Monday, August 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 483



লাজুকপাতা পর্ব-১৯

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১৯
টুম্পা ভাবী আর জামিল ভাইয়ের ডিভোর্স হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত । ভাবী মেয়েদের নিতে চায় না। সে জানায় মেয়েরা আপাতত বাবার কাছে থাকুক। সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তারপর মেয়েদের দায়িত্ব নিবে। জামিল ভাই ভাবীর উকিল কে জানান মেয়েদের দায়িত্ব নেয়া তো দূরে থাক, তাদের যেন চোখের দেখাও না দেখতে পারে সেই ব্যবস্থা উনি করবেন।

ভাবীকে আমার ভীষণ স্বার্থপর লাগে। নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার অর্থ হলো তার নতুন সংসার গুছিয়ে নেয়া। জামিল ভাইয়ের মুখে শুনেছি যে ভাবীর বাবা অনেক দিন আগেই নিজের পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে। শুধু অপেক্ষায় ছিলো অফিশিয়াল ছাড়াছাড়ির। এমনকি তার কঠিন শর্ত ছিলো ভাবী যেন কিছুতেই টাপুর টুপুর কে নিয়ে বাপের বাড়িতে না আসে।

জামিল ভাই কয়েকটা দিন খুব ছটফট করলেন। রাতে শব্দ করে কান্নাকাটি করেন, সবকিছু জ্বালিয়ে দেবার হুমকি দেন। আর টাপুর টুপুর কী বুঝতে পারে কে জানে! ওরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। প্রানখোলা সেই হাসি টা আর নেই। আমার দেয়া চকলেটগুলো তেমন ই থাকে টেবিলের উপর বইখাতার পাশে। খাওয়া নিয়েও বায়না করে না। বাবা তার নাতনিদের মন বুঝতে পারেন। সে ঘুরতে নিয়ে যায়। এভাবে কিছুদিন যাবার পর ওরা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

নাবিদের অফিসের ভীষণ চাপ। সপ্তাহ খানেকের জন্য চট্টগ্রাম যেতে হয়। আমাকে বাসায় রাখতে ভরসা পায় না, পরী আপার কাছে গিয়ে ক’টা দিন থাকতে বলে। আমি রাজী হতে পারি না ছেলেমেয়ে গুলোর জন্য। ওদের সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তবুও হাতে দুদিন সময় নিয়ে আপার ওখানে যাই। আপা ভীষণ খুশি হন। আমাদের মধ্যে যে সাময়িক দূরত্ব তৈরী হয়েছে সেটা মিটে গেছে অনেক দিন হলো। আমার কথা জমানোর বক্সে কথা না জমাতে পারলে ভীষণ খারাপ লাগে।

পরী আপার ওখানে ঘুরে আসি টাপুর টুপুর কে নিয়ে। ওদেরও মন ভালো হয়। আপা আমার জন্য আপ্যয়ন, আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখেন না। এখানে আসলে যে আদর যত্ন পাওয়া যায়, পলাশবাড়ীতে গেলেও সেটা মিলে না। আপা আমাকে কথায় কথায় বলেন,

“তোর নিরুর সঙ্গে কথাবার্তা হয় জরী?”

“মাঝেমধ্যে হয় আপা। আমি ফোন করি, নিরু আপা অবশ্য আমাকে মিসড কল দেয়। ”

“ওর সঙ্গে একটু খাতির কম করিস তো। ”

“কেন আপা?”

আপা এড়িয়ে যান। বলেন, এমনি রে। বাচাল স্বভাবের তো। সারাদিন ফোন নিয়েই থাকে। এই নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর সঙ্গেও নাকি ঝগড়াঝাটি লেগে থাকে।

আমার আপার কথা বিশ্বাস হয় না। নিরু আপার মুখ পাতলা টাইপ। বোকাসোকা ধরনের মানুষ। নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য আপা আমাকে দূরে থাকতে বলেছে।

আপার ওখান থেকে বাসায় ফিরতে হয়। টাপুর টুপুর এর স্কুল এখন অফ। ওদের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। ওদের আরও থাকার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু আমার জন্য থাকতে পারে নি।

***
বাড়িতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এক রাতে জুয়েল ভাই বাড়িতে আসে। নাবিদ তখন বাসায় নেই, জামিল ভাই আর বাবার পারমিশন নিয়ে মুক্তাকে নিয়ে যায়। জুয়েল ভাইয়ের মা অসুস্থ, তিনি ছেলের বউকে কাছে চাচ্ছেন। আম্মার সম্ভবত আপত্তি ছিলো, কিন্তু তিনি জামাইয়ের সামনে কিছু বলতে পারেন না। জুয়েল ভাই মুক্তাকে নিয়ে যাবার দুদিন পর জানান যে ও এখন থেকে শ্বশুর বাড়ি থাকবে। অনুষ্ঠান করার সময় তার নেই। আম্মার ভীষণ মন খারাপ হয়। তিনি দশজনের কাছে গল্প করেছিলেন মেয়ের শ্বশুর বাড়ির নামে। এখন তার মান ক্ষুন্ন হবে।

বাড়িতে মা আমাকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার এক কথা নাবিদ কে বলে সংসার আলাদা করতে। আমি চুপচাপ শুনি। মা একসময় বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। পরী আপাকে নিয়ে তার চিন্তা নেই। ডাল, ভাত খাক আর কম খাক তবুও সেটা নিজের সংসার। খবরদারি করার মতো কেউ মাথার উপর নেই। আমাকে নিয়ে তার রাজ্যের চিন্তা। আমার জীবন টাও শেষমেস মায়ের মতোই হয় কিনা!

সংসার নিয়ে ভাবনা আমারও আসে। সেই ভাবনা নিজেই থামিয়ে দেই। আম্মা ছাড়া এই বাড়ির অন্য মানুষগুলো আমাকে ভালোবাসে, সম্মান করে। আমি আলাদা হয়ে গেলে টাপুর টুপুর এর কী হবে! মেয়ে দুটো মানুষ হবে অনাদরে, অযত্নে। মায়ের অভাব আমি জীবনেও পূরন করতে পারব না জানি, তবুও বুঝতে শেখা অবধি আমার ওদের পাশে থাকা উচিত। একটা বয়স পর্যন্ত সবার জীবনেই স্নেহ, মায়া, আদর যত্ন প্রয়োজন।

বিয়ের একটা বছর এতো জলদি কিভাবে চলে গেল নিজেও টের পেলাম না। এই তো সেদিন পলাশবাড়ী থেকে নতুন বউ সেজে ঢাকায় এলাম। গাড়ির জার্নিতে সব সাজগোজের বারোটা বাজিয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় মটকা মেরে ঘুমিয়ে রইলাম। সব যেন সেদিনের ঘটনা। অথচ চোখের পলকেই সময়টা চলে গেল।

চৌদ্দ দিনের জায়গায় নাবিদ কে থাকতে হলো উনত্রিশ দিন। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। বাড়িতে কোনো সমস্যা হয় নি, তবুও সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। খেতে বসে দেখি গলা দিয়ে কিছু নামে না। প্রথম বেলায় ভাবলাম অরুচি সম্ভবত। কলেজ থেকে ফিরে খিদেয় চোখে দেখি না। দুই টুকরা মাংস আর ডাল দিয়ে মাখানো ভাত টাও দুই লোকমার বেশী খেতে পারলাম না। ঘুমাতে গিয়ে দেখি পাশের জায়গাটা খা খা করছে। পাশের জায়গাটা যতটা না, খা খা করছে তারচেয়ে বিশ গুণ বেশী খা খা করছে আমার হৃদয়। আম্মাও আমার অস্বাভাবিকতা টের পেলেন। তিনি আমার দিকে আড়চোখে তাকান। কথাবার্তা এমনিতেও প্রয়োজন ছাড়া বলেন না। মামী একদিন আমাকে দেখতে এলেন। এসে বললেন,

“তোমার গাল দুটো এমন চিপসে গেছে ক্যান? কোনো সমস্যা? ”

আমি হেসে বলি, না তো মামী।

মামীও আম্মার মতো অন্য কিছু সন্দেহ করে। ভাবে আমি বুঝি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু সেসব কিছুই না। আমার সমস্যা তো আমি জানি।

কলেজে যেতেও ভালো লাগে না। তবুও একদিন যেতে হয়। সামনে প্রি টেস্ট পরীক্ষা আছে। সাজেশন, নোট এগুলো কালেক্ট করতে হবে।

একদিন কলেজে যাবার পর সুবর্না হাসতে হাসতে বলল,

“এই জরী একটা মজার ব্যাপার শোন। আমরা এতদিন খেয়াল করি নি। আমাদের ফার্স্ট বয়ের নাম কিন্তু শুভ্র। চশ মাও আছে কিন্তু। ”

আমি প্রথমে বুঝতে পারি না, পরে বুঝেও কিছু বলি না চুপ করে থাকি।

পরের দিন ক্যান্টিনে যাবার সময় শুনি আরেকটা ছেলে বলল,

“এই মামা সাইড কর। শুভ্র’র জরী আসছে। ”

আমার খুব রাগ লাগলো। আমি সুবর্নাকে গিয়ে ধরলাম। বললাম,

“কাহিনী কী সুবর্না?”

সুবর্না হাসতে হাসতে বলে,

“আরে কাহিনী রোমান্টিক, তোর শুনতে ভাল্লাগবে না তাও বলি। রাজন নাকি তোর সাথে কথা বলছিল, সেটা দেখে শুভ্র রাজনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, জরীর সাথে এতো কিসের কথা। মানে শুভ্র’র মনে তোর জন্য সামথিং সামথিং….

রাগে আমি রীতিমতো কাঁপতে থাকি। সুবর্নাকে বলি,

“তুমি ওদের বলো নি যে আমি বিবাহিত। আমি তো তোমাকে বলেছিলাম। ”

“আরে না, বিবাহিত বললে ব্যাপার টা কী আর মজার থাকবে!”

আমি রেগে যাই। সেদিন পাপিয়া ম্যামের ক্লাশে হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলি,

“ম্যাম আমার একটা কথা আছে। ”

ম্যাম বলে, বলো জরী।

“কথাটা আসলে সবার উদ্দেশ্যে ম্যাম। ”

ম্যাম যেখানে লেকচার দেন সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। এতো সাহস আমার কবে কোত্থেকে হলো কে জানে! আমি বুক ভরে নি:শ্বাস নিয়ে বললাম,

“আমি আসলে ম্যারিড। হাজবেন্ড প্রচন্ডরকম সাপোর্টিভ, নাহলে আমার আর পড়াশোনা হতো না। কেউ প্লিজ আমার নামের সঙ্গে অন্য কারো নাম জড়াবে না। প্লিজ। ”

কথা বলা শেষ করে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে আমি নিজের সিটে বসি। ক্লাশ শেষে ম্যাম আমাকে ডাকেন। আমার ব্যাপারে খোঁজ নেন, বাড়ি, পড়াশোনা, হাজবেন্ড শ্বশুর সবকিছু। তারপর বলেন,

“তুমি খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে, তোমার জায়গায় অন্যকেউ হলে এই ব্যাপার টা এইভাবে হ্যান্ডেল না করে অন্যভাবে করতো। জরী একটা বিষয় সবসময় মাথায় রাখবে, জীবনে যত বড় ই হও সবাই কে সমান ভাবে সম্মান করবে। ”

সুবর্না আমাকে বলল,

“এই তুই এতো সেনসিটিভ কেন? সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এতো সিরিয়াস কেউ হয়! ”

আমি স্মিত হেসে বললাম, আমি আসলে নাবিদের জরী। অন্যকারো জরী শুনতে ভালো লাগলো না তাই…

সুবর্না হেসে ফেলে। বলে, তুই তো আস্ত পাগল রে। দেখে বোঝার উপায় নেই।

***
নাবিদ কে এতদিন পর দেখে বুঝলাম ও আমার মতো তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছিলো বুঝি। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ছাদের দিকে তাকালো। আমি তখন ছাদে গেছি বড়িগুলো দেখতে। অন্যান্য দিন এই সময় যাওয়া হয় না। তখন মধ্যদুপুর, নাবিদ আমাকে দেখে হাসলো। আমার মনে হলো আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। বেশী করে ঝাল দিয়ে চিংড়ি মাছের ভর্তা আর রসুন ভর্তা দিয়ে এক গামলা ভাত খেতে পারব। অরুচিও সেড়ে গেছে। সব রোগের ওষুধ কে পেয়ে গেছি যে!

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-১৮

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১৮
কক্সবাজারে চার দিন ভালোই কাটলো। বাড়ি থেকে একাধারে সবার ফোন, ম্যাসেজ এসেছে। আমরা কেউই সেগুলোর জবাব দেই নি। শুধু পরী আপাকে ফোন করে সমস্ত কাহিনী বললাম। চারদিন পর ঢাকায় ফিরে দেখি সবকিছু থেমে আছে। শাশুড়ী মা একা একা কাজ সামলাতে গিয়ে কোমড় ব্যথা নিয়ে বিছানায় চিতপটাং। মেয়ের বিয়ের সমস্ত কাজ একা সামলাতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন। নাজমা ভাবী বলল, মুক্তার শ্বশুর বাড়ির লোকের সাথে বিরাট ক্যাচাল গেছে। সকালের নাস্তায় খিচুড়ি খেতে দিয়েছে আধফোটা চালের। মুক্তার চাচাশ্বশুর সেমাই খেতে গিয়ে বড় সাইজের চুল আবিষ্কার করে আব্বাসহ তার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছে। বিয়েটা হয়েছে জুয়েল ভাইয়ের কারণে।

আমি ঘরে ঢুকে কারো সাথে কথা বললাম না। জামিল ভাই বললেন,

“খুব ভালো কাজ করছ। যেমন কুকুরের সাথে তেমন মুগুর হওয়া দরকার। ”

মুক্তা বাড়িতে নেই। ঘুরতে গেছে স্বামীর সঙ্গে। আম্মা আমার সঙ্গে কথা বললেন না। আমি নিজেই রান্নাবান্না করলাম। বাবা সেই খাবার নিয়ে তাকে দিলেন। খেয়েদেয়ে খানিকক্ষণ নিজের কপাল কে অভিশাপ দিলেন।

দুদিন পর ঘটলো বিশাল নাটকীয় ঘটনা। পরী আপা সবসময় আমাকে বলতেন বাড়িতে যেন আমার সংসারের কিছু না বলি। কিন্তু এইবারের ঘটনা সে নিজেই বলে দিলেন। সব শুনে মা, বাবা, চাচাজান এলেন। মা এসেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলল আমাকে। এতোকিছু হয়ে গেল তাও কেন আমি কিছু জানালাম না। এমন ছোটলোক ফ্যামিলি জানলে সে কিছুতেই এখানে বিয়ে দিতে রাজি হতেন না। এমনকি নাবিদকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো। অবস্থা এমন বেগতিক হবে আম্মা নিজেও বুঝতে পারেন নি। এই প্রথম আমি নাবিদের অসহায় চেহারা দেখলাম। বেচারা একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি পরী আপার উপর খুব বিরক্ত হলাম। আপাকে বললাম,

“এইটা কী ঠিক করলা আপা? নাবিদ যে এখন আমাকে ভুল বুঝতেছে৷”

“নাবিদ কে বল যে তুই কিছু বলিস নি, আমি বলেছি। ও তো জানে তুই কেমন। ”

“তুমি বা কেন বলতে গেছ আপা? তুমিই তো আমাকে সবসময় চুপ থাকতে বলতা। ”

“কিছু বিষয়ে চুপ থাকা যায় না। এবারের ঘটনা তেমন। সবসময় চুপ থাকলে দূর্বল ভেবে একের পর এক আঘাত আসতে থাকবে তোর দিকে। ”

আমি রাগ করে ফোন কেটে দেই। সিদ্ধান্ত নেই পরী আপাকে আর ফোন ই করব না।

মায়ের ঝগড়ার রুপ আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন দেখে ফেলে। শাশুড়ীর উদ্দেশ্য মায়ের প্রশ্নের ধরন দেখে সবাই ই নড়েচড়ে বসে। বোধহয় তারা বুঝে উঠতে পারে নি এমন আচরণ। এমন মায়ের মেয়ে হয়ে আমিই বা কিভাবে ঠান্ডা মেজাজ পেলাম এই ব্যাপারেও সবাই সন্দিহান। মামা বারবার চাচাজানের কাছে ক্ষমা চান। আম্মা গুছিয়ে কিছু বলতে পারেন না। শেষমেস বলেন যে গয়না তো সে মাত্র একদিনের জন্য নিছে। মুক্তার বিয়ের পর ফিরেই দিতো। এই কথার জের ধরে মামাও গয়না আমাকে দেবার ব্যবস্থা করেন।

মা আমাকে নিয়ে যেতে চায়। আমি রাজি হই না। মা নাবিদ কে বলে যায়,

“তোমার উপর আমার ভরসা আছে বাবা। কিন্তু তোমার ঘরের মানুষের যে কাহিনী শুনি তাতে তাদের উপর আমার ভরসা হয় না। ”

নাবিদ নত মস্তকে শোনে। মায়েরা থাকেন না। একবেলা আপ্যয়নের সুযোগ পর্যন্ত দেন না। তারা চলে যান। আম্মা তার কপাল চাপড়ান। তার কপালে পরের মেয়ে দিয়ে কোনো শান্তি নেই। আমি সেসব শুনেও চুপ করে থাকি। আমার চিন্তা নাবিদ কে নিয়ে। এতসব ঘটনায় নাবিদ আবার একটু একটু করে দূরে সরে যাবে না তো!

নাবিদ একদিন আমার উপর রেগে থাকে। পরদিন আবার আগের মতোই সহজ হয়। আমি নির্ভার হই। এই সংসারে আর কোনো মানুষ, কারোর থেকে কিছু চাওয়ার নেই। শুধু যার হাত ধরে পলাশবাড়ী ছেড়েছি সে আমার সঙ্গে থাকলেই হবে।

***
কলেজে একটা পরীক্ষা শেষ হয়। এই পরীক্ষার পর ক্লাশে কিছু লোকের নজরে আমি আসি। স্যার, ম্যাম রা ক্লাশে এসে আমাকে খোঁজে। কারণ টপ টেনের মধ্যে আমিই একমাত্র মেয়ে। পিছনের বেঞ্চে বসার বদলে আমাকে সামনের দিকে বসতে বলা হয়। ছেলেরাও আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলে টুকটাক। একদিন ক্যান্টিনে যাবার পথে রাজন নামে একটা ছেলে আমাকে বলল,

“জরী কেমন আছ? ”

আমি মাথা নেড়ে জবাব দেই ভালো। তারপর টুকটাক কথাবার্তা হয়। আমি কোথায় থাকি, পড়াশোনা ছাড়া আর কী করি এসব।

এরপর দেখা হলেই রাজন ছেলেটা কথা বলতো। কেমন আছি, কী করছি এসব। একদিন চা খাবার সময় আমার চায়ের বিলটাও দিলো। আমার খানিকটা অস্বস্তি হয়। নাবিদ কে এসব জানাই না।

***
ইদানীং মুক্তার চলাফেরায় খুব পরিবর্তন এসেছে। খুব টাকা, পয়সা খরচ করছে। সকালে সামনের হোটেল থেকে পরোটা আর চিকেন স্যুপ খায়। রুটি, ভাজি খেতে নাকি ভক্তি হয় না।

দুপুরে শোল মাছের ঝোল দেখে নাক শিটকায়। গলির মোড়ের স্পেশাল মোরগ পোলাও এনে খায় টাপুর টুপুর কে নিয়ে। আবার দেখলাম টাপুর টুপুর কে সস্তার আইসক্রিম খাওয়া নিয়ে বকাঝকা করছে।

বাবাকে একদিন পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল, ফকিন্নির মতো রং চা খাইয়ো না তো বাবা। বাবা সেই টাকা হাতে নিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইলেন।

জুয়েল ভাই ভদ্রলোক এখন পর্যন্ত মিশুক স্বভাবের। কথাবার্তা বলেন বেশী। এতো বয়স্ক একটা লোক ভাবী ভাবী করে! মাঝেমধ্যে বিরক্ত লাগে। টাপুর টুপুর কে আদর করে। উনি বাসায় আসলেই মুক্তার হাবভাব কথাবার্তা পাল্টে যায়। স্বামীর সঙ্গে কথা বলার সময় ন্যাকা স্বরে কথা বলে।

একদিন রাত ১ টার সময় জুয়েল ভাই এলেন। আমরা সবাই তখন ঘুমিয়েছি। মুক্তা এসে দরজায় ধাক্কা দিলো। নাবিদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুললাম। মুক্তা বলল,

“ভাবী তোমার দুলাভাই আসছে। রান্না করা লাগবে? ”

আমার মেজাজ খারাপ হলো। এতো রাতে কেউ এভাবে এসে বিরক্ত করে! তাও নতুন জামাই। আমি কিছু বললাম না। ফ্রিজে একটা বক্সে গরুর মাংস ছিলো আমি সেটা বের করছি। মুক্তা দেখে বলল,

“কী করো ভাবী, ওরে বাসী খাবার খাওয়াবা?”

“বাসী খাবার কোত্থেকে পেলে? এটা তো ডিপে ছিলো। ”

“এসব ফকিন্নি মার্কা খাবার ও খায় না। নতুন রান্না করো। একটু পোলাও কইরো, ডিমের কোর্মা কইরো। ডিমের কোর্মায় টমেটো দিও। ও টক পছন্দ করে। ”

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম,

“রাত একটার সময় আমি তোমার ফরমায়েশ মতো কিছু রান্না করতে পারব না। এমনকি এক কাপ চাও না। তোমার জামাইকে তুমি খাওয়াও। ”

মুক্তা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি ঘরে চলে এলাম। শেষমেস সেই বাসী গরুর মাংস দিয়েই জুয়েল ভাই কে ভাত দিলো মুক্তা। পরদিন সকালে জুয়েল ভাই বলল,

“ভাবী আপনি তো ফাটাফাটি রান্দেন। গরুর মাংস তো সেই মজা ছিলো! ”

আমি হাসলাম। দুপুরে জুয়েল ভাই খেয়ে যাবেন। মুক্তা আবারও এসে আমাকে ফরমায়েশ দিয়ে গেল কী কী রাঁধতে হবে। আমি সব উল্টো করলাম। ও মুরগির ঝাল রোস্ট করতে বলেছিল আমি মিষ্টি রোস্ট করেছি। ইলিশ মাছ ভাজার বদলে বেগুন দিয়ে ঝোল করেছি। ডিমের আইটেম টোট্যালি বাদ দিয়েছি। ছোট মাছ দিয়ে টমেটোর টক করেছি।

জুয়েল ভাই খেতে বসে প্রশংসা করলেন। বললেন,

“ভাবী আপনার মায়ের কাছ থেকে রান্না শিখছেন? খুব ভালো রান্না। ”

তারপর মুক্তার উদ্দেশ্যে বললেন,

“তুমি আম্মার কাছ থেকে যা শিখছ সব ভুলে যাও। ভাবীর থেকে রান্না শিখবা৷ প্রতি সপ্তাহে তিনটা আইটেম শিখবা। তারপর একদিন পরীক্ষা দিবা। তোমার এই সপ্তাহের টাস্ক হইলো আজকে যা যা রান্না হইছে সেইগুলো। ”

মুক্তার চোখের দৃষ্টি চাইলেও এড়াতে পারিনি। বেচারির হেরে যাওয়া চোখ দেখে মনে মনে ভাবি, এতো সংসার নয়, যুদ্ধক্ষেত্র।

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-১৭

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১৭
ঈদের পর একসঙ্গে অনেক গুলো ঘটনা ঘটলো। মনির সম্পত্তির ভাগ চাওয়া নিয়ে একদিন ঝামেলা হলো। পাশা মিয়া তার ফ্যামিলি সহ এসেছিল। সঙ্গে মনিও, এবারও ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র। সঙ্গে কয়েক রকম মাছও। মনি সম্পত্তির ভাগ চায়। সে সবকিছু বুঝে পেলে আর এদিকে আসবে না। তবে এবার ওরা ঝামেলা করতে পারলো না। এসেছিল ঝামেলা করতে। উল্টো কিল, ঘুষি, থাপ্পড় খেয়ে গেল। মামাশ্বশুর আর জামিল ভাই মিলে পাশা কে বেশ মারলেন। শিল্পী আক্তার চিৎকার চেঁচামেচি করতে গিয়ে মামীর হাতে এক থাপ্পড় খেলেন৷ মনিকে আম্মা কয়েকটা থাপ্পড় মারলেন। চূড়ান্ত রকম অশান্তি৷

এরা আবার পুলিশও নিয়ে এসেছে৷ তখনই আসল চাল টা চাললেন। মামাশ্বশুর মনির কাছ থেকে স্ট্যাম্পে যে সই নিয়েছিল সেখানে লেখা, মনি পাশা মিয়ার সঙ্গে বিয়ে করে চলে গেলে বাপের সম্পত্তির কিছুই পাবে না৷ এমনকি বাপের বাড়িতে এসে কোনোরকম অশান্তি করলেও তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এমন উইল দেখে মনি কেঁদেকেটে অস্থির। পাশা মিয়াও গ্যাড়াকলে পড়ে গেছেন। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছেন। মাছ খাইতে খাইতে তার শরীরে তেল জমে টইটম্বুর। এখন কয়দিন জেল হাজতের খাবার খাক, তেল কমবে।

শিল্পী আর মনির নাটক বেশীক্ষন চলল না। তারা বিদায় হলো নাটকীয় কান্নাকাটি করে। আম্মাকে দেখলাম খুব কাঁদলেন। কার অভিশাপে তার সংসারের এই দশা! এই আক্ষেপে কাঁদলেন৷

***
পরের ঘটনা টা হলো মুক্তাকে নিয়ে। মুক্তা এমনিতে মনির মতো নয়। পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ। কলেজে যায় সম্ভবত আড্ডা দিতে। পরীক্ষার আগে টেনশনে অস্থির থাকে। মনির মতো সাজগোজ নিয়ে অতো সচেতন না হলেও বাইরে গেলে সেজে যায়। আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক সহজ আবার কঠিন। পুরোপুরি সহজ, সরল হয়ে ওর সঙ্গে আমি মিশি না, তাতে কিছু সমস্যা হয়।

এবার আসি আসল ঘটনায়। সেদিন আমার কলেজ নেই। দুপুরে রান্না করছিলাম। ও’কে দেখলাম শোকেসে রাখা কাঁচের গ্লাস নিয়ে এসেছে ধুতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

“কেউ আসছে?”

“হ্যাঁ ভাবী, একজন মহিলা। পানি চাইলো। ”

“শুধু পানি দিও না, একটু লেবুর শরবত দাও। টিনের বাক্সে বিস্কুট আছে, কিছু বিস্কুটও দিও। ”

ও আচ্ছা বলে চলে গেল। লেবু আনতে গিয়ে দেখলো ফ্রিজে তরমুজও আছে। বলল,

“ভাবী তরমুজ কেটেও দেব? গরমে ঠান্ডা জিনিস ভালো হবে না?”

“দিতে পারো। ”

সেই মহিলা পানি আর শরবত টুকুই খেলেন। বাকী কিছু মুখে দিলেন না। নামাজ পড়ার জন্য জায়নামাজ চাইলেন। মুক্তা সব ব্যবস্থা করে দিলো।
আমি ভদ্রমহিলাকে ভাত খেতে অফার করলে রাজী হলো না।

আম্মা গেছিলেন পাশের বাসায়। এসে সবকিছু শুনে আমার উপর রাগ ঝাড়লেন খানিকক্ষণ। কে না কে আসছে, তারে তুমি খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হইয়া যাও! চোর, ডাকাতও তো হইতে পারে! আর ভালো মানুষ হইলেও তারে খাওয়ান লাগবে কিজন্য! জিনিসপত্রের যা দাম! এরপর কেউ পানি চাইলেও দিবা না।

ভদ্রমহিলা দিন দুয়েক পর আবার এলেন। তিনি এসেছিলেন পাত্রী দেখতে। এভাবে উনি পাত্রী দেখেন। মুক্তাকে উনি পছন্দ করেছেন তার ভাইয়ের ছেলের জন্য। মুক্তার আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করেছে। আশেপাশে অনেক গুঞ্জন শুনলেও মুক্তার সঙ্গে বিয়ে দিতে কোনো আপত্তি নেই।

নাবিদ রাজী হলো না। মুক্তা পড়ুক, ঠেলেঠুলে হলেও অন্তত ইন্টারমিডিয়েট টা কমপ্লিট করুক। আম্মা রাজী নন, এমন পাত্র এরপর যদি না পায়! মামাও পাত্রের খোঁজ খবর নিয়ে রাজী হলেন। পাত্রের নাম জুয়েল। চকবাজার কসমেটিক্স এর দোকান আছে নিজের। লালবাগে নিজেদের বাড়ি। ছয়তলা বাড়ির একেক ফ্ল্যাটে একেক জন থাকে। সব মিলিয়ে তারা আট ভাই বোন। জুয়েল ছেলেদের মধ্যে সবার ছোট।

জামিল ভাই শুনে বললেন,

“এইখানে বিয়া হইলেই ভালো, কেনু গুতা খাইয়া ঠিক হবে৷ এইগুলারে তো ভালো বানাতে পারে নাই। ”

আম্মা জামিল ভাইয়ের উপর রেগে যায়। নাবিদের সিদ্ধান্ত গুরুত্ব পায় না। মুক্তা নিজেও কেমন রাজী রাজী মনে হলো। একদিন জুয়েল ভদ্রলোকের সঙ্গে মুক্তা ঘুরতেও গেল। ফেরার পর মুখ দেখে বুঝলাম যে খুশি। অনেক কিছু কিনেও দিলো। বাসার সবার জন্য পুরান ঢাকার স্পেশাল কাচ্চি কিনে পাঠালো। মুক্তা আম্মাকে জানালো যে ওর বিয়েতে আপত্তি নেই।

একদিন পাত্রপক্ষ দেখতে এলো৷ মোট ষোলো জন এলো বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে৷ যথারীতি রান্নার দায়িত্ব আমার হাতে পড়লো। পোলাও, রোস্ট, ইলিশ মাছ ভাজা, চিংড়ি মাছ ভাজা, গরুর মাংস ভুনা, খাশির মাংস, টিক্কা, পায়েশ।

ঘরোয়া বৈঠকে আলোচনা হলো আপাতত বিয়ে হবে সাদামাটা৷ পরে বড় করে অনুষ্ঠান করবে৷ পরের শুক্রবার বিয়ের আয়োজন করা হলো৷ সাদামাটা বিয়েতেও তারা চৌত্রিশ জন আসবে। নাবিদ আম্মাকে বলল,

“এতো লোকের রান্না জরী সামলাতে পারবে না৷ বাবুর্চির ব্যবস্থা করা হোক৷ ”

আম্মার মুখ টা ছোট হয়ে গেল বাবুর্চির খরচের জন্য।

বিয়ে ঠিক হবার পর মুক্তার হাবভাব পাল্টে গেছে। আমার সঙ্গে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও জবাব দিতে কষ্ট হয়। আম্মাকেও ভীষণ উৎফুল্ল দেখায়। একেকজনের কাছে মুক্তার হবু শ্বশুর বাড়ির গল্প বলে। যা আছে তার চেয়ে তিন গুন বাড়িয়ে বলে।

বিয়ের আগের দিন আম্মা আমাকে বলেন,

“জরী শোনো, তোমারে বিয়ের সময় আমরা যে গয়নাগুলি দিছিলাম ওই গুলা দাও। ”

আমি বিস্মিত হই। বুঝতে পারি যে ওই গয়নাগুলো মুক্তাকে দেয়া হবে। বিনা বাক্যেই দিয়ে দেই৷ মা গয়নাগুলো দেখে বলেন,

“তোমাগো বাড়ি থেকে যে আংটি আর চেইন নাবিদ রে দিছিল ওইটাও দাও। বোঝোই তো, কত খরচ! এখন এগুলো দিয়া ম্যানেজ করি! কী বলো!’

আমি সেগুলোও দেই। বিপত্তি ঘটে পরী আপার দেয়া কানের দুল নিয়ে। আম্মা সেই কানের দুল চাইলে বলি,

“ওইটা দেব না। ওইটা আমার। ”

আম্মা কপাল কুঁচকে বলেন,

“আরে তোমার জিনিস কী একবারে নিতাছি আমি। মুক্তা কয়দিন পরবে৷ শ্বশুর বাড়িতে পুরান হইলে তোমার জিনিস ফিরায়ে দিবে। ”

আমি কঠিন গলায় বললাম, না।

আম্মা আমাকে রুক্ষ গলায় বললেন,

“বেয়াদব। বাপ, মায়ে আদব কায়দা না শিখায়েই শ্বশুর বাড়ি পাঠাইছে।”

এর পরবর্তী ঘটনা ভয়াবহ । আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম বাড়ি যাবার জন্য। নাবিদ কিছুতেই যেতে দিবে না৷ রাগে, অপমানে আমি খুব কাঁদলাম। আম্মার হেলদোল নেই। নাবিদ আম্মাকে কিছু বলতে গেলে উল্টো আরও দুই কথা শুনিয়ে দেয়।

মামাশ্বশুর আসেন, সঙ্গে মামিও৷ মামি বলেন,

“আপনে কোন মুখে ওর বাড়ির লোকেরে নিয়া খোঁটা দেন! আপনের মাইয়াই তো বিয়ের আগে কাইল্যা মাচ্ছুয়া ব্যটার লগে হোটেলে গেছে। আপনে এইগুলা শিখাইছেন। ”

আম্মাও পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করেন। মামিকে গালাগাল করেন৷ মামা নাবিদ কে বলেন,

“তুই জরীরে নিয়া যা। বিয়েতে তোর থাকা লাগবে না। বিয়া শেষ হোক, তারপর বাকী ব্যবস্থা নেয়া যাবে৷ ”

নাবিদ আমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। আমি রিকশায় বসে কাঁদতে কাঁদতে বলি,

“আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিলেই হবে। আমি একলা যাইতে পারব। ”

“পাগল আমি! আর এমন চেহারা নিয়ে তুমি বাড়ি গেলে আমাকে কেউ আস্ত রাখবে!”

“তাইলে পরী আপার বাসায় দিয়া আসো। ”

“কোনো বাসায় ই যাব না আমরা। আমরা কক্সবাজার যাব৷ অফিস থেকে তো ছুটিই পাই না৷ চলো এই সুযোগ কাজে লাগাই৷ ”

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-১৬

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১৬
আমার দিনগুলো কাটে ছন্দহীন। ছেলেমেয়েদের সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষা শেষ হলো রোজার আগেই। বিকেলে খানিকটা সময় পাওয়া গেল। ওরা কিছুদিন ছুটি নিলো। কলেজে যাওয়া হয়। সুবর্না একগাদা খাতা দিয়ে দেয়। লিখতে লিখতে হাপিয়ে যাই। মাঝেমধ্যে মনে হয় নিজেকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছি। আমারও একটু বিশ্রাম প্রয়োজন।

নিজের সুবিধার জন্যই বাড়িতে কাজের লোক পাল্টালাম। আগের খালা এসে কোনোরকম ঘর ঝাড়ু দিয়ে, মুছে রান্নাঘরের ক’টা বাসন মেজেই দৌড়াতো। প্রত্যেক মাসে আট দশ দিন বাড়ি গিয়ে থাকতো। আম্মার বহু দিনের পরিচিত লোক। কথাবার্তায়ও তেজ বেশী। আমি আম্মাকে না জানিয়েই কাজের লোক রাখলাম। সে ঘরদোর পরিস্কারের পাশাপাশি, বাসন মাজা, তরকারি কাটা, কাপড় ধোঁয়া, রুটি করা সব কাজ ই করে দিয়ে যায়। দুই বেলার বদলে আমি এখন একবেলায় সব রান্না করি।

আম্মা চোখ কপালে তুলে বলেন,

“এত্তগুলা টাকা খরচ করতে কইলজায় লাগে না তোমার? আমাদের কি সেই অবস্থা আছে যে এমন কাজের লোক রাখব। তোমার শ্বশুরের দোকানের অবস্থা ভালো না। জামিল তো কিছু দেয় না। বাড়িভাড়া আর নাবিদের টাকায় ই তো সংসার চলে। ”

আমি শান্ত গলায় বললাম,

“নাবিদের টাকা না আম্মা, এইটা আমার টাকা। আমার টিউশনির টাকা। ”

আম্মা গলার স্বর আরও রুক্ষ করেন। বলেন,

“টাকায় আমার তোমার বলে কিছু নাই। এই টাকা সংসারের টাকা। আর কী এমন কাজ, হাতে হাতে করলেই তো হয়ে যাবে। ”

“আমার তো দুইটা হাত মা। দুই হাতে পারি না, মুক্তা কলেজে যায়, পড়াশোনা করে ও’কে তো আপনি কিছু করতে দেন না। আর আপনি তো প্রায় ই অসুস্থ থাকেন। কোমড় ব্যথা, পা ব্যথা এসব লেগেই থাকে। তাহলে কাজ করার জন্য বাকী হাতগুলো কোথায়?”

আম্মা থতমত খেয়ে যায়। আমি যে এতগুলো কথা অকপটে বলব সেটা উনি ভাবে পারেন নি। উনি সারাদিন খিটমিট করতে থাকেন, বিনা কারণেই টাপুর টুপুর কে বকাঝকা করলেন। বাবার সঙ্গেও যাচ্ছেতাই আচরণ। আমি রাগের কারণ বুঝি, কিন্তু মাথা ঘামাই না।

আম্মা নাবিদ কে এই ব্যাপার বললেন। কিভাবে কী বলেছেন আমি জানিনা, তবে নাবিদ আমাকে এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করলো না। শুধু বলল,

“আম্মার সব ব্যাপার অতো গুরুত্ব দিও না, কিছু কথা এক কানে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিও। ”

আমি অবাক হলাম না। হেসে জিজ্ঞেস করলাম,

“এরকম বলছ কেন?”

“এমনি। কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা হলে আমাকে বলবে। ”

আমি হাসি। নাবিদ কে আমি কখনোই কোনো ঝামেলার কথা বলি না।

আম্মা নতুন খালার দোষ খুঁজে বেড়ান। তার কাজ পছন্দ হয় না। হেলেদুলে কাজ করে টাকা নিয়ে যান। এইভাবে খালি খালি টাকা নষ্ট হচ্ছে। এরচেয়ে সংসারের একটা জিনিস কিনলেও ভালো।

আমি পাত্তা দেই না। আমার মতো চলি। আম্মা এর ওর কাছে আমার বদনাম করে। দুটো পয়সা রোজগার করে দেমাগে বাঁচি না, হাভাতের ঘরের মেয়ে। পয়সা জীবনে চোখে দেখিনি।

এগুলো আমার পিছনে বললেও সামনাসামনি মাঝেমধ্যে খুব ভালো ব্যবহার করে। আমি মন খারাপ করেও আবার নিজেকে সান্ত্বনা দেই, ভালো মন্দ মিলিয়েই তো মানুষ হয়। কী হবে শুধু শুধু মন খারাপ করে। মানুষ কী তার পুরো জীবনে সবার কাছে ভালো হয়ে উঠতে পারে! আমিও নাহয় কারো কারো কাছে খারাপ ই রইলাম।

***
রোজার কয়েক দিন আগে ঝড়ের মতো এসে মনি আর পাশা মিয়া হাজির হয়। সঙ্গে রোজার বাজার। অনেক বাজার। আম্মা সবকিছু ভুলে যান। তিনি মেয়েকে নিয়ে আহ্লাদ করেন। খাবারের প্যাকেট গুলো দেখে খুশি আর ধরে না। একটা দিন কাটতেই হাজির হয় শিল্পী আক্তার লাভলী আর তার মেয়ে। শিল্পী আক্তার এক গাল হেসে বললেন,

“খালাম্মা আপনের নাতনি খালি কয়, নানুবাড়ি যাব তাই নিয়া আসছি। ”

তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“যাও তোমার নানুর কাছে বসো। নানুরে ছড়া শুনাও। ”

মেয়েও ছড়া শুনাতে শুরু করে। আম্মা বিরক্ত হলেও চুপ করে থাকে। ব্যাগভর্তি বাজার দেখে নরম হয়ে যায়।

নাবিদ আর জামিল ভাই প্রচন্ড রেগে যায়। বাবা দুজনকে সামলানোর চেষ্টা করেন। আম্মা বলেন,

“প্যাটের মাইয়া ফালাইয়া তো দিতে পারি না। আসছে, কয়টা দিন থাকুক। এরপর নাহয় বইলা দিলাম যে আর আসবি না। ”

নাবিদ খুব রেগে যায়। এতো রাগ ওর এর আগে কখনো দেখিনি।

মনি সবার জন্য জামা, কাপড় আনে। আমার জন্য আনা শাড়িটা আম্মার পছন্দ হয়। সে মুখ বেজার করে বলে,

“আমার জন্য মাইড্যা রঙ না আইন্যা ওই রঙ আনতি। ”

শিল্পী জবাব দেয়, খালাম্মা ওই রঙ আপনারে মানাবে না। ওইটা ভাবীরে মানাবে, ভাবী আবার ফকফকা সুন্দর। হিহিহি।

***
ঘরের কাজ সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাই। মনির সতীন, স্বামী সবারই মুখের রুচি খুব ভালো। মেয়েটা সারাদিন ঘুরঘুর করে আর খেতে থাকে। মুড়ি, বিস্কুট, চানাচুর, কলা সব খেয়ে শেষ করে তারপর চাল খায়। শিল্পী আক্তার মেয়ের সাফাই গায়। বলেন,

“মাসের পনেরো দিন মাইনষের খিদা বেশী থাকে। ”

আমি কিছু বলি না। শিল্পী আক্তার আমার সঙ্গে ভাব জমাতে আসে কিন্তু আমি চুপ থাকি। মনি একদিন বলল,

“ভাবী আপনে আপার সাথে কথা বলেন না ক্যান? আর আপনার মোবাইলে নিশি গান দেখতে চাইছে আপনি নাকি দেন নাই?”

“হ্যাঁ। ”

“ক্যান? ”

আমি মনির দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,

“আমার ইচ্ছা। ”

মনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,

“আপনি সুন্দর দেইখা আপনার অনেক দেমাগ তাই না?”

আমি জবাব দিলাম,

“হ্যাঁ। ”

মনি আবারও বিস্মিত হয়। একটু থেমে বলে,

” এতো দেমাগ ভালো না। ”

আমি ঠোঁট টিপে হেসে বলি,

“ভালো, মন্দ তুমি কেমনে বুঝলা! তুমি তো আর আমি মতো সুন্দর না। ”

মনি থতমত খেয়ে যায়। সারা বিকেল কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে যায়৷ পাশা মিয়াও তার ছোট বউয়ের দু:খে কাতর। শিল্পী আক্তার অবশ্য তেমন গুরুত্ব দেয় না। সে নিচতলার ভাবী আর নাজমা ভাবীর ওখানে ঘুরতে যায়।

***
দুদিন পর জামিল ভাই পাশা মিয়াকে বলে,

“এই মিয়া তোমার সার্কাস পার্টি নিয়া বিদায় হও। ”

পাশা মিয়া তখন রুটি ছিড়ে তার ছোট বউকে খাওয়াচ্ছেন। তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। মনি গলা চড়িয়ে বলল,

“বড় ভাই, এইগুলা কেমন কথা?”

জামিল ভাই মনিকে ঠাস ঠাস দুটো চড় মারলেন। পাশা মিয়া চোরের মতো এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলেন। শিল্পী আক্তার লাভলীও ভীত চোখে দাঁড়িয়ে আছে। মনি হু হু করে কাঁদতে লাগলো। জামিল ভাই গলা চড়িয়ে বললেন,

“এক ঘন্টার মধ্যে বিদায় হবি তোরা খবিশের দল। রাস্তাঘাটে বাইর হইতে পারি না তোদের নাটকের জ্বালায়। ”

বাক্স, প্যাটরা নিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই বেরিয়ে যায়। শিল্পী আক্তার লাভলী আম্মাকে বলেন,

“আমার বাড়ি যাইয়েন খালাম্মা। আপনের মতো এতো বাড়ি না থাকলেও আমার বড় মন আছে। আল্লায় দিলে একদিন আপনের চেয়েও বড় বাড়ি আমার হইবে দেইখেন। ”

আম্মা জামিল ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে আসেন। নাবিদও তখন রেগে যায়। বলে,

“আম্মা তোমার একি আক্কেল! মান সম্মান কিছু রাখবা না? তুমি তোমার এই মেয়েরে মাথায় উঠিয়ে নাচতেছ! এরপর মুক্তার জন্য ভালো সম্বন্ধ আসবে!”

আম্মা চুপ করেন। পরের দুটো দিন তার রাগ আর মেজাজ চড়া থাকে। দুদিন পর মুক্তা জানায় যে ওর জমানো চারশ চৌত্রিশ টাকা পাচ্ছে না। জামাকাপড়, কসমেটিক্স সব ঠিক আছে কিন্তু টাকাটা নেই।

***
রোজার মধ্যে মনি ফোন করে আম্মাকে বলল,ঈদের পর আসবে সম্পত্তি বুঝে নিতে।

চলবে….

লাজুকপাতা পর্ব-১৫

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১৫
পরী আপাও দুই তিন দিনের ছুটি নিয়ে পলাশবাড়ী চলে এলো। মা খুব খুশি হলেন। আপার কারণে আমার আরও কয়েকদিন থাকা হলো। নাবিদ অবশ্য রেগে যায় তাতে। ও দুদিনের ছুটি নিয়ে আমাদের নিতে আসতে চায়। আমি আজ না কাল, কাল না পরশু করে আরও পাঁচ দিন বেশী থাকি।

পরী আপা আসার পর আনন্দের মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেল। টাপুর টুপুরও নোটন কে পেয়ে ভীষণ খুশি। এখানে আসার পর মেয়েদুটো আরও বেশী হুটোপুটি করছে। কাদামাটি গায়ে মেখে খেলছে, হাসতে হাসতে জোয়ারের পানিতে গোসল করছে, বাড়ির অন্য বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বন বাদারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কিছুতেই বাঁধা দেই না। মা রেগে যান। বলেন, আমি ওদের খেয়াল রাখি না, ওদের লক্ষিছাড়া চেহারা দেখে আম্মা কী ভাববেন!

***
নাবিদ চলে আসে একদিন না জানিয়ে। অফিস করে রাতের ট্রেনে রওনা দেয়। ভোরবেলা পলাশবাড়ী স্টেশনে এসে নামে। আমাকে ফোন দিয়ে বলে,

“কাউকে একটু পাঠাও তো জরী, আমার একা যেতে লজ্জা লাগছে। ”

আমি পরী আপাকে বলি কাউকে পাঠাতে। নাবিদ একা আসতে লজ্জা পায়। নিরু আপা এই নিয়ে হাসাহাসি করে ভীষণ।

নাবিদ আসার পর জামাই আদরে যেন ত্রুটি না হয় তাই একটার পর একটা খাবার মা বানাতে থাকেন। এই পিঠে বানাচ্ছেন, মিষ্টি তৈরী করছেন। বিলের মাছ ধরা হচ্ছে, মাচার শাক কাটা হচ্ছে। বাবা দৌড়ে যান বাজারে তাজা মাছ কিনতে। চূড়ান্তরকম আতিথেয়তায় নাবিদ বিরক্ত হয়ে বলল,

“এই জরী, তুমি কী বাড়ির লোক কে বলেছ আমি রাক্ষস! আরে এতো খাবার আমি কিভাবে খাব! এতো খাওয়া যায়!”

নিরু আপা আসেন সস্তা রসিকতা করতে। পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো বের করে বলে,

“কী খবর দুলামিয়া, তোমার বউ কী এমন জাদুটোনা করছে! দুইদিন হইলো না, চইলা আসলা।”

নাবিদের কপাল কুঁচকে যায়। আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো কাশে। আমি বুঝতে পারি যে নিরু আপার রসিকতা ওর পছন্দ হয় না। অরুর সঙ্গে নাবিদের আচরণ সহজ সরল। ছোট বোনের সঙ্গে ভাইয়ের আচরণ যেমন থাকে তেমন। অরুও আমাদের দুই বোনের মতোই। নিজের সীমার মধ্যে থাকে।

সারাদিনের আদরমাখা অত্যাচার থেকে নিস্তার পেয়ে নাবিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ওর নাক দিয়ে চেপে ধরে আমার নাক। আমার নি:শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়, সরিয়ে দিতে চাইলেও সরে না। এক পর্যায়ে ছেড়ে দেয়। আমি বুক ভরে নি:শ্বাস নিয়ে বলি,

“তোমার রকমসকম তো সুবিধার না মোটেও। মেরে ফেলার জন্য এসেছ।”

নাবিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বলে,

“তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন! এত্তো দিন আমাকে ছাড়া থাকলে জরী? কেমনে পারলা…!”

আমি মৃদু হাসি। নাবিদ আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

“এই কয়দিনে আমি না পারছি খেতে, না পারছি ঘুমাতে। আর তুমি হাসো!”

“আম্মার রান্না আমার মতো মজা হয় নাই এজন্য ঘুমাতে পারো নাই, খাইতে পারো নাই ক্যান? ”

“ঘুমাব কেমনে! পাশ ফিরে নরম তুলতুলে পাশ বালিশ টা তো পাই না। ”

আমি হেসে ফেললাম। নাবিদও হাসলো।

***
নাবিদ তিন দিনের বেশি থাকতে পারে না। আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পরী আপা আরও দুদিন পর যাবেন। নোটনের ঠান্ডা লেগেছে। এই অবস্থায় মা কিছুতেই ছাড়বে না।

চাচাজান টাপুর টুপুরের জন্য জামা কিনে আনেন বাজার থেকে। সুন্দর জামা পরেও টাপুর টুপুর এর মুখ ভার। ওরা আরও ক’দিন থাকতে চায়। নাবিদ কে বলে,

“কাকাই, তুমি আসতে গেলা কেন? আমরা আরও কয়টা দিন থাকতাম। ”

নাবিদ আমার সঙ্গে কপট দেখিয়ে বলে,

“এই দুটো তো একদম তোমার মতো হইছে জরী, কী অবস্থা! ”

আসার সময় মা আমাকে বলে,

“মেয়ে দুটোর খেয়াল রাখিস। যতই দুষ্টমি করুক, তুই কিন্তু রাগ করবি না। নিজের মেয়েদের যেমন দেখতি, ওদেরকে তেমন দেখিস। ”

আমি হাসি। মা আমার স্বভাব জানেন। তবুও বারবার বলে দেন। আসার সময় আমি মায়ের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে গেলাম। মা ভীত গলায় বলে,

“কিছু বলবি?”

আমি মায়ের হাতে একটা বান্ডেল দেই। একশ টাকার কড়কড়ে একশোটা নোট। ব্যাংক থেকে নতুন নোট তোলা। মা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করেন,

“কিসের টাকা জরী?”

আমার মায়ের হাত ধরে বলি,

“আমার উপার্জনের টাকা মা। তোমাকে দিলাম। তুমি ইচ্ছেমতো খরচ কোরো। ”

“তোর এতো কষ্টের টাকা! আমায় এভাবে কেন দিচ্ছিস! ”

“মা তুমিও অনেকবার তোমার কষ্টের টাকা দিয়েছো তো। ”

কলেজে উঠে সায়েন্স পড়তে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। এক ধাক্কায় খরচ বেড়ে গেল। স্কুলে ভালো রেজাল্ট এর কারণে টিউশন ফি না লাগলেও কলেজে লাগলো৷ মাসে দুই হাজার টা। চাচাজান এতো টাকা দিবেন না, তিনি আর্টসে ভর্তি হতে বললেন। আমি তখন রোজ কাঁদতাম। পরী আপা মা’কে বোঝায়, মা রেগে গেলেও সেই টাকার যোগান দেন। মামাবাড়ি থেকে জমি লাগানো বাবদ কিছু টাকা বছরে পায়। এছাড়া কাঁথা সেলাই করতেন, কুশি কাটায় ব্যাগ বুনতেন। সেই টাকা দিয়ে আমার টিউশন ফি দেয়া হয়। ডানো দুধের কৌটোয় মায়ের জমানো টাকা থাকতো। মাসের শুরুতে সেই টাকা গুনে গুনে দিতেন। একদিন বড় ফুপু মা’কে বলেন,

“এইভাবে টাকাগুলো খরচা না করে মেয়েরে সোনার জিনিস বানায়ে দিতা। এতো পইড়া কী হবে, তোমার মেয়ে কী চাকরি বাকরি করে তোমারে দেখবে। ”

মা বললেন,

“সোনা, গয়না কপালে থাকলে শ্বশুরবাড়ি থেকে দিবে। আর পড়ালেখা জানা থাকলে কাজে আসবে, আর কিছু পারুক না পারুক। নিজের পোলাপান পড়াতে তো পারবে। ”

সেই মাসে টাকা নেবার সময় আমি মনে মনে বললাম,

“জীবনে আল্লাহ আমাকে আর কিছু দিক না দিক, মায়ের এই কৌটো ভরে টাকা দেবার সামর্থ্য যেন দেন।”

মা আমাদের তিন বোন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। আমরাও কাঁদি।

আমার যাবার সময় হয়। সবার মুখ থমথমে। নিরু আপার চোখ ছলছল করে। আমি বলি,

“ঢাকা বেড়াতে যাইয়ো আপা। তোমার না চিড়িয়াখানায় যাবার শখ। ”

নিরু আপা হেসে বলেন,

“তোগো মতন এমন কপাল নাই রে জরী। আমাগো ব্যটাগুলান বউয়ের শখ, আহ্লাদ কম বোঝে। ”

বাবা আসেন স্টেশন পর্যন্ত। টাপুর টুপুর কে চকলেট কিনে দেন। বাবা আমার ই মতন। সেও কিছু বলতে পারেন না, আমিও পারি না।

ট্রেন ছাড়ার পর নি:শব্দে কাঁদি। নাবিদ আমার কাঁধে হাত রাখে। টাপুর বলে,

“কান্না কইরো না কাকীমনি। আমরা আবার যাব। আবার পরীক্ষা হইয়া যখন স্কুল ছুটি হবে আমরা আবার যাব। ”

আমি হাসার চেষ্টা করি।

***
বাড়িতে যাবার পর আম্মার সাথে আমার কথা হয় নি একবারও। মুক্তার সঙ্গে একদিন কথা হয়েছিল। কিন্তু আম্মাকে আমি ফোন করিনি, সেও আমাকে ফোন করে নি।

ট্রেন জার্নির পর দীর্ঘ সময় গাড়ির জার্নিতে আমি অসুস্থ হয়ে গেছি। বমিও হয়ে গেল। সেই সঙ্গে অসহ্য গরম। আমাকে ঘরে ঢোকানো হলো ধরে। আমি বিছানায় শুয়ে রইলাম চোখ বন্ধ করে। আম্মা আমার জন্য লেবুর শরবত আনলেন। নিজ হাতে খাইয়েও দিলেন। সেদিন তার সঙ্গে আর কথাবার্তা হলো না। আমি ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলোও দেরি করে। নাবিদ অফিসে যাবার আগে ডেকে ঘুম ভাঙিয়েছে।

আমি রান্নাঘরে যেতেই আম্মা বললেন,

“গরমে এইদিকে আইসো না, ঘরে যাও। মুক্তা খাবার দিয়ে আসবে। ”

আমি টেবিলে বসি। প্লেট নিয়ে নিজেই খাবার বাড়তে যাই। আম্মা এগিয়ে আসেন। খিচুড়ি আর ডিমভাজা। লেবু আর কাচামরিচ এগিয়ে দেয়। হঠাৎ আমার কপালে হাত রেখে বলে,

“জ্বর আসে নাই তো! খাও আস্তে আস্তে। খিচুড়ি তুমি ভালো খাও তাই তোমার জন্য খিচুড়ি করছি। খাওয়া শেষ হইলে বিশ্রাম নাও। দুই তিন দিনে তোমার কোনো কাজ করার দরকার নাই। তুমি বিশ্রাম নাও। ”

আমি বিস্মিত হই। কঠিন মহিলার এমন নরম আচরণ আমাকে অবাক করে। আমার মনে হয় ক’টা দিন যে ছিলাম না তখন সে আমাকে মিস করেছে।

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-১৪

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১৪
আম, কাঁঠালের দিন শেষ হবার আগেই বাবা আসেন। সঙ্গে অরু আর আমার চাচাতো ভাই হাসান। বাবা ঝুড়ি ভর্তি করে আম, লিচু নিয়ে আসেন। আম্মা ভীষণ খুশি হন। অনেক দিন পর আমাকে দেখে অরু কেঁদে ফেলে। বলে,

“এমন নিষ্ঠুর কেন তুমি মেজপা, সেই যে বিয়ের পর একবার গেলে আর তো গেলে না। ”

আমি হাসি। বাবা আমাদের এখানে একটা দিন থেকে পরী আপার ওখানে যান। অরু আমার কাছে থাকে। অনেক দিন পর বোন কে পেয়ে আমারও ভালো লাগে। অরু আমাকে বলে,

“বাড়িতে সবাই ভাবতেছে তুমি রেগে আছ?”

আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করি,

“কিসের রাগ?”

“তোমার সাদামাটা বিয়া হইছে। তেমন কিছু দেয় নাই তোমারে এইজন্য। ”

আমি হাসি। বলি,

“কারা বলে এমন কথা?”

“মা, চাচীমা সবাই। চাচাজানের সাথে তো মায়ের একদিন তর্ক পর্যন্ত হলো। ”

আমি হাসি। অরুর পছন্দের রুই মাছের তরকারি রান্না হয়। তেতুলের টক দিয়ে রুই মাছের এই তরকারি টা ভীষণ পছন্দ করে অরু। মামাবাড়িতে গেলে ছোট মামী তখন এই রান্নাটা করে খাওয়াতেন। আমাদের বাড়িতে কখনো কারোর পছন্দের রান্না হতো না, যা রাঁধবে তাই খেতে হবে। না খেলে পিয়াজ, মরিচ দিয়ে খেয়ে নাও।

দুপুরে আমি অরুকে নিয়ে খেতে বসি। এক লোকমা খাবার মুখে দিয়ে অরু বলে,

“খুব মজা হয়েছে মেজপা। তোমার এমন সুন্দর গোছানো সংসার দেখলে মা খুব খুশি হতো। মা সারাদিন চিন্তায় থাকে। ”

অরুর কথা শুনে আমি হাসি। মফস্বল, কিংবা গ্রাম থেকে যারা আসে তাদের কাছে শহর কে প্রথমে রঙিন লাগে। বিকেলের টিউশন বাদ দিয়ে আমি অরু, টাপুর, টুপুর আর মুক্তাকে নিয়ে ঘুরতে যাই। অরু সবকিছু তে অবাক হয়। রাস্তায় ঝালমুড়ি খেয়ে ঝালে চোখ মুখ লাল করে ফেলে তবুও মুগ্ধতা কমে না। ফুচকা, ভেলপুড়ি, টিক্কা, আচার খাওয়া শেষে বাড়িতে ফিরি। অরুর চোখ, মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়।

বাবা বাড়ি ফেরার আগে আমাকে নিয়ে যেতে চান। শ্বশুরের কাছে অনুমতি চান, তিনি খুশিমনে অনুমতি দেন। নাবিদও বারন করে না। শুধু আড়ালে আমাকে জিজ্ঞেস করে,

“কতদিন থাকবা জরী। ”

আমি নাবিদ কে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করি। বলি,

“অনেক দিন পর যাচ্ছি তো, ক’টা দিন বেশী থেকে আসি। ”

নাবিদ অসহায় গলায় বলে,

“সপ্তাহ খানেকের বেশী থেকো না, প্লিজ।”

আমি হেয়ালি করি, নাবিদ আরও মন খারাপ করে। আমার বলতে ইচ্ছে করে, এই যে এতগুলো মাস বাড়িতে যাই নি সেটা কেন জানো? তোমার জন্য। আমি চলে গেলে তোমার খাবারে অনিয়ম হবে, বড্ড কষ্ট হবে।

***
পলাশবাড়ীতে যাওয়া হয় অনেক দিন পর। মনেই হয় না যে এতদিন হয়ে গেছে। এই তো সেদিন লক্কর ঝক্কর টাইপের গাড়িতে জবরজং বউ সেজে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম।

বাড়িতেই ঢুকতেই মা, চাচীরা সবাই যেন ঝাপিয়ে পড়লেন। তাদের ধারণা এক সমুদ্র অভিমান পুষে রেখেছি মনে। মা’কে কেমন যেন অচেনা লাগে। এমন আদর, যত্ন এর আগে সে করে নি। পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হয়। বড় কাতলা মাছ টা আমার জন্য রাখা হয়েছে। চাচাজান নিজ হাতে বাজার করেন। নিরু আপার সঙ্গে দেখা হয় অনেক দিন পর। ফুটফুটে সুন্দর একটা ছেলে হয়েছে। নিরু আপা বিশ্রী এক অভ্যাস বানিয়েছে। সারাক্ষণ মুখে পান, সুপুরি থাকে। আঙুলের ডগায় চুন। আবার বলে,

“বাবু পেটে থাকতে অভ্যাস হইছে রে। এখন আর ছাড়তে পারি না। ”

আমি সবার জন্য কিনে আনা জামা কাপড় গুলো দেই। এই জামাকাপড় গুলো আমার আর নাবিদের টাকায় কেনা হয়েছে। আম্মা সরু চোখে একবার দেখেছিলেন কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে নি। জামাকাপড় গুলো পেয়ে সবাই খুব খুশি।

আমার সঙ্গে টাপুর টুপুরও এসেছে। আমি মুক্তাকেও বলেছিলাম। মুক্তাও রাজি ছিল। নাবিদ কঠিন গলায় বলল,

“মুক্তার যাবার দরকার নাই। এদের স্বভাব ভালো না। একটা না একটা ঝামেলা করবে তারপর জরীকে দোষের বোঝা বইতে হবে। ”

জামিল ভাইও সেই কথায় তাল দিলেন। বললেন,

“ঠিক ই তো। একজন মাছওয়ালার সাথে ভাগছে, আরেকজন গাছওয়ালার সাথে ভাগবে। ”

মুক্তার মুখ ছোট হয়ে গেছে। আমি আর ও’কে জোর করতে পারলাম না। তবে বেচারির জন্য আমারও খারাপ লাগছিল।

***
নাবিদ আমাকে সারাদিনে অনেক বার ফোন করে। সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাতে। নিরু আপা চোখ কপালে তুলে বলে,

“তোরে তো জামাই মাথায় করে রাখেরে জরী! কী জাদুটোনা করলি রে!”

আমি আপার বোকা বোকা কথাগুলোকে মজা ভেবে হেসে উড়িয়ে দেই। নিরু আপা আমার হাতের ফোন টা দেখেও চোখ বড় করে।

“দাম কত রে… এতো দামী মোবাইল দিয়া তুই কী করবি?”

আমার পড়াশোনার ব্যাপার টা মা এখন মেনে নিয়েছে। পরী আপা মা’কে বুঝিয়েছে। বাড়ির অন্যান্য রা ব্যাপার টা ভালো চোখে দেখে নি। পড়াশোনার কী দরকার! চাকরির চিন্তা যেন ভুলেও না করি, চাকরি আর সংসার একসঙ্গে হয় না।

এসব কথা শুনে বরাবরের মতোই আমি চুপ থাকি। কাউকে কিছু বলি না। ম্যাট্রিকে সায়েন্স পড়তে গিয়েও অনেক কথা শুনেছি লোকের। তুই সায়েন্স পড়ে কী করবি, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবি। আবার ফেল করিস না যেন। সেই সময়গুলোও চুপ করে থেকেছে। আমি বিশ্বাস করি, একদিন আমার সময়ও আসবে। সেইদিন সবাই সবার জবাব পেয়ে যাবে। কাউকে কিছু আলাদা করে বোঝাতে হবে না।

***
ঘর, সংসার নিয়ে আলাদা করে ভাবনা কিংবা স্বপ্ন কোনোটাই ছিলো না আমার। কিন্তু এখন যেন কি হয়ে গেছে। পলাশবাড়ী তে আসার পরও সারাক্ষণ আমার ঢাকার বাসার কথা মনে পড়ে। নাবিদ কে বলে এসেছিলাম বারান্দার গাছগুলোয় পানি দিতে। ঠিকঠাক ভাবে দেয় কী না কে জানে। বাচ্চাগুলোকে পড়া দিয়ে এসেছি, ঠিকঠাক পড়ছে তো! সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষায় আবার খারাপ করবে না তো! সুবর্না ফোন করে খোঁজ নেয়। অনেকগুলো খাতা আমার জন্য জমিয়ে রেখেছে। নাবিদ সকালে ডাল, ভাত খেয়ে বেরিয়ে যায়! আম্মা যদি একটু মাছ টা হলুদ, লবন দিয়ে ভেজে দিতো তাও একটু ভালো হতো। বাবা বিকেলের চা টা বাইরে খেয়ে পেটের অসুখ বাঁধাচ্ছেন কি না কে জানে!

আমি কখনো এমন জীবন চাই নি। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি ব্যস্ততা থাকবে। তবুও এই জীবন টা ভালো লাগছে। সবশেষে এটাই মনে হয়, আল্লাহ যা করেছেন, যে ভাগ্য আমাকে দিয়েছেন ভালোর জন্য দিয়েছেন।

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-১৩

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১৩
পরী আপাদের ওখান থেকে আসার পর দেখলাম আম্মার আচরণ খানিকটা ঠান্ডা ধরনের। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন কম। ভাবলাম হয়তো মনির জন্য তার মন খারাপ। একটা দিন এমনই গেল। আমিও তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। নাবিদ অবশ্য আমার বেশী থাকা নিয়ে রাগ করলো না। স্বাভাবিক ই রইলো। কিন্তু আম্মার রাগের কারণ ধরতে পারলাম।

দুপুরে খেতে বসে আম্মা বললেন,

“তোমার আপার ওইখানে শুনলাম ভালোই বেড়াইলা। ”

টাপুর টুপুর এসে খুব গল্প করেছে। খালামনি ওদের অনেক আদর করেছে। মেলা থেকে ক্লিপ, মালা, জামা কিনে দিয়েছে।

আমি হেসে জবাব দিলাম,

“হ্যাঁ আম্মা, আপাও এমন জোর করলো যে দুদিনের জায়গায় চারদিন থাকতে হলো। ”

“বুঝলাম। যাবার সময় মুক্তারে একবারও বললা না, ক্যান ওরে নিলে তোমার আপার খরচ কী খুব বেশী হয়ে যাইতো?”

আমার কথা আটকে গেল। বিয়ের পর আম্মার ত্যাড়া কথার সম্মুখীন হলাম প্রথম। এর আগে আমার সঙ্গে এমন ত্যাড়া কথা বলে নি। আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম,

“ওর তো কলেজ ছিলো তাই…

আম্মা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,

“তুমি মুখের বলা তো বলতে পারতা। বিয়া হইয়া আসার পর দেখলাম না তো আমার মেয়েদের সঙ্গে তোমারে সেইরাম মিশতে। ক্যান দুনিয়ায় তুমি একলাই সুন্দর। ”

আমি আর কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না। প্রচন্ড কষ্টে গলা বুজে এলো। চোখ বেয়ে কষ্টগুলো ঝরে যাচ্ছে অবিরাম। সত্যি বলতে মুক্তাকে বলতে চেয়েও আমি বলিনি। আমি আপার কাছে গিয়েছিলাম দুটো দিন সব ভুলে আরাম আয়েশ করার জন্য। এটাও কী আমার দোষ ছিলো!

সেদিন আর রিনিদের পড়ানো হলো না। আমার কান্নাভেজা মুখ দেখে রিনি গিয়ে নাজমা ভাবীকে বলল। ভাবী বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। জোর করে ছাদে নিয়ে গেলেন। অনেক বার প্রশ্ন করলেন, আমি কিছু বললাম না। পরী আপা সবসময় একটা কথা বলেন, ঘরের কথা কখনো পরের কাছে কইতে নেই জরী। আমি চুপচাপ থাকি। নাজমা ভাবী বলেন,

“জরী, তুমি যে জায়গায় এখন দাঁড়িয়ে আছ, এই জায়গায় টুম্পা আসতো কাঁদার জন্য। কখনো কিছু বলতো না। তবুও আমি টের পেয়ে যেতাম অনেক কিছু। কান পাতলে দোতলার অনেক কিছুই কানে আসতো। এই বাড়িতে টুম্পাও এসেছিল তোমার মতো অল্প বয়সে। অনেক কিছু সহ্য করেছে, প্রতিবাদ করে খারাপও হয়েছে। তোমার সঙ্গে সেরকম কিছু যেন না হয়। ”

নাজমা ভাবী আমার মন ভালো করার জন্য অনেক কিছু করলেন। আচার খাওয়ালেন, তার বাপের বাড়ির গল্প করলেন। তবুও আমার মন ভালো হলো না।

**
নাবিদ অফিস থেকে ফিরে আমাকে দেখে চমকে উঠলো। বলল,

“কী হয়েছে জরী?”

আমি নাবিদের কাছ থেকে সরে যেতে চাইলাম। ও আমাকে ছাড়লো না। আমি বললাম,

“ছাড়ো, আমার কিছু হয় নি। ”

“কিছু না হলে, চোখ লাল কেন? কাঁদছিলে কেন?”

“এমনি। ”

“এমনি এমনি কেউ কাঁদে না জরী। আম্মা কিছু বলছে?”

আমি নাবিদের চোখের দিকে তাকাই। দুই ফোটা পানি আমার গাল বেয়ে পড়ে। চোখে চোখ রেখে বলি,

“আমি তো লক্ষি মেয়ে, লক্ষি মেয়েরা কখনো শাশুড়ী, সংসারের নিন্দে করে না। ”

নাবিদ চোখ নামিয়ে নেয়। রাতে আমার গলা দিয়ে কিছু নামে না। নাবিদ জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারে না। রাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে আমাকে। আমি টের পাই যে নাবিদও আমার মতো সারারাত জেগে থাকে। নীরবে কষ্টটুকু ভাগ করে নিতে চায়।

***
পরদিন সকালে অফিসে যাবার সময় নাবিদ আম্মাকে বলে যায়,

“জরীর শরীর ভালো না। ও রেস্ট নিক। ”

আম্মা হ্যাঁ, না কিছু বলে না। আমি কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার সময় বাবা জিজ্ঞেস করেন,

“কলেজে যাও? তোমার না শরীর খারাপ? ”

“তেমন কিছু না বাবা। গত সপ্তাহে একদিনও যাওয়া হয় নি। আজ যাওয়া দরকার। ”

“কিছু খাইয়া যাও। ”

“কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। খিদে পেলে বাইরে খাব। ”

আমি গলির মোড়ে এসে রিকশা খুঁজি। তখন বাবা আসেন। বলেন,

“একটু দাঁড়াও। ”

বাবা আসেন তিন, চার মিনিট পর। হাতে একটা পলিথিন। আমার হাতে দিয়ে বলেন,

“খালি পেটে থাকতে নাই মা। খাইয়া নিও। ”

আমার মন টা ভরে যায়। একটা সংসারের সবগুলো মানুষ একরকম কেন হয় না!

***
কলেজে এসে শুনি প্রথম ক্লাস টা হবে না। এই সুযোগে ক্যান্টিনে যাই। এখানে ক্যান্টিনের খাবার বেশ সস্তা। অনেকেই দেখছি ডিম, খিচুড়ি খাচ্ছে। আমি পিছনের দিকে একটা টেবিলে বসলাম।বাবার দেয়া খাবারের প্যাকেট টা খুললাম। পরোটা, বুটের ডালের সঙ্গে সবজি আর ডিমভাজি।

“হাই জরী কেমন আছ? ”

কলেজে আমার কোনো বন্ধু নেই। এক দুজনের সঙ্গে হাই, হ্যালো টাইপ আলাপ আছে। যে মেয়েটা আমাকে হাই বলেছে ওর নাম সুবর্না। সুবর্নার চুলগুলো রিবন্ডিং করা। রিবন্ডিং ব্যাপার টা আমি পলাশবাড়ী কলেজে পড়ার সময় জেনেছি। সুবর্না আমার সামনের চেয়ারে বসলো। বলল,

“তোমার সঙ্গে বসলে সমস্যা নেই তো…

“না না। ”

সুবর্না মেয়েটা স্মার্ট, চটপটে। ক্লাশে ছেলেদের সঙ্গেও হেসে গল্প করে। ওর বেশীরভাগ বন্ধুই ছেলে।

সুবর্না খাবার নিলো। খিচুড়ি আর অমলেট। খেতে খেতে বলল,

“তোমার প্র‍্যাকটিক্যাল খাতা দেখেছি জরী। কী সুন্দর হাতের লেখা তোমার। ”

আমি হাসলাম। থ্যাংক ইউ বলতেও কেমন যেন লজ্জা লাগছিল। সুবর্না আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

“কি করো তুমি?”

আমি জবাব দিতে সময় নিলাম। ও বলল,

“মানে পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু করো?”

“হ্যাঁ দুজন কে পড়াই। ”

“তাতে হয়? হাত খরচা হয়ে যায়?”

সুবর্না আমাকে দেখে বুঝলো না যে আমি বিবাহিত। আমিও আর বললাম না। খাওয়া শেষ করে যাবার সময় সুবর্না জিজ্ঞেস করলো,

“ফেসবুকে কী নামে আছ?”

“আমার তো ফেসবুক নেই।”

“কি বলো, স্মার্ট ফোন হাতে থাকা সত্যেও ফেসবুকে নেই! একটা একাউন্ট খুলে নাও। ”

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

***
বাড়িতে পর পর দুদিন আমি রান্নাঘরে গেলাম না। খাবারের মেন্যু রাতে আলুভর্তা আর ডাল, দুপুরে একটা তরকারি আর মাছ। সকালের খাবারের কোনো ঠিক নেই। জামিল ভাই টাপুর টুপুর কে টিফিন কিনে দিচ্ছেন। নাবিদও বাইরে খাচ্ছে। আমি ক্যান্টিনে ডিম খিচুড়ি দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। আমি ও আম্মা কেউই কারো সঙ্গে কথা বলছি না।

বেশ কিছুদিন পর আমার সঙ্গে সুবর্নার আবারও দেখা হলো ক্যান্টিনে। আমাকে দেখে বলল,

“এই জরী পরশু দিন কলেজে আসো নাই? আমি তো তোমারে খুঁজছিলাম। ”

“আমাকে? কেন?”

“ক্লাশে কয়েকজন কে প্র‍্যাকটিকাল খাতা ভাগ করে দিচ্ছিলাম তখন তোমার কথা মনে পড়ছিল। ”

সুবর্না আমাকে পুরো ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলল। এসএসসি থেকে শুরু করে অনার্সের প্র‍্যাক্টিক্যাল খাতা লিখে ও ওর হাত খরচের কিছুটা ম্যানেজ করে। ঠিকঠাক লিখতে পারলে, মাসে তিন চার হাজার টাকা পাওয়া যাবে।

আমি সুবর্নার কাছ থেকে খাতা আনা শুরু করলাম। বাড়িতে কাউকে কিছু বললাম না, নাবিদ কেও না। শুধু পরী আপা জানে। রিনি আর সিয়ামের সঙ্গে আরও তিনজন পড়তে আসতে শুরু করলো।

মাস শেষে দেখলাম হাতে হাজার দশেকের মতো টাকা আসছে। কলেজের প্রয়োজনে ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছিল। অল্প কিছু টাকা হাতে রেখে বাকীটা ব্যাংকে জমাতে শুরু করলাম।

আম্মার সঙ্গে আমি কথা বলি বুঝেশুনে। সেও আমার সঙ্গে লাগে কম। মুক্তার আজকাল প্রায় ই টাকা পয়সার দরকার হয়। দুইশ, একশ, পঞ্চাশ৷ নিলে সেই টাকা ফের‍ত দেবার আর প্রয়োজন মনে করে না।

একদিন বারন করে দিলাম। বললাম,

“তোমার ভাই বলেছে, ওর থেকে নিতে। তুমি বরং ওর থেকে নিও।”

এই ঘটনায় মুক্তার সঙ্গে সঙ্গে আম্মার মুখও ছোট হয়ে গেল। আম্মা আমার কাছে হঠাৎ হঠাৎ টাকা চান। না বলতে পারি না। একদিন বাড়িতে ডিনারসেট বিক্রি করতে এলো। নাজমা ভাবী, নিচতলার ভাবী এরাও এলেন। আম্মাও দেখলাম কাঁপ, পিরিচ, প্লেট, গ্লাস দেখছেন। মুক্তাকে ডেকে দেখালো ডিজাইন পছন্দ হয় কি না। হঠাৎ আমাকে ডেকে বলল,

“জরী, দুই হাজার টাকা নিয়ে আসো। ”

আমি প্রশ্ন করলাম, কিসের টাকা? ”

“তোমার কাছে আছে না, ওইখান থেকে দাও। ”

আমি মুখের উপর বলে দিলাম,

“না। সেই টাকা আমার কলেজে জমা দিতে হবে। ”

আম্মা ভয়ংকর আহত হলেন। ভাড়াটিয়াদের কাছে তার মুখ রইলো না। অনেক খুঁজে টুজেও দুই হাজার টাকা ম্যানেজ করতে পারলেন না। শেষমেস ডিনারসেট রাখা হলো না।

এই বিষয় নিয়ে নাবিদ কে একদফা নালিশও বোধহয় করেছে। নাবিদ আমাকে কোনো প্রশ্ন করে নি, কোনো কৈফিয়তও দেয় নি।

পরদিন সকালে জামিল ভাই বলল,

“জরী, সাবধানে থাইকো, এই বাড়িতে তোমার অবস্থা কিছুদিনের মধ্যে টুম্পার মতো হবে। ”

আম্মা ঝাপিয়ে পড়ে জামিল ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে শুরু করে। বেশীদূর পারে না, জামিল ভাই আগুনে ঘি লাগিয়ে চলে যান।

***
নাবিদ কে বলে আমি আরও একটা কাজ করলাম। টাপুর টুপুর এর নামে দুই হাজার টাকার ডিপিএস করলাম। নাবিদ কে বললাম,

“আমি যদি কখনো না পারি, তাহলে তুমি এই ডিপিএস দুটো চালিয়ে নিও। মেয়েরা একদিন বড় হবে, পড়াশোনার খরচ বাড়বে। ওদের আলাদা করে কিছু স্বপ্নও থাকতে পারে। জামিল ভাই চিরকাল একা নিশ্চয়ই থাকবে না। ভাবীর সঙ্গে ডিভোর্স এর প্রসেসিং চলছে। এই মেয়েরা আফসোস নিয়ে বড় হোক তা চাই না। ”

নাবিদ খুশি হলো। বলল,

“দিন দিন তুমি আমাকে মুগ্ধই করে যাচ্ছ জরী। যে মেয়েদের জন্য তুমি এতো ভাবছ তাদের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক নেই, তবুও এতো ভাবো! একদিন তুমি এর প্রতিদান পাবে!”

প্রতিদানের আশায় আমি কিছু করছি না। ওরা সারাজীবন আফসোসের জীবন বয়ে না বেড়াক সেটাই আমি চাই।

চলবে….

লাজুকপাতা পর্ব-১২

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১২
মনির জেদ কে হার মানতে হলো থানা পুলিশের কাছেও। সে কিছুতেই থাকবে না। উল্টো মায়ের নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ করলো। মারের চিহ্ন গুলোও দেখালো। শেষ অবধি পুলিশও হার মানলো। মনির বয়স জন্ম নিবন্ধন পত্রে উনিশ বছর। সেই হিসেবে এখন আর ও নাবালিকা নয়। বাবা, মা চাইলেই ঘরে আটকে রেখে মারতে পারে না।

পুলিশ চলে যাবার পর মামা এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। স্ট্যাম্পে মনির সই নিলেন। সেই সঙ্গে শিল্পী আক্তার লাভলী আর তার চাচীরও স্বাক্ষর নেয়া হলো। ভবিষ্যতে কোনো ঝামেলা হলে তারজন্য এই পরিবারের কেউ দায়ী থাকবে না।

আম্মা হাপুস নয়নে কাঁদলেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো তার মেয়ে এই কদিনের প্রেম ভালোবাসায় এতটাই আচ্ছন্ন যে মায়ের চোখের জলে কিছু যায় আসেই না যেন। মনি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। নিজের যা ছিলো সব নিয়ে গেল। মা, বাবার কাকুতি মিনতিতে কোনো কাজ হলো না। নাবিদ একবার কঠিন গলায় বলল,

“আরও একবার ভেবে দেখ, এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আর কিন্তু ফিরতে পারবি না। ”

মনি মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,

“হুহ! না ফিরতে পারলে মইরা যাব না। ”

আম্মার কান্না দেখে শিল্পী আক্তার এলেন সান্তনা দিতে। আম্মা তাকে একটা ধাক্কা মারলেন। রুক্ষ গলায় বললেন,

“দূরে সর নটি বেটি। ”

তাতে অবশ্য শিল্পী আক্তার লাভলীর কোনো ভাবান্তর হলো না। সে বেহায়ার মতো বলল,

“খালাম্মা গো, একদিন এই বেটিরে আপনে বুকে জড়ায়ে কানবেন। আজকে তো আপনের মাথার ঠিক নাই। ”

মনি চলে গেল। কী ভেবে যেন আমাকে বলে গেল,

“ভাবী যাই, দোয়ায় রাইখেন। ”

আমি বিস্মিত হবার সুযোগ পেলাম না। এতসব কান্ড ঘটে গেল! নতুন করে বিস্ময়ের কিছু নেইও আসলে।

***
বাড়ির পরিবেশ থমথমে রইলো দুদিন। অবশ্য বাইরের পরিবেশ এখনো গরম। নিচতলার ভাবী আমাদের দেখলেই একগাল হেসে জিজ্ঞেস করেন,

“মনির কোনো খবর আছে? কি করে ওইখানে যেয়ে। ”

আমরা বড় লজ্জায় পড়ে যাই। ওনার মুখ মামীর মতো উজ্জ্বল ঠেকে। জানিনা, মনির সঙ্গে কিংবা আমাদের সঙ্গে তার কী শত্রুতা। মুক্তার কাছে শুনলাম ওনারা এখানে আট বছর ধরে থাকেন।

সবকিছু নিয়মমাফিক চলে। জামিল ভাই কাজে যান, নাবিদ অফিসে। মুক্তা কলেজে যায়। বাবা টাপুর টুপুর কে স্কুল থেকে নিয়ে এসে ওদের সঙ্গে কার্টুন দেখে। আম্মা আগের চেয়ে আরও বেশি কপাল কুঁচকে থাকেন।
সব আগের নিয়মে চলে।

***
আমার দিনগুলো কাটে বিষন্নতায়। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে। সামনে রিনি, সিয়ামের পরীক্ষা। এই সময় বাড়িও যাওয়া যায় না। পরী আপা কিভাবে যেন আমার অস্থিরতা টের পেয়ে যায়। নাবিদ কে ফোন করে ওদের কাছে যেতে বলে। নাবিদ শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকে। আমি একটু শান্তি পাই। আপার কাছে গিয়ে একটু স্বস্তি পাওয়া যাবে।

শুক্রবার আসার আগে আমি নাবিদ কে বলি,

“একটা অনুরোধ করব তোমাকে?”

নাবিদ চমকে ওঠে। বলে,

“এরকম করে বলছ কেন জরী? ”

আমি হেসে বলি,

“আমি যদি দুটো দিন আপার ওখানে থাকি তাহলে কী তুমি রাগ করবে?”

নাবিদও হাসে। বলে,

“এই ব্যাপারও তোমার এমন করে আমাকে বলতে হলো জরী!”

“তুমি তাহলে রাগ করবে না ”

“দুই দিনের বেশী থেকো না প্লিজ। ”

আমি নাবিদের দিকে তাকাই। ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবি, সংসারে জটিলতা যাই থাকুক, এই মানুষ টা ঠিক থাকলে জীবনে আর কিছুর দরকার নেই আমার।

***
শুক্রবার সকালে নাবিদ আর আমার সঙ্গে টাপুর টুপুরও সেজেগুজে তৈরী হয়ে গেল। ওরাও বেড়াতে যাবে। জামিল ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ওদের নিয়ে গেলে সমস্যা নেই তো?
জামিল ভাই বললেন, কী বলো জরী! ওরা তোমার সঙ্গে যাবে তাতে আবার সমস্যা কিসের!

পরী আপা থাকেন মুন্সীগঞ্জে। বাস থেকে নামার পর রিকশা করে যেতে মিনিট দশেকের মতো লাগে। আপার দুই রুমের ছোট্ট বাসা। দুলাভাই ভালো মানুষ। আপার অবশ্য শ্বশুর বাড়ির ঝামেলা তেমন নেই। শ্বশুর শাশুড়ী কেউ বেঁচে নেই। দুলাভাই ভাই বোনেদের মধ্যে সবার ছোট। সবাই যে যার নিজেদের মতো থাকে। আপার নির্ভেজাল সংসার। টাকা, পয়সা কম হলেও শান্তিটুকু নিখাত।

আমাদের জন্য দুলাভাই অনেক বাজার করলেন। আপাও জমিয়ে রান্না করলেন। গরু, খাসি, রুই, পাবদা, ইলিশ, চিংড়ি সব আছে। নাবিদ খুব বেশী খেতে পারলো না। আপা খুব আফসোস করলেন। দুলাভাই এর সঙ্গে নাবিদের গল্পও হলো খুব। নাবিদ তো স্বভাবসুলভ চুপচাপ শুনলো। দুলাভাই ই নিজের মতো গল্প করলো।

নাবিদ যাবার সময় টাপুর টুপুর কে নিতে চাইলেও ওরা যেতে চাইলো না। নোটনের সঙ্গে ওদের ভাব হয়ে গেছে। নোটনও লক্ষি বাচ্চার মতো ওদের সঙ্গে খেলনা শেয়ার করছে।

আপাও টাপুর টুপুর কে রাখতে চাইলে নাবিদ আর না করলো না। যাবার সময় ও আপাকে বলে গেল, আমাকে যেন গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। আমার মনে হলো নাবিদের একটু মন খারাপ হচ্ছে, আমারও একটু মন খারাপ হলো।

***
দুলাভাই বাড়িতে নেই। অফিসের কাজে শ্রীমঙ্গল গেছেন। আমার বেড়ানোটা আরও ভালো হলো। আপা আমার পছন্দের সব রান্না করেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। ঘুম ভাঙে দেরি করে। ঘুম থেকে উঠতেই গরম গরম রুটি কিংবা চিতই পিঠা সামনে পাওয়া যায়। দুপুরে আপার রান্নার সময় আমি বসে বসে তেঁতুল মাখা খাই। সন্ধ্যে হলেই গরম চায়ে চালভাজা ভিজিয়ে খেতে খেতে ভাবি কী ভালো ভাগ্য আমার! এমন একটা বড় বোন আমার জীবনে আছে।

দুদিনের জায়গায় চারদিন থাকা হলো। আপা আরও রাখতে চাইলেন। নাবিদের ফোনকলে অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন বলে পারলেন না।

ফেরার দিন আমি আপাকে একটা শাড়ি দিলাম। আপা শাড়িটা হাতে নিয়ে বললেন,

“তুই কিনছিস? আমার জন্য? ”

শাড়ি খুলে দেখে আপা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। বললেন,

“এই জরী তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এতো দামী শাড়ি আনলি ক্যান? ”

আমি হাসলাম। আপা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে রইলেন। আমি জানি এই শাড়িটা আপার আলমারিতে থাকা শাড়িগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামী শাড়ি। আমার উপার্জন আর জমানো টাকায় কেনা। এই শাড়িটা কেনার জন্য আমি আর কারোর জন্য কিছু কিনিনি।

আপা আবারও বললেন,

“এতগুলা টাকা খরচ করলি ক্যান? এই শাড়ি দোকানে ফেরত দিলে নিবে?”

আমি হাসি। আপা আবারও কপট রাগ দেখায়। সারা রাস্তা এই শাড়ির গল্প চলতে থাকে।

গাড়িতে উঠে আপাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাই। আপা হাত নাড়েন, তার চোখভর্তি পানি। টাপুর টুপুর কে আরও কদিন না রাখতে পেরে অভিমানে নোটন ভেউভেউ করে কাঁদছে।

আমি আমার পরী আপাকে দেখি তখনও। আমার ফর্সা মায়ের দুধ সাদা এক মেয়ের জন্মের পর দাদীজান নাম রাখলেন পরী। এমন সুন্দর পরীর মতো মেয়ে সে দেখেন নি। সেই পরীর মতো সুন্দর মেয়েটার ছয় বছর বয়সে কী এক রোগ হলো। ডাক্তার, কবিরাজ কেউই রোগ ধরতে পারে না। চামড়া পঁচে যাচ্ছে। শহুরে ডাক্তার রা অনেক দিন ধরে চিকিৎসা করে। মা যখন তার সেই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে তখন সবাই হা হুতাশ করে। আহারে! এমন সুন্দর মেয়ের কী অবস্থা!

ব্যাহ্যিক সুন্দরের হিসাব করলে লোকে হয়তো আমাকে এগিয়ে রাখবে। কিন্তু সুন্দর মনের মানুষ, সেটা শুধু আমার পরী আপা’ই। আমি জীবনেও অমন হতে পারব না।

চলবে….

লাজুকপাতা পর্ব-১১

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১১
বাড়িতে কেউই পাশা মিয়ার সঙ্গে মনির সম্পর্ক মানতে রাজি নয়। বাবা নরম গলায় মেয়েকে যথেষ্ট বুঝালেন। কিন্তু তার বে*য়াদব মেয়ে কিছুতেই কিছু বুঝতে রাজি না। উল্টো বাবা, মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন। মামাশ্বশুর আবারও আসলেন। এবার সঙ্গে মামীও। উল্লেখ্য, মামী আম্মাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না। ওনার বাড়িতে আম্মা তেমন যান না। তবে নাবিদ কে উনি স্নেহ করেন। বিয়ের পর আমি আর নাবিদ যখন ওনাদের বাসায় গিয়েছিলাম তখন আম্মার সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হবার কথা বলেছিলেন। আম্মা ওনার কাছ থেকে কিছু গয়না এনেছিলেন। ফেরত দেবার সময় তার মায়ের দেয়া চেন টা দেয় নি। আম্মা নাকি অস্বীকার করেছেন চেনের ব্যাপার টা। সেই থেকে সম্পর্ক খারাপ।

মামীর মুখ টা উজ্জ্বল। ঘরে ঢুকতেই তার চাপা আনন্দ চোখে পড়লো। মনির আসন্ন সর্বনাশে সে বেজায় খুশি। আমাকে বলল,

“তোমার ননদের চয়েজ দেখছ জরী? মাছ বেঁচা বিয়াইত্তা ব্যটা ধরছে, হিহিহিহি! ”

আমি জোর করে একটু হাসতে চেষ্টা করলাম। তিনি চাপা গলায় বললেন,

“এক হোটেলে নাকি থাকছেও.. মানে বিয়ার আগের বাসর সাইরা আসছে। আল্লাহ গো!”

আমি চুপ করে রইলাম। এরা কেমন ধরনের আত্মীয় স্বজন! খারাপ সময়ে যে আত্মীয় রা খুশিতে টগবগ করে ফোঁটে তারা কী করে কাছের মানুষ হয়!

অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের জন্য ভালো মন্দ রাঁধতে হলো। আম্মার অবস্থা ভালো নয়, কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেবার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই। চারদিক থেকে সবাই তাকেই দুষছে। নাবিদ আর মামা মিলে ঠিক করেছে মনিকে আটকে রাখবে। মামা অবশ্য প্রথমে প্রস্তাব দিয়েছিল তার বাসায় রাখবে। মামী সঙ্গে সঙ্গে অমত জানালো। মুখের উপর বলে দিলো এমন কলঙ্কিনী মেয়ে তিনি তার ঘরে রাখবে না।

মনিকে আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। মুক্তা দিনের বেলা আমার সঙ্গে থাকে। বেচারি এই ঘটনায় ঘাবড়ে গেছে ভীষণ। আমাকে বলল,

“ভাবী মনি আমাকেও ফাঁসাবে। আম্মা এরপর যারে পাবে তার কাছে আমার বিয়ে দিবে। ”

আমি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। পারিবারিক এতো জটিলতা কম বেশী আগেও দেখেছি। তবে আমার মনির জন্য মায়া হয়। পরী আপা বলে, মনির চোখে রঙিন চশমা লাগানো জরী। যা ওর এখন সোনা মনে হচ্ছে, পরে তা কাঠকয়লা মনে হবে। ও’কে আটকে রেখে ভালো করছে। আমার মেয়েটার জন্য মায়া হয়। আমি একদিন কথা বলতে গিয়েছিলাম। আমাকে বলে,

“ভাবী আমাকে বাইর করনের ব্যবস্থা করেন। আপনার দুলাভাই আপনারে সোনার আংটি বানায়ে দিবে। ”

পাশা মিয়া ভদ্রলোক যে দুলাভাই বানিয়েছে সেটা বুঝতে আমার অবশ্য একটু সময় লাগলো।

আম্মা আমাকে বারন করে দিলেন ওর ঘরে যাবার জন্য। তিনি নিজে খাবার দিয়ে আসেন। যতবার খাবার দিতে যান ততবারই ঠাস ঠাস থাপ্পড়ের শব্দ পাওয়া যায়।

এতসব ঘটনায় জামিল ভাই ভীষণ খুশি। তিনি একেকবার একেকটা ঘটনা শোনেন আর হো হো করে হাসেন। একদিন আম্মাকে বললেন,

“আম্মা তোমার মাইয়া মাছ কুটতে পারে তো!”

আমি চুপ করে থাকেন। জামিল ভাই আবারও বলে,

“আম্মা তোমার আকাশী বাতাসী জামাই কী মাছ বেঁচে? ”

আম্মা রাগী গলায় বলেন,

“আমরা তোর কেউ না? মনি তোর কিছু হয় না? এতো ফূর্তি তোর! ”

জামিল ভাই আবারও হো হো করে হাসে। আর বলে,

“টাপুর, টুপুর আর ওদের মায়ের অভিশাপ। এই তো শুরু…

আম্মা ক্ষেপে যান। চিৎকার করে বলেন,

“কী করছি আমি? কিসের অভিশাপ? তুই কী ভালো মানুষ? সব খারাপ আমি করছি? তুই কিছু করস নাই? তোর বউ এই বাড়িতে থাকেনাই তোর জন্য। কোনো কাজ করতিস তুই! দুইটা বাচ্চা পয়দা কইরা তুই খালি ঘুমাইতি আর খাইতি। কোনো দায়িত্ব নিছস সংসারের! ”

জামিল ভাই আরও রাগারাগি করেন। নতুন কেনা ফিল্টার টা ফেলে দেন।

সন্ধ্যেবেলা নাবিদ এসে সব শুনে জামিল ভাইকে বলে,

“এখনো সময় আছে ভাইয়া। মেয়ে দুটো বড় হচ্ছে। তোমার থেকে ভালো কিছু শিখতেছে না। ওরা অলরেডি অনেক কিছু দেখছে। আর কিছু দেখাইয়ো না। এখন ছোট তাই একটা চকলেট দিয়া বুঝ দিতে পারো। বড় হইলে তুমি তা আর পারবা না। ”

নাবিদের সঙ্গে জামিল ভাইয়ের সম্পর্ক মাখামাখি ধরনের না হলেও নাবিদের কথা শোনে। জামিল ভাই চুপ থাকেন।

নাবিদ সংসারের ঝামেলা নিয়ে অনেক চিন্তিত ইদানীং। আমাকে একদিন বলল,

“তোমার অনেক খারাপ লাগে তাই না জরী। ”

“কই না তো।”

“আমি জানি তোমার খুব খারাপ লাগে। এতো জটিলতা কারোরই ভালো লাগার কথা না। তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই সংসার আলাদা করতে বলতো। এখানেই তুমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। ”

আমি অতি সন্ত:র্পনে দীর্ঘশ্বাস লুকাই। সংসারের ঝামেলা, জটিলতা মায়ের কানে পৌছানোর পর সে প্রায় ই বলে আলাদা হয়ে যাবার জন্য নাবিদ কে বলতে।

আমারও একটা নিজের সংসারের বড্ড লোভ। নিজের ছোট একটা বাসা। বারান্দাভর্তি গাছ, ছোট ছিমছাম রান্নাঘর। সকালে একসঙ্গে খেয়ে আমরা বেরিয়ে যাব। দুপুরে ফিরেই রান্নাবান্নায় ব্যস্ত থাকব। বিকেলের মধ্যে সব কাজ শেষ করে নাবিদের অপেক্ষায় থাকব।

এমন অন্যায় চাওয়া বোধহয় চাইতে নেই। তবুও কল্পনায় সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখি।

***
এইসব কঠিন দিনে বাড়িতে আরেক নাটক এসে উপস্থিত হলো। সেই নাটকের নাম শিল্পী আক্তার লাভলী। এক দুপুরে ঘরে দুজন বোরখা পরা মহিলা আর একটা বাচ্চা মেয়ে এলো। বাবাও বাড়িতে নেই। দোকানে কী একটা ঝামেলা চলছে সেই কারণে সেখানে গেছেন।

বাড়িতে শুধু আমরা মেয়েরা। ঘরে ঢুকেই আচমকা চিৎকার শুরু করলো।

“বইন.. বইনগো.. কই তুমিইইই…”

আম্মা দুপুরের খাবারের পর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। টাপুর টুপুর কেও অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছি। চিৎকার শুনে আমরা দৌড়ে এলাম। দরজা খুলেছিল মুক্তা। ও দেখছি ভীত চোখে দেখছে। আম্মা বললেন,

“এই তোমরা কে?” এইভাবে ঘরে ঢুকলা ক্যান? ”

শিল্পী আক্তার লাভলীকে আম্মার পা ধরে মরা কান্না কাঁদতে লাগলো।

“খালাম্মা, আপনি এমন পাষাণ! আমার বইনডারে আটকায়ে রাখছেন! ওরে খালাম্মা আমার কইলজাডা ফাইট্টা যায়। গলা দিয়া কিছু নামে না।”

নিচতলার ভাবী আর নাজমা ভাবীও ছুটে এলেন নাটক দেখতে। অন্য যে ভদ্রমহিলা ছিলেন সে নাকি পাশা মিয়ার চাচী। সে গিয়ে মুক্তার ঘরের দরজা খুলে মনিকে বের করে আনলো। পাশা মিয়ার বউ এবার মনিকে জড়িয়ে ধরে তার মরা কান্না শুরু করছে।

“ও বইন গো, নিশির বাপ বিছান নিছে গো.. খালি কান্দে আর কয়, ওরা আমার কইলজাটা কাইট্টা নিয়া গেছে রে নিশির মা। আমি আর বাঁচুম না। আমি মরলে তোমার আর নিশির কি হইবো!”

আমি সবাই কে ফোন করলাম। এই নাটক খানিকটা চলল। আম্মার ধমকে কোনো কাজ হলো না। শিল্পী আক্তার লাভলী তার নাটক চালিয়ে গেল।

এই নাটকের মাঝখানে পাশা মিয়ার বউ বললেন,

“মেলা দূর থিকা আসছি। ভাত, তরকারি যা আছে দাও।”

আমি কঠিন গলায় বললাম,

“আপনার জন্য রান্না করে রাখছি সেটা কে বলল?”

ভদ্রলোক বুঝতে না পেরে নাজমা ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলল,

“কী কয়? ”

নাজমা ভাবী বললেন,

“ও কিছু বলে না, পুলিশ যা বলার বলবে। আমরা পুলিশ খবর দিছি।”

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-১০

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-১০
মনি যাবার পর খেয়াল করলাম যে আমার গোছানো আলমারিটা একটু এলোমেলো। বুঝলাম যে এই আলমারিতেও হাত দিয়েছে। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে কিছু নিতে পারে নি। আলমারিতে আমার পরার নরমাল কাপড়গুলো ছাড়া আর কিছুই নেই। ভালো শাড়ি, জামা, গয়না সবকিছু ট্রলিতে লক করা। সেটা খোলার চেষ্টাও নিশ্চয়ই চালিয়েছে বেচারি।

আম্মা অধিক শোকে পাথর হয়ে আছেন। তার বহুদিনের জমানো টাকা। ষোলো হাজার তিনশ টাকা। খুচরো পঁচিশ টাকা অবশ্য রেখে গেছে। তবে মুক্তার জুতাটা নেবার রহস্য উদঘাটন করতে পারছি না। নিরু আপার মতো বেশী কথা বলার স্বভাব থাকলে নাবিদ কে হয়তো জিজ্ঞেস করতাম।

আমার মামাশ্বশুর আসেন কালেভদ্রে। বিয়ের পর দু’বার তাকে এবাড়ি দেখেছি। একবার আমাকে তার বাড়িতে নেবার জন্য এসেছিলেন, আরেকবার এসেছিলেন জামিল ভাইয়ের ঝামেলার সময়।

এবার এসে আমার শাশুড়ীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“আপনি এইগুলা কেমন পোলাপাইন বানাইছেন? আর ওর হাতে মোবাইল কে দিছে?”

নাবিদ দূর্বল গলায় বলল,

“মামা, জরী কলেজে যায় দেখে ওরে মোবাইল কিনে দিছিলাম। তারপর আম্মার জোড়াজুড়িতে ওরেও দেয়া লাগছে। ”

আম্মা ফোস করে উঠে বললেন,

“নাবিদ, কি বলিস এইগুলান! আমি জরীর মোবাইল দেখে হিংসায় মরি। ”

আমি অবাক হলাম। কী কথা হচ্ছিলো, আর সে কী অর্থ বের করেছেন।

মামা থামিয়ে দিয়ে বললেন,

“আপনি থামেন, আপনার বিন্দুমাত্র লজ্জা নাই! ঘরের বউ থাকে না, মেয়েরে সামলাইতে পারেন না। ”

আম্মার মুখ টা ছোট হয়ে গেল। আমার শ্বশুর কোনো কথা বলছেন না। তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।

মামা আমাকে বললেন, রাতে এখানে খাবেন। আমি রান্নার আয়োজন করতে গেলাম। ফ্রিজে একটু মুরগির মাংস আছে। ওটা নামিয়ে ভিজিয়ে রেখে ডিম সেদ্ধ দিলাম। কৌটায় রাখা পোলাওয়ের চাল টা বাছতে শুরু করলাম। বাবা তখন ডাকলেন,

“মা একটু এইদিকে আসো। ”

আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তার কাছে গেলাম। বসার ঘর, আর রান্না ঘরের মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা। বাবা বললেন,

“মনির মোবাইল নাম্বার টা আমারে একটু লিখে দিবা। আমি দোকান থেকে ফোন করে দেখি। ”

আমি ভীষণ অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষন। বললাম,

“বাবা ওর নাম্বার টা তো বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ”

“তবুও একবার চেষ্টা করে দেখি। ছোটমানুষ কই আছে, কেমন আছে!”

আমি কাগজে নাম্বার লিখে বাবাকে দিলাম। কাগজ নেয়ার সময় মুক্তা জিজ্ঞেস করলো,

“ভাবী কি করবা?”

“বাবা চাইলেন। দোকান থেকে ফোন করবেন বললেন।”

মুক্তা হঠাৎ আমার হাত ধরে বলল,

“আমার খুব ভয় করে। লোকজন দেখতে কেমন পিশাচের মতো। ওরে নিয়ে যদি বিক্রি করে দেয়!”

আমি আশ্বস্ত করে বললাম,

“চিন্তা কোরো না। ও বোকা টাইপ না। ও’কে ঠকাতে পারবে না।

***
মামা রাতে তৃপ্তি করে খেলেন। খাওয়ার সময় বললেন,

“পোলাও টা খুব ভালো হয়েছে জরী। ডিমের কোর্মায় নারকেল বাটা দিছো! কী সুন্দর ঘ্রাণ! তোমার শাশুড়ী জীবনেও এমন রানতে পারবে না। সে শুধু পারে এক পাতিল পেপের মধ্যে মুরগি দিয়ে ঝোল টাইপের একটা অখাদ্য রানতে। এরচেয়ে টুম্পার রান্নার হাত ভালো ছিলো”

এতো টেনশনের মধ্যেও সবাই পেট ভরে খেল। জামিল ভাইয়ের জন্য পোলাও বাড়তে গিয়ে দেখি কম হয়ে যায়৷ জলদি করে আরও এক পট চাল চড়িয়ে দেই।

নাবিদ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। ওর আবার সকালে জলদি অফিসে যেতে হবে। আমি জামিল ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করি। উনি একটা মার্কেটিং প্রজেক্টে কাজ করছেন। খুব সকালে বেরিয়ে যান, রাতে ফিরেন।

***
জামিল ভাই ঘরে ঢুকে বললেন,

“খাবারের গন্ধে আরও বেশী খিদে পেয়েছে জরী। গোসল না করে খেতে বসলে কী দোষ হবে? ”

আমি হেসে বললাম,

“না দোষ হবে না। কিন্তু গোসল করে খেলে ভালো লাগবে আপনার ই।”

জামিল ভাই হেসে বললেন,

“ঠিক বলছ।”

জামিল ভাই খেতে বসে বললেন,

“আমার মেয়েরা খেয়েছে?”

“হ্যাঁ। আমি দুজনকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। ”

“আমি জানি, তবুও প্রশ্ন করলাম মেয়েদের খোঁজ নেবার জন্য। ”

আমি হাসলাম। জামিল ভাই অতি দ্রুত খাচ্ছেন। আমার ভীষণ মায়া লাগলো। এই মানুষ টা যে জীবন কাটাচ্ছে সেটাকে কী আসলে কোনো জীবন বলে! পরী আপা বলে, মানুষের জীবনে খারাপ ঘটে দুটো কারণে। এক আল্লাহ যখন ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়। দুই তার নিজ কর্মগুনে। জামিল ভাইয়ের জীবনের খারাপ সময়টুকু যেন সাময়িক থাকে। মেয়ে দুটোর কারনেও যেন সব ঠিক হয়।

জামিল ভাইকে আমি বললাম,

“আপনার মনির জন্য টেনশন হয় না? ”

“না জরী, আমার সবকিছু জুড়েই শুধু আমার দুই মেয়ে। ”

“আজ মামা বলছিলেন, ভাবী নাকি ভালো রাঁধতেন।”

“অতো ভালো না। তবে কিছু আইটেম খুব ভালো করতো। ”

জামিল ভাই খাওয়া শেষ করতে পারেন না। হাত ধুয়ে চলে যায়। আমি সব গুছিয়ে ঘরে যাই। জামাকাপড় ঘামে ভিজে বিশ্রী অবস্থা। ঘুমানোর পোশাক পাল্টে বিছানায় বসি সাবধানে। নাবিদের ঘুম টা যেন না ভাঙে। তবুও বালিশে মাথা দিতেই ও হাত বাড়িয়ে কাছে টানে।

“তুমি ঘুমাও নি?”

“না। ”

“টেনশনে?”

“মনে হয়। ”

আমি শব্দ করে হাসি। নাবিদ বলে,

“আমার টেনশনে তুমি হাসো।”

“আমাকে একটা কথা বলবে?”

“কি?”

“ভাবী কেন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন?”

“এই প্রশ্নের জবাব না দিলে কী সূর্য কয়েক ঘন্টা দেরি করে উঠবে?”

আমি আবারও হাসি শব্দ করে। নাবিদও হাসে।

নিজের হাসিতে চমকে উঠি। এই বাড়িতে কতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে! অথচ কোনো কিছুই থেমে নেই। বাড়িতে ভালো রান্না হলো, তৃপ্তি করে সবাই খেলো। এখন যে যার মতো ঘুমাচ্ছে। সত্যিই কারো জন্য সময় থমকে যায়। সবকিছু চলে নিয়মমাফিক।

***
মনির খোঁজ পাওয়া গেল দুদিন পর। মাদারিপুরের সস্তা এক হোটেল থেকে পুলিশ ধরেছে। মেছো ব্যটাও সঙ্গে ছিলো। পুলিশের কাছে পরিচয় দিয়েছে স্বামী, স্ত্রী। কিন্তু প্রমাণ দিতে পারে নি। মেছো লোকটা কয়েক ঘা পিটুনি খেয়ে মুখ খুলল। ওরা আসলে বিয়ে করে নি। বাড়ি থেকে যাবার সময় টাকা, পয়সা নিয়ে গেলেও বার্থ সার্টিফিকেট নিলো না। সেই কারণে বিয়ে আটকে গেছে।

মনি ফিরে এসে নির্লজ্জের মতো বলল,

“আম্মা তোমরা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করো। অবশ্য আমাদের বিয়া আগে হইছে দুইবার। ”

আম্মাও প্রশ্ন করলেন,

“আগে কবে হইছে?”

“একবার মোবাইলে। শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আমরা দুইজন আল্লাহর কালাম পড়ে বিয়া করছি। আরেকবার মাদারিপুরে, আকাশ বাতাস সাক্ষী রাইখা। ”

আম্মা এতসব হজম করতে পারলেন না। প্রথমে জুতা তারপর ঝাড়ু,বালতি, পাতিল সবকিছু দিয়েই মারলেন। মারতে মারতে নিজেই ক্লান্ত হলো। এতো মার খাচ্ছে দেখে আমি গিয়েছিলাম ভালো মানুষের মতো ধরতে। আমিও দুটো খেলাম।

সপ্তাহ খানেক পর মেছো ব্যটার বাড়ি থেকে ফোন করলো আম্মার নাম্বারে। মেয়েটা নিজের পরিচয় দিলো। সে পাশা মিয়ার স্ত্রী শিল্পী আক্তার লাভলি। সে ম্যাট্রিক পাশ, তার একটা মেয়েও আছে, মেয়ে স্কুলে যায় না তবে আমপাড়া শিখতেছে। পাঁচটা সূরা তার মুখস্ত। ব্রেন ক্লিয়ার। সে চাচ্ছে তার স্বামী পাশা মিয়ার সাথে মনির বিয়ে হোক। সতীনের সংসার করতে তার আপত্তি নাই। আল্লাহ তারে অনেক টাকা, পয়সা না দিলেও বড় মন দিছে। মনিরে সে ছোট বোনের মতোই দেখবে।

মেছো লোকটার নামই পাশা মিয়া।

চলবে…