Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 50



যে আসে অগোচরে পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

#যে_আসে_অগোচরে

পর্ব ৬ (শেষপর্ব)

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

তিনদিন নুহাকে বাইরে না দেখতে পেয়ে নিষাদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে অপারগ হয়ে স্বশরীরে চলে এসেছে নুভাদের বাড়িতে। তিনদিন সে হসপিটালে ডিউটিও করেনি। নুভাকে না দেখতে পেয়ে নিষাদ যেনো আর নিজের মধ্যে নেই। খাওয়া, ঘুমও তার বরবাদ হয়ে গিয়েছিলো। ধারণা করেই ছিলো নিশ্চয় কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। নুভার বন্ধু শান্ত ও রুমিকেউ তলব করেছিলো নিষাদ। তবে তাদের কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি সে। তাই অগ্যতা বাড়িতেই চলে এসেছে সে একাই, কাউকে না নিয়েই।

নিষাদকে দেখে মিনারা নুভাকে গা’লিগালাজ করা বন্ধ করে, নিজের কপালের ঘাম মুছে, আগের রাগ সব উঠিয়ে রেখে, শান্ত স্বরে বললো,

” বাবা, এসেছো? এসে ভালোই করেছো, এই মেয়েকে আমি কোনোক্রমেই তোমার হাতে তুলে দিতে পারবো না!”

মিনারার কথা শুনে নিষাদের চোখে মুখে যুক্ত হলো একরাশ সংশয় ও দু:শ্চিন্তা। তবে সে চুপ থেকে মিনারাকে আরো কিছু বলার সুযোগ করে দিলো।

মিনারাও পুনরায় বলতে লাগলো কান্নারত স্বরে,

” বাবা, তুমি একজন উচ্চশিক্ষিত, সুযোগ্য পুত্র, ডাক্তার, তোমাদের পরিবারের সবাই অনেক উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্য, সমাযে তোমাদের একটা উল্লেখযোগ্য স্টেটাস আছে। আমি সব জেনে শুনেই আমার এই গুন্ডি, অবাধ্য, নষ্ট ও উগ্র মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারিনা, এতে আমার অনেক বড় পাপ যে হবে…”

এবারে মিনারার মুখের কথা নিজের মুখে তুলে নিয়ে নিষাদ বলে উঠলো,

” শোনেন আন্টি, পাপ পূর্ণের জ্ঞান আমার চাইতে হয়তো আপনারি বেশি আছে। তবে আমার মতে, এতে পাপ হতো, যদি আপনি জোর করে তুলে দিতেন তবে, আমি নুহাকে ভালোবাসি আন্টি, আর আমি ওর সম্পর্কে হেন কোনো তথ্য নেই যা জানি না, আর সব জেনে বুঝেই আমি নুহাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছি, সুতরাং আপনি এর মধ্য পাপ, পূর্ণ ইত্যাদি বিষয় টেনে এই বিয়েটাকে থামিয়ে দিবেন না আন্টি, প্লিজ আপনার দোহাই লাগে। ”

এদিকে নিষাদের উক্ত কথাগুলো শুনে আমির আলী প্রায় স্তব্ধ ও বাকরুদ্ধ হয়ে থাকা মিনারার কাঁধ ঝাঁকালো। এতে মিনারাও তার বিমূর্ত মূর্তি হতে ফিরে এসে পুনরায় নিষাদকে শুধালো,

” বাবা, তুমি ভেবে বলছো তো? তুমি পারবে কি আমার নেশাখোর মেয়েকে বিয়ে করতে?”

মিনারার এক প্রশ্নেই নিষাদের বুকের ভেতর ধ্বুকপুক করে উঠলো, তদুপরি সে উত্তর করলো,

” আপনি ভেবে বলছেন তো আঙ্কেল? নুভা ঘুনাক্ষরেও নেশা করে না, আমি নুভাকে প্রতি পদে পদে দেখেছি, বুঝেছি, ওকে বিচার বিশ্লেষণ করেছি, নিশ্চয়ই এ কারো চক্রান্ত ওকে হেনস্তা করার জন্য। এতে আমাদের বিয়েতে কোনো পিছপা হবো না। এ নিয়ে আপনি ভাববেন…”

নিষাদ তার কথা শেষ করতে পারলো না।

দরজায় কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো।

বিমর্ষ মিনারা গেইট খুলতেই একগাদা ইউনিফর্ম ধারী পুলিশ টগবগে বুটের শব্দে এসে ঢুকে গেলো সারা বাড়িতে।

আমির আলীকে উদ্দ্যেশ্য করে একজন বলে উঠলো,

” আপনারা মেয়ে নুভাকে ডাকুন, ওর জরুরি তলব আছে!”

আমির আলীর হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেলো এসব শুনে। জীবনেও সে পুলিশের স্বরণাপন্ন হয়নি। পুলিশকে তার জমের ন্যায় ভয়।

সে আমতা আমতা করতে লাগলো। ভয়ে তার মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করলো।

” একি? শেষ পর্যন্ত তার মেয়েকে পুলিশে ধরে নেবে? আর তার পুলিশের পেছনে পেছনে ধন্না দিতে হবে? সে প্রায়ই বলে থাকে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা ”

তাই নিষাদ আমির আলীর উদ্দ্যেশ্যে ছোঁড়া আদেশের বিপরীতে নিজেই পুলিশ অফিসারকে উদ্দ্যেশ্য করে বলতে লাগলো,

” আপনাদের নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে অফিসার, নুভা কিছুই করেনি”

অফিসার রুষ্ট স্বরে বলে উঠলো,

” আপনাকে আমি চিনি, আপনি ডক্টর নিষাদ না? ডাক্তার হয়েও আবার উকালতি কবে শুরু করলেন? শুনুন মিস্টার নিষাদ, আমরা জেনে শুনেই এসেছি, ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে যে, ওই মেয়ে এক নেশাজাত দ্রব্য পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িত আছে, আর ওকে এরেস্ট করার অর্ডার আছে উপর হতেই, এই দেখুন সব এভিডেন্স, সো লেট আস ডু আওয়ার ডিউটি”

মিনারা আর ক্ষণকালও বিলম্ব করলো না। নিজের মেয়েকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারলেই যেনো তার স্বস্তি। আর এ জন্যই যেনো সে তার মেয়েকে আটকে রেখেছিলো সযত্নে। সে তাই দরজা খুলে নুভাকে বের করে আনলো ঝটিকা বেগে। কে জানে মিনারার কোনো আক্ষেপ হচ্ছিলো কিনা? তবে আমির আলী নিজের মেয়ের হয়ে আবারো অনুনয় করে বলা শুরু করলো পুলিশের বড়কর্তার কাছে,

” অফিসার বিশ্বাস করুন, আমার মেয়ে বেয়াদব হতে পারে, মা’রামারি করতে পারে, রগচটা হতে পারে, তবে নেশা পাচারকারী ও কস্মিনকালেও না…!”

আমির আলি হাঁটু গেড়ে কান্না শুরু করলো।

নিষাদ অফিসারকে কিছু বুঝাতে উদ্যত হলো। তবে নুভা নিষাদকে ধমকালো,

” আরে আরে! ডাক্টার ডাক্টার! বাদ দাও তো, আমার মায়েই যেখানে কিছু বলছে না, সেইখানে তোমার এত এংজাইটি মানায় না আমার জন্য, তবে জীবনে সবকিছুর এক্সপিরিয়েন্স রাখা ভালো, জীবনে কোনোদিন জেল খাটিনি, তবে মনে হয় এই উছিলায় আমার এবার জেল খাটারও এক্সপেরিয়েন্স টা হয়ে যাবে, হা হা হা! আমি তো মহাখুশি! ”

অফিসার চোখের ঈশারা করতেই সেন্ট্রিরা এসে দ্রুত হাতকড়া পড়িয়ে দিলো নুভার হাতে।

যেতে যেতে সামান্য পিছু ফিরে মা বাবাকে উদ্দ্যেশ্য করে হাসতে হাসতে সে বললো,

” আব্বা, আম্মা, তোমরা তো জানোই আমি কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারি না, সুতরাং এইটাও জেনে রাখো আমি কয়েকদিনের মধ্যেই আবার ফেরত চলে আসবো, আমি জেলখানার ব্যাপারে খুউব এক্সাইটেড। হুররে! আমি জেলখানায় যাচ্ছি!

নুভার হাসি দেখে নিষাদের বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠলো। তার মনে হলো,

এ মেয়ে কি বদ্ধ উন্মাদ নাকি? এর নূন্যতম ধারণাও নেই, জেলে গেলে এর কি হাল হবে? আর মান-সম্মানের কি বারোটাই না বাজবে এর?

মিনারা ভৎসনা করে বলে উঠলো,

” নে গিয়া তোর এক্সপেরিয়েন্স কর গিয়া, আর ম’র গিয়া গরদে, আমি যদি মানুষের জন্মা হয়ে থাকি, তাইলে তোরে কোনোদিন বাইরে বের হইতে দিবো না, তোর বাপেরেও দিমু না বাইর করতে!”

এতসব গরলবাক্য শুনেও নুভা দুষ্টের হাসি হাসতে হাসতে পুলিশের সাথে চলে গেলো হাতকড়া পড়ে।

নুভা কে নিয়ে চলে গেলে মিনারা বুকফাটা আর্তনাদে কাঁদতে লাগলো।
.
.

গোটা শহরে মুহূর্তেই রটে গেলো, নুভার এরেস্ট হওয়ার খবর। বিশেষ করে নিষাদের মায়ের কানে খবরটা চলে গেলো টর্নেডোর বেগে।

এলাকার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো।

তবে এতদিন যারা নুভার দ্বারা উপক্রিত হতো তারাও বেশি ক্ষমতাধর ছিলো না বলে আফসোস, অনুতাপ করেই ক্ষান্ত হলো।

যেখাবে তার নিজের মায়ের মধ্যেই কোনো হেলদোল নেই, সেখানে অন্য লোকেদের কি যায় আসে?

নিষাদ দ্রুত যেখানে যেখানে পারে যোগাযোগ করতে লাগলো। এক ল’ইয়ার এর সাথেও তার পাকা কথা হলো। যে নুভার জন্য লড়তে রাজী হয়েছে।

এক সপ্তাহ পর।

গোটা এলাকা হইহই রইরই করছে নিষাদ নুভাকে ছাড়ানোর জন্য উকিল নিয়োগ দিয়েছে এই খবরে। গোটা শহরের বার্নিং ইস্যুতে পরিনত হয়েছে এটা।

এলাকার মুরুব্বিরা বলাবলি করছে,

” মেয়েটা ভালো না, এক্কেবারে খারাপ। খারাপ কাজের লিস্টে হেন কোনো কাজ নেই সেই মেয়ে করে নাই। তবে ছেলেটা বোকা। তুই ডাক্তার ছেলে! কত ভালো মেয়ে পাবি, আর এইরকম একটা মেয়েরে তোর বিয়ে করতে হবে? তাও বিয়ে করার জন্য দিওয়ানা হয়ে যাবি? ছি:ছি:”

সায়রা নিজের ছেলের এসব খবরে জ্ঞাত হয়ে বেশ উদ্বীগ্ন হয়ে গেলেন।

অসুস্থ্য হয়ে হসপিটালের বেডে তার ঠাঁই হলো।

সে ম’রবে তাও ছেলেকে নুভার সাথে বিয়ে দিবে না।

নুভা সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ছাড়া পেলো। ইভটিজ করা ছেলেদের উচিত শিক্ষা দেওয়ায় তারা যড়যন্ত্র করে নুভার বাইকে নেশাদ্রব্য দিয়ে রেখেছিলো, এমনই প্রমাণ করলো নিষাদের নিয়োগ করা উকিল। কিন্তু সায়রা এবার নিজের ছেলেকে এ বিয়ের ব্যাপারে মানা করে দিলো।

যে সায়রা কয়েকদিন আগেও ছেলের ইচ্ছাকেই প্রাধাণ্য দিতো এখন সে যেনো এই বিয়ের ভাঙ্গার প্রধান উদ্যোক্তা। সাথে মিনারাও আছে। কেউ ই আর চাচ্ছে না, নুভার সাথে নিষাদের মিলন হোক।

এমন সময় নুভাও লাপাত্তা। নিষাদের মন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। যে নিষাদ এত অপমান, অপবাদ সহ্য করেও নুভাকে জেল থেকে বাইরে এনেছে সে নুভাই এত অকৃজ্ঞের ন্যায় আচরন?

মনমরা নিষাদ সবকিছু থেকেই অব্যাহতি নিয়েও আবার বিধবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে সংবরন করলো।

মিনারা মেয়ের অজ্ঞাতবাসে যাওয়াতে দারুন মর্মাহত হলেও, মনে মনে তার বিশ্বাস ছিলো নুভা যেখানেই যাক আর যেখানেই থাকুক না কেনো, নিজেকে সে ভালো রাখবেই।

সত্যিই তাই ই হলো।

নিষাদের কাছে একদিন শান্ত ও রুমি দৌড়ে এলো।

” দুলাভাই, দুলাভাই, খবর আছে, খবর আছে ” বলে তারা নিজেদের মোবাইলের স্ক্রিন নিষাদের সন্মুখে তুলে ধরলো। ”

নিষাদের চোখে ভেলকি লাগলো যেনো।
অবাক করা বিষয়! নুভার গায়ে দেশের লাল সবুজের জার্সি!

জাতীয় নারী ক্রিকেট টিমের সদস্য সে এখন। প্রথম দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে সে।

তার হাতে মাইক, কিছু বলার জন্য সঞ্চালক তার হাতে তুলে দিয়েছে।

কাঁপা কাঁপা স্বরে মাইক হাতে স্টেজে উঠে নুভা ক্যামেরার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,

” থ্যাক্স ডাক্টার নিষাদ! তুমি আমার অনুপ্রেরণা, চেয়ে দেখো, শুণ্য হাতে বাড়ি ছাড়া আমি আজ আন্তর্জাতিক ভাবে খেলতে যাচ্ছি, সেদিন ম্যাচ ফিক্স করে আমাকে জিতিয়ে তুমি আমার মুখের হাসি দেখতে চেয়েছিলে। সেদিন মেকি হাসি দেখেছিলে, আজ দেখো আমার মুখে আসল হাসি, আর চোখে আনন্দের অশ্রু। এই অশ্রুই কি বলে না, যে এই নুভা তোমাকে ভালোবাসে? একদিন না বলেই চলে গিয়েছিলাম, আর আজ দেখো কি সারপ্রাইজ দিলাম। আজ সারা দেশের সামনেই আমি তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি, আমিও তোমাকে ভালোবাসি! ”

নিষাদ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো।

নুভার এত বড় কৃতিত্বের খবর অতিদ্রুত শহরে রটে গেলো। কয়েক বছর আগেও যারা নুভার বদনাম করতো, আজ তারা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যাচ্ছে। মাইকে তার নাম ঘোষিত হচ্ছে।

এলাকার টক অব দ্যা টাইম এখন নুভা।

মিনারা ও আমির আলীর মুখ গর্বে উজ্জ্বল।

কিছুদিন বাদে নুভা ম্যাচজয়ী হয়ে দেশে ফিরলো।

বিজয়ী নুভাকে বরণ করে নিলো গোটা শহর। সাথে নিষাদের পরিবারও।

বিশাল ধূমধাম সহযোগে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হলো।

(সমাপ্ত)

যে আসে অগোচরে পর্ব-০৫

0

#যে_আসে_অগোচরে

পর্ব ৫

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

শহরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে এক নদী। দু তীর ঘেঁষে বনানীর ছায়ায় দুকূল যেমন ছায়াযুক্ত ও ঠান্ডা থাকে নদীর পানিও থাকে তেমনি থাকে শীতল। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে এ নদীর পানিই এলাকার দামাল ছেলেদের স্বস্তির একমাত্র উৎস। স্কুল,কলেজ থেকে ফিরেই দলেবলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীর ঠান্ডা পানিতে। ডুবসাঁতার, চিৎসাঁতার, চিলসাঁতার, উল্টাসাঁতার, ব্যাঙ্গসাঁতারে মেতে উঠে তারা। মেয়েরাও কম যায় না। স্কুল, কলেজগামী মেয়েদের কাছেও ইতিমধ্যেই এ নদী হয়ে উঠেছে ওয়াটার পার্ক। প্রকৃতির তপ্ততার সাথে পাল্লা দিয়ে তারা মেতে উঠে নিজেদের শীতল করার কাজে।
আর নুভা হলো এ দলের ছেলেমেয়েদের লিডার।
সবার আগে সেই ঝাঁপ দিয়ে সূচনা করে এই ঝাঁপাঝাঁপি পর্ব। বেশি গরমের দিনে একেবারে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত চলে তাদের এ ঝাঁপাঝাঁপি। আগে মেয়েরা এই ঝাঁপাঝাঁপিতে অংশগ্রহন করতে ভয় পেতো। কিন্তু নুভা যতদিন যাবৎ এলাকার সব ইভটিজারদের ঘুম হারাম করেছে, ততদিন ধরে এ এলাকার মেয়েরাও নির্বিঘ্নে এই জলে ঝাঁপাঝাঁপি করে জলকেলি করার সুযোগ পায়।
তারা একে অপরের গায়ে পানি ছিটায়, আনন্দ করে, এক মনোরম পরিবেশে। মাঝে মাঝে ছোটোদের সাথে বয়োবৃদ্ধরাও যোগ দেয়।

তবে কতিপয় সংশয়বাদী নারী পুরুষ, সমালোচনা না করলে যাদের ঘুম হয়না বা পেটের ভাত হজম হয় না, তারা একথা, ওকথা, কূকথা বলতেই থাকে।

সেদিনও সন্ধ্যার ঠিক আগে নুভা যখন পানি থেকে উঠে এলো, সদলবলে, তখন একদল নারী এটা ওটা বলাবলি করছিলো। নুভার কানে ভেসে এলো কেউ বলছে,

” ছি:ছি: এই মাইয়ার শরম ভরম কিছুই নাই। ছেলেদের পোশাক পইরা কেমন করে এই মেয়ে ছেলেগো সঙ্গে পানিতে ভিজে, এর তো বিয়া হইবোই না, এই মেয়ে এলাকার অন্য ভালো মাইয়াগোও বিয়া হবার দিবো না!”

নুভা এর আগেও এ জাতীয় কথাবার্তার স্বীকার হয়েছিলো। সে বেশির ভাগ সময়ই এসবের প্রত্তুত্তর করে না। তবে আজ তার অনেক বেশি রাগ হলো।

সে সহাস্যে কঠিন স্বরে বলে দিলো,

” আপনাদের এমন কুকথা অনেক শুনছি, তবে আমার বিয়ে হবে না এটা আপনি কিকরে জানেন? আপনি কি ভবিষ্যত বলতে জানেন? তাইলে কইরে শখিগো দল সবাই আয় দলবলে, এই চাচী তোদের সবার ভাগ্য বলে দেবে!”

এই কথা বলে সে তার গ্রুপের মেয়েদেরকে উছলিয়ে দিলো সেই চাচীর কাছে নিজেদের হাত দেখানোর জন্য। সেই চাচীস্বরুপ নারী এবার বেশ ক্ষেপে গেলো, সে আবার চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

” এই মেয়ে, মুরুব্বীদের সাথে বেয়াদবী মার্কা কথা কউ কেন? নিজের দিকে তাকায় দেখো,পড়ছো তো পোলাগো পোশাক, আর চলোও স’ন্ত্রাসীদের মতো? এভাবে চললে কোনো পোলার ঘরেরই বউ হবার পারবা না আর, সারা জীবন আবিয়াত্তা থাকতে হবো।”

ঐ নারী এই কথা বলার সাথে সাথেই কোথা হতে যেনো ঝড়ের বেগে উদয় ঘটলো নিষাদের। সে সাইক্লোনের বেগে নুভার এক হাত ধরে বললো,

” ঐ চাচী কথাবার্তা একটু সাবধানে বলবেন, এই মেয়ে আমার হবু বঁধু, আর আমি হলাম ঐ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্টার নিষাদ, আর আগামী মাসেই এই মেয়ে আমার ঘরের ঘরনী হবে, সুতরাং বুঝে শুনে কথা বলুন।”

নিষাদের কথা শুনে সেই মহিলা সব আরো সব মহিলাদের মধ্যেই চঞ্চলতা শুরু হলো, আরে! সত্যিই এই মেয়ের ঐ ডাক্টারের সাথে বিয়ে হবে? অবিশ্বাস্য! এরকম গুন্ডি একটা মেয়ে এত ভালো বর পেলে ভালোই তো! মেয়েটার কপাল ভালো।

নিষাদ শুনে বলে উঠলো,

” না না চাচী, নুভার নয়, আমারই কপাল ভাল, যে নুভার মতো এক মেয়ে পেয়েছি। ”

নিষাদের একথা শুনে নদীতে ভিজতে আসা অন্য মেয়েরাও খুশিতে হর্ষ ধবনি দিয়ে উঠলো।

তারা জয় ধবনি করে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

” দুলাভাই, দুলাভাই, দুলাভাই জিন্দাবাদ, দুলাভাই জিন্দাবাদ!”

তবে নুভার মুখটা মলিন হলো, নিষাদের চোখ সেটা এড়ালো না। নিজের অজান্তেই নিষাদের মাথায় প্রশ্ন এলো, ” তাহলে কি নুভা আমাকে এখনো মেনে নেয়নি?”

তবে সে প্রশ্নের উত্তর এলো না। নুভা নিষাদের হাতের মুষ্টির বন্ধনী হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যত্র স্থান ত্যাগ করলো দৌড়ে । নিষাদ এর মানে খুঁজে পেলো না। আরে! নুভা কি লজ্জা পেলো? নাকি বিরক্ত হলো। হয়তো লজ্জাই! বিরক্ত হবে কেনো? নিষাদ লজ্জা ভেবেই নিজের মনকে সুখ দিলো।

“আরে! আমার লজ্জাবতী বধূ!”

রাতে নিষাদ আর ঘুমাতে পারলো না, উত্তেজনায়। নুভার হাত ধরার উত্তেজনায়! ঠিক সেদিন রাতের মতো যেদিন সে প্রথমবারের মতো নুভাকে দেখেছিলো; কোলে তুলে নিয়েছিলো, নিজ হাতে পায়ের লোহা খুলে সেলাই করে, পা টা জড়িয়ে ধরেছিলো।
নুভা মা’রামারি কা’টাকা’টি করলেও, তার হাতের স্পর্শ এত মোলায়েম হবে তা ভুলেও ভাবতে পারেনি নিষাদ। আর হাত ধরাকে নুভা মেনে নিয়েছে, নইলো তো আরেকটা চড় পড়তো তার গালে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ই নেই। বরং নুভা লজ্জা পেয়ে দৌড়েছে। অর্থাৎ সে নিষাদের হাত ধরা ব্যাপারটায় মোটেও মনোক্ষুণ্ণ হয়নি।

নিষাদের মন খুব করে চাইছিলো নুভার সাথে সামান্য কথা বলতে। কিন্তু কোনোক্রমেই মেয়েটার কন্টাক্ট নাম্বার জোগাড় করা যায় নি। এর কারনো অবশ্য আছে। নুভা ফোন তেমন ব্যবহার করে না। সে যেহেতু বেশিরভাগ সময় ছোটো ছেলেদের সাথেই মেশে সেহেতু সে তার বন্ধুদের দলের মতোই ফোন ছাড়াই চলে। তারা চলে এনালগ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ একে অপরকে নির্দিষ্ট টাইম দিয়ে দেয়, তারা সবাই সেই টাইম মোতাবেকই দেখা স্বাক্ষাত সারে।

সকাল সকাল ক্লিনিকে গিয়েও সে নুভার স্মৃতির সাগরেই ডুবে থাকে। ক্লিনিক থেকে এসেও আবার সেই একই দশা। দূর থেকে সে প্রতিদিনই নুভাকে দেখে, অনুসরন করে, আবার কখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাফ বুনো সৌন্দর্য দেখে, শুধু দেখে। কখনো ফুটবল খেলারত নুভা, আবার কখনোবা ক্রিকেট, কখনো পাড়ার মোডে ক্যারাম, লুডু আবার কখনো সে নদীতে সাঁতরাচ্ছে, আবার কখনো বাইকে দৌড়াচ্ছে। কখনো মারামারি করা অবস্থায়, আবার কখনো কাউকে গা’লিগালাজ। নুভা জানে কিনা তাও নিষাদ জানে না। নিষাদ মনে মনে ভাবে, মেয়েটাকে কয়েকদিন সময় দেওয়া উচিত। এতে সেও তার মনটাকেউ বুঝে নিক।
.
.

নিষাদের মা সায়রা বেগম একজন বিধবা মহিলা। নিষাদ যখন কেবল ক্লাশ এইটে পড়ে তখনই সে তার বাবাকে হারিয়েছে। তখন তার বড় ভাই নোবেল অবশ্য ইন্টার পাশ করেছে। আর ছোটো বোনটাও ক্লাশ ফাইভে পড়তো। সায়রা বেগম একাই কঠোর পরিশ্রম করে ছেলে মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। বড় ছেলে নোবেল বড় ইঞ্জিনিয়ার, স্ত্রী, পুত্র সহ সে জার্মানিতে থাকে। ছোটো ছেলে নিষাদ এম বি বি এস ডাক্টার, আর ছোটো মেয়ে নির্না; সে ও একজন বিসিএস ক্যাডার। নির্নার বিয়েও হয়েছে আর এক বিসিএস ক্যাডারধারী অফিসারের সাথে। সুতরাং একমাত্র নিষাদের বিয়ে করাতে পারলেই তার জীবনের ষোলোকলা পূর্ণ হবে। সাথে নিজের ছোটোভাই আব্দুল হকের বিয়েও দায়ও তার ঘাড়েই পড়েছে। নিষাদের বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইরাই সায়রা বেগমের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। তার তিন ভাই সায়রা বেগমের তিন সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়। তাই ছোটো ভাই আবুল হকের দায়িত্ব তার সন্তানেরাই তুলে নিয়েছে। বড় ছেলে নোবেলের বয়সী আবুল হক এখনো ব্যাচেলর। ভালো মেয়ে পেলে হকের বিয়ে দিতে তার কোনো আপত্তি নাই। কারন আব্দুল হক এখন নিজের ব্যাবসায় মনোযোগী হয়েছে উপার্জনও ভালোই করে।

আজ আব্দুল হক নিজের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাবে। সায়রা বেগম কোনোদিন পাত্রী দেখার আসরে যান না। কারন তিনি বিশ্বাস করেন, অন্য মানুষের নয়, বরং যে বিয়ে করবে পাত্রী তার মনমতো হওয়া উচিত। সেজন্যই যে বিয়ে করবে তাকেই পাত্রী দেখতে যাওয়া উচিত।

মহল্লার অন্য মহিলারা অবশ্য সায়রা বেগমকে তোড়জোর করেছে যেনো নিষাদের পছন্দের মেয়েটাকে একবার হলেও দেখে আসে। কারন শহরে এই মেয়ের রিপোর্ট ভালো না। সারাদিন মা’রপিট করে বেড়ায় গুন্ডি এই মেয়ে! তবে সায়রা বানু মানুষের কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কাটকাট স্বরে বলেছে,
” যে সারাজীবন কাটাবে ঐ মেয়ের সাথে, তার পছন্দ হলে আপনাদের সমস্যা কোথায়?”

তাই সে নিষাদকেউ নিজেই নিজের পাত্রী নিজে দেখার জন্য পাঠিয়েছিলো। কিন্তু আব্দুল হক ও অয়ন যেনো নিষাদের সাথে তার ছায়ার মতো সাথী। তাই তাদেরকেউ সাথে পাঠিয়েছিলো।
কিন্তু তার ডাক্তার ছেলে যে ঐ গুন্ডি মেয়ের প্রেমে এভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে তা সে চিন্তাও করতে পারে নি।
.
.
মিনারা বেগম নুভাকে জোর আটকানো আটকিয়েছে, তিন দিন যাবৎ। সেদিন সন্ধ্যায় বাইরে বের হতে ধরেছিলো সে, মিনারা বহুবার নিষেধ করে, বের হওয়ার জন্য! কিন্তু নুভা সেই নিষেধ মানতে নারাজ। সে তার সিদ্ধান্তে অটল, নিজের মনের মতো চলতে সে বে পরোয়া। আর মিনারা বহু সহ্য করেছে, আর সে এসব সহ্য করবে না বলে দাঁত খিঁচে রয়েছে। তাই নুভাকে ভেতরে আটকে সেই রুম বাইরে থেকে লক করে দিয়েছে। সে যে করেই হোক নুভাকে আর বাইরে যেতে দেবে না। আশপাশের মানুষজন খুব খারাপ এক অপবাদ ছড়িয়েছে তার মেয়ের নামে, যা সে জীবনেও কল্পনা করে নি। সেটা হলো, ” নুভা তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে নাকি গাঁজা, ফেন্সিডিল ইত্যাদি খায়!”

এতদিন- মারপিট করে, রাত-বিরেতে ঘুরে বেড়ায়, ছেলেদের সাথে ঘোরাঘুরি ও খেলাধূলা করে এসব খবর শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা। আর এখন মেয়ে নেশা করে, এ খবর শুনে তো মিনারার হার্ট এটাক করার উপক্রম। মেয়েকে আর কি করবে সে, পারলে সে নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ে। মিনারা যেনো উন্মাদের ন্যায় কাঁদছে। তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্ঠা করছে স্বামী আমীর আলী ও ছোটো মেয়ে তূর্ণা। ওদিক হতে নুভাও চিল্লাচিল্লি করে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবী করছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।

মিনারা কারো বুঝ মানছে না। মেয়ে মরে গেলে যাক, সে এই মেয়েকে বাড়ি হতে এক পা ও বাইরে বের হতে দেবে না, এতে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এমন সময় সে বাড়িতে আগমন ঘটলো নিষাদের। নিষাদ সাথে তার বন্ধু অয়নকেউ এনেছে।

আসলে তিনদিন নুহাকে বাইরে না দেখতে পেয়ে নিষাদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়ে স্বশরীরে চলে এসেছে নুভাদের বাড়িতে। তিনদিন সে হসপিটালে ডিউটিও করেনি। নুভাকে না দেখতে পেয়ে নিষাদ যেনো আর নিজের মধ্যে নেই। খাওয়া, ঘুমও তার বরবাদ হয়ে গিয়েছিলো। ধারণা করেই ছিলো নিশ্চয় কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। নুভার বন্ধু শান্ত ও রুমিকেউ তলব করেছিলো নিষাদ। তবে তাদের কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি সে। তাই অগ্যতা বাড়িতেই চলে এসেছে।

নিষাদকে দেখে মিনারা নুভাকে গালিগালাজ করা বন্ধ করে, নিজের কপালের ঘাম মুছে, শান্ত স্বরে বললো,

” বাবা, এসেছো? এসে ভালোই করেছো, এই মেয়েকে আমি কোনোক্রমেই তোমার হাতে তুলে দিতে পারবো না!”

( চলবে)

যে আসে অগোচরে পর্ব-০৪

0

#যে_আসে_অগোচরে

পর্ব ৪

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

“বন্ধু ও যখন রেগে থাকে না! আমার মনে হয় ওর দিকে শুধু চেয়েই থাকি রে! চোখ দুটিতে উছলে পড়ে ওর ভেতরের তেজ, ঠোঁট দুটি গোলাপি লাল বর্ণ ধারণ করে, গাল দ্বয় গোলাপী হয়ে যায়! এত সুন্দর লাগে ওরে!আমি এক্সট্রিম ভাবে ওর প্রেমে পড়েছি রে! স্পেশালি ওর রাগান্বিত চেহারার। ইটস কোয়াইট ইমপসেবল টু কন্ট্রোল মাইসেল্ফ!”

নিষাদ তার বন্ধু অয়নকে তার আবেগের সর্বচ্চো শৃঙ্গে থাকা এসব কথা বলছিলো নিষাদের বেডরুমে শুয়ে শুয়ে। তার হাতে নুভার একটা আপাদমস্তক ছবি। শাড়ী পরিহিত। চেহারা দেখে বুঝাই যাচ্ছে, এ শাড়ী পড়ে সে মোটেই কমফোর্ট জোনে নেই। মুখ বিষ করে রেখেছে। নিষাদ ও অয়ন দুজনেই সেই বাল্যকালের বন্ধু। হেন কোনো আবেগ নাই যে তারা একে অপরকে শেয়ার করে নি। অয়ন প্রতি মাসেই একবার করে প্রেমে পড়লেও, নিষাদ যে কোনোদিন প্রেমে পড়বে তা সে কোনোদিন ভাবে নি। নিষাদ ছিলো ছোটোকাল হতেই ছুঁকছুঁকে স্বভাবের। এটা খাবো না, এটা পড়বো না, এটা নেবো না, ওটা কিনবো না, এরকম নাক শিঁটকানো ছিলো নিষাদের জন্মগত অভ্যাস। আর সেই নিষাদই আজ প্রেমে পড়লো একটা রাগী মেয়ের?

অয়ন নিষাদের পিঠে সজোরে একটা চাপড় বসালো।

” কি বলিস তুই বন্ধু! মানুষের মুখে স্লিপিং বিউটি, লাফিং বিউটি শুনেছি, তবে তোর মুখে এংগ্রি বিউটি কথাটা শুনলাম, এই প্রথম! রাগ করলে তারে সুন্দর লাগে! অদ্ভুত তো! ”

নিষাদ আগের মতোই কথাগুলোকে আরেকটু ঝাঁজ মিশিয়ে দিয়ে বললো,

” সেই জন্যই ওরে আমি বারবার রাগিয়ে দেই, ওর সৌন্দর্য্য দেখার লোভে! আর যাদের রাগ বেশি তাদের মনটা অনেক নরম হয় আমি জানি! ”

অয়ন একথা শুনে প্রথমে তার মুখ ক্যাবলাকান্তের মতো করলো অত:পর সজোরে হেসে বললো,

” তাই বলে ওর সৌন্দর্য দেখার লোভে বারবার ওকে রাগালে, ওকে আর তোর বিয়ে করা লাগবে না, ও অন্য কারো বগলদাবা হয়ে ভাগবে তোর জীবন থেকে, বুঝলি! আর ঐ মেয়ে যার তার লগে মারামারি করে, যারে তারে গালিগালাজ করে! আর রাত বিরেতেও বাইরে থাকে। ”

নিষাদ গাল ফুলিয়ে আহলাদির স্বরে বললো,

” আচ্ছা, বুঝলাম! ওর খারাবি গাইতে হবে না আমার সামনে। আমার চোখ এখন ওর প্রেমে অন্ধ, আমাকে ওর নামে উল্টাপাল্টা কিছু বলিস না, আবার তোরই নাক ফাটিয়ে দেবো এক ঘুঁষিতে। বুঝলি? তবে বন্ধু, আমার এখনি ওকে দেখতে প্রচন্ড মন চাইছে!”

অয়ন বিস্ময়ের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে বললো,

” এক্ষুণি? এত রাতে? ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা। বুঝিস?”

নিষাদ বন্ধুকে জেঁকে ধরে বললো,

” হ্যাঁ, এত রাতেই, তুই মাকে বুঝাবি, তোর বাসায় আমার দাওয়াত, তাই আমি বের হবো, কেমন?”

অয়ন জোরপূর্বক মাথা নেড়ে বললো,

” আজ দুপুরেই না ওর লগে দেখা করে এলি,খেলার মাঠে? এখনি আবার দেখা লাগবে?”

নিষাদ পূর্বের চেয়ে দ্বীগুন জেঁকে ধরে বললো,

” দোস্ত! আম ক্রেজি ফর হার! যত দ্রুত পারিস বিয়ের ব্যাপারটা এগিয়ে নে, নইলে আমি কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে দেবো, আমার ওকে ছাড়া একটুও ভালো লাগে না , আর এখন না দেখলে আমার রাতে ঘুম হবে না!”

অয়ন বুঝালো,

” আচ্ছা আচ্ছা, মেয়ের মায়ের কন্টাক্ট নাম্বার আছে আমার কাছে। কল দিয়ে দেখি, কোনো কূল কিনারা করতে পারি কিনা?”

মিনারার ফোনে অয়ন কল দিলো, মিনারা আধোঘুমে ছিলো। ছোটো মেয়ে তূর্ণাকে সাথে নিয়ে সে ঘুমিয়েই পড়েছিলো। নুভা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইভ টিজিং এ আক্রান্ত এক মেয়ের মায়ের ডাকে সে সেই বিকেলে শান্তর বাসায় গিয়েছিলো এখনো ফেরার খবর নেই। ফোন ও বন্ধ। সে সে কখন বাড়ি ফিরবে তার জানা নেই। সে ভয়ে ভয়ে থাকে সবসময়, কখন না তার গুন্ডি মেয়েটা পুলিশ কেসে ফেঁসে যায়।

অয়ন দ্বীধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম আন্টি”

” ওয়ালাইকুম আস সালাম বাবা, কেমন আছো?”

” আন্টি, একটা জরুরি দরকার ছিলো, ভাবীর সাথে, একটু দেবেন ফোনটা?”

” ও বাবা, ইয়ে মানে বাবা নুভা তো বাসায় নেই, ও কি জানি কাজে শান্তর বাসায় গেছে!”

” আচ্ছা আন্টি” বলে অয়ন ফোন রেখে দিলো।

আর রাগান্বিত স্বরে বললো,

” দেখছিস! তোর বউ এখন তার ছেলে ফ্রেন্ড এর বাসায়! এত রাত! ”

নিষাদ যেনো কিছুই হয়নি এমন স্বরে বললো,

” আচ্ছা, ব্যাপার না, শান্ত নুভার অনেক জুনিয়র। একচুয়ালি আমি ওর সব ছেলে ফ্রেন্ডকেই আমি চিনি। সবাই এলাকারই ছেলে, সবাই জুনিয়র। এই ধর নাইন টেনে পড়ে। আর আমি শান্তর বাসার ঠিকানা জানি! চল এক্ষুণি যাবো!”

দুজনে নিষাদের মা সায়রা বেগমকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাত এগারোটার সময় ছুটলো শান্তর বাসায়।

শান্তর বাসার পাশেই এক ঝোপের ধারে কারো অপেক্ষায় ছিলো নুভা ও শান্ত।

নুভা পা ঝুলিয়ে বাইকের উপর বসা। আর শান্ত দাঁড়িয়ে। ওদের সাথে দুই দুইটা হকেস্টিক।

নুভাকে বলতে শোনা গেলো,
” মেয়ে পাইলেই ইভটিজ করিস! আজ মজা বুঝবি!”

তার চোখে মুখে যেনো প্রতিশোধের আগুন ঠিকরে পড়ছে।

ওদিকে নিষাদকে দেখেই শান্ত নুভাকে অগ্রাহ্য করেই জিহবায় কা’মড় দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

” আরে দুলাইভাই আইছে, হুশিয়ার! এই দলবল তোরা সবাই ঝোপ হতে বাইর হইয়া আয়! দুলাভাই আইছে!”

এভাবে হাঁকানোর সাথে সাথেই ঝোপের মধ্যে থেকে আরো চার পাঁচ জন বের হয়ে এলো। সবাই মিলে নিষাদকে সালাম ঠুকলো সজোরে।

” আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই!”

নিষাদও সালামের প্রত্তুত্তর দিলো সজোরে।
কুশল বিনিময় শেষে হঠাৎ ই নিষাদ শান্তর হাতে কি একটা গুঁজে দিতেই সবাই সেখান থেকে দৌড়ে পালালো।

নুভা এতক্ষণ না বুঝলেও, এখন যেনো সব বুঝে বলে উঠলো, এক লাফে বাইক থেকে নেমে তেড়েমেরে সামনে এগিয়ে এসে বললো,

” ঐ ডাক্টার, টাকা বেশি হয়ে গেছে না? আমার সাগরেদ সবাইকে টাকা দিয়ে, ঘুষ দিয়ে কিনে নিচ্ছো, না? সবাই দেখি তোমার ভক্ত হয়ে গেছে ”

নিষাদ হেসে বললো,

” কই কিনলাম? টাকা দিয়ে যদি তোমার মন কেনা যেতো তবে সেটাই প্রথমে কেনতাম? তবে আমি তোমাকে ভালোবাসি, মন দিয়েই মন কিনবো। ”

একথা শুনে নুভার সাঙ্গপাঙ্গরা করতালি দিয়ে উল্লাস করে উঠলো। আর একে অপরকে ঈশারা করে দূরে চলে গেলো নুভা আর নিষাদকে একা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে। নুভা ওদের যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে রাগান্বিত স্বরে বললো,

” ডাক্টার, তুমি ওদের এখান থেকে সরিয়ে দিয়ে ভালো করোনি, আশেপাশেই আমাদের এন্টি পার্টি অপেক্ষা করছে আমাদের মারতে, পোলাপানদের পাঠিয়ে দিয়ে এখন নিজেই মাইর খাবা!”

কথাটা বলার সাথে সাথেই নিষাদ নুভার মাথাটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে সপাটে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

লাঠির আঘাতটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।
নুভা শত্রুর উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত উঠে গিয়ে নিজের হকেস্টিক উচিয়ে ধরলো। একে একে তিনজনকে নিজ হাতে পিটিয়ে মাটিস্থ করে দিলো।

নিষাদও নিজের হাতকে কাজে লাগালো।

তিনজনই দ্রুত জান নিয়ে পালালো।

পাঁচ মিনিটেই জায়গা ক্লিয়ার।

নুভা নিষাদের দিকে ফিরে বললো,

” ঐ ডাক্টার! তুমিও দেখি ভালো ঢিসুম ঢাসুম করতে পারো! কই শিখলা এসব? ”

নিষাদের স্বীকারোক্তি,

” হুউম, তাছাড়া তোমার সাথে মিলবে কিভাবে? মানুষ বলবে কি? ”

নুভা এবার সহজ হয়ে বললো,

” তাইলে আমাকে বিয়ে করার ভূত তোমার মাথা থেকে সরলো না?’

” মাথা যতদিন আছে, ভুতও ততদিনই থাকবে, তোমাকে বিয়ে আমি করবোই করবো মিস নুভা!”

নুভা হাসলো। সে হাসি প্রতিধ্বনিত হলো পাশের বাঁশবনে।

নিষাদ অপলক চেয়ে রইলো নুভার পানে,

” আরে! হাসলেও তো এ মেয়েকে অপূর্ব লাগে!”

নিষাদ হঠাৎই নুভার হাত চেপে ধরলো। আর অপ্রস্তুত নুভা তার হাত ছাড়িয়েই ভোঁ দৌড়।
.
.

ডক্টর নিষাদের চেম্বারে একটা ছেলে এসেছে। পা ভাঙ্গা তার। বা পায়ের ফিবুলা অস্থি প্রায় পুরোপুরিই ফ্র‍্যাকচার। ছেলেটার বয়স আঠারো উনিশ হবে। পা ভাঙ্গা স্বত্ত্বেও ছেলেটার মা তাকে গালে পিঠে উপর্যুপরি চড়াচ্ছে। কি সব অশ্লীল ভাষায় গা’লি গালাজ করছে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে,

” তোরে জন্ম দেওয়াই আমার ভুল ছিলো, মাইয়া মানুষের হাতে মাইর খাস, এইবার সুস্থ্য হ, তারপর তোরেই মেয়েদের মতো থ্রি পিছ, লিপস্টিক, কাজল পড়াইয়া ঘরে বসায়া রাখমু হারা’মী”

ছেলেটার চোখ মুখ ব্যথায় নীল হয়ে গেছে। নিষাদের বুঝতে আর বাকি রইলো না যে, উক্ত কাজ নুভারই। নুভা ছাড়া আর কোন মেয়ে এমন মা’রপিট করে?

নিষাদ ছেলেটার পা যেখানে ফ্র‍্যাকচার হয়েছে সেখানটায় মুচড়ে হাড় বসিয়ে দিয়ে দ্রুত প্লাস্টার করতে লাগলো।
ব্যথায় ছেলেটা চিৎকার করে উঠলো।

ক্ষানিক বাদে ছেলেটা রাগে গরগর করে বলে উঠলো,

” আম্মা! শুনছিলাম, কয়দিন বাদে ঐ হারামী মাইয়ার বিয়া, আমি ওরে কোনোদিন বিয়া হইতে দিমু না, এই নাউ তোমার কীড়া, আমি ঐ মাইয়ার জীবন হেল কইরাই ছাড়মু, জবান দিলাম!”

নিষাদ পাশ থেকে সব শুনছিলো।

ভয় না পেলেও এক অজানা শঙ্কা তার মনে হানা দিলো আচমকাই।

(চলবে)

যে আসে অগোচরে পর্ব-০৩

0

#যে_আসে_অগোচরে

পর্ব ৩

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

” ঐ ডাক্টার, আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্ঠা করো না খবরদার! আমি তোমাকে জীবনেও বিয়ে করবো না!”

নুভার একথাকে নিষাদ ফুঁ মে’রে উড়িয়ে দিয়ে বললো,

” আচ্ছা, না করলে বিয়ে, চলো প্রেম করি! বুঝতেই তো পারছো, লাভ ইন ফার্স্ট সাইট হয়ে গিয়েছে আমার সাথে! ”

নুভা এক ভিলেনী হাসি হেসে বললো,

” হাহা! আমাকে কোন এঙ্গেলে তোমার প্রেমিকা বলে বোধ হলো? হুহ!”

নিষাদের চোখে তখনো নুভার প্রতি রাজ্যের মুগ্ধতার চাহুনী। সে বলতে লাগলো,

” প্রেমিকা হতে হলে কি কোনো স্পেশাল যোগ্যতার প্রয়োজন আছে? নাকি মেন্টাল এটাচমেন্ট ই যথেষ্ঠ?”

নিষাদ চেয়ে আছে আর নুভা তার টি শার্টের হাতা সরিয়ে তার হাতের ফ্যাটি মাসল বের করে দেখালো,

” এটাচমেন্ট কি জিনিস বুঝি না! তবে এই দেখো আমার বাইসেপ্স! বডি বিল্ডিং করি, দৌড় ঝাঁপ করি, কুস্তি, ক্যারাটে, এথল্যাট করি! মানুষকে পিটাই। আরো কত্ত কি? দুনিয়ার অভদ্র এক মেয়ে আমি। আরে! যাও যাও! তোমরা ভদ্র পোলারা কোনো এক শাড়ী পড়া শুশীল, ভদ্র মেয়ের সাথেই প্রেম করো গিয়া! আমার মতো ছেঁড়া জিন্স আর টি শার্ট পড়া উচ্ছন্নে যাওয়া মাইয়ার লগে প্রেম হয় না!”

নিষাদ আগের ন্যায় হাস্যোজ্জল হয়েই বললো,

” প্রেম কি কখনো ভেবে চিন্তে আসে নাকি? নইলে আর এতো রা’গী মেয়ের প্রেমে পড়ি?”

নিষাদের সহজ স্বীকারোক্তি নুভার কাছে অতি সাধারণ বলেই বোধ হলো।
হঠাৎই বৃষ্টির তেজ বাড়লো। নুভা তার পায়ের কাছে জমে থাকা পানিগুলোকে তার নগ্ন পা দিয়ে জোরে একটা লাথি মে’রে ক্রোধান্বিত স্বরে বললো,

” আমি প্রেম টেমে বিশ্বাস করি না ডাক্টার, তোমার প্রেমেরে আমি এইভাবেই লাথি মা’রি! আর এখন ফুটো আমার সামনে থেকে! আমার অনেক কাজ আছে এখন। এসব আজাইরা আলাপ করার টাইম নেই আমার। আর ভাবটা এমন দেখাইছো যেনো তুমিই ঐ খেলোয়াডকে আউট করছো। টাকা দিয়ে ম্যাচ ফিক্স করে আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্ঠা করছো৷ তা কি আমি জানিনা? তাছাড়া তুমি আবার কাউকে আউট করো? ফারদার আমার পিছুপিছু আসবা না!”

নিষাদ তার ছাতাটা নুভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

” আচ্ছা, মানলাম আমি টাকা দিয়ে ফিক্স করে নিয়েছিলাম। তবে সেটা তোমার খুশির জন্যই। আর যাচ্ছি আমি, তবে এখন এই ছাতাটা ধরো, তাছাড়া সর্দি, জ্বর বাঁধিয়ে আমার কাছেই আবার ট্রিটমেন্টের জন্য আসতে হবে! ”

নুভা ছাতাটা না নিয়েই বরং বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে বড় বড় ঝাঁপ দিয়ে হাসিমুখে বললো,

” আয়রন বডি বানিয়েছি ডক্টর! কত ঝড়-ঝঞ্চা গেলো তল, আর এখন বলছো, বৃষ্টি বলে কত জল! সেই ছোটো থেকেই এমন কোনো বৃষ্টি নাই যে ভিজি নাই, কস্মিনকালেও জ্বর হয়না। তোমার ছাতা নিয়ে তুমিই থাকো, আর আমি গেলুম। কই রে শান্ত? কই রে নীল? রুমি, ইভান..”

এসব নামে চিৎকার করে ডেকে ডেকে নুভা দৌড় লাগালো তার বন্ধুদের উদ্দ্যেশ্যে। নিষাদও নুভার পিছুপিছু ছুটে গেলো।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। খেলোয়াড়দের দল যে যার মতো নিজেদেরকে বৃষ্টির তোপ হতে নিজেদের বাঁচাতে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে নুভাকে রেখেই।

নুভা ” ধ্যাৎ” বলে তার পেছনে ছুটে আসা নিষাদকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,

” ডাক্টার! তোমার সাথে প্যাঁচাল পাড়তে গিয়ে আমার সব বন্ধু মিসিং! তাই ভাইবো না আমি এখন তোমারে সময় দিবো! আমার এখনো করার মতো বহু কাজ আছে, সো যাও ভাগো! আর খবরদার আমার পিছুপিছু আসবা না! ভাল্লাগেনা!”

বলেই একটা ভোঁ দৌড় লাগালো নুভা।

নিষাদও নুভার পিছুপিছু লুকঝুক করে এগিয়ে গেলো, ” দেখা যাক! এই বৃষ্টিতে কি করে মেয়েটা!”
.
.

” বইন রে বইন! মেয়েটারে যে কি বানাইলাম! কেন যে ছেলেদের মতো করে মেয়েকে বড় করলাম? এত বেশি দস্যিগিরি দেখায়! আর যে রাগ! মুখের ভাষা যেনো না, আগুনের ফুলকি! আজ এরে মা’রে তো কাল ওরে মা’রে। পাত্রপক্ষকে যেভাবে অপমান করলো! আমি জীবিত থেকেও একশ গজ মাটির নিচে ঢুকে গেলাম রে!”

মিনারা বসে বসে তার ছোটোবোন মিতারার কাছে উক্ত আফসোস বাক্য সমেত একরাশ অনুতাপ ঢেলে দিচ্ছে।

মিনারার ছোটো বোন মিতারা বলে উঠলো,

” আপা, তোমার কি দোষ? পরপর তিন তিনটা কণ্যা সন্তান হওয়াতে তোমার শাশুড়ী তোমাকে বাপের বাড়ি পাঠায়া দিলো, তারপর দুলাভাইও বিদেশে গিয়ে লাপাত্তা হইলো। এই মেয়েটাই আবার তোমার শ্বসুর বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পারলো। এত তেজওয়ালা মেয়ে বলেই তো বাপ দাদীকে শাসাতে পেরেছিলো। আর এই মেয়ের বুদ্ধির জোরেই তোমার চাকরি হলো। তুমি স্বাবলম্বী হলে। আর এই মেয়ের রাগ আর জেদের জোরেই তুমি তোমার হারানো সংসার পাইছো, তোমার স্বামি পাইছো! আবার বলো? রাগ, জেদেরও প্রয়োজন আছে জীবনে!”

মিনারা চুপ গেলো। সত্যিই মেয়েটার কি দোষ? এই মেয়েই তার অন্ধকার ঘরের চেরাগ! দ্বীর্ঘ এক শ্বাস বড় এক হাহাকার যোগে বাইরে নির্গত করে সে ভাবতে লাগলো তার অতীত দিন গুলোর কথা।

দিনগুলো তার ছিলো নির্মম কষ্টের। গর্ভবতী থেকেই সারাদিন পরিশ্রম করতে হতো স্বামীর সংসারে। শাশুড়ী তাহেরা বানু গ্রামের অন্য মানুষদের সাথে টক্কর দিয়ে নিজের জায়গা, জমি বাড়ানোর চিন্তায় ছিলো। নিজে দিন রাত এক করে সংসারে খাটতো, এবং ছেলের বউকেও খাটাতো। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ায় শাশুড়ী তার মুখ কালো করলো। মেয়ের নাম রাখলো স্নেহা যদিও কেউ তাকে স্নেহ করলো না। মিনারা বুঝলো না ঘটনা কি! স্বামীও দোকান হতে ঠিকমতো বাড়ি ফেরে না। দাম্পত্যে দূরত্ব বনে গেলো বহুদূর।
বছর যেতে না যেতেই দ্বিতীয় সন্তান! সেটাও মেয়ে! নাম রাখলো নুভা। নুভার জন্মের পর শাশুড়ী প্রায়ই মিনারার সাথে মেজাজ দেখায়। কারনে অকারনে ভুল ধরে। বাচ্চা সামলিয়ে যখন সংসারের কাজকর্ম করতে পারে না ঠিকঠাক, তখনি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। মিনারা বুঝলো একটা ছেলে সন্তানের জন্য শাশুড়ীর এত উদ্বেগ। তৃতীয় সন্তানও মেয়েই হলো। নাম রাখলো তূর্ণা। তূর্ণার জন্মের পর শাশুড়ী তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে আর ফিরে আসতে মানা করে দিলো। সেই সাথে আমীর আলিকে দ্বীতিয় বিয়ে করানোর জন্য পাত্রী খুঁজতে লাগলো।

আমীর আলী বিয়েতে রাজী না হওয়ায় তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেয় তার মা। একমাত্র ছেলের ঘরে কোনো ছেলে সন্তান নেই! তার ছেলের মৃত্যুর পর কে এই বংশের বাতি দেবে সে চিন্তায় অধীর হয়ে পড়ে তাহেরা। যার প্রভাব সে ফেলে তার পুত্রবঁধু মিনারার উপর। মিনারা অতি কষ্টে তিন কন্যা নিয়ে বাবার বাড়িতে দিনাতিপাত শুরু করে।

ওদিকে ছোটোবেলা হতেই মিনারা নুভাকে ছেলেদের মতো করে বড় করা শুরু করে। ছেলেদের পোশাক পড়িয়ে পাঠাতো ছেলেদের সাথেই কুস্তি করতে। নুভাও ওসব রপ্ত করে ফেলে খুব দ্রুত। দেখতে দেখতে নুভা বড় হয়। তবে সে যেনো কোনো ছেলেরুপী মেয়ে। দাঙ্গাবাজীতে ছেলেদেরকেউ সে টেক্কা দিতে লাগলো। সকল খেলাধূলায় ও শরীরচর্চায় সে এগিয়ে। কোনোকিছুর সামান্য হেরফের হলেই প্রচন্ড রাগ! ধীরে ধীরে এলাকার বাজে লোকদের ত্রাসে পরিনত হলো সে। এলাকার কোনো মেয়ে ই’ভটিজিং এর স্বীকার হলে নুভার ডাক পড়ে। নুভা মে’রে টেরে সেই ইভটিজারের হাত পা গুড়িয়ে দেয়। এলাকায় কোনো চোর ডাকাত ধরা পড়লেও নুভার ডাক পড়ে। সে নিজ হাতে চোর ডাকাতকে ক্যালানী দেয়। কেউ কোনো অন্যায় করে ধরা পড়লেও একইরকম ভাবে নুভাই সেটা দেখে নেয়।
তবে এত এত উপকারমূলক কাজ করে বলে সবাই তাকে ভালোবাসে ও স্নেহ করে। নুভার বুদ্ধিতেই মিনারা বাবার বাড়ি ছেড়ে শহরে আসে। কাপড়ের ব্যাবসা শুরু করে। নুভাই তাকে বাইরের সব কাজে সাহায্য করতো। নুভার ঝা’ড়ি খেয়েই দাদী তার মাকে পুনরায় স্বীকার করে নেয়। বাবাও বিদেশ হতে চলে আসে। তবে তারা আর গ্রামে যায় না। শহরেই স্থায়ী হয়। মিনারার ব্যাবসায় আমির আলীও অংশীদার হয়। ভালো ঘরে বড় মেয়ে স্নেহার বিয়ে দেয়। তবে মেয়ে মানুষ এত দা’ঙ্গাবাজী করে বলে অনেকেই তাকে অপছন্দ করে৷ এলাকার সবচেয়ে অভদ্র মেয়ের খেতাবও সে পেয়ে গেছে। আর এখন সেই নুভাকে নিয়েই চিন্তায় পড়ে আছে মিতারা।
মেয়েটাকে একটা ভালো পাত্রের হাতে সোপার্দ করতে পারলেই সে বাঁচে। সেক্ষেত্রে ঐ ডাক্তার ছেলে নিষাদের বিকল্প আর কেউ নেই।

(চলবে)

যে আসে অগোচরে পর্ব-০২

0

#যে_আসে_অগোচরে

পর্ব ২

রচনায়:

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

” মা বাইকের চাবিটা দাও, আমি বের হবো, এক ইতরকে ক্যালানি দিতে হবে এক্ষুণি”

নুভার এমন কথা শুনে নিষাদ বিষম খেলো। নুভা বেশ কড়া আদেশের স্বরেই তার মাকে কথাটা বললো, তবুও মীনারার করুন দৃষ্টি পাত্রপক্ষের দিকে। কি ভাববে পাত্র আর তার বন্ধু ও মামা? এ সম্বন্ধ কি আর আদৌ বিয়ে পর্যন্ত গড়ানোর কোন সম্ভাবনা থাকলো? কোনো ক্রমেই না! তাই মীনারা শোকাহত হয়ে মাথা চাপড়াতে থাকলো। কত কষ্ট করে বুঝিয়ে শুনিয়ে সে মেয়েটাকে শাড়ী পড়িয়ে বসিয়েছিলো পাত্র পক্ষের সামনে! আর হায় হায়! এ মেয়ে কিনা পাত্রপক্ষ না যেতে যেতেই তার আসল রুপ দেখিয়ে দিলো। বেরিয়ে এলো ছেলেদের পোশাক গায়ে দিয়ে!

নিষাদের মামা আবুল হক নুভার কথাবার্তা থ মেরে শুনছিলো।

ওদিকে বিষম খেতে খেতেই নিষাদ বলে উঠলো পূর্বের ন্যায় বিনীতস্বরেই,

” এত চিন্তা করছেন কেনো মিস নুভা? কে আপনাকে বিরক্ত করেছে? আর কাকে ক্যালানী দিতে হবে বলুন, আমি দিয়ে দিচ্ছি, আফটার অল কয়েকদিন বাদেই আমি আপনার হাজবেন্ড হতে যাচ্ছি, আপনাকে কেউ বিরক্ত করে মানে, সে আমাকেই বিরক্ত করছে!”

নুভা নিষাদের কথাগুলোকে চরমভাবে অগ্রাহ্য করলো, সে বরং ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি দেখিয়ে তার মা মিনারার দিকে চেয়ে বললো,

” মা, তোমার এ ডাক্টার মশাইকে বলো, এত বেশি বকর বকর না করতে, এ জানেই না ক্যালানী দেওয়া কাকে বলে! এর মুরদ আছে বড়জোর ছু’রি কাঁচি দিয়ে কে’টেকুটে পরে সেলাই আর ড্রেসিং৷ ব্যান্ডেজ করার, এর বেশি এ আর কি জানে? আর এক তোমার অনুরোধেই আমি এখানে পাত্রী সেজে বসেছিলাম পাত্রী দেখার আসরে, তাছাড়া আমি…”

এটুকু বলতে বলতেই মীনারা দৌড়ে এসে নুভার মুখ চেপে ধরলো,

” আর একটা কথাও না, চল এখান থেকে!”

এই বলে জোর করে নুভার বাহু টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো। মীনারা একা পারছিলো না বলে আমীর আলী ও তূর্ণা এই তিনজনে মিলে নুভাকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো। কিন্তু নুভা আরো কতগুলা বলেই ছাড়বে। তাই মীনারা তার মুখ চেপে ধরে ভেতরে নিয়ে চলল।

নিষাদ মিনারাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,

” উনাকে যেতে দেন আন্টি! কোনো সমস্যা নাই!”

কিন্তু মিনারা তার কথা মানলো না বরং নুভাকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে গেলো।

নুভাকে ভেতরে নিয়ে যেতেই নিষাদের মামা আব্দুল হক গটগটে স্বরে হটহট করে নিষাদকে বলা শুরু করলেন,

” নিষাদ মামা! এ তো দেখছি আজব কান্ড এক! আমার নাম আব্দুল হক, আমি একটা কথাও বলবোনা বেহক! তোমার আম্মা অর্থাৎ আমার আপা এই মেয়েকে তার ছেলের বউ হিসেবে কোনোক্রমেই মেনে নেবে না!”

নিষাদ হেসে বললো,

” মামা ও মামা, ডোন্ট ওরি, ছেলের বউ হিসেবে না মানলেও, মেয়ে হিসেবে আমার মা ওকে ঠিকই মেনে নেবে, এই আমি বললাম! আর তুমি তো আছোই, মা কে রাজী করানোর দায়িত্ব তোমার! তুমি যদি তোমার এই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করো, তাহলে তোমার সাথে আমার দোস্তি বেদোস্তি হয়ে যাবে বলে রাখলাম! ”

আব্দুল হক নিষাদের হাসি বিনিময় করে একটা ঢোক গিলে শুষ্ক মুখে বললো,

” দেখি! কি হয়! আই শ্যাল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট!”

একথা বলতেই নিষাদ আব্দুল হকের গালে একটা চুমু দিয়ে দিলো আনন্দে।

একথা উল্লেখযোগ্য যে আব্দুল হকের সাথে নিষাদের বয়সের ব্যবধান মাত্র পাঁচ বছরের। মামা হলেও আব্দুল হকই নিষাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। একে অপরকে সকল কিছুই শেয়ার করে। নিষাদের জীবনে প্রথম প্রেম এসেছে, একথা সে প্রথম তার মামাকেই বলেছে। আর মামা তার মাকে বলেছে, অত:পর নুভাকে দেখতে পাঠিয়েছে। আর একজন বন্ধু যে তার সাথে এসেছে, তার নাম অয়ন। অয়ন আর নিষাদ বাল্যকালের বন্ধু।

অয়ন এবার নিষাদের মুখপানে চেয়ে বললো,

” তো বন্ধু, তোর গালের হাল তো বেহাল দেখছি! হবু ভাবী তো এক আগুনের গোলা! এত জোরে থাপ্পড় দিছে তোরে? কি এমন বলছিলি তুই?”

নিষাদ উত্তরে শুধু হাসলো, আর কিচ্ছু বললো না।কারন সে ও জানে, ভুল কথাই বলছিলো সে। একটা মেয়েকে তার কুমারিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা, একটা অভদ্রতাই বটে! কারন মিনারা যখন নিষাদকে যখন নুভার সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দেয় তখন নুভা বেশ হাসিখুশি ভাবেই কথা বলছিলো, কিন্তু নিষাদের খুব করে নুহার রাগী চেহারা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। তাই শুধুমাত্র রাগানোর জন্যই ইচ্ছে করে নুভাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ” আর ইউ ভার্জিন?”

.
.

” হাউ ডেয়ার হি? তোকে জিজ্ঞেস করছে তুই ভার্জিন কিনা? সাহস কত দুলাভাইয়ের বাচ্চার!”

শান্ত একথা বলে উঠার সাথে সাথেই তার পিঠে একটা থাপ্পড় পড়লো,

” ঐ শান্তর বাচ্চা! ঐ? তুই ঐ ডাক্টারকে দুলাভাই বললি কেন?”

নুভার ক্রোধে ফেটে পড়া প্রশ্ন শান্তর প্রতি।

শান্ত তার দোষ স্বীকার করে কানে চিমটি কেটে বললো,

” ওহ! স্যরি দোস্ত! আমি তো এতদিন ভুলেই গেছিলাম, তুই ছেলে না মেয়ে, তবে এখন পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে আমার মনে পড়লো যে, তুই একটা মেয়ে, আর তুই তো বয়সে আমার চেয়ে বড়, তাই তোর হবু জামাইরে কি বলমু? দুলাভাই না তো কি? দুলায়াপা?”

এই কথা বলার পর শান্তর পিঠে পুনরায় ধুপুস ধাপুস পড়লো।

তবে এতক্ষন চুপ করে থাকা রুমি বলে উঠলো,

” তোর মায়ে বললো, বিয়ে যদি হয় তোর এই ছেলের সাথেই হবে, না হলে হবেই না কোনোদিন, তাইতো শান্ত ওরে দুলাভাই ডাকলো, ওর দোষ কোথায়?”

নুভা এবার নিজেকে সংযত করে বললো,

” তোদের কোনো দোষই নাই, দোষ সব ঐ ডাক্টারের, ঐ ডাক্টার শুরু থেকেই আমারে শুধুশুধু রাগিয়ে দিচ্ছে। প্রথম দিন তো আমাকে কোলে তুলে নিলো, লুইচ্চামি করলো। আর আজ আমাকে বলে কিনা আমি ভার্জিন নাকি? সাহস কত?”

রুমি বলে উঠলো,
” এত ভদ্র পোলারএই প্রশ্ন তো করার কথা না, তো তুই কি বলছিলি রে?”

নুভা কূট হাসি দিয়ে বললো,

” আমি ওরে বলছিলাম, আমারে বিয়ে করো না ডাক্টার, আমার অনেক ছেলের সাথে উঠাবসা, চলাফেরা, রাত্রে বাড়িও ফিরি না মাঝে মাঝে, ছেলে বন্ধু ছাড়া আমার চলেই না। আর যখনই এসব বললাম, তখন সে আমাকে বলে আমি কি ভার্জিন নাকি? আরে! কতবড় সাহস ওর, তোরাই বল আমি কি খারাপ!”

নুভার এসব কথা শুনে শান্ত আর রুমি মাথায় হাত দিলো। এই মেয়ে একটা চিজ বটে! নিজেই বলে যে ছেলেদের সাথে উঠাবসা করে, থাকে, চলে। আর এসব শুনে এই প্রশ্ন অমূলক কিভাবে হতে পারে?

.
.

পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলা নিয়ে মা’রামারি লেগেছে। একদলের একজন এল বি ডব্লিও হয়েও মানতে নারাজ বলে লেগেছে দারুন এক বিপত্তি। ন নুভার দলকেই এভাবে ঘাত ত্যাড়ামী করে হারিয়ে দিচ্ছে অপর দল বিধায় নুভা ব্যাট হাতে মা’রতে গিয়েছে অপর দলের ক্যাপ্টেনকে। নুভা অপর দলের ক্যাপ্টেন। কিন্তু হঠাৎ করেই সেখানে উপস্থিত হলো নিষাদ।

নিষাদকে দেখেই সবাই সমীহ করে বলতে লাগলো,

“ঐ যে ডক্টর নিষাদ এসেছে, কি বলতে চায় সে? ”

নিষাদ নুহাদের দলের হয়ে বোলিং করার অনুমতি চাইলো ক্যাপ্টেনের কাছে।

অপর দলের ক্যাপ্টেন হেসে হেসে বললো,

” আমাদের ব্যাটসম্যানেরে এল বি ডব্লিউ দিয়া আউট করে, সব আকাইম্মার দল, আপনিই দেখেন ডাক্টার সাহেব, কত ভালো ব্যাটসম্যান সে! দুধর্ষ ব্যাটসম্যান”

এসব বলে সে নিষাদের হাতে বল তুলে দেয়।
ডক্টর নিষাদ বলে কথা। তাকে অমান্য করা যায়?

সবার শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিক্ষা।

নিষাদের বল ব্যাটসম্যানের ব্যাট ছুঁয়ে পুনরায় তার হাতেই এসে পড়লো।

নিষাদের এক বলেই বোল্ড আউট হয়ে গেলো সেই দুধর্ষ ব্যাটসম্যান।

নুভা নিজের দলের সদস্যদের সাথে উচ্ছ্বাস করতে লাগলো।

একে একে সবাই চলে গেলো মাঠ ছেড়ে। নুভা তার দরকারী জিনিসপত্র গুছিয়ে চলে যেতে ধরতেই সেখানে নেমে গেলো বৃষ্টি।

নিষাদ যেনো সর্বজ্ঞ, সে যেনো আগেই জানতো বৃষ্টি নামবে। নিজের ব্যাগে থাকা ছাতাটা মেলে ধরলো নুভার মাথায়।

নুভা রেগে গিয়েও হেসে দিয়ে বললো,

” ঐ ডাক্টার, আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্ঠা করো না খুবরদার! আমি তোমাকে জীবনেও বিয়ে করবো না!”

(চলবে)

যে আসে অগোচরে পর্ব-০১

0

#যে_আসে_অগোচরে
(সূচনা পর্ব)
লেখিকা:জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

“আর ইউ ভার্জিন মিস নুভা?”

ভীত হয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে এই প্রশ্ন করার সাথে সাথে কষে একটা চ’ড় পড়লো প্রশ্নকর্তার গালে। প্রশ্নকর্তার ফর্সা গাল চিবুক মুহূর্তেই লাল আভা ধারণ করে গেলো। একদিকে লজ্জার লাল আর অন্যদিকে আ’ঘাতের দরুন লাল, দুই লাল মিলে সে একেবারে লালে লাল হয়ে গেলো। চ’ড়দাতা কন্যার নাম নুভা। আর যার গালে চ’ড়টা বসলো তার নাম নিষাদ। নিষাদ বেচারা প্রেমিক পুরুষ, যে কিনা নুভাকে দেখতে এসেছে পাত্র সেজে।
ওদিকে নুভা, যার রাগের খবর জানে গোটা এলাকাবাসী। এককথায় যে রাগের জন্য বিখ্যাত!
পিঠ পেছনে নুভাকে কে কি বললো তা নিয়ে নুভা কোনোদিন মাথা না ঘামালেউ এই প্রশ্ন সামনা সামনি নুভাকে কেউ করার সাহস রাখে তা নুভা কোনোকালেই ভাবেনি।

চড়ের শব্দ পেয়ে পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এলো নুভার মা মীনারা। মীনারা আগেই ভেবেছিলো তার মেয়ে কোনো একটা গন্ডগোল করবেই করবে। যে রাগ তার মেয়ের! তাই কান খাড়া করেই ছিলো সে। নুভার বাবা আমীর আলী ও ছোটো বোন তূর্ণাও দৌড়ে এলো সাথে সাথে। সবার চোখে মুখেই আতঙ্ক।
পাত্রবেশী বেচারা ছেলেটা গাল ধরে ঝিম মেরে বসে রয়েছে। হয়তো তার দু একটা আক্কেল দাঁতও নড়ে উঠেছে এই চড়ের ফলে। তবে তার চোখ দুটিতে খুশির জোয়ার বইছে। যেনো সে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জিতেছে।

মীনারা ভয়ার্ত চোখে ভ্রু নাচিয়ে কন্যা নুভাকে ঈশারায় জিজ্ঞেস করলো, ” ব্যাপার কি?”

নুভা কিছু বলার আগেই গালে হাত রেখেই সেই পাত্র নিজেই এগিয়ে এসে হাস্যোজ্জ্বল বদনে মীনারার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,

” কিছু হয়নি আন্টি, গালে একটা মশা বসেছিলো মাত্র আন্টি, তাই উনি মশাটাকে একটা চ’ড় মেরে তাড়িয়েছে আর কি! থ্যাংস মিস নুভা মশাটাকে মে’রে ফেলার জন্য! ”

শেষের ধন্যবাদ সূচক শব্দটা সে নুভার দিকে তাকিয়েই দিলো বিনয়ের সাথে।
ওদিকে নুভা তার দাঁতে দাঁত কটমট করছিলো প্রচন্ড ক্রোধের দাপটে।

নিষাদের উত্তর শুনে মীনারা আশ্বস্ত হয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে বিষম দু:শ্চিন্তা হতে মুক্তি দিলো।
মনে মনে বললো, ” যাক বাবা! বড় বাঁচা বাঁচলাম! মেয়ে আমার চড় টড় মারে নাই ছেলেটাকে অন্তত:!”

নুভা এখনো রেগেমেগে অগ্নীমূর্তী ধারণ করেই আছে। দাঁত কটমট করছে সে মায়ের পানে চেয়ে।

সে তার মা কে নিষাদের সামনেই শাসিয়ে বললো,

” মা, এই ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না, তোমরা জানো, আমি যা বলি সরাসরি সামনাসামনিই বলি, তা তোমরাও শুনে রাখো আর এই ডাক্টারও শুনে রাখো, আমি তোমাকে বিয়ে করবো না করবোনা, জীবনেও করবো না। আর আমি এখন ড্রেস চেইঞ্জ করবো, এই শাড়ীতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, সো, তোমরা বেরোও এখান থেকে! রাইট নাউ!”

অগ্যতা পাত্র নিষাদ সহ সব কয়জন উক্ত রুম হতে বের হয়ে গেলো।

মীনারা বেগম বের হতে হতে নিষাদকে বললো,

” বাবা, তুমি রা’গ করো না ওর কথায়, মেয়ের বয়স কম তো, তাই এরকম রগচটা! তাছাড়া আমরা বিয়েতে রাজী থাকলে মেয়েও আমার রাজী থাকবেই থাকবে, ভারী লক্ষী মেয়ে আমার! ”

নিষাদ মনে মনে হাসলো। চোখ মুখেও তার সেই হাসির প্রতিফলন ঘটেছে। কারন সে জানে মীনারা বেগমের মেয়ে কেমন!

তাই সে মনে মনে বলছে, ” আপনার মেয়ে লক্ষী হোক আর না হোক, সে আর কাউকে বিয়ে না করুক, আমাকেই করবে, আর বিয়ে যে করতে তাকে হবেই!”

মীনারা বেগমের বুক দুরুদুরু করছে। তার এমন রাগী, অভদ্র, বেহায়া আর গুন্ডী মেয়ের জন্য এই প্রথম এত ভালো কোনো সম্বন্ধ এসেছে। আর মেয়ের অসভ্যতার জন্য এই বিয়েটাই না আবার ভেঙ্গে যায়!
ছেলে পেশায় ডাক্তার। শহরেরই ছেলে। ভদ্রতার খ্যাতিতে সে যেমন সর্বেসর্বা, নুভা তেমনি অভদ্রতার অখ্যাতিতে তেমনি সর্বেসর্বা। দুই জন দুই মেরুর মানুষ।

এখন নুভা এই বিয়েতে রাজী হলেই মীনারা বেগমের গলায় আটকে থাকা দম যেনো মুক্তি পাবে। এত যোগ্য পাত্রে কণ্যা দান করতে পারলে সমাজে এতদিন সে যে হেনস্থা হয়েছে, তার বিপরীতে সে যোগ্য সম্মানও পাবে।

নিষাদ এসে ড্রয়িং রুমে বসলো। নানা পদের নাস্তার আয়োজন করা হয়েছে তার জন্য। নিষাদ আর তার এক বন্ধু ও একমাত্র মামা এসেছে পাত্রী দেখার জন্য।

নুভাকে নিষাদ প্রথম দেখেছিলো বাইকে। বাইকে দুই ছেলে বন্ধুর মাঝখানে বসে চুল উড়িয়ে সে প্রথম নিষাদের সামনে এসেছিলো মেডিক্যালে। গায়ে ছিলো সাদা জেন্টস টি শার্ট ও জিন্স প্যান্ট। পনি টেইল করা লম্বা স্ট্রেইট চুলগুলো ক্যাপের পেছনের ফোকর দিয়ে বের হয়ে ছিলো।
সেদিন ছিলো এক বৃষ্টির দিন। সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে সবে রাত পড়েছে। চারদিকে আধো আলো আধো অন্ধকার। সদ্য বৃষ্টি শেষ হয়ে গিয়ে এক মখমলে সুন্দর সমীরন বইছিলো। সে বাতাসে নুভার চুল উড়ছিলো। হসপিটালের রোগী বলতে ছিলো না। তাই ডক্টর নিষাদ দোতলার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ঠিক তখনি বাইকটা হসপিটালের গেইট দিয়ে ঢুকে। আর নিষাদ প্রথম নুভাকে দেখে। নিষাদ প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারে মেয়েটা দারুন বোল্ড, পোষাক আশাক বা চলাফেরার ক্ষেত্রে সে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দেয়। কিন্তু নুভার পায়ের তলায় এক লোহার তার ঢুকে গিয়েছিলো। এক পা তুলে দুইজনের কাঁধে ভর দিয়ে সে নিষাদের কেবিনে প্রবেশ করলো। হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে একমাত্র ডক্টর নিষাদই ছিলো তখন, আর একজন নার্স ছিলো মাত্র। নুভার চোখ মুখে ক্রোধ উপচে পড়ছিলো। সে বারবার কাকে জানি মা’রতে চাচ্ছিলো, আর তার দুই বন্ধু তাকে বারংবার শান্ত হতে বলছিলো। শান্ত ও রুমি নামের সেই দুই বন্ধু নুভাকে বারবার বলছিলো,

” আগে নিজে সুস্থ্য হয়ে নে, তারপর ওদেরকে ক্যালানি দিস!”

কিন্তু নুভা শান্ত হচ্ছিল না কোনোক্রমেই। তার চোখে মুখে প্রতিশোধের আগুন।

নিষাদ নুভাকে দেখে বিমোহিত হলো। বৃষ্টির জলে তার সর্বাঙ্গ ভেঁজা। ছেলের পোশাকে থাকলেও ভেঁজা কাপড়ের আড়ালে তার যৌবন ডগমগে সৌন্দর্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। তার আদ্র নরম মোলায়েম তনু দিয়ে যেনো এক মোহনীয় দ্যুতি বিকিরিত হচ্ছিলো। গোলাপী ওষ্ঠযুগলকে জল ছিটানো গোলাপী প্রস্ফূটিত গোলাপের পাঁপড়ি বলে বোধ হচ্ছিলো। নিষাদের চোখ আটকে গেলো রোগীনির ঠোঁটের পানে।

হঠাৎই নুভা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

” এই যে মিস্টার ডক্টর? আমার মুখে কি দেখছেন, ব্যথা তো পেয়েছি পায়ে? লুইচ্চা ডাক্টার!”

নিষাদের প্রচন্ড কষ্ট হলো নুভার ঠোঁট হতে চোখ ফেরাতে। তবে এবারও সে আর নুভার পায়ের দিকে তাকালো না, বরং সে তাকালো সরাসরি তার চোখের দিকে। ডাগর ডাগর আয়তাকার চোখ; অগ্নীশর্মা! গাঢ় ভ্রু যুগল দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো এক লোহিত সাগর! যে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে হাজার বার ম’রা যায়।

রাগলে কোনো মেয়েকে এত সুন্দর দেখায়? তা প্রথমবারের মতো দেখতে ও বুঝতে পেলো নিষাদ।

নিষাদ তার মনোযোগ ঐ মনোহরিনী চোখ আর ওষ্ঠদ্বয় হতে কোনো ক্রমেই দূরে সরাতে পারছিলো না।

এমতাবস্থায় পুনরায় চিৎকার!

” কি ডক্টর? পায়ে ব্লিডিং হচ্ছে, তা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না?”

” ইশ! ” শব্দযোগে ডক্টর নিষাদ এবার নুভার পায়ের পানে চাইলো।

” আহা! আপনার তো অনেক ব্লিডিং হচ্ছে!”

বলেই নুভাকে দ্রুত তার কোলে তুলে নিয়ে পাশের ওটির বেডে শুইয়ে দিলো। নুভা যার পর নাই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।

কোলে নিয়েই নিষাদ বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।

ওজন পঞ্চাশ কেজি, উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ, কোমড় ছত্রিশ, বডি চল্লিশ, নিতম্ব?

নুভা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

” এই ডাক্টার নামাও আমাকে জলদি! আমার পায়ে ব্লিডিং হচ্ছে আর সে আমার ওজন মাপছে! লুইচ্চাডার কাছে আনছে কেনো আমাকে?”

নিষাদ কোনো প্রত্তুত্তর না করে তাকে বেডে শুইয়ে দিলো হাসিমুখে। লুইচ্চা ডাকলে ডাকুক, মুখে তার জয়ীর হাসি। কারন, এতদিনে যারে সে খুঁজেছিলো, আজ সে তার দেখা পেয়ে গেছে!

নিষাদ নুভার পায়ে হাত দিতেই ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো নুভা।

” কিকরে এত বড় তার ঢুকলো?” নিষাদের প্রশ্ন

নুভা পুনরায় চেঁচিয়ে বললো,

” এত প্যাঁচাল না পেরে আগে ঐটা বের করেন, ইডিয়ট ডাক্টার!”

এই প্রথম কোনো মেয়ের মুখে ইডিয়ট সম্বোধন পেয়েও খুশি হলো নিষাদ। ইডিয়ট বলার সাথে সাথে সে নুভার মুখের দিকে চাইলো। আর বলে উঠলো,

” কি বের করবো আমি?”

নুভা পুনরায় চেঁচিয়ে বললো,

” ধুর! পায়ে যেটা ঢুকছে সেটা বের করেন..! ”

নিষাদ এবার বুঝতে পারলো, তার মনোহারিণীকে তাড়াতাড়ি সুস্থ্য করতে হবে, ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে সে।

সে তার ইকুয়েপমেন্টস গুলো নিতে নিতে মনে মনে বললো,

” ইশ! কি সুন্দর! কি সুন্দর! হাউ বিউটি! রাগান্বিত অবস্থায় এই মেয়ের রুপ দেখে তো আমি ম’রেই যাবো!”

অত:পর নুভার পায়ের তারটাকে সে এক বিশেষ কৌশলে এক চিমটাসদৃশ যন্ত্র দিয়ে টেনে বের করে আনলো। নুভা চিৎকার করে উঠলো, আর নিষাদ নুভার পা টা জড়িয়ে ধরলো যাতে সে বেশি নাড়াচাড়া না করে। এতে এক ছলকা মেরে ক্ষাণিক র’ক্ত নিষাদের মুখে ছিঁটে এলো।

দ্রুত এনেস্থাশিয়া দিয়ে সেলাইয়ের কাজ সেরে, ব্যান্ডেজ করে, পেইনকিলার দিয়ে সে নুভার সামনে এলো। মেয়েটাকে এক নজর কতক্ষণ দেখা যাক! এবার সে শান্ত হয়ে শুয়েছে চোখ দুটি বুজে।

নুভা চোখ বন্ধ করে ততক্ষন বেডেই শুয়ে আছে। আর ডক্টর নিষাদ তাকে কাতর হয়ে দেখছে একদৃষ্টে।

নাস্তা সামনে নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই নুভা আবার তার সামনে চলে এলো। শাড়ী খুলে এবার সে পুনরায় টি শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে এসেছে। চোখে সানগ্লাস। একটা লেডি মাস্তানের মতো স্বরে সে তার মা মীনারাকে উদ্দ্যশ্য করে বলে উঠলো,

” মা বাইকের চাবিটা দাও, আমি বের হবো, এক ইতরকে ক্যালানি দিতে হবে এক্ষুণি!”

নুভার এমন কথা শুনে নিষাদ বিষম খেলো।

চলবে?

হৃদয়হরণী পর্ব-৬২ এবং শেষ পর্ব

0

#হৃদয়হরণী
#অন্তিম পর্ব
#তানিশা সুলতানা

সামিরের বিয়ে আজকে। বিয়ের ডেট ফিক্সড ঠিক হতে হতে পাঁচ মাস লেগে গেলো। ছোঁয়া বর্তমানে নয় মাসের প্রেগন্যান্ট। ভাড়ি পেটটা নিয়ে চলাফেরা করতে বেশ কষ্ট হয়ে যায় তার। ছিঁচকাদুনি ছোঁয়া বড় হয়ে গিয়েছে। এখন বাচ্চাটা এতো জ্বালাতন করে তবুও কাঁদে না ছোঁয়া। সাদি চিন্তা করবে ভেবে সাদিকেও জানায় না। চুপি চুপি সয্য করে নেয় হবু সন্তানের দেওয়া ব্যাথা। সাদি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে দুই মাসের। মূলত ছোঁয়ার ডেলিভারি না হওয়া ওবদি সে ছোঁয়াকে একা ছাড়বে না। এতে ছোঁয়াও ভীষণ খুশি। মানুষটা আশেপাশে থাকলে ছোঁয়া সাহস পায়। মনোবল বাড়ে, শান্তি পায়৷ দূরে গেলেই মনে হয় এই বুঝি লেভার পেইন উঠলো। এই বুঝি কষ্ট হবে।

সাদি সামিরের বিয়েতে যাবে না৷ ছোঁয়াকে একা রেখে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আধপাগল সামিরও আর জোর করে নি যাওয়ার জন্য। বুঝেছে সাদির মনোভাব।
বাড়ির সকলেই বিয়েতে গেলেও রয়ে গিয়েছে নাজমা সাদি এবং সাবিনা।
দুই মা ছোঁয়াকে চোখের আড়াল করে না। ছটফটে ছোঁয়া কখন কিকরে বসবে এটাই তাদের চিন্তা। সেই চিন্তা থেকেই ছোঁয়াকে এতোটা চোখে চোখে রাখা।

বাড়িতেই টিচার রেখে দেওয়া হয়েছে। ছোঁয়া দুষ্টুমি কমিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগও দিয়েছে। বাড়িতেও একটু আতটু পড়ালেখা করে সে। এইচএসসি এখনো ৪ মাস দেরি আছে।

এখন বিকেল তিনটে বাজে। ছোঁয়ার পেটে একটু একটু পেইজ হচ্ছে। সাদি মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপ এ অফিসের কাজ করছে। কোম্পানি বড় একটা প্রজেক্ট এর দায়িত্ব দিয়েছে সাদিকে। বাড়ি বসেই সোি দায়িত্ব পালন করছে সে।
এই মুহুর্তে ছোঁয়ার ইচ্ছে করছে না লোকটাকে ডাকতে। করুক একটু নিরিবিলিতে কাজ। ছোঁয়া ভেবে নেয় ব্যাথা হয়ত একটু পরে ঠিক হয়ে যাবে। তাই টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে।
সময় গড়াতে থাকে। তার সাথে ব্যাথা। ডাক্তার বলেছিলো লেভার পেইনের কথা। যখন তখন লেভার পেইন উঠতে পারে এটাও বলা হয়েছিলো ছোঁয়াকে। নির্দিষ্ট ডেট দেওয়া থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রেই ডেট এর আগেই বাচ্চা চলে বসে। ছোঁয়ার ক্ষেত্রেও তেমন ব্যাপার হচ্ছে।

এবার আর ছোঁয়া টিকতে পারে না। মৃদু স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। সাদি ল্যাপটপ বন্ধ করে ফেলে সাথে সাথে। এগিয়ে আসে ছোঁয়ার দিকে। চিন্তিত ভঙিতে ছোঁয়ার হাত খানা ধরে
“কষ্ট হচ্ছে?
ছোঁয়া এক পলক দেখে নেয় সাদির মুখ খানা। তারপর ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে
“ব্যাথা করছে।

সাদি সময় নষ্ট না করে ছোঁয়াকে কোলে তুলে নেয়। ছুঁটে চলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

____

” সাদু কুদ্দুসকে বলুন বায়না না করে খেয়ে নিতে। আমি ভার্সিটিতে যাবো।

সাদিট তিন বছরের ছেলে ছোঁয়াদ এক মনে গেমস খেলে যাচ্ছে। কোনো দিকেই তার খেয়াল নেই। ছোঁয়া মুখে খাবার দিতে গিয়েছে বিধায় মুখের চার পাশে খাবার লেগে আছে। তবে একটা দানাও ছোঁয়া ছেলের মুখে দিতে পারে নি৷

সাদি শার্টের সব গুলো বোতাম লাগানো শেষ করে ছেলের পাশে বসে।
হাত বাড়িয়ে ডাকে
“ছোঁয়াদ পাপার কাছে এসো

ছোঁয়াদ ফোন ফেলে এক লাফে বাবার কোলে উঠে পড়ে।
ছোঁয়া গাল ফুলিয়ে ফেলে
“আমি এতোখন কুদ্দুস কুদ্দুস বলে ডাকলাম। সাড়া দিলো না।
ছোঁয়াদ তার ফোকলা দাঁতে হেসে আঙুল নারিয়ে বলে
“মাই নেম ইজ ছোঁয়াদ চৌধুরী।
সাদি হেসে ছেলের মাথায় চুমু খায়। তারপর ছোঁয়ার থেকে খাবারের বাটি নিয়ে চামচ দিয়ে ছেলের মুখে খাবার তুলে দেয়। ছোঁয়াদ খেতে থাকে।

ছোঁয়া রেগে বম হয়ে যায়। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়
“ছেলেকে একদম নিজের কব্জায় নিয়ে নিয়েছেন আপনি।
” তুমিও নিয়ে যাও।
“কালো জাদু করেছেন যে। আমি নিবো কি করে?
” তুমি সাদা জাদু করে ফেলো।

ছোঁয়াদ বলে ওঠে
“পাপা হোয়াট ইজ সাদা জাদু?

“কুদ্দুস তুই একদম ইংরেজি বলবি না। ওটা ইংরেজদের ভাষা।
ছোঁয়াদ ছোঁয়াকে ভেংচি কাটে। ছোঁয়া বলে ওঠে
” আমার এখুনি আরেকটা ছেলে লাগবে। যাকে আমি পালবো। যে আমার মতো হবে। বাবার মতো ছেলে আমার লাগবে না।

সাদি হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেয়
“ওই যে দরজা।
যাও নিয়ে এসো ছেলে।

ছোঁয়া সাদির চুল টেনে দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়। সাদি হাসে।
” আমার পরিবার।
আধপাগল বউ। আমার হৃদয়হরণী।
বড় আর হলে না তুমি।

____সমাপ্ত___

হৃদয়হরণী পর্ব-৬১

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৬১
#তানিশা সুলতানা

জীবন থেকে হারিয়ে যায় মানুষ গুলো রেখে যায় স্মৃতি। স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে হয় আমাদের। কখনো ভালো স্মৃতি বা কখনো খারাপ।
একটা কথা কিন্তু সঠিক “স্মৃতি হ”ত্যা করতে পারলে মানুষ আ”ত্ন”হ”ত্যা করতে না”
কিন্তু দেহ থেকে প্রাণ না বের হলে স্মৃতি হত্যা হয় না।
মায়া শুধু একটা নাম না। এক সমুদ্র ভালোবেসে ঠকে যাওয়া একটা চরিত্র। মায়া এমন একটা মানুষ যাকে কেউ একজন গভীর ভাবে ভেঙে দিয়েছে। স্বপ্ন গুলো পুরিয়ে দিয়েছে।
হ্যাঁ এই মায়া সেই মায়া যার সাথে সাদির বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।
দীর্ঘ দিন পরে প্রাক্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মায়া। ইচ্ছে করে দাঁড়ায় নি। হঠাৎই সামনে পড়ে গেলো। চোখ দুটো আটকে গেলো পাষাণ পুরুষের আদল খানায়।
সেই পুরুষের চোখ দুটো মায়া দেখে নেয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নাহহহ কোথাও তার জন্য মায়া বা ভালোবাসা দেখতে পেলো না।
মানুষ এতোটদই নিষ্ঠুর হয়?
আকাশ ছিলো মায়ার প্রেমিক। প্রেম ছিলো তাদের। তারপর কোনো কারণ ছাড়াই আকাশ সরি গিয়েছিলো মায়ার জীবন থেকে৷ স্বপ্ন দেখিয়প একটা সুস্থ মস্তিষ্কের মেয়েকে অসুস্থ বানিয়ে চলে গিয়েছিলো। পিছু ফিরে তাকায় নি আর। কখনো জানতেও চায় নি “কেমন আছো?”
মায়া অপেক্ষায় থেকেছিলো। কতো রাত কান্না করেছে। তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে চেয়েছে আকাশকে। হয়ত চাওয়াও ক্রুটি ছিলো। তাই তো মায়া পেলো না।
মাঝেমধ্যে মায়ার ইচ্ছে করতো আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করতে “কেনো ঠকালে আমায়? কেনো আমার ভালো থাকাটা কেঁড়ে নিলে? কেনো আমায় মে রে ফেললে”
কিন্তু আত্মসম্মান নামক শব্দটা মায়াকে আটকে দিয়েছে। প্রশ্ন করতে দেয় নি। বরং বার বার এটাই বুঝিয়েছে “যে চলে গিয়েছে তাকে প্রশ্ন করে আটকানো যাবে না। তাকে ইমোশনালি ব্লাকমেইল করে আটকানো সম্ভব না”

আকাশও অবাক হয়েছে মায়াকে দেখে। এই মুহুর্তে এখানে মায়াকে একদম আশা করে নি সে। সাদি কল করে ডেকেছে তাকে। তাই এই অবেলায় শপিং এ আসা।

আকাশ মায়ার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। রাস্তা তৈরি করে দেয় মায়াকে যাওয়ার।
মুচকি হেসে হাত দিয়ে যেতে ইশারা করে।
মায়া দৃষ্টি সরায় আকাশের থেকে। চোখ দুটো জ্বলছে। বোধহয় পানি জমেছে। চোখের পানিও। যখন তখন চলে আসে। কারণে অকারণে। দুর্বলতা লুকাতেই দেয় না।
মায়া যাচ্ছে না দেখে আকাশ ভ্রু কুচকে তাকায়।

“কিছু বলবে?

মায়া চমকায়। প্রশ্নটা আশা করে নি সে। তবে জবাব দিতে ইচ্ছে করছে ” হ্যাঁ অনেক কথা বলার আছে তোমায়। অনেক প্রশ্ন আছে তোমার কাছে। জবাব চাই আমার”
কিন্তু ওই যে বিবেক। কথা বলতে বাঁধা দেয়।
মায়াও মুচকি হেসে মাথা নারিয়ে বোঝায় কিছু বলবে না। অতঃপর পাশ কেটে চলে যায়। কিছু দূর গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ঘুরে তাকায়। কিন্তু আকাশকে দেখা যায় না। কারণ সে চলে গিয়েছে। একবারও বোধহয় পেছন ফিরে তাকায় নি।
“আচ্ছা মানুষ এতো দ্রুত সব ভুলে যাই কি করে?
তাদের কি মন নেই? মায়া শব্দটা তাদের মধ্যে নেই কি?”

___

সামিরকে আকাশের দায়িত্বে রেখে সাদি বিদায় নিয়েছে। সামিরের সাথে থাকলে আজকে আর বাসয় ফেরা হবে না তার। সামিরের বকবক এ মাথা ধরে গিয়েছে। সাদির ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যে গালে হাত দিয়ে দুই তিন দিন এর জন্য ভাবনার জগতে চলে যেতে। “সব পাগল তার কপালেই কি করে জুটলো?”
তবে সাদির ভালোও লাগে। ভালো থাকার মেডিসিন হচ্ছে সামির এবং ছোঁয়া। এরা দুজন চুপ থাকলে সাদির নিজেরই দম বন্ধ লাগে।
আল্লাহর কাছে বারবার শুকরিয়া আদায় করে এমন বউ এবং বন্ধু পাওয়ার জন্য।

দুই হাতে ফলমূল নিয়ে সাদি বাসায় ফিরে। সন্ধ্যা হয়েই গিয়েছে প্রায়।
ছোঁয়া এই সময় বাগানে একটু হাঁটাহাঁটি করে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয় নি৷ ছোঁয়া রানী হাঁটছপ এবং বই পড়ছে৷ সাদির চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায়। এ কি দেখছে সে?
তার আধপাগল বউ বই পড়ছে? স্বপ্ন টপ্ন দেখছে কি?
সাদি ফলমূলের ব্যাগ নামিয়ে নিজের শরীরপ চিমটি কাটে। ব্যাথা পেয়ে মুখ দিয়ে “উহহ” শব্দ বেরিয়ে আসে। তার মানে স্বপ্ন নয়।
তার আধপাগল বউ সত্যিই বই পড়ছে।
সাদি মুচকি হেসে এগিয়ে যায়।
ছোঁয়ার পেছনে দাঁড়ায়।

“সূর্য কি আজ উঠে নি?

ছোঁয়া যেনো জানতোই সাদি আসবে। তাই চমকায় না। বইটা বন্ধ করে মুখ গোমড়া করে তাকায় সাদির দিকে। বউয়ের মুখ খানা কালো দেখে সাদি ভ্রু কুচকে ফেলে। চতুর সাদি বুঝে ফেলে বউ তার গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছে।

“আমাকে স্যার খুঁজে দেন। সামনে আমার পরিক্ষা সে খেয়াল আছে আপনার? ফেল করলে তো আবার বলবেন ফেলটু বউ।

অবাকের ওপর অবাক সাদি। সারা বছর যে মেয়ে বই ছুঁয়ে দেখে না। সে স্যার খুঁজতে বলছে?

” শুনেন আধবুড়ো স্যার খুঁজে আনিয়েন। আমি আবার দেখতে সুন্দরী। কম বয়সী স্যার আনলে প্রপোজ করে বসতে পারে।

সাদি ছোঁয়ার মাথায় টোকা দেয়।
“সুন্দরী ফকিন্নি
তোমার পড়ালেখার নেশা জাগলো কেন?
কেচটা কি? খুলে বলো।

ছোঁয়া মুখ বাঁকায়।
” এখানে খুলতে পারবো না। আমার শরম করে।
সাদি হকচকিয়ে যায়।
“ঘটনা বলতে বলছি৷

” ঘটনা কিছুই না। আমি শিক্ষিত হবো। ভার্সিটিতে পড়বো। ব্যাংকার হবো। তারপর আপনাকে আর আপনার বাচ্চাদের ফেলে আরেক বেডার সাথে ভেগে যাবো।

সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এখন কথা বাড়ালে এসবই টানবে ছোঁয়া।
“আচ্ছা ভেতরে চলো।
ছোঁয়া দাঁড়িয়ে যায়। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে সাদিকে।
“আমি আপনার যোগ্য হতে চাই। যাতে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলতে না পারে। বলতে না পারে সাদমান চৌধুরী যোগ্য বউ পাই নি। আমাদের বাচ্চা যাতে বলতে না পারে তাদের মা আধপাগল।
আমি বউ হিসেবে আধপাগলই থাকতে চাই। কিন্তু মা হিসেবে পারফেক্ট।
আর পারফেক্ট হতে গেলে আমাকে উচ্চশিক্ষিত হতে হবে।
সাদু আমি বুঝি কম। কিন্তু বোকা নই৷ আমাকে সাপোর্ট করবেন। ভুল করলে বকবেন। আমার সব কথায় সায় জানাবেন না।
সাদি মুচকি হাসে। চুমু খায় ছোঁয়ার মাথায়।
” তোমার থেকে পারফেক্ট এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই।

ছোঁয়া তাকায় সাদির মুখপানে।
“এভাবে বলে আমাকে দমিয়ে দিবেন না। আপনি আমায় ভালোবাসেন বলে আমার সব কিছু পারফেক্ট লাগে। কিন্তু সত্যি কথা আমি পারফেক্ট না।

চলবে

হৃদয়হরণী পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৫৮
#তানিশা সুলতানা

ছোঁয়ার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে কেউ খুশি না। সকলের মুখ ভারি। শুধু ছোঁয়ার ঠোঁটের কোণা থেকেই হাসি সরছে না।
বাড়িতে গোল বৈঠক বসেছে। ছোঁয়া আপাতত তার রুমে। তাকে সাবিনা বেগম ঘুমাতে বলে চলে এসেছে।
ডাক্তার সাদিকে প্রেগ্ন্যাসি কনফার্ম জানানোর পর থেকে সাদির চোখে মুখে গম্ভীর একটা ভাব চলে এসেছে।এমনিতেই সব সময় গম্ভীর ভাব সাদির মুখখানায় বজায় থাকলেও আজকে মুখখানা অন্য রকম। রেগে আছে না কি খুশি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কেউ বুঝতে চাইছেও না।
সেলিম একটু পরপরই কটমট চোখে তাকাচ্ছে সাদির দিকে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। বড্ড বেয়াদব ছেলেটা।
নাজমা বেগমও হতাশ হয়েছে। তার মেয়েটা কখনো নিজে হাতে খেতে পারে না ঠিকঠাক। সে কি করে বাচ্চা সামলাবে? কি করে প্রেগ্ন্যাসির এই কঠিন লড়াই লড়বে?

সাজ্জাদ ছেলের মুখ পানে তাকিয়ে বলে ওঠে
“বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে। আমাদের উচিত তাকে সাদরে গ্রহণ করা। এদের মুখ গোমড়া করে থাকার মতো কিছু হয় নি।

সাজ্জাদের এই কথায় তেঁতে ওঠে সেলিম। সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়
” আমার মেয়েটার বয়স খেয়ালে নেই তোমার ভাইয়া? বাচ্চা সামলানোর মতো বয়স হয়েছে ওর?
তোমার ছেলে সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি করবে।

সাবিনার কপালে ভাজ পড়ে। এখানে তার ছেলের দোষ খুঁজে পাচ্ছে না তিনি।
“ছোট ভাই
সাদু কি করেছে এখানে? ছোঁয়াকে চিনেন না আপনি?
সব সময় সাদুর ওপরেই কেনো তোমার এতো রাগ? কেনো আমার ছেলেকেই কথা শোনাও তুমি?

সেলিম আজকে আর চুপ থাকে না। তিনি আঙুল তুলে বলে ওঠে
” আরও দশ বছর আগে তোমার ছেলে ছোঁয়াকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে আমাকে। আরও আগে থেকেই সে বিয়ে করার পরিকল্পনা করে রেখেছে।

সকলেই থমকে যায়। এই বিষয়ে কারোরই ধারণা ছিলো না। কেউ এতোটুকুও আন্দাজ করতে পারে নি যে সাদি ছোঁয়াকে ভালোবাসতো।
কারণ সাদি সারাক্ষণই ছোঁয়াকে এড়িয়ে চলতো।

সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে
“ভালোবেসেছি তাই আপনাকে বলেছিলাম। গোটা দুনিয়া খুঁজে দেখো আমার মতো তোমার মেয়েকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। তোমার আধপাগল মেয়েকে ভালোবেসে আগলে রাখতে কোনো পুরুষই পারতো না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো।

সেলিমের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। সত্যিই সাদি তার মেয়েকে খুব ভালোবাসে সেটা সে জানে। বলা বাহুল্য সেলিমও মনে মনে সাদিকে বেশ পছন্দ করে। কিন্তু সে স্বীকার করতে নারাজ।

সিমি বলে
” তোমরা এভাবে কেনো বসে আছো? কেনো টেনশন করছো? ছোঁয়াকে দেখো সে কতোটদ খুশি। আমাদের মুখ গোমড়া দেখে ছোঁয়া ডিপ্রেশনে চলে যাবে।

সাদি দাঁড়িয়ে যায়।
“তোমার বোনের ডিপ্রেশনে চলে যাওয়াই উচিত। আস্ত পাগল একটা। জানটা জ্বালিয়ে খেলো আমার।

বলেই সাদি চলে যায়। সিমি মুখ টিপে হাসে। এদের খুনশুটি দেখতে বেশ ভালো লাগে সিমির।
সাজ্জাদ উঠে দাঁড়ায়। সেলিমের মুখোমুখি দাঁড়ায়
” ভাই সব ভুলে যা। তুই নানা হতে যাচ্ছিস আর আমি দাদা। সেলিব্রিট করি। পরির দাদুভাইয়ের ভাই আসবে মিষ্টির বন্যা বয়িয়ে দিতে হবে না?
সেলিম আর মুখ ভার করে থাকতে পারে না। হেসে জড়িয়ে ধরে সাজ্জাদকে। অতঃপর দুই ভাই বেরিয়ে যায় মিষ্টি কিনতে।

___

সাদি রুমে ঢুকে দেখে অশান্ত রানী শান্ত হয়ে ঘুমচ্ছে। এক পলক ঘুমন্ত রানীকে দেখে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় সাদি। মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। সাদি তো ঠিকঠাকই ছোঁয়াকে ঔষধ দিতো। ছোঁয়া খেয়েও নিতো। তাহলে?
কিভাবে কি হলো?
না কি ছোঁয়া খেতো না?
ফেলে দিয়ে সাদিকে মিথ্যে বলতো?
চোয়াল শক্ত করে ফেলে সাদি। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চর বসিয়ে দিতে ছোঁয়ার তুলতুলের নরম গালে।

ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখতে পায় ছোঁয়া খাটের ওপর গোল হয়ে বসে আছে। চোখে এখনো ঘুম জড়ানো। বিরক্তির মাত্রা বেরে যায় সাদির। ঘুম শেষ হয় নি তবুও উঠে বসে থাকতে হবে।

সাদি দৃষ্টি সরিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সময় নিয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। বা হাত চুলে চালিয়ে চুল গুলো পরিপাটি করার চেষ্টা চালায়।
ছোঁয়া তাকিয়ে আছে সাদির মুখ পানে। বেশ বুঝতে পারছে সাদি রেগে আছে। রাগ ভাঙাতেই মূলত ঘুমকে বিদায় জানিয়ে এভাবে বসেছে।।

“আপনি কি রেগে আছেন আমার ওপর?

মাথা নিচু করে নরম গলায় সুধায় ছোঁয়া। সাদি জবাব দেয় না। তাকায় না পর্যন্ত। নিজের মতো পারফিউম লাগাতে থাকে। ড্রেসিং টেবিল গোছাতে থাকে।
সাদির থেকে এমন ইগনোর পেয়ে ছোঁয়ার কান্না পায়। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না।

” আপনি এতোটা অখুশি হলে আমি এর্বোশন করাতেও রাজি।

বুক কেঁপে ওঠে সাদির। হাত থেমে যায়। হাতে থাকা পারফিউমের বোতল ঠাসস করে রেখে পেছন ঘুরে তাকায় ছোঁয়ার দিকে।
বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে যায়। বসে পড়ে ছোঁয়ার পাশে।

“বয়স কতো তোমার? প্রেগন্যান্সির মানে জানো? মুখের কথায় বাচ্চা হয়ে যাবে? নিজে যেটা ভালো মনে করো সেটাই ভালো? বাকিরা ভুল?
ছোঁয়া তুমি বুঝতে পারো না কিছু? সারাক্ষণ বাঁদরামি ছাড়া আর কিছু পারো তুমি?

বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলে সাদি। ছোঁয়ার কান্নার সুর বেরে যায়। সে সাদির কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকে। ব্যাসস সাদির রাগ গলে পানি হয়ে যায়।
দুই হাতে আগলে নেয় ছোঁয়াকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

” আপনি আমার পাশে থাকলে আমি সব পারবো। আমায় শুধু একটু ভালোবাসবেন আর সাহস দিবেন। তাহলেই হলো।

ফোঁস করে শ্বাস ফেলে সাদি।
ছোঁয়াকে সোজা করে বসিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
“আমার কথার অবাধ্য হলে মে রে হাত পা বেঁধে নদীতে ফেলে আসবো। বলে দিলাম আমি।

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৫৯
#তানিশা সুলতানা

সামিরের সাথে ঐশীর বিয়ে দিতে রাজী হয়েছেন আতোয়ার হোসেন। সামিরকে তার কোনো কালেই পছন্দ ছিলো না। তবে সাদিকে পছন্দ। গম্ভীর রাগী প্রাপ্তমনষ্ক সাদিকে তার প্রচুর ভালো লাগে। ইচ্ছে ছিলো তার মেয়ের জন্য প্রস্তার দেওয়ার। কিন্তু তার আগেই খবর পেয়েছে সাদির বিয়ের। তাই আর তার আশাটা পূরণ হলো না।
গোল বৈঠক বসেছিলো সাদি, সামির,এবং আতোয়ার। আতোয়ার যখনই বলেছে

“ঠিক আছে। আমার মেয়ে ভালো থাকলেই হলো।

সামির একটা চিল্লানি দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এক লাফে আতোয়ারের পাশে এসে বসে এবং জাপ্টে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে নেয়। আতোয়ার চোখ বড়বড় করে ফেলে

” শশুড় মশাই লাভইউ। ২০২৪ সালেই আপনাকে নানা বানিয়ে ফেলবো। আপনার মেয়ে কখনোই খালি পেটে রাখবো না। প্রতি বছর একটা করে বাচ্চা গিফট করবো। কথা দিলাম।

আতোয়ার শুকনো ঢোক গিলে সামিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কটমট চোখে তাকায় সামিরের দিকে।

“অসভ্য একটা

বলেই তিনি চলে যায়। সামির গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে।
” আশ্চর্য অসভ্য কেনো কইলো? আমি তো সত্যি কথাই কইলাম।

সাদি ঠোঁট টিপে হাসে।
“সত্যি কথার ভাত নাই জানিস না।

সামির দীর্ঘ শ্বাস ফেলে
” হাহহ তাই তো সত্যি কই না।

“আর বলিসও না। তুই সত্যি বললে দুনিয়ায় মিথ্যা শব্দটাই উঠে যাবে।

সামির মুখ বাঁকায়।
” বাজে বকিস না। ঐশীকে আনার ব্যবস্থা কর। বিয়ে ঠিক হলো একটা চুমু খাবো না?

“শালা তোর কপালে বউ নাই।

” অভিশাপ দিবি না সাদি চাচা। একটাই জীবন। এক জীবনে বিয়ে ছাড়া চাওয়ার আর কিছুই নাই। জীবনের এক মাত্র লক্ষ হওয়া উচিত বিয়ে করা আর বাচ্চা দেওয়া।
আমি সরকার হলে স্লোগান দিতাম
“বিয়ে বিয়ে বিয়ে চাই
বিয়ে ছাড়া উপায় নাই
বিয়ে করবো থাকবো পাশে
বাচ্চা দিবো মাসে মাসে

সাদি হাত তালি দেয়।
” বাহহ বাহহ বাহহ
কপাল করে বউ আর বন্ধু পেয়েছিলাম।

সাদি নিজের শার্টের কলার ঠিক করে একটু ভাব নিয়ে বলে
“গর্বে তুই গর্ববতী হচ্ছিস? স্বীকার করো।

সাদি নিজের পায়ের জুতো খুলে
“গর্ববতী তোকে বানাবো এখন।
সামির এক লাফে সোফার অন্য পাশে চলে যায়।
” শালা দূরে যা। আমার ভার্জিনিটির দিকে হাত বাড়াবি না তুই।

_____

বমি করতে করতে অস্থির ছোঁয়া। গলা দিয়ে রক্ত আসার উপক্রম। পেট ব্যাথা করছে সাথে মাথা ব্যাথা। কিছুই খেতে পারছে না। পেটে খুধা। অসয্য লাগছে ছোঁয়ার৷ কান্না করে ফেলে সে। সাবিনা বেগম চিন্তিত ভঙিতে ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সিমি এক বাটি ঝাল ঝাল সুপ বানিয়ে এনেছে। যাতে একটু খেতে পারে।
ছোঁয়া তাকিয়ে ওয়াক করে ওঠে।
সিমির রাগ হয়।

“ঢং করিস না ছোঁয়া। এভাবে চলে না কি? একটু খেতেই হবে।

ছোঁয়ার চোখের কোণে পানি জমেছে। চোখ বন্ধ করতেই দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি।
” বাচ্চা দুনিয়াতে আনতে এতোটা কষ্ট হয়? আমি আর কখনোই আম্মুর সাথে বাজে বিহেভিয়ার করবো না। আর আমার কুদ্দুসকেও কখনো বকবো না।

সিমিও সুপের বাটি রেখে ছোঁয়াকে তুলে বসায়।
“একটু শক্ত হ। এখনো অনেক দিন বাকি। এখনই তোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পরে কি হবে?

ছোঁয়া মাথা নিচু করে ফেলে।
“আমি শক্তই তো আপু।
একাই খেতে পারবো দাও।

সুপের বাটি নিয়ে ছোঁয়া একাই খেতে থাকে। বেশ কষ্ট হচ্ছে খেতে। গা গুলিয়ে উঠছে আবার। তবুও কষ্ট করে খাচ্ছে।
অনেকটা খাওয়ার পরে ছোঁয়া অস্থির হয়ে ওঠে। এবার আর পেটে ঢুকছে না। পেট থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
তখনই সাদি একটা তেঁতুলের আচার ধরে ছোঁয়ার মুখের সামনে। ছোঁয়া তাকায় সাদির মুখ পানে। সাদি খেতে ইশারা করে।
ছোঁয়া খেয়ে নেয়। আঁচার খেয়ে বমির ভাব চলে যায় ছোঁয়ার।
সাদিকে দেখে সাবিনা বেগম নিঃশব্দে চলে যায়। সিমিও সুপের বাটি নিয়ে বেরিয়ে যায় ওদের প্রাইভেসি দিয়ে।

ওরা বেরিয়ে যেতেই ছোঁয়া গাল ফুলিয়ে বলে ওঠে
” বউ নতুন নতুন প্রেগন্যান্ট হলে গিফট দিতে হয় জানেন না? আনরোমান্টিক একটা।
সাদি ফ্লোরে হাঁটু মুরে বসে পড়ে। পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করে ছোঁয়ার সামনে মেলে ধরে। ভেতরে চিকচিক করছে ডায়মন্ডের রিং।
ছোঁয়ার চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায়।

“এটা কি?

সাদি আংটিটা তুলে ছোঁয়ার আঙুলে পড়িয়ে দিতে দিতে জবাব দেয়
“আমার অমূল্য রতনের জন্য সামান্য ডায়মন্ডের রিং।

ছোঁয়া হেসে ফেলে। সাদির গলা জড়িয়ে ধরে বলে।
আই লাভ ইউ জামাই
একটা চুমু দিন।

সাদি ছোঁয়ার কপালে চুমু খেয়ে জবাব দেয়
” লাভ ইউ টু বউ

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৬০
#তানিশা সুলতানা

একটা মেয়ে যতই পাগল হোক সে তার বাচ্চার কাছে পারফেক্ট মা। এই যে আধপাগল ছোঁয়া যে সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। বকবক করতে থাকে। দুষ্টুমি যার শিরায় শিরায় রয়েছে সে ছোঁয়া এখন বাচ্চার কথা চিন্তা করে ধীরে ধীরে পা ফেলে। যখন তখন লাফিয়ে ওঠে না। প্রচন্ড খুশিতেও গড়াগড়ি খেয়ে হাসে না।
ঠিক সময়ে খাবার খেয়ে নেয়। একদম অনিয়ম করে না। ডাক্তার বলেছে প্রতিদিন সকাল সকাল গোছল করতে ছোঁয়া তাই করে। একদম গোছলে অনিয়ম করবে না সে।

আজকে বাড়িতে সিমি এবং ছোঁয়া ছাড়া আর কেউ নেই। সাদি অফিসে গিয়েছে। নাজমা এবং সাহেলা মার্কেটে গিয়েছে। বাকি সবাই তাদের কাজে।
সিমি পরিকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ছোঁয়াকে বসিয়ে রেখে গিয়েছে সাদির রুমে। ছোঁয়াকেও একটু ঘুমতে বলেছে। ছোঁয়া ঘুমতেই চাচ্ছিলো তখনই তার মনে হলো ফোনে দুটো ভিডিও দেখে নেওয়া যাক। বেবি বাম্পের সময় মায়েদের কেমন করে চলাফেরা করা উচিত, কি কি খাওয়া উচিত। যদিও ডাক্তার বলে দিয়েছে। তারপরও ডিজিটাল যুগ। ইউটিউব এ সার্চ দিলে সকল বিষয়ের তথ্যই জানা যায়।
যেই ভাবা সেই কাজ। ছোঁয়া ইউটিউব এ সার্চ দেয় “বেবি বাম্প” লিখে। সেখানে বিভিন্ন ধরণেরই ভিডিও শো করে। ছোঁয়া নজর পড়ে টুইন বেবিদের ভিডিওর দিকে। কি সুন্দর দুটো বাচ্চা। একদম একই রকম দেখতে হয়েছে। ছোঁয়ারও সাধ জাগে তারও যদি টুইন বেবি হতো।
চট করে মাথায় ধরে যায় ছোঁয়ার “টুইন জিনিস খেলে টুইন বেবি হয়”
ফোনটা রেখে চট জলদি রান্না ঘরে ছোটে ছোঁয়া। কারণ একটু আগেই তার চোখের সামনে সিমি টুইন দুটো বিস্কুট রাখছিলো তাকের ওপর। টুইন বলতে দুটো বিস্কুট জোড়া লেগে গিয়েছে। ছোঁয়া সেটাই খাবে এখন।

একটু দৌড়াতে যেতেই ছোঁয়ার মাথায় আসে “পেটে বাচ্চা”
এবার হাঁটার গতি থামিয়ে দেয় ছোঁয়া। আস্তে ধীরে হেঁটে রান্না ঘরে প্রবেশ করে। তাক থেকে বিস্কুটের ডিব্বা নিয়ে মোড়া টেনে বসে খেতে শুরু করে টুইন বিস্কুট খানা। খেতে খেতেই চিন্তা করে “একটা বিস্কুট খেলে টুইন হওয়ার চান্স থাকবে না”
এখন থেকে সব কিছুই টুইন খেতে হবে। কিন্তু বাড়িতে তো আর টুইন কিছু নেই। সাদিকে কল করতে হবে। এবং বলতে হবে বাজারে যত টুইন ফলমূল আছে সবই জেনো নিয়ে আসে।
ভাবতে ভাবতেই খাওয়া শেষ করে ফেলে। এক গ্লাস পানি পান করে খানিকক্ষণ বসে রেস্ট নেয়। ডাক্তার পই পই করে বলে দিয়েছে “খাবার খাওয়ার পরে একটুখানি রেস্ট নিতে। ভরা পেটে লাফালাফি করলে পেট ব্যাথা করতে পারে”

___

অফিস বাদ দিয়ে সাদি সামিরের পেছনে ঘুরছে। তার অবশ্যই কারণ আছে। ঐশির বাবা বিয়ে তো দিতে চেয়েছে কিন্তু ডেট তো বললো না। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে দিবে দিবে করে এক বছর ঘুরাবে ঢেড় বুঝতে পারছে সামির। তাই সে সাদির অফিসে গিয়ে বসের হাত পা ধরে কেঁদেকেটে বলেছে “আমার বউ আরেক বেডার লগে ভাগছে। এবার সাদি ছাড়া কেউ তাকে ফেরাতে পারবে না। আজকের মতো ছুটি দিয়ে দেন সাদিকে। আপনার পা দুটো মাথায় তুলি আমি”
বস হকচকিয়ে গিয়ে সাদিকে ছুটি দিয়েছে। সাদি অফিস থেকে বেরিয়ে অবশ্য সামিরকে দুটো থাপ্পড় মেরে দিয়েছে। এবং আবারও অভিশাপ দিয়েছে “তোর বউ সত্যিই একদিন আরেক বেডার সাথে যাবে দেখিস”

সামির বুক ফুলিয়ে শার্টের কলার ঠিকঠাক করে জবাব দিয়েছে “যেতে পারবে না রে ভাই। সামির বোকা হতে পারে কিন্তু চালাক না। বিয়ের প্রথম বছরেই বেবি নিয়ে ফেলবো। পরের বছরে আবারও।
এমন করতে করতে বাচ্চার ভুবন বানিয়ে ফেলবো। তখন বউ যাবে কি করে? তাকে নিবেই বা কে?

সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এর সাথে কথা বলাই অপরাধ।

মার্কেটে নিয়ে গিয়েছে সামির সাদিকে। উদ্দেশ্য শপিং করবে। শশুড় বাড়ির সকলের জন্য নানান জিনিস কিনবে। জিনিস দেখেই শশুড় মশাই পটে যাবে। আর বিয়ে দিয়ে দেবে তাড়াতাড়ি। এমনটাই ধারণা সামিরের।
সাদি বিরক্ত হয়ে সামিরের পেছন পেছন ঘুরছে। একেতো এই ভর দুপুর বেলা মার্কেটে ঘুরতে ভাল্লাগছে না। তারওপর আবার সামিরের আজাইরা চিন্তা ভাবনা।

” সাদি শশুড় মশাইয়ের জন্য জাঙ্গিয়া কিনে নিয়ে যাই কতো গুলো। বেডা খুশি হবে।

সাদি চোখ পাকিয়ে তাকায় সামিরের দিকে।

“এভাবে তাকানোর কি হলো? দেখ শশুড় মশাই আমার কিপ্টা। টাকা দিয়ে কিনে জীবনেও পড়ে না আমি শিওর।
আমি দিলে ভালোই হবে বল।

সাদি দাঁতে দাঁত চেপে বলে
“তোর শাশুড়ীর জন্যও কতো গুলো বা
থেমে যায় সাদি।
সামির বুদ্ধিমান। সে চট করে ধরে ফেলে
” মন্দ বলিস নি। তুই দাঁড়া আমি কিনে আনি।

সামির যেতে নিয়ে থেমে যায়। মুখটা গোমড়া করে ফেলে সে।
“কিন্তু ভাই। জানবো কি করে? ক
সাদি জুতো খোলার জন্য নিচু হতে যায় সামির এক দৌড়ে পালায়। সাদি কোমরে হাত দিয়ে হাসফাস করতে থাকে। পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না। ঠিক আছে। তাই বলে সব পাগল?

ভাবতে ভাবতেই সাদির ফোন বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোন বের করতেই স্কিনে ভেসে ওঠে “কুদ্দুসের মা” নাম খানা। সাদি এই নামে সেভ করে নি৷ করেছে ছোঁয়া। সাদি জানতোও না। জেনেছে গতকাল।

কল রিসিভ করে সাদি কানে তুলে
“হ্যাঁ জান বলো।

” জান আই লাভ ইউ

সাদি ঠিক বুঝে ফেলে কোনো আবদার আছে।

“লাভ ইউ টু। কিছু লাগবে?

“হুমম
বাজারে যত জমজ শাক সবজি ফল আছে নিয়ে আসেন আমার জন্য।

কপালে ভাজ পড়ে সাদি।

” কিন্তু কেনো?

“আমি খাবো। টুইন ফল খেলে টুইন বেবি হবে।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাদি।
” আচ্ছা আনবো।

“শুনেন

” বলেন

“বেশি বেশি করে আইনেন। আপনাকেও খেতে হবে। দুজন মিলে খেলেই কাজে দিবে।

সাদি নিজের কপালে নিজেই কয়েকটা থাপ্পড় দেয়।

” আনবো রাখো তুমি।
শালার কপাল
ঘরে বাইরে সব জায়গায় পাগল।

“কিছু বললেন?

চলবে

হৃদয়হরণী পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৫৫
#তানিশা সুলতানা

দিন দিন সকলে ছোঁয়াকে যত দেখছে অবাক হয়ে যাচ্ছে। সেই দিনের ছোঁয়া যে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেললো লাফালাফি করে। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করাই ছিলো যার পেশা। সেই ছোঁয়া এখন কোমরে ওড়না বেঁধে স্বামীর সেবা করে যাচ্ছে। রান্না থেকে শুরু করে সাদির জামাকাপড় ধোঁয়া সবটা একা হাতে করে যাচ্ছে সে। কাউকেই কিচ্ছু করতে দিচ্ছে না। এতে অবশ্য ছোঁয়ার চেহারায় অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। এই কয়েকদিনেই জাদু ছোঁয়া খানিকটা শুকিয়ে গিয়েছে। ধবধবে ফর্সা মুখ খানায় একটুখানি কালচে বর্ণের দেখা মিলেছে। চোখের নিচেও কালি জমে গেছে। সার জেগে সাদির হাতে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এটা অবশ্য সাদি জানে না। সে ঘুমিয়ে পড়লেই ছোঁয়া এ কাজ করে। ছোঁয়ার ধারণা রাতে হাতে পায়ে ব্যাথা করবে আর কষ্টে সাদির ঘুম ভেঙে যাবে। হাত বুলিয়ে দিলে ব্যাথা কমবে।

সাত দিন পার হয়েছে। পায়ের ব্যাথা খানিকটা কমেছে। আজকে ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হবে। এক পা দু পা বাড়াতে পারে সাদি। একটু কষ্ট হলেও ম্যানেজ করে নিতে পারে।

সাদির শরীর মুছিয়ে তার গায়ে শার্ট চাপিয়ে ছোঁয়া নিজে গোছল করতে গিয়েছে। সাদির সাথে সেও যাবে। তাকে হাজারবার না করেছে সাদি। বলেছে যেতে হবে না। কিন্তু ছোঁয়া মানতে নারাজ সে যাবেই। এটা নিয়েও সাদি হতাশ। সেখানে গেলে কেঁদে কুটে অস্থির হয়ে যাবে। ডাক্তার ভালো মন্দ কিছু বললেও সে কাঁদবে। কিন্তু কি আর করার?
বউ যখন যাবে বলেছে তাকে নিতেই হবে। উপায় নেই।

সাদি উঠে দাঁড়ায়। এক পা এক পা করে এগোতে থাকে। দরজা ওবদি আসতেই হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ব্যান্ডেজ না থাকলে অবশ্য এতোটা কষ্ট হতো না। হুইল চেয়ারও আনা হয়েছে তার জন্য। কিন্তু তাতে খুব প্রয়োজন ছাড়া সাদি বসে না।
দরজা ধরে দাঁড়িয়ে যায়। ভেবেছিলো নিচে যাবে। কিন্তু এই অবস্থায় যাওয়া সম্ভবই না। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাদি। দরজা ধরে দাঁড়িয়েই থাকে ছোঁয়ার আসার অপেক্ষায়। এই মুহুর্তে সে ছোঁয়ার সাহায্য ছাড়া খাট ওবদি যেতেই পারবে না।
মুচকি হাসে সাদি। এক্সিডেন্ট হওয়াতে তার এতটুকুও আক্ষেপ হচ্ছে না৷ বরং মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে। এক্সিডেন্ট না হলে কখনোই ছোঁয়ার এই রূপটা দেখতে পেতো না। কখনোই বুঝতে পারতো না তার বউ এতোটা যত্নশীল।

চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয় ছোঁয়া। কিছু দিন আগেও শীতের মধ্যে গোছল করতে ভয় পেতো। বায়না ধরে বসতো। সেই ছোঁয়া এখন কোনো বায়না ছাড়াই গোছল করে ফেলে।

সাদিকে দরজার সামনে দেখে কলিজা কেঁপে ওঠে ছোঁয়ার। সে দৌড়ে আসে।
“কি হয়েছে আপনার? এখন কেনে এসেছেন? কিছু লাগবে? আমাকে কেনো ডাকলেন না?
ছোঁয়ার উত্তেজনা দেখে সাদি তার ডান হাতটা আলতো করে ছোঁয়ার গালে রাখে।

” ঠিক আছি আমি। একটু হাঁটার চেষ্টা করছিলাম।

ছোঁয়ার আঁখি পল্লব ভিজে উঠেছে। এখুনি গড়িয়ে পড়বে গাল জুড়ে।
“একা একা হাঁটার চেষ্টা করতে হবে না। আমি আছি তো। আমি সাহায্য করে দিবো।
সাদি ভদ্র ছেলের মতো মাথা নারায়। এই মুহুর্তে এতটুকুও অবাধ্যতা করলে তার আধপাগল বউ কেঁদে কেটে পুরো বন্যা বানিয়ে ফেলবে।

ছোঁয়া হাত ধরে সাদিকে খাটে এনে বসায়। তারপর ভেজা কাপড় মেলতে যায়। সাদি দেখতে থাকে তার ম্যাচুউট বউকে।

____

কেটে যায় দুটো মাস। সাদি এখন পুরোপুরি সুস্থ। তাকে আর তার ভাড়া বাড়িতে যেতে দেওয়া হবে না। সাদিও আর যেতে চায় না। ছোঁয়ার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের এক্সাম শেষ হয়েছে। পরিক্ষা খুব খারাপ দিয়েছে। ক্লাস করে নি ঠিকঠাক তারপর বাড়িতেও বই ছুঁয়ে দেখে নি। এক্সাম খারাপ হওয়ারই কথা। দুই সাবজেক্টে ফেল করবে এটা ছোঁয়া ভালো করেই জানে।

সাদি অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। দু মাস রেস্টে থাকার পরে আজকেই তার প্রথম অফিস। সকাল সকাল অফিসের জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছে সে। ছোঁয়া এখন আর সাদির পেছনে লেগে থাকে না। মা এবং শাশুড়ীর হাতে হাতে কাজ করে দেয়। আজকেও তেমন কোমরে ওড়না গুঁজে রুটি বেলছিলো।
সাবিনা রুটি ভাজি করছে।

” ছোঁয়া মা যা তুই। আমরা পারবো। অনেক বেলেছিস।
সাবিনা বলে ওঠে।
ছোঁয়া রুটি বেলায় মনোযোগ দিয়ে বলে
“বড় মা যেতে বলিও না। সংসার করা শিখছি গো। ইন ফিউচার আমার যখন বারোটা বাবু হবে তখন তো আমাকে সব কাজ করতে হবে তাই না? এতো এতো রুটি বেলতে হবে।

নাজমা বেগম সবজি কাটছিলো। তিনি চাকু রেখে মেয়ের পানে তাকায়। সাবিনাও হতদম্ভ।

” কয়টা বেবি?

বড়বড় চোখ করে সুধায় নাজমা।

“কয়টা আবার? বারোটা।
এগারোটা ছেলে আর ১ টা মেয়ে।

সাদি এসেছিলো খাওয়ার জন্য। ছোঁয়ার এমন কথা শুনে তার কাশি উঠে যায়। ছোঁয়া বেলুন রেখে তারাহুরো করে সাদিকে পানি দেয়। নাজমা এবং সাবিনা মুচকি হেসে নিজেদের কাজে মন দেয়।
সাদি ছোঁয়ার হাত থেকে পানির গ্লাস না নিয়ে কান টেনে ধরে।
” কয়টা বেবি না?
ছোঁয়া কান ছাড়ানোর চেষ্টা করে জবাব দেয়
“চব্বিশটা
সাদি আরও একটু জোরে কান টেনে ধরে। ছোঁয়া ব্যাথা পায়।
” এবার বলো কয়টা?
ছোঁয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলে
“বারোটা
সাদি আরও একটু জোরে টেনে ধরতেই ছোঁয়া বলে ওঠে
” দুটো দুটো
দুটো বাচ্চা নিবো।
আমি সরকারি স্লোগান জানি তো
“দুটো সন্তানের বেশি নয় একটা হলে ভালো হয়”

সাদি কান ছেড়ে দেয়।
“হুমম গুড গার্ল। যাও খাবার নিয়ে এসো আমার জন্য।

ছোঁয়া ভেংচি কেটে খানিকটা দূরে যায় সাদির থেকে। তারপর বলে ওঠে
” আমি সরকারের স্লোগান ভেঙে দিবো। ছোঁয়া নিজের স্লোগান ঘরে ঘরে পৌঁছে দিবে
“বারোটা সন্তানের বেশি নয় চব্বিশটা হলে ভালো হয়”

সাদি পায়ের জুতো খুলতে যেতেই ছোঁয়া এক দৌড়ে পালিয়ে যায়। নাজমা এবং সাবিনা শব্দ করে হাসতে থাকে। কতোদিন পরে মেয়েটার বাচ্চামি দেখলো তারা। এতোদিনে বোধহয় বাড়ির প্রাণ ফিরে এলো।
সাদিও হাসে। তার আধপাগল বউ যে নিজের রূপে ফিরে এসেছে এটা ভেবেই তার মনের মধ্যে সুখ বয়ে যাচ্ছে।

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৫৬
#তানিশা সুলতানা

মিহির বর মিহিকে ছেড়ে দিয়েছে। তার কারণ হচ্ছে মিহি সংসারী নয়। সে স্বামী সংসার সামলে উঠতে পারছিলো না। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় রান্না করে দিতে পারতো না। মোট কথা মিহি তার স্বামীকে কেনো ভাবেই সন্তুষ্ট করতে পারছিলোনা। বা মিহি চাইছিলোও না। মনের মধ্যে কোথাও একটা সাদি রয়েই গিয়েছিলো।
বিয়ের দুই বছর পরে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। এবং ডিভোর্সের ঠিক এক সপ্তাহ পরে মিহির এক্স বর নতুন বিয়ে করে নেয়।
মিহি হচ্ছে মায়ার চাচাতো বোন। মিহির মনে হয় এখনো কোথাও না কোথাও সাদির মনে তার জন্য জায়গা রয়েছে। এবং সে চেষ্টা করলে সাদির সাথে সবটা ঠিক করে নিতে পারবে।
আজকেও মিহি এসেছে সাদির অফিসে। শেষবার খোলাখুলি কথা বলতে চায় সাদির সাথে।
অফিসে ঢুকতে ঢুকতেই সাদি মিহিকে খেয়াল করে। এবং আন্দাজও করতে পারে এখানে তার আসার কারণটা।
সাদি এগিয়ে যায়। মিহির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে
“এখানে তুমি?

মিহি বসে ছিলো। সাদির কন্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
” তোমার সাথে কথা বলতে চাই আমি।

“ক্যান্টিনে চলো

সাদি আগে আগে হাঁটতে থাকে। মিহি পেছনে পেছনে। ক্যান্টিন এখন ফাঁকা। হাতে গোনা কিছু মানুষ রয়েছে। সাদি ফাঁকা একটা টেবিল দেখে বসে পড়ে। মিহিও সাদির সামনাসামনি বসে পড়ে।
সাদি টেবিলের ওপর দুই হাত তুলে মিহির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে
” কিসের আশায় এখানে এসেছো মিহি?
তোমার কি মনে হয় না তুমি বোকা? তোমার সাথে রিলেশনশিপ এ থাকার সময়ও আমি তোমাকে বলেছিলাম ছোঁয়ার কথা। তার প্রতি আমার ফিলিংস আমি শেয়ার করেছিলাম তোমার সাথে। তাহলে?
তুমি কি বুঝতে পারছো না? আমি ছোঁয়াকে কতোটা ভালোবাসি? ওকে পেয়ে আমি কতোটদ খুশি?

মিহির চোখে পানি টলমল করছে। সে সাদির হাতের ওপর হাত রাখে। সাদি হাতটা সরিয়ে নেয়।

“একটু ভালো থাকার লোভে তোমার কাছে আসি আমি।

হাসে সাদি।
“এখানে সুখ পাবে না তুমি। আর এসো না। ছোঁয়া জানতে পারলে তোমার এটা সেটা নানান কথা শুনিয়ে দিবে। তখন নিজেও লজ্জা পাবে আমিও লজ্জায় পড়ে যাবো।

বলেই সাদি চলে যায়। মিহি বসে থাকে। তাকিয়ে থাকে সাদির চলে যাওয়ার দিকে।

সেলিম হাজারবার সরি বলে বউয়ের সাথে সম্পর্ক ঠিকঠাক করে নিয়েছে। শেষবারের মতো সেলিমকে ক্ষমা করে দিয়েছে তিনি। দ্বিতীয় বার এই রকম ভুল করলে একদম সোজা ডিভোর্স দিয়ে দিবে এমনটাও হুমকি দিয়েছে।।

ছোঁয়ার একা একা ভালোই লাগছে না। এতোদিন সাদির সাথে চিপকে চিপকে থাকতো। একটা মিনিটের জন্যও চোখের আড়াল করতো না। কিন্তু আজকে লোকটা কতো দূরে।
আসবেও সেই রাতে। সাদি আসার আগে আগে বই নিয়ে পারতে বসতে হবে। যাতে রেজাল্ট দিলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে পারে ” পড়েছিলাম তো। মনে না থাকলে আমি কি করবো”

এখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা। সাদি ফিরবে নয়টায়। এতো সময় কি করবে ছোঁয়া? ভাবতে ভাবতপ মাথায় চলে আসে দুষ্টু বুদ্ধি।
সেই যে একদিন বরটার সাথে সুন্দর একটা রাত কাটালো তারপর তো আর তেমন সময় পার করা হলো না। আজকেই তাহলে সাদিকে একটু চমক দেওয়া যাক।
যেই ভাবা সেই কাজ। ছোঁয়া চট করে কাবাড থেকে সেই হাঁটু বের করা জামা খানা বের করে ফেলে। ফল্ট মুভিটা চালিয়ে নোয়াকে ফলো করতে থাকে। একদম পারফেক্ট নোয়ার মতো সাজবে সে।
সাদির জন্যও কাবাড ঘেটে একখানা কালো জ্যাকেট বের করে নেয়। এটা সাদিকে পড়াবে। একদম পারফেক্ট নোয়া এবং নিক লাগবে দুজনকে।

নোয়ার মতে চুল গুলো উঁচু করে বেঁধে ফেলে। হদঁটু বের করা জামা এবং হালকা মেকাপ। রুমে কয়েকটা মোমবাতিও জ্বালিয়ে ফেলে। ব্যাস এবার শুধু সাদি আসার অপেক্ষা।
সব কিছু শেষ করে বিছানার ওপর বই নিয়ে বসে পড়ে ছোঁয়া। একটু পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়ার নাটক আর কি।

সাদিকে আজকে একটু দ্রুতই ছুটি দেওয়া হয়েছে। তাই জলদি বাসায় চলে আসে। দরজা খুলে খাটের দিকে নজর দিতেই সাদির কপালে তিনটে ভাজ পড়ে। তার আধপাগল বউ পড়ছে। পড়ার স্টাইল ও আলাদা। সব গুলো বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে বিছানায়। উপুড় হয়ে শুয়ে একটা বই রেখেছে মাথার ওপরে এবং আরেকটদ বই উল্টো করে ধরে বইয়ের পেছনে ফুল আঁকছে।
ফোঁস করে শ্বাস টানে সাদি।

“কি করছো?

ফুল আঁকায় এতোটাই মনোযোগ দিয়েছিলো যে সাদি এসেছে এটা সে টেরই পায় নি। জলদি উঠে বসে ছোঁয়া। মাথার ওপর থেকে বই নামিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলে

” একটু পড়ছিলাম আর কি?

সাদি কিছু বলে না। দরজা আটকে অফিসের ব্যাগ জায়গা মতো রাখে। তারপর ট্রাই খুলতে থাকে।
সাদির কোনো রিয়াকশন না পেয়ে ছোঁয়া বলে ওঠে
“আমাকে কেমন লাগছে বললেন না?

সাদি পরনের শার্ট খুলে ফেলে৷ চুল গুলো হাতের সাহায্যে এলোমেলো করে নেশাতুন কন্ঠে বলে।
” বলবো না বোঝাবো।

তারপর রুমের লাইট অফ করে জাপ্টে জড়িয়ে নেয় ছোঁয়াকে। কোলে বসিয়ে চুম্বন এঁকে দেয় ছোঁয়ার ললাটে।
ফিসফিস করে বলে
“তুমি করে বলবে?
ছোঁয়া নার্ভাস। লোকটা একটুখানি ছুঁয়ে দিলেই ছোঁয়া জমে বরফ হয়ে যায়।
গলা দিয়ে কথাই বেরুতে চায় না।
” বলো না জান? জাস্ট একবার।

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ছোঁয়া আস্তে করে ডাকে
“ও গো শুনছো। ভালোবাসি তোমাকে।

সাদমান চৌধুরীকে পাগল করতে এইটুকুই যথেষ্ট ছিলো।
সে তার আদরকে নিয়ে ডুবে যায় ভালোবাসার সাগর। আরও একটা সুন্দর রাত কাটায় দুজন।

___

প্রত্যাশার থেকে বেশি কিছু পেয়ে গেলে সাধারণত একটু বেশিই খুশি লাগে। আজকে ছোঁয়ারও খুশি হওয়ার দিন। তবে সে খুশি না। আবার কষ্টও হচ্ছে না। মোটামুটি একটা শকের মধ্যে আছে। ইয়ার চেঞ্জ পরিক্ষায় তিন সাবজেক্টে ফেল করছে ছোঁয়া। মনে মনে আশা ছিলোদুই সাবজেক্ট এ ফেল করার। কিন্তু একটা সাবজেক্ট বেশি ফেল করায় ছোঁয়া হতদম্ভ। কেনোনা আগেই নোটিশ দেওয়া হয়ে গিয়েছে দুই সাবজেক্টে ফেল করলে ওঠাবে সেকেন্ড ইয়ারে। কিন্তু তিন সাবজেক্টে করলে গার্ডিয়ান লাগবে। এখানেই ছোঁয়ার টেনশন। গার্ডিয়ান পাবে কই এখন? বাবা জানলে ঠ্যাং ভাঙবে। সাদি কান ছিঁড়ে দিবে।
তাহলে?

কলেজের মাঠে এসব চিন্তা করতে করতে হাঁটতেছিলো ছোঁয়া। হঠাৎ করে মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে। গা গুলিয়ে গড়গড় করে বমি করে দেয়।
ছোঁয়ার বন্ধু তিথি ছোঁয়াকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়।
ছোঁয়া পানি খেয়ে একটু ঠিকঠাক হয়ে তিথিকে বলে
“দোস্ত আমাকে কনগ্যাচুলেশন বল। আমি প্রেগন্যান্ট।

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৫৭
#তানিশা সুলতানা

অসুস্থতায় একটা মানুষ এতোটা খুশি হতে পারে?
ছোঁয়া পারে। এই যে মাথা ব্যাথায় চোখ খুলতে পারছে না। বমি করতে করতে গলা ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। তবুও সে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। নাচার জন্য বারবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সাদি চোখ রাঙিয়ে বসিয়ে রেখেছে।
সাবিনা বেগম চিন্তিত। সে ভাতের থালা নিয়ে ছোঁয়ার সামনে বসে আছে। আপাতত বাড়িতে কেউ নেই। সকলেই গিয়েছে পাশের বাড়িতে দাওয়াত খেতে। সাদিকে কল করে বাড়িতে এনেছে ছোঁয়া। সাবিনা বেগমও গিয়েছিলো দাওয়াতে। সাদি কল করে বাড়ি আসতে বলেছে।

“বড় মা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। সুখবর নিয়ে আসি। আর কুদ্দুসের বাপ জলদি দোকানে যান মিষ্টি আনতে৷ পুরো পাড়াতে আমি নিজে হাতে মিষ্টি দিবো।

কথা বলার শক্তি নেই। তবুও টেনে বলছে ছোঁয়া। সাদির বিরক্ত আকাশ ছুঁই ছুঁই। ইচ্ছে করছে একে একটা লাথি মেরে ফুটিয়ে ফেলতে। কিন্তু পারছে না। কি আর করার আধপাগল হোক বউ তো।

সাবিনা বেগম ছেলের পানে এক পলক তাকায়। তারপর ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
” ভাত খেয়ে নে। তারপর নিয়ে যাবো।

ছোঁয়া তাকায় ভাতের থালার দিকে। ইলিশ মাছের পিচ দেখে আবারও গা গুলিয়ে আসে। মনে হচ্ছে নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসবে।
“বড় মা খেতে পারবো না গো। কুদ্দুস খেতে বারণ করছে।

সাদি দাঁড়িয়ে যায়। ছোঁয়া বড়বড় চোখ করে দুই গালে হাত দেয়। যাতে থাপ্পড় টাপ্পড় দিতে না পারে। সাদি ছোঁয়ার কাছে এসে পাজা করে কোলে তুলে নেয়। ছোঁয়া ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে ফেলেছে। সাবিনা বেগম মাথা নিচু করে ফেলে।
সাদি গটগট পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
ছোঁয়া শক্ত করে সাদির গলা জড়িয়ে ধরেছে। বেশ ভালো লাগছে তার। বরের কোলে থাকার মজাই আলাদা। ছোঁয়ার তো ইচ্ছে করে সারাক্ষণ লোকটার কোলে চরে থাকতে। এমন দিন কবে আসবে? যে দিনে সাদমান চৌধুরী তার বউকে কোল থেকে নামাবে না?

গাড়ির মধ্যে এক প্রকার ছুঁড়ে ফেলে ছোঁয়াকে। ছোঁয়া মুখ বাঁকিয়ে সেভাবেই পড়ে থাকে। বজ্জাত লোক। সন্তান আসছে কোথায় বউকে ধরে কয়েকটা চুমু খেয়ে নিবে তা না রাগ দেখাচ্ছে।
এমন বরকে ঘেন্না করা উচিত। কিন্তু ছোঁয়ার মনটা বড় কি না? তাই সে ঘেন্না করতে পারে না।

হাসপাতালের করিডোরে বসে থাকার ধৈর্য ছোঁয়ার নেই। লম্বা লাইন পড়েছে। সাদি ছোঁয়াকে নিয়ে বসেছে এক পাশে। সাদি নিরবে বসে ফোন দেখতে থাকলেও ছোঁয়া স্থির থাকতে পারছে না। ছটফট করেই যাচ্ছে। কখনো সাদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ছে তো কখনো কাঁধে মাথা রাখছে। কখনো চুল ধরে টানছে আবার কখনো দাঁড়ি ধরে টানছে। শার্টের কলার ধরে টানছে। সাদিকে বেশ ধৈর্যশীল দেখাচ্ছে।

“আজকেই সবাইকে অসুস্থ হতে হলো?

ছোঁয়া বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বলে। সাদি ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এক পলক তাকায় ছোঁয়ার মুখ পানে।

” অসুখেরও আক্কেল নাই। আব্দুল কুদ্দুসের একমাত্র মাকে চেপে ধরেছে ভালো কথা। থাক আমার কাছেই। কাল নাহয় বাকি সবার কাছে যাইস। তা না ভাগ ভাগ করে সকলের কাছেই গিয়েছে।
ভালো কথা
আচ্ছা সাদু অসুখের বংশ কতো বড়? না মানে দেখুন এক সাথে কতো জনকে চেপে ধরে। ডেঞ্জারাস

হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে সাদি। এই মেয়ে কি জীবনেও মানুষ হবে না? আল্লাহ কি তাকে কখনোই এতটুকু বুদ্ধি দেবে না? সারাজীবন এমন গাঁধাই থেকে যাবে?

সাদির মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে ছোঁয়া। একটু হাসার চেষ্টা করে বলে
” হে হে মজা করছিলাম। রাগিয়েন না প্লিজ। হবু বাচ্চার মাকে বকলে আল্লাহ পাপ দেবে।

সাদি পকেট থেকে হেডফোন বের করে কানে গুঁজে নেয়। ছোঁয়া কয়েকবার মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কাটে সাদিকে। বেডার ভাব দেখলে ইদানীং ছোঁয়ার ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলতে “বিবাহিত বেডাদের ভাব ধরা মানায় না। কারণ তাদের দাম নাই”
খালি লোক লজ্জার ভয়ে বলতে পারে না ছোঁয়া।

অবশেষে ছোঁয়ার সিরিয়াল আসে। সাদির আগেই ছোঁয়া ঢুকে পড়ে৷ কপালে তিনটে ভাজ পড়ে সাদির। এই তো কথাই বলতে পারছিলো না। এখুনি এতো শক্তি কই পেলো?

মধ্য বয়স্ক একজন মহিলা বসে বসে কিছু একটা দেখছে। ছোঁয়া প্রায় দৌড়ে মহিলা ডাক্তারের সামনে বসে পড়ে এবং বলে ওঠে
“আমি কিট পরিক্ষা করে নিয়েছি। পজিটিভ দেখেছি। মানে হচ্ছে আমার সন্তান আসছে। আপনি আমার বরকে এটা বলে দিন।

ডাক্তার ভ্রু কুচকে তাকায় ছোঁয়ার মুখপানে। সাদিও চোখ দুটো বড়বড় করে ফেলে। বসার জন্য চেয়ার ধরেছিলো সে। কিন্তু ছোঁয়ার কথা শুনে বসতে ভুলে গিয়েছে। প্রেগন্যান্ট কিটও পরিক্ষা করাও শেষ?

ডাক্তার ছোঁয়ার কথা শুনে মুচকি হাসে। সাদির দিকেও এক পলক তাকায়।
” বাহহ তুমি তো খুবই ফাস্ট

“আমি কুদ্দুসের মা কি না।
কালকেই পরিক্ষা করেছি। বমি হচ্ছিলো না বলে কাউকে জানায় নি। আজকেই বমি হয়েছে।

ছোঁয়ার কথায় এবার শব্দ করে হেসে ওঠে ডাক্তার। সাদি চোখ পাকিয়ে ছোঁয়াকে শ্বাশায়।

” সরি ডাক্তার
আমার বউয়ের মাথায়,একটু প্রবলেম আছে।

ছোঁয়া মুখ বাঁকিয়ে বলে
“আমার মাথায় কোনো প্রবলেম নাই। আমি ঠিকঠাক।
ডাক্তার আন্টি আপনি বলুন কিভাবে চলতে হবে? কি করতে হবে? আমি শুনছি।

চলবে