Saturday, July 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 49



কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৬২

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬২)

সময় এগিয়েছে।ডেস্ক ক্যালেন্ডার থেকে চারটে মাস গায়েব।বসন্ত শেষ হয়ে বর্ষার মাঝামাঝি চলছে।আজ সকালেও আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি হয়েছে।এখন আবহাওয়া একদম গুমোট।আকাশের রং কালো।দেখে মনে হচ্ছে আর দশ মিনিট পরেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামবে।

নবনীতা পর্দা সরিয়ে জানালা খুলল।বৃষ্টি থামার পর মাটির একটা ভেজা ঘ্রাণ নাকে লাগে।এই ঘ্রাণটা তার ভীষণ ভালো লাগে।চিত্রা একটু পরেই স্কুল থেকে আসবে।শুভ্রা গিয়েছে তাকে আনতে।রান্নাঘর থেকে মাছ ভাজার সুন্দর ঘ্রাণ আসছে।বৃষ্টির দিনে গরম গরম ভাত আর মাছ ভাজা।দারুন একটা ব্যাপার!

সে গালের নিচে হাত রেখে জানালা গলিয়ে বাইরে দেখে।সামনের বিশালাকার গাছের মগডালে দু’টো শালিক বসা।নবনীতা তাদের দেখে মুচকি হাসল।নিজ থেকেই বলল,’তোদেরই ভালো।কথা বলতে পারিস না,ভেজালেও পড়িস না।আমাদের মানুষদেরই যতো জ্বালা।কথার আঘাতে অন্যজনকে জর্জরিত করি।পরে আর শত চেষ্টাতেও কোনো কিছু স্বাভাবিক হয় না।’

কলিংবেল বাজছে।নবনীতা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল।দুই বোনকে দেখতেই তার মুখের হাসি চওড়া হলো।সে চিত্রার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে যেতে যেতে বলল,’এক্ষুণি গোসলে যা চিত্রা।এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।’

ঘরে এসে ক্লাচারের সাহায্য আনাড়ি হাতে কোনোরকমে চুলগুলোকে খোঁপা বাঁধে সে।এটা তার নতুন একটা জীবন।খুবই আলাদা একটা জীবন।সাত বছর আগের জীবনটা থেকে একদমই আলাদা।সাত বছর আগে মামি তাকে এতো স্নেহ করতো না,এখন করে।সাত বছর আগে প্রথার সাথে তার সম্পর্ক এতোটা প্রাণবন্ত ছিলো না।এখন প্রথা রোজ রোজ তার ঘরে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে।

প্রথার সাথে তার এই সুন্দর সম্পর্কের একটা দুর্দান্ত পটভূমি আছে।এক বিকেলে প্রথা গালভর্তি হাসি নিয়ে তার ঘরে এলো।এসেই বলল,’আপু থ্যাঙ্ক ইউ।’

নবনীতা তখন কাপড় ভাঁজ করছিলো।কাজ করতে করতেই সে আড়চোখে তাকে দেখে বলল,’কেন?আমি আবার কি করেছি?’

প্রথা উৎফুল্ল হয়ে খাটে বসল।বলল,’সেদিন আব্বুর সাথে ঝগড়া করছিলাম না টাকা দেওয়ার জন্য?ব্যবসা করব বলে।পরে তো তুমি টাকা দিতে দাওনি।ব্যবসাটাও আর করতে পারিনি।আমার বাকি ফ্রেন্ডরা ব্যবসা করেছে।আর জানো,তারা লস খেয়েছ ,তাও আবার মোটা অঙ্কের টাকা।আমি তো টাকা দেই নি।তাই আমি বেঁচে গেছি।’

বলেই সে ফিক করে হেসে দিলো।তার হাসি দেখে নবনীতার আপনাআপনি হাসি চলে এলো।আসলে হাতে গোনা কিছু মানুষ ব্যতীত সব মানুষই বোধহয় একরকমই হয়।এই যে প্রথাকে সে ভীষণ দাম্ভিক ভাবতো,বিষয়টা কিন্তু তেমন না।একটু মনোযোগ দিলে দেখা যায় প্রথাও আসলে খুব মিষ্টি একটা মেয়ে।শুধু চরিত্রের রুক্ষ ভাবটা সরিয়ে নিলে তবেই হলো।

নবনীতা হুট করেই তার কাছে জানতে চেয়েছিলো,’এই প্রথা! ব্যবসা করবি?তুই আর আমি মিলে?’

প্রথা অবাক হয়ে বলল,’সেকি! কিসের ব্যবসা করব আমরা?এতো টাকা কোথায় পাবো?’

সেই থেকে শুরু।তারপর তারা দু’জন সত্যিকার অর্থেই ক্ষুদ্র পরিসরে একটা ব্যবসা শুরু করেছিল।হ্যান্ড ক্রাফটের ব্যবসা।নবনীতাই অনেক চিন্তা করে এটাকে ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছে।এটাতে খরচ কম।অর্ডার আসলে তবেই বানানোর কাজ শুরু করা যায়।পাশাপাশি মামিও এসবে পারদর্শী।তিনজন একসাথে মিলে সময় দিলে নবনীতার উপর চাপও কমবে।বেশ দ্বিধাদ্বন্দে থাকার পর অবশেষে সে বিসমিল্লাহ বলে ব্যবসার অঙ্গনে নেমেছিলো।দেখা গেল দুই মাসে সে মোটামুটি ভালোই অর্ডার পেল।প্রথম মাসে তার লাভ হয়েছিলো তিন হাজার টাকা।গত মাসে লাভ হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা।এই মাসের অর্ডার দেখে মনে হচ্ছে এই মাসে আরো বেশি লাভ হবে।তার অবশ্য এখনই ব্যবসা রমরমা করার কোনো তাড়া নেই।চাকরি তো আছেই,পাশাপাশি ব্যবসা থেকে যা লাভ হচ্ছে সেটাই অনেক।

প্রথার লাস্ট সেমিস্টার চলছে।বেচারির যাতায়াতে সমস্যা হয় খুব,তবুও মানিয়ে নিচ্ছে।দিনভর পড়াশোনাতে ব্যস্ত,আর রাতে ব্যবসার কাজ।এই ব্যবসা শুরু করার পর থেকেই নবনীতার সাথে তার সখ্যতা বেড়েছে।একটু অবসর হলেই সে তার ঘরে চলে আসে।তারপর চা খেতে খেতে দু’জন দীর্ঘসময় আড্ডা দেয়।

জীবনের এই নতুন মোড় নবনীতার মাঝে মিশ্র অনুভূতির সঞ্চার করে।যেই অধ্যায় সে পেছনে রেখে এসেছে,সেই অমীমাংসিত অধ্যায় মাঝে মাঝেই তাকে শেকড়ের মতো আঁকড়ে ধরে।তাসনুভা,আরিশ এদের কথা ভীষণ মনে পড়ে।আর আরশাদ?তার কথা তো নবনীতা ভাবতেই পারে না।ভাবলেই তার চোখে পানি এসে যায়।বাচ্চাটা নিশ্চয়ই এই কয়দিনে কিছুটা বড়ো হয়েছে।সে কি আর কোনোদিনই তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারবে না?

এই তিনমাসে সবচেয়ে চমৎকার যেই ব্যাপারটি ঘটেছে তা হলো শুভ্রানীর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে।নবনীতা ভেবেছিল সে খুব বেশি ভালো করতে পারবে না পরীক্ষায়।যেহেতু তার এডমিশন ফেজ টা পুরাই একটা টানা হ্যাঁচড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।কিন্তু নবনীতাকে আশ্চর্য করে দিয়ে শুভ্রা ময়মনসিংহ মেডিকেলে চান্স পেল।রেজাল্ট দেখার পর নবনীতা হা হয়ে কতোক্ষণ রেজাল্টশীট টা দেখল।কি হচ্ছে এসব?আল্লাহ তাকে সবদিক থেকে এতো কিছু দিচ্ছে কেন?

শুভ্রার ক্লাস শুরু হতে এখনো অনেকদিন বাকি।নবনীতা তাকে এখন খুব একটা কাজ করতে দেয় না।জীবনের এই সময়টা একবারই আসে।তারপর যে শুভ্রা ব্যস্ততায় ঢুকবে,সেই ব্যস্ততা থেকে আর মুক্তি নেই।শুভ্রা অবশ্য নিজ থেকেই টুকটাক কাজ করে।সে খুব ভালো অরনামেন্টস বানাতে জানে।সন্ধ্যের দিকে আপাই আর প্রথা আপু যখন সেগুলো নিয়ে বসে,তখন সেও টুকটাক সাহায্য করে।তার ভীষণ মজা লাগে এই কাজ করতে।

এই হলো নবনীতা নূরের সংক্ষিপ্ত জীবন।কিছুটা ছন্নছাড়া,কিন্তু তবুও আগের তুলনায় যথেষ্ট গোছানো।নিজের টাকায় চলছে,সংসার চালাচ্ছে,বোনদের ছোটখাটো চাহিদা পূরণ করছে।এতে মন্দ কি?বেশ ভালোই আছে সে।

আরহাম সেদিন যাওয়ার পর আর আসেনি।মাঝে একবার ফোন দিয়েছিল অবশ্য।নবনীতার কাছে জানতে চেয়েছিল ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কি করতে হয়?সে কাটকাট জবাব দিয়েছে ‘রাজনীতি ছাড়তে হয়।’
আরহাম তারপর আর যোগাযোগ করেনি।খুব সম্ভবত সেদিনই সে ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছে রাজনীতি ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব না।এরপর শেষ।নবনীতার সাথে তার আর কোনো কথা হয়নি।ভবিষ্যতে কবে হবে কিংবা আদৌ হবে নাকি নবনীতা জানে না।জানার ইচ্ছেও করে না।সে বেশ আছে তার জীবনে।আর যাই হোক,প্রতি মুহূর্তে মু’ত্যু ভয় নিয়ে তো আর ঘুরতে হয় না।নবনীতার জন্য এই জীবনই ঠিক আছে।ওসব ভিআইপি,চব্বিশ ঘন্টা গার্ড নিয়ে ঘুরা বড়লোকি জীবন তাকে টানে না,একটুও টানে না।
.
.
.
.
‘তুই কি জানিস আমি যে তোকে ভালোবাসি না?’ বেঞ্চে বসে পা দোলাতে দোলাতে প্রশ্ন করল ইজমা।

আদি তীর্যক চোখে তাকে দেখল।রুক্ষ স্বরে বলল,’তো আমি কি তোকে ভালোবেসে মরে যাচ্ছি?ফালতু কোথাকার!’

‘না সেটা না।তোর আর আমার একটা পার্থক্য আছে।’

আদি চোখ পাকায়।
‘সেটা কি?’

‘সেটা হলো আমি একজনকে ভালোবাসি।’

একেবারে ঠান্ডা উত্তর।অথচ আদি এমনভাবে চমকালো যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।বড় বড় চোখে পাশ ফিরে বলল,’সত্যি?নাকি মজা করছিস?’

‘সত্যি।’ ভীষণ কটকটে জবাব।

আদি ঝুকলো।চোখ সরু করে বলল,’কাকে পছন্দ করিস তুই?বাড়িতে কি জবাব দিবি?’

‘বাড়িতে কি জবাব দিব মানে?তুই সব সামলে নিবি।’

আদি খেঁকিয়ে উঠল,’থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিব বেয়াদব।পরকীয়া করছিস,আবার বলিস তুই সামলে নিবি।’

ইজমা তার মাথায় একটা গাট্টা মেরে কটমট চোখে বলল,’পরকীয়া মানে?তোর সাথে বিয়ে হয়েছে আমার?ঐসব হাসবেন্ড হাসবেন্ড ভাইবস আমি তোর থেকে পাই না।’

আদির গায়ে লাগল কথাটা।সে ইজমার চেয়েও দ্বিগুন জোর দিয়ে বলল,’আর তোর থেকে তো আমি কোনো মেয়ে মেয়ে ভাইবসই পাই না।তুই একটা বেডা।’

সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর ফিসফিস করে বলল,’ছেলেটা কে?’

ইজমা মাথা নামায়।লাজুক হেসে বলে,’ইফাজ।’

‘ইফাজটা আবার কে?’ আদি কপাল কুঁচকে জানতে চাইল।

আবারো নিচু স্বরে সে জবাব দিলো,’ঐ যে আমার ডাক্তারটা।’

আদি চোখ বড় বড় করে তাকে দেখল।তারপরই আচমকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।ইজমা ভড়কে গিয়ে বলল,’কি?এভাবে হাসছিস কেন?’

‘সিরিয়াসলি ইজমা! তোর চয়েজ এতো ক্ষেত? এতো সুন্দর সুন্দর ছেলে ফেলে তুই ঐ ডাক্তার আতেলটার প্রেমে পড়েছিস?ঐটাকে দেখতে আমার নবিতার মতো লাগে।’

কথা শেষ করেই সে আরো একদফা হেসে কুটি কুটি হয়।ইজমা রাগী রাগী মুখে তাকে দেখে।শেষে ভেঙচি কেটে বলল,’তো কি হয়েছে?সে যদি নবিতা হয়,আমি তবে সিজুকা হবো।তোর কোনো সমস্যা?’

আদি খিলখিল করতে করতে জবাব দিলো,’না,আমার কোনো সমস্যা নাই।’

তার হাসি থামে না।ইজমার বিরক্তি বাড়ে।সে অধৈর্য হয়ে বলে,’এমন ষাঁড়ের মতো হাসছিস কেন?থামবি তুই?রাগ হচ্ছে আমার।’
.
.
.
.
মেয়েটির নাম শাহানা।বয়স বারো।শাহবাগে ফুল বিক্রি করে।গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা।দুই দিকে দুই বেণী করে ফেলে রাখা।বেণীতে আবার লাল ফিতা বাঁধা।গোল গোল মুখটা অদ্ভুত রকমের মায়ায় ভরা।শাহানার বাড়ি নেত্রকোনা।গত বছর সে বাবার হাত ধরে ঢাকায় এসেছে জীবিকার তাগিদে।বাবা একটা ইটের ভাটায় চাকরি করে।আর সে শাহবাগে ফুল বিক্রি করে।

গত দুইদিন যাবত শাহানার মন খারাপ।এখানে কয়েকটা কলেজ পড়ুয়া ছেলে প্রায়ই এসে আড্ডা জমায়।মেয়েদের দেখলেই তারা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে।শাহানাও বাদ যায়নি এসবের থেকে।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য মেয়েদের তারা কেবল মুখেই বাজে ইশারা করে।তবে শাহানাকে প্রায়শই ফুল কেনার নামে বাজে ভাবে স্পর্শ করে।তার মাঝে মাঝে বুক ফেটে কান্না আসে।তারা গরীব হতে পারে।তাই বলে যখন তখন তাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করার অধিকার কারো নেই।সে আর বাচ্চা না।সে কিশোরী।আদর আর অসভ্যতার মাঝের পার্থক্য টুকু শাহানা বুঝে।

সেদিন সে রোজকার মতোন ফুল বিক্রি করছিল।হঠাৎই দু’টো ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।শাহানা প্রথম দেখাতেই বুঝল এরা কেউ ফুল কিনবে না।সে তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে চাইল।একটা ছেলে আচমকা তার হাত চেপে ধরে বলল,’দাম কতো?’

শাহানা চমকায়।আমতা আমতা করে বলে,’গ গোলাপ?একটা বিশ টাকা।’

‘গোলাপ না।তোর দাম কতো?’

শাহানা স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনে।তার দাম মানে?মানুষের আবার কোনো দাম হয় নাকি?ছেলে দু’টোর চাহনি অদ্ভুত।এই চাহনি দেখলেই তার সমস্ত শরীর ঘিন ঘিন করে।সে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল,এতেই বোধহয় হাতের বন্ধন আরো জোরাল হলো।

পাশ দিয়ে একটা ভিআইপি গাড়ি যেতে যেতেই তাদের দেখল।দেখামাত্রই ভেতরে থাকা মানুষটা ড্রাইভারকে ডাকল,’মোতাহের! গাড়ি থামাও।’

সে দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়।গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে ধমকে উঠে,’এ্যাই ছেলে! সমস্যা কি?হাত কেন ধরছিস?’

শাহানা পেছন ফিরে।দেখে তাদের চেয়ে কয়েক হাত দূরে ধূসর রঙের পাঞ্জাবি গায়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখতেই শাহানার দুই চোখে বিস্ময় খেলে।এটা তো একটা নেতা।দুই দিন পর পর সমাবেশে বক্তৃতা দেয়।

আরহাম আরো দুই কদম এগিয়ে আসলো।ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে শাহানার হাত ছেড়ে দিলো।সে তখনো তব্দা খেয়ে আছে।আরহাম সামনে এসেই কটমট করে বলল,’থাপ্পড় চিনিস?বাচ্চা একটা মেয়ে ফুল বিক্রি করছে।অসভ্যতা করছিস কেন?’

ছেলে দু’টো শুকনো ঢোক গিলল।তৎক্ষনাৎ শাহানার কাছে ক্ষমা চেয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল।শাহানার চোখে মুখে তখনো রাজ্যের বিস্ময়।আরহাম চোখ সরু করে বলল,’নাম কি তোমার?’

সে তড়িঘড়ি করে উত্তর দেয়,’শাহানা।শাহানা খাতুন।’

‘ওহহ।ছেলেরা কি রোজ রোজ এমন করে?’

‘হু’

‘এরপর থেকে এমন করলে আমার অফিসে গিয়ে বিচার দিবে।ঠিক আছে?’

বলেই সে ঘুরে দাঁড়ালো।আজকে দুপুরে একটা মিটিং আছে।একটু পরেই মিটিং শুরু হয়ে যাবে।শাহানা তাকে পিছু ডাকলো,’ভাইয়া।’

সে পেছন ফিরে।জিজ্ঞাসু হয়ে শাহানার দিকে তাকায়।সে এগিয়ে এসে প্রশস্ত হেসে বলল,’আপনে অনেক ভালো ভাইয়া।আপনের মতো ভালো নেতা আমি আগে দেখি নাই।আল্লাহ আপনাকে অনেকদিন বাঁচাবে।’

আরহাম ভড়কে গিয়ে বলল,’আমাকে বলছ?আমি কি করলাম?’

‘এই যে আপনে আমাকে দেখে গাড়ি থামালেন।আমাদের জন্য এতো কিছু কেউ ভাবে না ভাইয়া।আপনে খুব ভালো।’

মুহূর্তেই তার মুখে হাসি ফুটল।সে বরাবরই প্রশংসায় গলে যায়।এই প্রশংসাটাও তার মনে ধরেছে।সে শাহানার হাতে থাকা ফুল গুলো দেখে চওড়া হেসে বলল,’এই মেয়ে! তোমার এই ফুল গুলোর দাম কতো?’

‘সবগুলো?’

হ্যাঁ সবগুলো।

‘দুই হাজার টাকা।’

আরহাম মানিব্যাগ বের করল।গুনে গুনে পাঁচটা হাজার টাকার নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’এই নাও।দুই হাজার ফুলের।আর তিন হাজার আমার পক্ষ থেকে সালামি।’

শাহানার চোয়াল ঝুলে গেল।সে বিস্মিত হয়ে বলল,’এতো টাকা বকশিস?কেন?’

আরহাম ঠোঁট চেপে হাসল।মনে মনে উত্তর দিলো,’আমার প্রশংসা করার জন্য।’
অথচ মুখে বলল,’এমনিতেই।তোমাকে দেখে আমার ছোট বোনের কথা মনে পড়েছে তাই।’

শাহানা কাঁপা হাতে টাকাটা নিল।তার দুই চোখ কৃতজ্ঞতায় ভরা।এতোকিছুর মাঝেও সে মনে করে আবার বলল,’আপনে অনেক ভালো ভাইয়া।’

আরো একটা প্রশস্ত,মুখ ভর্তি হাসি।আরহাম প্রচন্ড ফুরফুরা মেজাজে গাড়িতে গিয়ে বসল।এইটুকু?ব্যাস এইটুকু কনসার্ন দেখানো তে মেয়েটা তাকে এতো ভালো বলল?এই সামান্য একটা আচরণে মেয়েটা এতো খুশি হলো?সাধারণ মানুষরা এতো সরল হয় কেন?এতো অল্পতেই নেতাদের প্রতি তারা তুষ্ট হয়ে যায়!

সে হাসি হাসি মুখ করে ব্যাক সিটে গা এলিয়ে দিলো।আচমকা তার ভেতর ভূত চেপেছে।ভালো নেতা হওয়ার ভূত।এর আগে তার সাথে যারা ভালো আচরণ করেছে,তারা সবাই তার ক্ষমতার দাপটে বাধ্য হয়ে ভালো আচরণ করেছে।তাকে শ্রদ্ধা করে,ভালোবেসে এতো সুন্দর আচরণ কেউ করেনি।শাহানার এই সামান্য কৃতজ্ঞতা তার ভেতরে একটা মিষ্টি পরিবর্তন এনে দিলো।

সে সিদ্ধান্ত নিল সে ভালো নেতা হবে।জনমানুষের নেতা।সে পার্টির পোষা কুকুর হবে না।সে হবে জনগণের ভরসার নেতা।ঠিক তার বাবার মতো।লোকে তখন বলবে আজিজ হোসেনের ছেলে ঠিক তার মতোই হয়েছে।আরহাম সামনে দেখতে দেখতে প্রশ্ন ছুড়ে,’মোতাহের! সত্যি করে বলো তো আমাকে তোমার কেমন লাগে?’

মোতাহের থতমত খায়।কোনোরকমে বলে,’ভালোই লাগে স্যার।’

‘তোমার কি মনে হয়,আমি যদি ভালো মানুষ হয়ে যাই,তবে কি তোমার ম্যাডাম আবার আমার কাছে ফিরে আসবে?’

মোতাহের কি জবাব দিবে?সে কেমন করে জানবে ম্যাডাম আসবে নাকি?তবুও সে স্যারকে খুশি করার জন্য বলল,’অবশ্যই আসবে।ম্যাডাম খুব নরম মনের মানুষ।’

আরহাম জবাবে কেবল হাসল।ফোন বের করে নবনীতার হাসি হাসি মুখটা দেখল।এই ছবিটা তার নিজের হাতে তোলা।নবনীতা যখন খালি মুখে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়,তখন আরহামের মনে হয় তার মতো সুন্দর মেয়ে এই পৃথিবীতে দু’টো নেই।সে এই অবস্থায় তার অগণিত ছবি তুলেছে।পুরোনো সেই ছবি গুলো সে মাঝে মাঝেই দেখে।ছবিটা দেখার পরেই সে মুচকি হেসে একহাতে সেটা স্পর্শ করল।অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে বলল,’জানো মোতাহের।তোমার ম্যাডাম তো ব্যবসা করছে।তোমার যদি ঘর সাজানোর জিনিস লাগে তবে তোমার ম্যাডামের কাছ থেকেই নিবে বুঝেছ?’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৬১

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬১)[প্রথম অংশ]

‘ভেতরে আসবো?’
বলতে বলতেই সে দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দেয়।

ইফাজ চোখ তুলে সামনে দেখে।স্মিত হেসে বলে,’ইজমা! আপনি?আসুন না।এনি প্রবলেম?’

ইজমা গালভর্তি হেসে ভেতরে প্রবেশ করল।ইফাজের মুখোমুখি থাকা চেয়ারটা টেনে বলল,’কেমন আছেন আপনি?’

‘আমি ভালো।আপনার কি অবস্থা?হাত নাড়তে পারেন স্বাভাবিক ভাবে?’

‘জ্বী পারি।আজও একটা টেস্ট করিয়েছি।’

‘গুড।’

ইফাজ পুনরায় নিজের কাজে মন দেয়।ইজমা উসখুস করতে করতে বলল,’আপনি কি জ্বর মাপতে পারেন?’

‘সরি?’

‘জ্বর।ফিভার।মাপতে পারেন আপনি?’

‘মাপার কি আছে?হাত দিলেই তো বুঝা যায়।’ অবাক হয়ে উত্তর দেয় ইফাজ।

‘তাহলে আমার কপালে হাত দিয়ে বলুন তো আমার জ্বর আছে নাকি?’

ইফাজ তীর্যক চোখে তার দিকে তাকায়।তারপরই উঠে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে তার কপালে হাত ছুঁয়িয়ে বলল,’জ্বী না ইজমা।আপনার শরীর অনেক ঠান্ডা।কোনো জ্বর নেই আপনার।’

বলে সে আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে।ইজমা পা দোলায়।হাত নেড়ে বলল,’আপনি কি প্রেশার মাপতে পারেন?আমার মনে হচ্ছ আমার প্রেশারও বেড়ে গেছে।’

ইফাজ ঠোঁট টিপে হাসল।মাথা নেড়ে জানালো,’প্রেশার যেকোনো ডাক্তারই মাপতে পারে।এটা আমাদের থার্ড ইয়ারেই শেখানো হয়।আপনি কি প্রেশারও মাপবেন?’

‘জ্বী।’

ইফাজ মাথা নামিয়েই একগাল হাসল।কোনো কথা না বাড়িয়ে ইজমার প্রেশার মেপে সে গাঢ় স্বরে বলল,’নো মিস।আপনার প্রেশারও একদম নরমাল।আপনি পুরোপুরি সুস্থ একজন মানুষ।’

ইজমা হতাশ হলো।তার পাংশুটে মুখখানা দেখেই ইফাজ বড় বড় চোখ করে বলল,’সেকি! মন খারাপ কেন?সুস্থ হওয়া কি কোনো মন খারাপের বিষয়?’

ইজমা সে কথার জবাব দেয় না।কতোক্ষণ থম মেরে বসে থেকে শেষে ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহন করে ইফাজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল।আশ্চর্য! তার শরীর আজ এতো সুস্থ কেন?সে কি একটু অসুস্থ হতে পারতো না?তাহলে তো সেই অসুস্থতা নিয়ে ইফাজের সাথে অহেতুক বকবক করা যেত।

সে যেতেই ইফাজ শব্দ করে হেসে ফেলল।একহাত মাথার পেছনে নিয়ে দরজার দিকে দেখতে দেখতে বলল,’অসুখ তো একটা হয়েছে আপনার ইজমা।কিন্তু সেটা জ্বর কিংবা প্রেশারজনিত না।বিষয়টা তার চেয়েও জটিল।’

______________________________________________

এপার্টমেন্টের সামনে আসতেই আপনাআপনি কপাল কুঁচকে এলো ওয়াজিদের।অন্য সময় দরজা পর্যন্ত আসতেই ভেতরের হই হুল্লোড়ে তার কানে তালা লাগার মতো অবস্থা হতো।অথচ আজ বাড়ির অবস্থা একদমই ঠান্ডা।ভেতর থেকে কোনো শব্দ পর্যন্ত বের হচ্ছে না।সে বিচলিত হয়ে দ্রুত চাবি ঘুরিয়ে লক খোলে।

এপার্টমেন্টে পা রেখে সে আরো এক দফা বিস্মিত হয়।পুরো বাড়ি আধার করে রাখা।এখনো বাতি জ্বালানো হয়নি।দেখে মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ নেই।সে তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করে রিমিকে ফোন দিলো।কোথাও গেল নাকি তারা?

কাছে কোথাও টুংটুং শব্দে মোবাইল বেজে উঠে।ওয়াজিদ কপাল কুঁচকে বলল,’রিমি! আছো তুমি এদিকে?’

সে বিভ্রান্ত হয়ে আরো দুই পা সামনে বাড়ায়।আচমকা কানের কাছ থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠল,’হ্যাপি বার্থডে!’

হকচকিয়ে গেল ওয়াজিদ।লাফিয়ে দুই পা পিছিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে।হাত তার আপনাআপনি বুক পর্যন্ত উঠে এলো।ক্ষণিক বাদেই ঘরের সবগুলো বাতি জ্বল জ্বল করে জ্বলে উঠল।ওয়াহিদুল সাহেব এক কোণায় দাঁড়িয়ে ভারি গলায় বললেন,’শুভ জন্মদিন বাবা।’

তার পাশেই শীলা।তার পরণে খয়েরি রঙের একটা শাড়ি।ওয়াজিদ তাকে দেখতেই তিনি হাসিমুখে বললেন,’শুভ জন্মদিন আব্বু।জীবনে অনেক বড় হও।’

আশ্চর্যে তার চোয়াল ঝুলে যায়।বড় বড় চোখ করে সে সবাইকে দেখে।চোখ যায় ডানপাশে,তার থেকে কয়েক হাত দূরে।একটি মিষ্টি মতোন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার হাতে একটা কেক,মুখে তার সবসময়ের মতো চওড়া হাসি।ওয়াজিদের সাথে চোখাচোখি হতেই সেই হাসি আরো প্রশস্ত হলো।উৎফুল্ল স্বরে সে বলল,’শুভ জন্মদিন ওয়াজিদ।মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অব দ্য ডে।’

আজকের তারিখটা মনে করার চেষ্টা করল ওয়াজিদ।ওহ হ্যাঁ।আজ তো তার জন্মদিন।দুই দিন আগেও মনে ছিল,এখন আর মনে নেই।মুহূর্তেই তার মন ভালো হয়ে গেল।সে ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে খানিকটা লাজুক হেসে বলল,’থ্যাঙ্ক ইউ।’

জন্মদিন উপলক্ষে তেমন কোনো আয়োজন নেই।রিমি একটা কেক অর্ডার করেছে।শীলা পোলাও আর রোস্ট রান্না করেছে।ওয়াহিদুল সাহেব কয়েক রকমের মাছ কিনেছেন।এর মধ্যে শীলা রান্না করেছেন রূপচাঁদা আর রুই মাছ ভাজা।

সেই রাতে সবাই একসাথেই খেলো।এই মুহূর্তটা কি দারুণ না?ওয়াজিদের দারুণ লাগে।খেতে খেতে শীলা আর ওয়াহিদুল ওয়াজিদের ছোট বেলার নানা গল্প,নানা স্মৃতিচারণে মশগুল হলেন।ওয়াজিদ মাথা নামিয়ে সেসব কথা শুনে।মাঝে মাঝে লজ্জায় তার মাথা হেট হয়।রিমির সামনে এসব কথা বলার কোনো মানে আছে?মা বাবা কি কিছুই বুঝে না?

রাতের খাবার শেষে সবাই মিলে কেক কাটলো।ওয়াজিদ সবাইকে নিজ হাতে একটু একটু কেক খাওয়ায়,রিমিকেও।ওয়াহিদুল আর শীলা কিছুক্ষণ পর তাদের ঘরে চলে গেলেন।পড়ে রইল কেবল ওয়াজিদ আর রিমি।একবার মা বাবার ঘরের দিকে দেখেই ওয়াজিদ সামনে ফিরে।কেকের উপর থেকে সামান্য পেস্ট্রি হাতে তুলে চট করে রিমির গালে মাখায়।

চমকে উঠে সামনে দেখল রিমি।মুখ হা করে নিজের গালে হাত রেখে সে ওয়াজিদের দিকে তাকায়।দু’জনের চোখাচোখি হতেই ওয়াজিদ তার হাত টেনে ধরল।গাঢ় স্বরে বলল,’তা কি যেন বলছিলে তুমি?’

একরাশ অস্বস্তি জেঁকে ধরল রিমিকে।ওয়াজিদ কাছে আসতেই যেন কয়েকটা হৃদস্পন্দন মিস হলো।কন্ঠ শুকিয়ে কাঠ।আমতা আমতা করে সে জবাব দেয়,’কই কিছু বলিনি তো।’

ওয়াজিদ সামান্য ঝুকে তার কপালে কপাল ঠেকায়।ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,’রিমি! আর ইউ লিসেনিং?’

রিমি কি উত্তর দিবে?তার তো গলা বসে যাচ্ছে।মন চাচ্ছে চিৎকার করে বলতে,’ইয়েস আই অ্যাম লিসেনিং।’কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সে মাথা নেড়ে মিনমিনে স্বরে বলল,’হু।’

ওয়াজিদ মুচকি হাসে।হাস্কি গলায় বলে,’Anata o aishitemasu’

রিমি ভড়কে গিয়ে বলল,’জ্বী?’

হাসি চওড়া হয় ওয়াজিদের।একহাতে রিমির কানের পেছনে এক ফালি চুল গুজে দিয়ে বলল,’কালকে গুগল করে দেখবে কেমন?’

‘জ্বী আচ্ছা দেখব।’

ওয়াজিদ তার গালের সাথে আলতো করে নিজের গাল চেপে ধরল।রিমির মনে হলো রিমি এখুনি দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাবে।সে টেনে টেনে কিছুক্ষণ শ্বাস নেয়।ওয়াজিদ আগের মতো করেই জানতে চায়,’আমাকে তোমার কেমন লাগে রিমি?’

রিমি ছটফট করে উঠল।বুক ধুকপুক করছে তার।আনত স্বরে সে উত্তর দেয়,’ভালো লাগে।’

‘কতোখানি?’

রিমি বোকা বোকা হয়ে তার দিকে তাকায়।এর উত্তর সে কিভাবে দিবে?অনেকক্ষণ চুপ থেকে শেষে লাজুক হেসে সে জবাব দিলো,’যতোখানি ভালো লাগলে কেউ পাত্তা না দেওয়া স্বত্তেও তার পেছন পেছন ঘুরা যায়,ততখানি ভালো লাগে।’

ওয়াজিদ ভ্রু কুঁচকায়।
‘আমি তোমায় পাত্তা দেই না?’

‘জ্বী না।’

‘এতো বড়ো অপবাদ?’

দু’জন সমস্বরে হেসে ফেলল।ওয়াজিদ তার গালে আলতো করে চুমু খায়।রিমির ঘন ঘন নিশ্বাস তার মুখে এসে পড়ছে।সে জড়ানো মোহাবিষ্ট কন্ঠে বলল,’আমি তোমায় পাত্তা দেই না বিষয়টা একদমই এমন না।তুমি যে আমার পেছন পেছন ঘুরে এতো রকম কথা বলো,এই বিষয়টা আমার দারুণ লাগে।আই ফিল ইউ গার্ল।’

রিমির মনে হলো তার অনুভূতি সব দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে গেছে।তার হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে মাটি ফাঁক করে যদি ভেতরে ঢোকা যেত,তবে এক্ষুনি সে সেখানে ঢুকে বসে থাকতো।

‘আমাদের বিয়ের কয়দিন হয়েছে রিমি?’

রিমির ধ্যান ভাঙে।কাঁপা গলায় সে জবাব দেয়,’এই তো দেড় মাস বোধহয়।’

ওয়াজিদ আর কিছু জানতে চাইল না।আচমকাই দুই হাতে তাকে পাজাকোলা করে তুলে নিল।রিমি প্রথমে হতভম্ব হলো,শেষে ধাতস্থ হয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল।তার সব তালগোল পাকাচ্ছে।ওয়াজিদ কাছে এলেই তার সব তালগোল পাকিয়ে যায়।নবনীতার বিয়ের দিন থেকে তার মনে ওয়াজিদের জন্য সুপ্ত অনুভূতি ছিল।এই কথা কি তার ওয়াজিদ কে বলে দেওয়া উচিত?ওয়াজিদ তাকে খারাপ ভাববে না তো?

ঘরে আসার পরেই ওয়াজিদ তাকে খাটে নামিয়ে আবারো তার কাছাকাছি গিয়ে বসল।রিমির মনে তখন কালবৈশাখীর ঝড়।মন চাচ্ছে ওয়াজিদকে সেই ঝড় দেখাতে।কিরকম অস্থির অস্থির লাগছে সব।

সেই রাতে দু’জন সত্যিকার অর্থে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ককে একটা পূর্ণতা দিলো।ওয়াজিদ তার সহধর্মিণীর ভীষণ কাছে গেল।যতখানি কাছে যাওয়ার জন্য একটা সম্পর্কের নির্দিষ্ট বৈধতা থাকা বাঞ্ছনীয়,ঠিক ততখানি কাছে।আর রিমি লজ্জায়,জড়তায়,স্বামীর ভালোবাসায় রীতিমতো রক্তিম হচ্ছিল।তার আরক্ত মুখটা দেখেই ওয়াজিদ একগাল হাসল।রিমির সাথে বিয়ের মতো দুর্ঘটনা যদি তার জীবনে না ঘটতো,তবে জীবন কখনোই এতো সুন্দর হতো না।সে রিমির কপালে প্রগাঢ় চুম্বন খেয়ে বলল,’সেদিন সত্য বলে ধরা খাওয়ানোর জন্য তোমায় ধন্যবাদ।আর সবকিছুর শেষে আমাকে বিয়ে করার জন্য আরো একটা ধন্যবাদ রিমি।’
.
.
.
.
নবনীতার চাকরি হয়েছে একটা কলেজে,পদার্থবিজ্ঞানের গেস্ট টিচার হিসেবে।রোজ সকাল আটটায় তাকে বের হতে হয়।বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ছয়টা।কলেজ শেষ হওয়ার পরেও অনেকটা সময় তাকে অন্য কাজ করতে হয়।নবনীতার অবশ্য তাতে আপত্তি নাই।বেতনের টাকা টা কল্পনা করলে এসব কষ্ট আর কষ্ট বলে মনে হয় না।

রোজকার মতো আজও সে কলেজ শেষ হওয়ার পর তার ডেস্কে বসে কাজ করছিল।শুরুতে তার সাথে আরো অনেকেই ছিল।বেলা গড়াতেই আস্তে আস্তে মানুষ কমতে শুরু করল।নবনীতা একবার পাশ ফিরে আশপাশ দেখল।তার কলিগ কেউই আপাতত এখানে নেই।জায়গা টা কেমন নিরব।গা ছমছম করার মতো।সে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে।আর মাত্র আধঘন্টা।তারপর সে নিজেও বেরিয়ে যাবে এই নিরব নিস্তব্ধ অফিসরুম থেকে।

সাইফুল সাহেব একটা ঢোক গিলে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন।তার দৃষ্টি একেবারে কোণার দিকে ডেস্কে বসে থাকা মেয়েটার দিকে।তার পরণে নীল সুতির শাড়ি।কি সুন্দর গায়ের গড়ন।তিনি জিভ দিয়ে দুই ঠোঁট ভেজান।একবার চোখ রাখেন তার কোমরের দিকে।মুহুর্তেই কেমন মাদকতা আর অস্থিরতা জেঁকে ধরল তাকে।তিনি এগিয়ে যান।তার লোলুপ দৃষ্টি মেয়েটার সমস্ত অঙ্গে বিচরণ করছে।কাছে গিয়েই তিনি সহসা একহাত তার কাঁধে রাখলেন।

মুহূর্তেই ছিটকে দূরে সরে আসে নবনীতা।এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।বিস্ময়ে তার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।সেকেন্ডের মাথায় তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়।সে তেঁতেঁ উঠে বলল,’এসব কেমন অসভ্যতা?দূরে যান।’

তার কথায় সাইফুলের কোনো হেলদোল হলো না।তিনি উল্টা কুটিল হেসে বললেন,’আহা নবনী! কাম অন।কেউ কিছু জানবে না।জাস্ট তুমি আর আমি।’

নবনীতা আরো দুই পা পেছায়।ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে সামনে দেখেই কটমট করে বলে,’একটা চড় দিব ধরে।বেয়াদব কোথাকার!’

সে সাথে সাথে সবকিছু গুছিয়ে নেয়।এখানে আর এক মুহূর্তও না।দরকার পড়লে কাল সে ওভারটাইম করবে।কিন্তু এখানে আর কিছুতেই থাকবে না।সে সবকিছু গুছিয়ে সামনে এগোতেই সাইফুল সাহেব খপ করে তার আঁচল টেনে ধরলেন।নবনীতা পেছন ফিরে স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকায়।মুহূর্ত গড়াতেই তার একহাত গিয়ে সপাটে চড় বসালো সাইফুলের গালে।

সাইফুল গালে হাত রেখেই অগ্নিচোখে তার দিকে তাকায়।নবনীতা একটানে নিজের আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে কড়া গলায় হুংকার তুলে,’একদম জেলের ভাত খাওয়াবো বলে দিলাম যদি আর এই দুঃসাহস দেখিয়েছেন তো।’

সাইফুলের গায়ে জ্বালা ধরল ভীষণ।এতো দেমাগ এই মেয়ের?এই একা ঘরেও সে এতো সাহস দেখাচ্ছে কেমন করে?সে দাঁত কিড়মিড় করে এগিয়ে যায়।দুই হাতে নবনীতার কনুই চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’দরকার হয় আমি জেলের ভাত খাবো,তার আগে তোকে ভোগ করব।’

নবনীতা আঁতকে উঠে তার দিকে তাকালো।এই মুহূর্তে তার সমস্ত শরীর ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে।সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে চেঁচিয়ে উঠে,’ছাড়ুন।আপনি একজন শিক্ষক।মাথা খারাপ আপনার?’

সাইফুল খেঁকিয়ে উঠল,’শিক্ষক তো কি হয়েছে?পুরুষ না আমি?এই শরীর দেখলে কি আমাদের কামনা জাগে না?বললাম তো কেউ জানবে না।শুধু তুমি আর আমি।তাতে এতো সমস্যা কি?এমনিতেই তো জামাই তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে।আমার সাথে কিছু করলে তো কেউ তোমায় কিছু বলবে না।’

নবনীকার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।সাইফুল তাকে যেভাবে ধরেছে সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া অসম্ভব।সে তবুও গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দেয়,চিৎকার করে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সাহায্য চায়।ফলাফল শূন্য।সাইফুলের পুরুষালি শক্তির কাছে যখন সে পুরোপুরি পরাজিত হয়ে যাচ্ছিল তখন একটা কথাই তার মাথায় আসলো।

‘আমার ছায়া থেকে বেরিয়ে দুনিয়াতে চলতে শেখো না।তখন দেখবে দুনিয়া কি জিনিস।হায়নারা তো সব খুবলে খাবে।তখন বুঝবে বর কি জিনিস।’

নবনীতা শব্দ করে কেঁদে ফেলল।মানুষটা রাগের মাথায় কথাটা বলেছিল।কিন্তু ভুল কিছু বলেনি।এই এতোগুলো মাসে কেউ কোনোদিন আড়চোখেও তাকে দেখার সাহস করেনি।আজ দেখছে,নিস্তব্ধ জনমানবশূন্য অফিসরুমে তার সম্মান আর সম্ভ্রমে হাত দিয়ে তাকে কলুষিত করতে চাইছে।শক্তিতে সে ভীষণ দুর্বল।কিভাবে সে এদের সাথে পেরে উঠবে?

সে শেষ মুহূর্তে আর কোনো উপায়ান্ত না দেখে গলা ছেড়ে চিৎকার করলো।তার দুর্বল শরীরটা মাটিতে ঢলে পড়ার আগেই অকস্মাৎ বিকট শব্দে কেউ দরজা খুলল।মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে নবনীতার চোখ জোড়া ছলকে উঠে তাকে দেখল।দেখতেই তার মুখে হাসি ফুটল।সে বিড়বিড় করে আওড়ায়,’আরহাম! আপনি এসেছেন?সত্যিই আপনি এসেছেন?’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে[তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬১)[দ্বিতীয় অংশ]

‘পরী’

দখিনের জানালা খোলা।বসন্তের সুন্দর বাতাস সেই জানালা দিয়ে সুড়সুড় করে ভেতরে প্রবেশ করছে।ঘরের বাতি নিভিয়ে রাখা।চাঁদের আলোতে যতখানি দেখা যায়,ঠিক ততটুকুই দেখা যাচ্ছে।নবনীতা বসেছে খাটের মাঝামাঝি দুই হাঁটু ভাঁজ করে।হাঁটুর ভাজেই কপাল ঠেকানো।তার শরীর স্বাভাবিকের চাইতে একটু গরম।জ্বর আসবে বোধহয়।সে জবাব দিলো না।যেভাবে বসেছিল সেভাবেই বসে রইল।

আরহাম বসেছে তার একদম সামনে।খাটে না,একটা টুলে।তিনবার ডাকার পরেও যখন মেয়েটা কোনো সাড়া দিলো না,তখন সে আর অহেতুক ডেকে শক্তি অপচয় করলো না।কেবল মাথা নামিয়ে নিজের হাতটা দেখল।উফফ! জ্বলছে ভীষণ।ঐ সাইফুল কে মারতে মারতে তার হাত ব্যাথা হয়ে গেছে।শেষে যখন কিল ঘুষি মেরেও কাজ হচ্ছিল না,তখন সোজা তার মাথা ফাটিয়েছে সে।আইন আদালত নিয়ে সে ভয় পায় না।এসব তার অনুকূলেই থাকবে।ক্ষমতার এইতো সুবিধা। নিজের খেয়ালখুশি মতো যা মন চায় করা যায়।

সে মাথা না তুলেই বলল,’কেমন আছো পরী?রাগ কমেছে তোমার?’

নবনীতা নিশ্চুপ।কিছুক্ষণ জড়ো পদার্থের ন্যায় চুপ থেকে শেষটায় ঠান্ডা গলায় বলল,’আপনি যান এখান থেকে।’

আরহাম চোখ তুলে।গভীর মনোযোগ দিয়ে তার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করে।গাঢ় স্বরে প্রতিউত্তর করে,’জেদ ছেড়ে দাও পরী।অনেক হয়েছে।বাড়ি চলো।’

‘যাব না আমি।’ এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে জবাব দেয় সে।

‘বেশ।তো কি করবে এখন?কিভাবে চলবে?বলেছিলাম না মেয়ে মানুষ একা দুনিয়ায় চলতে পারে না।মিলল তো আমার কথা?’

তার কন্ঠে দম্ভ,স্পষ্ট অহংকারের ছাপ।সে জয়ী,নবনীতা পরাজিত।হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়েই নবনীতা ক্লান্ত স্বরে বলল,’আপনি না আসলেও আমি কোনো না কোনো ভাবে ঠিকই নিজেকে রক্ষা করতাম।’

‘কিভাবে?’
আরহাম বিদ্রুপ করে বলল,’সুপার ওম্যান নাকি তুমি?যেভাবে ঐ কু’ত্তার বাচ্চা তোমাকে ধরেছিল,নড়তেও তো পারছিলে না।’

‘সে যাই হোক।আল্লাহ বাঁচাতো আমায়।’

‘আল্লাহ কেন বাঁচাবে?আল্লাহ কি বলেছে স্বামীর সাথে জেদ দেখিয়ে এমন বেডাগিরি করতে?’

‘বেডাগিরি কখন করেছি?’

‘আমার সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও তুমি আবার এসব চাকরি করছো কেন?এতো জেদ কেন ধরছো?আল্লাহ তো এসব করতে বলেনি।’

‘ওহহ আচ্ছা।আল্লাহ বলেছে বউকে থাকার খোঁটা দাও,খাওয়ার খোঁটা দাও,যোগ্যতার খোঁটা দাও।তাই না?’

আরহাম চুপ থাকলো কিছুক্ষণ।কতোক্ষন মেঝেতে পা দিয়ে আঁচড় কেটে অবশেষে অতিমাত্রায় ক্ষীণ স্বরে বলল,’আই অ্যাম সরি।এবার চলো।’

নবনীতা হাঁটুর কাছ থেকে মাথা তুলল।তার হঠাৎই হাসি পেল ভীষণ।সে এলোমেলো হেসে বলল,’সরি বলতে এতো জড়তা আপনার?’

‘বেশি কথা বলবে না।বাড়ি চলো।’

‘আমি যাব না।’

‘বাড়াবাড়ি করছো পরী।’

‘আমি এমনই।’

আরহাম কটমট করে বলল,’মামার পেনশনের টাকা দিয়ে এতো ভাব নিচ্ছ।বসে বসে খেলে তো রাজার সম্পদও ফুরায়।আর তোমার এই কয়টা টাকা ফুরাতে কয়দিন?’

‘যতদিনই হোক।আগে ফুরাক,তারপর দেখা যাবে।আমাদের টাকা হালাল,কম হলেও দেরিতে ফুরায়।’

আরহাম খেঁকিয়ে উঠল,’আর আমার টা কি হারাম?’

নবনীতা ঠোঁট উল্টে বলল,’কে জানে! আপনি নির্বাচনে জেতার আগ পর্যন্ত বোধহয় হালালই ছিলো।এখন কি জানি না।’

‘আমি কোনো চিটার বাটপার না পরী।আগেও বলেছি,এখনো বলছি।’

‘আর আমি কোনো জন্ম পরিচয় বিহীন কুকুর বিড়াল না।মন চাইলো আর অপমান করবেন,মন চাইল আর ভালোবাসবেন।আর্থিক ভাবে দুর্বল হলেও এতোটা ছাপোষা আমি না।’

আরহাম তপ্ত শ্বাস ছাড়ল।কন্ঠে অতিমাত্রায় কোমলা ঢেলে বলল,’সরি বলছি তো পরী।মাথা ঠিক ছিলো না আমার।আর এমন হবে না।বাসায় চলো।সব বুঝিয়ে বলছি।’

নবনীতা তাকালো,একদম তার চোখ বরাবর।তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।
‘এই এক কথা শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে।আর এমন হবে না,আর এমন হবে না।আর কতোবার এক কথা শুনবো?এমনই তো হয়ে আসছে আরহাম।আমি একটু শান্তি চাই।প্লিজ আপনি এমন হুটহাট বাড়িতে চলে আসবেন না।ভালো লাগে না আমার।এই বাড়ি,এই বাড়ির সব ফার্নিচার,আমার পরনের সব শাড়ি আমার নিজের টাকায় কেনা,কয়েকটা অবশ্য মামার টাকায় কেনা।কিন্তু আপনার টাকার কিচ্ছু এখানে নেই।যা ছিলো সব আগের বাসার ওয়্যারড্রবে রাখা।’

বলা শেষ করেই সে আরেক দফা হাসল।আরহাম একটা শুকনো ঢোক গিলল।গম্ভীর কিন্তু অনুতপ্ত সুরে বলল,’পরী তখন আমার মাথা ঠিক ছিলো না।বারবার বিষয় গুলো এভাবে প্রেজেন্ট করছো কেন?আই ফিল আনকম্ফোর্টেবল।’

‘এন্ড আই ফিল ইনসাল্টেড।মনে পড়লে নিজের উপরই কেমন ঘিন ঘিন লাগে।কেন চাকরিটা ছেড়ে দিলাম?কেন নিজেকে এতোটা পরনির্ভরশীল বানালাম?কোনো কেনো’র ই উত্তর নেই আমার কাছে।’

সে পুনরায় হাঁটুতে মুখ গুজে।ধরে আসা গলায় কোনোরকমে বলে,’আপনি সত্যিটা মেনে নিন আরহাম।আপনি যেমন করে আশা করছেন আমি সবটা ভুলে যাব,এটা আসলে সম্ভব না।সবটা ভুলতে হলে আমার আগে নিজেকেই ভুলতে হবে।সেটা সম্ভব না।আপনি যদি এই সম্পর্ককে ন্যুনতম সম্মান করে থাকেন,তবে আমার এই সিদ্ধান্তকেও সম্মান করুন।একটু স্পেস চাই আমার।প্লিজ।নিজের কাছে যেই অপরাধবোধ হচ্ছে আমার,সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি চাই।আপনি আসুন।আমাদেরকে আমাদের মতো ছেড়ে দিন।যিনি আমাদের সর্বশূন্য করেছেন,তিনিই আমাদের টিকে থাকার ব্যবস্থা করবেন।আপনাকে এতো ভাবতে হবে না এসব নিয়ে।যান আপনি।’

আরহাম কতোক্ষণ তাকে দেখল।শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।মন চাইছে ঠাস ঠাস কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে।তবুও দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে রাগটুকু গিলে নিলো।তার মুষ্টিবদ্ধ হাত নবনীতার নজর এড়ালো না।সে মাথা নামিয়ে বলল,’ভুল আপনি একা করেন নি।আমিও করেছি।গায়ে হাত দেওয়া আমার ভুল ছিলো।সম্ভব হলে ক্ষমা করে দিবেন।’

আরহাম তার দিকে ফিরে তাচ্ছিল্য করে বলল,’সরি বললেই মিটে গেল?আমি যেমন আমার কথা ফিরিয়ে নিতে পারব না,তুমি পারবে ঐ কাজগুলো ফিরিয়ে নিতে?আমি যদি মেইডদের সামনে তোমায় ঠাটিয়ে চড় মারতাম তবে কেমন লাগতো তোমার?’

আরহাম আর কথা বাড়ালো না।বলতে গেলেই তার সমস্ত শরীর রাগে রিরি করে।সে না হয় হঠকারিতা করে।পরী সেদিন যেটা করল ঐটা কি খুব ভালো কাজ?বড় বড় পা ফেলে সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।দরজার কাছেই চিত্রা দাঁড়িয়েছিল।আরহাম তাকে দেখতেই হাঁটু মুড়ে বসল।তার গালে হাত রেখে বলল,’কি পাখি?কেমন আছো?তুমি যে এতো গুলো দিন আমায় ফোন দিলে না একবারো,আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করেছি।’

চিত্রা নখ কামড়াতে কামড়াতে নবনীতার দিকে তাকায়।তার অসহায় চোখ জোড়া দেখেই আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’আপাই ফোন করতে দেয়নি তাই না?’

সে এক টানে চিত্রাকে কোলে তুলে নেয়।কপালে টপাটপ চুমু খেয়ে বলে,’ভাইয়া তোমাকে অনেক মিস করেছি সোনা।আরশাদও মিস করেছে।’

চিত্রা একটু লজ্জা পেল বোধহয়।সে এখন স্কুলে পড়ে।ভাইয়া তাকে আরশাদের মতোন হুটহাট কোলে নেয় কেন?সে কি বাবু নাকি?সে নিচু গলায় বলল,’ধুর! আরশাদ কি অতোকিছু বুঝে নাকি?’

‘বুঝে বুঝে।তোমাকে চিনে তো।চোখ দিয়ে তোমাকে খুঁজে।তুমি যাবে আরশাদের সাথে দেখা করতে?’

চিত্রা অসহায় গোল গোল চোখে নবনীতার দিকে তাকায়।ব্যাপারটা বুঝতেই আরহাম বলল,’আচ্ছা থাক যেতে হবে না।পরে কোনোদিন যাবে।এখন বলো কি খাবে?চকলেট,চিপস,নাকি আইসক্রিম?নাকি সবগুলোই?’

আরো একটা মলিন,অসহায় চাহনি।চিত্রার ছটফটে মুখটা দেখেই আরহামের মায়া হলো।সমস্যা চলছে তার আর নবনীতার মাঝে।মাঝখানটায় এই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা কেন দোটানায় পড়ছে?

নবনীতা খাট থেকেই চেঁচিয়ে উঠল,’কিছু খাবে না চিত্র।বলো আমাদের যা আছে তাই নিয়ে আমরা খুশী।আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।আমার দুই বোন যার তার টাকায় চলে না।’

আরহাম থমথমে মুখে একবার তার দিকে তাকালো।তারপর আবার ঘুরে চিত্রার দিকে ফিরে বলল,’চলো আমরা একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি।’

চিত্রা কিছুক্ষণ চুপ থাকল।তারপর গোল গোল চোখ করে বলল,’আমি যদি তোমার থেকে চকলেট আর চিপস নেই তাহলে কি তুমি ভাববে আমি শুধু টাকার জন্যই তোমাকে পছন্দ করি?’

দ্রুত মাথা তুলে নবনীতা।কি সর্বনাশ! চিত্র সব কথা এমন জায়গা মতো ফাঁস করে দিচ্ছে কেন?তার প্রশ্ন শুনেই আরহামের চোখ মুখ শক্ত হলো।সে কটমট করে জানতে চাইল,’কেন?তোমার এমনটা কেনো মনে হয়েছে?’

‘আপাই বলেছে কারো থেকে চকলেট চিপস না নিতে।কারণ এগুলো তারা আমাদের ভালোবেসে দেয় না,আমাদের যে টাকা কম তাই খোঁটা দেওয়ার জন্য দেয়।”

একহাত আপনাআপনি কপালে গিয়ে ঠেকলো নবনীতার।বিড়বিড় করে বলল,’চিত্র রে! তোর গাড়িতে ব্রেক দে এক্ষুনি!’

আরহাম আর সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না।কেবল কটাক্ষ করে বলল,’তোমার সবজান্তা আপাই এসব কথা বলেছে তাই না?যাক গে।তুমি চলো ভাইয়ার সাথে।আমরা একটু ঘুরে আসি।সে ঘরে থাকুক।ঘরে থেকে সে বিশ্বজয় করুক।’

সে চিত্রাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সাথে সাথে।নবনীতা সেভাবেই আগের মতো হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকলো।হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসছে তার।আরহাম কি করে জানলো যে এটাই তার বাসা?তার কলেজ পর্যন্তও বা পৌঁছুলো কি করে?সে একটা ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ে।মানুষকে প্রতি মুহূর্ত ট্রেস করার স্বভাব তার আর যাবে না।
.
.
.
.
‘আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো মনোরোগে ভুগছি।’ দুই হাত ডেস্কে রেখে সামান্য ঝুঁকে কথাটা বলল ইজমা।

ইফাজ ফাইল চেক করার ফাঁকে ফিচেল হাসল।চোখ না তুলেই বলল,’বাপরে! জটিল বিষয়।’

‘জ্বী।অনেক বেশি জটিল।আপনি কি আমার সমস্যা টা ধরতে পারবেন?’

ইফাজ মাথা নাড়ল।
‘জ্বী না মিস।আমি কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট নই।আমি আপনার মনের অসুখ ধরতে পারব না।’

ইজমা কিছুটা হতাশ হলো।গালের নিচে হাত রেখে বলল,’আচ্ছা তাহলে কোনো ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের খোঁজ দিন আমায়।’

‘আপনি ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে কি করবেন?আমেরিকাতে এর চেয়ে অনেক ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট আছে।ফিরে গিয়ে তাদের কাউকে দেখিয়ে নিবেন,তার সাথে কনসাল্ট করবেন।কেমন?’

ইজমা অন্যদিকে ফিরে ভেঙচি কাটে।এই লোক একবারো চোখ তুলছে না কেন?সে আরো কিছুক্ষণ উসখুস করল।মাথা চুলকে বলল,’এমনিতে প্রাথমিকভাবে আপনার কি মনে হয়?আমার সমস্যা টা আসলে কি?’

ইফাজ ফাইল থেকে চোখ সরালো।ইজমাকে দেখে ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’সমস্যা টা জটিল।আমার অনুধাবনের বাইরে।’

‘এতে কি আমার মরে যাওয়ার কোনো চান্স আছে?’

ইফাজ মুচকি হাসল।
‘জ্বী না।তবে বৈরাগী হওয়ার চান্স আছে।’

ইজমা লজ্জা পেল খানিকটা।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,’আমি আসি তাহলে।’

সে দরজার কাছে যেতেই ইফাজ তাকে পিছু ডাকল,’দাঁড়ান ইজমা।’

সে ঘুরে দাঁড়ায়।তার আরক্ত মুখখানা দেখেই ইফাজ স্মিত হাসে।বলপয়েন্ট কলমটা গালের সাথে চেপে ধরে বলে,’আবার আসবেন ইজমা।সমস্যা যেটাই হোক,আমি সমাধানের চেষ্টা করব।আর সমস্যা না থাকলেও আসবেন।আমার ধারণা সমস্যা টা মূখ্য বিষয় না,বরং আমার সাথে সাক্ষাৎ হওয়াটাই মূখ্য।’

ইজমা পুনরায় ঘুরে দাঁড়ায়।সে ধরা পড়ে গেছে।একটু আগেও তার ভেতর কোনো জড়তা কাজ করছিল না।এখন করছে।সে সিদ্ধান্ত নিল সে আর পেছন ফিরবে না।ফিরলেই অস্বস্তিতে পড়বে।সে তাড়াতাড়ি সামনের দিকে পা বাড়ায়।যেতে যেতে শুনলো ইফাজ পেছন থেকে খানিকটা চওড়া গলায় বলছে,’কাল আবার আসবেন ইজমা।আমি অপেক্ষা করব।’
.
.
.
.
‘তুই এক কাজ কর।তুই নারায়ণগঞ্জে একটা বাড়ি কিনে ফেল।তারপর সেখানেই থাকা শুরু কর।সব মিটিং ভার্চুয়ালি করবি।আর সারাদিন বউয়ের উপর নজর রাখবি।ভালো না আইডিয়া টা?’

আরহাম সোফায় বসে চা খাচ্ছিল।আদি তার পাশে বসতে বসতে কথাটা বলে তার দিকে তাকালো।সে বিরক্তি হলো ভীষণ।কপাল কুঁচকে বলল,’বাজে বকিস না তো।তুই জানিস সেদিন আমি লেইট করলে কি হতো?’

‘না জানি না।জানতে চাইও না।যা হওয়ার হতো।তুই তো বলেই দিয়েছিস নবনীতার যা খুশি হোক,তোর কিছু যায় আগে না।এখন এতো জ্বলছে কেন?’

আরহাম ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে আরো একটা চুমুক দিলো।শ্বাস ছেড়ে বলল,’আর কয়বার মাফ চাইলে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে?’

আদি একটা হাত তার কাঁধে রাখল।ঠান্ডা গলায় বলল,’এতো অধৈর্য হচ্ছিস কেন?সময় দে একটু।টাইম হিলস এভরিথিং।’

‘আর কতো টাইম?মাস গড়িয়ে যাচ্ছে।’

‘যাক না।এই একমাসে তুই কি কি পরিবর্তন এনেছিস নিজের মাঝে আমাকে বল।’

আরহাম কটমট চোখে তার দিকে তাকালো।চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’তাকে আমি চাইলে সেদিনই আমার সাথে নিয়ে আসতে পারতাম।নবনীতাকে আমি অনেক ভাবেই পরাজিত করতে পারি আদি।সে যেই কলেজে চাকরি করে সেখানের প্রিন্সিপালকে যদি আমি একবার কল দেই,তাহলে পরের দিনই তার চাকরি থাকবে না।আমি সেটা করিনি।আমার নির্লিপ্ততাই কি আমার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন না?সে আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে।যাকগে,তার বয়স অল্প,বুঝজ্ঞান কম।বুঝজ্ঞান থাকলে বুঝতো যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে,যোগ্যতায় তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।থাক,সে কথা আর বলছি না।করুক চাকরি,আমার আপত্তি নেই।কিন্তু একটা সম্পর্ক ঠিক কতোদিন এভাবে ঝুলে থাকবে তুই বলতে পারিস?আমাদের একটা কনক্লুসানে যেতে হবে।না সে কিছু বলছে,না সে আমার কথা শুনছে।হোয়াট শ্যুড আই ডু?সে তো দিব্যি আনন্দে আছে।মাঝখানটায় আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে।সে জানে আমি তার প্রতি দুর্বল।এটারই ফায়দা নিচ্ছে সে।সব মেয়েই একরকম।’

আদি মাথা নামিয়ে শব্দ করে হাসল।একটা হাত আরহামের হাঁটুর উপর রেখে বলল,’বাচ্চাদের মতো অভিমান করছিস তুই।বাদ দে।নিজের কাজে মন দে।দেখ না,সামনের দিনগুলো তে কি হয়।এখনই এতো অধৈর্য হোস না।’

আরহাম এক ঝাড়ায় তার হাত সরিয়ে দিলো।জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা ধরেছে,ভয়াবহ রকমের বিতৃষ্ণা।ইশশ! এমন কি কোনো যন্ত্র নেই,যেই যন্ত্রের ভেতরে গিয়ে আরহাম সবার মেমরি থেকে সেদিনের সমস্ত স্মৃতি মুছে দিবে?তারপর সব আবার আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে।আর কতো?আর কতো হায় হুতাশ করবে সে?এতোদিনে তো তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাওয়ার কথা।
.
.
.
.
প্রথম মাসের বেতনটা হাতে পাওয়া মাত্রই নবনীতার মুখে হাসি ফুটল।কতো মাস পর সে আবার নিজ থেকে উপার্জন করছে! সাতাশ হাজার টাকা।কম কি?যেদিন সে বেতন পায়,সেদিন সে রিকশা করে বাড়ি ফিরে।আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

সে বাড়ি ফিরতেই চিত্রা তার কাছে দৌড়ে এলো।নবনীতা চোখ সরু করে জানতে চায়,’কি রে?এমন দৌড়াচ্ছিস কেন?’

‘আপাই আমি আজকে ত্রি স্টার পেয়েছি ক্লাস টেস্টে।’ অত্যাধিক আনন্দিত স্বরে উত্তর দিলো চিত্রা।

নবনীতার মুখে হাসি ফুটল।সে হাঁটু গেড়ে বসে চিত্রার গালে চুমু খেয়ে বলল,’আমি তো জানতাম তুমি পাবে।তুমি না আমার লক্ষী বোন?’

‘পরী! আজ কি দিয়ে ভাত খাবে পরী?’

মিসেস রোকেয়া ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।নবনীতা হাসি মুখ করে বলল,’একটা হলেই হলো।তোমার সব রান্নাই আমার ভালো লাগে।’

মিসেস রোকেয়া জবাব শুনেই আবার রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন।নবনীতা অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’তোমার ঐ চিংড়ি মাছ আর পুঁইশাকের ঝোলটা আমাকে শিখিয়ে দিয়ো তো মামি।আরহামের অনেক পছন্দ—-

সে থামল।আঁতকে উঠে রান্নাঘরের তাকালো।সাথে সাথে মুখ চেপে চারপাশ দেখল।মামি শুনেনি তো?কেউ আশেপাশে নেই তো?সে তাড়াতাড়ি তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।অতীত সে ভুলে গেছে।নিজের ভেতর যেই যন্ত্রণা সে চেপে রেখেছে,সেটা সে বাইরে প্রকাশ করতে চায় না।সম্পর্কের সমঝোতায় সে আসতে চায় না।আগে বহুবার এসেছিল।ফলাফল শূন্য।

সে ঘরে গিয়েই প্রথম বর্ষের মিডটার্মের খাতা গুলো খুলে বসল।মোট একশো আঠারোটা খাতা।আজ রাতের মধ্যেই তাকে এগুলো দেখতে হবে।ধ্যাত! এতো কাজ সে কতোক্ষণে শেষ করবে?আঁচল দিয়ে কপাল মুছে সে কাজে লেগে গেল।বাইরে সূর্যের তাপ বাড়ছে।এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত হলে ভালো হতো।সে খাতা কাটায় মনোযোগ দেয়।কাজের ফাঁকেই তিন বছর বয়সের একটা ছোট্ট বাচ্চার মুখ বার বার তার মস্তিষ্ক ভেসে উঠে।কতোদিন হয়েছে সে তাকে আদর করে না,বুকের সাথে চেপে ধরে ঘুম পাড়ায় না! এতো গুলো দিন সে কেমন করে মা কে ছাড়া থাকছে?মায়ের বুকের ওম না পেলে তো তার ঘুম হয় না।মাও তো তাকে ছাড়া নির্বিঘ্নে ঘুমুতে পারে না।এই কথা সে কাকে বলবে?কে বুঝবে তার ভেতরের টানাপোড়েন?

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৫৯+৬০

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৯)

কপালের দিকটায় চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে।বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠছে কিছু অপ্রীতিকর দৃশ্য।একটা খুব কাছের মানুষ তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে কাঁচের টি-টেবিলের দিকে ছুড়ে মেরেছে।সে হুড়মুড়িয়ে সেটার উপর আঁছড়ে পড়তেই তার মাথা গিয়ে ঠেকল টেবিলের এক কোণায়।আর তারপর?মানুষটা হাঁটু মুড়ে বসে তার গাল চেপে ধরল।জানতে চাইল তার কি যোগ্যতা আছে স্ত্রী হওয়ার?আদৌ কি কোনো যোগ্যতা আছে?উঠে দাঁড়িয়ে লোকটা গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’তার জায়গা আমার পায়ের কাছেই।’

দৃশ্য গুলো অনেকটা বড় পর্দায় দেখানো সিনেমার মতো মানসপটে ভেসে উঠল।স্তব্ধ,নির্বাক হয়ে পড়ে থাকা রুগ্ন দেহটা সামান্য কেঁপে উঠে।মুহূর্ত গড়াতেই সে ঘুমের ঘোরেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।সেই কান্না সময়ে সময়ে গোঙানিতে রূপ নেয়।মা বাবার মৃত্যুর পর সে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল।তারপর একেবারে রূপকথার নায়কের মতো একটা মানুষ তার জীবনে এসে শক্ত হাতে তাকে আগলে নিয়েছে।সেই হাতে সে নিজেকে ভীষণ নিরাপদ ভাবতো।সেই লোকটা কি গ্রীক পুরাণের কোনো অসাধারণ মানবের চেয়ে কম কিছু ছিল?তার শূন্য জীবনটা সে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে,আদরে ভালোবাসায় তাকে অনুভব করিয়েছে সে একা না,তার জন্যও কেউ না কেউ আছে।তার মামা,মামি দুই বোন-সবার দায়িত্ব নিয়েছে।আভিজাত্য আর জৌলুসে তাকে মুড়িয়ে রেখেছে।কিন্তু হঠাৎই একদিন সে তাকে মনে করিয়ে দিলো সে আসলে একটা অযোগ্য মেয়ে।পায়ে থাকার জিনিস,যাকে সে মহানুভবতা দেখিয়ে মাথায় তুলে রেখেছিল।তার গলা চে’পে,তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে সে প্রমাণ করেছে সে লাথি উষ্ঠা খাওয়ারই যোগ্য।তার যোগ্যতা ঐটুকই।মা নেই বাবা নেই,দুই পয়সার আয় নেই,,সে আবার কিসের ভিত্তিতে অতো বড়ো নেতার বউ হবে?আছে তার কোনো যোগ্যতা?

সে ফুপিয়ে উঠল।বুজে রাখা চোখ গলিয়ে নোনা জল গাল পর্যন্ত নেমে এলো।রিমি আলতো করে নিজের হাতটা তার মাথায় রাখে।ধিমি আওয়াজে ডাকে,’নবনী! এ্যাই নবনী! আর কতো কাঁদবি?চোখ খুল।দেখ আমরা সবাই তোর সাথে আছি।’

আওয়াজ কানে যেতেই খাটের এক কোণায় শুয়ে থাকা মেয়ে মানুষটা সামান্য নড়ে উঠল।ক্লান্ত চোখ জোড়া মেলে দিয়ে সামনে দেখার চেষ্টা করল।রিমিকে দেখামাত্রই তার কান্নার বেগ বাড়ল।এক লাফে উঠে সহসা সে রিমিকে শক্ত
করে জড়িয়ে ধরল।কান্নার মাঝেই হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,’চলে এসেছি রিমি।সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছি।আর সম্ভব না,আর পারছি না।হেরে গেছি রিমি,খুব বাজে ভাবে হেরে গেছি।’

সে থামে।টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করে।একটু ধাতস্থ হতেই পুনরায় জড়ানো গলায় বলে,’সে আমাকে থাকার খোঁটা দিয়েছে,খাওয়ার খোঁটা দিয়েছে।বলেছে আমি নাকি পায়ে থাকার জিনিস।মাথায় এনে জায়গা দিয়েছে সে।রিমি সত্যি বলছি।আরহাম এই কথা বলেছে।আরহাম।আমার হাসবেন্ড।আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ।’

রিমি শান্ত।কেবল একহাতে অনবরত নবনীতার পিঠে হাল বুলিয়ে দিচ্ছে।ভীষণ আদুরে গলায় বলছে,’নবনী! তুই না সাহসী মেয়ে?তুই না একা হাতে চিত্র আর শুভিকে বড়ো করেছিস?তুই এভাবে কাঁদলে হবে?’

‘ওহহ হ্যাঁ।চিত্র আর শুভিকে নিয়েও খোঁটা দিয়েছে।বলেছে আমাকে পালে,আমার বোনদের পালে।তার টাকায় আমার পুরো ঘর চলে।ঠিক এভাবেই বলেছে রিমি।বিশ্বাস কর আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না।’

রিমির কন্ঠ জড়িয়ে যায়।তবুও সে কোনোরকমে বলল,’জানি আমি।বিশ্বাস কেন করব না?বোকা নাকি তুই?’

‘তুই বিশ্বাস করছিস?অথচ আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।’

বলতে বলতেই তার শ্বাস উঠল।এমনভাবে কি কেউ কাউকে ভাঙতে পারে?সেদিনের কথা কি নবনীতা ভুলে গেছে?যেদিন আরহাম তার হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিল তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার যাবতীয় সমস্ত খরচ আরহাম বহন করবে।তারপর সে চাকরি পেলে তখন সে নিজেই তার পরিবারের খরচ চালাবে।ঠিক এমন করেই তো বলেছিল।ভালোবেসে বলেছিল তাই না?তবে সময়ের সাথে ভালোবাসা ফুরিয়ে গেল?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে রিমিকে ছেড়ে দিলো।এতোক্ষণে তার খেয়াল হয়েছে রুমে সে বাদেও ওয়াজিদ আর আরিশ আছে।সে একটু শান্ত হয়ে বসতে আরিশ এগিয়ে এলো।তার মুখটা ভীষণ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।খাটের এক কোণায় বসেই সে মলিন মুখ করে বলল,’তুমি সত্যিই আর আমাদের বাড়ি যাবে না ভাবি?তুমি না গেলে আমাদের কি হবে?’

নবনীতা হাসল।বিষন্ন আর উদাস হাসি।দুই ঠোঁট সামান্য প্রসারিত রেখেই বলল,’কিছুই হবে না আরিশ।জীবন জীবনের মতো চলবে।আমি যখন ছিলাম না তখন কি তোমরা থাকতে না ঐ বাড়িতে?এখন আবার থাকবে।সমস্যা কি?’

আরিশের আবারো মায়া হলো।ভাবির জন্য তার আর তাসনুভার বিশেষ টান আছে।মা চলে যাওয়ার পর ভাবিই প্রথম মানুষ যে রোজ রোজ মনে করে তার আর তাসনুভার খেয়াল রাখতো।রোজ সন্ধ্যায় ভাবির ঘরে গিয়ে তারা চায়ের আসর জমাতো।অথচ তিনদিন ধরে ভাবি বাড়ি নেই।বাড়িটা কেমন আধার হয়ে আছে।এই নিস্তব্ধ,থমকে যাওয়া বাড়ি আরিশ চায় না।কিন্তু সে কোনোভাবেই ভাবিকে বাড়ি ফেরার কথা বলতে পারে না।তার বিবেকে বাঁধে,মন সায় দেয় না।ভাইয়ের এমন আচরণের পর সে কেমন করে তাকে ফিরে যেতে বলবে?

ওয়াজিদ এসে রিমির পিঠ বরাবর দাঁড়ায়।একটু গম্ভীর হয় জানতে চায়,’এই অ্যাপার্টমেন্টও ছেড়ে দিচ্ছ?’

নবনীতা তাকে দেখল না।খাটের বেডশীট টার দিকে চোখ রেখে বলল,’হুম।বেঁচে থাকতে আর এখানে থাকছি না।আমি আমার দুই বোনকে নিয়ে দরকার হয় না খেয়ে মরব।কিন্তু অন্যের মালিকানাধীন ফ্ল্যাটে আমি আর থাকছি না।’

রিমি লক্ষ্য করল প্রতিটা শব্দে,প্রতিটা বাক্যে তার বিধ্বস্ত ভাব কেটে যাচ্ছে।উল্টো সেখানে এসে জড়ো হচ্ছে একটা চাপা রাগ,একটা দুর্দমনীয় জেদ।

নবনীতা চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়।চোখের পানি মুছে একবার নিজের হাত দেখে।এই শেষ,আর সে কাঁদবে না।এই দুই দিন সে অনেক কান্না করেছে।আর না।সে দ্রুত সাদেক সাহেবের ঘরে গেল।মিসেস রোকেয়া সেসময় ঘরেই ছিলেন।নবনীতা তাদের দেখেই জোরপূর্বক সামান্য হাসার চেষ্টা করল।ব্যর্থ প্রয়াস।তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা সম্পর্কে সবাই অবগত।

নবনীতা বসল একেবারে সাদেক সাহেবের মুখোমুখি।বসেই তার দুই হাত লুফে নিয়ে নরম সুরে বলল,’মামা আমি আমার জীবনে তেমন কিছুই করতে পারিনি।কোনোরকমে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে তারপর সংসারের জালে জড়িয়ে গেছি।এখন মনে হচ্ছে সেদিন বিয়ের জন্য রাজি না হলেই বোধহয় ভালো ছিল।যাকগে,পুরোনো কথা তুলে লাভ নেই।যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।তোমরা হয়ত জানো আমি সেদিন কেবলই বেড়ানোর জন্য এখানে আসি নি।আমি নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে তবেই এসেছি।আরহামের ঘর,তার সংসার,তার জীবন সবকিছু থেকেই আমি সরে এসেছি।সরে এসেছি বললে ভুল হবে,সে নিজেই আমাকে মুক্তি দিয়েছে।নিজের কোনো ব্যক্তিগত ইনকাম নেই এমন মেয়ের সাথে তার সংসার করা যায় না।আমি সেই সংসার ছেড়ে চলে এসেছি।কিন্তু এই বাড়িটাও তার।তার বাড়িতে আমি আর থাকছি না।ইচ্ছে ছিল সেদিনই একেবারে খালি হাতে সবকিছু ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার।কিন্তু এই দুইদিন শরীর এতো খারাপ ছিলো যে নড়তেও পারছিলাম না।এখন একটু স্থির হয়েছি।এই বাড়িতে আমি আর থাকছি না।আমিও না,তোমরাও না।জানি না তোমাদের নিয়ে কোথায় যাবো।কিন্তু এখানে আপাতত থাকছি না।রিজিক নিয়ে ভাবছি না,আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করবেন।কিন্তু ঠিক কিভাবে সবকিছু গোছাবো,সেটা নিয়ে আমার চিন্তা।আমি গুছিয়ে উঠতে পারছি না।তোমরা কি বলতে পারো কিভাবে এই যন্ত্রণা থেকে আমি মুক্তি পাবো?’

সে কথা গুলো বলল একেবারে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে।বলতে গিয়ে কোথাও থামল না,কোথাও হোঁচট খেল না।তাকে এখন খুবই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।অথচ যেদিন সে এসেছিল সেদিন সে এতো বেশি বিধ্বস্ত ছিল যে কথা পর্যন্ত বলতে পারছিল না ঠিকঠাক।অথচ দুই দিনে মেয়েটি নিজেকে সামলে নিলো।নিজের সাংসারিক টানাপোড়েন এতো সহজভাবে বলে দিলো যেন তার আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না।

মিসেস রোকেয়া তার কাঁধে নিজের একটা হাত রাখলেন।অভয় দিয়ে বললেন,’ভয় কিসের পরী?তোমার মামার পেনশনের টাকা আছে না?দরকার পড়লে সেই টাকা ভাঙবো।তবুও তুমি ভেঙে পড়ো না।তুমি ভেঙে পড়লে আমাদের খুব দুর্বল লাগে পরী।

ভীষণ আশ্চর্য হয়ে সামনে তাকায় নবনীতা।মামি তাকে এই কথা বলেছে! তার বিশ্বাস হচ্ছে না।অবিশ্বাস্য চোখেই সে জানতে চাইল,’কি বললে মামি?পেনশনের টাকা ভাঙবে?’

‘হ্যাঁ ভাঙব।তোমাদের ভালোর জন্য যা লাগে তাই করব।অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাদের।আর না।তোমার কাছে আমাদের অনেক ঋণ পরী।তুমি শুধু বলো কোথায় যাবে, আর কিভাবে থাকবে।টাকা নিয়ে ভেবো না।তোমার মামা আছি,আমি আছি।টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

নবনীতার বিস্ময়ভাব তখনো কাটেনি।সে হা করে কতোক্ষণ মিসেস রোকেয়াকে দেখল।মামি তাকে এসব বলছে?এতো যত্ন কি এর আগে কখনো মামি তাদের করেছিল আগে?মনে পড়ছে না।সহসা সে জাপ্টে ধরিয়ে ধরল মিস রোকেয়া কে।সেই প্রথমদিনের মতো ঝর ঝর করে কেঁদে উঠে বলল,’বিশ্বাস করো মামি।অনেক চেষ্টা করেছি ঘরটা বাঁচানোর।আমি তার অনেক অপরাধ দেখেও এড়িয়ে গিয়েছি।এই সংসার বাঁচাতে আমি নিজের ইগো,প্রেসটিজ কোনোকিছুর তোয়াক্কা করিনি।সত্যিই করিনি।তবে শেষ পর্যন্ত আমি পারি নি মামি।আর সম্ভব হচ্ছে না।বিশ্বাস করো।এই ঘর করা আর সম্ভব না আমার পক্ষে।সে আমার সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত দিয়েছে।আমি আর পারছি না মামি।ঐ বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো।সত্যি বলছি।’

মিসেস রোকেয়া নিরবে তার মাথায় হাত বুলান।তাকে ভরসা দিয়ে বললেন,’থাকতে হবে না ঐ ঘরে পরী।ঐ ছেলের সংসার আর করতে হবে না।আমরা অতো বড়লোক নই,বড়লোকদের সাথে আমাদের যায়ও না।আমরা যেমন আছি,আমাদের যা আছে তা নিয়ে আমরা সুখে আছি।’

নবনীতা আরো কিছুক্ষণ সেভাবেই পড়ে রইল।তার ভালো লাগছে ভীষণ।সে সাহস পাচ্ছে।যেই জেদ তার ভেতর চেপেছে,সেই জেদ বোধহয় মিসেস রোকেয়ার জোরাল আলিঙ্গনে আরেকটু আশকারা পেল।সে পারবে,অবশ্যই পারবে।

***

শুভ্রা মলিন মুখে পড়ার টেবিলে বসেছিল।কাল তার প্র্যক্টিক্যাল শেষ হয়েছে।আজ কথা ছিলো তারা পুরো শহর ঘুরবে।কিন্তু আজ সারাদিন তার এতো বাজে কেটেছে যে সে একটু ভাত পর্যন্ত মুখে দেয়নি।

আপাইকে দেখলেই তার কান্না পায়।আপাইয়ের মুখটা দেখলেই তার মন হয় তার ভেতর ছিঁড়ে যাচ্ছে।সেদিন যখন আপাই বাড়ি এলো,শুভ্রা দরজা খুলেই আঁতকে উঠেছে।আপাইয়ের কপালে ব্যান্ডেজ।চোখে পানি।এই আপাই শুভ্রার অপরিচিত।বাকিদের বিষয় সে জানে না,তবে আপাইয়ের এই বিধস্ত রূপ শুভ্রা সহ্য করতে পারে না।আপাই কে এভাবে ধাক্কা দেওয়ার অধিকার কারো আছে?নেই তো,কিছুতেই নেই।তাহলে কেন দিলো?আপাইয়ের যখন এভাবে রক্ত বেরুচ্ছিলো তখনও কি তার মন গলেনি?তখনও কি একটু মায়া হয়নি তার?

আরিশ তার ঘরের দরজার কাছে এসে গলা খাকারি দেয়।শুভ্রা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে একনজর দেখল,তারপর পুনরায় সোজা হয়ে বসল।আরিশ দরজা ছেড়ে একটু সামনে এগিয়ে এসে জানতে চাইল,’কিছু খেয়েছ শুভ্রা?’

সে কটমট করে জবাব দেয়,’না খাইনি।’

‘অদ্ভুত! আমার সাথে এমন ব্যবহার করছ কেন?’

শুভ্রা পেছন ফিরে।গলা উঁচু করে জানতে চায়,’তো কি করব?কিভাবে কথা বলব আপনার সাথে?আপনাদের টাকায় আমরা খাই,পরি।সেজন্য কি এখন আপনাদের পা ছুঁয়ে কথা বলব?’

আরিশ চোখ বড় বড় করে বলল,’আশ্চর্য ব্যাপার!ভাইয়ার ইস্যু নিয়ে তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন?আমি কখনোই এমন কিছু বলিনি।’

‘তো ভাইয়ার ইস্যু নিয়ে বলব না?আপনার ভাই কে দিয়েই তো আপনার সাথে পরিচয়।আপনি এক কাজ করুন।আপনার ভাইকে পাগলের ডাক্তার দেখান।আপনার ভাই কোনো সুস্থ মানুষ না।ভাববেন না মজা করছি।রাগের মাথায় সে আপনাদেরও মেরে ফেলতে পারে।তার কোনো ভরসা নাই।’

কথাটা আরিশের লাগলো খুব।সে আরো এক পা এগিয়ে কাটকাট গলায় বলল,’একদমই এমন না।ভাইয়ার রাগ বেশি।তবে তুমি যেমন বলছ সে একদমই এমন না।ভাবি তাকে সবার সামনে চড় না দিলে সে কখনোই এমন কাজ করতো না।আমি আমার ভাইয়াকে চিনি।’

‘আর আমিও আমার বোনকে চিনি।’ এক সেকেন্ডও বিলম্ব না করে উত্তর দিলো শুভ্রা।

‘আমার বোনও সামান্য কারণে কাউকে চড় দেয় না।কতোখানি সহ্য করার পর সে এই কাজ করেছে এটা আপনি কোনোদিনও বুঝবেন না।যাকগে,আপনার ভাই আপনার কাছে সেরা।আমার বোন আমার কাছে সেরা।আমরা আর এসব নিয়ে কথা না বাড়াই।আপনি থাকুন আপনার ভাইকে নিয়ে।আমরা চলে যাচ্ছি শহর ছেড়ে।আপনার ভাইকে বলবেন দয়া করে যেন সে অন্য শহরে এসেও আমার বোনকে না জ্বালায়।’
.
.
.
.
ব্যাংক থেকে তিনলক্ষ টাকা তোলা হয়েছে।আপাতত একমাস এই টাকাতেই সবকিছু গুছিয়ে উঠা যাবে আশা করা যায়।আজ রাত দুইটায় বাস।এখন বাজে আটটা ত্রিশ।

শুভ্রা ব্যাগ গোছাচ্ছে।মালামাল তেমন কিছু নেই সাথে।কেবল আছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর বই খাতা।সাদেক সাহেবের ঘর থেকে রিমির গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।সে রোজ রোজ বাড়ি আসে নবনীতাকে একটু দেখার উদ্দেশ্যে।নবনীতা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে এই কথা শুনলেই তার চোখ ভিজে যায়।কি আশ্চর্য!মেয়েটা তাকে এতো ভালোবাসে কেন?

নবনীতা চেয়ার টেনে বসল।কোথা থেকে চিত্রা ছুটে এসে খুশিতে গদো গদো হয়ে বলল,’আপাই আপাই।আমরা কি ঘুরতে যাচ্ছি?’

নবনীতা শান্ত চোখে তার দিকে তাকায়।তার গালে আদর দিয়ে বলল,’হ্যাঁ চিত্র।আমরা ঘুরতেই যাচ্ছি।’

খুশিতে চিত্রার দুই চোখ ভরে আসে।সে লাফাতে লাফাতে চলে গেল।আবার কি একটা ভেবে হঠাৎ ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’আর আরশু আর আরাম ভাই?ওরা কখন যাবে?এখনো আসলো না তো আপাই।’

নবনীতা শীতল চোখে তাকে দেখল।ঠান্ডা স্বরে বলল,’ওরা আসবে না চিত্র।যাও তুমি তোমার জামা গুলো নেওয়া হয়েছে নাকি দেখো।পরে কিন্তু কান্নাকাটি করলে হবে না।যাও সব ঠিক আছে নাকি দেখ।’

চিত্রা চলে গেল।নবনীতা একটা ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে কলম হাতে নিল।

_________________________________________________

“সাত বছর।আনুমানিক সাত বছর আগে আমি এই শহরে এসেছিলাম।একেবারে শূন্য হাতে।দু’টো বোন আর নিজের অনিশ্চিত জীবন নিয়ে এ শহরে পা রেখেছিলাম।সাতটা বছর কিভাবে কাটিয়েছি জানি না।সাত বছর পর আবারো এক প্রকার শূন্য হাতেই চলে যাচ্ছি শহর ছেড়ে।এই শহর আমায় কি দিয়েছে আমি জানি না।ক্ষণিকের আনন্দ দিয়েছে অবশ্যই।বিগত আটমাস আমি রানীর হালে কাটিয়েছি।একটা বড়লোক আর ক্ষমতাধর বর ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে।নয়তো আমার মতো মা বাবাহীন মেয়ের পক্ষে থোড়াই এতো ভালো থাকা সম্ভব।

আসলে কি লিখবো নিজেও জানি না।কেমন ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতি হচ্ছে।সেদিন যখন আমি তার বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম,সে খুব তাচ্ছিল্য করে বলল আমি নাকি তার ছায়া থেকে বেরিয়ে দুই দিনও বাঁচতে পারব না।বাড়িতে সে আরশাদকে ছুঁয়েও দেখে না।সারাক্ষণ আরশাদ আমার কাছেই থাকে।অথচ সে আরশাদকে আমার সাথে আনতে দেয়নি।কারণ আমি জানি।সে ভেবেছিল আরশাদকে না আনতে দিলে আমি হয়তো ঐ বাড়ি ছেড়ে যাব না।কিন্তু এবার আর এসব হচ্ছে না।আরশাদের তকদির সে আগেই লিখে এনেছে।আল্লাহই তার ব্যবস্থা করবেন।তার কথা ভেবে নিজের সম্মান খুয়িয়ে ঐ বাড়িতে থাকা সম্ভব না।আমি হয়তো কিছুটা অসহায় হয়ে পড়েছিলাম।কিন্তু আমি এতো সস্তা নই।নবনীতা কোনো রাস্তার কীট না।আরহামকে এই কথা বুঝতে হবে।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা নারায়ণগঞ্জ যাব।সেখানে গিয়ে একটা বাসা ভাড়া নিব।শুভ্রা অনলাইনেই মেডিকেলের কোচিং করবে।চিত্রাকে সেখানের স্কুলে ভর্তি করাবো।আমি দেখি একটা চাকরি খুঁজে নিব।পাশাপাশি পড়াশোনা করব।অনেক অনেক পড়ব আমি।আমি কোনো লুজার নই।ভীত নই আমি।আর কখনো ন্যাকুদের মতো কাঁদবো না।খুব বড় হবো জীবনে।নূর আহমদের মেয়েটি কিছুতেই হারবে না।অপমানে অপমানিত হয়ে কান্না করার কোনো মানে নেই।আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে নিজের অপমান পুষিয়ে দেবো।আরহাম বলেছে না যে আমার দুই পয়সার মুরোদ নেই?আমি আমার পরিশ্রম দিয়ে দিয়ে মুরোদ দেখাবো।মুখে কিছু বলব না,যা বলার আমার যোগ্যতা বলবে।আরহাম সম্ভবত ভুলে গেছে আমি আমার তিনমাসের বোনকে সামলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগও পেয়েছি।তখন মামিও আমার সাথে ছিল না,শুভি ছিলো অনেক ছোট।এখন সবাই আমার সাথে আছে।আমি পারব না তো কে পারবে?যেই আমি ছয় বছর কোনো সাহায্য ছাড়া এতোদূর আসতে পেরেছি,সেই আমি এইটুকুতেই ভেঙে যাব?

আমি বিয়ের পর সব মেনে নিয়েছি।এর মানে এই না আমি দুর্বল।আমি খামোখা ঘর ভাঙতে চাইনি।সংসারে অশান্তি করতে চাইনি।সবচেয়ে বড় কারণ আমি আরহামকে ভালোবেসেছি।যতখানি ভালোবাসা সম্ভব,ঠিক ততখানি।সেই দুর্বলতা আমাকে এখনো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।যাকগে,সে কথা থাকুক।সবাই কি ভালোবেসে সুখে থাকতে পারে?আমাদের না হয় বিচ্ছেদেই মুক্তি।

আরহাম,
আপনি ভালো থাকুন।সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করা,পায়ের জুতো হওয়ার যোগ্য মেয়েটি আর কখনোই আপনার সামনে আসবে না।যেদিন তার মুরোদ হবে,সেদিনই না হয় তার সাথে আপনার দেখা হোক।ভালো থাকবেন আপনি আপনার এই ঠুনকো সাম্রাজ্যে।নবনীতা নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে এই বিত্ত বিভবের মাঝে থাকার চেয়ে নিজের সম্মান নিয়ে বস্তির ছোট্ট খুপরিতে থাকাকেই বেশি সাচ্ছন্দ্যের মনে করে।নবনীতা দুর্বল না,সে কোনোদিনই দুর্বল ছিলো না।ভালোবাসার জন্য ছটফট করাকে কি দুর্বলতা বলা যায়? ”

নবনীতা নূর
২৯ শে মাঘ ১৪২৯

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬০)
[রিচেক দিতে আলসেমি লাগে।পরে দিবো]

আমার হাতে এক কাপ চা।অন্য হাতে একটা পাউরুটি।আমি পুরোটা চা এক নিমিষে খেলাম না।উল্টা অর্ধেক চা নিজে খেলাম,আর বাকি অর্ধেক চা পাউরুটিকে খাওয়ালাম।এটা হলো আমার উদারতা।ক্ষণিক বাদেই আমি চায়ে ভেজানো পাউরুটিটা খেয়ে নিলাম।এটা কি?এটা হলো রাজনীতি।দূর থেকে যেটা জনসেবা কিংবা মহানুভবতা বলে মনে হয়,ভেতরে উঁকি দিলে দেখা যায়,কোনো না কোনোভাবে সেখানে ব্যক্তি স্বার্থ জড়িয়ে আছে।এই রাজনীতির অঙ্গনে কয়জন টিকে থাকতে পারে বিচক্ষণতার সাথে?অপরপক্ষের কূটচাল ধরে ফেলার মতো দুরদর্শিতা কি সবার থাকে?

সবার খবর জানা নেই,তবে শাহরিয়ার আরহামের সেই দুরদর্শিতা নেই।বিষয়টা দূরদর্শিতার না,বিষয়টা অবিবেচক হওয়ার।রাজনীতিতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি হলো সে যে নিজের কোনো পিছুটান রাখে না।যার মনে মায়া,দয়া,আবেগ কোনো কিছুরই ঠাই নেই।আরহাম এখনো সেই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছুতে পারেনি।এখনো এতোখানি পাষন্ড আর অনুভূতি শূন্য সে হয়ে যায় নি।তাই তার পক্ষে তথাকথিত দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হওয়া সম্ভব না।সে সর্বোচ্চ যা করতে পারে তা হলো বাকিদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজের গদি মজবুত করা।ব্যাস এইটুকুই।

আরহাম বয়সে অপরিপক্ক,অভিজ্ঞতা সীমিত,রাজনীতির মারপ্যাচ গভীরভাবে বোঝার মতোন বিচক্ষণ সে কখনোই না।এই কথা সে অস্বীকার করে না।তবে রাজনীতির ভয়াবহ দিকগুলো আজকাল তাকে ভীষণ ভাবায়।যেই লুপ হোলে সে আটকে যাচ্ছে,এর থেকে মুক্তি কোথায়?আরহাম কি কোনো কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে?তাই যদি হয়,তবে এখান থেকে তাকে টেনে তুলবে কে?

সময়টা বসন্তের শুরুর দিকের।খুব সম্ভবত ফাল্গুনের এগারো তারিখ।আরহাম ব্যস্ত তার ব্যবসায়িক কাজে।ইংরেজি মাস শেষ হতে আর কিছুদিন বাকি।কিছু ব্যবসার হিসেব মেলাতে হবে।এ নিয়ে কয়েকদিন যাবত সে ভীষণ ব্যস্ত।তারপর আবার পার্টি অফিসেও যেতে হবে।এতো কিছু সে সামলাবে কেমন করে?

আরহাম ঘন্টাখানকের মতো কাজ করে একটু দম ছাড়ে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে।কি ভ্যাপসা গরম চারপাশে!দ্রুত এসির পাওয়ার বাড়ায় সে।হঠাৎ কি মনে করেই টেবিলের উপর রাখা মুঠোফোনটা হাতে নিল আরহাম।আনমনে স্ক্রল করে ডায়ালার অপশনে যায়।নাহ,কোনো ফোন আসেনি।কেউ ফোন দিয়ে জানতে চায় নি,’আরহাম আপনি কোথায়?বাড়ি ফিরবেন কখন?’

ফোনটা আবারো জায়গা মতো রেখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আরহাম।শুধু শুধু কেন রোজ এই কাজ করছে সে?কেনো মেনে নিতে পারছে না ঐ নম্বর থেকে আর কোনোদিনও তার ফোনে কল আসবে না?শেষ।সব শেষ।দীর্ঘশ্বাস আর ঘৃণা ব্যতীত ঐ সম্পর্কের আর কিছুই বাকি নেই।

সব কাজ শেষ করে,সব ঝামেলা মিটিয়ে সে বাড়ি ফিরল আটটার দিকে।তাসনুভা নিচতালার ইয়ার্ডে জীবনের সাথে কথা বলছিলো।আরহামকে দেখামাত্রই সে মুখ ফিরিয়ে নিল।আরহাম দেখেও না দেখার ভান করল।এসব আজাইরা ঢং দেখার সময় তার নেই।

সে ঘরে গিয়ে বাতি জ্বালায়।আফরোজা বেগম তখন তার ঘরে।আরশাদ ঘুমিয়েছে একটু আগে।আফরোজা এসেছিলেন তাকে খাটে শুয়িয়ে দিতে।আরহামকে দেখতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন।আরহাম হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে গম্ভীর হয়ে জানতে চায়,’খেয়েছে রাতে?’

‘হ্যাঁ,আমি খাইয়ে দিয়েছি।’

বিনিময়ে সে কেবল মাথা নাড়ল।কাবার্ড থেকে তোয়ালে টা বের করেই শাওয়ার নিতে গেল।সমস্ত শরীর ভার ভার লাগছে,মাথা ধরে আছে।একটু গোসল করলে ভালো লাগবে।যেতে যেতে সে ভারি স্বরে বলল,’এক কাপ চা পাঠাবেন আমার ঘরে।মাথা ধরে আছে আমার।’

সে গোসল শেষে বেরিয়ে আসলো মিনিট দশেক বাদে।তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতেই সে ফোন হাতে তুলে নেয়।কোনো একটা জায়গায় কল দিয়েই জানতে চায়,’তোমার ম্যাডাম কি আজকে বের হয়েছিল কোথাও?’

‘জ্বী স্যার।’

‘কোথায় গিয়েছে?ইন্টারভিউ দিতে?’

অন্য পাশ থেকে কি জবাব এলো বোঝা গেল না।তার আগেই সে গম্ভীর মুখ করে বলল,’একটু খেয়াল রেখো।কোথায় যাচ্ছে,কেমন জায়গায় ইন্টারভিউ দিচ্ছে একটু দেখে রেখো।’

সে ফোন কাটে।চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বাতি নিভিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।চা খাওয়ার ফাঁকে একবার পেছন ঘুরে নিজের অন্ধকার নিস্তব্ধ ঘরটা দেখে।যেই ঘরটা দেখলেই তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়।এই ঘরে একটা মেয়ে থাকতো।যার হাসির ঝংকারে ঘরটা আলো হয়ে থাকতো।অথচ মেয়েটা এখন আর নেই।সারাদিন ব্যস্ততা শেষে বাড়ি ফেরার পর আরহামের বুকে মাথা রাখার মতো কেউ নেই।একটা মানুষের অনুপস্থিতি পুরোটা ঘর কেমন মলিন করে দেয়! ঘরের সমস্ত চঞ্চলতা এক নিমিষে শেষ হয়ে গেল! সে কি জানে আরহাম এই কয়দিনে মানসিক ভাবে কি পরিমান বিপর্যস্ত হয়েছে?জানে কি?ভালো কি সে একা বেসেছে?আরহাম বাসেনি?তবে সবাই কেনো তাকে দয়া দেখাচ্ছে?সবার সহমর্মিতা শুধু তার জন্য।আরহাম কি কিছুই হারায় নি?

সে ধীর পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে এলো।টি টিবিলের নিচের তাকে কাগজ রাখা আছে।ব্যবসার হিসেব করার জন্যই মূলত সে রেখেছিল।হঠাৎ কি ভেবে সে একটা টুল টেনে টি টেবিলের সামনে বসল।নিচের তাক থেকে কয়েকটা কাগজ হাতে নিয়ে কলম খুলে বসল।তার মাথায় অনেক কিছু চলছে।অথচ সে কিছু লিখতে পারছে না।পরীকে দেখতো মন খারাপ হলেই ডায়রি লিখতে।ডায়রি লিখলে কি মন হালকা হয়?তবে সেও চেষ্টা করে দেখতো।এতো বিষন্ন মন নিয়ে আর চলা যাচ্ছে না কিছুতেই।

সে কাগজে কলম চালায়-
“প্রিয় পরী”

স্থির চোখে সম্বোধনটার দিকে একমনে তাকায় সে।উহু,ভালো লাগছে না।কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে।সে আবারো লিখে-
“প্রিয় নবনীতা”

ধ্যাত।কেমন পর পর লাগছে।অনেকক্ষণ ধরে বলপয়েন্ট কলমটা গালের সাথে চেপে ধরে সে অবশেষে লিখল,

“আমার পরী,

ভালোবাসা নিবে।আগেই বলি,তোমার মতো গুছিয়ে আমি লিখতে পারি না।তবু লিখছি।তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ে পরী।সেদিন কি থেকে কি হলো আমার জানা নেই।তবে সব দোষ এসে আমার উপর পড়ল।আচ্ছা পরী,আমাকে একটা কথা বলো তো?তোমার কি মনে হয় না সেদিন তুমিও একটু বাড়াবাড়ি করেছো?তুমি বেডরুমে কাজটা করলেও আমি হজম করে নিতাম।তুমি কাজটা করেছো লিভিং রুমে,বাড়িভর্তি মানুষের সামনে।আমার প্রচন্ড মেল ইগো,এটা তুমি জানো।তুমি এই কাজটা করাতে আমি কি পরিমান ট্রিগারর্ড হয়েছি তোমার কোনো ধারনা আছে?আমার মেজাজ খুব খারাপ ছিলো পরী।তুমি জানো না সেদিন আমাকে সারাদিন কিসব ফেস করতে হয়েছিল।কিন্তু টি টেবিলে ধাক্কা খেয়ে তোমার কপাল কেটে যাবে এমনটা জানলে আমি কখনো এই কাজ করতাম না।বিশ্বাস করো,কসম করে বলছি।আমি তোমার ঐ বিধ্বস্ত রূপটা দেখেই দমে গেছি।কিন্তু তুমি তারপর বললে তুমি ঘর ছেড়ে দিবে।এ কথা শুনেই আমার মাথা ঘুরে গেল।যেই ভয় এতোদিন ধরে পাচ্ছিলাম,সেটাই সত্যি হলো।আমি আবারো একটা ভুল করলাম।আরশাদকে ব্যবহার করে তোমাকে আটকানোর চেষ্টা করলাম।তুমি আমায় ভুল বুঝলে।অন্য কেউ আমাকে ভুল বুঝলে আমার কষ্ট কয় না।কারণ অধিকাংশ মানুষই আমায় ভুল বুঝে।কিন্তু তুমি ভুল বুঝলে আমার কেমন যেন দমবন্ধ লাগে পরী।তোমার মতো কেউ কখনো আমায় বুঝেনি।তুমি সব ক্ষেত্রে আমাকে বুঝেছ।তাহলে কেন সেদিন বুঝলে না?আমি নিলয়ের মৃ’ত্যুতে স্বাভাবিক ছিলাম না পরী,কিন্তু স্বাভাবিক থাকতে হয়েছে।তুমি কেন আমাকে বুঝতে পারো নি?তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে।আমি কয়েক শতবার তোমায় ফোন দিতে গিয়েও দেইনি।আমার মেল ইগো বার বার আমাকে টেনে ধরছে পরী।তুমি কি কোনো যাদুবলে আমার মনের কথা শুনতে পাচ্ছ পরী?প্লিজ ফিরে এসো,প্লিজ।প্রয়োজনে পড়াশোনা করবে,আমার আপত্তি নাই।তবুও এই অধম,রগচটা আর জঘন্য মানুষটার জীবনে ফিরে এসো।প্লিজ।’

সে কলম বন্ধ করে।লিখাটা একবার পড়েই তার হাসি পেল।পরী কতো সুন্দর করে লিখে! সে কিছুই পারে না।কেমন বাচ্চাদের মতো লিখা হয়েছে।লিখার মাঝে কোনো আবেগ,ভালোবাস,মাধুর্য্য কিছুই নেই।আরহাম তবুও কাগজটা বুকের সাথে চেপে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।তার ইদানিং সবকিছু দমবন্ধ লাগে।একদম সবকিছু।
.
.
.
.
‘এই বাচ্চা! কি হয়েছে তোমার?’

তাসনুভা অন্যমনস্ক হয়ে দেয়ালে ঝুলানো ওয়েল পেইন্টিং টা দেখছিল।আদির আওয়াজ কানে যেতেই সে সেদিকে ফিরল।আদি ঘরে উঁকি দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’আসতে পারি?’

সে দ্রুত মাথা নাড়ে।আদি চুপচাপ ঘরে এলো।তার পেছনে থাকা মেয়েটাকে দেখতেই তাসনুভা খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে,’ইজমা আপু তুমি?’

বিনিময়ে ইজমাও মিষ্টি করে হাসল।এগিয়ে এসে তাসনুভার গোছানো পরিপাটি খাটটায় বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল,’তোমার কথা মনে পড়ল।তাই চলে এলাম।’

‘বেশ করেছো।’

আদি মেঝেতে বিছিয়ে রাখা কার্পেটে হাত পা ছড়িয়ে বসল।তাসনুভা কে দেখে আদুরে গলায় বলল,’এবার বলো।মন খারাপ কি নিয়ে বাচ্চা?’

তাসনুভার মুখটা হঠাৎই চুপসে গেল।সে মিনমিন করে জবাব দিলো,’ভাবিকে খুব মিস করি।’

‘সে তো আমরা সবাই করি।কিন্তু তোমার ভাই তো নিজের জেদ ধরে রেখেছে।কি করব বলো?’

‘ভাইয়া এমন কেন?’ তাসনুভার গলা ভেঙে আসে।

‘আরহাম এমনই।মেয়ে মানুষের মতো।বুক ফাঁটে কিন্তু মুখ ফুটে না।সে যে তোমার ভাবির জন্য এই কয়দিনে আধপাগল হয়ে গেছে,সেটা কি তুমি টের পাচ্ছো?’

‘পাচ্ছি।কিন্তু পাগল হলেও তো মুখে কিছু বলছে না।’

আদি একপেশে হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’বাপরে! আরহাম মুখে কিছু বলবে?বললে তার জাত যাবে না?সে তো সিগমা মেল।সিগমা মেল রা কখনো নিজের ভুল ত্রুটি স্বীকার করে না।জানো না এটা?’

ইজমা ফট করে প্রশ্ন করল,’আর তুই কি?ছ্যাচড়া মেল?একশোবার অপমান করলেও পেছন পেছন ঘুরিস।ছ্যাচড়ার ছ্যাচড়া!’

আদি কটমট চোখে তার দিকে তাকালো।চোখ পাকিয়ে বলল,’দাঁড়া,তোর সাথে আমার পরে হিসেব হচ্ছে।’
___

তাসনুভার মন আজকে বিকেলেও খুব খারাপ ছিলো।কিন্তু আদি আর ইজমা বাড়িতে আসার পর থেকেই তার মন ভালো হয়ে গেছে।ইজমা হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার পর তার ফুফুর বাড়িতেই থাকে।আদি কোনোদিন ওয়াজিদদের বাড়ি,কোনোদিন এই বাড়ি,কোনোদিন তার খালামনির বাড়ি-যখন যেদিকে থাকতে মন চায় সেদিকেই থাকে।আজ সে তিনদিন পর এখানে এসেছে।এসেই তাসনুভার সবচেয়ে পছন্দের চাউমিন বানিয়েছে,তাও আবার নিজ হাতে।

কাটা চামচ দিয়ে বেশ খানিকটা চাউমিন নিয়ে তাসনুভার মুখের সামনে ধরে সে তাড়া দিলো,’দেখি দেখি,দ্রুত শেষ করো তো বাচ্চা।খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।’

তাসনুভা হাসিমুখে পুরোটা চাউমিন খেল।খেতে খেতে দু’হাত নেড়ে বলল,’দারুন দারুন।তোমার এই চাউমিনটা অনেক বেশি মজা হয়।’

‘তাহলে রোজ রোজ তোমার জন্য বানাবো কেমন?তবুও তুমি খুশি থাকবে বুঝেছো?’

তাসনুভা জোরে জোরে মাথা নাড়ে।খুশিতে তার দুই চোখ চিকচিক করছে।পরী ভাবি চলে যাওয়ার পর সে আরহামের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না।আরিশ ভাইয়াও ইদানিং কেমন মন মরা হয়ে থাকে।আদি ছাড়া তার মনের অবস্থা কেউ বুঝে না।কেউ আসে না দুই মিনিট বসে তার সাথে কথা বলার জন্য।

সে খাওয়া শেষ করতেই আদি তার পকেটে থাকা টিস্যুটা বের করে তার মুখ মুছিয়ে দিলো।একগাল হেসে বলল,’দেখো কেমন বাচ্চাদের মতো সব ভরিয়ে ফেলেছো।এজন্যই তো তোমায় বাচ্চা বলি।’

ইজমা গালের নিচে হাত দিয়ে তাদের দু’জনকে দেখে।আদি সামনে আসা মাত্রই তাসনুভার চোখে মুখে যেই দীপ্তি খেলে,সেটা সহজেই এড়ানো যায় না।ইজমা এড়াতে পারে না।আদির তার প্রতি আচরণ,তার প্রতি যত্ন তাকে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দেয়।সে ভাবে,খুব মন দিয়ে ভাবে।এই যে পকেট থেকে টিস্যু বের করে সে তার মুখ মুছিয়ে দিলো,এর মাঝে কি কোথাও কোনো স্বচ্ছ অনূভুতি নেই?যেই অনুভূতি আদির অগোচরে তার মনে বাসা বাঁধছে।ইজমা অকারণেই শব্দ করে হাসল।এটাকে বলে প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট।যেটা ছেলেরা কেবলই একজনকে করে।ইজমা সেই একজন না,সে কখনোই ছিল না।
.
.
.
.
‘চিত্র! ঘুমাতে এসো না।আর কতো রাত জাগবে?’

গুটি গুটি পায়ে চিত্রা এগিয়ে আসে।রিনরিনে গলায় বলে,’মাত্র এগারোটা বাজে।’

নবনীতা চোখ পাকায়।
‘এগারোটা মাত্র?’

‘মাত্রই তো।’

‘হয়েছে।এসো ঘুমুবে।আপাইয়ের খুব মাথা ধরেছে।তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমুবো।’

চিত্রা কথা বাড়ালো না।চুপচাপ হেঁটে নবনীতার পাশ ঘেঁষে শুলো।নবনীতা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,’স্কুল কেমন লাগে সোনা?’

‘লাগে।মোটামুটি।’

‘বাপরে! কি পাকা পাকা কথা! তা মোটামুটি কেন শুনি?’

‘কারণ স্কুলে সবাই কেমন অন্যরকম।আমার মনের মতো কেউ নেই।’

নবনীতা মুচকি হাসল।বলল,’আরো কিছুদিন যাক।দেখবে মনের মতো বন্ধু পেয়ে যাবে।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিত্রা ডাকলো,’আপাই!’

‘জ্বী সোনা।বলো।’

‘আমার এই শহর ভালো লাগে না আপাই।আমি ঢাকা যেতে চাই।তোমার ঐ সুন্দর বাসাটায় যেতে চাই আপাই।এখানে আমার ভালো লাগে না।’

নবনীতা ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত বুলায়।মিষ্টি গলায় বলে,’এভাবে বলে না পাখি।এটাও সুন্দর বাসা।এই শহরও সুন্দর।কয়েক বছর থাকলে দেখবে আর যেতে মন চাচ্ছে না।’

‘আপাই!’

‘বলো।’

‘আমরা কি অনেক গরীব আপাই?’

নবনীতা থমকায়।শ্বাস টেনে বলে,’না,আমরা গরীর না।আমরা হালাল টাকায় চলি।’

‘আপাই!’

‘হু।’

‘আরহাম ভাইয়া কি আর আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে না?আরহাম ভাইয়া আসলেই তো হাত ভরে খাবার দাবার নিয়ে আসতো।আমি আরহাম ভাইয়াকে মিস করি আপাই।তুমি একটু তাকে বলো না সে যেন আবার আমাদের ঐ সুন্দর বাসাতে নিয়ে যায়।এখানে ভালো লাগে না আপাই।’

নবনীতা তাকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল।কপালে একটা চুমু খেয়ে আর্দ্র কন্ঠে বলল,’না সোনা।এভাবে বলে না।আমরা কি শুধু তার বাড়ি আর চকলেট-চিপসের জন্য তাকে পছন্দ করি?কোনো মানুষকে কখনোই তার টাকা দেখে পছন্দ করতে নেই চিত্রা।’

‘তাহলে কি দেখে পছন্দ করব?’

চিত্রার সোজা সরল প্রশ্নে নবনীতার হাসি পেল ভীষণ।সে একগাল হেসে উত্তর দিলো,’আমরা মানুষ কে পছন্দ করব তার দৃষ্টিভঙ্গি দেখে।একটা মানুষ কিভাবে আমাদের দেখছে সেটা দিয়ে আমরা তাকে পছন্দ করব।আমাদের টাকা কম থাকাটা যাদের কাছে উপহাসের বস্তু,আমরা কখনোই তাকে পছন্দ করব না।আমরা কম টাকা থাকা স্বত্তেও নিজের শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখি।আমাদের এই স্বপ্ন গুলোকে যারা সম্মান করে,আমরা তাদেরই পছন্দ করব।’

‘আরহাম ভাই কি এমন না?’ ঠোঁট উল্টে জানতে চাইল চিত্রা।

নবনীতা ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে।নিচু আওয়াজে জবাব দেয়,’জানি না রে সোনা।সত্যিই জানি না।তুমি ঘুমাও।কালকে না আবার স্কুল।’

চিত্রা ঘুমালো বিষন্ন মনে।আপাই যতোই বুঝাক,তার এই শহর ভালো লাগে না।বাড়িটা তো আরো আগে ভালো লাগে না।এর আগে তারা কতো সুন্দর বাড়িতে থাকতো! এখন আবার সেই ভাঙা দেয়ালের দালান,প্লাস্টার খুলে খুলে পড়ছে। কি বিচ্ছিরি লাগে দেখতে!’

সে ঘুমুতেই নবনীতা তাকে ছেড়ে উঠে এলো।শুভি পড়ছে পাশের ঘরে।নবনীতা একটু পরে সেখানে গিয়ে তার পাশাপাশি বসে থাকবে।যতক্ষণ সে পড়বে,ততক্ষণ সে বসে থাকবে।তার ইদানিং ঘুম আসে না।সিলিং দেখতে দেখতেই কখন রাত পার হয়ে যায়,সে টেরও পায় না।

রোজকার মতো আজও সে কলম খুলে বসল।

প্রিয় আরহাম,
অনুশোচনায় নিশ্চয়ই তড়পাচ্ছেন ভীষণ।বারবার ভাবছেন কেন বললাম এতো গুলো কথা।না বললেই পারতাম।কয়েকবার ফোন হাতে নিয়ে কল দিবেন ভেবেও রেখে দিয়েছেন।ঐ যে,নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে ফোন দিলেই আপনার জাত যাবে।যাকগে,আপনার চিন্তা আপনার কাছে।আমি বলার কে?

নতুন শহরে আসার পরেই মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।চাকরির জোগাড় হয়েছে।সে নিয়ে ভাবছি না।ভাবছি চিত্রকে নিয়ে।সবাই সব বুঝলেও সে তো বাচ্চা।অতো কিছু বুঝে না।আপনাকে খুব মিস করে,বার বার আপনার কথা বলে।ওহ ভালো কথা।মেয়েটা খুব বড় হয়ে গেছে আরহাম।এখন আর আপনাকে আরাম ভাই বলে ডাকে না।আরহাম ভাই বলেই ডাকে।স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই সে কেমন বড় হয়ে গেছে আরহাম।আপনার কথা খুব বলে।খুব মিস করে আপনাকে।আমিও আপনাকে মিস করি।খুব মনে পড়ে আপনার কথা।তবে মানিয়ে নিচ্ছি।আপনাকে আমি ভালোবেসেছিলাম।আপনি আমাকে বিনিময়ে টেকেন ফর গ্রান্টেড হিসেবে নিয়ে ছিলেন।অর্থাৎ সম্পর্কে সহ্য আর স্যাক্রিফাইস সব সময় আমাকেই করতে হবে,এটাই যেন নিয়ম।অথচ সম্পর্ক এমন না,এটা ভালোবাসা না আরহাম।আপনি এটা উপলব্ধি করুন।যেদিন উপলব্ধি করবেন,সেদিন আমার দরজায় এসে দাঁড়াবেন।নবনীতা আপনাকে জড়িয়ে ধরে আপনার বুক ভাসাবে।কিন্তু তার আগে না।আপনি যেদিন আপনার জঘন্য রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবেন,সেদিন পরীর সাথে পুনরায় আপনার ঘর হবে।তার আগে না। আমি আর কোনো কথাতেই পড়াশোনা ছাড়ছি না।একটা পার্মানেন্ট চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত নবনীতা এই যাযাবর জীবনেই ঠিক আছে।আমি বরাবরই নারী হিসেবে ব্যর্থ।কারণ এতো কিছুর পরেও আমি আপনাকে ঘৃণা করতে পারিনি।কারণ আমার অনুভূতি স্বচ্ছ ছিলো।কিন্তু ভালোবাসি বলেই যে সব কথার পরিশেষে ‘কোনো ব্যাপার না’ বলে এগিয়ে যাবো বিষয় টা এমন না।ভালোবাসা ভালোবাসার জায়গায়,আত্মসম্মান আত্মসম্মানের জায়গায়।আপনি যতদিন না সংশোধন হচ্ছেন,আমি এমনই থাকবো।আমি এমন বেপোরোয়া লোকের ঘর করব না যে কিনা মাথা গরম থাকলে যা নয় তাই বলে অপমান করবে।আপনি ভালো থাকুন।আমার আরশাদের খেয়াল রাখবেন।যদিও আমি জানি আপনি তার খেয়াল রাখবেন।কারণ আপনি আর যাই হোক,দায়িত্বে অবহেলা করেন না।

নবনীতা লিখা শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।রূপোলি চাঁদের আলোয় চারপাশ কি মনোরম দেখাচ্ছে!তারা যেই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে,সেটা লোকালয় থেকে একটু দূরে।সামনে একটা খোলা মাঠ।বাড়িটা বেশ পুরোনো,দেয়ালের রং খসে খসে পড়ছে।মোট চারটা ঘর।ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।তারা থাকে দোতালায়।বাড়িটা নবনীতার ভালোই লাগে।কেমন একটা গ্রামীন ভাব আছে।মন্দ না,মানিয়ে নেওয়া যায়।

নবনীতা গ্রীলের সাথে মাথা ঠেকায়।একটু দূরেই মূল সড়ক,এখন অন্ধকারে ঢেকে আছে।রাস্তায় একটা হুন্ডা থামানো।হেড লাইট জ্বলছে।সেই আলো এখনো নবনীতার চোখে পড়েনি।

কালো রঙের বাইকে থাকা যুবক হেলমেটের আড়াল থেকে তাকে দেখে।সে এতো বেপরোয়া হচ্ছে কেন দিনকে দিন?এই রাতে শুধু একনজর মেয়েটাকে দেখার জন্য সে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ ছুটে এসেছে।এই কাজ সে আগেও করেছে।রাতে সে কিছু সময় বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।এই খবর তার আগে থেকেই জানা।মেয়েটাকে দেখামাত্র তার স্নায়ু শান্ত হয়,শরীরের অস্থিরতা কেটে যায়।তার একে চাই চাই।যে করেই হোক,আবারো চাই।

সে গভীর চোখে একবার তাকে পরোখ করে।কিছু একটা চোখে পড়তেই দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে,’স্টুপিড! দুনিয়ার সব বুঝে।আর এই ঠান্ডার রাতে যে এমন পাতলা জামা পরে বারান্দায় দাঁড়ানো যায় না,সেটা বুঝে না?এখন একটা অসুখ বাঁধলে কি হবে?কে যত্ন করবে তার?বেয়াদব মেয়ে একটা!’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৫৭+৫৮

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৭)

ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে গাঢ় নীল ল্যান্ড ক্রুজারটা মতিঝিলের অফিসে পৌঁছায়।গাড়ির চাকা পুরোপুরি থামার আগেই গাড়ির দরজা খুলে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে আসে শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত যুবক।তার অস্থির দৃষ্টি,ছুটে যাচ্ছে এখানে সেখানে।সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘাম মুছল।শব্দ করে বড় বড় পা ফেলে মহানগর কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করল।

এসি চলছে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়।এমনিতেও বাইরে ঠান্ডা।অথচ তা স্বত্বেও দরদর করে ঘামছে আরহাম।সে বড় করে দু’টো শ্বাস ছাড়ে।কি থেকে কি হয়েছে সে জানে না।কিচ্ছু জানে না সে।মাথার শিরা গুলো মনে হচ্ছে এখনো লাফাচ্ছে তার।ফোন হাতে নিতে গিয়ে সে টের পেল তার হাত জমে গেছে।কি আশ্চর্য বিষয়! শরীর ঘেমে একাকার,কিন্তু হাত পা ক্রমেই জমে যাচ্ছে।এমন হচ্ছে কেন?সে কাঁপা হাতে ডায়াল করল।

ঢামেকের রেজিস্টার্ড ডাক্তার ইউসুফ বিন জামান।যান্ত্রিক শব্দে ঘোর কাটতেই তিনি তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করেন।ওপাশ থেকে গুরুগম্ভীর কিন্তু কিছুটা বিচলিত আর অস্থির কন্ঠ ভেসে আসে,
‘ইজ হি অ্যালাইভ অর নট?’

‘আপনি কে?কার কথা বলছেন?’ গলা খাকারি দিলেন ডাক্তার ইউসুফ।

অন্যপাশ থেকে শীতল গলায় জবাব আসে,’আমি শাহরিয়ার আরহাম।জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেটার বিষয়ে জানতে চাইছিলাম।’

নড়েচড়ে উঠেন ডাক্তার ইউসুফ।চোখে তার হতভম্ব ভাব।বিস্ময় কাটিয়ে কোনোরকমে একপাশে চেপে তিনি নিচু স্বরে বললেন,’নিলয় নাম যে তার কথা বলছেন?’

‘জ্বী।’

‘সে তো এখানে আসার আগেই মারা গেছে।ইনফ্যাক্ট রাতেই মারা গেছে।’

অন্যপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা গেল না।আরহাম নিশ্চুপ।সে নিশ্চিত হয়েছে নিলয় নামের ছেলেটার মৃ’ত্যুর ব্যাপারে।এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃ’ত্যু তাকে কি পরিমান ভোগাবে সে জানে না।সে কোনো জবাব না দিয়ে ফোন কাটল।

নিজের দুইহাতে চুলগুলো টেনে ধরল আরহাম।দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত আর কিছু তার কাছে নেই।নিলয়ের লাশ কি হবে,কোথায় যাবে কিছুই তার জানা নেই।সামান্য ঝুকে কপালটা ডেস্কের সাথে ঠেকিয়ে সে শ্বাস টানে,দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।

‘ভাই আসবো?’

তোফায়েলের কন্ঠ।আরহাম মাথা না তুলেই থমথমে গলায় উত্তর দেয়,’আয়।জানো’য়ার টাকে সাথে এনেছিস?’

সে উত্তরের অপেক্ষা না করে মাথা তুলে।দুই হাত একসাথে করে গুটি গুটি পায়ে আবির এগিয়ে আসে।তার মস্তক নোয়ানো,শরীর সামান্য কাঁপছে,সে নিজেও ঘামছে ভীষণ।

আরহাম তাকে দেখামাত্রই উঠে দাঁড়ায়।এক প্রকার ছুটে গিয়ে তার কলার টেনে ধরে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ঠাটিয়ে দু’ঘা বসায়।ক্রোধে খেই হারিয়ে বিকট শব্দে চেঁচায়,’কু’ত্তার বাচ্চা! তোকে এতো বড় সাহস কে দিয়েছে?তুই কোন সাহসে এই কাজ করেছিস?মানা করেছিলাম না যে ঐ নিলয় সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে যেন তোকে না দেখি।তবুও তুই কোন সাহসে ঐ কাজ করেছিস?’

বলতে বলতেই সে হাঁপিয়ে উঠে।সে বিধ্বস্ত,পুরোপুরি বিধ্বস্ত।এমন একটা দিন তাকে দেখতে হবে সেটা তার কল্পনাতীত।তার নির্লিপ্ততা,তার মৌন থাকাকে তার নিরব সম্মতি ভেবে ছেলেরা যা খুশি তাই করেছে।একটা নিষ্পাপ ছেলেকে নিছক ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে মারধর করে শীতের রাতে বয়েজ হোস্টেলের ছাদে ফেলে এসেছে।ছেলেটা মাঝরাতের গা কনকনে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জমে গেছে।দীর্ঘসময় সেই ঠান্ডা সহ্য করে অবশেষে তার শরীর পরাজয় মেনে নিয়েছে।গা হিম করা ঠান্ডা বাতাসে নিলয়ের স্নায়ু থেমে গেছে,বন্ধ হয়েছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া।চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে হাইপোথার্মিয়া অর্থাৎ অত্যাধিক ঠান্ডায় মৃ’ত্যু।

মৃ’ত্যুর পর তাকে সবচেয়ে প্রথম দেখতে পায় হলের হাউস কিপার।সকালে ছাদের দরজা খুলতেই তিনি দেখেন ছাদের এক কোণায় রেলিং ঘেঁষে একটা ছেলে জড়োসড়ো হয়ে বসা।তার শরীরে কোনো হেলদোল নেই।মাথাটা হাঁটুর সাথে ঠেকানো।যতোটা সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে রাখা অবয়বটি দেখতেই হাউস কিপার শামসুল ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেলেন।সামনে এসে কিছুটা নত হয়ে ডান হাত দিয়ে তাকে ডাকলেন।

বরফের মতো জমে যাওয়া শরীরটা স্পর্শ করতেই আপনাআপনি চোয়াল ঝুলে যায় শামসুলের।মুহূর্তেই ছিটকে দূরে সরে আসলেন তিনি।কি সাংঘাতিক!এতো শক্ত কেন তার শরীর?প্রথমেই যেই চিন্তাটা মাথায় আসলো,সেটা এক ঝাড়ায় মাথা থেকে সরালেন তিনি।শামসুল আবার এগিয়ে গেলেন।একটা শুকনো ঢোক গিলে কম্পমান হাতে ছেলেটার হাঁটুর উপর পড়ে থাকা হাত স্পর্শ করলেন।তার মনে হলো এটা কোনো হাত নয়,বরং একটা স্টিলের টুকরো।অত্যন্ত শীতল আর জড় পদার্থের মতো শক্ত।

আর্তচিৎকার দিকে কয়েক পা পিছিয়ে আসেন শামসুল।তার মাথা ঘুরছে,সমস্ত শরীর দুলছে।দুই হাত মাথায় চেপে তিনি চিৎকার ছুড়েন,’কে আছো এখানে?জলদি ছাদে এসো।দেখে যাও কি সর্বনাশ হয়েছে!’

পরের ঘটনা গুলো ঘটে গেল খুব জলদি।হল ভর্তি ছেলে সব ছাদে গিয়ে জড়ো হলো।হল প্রভোস্টকে জরুরি ভিত্তিতে ডাকা হলো ছাদে,পুলিশ কল করা হলো।পুলিশ এসেই সবাইকে সরাতে চাইলেন।বাঁধ সাধে বাকি ছাত্ররা।তারা সরবে না।আধঘন্টা তর্কাতর্কির পর নিলয়কে হাসপাতালে নিতে হবে আর মূল ঘটনার খোলাসা করতে হবে এই মর্মে পুলিশের হাতে নিলয়কে হস্তান্তর করা হলো।ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পর কর্তৃব্যরত চিকিৎসক প্রথম দেখাতেই জানিয়ে দিলেন,’হি ইজ নো মোর।তিন ঘন্টা আগেই সে মারা গেছে।’

ডান গালে আরো একটা জোরাল চড় খেয়ে আবির ছিটকে পড়ে দেয়ালের দিকে।আরহাম হিংস্র শ্বাপদের মতো ছুটে যায় তাকে আরো এক দফা প্রহার করার জন্য।তার আগেই কোথা থেকে জালালুর রহমান দৌড়ে এসে তাকে জাপটে ধরলেন।জোর গলায় বললেন,’না আরহাম।ডোন্ট ডু দিস।থামো তুমি।’

আরহাম থামল না।জোর খাটিয়ে নিজেকে বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,’থামতে পারব না আঙ্কেল।লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠে গেছে এরা।কোন সাহসে এরা নিলয়কে মারধর করল?অনুমতি দিয়েছিলাম আমি?দিস ইজ টু মাচ।মারধর করল বুঝলাম।কিন্তু এই শীতের রাতে তাকে ছাদে দাঁড় করিয়ে রাখলো পানিশমেন্ট হিসেবে?এতো বড় কলিজা এদের হলো কীভাবে আমি দেখতে চাই।’

তার গর্জনে জালালুর রহমান মুখ খিঁচে নিলেন।তাকে পেছনের দিকে টানতে টানতে বললেন,’মাথা ঠান্ডা করো আরহাম।যা হওয়ার হয়ে গেছে।সবকিছু ঘেটে ফেলছ তুমি।একটু শান্ত হও।’

আরহামকে শান্ত করতে জালালুর রহমানের কিছুটা বেগ পেতে হলো।আজ প্রথমবার তার মনে হলো শেখ আজিজ পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যান নি।তার সামনে বসে থাকা ছেলেটা কিঞ্চিৎ পরিমান হলেও বাবার মতাদর্শকে নিজের মাঝে ধারণ করে।এতোদিনের এতো মগজ ধোলাইয়ের পরেও আরহাম নিজের স্বকীয়তা হারায়নি।ধপ করে চেয়ারে বসেই সে একহাতে চুল টেনে বলল,’ছেলেটা মা’রা গেছে।আমি এটা সহ্য করতে পারছি না।না সে আমার বিরুদ্ধে কিছু করেছে,না সে আমার বিরুদ্ধে কিছু বলেছে।না সে কোনো সরকার বিরোধী কাজ করেছে।তাহলে কেন আমারই দলের ছেলেরা তাকে মারল?আমি হজম করতে পারছি না।আমি নিতে পারছি না।সারারাত ঠান্ডায় জমে একটা ছেলে মা’রা গেল।আমারই আসনে,আমারই দলের ছেলেরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।রাজনীতিতে ভালো কিছু নেই মানলাম।আমরাও কোনো সাধু সন্ন্যাসী না।তাই বলে আমরা তো কোনো পশুও না।এমন পাশ’বিক জন্তু জানো’য়ারের মত কাজ মানুষ কিভাবে করে?’

জালাল সাহেব বাঁকা চোখে তার অস্থির উদ্ভ্রান্ত আচরণ পরোখ করে।সে ঘামছে,তার কন্ঠ কাঁপছে।সেই কন্ঠে অনুতাপ আছে,সহানুভূতি আছে।এই সহানুভূতি জালালুর রহমানের জন্য সুখকর না।কিসের এতো দরদ?আরহাম কি এতো গুলো দিনেও নিজেকে মনুষ্যত্বের একেবারে নিম্নস্তরে নামাতে পারে নি?কি এমন শুভ শক্তি তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে যেই শক্তির কাছে জালালুর রহমানের সব জল্পনা কল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে?আরহাম এতোটা মানবিক হচ্ছে কেন?অসম্ভব ভালো মানুষের সন্তান বলেই কি তার ভেতরটা এখনো পুরোপুরি কলুষিত হয়নি?

তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে আবিরকে দেখলেন।আবিরের সমস্ত মুখ রক্তিম,চোখ দু’টো টকটকে লাল,মুষ্টিবদ্ধ হাত একটু একটু কাঁপছে।অপমানে তার মস্তক নত।ঘরভর্তি মানুষের সামনে ভাই তাকে এভাবে মেরেছে?সে কি কোনো ছাপোষা নাকি?তার বাবারও যথেষ্ট নাম ডাক আছে।এমন সবার সামনে চড় খাওয়ার মতো নগন্য কীট সে না।

জালালুর রহমান ঘন ঘন শ্বাস ফেলে পুনরায় আরহামের দিকে মনোনিবেশ করলেন।
‘আরহাম একটু পর সাংবাদিক রা তোমার অফিস ঘিরে ফেলবে।তোমাকে একটা বক্তব্য অবশ্যই রাখতে হবে এই ঘটনা নিয়ে।তুমি কি সেটা নিয়ে কিছু ভেবেছ?’

আরহাম ঘোলাটে চোখে সামনে তাকায়।কন্ঠে সমস্ত ক্রোধ উগড়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’ভাবার কি আছে?বলব এই জানো’য়ার গুলোকে জেলে পুরে রাখতে।এরা সাধারণ মানুষের জন্য বিপজ্জনক।এরা খাঁচাতেই সুন্দর।’

‘আহা,র‍্যাশনালি চিন্তা করো আরহাম।হঠকারিতা করো না।’

‘পারব না র‍্যাশনালি চিন্তা করতে।মাথা কাজ করছে না আমার।মন চাইছে সবগুলো কে গু’লি করে মা’রতে।’

জালালুর রহমান আলতো করে তার একটা হাত আরহামের কাঁধে রাখলেন।আরহাম যেন নড়ে উঠল সামান্য,তবে পাশ ফিরল না।

নিরবতা ছাপিয়ে তিনি ভরাট গলায় বললেন,’তুমি ক্যামেরার সামনে বলবে নিলয়ের মৃ’ত্যু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক।শীতে না,বরং হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে সে।’

চকিতে মাথা তুলে আরহাম।বিস্ফারিত,অবিশ্বাস্য চোখে পাশ ফিরে এক প্রকার চেঁচিয়ে উঠে,’কি?’

‘শান্ত হও।যা বলছি,ভেবে চিন্তেই বলছি।এতে তোমারই লাভ।’

এক ঝাড়ায় নিজের কাঁধ ছাড়ায় আরহাম।জালালুর রহমান লক্ষ্য করলেন তার হিংস্র মুখটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো বেশি ভয়ংকর দেখাচ্ছে।সে গর্জন করে উঠে,’পা’গল নাকি?এতোটা স্বার্থপর হতে পারব না আঙ্কেল।একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার একটা খু’নকে আমি কিছুতেই নরমাল ডেথ বলতে পারব না।পাবলিক কি অন্ধ নাকি?তারা কি গাঁ’জা খায়?এসব করে আমি নিজেরই ভাবমূর্তি নষ্ট করব।’

‘আর এসব না করলে তুমি নিজেই নিজের তরী ডুবাবে।তুমি যদি এটাকে নেহাৎ স্বাভাবিক মৃত্যু বলে না আখ্যা দাও,তারপর এ জাতীয় সমস্ত তদন্ততে তোমাকে সম্মতি দিতে হবে।’

‘হ্যাঁ,তো দিব।সমস্যা কি?’

জালালুর রহমান ভড়কে গেলেন ভীষণ।তড়িঘড়ি করে বললেন,’না।এতে তোমারই বিপদ আরহাম।তোমার দলের লোকরাই তোমার বিরুদ্ধে যাবে।তুমি এটা করতে পারো না আরহাম।রাজনীতিতে তোমার একার সিদ্ধান্ত বলে কিছু নাই।যেহেতু দলের হয়ে মনোনীত হয়েছ,তাই দলের প্রতি তোমার দায়বদ্ধতা আছে।’

দুই হাতে মুখ চেপে আবারো মাথা নামায় আরহাম।নুয়ানো মস্তকেই কোনোরকম ক্ষীণ স্বরে বলে-‘ভালো হচ্ছে না আঙ্কেল।বিষয়টা একদমই ভালো হচ্ছে না।’

জালাল সাহেব তার পিঠে হাত বুলায়।তাকে ভরসা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,’হতাশ হয়ো না আরহাম।যেভাবে বলছি সেভাবে করো।দেখবে ভালোই হবে।তাছাড়া নিলয় কে তো কেউ জেনেবুঝে মারেনি।এমন পানিশমেন্ট তো কত ছেলেই পায়।কেউ কি ওমনভাবে মরে যায়?নিশ্চিত নিলয়ের অন্য কোনো সমস্যা ছিল আগে থেকে।’

আরহাম উত্তর দেয় না।তার বুক ধড়ফড় করছে।প্রভার মুখটা মনে পড়ছে।প্রভা সেদিন তার অফিসে এসেছিল।হাতে লাড্ডুর প্যাকেট।বলছিল নিলয়কে নাকি সে বিয়ে করবে।এই কথা নাকি সে কেবল আরহামকে জানিয়েছে,আর কাউকে না।আরহাম জানতে চাইল,’কেন কেন?আমিই কেন?’

প্রভা হাসল।লাজুক মুখে বলল,’ভাইয়া।আপনি ছাড়া তো এমন অভিভাবক শ্রেণির আর কাউকে আমি চিনি না।আপনি আমার কথায় ঐ ছেলেদের ধমক দেওয়াতেই তো নিলয়কে তারা জ্বালাতন করা বন্ধ করেছে।তাই শুধু আপনাকেই জানালাম।দোয়া করবেন ভাইয়া।’

‘আমার দোয়ায় কাজ হবে?’ সরু চোখে প্রশ্ন করে সে।

প্রভাতি জোরে জোরে মাথা নাড়ে,’অবশ্যই হবে।কেন হবে না?সাফ মনে দোয়া করলে সব দোয়াই কবুল হয় ভাইয়া।’

‘মন টাই তো সাফ না প্রভা।’

‘জ্বী ভাইয়া?বুঝিনি।’

আরহাম দ্রুত মাথা নাড়ল,’না না কিছু না।’

বুকের সূক্ষ্ম যন্ত্রণায় তার ঘোর কাটে।বাস্তবে ফিরতেই তার যন্ত্রণা আরো বাড়ল।প্রভার আশা পূরণ হয়নি।আরহাম কিভাবে তার মুখোমুখি দাঁড়াবে?কিভাবে সে স্পষ্ট খু’নকে স্বাভাবিক মৃ’ত্যুর তকমা দিয়ে ধামাচাপা দিবে?

পরীর মুখটা আচমকাই মনসপটে ভেসে উঠে।আঁতকে উঠে চোখ খুলে আরহাম।অজান্তেই একহাত বুকে গিয়ে ঠেকে।পরীর সাথে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হতো।সে দ্রুত পকেট হাতড়ায়।ব্যস্ত হয়ে বলে,’আমাকে একটা ফোন করতে হবে এখুনি।’

জালালুর রহমান শক্ত করে তার হাতটা চেপে ধরলেন।জানালার কাঁচ গলিয়ে সামনে দেখতে দেখতে বললেন,’এখন না।নিউজ রিপোর্টার রা সবাই চলে এসেছে।পরে ফোন করবে।’
.
.
.
.
হাসপাতালের খোলা করিডোরে আজ ভীষণ ভীড়।অন্যান্য দিনের তুলনায় লোকসংখ্যা চোখে পড়ার মতো বেশি।এদের সবাই কাছাকাছি বয়সের,বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া।সবার মৃদু গুঞ্জনে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে।করিডোরের একেবারে মাঝামাঝি অবস্থানে একটি স্ট্রেচার,স্ট্রেচারে শোয়ানো একটা মৃ’তদেহ।

ডাক্তার ইউসুফ মৃ’তের ফাইল ঘেটে জানতে চাইলেন,’এই ছেলেটার কি কোনো গার্ডিয়ান নেই?লাশ হস্তান্তর করার জন্য তো অভিভাবকের সাক্ষর লাগবে।অথচ এখনও তো কেউ আসে নি।’

সোনালী পাড়ের গাঢ় লাল কাতান শাড়ির আঁচল মেঝেতে গড়াচ্ছে।কোনোরকমে বুকের কাছটা ঠিক করে একহাতে কুচি চেপে সে উন্মাদের মতো ছুটে যায় হাসপাতালের মূল ফটকের দিকে।মানুষজন সব ঘুরে ঘুরে তাকে দেখল।তার চোখ ভেজা।কাজল লেপ্টে তাকে কেমন ভয়ানক দেখাচ্ছে।ছুটতে ছুটতেই সে কয়েক দফা ফুপিয়ে উঠে।

করিডোরে এসেই আচানক তার পা থামল।এমন ভাবে থামল যে তার চলার শক্তিটুকু ফুরিয়ে গেল।মনে হচ্ছে আর সামনে এক পা বাড়ালেই সে মুখ থুবড়ে পড়বে।তার কন্ঠরোধ হয়ে আসে,শ্বাস প্রশ্বাস থেমে যাওয়ার উপক্রম।নিজের হৃদস্পন্দন নিজেই শুনতে পায় সে।মুহূর্তেই অক্ষিকোটর ভরে উঠে নোনা জলে।

বিধ্বস্ত,এলোমেলো আর ভঙ্গুর পায়ে প্রভাতি সামনে এগিয়ে আসে।তার পা কাঁপছে,সমস্ত শরীর ঝংকার তুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মতোন অবস্থা।চোখ ঝাপসা হচ্ছে বারবার।ঘোলা চোখে সে সামনে থাকা স্ট্রেচারটা দেখে।তার সাহস হচ্ছে না ঐটুকু পথ পাড়ি দিয়ে মৃ’তদেহর মুখের উপর থেকে কাপড় সরাতে।কাপড় সরানোর পরের দৃশ্যটুকু সে সহ্য করতে পারবে তো?

প্রভার কষ্ট করতে হয়নি।আচানক বাতাসের দাপটে নিথর হয়ে পড়ে থাকা দেহের উপর থেকে কাপড় সরল।দৃশ্যমান হলো নিলয়ের নীল হয়ে যাওয়া হেলদোল বিহীন দেহ।তার সমস্ত শরীর নীল,রক্ত জমাট বেঁধে গেছে।ঠোঁট উল্টানো।চোখ অল্প খোলা।প্রভাতি চোখ বন্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে।কি বিভৎস দৃশ্য।

সময় গড়ায়।হঠাৎই সব ভুলে সে ছুটে যায় মুর্তির মতো শুয়ে থাকা মানবশরীর টার দিকে।গিয়েই লুটিয়ে পড়ে তার জীর্ণ বক্ষে।সেই প্রথম যখন তাকে জড়িয়ে ধরেছিল,ঠিক তেমন ভাবে।কাঠের তক্তার মতো শক্ত বক্ষে মাথা রেখেই সে হাউমাউ করে উঠে।তার চোখের বাঁধ খুলেছে।ঝরঝর করে নোনাজল তার গাল বেয়ে নেমে আসছে।কান্নার দরুন তার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে।তার চোখের পানি নিলয়ের বুক ভাসাচ্ছে।ঐ সেদিন যেমন ভাসিয়েছিল,ঠিক তেমন।কিন্তু সেদিনের মতো আজ আর কেউ আলতো হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল না।বলল না,’প্রভা কি করছ এসব?এতো মানুষের সামনে কেউ এমন করে?’

প্রভা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে।তার আর্তনাদ,আহাজারি আর গগনবিদারী চিৎকারে করিডোরের পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠেছে।প্রভা মানুষের দিকে তাকালো না।সে তার বন্ধন আরো গাঢ় করে।মাথাটা শক্ত করে নিলয়ের বুকের সাথে চেপে ধরে রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে বলে,’নিলয়! তুমি এভাবে কথার খেলাপ করতে পারো না নিলয়।এতো স্বপ্ন দেখিয়ে তুমি এভাবে চলে যেতে পারো না।তুমি কেন এভাবে আমায় মেরে ফেলছ নিলয়?একবার চোখ খুলো।আমাকে এমন অন্তহীন অপেক্ষায় রেখে তুমি চলে যেতে পারো না।এই দেখো,আমি তোমার দেওয়া শাড়ি পরেছি।তুমি এভাবে এই অবস্থায় চলে যেতে পারো না নিলয়।কাউকে এমন মরণযন্ত্রনা দেওয়ার অধিকার তোমার নেই।তুমি দয়া করো আমায়,একটু রহম করো নিলয়।এতো জঘন্যভাবে তোমার জীবন শেষ হতে পারে না।আল্লাহ! এই দুঃখ আমি কিভাবে সহ্য করব?’

প্রভাতি চোখ তুলে।নিলয়ের গালে একটা কালচে দাগ।মেরেছে নিশ্চয়ই।ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে তার।আলতো হাতে সেই আঘাতটুকু ছুঁয়ে দিলো প্রভা।এই শেষ দেখা।আর কোনোদিন তাদের দেখা হবে না।কোনোদিন না।প্রভার সমস্ত শরীর অদ্ভুতভাবে কেঁপে ওঠে।তার চারপাশ কেমন ঘোলা আর অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে সে শেষ একবার নিলয়ের মুখটা দেখে।নিভু নিভু চোখে অস্পষ্ট বুলি আওড়ায়,’বিদায় নিলয়।আমাদের আর কোনোদিনও দেখা হবে না।তুমি ভালো থেকো তোমার পরবর্তী জীবনে।মরে গিয়ে বোধহয় তুমি বেঁচেই গেছ।আমি আর বাঁচলাম কোথায়?’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৮)
[একটা কাজ আছে বলে রিচেক দেইনি।রাতে বাড়ি ফিরে রিচেক দিবো।আপাতত একটু কষ্ট করুন।]

আরহামের গাড়িটা হাসপাতালে মূল ফটকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা ঘনায়।হাসপাতাল তখনো লোকে লোকারণ্য।একটা মানুষও যায়নি।পোস্টমর্টেম নিয়ে কিছুক্ষণ আগে অথোরিটি আর সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল।সেই ঝামেলার মিটমাট হয়েছে।নিলয়ের লা’শ ম’র্গে পাঠানো হয়েছে।সেখানে তার শরীর কেটে কুটে ছি’ন্নভি’ন্ন করা হবে।তারপর একটা পূর্ব পরিকল্পিত রিপোর্ট বেরিয়ে আসবে যেখানে লিখা থাকবে অপমৃ’ত্যু নয়,বরং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ব্যাহত হয়ে খুবই স্বাভাবিক মৃ’ত্যু হয়েছে তার।তারপর সবকিছু এক নিমিষেই ঠান্ডা হয়ে যাবে,চাপা পড়ে যাবে নিলয়ের নিদারুণ আর্ত’নাদ,চাপা পড়ে যাবে সমস্ত অন্যায়।

প্রভাতি ফ্লোরে বসেছিল।তার চোখের দৃষ্টি ভীষণ শান্ত।দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দুই পা গুটিয়ে নিয়েছে সে।মাথাটা হাঁটুর উপর ফেলে রাখা।দুই হাতে পা দু’টো চেপে ধরেছে।চোখ দু’টো এখন আর ভিজে নেই।বরং শুকিয়ে কটকট করছে।টকটকে লাল নেত্রযুগল অবশ্য জানান দিচ্ছে যে একটু আগেও সে হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে।ছেলে বুড়ো থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডাক্তার নার্স সবাই যেতে যেতে একনজর চোখ বাঁকা করে তাকে দেখল।তবে কেউ এগিয়ে এসে কিছু জানতে চাইল না।

আরহাম তার লোকবল নিয়ে হাসপাতালে আসতেই চারপাশ থেকে সব সরে দাঁড়ায়।প্রভাতি সবার আগে তার পা দেখে।খুব বড় বড় পা ফেলে সে সামনের দিকে হেঁটে আসছে।সাথে সাথে মাথা তুলে সে।দেখতে পায় অত্যন্ত নির্বিকার চিত্তে আরহাম সামনে এগিয়ে আসছে।তবে তাকে একেবারেই ভাবলেশহীন মনে হচ্ছে না।তার দৃষ্টি অস্পষ্ট।একটা চাপা আতঙ্কে তার মুখ আধার দেখাচ্ছে।

প্রভাতি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়।বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে তীব্র বেগে তার দিকে ছুটে যায়।তাকে দেখতেই আরহামের পা থামল।সে নিজেও থমকে গেল।শুকনো একটা ঢোক গিলে সে প্রভাতির দিকে চোখ মেলল।

প্রভাতি তার সামনে এসেই পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়ল।দ্রুত চোখ মুছে নিয়ে বাচ্চাদের মতোন অসহায় গলায় বলল,’ভাইয়া ওরা নিলয়কে মে’রে ফেলেছে ভাইয়া।সত্যি সত্যি মে’রে ফেলেছে।’

তার রক্তিম বিধ্বস্ত মুখটা দেখতেই আরহাম একেবারে দমে গেল।দপদপ করে জ্বলতে থাকা প্রদীপটা যেমন করে নিভে যায়,সেও ঠিক তেমন করে নিভে গেল।ভেতরটা কেমন অস্থির লাগছে।সে আসতেই পুনরায় সেখানে একটা জটলা বাঁধলো।

ঈষৎ কাঁপা হাতটা প্রভাতির মাথায় রাখে আরহাম।আপাতত এইটুকু সান্ত্বনাই সে তাকে দিতে পারে।প্রভাতি মাথা নামিয়ে নেয়।নাক টেনে বলে,’আপনি দয়া করে এদের এমন শাস্তি দিন যে আর কাউকে যেন নিলয়ের মতো করে মর’তে না হয়।’

আরহাম স্থির চোখে তাকে দেখল।আস্তে করে তার মাথা থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল।তার কন্ঠ খচখচ করছে।একবার কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে একেবারে ঠান্ডা স্বরে সে বলল,’কাকে শাস্তি দিব?আগে তো এটা প্রমাণ হতে হবে যে নিলয় কে খু’ন করা হয়েছে।তার আগে কিভাবে কাউকে শাস্তি দিব?’

প্রভাতি হতবাক হয়ে তাকে দেখে।তার ফ্যালফ্যাল চোখের দৃষ্টিতে আরহাম অপ্রস্তুত হয়ে উঠে।প্রভাতি চোখের দৃষ্টি এমন রেখেই বলল,’আপনি এসব কি বলছেন ভাইয়া?প্রমাণ মানে?ঐ আবির আর তার বন্ধু বান্ধবরা তাকে মেরে ছাদে রেখে এসেছে।বলেছে সারারাত ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে।তার আগে তারা তাকে মেরেছে।এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরেই সে,,’

প্রভাতি আর কথা শেষ করতে পারল না।তার আগেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।পরের কথা সে আর বলতে পারবে না।তার মুখ দিয়ে সে কথা বের হতে চায় না।বলতে গেলেও বারবার থেমে যায় সে।

আরহাম সোজা সটান হয়ে দাঁড়ায়।দুই হাত বুকে ভাঁজ করা।মুখোভঙ্গি বোঝা মুশকিল।অবশেষে কিছুটা নমনীয়,কিছুটা দৃঢ় কন্ঠে সে জবাব দিলো,’আমার মনে হয় না শীতের কারণে তার কোনো সমস্যা হয়েছে।যতটুকু মনে হচ্ছে,তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।শীতে সে কেনো মরবে?স্টেশনে ফুটপাতে যারা থাকে তারা কি মরে যাচ্ছে নাকি?নিলয়ের মৃত্যু আমার স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে প্রভা।’

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে আরহামের মনে হলো তার কন্ঠরোধ হয়ে আসছে।গলা ছিঁড়ে যাচ্ছে,তবুও সে একটানে পুরো কথা শেষ করল।শেষ করেই আর কোনোদিক না দেখে সে মর্গের দিকে এগিয়ে যায়।সে জানে প্রভাতির কাছে তার ভাবমূর্তি পুরোপুরি ভাবে নষ্ট করে দিয়েছে সে।যেই চোখে প্রভাতি তার জন্য অনেক বেশি সম্মান আর ভালোবাসা ধরে রেখেছিল,সেই চোখ দু’টো এখন পূর্ণ হবে সীমাহীন ঘৃণা আর বিতৃষ্ণায়।আরহাম সচক্ষে সেই ঘৃণা দেখতে চায় না।প্রভাতির ফ্যাকাশে,পরাজিত মুখটা সে আর কখনোই দেখতে চায় না।প্রভাতি তাকে বীরপুরুষ ভাবতো।সে তো কোনো বীরপুরুষ না।প্রভাতির ভুল ভেঙেছে।এখন তার মুখোমুখি হতেও আরহামের অস্বস্তি হচ্ছে।সে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে যায়।আচ্ছা আজ হঠাৎ বুকটা এতো পোড়াচ্ছে কেন?
.
.
.
.
সব ঝায় ঝামেলা শেষ করে আরহাম বাড়ি ফিরল রাত দশটায়।সদর দরজা পেরিয়ে সে এক পা সামনে দিতে না দিতেই দোতালার সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল,’এসব কি আরহাম?’

আরহাম চোখ তুলে।শান্ত চোখে নবনীতার থমথমে কাঠিন্যে ভরা মুখটা দেখে।সব জেনেও না জানার ভান ধরল সে।আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি মানে?কি হয়েছে আবার?’

নবনীতা ধুপধাপ পায়ে সিঁড়ি ভাঙে।একপ্রকার ছুটে যায় তার দিকে।মুখোমুখি হতেই দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’আপনি জানেন না কি?আপনি আজ এসব কি বলেছেন?আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

আরহাম হাত বাড়িয়ে আলতো করে তার কাঁধ চেপে তাকে নিজের সামনে দেখে সরায়।খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,’যাও সরো তো।রোজ রোজ এসব ভালো লাগে না।রেস্ট করব আমি।’

সে আরো দুই পা সামনে যেতেই নবনীতা অকস্মাৎ উঁচু স্বরে চেঁচায়,’আরহাম!!’

আরহাম ঘুরে দাঁড়ায়।হতবাক হয়ে বলে,’পাগল তুমি?এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন?’

‘চেঁচাবো না?আপনি এসব কি করেছেন?বাড়াবাড়িরও একটা সীমা থাকে আরহাম।’

‘কি করেছি আমি?শীতের রাতে এক ছেলে ম’রে গেছে।তাতে আমার কি করার আছে?’

‘ম’রে গেছে মানে?’ চোখ ভিজে উঠল নবনীতার।

‘বলুন মে রে ফেলেছে।একটা দেশে আইনকানুন থাকার পরেও কি করে ছেলেরা এমন দুঃসাহস দেখাতে পারে?আপনাকে আগেই বলেছিলাম এদের লাই দিবেন না।আপনি শুনেন নি আমার কথা।’

‘চুপ থাকো তো তুমি।সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান ভালো লাগে না।’

নবনীতা আশ্চর্য হয়।ব্যথিত চোখে সামনে দেখে বলে,’আপনি এতো খারাপ?এতোদিন ধরে আমি আপনার ঘর করছি?’

কথাটা আরহামের গায়ে লাগল ভীষণ।সে এগিয়ে এসে দুই হাতে নবনীতার কাঁধ চেপে ধরল।দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’কি সমস্যা তোমার?তোমার কোন ক্ষতি করেছি আমি?’

এক ঝাড়ায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নবনীতা।খানিকটা চেঁচিয়ে উঠে বলে,’আমাকে স্বর্গে রেখে মানুষকে ন’রকের দিকে ঠেলে দেওয়ার কি মানে?এমন সংসার আমি চাই নি।এমন সুখ আমি চাই নি।আমি সুখে আছি বলে কি আমি বাকিদের টা দেখব না?আপনি দিন দিন জঘন্য হয়ে যাচ্ছেন আরহাম।’

আরহাম আবারো তার দুই কাঁধ চেপে ধরল।প্রচন্ড রাগে তার মুখ রক্তিম দেখাচ্ছে।চোখ দু’টো আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে আবার নিভে যাচ্ছে দপ করে।তার হিংস্র মুখটা দেখেই নবনীতার চোখ ছলছল করে উঠল।সে ভাঙা গলায় বলল,’একবার আয়নায় নিজের মুখটা দেখুন।দেখুন কতোটা জঘন্য দেখাচ্ছে আপনাকে।’

‘আমি তো জঘন্যই।এখন তো আমাকে জঘন্য লাগবেই।বিয়ের অনেক দিন হয়ে গেছে না?এখন তো আর আমাকে ভালো লাগবে না।এক মানুষ কে তো আবার তোমাদের বেশি দিন ভালো লাগে না।’

নবনীতা চমকে তার দিকে তাকায়।সে কি বলল এটা?কি বলল এখন?সে কি বোঝাতে চাইল নবনীতা দ্বিচারিতা?সে অস্ফুটস্বরে আবারো জানতে চায়,’কি বললেন আপনি?’

আরহাম গজরাতে গজরাতে বললো,’কেন তুমি শুনো নি?’

সে আর কথা বাড়ালো না।শুধু নিজেদের দুরত্ব খানিকটা কমিয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখ মেলে বলল,’আমায় রাগাবে না পরী।বউ আছো বউয়ের মতো থাকো।বেশি বাড় বাড়বে না বলে দিলাম।আমার রাজনৈতিক জীবন আমায় বুঝতে দাও।তুমি ঘরের জিনিস,ঘর নিয়েই ভাবো।’

সে থামল।চোখ তুলে নবনীতার মুখ দেখার আগেই সপাটে একটা চড় এসে পড়ল তার গালে।আরহাম হতভম্ব হয়ে সামনে তাকায়।দেখে নবনীতার ঘৃণাভরা দৃষ্টি তারই উপর নিবদ্ধ।সে তাকাতেই নবনীতা চেঁচিয়ে উঠে,’সহ্যের সীমা থাকে আরহাম।আপনি সব সীমা লঙ্ঘন করে ফেলছেন।বউ আমি,কোনো পুতুল নই।’

সে চোখ মুছে আরো কিছু বলল।আরহাম শুনলো না।তার হতভম্ব দৃষ্টি তখনো নবনীতার দিকে।স্তব্ধ হয়ে একহাতে নিজের গাল ছোঁয় সে।পরী তাকে চড় মেরেছে?সে আড়চোখে রান্নাঘরের দিকে দেখে।রহিমা আর আফরোজা বেগম মাথা বের করে গোল গোল চোখ করে তাকে দেখছে।তার একরোখা,জেদি আর গোয়ার পুরুষালী স্বত্তাটি এই অপমান নিতে পারল না।বউ তাকে চড় মারবে?তাও আবার বাড়ির মেইডদের সামনে?

সে দাঁতে দাঁত চেপে সামনে এগিয়ে যায়।একটানে নবনীতাকে তার কাছে এসে ডান হাতে তার দুই গাল চেপে ধরে।ক্রোধে ফেটে পড়ে চেঁচিয়ে উঠে,’একদম মেরে ফেলব আমার সাথে এমন আচরণ করলে।আমায় চড় মারো কোন সাহসে তুমি?তোমার চাকর লাগি আমি?আমার খাও,আমার পরো,আবার আমার সাথেই এমন বেয়াদবি করো।’

তার হাতের চাপে নবনীতার গাল ভেঙে এলো।সে দুই হাতে আরহামের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে চিৎকার করে উঠল,’ছাড়ুন।বাড়িভর্তি মানুষের সামনে সিনক্রিয়েট করবেন না।’

‘আমি সিনক্রিয়েট করছি?তুমি শুরু করেছ এসব।খাইয়ে পরিয়ে আদর সোহাগ দিয়ে তোমার সাহস বাড়িয়েছি আমি।ডানা গজিয়েছে তাই না?ডানা সব ছেটে দিবো বলে দিলাম।’

দু’জনের উচ্চবাচ্যে আদি আর আরিশ দৌড়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।তাসনুভার ঘুম ভেঙেছে একটু আগে।সে তড়িঘড়ি করে হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ঘরের বাইরে আসতেই সামনের দৃশ্য দেখে থমকে গেল।নবনীতা তার একহাত দিয়ে পুনরায় সজোরে চড় বসালো আরহামের গালে।সেই শব্দ দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে একেবারে আরহামের কানের কাছে এসে ঠিকরে পড়লো।

আরিশ সঙ্গে সঙ্গে একহাত মুখে চেপে ধরে।ভয়াতুর চোখে দুই কদম এগিয়ে ভাইয়ের মুখটা দেখার চেষ্টা করে।আরহামের চোয়াল ঝুলে গেছে।তার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।পরী তাকে এভাবে সবার সামনে চড় মারছে?এতো বড়ো স্পর্ধা সে কি করে দেখাচ্ছে?আরহাম কে কি তার খুব সুপুরুষ মনে হয়?

সে খেই হারালো।খেই হারিয়ে যা করার ঠিক তাই করল।সেকেন্ডের মাথায় তার দুই হাত নবনীতার গলা চেপে ধরে।ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’একদম জানে মেরে ফেলব যদি এতো বড় সাহস আর দেখিয়েছ তো।কোন সাহসে চড় মারছ তুমি?এতো গায়ের জোর আসে কোথা থেকে?চলো তো আমার টাকাতেই।নিজের তো কোনো মুরদ নাই।’

নবনীতার শ্বাসরোধ হয়ে আসে।কথা সব জড়িয়ে গিয়ে গলার কাছে এসে থেমে যায়।সে টেনে একবার শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল।চোখ দু’টো তার পানিতে টইটম্বুর।মানুষ এতো হিংস্র হয়?এতো হিংস্র মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব?সে না তার স্ত্রী?তাকে না সে ভালোবাসে?

আদি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল।হুশ হতেই দিগবিদিক ভুলে ছুটে গেল।দুই হাতে আরহামের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে চেঁচিয়ে উঠে বলল,’গলা ছাড় আরহাম।এখনি ছাড়।পাগল নাকি তুই?ছাড় বলছি।’

সে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে টেনে আরহামের হাত দু’টো নিজের হাতের দখলে নেয়।আরহাম তখনও সামনে দেখতে দেখতে চেঁচিয়ে যাচ্ছে,’বেঈমানের জাত! কি দেই নি আমি তাকে?তার পরিবারকে পর্যন্ত আমি চালাচ্ছি।তার এক পয়সার রুজি আছে যে এতো বড় বড় কথা বলছে আমার সাথে?কি যোগ্যতা আছে তার শুনি?’

সঙ্গে সঙ্গে নবনীতার দুই চোখ ভরে উঠল।নোনা জলে চিকচিক করতে থাকা অক্ষিকোটরের দিকে দেখেই তাসনুভার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল।ভাবির চোখ,তার চোখের এই দৃষ্টি ভীষণ অচেনা ঠেকল তার কাছে।ভাবি কি কখনো এমন করে ভাইয়াকে দেখেছে?এই চাহনির কোথাও কি ভাইয়ার জন্য তার ভালোবাসা অবশিষ্ট আছে?

নবনীতা কান্নাটুকু গিলে কিছু একটা বলার জন্য এগিয়ে এলো।তার আগেই আরহাম সমস্ত গায়ের জোর দিয়ে তাকে একটা ঝাক্কা দিলো।সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সে টি টেবিলের উপর গিয়ে পড়ল।তাসনুভা চিৎকার করে উঠল,’ভাবি!’

তাল হারিয়ে ফেলা শরীরটা আছড়ে পড়ল টি টেবিলের উপর।মাথাটা গিয়ে ঠেকল একেবারে টেবিলের কোণায়।সে স্তব্ধ,হতভম্ব।মুখ দিয়ে কথা বলার মতো কোনো শক্তি নেই।

আদি চিৎকার করে উঠল,’আরহাম! আর ইউ সিক?পাগল হয়েছিস তুই?’

আরহাম সেই কথা গায়ে মাখল না।উল্টো বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠল,’আমি ঠিকই আছি।এতোদিন ঠিক ছিলাম না।যাকে তাকে মাথায় তুলে রেখেছিলাম।যার জায়গা যেখানে তাকে সেখানে রাখা উচিত।এর জায়গা এখানেই।আমার পায়ের কাছে।’

বলেই সে আদির দুই হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।হাঁটু মুড়ে সামান্য ঝুঁকে নবনীতার মুখোমুখি হয়ে বলে,’এ্যাই পরী! তোমার কি যোগ্যতা আছে শুনি?এক টাকাও তো কামাই করো না।চলো তো সব বরের টাকায়।এই শাড়ি,এই গয়না,এই আভিজাত্য সব তো আমার বদৌলতেই পেয়েছ।তোমার কি যোগ্যতা আছে আমার বউ হওয়ার শুনি?’

সে একহাতে নবনীতার গলার নেকলেসটা টেনে ধরল।তাচ্ছিল্য করে বলল,’দুই লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার টাকা দাম পড়েছে এটার।এই ছয় বছরে কোনোদিন একসাথে এতো টাকা দেখেছ?’

নবনীতা নিশ্চুপ,নিরুদ্বেগ।একবার চোখ তুলে তাকালো পর্যন্ত না।যেভাবে আরহাম তাকে ছুড়ে মেরেছে,সেভাবেই বসে থাকল।কপাল কেটে গলগল করে চটচটে তরল গড়াচ্ছে একপাশ ঘেঁষে।সে বসে আছে একটা পুতুলের মতো।না পলক ফেলছে,না কিঞ্চিৎ নড়ছে।

আরিশ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে।মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতেই দেখে ভাবির কোলের উপর রাখা হাত দু’টোতে একটু পর পর টপটপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে।তার মায়া হলো ভীষণ।ভাবি তাদের কতোখানি ভালোবাসে সেটা সে আর তাসনুভার চেয়ে ভালো কে বুঝে?সে জড়ানো গলায় কিছুটা অনুরোধ করে বলল,’প্লিজ ভাইয়া।দয়া করে থামো।ভালো লাগছে না আমার।’

আরহাম খেঁকিয়ে উঠল,’কেন থামব?কি করিনি আমি তার জন্য?তার মামা আমার কি লাগে?তবুও তাদের সব খরচা দিচ্ছি না?তার মনের শখ পূরণের জন্য কি না করেছি আমি?আরশাদ কে পর্যন্ত এডোপ্ট করেছি।আরশাদ আমার কি লাগে?তাও তাকে নিজের ছেলের পরিচয় দিয়েছি।কি না করেছি তার মন ভালো করার জন্য?নিজের খামখেয়ালি তে সে আমার বাচ্চাটাকে মে’রে ফেলেছে।তবুও তো কোনোদিন খোঁটা দেইনি।কোনোদিন কটু কথা বলিনি। বিয়ের এতোগুলা দিনে সে বলতে পারবে যে তাকে কোনোদিন ফুলের টোকা দিয়েছি?তাকে অতিরিক্ত ভালোবেসেছি তো,তাই মূল্য দিতে শিখেনি।আসলে যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু মানুষ ডিজার্ভই করে না।পায়ের জিনিস তুলে এনে জোর করে মাথায় বসিয়ে দিলেই তো হয় না।মাথায় থাকার মুরোদও তো থাকতে হয় নাকি?’

নবনীতা মাথা নামিয়েই ফিচেল হাসল।তার সত্যি সত্যি হাসি পাচ্ছে।নিজেকে কেমন নোংরা কীট মনে হচ্ছে।সে আরেকদফা এলোমেলো হাসে।চোখ দু’টো কেন বার বার ছলছল করছে বুঝে আসে না।

আরহাম আবারো ঝুকল।পুনরায় নবনীতার দুই গালে চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’এতো যখন আমাকে অসহ্য লাগে,তখন আমার ছায়া থেকে বেরিয়ে দুনিয়াতে চলতে শেখো না।তখন দেখবে দুনিয়া কি জিনিস।হায়নারা তো সব খুবলে খাবে।তখন বুঝবে বর কি জিনিস।’

নবনীতা উদ্ভ্রান্ত চোখে তার দিকে তাকায়।তার কপালের গভীর ক্ষত দেখতেই আরহাম নড়েচড়ে উঠে।নবনীতা আচমকাই ফিক করে হেসে দিলো।আরহাম ভড়কে গিয়ে বলল,’কি হয়েছে?পাগলের মতো হাসছো কেন?’

সে হাসি থামালো না।মুখে সে হাসি ধরে রেখেই বলল,’খুশিতে হাসছি।আমার অনেক খুশি লাগছে তাই হাসছি।’

আরহামের দৃষ্টি স্থির হলো।একটু আগের রাগ সব বরফের মতো গলে গেল।সাথে সাথে নবনীতার গাল ছেড়ে দিলো সে।তার স্নায়ুর অস্থিরতা থেমেছে।এতোক্ষণে তার হুশ ফিরেছে।কিন্তু তার মনে হলো হুশ না ফিরলেই বোধহয় ভালো ছিল।কারণ যা কিছু ঘটানোর ছিল,সে ঘটিয়ে ফেলেছে।সারাদিনের যত রাগ তার ভেতরে জমা হয়েছিল,সবটা সে ভুল মানুষের উপর উগড়ে দিয়েছে।

সে শীতল চাহনিতে নবনীতার মুখ দেখে,সেই সাথে দেখে তার কপাল।কপালের ক্ষতটা দেখতেই তার বুক মোচড় দিয়ে উঠে।সে তাকে মেরেছে?এতো রূঢ় সে কিভাবে হলো?এতো পাষাণ তো সে কখনো নিজের মায়ের সাথেও হয়নি।

আবারো শব্দ করে হেসে দিলো নবনীতা।অথচ আরহামের মনে হলো এর মতো মলিন আর করুন হাসি পৃথিবীতে আর দু’টো নেই।হাসির মাঝেই আচমকা ফুপিয়ে উঠলো নবনীতা।সাথে সাথে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে।না না সে কাঁদবে না।কিছুতেই কাঁদবে না।শত চেষ্টার পরেও সে নিজেকে দমাতে পারল না।হঠাৎ দুই হাতে মুখ চেপে বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠল সে।আরহাম একটা ঢোক গিলে সামান্য পিছিয়ে আসে।নবনীতার এই ভয়ংকর ক্রন্দনরূপ তার সহ্য হচ্ছে না।মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কেউ কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দিয়েছে।সে একহাত বাড়িয়ে তার গাল ছুঁয়ে দিতে চাইল,প্রগাঢ় চুম্বনে তার সমস্ত অভিমান ভেঙে দিতে চাইল।কিন্তু তার আগেই নবনীতা জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।তার সমস্ত শরীর তখনো থরথর করে কাঁপছে।অথচ তার মনে হলো সে একটা অনুভূতি শূন্য মৃ’ত লাশ।যাকে একটু আগে তারই স্বামী গলা টিপে মে’রে ফেলেছে।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৫৬

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৬)[প্রথম অংশ]
[রিচেক নাই।আপাতত কষ্ট করে পড়ুন]

টিক টিক টিক।ছন্দোময় গতিতে চলতে থাকা ঘড়ির কাটা সময় মতো জানান দিলো রাত এখন কাঁটায় কাঁটায় তিনটা।হেমন্তের সমাপ্তি।শীতের আগমনী বার্তা স্বরূপ ঠান্ডা,শরীর হিম করা বাতাস পর্দা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করছে।সেই বাতাসে রুগ্ন,বিমূঢ় নারী কায়াটি অল্প অল্প কাঁপছে।তার শিয়রে বসে থাকা পুরুষ যখনই নিজের স্ত্রীর কম্পমান শরীরটা দেখলো,তখনই পরম স্নেহে তাকে জড়িয়ে ধরল।নিজের দুই হাতের আলতো আলিঙ্গনে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।

আরহাম ঘোর লাগা কন্ঠে ডাকে,’পরী!’

কিছুসময় শান্ত থেকে মেয়েটি জবাব দেয়,’জ্বী।’

‘কবে টেস্ট করিয়েছ?’

‘কিছুদিন আগে।পরশু হাসপাতালে গিয়েছিলাম শিউর হওয়ার জন্য।’

সে শুরুতে কিছুটা বিরক্ত হলো,তারপর খুব বেশি রাগ হলো।
‘এতো কিছু করে নিলে,অথচ আমাকে একবার বললেও না?’

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নবনীতা কোনোরকমে উত্তর দেয়,’আপনি কোনো যোগাযোগ করেননি।’

আরহাম সারোষ চোখে তাকে দেখল।তার থমথমে মুখখানা দেখেই নবনীতা প্রশ্নাত্মক চোখে তার দিকে তাকায়।আরহাম রাগ ঝাড়ল না।নবনীতাকে টেনে দু’জনের দূরত্ব আরো কিছুটা ঘুচিয়ে নিয়ে বলল,’এই খবর জানলে অবশ্যই যোগাযোগ করতাম।তোমার উচিত ছিল জানানো।আমার উচিত এখন রাগ হওয়া।’

বলতে বলতেই তার মুখ রক্তিম হয়।নবনীতা ঈষৎ কাঁপতে থাকা হাতে তার গাল ছোঁয়।আরহামের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি তার আঙুলে চুবছে।সে এক দুইদিন আগেই শেভ করেছে বোধহয়।নবনীতা একবার বড় করে শ্বাস টেনে বলল,’তাহলে রাগ করুন।’

‘রাগ আসছে না।তোমার মুখটা দেখলে আমার রাগ পড়ে যায়।বড্ড দুর্বল লাগে নিজেকে।’

আরহাম নিঃসংকোচে কোনোরকম জড়তা ছাড়া জবাব দেয়।পরীর প্রতি তার সীমাহীন দুর্বলতা,এই কথা কি সে অস্বীকার করতে পারবে?অস্বীকার করেও লাভ নেই।পুরো জগৎ জানে সে পরীর প্রতি দুর্বল।এই দুর্বলতার কোনো সূচনা কিংবা সমাপ্তি নেই।যেই দুর্বলতা তাকে তার মেল ইগো ছাড়তে বাধ্য করেছে,যেই দুর্বলতার কাছে পরাস্ত স্বীকার করে সে বারবার মেয়েটির কাছে ফিরে যাচ্ছে,এই দুর্বলতাকে অস্বীকার করা বোকামি ছাড়া কিছুই না।

নবনীতার চোখে ঘুম নামল আরো কিছুক্ষণ পরে।আরহাম খুব যত্নে সাদা রঙের নকশিকাঁথাটা তার গায়ের উপর চাপায়।তার গায়ের ওমে নবনীতা নিজেকে আরো গুটিয়ে নেয়।তার মুখ জুড়ে প্রশান্তির হাসি দেখেই আরহাম বুঝল এই সামান্য উষ্ণতা নবনীতার আরাম লাগছে।সে তাকে আর বিরক্ত করে না।থাক একটু ঘুমোক।মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই কয়দিন সে একদমই ঠিক মতো নিজের যত্ন করেনি।আচ্ছা মেয়ে মানুষ এতো স্পর্শকাতর কেন?এতো নাজুক স্বত্তা! সামান্য অবহেলাতেই কেমন মূর্ছা যায়।

আরহাম একহাতে তার কপালের সামনে থাকা চুল সরায়।এগিয়ে এসে খুবই আলতো করে চুমু খায়।মেয়েটার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রী তার বড্ড মায়া লাগে।আচ্ছা সে কি হকিংয়ের বর্ণনাকৃত কোনো কৃষ্ণগহ্বরের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে?যেই দুর্দমনীয় আকর্ষণে পরী তাকে টানছে সে আকর্ষণ ছিন্ন করার জো কি তার আছে?আরহাম কেন ছুটে এলো তার কাছে?না এলেও তো পারতো।থাকতো যে যার মতো।কিন্তু সে পারেনি।সবকিছুর শেষে সে হেরে যাচ্ছে।পরী ভালো নেই,এই বাক্য তার সহ্য হয় না।পরী কেন ভালো থাকবে না?পরীকে ভালো থাকতে হবে।জীবনে এতো যন্ত্রণা ভোগ করার পর মেয়েটি মন্দ থাকতে পারে না।আরহাম তাকে মন্দ থাকতে দিবে না।

সে আবারো আলতো করে চুমু খায়।নবনীতার ঘুম ভাঙবে এই ভয়ে সে আর তার পাশ ঘেঁষল না।শুধু নির্নিমেষ চাহনিতে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে দেখল।পরী মা হচ্ছে।আর সে হচ্ছে বাবা।কথাটা একদিক দিয়ে ভাবতে গেলে খুবই সাধারণ,অন্যদিকে ভীষণ রকম অসাধারণ।সে সত্যিকার অর্থে বাবা হচ্ছে।তার ঔরসজাত সন্তান নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়েছে।আরহামের খুশি লাগছে।ভীষণ ভীষণ খুশি।মন চাইছে কোনো একটা খোলা মাঠে গিয়ে কতোক্ষণ চিৎকার করতে।সে রাতভর ভাবল।নিজেকে নিয়ে,পরীকে নিয়ে,তাদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে।ভাবতে ভাবতেই তার ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হয়।

দূর থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে।আরহাম মাথা নামিয়ে নবনীতার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে,’পরী! পরী! আযান দেয়।নামাজ পড়বে না?তোমার তো স্রষ্টার উপর অন্ধবিশ্বাস।যাও তাকে ডেকে এসো।’

***

বাম হাতের কালচে হয়ে উঠা স্থানে বার্নল লাগাতেই ইজমা নড়ে উঠল সামান্য।তারপরই আবার ডানহাত মুখে চেপে যন্ত্রণা টুকু গিলে নেয়।

ইফাজ মলম লাগানোর ফাঁকেই আড়চোখে একবার তাকে দেখে।তারপর আবার নিজের কাজে মন দেয়।পু’ড়ে যাওয়া অংশটুকুতে বার্নল লাগাতে লাগাতে সে শান্ত কিন্তু খানিকটা অবিশ্বাস্য হয়ে প্রশ্ন করে,’এতোখানি পুড়ে গেল,আর আপনি টেরও পেলেন না।আপনি কি আদৌ কোনো মানুষ?’

ইজমা লজ্জায় মাথা নোয়ায়।দরজার কাছে নার্সরা উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে আর মিটমিট করে হাসছে।তাদের চাহনিতে ইজমা ভৎসনার আভাস পায়।ছিহ ইজমা!এমন মরার মতো কেউ ঘুমায়?

আজ হাসপাতালে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।তাও আবার তার কেবিনে।কেবিনের ডান দিকে থাকা এসিতে হুট করে আগুন ধরে গেছে।আগুনের ধোঁয়া চোখে পড়তেই সবাই এর উৎস খোঁজা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।যখন সবাই আবিষ্কার করলো তিনতালার তিনশো ছয় নম্বর কেবিনেই আগুন লেগেছে,তখন দলবেঁধে সব সেখানে জড়ো হলো।আর তখনই ডজনখানেক মানুষ আবিষ্কার করল যার ঘরে আগুন লেগেছে সে দিব্যি ঘুমুচ্ছে।কি আশ্চর্য!কি অদ্ভুত! তার কি শরীরে তাপের আঁচ লাগছে না?

ইজমার ঘুম ভেঙেছে কারো হ্যাঁচকা আর জোরাল টানে।সে হকচকিয়ে উঠল।চোখ মেলতেই দেখল তার মুখোমুখি ইফাজ দাঁড়িয়ে আছে।যার চোখ দু’টো ভীষণ ক্রোধান্বিত।ইজমা তাকে দেখতেই সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’পাগল নাকি?উঠে আসুন।আগুন লেগেছে কেবিনের এসিতে।’

ততক্ষণে অবশ্য অনেকেই দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে পানি ঢালা শুরু করেছে।ইজমা এ দৃশ্য দেখেই আঁতকে উঠে।তার মাথা কাজ করছে না।বড্ড বোকা বোকা হয়ে সে সবকিছু দেখে।হঠাৎই তার চোখ পড়ল তার নীল রঙা ব্যাগটা সাইডবক্সের উপরে।ব্যাস,আর কোনো কিছু না ভেবে সে থাবা বসায় ব্যাগের উপর।ইফাজ আঁতকে উঠে চেঁচায়,’আর ইউ ক্রেজি?’

আগুনের আঁচ লেগে হাত পুড়িয়েছে সে।ইফাজ কতোক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকে দেখল।মনে হচ্ছে আগুন জ্বলছে তার মাথায়।এই মেয়ে কি গর্দভ নাকি?তার রাগ কমতে সময় নিল।আর রেগে কি হবে?যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।

সে মলম মাখিয়ে উঠে দাঁড়ায়।ইজমা অসহায় চোখে নিজের হাতটা দেখে।গতকালই ব্যান্ডেজ খুলেছিল হাতের।কাল হয়তো সে ডিসচার্জও পেয়ে যাবে।কিন্তু জখম আর পিছু ছাড়ল না তার।এই পোড়া আবার কয়দিন তাকে জ্বালায় কে জানে?

ইফাজ দরজার কাছে যেতেই সে পিছুডাকে,’এ্যাই ছেলে!’

সে অবাক হয়।পেছন ফিরে জানতে চায়,’আমাকে ডাকছেন?’

‘জ্বী।’

পুনরায় পেছন ফিরে সামনে এগিয়ে আসে সে।তার সন্দিহান দৃষ্টি দেখেই ইজমা হাসল।হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,’আপনাকে ধন্যবাদ।’

‘কেন?আপনাকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য?’

ইজমা আরো একদফা হাসল।দিরুক্তি করে বলল,’মোটেও না।সুন্দর করে অয়েন্টমেন্ট লাগানোর জন্য।’

‘আর আপনাকে ধন্যবাদ ঘুম থেকে উঠার জন্য।আপনার যা ঘুম!’

শেষ বাক্যে খানিকটা ব্যাঙ্গ,খানিকটা কটাক্ষের সুর।ইজমা সেটা গায়ে মাখল না।কেবল শব্দ করে একটু হাসল।ইফাজ অন্যমনস্ক হয়ে এদিক ওদিক দেখতেই হঠাৎ তার হাসি দেখে থামল।এই প্রথম সে আবিষ্কার করল মেয়েটার গালে টোল পড়ে।হাসলে সেটা আরো বেশি বোঝা যায়।সে চোরা চোখে দুইবার তাকে দেখে।তারপরই নিজের কাজে বিস্মিত হয়।সে এমন চোরের মতো তাকে দেখছে কেন?কি অদ্ভুত!

সে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান নেয়।মেয়েদের হাসিতে আটকানোর মতো ফালতু জিনিস এই পৃথিবীতে আর দু’টো নেই।জীবনে একবার সে এই ভুল করেছে।আর না।আর যদি এই ভুল করে তাহলে সে একটা ছাগল,ইয়া বড়ো রামছাগল।
.
.
.
.
নিলয়ের জ্বর হলো।ভীষণ জ্বর।তার ঘরে থার্মোমিটার নেই।তবে নিজের কপালে হাত রেখে সে অনুমান করল একশো তিনের কম হবে না কিছুতেই।মাথায় হাত চেপেই সে কিছুক্ষণ কাশে।কাশতে কাশতে তার শ্বাস উঠল।সে কোনোরকমে দুই হাতে ভর গিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসার চেষ্টা করল।ফলাফল শূন্য।

চার পায়ের কাঠের চৌকিতে শুয়ে সে এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি খায়।কিচ্ছু ভালো লাগছে না।মুখ কেমন তেতো হয়ে আছে।বিকেলের দিকে তার জ্বর আরো বাড়ল।ছোট্ট খুপরির মতোন ঘরটায় সে যন্ত্রনায় কতোক্ষণ ছটফট করল।তার গা কাঁপিয়ে জ্বর।অথচ এই এতো বড় পৃথিবীতে তার মাথায় পানি দেওয়ার মতোন মানুষ নেই।কি অদ্ভুত না?তার হৃদয়ে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয়।মায়ের কথা মনে পড়ে ভীষণ।মায়ের মতো ভালো এই জগতে আর কেউ বাসতে পারে?

কলিং বেল বাজল।পাশের ঘরের শফিক দরজা খুলল।নিলয়ের চোখদু’টো আধো আধো বুজে রাখা।নিভু চোখে সে দেখল শফিক বড় বড় পা ফেলে তার ঘরে আসছে।এসেই ভীষণ তাড়াহুড়ো করে বলল,’এ্যাই নিলয়!তোর ভার্সিটি ফ্রেন্ড এসেছে।তোর সাথে দেখা করতে।’

নিলয় যন্ত্রনায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে দুই চোখ মেলে।মুমূর্ষু কন্ঠে কোনোরকমে আওড়ায়,’কে এসেছে?’

মিষ্টিমুখো মেয়েটি একটা প্যাকেট হাতে তার ঘরে এলো।নিলয় তাকে দেখেই আঁতকে উঠল।জ্বর আর শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে সে ধড়ফড়িয়ে উঠল।বড় বড় চোখ করে বলল,’প্রভা! তুমি?’

শফিক বেরিয়ে গেছে।নিলয় তবুও মাথা নামিয়ে হিশহিশ করে বলল,’তুমি কেন এখানে এসেছ?আশেপাশে সব ছেলে।ভয় করেনি তোমার?’

প্রভাতি নির্বিকার।জানতে চায়,’ভয় কেন করবে?’

‘যদি কোনো বিপদ হতো?’

‘বিপদ কেন হবে?তুমি আছো না?অপরিচিত ছেলেদের ভীড়ে একজন তো আমার পরিচিত।তার ভরসায় চলে এসেছি।’

নিলয় একপেশে হাসল।খুবই রুগ্ন আর বিমুঢ় দেখায় সে হাসি।হাসির দমকেই সে বলল,’আর আমি যদি এই মুহূর্তে তোমার ভরসা টা ভেঙে দেই প্রভা।তখন?’

প্রভাতির ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।তীর্যক চাহনিতে একবার নিলয়কে দেখে পরক্ষণেই আবার মুচকি হেসে বলল,’ভেঙে দিলে আর কি করার?ভাঙলে ভাঙবে আরকি।আমি আমার জীবনে খুব বেশি ভালো কিছু আশাও করি না।’

তার কথার ধরনেই নিলয় ভীত হয়।দ্রুত হাত নেড়ে সাফাই দেয়,’ছি ছি।তুমি আমায় ভুল বুঝছ! আমি তো মজা করছিলাম।’

‘আমিও মজাই করছি।’ ফিক করে হেসে দেয় প্রভাতি।

নিলয় কিছুটা আশ্বস্ত হলো।পুনরায় চৌকিতে গা এলিয়ে প্রশ্ন করল,’বাড়ি কিভাবে পেলে?’

‘অনেক কষ্টে তোমার ছবি দেখিয়ে খুঁজে বের করেছি।’

‘সাংঘাতিক ব্যাপার!’

নিলয় নিজ থেকেই বলল,’আমার ভীষণ জ্বর প্রভা।’

‘জানি।তুমি আসোনি,কিছু জানাওনি আমাকে।আমি বুঝে নিয়েছি।’

সে উঠে গিয়ে একটা বালতিতে পানি এনে তাকে জলপট্টি দেয়।নিলয় প্রশান্তিতে চোখ বুজে।বন্ধ চোখেই বিড়বিড় করে বলে,’তোমায় ধন্যবাদ প্রভা।আমার ভীষণ ভালো লাগছে।’

প্রভাতি কিছুক্ষণ চুপ থাকলো।তারপরই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল,’এখন আমি যেটা করব সেটা তোমার আরো বেশি ভালো লাগবে।’

চোখ খুলে কপাল কুঁচকায় নিলয়।
‘সেটা কি?’

উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মেয়েটা অকস্মাৎ তীব্র বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার পুরুষালি বক্ষে।নিলয় কিছুটা চমকায়,তবে মুখে কিছু বলে না।সে জানতো এই দিন আসবে।তবে এতো দ্রুত আসবে সেটা ধারণা করেনি।সে তাকে সরাল না।কিন্তু খানিকটা ধমকের সুরে বলল,’হচ্ছে টা কি প্রভা?পাশের ঘরে মানুষ আছে।এগুলো কেমন বাচ্চামো?’

সে তাকে ছাড়লো না।উল্টো আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,’ছাড়ব না।আমি বাচ্চাই।’

নিলয় তাকে লাই দেয়,তার বাচ্চামো কে প্রশ্রয় দেয়।সে ভীষণ অবাক হলো যখন দেখল প্রভাতির চোখের পানিতে তার পরনের শার্ট ভিজে যাচ্ছে।হকচকিয়ে উঠে একহাতে প্রভাতিকে সরাতে চায় সে।ব্যস্ত হয়ে বলে,’এ্যাই প্রভা তুমি কাঁদছো কেন?’

প্রভাতি সরল না।হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিলো,’আমি খুশিতে কাঁদছি।মানুষ পাওয়ার খুশিতে আমার কান্না এসে গেছে।আমি একা নই নিলয়।আমার কেউ একজন আছে।এর চেয়ে খুশির আর কি হতে পারে?
.
.
.
.
নবনীতার দিন যাচ্ছিল কোনোরকম।ভালো খারাপ মিলিয়ে।সে স্বামীর ঘরে ফিরেছে বেশ কিছুদিন হয়েছে।তার স্বাস্থ্য একদমই ভালো থাকে না ইদানিং।শরীর খারাপ,মাথাব্যাথা,বমি বমি ভাব সবকিছু যেন লেগেই আছে।দিনের বেশির ভাগ সময়ই সে শুয়ে বসে কাটায়।আরশাদকেও ঠিক মতো কোলে নিতে পারে না।বাচ্চা ছেলেটা একা একাই খেলে।নবনীতার তার জন্য মায়া হয়।

আজ দুপুর থেকেই তার মাথাব্যথা,অন্য দিনের চাইতেও প্রকট।সে কতোক্ষন ঘরের এই মাথা ঐ মাথা পায়চারি করে।তারপর ধপ করে খাটে বসে মিনিট দশেক ঝিমায়।একটা ঘুমের ঔষধ খেয়েই চাদর টেনে কোনোরকমে নিজের চোখ বুজল সে।

সে ভেবেছিল তার ঘুম বেশি গাঢ় হবে না।অথচ সে ঘুমালো ছয় ঘন্টারও বেশি।ঘুম ভাঙতেই সে প্রথমে আবিষ্কার করল ঘড়িতে এই মুহূর্তে নয়টা পয়তাল্লিশ বাজছে।আর তারপর আবিষ্কার করল আরহাম তার শিয়রে বসা।বসে বসে সে ঝিমুচ্ছে।নবনীতা স্মিত হেসে উঠে বসল।

উঠে বসতেই তার কেমন অদ্ভুত অনুভূত হয়।খানিকটা বিচলিত হয়ে সে শরীরের উপর থেকে চাদর সরায়।সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠে নবনীতা।তার দৃষ্টি তার পায়ের দিকে।চিকন ধারায় তরল গড়িয়ে তার পা বেয়ে নামছে।কম্পিত হাতে একটা ঢোক গিলে ডান হাতে লাল রঙা তরল স্পর্শ করে সে।বুঝতে বাকি নেই এই চটচটে তরল রক্ত বৈ কিছু না।সে ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে নিল।মৃদু আর্তনাদ করে ডাকলো,’আরহাম! আরহাম!’

এক ডাকেই তন্দ্রা ছুটে গেল আরহামের।ধড়ফড়িয়ে উঠে সে নিজেও আতঙ্কিত হয়ে চেঁচায়,’কি হলো?খারাপ লাগছে?’

নবনীতা টলমল চোখে ইশারায় তাকে তার পা দেখায়।কাঁপা স্বরে কোনোরকমে বলে,’আ-আমার ব্লিডিং হচ্ছে আরহাম।দেখুন রক্তে আমার সমস্ত শরীর ভেসে যাচ্ছে।’

সে আর বেশি কিছু বলতে পারল না।তার আগেই তার দুর্বল শরীরটা ঢলে পড়ল আরহামের প্রশস্ত বক্ষে।আরহাম তাকে জড়িয়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে কতোক্ষণ বসে থাকল।মস্তিষ্ক কাজ করছে না তার।এসব কি হচ্ছে?হুশ ফিরতেই সে আরেক দফা হোঁচট খায়।তারপরই গলা ছেড়ে চিৎকার করে,’আরিশ! এক্ষুনি নিচে যা আরিশ।মোতাহের কে বল গাড়ি বের করতে।’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৬)[দ্বিতীয় অংশ]

হাসপাতালের করিডোর তখন শান্ত।দুই একটা মানুষ বাদে আশেপাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।ব্যস্ত নগরী ঢাকা পড়েছে সুনশান নিরবতায়।চারদিকে কেমন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য! হৃদয়ে বিরাজ করছে ভয়ানক নিস্তব্ধতা।

আরহাম করিডোরে পাতা বেঞ্চিতে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।তার মুখোমুখি অন্যপাশে আরিশ দাঁড়ানো,একটা পা দেয়ালে ভর দেয়া।তার মুখটা গুমোট।আসার পর থেকে আর কোনো শব্দ করেনি সে,কোনো কথাও তুলেনি।যা বোঝার সে বুঝে গিয়েছে।আদি দাঁড়ানো করিডোরের অন্য মাথায়।এক প্রকার দৌড়ের মাঝে এখানে এসে পৌঁছেছে সে।তার মাথা এখনো ঝিমঝিম করছে।একহাতে কোনোরকমে মাথার বা পাশটা চেপে ধরে সে।

আরহাম আনমনে নিজের চুলে হাত ছোঁয়ায়।তারপর আরো একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে নিস্তব্ধ পরিবেশটা আরো বেশি ভারি করে।পরীর মিস ক্যারেজ হয়েছে।ছোট্ট ভ্রুণটা খুব বেশিদিন নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারেনি।অতি ক্ষুদ্র মাংসপিন্ডটি চাকা চাকা রক্তের দলা হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে।বিলীন হয়েছে আরহাম আর নবনীতার ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন।আহা! ঘুম ভাঙার পর মেয়েটা যখন সবকিছু জানবে তখন তার কেমন লাগবে?একটা সামান্য ঘুমের ঔষধ থেকে এতোকিছু হয়ে গেছে শোনার পর তার কেমন লাগবে?নিশ্চয়ই নিজের উপর ভীষণ রাগ হবে তার,অভিমানে আরহামের মুখোমুখি হবে না।দিনরাত ভুলে সারাক্ষণ শুধু কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে।বাচ্চা তো তার ভীষণ প্রিয়।রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ছোট্ট প্রাণের জন্য যার মায়া হয়,নিজের গর্ভের সন্তান হারানোর কষ্টে কি তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠবে না?

আরো এক দফা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে আরহাম।সামিউল সাহেব তাকে ডাকছেন তার চেম্বারে।উঠে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে ভঙ্গুর পায়ে শরীরটা টেনে নিয়ে সে চেম্বারে গিয়ে ধপ করে একটা চেয়ার টেনে বসে।

সামিউল স্থির চোখে একনজর তাকে পরোখ করে।তারপর একটু কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে,’নবনীতা সিস্টিক ফাইব্রোসিসের পেশেন্ট।এটা জন্মগত এবং জিনগত রক্তশূন্যতা জনিত ব্যথি।তার রক্তশূণ্যতার সমস্যা অনেক আগের।নবনীতা নিজেই প্রতিমাসে রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকে।কনসিভ করার জন্য কিছু শর্ত লাগে।ডোন্ট ইউ থিঙ্ক শী নেভার রিয়েলি হ্যাড দ্য এবিলিটি টু গিভ বার্থ?’

আরহাম মাথা নামায়।চুপচাপ নিজের হাত দেখে।তার দীর্ঘশ্বাসে পরিস্থিতি আরো বেশি গুমোট হচ্ছে।

‘আমি তার রিপোর্ট দেখেই আন্দাজ করেছিলাম শেষ পর্যন্ত সম্ভবত সে এই বাচ্চাটা ধরে রাখতে পারবে না।কিন্তু তোমাদের আনন্দে বিঘ্ন ঘটাতে চাই নি।নবনীতা আজ এই হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ না খেলে খুব সম্ভবত এই মেকি আনন্দে তোমরা আরো একমাস বিভোর থাকতে।কিন্তু আজ যা হয়েছে সেটা হওয়ারই ছিলো আরহাম।শী ক্যান নট,শী নেভার ক্যান।তুমি তাকে সুন্দর করে বোঝাও।এই স্টেজে মেয়েদের মানসিক অবস্থা বেশ জটিল থাকে।নবনীতার জন্য বিষয় গুলো আরো জটিল।তুমি তাকে নিজের মতো করে সামলাও।আফটার অল তোমার ওয়াইফ।পারবে না?’

আরহাম চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো।তার কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।ভেতরে সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।কেবল যেতে যেতে সে সংক্ষেপে জবাব দিলো,’পারব।’
.
.
.
.
নিলয়ের শরীর কিছুটা ভালো।সকাল থেকে নিজের কাজ সব নিজেই করতে পারছে।আসলে মনের সাথে শরীরের একটা সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে।যেদিন আমাদের মন ভালো থাকে,সেদিন শরীরও ভালো থাকে।আজ তার মন ভালো।তাই শরীরের জ্বরটা খুব বেশি অনুভূত হচ্ছে না।

পুরোনো একখানা চেক প্রিন্টের শার্ট গায়ে চাপিয়ে সে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে।কেচি গেট থেকে বেরিয়ে গলির রাস্তায় পা দিতেই সে দেখল তার থেকে সামান্য কয়েক হাত দূরে প্রভাতি দাঁড়ানো।সে অবাক হয় খানিকটা।চোখ বড় বড় করে বলে,’প্রভা তুমি?এতো দ্রুত এসে গেছ?বলো নি কেন?ফোন কেন দাও নি?তুমি তো বলেছিলে দশটার পরে আসবে।তাই আমিও সেভাবে বের হয়েছি।অথচ এখন দেখছি তুমি দশটা না বাজতেই হাজির।’

জবাবে প্রভাতি কেবল মুচকি হাসে।এগিয়ে এসে নিলয়ের উষ্ণ হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতে নিতে বলে,’এমনিই বলিনি।আমার অপেক্ষা করতে ভালো লাগে।’

‘তাই?অপেক্ষা করতে ভালো লাগে?’

‘হু।’

‘অপেক্ষা কোনো ভালো জিনিস?’

প্রভাতি জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
‘অবশ্যই।এই যেমন আমি দাঁড়িয়েছিলাম এতোক্ষণ।বার বার গেটের সামনে কেউ এলেই আমার মনে হতো এটা তুমি।মনে হলেই আমার মন অস্থির হয়ে উঠতো।এই অস্থিরতা টা ভীষণ ভালো।তুমি জানো না হুমায়ুন আহমেদ কি বলেছেন?’

‘কি বলেছেন?’

‘অপেক্ষা হলো মানুষের বেঁচে থাকার টনিক।জীবনে যদি অপেক্ষাই না থাকতো,তাহলে আমরা বেঁচে থাকতাম কীভাবে?’

নিলয় কথা বাড়ালো না।শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পাশ ফিরে প্রভাতির মুখটা দেখল।কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে আজ তাকে! হতে পারে নিলয়ের চোখের ভুল।তাকে রোজ যেমন লাগে এমনই লাগছে।কিন্তু নিলয়ের তাকে আলাদা লাগছে।কারণ প্রভাতি মেয়েটার সাথে তার সখ্যতা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।এখন আর তাকে কেবলই বন্ধু বলে আখ্যা দেওয়া যায় না।সে বন্ধুর চেয়েও একটু বেশি।একটু না,অনেকখানি বেশি।

প্রভাতি মোড় থেকে সিএনজি ঠিক করে।আজ তারা রমনা যাচ্ছে।নিলয় সিএনজিতে বসেই উসখুস করতে করতে বলল,’ভাড়াতেই তো অনেক টাকা চলে যাবে।’

প্রভাতি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়।
‘যাক।টাকা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।আমার কাছে জমানো টাকা আছে।’

কথা শেষ করে সে বেশ স্বাভাবিক ভাবে নিলয়ের কপালে হাত ছোঁয়ায়।স্মিত হেসে বলে,’বাহ।জ্বর অনেকটা কমে গেছে।’

বিনিময়ে নিলয় কেবল একগাল হাসল।এসবই হচ্ছে ছুতো।বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর প্রভা দশবারের ও বেশি নিলয়ের কপালে হাত রেখে এমন করে জ্বর মেপেছে।নিলয় জানে সে জ্বর মাপছে না।সে কেবল হুট করে সবার সামনে নিলয়ের কপাল ছোঁয়ার একটা সুযোগ খুঁজছে।
তারা রমনায় পৌঁছুলো আরো চল্লিশ মিনিট পর।যাওয়ার পরেই প্রভাতি ছুটে গিয়ে একটা বেঞ্চ দখল করে।

ভীষণ দুরন্ত আর ডানপিটে এই মেয়েটা স্বভাবে নিলয়ের একেবারে বিপরীত।তবুও মেয়েটাকে ভীষণ মায়া লাগে।মনে হয় একটুখানি ভালোবাসা আর স্নেহের বাণীতে মেয়েটা গলে যায়।এতো সরল কেন এই মেয়েটা?নিলয় এই সরলতায় আটকে গেছে।প্রভাতি সবসময় বলে নিলয়কে পেয়ে তার জীবনের একাকীত্ব কেটেছে।নিলয়েরও মন চায় চিৎকার করে বলতে,’শোনো প্রভা! তুমি আসার পর আমার পুষ্পবিহীন বাগানে সুন্দর একটা ফুল ফুটেছে।আমি রোজ সেই ফুলের যত্ন নেই।ফুলটা বড্ড বেশি আদুরে!’

‘প্রভা! আমরা বিয়ে করছি কবে?’

প্রভাতি কথার মাঝেই আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে ভড়কে গেল।আশ্চর্য হয়ে পাশ ফিরে জানতে চাইল,’কি?কি করছি আমরা?’

নিলয় নির্বিকার।পুনরায় ভাবলেশহীন হয়ে বলে,’বিয়ে।শুধু শুধু অকারণে বিয়ে টা পিছিয়ে লাভ কি?দু’জনই যখন রাজি,তখন বিয়ে টা করে নিলেই হয়।’

প্রভাতি বিষম খায়।কাশতে কাশতে কেবল ফ্যাল ফ্যাল চোখে নিলয়কে দেখে।কি বলল নিলয়?তারা বিয়ে করবে?সময় গড়ায়।অথচ তার চোখের বিস্ময় কাটে না।প্রভার সত্যি সত্যি বিয়ে হবে?তারপর বাস্তবিক অর্থে তার মাথার উপর একটা স্থায়ী ছাদ হবে।অন্তত একজন মানুষ থাকবে যাকে প্রভা জোর গলায় নিজের বলতে পারবে।স্বজনবিহীন জীবনে এই বিয়ের প্রস্তাবটা কি এক নিমিষেই হজম করার মতো?
.
.
.
.
“তুমি যাও যাও যাও,
পরিচিত কোনো ডাকে,
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।

পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ আধার ঘনালে নীড়ে ফিরে আসে।অথচ আমার ভেতরে থাকা ছোট্ট প্রাণটা নীড়ে ফেরেনি।মায়ের সাথে অভিমান করে সে চিরতরে হারিয়ে গেছে।আমার একটা ভুল,একটা খামখেয়ালি তে আমার বাচ্চাটা শেষ হয়ে গেল।এই যন্ত্রণা আমি কোথায় রাখি?কেমন করে এটা আমি সহ্য করব যে সে আর নেই।সে আমার বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু ছিল।আমি নিজের দোষে তাকে হারালাম।আরহাম যত যাই বলুক,আমি জানি দোষটা আমারই।

আমার ছোট্ট সোনামণি,
তুমি কি মায়ের সাথে অভিমান করেছ?মা একটু সচেতন হলে নিশ্চয়ই তোমার সাথে এমন হতো না।তোমাকে মা দেখিনি।কিন্তু তুমিও তো মায়ের আদরের বাচ্চাই ছিলে।তুমি জানো বিগত সাতদিন মা ঘুমুতে পারিনি।অনুশোচনা আর অনুতাপে দ’গ্ধ হচ্ছি প্রতিনিয়ত।আমার বাচ্চাটা আর নেই।আমি আর পেটে হাত রেখে মুচকি হাসার কোনো কারণ পাই না।আমি কিভাবে এই যন্ত্রণা বাকিদের বোঝাই?

আরহাম আমাকে খুব করে বোঝায়।তার একটা কথা,যাকে দেখিনি তার জন্য এতো কাঁদার কি মানে?আমি কেমন করে বোঝাই স্রষ্টা মায়েদের এভাবেই বানিয়েছেন।আমরা আমাদের গর্ভের সন্তানকেও ততখানি ভালোবাসি,যতখানি ভালোবাসি আমাদের সামনে থাকা সন্তানকে।

সন্তান হারানোর এই যন্ত্রণা আমি তাও সহ্য করে নিচ্ছিলাম।তারপর সেদিন রিপোর্ট দেখে জানলাম আমার যা শারিরীক অবস্থা,তাতে আমার পক্ষে কনসিভ করা সম্ভব হলেও পুরোপুরি নয় মাস একটা বাচ্চাকে সুস্থ ভাবে নিজের গর্ভে রাখার সক্ষমতা আমার নেই।এই জিনিসটা আমায় পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে।আরহামের একটা সন্তানের ভীষণ ইচ্ছে।আমি এই ইচ্ছে পূরণ করব কীভাবে?আমি কি কোনোদিনই মা হতে পারব না?নয় মাস একটা বাচ্চাকে নিজের মধ্যে ধারণ করার যে অনুভূতি সেটা কোনোদিন আমার জীবনে আসবে না?আমার জীবন এমন কেন?সবকিছুই এমন আধা আধা কেন আমার জীবনে?

আমি সহ্য করতে পারছি না এই মানসিক যন্ত্রণা।আরহাম মুখে যতই বলুক,আমি জানি উনিও ব্যাপারটাতে কষ্ট পেয়েছেন।উনার তো সন্তান চাই।এখন উনি কি করবে?আরেকটা বিয়ে করবে?এরপর আমি কোথায় যাব?আমার কি হবে?আমার তো কেউ নেই।”

এইটুকু লিখে সে থামে।কান্নার দমকে তার হেঁচকি উঠে যাচ্ছে।সে সামনে এগোতে পারছে না।কলমটা বন্ধ করে সে মুখ চেপে আরো কিছুক্ষণ টেনে টেনে শ্বাস নেয়।

আরহাম নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে।সে জানতো আসার পর এমন কিছুই হবে।পরীর এই রোজ রোজ কান্নাকাটি নতুন কিছু না।সে চুপচাপ তার খাটে গিয়ে বসল।কারো অস্তিত্ব টের পেতেই নবনীতা মাথা ঘুরিয়ে তাকে দেখে।তারপর ক্লান্ত পায়ে হেঁটে তার মুখোমুখি গিয়ে বসে।আরহাম চোখ তুলে একবার তার মুখটা দেখল।পরে আবার মাথা নামিয়ে নিল।

বেডশিটে আনমনে আঁচড় কাটতে কাটতে আরহাম বলল,’আমি অবাক হচ্ছি পরী।কোন মেয়ে কে আমি বিয়ে করেছি,আর কোন মেয়ের সাথে আমি সংসার করছি।তুমি এতো দুর্বল পরী! একটা সামান্য বিষয়ে এমন ভেঙে যাচ্ছ?’

‘সামান্য বিষয়?আমার কখনো বাচ্চা হবে না।এটা সামান্য বিষয়?’

‘হবে না বিষয় টা এমন না।আপাতত হচ্ছে না।কয়েক বছর অপেক্ষা করি।এরপর তো হতেও পারে।’

‘আমি জানি হবে না।’

‘তুমি সব জানলে আর আমার সাথে কথা বলছ কেন?তুমি যা জানো তা নিয়েই থাকো।’

নবনীতা চাপা স্বরে বলল,’আমার কপালে আসলে সুখই নাই আরহাম।’

আরহাম মৃদু হাসল।একহাতে নবনীতার একটা হাত টেনে ধরে বলল,’মন খারাপ করে না পরী।অনেক তো কান্নাকাটি করেছ।এখন এসব ভুলে যাও।আগের মতো মন দিয়ে সংসার করো।বাচ্চা নিয়ে অতো তাড়া কিসের?এখনো তো পঁচিশও হয়নি।সাতাশ আটাশ বয়স পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতেই পারি তাই না?’

নবনীতা এক মনে তার কথা শুনল।সে কথা শেষ করতেই নবনীতা অকস্মাৎ তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।অষ্টাদশী মেয়েদের ন্যায় নাক টেনে টেনে ভীষণ আবেগী হয়ে বলল,’আরহাম আমার যদি আটাশেও বাচ্চা না হয় তাহলে কি আপনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকটা বিয়ে করবেন?’

আরহাম হকচকায়।পরক্ষণেই আবার স্থির হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।তার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,’হুম করব।তুমি না পারলে আরেকজন লাগবে না?আমি তো বিয়েই করেছি বাচ্চার জন্য।’

চকিতে মাথা তুলে নবনীতা।তার অবিশ্বাস্য চাহনি দেখেই আরহাম ফিক করে হেসে দিলো।নবনীতা পুনরায় তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,’আমি শেষ হয়ে যাব আরহাম।সত্যি সত্যি শেষ হয়ে যাব।আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই।’

আরহাম তাকে টেনে নিজের আরো কাছাকাছি আনে।তার মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কপালে দীর্ঘ চুম্বন খেয়ে বলে,’পরী! অবশ্যই আমরা সবাই চাই আমাদের একটা সুন্দর সংসার হোক,সন্তান হোক।সবাই চায়।আমি চাই,তুমি চাও।এটা স্বাভাবিক তাই না?কিন্তু এর মানে এই না যে শুধু সন্তানের জন্যই আমরা স্ত্রীকে চাই।মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি জানি না,তবে আমার মনে হয় ছেলেরা সংসারে একটু শান্তি চায়।পিচ অব মাইন্ড যেটাকে বলে।আমি ঘরে এলাম,এসে দেখলাম তুমি খাবার সাজিয়ে আমার অপেক্ষা করছো,,আমার শরীর খারাপ,তুমি আমার যত্ন করছ,,আমার মন ভালো না,তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে আমার মন ভালো করে দিচ্ছ,,এই জিনিস গুলো খুব প্রিশিয়াস পরী।অবশ্যই আমি চাই আমার সন্তান হোক,আমাকে বাবা বলে ডাকুক।কিন্তু তার চেয়েও বেশি আমি তোমাকে চাই।তুমি সবসময় বলতে না যে পৃথিবীতে মানুষ কখনোই সব পায় না।এই পাওয়া না পাওয়ার মাঝে আমি না হয় তোমাকেই বেছে নিলাম।এবার খুশি?’

নবনীতা তাকে ছাড়ল না।উল্টো হাতের বন্ধন আরো বেশি জোরাল করে বলল,’আর যদি আমি মা’রা যাই,তাহলে কি আপনি আরেকটা বিয়ে করবেন?’

****

গাঢ় লাল কাতানের শাড়িটা গায়ের সাথে ধরেই প্রভাতি মুচকি হাসে।ঘড়ির কাঁটাতে সময় তখন রাত আটটা।তার তৈরি হতে হতে নয়টা বাজবে।আর কাজি অফিসে যেতে হয়তো দশটার মতো বাজবে।

আজ তার আর নিলয়ের বিয়ে।তাও আবার এই রাতে।এই সিদ্ধান্ত নিলয়ের।দিনে তার একটা পরীক্ষা আছে।তাই সে ভেবেচিন্তে সময় ঠিক করেছে রাতে।প্রভাতি অবাক হয়ে বলল,’এই রাতে কাজি অফিস খোলা থাকবে?’

নিলয় ভাব দেখিয়ে বলেছে,’কাজি অফিস দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে।’

প্রভাতির অবশ্য তৈরি হতে এতো সময় লাগল না।সে নয়টার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।রাস্তায় নেমেই সে এদিক সেদিক দেখে লোকাল বাসের খোঁজ করে।নাহ,এই সময়ে বাস পাওয়া যাবে না।টেম্পু পাওয়া যেতে পারে।

টেম্পুতে উঠেই সে কতোক্ষণ নিলয়কে গালমন্দ করল।এটা কোনো সময় হলো বিয়ে করার?বাস নাই,কিচ্ছু নাই।একটু পরেই আবার তার মন ভালো হয়ে গেল।আজ তার বিয়ে।এটা ভাবলেই তার লজ্জা লাগে,আনন্দ হয়।উফফ,রাস্তাটা আজ এতো বড় মনে হচ্ছে কেন?গন্তব্য এতো দূরে কেন?আর অপেক্ষা করতে পারছে না প্রভা।

কাজি অফিসের সামনে এসেই প্রভাতির চোখ আপনাআপনি বড় হলো।সে ভেবেছিল নিলয় তার আগে আসবে।কিন্তু নিলয় আসেনি।করিডোরে পাতা বেঞ্চ গুলো একদম ফাঁকা।

সে চুপচাপ হেঁটে বেঞ্চে গিয়ে বসে।অফিসের পিওন তাকে দেখেই এগিয়ে গেল।নিচু স্বরে জানতে চাইল,’বিয়ে করবে তুমি?’

সে চকিতে মাথা তুলে।সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলে,’জ্বী।’

‘বর কোথায় তোমার?’

‘আসেনি এখনো।আসবে একটু পর।’

লোকটা চলে গেল।প্রভাতি বেঞ্চে হেলান দিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।সময় যতো গড়াচ্ছে,ঠান্ডা তত বাড়ছে।সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে একটা শাল বের করে গায়ে জড়ায়।খানিকটা বিরক্ত হয়ে নিলয়ের নম্বরে ফোন দেয়।আজ সকালের পর তার সাথে আর প্রভাতির কথা হয়নি।

নিলয়ের ফোনটা বন্ধ।প্রভাতির বিরক্তিভাব দ্বিগুন হলো।সে থমথমে মুখে দুই হাত বগলদাবা করে বসে থাকলো।নিলয় আসলে সে দশ মিনিট তার সাথে কোনো কথা বলবে না।এতো দায়িত্ব জ্ঞানহীন মানুষ হয়?

সে অপেক্ষা করে।রাত দশটা থেকে এগারোটা,এগারোটা থেকে বারোটা হলো।কাজি অফিসের বাইরে লোক সমাগম একেবারেই কমে এল।একসময় কেবল অবশিষ্ট রইল প্রভাতি আর অফিসের পিওন।প্রভাতি একটা নিশ্বাস ছেড়ে আবারো রাস্তার দিকে তাকায়।তার বুকে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে।নিলয় এখনো আসছে না কেন?কি হয়েছে তার?তার চোখ ফেটে কান্না আসছে।সে আবারো অপেক্ষা করে।সরল সোজা মেয়েটা টের পেল না তার এই অপেক্ষা আমরণ।নিলয় ফিরবে না,কোনোদিনই ফিরবে না।এই অপেক্ষার কোনো অন্ত নেই।প্রভাতির অপেক্ষার কোনো শেষ নেই।যেই অজানা গন্তব্যে নিলয়ের আত্মা পাড়ি জমিয়েছে,সেখান থেকে আর কারো পক্ষে ফেরা সম্ভব না।আজ পর্যন্ত কোনো জীব সেখান থেকে ফিরে আসতে পারে নি,কোনোদিন পারবেও না।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণ পর্ব-৫৫

0

#কোনো_এক_শ্রাবণ[তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৫)[প্রথম অংশ]

‘হেলমেট পরে রিকশায় উঠে কেডা?এটা কি কোনো হুন্ডা?’

আবাসিক এলাকার মধ্যে দিয়ে ধীর গতিতে চলমান রিকশার চালক অত্যন্ত বিরক্ত আর লটকানো মুখে মাথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে।কোঁচকানো চোখে পেছনের সিটে থাকা নর নারী দু’জনকে দেখে।

মেয়েটার পরনে মেরুন রঙের তাঁতের শাড়ি।আর ছেলেটার পরনে কালো টি-শার্ট।জামা কাপড় বেশ ভালো,পরিপাটি।তা নিয়ে চালকের কোনো সমস্যা নেই।তার সমস্যা ছেলেটার মাথার হেলমেট নিয়ে।এই দিনে দুপুরে হেলমেট পরে কে ঘুরে?তাও আবার রিকশাতে বসেছে হেলমেট পরে।মাথায় সমস্যা নাকি?

তার কথায় পেছনের সিটে থাকা ছেলেটা দ্বিগুন বিরক্ত হয়।দাঁতে দাঁত চেপে সে তিতিবিরক্ত মেজাজে জবাব দেয়,’তোর সমস্যা কি আমার মাথায় হেলমেট থাকলে?তুই তোর রিকশা চালা।আমার মাথায় আমি হিলটন টাওয়ার নিয়ে ঘুরলেও তোর সমস্যা কি?’

পাশে থাকা মেয়েটা তৎক্ষনাৎ তার হাত চেপে ধরে।চোখ পাকিয়ে ইশারায় বোঝায় এসব কথা বলা একদমই অনুচিত।সে কিছুটা শান্ত হয়,তবে বিরক্তিতে কুঁচকে ফেলা ললাট আর মসৃণ হয় না।কিছুক্ষণ এদিক সেদিক দেখে সে অবশেষে আলতো হাতে মেয়েটির একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।রোগা পাতলা গড়নের মেয়ে মানুষটি মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকায়।এই অতিমাত্রায় নিরীহ মেয়েটির প্রতি তার এক আকাশ মায়া।সে একদমই পারে না তাকে এড়িয়ে যেতে।তার ভালো লাগা,মন্দ লাগা সবকিছু নিয়ে তার মাথাব্যথা আছে।

আরহাম আর কথা বাড়াল না।তার শিরা উপশিরার ছুটতে থাকা রক্ত সামান্য একটু প্রশান্তির খোঁজে ব্যস্ত।যেই মেয়েটা কাছে এলো,ওমনি তার চটে যাওয়া মেজাজ শান্ত হলো।মাঝে মাঝে সে নিজেকেই বুঝে উঠতে পারে না।এই যে আজকে সে সমস্ত ব্যস্ততা কে একপাশে সরিয়ে এই মেয়েটির মন ভালো করার নিমিত্তে এমন ছুটে এসেছে তার কাছে।নিজের পরিচয় গোপন করতে তাকে সারাক্ষণ মাথার উপর এই ভারি হেলমেট পরে থাকতে হয়।অথচ তার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে এই মেয়েটির ভালো থাকা,তার খুশি থাকা।প্রিয়তম’র সাথে একান্তে রিকশা ভ্রমণ তার ভীষণ পছন্দ।শুধুমাত্র তার পছন্দ বলেই প্রিয়তম দুইদিন পর পর তাকে নিয়ে এভাবে ঘুরতে বের হয়।

রবীন্দ্র সরোবরের সামনে এসে রিকশার চাকা থামল।আরহাম এক লাফে রিকশা থেকে নেমে ভাড়ার ঝামেলা মেটাল।নবনীতা নেমেই চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখল।কি সুন্দর মনোরম পরিবেশ!তাদেরই মতোন কপোত-কপোতীরা হাতে হাত রেখে হাঁটাহাঁটি করছে।কেউ আবার পাশাপাশি বসে গল্প করছে নিজেদের মতো।হঠাৎই তার চোখ গিয়ে থামে একেবারে উত্তর দিকের একটা সিঁড়িতে।দেখতে পায় চঞ্চল চপলা মেয়েটি আইসক্রিম খেতে খেতে একহাত নেড়ে অনর্গল কারো সাথে কথা বলে যাচ্ছে।নবনীতার কপালে ভাঁজ পড়ে।সে একহাতে আরহামের শার্ট টেনে কুঁচকানো মুখে প্রশ্ন করে,’এটা রিমি না আরহাম?’

আরহাম তার দৃষ্টি অনুসরন করে সামনে দেখল।দেখেই চওড়া গলায় বলল,’আরে আরে তাই তো।সাথে কে?ওয়াজিদ নাকি?’

___

বিয়ের আগে রিমি প্রায়ই নবনীতার সাথে রবীন্দ্র সরোবরে এসে গল্প করত।বিয়ের পর পুরো জীবনের রুটিনই পাল্টে গেছে।এই জীবনটাও অবশ্য রিমির খারাপ লাগে না।স্বামী সংসার সবকিছুই তার ভালো লাগে।ওয়াজিদ আজ বাড়ি ফিরে বলছিল সে আর রিমি কোথাও ঘন্টা দুয়েকের জন্য ঘুরতে গেলে ভালো হয়।ঢাকায় ঘুরাঘুরির জায়গার অভাব নাই।কিন্তু কয়েক ঘন্টায় ঘুরে আবার বাড়ি ফেরা যায়,এমন জায়গা আছে হাতে গোনা।হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান,নয়তো রমনা,নয়তো রবীন্দ্র সরোবর,চাইলে আবার ধানমন্ডি লেক।রিমি এদের মধ্যে রবীন্দ্র সরোবরই বেছে নিল।এখানে আসার পর তার মুখ আর বন্ধ নেই।একটার পর একটা খাবার খেয়েই যাচ্ছে।ওয়াজিদ মাথা নামিয়ে ফোন স্ক্রল করছে।রিমির সাথে ঘুরতে তার ভালোই লাগে।কিন্তু চারপাশে এতো মানুষের মাঝে তার কিছুটা অস্বস্তি হয়।সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক সংঘটনের সদস্য।ছাত্ররা প্রায় সবাই তাকে চেনে।বড় ভাই বউ নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে ঘুরাঘুরি করছে,এ বড় লজ্জার ব্যাপার।ওয়াজিদের অন্তত তাই মনে হয়।

আচমকা তাদের সম্মুখে একজন যুবক এসে দাঁড়াল।ওয়াজিদ চমকে মাথা তুলে তার মুখ দেখার চেষ্টা করে।সে মাথা তুলতেই ছেলেটা দুষ্টু হেসে বলল,’কিরে?কল দিলে ধরিস না কেন?সারাদিন বউ নিয়ে পড়ে থাকলে হবে?আমাদের কথাও তো ভাবতে হবে ব্রো।’

ওয়াজিদ থমথমে মুখে সামনে দেখে।সামনের যুবকটা কথা শেষ করতেই সে বরফ শীতল কন্ঠে জবাব দেয়,’তোর কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছি না।যা এখান থেকে।’

‘যাবো মানে?আমার বন্ধুর কাছ থেকে আমি কেন যাব?’
বলেই সে একদম তার পাশ ঘেঁষে বসল।রিমি তার উপস্থিতি দেখতে পেয়েই সরে এলো।দ্রুত ডানে বামে দেখে অন্য কাউকে খোঁজার চেষ্টা করল।সে খুঁজে পাওয়ার আগেই নবনীতা কোথা থেকে ছুটে এসে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল।দীর্ঘদিন পর নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর জোরাল আলিঙ্গনে রিমি শব্দ করে হেসে ফেলল।খুশিতে তার চোখ ভরে গেছে।সে বিনিময়ে তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,’অনেক মিস করি তোকে।কোথায় থাকিস সারাদিন?ফোনটাও তো ধরিস না ঠিক মতো।’

‘আরশাদের জ্বর,তাসনুভার ঠান্ডা কাশি,আমার নিজের শরীর খারাপ।সব মিলিয়ে খুবই বাজে অবস্থায় আছি।একটু আগেও বমি করে বেসিন ভাসিয়েছি।শরীরটা এত্তো খারাপ লাগে! ভাবছি কালই ডাক্তার দেখাবো।’

রিমি আর নবনীতা আরো আধঘন্টার মতো নিজেরা নিজেরা কথা বলল।কতোগুলো দিন পর তাদের দেখা হয়েছে।জীবন কতো গতিময়! কতো দ্রুত সবকিছু পাল্টে যায়।রোজ রোজ যেই মুখ গুলোর সাথে আমাদের দেখা হতো,গ্র্যাজুয়েশনের পর সংসারের জালে জড়িয়ে গেলে সেভাবে আর ঘন ঘন দেখা করা সম্ভব হয় না।রিমিদেরও আর রোজ রোজ দেখা হয় না।অথচ একটু দেখা হতেই মনে হয় এভাবেই অহেতুক কথা বলে সারাজীবন কাটিয়ে দিলে মন্দ হয় না।

__

আরহাম আনমনে উদাসীন চোখে সামনে দেখে নিজ থেকে প্রশ্ন করে,’ভাই! তুই আমার উপর এখনো রাগ?’

ওয়াজিদের দৃষ্টি নত,চোখের ভাষা অস্পষ্ট।আরহামের কথার প্রেক্ষিতে তার মুখোভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।সে আগের মতোই নির্লিপ্ত,শান্ত।

আরহাম তার হাত ঝাকায়।ওয়াজিদ সেভাবেই মাথা নামানো অবস্থায় জবাব দেয়,’না,রাগ না।’

‘তাহলে আমার ফোন ধরিস না কেন?পার্টি অফিসে আসিস না কেন?’

‘ব্যস্ত থাকি।কাজ থাকে,তাই আসতে পারি না।’

‘মিথ্যা বলিস কেন?তুই আমার সাথে রাগ।’

ওয়াজিদ একট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার চোখের দিকে তাকালো।মুখে কোনোরকমে একটা বিষন্ন হাসি ফুটিয়ে বলল,’তোর জীবন,তোর সবকিছু।আমি কেন তোর সাথে রাগ হবো?তুই বলেছিস তোর ব্যাপারে কথা কম বলতে।তাই আমি কথা কম বলি।’

আরহাম উত্তর শুনেই নাক ছিটকায়।ওয়াজিদের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বিরক্ত হয়ে বলে,’উফ মন থেকে বলি নি।মাথা ঠিক ছিল না আমার।’

‘এখন আর মাথা ঠিক করতে হবে না।সেভাবেই থাক।’

‘ওয়াজিদ!’

মৃদু হুংকারেও তার কোনো ভাবোদয় হলো না।এক ঝাড়ার নিজের কাঁধ ছাড়িয়ে নিয়ে সে রাগত স্বরে বলে,’বিরক্ত লাগে।যা তো।’

আরহাম কয়েক পল তাকে দেখে।তারপর হঠাৎই সবার সামনে এক ঝাপ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।ওয়াজিদ তার এহেন আচরণে হকচকিয়ে উঠে চেঁচায়,’আরে হচ্ছে টা কি?ছাড় বলছি।’

‘না ছাড়ব না।’

‘আরহাম!বিরক্ত লাগছে।’

‘লাগুক।’

‘সমস্যা কি তোর?কি চাস তুই?’ বিক্ষিপ্ত মেজাজে প্রশ্ন ছুড়ে ওয়াজিদ।

আরহাম তাকে জড়িয়ে ধরেই অস্পষ্ট আওয়াজে বলল,’তোকে চাই।তুই আমার সাথে কথা বল,আমাকে জ্ঞান দিস,আমার ভুল ধরিয়ে সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করিস ,সেটা চাই।’

ওয়াজিদ নিরুত্তর।কেবল ডান হাতটা তুলে হালকা করে আরহামের পিঠে রাখল।

‘ওয়াজিদ!’

‘কি?’

‘সরি ভাই।প্লিজ এভাবে ইগনোর করিস না।’

‘আচ্ছা করব না।আগে কসম কাট তুই ওমনভাবে আর আমার সাথে কথা বলবি না।’

‘আচ্ছা যা কসম।তাও একটু ভালো করে কথা বল আমার সাথে।প্লিজ ভাই।’
.
.
.
.
‘প্রভা,প্রভা! দাঁড়াও একটু।’

প্রভাতি ঘুরে দাঁড়ায়।অবিশ্বাস্য চোখে সামনে দেখে বলে,’নিলয়! তুমি?’

দু’জনের দুরত্ব যখন দুই হাতের মতো,তখন নিলয় অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,’আমি আজ তোমার সাথেই যাবো।’

‘আর তোমার ক্লাস?তোমার ক্লাস তো আজ আরো এক ঘন্টা পর শেষ হওয়ার কথা।’

‘ক্লাস একটা মিস দিয়েছি।করব না ঐটা।’

প্রভাতি তীক্ষ্ণ চোখে একনজর তাকে দেখল।তারপরই ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’আচ্ছা।চলো তাহলে।’

নিলয় ঘাম মুছতে মুছতে সামনের দিকে পা বাড়ায়।সে সাধারণত ক্লাস মিস দেয় না।আজ কেন দিয়েছে সে জানে না।যেই শুনেছে প্রভাতির শেষ ক্লাসটা ক্যানসেল হয়ে গেছে,ওমনি সে নিজেও তার শেষ ক্লাসটা করেনি।গত কিছুদিন যাবত সে প্রভাতির সাথেই বাসে করে বাড়ি ফিরে।আজ প্রভাতি চলে গেলে তার একা ফিরতে হতো।শুধুমাত্র সফরসঙ্গী হিসেবে প্রভাতিকে পাওয়ার অভিপ্রায়ে সে ক্লাস মিস দিয়েছে।আজকাল নিলয়ের একাকিত্ব ভালো লাগে না।মনে হয় প্রভাতি নামের ট্যাপ রেকর্ডার সারাক্ষণ কানের কাছে প্যাক প্যাক করলে ভালোই লাগে।কেমন একটা খুশি খুশি লাগে সবকিছু।

প্রভাতি সামনে হাঁটতে হাঁটতে জানতে চায়,’ঐ বান্দর গুলা তোমাকে আর জ্বালাতন করেছে?’

‘না,করেনি।শুধু তাকায়।কিন্তু কিছু বলে না।’

‘বলবেও না।ভাইয়াকে দিয়ে ওয়াশ দিয়েছি তো।এখন আর কিছু বলবেও না।’

‘তোমাকে ধন্যবাদ। আমার কথা এতোটা ভাবার জন্য।’

প্রভাতি ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখল।রোদে ঘেমে ঘেমে তার অবস্থা খারাপ।সে নিজের মাথায় থাকা ঘোমটা ঠিক করতে করতে উৎসাহী গলায় বলল,’এসির ঠান্ডা বাতাস খেতে চাও?’

নিলয় বিস্ময়ে নেত্রযুগল প্রসারিত করে।
‘খেতে তো চাই।কিন্তু কিভাবে কি?’

প্রভাতি ঠোঁট টিপে হাসল।হাসির মাঝেই বলল,’দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমায়।’

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটু দূরেই কয়েকটা ব্র্যান্ডেড দোকানের শো রুম ছিল।প্রভাতি নিলয় কে নিয়ে সেগুলোর একটাতে গেল।নিলয় চমকে উঠে বলল,’এতো দামি দোকানে এসেছ! এখানে তো প্রচুর দাম জিনিসের।’

‘তো?আমি কি কিনতে এসেছি?আমি এসেছি ফ্রি তে এসির বাতাস খেতে।আধঘন্টা কাপড়গুলো নেড়ে চেড়ে দেখব।তারপর নাক ছিটকে বেরিয়ে আসব,যেন দেখে মনে হয় কোনো কাপড়ই আমাদের পছন্দ হয়নি।আইডিয়া টা ভালো না?’

নিঃসংকোচে জবাব দিলো প্রভাতি।নিলয় গোল গোল চোখে তার দিকে তাকায়।বিস্ময়ে তার চোয়াল ঝুলে গেছে।সে হতভম্ব হয়ে বলল,’কি সাংঘাতিক! এসির বাতাস খাওয়ার জন্য এতো কিছু?’

‘হ্যাঁ তো কি হয়েছে?নিজের তো এসিতে থাকার মুরদ নেই।তাই বলে কি এসির বাতাস খাবো না?শোন নিলয়,আমি মনে করি আমাদের সারাদিন অভাব অনটনের কেচ্ছা না শুনিয়ে অভাবের মধ্যেও ভালো থাকার উপায় খুঁজে নেওয়া উচিত।আমি সবসময় সেটাই করি।ইচ্ছে থাকলে আর্থিক সমস্যাকে এক পাশে সরিয়েও জীবন উপভোগ করা যায়।হয়তো সেই জীবন বিলাশবহুল হয়না বড়লোকদের মতো।কিন্তু আনন্দবহুল যে হয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
.
.
.
.
সারাদিনের ক্লান্তি আর বিগড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে আরহাম বাড়ি ফিরল রাত দশটা পঞ্চাশের দিকে।এসেই সে কতোক্ষণ টানা গালমন্দ করল।কাকে গালমন্দ করছে সে নিজেও জানে না।

আজ তার মেজাজ ভয়াবহ রকমের খারাপ।সে কালকে আবির আর দ্বীপকে নিলয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ঝাড়ি মেরেছে।একদিকে নবনীতার মন খারাপ,অন্যদিকে ওয়াজিদের উপদেশ,সাথে প্রভাতির বিশ্বাস ভরসা,সবকিছুর কথা একসাথে চিন্তা করে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে তার ছেলেদের সে অল্প স্বল্প শাসনের মধ্যে রাখবে।এটা একদমই হয় না যে সে একজন সংসদ সদস্য হয়ে এভাবে এদের অন্যায়কে লাই দিবে।একটুখানি এথিকস তো থাকা উচিত।আর সে নেতা হয়ে ঐসব ছেলেদের এমন মেনে চলবে কেন?তার কি কোনো ক্ষমতা নেই?এখন থেকে সে আর এসব মুখ বুজে সহ্য করবে না।যেই বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে প্রভা তার কাছে এসেছিল,সেই আস্থার সে সামান্য হলেও মূল্য দিবে।

কিন্তু তার এই মূল্য দেওয়াটা সম্ভবত কারো ভালো লাগছে না।জালালুর রহমান আজ দুই ঘন্টা তাকে জ্ঞান দিলেন।সে যা করছে সেটা নাকি তার জন্য ভালো হচ্ছে না,ভবিষ্যতে তাকে পচতাতে হবে।কেবল একটা মেয়ের বিচারের প্রেক্ষিতে ঐ ছেলেদের কিছু বলা তার একদমই উচিত হয়নি।সে বোকামি করছে,সে অবুঝের মতো কাজ করছে আরো কতো কি।আরহাম অনেকক্ষণ তার অহেতুক বকবক সহ্য করেছে।তারপর বিরক্ত হয়ে সবকিছু ফেলে চলে এসেছে।বিরক্তিতে বারবার তার মুখ কুঁচকে যাচ্ছে।এতো মানুষের এতো কথা,এতো পরামর্শে তার মাথা ঘুরায়।একজন বলে এটা ঠিক,আরেকটা বলে ঐটা ঠিক,আরহামের মনে হয় এরা দু’জনই ভুল,কেবল সেই ঠিক।এতো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে সে চলবে কেমন করে?

এখন তার পরীকে প্রয়োজন।সে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ধপ করে পরীর কোলে মাথা রাখবে।আর পরী তার কোমল হাত দু’টো দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে।তখন এই সমস্ত দিনের ক্লান্তি,মন খারাপ এক নিমিষেই ভালো হয়ে যাবে।সে আর কোনোদিকে না দেখে সোজা নিজের ঘরের দিকে ছুটলো।

ঘরের দরজা খোলা।আরহাম ভেতরে ঢুকেই চারপাশ দেখে বলল,’সেনোরিটা! কোথায় তুমি?আরশাদ কোথায়?’

পুরো ঘর নিস্তব্ধ।কোনো শব্দ নেই,কারো কোনো বিকার নেই।আরহাম কিছুটা চমকায়।এমন তো হওয়ার কথা না।এই সময়ে তাসনুভা আদি সবাই তার ঘরেই থাকে।ঘর আজ এতে খালি কেন?

হঠাৎই তার চোখ যায় বেড বক্সের উপর।যেখানে একটা কাগজ ভাজ করে রাখা।কাগজের উপর একটা পেপার ওয়েট।আরহাম কপালে ভাঁজ ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায়।অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খোলে।দেখতে পায় কাগজের লিখাগুলো সব নবনীতার হাতে লিখা।

প্রিয় আরহাম,
সালাম নিবেন। সাথে নিবেন এই ব্যর্থ স্ত্রীর ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় আপনার হৃদয়ের কিয়দংশও পরিবর্তন হয়নি।আমি আপনাকে দোষ দিচ্ছি না,নিজেই দোষী হচ্ছি।আমিই সম্ভবত আপনাকে কোনোদিন আমার দিকটা বোঝাতে পারি নি।আমিই কোনোদিন বোঝাতে পারি নি আমি আসলে কি চাই।আপনি আমার অনুভূতি,আমার যন্ত্রনা গুলোকে এমন ভাবে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন যেন আমি রাস্তার ধারে পড়ে থাকা কোনো অসহায় জীব,যার কেউ নেই,কোথাও কেউ নেই।এই জীবের থেকে ভালোবাসা নেওয়া যায়,কিন্তু বিনিময়ে ভালোবাসা দেওয়া যায় না।

আপনি হয়তো জানেন,হয়তো জানেন না,কিন্তু আজ বলছি আমার বাবা আমার জীবনের প্রথম পুরুষ যাকে আমি আমার হৃদয়ের সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবেসেছি।আমার বাবা আমার শত অসুস্থতায় কোনোদিন নাক ছিটকায় নি।বাবা আমার কাছে কোনো গ্রিক পুরাণের নায়কের চেয়ে কম কিছু না।আমার বাবা মায়ের মৃত্যু আমার কাছে কতোটা যন্ত্রনার সেটা যদি আপনি জানতেন তাহলে কোনোদিন সেটাকে পুরোনো কাসুন্দি বলে দায়মুক্ত হতে পারতেন না।যাই হোক,ব্যর্থতা আমার।আমি বোঝাতে অক্ষম।আপনি আমার কসম খেয়ে বলেছিলেন আপনি রহমানের সাথে কথা বলবেন না।কিন্তু আপনি সেই কসমের তোয়াজ করেন নি।আপনি রোজ তার সাথে কথা বলেছেন,এমনকি আপনাদের অফিশিয়াল পেইজে গতকাল তার সাথে আপনার ছবিও আপলোড করা হয়েছে।আমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আপনার কাছে এতো ফিকে আরহাম?আপনার এই আচরণটা আমার বুকে লেগেছে ভীষণ।মনে হচ্ছে কলিজায় কেউ ছুরি দিয়ে আঁচড় কেটেছে।আপনি আমার কসম কেটেও দিব্যি সেটা ভেঙে আরামে আয়েসে আছেন।

আমার আত্মসম্মান ফুরিয়ে যায়নি আরহাম।শুধু সংসারে যেন কোনো ঝামেলা না হয়,সেজন্য অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করি।কারণ আমি অশান্তি চাইছিলাম না।এতো গুলো বছর পরে একটা নিজের ঘর পেয়ে আমি সবকিছু এড়িয়ে কেবল একটা শান্তির জীবন চাইছিলাম,কিন্তু সেটা অবশ্যই নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে না।যাই হোক,আপনার জীবনে আপনি সুখে থাকুন,ভালো থাকুন।কয়টা দিন আমাকে একা থাকতে দিন।আরশাদকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছি।তার ঘ্যান ঘ্যানানি,আমার জ্ঞান কোনোটাই এখন আর আপনাকে শুনতে হবে না।আপনি আরামে থাকুন।আমাকে ঘুমে রেখে এখন আর কষ্ট করে বারান্দায় গিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে হবে না।নিজের ঘরে,নিজের খাটে শুয়েই গলা ছেড়ে চিৎকার করে কথা বলুন,কেউ কিছু বলবে না।আর পারছি না এসব সহ্য করতে।সহ্যশক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে দিন দিন,অনুভূতি সব কেমন ভোঁতা ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে।কিছুতেই কিছু ভালো লাগে না আর।নবনীতা শান্তি চায়,দু’দন্ড শান্তিতে বাঁচতে চায়।একটা সত্যিকারের ভালোবাসা চায় যে ভালোবাসা কখনোই তার নামে মিথ্যা কসম কাটবে না।আরহাম আপনি ভালো থাকুন।আপনার প্রতি অভিযোগ রাখিনি।সমস্ত দোষ আমার নিজের।আমি পুরোদস্তুর ব্যর্থ অর্ধাঙ্গিনী।যার স্পর্শে আপনি নিজের স্বরূপ ত্যাগ করতে পারেন নি।যাকগে,ভুল তো আমারই।এতো বেশি আশা করছি কেন?এখনের রাজনীতিতে ভালো বলে কিছু নেই,এটাও তো মানতে হবে নাকি?

শাহরিয়ার আরহামকে তার রাজনৈতিক জীবনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।সে যেন ক্ষমতার দাপটে সত্যকে মিথ্যা,মিথ্যাকে সত্য,সবকিছু করতে পারে।দোয়া থাকবে,নবনীতার মতো ফালতু,প্যাচিলা আর অকারণে ঝামেলা করা মেয়েটির সাথে যেন কখনোই আর তার দেখা না হয়।

ইতি,
সবসময় জ্ঞান দিয়ে আপনাকে বিরক্ত করা মেয়ে,
আপনার স্ত্রী যার মিথ্যা কসম কাটতে আপনি ওস্তাদ।

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৫)[দ্বিতীয় অংশ]

গাছের মগডালে শালিক দু’টো পাশাপাশি বসা,নিজেদের মধ্যে খুনশুটিতে ব্যস্ত।আচ্ছা শালিকদেরও কি প্রেম হয়?তারাও কি ভালোবাসা বুঝে?তাদেরও কি অভিমান হয় নিজেদের মধ্যে?যেমনটা নবনীতা আর আরহামের হয়েছে।অভিমানের পর তারা কি সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যায়?নবনীতা যেমন করে নিজের সংসার ছেড়েছে?

নবনীতা জানালা থেকে চোখ সরায়।তার আর্দ্র চোখ অন্যমনস্ক হয়ে চিত্রাকে খুঁজে।সে সম্ভবত মামির কাছে।সে আর তাকে ডাকল না।থাকুক।ঐখানেই থাকুক।নবনীতার একা থাকতেই ভালো লাগে।কাল রাতে সে এখানে এসেছে।আসার পরেই নিজের ঘরে গিয়ে কয়েকঘন্টা টানা ঘুমিয়েছে।মন খারাপ থাকলে ঘুম বেশি হয়।এই কথা সে আগেও শুনেছে।এখন বিশ্বাসও করে।এই যে তার মন খারাপ,অথচ সে দিব্যি ঘুমুচ্ছে,খাচ্ছে,যা মন চায় করছে।তার এখন কোনোকিছুই আর আগ্রহ লাগে না।

কতোক্ষণ জানালার ধারে থেকে সে আবার নিজের খাটে গিয়ে বসে।চারপাশ দেখেই সে বিদ্রুপ করে হাসল।আরহামের সাথে তেজ দেখিয়ে আবার আরহামের মালিকানাধীন এপার্টমেন্টেই এসেছে।কি হাস্যকর ব্যাপার! সে আলগোছে চোখ মুছে।আরহাম একটা ফোনও দেয়নি কাল।চিঠি নিশ্চয়ই পড়েছে।পড়েও যখন কোনো ফোন দেয়নি,তার মানে নবনীতার থাকা না থাকায় তার কিছু যায় আসে না।যায় আসার কথাও না।তার জীবনে রাজনীতি আর জালাল আঙ্কেল থাকলেই চলবে।
পরী?পরী যদি মরে লাশও হয়ে যায় তাতে তার কি?

নবনীতা আস্তে করে পালঙ্কে নিজের পিঠ ঠেকায়।দুর্বল শরীরটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।ইদানিং এতো খারাপ লাগে কেন সে জানে না।সারাদিন শরীর ভার ভার লাগে,মনে হয় শরীরের ভারে এক্ষুনি মাথা ঘুরিয়ে সে মেঝেতে পড়ে যাবে।

হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা হাতে তুলে সে রিমিকে কল দেয়।দুইবার ডায়াল হতেই কল রিসিভ হয়।

‘কিরে নবনী! তুই?এই সময়ে?সব ঠিক আছে তো?’

অন্য পাশের মেয়েটির কন্ঠে উৎকন্ঠা ভীষণ।নবনীতা মলিন হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’আছি রে বোন।ঠিকই আছি।তুই কি বেশি ব্যস্ত।বাড়ি আয় না একটু।’

‘কোথায়?ধানমন্ডি?’

‘হু?’

রিমি অন্যপাশ থেকে আর কিছু জানতে চাইল না।জিজ্ঞেস করল না কেন নবনীতা গুলশান থেকে এখানে এসেছে।নবনীতার মনে হলো মেয়েটা বিয়ের পর হঠাৎই ভীষণ বুঝদার হয়ে উঠেছে।হবে না কেন?তার বর অত্যন্ত ম্যাচিউর।ওমন সঙ্গ পেলে বুঝদার না হয়ে উপায় আছে?

নবনীতা কথা ঘুরায়।রিমির সংসার জীবনের প্রসঙ্গ টেনে আরো কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলে।রিমির সাথে কথা বললে তার শান্তি লাগে।সে যেই মনস্তাত্ত্বিক পীড়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে,সেখান থেকে তাকে বোঝা শুভি কিংবা চিত্রর পক্ষে সম্ভব না।একমাত্র রিমিই আছে যে নবনীতার মনের অবস্থা একটু হলেও বুঝতে পারবে।

কথার ফাঁকেই হঠাৎ নবনীতা মৃদু স্বরে চিৎকার করে ফোনটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে একটু দূরে ছুড়ে মারে।তারপর একহাত মুখে চেপে বাথরুমে গিয়ে গলগল করে আরেকদফা বমি করে।বমি করার পর তার মনে হলো দুর্বলতায় তার সমস্ত শরীর ভেঙে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে চেতনা হারাবে।মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে সে নিজেকে ধাতস্থ করে।বেসিনে ভর দিয়ে কতোক্ষণ শ্বাস টানে।তারপর ধীর পায়ে হেঁটে খাটে গিয়ে বসে।

ফোনের অন্যপাশ থেকে রিমির কন্ঠের জোর আরো বাড়ে।
‘এ্যাই নবনী! তোর কি হয়েছে?কোথায় তুই?কিছু তো বল।হ্যালো?’

‘রিমি!’ কাঁপতে থাকা হাতে ফোনটা কানে চাপে সে।

‘কি হয়েছে তোর?’

‘জানি না।আবার বমি হয়েছে।’

কিছুক্ষণ নিরবতা।হয়ত দু’জনই কিছু একটা অনুমান করেছে।কিছুক্ষণ পর নবনীতা নিজ থেকেই কাঁপা স্বরে বলে উঠল,’আমার এই মাসে মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল মিস গিয়েছে রিমি।এখন গুনে দেখলাম দুই সপ্তাহ আগেই ডেট চলে গেছে।’

তার কম্পমান কন্ঠ কানে যেতেই রিমি নড়েচড়ে উঠল।অতি ক্ষীণ স্বরে ফিসফিস করে বলল,’ভাইয়া জানে না কিছু তোর অসুস্থতা নিয়ে?’

‘জানত।তবে আমরা ভেবেছিলাম ফুড পয়সনিং।’

নবনীতা আবার কিছুক্ষণ টেনে টেনে শ্বাস নেয়।রিমি ব্যস্ত গলায় বলে,’দাঁড়া।আমি আধ ঘন্টার ভেতরই আসছি।তারপর সব বিস্তারিত শুনবো।’

‘রিমি!’

ফোনটা কাটতে গিয়েও আর কাটা হলো না।পুনরায় সেটা কানে চেপে রিমি বিচলিত হয়ে জানতে চায়,’কি?আর কিছু বলবি?’

‘আসার সময় একটা কিট কিনে আনতে পারবি?’ বুজে আসা চোখে থেমে থেমে জানতে চায় নবনীতা।

‘পারব,পারব।তুই রেস্ট কর।’

নবনীতা ফোন কাটে।তারপর কি একটা ভেবে নিজের পেট স্পর্শ করে।তার কেমন এলোমেলো লাগছে সবকিছু।অনুভূতি গুলো কি সত্যিই ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে?

‘মা।মা।’

সে পেছন ফিরে।আরশাদের বড় বড় চোখের দৃষ্টি চোখে পড়তেই দ্রুত হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে নেয়।আরশাদ তার কোলে আসতেই নিজেকে কি সুন্দর গুটিয়ে নিল,ঠিক যেমন করে নীড়ে ফেরা পাখির বুকে তার ছানারা আশ্রয় খুঁজে নেয়।তার বুকের ওম গায়ে লাগতেই আরশাদ খুশিতে গাল ভর্তি হাসে।নিজেকে নবনীতার মাঝে ঘাপটি মেরে বসিয়ে সে আধো আধো বুলিতে ডাকে,’মাম মা মা।আদল আদল।’

নবনীতা হাসল।চটপট তার সমস্ত মুখে চুমু খেয়ে জড়ানো গলায় বলল,’আরশুকেও অনেক অনেক আদল।’
.
.
.
.
নীল রঙা ওড়নার এক মাথায় টান পড়তেই প্রভাতি চকিতে পেছন ফিরে।পেছন ফিরতেই সে দেখল তার ওড়না একটা শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি।সে চোখ তুলে।সামনে থাকা ছেলেটাকে দেখেই কিছুটা মুখ খিঁচে বলে,’আপনি?’

আবির তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।থমথমে মুখে প্রশ্ন করে,’তুমি নাকি আরহাম ভাইয়ের কাছে আমার নামে বিচার দিয়েছ?’

প্রভাতি চোখ পাকিয়ে তাকে দেখে।বিরক্তি জড়ানো কন্ঠে উত্তর দেয়,’জ্বী না।আমি আমার কথা বলেছি।কারো নামে কোনো বিচার দেই নি।’

‘অবশ্যই দিয়েছ।তোমার বিচারের প্রেক্ষিতেই এতো কিছু হয়েছে।তুমি কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ো?’

‘জানি না।’

তার কাটকাট জবাব আবিরের পছন্দ হলো না।সে দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে,’ঐ মেয়ে।কথা কানে যায় না?কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ো?’

প্রভাতি কটমট চোখে তার দিকে তাকায়।ত্যাড়া গলায় জবাব দেয়,’বলব না।বলতে বাধ্য না।পথ ছাড়ুন।’

আবিরের রক্ত গরম হলো।এই মেয়ের ঔদ্ধত্য আচরণ তাকে অবাক করে।সে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে শক্ত করে প্রভাতির ডান হাতের কবজি চেপে ধরে।প্রভাতি তার স্পর্শ পেতেই এক লাফে দুই পা পিছিয়ে আসে,নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে জোর গলায় চেঁচায়,’হাত ছাড়ুন।এগুলো কেমন অসভ্যতা?’

আবির দমল না।উল্টো রাগে আরো বেশি রক্তিম হয়ে জবাব দিলো,’অসভ্যতা এখনো করিনি।কিন্তু এখন করব।তোর একটা শিক্ষা পাওয়ার দরকার আছে।’

প্রভাতি গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।সে যতো জোরে নিজেকে টেনে আনতে চায়,আবিরের হাতের বন্ধন তত বেশি জোরাল হয়।

নিলয় নিজের ক্লাস শেষে বেরিয়ে এসে এই দৃশ্য দেখতেই থমকে গেল।ভয়ে,আতঙ্কে তার কন্ঠ শুকিয়ে কাঠ।সে শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজায়।তারপর মলিন চোখে চারপাশ দেখে।স্টুডেন্ট রা জায়গায় জায়গায় জড়ো হয়ে আবির আর প্রভাতির কার্যকলাপ দেখছে।অথচ কেউ এগিয়ে এসে কিছু বলার মতো সাহস দেখাচ্ছে না।নিলয় কিছুক্ষণ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।যখন সে বুঝল সে বাদে আর প্রভাতিকে আবির হাত থেকে ছাড়ানোর মতো কেউ নেই,তখনই সে আর কোনো কিছু না ভেবে ছুটে যায় তাদের দিকে।গিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে খানিকটা অনুযোগ করে বলে,’আবির ভাই প্লিজ।প্রভাতি কে ছেড়ে দেন।মেয়ে মানুষ ভাই।ওকে কিছু করবেন না।মানুষ সব দেখছে।’

আবির হাত ছাড়ল না।উল্টো চোখ ঘুরিয়ে একনজর তাকে দেখল।তারপরই তাচ্ছিল্য করে বলল,’দেখুক।আমার কি?তুই সর টিউবলাইট।’

সে কথা শেষ করেই বাঁকা চোখে প্রভাতির দিকে তাকায়।তার চাহনিতেই প্রভাতির সমস্ত শরীর গুলিয়ে আসে।নিলয় ব্যথিত চোখে তার মুখটা দেখে।দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে।

প্রভাতি যথাসম্ভব নিজেকে শক্ত রাখল।নিজের চাহনিতে একমুহূর্তের জন্যও দুর্বলতা প্রকাশ করল না।কিন্তু যখনই আবির এতো গুলো মানুষের সামনে অবলীলায় তার ওড়না টেনে ধরল,তখন অপমানে,লজ্জায় তার দুই চোখ ছল ছল করে উঠল।সে ভেজা চোখে নিলয়ের দিকে তাকায়।আশেপাশের মানুষের নির্লিপ্ত আচরণ তার ভেতরের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে।সে বুঝতে পারছে তাকে বাঁচানোর মতোন কেউ এখানে নেই।নিলয় সে চোখের ভাষা বুঝল।তার হঠাৎ কি হলো সে জানে না,ছুটে গিয়ে সে কষিয়ে আবিরের ডান গালে পর পর দু’টো চড় বসাল।

প্রভাতি শব্দ শুনেই আঁতকে উঠল।ভয়ার্ত,অবিশ্বাস্য চোখে সামনে দেখে আবিষ্কার করল এই দুঃসাহসিক কাজ নিলয়ই করেছে।সে ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকায়।ক্যাম্পাস ভর্তি ছেলে মেয়েদের নজর তাদের দিকে।কি সর্বনাশ! ঘটনা এতো দূর পর্যন্ত যাক,সে কখনোই চায়নি।

নিলয় চড় মেরেই সঙ্গে সঙ্গে দুই কদম পিছিয়ে আসে।তারপরই বড় বড় চোখে নিজের হাত দেখে,তারপর দেখে আবিরের গাল।সে এটা কি করেছে?তার কি মাথা খারাপ?এতোগুলো মানুষের সামনে সে আবির কে চড় মেরেছে।নিজের আচরণে সে নিজেই হকচকায়।কাঁপা হাতে নিজের ঘাম মুছে আবিরের দিকে তাকায়।মুহুর্ত গড়াতেই একটানে প্রভাতির ওড়না তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সুন্দর করে সেটা প্রভাতির গায়ের উপর চাপায়।তারপর আর কোনোদিক না ভেবে,কোনোকিছু না দেখে খপ করে প্রভাতির একটা হাত চেপে ধরে দ্রুত সেখান থেকে সরে আসে।

সবার দৃষ্টির আড়াল হতেই নিলয় টেনে টেনে দুইবার শ্বাস নেয়।বুকের বা পাশে হাত রেখে নিজের হৃদস্পন্দন বোঝার চেষ্টা করে।হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,’বুকটা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে।’

প্রভাতি তখনো সংকোচে,দ্বিধায় আড়ষ্ট।সে কেবল মাথা তুলে বলল,’এই কাজ কেন করলে?এখন তো তুমি আরো বেশি কালার হবে।’

‘হোক।আর কোনো উপায় ছিল আমার?দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতাম?অসভ্যতা করছিল সবার সামনে।কি করার ছিল আমার?’

‘আমার সাথে অসভ্যতা করছিল।তুমি কেন গেলে?’

নিলয় চোখ মুখ শক্ত করে তাকে দেখল।চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’র‍্যাগ তো আমায় দিচ্ছিল।তুমি তোমার ভাইয়ের কাছে বিচার দিলে কেন?’

প্রভাতি চুপচাপ তাকে দেখে।নিরুত্তর হয়ে একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।অজানা আতঙ্কে তার ভেতর দুর দুর করছে।এতো গুলো মানুষের সামনে নিলয় আবিরকে চড় মেরেছে।আবির কি তাকে ছেড়ে দিবে?না,কখনো না।

***

তরুণী মেয়েটির মস্তক নোয়ানো।দৃষ্টি অস্থির,বারবার এখানে সেখানে ছুটে যাচ্ছে।চোখ দু’টো ভেজা।যতোবারই মুছে নিচ্ছে ততবারই আবার ভিজে যাচ্ছে।তার চোখ ঘুরে ফিরে তার কোলের উপর থাকা বস্তুর দিকে গিয়ে থামছে।

জ্বল জ্বল করতে থাকা দু’টো লাল দাগ।এটা কিসের প্রতীক?নবনীতার নতুন জীবনের?নবনীতার দাম্পত্যের?নাকি নবনীতার নারী হিসেবে পূর্ণতার?সে একমনে দাগ দু’টো দেখে,দেখতেই থাকে।

রিমি তার পাশাপাশি বসা।মাথা নুয়িয়ে সে নিজেও কিটটা দেখে।একহাত নবনীতার কাঁধে রেখে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে বলে,’নবনী! টেস্ট পজিটিভ এসেছে।তুই সত্যিই প্রেগন্যান্ট।আল্লাহ! কি আনন্দ হচ্ছে আমার।’

সে কথা শেষ করেই পাশ ফিরে।লক্ষ্য করে মেয়েটা অন্যদিনের তুলনায় আজ আরো বেশি শান্ত।চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ে তার কোল ভিজে যাচ্ছে,অথচ মুখ ফুটে সে এখনো কিছু বলে নি।রিমির কেমন অদ্ভুত লাগল।বাচ্চা পাগল মেয়েটা নিজের জীবনের এতো বড় একটা বিষয় জেনে সেটা নিয়ে খুশি হচ্ছে না?এটাও কি সম্ভব?তার তো এই মুহূর্তে খুশিতে পাগল হওয়ার কথা।অথচ সে একেবারেই শান্ত,খুব বেশি নির্লিপ্ত!

রিমি সামান্য ঝুকে তার মুখ দেখে।কোমল কিন্তু স্পষ্ট আওয়াজে জানতে চায়,’নবনী! তুই ঠিক আছিস?এমন চুপ মেরে বসে আছিস কেন?’

নবনীতা চোখ তুলল না।তবে আচমকাই কেমন ঠোঁট ভেঙে হু হু করে কেঁদে ফেলল।রিমি হতভম্ব হয়ে তার কান্না দেখে।নবনীতা এক নিমিষে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার বেগ বাড়ায়।ক্রন্দনরত অবস্থাতেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,’রিমি।আমার তার কথা মনে পড়ছে খুব।উনি আমাকে তিন দিনে একবারো ফোন দেয়নি।মানুষ এমন কিভাবে হয় রিমি?এতোগুলো দিনের সংসার মানুষ এক নিমিষে কিভাবে ভুলে যায়?’

রিমি দুই হাতে তাকে সামলে নেয়।সে কি উত্তর দিবে?সম্পূর্ণ পারিবারিক আর ব্যক্তিগত বিষয়ে রিমির উত্তর দেওয়া কতোটা যুক্তিসঙ্গত?সে ঐসব কথায় যায় না।কেবল একটা হাত নবনীতার মাথায় ছোঁয়ায়।জড়ানো গলায় বলে,’কান্না করে না নবনী।তোর মতো বউ যে ধরে রাখতে পারেনি,তার মতো দুর্ভাগা এই দুনিয়াতে নেই।কান্না করিস না প্লিজ।তুই মা হচ্ছিস।একটু তো খুশি হ।’

নবনীতা তার হাতের বন্ধন আরো জোরাল করল।নাক টানতে টানতে নিজের ক্লান্ত মাথাটা রিমির কাঁধে ফেলে বলল,’খুশি হতে পারছি না রিমি।মানুষ এমন দায়সারা কীভাবে হয়?আমি চলে এলাম।সেও আমায় ফেলে দিলো।ব্যাস,আমাদের সব কথা ফুরিয়ে গেল?সব বোঝাপড়া শেষ আমাদের?আমি পাশে না থাকলে নাকি তার রাতে ঘুম হয় না।তাহলে এই সাতদিন কি সে জেগে ছিল একটানা?’

তার শেষ কথাটা শুনেই রিমি খিলখিল করে হেসে ফেলল।একটা হাত পেটে চেপে বলল,’সিরিয়াসলি নবনী! তুই এসব বাচ্চাদের মতো আচরণ করছিস?এগুলো কেমন বাচ্চামো শুনি।তুই নিজেই তো ছেড়ে এলি।’

‘তো?ছেড়ে এলাম আর সে ছেড়ে দিলো?একবার আসবে না?এসে কথা বলবে না?ছেড়ে এসেছি মন খারাপ করে।সে এমন ভাব করছে যেন আমরা সেপারেশনে চলে গেছি।’

রিমি পড়েছে মহা বিপাকে।কথায় আছে,মেয়েদের বুক ফাটে,কিন্তু মুখ ফুটে না।নবনীতার হয়েছে এই দশা।বরের জন্য বুক ফেটে যাচ্ছে,অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতে তার ঘোর আপত্তি।সে কথা না বাড়িয়ে নবনীতার মাথায় হাত বুলায়।মেয়েটা কনসিভ করেছে।এই সময় তো এমনিতেই মন খারাপ থাকে।তার উপর আবার মান অভিমানের পালা তো চলছেই।নবনীতা হঠাৎই তার কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে বাথরুমের দিকে ছুটে যায়।রিমিও উৎকন্ঠায় অস্থির হয়ে তার পিছু পিছু ছুটে।দুই হাতে তার ভঙ্গুর শরীরটা আগলে ধরে ব্যস্ত হয়ে বলে,’নবনী! নবনী! তুই ঠিক আছিস?ডাক্তারের কাছে যাবি?’
.
.
.
.
নবনীতার জীবন হুট করেই কেমন ছন্নছাড়া হলো।কোনোকিছুতেই যেন আর আগ্রহ খুঁজে পায় না সে।চিত্র,শুভি,আরশাদ সবকিছুই ফিকে লাগে।মনে হয় জীবনের সিংহভাগ আনন্দই যেন গায়েব হয়ে যাচ্ছে।একটা মানুষ,তার একটা ফোনকল,তার একটু সুন্দর কথার অপেক্ষা কি কেউ এতো আকুল হয়ে করতে পারে?নবনীতা করছে।প্রতিটা মুহূর্তে,প্রতিটা সময়ে সে যন্ত্রনায় ছটফট করছে।এতো অচেনা মানুষ কেমন করে হয়।তার কি একবারও নবনীতার কথা মনে হয় না?একটা বারও এসে দেখল না নবনীতা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে?মানুষ এতো অদ্ভুত কেন?আমাদের ভালোবাসার মানুষরা এতো পাষাণ হয় কেন?

দুপুর গড়াতেই মিসেস রোকেয়া ভাতের প্লেট হাতে তার ঘরে এলেন।এই তিন বোনকে আজকাল তার আদর লাগে।বিশেষ করে চিত্র কে।মেয়েটা তাকে এত্তো ভালোবাসে! মিসেস রোকেয়া ভেবেই পান না তার মাঝে কি এমন আছে যার জন্য চিত্র তাকে এতোখানি পছন্দ করে।প্রথা তার সাথে একটু বোয়াদবি করলেই চিত্রা ক্ষেপাটে গলায় তার বিরোধিতা করে।মিসেস রোকেয়ার জন্য এতো টান কখনো কেউ দেখিয়েছে বলে তার মনে পড়ে না।তিন বোনকে ইদানিং তার মন্দ লাগে না।বরং এরা বাড়িতে থাকলে তার ভালোই লাগে।

তিনি চুপচাপ হেঁটে নবনীতার পাশাপাশি বসলেন।নবনীতা তাকে দেখেই একটু নড়েচড়ে উঠে।কিছু বলতে গিয়ে সে টের পায় তার কন্ঠ জমে গেছে।একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে সে ধিমি আওয়াজে বলল,’মামি,খাবো না আমি।খিদে নেই আমার।’

‘খেতে হবে।এই অবস্থায় একটু বেশি বেশি খেতে হয় পরী।’

চকিতে চোখ তুলে সে।স্তব্ধ হয়ে বলে,’মামি তুমি জানো?’

‘হুম,জানি।দুই দিন দেখেই বুঝেছি।এখন এসব ছাড়ো।এই নাও,মামি খাইয়ে দিচ্ছি।এই অবস্থায় একটু মন খারাপ হয়ই।এসব মন খারাপ এক পাশে সরিয়ে খেয়ে নাও।’

নবনীতা ভেজা চোখে তাকে দেখে।মাথা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আচমকাই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়।মিসেস রোকেয়া ভড়কে গেলেন।পরী কাঁদছে,তাও একেবারে প্রকাশ্যে।এমনটা আগে কখনো হয়নি।এতো দুর্বল মেয়ে সে কখনোই ছিল না।নিজের আবেগ অনুভূতি সে বেশ ভালোই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।অথচ মিসেস রোকেয়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন অত্যন্ত মজবুত চিত্তের অধিকারী মেয়েটা দিন দিন ক্রমশ ভেঙে পড়ছে,সে দুর্বল হচ্ছে ভীষণ।কার জন্য?নিজের স্বামীর জন্য?ফেলে আসা সংসারের জন্য?এই দুর্বলতা ভালো নাকি খারাপ তিনি জানেন না।কিন্তু এই দুর্বলতা পরীকে ভোগাবে,ভীষণ ভোগাবে।তাতে কোনো সন্দেহ নেই।মেয়েদের বেশি ভালোবাসতে নেই।বেশি ভালোবাসলে মেয়েরা একসময় নিজেদেরই হারিয়ে ফেলে।নবনীতা হারাচ্ছে।প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মেয়েটা সংসারের জালে জড়িয়ে নিজেকে হারাচ্ছে।মা হওয়ার খবর কানে আসতেই সে যেন আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে।মিসেস রোকেয়া কোনোরকমে তাকে কয়েক লোকমা খাইয়ে উঠে এলেন।যাওয়ার আগে একবার পেছন ফিরে দেখলেন মেয়েটার একহাত তার পেটে।চোখ দু’টো এখনো ভেজা।সে মা হচ্ছে।কি স্বচ্ছ আর চমৎকার সে অনুভূতি!তার গাঢ় বাদামি চোখ দু’টো একটু পর পর তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষের অনুপস্থিতি টের পেয়ে কেমন মলিন আর ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।আচ্ছা সে যেমন করে ঐ ছেলেটাকে ভালোবাসে,ছেলেটা কি কখনো তাকে তেমন করে ভালোবেসেছিল?ভালোবাসায় কেন কখনো দু’জনেই সমান সমান থাকা যায় না?কেন সবসময় একজন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জড়িয়ে যায় সবকিছুতে?প্রেম হয় দু’জনের।অথচ যন্ত্রনা গুলো জমা হয় একজনের ঝুলিতে।
__

সেই রাতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো।রাত এগারোটার দিকে ধানমন্ডির ছিমছাম এপার্টমেন্টে ছুটে এলো একটা ক্লান্ত,ভঙ্গুর শরীর।শুভ্রা দরজা খুলে তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখে বলল,’ভাইয়া তুমি?’

সে দুই কদম এগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।বরফ শীতল কন্ঠে জানতে চায়,’পরী কোথায়?’

‘আছে।রুমেই আছে।’

সে আর কথা না বাড়িয়ে সোজা তার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।

নবনীতা আরশাদকে ঘুম পাড়িয়ে পুরো ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা খেলনা গুলো নিজের হাতে নেয়।দরজার কাছে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই সে সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ায়।দেখতে পায় একটা ছায়া খুবই সাবধানী পা ফেলে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।নবনীতা থমকায়।দু’জনের চোখাচোখি হতেই তার সমস্ত শরীর অবস হয়ে আসে,দুই চোখ ছাপিয়ে নোনা জল নেমে আসে গাল পর্যন্ত।

আরহাম রুমে প্রবেশ করা মাত্রই পেছন না ফিরে আন্দাজে দরজা বন্ধ করে।তারপর ধীর পায়ে হেঁটে নবনীতার মুখোমুখি দাঁড়ায়।বহুদিন নিজের রাগ ধরে রেখেছে সে।রাগ ধরে নিজেই নিজের সাথে জুলুম করেছে।প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত নিজের সাথে সংগ্রাম করার পর অবশেষে আরহাম নিজের পরাজয় স্বীকার করেছে।মেনে নিয়েছে পরীকে ছাড়া তার পক্ষে এভাবে চলা সম্ভব না।তার পরীকে প্রয়োজন,ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন।

কথা না বাড়িয়ে একটানে নবনীতাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল সে।জোরাল আলিঙ্গনে নবনীতাকে চেপে একেবারে বক্ষপিঞ্জরের মাঝে ঠাই দিলো,এতো শক্ত সে বন্ধন যেন ছেড়ে দিলেই নবনীতা পালিয়ে যাবে।

নবনীতা প্রথম এক মিনিট জড় পদার্থের মতো অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।তারপর হুশ ফিরতেই নিজ থেকে দুই হাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

‘আই মিসড ইউ পরী।আজ না আসলে দম বন্ধ হয়ে মরেই যেতাম।সরি! সরি পরী।এই কয়দিনের জন্য ভীষণ সরি।তুমি প্লিজ আর মন খারাপ করে থেকো না।’

সে কথা শেষ হতেই নবনীতার সমস্ত মুখে চুমু খায়।এতো বেশি চুমু যে নবনীতা ঠিক গুনে শেষ করতে পারল না।আদরে আদরে তার চোখ,গাল সবকিছু ভিজে উঠল।তার ভেজা চোখ আরো বেশি পানিতে টইটম্বুর হয়।পুরুষালি হাত জোড়া তাকে কাছে পেয়েই আরো বেশি লাগামছাড়া হয়।দীর্ঘদিনের বিরহ বিচ্ছেদ,তারপর হঠাৎই দু’জনের সাক্ষাৎ।প্রিয় নারীর স্পর্শ পেতেই আরহামের তপ্ত মরুর ন্যায় বক্ষপিঞ্জর ছটফটিয়ে উঠে।সে মন ভরে চুমু খায়।অথচ তার মনের অস্থিরতা দূর হয় না।সে একবার আড়চোখে আরশাদকে দেখে।তারপর আবার ডুব দেয় নবনীতার অধরের মাঝে,গলার ভাঁজে।তার ঘনিষ্ঠতা টের পেতেই নবনীতা ধড়ফড়িয়ে উঠে।সে যখন চূড়ান্ত রকমের লাগামছাড়া,তখনই তার শক্তপোক্ত শরীরের ভারে নুয়ে পড়া রমণী তার ঠোঁটে একহাত চেপে ছটফট করে বলে উঠল,’আ-আরহাম থামুন।আমি প্রেগন্যান্ট।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৫৪

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৪)

[রিচেক নাই একদমই।আধঘন্টা পর রিচেক দিচ্ছি]

ঘুম ভাঙতেই সূর্যের কড়া আলোতে ইজমার কপাল কুঁচকে এলো।কাল রাতে সে বেশ দেরিতে ঘুমিয়েছে।আদি ছিল প্রায় তিনটা পর্যন্ত।আজ হয়তো আবার আসবে একটু পরেই।

সে ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে চারপাশ দেখে।দরজার দিকে কাউকে আসা যাওয়া করতে দেখা যাচ্ছে না।তার ওয়াশরুমে যেতে হবে।প্রায় মিনিট দুইয়ের মতোন অপেক্ষা করে সে সিদ্ধান্ত নিল সে নিজের থেকেই ওয়াশরুমে যাবে।ফ্রেকচার হওয়া হাতটা একনজর দেখে সে আস্তে ধীরে বেডের এক কোণা পর্যন্ত এসে বসে।একটা পা সাবধানে মেঝেতে রেখে তার উপর হালকা করে ভর দেয়।ভাঙা হাত সামলেই অতি সাবধানতার সাথে অন্য পা মেঝেতে রেখে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।হালকা একটু উঠতেই তার শরীর ব্যথায় ভেঙে আসে।মুখ থুবড়ে ফ্লোরে পড়ার আগেই শক্ত একটা হাত তার কনুইয়ের কাছটা চেপে ধরে।

ইজমা ঘাড় বাঁকা করে তার পাশে থাকা মানুষটাকে দেখে।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,’ওয়াশরুমে যাচ্ছিলাম আমি।’

ইফাজ তার হাত ছাড়ল না।তবে সামান্য খানিকটা পিছিয়ে নিজেদের দুরত্ব বাড়িয়ে বলল,’সিস্টার কেউ ছিল না আশেপাশে?’

‘জ্বী না।’

‘ওয়াশরুমে যাবে?’ একেবারে ঠান্ডা গলায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানতে চায় সে।

ইজমা মাথা নাড়ে।একেবারে ধিমি আওয়াজে বলে,’জ্বী।’

ইফাজ তার হাতে থাকা রিপোর্ট টা বেডসাইড টেবিলের উপর রাখে।তারপর ভাবলেশহীন হয়ে বলে ‘আচ্ছা চলুন।দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছি।’

ইজমা চুপচাপ হেঁটে তার সাথে ওয়াশরুম পর্যন্ত গেল।ইফাজ তাকে সেখানে ছেড়ে পুনরায় তার বেড পর্যন্ত হেঁটে আসে।খুব মনোযোগ দিয়ে রিপোর্ট চেক করে।ইজমার হাতের অবস্থার উন্নতি হয়েছে।আর কিছু দিনেই হয়তো টুকটাক নাড়াচাড়া করতে পারবে।

ইজমা বের হলো গুনে গুনে তিন মিনিট পরে।ইফাজ ঘাড় ঘুরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,’আসতে হবে?’

‘না হবে না।নিজেই পারব আমি।’

চট করে সামনে ফিরে সে।রিপোর্টের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে,’গুড।’

ইজমা শম্বুক গতিতে হেঁটে খাটে গিয়ে বসে।ইফাজ অবলীলায় নিঃসংকোচে তার কপালে হাত ছোঁয়ায়,মুখে আগের মতোন গাম্ভীর্য ধরে রেখে বলে,’সিস্টার বলছিল কাল নাকি একটু জ্বর জ্বর ছিল?এখন তো মনে হয় সুস্থ আছেন।টেম্পারেচার নরমালই মনে হচ্ছে।’

ইজমা দ্রুত মাথা নাড়ে।তার চেয়েও দ্রুত জবাব দেয়,’জ্বী জ্বী।এখন আর তেমন জ্বর নেই।’

ইফাজ আরো কিছুক্ষণ থেকে কয়েকটা ঔষধ নতুন সংযোজন করে পুরোনো কিছু ঔষধ প্রেসক্রিপশন থেকে বাদ দিলো।তারপরই সেটা ইজমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,’আপনার ফ্রেন্ড কে এটা দিবেন আজকে আসলে।মনে থাকবে তো?’

‘জ্বী থাকবে।’

ইফাজ হনহন করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।ইজমা হাতড়ে হাতড়ে নিজের ফোন খুঁজে কতোক্ষণ আনমনে স্ক্রল করল।তার আবার ঘুম পাচ্ছে।আরো একবার ঘুমুতে ইচ্ছে করছে।ইজমা বড় করে দুইবার হাই তোলে।তার হঠাৎই মনে হলো সে এখন হসপিটালে আর তার এখন যখন খুশি ঘুমানোর অনুমতি আছে।সে সিদ্ধান্ত নিল সে এখন আবার ঘুমুবে।কতোক্ষণ ঘুমুবে?যতোক্ষণ না আদি এসে ভিত্তিহীন কৌতুকে হাসাতে হাসতে তার চোখ ঝাপসা করে দিবে,ঠিক ততোক্ষণ।
.
.
.
.
‘নিলয়!নিলয়!’

ঢিলেঢালা পোশাকের তরুণী মেয়েটা দ্রুত বেগে ছুটতে ছুটতে সামনে এগিয়ে আসে।তার মাথায় চাপানো ঘোমটা বাতাসের দাপটে অবস্থানচ্যুত হয়েছে।সে দৌড়ের মাঝেই আবার নিজের স্কার্ফ ঠিক করে।

দৌড়ে দৌড়ে তার শ্বাস উঠে গেছে।তবে এতো কিছুতে মুখের হাসি বিলীন হয় নি।নিলয় খানিকটা বিরক্ত হয়।পেছন ফিরে কপাল কুঁচকে বলে,’সমস্যা কি?’

প্রভাতি তার নাগাল পেতেই মাটির দিকে ঝুকে নিজের দুই হাঁটুতে হাত রেখে বড় বড় শ্বাস টানে।সেই অবস্থাতেই অস্পষ্ট আওয়াজে বলে,’তোমাকে সেই কখন থেকে ডাকছি’

‘আমি শুনেছি।’

‘শুনলে সাড়া দাওনি কেন?’

‘সামনে বড় ভাইরা ছিল তাই।’

‘কেন?বড় ভাইরা থাকলে কি হয়েছে?আমি তোমার হাত ধরেছি নাকি কোনো অসভ্যতা করেছি?’

‘যাই হোক।সবকিছুতে এতো কেন খুঁজবে না।নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছো।এখন এতো কেন খুঁজবে না।সিনিয়রদের নজর থেকে যতোটা পারো বেঁচে চলবা।একবার টার্গেট হলেই জীবন শেষ।’

প্রভাতি তার কথা শুনেই চোখ বাঁকা করে তার দিকে তাকায়।ঠোঁট উল্টে বলে,’বাপরে! এতো কিছু মেনে চলার পরেও তো তুমি থাবড় চটকটা খাচ্ছো রোজ রোজ।’

যদিও তার কথায় নিলয়ের অপমানিত বোধ করার কথা ছিল,কিন্তু সে অপমানিত বোধ করল না।উল্টো কথার ধরন শুনেই ফিক করে হেসে ফেলল।মাথা চুলকে বোকা বোকা হেসে বলল,’আমি তো থাবড় চটকটা খেয়েই শিখেছি প্রভা।’

প্রভাতি হাঁটার গতি কমায়।ভীষণ কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়,’আচ্ছা তারা সবসময় তোমার সাথেই এমন করে কেন?তুমি তাদের কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছো শুনি?’

***

হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে মিষ্টি মুখের মেয়েটা ইজমার মুখোমুখি এসে থামে।তার মুখে অমায়িক আর স্নিগ্ধ হাসি।কিছু মানুষের দর্শনই যেন শুভ্রতা ছড়ায়।ইজমার মনে হলো তার সামনে থাকা মেয়েটিও তাই।সে এসে থামল,আর ইজমার মনে হলো একেবারে ঠান্ডা একটা বাতাস তার গা ছুঁয়ে গেল।সে মিষ্টি হেসে শুধায়,’তাসনুভা! রাইট?’

ধূসর রঙের জামায় নিজেকে আবৃত করে রাখা মেয়েটা জোরে জোরে উপরনিচ মাথা নাড়ে।মুখের সেই অতিসুন্দর হাসি ধরে রেখেই বলে,’জ্বী।আমিই তাসনুভা।’

‘কেমন আছো তাসনুভা?’

‘আমি ভালো আছি।’

সে থামল।নিজ থেকেই আবার মলিন মুখে বলল,’কিন্তু তুমি ভালো নেই।’

তার বিষন্ন মুখশ্রী দেখেই ইজমা স্মিত হাসে।ব্যান্ডেজে মুড়ানো হাতটা দেখে খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,’দেশে এসেই একটা উটকো ঝামেলায় পড়ে গেলাম দেখেছো?’

আদি দুই হাতে দু’টো আইসক্রিম নিয়ে কেবিনে আসল।স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিম টা ইজমার দিকে আর চকোলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম টা তাসনুভার দিকে বাড়িয়ে তাড়া দিয়ে বলল,’ধরো,তাড়াতাড়ি খাও।নয়তো গলে যাবে।’

ইজমা একহাতে আইসক্রিম নিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল,’তোর জন্য আনিস নি?’

‘নাহ।আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’

‘যাহ মিথ্যুক।’

‘সত্যি।’

আদি ক্লান্ত হেঁটে ইজমার পায়ের কাছটায় বসে।তাসনুভা আইসক্রিম খেতে খেতে দু’জনের দিকে একবার একবার করে তাকায়।আদি আজ তাকে নিজের সাথে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।সে জানতো না যে ইজমা নামের মেয়েটা দেশে এসেছে।জানার পরেই জোরাজুরি শুরু করল সেও যাবে ইজমাকে দেখতে।ইজমাকে দেখেই তার চোয়াল ঝুলে গেল।পুরোদস্তুর ভিনদেশীদের মতোন দেখতে একটা মেয়ে।গায়ের রং মাত্রাতিরিক্ত উজ্জ্বল।চুলগুলো বাদামি।মেয়েটা এতো সুন্দর যে তাসনুভার মনে হলো তাকে বাড়ি এনে শো কেসে সাজিয়ে রাখতে।ইজমা যখন চোখের পাতা মেলে স্থির হয়ে কিছু দেখে,তাসনুভার মনে হয় জলজ্যান্ত কোনো পুতুল চোখের সামনে বসে আছে।পরী ভাবির পর তাসনুভার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে এই ইজমা।এতো শুভ্র গায়ের রং তাসনুভা খুব কমই দেখেছে।

ইজমা তার হাতে থাকা আইসক্রিম টা অর্ধেকের মতো শেষ করে বাকিটা আদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’নে একটু খা।’

আদি সরু চোখে তার দিকে তাকায়।সন্দিহান গলায় বলে,’খেতে বলছিস?’

‘হ্যাঁ।খা।’

আদি ডান হাতের উপর ভর দিকে সামনের দিকে ঝুকে।ইজমা সোজা সরল মনে হাতের আইসক্রিমটা তার মুখের কাছাকাছি এনে দেয়।আদি একবার চোখ তুলে কুটিল হাসে।তারপরই বড় করে হা করে পুরোটা আইসক্রিম এক কামড়ে নিজের মুখে নেয়।ইজমা প্রথমে বিস্ময়ে হকচকিয়ে উঠে,তারপরই অবস্থা বুঝে চেঁচিয়ে উঠে,’আদির বাচ্চা!! পুরোটা নিতে বলি নি।দে,আমার আইসক্রিম দে।’

বলেই সে একহাত দিয়ে আদির গালের দুই পাশ চেপে ধরে।উদ্দেশ্য সে আদিকে কিছুতেই চিবুতে দিবে না।আদি একহাতে ইজমার হাতটা সরাতে সরাতে হাসিতে গড়াগড়ি খায়।ইজমা দাঁত কিড়মিড় করে চেঁচায়,’ফাজিল! তোকে পুরোটা খেতে বলেছি?এগুলা ঠিক না।’

এক ঝাড়ায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আদি গপাগপ আইসক্রিম টা শেষ করে।ইজমা থমথমে মুখে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তাকে দেখল।তারপরই হঠাৎ দু’জন খিলখিল করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।ইজমা দুম করে আদির পিঠে একটা কিল বসিয়ে বলল,’বেয়াদব! তোকে আর কখনো কিছু সাধবো না।নাদান কোথাকার!’

‘সাধিস না।কে বলেছিল তোকে সাধতে?’

তাসনুভা গোল গোল চোখে তাদের দু’জনকে দেখে।এই বন্ধুত্ব,এই খুনশুটি তার দারুণ লাগছে দেখতে।কতো সুন্দর তাদের বন্ধুত্ব।কতোখানি আপন তারা নিজেদের! কোনো সংকোচ কিংবা দ্বিধা কিছুই নেই।তাসনুভার এমন কোনো বন্ধু নেই।এমন কেউ তাসনুভার জীবনে নেই যার সাথে তাসনুভা এমন খ্যাক খ্যাক করে হাসতে পারবে।স্কুলেও কখনো কোনো মেয়ে নিজ থেকে তার সাথে বন্ধুত্ব করেনি।তাকে দেখলেই সবাই ভয়ে দূরে সরে যেত।কি আশ্চর্য ব্যাপার! হাঁটতে অক্ষম হওয়া কি এতো ভয়ানক কিছু যে একারনে তাকে ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতে হবে?

‘এ্যাই বাচ্চা! আইসক্রিম গলে যাচ্ছে তো।’

আদির ডাকে তাসনুভার ধ্যান ভাঙে।সে নড়েচড়ে উঠে দেখল তার আইসক্রিম গলে তার আঙুল চুয়ে চুয়ে পড়ছে।সে তাড়াহুড়ো করে হাতটা উপরে তুলে আঙুলে লেগে থাকা আইসক্রিম টুকু খেয়ে নেয়।খেতে গিয়ে নিজের নাক ভরায়।ইজমা একগাল হেসে তার গাল স্পর্শ করে বলে,’আসলেই তো বাচ্চা তুমি।মিষ্টি একটা বাচ্চা।’

তাসনুভা একটু লজ্জা পেল বোধহয়।ইজমার কথা শুনেই সে লজ্জাবতী গাছের ন্যায় কিছুটা মিইয়ে গেল।নিচু গলায় বলল,’আমি বাচ্চা নই।’

আদি পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে সেটা তাসনুভার হাতে দিলো।তাসনুভা জিজ্ঞাসু হয়ে তাকে দেখতেই সে নরম গলায় বলল,’হাত মুখ নাক সবকিছু তো আইসক্রিম মেখে ভরিয়েছো।এটা দিয়ে মুছে নাও আপাতত।বাইরে গেলে তখন পানি দিয়ে আবার ধুয়ে নিও।’

ইজমা ডান পা দিয়ে আস্তে করে আদির হাঁটু বরাবর একটা লাথি মেরে বলল,’তাসনুভাকে টিস্যু দিচ্ছিস,আমার টিস্যু কোথায়?আমারও তো হাত মুখ ভরেছে।’

আদি চোখ বাঁকিয়ে তাকে দেখে।ঠোঁটে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে দরজার সামনে দেখতে দেখতে বলে,’ঐ যে দেখ,তোর জন্য পাপোশ রাখা আছে।তুই গিয়ে ঐটাতে একটু মুখ ঘষা দে যা।তোর আবার কিসের টিস্যু?পাপোষই তোর টিস্যু।’
.
.
.
.
মেয়েটির পোশাক অত্যন্ত মার্জিত।গায়ে চাপানো চুড়িদারের রং একেবারে হালকা আকাশি।শরৎের আকাশে যেমন নীলের মাঝে ভাসা ভাসা শুভ্র তুলার মতো কিছু মেঘ থাকে,তার পরনের জামাতেও এমন সাদা মেঘের অস্তিত্ব আছে।চুড়িদারের উপরে আছে ধবধবে সাদা ওড়না।সাদা কাপড় সহজে ময়লা হয়,চকচকে ভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়না।মেয়েটির ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন হয়নি।তার ওড়না একেবারেই সাদা।তার চুলের একপাশে বেণী করা।মুখে একটা সৌজন্য সূচক স্বচ্ছ হাসি,চোখে খেলা করছে অদ্ভুত দিপ্তী।সে দুই হাত টেবিলে রেখে মাথা সামান্য সামনে ঝুকায়।সুমিষ্টি রিনরিনে কন্ঠে বলে,’আপনি কি বেশি ব্যস্ত ভাইয়া?’

তার মুখোমুখি চেয়ারে বসে থাকা যুবকের দৃষ্টি স্থির,সামান্য সন্দিহানও বটে।জহুরি চোখে সে কয়েকবার তাকে পরোখ করে।নাহ,খুবই সহজ সরল আর বোকাসোকা মনে হচ্ছে মেয়েটাকে।সে গম্ভীর গলায় থমথমে মুখে জবাব দেয়,’না,আপাতত ব্যস্ত নই।’

মেয়েটির হাসি প্রশস্ত হয়।সে আগের চেয়েও উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,’আমার নাম প্রভাতি রহমান।’

তার কথায় যুবকের কপাল কুঞ্চিত হয়।সে খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,’তোমার নাম জেনে আমার কি কাজ?’

প্রভাতি থতমত খেয়ে কোনোরকমে বলল,’না এমনিই।পরিচয় দিলাম আরকি।’

মেয়েটা নিজের দুই বেণী দুই হাতে ধরে কতোক্ষণ কিছু একটা ভাবে।মনে মনে কথা সাজায়।তবে শব্দভান্ডার তার অতো সমৃদ্ধ না।সে অনেকটা সময় খচখচ করে শেষে অধৈর্য হয়ে নিজের ব্যাগ হাতড়ে একটা ছবি বের করে।তারপরই সেটা তার সামনে থাকা যুবকটার সম্মুখে বাড়িয়ে দেয়।

একটানে ছবিখানা নিজের হাতে নেয় আরহাম।দেখতে পায় ছবিতে ঠিক তিনজন মানুষের অস্তিত্ব।একটা মাঝবয়সের লোক বসা,তার কোলে একটা এক দেড় বছরের বাচ্চা মেয়ে।মেয়েটা হাত নাড়ছে।পাশেই একটা ছেলে গালে হাত রেখে দু’জনকে দেখছে।ছবির মান তেমন একটা ভালো না।সাদা কালো,ঝাপসা।কিন্তু আরহাম সেই ছবিটাই খুটিয়ে খুটিয়ে চোখ বড় করে দেখল।এক পর্যায়ে ভীষণ চঞ্চল হয়ে বলল,’এটা তো আমি।এই যে আমি,পাশে আমার বাবা।আর কোলের মেয়েটা,,’

সে থামে।কোলের মেয়েটার নাম তার মনে নেই।প্রভাতি গালের নিচে হাত রেখে প্রফুল্ল কন্ঠে জবাব দেয়,’আর কোলের মেয়েটা প্রভাতি।এই যে আমি প্রভাতি।’

আরহাম গোল গোল চোখে অবাক হয়ে তাকে দেখে।অতীতের স্মৃতি একটু ঝাপসা ভাবে তার মনে পড়ছে।সম্ভবত দুই হাজার এক সালের দিকের ঘটনা।শাহবাগের ঐদিকটায় নাসরিন নামের এক ভদ্রমহিলা ফুল বিক্রি করত।হঠাৎই একদিন শোনা গেল নাসরিন বেঁচে নেই।উল্কাবেগে ছুটে আসা লোকাল বাসের চাকার পিষ্টনে তার মৃ’ত্যু হয়েছে।নাসরিন বিধবা ছিল।তার বয়সও তেমন বেশি ছিল না।তার একটা ফুটফুটে সুন্দর কন্যা সন্তান ছিলো।শেখ আজিজ তখন মহানগর ০৪ এর সংসদ সদস্য।এই খবর কানে যাওয়া মাত্রই তিনি বস্তিতে নাসরিনের থাকার জায়গাতে ছুটে যান।দেখতে পান পৃথিবী ছাড়ার পূর্বে নাসরিন একটা সুন্দর প্রাণ এই পৃথিবীর বুকে রেখে গেছে।আজিজ হোসেন অত্যন্ত ভালোবাসায় বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নেন।লোক মুখে তার কানে খবর এলো মেয়েটির নাকি কোনো নাম নেই।নাসরিন নাকি তাকে বাবু বলেই ডাকতো।তার বাবার নাম ছিলো রহমান।আজিজ হোসেন তার একটা পুর্নাঙ্গ নাম দিলেন-প্রভাতি রহমান।কারণ তার মনে হয়েছিল এই মেয়ে সকালের সূর্যের মতোই স্নিগ্ধ,দীপ্তমান।প্রভাত থেকে প্রভাতি।তারপর গোটা জীবন নাসরিনের অভাগা মেয়েটি এই নাম নিয়েই চলল।তাকে আজিজ হোসেন সেদিনই নিজের চাইল্ড হোমে নিয়ে আসেন।সানশাইন অরফানেজ সেন্টারের খোলা বারান্দায় তিনি তাকে কোলে নিয়ে বসেন।তার পাশাপাশি ছোট ছোট পা ফেলে একজন বালক এসে দাঁড়ায়।আজিজ সাহেব তার হাত টেনে তাকে তার পাশে বসায়।ছেলেটির চোখে বিস্ময়।বাবা মানুষটা এতো অদ্ভুত কেন?কেমন যেন অদ্ভুত রকমের ভালো।সে তার বাবার মতো হতে চায়।সে সবাই কে ভালোবাসতে চায়।

বুকের চিনচিন ব্যথায় তার মস্তিষ্ক সচল হয়।সে খানিকটা নড়েচড়ে উঠে নিজেকে সামলায়।একটু কেশে জমে যাওয়া কণ্ঠনালী পরিষ্কার করে।তারপরই সামনে তাকায়।বাস্তবতায় ফিরতেই তার মন আরো খারাপ হয়।সে বাবার মতো হতে পারেনি।বাবার কিয়দংশও সে পায়নি।সে বাবার মতো মানুষের অন্তরের নেতা হতে পারে নি।সে পারেনি রাস্তার কোনো ছাপোষা কে পরম স্নেহে নিজের কোলে ঠাই দিতে।

সে কিছুটা আবেগী হয়।সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে একটু এগিয়ে এসে প্রভাতির মাথায় স্নেহের হাত বুলায়।অনেক চেষ্টার পরেও তার কন্ঠ কিছুটা জড়িয়ে যায়।সে খানিকটা ব্যাকুল হয়ে বলে,’তুমি সেই ছোট্ট প্রভা?’

ব্যাকুল হয় প্রভাতি নিজেও।জোরে জোরে মাথা নেড়ে সে জানায় সেই প্রভাতি।সঙ্গে আরো কিছু কথা নিজ থেকে যোগ করে।
‘আর আপনি আরহাম ভাই।ছোট বেলা থেকেই সব কিছুতে রাগে লাল হয়ে যাওয়া আরহাম ভাই।’

আরহাম স্মিত হাসে।পরক্ষণেই ব্যস্ত হয়ে বলে,’আরে তুমি কি খাবে?তোফায়েল! এ্যাই তোফায়েল এদিকে আয় তো।’

প্রভাতি দ্রুত হাত নেড়ে জানায়,’না না ভাইয়া।আমি কিছু খাব না।’

সে তাকে মৃদু ধমকে উঠে,’চুপ করো তো।খাবা না আবার কি?খেতেই হবে।আমার এখানে আসলে খেয়ে যেতে হয় জানো না?’

প্রভাতি আর জোরাজুরি করল না।আরহাম নিজের মন মতো কয়েকটা খাবার তোফায়েল কে দিয়ে আনার ব্যবস্থা করে।তারপরই ডেস্কের সাথে হেলান দিয়ে পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,’তো প্রভাতি।তুমি তো বোধ হয় এখন আর অরফানেজ সেন্টারে থাকো না।তাই না?’

‘জ্বী ভাইয়া।আমি সাবলেট থাকি।রামপুরায়।’

‘পড়ছো কিসে?’

‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।’

‘যাক।ভেরি গুড।’

প্রভাতি জবাবে সামান্য হাসল।ক্ষণকাল গড়াতেই চাপা কন্ঠে বলল,’আপনাকে একটা কথা বলার ছিল ভাইয়া।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলো না।কোনো সমস্যা নেই প্রভা।তুমি যেকোনো সমস্যা আমাকে বলতে পারো।তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি?’

‘না না।আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’

‘তাহলে?’

‘আমার ফ্রেন্ডের সমস্যা হচ্ছে।’

‘কি সমস্যা?’ আরহাম ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়।

প্রভাতি চেহারায় সামান্য ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে।অত্যন্ত শান্ত হয়ে বলে,’নিলয় নামে আমার একজন বন্ধু আছে।সে আর আমি একই ঘাটের মাঝি।তারও মা বাবা কেউ নেই।নিলয় একটু সরল প্রকৃতির ছেলে।অনেকটা ধার্মিকও বটে।আবির,দ্বীপ তাদের তো নিশ্চয়ই চেনেন।আপনাদের দলেরই ছেলে।তারা নিলয় কে শুরু থেকেই অকারণে র‍্যাগ দিতো।নিলয়কে মারধর করলেও বা কি?তার তো দুই কুলে কেউ নেই।নিলয়ের দাঁড়ি থাকা নিয়েও তাদের সমস্যা।নিলয় একবার তাদের প্রতিবাদ করাতে তাকে শিবির বলে পুলিশের হাতে তুলে দিলো।অথচ নিলয়ের রাজনীতির সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই।সে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মানুষ।কিন্তু তা স্বত্বেও শুধুমাত্র ভাইদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে টু শব্দ করার অপরাধে নিলয়কে সাতদিন জেলে থাকতে হলো।তারপর থেকে সে আর কোনো প্রতিবাদই করে না।বড় ভাইরা যাই করে সব মেনে নেয়।নিলয়ের না হয় অভিযোগ করার জায়গা নাই।কিন্তু আমার তো অভিযোগ করার জায়গা আছে।আমার তো আরহাম ভাই আছে।তাই আমি এতো গুলো বছর পর আপনার কাছে ছুটে এলাম।কারণ আমি জানি পুরো পৃথিবী নোংরা রাজনীতি তে জড়িয়ে গেলেও আরহাম ভাই এমন কিছু করবে না।আজিজ আঙ্কেলের ছেলে তো তারই মতো হবে তাই না?’

তার কথা শুনেই আরহাম বিষম খায়।একহাত মুখে চেপে কতোক্ষণ কাশে।প্রভাতি আশ্চর্য হয়ে শুধায়,’কি হয়েছে ভাইয়া?পানি খাবেন?’

আরহাম কাশি থামানোর চেষ্টা করতে করতে জবাব দেয়,’না না দরকার নেই।’

প্রভাতি তার কাশি পুরোপুরি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করে।সে একটু স্থির হতেই তার দিকে ভীষণ উৎসাহী চোখ মেলে দেখে বলে,’ভাইয়া! আপনি কিছু বলবেন না তাদের?নিলয় ছেলেটার কিন্তু কোনো দোষ নেই।’

আরহাম চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলল।প্রভাতির প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী মুখটা দেখেই তার ভেতরটা সামান্য আন্দোলিত হয়।সে গাঢ় এবং জোরাল গলায় তাকে আশ্বস্ত করে,’অবশ্যই।অবশ্যই আমি তাদের কিছু বলব প্রভা।তুমি আমাকে বিচার দিয়েছ,আর আমি সেটা শুনব না সেটা কি করে হয়?তোমার বন্ধুকে বলে দিবে তার আর কোনো চিন্তা নেই।আমি আমার ছেলেদের বলে দিব।তুমি নিশ্চিন্ত থাকো প্রভাতি।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৫২+৫৩

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫২)

ওয়াজিদ বাড়ি ফিরল অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত মেজাজে।আরহামের উপর তার ভয়ানক রকমের রাগ হচ্ছে,রাগের চেয়েও বেশি অভিমান হচ্ছে।অমন দুম করে মুখের উপর বলে দিলো সে তার সংসারে অশান্তি করছে?ওয়াজিদ তার সংসারে ঝামেলা বাধাচ্ছে?নাকি সে নিজেই অমন কাজ করছে?একে তো সে নিজে যা খুশি তা করছে,তার উপর ওয়াজিদকে খোঁচা দিয়ে কথা বলছে।ওয়াজিদ ফোস ফোস করে কয়েকটা শ্বাস ছেড়ে দরজার লক ঘুরিয়ে বাড়ির ভেতর এলো।আরহামকে সে ভালোর জন্যই সাবধান করেছে।সে ইদানিং যা করছে,তার নিজের দোষেই তার সংসারে ঝামেলা হবে।হোক গিয়ে।ওয়াজিদের কি?সে ঐ বেয়াদবের কোনো বিষয়ে এখন থেকে নাক ই গলাবে না।থাকুক সে তার মতো।সে আর তার নোংরা রাজনীতি।এসব ছাড়া তার জীবনে আর আছে টা কি?

সে বসার ঘর পর্যন্ত হেঁটে আসতেই কোথা থেকে সামান্য তরল সবেগে ছুটে এসে তার গায়ে পড়ল।ওয়াজিদ লাফিয়ে উঠে দুই কদম পিছিয়ে গেল।বুকে আর বাহুতে হাত রেখে তরলটুকু স্পর্শ করেই বুঝল এটা পানি।সে ঘাড় ঘুরিয়ে এ’পাশ ঐ’পাশ দেখে।

নিহাদ দেয়ালের ওপাশ থেকে মাথা বের করে বসার ঘরে উঁকি দেয়।তার দুষ্টুমি ভরা মুখটা দেখতেই ওয়াজিদ চোখ পাকায়।নিহাদ তার খালাতো বোনের ছেলে।সে এগিয়ে এসে খপ করে তার হাতটা ধরে তাকে নিজের মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো।চোখ পাকিয়ে বলল,’কিরে নিহাদ?তুই কখন এলি?দিয়া কোথায়?’

নিহাদ নিজের আঙুল কা’মড়াতে কা’মড়াতে মাথা নেড়ে বলল,’মাম্মাম নানুমনির ঘরে।’

‘মাম্মাম নানুমনির কাছে,আর তুই এই সুযোগে ওয়াটার গান দিয়ে আমার শার্ট ভেজাচ্ছিস?’

ওয়াজিদের খানিকটা ধমক মেশানো কন্ঠে ভীত হয়ে নিহাদ সঙ্গে সঙ্গে হাত নেড়ে বলল,’না না।আমি তোমাকে ভেজাতে চাইনি মামা।মামানি আমাকে বলেছে তুমি আসলে যেন তোমার উপর ফায়ারিং করি।’

ওয়াজিদ কোমরে হাত রেখে মুখ বাঁকা করে বলল,’ওহহ,এইসব তোর মামানির কাজ।তো সে কোথায় এখন?’

‘তোমার ঘরে।’

‘আমার ঘরে?কি করে?’

‘জানি না।ঢুকতে দেয় না।’

ওয়াজিদ ঠোঁট উল্টে তাড়াতাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যায়।তারপরই কিছু একটা ভেবে পুনরায় পিছিয়ে এসে নিহাদের হাত থেকে ওয়াটার গান টা নিয়ে মুচকি হেসে বলে,’দাঁড়া! কিছুক্ষণের জন্য এটা আমাকে দে।’

বলেই সে ধুপধাপ পায়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে দোতালায় উঠল।দোতালার পূর্ব পাশে তার রুম।রুমের সামনে এসেই সে দেখল দরজা চাপিয়ে রাখা।সে আস্তে করে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়।

রিমি খাটের এক পাশে বসে আছে।দরজার দিকে পিঠ করে আছে বিধায় সে কি করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না।ওয়াজিদ নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে এলো।

হঠাৎ পিঠে সামান্য পানি ছলকে পড়তেই সে লাফিয়ে উঠে।পানির উৎস খুঁজতে পেছন ফিরতেই ওয়াজিদ তার হাতের ওয়াটার গানটা রিমির মুখ বরাবর তাক করে আরো কয়েক দফা ফায়ারিং করল।রিমি কতোক্ষণ ভ্যাবলার মতো তাকে দেখল।তারপরই চটজলদি নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,’এসব কি?আপনি কি নিহাদের মতো বাচ্চা হয়ে গেছেন?’

ওয়াজিদ মুখে হাসি ধরে রেখেই গুনে গুনে তিন পা সামনে এগোয়।চাপা কন্ঠে উত্তর দেয়,’হ্যাঁ হয়েছি।তোমার সমস্যা?’

বলেই সে রিমির মুখে আরো একবার গান দিয়ে পানি ফেলল।রিমি দ্রুত নিজের মুখ ঢেকে নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে বলল,’ধ্যাত! ভাল্লাগে না সবসময়।’

ওয়াজিদ থমথমে মুখে তাকে দেখে।তারপরই গম্ভীর হয়ে বলে,’আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি।তুমি থাকো এদিকে।’

রিমি দ্রুত মুখের সামনে থেকে হাত সরায়।তার সামনে থাকা টগবগে যুবকটির দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়া পদযুগল দেখেই ছুটে গিয়ে তার একটা হাত চেপে ধরে।অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে বলে,’আহা! আপনি আবার মন খারাপ করছেন কেন?এভাবেই বলেছি।আপনার ঘর ছেড়ে আপনি যাবেন কেন?বোকা নাকি?’

ওয়াজিদ চোখ তুলল।মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে নিচু স্বরে বলল,’হুম।তোমার সাথে থেকে থেকে একটু বোকাই হয়েছি বোধহয়।’

সে হেঁটে গিয়ে খাটের ধার ঘেঁষে বসল।রিমি কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই কিছু একটা মনে পড়তেই এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।ভ্রুদ্বয় আপনাআপনি কুঁচকে নিল ওয়াজিদ।এই মেয়ে হঠাৎ এমন ছুটোছুটি শুরু করেছে কেন?

রিমি ফিরল তিন মিনিট পরে,হাতে একটা পানির গ্লাস নিয়ে।সে হাঁপাতে হাঁপাতে গ্লাসটা ওয়াজিদের সম্মুখে বাড়িয়ে দেয়।কোনোরকমে শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলে,’নিন।পানি খান।’

‘আশ্চর্য! পানি কেন খাবো?আমার কি পিপাসা পেয়েছে নাকি?’

‘পিপাসা না পেলেও খেতে হবে।মা বলেছে আপনি বাড়ি আসলেই যেন আপনাকে এক গ্লাস পানি এনে দেই।’

ওয়াজিদ স্মিত হেসে গ্লাসটা হাতে নিল।ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে প্রসন্ন হেসে বলল,’গুড গার্ল।এবার একটু চুপচাপ এখানে এসে বসো।’

রিমি এক ডাকেই তার পাশাপাশি এসে বসল।ওয়াজিদের পাশ ঘেঁষে বসতে তার ভালো লাগে।বিয়ের পর সারাদিন তার বরের পেছন পেছন ঘুরতে ইচ্ছে করে।শুরুতে ওয়াজিদ কিছুটা এড়িয়ে চলতো তাকে।এখন অবশ্য সেই জড়তা অনেকটাই কেটে গেছে।এখন দু’জন বেশ সময় নিয়ে গল্প করে।গল্পের কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই।এমনিই যা মাথায় আসে,তাই নিয়ে এদের আলোচনা।ওয়াজিদকে তার ভীষণ ভালো লাগে।তাকে দেখামাত্রই রিমির চিৎকার ছুড়ে বলতে ইচ্ছে করে,’আপনাকে আমার এত্তো বেশি ভালো লাগে।আপনার আমাকে কেমন লাগে?’

তখন নিশ্চয়ই ওয়াজিদ মুখ কুঁচকে বলেবে,’আমার তোমাকে একদমই ভালো লাগে না।’ এই না শোনার ভয়ে রিমি এখন পর্যন্ত নিজের মনের কথা চেপে রেখেছে।প্রত্যাখ্যানে রিমির ভীষণ ভয়।

ওয়াজিদ খাটের উপর ছড়িয়ে রাখা কাগজপত্র গুলো দেখে জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’এসব আবার কি?’

রিমি ঘাড় ঘুরিয়ে দুইটা কাগজ হাতে নেয়।কাগজের দুই পাশ নেড়ে চঞ্চল গলায় বলে,’এগুলো আর্ট পেপার ওয়াজিদ।’

‘বাপরে! তুমি কি আর্ট করা শুরু করবে নাকি?ফিজিক্স থেকে ডিরেক্ট আঁকাআঁকিতে!’

রিমি শব্দ করে হাসল।দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’ধুর না।আমি এসব আর্ট করতে জানি না।আমি তো আপনার ছবি স্কেচ করব ভাবছি।’

‘সর্বনাশ! এতো মানুষ থাকতে আমিই কেন তোমার জঘন্য এক্সপেরিমেন্টের শিকার হবো?’

রিমি গালভর্তি হেসে বলল,’কারণ আপনি হচ্ছেন আমার স্বামী।স্বামী ছাড়া অন্য লোকের স্কেচ আমি কেন করব?আমার তো পাপ হবে।’

ওয়াজিদ কতোক্ষণ গোল গোল চোখ করে তাকে দেখল।তারপরই আচমকা হো হো করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতেই পেটে একটা হাত চেপে বলল,’আল্লাহ! তুমি যে কিসব বলো! অন্য লোককে আঁকবে না পাপের ভয়ে।আর স্কেচ যে করছ,এটা কি খুব পূণ্যের কাজ?’

‘অতোকিছু বুঝি না।কিন্তু আমি কয়েকটা টিউটোরিয়াল দেখেছি।এবার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে এঁকেই ফেলব।এঁকে একদম তাক লাগিয়ে দিব।’

ওয়াজিদ ক্লান্ত শরীরটা খাটে এলিয়ে দিয়ে আরো কিছুক্ষণ হাসল।হাসতে হাসতেই ঘাড় বাঁকা করে পাশ ফিরে বলল,’এক কাজ করো।তুমি এখনই স্কেচিং শুরু করে দাও।এই যে আমি শুয়ে আছি।তুমি এখন আমাকে দেখে দেখে টাইটানিক মুভির মতো একটা স্কেচ শুরু করো।’

রিমি গালের নিচে হাত রেখে ওয়াজিদের হাসিখুশি মুখটা দেখে।তারপরই ঠোঁট টিপে বলে,’ছিহ! কিসব অশ্লীল কথা!’

ওয়াজিদও বিনিময়ে একগাল হাসি উপহার দিয়ে বলল,’উহু।আমি রোজের মতো জামাকাপড় খুলছি না।তুমি বরং শার্ট প্যান্ট পরা লোকের স্কেচই করো।’

রিমি খিলখিল করে আর্টপেপারটা খাটে রেখে বলল,’আপনি যে এমন হাসিখুশি সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।’

‘বাইরে থেকে বোঝার তো প্রয়োজন নেই।ভেতর থেকে বুঝো।তাহলেই হবে।’
.
.
.
.
আদি হন্তদন্ত হয়ে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।মলিন চোখ জোড়া তার দর্শন পেতেই ভাঙা গলায় বলল,’হেই ড্যুড।লুক এ্যাট মি।’

আদি সামনে দেখেই মুখ হা করে বলল,’কিরে কিরে! এতো খানি ইঞ্জুরড হলি কেমন করে?নিজ থেকে দৌঁড়ে গিয়ে গাড়ির নিচে শুয়ে গিয়েছিলি নাকি?’

সে দ্রুত হেঁটে ইজমার মুখোমুখি হয়ে বসল।একটু আগে একটা অপরিচিত নম্বরের কল রিসিভ করার পর সে জানতে পেরেছে ইজমা দেশে ফিরেছে।ফিরে নাকি আবার এক্সিডেন্টও করে ফেলেছে।আদি সেই খবর পেতেই এক প্রকার ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে এসেছে।

ইজমা তার সুন্দর মুখখানা অমাবস্যার গভীর রজনীর ন্যায় কালো করে বলল,’আর বলিস না এই কথা।সিএনজিতে ছিলাম।পেছন থেকে ট্রাক এসে উড়িয়ে দিলো।’

‘বলিস কি?ডেঞ্জারাস ব্যাপার।বেঁচে আছিস যে এটাই তো অনেক।’

‘অবশ্যই।প্রথম ধাক্কা খেয়ে তো মনে হচ্ছিল অর্ধেক মনে হয় আল্লাহর কাছে চলেই গিয়েছি।’

বলেই সে সামান্য হাসার চেষ্টা করল।আদি চেহারায় একটা দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে বলল,’আহারে! তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?’

‘দুইটা ফ্রেকচার! তুই বুঝিস?শরীর ব্যথায় শেষ।কষ্ট না হয়ে কি আরাম হবে?’

‘থাক থাক।ব্যাপার না।সুস্থ হয়ে যাবি।’

আদি কথা শেষ করেই নিজের মুখোভঙ্গি পাল্টে কিছুটা ধমকের সুরে বলল,’দোষ তো তোরও আছে।দেশে আসবি,এই কথা আগে জানাবি না?জানালে তো আমিই এয়ারপোর্টে যেতাম তোকে রিসিভ করতে।’

‘সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তোকে।তোকে জানিয়ে দিলে সারপ্রাইজ হতো?এসব যে হবে তা তো ভাবিনি।’

‘বেশ হয়েছে।পাকনামি করলে এমনই হয়।এখন পড়ে থাক ভাঙা হাত নিয়ে পনেরো দিন।’

ইজমা কেবিনের শুভ্র রঙের দেয়ালে চোখ রেখে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।দীর্ঘসময় বসে থাকতে থাকতে তার কোমরে যন্ত্রণা হচ্ছে।হাত দু’টোতে থেমে থেমে একটু পর পর ব্যথা শুরু হয়।

আদি তার যন্ত্রণায় কাঁতর মুখটা দেখেই করুণ স্বরে বলল,’কিরে ইজমা?বেশি কষ্ট হচ্ছে?’

‘ঐ তো একটু।’

আদি তার অক্ষত হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল।তার উপর নিজের আরেকটা হাত রেখে গাঢ় স্বরে বলল,’ব্যাপার না।এই তো কিছুদিন।এরপরই সুস্থ হয়ে যাবি।’

ইজমা বিনিময়ে মিষ্টি হাসল।সে হাসির মাঝেই কোমল গলায় বলল,’তুই চলে এসেছিস না?তোকে দেখেই তো আমার মন ভালো হয়ে গেছে।এতোক্ষণ কেমন এতিম এতিম লাগছিল।এখন অনেক ভালো লাগছে।’

‘কি অদ্ভুত! আমি কি তোর বাপ নাকি?আমাকে দেখেই তোর এতিম ভাব কেটে গেল! পাগল নাকি রে তুই?’

ইফাজ কেবিনের সামনে এসে ভেতরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দরজার কাছেই কিছুক্ষণ দাঁড়ালো।সম্ভবত এটাই সেই ছেলে যাকে ইজমা ফোন দিয়েছিল।ছেলেটার মুখটা চেনা চেনা লাগছে।হয়তো দেখেছে কোথাও।

ইজমা একহাতে তার মুখের সামনে উড়ে আসা চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে বলল,’তোর ভরসায় এতো বছর পর দেশে এসেছি আদি।ভাবলাম তুই চলে এলে আর সুযোগ পাব না।তাই তুই থাকতে থাকতেই বাংলাদেশ দেখতে চলে এলাম।ভালো করেছি না বল?’

আদি মাথা চুলকে বলল,’তা অবশ্য ভালোই করেছিস।কিন্তু আমি নিজেই তো শরনার্থী।তোকে কোথায় জায়গা দিব?’

‘উহু।আমার থাকা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।আমার রিলেটিভস আছে এখানে।তুই বল তোর দিনকাল কেমন যাচ্ছে?তোর ঐ আদরের বাচ্চার কি খবর?’

‘তাসনুভা?আরে আর বলিস না।তোর কথা বললাম তাকে।সে বলল সে তোর সাথে দেখা করতে চায়।’

‘তাই নাকি?তুই বলিস নি তুই যে তার আর তার ভাইয়ের কথা বলতে বলতে আমার কানের পোকা সব বের করে ফেলিস?’

***

তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে
মম জীবন যৌবন, মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে||

সুমিষ্ট নারী কন্ঠের চমৎকার সংগীতের শব্দে দরজা পর্যন্ত এসেই পদযুগল থমকে গেল আরহামের।সে অত্যন্ত সাবধানে কোনো শব্দ না করে ভেতরে উঁকি দিলো।

নবনীতা জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।তার দুই হাত এক করা।চুলগুলো পুরোপুরি উন্মুক্ত।সেই উন্মুক্ত অবাধ্য কেশ তাকে বারংবার জ্বালাতন করছে।নবনীতা সেই জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হলো না।তার কোমল,স্নিগ্ধ,অতিমাত্রায় মিষ্টি মুখশ্রী দৃষ্টিগোচর হতেই আরহাম চওড়া হাসল।ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে ঠিক তার পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়াল।

নবনীতা তার অস্তিত্ব টের পেতেই নড়েচড়ে উঠল।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’আপনি এসেছেন! সরি,আমি খেয়াল করিনি।’

আরহাম তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল।মাথা নিচু করে তার আঙুলের ভাঁজে পর পর কয়েকটা চুমু খেল।নবনীতা সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর ন্যায় লজ্জায় কিছুটা আড়ষ্ট হয়।মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,’দরজা খোলা।রহিমা খালা পাশের ঘরে কাজ করছে।’

‘করুক।তুমি গান থামালে কেন?গাও না।অনেক ভালো লাগছে শুনতে।কার গান এটা?’

‘এটা রবীন্দ্র সংগীত।’

‘ওহহ আচ্ছা।সুন্দর তো।গাও তুমি।’

নবনীতা জানালা দিয়ে পুনরায় বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।আকাশের এক ফালি বাঁকা চাঁদ,নিস্তব্ধ নিশুতি,নবনীতা,আর পাশে তার প্রিয়তম।গান গাইতে এর চেয়ে চমৎকার পরিবেশ আর কি হতে পারে?সে আগের মতো করেই পুনরায় গান ধরে,

জাগিবে একাকী,তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।
মম দুঃখবেদন, মম সফল স্বপন
মম দুঃখবেদন, মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে||

সে গান শেষ করতেই আরহাম হাততালি দিয়ে বলল,’চমৎকার! দারুণ হয়েছে পরী।তুমি এখন থেকে রোজ রাতে আমায় একটা করে গান শোনাবে।ঠিক আছে?’

বলেই সে তার পকেট থেকে চার-পাঁচটা বেলি ফুল বের করে নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’বাগানে পড়েছিল।দেখেই তোমার জন্য নিয়ে এলাম।’

নবনীতা আলগোছে হাসল।খুব সাবধানে ফুলগুলো হাতের মুঠোয় নিল।তারপর নাকের কাছে এনে টেনে টেনে ঘ্রাণ নিল।বেলী হওয়া দরকার ছিলো ফুলের রানী।এতো সুন্দর ঘ্রাণ,এতো বেশি শুভ্রতা ছড়ানো ফুল থাকা স্বত্তেও গোলাপ নিয়ে মানুষ এতো মাতামাতি করে কেন?তারা কি বেলীর সুঘ্রাণে অদ্ভুত রকমের প্রশান্তি খুঁজে পায় না?সেই প্রশান্তি কি অন্য কোনো ফুলের ঘ্রাণে আছে?

আরহাম হাতমুখ ধুয়ে খাটে বসতেই নবনীতা চুপচাপ হেঁটে এসে তার পাশাপাশি বসল।আরহাম জিজ্ঞাসু হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে তার মাথাটা আরহামের কোলে রেখে বেড়াল ছানার মতো গুটিশুটি মেরে শু’য়ে পড়ে।বুকটা আচমকাই ধ্বক করে উঠে তার।মনে হচ্ছে হৃদসম্পন্দ হঠাৎই থেমে গেছে।সে একটা ঢোক গিলে কাঁপা কন্ঠে বলে,’কি হয়েছে পরী?তোমার কি মন খারাপ?’

জড়ানো কন্ঠে অতি ক্ষুদ্র উত্তর আসে,’জ্বী।’

‘কেন?কেউ কিছু বলেছে?’

‘নাহ।এমনিই।’

আরহাম নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁফ ছাড়ে।নবনীতা তার হাতটা নিজের মাথায় রেখে ক্ষীণ কন্ঠে বলে,’মাথায় হাত বুলিয়ে দিন আরহাম।’

আরহাম তার কথা শুনতেই একগাল হাসল।অত্যন্ত যত্নে,সীমাহীন ভালোবাসায় সে সহধর্মিণীর মাথায় হাত ছোঁয়ায়।এই মেয়েটাকে সে কতোখানি ভালোবাসে সেটা কি সে জানে?কোনোদিন সেই ভালোবাসা মাপতে পারবে সে?জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে আরহাম বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছে।এই চমৎকার মেয়েটির সান্নিধ্যে সে সুপুরুষ ব্যতীত অন্য কোনো ভূমিকা পালন করে নি।মেয়েটি তার কাছে সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্ম ফুলের ন্যায়।সে তাকে তেমন ভাবেই যত্ন করেছে।তার ছলনা,কপটতা,স্বার্থপর আচরণের কোনোটাই এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে ছুঁতে পারেনি,আরহাম ছুঁতে দেয় নি।সে মাথা নামিয়ে তার কপালে,চোখের পাতায়,গালে গাঢ় করে চুমু খায়।চব্বিশে পৌঁছে যাওয়া মেয়েটা সেই আদর পেতেই আবেশে চোখ বুজে নেয়।

দূর আকাশে মেঘ জমা হচ্ছে।ঘন কালো মেঘ একত্রিত হচ্ছে কালবৈশাখীর তান্ডব চালানোর জন্য।সেই তান্ডবে একটি স্বচ্ছ,সুন্দর আর নির্মল সংসার ভেঙে চুরমার হবে।নবনীতার স্বপ্ন গুলো গ্যাস বেলুনের মতো হাওয়া ছেড়ে দূর আকাশে মিলিয়ে যাবে।সেই তান্ডবের গর্জন নবনীতার কান অব্দি এখনো পৌঁছায়নি।সাজানো গোছানো,স্বপ্নের ন্যায় সুন্দর সংসারটা তুমুল ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হতে অপেক্ষা মাত্র কয়েক দিবসের।
.
.
.
.
পাবলিক ট্রান্সপোর্ট প্রভাতির জন্য এক আতঙ্কের নাম।সামনের দিকে মহিলাদের জন্য বরাদ্দকৃত সিটগুলো পেলে তো হলোই।নয়তো সেই ছেলে মানুষদের ঠেলেঠুলে বাসে ঝুলে ঝুলে মেসে ফিরতে হয়।

আজ প্রভাতির ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি।সে বাসের ভেতর এক পা রেখেই আঁতকে উঠে।হেল্পার শালাটা বলেছে ম্যাডাম বাস একদম খালি।তাড়াতাড়ি উঠুন।সেও গাধির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাসে উঠেছে।কিন্তু উঠার পর মনে হচ্ছে এখানে সুঁচ ঢোকানোর জায়গাও নেই।সে কটমট চোখে হেল্পার ছেলেটার দিকে তাকায়।হেল্পারের মনোযোগ অবশ্য তার দিকে নেই।সে বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে মাথা বের করে চিৎকার ছুড়ছে,’রামপুরা রামপুরা।আরো পাঁচটা সিট খালি।’

প্রভাতির মেজাজ গরম হয়।সে খ্যাক খ্যাক করে বলল,’এ্যাই ছেলে!মিথ্যা কথা বলো কেন?কোথায় সিট আছে বাসে?আর নতুন মানুষ এলে দাঁড়াবে কোথায়?দাঁড়ানোর জায়গাও তো নেই এখানে।’

হেল্পার ছেলেটা তার কথার কোনো তোয়াজ করল না।একেবারে সস্তা মানের কৌতুকের মতো সবকিছু উড়িয়ে দিয়ে সে পুনরায় বাসে মানুষ তোলার কাজে লেগে পড়ল।প্রভাতি আশাহত হয়ে একটু সামনে এগিয়ে শক্ত করে ধরার মতোন একটা অবলম্বন খুঁজল।

‘প্রভাতি!তুমি?’

সে ঘাড় ঘুরায়।অত্যন্ত বিস্ময় মাখা কন্ঠে শুধায়,’নিলয়! তুমি?’

নিলয় দ্রুত তার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।চোখ দিয়ে নিজের সিটের দিকে নির্দেশ করে বলল,’বসো না প্রভাতি।আমি একটু সামনেই নেমে যাব।তুমি বসো।’

প্রভাতি এক বলাতেই সে প্রস্তাব লুফে নিল।তাড়াহুড়ো করে নিলয়ের সিটটা দখল করেই হাঁফ ছেড়ে বলল,’থ্যাঙ্কু নিলয়।তোমায় নাম ধরে ডাকছি বলে কিছু মনে করো না।আসলে আমার একটা বছর ড্রপ গিয়েছিল তো।সেই হিসেবে আমরা সমবয়সীই।’

নিলয় অমায়িক হেসে তার দিকে তাকায়।
‘নাহ প্রভাতি।আমি কিছু মনে করিনি।’

প্রভাতি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখল।নিলয় দাঁড়িয়েছে একদম তার পাশাপাশি।এটাতে তার ভালোই হয়েছে।অন্য কোনো ছেলে তার গা ঘেঁষে দাঁড়াতে পারছে না।

‘প্রভাতি! তুমি কি রামপুরাই নামছ?’

‘হুম।তুমি?’

‘বাড্ডায়।’

প্রভাতি কতোক্ষণ উসখুস করল।তারপর মাথা তুলে বলল,’প্রভাতি নামটা খুব বিশাল।তুমি আমাকে প্রভা বলেই ডাকো।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।প্রভা বলেই ডাকব।’

‘তার আগে বলো কোনটা বেশি সুন্দর?প্রভাতি নাকি প্রভা?’

নিলয় হাসল।মাথা চুলকে বলল,’দু’টোই সুন্দর প্রভা।দু’টোরই একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।আমি না হয় যখন যেটা মুখে আসে সেটাই বলব।’

প্রভাতির এই প্রস্তাব পছন্দ হলো।সে মাথা নেড়ে পা দুলিয়ে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।দু’টোই বলবে।আগে বলো,কাল ভার্সিটি যাচ্ছো?আমি কিন্তু কালও তোমার ডিপার্টমেন্টের সামনে আসবো বলে দিলাম।’

বাস বাড্ডা পর্যন্ত আসতেই নিলয় লাফিয়ে লাফিয়ে কোনোরকমে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।গরমে আর মানুষের ভীড়ে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।এখন খোলা রাস্তায় এসে তার কিছুটা আরাম লাগছে।

‘নিলয়! নিলয়! দাঁড়াও।’

গলির মাথা থেকে একটু ভেতরে যেতেই স্বল্প পরিচিত কন্ঠের ক্রমাগত সম্বোধনে নিলয় ঘুরে দাঁড়ালো।আশ্চর্য হয়ে বলল,’প্রভা তুমি?’

প্রভাতি ছুটতে ছুটতে তার সামনে এলো।দৌড়ে দৌড়ে সে হাঁপিয়ে উঠেছে।নিলয়ের কাছাকাছি এসেই সে সামান্য ঝুকে দুই হাটুতে হাত রেখে শ্বাস টানতে টানতে বলল,’তুমি যাওয়ার পর কেমন কেমন যেন লাগছিল বাসে।তাই নেমে চলে এসেছি।’

‘অদ্ভুত তো।আমি কি রোজ তোমার সাথে থাকি নাকি?কেমন কেমন লাগার কি আছে?’

‘জানি না।’

‘এখন?মাঝপথে যে নেমে গেলে,এখন বাড়ি যাবে কেমন করে?’

প্রভাতি দাঁত দিয়ে কতোক্ষণ নিজের নখ কা’মড়ায়।তারপর কংক্রিটের রাস্তা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে,’তুমি এখন কোথায় যাবে?’

‘হোটেলে যাব।খিদে পেয়েছে খুব।’

‘আমাকেও তাহলে তোমার সাথে হোটেলে নিয়ে যাও।’

‘তুমি হোটেলে যাবে?সেখানে তো মেয়ে তেমন কেউ যায় না।তোমার আনইজি লাগবে না?’

‘আনইজি লাগবে কেন?তুমি আছ না আমার পরিচিত?তাছাড়া আমি খেতে যাচ্ছি না।তুমি খাবে,আর আমি বসে থাকব।’

নিলয় সূক্ষ্ম চোখে আগাগোড়া মেয়েটাকে পরোখ করে।তার পরনে গাঢ় টিয়া আর সাদার মিশেলে একটা সাদামাটা কুর্তি।মুখে প্রশস্ত হাসি।আচরণ অতিমাত্রায় মিশুক প্রকৃতির।সে ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে বলল,’আচ্ছা চলো।আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।খাওয়া শেষ করে বাকি কথা বলছি।’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে[তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৩)

ভাতের প্লেট টা টেবিলের উপর রাখার শব্দেই নিলয়ের হুশ ফিরে।সে একনজর প্লেট টা দেখেই সেটা টেনে নিজের আরো কাছাকাছি আনে।তারপরই কোনোদিকে না দেখে বড় বড় লোকমা তুলে সেটা খেতে আরম্ভ করে।

প্রভাতি গালের নিচে হাত রেখে তার কর্মকাণ্ড দেখে।তারপর আনমনেই হাসে।নিলয়কে এখন বাচ্চাদের মতোন দেখাচ্ছে।সে সবজির বাটিটা ধীরে সুস্থে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’নাও সবজি খাও।মুরগি অথবা মাছ খাবে না?শুধু সবজি দিয়ে কিভাবে খাবে?’

নিলয় দ্রুত বাম হাত নেড়ে বলল,’না না।আমি আর কিছু খাবো না।চলবে আমার।’

‘আরে এতো কিপ্টেমি করতে হবে না।আজ বিল আমিই দিব।’

নিলয় হাতে তোলা লোকমাটা পুনরায় প্লেটে রেখে মাথা তুলে বলল,’কেন?তুমি কেন দিবে?’

‘এভাবেই।দিলে কোনো সমস্যা?’

‘সমস্যা না বলছ?চেনো না,জানো না একজনের বিল তুমি কেন দিবে?’

‘চিনি না কোথায়?একই ভার্সিটিতে পড়ি।বিল পরিশোধ করার জন্য এইটুকু চেনাজানাই যথেষ্ট।’

প্রভাতি নিজ থেকে ওয়েটারকে ডেকে ডিম ভুনা আর মুরগির মাংসের তরকারি নিল।বাটি দু’টো নিলয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’নাও।এটা খাও।পরে কথা বলবে।’

নিলয় আড়চোখে একবার তাকে দেখল।তারপর আবার নিজের খাওয়ায় মন দিলো।তার খাবার শেষের দিকে আসতেই প্রভাতি সহজ গলায় প্রশ্ন করল,’তোমার বাড়িতে কে কে আছে?এখানে কি মেসে থাকো নাকি বাসায়?’

নিলয় থামল।এক ঢোক পানি গিলে প্রভাতির দিকে দেখে বলল,’মেসে থাকি।পাঁচজন মিলে।’

‘ওহ।’
‘তুমি কিন্তু আমার প্রথম প্রশ্নের জবাব দাও নি।’

নিলয় পুরোপুরি খাওয়া শেষ করল।তারপর গিয়ে বেসিনের সামনে থেকে হাত মুখ ধুলো।ওয়েটারের থেকে একটা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,’আমার বাড়িতে কেউ নেই।আমি একাই।’

‘মা বাবা কেউ নেই?’

‘নাহ,বাবা অনেক আগে মারা গেছে।মা মারা গেছে দুই বছর আগে।’

প্রভাতি প্রথমে কিছুক্ষণ মলিন মুখ করে নিলয় কে দেখল।তারপরই তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলল,’হ্যান্ডশেক করো।আমারও কেউ নেই।একদম তোমার মতো।’

নিলয় তার হাতটা দেখল,তবে ধরল না।কেবল চোখ সরু করে বলল,’তুমি থাকো কার সাথে?’

‘আমি?আমি সাবলেট থাকি।মাধ্যমিক পর্যন্ত অনাথ আশ্রমে ছিলাম।কলেজে উঠার পর নিজেই টুকটাক আয় করি।তখন থেকেই আলাদা থাকি।’

‘ওহ।’

প্রভাতি সত্যি সত্যিই সেদিন পুরো বিল দিলো।নিলয়ের দুপুরের খাবার বাবদ যতো টাকা খরচ হলো,তার পুরোটাই সে বহন করল।নিলয় তাজ্জব হয়ে বলল”তুমি আমার বিল কেন দিচ্ছ?আমি কি বেকার নাকি?আমি নিজেও টিউশন করাই।’

‘উহু।আমি এমনিই দিয়েছি।তুমি খুব সুন্দর করে ভাত খাও।আমার দেখতে ভালো লেগেছে।’

‘ভাত খাওয়াতে সৌন্দর্য থাকে?’

‘হু।থাকে।’

নিলয় সবার আগে বেরিয়ে এলো হোটেল থেকে।প্রভাতি এলো তার পিছু পিছু।পিঠের ব্যাগটা সে বুকের সাথে চেপে ধরেছে।নিলয়ের বড় বড় পায়ের সাথে পা মেলানো তার জন্য কষ্টকর।তাই সে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে তার পাশাপাশি এসে বলল,’তুমি কি আমার উপর বিরক্ত হচ্ছো?’

নিলয় বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে হাঁটার গতি আরো বাড়াতে বাড়াতে জবাব দেয়,’না হচ্ছি না।’

প্রভাতি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’আসলে ক্লাসে আমার সাথে কেউ কথা বলে না তো,তাই তোমার পেছন পেছন ঘুরছি।তুমি জানো,ভার্সিটিতে আমাকে কেউ পাত্তা দেয় না।’

নিলয় থামল।পেছন ফিরে অবাক হয়ে বলল,’কেন?কেউ পাত্তা দেয় না কেন?’

‘কারণ আমি দেখতে অনেক ক্ষেত।এখানে সবাই স্মার্টদের তোয়াজ করে।আমি তো গেঁয়ো,তাই কেউ আমার সাথে কথা বলে না।’

বলেই সে বোকা বোকা হাসে।নিলয় লক্ষ করে কথাটা বলতে গিয়েই মেয়েটার চোখ ছলছল করে উঠেছে।এই চোখের ভাষা নিলয় কিছুটা বুঝে।বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ছাপোষা দের টিকে থাকা একটু কঠিন।প্রভাতি ভুল কিছু বলে নি।মা বাবা ছাড়া জীবন কোনো কুকুর বিড়ালের জীবনের চেয়ে ভালো কিছু না।শীতের রাতে রাস্তার ধাঁরের ল্যাম্পপোস্টের নিচে থাকা কুকুরটা যেমন অসহায়,পিতা মাতাহীন সন্তান মস্ত বড় পৃথিবীতে ঠিক ততোটাই অসহায়।নিলয় সেই অসহায়ত্বের যন্ত্রণা বুঝে।প্রভাতি মেয়ে মানুষ,তার কষ্ট নিলয়ের চেয়ে খানিকটা বেশিই হওয়ার কথা।অথচ মেয়েটার চোখে মুখে সেই কষ্টের ছিটে ফোঁটাও নেই।

প্রভাতি একটা টেম্পু ডেকে দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে তার একটা সিট নিজের দখলে নিল।নিলয় নিঃশব্দে টেম্পুতে উঠে তার মুখোমুখি এসে বসল।প্রভাতি কপাল কুঁচকে বলল,’তুমি কেন উঠেছ?রামপুরার টেম্পু এটা।’

‘জানি।আমি রামপুরাই যাচ্ছি।কাজ আছে আমার।’

মিনিট দশেকের মাথায় ভাঙাচুরা টেম্পুটা রামপুরা এসে পৌঁছায়।প্রভাতি হাসি হাসি মুখ করে টেম্পু থেকে নেমে আসে।নিলয় একহাত পকেটে গুজে জানতে চায়,’বাসা কোনদিকে তোমার?’

‘এই তো।সামনে গিয়ে বাম দিকে।’

বলা শেষ করেই সে একগাল হেসে রাস্তার একপাশের ছোট একটা গলির দিকে এগিয়ে যায়।নিলয়ের মন চায় তাকে পিছু ডেকে বলতে,’এই প্রভা শুনো! তুমি মোটেও ক্ষেত না।তুমি ভীষণ মিষ্টি।যাদের ডায়বেটিস আছে,তাদের উচিত তোমায় এড়িয়ে চলা।’

সে ততক্ষণ তাকে দেখল যতক্ষণ না তার অবয়ব ছোট হতে হতে একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।সে চোখের আড়াল হতেই নিলয় ব্যস্ত হয়ে রাস্তার দুই পাশ দেখে।তাকে এখন বাড্ডার বাস ধরে উল্টো পথে বাড়ি ফিরতে হবে।
.
.
.
.
রাত একটা তিপ্পান্নো।টিকটিক শব্দ করে দেয়াল ঘড়ি চলছে।চারপাশ এতো নিরব যে সেই শব্দও কর্ণকুহরে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।নবনীতা মেঝের এক কোণায় চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বসে আছে।নোনা জল গাল বেয়ে থুতনি পর্যন্ত নামতেই সে দ্রুত সেটা মুছে নেয়।তার হাত দু’টো অল্প অল্প কাঁপছে।আজ সে একটি জঘন্য আর দুঃসাহসিক কাজ করেছে।

আরহাম আর সে আজ একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল।আরহামের কোনো এক কলিগের ভাইয়ের বিয়ে।উত্তরার একটা নামি দামি রিসোর্টে সেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।নবনীতা যেহেতু আরহামের সহধর্মিণী,তাই সেই সূত্রে সে নিজেও সেই বিয়েতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

ভিআইপি দের সবকিছুই ভিআইপি।নবনীতার মনে হলো বড়লোক আর ভিআইপি শব্দ দু’টোর মাঝে বিশাল পার্থক্য।তার বাবাও তো শিল্পপতি ছিলো।কোথায় তারা তো কখনো এসব প্রটোকল ফোটোকল মেনে চলেনি।সে মুখ চেপে হাসল।আসলে এগুলো সব জনগণের টাকা মেরে পেট ফুলিয়েছে তো,তাই মনের ভেতর এতো ভয়।দেশে কি আর বিত্তমান মানুষ নেই?কই তারা তো এতো হাই সিকিউরিটি মেইনটেইন করে চলে না।

রিসোর্টে পা রেখেই নবনীতা ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখল।কতো জাকজমকপূর্ণ আয়োজন! দেখেই বোঝা যাচ্ছে,অর্থ ব্যয়ে কোনোরকম কার্পন্য করা হয়নি।সে হালকা গোলাপি রঙের মসলিনের শাড়িটার কুচি আর আঁচল সামলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

বিয়েতে আরহাম বাদেও আরো অনেক নেতা শ্রেণীর মানুষদের দেখা মিলল।নবনীতা সরু চোখে তাদের প্রত্যেককে দেখল,বোঝার চেষ্টা করল তাদের মতিগতি।আচমকাই তার চোখ গিয়ে আটকায় একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত মাঝবয়সী ভদ্রলোকের দিকে।তার চেহারার অর্ধেক দেখেই নবনীতা কপাল কুঁচকে নেয়।তার কেন মনে হচ্ছে এই মুখটা তার খুব চেনা?

একটা শুকনো ঢোক গিলে নবনীতা এগিয়ে যায় সামনের দিকে।হঠাৎই লোকটা ঘুরে দাঁড়াল।নবনীতা আঁতকে উঠে তার দিকে তাকায়।চোখ জোড়া আপনাআপনি বড় হলো তার।মনে হলো সমস্ত শরীর ভেঙে আসছে।শরীরের সমস্ত জোর কোনো এক অদৃশ্য শক্তি টেনে নিচ্ছে।মেঝেতে ভর দেওয়ার মতো জোর টুকুও তার নেই।মাঝবয়সী লোকটার মুখশ্রী দেখেই তার মস্তিষ্ক পুনরায় কিছু ভয়াবহ অসহনীয় স্মৃতিদের স্মরণ করল।নবনীতা কম্পমান হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে।কি অসহ্য এই যন্ত্রণা! কি অসহ্য সবকিছু!

লোকটার সাথে তার দৃষ্টি বিনিময় হতেই তার চোখ ছলছল করে উঠে।সে ঘৃণার দৃষ্টিতে একনজর তাকে দেখেই কোনোরকমে বলল,’রহমান চাচা! আপনি?’

পাথরের মতো কতোক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর তার কি হলো সে জানে না,আচমকাই সে ছুটে গিয়ে সশব্দে তার ডানগালে কষিয়ে একটা চড় বসাল।

জালালুর রহমান তার এমন আচরণে স্তব্ধ হয়ে কতোক্ষণ তাকে দেখলেন।তারপরই ধীরে ধীরে একটা হাত তুলে নিজের গালে ছোঁয়ালেন।এই মেয়েটা তাকে চড় মেরেছে?কি অদ্ভুত! এর কি মাথা নষ্ট?

তার হতভম্ব,অবিশ্বাস্য দৃষ্টির বিন্দু পরিমান তোয়াক্কা না করে মেয়েটা ক্রোধে রক্তিম হয়ে চেঁচিয়ে উঠল,’তুই একটা খু’নী।তুই আমার মা বাবাকে মেরেছিস।তুই একটা জানো’য়ার।’

***

‘পরী! দরজা টা কি তুমি খুলবে নাকি আমি ভাঙব?’

দরজার ওপাশের পুরুষালি কন্ঠ টা দীর্ঘসময় ধৈর্যধারণ করে শেষটায় কিছুটা ধমকে উঠল।অথচ সেই ধমকে ভেতরে থাকা মেয়েটার কোনো হেলদোল হলো না।

ঠান্ডা ফকফকা মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে সে সিলিং এর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।জালালুর রহমান কে সে রহমান চাচা বলেই চিনতো।তাদের বাড়িতে এই লোকের রোজ রোজ আসা যাওয়া ছিল।বাবার বিরাট ব্যবসার কিছু অংশে রহমানের শেয়ার ছিল।নবনীতা তাদের বসার ঘরে প্রায়ই তাকে দেখেছে।

নূর আহমেদের বিরাট কারবার।ব্যবসায় বিশাল নামডাক,সম্পদের পরিমান প্রতিবছর শেষে বাড়ছে বৈ কমছে না।অট্টালিকার মতোন বিশাল বাড়ি,টাকা পয়সা,কিছুরই তো অভাব নেই।তার এই আড়ম্বরপূর্ণ জীবন তার সহকর্মীদের সইলো না।তারা উঠে পড়ে লাগল তার সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য।এই প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে প্রাণ হারাতে হলো নূর আহমেদ এবং তার স্ত্রীর।তিনটা প্রাণ রাতারাতি নিজেদের মা বাবা হারিয়ে এলোমেলো,উদ্ভ্রান্ত আর ছন্নছাড়া জীবনে পদার্পন করল।কতোকিছু হয়ে গেল জীবনে।নবনীতার শ্বাস রোধ হয়ে আসে সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করতে গিয়ে।মনে হয় অতীতের স্মৃতি গুলো সব চোখের সামনে ভাসছে।আচ্ছা,এমন কেন হয়?আমরা যা কিছু ভুলে যেতে চাই,তাই কেন বারবার আমাদের কল্পনায় এসে আমাদের কষ্ট দেয়?

আরহাম আবারো দরজা ধাক্কায়,এবার একটু জোরে,অন্যবারের তুলনায় বেশ অধৈর্য হয়ে।পরী আজ কি করেছে পরী নিজেও জানে না বোধহয়।একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে সে একটা মানুষকে গাল ফাটিয়ে চড় মেরেছে।সেই মানুষটা স্বয়ং জালাল আঙ্কেল।মানে এই মেয়ে আরহামের মানসম্মান বলে আর কিছু বাকি রাখবে না।জালাল আঙ্কেল কি গলির কোনো পাতি নেতা যে মন চাইল আর মেরে দিলাম?এই মেয়ের কি কোনো কান্ডজ্ঞান বলতে নেই?এতোকিছুর মাঝে সে আরহামকে একবার ডাকে পর্যন্ত নাই।মহান কাজ শেষ করেই সে হনহনিয়ে রিসোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।আরহামের এখনো সবকিছু বিশ্বাস হচ্ছে না।কেমন বোকা বোকা লাগছে সবকিছু।

নবনীতা দরজা খুলল আরো আধঘন্টা পরে।তার চোখ মুখের করুণ অবস্থা দেখেই আরহাম নিজের রাগ ভুলে গেল।আঁতকে উঠে বলল,’পরী! কি হয়েছে তোমার?তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

নবনীতা কোনো উত্তর না দিয়ে রোবটের মতোন হেঁটে খাটের এক কোণায় গিয়ে বসল।আরহাম ধীর কদমে তার পাশাপাশি এসে বসে।অনেক ভেবে চিন্তে তার একটা হাত নবনীতার হাতের উপর রেখে শান্ত গলায় বলে,’তুমি এই কাজ কেন করেছ পরী?এসব হঠকারিতা তো তোমার সাথে যায় না।তুমি কেন এই কাজটা করলে?’

নবনীতা আস্তে করে নিজের মাথাটা মেঝের দিকে ঝুকায়।নিজের পা দু’টো দেখতে দেখতে ভাঙা গলায় অতি ক্ষীণ আওয়াজে বলে,’আপনি সেদিন আপনার মা কে আপনার বাড়িতে দেখে রিভলভার হাতে নিয়েছিলেন কেন?সেদিনও তো চারপাশে অনেক মানুষ ছিল।তবুও কেন আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি?’

আরহাম ভড়কে গিয়ে উত্তর দেয়,’সেটা তো অন্য হিসাব।তুমি তো সবটা জানো।’

‘আমি আপনার সবটা জানি।আপনি জানেন না,কখনো জানতে চাননি।তাই জানেন না।’

কাটকাট উত্তরটা আরহামের ঠিক পছন্দ হলো না।সে কপালে ভাঁজ ফেলে পাশ ফিরে একবার মেয়েটা মুখভঙ্গি দেখে।

‘জালাল আঙ্কেল তোমাদের পাস্টের সাথে সামহাউ কানেক্টেড?’

নবনীতা কান্না থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে জবাব দেয়,’হুম।বাবার বিজনেস পার্টনার।আপনার ঐ গুরু,ঐ জানোয়ারটাই ঠান্ডা মাথায় আমার মা বাবাকে মেরেছে।’

বলা শেষে সে শব্দ করে কেঁদে ফেলল।একহাত দিয়ে মুখ চেপে বলল,’আপনি এই ধরনের লোকদের আদর্শ মানেন,যারা অন্যের সম্পদ দখল করে নিজেরা সবকিছু ভোগ করে?’

আরহাম একটু কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করল।থমথমে মুখ করে বলল,’জালাল আঙ্কেল কার জায়গা দখল করেছে সেটা আমি জানবো কেমন করে?উনি নিশ্চয়ই আমাকে এসব বলে নি।তাছাড়া তোমার বাবার বিজনেস পার্টনার হয়েছে মানে তো এটা না যে উনিই তার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত।তুমি এমন সিলি সিলি কথা বলছ কেন?’

নবনীতা ঝাপসা চোখে তার মুখের দিকে তাকায়।কাঁপা স্বরে থেমে থেমে বলে,’আপনার মনে হচ্ছে এতো বড় কথা আমি স্রেফ অনুমান করে বলছি?’

‘জানি না।তবে তোমার কাজটা আজ আমার ভালো লাগেনি।’

‘আরহাম আপনি এমন কেন?’

আরহাম তার থেকে চোখ সরিয়ে সোজা হয়ে বসল।কাঠখোট্টা স্বরে বলল,’আমি এমনই।’

সে থামল।পুনরায় নিরবতা ছাপিয়ে বলল,’আমি জালাল আঙ্কেলের ব্যবসায়িক ব্যাপারে কিছুই জানি না।এমনকি চট্টগ্রামে যে তার ব্যবসা আছে এটাও আমি জানি না।তাছাড়া এখন এসব জেনে কি লাভ পরী?যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।এখন এসব পুরোনো কাসুন্দি ঘাটলে তো তোমার মা বাবা ফেরত আসবে না তাই না?’

নবনীতা তার অশ্রুদের চোখ বেয়ে নামার সুযোগ দিলো না।তার আগেই হাত বাড়িয়ে চোখ মুছে নেয়।তার দুর্বল লাগছে ভীষণ।সে দুর্বল গলায় সামান্য জোর এনে বলল,’আপনার কাছে তার অপরাধ কেমন লাগছে আমার জানা নেই।কারণ আমার ধারণা আমি যেমন করে আপনার দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করতে পারি,আপনি সেটা কখনোই পারেন না।আপনি কোনোদিনই বুঝবেন না সে আসলে কি করেছে।কারণ নিজেকে ছাড়া আপনি আর কাউকে বুঝেন না।তবুও আপনার জন্য বলে রাখি,যেটাকে আপনি অতীত কিংবা পুরোনো কাসুন্দি বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন,সেই অতীত তিন তিনটা মানুষের জীবন উজাড় করে দিয়েছে।মা বাবার সাথে সাথে তিনটা মেয়ের শৈশব কৈশোর সবকিছুর মৃত্যু হয়েছে।আপনি খুব অবলীলায় বলে দিলেন তোমার বাবা মা।চাইলে আমিও সেদিন বলতে পারতাম আপনার বাবা মা।আমি বলিনি।আমি,,’

নবনীতা পুরো কথা শেষ করার আগেই আরহাম বিরক্তিতে চ কারান্ত শব্দ করে বলল,’আহা পরী! শুধু শুধু এতো প্যাচাচ্ছ কেন সবকিছু?আমি তেমন কিছুই বলিনি।আমি শুধু বলছি এতো বছর আগের ঘটনার সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।তুমি আমাকে এসবের সাথে কেন জড়াচ্ছ?’

‘অদ্ভুত! জড়ালাম কখন?’

‘এই যে জালাল আঙ্কেলের বিষয়ে তুমি আমার সাথে রাগ হচ্ছো?আই ডোন্ট নো হিজ পাস্ট এক্টিভিটিজ।তার কারণে তুমি আমার সাথে মিস বিহেভ কেন করছ?’

নবনীতা ব্যথিত চোখে তার দিকে তাকায়।ঝাপসা চোখ জোড়া আরহামের দিকে মেলে দিয়েই একটা শ্বাস টেনে বলে,’আপনি বুঝেন না কেন করছি?আপনি তো ঐ জালালকে পীর মানেন।তার সব কথা শুনেন।আপনার মাথায় চব্বিশ ঘন্টা ঐ লোক বুদ্ধি দেয়।ঐ জানো’য়ারের বুদ্ধিতে আমার হাসবেন্ড চলে।এটাই কি মিস বিহেভ করার জন্য যথেষ্ট না?’

‘ঐ লোক তো আমাকে আরেকজনকে মেরে তার ঘরবাড়ি দখল করার বুদ্ধি দিচ্ছে না।’

নবনীতা তাচ্ছিল্য করে হাসল।বিদ্রুপের সুরে বলল,’নাহ সেই বুদ্ধি দিচ্ছে না।তবে কিভাবে আরেকজনকে মেরে নিজে গদিতে টিকে থাকতে হয় সেটা ঠিকই শিখিয়ে দিচ্ছে।আপনি পাল্টে যাচ্ছেন আরহাম।’

‘বাজে বকবে না।’

‘আমি তো বাজেই বকি।’

নবনীতা আরো কিছু বলার জন্য ছটফট করছিলো,কিন্তু শারীরিক দুর্বলতায় সে আর মুখ খোলার জোর পেল না।তার মনে হচ্ছে তার ইন্দ্রিয় সমূহ অচল হয়ে যাচ্ছে।আরহাম একটা হাত তুলে তার গাল স্পর্শ করল।একটু এগিয়ে এসে নিজেদের দুরত্ব মিটিয়ে নিতেই তার ব্যবহৃত পারফিউমের কড়া ঘ্রাণে নবনীতার গা গুলিয়ে এলো।দুই সেকেন্ড চোখ মুখে খিঁচে আচমকাই সে এক ধাক্কায় আরহামকে তার সামনে থেকে সরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটে যায়।গিয়েই শব্দ করে বমি করে।
আরহাম তার এহেন কর্মকান্ডে হকচকিয়ে গেল।এক লাফে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বড় বড় পায়ে সামনে যেতে যেতে বলল,’এ্যাই পরী! কি হয়েছে তোমার?অদ্ভুত! আমি কি এতোই খারাপ যে কাছে আসতেই তোমার বমি পাচ্ছে?’

নবনীতা দুই হাত বেসিনে চেপে মাথাটা যতোটা সম্ভব ঝুকিয়ে কতোক্ষণ কাশলো।তার শরীর আজ মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল।সে দ্রুত মুখে পানির ঝাপটা দেয়।মুখে পানি ছিটিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই তার মাথা ঘুরপাক খায়।মনে হচ্ছে এখনি সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে।আরহাম ব্যস্ত পায়ে তার পেছনে এসে দাঁড়ায়।একটা হাত তার পিঠে রেখে কোমল গলায় বলে,’কি হয়েছে তোমার?কিছু তো খেলেই না দাওয়াতে।বমি করছো কেন?’

নবনীতা তার অস্তিত্ব টের পেতেই তার পিঠটা আরহামের বুকের সাথে ঠেস দিয়ে টেনে টেনে দু’টো শ্বাস নেয়।তার কাঁপতে থাকা হাত দু’টো আরহাম চট করে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।একহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে শুধায়,’খারাপ লাগছে পরী?’

নবনীতা দু’চোখের পাতা বুজে রেখেই মূর্ছা যাওয়া গলায় বলল,’আমাকে একটু খাট পর্যন্ত নিয়ে যাবেন আরহাম?মাথা ঘুরছে আমার ভীষণ।’

আরহাম তাকে পাজাকোলা করে তুলে নেয়।বাড়তি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই চুপচাপ তাকে নিয়ে এনে খাটের একপাশে শোয়ায়,মনে করে চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দেয়।নবনীতা দুর্বল হাতে পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বলল,’আপনিও আসুন।’

আরহাম জড় পদার্থের মতো টানটান হয়ে শোয়।নবনীতা তার প্রশস্ত পুরুষালি বক্ষে ঝাপিয়ে কতোক্ষণ নাক টানে।নিঃশব্দ অশ্রু বিসর্জন এক পর্যায়ে হেঁচকিতে রূপ নেয়।নবনীতা তার বন্ধন আরো শক্ত করে জড়ানো গলায় বলল,’আমার বাবা মা বলে আপনি আমার দুঃখটা অনুধাবন করতে পারছেন না হয়ত।যাক সমস্যা নেই।পৃথিবীর কয়জনই বা অন্যের যন্ত্রণা নিজে অনুভব করতে পারে?কিন্তু আপনি যাদের সাথে উঠা বসা করছেন নিয়মিত,তারা সবাই কোনো না কোনো ভাবে এসব পাপের সাথে জড়িয়ে আছে।আপনি এই পাপিষ্ঠদের ভীড়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেন না আরহাম।এটা সম্ভব না।আপনি দয়া করে নিজেকে গুটিয়ে নিন।আমি হয়তো খুব বেশি কিছু চাইছি,কিন্তু আমার অনুরোধ আপনার কাছে,আপনি এসব থেকে সরে আসুন।আমি চাই না অনেক গুলো বছর পর আপনিও তাদের মতো অমানুষ হয়ে উঠেন।আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই আরহাম।’

শেষে বাক্যে অসহায়ত্ব ছিল,একজন স্ত্রী’র আকুল আবেদন ছিল।আরহাম একটা গাঢ় শ্বাস ছেড়ে দুই হাতে নবনীতাকে জড়িয়ে ধরল।চাপা স্বরে বলল,’শ্বাস টানছো কেন তুমি?ইনহেলার দিব?ডাক্তারের কাছে যাবে?’

নবনীতা চোখ বুজেই জবাব দেয়,’নাহ।আপনার কাছে থাকব আমি।আপনি ঐ রহমানের সাথে আর কথা বলবেন না।’

‘আচ্ছা বলব না।’

‘আমার কসম।’

‘আচ্ছা।’

রাত বাড়ে।নবনীতা নাক টানতে টানতে এক সময় তার প্রিয়তমর বুকে গুটিশুটি মেরেই গভীর ঘুমে অসাড় হয়।আরহামের চোখে ঘুম নামে না।টিক টিক করে চলতে থাকা ঘড়ির কাটা তার হৃদস্পন্দন আরো বাড়ায়।জালালুর রহমানের এমন অন্যের সম্পদ দখলদারির বিষয়টি সে আরো আগেই জানতো।তবে পরীর জীবনের সাথে এই লোক এমনভাবে জড়িয়ে থাকতে পারে,সেটা তার কল্পনাতীত ছিল।পরী দুঃখ পেয়েছে।পরীকে দুঃখ দিতে সে চায় না।কিন্তু পরী যেই কথা বলছে সেটাও তার পক্ষে মানা সম্ভব না।রাজনীতি ছেড়ে দিবে?এও কি সম্ভব?সে তাহলে এতো বছর কিসের জন্য এতো কষ্ট করল?রাজনীতি করলে কি এতো ভালো থাকা যায়?আরহাম যদি রাজনীতি ছেড়েও দেয়,তাহলে সেই জায়গায় অন্য কেউ এসে বসবে।নিঃসন্দেহে সে আরহামের চেয়েও বেশি অসৎ হবে।এতে দেশের তো কোনো উন্নতি হবে না।তাহলে খামোখা আরহাম কেন ক্ষমতা ছেড়ে দিবে?

হঠাৎই পিঁক পিঁক শব্দে তার ধ্যান ভাঙে।তাড়াহুড়ো করে সে ফোনটা হাতে নেয়।স্ক্রিনে ভাসা নম্বরটা দেখেই সে একটা শুকনো ঢোক গিলে পাশ ফিরে নবনীতার ঘুমন্ত মুখখানা পর্যবেক্ষণ করে।তারপরই অতি সন্তর্পণে তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে চাদরটা তার গায়ের উপর টেনে দিয়ে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।তাড়াহুড়ায় কলটা রিসিভ করে নবনীতা যেন ঘুমন্ত অবস্থাতেও শুনতে না পায়,ততোটা ক্ষীণ কন্ঠে বিড়বিড় করে,’জ্বী আঙ্কেল বলুন।আমি শুনছি।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৫১

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫১)

পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্রের পরীক্ষা নিয়ে শুভ্রানী খানিকটা দ্বিধায় ছিল।কয়েকটা অধ্যায়ে সে বেশ পটু।অন্য অধ্যায় গুলোতে কিছুটা কাঁচা।কিন্তু সেই তুলনায় তার পরীক্ষা বেশ ভালোই হয়েছে।সে হল থেকে বেরিয়েই কাঙ্ক্ষিত মানুষের খোঁজ করে।আশেপাশে কোথাও তাকে না দেখতেই সে কিছুটা আশাহত হয়।আরশাদের কি জ্বর হলো নাকি?নয়তো সে আসেনি কেন?

একটু সামনে যেতেই টয়োটার সেই কালো গাড়িটা তার সামনে এসে থামল।ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা ছেলেটা গ্লাস নামানোর আগেই শুভ্রা গোল গোল চোখ করে বলল,’আরিশ ভাইয়া! আপনি?’

আরিশ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে তাকে দেখল।সাবলীল গলায় বলল,’পরীক্ষা কেমন হয়েছে শুভ্রা?’

‘জ্বী ভাইয়া।আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

‘তোমার আপাই কে খুঁজছ?’

শুভ্রা নামিয়ে সামান্য লাজুক হয়ে বলল,’জ্বী ভাইয়া।রোজ রোজ আসে তো তাই।’

আরিশ নিজের সিটে বসেই সামনে ঝুকে গাড়ির দরজা খুলে নিরেট স্বরে বলল,’আজকে মনে হয় ভাইয়া আর ভাবি কোথাও গিয়েছে।তুমি গাড়িতে উঠো।আমি তোমায় ড্রপ করে দিচ্ছি।’

শুভ্রা চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল।কিছুক্ষণ খচখচ করার পর শেষে খানিকটা অধৈর্য হয়ে বলল,’আচ্ছা আপাই আর ভাইয়ার মধ্যে কি সব ঠিকঠাক আছে?’

আরিশ তার দিকে না ফিরেই সামনে দেখতে দেখতে নিরুদ্বেগ হয়ে বলল,’ঐ একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল বোধহয়।এখন সব ঠিকই আছে।’

শুভ্রা মাথা নামায়।কতোক্ষণ একদৃষ্টিতে নিজের কোল দেখে।তারপরই অন্যমনস্ক হয়ে বলে,’একটা কথা বলি?’

‘হু।বলো।’

‘লীগের ছেলেরা ইদানিং অতিরিক্ত করছে সবকিছুতে।আরহাম ভাইয়া তাদের সবকিছুতেই চুপচাপ থাকেন।না একটু ধমক দেন,না কিছু বলেন।তারা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সবকিছুর।আজকেও একটা মেয়ের সাথে খুবই বাজে আচরণ করেছে।ভাইয়ার উচিত তাদের একটু শাসনে রাখা।ভাইয়া তাদের সবকিছুতে এতো ছাড় দিচ্ছেন কেন?’

আরিশ তার গাড়ির গতি কমালো।কমতে কমতে একসময় সেটা শূন্যে নেমে এলো।সে পাশ ফিরে একনজর শুভ্রাকে দেখে অতিশয় শান্ত গলায় বলল,’ভাইয়া একজন পলিটিক্যাল পারসন।অনেক ধরণের প্রটোকল মেনেই তাদের চলতে হয়।আমি জানি ভাইয়া যা করছে সেটা ঠিক না।কিন্তু কি করার আছে বলো?এই পেশায় সার্ভাইব করতে হলে এভাবেই করতে হবে।তুমি নিশ্চয়ই চাও না পরীক্ষায় কিছু কোয়েশচান ছেড়ে তোমার নম্বর কমাতে।তেমন ভাইয়াও চায়না কিছু কর্মী হারিয়ে নিজের দল হালকা করতে।একদম সহজ ইকুয়েশন।’

‘কিন্তু পাবলিকের মধ্যে এসব বিরূপ প্রভাব ফেলছে।ভাইয়া নির্বাচনের আগে বলেছিল যে নির্বাচিত হলে ক্যাম্পাসে মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।সেই কথা ভাইয়া রাখেনি।আমি অন্তত ভাইয়াকে সেরকম ভাবিনি।’

আরিশ একগাল হেসে স্টিয়ারিং ঘুরায়।পুনরায় গাড়ি চালু করতে করতে বলে,’এটা রাজনীতি শুভ্রা।স্বচ্ছ সুন্দর চিন্তাধারার মানুষ এই পেশায় এসে গায়ে কালি মাখায় না।আমার ভাইকে তুমি একটু বেশিই ভালো ভাবো।এতোটাও ভালো সে না।’

***

ইজমার হাতে দুইটা ফ্রেকচার হয়েছে।শুরুতে ব্যথা তেমন টের না পেলেও একটু সময় যেতে ব্যথা টা প্রকট থেকে প্রকটতর হলো।ইজমা সেই অসহনীয় ব্যথায় কতোক্ষণ গোঙাল।পুরো শরীর যন্ত্রনায় ভেঙে যাচ্ছে।মন চাইছে গলা ছেড়ে কতোক্ষণ কাঁদতে।

সে কোনোরকমে বলল,’আমার ফোনটা কি একদম ভেঙে গেছে?একটা কলও কি করা যাবে না?’

ইফাজ তার রিপোর্টে চোখ বুলাতে বুলাতে ছোট করে বলল,’না।আপনাকে যারা হসপিটালে এডমিট করিয়েছে,তারা কেউ আপনার ফোন সাথে আনে নি।’

‘এখন?বাসায় যোগাযোগ করব কীভাবে?’

‘একদিন অপেক্ষা করুন।আমি একটা ব্যবস্থা করছি।নাম কি আপনার?’

মেয়েটা পাংশুটে মুখে জবাব দেয়,’ইজমা বিনতে সাঈদ।’

‘ওয়েল।ইজমা! আপনাকে কিন্তু কিছুদিন হসপিটালেই থাকতে হবে।ইঞ্জুরিটা যথেষ্ট ডিপ।তাই আপাতত খুব জলদি রিলিজ দিতে পারছি না।বুঝছেন তো?’

ইজমা মাথা তুলে অধৈর্য হয়ে বলল,’এখানে থাকা নিয়ে সমস্যা না।কিন্তু আমি কাউকে কিছু জানাইনি।শুধু আম্মু আব্বু জানে।নয়তো দেশে কাউকে ইনফর্ম করিনি।’

‘ব্যাপার না।নম্বর বলুন।আমি যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি।’

ইজমা অতিশয় ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয়,’নম্বর মুখস্থ নেই।মোবাইল থাকলে ভালো হতো।’

সে কিছুক্ষণ চুপ থাকে।হঠাৎই ভীষণ চঞ্চল হয়ে বলে,’আচ্ছা আপনি কি আমাকে আপনার ফোনটা একটু দিবেন?আমি আমার ফেসবুকে লগ ইন করে আমার ফ্রেন্ড কে একটা মেসেজ দিব।’

ইফাজ কতোক্ষণ ত্যাড়ছা চোখে তাকে দেখল।তারপরই নিজের মুঠোফোন টা পকেট থেকে বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বলল,’জ্বী।আপনি লগ ইন করুন।’

___

‘তুমি এমন ফ্যাকাশে মুখ করে রেখেছ কেন?কি হয়েছে তোমার?’

তাসনুভা কদম গাছটার চূড়া থেকে চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে।আদি,সে আর জীবন একটু আগে বাগানে এসেছে।তার বাগানে ঘুরাঘুরি করতে ভালো লাগে।প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষের মন ভালো হয়।এ এক চিরন্তন সত্য।তাসনুভা প্রায় প্রতিদিনই বাগানে এসে এ’মাথা ঐ’মাথা ঘুরে বেড়ায়।অন্যসময় আদি অনেক রকমের কথা বলে তার মন ভালো করে দেয়।অথচ গত কয়েকদিন ধরে সে বেশ চুপচাপ,কিছুটা নির্লিপ্ত।সারাক্ষণ শুধু ফোনে ব্যস্ত।

তাসনুভার কথা কানে যেতেই আদি তার দিকে ফিরল।বিচলিত হয়ে বলল,’আমি একটি বিষয় নিয়ে খুব টেনসড।’

‘কি বিষয়?’

‘ইজমা গত তিনদিন যাবত আমার কল রিসিভ করছে না।আমার চিন্তা হচ্ছে তাকে নিয়ে।ওখানে সব ঠিক আছে নাকি সেটাও জানি না।’

তাসনুভা কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইল,’ইজমা কে?’

আদি আশ্চর্য হয়ে উত্তর দেয়,’তুমি জানো না ইজমা কে?ইজমা আমার ফ্রেন্ড।সবচেয়ে কাছের ফ্রেন্ড।উই আর এনগেজড।’

তাসনুভা ধিমি আওয়াজে বলল,’এনগেজড মানে?’

আদি তার কথার ধরন শুনেই একগাল হাসল।একটা হাত তার মাথায় রেখে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’আরে বোকা,এনগেজড মানে বিয়ে ঠিক হয়েছে আমাদের।এই যে দেখো,আমাদের এনগেজমেন্ট রিং।’

বলেই সে একহাত উপরে তুলে তার অনামিকা দেখায়।তাসনুভা গোল গোল চোখে তার অনামিকা আঙুলের ভাঁজে থাকা খুবই সিম্পল ডায়মন্ড রিংটা দেখে।অবাক হয়ে বলে,’তার মানে ইজমা তোমার পারমানেন্ট গার্লফ্রেন্ড?’

‘ইসস! মোটেও না।ইজমাকে আমি সেভাবে কখনো দেখিই নাই।ক্যালিফোর্নিয়া তে থাকাকালীন আমরা একই ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট গ্রেডুয়েশন শেষ করেছি।ইজমা আমার দেখা সবচেয়ে সুইট মেয়েদের একজন।তাকে সেরকম গার্লফ্রেন্ড কিংবা টাইমপাসের মানুষ হিসবে আমি কোনোদিন দেখিই নাই।সে খুবই ভালো মেয়ে।কখনো পরিচয় হলে তবে বুঝতে।’

তাসনুভা একমনে তার কথা শুনে।তারপরই গালের নিচে হাত রেখে বলে,’তুমি তো তোমার হবু বউকে খুব পছন্দ করো দেখছি।’

আদি মাথা নামিয়ে স্মিত হাসল।একহাত তুলে নিজের চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল,’আসলে ইজমার সাথে সেরকম বউ জামাই টাইপ ভাইবস এখনো পাই না।মানে শী ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।কিন্তু তার সাথে বিয়ে,সংসার এসব ভাবলে আমার নিজেরই হাসি পায়।তার ক্ষেত্রেও সেম।আমরা নিজেরাই এসব নিয়ে খুব হাসাহাসি করি।কিন্তু আমার মনে হয় আমার জন্য ইজমাই পারফেক্ট।যেহেতু ভবিষ্যতে আমেরিকাতেই স্যাটেল হচ্ছি,সেহেতু এই দেশে আর মেয়ে খুঁজে লাভ নাই।সবদিক বিবেচনায় একমাত্র ইজমাই এমন একজন মেয়ে যে আমার সবকিছু সহ্য করে নিতে পারে।’

তাসনুভা অল্প হাসল।অথচ তার মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে তার সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে।কিসের যন্ত্রণা সে নিজেও জানে না।মনের অদ্ভুত অস্থিরতা কে পাত্তা না দিয়ে সে গাঢ় হেসে বলল,’ইজমা আপুর সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার।তুমি যখন বলছ ভালো,তাহলে ভালোই হবে।’
.
.
.
.
ভার্সিটির গেইটে এসেই নিলয় একটা শুকনো ঢোক গিলে।তার ভেতরটা অজানা আতঙ্কে ধুক ধুক করছে।গেইটের সামনে আসলেই তার বুক ফেটে কান্না আসে।মনে হয় দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে।সে দুই হাতে নিজের ব্যাগের ফিতা খাঁমচে ধরে সামনের দিকে পা বাড়ায়।

ক্যাম্পাসের ভেতর কয়েক কদম সামনে যেতেই আপনাআপনি তার পা জোড়া থেমে গেল।তার থেকে সামান্য দূরে লীগের ছেলেপুলে সব দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে।তারা কেউ এখনো নিলয়কে দেখতে পায়নি।তারা ব্যস্ত নিজেদের আড্ডায়।নিলয় সিদ্ধান্ত নিল সে আজ উল্টো রাস্তা দিয়ে তিনগুন ঘুরে তারপর তার ডিপার্টমেন্টে যাবে,তবুও সে এই রাস্তা দিয়ে পার হবে না।সে রাস্তা পরিবর্তন করার জন্য পেছন ফিরতেই দূর থেকে আবির গলা ছেড়ে চেঁচায়,’এ্যাই মফিজ! এদিকে আয় তো।কোথায় যাচ্ছিস তুই?’

নিলয় বাধ্য ছেলের মতো পুনরায় পিঠ ঘুরিয়ে তাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।অতিশয় ক্ষীণ কন্ঠে বলে,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।’

আবির হাত নেড়ে তাকে নিজের কাছে ডাকল।নিলয় গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে।আবির তার নাগাল পেতেই তার চুলগুলো টেনে বলে,’বাহ! অনেক মজবুত চুল তো।দেখি তোর গাল মজবুত নাকি?’

কথা শেষ করেই সে ঠাটিয়ে তার গালে পর পর দু’টো চড় বসায়।নিলয় পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে সেই চড় দু’টো সহ্য করে নেয়।মুখের উপর কিছু বলা বারণ।সহ্য করে নেওয়াই উত্তম।’

দ্বীপ পাশ থেকে উঁচু গলায় বলল,’দেখি আমাদের একটু গান শোনা তো নিলয়।তোর গানের গলা কেমন শুনি?’

নিলয় কাঁপা স্বরে বলল,’আমি গান গাইতে জানি না ভাই।’

‘ঐ শু’য়োর! মুখে মুখে কথা বলিস কেন?যেটা বলেছি ঐটা কর।গা গান।’

নিলয় কাঁপতে থাকা কন্ঠে কোনোরকম একটা গান গায়।দ্বীপ মুখ কুঁচকে বলল,’ধুর।তোর গলা কার্টুনের মতো।মজা পাইনি গান শুনে।আচ্ছা যাক,একটু নেচে দেখা এবার।’

‘ভাই!’ আঁতকে উঠে নিলয়।

জামান আলতো হাতে তার গালে আরেকটা চড় মেরে বলল,’এতো ভাই ভাই করছিস কেন?যেটা বলছি সেটা কর।নয়তো ডোজ আরো বাড়াবো।’

নিলয় মাথা নামিয়ে হাত পা নেড়ে কতোক্ষণ নাচল।লজ্জায় তার মাথা নামতে নামতে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার জোগাড়।ক্যাম্পাসের প্রশস্ত রাস্তায় হেঁটে যাওয়া ছেলে মেয়েরা অবাক হয়ে তাকে দেখছে।তাদের চোখে বিস্ময়,আচরণে কিছুটা উপহাস।নিশ্চয়ই নিলয়কে এরা প্রতিবন্ধী ভাবছে।নিলয় টের পেল অপমানে তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।মন চাইছে এক ছুটে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে।এই বিশ্ববিদ্যালয়,এই ক্যাম্পাস সবকিছু তার এখন অসহ্য লাগে।

সবকিছুর খপ্পর থেকে বেরিয়ে নিজের ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত আসতে তার আরো ঘন্টাখানেক লাগল।প্রথম ক্লাসটা কোনোরকম করার পরেই সে বেরিয়ে এলো।ক্লাসে তার মন বসছে না।একটু পর পর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।ডিপার্টমেন্ট থেকে একটু সামনেই একটা পুকুর।সে গিয়ে পুকুরের পাশের পাকা জায়গায় বসল।পুকুরের পানির রং সবুজ।আচ্ছা পানি কি কখনো সবুজ হয়?ধুর না।পানি কেমন করে সবুজ হবে?পানিতে গাছের ছায়া পড়লে সেটা সবুজ দেখায়।নিলয় নিজের বুদ্ধিমত্তার উপর নিজেই কিছুক্ষণ হাসে।একটু সময় যেতেই পুনরায় সে হাসি মিলিয়ে যায়।সে বিষন্ন মুখে সামনে দেখে।

‘এ্যাই ছেলে!মন খারাপ?’

রিনরিনে মেয়েলি কন্ঠটি কানে যেতেই নিলয় চকিতে পেছন ফিরে।দেখে তার থেকে একটু দূরে একটা নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরা মেয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।সে পেছন ফিরতেই মেয়েটা ছোট ছোট সাবধানী পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসে।চোখ দিয়ে নিলয়ের পাশের জায়গাটা দেখিয়ে উৎসাহ নিয়ে বলে,’বসি আমি?’

নিলয় একটু সরে তার জন্য জায়গা করে দিলো।মেয়েটা জায়গা পেতেই চট করে সেখানে বসল।

‘তোমার মন খারাপ তাই না?’

অন্য পাশ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে মেয়েটা পুনরায় মলিন মুখ করে বলল,’আমি আসার সময় তোমাকে দেখেছি।আমার খুব খারাপ লেগেছে তোমার জন্য।তুমি মন খারাপ করো না।আল্লাহ তাদের বিচার করবে।তুমি তাদের জন্য নিজে কষ্ট পেও না।’

নিলয় মাথা তুলে তাকে দেখল।একটি চরম হতাশার দিনে মেয়েটির সামান্য সহানুভূতি তাকে আকাশ সমান প্রশান্তি এনে দিয়েছে।সে মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে জানতে চাইল,’নাম কি তোমার?’

‘প্রভাতি রহমান।’

‘ফ্রেশার?’

‘জ্বী।’

‘কোন ডিপার্টমেন্ট?’

‘ইকনোমিক্স।’

‘ওহ।’

প্রভাতি সামান্য ঝুকে জানতে চাইল,’আপনি কি ফ্রেশার নাকি সিনিয়র?’

‘এক বছর সিনিয়র।’

‘সিনিয়র হয়েও এতো র‍্যাগ খাচ্ছেন কেন?’ চটপটে হয়ে জানতে চায় প্রভাতি।

নিলয় মাথা নিচু করেই ম্লান হাসে।উদাস গলায় জবাব দেয়,’আছে।অনেক ঘটনা আছে প্রভাতি।পরে কখনো বলব তোমায়।’
.
.
.
.
নবনীতা বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে শেষ একবার নিজের ব্যাগ চেক করে।নাহ,সবই নিয়েছে সে।যাওয়ার আগে সে পুনরায় তাসনুভার ঘরে উঁকি দেয়।আরশাদ আজকে তাসনুভার ঘরেই ঘুমুচ্ছ।নবনীতা কন্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,’তাস! আমি যাচ্ছি।আরশাদের ঘুম ভাঙলে রহিমা খালাকে খিচুড়ি খাওয়ানোর কথা মনে করিয়ে দিও কেমন?’

তাসনুভা মিষ্টি হেসে একদিকে মাথা কাত করে জানায় সে মনে করিয়ে দিবে।নবনীতা আর দেরি করল না।তাড়াতাড়ি নিজের ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বড় বড় পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।

____

নামকরা বোডিং স্কুলটা আজ বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।প্রতি মাসেই নির্দিষ্ট একটা দিনে স্কুল সাজানো হয়।আজ স্কুলের প্যারেন্স টিচার মিটিং।সেই উপলক্ষে পুরো স্কুল,বিশেষ করে অডিটোরিয়ামে ডেকোরেশন করা হয়েছে।

নবনীতার গাড়িটা সেখানে পৌঁছুল সকাল এগারোটার একটু পরে।স্কুলের সামনে আসতেই সে ব্যস্ত পায়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।তার পিছু পিছু দু’জন গার্ড নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায়।নবনীতা পেছন ফিরে একনজর তাদের দেখে,মনে করে নিজের জিপিএস অন করে।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনের দিকে হেঁটে যায়।এটা একটা জীবন হতে পারে?এতো রেস্ট্রিকশন,এতো সিকিউরিটি,এতো প্রটোকল! নবনীতা কি কোনো চোর নাকি?নাকি কোনো ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি?তাকে কেন এভাবে প্রতি মুহূর্তে জান হাতে নিয়ে বাঁচতে হবে?সে আর ঐসব নিয়ে ভাবল না।ভাবলে লাভ কিছু হয় না।উল্টো বিরক্ত লাগে।

ভিআইপি শব্দটা সম্ভবত আরহামের খুব প্রিয়।সে নিজেও সব জায়গায় ভিআইপি ট্রিটমেন্ট নেয়,নিজের বাড়ির লোকদেরও সেইরকম সুবিধার মধ্যেই রাখে।আজ যেমন সে নবনীতার জন্য আলাদা আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছে।সব গার্ডিয়ান বসেছে অডিটোরিয়ামে,অথচ নবনীতার জন্য আলাদা একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ রাখা হয়েছে।নবনীতা চুপচাপ সেখানে গিয়ে বসল।একটু পরেই দরজা থেকে রুমের ভেতর উঁকি দিলো একটা ছেলে।

নবনীতা তাকে দেখতেই প্রশস্ত হাসল।হাত নেড়ে বলল,’আরে শাহাদাত।এসো এসো।’

শাহাদাত মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে ভেতরে এলো।নবনীতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল,’কেমন আছো ভাই?’

‘আমি ভালো আছি আপাই।তুমি?’

নবনীতা মুচকি হেসে বলল,’আমিও ভালো আছি।তবে তোমার মুখে শুদ্ধ ভাষা শুনে সেটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ।’

শাহাদাত জবাবে কেবল দাঁত বের করে হাসে।তারপরই নিজ থেকে বলে,’সবাই এতো শুদ্ধ বলে এখানে,যে নিজের বলার ধরনটাই ভুলে গেছি।শুরুতে একমাস কষ্ট হয়েছে।এখন পারি সবকিছু গুছিয়ে বলতে।’

‘কিন্তু আমার তো এখন অশুদ্ধ বলা শাহাদাতের কথাই মনে পড়ছে।তোমাকে আর ধমক দিতে পারব না এটা ভেবেই কষ্ট হচ্ছে।’

কথা শেষেই দু’জন সমস্বরে হেসে ফেলল।নবনীতা শাহাদাতকে নিয়ে স্কুলের মাঠে কতোক্ষণ হাঁটলো।তার বোডিং স্কুলের দিনলিপি জানতে চাইলো।বারবার নবনীতা চোখ নামিয়ে ছেলেটার আচরণ পর্যবেক্ষণ করে।কতোটা বদলে গেছে এই ছেলে।কতো সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছে! অথচ আগে সে একটা বাক্যেই একশোটা ভুল করত।

শাহাদাত কথার ফাঁকে বলল,’আপু,আমাদের সবার একজন সিনিয়র গাইড থাকে।যারা আমাদের চেয়ে কয়েক বছর বড়।কিন্তু এই বোডিং স্কুলেরই ছাত্র।আমারও একজন সিনিয়র গাইড আছে।তুমি দেখা করবে তার সাথে?’

নবনীতা দ্রুত উপরনিচ মাথা নাড়ে।
‘অবশ্যই দেখা করব।কোথায় তোমার গাইড?’

শাহাদাত তাকে তার থাকার ভবনটিতে নিয়ে গেল।চারতালা পর্যন্ত উঠে একটা দরজায় আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলল,’ভাইয়া দরজা খুলো,আমি শাহাদাত।’

খটখট শব্দে দরজা খুলে একজন কিশোর বাইরে বেরিয়ে এলো।নবনীতা তাকে দেখেই প্রশস্ত হাসল।অথচ কালো সাদা চেকের শার্ট গায়ে জড়ানো ছেলেটা তাকে দেখেই কিছুটা ভড়কে গেল।নবনীতা ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল,’তোমার নাম কি ভাই?’

ছেলেটা কিছুটা হচকচায়।তারপরই অত্যন্ত নিচু স্বরে জবাব দেয়,’আমার নাম নওফেল।’

‘বাহ! খুব সুন্দর নাম।তুমি নাকি শাহাদাতের গাইড?শাহাদাত কি তোমায় খুব জ্বালায়?’

‘জ্বী না।শাহাদাত খুব ভালো ছেলে।আমার তাকে খুব ভালো লাগে।’

‘শাহাদাতের এতো যত্ন করার জন্য তোমায় ধন্যবাদ নওফেল।’

নবনীতা সৌজন্যসূচক আরো কিছু কথা বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।নওফেল আচমকাই তাকে পিছু ডাকল।নবনীতা ঘুরে দাঁড়াতেই সে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,’আপনার নাম নবনীতা।তাই না?’

নবনীতা খানিকটা বিস্মিত হয়ে জবাব দেয়,’হ্যাঁ।আমিই নবনীতা।কেন বলো তো?’

‘আরহাম ভাই তোমার বর তাই না?’

নবনীতা এবারো হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’জ্বী।তোমাদের আরহাম ভাই আমার বর।’

‘আমি কিন্তু নেতা বলে তাকে আমার ভাই বলছি না।’

নবনীতা কপাল কুঁচকায়।
‘তাহলে?’

‘সে সত্যিই আমার ভাই।আমার আর তার মা একজনই।’

নবনীতা চোখ বড় বড় করে তাকে দেখে।কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,’তুমি ফাহাদের চাচাতো ভাই?’

‘জ্বী।আমিই সে যাকে আরহাম ভাই কোনো দোষ না করা স্বত্বেও দুই চোখে দেখতে পারে না।’

‘আর তুমি?তুমি তাকে দেখতে পারো?’

নওফেল আত্মবিশ্বাসী হয়ে জবাব দিলো,’অবশ্যই।আমি কেন তাকে দেখতে পারব না?তার জায়গা থেকে সে ঠিকই আছে।আমার তাকে ভালোই লাগে।সে যদি একটু ভালো করে আমার সাথে কথা বলতো,তাহলে আরো ভালো লাগতো।’

সে থামল।একটু বিরতি নিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করল,’আসলে আমার কোনো সিবলিং নেই তো,তাই আমি ছোট থেকেই একা একা বড় হয়েছি।এসব ভাই বোন আমার খুব ভালো লাগে।একেবারে ১০০% আপন না হোক,তবুও তো তারা আমার আপনই।তুমি আরহাম ভাইকে বলবে আমার সাথে রাগ না করতে।আমার তার প্রতি কোনো কষ্ট নেই।’

নবনীতা জবাবে কেবল একগাল হাসল।আরহাম কে সে বলবে,আর আরহাম সে কথা শুনবে।এমনটা কোনোদিন হয়েছে?আর এসব ব্যাপারে তো নবনীতা কিছু বলতেই পারে না।সে বলতে চায়ও না।এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করাই ভালো।তবে নওফেলের ব্যাপারটা নিয়ে আসলে বলা যায়।কারণ নওফেলের এদিকে কোনো দোষ নেই।একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে যে কেউ বলতে বাধ্য সেও আরহাম,আরিশ আর তাসনুভার মতোই একজন ভুক্তভোগী।কিন্তু সমস্যা হলো আরহাম কোনোকিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবে না।

নবনীতা তার ফোনের ডায়াল অপশন চেক করে।কি অদ্ভুত! এখনো কোনো ফোন দেয় নি তাকে?সে নিজে নিজেই বিড়বিড় করল,’করছে টা কি সে?এতোক্ষণে তো অন্তত একবার ফোন দেওয়ার কথা।’
.
.
.
.
ওয়াজিদ র’ক্তচক্ষু মেলে সামনে দেখে চেঁচিয়ে উঠে,’এসব কি আরহাম?অতিরিক্ত করছিস তুই।দোষ টা তামজিদের ছিল।’

আরহাম টিস্যু দিয়ে তার গলার কাছের ঘাম মুছে।দায়সারা হয়ে জবাব দেয়,’কার দোষ সেটা আমার দেখে কাজ কি?আমি কি কোনো বিচারক নাকি?’

রাজনীতির অঙ্গনে এক মুহূর্তের জন্যও ভালো থাকা দায়।এমনকি শান্তিতে যে একটা দিন পার করবে,তারও জো নেই।রোজ রোজ একটা না একটা ঝামেলা হতেই থাকে।আরহামকে অত্যন্ত অনৈতিক উপায়ে সেসব ঝামেলার সমাধান করতে হয়।

আজকের ঘটনা তামজিদকে নিয়ে।সে তার এলাকায় একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছে।দোষ মূলত তারই।কিন্তু যেহেতু সে আরহামের অত্যন্ত কাছের,তাই আরহামের পাল্লা তার দিকেই ঝুকল।সে তামজিদকে একটা কটু কথা বলা তো দূর,উল্টা তার অন্যায়কে হাসতে হাসতে লাই দিলো।খামোখা এই ছেলেদের সাথে ঝামেলা বাধিয়ে কোনো লাভ নাই।দিনশেষে এরাই এক ডাকে আরহামের প্রয়োজনে ছুটে আসে।আরহাম নিজের দল হালকা করবে না।সে এতো সৎ হয়ে করবে টা কি?সে সৎ হলেও দেশের যা হবে,না হলেও তাই হবে।এর চেয়ে ভালো নিজের পিঠ বাঁচিয়ে চলা।পাওয়ার,ক্ষমতা,এসবই তো তার চাই।বাদ বাকি যা কিছু হোক,তার কি?সে তো ভালো আছে।এটাই মূল কথা।

ওয়াজিদ তার লাপরোয়া মুখটা দেখল।তারপরই নিজেকে সামলে গাম্ভীর্যপূর্ণ গলায় বলল,’আরহাম তুই যে ক্ষমতায় টিকতে এতো এতো অন্যায় করছিস,এটা যদি নবনীতা জানে?বিয়ের সময় তুই আমাকে বলেছিলি তুই শুধরে যাবি।এই তোর শুধরানোর নমুনা?’

আরহাম তার কথা শুনেই খেঁকিয়ে উঠল,’নবনীতা জানবে মানে?পরীকে এসব কে বলবে?এসব কি পরীর জানার জিনিস?পরী আমার ফ্যামিলি।ফ্যামিলি কে এসবে আনছিস কেন?আর সে জানলেই বা কি?আমি তাকে ভয় পাই নাকি?বিয়ের আগে সে দেখেনি সে কার সাথে বিয়ে করছে?’

‘না দেখেনি।কারণ বিয়ের আগে তোর এমন রূপ তুই তাকে দেখাসনি।ইভেন তুই কখনোই এমন ছিলি না আরহাম।ইউ আর গ্রেজুয়ালি চেঞ্জিং।তুই ইদানিং কেমন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছিস।কেমন পাষাণ পাষাণ।’

‘ভালো।খুব ভালো।আমাকে ভালো না লাগলে তুই আমার সাথে চলিস না।জোর করেছি নাকি তোকে আমি?আমাকে জ্ঞান দিতে আসবি না।তোর চেয়ে এসব আমি ভালোই বুঝি।আর খবরদার! পরীর কানে এসব কিছু ঢুকাবি না।পরীর আর আমার সংসারে ঝামেলা বাধাবি না।’

ওয়াজিদ আশ্চর্য হয়ে সামনে তাকায়।গোল গোল চোখ করে বলে,’হোয়াট?ঝামেলা বাধাবো না মানে?আমি তোর সংসারে ঝামেলা করি?’

‘করিস।তুই সেদিন পরীর কান ভরেছিস কোন মিজান না কি যেন নাম,তার ব্যাপারে।এই কাজ করবি না।এমনিতেও আমার সংসারে ঝামেলার শেষ নাই।তুই নতুন করে ঝামেলা করবি না বলে দিচ্ছি।’

ওয়াজিদ সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।আরহামের সাথে তার চোখাচোখি হতেই সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’তোর ভালোর জন্য বলেছিলাম।শিক্ষা হয়েছে।আর জীবনে তোর ব্যাপারে কাউকে কিছু বলব না।আর কখনো তোর জীবন নিয়ে মাথা ঘামাবো না।থাক তুই তোর মতো।তোর এই অফিসে যেন আর কোনোদিন আমার পা না পড়ে।’

বলেই সে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।সে যেতেই আরহাম নিজের মাথার চুল টেনে ধরল।নিজের উপর তার নিজেরই রাগ হচ্ছে।মাঝে মাঝে কথা বলার সময় সে ভুলেই যায় সামনের মানুষটা কে।ওয়াজিদের সাথে সে কোন আক্কেলে এভাবে কথা বলল?

তার ফোনটা সেই কখন থেকে বাজছে।মেজাজ একটু ঠান্ডা হতেই সে ফোনটা হাতে নেয়।বড় বড় করে দু’টো শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে।তারপরই কলটা রিসিভ করে গাঢ় স্বরে বলে,’হ্যালো ম্যাডাম।কাজ শেষ?’

‘জ্বী।মাত্র গাড়িতে উঠলাম।আপনি কি করছেন?’

‘আমি কাজ করছি।এখন একটু অবসর হলাম।’

‘আপনার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?মন খারাপ?’

আরহাম ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসল।মাথার পেছনে একহাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’হুম একটু খারাপ।বাড়ি এলে তুমি মন ভালো করে দিও।’

নবনীতা মোবাইলটা কানের সাথে চেপেই অল্প হাসে।মাথা নেড়ে বলে,’আমার মনও ভালো না।আমারটা কে ভালো করবে?’

‘অবশ্যই আমি।’
‘পরী।’

‘জ্বী।’

‘মিস করছি।’

‘আমিও।’

‘রাতে কথা হচ্ছে।টাটা।’

‘টাটা।’

আরহাম ফোন রেখে আবারো টেনে টেনে দু’টো শ্বাস নেয়।ধরা যাক তার সমস্ত কুকীর্তি পরী জেনে গেল।এরপর কি হবে?পরী একটু ঘ্যান ঘ্যান করবে।ব্যাপার না।সে সেটা সহ্য করে নিবে।পরীকে খুব সহজে ম্যানিপুলেট করা যায়।কিন্তু তাও যদি এসবে কাজ না হয়?তখন কি পরী তাকে ছেড়ে চলে যাবে?

আরহাম কল্পনা করতেই আঁতকে উঠে।না না,এটা সম্ভব না।পরী তাকে ভালোবাসে ভীষণ।আগে যতোবার পরী তার বিরোধিতা করেছে,তখন তো সে তার ভালোবাসার মানুষ ছিল না।এখন তো সে তার বর।পরী তো তাকে অসম্ভব ভালোবাসে।সে নিশ্চয়ই কোনোদিন তার মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে না।এই সংসার,এই ভালোবাসা,এই আদর-যত্ন উপেক্ষা করার সাধ্যি কি পরীর আছে?আরহাম মানুষ হিসেবে না হয় খুব মন্দ।কিন্তু স্বামী হিসেবে তো সে নিজের ভেতর কোনো কমতি রাখে নি।পরী কোনোদিন তাকে কষ্ট দিবে না।দিতেই পারে না।পরী অমন মেয়েই না।সে খুব কোমল হৃদয়ের।আরহাম একবার তাকে জড়িয়ে ধরলেই তার সব রাগ পড়ে যাবে।আরহাম তো তার প্রিয়তম।সে জানে প্রিয়তম’র বিপরীতে এসে দাঁড়ানোর মতো কঠিন মন পরীর নেই।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে[তৃতীয় অধ্যায়] পর্ব-৫০

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে[তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫০)

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।সকাল নয়টা ত্রিশে ল্যান্ড করা দুবাই এয়ারলাইনসের যাত্রীরা ব্যস্ত তাদের ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মেটাতে।ইমিগ্রেশন সহ বাকি ঝায় ঝামেলা মিটিয়ে এয়ারর্পোটের প্রথম টার্মিনাল পর্যন্ত পৌছাতে সময় নিল আরো এক ঘন্টা।

নিজের লাগেজ দু’টো দুই হাতে টেনে ইজমা বেরিয়ে এলো এয়ারর্পোট থেকে।বেরিয়েই কতোক্ষণ নিজের ঘাম মুছলো।তারপরই চোখ উপরে তুলে আকাশ দেখলো।অদ্ভুত বিষয়! সে শীতের একটু আগে আগে দেশে এসেছে,যেন অতিরিক্ত গরমে তার কষ্ট না হয়।অথচ এদিকে আসার পর মনে হচ্ছে এখানে এখনো গ্রীষ্মের গা জ্বালানো মৌসুম শেষ হয়নি।সে তাড়াতাড়ি মেইন রোডে এসে একটা সিএনজির খোঁজ করল।

মনে মনে সে ভীষণ এক্সাইটেড।কতোগুলো বছর পরে সে এই দেশে এসেছে।সে একটু মনে মনে ভাবল।দশ বছর তো হবেই।এখানকার রাস্তাঘাট সে চেনে না।রাস্তা সম্পর্কে কোনো ধারণা তার নেই।তাড়াহুড়ায় সে উবার কিংবা পাঠাও কোনোটাই ইন্সটল করেনি।দেশের মাটিতে পা রাখার পর তার মনে হলো এই কাজটা একদমই ঠিক হয়নি।সে এখন কি করবে?আদি কে তো এই ব্যাপারে জানানোও হয়নি।

সে জিপিএস অন করে নিজের লোকেশন দেখল।ওয়ারিতে তার এক দুঃসম্পর্কের ফুফু থাকে।সেখানে আপাতত গিয়ে উঠা যায়।তারপর আদির এড্রেসে গিয়ে বাকি কাজ করা যাবে।

সে তাড়াতাড়ি একটা সিএনজি ডাকে।কোনোরকমে ঠিকানা দিয়ে সেটার উপর চেপে বসে।সবকিছু বেশ ভালোই যাচ্ছিল।সিএনজি চলতে শুরু করার পর একটা সুন্দর শরীর জুড়ানো ঠান্ডা বাতাসে তার বেশ আরাম লাগছিল।কিন্তু দশ মিনিট পরেই কি থেকে কি হলো সে জানে না,,দ্রুতগামী একটা বাস পেছন থেকে ছুটে এসে ইজমার সিএনজিতে সজোরে আঘাত করল।তারপরই আর কোনো দিক না দেখে আগের চেয়েও দ্রুত বেগে সামনের দিকে ছুটে গেল।

মুহুর্তেই সবুজ রঙের সিএনজি টা একপাশ উল্টে ফুটপাতের উপর গিয়ে পড়ল।ইজমা প্রথমে ঘটনার আকস্মিকতায় চেঁচিয়ে উঠল,আর তারপর ভয়াবহ শারিরীক যন্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠল।চোখ বন্ধ হয়ে আসার আগমুহূর্তে সে টের পেল চারদিকে ভীষণ কোলাহল।লোকজন সব তাদের উল্টে যাওয়া গাড়ির দিকে দৌড়ে আসছে।ইজমা নিভু নিভু চোখ নিজের হাত দেখে।সিএনজির একটা রড লেগে তার হাতের একটা জায়গা কেটে সেখান থেকে র’ক্ত বের হচ্ছে।তার মস্তিষ্ক একটু একটু করে চেতনা হারাচ্ছে।এখন?তাকে কে বাঁচাবে?আদি তো জানে না সে যে দেশে।
.
.
.
.
‘রাজারবাগ মোড়ে মিজান চাচার একটা টং দোকান আছে।চাচা মানুষ হিসেবে ভীষণ ভালো।লুবনা কে যখন পড়াতাম,তখন প্রায়ই চাচার দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতাম।কখনো আবার বান পাউরুটি কিনতাম।চাচা তখন থেকেই আমায় খুব স্নেহ করতেন।কিছু মানুষ আছে না,যারা অকারণেই আমাদের ভালোবাসে।মিজান চাচা তাদেরই একজন।সেদিন গিয়ে দেখি মিজান চাচার দোকান ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে লীগের ছেলেরা।তার অপরাধ সে ঠিক মতো চাঁদা দেয়নি।চাচা কাঁদতে কাঁদতে বলল তার নাকি রোজ রোজ যা আয় হয়,তার চেয়েও বেশি চাঁদা চায় ছেলেগুলো।না দেওয়াতে দোকান ভেঙে এই অবস্থা করেছে।আমি এই বিষয়টা নিতে পারিনি।একটা অসহায় মানুষ কোনোরকমে একটা দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছে।তার দোকানটাও ভেঙে দিতে হবে?এই মানুষটা থেকেও বাধ্যতামূলক চাঁদা তুলতে হবে?আমি এইসব অনাচার নিতে পারি না।আমার খুব খারাপ লাগল মিজান চাচার এই বিষয়টা।মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।আর নবনীতার দৌড় আরহাম পর্যন্ত।তাই আমি ছুটে গেলাম তার কাছে।সবকিছু খুলে বললাম।সে পুরো কথা শুনেই থমথমে মুখে বলল তার পক্ষে নাকি কিছু করা সম্ভব না।দলের ছেলেদের সে কিছু বলতে পারবে না।এরা তার জলজ্যান্ত হাতিয়ার।এদের কটু কথা বলে সে নিজের দল হালকা করতে পারবে না।আমি দুইবার মুখের উপর উত্তর দিতেই সে ক্ষেপে গেল।চিৎকার চেঁচামেচি করে ঘরের পরিবেশ নষ্ট করে বেরিয়ে গেল।আমি সমস্ত রাত তার অপেক্ষায় জেগে রইলাম।অপমান আর অবহেলায় আমার দুই চোখ পানিতে ভরে গেল।আচ্ছা ইদানিং আরহামের ব্যাপার গুলোতে আমি এমন আবেগী হয়ে যাচ্ছি কেন?কেন আমি মেনে নিতে পারছি না যে আরহাম কখনোই এসব নোংরা রাজনীতি থেকে সরে আসবে না?আমার মন আজ ভীষণ খারাপ।সারারাত আমি জেগে ছিলাম।অথচ সে আসলো না।আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে হয়রান।কোথায় আগে তো কখনো এমন করতাম না আমি।ইদানিং এসব কি হচ্ছে?আমি এতো কাঁদছি কেন?আরহাম একটু দুর্ব্যবহার করলেই দু’চোখে ঝাপসা দেখি।প্রতিবাদ করার আগেই ন্যাকুদের মতোন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে ফেলি।আরহাম ইদানিং কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।ভালো লাগে না,কিচ্ছু ভালো লাগে না।’

ডায়রি লিখা পুরোপুরি শেষ হয়নি,তার আগেই নিচ থেকে লাগাতার গাড়ির হর্ন বাজানোর শব্দে নবনীতার কলম আপনাআপনি থামলো।সে দ্রুত জানালা দিয়ে নিচে উঁকি দেয়।আরহামের গাড়ি।পুনরায় নিজের টেবিলে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল সে।

‘পরী! এ্যাই পরী! কোথায় তুমি?নিচে এসো তো এখনি।’

গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠটা একপ্রকার হুকুম ছুড়ে ডাকে।নবনীতা শক্ত হয়ে চেয়ারে বসে থাকে।যাবে না সে কিছুতেই।গমগমে নিরেট স্বরটা পুনরায় তাকে ডাকে।ডাকতে ডাকতেই কিছুটা রেগে যায়।পরমুহূর্তেই রাগ সামলে নেয়।অত্যন্ত শান্ত গলায় ডাকে,’সেনোরিটা! আমার জানেমান,একটু নিচে এসো গো পাখি।তোমার চাঁদবদন খানি একটু দেখি।’

নবনীতা বসে বসেই চোখ পাকায়।কি উদ্ভট সম্বোধন! ইচ্ছে করে তাকে ক্ষেপানোর জন্য এমনটা করছে।আরহাম পুনরায় গলা খাঁড়া করে ডাকে,’আরে পরী! সিরিয়াসলি ডাকছি।এসো না।’

নবনীতা উঠে গিয়ে ধুপধাপ পায়ে সিঁড়ি ভাঙে।সামনে না দেখেই কাটকাট স্বরে বলে,’কি হয়েছে?’

বলেই সে চোখ তুলে সামনে দেখে।সামনের দৃশ্য চোখে পড়তেই সে থমকায়।খানিকটা আশ্চর্য হয়ে বলে,’এসব কি?’

আরহাম তার হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাইয়ের স্ট্যান্ডটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পুরো মুখে একটা ঝকঝকে হাসি ফুটিয়ে বলল,’এই নাও।এগুলো সব তোমার।তুমি নাকি হাওয়াই মিঠাই খুব পছন্দ করো?’

নবনীতার মুখের বিস্ময়ভাব তখনো কাটেনি।সে ফ্যালফ্যাল চোখে সামনে দেখে বলল,’এসব আবার কেন এনেছেন?’

‘কেন? তুমি খুশি হওনি?’
‘জ্বী হয়েছি।কিন্তু,,’

নবনীতা হাত বাড়িয়ে স্ট্যান্ডটা নিজের হাতে নেয়।তার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।তার যতটুকু মনে আছে শেষবার যখন তাদের কথা হয়েছিল,তখন তাদের ঝগড়া হয়েছিল।তাহলে আরহাম হঠাৎ এমন ভালো আচরণ করছে কেন?পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ল শাহরিয়ার আরহাম কখনো মাফ চায় না,বিনিময়ে সে অত্যাধিক ভালো ব্যবহার শুরু করে।এই যেমন এই মুহুর্তে সে খুবই মোলায়েম আচরণ করছে।কারণ রাতেই সে বুঝতে পেরেছে ভুলটা তার।বাড়াবাড়ি টা বরাবরের মতো সেই করেছে।

নবনীতা একটা হাওয়াই মিঠাই নিজের হাতে নিয়ে বলল,’আপনি কি করে জানলেন আমার এসব পছন্দ?’

‘জানি।আমি সব জানি।’

নবনীতা হাওয়াই মিঠাই হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।তার গম্ভীর অভিমানী মুখটা দেখেই আরহাম তার একহাত টেনে বলল,’চলো তো।আজ আমরা রিকশা বিলাশ করব।’

আশ্চর্যে তার মুখ হা হয়।সে কোনোরকমে হাওয়াই মিঠাই গুলো একপাশে রেখে আরহামের পায়ের সাথে নিজের গতি মেলাতে মেলাতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।যেতে যেতে বিস্ময় জড়ানো কন্ঠে জানতে চায়,’রিকশা বিলাশ করব মানে?’

আরহাম বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা হেলমেট মাথায় দিলো।কেবল চোখ দু’টো উন্মুক্ত করে নবনীতার দিকে দেখে চঞ্চল গলায় বলল,’কেউ দেখে নিলে ঝামেলা হবে।তাই এই সিস্টেম।চলো তো।আমার সাথে চলো।’

সে তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে একটা রিকশা ডাকে।নবনীতা তখনও হতবাক হয়ে তার কাজকর্ম দেখে।এই লোক হঠাৎ রিকশা ডাকছে কেন?

আরহাম রিকশায় চেপেই উঁচু গলায় বলল,’এ্যাই আমাদের কে একটু শহর ঘুরাও তো।খবরদার মেইনরোডে যাবা না।অলিগলি দিয়ে ঘুরো।চারপাশে যেন গাছপালা থাকে।’

কথা শেষ করেই সে নবনীতার দিকে তাকায়।স্মিত হেসে বলে,’তোমার নাকি অকারণেই রিকশায় ঘুরতে ভালো লাগে?তাই ভাবলাম তোমার শখ পূরণ করি।আমি না তোমার স্বামী?হু?’

নবনীতা কপাল কুঁচকায়।ক্ষমা চাওয়ার অভিনব কৌশল এই মানুষের জানা আছে।কাল রাতে খ্যাক খ্যাক করে এখন তার শখ পূরণ করতে তাকে করে হেলমেট পরে শহর ঘুরছে।সে গালের নিচে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে বলল,’শুভির আজকে ফিজিক্স পরীক্ষা।আপনি তাকে আমি কি পছন্দ করি না করি,এসব বেহুদা প্রশ্ন করে বিরক্ত করেছেন তাই না?’

‘মোটেই বিরক্ত করি নি।শুভ্রার প্রস্তুতি এমনিতেই ভালো।তুমি চুপচাপ সবকিছু এনজয় করো।’

তিন পায়ার রিকশাটা ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ছুটে যায় আবাসিক এলাকার অলিতে গলিতে।নবনীতা আলতো করে তার মাথাটা আরহামের কাঁধে রাখে।তার ভীষণ খুশি খুশি লাগছে।তার রাগ পড়েছে,বেহায়া মনটাও স্বল্প আদরে বরফের মতোন গলে গেছে।সে তার কাঁধে মাথা রাখতেই আরহাম গাঢ় স্বরে বলল,’মন খারাপ কমেছে পরী?’

‘জানি না।’

‘তুমি নাকি রাতে ঘুমাওনি?’

‘জানি না।’

‘যাকগে,জানতে হবে না।আমিও ঘুমাইনি।তোমায় জানিয়ে দিলাম।’

নবনীতা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎই মাথা তুলে বলল,’আচ্ছা আরহাম,আপনি আপনার ছেলেদের কিছু বলবেন না?মিজান চাচার ব্যাপারে আপনি কাল রাতে কিছু ভেবেছেন?’

আরহাম থমথমে মুখে তাকে দেখে।তারপরই তার একহাত চেপে সামনে দেখতে দেখতে বলে,’ঐ দেখো,কৃষ্ণচূড়া গাছ।তোমার না কৃষ্ণচূড়া পছন্দ ভীষণ?’
.
.
.
.
পোড়া গন্ধ নাকে লাগতেই ওয়াজিদ মুখ কুঁচকে নিল।ধীরে ধীরে সেই গন্ধটা প্রকট হয়ে নাসিকারন্ধ্রে পৌঁছুতেই সে চোখ খুলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল।বড় বড় চোখে চারপাশ দেকে পোড়া গন্ধের উৎস খুঁজতেই তার মনে হলো গন্ধটা রান্নাঘর থেকে আসছে।চারপাশে কোথাও ঐ বাচালের অস্তিত্ব নেই।তার অস্তিত্ব না থাকা ওয়াজিদের জন্য আরেক আতঙ্কের বিষয়।সে তীব্র বেগে ছুট লাগায় রান্নাঘরের দিকে।

রান্নাঘরে পা রাখতেই তার চক্ষু চড়াকগাছ।রিমি কেবিনেটে বসে বসে ঝিমুচ্ছে।তার থেকে একটু দূরে চায়ের পাতিল থেকে চা উপচে পড়ছে।সেই চা পোড়া গন্ধই বারবার তার নাকে এসে লাগছে।সে হাত নেড়ে নেড়ে ধোঁয়া সরায়।বড় বড় পায়ে সামনে এসে রিমির কাঁধ ধরে ধাক্কায়,’এ্যাই রিমি! রিমি!’

রিমি চোখ খুলে লাফিয়ে উঠে বলল,’জ্বী।জ্বী।’

‘তুমি এসব কি করেছ?’

রিমি দ্রুত পাশ ফিরে।চুলার অবস্থা দেখতেই আঁতকে উঠে বলে,’কি সর্বনাশ! এসব কিভাবে হয়েছে?’

‘আমি কি করে জানবো?তুমি রান্নাঘরে ছিলে।আম্মু কোথায়?’

রিমি মলিন মুখে চুলায় বসানো পাতিল দেখতে দেখতে জবাব দেয়,’আপনার আম্মু আর আব্বু আপনার ফুফুকে দেখতে গিয়েছে।তার নাকি শরীর খারাপ?এজন্য আমাকে বলেছে সকালে উঠে যেন আপনাকে চা করে দেই।’

ওয়াজিদ বিরক্ত মুখে একবার স্টোভ,আরেকবার রিমিকে দেখে।ভ্রু কুঁচকে বলে,’আম্মু আর মানুষ পায়নি।তোমাকে এসব দায়িত্ব দিয়ে গেছে।যাও বের হও তো।আমার চা আমি করে নিব।’

বলা শেষ করেই সে এগিয়ে যায়।রিমি তাড়াহুড়ো করে তার হাত চেপে ধরে।দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,’না না।আমি করে নিব।আপনাকে কাজ করতে দেওয়া যাবে না।আপনি কাজ করলে আমার গুনাহ হবে।’

ওয়াজিদ মুখ বিকৃত করে তার একহাত টানতে টানতে বলল,’তোমার এতো ভাবতে হবে না এসব নিয়ে।তুমি কাজ করার চেয়ে কাজ না করলেই আমার জন্য বেশি ভালো হয় ব্যাপারটা।’

ওয়াজিদ তাকে সরিয়ে নিজে স্টোভের সামনে দাঁড়ায়।কোনোরকমে দুই কাপ চা করে কেবিনেট থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট হাতে নিতে নিতে বলল,’চলো চলো।চা বিস্কুট খেয়ে নেই।’

বলেই সে একটা ট্রে তে সবকিছু নিয়ে ডায়নিং এর দিকে পা বাড়ায়।রিমি তার পিছু ছুটতে ছুটতে বলল,’কিন্তু সব তো আপনিই করলেন।আমি তো কিছুই করতে পারলাম না।আমারও কিছু করতে ইচ্ছে করছে।’

ওয়াজিদ পেছন ফিরে তাকে দেখে।মৃদু হেসে বলে,’আপনি তো প্রিন্সেস ডায়না।আপনি শুধু অর্ডার করবেন।আমি করে দিব সবকিছু।আসুন।বসে খেয়ে যান।ধন্য করুন আমায়।’

রিমি বোকা হেসে টেবিলে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল।একটা কাপ হাতে নিয়ে ওয়াজিদকে দেখে কাচুমাচু মুখ করে বলল,’আমার নিজে থেকে অনেক কিছু করতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু কেন যেন গুছিয়ে করতে পারি না কিছু।’

বলেই সে একটা চুমুক দেয় কাপে।আজ তাদের বিয়ের তেরো তম দিন।বিয়ের পর রিমি এই বাড়িতে দুই দিনের মতো ছিলো।তারপর সপ্তাহখানেক নিজের বাড়িতে থেকে গত পরশু সে আবার এখানে এসেছে।তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি অত্যাধিক ভালো মানুষ।সে চায় তাদের মন মতো মেয়ে হতে।পড়াশোনার তো এমনিতেই তার ভয়াবহ অবস্থা।একপ্রকার ফেল করতে করতে পাশ করেছে শেষ বর্ষে।পড়াশোনা করার চেয়ে সংসার করা ঢের ভালো।রিমি এখন আটঘাট বেঁধে সংসার জীবনে নেমেছে।অনেক পড়াশোনা হয়েছে,এবার সে হবে যোগ্য গৃহিনী।

ওয়াজিদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রিমির দিকে দেখে অল্প হেসে বলল,’তোমার এতো গোছানো হতে হবে না।তুমি এমনিতেই ঠিক আছো।আমার তোমাকে এমনই বেশ লাগে।’
.
.
.
.
কানের ডানপাশে যান্ত্রিক শব্দে ঘট ঘট শব্দ হচ্ছে।শরীরের কিছু জায়গায় চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।অবষন্ন শরীরটা সেই ব্যথা উপেক্ষা করেই অল্প নড়েচড়ে উঠে।মুখ দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে কিছু একটা বলে।

প্রায় দশ মিনিট চেষ্টা করার পর ইজমা তার চোখ খুলতে সক্ষম হলো।চোখ খুলতেই সবার প্রথমে সে হাসপাতালের সাদা পর্দাটা দেখলো।তারপর দেখল নিজের হাত।দেখতেই সে আঁতকে উঠে।তার হাত ভেঙে গেছে।হাতে প্যাঁচানো ব্যান্ডেজে ছোপ ছোপ র’ক্তের দাগ লেগে আছে।সে খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে ডাকে,’এক্সকিউজ মি,কেউ আছেন?’

ডিউটিরত নার্স পাঁচ মিনিট পর তার কেবিনে এলো।সে তাকে দেখতেই ম্লান হেসে বলল,’আমি কোথায়?’

নার্সের পোশাক পরিহিত ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে গাঢ় স্বরে বললেন,’তুমি হসপিটালে।তোমার সিএনজি নাকি উল্টে গিয়েছিল?যারা তোমাকে এখানে এনেছেন,তারাই এই কথা বলল।’

ইজমা অসহায় চোখে নিজের হাত দেখে।অতিশয় ক্ষীণ কন্ঠে বলে,’ভেঙে গেল নাকি?’

তার ভাবভঙ্গি দেখেই সিনিয়র নার্স রুবাইদা শারমিন হেসে ফেললেন।নিজের একটা হাত তার মাথায় রেখে বললেন,’সমস্যা নাই।পনেরো দিনে ঠিক হয়ে যাবে।বাড়ি কোথায় তোমার?’

ইজমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দেয়,’আমেরিকা।’

‘কি সাংঘাতিক! জন্ম থেকেই সেখানে থাকো নাকি?’

‘হু।বাবা স্টুডেন্ট থাকা অবস্থাতেই সেখানে সেটেল্ড।আমার জন্ম সেখানেই।’

‘দেশে কি একাই এসেছ?’

ইজমা মুখ কালো করে জবাব দেয়,’হু।আমার ফ্রেন্ড কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য।’

রুবাইদা আরো কিছু বলতেন।কিন্তু তার আগেই সাদা এপ্রোন গায়ে জড়ানো যুবকটা বেশ তাড়াহুড়ো করে কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে বলল,’পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে সিস্টার?’

ইজমা চোখ তুলে।কেবিনে আসা আগন্তুকের গায়ের পোশাক বলছে সে পেশায় একজন চিকিৎসক।ইজমার কৌতূহলী চোখজোড়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যুবকটা তার একহাত তুলে পালস রেট চেক করে।তারপরই গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠে,’আমি ডাক্তার ইফতেখার আহমেদ ইফাজ।’

চলবে-