Tuesday, August 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 484



লাজুকপাতা পর্ব-৮+৯

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-৮
মাঝরাতে ঘুম ভাঙে চেঁচামেচির শব্দে। জামিল ভাইয়ের গলা। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসি। নাবিদও চোখ কচলে উঠে বসে। বাইরের ঘরে জিনিসপত্র ফেলে দেবার শব্দ। নাবিদ আমাকে বলে,

“তুমি ঘরে থাকো জরী। বাইরে আইসো না। ”

আমি তবুও যাই। জামিল ভাইয়ের চোখ দুটো লাল। বিশ্রী রকমের কড়া সিগারেটের গন্ধ। নরমাল সিগারেটে বোধহয় এতো কড়া গন্ধ হয় না। নাবিদের টুকটাক সিগারেট খাবার অভ্যাস আছে। তবে আমার সামনে আজ অবধি খায় নি।

জামিল ভাই চিৎকার করে বলছে,

“আমার জীবন টা নষ্ট হয়ে যাইতেছে। আর তোমরা আনন্দ ফুর্তি করো! কিসের এতো আনন্দ তোমাদের!”

আম্মা চাপা গলায় বললেন,

“থাম, ভাড়াটিয়াদের কাছে মান সম্মান কিছু আর থাকলো না। ”

জামিল ভাই রেগে গিয়ে আম্মাকে বলেন,

“তুমি মান সম্মানের বানী কারে শুনাও! তোমার কারণে আজ আমার এই দশা। তোমার জন্য আমার মেয়ে দুটো মা ছাড়া। ”

নাবিদ চেয়ারে বসে ঢুলছে। কাউকে কিছু বলছে না। বাবা জামিল ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। জামিল ভাই খানিকক্ষণ চেঁচামেচি করে হঠাৎই গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলো। মুক্তা আমাকে আস্তে করে বলল,

“ভাবী টুপুর রে একটু কোলে নাও। ভয় পাইছে। টাপুর ঘুমায়। ”

আমি টুপুর কে কোলে নিয়ে মুক্তার রুমে আসলাম। এটা অবশ্য মুক্তার একার রুম না, মনিরও। মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

“টুপুর সোনা পানি খাবা?”

“বাবায় অমন করে ক্যান কাকিমনি?”

“বাবার শরীর টা ভালো নেই। ”

“কি হইছে?”

“একটু জ্বর। ”

“মাথায় পানি দিবে না? আমার জ্বর হইলে আম্মু মাথায় পানি দিতো৷ জ্বর কমে যাইতো। ঘুমায়ে যাইতাম।”

আমার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। মেয়ে দুটো সারাদিন কতো হুটোপুটি করে, খেলে, টিভি দেখে। অথচ একবারও মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে না। আম্মা একদিন বলেছিলেন,

“মা’টা এমন পিশাচ দেখেই মাইয়া দুইটার মায়েরে মনে পরে না। একবারও শুনছ ওগো মা মা করতে। ”

আজ টাপুর টুপুর এর জন্মদিন। একটু কেক কাটা, ওদের সঙ্গে যে বাচ্চাগুলো খেলে তাদের ডাকা, আর একটু ভালো রান্না হয়েছে। টেবিলে খাবার দেখেই হয়তো জামিল ভাইয়ের মনে হয়েছে বাড়ির লোক ভীষণ আনন্দ, ফূর্তিতে আছে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বসার ঘরে জামিল ভাইয়ের কান্নার শব্দ এখনো ভেসে আসে। টুপুর আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে। জামিল ভাইয়ের জন্য কেন যেন আমার খারাপ লাগে না। মেয়েটার জন্য খারাপ লাগে। একদিন এই মেয়েটা বড় হবে। পড়াশোনা করে চাকরি করবে, নিজের সংসার হবে। তবুও জন্মদিন পালন করার সময় এই রাতের কথা মনে করে গলায় জমাট বাঁধা কান্নাগুলোও গিলে ফেলবে এক টুকরো কেকের সঙ্গে।

জামিল ভাই পরদিন নিজের কৃতকর্মের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত হলেন। আমি এই প্রথম জিজ্ঞেস করলাম,

“ভাইয়া, ভাবী কি ফিরবে না?”

জামিল ভাই অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকেন খানিকক্ষণ। তারপর বলেন,

“ও ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছে জরী। মেয়ে দুটোর জন্যও একটু মায়া হয় না। কত পা ধরলাম! ”

“টাপুর টুপুরের জন্য আপনার কী মায়া হয় ভাইয়া?”

জামিল ভাই বোকার মতো তাকিয়ে থাকেন। সেদিন বিকেলে মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে যায়। ফেরার সময় মেয়েরা আইসক্রিম, বেলুন নিয়ে খুশিমনে ফিরে আসে। তারপর থেকে মেয়েদের স্কুলে নেবার দায়িত্ব জামিল ভাই নেন।

সেই রাতের পর না চাইতেও আমি টাপুর টুপুরের মা হয়ে উঠলাম একটু একটু করে। এই বাড়িতে অন্যান্য মানুষদের চেয়ে ওরা আমাকে অন্য চোখে দেখে। এর আগে আমার ঘরে এসে জিনিসপত্র নষ্ট করেছে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা লিপস্টিক নেইলপলিশ নিয়ে দেয়াল নষ্ট করেছে। ওড়না, বই নিয়ে ভিজিয়ে ফেলেছে। নাবিদ, আম্মা অনেকবার বলেছে ওদের প্রশ্রয় দিও না। দুই একদিন থাপ্পড়, কিল খেলে আর কিছু নষ্ট করবে না।

আমি ওদের কখনো কিছু বলিনি। দিনভর দুষ্টমি করা মেয়ে দুটো যে মায়ের ভালোবাসা না পেয়ে কতটা অপূর্ণতা নিয়ে বড় হচ্ছে সেটা আমি অনুভব করতে পারি।

নিউটনের তৃতীয় সূত্রের হিসেব অনুযায়ী ওরাও আমাকে বুঝতে পারে। এক দুপুরে কলেজ থেকে ফিরলাম। ঘেমে নেয়ে জামাকাপড় এর যাচ্ছেতাই অবস্থা। বসার ঘরে ফ্যান চালিয়ে বসতেই টাপুর এসে জিজ্ঞেস করলো,

“কাকীমনি, তুমি পানি খাবা?”

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে পানি নিয়ে আসলো। ছোট মগে অর্ধেকের বেশী পানি। ঠান্ডা পানি। আমাকে বলল,

“তোমার জন্য ফ্রিজে রাখছি। বাইরে থেকে আসলে তোমার কষ্ট হয়। ”

আমি বাড়িতে না থাকলে এরা আমার জিনিসপত্র আগলে রাখে। বিকেলে ছাদে উঠে কেবল আমার জামাকাপড় ই নিয়ে আসে।

আমার চোখে পানি এসে গেল। মাঝেমধ্যে আমার ভাবীর প্রতি অভিমান হয়। জামিল ভাইয়ের ওই কান্নাও মিথ্যে নয়। তবুও এই সংসার টার প্রতি ভাবীর এমন বিতৃষ্ণা।

***
সংসার, পড়াশোনা আর নাবিদ ছাড়াও আমার জীবনে আরও একটা অধ্যায় যুক্ত হলো। তিনতলায় থাকে নাজমা ভাবী। ভাবী ভীষণ মিশুকে স্বভাবের মানুষ। ঘরে ভালো, মন্দ খাবার বানালে আমাদের দিতে ভুলে না। আম্মার অবশ্য ধারণা যে বাড়িওয়ালা বলে তেল দিচ্ছে। আমার তেমন মনে হয় না। শেষ বিকেলে জামা কাপড় তুলতে ছাদে গেলেই ভাবীর সঙ্গে দেখা হয়। প্রায় প্রতিদিনই। আমার ধারণা নাজমা ভাবী আমার সঙ্গে কথা বলবেন বলেই আসেন। ভাবীর সুন্দর ছিমছাম গোছানো সংসার। মেয়েটা সেভেনে আর ছেলেটা ফাইভে পড়ে। ভাবী একদিন বললেন,

“জরী একটা কথা বলব কিছু মনে করবা না তো?”

“জি ভাবী বলুন।”

“মেয়েটার অংক টিচার নিয়ে খুব ঝামেলায় আছি। ব্যাচে পড়তে যায় ঠিকই, কিন্তু তারপরও পিছিয়ে আছে। ফার্স্ট টার্মে অংকে পেয়েছে কত জানো! উনচল্লিশ। ”

আমি ভাবীর কথার মানে বুঝতে পারি। হেসে বলি,

“ভাবী ও কী বিকেলে ঘুমায়? সন্ধ্যেবেলা আমার রান্নার দিকটা দেখতে হয়। ”

“থ্যাংক ইউ জরী। মুক্তাই তোমার কথা বলছিল। আমি অবশ্য সাহস পাচ্ছিলাম না। ”

আমি হাসলাম। ভাবীর বাচ্চা দুটোর নাম রিনি আর সিয়াম। দুজনকে বিকেলে এক ঘন্টা করে অংক পড়ানো শুরু করলাম। আম্মা ভালো চোখে দেখলেন না সেটাও। বললেন,

“এ কী কথা! তুমি এসব কী শুরু করছ! মানুষ কী বলবে?”

“দুটো ছেলেমেয়ে পড়তে আসলে অসুবিধে তো কিছু নেই আম্মা। ”

“লোকে ভাববে নাবিদের টাকা নাই তাই বউরে দিয়ে কাজ করায়। ”

আমি আর জবাব দিলাম না। নাবিদ শুনে বলল,

“তোমার টাকার দরকার হলে আমাকে বলবে তুমি। এতো কষ্ট করতে হবে না। সারাদিন তো কাজ করোই। ”

আমি হেসে বললাম,

“আমার যা দরকার সেটা তো তুমি না চাইতেই দাও৷ আমি শুধু পড়াতে চাইছি নিজেকে যাচাই করার জন্য। কেমন পড়াতে পারি সেটা দেখার জন্য। ”

নাবিদ হেসে বলল,

“তুমি ভালো টিচার হতে পারবে না। অবশ্য কলেজের টিচার হতে পারবে। কিন্তু বাচ্চাদের টিচার হতে পারবে না। ”

“কেন? বাচ্চাদের টিচার হতে পারব না কেন?”

নাবিদ আরও একটু এগিয়ে আসে। গভীর গলায় বলে,

“তুমি হলে মেঘের মতো জরী। কালো মেঘ নয়। নীল আকাশে ভেসে আসা সাদা নরম মেঘ। মেঘের মতো নরম, স্নিগ্ধ, সুন্দর। ”

আমি হেসে চোখ নামিয়ে নেই। জীবনের কাছে আমার বাড়তি কোনো চাওয়া নেই। এই যেমন আছি তেমনই সুন্দর।

চলবে…

#লাজুকপাতা
#পর্ব-৯
নাজমা ভাবী এক মাস পর আমাকে একটা খাম দিলেন। দেয়ার সময় খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন। বললেন,

“কম হলে জানাবে জরী। আরেকটু বেশী দেয়া উচিত ছিলো আসলে…

আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,

“ধ্যাৎ! কী বলছেন ভাবী! ”

“অনেক ধন্যবাদ জরী। তুমি আমার অনেক উপকার করেছ। বিকেলে এই দুটোকে নিয়ে টিউশনে দৌড়াতে গেলে আমার অনেক সময়ও নষ্ট হয়। এখন সন্ধ্যের মধ্যেই কাজ শেষ করে একটু রেস্ট নিতে পারি। ”

আমি স্মিত হাসলাম। ভাবীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি খুব। খাকি খামে পাঁচশ টাকার পাঁচ টা নোট! আমি আমার জীবনের প্রথম উপার্জন। আমি টাকাটা নাবিদ কে দিতে চাইলাম,কিন্তু ও নিলো না। বলল,

“তুমি খরচ করো জরী। যা কিনতে মন চায় কিনো। ”

আমি টাকাটা খরচ করলাম না। আলমারিতে ছোট ব্যাগে রাখলাম। নাবিদ আমাকে প্রতি মাসে কিছু টাকা দেয় খরচের জন্য। সেটাও জমাই।

আম্মা জিজ্ঞেস করলেন,

“নাজমা নাকি পড়ানোর জন্য তোমাকে টাকা দিছে?”

আমি তখন মাছ ভাজতে ব্যস্ত। বললাম,

“কত দিছে?”

“আড়াই হাজার। ”

“কি করছ টাকা? ”

“আমার কাছে আছে। ”

“নাবিদ কে দাও নাই?”

“দিয়েছিলাম। কিন্তু ও নেয় নি। ”

আম্মা গম্ভীর মুখে বললেন,

“ওহ। ”

আম্মা পরদিন সকালে বললেন,

“জরী এইদিকে আসো, নাজমারে বলবা পরের মাস থেকে তিন হাজার দিতে। ”

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,

“কেন আম্মা?”

“দুইজন রে পড়াইতেছ না। ও তো তোমারে ঠকাইতেছে। আমি খোঁজ নিছি, এমন ই নেয় সবাই। ”

আমি স্বভাবসুলভ আচরনের কারণে কোনো কথা বললাম না। বিকেলের দিকে আম্মা বললেন,

“জরী তোমার কাছে দুইশ টাকা হবে?”

“হবে আম্মা। ”

দুইশ টাকা দেবার পর বললেন,

“টাকা, পয়সা সাবধানে রাখবা। ময় মুরব্বিদের কাছে টাকা থাকলে খোয়া যায় না। তোমরা হইলা গিয়া সিধা টাইপ। ”

আমি কিছু বললাম না।

পরদিন মনি আমার ঘরে এলো। প্রয়োজন ছাড়া ও আমার ঘরে আসে না। নরম গলায় বলল,

“ভাবী কি করেন?”

“কিছু না। শুকনো জামা কাপড় গোছাচ্ছি। ”

মিনিট দুয়েক খাটের উপর বসলো। বলল,

“ভাবী আপনার কাছে টাকা হবে?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আরও তিনশ টাকা গচ্চা গেল।

মনটা ভীষণ খারাপ হলো। সারাদিন আমার এতো মন খারাপ হলো যে ভালো করে কিছু খেতেও পারি নি। হোক পাঁচশ টাকা, তবুও এই টাকাটা আমার কাছে স্পেশাল ছিলো।

মন খারাপের দিনে এক পশলা বৃষ্টির মতো পরী আপা এসে হাজির হলো। আপা এবার শুধু নোটন কে নিয়ে এসেছে। দুলাভাই আসতে পারে নি ব্যস্ততার কারণে।

আপাকে দেখার কারণে পাঁচশ টাকার কষ্ট টা আমি ভুলে গেলাম।
আপা আমার সমস্যার কথা শুনে বললেন,

“ভুলেও এই কথা নাবিদ কে বলবি না। সংসারের কোনো কিছুই ওর কানে তুলবি না। যেমন যাচ্ছে যেতে দে। তোর পাঁচশ টাকা আমি তোকে দিয়ে যাব। মন খারাপ করিস না। ”

আপা রাতে খেয়ে গেলেন না। এসেছিলেন একটা বিশেষ কারণে। বিয়ের সময় আমাকে তেমন কিছু দিতে পারে নি। দুলাভাই এর হাতের অবস্থা ভালো ছিলো না তখন। তাই এখন এক জোড়া কানের দুল নিয়ে এসেছে। কানের দুল টা খুব সুন্দর। ডিজাইন টা ভালো। আম্মার চোখ কপালে উঠে গেল কানের দুল দেখে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন,

“তোমার দুলাভাইর আয় রোজগার তো ভালোই। তাই তোমার বোন খরচ করতে পারে। ”

আমি কিছু বললাম না সেই কথার জবাবে।

***
বাড়িতে নতুন ঝামেলা শুরু হতে যাচ্ছে। জামিল ভাইয়ের ঝামেলা তো ছিলোই সেই সঙ্গে আরেক ঝামেলা যুক্ত হচ্ছে। আম্মার কথায় নাবিদ মনি, মুক্তা দুজনকেই মোবাইল কিনে দিলো। সেই ফোন সবসময় ই দুজনের হাতে থাকে। দিনরাত ফোন নিয়ে বসে থাকে। কখনো গান দেখছে, কখনো ভিডিও দেখছে।

এসবের সঙ্গে যুক্ত হলো মনির সারাক্ষণ ফোনে কথা বলা। বাথরুমে গেলেও ফোন টা কানে থাকে। কী বিশ্রী অবস্থা! এভাবে অনেক দিন ধরে চলছে। এসব দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম। কিন্তু পরী আপা নাবিদ কে বলতে বারন করেছে।

একদিন নাজমা ভাবী বলল,

“তোমার বড় ননদের খবর জানো কিছু? ”

“না ভাবী। সারাদিন এতো ব্যস্ত থাকি যে কারোর খোঁজ নেবার সুযোগ পাই না। ”

ভাবী নিচু গলায় বলল,

“খবর ভালো না জরী। কাওরান বাজার মাছ বেঁচে এমন একজনের সাথে তার প্রেম হইছে। সেই ছেলে সন্ধ্যের পর বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করে। ”

আমি অবাক হলাম। সত্যতা যাচাই করতে একদিন ছাদে গিয়ে সন্ধ্যেবেলা দাঁড়ালাম। কালো, রোগামতন একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে চোরের মতো। একটু পর মনি বের হলো। সাদা, নীল জর্জেটের জামা পরা।

পরের দিনের ঘটনাও একই রকম। সামনের বিল্ডিং এর তানিয়াদের বাসায় যাই বলে সেজেগুজে বেরিয়ে গেল। গেটের ওখানে ওই ছেলেটা দাঁড়িয়ে। মনি আগে আগে গেল, ছেলেটা পিছনে।

আমি পরী আপার কথা শুনলাম না। নাবিদ কে জানালাম। নাবিদ এক সন্ধ্যেবেলা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো,

“ভাই কে আপনি? প্রতিদিন নাকি এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। কাউকে খোঁজেন?”

ছেলেটা আমতা আমতা করতে লাগলো। এরমধ্যে মনিও বেরিয়ে আসলো। নাবিদ স্বভাবসুলভ ভ্রু কুঁচকে মনিকে জিজ্ঞেস করলো,

“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

বেচারি ঠিকঠাক জবাব দিতে পারে নি। নাবিদ সেদিন যথেষ্ট শাসন করলো। আম্মা মেয়ের পক্ষ না নিলেও চুপ করে রইলেন। তার দিন দুয়েক পর সেই মেছো ছেলেটার সঙ্গে মনি পালিয়ে গেল। যাবার আগে আম্মার আলমারি থেকে তার জমানো টাকা আর মুক্তার এক জোড়া জুতা নিয়ে গেল।

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-৬+৭

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-৬
আমি ভর্তি হবার সুযোগ পেলাম তিতুমীর কলেজে। সাবজেক্ট প্রানীবিদ্যা। ইউনিভার্সিটির ভর্তি যুদ্ধে ছিটকে গেলাম প্রথম দফাতেই। শেষ ভরসা ছিলো জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি। নাবিদ সেখানে পড়াতে চাইলো না। বলল,

“বাসা থেকে এতো দূরে গিয়ে ক্লাস করতে পারবে না তুমি জরী। আর ওখানে একা থাকার তো প্রশ্নই আসে না। তুমি বরং কাছের কলেজেই পড়৷ ”

আমি মেনে নিলাম। নাবিদ ভুল কিছু বলে নি। তাছাড়া অত দূরের পথ জার্নি করা আমার পক্ষেও সম্ভব না।

আম্মা আমার পড়াশোনা মেনে নিতে পারলেন না। কিন্তু নাবিদের মুখের উপরও কিছু বলতে পারছেন না। তিনি আড়েঠাড়ে আমাকে বেশ কয়েকবার বোঝালেন যে পড়াশোনা করে আসলে লাভ কিছু নেই। শেষ অবধি রান্নাঘর ই মেয়েদের আসল জায়গা।

আমি এসব কিছুতে মাথা ঘামাই না। বাপের বাড়িতে থাকাকালীন সময় থেকেই একটা ভালো গুন আমি রপ্ত করেছিলাম। লোকের কথায় মাথা ঘামিয়ে নিজের সময় নষ্ট করব না।

মনি সারাদিন বসেই থাকে। বিকেল হলে সেজেগুজে বেরোয় পাড়ার সমবয়সী কিছু মেয়েদের সাথে। ঘন্টা দুয়েক পর ফিরে। প্রায়ই মেজাজ খারাপ থাকে। পঞ্চাশ, একশ টাকা নাবিদের কাছে চেয়ে নেয় হাত খরচের জন্য। মুক্তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পড়ে পড়ে কয়েকটা দিন ঘুমালো। তারপর নেমে পড়লো সেলাই মেশিন নিয়ে। সেলাই মেশিন টা আমার মামাশ্বশুরের বাসা থেকে আনা। পুরোনো জিনিস। কলকব্জা প্রায় নষ্ট। সেটাকে পয়সা খরচ করে সারিয়ে জামা কাপড় বানায়। প্রথমে বানালো টাপুর টুপুর এর জন্য জামা। সেই জামা ওদের গায়ে বড় হয়৷ হাতা খুলে পড়ে। আমার সাথে সম্পর্ক আগের চেয়ে ভালো। গল্পটল্প করতে গেলে হাসিমুখে কথা বলে।

আমার অবশ্য গল্প করার সময় নেই। সকালে উঠেই রান্নাঘরে দৌড়াতে হয়। নাবিদের খাবার গুছিয়ে, সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে টাপুর টুপুর কে নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। বাচ্চাদুটো সামনের কেজি স্কুলেই পড়ে। জামিল ভাই মেয়ে দুটোর দিকে ফিরেও তাকান না। এদিকে ওদের মা’ও মেয়েদের খোঁজ খবর নেয় না। মেয়ে দুটো বড় হচ্ছে নিজেদের মতো। দাদী, ফুপুর আদরের পরিবর্তে থাপ্পড় খেয়ে বড় হচ্ছে।

এই বাড়িতে টুম্পা ভাবীর সম্পর্কে কেউই ভালো কথা বলে নি। আম্মাকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন,

“এমন বিষে ভরা মেয়ে মানুষ আমি জম্মেও দেখিনি। তার গুনকীর্তন তোমার শুনে লাভ নাই। ”

মুক্তা কে জিজ্ঞেস করার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল,

“তোমার মতোই সুন্দর ভাবী। একটু অন্যরকম সুন্দর। বড়ভাই’র সঙ্গে মানায় না। মোটকথা আমাদের পরিবারে মানায় না। ”

মুক্তার এই গুণ আমাকে চমৎকৃত করেছে। টুম্পা ভাবী ভালো কী মন্দ সে আমি জানিনা। তবে এই যে দোষ টুকু সরাসরি না বলা এটা আমার বেশ লেগেছে।

নাবিদ অবশ্য ভাবীর ব্যাপারে অন্য কথা বলেছে,

“শোনো জরী, দোষ গুণ মিলিয়েই মানুষ। ভাবীর অনেক দোষ ছিলো। হয়তো মায়েরও দোষ ছিলো। তবুও মেয়েদের অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। শ্বশুর বাড়িতে চটাং চটাং কথা বলতে হয় না। ”

আমি অনেক কিছুই বুঝি না। এতসব সাংসারিক জটিলতার সম্মুখীন এখনো অবধি হয় নি সম্ভবত আমার সহজাত চুপচাপ স্বভাবের কারণে। তবুও একটা প্রশ্ন মাথার ভেতর চলতে থাকে। সেই প্রশ্নটা আমি নাবিদ কে করতে পারি না। মেনে নেয়া আর মানিয়ে নেয়ার দায়ভার কী শুধু মেয়েদেরই!

***
এই বাড়িতে আমার অনেক কিছু পাওয়ার কথা ছিলো না। তবুও পাচ্ছি তার কারণ বোধহয় টুম্পা ভাবী৷ আম্মাকে একদিন পাশের ঘরে বসে তার দু:সম্পর্কের বোন বলেছিল,

“এই বউয়ের সঙ্গে দজ্জালপানা কম দেখাইস। আগেরবারের কথা মনে আছে! ছি: ছি: ভদ্রঘরের মহিলারা জেল হাজতে থাকে!”

এই একটি কথাতেই আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে যায়। অজান্তেই সেই মানুষটির জন্য দোয়া চলে আসে। যাকে আমি কোনোদিন দেখিও নি। আমার টাপুর টুপুর এর মা, যেখানে থাকুক ভালো থাকুক।

চলবে…

#লাজুকপাতা
#পর্ব-৭
পলাশবাড়ীতে আমার স্কুল কলেজ কেটেছে মেয়েদের সঙ্গে। গার্লস স্কুল, গার্লস কলেজ। শিকদার বাড়ির মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে পড়াশোনা করবে! ছি: ছি: মেয়েদের বিয়ের বাজারে যদি দর কমে যায়!

ক্লাস এইট থেকেই আমার বোরখা পরা লাগতো। সেদিক দিয়ে নাবিদ আমাকে বেশ ছাড় দিয়েছে। কলেজের জন্য জিনিসপত্র কিনতে যেদিন নিউমার্কেট গেলাম সেদিন নাবিদ আমাকে বলল,

“এই জরী, তুমি কী বোরখা পরতে?”

আমি জবাব দিতে খানিকক্ষণ সময় নিলাম। নাবিদের সঙ্গে একবার ই আমার বাড়ি যাওয়া হয়েছে। সেইবার মা আড়ালে ডেকে বলেছিলেন,

“কিরে বোরখা ছাড়া আসলি! আদব লেহাজ বিয়ের পর সব গেছে। ”

আমি আমতা আমতা করে বলেছিলাম,

“নাবিদ বারন করলো৷ ”

মা একটু মিইয়ে গেলেন। বললেন,

“তাইলে থাক৷ শহুরে ছেলেপেলে, আমাদের মতন তো আর না।”

নাবিদ যখন আমাকে বোরখার কথা জিজ্ঞেস করলো তখন আমি স্মিত হেসে বললাম,

“তুমি চাইলে নিশ্চয়ই পরব।”

নাবিদ কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখ দুটো ভীষণ রকম উজ্জ্বল ঠেকছিল। খুব খুশি হলে বাচ্চাদের চোখ যেমন হয় তেমন।

অনেক জিনিসপত্র কেনা হলো। বাড়তি কিছু কসমেটিক্স কেনা হলো ইডেনের সামনে বসা দোকানগুলো থেকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি ঘোরা হলো। টিএসসি তে চা খাওয়ার সময় নাবিদ বলল,

“ভালো করে পড়াশোনা করলে এখানে রোজ চা খেতে পারতে।

আমি হাসলাম। নাবিদ পড়েছে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে। রাজশাহী শহর টা ওর খুব পছন্দের। চাকরি বাকরির চেষ্টা করেছিল সেখানে, কিন্তু হয় নি। এখানের চাকরিটাও ভীষণ ভালো। বেতনও ভালো, বিয়ের আগে মা চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, পঞ্চাশ হাজার বেতন রে! পঞ্চাশ হাজার।

আমাদের অনেক ঘোরাঘুরি হলো সেদিন। নাবিদ আমাকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গেল। শহুরে জীবন, স্টাইল সবকিছুতে অনভ্যস্ত আমাকে নাবিদ একটু একটু করে সব শিখাচ্ছে। রাস্তা পাড় হবার সময় আমার হাত শক্ত করে ধরে থাকে। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। গাড়ি কাছাকাছি চলে এলে পায়ের নিচে বরফ হয়ে যায় যেন। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। নাবিদ টেনে আমাকে নিয়ে যায়। কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

“এই বোকা মেয়ে, আমি শক্ত করে হাত ধরে আছি তবুও ভয় কিসের! ”

আমি হাসি। সত্যিই তো! যার ভরসায় আমি পলাশবাড়ী ছেড়ে এখানে এলাম সে তো আমার হাত শক্ত করেই ধরে আছে।

রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও অপ্রস্তুত হয়ে যাই। চিকেন কাটলেট জিনিস টা এর আগে জীবনেও খাই নি। এক টুকরো নরম তুলতুলে পাউরুটি আর গরম ধোঁয়া ওঠা চিকেন কাটলেট এর সঙ্গে শসা পেয়াজ সামনে নিয়ে অপ্রস্তুত মুখে বসে থাকি৷ নাবিদ কাটাচামচ আর ছুড়ি দিয়ে কিভাবে কাটতে হয় সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখি। প্রথমবারে হাত কাঁপলেও সফল হই। নাবিদ আমাকে দেখে হাসে, কিছু না বললেও ওর হাসি দেখে আমি বুঝে যাই ও মনে মনে বলে,

“তুমি একদিন সব পারবে। ”

***
ভাত, ডাল, মাছ, মাংসের পদ, সবজি, ভাজি ছাড়াও পিঠেপুলি বানাতে আমি পারি। শহরে এসে নতুন করে আরও কিছু শিখছি। যেগুলো শহরের মানুষ খায়। আমার টাপুর টুপুরের জন্য পাস্তা, চাউমিন বানানো শিখলাম। প্রতিদিন ই কিছু না কিছু শিখছি।

কলেজে যাবার দুদিন আগে আম্মা আমাকে ডেকে বললেন,

“জরী তুমি তো এখন থেকে কলেজে যাবা। তাইলে রান্নার কি ব্যবস্থা হবে।”

আমার খুব মন খারাপ হলো। রান্নার দায়িত্ব তো আমি নিজে ভালোবেসে নিয়েছিলাম।

আমার যে মন খারাপ হয়েছে সেটা বুঝতে দিলাম না। আম্মাকে বললাম,

“আমার তো সকালে ক্লাস থাকবে। দুপুর নাগাদ তো চলেই আসব আম্মা। সকাল টা একটু ম্যানেজ করতে হবে। ”

আম্মা খানিকটা রুক্ষ গলায় বলল,

“মানে আমিই তো ম্যানেজ করব তাই তো? ”

আমি খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। এই মহিলার প্রতি সমস্ত ভালোলাগা এক নিমিষেই মুছে গেল। বাড়িতে মা, চাচিমা আমাকে, অরুকে পড়ার টেবিলে দেখলে কোনোদিন কাজে ডাকতো না।

আমি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললাম,

“আপনাকে কিছু ম্যানেজ করতে হবে না। আমি আগে যেমন করেছি, এখনো তেমন করব।

আম্মার গলার স্বর সহজ হলো। বললেন,

“ঘরের সবাই তো তোমার রান্নায় মজে গেছে। আমার রান্না আবজাব লাগে। নাইলে রানতে বাড়তে কী এমন কষ্ট! ”

আমার মনে দুটো ঘর আছে। এক জায়গায় ভালো মানুষেরা থাকে, আরেক জায়গায় খারাপ মানুষেরা। আম্মাকে আমি ভালো মানুষের ঘরে রেখেছিলাম বলেই তার আচরণে কষ্ট পাচ্ছি। পরী আপাকে বললাম কষ্টের কথা। আপা বললেন, এসব গায়ে মাখবি না। ভোরবেলা উঠে রান্না করে কলেজে যাবি। মুখে মুখে উত্তর দিয়ে কাজ হয় না জরী। তুই কিন্তু টাপুর টুপুর এর মায়ের মতো হবি না। তুই তোর কাজ দিয়ে জবাব দিবি।

নাবিদ কে আমি কিছুই বললাম না। পরী আপা বারন করে দিলেন। নাবিদ কে কখনো সংসারের জটিলতা যেন না জানাই।

নাবিদ আমাকে একটা নতুন মোবাইল কিনে দিয়েছে। ফোন টা সুন্দর। রঙ টা গোলাপি। স্মার্ট ফোন। আমাদের বাড়িতে সবার ই বাটন ফোন।

আমার হাতে স্মার্ট ফোন দেখে কুটিলা, জটিলা দুজনেই মন খারাপ করলো। নাবিদ কে সেটাও বলতে হলো না। কিভাবে যেন বুঝে গেল৷ নাবিদ একদিন খাবার টেবিলে বসে বলল,

“যারা কলেজে যাবে আমি শুধু তাদের ই ফোন কিনে দেব। এখন জরীকে দিলাম। এরপর মুক্তা যদি কলেজে যায় তখন ও’কে দেব। ”

মুক্তার চেহারাটা পাল্টে গেল খুশিতে। ওদিকে মনি সে গরম চোখে তাকাচ্ছে। আম্মা বললেন,

“এ কেমন কথা, কলেজে না গেলেও বাইরে তো যায়।”

নাবিদ নির্লিপ্ত গলায় বলে,

“তোমার মনে চাইলে মাথায় উঠায়ে নাচো আম্মা। যারা কোনো কাজের না, তাদের জন্য আমি এক পয়সাও খরচ করব না। ”

মনি খাবার রেখে উঠে গেল। সারাদিন চলল হু হু করে কান্নাকাটি। আম্মার ধারণা আমি নাবিদ কে কানপড়া দিচ্ছি।

***
আমার কলেজে যাওয়াও নাবিদের সঙ্গে। গলির মোড়ে রিকশায় ওঠা। পরনে সালোয়ার কামিজ। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। নাবিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

“ভয় পাচ্ছ জরী?”

আমি হেসে বললাম,

“না। ”

নাবিদ হেসে আমার হাত ধরলো। বড় রাস্তায় এসে পাড় হবার সময়ে হাত ধরলো না। বলল,

“একা পাড় হও তো। প্রতিদিন তো আমি সঙ্গে থাকব না।”

আমি অপ্রস্তুত হাসি দিলাম। নাবিদ আমার সঙ্গেই আছে। আমি এক পা বাড়িয়ে পিছিয়ে আসি। আবার কয়েক পা এগিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। নাবিদ সব টা দেখে। আমি নার্ভাস হয়ে যাই৷ ওর হাত ধরি, ও আমাকে রাস্তা পাড় করায়। বলে,

“আসার সময় কী করবে? আমি তো নিতে আসতে পারব না। ”

আমি জবাব দিতে পারি না। ও আবারও বলে,

“এক সঙ্গে অনেক মানুষ যখন রাস্তা পাড় হবে তখন তুমিও ওদের সঙ্গে রাস্তা পাড় হবে। জীবনে অনেক রাস্তা পেরোতে হবে জরী, আমি সবসময় তোমার সঙ্গে নাও থাকতে পারি। ”

কলেজ গেট দিয়ে ঢোকার সময় আমি নাবিদের দিকে তাকালাম। ও হাত নেড়ে বিদায় জানালো। আমিও হাত নাড়লাম। আমার চোখভর্তি পানি, নাবিদ কে ঝাপসা দেখছি। আমি হয়তো নাবিদ কে কখনো বলতেও পারব না যে, ও আমাকে সেই স্বপ্নটা পূরন করতে সাহায্য করছে। যেটা দেখার দু:সাহস করেও আমি থেমে গেছি। পলাশবাড়ীর শিকদার বাড়ির আমিই প্রথম মেয়ে যে অনার্সে পড়ার জন্য কলেজে পা রাখছে।

কলেজ শেষ হবার পরও দেখলাম নাবিদ দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

“অফিসে গেলে না?”

“গিয়েছিলাম, মাথা থেকে টেনশন যাচ্ছিলোই না। মনে হচ্ছিল তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছ। গাড়িগুলো এসে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। কারণ তুমি তো তখন শক্ত মানবী হয়ে যাও। ”

নাবিদের হাত ধরে আমি মনে মনে বললাম,

“আমি জীবনের ক্ষুদ্র, দীর্ঘ সব পথই তোমার হাত ধরে পাড়ি দিতে চাই। ”

চলবে….

লাজুকপাতা পর্ব-০৫

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-৫
রান্নাঘরের দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের লিস্ট বানানোর দায়িত্বটাও আমি পেয়ে গেলাম। বাজার করেন শ্বশুর বাবা। উনি আমার সাথে কথা কম বলেন তবে আমার প্রতি তার স্নেহ, আন্তরিকতা টুকু আমি টের পাই। উনি আমাকে জরী কিংবা বউমা বলে ডাকেন না। মিষ্টি করে মা ডাকেন।

এই বাড়িতে সকালের নাস্তায় এখন আর প্রতিদিন ভাত হয় না। একদিন পাতলা খিচুড়ি, একদিন পরোটা, একদিন ভাত, ডাল, আলুভর্তা আর অন্যান্য দিনগুলোতে রুটি করা হয়। খাবারের এই নিয়মে সবাই ই খুশি। জামিল ভাই একদিন রুটি খেতে খেতে বললেন,

“থ্যাংক ইউ জরী। একঘেয়ে খাবার খেতে খেতে মুখ পঁচে গেলেও কিছু বলতে পারি না। কামাই রোজগার নেই তো।”

আম্মা খানিকটা অসন্তুষ্ট হলেন বোধহয়। একদিন বললেন,

“এইগুলারে তো তুমি চেন না, একেকটা রাক্ষস বানাইতেছ।”

আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। আম্মা বিরক্ত গলায় বললেন,

“হাইসো না। আমি হাসার মতো কিছু বলিনাই। ”

পরী আপা একদিন আসলেন দুলাভাই কে নিয়ে। ফল, মিষ্টির দোকান টা উঠিয়ে আনতে বাকী রেখেছিলেন। পরী আপার আদর যত্নের কমতি রাখলো না। এই যে ছোট ছোট যে ব্যাপার গুলো এগুলোর জন্যই এই বাড়ির মানুষজনকে আমার এতো ভালো লাগছে।

আমার মনে আছে একবার বড় আপার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। আমি, নিরু আপা আর অরু। বড় আপা পোলাও মাংসের আয়োজন করেছিলেন। খাবার সময় যখন মাংস তুলে দিচ্ছিলেন তখন আপার শাশুড়ী হায় হায় করে উঠলেন। বললেন,

“আরে, করো কি? ভালো মাংসের পিস গুলান তোমার স্বামী, ভাসুরের জন্য রাখো। ”

লজ্জায় অপমানে আমি আর কখনো ওই বাড়ি যাই নি। আসার সময় নিরু আপা বলছিল, খবিশ বুড়ি আমার পাল্লায় পড়লে বুঝতো। বড় আপা ভালো মানুষ বলে সহ্য করছে।

***
আমি পড়াশোনা করব এই ব্যাপারটায় বাড়ির কেউ তেমন আপত্তি করলো না। তবে আম্মার কপাল কুঁচকানো দেখে বুঝলাম যে উনি বোধহয় খুশি নন। বাবা বললেন,

“পড়তে চায় পড়ুক না। এখন কী আর সেই আগের যুগ আছে! এখন মেয়েরাও বিয়ের পর পড়তেছে। ”

নাবিদ আমাকে কোচিংএ ভর্তি করাতে চাইলো। আমি রাজি হলাম না। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। কোচিং এর শিট গুলো কালেক্ট করে পড়তে শুরু করলাম। একা একাই পড়ছিলাম। নাবিদ অবশ্য বলেছিল একজন টিচার দেখবে কি না। আমি তাও রাজি হলাম না।

আমার পড়াশোনার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে চাচাজান আর মা ফোন করলেন। বোঝালেন, পড়াশোনার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো সংসার। সংসারে মন দেয়া উচিত। একসঙ্গে সব পাওয়া যায় না। পড়াশোনার চক্করে আমার সংসার টা ভেসে যেতে পারে।

আমি এসব কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলাম। পরী আপা ভীষণ খুশি হলেন। সেই সঙ্গে শুরু হলো আরেক উৎপাত। আপা ভোরবেলা মিসড কল দিয়ে জ্বালিয়ে মারেন। বাধ্য হয়ে আমাকেও উঠে পড়তে বসতে হয়।

***
নাবিদের সাথে আমার দূরত্ব কমে গেল আস্তে আস্তে। আমাকে অবশ্য পরী আপা আর মা যখনই জিজ্ঞেস করেন সব ঠিক আছে কি না, আমি উত্তর দেই হ্যাঁ সব ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেক কিছুই ঠিক ছিলো না। নাবিদ দূরে দূরে থাকতো বলে আমিও দূরে থাকতাম। সূক্ষ্ম অহম বোধ আমার মধ্যেও ছিলো। ডানাকাটা পরী না হলেও সবাই আমাকে সুন্দর ই বলতো। আমার বড় মামার মেয়ে ফাইজা আপুর বিয়ের সময় ভাইয়ার এক কাজিন বলেছিল, এই জরী দিব্যা ভারতী কে চেন? তুমি দেখতে অনেক টা ওনার মতো।

তবুও নাবিদের দূরে থাকার কারণ হিসেবে ধরে নিলাম যে ওর হয়তো আগে কেউ ছিলো। কিন্তু আমার জটিলা ননদের কাছ থেকে সেরকম কোনো খবর পেলাম না। বলল, আরে না ভাবী। ছোট্ট ভাই অমনই ম্যুডি টাইপ। বড় ভাইয়ের মতো না।

এক ঝিমধরা শীতের সকালে টের পেলাম নাবিদ আমাকে ওর কম্বল দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে৷ ঘুম ভাঙার পর নড়েচড়ে সরে আসতে গেলেই নাবিদ বলল,

“তোমার কম্বলে ঠান্ডা মানছিল না। ঠকঠক করে কাঁপছিলে। ”

আমি অস্ফুটস্বরে বললাম,

“হু। ”

“এখনো কাঁপছ কিন্তু! ”

নাবিদ আরও একটু কাছে এলো। ওর খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা গাল আমার গালের সঙ্গে ঘষলো৷ অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল সমস্ত শরীরে। নাবিদ আরও একটু ঘনিষ্ঠ হলো, প্রথমে নাকের পাশে চুমু খেল, তারপর গালে ও কপালে। আবেশে আমি চোখ বন্ধ করলাম। নাবিদ ফিসফিস করে বলল,

“তুমি এতো দূরে দূরে থাকো কেন? আমি কী অন্য শিবিরের মানুষ! আগ বাড়িয়ে একটু কাছে আসা যায় না!”

আমি বললাম,

“তুমি বা কবে কাছে ডাকলে! তাছাড়া তুমি তো কম্বলও শেয়ার করতে পারো না। ”

নাবিদ হাসলো। বলল,

“ওহ এই ব্যাপার! শীত তো প্রায় চলেই যাচ্ছে। এখন কাছে আসবে তো?”

“ডাকলে আসব। ”

“আর না ডাকলে আসবে না?”

নাবিদ আমার জবাবের অপেক্ষা করলো না। আমিও ভালোবাসা টুকু উপভোগ করতে লাগলাম।

***
বিয়ে নিয়ে আমার রাজ্যের ভয় ছিলো। অচেনা, অজানা মানুষগুলো কেমন হবে! বিছানায় হাত বাড়ালেই যাকে ছুঁয়ে দেয়া যায় সে না জানি কেমন হবে! সব মিলিয়ে চিন্তার শেষ ছিলো না। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর নাম পুতুল। পুতুলের বিয়ে হয়ে গেল কলেজে পড়ার সময়ে। এইচ এসসি পরীক্ষা দিতে পারলো না কারণ বাচ্চা পেটে এসেছিল। পুতুলের সঙ্গে শেষবার যখন দেখা হলো ভীষণ আক্ষেপ করে বলল,

“বিয়ে মানে হলো জীবন টা শেষ হয়ে যাওয়া জরী। নিজের জন্য তখন আর কিছু করা যায় না। ”

আমার কাছে বিয়ে মানে জীবন শেষ হওয়া মনে হয় নি। বিয়ের আগে কতশত পরিকল্পনা করেছিলাম, দূরে কোথাও পালিয়ে যাব। পড়াশোনা করে, চাকরি বাকরি করে ফিরে আসব।

এসব পরিকল্পনা আসলে ভাবনার জগৎ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আমি আসলে কিছুই পারতাম না।

নাবিদের সঙ্গে দূরত্ব কমে যাবার পর দারুণ একটা বন্ধুত্বও জমে উঠেছে। আমরা দুজন দুজনের খেয়াল রাখি। আমার প্রতি আম্মার অভিযোগ নেই বলে বাড়ির সকলের কাছে লক্ষিমন্ত বউ। নাবিদও বলে,

“তুমি আসলেই লক্ষি জরী। ”

আমি লাজুক হাসি। নাবিদ আমাকে প্রশ্ন করে,

“তুমি কখনো কাউকে ভালোবেসেছ?”

“হু। তোমাকে বাসলাম যে। ”

নাবিদ হাসে। বলে,

“এখন আর বাসো না?”

“কিজানি!”

“তুমি ভালো হেয়ালি করে কথা বলতে পারো। দেখে বোঝা যায় না?”

“দেখে কী বোঝা যায়?”

“ভীতুর ডিম, লজ্জাবতী। ”

“আমি শুধু তোমার সঙ্গেই এমন হেয়ালি করি। আর কারোর সঙ্গে করিনি। ”

নাবিদ খানিকটা শাসিয়ে বলে,

“আর কারোর সঙ্গে করার কথা ভাববেও না। ”

“যদি ভাবি?”

“খুন হয়ে যাবে তাহলে। ”

আমি শব্দ করে হাসি৷ আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ও হাসে।

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-০৪

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-৪
মাস পেরোনোর আগেই আমার রান্নাঘরে ঢোকার সৌভাগ্য হলো। আমাকে অবশ্য পরী আপা বুদ্ধি দিলো। রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

“জরী শোন, শ্বশুরবাড়ি মামাবাড়ি না। খেয়েদেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমানো ভালো কথা না। শাশুড়ী এখন কিছু বলছেন না মানে সবসময় ই চুপ করে থাকবে এমন না। তুই আগ বাড়িয়ে কাজ কর।”

আমি আগ বাড়িয়ে টুকটাক কাজ করতে লাগলাম। আলু,পিয়াজ, মরিচ টা কেটে দেই। বোতলে খাবার পানি ভরে রাখি। বিছানা, বালিশ গুলো ঝেড়েমুছে পরিস্কার করি। আম্মা অবশ্য প্রথমদিকে বললেন,

“থাক, তোমার কিছু করা লাগবে না। আর কয়টা দিন যাক। ”

তার গলার স্বরে মনে হয় বলার জন্যই বলা। আসলে সেও চায় আমি তাকে সাহায্য করি।

যেদিন প্রথম রান্নার সুযোগ পেলাম সেদিন আম্মা একটু অসুস্থ ছিলেন। সন্ধ্যে থেকে বিছানায় শুয়ে আছেন। আমিই গিয়ে বললাম,

“আম্মা আজকে আমি রান্না করি?”

আম্মা আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন,

“তুমি রাঁধতে পারো? আচ্ছা করো। আলু সেদ্ধ দাও, আর ভাত করো। আজ সবাই আলুভর্তা আর মরিচ ভর্তা খাবে। আমি রোজ রোজ পারি না।”

আমি তার কথার অবাধ্য হয়ে অনেক কিছু রান্না করে ফেললাম। আলু ভাজা, ঘন করে মসুর ডাল, পেপে দিয়ে মুরগিরর ঝোল, বেগুন দিয়ে একটা তরকারি।

খাবার টেবিলে আম্মা এত পদ দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন,

“এতকিছু তুমি রানলা? ক্যামনে পারলা!”

আমি হাসলাম। রান্নাটুকু হাতে ধরে মা আর চাচিমা’ই শিখিয়েছেন। শুধু রূপ দিয়ে কী আর সংসার চলে! তবে পরী আপা, নিরু আপাদের মতো সেলাই,ফোড়াই শেখার সুযোগ আমার হয় নি। আমি সেই সময় টা কাটাতাম বইয়ের সঙ্গে।

আমার রান্না করা খাবার খেয়ে নাবিদ প্রথমেই বলল,

“জরী রান্না করছে। ওর রান্নার হাত তো ভীষণ ভালো। মাঝেমধ্যে ওরে রাঁধতে দিও মা, তোমারও কষ্ট কম হবে আর আমাদেরও সুবিধা হবে।”

নাবিদের কথা আম্মার মন:পুত হলো না। তিনি আমার সামনে মুখ ফুলিয়ে কপাল কুঁচকে থাকলেও কিছু বললেন না। রান্নাঘরে থালাবাসনের আওয়াজে বুঝলাম যে জড়বস্তুর উপর দিয়েই রাগ টা ঝাড়ছেন।

আমার ননদ কুটিলা রান্না নিয়ে কিছু না বললেও জটিলা বলে ফেলল,

“তোমার রান্না ভালো হইছে ভাবী। মায়ের সামনে বলিনাই। মায়ের রান্নায় তো মাঝেমধ্যে হলুদ এতো দেয় যে মুখেও তোলা যায় না। তার চোপার ভয়ে আমরা তো কিছু বলিও না।”

মুক্তার কথার ধরনে আমি হেসে ফেললাম। ওর সঙ্গে আমার একটু একটু ভাব হচ্ছে৷ একমাস বাদেই ওর পরীক্ষা শুরু। পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছে। অংক ভুলে যায়। সম্পাদ্য আঁকতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে অবস্থা একাকার। আমিই ওকে একটু দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করি। সেই সুবাদেই বোধহয় ও আমাকে একটু পছন্দ করে।

কুটিলা তার স্বভাবেই আছে। সে নিজের মতোই থাকে। এস এসসি দুইবার দিয়েও পাশ করতে পারে নি। প্রথমবার পাঁচ সাবজেক্টে ফেল করার পর দ্বিতীয়বার আবারও পরীক্ষায় বসানো হয়। সেইবার ছয় সাবজেক্টে ফেল করেছে। আম্মা এর পিছনে আর খরচ করতে চান না। ওরও পড়াশোনায় তেমন মন নেই। সাজগোজেই বেশী মন৷

***
দুপুরে খাবার পর সবাই ঘুমায়। টাপুর টুপুর কে অনেক কষ্টে ঘুমের অভ্যাস করিয়েছি। আগে নাকি ওরা ঘুমাতো। ভাবী যাওয়ার পর মেয়ে দুটো আরও বিচ্ছু হয়ে গেছে।

আমার ঘুম হয় না। নাবিদের বইগুলো থেকে বেছে বেছে কিছু বই পড়া হচ্ছে। আজ আর বই নিলাম না। বারান্দায় এমনিই বসলাম। গ্রিল গলে সোনালী রোদ পড়েছে। এই বছর শীতও মনে হয় বেশি দিন থাকবে।

বিয়ের এই একমাসে আমি নিজেকে অন্যরকম ভাবে আবিষ্কার করলাম। আমার মধ্যে এই ঘর, এই সংসারের মানুষ জনকে আপন করে নেয়ার তাড়না আছে। বাপের বাড়িতে আমি প্রায় একাই ছিলাম। অথচ এই বাড়ির মানুষজনের ভালোবাসা পাওয়ার লোভ জন্মে গেছে।

আর নাবিদ! সে এক অন্য মানুষ। আমার বিবাহিত বন্ধুদের কাছে স্বামীর ভালো, মন্দ যে গুণকীর্তন শুনেছি নাবিদ সেদিক থেকে একদম আলাদা। বিছানায় ঘুমানোর সময় মাঝখানে বেশ দূরত্ব থাকে। দুজনের কম্বলও আলাদা। তবুও প্রায় প্রতিদিনই আমার পায়ের কাছের কম্বল ঠিক করে দেয়। কি লাগবে না লাগবে সেদিকেও ভীষণ নজর। তবুও আমার মনে হয় কোথাও কোনো কিন্তু আছে। কিছু অংক সরল মনে হলেও মেলাতে পারি না।

আমার বিয়েটা আচমকা হয় নি। অনেক দিন ধরে কথাবার্তা চলছিল। টেস্ট পরীক্ষার পর চাচাজানের মাথায় ভুত চাপলো জরীর বিয়ে দিতে হবে। আমার মামাশ্বশুর তার পূর্বপরিচিত। তার মাধ্যমেই বিয়ের কথাবার্তা এগোয়। আমার ছবি পাঠানো হয়। ছবি দেখে সবাই পছন্দ করে। কথা হয় একদিন দেখতে আসবে। সব আয়োজন ঠিকঠাক, মা চাচিরা পিঠা বানাচ্ছেন, ঘর গোছাচ্ছেন। এই বৈঠকেই বিয়ে হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।

কিন্তু আসার দুদিন আগেই জানান যে তারা আসতে পারবে না। একটু সমস্যা আছে। কিছুদিন পর জানানো হয় যে ছেলের একটু সময় লাগবে। চাকরি তো বেশীদিন না, হাতে আরও একটু পয়সাপাতি জমুক।

চাচাজান একটু নরম হলেন। আমার পরীক্ষা পর্যন্ত চুপই ছিলেন৷ পরীক্ষার পর আবারও বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। নাবিদ দের ওখান থেকে সরাসরি কিছু বলে না। অন্য জায়গায় সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে। এরমধ্যে আমার মামাশ্বশুর গিয়ে জানালেন যে তার ভাগ্নের জন্য এই মেয়েই চাই।

আমাকে সেদিন মুক্তাও বলল,

“মায়ের ইচ্ছে ছিলো শহুরে মেয়ে আনার। কিন্তু ছোট্ট ভাই বলল জরীর সঙ্গে বিয়ে না হইলে সে আর কাউকেই বিয়ে করবে না। ”

চলবে….

লাজুকপাতা পর্ব-০৩

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-৩
নাবিদ দের বাড়িটা পুরোনো আমলের। তিনতলা বাড়ি। একতলা আর তিন তলাটা ভাড়া দেয়া। দোতলায় নাবিদ রা থাকে। আমার শ্বশুর আরামপ্রিয় লোক। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়ি আর একখানা দোকান ছাড়া নিজে কিছুই করে উঠতে পারেন নি। সেই আরামপ্রিয় স্বভাব পেয়েছেন আমার ভাসুর জামিল

বাড়িতে আসার দুদিনের মধ্যেই টের পেলাম আমার শাশুড়ী রাগী মানুষ। তার মেজাজ সম্ভবত সবসময় ই খারাপ থাকে। তার কাছ থেকে তার বড় ছেলে আর বউয়ের গল্প শুনলাম।

জামিল ভাই মানে আমার ভাসুর বিয়ে করেছিলেন ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে। তখন তেমন কিছু করতেন না। অথচ ভাবী বেশ অবস্থাপন্ন ফ্যামিলির মেয়ে। বিয়ের পর পর ভাবী জমজ সন্তানের জন্ম দিলেন। দুটো ফুটফুটে দুষ্ট মেয়ে। ওদের নাম টাপুর টুপুর। আর ভাবীর নাম টুম্পা। টাপুর, টুপুরের বয়স এখন পাঁচ। জামিল ভাই এখনো কিছু করেন না। আজ করব, কাল করব বলে পাঁচ টা বছর কাটিয়ে দিলেন। উল্টো ভাবীর টিউশনির টাকা নিয়ে বাইরে খরচ করে বেড়ান।

মাস দুয়েক আগে চূড়ান্তরকম ঝগড়া করে ভাবী বাড়ি ছাড়েন। আমার বিয়ের আগের দিন জামিল ভাইকে তালাকনামা পাঠিয়েছেন। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন যে টাপুর টুপুর এর দায়িত্ব সে নিবে না।

***
এই বাড়িতে দুটো সপ্তাহ কাটিয়ে ফেললাম। নাবিদ একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যায়, ফিরে সন্ধ্যেবেলা। সন্ধ্যেবেলা যখন ফিরে তখন তার মেজাজ থাকে বিক্ষিপ্ত। আমাকে আম্মা শিখিয়ে দিয়েছেন নাবিদ এলে যেন শরবত, তোয়ালে এগুলো এগিয়ে দেই। প্রথম দিন শরবতের গ্লাস দেখে নাবিদ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

“এই শীতে কেউ শরবত খায়?”

আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। পরের দিন চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম। দারুচিনি, এলাচি দিয়ে চা। সেটা দেখে আগের দিনের মতো কপাল কুঁচকে বলল,

“এখন চা খেলে ভাত কখন খাব?”

আমি গতদিনের তুলনায় আরও দ্বিগুণ বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। নাবিদও কেমন যেন অন্যচোখে তাকিয়ে থাকে কিছুসময়।

**
এই বাড়িতে নাবিদ আর জামিল ভাই ছাড়া আর একটা ফোন আমার আম্মার কাছে থাকে। সেই ফোনে মা আর পরী আপা একদিন পর পর ফোন করেন। আম্মা সামনেই থাকেন বেশীরভাগ সময়। মা ফোন করেন, কেমন আছস! কি দিয়া ভাত খাইছ! জামাইর সাথে সব ঠিক আছে। মায়ের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি লজ্জায় পড়ে যাই। আম্মা বিরক্ত হন সম্ভবত। এখনো ওনার রাগ কিংবা মেজাজ আমার সঙ্গে দেখান নি। তবে অন্যদের সঙ্গে দেখিয়েছেন। বিশেষ করে মনির সঙ্গে।

মনি মুক্তা দুজনের আমি আলাদা নাম দিয়েছি। মনির নাম কুটিলা আর মুক্তার নাম জটিলা। মুক্তার নাম জটিলা দেবার কারণ হলো ওরও প্রায় সময়ই নাবিদের মতো কপাল কুঁচকানো থাকে। সামনেই এসএসসি পরীক্ষা। দিন রাত পড়াশোনা করে। মাঝরাতেও গুনগুন করে পড়ার শব্দ পাই আমার ঘর থেকে।

আর মনির নাম কুটিলা দেয়ার কারণ হলো ওর স্বভাব। কোনো এক বিচিত্র কারণে ও আমাকে পছন্দ করছে না। ওদের সঙ্গে ভাব করতে গিয়েও আমি বিশেষ পাত্তা পাই নি।

এই বাড়িতে যাদের সঙ্গে আমার গলায় গলায় ভাব হয়েছে তারা হলো টাপুর টুপুর। কী যে দুষ্ট বাচ্চা দুটো। আমার শাশুড়ী সামলাতে গিয়ে অস্থির হয়ে যায়। ওদের সঙ্গে আমার ভালোই ভাব হয়েছে। ওরা আমার ঘরে এসে হুটোপুটি করেও আনন্দ পায়, আমারও তেমন খারাপ লাগে না।

***
আমার ঘর টা ছোট। তবে ছোট্ট একটু বারান্দা আছে। ঘরে মাঝারি সাইজের দুজনের ঘুমানোর মতো খাট, আলমারি আর একটা টেবিল। টেবিল টা অবশ্য নাবিদের। সেখানে ওর কম্পিউটার, চার্জার, বইপত্র এসব থাকে। ওর কালেকশনে বেশ ভালো বইও আছে। অলস দুপুরে কিছু করার না থাকলে তখন বই পড়া হয়।

নাবিদের সাথে আমার সম্পর্ক এখনো অতটা আন্তরিকতার না। আমি চেষ্টা করি সকালে উঠে চা’টা করে দেবার। চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে নাবিদ প্রতিদিনই বলে,

“এতো সকালে ওঠার তো দরকার নেই জরী। তুমি ঘুমাতে।”

এই বাড়িতে সকালের খাবারে ভাত হয়। পাতলা মসুর ডাল, আলুভর্তা আর ডিম। একটা ডিম কে তিন ভাগ করা হয়। নাবিদ যাওয়ার সময় বক্সে করে ভাত নিয়েও যায়। গতরাতের তরকারি থেকে একটু তরকারি আর ডাল।

রান্নাবান্না আম্মা করেন। একটা দুটো তরকারির বেশী করেন না। তরকারিও প্রায় দিন একইরকম। কাজের একজন লোক আছে। সে এসে কাপড় ধোঁয়া, ঘর মোছা, থালাবাসন ধোঁয়া এগুলো করেন।

আমাকে এখনো কোনো কাজ আম্মা করতে দেন নি। কিছু করার কথা বললেও বলে,

“আর কয়টা দিন যাক। নাইলে তো বাপের বাড়িতে মোবাইল কইরা বলবা যে শাশুড়ী এরমধ্যে ঘরের কাজে লাগাই দিছে। ”

আমিও আর কিছুতে যাই না। আমার শ্বশুর মুখচোরা মানুষ। তিনি আমার সঙ্গে অতো সহজ হতে পারেন নি। একটু দূরে দূরে থাকেন।

জামিল ভাই সকালে খেয়ে বেরিয়ে যান আর রাতে ফিরে নি:শব্দে খেয়ে ঘুমাতে যান। তবে তাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমাকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করেন,

“জরী ঘুমাও নাই? আসলে একটু কাজ ছিলো বুঝলা… একটা কাজের কথা চলতেছে। আল্লাহ চাইলে একটা বন্দোবস্ত হবে।”

আমি স্মিত হাসি। মনে মনে বলি, আল্লাহ সব সহজ করে দিক। টাপুর টুপুরের মা ফিরে আসুক। মেয়েদুটো আক্ষেপ নিয়ে বড় না হোক।

***
প্রায় পনেরো দিন পর নাবিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার কিছু লাগবে?”

আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,

“কী?”

“কিছু লাগবে কি না!”

আমার তখন পরী আপার কথা মনে পড়ে। আপা বলেছিল পড়াশোনার ব্যাপারে কথা বলতে। কিন্তু আমি বলতে পারি না। আমার ভয় হয়।

নাবিদ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে কী ভাবে কে জানে! আলমারি থেকে চারটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে হাতে দেয়। বলে,

“এটা রাখো। ”

আমি লাগবে না বলতে গিয়েও বলতে পারি না। যন্ত্রের মতো টাকাটা নেই। নাবিদ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ ফিরে এসে বলে,

“তুমি পড়তে চাও আরও? ”

আমি তাকিয়ে রইলাম। নাবিদ আমার প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায় আছে। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

“তোমার আপা বলল। তুমি নাকি ভয়ে বলতে পারছ না। এতে ভয়ের কি আছে! আজব তো!”

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-০২

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-২
(কপি করা নিষেধ।)
রাতে আমার ঘুম হলো না। সারাদিনে আমার অতোটা ভয় লাগে নি যেটা এখন লাগছে। কেমন যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। ঠিক বোঝানো যায় না। সকাল শুরু হলো টুংটাং আওয়াজে। এই বাড়িতে আজও ভোর থাকতে থাকতে চুলায় রান্না চাপানো হয়েছে। আমাকে বিয়ে করা রাজপুত্তুর এখনো ঘুমিয়ে আছে। আমি বিছানা ছাড়লাম। এলোমেলো শাড়ির খসখস আওয়াজ আর হাতভর্তি চুড়ির টুংটুং শব্দে রাজপুত্তুরের কপালে ভাজ পড়লো। ভোরের আলোয় ভালো করে দেখা হলো। গায়ের রঙ অনেক ফর্সা না। শ্যামলা চেহারা, মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল, ডানদিকের ভ্রু’র কোনায় কাটা দাগ। খুব বেশী রোগা না। চলনে-বলনে খানিকটা সিনেমার নায়কদের মতো। পরী আপা সেই কারণে বোধহয় রাজপুত্তুর বলেছে। আমার কাছে তো কোনোদিক দিয়েই রাজপুত্তুর লাগছিল না। ওনার নাম নাবিদ। চার ভাইবোনের মধ্যে উনি মেজ। এরপর দুজন ছোট বোন আছে। মনি, মুক্তা ওদের নাম। দুজনের সঙ্গে কাল আলাপ হয়েছে। বয়সে আমার থেকে খানিকটা ছোট।

দরজা খোলা দেখে পরী আপা আমাকে ডাকলো।

“জরী, উঠছস?”

আমি শব্দহীন ভাবে বাইরে গেলাম। আপা চোখ কপালে তুলে বললেন,

“আরে বেকুব, এই শাড়ি পরে ঘুমাইছস!”

আমি স্মিত হাসলাম। পরী আপাকে আর বলিনি যে আমি ঘুমাই নি।

আপা নতুন শাড়ি বের করে দিলেন। একরঙা খয়েরী সুতি শাড়ি। আপা বললেন,

“ব্যটা মানুষ বিয়ের বাজার করছে বুঝছস। রঙচঙ ভালো বুঝেনা। ”

মা এলেন আমার কাছে। তাকে বেশ নির্ভার লাগছে। খুশি হয়েছেন নাকি বেজার হয়েছেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মা জিজ্ঞেস করলেন,

“কী খাবি?”

“কিছু না।”

“একী কথা, কিছু খাবি না ক্যান! ”

পরী আপা আমার হয়ে বলে,

“তুমিও না মা! ও তো কিছু খাইতে চাবে না! জানো না, টেনশন হইলে ও কিছু খাইতে পারে না। ”

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বলেন,

“জামাই ঘুমাইতেছে?”

“হু।”

“সহজ হইতে একটু সময় লাগবে। ঢাকার বড় কলেজে পড়ছে। আমাগো মতন তো না। ”

আমি চুপ করে রইলাম। মা আবারও বলেন,

“ওই বাড়িতে গিয়ে মানায়ে নিস। কারোর মুখের উপর কথা বলবি না, শ্বশুর শাশুড়ী যেমন বলবেন তেমন চলবি। বাড়ির যেন বদনাম না হয়। কেউ যেন আঙুল তুলতে না পারে। তোর চাচাজানের মান যেন না যায়।”

মায়ের গলা শুনে মনে হচ্ছে আমাকে বোঝাচ্ছে না, ভয় দেখাচ্ছে। আমি চুপ করে রইলাম। পরী আপা আমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে দিচ্ছেন। যেকটা ভালো জামাকাপড় ছিলো সেগুলো ব্যাগে গুছিয়ে দিচ্ছেন। মা আপার উদ্দেশ্যে বললেন,

“বেগুনি রঙের জামা টা ব্যাগে রাখিস না। অরুর জন্য রাখ। ওর ওই জামা টা পছন্দ। ”

পরী আপা বলেন,

“অরুরে তুমি এই রঙের জামা কিনে দিও মা। এইটা জরীর থাকুক।”

মা আর কিছু বলেন না।

**
আমার যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। পলাশবাড়ী ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো কিছুক্ষনের মধ্যেই। দাদার আমলে তৈরী করা এই ঘরে আমার নিজের বলে তেমন কিছু ছিলো না। রুম, পড়ার টেবিল থেকে শুরু করে সবকিছুই অরু কিংবা নিরু আপার সঙ্গে ভাগ করতে হতো। এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানেও একজনের সঙ্গে ভাগ করতে হবে। তার সঙ্গে আমার ভালো করে আলাপও হয় নি।

আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছেন পরী আপা। সঙ্গে গোল হয়ে বসে আছে অরু আর ফুপুর মেয়েরা। মা, চাচিমা ব্যস্ত আছেন মিষ্টি, পিঠেগুলো গোছাতে। পরী আপা অতি যত্নে চোখে কাজল পরিয়ে দিচ্ছেন। পলক ফেলে তাকাতেই দেখি আপার চোখে পানি। আপা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,

“আজ রাতে নাবিদ যদি তোরে জিজ্ঞেস করে কী চাস তাইলে বলবি যে তুই আরও পড়তে চাস। তোর আরও পড়ার ইচ্ছা।”

আমি হাসি। আপা বলেন,

“একবার বইলা দেখিস। এই সংসারে তো চুপ কইরাই থাকলি। ওইখানে গিয়া অন্তত মুখ ফুঁটে নিজের শখ, আহ্লাদ গুলো বলিস।”

আমি আবারও হাসলাম। আমার এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে গত সপ্তাহে। প্রিন্সিপাল স্যার বাড়িতে মিষ্টি পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে চাচাজানকে বললেন,

“এই মেয়েকে পড়ান, ও যতটুকু পড়তে চায়। ”

চাচাজান অতোটা গুরুত্ব দিলেন না। তার তাড়া ছিলো অতি জলদি আমার বিয়ে দেবার। ততদিনে আমিও বুঝে গেছি সুন্দর হবার খানিকটা জ্বালাও আছে।

***
মা হাপুস নয়নে কাঁদেন। পরী আপা অরু এরাও কাঁদে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম চাচিমাও কাঁদছেন। আমার দুই ননদ কে চাচিমা বলছেন,

“ওরে একটু দেইখো। ও তো এর আগে ঢাকায় শুধু বেড়াইতেই গেছে। ”

চাচাজান আমার মামাশ্বশুর কে বলেন,

“মেয়েটা ভারী লক্ষি। তবুও ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।”

আমি ভেবেছিলাম আমার খারাপ লাগবে না। কিন্তু ভীষণ খারাপ লাগছে। শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো। সবচেয়ে বেশী কষ্ট হলো বাবার চোখে পানি দেখে। এই মানুষ টা’কে সারাজীবন আমি নির্লিপ্ত মুখচোরা মানুষ হিসেবে জেনেছি। সংসারের মারপ্যাঁচ যে বোঝেনা। মেয়েদের সাথে বিশেষ কথাবার্তা বলে না। মাঝেমধ্যে লুকিয়ে এটা সেটা কিনে এনে নিশ্চুপে হাতে গুজে দিয়ে যায়।

জীবনে প্রথমবার আমি উপলব্ধি করলাম যে এই সংসারের মানুষজন আমায় ভালোবাসে। সারাজীবন তিনটি মেয়ে নিয়ে অভিযোগ করে গেছেন যে মা সেই মায়ের চোখের জল আমাকে বুঝিয়ে দিলো ভালোবাসা।

***
পলাশবাড়ী থেকে ঢাকার দূরত্ব আট, নয় ঘন্টার মতো। আমার মামা শ্বশুর জানালেন যে পৌছাতে বিকেল হবে।

আমাদের যাবার ব্যবস্থা হলো গাড়িতে। লক্কর ঝক্কর টাইপের গাড়ি। বিকট শব্দে মাথা ধরে যায়। অন্যরা অবশ্য ট্রেন ধরলো। গাড়িতে আমি, নাবিদ আর আমার মামাশ্বশুর।

২০১৩ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর আমি পলাশবাড়ী ছাড়লাম। সেই সঙ্গে ছেড়ে গেলাম জীবনের অসংখ্য ভালো, মন্দ স্মৃতি।

***
আমার শ্বশুর বিয়েতে যেতে পারে নি। বাড়িতে বিশাল অঘটন ঘটে গেছে। সেই অঘটনের খবর পেলাম পথেই। শাশুড়ী মা বরন করে ঘরে তুললেন। আত্মীয় স্বজন রা সবাই এসেছে বউ দেখতে। সেই সঙ্গে বাড়ি থেকে কী দিলো, না দিলো সেসব নিয়েও গুঞ্জন হলো খানিকক্ষণ। শাশুড়ী মা চাপা গলায় বললেন,

“আমাদের কিছুর দরকার নাই। নাবু’র জন্য আমার দরকার ছিলো সুন্দর বউয়ের। আর কিছু লাগবে না। এমনিতেই বড় ঘরের মেয়ে একবার এনে কম জ্বলতেছি না। ”

আমার দুই ননদ কে বাড়িতে বসে তেমন দেখার সুযোগ পাই নি। এখন সঙ্গেই আছে। দুজন পিঠেপিঠি। আমাকে এটা সেটা এগিয়ে দিলো। বলল, কিছু লাগলে যেন ডাকি।

বাড়িতে ঢোকার পর নাবিদ কোথায় যেন গেল। গাড়িতে বসে আমার সঙ্গে ভালোভাবেই কথা বলেছে। গতকালের মতো কঠিন গলায় কিছু বলে নি। স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি ঠিক আছ?”

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

“গাড়িতে উঠলে তোমার মাথা ঘুরে?”

আমি চুপ করে রইলাম। আমি গাড়িতে জার্নি করতে পারি না। অল্প কিছুক্ষনের পথ হলেও খারাপ লাগে।

“জরী তোমার কী খারাপ লাগছে? ”

আমি এবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

নাবিদ মামাকে ডেকে বললেন,

“মামা পানির বোতল টা দেন তো। জরীর খারাপ লাগছে, গাড়িটাও একটু আস্তে চালাতে বলেন।”

এই বাক্য দুটো আমি কোনোদিন ভুলে যেতে চাই না। সারাজীবন মনে রাখতে চাই।

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা

লাজুকপাতা পর্ব-০১

0

লাজুকপাতা
#পর্ব-১
সাবিকুন নাহার নিপা

উঠোনের দক্ষিন কোনে বড় হাড়িতে রান্না চাপানো হয়েছে। এলাকার বিখ্যাত বাবুর্চি মজনু মিয়া রান্নার তদারকি করছেন। ডেকোরেটরের লোকজন বাড়ি সাজাতে ব্যস্ত। ছোট বাচ্চাগুলো রঙিন কাগজের ফুল গুলো আঠা দিয়ে লাগানো হচ্ছে। বৈঠকখানা পেরিয়ে মূল দরজার উপরে কাগজ কেটে লেখা হয়েছে,

‘জরীর বিয়ে।’

আমার নাম জেরিন জাহান জরী। বয়স বিশ। তবে আমার মা কারো কাছে বলার সময় দুই বছর কম করে বলেন। মেয়েদের নাকি সঠিক বয়স বলতে নেই। আমি এইবার পলাশবাড়ী কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করেছি। কলেজের গন্ডি এক বছর আগেই পাড় হবার কথা থাকলেও হয় নি। ঠিক পরীক্ষার আগে টাইফয়েড বাঁধিয়ে হাসপাতাল ঘুরে আসতে হলো।

ঘরের পরিবেশ ভীষণ থমথমে। চাচাজানে’র সামনে এক থালা পেপে রাখা, কিন্তু তিনি ছুঁয়েও দেখছেন না। আমাদের বাড়িতে সকালে সবাই চা খায় শুধু চাচাজান বাদে। তার পাশে ভাবলেশহীন মুখে বসে আছেন বাবা। খানিক দূরে বেতের চেয়ারে বসে আছেন আমার দুই ফুপা। বিয়ে উপলক্ষ্যে সবাই এসেছেন। রান্নাঘরে একটু আগে হাসাহাসি, গল্প গুজবের শব্দ ছিলো। এখন কেমন সব ঠান্ডা। আমি ঘড়িতে সময় দেখলাম। সাতটা বেজে বিশ মিনিট। বারান্দায় পাতা বিছানাগুলো এখনো তোলা হয় নি। সবার চা খাওয়া হয়ে গেছে। বিয়েবাড়ি বলে সবাই সকাল সকাল ই উঠে পড়েছে। শুধু আমাকেই কেউ ডাকে নি।

“ও জরী উঠছস? দুই পিস পিঠা খাবি? গরম গরম খা ভাল্লাগবে।”

“আপা কিছু কী হইছে? কেমন যেন লাগতেছে! ”

পরী আপা একটু থতমত খেয়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন,

“কি হইবে? তোর ঘুম কেমন হইছে? দেখি, তোর মেহেদীর রঙ কেমন হইছে?”

পরী আপা আমার হাত উল্টে পাল্টে দেখে পিঠা আনতে ছুটে গেলেন। আপা আমার নিজের ই বোন। আমরা তিন বোন। পরী আপা, আমি আর অরু। অরু ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশোনায় মোটামুটি টাইপ হলেও পড়ায় আগ্রহ নেই। গম্ভীর মুখ করে বলে,

“এতো কষ্ট করে, উপপাদ্য সম্পাদ্য গুলো পড়ে কি লাভ গো মেজপা। এগুলো তো আর সংসারের কাজে লাগবে না। ”

অরুর এইসব বোকা বোকা কথায় চাচিমা আর নাজু ফুপু সায় দেন। মা ভীষণ হতাশ হয়।

***
পরী আপা পিঠা আনতে গিয়ে কোথায় হারালেন কে জানে! বেশ ভালো শীত পড়েছে। গায়ে চাদর চাপিয়ে পুকুর পাড়ের দিকে গেলাম। বর্ষায় এই পুকুরে জল থই থই করলেও এখন পানি নেই বললেই চলে।

চিরচেনা জগত ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে আজ। পলাশবাড়ীতে আমার অনেক সুন্দর সুখকর স্মৃতি আছে। এরপর বছরান্তে হয়তো পলাশবাড়ীতে আসা হবে পরী আপার মতো।

“মেজপা চাচাজান ডাকছেন। শিগগিরই আয়।”

আমাদের ঘরের প্রধান হলেন চাচাজান। আমার বাবার বড় ভাই। চাচাজানের দুই ছেলে আর দুই মেয়ে। বড় আপার বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে৷ বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেন। সেই দুলাভাই এর সঙ্গেই নিরু আপার বিয়ে হলো। কী বিশ্রী ব্যাপার! নিরু আপা কত কান্নাকাটি করলো। এক রাতে আমাকে উঠিয়ে বলল,

“এই জরী শোন, আমি গলায় ফাঁস দিবো। ওই দাড়িওয়ালা মুশকো ব্যটাকে আমি জীবনেও বিয়ে করব না। ”

নিরু আপা ফাঁস নিলো না। কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। নাইওর যখন এলো তখন বেশ হাসিখুশি। সবাই কে ডেকে গল্প করছে। কে কি গয়না দিলো সেসবের গল্প।

**
চাচাজান কে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। তার আশেপাশে এখন কেউ নেই। আমাকে দেখে বলল,

“এতো শীতে বাইরে গেছ ক্যান? বাইরে যাওয়া ঠিক হয়নাই। ”

আমি চুপ করে থাকি।

“একটা ঘটনা ঘটছে। পাত্রপক্ষের একটা সমস্যা হয়ে গেছে। ”

আমি চাচাজানের দিকে তাকালাম। তিনিও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সে বললেন,

“তোমার শ্বশুর জানিয়েছেন যে তাদের একটু সমস্যা হইছে। কিছু একটা ঝামেলায় আছে। তাদের আসতে দেরি হইতে পারে। আজকে না আসাও হইতে পারে। তবে ভয়ের কিছু নাই, বিয়া এইখানেই হবে ইনশাআল্লাহ। ”

আমি জানালা দিয়ে উঠোনের দিকে তাকালাম। মজনু মিয়া বড় হাড়িতে গরুর মাংস কষাতে ব্যস্ত। ঝাঝ, গন্ধে খিদে পেয়ে গেল। গরম এক প্লেট ভাত, আর ঝোল ঝোল গরুর মাংস সঙ্গে একটা কাঁচামরিচ!

চাচাজান আমার মাথার উপর হাত রাখলেন। আমি চমকে উঠলাম। আমার কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। না কোনো দু:খবোধ আর না কোনো ভয়। আমি হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে আছি। মেহেদীর রঙটা দারুণ হয়েছে।

***
আমার মায়ের নাম হাসিনা বেগম। বাপের বাড়িতে তার আদুরে ডাকনাম হাসু। মায়ের ভাইয়েরা তাকে হাসু আপা বলে ডাকেন। মামাবাড়ির অবস্থা মোটামুটি ধরনের। তবে ভাইদের সঙ্গে মায়ের বনিবনা তেমন হয় না। আমার মা তার ভাইদের আঙুলের এক কড় পরিমান ছাড় দেন না। তার ভাষ্যমতে বাপের বাড়িতে বাপ, মা না থাকলে সব পর। এই পৃথিবীতে যত দু:খী মানুষজন আছে তাদের মধ্যে একজন আমার মা। প্রথম কারন হলো তার তিনটি মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। আর দ্বিতীয় কারণ হলো আমাদের বাবা।

আমার বাবার নাম আজিজ শিকদার। দাদার আমলে চালের আড়ত ছিলো। চাচাজান সেটার দেখাশুনা করা। বাবা এককালে ক্যাশবাক্সে ছিলেন। এখন সেখানে দখল দিয়েছে অন্য লোক। চাচিমা’র ছোট ভাই মনা মামা। বাবার তেমন কাজ নেই। হাটবারে বাজার করা আর টুকটাক ফরমায়েশ খাটা ছাড়া। মায়ের সাথে এই নিয়ে অশান্তির শেষ নেই। বাবা গো বেচারা মানুষ। সংসারের সাত পাঁচে সে মাথা ঘামায় না। ডাল ভাত,লেবু আর একটা তরকারি মিশিয়ে মহা আনন্দে এক থালা ভাত শেষ করেন। মাছের লেজের কাছের টুকরো টা কেন তার জন্য রাখা হলো এই নিয়ে কখনো অভিযোগ করেন না। বরং সেই মাছের টুকরোটা ছোট মেয়ের জন্য রেখে দেন। বাবা আমাদের তিন বোনের মধ্যে পরী আপাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আর মা অরুকে।

***
বাড়ির থমথমে পরিবেশ ঘন্টাখানেকের বেশী থাকলো না। তারপর সবাই আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কে কী সাজবে, বাচ্চাগুলোর হুটোপুটি, পিঠে বানানোর তোড়জোড়। নিরু আপা আমার বিয়েতে আসে নি। আপার বাচ্চা হবে। এই অবস্থায় নদী পাড় হওয়া অমঙ্গল বলে আপার শাশুড়ী আসতে দেন নি৷

মা আর পরী আপা ভীষণ টেনশন করছেন। তারা ধরেই নিয়েছেন যে পাত্রপক্ষ আসবে না। চাচাজান ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে ভুলিয়ে রাখছেন। শেষমেস একজন কে ধরে এনে বিয়ে দেবে।

এই ভাবনা হলে হতেও পারে সেটা আমিও বুঝি। চাচাজানের কাছে মান সম্মানের কাছে আর কোনো কিছুই বড় নয়। তাছাড়া সংসারে বাবার জোরও খানিকটা কম। এই নিয়ে মা আর পরী আপার চিন্তার শেষ নেই।

***
পাত্র পক্ষ এলেন সন্ধ্যেবেলা। একুশ জন আসার কথা ছিলো সেখানে তেত্রিশ জন এসেছে। চাচিমা আর ফুপু ফিসফিস করে কিছুক্ষন গালমন্দ করলেন। আমার দুই ফুপু চাচিমাকে খুব তোয়াজ করে চলেন। চাচিমা সংসারের কর্ত্রী বলে কথা। আমার বিয়েতে চাচিমা তেমন খুশি নয়। শুনেছি চাচাজান কে বলেছেন,

‘নিজের মেয়েরে কোথায় বিয়া দিলেন! আর পরের মেয়েরে ঢাকায় বিয়া দিতাছেন!”

চাচাজান হুংকার দিয়ে বলেছেন,

“নিজের, পরের আবার কিসের সব শিকদার বাড়ির মেয়ে।”

***
টুকটুকে লাল রঙের বেনারশী শাড়ি আনা হয়েছে আমার জন্য। সেই সঙ্গে কিছু বনেদি গয়না। মা আর পরী আপা ভীষণ খুশি। বড়ফুপু উল্টেপাল্টে গয়না দেখছেন। চাচিমা সবকিছু ভালো করে দেখতে লাগলেন। যা দিয়েছে মন্দ দেয় নি। তবুও গুজগুজ ফিসফিস চলতে লাগলো। কানের দুলটা পুরোনো আমলের। চকচক করে না। হাতের চুড়ি দুটো ভীষণ হালকা স্বর্ন কম।

পরী আপা আমাকে সাজালেন। নিজেই বারবার বলছে,

“কী সুন্দর লাগতেছে রে জরী! কী সুন্দর! ”

আমার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। ভয়,শঙ্কা, লজ্জা সব মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি।

অবশেষে বিয়ে পর্ব সমাপ্ত হলো। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। কাল ঢাকার উদ্দেশ্যে আমাকে নিয়ে রওনা হবে। বিয়ে শেষ হবার পর আমার কেমন খালি খালি লাগতে শুরু করলো। না! এই ঘর, ঘরের মানুষের জন্য আমার খারাপ লাগছে না। কিন্তু কেমন একটা হাহাকার করা অনুভূতি।

***
পরী আপা আমাকে বলেছিল,

“রাজপুত্তুরের মতো বর খুঁজে এনেছেন চাচাজান। তোর কপালে রানি হওয়া ছিলো যে!”

স্বামীর সঙ্গে আমার দেখা হলো বাসরঘরে। আমার চাচাতো, ফুপাতো ছোট ভাই, বোনগুলো মিলে কতো যত্নে ঘর সাজিয়েছিল! কিন্তু ওনার তা পছন্দ হয় নি। বললেন,

“এর মধ্যে ঘুমাবো কিভাবে? ”

আমি খাট থেকে নেমে বললাম,

“পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”

“দ্রুত করো।”

শুতে গিয়ে বললেন,

“আমি কম্বল তোমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারব না কিন্তু। ”

“আচ্ছা।”

আর কোনো কথা হলো না। মিনিট দশেকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো। এই সুযোগে আমিও সাহস করে রাজপুত্তুর কে দেখে ফেললাম!

চলবে….

মিঠা রোদ পর্ব-৭০ এবং শেষ পর্ব

0

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:শেষ পর্ব(একাংশ)
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“মায়ান আজ চলে যাচ্ছে।তুমি কী ওর সাথে দেখা করবেনা তাহিয়া?”

আসিফের প্রশ্নে ভ্রুঁ কুঁচকে তাঁকালো তাহিয়া।গম্ভীর সুরে বলল,

“ওনার সাথে দেখা করতে হবে কেন?আমাদের সম্পর্ক নেই।”

“এরপর জীবনে কখনো নাও দেখা হতে পারে।আমি শুনেছি মায়ান দীর্ঘ সময়ের জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।”

তাহিয়ার মুখ বিবরে কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটলো না।বরং অদৃশ্য হাসি খেলে গেলো যেন।কিছু জিনিস প্রতিক্রিয়া জানানো মানুষ বন্ধ করে দেয়।মায়ানও সেরকম কেউ।আসিফ আরাম করে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,

“সারাজীবন তাহলে একা থাকবে?”

“আশ্চর্য।এখন আমি নানী হয়ে গিয়েছি।তো একা থাকবো না?”

“তা ঠিক।একা থাকা আসলে খারাপ নয়।বরং ভালো বলা চলে।এক আলাদা ধরণের এনার্জি পাওয়া যায়।”

“আপনি চাইলে জীবনসঙ্গী গ্রহণ করতে পারতেন।”

“একটা সময় পর মন উঠে যায় তোমার কথাটা বললাম।তোশা কেমন আছে?মরিশাসে ছুটি কেমন কাঁটাচ্ছে?”

“ভালো।সকালে ফোন করেছিলো একবার।মেয়েটাকে এতো খুশি কখনো আমি দেখিনি।”

“তুমি রাজী হলে কেন বিয়েতে?যেহেতু প্রথম থেকে মানতে নারাজ ছিলে।”

“আহনাফের জন্য।আমি বিষয়টা কাওকে বলিনি।”

একটু উশখুশ করতে লাগলো তাহিয়া।তবুও ছোট্ট করে বলল,

“আহনাফ একদিন আমার অফিসে এসে অনেক কান্নাকাটি করেছে।যদিও এটা নিয়ে আমার বাচ্চাটা অনেক লজ্জায় ভুগে এখনও।তোশার সাথে বুঝলেন আসিফ ভাই আমি কতোগুলো নতুন কথা বলার মানুষ পেয়েছি।এরমধ্যে সবার প্রথমে ছোট শাহ একজন।”

“তোমাকে এখন অনেক হাসিখুশি লাগে।ঠিক যেমন তেইশ চব্বিশ বছর পূর্বে লাগতো।ছোট্ট খরগোশের মতোন।”

“আপনার আমাকে সেসময় কেমন লাগতো সব মনে আছে?”

“মানুষ সব মনে রাখতে সক্ষম নয়।কিন্তু বেশীরভাগ মনে আছে।তুমি যেভাবে কথা বলতে যেভাবে হাসতে সবই।মায়া খুব কঠিন জিনিস বুঝলে।সেটা এক জীবন হলেও কাঁটানো যায়না।”

প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য তাহিয়া বলল,

“আপনাকে ইদানীং সুন্দর লাগে দেখতে আসিফ ভাই।মেয়েরা এমনি ভোট দিয়ে দিবে।”

“তুমি ভালোভাবে কথা ঘুরিয়ে নিতে জানো।তবে একথার জবাবে বলবো আমাকে সবথেকে বেশী ভোট পুরুষেরা দিবে।”

তাহিয়া হেসে ফেললো।ফাইল থেকে মনোযোগ সরিয়ে বলল,

“আসিফ ভাই সকলে আমাকে খুব জাজ করে মেয়ের বিয়ে নিয়ে।কিন্তু জানেন এখন খারাপ লাগেনা।বরং মনে হয় মাথার উপর শক্তিশালী এক অভিভাবক আছে।”

“শুনো তাহিয়া মন যেটা বলবে জীবনে ঠিক সেটা করা উচিত।এবং মন তুমি কোথায় কম্ফোর্টেবল বোধ করো সেই জায়গা চিনিয়ে দিবে।জীবন নিয়ে আর কোনো আক্ষেপ আছে?”

“নেই।”

“আচ্ছা তাহলে উঠি আমি তাহিয়া।”

“সে-কি?এখুনি কেন?”

“ধরে নাও কথা শেষ।”

আসিফকে একটু উশখুশ করতে দেখা গেলো।ধীর কণ্ঠে বলল,

“আমার তোমাকে কিছু বলার ছিল তাহিয়া।কিন্তু বলবো না।”

কৌতুহলী তাহিয়া কিছুক্ষণ সফেদ ত্বকের ব্যক্তিটির পানে তাঁকিয়ে রইলো।উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,

“যে কথার জবাব আমাদের কাছে থাকে না।সেকথা বোধহয় না বলা ভালো আসিফ ভাই।আমাদের মন একটা সময় তিক্ততায় ভরে যায়।যেখানে মিষ্টতাকে গ্রহণ করতে ভয় অনুভব হয়।যদিও সেটা উপকারী কিংবা সুফল বয়ে আনা হোক না কেন।”

“ভালো থেকো তাহিয়া।”

“আপনিও।”

আসিফ অবর্ণনীয় ভাবে হেসে ফেললো।তার গমন পথে তাঁকিয়ে থাকতে তাহিয়ার চোখ দুটো ভরে উঠলো।সে চাইলে জীবনের অন্য পথ অবলম্বন করতে পারতো।কিন্তু এক্ষেত্রে মন কেন মানছেনা?তাহিয়া জানেনা।

(***)

তোশার ঘুম ভাঙলো একলা রুমে।নিভন্ত দৃষ্টিতে সে চারিধার দেখলো।কোথাও কবীর নেই।হুট করে উঠে বসলো সে।ঘুম ছুটে যেতে মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেলো।কম্পমান কণ্ঠে শুধালো,

“কবীর শাহ!কবীর শাহ!কোথায় আপনি?”

কিন্তু জবাব নেই।রুমের লাগোয়া বারান্দায় ভালো করে দেখে মূল দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো তা বাহির থেকে লাগানো।জোরে জোরে তা শব্দ করলো তোশা।

“কবীর শাহ?”

হঠাৎ কী হলো মেয়েটির শক্তি পাচ্ছে না।দরজাতে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লো।ফোনের কাছে গিয়ে কল করবে সেই শক্তিও পাচ্ছে না।মনে হচ্ছে সব অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে।অকস্মাৎ পিঠে চাপ অনুভব করলো।সূর্যের অনুরুপ উজ্জ্বলতা নিয়ে উঁকি দিলো কবীর।তোশার কান্নারত মুখ দেখে শুধালো,

“কী হয়েছে বেলাডোনা?তুমি কাঁদছো কেন?”

“আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন?জানেন কতো ভয় পেয়েছিলাম আমি।”

তোশা জড়িয়ে ধরলো কবীরকে।নাকটা বুকে ঘষে বলল,

“আমার মনে ভয় ঢুকে গিয়েছে।”

“কোনো ভয় নেই।আমি একটু বাহিরে গিয়েছিলাম।তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”

“আমার জন্য?সেটা কী?”

“সেটা তো সময় হলে জানবে।এখন তৈরী হবে।আমরা বীচে যাবো।”

“দারুণ কিছু আছে আমার জন্য?”

“অনেক দারুণ কিছু।”

তোশা উচ্ছাসিত হয়ে অতি দ্রুত তৈরী হতে লাগলো।যেন চড়ুই পাখি।কবীর ভেবে পায়না মেয়েটা কে সে কীভাবে ভালোবাসবে।এখনও এতোটা বাচ্চা।

“আমি তৈরী কবীর শাহ।দেখেন তো কেমন লাগছে?সুন্দর না?”

ছোট বাচ্চার মতোন পোশাকের এক পাশে ধরে ঘুরে দেখালো।হলুদ রঙা পোশাকে মেয়েটাকে দারুণ লাগছে।চেহারার উজ্জ্বলতা শতগুণে বেড়ে গিয়েছে যেন।কবীর হুট করে তোশার দিকে গভীরভাবে তাঁকালো।এক আশংকায় চমকে গেলেও তা ফিরিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ।নিজেও তৈরী হওয়া শেষ করে প্রিয়তমা স্ত্রীর কপালে চুমো খেলো।

“চলো যাওয়া যাক।”

তোশার হাতটা ধরে তাকে নিয়ে সী বীচে এলো কবীর।দুজনের চোখে মুখের ভালোবাসার গান ভেসে বেড়াচ্ছে।হুট করে তার চোখ দুটো হাতের সাহায্য আঁটকে দিলো কবীর।

“সারপ্রাইজকে এভাবে দেখতে হয় বেলাডোনা।ভয় নেই আমি তোমার চোখ হয়ে আছি।”

“একদম সিনেমার মতোন সবকিছু করছেন।”

“বলতে পারো।”

উল্লেখিত এক জায়গায় এনে কবীর তোশার চোখের সামনে থেকে হাত সরালো।চারিধার পানসে হলদে আলো ও নানা ফুল দিয়ে সাজানো।

“সী-বীচ ডেট বেলাডোনা।খুব সাধারণ কিন্তু আমি তোমার জীবনে সব সাধারণ ও অসাধারণকে একত্রে এনে দিবো।”

তোশার চারিধার মুগ্ধ হয়ে দেখলো।তার চোখে পানি এসে গিয়েছে।কবীরের বুকে মাথা রেখে বলল,

“অনেক সুন্দর।এই সারপ্রাইজের কথা বলছিলেন?”

“জি।একটু সময়ে এতোটা পসিবল হয়েছে।”

“তাও দারুণ।”

কবীরকে ছেড়ে তোশা এগিয়ে গেলো সফেদ কাপড়ের আড়ালে থাকা টেবিলটির দিকে।যেখানে একটি রেড ভেলভেট কেক রাখা।তোশা হঠাৎ কোনোকিছু চিন্তা না করে তা খেতে লাগলো।কবীর হেসে বলল,

“তোমার কী খুব খুদা লেগেছে?আমি ডিনার ডেকে দিচ্ছি।”

“ঠিক আমার নয়।তর্নির খুদা লেগেছে।”

“তর্নি?”

“আপনি চিনেন ওকে তামাটে পুরুষ।”

কবীর কিছুক্ষণ দ্বিধা নিয়ে তাঁকিয়ে রইলো।তোশা শুধালো,

“বুঝলেন না তো?”

“না।তবে নাম শোনা মনে হচ্ছে।”

“আসলেও মনে নেই?”

কবীর ঋণাত্মকবোধক মাথা দুলালো।এরপর তোশার মনে হলো সে বিষয়টা নিয়ে বোধহয় খুব কম কবীরের সাথে আলাপ করেছে।একটু কেঁশে বলল,

“আমার মায়ের নাম তাহিয়া।তার যখন মেয়ে হলো তখন রাখলো তোশা।সেই তোশার যখন মেয়ে হবে নাম কী হবে তার?তর্নি।ইশ,আপনি কিছুই বুঝেন না।”

“কিন্তু তুমি তো প্রেগনেন্ট নও?কিংবা…।”

তোশার মুখে ফুল ফোঁটার হাসি ফুটে উঠলো।সামনের চেয়ারে বসে সমানতালে কেক খেয়ে চলেছে সে।ফিসফিস করে বলল,

“আমাদের বিয়ের তিন মাস অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে কবীর শাহ।”

কবীর বুঝতে পারছে না ঠিক কী বলবে?এ সময়টা তার জীবনে দ্বিতীয়বার এলো।কিন্তু দুজন ভিন্ন নারীর সাথে।কিন্তু অনুভূতি তো ভিন্ন নয়।সেই শব্দ ভুলে বসার অনুরুপ শূন্যতা।কবীর অবাক হয়ে তোশার সামনে বসে বলল,

“কিন্তু আমাদের কথা হয়েছিল এটা নিয়ে।”

“আমি আপনার কথা কবে শুনেছি বলুন তো?আমার একটা ছেলে আছে।বলবেন না ছোট।হুহ আই এম এ বিগ গার্ল।এন্ড এ ভেরি গর্জিয়াস ওয়াইফ।আমি জানি আপনি অনেক খুশি লাফাতে হবেনা।”

তোশার ব্যবহার এখনও অনেকটা বাচ্চা ধরণের।কবীর হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো তার সামনে।হাত দুটো ধরে বলল,

“আমি ঠিক কী বলবো সেকথা জানিনা।কিন্তু আমি অনেক খুশি।”

“তাহলে বড় করে হাসেন।আমি না কবীর শাহ অনেক বড় ফ্যামিলি তৈরী করবো।এরপর আমাদের নতুন বাড়ীটাতে সকলকে নিয়ে থাকবো।আমাদের ছেলের বিয়ে হবে।মেয়ের বিয়ে হবে তাদের বলবো পরিবার অনেক বড় করে তুলতে।”

“সেই অবধি আমি বেঁচে থাকবো?”

“আরে থাকবেন তো।বাকীটা শুনেন…।”

তোশা চেয়ার থেকে নেমে কেক নিয়েই মাটিতে বসে পড়লো।এতোক্ষণে অর্ধেক তার পেটে।কবীরের মুখোমুখি বসে জীবন নিয়ে তার সমস্ত আলাপকে বলে দিচ্ছে একদমে।যেখানে আছে শুধু প্রাপ্তির মেলা।কবীরকে ঠিকঠাক ভাবে মেয়েটা নতুন বাবা হওয়ার অনুভূতিও জাহির করতে দিলো না।সে নিজ খেয়ালে বলে চলেছে।

“তোশা আস্তে এতো কথা নয়।আমি বুঝেছি তোমার অনেক প্ল্যান।কিন্তু নিজের হেলদ কন্ডিশন দেখে তো…।”

“আমি সুস্থ তো কবীর শাহ।আপনাকেও শক্তিতে হারিয়ে দিতে পারবো।”

“আচ্ছা?তবে হবে নাকী একবার।মনে আছে একদিন হারিয়ে দিয়েছিলাম।”

“এখন আমরা দুজন।এক মিনিট খাওয়া শেষ করি।”

কেকের বাকী অংশ দ্রুত খাচ্ছে তোশা।হ্যামেস্টারের মতোন গাল গুলো ফুলে গেলো।হুট করে থামিয়ে বলল,

“আমি তো একবার আপনাকে সাধলাম না।ব্যাপার না আমি খেয়ে ফেলি।ইয়াম্মি জিনিস একটু খেলে পেট খারাপ হয়।”

উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো কবীর।তোশার এমন উল্টোপাল্টা কথাগুলো সে আগে থেকে ভালোবাসে।এ কথাগুলোই তো তার মনে ছাঁপ সৃষ্টি করে গিয়েছিলো।কপালে আঙুলের ছোঁয়া দিয়ে বলল,

“তুমি আমাকে দিতে চাওনা সেটি হলো আসল কথা।”

“ঠিক ধরেছেন।এতে রাগ করলে করুন।কিন্তু ইদানীং আমার সব খেতে ভালো লাগে।মনে হয় ওইযে আকাশের চাঁদটাকে খেয়ে ফেলবো।”

“ওয়েল।তাইতো তুমি কয়েকদিন ধরে খুব খাও।আর আমি বোকা খেয়াল করিনি।যদিও একটু আগে রুমে তোমার পেটটা দেখে মনে হয়েছিল।”

“ব্যাপার না।এখন প্রত্যেক বছর একই এক্সপিরিয়েন্স পাবেন।আমি সিরিয়াস।চলুন খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে।শক্তির পরীক্ষা হবে।”

কবীরের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে তোশার।মাথার উপর চাঁদ পাশে মৃদু গর্জন করা সমুদ্র এ লড়াইয়ের দর্শক।তারা কার পক্ষে আছে?একবার জানতে ইচ্ছা হলো তোশার।কিন্তু পূর্বের অনুরুপ সে এবারও জিততে সক্ষম হলো না।

“এটা কী হলো?আমি হেরে গেলাম।”

“যা হলো তাই হওয়ার ছিল।কবীর শাহ এর সঙ্গে তার বেলাডোনা কখনো জিততে পারবেনা।”

“আমার রাগ হচ্ছে কিন্তু।”

“করো রাগ।আমি তাঁকিয়ে তাঁকিয়ে দেখি।”

তোশা সত্যি রাগ করলো।হেঁটে ঠান্ডা বালুতে বসে সমুদ্র দেখতে লাগলো।মেয়েটার বাচ্চামো তে কবীর মুগ্ধ হয়।অবশ্য মন বলল এটা তো সেই ছোট্ট মেয়েটা।সে খাবার আনতে বললে তা কিছুক্ষণের মধ্যে দিয়ে গেলো।তোশার পছন্দ মতোন পদ নিয়ে কবীর তার পাশে গিয়ে বসে বলল,

“চাঁদ পরে খেলেও চলবে।আপাতত এটা নাও।নাকী রাগ করে থাকবে?”

“রাগ আপনার সাথে?কখনো সম্ভব নয়।আমি একটু ভাব নিলাম।”

হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে এবার খাওয়ার আগে কবীরকে খাওয়ালো।পুরুষটি বিদ্রুপ করে বলল,

“ভাগ্যিস দিলে।কিন্তু আমার সাথে খুব কম রাগ করো তুমি।”

“আপনি এতো সুন্দর কবীর শাহ রাগ করে থাকা দুস্কর।ঠিক ওই সমুদ্রের মতোন।”

কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে অন্য কোনো আলাপ হয়না।নিশ্চুপ খেতে খেতে সমুদ্র দেখতে থাকে।

“কবীর শাহ,আমি একসময় ভাবতাম আমাদের পথ শেষ।আর কখনো দেখা হবেনা।শাহবাগে একসময় পানি ছুঁড়ে মে’রে’ছিলাম।মনে আছে?”

“আছে।সেদিন তোমাকে প্রায় চার বছর পর দেখেছিলাম।সত্যি বলতে আমি কখনো ভাবিনি মেয়েটা ওই মাধ্যমে জীবনে ফিরে আসবে।”

“আমিও না।পরবর্তী তে অপ্সরার সঙ্গে প্ল্যান করে আপনাকে ভালোবাসায় ফেলতে চেয়েছিলাম।দেখেন তো আমাদের কোনকিছু ঠিকঠাক হয়নি।কোনো প্ল্যান কাজে লাগেনি কিন্তু আমরা একসাথে আছি।”

“থাকার কথাটাও ছিল।”

প্লেটটা একপাশে রেখে মাটিতে শুয়ে পড়লো তোশা।অনুকরণ করে কবীরও শুয়ে পড়লো।তার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো তোশা।হঠাৎ বিভ্রম হলো।তারা দুজন ভিন্ন।আলাদা রুপে এই সমুদ্রের কিনারাতে শুয়ে আছে।এক সুন্দর মিঠা রোদ দুজনকে ভাসিয়ে চলেছে।তাদের মুখে স্মিত হাসি।যা বর্ণনা করা দুস্কর।তোশা ফিসফিস করে বলল,

“আমরা সব রুপে,সব সময়ে শুধু একে অপরের।আপনি বেলাডোনার বাজপাখি।এবং শুধু তার বাজপাখি।”

কল্পনাতে মিঠা রোদ আরো উজ্জ্বলিত হয়ে চারিধার আলোকিত করতে লাগলো।

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:শেষ পর্ব(বাকী অংশ)
#লেখা:সামিয়া খান প্রিয়া

“গল্পটি আমার নয়।আমাদের ছিল।যেখানে তোশা তার তামাটে পুরুষকে একান্ত নিজের করে পেয়েছিলো।”

“পেয়েছিলো?কথাটি তে অতীতকাল কেন?কবীর শাহ এখন কোথায়?”

প্রশ্নের ফলে তোশা মিষ্টি করে হাসলো।নিজের আর্লি থার্টিসেও সে ঠিক যেন মোলায়েম পদ্ম।কপালের সামনের চুলগুলো সরিয়ে বলল,

“আমার সাথে আছে।অতীতকাল নয়।কিন্তু আশ্চর্য কী জানেন?সে থেকেও নেই।অথবা আমাকে বুঝতে পারেনা।এখনও যখন আমাদের দেখা হয়,কথা হয় তার চোখে থাকে একরাশ বিস্ময়।দৃষ্টির প্রশ্নগুলো কিন্তু আমি অনুধাবন করতে সক্ষম।সে মনে মনে কী বলে জানেন?”

“কী?”

“এই নারীটি তার খুব চেনা।কিন্তু সে চিনতে পারেনা।যেমনটা তাঁকিয়েছিল প্রথমবার তাকে ভালোবাসি বলার সময়।চোখে অবর্ণীয় রুপকথা।সেভাবে তাঁকায়।আমাকে যখন সবার সামনে কবুল বলে নিজের করেছিলো তখনও চোখে এমন বিস্ময় ছিল।”

“আপনাদের তর্নি জন্মেছিল?”

“হাঁ।আজ থেকে চৌদ্দ বছর পূর্বে।এখন সে কিশোরী।মা বলে ঠিক আমার মতোন।স্বপ্নবিলাসী, বোকা, সরল মনের।তার সবথেকে প্রিয় ব্যক্তি হলো নিজের ভাই।”

“তাহলে আপনাদের বিশাল পরিবারের চিন্তা?”

“কবীর শাহ এর সাথে আমার সেই ডিলটা চলেনি।কিন্তু তর্নি ওয়াদা করেছে।সে একদিন পূরণ করবে।”

সামনের ব্যক্তিটি নিশ্চুপ হয়ে গেলো।তোশা চোখে একরাশ মায়া নিয়ে পরবর্তী প্রশ্ন শোনার অপেক্ষায় আছে।এ কথাগুলো সে রোজ বলে এই ব্যক্তিকে।একই প্রশ্ন ও জবাব ফিরে আসে।কিন্তু তাও তোশা ক্লান্ত হয়না।অবশেষে মৌনতা ভেঙে বলল,

“আপনাদের কী বিচ্ছেদ হয়েছে?”

“না।এমনটা কখনো হওয়ার নয়।”

“তাহলে আপনার কথাতে কেন মনে হয় আপনারা কাছে থেকেও নেই?”

প্রশ্নটির সঙ্গে আঁধার নেমে এলো।এখন সন্ধ্যার সময়।শীতের কুয়াশায় চারিধার ভরে গিয়েছে।তোশা উষ্ণ শ্বাস ফেলে ব্যক্তিটির গায়ে চাদর জড়িয়ে বলল,

“ভেতরে চলুন কবীর শাহ।আপনার ঠান্ডা লাগবে।”

ব্যক্তিটি বিস্ময়ে শুধালো,

“আমি কবীর শাহ?”

“আপনি কবীর শাহ।”

কবীর এতোক্ষণে তোশার দিকে তাঁকালো।যে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু চোখদুটোতে কতো না বেদনা লুকিয়ে আছে।তবে এ ভাবনাও হয় কবীর নামের ব্যক্তিটি এই সুন্দর দেখতে নারীকে কীভাবে পেলো?কিন্তু সে নিজেই তো কবীর।কিছু মনে হচ্ছে না কেন?

“কী ভাবছেন তামাটে পুরুষ?ভেতরে চলুন।তর্নি ও আহনাফ অপেক্ষা করছে।”

“আমার জন্য?”

একদম বাচ্চার অনুরুপ প্রশ্ন।তোশা আস্তে করে বলল,

“সবার আপনার জন্যই অপেক্ষা।”

কবীরের হাতটি শক্ত করে ধরলো তোশা।মানুষটি হয়তো মনের দিক থেকে উদাসীন।কিন্তু আজও সেই কঠিন শিলার অনুরুপ দৃঢ় ও সুগঠিত।কুয়াশা গুলো তাদের উপর বৃষ্টি হয়ে ঝড়ছে।তাদের জীবনে মিঠা রোদের ক্ষণস্থায়ী আভাস তো হয়েছিল।এখন ঝড়ের সময় চলছে।হয়তো আবার একদিন ছোট করে সেই পানসে হলুদ রঙ ধরা দিবে।

পরিশিষ্ট:

“শুনেছি আমার জন্মের অনেক আগে মা নাম রেখেছিলো তর্নি।তিনি নাকী আমাকে স্বপ্নে দেখেছিলো।আমি জন্মের এতো আগে আম্মুকে সিগন্যাল দিয়েছিলাম?ভাবতে অবাক লাগে।আম্মু বলে আমি খুব দুষ্ট।তবে শাসন করেন না।তাছাড়া আম্মু নিজেও এখনও নানুর কাছে ব” কা খায়।আমি আসাতে বলে নানুর সাথে তার সম্পর্কের বদল ঘটেছে।আগে বকতো না।কিন্তু এতো বড় বয়সে তাকে শাসন করে।আমি অবশ্য সেটা মনে করিনা।নানু,নানা,আসিফ নানা,দাদা,দাদু, বাবা ও আহনাফ ভাইকে নিয়ে তর্নি শাহ দুনিয়া।সবথেকে সুন্দর, সবথেকে মেধাবী মেয়ে আমি।কবীর শাহ এর সবথেকে মূল্যবান বস্ত।জীবনে কাওকে অপছন্দ করিনা।একজন গ্রহণ কে ছাড়া।তাকে গ্রহণ বলার কারণ হলো আমার জীবন পার্ফেক্ট ছিল।সেখানে এসে সব এলেমেলো করে কেন দিলো?ভাইয়ের ওই বন্ধুটাকে আমি ভীষণ অপছন্দ করি।সত্যি কী তাই?

আম্মু বলে আমি যখন জন্ম নিলাম সেদিন নাকী অনেক বৃষ্টি হয়েছিলো।প্রাণের ঢাকা শহর প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল প্রায়।আমার মনে হয় আম্মু ভুল বলে।এতোটাও কী বৃষ্টি হয়েছিল?কিন্তু আমার সেরা বাবা যে আমাকে কোলে নিয়ে কেঁদে দিয়েছিল সেই দৃশ্য সত্য।কতোবার যে আমি ভিডিওটি দেখেছি।

আমি আমার মায়ের মেয়ে।সবকিছুতে সেরা।কিন্তু মনে হয় কোথাও একটা কষ্ট আছে জীবনে।আমার ছোট্ট এই শরীরটাতে কতো দায়িত্ব কেউ জানেনা।আমার নানু কে আসিফ নানার সাথে বিয়ে দিতে হবে।মায়ান নানার মাথায় করা নতুন হেয়ার ট্রান্সপ্লান্টটা নষ্ট করতে হবে।বৃষ্টি আপুর সাথে কল্লোল মামার বিয়ে দিতে হবে।আমার মনে হয় এরা সিক্রেট প্রেমিক-প্রেমিকা।তা নয় একই হসপিটালে থেকে অভিমানে কথা বলে না কেন?আবার দিশা মামুনির কাছেও ঘুরতে যেতে হবে ভার্জিনিয়ায়।তিনি নাকী এখন দারুণ কেক বানাতে পারে।আহনাফ ভাইয়ের জন্য মেয়েও তো খুঁজতে হবে।সে বলে বিয়েকে ভয় পায়?বিয়ে ভয়ের জিনিস নাকী?আমি জানি এসব বোকা কথা ওই তার বিশেষ বন্ধুটি ঢুকিয়েছে।একদিন অপছন্দের ভাইয়ের বন্ধুটাকে বিয়ে করে প্রতিশোধ নিবো আমি।সে যতো বলুক আমি ছোট।থোড়াই মানবো তা?

তবে সবথেকে সেরা যে কাজটি করতে হবে সামনে আম্মু-আব্বুর বিবাহ বার্ষিকী তে আবারও তাদের বিয়ে দেওয়া।যারা রোজ প্রেমে পড়ে তাদের একবার মাত্র বিয়েতে হয় নাকী?

আমার বান্ধুবীরা বলে তর্নি, “তোমার সবথেকে প্রিয় জিনিস কী?”আমি তাদের ফিসফিস করে জবাব দেই,”আমার বাবার সেই গোপন চিঠিটা যেটা আমার মা সবসময় লুকিয়ে রাখে।কিন্তু আমি চুরি করে ফেলি।”

এজন্য কতো বকা খেতে হয় কেউ জানেনা।আমার দিনের একটা সেরা মুহুর্তে আছে।ঠিক সন্ধ্যার সময়।যখন বাবা রোজকার মতোন নিজেকে ভুলে যায় এবং মা তাদের কাহিনী বলে।বেলাডোনা ও বাজপাখির কাহিনি শোনায়।তখন তার মুখের উজ্জ্বলতার সামনে বোধহয় সব মলিন হয়ে যাবে।মোট কথা কবীর শাহ এর মেয়ে তর্নি শাহ এর জীবনে সবকিছু দারুণ পার্ফেক্ট।”

ডায়ারি তে নিজের কথাগুলো লিখে উঠে দাঁড়ালো তর্নি।লিখতে লিখতে হাত ব্যাথা হয়ে গিয়েছে তার।সন্ধ্যা নামছে দেখতে পেয়ে দ্রুত জানালার কাছটায় এলো।তার মা অতি সন্তপর্ণে বাবাকে নিয়ে রুমে ফিরে আসছে।এই তীব্র ভালোবাসায় তার বুকটা ভরে উঠে।ইশ, সে যদি তার মায়ের মতোন প্রেমিকা হতে পারতো।

গোপন জায়গা থেকে চিঠিটা বের করলো তর্নি।তার বাবার শেষবার সজ্ঞানে মা কে বলা কথাগুলো।সে সহস্রবার পড়েছে।আবার পড়তে লাগলো,

প্রিয় বেলাডোনা,

আমি জানি এ চিঠিটা যখন তোমার কাছে পৌঁছাবে তখন কিছু খারাপ হয়ে যাবে আমার সাথে।কানাডার এক হসপিটালে বসে কথাগুলো লিখছি।সামনে বলার সাহস নেই।হবে কীভাবে?মায়ান যখন আজ ডক্টরের রিপোর্ট পেলো তখন থেকে কাঁদছে আড়ালে।চোখ মুছে এসে অবশ্য সে ভাব প্রকাশে বিরত রেখেছে।দেখেছো কী পাগল তোমার বাবা?আমি হয়তো ওকে ভুল বুঝেছিলাম।কিন্তু মায়ান সেই চিরবন্ধুর মতোন সারাজীবন রয়ে গেলো।

আমার সমস্যা কী জানো বেলাডোনা?ফ্রান্সিসকো এতোদিন সেক্রেটারির মাধ্যমে স্লো পয়জন দিয়ে গিয়েছে।আমি বিষয়টা যখন জানলাম তখন দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা করলাম।এ কারণে কানাডায় এতোটা নিয়মিত যাতায়াত ছিল।কিন্তু বোধহয় দেরী হয়ে গিয়েছিলো।জানে বেঁচে গেলেও কিছু একটা হবে।হয় আমি পুরোপুরি কোমায় চলে যাবো তা নয় প্যারালাইসিস।কিন্তু সবথেকে খারাপ হবে আমি নিজের অতীত ভুলে যাবো।সব স্মৃতি ভুলে যাবো।আমি এটা চাইনা।কিন্তু জীবনে এতো সুখ পেয়েছি যে বোধহয় এটা হবে আমার সাথে।তুমি ভয় পেওনা।ফ্রান্সিস্কো কিংবা আমার সেক্রেটারির ব্যবস্থা আমি করে গিয়েছি।শুধু তুমি ভালো থাকবে।আমার দেওয়া অনেক গুলো দায়িত্ব তোমার উপর এসে পড়লো।এতে কী তুমি আমাকে ঘৃ”ণা করবে?

লিটল চেরী তুমি আমার জীবনে সেই সময় এসেছিলে যখন আমি বোধহয় যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।সেখানে ফুল হয়ে ধরা দিলে।আমি খুব কম প্রকাশ করতে পারি এই বিষয়টাতে।তবে তোমাকে ধন্যবাদ কবীর শাহ এর জীবনে আসা।

একটা অনুরোধ রাখবে?আমি যদি সব ভুলে যাই রোজ আমাকে মনে করিয়ে দিবে?বোধহয় তুমি দিবে।

আমাদের শেষ কথা হয়তো এটা বেলাডোনা।আমি তোমার সাথে থাকবো কিন্তু আগের মতোন নয়।আমার ডাকটা আগের মতো থাকবেনা।আমাদের সংসারটা আগের মতো থাকবেনা।কিন্তু একসাথে থাকবো।এটা কী বেশী আনন্দের?স্বস্তির?তর্নি ও আহনাফকে দেখে রাখিও।ওদের নিজের মতো করে বড় করবে।এবং তাহিয়াকে বলিও ও অনেক দারুণ মা সঙ্গে বন্ধুও।আসিফ ভাইকে একবার যেন জীবনে আসার অনুমতি দেয়।বাবা,মা,আহনাফ,বৃষ্টি, ভাই, ভাবী ও দিশার জন্য আলাদা চিঠি আছে।তুমি পৌঁছে দিও।

আমার কিশোর বয়সে পত্রের প্রচলন ছিল।তখনকার মতোন এ চিঠিরও শেষ লাইন টেনে দিলাম লিটল চেরি।আমি তোমাকে সব রুপে,সব সময়ে কাছে চাই বেলাডোনা।জানি খুব স্বার্থপর।চেয়ে গেলাম কিন্তু দেওয়া হলো হলো না তেমন।

ভালো থেকো
তাইয়ুবা চৌধুরী তোশাকে কবীর শাহ এর ভালোবাসা।

(সমাপ্তি)

মিঠা রোদ পর্ব-৬৮+৬৯

0

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৬৮
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আমার ছেলের মন ভে’ঙে মেয়েকে এতো বয়স্ক কারো কাছে বিয়ে দিচ্ছো।কল্লোল তোশাকে ভালোবাসে বিষয়টা কী কখনো বুঝতে পারো নি?”

নিজ ভাবীর কথায় তাহিয়া একটু দমে গেলো।সে জানতো না কল্লোল তোশাকে ভালোবাসে।তাছাড়া জানলেও বিশেষ কোনো উপকার বোধহয় ছিলনা।মুচকি হেসে তাই বলল,

“কল্লোলের জন্য লাল টুকটুকে বউ আনবো আমরা ভাবী।এসব বলো না।দুটো বাচ্চার এই বিয়ের অনুষ্ঠানে মন খারাপ হবে।”

“বলিনি তো কখনো।আজ ক্ষো’ভ থেকে বললাম।হ্যাঁ কবীর দেখতে সুন্দর।তোশার সাথে ভালো মানায়।কিন্তু খেয়াল করেছো দুজনের শারীরিক গঠণ কতোটা ভিন্ন?কবীরকে লাগে দৈ’ত্য আর তোশাকে ছোট বাচ্চা।”

“ভাবী আমি তোশার মা। এসব আমার সামনে বলো না।কিন্তু হয়েছে কী?”

“কল্লোল কাল কাঁদছিলো।আজ তোশার গায়ের হলুদ।কিন্তু একবারও দেখেছো রুম থেকে বের হতে?”

“দেখিনি।আমি ওর সঙ্গে কথা বলে নিবো।”

“দরকার নেই।এতে আরো ছেলেটা কষ্ট পাবে।তুমি বরং নিজের মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করো।সন্তান তো আমারও আছে ভাই।তাই বলে যাই চাইবে তাই কেন দিবো?”

তাহিয়া নিস্তেজ কণ্ঠে জবাব দিলো,

“আমি তোশাকে দেখে আসছি।”

চট জলদি ভাবীর চোখের আড়ালে চলে গেলো সে।পুরো বাড়ীতে নানান ধরণের মেহমান এসেছে।সবার চোখেমুখে এক কথা হেসেখেলে বেড়াচ্ছে।তাহিয়াকে যেই একটু একা দেখছে ওমনি কথাটা বলে দিচ্ছে।বোধহয় সারাজীবন বলবে।এসব কিছু মলিন হয়ে যায় যখন হাতের কাজ ফেলে প্রত্যেকবার তোশার রুমে গিয়ে মেয়েটাকে দেখে সে।কী সুন্দর লাগছে।বিয়ের রঙ লেগেছে যে।তাহিয়ার কান্না পায়।তার এমন গায়ের হলুদ হয়েছিলো না।কিন্তু সকলে বিয়ের পর বলতো কাঁচা হলুদের রঙ ফুঁটেছিলো তার চেহারাতে।আজ তোশার বাবা হয়ে মায়ান হয়তোবা এ বাড়ীতে এসেছে।নিজের কর্তব্য পালন করে চলেছে।মায়ের অবাক করা দৃষ্টিতে তোশার দৃষ্টি মিললো।সে বান্ধুবীদের মধ্যে বসে থেকে শুধালো,

“কিছু বলবে আম্মু?”

“হ্যাঁ।একদম কম সাজবে কিন্ত।আমার মেয়ে এমনি সুন্দর।”

তোশা হাসলো।সে বুঝতে পারে এটা মায়ের দৃষ্টির কথা না।তাহিয়া বিনা বাক্য ব্যয় করে মেয়ের মুখে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে চলে গেলো।অপ্সরা দুদিন আগে থেকে তোশাদের বাড়ীতে এসেছে।সে হাঁফ ছাড়ার মতোন করে বলল,

“ভাগ্যিস তোদের বিয়ে আগে হয়েছে।তা নয় আমি এখনও সন্দেহে থাকতাম।তামাটে পুরুষটি পাছে মত বদলে ফেলে।”

“না না।সে কখনো নিজের ওয়াদা ভুলে না।”

“ভুলবে কীভাবে?একদম যুবতী পাচ্ছে।সেটা দেখতে হবে না?আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমাদের খুশি দেখে।”

তোশার দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোন কথাটি বলল।বাক্যটিতে গভীর বিদ্রুপ বিদ্যমান।তোশা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

“আমাদের খুশি দারুণ না?সকলে অবাক হয়।”

“একদম খুব দারুণ।দেখছি তো।”

রুমের পরিবেশ বদলে গেলো।তোশা খেয়াল করছে তার দাদীর বাড়ী থেকে আগত মানুষের থেকে নানীর বাড়ীর লোকেরা বেশী কথা শুনিয়ে যাচ্ছে।সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।কবীর নিষেধ করে দিয়েছে।সকলের থেকে উঠে নিজের ফোনের সন্ধান করলো।কবীরের সাথে অনেকটা সময় কথা হয়না।স্ক্রিন অন করে দেখতে পেলো উল্লাস এসএমএস করেছে।সে প্যারিসে একটি ফ্যাশন শো উপলক্ষে চলে যাচ্ছে।বিয়েতে আসতে পারবেনা।তোশার আরো খারাপ লাগলো এতে।সে জানে তাহিয়া বিয়েতে রাজী হওয়ার পিছনে উল্লাসের অবদান সবচেয়ে বেশী।সে আহনাফকে নিয়ে তাহিয়ার কাছে গিয়েছিলো।এরপর কীভাবে মানিয়েছে তা কেউ বলে না।উল্লাসকে সারাজীবন মনে রাখবে তোশা।এলেমেলো উল্লাস।হয়তোবা তার ভিন্ন কাহিনী, ভিন্ন গল্প আছে।কিন্তু তোশার নিকট সে প্রাণবন্ত জীবন।

(***)

“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

কান থেকে হেড ফোন খুলে নিলো কল্লোল।এখন সন্ধ্যার সময়।তোশাকে হলুদ দিতে কবীরের বাড়ী থেকে মানুষ এসেছে।সকলের সঙ্গতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো দেখে কল্লোল ছাদে একা বসে ছিলো।বৃষ্টিকে এখানে দেখে কৌতুহলী হয়ে বলল,

“হ্যাঁ কী বলবে?”

“আমি আপনাকে ভালোবাসি।প্লিজ বিয়েটা আঁটকান।আমি আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।কখনো না।প্লিজ সিনিয়র।”

বৃষ্টি এগিয়ে গিয়ে কল্লোলের হাত ধরে ফেললো।আলো অন্ধকারে চোখ অশ্রুত টলমল করছে।

“হাত ছেড়ে কথা বলো বৃষ্টি।বিয়েটা আমার নয়।তোশা ও…”

সম্বোধনে আঁটকে গেলো কল্লোল।বৃষ্টি শক্ত কণ্ঠে বলল,

“কী বলে ডাকবেন?ভাই,আঙকেল?নাকী দুলাভাই?বলুন তো আপনি।জানি জবাব নেই।দেখুন তো দুটো মানুষ নিজেদের খুশির জন্য সকলের মনে কষ্ট দিলো।”

“কোথায়?প্রায় সকলে তো খুশি।”

“না।আমি না।তাদের বিয়ে হয়ে গেলে আমাদের কিছু সম্ভব না।”

“আমাদের কী কিছু হওয়ার কথা ছিল?তুমি ভালোবাসি বললে।আমি বলিনি।”

“তো কী?এরেঞ্জ ম্যারেজ হতো।তাহিয়া আন্টি আমার মা কে বলেছিলো।সব শেষ হলো ওদের জন্য।আপনি বিয়েটা আঁটকান।”

“থামো বৃষ্টি।শান্ত হও।”

বৃষ্টির নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে।কল্লোল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,

“আমি তোশাকে ভালোবাসি।সেটা এখন থেকে না।যেদিন থেকে মন নারীদের চিনতে শুরু করেছে।তোশা ও কবীর স্যারের সাথে সম্পর্কের কথা আমি অনেক দিন ধরে জানি।কিন্তু কখনো কাওকে বলিনি।চাইলে আমি বহু ছলের আশ্রয় নিতে পারতাম।কিন্তু এতে সুফল কী বলো?তোশা আমাকে ভাই হিসেবে মানে।আমি নিজে সুখী হতে গিয়ে ওদের যেখানে সম্পর্কের নাম আছে।দুটো মানুষ একে অপরের প্রতি লয়্যাল সেটা কেন ভা’ঙ’বো?আর তোমার আমার সম্পর্ক হতে গেলে এখনও কোনো বাঁধা নেই।কিন্তু আমি নিজে আগাবো না।”

“কেন?”

“অনুভূতি থাকতে হয় বৃষ্টি।যা নেই।তাছাড়া আমার জন্য কেন তোশা কষ্ট পাবে?ভালোবাসা পেতে হবে এটা বৃথা কথা।তবে তখুনি জোর করে পাওয়া প্রযোজ্য হয় যখন ভালোবাসার মানুষের ক্ষ” তি হয়না এতে।”

“এভাবে সরাসরি আমাকে বললেন যে পছন্দ করেন না?যদি পরিবারের দিক থেকে হয়?”

“আমি বলতে পারবো না বৃষ্টি।অথবা ভাবতে চাইনা।তুমি নিচে চলে যাও।এমন কথা অন্য কাওকে বলো না।”

বৃষ্টির পুরোপুরি মন ভে”ঙে গেলো।সে যাকে পছন্দ করে এতোদিন নিজের বাবাতুল্য চাচার কাছ থেকে অসন্তুষ্টি পেয়েছে।ভালো বন্ধুকে হে”য় করেছে সে তার কথাগুলোর দাম অবধি দিতে নারাজ?এটা কী ভীষণ খারাপ নয়।অভিমানে, দুঃখে সে দ্রুত নিচে নেমে গেলো।পিছন ফিরলে দেখতে পেতো যে কল্লোল এতোক্ষণ নিজের উদারতার কথা বলছিলো সেই ব্যক্তিরও মন ভেঙেছে।কল্লোল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোশাকে সে হলুদ লাগাবেনা।থাক না অনুভূতি গুলো আড়ালে।নতুন মানুষ আসবে তখন আপনা-আপনি সব ঠিক হয়ে যাবে।

(***)

অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত হয়ে গেলো।তোশা আজ তাহিয়ার সাথে ঘুমিয়েছে।সারাদিন ক্লান্ত থাকার দরুণ তাহিয়া গভীর ঘুমে মগ্ন।ধীর পায়ে পাশ থেকে উঠে এলো তোশা।পাছে কেউ যদি জেগে যায়।সবকিছু ঠিকঠাক দেখে দ্রুত বাগানে চলে এলো।যেখানে সরু দন্ডায়মান গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কবীর।অন্ধকার ছিল না পরিবেশে।তাই তোশা সব লাইট অফ করে এসেছে।কবীর ইশারাতে তোশাকে ডাকলো।

“আপনি ইদানীং খুব মুভির হিরোদের মতোন রোমান্টিক হয়ে গিয়েছেন।হলুদের দিন দেখা করতে আসতে হয়।”

“দেখো লিটল চেরী।আমি মুভির হিরো নই।বরং সাধারণ মানুষ।বউকে দেখতে মন চাইলো এসেছি।ভয় নেই আমি হলুদ সঙ্গে আনিনি।ওসব লাগাবো না।”

“তো কেন এলেন?”

“নিজেদের ব্যাচেলর লাইফের শেষ মুহুর্ত একসাথে অতিবাহিত করার জন্য।হ্যাঁ মানছি আমার দ্বিতীয় বিয়ে।কিন্তু বিশ্বাস করো ইদানীং খুব ইয়াং লাগে নিজেকে।এসো আমার কাছে।”

কবীর হাত বাড়িয়ে দিলো তোশার জন্য।যুবতী তা মুহুর্তে আঁকড়ে ধরলো।দুজনের কপাল একত্রে মিলিত হলো।চাঁদের আলো তাদের ডুবিয়ে দিচ্ছে যেন।কবীর ফিসফিস করে বলল,

“যদি তোমার আগে পৃথিবী থেকে চলে গেলে যাই। তাহলে তুমি এসব স্মৃতি, আমার সাথে বিয়ে মনে রাখবে লিটল চেরী?ভুলে যাবেনা?”

“প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য চিরকাল থেকে যান আমার নিকট কবীর শাহ।”

“আমার মনে হয় খুব বেশীদিন হবেনা একসাথে থাকা।”

“একথা কেন?আপনি সুস্থ সবল বাজপাখি।এসব ভুলে যান।”

তোশাকে বুকে আগলে রেখে আকাশ পানে তাঁকিয়ে থাকে দুজনে। গাঁদা ফুলের গন্ধে ভরে গিয়েছে পরিবেশ।শীতল সমীরণ ছুঁয়ে দিতে গিয়েও ভয় পাচ্ছে তাদের।পাছে বেলাডোনা ও তার বাজপাখির প্রেমেতে ব্যাঘাত ঘটে।

চলবে।

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৬৯
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“তোমার শরীরে তুমি গেঁথে রাখো গান
রাত্রিকে করেছো তাই ঝঙ্কারমুখর
তোমার ও সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ
অজান্তে জীবনে রাখো জয়ের সাক্ষর।” (সুনীল গঙ্গোপধ্যায়)

বুকে জড়িয়ে তামাটে পুরুষটি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে প্রশংসায় ভরিয়ে তুলে।মৃদুমন্দ সমীরণে চারিধারের গাছপালা নেচে উঠছে।সমুদ্রে রৌদ্রের কিরণ পড়ায় স্মরণে হচ্ছে স্বর্ণের তৈরী পানি সেগুলো।তোশা একমনে সেদিকে দেখছে।রোদের সঙ্গে সে নিজের খুব মিল পায়।তাকে উদাসীন কিছু ভাবতে দেখে কবীর শুধালো,

“কী ভাবছো বেলাডোনা?”

তোশা স্থিমিত কণ্ঠে বলল,

“তেমন কিছু না।আপনার মনে হচ্ছে না কবীর শাহ ইদানীং আপনি খুব বেশী রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছেন?”

“রোমান্টিক?কীভাবে?”

“এইযে সব বাক্যের পর আমার প্রশংসাতে ডুবে যান।এটাকে রোমান্টিসিজম বলে জনাব।”

“স্ত্রীর প্রশংসা করা সকল পুরুষদের নিজস্ব দায়িত্ব।আর আমি এতো বয়সে এসে দারুণ সুন্দরী স্ত্রী পেয়েছি।সেক্ষেত্রে আমার প্রশংসা একটু বেশী করতে হবে।এতো বড় পাওয়া সেটা তো দারুণ ভাগ্য।”

“আমাকে পাওয়ার বিষয়টা আপনি সৌভাগ্য হিসেবে ধরে নিলেন?”

তোশা স্বীয় আঁখিতে বিস্ময় ফুটিয়ে কবীরের দিকে জবাবের আশায় তাঁকিয়ে রইলো।এমন নয় যে সে জানেনা কবীর তাকে অনেক ভালোবাসে।মানুষটাকে পেতেও তোশার খুব বেশী লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে।কিন্তু সেসব সে গ্রাহ্য করেনি।বরং তোশার মনের কোথাও একটা জায়গা বিশ্বাস করতো কবীর নেহাৎ ভালো মানুষ বিধায় সকলের থেকে এতো অপমান পাওয়ার পরেও বিয়ে করেছে তাকে।যে মানুষ এতো বিত্ত্বশালী কিংবা ক্ষমতাবান তার বিশেষ দরকার ছিলনা তার মতোন বোকা একটা মেয়েকে পছন্দ করার।সে তো বিশেষ কেউ কিন্তু তোশা বিশেষ নয়।যুবতীর করা প্রশ্নে কবীর হেসে উঠলো।কী মায়াময় ব্যক্তিটির দৃষ্টি!তোশাকে হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

“তোমাকে পাওয়া আমার জন্য সৌভাগ্য তোশা।সেই ব্যাখা আজ নয় কোনো এক বিশেষ দিনে দিবো।কিন্তু আমার ভালোবাসা নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ আছে?”

“নেই।কিন্তু আপনি ভালোবাসা প্রকাশ করেন না খুব একটা।”

“কে আমি?”

“জি খুব বেশী প্রকাশ আপনার দ্বারা হয়নি।”

“ভালোবাসা প্রকাশ করতে হলে আমার ঠিক কী করতে হবে?”

কবীরের মুখোমুখি হয়ে বসলো তোশা।একটু প্রহেলিকা করে বলল,

“আপনি দেখুন কী করতে হবে।হানিমুনে আমার কথা মতোন মরিশাস দ্বীপে আসা কিন্তু ভালোবাসা জাহির করা নয়।”

তোশাকে এতোটা খামখেয়ালি ভাবে কখনো দেখেনি কবীর।কিছুক্ষণ স্ত্রীর পানে তাঁকিয়ে সে ভাবতে লাগলো।কিন্তু এখানেও বিপদ।এতো সুন্দর মুখটাকে দেখে বারংবার সে নিজ ভাবনা থেকে সরে যাচ্ছে।ফোলা ফোলা মেদুর শুভ্র গালটাকে দেখতে সত্যি চেরির মতো লাগে।কবীরের মনে পড়ে গেলো তাদের প্রথম রাত্রীর কথা।সেদিন গাল দুটো আরো রঙিন ছিল।অজান্তে হেসে উঠলো কবীর।তোশা কী কখনো খেয়াল করেছে তার গাল দুটো আলোর সংস্পর্শে নাকী বাজপাখির ছোঁয়ায় আরো বেশী রক্তিম হয়ে উঠে।

“কী হলো কোন ভাবনায় চলে গেলেন।”

“ভালোবাসা আমি অনেক ভাবে দেখাতে সক্ষম সুন্দর মেয়ে।কিন্তু এই উপায় পছন্দ হলে বিনিময়ে কী আছে আমার জন্য?”

“সুন্দর নারীটি তো আপনার।এর বাহিরে কী আর চাওয়ার থাকতে পারে?”

কবীরের অধরযুগল প্রসারিত হলো।পুরুষটি যেন চিরযৌবনা।হাসিতে আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠে শরীর।সরু শক্ত আঙুল গুলো দ্বারা যুবতীর কানের পিঠে চুল গুলো গুঁজে দিয়ে বলল,

“এটা শুধু ভালোবাসা আমার তোমার জন্য।”

লম্বা লম্বা পা ফেলে একটু দূরে সাদা ত্বকের লোকটির সামনে দাঁড়ালো কবীর।তার মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল,

“Hey,That beautiful woman sitting there is my wife. And I love her very much.”

লোকটি কবীরের কথায় ভ্রু কুঁচকালো।বিনিময়ে কবীর হেসে সামনে অগ্রসর হয়ে অন্য আরেকজন লোককে একই কথা জানালো।এমনকি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি মানুষকে জানালো তোশা তার স্ত্রী এবং তাকে সে খুব ভালোবাসে।তোশা দৃষ্টিতে একরাশ অশ্রু নিয়ে পুরো জিনিসটা দেখছে।কবীরের চোখেমুখে কতোটা মুগ্ধতা খেলা করছে একই ভালোবাসার বাক্য ভিন্ন মানুষকে বলার সময়।অনেকজনকে বলে এসে তোশার কাছে থামলো কবীর।এতোক্ষণে প্রায় সকলের জানা হয়ে গেছে কবীরের ভালোবাসা কে।তোশা শুকনো ঢোক গিলে বলল,

“আরো কেউ বাদ আছে?যাকে আপনি জানাতে চান?”

” এখনো সমুদ্র ও আকাশকে বলা বাকী।”

“তাদেরও জানাবেন?কীভাবে?”

“এ জিনিসটা খুব স্পেশাল হবে।এখন রুমে চলুন ম্যাডাম।বেশী রোদে থাকলে ত্বক কালো হয়ে যাবে।”

“আপনার মতোন?”

“আমাকে কালো বলে কী শান্তি পাও?”

“ভালো লাগে।”

কবীরের একটা হাত জড়িয়ে হাঁটতে লাগলো তোশা।এক সুখী দম্পতিকে আশেপাশের মানুষ তাঁকিয়ে দেখছে।বিয়ের তিনমাস অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর হানিমুনে এখানে আসতে পেরেছে।তা নয় এ আত্মীয়ের বাড়ী ও আত্মীয়ের বাড়ী ঘুরতে ঘুরতে সুযোগ হয়ে উঠেনি।রিসিপশনে তাদের থামিয়ে দিলো একজন লোক।হাত বাড়িয়ে একটা ফুলের তোড়া দিলো।ইংলিশে বলল,

“আপনাদের জন্য গিফট এসেছে।”

“আমাদের জন্য?”

“জি।”

কবীর হাতে নিলো ফুলগুলো।সাদা গোলাপ দেখে মুহুর্তে স্নায়ুর কোথায় স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠলো।কর্মরত লোকটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো কে এগুলো দিয়েছে।আগুন্তকের নাম ফ্রান্সিসকো শুনতে কপালে ভাঁজ পড়লো তার।পিছন থেকে তোশা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

“সেই লোকটা?এখানে কেন?”

“ও আমাকে বলেছিল আমার খুশির সময়টা আমার থেকে চু”রি করে নিবে।আর এখনকার থেকে বেশী খুশি বোধহয় আমি কখনো হইনি।”

“এখন কী করবেন তাহলে?”

“আমার প্রথম কাজ তোমাকে নিরাপদ রাখা।”

“কিন্তু আপনি?”

“আমিও থাকবো।ভয় নেই আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমি পূর্ব থেকে করে রেখেছি।শুধু লোকটাকে হাতের নাগালে মিলছে না।”

কবীরের কথা তবুও তোশাকে শান্ত করতে পারলো না।সে মুখটা গোমড়া করে রইলো।

(***)

অনেকক্ষণ ঘুমালো তোশা।মেয়েটার দিকে এক ধ্যানে তাঁকিয়ে আছে কবীর।চোখ তুলে ফুলগুলোকে পুনরায় দেখলো।মাথায় অহেতুক অনেক চিন্তাভাবনা ঘুরছে।বিশেষ করে সে জানে ফ্রান্সিসকো বেশ বুদ্ধিমান।যদি তোশার বা তার পরিবারের কোনো ক্ষতি করে?এই প্রশ্নটি থেকে যায়।হুট করে সোশ্যাল মিডিয়াতে এসএমএস আসার শব্দ হলো।কবীর ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অচেনা একটি একাউন্ট থেকে এসএমএস এসেছে।সে কৌতুহল হয়ে রিপ্লাই করতে ওপাশ থেকে ফোন এলো।কবীর দ্বিধা নিয়ে রিসিভ করলো,

“হ্যালো।”

“কেমন আছো কবীর শাহ?বিবাহিত জীবন কেমন কাঁটছে?”

“ফ্রান্সিসকো?”

“আমি নয় তো আর কে?”

“কী চাও?”

“কী চাইনা সেটা বলো।তোমার সুখের সময়কে কামনা করছি।যেভাবে তুমি আমার বিয়ের পূর্বে।”

“মিথ্যা বলো না।তুমি দো’ষী না হলে আইনের কী দরকার ছিল তোমাকে হে’ন’স্তা করার?”

“আমি নি”র্দোষ কখনো বলিনি নিজেকে।তবে আমার সমস্যা ভিন্ন জায়গায়।মনে আছে এখানে আসার পর একজন তোমাকে ড্রা” গ নিয়ে ফাঁসাতে চেয়েছিলো?আমি সেদিন না থাকলে তোমার কী করুণ অবস্থা না হতো।”

“মনে আছে।”

“যদি আমার সাহায্য পেয়ে তুমি আজ এমন শক্তির অধিকারী হতে পারো তাহলে আমার কথা লুকানোতে কী সমস্যা হতো?আমি উপকারের বিনিময়ে কী কিছুই প্রাপ্য ছিলাম না?”

“এখানে কথা ভিন্ন ছিল ফ্রান্সিসকো।আমি নির্দোষ কিন্তু তুমি ছিলে শয়তান।এখন নিজের গণনা শুরু করো।একবার যদি আমি ধরতে পারি।”

“কী করবে?নিজের প্রাক্তন স্ত্রীকে যেভাবে বিশেষ ঔষধ দিয়ে পা’গ’ল করে রেখেছো আমাকেও তেমন করবে?”

“তুমি এটা কীভাবে জানো?”

শব্দ করে হেসে উঠলো ফ্রান্সিসকো।কবীরের বড় রাগ হলো তাতে।

“আমি কীভাবে জানি?সেকথা না হয় বাদ থাকুক।এবার চলো আমরা যু’দ্ধ করি।একটা নিরব যু’দ্ধ।যেখানে দেখবো কার হা’র হয়।আমি তোমাকে বিশেষ সময়ে আবার দেখা দিবো।কিন্তু সেটা হবে আমাদের শেষ দেখা।আমি তোমার শেষ দেখে নিবো।ভালো থাকবে কবীর শাহ।এবং হোয়াইটকে বলো ও খুব সুন্দর।”

কলটা রেখে দিলো ফ্রান্সিসকো।সে কী করতে চাচ্ছে?আদুরে বিড়াল ছানার মতোন ঘুমের মধ্যে থেকে শব্দ করে উঠলো তোশা।এতোক্ষণ মস্তিস্কে চলা ঝড়টা থেমে গেলো কবীরের।মেয়েটির পাশে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়লো সে।ঘুমন্ত মুখটা কী দারুণ মায়াবী।ফিসফিস করে বলল,

“আমাদের জীবনের মিঠা রোদ কখনো শেষ হবেনা বেলাডোনা।একটি সুন্দর দিনের সূচনা হয়েছে।যা থামবার নয়।”

চলবে।

মিঠা রোদ পর্ব-৬৬+৬৭

0

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৬৬
#লেখা:সামিয়া খান প্রিয়া

“দিনটি কতো সুন্দর।”

তোশা লম্বা একটি শ্বাস টানলো।নাকের ভেতর তরতাজা গোলাপের সুবাস ঢুকে গেলো।কী সুন্দর দিন।মনোরম পরিবেশ।তার নানা নেয়ামত তখন বাগানে দাঁড়িয়ে বেলা বারোটায় গাছে পানি দিচ্ছিলো।নাতনির মুখে থেকে বের হওয়া বাক্যটি কর্ণকুহর হতে সে মেয়েটির দিকে তাঁকালো।হালকা গোলাপি রঙের শাড়ী পরেছে।তার মনে পড়ে গেলো ষাটের দশকের এক নায়িকার কথা।নামটা যদিও এখন মনে পড়ছেনা।

“তোশামণি দিনটি আসলেও সুন্দর।তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“আহনাফের সঙ্গে ঘুরতে নানা।আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে দেখতে।”

নেয়ামত হাসলো।তাহিয়ার মেয়েটিকে তার নির্বোধ মনে হয়।দিনে দুপুরে বুড়ো মানুষটিকে সুন্দর বলে দিচ্ছে।বিয়ের পর মাথাটা গেলো নাকী?

“তোমাকেও সুন্দর লাগছে।সময় মতো চলে এসো।”

মায়ের গাড়ীটা নিয়ে বের হয়ে পড়লো তোশা।একবার ভাবলো রিক্সায় যাবে।কিন্তু গেটের বাহিরে মানুষের চাহনি দেখে সে ইচ্ছাটাকে পাশে সরিয়ে রাখলো।আজকে দিনটা তোশার নিকট অন্যরকম লাগছে।সে বিবাহিত।যতোবার নিজের ফোলা ফোলা মুখটা দেখছে আয়নায় ততোবার শিহরিত হচ্ছে শরীর।মিনিট বিশেক বাদে শপিং মলে পৌঁছে গেলো সে।

“একা কেন এসেছো?”

স্বামী হওয়া কবীর শাহ কে দেখেও তোশার অন্যরকম লাগছে।তামাটে মুখশ্রীটার বয়স যেন আরো কমে গেছে।তোশা মুখ গোমড়া করে বলল,

“আপনি কেন? আমার ও আহনাফের একা ঘুরার কথা ছিল।”

“আহনাফের নিজস্ব ক্রেডিট কার্ড নেই বেলাডোনা।তো আপনাদের নিজস্ব ব্যাংক হয়ে এসেছি।”

“এই কথা বললে হবেনা।”

“অবশ্যই হবে।চলো এখন।”

তোশা মিষ্টি হেসে কবীরের হাতখানা জড়িয়ে ধরলো।এই মানুষটা তার।একমাত্র নিজস্ব বলা হোক কিংবা ব্যক্তিগত পুরুষ।কবীরের ফোনে কল আসায় সে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।তোশা খেয়াল করলো সকল মানুষ তাদের দেখে কৌতুহল হয়ে তাঁকাচ্ছে।সেটা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে একটি শপের ভেতর ঢুকলো তারা।

“আহনাফ।”

“আইসক্রিম।তুমি লেট করেছো দশ মিনিট।”

“আহনাফ তুমি তোশাকে এখনও আইসক্রিম বলে ডাকবে?”

“সবসময়।”

কবীর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।আহনাফ তোশাকে অনেক আগেই নিজের মায়ের আসনে বসিয়েছিলো।যে ছেলেটা সহজে কারো সাথে ঠিকঠাক মিশতো না কিংবা মা শব্দটাকে ভয় পেতো।সেই ছোট বাচ্চাটা আজ কতো সহজে মিশে গেলো আরেক লিটল চেরীর সাথে।তোশার দিকে তাঁকালো কবীর।নিজস্ব বেলাডোনার মধ্যে তফাৎ খুঁজলো বিয়ের পরের।কিন্তু এখনও তো সেই দস্যু ভাব রয়ে গেছে চোখেমুখে।অথচ গতকাল রাতে তাকে অনেকটা গভীরভাবে ছুঁয়েছে কবীর।সেজন্য কোনো ক্লান্তি ভাব নেই।উল্টো প্রদীপের ন্যয় দ্বীপশিখা ছড়িয়ে যাচ্ছে।কবীর নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো এমন একটা সুন্দর ফুল তার জীবনে এসেছে তাই।

“চলো তোমরা এখন।শপিং শুরু করা যাক।”

তোশা ও আহনাফের উচ্ছাস ছোট ছোট হাসি এই অভিজাত শপে থাকা প্রত্যেকটি মানুষকে একবার হলেও তাদের দিকে আকর্ষণ করছে।কেউ মুগ্ধতা ভরে দেখছে।তো কেউ চোখেমুখে ঘোলাটে ভাব বজায় রেখেছে।এরমধ্যে ত্রিশ অতিক্রম করা সফেদ ত্বকের এক নারী তোশাকে খোঁচা মেরে আস্তে করে বলল,

“কম শপিং করো।তুমি যেভাবে জিনিসপত্র কিনে চলেছো তাতে মনে হচ্ছে এসব জিনিস কেনার সাধ্য কখনো ছিলনা।কিন্তু তোমার মা কে দেখেছিলাম একবার আমার কাজিনের বিয়েতে।ভদ্রমহিলাকে দেখে তো যথেষ্ট ডিসেন্ট লেগেছিলো।তুমি এমন যে কেন?”

তোশা জবাব দিলো না।বরং সব কথাগুলো শুনে নরমভাবে হাসলো।একটু দূূরে বাবা -ছেলে মিলে কী যেন আলাপ করছে।তাদের মন খারাপ হবে দেখে আস্তে করে বলল,

“আমি যার টাকায় এসব কিনছি সে নিজেও আমার আপন।এবং আমার মা তিনিও আমার সবথেকে আপন।দুজনের অর্থের উপর অধিকার আছে।বরং আপনার অধিকার নেই আমার ব্যাপারে মন্তব্য করার।

” তোমার সবকিছু এখন লোকের মুখে মুখে।অধিকার কেন থাকবেনা?”

“আমার কথা টক অফ দ্য টাউন হতে পারে।কিন্তু আমি সহজলভ্য কেউ নেই।”

“কথা দারুণ বলতে পারো।আমাকে চিনো আমি কে?”

“কে?”

ভদ্রমহিলা নিজের স্বামীর ছায়াতলে নিজস্ব পরিচয় বর্ণনা করতে লাগলো।বরং বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ব্যাখা করতে লাগলো সব।তোশা শুধালো,

“আপনি কি করেন?”

“আমার হাজবেন্ডের সব আছে।কিছু করতে হবে কেন?”

“আমার হাজবেন্ডেরও সব আছে।তাও আমি অনেককিছু করতে চাই।কী সুন্দর দেখুন আমার ভাগ্য।যা চাই তা পেয়ে যাই।”

ভদ্র মহিলার হাত থেকে পার্সটা টান দিয়ে নিয়ে তোশা পাশের সেলসম্যানকে দিলো।এটা তার পছন্দ হয়নি।কারণ দামটা বেশী।তবে দেখানোর জন্য হলেও সে বিল করার জন্য দিয়ে দিলো।ভদ্রমহিলার মুখটা বেজায় মলিন দেখা গেলো।কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।কারণটা হলো শুরু সে করেছিলো।

“পরিবেশটাকে ন’ষ্ট করে দিচ্ছো তোমরা।এখানে যে কেন এসেছো।একজন বিশ বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করেছে আরেকজন..।”

“আমার থেকে বিশ বছরের ছোট একটি মেয়েকে আমি বিয়ে করেছি।এতে চোখ নামানোর কিছু আছে বলে মনে করিনা।এবং মিস খেয়াল করে দেখুন এই শপটি সকলের জন্য।এখানে কে আসবে বা যাবে সেটি দেখার বিষয় বোধহয় আপনার নয়।এবং আমাকে রাগাবেন না।যেহেতু অপরিচিত তাই পরিচিত হতে চাচ্ছিনা।সেটা হতে গেলে বোধহয় আপনার জন্য ভালো হবেনা।

তোশার হাতটা নিজের মধ্যে নিয়ে নিলো কবীর।মহিলার দিকে তর্জনি উঁচু করে বলল,

“ভালো থাকতে চান নিশ্চয়?”

মহিলা জবাব দিলো না।মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে চলে গেলো।তোশা ভ্রু কু্ঁচকে শুধালো,

“আপনাকে যতোটা ভালো দেখায় আসলে আপনি ততোটা নন।”

“তো কেমন বেলাডোনা?”

“অন্ধকারের মতোন।জরুরি কিন্তু ভয়া’বহ।”

“দারুণ কথা তোমার সুন্দর নারী।”

“ধন্যবাদ তামাটে পুরুষ।”

দুজনে হেসে উঠলো।তারা জানে এমন ঘটনা প্রায় রোজ আসবে।মাঝেমধ্যে এমন মানুষের সঙ্গে দেখা হবে ।তাদের কাওকে থামাতে হবে কথা দিয়ে।আবার কাওকে অবহেলা করে চলে যেতে হবে।চড়ুই ও বাজপাখির সম্পর্ক অনন্য তখুনি তো হবে।

চলবে।

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৬৭
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

সন্ধ্যা হয়ে আসছে।সব মানুষের ঘরে ফেরার তাড়া।বিরাট জ্যাম লেগেছে রাস্তায়।একঘেয়ে নিশ্চলতাকে মুখ বের করে দেখছে তোশা।কবীর আদেশ করার ভঙিমাতে বলল,

“মাথা ভেতরে ঢুকাও বেলাডোনা।ব্যাথা পাবে।”

“জ্যাম কখন ছাড়বে?ভালো লাগছেনা।”

পিছন ফিরে তাঁকিয়ে দেখলো আহনাফ একমনে ফোনে কিছু একটা করছে।তোশা একবার ছেলের দিকে আরেকবার দিকে কবীরের দিকে তাঁকালো।দুজনের চেহারাতে কতো মিল।কিন্তু গায়ের রঙে তফাৎ।

“কী দেখছো এভাবে?”

“আপনাদের।”

“মায়ের সাথে কথা হয়েছে তোমার?আমার মা।তোমার শ্বাশুড়ী।”

তোশা ধীর কণ্ঠে বলল,

“বুঝেছি তো।বলিনি রাতে গিয়ে বলে নিবো।”

“এখন তোমার অনেক দায়িত্ব।সেগুলো নিয়ে টেনশন করবে না।খাবে ঠিকমতো।ঘুমাবে ও পড়াশোনা।নিজেকে বড় ভাবার কোনো দরকার নেই।”

“আপনি ও আম্মু আমাকে বড় হতে দিলেন না কখনো।”

“তুমি থাকো না ছোট্ট চেরী হয়ে।এটা ভালো লাগে।আমি তোমার পাগলামি তে মজেছিলাম।”

তোশা লাজুক হাসলো।পিছন ফিরে আহনাফকে দেখলো।যে কানে হেডফোন লাগিয়েছে।আশ্চর্য এই ছোট ছেলেটা কীভাবে বুঝলো বড়রা কথা বলছে সেটা না শুনলে ভালো হয়।কারণ ক্ষণপূর্বেও কানে হেডফোন ছিলনা।তোশার মনটি ফুলে ফুলে ভরে গেলো।দুটো অসাধারণ মানুষের সঙ্গে তার জীবন শুরু হতে চলেছে।দীর্ঘ ক্ষণ পর গাড়ীগুলো আপন গতিতে চলতে লাগলো।এসি বন্ধ করে কবীর জানালা গুলো খুলে দিলো।শীতল সমীরণ তোশার সামনের চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে।কী সুন্দর দিন।কে বলবে কয়েক দিন পূর্বে অসহনীয় আশংকায় মনটা শেষ হয়ে গিয়েছিলো।তোশাকে বাড়ীর সামনে নামিয়ে দিলো কবীর।মেয়েটা চলে যেতে নিলে তার শাড়ীর আঁচল টেনে শুধালো,

“কালকে ভার্সিটি থেকে আমি নিয়ে আসবো তোমাকে।গাড়ী ফেরত পাঠিয়ে দিও।”

“বাবা তুমি সদ্য প্রেমে পড়া টিনেজারের মতোন বিহেভ করছো কেন আইসক্রিমকে দেখে?”

আহনাফের দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাঁকিয়ে বলল,

“তোমার বয়স কম।তাহলে কীভাবে জানলে টিনেজাররা প্রেমে পড়লে কেমন করে?”

তোশার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,

“আইসক্রিম দেখিয়েছে।তুমি জানো একদিন আমাকে জড়িয়ে কী কান্না।তোমার মতোন দেখতে এই কারণে।”

তোশা ভ্রুঁ জোড়া কুঞ্চিত করে বিদায় বলল।কবীর হাসছে।শক্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল,

“বিদায় বেলাডোনা।সবিনয়ভাবে কবীর শাহ এর ভালোবাসা মনে রাখবেন।”

“ভুললাম কবে?”

তোশা গেটের ভেতর চলে গেলো।হঠাৎ পিছন দারোয়ান ডেকে বলল,

“তোশামণি তোমার জন্য একজন ফুল পাঠিয়েছে।নিয়ে যাও।”

“ফুল?কোথায় দেখি।”

দারোয়ান লোকটি সাদা তিনটা গোলাপ তোশার হাতে রাখলো।সঙ্গে একটি কাগজ।তোশা খুলে দেখলো সেখানে বিয়ের জন্য শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে।আশ্চর্য কারো নাম নেই।সে ততোটা না ভেবে ভেতরে ঢুকলো।কিন্তু ড্রয়িং রুমে টিনাকে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলো।

“আপনি?”

তোশার দিকে তাঁকালো টিনা।মেয়েটাকে পরখ করে বুঝতে পারলো চেহারাতে প্রাণবন্ত ভাব ফুঁটে উঠেছে।

“তোমার বাবার সাথে এসেছি।”

“বাবা এসেছে?কোথায়?”

“ভেতরে গেলো এখন।”

তোশা পা বাড়িয়ে মায়ের রুমের দিকে এগুতে লাগলো।মায়ান যদিও আর কিছু করতে পারবেনা।কিন্তু তবুও তোশা নিজ মা কে আর কথা শোনাতে দিবে না।রুমের কাছাকাছি গিয়ে শুনতে পেলো তাহিয়া বলছে,

“আপনার কথা মানতে আমি বাধ্য নই।তোশার বিয়ে আমার বাসা থেকেই হবে।”

“এটা তোর বাবার বাসা।বুঝতে কেন পারিস না যে তোশার বাবা, দাদা বেঁচে আছেন।তারা কেন বিয়েটা এখানে হতে দিবে।”

“আপনি কালকে কবীরকে আ” ঘা”ত করেছেন।এরপরও মায়ান?”

“সেটা আমার ও আমার বন্ধুর ব্যাপার।তোর কথা বলতে হবেনা।”

“লজ্জাহীন।” বলল তাহিয়া।কণ্ঠে কেমন বিরক্ত হওয়ার ভাব।মায়ান অবশ্য তোয়াক্কা করলো না।বিছানাতে বসে বলল,

“তোর মুখ বেশী চলে।মেয়ের বিয়ের পর নিজে যখন বিয়ে করবি তখন না হয় এই বাড়ী থেকে অনুষ্ঠান করবি।”

“বাবা!”

তোশার কণ্ঠে তাহিয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।মায়ান মেয়েকে দেখলো।এখনও তার মস্তিস্ক স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেনা নিজের মেয়ের বিয়ে বাল্যকালের বন্ধুর সাথে হয়েছে। ভাবতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো।

“ভেতরে এসো তোশা।বসো এখানে।”

“আমার বিয়ে এই বাড়ী থেকেই হবে।জেদ করো না।এখন বাদ দাও আমার মা কে কথায় কথায় খোঁ’চা দেওয়া।দুজন প্রাক্তনকে এভাবে ল’ড়’তে দেখলে আমার মটেও ভালো লাগেনা।”

“তোমার নিজস্ব বাবার বাড়ী ওটা।”

“যে বাড়ীর রাস্তা আমার মায়ের জন্য বন্ধ সেটা আমার বাড়ী নয়।”

মায়ান তর্ক করতে গিয়েও থেমে গেলো।পকেট থেকে একট বক্স বের করলো।যেখানে সুন্দর দেখতে একটি লকেট।

“আমার মেয়ের বিয়ের উপহার।এটা নিবে?”

মায়ানকে অবাক করে দিয়ে তোশা নিজ হাতে পড়িয়ে দিতে বলল।তাহিয়া একপাশে নির্বিকার হয়ে তাঁকিয়ে আছে মেয়ের গলায় ঝুলতে থাকা দামী লকেটটিকে দেখছে।

“আমি ভেবেছিলাম নিবেনা তোশামণি।ভালো থাকবে সবসময়।যদি জীবনের এক পর্যায়ে মনে হয় কোনোভাবে তোমার আরো পাওনা আছে।তাহলে মনে রাখবে বাবা সবসময় তোমার সাথে আছে।”

“আমার বিশ্বাস কবীর শাহ ও আম্মু সবকিছু এনে দিবে আমাকে।বাবা বিশ্বাস করো তোমরা দুজন আমার বাবা-মা হয়ে ল’ড়া’ই করো ভালো লাগেনা।এটা বন্ধ করতে পারবে?আমি হয়তো একটু কম বেশী।কিন্তু দুজনকেই ভালোবাসি।”

“তোমার মা কে বেশী ভালোবাসো?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি অনেক সেন্সিবলভাবে কথা বললে।”

“আম্মু শিখিয়েছে এভাবে বলতে।জীবনের সেরা শিক্ষক।দুনিয়ার বেস্ট মা।”

তাহিয়ার চোখেমুখে উজ্জ্বলতা ফু্টে উঠলো।যা মায়ানের চক্ষু আড়াল হলো না।সেদিনের কথার কী সুন্দর জবাব আজ তোশা দিলো।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বাহিরে চলে এলো মায়ান।টিনা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,

“কী হলো?”

“বিয়ে এখান থেকে হবে।”

“কিন্তু তুমি তো।”

“টিনা একটা কথা কী জানো আমি বোধহয় আমার প্রথম সন্তানের জীবনে কোথাও নেই।তারা মা-মেয়ে আলাদা জগত তৈরী করে নিয়েছে।সেখানে আমার প্রবেশ নি’ষে’ধ।”

“দুঃখ পেওনা।”

মায়ান স্মিত হেসে বলল,

“হচ্ছে না।বরং কয়েকটা লাইনে আমার মেয়ে বুঝিয়ে দিলো পুরো জীবনটাকে আমি যেভাবে দেখেছি সেটি বোধহয় পুরোপুরি সঠিক বা উচিত নয়।আমার অনুমানও সর্বদা সঠিক নয়।চলো আমরা ফিরে যাই।ওদের একা থাকতে দাও।”

টিনার হাত ধরে মায়ান বের হয়ে গেলো।তাহিয়াকে ছেড়ে দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে সে এই রমণীর হাতখানা ধরেছিলো।কখনো খারাপ লাগেনি।কিন্তু আজ জিতে যাওয়া তাহিয়া নামক নারীটির মুখখানা দেখে বেশ শূন্য অনুভব হচ্ছে।

চলবে।
এডিট ছাড়া পর্ব।