হতো না।”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে বললো,”ঠিক বুঝলাম না তোমার কথা।”
“নায়ক সাজতে ইচ্ছা করে? বিপদে হাজির হয়ে নিজেকে সুপারম্যান মনে করেন? আজ আপনার এই অতিরিক্ত মহান সাজার জন্য আমাদের এই অবস্থা।”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার শরীর থেকে সিগারেটের ধোঁয়া মিশ্রিত একটা গন্ধ আসছে। যে গন্ধ প্রিয়তার অসম্ভব প্রিয় ছিলো। কিন্তু আজ ভালো লাগছে না।
“তুমি কি বলছো এসব? তুমি কি কোনো কারণে মামার এই অবস্থার জন্য আমাকে দায়ী করছো?”
প্রিয়তা হালকা চিৎকার করে বললো,”অবশ্যই আপনি দায়ী। আজ আপনার জন্য এই অবস্থা আমাদের।”
চোখ বড় বড় করে উচ্ছ্বাস ফিসফিস করে বললো,”পাগল হয়ে গেলো নাকি শুয়োপোকাটা?”
“এই কি বললেন আমাকে?”
“কিছু বলিনি। দয়া করে এটা বলো তোমাদের এই অবস্থার জন্য আমি কীভাবে দায়ী?”
প্রিয়তা ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,”আমাকে কলেজ থেকে ফেরার সময় বিরক্ত করেছে দেখে কেনো মারতে গেলেন তাদের? কে বলেছিলো এতো মাতব্বরি করতে? আমি বলেছিলাম? আমাকে একটু কলেজে এগিয়ে দিতে বলেছিলাম, এটাই কি আমার অন্যায় ছিলো? কে বলেছিলো এতো হিরো সাজতে?”
একদমে কথাগুলো বলে থামে প্রিয়তা।
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”ওই বদমাশগুলোই কি তবে মামার উপর আক্রমণ করেছে?”
“জেনে কি করবেন আপনি? আমার মারবেন ওদের? আমাদের পুরো পরিবারটাকে এবার শেষ করে দিতে চান?”
উচ্ছ্বাস দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,”তুমি শুধু বলো এই কাজ কি ওরা করেছে? তুমি কি নিশ্চিত?”
“এবার থামুন দয়া করে, অনেক করেছেন আমার জন্য। আর কিচ্ছু করা লাগবে না। আমি হাতজোড় করে অনুরোধ করছি আপনার কাছে।”
উচ্ছ্বাস জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। তার ফর্সামুখ রাগে লাল হয়ে যায়।

ঠিক এমন সময় পেখমের চিৎকারে কেঁপে ওঠে উচ্ছ্বাস, প্রিয়তা দুইজনই। পেখম চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ওদের দিকেই ছুটে আসছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে প্রিয়তার। কোনো খারাপ খবর কি নিয়ে আসছে পেখম? প্রিয়তার মনে হয় এবার সত্যিই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে।

(চলবে…….)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-২০+২১

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২০

“আচ্ছা পেখম তোর কি মনে হয় উচ্ছ্বাস ভাই ফিরে আসবে?”
পেখম হাসিমুখে বললো,”আসবে না মানে? অবশ্যই আসবে, একশোবার আসবে। শোন আমি একটা সিনেমা দেখেছিলাম। নায়ক নায়িকাকে ফেলে অনেক দূরে চলে যায়। নায়িকা অনেক কষ্ট পায়। তবুও নায়ক ফিরে আসে না। এরপর হঠাৎ করে একদিন নায়িকার অন্য একটা ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। যেদিন বিয়ে, ঠিক সেদিন নায়ক ফিরে আসে। শেষমেশ নায়কের সাথেই বিয়ে হয়।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”তো এখানে ওই গল্প শোনানোর মানে কি?”
পেখম ঠোঁট উলটে বললো,”তুইও এক কাজ কর। ওই টাক বেটা নিয়াজকে বিয়ের ঘোষণা দে। ঠিক বিয়ের দিন দেখবি উচ্ছ্বাস ভাই এসে হাজির। একদম পঙ্ক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে তোকে নিয়ে যাবে। বেচারা নিয়াজ টাক মাথায় সরষের তেল ঢালবে।”
প্রিয়তা রাগে লাল হয়ে বললো,”পেখম ভালো হবে না কিন্তু।”
“আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হ। তোর এই পেঁচার মতো মুখটা দেখতে আর ভালো লাগছে না। তাই একটু মজা করলাম তোর সাথে।”
প্রিয়তা ধীরে ধীরে হেঁটে জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। রাতের আকাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করে, কোথাও মেঘ জমেছে কিনা। কারণ মেঘ জমলেই বৃষ্টি হতে পারে। আর ওই মানুষটা কথা দিয়েছে যে এরকম কোনো এক মাতাল করা বৃষ্টির দিনে সে আসবে। কথা দিয়ে কথা না রাখার মানুষ সে না।
পেখম উঠে এসে আপার পিছনে দাঁড়ায়। প্রিয়তার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,”আপা আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস?”
প্রিয়তা মৃদু গলায় বললো,”কি?”
“আমার মনে হয় তুই উচ্ছ্বাস ভাইকে যতোটা ভালোবাসিস, উনি তোকে তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসে।”
প্রিয়তা চমকে উঠে বললো,”কীভাবে বুঝলি?”
“সেই পহেলা বৈশাখের দিনের কথা মনে আছে? ওইদিন উনার চোখেমুখে আমি রাগের আড়ালে তোর জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম।”
প্রিয়তার শরীরে উষ্ণ স্রোত বয়ে যায়।
নিজেকে সামলে পেখমের কান ঈষৎ টেনে বললো,”খুব পেকেছিস তুই। এবার বাবাকে বলে তোর ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।”
পেখম খিলখিল করে হেসে দেয়। প্রিয়তাও হাসে। অনেকদিন পর দুই বোনের হাসির শব্দ শোনা যায়।

কবির শাহ টিউশন করিয়ে ফিরেই প্রথম মেয়েদের ঘরে আসে, এরপর অন্য কথা। মেয়েদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দুই মেয়েকে এভাবে খোলা প্রাণে হাসতে দেখে মনটাই ভালো হয়ে যায় তার। বড় মেয়েটার মুখে কতোদিন পর হাসি দেখা গেলো। মেয়েটা না হাসলে যে বাড়ি নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।

“আচ্ছা আমি বরং তবে পরেই আসি।”
দুই বোন ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে দেখতেই হাসি থামিয়ে দেয় জোর করে। তাও ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকে।
পেখম ছুটে যেয়ে বাবার এক হাত চেপে ধরে।
“পরে আসবে মানে? এমন কি কোনোদিন হয়েছে যে তুমি বাইরে থেকে ফিরে আমাদের ঘরে পরে এসেছো?”
কবির শাহ মুচকি হাসে।
“তোরা দুই বোন তো খুব হাসাহাসি করছিলি, তাই আর বিরক্ত করতে চাইনি তোদের।”
প্রিয়তা স্মিত হেসে বাবার আরেক হাত ধরে।
“তুমি শুধুমাত্র আমাদের বাবা নও, তুমি আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সেই শৈশব থেকে দেখে আসছি তুমি যেমন বটবৃক্ষের মতো আমাদের আগলে রেখেছে ঠিক তেমনই বন্ধুর মতো পাশে থেকেছো। তুমি আসায় আমরা বিরক্ত হবো?”
দুই মেয়ে দুই পাশ থেকে হাত চেপে রেখেছে শক্ত করে। কবির শাহ চাইলেও চোখের পানিটুকু মুছতে পারছে না।

“ও বাবা খুব খিদে পেয়েছে।”
প্রিয়তা পেখমের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো,”একটু আগেই তো সন্ধ্যার নাস্তা করলি, এরমধ্যেই খিদে পেয়ে গেলো তোর?”
পেখম অসহায় মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”পেলে কি করবো বাবা?”
কবির শাহ দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে তাকায়।
মেয়েদের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,”চটপটি খাবি?”
পেখম হইহই করে উঠতেই কবির শাহ মুখে আঙ্গুল দেয়।
“আস্তে আস্তে চিৎকার কর। তোর মা জানলে কুরুক্ষেত্র বাঁধাবে। গতবার পেট খারাপ বাঁধিয়ে তুই তোর মায়ের কাছে বকা শুনিয়েছিস আমাকে।”
পেখম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”আমি?”
প্রিয়তা চোখমুখ কুঁচকে বললো,”তা নয়তো কি? বললাম এক প্লেট খা আপাতত। গুণে গুণে তিন প্লেট সাবাড় করে ফেললি। এরপর বাড়ি এসে পেট খারাপটা যে হলো তোর। এরপর থেকেই তো মা আমাদের বাইরে চটপটি খাওয়া বন্ধ করে দিলো।”
কবির শাহ দুই মেয়েকে থামায়।
“থাম থাম, তোদের চিৎকারেই তো তোদের মা বুঝতে পারবে। যেতে চাইলে ঝটপট তৈরি হয়ে নে। সময় মাত্র পাঁচ মিনিট।”
“বাবা পাঁচ মিনিটে তৈরি হওয়া যায়?”
কবির শাহ একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকায়, যে দৃষ্টির অর্থ যেতে চাইলে পাঁচ মিনিটেই তৈরি হতে হবে।

“মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
কবির শাহ জোর করে হেসে বললো,”এই একটু হাওয়া খেয়ে আসি। কি রে চুপ করে আছিস কেনো তোরা? বল কিছু।”
পেখমও একটা তেলতেলে হাসি দিয়ে বললো,”হ্যা মা, যা গরম পড়েছে। বাইরে থেকে একটু হাওয়া খেয়ে এলে মন্দ হয়না।”
মার্জিয়া বেগম কাজ করতে করতে নির্লিপ্ত মুখে বললো,”গতবার হাওয়া খেতে যেয়ে যে পেট খারাপ বাঁধালে, এবারও এমন কিছু হলে আমাকে রাতে ডাকতে আসবে না। ‘ওমা পেট ব্যথা করছে, ও মা ওষুধ দাও।’ যে হাওয়া খাওয়াতে উষ্কানি দিচ্ছে তাকেই ডেকো, কেমন?”
কবির শাহ দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। বরাবরই তার স্ত্রীর বুদ্ধির কাছে হেরে যেতেই হয় তাকে।

“আসলে মার্জিয়া তুমি যা ভাবছো এমন কিছু না……”
“এই নমুনা দু’টোকে আমি পেটে ধরেছি তুমি না মাষ্টারমশাই। তাই ওদের মুখ দেখলে আমি ওদের ভিতরে কি চলছে বলে দিতে পারি।”
শেষের কথাটা মার্জিয়া বেগম কিছুটা জোর দিয়ে বলে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কবির শাহ ছোট্ট করে হেসে স্ত্রীর কাছে যেয়ে দাঁড়ায়।
“পাঁচ মিনিটে তৈরি হতে পারবে?”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”এই রাতে তৈরি হবো মানে?”
“আজ নাহয় তুমিও আমাদের সাথে হাওয়া খাবে।”
“না না আমি এসবের মধ্যে নেই।”
প্রিয়তা পেখম দুইজনই ভীষণ জোরাজোরি শুরু করে দেয়।
“ও মা চলো না, খুব মজা হবে।”
মেয়েদের না বলার জন্য কবির শাহের দিকে তাকাতেই সে কিছুটা থমকে যায়। কবির শাহ সুন্দর করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো চোখ দিয়েই আকুতি করছে।
মার্জিয়া বেগম কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”আমি যেতে পারি কিন্তু একটা শর্তে। আমি কিছু খাবো না।”
পেখম চিৎকার করে বললো,”আচ্ছা মা, সে দেখা যাবে। মনির চাচা চটপটি যা বানায় না, ঘ্রাণেই তোমার…..”
মার্জিয়া বেগম রাগী চোখে তার দিকে তাকাতেই পেখম থেমে যায়।

“অনুরোধটা যখন রাখলেই তবে আরেকটা অনুরোধ রাখবে মার্জিয়া?”
“আবার কি?”
“তোমার ওই ধূসর পাড়ের নীল শাড়িটা পরবে? ওটায় দারুণ লাগে তোমাকে।”
মার্জিয়া বেগম কপট রাগ দেখায়, ভিতর ভিতর লজ্জায় লাল হয়ে যায় একদম। মেয়েদের সামনে লোকটা কি শুরু করেছে? বয়স বাড়ছে আর বোধবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে লোকটার।

পেখম প্রিয়তার ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো,”আপা রে আমাদের কেউ এখনো প্রেম দেখিয়ে শাড়ি পরার আবদার করেনা। দেখেই যেতে হবে আমাদের।”
মার্জিয়া বেগম কোমরে হাত বেঁধে বললো,”অসভ্য মেয়ে, বাবা মায়ের সাথে মজা করা হচ্ছে? এবার কিন্তু মার খাবি আমার কাছে।”
মার্জিয়ার রাগ দেখে কবির শাহ হাসে। হাসি সংক্রামক, প্রিয়তা আর পেখমও নিজেদের জীবনের সব কষ্ট ভুলে মন খুলে হাসতে থাকে। মধ্যবিত্ত সংসারের পুঁজি বুঝি শুধু এই নির্মল হাসিটুকুই। এটাই তাদের বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র।

ঘোরাঘুরি করে আসতে আসতে বড্ড রাত হয়ে যায়। প্রিয়তা ঘড়িতে দেখে রাত প্রায় দশটা বাজতে চললো। গরমে ঘামে ভিজে অস্থির হয়ে আছে তারা। তবুও মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে আছে। কতোদিন পর তারা চারজন এভাবে মজা করে চটপটি খেলো। ওরা বড় হয়ে যাওয়ার পর এমন সুযোগ আর তেমন আসেনি তাদের জীবনে।

কিন্তু দূর থেকেই তাদের বাড়ির সামনে মর্জিনা বেগমের গাড়ি থেমে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায় তারা।
মার্জিয়া বেগম কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”কি হয়েছে বলো তো? আপা এতো রাতে এখানে কেনো? কোনো সমস্যা হলো নাকি?”
“আমিও তো বুঝতে পারছি না।”

দ্রুততার সাথে হেঁটে আসে মার্জিয়া বেগম। গাড়ির সামনেই ঘর্মাক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে মর্জিনা বেগম।
“কি সমস্যা তোদের? সবাই মিলে গিয়েছিস কোথায়?”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেওয়ার আগেই পেখম মুখ টিপে হেসে বললো,”চটপটি খেতে গিয়েছিলাম খালা, আপনি খাবেন? মনির চাচার চটপটি যা মজার। খেলেই পাগল হয়ে যাবেন আপনি।”
“তুই থাম তো, আমি খাবো নাকি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চটপটি। ওসব মধ্যবিত্তদেরই সাজে।”
কবির শাহ মুখটা অন্ধকার করে বললো,”দেখে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছে আপনাকে। ঘরে যান, বিশ্রাম করুন। মার্জিয়া, তুমি আপাকে নিয়ে ঘরে এসো।”
মেয়েদের নিয়ে কবির শাহ চলে যায়।
মার্জিয়া বেগম মাথা নিচু করে বললো,”তুমি প্রিয়তার বাবার সামনে এভাবে না বললেও পারতে আপা। মধ্যবিত্ত হওয়াটা কি দোষের? বরং ওই মানুষটা তার অল্প রোজগারে আমাদের যেভাবে সুখী রেখেছে, অনেক ধনীরাও হয়তো তা পারেনা।”
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”তুই আবার কবে থেকে তোর বরের মতো এমন কাব্যিক কথা শুরু করলি মার্জিয়া? তোর কখনো ইচ্ছা হয়না দামী রেস্টুরেন্টে খেতে, দামী শাড়ি পরে এমন গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে? ইচ্ছা হয় ঠিকই, পারিস না।”
মার্জিয়া বেগম ঝট করে আপার দিকে তাকায়।
“মনে করো যে ইচ্ছা হয়, কি করবে তাহলে বলো? আমি তো নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করিনি। যখন বাবাটা আমার বিয়েটা দিচ্ছিলেন তখন নিষেধ করোনি কেনো? নিষেধ যখন করোনি তখন আমাকে আমার মতো করে সুখী হতে দাও। প্রতিনিয়ত তুমি আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছো তুমি কতোটা সুখে আছো আর আমি কতোটা কষ্টে। না আমি পেরেছি তোমার মতো বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে, না পেরেছি আমার সংসারে সুখী হতে। আগে খুব আফসোস হতো আপা, বিশ্বাস করো এখন আর হয়না, সত্যিই হয়না। এই মাঝবয়সে এসে মনে হয় আমার জীবনটা তো প্রায় শেষই হতে চললো, আমার মেয়েদের জীবন শুরু। আমি যা পাইনি আমি চাই ওরা যেনো পায়। ওদের সুখেই আমার সুখ হবে।”
একনাগাড়ে কথা শেষ করে মার্জিয়া বেগম থামে। তার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল।
মর্জিনা বেগম কিছুক্ষণ উশখুশ করে। সে সবসময় চায় নিজের প্রতিপত্তি মার্জিয়ার মাধ্যমে এই বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করতে। আর এতোদিন সে সফল হয়েছেও। মার্জিয়া বোকা, তার মাথায় এসব ঢুকিয়ে তাকে বশে আনতে পেরেছে। ইদানীং মার্জিয়া বেগম অল্পেই ছ্যাৎ করে ওঠে, দু’চারটা কথাও শুনিয়ে দেয় বড় বোনকে।
মর্জিনা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বললো,”খুব দরদ উথলে পড়ছে স্বামীর উপর, তাইনা? যত্তসব আদিখ্যেতা।”

“আপা, এতো রাতে তুমি এসেছো? কিছু বলবে তুমি? ঘরে চলো।”
“বলতে তো এসেছি বটেই। তবে ঘরে যাওয়া যাবে না এখন। ঘরে গেলেই তোর ওই মহাজ্ঞানী স্বামীটা এসে কথার মধ্যে ঢুকে যাবে।”
মার্জিয়া বেগম বিরক্ত চোখে তাকায় বোনের দিকে, কিছু বলেনা।
“বেশ, এখানেই বলো কি বলবে।”
মর্জিনা বেগম এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললো,”তোদের বাড়ির ওই আশ্রিত ছেলেটা কোথায়?”
“আপা, ওকে বারবার আশ্রিত বলার কি খুব দরকার? কিছুদিন বিপদে পড়েছিলো, এখানে ছিলো। এখন এখান থেকে চলে গেছে।”
মর্জিনা বেগম মনে মনে বললো,’স্বামী তো মাথায় ভালোই জ্ঞান ঢুকিয়েছে। দুইদিন আগে নিজে যে ছেলেকে দেখতে পারতো না, এখন তার হয়েই কথা বলছে। দেখছি তোকে…..’

“এখান থেকে চলে গেছে না ছাই, বরং এখানে যা পারতো না দূরে যেতে তাই করার চেষ্টা করছে।”
“তার মানে? কি বলতে চাচ্ছো তুমি?”
“তোর মেয়ে তো চুটিয়ে প্রেম করছে ওই বদমায়েশটার সাথে। ছি ছি, শেষে কিনা পচা গর্তে পা দিলো তোর মেয়ে?”
মার্জিয়া বেগমের শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে।
“আপা এসবের মানে কি? খোলসা করে বলো।”
“ওই ছেলে তোর মেয়েকে প্রেমপত্র দেয়, তাও প্রিয়তার কলেজে যেয়ে। পুরো কলেজে ছি ছি পড়ে গেছে। এমন মফস্বল শহরে এই কাজ কেউ করে?”
মার্জিয়া বেগমের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
“তুমি জানলে কীভাবে? আমি কাছে থেকেও কিছু জানতে পারলাম না।”
মর্জিনা বেগমের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। জায়গামতো লেগেছে ওষুধ। এবার শুধু প্রলেপ দেওয়ার পালা।
“এসব খবর কি আর চাপা থাকে রে? কলেজের আশেপাশের সবাই পর্যন্ত জেনে গেছে। যার হাত দিয়ে ওই ছেলে প্রেমপত্র পাঠিয়েছে, সে জানিয়েছে নিয়াজকে। নিয়াজ ছেলেটা তো ওই কলেজের একজন হর্তাকর্তা বলা যায়, কতো টাকা ডোনেট করে প্রতিবছর কলেজে ভাবতে পারবি না। ছেলেটা এমন ভালো, বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পরেও কলেজে সবাইকে জানিয়েছে প্রিয়তা তার হবু স্ত্রী, যাতে কেউ সাহস না করে ওকে কোনো কটু কথা বলতে। নিয়াজ এ কথা শোনার সাথে সাথে কি ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। ছুটে এসেছে আমার কাছে। মন খারাপ করে বলছিলো, ‘খালা ওর যে আমার সাথে বিয়ে হবে না তা নিয়ে আমার দু:খ নেই। ও যেখানে ভালো থাকবে তাতেই আমার ভালো লাগবে। কিন্তু অমন ফুলের মতো একটা মেয়ে একটা বখাটে ছেলের সাথে প্রেম করছে ভেবেই আমার কষ্ট হচ্ছে।’
কি ভালো ছেলে তুই ভাব একবার। এতো অপমান সহ্য করার পরেও কেমন প্রিয়তার কথা ভাবছে।”
মার্জিয়া বেগম রাগে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। মর্জিনা বেগম সেদিকে তাকিয়েই মুখ টিপে হাসে।

“শুধু কি তাই? কতো আশা নিয়ে ছেলেটা বড় মাছ কিনে এনেছিলো এ বাড়িতে, ওই বদ ছেলেটা ওর গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে। দূর দূর করে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে।”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে বললো,”গায়ে হাত তুলেছে? উচ্ছ্বাস তো এমন ছেলে নয়।”
“তুই চুপ কর তো। নিয়াজ কি মিথ্যে বলেছে? এখনো ছেলেটার মুখ বাঁকা হয়ে আছে মার খেয়ে।”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না। রাগে তার শরীর কাঁপছে। ইচ্ছা করছে এখনই মেয়ের চুলের মুঠি চেপে ধরে ইচ্ছামতো মারতে। আহ্লাদ পেয়ে অসভ্য হয়েছে। বখাটে এক ছেলের সাথে প্রেম? এজন্যই বুঝি ছেলেটা এ বাড়ি ছেড়েছে।

“তুই আবার মেয়েটাকে কিছু বলিস না। ছোট মানুষ একটা ভুল করে ফেলেছে। দোষ তো ওই ফাজিল ছেলেটার।”
“ইচ্ছা তো করছে মেয়েটাকে মেরেই ফেলতে। কিন্তু ওর বাবার জন্যই তো কিছু করতে পারিনা।”
“আমার কি মনে হয় জানিস মার্জিয়া? কবির নিজেও চায় ওই ছেলের সাথেই মেয়েকে বিয়ে দিতে।”
“কি বলছো আপা? ওর বাবা কেনো চাইবে এমন?”
“এমন একটা ভাব করছিস যেনো কিছু জানিস না। বিয়ের আগে ওই ছেলের মায়ের সাথে যে কবিরের প্রেম ছিলো ভুলে গেছিস তুই? নিজের প্রেম সফল করতে না পেরে মেয়েকে উষ্কে দিচ্ছে। নাহলে তুই ভাব নিয়াজের মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিতে মেয়ের বাবারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতো ভালো সম্বন্ধ হাতছাড়া করতে চায় কবির।”
বিস্ফারিত চোখে মর্জিনা বেগমের দিকে তাকায় মার্জিয়া। এমন কিছু তো আগে ভাবেনি কখনো।
“আমি ছুটতে ছুটতে এসেছি তোর কাছে। একটু আগেই তুই বললি তুই যা পাস নি, মেয়েরা পেলেই তোর শান্তি। তুই কি চাস না মেয়ে সুখী হোক?”
মার্জিয়া বেগম নির্লিপ্ত চোখে আপার দিকে তাকিয়ে বললো,”তাহলে কি করা উচিত আপা এখন?”
মুখে ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে মর্জিনা বেগম ফিসফিস করে বললো,”নিয়াজ এখনো প্রিয়তার জন্য পাগল হয়ে আছে। কবিরকে কিছু একটা বুঝিয়ে রাজি করিয়ে ফেল।”
মার্জিয়া বেগম অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”কিন্তু আপা সে কি রাজি হবে? তুমি তো তার স্বভাব জানোই।”
“মেয়েরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। ছলেবলে কৌশলে যেভাবেই হোক রাজি করাতে হবে তোকে। আর একটা কথা, যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। পারলে এই সপ্তাহতেই।”
“কি বলছো আপা? এই সপ্তাহেই?”
“যদি সব জানতে পেরে তোর মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায় ওই ছেলেটা এরমধ্যে, তখন কি করবি?”
মার্জিয়া বেগম অস্বস্তিতে ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকায়। কিছুই ভালো লাগছে না তার। কি করবে এখন? আপার কথা ফেলে দেওয়াও যাচ্ছে না।
“আর হ্যা, প্রিয়তাকে এ কয়দিন কলেজে যেতে দিস না। বিয়ে হয়ে গেলে এতো পড়ে কি হবে? ওদের কি কম আছে? তাছাড়া ওরা মেয়েদের এতো পড়াশোনা পছন্দও করেনা। মেয়েরা থাকবে সারাদিন বাড়িতে, ওদের এতো পড়ে কি হবে?”
“কি বলছো আপা? মেয়েটা উচ্চমাধ্যমিকও দিবে না?”
“বিয়েটা একবার হয়ে যাক, প্রিয়তা চাইলে নাহয় কোনোভাবে নিয়াজকে বুঝিয়ে আবার কলেজে যাবে। নিয়াজ কি প্রিয়তার কথা ফেলে দিবে?”
মার্জিয়া বেগম উত্তর দেয়না, কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না সে। যদি সত্যিই এমন প্রেমপত্র দেওয়া নেওয়া হয় তবে সত্যিই তো অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কীভাবে আটকাবে সে এখন?

“চলি রে আজ, তোর মেয়েদের ভালো চাই বলেই ছুটে ছুটে আসি। অন্য কেউ হলে কবিরের এমন ব্যবহারের পরে কবেই সম্পর্ক চুকেবুকে দিতো। নেহাৎ তোর মেয়েদের নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসি তাই।”
মার্জিয়া বেগম পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে হাসতে হাসতে মর্জিনা বেগম গাড়িতে ওঠে। মার্জিয়া বেগমের সামনে দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে যায়।
মার্জিয়া ঘোর লাগা চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আচ্ছা, তার মেয়েটাও যদি এমন দামী গাড়ি করে ঘুরে বেড়ায়, দামী শাড়ি পরে তবে মা হিসেবে তার কি আনন্দ হবে না? আচ্ছা, এসব না পেয়েও কি সে খারাপ আছে? যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে পড়তে চায় মার্জিয়া বেগমের।

আকাশে আজ হাজারটা তারার মেলা। উচ্ছ্বাস মাটিতেই মাদুর পেতে শুয়ে তারার দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে তারা গোণার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে।
“মা ওই উজ্জ্বল তারাটা তুমি, সবসময় কেমন জ্বলজ্বল করে চলেছো। আর তার পাশেরই ওই বড় তারাটা বাবা। কি সুন্দর পাশাপাশি আছো তোমরা।”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো,”জানো মা প্রথমবারের মতো কোনো মায়াবতীর চোখে আটকে গিয়েছি আমি। সকাল নেই সন্ধ্যা নেই চোখজোড়া আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি একদন্ডও শান্তি পাচ্ছিনা তাকে না দেখে। তুমি সবসময় বলতে না, আমার জীবনে একটা মায়াবতী আসবে? মা জানো ও তোমার মতোই ভালো। আমি ওর চোখে আমার জন্য এক আকাশ সমান ভালোবাসা দেখেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এটা ওর বয়সের আবেগ। কিন্তু যতো দিন গেছে আমার মনে হয়েছে এই অনুভূতি শুধুমাত্র আবেগের চেয়েও অনেক ঊর্ধ্বে। মা আমি চাইনি আমার এই রঙহীন জীবনে ওকে ঠাঁই দিতে। কিন্তু মা, এই অন্তরটা কি কারো শাসন বারণ মানে? আমি কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছি ওর কাছ থেকে। কিন্তু প্রতিটা দিন আমার একেকটা বছরের মতো লেগেছে ওকে ছাড়া। তৃষ্ণায় গলা, বুক খা খা করছে আমার। তুমি বলে দাও মা আমি কি করবো? আমি যে কাপুরষ নই মা।”

“ও ভাইজান।”
উচ্ছ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দোকানে থাকা ছোট ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে, ওর নাম মকবুল।
“কি রে মকবুল মিয়া, কিছু বলবি?”
“বাড়ি যাইবেন না আফনে? সারারাত এইখানে শুইয়া তারাগো লগে আলাপ করবেন?”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে উঠে বসে।
“একটা সিগারেট নিয়ে আয় দোকান থেকে।”
মকবুল বিরস মুখে নিজের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দেয়। উচ্ছ্বাস নি:শব্দে এসে সিগারেটটা ধরায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।
“এইসব না খাইলে হয়না? শরীরের ক্ষতি হয়।”
উচ্ছ্বাস মকবুলের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমার শরীরের ক্ষতি হলে তোর কি?”
মকবুল উত্তর দেয়না, শার্টের হাতায় চোখ মোছে। সে নিজেও জানেনা কেনো, এই কয়দিনেই এই মানুষটাকে সে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে। লোকটার দিকে তাকালেই তার মায়া হয়। কিছুটা পাগলাটে মনে হয় তার এই মানুষটাকে। একা একা তারার সাথে কথা বলে।

“কাঁদিস কেনো রে বেটা?”
“কান্দি না, চোখে কি যেনো পড়ছে।”
উচ্ছ্বাস ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাসে।
“ভাইজান হ্যায় কি অনেক সুন্দরী?”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কে?”
“আপনার ভালোবাসার মানুষটা।”
উচ্ছ্বাস হতভম্ব হয়ে বললো,”তুই এসব কীভাবে জানিস?”
মকবুল নিজের হলুদ দাঁত বের করে হাসে।
“আপনারে দেখলেই বোঝা যায়। যারা প্রেম করে তারাই এমন বেবাগী হইয়া যায়।”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না।
“কইলেন না? হ্যায় কি অনেক সুন্দরী?”
উচ্ছ্বাস ম্লান হেসে মাথা নাড়ায়।
“বোধহয় অনেক সুন্দরী।”
“বোধহয় ক্যান?”
“কারণ তারে দেখার পর আর কাউরে সুন্দর লাগে নাই।”

মকবুল কিছু বলতে যাবে তার আগেই দুইটা ছেলে হন্তদন্ত হয়ে উচ্ছ্বাসের কাছে এসে দাঁড়ায়। দুইজনের মুখই কালো কাপড়ে অর্ধেক ঢাকা। উচ্ছ্বাস তাদের চিনতে পারে।
“মকবুল তুই যা এখন।”
মকবুল লোক দু’টোর দিকে তাকিয়ে চলে যায়।

“ভাই একটা সুখবর আছে আপনার জন্য। বলতে পারেন সুবর্ণ সুযোগ আছে আজ রাতে আপনার জন্য।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি সুযোগ?”
ছেলেটা চারপাশে চোখ বুলিয়ে আস্তে আস্তে বললো,”আপনার ছোট চাচা আজ এক মহিলা নিয়ে উত্তরের ওই নিরিবিলি বাড়িটায় থাকবে, আর কেউ থাকবে না। খবর আছে কোনো গার্ডও থাকবে না আজ ওখানে।”
উচ্ছ্বাস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
“তুই নিশ্চিত?”
“একশত ভাগ ভাই। আপনি আমারে চিনেন না? আমি কি ভুল তথ্য দিতে পারি?”

দশ মিনিটের মধ্যে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়ে যায়। চারিদিকে ধুলা উড়তে থাকে। উচ্ছ্বাস শার্টের হাতায় চোখ ঢাকে। হঠাৎ করেই তারাগুলো উবে যেয়ে কালো মেঘে ঢেকে যায় রাতের আকাশ। যে কোনো মুহুর্তে অঝোরে বৃষ্টি নামবে।

এখন উচ্ছ্বাসের সামনে দু’টো পথ খোলা। বাবা মায়ের হয়ে প্রতিশোধ নেওয়া নয়তো প্রিয়তার কাছে ছুটে যাওয়া। তাকে যে সে কথা দিয়েছে ঝুম বৃষ্টির রাতে সে প্রেমিক হয়ে ধরা দিবে প্রিয়তার কাছে।

“ভাই কি করবেন? সব তৈরি আছে।”
উচ্ছ্বাস হতবিহ্বল হয়ে তাকায়। প্রকৃতির চারদিক তখন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ঝড়ো দমকা হাওয়ায়।

জানালার শিকগুলো শক্ত করে চেপে ধরে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। চোখের পলক ফেলতেও যেনো ভুলে গেছে। পলক ফেললেই যেনো মানুষটা পালিয়ে যাবে। তীব্র গরমের শেষে স্বস্তির ঝড়ো হাওয়া বইছে। প্রিয়তার মনেও বইছে, তবে সে বাতাস প্রেমের। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। যদি আজ মানুষটা আসে, সে সারারাত তার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে, রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলো হবে এক বৃষ্টিময় প্রেমের সাক্ষী। আর তার বিশ্বাস সে আসবেই, তাকে কথা দিয়েছে যে সে। আসতে তো তাকে হবে, হবেই।

(চলবে……..)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২১

“আপা, এই আপা। আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস? এখানে শুয়ে আছিস কেনো তুই? এই আপা, এই।”
পেখম অবাক হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপাকে পাশে না পেয়ে বেশ অবাক হয় সে। তার ঘুমকাতুরে আপাটা কখনোই সকালে তার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। তাড়াতাড়ি করে সে উঠে এসে দেখে প্রিয়তা জানালার পাশে মাটিতেই কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। গত রাতে অনেক ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। প্রিয়তার পরনের জামার কিছু অংশ এখনো ভেজা। তার মানে কি সে গতকাল সারারাত এখানেই ছিলো?
পেখম আঁৎকে উঠে প্রিয়তার গায়ে হাত দিতেই থমকে যায়। প্রিয়তার শরীর অসম্ভব গরম, জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। পেখমের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়।

“বাবা, ও মা, তাড়াতাড়ি এসো তোমরা।”
কবির শাহ পেখমের গলা পেয়ে ছুটে ছুটতে এসে দেখে প্রিয়তা মাটিতে অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। পেখম তার কোলে প্রিয়তার মাথা ধরে কান্নাকাটি করছে।
কবির শাহের যেনো পা দু’টো ভারী হয়ে যায়। আর এক কদমও হেঁটে যেতে পারবে না এমন মনে হচ্ছে।
মার্জিয়া বেগমও দৌড়ে আসে।

“কি হয়েছে এখানে? প্রিয়তা মাটিতে শুয়ে আছে কেনো?”
পেখম ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,”ও মা, সকালে উঠে দেখি আপা মাটিতেই শুয়ে আছে এভাবে। এখন গায়ে হাত দিয়ে দেখি গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা কেঁপে ওঠে। কবির শাহ তখনও পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। তার মনে হচ্ছে বুঝি কলিজাটাই ছিঁড়ে যাচ্ছে তার।

শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রায় জ্ঞান হারিয়েছে প্রিয়তা। তার মাথার কাছে বসে একনাগাড়ে মাথায় পানি দিচ্ছে মার্জিয়া বেগম। হাত কাঁপছে তার থরথর করে। গত রাতেই মেয়েটা কতো হাসিখুশি ছিলো, একসাথে চটপটি খেতে গেলো হৈ হৈ করে। অনেক কষ্টে নিজের কান্নাটা চেপে ধরে রাখে সে।
পেখম কবির শাহের বুকের উপর মাথা রেখে কাঁদছে।
“বাবা আপা ঠিক হয়ে যাবে তো? ও বাবা বলো না। আপার কিছু হবে না তো?”
কবির শাহ ঠোঁট কামড়ে বললো,”কিচ্ছু হবে না ওর, কিচ্ছু না।”

জ্বরের ঘোরে হঠাৎ প্রলাপ বকে ওঠে প্রিয়তা৷ সবাই চমকে উঠে তাকায় তার দিকে।
মার্জিয়া বেগম ছলছল চোখে কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে প্রিয়তার বাবা।”
কবির শাহ ছুটে মেয়ের মাথার কাছে এসে বসে।
“এইযে মা আমি এখানে। বাবা চলে এসেছে আর কোনো ভয় নেই। বাবা এক চুটকি মেরে সব সমস্যার সমাধান করে দিবে।”
প্রিয়তা অস্পষ্টভাবে কিছু বলেই যাচ্ছে একনাগাড়ে।
পেখম কিছু একটা সন্দেহ করে কান খাঁড়া করে।

‘আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন। আমি ভুল করেছি আপনাকে বিশ্বাস করে। আসলেই আপনি আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। আমি সারাটা রাত বৃষ্টির পানিতে ভিজে আপনার অপেক্ষা করেছি। এতোটা বোকা আমি?’
পেখম ভয়ে ভয়ে বাবা মায়ের দিকে তাকায়। তারা কিছু শুনে ফেলেনি তো?
মার্জিয়া বেগম মাথায় পানি দিয়েই যাচ্ছে আর কবির শাহ মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে নি:শব্দে কাঁদছে। মনে হয়না তারা কিছু শুনেছে।
পেখম এগিয়ে এসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”ও মা আপাকে তো ওষুধ দিতে হবে এখনই। তুমি যাও আপার জন্য তার আগে কিছু খাবার নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণে আপার মাথায় পানি দিচ্ছি।”
মার্জিয়া বেগম আঁচলে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। মেয়ের জন্য হঠাৎ করেই ভীষণ মায়া হচ্ছে তার। এইতো সেদিনই মেয়েটা প্রথম হাঁটা শিখলো, সারা ঘর যেনো প্রজাপতির মতো দৌড়ে বেড়াতো। কি মিষ্টি লাগতো দেখতে। আর যখন আধো আধো বুলিতে প্রথম মা ডাকলো কি অসম্ভব শান্তি হতো তার। এরই মাঝে এতোগুলা বছর কখন কেটে গেলো সে বুঝতেই পারলো না। মনে হয় বুঝি সেদিনের কথা।
“মেয়েকে দেখো প্রিয়তার বাবা।”
“আমি আছি আমার কলিজার কাছে তুমি যাও।”
মার্জিয়া বেগম চলে যেতেই পেখম আপার খুব কাছে এসে বসে। আপার হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে।

“পেখম, আপার কাছে একটু বোস। আমি স্কুলে বলে আসি আজ ক্লাস নিবো না। আসার সময় মোহনলাল ডাক্তারকেও ডেকে আনবো।”
পেখম মাথা নেড়ে বাবাকে আশ্বস্ত করে। কবির শাহ কিছুক্ষণ মেয়ের রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায়।

“আপা, এই আপা। আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস তুই? কার আসার কথা ছিলো গত রাতে?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। পেখম এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় আবারও বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই আসতে চেয়েছিলো?”
প্রিয়তা কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। তার চোখমুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। ভীষণ খারাপ লাগে সেদিকে তাকিয়ে পেখমের।
“আপা তুই তাকিয়েছিস? কেমন লাগছে এখন তোর?”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”পানি খাবো, পানি।”

“ভাই তাই বলে খু’ন করলেন আপনি? কাজটা কি ঠিক হলো? আপনি আমাদের বলেছিলেন শুধু একটু ভয় দেখাবেন। কিন্তু এ কি করলেন? এখন যে আমরাও ফেঁ’সে যাবো আপনার সাথে।”
উচ্ছ্বাস হাতের সিগারেটটা টান দিয়ে ফেলে সামনের ছেলেটার কলার চেপে ধরে। রাগী লাল চোখে তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,”আমি বলছি না, এই খু’নটা আমি করিনি? আমি যাওয়ার আগেই কেউ মেরে রেখে গিয়েছে ওকে। আর কতোবার বলবো তোদের?”
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললো,”কীভাবে বিশ্বাস করবো ভাই এই কথা? আপনি যেভাবে গত রাতে রাম’দা নিয়ে ছুটে গেলেন। আর তার সাথে এতো শত্রুতা কার থাকতে পারে?”
উচ্ছ্বাস জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে।
ছেলেটা কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”ভাই আমাদের পাঁচিলের বাইরে রেখে আপনি ভিতরে গেলেন। কি হয়েছিলো তারপর?”
কিছুক্ষণ থেমে উচ্ছ্বাস আবারও একটা সিগারেট ধরায়। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,”আমি যখন বাড়ির ভিতরে যাই পাঁচিল টপকে তখন দেখি বাড়ির ভিতরটা একদম অন্ধকার। এক ফোঁটা আলো নেই কোথাও। এমনকি গেটে গার্ডও ছিলো না কোনো। আমি কিছুটা অবাক হই। এরপর আস্তে আস্তে পা টিপে বাড়ির সামনের দরজায় হাত রাখতেই দরজাটা খুলে যায় নিজে থেকে। আমি আরো অবাক হই তখন। আমি ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকি। চারদিকে এতো অন্ধকার যে কিচ্ছু দেখতে পারছিলাম না। আমি সুইচবোর্ড খোঁজার জন্য দেওয়াল হাতড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ ধাতব কিছুটা পা বেঁধে আমি পড়ে যাই। আমার শার্টের পিছন থেকে রাম’দাটা নিচে পড়ে যায়। আমি উঠে দাঁড়াতেই দেখি আমার হাতে কোনো একটা তরল লেগে আছে। কিছুটা পিচ্ছিল তরল। আমি গন্ধটা নিতেই দেখি একটা বুনো গন্ধ, খুব পরিচিত। হঠাৎ সুইচবোর্ড হাতে পেতেই জ্বালিয়ে দিই। আর সামনে যা দেখি…..”
“কি দেখেছেন?”
উচ্ছ্বাস একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,”বাদ দে সেসব। তবে এই কাজ আমি করিনি। কিন্তু আমি শুধু ভাবছি আর কে করতে পারে এই কাজ? আমি কার এতোটা শত্রুতা থাকতে পারে ওর সাথে?”
উচ্ছ্বাস চিন্তিত মুখে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে।

প্রিয়তার অসুখ শুনে ছুটে এসেছে সেতারা। আসার পর থেকে প্রিয়তার হাত ধরে মুখ ভোঁতা করে বসে আছে সে। তার চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব কেঁদেছে কিছুক্ষণ আগেই। তার স্বামী আরিফও এসেছে সাথে। বসার ঘরে গম্ভীর হয়ে বসে আছে সে। সেতারার কথা হয়ে গেলে একবারে তাকে নিয়ে আবার চলে যাবে।

সেতারার দিকে তাকিয়ে পেখম, প্রিয়তা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কিন্তু কেউ কিছু বলেনা।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর প্রিয়তা সেতারার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললো,”আপা তুমি ঠিক আছো তো?”
সেতারা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”এমন কেনো বলছিস? আমি ঠিক আছি তো।”
“আসলে তোমাকে কেমন অসুস্থ লাগছে। এমন এলোমেলো আগে কখনো লাগেনি তোমাকে।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেতারা আস্তে আস্তে বললো,”একটা কথা বলবো প্রিয়তা?”
“হ্যা আপা বলো না।”
সেতারা একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”শুধুমাত্র টাকাপয়সা দেখে বিয়ে করিস না। হ্যা জীবনে টাকার প্রয়োজন আছে, তবে সেই প্রয়োজন ভালোবাসার ঊর্ধ্বে না।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে সেতারার দিকে তাকায়।
পেখম পাশ থেকে মুখ টিপে হেসে বললো,”আজ কার মুখে কি শুনছি। তুমি তো সারাজীবন বলেছো টাকা ছাড়া শান্তি নেই, প্রেম ভালোবাসার কোনো দাম নেই। আজ তুমি কিনা এসব বলছো।”
সেতারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রিয়তা কঠিন দৃষ্টিতে পেখমের দিকে তাকায়। পেখম চুপ করে যায়।
প্রিয়তা ঈষৎ হেসে সেতারার দিকে তাকায়।
“আচ্ছা সেতারা আপা, তুমি একটা কথা বলো তো। ভালোবাসা কি সবসময় ভালো রাখে?”
সেতারা থতমত খেয়ে যায়।
“কি হলো আপা উত্তর দাও। টাকাপয়সা এগুলো সুখী করতে যথেষ্ট নয় এটা হয়তো সত্যি। কিন্তু কাউকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসার পরেও কি সুখী হওয়া যায় সবসময়?”
সেতারা মাথা নিচু করে বসে থাকে। বিয়ের আগে একজন তাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। তাকে খুব মনে পড়ে মাঝে মাঝে। পুরো দুনিয়ার সামনে সুখী মেয়েটাও গভীর রাতে বালিশে মুখ গুঁজে ফোঁপায় আর পূর্ব প্রেমিকের কথা ভাবে। তার কনুইতে, গলায় কিংবা ঘাড়ে হয়তো তখন আঘাতের লাল দাগ। পরের দিন সকালেই আবার প্রসাধনীর প্রলেপে ঢাকতে হবে সেই দাগ, নাহলে যে মানুষ জেনে যাবে ভদ্র মুখোশের আড়ালে থাকা আরিফ ঠিক কতোটা ভয়ংকর।

“সমস্যা কি তোমার?”
সেতারা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”আস্তে কথা বলো আরিফ। সবাই শুনতে পাবে।”
আরিফ রাগে লাল হয়ে গেলো। গলার স্বর আরো চড়িয়ে বললো,”কে কি শুনতে পেলো আমার জানার দরকার নেই। তুমি এক্ষুনি আমার সাথে বাড়িতে যাবে।”
সেতারা মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললো,”ওরা খুব করে চাচ্ছে আজ রাতটা যেনো এখানে থেকে যাই।”
আরিফ ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি বললে তুমি?”
কেঁপে ওঠে সেতারা।
“আসলে ওরা অনেক অনুরোধ করছিলো……”
“আমার বাবা যে কাজের লোকের রান্না করা খাবার খায়না তুমি জানো না?”
সেতারা ঢোক চেপে বললো,”আজ রাতটা নাহয় আম্মা রান্না করবে।”
চিৎকার করে ওঠে আরিফ। চুলের মুঠি চেপে ধরে সেতারার। ব্যথায় চোখ বন্ধ করে সেতারা। তার চেয়ে বড় দুশ্চিন্তা খালা বা খালু এই অবস্থায় দেখে ফেললে কি হবে? চোখে পানি চলে আসে তার।
“তোর এতো বড় সাহস। তুই এই বয়সে আমার মা কে রান্নাঘরে যেতে বলিস। তাহলে তোকে রেখে আমার লাভটা কি? তোর পিছনে এতো টাকা খরচ করবো কেনো আমি তাহলে? বাড়ির সব কাজ কাজের লোক করে। তুই শুধু রান্নাটা করিস। রানীর হালে থাকিস। সেইটাও পারবি না?”
“পারবো না তাতো বলিনি। আমি তো রোজ রোজ রান্না করতে বলছি না উনাকে। একটা রাতের জন্য……”
“খুব মুখ হয়েছে তাইনা? এই মুখ কীভাবে বন্ধ করতে হয় আমার ভালো করে জানা আছে। আজ যদি আমাকে একা বাড়িতে ফিরতে হয়, তবে মনে রাখিস সারাজীবন তোকে এখানেই থাকতে হবে। তোর জন্য আমার বাড়ির দরজা বন্ধ।”
কেঁপে উঠে তাকায় সেতারা স্বামীর দিকে। জামাইয়ের এসব আচরণ সম্পর্কে সবই জানে তার মা মর্জিনা বেগম। কিন্তু তার বড়লোক সোসাইটিতে নিজেকে সমুন্নত রাখাটা এতোটাই দরকার যে মেয়ের কষ্ট তাকে স্পর্শ করেনা। তাকে মানিয়েই চলতে হবে স্বামীর ঘরে।

ঠিক তখনই রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে মার্জিয়া বেগম দরজার কাছে আসে। তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে সামনের দৃশ্য দেখে। এ কি দেখছে সে? তবে যে সে শুনে এসেছে রাজরানীর মতো থাকে সেতারা? এই রাজরানীর হাল?
বিশ হাজার টাকা দামের কাতান শাড়িটা সরে যেয়ে কাঁধের দগদগে আঘাতের ঘা দেখা যাচ্ছে। দুই ভরী ওজনের সোনার চুড়ির উপর হাত চেপে ধরায় চুড়ির দাগ পড়ে যাচ্ছে নরম ফর্সা হাতে। তবে কি লাভ এই দামী শাড়ির? কি লাভ এই গহনার? তবে কি এটাই সেতারার জীবন? এভাবেই রেখেছে তার কোটিপতি স্বামী তাকে? কই প্রিয়তার বাবা তো কোনোদিন তার দিকে রাগী চোখে তাকায়নি পর্যন্ত।

হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে মার্জিয়া বেগমের। এ কি ভুলের সাগরে ভাসছিলো সে এতোদিন? আস্তে আস্তে পা ফেলে বসার ঘরে আসে সে। মাথাটা অসম্ভব ঘুরছে। পানি পিপাসা পাচ্ছে। চোখজোড়া অস্বাভাবিক জ্বলছে।
“পানি নাও।”
চমকে উঠে তাকাতেই মার্জিয়া দেখে কবির শাহ এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে রেখেছে তার সামনে।
“পানি এনেছো কেনো?”
“তোমার তৃষ্ণা পেয়েছে তাই।”
মার্জিয়া বেগম অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি কীভাবে জানলে?”
কবির শাহ সুন্দর করে হাসে।
“কি যে বলো মার্জিয়া, একুশটা বছর হতে যাচ্ছে এই মানুষটা আমার। তার কখন কি প্রয়োজন এটা জানতে না পারলে কীভাবে তার সারাজীবনের দায়িত্ব নিলাম আমি বলো? নাও পানিটা খেয়ে নাও। সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমার উপর। একদিকে মেয়ে অসুস্থ, আবার জামাইয়ের জন্য এতো রান্নাবান্না। বাকি যা কাজ আছে আমি করে ফেলবো। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো এখানে দু’দণ্ড। আমার পুতুল বউটা যে এতো কষ্ট করতে পারে না।”
আচমকা শব্দ করে কেঁদে দেয় মার্জিয়া বেগম। হতবাক হয়ে যায় কবির শাহ। সে কিছু বলার আগেই মার্জিয়া বেগম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। একাধারে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে সে। কবির শাহ কিছু না বুঝেই স্ত্রীকে আঁকড়ে ধরে দুই হাতে। আরো জোরে কেঁদে দেয় মার্জিয়া।
“কি হয়েছে মার্জিয়া আমাকে বলো? কে কষ্ট দিয়েছে তোমাকে?”
“আমাকে মাফ করে দাও তুমি। তুমি মাফ না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি, পাপ করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
“তুমি কোনো অন্যায় করোনি মার্জিয়া। আমার তোমার উপর সত্যিই কোনো অভিযোগ নেই, একদম সত্যি। তুমি সবসময় নীলিমার কথা ভেবে একা একাই কষ্ট পাও। তুমি কোনোদিন জানতে পারলে না, সে আমার অতীত ছিলো। আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ তুমি, শুধুই তুমি।”
মার্জিয়া বেগমের বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। তার ইচ্ছা করছে না এই মানুষটার বিশালতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে।
কবির শাহ মাথা চুলকে বললো,”ঘরে যেয়ে মেয়ে, মেয়ে জামাই আছে মহিলাটি কি ভুলেই গেলো? বলছি এগুলো কি ঘরে যেয়ে করা যায়না?”
মার্জিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দেয়। কবির শাহকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
শব্দ করে হেসে দেয় কবির শাহ।
“তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগে এভাবে কান্নার মধ্যে হঠাৎ হেসে দিলে।”
মার্জিয়া বেগম একদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকায়। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে দুনিয়া উলটে গেলেও স্বামীর সাথে আর খারাপ ব্যবহার করবে না সে। যে দামী সম্পদ সে জীবনে পেয়েছে পৃথিবীর সব সম্পদ একত্র করলেও তার সমান হবে না। মেয়ের জীবনের সিদ্ধান্তগুলোও খুব ভেবেচিন্তে নিতে হবে এবার। কোনো ভুল করা যাবে না।

কালো চাদরে নিজেকে ঢেকে নেয় উচ্ছ্বাস। ঠোঁটের কোণায় সিগারেটের আগুন জ্বলজ্বল করে তার। দুই হাত প্যান্টের পকেটে।
“ভাই আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“আমাকে এখন যেতে হবে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। তার চোখজোড়া দেখতে না পারলে আজ আমি খু’ন হয়ে যাবো নিজের হাতেই।”
“পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে খু’নীকে।”
“আমি তো খু’নী না। আমি কেনো লুকিয়ে থাকবো?”
“আপনি বুঝতে পারছেন না।”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে মিজানের কাঁধে হাত রাখে।
“পুলিশ আমাকে বন্দী করবে কিনা জানিনা, আমি ইতোমধ্যে নন্দিনীর হাতে বন্দী হয়ে আছি। তার হাতের ইশারা আমার দরজায় কড়া নাড়ছে প্রতিনিয়ত। আমাকে যেতে হবে, হবেই।”

ছেলে দু’টোকে রেখেই উচ্ছ্বাস নেমে যায় রাস্তায়। তাদের কেনো যেনো মনে হচ্ছে মানুষটা কোনো বিপদে পড়বে, তাদের বাঁচাতে হবে তাকে। যে কোনো মূল্যে।

রাস্তায় সিগারেটটা ফেলে পায়ের সাথে পিষে ফেলে উচ্ছ্বাস।
“আজকের মতো তোকে ছুটি ধোঁয়া। তোর জন্য তার কোনো কষ্ট হোক, তা আমি সহ্য করবো না।”

(চলবে…..)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-১৮+১৯

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১৮

নীল চুড়ি গুলো হাতে নিয়ে বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে প্রিয়তা। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার। কি যে ভালো লাগছে তার। ইচ্ছা করছে সবসময় পরে থাকতে এগুলো। সে ঠিক করেছে আজ সারারাত এগুলো পরে থাকবে সে।

দূরে বসে আপার কাণ্ড দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে পেখম। অনেকদিন পর আপাকে এতোটা খুশি দেখে খুব ভালো লাগছে তার। এই আপার মুখে সে সবসময় এমন হাসি দেখতে চায়। আপার মুখটা গোমড়া থাকলে তার কিছুই ভালো লাগেনা।
“আপা।”
প্রিয়তা আনমনে উত্তর দেয়,”বল।”
“চুড়িগুলো খুব মানিয়েছে তোর হাতে। মনে হচ্ছে তোর জন্যই বুঝি বানানো হয়েছে।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে মিটমিট করে হাসে। পেখম অবাক হয়ে দেখে সেই হাসি। আচ্ছা প্রথম প্রেমে পড়লে কি মেয়েদের রূপ কয়েক গুণ বেড়ে যায়?

পেখম ধীরে ধীরে হেঁটে এসে প্রিয়তার পাশে দাঁড়ায়। আপার কাঁধে হাত রাখতেই প্রিয়তা হাসিমুখে তাকায় পেখমের দিকে।
“আপা আজ বুঝি তুই অনেক খুশি?”
প্রিয়তা পেখমের দুই হাত ধরে তাকে ঘুরাতে থাকে। পেখম চিৎকার করে বলতে থাকে,”ওরে আপা থাম থাম। এবার তো মাথা ঘুরে পড়েই যাবো।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা? প্রিয়তা একনাগাড়ে ঘুরাতেই থাকে পেখমকে।

“অনেক খুশি আজ আমি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েটা আজকের জন্য আমি।”

“তা এতো খুশির কারণ কি তোর প্রিয়তা?”
পেখমকে থামিয়ে দিয়ে দরজার দিকে তাকায় প্রিয়তা। তার বড় খালার মেয়ে সেতারা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
প্রিয়তা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে সেতারার কাছে এগিয়ে যায়।
“সেতারা আপা তুমি কখন এলে?”
“এইতো এলাম বেশ কিছুক্ষণ। এসে তোদের দুই বোনের কাণ্ড দেখছিলাম। মেয়েটাকে তো এক্ষুনি ঘোরাতে ঘোরাতে ফেলেই দিচ্ছিলি।”
প্রিয়তা মিষ্টি করে হাসে। আজ তার সবকিছু ভালো লাগছে। যদি বড় খালা এসে তাকে বকাঝকাও করে তাও ভালো লাগবে ওর শুনতে।

সেতারা প্রিয়তার পাশ কাটিয়ে খাটে এসে বসে। চারদিক ভালো করে তাকাতেই দেখে টেবিলে বরাবরের মতো একগাদা গল্পের বই।
“তোর এই গল্পের বই পড়ার অভ্যাসটা আর গেলো না। কয়দিন পর তো শুনবো বিয়ের পর নাচটাও ছাড়বি না।”
প্রিয়তার মুখ কালো হয়ে যায়।
পেখম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”কেনো সেতারা আপা? বিয়ের পর আপার নাচ ছাড়তে হবে কেনো?”
সেতারা অবাক হয়ে বললো,”তো বিয়ের পরও কি ও ধেই ধেই করে নাচবে? ওর বর কি বলবে? দেখলি না বিয়ের আগে এতো সুন্দর গান করতাম। বিয়ের পর তোর দুলাভাই বললো গান বন্ধ করে সংসারে মন দাও। শুনতেই হলো তার কথা।”
পেখম সেতারার কাঁধে থুতনি রেখে বললো,”আচ্ছা সেতারা আপা দুলাভাই বিয়ের আগে থেকে ফুটবল খেলতো, বিয়ের পর তাকে নিষেধ করোনি? বলোনি যে ফুটবল খেলা যাবে না?”
সেতারা অবাক হয়ে বললো,”শোনো মেয়ের কথা। ও ফুটবল খেলবে আমি নিষেধ করবো কেনো?”
পেখম মুচকি হেসে বললো,”ওমা তো বলবে না যে বিয়ের পর এভাবে ধেই ধেই করে ফুটবল খেলা যাবে না। ফুটবল বাদ দিয়ে সংসারে মন দাও।”
“কি যে বলিস তুই পেখম। তুই আর বড় হবি না, ছোটটি থেকে যাবি। পুরুষ মানুষের এসব একটু আধটু শখ থাকতেই পারে, এগুলো দোষের কিছু না।”
প্রিয়তা ঈষৎ হেসে এগিয়ে আসে। ওদের পাশে বসে সেতারার বাম হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে বললো,”এসব নিয়ম কে বানিয়েছে সেতারা আপা? পুরুষেরা নাকি আমরা মেয়েরাই? একটা মেয়ে বিয়ের পর নাচলে সেইটা ধেই ধেই করে নাচা আর একটা পুরুষ যখন সবার মধ্যে হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলছে তা তার শখ।”
সেতারা বিরক্ত হয়ে বললো,”খালু যে কেনো তোদের এতো পড়াশোনা করাতে গেলো বুঝি না। পড়াশোনা করে এসব উল্টাপাল্টা কথা শিখেছিস। কোথায় কি উদাহরণ টানছিস নিজেরাই জানিস না।”
পেখম স্মিত হেসে বললো,”আমরা উল্টাপাল্টা বলছি নাকি তুমি নিজের যুক্তি খণ্ডাতে ব্যর্থ?”
সেতারা চুপ করে থাকে। প্রিয়তা পরিস্থিতি সামলাতে সেতারাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,”পেখম এবার থাম তো, আপাকে আর জ্বালাস না। সেতারা আপা তুমি একটা গান ধরো তো। কতোদিন শুনিনা তোমার গান।”
সেতারা ভ্রু কুঁচকে বললো,”পাগল হয়েছিস তুই? কতোদিন আগেই সেসব বাদ দিয়েছি।”
“কেনো বাদ দিলে আপা? নিজের সত্ত্বাটাকে নিজেই গলা টি’পে মেরে ফেললে?”
সেতারা উদাস হয়ে বললো,”বিয়ের পর মেয়েদের আলাদা সত্ত্বা বলে কিছু থাকে না। সংসারটাকে আপন করাই তাদের কাছে মুখ্য।”
“তুমি সুখী তাতে?”
“অবশ্যই সুখী আমি। কিসের অভাব আমার? দামী গাড়িতে চলাফেরা করি, নিত্যনতুন দামী শাড়ি, গহনা পরি। জীবনে সুখী হতে আর কি লাগে বল তো?”
প্রিয়তা ম্লান হেসে বললো,”তাহলে তোমার চোখের নিচে কালি কেনো সেতারা আপা তোমার? যে সৌন্দর্য দেখে তোমাকে দুলাভাই বিয়ে করে নিয়ে গেলো, কোথায় সেই সৌন্দর্য? তোমার এতো সুখের মাঝেও কখনো হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে বুকের মধ্যে ব্যথা করেনা? গান গাওয়ার জন্য গলা শুকিয়ে আসে না? অস্বীকার করতে পারবে তুমি?”
সেতারা ইতস্তত করতে থাকে। তার এসব আলোচনা ভালো লাগছে না। প্রিয়তার বলা একটা কথাও মিথ্যা না। কিন্তু এসব বলে এখন কিছু হবে না। তার জীবনের পথ বেঁকে গেছে। এই অদৃষ্টকেই তাকে আপন করে নিতে হবে, এখানেই খুঁজতে হবে সুখ। মিথ্যা সুখের চাদরে মুড়িয়ে রাখতে হবে নিজেকে।
সেতারা জোর করে হেসে বললো,”তুই রাখ তো এসব ভারী ভারী কথা, গল্পের বই পড়ে মাথাটা নষ্ট হয়ে গেছে তোর। এখন আমাকে তোর গল্প বল।”
“আমার আবার কি গল্প সেতারা আপা?”
“এইযে তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? শুনলাম কলেজের অনুষ্ঠানে নাকি খুব সুন্দর নেচেছিস।”
প্রিয়তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
সেতারা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,”তোর নাকি একটা প্রেমিক হয়েছে। ভবঘুরে এক ছেলেকে নাকি মন দিয়ে ফেলেছিস তুই।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে বললো,”এসব কথা কে বলেছে আপা তোমাকে?”
“এসব কি আর চাপা থাকে? তুই নাকি সেই ছেলের জন্য নিয়াজের সাথে এতো ভালো সম্পর্কটাকেও বারণ করে দিয়েছিস। যাই বলিস, তুই কিন্তু ভুল করেছিস। নিয়াজকে বিয়ে করলে রাজরানী হয়ে থাকতে পারতিস আজ।”
প্রিয়তার মাথা শব্দশুন্য হয়ে যায়। সে খুব ভালো করে বুঝতে পারে বড় খালা এসব নোংরা কথা ছড়াচ্ছে। সে ভেবেছিলো আজ সে মন খারাপ করবে না। কিন্তু হঠাৎই সে টের পায় তার মন খারাপ হচ্ছে। সামনে বসে থাকা সেতারা আপাকে একটুও সহ্য হচ্ছে না এখন।
“তুই আবার আমার কথায় কিছু মনে করিস না। বড় বোন হিসেবে সাবধান করে দিলাম। এসব ভবঘুরে বাউন্ডুলে ছেলেদের ফাঁদে পা দিস না ভুলেও। জীবনটা অনেক বড়। আবেগে জীবন চলে না।”
প্রিয়তা ধীরে ধীরে হেঁটে যেয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়। আজ আকাশে অর্ধ চাঁদ উঠেছে। চারপাশটা খুব মায়াবী লাগছে দেখতে।
“জীবনটা হয়তো অনেক বড়, কিন্তু জীবনটা তো একটাই আপা। সুখ খুঁজতে খুঁজতে ভালোবাসা হারিয়ে ফেলবো না তো আমরা?”
সেতারা উত্তর দেয়না। জলভরা দুই চোখ নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

অস্থির হয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করছে প্রিয়তা। অনেক রাত হলো, এখনো উচ্ছ্বাস ফেরেনি। কেমন যেনো কু ডাক ডাকছে মনের মধ্যে। কোথায় গেলো মানুষটা? উত্তেজনায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে প্রিয়তার কপালে।

“প্রিয়তা খেতে আয় মা।”
প্রিয়তা ঈষৎ চমকে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”বাবা তোমরা খেয়ে নাও, আমি পরে খাবো।”
কবির শাহ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়তার কাছে এগিয়ে আসে। তার মাথায় হাত রেখে বললো,”আজ তোর জন্মদিন। আর আজ আমি তোকে রেখেই খেতে বসবো? এমন কি কোনোদিন হয়েছে?”
প্রিয়তার বুকে অসহ্য রকম ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে নি:শ্বাসটাও ঠিকমতো নিতে পারছে না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। সময় এখন রাত দশটা বেজে বারো মিনিট। উচ্ছ্বাস কখনোই এতোটা দেরি করে না ফিরতে।
“আমার খেতে ইচ্ছা করছে না বাবা। আমাকে জোর করো না দয়া করে।”
প্রিয়তার কণ্ঠের উত্তাপ টের পায় কবির শাহ। নিজেও চিন্তা করছে উচ্ছ্বাসের জন্য। তবে কি সকালে বলা কথাগুলোতে কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা? সত্যি সত্যিই চলে গেলো বাড়ি ছেড়ে? অনেক বেশি অভিমান করে ফেললো?
“মা রে ছাদে যাবি?”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”এতো রাতে ছাদে যাবো কেনো বাবা?”
“অনেক দিন তোর সাথে মন খুলে গল্প করা হয়না। আজ তোর সাথে একটু গল্প করতে ইচ্ছা করছে। শুধু তুই আর আমি। বড্ড গরম লাগছে ঘরে। বাইরে সুন্দর হাওয়া আছে। দেখবি তোর ভালো লাগবে।”
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারে না প্রিয়তা। সে জানে এখন তার কিছু ভালো লাগবে না, কিছুই না।

“প্রিয়তা।”
“বলো বাবা।”
“তোর কি খুব বেশি মন খারাপ?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। এখন মুখ খুললেই সে কেঁদে দিবে। মনটা খুব নরম ওর। অনেক মন খারাপের সময় কেউ সুন্দর করে কথা বললেও ওর চোখে পানি চলে আসে।
“দূরের তারাগুলো দেখ, কেমন জ্বলজ্বল করছে। তুই কি জানিস দূর আকাশে যতো তারা দেখছিস তার অনেকগুলোর অস্তিত্বই এখন আর নেই।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”অস্তিত্ব না থাকলে আমরা ওগুলো কীভাবে দেখছি বাবা?”
কবির শাহ মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
“তারাগুলোকে যতোটা কাছে তুই মনে করছিস ওরা কিন্তু এতো কাছে না। লক্ষ কিংবা কোটি আলোকবর্ষ দূরে ওরা। ওখান থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছাতেও অনেক সময় প্রয়োজন হয়। হয়তো আমরা এখন যা দেখছি শুধুই তারার আলো। তারাগুলোর বেশিরভাগেরই অস্তিত্ব এখন নেই। কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে গেছে।”
প্রিয়তা ঘোর লাগা চোখে একবার বাবার দিকে আরেকবার তারাগুলোর দিকে তাকায়। কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে সবকিছু তার। এমনও আবার হয় নাকি? কিন্তু বাবা যে বললো? বাবা অনেক বই পড়ে, সে ভুল বলতেই পারেনা।

“আমাদের জীবনে হঠাৎ হঠাৎ এমন মানুষ আসে জানিস তো? যারা আমাদের জীবনে আলো ছড়ায়। আমাদের মনে হয় তাদের আলো ছাড়া আমরা অপূর্ণ। কিন্তু সত্যি বলতে তাদের অবস্থান অনেক অনেক ক্রোশ দূরে আমাদের চেয়ে। হয়তো ওই আলোকবর্ষ সমান দূরে। তারা চায়না নিজেদের অস্তিত্ব আমাদের জীবনে রাখতে। তবুও আমরা ওই আলোটুকুর লোভে তাদের আঁকড়ে বাঁচতে চাই। মিথ্যা মরিচীকার মতো তারা ধরা দেয় বার বার। শেষে এসে কষ্টই পেতে হয় শুধু।”
প্রিয়তা বুঝতে পারে বাবার কথাগুলো। কিন্তু বাবা হঠাৎ এসব কেনো বলছে বুঝতে পারেনা। তবে কি বাবা জানে কিছু উচ্ছ্বাস ভাইয়ের ব্যাপারে? সাহস করে জিজ্ঞেসও করতে পারে না প্রিয়তা।
মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে কবির শাহ তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,”তুই খুব আবেগী আর কোমল একটা মেয়ে। অল্পেই তুই ভেঙে পড়িস। সবাই চাইবে তোকে আরো ভেঙে দিয়ে চলে যেতে। কারণ কি জানিস? যারা কোমল, নরম তাদের ভেঙেচুরে দেওয়া মানুষের একটা নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি। কেউ কেউ পৈশাচিক আনন্দ পায় এই কাজটা করে। কিন্তু মেয়েটা যে আমার, আমার শরীরের অংশ। তার কোনো কষ্ট যে আমি সহ্য করতে পারবো না।”
প্রিয়তা আচমকা বাবার বুকে মাথা রেখে চিৎকার করে কেঁদে দেয়। কবির শাহ তাকে থামায় না। কাঁদুক মেয়েটা, কেঁদে হালকা করুক নিজেকে। ওর এখন শক্ত হওয়া উচিত।
“বাবা।”
“বল মা।”
“আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো বাবা? মনে হচ্ছে আমি আমার জীবনের খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলেছি।”
“তোর মনে আছে, তুই ছোটবেলায় তোর প্রিয় পেন্সিলটা হারিয়ে ফেললি। যেটা তোর খালুজান বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিলো তোকে। তখন এখানের কোনো দোকানে সেই পেন্সিল পাওয়া গেলো না। তুই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলি। আমি অনেক খুঁজে অবিকল একই না হলেও অনেকটা কাছাকাছি দেখতে একটা পেন্সিল এনে দিয়েছিলাম তোকে। তুই খুব খুশি হয়েছিলি পেন্সিলটা পেয়ে। সব প্রিয় জিনিসেরই একটা রিপ্লেসমেন্ট থাকে।”
প্রিয়তা বাবার বুকের উপর থেকে মাথা তুলে চোখে মুছে অন্যদিকে তাকায়।
এরপর যন্ত্রের মতো বললো,”তোমাকে কখনো বলা হয়নি বাবা, তুমি কষ্ট পাবে বলে। তোমার আনা ওই পেন্সিল সেদিন আমার পছন্দ হয়নি। আমি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া পেন্সিলটার রিপ্লেসমেন্ট এখনো পাইনি। প্রিয় জিনিসের রিপ্লেসমেন্ট হয়না বাবা। যেটা হয় তা হলো স্বান্তনা।”
কবির শাহ স্তব্ধ হয়ে যায় মেয়ের কথা শুনে। মেয়েটা হঠাৎ এতোটা বড় হয়ে গেলো? সে বুঝতেও পারলো না?
“নিচে এসো বাবা, মা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।”
হতভম্ব বাবাকে একা রেখেই প্রিয়তা নিচে চলে আসে।

রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। উচ্ছ্বাসের ঘরে জবুথবু হয়ে বসে আছে প্রিয়তা। উচ্ছ্বাস ফেরেনি। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। এখন আর কাঁদতেও ইচ্ছা করছে না, ভীষণ দূর্বল লাগছে।
দূরেই উচ্ছ্বাসের গীটারটা পড়ে আছে ভীষণ অনাদরে। প্রিয়তা ধীরে ধীরে হেঁটে যেয়ে গীটারটা হাতে নেয়। তারগুলোতে আঙ্গুল পড়তেই টুংটাং শব্দ ওঠে।
প্রিয়তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি পড়ে গীটারের উপর।
“আপনি যদি চলেই যাবেন তবে মিথ্যা আশা কেনো দিলেন আমাকে? তবে কি ভুলটা আমারই ছিলো? আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি? সবাই বলতো এই কথা। মা, বড় খালা, সেতারা আপা। আমি কারো কথাই কানে তুলিনি। ভেবেছিলাম আপনি আলাদা। আমার জীবনে আপনিই প্রথম পুরুষ যাকে দেখে আমি নিজের অজান্তেই শিউরে উঠেছি। আমি জানিনা ভালোবাসা কি কিংবা প্রেমে পড়া কাকে বলে। শুধু আপনাকে দেখার পর থেকে আর কোনো পুরুষকে ভালো লাগেনা। সবসময় আপনার কাছে থাকতে ইচ্ছা করে। আপনি ঘুমিয়ে থাকলে কতোবার যে জানালার পর্দা সরিয়ে আপনার ঘুমন্ত মুখটা দেখেছি তা শুধু আমার এই বেহায়া চোখ দু’টো জানে। অবাধ্য মনটা আপনার দু’টো চোখের গভীরতায় খেই হারিয়ে বারবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যদি একে ভালোবাসা বলে তবে আমি পুরো দুনিয়ার সামনে চিৎকার করে বলতে পারি আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি ভেবেছিলাম আমার এই বেহায়া ভালোবাসা বুঝি একটু হলেও আপনার পাষাণ মনটাকে আকৃষ্ট করেছে আমার প্রতি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আপনি আমাকে সবার কাছে ছোট করে দিলেন উচ্ছ্বাস ভাই। আপনি আমার ক্ষমা পাবেন না, কোনোদিন না।”
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে প্রিয়তা। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়। জীবনের একটা বিশেষ দিন এভাবে চোখের পানিতে প্লাবিত হয়ে যাবে সে কোনোদিন ভাবতে পারেনি।

মাঝরাতে বাড়ির দরজায় জোরে জোরে করাঘাত পড়ে। ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে বসে কবির শাহ। স্বামীর পাশে মার্জিয়া বেগমও উঠে বসে।
ভয়ে, দুশ্চিন্তায় কবির শাহের বুক কাঁপতে থাকে। এমনিও রাতে ঘুম আসেনি সেভাবে। ছেলেটা কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেলো, এখন কি অবস্থায় আছে এই ভয়ংকর চিন্তাগুলো ঘুমাতে দেয়নি তাকে।
ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে রাত তিনটা পঞ্চাশ বাজে। কে আসবে এই অসময়ে? উচ্ছ্বাস? নাকি কোনো খারাপ সংবাদ?

“কোথায় যাচ্ছো তুমি? এতো রাতে তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না আমি।”
“এটা কেমন কথা মার্জিয়া? কে এসেছে দেখবো না?”
“এতো রাতে কে আসবে? দেখো তোমার ওই বোনের ছেলে নেশা করে মাতাল হয়ে এলো কিনা।”
কবির শাহ স্ত্রীর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,”একদম নোংরা কথা বলবে না ওকে নিয়ে। ও এমন ছেলে নয় তুমি ভালো করেই জানো?”
মার্জিয়া বেগম মুখ বাঁকায়।

অপরিচিত এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। আগে কখনো তাকে দেখেনি কবির শাহ। চশমা চোখের চিকন একটা ছেলে। কবির শাহ চোখের চশমাটা ভালো করে পরে তাকায় ছেলেটার দিকে, চেনার চেষ্টা করে।
“আপনি কি কবির শাহ? উচ্ছ্বাস ভাইয়ের মামা?”
কবির শাহ ভয়ে ভয়ে বললো,”হ্যা আমি কবির শাহ। উচ্ছ্বাস কোথায়? কি অবস্থায় আছে ও? ভালো আছে তো?”
মার্জিয়া বেগম ততক্ষণে স্বামীর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
ছেলেটা অবাক হয়ে বললো,”এ কি বলছেন মামা? উচ্ছ্বাস ভাই বাড়িতে নেই? কোথায় গিয়েছেন উনি?”
কবির শাহের মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে ওঠে। মার্জিয়া বেগম ধরে বসে তাকে।
“আপনি ঠিক আছেন মামা?”
“তোমার পরিচয় কি বাবা? উচ্ছ্বাসকে কীভাবে চিনো তুমি?”
ছেলেটা কিছুক্ষণ থেমে বললো,”এতোকিছু বলতে পারবো না আপনাকে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলতে এসেছি। উনি আসার সাথে সাথে বলে দিবেন দয়া করে। উনার প্রাণনাশের ঝুঁকি আছে।”

প্রিয়তার ঘুম হয়নি সারারাত। বাইরের ঘরে এতো শব্দ শুনে ছুটে এসেছে সে। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়।
কবির শাহ চিৎকার করে বললো,”প্রাণনাশের ঝুঁকি মানে? কি হয়েছে উচ্ছ্বাসের?”
ছেলেটা একবার মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললো,”উনার চাচারা হন্যে হয়ে খুঁজছে উনাকে। উনার বাবা মায়ের মতো উনাকেও……”
কবির শাহ থরথর করে কাঁপতে থাকে। মার্জিয়া বেগম কিছু না বুঝে তাকায় কবির শাহের দিকে। সে তো জানে উচ্ছ্বাসের বাবা মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এসবের মধ্যে উচ্ছ্বাসের চাচারা এলো কোথা থেকে? উচ্ছ্বাসের প্রাণনাশের ঝুঁকি-ই বা হবে কেনো তাতে?
“এসব কি বলছো বাবা তুমি?”
“আমি চলি মামা। আমি উনাকে সাবধান করে দিতে এসেছিলাম। কিন্তু উনি বাড়িতে নেই শুনে অনেক দুশ্চিন্তা হচ্ছে এখন। উনার চাচারা মানুষ ভালো না। উনি একা, কি করবেন উনি?”
ছেলেটা দাঁড়ায় না। একদমে কথাগুলো বলে চলে যায়।
কবির শাহ কাঁপা কাঁপা পায়ে এসে চেয়ারে বসে। তার সামনে পুরো পৃথিবীটাই যেনো ঘুরছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে। ছেলেটা কোথায় গেলো? কাউকে কিছু না বলে এভাবে কেনো চলে গেলো? তবে কি ইতোমধ্যেই সে ওদের হাতে বন্দী হয়েছে? ওরা কি মেরে ফেলেছে উচ্ছ্বাসকে এতোক্ষণে?
কবির শাহ আর ভাবতে পারেনা। ডুকরে কেঁদে ওঠে। নীলিমার সন্তানকে সে রক্ষা করতে পারলো না? এতোটা ব্যর্থ সে আজ?

মার্জিয়া বেগমের মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু স্বামীর এই অবস্থায় কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। ছেলেটার জন্য এই প্রথম সে এক অজানা মায়া অনুভব করছে বুকের ভিতর। কিছুটা দুশ্চিন্তা তাকেও ঘিরেও ফেলেছে। কোথায় গেলো ছেলেটা এই চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে তার। একেই কি বলে মাতৃত্ব? যাকে দুই চোখে সহ্য করতে পারতো না, যার উপস্থিতি কাঁটার মতো বিঁধতো চোখে তার জন্যই অস্থির লাগছে এখন। সে তো সবসময় চেয়েছিলো ছেলেটা যেনো আর না আসে তার চোখের সামনে, চলে যায় চিরতরে এই বাড়ি ছেড়ে। তার তো ভালো লাগার কথা। তবে এমন কেনো লাগছে আজ? সে নিজেও তো একজন মা। এক মা হারা ছেলের জন্য এতো খারাপ লাগছে কেনো তার?
স্বামীকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায়না সে। শুধু তার মাথায় হাত দিয়ে ফিসফিস করে বললো,”চিন্তা করোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। ও ফিরে আসবে দেখো তুমি, ওকে আসতেই হবে।”

পা দু’টো অনড় হয়ে আছে প্রিয়তার। মনে হচ্ছে এক পা-ও আর এগোতে পারবে না সে। ভিতর থেকে বোবাকান্না গুলো ঠেলে বাইরে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু এক অজানা শক্তি গলাটা চেপে ধরে রেখেছে যেনো তার।
হঠাৎ প্রিয়তার মনে পড়ে চুড়ির সাথে একটা চিরকুটও তো মোড়ানো ছিলো কাগজের সাথে। উত্তেজনায় তো ভুলেই গিয়েছিলো চিরকুটটার কথা।
ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে দেয় প্রিয়তা। উন্মাদের মতো চিরকুটটা খুঁজতে থাকে সে। সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে নিমিষেই। হাত-পা ভীষণ কাঁপছে তার।

কিছুক্ষণ পর ফেলে দেওয়া কাগজগুলোর মধ্য থেকে দুমড়ানো মোচড়ানো চিরকুটটা বের করে সে। সাধারণ কাগজ ভেবে ফেলেই দিয়েছিলো ওটা। সাথে সাথে চোখের সামনে মেলে ধরে ওটা।

নন্দিনী,
নামটা কি তোমার পছন্দ? ঠিক যেমন পছন্দ তোমার বৃষ্টি কিংবা মোটা মোটা গল্পের বইগুলো? নামটা আমার খুব পছন্দ। কারণ আমার বাবা আমার মা কে এই নামে ডাকতো। আমি কেনো তোমাকে এই নামে ডাকলাম সেই উত্তর জানতে চেয়ো না, আমার নিজের কাছেও নেই।
হরিণচোখের কন্যা, তুমি যে আমার প্রেমে পড়েছো এ কথা অনেক আগেই আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কি করবো বলো? আমার এই ভাঙাচোরা জীবনে তোমার মতো ফুলের কোমল পাপড়িকে আমি জায়গা দিতে চাইনি। তুমি এলোমেলো হয়ে যাবে ঝড়ের মতো। কিন্তু এক সময় দেখলাম, আমি নিজেও নিজের অজান্তে অল্প অল্প করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি ওই চোখজোড়ায়। আমি নিজেকে সামলানোর অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। দুনিয়ার সব সৌন্দর্য তোমার কাছে বারবার ম্লান হয়েছে। আমি আটকাতে পারিনি নিজেকে।
তুমি যখন এই চিঠি পড়বে হয়তো আমি তোমার থেকে তখন অনেকটাই দূরে। তবে তুমি চিন্তা করোনা। আমি ফিরে আসবো তোমার কাছে। তোমাকে কথা দিলাম। আমি স্বার্থপর হবো। আমার এই এলোমেলো জীবনটাকে গোছানোর ভার আমি তোমাকে দিবো। যদি এই অপরাধে আমার শাস্তি হয়, তবে হোক। তবুও আমি স্বার্থপর হবোই।
শেষে আর একটা কথা বলি? কাজল লেপ্টে যাওয়ার জন্য আমার ভালোবাসাই যথেষ্ট, তার জন্য এভাবে দিনরাত এক করে কাঁদতে হবে না।

তুমি চাইলে মহাবিশ্ব হাতের নাগালে এনে দিতে পারি, আর তো সামান্য চাঁদ।
চন্দ্রাবতী আমার ধ্বংসযজ্ঞ ভরা জীবনে তুমি সর্বনাশের শুরু, তুমি মরণ ফাঁদ।

ইতি,
তোমাকে যন্ত্রণায় ম্লান করিয়ে দেওয়া এক যুবক।

প্রিয়তা চিঠিটা কাঁপা হাতে মুখের চেপে ধরে। মনে হচ্ছে এখানে মানুষটার গায়ের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হয় প্রিয়তার। ঝাপসা হয়ে আসে তার সামনের সবকিছু।

(চলবে……)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১৯

প্রিয়তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মার্জিয়া বেগম। এক রাতেই মেয়েটার চোখমুখের অবস্থা করুণ। চোখের নিচে কালি পড়েছে, কেমন যেনো কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে চোখ দু’টো। মার্জিয়া বেগমের রাগের উত্তাপ বাড়ে ভিতর ভিতর। এমন একটা ভাব করছে যেনো ওর মা মারা গেছে। তার ইচ্ছা করছে মেয়ে গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে। মেয়ে এখন যেই বয়সটা পার করছে তা সাক্ষাৎ আগুন। এই আগুন নেভানোর জন্য পানি লাগবে। আর পানি হলো মায়ের মুখের মিষ্টি কথা।
“কি রে প্রিয়তা? আজ এতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লি যে? অন্যদিন তো হাতি দিয়ে টানলেও তোর ঘুম ভাঙে না।”
প্রিয়তা ম্লান স্বরে বললো,”আজ কলেজে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”বলছি আজ কলেজে না গেলে হয়না?”
প্রিয়তা ঝট করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,”কেনো আজ কি?”
মার্জিয়া বেগম আমতা আমতা করে বললো,”তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর শরীরটা ভালো না।”
প্রিয়তা কঠিন গলায় বললো,”আমি ঠিক আছি।”

“চল প্রিয়তা, আজ আমি তোকে কলেজে নামিয়ে দিবো।”
কবির শাহ কখন এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পাশে টেরই পায়নি ওরা।
“কেনো বাবা তোমাকে যেতে হবে কেনো?”
“আমি গেলে কি তোর সমস্যা হবে?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে না-সূচক মাথা নাড়ে।
কবির শাহ মুচকি হাসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে।

প্রচন্ড দূর্বল লাগছে প্রিয়তার শরীরটা। সারারাত ঘুম হয়নি, ঠিকমতো খায়নি। ঘরের মধ্যে অসহ্য লাগছিলো তাই নিজের সাথে জোর করে কলেজে এসেছে। ক্লাসে ঢুকেই চুপচাপ এক কোণায় বসে আছে প্রিয়তা।

“কি গো সখী? মনটা মনে হচ্ছে খারাপ। এখন তো তোমারই দিন। মুখে হাসি ঝলমল করবে।”
রুনার কথায় প্রিয়তা কিছুটা চমকে ওঠে। মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বললো,”রুনা তুই কখন এলি?”
“এই এলাম গো বেশ কিছুক্ষণ। তোমার তো কোনোদিকেই মন নেই এখন। থাকবেই বা কীভাবে? এখন যে স্বপ্নপুরুষের ধ্যানে মগ্ন তুমি।”
“দেখ রুনা…..”
“হুম বুঝছি বুঝছি। আর কিছু বলার দরকার নেই। এখন ফটাফট বলে ফেল তো, সুদর্শন পুরুষটি কে?”
প্রিয়তা আস্তে আস্তে বললো,”কোন পুরুষের কথা বলছিস?”
“ইশ কি নাটকটাই না করতে পারিস তুই। বললেই কি তোর মানুষটাকে আমি নিয়ে নিবো নাকি?”
প্রিয়তা গলার স্বর আরো অনেকটা নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,”দেখ রুনা তুই যা ভাবছিস তা নয়।”
“কিছু ভাবছি না, যা দেখার নিজের চোখেই দেখেছি গতকাল। লাল গোলাপ কারা যে ওভাবে দেয় আমরা জানি।”
রুনা মুখ টিপে হাসতে থাকে।
হঠাৎ রুনাকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়তা ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। রুনা হাসি থামিয়ে থমকে যায় প্রিয়তার কান্না দেখে। সবসময় হাসিমুখে থাকা মেয়েটার চোখে পানি কেনো?
রুনা ব্যস্ত হয়ে বললো,”কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেনো তুই? দয়া করে বলবি কি হয়েছে?”
প্রিয়তা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,”আমার কিছু ভালো লাগছে না রুনা। আমার মনটা ভালো করে দে।”
রুনা প্রিয়তার মাথায় হাত রাখে। সেই স্কুলজীবন থেকেই বন্ধুত্ত্ব দুইজনের। যেনো বান্ধবী নয়, দুই বোন। মেয়েটাকে দেখেই মনে হচ্ছে চাপা কোনো কষ্ট পুষে রেখেছে সে ভিতরে। কান্নারত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তারও কষ্ট হতে থাকে।
“প্রিয়তা তুই কি ভীষণ ভাবে কারো ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছিস?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। লাল পদ্মের মতো এক জোড়া চোখে রুনার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।

সারারাত ঘুম হয়নি আরো একটা মানুষের। সে হলো উচ্ছ্বাস। সারারাত রাস্তায় হেঁটেছে সে। চোখজোড়া লাল হয়ে আছে তার। সারাটা রাত রাস্তায় হেঁটে সে নিজেকে সময় দিয়ে চেয়েছে। নিজের মনকে প্রশ্ন করেছে সে কি সত্যিই প্রিয়তাকে ভালোবাসে? নাকি সম্মুখে প্রতিদিন মেয়েটার মিষ্টত্ব একটু একটু করে বৃদ্ধি পেয়ে তার চোখে ধরা দিচ্ছে বলে তার অবচেতন মন তাকে ভালোবাসা বলে ধরে নিয়েছে? আর যাই হোক, মেয়েটাকে কষ্ট দিতে পারবে না সে। যদি সত্যিই মেয়েটার অনুপস্থিতি তাকে পীড়া দেয়, তবে সে বুঝবে সে প্রিয়তাকে ভালোবেসেছে। আর যদি তা না হয় তবে সরে আসবে প্রিয়তার জীবন থেকে।

কিন্তু সকাল হতে না হতেই এক আবদ্ধকর বিষাদে মনটা ছেয়ে যায় তার। মনে হচ্ছে কয়েক যুগ হয়ে গেছে মেয়েটাকে দেখেনা সে। এমন তো আগে কখনো কারো জন্য হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে একটা মেয়েকে মন দিয়েছিলো সে। মেয়েটাও তাকে ভালোবাসতো। দুইজনের ডিপার্টমেন্ট ছিলো আলাদা। দুইজনের ক্লাস শেষ হলে তারা টিএসসিতে একসাথে হাঁটতো। মেয়েটার হাসিটা খুব বেশি পছন্দ ছিলো উচ্ছ্বাসের। কিন্তু মেয়েটার মনে হয়তো অন্য কিছু ছিলো। আর তাইতো মাঝ রাস্তাতেই উচ্ছ্বাসকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরতে দ্বিধাবোধ করলো না। অনেক কষ্ট পেয়েছিলো উচ্ছ্বাস। প্রেম-ভালোবাসা এসবের উপর থেকে মন উঠে গিয়েছিলো একরকম। এরপরই এলো তার জীবনের ভয়ংকরতম সেই কালো অধ্যায়।

সকাল হতে না হতেই প্রিয়তার কলেজের সামনে দাঁড়িয়েছে উচ্ছ্বাস। সারারাত ঘুম না হওয়ায় চোখ জ্বলছে তার। মেয়েটাকে এক নজর দেখার তৃষ্ণা তাকে জেঁকে বসেছে।
কলেজের সামনে একটা দোকান থেকে সিগারেট জ্বালিয়ে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে কলেজ গেটের দিকে।

হঠাৎ দূর থেকে প্রিয়তাকে দেখেই সময় থমকে যায় তার। অসম্ভব ক্লান্তি ভরা মুখটা দেখে বুকের মধ্যে খচখচ করে ওঠে। সে কি একটু বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললো মেয়েটাকে? সিগারেট জ্বলতে জ্বলতে হাতের অনেকটা কাছে চলে এসেছে। যে কোনো সময় পুড়ে যাবে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই তার। কি অসম্ভব স্নিগ্ধতা ঘিরে আছে মেয়েটার চারপাশ।
“ও ভাই ওইভাবে কি দেখেন? সিগারেটে হাত পুড়বো তো।”
উচ্ছ্বাস ধাতস্থ হয়ে সিগারেটটা ফেলে দেয়, ততক্ষণে আঙ্গুলে কিছুটা আগুনের ছ্যাঁকা লেগেছে। কিন্তু একটুও কষ্ট হচ্ছে না তার, পুড়ছে তী তার হৃদয়টা।
“কড়া করে একটা চা লাগাও তো?”
দোকানদার আপন মনে হাসতে হাসতে চা বানাতে থাকে।
“প্রেমে পড়ছেন ভাই?”
উচ্ছ্বাস চমকে দোকানদারের দিকে তাকায়, উত্তর দেয়না।
“যদি ভালোবাসেন তবে এভাবে লুকিয়ে না দেখে তারে বলে দেন। মনের মধ্যে কথা লুকায় রাখলে মনে ক্ষত সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষত সহজে শুকাতে চায়না।”
উচ্ছ্বাস বিরক্ত গলায় বললো,”চা লাগাও তাড়াতাড়ি, কথা কম বলো।”
দোকানদার আপন মনে হাসতে হাসতে বললো,”আপনার ভাবীরে ভীষণ ভালো পাইতাম, সে-ও আমারে ভালো পাইতো। কিন্তু লজ্জায়, ভয়ে কেউ কাউরে কোনোদিন বলিনি। হঠাৎ একদিন সে কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে হাজির। আমি কই, ঘটনা কি, কান্দো ক্যান? সে বললো আইজ রাতেই তার বিয়ে। আমার মাথায় পড়লো বাজ। আমি তখন বেকার। তারে নিয়া রাখবো কই, খাইতে দিবো কি? ফিরায় দিতেই চাইছিলাম। কিন্তু কি জানেন তো? মায়ায় জড়ায় গেলাম তার কান্নাভেজা চোখ দুইটা দেখে। মায়া এক ভয়ংকর নেশার নাম গো ভাইজান। জীবনের সব নেশা অতিক্রম করে ফেলতে পারবেন কিন্তু মায়া কাটাইতে পারবেন না। এটাই জগৎ সংসারের নিয়ম। সাহস কইরা বিয়ে করে ফেললাম। এরপরই এই দোকানডা দিলাম। কি যে দিন কাটাইছি ভাইজান। একটা ডিম ভেজে দুইজন খাইতাম। সে আমারে মুখে তুলে খাওয়ায় দিতো। কি যে স্বাদ সেই ডিম ভাজিতে ভাইজান, এখনো সেই স্বাদ ভুলিনি। ভাঙা টিনের ছাদ থেকে জ্যোৎস্নার আলো আসতো ঘরে। আমি গীত গাইতাম, সে আঁচলের তলায় মুখ লুকায় মিটমিট করে হাসতো। আমার মনে হতো বেহেশত কি এর চাইতেও সুন্দর? এই সুখের চাইতে আর কিছু সুন্দর হইতে পারে?”
উচ্ছ্বাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো দোকানদারের কথা শুনছিলো। একরকম ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলো সে।
“তাইলে তো ভাবী খুবই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। এখনো কি একসাথে ডিম ভাজা খাওয়া হয়?”
দোকানদার আবার হাসে, কিন্তু এবারের হাসিটা উচ্ছ্বাসের কাছে খুব বিষাদের লাগে।
“দিন গুণতেছি ভাইজান, মৃত্যুর দিন। একসাথে যেদিন বেহেশতে যাবো সেদিন আবারও ডিম ভাজা খাবো। একটা ডিম দুইজন মিলে।”
উচ্ছ্বাস চমকে উঠে বললো,”তার মানে?”
“বিয়ের দুই বছরের মাথায় সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে আমার সোনাপাখিটা তার ছানা নিয়াই মরে গেছে। সেই থেকে এই চৌদ্দ বছর আমি একা। ওইযে বললাম মায়া, মহিলা গেছে গেছে কিন্তু আমারে তার মায়া কাটানোর ঔষধটা দিয়ে যায়নি। এখনো তার মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়ায় আছি আমি। আর কাউরে জীবনে আনতেই পারলাম না।”
উচ্ছ্বাসের মনে হলো জমাট বাঁধা কোনো কষ্ট গলার মধ্যে আটকে আছে। শ্যামসুষমা তরুণীটার জন্য বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা যন্ত্রণা হচ্ছে হঠাৎ।
“বুঝছেন ভাই, চেষ্টা করি দিনের মধ্যে একটাও খারাপ কাজ না করার। তারে তো আল্লাহ বেহেশতে নিবে, জীবনে কোনো পাপ কাজ সে করেনি। তার সাথে বেহেশতে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনা। সেখানের ফেরেশতা যদি বলে একটা ডিম খাও কেনো? দুইজন দুইটা খাও। আমি তখন ফেরেশতারে বলবো দুইজন মিলে একটাই খাবো। বেহেশতে তো সব আছে, খালি বিচ্ছেদ নাই, তাই না ভাইজান?”
উচ্ছ্বাস উঠে দাঁড়ায়। মাথাটা অসম্ভব ঘোরাচ্ছে তার। ইচ্ছা করছে ছুটে যেয়ে মেয়েটাকে উন্মাদের মতো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।
“যদি কাউরে ভালোবেসে থাকেন, দেরি না করে বলে দেন। যে কয়টা দিন একসাথে থাকবেন সে কয়টা দিনই জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। দিন ফুরায় গেলেই সব শেষ।”
উচ্ছ্বাস ছোট্ট করে হাসে, কিছু বলেনা। ব্যস্ত শহরটাকে বড় এলোমেলো লাগে তার। কোনো এক অপরূপার চোখের মাঝে যেনো শহরটা আটকে আছে।

ক্লাস শেষ করে কলেজ গেটেই বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলো নীলু। হঠাৎ তার চোখ যায় অদূরেই এক জোড়া চোখের দিকে। যে অধীর আগ্রহে কলেজের দিকেই তাকিয়ে আছে। আর সেই চোখজোড়া দেখে বুকের মধ্যে হাতুড়িপেটা হতে থাকে নীলুর। ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, না ঘুমানো লাল চোখে, হাতে সিগারেট, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। হাতা গুটিয়ে রাখা নীল পাঞ্জাবিতে ঠিক যেনো গ্রীক কোনো দেবতা। নীলুর মাথা খারাপ হওয়ার জন্য এতোটুকুই বোধহয় যথেষ্ট ছিলো। নিশ্চয়ই তার সাথে দেখা করতে এসেছে। গতকাল একবার দেখেই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছে ছেলেটা, সে নিশ্চিত।

“এই দেখ তো আমাকে কেমন লাগছে। চুলগুলো কি খুব রুক্ষ দেখাচ্ছে? ইশ কেনো যে আজ চুলে খোঁপা করলাম না।”
নীলুর বান্ধবী ইশিতা হালকা হেসে বললো,”এমন ভাব করছিস যেনো ওই সুদর্শন ছেলেটা তোর প্রেমিক।”
নীলু চোখ পাকিয়ে বললো,”প্রেমিক এখনো হয়নি, তবে হবে।”
ইশিতা মুখ বাঁকিয়ে বললো,”এতোই সোজা বুঝি?”
“তুই দেখবি? ও আমাকে দেখতেই এখানে এসেছে।”
ইশিতা চোখ বড় বড় করে বললো,”আমি মজা করে বলেছি।”
“কিন্তু আমি মজা করিনি, আয় আমার সাথে।”
ইশিতাকে জোর করে টানতে টানতে নীলু উচ্ছ্বাসের সামনে দাঁড়ায়। তবে উচ্ছ্বাসের তার দিকে কোনো খেয়াল নেই।
উচ্ছ্বাসের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য দুইবার খুকখুক করে কাশে নীলু। উচ্ছ্বাস তাকায় না। ইশিতা মুখ টিপে হাসে।
রাগে লাল হয়ে নীলু বললো,”এইযে শুনছেন?”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে নীলুর দিকে তাকায়।
“কি ব্যাপার?”
নীলু লাজুক মুখে হেসে বললো,”ভালো আছেন আপনি?”
উচ্ছ্বাস রুক্ষ গলায় বললো,”তাতে আপনার কি? আপনাকে কি আমি চিনি?”
মুখটা চুপসে যায় নীলুর। এই লোকটার কি ভুলে যাওয়ার রোগ আছে? গতকালই দেখা হলো, আর আজ কিনা বলছে চিনেই না?
“আপনি আমাকে চিনতে পারেননি?”
উচ্ছ্বাস চোখমুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবার চেষ্টা করে।
এরপর ঈষৎ হেসে বললো,”ও হ্যা চিনেছি।”
নীলু বাঁকা ঠোঁটে হেসে ইশিতার দিকে তাকায়। যেনো যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে।
“আপনি এই কলেজের ঝাড়ুদার মহিলাটা তাইনা? পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম মনে হয় ঝাড়ু দিতে।”
মুখটা ঝুলে যায় নীলুর। লোকটা কি পাগল? কি বলছে এসব? কলেজের নামকরা সুন্দরী, সব ছেলেরা যার জন্য পাগল তাকে কিনা বললো ঝাড়ুদার মহিলা?
ইশিতা হেসেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে ওদিকে।
নীলু কঠিন গলায় বললো,”আমি কেনো ঝাড়ুদার মহিলা হতে যাবো? আমি নীলু।”
“নীলু হোন বা কালু হোন আমার কাছে কি চান?”
রাগে, দু:খে চোখে পানি চলে আসে নীলুর। নেহাৎ লোকটা সুদর্শন বলে, নাহলে ঠেকা পড়েছিলো এভাবে যেচে পড়ে অপমানিত হতে?
“আপনি কি কিছুই মনে করতে পারছেন না? গতকাল যে প্রিয়তাদের বাড়িতে আপনার সাথে আমার দেখা হলো। আপনি ছাদ থেকে আমাকে দেখছিলেন বারবার।”
উচ্ছ্বাস নির্লিপ্ত গলায় বললো,”ছাদ থেকে দেখার মতো কোনো বস্তু আপনি নন। এবার চিনেছি আপনাকে। গতকাল তো এমন সাজ সেজেছিলেন যে আপনি প্রসাধনী ব্যবহার করেছেন নাকি প্রসাধনী আপনাকে ব্যবহার করেছে বোঝা মুশকিল ছিলো। এজন্যই চিনতে পারিনি আজ।”
নীলু লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়। এ বান্দা যে যেনোতেনো বান্দা নয় সে ভালো করে বুঝতে পারছে।
“দাঁড়িয়ে আছেন যে? দাঁড়াতে হলে একটু দূরে যেয়ে দাঁড়াবেন। ভীষণ ঘামের দুর্গন্ধ আসছে। যে গরমটা পড়েছে, বুঝতেই পারছেন। আমি আবার দুর্গন্ধ নিতে পারিনা।”
নীলু বিস্ফারিত চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। একটা মানুষ এমন কঠিন মুখে এরকম কথা কীভাবে বলতে পারে?
ইশিতা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে নীলুর গায়ে। নীলু এক ঝটকা দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়।
“ভাইয়া আপনি তো খুব মজার মানুষ। আপনাকে দেখলে কিন্তু মনে হয়না এতো মজার মানুষ আপনি।”
“আপনাকে দেখলেও মনে হয় না আপনি এভাবে পেত্নীর মতো হাসতে পারেন। বাপরে, এটা মানুষের হাসি? মনে হচ্ছিলো একটা হায়েনা হাসছে।”
ইশিতার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। নীলু ইশিতা দিকে তাকিয়ে মুখ হাসে। মনে মনে বলে,’দেখ কেমন লাগে। সুন্দর ছেলে দেখে খুব ভাব জমাতে গিয়েছিলি।’
ইশিতা বুঝতে পারে নিজের সম্মান রাখতে হলে এই ছেলের সামনে থেকে চলে যেতে হবে। এটা ছেলে নাকি এলিয়েন?
“চল নীলু, এখান থেকে চল।”
“আরে দাঁড়া তো তুই।”
এরপর কিছুটা উশখুশ করে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে নীলু বললো,”আপনি এখানে যে? প্রিয়তাকে নিতে এসেছেন? ওদের ছুটি হওয়ার তো অনেক দেরি। চলুন না, ওদিক কোথাও যেয়ে বসি।”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে।
“একটা কাজ করে দিতে পারবেন?”
নীলু ঘোর লাগা গলায় বললো,”একটা কেনো, একশটা কাজ বলুন না।”
“আপনাকে দেখে মনে হয়না একশোটা কাজ পারবেন। তাই একটাই কাজ দিচ্ছি।”
নীলু থতমত খেয়ে যায়।
“আপনাকে একটা কাগজ দিচ্ছি, ওটা প্রিয়তার হাতে পৌঁছে দিবেন। এটাই আপনার কাজ।”
“ব্যস এতোটুকুই?”
“জ্বি এতোটুকুই।”
নীলু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো,”কিন্তু কিসের কাগজ?”
“ওর পেট খারাপ হয়েছে তো। কাগজে ওষুধের নাম লিখে দিবো, আপনার সমস্যা?”
“পেট খারাপ?”
উচ্ছ্বাস পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে নীলুর হাতে দেয়।
নীলু চিরকুটটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,”প্রিয়তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে জানেন তো? ব্যবসায়ী নিয়াজ মোর্শেদের সাথে।”
উচ্ছ্বাসের মুখটা বিষিয়ে উঠলো। এই খবর কলেজ পর্যন্তও জেনে গেছে?
“কেনো আপনার হিংসা হচ্ছে নাকি? হিংসা হলে আপনিই বিয়ে করে নিন না নিয়াজ মোর্শেদকে, খুব মানাবে।”
নীলু রাগান্বিত হয়ে বললো,”আমার এসব শখ নেই।”
“এবার দয়া করে কাগজটা প্রিয়তাকে দিয়ে আসুন। ভুলেও এটা খুলে পড়ার চেষ্টা করবেন না।”
“পড়লে কি হবে?”
উচ্ছ্বাস নীলুর চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকায়। নীলু কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।
“পড়লে আপনারও পেট খারাপ হবে।”
হতভম্ব নীলু আর ইশিতাকে পিছনে ফেলে উচ্ছ্বাস চলে যায়।

“ছেলেটা কে রে নীলু? বাপ রে বাপ, ছেলে তো নয় যেনো সাক্ষাৎ এক অ্যানাকোন্ডা। নি:শ্বাস দিয়েই যেনো বিষ বের হয়।”
নীলু মিটমিট করে হেসে বললো,”ঠিক এমন আগুন পুরুষই আমার পছন্দ। ইশ কি দুষ্টু!”
ইশিতা জোর করে হেসে নীলুর দিকে তাকায়।

ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি থেকে নামছিলো প্রিয়তা। রুনা তার হাত ধরে তাকে নামাচ্ছে। মেয়েটার শরীরটা বড্ড নরম লাগছে। রুনা ঠিক করেছে আজ ওকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিবে, একা ছাড়বে না কোনোভাবেই।

সিঁড়ির মুখেই পথ আগলে দাঁড়ায় নীলু ওদের।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে নীলুর দিকে তাকিয়ে বললো,”নীলু আপা, কিছু বলবেন?”
“কি হয়েছে তোর প্রিয়তা?”
“আমার আবার কি হবে?”
“কিছুই হয়নি?”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। তার বুকটা ঢিপঢিপ করছে। এই মেয়েটাকে তার অদ্ভুত কারণেই ভালো লাগেনা।
নীলু শব্দ করে হেসে বললো,”পেট খারাপ এটা বলতে আবার লজ্জা কিসের?”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”পেট খারাপ?”
“আমাকেও লজ্জা পাস নাকি তুই? তোর উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কাছে তো লজ্জা পাস না, তাকে ঠিকই জানিয়েছিস।”
হতবাক হয়ে যায় প্রিয়তা। এসব কি বলছে নীলু আপা? কোনো কথা সরে না মুখ দিয়ে তার।
“নীলু আপা…..”
নীলু হেসে বললো,”এই নে তোর ওষুধ। তোর ওই অতিরিক্ত সুন্দর ভাইটা এটা আমার হাতে দিয়ে গেলো। বললো এখানে তোর পেট খারাপের ওষুধের নাম লেখা আছে।”
প্রিয়তা ভয়ংকরভাবে চমকে ওঠে। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা নেয়। মনে হচ্ছে কাগজ না, বরং তার প্রাণটাই লুকিয়ে আছে এর মধ্যে।

“উনি কোথায় নীলু আপা?”
“উনি তো চলে গিয়েছেন এটা দিয়েই। আচ্ছা উনি কি তোদের বাড়িতে আর থাকেন না? কোথায় থাকেন রে? ঠিকানাটা দে না। কিছু না, রোজ সকালে উনি যে কালো শার্টটা পরে সিগারেট খান বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, ওটা দেখবো শুধু।”
প্রিয়তা যন্ত্রের মতো বললো,”আমি জানিনা উনি কোথায় থাকেন।”
নীলু রাগী চোখে কিছুক্ষণ প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে চলে যায়।

শক্ত করে চিঠিটা হাতের মধ্যে চেপে ধরে আছে প্রিয়তা। খুলতে ভয় পাচ্ছে সে। খুললেই তো শেষ হয়ে যাবে চিঠিটা। তার চেয়ে যতোক্ষণ হাতে আছে, থাক না।
একাই রিকশাতে বাড়ি ফিরছে সে। রুনা আসতে চাইলেও সে বলেছে দরকার হবে না। একাই চলে যেতে পারবে।

‘চাঁদ মুখে গ্রহণ লেগেছে কেনো? অমাবস্যা দেখতে অভ্যস্ত নই আমি। আমার সবসময় পূর্ণচন্দ্র লাগবে। যার জ্যোৎস্নায় সব মন খারাপ ধুয়েমুছে যাবে। ঝুম বৃষ্টির অপেক্ষা করো নন্দিনী। তার আগ পর্যন্ত যেনো জ্যোৎস্না ফুরিয়ে না যায় চাঁদ থেকে।’

চিঠিটা বুকে চেপে ধরে হু হু করে কাঁদছে প্রিয়তা। না এটা কষ্টের কান্না নয়। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে সে ক্ষণে ক্ষণে। আচ্ছা, খুব শান্তি হলে কি এভাবে কান্না পায়? আগে তো জানতো না সে। সুখের কান্নারও যে অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য আছে, এটা আগে বুঝতে পারেনি কেনো সে?

বয়স্ক রিকশাওয়ালা প্রিয়তার কান্নার আওয়াজে পিছন ঘুরে তাকায়। কম বয়সী মেয়েটার কান্নায় বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে তার।

“কাইন্দো না আম্মাজান, কাইন্দো না। ফেইল মারছো পরীক্ষায়? একবার মারছো তাতে কি হইছে? তার জন্য এইভাবে কানতে হইবো? পরের বার ঠিক পাশ দিবা, আমি দোয়া কইরা দিলাম। চোক্ষের পানি মুছো তো আম্মাজান, এতো সুন্দর ফুটফুটে মাইয়্যার চোক্ষে কান্দন মানায় না।”
হাসবে না হাসবে না করেও প্রিয়তা হেসে দেয়। সবকিছু আবারও রঙিন লাগতে শুরু করেছে তার। জীবন সুন্দর, অসম্ভব সুন্দর।

(চলবে……)

তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-১৭

0

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ১৭

রুনা প্রিয়তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,”তুই চিনিস উনাকে?”
প্রিয়তা এখনো ঘোর থেকে বের হতে পারছে না। তার পুরো শরীর কাঁপছে। আচ্ছা সে কি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে? মাঝ রাস্তায় এভাবে পড়ে গেলে তো ভারী কেলেংকারী হবে। উচ্ছ্বাস কি তাকে ধরবে পড়ে যাওয়ার আগে?

উচ্ছ্বাস ভারী পুরুষালী গলায় বললো,”কি হলো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ফুলটা নিবে না?”
প্রিয়তা মৃদুস্বরে বললো,”ফুলটা আপনি আমার জন্য এনেছেন?”
উচ্ছ্বাস এদিক ওদিক তাকায়।
এরপর রুনার দিকে তাকিয়ে বললো,”আজ কি আপনার জন্মদিন?”
রুনা যন্ত্রের মতো না-সূচক মাথা নাড়ে।
“এখানে তো আপনারা দুইজন ছাড়া আর কাউকে দেখছি না আশেপাশে। যদি আপনার জন্মদিন না হয় ফুলটা নিশ্চয়ই আজ যার জন্মদিন তার জন্য।”
রুনা শব্দ করে হেসে দেয়। প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে ফুলটা নেয়।
ছোট্ট করে বললো,”ধন্যবাদ আপনাকে।”
উচ্ছ্বাস দুই হাত পিছনে বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে, যা কিছু হয়ে যাক এই মায়াবতীকে সে ছাড়তে পারবে না। জীবন একটাই, হোক না কিছু ভুল, ক্ষতি কি?
প্রিয়তা লাজুক চোখে একবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। তার মনে হচ্ছে এটা কোনো স্বপ্ন, তার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন। যদি স্বপ্নও হয়, এই ঘুম যেনো আর না ভাঙে। এভাবেই যেনো জীবনটা কেটে যায়।
রুনা অবাক হয়ে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। কলেজের ডাকসাইটে সুন্দরী সে। লোকে আড়ালে আগুন সুন্দরী বলে তাকে। অথচ এই মানুষটা পাশে এমন এক সুন্দরীকে রেখে, এক শ্যামবর্ণা মেয়ের দিকে অপার মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। না, সেই দৃষ্টিতে কোনো লোভ নেই, কোনো কামুকতা নেই, নেই কোনো অশোভন চাহনী। শুধু এক গভীর মায়া ডুবে আছে চোখেমুখে। কে এই ছেলেটা? কি পরিচয় তার? প্রিয়তার সাথে কি সম্পর্ক হতে পারে?

কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে যায়। রুনাই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে।
হালকা কেশে মুখ টিপে হাসে সে। প্রিয়তার কাছে এসে আস্তে আস্তে বললো,”আজ চললাম সখী, কাল তোমার খবর আছে। কলেজে আসো একবার। ডুবে ডুবে জল খাওয়া বের করবো তোমার।”
প্রিয়তা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
“এখনই চলে যাবি? আরেকটু থাক। আমার কেমন ভয় করছে।”
“ইশ ঢং দেখো মেয়ের। আর একটুও থাকবো না। তোমার প্রেমিকের যে রাগী চেহারা। আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় মেরেই বসবে আমাকে।”
প্রিয়তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুনা হাসতে হাসতে চলে যায়।
প্রিয়তা স্তব্ধ হয়ে যায়। কানে বার বার বাজতে থাকে ‘তোমার প্রেমিক, তোমার প্রেমিক।’ সত্যিই কি এতোটা সুখ আছে তার কপালে?

“চলো কিছুক্ষণ হাঁটি?”
প্রিয়তা চমকে ওঠে আবার। ইশ, আজকের বিকেলটা এতো সুন্দর কেনো? সবকিছু এতো রঙিন লাগছে কেনো আজ? কলেজ গেটে দাঁড়ানো ঝালমুড়িওয়ালা, রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো রঙবেরঙের বেলুন বিক্রি করা ছোট্ট ছেলেটা কিংবা ঘাসের উপর উড়ে বেড়ানো সবুজ ঘাসফড়িং সবকিছু সুন্দর লাগছে, সবকিছু দারুণ লাগছে। প্রিয়তার দুই চোখে জল ভরে যায়।
“যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে।”
প্রিয়তা গাঢ় গলায় বললো,”চলুন।”

পাশাপাশি হাঁটছে উচ্ছ্বাস-প্রিয়তা। মাঝে মাঝে উচ্ছ্বাসকে আড়চোখে দেখছে সে। নিজেকে একটা রঙিন প্রজাপতি মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে ছোট্ট দু’টো ডানা হলেই উড়ে বেড়াতো ঘাসের উপর, ফুলের উপর। কি ভীষণ শান্তি, আর কি চাই জীবনে?

“তুমি শাড়ি পরলে শাড়িটিকে বেশ মানায়। তুমি টিপ পরলে টিপের মন ভালো হয়ে যায়। নন্দিনী, তুমি পাশে থাকলে জীবন সুন্দর হয়ে যায়।”
উচ্ছ্বাসের ঘোর লাগা কণ্ঠ শুনে হকচকিয়ে যায় প্রিয়তা। এই কথাগুলো কি তাকে বললো? কি হয়েছে এই মানুষটার আজ?
উচ্ছ্বাস সুন্দর করে হাসে।
“বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে বন্ধুদের সাথে রাত জাগতাম প্রায়ই। ওরা জোর করতো দুই লাইন কবিতা বলতে। তখন লিখেছিলাম ছোট্ট কবিতাটি।”
প্রিয়তার বুকের মধ্যে কেমন ব্যথা করে ওঠে। কিছু সময়ের জন্য প্রিয়তার মনে হয়েছিলো লাইন দু’টো বুঝি তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে।

“এতো সুন্দর কবিতা তো এমনিতেই মাথায় আসার কথা না। নিশ্চয়ই কোনো নন্দিনীকে কল্পনা করে লিখেছেন।”
উচ্ছ্বাস উদাস গলায় বললো,”যদি তাই হয় তবে কি আমার পাপ হবে? সেই পাপে কি হবে জেল? আদালত, ফাঁ সি দিবে?”
প্রিয়তা ঝট করে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। তার মানে কি উচ্ছ্বাসের জীবনে আগেও কোনো মেয়ে এসেছে?
প্রিয়তার ছলছল চোখ দেখে শব্দ করে হেসে দেয় উচ্ছ্বাস। প্রিয়তা হতবাক হয়ে দেখে সেই হাসি। একটা পুরুষ মানুষ এতো সুন্দর করে কেনো হাসবে? কেনো?

সন্ধ্যা মিলিয়েছে কিছু সময় আগে। এখনো পশ্চিম আকাশ রক্তিম হয়ে আছে। এই সামান্য আলোতে উচ্ছ্বাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীকে অসামান্য লাগে।
“জানো প্রিয়তা, আমার মা অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। আমার ছোট ছোট সৃজনশীলতার হাতে খড়ি আমার মায়ের হাত ধরেই। আমি যখন গান করতাম মা মায়াভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে। আসলেই মানুষটার কথা শুনে ভীষণ কষ্ট হয় তার। মা ছাড়া দুনিয়া বড্ড নিষ্ঠুর।
“মা একটা কথা বলতো, সন্ধ্যা মিলানোর এই সময়ের আলোকে বলে কন্যাসুন্দর আলো। এই আলোতে সাধারণ মেয়েকেও অসাধারণ লাগে। গোধূলির আলো ললনাদের সৌন্দর্য নাকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আবার গ্রামের দিকে এই আলোকে পাত্রপক্ষ ঠকানো আলোও বলে।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”পাত্রপক্ষ ঠকানো আলো মানে?”
“মানে গ্রামের দিকে কোনো মেয়ে কালো হলে নাকি পাত্রপক্ষকে এই সময়ে মেয়ে দেখানো হতো। এতে মেয়ের সৌন্দর্য বেড়ে যেতো। পাত্রের পছন্দ হয়ে যেতো মুহুর্তেই।”
উচ্ছ্বাসের কথা শুনে প্রিয়তা চোখ বড় বড় করে তাকায়। এরপর খিলখিল করে হেসে দেয়। নীড়ে কিছু পাখি ফিরছিলো তখনই। তাদের গুঞ্জনের সাথে প্রিয়তার অসম্ভব মিষ্টি হাসি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
উচ্ছ্বাস সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে বললো,”নন্দিনীর হাসির পানে বার বার চাহনী দেওয়া কি অপরাধ? যদি অপরাধ হয় তবে সেই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি আমার হোক, বারবার হোক।”
হাসি থামিয়ে প্রিয়তা তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। আজকের এই সন্ধ্যাটাকে অসহ্য সুন্দর লাগছে তার। নিজেই নিজেকে হিংসা করছে। এই মানুষটা এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে? হঠাৎ কেনো-ই বা বলছে আজ?

হাঁটতে হাঁটতে উচ্ছ্বাস হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে।
“এ কি দাঁড়িয়ে পড়লেন যে?”
“তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার আছে প্রিয়তা।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললো,”আজকের এই সন্ধ্যাটা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার। আমার আর কোনো উপহার চাইনা।”
ঠোঁট কামড়ে হাসে উচ্ছ্বাস। আচমকাই লজ্জা পেয়ে যায় প্রিয়তা। কি বলে ফেললো সে? এখন তাকাবে কীভাবে সে মানুষটার চোখের দিকে? কি লজ্জা! কি লজ্জা!

পকেট থেকে উচ্ছ্বাস কাগজে মোড়ানো একটা উপহার বের করে প্রিয়তার হাতে দেয়।
“কাচের চুড়ি খুব পছন্দ আমার। আমার মা খুব ভালোবাসতো কাচের চুড়ি পরতে। প্রায়ই মা আর আমি টিএসসিতে ঘুরতে যেতাম। মা কে হাতভর্তি কাচের চুড়ি কিনে দিতাম। আজ অনেকদিন পর চুড়ি কিনলাম। তোমার হাতে সুন্দর লাগবে।”
প্রিয়তা হাত বাড়িতে চুড়িগুলো নেয়। কাগজটা খুলতেই দেখে একমুঠ নীল কাচের চুড়ি। সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট।
প্রিয়তা সাথে সাথেই চুড়িগুলো হাতে পরে নেয়। রিনিঝিনি শব্দ করে ওঠে সেগুলো।

প্রিয়তার চোখ ভর্তি পানি। যে কোনো সময় টুপ করে নিচে পড়বে।
এক ফোঁটা পানি পড়তেই উচ্ছ্বাস এক আঙ্গুল বাড়িতে ধরে।
“হীরার টুকরোগুলো অনেক মূল্যবান প্রিয়তা, এভাবে নষ্ট করোনা।”
প্রিয়তা কিছুই বলতে পারেনা। এখন কিছু বললেই সে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে।

“বাড়ি ফিরে যাও।”
“আপনি যাবেন না?”
“ওটা যে আমার নিজের বাড়ি নয়। কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই। তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছে।”
উচ্ছ্বাসের কথা শুনে খটকা লাগে প্রিয়তার। হঠাৎ এমন বলছে কেনো উনি?
উচ্ছ্বাস সুন্দর করে হেসে বললো,”তুমি যাও, আমি আসবো।”
প্রিয়তা অসহিষ্ণু কিছু বলতে যেয়ে থেমে যায়। তার মনে হচ্ছে এখন উচ্ছ্বাসকে যেতে দিলে আর কোনোদিন তার দেখা পাবে না। চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবে। এমন মনে হচ্ছে কেনো তার?

“কি হলো যাও?”
প্রিয়তা আকুল হয়ে বললো,”আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য।”
উচ্ছ্বাস কিছু বলেনা, নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার দিকে।

যেতে যেতে প্রিয়তা আবার পিছনে তাকায়। এখনো বটবৃক্ষের মতো মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে বুকে দুই হাত বেঁধে। প্রিয়তা বাড়িতে না ঢোকা পর্যন্ত সে মনে হয় যাবেনা। প্রিয়তার ইচ্ছা করে ছুটে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে। কোনো এক অদম্য নেশা তাকে চেপে ধরে। এমন লাগছে কেনো তার? সে তো বলেছে সে ফিরে আসবে। তবুও কেনো বার বার মনে হচ্ছে সব পেয়েও হারিয়ে ফেলবে?
অন্ধকার নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। তবুও উচ্ছ্বাস দূর থেকে বুঝতে পারছে মেয়েটা কাঁদছে। তার চোখের পানিগুলো মুক্তোর মতো গড়িয়ে পড়ছে দুই গাল বেয়ে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাস পা বাড়ায় অজানার দিকে।
‘কাঁদো প্রিয়তা, মন ভরে কাঁদো। শেষবারের মতো কেঁদে নাও। আর কাঁদতে দিবো না তোমাকে।’

(চলবে…..)