Monday, August 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 482



ধূসর রাঙা মেঘ_২ পর্ব-০৪

0

#ধূসর_রাঙা_মেঘ_২
#পর্ব_৪
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মাগরিবের নামাজ শেষ করে মেঘ নিচে নামলো কফি খাওয়ার জন্য। কিচেনে গিয়ে দেখলো মায়মুনা চৌধুরী চা বানাচ্ছে। মেঘকে দেখে মায়মুনা চৌধুরী বলল,,

“তুমি এখানে?”

“কেন আসতে পারি না বুঝি। ভয় পাবেন না আপনার কিচেন জ্বালিয়ে দেব না। ”

“আমি সেভাবে কিছু বলি নি। আমি বলতে চাইছিলাম কি দরকারে এসেছো?

“আপনি তো বলেন নি কোন কিছু দরকার কি না? আপনি বলেছেন তুমি এখানে তাহলে।”

মায়মুনা চৌধুরী কিছু বললো না। নিজের কাজ করতে লাগলো চা বানানো শেষ এখন কাপে ঢালছে। তা দেখে মেঘ বলল,

“কফি বানাতে এসেছিলাম।”

“আমি সবার চা বানাচ্ছিলাম।”

“আমার জন্যও নাকি?”

“তুমি চাইলে খেতে পারো?”

“লাগবে না আপনি যান আমি আমার কফি বানিয়ে খেতে পারবো।”

মায়মুনা চৌধুরী একবার মেঘের দিকে তাকিয়ে চলে গেল ট্রে নিয়ে। বাকিরা সবাই আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলো। এই সময়টা সবার চা খাওয়ার সময়। মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিল কারন আয়মান চৌধুরীও কফি খাবেন। সবাই চা খাচ্ছে আয়মান চৌধুরী বাদে তিনি আর সমশের চৌধুরী একটা সোফায় বসেছে । মেঘ গিয়ে মাঝখানে বসে পরলো। আর আয়মান চৌধুরীর দিকে কফি এগিয়ে দিল। আয়মান চৌধুরী মুচকি হেসে কফি নিল। তখন সমশের চৌধুরী বললেন,,

“মেঘ আবার কফি বানানোর কি দরকার ছিল?”

“দরকার ছিল দাদুভাই। কারন আমি আর আব্বা এই সময় এতদিন কফি খেয়েই এসেছি। এখন এ বাড়িতে এসে হুট করে নিজের পছন্দ বদলাতে পারবো না তাই না।”

“বুঝতে পেরেছি তো সবাই যখন এখানে আছো তাহলে তোমাদের সবাইকে একটা সিদ্ধান্ত জানাতে চাই। কাল থেকে আয়মান আমাদের অফিসে বসবে।”

এ কথা শুনে কিছু লোকের যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তখন আয়মান চৌধুরী বলল,,

“আব্বা আমার সময় হবে না। কারন আমি আমার অফিস থেকে সময় বের করতে পারবো না। ওটা এতদিন যেমন শাফিয়ান দেখছিল তেমনটাই দেখবে না হয়। তাছাড়া ওর সাথে দুলাভাই তো আছে দেখাশোনা করছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে বসতে হবে না। তুমি না হয় সবকিছু দেখে নিও একবার করে। এটা তো তোমারও অফিস।”

“না আব্বা আমার অফিস নয়। আমি সেই অফিস ছয় বছর আগেই পরিত্যাগ করেছি। এবং নিজের বিজনেস দাড় করিয়েছি। যার মাধ্যমে এখন আমি একজন সফল বিজনেসম্যান।”

তখন শাফিয়ান চৌধুরী বললেন,,

“তাছাড়া ভাইয়া বসবে কিভাবে? এতবছর ধরে আমি আর রেজাউল ভাইয়া অফিসের সবকিছু দেখছি হুট করে তো বুঝতেও পারবে না ভাইয়া।”

“একজন সফল বিজনেসম্যান এর কাছে বিজনেস বোঝা কঠিন ব্যাপার নয়। ছয় বছর আগে আয়মান যেভাবে বিজনেস সামলাতো তোমাকে দায়িত্ব দেওয়ায় পর কি সেই ভাবে পালন করতে পারছো? আমরা তো উপরে উঠতেই পারছি না মনে হচ্ছে নিজেদের দাড় করানো বিজনেসটা নিচের দিকে নামছে।”

এ কথা শুনে শাফিয়ান চৌধুরী মাথা নিচু করে ফেলল তখন রেজাউল আহমেদ বললেন,,

“বিজনেসের অবস্থা একদম ভালো না বাবা। তাই তো আমি আর শাফিয়ান মিলেও কিছু করতে পারছি না। আজকাল বিজনেসের সাথে রাজনীতি যুক্ত হয়েছে।”

“এই তোমাদের এক্সকিউজ শুরু হয়ে গেল। আয়মান তুমি বলো কি করবে?

“আমি অফিসে বসবো না আব্বা। আমি আমার বিজনেসটাই দেখবো।”

তখন আয়না চৌধুরী বলল,,,

“ভাইয়া বসে পড়ো অফিসে। এখানে বসলে তুমি আবারও তাড়াতাড়ি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। তুমি কি বিজনেস করো ? তোমার কম্পানির নাম ও শুনলাম না কোথাও? আমাদের এত বড় চৌধুরী ইন্ড্রাস্ট্রিজ যা সবাই এক নামে চিনে এখানে বসলে তোমারই লাভ হবে।”

এতক্ষন চুপ করে থাকলেও মেঘ এখন বলল,,

“কেন? আমার আব্বার নাম কি কম নাকি? আমার আব্বাকে আয়মান চৌধুরী নামে সবাই একনামে চেনে। কি বললেন? আমার আব্বার কম্পানির নামও শুনেননি। শুনবেন কিভাবে? আমার আব্বার কম্পানির নাম জানেন আপনি। তাছাড়া আমার আব্বা অন্যের বিষয়ে নিজের নাম কামায় না। সে নিজের কাজের মাধ্যমেই নিজেকে আলোকিত করতে ভালোবাসে অন্যের আলোয় নয়। তাছাড়া আমার আব্বার লাভের দরকার নেই তাই না আব্বা?

আয়মান চৌধুরী হেঁসে বললেন,,

“একদম তাই!”

তখন সমশের চৌধুরী মেঘের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,,

“কি করছো মেঘ?”

তখন মেঘ ও ফিসফিস করে বলল,,

“আহ হা দাদুভাই আপনি টেনশন কেন নিচ্ছেন? যা হবে ভালো হবে আপুর বিয়েটা ভালোভাবে মিটতে দিন। তারপর থেকে দেখুন না কি কি হয়।”

মেঘ সরে আসলো বাকি সবাই অবাক চোখে দেখলো। তখন সমশের চৌধুরী আবার বলল,,

“আচ্ছা আয়মান যেহেতু পারবে না তাহলে আর বলে লাভ নেই।”

তখন মেঘ বলল,,

“আপনাদের আর কোন জরুরি কথা না থাকলে আমি ওপরে যেতে পারি।’

তখন জায়মা বলল,,

“একদম না মেঘ এখন আমরা সবাই আড্ডা দেব। তুই ওপরে যাবি না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আমার কাজ আছে আমি তাড়াতাড়ি চলে যাবো কিন্তু!”

“আচ্ছা ঠিক আছে!”

তখন সমশের চৌধুরী বললেন,,

“আমিও আমার নাতি নাতনিদের সাথে আড্ডা দিতে চাই। আমি কি তোমাদের সাথে জয়েন হতে পারি?”

এ কথা শুনে সবাই হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কারন সমশের চৌধুরী সবসময় নাতি নাতনিদের থেকে দূরে থাকতেন কারন কেউ ভয়ে তার কাছে ঘেঁষতো না। তখন মেঘ বলল,,

“কেন নয় দাদুভাই।”

“তো বড়রা তোমাদের এখানে থাকতে ইচ্ছে হলে থাকো নাহলে চলে যাও। কিন্তু আমাদের ডিসটার্ভ করা যাবে না। এখন আমি আমার নাতি নাতনিদের সাথে আড্ডা দেব।”

বড়রা সবাই নিজেদের কাজে চলে গেল আবার কতোজন বসেও রইলো। সমশের চৌধুরী আয়মান চৌধুরী কে সরিয়ে মেঘকে নিয়ে জায়মাদের কাছাকাছি সোফায় বসলেন। সবাই চুপ করে আছে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তখন মেঘ বলল,,

“দাদুভাই আপনাকে ভয় পেয়ে সবাই চুপ করে আছে।”

“কেন আমি বাঘ না ভাল্লুক যে ভয় পাবে?”

তখন শায়লা বলল,,

“আসলে নানাভাই তুমি তো তেমন আমাদের সাথে মিশতে না তাই কেমন যেন লাগছে।”

“সত্যি বলতে গেলে আমার গিন্নিকে হাড়িয়ে, আমি খুব একা হয়ে পরেছিলাম। সারাক্ষণ তাকে ভোলার জন্য কাজ নিয়ে পরে থাকতাম। ঐ ঘটনার পর বাচ্চা সহ্য হতো না আমার‌। তাই তোমাদের থেকে দূরে থাকতাম। তবে আমি কিন্তু মানুষ টা খারাপ না‌।”

এ কথা শুনে মেঘ অন্য দিকে তাকালো। তখন জায়মা বলল,,

“দাদুভাই তোমাদের তো এরেঞ্জ ম্যারেজ ছিল তাই না। দাদি তো আমাদের গল্প বলতো তুমি নাকি একদিন দাদিকে ভুত ভেবেছিলে গাছে চড়েছিল বলে।”

“তো ভাববো না তোমার দাদি ছিল গ্ৰামের চঞ্চল মেয়ে। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। সে ভরদুপুরে বাড়ির ভেতরে আম গাছে ছিল। সে কাঁচা আম পারতে গাছের মাথায় উঠেছিল পাতার জন্য তার শুধু পা দেখা যাচ্ছিল। আমি দুপুর বেলা কাজ থেকে ফিরে হুট করে গাছের দিকে তাকাতেই শুধু পা দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়েছিলাম। গ্ৰামের মানুষ ভুতের ভয় তো থাকবেই তাই না। কি বোকা ছিলাম ভাবতেই হাঁসি পায়। সেদিন ও কি দিন ছিল।

বলেই তিনি হাসলেন সবাই মুগ্ধ চোখে তার হাঁসি দেখলো। তখন কোথা থেকে আজান এসে বলল,

“বাহ ইন্টারেস্টিং তো। দাদুভাই আমি ভাবছি আমার বউয়ের জন্য এখনই একটা আম গাছ লাগাবো। তোমার এই ব্যাপারটা বোঝার জন্য আমার বউকে শাড়ি পড়িয়ে গাছে উঠিয়ে দেব। তারপর তাকে দেখে ভয় পাওয়ার এক্টিং করবো। তারপর আমিও আমার নাতি নাতনিদের গল্প শোনাবো।”

এ কথা শুনে সবাই হাসলো কিন্তু মেঘ তার চিরচেনা মুচকি হাসিটাই হাসলো। হুট করে মেঘের লিলি আর গোলাপ গুলোর কথা মনে পড়লো। মেঘ বলল,,

“দাদুভাই তোমরা আড্ডা দাও আমি যাচ্ছি।”

“আরো বসো না এখন তো আমি ভাবছি বুদ্ধির খেলা খেলবো। ”

“এই মেঘ বোস তুই সবসময় শুধু পালাই পালাই করিস।”

শায়লার ধমকে মেঘ আবার বসলো। তখন সমশের চৌধুরী বললেন,,

“তো আমি দশটা প্রশ্ন করবো। যে সবথেকে বেশি উত্তর দিতে পারবে তার জন্য একটা গিফট থাকবে। তবে হ্যা ফোন ইউজ করা বা কারো কাছে জিজ্ঞেস করা যাবে না।

সবাই ‘ঠিক আছে” বলল, সবাই গিফট পাওয়ার কথা শুনে খুশি হয়ে গেল। তখন জিয়ান বলল,,

“তাহলে তো গিফটা আমিই পাবো কারন আমি এখানে সবথেকে বেশি ইন্টেলিজেন্ট।”

“এই আইছে গোবর পচা মাথা নিয়ে বলতে আমি সবথেকে ইন্টেলিজেন্ট !”

“জায়মা আপু একদম ইনসাল্ট করবে না। ”

তখন মেঘ বলল,,

“আচ্ছা প্রশ্ন শেষ হলেই তো বোঝা যাবে তোমরা ঝগড়া করছো কেন?”

“মেঘ একদম ঠিক বলেছে জিয়ান তুই হম্বিতম্বি না করে বসে থাক‌।”

সমশের চৌধুরী বললেন,,

“তো তোমাদের সবার প্রথম প্রশ্ন হলো এই, এমন কোন Word আছে যার মধ্যে সবগুলো Vowel আছে? ”

সবাই ভাবতে লাগলো কি হতে পারে। মেঘ হাসলো শুধু বাকিরা ভাবতে লাগলো তিন মিনিট পর সবাই হাল ছেড়ে বলল জানি না। তখন সমশের চৌধুরী বললেন,,

“মেঘ তুমি কিছুই বললে না তারমানে তুমি জানো এর উত্তর কি?”

“হ্যা দাদুভাই উত্তর হলো education. এই ইডুকেশন word টায় পাঁচটা Vowel – ই আছে। a.e.i.o.u সবগুলোই।”

তখন সমশের চৌধুরী হেঁসে বলল,,

“আমি জানতাম তুমি পারবে।”

তখন আজান বলল,,

“আরে মেঘ আপু তুমি তো জিনিয়াস । আমার মাথাতেই আসে নি।”

সবাই মেঘের বাহবা দিল। তখন সমশের চৌধুরী বললেন,,

“আচ্ছা তো এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন , আল কুরআন এ কোন সূরায় দুই বার ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ আছে?”

এটা শুনে সবাই আগেই বলল পারবেনা তখন মেঘ বলল,,

“সূরা নামল এ!”

“ওকে তৃতীয় প্রশ্ন আল কুরআন এ মোট কয়বার বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আছে?”

তখন জিয়ান তাড়াতাড়ি করে বলল,,

“১১৫ বার।”

“ভুল উত্তর!” তখন আজান বলল,,

“আমি জানি, ১১৪ বার কারন সূরা নাজমে দুইবার বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম থাকলেও সূরা তওবা তে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম নেই। তাই মোট ১১৪ বার‌।”

“মাশাআল্লাহ দাদুভাই! তো একটা প্রশ্নের উত্তর আজানের কাছে গেল। তো চতুর্থ প্রশ্ন জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি কে?”

তখন শায়লা বলল,,

“হামিদুর রহমান!”

“ভুল উত্তর!” তখন জায়মা বলল,,

“আমি জানি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। আরে শায়লা হামিদুর রহমান তো শহিদ মিনার এর স্থপতির নাম।”

তখন শায়লা বলল,,

“আসলে দুটোর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক আমারটা তুই নিলি।”

তখন সমশের চৌধুরী বললেন,,

“যাক তোমরা মনে রেখোছো একজন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার এগুলো জানা উচিৎ।”

এভাবেই আরো নয়টা প্রশ্ন করে ফেললেন সমশের চৌধুরী। তার মধ্যে মেঘ উত্তর দিয়েছে তিনটা, শায়লা একটা, জিয়ান একটা, জায়মা একটা,আর আজান দুইটা। শিফা আর মুন একটার উত্তর ও দিতে পারে নি। তখন সমশের চৌধুরী বললেন,,

“তো দশ নাম্বার এবং শেষ প্রশ্ন আজান দাদুভাই তোমার একটা চান্স আছে জেতার। কারন তুমি যদি উত্তর দিতে পারো তাহলে তোমাদের দুজনের মধ্যে আরো একটা প্রশ্ন করবো। তবে প্রশ্নটা সবার জন্যই তারপর যে জিতবে তাকে গিফট দেব। তার আগে একটা খাতা কলম নিয়ে এসো।”

আজান গিয়ে খাতা নিয়ে আসলো। সমশের চৌধুরী এক থেকে দশ পর্যন্ত নাম্বার উঠালো। তারপর বলল,,

“এই ১-১০ এর মধ্যে তোমরা যেকোন চারটা সংখ্যা দিয়ে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ যেকোন একটা করে করে তোমাদের ফলাফল ৭৭৭ বানাতে হবে।
আমি আবারও বলছি যেকোন একভাবেই ফল বের করতে হবে এবং চারটার বেশি সংখ্যা নিতে পারবে না কিন্তু ফলাফল ৭৭৭ ই হতে হবে।”

সকলে চেষ্টা করুল কিন্তু উত্তর মিললো না। তখনি ওর ফোনে একটা মেসেজ এলো তা দেখে ও তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে এসে খাতায় লিখতে শুরু করলো কারন এতক্ষন সবার জন্য অপেক্ষা করছিল কেউ পারে কি না ? মেঘ লিখতে লাগলো আর বলল,,

“আমি পারবো দেখো কিভাবে হয়। আমি প্রথমে তিনটা সংখ্যা নিলাম ২৫৯ তার এটাকে ফলাফল ৭৭৭ বের করার জন্য আরেকটা সংখ্যা নিলাম সেটা হলো ৩ মোট চারটা সংখ্যা নিলাম । এরপর ২৫৯× ৩ = ৭৭৭। এবার সব প্রশ্ন শেষ দাদুভাই আমি জিতে গেছি। কিন্তু আপনি গিফট টা আজান কে দিয়ে দিয়েন এখন আমি ওপরে গেলাম।

বলেই মেঘ ফোন নিয়ে কাউকে কল করে ওপরে চলে গেল কারো কথা না শুনেই। কিন্তু ওর কার্যকলাপে সবাই অবাক। তখন আজান বলল,,

“মেঘ আপু একটা জিনিয়াস লেডি। কারন আপু যেগুলোর উত্তর দিয়েছি সেগুলো আমরা ভাবতেই পারি নি। আর আমরা সবাই যেগুলোর উত্তর দিয়েছি সব নরমাল ছিল।”

তখন সমশের চৌধুরী বললেন,,

“ঐ প্রশ্নগুলো আমি তোমাদের জন্য নয় বরং মেঘের জন্যই করছিলাম। আমি জানতাম আমার শের নি পারবে। যাই হোক আজান আমার রুমে এসো তোমার গিফটা নিয়ে যেও‌।”

“না দাদুভাই লাগবে না কারন ওটার আসল হকদার আমি না।”

“তোমার প্রতি গর্ব হচ্ছে আমার। আচ্ছা আমিও রুমে গেলাম।”

বলেই তিনি চলে গেলেন। তখন জায়মা বলল,,,

“কি জিয়ান মুখ থেকে সব কথা হাওয়া। এই জন্যই বলে বেশি হম্বিতম্বি করতে নেই। মেঘের ভাষায় যদি বলি তাহলে বলা হতো , সামনের জন চুপ করে আছে মানে সে দূর্বল নয় হতেও পারে সে বড় মাপের খেলোয়াড়।”

জিয়ান রেগে চলে গেল জায়মা, শায়লা, আজান আর মুন হাসলো।

এদিকে মেঘ ফোন করে জানতে চাইলো,,

“তুমি সিওর যে ওরা ঐ ফ্ল্যাটেই ঢুকেছে?”

“………..

“ওয়াও গ্ৰেট তুমি নজর রাখো। আর হ্যা এটা তুমি ছাড়া যেন আর কেউ না জানে।”

“……………

“গুড জব নিজের খেয়াল রেখো আল্লাহ হাফেজ।”

ফোন রাখতেই মেঘ হেঁসে বলল,,

“ওকে মিস্টার এবার দেখবো তোমরা পালাও কিভাবে। এখন দাদুভাই এর প্রশ্ন সাজাতে হবে কি বললো ৭৭৭ এটা দিয়ে কি বুঝালো।”

মেঘ কিছুক্ষন ভেবে বের করলো। তারপর গোলাপের দিকে নজর পরতেই দেখলো লিলি গোলাপের সামনে শুয়ে আছে। তা দেখে মেঘ হেসে বলল,,

“লিলি গোলাপ ফুল তোর এত পছন্দ কেন? এত ভালো বিছানা ছেড়ে তুই টেবিলে গিয়ে শুলি। ”

লিলি আয়েশি ভঙ্গিতে ডেকে উঠলো তারপর ওর কোলে বসে পড়লো আর মিয়াও মিয়াও করতে লাগলো। তখন মেঘ ওকে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,,

“তুই জানিস লিলি আজ তোর বাবার সাথে দেখা হয়েছিল। আমার কি মনে হয় জানিস তোর বাবা আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের প্রস্তাব দেবে। কারন তোর বাবার চোখে দেখেছি আমাকে পাওয়ার আকুলতা আর তীব্র ইচ্ছা। মুখ ফুটে বলতে পারলো না আজ কিন্তু ওনার চোখ বলে দিচ্ছিল।”

লিলি ধূসরের কথা শুনে আরো বেশি মিয়াও মিয়াও করতে লাগলো। তা দেখে মেঘ হাসলো। আর বলল,,

“বাবাকে বুঝি খুব মিস করছিস। আর ক’টা দিন অপেক্ষা কর তোর বাবা আসবে।”

লিলি ওর মতো ডাকতে লাগলো। মেঘ ওকে খাবার দিল। ডিনার সময় হয়ে গেল মেঘ ডিনার করে এসে শুয়ে পড়লো। আজ তার ভালো লাগছে।

________________

“আমায় বিয়ে করবেন ধূসর এহসান শুভ্র?”

কোন মেয়ের এহেন কথায় ধূসর যেন আকাশ থেকে পড়ল। কিন্তু মেয়েটার চেহারা দেখে ধূসর খুশি হয়ে বলল,,

“আপনি সিওর, আপনি কি বলছেন?”

“হুম সিওর!”

“তারমানে আপনি আমায় মেনে নিলেন।”

“হুম নিলাম!”

“আলহামদুলিল্লাহ আর শুকরিয়া মিস কাশফিয়া তাহলে চলুন কাজী অফিসে।”

“হুম চলুন।”

ওরা কাজী অফিসে গেল কিন্তু কাজী অফিস বন্ধ তা দেখে ধূসর বলল,,

” এটা কোন কথা আমি বিয়ে করতে এলাম আর কাজী অফিস বন্ধ। এটা ঠিক না।”

ধূসরের কথা শুনে মেঘ হেঁসে উঠল। তা দেখে ধূসর বলল,,

“একদম হাসবে না নিষ্ঠুর মেয়ে আমি এদিকে টেনশন করছি আর তুমি হাসছো।”

মেঘ হেঁসেই যাচ্ছে তা দেখে ধূসর রেগে একটা পাথর উঠিয়ে কাজী অফিসের জানালায় মারলো। কাঁচ ভাঙ্গার বিকট আওয়াজ হলো। ধূসর ধরফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলো। ধূসর এখন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো ভোর চারটা বিশ বাজে তার মানে সে স্বপ্ন দেখছিল। ধূসর পানি খেল আর বলল,,

“কি অদ্ভুত ভয়ঙ্কর সুন্দর স্বপ্ন। মিস কাশফিয়া আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। আমরা বিয়ে করতে গেলাম কিন্তু কপাল খারাপ শালা স্বপ্নেও বিয়ে করতে পারলাম না।আবার তাকে নিষ্ঠুর মেয়ে বললাম সে হেঁসে উঠল। অদ্ভুত মেয়ে। আচ্ছা আমি ওনাকে এত অবলীলায় কিভাবে নিষ্ঠুর মেয়ে বলতে পারি? কোন জড়তাই কাজ করে না।”

ধূসর মেঘের কথা ভেবে হাসলো তারপর একটু থেমে বলল,,

“আমি বোধহয় আপনাকে ভালোবাসি মিস কাশফিয়া। আপনি জানেন রোজ রাতে আপনি আমার স্বপ্নে আসেন কোন শুভ্র শহরে আপনাকে যখন ধরতে যাই তখনি আপনি অদৃশ্য হয়ে যান। আপনার মুখটা দেখার জন্য কত অস্থির হয়ে উঠে আমার চোখগুলো। আপনার কন্ঠ শোনার জন্য সবসময় আমার কানদুটো খাড়া হয়ে থাকে। আমি জানি এটা ঠিক নয়। কিন্তু আমি আপনার প্রতি এই অনুভূতি গুলো কন্ট্রোল করতে পারি না। এই অনুভূতি খারাপ দিকে যাওয়ার আগে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আমি আপনাকে হালাল ভাবে পেতে চাই। বেশি অপেক্ষা করবো না আর কয়েকটা দিন তারপরেই আপনাকে আমার করে নেব।”

ধূসর খুশি মনে মেঘের কথা ভাবতে লাগলো কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান দিলে ও ফজরের সালাত আদায় করে নিল। আল্লাহর কাছে দোয়া করলো খুব সহজেই যেন কাশফিয়া নামক মেয়েটাকে পেতে পারে।

মেঘ ফজরের নামাজ আদায় করে । ভোর হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে ও গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ালো। সূর্য উঠে পড়েছে তখন ওর ফোনটা বেজে উঠলো ও ফোনটা হাতে নিতেই অবাক হলো কারন ফোনটা ধূসর দিয়েছে। মেঘ ফোন ধরে কানে নিতেই শুনলো,,

“আসসালামু আলাইকুম নিষ্ঠুর মেয়ে!”

হুট করে নিষ্ঠুর মেয়ে শুনে মেঘ চমকে উঠলো। ও নিজেকে সামলে বলল,,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম! কিন্তু ডক্টর আপনি ঠিক আছেন?”

“ওহ সরি সরি আসলে ভুলে বলে ফেলেছি কিছু মনে করবেন না। আমার মাথায় বোধহয় একটু সমস্যা হয়েছে শুধু নিষ্ঠুর মেয়ে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।”

“তা সকাল সকাল আপনি পাগল হয়েছেন সেটা জানাতে ফোন করলেন। কিন্তু আপনি পাগল হলে সকলে কি বলবে আপনাকে? পাগল ডক্টর।”

পাগল ডক্টর শুনে ধূসরের কেমন যেন লাগলো। কিন্তু ও বলল,,

“বললে আর কি করার?”

“তা কি মনে করে ফোন দিলেন?”

“আপনি তো একজন লয়ার তাই না।”

“হুম তো!”

“আমার একটা কেসে আপনাকে সাহায্য করতে হবে।”

“তা কি রকম কেস?”

“আমার এক বন্ধু ওর গ্ৰামের বাড়িটা বিক্রি করতে চায়। কিন্তু ওর চাচা অবৈধ ভাবে ওটা দখল করেছে। ওকে দখল ও দিচ্ছে না আবার বিক্রি করতেও দিচ্ছে না ।বেশ প্রভাবশালী লোক গ্ৰামের । ওখানের পুলিশরাও ওকে সাহায্য করতে নাকচ করে দিয়েছে।”

“ওহ আচ্ছা তাহলে নিশ্চয়ই পুলিশকে টাকা খায়িয়ে রেখেছে। এটা আজকালকার যুগে তেমন কোন ব্যাপার না।”

“হুম ব্যাপারটা ও কাল রাতে আমার সাথে শেয়ার করলো। আর জিজ্ঞেস করল আমার পরিচিত লয়ার আছে কি না? আমি আপনার নাম বলেছি আর সকালে আপনাকে জানালাম।”

“আপনার বন্ধুর কাছে ঐ বাড়ির কাগজ আছে?”

“এখানেই তো সমস্যা ওর কাগজ টা ওদের বাড়িতে কোথায় যেন আছে। তাই তো জোর দিয়ে কিছু বলতেও পারে না তাছাড়া ওকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। ওর বাবা পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। এখানে সব পড়াশোনা করতো বলে ওর মাকে এখানে নিয়ে আসে। এখন ওর কিছু টাকা লাগবে তাই বাড়ি বিক্রি করতে চাইছে। কিন্তু গ্ৰামে গিয়ে দেখে এই অবস্থা। ওকে বাড়ির বাইরে থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছে ওর চাচা।”

সবশেষে মেঘ বলল,,

“ওহ আচ্ছা। সত্যি আপনার বন্ধু নাকি আপনার কলিগ!”

এ কথা শুনে ধূসর একটু অবাক হলো তাই বলল,,

“হুম আমার কলিগ ছয় মাস আগে আমাদের হাসপাতালে জয়েন করেছে। এগুলো সব উনিই বলেছে আমি আগে থেকে জানতাম না। আমার বন্ধু বললাম যাতে আপনি কাজটা নেন।”

মেঘ হাসলো ধূসরের কথা শুনে। ও বলল,,

“আপনার কলিগ বললেও আমি কাজটা করতাম। আপনি আপনার কলিগকে আমার অফিসে পাঠিয়ে দেবেন। যা করার আমি করে নেব।”

“আপনার অফিসের ঠিকানা তো আমি জানি না?”

“তাহলে আমার নাম্বার দিয়ে আমার সাথে কথা বলতে বলবেন। আমি জানিয়ে দেব।”

“কেন আমাকে অফিসের ঠিকানা দিলে কি সমস্যা?”

“আপনার দ্বারা আমার বিশ্বাস নেই কখন হুটহাট অফিসে হামলা করেন।”

কথাটা শুনে মেঘ নিজেই থতমত খেল আর ধূসর তো অবাক হলোই। ধূসর বলল,,

“কি বললেন?”

“আপনার রোগ আমাকে ধরেছে বোধহয় আজব কথাবার্তা বলছি। এক কাপ কফি খাওয়া প্রয়োজন।”

“তো বানিয়ে খেয়ে নিন।”

“হুম এখন কিচেনে যাচ্ছি।”

বলতে বলতে মেঘ নিচে চলে এলো। নিচে কেউ নেই। ও কিচেনে ঢুকে দিল। কফি বানানোর কার্যক্রম শুরু করলো। তখন ধূসর বলল,,

“কিচেনে পৌঁছে গেছেন। ইশশ আমি আর আপনি এক জায়গায় থাকলে এক সাথে কফি খেতে পারতাম।”

মেঘ হেঁসে বলল,,

“তো আমার সাথে কফি খাওয়ার ইচ্ছে কেন হলো?”

“এমনিই! আচ্ছা আপনি আমাকে আরেকটা বন্ধুর কাজে হেল্প করতে পারবেন?

“বলুন শুনি তারপর দেখছি হেল্প করতে পারবো কি না?”

“আচ্ছা বলছি আমার বন্ধু একটা মেয়েকে অনেক পছন্দ করে। মনে করেন অনেক অনেক। তাকে সবসময় সামনে বসিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে। একটা অদ্ভুত টান অনুভব হয় যেন শত বছরের চেনা। তার সব কাজই মূলত ভালো লাগে। এখন আমার বন্ধুর কি করা উচিৎ।”

মেঘ মনোযোগ দিয়ে ধূসরের কথা শুনলো। সব শুনে বলল,,

“তাহলে তার উচিৎ মেয়েটাকে নিয়ে তার অনুভূতি খারাপ দিকে যাওয়ার আগেই বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া।”

“যদি সে প্রস্তাবে রাজি না হয়?”

“তাহলে তার থেকে তার অনুভূতি কে কন্ট্রোল করা উচিৎ। আর মেয়েটাকে ভুলে যাওয়া উচিৎ।”

এ কথা শুনে ধূসর রেগে গেল আর বলল,,

“বললেই হলো ভুলে যাওয়া এতোই সহজ। নিষ্ঠুর মেয়ে একটা। একটু ভালো কথা বললেই ওনার নেগেটিভ কথা বলতে হবে। কেন ভালো বললে কি হবে? বললেই তো হয়, মেয়েটা রিজেক্ট করলে তুলে নিয়ে বিয়ে করা উচিৎ। কিন্তু না সে বলছে ভুলে যাওয়া উচিৎ নিষ্ঠুর একটা। আমার ভালোবাসার মূল্য নেই নাকি। আমি আমার কথা বললাম আর উনি বলছে ভুলে যেতে সাধে তোমায় নিষ্ঠুর মেয়ে বলি।”

ধূসর নিজেও জানে না ও কি বলছে এদিকে ধূসরের কথা শুনে মেঘের চোখ ছলছল করে উঠলো। ও বুঝতে পারল এগুলো সব ওর জন্যই বলা বন্ধু এমনিই বলেছে। মেঘ নিজেকে সামলিয়ে বলল,,

“ডক্টর আপনি ঠিক আছেন?”

এতক্ষনে ধূসরের হুশ ফিরল ও কি বলছিল। কিন্তু কি বলছিল ওর মনে নেই। ধূসর বলল,,

“আমি কি আপনাকে কিছু বলছিলাম সরি আমি বুঝতে পারছি না। সবকিছু যেন মাথার ওপর দিয়ে গেল। যদি খারাপ কিছু বলে থাকি তাহলে সরি।

“সরি বলার দরকার তেমন কিছু বলেন নি। এখন তো মনে হচ্ছে আপনার ও কফি খাওয়া প্রয়োজন আমার কফি হয়ে গেছে।”

“ওহ আচ্ছা আপনি জানেন রাতে আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম ?

“আমি কিভাবে জানবো?”

মেঘ কফি নিয়ে সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিল। তখন ধূসর বলল,,

“তাও ঠিক। স্বপ্নে আপনি আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।”

কথাটা শুনেই মেঘের কফি গলায় আটকে গেল ও কোনরকম কোন শব্দ ছাড়া নিজেকে সামলিয়ে নিল। তারপর বলল,,

“সত্যি বলছেন নাকি মজা করছেন?”

“সত্যি বলছি তারপর শুনুন আপনি আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি সিওর কি না। আপনি সিওর জানালেন তারপর দুজন মিলে কাজী অফিসে গেলাম। কিন্তু কি হলো জানেন?

“কি হলো?”

“কাজী অফিসে তালা ঝুলছিল মানে বন্ধ। আপনি হাসছিলেন তাই আমি রেগে কাজী অফিসের জানালায় পাথর ছুড়ে মারলাম। কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমার আর বিয়ে করা হলো না।

এ কথা শুনে মেঘ একটু জোরেই হেঁসে উঠল। তা শুনে ধূসর বলল,,,

“আর আপনি ঠিক এভাবে হাসছিলেন যখন দেখলাম কাজী অফিস বন্ধ।”

মেঘ হাঁসি থামিয়ে বলল,,

“সিরিয়াসলি ডক্টর আপনি এরকম স্বপ্ন দেখেছেন?”

“হুম সিরিয়াসলি তবে আমার মনে হয় এরকম কেউ কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলে তাকে বলে না। কিন্তু আমার মনে হলো আপনাকে জানাই। আপনি আমার জীবনের এমন একজন মানুষ যার সাথে কথা বলতে জড়তা কাজ করে না। মনে হয় আপনি আমার বউ। যাই হোক অনেক অহেতুক কথা হলো। রাখছি আল্লাহ হাফেজ, নিজের খেয়াল রাখবেন।”

বলেই ধূসর তাড়াতাড়ি করে ফোন কেটে দিল। কি বললো? আপনি আমার বউ কি লজ্জার ব্যাপার। এখনো তো প্রস্তাবই দেয় নি। এদিকে মেঘ আমার বউ শুনে মনে থমকে গেছে কতোদিন পর শুনলো কথা টা ‘আমার বউ’।

~চলবে,,

ধূসর রাঙা মেঘ_২ পর্ব-০৩

0

#ধূসর_রাঙা_মেঘ_২
#পর্ব_৩
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“আরে মিস কাশফিয়া আপনি তো দেখি আজ কাশফুল হয়ে সবুজের মাঝে বসে আছেন।”

হুট করে অপত্যাশিত ভাবে কাঙ্ক্ষিত কন্ঠস্বর শুনে তাড়াতাড়ি করে পাশ ফিরলো মেঘ । কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পছন্দের শুভ্র পাঞ্জাবিতে দেখে একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে ধরলো ওকে।মেঘ সামনের মানুষটার দিকে তাকালো হাতে রঙ বেরঙের কয়েকটা বেলুন আর লাল গোলাপ। মুখে মাস্ক বিদ্যমান তবুও লোকটাকে চিনতে তার অসুবিধা হলো না। না চাইতেও মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ও বলল,,

“আরে ডক্টর শুভ্র যে, আপনি এখানে? বাহ হাতে আবার গোলাপ।”

“আমাদের কতো মিল দেখেছেন একই রঙের ড্রেস পরেছি। আবার দেখুন আপনি গোলাপ আর বেলুন নিয়ে বসে আছেন। আমিও গোলাপ আর বেলুন নিয়ে এলাম।”

“তাই তো দেখছি এত বড় কোয়েন্সিডেন্স কিভাবে হতে পারে বলুন তো! তা আপনি না কোথায় যেন গিয়েছিলেন সেটা তো আরো একদিন পরে শেষ হওয়ার কথা ছিল।”

“হুম কিন্তু কি মনে করে এলাম আজকেই। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আপনার এই বেঞ্চে বসতে পারি যদি কিছু মনে না করেন।”

“হ্যা বসতে পারেন।”

“শুকরিয়া মিস!”

ধূসর বসে মাস্ক খুলে ফেলল তখন মেঘ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তা হুট করে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পড়ে, বেলুন আর লাল গোলাপ নিয়ে এখানে এলেন কেন?”

“শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি ভালো লাগলো তাই পড়লাম।আর জানিনা গোলাপ আর বেলুন দেখে ইচ্ছে হলো কিনতে তাই কিনলাম। আর বাকি রইল এখানে আসার কথা সেটা আমি জানি না মনে হলো এই জায়গাটা আমি চিনি।”

“আপনার বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর জানি না এটা কেন বলুন তো? জানি না বলেও সব করে ফেলেন কিভাবে?”

“জীবনে অনেক কিছুই আমরা জানি না। কিন্তু তাই বলে কি আমাদের জীবন থেমে থাকে নাকি। থেমে তো থাকে না তাইনা। অনেক কিছুই আপনাআপনি ভাবে হয়ে যায়। তা আপনি শুভ্র রঙের শাড়ি পড়ে এখানে কেন?

মেঘ হেসে বলল,,

“ঐ আপনার মতো ইচ্ছে হলো পরতে তাই পরলাম। আর এটা আমার প্রিয় জায়গা। মনে হলো নিজের সাথে একটু সময় কাটানো যাক তাই এলাম। তাছাড়া এখানে আমি প্রায়ই আসি।”

“ওহ আচ্ছা!”

“হুম এখন বলুন তো সব ঠিক আছে কিন্তু মাস্ক কেন?”

“কোন নিষ্ঠুর মেয়ে বলেছিল যে শুভ্র পাঞ্জাবি পড়ে আমি যেন মাস্ক ছাড়া বের না হই।”

মেঘ অস্ফুট স্বরে আওয়াজ করলো,,

“নিষ্ঠুর মেয়ে”

তা শুনে ধূসর বলল,,

“হ্যা নিষ্ঠুর মেয়ে! আপনি জানেন, বাড়িতে ভাবি এই কথা জিজ্ঞেস করেছিল মাস্ক কেন পড়েছি তখন আমি বলেছিলাম কেউ বলেছিল পড়তে । কিন্তু রাস্তায় এসে মনে পড়লো কোন নিষ্ঠুর মেয়ে নামক মেয়ে বলেছিল। সে বলেছিল, জনাব এই শুভ্র পাঞ্জাবি পড়ে কখনো মাস্ক ছাড়া বের হবেন না কিন্তু! আমি উত্তরে বলেছিলাম ‘যেমনটা বলো নিষ্ঠুর মেয়ে। তাই বুঝলাম কোন নিষ্ঠুর মেয়ে বলেছিল।”

কথাটা শুনে মেঘের চোখ ছলছল করে উঠলো। ও “ওহ আচ্ছা!” বলে ধূসরের থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। তখন ধূসর বলল,,

“জায়গাটা অনেক সুন্দর তাইনা খোলা আকাশ, কি সুন্দর বিশুদ্ধ বাতাস ,সামনে বিশাল নদী আর সিগ্ধ প্রকৃতি এরকম আজকাল ঢাকায় পাওয়ায় যায় না।”

ধূসর হাতের বেলুন গুলো মেঘের মতো বেঞ্চের হাতলে বেঁধে দিল আর গোলাপগুলো মেঘের গোলাপের পাশে রাখলো। ধূসর সামনের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি অনুভব করতে লাগলো আর মেঘ সে তার দৃষ্টি ধূসরে নিবদ্ধ করলো। এক দৃষ্টিতে ধূসরকে দেখতে লাগলো এক তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির মতো। যেন কতোদিনের তৃষ্ণা তার শুভ্র মানবকে দেখার এখন তার দিকে তাকিয়ে তার তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। কতোক্ষণ এভাবে সময় পেরিয়ে গেল দুজনের জানা নেই। একটা সময় ধূসর পাশে তাকাতেই দেখলো মেঘ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ তাড়াতাড়ি করে চোখ সরালো আর অন্যদিকে তাকালো। ধূসর ওর দিকে তাকালো ওর দিকে তাকিয়ে ওর কি হলো কে জানে? ও নিজেও তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির মতো মেঘকে দেখতে লাগলো। মেয়েটা হিজাব নিকাব পরে আছে তবুও অদ্ভুত টান অনুভব করছে ধূসর । হুট করেই মেঘ বলল,,

“নিষ্ঠুর মেয়ে আপনার কে হয় ডক্টর?”

মেঘের কথায় ধূসরের ধ্যান ভাঙল ও তাড়াতাড়ি করে দৃষ্টি সরিয়ে ছোট করে বলল,,

“জানিনা!”

“কেন জানেন না আপনি? আচ্ছা নিষ্ঠুর মেয়ে টা যদি আপনার খুব কাছের কেউ হয় তাহলে।”

“হ্যা আমার কাছের কেউই তো হবে নাহলে আমি তার কথা শুনবো নাকি। কিন্তু এই নিষ্ঠুর মেয়েটা কে? সেটাই তো আমি জানি না। এই দেড় বছরে আমি কোথাও নিষ্ঠুর মেয়ে নামক কাউকে দেখি নি। অবশ্য নিষ্ঠুর মেয়ে কারো নাম হয় নাকি?”

“হয়তো! দিলেই হয় মনে করার চেষ্টা করুন আপনিই নামটা দিয়েছিলেন নাকি তাকে।”

ধূসর চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো তখন বোধহয় ওর মতো কারো মুখে শুনতে পেল “তুমি একটা নিষ্ঠুর মেয়ে তোমার এই উপাধি তোমার কাজের সাথে একদম পারফেক্ট দিয়েছি আমি। নিষ্ঠুর মেয়ে একটা।” কিন্তু সামনের মেয়েটার চেহারা স্পষ্ট নয় অস্পষ্ট। এটুকু শুনে আর দেখে ধূসরের মাথাব্যথা শুরু হলো কিন্তু সে প্রকাশ করলো না। মনে মনে ভাবলো কাশফিয়া নামক মেয়েটা ঠিক বলেছে। ধূসর বলল,,

“জানিনা আমি! বাদ দাও ! তো নিষ্ঠুর মেয়ে তুমি বলো এই বেলুন আর লাল গোলাপ কার জন্য এনেছো?”

মেঘ চমকে তৎক্ষণাৎ ধূসরের দিকে তাকালো। তা দেখে ধূসর বলল,,,

“ও সরি সরি আসলে সেই গাড়ি থেকে নিষ্ঠুর মেয়ে নাম ঘুরছে তো তাই আপনাকে নিষ্ঠুর মেয়ে বলে ফেলেছি সরি কিন্তু। তা বলেন এগুলো কার জন্য এনেছেন?

মেঘের ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে ,,

“ধূসর এগুলো সব আপনি আমায় দিতেন এই দিনে। কিন্তু আজ তো আমি ভেবেছিলাম আপনি দেবেন না। তাই নিয়ে এসেছিলাম আমার সাথে কিন্তু আপনি আপনার অজান্তেই এগুলো এনেছেন। কারন আপনার কোথাও না কোথাও আজ ও নিষ্ঠুর মেয়ে বিরাজ করে।”

কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না। মেঘ নিজেকে সামলিয়ে বলল,,

“এই বেলুন তো আমি ঐ ধূসর রাঙা আকাশের জন্য এনেছি একটু পরেই উড়িয়ে দেব। আর গোলাপগুলো আপনার মতো ইচ্ছে হলো নিতে তাই নিয়ে এলাম।”

“ওহ আচ্ছা তাহলে বেলুন গুলো আমিও উড়িয়ে দেব । কিন্তু গোলাপ? আচ্ছা গোলাপ গুলো আপনি নিয়ে যান। এগুলো আমি আপনাকে দিলাম।”

বলেই ধূসর মেঘের দিকে ওর আনা গোলাপ গুলো এগিয়ে দিল। মেঘ হাসলো খুব করে ও হেঁসে বলল,,

‘কাউকে কোনো ফুল দেওয়া হলে সে যেন তা প্রত্যাখ্যান না করে। কেননা, তা বহনে হালকা ও ঘ্রাণে উত্তম।”
(মুসলিম, হাদিস : ৫৬৮)
তবে তা পরিস্থিতি সাপেক্ষেও বটে এটা আমার মতামত। তবে আপনার ফুল আমি নিলাম।

মেঘ ধূসরের হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে দু’টো ফুল ধূসরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,

“এগুলো আপনার জন্য।”

ধূসর হেসে ওগুলো নিল কিন্তু ওর মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো। মনে হলো এই ঘটনা আগেও ঘটেছে কিন্তু আবছা, ও তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে নিল। এক হাত দিয়ে মাথাটা ধরলো মেঘ সবকিছু দেখে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে ওর সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,,

“কি হয়েছে আপনার মাথা ব্যাথা করছে?”

ধূসর চোখ খুলে তাড়াতাড়ি করে বলল,,

“না না তেমন কোন ব্যাপার না কেন যেন মনে হলো,,,, না তেমন কিছু না। আমিও আপনার ফুল নিলাম।”

ধূসর মেঘকে কিছু বললো না। মেঘের অস্থিরতা কমছে না। কিন্তু ধূসর বোধহয় চোখ দেখে বুঝতে পারল মেঘের অস্থিরতা। তাই ও বলল,,

“মিস কাশফিয়া আমি ঠিক আছি । আই এম ওকে। টেনশন করবেন না।”

মেঘ নিজেকে সামলিয়ে বেঞ্চে বসে পড়লো। তখন আবার ধূসর বলল,,

“আপনি জানেন এই শুভ্র শাড়িতে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে। এক টুকরো শুভ্র মেঘ লাগছে মাশাআল্লাহ। এ যেন এক মেঘবালিকা।

হুট করে এমন কথা শুনে মেঘ চমকে ধূসরের দিকে তাকালো। মেঘ মনে মনে বলল,,

“আপনি সবকিছু ভুলে গেলেও কিছু জিনিস আপনি একেবারেই ভুলেন নি ধূসর।”

কিন্তু মুখে বলল,,

“শুকরিয়া তবে আপনি কিন্তু?”

মেঘকে বলতে না দিয়ে ধূসর বলল,,

“আই নো! আই নো! আপনি কি বলবেন এটা ঠিক নয়। আমার দৃষ্টি সংযত করা উচিৎ। সত্যি বলতে এটা আমার উচিত হয় নি। তবে অজান্তেই যেন আমি সব করলাম। কিছু মনে করবেন না।”

কথাটা শুনে তখন মেঘের খুব হাসি পেল। বিশেষ করে এই কথাটা ‘আমার দৃষ্টি সংযত করা উচিৎ’। কিন্তু একটা সময় বলেও ধূসরের চোখ সরানো যেত না। কিছু বললেই বলতো আমার মেঘবালিকা কে আমি দেখবো তাতে তোমার কি নিষ্ঠুর মেয়ে। সবকিছু ভেবে মেঘ হাসলো। ভুলে গেলে কি হবে মনের টান এখনো রয়েছে। মেঘ হেঁসে বলল,,

“হুম আমার সাথে ফুচকা খাবেন ডক্টর?”

“তারমানে আপনি?”

“আপনার দৃষ্টিতে আমি খারাপ কিছু দেখি নি। তাই আপনার সাথে ফুচকা খাওয়ায় যায় চলুন। তাই বলে সবাইকে কিন্তু এমন অফার দিই না আমি। আপনি আমার জীবনের দ্বিতীয় পুরুষ যার সাথে আমি নিরাপদ।”

“তা প্রথম পুরুষ কে? আপনার বাবা নাকি।”

“আপনি জানলেন কিভাবে?”

“এভাবেই! আপনার যে ব্যক্তিত্ব যাই হোক। চলুন ফুচকা খাবো।”

“দাঁড়ান বেলুন গুলো তো উড়িয়ে দিই। আপনি আপনার বেলুনের গিট খুলে দিন তাহলে ।”

বলেই মেঘ হেঁসে বেলুনের গিট খুলে দিল। ধূসর ও গিট খুলে দিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে উড়ন্ত বেলুন গুলো দেখলো। বেলুন দেখতে দেখতে মেঘ হাসলো তারমানে ওর মন্জিল বেশি দূরে নেই। খুব তাড়াতাড়ি এই মিশনে সাকসেসফুল হতে চলেছে ও। মেঘ গোলাপগুলো নিয়ে ওর গাড়িতে উঠলো। ধূসর ও গোলাপ নিয়ে তার গাড়িতে উঠতো। ওরা দুজনে দুজনের গাড়ি করে একটা ফুচকার দোকানে গেল। ধূসর নেমে মেঘের গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে জানালো মেঘকে নামতে হবে না। ধূসর নিজেই ওর জন্য গাড়িতে ফুচকা আনছে। মেঘ কিছু বলেনি কিছুক্ষণ পর ধূসর এলো হাতে ফুচকার প্লেট নিয়ে মেঘ ধূসরকে বলল তার গাড়িতে উঠে আসতে ধূসর ও উঠে গেল। দুজনে বেশ ফুচকা খেল। মেঘ নিকাব খুলে ফেলেছে এইবার দিয়ে ধূসর মেঘের মুখ দেখল মোট পাঁচবার। ধূসর এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু মেঘ দেখার আগেই তাড়াতাড়ি করেই নিজের দৃষ্টি সংযত করে নিল। কিন্তু সে তো জানে না মেঘ সবকিছুই আড়চোখে গাড়ির মিররে সব দেখছে। সব দেখে মেঘের কিরকম হাঁসি পাচ্ছে। ধূসর গাড়ি থেকে নেমে বিল মিটিয়ে এসে মেঘকে বলল,,

“তাহলে আপনি বাড়ি যান আমিও যাই। এতগুলো সুন্দর মুহূর্ত দেওয়ার জন্য শুকরিয়া আপনাকে। আল্লাহ হাফেজ নিজের খেয়াল রাখবেন আসি।”

বলেই ধূসর চলে গেল। মেঘ কিছু বললো না। মেঘ নিজেকে সামলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না দু ফোঁটা পানি গড়িয়েই পড়লো। মেঘ তাড়াতাড়ি করে মুছে ফেলল। বেশ অনেকটা সময়ই সে ধূসরের সাথে কাটিয়েছে। দুপুর তিনটা বেজে গেছে। ও ওখানে গিয়েছিল এগারোটার দিকে ধূসর এসেছিল সাড়ে এগারোটায়। এত সময় কোথা দিয়ে চলে গেল।ও বুঝতেই পারলো না। ও গাড়ি স্টার্ট দেবে এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠলো ও ফোনটা কানে নিয়ে ওপাশ থেকে যা শুনলো তা শুনে ওর মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। ও ফোনটা রেখে বলল,,

“আজকের দিনটা অনেক লাকি আমার জন্য। শুকরিয়া আব্বা আপনার কথা সত্য হয়েছে । যার সাথে আজকের দিনটা সেলিব্রেট করার ছিল তার সাথেই পুরোটা না হলেও কিছু সময় তো ছিলাম। আর দ্বিতীয়ত আজ তাদের খোঁজ পেয়েছি।

তারপর কিছুটা থেমে আবার বলল,,

“ইশশ একবছর হয়ে গেলো কতো খুঁজলাম তোমাদের কিন্তু পেলাম না। পাবো কিভাবে তোমরা তো দেশেই ছিলে না। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আজকেই তোমাদের খোঁজ পেলাম। রেডি থেকো মিস্টার এন্ড মিস । তোমাদের কৃতকর্মের শাস্তি খুব তাড়াতাড়ি পাবে। তোমাদের জন্য ধূসরের থেকে আলাদা হয়েছি তোমাদের কি শাস্তি দেব তোমরা ভাবতেও পারবে না। তবে আলাদা হলেও ধূসরের অনুভূতি হারায় নি আমার প্রতি।”

বলেই মেঘ খুশিমনে গাড়ি স্টার্ট দিল। প্রথমে ফ্ল্যাটে গেল তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। বাড়ি পৌঁছে দেখলো জায়মা, শায়লা,শিফা আর মুন শায়লার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। মেঘকে দেখেই জায়মা বলল,,

“এই তোর আসার সময় হলো মেঘ?”

“কেন আপু আমি তো বলেই গিয়েছিলাম বিকেল বা সন্ধ্যা হবে।”

“তা তোমরা সবাই এখানে কেন? তোমরা তো রুমে আড্ডা দাও সবসময়।”

তখন মুন বলল,,

“একটু পর ওয়েডিং প্ল্যানার আসছে তাই আমরা তাদের জন্য অপেক্ষা করছি।”

“ওহ আচ্ছা দাদুভাই কোথায়?”

“রুমে বোধহয়।”

‘ওহ আচ্ছা।”

“আয় না এখানে বোস ওরা চলে আসবে। তুই কিছু প্ল্যান করেছিস নাকি সেটাও তাদের বলতে পারবি।”

“না আপু আমার কোন প্ল্যান নেই। তুমি ভালো করেই জানো আমার অনুষ্ঠান পছন্দ নয়। তোমরা তোমাদের মতো করো না। আমি বাইরে থেকে এলাম ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়বো এখন।”

বলেই মেঘ ওপরে চলে গেল। তখন শায়লা বলল,,

“মেঘ সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। এখনো সেই গম্ভীর কোন অনুষ্ঠানে থাকতে চায় না।”

তখন জায়মা বলল,,

“ওর জীবনটা আমাদের মতো স্বাভাবিক ছিল না তাই হয়তো এরকম। একই বাড়ির মেয়ে হয়ে অনেক ভিন্ন ভাবে সে বড় হয়েছে এই পরিবার ওকে কি দিয়েছে শুধু অবহেলা। একজন মানুষের ভালোবাসায় সে টিকে ছিল এখানে সেটা হলো কাকাই এর ভালোবাসা। আমরা ছোট ছিলাম ওতো বুঝতাম নাকি।”

তখন মুন মাথা নিচু করে নিল। কারন তার আপন বোন হওয়া সত্ত্বেও সে কখনো নিজের ভালোবাসা দেখায় নি।তখনি দুজন ওয়েডিং প্ল্যানার এলো। শিফা মেঘকে বাদ দিয়ে বাকি সবাই কে ডেকে আনলো যেহেতু বাড়ির বিয়ে সবার মতামত নেওয়া প্রয়োজন। শমশের চৌধুরী থেকে শুরু করে আজান সবাই এলো। আয়মান চৌধুরী কোথাও গিয়েছেন তাই এখন বাড়িতে নেই তবে শাফিয়ান চৌধুরী আর জিয়ান দুপুরে বাড়ি চলে এসেছে। সবাই আসতেই নিজেদের মতামত দিতে লাগলো। এদিকে মেঘ আগে ওর ব্যাগ থেকে ফুল বের করে যত্ন করে টেবিলের ওপরে রাখলো তারপরও ফ্রেশ হয়ে আসরের সালাত আদায় করে নিল তারআগে যোহরের কাযা সালাত আদায় করেছে। দুপুরে ফুচকা ছাড়া কিছু খাওয়া হয় নি তবুও যেন তার খিদে পেল না কিন্তু পানি খাওয়া প্রয়োজন তাই নিচে নামলো। নিচে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছে দুজন মেয়ের সাথে। তাদের চেহারা চেখে মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে ঘোমটা বড় করে টেনে টেবিলে বসে পানি পান করলো। মেয়ে দুটো বোধহয় মেঘকে খেয়াল করে নি। মেঘ বসে তাদের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। অতঃপর বিশ মিনিট পর মেয়ে দুটো উঠে চলে যেতে নিল তখন মেঘ উঠে পেছন থেকে বলল,,,

‘মিস মুমতাহিনা হির এবং মিসেস লিয়া আহমেদ! একটু শুনবেন।

হুট করেই নিজেদের প্রানপ্রিয় বান্ধবীর কন্ঠ শুনে দুজনেই চট করে পেছনে তাকালো। মেঘ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে তার কাছে যেতে চাইলো কিন্তু মেঘ হাত দিয়ে থামিয়ে দিল তা দেখে দুই বান্ধবীর অভিমান হলো । বাকি সবাই অবাক মেঘ কিভাবে জানলো। তখন লিয়া বলল,,,

“জি বলেন কি বলবেন?”

“এখানে নয় বাহিরে চলুন। আপনাদের সাথে কথা আছে।”

বলেই মেঘ হাঁটা ধরলো হির আর লিয়া কিছু আন্দাজ করে ওর পেছনে হাঁটা ধরলো। বাইরে এসে মেঘ হেঁসে বলল,,

“আমার রুমটা একটু সাজাতে চাইছিলাম আপনারা তো ওয়েডিং প্ল্যানার । আমার রুমটা একটু সিম্পল করে ডেকোরেশন করে দিবেন।”

তখন হির বলল,,

“আপনার মতো নিরামিষ মহিলা রুম ডেকোরেশন করবে হাও ফানি।”

এটা শুনে লিয়া হেঁসে উঠল । মেঘ ছোট ছোট করে ওদের দিকে তাকালো আর বলল,,

“এই রকম ব্যবহার আপনাদের। ক্লাইন্টদের সাথে বিনয়ের সাথে কথা বলতে হয় তাকে এভাবে বলতে হয়না ঠিক আছে।

‘আপনি আমাদের ক্লাইন্ট। ওহ আচ্ছা তা কয়টাকা দিবেন আপনার রুম ডেকোরেশন করে দিলে।”

“এক টাকাও না। আপনাদের এক টাকা দিলে সেই একটাকাই লস আমার জন্য।”

“মেঘ এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।”

‘এই আপনি ক্লাইন্টদের এভাবে নাম ধরে ডাকেন এটা ঠিক না।”

তখন একজন ধুম করে মেঘের পিঠে একটা কিল মেরে বলল,,,

“তো! তোর মতো মেয়েরে আবার সম্মান দেওয়া লাগবে।”

“আরে ভাই এত জোরে দিলি কেন লিয়া? ব্যাথা পাইলাম তো।”

তখন হির মাথায় চাটি মেরে বলল,,

“ব্যাথা পাওয়ার জন্যই তো মারলো। তোকে না মারলে তো তুই ঠিক হবি না। তোর মেরুদন্ড তো বাঁকা।”

“আরে ভাই তোরা মারছিস কেন?”

“কাল আমাদের না বলেই চলে এসেছিস তুই।”

“তোরা তো তোদের ফ্ল্যাটে ছিলিস না তাই বলতে পারি নি সরি।”

“তোর বিলাই কই আসার পরে দেখলাম না হাসপাতাল থেকে আনিস নি।”

“আমার লিলি রে একদম বিলাই বলবি না।”

“তোর বিলাই আর আমি হইলাম চিরশত্রু আমি কেন তোর বিলাইরে নাম ধইরা ডাকমু শয়তান বিলাই।”

“একবার মাত্র খামছি দিছিল তাতেই হির ওরে দেখতে পারে না।”

লিয়ার কথায় মেঘ হাসলো। আর বলল,,

“আচ্ছা বাদ দে। আমি তো জানতামই না তোরাই আপুর বিয়ের ওয়েডিং প্ল্যানার।”

“আমরাও জানতাম না এটা তোর ফ্যামিলি। তারমানে এটা তোর ফ্যামিলি থাক দাওয়াত না দিলেও আমরা তোর বোনের বিয়ে খাইতে পারুম। কিন্তু জাবিন ওরে কেমনে আনমু বেচারি একা একা থাকবোনি।”

তখন পেছন থেকে কারো কন্ঠস্বর এলো,,

“না জাবিন মামনি কেন একা থাকবে? ওকে দাওয়াত দিয়েছি আমি।”

ওর পেছনে তাকিয়ে দেখলো আয়মান চৌধুরী একটা গোল্ডেন কালার বিড়াল হাতে নিয়ে ওদের দিকে আসছে। মেঘ হেঁসে লিলিকে নিজের কোলে নিল। লিলিও মেঘকে দেখে আদুরে ভঙ্গিতে ডেকে মেঘের কোলে রইল। তখন হির বলল,,

“আরে ভালোবাবা! কেমন আছো তুমি?”

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোরা কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

তখন মেঘ বলল,,

“আব্বা লিলির আর কোন সমস্যা নেই তো ডক্টর কি বলেছে?”

“না সমস্যা নেই একটা ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছে এখন আর অসুস্থ হবে না।”

“আলহামদুলিল্লাহ! হির লিয়া তোরা এখন বাড়ি যা পরে কথা হবে।”

তখন হির বলল,,

“ঠিক এই কারনে তোর বিলাইরে আমার সহ্য হয় না। ওরে পেলেই দুনিয়া ভুলে যাস মানলাম দুলাভাই দিছে তাই সবসময় মাথায় করে রাখতে হইবো শয়তান বিলাই।”

হুট করে দুলাভাই শুনে মেঘ স্থির চোখে হিরের দিকে তাকালো হির বুঝতে পারল বেফাঁস কিছু বলেছে তাই বলল,,

“সরি !”

“ধুর কিসের সরি বাই দা ওয়ে আজ কিন্তু তোদের দুলাভাই আমারে গোলাপ ফুল দিছে আবার ফুচকাও খাওয়াইছে।”

“সত্যি?”

“তিন সত্যি।”

মেঘের কথায় তিনজনেই হাসলো মেঘ ও মুচকি হাসলো।ওরা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আয়মান চৌধুরী জিজ্ঞেস করতেই মেঘ সব বলল। তারপর লিলি কে কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো ও ভেতরে ঢুকতেই আজান দৌড়ে এসে বলল,,

“আপু তুমি এই বিড়াল টা কোথা থেকে আনলে? আমাকে একটু কোলে দেবে, আমার বিড়াল খুব পছন্দ।”

মেঘ হেসে বলল,,

“এটা আমার বিড়াল। আমার সাথেই থাকতো। একটু অসুস্থ ছিল তাই ওকে পশু হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। আব্বা এখন নিয়ে এলো। ওর নাম লিলি।”

“নামটা তো দারুন দিয়েছো রঙটাও অনেক সুন্দর দাও আমার কাছে।”

আজান মেঘের থেকে লিলিকে নিতে চাইলো কিন্তু লিলি গেল না উল্টো চিৎকার করে উঠল মানে সে যাবে না ।লিলি আজান কে এমন লুক দিল মনে হলো খেয়েই ফেলবে। তা দেখে আজান বলল,,

“যাহ নিলাম না তোকে ভাবলাম তোকে চকলেট দেব। এখন কিছুই দেব না শয়তান বিলাই।”

তখন মেঘ বলল,,

“আসলে দুদিন আমার কাছে ছিল না তো তাই যেতে চাইছে না কিন্তু ও সবার কাছেই যায় দেখবি কাল তোর কাছে যাবে।”

তখন শিফা বলল,,

‘মেঘ আপু তুমি ঐ ওয়েডিং প্ল্যানার দের চেনো?”

“হ্যা চিনি ! আচ্ছা আমি ওপরে যাই লিলিকে খাওয়াতে হবে।”

বলেই মেঘ ওপরে চলে গেল। আয়মান চৌধুরীও ওপরে চলে গেল।বাকিরা শুধু দেখেই গেল।

____________________

ওদিকে,,

বিকেল বেলা ধূসর খুশি মনে গোলাপ ফুল দু’টো নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। দিলরুবা খানম, রোহিনী আর নোলক ড্রয়িংরুমে কথা বলছিল ধূসরের হাতে ফুল দেখে নোলক বলল,,

“ছোট ভাইয়া কেউ প্রপোজ করেছে নাকি হাতে ফুল তাও লাল গোলাপ।”

ধূসর হেসে বলল,,

“প্রপোজ করে নি তবে এমনি দিয়েছে।”

তখন দিলরুবা খানম বললেন,,

“কে দিয়েছে?”

“আরে মা তোমাকে একবার বলেছিলাম না আট মাস আগে হাসপাতালে একটা নিষ্ঠুর মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। যার হাত থেকে কতো রক্ত পরছিল তবুও সে একটা টু শব্দ করে নি । তাকে দেখে মনে হচ্ছিল কিছুই হয় নি । তাই তাকে নিষ্ঠুর মেয়ে বলেছিলাম। আর মেয়েটা আমার নিষ্ঠুর মেয়ে শুনে মুচকি হাসছিল। ”

ধূসরের কথা শুনে দিলরুবা খানমের মুখে অবাকতা ছেয়ে গেল। তিনি অবাক হয়েই বললেন,,

“হ্যা তো কি হয়েছে?”

“সেই মেয়েটা দিয়েছে এই দুটো ফুল । অবশ্য আমি তাকে আগে কতগুলো ফুল দিয়েছি।তারপর সেখান থেকে সে দু’টো ফুল আমাকে দিল।”

“তুই কেন ফুল দিলি তাকে?”

কথাটা শুনে ধূসর অপ্রস্তুত হয়ে গেল তাও বলল,,

“আসলে আমি অনেক গুলো গোলাপ কিনেছিলাম। আমি গোলাপ রেখে কি করবো মনে হলো, ওনার গোলাপ পছন্দ তাই ওনাকে দিলাম। তুমি জানো মা উনিও আমার মতো শুভ্র রঙ পরেছিল। শুভ্র রঙের শাড়ি হিজাব নিকাব‌। তুমি জানো ওনাকে কি সুন্দর লাগছিল মনে হচ্ছিল এক টুকরো মেঘ কোন মেঘবালিকা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উনিও কিছু গোলাপ কিনেছিল আর হ্যা বেলুন ও কিনেছিল। উনি সেগুলো নিয়ে একটা লেকে বসেছিল। আমিও ঘুরতে ঘুরতে সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি উনি একা একা গোলাপ আর বেলুন নিয়ে বসে আছে। তুমি জানো, কি মনেকরে আমিও বেলুন কিনেছিলাম আমরা একসাথে সেই বেলুন গুলো উড়িয়ে দিয়েছি আকাশে আর আমার গোলাপগুলো ওনাকে দিয়ে দিয়েছি।”

ধূসরের মেঘের কথা বলতে বলতে মুখে অদ্ভুত হাসি দেখা যাচ্ছিল। সে আজ ভিশন খুশি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তিনজন ধূসরের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে তারা যে মনোযোগ সহকারে ধূসরের কথা শুনছিল তাতে সন্দেহ নেই। নোলক বলল,,

“ভাইয়া তুমি ঠিক আছো?”

“আমার আবার কি হবে?”

‘তোমাকে শুধু জিজ্ঞেস করা হলো তাকে ফুল কেন দিলে? কিন্তু তুমি তো পুরো ইতিহাস বলে দিলে। যার মেয়েদের সম্পর্কে কোন ইন্টারেস্ট থাকে না সে একটা মেয়ের সম্পর্কে এতকিছু বলে ফেলল।”

ধূসর হেঁসে বলল,,

“কি জানি তবে মিস কাশফিয়ার কথা বলতে গেলে কোন জড়তাই কাজ করে না বরং মুগ্ধতা আসে। এই আটমাসে ওনার সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে অনেকবার। সব থেকে বড় কথা আমার হাসপাতালে মাসে একবার হলেও কোথাও না কোথাও আঘাত পেয়ে আসে। আমি বুঝতেই পারি না উনি কিভাবে এত আঘাত পায় আমার কেমন যেন লাগে। কিন্তু ওনার মুখে হাঁসি থাকে। কি অসাধারণ সে আজ শুভ্র রঙে তাকে অনেক সুন্দর লাগছিল। আমি ভাবছি ওনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেব।”

এ কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো। বিশেষ করে নামটা আর বিয়ের কথা শুনে। দিলরুবা খানম বললেন,,

“কি নাম বললি?”

“মিস কাশফিয়া, কাশফিয়া আয়মান!”

এ কথা শুনে তিনজনের খুশিতে চোখ চকচক করে উঠলো। আর তিনজনের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসলো,, “কাশফিয়া আয়মান মেঘ” দিলরুবা খানম খুশি হয়ে বলল,,

“কবে বিয়ের প্রস্তাব দিবি?”

“খুব তাড়াতাড়ি!”

বলেই ধূসর ওপরে গেল। এদিকে তিনজনেই খুব খুশি। দিলরুবা খানম বলল,,

“ওটা মেঘ ছাড়া আর কেউ নয় ! ওটাই মেঘ শুভ্র রঙের শাড়ি শুনেই আন্দাজ করেছিলাম ওটা মেঘ হবে নাম শুনে সিওর। ধূসরের স্মৃতিতে মেঘ না থাকলেও মেঘ নতুন রুপে কাশফিয়া হয়ে এসেছে। আট মাস আগে ধূসর বলেছিল তখন আমি অবাক হয়েছিলাম এরকম মানুষ হয় সেটা শুধু মেঘকেই দেখতাম কিন্তু তখন বুঝতে পারি নি ওটা মেঘ হবে। আমার ছেলের ভালোবাসা দেখে আমার গর্ভ হচ্ছে রোহিনী। আমার ছেলে তার নিষ্ঠুর মেয়ে তার মেঘবালিকা কে এখনো অনুভব করে তাই তো বিয়ের কথা বলল । ও এখন মেঘের থেকে দূরে থাকতে চাইছে না বা পারছে না তাই তো হালাল ভাবে পেতে চাইছে যেমনটা পাঁচ বছর আগে চেয়েছিল এটাই তো হালাল সম্পর্কের জোর।”

“আপনি ঠিক বলেছেন মা এখন আর বাঁধা নেই ভাইয়ার লাইফ রিস্ক ও নেই। কারন এটা পুরোনো স্মৃতি নয় নতুন স্মৃতি তৈরি হয়েছে। তার নিষ্ঠুর মেয়ে তাকে ছেড়ে দেয় নি। বরং যাতে তার জীবনসঙ্গীর ভালো হয় সেটাই করেছে। এটাই আমাদের মেঘ।”

“ছোট ভাবিকে বোঝা কার সাধ্য। সে যে ধূসর রাঙা মেঘ সে কখন কি করে কিছু বোঝা যায় না। এই যে ভাবির সাথে কথা হয় ভাবি বুঝতেও দেয় নি ভাইয়ার সাথে তার যোগাযোগ আছে।”

~ চলবে,,

ধূসর রাঙা মেঘ ২ পর্ব-০২

0

#ধূসর_রাঙা_মেঘ_২
#পর্ব_২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেঘ আর আয়মান চৌধুরী সমশের চৌধুরীর রুমে প্রবেশ করেই দেখতে পেল সে কিছু কাগজপত্র দেখছেন। আয়মান চৌধুরী বললেন,,

“আব্বা আসবো?”

সমশের চৌধুরী মাথা উঠিয়ে বললেন,,

“হ্যা এসো!’

“আব্বা কি বলবেন যার জন্য রুমে আলাদা ভাবে আসতে বললেন?”

“আগে বসো তারপর বলছি মেঘ দরজা আটকে দিয়ে আসো।”

মেঘ দরজা আটকে আয়মান চৌধুরীর পাশে বসলো। সমশের চৌধুরী বলল,,

“আয়মান গ্ৰামে আমাদের যে বাড়ি আছে সেটা আমি তোমার নামে করতে চাচ্ছি। ”

“আব্বা আমার এসবের প্রয়োজন নেই আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ওগুলো শাফিয়ান কে দিয়ে দিয়েন।”

“তোমার প্রয়োজন না হলেও আমার প্রয়োজন আছে তোমার নামে করে দেওয়ার। প্রথমত তুমি আমার বড় পুত্র সন্তান। আমি আগে থেকেই ওটা তোমার নামে করে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সবকিছু এমন ভাবে অগোছালো হয়ে গেল যে কিছুই হলো না। দ্বিতীয়ত ওটা আমি শাফিয়ান কে দিতে চাই না কারন সে ঐ বাড়ি ভেঙে ফ্যাক্টরি তৈরি করতে চায় যা গ্ৰামের জন্য ক্ষতিকারক। আমি আমার পৈতৃক বাড়ি ভাঙতে চাই না।”

“কিন্তু আব্বা এটা সবাই খারাপ ভাবে নেবে আয়না, বড় আপা আছে ওদের অধিকারও তো আছে।”

“অধিকার থাকলেও আমি ঐ বাড়িটা ওদের দিয়ে রিস্ক নিতে চাই না। আমি অন্য জায়গায় থেকে ওদের ন্যায্য অধিকার দিয়ে দেব। তাছাড়া সারাজীবন তো ভাইবোন আর পরিবারের কথা ভাবলে এবার না হয় আমার কথা ভাবো।”

“আব্বা আপনি বুঝতে পারছেন না।”

“আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে তাই বাড়িটা আমি মেঘের নামে করে দিয়েছি।”

সমশের চৌধুরীর এহেন কথায় মেঘ চমকে তার দিকে তাকালো। আয়মান চৌধুরীও তাই মেঘ বলল,,

“দাদুভাই আবার আমি কেন?”

“কারন আমি জানি আমার শেরনি বাড়িটা রক্ষা করতে পারবে। তাছাড়া বাড়িটার ওপর শুধু শাফিয়ান এর নজর নেই আরো অনেকের আছে।”

“কিন্তু এখন হঠাৎ করে এসব কেন দাদুভাই?”

সমশের চৌধুরী মেঘের গালে হাত রেখে বলল,,

“সত্যি বলতে আমার মনে হচ্ছে আমার জীবনের গন্তব্য শেষ হতে চলেছে। আজকাল তোমার দাদীকে ভিশন মনে পড়ে। আমার মনে হয় এই পৃথিবীতে আমি বেশিদিন নেই। তাই তো সব তোমাদের দুজনের হাতে দিচ্ছি।”

“এসব কি বলছেন দাদুভাই ইনশাআল্লাহ আপনার আয়ু দীর্ঘ হবে।”

“আব্বা দয়া করে এরকম কথা বলবেন না।”

“বুঝলে আয়মান পৃথিবীতে সবকিছু অনিশ্চিত থাকলেও মৃত্যু নিশ্চিত আজ না হয় কাল সবাইকে এই দুনিয়া ছাড়তে হবে। আল্লাহ তায়ালা আল কুরআন স্পষ্ট করে বলেছেন প্রত্যেকটা প্রান অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। মৃত্যুর কথা ভেবে ভয় না করে আখিরাত নিয়ে আমাদের ভয় করতে হবে। কে জানে রবের নিকট তার প্রিয় বান্দা হয়ে নিজেকে পেশ করতে পারবো কিনা।”

“দাদুভাই এমন করে কেন বলছেন ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হবে।”

সমশের চৌধুরী কাগজ এনে মেঘের কাছে দিয়ে বলল,,

“এই যে মেঘ তোমার বাড়ি । যাই হয়ে যাক বাড়িটা তুমি অবশ্যই রক্ষা করার চেষ্টা করবে। কারন ঐ বাড়িতেই তোমার দাদুভাই এর শৈশব কৈশোর আর বিবাহের পনেরোটি বছর কেটেছে। ঐ বাড়ি নিয়ে অনেক স্মৃতি আমার।”

“দাদুভাই কেউ কি ঐ বাড়ি নিয়ে আপনাকে থ্রেট দিয়েছে। নামটা বলুন শুধু বাকি দায়িত্ব আমার।”

“কার কার নাম বলবো এখানে আপনপর সবাই আছে। তাই নাম বলছি না।”

মেঘ কিছু ভাবলো তারপর বলল,,

“আচ্ছা ঠিক আছে কিছু বলতে হবে না। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। কাগজটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। টেনশন করবেন না যা হবে ভালোই হবে। আব্বা চলুন আল্লাহ হাফেজ দাদুভাই।

“আল্লাহ হাফেজ।”

মেঘ কি ভেবে কাগজটা ওরনার নিচে লুকিয়ে দরজা খুলে বেরুলো ও বেরুতেই কয়েকটা ছায়া দেখতে পেল আয়মান চৌধুরী ও। মেঘ হাসলো আর বলল,,

“আব্বা দাদুভাই এর সাথে আড্ডাটা বেশ ভালো হলো তাই না। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আশেপাশে কিছু দৃশ্যমান দুষ্টু শয়তান জ্বীন ঘুরছে।”

কথাটা শুনে ছায়া গুলো তাড়াতাড়ি করে সরে গেল। মেঘ মুচকি হাসলো আয়মান চৌধুরী মেয়ের দিকে হেঁসে বলল,,

“আম্মা রাতে অবশ্যই আয়তুল কুরসি পাঠ করে ঘুমাবেন। তাহলে দুষ্টু শয়তান জ্বীন আপনাকে ছুঁতে পারবে না।”

“অদৃশ্য দুষ্টু শয়তান জ্বীন এর থেকে কিছু দৃশ্যমানুষ ভয়ঙ্কর বেশি, জ্বীনদের থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া গেলেও এই ভয়ঙ্কর মানুষদের থেকে সহজে মুক্তি মেলেনা।”

“আপনার তো কাজ আছে যান রুমে যান।”

“হুম আব্বা তুসবিহুন আলা খইর!”

“তুসবিহুন আলা খইর আম্মা!”

মেঘ হেসে নিজের রুমে চলে গেল। কিন্তু রুমে গিয়ে তার হাঁসি গায়েব হয়ে দীর্ঘশ্বাসে পড়িনত হলো। মেঘ কাগজ টা আলমারির লকারে রেখে দিল। তারপর তার ল্যাপটপ টা বের করে কিছু কাজ করতে লাগলো। কাজ করতে করতে একটা সময় কিছু মনে পড়তেই চোখটা ছলছল করে উঠলো। মেঘ ল্যাপটপ বন্ধ করে শুয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল,,,

“মাই ডিয়ার রুম আবার ও তোমাদের নিকট ফিরে এসেছি সেই পুরোনো ভাঙা মেঘ হয়ে। কিন্তু তোমাদের থেকে দূরে গিয়ে এই আমি জুড়ে গিয়েছিলাম অনেক সুন্দর ভাবে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আবারও সেই ভাঙা মেঘ হয়েই ফিরলাম। তবে সেখানেও আমি শেষের দিকে ভাঙাই ছিলাম। তোমরা আমার কথা শুনে হাসছো নাকি তোমাদের বলছি কারন তোমরাই তো এই ভাঙা আমাকে দেখতে পাও আর কেউ কি পায়। সবাই তো দেখতে পায় একটা নিষ্ঠুর মেয়ে কে।”

এটুকু বলে কি ভেবে মেঘ উঠে পড়লো। একটা চিঠি লিখলো সবার ওপরে প্রিয় সম্বধোন তার ব্যাক্তিগত মানুষের নাম লিখলো। তারপর একটা আবেগ মাখা চিঠি লিখতে শুরু করলো চিঠি লেখার মাঝে তার মুখে মিষ্টি হাঁসি দেখা গেল একটু অভিমান ও দেখা গেল।সবার শেষে,, “ইতি আপনার একান্ত ব্যক্তিগত নিষ্ঠুর মেয়েটা।” লিখে সুন্দর করে চিঠিটা ওর টেবিলে রাখা একটা ব্যাগে রাখলো সেখানে আগে থেকেই অনেকগুলো চিঠি ছিল । সবার ওপরে চিঠি রেখে ব্যাগটা যত্ন করে আলমারি তে রেখে দিল এটা তার কত নম্বর চিঠি সেটা একমাত্র সেই জানে। সে খুশিমনে বিছানায় বসলো কিন্তু কি যেন মনে হতেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল সে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু টাইপিং করতে লাগলো।

“কঠিন বাস্তবতা আর চারপাশের মুখোশধারী ভালোবাসার ভিড়ে, নিঃস্বার্থ আপনাকে পাবার জন্য অপেক্ষা নামক বস্তুটা রয়েছে আমাকে ঘিরে।”

এটুকু লিখে কারো নাম্বারে সেন্ট করতে গিয়েও করলো না ড্রাফট এ রেখে দিল। মেঘ উঠে ওযু করে নফল সালাত আদায় করলো কেন যেন মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে কমছেই না। তাই মানসিক শান্তি পেতে সালাত আদায় করে নিল। দীর্ঘ মুনাজাত শেষ করে নামাজ শেষ করলো এখন একটু ভালো লাগছে। কারন শান্তির চাবিকাঠিই তো নামাজ। মেঘ শুয়ে পড়লো যদি একটু ঘুম হয়।

_________________

এদিকে রুমে ঢুকে আয়মান চৌধুরী দেখলো মায়মুনা চৌধুরী বিছানায় বসে আছে আয়মান চৌধুরীর অস্তিত্ব টের পেয়ে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,,

‘ও তুমি এসো গেছো তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

“কেন তার দরকার তো দেখছি না।”

‘আয়মান তুমি কি আজ কাঁদছিলে?”

মায়মুনা চৌধুরীর এহেন কথায় আয়মান চৌধুরী একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তিনি নিজেকে সামলিয়ে বললেন,,

‘না তো!”

“তাহলে মেঘ তোমার চোখে কি পরিস্কার করলো।”

‘একটা ময়লা ঢুকে পড়েছিল বোধহয় তাই।”

” মিথ্যে বলছো তাই না ঠিক আছে বলতে হবে না কিছু। আচ্ছা আয়মান এবার কি আমাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ঠিক করা যায় না।”

‘তোমার কি মনে হয় আমাদের সম্পর্ক ঠিক নেই।”

“ব্যাপারটা তেমন না ঠিক আছে কিন্তু কোথাও একটা কিন্তু রয়েই গেছে।”

“এই কিন্তু থাকার কারন তুমি ভালো করেই জানো তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি সত্যি করে বলবে তুমি কি এখনো আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারো। যেমনটা ছয় বছর আগে করতে।”

মায়মুনা চৌধুরী আয়মান চৌধুরীর দিকে ছলছল চোখে তাকালেন আর বললেন,,

“তোমার সত্যতা জানার পর আমি আগের মতোই তোমাকে বিশ্বাস করি।”

আয়মান চৌধুরী হাসলেন আর বললেন,,

“সত্যতা জানার পর তুমি বিশ্বাস করলে কিন্তু এই বিশ্বাস টা আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে সেই ছয়বছর আগেই সেই নোংরা ঘটনায় করতে তাহলে কি আমাদের জীবন এমন হতো, হতো না আমরা আগেই মতোই একটা স্বাভাবিক সম্পর্কে থাকতাম। জীবনসঙ্গী মানে কি শুধু সঙ্গী তা নয় একে অপরের প্রতি সম্মান, বিশ্বাস আর ভরসা করাও সম্পর্কে থাকতে হয় সবথেকে বড় কথা একেঅপরের বোঝা পড়াটা থাকতে হয়। তুমি আমাকে চিনতে না আমার সাথে এত বছর সংসার করেছো তবুও তুমি আমাকে চিনতে পারো নি বুঝতে পারো নি সবথেকে বড় কথা একটা ছোট জিনিসে তুমি আমাকে অবিশ্বাস করেছো তুমি কি পারতে না মেঘের মতো আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে আর বলতে পৃথিবীর সব মানুষ তোমার বিপক্ষে গেলেও আমি তোমার সাথে আছি।”

এটুকু বলেই আয়মান চৌধুরী থামলেন। ওনার চোখে পানি চিকচিক করছে। মায়মুনা চৌধুরী কাঁদছেন তিনি কাঁদতে কাঁদতে আয়মান চৌধুরী কে জরিয়ে ধরে বললেন,,

“আমার অনেক বড় ভূল হয়ে গেছে আমাকে মাফ করো প্লিজ আমি তোমাকে এভাবে সহ্য করতে পারছি না। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি তোমার এই অদৃশ্য দূরত্ব আমাকে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।”

আয়মান চৌধুরী ওনাকে ধরলেন না শুধু বললেন,,

“পৃথিবীর সবথেকে অসহায় সময় কোনটা জানো যখন তোমার আপন জনেরাই তোমাকে বিশ্বাস করে না। ঐ পরিস্থিতিতে যারা পড়ে তারাই বুঝতে পারে বাকিরা শুধু নাটক ভেবে দেখে যায়।”

“আমাকে মাফ করে দাও জীবনে এই ভুল আর কখনো করবো না। তোমাকে ওয়াদা করলাম।”

” হুম অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড় এখন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”

বলেই আয়মান চৌধুরী মায়মুনা চৌধুরী কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে দিল তখন মায়মুনা চৌধুরী বলল,,

“আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? ঐ সময়টা আমার মাথাই কাজ করছিল না সবকিছু বোধহয় আমার গলা চেপে ধরেছিল মন মস্তিষ্কে দুটোই কার্যক্ষমতা হাড়িয়ে ছিল। কাছের মানুষটির অপত্যাশিত ঘটনা যখন সামনে আসে তখন বোধ বুদ্ধি সব লোপ পায় আমারও পেয়েছিল আমায় ক্ষমা করে দাও। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমাকেও হাড়িয়ে আমি একদম ভালো ছিলাম না। প্রত্যেকটা দিন আমার অসহ্য লাগতো শুধু পরিবারের কথা ভেবে বাচতাম‌।

আয়মান চৌধুরী হেঁসে বলল,,

“তোমার ওপর আমার রাগ কখনোই ছিল না। তোমাকে আমি বহু আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি যা ছিল তোমার প্রতি অভিমান তুমি তো আমায় জানতে চিনতে তাহলে।আর যা হয়েছে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে কেউ ধোঁকা খাবে। তবে আমি তোমার ঐ অবিশ্বাস করে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া ভুলতে পারছিলাম না তাই সম্পর্কে কিছু একটা থেকেই গেছে। তবে আজ থেকে থাকবে না কথা দিচ্ছি তুমি এভাবে কেঁদো না প্লিজ। এই তিনটা বছর তো শাস্তি পেলে আর না।”

মায়মুনা চৌধুরী কান্না বন্ধ করে হেঁসে আয়মান চৌধুরী কে জরিয়ে ধরলেন আর বললেন,,

“তুমি তাহলে আমাকে ইচ্ছে করে শাস্তি দিচ্ছিলে।”

এই তিনিও জরিয়ে ধরে হেঁসে বললেন,,

“তুমি যে আগুনে আমাকে পুড়িয়েছিলে সে আগুনে তোমাকেও তো পুরতে হতো তবে এই তিনবছর তোমার মাঝে আমাকে মানানোর সেই আমার নতুন বউকে দেখতে পেতাম তাই তো সুযোগ লুফে নিয়েছি। আমি জানতাম তো আমাকে ছাড়া তুমি ভালো ছিলে না।”

“তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে ক্ষমা করার জন্য।”

“পুরনো সব বাদ এখন আমরা আবার নতুন করে শুরু করবো। যে অতীত কষ্ট দেয় সেই অতীত মনে না করাই উত্তম।”

_________________

ফজরের আজান কানে যেতেই ঘুম থেকে ওঠার দোয়া পড়ে বিছানা ছাড়ল মেঘ। ওয়াশরুম থেকে ওযু করে একমনচিত্তে ফজরের নামাজ আদায় করে নিল। কিছুক্ষণ তসবিহ তাহলিল পাঠ করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ সকালের স্নিগ্ধ হাওয়া গায়ে লাগিয়ে আবার রুমে প্রবেশ করলো। কিছু কাগজপত্র দেখলো তারপর গোসল করলো। আটটা বাজতেই মাথায় ওরনা দিয়ে নিচে নামলো। এখন খেয়ে দেয়ে তাকে কোথাও যেতে হবে। মেঘ নামতেই দেখলো সকলে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পরেছে মেঘ গিয়ে বসলো তার আব্বার পাশে কারন আজ জিয়ান দাদুভাই এর পাশের চেয়ারে বসেছে। মেঘ বসতেই মেঘের বড় ফুপি মেঘকে খাবার দিল। মেঘ চুপচাপ খেতে শুরু করলো খাওয়া শেষ করে মেঘ বলল,,

“দাদুভাই আমাকে বেরুতে হবে দুপুরে বাড়ি ফিরতে পারবো না বিকেল বা সন্ধ্যা হতে পারে।”

তখন সমশের চৌধুরী বলল,,

“ঠিক আছে তবে বাড়ির গাড়ি আর ড্রাইভার নিয়ে যেও।”

“দরকার নেই আমার গাড়ি আছে আর আমি ড্রাইভ পারি তাই আমি সেটায় করে চলে যাবো।”

“যেমন তোমার ইচ্ছে কিন্তু কাল তো গাড়ি আনো নি ওটা তো আয়মানের।”

“আমার টা রাস্তায় আছে আসছে। আমি রেডি হতে হতে চলে আসবে।”

“ঠিক আছে।”

মেঘ চলে গেল । ও যেতেই জিয়ান বলল,,

“এমন ভাবে আমার গাড়ি আছে বলল যেন ওর নিজের টাকায় কেনা গাড়ি। নিজের তো যোগ্যতা নেই নিশ্চয়ই কাকাই কিনে দিয়েছে। কিন্তু ভাব দেখো।”

তখন আয়মান চৌধুরী হেঁসে বলল,,,

“কাশফিয়া আয়মান মেঘ কখনো অন্যের জিনিস নিয়ে ভাব নেয় না। গাড়িটা সে নিজের টাকা দিয়ে কিনেছে তাই নিজের গাড়ি বললো। মেঘের যোগ্যতা সম্পর্কে তোমার ধারনা নেই। যার সম্পর্কে ধারণা নেই তার সম্পর্কে কথা না বলাই উত্তম।”

বলেই আয়মান চৌধুরী চলে গেলেন বাকি সবাই অবাক সবথেকে বেশি বড়রা। তবে সমশের চৌধুরী জানেন তাই তিনি মুচকি হাসলো। রেজাউল আহমেদ বলল,,

“মেঘের পড়াশোনাই তো শেষ হয়েছে শুনলাম দশ মাস নাকি এক বছর আগে তাহলে এত তাড়াতাড়ি কিভাবে কি? বাবা আমার মনে হয় মেঘের সম্পর্কে আমাদের জানা উচিৎ ও কোন বে আইনি কাজ করছে না তো।”

তখন সমশের চৌধুরী বলল,,

“সমশের চৌধুরীর নাতনির রক্তে কোন ধোঁকাবাজি নেই। নিজে যা করে মানুষ ভাবে সামনের মানুষ টা তার মতোই। কাশফিয়া আয়মান মেঘ শুধু একজন সাধারণ মেয়ে নয় অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী সে তার মতো হতে এবাড়ির সবার যুগ চলে যাবে তবুও হতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। সে ধূসর রাঙা মেঘ তাকে বোঝার ক্ষমতা সবার নেই। এতদিন কেউ মেঘের খোঁজ নেয়নি আজ সামান্য কারনে মেঘের খোঁজ করতে বলছো হাও ফানি।”

অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেল রেজাউল এর। তখন আয়না চৌধুরী বলল,,

“রেজাউল ভাই তো খারাপ কিছু বলে নি।”

“এটা নিয়ে আমি কিছু শুনতে চাই না। শুধু শুনে রেখো মেঘ খারাপ কিছু করে না। যা করে সততা আর নিষ্ঠার সাথে।”

তখন মেঘ নামলো কালো বোরকা হিজাব নিকাব পড়ে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে আয়মান চৌধুরীর সাথে কিছু কথা বলছে। আয়মান চৌধুরী মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল,,

“আজকের দিনটা আপনার জীবনে সুখ নিয়ে আসুক।”

মেঘ ‘আমিন আর শুকরিয়া” বলে চলে গেল। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে দেখলো। তারপর যে যার কাজে চলে গেল।

_____________

সকাল দশটায় কলিং বেল এর শব্দ শুনে দরজা খুলে দরজার পাশের মানুষ টাকে দেখে হেসে বলল,,

‘ধূসর তোর না কাল আসার কথা ছিল তাহলে আজ?”

“আহ হা মা তোমার ছেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে তুমি খুশি হও নি বুঝি।”

ছেলের কথায় দিলরুবা খানম হেসে গালে হাত রেখে বলল,,

“খুশি তো খুব হয়েছি পনেরো দিন পর গ্ৰামের মেডিকেল ক্যাম্প থেকে আমার ছেলেটা বাড়ি ফিরলো কিন্তু কাল রাতে তুই না বললি কাল ফিরবি তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

“ওহ আচ্ছা কিন্তু মনে হলো আজকেই আসি তাই চলে এলাম। বাড়িতে কেউ নেই না সবাই সবার কাজে চলে গেছে তাই না।”

“হুম তোর বাবা আর ভাইয়া অফিসে, নোলক ভার্সিটিতে কিন্তু তোর দুই পাকনি তো রয়েছে রিমঝিম।”

“মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা বলবেন নাকি। ছোট ভাইয়া এত দূর থেকে জার্নি করে এসেছে আগে বাসায় ঢুকতে তো দিন।”

বড় ছেলের বউ রোহিনীর কথায় দিলরুবা খানম হাসলো। তখন ধূসর বলল,,

“একমাত্র তুমি আমার কষ্টটা বুঝতে পারলে ভাবি দেখো না মা সেই কখন থেকেই ক্লাস নিচ্ছে। তা আমার আম্মাজান রা কোথায়?”

তখনি দুটো চার বছরের বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে বলল,,

“ছোট বাবা আমরা দুজন এখানে।”

ধূসর এগিয়ে গিয়ে দুজন কে কোলে তুলে নিল। রিম বলল,,

“ছোট বাবা যাও হাত মুখ ধুয়ে নাও বাইরে থেকে আসলে সবার আগে হাত মুখ ধুতে হয় তুমি জানোনা।”

তখন দিলরুবা খানম বললেন,,

“দ্যাখ ধূসর কিছু শিখ তোর মতো ডাক্তার মানুষ এটা ভুলে গেছে কিন্তু আমার দিদিভাইদের দ্যাখ সব মনে রাখে।”

ধূসর ওদের নামিয়ে দিল তারপর পকেট থেকে চকলেট বের করে ওদের দিয়ে ওপরে গেল ব্যাগ নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ধূসর ফ্রেশ হয়ে এলো। ওর মা খাবার বেড়ে অপেক্ষা করছিল। ধূসর ড্রাইনিং টেবিল এ বসে খাওয়া শেষ করে ওর মাকে বলল,,

“মা আজকে কি কোন স্পেশাল দিন?”

ধূসরের কথায় দিলরুবা খানম হকচকিয়ে উঠলো। তিনি ভাবতেই পারেনি ধূসর এরকম কিছু জিজ্ঞেস করবে। তিনি নিজেকে সামলিয়ে বলল,,

“তোর কেন মনে হলো আজ স্পেশাল দিন?”

“কি জানি তবে মনে হলো আজকে আমার জন্য কোন স্পেশাল দিন। কারো সাথে সারা দিনটা আমি সেলিব্রেট করতাম। আমি তো কালকেই আসতে চাইছিলাম কিন্তু মনে হলো আজকের দিনটা স্পেশাল তাই আজকেই সকালে চলে এলাম।”

কথাগুলো শুনে দিলরুবা খানম আর রোহিনীর চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। রোহিনী বলল,,

“কার সাথে সেলিব্রেট করতে বলে তোমার মনে হয় ছোট ভাইয়া।”

“জানি না তবে মনে হয়, সব কেমন ঘোলা। মাথাটাও কেমন যেন করে।”

এ কথা শুনে দিলরুবা খানম বলল,,

“থাক ধূসর এখন এগুলো বাদ দাও আবার মাথা ব্যাথা শুরু করবে। যাও ওপরে গিয়ে রেস্ট নাও।”

“না মা বাড়িতে একা থেকে কি করবো আমি বরং একটু ঘুরে আসি।”

“তোর যেমন ইচ্ছে এমনিতে তো তোর যা ইচ্ছে করে সেটা পূরন করেই ছারিস।”

ধূসর হেঁসে ওপরে চলে গেল ও যেতেই দিলরুবা খানমের চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল। তা দেখে রোহিনী এগিয়ে এসে বলল,,

“মা একদম কাঁদবেন না প্লিজ। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। দেখেন আজকের সবকিছু কিন্তু পজিটিভ সাইন। ইনশাআল্লাহ সবকিছু তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।”

“ইনশাআল্লাহ, হুম তুমি ঠিক বলেছো। আল্লাহর লাখ লাখ শুকরিয়া।”

ধূসর রুমে এসে আলমারি খুলল আর ভাবতে লাগলো কোনটা পরে বের হবে ও আলমারিতে খুঁজতে লাগলো হুট ধূসরের চোখ গেল একটা শুভ্র পাঞ্জাবি তে। কি মনে করে সে শুভ্র পাঞ্জাবি টাই পড়লো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে দেখতে লাগলো আর বলল,,

“এই পাঞ্জাবি টা কবে কিনলাম এটা আমার আলমারিতে ছিল খেয়ালি করিনি এতদিন। মনে হয় এটা আমি কিনি নি। কেউ আমাকে কিনে দিয়েছে তবে যে দিয়েছে তার পছন্দ আছে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি হলেও হালকা কাজ করা।”

কি মনে করে বের হওয়ার সময় একটা মাস্ক পরে নিল। নিচে আসতেই দিলরুবা খানম বলল,,

“মাশাআল্লাহ আমার ছেলেটাকে শুভ্র রঙে দারুন লাগছে। তা কোথায় যাচ্ছো এত পরিপাটি হয়ে।

“শুকরিয়া মা দেখি কোথায় যাওয়া যায় আজ একা একাই ঢাকা ঘুরবো ভাবছি।”

“তা ছোট ভাইয়া মাস্ক কেন?”

‘জানিনা তবে কেউ একজন বলেছিল এই শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পড়লে আমি যেন মাস্ক ছাড়া বের না হই। তাই পরে নিলাম মনে হলো তার কথাটা অনেক ইম্পোর্টেন্ট মানতেই হবে।”

“কে বলেছিল?”

হুট করে ধূসর নিজেই অবাক হলো ও এই কথা কেন বলল । ওকে কে বলেছিল এটা ধূসর নিজেও জানে না। ধূসর বলল,,

“জানিনা তবে কেউ তো বলেছিল। আচ্ছা আমি যাই হ্যা। আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই ধূসর চলে গেল । ও চলে যেতেই দিলরুবা খানম আর রোহিনী হাসলো। রোহিনী বলল,,

‘কি বুঝলেন মা সুখের দিন খুব তাড়াতাড়ি আসতে চলেছে ভাইয়ার জীবনে।”

‘ইনশাআল্লাহ!”

______________

মেঘ বের হয়ে ওদের ফ্ল্যাটে আসলো আলমারি থেকে একটা শুভ্র রঙের শাড়ি বের করলো শাড়িটাকে ছুঁয়ে মেঘের চোখটা ছলছল করে উঠলো। মেঘ নিজেকে সামলিয়ে নিল তারপর মুচকি হেসে শাড়িটা পরিধান করলো শুভ্র রঙের ফুল হাতা ব্লাউজের সাথে শুভ্র শাড়িটা দারুন লাগছে। ও শুভ্র রঙের হিজাব আর নিকাব বেঁধে নিল। হাতে লাভ শেপের ওপরে ডি আর এম লেখা ব্রেসলেট। মেঘ আয়নায় একবার নিজেকে দেখলো। অসহায় চোখে ব্যর্থ হাঁসি ফুটানোর চেষ্টা করলো। মেঘ চোখ বন্ধ করলো তখন ওর কানে কেউ ফিসফিস করে বলল,,

“মাশাআল্লাহ মেঘবালিকা তোমাকে আজ এক টুকরো শুভ্র মেঘ লাগছে। আমি তো চোখই ফেরাতে পারছি না। নিষ্ঠুর মেয়ে আমাকে মারার প্ল্যান করেছো নাকি আজ। আজ কিন্তু তোমাকে আমার ভালোবাসায় নিষ্ঠুর হতে দেব না বলে দিলাম।”

মেঘ”ধূসর” বলে চোখ খুললো কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। নিজেকে সামলিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মেঘ শুনশান একটা নির্জন লেকে আসলো লোকজন নেই একটা নিরব পরিবেশ। এই দিনটাতে এখানেই সে আসে। সামনে নদী মাথার ওপর বড় বট গাছ তার নিছে একটা বেঞ্চ পাতা। মেঘ আসার সময় কতগুলো গোলাপ আর দশটা বেলুন নিয়ে এসেছে। মেঘ বেঞ্চে বসে পড়লো গোলাপ গুলো তার বাম পাশে বেঞ্চে রাখলো আর বেলুন গুলো বেঞ্চের হাতলে বেঁধে রেখে সামনের নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছু সময় পর মেঘ শুনতে পেল,,,

“আরে মিস কাশফিয়া আপনি তো দেখি আজ কাশফুল হয়ে সবুজের মাঝে বসে আছেন।”

~চলবে,,

ধূসর রাঙা মেঘ ২ পর্ব-০২

0

#ধূসর_রাঙা_মেঘ_২
#পর্ব_২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেঘ আর আয়মান চৌধুরী সমশের চৌধুরীর রুমে প্রবেশ করেই দেখতে পেল সে কিছু কাগজপত্র দেখছেন। আয়মান চৌধুরী বললেন,,

“আব্বা আসবো?”

সমশের চৌধুরী মাথা উঠিয়ে বললেন,,

“হ্যা এসো!’

“আব্বা কি বলবেন যার জন্য রুমে আলাদা ভাবে আসতে বললেন?”

“আগে বসো তারপর বলছি মেঘ দরজা আটকে দিয়ে আসো।”

মেঘ দরজা আটকে আয়মান চৌধুরীর পাশে বসলো। সমশের চৌধুরী বলল,,

“আয়মান গ্ৰামে আমাদের যে বাড়ি আছে সেটা আমি তোমার নামে করতে চাচ্ছি। ”

“আব্বা আমার এসবের প্রয়োজন নেই আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ওগুলো শাফিয়ান কে দিয়ে দিয়েন।”

“তোমার প্রয়োজন না হলেও আমার প্রয়োজন আছে তোমার নামে করে দেওয়ার। প্রথমত তুমি আমার বড় পুত্র সন্তান। আমি আগে থেকেই ওটা তোমার নামে করে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সবকিছু এমন ভাবে অগোছালো হয়ে গেল যে কিছুই হলো না। দ্বিতীয়ত ওটা আমি শাফিয়ান কে দিতে চাই না কারন সে ঐ বাড়ি ভেঙে ফ্যাক্টরি তৈরি করতে চায় যা গ্ৰামের জন্য ক্ষতিকারক। আমি আমার পৈতৃক বাড়ি ভাঙতে চাই না।”

“কিন্তু আব্বা এটা সবাই খারাপ ভাবে নেবে আয়না, বড় আপা আছে ওদের অধিকারও তো আছে।”

“অধিকার থাকলেও আমি ঐ বাড়িটা ওদের দিয়ে রিস্ক নিতে চাই না। আমি অন্য জায়গায় থেকে ওদের ন্যায্য অধিকার দিয়ে দেব। তাছাড়া সারাজীবন তো ভাইবোন আর পরিবারের কথা ভাবলে এবার না হয় আমার কথা ভাবো।”

“আব্বা আপনি বুঝতে পারছেন না।”

“আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে তাই বাড়িটা আমি মেঘের নামে করে দিয়েছি।”

সমশের চৌধুরীর এহেন কথায় মেঘ চমকে তার দিকে তাকালো। আয়মান চৌধুরীও তাই মেঘ বলল,,

“দাদুভাই আবার আমি কেন?”

“কারন আমি জানি আমার শেরনি বাড়িটা রক্ষা করতে পারবে। তাছাড়া বাড়িটার ওপর শুধু শাফিয়ান এর নজর নেই আরো অনেকের আছে।”

“কিন্তু এখন হঠাৎ করে এসব কেন দাদুভাই?”

সমশের চৌধুরী মেঘের গালে হাত রেখে বলল,,

“সত্যি বলতে আমার মনে হচ্ছে আমার জীবনের গন্তব্য শেষ হতে চলেছে। আজকাল তোমার দাদীকে ভিশন মনে পড়ে। আমার মনে হয় এই পৃথিবীতে আমি বেশিদিন নেই। তাই তো সব তোমাদের দুজনের হাতে দিচ্ছি।”

“এসব কি বলছেন দাদুভাই ইনশাআল্লাহ আপনার আয়ু দীর্ঘ হবে।”

“আব্বা দয়া করে এরকম কথা বলবেন না।”

“বুঝলে আয়মান পৃথিবীতে সবকিছু অনিশ্চিত থাকলেও মৃত্যু নিশ্চিত আজ না হয় কাল সবাইকে এই দুনিয়া ছাড়তে হবে। আল্লাহ তায়ালা আল কুরআন স্পষ্ট করে বলেছেন প্রত্যেকটা প্রান অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। মৃত্যুর কথা ভেবে ভয় না করে আখিরাত নিয়ে আমাদের ভয় করতে হবে। কে জানে রবের নিকট তার প্রিয় বান্দা হয়ে নিজেকে পেশ করতে পারবো কিনা।”

“দাদুভাই এমন করে কেন বলছেন ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হবে।”

সমশের চৌধুরী কাগজ এনে মেঘের কাছে দিয়ে বলল,,

“এই যে মেঘ তোমার বাড়ি । যাই হয়ে যাক বাড়িটা তুমি অবশ্যই রক্ষা করার চেষ্টা করবে। কারন ঐ বাড়িতেই তোমার দাদুভাই এর শৈশব কৈশোর আর বিবাহের পনেরোটি বছর কেটেছে। ঐ বাড়ি নিয়ে অনেক স্মৃতি আমার।”

“দাদুভাই কেউ কি ঐ বাড়ি নিয়ে আপনাকে থ্রেট দিয়েছে। নামটা বলুন শুধু বাকি দায়িত্ব আমার।”

“কার কার নাম বলবো এখানে আপনপর সবাই আছে। তাই নাম বলছি না।”

মেঘ কিছু ভাবলো তারপর বলল,,

“আচ্ছা ঠিক আছে কিছু বলতে হবে না। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। কাগজটা আমি নিয়ে যাচ্ছি। টেনশন করবেন না যা হবে ভালোই হবে। আব্বা চলুন আল্লাহ হাফেজ দাদুভাই।

“আল্লাহ হাফেজ।”

মেঘ কি ভেবে কাগজটা ওরনার নিচে লুকিয়ে দরজা খুলে বেরুলো ও বেরুতেই কয়েকটা ছায়া দেখতে পেল আয়মান চৌধুরী ও। মেঘ হাসলো আর বলল,,

“আব্বা দাদুভাই এর সাথে আড্ডাটা বেশ ভালো হলো তাই না। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আশেপাশে কিছু দৃশ্যমান দুষ্টু শয়তান জ্বীন ঘুরছে।”

কথাটা শুনে ছায়া গুলো তাড়াতাড়ি করে সরে গেল। মেঘ মুচকি হাসলো আয়মান চৌধুরী মেয়ের দিকে হেঁসে বলল,,

“আম্মা রাতে অবশ্যই আয়তুল কুরসি পাঠ করে ঘুমাবেন। তাহলে দুষ্টু শয়তান জ্বীন আপনাকে ছুঁতে পারবে না।”

“অদৃশ্য দুষ্টু শয়তান জ্বীন এর থেকে কিছু দৃশ্যমানুষ ভয়ঙ্কর বেশি, জ্বীনদের থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া গেলেও এই ভয়ঙ্কর মানুষদের থেকে সহজে মুক্তি মেলেনা।”

“আপনার তো কাজ আছে যান রুমে যান।”

“হুম আব্বা তুসবিহুন আলা খইর!”

“তুসবিহুন আলা খইর আম্মা!”

মেঘ হেসে নিজের রুমে চলে গেল। কিন্তু রুমে গিয়ে তার হাঁসি গায়েব হয়ে দীর্ঘশ্বাসে পড়িনত হলো। মেঘ কাগজ টা আলমারির লকারে রেখে দিল। তারপর তার ল্যাপটপ টা বের করে কিছু কাজ করতে লাগলো। কাজ করতে করতে একটা সময় কিছু মনে পড়তেই চোখটা ছলছল করে উঠলো। মেঘ ল্যাপটপ বন্ধ করে শুয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল,,,

“মাই ডিয়ার রুম আবার ও তোমাদের নিকট ফিরে এসেছি সেই পুরোনো ভাঙা মেঘ হয়ে। কিন্তু তোমাদের থেকে দূরে গিয়ে এই আমি জুড়ে গিয়েছিলাম অনেক সুন্দর ভাবে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আবারও সেই ভাঙা মেঘ হয়েই ফিরলাম। তবে সেখানেও আমি শেষের দিকে ভাঙাই ছিলাম। তোমরা আমার কথা শুনে হাসছো নাকি তোমাদের বলছি কারন তোমরাই তো এই ভাঙা আমাকে দেখতে পাও আর কেউ কি পায়। সবাই তো দেখতে পায় একটা নিষ্ঠুর মেয়ে কে।”

এটুকু বলে কি ভেবে মেঘ উঠে পড়লো। একটা চিঠি লিখলো সবার ওপরে প্রিয় সম্বধোন তার ব্যাক্তিগত মানুষের নাম লিখলো। তারপর একটা আবেগ মাখা চিঠি লিখতে শুরু করলো চিঠি লেখার মাঝে তার মুখে মিষ্টি হাঁসি দেখা গেল একটু অভিমান ও দেখা গেল।সবার শেষে,, “ইতি আপনার একান্ত ব্যক্তিগত নিষ্ঠুর মেয়েটা।” লিখে সুন্দর করে চিঠিটা ওর টেবিলে রাখা একটা ব্যাগে রাখলো সেখানে আগে থেকেই অনেকগুলো চিঠি ছিল । সবার ওপরে চিঠি রেখে ব্যাগটা যত্ন করে আলমারি তে রেখে দিল এটা তার কত নম্বর চিঠি সেটা একমাত্র সেই জানে। সে খুশিমনে বিছানায় বসলো কিন্তু কি যেন মনে হতেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল সে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু টাইপিং করতে লাগলো।

“কঠিন বাস্তবতা আর চারপাশের মুখোশধারী ভালোবাসার ভিড়ে, নিঃস্বার্থ আপনাকে পাবার জন্য অপেক্ষা নামক বস্তুটা রয়েছে আমাকে ঘিরে।”

এটুকু লিখে কারো নাম্বারে সেন্ট করতে গিয়েও করলো না ড্রাফট এ রেখে দিল। মেঘ উঠে ওযু করে নফল সালাত আদায় করলো কেন যেন মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে কমছেই না। তাই মানসিক শান্তি পেতে সালাত আদায় করে নিল। দীর্ঘ মুনাজাত শেষ করে নামাজ শেষ করলো এখন একটু ভালো লাগছে। কারন শান্তির চাবিকাঠিই তো নামাজ। মেঘ শুয়ে পড়লো যদি একটু ঘুম হয়।

_________________

এদিকে রুমে ঢুকে আয়মান চৌধুরী দেখলো মায়মুনা চৌধুরী বিছানায় বসে আছে আয়মান চৌধুরীর অস্তিত্ব টের পেয়ে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,,

‘ও তুমি এসো গেছো তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

“কেন তার দরকার তো দেখছি না।”

‘আয়মান তুমি কি আজ কাঁদছিলে?”

মায়মুনা চৌধুরীর এহেন কথায় আয়মান চৌধুরী একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তিনি নিজেকে সামলিয়ে বললেন,,

‘না তো!”

“তাহলে মেঘ তোমার চোখে কি পরিস্কার করলো।”

‘একটা ময়লা ঢুকে পড়েছিল বোধহয় তাই।”

” মিথ্যে বলছো তাই না ঠিক আছে বলতে হবে না কিছু। আচ্ছা আয়মান এবার কি আমাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ঠিক করা যায় না।”

‘তোমার কি মনে হয় আমাদের সম্পর্ক ঠিক নেই।”

“ব্যাপারটা তেমন না ঠিক আছে কিন্তু কোথাও একটা কিন্তু রয়েই গেছে।”

“এই কিন্তু থাকার কারন তুমি ভালো করেই জানো তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি সত্যি করে বলবে তুমি কি এখনো আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারো। যেমনটা ছয় বছর আগে করতে।”

মায়মুনা চৌধুরী আয়মান চৌধুরীর দিকে ছলছল চোখে তাকালেন আর বললেন,,

“তোমার সত্যতা জানার পর আমি আগের মতোই তোমাকে বিশ্বাস করি।”

আয়মান চৌধুরী হাসলেন আর বললেন,,

“সত্যতা জানার পর তুমি বিশ্বাস করলে কিন্তু এই বিশ্বাস টা আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে সেই ছয়বছর আগেই সেই নোংরা ঘটনায় করতে তাহলে কি আমাদের জীবন এমন হতো, হতো না আমরা আগেই মতোই একটা স্বাভাবিক সম্পর্কে থাকতাম। জীবনসঙ্গী মানে কি শুধু সঙ্গী তা নয় একে অপরের প্রতি সম্মান, বিশ্বাস আর ভরসা করাও সম্পর্কে থাকতে হয় সবথেকে বড় কথা একেঅপরের বোঝা পড়াটা থাকতে হয়। তুমি আমাকে চিনতে না আমার সাথে এত বছর সংসার করেছো তবুও তুমি আমাকে চিনতে পারো নি বুঝতে পারো নি সবথেকে বড় কথা একটা ছোট জিনিসে তুমি আমাকে অবিশ্বাস করেছো তুমি কি পারতে না মেঘের মতো আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে আর বলতে পৃথিবীর সব মানুষ তোমার বিপক্ষে গেলেও আমি তোমার সাথে আছি।”

এটুকু বলেই আয়মান চৌধুরী থামলেন। ওনার চোখে পানি চিকচিক করছে। মায়মুনা চৌধুরী কাঁদছেন তিনি কাঁদতে কাঁদতে আয়মান চৌধুরী কে জরিয়ে ধরে বললেন,,

“আমার অনেক বড় ভূল হয়ে গেছে আমাকে মাফ করো প্লিজ আমি তোমাকে এভাবে সহ্য করতে পারছি না। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি তোমার এই অদৃশ্য দূরত্ব আমাকে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।”

আয়মান চৌধুরী ওনাকে ধরলেন না শুধু বললেন,,

“পৃথিবীর সবথেকে অসহায় সময় কোনটা জানো যখন তোমার আপন জনেরাই তোমাকে বিশ্বাস করে না। ঐ পরিস্থিতিতে যারা পড়ে তারাই বুঝতে পারে বাকিরা শুধু নাটক ভেবে দেখে যায়।”

“আমাকে মাফ করে দাও জীবনে এই ভুল আর কখনো করবো না। তোমাকে ওয়াদা করলাম।”

” হুম অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড় এখন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”

বলেই আয়মান চৌধুরী মায়মুনা চৌধুরী কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে দিল তখন মায়মুনা চৌধুরী বলল,,

“আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? ঐ সময়টা আমার মাথাই কাজ করছিল না সবকিছু বোধহয় আমার গলা চেপে ধরেছিল মন মস্তিষ্কে দুটোই কার্যক্ষমতা হাড়িয়ে ছিল। কাছের মানুষটির অপত্যাশিত ঘটনা যখন সামনে আসে তখন বোধ বুদ্ধি সব লোপ পায় আমারও পেয়েছিল আমায় ক্ষমা করে দাও। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমাকেও হাড়িয়ে আমি একদম ভালো ছিলাম না। প্রত্যেকটা দিন আমার অসহ্য লাগতো শুধু পরিবারের কথা ভেবে বাচতাম‌।

আয়মান চৌধুরী হেঁসে বলল,,

“তোমার ওপর আমার রাগ কখনোই ছিল না। তোমাকে আমি বহু আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি যা ছিল তোমার প্রতি অভিমান তুমি তো আমায় জানতে চিনতে তাহলে।আর যা হয়েছে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে কেউ ধোঁকা খাবে। তবে আমি তোমার ঐ অবিশ্বাস করে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া ভুলতে পারছিলাম না তাই সম্পর্কে কিছু একটা থেকেই গেছে। তবে আজ থেকে থাকবে না কথা দিচ্ছি তুমি এভাবে কেঁদো না প্লিজ। এই তিনটা বছর তো শাস্তি পেলে আর না।”

মায়মুনা চৌধুরী কান্না বন্ধ করে হেঁসে আয়মান চৌধুরী কে জরিয়ে ধরলেন আর বললেন,,

“তুমি তাহলে আমাকে ইচ্ছে করে শাস্তি দিচ্ছিলে।”

এই তিনিও জরিয়ে ধরে হেঁসে বললেন,,

“তুমি যে আগুনে আমাকে পুড়িয়েছিলে সে আগুনে তোমাকেও তো পুরতে হতো তবে এই তিনবছর তোমার মাঝে আমাকে মানানোর সেই আমার নতুন বউকে দেখতে পেতাম তাই তো সুযোগ লুফে নিয়েছি। আমি জানতাম তো আমাকে ছাড়া তুমি ভালো ছিলে না।”

“তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে ক্ষমা করার জন্য।”

“পুরনো সব বাদ এখন আমরা আবার নতুন করে শুরু করবো। যে অতীত কষ্ট দেয় সেই অতীত মনে না করাই উত্তম।”

_________________

ফজরের আজান কানে যেতেই ঘুম থেকে ওঠার দোয়া পড়ে বিছানা ছাড়ল মেঘ। ওয়াশরুম থেকে ওযু করে একমনচিত্তে ফজরের নামাজ আদায় করে নিল। কিছুক্ষণ তসবিহ তাহলিল পাঠ করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ সকালের স্নিগ্ধ হাওয়া গায়ে লাগিয়ে আবার রুমে প্রবেশ করলো। কিছু কাগজপত্র দেখলো তারপর গোসল করলো। আটটা বাজতেই মাথায় ওরনা দিয়ে নিচে নামলো। এখন খেয়ে দেয়ে তাকে কোথাও যেতে হবে। মেঘ নামতেই দেখলো সকলে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পরেছে মেঘ গিয়ে বসলো তার আব্বার পাশে কারন আজ জিয়ান দাদুভাই এর পাশের চেয়ারে বসেছে। মেঘ বসতেই মেঘের বড় ফুপি মেঘকে খাবার দিল। মেঘ চুপচাপ খেতে শুরু করলো খাওয়া শেষ করে মেঘ বলল,,

“দাদুভাই আমাকে বেরুতে হবে দুপুরে বাড়ি ফিরতে পারবো না বিকেল বা সন্ধ্যা হতে পারে।”

তখন সমশের চৌধুরী বলল,,

“ঠিক আছে তবে বাড়ির গাড়ি আর ড্রাইভার নিয়ে যেও।”

“দরকার নেই আমার গাড়ি আছে আর আমি ড্রাইভ পারি তাই আমি সেটায় করে চলে যাবো।”

“যেমন তোমার ইচ্ছে কিন্তু কাল তো গাড়ি আনো নি ওটা তো আয়মানের।”

“আমার টা রাস্তায় আছে আসছে। আমি রেডি হতে হতে চলে আসবে।”

“ঠিক আছে।”

মেঘ চলে গেল । ও যেতেই জিয়ান বলল,,

“এমন ভাবে আমার গাড়ি আছে বলল যেন ওর নিজের টাকায় কেনা গাড়ি। নিজের তো যোগ্যতা নেই নিশ্চয়ই কাকাই কিনে দিয়েছে। কিন্তু ভাব দেখো।”

তখন আয়মান চৌধুরী হেঁসে বলল,,,

“কাশফিয়া আয়মান মেঘ কখনো অন্যের জিনিস নিয়ে ভাব নেয় না। গাড়িটা সে নিজের টাকা দিয়ে কিনেছে তাই নিজের গাড়ি বললো। মেঘের যোগ্যতা সম্পর্কে তোমার ধারনা নেই। যার সম্পর্কে ধারণা নেই তার সম্পর্কে কথা না বলাই উত্তম।”

বলেই আয়মান চৌধুরী চলে গেলেন বাকি সবাই অবাক সবথেকে বেশি বড়রা। তবে সমশের চৌধুরী জানেন তাই তিনি মুচকি হাসলো। রেজাউল আহমেদ বলল,,

“মেঘের পড়াশোনাই তো শেষ হয়েছে শুনলাম দশ মাস নাকি এক বছর আগে তাহলে এত তাড়াতাড়ি কিভাবে কি? বাবা আমার মনে হয় মেঘের সম্পর্কে আমাদের জানা উচিৎ ও কোন বে আইনি কাজ করছে না তো।”

তখন সমশের চৌধুরী বলল,,

“সমশের চৌধুরীর নাতনির রক্তে কোন ধোঁকাবাজি নেই। নিজে যা করে মানুষ ভাবে সামনের মানুষ টা তার মতোই। কাশফিয়া আয়মান মেঘ শুধু একজন সাধারণ মেয়ে নয় অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী সে তার মতো হতে এবাড়ির সবার যুগ চলে যাবে তবুও হতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। সে ধূসর রাঙা মেঘ তাকে বোঝার ক্ষমতা সবার নেই। এতদিন কেউ মেঘের খোঁজ নেয়নি আজ সামান্য কারনে মেঘের খোঁজ করতে বলছো হাও ফানি।”

অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেল রেজাউল এর। তখন আয়না চৌধুরী বলল,,

“রেজাউল ভাই তো খারাপ কিছু বলে নি।”

“এটা নিয়ে আমি কিছু শুনতে চাই না। শুধু শুনে রেখো মেঘ খারাপ কিছু করে না। যা করে সততা আর নিষ্ঠার সাথে।”

তখন মেঘ নামলো কালো বোরকা হিজাব নিকাব পড়ে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে আয়মান চৌধুরীর সাথে কিছু কথা বলছে। আয়মান চৌধুরী মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল,,

“আজকের দিনটা আপনার জীবনে সুখ নিয়ে আসুক।”

মেঘ ‘আমিন আর শুকরিয়া” বলে চলে গেল। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে দেখলো। তারপর যে যার কাজে চলে গেল।

_____________

সকাল দশটায় কলিং বেল এর শব্দ শুনে দরজা খুলে দরজার পাশের মানুষ টাকে দেখে হেসে বলল,,

‘ধূসর তোর না কাল আসার কথা ছিল তাহলে আজ?”

“আহ হা মা তোমার ছেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে তুমি খুশি হও নি বুঝি।”

ছেলের কথায় দিলরুবা খানম হেসে গালে হাত রেখে বলল,,

“খুশি তো খুব হয়েছি পনেরো দিন পর গ্ৰামের মেডিকেল ক্যাম্প থেকে আমার ছেলেটা বাড়ি ফিরলো কিন্তু কাল রাতে তুই না বললি কাল ফিরবি তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

“ওহ আচ্ছা কিন্তু মনে হলো আজকেই আসি তাই চলে এলাম। বাড়িতে কেউ নেই না সবাই সবার কাজে চলে গেছে তাই না।”

“হুম তোর বাবা আর ভাইয়া অফিসে, নোলক ভার্সিটিতে কিন্তু তোর দুই পাকনি তো রয়েছে রিমঝিম।”

“মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা বলবেন নাকি। ছোট ভাইয়া এত দূর থেকে জার্নি করে এসেছে আগে বাসায় ঢুকতে তো দিন।”

বড় ছেলের বউ রোহিনীর কথায় দিলরুবা খানম হাসলো। তখন ধূসর বলল,,

“একমাত্র তুমি আমার কষ্টটা বুঝতে পারলে ভাবি দেখো না মা সেই কখন থেকেই ক্লাস নিচ্ছে। তা আমার আম্মাজান রা কোথায়?”

তখনি দুটো চার বছরের বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে বলল,,

“ছোট বাবা আমরা দুজন এখানে।”

ধূসর এগিয়ে গিয়ে দুজন কে কোলে তুলে নিল। রিম বলল,,

“ছোট বাবা যাও হাত মুখ ধুয়ে নাও বাইরে থেকে আসলে সবার আগে হাত মুখ ধুতে হয় তুমি জানোনা।”

তখন দিলরুবা খানম বললেন,,

“দ্যাখ ধূসর কিছু শিখ তোর মতো ডাক্তার মানুষ এটা ভুলে গেছে কিন্তু আমার দিদিভাইদের দ্যাখ সব মনে রাখে।”

ধূসর ওদের নামিয়ে দিল তারপর পকেট থেকে চকলেট বের করে ওদের দিয়ে ওপরে গেল ব্যাগ নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ধূসর ফ্রেশ হয়ে এলো। ওর মা খাবার বেড়ে অপেক্ষা করছিল। ধূসর ড্রাইনিং টেবিল এ বসে খাওয়া শেষ করে ওর মাকে বলল,,

“মা আজকে কি কোন স্পেশাল দিন?”

ধূসরের কথায় দিলরুবা খানম হকচকিয়ে উঠলো। তিনি ভাবতেই পারেনি ধূসর এরকম কিছু জিজ্ঞেস করবে। তিনি নিজেকে সামলিয়ে বলল,,

“তোর কেন মনে হলো আজ স্পেশাল দিন?”

“কি জানি তবে মনে হলো আজকে আমার জন্য কোন স্পেশাল দিন। কারো সাথে সারা দিনটা আমি সেলিব্রেট করতাম। আমি তো কালকেই আসতে চাইছিলাম কিন্তু মনে হলো আজকের দিনটা স্পেশাল তাই আজকেই সকালে চলে এলাম।”

কথাগুলো শুনে দিলরুবা খানম আর রোহিনীর চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো। রোহিনী বলল,,

“কার সাথে সেলিব্রেট করতে বলে তোমার মনে হয় ছোট ভাইয়া।”

“জানি না তবে মনে হয়, সব কেমন ঘোলা। মাথাটাও কেমন যেন করে।”

এ কথা শুনে দিলরুবা খানম বলল,,

“থাক ধূসর এখন এগুলো বাদ দাও আবার মাথা ব্যাথা শুরু করবে। যাও ওপরে গিয়ে রেস্ট নাও।”

“না মা বাড়িতে একা থেকে কি করবো আমি বরং একটু ঘুরে আসি।”

“তোর যেমন ইচ্ছে এমনিতে তো তোর যা ইচ্ছে করে সেটা পূরন করেই ছারিস।”

ধূসর হেঁসে ওপরে চলে গেল ও যেতেই দিলরুবা খানমের চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল। তা দেখে রোহিনী এগিয়ে এসে বলল,,

“মা একদম কাঁদবেন না প্লিজ। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। দেখেন আজকের সবকিছু কিন্তু পজিটিভ সাইন। ইনশাআল্লাহ সবকিছু তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।”

“ইনশাআল্লাহ, হুম তুমি ঠিক বলেছো। আল্লাহর লাখ লাখ শুকরিয়া।”

ধূসর রুমে এসে আলমারি খুলল আর ভাবতে লাগলো কোনটা পরে বের হবে ও আলমারিতে খুঁজতে লাগলো হুট ধূসরের চোখ গেল একটা শুভ্র পাঞ্জাবি তে। কি মনে করে সে শুভ্র পাঞ্জাবি টাই পড়লো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে দেখতে লাগলো আর বলল,,

“এই পাঞ্জাবি টা কবে কিনলাম এটা আমার আলমারিতে ছিল খেয়ালি করিনি এতদিন। মনে হয় এটা আমি কিনি নি। কেউ আমাকে কিনে দিয়েছে তবে যে দিয়েছে তার পছন্দ আছে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি হলেও হালকা কাজ করা।”

কি মনে করে বের হওয়ার সময় একটা মাস্ক পরে নিল। নিচে আসতেই দিলরুবা খানম বলল,,

“মাশাআল্লাহ আমার ছেলেটাকে শুভ্র রঙে দারুন লাগছে। তা কোথায় যাচ্ছো এত পরিপাটি হয়ে।

“শুকরিয়া মা দেখি কোথায় যাওয়া যায় আজ একা একাই ঢাকা ঘুরবো ভাবছি।”

“তা ছোট ভাইয়া মাস্ক কেন?”

‘জানিনা তবে কেউ একজন বলেছিল এই শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পড়লে আমি যেন মাস্ক ছাড়া বের না হই। তাই পরে নিলাম মনে হলো তার কথাটা অনেক ইম্পোর্টেন্ট মানতেই হবে।”

“কে বলেছিল?”

হুট করে ধূসর নিজেই অবাক হলো ও এই কথা কেন বলল । ওকে কে বলেছিল এটা ধূসর নিজেও জানে না। ধূসর বলল,,

“জানিনা তবে কেউ তো বলেছিল। আচ্ছা আমি যাই হ্যা। আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই ধূসর চলে গেল । ও চলে যেতেই দিলরুবা খানম আর রোহিনী হাসলো। রোহিনী বলল,,

‘কি বুঝলেন মা সুখের দিন খুব তাড়াতাড়ি আসতে চলেছে ভাইয়ার জীবনে।”

‘ইনশাআল্লাহ!”

______________

মেঘ বের হয়ে ওদের ফ্ল্যাটে আসলো আলমারি থেকে একটা শুভ্র রঙের শাড়ি বের করলো শাড়িটাকে ছুঁয়ে মেঘের চোখটা ছলছল করে উঠলো। মেঘ নিজেকে সামলিয়ে নিল তারপর মুচকি হেসে শাড়িটা পরিধান করলো শুভ্র রঙের ফুল হাতা ব্লাউজের সাথে শুভ্র শাড়িটা দারুন লাগছে। ও শুভ্র রঙের হিজাব আর নিকাব বেঁধে নিল। হাতে লাভ শেপের ওপরে ডি আর এম লেখা ব্রেসলেট। মেঘ আয়নায় একবার নিজেকে দেখলো। অসহায় চোখে ব্যর্থ হাঁসি ফুটানোর চেষ্টা করলো। মেঘ চোখ বন্ধ করলো তখন ওর কানে কেউ ফিসফিস করে বলল,,

“মাশাআল্লাহ মেঘবালিকা তোমাকে আজ এক টুকরো শুভ্র মেঘ লাগছে। আমি তো চোখই ফেরাতে পারছি না। নিষ্ঠুর মেয়ে আমাকে মারার প্ল্যান করেছো নাকি আজ। আজ কিন্তু তোমাকে আমার ভালোবাসায় নিষ্ঠুর হতে দেব না বলে দিলাম।”

মেঘ”ধূসর” বলে চোখ খুললো কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। নিজেকে সামলিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মেঘ শুনশান একটা নির্জন লেকে আসলো লোকজন নেই একটা নিরব পরিবেশ। এই দিনটাতে এখানেই সে আসে। সামনে নদী মাথার ওপর বড় বট গাছ তার নিছে একটা বেঞ্চ পাতা। মেঘ আসার সময় কতগুলো গোলাপ আর দশটা বেলুন নিয়ে এসেছে। মেঘ বেঞ্চে বসে পড়লো গোলাপ গুলো তার বাম পাশে বেঞ্চে রাখলো আর বেলুন গুলো বেঞ্চের হাতলে বেঁধে রেখে সামনের নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছু সময় পর মেঘ শুনতে পেল,,,

“আরে মিস কাশফিয়া আপনি তো দেখি আজ কাশফুল হয়ে সবুজের মাঝে বসে আছেন।”

~চলবে,,

ধূসর রাঙা মেঘ ২ পর্ব-০১

0

#ধূসর_রাঙা_মেঘ_২
#সূচনা_পর্ব
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

দীর্ঘ ছয় বছর পর নিজের বাড়িতে পা রাখতে চলেছে কাশফিয়া আয়মান মেঘ। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাড়িটাকে একবার অবলোকন করে নিল সে। মেঘের ভেতর কি অনুভুতির মিশ্রন ঘটছে তা বোঝা যাচ্ছে না। রাগ নাকি অভিমান সে স্থির চোখে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ছয় বছর আগে তার বাবার হাত ধরেই এই বাড়ি ত্যাগ করা হয়েছিল তার।পাশে তার বাবা আয়মান চৌধুরী। তিনিও অনেক দিন পর আসলেন যদিও এই ছয় বছরে প্রথম তিন বছর তার এই বাড়িতে আসা যাওয়া হতো না তবে শেষের তিন বছরে তিনি স্বল্প সময়ের বা স্বল্প দিনের জন্য হলেও এই বাড়িতে আসতেন।বলতে গেলে প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তিনিও ছয় বছর পর একেবারের জন্য নিজের পৈত্রিক বাড়িতে এলেন। মেঘ এক দৃষ্টিতে বাড়ির দিকেই তাকিয়ে ছিল প্রায় তিন মিনিট হবে সে গাড়ি থেকে নেমেছে। আয়মান চৌধুরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আম্মা ভেতরে যাওয়া যাক !”

মেঘ একবার আয়মান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। মেঘের পড়নে কালো বোরকা, কালো হিজাব আর নিকাব। এক কাঁধে একটা ব্যাগ রয়েছে। আয়মান চৌধুরীর ফর্মাল কোর্ট প্যান্ট পড়েছেন। তারা এসেছে এটা ড্রয়িংরুম পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে কি না জানা নেই তাদের। মেঘ গিয়ে কলিং বেল চাপলো তখন কেউ একজন দরজা খুলে মেঘ কে দেখে বলল,,

“কে আপনি আর কাকে চাই?”

যে দরজা খুলেছে সে বোধহয় পেছনে আয়মান চৌধুরী কে দেখেন নি। আয়মান চৌধুরী এগিয়ে এসে বলল,,

“ও মেঘ আমার মেয়ে সম্পর্কে তোমার কাকাতো বোন জায়মা!”

কথাটা শুনেই জায়মা নামক মেয়েটা হেঁসে বলল,,

“ও কাকাই তুমি আসলে মেঘকে চিনতে পারি নি নিকাবের জন্য, আর তোমাকে খেয়াল করি নি। আসো ভেতরে আসো। মেঘ কেমন আছিস তুই? কতোদিন পর দেখা হলো বল!”

মেয়েটা এগিয়ে এসে মেঘকে জরিয়ে ধরলো কিন্তু মেঘের কোন ভাবান্তর নেই। সে ছোট করে উত্তর দিল,,

“জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপনি কেমন আছেন?”

জায়মা মেঘ কে ছেড়ে বলল,,

“কি ব্যাপার মেঘ আমি কি তোর পর যে আপনি করে বলছিস তুমি করে বল নাহলে ছোটবেলার মতো থাপ্পড় খাবি।”

এবার মেঘের মুখে একটু হাঁসি দেখা গেল যদিও নিকাবের আড়ালে সে হেসে বলল,,

“আরে জায়মা আপু তুমি কেন পর হতে যাবে, তবে কি বলো তো কতো বছর পর দেখা হলো তাই আর কি দেখলাম তুমি আমায় ভুলে গেছো নাকি।”

“তোকে ভুলবো আমি তুই হলি আমার পিচ্চি বোন!”

তখন পেছনে কেউ একজন এসে বলল,,

‘এতক্ষন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছো জায়মা?”

“কাকিমনি দেখো মেঘ আর কাকাই এসেছে!”

কথাটা শুনে মেঘের মা মায়মুনা চৌধুরী একটু থমকে গেলেন বোঝাই যাচ্ছে সে এদের আশা করেনি। মেঘ জায়মার পাশ কাটিয়ে মায়মুনা চৌধুরীর সামনে গিয়ে বলল,,

“আসসালামু আলাইকুম কেমন আছেন আপনি? আমি মেঘ!”

মায়মুনা চৌধুরী মেঘের গালে হাত রাখতে গেল আবার কি মনে করে গালে হাত না রেখে মুখটা গম্ভীর করে বললেন,,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম! আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি!”

মেঘ মায়ের সবকিছুই পর্যবেক্ষন করলো। দীর্ঘ ছয় বছর পর মুখোমুখি হয়েছে তারা। মেঘের চোখটা একটু জ্বালা করছে তার মায়ের সাথে এতবছর পর দেখা অথচ একবারও জিজ্ঞেস করল না সে কেমন আছে। সে নিজেকে সামলিয়ে নিলো। কিন্তু ততক্ষনে ড্রয়িংরুমে সবাই জেনে গেছে কারা এসেছে মেঘ তার বাবার কাছে গেল। আয়মান চৌধুরী সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। হুট করে তখন মেঘের ছোট ফুপি আয়না চৌধুরী বললেন,,

“অবশেষে তাহলে মহারানীর পা পড়লো চৌধুরী বাড়িতে! এতদিন তো ঢং ধরে বাড়িতে আসার প্রয়োজন বোধ করে নি।”

তখন মেঘ হেসে বলল,,

“একদম ঠিক বলেছেন ছোট ফুপি এ বাড়িতে আসার প্রয়োজন পড়ে নি তাই আসি নি। যদিও আজও আসতাম না কিন্তু এই বাড়ির প্রয়োজন পড়লো তাই আসতে হলো।”

তখন মায়মুনা চৌধুরী বলল,,

“এটা কি রকম ব্যবহার তুমি আগের মতোই বেয়াদব রয়েছো একটুও পাল্টাও নি।”

তখন মেঘের দাদুভাই সমশের চৌধুরী বললেন,,

‘মেয়েটা আসতে না আসতেই কি শুরু করলে! এতদিন পর বাড়িতে এসেছে তার আপ্যায়ন করবে তা না করে কি করছো তোমরা।”

তখন আয়না চৌধুরী বলল,,

“ও তেমন ইম্পোর্টেন্ট কেউ না বাবা যে তার আপ্যায়ন করতে হবে।”

“আয়না একদম চুপ! বাবার বাড়িতে এসেছো সে ঠিক আছে। কিন্তু আমার সংসারে তোমার কথা আমি অ্যালাও করবো না। তাই কোন কথা না। সবথেকে বড় কথা আমার নাতনি কে কিছুই বলবে না তুমি। ও ইম্পোর্টেন্ট কি ইম্পোর্টেন্ট না সেটা তোমার থেকে জানতে হবে না।

বাবার কথা শুনে আয়না চৌধুরী চুপ মেরে গেলেন। মেঘ সমশের চৌধুরীর সামনে গিয়ে বলল,,

“আসসালামু আলাইকুম দাদুভাই কেমন আছেন?”

তিনি মেঘের মাথায় হাত রেখে বলল,,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম! আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি তুমি কেমন আছো? আমার কথা রাখার জন্য শুকরিয়া!”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি! আপনি তো শের চৌধুরী আপনার কথা অমান্য করা কার সাধ্য!”

সমশের চৌধুরী হাসলো আর বলল,,

“আমি যদি শের হয়ে থাকি তাহলে তুমি হলে শেরনি! যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও তোমার রুম আমি পরিস্কার করিয়ে গুছিয়ে রেখেছি! জায়মা ওকে রুমে নিয়ে যাও। আর আয়মান তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমরা একসাথে দুপুরের খাবার খাবো।”

“দাদুভাই মুন আপু , আজান, জিয়ান ভাইয়া,শিফা ওরা কোথায়?”

“ওরা একটু মার্কেটে গেছে এসে পড়বে তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো।”

“ঠিক আছে!”

আয়মান চৌধুরী মেঘের কাছে এসে বলল,,

“চলেন আম্মা ওপরে যাই!”

হুম মেঘ আর আয়মান চৌধুরী নিজেদের ঘরে চলে গেলেন। ওরা যেতেই মায়মুনা চৌধুরী বলল,,

“বাবা আজকে ওরা আসবে আপনি বলেন নি তো সেই জন্যই কি এতো খাবারের আয়োজন করতে বলেছেন?”

“হুম ওদের জন্যই বলেছি। আর আসার কথা বললে কি ওয়েলকাম করার জন্য বরনডালা সাজিয়ে রাখতে নাকি! মনে তো হয় না ব্যাপারটা তোমাদের তাই আমি কিছু বলছি না। তবে মনে রেখো কিছু কিছু মানুষের আগমন হুট করেই হয় তাদের আগমনী বার্তা পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না। এখন ওপরে গিয়ে দেখো আয়মানের কিছু লাগবে কি না। তারপর খাবার সাজাও অনেক দিন হলো পরিবারের সবার সাথে খাবার খাওয়া হয় না। জাহানারা শাফিয়ানকে অফিস থেকে আসতে বলো আর জিয়ানদের ফোন দাও বাড়িতে আসতে বলো দেরি যেন না হয়।”

মায়মুনা চৌধুরী চুপ মেরে গেলেন। সমশের চৌধুরী সেখান থেকে চলে গেলেন। আয়না চৌধুরী বলল,,

“আমি বুঝি না বাবা আর ভাইয়া ঐ কালো মেঘের মাঝে কি দেখে মনে হয় পারলে সবসময় মাথায় করে রাখে। যত্তসব আদিখ্যেতা!”

বলে তিনি ও চলে গেলেন মায়মুনা কিছু ভাবতে ওপরে গেলেন হাজার হোক তার হাজবেন্ড এসেছে ওপরে গিয়ে দেখা প্রয়োজন।

______________

মেঘ নিজের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো জায়মা মেঘের রুমের দরজা খুলে দিল । মেঘ আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকলো যেমনটা রেখে গিয়েছিল ঘরটা তেমনই রয়েছে বোধহয় এই ঘরটা কেউ পরিষ্কার করে রাখতো। মেঘ জায়মাকে গিয়ে বলল,,,

“আপু তুমি এখন যাও! আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যাবো।”

“আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের কষ্টকে আড়াল করতে চাইছিস!”

“কষ্ট! আর এই রুমের সাথে কষ্টের কি সম্পর্ক!”

“কিসের সম্পর্ক তা আমার থেকে তুই ভালো জানিস মেঘ!”

“উহু কোন সম্পর্ক নেই! তুমি যাও তো!”

“হুম যাচ্ছি যাচ্ছি নিজের রুম পেয়ে দখল নেওয়ার জন্য তাড়িয়ে দিচ্ছিস!”

“আপু প্লিজ এখন মজা কোরো না এখন, অহেতুক মজা করা আমার পছন্দ নয় এটা তুমি ভালো করেই জানো।”

“যা নিরামিষ মহিলা।”

বলেই জায়মা চলে গেল। মেঘের পুরোনো কথা ভেবেই চোখ ছলছল করে উঠলো। মেঘ ধীরে ধীরে গিয়ে ওর দক্ষিন পাশের জানালা খুলে দিল শা শা করে বাতাস প্রবেশ করলো ওর রুমে। মেঘ বোরকা হিজাব আর নিকাব খুলে ফ্রেশ হয়ে এলো। তার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো পরনে সাদা রঙের থ্রিপিস। মেঘ রুম থেকে বেরুবে কি বেরুবে না ভাবতে ভাবতে আয়মান চৌধুরী ওর রুমে প্রবেশ করলো মেঘ তার বাবাকে দেখে রুমে আসলো তখন আয়মান চৌধুরী বলল,,

“আম্মা আমার মনে হয় একেবারে বিয়ের মধ্যে আসাই উচিত ছিল। এখনো মুনের বিয়ের দশদিন বাকি! আপনার সমস্যা হতো না।

মেঘ হেঁসে বলল,,

“আব্বা আপনি হলেন কনের বাবা আপনার একটা দায়িত্ব আছে। দূরে ছিলেন বলে আপনার দায়িত্ব বদলে যায় নি সব বাবাদের আলাদা দায়িত্ব থাকে। মুন আপুর বিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে থেকে সব দায়িত্ব পালন করবেন দেখবেন আপনার মেয়ের বিয়েতে যেন কোন অসুবিধা না হয়। যদিও আপনার দায়িত্ব আপনি ভালো করেই জানেন এবং সবার অগোচরে হলেও এতবছর ধরে পালন করে আসছেন।”

“দায়িত্ব থেকে কখনো পালাতে নেই সে যাই হোক না কেন আপনজন পর করে দিলেও নিজের দায়িত্ব পালন করতে হয়। দায়িত্ব পালন অবশ্যই সঠিক ভাবে পালন করবো। আপনি অস্বস্তি বোধ করছেন না তো?”

‘এটা আমার বাড়ি আব্বা তাহলে অস্বস্তি কেন হবে? হ্যা মানছি অনেক বছর এখানে থাকি নি তাই বলে বাড়ির প্রতি টান কমে যায় নি। তাছাড়া এখন থেকে আমি তো এই বাড়িতেই থাকবো।”

“হুম!”

“মায়ের সাথে সব ঠিক ঠাক আব্বা!”

“হুম চলুন নিচে যাই!”

“চলুন!”

মেঘ আর আয়মান চৌধুরী নিচে চলে গেল তারা দুজন সবার থেকে দূরে সোফায় বসে পড়লো। বাবা মেয়ে কিছু নিয়ে কথা বলছে সবাই দেখল কিন্তু কিছু বললো না। মেঘের একটা ফোন আসাতে ও উঠে রিসিভ করতে যাবে তখনি মুনরা চলে এলো আজান নিজের বোনকে দেখে মেঘ আপু বলে চিৎকার দিয়ে মেঘকে জরিয়ে ধরলো। সকলে অবাক কারন সবার জানামতে আজানের মেঘকে চেনার কথা নয়। কারন সে এই ছয়বছরে মেঘকে দেখেনি তাহলে । কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বললো না। এদিকে মেঘ একটু চমকালেও ভাই এর কান্ড দেখে মুচকি হেঁসে বলল,,

“আরে আজান কি করছিস ছাড় আমাকে আমি তো তোর জন্য কিমা হয়ে যাবো”

তখন আজান বলল,,

“আপু তুমি আসবে কেউ কিছু বললো না কেন তুমি কি আমাদের সারপ্রাইজ দিতে এসেছো!”

মেঘ হেসে আজানকে ছাড়িয়ে বলল,,

“হুম!”

তারপর মুনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“মুন আপু কেমন আছো?”

“তুই মেঘ আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না তুই এখানে?”

“কেন আসতে পারি না বুঝি আমার আপন বোনের বিয়ে আর আমি থাকবো না তা কি করে হয় বলোতো তবে তুমি যদি না চাও তাহলে বলো আবার চলে যাচ্ছি।”

মুন এগিয়ে এসে মেঘকে জরিয়ে ধরে বলল,,

“এই না না আমি এমনি বলেছি তুই বিয়ে অবশ্যই থাকবি তোর একমাত্র বোনের বিয়ে তোকে ছাড়া হবে না। কেমন আছিস তুই অনেক দিন পর দেখা হলো।”

“হুম আলহামদুলিল্লাহ ভালো তুমি কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো!”

“জিয়ান ভাইয়া শিফা তোমরা কেমন আছো?”

ভালো বলেই তারা দুই ভাইবোন চলে গেল। অতঃপর সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খেতে বসলো সমশের চৌধুরীর ডান পাশে তিনি মেঘকে বসালেন আর বামপাশে আয়মান চৌধুরী কে। এই দুটি চেয়ার এতদিন শাফিয়ান চৌধুরী এবং তার ছেলে জিয়ান বসতো হুট করে তাদের জায়গা দখল হওয়ায় তাদের ভিশন রাগ হলো তবুও সমশের চৌধুরীর জন্য কিছু বললো না। সমশের চৌধুরী মেঘকে দেখে খাওয়াচ্ছে যা চৌধুরী পরিবারের কাছে অষ্টম আশ্চর্য ছাড়া কিছু নয়। আজান ছাড়া তার সব নাতি নাতনিরা তাকে দেখে যথেষ্ট ভয় পায় কেউ তার কাছে ঘেঁষে না এমনকি তিনিও কারো কাছে এগিয়ে আসেন না। তিনি মেঘকে দেখে দেখে খাওয়াচ্ছে এটা তাদের হজম হচ্ছে না কারন এই মেয়েটাকেই এক সময় সে সহ্য করতে পারতো না। মায়মুনা চৌধুরী ও অবাক চোখে দেখছে। আয়মান চৌধুরী মুচকি হাসছে । খাওয়া শেষ করে মেঘ নিজের রুমে চলে গেল। বাকি সবাই সোফায় বসলো সবাই মেঘকে নিয়ে আলোচনা শুরু করলো।

(চৌধুরী পরিবারের হেড সমশের চৌধুরী। তার স্ত্রী মেঘের পাঁচ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন। তাদের বড় ছেলে আয়মান চৌধুরী স্ত্রী মায়মুনা চৌধুরী। তাদের তিন সন্তান, বড় সন্তান মুনজেরিন ডাকনাম মুন তার পড়াশোনা শেষ আরো বছর তিন আগে তার তিনবছর আগে আকদ হয়েছিল কিন্তু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা কোন কারন বশত হয় নি এখন হচ্ছে। তারপর কাশফিয়া আয়মান মেঘ পড়াশোনা শেষ বলেই সবাই জানে তারপর আজান এইবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। ছোট ছেলে শাফিয়ান চৌধুরী তার স্ত্রী জাহানারা তাদের তিন সন্তান জায়মা বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর আগে, তারপর জিয়ান পড়াশোনা শেষ করে বাবা দাদার সাথে বিজনেস দেখছে তারপর শিফা এবার অনার্স ফাস্ট ইয়ারে। সমশের চৌধুরীর দুই মেয়ে আশা চৌধুরী আর আয়না চৌধুরী। )

_______________

দেখতে দেখতে মেঘের চৌধুরী বাড়িতে বিকেলটা ভালোই কেটে গেল। যদিও আজান আর সমশের চৌধুরী ছাড়া বাকি কারো সাথে তেমন কথা হয়নি। মেঘের কথা শুনে রাতে মেঘের বড় ফুপি আশা চৌধুরী তার হাজবেন্ড আর মেয়ে শায়লা কে নিয়ে এসেছেন। এসেই শায়লা মেঘের ঘরে ছুটলো তার ভিশন আদরের সে তাই তো আদর করে পিচ্চি ডাকে। মেঘ কিছু একটা করছিল হুট করেই কেউ মেঘের চোখ ধরলো মেঘ কিছু বুঝতে না পেরে বলল,,

“কে?”

“কে বলতো পিচ্চি?”

“শায়লা আপু!”

শায়লা চোখ ছেড়ে দিয়ে বলল,,

“কি করে বুঝলি আমি তো কন্ঠস্বর আলাদা করে বললাম!”

মেঘ হেসে বলল,,

“তোমার পিচ্চি শুনে কারন তুমি ছাড়া কেউ আমাকে পিচ্চি বলে না।”

“বাহ বাহ ভালো তো !”

“কেমন আছো, কে কে এসেছে দুলাভাই আর তোমার মেয়ে আমার ভাগ্নি ওরাও নাকি?”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই জানলি কেমনে যে তোর দুলাভাই আছে আবার ভাগ্নি ও। তোকে তো আমাদের বিয়েতে ইনভাইট করা হয় নি তাছাড়া বিয়েটা পাঁচ বছর আগে হয়েছে তাহলে তোদের সাথে তখন যোগাযোগ ছিল না কেসটা কি বলতো।”

এ কথা শুনে মেঘ একটু থমকালো আর বলল,,

“বাড়ি ফিরেছি দুপুরে খবর পাবো না তাই কখনো হয়। তাছাড়া আব্বা তিন বছর ধরে এই বাড়িতে যাতায়াত করে তোমার মাথায় একটুও ও বুদ্ধি নেই।

“ওকে বুঝলাম! এখন যাই ফ্রেশ হয়ে নিই।”

“হুম যাও।”

শায়লা মেঘের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। মেঘ কিছু ভাবলো তারপর গিয়ে বড় ফুপির সাথে দেখা করতে নিচে এলো। কিন্তু ঘটনা চক্রে মেঘ আশা চৌধুরীর হাজবেন্ড এর আয়মান চৌধুরী সম্পর্কে কিছু তিক্ত কথা শুনতে পেল।আয়মান চৌধুরী মাথা নিচু করে রেখেছে। তা দেখে রাগে মেঘের মাথা ফেটে যাচ্ছে। মেঘ কঠোর স্বরে একটু জোরেই বলল,,

‘আসসালামু আলাইকুম ফুপা!”

হুট করে মেয়ের আগমনে তিনি চমকে উঠলো। মেঘের ফুপা রেজাউল আহমেদ একটু হকচকিয়ে গেল সাথে বাকি সবাই। এখন ইয়াংস্টার রা নিচে নেই কিন্তু বড়রা মায়মুনা চৌধুরী, জাহানারা, শাফিয়ান আর আয়না চৌধুরী। সকলেই আছে সমশের চৌধুরী ছাড়া। রেজাউল আহমেদ বলল,,

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম আরে মেঘ যে!”

“হ্যা আমি! তবে কি বলুন তো ফুপা সামনের মানুষটা চুপ করে আছে মানে এই না যে অন্যায়টা সে করেছে। আসলে মুর্খের সাথে তর্ক করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।এটা আমার আব্বা ভালো করেই জানে।”

মেঘের কথা শুনে অপমানে রেজাউল আহমেদ এর মুখ থমথমে হয়ে গেল। এক কথায় কিভাবে মুখ বন্ধ করতে হয় সেটা মেঘ ভালো করেই জানে। তিনি বলল,,

“মেঘ তুমি আমাকে মূর্খ বললে?”

“হ্যা বললাম আপনি তো মূর্খই না হলে সত্যতা প্রমান পাওয়ার পরও কেউ পুরোনো কাসুন্দি ঘাটে। সরি ফুপি কিন্তু তোমার জামাই এর এভাবে ব্যবহার করার ইচ্ছে ছিল না তবে তিনি এমন কাজ করলো যে মন খারাপ করো না ঠিক আছে। আর বাকি সবাই কি দেখছেন তাকিয়ে প্রতিবাদ করার মুরদ না থাকলে সেই স্থানে থাকার কোন প্রয়োজন তো দেখছি না আমি। চৌধুরী বাড়ির ছেলেকে অপমান করছে আর বাড়ির সবাই মজা নিচ্ছে। শেম অন ইউ অল।

কথা গুলো সে আশা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল। সবাই মাথা নিচু করে ফেলল। আয়মান চৌধুরীর মুখে তৃপ্তির হাসি। আশা চৌধুরী কিছু বললো না তবে মুচকি হেসে মেঘকে জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করলো। এটা দেখে সবাই অবাক সমশের চৌধুরী সেখানে ছিলেন না তাই এ সম্পর্কে ধারনা নেই নাহলে কোন ভাবেই তার ছেলেকে অপমান করার জন্য ছাড় দিতেন না । মেঘ আশা চৌধুরী কে ছেড়ে ওর আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তাড়াতাড়ি সোফায় বসেন আপনার ওষুধের সময় হয়ে গেছে আমি ওষুধ নিয়ে আসছি। খাবার আগে ওষুধ আছে তো।”

তিনি মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল মেঘের অবস্থা সে রেগে আছে। তিনি তাড়াতাড়ি করে মেয়ের কাছে এলো বাকিরা বেশ অবাকই হলো।তিনি গিয়ে বলল,,

“আম্মা আমি!”

“চুপ করে সোফায় বসুন! ”

বলেই মেঘ ওপরে চলে গেল তিনি চুপ করে সোফায় বসলো। কেউ কিছু বললো না। কিন্তু রেজাউল আহমেদ রেগে ওখান থেকে চলে গেল আশা চৌধুরী ভাইয়ের কাছে এসে বলল,,,

‘সরি ভাই মাফ করে দিস। কিছু মনে করিস না, তুই তো জানিস ও কেমন?

“অন্যের ভুলের জন্য তুমি কেন মাফ চাইছো আপা। ছেড়ে দাও কিছুই মনে করি নি। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও ডিনার টাইম হয়ে গেছে।”

আশা চৌধুরী চলে গেল । তখন ইয়াংস্টার রা আর সমশের চৌধুরী সবাই নিচে আসলো ডিনারের সময় হয়ে গেছে। এখানে কি হয়েছে কেউ জানে না। আর হয়তো কেউ কিছু বলবেও না। সবার পরে মেঘ আসলো টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়মান চৌধুরীর হাতে ওষুধ আর পানি দিলো তিনি বিনা বাক্যে খেয়ে নিল। তারপর নিজের আব্বার জন্য একটা প্লেটে নিজ হাতে খাবার বাড়লো আর বলল,,

“আমি আর আব্বা সোফায় খাবো দাদুভাই আপনারা খেয়ে নিন।”

বলেই মেঘ উত্তরের অপেক্ষা না করে সোফায় বসলো। সকলে দেখলো মেঘ ভাত মাখিয়ে আয়মান চৌধুরীর সামনে তুলে ধরলো। আয়মান চৌধুরীর চোখ ছলছল করে উঠলো কারন আর কেউ না বুঝলেও মেঘ বুঝতে পারে তার আব্বার মন খারাপ কখন হয়। আর মন খারাপ থাকলে সে খেতে পারে না তাই তো নিজ হাতে খায়িয়ে দেয় এই সময়টা। খাবার টা গালে নিচ্ছে না দেখে মেঘ বলল,,

“কি হলো আব্বা খাবারটা মুখে নিন!”

আয়মান চৌধুরী খাবারটা নিল। খাবার টা গিলে বলল,,

“আমি কিছু বলিনি বলে আপনি আমার ওপর রেগে আছেন আম্মা। মনে করেন কেউ আপনাকে অনেক কষ্ট দিলো, আপনার মনে প্রচুর আঘাত করলো, অপমান করলো ,কিন্তু না আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না আল্লাহ সবই দেখছে। সময় হলে তিনি ঠিকই বিচার করবেন। যেখানে কোনো দোষই আপনার ছিল না। অন্য কারও দোষ আপনার উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো, এতে আপনি মন খারাপ করবেন না। সর্বদা আল্লাহর ওপর ভরশা রাখবেন। রাসূল (সা:)বলেছেন – তুমি জানো,তুমি সঠিক, তবুও তুমি তর্কে যেও না ।
[সহীহ বুখারী:৪০৭৯]
এই কারনে আমি কিছু বলি নি আম্মা।

মেঘ আরেক লুকমা এগিয়ে দিয়ে বলল,,,,

” আপনার কিছু না বলার জন্য আমি রেগে নেই আব্বা। কিন্তু কখনো মূল্যহীন মানুষের নিকট মাথা নত করতে নেই আব্বা। কিন্তু আজ আপনি ওখানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন? ফুপা যা বলল তা সব মিথ্যে তাহলে আপনি মাথা নিচু করে ছিলেন কেন? আমি আপনাকে বলেছি না আমার আব্বা আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নিচু করবে না। মানলাম আপনি তর্কে জড়ান নি তাই বলে মাথা নিচু করে রাখবেন এটা আমি মানতে পারছি না।”

আয়মান চৌধুরী খাবারটা গিলে অসহায় মুখ করে বললেন,,

“পৃথিবীতে এমন কি আছে যা হয়তো মৃত্যুর যন্ত্রনার থেকেও বেশি যন্ত্রনা দেয়?”

কথাটা শুনে মেঘের হাত আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল।মেঘ আয়মান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো তার চোখ ছলছল করছে। মেঘ নিজেকে সামলিয়ে জবাব দিল,,

“সবার সামনে করা অপমান!”

আয়মান চৌধুরীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরল। মেঘ তাড়াতাড়ি করে বাম হাত দিয়ে তার আব্বার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,,

“আর একটাও কথা না আব্বা চুপচাপ খান। খাওয়ার সময় কথা বলতে হয়না অথচ আপনি বলেই যাচ্ছেন।”

আয়মান চৌধুরী চুপচাপ খাচ্ছেন মেঘ ও খাচ্ছে। এদিকে ড্রাইনিং টেবিল থেকে সকলেই এই দৃশ্য দেখলো। এখনো কেও খাবার শুরু করে নি। সবার দৃষ্টি যেন ওদের দিকেই। সমশের চৌধুরী বলল,,

“হুম অনেক হয়েছে খাওয়া শুরু করো। ওদের কে ওদের মতো ছেড়ে দাও।”

তখন আজান বলল,,

“দাদুভাই বাবা কি কাঁদছিল মেঘ আপু মুছে দিল।”

“না কাঁদছিল না হয়তো চোখে কিছু পড়েছিল। এখন খাবার খাওয়া শুরু করো। আর মায়মুনা আমি নিচে আসার আগে কি নিচে কিছু হয়েছিল?”

তখন আয়না চৌধুরী তাড়াতাড়ি করে বলল,,

“না বাবা কিছু হয় নি।”

মেয়ের কথা শুনে সমশের চৌধুরী কিছু বললেন না তবে এটা বুঝতে পারলো তার ছেলের চোখে কিছু পড়েনি তার ছেলে কাঁদছিল। তিনি খাওয়া শুরু করলো। খাওয়া শেষে মেঘ আয়মান চৌধুরীর হাত ধরে বলল,,

“পৃথিবীতে এমন কি আছে যা জীবনে সাময়িক কষ্ট আর বাঁধা হয়ে তো আসে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জীবনে সফলতার পথে সুগম করে দেয়।”

আয়মান চৌধুরী হাসলো আর বলল,,

“মানুষের অপমান।”

মেঘ হাসলো আর বলল,,

‘ঠিক বলেছেন আব্বা তাহলে এসব ভেবে কষ্ট পাওয়ার কোন কারন নেই। তাদের দেওয়া কষ্টের জন্যই আমরা আজ সফল কিন্তু তাদের অগোচরে।”

“আমি তো সবাইকে ভালোবাসি আম্মা!”

“সবাই আপনার ভালোবাসা ডিজার্ভ করে না আব্বা। আপনি সবাইকে ভালোবেসেই তাদের ভালোর জন্য চুপচাপ মেনে সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কি হলো আপনার ভালোবাসার মূল্য কে কে দিতে পারলো। মূল্যহীন মানুষের কাছে কখনোই ভালোবাসা দেখাবেন না। সবই স্বার্থের খেল স্বার্থের জন্য সবাই সবকিছু করতে পারে।”

” আম্মা এই স্বার্থপর দুনিয়ায় আপনি আমার নিঃস্বার্থ বিশ্বস্ত বন্ধু!”

মেঘ কিছু বললো না হেসে প্লেট নিয়ে কিচেনে রাখলো আর হাত ধুয়ে আসলো। তখন জায়মা বলল,,

“মেঘ আগেই ঘুমিয়ে পড়িস না আজ রাতে আমরা সব বোনেরা আড্ডা দেব।”

“সরি আপু আমার হবে না আমার কিছু কাজ আছে। ওগুলো করে ঘুমিয়ে পড়বো কাল সকালে আমার একটা জায়গায় যেতে হবে তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরতে হবে।”

“আমি ভাবলাম আজ সবাই আড্ডা দেব। আগের মতো সবাই কতোদিন পর একসাথে হলাম।”

“এখনো অনেক সময় আছে আপু তাছাড়া আমি তো এখন থেকে বাড়িতেই থাকছি।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

মেঘ চলে যেতে নিল তখন সমশের চৌধুরী বলল,,

“মেঘ একটু পর আমার রুমে এসো তো কিছু কথা ছিল আর আয়মান কেও বলে দিও।”

“ঠিক আছে।”

মেঘ আয়মান চৌধুরীর কাছে গিয়ে তাকে বলে ওপরে নিয়ে গেল ওষুধ খেতে হবে। তখন শাফিয়ান চৌধুরী বলল,,

“বাবা ওদেরকে কেন ডাকলে তোমার ঘরে?”

“তেমন ইম্পোর্টেন্ট কিছু না ওদের সাথে একটু কথা ছিল।”

“ওহ আচ্ছা।”

আর কেউ কিছু বললো না। খাওয়া শেষ করে সবাই যে যার রুমে চলে গেল। মেঘ আর আয়মান চৌধুরী কিছুক্ষন পর সমশের চৌধুরীর ঘরে গেল।
অতঃপর,,

~ চলবে,,,,,

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। চলে এলাম আপনাদের পছন্দের গল্পের সিজন ২ নিয়ে। যারা ধূসর রাঙা মেঘ গল্পটা পড়েন নি তারাও পরতে পারবেন সমস্যা নেই। গল্পের সূচনাটা কেমন হলো অবশ্যই জানাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং!

ধূসর রাঙা মেঘ সিজন-১ পড়তে লিখাটির উপর ক্লিক করুন

লাজুকপাতা পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

1

#লাজুকপাতালাজুকপাতা
#শেষ পর্ব
অসময়ে আমাকে বাড়ি যেতে দেখে মা চিন্তায় পড়ে গেল। কিছু হয় নি তো আবার! আমি হেসে নিশ্চিন্ত করলাম যে সব ঠিক আছে। আসলে অনেক কিছু ঠিক নেই। আমার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে ঝড়ের খবর আমি কাউকে বলতে পারছি না। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম সংসার করতে গিয়ে আমিও একটু, আধটু নাটক শিখে গেছি।

পরী আপা আমাকে ফোন করে কারণ জিজ্ঞেস করে। আমি তাকেও কিছু বলি না। নাবিদ নাকি তাকে ফোন করে বলেছে আমি রেগে বাড়িতে এসেছি। আমি চুপচাপ থাকি। আপা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলে। আমি তবুও মুখ খুলি না।

এখন ভরা বর্ষাকাল। চারদিকে জল থৈথৈ। পুকুরের পানি ঘাট পর্যন্ত উঠে এসেছে। কদম গাছে ফুল ফুটে চিকচিক করছে।
দিন দুয়েক পর পরী আপাও আসে। মায়ের সন্দেহ আরও বাড়ে। আপা সামলে নেয় সব টা। বলে, জরী এসেছে বলে এলাম। আমিও জরীর সঙ্গে চলে যাব আবার।

আপা সব টা জানে। আমি কিছুই বলি না। আপা আমাকে বলে,

“নাবিদ আমাকে সব বলেছে জরী। ও তোর ছবি সেই ছেলেটার কাছেই পেয়েছিল। তোকে দেখে ভীষণ ভালো লাগে তারপর ই বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। এইটুকু ঘটনায় তো আমি দোষের কিছু দেখছি না জরী। তুই ঠিক কী কারণে এটা নিয়ে আপসেট আমাকে বল তো?”

আমি আপার প্রশ্নের জবাব দেই না। নাবিদের কথা ভাবি, মুক্তা একবার বলেছিল যে নাবিদ বাড়িতে বলেছে ও আমাকেই বিয়ে করবে। আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব না।

আপা আমাকে ঘুরিয়ে তার দিকে ফেরায়। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে,

“উল্টাপাল্টা কিছু ভাবছিস না তো! ভুল কিছু ভাবিস না জরী। ”

আমি আপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি। আমি আমার সমস্যা টা কাউকে বুঝাতে চাই না।

নাবিদ আসে দুদিন পর। বেচারার চেহারা দেখেই বোঝা যায় খাওয়া, ঘুম সব বন্ধ হয়ে গেছে। মা বলেন,

“আমিও বুঝেছিলাম, ঝগড়া করে এসেছে না! ও তো এমনিতে শান্তই কিন্তু….

মায়ের ইঙ্গিত বুঝে নাবিদের মাথা নত হয়। ঘরে চাচিমা, চাচাজান সবাই আমার উপর রাগ হয়। মোটে একটা বছর পার হয়েছে বিয়ের, এরমধ্যেই রাগ করে একা একা বাপের বাড়ি আসা শিখে গেছে! একটু বেশীই বুঝি সবকিছুতে।

নাবিদ আমাকে বলল,

“আমি মিথ্যে বলেছি, তোমার অপরাধীও। এখন যদি শাস্তি দিতে চাও তো তাই দাও।”

“আমি তোমাকে যেমন ভেবেছি, তুমি আসলে তেমন না নাবিদ। হঠাৎ ধাক্কাটা মেনে নিতেও তো একটু সময় লাগবে। ”

নাবিদ বিস্মিত গলায় বলল,

“তুমি আমাকে এখন কেমন ভাবছ জরী?”

আমি নাবিদ কে বলি না যে ওর অভিনয় টুকু আমার প্রত্যাশার বাইরে ছিল। নাবিদ আরও অস্থির হয়। ও কী ভাবে কে জানে, বারবার আমার কাছে ক্ষমা চায়।

আমি দুদিন পর ওর সঙ্গে ফিরেও যাই। যাবার সময় আপা বলে,

“মানুষ কে অনেকসময় অন্ধের অভিনয় করতে হয়। অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করতে হয়। তুইও ওই ছবির অংশ টা জীবন থেকে মুছে ফেল। ধরে নে, ওটা তোর হাতেই আসে নি। ওটার আগ পর্যন্ত নাবিদ তোর কাছে যেমন ছিলো তেমন ই আছে। তবে ছেলেটা তোকে ভালোবাসে! ওর চোখে পানি দেখেছি আমি তোর জন্য। ”

আমি বাড়ি ফিরি, স্বাভাবিক হই। সংসারের কাজকর্মে মন দেই। তবুও কোথায় যেন মনে হয় জীবনের ছন্দ নেই। লিপি ভাবী একদিন বলে, আম্মা নাকি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন আমার ওভাবে চলে যাওয়ায়। তিনি আরও বলেছেন যে আমি তার ছেলেকে জাদুটোনা করেছি। শুধু আমি একা না, আমার পরিবারও এরসঙ্গে জড়িত আছে।

আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। একা একা ভাবি এ আর নতুন কী। দেড় বছর তো কেটেই গেল! এখনো কেন এসবে অভ্যস্ত হতে পারছি না।

মুক্তা দিন দিন আরও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। বেচারির রাতে ঘুম হয় না, বড় কষ্ট হয়। রোগা হয়ে যাচ্ছে। প্রেগন্যান্সির এই ধকল টা নিতে পারে না। লিপি ভাবী ফরমায়েশ মতো কাজ করে, তবুও একটু কিছু ভুল হলে খিটমিট করে। আম্মা মেয়েকে আরও প্রশ্রয় দেন। আমার মনে হয় এই সময় এই প্রশ্রয় টুকু ঠিক আছে। কিন্তু ভাবীকেও আলাদা করে বলে দেয়া উচিত যেন মন খারাপ না করে।

লিপি ভাবীর সঙ্গে জামিল ভাইয়ের সম্পর্ক সম্ভবত খুব একটা সহজ না। জামিল ভাই ভাবীকে বিয়ে করে এনেছেন ঠিক ই কিন্তু তার সঙ্গে এখনো সহজ হতে পারে নি। লিপি ভাবী একদিন মন খারাপ করে বললেন,

“আমার আর সংসার হবে না জরী। আল্লাহ আমারে কঠিন শিক্ষা দিছে। ক্যান যে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝলাম না। ক্যান যে ওইদিন সকলের কথায় সিনেমা দেখতে গেছিলাম! এমন সোনার সংসার ছিলো আমার! কিছু করার আগে কাউরে জিগান লাগতো না। আর মেহেদীর বাপেরে মুখফুটে একবার কিছু আনতে বললে ঘরে নিয়া আসতে দেরি করতো না। ”

জামিল ভাই প্রায় রাতেই কাঁদেন। ছাদের ঠিক যে জায়গায় টুম্পা ভাবী দাঁড়িয়ে নি:শব্দে কাঁদতো ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সেও কাঁদেন। নাজমা ভাবী এই কথা বলেছেন আমাকে। জামিল ভাইও সম্ভবত লিপি ভাবীর মতো ভাবে, কেন আগে তার একান্ত মানুষ টার মূল্য বোঝে নি।

আমি নাবিদের উপর রেগে থাকি না আর। যে শীতলতা দুজনের সম্পর্কে এসেছে সেটা নিজেই মিটাই। নাবিদ কে বলি, আর কোনোদিন আমায় মিথ্যা যেন না বলে। সংসারে ও আমার একমাত্র মানুষ যার সঙ্গে আমি কোনো ভান করি না। যেটুকু ভালোবাসা আসে সেটা হৃদয় থেকেই আসে। এই একই বাক্য টাপুর টুপুর এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য না। মা ছাড়া দুটো মেয়েকে আমি ওদের জন্য ভালোবাসি। কিন্তু নাবিদ কে আমি ভালোবাসি নিজের জন্য।

নাবিদ আমাকে ছুঁয়ে কথা দেয়। আমি বিশ্বাস করি ও নিশ্চয়ই ওর কথা রাখবে। যার হাত ধরে পলাশবাড়ী ছেড়ে কংক্রিটের শহরে এসেছিলাম তাকে তো আমি চিনতামও না। তবুও বিশ্বাস, ভরসায় এসেছি। আর এখন তো আমি ও’কে চিনি।

***
ভাদ্র মাসের এক দুপুরে শিল্পী আক্তার লাভলী আসে তার মেয়েকে নিয়ে। ওরা ভীষণ বিপদে পড়ে আসে। পাশা মিয়া শিল্পীর নামে চারটা এনজিও থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা লোন নিয়েছে। স্থানীয় পয়সাওয়ালা কয়েকজনের থেকেও সুদে বিরাট অঙ্কের টাকা নিয়ে ঘরের দামী সব জিনিসপত্র নিয়ে মনিকে সাথে করে পালিয়েছে। আমাদের কাছে এসেছে আমরা খোঁজ খবর জানি কিনা সেটার জন্য। অনেক হাতে পায়ে ধরেছে সবার। এই ঘটনা শুনে বাবা জামিল ভাই কে বললেন সে বেঁচে থাকতে মনি যেন এই বাড়িতে আর না আসে।

মনির জন্য এবার তার ভাইদের খুব চিন্তা হয়। অল্প বয়সের আবেগ কে প্রশ্রয় দিয়ে বিয়ে করেছে সেই অবধি ঠিক আছে। কিন্তু এখন কি করছে! এই বিপদ কে কিভাবে সামলাবে।

আর আমি ভাবি শিল্পীর কথা। জানিনা ও কী ভেবে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিয়েছিল! এভাবে একদিন সব হারিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার আশা তো নিশ্চয়ই করে নি। বাপের বাড়ি, ভাইয়ের বাড়ি কোথাও জায়গা পাচ্ছে না। নবীনগর এক দু:সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় উঠেছে তাও অনেক লাঞ্চিত হতে হচ্ছে।

আমি দুপুরে খেয়ে যেতে বললাম। মা মেয়ে দুজনের কেউই তেমন কিছু খেতে পারলো না। মেয়েটার জ্বর, ওষুধ কেনার টাকা আছে কিনা ভেবে কিছু টাকাও দিলাম।

জামিল ভাই সাবধান করে দিলেন এদিকে যেন না আসে। বারবার এলে কারো চোখে পড়তে পারে। তাতে মা মেয়ের সমস্যা আরও বাড়বে।

***
অবশেষে আমার নিজের সংসারের স্বপ্ন পূরন হলো। আমার মা বনেদী বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারে বউ হয়ে আসার পর কোনোদিনই খুশি ছিলেন না। ওই সংসারের কর্তা, কর্ত্রী চাচাজান আর চাচিমা। মা নিজের মতো কখনো কিছু পারতেন না। আমাকে নিয়েও তার আফসোসের শেষ ছিলো না। একটা সময় আমিও হাপিয়ে যাই। একটা বাড়িতে ভালো, মন্দ দুই ধরনের মানুষই থাকে। তবুও কেউ একজন আমাকে খারাপ জানছে, আমার খারাপ চাইছে এটা ভাবলে অস্বস্তি হয়।

নাবিদ কে আমার কিছু বলতে হয় না। ও নিজেই বলে, আলাদা বাসা হলে তুমি সবকিছু একা সামলে নিতে পারবে তো? ভয় পাবে না তো!

আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। গোপনে আলাদা সংসারের স্বপ্ন যে আমিও দেখি। সে স্বপ্নের কথা কাউকে বলি না, এটাও ভাবি যে সেই স্বপ্ন কখনো পূরন হবে না।

আমাদের বাড়ি ছাড়ার কথা শুনে সবার মন খারাপ হয়। নাবিদ কোনো কারণ বলে না। অফিসের কাছে বাসা নিলে ওর সুবিধা হয় এটুকুই বলে। আম্মার মুখটা ছোট হয়ে যায়। তিনি নাবিদ কে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করেন। নাবিদ খানিকটা অভিমান করে বলে,

“এমনিতেও তোমার সংসারে টাকা দেয়া ছাড়া আর কোনো কাজ তো আমার নাই আম্মা। আর টাকা তো আমি দেব। ওটা নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না। ”

আম্মা অনেক দিন পর আমার সঙ্গে নরম গলায় কথা বলতে আসেন। নিজেদের বাড়ি ছেড়ে আমরা কেন ভাড়া বাড়িতে থাকব। ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই।

***
সবকিছু কেমন দ্রুত হয়ে যায়। কলাবাগানে দুই বেডরুম, এক ডাইনিং, ড্রইং এর বাসা পছন্দ হয়। নাবিদ আমাকে নিয়ে যায় দেখার জন্য। ছিমছাম, সুন্দর বাসা। আমি স্বপ্নে ঘরটাকে নানারকম ভাবে সাজাই। আমার মা আর পরী আপা ভীষণ খুশি হয়। মা নিশ্চিন্ত হয় এবার। আমি আমার জমানো টাকা দিয়ে সংসারের জিনিসপত্র কিনি। প্লেট, গ্লাস, কাঁচের বাটি, চায়ের কাপ। একটা একটা জিনিস হাতে ধরে কেনা হয়। এই সময়ের অনুভূতি অন্যরকম আনন্দের। এই আনন্দের কোনো বর্ননা হয় না।

***
আজ আমার যাবার পালা। আম্মা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমি অবশ্য কিছু আশাও করি নি। আমরা দুজনেই কখনো কারোর প্রিয় হতে চাই নি, হবার কথাও না। বাক্স, প্যাটরার সঙ্গে দুটো রক্তে মাংসে গড়া মানুষও যাচ্ছে আমাদের সাথে। নাবিদ জামিল ভাই কে বলেছে, টাপুর টুপুর জরীর সঙ্গে থাকুক ভাইয়া। জরী ওদের যতটুকু যত্ন নিবে তা ওরা এই বাড়িতে জীবনেও পাবে না। অন্তত মেয়ে দুটো আরেকটু বড় হওয়া পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকুক।

জামিল ভাই মেনে নিয়েছেন। তিনি মেয়েদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। মেয়েরা নতুন বাসায় যাবার আনন্দে এতটা বিমোহিত যে বাবার দু:খ তাদের ছোট্ট হৃদয় স্পর্শ করলো না।

আম্মা খুব কাঁদলেন। তিনি কিছুতেই নাতনিদের কাছছাড়া করবেন না। তবুও আমাদের ফিরতে হয়, সব মায়া কাটিয়ে।

***
আমরা সবাই মিলে আমাদের নতুন বাসা সাজাই। টাপুর টুপুর নতুন পরিবেশ, নতুন বাসায় এসে খুব খুশি হয়। আলাদা আলাদা জিনিস কেনা হয় ওদের জন্য। নাবিদ এখন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে।

সপ্তাহের চার, পাঁচ টা দিন ই বাবা এসে এখানে থাকেন। আমি একা সব সামলাতে পারব না এই অজুহাতে আসেন। আমি খুশি হই। জামিল ভাই আর লিপি ভাবীও আসেন। তাদের আসা দেখে টাপুর টুপুর প্রথমে ভয় পেত। ওরা ভাবতো এই বুঝি নিয়ে যাবে।

বাবা প্রতি মাসে কিছু টাকা আমার হাতে দিয়ে যান জোর করে। তিনি বলে দিয়েছেন নিচতলার বাসা ভাড়া জামিল ভাই কে নিতে, আর তিন তলার বাসা ভাড়া নাবিদ কে নিতে। আমরা প্রথমে না করলেও বাবা জোর করে দিয়ে গেছেন।

অরু পরীক্ষা শেষ করে আমার কাছে থেকে যায় অনেকদিন। পরী আপা আসেন মাঝেমধ্যে। আপা একদিন জানালো যে সে আবারও পড়াশোনা শুরু করবে ওপেন ইউনিভার্সিটিতে। দুলাভাই রাজি হয়েছে।
শুনতে ভালোই লাগে, কেন যেন দু:খের গল্প আমি নিতে পারি না। ভীষণ মন খারাপ হয়। সবসময় ই চায় আমার আশেপাশে সবাই ভালো থাকুক, কারো দু:খের গল্প আমার কানে না আসুক।

***
নাবিদ কে আমি কখনো সেই ছেলেটার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। জানতেও চাই নি সেই ছেলেটা ওর কী হয়, কিভাবে চিনতো, কোথায় থাকে। কিছু ব্যাপারে কৌতূহল হলেও জানতে চাওয়া উচিত না। তবে আমার সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন কাজল পরতে যাই তখন মনে পড়ে ছেলেটা আমাকে বলেছিল, এই তোমাকে দেখতে অনেকটা দিব্যা ভারতীর মতো।

আমার ঘরটা উত্তরমুখী। ছোট একটু বারান্দাও আছে। সেই বারান্দায় বসে আমি বই পড়ি, চা খাই, ফোনে কথা বলি। আর মাঝেমধ্যে সেই ছেলেটার কথাও ভাবি। এই ভাবনা বোধহয় অন্যায়। তবুও ভাবতে ভালো লাগে। সেই ছেলেটা বোধহয় জানে তার লাজুকপাতা অন্য একজনের বউ। যার বউ সে আবার তার ই কাছের লোক। ছেলেটার নিজেরও একদিন ঘর, সংসার হবে। আটপৌরে শাড়ি পরে ঘামে ভিজে একজন তার জন্য রান্না করবে। সেই মেয়েটা জিজ্ঞেস করবে ছেলেটা এর আগে কাউকে পছন্দ করতো কিনা! ছেলেটা তখন আত্মবিশ্বাসী গলায় বলবে না। তার বউই একমাত্র ভালোবাসা তার জীবনে। কিন্তু মনে মনে বলবে,
একজন তো ছিলো, সে নিজেও আমার হতে চায় নি, আর আল্লাহও আমার ভাগ্যে লিখে নি। এজন্যই বোধহয় সে লাজুকপাতা।

কিছু কথা ভাবনায় ই সুন্দর। আমি ওই ছেলেটাকে ভাবনায় সুন্দর ভাবি। জানিনা বাস্তবে সে কেমন হতো। সুবর্না একদিন বলেছে মানুষ অতি শখের জিনিসের যত্ন নিতে পারে না। বরং কল্পনাতীত কিছু পেয়ে গেলে সেটাকে আগলে রাখে। তবুও যা পেয়েছি সেটাতে অনেক খুশি।

সমাপ্ত…….

লাজুকপাতা পর্ব-২৩

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-২৩
টুম্পা ভাবী যাবার আগে টাপুর টুপুর কে নিয়ে বাবা দেখা করতে যান। জামিল ভাইয়ের রাগারাগি, হুমকি কোনো কিছুই বাবা কর্নপাত করেন না। তিনি নাতনিদের নিয়ে চলে যান। আম্মা নিজের চোখ কে যেন বিশ্বাস করতে পারেন না। যে মানুষ টা সারাজীবন তার হ্যাঁ তে হ্যাঁ, না তে না বলেছে সে আজ কথা শুনলো না।

জামিল ভাই রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন দুদিন পর। ফেরার পর বাবার সঙ্গে তেমন কথাও বলেন না।

মুক্তার জীবন টা অনেক সহজ হলো এবার। দুই মাসের প্রেগন্যান্ট শুনে জুয়েল ভাই পারলে এলাকাশুদ্ধ সবাই কে মিষ্টি খাওয়াতেন। আমাকে বলল,

“ভাবী দোয়া করবেন। ছেলে হোক, মেয়ে হোক একটা সুস্থ সুন্দর বাচ্চা হোক। আমি দুইটা গরু জবাই করে খাওয়াব। ”

জুয়েল ভাইয়ের উচ্ছ্বাসে আম্মা ভীষণ খুশি। কিন্তু মুক্তার শাশুড়ীর কাছে আদিখ্যেতা লাগছে। আর জুয়েল ভাইকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত সে মুক্তাকে কিল, ঘুষি দিয়েছে।

আম্মা মুক্তাকে বাড়িতে আনলেন। ও বাড়িতে আদর যত্ন হবে না ঠিকঠাক। প্রথম বাচ্চা হবার সময় মেয়েদের নাকি আদর, যত্ন লাগে ভালোমতো।

মুক্তা বাড়িতে আসার পর লিপি ভাবীর কাজ আরও বেড়ে গেল। সে আনন্দেই কাজগুলো করছে। কাজ করতে তার কোনো ক্লান্তি নেই।

মুক্তা আবার সেই আগের মতো। স্বামীর অনেক টাকা, শ্বশুর বাড়িতে অনেক কিছু আছে সেই গল্প। ইচ্ছেমতো টাকা পয়সা খরচ করে এটা সেটা কিনে। একদিন আম্মাকে ডিনার সেট কিনে দিলো। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, টাকা থাকলেই হয় না শুধু। খরচ করতেও জানতে হয়।

আমার আর চুপ থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি হেসে বলি, যারা রোজগার করে না তারাই এই কথা বলতে পারে। রোজগারি মানুষজনের মুখ থেকে এমন কথা বেরোয় না।

মুক্তার জবাবও বেশ কঠিন। বলে,

“সবার রোজগার লাগে না। স্বামী হাতখোলা হলে রোজগার লাগে না। ”

আমার যেন কী হয়। সবসময় চুপ থাকতে পারলেও এবার আর পারি না। ক্ষেপে গিয়ে বলি,

“মুক্তা, দশ মাস পর তোমার অবস্থা যে আবার আগের মতো হবে না। তার কী কোনো ঠিক আছে। দিনের শুরু যে ঘুষি দিয়ে হবে না তার গ্যারান্টি কী! অবশ্য টাকা হাতে পেলে এটা তোমাদের জন্য কিছুই না। ”

মুক্তা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে। আর কারোর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষা আমি করি না। দরজা আটকে দেই। নিজের উপর রাগ হয়। এই বাড়িতে আসার পর মুক্তার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক হয়েছিল। কি সুন্দর গল্প হতো মাঝেমধ্যে! আর এখন!

এই নিয়ে আম্মা নাবিদের কাছে অনেক নালিশ করে। বাইরে পড়তে গিয়ে আমার খুব অহংকার হয়েছে। ছেলেমেয়ে পড়িয়ে কটা টাকা হাতে আসার পর কাউকে মানুষ বলে মনে করি না। নাবিদ আমাকে ঠান্ডা গলায় বলল,

“মুক্তা যতদিন আছে তুমি আর ওর সঙ্গে কথা বোলো না। আমি জানি ও এখন বেয়াদব হইছে। তুমি চুপচাপ থেকো।”

এই ঘটনার পর আমি নীরব হয়ে যাই। অন্যরাও আমার সঙ্গে কথা বলার সময় সতর্ক হয়।

***
বর্ষাকালের এক দিনের ঘটনা। নাবিদ ওর কিছু জরুরী কাগজপত্র খুঁজে পাচ্ছিলো না। নিজে খুঁজছিলো, সঙ্গে আমাকেও বলছিল খুঁজে দিতে।

আলমারি, বইপত্র সব জায়গায় খোঁজা হচ্ছিলো। হঠাৎ একটা বইয়ের ভাজে একটা খাম পেলাম। পুরোনো খাম। খামে আমার ছবি। ছবিটা দেখে আমি থমকে গেলাম। নাবিদ তখনও নিজের জিনিসপত্র খুঁজতে ব্যস্ত। আমি ছবিটা হাতে নিয়ে ওর সামনে গেলাম। ও খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। একটু হাসার চেষ্টা করলো। অপরাধী দের অপরাধ ধরা পড়লে মুখের অভিব্যক্তি যেমন হয় তেমন হলো। বলল,

“এটা কোথায় পেলে? ”

আমিও পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তুমি এটা কোথায় পেলে? ”

নাবিদ জবাব দিতে একটুও সময় নেয় না। বলে,

“তোমাদের বাড়ি থেকে দিয়েছিল বোধহয়। হ্যাঁ, মামাই দিয়েছিল তো। নাহলে তোমার আগের ছবি আমি কোথায় পাব। ”

আমি নাবিদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাবিদও কিছু সময় আমাকে দেখলো, তারপর চোখ নামিয়ে নিলো।

আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। উত্তর জানতেও ইচ্ছে করে না। সবকিছু কেমন ফাঁকা লাগে। ভোতা অনুভূতির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়।

আমি চুপচাপ থাকি, নাবিদও কেমন চুপচাপ হয়ে যায়। দুই, এক কথার পিঠে আমার তরফ থেকে যখন স্বতঃস্ফূর্ততা পায় না তখন ই চুপচাপ হয়ে যায়।

পরের দিন টা শুরু হয় অন্যান্য দিনের মতোই। নাবিদ সবকিছু হাতের কাছে পেয়েও যখন আমাকে ডাকে তখন আমার নির্লিপ্ততা বোধহয় ওর চোখে পড়ে। খেতে বসে ঠিকঠাক গলা দিয়ে খাবার নামে না। লিপি ভাবী আমাকে বলে,

“ভাইয়ের কি হইছে জরী। একটা রুটিও আজ ঠিকঠাক শেষ করতে পারলো না?”

আমি জবাব দেই না৷ পরের বেলা আমাকে আবার প্রশ্ন করে,

“তোমার কি হইছে জরী। ”

এবারও আমি চুপচাপ থাকি৷ আমার আসলে কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।

নাবিদ রোজকার মতো আমাকে যাবার সময় বলে,

“আমি গেলাম জরী। ”

আমি অন্যান্য দিনের মতো আচ্ছা বলার পরিবর্তে বলি,

“আমি বাড়ি যাব। ট্রেনের টিকিট নিজেই করে নিতে পারব। এবার কটা দিন বেশী করে থেকে আসি। লিপি ভাবী তো আছেই। কারোর কোনো সমস্যা হবে না।”

নাবিদ বোধহয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বোধহয় বললাম এই কারণে, আমি তো ওর দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলেছিলাম।

***
আমি যেদিন পলাশবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি। আমাকে যেতে দেখে জামিল ভাই বললেন,

“বাড়িতে এমন কী আর্জেন্ট জরী! এমন বৃষ্টিতে কেউ যায়! বাদ দাও, কাল যাবে। আমি স্টেশনে পৌছে দেব। ”

নাবিদও সেখানে থাকে। কোনো কথা বলে না। বাবা, লিপি ভাবী, সবার বারন স্বত্তেও আমি আসি। বারবার বারন করার পরও নাবিদ আমাকে এগিয়ে দিতে আসে।

সিএনজি তে ওঠার পর আমার খেয়াল রাখে। প্লাস্টিকের কাগজ টা এগিয়ে দেয় যেন না ভিজে যায়। ট্রেনে একগাদা খাবার কিনে দেয়। অনেক প্রশ্ন করেও আমার থেকে হু, হা জবাব ছাড়া আর কিছু পায় না।

ট্রেন ছাড়ার আগে শুধু একবার বলে,

“ফোন টা ধইরো জরী। ”

আমি তখনও অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। ট্রেন ছেড়ে দেবার পর একাই কিছুক্ষন কাঁদি। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমি ভান জানিনা। নাটক করতে পারি না। চুপচাপ থাকা আর ভান করার মধ্যে অনেক তফাত।

আমার হাতে সেই ছবিটা। যেটা নাবিদের বইয়ের ভাজে পেয়েছিলাম। পেছনে লেখা লাজুকপাতা।

এই ছবির গল্প আমি জানি। নাবিদ জানেনা। এই ছবিটা তুলেছিল একজন লুকিয়ে। আমার মামার মেয়ের বিয়ের সময় তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। গায়ে পড়ে সে আলাপ করতে এলেও আমি ভয়ে সরে এসেছিলাম।

তারপর মাস দুয়েক পর একদিন আমার নামে চিঠি আসে। পোস্ট অফিস থেকে বাবাকে চিঠিটা দেয়া হয়। বাবা সেই চিঠি পেয়ে অবাক হয়। তার মেয়েকে কে চিঠি পাঠালো! তাও আবার অন্য শহর থেকে।

বাবা সেই চিঠি মাকে কিংবা আমাকে না দেখিয়ে পরী আপাকে দেখায়। পরী আপা বলে তার এক পরিচিত আমার নামে চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠি তার৷ বাবা সরলমনে মেনে নেয়।

পরী আপা আমাকে নিয়েই চিঠি খোলে। চিঠির সঙ্গে কয়েকটা আমার ছবি। সেই সঙ্গে লেখা,

“তুমি নাম না বললেও আমি কিন্তু নাম জেনে নিয়েছি। তবে সেই নামে তোমায় মানায় না। আমি তোমার নাম দিলাম লাজুকপাতা। ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরোতে আমার বছর দুয়েক লাগবে। আমাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। ”

এই চিঠি, ছবি পরী আপা ছিড়ে ফেলে বলল, এসব মাথায় নিস না তো। কোথাকার কোন আলতু ফালতু ছেলে।

তবুও কেন জানি লাজুকপাতা নাম টা আমি মাথা থেকে বের করতে পারলাম না।

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-২২

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-২২
লিপি ভাবীর সঙ্গে আমার একটা সহজ সম্পর্ক হয়ে গেল। ওনার কথাবার্তা এখন আর আমার তেমন খারাপ লাগে না। হাতে হাতে কাজগুলো এগিয়ে দেয় যেটা আমার ভালো লাগে। যেদিন আমার ক্লাশ থাকে, সেদিন আমার জন্য আলাদা বাটিতে খাবার বেড়ে রাখে। ওনার একটা বিষয় আমার ভালো লেগেছে। আম্মা আমার যত রকমের বদনাম তার সঙ্গে করেছে, সে সেগুলো আমাকে বলে নি। কিন্তু সেই কথাগুলো আমি জেনেছি কাজ করতে আসেন যে খালা তার থেকে। ওনার আরও একটা বিষয় আমার ভালো লেগেছে, সেটা হলো ওনার হাসি। শব্দ করে হাসেন কিন্তু দেখতে ভালো লাগে।

আম্মা আমার থেকে ওনাকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাতে অবশ্য আমার তেমন অসুবিধা নেই। আমি আমার মতো থাকি। পরীক্ষা শেষ করে কলেজে ছুটি পেলাম বেশ কিছুদিন। টিউশন ব্যাচে ছেলেমেয়ের সংখ্যা আরও বাড়ছে। তিন টা ব্যাচ হয়েছে এখন। ভালোই লাগে এই ব্যস্ততাটুকু আমার। নাবিদ মাঝেমধ্যে বলে, এতো কাজ না করতে। একটু রেস্ট নিতে। কিন্তু আমার রেস্ট নিতে ইচ্ছে করে না। নতুন নতুন অনেক কিছু শিখতে ইচ্ছে করে, জানতে ইচ্ছে করে।

ফেসবুক নামক এক আশ্চর্য জিনিসের সঙ্গে শেষমেস আমিও জড়ালাম। স্কুল, কলেজের পুরোনো কিছু বন্ধুদের খুঁজে পেয়েছি সেখান থেকে। কিছু আজেবাজে ছেলেও আছে যারা সারাক্ষণ মেসেজ দিয়ে বেড়ায়। সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য সব কিছুই ভালো লাগে।

বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। যাকে নিয়ে আমার কৌতুহলের শেষ নেই, তার চিঠি এলো। চিঠিটা দিয়েছেন বাবা। সন্ধ্যেবেলা চা দিতে যাবার সময় আমার হাতে দিয়ে বললেন, বড় বউমা তোমাকে দিছে। কাউরে জানাইয়ো না।

চিঠিটা হাতে নিতেই আমার মন টা দ্রবীভূত হয়ে গেল। দ্রুত ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। আমার কেমন অস্থির লাগে! আমি চিঠির উপর টা দেখি। কমলা রঙের খামে কিছু লেখা নেই। এমন রঙের খাম সচরাচর দেখা যায় না।

আমি খাম খুললাম। সাদা কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠি।

আমার টাপুর টুপুর এর কাকিমনি,

তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম আমার মেয়েদের সঙ্গে। দুই হাতে দুজন কে নিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছ। আমি মুগ্ধ চোখে মেয়েদের দেখার বদলে তোমাকে দেখলাম। কত বয়স হবে মেয়েটার! উনিশ, বিশ। সেদিন বেশী কাছ থেকে দেখি নি। তারপর আরেকদিন দেখলাম কাছ থেকে। আমি শুধু চোখ দুটোই দেখলাম। আমাকে নিয়ে তোমার ভাবনা হয়তো খুব একটা ভালো না, হয়তো আমাকে ভীষণ স্বার্থপরও ভাবছ। আসলে তোমার ভাবনাই ঠিক। আমি ভালো নই, স্বার্থপরও। কিন্তু আমি ভালো হবার নাটক করেছি, চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি।

টাপুর টুপুর এর বাবার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে। রোগা কালোমতন একটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বেহায়া ছেলেটা একদিন কবিতা লিখেও পাঠালো। আমি মুগ্ধ হলাম না। বছর খানিক এভাবে যাবার পর আমার মনে হলো এই ছেলেটা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমার ওকেই দরকার। জীবনে আমার শুধু ওর ভালোবাসাই দরকার। আমি বাবার বাড়ির আরাম আয়েশ ছেড়ে এক কাপড়ে শ্বশুরবাড়ি এলাম। আমার বিয়ে হয়েছিল ছয়শ টাকায় কেনা নাকফুল আর সাড়ে চারশ তে কেনা শাড়িতে। অথচ বাবার কাছে আমি ছিলাম একমাত্র রাজকন্যা।

বিয়ের পরের জীবন টা অদ্ভুত রকমের। আমি আজও জানিনা যে সেই অদ্ভুত রকমের জীবন টা খারাপ নাকি ভালো। টাপুরের বাবার কাজের দিকে কোনো মন নেই। টিউশনি করাতে পারবে না, বাবার দোকানও তার ভালো লাগে না। সকালে খেয়ে ঘুমায় ওঠে সন্ধ্যেবেলা। রাত দুটো অবধি সে বাইরে আড্ডা দেয়। আমি কেমন আছি, মেয়ে দুটো কেমন আছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। এভাবে কী কারো জীবন কাটে! টাপুরের দাদি তার ছেলেকে কিছু বলেন না। তার যত বিরক্তি আমার উপর। আমি খুব বেশি অশান্তি করি। আমি মেয়েদের রেখে বাইরে কাজ করতে গিয়েও অনেক লাঞ্চনার শিকার হয়েছি। সেসব গল্প নাহয় না বলি। বিভীষিকাময় গল্পটা বলে নেই।

আমি দ্বিতীয়বার অন্ত:স্বত্তা হবার পর আমার গর্ভপাত করানো হয়। কাজ টা করে মেয়েদের বাবা আর দাদি মিলে। আমি বিষয় টা মানতে পারিনি। ওই বাড়ি আমি ছেড়ে দেই। যারা আমার গর্ভে থাকা বাচ্চাকে মেরেছে তারা যে কোনোদিন আমায় মেরে ফেলবে না তার গ্যারান্টি কী!

পরবর্তী যেসব স্টেপ আমি নিয়েছি সবসময় নিজের কথা ভেবেছি। আমি মেয়েদের নিয়ে আসিনি। দুনিয়ার মানুষ ভাবছে মেয়েদের আমি ভালোবাসি না। ভাবুক, তাতে সমস্যা নেই। আমিও তো কতকিছু ভেবে ঘর ছেড়েছিলাম, বিয়ে করেছিলাম। এখন আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি। আরেকবার সংসার শুরু করার সুযোগ এই মুহুর্তে চাচ্ছি না। এই মুহুর্তে শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবতে চাই, আরও স্বার্থপর হতে চাই।

টাপুর টুপুর কে দেখো এই কথাটা তোমাকে বলার দরকার নেই। নাবিদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তোমার কথা বলল, তুমি নাকি আমায় দেখতে চেয়েছিলে! সামনাসামনি দেখা হবে একদিন। আমার মেয়েদের কত প্রিয় তুমি! ভালো থেকো।

টাপুর, টুপুর এর মা

চিঠির সঙ্গে একটা ছবি। সেই ছবিতে হাস্যজ্জ্বল এক মেয়ে। সাদা জামা, ওড়নায় বসে আছে দিঘির পাড়ে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসছে। আমার মনে হলো আমাকে দেখেই হাসছে। মনে মনে বললাম, আমাদের একদিন দেখা হবে।

চলবে….

লাজুকপাতা পর্ব-২১

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-২১
জামিল ভাইয়ের মনে যে ঠিক কী চলে তা আমি বুঝে উঠতে পারি না। যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছে তারও এটা দ্বিতীয় বিয়ে। দেখতে চুপচাপ লাগলো। অবশ্য এক দেখায় মানুষ কে আর কতটুকুই চেনা যায়। উনি বাড়িতে এসে চুপচাপ রইলেন, খুব বেশী নাটকে গেলেন না। ওনার নাম লিপি। লিপি ভাবীকে নিয়ে আম্মার খুশি যেন ধরে না, হাবভাব এমন যে তিনি আগে থেকেই জানতেন যে জামিল ভাই তার জন্য বউ আনতে যাচ্ছেন।

মুক্তা আর জুয়েল ভাইও এলো। জুয়েল ভাই মিষ্টি নিয়ে এলো অনেক। জামিল ভাইকে দেখে কিছু বোঝা গেল না। তবে টাপুর টুপুর এসব থেকে দূরে রইলো। ওরা গিয়ে নাজমা ভাবীর ওখানে বসে রইলো এই বাচ্চা মেয়ে দুটো অনেক কিছু বোঝে। ওদের মা জীবনে না থেকে বয়সের আগেই খানিকটা বড় বানিয়ে দিয়েছে।

আমি বুঝলাম বাড়িতে আরও একজন লোক এসেছে যে আমাকে ঠিকঠাক পছন্দ করতে পারবে না। মা, চাচীমার সম্পর্ক ছিলো লোক দেখানো। সবাই জানতো যে এরা একে অন্যকে পছন্দ করে না। কিন্তু সামনাসামনি দেখে বোঝার উপায় নেই।

পরী আপা জামিল ভাইয়ের বউয়ের কথা শুনে আমাকে একটু সতর্ক হতে বলে। আম্মার অতিরিক্ত খাতির, যত্নের কথা শুনে বলে এটা নাকি আমাকে দেখানোর জন্য। আমারও তাই মনে হলো। আমাকে শায়েস্তা করার জন্য কিছুদিন এই নাটক চলবে।

নাবিদ এই ব্যাপার টা নিয়ে খুব রাগ দেখাল জামিল ভাইয়ের উপর। লিপি ভাবীর বংশ তেমন উঁচু না। পড়াশোনাও নাইন পর্যন্ত। নাবিদ তো বলেই ফেলল,

“কোথায় টাপুর টুপুর এর মা আর কোথায় উনি। ভাইয়া এইটা কী করলো!”

জামিল ভাই কী ভেবে করেছেন আমি জানিনা, তবে ওনার মেয়েদের দিকটাও একবার দেখা উচিত ছিলো।

চার, পাঁচ দিন যাবার পর আমি বুঝলাম যে লিপি ভাবী সম্পূর্ণ আমার উল্টা। তিনি অনেক কথা বলেন। কাজের হাতও বেশ চালু। দুই হাতের কাজ দেখে আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। আম্মা তো ভীষণ খুশি, এমন ঘরোয়া কাজের মেয়েই তো সে চেয়েছিলেন এতকাল। কাক ডাকা ভোরে উঠে এক চুলায় চা আরেক চুলায় ভাত বসিয়ে হাড়ি পাতিল সব ধুয়ে ফেলে। অন্যরা ঘুম থেকে উঠতে উঠতে তার অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যায়। আমি অবশ্য একদিন বললাম যে আপনার এতো কাজ করার দরকার নেই। খালা তো আসেই, সে করবে এসব।

টাপুর টুপুর এর সঙ্গে তেমন ভাব জমাতে পারলো না। ওদের কাছে গেলে দৌড়ে পালায়। এমনকি জামিল ভাইয়ের সঙ্গেও মেয়েরা কথা বলা বন্ধ করে দিছে।

একদিন লিপি ভাবী টাপুর কে বলল, যাও তোমার আব্বাকে ডাইকা আনো।

টাপুর দাঁত, মুখ খিচিয়ে বলল,

“আমার নাম বলবেন না। টুপুর রে বলেন। ”

টুপুর পাশেই ছিলো। ও দৌড়ে গিয়ে টাপুরের চুল ধরে ঝুলে পড়লো। বলল, আর বলবি আমার নাম বলতে।

এই ঘটনায় উনি মুখ চেপে হাসলেন। আমি খানিকটা বিরক্ত হলাম। বললাম,

“আপাতত দূরে থাকেন ওদের থেকে। পরে আমি বুঝিয়ে বলব ওদের।”

উনি হেসে বললেন,

“ওরা জীবনেও বুঝবে না। আমার ছেলেও এমন। বাপের কাছে যাইতে চায় না। এক দুদিনের জন্য যায়। সৎ মায়ে তেমন কিছু বলে না। তবুও দেখতে পারে না। ছোট পোলাপানের মধ্যে ঢুকে গেছে যে সৎ মা খারাপ হয়। ”

লিপি ভাবীর থেকে শুনলাম বিয়ে ভাঙার কাহিনী। খুব তুচ্ছ কারণে তাদের বিয়ে ভেঙেছে। ওনার প্রাক্তন স্বামী ঢাকায় ব্যবসা করেন। সপ্তাহে দুদিন বাড়িতে যেতেন। একদিন না জানিয়ে গিয়ে দেখলেন ওনারা বাসায় নেই। উনি ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির আরও দুজনের সঙ্গে হলে সিনেমা দেখতে গেছে। বাড়ি ফেরার পর খুব মার খেলেন। শরীর ভর্তি ব্যথা নিয়ে বাপের বাড়ি গেলেন ছেলেকে নিয়ে। দুদিন পর ভরা মজলিশে তাকে তালাক দিলো। উনি ভেবেছিল কিছুদিন গেলে ওনার প্রাক্তন স্বামীর রাগ পরে যাবে। তাকে নিতেও আসবে। কিন্তু ভদ্রলোক দুই সপ্তাহের মধ্যেই ঘরে নতুন বউ তুললেন।

ওনার ধারণা প্রাক্তন স্বামীকে কেউ তাবিজ করেছে। উনি নাকি ভালো মানুষ ছিলেন।

পরী আপা, নাবিদ এরা বলেছিল ওনার সঙ্গে কম মিশতে। আমিও তাই প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলতাম না। কিন্তু উনি ভীষণ মিশুকে স্বভাবের। রান্নাঘরে কাজ করার সময় কথাবার্তা বলেন। আমার খাওয়ার খোঁজ নেন। চাইলেও তাকে এড়াতে পারি না। তবে আমার সঙ্গে তার এতো খাতির আম্মা মানতে পারেন না। তবে তিনি কিছু করতেও পারছেন না। কারণ এই মুহুর্তে তার মাথায় অন্য টেনশন। জুয়েল ভাই কে উনি খাটি হিরা ভেবেছিলেন। এখন দেখছেন হিরের বদলে কয়লা। জুয়েল ভাই মুক্তাকে দিয়ে কাজ করায়। কাজে ভুল হলে সেই কাজ আবার করান। মুক্তা কোনো কাজ করতে অস্বীকার করলে তিনি আরও কাজ বাড়িয়ে দেন।

এই ঘটনা শুনে মামা আর নাবিদ বলেছে আম্মাকে মুক্তার সংসারে নাক না গলাতে। ওদের সংসার ওরা বুঝুক। কিন্তু মুক্তার কান্নাকাটিতে সে অস্থির হয়ে গেছে৷ সারাদিন আফসোস করেন। বলেন,

“এই শীতে সকালে উঠে দুনিয়ার কাজ করে। এতো কাজ কী আমি আমার মেয়েরে করাইছি?”

নাবিদ এই কথার জবাবে বলে, টুম্পা ভাবীও কোনোদিন রান্নাঘরে কাজ করেনাই। তারে দিয়েও তুমি অনেক কাজ করাইছ। এখন এইগুলা বলা বন্ধ করো। তুমি বেশী বুঝলে মুক্তার সমস্যা।

আম্মা ছেলেদের কথা শোনেন না। তিনি তার বোনের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন যে মুক্তার বাসায় গিয়ে ক’টা দিন থাকবে।

আম্মা তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তার বাসায় চলে যান। ছেলেদের কথা শোনে না। তিন, চার দিন থাকেন। এরমধ্যে মুক্তা একদিন জুয়েল ভাইয়ের হাতে ঘুষি খায়। আম্মার সামনেই ঘুষি মারে, তার হাবভাবে মনে হয় মেরে ধরে, হাত পা ভেঙে হলেও মুক্তাকে সংসারের কাজ শিখিয়ে ছাড়বে।

চলবে…

লাজুকপাতা পর্ব-২০

0

#লাজুকপাতা
#পর্ব-২০
বাচ্চাগুলোর পরীক্ষা শেষ, নতুন বছর শুরু হতে চলল। মা ফোন করে বাড়ি যেতে বলছেন বারবার। শীত মানে পলাশবাড়ীতে হৈচৈ আনন্দ। পিঠে বানানোর প্রতিযোগিতা লেগে যায়। এদিকে পরী আপাও আমাকে লোভ দেখায়। জরী তুই গেলে আমিও যাব। আমি নাবিদ কে বলতে সাহস পাই না। টানা উনত্রিশ টা দিন আমাকে ছেড়ে দূরে থেকে বেচারা এমনিতেই কেমন পাগল পাগল হয়ে গেছে। ফেরার পর বারবার বলল,

“আমি যদি জানতাম এত্তগুলা দিন থাকতে হবে, তাইলে তোমাকে বগলদাবা করে নিয়ে যাইতাম। ”

আমি মৃদু হাসি। নাবিদ আমার হাসি দেখে বলে,

“তুমি আমাকে ছাড়া ভালোই ছিলে না? আপার ওখানে ঘুরে আসছ! রাত জেগে সিনেমা দেখছ তাই না! ”

আমি কিছু বলি না। আমার অনুভূতি, ভাবনা কিছুই নাবিদ কে জানাই না। জানাতে ইচ্ছে করে না। আমি জানি ও অনেক কিছু বোঝে। তবুও ক্ষেপানোর জন্য এসব বলে।

নাবিদ আমাকে সহজেই পারমিশন দেয়। তবে শর্ত দেয়, পাঁচ দিনের বেশী একদিনও নয়। আজ, কাল, পরশু এসব ধানাইপানাই যেন না হয়। তবে এবার আম্মাও অসন্তুষ্ট হয়। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে খালার সঙ্গে বলে,

“আমাগো সময় শাশুড়ীর অসুখ দেখে একলা ফালাইয়া বাপের বাড়ি যাবার কথা জীবনেও ভাবি নাই৷ আর এখনকার বউরা…. অবশ্য বউদের কী দোষ! আমার পেটের পোলাই তো আমারে শত্রু ভাবে। এমন ভাব করে যেন আমি শত্রু। ”

আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। তিনি জানেন যে আমি কোনো জবাব দেব না। তাই টাপুর টুপুর কে নিয়ে ঝামেলা করার চেষ্টা করলো। বলল,

“এই শীতে তুমি যাও, আমার নাতনিদের নিও না। বন জঙ্গলে আমার নাতনিদের আমি পাঠাব না। ”

আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম। বললাম,

“আমাদের বাড়ি বন জঙ্গলে? আপনি না গিয়েই কিভাবে জানলেন?”

আম্মাও বিদ্রুপ করে বললেন, যারা গেছে তারাও তো কেউ বলল না তোমরা রাজপ্রাসাদে থাকো।

আমি হেসে বললাম,

“আচ্ছা মা টাপুর টুপুর আপনার কাছেই থাকুক। ওরা তো আর নিজের মেয়ে না যে জোর দেখাব। আমি বরং শান্তিতেই বেরিয়ে আসি। ”

পরী আপাদের সঙ্গে ট্রেনে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। আপা আমার জন্য ঢাকায় আসেন। তাকে ছাড়তে দুলাভাইও আসেন। শীতের রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে স্টেশনে পৌছাই নাবিদ কে নিয়ে। ও আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, কী কী করা যাবেনা। আমি হু হা তে জবাব দেই। নাবিদ ট্রেনে উঠিয়ে দেয়ার সময় রাজ্যের খাবার দিয়ে দেয়। ট্রেন ছেড়ে দেয়, আমি নাবিদ কে জানালা দিয়ে বিদায় জানাই। এক মিশ্র অনুভূতি, একদিকে আনন্দ অন্যদিকে ছেড়ে যাবার কষ্ট।

শীতের রাত, ট্রেন জার্নি, বাড়ি যাবার আনন্দ সবমিলিয়ে দারুণ এক অনুভূতি।

***
বাড়িতে ক’টা দিন আনন্দেই কাটে। নিরু আপা আসে। ফুপুরাও আসেন তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে। পাশের বাড়িতে ঢেকিতে চাল কোটা হয় পিঠের জন্য। ভাপা, পুলি, চিতই বানানোর ধুম লেগে যায়। শীতের রাতে বাড়ির সবাই মিলে দেশী হাসের সঙ্গে চিতই পিঠা নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করে, উঠোন ভর্তি বাচ্চাদের ছুটে বেড়ানো দেখে আমার টাপুর টুপুর এর জন্য মন খারাপ হয়। মেয়ে দুটো থাকলে একটু আনন্দ করতে পারতো।

নিরু আপার সঙ্গে এবারের গল্পগুলো অন্যরকম। আপা এবারে আন্তরিকতা একটু কম দেখায়। বরং আমার কষ্টের গল্প শুনে বেশী খুশি হয়। আমাকে জিজ্ঞেস করে,

“তোর শাশুড়ী নাকি অনেক জালায়?”

“কে বলল আপা? তেমন কিছু না তো।”

“আরে এসব জিনিস তুই চাপায়ে রাখবি কেমনে? ছোট চাচি আর আব্বা গেল না কয়মাস আগে? তোর গা থিকা নাকি গয়না খুলে নিছে তোর শাশুড়ী। ”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এখানকার এই এক সমস্যা, ঘটনা ঘটে এক লোকে বানায় আরেক। আমি হেসে বলি,

“না খুলে নেয় নাই। আমি এমনিই দিয়া দিছি। ”

নিরু আপার মুখটা অন্যরকম লাগে। খুশি চেপে রাখলে মানুষের মুখ যেমন লাগে তেমন। আপা আমাকে বলে,

“তার মানে তোর সংসারও আমাগো মতনই! পুরোপুরি শান্তি নাই?”

আমি পরী আপার সতর্কতার মানে বুঝতে পারি। কিছু সময় মন খারাপ থাকে তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়। এইসব কথাবার্তার পর নিরু আপার সঙ্গে আর গল্প জমে না।

বাড়িতে সপ্তাহ খানেক কাটিয়ে ঢাকায় আপার সঙ্গেই ফিরি। আম্মা আমার সঙ্গে প্রথমে অতো বেশী কথা না বললেও আমার ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র দেখে তার মেজাজ ভালো হয়ে যায়। এদিকে টাপুর টুপুর আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ওদের সঙ্গে ভাব জমাতে অবশ্য বেশী সময় লাগে না।

দুদিন যেতে না যেতেই আম্মা মুক্তার গল্প বলেন। জুয়েল ভাই লোকটা নাকি বিরাট শয়তান। মুক্তাকে দিয়ে ঘরের কাজকর্ম করায়। আমি একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করব যে এতে শয়তানির কী আছে আম্মা! ঘরের কাজ তো কম বেশী সবাই কেই করতে হয়। কিন্তু ঘটনা অন্যকিছু। জুয়েল ভাইয়ের জন্য রাতে উঠেও মুক্তাকে রাঁধতে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে রুটি বানাতে হয়। সেই রুটি গোল হয় না কেন এই নিয়ে আরেক কাহিনী।

জুয়েল ভাই আমাকে ফোন করে তার বউয়ের কাহিনী বলে। বলে,

“চিন্তা করবেন না ভাবী, দুইমাসে এমন ট্রেনিং দেব যে একদম সিধা হয়ে যাবে। ঘরে বসে শুধু খাইতো আর ঘুমাইতো না!”

একদিন সকালে দেখি আম্মার ভীষণ মন খারাপ। শুনলাম মুক্তাকে নাকি জুয়েল ভাই পিঠে ধড়াম ধড়াম কয়েকটা কিল দিয়েছে। বেচারি বলেছিল সকালে রান্না করতে পারবে না, ঘুমাবে। এই ঘটনা আবার জুয়েল ভাই নিজেই ফোন করে জানিয়েছে। সেই সঙ্গে আম্মাকে এও বলেছে,

“ওর টোট্যালি আপনার বাসায় যাওয়া বন্ধ। আপনে তুলুতুলু করেন দেখে এই অবস্থা! নবাবজাদী দশ টা পর্যন্ত ঘুমায়। নামাজ কালামের খবর নাই। ”

আম্মার মুখের দিকে তাকানো যায় না। জামিল ভাই অবশ্য এই ঘটনায় খুশি। সে বলে, জামাই একখান হইছে মাশাল্লাহ। একদিন বাজার কইরা ভালো, মন্দ খাওয়ান দরকার।

জানুয়ারীর শেষে বাড়িতে নতুন বিপদ এলো। বিপদ বলব, নাকি আপদ বলব বুঝে উঠতে পারি না। জামিল ভাই বিয়ে করে আনলেন। আগে পিছে কাউকে কিছু জানালেন না, সরাসরি বিয়ে করে আনলেন। ভৈরবে গিয়েছিল কাজের জন্য। সেখানে দিন পাঁচেক ছিলো। ফেরার সময় বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে। বিয়ে হয়ে যাবার পর নাবিদ কে ফোন করে জানালো।

সংসারে শান্তি যেটুকু বা ছিলো সেটুকুও শেষ হতে চলল।

চলবে…