Wednesday, July 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 405



মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-১০

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১০

🍁
ধরনীর বুকে আঁধার ঢেলে সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। মাগরিবের সালাত আদায় শেষে শওকত রহমানের সাথে হালকা নাস্তা করে আজ অনেক দিন পর পড়ার টেবিলে বসেছে মীরা। বাড়ি এসেছে থেকে পড়ালেখা গোল্লায় উঠেছে। আর তিন মাস পর সেমিস্টার ফাইনাল। এমনিতে এই তিন মাসকে অনেক সময় মনে হলেও দেখতে দেখতে যে কিভাবে চলে যাবে বুঝতেও পারবে না। চেয়ারে বসে ডিপার্টমেন্ট এর নোটবইটা খুলল। ভ্যাপসা গরম আজ। মাথার উপর ভনভন করে ঘোরা বৈদ্যুতিক ফ্যান টাকে মীরা মনে মনে হাজারো ক’টুক্তি আর ঠেলা গাড়ির সাথে তুলনা করতেও ছাড়ল না। বৃষ্টি হওয়াটা খুব দরকার বলে মনে হচ্ছে মীরার। মাথায় জড়ানো ওড়নাটা খুলে গলায় ঝুলিয়ে রাখল। পাশের জানালা হতে শিরশির করে বাতাস এসে একটু স্বস্তি দিচ্ছে তাকে। চেয়ারের উপর পা তুলে আরাম করে বসে কলম টা আঙ্গুলের ফাঁকে গুজল। নিঃশব্দে মনোযোগের সহিত লাইনের পর লাইন পড়ছে আর টুকটাক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলো ঝটপট লিখেও ফেলছে৷ খাদিজা বেগম এর মাঝে এক কাপ কফি দিয়ে গেছেন পাঁচ মিনিট হলো। কিন্তু গরমে মীরা কফির মগে হাত ও দিচ্ছে না। ঠান্ডা হলে শরবতের মতো একেবারে গিলে ফেলবে নাকি কে জানে! পড়তে পড়তে হঠাৎ বেখেয়ালি তে নজর থেমে গেলো টেবিলের এক কোনায় রাখা ছোট্ট আয়নাতে। সাথে সাথেই তার মানস্পটে ভেসে ওঠে দুপুরের ঘটনা। কেমন ইতর একটা লোক, সমস্যাটা কি তার? আর এতো অভদ্রই বা কেনো? আরেক দিন দেখা হোক, তুলে আছাড় মা|রতে ভুলবে না বলে পণ করে বসল। মাথা থেকে যতই বের করতে চাচ্ছে ততই তার সাথে ঘটা অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ সমূহ পর্যায় ক্রমে হানা দিচ্ছে মস্তিষ্কের নিউরনে। প্রথম অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ, লজ্জাকর পরিস্থিতি। পরের দিন লোকটির শেষ মূহুর্তের কথাটা আর সেদিন ছাদে বলা কথাটা দিয়ে কি বোঝাতে চায় সে? মীরা জানে সে কি বুঝাতে চায়, কিন্তু এতো কিছু করেও যে লাভের লাভ কিছু হবে না সেটা ভেবে মুচকি হাসে মীরা। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে একটা থিউরি পড়লো কয়েক বার এবং বারবার। উহু কাজ হচ্ছে না। মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই। ঢুকবে কি ভাবে, মীরার মস্তিষ্ক জুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখন যে সেই অসভ্য লোকের বসবাস। যা ধীরে ধীরে হৃদমাঝারে এ জায়গা করে নেওয়ার জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মীরা ঘূনাক্ষরেও টের পাচ্ছে না সেটি।

_______________________

পড়ন্ত বিকেল। সূর্যের তাপ মলিন হয়ে এসেছে পৃথিবীর বুকে। আকাশ পরিষ্কার, মেঘ গুলো থোকায় থোকায় নানা রঙে সেজেছে আজ। শহরের আভিজাত্য এক রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডার পসরা বসিয়েছে রাইফের বন্ধু মহল। অফিস শেষেই একত্রিত হয়ে খোশগল্পে মেতেছে তারা। এক গল্প দিয়ে শুরু করলে আগামাথা বাদ দিয়ে অন্য গল্পে গিয়ে থামে।ব্যাক্তিগত থেকে রাজনৈতিক কোনোটাই বাদ নেই যেনো। এখন আপাতত আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু রাইফ এবং তার ছুঁয়ে দেওয়ার আগেই আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া লাজুকলতা। ফাহাদ, পল্লব এবং রাজন এর একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছে রাইফ। তিনজন কে টেক্কা দিয়ে চতুরতার সহিত রাখঢাক করে কথা বলছে, এই একটা বলে তো অন্যটা চেপে যায়। পল্লব ধৈর্য রাখতে পারছে না কিছুতেই। হাঁসফাঁস করছে আদ্যোপান্ত জানার জন্য। রাজন পায় তো রাইফের পেটে ঘু’ষি দিয়ে সমস্ত কথা বেড়িয়ে আনে। ফাহিম শেষে ধৈর্য রাখতে না পেরে রাইফের গা ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে পুরো ঘটনা জানার জন্য। এদের অবস্থা দেখে নিরবে হাসে রাইফ। বন্ধুদের হৈ হুল্লোড়ে না পেরে অবশেষে মুখ খুলে বলল,

-‘আরেহ ভাই, থাম এবার। এতো অস্থির হচ্ছিস কেনো?’

-‘তুই শালা একেবারে সব বললে কি আমাগো এতো উতলা হওয়া লাগে?’

পল্লবের কাঠকাঠ কথাতে রাইফ মাথা চুলকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

-‘তোরা মেয়েটা কে যেমন ভাবছিস তেমন না। আলাদা, একেবারেই আলাদা। ওর নীরবতা স্বভাবটাই আমাকে টানছে বেশি। ওর সাধারণ বেশভূষা, ওকে অসাধারণ করে তুলেছে।’

ফাহাদ গলা টেনে কথার মাঝে ফোঁড়ন কা’টল,

-‘ওহ….হো মিঁয়া, দেখতে হইব তাইলে আজকেই।’

-‘আমি দেখা পাচ্ছি না আবার তুই! ‘

-‘কেনো দেখতে পাচ্ছিস না? সে কি বিদেশ থাকে? কোন গলির মাইয়া? ক খালি একবার, এই পল্লব এখনি হাজির করব।’

-‘আগলা ভাব নেওয়া বন্ধ কর পল্লু। কাজের কাজ কিছুই করতে পারবি না।’

রাজনের মুখে ‘পল্লু’ ডাকটা শুনেই ক্ষেপে উঠল পল্লব। বসা থেকে উঠে তেড়ে গেলো রাজনের দিকে। ফাহাদ দ্রুততার সহিত ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে মাঝে ঢুকে বাধা প্রদান করে শান্ত করল দুজন কে। ভার্সিটি থাকা কালীন সেম ডিপার্টমেন্ট এর এক ব্যাচ জুনিয়র মেয়ের সাথে ভাব হয়েছিলো পল্লবের। মেয়েটা সবার সামনেই মিষ্টি সুরে “পল্লু” বলে ডাকত। কিছু দিন যেতে না যেতেই মেয়েটি বিয়ে করে ফেলে অরেক জন কে। পল্লবের কচি মন তখন ছ্যাঁ’কা খেয়ে ব্যাকা হয়ে মুষড়ে পরার জোগাড়।তখন থেকে মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে এই নামে ডেকে ক্ষে’পিয়ে দেয়। রাইফ এবং ফাহাদ কে উদ্দেশ্য করে অভিযোগ জানিয়ে পল্লব বলল,

-‘মামা, ওই যদি আরেক বার পল্লু ডাকে, আমি কিন্তু ওর বোন রে নিয়া ভাগমু।’

পল্লবের কথা শুনে বাকি তিন জন হো হো করে হেসে দিলো একজোগে। রাইফ মিটিমিটি হেসে চুপচাপ শুনেই যাচ্ছে, এই গন্ডগোল থামানোর কোন তাগিদ তার মাঝে নেই। আরাম করে হেলান দিয়ে বসল আরো। এমন একটা ভাব যেনো সে খুব উপভোগ করছে এটা।
ফাহাদ এবার উচ্চস্বরেই ধমকে উঠল,

-‘থামবি নাকি কি’ক খাবি তোরা। ফাও পেচ্যাল পেরে আসল কাহিনী শুনতে দেস না।’

ফাহাদের ধমক আর নিজেদের বোকামিতে চুপসে গেলো রাজন এবং পল্লব। তিন জোড়া চোখ এক সাথে দৃষ্টি ঘুরালো রাইফের দিকে। ফাহাদ টেবিল চাপড়ে রাইফকে মৃদু ধমকে বলল,

-‘বলবি তুই, নাকি আরো তোষামোদ করা লাগবো?’

-‘হাইপার হচ্ছিস কেনো! গন্ডগোল করলি নিজেরা, দোষ হচ্ছে আমার!’

-‘এখন বল।’

-‘এই কয়েক দিনে যা বুঝলাম, নিজের মাঝেই মত্ত থাকতে পছন্দ করে বেশি। ভীষণ ম্যাচিউর একটা মেয়ে।’

-‘বোন আছে?’

কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই মাথা ঘুড়িয়ে সবার নজর গেলো পল্লবের উপর। এই পল্লবটা সারাদিন এর বোন তো ওর বোন নিয়ে পরে থাকে। ফাহাদের তো মন চাচ্ছে এখনি একে উপর থেকে নীচে ফেলে দিতে। তারপর কারো বোনের উপর গিয়ে পরুক, মনের সাধ মিটে যাক।

-‘কথা হয় রাতে?’

হুট করে রাজনের খাঁপছাড়া প্রশ্ন শুনে রাইফের চক্ষু কোটর বাহিরে আসার জোগাড়। যেখানে সে দেখা পাওয়ার জন্য সেই সকাল থেকে বসে ছিলো রাস্তায়, কতো রজনী অপেক্ষায় কাটিয়েছে ছাদে, কতো রাত গেছে নির্ঘুম তার হিসেব নেই, আর এই রাজন টা বলে কি? সব সময় এতো এডভান্স কেনো চিন্তা করতে হবে ওর? বিশ্রী গালি দিতে ইচ্ছে করছে ওকে। মুখটা আলাভোলা করে রাজনের গাল টেনে রাইফ আহ্লাদী কন্ঠে বলল,

-‘কথা কেনো, দেখাও হয়। এক সাথে বসে গল্প করি, চন্দ্র বিলাস করি। রান্না করে খাওয়ায় নিজ হাতে। আজ ডেটিং এ আসবে একটু পর। এমন ই তো শুনতে চাইছিলি, এবার হ্যাপি?’

রাইফ এর কথা শুনে ফাহাদ হতাশার শ্বাস ফেলল। বন্ধু যে এখনও ঝুলে আছে তা ঠিক বুঝতে পারছে। পল্লব আসনে হেলান দিয়ে ভাবুক কন্ঠে আফসোস করতে করতে বলল,

-‘এমন কথা বলিস না বন্ধু, আত্মাটা ধ্বক প্বক করে একটা বউ এর জন্য।’

রাজন হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,

-‘সারাদিন বোন বোন ই করিস, বউ জুটাইতে পারবি না।’

তৎক্ষনাৎ সবাই হো হো করে হেসে উঠলো সমস্বরে। এই আড্ডা কখন থামবে তা ওদের জানা নেই। এইযে রাইফ থেকে এখন পল্লবের বউ পর্যন্ত আসল সেটা হয়তো এক সময় সালমান খান সিঙ্গেল কেনো সেই প্রশ্নে গিয়ে থামবে। এভাবে চলবে তাদের কথার ফুলঝুড়ি।

চলবে…

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০৯

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৯

🍁
সকালের নাস্তা শেষে ড্রয়িং রুমে বসে আছে খাদিজা বেগম আর সানজিদা বেগম। পাঁচ দিন হলো তিনি এসেছেন মীরাদের বাসায়। চলে যেতে চেয়েছিলেন গত কাল বিকেলেই। কিন্তু মীরা আর উর্মির বাঁধাতে যেতে পারেন নি। আজ যেতেই হবে। একেবারে তৈরি হয়েই বসেছেন সোফায়। রান্নাঘর হতে টুংটাং শব্দ আসছে। মীরা চা বানাচ্ছে। উর্মি ঘুরে ফিরে একেকটা বয়াম এর মুখ খুলছে আর লাগাচ্ছে। কিসের সন্ধানে যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। মীরা ফুটন্ত গরম দুধে চামচ দিয়ে চা পাতা ঢেলে দিয়ে উর্মিকে লক্ষ্য করে চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছে সে। মেয়েটা থানা ত’ল্লাশি দিয়েই যাচ্ছে কখন থেকে। কখনও নীচের তাকে তো কখনও মোড়ার উপর দাঁড়িয়ে উপরের তাকে। উর্মি মনে মনে ভাবল, মামী তো এখানেই বলেছিলো, তাহলে পাচ্ছে না কেনো। পুরো কিচেন খুঁজে কিছুতেই পাচ্ছে না কাংখিত বস্তুটি। শেষ মেষ হতাশ হয়ে বসে পরল মোড়ায়। উর্মির এহেন কান্ড দেখে মীরার হাসি পেলো। মুচকি হেসে বলল,

-‘পেলি?’

-‘দেখছিস না?’

রাগ হলো উর্মির। দেখতেই পাচ্ছে খুঁজে পায় নি তার পরেও খোঁচা দিচ্ছে। মুখ ভেংচি দিয়ে এক গ্লাস জল একটু একটু করে খাচ্ছে। মীরা ওর পাশে বসে বলল,

-‘কাল আসবি না?’

-‘ঠেকা পরে নাই আমার।’

-‘রেগে আছিস?’

-‘না, হাসছি আমি।’

-‘তোর হাসি এমন কেনো? দেখতে রাগ রাগ লাগে, মুখটাও কেমন বোচা বোচা।’

ঠাড্ডার সুরে কথাটা বলেই মীরা ঠোঁট চেপে হেসে দিল। এবার আর উর্মি রাগ সংবরণ করতে সক্ষম হল না। চেতে উঠে হড়বড় করে কর্কশ কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল,

-‘আর তুই হাসলে যেনো মনে হয় অস্পরা লাগে! শোন, তুই হাসলে পে’ত্নির মতো লাগে। সামনের দুইটা দাঁত বের হয়ে আসে। আমি তো ভয়ে দিশেহারা হয়ে যাই।’

-‘সত্যি!’

-‘জ্বী আপা মনি। ভুলেও দাঁত কেলায়ে হাসবি না।’

-‘তাহলে কিভাবে হাসব?’

-‘মুচকি হাসবি। তবু দাঁত বের করবি না।’

মীরা উর্মির আরেকটু কাছে ঘেষে মুখটা আলাভোলা করে বোকা বোকা কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,

-‘জোরে হাসি পেলে তখন?’

-‘জোরে হাসি পেলে গাল কেলায়ে হাসবি। প্রয়োজনে চোখও কেলাবি। কিন্তু দাঁত, একেবারেই না।’

উর্মির কথা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই প্রাণখোলা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো মীরা। গা কাঁপিয়ে হাসছে সে। হাসির চোটে এদিক ওদিক ঢলে পরছে। উর্মি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছে মীরাকে। এই মেয়েটা হাসলে কি অনিন্দ্য সুন্দর লাগে দেখতে। হৃদয় এবং আঁখি দুটোই জুড়িয়ে যায় এই প্রাণখোলা হাসিতে। অথচ মেয়েটা হাসতেই যেনো ভুলে গেছে নানীজানের মৃ’ত্যুতে। এভাবে রোজ একটু হাসলে কি হয়! এতো কেনো কিপ্টামি এই মেয়েটার। কেউ তো ওর হাসি নিয়ে নিচ্ছে না। তবে? মীরা চকচকে সাদা দন্তপাটি বের করে উর্মিকে বলল,

-‘নে, এবার হাসির তারিফ কর একটু।’

-‘তোর এই প্রাণখোলা এক চিলতে হাসি মূহুর্তের মাঝে যে কারো হৃদযন্ত্র থমকে দিতে সক্ষম।’

-‘ধ্যাত, বেশি বেশি বলছিস এবার।’

উর্মি এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

-‘হ্যাঁ, ভালো কথার তো ভাত নায়।’

মীরা নীচু হয়ে একটা ছোট্ট বয়াম বের করে হাতে দিলো উর্মির। তা দেখে চোখ জোড়া চকচক করে উঠল। ছো মেরে হাতে নিয়ে খুলে ফেলল ঢাকনা। এক মুঠো কিসমিস বের করে তিন চারটে মুখে পুরলো। শান্তি লাগছে এখন তার। মামীর কিচেনে এসে কিসমিস এ হাত দেওয়া যেনো নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে উর্মির। এই ফাঁকে মীরা ফুটন্ত গরম চা কাপে ঢেলে ড্রয়িং রুমে এসে বসেছে। ফুপুর বিদায় বেলায় আবেগপ্রবণ অনুভূতিতে কিছু সময়ের জন্য গল্প জুরে দিল।

__________________

খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। সাদা কালোর সংমিশ্রণে সুতার কারুকাজ করা শুভ্র রঙের ফিনফিনে পর্দা উড়ছে মৃদু বাতাসে। দু পাশে সাদা পর্দার মাঝে অবস্থান করা মানবী কে কালো সালোয়ার কামিজে আজ অন্য রকম সুন্দর লাগছে। মীরা চুপটি ঠাঁই দাঁড়িয়ে। ভাবুক তার মুখাবয়ব। দৃষ্টি তার খোলা আকাশে তুলোর মতো উড়ে যাওয়া সাদা সাদা মেঘ পুঞ্জতে। মৃদু বাতাসে খোলা চুল উড়ছে দুপাশে। কালো ওড়নাটা ঢিলাঢালা করে মাথায় দেওয়া। জোরালো বাতাসেই পরে যাবে যেকোনো সময়। মীরার কোন ধ্যান জ্ঞান নেই আশে পাশে। সামনের ব্যাস্ত সড়কে শো শো করে গাড়ি যাচ্ছে। কোলাহল ময় পরিবেশ। হঠাৎ উচ্চশব্দে গাড়ির হর্ন কানে আসাতে ধ্যান ফিরলো মেয়েটির। বিরক্ত হলো, চোখ মুখ কিঞ্চিৎ কুঁচকে ফেলল। শব্দের উৎসের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাল। এদিক সেদিক তকাতেই আকাশী রঙের শার্ট পরিহিত বলিষ্ঠ মানবের কাছে দৃষ্টি এসে থামল। রাস্তার এক পাশে বাইকে বসা। সামনে কোনো গাড়ি নেয়। তারপরেও তুমুল বেগে হর্ণ দিয়েই যাচ্ছে। রাইফকে দেখার সাথে সাথেই মীরা পর্দার আড়াল করল নিজেকে। লোকটা এই ভর দুপুরে কি করে এখানে? কার জন্য অপেক্ষা করছে আর পা’গলের মতো এতো হর্ণ ও বা দিচ্ছে কেনো! মীরা চুপিচুপি পর্দার আড়াল হতে চোখ দুটো বের করে আবারও দৃষ্টি দিলো পুরুষটির পানে। লোকটাকে দেখে ভদ্রলোক ই মনে হয়, কিন্তু সুযোগ পেলেই মানুষকে লজ্জায় ফেলাতে ওস্তাদ যেনো। রাইফ তাকে দেখছে না ভেবে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। পর্দার আড়াল হতে বেরিয়ে পরখ করতে থাকলো মীরার ভাষ্যমতে অসভ্য লোকটিকে। রাইফ এবার নড়েচড়ে বসলো। বেশ আরাম করে বসে সামনে ঝুঁকে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছে। আরেকটু ঝুঁকে সময় নিয়ে খুব যত্নের সহিত ডান হাতের বৃদ্ধ আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো আয়নার ভেতরের আবদ্ধ মানবী কে। ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে বাইকটা একটু বাঁকা করল। শরীর টা একটু পিছিয়ে এনে লুকিং গ্লাসে হাত রাখল। বা হাতে চুল গুলো ব্যাক ব্রাশ করে ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলল কিঞ্চিৎ বাঁকা রহস্যময় হাসি। ডান হাতের কব্জি ঘুড়িয়ে লুকিং গ্লাস সূর্য বরাবর তাক করল। রাইফের মুখের হাসি এবার প্রসারিত হলো। আঙুলের টোকায় লুকিং গ্লাস টা কিঞ্চিৎ নড়াতেই সেকেন্ড এর ব্যাবধানে মীরার চোখে মুখে গিয়ে পরলো সূর্যরশ্মি। মীরা চোখ মুখ কুঁচকে হাত দিয়ে ঝলমলে আলো থেকে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা। রাইফ ঘুরে তাকিয়েছে মীরার দিকে। মিরার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে চোখের ইশারায় বুকের বা পাশে তাক করে বুঝিয়ে দিলো মীরার স্থান টুকু।

চলবে…..

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০৮

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৮

🍁
নিকষ কালো আঁধার চারিদিকে। আজ আকাশের বিশালতায় নেই কোনো নক্ষত্রের মেলা। চাঁদটাও মেঘার আড়ালে ঢেকে আছে। আশেপাশের বিল্ডিং গুলোতে অল্প কিছু ফ্লাটে আলো জ্ব/লছে। কোলাহল ময় শহর ঢেকে আছে পিনপতন নিরবতায়। পিঠ টান টান করে রাইফ বারান্দায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে অনেক ক্ষণ হলো। পরনে নেভি ব্লু টিশার্ট। বুকের উপর দু হাত আড়া আড়ি ভাঁজ করা। অন্ধকারে ঢেকে আছে তার মুখাবয়ব। এক ধ্যানে সম্মুখে স্থির দৃষ্টি। বিষন্ন মন তার। কিছুক্ষণ আগে বাবা জাহাঙ্গীর আলম এর কবর জিয়ারত করে এসেছে মা ছেলে মিলে। ফেরার সময় থেকে বাসায় আসা অব্দি একে অপরের সহিত একটা টু শব্দও করে নি দুজন। এসেই রাজিয়া বেগম সোজা তার রুমে ঢুকেছে। রাইফ জানে উনি আর বের হবেন না আজ। মুখে আঁচল চেপে ডুকরে কাঁদবে সারা রাত। প্রিয় জন হারানোর ব্যাথা তিল তিল করে আঘাত করবে তাকে। এক সময় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হবেন। কিন্তু রাইফ, তার কি আজ দু চোখের পাতা এক হবে! জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুর পর কতো রজনী যে বারান্দায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কেটেছে তা এক আল্লাহ আর এই শহরের কাক পক্ষী ব্যাতিত বোধহয় কেউ জানে না। রাইফের খুব ইচ্ছে করে মায়ের মতো করে কেঁদে নিজেকে হালকা করতে। এই যে ভেতরটায় পাথর জমে আছে সেটা গলিয়ে ফেলার নিরন্তর প্রচেষ্টা তার ভেতর। কিন্তু আঁখিজল যেনো কঠিনপণ করেছে বাহিরে না আসার। এই বোঝা যে ভীষণ ভারী। বুকে রক্তক্ষরণ হবে কিন্তু চোখে বের হবে না একবিন্দু নোনাজল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে সুস্থে মায়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাতের খাবার খায়নি কেউ ই। মেডিসিন টুকু না নিলে ব্লা/ড প্রেসার হাই হয়ে যাবে রাজিয়া বেগমের। রুমের ভেতর থেকে গুঙ্গিয়ে কান্নার চাপা আওয়াজ আসছে। কি যে হাহাকার সেই কান্নায়!রাইফের হৃদয়টা যেনো এবার আরো বেশি ভার হলো। জড়তা কাজ করছে মা কে ডাকাতে। দ্বিধা-দ্বন্দ করে সময় নিয়ে টোকা দিলো হালকা কারুকাজের কাঠের দরজায়। খুব মোলায়েম স্বরে আবেগ মাখা কন্ঠে ডাকল,

-‘আম্মা?’

ডাকার সাথে সাথেই কান্নার আওয়াজ থেমে গেলো। ঘড়ির কাটার সময় টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। রাইফ নড়ছেনা। চলেও যাচ্ছে না। সম্মুখে স্থির দৃষ্টি তার। যেনো এখান থেকে ঠিক কিছু আসবে, তাকে ফিরিয়ে দিবে না। ভেতরের মানুষটি নিজেকে সামলানোর জন্য যে সময় প্রয়োজন তা রাইফ জানে।মিনিট চারেক পেরুতেই ভেতর থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠের আওয়াজ এলো,

-‘আমি ঠিক আছি আব্বা। তুই শুয়ে পর। মেডিসিন খেয়ে নিবো, চিন্তা করিস না।’

রাইফ পলক ঝাপ্টালো। মায়ের এই যে ‘আমি ঠিক আছি’ বলাটা। কিন্তু আসলেই কি উনি ঠিক আছেন? উনার ভেতর বাহির পুরোটাই যে আজ বিধ’স্ত। তারপরেও এখন একটু স্বস্তি বোধ করছে রাইফ। মাকে দ্রুত শুয়ে পড়ার জন্য আদেশ দিয়ে শব্দবিহীন পায়ে আবারও বারান্দায় এলো। চেয়ারে বসে পা তুলে দিলো সামনের গ্রিলে। আজ আকাশ এর গভীরতা দেখেই কাটাবে নিঃসঙ্গ রাত্রী। কিন্তু তার অজানায় রয়ে গেলো তার মতো এই শহরেরই ঠিক দুতলা নিচে ফ্লোরে বসে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে অন্ধকারে আচ্ছন্ন এক ব্যাথাতুর নারী। রাইফের মতো প্রিয় জন হারানোর ব্যাথায় সে জর্জরিত হয়ে আসছে দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। নিজেকে নিজে সামলানো এখন আরো কঠিন হচ্ছে মেয়েটির।

____________________

রাতের শেষ ভাগে আকাশে নক্ষত্র রাজি ফুটে উঠেছে। জ্বল জ্বল করছে আপন স্বত্তায়। ফজরের আজান আসছে পাশের এবং দূর দূরান্তের মসজিদ হতে। কি সুমধুর তার বানী।
‘আস সালাতু খাইরুম মিনার নাউম….
আস সালাতু খাইরুম মিনার নাউম…’

মীরা নড়ে চড়ে উঠলো। ফোলা ফোলা ঝাপসা চোখে আশে পাশে আবছায়া আলোয় পরখ করে নিলো নিজের অবস্থান। মাথাটা প্রচন্ড ভার ভার লাগছে তার। কোনো রকমে উঠে বসলো। কতোক্ষণ ঝিম মে/রে থেকে এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে নিল। ফ্লোর থেকে উঠে তাওয়াল নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পরেছে। গোসল না করলে কিছুতেই ফ্রেশ লাগবে না। হালকা হবে না শরীর এবং মন।

_______________________

ভোরের সূর্য এখনও উঠেনি পূর্ব আকাশে। অন্ধকার ভাব এখনও বিরাজমান। ধরণীতে আলো ফুটবে ফুটবে ভাব। শীতল হাওয়া বইছে।
শওকত রহমান আর উর্মি আগে আগে হাঁটছেন। মীরা পেছন পেছন। ধীর পায়ে ভোরের স্নিগ্ধতা টাকে অনুভব করছে সবাই। উর্মি মামু মামু করে অস্থির করে তুলেছে শওকত রহমান কে। একের পর এক প্রশ্ন চলছেই। এটা কেনো হলো, না হলে কি হতো, হওয়ার কি খুব দরকার ছিলো? শওকত রহমান ধৈর্যের সহিত বুঝিয়েই যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর পর হীম শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের। রাতের ঘটনার পর খারাপ ছিলো মীরার মন। এমন চমৎকার পরিবেশ পেয়ে মূহুর্তেই ফুরফুরে হলো মীরার হৃদয়। পিচ ঢালা রাস্তায় পথ চলতে চলতে হঠাৎ কি মনে করে পিছু ফিরলো। রাইফের সেদিনের বলা কথাটা ‘বারান্দায় আসো না কেনো মেয়ে, সমস্যা কি? কেউ অপেক্ষা করে তোমার জন্য।’ মনে হতেই উপরে তাকিয়ে নিজের বারান্দায় চোখ বুলালো। দৃষ্টি ফিরাবে তখন বেহায়া নজর গেলো পাঁচ তলা বিল্ডিং এর বারান্দায় অবস্থান করা পুরুষটির দিকে। কেমন শক্ত হয়ে বসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দুই পায়ে দুই হাতের কুনুই ভর দিয়ে শরীর একটু সামনের দিকে ঝুঁকে একত্র করে দেখেছে দু হাতের দশটি আঙ্গুল। চুল এলো মেলো, বি’ধ্ব’স্ত চেহারা, স্থির তার চাহনী। নিশ্চয় চোখ দুটি রক্তিম লাল হয়ে আছে। অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে মীরার দিকেই। মীরা সম্মুখে হাঁটছে ধীর পায়ে। কিন্তু দৃষ্টি তার পেছন দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেই যাচ্ছে আজ। সংকোচ কাজ করছে না একটুও। কোনো এক শক্তির বলে নজরও ফেরাতে পারছে না। মীরার মনে হচ্ছে আজ কেনো যেনো লোকটিকে অন্য রকম লাগছে। আজ তার চোখে মুখেও নেই কোনো দুষ্টমির ছোঁয়া। এমন কেনো লাগছে লোকটিকে? রাইফ ও স্থির। ভাবলেশহীন তার চেহারা। গভীর চোখে মীরার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মীরাকে। চোখে কি তার মায়া! কি স্নিগ্ধ, পবিত্র লাগছে ভোরের প্রথম আলোয়। পেছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁটার কারণে মীরা হোঁচট খেলো রাস্তায়, পরতে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে। সামনে দৃষ্টি দিলো। পিছু না ফিরে সঙ্গী হলো আব্বাজানের। পেছনে রেখে গেলো কারোর এক বুক অপেক্ষার আর্তনাদ। মন ভরে দেখার এক বুক তৃষ্ণা। কেউ খুব করে চাচ্ছে, এই মূহুর্তটা থেমে যাক এখানেই। হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে চায় তার চোখের ভাষা। মনে মনেই আওড়ালো গানের দুই লাইন,

“আমি প্রথম দেখে পা’গল হইলাম
মন তো আর মানে না……
কাছে আইসো, আইসো রে, বন্ধু.. প্রেমের কারণে
ভালোবাইসো বাইসো রে, বন্ধু, আমায় যতনে”

চলবে……..

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০৭

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৭

🍁
বছর তিনেক আগের কথা। মীরা তখন অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার জন্য ঢাকা থাকে। মাসের অর্ধেক যদি কলেজের হলে থাকে তো বাকি অর্ধেক পরিবারের সাথে। পরিবার এ চার জন সদস্য। বাবা, মা, দাদী আর মীরা। দাদা রহমত আলী গত হয়েছেন অনেক বছর আগে। মীরার স্মৃতিতে খুব একটা জায়গা নেই তার। কিন্তু দাদী নূরজাহান বেগম হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্থান দখল করে আছে। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যুবতী। পুরোটা সময় জুড়েই মীরার জীবন জুড়ে পদচারণা ছিলো তার দাদীর। মীরার চেহারার নব্বই শতাংশ নূরজাহান বেগমের সাথে মিল। যার কারণে শওকত রহমান মেয়ের মাঝে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। নূর জাহান বেগমকে জীবিতকালে আম্মাজান, মীরাকে ছোট আম্মাজান বলে ডাকতেন। চেহারার এই মিলটা কে নিয়ে মাঝে মাঝেই মীরা ফায়দা লুটত। দাদীর শুভ্র সাদা শাড়ি পেঁচিয়ে, ঢিলা-ঢোলা ব্লাউজ পরে লাঠিতে ভর করে আব্বাজানের সামনে বসে পরতো। খুক খুক করে কেশে দাদীর মতো অনুকরণ করে বলত,

-‘আমার বাপজান গো, পানের ডালা কই। দাও তো দেহি।’

শওকত রহমান মেয়ের কান্ডকৃত্তি তে হো হো করে হেসে দিতেন। মীরা চোখ রাঙ্গিয়ে বুঝিয়ে দিতো তাকে যেনো নূর জাহান বেগম ই ভাবা হয়। আবারো ভাব-সাব নিয়ে আঁচল টা কাঁধে টেনে নিয়ে বলত,

-‘শোনো বাপজান, এতো আনন্দিত হইয়ো না। আমার সমস্ত সম্পত্তির এক আনাও তুমি পাইবা না এই বলে রাখলাম। সব আমার দুই নাতনী পাইবো। তুমি এখনি ওসব এর আশা ছাইড়া দাও।’

শওকত রহমান ও তখন মীরার দুষ্টমিতে সায় দিতেন।
বলতেন,

-‘আম্মাজান, আপনার নাতনীদের তো বয়স হয় নায় তেমন। ওরা সামলাইতে পারবো না। আমাকে আপনি নিশ্চিন্তে দ্বায়িত্ব দিতে পারেন। আমি দেখে শুনে রখবো’

-‘তোমার ওসব বুঝা লাগবো না। আসছে মাতব্বর। ওরা যখন বুঝবো তখনি সামলাবো।’

মীরার নূর জাহান বেগমের মতো হুবুহু অভিনয় দেখে শওকত রহমান থ মেরে গেলেন। মীরা পাশের টেবিল থেকে একটা পান তৈরি করতে করতে বলত,

-‘আমার তিনডা শাড়ি কিনন লাগব বুঝছ। তোমার আব্বাজান থাকতে আমার শাড়ি কিনার কথা কওন লাগতো না। দাও ক্যাশ থাইকা টেকা দাও পাঁচ দশ হাজার যা পাও।’

-‘আসলেই নিবেন আম্মাজান?’

মীরা চুপি চুপি নিরবে ঠোঁট চেপে হাসে। দাদীর অনুকরণ করে শওকত রহমান কে যে কঠিন জব্দ করা গেছে এটা ভেবে তুমুল বেগে হাসি পায় তার। ঠোঁট চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে। হুঙ্কার দিয়ে বলে,

-‘আসল নকল কি বাপজান। টাকা বাইর করো। তোমার আব্বা আমারে একা ফালাইয়া গেছে, আমার হইছে যতো জ্বা’লা।’

শওকত ওসমান মেয়ের দুষ্টমিতে এবার ও তাল মিলাতেন। পাঞ্জাবির পকেট হাতরে সাড়ে তিন হাজার টাকা মেয়ের হাতে পুরে বলতেন,

-‘এটাতেই কিনে ফেলেন আম্মা। যেদিন আপনার সম্পত্তির দ্বায়িত্ব দিবেন ওইদিন আপনাকে লাড্ডু খাওয়াবো।’

মীরা টাকা পেয়ে পান টা হাতে নিয়েই দিক-বিদ্বিক ভুলে দৌড় লাগাতো নূর জাহান বেগমের রুমে। লাফ দিয়ে বিছানায় বসে জাপটে ধরতো শক্ত করে দাদীজান কে। হৈ হৈ করে বলত,

-‘পেয়ে গেছি দাদীজান, পেয়ে গেছি। আজকেই শপিং এ যাবো। ইয়াহুউউউউ!!’

বলেই কচকচে সাতটা পাঁচশত টাকার নোট সামনে মেলে ধরত। নূর জাহান বেগম খুক খুক করে কেশে গালা ঝেড়ে বলতেন,

-‘আমার শাড়ি, আমার লাঠি নিয়ে তুই এতো গুলা টাকা হাতায়ে নিলি হতচ্ছাড়ি। এক হাজার টাকা নিয়ে বাকি টাকা আমাকে দে। দে দেখি, দে।’

মীরা জানে দাদী এই টাকা নিবে না কখনও। তবুও সে মিছেমিছি ভান করে অসহায় কন্ঠে বলত,

-‘দাদীজান, আমার স্বামী সন্তান কেউ নাই। সাথে টাকা পয়সাও নাই। খুব কষ্ট করে তোমার অভিনয় করছি। আব্বাজান কে পটানো সহজ ছিলো না। তুমি তোমার ছেলের কাছে গিয়ে চাও যাও।’

-‘আমার হয়েই তো টাকা গুলা আনলি। আমি গেলে এখন কি দিবো রে ছেমড়ি।’

-‘না দিলো। টাকা দিয়ে কি করবা? এই নাও পান, মিষ্টি পান। গালে দিয়ে মুখ টা লাল করে ফেলো। ‘

নূর জাহান বেগম এক গাল হেসে মুখে পান ঢুকালেন। ধীরে ধীরে চিবিয়ে পানের স্বাদ গ্রহন করতে থাকেন। কিছুক্ষণের মাঝেই লাল হয়ে ওঠে তার ঠোঁট। মীরা বিছানায় এক কাঁধে ভর দিয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে নূর জাহান বেগমের পানে। নূর জাহান বেগম ইতস্তত বোধ করেন। পানের পিক কৌটায় ফেলে জিজ্ঞাসা করেন,

-‘কি দেখতাছস এমন কইরা?’

-‘তুমি এতো সুন্দর করে পান খাও কিভাবে দাদী?’

-‘তুই ও খা। আয় শিখায়া দেই’

-‘পান খেলে যে বুকে জ্যাম হয় আমার।’

-‘আমি শিখাইয়া দিলে হইবো না। তোর জন্য একটা রাজপুত্তুর আনুম। এক লগে বইয়া পান খাবি।’

-‘ইস, তোমার রাজপুত্তর এর সাথে আমি পান খাবো কেনো! দুনিয়াই আর কিছুই নায় নাকি!’

-‘আহা, এক লগে বইয়া পান চিবাবি। ঠোঁট লাল কইরা ভালোবাসার মানুষটার লগে প্রেম বিনিময় করবি আর সুখ দুঃখের আলাপ করবি। মহব্বত বাড়বো।’

-‘আসলেই বাড়বো?’

-‘হ রে দিদিভাই। তোর দাদাভাই তো আমারে রোজ রাতে এক খিলি পান আইনা কইতো “নূর, পান খাইয়া মুখটা লাল করো তো দেহি। এই ধলা মুখটাই পান ছাড়া তোমারে পাইনসা লাগে দেখতে”।’

-‘মহব্বত করতো তোমাকে অনেক তাই না।’

নূর জাহান বেগম এই বয়সেও স্বামীর ভালোবাসার কথা শুনে একটু লজ্জা পেতেন বোধ হয়৷ মিহি সুরে বলতেন,

-‘মহব্বত করতো কি না জানি না। তয় আমারে ছাড়া উনার চলতো না। দিন শেষে আমারে ধইরাই ঘুমাইতো। শান্তি লাগতো নাকি তার।’

নূর জাহান বেগমের খোলা মেলা কথাতে লজ্জা পায় মীরা। দাদীর মুখে একটুও লাগাম নায়। হুটহাট কি সব বলে ফেলে। লজ্জামাখা বদনে মিন মিন কন্ঠে বলত,

-‘তুমি অনেক সুন্দর দাদী। এখন তখন সবসময়। আমার জন্য যে রাজপুত্তুর আনবা সেও পাগল হবে তোমার জন্য। ‘

মীরার কথা শুনে উচ্চ স্বরে হেসে উঠতেন নূর জাহান বেগম। মীরার থুতনিতে হাত রেখে বলতেন,

-‘আমার দিদিভাই এর উপর থাইকা নজর ফেরানো মুশকিল হবে যে কোনো রাজপুত্তুর এর। এক নজরেই আইটকা যাইবো তার হৃদযন্ত্র। তোরে ছাড়া ওই যন্ত্র আর চলবো না। হা হুতাশ কইরা বেড়ান লাগবো।’

-‘ইস! কখনও না।’

-‘হ রে ছেমড়ি। তুই হইছস আমার লাহান টুকটুকে সুন্দর। আর গুণ তো মাশাল্লাহ আমার থাইকাও এক কাঠি উপরে। বাঁইচা থাকতে তোর কদর করবার পাইবো এমন একজনের হাতে উঠায়া দিবার পাইলে শান্তি পাইতাম।

-‘দাদীজান, এভাবে বলো কেনো? আল্লাহ তায়ালা তোমার নেক হায়াত বৃদ্ধি করে দিক।’

-‘আমিন। এবার ক শান্তি দিবি?’

-‘আমি এখানে থাকলে তোমার অশান্তি হয়? দূরে ঠেলতে চাচ্ছো কেনো?’

-‘না রে বুবু। মাইয়াগো স্বামীর সংসার ই সর্বসুখ। আইজ নয়তো কাল যাওয়াই লাগে। আমি বাঁইচা থাকতে তোগো চার হাত এক করবার পারলে, দেইখা যাইবার পারলে চোখ দুইডা জুড়াই যাইতো।

মীরা ছলছল নয়নে তাকায় নূর জাহান বেগম এর দিকে। সে জানে একদিন না একদিন ঠিক আপন জনকে ছেড়ে যেতে হবে। নিজের ঠিকানা গড়ে তুলতে হবে নতুন করে। কেমন হবে দাদীজানের রাজপুত্তুর! যদি ঠিকানা গড়তে সাহায্য না করে সে, তখন কি হবে! পারবে কি সে নিজের জন্য শক্ত জায়গা করে নিতে?

চলবে……

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০৬

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৬

রাইফের আকস্মিক এমন উদ্ভট কথা শুনে মীরার কান তব্দা খেলো। কস্মিনকালেও ভাবে নি এমন কথা শুনতে হবে তার। ভালো ভেবেছিলো সে কিন্তু লোকটার মাথায় যে সমস্যা আছে আজ পুরোপুরি নিশ্চিত। মনে মনে ভাবলো,’মহাবিপদ তো! এ কার পাল্লায় পরলাম আমি। এমন ভাবে বলছে যেনো মামার বাড়ির আবদার। দেখতে চাইলেই দেখতে দিবে।’ তড়িৎগতিতে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। শুধু কাজল কালো আঁখিদ্বয় দৃশ্যমান। রাগে গজগজ করছে মীরার মাথা। রাইফের স্থির শীতল চাহনি দেখে মেজাজ আরো বিগড়ে গেল।
কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,

-‘অসভ্য লোক। সরেন সামনে থেকে।’

রাইফ ঠাঁই দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে ধীরে ধীরে মৃদু হাসি স্থান করে নিচ্ছে। বাঁকা কন্ঠে বলল,

-‘ছুঁয়ে দিয়ে টি-শার্ট ছিড়ে দিলে অসভ্যতামী হয় না, আমি একটু দেখতে চাইলেই দোষ!’

-‘অবশ্যই দোষ এবং গুনাহও বটে’।

রাইফ এবার নিবিড় ভাবে দৃষ্টিপাত করল। চাপা কন্ঠে ভরাট গলায় ফিসফিস আওয়াজে বলল,

-‘আমার করে নিয়ে দেখলেও কি গুনাহ হবে?’

মীরা কেঁপে উঠলো। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,

-‘মা-মানে!’

-‘মানে অনেক কিছু। শান্তি প্রয়োজন আমার। সাথে তোমার ও শান্তির ঠিকানা হতে চাই।’

মীরার মাথা শূন্য শূন্য লাগছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। নিজেই গমগম করে পাশ কেটে চলে যাবে তখনি রাইফ দ্রুততার সহিত বলল,

-‘বারান্দায় আসো না কেনো মেয়ে, সমস্যা কি? কেউ অপেক্ষা করে তোমার জন্য।’

মীরার পা থেমে গেলো। ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছু ফিরলো। কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

-‘আমার মহাভারত অশুদ্ধ হয় বারান্দায় গেলে।’

কথাটা বলেই হনহন করে নিচে চলে গেলো। রাইফ কিছুক্ষণ থ মেরে থাকলো। মিনিট সময় পেরুতেই অট্টহাসি তে ফেটে পরলো সে। যেমন ভেবেছিলো তেমন টাও না। তেজ আছে দেখা যায়। এই তেজটা যেনো বহুগুণ সুন্দর করে তুললো মীরার ব্যাক্তিত্ব।

মীরা দৌড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকেছে। ঘেমে উঠেছে শরীর। খাদিজা বেগম ডাকছে ড্রয়িং রুম থেকে। মীরা আয়নায় তাকালো। ধুকপুক করছে তার হৃদয়। কি বলল লোকটা! আঁখিদ্বয় বন্ধ করে মনে করলো সেই উক্তিটি “আমার করে নিয়ে দেখলেও কি গুনাহ হবে”
বিড়বিড় করে কয়েকবার আওড়ালো সেই কথা। তড়িৎগতিতে চোখ খুলে দুহাত ভরা জল মুখে ঝাপ্টা দিলো। পর পর কয়েকবার। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বাহিরে বেরিয়ে এলো। খাদিজা বেগম এগিয়ে এলেন। বাদামের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-‘নে।’

-‘রাখো।’

-‘যাবি না?’

-‘না। ‘

-‘কেনো?’

-‘ইচ্ছে করছে না।’

-‘কি হলো আবার?’

-ঃমন খারাপ। একটু একা থাকি প্লিজ।’

-‘মন ভালো হলে রুমে আসিস। শুনবো তোর মন খারাপের গল্প।’

-‘ঠিক আছে। ‘

মায়ের মমতা মাখা হাত ছুয়ে দিলো মীরার মাথা। চোখ বন্ধ করে শান্তি টুকু কুড়িয়ে নিলো। পাশ থেকে কাঁথা টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে শুয়ে পরলো। যখনি মীরাকে দুঃশ্চিন্তা ঘিরে ধরে তখনি সে চুপ করে শুয়ে পরে।

_______________

রাইফ ছাদে ঢুকতেই বা দিকে উর্মিকে নজরে এলো। কাছাকাছি এসে বলল,

-‘আরেহ উর্মি যে…’

-‘জ্বী ভাইয়া। কেমন আছেন?’

-‘ভালো। এখন একটু বেশি ভালো আলহামদুলিল্লাহ।
তোমার কি খবর? কি করছো?’

-‘আঁচার খাচ্ছি। খাবেন?’

-‘নাহ। তুমি খাও।’

-‘বাদাম আনতেছে মীরা। বাদাম খাইয়েন।’

-‘আর আসবে না।’

-‘কী?’

-‘বাদাম। যাও নীচে যাও।’

-‘কেনো আসবে না?’

-‘মন বলছে।’

সন্দেহর নজরে তাকালো উর্মি। উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,

-‘আপনার মন কেনো বলছে আসবে না? আপনার মন সব জানে?’

-‘নাহ, তবে বাদাম আসবে না এটা জানে। বাদামের দেখা আমি আরো ১ সপ্তাহ পাবো না সেটাও জানে। হায় কপাল আমার।’

আফসোস ঠিকরে পরছে রাইফের কন্ঠে। তারপরেও তার মনটা ফুরফুরে লাগছে। অফিসের ব্যাস্ততা শেষে আজ রাইফ বাসাতেই ছিলো। ঘুমিয়েই কাটিয়েছে দিন। বিকেলে বাহিরে একটু ঘুরে আসবে বলে বের হয়ে কি মনে করে নীচে না গিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালো। এভাবে যে প্রেয়সীর সাক্ষাৎ লাভ করবে সে এক বিন্দুও আন্দাজ করতে পারে নি।

______________

নৈশভোজ করতে ডাইনিং এ বসেছে সবাই। খাদিজা বেগম কয়েকবার ডেকে এসেছে মেয়েকে। কিন্তু এখনও উঠার নাম নিচ্ছে না মেয়েটা। হঠাৎ কি হলো ভেবে চিন্তার ভাঁজ পরলো কপালে। শওকত রহমান তাকালেন খাদিজা বেগমের পানে। সহধর্মিণীর মলিন মুখ দেখে কিছু ঠাহর করতে পারলেন বোধহয়। ধীরে সুস্থে উঠে মীরার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। টোকা দিয়ে ডাকলেন,

-‘আমার আম্মাজান, ভেতরে আসি?’

মীরা প্রাণপ্রিয় আব্বাজানের ডাক শুনে ধরফর করে বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসলো। বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে মাথায় জড়ালো। কন্ঠস্বর উঁচু করে জবাব দিলো,

-‘অবশ্যই আব্বাজান। আসুন আসুন। বাহিরে দাঁড়িয়ে কেনো?’

শওকত রহমান দরজা খুলে ধীর পায়ে মেয়ের কাছাকাছি এলেন। পাশাপাশি বসে মীরার পানে দৃষ্টিআরোপ করলেন। মোলায়েম স্বরে বললেন,

-‘শরীর খারাপ নাকি মন?’

-‘মন।’

মীরার সহজ স্বীকারোক্তি। শওকত রহমান আরেকটু কাছ ঘেষে বসলেন। বললেন,

-‘কি করতে পারি আপনার আম্মাজানের জন্য?’

-‘কিছু করতে হবে না আব্বাজান। এখন ঠিক আছি আমি।’

-‘আলহামদুলিল্লাহ। রাতের খাবার টুকু খাবেন আমার সাথে?’

-‘ফ্রেশ হয়ে আসি?’

-‘অবশ্যই।’

-‘আপনি শুরু করেন। আমি আসছি।’

_________________

সানজিদা বেগম বসে আছেন শওকত রহমানের কক্ষে। খোশমেজাজে গল্প করছে ভাই বোন। উর্মি মামার রুমের বারান্দার গাছগুলো থেকে আগাছা পরিষ্কার করছে। খাদিজা বেগম চা নিয়ে আসলেন। পাশে বসে তিনিও বিভিন্ন বিষয়ের আলাপচারিতায় যুক্ত হলেন। এক পর্যায়ে সানজিদা বেগম বললেন,

-‘মীরার ব্যাপারে এখন কিন্তু চিন্তা করা দরকার ভাইজান।’

কথাটা শুনে খাদিজা বেগম তাকালেন স্বামীর পানে। এই বিষয়টি যে তাকেও অনেক ভাবায়। কম তো চেষ্টা করছে না। কিন্তু কোনো ভাবেই রাজী করানো যাচ্ছে না মেয়েকে। শওকত রহমান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন। অসহায় কন্ঠে বললেন,

-‘কম তো চেষ্টা করলাম না। আমার মেয়েটা যে একেবারেই নাজুক। ‘

-‘এভাবেও তো চলবে না ভাইজান। মেয়ে মানুষ, এক দিন না একদিন পরের ঘরে যেতেই হবে।’

-‘তা তো অবশ্যই। আমার নিজের ও তো কম চিন্তা হয় না। স্বস্তি পাই না আমি।’

-‘যেভাবেই হোক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এবার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। ওর অবস্থা দেখছেন আপনি? সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে।’

চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শওকত রহমান। তিনি খুব ভালো করেই জানেন মীরা ভালো নেই। ওর হৃদয় টা যে খণ্ড-বিখণ্ড। এই খণ্ড বিখণ্ড মেয়েটাকে একটু চাপ দিলেই একেবারে ভেঙ্গে পরবে। বাবা হয়ে এমন টা কিছুতে দেখতে পারবেন না তিনি।

মীরা দ্রুত মুখ চেপে ধরলো। কিছুক্ষণ আগে এসেছিলো সবার সাথে গল্প করতে। দরজায় টোকা দিবে সে মূহুর্তেই কানে আসে ফুপুর বলা কথাটুকু। তখনি থেমে যায় হাত। লুকিয়ে কারো কথা শোনার অভ্যাস নেই কিন্তু কোনো ভাবেই যেনো বাবার উত্তরটা না শুনে ফেরত আসতে পারছিলো না। মীরা চোখ বুজলো। নোনাজল গুলোকে বেরিয়ে না আসার আকুল আবেদন তার চোখে মুখে। হুরমুর করে কান্নারা গলায় হামলে পরেছে। যে কোনো সময় চিৎকার এর সহিত বেড়িয়ে আসবে। ধপা-ধপ আওয়াজ তুলে দৌড়ে গেলো নিজের কক্ষে। দরজা বন্ধ করে বসে পরলো ফ্লোরে। চিৎকার করে ভেতরের আর্তনাদ গুলো বের করে দিতে ইচ্ছা করছে। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিজেকে খোলস থেকে বেড়িয়ে আনলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে মানসপটে ভেসে উঠলো বছর তিনেক আগের কথা।

চলবে…..

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০৫

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৫

🍁
ছাদের রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসে আছে রাইফ। অফিস থেকে বাসায় না গিয়ে সোজা ছাদে চলে এসেছে সে। টানা চার দিন অফিসের কাজে ব্যাস্ত ছিলো। ঘাড় ঘুরানোর সময় বা সুযোগ কিছুই হয় নি তার। আজ কাজ শেষ করে কিছুক্ষণ সময় অবসর পেলো। অফিসেই বেশিরভাগ সময় কাটানোর ফলে এই পাঁচ দিন দেখা হয়নি মীরার সাথে। যেতে আসতে ওই একটু বারান্দায় নজর বুলিয়ে গেছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
মাগরিবের আজান হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। ভ্যাপসা গরম। শার্টের হাতা কুনুই পর্যন্ত ভাঁজ করে রাখা রাইফের। শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খুলে রেখেছে। এলোমেলো চুল গুলোকে হাতের সাহায্যে গুছিয়ে নিলো। আকাশ পানে তাকিয়ে দেখলো চাঁদ নেই আকাশে। নক্ষত্র রা আজ পুরো আকাশ ছেঁয়ে আছে। আচ্ছা, রাইফ যদি তার পাখি টাকে নক্ষত্র করে বুকে রাখে তাহলে কি সে থাকবে। নাকচ করবে নাকি কোনো জবাব ই দিবে না। লজ্জাবতী পাতার মতো কুঁকড়ে যাবে নাকি লজ্জায় লাল হবে তার গাল! মাথা নিচু করে কি নিরব থাকবে! নাকি দৌড়ে পালাবে। মুচকি হাসলো আপনমনে। সেদিন পালাতে পারলেও আর দিবে না সে পালাতে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলালো। নিজের চিন্তা ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলল।
আপন মনে শুধালো,

“আমার মীরাবতী, আমার লাজুকলতা। একবার কাছে এসো, আমার করে রেখে দিবো মন পিঞ্জিরায়।”

_______________

মীরা কিচেনে বসে খাদিজা বেগমের সাথে টুকটাক কাজ করছে আর গল্প করছে। শওকত রহমান অফিসে গেছেন। ফিরতে বিকাল হবে। বাজারের ব্যাগ থেকে মরিচের প্যাকেট বের করে মরিচ থেকে বোটা আলাদা করছে মীরা। খাদিজা বেগম তেলে মাছ ছাড়লেন। তন্মধ্যে কলিং বেল বেজে উঠলো পর পর দুবার । খাদিজা বেগম পিছু ফিরে তাকালেন। মীরাকে বললেন,

-যা তো মা, দেখ কে এসেছে?

-এই সময় কে আসলো আবার?

-বসে না থেকে গিয়ে দেখ।

মীরা মাথায় ওড়না দিয়ে দরজায় গেলো। লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলো বাহিরে সানজিদা বেগম আর উর্মি দাঁড়ানো। দ্রুত দরজার নব ঘুরিয়ে খুলে ফেলল,
ব্যাতিব্যাস্ত কন্ঠে বলল,

-‘আস সালামু আলাইকুম ফুপুজান। মাফ করবেন, আপনাকে অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করালাম।’

কথাটা বলে মীরা সানজিদা বেগমকে জড়িয়ে ধরল। এর মধ্যেই উর্মি হনহন করে ড্রয়িং রুমে গিয়ে সোফায় বসে পরেছে। সানজিদা বেগম ভাতিজিকে আলিঙ্গন করে ছেড়ে দিলেন। থুতনিতে হাত রেখে বললেন,

-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম মীরা।বেশি অস্থির হওয়ার দরকার নায়। এক মিনিট ও দাঁড়িয়ে ছিলাম না। কেমন আছিস বল?’

-‘আলহামদুলিল্লাহ ফুপু। আসেন আসেন বসেন। ঘেমে গেছেন একেবারে।’

খাদিজা বেগম কিচেন থেকে উঁকি দিয়ে দেখলেন তাদের। শাড়ির আঁচল কোমড় থেকে বের করে কাঁধে জড়িয়ে ডাইনিং এ আসলেন। সানজিদা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-‘আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো আপা?’

-‘না না, কোনো অসুবিধা হয় নি। কি করছো?’

-‘রান্না করছি আপা। ইলিশ মাছ ভাঁজছি।’

তৎক্ষনাৎ উর্মির চোখ চকচক করে উঠলো। তড়িঘড়ি করে বললো,

-‘আমার জন্য কিন্তু দুই পিস রাখবেন মামি। সাথে কাঁচা মরিচ ও ভাঁজবেন। অনেক মজা করে খাবো।’

-‘তোকে আস্ত মাছ ই ভেজে দিবো। তোরা খেলেই আমার শান্তি।’

-‘ঠিক আছে, তাহলে তাই করো।’

মীরা ট্রে হাতে ডাইনিং এ আসলো। ঠান্ডা শরবতের গ্লাস সানজিদা বেগমের দিকে এগিয়ে পাশে গিয়ে বসলো। ফুপুর কাঁধে মাথা রেখে আবদারের সুরে বলল,

-‘এবার কিন্তু অনেক দিন থাকতে হবে ফুপু। যাওয়ার নাম ও নিবেন না বলে দিলাম। তাহলে আমি অনেক কষ্ট পাবো।’

-‘থাকবো কিছুদিন।’

-‘অনেক অনেক ধন্যবাদ ফুপু।’

উর্মী তাকালো তাদের দিকে। রিমোট হাতে নিয়ে মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘গলা ধরাধরি শেষ হলে আমাকেও এক গ্লাস দে। আমিও এখানে আছি ভাই। গলাটা ফেটে যাচ্ছে।’

-‘এতো খারাপ অবস্থা তোর! তাহলে তো গ্লাসে হবে না। ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখতে হবে। যা ফ্রিজে গিয়ে শুয়ে পর। একেবারে রাতে উঠিস।’

-‘মীরুর বাচ্চা…!!’

উর্মি কপট রাগ দেখালে হেসে দিলো সবাই।

____________

থোকা থোকা সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পরেছে। পৃথিবী কিছুটা শীতল এখন। হালকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। উর্মি ফ্রিজ থেকে আঁচারের বয়ম বের করে একটা বাটিতে আঁচার নিলো। রুমে এসে মীরাকে তড়িঘড়ি করে বলতে লাগল,

-‘নে নে, চল। সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তখন আর মামু বের হতে দিবে না।’

-‘কই যাবি?’

-‘তোর মাথায়। ছাদে যাবো চল।’

-‘ছাদে কেনো?’

-‘নাচতে।ঃ

-‘এখানেই নাচ। আমি দেখি।’

-‘তোকে দেখাবো কেনো। ছাদের গিয়ে পুরা এলাকাবাসী কে দেখাবো।’

-‘যেতে পারবো না।’

-‘যাবি না?’

-‘না’

-‘মীরু?’

-‘লাভ নায় রাগ দেখিয়ে। আমি উঠছি না এখান থেকে। হাতে কি? আঁচার? দেখি দে তো।’

-‘খাইতে হলে ছাদে চল।’

-‘খাবোনা।’

উর্মি মীরার হাত ধরে টেনে তুললো। হা হুতাশ করে বলতে লাগলো,

-‘এতো ওজন কেন তোর? পুরাই একটা হাতির বাচ্চা।’

উর্মির কথা শুনে মীরার মুখ হা হয়ে গেলো। বিস্মিত কন্ঠে জবাব দিলো,

-‘আমি হাতি হলে তুই কি! আমার থেকে তোর ওজন দুই কেজি বেশি।’

-‘আমি হাতি, আর তুই হাতির বাচ্চা। হয়েছে? এবার চল না বাপ। রুমে আর কতোক্ষণ থাকা যায় এভাবে।’

মীরা এই কয়দিন একেবারেই বের হয়নি বাসা থেকে। ওর ও দমবন্ধ লাগছে রুমে বসে। মন তো চাচ্ছে ছাদে যেতে কিন্তু আবার যদি লোকটির সাথে দেখা হয় তখন। সাত পাঁচ ভাবলো। নিজেকে বুঝালো হয়তো লোকটা অফিস থেকে ফিরেনি। দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুব ই কম। চেয়ার হতে কালো ওড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে ছাদের দিকে রৌওনা হলো তারা দুজন।

___________

মাথার উপর খোলা আকাশ। মীরা আর উর্মি নীচে পা ভাঁজ করে ছাদে বসেছে। দুজনের মাঝে বাটিতে টক ঝাল মিষ্টি আমের আঁচার রাখা। চামচে নিয়ে একটু একটু করে স্বাদ গ্রহন করছে দুজন। মীরা কিছুক্ষণ কিছু ভাবলো। বলবে না বলবে না করেও স্বাভাবিক কন্ঠে উর্মীকে ডাকলো,

-‘উর্মি?’

চামচে আঁচার নিয়ে মুখে পুরে জবাব দিলো,

-‘হ্যাঁ।’

-‘আমাদের বিল্ডিং এ কি নতুন কোনো ভাড়াটিয়া এসেছে?’

-‘নাহ তো।’

-‘মনে করে দেখ।’

-‘রাজিয়া আন্টিরা আসছে। ওই যে মোজাম্মেল আঙ্গেল রা ছিলো না পাঁচ তলায়। উনারা চলে গেছে।’

-‘ফ্লাট বিক্রি করছে?’

-‘নাহ রে। ফ্লাট তো আন্টিদের ই। মোজাম্মেল আঙ্গেল রা ফুল ফ্যামেলি আমেরিকা চলে গেছে। জোবাইদা আন্টির হাসবেন্ড আর মোজাম্মেল আঙ্গেল আপন ভাই। জাহাঙ্গীর আঙ্গেল আছে না, উনি জোবেদা আন্টির হাসবেন্ড।’

-‘কতো দিন হলো চলে গেছে?’

-‘এই তো সাত আট মাস।’

-‘আগে কখনো দেখিনি উনাদের।’

-‘দেখবি কি করে রে পটল। উনারা আগে ঢাকায় থাকতো। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতো। ময়মনসিংহ আসছে তিন বছর হবে প্রায়। তাও উনাদের অন্য বাসায় ছিলো। এখানে আসছে সাত আট মাস হবে।’

-‘এতো কিছু জানলি কি করে?’

-‘অল্প অল্প জানি। বেশি জানি না। শুধু দুই তিন দিন কথা হইছিলো রাজিয়া আন্টির সাথে। তখনি এসব শুনেছি। উনি আর উনার ছেলে থাকে।’

-‘আর কেউ নায়?’

-‘নাহ। আঙ্গেল নায়। মারা গেছে নাকি কয় বছর হলো।’

-‘ওহ। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করুক।’

মীরা চুপ হলো। এতোক্ষণ উর্মী নিজ ধ্যানে খাচ্ছিলো বলে কোনো কিছুতে ধ্যান ছিলো না। যেমন যেমন প্রশ্ন করেছে তেমন ভাবেই সোজা সাপটা উত্তর দিয়েছে।টনক নড়লো উর্মীর, মীরা তো সহজে কারো কথা নিজ থেকে জিজ্ঞাসা করে না। তাহলে! ঘটনার পেছনের কাহিনী জানতে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসা করল,

-‘তুই এসব জিজ্ঞাসা করছিস কেনো?’

-‘অপরিচিত একজন কে দেখেছিলাম বিল্ডিং এ।’

-‘কাকে?’

-‘একটা ছেলে। রাইফ নাম মেবি।’

-‘ওহ রাইফ ভাইয়া। উনিই তো রাজিয়া আন্টির ছেলে। মাঝে মাঝেই দেখা হয়।’

-‘আচ্ছা?’

-‘হুম। ভালো আছে।’

এই মধ্যেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো মীরার। পাশ থেকে তুলে কানে গুজলো।

-‘আম্মা বলেন।’

-‘বাদাম আনছে তোর আব্বা। এসে নিয়ে যা।’

-‘ঠিক আছে, আসছি।’

ফোন কেটে কোলের উপর রাখলো। মীরা কিছু বলবে
তার আগেই উর্মি ভরভর করে বলল,

-‘আমি যেতে পারবো না। আজ অনেক উঠা নামা করছি। তুই গিয়ে আন।’

মীরা হতাশ হয়ে উর্মির দিকে তাকালো। উর্মি মুখ ভেংচি দিয়ে মাথা নেড়ে চূড়ান্ত ভাবে অসম্মতি জানালো। বাধ্য হয়ে মীরা উঠে দাঁড়ালো। খালি পায়েই ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গেলো সিঁড়ির দরজার কাছে। সামনে পা ফেলবে তখনি কারো উপস্থিতি টের পেলো। পাশ কেটে চলে যাওয়ার জন্য ডান দিকে সরে আসতেই সামনের জন ও সেদিকেই এলো। আবার বা দিকে সরে গেলো। এবারও সামনের জন বা পাশে একি ভাবে সরে এলো। বিরক্ত হলো মীরা। মুখ দিয়ে চ কারান্ত শব্দ উচ্চারিত হলো। মনে মনে ভাবল ‘মহাবিপদ তো!’ পরক্ষণে মীরা নিজেই স্থির হলো। নিচ থেকে মাথা তুলে উপরে তাকালো। স্তব্ধ হলো তার মুখাবয়ব। বিস্ময়ে একটু ফাঁকা হলো গোলাপি দুই ঠোঁট। সামনের সুদর্শন পুরুষটি প্যান্টের পকেটে দু হাত গুঁজে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি। চোখের পলক পরছে না একটুও। মীরা নজর এদিক সেদিক ঘুরিয়ে পাশ কেটে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাইফ ডান হাত আর ডান পা বাড়িয়ে পথ আটকে দিলো। ধীরে সুস্থে মীরার সামনে বাম পা এনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। রাগ হলো মীরার। এ কেমন বেয়াদবি! কড়া কথা শুনাবে বলে মনস্থির করল। রাইফের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তখনি ভারী গলার গমগমে শীতল কন্ঠ ভেসে এলো,

“-তোমাকে দেখে আমার শান্তি না আসা পর্যন্ত ছাড়ছি না লাজুকলতা। খুব জ্বালিয়েছো এই কয় দিন। স্থির হয়ে দাঁড়াও”

চলবে…

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০৪

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৪

🍁
মীরা থমকালো, ভড়কালো। অন্তরাত্মা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। স্তব্ধ হয়ে আছে তার মুখাবয়ব। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে দ্রুত গতিতে। অশান্ত হলো তার মন। হৃদয় মাঝে হানা দিয়েছে অজানা অনুভূতি। কি বলে গেলো লোকটি! বেশি চিন্তা করতে পারলো না। বাবার ডাকে দ্রুততার সহিত হাঁটা ধরলো সে।

___________

দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে গভীর নিদ্রায় উর্মি এবং মীরা। খোলা জানালা ভেদ করে মৃদু বাতাস আসছে। মীরার চোখে মুখে খেলা করছে কিছু ছোট বড় চুল। যেখানে বিছানার এক পাশে মীরা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সেখানে উর্মি তার একেবারেই বিপরীত। হাত পা ছড়িয়ে বিছানার অর্ধেক এর বেশি জায়গা টুকুই দখলে তার। আসরের আজান ধ্বনি আসছে পাশের মসজিদ হতে। মীরার ঘুম পাতলা হলো এবার। নড়েচড়ে পাশ ফিরল। চোখ মুখ ডলে উঠে বসলো। পিঠের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুল গুলো হাত খোঁপা করে ছোট একটা ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল। বালিশের পাশ থেকে ওড়না গলায় জড়িয়ে ফ্লোরে পা রেখে উঠে দাঁড়াতেই কোমড়ের ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে গেলো তার। হাত রাখলো কোমড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সকালের দৃশ্যপট। সে তো ভুলেই গিয়েছিলো লোকটির আচমকা কাছে এসে বলা কথাটুকু। আশ্চর্য হচ্ছে মীরা বার বার। কাথাটার মানে সে বুঝে। বোঝার মতো ম্যাচুরিটি তার এসেছে অনেক আগেই। অসভ্য লোক! বাসা থেকে আর বের হবে না এখান থেকে গেলে। মানলো সে ভুল করেছে, তাই বলে যখন তখন কথা শোনাবে নাকি। ভুল তো তার ও ছিলো। মীরার চোখ না হয় দেখে নি,তার চোখ কই ছিলো। কপালে নাকি মাথায়!এই লোককে আর কোনো ভাবেই প্রশয় দিবে না সে।

_________________

রাইফ বসে আছে দেশের সনামধন্য এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের অফিস ভবনে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনের পাঠ চুকিয়েছে তিন বছর আগে। চাকরিতে যোগদান করেছে দেড় বছর হলো। যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সহিত দ্বায়ীত্ব পালনের জন্য উর্ধতন কর্মকর্তা কর্তৃক প্রমোশনও লাভ করেছে। মোটা অংকের বেতন পায় সে। মা আর তার সংসার বেশ ভালো চলে। রাইফ হাতঘড়িতে চোখ বুলালো। সেল ফোন হাতে নিয়ে বন্ধু পল্লব কে কল দিলো। লাউড স্পিকারে রেখে চোখ রাখল ল্যাপটপের স্কিনে।। পর পর দুই বার কল দিয়ে যখন টুট টুট করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো তখনি ভাইব্রেট এ কেঁপে উঠলো ফোনটি। বৃদ্ধ আংগুলের সাহায্যে রিসিভ করে কানে ফোন ধরার সাথে সাথেই অপর পাশে হট্টগোল শোনা গেলো,

-‘রাইফ মাম্মা, কখন আসবি শালা?’

-‘কোনটা নিবি সেইটা আগে ডিসাইড কর আঙ্গেল। বোনতো নাই, দুইটা মামী আছে চল্লিশ এর উপরে। দুইজন ই দেখতে তোর ছোট দাদীর মতো। কোন মামীকে নিবি সেটা বল। তরপর না হয় আমাকে জানাস, ঢাকঢোল পিটায়ে যাবো তোকে আনতে। কোলে পিঠে মানুষ করবে।’

রাইফের উত্তর শুনে পল্লবের মুখ ছোট হয়ে গেলো। পাশে বসে থাকা রাজন আর ফাহাদ এর অট্টহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। পল্লব আফসোসের সুরে বলল,

-‘তোর বোন না থাকা টা বিরাট অপরাধের পাল্লায় পরে বুঝলি। তুই যেমন সুন্দর, তোর বোনটা না জানি কতো সুন্দর হতো রে। আফসোস আফসোস! একটা সুন্দরী মাইয়া আমারে পাইলো না।’

কলার উঁচু করে মিছেমিছি ভাব ধরলো পল্লব। রাইফ ল্যাপটপ বন্ধ করে ফাইল গুছিয়ে জবাব দিলো,

-‘থাকলে কি তোর মতো মানুষবেশি শয়তান কে বোন দিতাম রে হাঁদারাম। যারে দেখস তার উপ্রেই তো তোর দিলের লাড্ডু ফুটে।’

মুখ টা চুপসে গেলো পল্লবের। কিছু বলবে তখনি রাজন ফোন কেড়ে নিলো। তড়িঘড়ি করে বলল,

-‘আহ দোস্ত, তুই ও ওর সাথে পাগল হলি নাকি! তোর অফিসের নীচে আছি। নাম দ্রুত।’

-‘আসছি।’

ফোন কেটে দিলো রাইফ। বন্ধুরা জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে বিরাজ করে। হাসি কান্না, সুখে দুঃখে সবসময় এরা সাক্ষী থাকে। এই যে, অনার্স পড়া কালীন যখন রাইফের বাবা ইন্তেকাল করেন তখন একেবারেই ভেঙ্গে পরেছিলো মা-ছেলে। সে সময় এই বন্ধুগুলো পাশে না থাকলে ঘুড়ে দাঁড়ানো সহজ হতো না। মানসিকভাবে এরা অনেক সাপোর্ট করেছে রাইফকে। রাইফ কললিস্ট থেকে ‘আম্মা’ নামে সেভ করা নাম্বারে কল দিলো। রিসিভ হতেই বলল,

-‘আম্মা, কি করো?’

-‘ছাদ থেকে তোর কাপড় গুলা এনে ভাঁজ করছি। একেবারে শুকিয়ে ম’রম’রা হইছে। একটুও মনে ছিলো না আনতে।’

– ‘তুমি আনতে গেলা কেনো আম্মা। উঠতে কষ্ট হইছে না? আমি গিয়ে কাপড় নিয়ে একেবারে বাসায় ঢুকতাম।’

-‘কষ্ট একটু হয়েছে আব্বা। তবে এখন ঠিক আছি।’

-‘খাইছো আম্মা?’

-‘হ্যাঁ রে। তুই খাইছিস?’

-‘হ্যাঁ। আম্মা আজ আমার আসতে দেড়ি হবে। ফাহাদ রা আসছে। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যেয়ো। আমি খেয়েই ফিরবো।’

-‘তাড়াতাড়ি আসিস, ওদের কেউ আনিস পারলে। অনেক দিন হলো দেখি না। আর শোন সাবধানে থাকবি। আর গাড়ি আস্তে চালাবি।’

-‘আহ-হা আম্মা, আমি ঠিক থাকবো তোমার দোয়ায়। টেনশন করো না তো। রাখছি।’

-‘ঠিক আছে।’

রাইফ উঠে দাঁড়াল। অফিসের অনেকেই চলে গেছে, কেউ বা প্রস্তুতি নিচ্ছে। টেবিলে রাখা ওয়ালেট পকেটে ঢুকিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো বাহিরে ।

__________________

আড্ডা শেষে লং ড্রাইভে বের হয়েছিলো চারবন্ধু। মাঝে মাঝেই ঘুরতে বের হয় তারা। কোনোদিন শহরে আবার কোনো দিন শহরের বাহিরে। আজ তারা বেশ দূর পর্যন্ত গিয়েছিলো। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। বাসার সামনের টং দোকানে বসে চা খাচ্ছে দুই বন্ধু ফাহাদ আর রাইফ। ফাহাদের বাসা পাশের গলিতে। এই গলি হয়েই যেতে হয়। রাইফ বারবার নজর দিচ্ছে তিন তলার বারান্দায়। রুমে লাইট জ্বলছে এখনও। এক পলক কিংবা তার ছায়ামূর্তি ও যদি দেখা যেতো তবুও হৃদয়ের ছটফটানি কমে যেতো। যতই চেষ্টা করছে চোখে লাগাম দিতে ততই অবাধ্য হচ্ছে নজর। ফাহাদ নোটিশ করলো রাইফের বারংবার উপরে তাকানো সাথে উচাটন ভাব। রাইফের পিঠ চাপরে মুচকি হেসে শুধালো,

-কি বন্ধু, উপরে কি?

রাইফ তাকালো ফাহাদের দিকে। দু পাশে ঘাড় কাত করে গম্ভীর ভরাট কন্ঠে জবাব দিল,

-একটা পাখি। খুব মিষ্টি একটা আদুরে পাখি।

-ভাল্লাগছে?

-ভীষণ।

-আন্টিকে বলি?

-পাখিটাকে পোষ মানাই আগে।

-এতো দিন ধৈর্য ধরবি। প্রস্তাব দিলেই তোর।

-আমি যে পাখিটার সেটা তো তাকে বুঝাতে হবে।

-কিভাবে?

-তার খোলা আকাশের চেয়ে আমার এক বুক ভালোবাসা বিশাল। সেটা বুঝাতে পারলে সে একাই ধরা দিবে আমার কাছে।

-খাটনি আছে মাম্মা।

-মেহনত ছাড়া তাকে পেতেও চাই না।

-পিচলে পড়ছিস তাহলে প্রেমে?

-আমি কই পড়লাম, পড়লো তো সে।

-মানে

-বুঝতে হবে না। বাসায় যা।

-আসছি রে।

-হুম

বিল পরিশোধ করে বাইক নিয়ে গ্যারেজে আসলো। বাইক স্ট্যান্ড করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে বড় বড় পা ফেলে। তিন তলায় এসে দুই সিঁড়ি উপরে উঠে আটকে গেলো পা। যে ভাবে উঠেছিলো সেভাবেই পিছিয়ে এলো। ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ আসছে। কি মিহি সেই হাসি। কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছে প্রাণখোলা হাসির মালিক টা কে। ত্রিশ সেকেন্ড মাঝেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,
‘মীরা হাসি থামা, পরের কাহিনী তো বল। ‘

রাইফ চোখ বন্ধ করলো। বাকিটুকু শোনার প্রয়োজন নেই তার। বুকের বা পাশে হাত বুলিয়ে আপন মনে বলল,

‘আমাকে আরো এক নির্ঘুম রাত্রী উপহার দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ লাজুকলতা।’

চলবে…..

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০৩

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩

🍁
সকাল আট টা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট, বিছানায় উপুড় হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে রাইফ। মুখের একপাশ দৃশ্যমান। গতরাতে অনেক রাত করে ছাদ থেকে এসেছিলো সে। রাজিয়া বেগম ঘরে আসলেন। মেরুন রঙের পর্দা টেনে সরিয়ে দিলেন। জানালা খুলে ফেলার সাথে সাথেই রুম আলোকিত হয়ে উঠলো। বারান্দার দরজা খুলে দিয়ে তিনি বিছানার কাছে এলেন। রাইফ এর শিয়রে বসে ছেলের মাথায় আঙুল বুলিয়ে মমতা ভরা কন্ঠে ডাকলেন,

-‘রাইফ, আব্বা উঠ। অফিস যেতে হবে না? নয়টা বেজে গেলো তো।’

রাইফ কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠলো। মায়ের দিকে পাশ ফিরে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,

-‘আর পাঁচটা মিনিট ঘুমাই আম্মা। রাতে ঘুম হয় নাই। তুমি একটু মাথাটা বুলিয়ে দাও।’

-‘তোর কি শরীর খারাপ বাজান? ঘুম হয় নি কেনো রাতে?’

-‘তেমন কিছু না আম্মা। রাতে একটা লতাপাতার সাথে ধাক্কা লাগছিল। তার পর থেকেই কেমন আতলাম মা’তলাম ফিল হচ্ছে। খুব কষ্টে চোখে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমাইছি।’

-‘কি বলিস বাবা! কিসের লতাপাতা ছিলো? অনেক পাতায় কিন্তু ভাইরাস থাকে। অসুখ বিসুখ হয় নি তো আবার?’

‘হয়েই গেছে অলরেডি আম্মা। আমিতো নেশা করিনা। তাহলে এমন মা/তাল মা/তাল লেগে কেনো!’
মনের কথা মনে রেখেই রাইফ তার গালে হালকা দাড়িতে হাত বুলাল। রাজিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,

-‘নাম জানি না আম্মা, তবে দেখতে মনোমুগ্ধকর। টোকা দিলেই চুপসে যায় এমন। নাম জানলে তোমাকে জানাবো।’

-‘লজ্জাবতী গাছের কথা বলছিস নাকি?’

-‘লজ্জাবতী!!’

রাইফ এবার চোখ খুললো। মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। আবারও চোখ বুজে বালিশে মুখ গুজলো। মায়ের উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে বলল,

-‘লজ্জাবতী চুপসে গেলেও এতো সুন্দর কেনো আম্মা, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে!’

-‘হ্যাঁ? কি বললি আব্বা?’

-‘কিছু না আম্মা, তুমি যাও। আমি আসছি।’

___________________

মীরা বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টি তার খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে নীলাভ আকাশে।সিঁড়িতে পরে যাওয়ার ফলে কোমড়ে অতি তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করছে ভোর থেকে। ফজরের আজান শুনে সালাত আদায়ের জন্য যখন উঠবে তখনি কোমড়ের আচমকা ব্যাথার বিষিয়ে গিয়েছিলো মীরার মুখ। রাতে বুঝতে পারেনি এতোটা ব্যাথা সে পেয়েছে৷ বুঝতে পারলে সাথে সাথেই পেইন কিলার খেয়ে নিতো। কাল রাতের ঘটনার পর মনটাকে কিছুতেই স্থির করতে পারছে না। নিজের আহম্মকিতে মিনিটে মিনিটে নিজেই নিজেকে বকা দিচ্ছে। কিভাবে পারলো সে একজন অপরিচিত ব্যাক্তির টি-শার্ট ছিড়ে ফেলতে। কি লজ্জাজনক ব্যাপার স্যাপার। ভাবলো, আর দেখা না হোক অপরিচিত ব্যাক্তিটির সাথে। আর না কোনো কথা হোক।

ডাইনিং এ বসে সকালের নাস্তা করছেন শওকত রহমান। খাদিজা বেগম ডিম পোচ করে টেবিলে রাখলেন। শওকত রহমান মীরার উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লেন,

-‘আম্মাজান, আসেন। খাওয়া শুরু করে দিয়েছি।’

রুমের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,

-‘আসছি আব্বাজান। আপনি বিসমিল্লাহ করেন।’

মীরা খাবার রুমে এলো। কুশলাদি বিনিময় করে শওকত রহমানের পাশের চেয়ারে বসলো। দুটো পাতলা রুটি, সবজি আর ডিম পোচ নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে। ছোট ছোট রুটির টুকরো মুখে পুরে ধীরে ধীরে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে টুকটাক কথা হচ্ছে বাবা-মার সাথে। আবার নিরবতায় ছেঁয়ে যাচ্ছে। খাদিজা বেগম নিরবতা ভাঙ্গলেন। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-‘তোর ফুপু ফোন দিছিলো, তোকে যেতে বলেছে। তোর পছন্দের ঝাল পিঠা বানাইছে নাকি।’

-‘না গেলে হয় না আম্মাজান? ফুপুদের বাসায় অনেক মানুষ। উর্মির চাচা-চাচী’ ফুপুরা সবাই থাকে। আমার সংকোচ লাগে অনেক।’

খাদিজা বেগম স্বামীর পানে তাকালেন। শওকত রহমান তার বেগম কে শান্ত থাকার ইশারা করলেন।
মীরার দিকে তাকিয়ে মোলায়েম সুরে বললেন,

-‘মানুষদের সাথে মিশিতে হবে তো আম্মাজান। তারা আপনার আপনজন। আপনার ফুপু আপনাকে কতো ভালোবাসে তা কি আপনি জানেন না। আপনি গেলে সানজিদা আনেক খুশি হবে।’

-‘জানি তো। মিশতে চেষ্টা তো করছি আব্বজান। কিন্তু সবাই যেমন খোলামেলা ভাবে মিশে, আমি যে তা পারি না।’

-‘পারবেন ইনশাআল্লাহ। না গেলে আমার ছোট বোন টার মন খারাপ হবে অনেক। খাওয়া টুকু শেষ করেন। আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিসে যাবো।’

-‘ঠিক আছে’
বলে খাওয়াই মনোযোগ দিলো মীরা।

_________________

গুটিগুটি পায়ে পাশের ভবনে ফুপু সানজিদা বেগমের বাসার উদ্দেশ্যে শওকত রহমানের পেছন পেছন হাঁটছে মীরা। পরনে তার শালীন বেশভূষা। মাথায় বরাবরের মতো হালকা গোলাপি রংয়ের ওড়না পেঁচানো। মুখে নীল রংয়ের সার্জিক্যাল মাক্স। ছোট ছোট পা ফেলে এগুচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে সামনের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই নজরে এলো গত রাতের সেই পুরুষটির৷ বাইকে বসে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই। ফুল হাতা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো জুতা তে ফরমাল লুক এ একেবারে পরিপাটি লাগছে। হাতে কালো রংয়ের ঘড়ি জ্বল জ্বল করছে। মীরা শওকত রহমানের পেছনে নিজেকে আড়াল করলো । রাইফ নেমে এগিয়ে এলো। পেছনের মেয়েটিকে চিনতে তার অসুবিধা হলো না একটুও।মুচকি হেসে শওকত রহমান কে জিজ্ঞাসা করলো,

-‘আস সালামু আলাইকুম চাচা। কেমন আছেন? শরীর ভালো তো?’

-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি রাইফ বাবা। তোমার কি অবস্থা বলো?’

-‘আল্লাহর রহমতে ভালো আছি চাচা। আপনি নাকি সিঁড়ি থেকে পরে গেছিলেন? কোমড় ঠিক আছে তো আপনার?’

কথা টা বলেই রাইফ চোরা চোখে শওকত রহমানের পেছনে লুকানো মীরার দিকে তাকালো। মীরা রাইফের কথা শুনে থ মেরে গেলো৷ সুক্ষ্ণ খোঁচাটা বুঝতে মীরার এক মিনিট ও লাগলো না। লোকটাকে সে যেমন ভেবেছিলো, এখন ঠিক তার উল্টো স্বভাবের বলে মনে হচ্ছে। শওকত রহমান শুধালেন,

-‘না না বাবা। আমার তো কিছু হয় নি। ঠিক আছি আমি।’

-‘ওহ, দাড়োয়ান ব্যাটা কি উল্টা পাল্টা নিউজ দিলো বলেন তো দেখি। তাহলে বোধহয় আশেপাশের কেউ পরেছে। খাওয়া দাওয়া করে না মনে হয় ঠিক মতো বুঝলেন চাচা। নিজের কোমড় ভাঙ্গবে সাথে আশেপাশের মানুষ কেউ চিন্তায় রাখবে।’

রাইফ এর কথা শুনে মীরা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো নিচের দিকে। একের পর এক এই লোকটা কে নিয়ে ধারণা পাল্টে যাচ্ছে মূহুর্তেই। শওকত রহমান মাথা নেড়ে বললেন,

-‘হবে হয়তো। অফিস যাচ্ছো?’

-‘জ্বী। চলেন একসাথে যাই। আপনার অফিসের সামনে দিয়েই যাবো।’

-‘না না বাবা, আজ না। মীরা আম্মাজান কে ওর ফুপুর বাসায় রেখে তারপর যাবো।’

রাইফ আরেকবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মীরার দিকে।
চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে মনে মনে আওড়ালো
‘মীরা! লজ্জাবতী মীরা’

মীরা শওকত রহমানের কাছে ঘেষলো। খুবই ধীর কন্ঠে বাবাকে বলল,

-‘আব্বাজান চলেন, দেড়ি হচ্ছে।’

-‘হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি। ভালো থেকো রাইফ। বাসায় এসো।’

-‘ঠিক আছে চাচা। আস সালামু আলাইকুম।’

সালাম ফিরিয়ে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হলেন শওকত রহমান। মীরা এগোবে তখনি রাইফ একটু কাছে এলো তার। মীরা থমকে গেলো। শক্ত পোক্ত দেহের দীর্ঘাকৃতির লোকটি সরাসরি মীরার চোখে তাকিয়ে নে/শাময় ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

-‘কোমড় ভাঙ্গলো একজনের, পেইন হচ্ছে আমার। ঠিক বুকের বা পাশে।

বলেই শো করে অপর দিকে চলে গেলো রাইফ।

চলবে……

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০২

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২

🍁
রাত এগারো টা বেজে ত্রিশ মিনিট। নূরজাহান ভিলায় সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। চারিদিকে পিনপিতন নিরবতা। জেগে আছে শুধু অস্বচ্ছ মায়াবী দুটি চোখ। রাতের আঁধারে শব্দবিহিন পায়ে একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো কেউ। মুষ্ঠিবদ্ধ চাবিটা জায়গা মতো ঘুরিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ তুলে দরজাটা সর্তকার সহিত ধাক্কা দিলো। উন্মুক্ত হলো রুমের দরজা। ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ভ্যাপসা গন্ধ নাকে হুরমুর করে ঢুকে পরলো তার। অন্ধকার হাতরে লাইট ফ্যানের সুইচ অন করে দিলো মীরা। আলোকিত হলো রুম। দৃশ্যমান হলো সামনের সব কিছু। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রুমের জিনিসপত্র অবলোকন করতে থাকলো। সব আছে, সব। কিন্তু তার প্রিয় ব্যাক্তিটিই শুধু নেই৷ যার বুকে মাথা পেতে রাতের পর রাত যাপন করেছে সে। মুখ দু হাত দিয়ে ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেললো। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার বুকের বা পাশে। অশ্রুভেজা নয়নে দাঁড়ালো কাঠের তৈরি আলমিরার সামনে। ডান হাতের সাহায্যে খট করে খুলেও ফেললো। তাকে তাকে শাড়ি ভাঁজ করা। হাত দিয়ে ছুঁয়ে অনুভব করছে তার প্রিয় মানুষটিকে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে নিলো। এই সেই গন্ধ, যে গন্ধের পরশে প্রতিটি রাত ঘুমাতো সে। উপরের তাকে শাড়ির উপর আংগুল রাখলো। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আংগুল নিচে নামাতে নামাতে একটা শাড়িতে এসে থেমে গেলো। চোখ খুলে দেখলো সাদা রংয়ের একটা সুতি শাড়ি। টেনে বের করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। গায়ের উপর জড়িয়ে ধরে অপর দিকে অনুভব করছে তার দাদী নূরজাহান বেগম কে। কান্না গুলো বার বার দলা পাকিয়ে আসছে মীরার। কিন্তু সে এখন আর ভেঙ্গে পরবে না। মাসের পর মাস নিজেকে শক্ত করেছে। এখন নিজেকে সামলাতে জানে মীরা। সুইচ অফ করে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।

_______________

রুটির মতো গোল রুপালি চাঁদ তার আলো ছড়াতে ব্যাস্ত। মীরা ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। দাদীজানের মৃত্যুর পর কতো রজনী এখানে কাটিয়েছে তার হিসাব নেই। মাঝে মাঝে তো এখানেই ঘুমিয়ে যেতো। বাবা এসে ভোরে নিয়ে যেতেন। মেয়ের এহেন অবস্থা দেখে উপায়ন্তর না পেয়ে রেখে আসেন কলেজ এর হোস্টেল এ। কিন্তু যখনি বাড়িতে আসে তখনি আবার শুরু হয় মীরার পাগলামি। ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত নূরজাহান বেগমের স্নেহ আদরেই তো এতো বড় হয়েছে সে। তার অনুপস্থিতি মীরার জন্য যেনো কঠিন বাস্তবতা।

পাশ্ববর্তী লাইটের অল্প আলোতে মীরার আবয়ব আবছায়া লাগছে। শুভ্র শাড়ির আঁচল ছুয়েছে ছাদের ফ্লোর। লাল রঙের ব্লাউজ মীরার সৌন্দর্য কে আরো কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। দু হাত প্রসারিত করে ঘন পল্লবের নয়ন জোড়া বন্ধ করলো সে। মৃদু বাতাসে উড়ছে আঁচল। সময়ের পর সময় অতিবাহিত হচ্ছে, কিন্তু মীরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে। উর্ধ্ব গগনে দৃষ্টি তার। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে ধ্যান ভাংলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে সে। দ্রুত নিচে নামার জন্য সিড়ির দিকে অগ্রসর হলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। শাড়ির কুচি এক হাতে ধরে উপরে একটু উপরে তুলে নিলো। নিচে নামার জন্য দ্রুত পা ফেলে দুই-তিন ধাপ করে অতিক্রম করতে থাকলো। শওকত রহমান জানলে আজ আর রক্ষা নায়। মেয়ে যে এখনও ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি তা জানলে তিনি এবার একেবারেই মুষড়ে পরবেন। শওকত রহমানের মুখোমুখি হলে মীরা কি জবাব দিবে তার আব্বাজান কে।
দিশেহারা অবস্থা তার। সামনের কোনো কিছুর ধ্যান জ্ঞান নেই একটুও। আকস্মিক শক্তপোক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেলো, নিচে পরে যাবে ভেবে চোখ বন্ধ করে আশে পাশে যা পেলো ধরে ফেললো। কিন্তু ভাগ্য আর সহায় হলো না। ধপাস করে নীচে পরে গেলো। চোখ মুখ কুঁচকে ‘আহ’ শব্দ করে ব্যাথা টুকু হজম করে নিলো। কোমড়ে হাত রেখে ধীরে ধীরে চোখ খুললো, সামনে যা দেখতে পেলো এতে মীরার মুখে হতভম্ব আর ভয়ের সংমিশ্রণ ঘটেছে। একজন উজ্জ্বল শ্যামবর্নের সুঠাম দেহি পুরুষ বিস্ফোরণ চাহনি তে দাঁড়িয়ে আছে। চৌকস তার চেহারা। কপালে বিরক্তির সুক্ষ্ণ ভাঁজ। শক্ত পেশির হাত ফুলে ফেঁপে আছে। কালো টাউজার পরনে। নগ্ন তার বুক। চোখে মুখে গাম্ভীর্যতা। হাতে ভাংগা বালতির হ্যান্ডেল ঝুলছে শুধু। চারিদিকে ভেজা কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মীরা নির্বাক হয়ে পরখ করছে সব। শ্যাম সুন্দর পুরুষটি এগিয়ে এলো মীরার দিকে। মীরা দুরুদুরু বুকে তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি ঝুঁকে ফেলল। খাঁমচে ধরলো শাড়ির আঁচল। এই বুঝি গালে সাপটে এক চড় পরে কিংবা বজ্রপাতের মতো রাম ধমক। লোকটি হালকা ঝুঁকে মীরার চোখে চোখ রাখলো। চোয়াল শক্ত করে ক্ষিপ্রগতিতে মিরার হাত থেকে টেনে নিলো তার ছেঁড়া টি-শার্ট টি। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে মীরা লোকটির হাতের দিকে। কপালে আংগুল ঘষে বোঝার চেষ্টা করছে একটু আগে কি ঘটেছে। ত্রিশ সেকেন্ড সময় এর ব্যাবধানে যখন বুঝে গেলো তখন ঝটপট উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত মাথায় একপ্যাচ দেওয়া সাদা হিজাব টা ঠিক আছে কিনা তা ডানহাতে পরখ করে নিলো। মাথা নিচু করে মিনতি সুরে জড়ানো কন্ঠে বলল,

-‘মাফ করবেন মহাশয়, আমি খেয়াল করি নি। পরে যাচ্ছি ভেবে হাতের কাছে যা ছিলো তাই টেনে ধরেছিলাম। ওটা যে আপনার টি-শার্ট ছিলো বুঝতে পারি নি।’

উশখুস করছে মীরার মন। লোকটা কি চিৎকার চেঁচামেচি করবে নাকি আব্বাজান কে বিচার দিবে?
” ইয়া আল্লাহ, আমাকে রক্ষা করুন, আপনার বান্দা মসিবতে আপনি সহায় হন”
মনে মনে আল্লাহ কে স্মরণ করলো। নিজের উপর ও তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। কি করে এতো বড় ভুল টা করলো সে। এমন পরিস্থিতিতে যে কখোনও পরতে হয় নি তার। মীরার মনে হচ্ছে মাটির নীচে লুকাতে পারলে ভালো হতো। আগাগোড়া পরখ করে নিরবতা ছেদন করলো পুরুষটি। গলা খাঁকারি দিয়ে তার পুরুষালী গলার গমগমে কন্ঠে শুধালো,

-‘মেহেরবানী করে যদি মাথাটা একটু উপরে তুলতেন তাহলে আমার বড়ই উপকার হতো। অলরেডি তো উপকার করেই ফেলছেন, এইটুকু উপকার করে আমাকে ধন্য করেন”

মীরা নিজেকে আরো আড়ষ্ট করল। ধুকপুক করছে অন্তরাত্মা। তাকাবেনা ভেবেও ধীরে ধীরে মাথা তুললো। পিটপিট চোখে চোখ রাখলো দীর্ঘকায় পুরুষটির চোখে। কি ধারালো তার দৃষ্টি! লোকটি তার ডান হাত তুলে সামনে ধরলো। ভাঙ্গা বালতির হ্যান্ডেল দুলছে দুজনের মাঝে। বালতির ভাংগা অংশ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় গুলোর দিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইশারা করলো লোকটি। তার চোখের ইশারা এতোই তীক্ষ্ণ ছিলো যে মীরা সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে মাথা ঝুঁকে ফেললো। চোরা দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। অপরাধী লাগছে নিজেকে। কাচুমাচু করে আমতা আমতা স্বরে জবাব দিলো মীরা,

-‘আমি সত্যি বুঝতে পারিনি। আমার বেখায়ালী কাজের জন্য আমি লজ্জিত। ক্ষমা করেবেন প্লিজ। আসছি।’

কথাটুকু বলেই হন্তদন্ত পায়ে নিচে নামতে শুরু করলো। এখান থেকে পালাতে পারলেই যেনো বাঁচে।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো আবারো, হোঁচট খেলো শাড়িতে পা বেজে৷ দেয়াল ধরে সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলো। নিজের আহাম্মকি তে এবার তার সত্যি সত্যি জ্বীন পরী দের মতো হাওয়ার সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। পেছন ফিরে তাকানোর মতো সাহস হলো না তার। দ্রুত জায়গা ত্যাগ করল। লোকটি ঘুরে দাঁড়ালো, রেলিং এ হেলান দিয়ে ঘাড় কাত করে নিচে তাকালো। ধপা-ধপ পা ফেলার শব্দ আসছে। খট করে দরজা খোলার আওয়াজ করে পায়ের শব্দ হারিয়ে গেলো। আঁখিযুগল বন্ধ করলো সুঠাম দেহের শ্যাম সুন্দর পুরুষটি। ভেতরের দিকে শ্বাস টেনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুধাবন করছে মিষ্টি মেয়েলি মিঠে ঘ্রান। ধ্যান ফিরলো লোকটির। ভেজা কাপড় গুলো কাঁধে নিয়ে ছাদের দিকে অগ্রসর হলো।
গুন গুন করে গান ধরলো শ্যাম সুন্দর পুরুষ টি

“দুধে আলতা গায়ের বরন, রূপ যে কাঁচা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো, চোখ যেন পড়ে না”

মীরা ফিরে তাকালে দেখতে পেতো শক্ত গম্ভীর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি যা তার অগোচরেই রয়ে গেলো।

চলবে….

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-০১

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
সূচনা পর্ব

মধ্যরাত্রি, নিস্তব্ধ চারিদিক। একফালি চাঁদ কালো মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় যেনো মত্ত হয়েছে আজ। আলো আধাঁরির এই আয়োজন একজন খুব আগ্রহ নিয়ে দেখেই যাচ্ছে ঘন্টা দুয়েক হলো। বিছানার সাথের জানালায় হেলান দিয়ে আকাশের পানে তার ভাবলেশহীন দৃষ্টি। জোৎস্নার রুপালি আলো এসে মেখে দিচ্ছে তার মুখাবয়ব। কোমড় সমান চুল গুলো বেশ পরিপাটি করে বেণি করা। সামান্য কিছু অলস চুল মুখের সামনে খেলা করছে। হঠাৎ কারো ডাকে ধ্যান ভাংলো মীরার। ধরফর করে তাকিয়ে দেখলো তার সমবয়সী উর্মি চোখ পাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখটা কাচুমাচু করে আমতা আমতা স্বরে জিজ্ঞাসা করল মীরা,

– ‘উর্মিমালা তুই! কখন এলি?’

-‘আসা কেনো, এখানে যদি একটা হাতিও জ’বাই করা হয় সেটা কি তুই বুঝবি?’

বেশ ঝাঁঝালো স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো উর্মি। মীরার ফুপুর মেয়ে সে। মীরাদের পাশের ভবনটাই উর্মিদের।
তৎক্ষনাৎ মীরার মনে দুষ্টুমি খেলা করল, বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে জবাব দিলো,

-‘আরেহ বাহ, হাতি জ’বাই করে ফেলছিস! কান দুইটা আমাকে দিস, বাতাস খাবো। যে গরম পরছে বাবা।’

উর্মিকে আরেকটু জ্বা লাতে এতোটুকু কথায় যেনো বাকি ছিলো। উর্মি রেগে হনহনিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। শুতে যাবে তখনি মীরা বলে উঠলো,

-‘গলার মালা, যাই কর আর তাই কর, আমি কিন্তু কাল সকালে উঠতে পারবো না। খবরদার ডাকবি না সকালে। ইয়া আল্লাহ! কত্তো দিন হলো ঘুমায় না। দেখি দেখি কোল বালিশ টা দে তো।’

উর্মি যেনো আকাশ থেকে পরলো। এই মেয়ে বলে কি, যে কিনা দিনের বেশির ভাগ সময় শুয়ে, বসে, ঘুমিয়ে কাটায় সে নাকি কতো দিন হলো ঘুমায় না। আর গলার মালা, উর্মিমালা এসব কি নাম। তার নাম তো উর্মি, শুধুই উর্মি। মীরার মাথার বাকি তার টুকুও নিশ্চিত ছিড়ে গেছে ভেবে দুদিকে মাথা নেড়ে হতাশার শ্বাস ছাড়লো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো,
‘মামুজান কে বলে এর মাথার তার জোরা দিতে হবে খুব দ্রুত। কি মেয়েরে বাবা!’

________________

স্নিগ্ধ সকাল, কর্মব্যাস্ত হয়ে পরেছে বাড়ির গিন্নিরা। মশলা মাখানো রান্নার ঝাঁঝালো গন্ধে চারিদিক মুখরিত হয়েছে। কর্তা রা খবরের কাগজ হাতে চা পানে ব্যাস্ত।
পর্দা ভেদ করে সূর্যরশ্মি উঁকি দিচ্ছে। সোনালি আভা ছুঁয়ে দিচ্ছে কারোর কোমল গাল, নাক, মুখ, চোখ, গোলাপি ঠোঁট। মিনিট সময় পেরোতেই ভ্রু কুচকে গেলো মীরার। কাঁথা টেনে মুখ ঢাকলো। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

-‘আম্মা, আজকের মতো ছেড়ে দেন আম্মা। একটু ঘুমাই।’

-‘একটু করতে করতে সকাল ১০ টা বেজে গেছে। ওঠ, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করবি আয়।’

পর্দা টেনে জানালা খুলে দিয়ে খাদিজা বেগম ঘর হতে প্রস্থান করবে সেই সময় কোমল কন্ঠের গাঢ় ডাক ভেসে এলো,

-‘আম্মা’

-‘হ্যাঁ বল। কিছু লাগবে? চা আনবো?’

পেছন ফিরে তাকালো খাদিজা বেগম। গুটিগুটি পায়ে মীরার কাছে এলো। মা কে টেনে কাছে বসালো। হাত টা মুঠোয় পুরে মিনমিন করে বলল,

-‘আমি আর যাবো না আম্মা। তোমাদের ছাড়া ভালো লাগে না হলে। পরীক্ষার সময় শুধু পরীক্ষা দিবো। তুমি আব্বাকে বুঝাও। আমার সেখানে খুব শূন্য শূন্য লাগে। আমি অসুস্থ হয়ে যাই।’

-‘ ক্লাস না করলে পড়াশোনা হবে কিভাবে।আর তো একটা সেমিস্টার। কষ্ট করে থাকতে পারবি না?’

-‘পারবো না কেনো আম্মা, এতো দিন যখন পেরেছি, এখন ও পারবো। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ভেতর টা ম রে যাবে।’

-‘এভাবে কেনো বলছিস মীরা? আমরা আছি তো। আচ্ছা ঠিক আছে, তোর আব্বার সাথে কথা বলবো আমি। এবার ওঠ।’

-‘আম্মা প্লিজ।’

অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে মীরার থমথমে কন্ঠে। খাদিজা বেগম নমনীয় দৃষ্টিতে তাকালেন মীরার দিকে। মেয়ের গালে হাত রেখে শুধালেন,

-‘পাগল মেয়ে, বললাম তো তোর আব্বাকে বলবো। ভয় কিসের। আমরা থাকতে কোনো ভয় নেই। আমার মীরা ভীষণ সাহসী।’

কথার মাঝেই শওকত রহমান এর ডাক ভেসে এলো,

‘ খাদিজা, ওষুধ টা কোথায় রাখছো?’

উচ্চস্বরে ‘আসছি’ বলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন খাদিজা বেগম। হন্তদন্ত পায়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন রুম হতে। দরজার কাছাকাছি গিয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আমি গেলাম। তুই ও আয় দ্রুত’

______________

রৌদ্রজ্বল তপ্ত দুপুর। কেউ অলস ঘুমে আচ্ছন্ন, কেউবা ব্যাস্ত তার দৈনন্দিন কাজ-কর্মে। শওকত রহমান আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বই পড়ছেন। মাথার উপর ভনভন শব্দ করে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। গুটিগুটি পায়ে শওকত রহমানের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো মীরা। হালকা গোলাপি রঙের ঢোলা-ঢিলা সালোয়ার-কামিজ পরিহিত সে৷ সাদা ওড়নাটা এক প্যাঁচে মাথায় এমন ভাবে জড়িয়ে রেখেছে যে শুধু মুখ টুকু দৃশ্যমান। দু আংগুল ভাঁজ করে টোকা দিলো দরজায়। ভেতর থেকে উত্তর এলো,

-‘আমার আম্মাজান, ভেতরে আসেন।’

হৃদয় টা পরম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধায় সিক্ত হলো মীরার। এই দরজায় এসে একটা টোকাতেই শওকত রহমান কিভাবে যেনো বুঝে যায় তার একমাত্র আদরের কন্যার উপস্থিতি। মীরা কপাট ঠেলে ভেতরে পা রাখলো। মুচকি হেসে শওকত সাহেব কে সালাম জানালো তার মিষ্টি কন্ঠে,

-‘আস সালামু আলাইকুম আব্বাজান?’

-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাহতুহু। আমার কাছে দ্রুত আসেন আম্মাজান। আমার হৃদয়টাকে শীতল করেন।’

বইটা পাশ্ববর্তী টেবিলে রেখে দুহাত মেলে দিলেন তিনি। মেয়েকে বুকের বাহুডোরে আগলে রাখার আকুল আবেদন তার চোখে মুখে। মীরার নেত্রপল্লব এ জল ভীর করলো বাবার আদুরে ডাকে৷ ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে নোনাজল। গিলে ফেলতে চাচ্ছে কান্না গুলো, কিন্তু তারা কি আর এতো সহজে বাঁধা মানে। মীরা বড় বড় পা ফেলে বাবার পাশে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। মাথা রাখলো বাবার কাঁধে। আগলে নিলেন শওকত রহমান। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়। এবার আর বাঁধা মানলো না অশ্রু। ঝরঝর করে নোনাজল গুলো গাল ভিজিয়ে দিলো। ভাংগা ভাংগা কন্ঠে হেঁচকি তুলে শওকত রহমান কে শুধাল,

-‘আপনি কেমন আছেন আব্বাজান? আপনার শরীর ভালো তো?’

-‘একি, কান্না করছেন কেনো আম্মাজান! আপনি জানেন না আপনার বিষন্ন মুখ আমাকে কতো কষ্ট দেয়। আপনার ছেলে একদম ঠিক আছে। আপনি এসেছেন, আমার আর কোনো চিন্তা নাই। চোখের জল মুছে ফেলেন তো দেখি।’

-‘আপনি শুধু শুধু কেনো চিন্তা করেন আমার জন্য। আমি তো ভালো আছি আব্বাজান। কেমন শুকিয়ে গেছেন আপনি।’

– শুকাই নাই আম্মাজান। অনেক দিন পর দেখছেন বলে এমন মনে হচ্ছে। কাল আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো আপনার?

-‘না আব্বাজান। আপনাদের দোয়ায় আর আল্লাহর অশেষ রহমতে সহি-সালামতে এসেছি সন্ধ্যায়। রুমে দু চক্কর ও দিয়েছি রাতে। আপনি বাহিরে ছিলেন।’

-‘মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো আমার আম্মার? খেয়েছেন পেট ভরে? আপনার জন্য নদীর মাছ এনেছি। দুপুরে খাবো একসাথে।’

-‘ঠিক আছে আব্বাজান।’

শওকত রহমানের আরেকটু কাছ ঘেষে বসলো মীরা। আমতা আমতা করছে কথাটা বলতে। তবে না বললে মনে হয় স্বস্তি পাবে না সে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব করতে করতে মাথানিচু অবস্থায় জড়ানো কন্ঠে বলেই ফেললো সে,

-‘আব্বাজান’

-‘জ্বী।’

-‘একটা জরুরি কথা ছিলো আপনার সাথে।’

-‘হ্যাঁ বলেন।’

-‘আমি আপনার অনুমতি না নিয়েই একেবারে চলে এসেছি। আমাকে মাফ করবেন। কিন্তু আমি কি করবো বলেন। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার একা একা। আমি আর যাবো না সেখানে। আপনি প্লিজ দ্বিমত করবেন না।’

-‘আপনি কি পড়াশোনা করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?’

-‘তা না। পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিবো। কিন্তু আপনাদের ছাড়া আমি আর থাকতে পারবো না। আমাকে মাফ করবেন আব্বাজান।’

মীরার মাথাটা আরেকটু ঝুঁকে গেলো অপরাধবোধে। বুকটা উচাটন করছে, না জানি কি জবাব দেয় তার বাবা। শওকত রহমান বুঝলেন মেয়ের ভেতরের অবস্থা। মেয়ের হাত টা মুঠোয় নিয়ে বললেন,

-‘মাথা উঁচু করেন আমার প্রাণের আম্মাজান। নিচু মাথায় আমার আম্মাকে মানায় না। আমি আপনাকে আর ফোর্স করবো না। তবে হল কিন্তু ছাড়া যাবে না। পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষাটা তো দিতে হবে। আমি আপনার এমন মুখ দেখতে চাইনা আর। আমার সেই হাসিখুশি আম্মাকে দেখতে চাই। আপনার হাসিতে যে আমার প্রাণ ভরে যায়।’

মীরার আতংক গ্রস্থ মন বাবার কথা শুনে স্থির হলো। শওকত সাহেব এর হাতের উপর হাত রাখলো। নীচু স্বরে বলল,

-‘আপনাকে অনেক ভালোবাসি আব্বাজান, আমি কোনো ভুল করলে শুধরে দিবেন দয়াকরে।’

-‘আমার আম্মাজানের সব ভুল মাফ আমার দরবারে।’

বাবা-মেয়ের আলাপচারিতায় রুমে প্রবেশ করলেন খাদিজা বেগম। হাতে চা এর ট্রে। শওকত রহমান এ সময় এক কাপ চা খেয়ে গোসলে যান। টি টেবিলে রেখে মীরাকে বললেন,

-‘কিচেনে যা তো মা একটু। মাছ চুলায়, এক পিঠ ভাঁজা হলে উল্টে দিস। আমি আসছি।’

-‘ঠিক আছে আম্মা, আসি আব্বাজান।’

-‘হ্যাঁ যান, গোসল দিয়েন দ্রুত।’

-‘ঠিক আছে।’

_____________

ঝকঝকে বিকাল, মীরা ঘুম থেকে উঠে আসরের সালাত আদায় করেছে কিছুক্ষণ হলো। এখনও সে জায়নামাজে বসা। এর মাঝে রুমে হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করলো উর্মি। মীরার পাশে ধপাস করে বসে পরলো।

-‘ ছাদে যাবো চল, খুব সুন্দর বাতাস। রুমে ভ্যাপসা গরম।’

-‘কখন এলি?’

-‘এক ঘন্টা হলো। তুই ঘুমাচ্ছিস বলে ডাকি নি। তোর নামে মামুর কাছে নালিশ দিতে গিয়ে শুনলাম তুই নাকি একেবারে এসেছিস?’

মীরা অবাক নেত্রে তাকালো উর্মির দিকে৷ মনে মনে ভাবছে ‘নালিশ দেওয়ার মতো আমি কি করেছি আশ্চর্য!’ জায়নামাজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালো। মাথার হিজাব টা খুলে বিছানায় বসলো। উর্মিও পেছন পেছন বিছানায় এসে পাশাপাশি বসলো। কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,

-‘কি হলো বল? একেবারে এসেছিস?’

-‘হুম।’

ছোট্ট জবাব মীরার। উর্মি যেনো এই জবাবের ই অপেক্ষায় ছিলো। লাফিয়ে উঠলো বিছানায়। খুশিতে আত্মহারা সে। খুশি হবেই না বা কেনো। সকালে যখন মামীর কাছে শুনেছে মীরা একেবারে এসেছে তখনি মসজিদে একশত টাকা দিবে বলে মনস্থির করেছে৷ সকালের কথা মনে হতেই উর্মির মুখ চুপসে গেলো৷ এলোমেলো দৃষ্টিতে কিছু খুঁজতে লাগলো সে। ড্রেসিং টেবিলের উপর পেয়েও গেলো বস্তুটি। দৌড়ে ঝটপট হাতে নিলো পার্সব্যাগ টা। চেইন খুলে দুইশত টাকার একটা নোট নিয়ে জায়গা মতো রেখে দিলো ব্যাগটি। উর্মির কর্মকান্ডে হতভম্ব মীরা। উর্মি বোকাবোকা হেসে বলল,

-‘তুই যেনো একেবারে থেকে যাস এজন্য মানত করেছিলাম একশ টাকা। দিতে হবে তো।’

-‘আচ্ছা, তা বাকি ১০০ টাকা কিসের জন্য?’

-‘কিসের আবার। সকাল থেকে টেনশনে আমার ছোট্ট আত্মাটা শুকিয়ে গেছে। কোল্ড ড্রিংকস খেতে হবে। চল নারে ভাই, এখন উপরে চল।’

মীরা চুল গুলো হাত খোঁপা করে ওড়না টা মাথায় জড়িয়ে নিলো। স্লিপার পায়ে সিঁড়ির ধাপ গুটিগুটি পায়ে অতিক্রম করছে। কিন্তু উর্মি, সেতো খরস্রোতা নদীর মতোই চঞ্চল। স্থিরতা নেই একটুও। বড় বড় পা ফেলে দুই সিড়ি অতিক্রম করে ছয় তলা বিল্ডিং এর ছাদে ওঠা শেষ। মীরা ধীর পায়ে খুব সতর্কতার সহিত উপরে উঠলো। রেলিং এর ধারে উর্মির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হিমেল হাওয়াতে মীরার মন ফুরফুরে হয়ে গেলো মূহুর্তেই। চার মাস পর আবার সেই চিরচেনা ছাদে সে দাঁড়িয়ে। এই বিস্তৃত খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করা রমনীর ধ্যান জ্ঞান সবটাই এখন স্মৃতিচারণে ব্যাস্ত।

চলবে…