Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 386



প্রিয় অনুভব পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_৩২
—অন্তিম পর্ব

পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙলো নাহিয়ান এর। পাশে রাদিফকে দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে নিলো নাহিয়ান। পরক্ষণেই মনে পড়লো কাল তার বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে শ্বশুরবাড়ি এসে এখানে জায়গা হয়েছে তার। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। আজকে ছুটি নিয়েছে সে। নীতিকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে সে। ফ্রেশ হয়ে একেবারে রেডি হয়ে নামলো সে। ওকে দেখা মাত্রই নীতির মা বলে উঠলেন, “এসেছো বাবা, নাশতা করে নেও!”

নাহিয়ান মুচকি হেসে বসলো। পরমুহূর্তেই বর্ষা এসে নীতির মাকে জিজ্ঞেস করলো, “নীতি কি বেরিয়ে গিয়েছে?”

“হ্যাঁ, সেই কখন!”

কথাটা শোনা মাত্রই নাহিয়ান খাওয়া থামিয়ে তাকালো।

“বেরিয়ে গিয়েছে মানে?”

বর্ষার খেয়াল হলো নাহিয়ান এখানে। আমতা আমতা করে বলল, “মানে হলো..”

“নীতি কোথায় গিয়েছে?”

বর্ষা মিন মিনে গলায় বললো, “আপনার বাড়ি!”

“আমাকে রেখেই?”

বর্ষা বলার কিছু পেলো না! নাহিয়ান চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলো। অতঃপর জোহরাকে বললো, “আমি আসি মা!”

তিনি যেনো চমকালেন।

“যাবে মানে কি? তোমার না আজকে ছুটি? থাকো, পরে যেও!”

“না আন্টি, অফিসে কাজ আছে। যেতে হবে!”

বলে তাকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। ওদের কিছু বলার সুযোগ দিলো না। বর্ষা চট জলদি নীতিকে ফোন করলো।

“নীতিরে, তোর জামাই বেরিয়ে গিয়েছে। বলে অফিসে কাজ আছে। আমাদের আটকানোর সুযোগও দেয় নি!”

“ইডিয়েট!”

বলেই কেটে দিল নীতি। রীতিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোমার বন্ধু আসতেছে। সব লুকাও।”

কথাটা শোনা মাত্রই যেনো সবাই যতটা জলদি কাজ করছিলো, তার থেকেও বেশি জলদি করে সবটা লুকাতে লাগলো। শোন লুকানো শেষে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে লাগলো। বেশ অনেকক্ষন পর নাহিয়ান এলো। কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজে রুমে গেলো। নীতি ভরকে গেল। সে তো কারো দিকে তাকালো না!

“তোমার দেওর মেবি রেগে আছে আপু! দেখে আসি!”

“আচ্ছা যা!”

নীতি রুমে গেলো। নাহিয়ানকে পেলো না। হয়তো ওয়াশরুমে। নীতি কিছুক্ষণ পায়চারি করতেই নাহিয়ান বেরিয়ে এলো। তাকে ফরমাল লুকে দেখে নীতি ভ্রু কুঁচকে নিলো।

“কোথায় যাচ্ছেন?”

নাহিয়ান ওর দিকে তাকালো। তবে উত্তর না দিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে চুল ব্রাশ করতে লাগলো।

“আজকে তো ছুটি নিয়েছেন তাই না?”

নাহিয়ান এবারও উত্তর দিলো না। টাই বাঁধতে লাগলো। নীতি ওর টাইয়ে হাত দিতে গেলেই নাহিয়ান বাঁধা দিয়ে বললো, “প্রয়োজন নেই!”

“বউয়ের হাতে টাই না বেঁধে বউকে অপমান করছে।”

নাহিয়ান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, “আর বউ তার বরকে তার বাড়ির লোকের সামনে যেই অপমান করেছে, সেটা?”

“আমি আপনাকে অপমান কখন করলাম?”

“আমি গিয়েছিলাম ওখানে তোমার জন্য। একসাথেই ফিরতে পারতাম আমরা। কিন্তু তোমার রাগ এত, যে তুমি না বলে কয়ে আমাকে ফেলেই চলে আসলে।”

টাই বাঁধা শেষে নাহিয়ান ওর দিকে তাকালো।

“ওটা আমার শ্বশুর বাড়ি! সেখানে এত মানুষ, সবাই কি ভেবেছে বলতে পারো? আমার নিজেকে কতটা ছোট লেগেছে, জানো? অথচ এরকম ভাবে চলে আসার কারণ কিন্তু অনেক সামান্য ছিল!”

“আপনি ভুল বুঝছেন!”

নাহিয়ান কিছু না বলে বেরিয়ে যেতে নিলেই নীতি ওর হাত ধরে আটকালো। নাহিয়ান তাকাতেই বললো, “আপনি ভুল বুঝছেন নাহিয়ান। একটু অপেক্ষা অন্তত করুন। ও বাড়ির কেউ আপনাকে নিয়ে কিছু ভাবেনি!”

নাহিয়ান মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললো, “কেউ কিছু ভাবেনি এটা হয়তো আমিও জানি। কারণ মানুষগুলো ভালো, তবে তুমি উপলব্ধিও করতে পারছো না আমাকে কতটা আঘাত করেছো!”

বলেই হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। নীতি ছলছল চোখে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। ও তো এতসব ভেবে কিছু করেনি!

__________________________________ বাজারের ব্যাগ হাতে ফিরছে তূর্ণা। এসব যদিও ওর কাজ না, তবুও বড় হয়েছে। এসব একটু শিখে রাখা দরকার। তাই মাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে এসেছে সে। আগের মতো আর নেই কিছুই তার মধ্যে। বোকাসোকা মেয়েটা এখন আর আগের মতো বোকামি করে না। বাস্তবতাকে ভীষণভাবে উপলব্ধি করে সে।

“তূর্ণা!”

সেই চেনা পরিচিত কণ্ঠ শুনে থমকে দাঁড়ালো তূর্ণা। কতগুলো মাস কথা হয় নি এই মানুষটার সাথে, তবুও কন্ঠটা এখনও চিনতে পরে সে। আরহাম ওর পাশে এসে দাঁড়ালো।

“তুমি এখানে যে?”

“বাজারে এসেছিলাম। বাড়ি ফিরছি!”

“ওহ, রিকশায় যাবে?”

তূর্ণা মাথা নাড়লো। যদিও রিকশায় যেতো না সে। কিন্তু আরহামের কাছাকাছি থাকার ইচ্ছে নেই তার। দূরে যেতে পারলেই বাঁচে।

“আচ্ছা চলো, তাহলে একসাথে যাওয়া যাক!”

তূর্ণা চমকে উঠে বললো, “একসাথে মানে?”

“তোমাদের বাড়িতে আমার মা আছেন। তাই আমাকেও যেতে হবে তাকে আনতে! এখানে এসেছিলাম মিষ্টি কিনতে। আর তোমার দেখা পেয়ে গেলাম। দাঁড়াও, রিকশা ডাকি!”

“না, প্রয়োজন নেই! হেঁটেই চলুন!”

“কেনো?”

“এমনি!”

বিড়বিড় করে বললো, “রিকশায় জড়তা নিয়ে বসার চেয়ে হাঁটা ভালো!”

“ওকে, চলো!”

অতঃপর হাঁটতে শুরু করলো দুইজন।

“পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“ভালোই!”

“আগের মতো ক্রাশের সাথে বিয়ের স্বপ্ন নিয়ে আছো নাকি? ক্রাশ কত হলো এবার?”

হাসলো তূর্ণা।

“শেষ বার যার হাসিতে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তার মায়া কাটিয়ে উঠতে পারি নি। তাই নতুন কেউ আসেওনি!”

আরহাম চুপ রইলো। তূর্ণা জানতো ওর প্রসঙ্গ উঠলেই ও চুপ করে যাবে। আর সেটাই চাইছিলো সে। অনেক কষ্টে সামলে উঠেছে সে। আবার দুর্বল হতে চায় না!

“ভালোবাসো তাকে এখনও?”

তূর্ণা চমকালো। তবুও স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “এসব জিজ্ঞেস করে আদো কি লাভ আছে?”

“যদি বলি আছে!”

“কি লাভ?”

আরহাম চুপ রইলো।

“লাভ পাচ্ছেন না, তাই তো?”

আরহাম তবুও চুপ!

“আমি মেনে নিয়েছি সব ভাইয়া। ভালোবাসা একটা সুন্দর অনুভূতি। কাউকে জোর করে সেই অনুভূতি কারো প্রতি আনা যায় না! আমার মনে হয় আপনি গিলটি ফিল করছেন আজও। আপনি যে কথা দিয়েছিলেন। তবুও আমি বলছি এই নিয়ে কোনো কথা মনে রাখবেন না। আমার আপনার উপর কোনো ক্ষোভ নেই!”

আরহাম দাঁড়ালো। তূর্ণার হাত ধরে ওকেও থামিয়ে দিলো। তূর্ণা ওর দিকে তাকাতেই সে চোখে চোখ রেখে বললো, “ভালোবাসি!”

দ্বিগুণ চমকে উঠলো তূর্ণা। আরহাম আবারও বললো,

“শুরু থেকেই করতাম। কিন্তু তোমার লাইফে ছেলেরা ছিলো অন্যরকম। আজ এর পিছু তো কাল ওর পিছু ঘোরা মেয়েটিকে দেখে বুঝলাম সে আমায় কোনোদিনও বুঝবে না। আর না ভালোবাসবে, তাই তোমার সাথে কথা বলতাম না আমি। কিন্তু ভাগ্যের কারণে সেই তোমার কাছেই আসতে হয়েছে আমায়। তুমি যেদিন প্রথম বলেছিলে আমায় চাও, তখনও ভেবেছি আমাকেও অন্য ছেলেদের মতোই ট্রিট করতে চাচ্ছো। বলেও ছিলে আমি তোমার ক্রাশ! তাই…”

থামলো আরহাম। আবার বললো,

“এরপর শর্ত দিলাম। আমি ভাবতাম তুমি অতটাও সিরিয়াস হবে না। কিন্তু ধারণা ভুল। তোমার পরিবর্তন, আমাকে পাওয়ার আকুলতা সব বুঝেছি আমি। তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়! তাই সেদিন তোমার বলা কঠিন কঠিন কথার প্রেক্ষিতে কিছুই বলিনি আমি। এই এতগুলো মাস আমি তোমায় পরখ করেছি তূর্ণা। ভালোবাসা খুব সেনসিটিভ জিনিস। সহজে এর থেকে মুক্তি মেলে না। সব শেষে বুঝলাম, তুমি সম্পূর্ন আমার মনের মতো! আমি চাই না তোমায় হারাতে!”

তূর্ণা বলার মতো অবস্থায় রইলো না। থমকে আছে সে! তার মনে প্রশ্ন জাগছে, আচ্ছা এটা সত্যি তো?

“তূর্ণা?”

“মজা করছেন?”

আরহাম হতাশ!

“এত কষ্ট করে এতগুলো কথা আমি মজা করে বলবো?”

“তাও ঠিক!”

অতঃপর ঠোঁট চেপে হেসে বললো, “তাহলে আমার ক্রাশের সাথে সংসারের ইচ্ছে পূরণ হতে যাচ্ছে?”

আরহাম চোখ বড় বড় করে তাকালো। তাই দেখে ফিক করে হেসে দিলো তূর্ণা!

__________________________________

রাত সাড়ে এগারোটা। নিজের ডেস্কে এখনও বসে আছে নাহিয়ান। বাড়ি যায়নি সে। মূলত নীতির উপর রাগ করেই যায়নি! অন্যদের সাথে ওভারটাইম করছে সে। যদিও ওভারটাইমের জন্য ওকে কেউ জোর করেনি, তবুও সে করছে। কিছুক্ষণ পর এক স্টাফ এসে খবর দিলো, “স্যার, ম্যাম এসেছেন!”

নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কোন ম্যাম?”

“আপনার ওয়াইফ!”

নাহিয়ান চমকালো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট হচ্ছে। সে জলদি করে নীতির কাছে গেলো। বাইরে যেতেই দেখলো কালো রঙের সিল্কের শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে নীতি। এই ঠান্ডায়ও গায়ে কোনো গরম কাপড় নেই। নাহিয়ান বুঝে পেলো না হঠাৎ এত সাজগোজ কেনো?

“এখানে কি করছো?”

নীতি নাহিয়ানের দিকে তাকাতেই নাহিয়ানের বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। নীতির চোখে পানি।

“বাড়ি ফিরছেন না কেনো?”

“আশ্চর্য, আমার কাজ শেষ না করে আমি বাড়ি ফিরবো কি করে?”

“আপনার কলিগ টুম্পাকে কল করেছিলাম। সে বলেছে আপনি নিজেই ওভারটাইম করছেন!”

“টুম্পার নাম্বার…”

“আমাদের বিয়েতে এসেছিলো, তখন ভাব জমেছিলো। আর নাম্বার নিয়েছিলাম!”

নাহিয়ান চুপ করে রইলো।

“বাড়ি চলুন!”

“আমার দেরি হবে, চলে যাও!”

“বেশ, তবে শেষ করুন। আমি রইলাম এখানে!”

নাহিয়ান ওর দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে ভিতরে চলে গেলো আবার। নীতি চোখের কোণে থাকা পানিটুকু মুছে নিলো। মিনিট খানেক বাদে নাহিয়ান আসলো। ওকে দেখে হাসলো নীতি। অতঃপর দুইজন বাড়ি ফিরলো।

__________________________________

বারোটা বেজে পঁচিশ মিনিট। নাহিয়ান বাড়িতে ঢোকা মাত্রই চমকে উঠলো। বসার ঘরে রীতি, প্রীতি, বর্ষা, রাদিফ, আনাফ, শাফিন, তূর্ণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো খানিকটা সাজানো। নীতির দিকে তাকাতেই সে মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকলো। রীতির কাছে গিয়ে ওকে ডাকলো!

“আপু!”

বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর উঠলো সে। কোনো মতে চোখ খুলে আদো আদো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তোর বর এসেছে?”

নীতি ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “হুমম!”

রীতি চিল্লিয়ে বললো, “আজকে কই ম’রছিলো ওই হারামী?”

ওর চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। শাফিন ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো, “আজকে এত লেট কেন ভাই? কখন থেকে অপেক্ষা করেছি!”

নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “হঠাৎ অপেক্ষা করতে গেলে কেনো?”

তূর্ণা মাঝে বলে উঠলো, “হ্যাপি বার্থডে ভাইয়া। আমি ঘুমালাম!”

রীতি বিরক্ত হয়ে বলল, “বাসি বার্থডে হবে।”

নাহিয়ান হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রীতি ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “আর দিন তো টাইমেই চলে আসিস! আজকে কি হলো?”

“কেকটা কেটে ঘুমিয়ে পড়ো সবাই।”

“এ ছাড়া আর উপায় কি? আজকেই তোর এত কাজ থাকতে হলো? নীতি কত পরিকল্পনা করে তোর বার্থডে প্ল্যান করলো।”

“হুমম, নীতি বলেছিলো আপনাকে ও বাড়িতে আটকে রাখবো আমরা। আর সেই ফাঁকে ও এদিকে সব সাজিয়ে ফেলবে। তারপর টাইম মতো আপনাকে ছাড়া হবে। সাথে আমরাও আসবো! কিন্তু মাঝে আপনার কাজ পড়ে যাওয়ায় সব ঘেঁটে গেলো। আর শেষে সব বৃথা!”

বর্ষার কথার প্রেক্ষিতে তূর্ণা বললো, “তোমার বার্থডে তো কখনো সেলিব্রেট হয়নি। তাই আমরা সবাই কত এক্সসাইটেড ছিলাম। নীতি ভাবীর সব কষ্ট বৃথা!”

নীতি মুচকি হেসে বললো, “বৃথা কে বললো? ফ্রিজ থেকে কেক বের করো। তারপর খাওয়া দেওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়।”

কেউ আর কিছু বললো না। নাহিয়ান চুপচাপ নীতির দিকে তাকিয়ে আছে। ইশ, মেয়েটা কত আশা নিয়ে সবটা করেছিলো। আর ও? অতঃপর কেক কাটা শেষে সবাই খেয়ে দেয়ে ঘুমোতে চলে গেলো। নাহিয়ান ফ্রেশ হয়ে নিলো। রুমে নীতিকে পেলো না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাইরে উকি দিয়ে দেখলো লাইট সব বন্ধ! নীতি কোথায়? বারান্দার কথা মাথায় আসতেই সেখানে গেলো। আর তাকে সেখানেই পেলো। উদাসমনে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। নাহিয়ান পিছ থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।

“সরি বউ!”

নীতি উত্তর দিল না।

“সরি, সরি, সরি! আর কখনো এমন হবে না বউ!”

নীতি তবুও চুপ।

“আচ্ছা, আমাকে শাস্তি দেও। কান ধরে উঠবস করবো? করছি দাঁড়াও!”

বলেই ওকে ছেড়ে এক, দুই, তিন বলে কান ধরে উঠবস করতে লাগলো। নীতি এবার ওর দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বলল, “দাঁড়ান।”

নাহিয়ান কান ধরেই দাঁড়ালো। নীতি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। নাহিয়ান ওর মাথায় হাত রাখতেই ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো সে। নাহিয়ানের বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। অস্থির হয়ে বললো, “প্রিয়, প্লিজ সরি! তোমার যা শাস্তি দেয়ার দেও, তাও কেঁদো না। আমি খারাপ, খুব খারাপ! সরি বউ! প্লিজ!”

নীতি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো, “রাগ করে দরকার পড়লে অনেক বকবেন, কিন্তু কখনো এভাবে দূরে সরে যাবেন না প্লিজ! আমার কষ্ট হয়! আর কখনো এমন রাগ করবেন না। আমি সইতে পারবো না।”

বলেই নীরবে চোখের পানি ফেললো।

“আ’ম সরি প্রিয়! আর কখনো এমন হবে না। কখনো না, সরি!”

নীতি একটু স্বাভাবিক হলো। তবুও সেভাবেই থেকে বললো, “হ্যাপি বাসি বার্থডে!”

নাহিয়ান হাসলো। ওর মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বললো, “ভালোবাসো খুব, তাই না প্রিয়?”

“হুমম, অনেক!”

“আমি কখনো ছেড়ে গেলে কি করবে প্রিয়?”

নীতি চুপ করে রইলো।

“প্রিয়!”

“ছেড়ে গেলে বেচেঁ হয়তো থাকবো, কিন্তু ভিতর থেকে ম’রে যাবো!”

“ভালোবাসি প্রিয়!”

“ভালোবাসি অনুভব!”

অতঃপর নীরবতা রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর নীতি সরে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বললো, “নিন, এবার উঠবস শুরু করুন!”

নাহিয়ান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো, “কি?”

“শাস্তি দিতে বললেন না? শাস্তি! করেন করেন!”

নাহিয়ান অসহায় মুখ করে তাকালো। নীতি হাসলো!

“ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। শুরু করুন!”

নাহিয়ান উপায় না পেয়ে উঠবস করতে লাগলো। কোন দুঃখে যে শাস্তি, শাস্তি করছিলো। নীতি ওর আড়ালে হাসলো। বারান্দা দিকে বাইরে আকাশের দিকে তাকালো। বাতাস বইছে মিহি। নিরবতায় ঘিরে আছে চারপাশটা। এর মাঝে কেবল নাহিয়ানের কাউন্টিং শোনা যাচ্ছে। হাসলো নীতি। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, “সবটা যেনো এমনই চলে। খুনসুটি, মান-অভিমান সব কিছুর পরেও যেনো এই ভালোবাসা না কমে। প্রিয় আর অনুভবের সম্পর্কটা যেমন এভাবেই রয়ে যায়!”

নীতি নাহিয়ানের দিকে তাকালো। নাহিয়ান দাঁড়াতেই আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বেশ জোড়েই বললো, “ভালোবাসি প্রিয়র অনুভব!”

নাহিয়ান প্রথমে ভরকে গেলেও পরক্ষণে হেসে বললো, “ভালোবাসি টু অনুভবের প্রিয়!”

অতঃপর আবারও নিরবতা। কেবল দুই মানব মানবীর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মৃদু বাতাসও যেনো কানে এসে জপে চলেছে, ‘প্রিয় অনুভব!’

রইলো গেঁথে এক ভালোবাসার কথন। না দেখে, না ছুঁয়ে সেই ভালোবাসার নাম ছিল ‘প্রিয় অনুভব’। সবার ভাগ্যে এই ভালোবাসাটুকু থাকে না। অতঃপর এভাবেই চলতে থাকলো তাদের দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক!

“মনকুঠিরে তুমি আছো,
আছো মনোভাবে..
অনভূতিগুলো সামলে রেখো,
তোমার প্রিয় অনুভবে!”

~সমাপ্ত

প্রিয় অনুভব পর্ব-৩০+৩১

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_৩০

চুড়ির রিনঝিন শব্দের সাথে কারো বিরবির করে কথা বলার আওয়াজ শুনে ঘুম হালকা হলো নাহিয়ানের। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে সে। বিছানা হাতড়ে নিজের ফোন বের করে টাইম দেখে নিলো সে। আটটা বাজতে চললো কেবল। আধো আধো চোখ খুলে শব্দের উৎসের দিকে তাকালো সে। গোলাপী রঙা শাড়ি, আর হাতে গোলাপী কাচের চুড়ি পরিহিত রমণীকে সেভাবেই পর্যবেক্ষণ করে নিলো সে। চুলগুলো এক পাশে এনে শাড়ীর কুচি দেয়ার চেষ্টা করছে সে। মাথা ঝুঁকে থাকার কারণে সামনের ছোট ছোট চুলগুলো মুখে এসে পড়ছে তার। সে বিরক্ত নিয়ে সেগুলোকে সরিয়ে দিয়ে আবারও কুচি ঠিক করতে লাগলো। আরেকটু নজর যেতেই নীতির পেটের দিকে নজর পড়লো তার। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিলো সে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো, “সকাল সকাল আমার ঘুম নষ্ট কেন করছো বউ?”

নাহিয়ানের কথা শুনে ওর দিকে তাকালো নীতি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কিভাবে আপনার ঘুম নষ্ট করলাম?”

“এইযে কখন থেকে বিড়বিড় করেই যাচ্ছো!”

নীতি অসহায়ের মতো মুখ করে বললো, “শাড়ীর কুচি দিতে পারছি না?”

“পারছো না, নাকি চাইছো না?”

“মানে এই যে তুমি চাইছো আমি এসে তোমায় শাড়ী পড়িয়ে দেই?”

“এমন চাইবো কেন শুনি?”

“চাইতেই পারো। মেয়েরা সাধারণত জামাইয়ের হাতে শাড়ী পড়বে বলেই শাড়ী পড়া শিখে না!”

“ফালতু কথা বলবেন না তো! বাড়িতে সবাই আমার কাছেই এসে শাড়ী পড়ে! আমি এক্সপার্ট শাড়ী পড়ানোতে আর পড়তে!”

“তো এখন কি হলো?”

নীতি ঠোঁট উল্টে বললো, “প্রথমবার বিয়ে করেছি তো, নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি! আর নার্ভাসনেস থেকেই শাড়ী পড়াতে মন দিতে পারছি না!”

নাহিয়ান ঝট করে চোখ খুললো। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে বললো, “প্রথমবার বিয়ে করেছো মানে কি?”

নাহিয়ানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীতি।

“আপনার কি মনে হয় আমি এর আগে আরো বিয়ে করেছি?”

“সেটা কেনো মনে হবে? তুমি বলছো প্রথমবার বিয়ে করেছো, তো বিয়ে মানুষ কয়বার করে?”

“হাজারবার করে, আপনার সমস্যা?”

নাহিয়ান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই মুচকি হেসে বিছানা থেকে নামলো সে। সঙ্গে সঙ্গে নীতি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নাহিয়ান হতভম্ব হলো আবারও। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো?”

“আব.. কিছু না!”

নীতির কাছে গেলো সে। ওকে নিজের দিকে ফেরালো। নীতি চোখ বন্ধ করে আছে। নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “চোখ বন্ধ করে আছো কেনো?”

“কেউ যদি তার উন্মুক্ত বুক এভাবে প্রদর্শন করে, তাহলে তার লজ্জা না লাগলেও আমার লাগে!”

নাহিয়ান নিজের দিকে তাকালো। ট্রাউজার পড়ে আছে কেবল সে! বুকে হাত গুঁজে বললো, “সিরিয়াসলি?”

“কি সিরিয়াসলি?”

নাহিয়ান নীতির দিকে ঝুকলো। মিহি কণ্ঠে বলল, “আই থিঙ্ক তুমি নিশ্চয়ই চাইছো না আমি রাতের কথা মনে করাই তোমাকে?”

সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুললো নীতি। নাহিয়ান বাঁকা হাসলো। নীতির মনে হলো ওর কান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে লজ্জা লুকানোর চেষ্টা করলো। ওর চেষ্টা দেখে মুচকি হাসলো নাহিয়ান। অতঃপর তার শাড়ীর কুচি গুছিয়ে দিতে দিতে জানতে চাইলো, “আপনার কতবার করার ইচ্ছে আছে ম্যাম?”

নীতি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিলো,

“আপাতত একবারের বিয়ে সামলে নেই। পরে ভেবে দেখবো!”

নাহিয়ান হাসলো।

“আমার তো চারবার বিয়ে করার বিয়ে করার ইচ্ছে আছে!”

নীতি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলো, “চারবার কেনো?”

“কারণ আমরা চার বিয়ে করতেই পারি!”

“সেটা অবশ্য তখন হবে যখন আমি চাইবো!”

“তুমি না চাইলেও হবে।”

নীতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। নাহিয়ান কুচি গুঁজে দিয়ে ওকে নিজের একটু কাছে এনে বললো, “এখন নীতিকে বিয়ে করেছি, এরপর প্রিয়কে করবো, তারপর শুভ্রময়ীকে করবো। আর সবশেষে আমার বাবুর আম্মুকে করবো!”

হাসলো নীতি। নাহিয়ানের গলা জড়িয়ে বললো, “বললেই পারেন চারবার আমাকেই বিয়ে করবেন!”

“তুমি ছাড়া আমার কে আছে বলো সুন্দরী!”

“হয়েছে, হয়েছে! ফ্রেশ হয়ে আসুন!”

নাহিয়ান কিছু না বলে নীতির কোমর জড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।

“কি হলো?”

“আমার বউ!”

ফিক করে হেসে দিলো নীতি।

“তো কি পরের বউ হবো নাকি?”

“পরের বউ হতে দিতাম নাকি?”

“হুমম, বুঝেছি! এখন যান!”

নাহিয়ান আর কথা বাড়ালো না। মৃদু হেসে নীতির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললো, “শুভ সকাল বউ!”

নীতিও মিষ্টি করে হেসে বললো, “শুভ সকাল!”

__________________________________

ফোন হাতে নিয়ে ননস্টপ পায়চারি করছে তূর্ণা। আর তিন ঘণ্টা পর ওর এইচ এস সি রেজাল্ট দিবে। টেনশন হচ্ছে তার। হুট করেই মনে পড়লো, আগেরবার রেজাল্টের সময় কত চিল করেছিলো। আর এখন?

“টেনশন হচ্ছে?”

মায়ের কথায় মাথা নাড়লো তূর্ণা। তিনি হাসলেন! মেয়েটা এখন তার আর আগের মতো নেই। নিজের জীবন নিয়ে এখন সে যথেষ্ট সচেতন। এইজন্য আরহামকে কতবার যে ধন্যবাদ দিলেন।

“এখনও অনেক সময় বাকি আছে। চিন্তা করিস না, তোর রেজাল্ট খুব ভালো হবে। এক কাজ কর, নীতির কাছে যা! ও এখন নতুন মানুষ, গল্প করলে ভালো লাগবে!”

তুর্ণা মানা করতে গিয়েও করলো না। নীতির সাথে কথা আছে তার। দেরী করলো না সে, ছুটলো নীতির কাছে।

__________________________________বিছানায় বসে ফোন দেখছে নাহিয়ান। আর নীতি ঘর জুড়ে হাঁটছে। নিচে তার কোনো কাজ নেই। নেই বলতে তাকে কেউ আপাতত নিচে থাকতে দিচ্ছে না। এদিকে নাহিয়ানও ফোনে ডুবে আছে। নীতির মন চাইলো ফোন নিয়ে আছার দিতে। পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করতে হাঁটছে সে। বিরক্ত লাগছে তার। নাহিয়ান বুঝতে পেরেও কিছু বলছে না, নীতিকে জ্বালিয়ে মজা পাচ্ছে সে! নীতি এবার নিজের ফোন হাতে নিলো। ঝট করে কল লাগালো বর্ষার নাম্বারে। বর্ষা তখনও ঘুমে। ঘুমের ঘোরেই ফোন রিসিভ করে বললো, “হ্যালো!”

নীতির রাগ সব গিয়ে পড়লো বর্ষার উপর!

“ম’রার মটনঘুমাচ্ছিস কেন? বেস্ট ফ্রেন্ড এর বিয়ে হয়েছে, কোথায় ফোন দিয়ে বলবি বাসরের গল্প শোনাতে, তা না করে তুই ঘুমাচ্ছিস? কেমন বেস্ট ফ্রেন্ড তুই?”

নীতির কথা শুনে ঘুম উড়ে গেলো বর্ষার। পরক্ষণেই ফোন সামনে এনে দেখে নিলো এটা নীতির নাম্বার কিনা! এদিকে নাহিয়ানের কাশি উঠে গিয়েছে।

“বইন, বিয়ে করে কি তোর মাথা গেলো নাকি?”

“মাথা কেন যাবে?”

“না মানে তুই নিজে বলছিস এসব জিজ্ঞেস করতে?”

“আজব, জিজ্ঞেস করবি না কেনো? সারাদিন ফোন গুতালে জিজ্ঞেস করবি কি করে? আমার দিকে নজর আছে তোর? আমি যে বোর হচ্ছি! ফোনের মাঝে ডুবে ম’র!”

বর্ষা ব্যাক্কল হয়ে গেলো। এ কি বলছে? ফোন কখন ধরলো সে? এদিকে নাহিয়ান কাশি থামিয়ে এখন ঠোঁট চেপে হাসছে। নীতি যে তাকেই এসব বলে যাচ্ছে তার তা বুঝতে বাকি নেই।

“বান্ধবী, কি হয়েছে তোর? পা’গল হলি?”

“তুই পা’গল, তোর জামাই পা’গল! ফোন রাখ, সক্কাল সক্কাল ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করে, যত্তসব!”

বর্ষা ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই পাশে ঘুমন্ত রাদিফের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে বললো, “কি নিশ্চিন্তে ঘুমায় দেখো! এদিকে তার বোন আমার ঘুম নষ্ট করলো। আশ্চর্য, আমি কখন ফোন দিলাম ওকে? ধুর!”

বলেই আবার শুয়ে পড়লো সে।

নাহিয়ান ফোনের দিকে তাকিয়েই বললো, “রাগ ঝাড়া শেষ ম্যাম!”

“আমার দিকে তাকানো লাগবে না আপনার! ফোনই দেখেন। ঐটাই আপনার বউ!”

“হুমম, আমারই বউ!”

বলেই ফোন ওর দিকে ঘুরালো। স্ক্রিনে নিজেদের বিয়ের ছবি দেখে চোখ ছোট করে তাকালো সে।

”আপনি এগুলো দেখছিলেন বসে বসে?”

“হুমম!”

“আমিও দেখবো!”

নাহিয়ান হাসলো। নীতি বসে বসে ছবি দেখতে লাগলো।

“একেকটা ছবি কি সুন্দর হয়েছে! দেখুন এই ছবিতে বেশি ভালো লাগছে আমাদের!”

“আমি সুদর্শন মানুষ, আমাকে তো ভালো লাগবেই!”

“তাই নাকি?”

“অবশ্যই তাই, তবে…”

“তবে?”

“পাশে থাকা রমণীটা আরো বেশি সুন্দর!”

“তা যা বলেছেন!”

নাহিয়ান আলতো করে নীতিকে পিছ থেকে জড়িয়ে ধরলো, ওর কাঁধে নিজের থুতনী রেখে বললো, “মুহূর্তগুলো সুন্দর না নীতি?”

“যেই মুহূর্তে আপনি আমার সাথে আছেন, সেই মুহূর্ত কি সুন্দর না হয়ে পারে?”

“আমার কথা বলছো কেনো?”

“আপনার কথা হোক বা আমার কথা! একই তো!”

“দরজা অন্তত চাপিয়ে নেয়ার প্রয়োজন তোমাদের!”

তুর্ণার কথা শুনে নীতি ছিটকে নাহিয়ানের থেকে সরে আসলো। তুর্ণা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপরদিকে মুখ করে আছে। নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “তুই এখানে কেনো?”

সে এক গাল হেসে বললো, “ভাবীকে দেখতে আসলাম!”

“আগে জীবনে দেখিস নাই?”

“ফ্রেন্ড হিসেবে দেখেছি! ভাবী হিসেবে না!”

“কারো ঘরে ঢোকার আগে নক করে পারমিশন নিতে হয়, জানিস না?”

“প্রথমত আমি ঘরে এখনও ঢুকিনি! দ্বিতীয়ত, নক করার জন্য আটকানো দরজা প্রয়োজন হয়! খোলা দরজায় নক দিবো কি করে?”

“তোকে আমি!”

নাহিয়ান উঠার আগেই নীতি বলে উঠলো, “ভিতরে এসো তূর্ণা!”

“তোমার বর যেই লুক দিচ্ছে, তাতে ভিতরে আসা নিয়ে দ্বিধা হচ্ছে।”

“আরে আসো তো তুমি!”

তুর্ণা ভিতরে আসলো। কোমরে হাত রেখে বলল, “ভাইয়া বাইরে যাও! আমার ভাবীর সাথে সিক্রেট কথা আছে!”

“কিসের সিক্রেট কথা, যা বলার এখানেই বল। আমি বাইরে যাচ্ছি না!”

“ওকে, আমি তাহলে ভাবীকে নিয়ে যাচ্ছি। চলো ভাবী!”

বলেই নীতির হাত ধরলো।

“কোথায় যাস?”

“আমার বাড়ি! রিসিপশনের আগে আজকে আর ভাবীর দেখা পাবে না!”

নাহিয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “ব্ল্যাকমেইল শিখেছিস দেখি!”

“হুমম হুমম!”

“বেশিক্ষণ নিবি না! যাচ্ছি!”

বলেই বেরিয়ে গেলো নাহিয়ান। তুর্ণা আয়েশ করে নীতির পাশে বসলো।

“ভাইয়া তোমায় চোখে হারায় দেখি!”

নীতি হাসলো।

“তোমার সিক্রেট কথা কি শুনি?”

তুর্ণা চুপ করে গেলো।

“কি হলো?”

“তোমাকে কিছু কথা শেয়ার করি? কাউকে বলবে না কিন্তু!”

“ওকে!”

তুর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে সব বলতে শুরু করলো। আরহামকে নিয়েই যত কথা!

“এসব আমায় বললে যে?”

“কারণ আর কেউ আমার পরিবর্তন লক্ষ্য না করলেও তুমি করেছো! আমার মনে হলো তোমায় বলতে পারি আমি! আমি এখনও জানি এটা ভালোবাসা, নাকি মোহ?”

নীতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, “এটার পরীক্ষা আমি সেদিনই বলেছি!”

“হুমম কিন্তু..”

“এখন রেজাল্টের চিন্তা কিন্তু তুমি তার জন্যই করছো! তাকে পাবে বলে!”

তুর্ণা চুপ করে গেলো। আসলেই সে তার জন্যই করছে! নীতি ওর হাত মুঠোয় নিয়ে বললো, “তোমার দিক থেকে তুমি সত্যিই তাকে ভালোবাসো! কিন্তু সে বাসে না তূর্ণা!”

তুর্ণা অবাক হয়ে তাকালো।

“তুমি তার মন মতো ফলাফল পেয়ে যদি তাকে পেয়েও যাও, তবুও সে তোমাকে ভালোবাসবে না। ভালোবাসা জোর করে পাওয়া যায় না। উনি কেবল তোমার পড়াশোনা ঠিক রাখতে এসব করেছেন। তোমার কথা শুনে আমার তাই ই মনে হলো!”

তুর্ণা নিশ্চুপ!

“তূর্ণা?”

“বুঝে গিয়েছি আমি! এই কারণেই তোমার কাছে আসা! ধন্যবাদ!”

বলে সে চলে গেলো। নীতি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। ও যা বললো, তার এক বর্ণও ভুল নয় যে!

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_৩১

তুর্ণা বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই নাহিয়ান ভিতরে এলো।

“চলো!”

“কোথায়?”

“ছাদে!”

ছাদের নাম শুনতেই নাক কুঁচকে নিলো নীতি।

“ওইসব নিরামিষ মার্কা ছাদে যাই না আমি!”

নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “নিরামিষ মার্কা ছাদ আবার কি?”

“ওইযে আপনার ফাঁকা ছাদ!”

“আমি আমিষ মার্কা আছি, ওতেই চলবে। ছাদ নিরামিষই থাকুক! এখন চলো!”

নীতিকে কিছু বলতে না দিয়ে টেনে নিয়ে চললো সে। সবার আড়ালে ছাদে আসলো তারা। ছাদে আসতেই চমকে উঠলো নীতি। চারপাশে ফুলের টব দিয়ে সুন্দর করে সাজানো গোছানো দেখে নাহিয়ানের দিকে তাকালো সে। নাহিয়ান হেসে বললো, “তাহসিন বলেছিলো, কোনো একজনের আমার বাড়ির ছাদ পছন্দ নয়!”

নীতির মনে পড়লো। সেইযে ছাদ নিয়ে তাহসিনের সাথে আলোচনা করেছিলো! হাসলো নীতি!

“আপনার তো পছন্দ ছিল না এসব!”

“ছিলো না, তবে ভাবলাম হলে মন্দ হবে না। যতই হোক প্রিয়র প্রিয় বলে কথা!”

নীতি তাকিয়ে রইলো নাহিয়ানের দিকে। শুরু থেকেই মানুষটা ওর সব চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েই যাচ্ছে। এই মানুষটা ওর ভাগ্যে ছিলো, ভাবতেই ওর মন ভরে উঠছে। আশেপাশে চোখ বুলালো সে। মনের মতো পরিবেশ এখন!

“ভালো লেগেছে?”

“ভীষণ!”

“কতটা?”

“যতটা আপনাকে লাগে!”

নাহিয়ানের মুখে হাসি ফুঁটলো। অতঃপর দুজনে মিলে কিছুটা সময় কাটালো।

__________________________________

আরহামদের বাসায় বসে আছে তূর্ণা আর তার মা। তুর্ণার রেজাল্ট বেড়িয়েছে। আর তার সব বিষয়ে এ প্লাস এসেছে। তুর্ণার মা এতটা আশা করেননি। তাই খুশি হয়ে মিষ্টি নিয়ে হাজির আরহামের বাসায়। তুর্ণা আর আরহামের মা গল্প করছেন। এই ফাঁকে তূর্ণা আরহামের রুমে গেলো। ল্যাপটপে কাজ করছিলো আরহাম।

“আসবো ভাইয়া?”

তূর্ণাকে দেখে অবাক হলো আরহাম। এইচএসসি এর পর আর যায়নি সে। বেশ অনেকটা সময় দেখা হয়নি তাদের। আর না কোনো কথা। তুর্ণাকে এক পলক দেখে নিলো আরহাম। মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। বড় কথা সবসময় মুখে মেকআপ আর টপস, টিশার্ট পড়ে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটিকে কামিজ আর মাথায় ওড়না দিতে দেখে চমকিয়েছে। যদিও আগের পোশাকেও সে যথেষ্ট শালীন ছিলো, তবুও এই তূর্ণাকে ভিন্ন লাগলো তার!

“ভাইয়া!”

“হু, হ্যাঁ এসো!”

তুর্ণা ভিতরে আসতেই আরহাম ওকে বিছানায় বসতে বললো। বিছানায় বসে তূর্ণা আরহামের রুম দেখতে লাগলো।

“হঠাৎ আসলে যে?”

তুর্ণা তাকালো আরহামের দিকে! হেসে বললো, “আজকে কি জানেন তো?”

আরহাম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি?”

“আমার রেজাল্ট!”

“ওহ, হ্যাঁ! তো কি খবর?”

“আপনি যার শর্ত দিয়েছিলেন তাই ই পেয়েছি!”

আরহাম হকচকালো। মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো তার। সে মোটেও এতটা আশা করেনি। তুর্ণা বুঝতে পেরে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো!

“আপনার শর্ত আমি পূরণ করেছি ভাইয়া!”

আরহাম মেঝের দিকে দৃষ্টি রাখলো। তুর্ণা পুনরায় হাসলো।

“ভয় পাবেন না! আপনাকে চাইবো না আমি!”

আরহাম চমকালো। তুর্ণার দিকে তাকাতেই সে বললো, “ভালোবাসা জোর করে হয় না। জানেন, যখন প্রথম আপনায় দেখেছিলাম, তখন ভাবতাম লোকটা এত গম্ভীর কেনো? ক্রাশ খেয়েছিলাম, তবে আপনার গম্ভীরতার জন্য আর তেমন ট্রাই করিনি। অথচ ভাগ্যে কারণে আপনিই আমার টিচার হলেন। চেয়েছিলাম এমন কিছু করবো যেনো আপনি আমায় আর পড়াতে না আসেন। কিন্তু হুট করেই আপনার হাসির মায়ায় পড়েছিলাম। প্রথম প্রথম এসব বুঝিনি। সারাদিন এই ছেলে, ওই ছেলের প্রতি ক্রাশ খেয়ে খেয়ে ভালোবাসা আসলে কি ভুলেই গিয়েছিলাম। অথচ সেদিন আপনি আমাকে যেসব কথা বোঝালেন সেগুলো বোঝার সাথে সাথেই আপনার প্রতি সম্মান বাড়লো। ধীরে ধীরে নিজের পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হলাম। আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগতো। তাই পড়ার বাহানা করে মেসেজ করতাম, ফোন দিতাম। তারপর হুট করেই একদিন আপনাকে একটা মেয়ের সাথে দেখলাম। সেদিন মনের মাঝে কি রকমের ঝড় বইছিলো, আমি ছাড়া কেউ বোঝেনি। সেদিনই বলে ফেললাম, আপনাকে পেতে হলে কি করতে হবে? আপনি বললেনও। তাই পূরণ করলাম, কিন্তু!”

তুর্ণা থামলো। পুনরায় হেসে বললো, “কিন্তু এর কোনো মানে নেই। এটা অনেকটা জিনিস কেনার মতো হয়ে গেলো। তা কিছুক্ষণ আগেই বুঝলাম! তাই আপনার চিন্তার কারণ নেই। আমি এর দাবীতে আপনায় চাইছি না। তবে অবাক করা বিষয় কি জানেন? যেই মেয়েটা সবসময় ক্রাশ নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো, সে আজ সব বাদ দিয়ে একজনকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। এগুলো বলতেই এলাম! আসি, আর ধন্যবাদ আমাকে এত সুন্দর গাইড করার জন্য। নয়তো এত ভালো রেজাল্ট আমি করতাম না!”

বলেই উঠে বেরিয়ে আসলো তূর্ণা। ওখানে আরেকটু থাকলে বহু কষ্টে আটকে রাখা চোখের পানি গড়িয়ে পড়তো! ছোট থেকে তো সব পেয়েছে সে। কিছু জিনিস নাহয় অপ্রাপ্তি হয়েই থাকুক!

__________________________________

দেখতে দেখতে বিয়ের চার মাস কেটে গেছে। রীতি আর নীতি মিলে সবার জন্য রাতের খাবার বানাচ্ছে। সোফায় বসে সালেহা রাফিনকে নিয়ে বসে আছে। রাফিন রীতি আর শাফিনের ছেলে। সব প্রায় শেষ, সেই মুহূর্তে নাহিয়ান বাড়ি ফিরলো। সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত। ভিতরে আসতেই রান্নাঘরে চোখ গেলো তার। শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে পাক্কা গিন্নি মতো কাজ করছে নীতি। একবার ভাবলো সেদিকে যাবে, পরক্ষণেই রীতি আর মাকে দেখে সিদ্ধান্ত বদলালো। মাকে সালাম দিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে গেলো সে। সালেহা নীতিকে ডাক দিলেন।

“নীতি, নাহিয়ান এসেছে। দেখো ওর কি লাগবে!”

“যা তুই, কাজ শেষ! বাকিটা আমি করতে পারবো!”

নীতি কথা বাড়ালো না। চুপচাপ নিজের ঘরে গেলো। এটাই হয়ে আসছে চার মাস ধরে। শুধু ওর ক্ষেত্রে না, রীতির ক্ষেত্রেও এক। দুই ছেলে বাড়ি ফিরলে সালেহা দুই বউকেও ঘরে পাঠিয়ে দেন। পুরুষ মানুষ সারাদিনের কাজ শেষে যখন বাড়ি ফিরে তখন যদি অর্ধাঙ্গিনীরা তাদের কাছে থাকে তাহলে তারাও খুশি হয়! অর্ধাঙ্গিনী তাদের ওড়না বা শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখশ্রী মুছে দিয়ে একটু যত্ন নিলেই তাদের মনে হয়, তাদের সকল কষ্ট স্বার্থক!

রুমে যেতেই দেখলো নাহিয়ান বিছানায় বসে আছে। গলার টাই লুজ করে, শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে ফ্যানের দিকে মুখ করে বসে আছে। নীতি এগিয়ে গেলো। গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলো তার দিকে। নাহিয়ান বিনা বাক্যে খেয়ে নিলো। অতঃপর দম ফেলে বললো, “শীতের সময়ও ঘেমে যাচ্ছি আমি!”

নীতি গ্লাসটা রেখে পাশে বসে বললো, “সারাদিন কাজ করলে এমনটা তো হবেই! দেখি!”

বলেই নাহিয়ানের মুখ নিজের দিকে ফেরালো। পরক্ষণেই শাড়ীর আঁচল দিয়ে কপালে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিয়ে বললো, “হাত মুখ ধুয়ে খেতে আসুন!”

“আজ শাড়ী পড়লে যে?”

“আপু আর আমি প্ল্যান করে পড়েছি! বিয়ের আগেও এমন করতাম আমরা!”

নাহিয়ান হাসলো। নীতির কাঁধে মাথা রাখলো সে।

“তোমার রাগ হয় না?”

“রাগ হবে কেনো?”

“এইযে সারাদিন অফিসে থাকি। আসি রাত করে, তোমাকে সময় দেয়া হয় না! এইজন্য!”

”সময় দেন না কে বললো? এইযে কাজ থেকে অবসর হলেই ফোন দিয়ে কথা বলেন, তারপর লাঞ্চ ব্রেকে কথা বলেন, আর রাতে তো বলেনই!”

নাহিয়ান হাসলো। ওকে রাগাতে বললো,

“যাই বলো, অফিসে টুম্পাকে দেখতে দেখতে বোর হয়ে যাই। কখন যে বউকে দেখবো এই আশায় থাকি!”

নীতি যেনো পরের কথা শুনেই নি। ঝট করে জিজ্ঞেস করলো, “টুম্পা কে?”

“কলিগ!”

“সারাদিন ওকে দেখেন কিভাবে?”

“আমার সামনের ডেস্কেই বসে!”

“এইজন্য মহারাজ দেরীতে বাড়ি ফেরে!”

ভরকে গেলো নাহিয়ান। মাথা উঠিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললে?”

“অফিসে সারাদিন টুম্পাকে দেখেন। তাই বাড়ি ফেরার কথা মনে থাকে না!”

“কে বললো! তোমার জন্যই তো বাড়ি ফিরি!”

“বোঝা হয়ে গিয়েছে আমার। ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন! টুম্পার কথা মনে করতে করতে খেয়ে নিন। তারপর ওর কথা মনে করে ঘুমোন! আমি কালকেই বাপের বাড়ি চলে যাবো। থাকেন আপনি!”

বলেই হন হন করে বেরিয়ে গেলো। নাহিয়ান হতভম্ব! এটা কি হলো? এইজন্যই বলে যাই হয়ে যাক না কেনো, বউয়ের সামনে কোনো নারীর নাম মুখেও এনো না! তুফান বয়ে যাবে নয়তো!

__________________________________

বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে নীতি। নাহিয়ান অফিসের জন্য বের হতেই বাপের বাড়ি এসে পড়েছে সে। এখন গাল ফুলিয়ে বর্ষাকে সব কথা বলে যাচ্ছে। বর্ষা গালে হাত দিয়ে সব শুনে বললো, “এই সামান্য ব্যাপারে রাগ করে চলে আসলি?”

“এটা তোর কাছে সামান্য?”

“অবশ্যই সামান্য! তোর ভাই তো মেয়ে কলিগের সাথে কলেও কথা বলে। ওই দেখ, ফোন নিয়ে বসছে!”

রাদিফের আজকে ছুটি! সেই সুবাদে বাসায় আছে সে। এতক্ষণ নীতির কথা শুনছিল। পরক্ষণেই বর্ষার কথা শুনে কেশে উঠলো সে।

“দেখ কেমনে কাশে!”

“আরে আমি তো কাজের জন্য কথা বলি!”

“হ্যাঁ, কাজের জন্য হাই, হ্যালোও বলা লাগে?”

“তাহলে কি আমি ফোন ধরে বলবো অমুক কাজ আপনার হয়েছে নাকি? আরে কথা বললে তো হ্যালো বলাই লাগে!”

“বিশ্বাস করিস না বর্ষা! একদম করিস না!”

রাদিফ অসহায় কণ্ঠে নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার সুখের সংসারে আ’গুন লাগাচ্ছিস কেনো বইন?”

“তোমার কলিগের সাথে সংসারও আছে?”

রাদিফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওর আড়ালেই বর্ষা আর নীতি ইশারায় মুচকি হাসলো!

__________________________________

নাহিয়ানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নীতি। অফিস থেকে ফিরে বউকে না পেয়ে শ্বশুরবাড়ি হাজির সে। সালেহার কড়া আদেশ, বউয়ের রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে আসতে হবে। নয়তো ঘরে জায়গা নেই। সোফায় বসে আছে সে। আর সবাই তার যত্ন নিতে ব্যাস্ত! নীতি কয়েক পলক ওকে দেখে মুখ বাঁকিয়ে নিজের ঘরে গেলো। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমোতে যেতেই বাঁধলো বিপত্তি! নীতি আর বর্ষা এক সাথে ঘুমাবে! তাই নাহিয়ানের নো এন্ট্রি! সে যেনো রাদিফের ঘরে ঘুমায়! শেষ মেষ উপায় না পেয়ে নাহিয়ান রাদিফের ঘরেই গেলো। যতই হোক, শ্বশুর বাড়ি! এখন কিছু বললেই বিপদ।

বর্ষার সাথে ঘুমোবে বললেও ঘুমোতে পারলো না নীতি। বিয়ের দুই বছরের বেশি হলো, তাও মেয়ের শোয়া ঠিক হলো না। মুখের উপর থেকে বর্ষার হাত, আর পেটের উপর থেকে পা সরিয়ে উঠে বসলো সে। এর চেয়ে ভালো নাহিয়ানের সাথেই ঘুমাতে পারতো ও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় গেলো সে। নাহিয়ানের সাথে রাগ করার কোনো কারণ নেই তার। সে তো কেবল একটা অজুহাত তৈরি করেছে। আপাতত সব তার প্ল্যান মতোই হচ্ছে। কেবল কালকের অপেক্ষা। ফোনের মেসেজ টোন শুনে ফোনের দিকে তাকালো সে। ফোন হাতে করেই এনেছে। নাহিয়ানের মেসেজ।

“বারান্দায় এত রাতে কি করেন ম্যাম?”

চমকে গেলো সে। পরক্ষণেই রাস্তার দিকে তাকালো। সেদিনের মতো আজও একই জায়গায় নাহিয়ান দাঁড়ানো। চোখ বড় বড় করে তাকালো সে। জলদি রিপ্লাই করলো,

“আপনি এখানে কি করেন?”

“বউ দেখতে এসেছি!”

“পা’গল নাকি?”

“বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে আসলে কেউ পা’গল হয় নাকি?”

হাসলো নীতি। নাহিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলো সে আবার কিছু লিখছে,

“আবছা আলোতেও আপনার হাসিটা অসম্ভব সুন্দর লাগে প্রিয়!”

“ঠান্ডা লাগবে, রুমে যান!”

“না যাবো না!”

“না যান, আমার কি! আমি আর মেসেজ দেখবো না!”

বলেই ফোনের স্ক্রিন অফ করলো। নাহিয়ান অসহায়ভাবে তাকালো ওর দিকে। নীতি ঠোঁট চেপে হাসলো। ইশারায় বললো, “রুমে যান!”

নাহিয়ান মাথা নেড়ে না বোঝালো। পরক্ষনেই কানে হাত দিয়ে সরির ভঙ্গিমা করলো। নীতি হাসলো! ওর সামান্য রাগে মানুষটা কেমন পা’গলামি করছে! অথচ সবার সামনে এসে কত ভিন্ন! অবশ্য, নিজ মানুষের কাছে সব রকমের পা’গলামি করার মজাই আলাদা! ফোন হাতে নিলো সে।

“ঠান্ডা লাগবে! প্লিজ রুমে যান!”

“সরি!”

“সকালে বাড়ি ফিরতে হবে। ঘুমান!”

নাহিয়ানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটলো। নীতির দিকে একবার তাকিয়ে রিপ্লাই করলো,“ভালোবাসি বউ!”

“ভালোবাসি বর!”

অতঃপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সে। তাকিয়ে রইলো নীতির পানে। নীতির দৃষ্টিও তার মাঝেই আবদ্ধ! ওদের এই খুনশুটির সম্পর্ক বহমান থাকুক শেষ অব্দি!

#চলবে

প্রিয় অনুভব পর্ব-২৮+২৯

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৮

আটপৌরে পড়া কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িটা হালকা উচু করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘরে আসলো নীতি। গালে হলুদ, মুছতে নিয়েও মুছলো না সে। নাহিয়ান ফোন দিবে বলেছে। হয়তো দেখবে ওকে। হাসলো নীতি। দরজা আটকে বিছানায় ফোন হাতে নিয়ে বসলো সে। অপেক্ষা করতে লাগলো তার ফোনের। সেই সাথে ভাবতে লাগলো পেরিয়ে যাওয়া সময়ের কথা। ইশ, দেখতে দেখতে কতটা সময় কেঁটে গিয়েছে। তার পড়াশোনা শেষ, নাহিয়ানও এখন সেটেল হয়ে গিয়েছে। ব্যস, সবশেষে শুরু তাদেরও বিবাহ অভিযান! ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো তার। নাহিয়ান কল দিয়েছে।

“নাম্বারে কল দিলেন যে? ভিডিও কল যখন দিবেন না আমাকে কেনো বললেন চেঞ্জ না করতে?”

“বারান্দায় আসো!”

নীতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বারান্দায় কেনো? আপনি কি বাই এনি চান্স নিচে?”

নাহিয়ান হাসলো। নীতি এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে দৌড়ে বারান্দায় গেলো। ওর রুমের বারান্দা থেকে বাড়ির পিছনের রাস্তাটা দেখা যায়। সেই রাস্তায় ফোন কানে নাহিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত সে।

“হলুদ কোথায় আপনার?”

“এতটা রাস্তা আসবো, হলুদ নিয়ে আসবো নাকি?”

“আমারটাও তাও ওঠানো উচিত!”

“একটু থাকুক। দেখি!”

“কি দেখবেন?”

“আমার হবু অর্ধাঙ্গিনীকে!”

নীতি হাসলো।

“কাল বিয়ে, আর আজ এখানে আপনি? কত বাজে স্যার?”

“বিয়ের আগে শেষ দেখা করতে আসলাম!”

“শেষ দেখা কেনো?”

“বারে, কাল নীতির বিয়ে না? বিয়ের পর বিবাহিত নারীকে দেখতে আসবো নাকি?”

“এমনভাবে বলছেন, বিয়ে যেনো অন্য পুরুষের সাথে!”

“হ্যাঁ, আপনার বিয়ে, আপনার অনুভবের সাথে। আমি বেচারা নাহিয়ান, এখন আপনার বিয়ে দেখবো!”

নীতি হেসে বললো,

“আপনারও তো বিয়ে, প্রিয়র সাথে!”

নাহিয়ানও হাসলো।

“এই একটু দাঁড়ান তো, আসছি!”

“কোথায় যাচ্ছো?”

“রাখুন, আসছি!”

“আসছো মানে? কোথায় আসছো! হ্যালো?”

নীতি ফোন কেটে দিয়েছে। নাহিয়ান অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলো। এই নীতি করবে টা কি? বেশ কিছুক্ষণ পর কিছু পরার শব্দে সেদিকে তাকালো সে। নীতি দেয়ালের উপরে। নিচেই তার জুতো পড়ে আছে, যেগুলো সে ফেলেছে। চোখ বড় বড় করে তাকালো ও। দ্রুত পায়ে সেখানে গেলো।

“কি করছো তুমি?”

নীতি শাড়ী সামলে কোনোমতে পা দেয়ালের এদিকে আনলো। নামার চেষ্টা করে বললো, “কথা না বলে সাহায্য করুন!”

বলেই নিজের সাইড ব্যাগ নাহিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিলো।

“আরে আসছো কেনো? রাত হয়েছে!”

“সাহায্য করবেন? নাকি লাফ দিবো?”

“উঠেছো কি করে?”

“যেমনেই উঠি, আপনি নামান আমায়!”

“উফ! হাত দেও।”

নীতি নাহিয়ানের সাহায্য নিয়ে অবশেষে নিচে নামলো। অতঃপর ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলো। পায়ে জুতো জোড়া পড়ে নিলো। বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বললো!

“বাবা! কত কষ্ট!”

“করতে কে বলেছে?”

“আমি! চলুন..”

বলেই হাত ধরে টানতে শুরু করলো।

“কোথায়?”

“পালাবো!”

“পালাবো কেনো? বিয়ে তো হচ্ছেই!”

“উফ, এত প্রশ্ন করা শিখলেন কবে থেকে? চলুন!”

“কি শুরু করলে নীতি?”

নীতি নাহিয়ানের চোখে চোখ রেখে বললো, “বিয়ের আগে লাস্ট ডেটে যাচ্ছি। চলুন!”

বলেই নাহিয়ানকে নিয়ে এগিয়ে চললো সে। একটু দূরেই চায়ের টং ছিলো। রাত আনুমানিক একটা। দোকানদার সবেই দোকান বন্ধ করতে যাচ্ছিলো। নীতি এক প্রকার ছুটে গিয়েই বললো, “মামা, দুইটা চা দিন!”

দোকানদার বিস্মিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।

“দিন না! পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিবো!”

তিনি কিছু না বলে চা বানানো শুরু করলেন। নীতি আর নাহিয়ান বেঞ্চে বসলো।

“এটা তোমার ডেট?”

“হুমম! চায়ের ডেট।”

নাহিয়ান হাসলো।

“তো ম্যাম, ডেটে এখন কি নিয়ে গল্প করবেন?”

“কি নিয়ে গল্প করবো বলতে?”

“ডেটে আসে মানুষ একে অপরকে জানার জন্য, এখন বলো আমাকে কিভাবে জানবে? মানে জানার কি কিছু বাকি আছে?”

“ডেট যে সবসময় জানার জন্যই হতে হবে এমন কথা কোথাও লিখা আছে নাকি? চলুন আজ গল্প স্মৃতিচারণ করি!”

“স্মৃতিচারণ?”

“হুমম শুরু থেকে সবটা!”

নাহিয়ান নীতির মুখপানে তাকালো। নীতি হাসলো। সেই হাসি দেখে তার মুখেও হাসি ফুটলো। দুজনার দৃষ্টি বিনিময় হতে লাগলো। নীতি বলে উঠলো,

“অনলাইন প্লাটফরম!”

“প্রিয় আর অনুভব!”

“দুষ্টু মিষ্টি কথন!”

“হঠাৎ গড়লো প্রেম ভুবন!”

“চলছিলো অনুভূতিদের মেলা।”

“হুট করেই হারালো সে অবেলায়!”

“কেঁটে গেলো অনেকটা সময়!”

“অবশেষে আসলো নতুন এক দিন!”

“আলাপ হলো আমাদের!”

“শুরুটা ছিল আজব!”

“গিটার ভাঙ্গা!”

“চুল টানা!”

“কারণে অকারণে ঝগড়া করা!”

“হুট করেই বন্ধু হওয়া!”

“হঠাৎ করেই হলো ঝগড়া..”

“শুরু হলো অনুভূতি এড়িয়ে চলার চেষ্টা!”

“অবশেষে অনুভব আর প্রিয় পেলো একে অপরের খোঁজ।”

“ছন্দে সাজলো আবার সেই মিষ্টি তাদের কথন!”

“অতঃপর হলো তাদের আলাপ, প্রিয় অনুভব হিসেবে..”

“চমকিয়েছিলো তারা।”

“থমকে ছিলো প্রহর!”

“শহর ঘোরা হয়নি তাদের সেদিন,”

“কিন্তু সাময়িক বিচ্ছেদ চলেছিলো ক’ দিন!”

“একটা সময় সব ঠিক হলো, বুঝলো একে অপরকে!”

“সেই থেকে রয়েছে তারা এক অনুভূতির সম্পর্কে।”

“অতঃপর তাদের বিরহের সমাপ্তি..”

“পরিশেষে প্রিয় অনুভবের কথন অনুভূতি পেলো তাদের পূর্ণতার প্রাপ্তি!”

হাসলো দুজন!

“সত্যিই পূর্ণতা পেতে চলেছে আমাদের গল্প!”

“খুশি তুমি প্রিয়?”

“ভীষণ খুশি!”

কথার মাঝেই চা দিয়ে গেলো ওদের। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই নীতি বললো, “একটা জিনিস দেখানোর ছিল!”

“কি?”

চায়ের কাপ সাইডে রেখে নিজের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরী বের করলো। ডায়েরীর একটা নির্দিষ্ট পাতা খুলে নাহিয়ানের দিকে এগিয়ে দিলো। নাহিয়ান হাতে নিলো সেটা। চোখ বুলাতেই দেখলো সেখানে লিখা,

“আপনার সাথে আলাপ হওয়া ছিল আমার মস্ত বড় ভুল,
সেই ভুল কি কখনো ফুল হবে অনুভব?”

নাহিয়ান নীতির দিকে তাকালো। নীতি আবারও চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, “কথাগুলো যখন প্রিয় আর অনুভবের প্রথম দেখা হয়েছিলো, তখন লিখেছিলাম! ভেবেছিলাম ওখানেই আমাদের গল্পের সমাপ্তি রেখা। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম!”

“কলম আছে?”

“ডায়েরীর সাথেই লাগানো?”

“ওহ, খেয়াল করিনি!”

বলেই কলম নিয়ে কিছু লিখলো। নীতি দেখার চেষ্টা করলো। নাহিয়ান ডায়েরীটা বন্ধ করে নীতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “বাসায় গিয়ে দেখো।”

নীতি বিনা বাক্যে ডায়েরীটা আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।

“অন্য পাতাগুলো পড়েননি কেনো?”

“তোমার সব আমার জানা। ওই ডায়েরী অন্তত আমার থেকে বেশি কিছু জানবে না!”

“তাও ঠিক!”

চা শেষ করে বাড়ির দিকে আসতে শুরু করলো তারা। বাড়ির সামনের সদর দরজার দিকে এসে বর্ষাকে দেখে চমকে উঠলো দু জন। সে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে।

“তুই এখানে?”

“তোকে বের হতে দেখলাম। কষ্ট করে আবার দেয়াল বেয়ে আসা লাগবে না। গেট খোলা রইলো। লাগিয়ে আসিস। টাটা!”

বলেই সে চলে গেলো।

“এবার যাও নীতি।”

“হুমম!”

বলেই এগিয়ে গেলো সে। ভিতরে ঢুকতে গিয়েও গেলো না। আবার ফিরে আসলো সে।

“কাল সত্যিই আমার বিয়ে, তাই না?”

নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল, “হুমম!”

নীতি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পা দুটো একটু উঁচু করে নাহিয়ানের কপালে তার অধর ছোঁয়ালো। ছল ছল চোখে নাহিয়ানের চোখ চোখ রাখলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো, “কাল আমার বিয়ে, আসবেন কিন্তু! অপেক্ষা করবো।”

“অবশ্যই আসবো! বিয়ে শুরুর আগেই আসবো। একদম তোমার পাশে দাঁড়াবো!”

নীতি হাসলো।

“এবার যাও!”

“আপনিও যান। কাল আপনারও বিয়ে। সকাল সকাল উঠতে হবে!”

“হুম, যাও!”

“আসি!”

বিদায় নিয়ে গেট আটকিয়ে জলদি উপরে নিজের ঘরে গেলো। বারান্দা দিয়ে উঁকি দিলো নাহিয়ানকে দেখা যায় নাকি, কিন্তু পেলো না। শাড়ি পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। অতঃপর ডায়েরী আর ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় বসলো। ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পেলো নাহিয়ানের মেসেজ।

“জানো প্রিয়? হলুদ আমার খুব অপছন্দের রং কিন্তু সেই অপছন্দের রঙে আমার প্রিয়কে এতটা দারুন লাগবে। আবার প্রেমে পড়েছি প্রিয়! ভালোবাসি। ঘুমিয়ে পড়! হলুদ কন্যাকে তো আজ দেখলাম। কাল কনেকে দেখতে আসবো, আর সাথে করে নিয়েও যাবো। তৈরি থেকো! শুভ রাত্রি!”

‘হলুদ কন্যা’ সম্বোধন দেখে হাসলো নীতি। ডায়েরী হাতে নিয়ে সেই পাতা বের করলো। লিখাটা পড়ে মুচকি হাসলো সে। আবার অস্পষ্ট স্বরে পড়লো,
“আমাদের আলাপ হওয়ার ভুলটা ফুল হয়ে গিয়েছে। তুমি আমার ভুল নামক মিষ্টি এক ফুল প্রিয়! সেই মিষ্টি ফুলকে আমি পেতে চলেছি নিজের করে। সম্পূর্ণ নিজের। ভুল নামক ফুলে, প্রিয় নামক একটা মিষ্টি ফুলকে স্বাগতম, আমার নতুন জীবনে!”

তারই নিচে লিখা, “প্রিয় ফুল, ভালোবাসি!”

হাসলো নীতি। ডায়েরীটা বুকে জড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। ইশ, সবটা এত সুন্দর কেনো?

__________________________________

ঘর ভর্তি মানুষ। নীতিকে ঘিরে বসে আছে বর্ষা, প্রীতি, রীতি। নানারকম গল্পের মাঝেই উপস্থিত হলো তূর্ণা।

“ভাইয়ারা এসে গিয়েছে। নিচে যাবে না?”

বর্ষা তড়িঘড়ি উঠে শাড়ির আঁচল সামলে নিয়ে বললো, “যাবো না মানে? প্রীতি চল, টাকা নিতে হবে!”

দুইজন একপ্রকার ছুটে গেলো। রীতি হেসে বললো, “আমিও যাই। দেখে আসি!”

“এই অবস্থায় এখন এত হাঁটাচলা করো না আপু! চার মাস চলছে, সাবধানে থাকো একটু!”

“নীতি ভাবী একদম ঠিক বলেছে রীতি ভাবী!”

রীতি হাসলো।

“কিছু হবে না। নিচে গিয়ে বসেই থাকবো!”

তুর্ণা মশকরার সুরে বললো, “ভাইয়াকে দেখার জন্য তাই না?”

রীতি লজ্জা পেলো। কিছু না বলে বেরিয়ে এলো। তুর্ণা নীতিকে পর্যবেক্ষণ করলো। হালকা গোলাপী রঙের লেহেঙ্গা সাথে ব্রাইডাল সাঁজ। অত গর্জিয়াস না, তবুও অসাধারণ! সে নীতির এক পাশে বসে বললো,

“তোমায় এত্ত সুন্দর লাগছে ভাবী!”

নীতি হাসলো।

“তোমাদের লাভ স্টোরির মতো, জুটিটাও কিউট!”

“তাই?”

“হুমম!”

তুর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা ভালোবাসার অনুভূতি কি করে বুঝতে পারো তোমরা?”

“মানে?”

“এইযে তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো এটা বোঝো। কিন্তু কি করে বোঝো?”

“চোখ বন্ধ করো!”

“কেনো?”

“করো না!”

তুর্ণা চোখ বন্ধ করলো।

“এবার ফিল করো এমন একজন মানুষকে যার সাথে তোমার সম্পর্ক একটু ভিন্ন। মানে কোনরকম আত্মীয়তার সম্পর্ক নয়, একদম অন্যরকম মনে হয়!”

তুর্ণা আরহামকেই ফিল করলো।

“এখন ভাবো, মানুষটা তোমার সাথে নেই। তোমার জীবনে তার অস্তিত্ব নেই। সে অন্য কারো!”

ঝট করে চোখ খুললো তূর্ণা। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নীতির দিকে তাকালো। নীতি হাসলো। ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “চঞ্চল মেয়ে হুট করে শান্ত হয়ে যাওয়ার সাথে আমি পরিচিত তূর্ণা। তাই ধরতে অসুবিধে হয় নি। মানুষটা যেই হোক, মনের মাঝে যা আছে সব বলে দিও। এতে মানুষটাকে পাও বা না পাও, কিন্তু এই ভেবে শান্তি পাবে নিজের মনের কথা বলতে পেরেছো তাকে। বুঝেছো?”

তুর্ণা মাথা ঝাঁকালো। অন্যমনস্ক ভাবতে লাগলো এই বিষয়ে। তখনই মেসেজ এলো নাহিয়ানের। নীতি উঠে বারান্দায় গেলো। কল দিলো তাকে।

“ম্যাম, আপনার বিয়ের দাওয়াত খেতে এসে গিয়েছি। আপনি কোথায়?”

“আমার রুমে!”

“নার্ভাস?”

“কিছুটা!”

“কারণ?”

“অদ্ভুত লাগছে। বিশ্বাস হচ্ছে না আমি অনুভবকে পেতে চলেছি!”

“গান শুনাবেন?”

“আমি?”

“কোনো সমস্যা?”

“এখন কি করে কি?”

“আরেকটা স্মৃতি সংগ্রহে রাখার চেষ্টা!”

নীতি আর বারণ করার কারণ পেলো না!

“সে-কি নিরবতায় আমার প্রেমে ডুবে রয়?
সে-কি মনে রাখে পথে হলো পরিচয়?”

“ও বাতাস তুমি বলে দিও তারে..
সে যেনো আমারই থাকে, ভোলে না আমারে!”

হাসলো নীতি!

“সবার সামনে গাইলেন?”

“সমস্যা নেই, কেও বোঝে নি!”

“নিচে আসুন! আপনাকে আনতে যাচ্ছে!”

“আসছি!”

এর মাঝেই রীতি, প্রীতি, বর্ষা এলো ওকে নিয়ে যেতে। অতঃপর একসাথে নিচে নামলো তারা।

__________________________________

স্টেজের উপর বসে আছে নাহিয়ান। একই জায়গায় কতবার এসেছে সে। অথচ আজকে অনুভূতিটা অন্যরকম। আগে ছিল দর্শক, আর এখন বর বেশে। এর মাঝেই শুনতে পেলো কেউ বলছে, “ওইতো কনে হাজির!”

সেদিকে তাকালো নাহিয়ান। বধূ বেশে নীতিকে দেখে মুগ্ধ হলো সে। অজান্তেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে। নীতিকে নিয়ে এগিয়ে আসছে বর্ষারা। যতই এগিয়ে আসছে তারা, ততই নাহিয়ানের হৃদস্পন্দন বাড়ছে। নীতি স্টেজে উঠবে তখনই নাহিয়ান এগিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। হাতে হাত রেখে নীতি মুচকি হাসলো। বরাবরের মতো এবারেও সেই হাসিতে নাহিয়ানের মুখে হাসি ফুঁটলো।

সবশেষে তিন কবুলে সম্পন্ন হলো তাদের বিয়ে। সকলের আড়ালে অত্যন্ত শপ্তপর্নে নিজের চোখের কোণের জলটুকু মুছে ফেললো নাহিয়ান। অবশেষে সে পেয়েছে তার প্রিয়কে। এই দৃশ্য চোখ এড়ালো না নীতির। তার চোখেও পানি!

“কাঁদছেন অনুভব?”

“না তো!”

“দেখছি তো!”

নাহিয়ান ছল ছল চোখে নীতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

“কিছু খুশি হেসে বা শব্দে প্রকাশ করা যায় না প্রিয়! কখনো কখনো চোখের পানিও সেই খুশির সামিল হয়!”

নীতি নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর পানে। তাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে কতটা খুশি সে। তবুও, প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাওয়ার অনুভূতি কি শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব? একদম সম্ভব না! হাসলো নীতি। নাহিয়ানের হাতে হাত রাখলো সে। সেও খুশি, ভীষণ খুশি!

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৯

একবার হাতের দিকে, তো একবার সামনে থাকা পোলাও, রোস্টের দিকে তাকাচ্ছে নীতি। হাত ভর্তি চুড়ি, আংটি এসব পড়ে কি খাওয়া যায়? আশ্চর্য! কনে এখন খাবে কি করে? ভেবেই আশেপাশে তাকালো। সকাল থেকে তেমন কিছু খায়নি। এখন পেটে যেনো তার ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। পাশেই নাহিয়ান আরমছে খেয়ে যাচ্ছে। রাদিফ, বর্ষা, প্রীতি, রীতি, আনাফ, তূর্ণা সব খাওয়ায় ব্যাস্ত। এক সাথেই বসেছে ওরা। নীতি একবার ভাবলো রীতিকে বলবে, পরক্ষনেই চুপ করে গেলো। কি করবে ভেবে পেলো না। ভাবনার মাঝেই কেউ ওর মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলো। মানুষটির দিকে না তাকিয়েও হাসলো নীতি। অতঃপর খাবারটুকু মুখে নিলো।

“এত ভাবনা চিন্তা না করে বললেই তো পারতেন ম্যাম!”

নীতি নাহিয়ানের দিকে তাকালো। হেসে মৃদু স্বরে বললো, “বলার আগেই যেই মানুষ আমার সমস্যা বা আমি কি চাই বুঝে ফেলে, তাকে আমি বেশি ভালোবাসি!”

নাহিয়ান হাসলো। আবারও নীতিকে খাওয়াতে গেলে, টেবিলে বসা সকলে একত্রে বলে ওঠে, “ওহো!”

নীতি লজ্জা পেলো। রীতি গালে হাত দিয়ে বললো, “হাউ সুইট! ইশ, নাহি, আমি যদি আগে জানতাম তুই এত কেয়ারিং একজন হাসব্যান্ড হবি, সিরিয়াসলি আমি তোর এই কচুর ভাইকে জীবনেও বিয়ে করতাম না। তোকেই করতাম!”

শাফিন পোলাও সবে মুখে দিয়েছিল। রীতির কথা শুনে খাবার তার নাকে উঠে গেলো। কোনোমতে পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করে বললো, “আমি কচু?”

“অবশ্যই, কোনো সন্দেহ?”

“আমি কেয়ার করি না তোমার?”

“হ্যাঁ, অনেক করো! এতই করো যে আমি আমাদের বিয়ের সময়ও এভাবে বসে ছিলাম। তুমি দেখেও খাওয়ানোর দুঃসাহস করো নি!”

শাফিন ভ্রু কুঁচকে জবাব দিল, “পরে ঠিকই তো রাতে তোমার প্রিয় ফ্রাইড রাইস এনেছিলাম!”

রীতি সোজা হয়ে বসলো। আমতা আমতা করতে লাগলো সে। প্রীতি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“আপু তুমি ফ্রাইড রাইস খেয়েছিলে, আর আমাদের দিলে না!”

ওর কথা শুনে উপস্থিত সকলে হাসলো। তুর্ণা শশা মুখে নিয়ে বলতে লাগলো, “তবে যাই বলো, এদের জুটি লাখে একটা! নয়তো অনলাইনের প্রেম, বাস্তবে পূর্ণতা পাওয়া কি সম্ভব?”

তুর্ণার কথার সাথে সবাই একমত হলো। নাহিয়ান হেসে উত্তর দিলো, “যদি সত্যিই কাউকে ভালোবাসো তাহলে ভালোবাসা অনলাইনে হোক বা অফলাইনে! ভাগ্যে থাকলে পূর্ণতা পাবেই!”

“না দেখে, না শুনে ভালোবাসা হয় কি করে?”

তুর্ণার প্রশ্নে হাসলো নাহিয়ান।

“বাস্তব আর অনলাইন দুটোই ভিন্ন একটা জগৎ। বাস্তবে আমরা এমন অনেক কিছুই আছে যেগুলো সম্মুখে কারো সামনে করতে লজ্জা পাই। অথচ সেগুলোই অনেকসময় অনলাইনে নির্দ্বিধায় করতে পারি। আমাদের ক্ষেত্রেও সেম। জনসম্মুখে গান গাইতে আমার অস্বস্তি হতো। নিজের লিখা ছন্দগুলো শোনাতে গেলে অড লাগতো। তাই আমার সেগুলোই নীতির সাথে শেয়ার করতাম। নীতিও তেমন। দুইজন কখনো নিজেদের বাস্তব লাইফের গল্প নিয়ে আলোচনা করিনি। যা কথা ছিল কেবল নিজেদের এমন কিছু বিষয় নিয়ে যেগুলো আমরা বাস্তবে একদম বিনা দ্বিধায় করতে পারি না। একে অপরকে বুঝতাম। নীতি আসতো সময় কাটাতে। কারণ তখন বর্ষা আর ও আলাদা ছিলো। আড্ডা দেয়ার মত কাউকে পেতো না। তাই পেয়ে গেলো আমায়। শুরুর দিকে সব ঠিক থাকলেও হঠাৎ উপলব্ধি করলাম আমি ওর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছি। যেহেতু সে একটা মেয়ে, আর তাকে কখনো, কোনোদিন দেখি নি। তার সাথে জড়িয়ে পড়াটা শোভনীয় নয়। তাই বাড়ালাম দূরত্ব। কিন্তু সর্বোপরি বুঝলাম বেশ গভীর টান সৃষ্টি হয়েছে আমাদের মাঝে। অতঃপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কথা চালাতে থাকবো। ভাগ্যে যা থাকে তাই ঘটবে! আমাদের কথোপকথন চলতে রইলো, একে অপরকে অনুভব করতে লাগলাম। কলে কথা হতে লাগলো। ব্যস !”

সবাই খেতে খেতে নাহিয়ানের কথা শুনছিলো। নাহিয়ানের কথা শেষ হতেই বর্ষা বললো, “আপনার কথা আমি জানতাম না আগে, তবে এই মেয়ের কথা জানি! হুট করে এর পরিবর্তন চোখে পড়েছে আমার। তারপর উনি বললেন, আর আমি জানলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম চেনা জানা কিছু নেই, মন দিয়ে বসে আছে। এ কোন বোকামি? আমি বললাম এসব কিছু নয়, ভুলে যা! কিন্তু ম্যাডাম আমায় বললেন..”

বর্ষাকে বলতে না দিয়ে নীতি বলে উঠলো,

“যাকে অনুভব করে ভালোবাসা হয়, তাকে ভোলা যায় না!”

“হুমম, এটাই বলেছেন! যদিও ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝেছিলাম অনুভব ওর কাছে কি, তবুও আপনাকে নিয়ে কনফিউসন ছিল। না জানি যদি আপনি আবার কোনো মেয়ে হন, আর ওর সাথে মজা করেছেন!”

নাহিয়ান হাসলো।

“অনলাইনে সব সত্য হয় না। মিথ্যেই বেশি। লাখে একজনের হয়তো ভাগ্য সাথে থাকে, তাই পায়! আর বেশিরভাগই টাইমপাস।”

“আর সেই লাখের একজন অর্থাৎ এক জুটি হচ্ছো তোমরা!”

তুর্ণার কথা শুনে হাসলো নীতি। নাহিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলো সে তারই পানে চেয়ে আছে। নাহিয়ান নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “হুমম, লাখ লাখ মানুষের মাঝে সেরা কাউকে পেয়েছি। যে অনন্য, প্রেমময়ী। আর আমার শুভ্রময়ী!”

“আর আপনি আমার শুভ্রপুরুষ!”

নীতির কথার প্রেক্ষিতে ওরা সমস্বরে বলে উঠলো, “হায়, ইতনা পেয়ার!”

নীতি মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

__________________________________
বিদায়ের বেলা। কেঁদে কেটে ভাসিয়ে ফেলছে নীতি। জীবনের এতটা সময় একজায়গায় কাটিয়ে এখন নতুন জায়গায় নতুনভাবে তার নতুন জীবন শুরু করতে হবে। সবার চোখে পানি থাকলেও বর্ষা আনন্দে সেলফি তুলে যাচ্ছে। রাদিফ ওকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো, “তোমার মনে এত আনন্দ কেনো? নীতির বিদায়ে তোমার কষ্ট হচ্ছে না?”

“ওমা, কষ্ট হবে কেনো? আমি ওর শশুরবাড়ি গিয়ে ওকে দেখে আসবো! এইযে এখন যেমন আসি।”

রাদিফ কপাল চাপড়ালো।

“বিয়ের এক বছরের বেশি হতে চললো, তুমি এখনও নিজেকে সিঙ্গেল ভেবে বসে আছো! আরে তোমার বিয়ে হয়েছে। এই কয়টা মাস তুমি আর নীতি একই বাড়িতে ছিলে। তোমারও শ্বশুরবাড়ি আছে, ওরও হয়েছে! যখন তখন যাওয়া-আসা যাবে না, ব’ল’দ!”

বর্ষার যেনো এতক্ষণে খেয়াল হলো। বেস্টুর বিয়ের আনন্দে এতটাই মত্ত ছিলো যে ভুলেই গিয়েছে তারও বিয়ে হয়েছে। চোখ মুখে দুঃখের ছাপ এনে বলে, “তাই তো! বান্ধবী!”

বলেই ঝাঁপিয়ে নীতিকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদো সুরে বললো, “তুই কেন বিয়ে করলি! ভালোই তো ছিলাম আমরা। এখন আমাদের দেখা কবে হবে আবার!”

নীতি কাঁদার মাঝেও হেসে ফেললো বর্ষার কাণ্ড দেখে। বর্ষা নাক টেনে বললো, “বিদায়ের সময় কনের হাসতে নেই!”

নীতি তবুও ফিক করে হেসে দিলো। অতঃপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বর্ষাকে। রীতির সময় সে চলে যাচ্ছে বলে কষ্ট পেয়েছে, আর এখন? পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট যে তার চেয়েও বেশি। কিন্তু কি করার? মেয়েতো! যেতে তো হবেই!

নাহিয়ান পাশেই দাঁড়িয়ে। রীতি ওর বাহুতে চ’ড় দিয়ে বললো, “কিরে হিরো! এখন বউয়ের কেয়ার নিচ্ছিস না কেনো? দেখিস না কাঁদছে?”

নাহিয়ান হেসে বললো, “এখন কেঁদে নিতে দে।”

অতঃপর নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “কথা দিচ্ছি, এখান থেকে যাওয়ার পর, সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ওর চোখে পানি না আনার!”

নীতি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নাহিয়ানের দিকে। নাহিয়ান নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “যাওয়া যাক? আমাদের নতুন জীবনে, নতুন মুহূর্ত তৈরি করতে?”

নাহিয়ানের হাতে হাত রেখে মাথা উপর নিচ নাড়লো সে। কষ্টের মাঝেও এক ফালি সুখ খুঁজে পেলো সে। ইশ, মানুষটা যেনো সবসময় এভাবেই তাকে সামলে নেয়!

__________________________________

বিছানায় উদাস মনে বসে আছে বর্ষা। সারাদিনের হৈ হুল্লোরে সে ভুলেই গিয়েছে সে এই বাড়ির বউ। আর নীতি তাদের ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যাবে। কষ্ট হচ্ছে তার। দুইজনের এক সাথে, এক বাড়িতে থাকার শখ মিটলেও, শখটা স্থায়ী হলো না। রাদিফ বর্ষার দিকে রুমাল এগিয়ে দিল।

“কাঁদছো কেনো?”

“আপনার সাথে বিয়ে হওয়ার দুঃখে কাঁদছি!”

“কি?”

“কি আবার কি? আপনার সাথে বিয়ে না হলে ভালো হতো। আর নাহিয়ান ভাইয়ার আরেকটা ভাই থাকলে ভালো হতো। তাহলে আমিও তার ভাইকে বিয়ে করতাম!”

রাদিফ হতভম্ব! অতঃপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো, “ভাই তো নেই, তাহলে বিয়ে করতে কাকে?”

“তাও ঠিক!”

রাদিফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এর মাঝেই বর্ষা ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো। রাদিফ আলতোভাবে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

“যখন খুশি ওকে গিয়ে দেখে এসো!”

“যেতে দিবেন?”

“দিবো, তবে সীমিত! বুঝতে হবে ওটা ওর শশুর বাড়ি!”

বর্ষা চুপ করে রইলো।

“বর্ষা!”

“হুমম!”

“আই লাভ ইউ!”

“হুমম!”

“শুধু হুমম?”

বর্ষা হাসলো। রাদিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, “আই লাভ ইউ টু!”

__________________________________

ফুল সজ্জিত বিছানায় বসে আছে নীতি। এ বাড়িতে আসলেও নাহিয়ানের ঘরে সেভাবে আসা হয় নি। দরজা চাপিয়ে গিয়েছে তূর্ণা। নাহিয়ানের আশায় বসে আছে সে। হুট করেই দরজার দিকে খেয়াল গেলো ওর। সেখানে ছোট একটা নেমপ্লেট আছে, যেখানে লিখা ‘প্রিয় অনুভব’। উঠে গিয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলো সেই লেখাটুকু। দরজার বাইরে না দিয়ে, ভিতরে এটা দেয়ার মানে বুঝলো না নীতি। তবুও মন্দ না! বেশ লাগছে! সেই মুহূর্তে নাহিয়ান দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো। নীতি তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে গেলো দুই পা।

“এখানে কি করছিলে?”

“ওটা দেখছিলাম!”

নাহিয়ান নিজেও তাকালো। অতঃপর হেসে দরজা আটকে দিলো।

“পছন্দ হয়েছে?”

“হুমম, তবে এটা ভিতরে কেনো?”

“এমনি! চাইনি এই নামটা কেউ বার বার পড়ুক!”

হাসলো নীতি। নাহিয়ান এগিয়ে আসলো ওর দিকে। নীতি নড়লো না। নাহিয়ান আলতো করে নীতির কপালে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে দিলো।

“ফাইনালি!”

“কি?”

“সম্পূর্ণরূপে তোমার হয়ে গেলাম।”

নীতি মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো। নাহিয়ান ভ্রু নাচিয়ে বলল, “বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে, এখন কি করবে?”

“নাচবো!”

“ওকে নাচো, আমি দেখি!”

“নাহিয়ান!”

নাহিয়ান হেসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ধীরে ধীরে বাঁধন শক্ত হলো।

“আমার এখনও সবটা কল্পনার মতো মনে হচ্ছে প্রিয়!”

বলেই কপালে গভীরভাবে চুমু এঁকে দিলো সে। অতঃপর নীতির গলায় তার অধর ছোঁয়ালো। কেঁপে উঠলো নীতি। লেহেঙ্গার ওড়না মুঠো করে ধরলো সে। জিভ দিয়ে ঠোঁট কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ডাকলো, “নাহি..”

কথা সম্পূর্ণ করার আগেই নাহিয়ান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নীতির কোমর জড়িয়ে ওকে নিজের কাছে টেনে নিলো। নীতির সাথে কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়ালো সে। চোখ বন্ধ তাদের। নাহিয়ান মিহি কণ্ঠে বললো, “আমি উন্মাদ হয়েছি প্রিয়। তোমায় পেতে ইচ্ছে করছে। প্লিজ, মে আই?”

নীতি উত্তর দিলো না। খামচে ধরলো নাহিয়ানের শেরওয়ানি। নাহিয়ানের উত্তরের প্রয়োজন আর হলো না। আলতো করে নীতির ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। ধীরে ধীরে স্পর্শ গভীর হতে লাগলো। অতঃপর ডুব দিলো ভালোবাসাময় এই রাতের আঁধারে!

#চলবে

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।)

প্রিয় অনুভব পর্ব-২৬+২৭

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৬

বর্ষা আর রাদিফ একটু দূরে যেতেই নীতি ওদের পিছু ছুটলো। ভদ্র মহিলাটি অসহায় চোখে নাহিয়ানের দিকে তাকাতেই নাহিয়ান ভরকে গেলো। এখন কি ওকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমার নাম কি মা?’।পরক্ষণেই মাথা ডান বাম করে ঝেড়ে মেকি হাসলো। মহিলাটি কিছু বলার আগেই সে ঝটপট বলে উঠলো, “আসি আন্টি!”

বলেই সেও চলে আসলো ওদের পিছু। মহিলাটি বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “যেই পরিস্থিতি দেখছি, আমার ছেলের জন্য মেয়ে পাবো না পরে। না, না! জলদি মেয়ে খুঁজতে হবে!”

__________________________________

রাদিফের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীতি। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। বিস্ময়ের রেশ এখনো কাটেনি তার। নাহিয়ান রাদিফের পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে। আর রাদিফ? সে মনের আনন্দে বসে বসে শিস বাজাচ্ছে।

“তুমি ওই আন্টিকে কি বললে?”

“কি বললাম?”

“তুমি বর্ষার জামাই হও?”

“অবশ্যই!”

“বিয়ে কবে হলো তোমাদের?”

“তুই ই তো দিয়েছিলি!”

নীতি চমকে উঠে বললো, “মানে?”

“মানে আবার কি? ছোটবেলায় তো রান্না বাটি খেলার সময় আমাকে ওর জামাই বানিয়ে তোর ঘরে গেস্ট হিসেবে এনেছিলে! মনে নেই!”

নীতি থতমত খেলো। তেজী কণ্ঠে শুধালো, “ওটা খেলা ছিলো!”

“আমি সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছি, কিছু করার নেই।”

নীতি হতাশ হলো। চেয়ার টেনে নিজেও এবার বসে পড়লো। আশেপাশে চেয়ারের ছড়াছড়ি। বর্ষাকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীতি আরেকটা চেয়ার টেনে ওকে বসিয়ে দিলো। এবার হয়তো বর্ষার বিস্ময় কাটলো। নীতির দিকে একবার তাকিয়ে আবার রাদিফের দিকে তাকালো।

“মজা নিও না তো ভাইয়া? ”

রাদিফ এবার সোজা হয়ে বসলো, “তুই আর না মান, তোর এই বান্ধবীকে আমি বোঝ জ্ঞান হবার পর থেকেই পছন্দ করি। এখন তুই মজা হিসেবে নিবি নাকি সিরিয়াসলি তোর ব্যাপার!”

নীতি এবার নাক মুখ কুঁচকে বললো, “ছি, লজ্জা করে না? বোনকে এভাবে পছন্দ করার কথা বলছো। আবার তারই বান্ধবীর কথা বলছো?”

“সেদিন ছাদে তোরা দুইজন যে আমি আর ভাইয়া উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কি করেছিলে সেটা মনে করিয়ে দিবো? আমরা তো তোকে তাও সুযোগ দিয়েছি!”

নাহিয়ান গলা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নীতিকেও টেনে দাঁড় করিয়ে বললো, “চলো, এখান থেকে। বর্ষার ব্যাপার, বর্ষাকে বুঝতে দেও।”

“আরে, কিন্তু!”

নীতি কিছু বলার সুযোগ পেলো না তার আগেই নাহিয়ান ওকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। বর্ষা ওদের যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনে নিজেও উঠে চলে গেলো। রাদিফ বাঁধা দিলো না। আপাতত বিষয়টা কেমন যেনো হয়ে গিয়েছে। তাই ওকে একটু ভাবার সময় দেয়া উচিত!

__________________________________

“আজব, আমায় এখানে আনলেন কেনো? কথা বলছিলাম তো!”

“এত কথা কিসের তোমার?”

“আরে আমায় জানতে হবে না সব?”

“জেনে কি করবে? আগে বর্ষাকে জানতে দেও! তুমি যদি নিজেই সব প্রশ্ন করে ফেলো তাহলে বর্ষা কি বলবে? ওদের নিজেদের একা কথা বলা উচিত। যেমন পরিস্থিতি হলো এতে বর্ষা এখনও হয়তো অস্বস্তিতে আছে। এখন ওর হয়ে তুমি ই সব বলে দিলে ও কিছুই বলবে না। পরে বর্ষা স্বাভাবিক হবে না!”

“কি এমন অস্বাভাবিক হওয়ার বিষয় ঘটেছে? সামান্য ব্যাপার!”

“প্রিয় আর অনুভব হিসেবে আমাদের প্রথম দেখা যখন হয়েছিল, তখনও কিন্তু ব্যাপারটা সামান্যই ছিলো।”

নীতি চুপ করে গেলো। বাড়ির পিছনদিকে আছে তারা। মৃদু আলোয় চারপাশটা ফুঁটে উঠেছে। নীতি আকাশপানে তাকালো। মিহি কণ্ঠে বলে উঠলো, “আজকের আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে, দেখেছেন?”

“আমার সামনেই আমার চাঁদ উপস্থিত, আকাশ দেখার প্রয়োজন নেই!”

নীতি হাসলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো, “সেদিন যদি আপনাকে নিজের কথাগুলো ব্যাক্ত না করতাম, তাহলে আপনিও আমাকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিতেন না। আর দুজন আলাদা থাকতাম আজ!”

নাহিয়ান নীতির চোখের দিকে তাকালো। নীতি আবারও হেসে বললো, “আমিহীনা অস্তিত্ব কি করে সামলে উঠতেন অনুভব?”

নাহিয়ান হাসলো। নীতির কনিষ্ঠ আঙ্গুল নিজের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলো।

“পুরনো কথা কেনো তুলছো?”

“হঠাৎ মনে আসলো!”

“ভুলে যাও!”

“পুরোনো সব স্মৃতি?”

“উহু, সব না! আমাদের সুখকর মুহূর্তগুলো বাদে, কিছু বিষাক্ত মুহূর্ত ভুলে যাও!”

“বিষাক্ত মুহূর্ত তো ছিল না!”

“কেনো? সেই দুঃখগুলো বিষাক্ত নয়?”

“আপনার সাথে সম্পর্কিত সেই দুঃখগুলোও আমার সুখ ছিল!”

নাহিয়ান চুপটি করে তাকিয়ে রইলো। নীতি হাসলো।

“কি দেখছেন?”

“প্রেমময়ীকে!”

“কেনো?”

“একটু বেশীই সুন্দর লাগছে তাকে।”

“আর আপনায় স্নিগ্ধ!”

নাহিয়ান মুচকি হাসলো। নীতি আবার বলে উঠলো,

“ভালোবাসা কী জানো স্নিগ্ধ মানব?”

“হুমম, জানি!”

“কী বলুন তো?”

“আমার স্নিগ্ধময়ী নামক অনুভুতি!”

“স্নিগ্ধময়ী?”

“হুমম, আমি স্নিগ্ধ মানব হলে, তুমি স্নিগ্ধময়ী। আর স্নিগ্ধময়ী হলো, তুমি নামক স্নিগ্ধতা!”

নীতি নাহিয়ানের চোখে চোখ রাখলো। নাহিয়ান নীতির এক হাত নিজের বুকের বা পাশে রাখলো। অতঃপর ছন্দ সুরে মিলিয়ে শুধালো, “তুমি আমার মন গহীনের
অন্যতম অনুভূতি,
তোমার মন মাতানো ছন্দে আমি
হারাই মনের গতি!
যার মাঝেতে আমি খুঁজে পাই—
আমার সকল ছন্দ,
তোমায় আমি ভালোবাসি,
এ কথা নয় মন্দ!”

নীতি নাহিয়ানের কিছুটা কাছে এগিয়ে এলো। পলক না ফেলেই বলতে শুরু করলো, “মন্দ নয় এই ভালোবাসার কথন, স্নিগ্ধ কেবল প্রতিটা মুহূর্ত! এভাবেই থমকে থাকুক সময়, চলতে থাকুক প্রিয় অনুভবের প্রহর!”

__________________________________

বিয়ের আমেজ শেষ! দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। সকলে নিজেদের দৈনন্দিন কাজে ব্যাস্ত। এর মাঝে সব ঠিক থাকলেও পরিবর্তন এসেছে তূর্ণা আর বর্ষার মাঝে। রাদিফকে সে পছন্দ করলেও নিজের মাঝে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। আদো এসব নিয়ে কি তার ভাবা উচিত? সেদিনের পর রাদিফের সাথে কথা হয়নি তার। মূলত অস্বস্তির জন্যে সে কথা বলতে পারছে না। না পারছে নিজের মনে জমা প্রশ্নগুলো করতে, নিজের না বলা কথাগুলো ব্যক্ত করতে।

অন্যদিকে নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে না পেরে দিন দিন নিশ্চুপ মানবী হয়ে উঠছে তূর্ণা। এই অনুভুতির সাথে সে পরিচিত নয়। সবসময় হাসি, ঠাট্টা করা মেয়েটি হুট করেই কেমন হয়ে গেলো। নিজের পরিবর্তনে চরম অবাক সে! কেনো হচ্ছে এমন? রিকশায় বসে এসব ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ভাবনাগুলো থেকে মুক্তি পেতে আশেপাশে তাকালো। পরমুহূর্তেই চোখ আটকে গেলো তার। চলন্ত রিকশায় থেকেও কয়েক সেকেন্ডের জন্য দৃষ্টি সেখানে থমকালো। আরহাম একটা মেয়ের সাথে বসে আছে পার্কে। হেসে হেসে কথা বলছে তারা। সেকেন্ড কয়েকের থমকানো দৃষ্টিতেই সে উপলব্ধি করলো তার মনে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ দিয়ে নোনা পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে। লম্বা, লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করলো তূর্ণা। বাড়ি পৌঁছেই দীর্ঘক্ষণ শাওয়ার নিলো সে। বের হতেই তার মায়ের ডাক পড়লো। আরহাম পড়াতে এসেছে। চুলের পানি না ঝরিয়েই ওড়না মাথায় দিয়ে চলে গেলো সে। চুপচাপ বসে পড়লো আরহামের সামনে। আরহাম চোখ তুল তাকালেও তূর্ণা তাকায়নি। অবাক হচ্ছে আরহাম। বিয়ে বাড়ি থেকে আসার পরই কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। এত শান্ত তো সে নয়! যেখানে পড়তে বসলেই কথা বলে সময় নষ্ট করার চেষ্টায় থাকতো তূর্ণা সে এখন প্রয়োজন ছাড়া কিছুই বলে না। আরহাম খেয়াল করলো তূর্ণার চোখ ফুলে আছে। তবুও এড়িয়ে গিয়ে ওকে ফিজিক্স করতে দিলো। তুর্ণা চুপচাপ সেটা সলভ করে দিলো। আরহাম প্রসন্ন হয়ে বললো, “ভেরি গুড। এভাবে পড়তে থাকলে এবার তোমার রেজাল্ট ভালো হবে তূর্ণা। তোমার ব্রেইন মাশাআল্লাহ। যদি এই মনোযোগ আগে দিতে এখন ভালো ভার্সিটিতে থাকতে। যাক ব্যাপার না, আরেকটু পরিশ্রম করো। ভালো কিছু পাবে দেখো!”

তুর্ণা এবার চোখ তুলে তাকালো। মলিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে পেতে হলে কি করতে হবে আরহাম ভাইয়া?”

চমকে তাকালো আরহাম। তুর্ণা তখনও তাকিয়ে। নীরব দৃষ্টি বিনিময় হলো তাদের মাঝে। অতঃপর আরহাম গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

“কি বলতে চাইছো?”

তুর্ণা আবারও নিজের মলিন কণ্ঠে বলে উঠলো, “আপনাকে পেতে হলে কি করতে হবে আমায়?”

“পড়ায় মন দেও তূর্ণা!”

“উত্তর চাই আমার!”

“আমি তোমার শিক্ষক!”

তুর্ণা নিশ্চুপ রইলো। আরহাম আবার নিজের পড়ানোতে মন দিলো। পড়া শেষে সে যেতে নিলেই তূর্ণা বলে উঠলো, “বললেন না তো আরহাম ভাই!”

“এসব কথা পরবর্তীতে বললে আমার পক্ষে তোমাকে পড়ানো আর সম্ভব হবে না।”
এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না আরহাম। চলে গেলো সে।

এদিকে কথাটা শোনা মাত্রই তূর্ণার বুক কেঁপে উঠলো। চোখ ছল ছল করে উঠলো। তুর্ণার জানা নেই কেনো সে এ কথা বললো! তবে মনকে বেঁধে রাখতে চায় না সে। একদম না! মনের কথা শোনা উচিত! এতে যদি দুঃখ থেকেও থাকে, তবুও শান্তি পাওয়া যায়। আর প্রত্যেকেরই সেই শান্তি পাবার অধিকার আছে। আছেই!

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৭

পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে নীতি। এখানে এসেছে প্রায় মিনিট দশেক হয়ে গিয়েছে। নাহিয়ানের আসার নাম নেই। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো সে। দুটো বেজে দশ মিনিট। এখন তো অফিসে লাঞ্চ ব্রেক থাকার কথা। অফিস থেকে একটু দূরেই পার্কে বসে আছে সে। পাশে রাখা বিরিয়ানির বক্সের দিকে তাকালো। আজ প্রথমবার রান্না করেছে সে। যদিও নিজের ইচ্ছায় না, মায়ের জোরাজুরিতে। হুট করেই ইচ্ছে হলো নাহিয়ানের জন্য নিয়ে যাওয়া উচিত তার। ব্যস! চলে এসেছে।

“সরি! লেট হয়ে গেলো।”

নাহিয়ানের আওয়াজ শুনে ওর দিকে তাকালো নীতি। গ্রে রঙের শার্ট আর ব্ল্যাক পরিহিত মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো সে। বরাবরের শার্টের মতোই উপরের দুটো বোতাম খোলা তার। চুলগুলো এলোমেলোভাবে কপালে পড়ে আছে। ঠোঁটের কোণে সেই ক্লান্তি মাখা হাসি। সেই হাসিতে নীতির মন প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। ইশ, মানুষটা তার ব্যাস্ততার মাঝেও হুটহাট নীতির ডাকে চলে আসে। সেও মুখে হাসির রেখা ফুঁটিয়ে তুললো। নাহিয়ান বসলো ওর পাশে। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো, “হঠাৎ এখানে যে?”

“দেখতে আসলাম।”

“কাকে?”

“আপনায়!”

“এতদূর?”

“বেশি দূর নয়।”

বলেই নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল আর সাথে থাকা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো, “মুখে একটু পানির ঝাপটা দিয়ে নিন।”

নাহিয়ান বিনা বাক্যে নিয়ে নিলো। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিলো সে।

”অফিসে কাজের খুব প্রেসার তাই না?”

রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নাহিয়ান উত্তর দিলো, “যতক্ষণ অফিসে থাকি ততক্ষণ প্রেসার থাকে। এরপর তেমন কিছু থাকে না!”

নীতি ভ্রু কুঁচকে বললো, “অফিসে কাজ থাকবে না তো কি বাসায় থাকবে?”

নীতির কথা শুনে হাসলো নাহিয়ান। নীতি ততক্ষণে বক্স এগিয়ে দিলো নাহিয়ানের দিকে। হাত বাড়িয়ে চামচ দিয়ে বললো, “এখন ঝটপট খেয়ে বলুন তো, কেমন হয়েছে?”

নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।

“কি হলো?”

“কি এটা?”

“খুলে দেখুন!”

বক্স হাতে নিলো সে। বিরিয়ানি দেখে হাসি চওড়া হলো তার। বিরিয়ানি বড্ড পছন্দের তার!

“তুমি বানিয়েছো?”

“হুমম!”

নাহিয়ান অবাক হওয়া কণ্ঠে শুধালো, “হঠাৎ?”

নীতি নড়েচড়ে বসলো। অতঃপর বললো, “মা বলছিলো রান্না বান্না পারি না, শ্বশুর বাড়িতে কি করে খাওয়াবো সবাইকে। এখন মা তো আর জানে না, তার মেয়ে কত ট্যালেন্টেড। তাই একটু চমকে দিতে বানিয়েছি। যদিও ইউটিউব দেখে করেছি। আর সবাই বলেছে ভালো হয়েছে। আমি এখনও টেস্ট করিনি। আপনার কথা মনে পড়লো, তাই দেরি না করে নিয়ে আসলাম।”

নাহিয়ান হাসলো। মধ্যাহ্নের এই সময়ে আশেপাশে কাউকে খুঁজে পাওয়া দায়। বিরিয়ানি বক্স নীতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “কষ্ট করে এনেছো যখন, খাইয়েও দেও!”

নীতি কয়েক পলক তাকালো নাহিয়ানের দিকে। অতঃপর চামচ দিয়ে খাওয়াতে নিলেই নাহিয়ান গাল ফুলিয়ে বললো, “হাত দিয়ে খাওয়াতে অসুবিধা হবে নাকি?”

হাসলো সে। বোতল থেকে পানি নিয়ে হাত ধুয়ে নিলো। অতঃপর এক লোকমা নাহিয়ানের মুখের সামনে ধরে বললো, “এবার হয়েছে?”

নাহিয়ান খাবারটুকু মুখে নিয়ে জবাব দিলো, “হুমম!”

নীতি আর কিছু বললো না। খাওয়ার মাঝেই নাহিয়ানের চোখ যায় নীতির ডান হাতের দিকে। সেখানে কেমন হালকা কালচে দাগ হয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত টেনে নিজের সামনে আনলো সে।

“এটা কিসের দাগ?”

নীতি তাকালো। হেসে বললো, “এটা? রান্নার সময় গরম কড়াইয়ে হাত লেগে গিয়েছিলো!”

নাহিয়ান মিহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “জ্বলছে না?”

নীতি ডানে বামে মাথা নাড়লো।

“সত্যি?”

“সত্যিই!”

“খেয়াল করে কাজ করা দরকার ছিল তোমার! এত বেখেয়ালি হও কেনো তুমি? ওষুধ লাগিয়েছো? তুমি তো আবার নিজের যত্ন নিতে পারো না!”

নীতি হাসলো। নাহিয়ানের চোখে চোখ রেখে বললো, “যত্ন রাখার জন্য আপনি আছেন তো! তাহলে নিজে কেনো এত কষ্ট করবো?”

নাহিয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। পরক্ষণেই নীতির হাতে থাকা বক্স থেকে বিরিয়ানি নিয়ে ওর সামনে ধরলো। নীতি মাথা পিছু নিয়ে নিলো।

“আপনি খান! আমি বাসায় গিয়ে খাবো। এখানে কেবল একজনের খাবার।”

“হা করো!”

নীতি কিছু বলতে নিবে তার আগেই নাহিয়ান চোখ রাঙ্গালো। উপায় না পেয়ে নীতি বিনা বাক্যে খেয়ে নিলো। অতঃপর নাহিয়ান বললো,

“ভাগাভাগি করে খেলে ভালোবাসা বাড়ে!”

“এখন কি কম আছে নাকি?”

“কম আছে নাকি জানা নেই। তবে চাই আমাদের মাঝে শত ঝগড়া, মান-অভিমান, রাগারাগি হোক না কেনো, কখনো যেনো তা ভালোবাসাকে ডিঙিয়ে যেতে না পারে!”

“তারপর?”

“তারপর আবার কি?”

“শেষ করুন এখন, আমি আর খাচ্ছি না! ভালোবাসা বাড়ার জন্য ভাগাভাগি করে অন্যদিন খাবো। এখন শেষ করে জলদি ফিরে যান। সময় যাচ্ছে!”

“যেতে ইচ্ছে করছে না!”

“করতে হবে! জলদি জলদি, আমাকেও বাড়ি ফিরতে হবে।”

“একা যাবে?”

“আপনি যাবেন সাথে?”

“হুমম, চলো!”

“অফিস কে করবে?”

“তোমায় দিয়ে এসে করবো!”

নীতি হাসলো। বাম হাত দিয়ে আলতোভাবে নাহিয়ানের চুল ঠিক করে দিতে দিতে বললো, “এখন সন্ধ্যা নয়! চারপাশ উজ্জ্বল, অন্ধকার নেই। তাই ভয়ও নেই। সেজন্য আপনাকে এত ভাবতে হবে না। আমি চলে যাবো!”

“কিন্তু..”

“কিন্তু পরন্তু করলে আমি আর আসবো না এমন করে!”

নাহিয়ান হাসলো। খাওয়া শেষে দুইজনেই উঠলো। নীতিকে রিকশায় উঠিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিলো সে। রিকশা চোখের আড়াল হতেই নাহিয়ানও ছুটলো তার অফিসের দিকে! অতঃপর দুজনার সুন্দর আরেকটি মুহূর্ত স্মৃতিতে জমা হলো!

__________________________________

“আমার দিকে না তাকিয়ে পড়ায় মন দেও তূর্ণা।”

চুপচাপ পড়ার ফাঁকে আড়চোখে আরহামকে দেখে চলেছিলো তূর্ণা। আরহাম গম্ভীর দৃষ্টিতে সামনে আরেকটা বই নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছে। তুর্ণার দিকে না তাকিয়েও সে বুঝতে পেরেছে তূর্ণা তার দিকেই তাকিয়ে। তুর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মৃদু স্বরে বললো, “আপনি আমাকে আর পড়াতে আসবেন না ভাইয়া!”

আরহাম চমকালো। তবে বাহিরে সেটা প্রকাশ না করেই তূর্ণার দিকে তাকালো সে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বললো, “নতুন টিচার রেখেছে চাচী?”

“তো আমি না পড়ালে, পড়াবে কে?”

“ম্যানেজ করে নিবো!”

“কি ম্যানেজ করবে? তোমার এখন একটা দিন লস মানেই অনেক কিছু লস যাবে, বোঝো?”

“যাক!”

তুর্ণার এমন জবাবে আশাহত হলো আরহাম।

“ফেইল করতে চাও নাকি আবার?”

“জানা নেই!”

“তোমার সমস্যা কি তুর্ণা?”

তুর্ণা এবার আরহামের চোখে চোখ রাখলো। স্পষ্টভাবে উত্তর দিলো, “আমার সমস্যা আপনি! মন শান্ত হচ্ছে না আমার। আমি এই অনুভুতির সাথে পরিচিত নই। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বার বার মনে বলছে আপনাকে চায়! আমি মনোযোগ দিতে পারছি না। অসহ্য লাগছে সবটা!”

কথার মাঝেই চোখ ছল ছল করে উঠলো তূর্ণার। আরহাম লম্বা নিঃশ্বাস নিলো। অতঃপর বলে উঠলো, “আমি গেলে পড়ায় মনোযোগ দিবে? সমস্যা সমাধান হবে? যদি হয়, তবে সত্যিই আসবো না। বলো এখন কি চাও?”

তুর্ণার বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। সত্যিই মানুষটা আসবে না? চোখ নিচে নামিয়ে নিলো সে। অস্পষ্ট স্বরে বললো, “আপনাকে চাই!”

আরহাম বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। এ কোন জ্বালা? অতঃপর কিছু একটা ভেবে বললো,

“বেশ ঠিক আছে!”

তুর্ণা চমকে তাকালো। আরহাম কি মেনে নিলো সব?

“দেখো তুর্ণা, আমি বরাবরই পড়ালেখা নিয়ে সিরিয়াস। তা তুমি ভালো করেই জানো। সেই হিসেবে আমি চাইবো আমার সঙ্গীনি যে হবে সেও একজন ব্রাইট স্টুডেন্ট হোক। তাই তোমাকে এক বছর সময় দিলাম। মানে তোমার বোর্ড পরীক্ষা পর্যন্ত সময়। যদি তুমি প্রতিটা বিষয়ে এ প্লাস আনতে পারো তবেই আমায় পাবে। নয়তো না! রাজি?”

তুর্ণা ভাবলো কিছুক্ষণ। অতঃপর বলে উঠলো, “রাজি!”

আরহাম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আপাতত বুঝ দেয়া গিয়েছে এতেই শান্তি। আবার তার এও বিশ্বাস, তূর্ণা কখনোই তার শর্ত পূরণ করতে পারবে না! ব্যস, সমস্যা সমাধান!

__________________________________

ভার্সিটির গেটের বাইরে পা রাখতেই অদূরে রাদিফের দেখা পেলো বর্ষা। ওকে দেখা মাত্রই দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলো সে। রাদিফকে কোনো মতে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো। রাদিফ এতক্ষণ ফোন দেখছিলো। বর্ষার উপস্থিতি টের পেতেই খেয়াল করলো বর্ষা ওকে এড়িয়ে সামনে চলে গিয়েছে। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে পিছু চললো সেও।

“বর্ষা!”

থামলো বর্ষা। তবে ঘুরে তাকালো না। রাদিফ সামনে এসে দাঁড়ালো ওর। বর্ষা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

“এড়িয়ে চলার কারণ কি?”

“এড়িয়ে চলছি কোথায়?”

“তো দেখেও, না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছো কেনো?”

“আমি সত্যিই খেয়াল করিনি।”

“আমার হাইট কি অনেক কম?”

এমন প্রশ্নে থতমত খেলো বর্ষা। অবুঝের মত তাকালো সে।

“হ্যাঁ?”

“আমি কি হাইটে ছোট?”

“না তো!”

“তাহলে নিচে তাকিয়ে কথা বলছো কেনো?”

বর্ষা আমতা আমতা করতে লাগলো।

“তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো, চলো!”

বর্ষা বিনা বাক্যে হাঁটতে শুরু করলো। দুজনের মাঝে এক হাতের দুরত্ব। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর রাদিফ বলে উঠলো,

“এসব রিলেশনে আমি বিশ্বাসী নই। তাই আগে বলিও নি আমার পছন্দের কথা। কিন্তু মা জানে এর ব্যাপারে। ইচ্ছে ছিলো একবারে বিয়ের পর বলবো। বাট সেদিন ওই আন্টির কথা শুনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি।”

বর্ষা নিরুত্তর রইলো।

“আমি তোমায় পছন্দ করি, এক কথায় ভালোবাসি। এটা অনেক আগে থেকেই। আমি এও জানি তুমিও হয়তো আমায় পছন্দ করো!”

বর্ষা দাঁড়িয়ে গেলো। চমকে তাকালো রাদিফের দিকে। রাদিফ কনফিউজড হয়ে বললো, “সিউর না, বাট মনে হতো আরকি!”

বলেই হাত দিয়ে সামনে যাওয়ার ইশারা করলো। বর্ষা আবার হাঁটা শুরু করলো।

“আমি ভেবেছিলাম তোমার পড়াশোনা শেষে তোমাকে এগুলো বলবো, কিন্তু ওই আন্টির মত এখন অন্যকেও যদি তোমাকে তার ছেলের বউ করে ফেলে তাহলে আমাকে দেবদাস হতে হবে। এত রিস্ক নিতে পারবো না। তুমি বিয়ের পরেও পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে পারবে। বিয়ের আগে বা পরে যখনই হোক, পড়াশোনা মাস্ট কমপ্লিট করা লাগবে। কিন্তু যদি তোমার অন্য কাউকে পছন্দ থাকে বা আমায় পছন্দ না করো তাহলে বলে দিতে পারো। এই বিষয় এখানেই শেষ হবে!”

বর্ষা চুপ করে রইলো।

“আমি উত্তরের আশায় আছি।”

মনে মনে সাহস জুগিয়ে বলে উঠলো, “কোনোটাই নয়!”

“তাহলে কি ধরে নিবো?”

বর্ষা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, “বিয়ে না করলেও পড়াশোনা করা লাগবে, করলেও করা লাগবে। এর থেকে ভালো বিয়ে করেই পড়াশোনা করি!”

“ইনডাইরেক্টলি মত দিলে?”

বর্ষা ঠোঁট চেপে হেসে বললো, “ডাইরেক্টলি ই দিলাম!”

রাদিফ হাসলো। পকেটে হাত গুঁজে বললো, “বললেই পারো আমাকে বিয়ে করার তাড়া অনেক তোমার!”

“মোটেও না!”

“অবশ্যই হ্যাঁ!”

“তাইলে করলাম না বিয়ে!”

“কিন্তু আমি তো এক কথার মানুষ।”

বর্ষা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। রাদিফ হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “সবসময় এমন থাকবে। এড়িয়ে গিয়ে চুপচাপ থাকবে না। অমন বর্ষাকে আমি ভালোবাসি না!”

বর্ষা চুপ করে রইলো। অতঃপর হেঁটে চললো দুজন।
__________________________________

সমস্ত কিছু পেরিয়ে অবশেষে সম্পন্ন হলো বর্ষা আর রাদিফের বিয়ে। বর্ষাকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে নীতিরা। সারাদিনের ছোটাছুটির কারণে ক্লান্ত সে। এখনও রিসেপশন বাকি। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো সে। তখনই ফোন বেজে উঠলো। অলস ভঙ্গিমায় উঠে ফোন নিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। অতঃপর কল রিসিভ করে ক্লান্তি মাখা কন্ঠে বললো, “হ্যালো!”

“বাড়ি পৌঁছেছো?”

“হুমম, আপনারা?”

“একটু আগেই!”

“ওহ!”

“ক্লান্ত ভীষণ?”

“হুমম!”

“ঘুমাও তবে। রাখছি!”

“উহু!”

“কি উহু?”

“কথা বলুন, ভালো লাগছে!”

নাহিয়ান হাসলো।

“সময় খুব দ্রুত যাচ্ছে , তাই না নীতি?”

“হুমম!”

“সবাই তাদের মানুষকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পেয়ে যাচ্ছে।”

“হুমম!”

“আমাদের এমন মুহূর্ত কবে আসবে?”

নীতি অস্পষ্ট আওয়াজে বলে উঠলো, “যখন আপনি চাইবেন!”

অস্পষ্ট হলেও নাহিয়ান বুঝেছে সবটা।

“ভার্সিটি শেষ করো নীতি। আমিও একটু নিজেকে ঠিকভাবে দাঁড় করাই, তারপর তোমাকে নিয়ে আসবো! সম্পূর্ণ নিজের করে!”

নীতি হাসলো তবে উত্তর দিলো না।

“নীতি?”

“হুমম!”

“ভালোবাসি!”

“হুমম!”

নাহিয়ান বুঝতে পারলো নীতি ঘুমের দেশে যেতে চলেছে। হাসলো সে, তবে ফোন কাটলো না। ওভাবেই কানে রেখে শুয়ে পড়লো। কোনো কথা নেই। কেবল আসছে ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ! কিছু মুহূর্ত বার্তাহীন হয়েও সুন্দর হয়! তাই না?

#চলবে

প্রিয় অনুভব পর্ব-২৪+২৫

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৪

“তোর মামাতো বোনকে সামলে রাখ প্রীতি।”

প্রীতি সবে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসেছিলো। নীতির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে রাগে ফুসছে।

“কি হয়েছে? কি করেছে ও?”

“তোর বোনের এত দরদ কেনো নাহিয়ানের প্রতি? নাহিয়ান চা না চাইতেই চা নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছে সে!”

প্রীতি বিরক্ত হলো।

“সবাইকেই ও চা দিয়েছে। কি এমন হয়েছে শুনি?”

“দেয়ার ভঙ্গিমা স্বাভাবিক থাকলে আমি কিছুই বলতাম না। এসে নব বধূর মতো বলে, ‘আপনার চা!’, হুহহ, ঢং!”

“বেশি ভাবিস তুই। মাথা খাইস না তো!”

বলেই বারান্দায় চলে গেলো। নীতি রেগে আবার বেরিয়ে এলো। সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখলো নাহিয়ান এক হাত দিয়ে কপাল স্লাইড করতে করতে উপরে উঠছে। নজর তার নিচের দিকে। নীতি একটু আড়ালে চলে গেলো। নাহিয়ান নিজের রুমে যেতেই নিচে তাকালো সে। টেবিলের উপর চায়ের কাপটা রাখা। খায়নি সে। মুচকি হাসলো সে। জলদি করে নিচে নামলো সে। দুধ ছাড়া কড়া করে রং চা বানালো। অতঃপর সিনথীকে ডেকে বললো,

“তোর নাহিয়ান ভাইয়াকে দিবি এটা। আর বলবি ঢং কম করতে বলেছে প্রিয়। খেয়ে নিতে বলেছে, ব্যাথা কমে যাবে।”

সিনথী বুঝলো না। অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। নীতি তাড়া দিয়ে বললো, “এটা সিনেমার ডায়লগ। যা এখন! এত বুঝা লাগবে না তোর।”

সিনথী কথামতো নাহিয়ানের কাছে গেলো। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো, “ঢং কম করতে বলেছে প্রিয়। খেয়ে নিতে বলেছে, ব্যাথা তাহলে কমে যাবে।”

নাহিয়ান মুচকি হেসে চা নিলো। সিনথীর গাল টেনে বললো, “ধন্যবাদ প্রিয়!”

পর্দার আড়ালে থাকা নীতি মুচকি হাসলো।
__________________________________

মিষ্টি রঙের শাড়িকে লেহেঙ্গার মত করে পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নীতি। ঘোরার তেমন কোনো কারণ নেই। নাহিয়ানকে খুঁজে পাচ্ছে না সে। কোথায় যে গেলো মানুষটা! সারা বাড়ি ঘুরে বিরক্ত হয়ে নিজের রুমে এলো সে। হলুদের আয়োজন বাগানে হয়েছে। সবাই সেখানেই। নীতি আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। মিষ্টি রঙের শাড়ির সাথে গাঢ় নীল রঙের ব্লাউজ। গলায় অ্যান্টিকের হার, কানে ঝুমকো। সেই সাথে মাথায় টিকলি লাগিয়েছে সে। বুঝে উঠতে পারছে না এভাবে তাকে কি ভালো লাগছে, নাকি না! সবাইকে সাজিয়ে নিজেরই সাজতে দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন আপাতত সব সেখানে। হয়তো নাহিয়ানও ওখানে। ভাবনার মাঝেই কেউ ওর হাত ধরলো। ফলস্বরূপ চমকে উঠলো নীতি। হাত ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও নাহিয়ানকে দেখে স্বাভাবিক রইলো। ড্রেসিং টেবিলের উপর ব্লাউজের সাথে ম্যাচিং করা খাঁজ কাটা কাচের চুড়ি রেখেছিলো পড়ার জন্য। নাহিয়ান সাবধানতার সাথে সেগুলো পরিয়ে দিতে লাগলো। নীতি একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। নীল রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত যুবকটিকে দেখে মুগ্ধ হলো সে। পাঞ্জাবীর উপরের তিনটা বোতাম খোলা থাকায় তার বুক দৃশ্যমান। হুট করেই নীতির ইচ্ছে হলো তাকে একটু ছুঁয়ে দিতে। পরক্ষণেই চোখ গেলো ঠোঁটের দিকে। সেদিনের স্পর্শের কথা মনে হতেই বাম হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট ঢাকলো নীতি। নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

“কি হলো?”

নীতি ডানে বামে মাথা নেড়ে বোঝালো কিছু না।

“ওই হাত দেও।”

নীতি বিনা বাক্যে হাত বাড়িয়ে দিলো। চুড়ি পড়ানো শেষে নাহিয়ান বলে উঠলো, “সারা বাড়ি আমাকে খুঁজছিলে কেনো?”

নীতি চোখ ছোট ছোট করে বললো, “আপনি জানলেন কি করে আপনায় খুঁজছি?”

“যেভাবে আমাদের রুমে উকি দিচ্ছিলে, তারপর এদিক ওদিক খুঁজছিলে। আমি ছাড়া আর কাউকে তো এভাবে খোঁজার কথা না!”

“বয়েই গিয়েছে আপনাকে খুঁজতে।”

“তাই?”

“হুমম, নিচে চলুন!”

বলেই এগিয়ে গেলো সে। নাহিয়ান হাসলো।

__________________________________

“এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে একা?”

রাদিয়ার কণ্ঠ শুনে ওর দিকে তাকালো নাহিয়ান। অফিসের কিছু ইমেইল চেক করার জন্য একটু নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়েছে সে।

“অফিসের ইমেইল চেক করছিলাম।”

”ওহ!”

বলে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। নাহিয়ান কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। ওকে এড়িয়ে চলে আসতে নিবে সেই মুহূর্তে রাদিয়া বলে উঠলো, “আমায় কেমন লাগছে?”

নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আশ্চর্য! মেয়েটা এমন কেনো? তবুও মুখে বললো, “সবাইকেই সুন্দর লাগছে!”

বলেই স্টেজের দিকে গেলো। না জানি কখন নীতি দেখে ফেলে। এমনিতে নাহিয়ানেরও মনে হলো রাদিয়ার কথা বার্তার মাঝে কিছু আছে। একে এড়িয়ে চলাই ভালো।

“কই ছিলি তুই?”

রীতির প্রশ্ন শুনে নাহিয়ান ওর পাশে বসে বললো, “অফিসের কাজ ছিল একটা। ওটাই করে আসলাম!”

বর্ষা নাহিয়ানের পাশে এসে দাঁড়ালো।

“কাজ নাকি অন্য কিছু?”

নাহিয়ান হেসে বললো, “অন্য কিছু কি হবে আবার?”

“নাহ, কালকে যা যা শুনলাম আপনাদের দিয়ে আর বিশ্বাস নাই। নীতিও এখানে নেই। তাই বললাম!”

নাহিয়ান হাসলো কেবল। প্রীতি মাঝে বলে উঠলো, “আসলেই, আপনি আর নীতি এমন দুইজন মানুষ, যাদেরকে ঝগড়া ছাড়া তেমন আলাপ করতে দেখিনি। তাদের মাঝে কি করে কি হয়?”

“ঝগড়া তো আমি করি না! তোমার বোন করে।”

“আমি ঝগড়া করি?”

হঠাৎ নীতির আগমনে নাহিয়ান ভরকে গেলো। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো, “কোনো সন্দেহ আছে?”

”শুরুটা আপনি করেন, আমি না!”

“এখন কে চিল্লিয়ে ঝগড়া করছে?”

নীতি রাগে ফুসছে। সবাই মুখ চেপে হাসছে। রীতি ওর কাছে আসলো। হেসে বললো, “আমার বোন মোটেও ঝগড়া করছে না। তুই ই করছিস। সর!”

“বোনের পক্ষই তো নিবি তুই!”

শাফিন ওর মাথায় চড় দিয়ে বললো, “কতবার বলবো? ভাবী হয় তোর, সম্মান দিয়ে ভাবী ডাক!”

“চার বছর বান্ধবী ডেকে তোমার জন্য ভাবী ডাকবো। পা’গলে ধরছে নাকি আমায়?”

রীতি হাসলো।

“ভাবীকে ভাবী ই ডাকবি। তার উপর আমার কিউট শালীকারে পাচ্ছিস, তোর কি ভাগ্য?”

“ও কিউট? হাস্যকর!”

নীতি কোমরে দু হাত রেখে বলল, “আমি কিউট না?”

“একদমই না!”

“তাহলে কিউট কে শুনি?”

সেই মুহুর্তে রাদিয়া ওদের কাছেই আসছিলো। তাই দিক কূল না ভেবেই ভুলবশত মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো, ”রাদিয়া।”

সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাত দিলো ও। মোটেও ওর নাম বলতে চায়নি নাহিয়ান। নীতির দিকে তাকাতেই দেখলো সে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । এক মুহুর্ত দেরি না করে স্টেজ থেকে নেমে গেলো নীতি। শাফিন বলে উঠলো, ”ভাই তুই শেষ!”
রীতি তেঁতে উঠে বললো, “তোদের দুই ভাইয়ের দেখি এক সমস্যা। খালি অন্য মেয়ের দিকে নজর যায়!”

“আমি কি করলাম?”(শাফিন)

“কচু!”

“বিশ্বাস কর আমি এই নাম বলতে চাই নাই!”

“আমাকে না বলে ওকে গিয়ে বল!”

নাহিয়ানও উঠে গেলো। নীতির পিছু নিলো সে। উফ, কি ঝামেলা!

__________________________________

“নীতি, দাঁড়াও না!”

ধপাধপ পা ফেলে নিজের রুমে আসলো নীতি। দরজা আটকাতে যাবে তার নাহিয়ান দরজা ঠেলে ভিতরে আসলো। নীতি মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলেই নাহিয়ান ওর হাত ধরে আটকালো। অতঃপর এক টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ওকে। নীতি মুচড়া মুচড়ি করলেই নাহিয়ান ওর দু হাত ওর পিছনে নিয়ে গিয়ে আটকে দিলো।

“এত নড়াচড়া করো কেনো?”

“হ্যাঁ, আমি তো নড়াচড়া করি। ওই রাদিয়াকে গিয়ে ধরুন না। একদম নড়াচড়া করবে না।”

“আরে, ওটা ভুলে বলে ফেলেছি। সরি!”

“বুঝি তো। খাই না সুজি, সবই বুঝি! আমাকে তো এখন আর ভাল্লাগে না। আমি কিউটও না। যান ওই রাদিয়ার কাছে।”

শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে নীতির গলা কাঁপছিলো। নাহিয়ান হাসলো।

“আমার প্রিয় ভীষণ কিউট!”

নীতি মুখ ঘুরিয়ে রেখে নিশ্চুপ রইলো। নাহিয়ান হেসে বললো,

“এখনও রাগ করে থাকবে?”

নীতি নিশ্চুপ। নাহিয়ান আবার বললো, “তবে যাই বলো, রাগলে কিন্তু তোমায় হেব্বি লাগে জান!”

“ছি, এসব জান টান কে বলে এখন?”

“আমি বলি! কোনো সমস্যা?”

“না, ছাড়ুন।”

নাহিয়ান আরও শক্ত করে চেপে ধরলো ওকে। নীতি ওর চোখে চোখ রাখলো।

“জানো প্রিয়? তোমার কাজল রাঙা এই চোখ আমার ভীষণ প্রিয়। যতবার তোমায় দেখি আমি আর নিজের মাঝে থাকি না। খুব ইচ্ছে করে বড়সড় ভুল করে বসতে। কিন্তু…”

নীতি ঢোক গিললো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো, ”কেউ দেখলে সমস্যা হবে, ছাড়ুন!”

নীতির মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠ শুনে ওকে ছেড়ে দিলো নাহিয়ান। ছাড়া পেতেই দূরে সরে দাঁড়ালো নীতি। লম্বা নিঃশ্বাস নিলো সে।

“চলো!”

নীতি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়?”

“চলোই না।”

বলেই ওর হাত ধরে বেরিয়ে এলো নাহিয়ান। বাড়ির বাইরে গিয়ে একটা রিকশা ডেকে বললো, “উঠো!”

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“বিয়ে করতে!”

নীতি চমকে উঠে বললো, “কি?”

“এত প্রশ্ন কেনো করো? চলো না!”

নীতি মুখ বাঁকিয়ে উঠতে নিলেই নাহিয়ান ওর হাত ধরলো। নীতি তাকাতেই বললো, “শাড়ি সাবধানে ধরে উঠো!”

নীতি হাসলো। সে বসতেই নাহিয়ান ওর আঁচল গুছিয়ে দিলো যাতে চাকার কাছে না যায়। অতঃপর নিজে ওর পাশে বসলো।

“মামা চলেন!”

নীতি ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নাহিয়ান ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”

“দেখছি!”

“কি?”

“আমার মানুষটা আমার কতটা যত্ন নেয়!”

নাহিয়ান হাসলো। নীতির কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, “এভাবে দেখতে নেই প্রিয়। প্রেমে পড়ে যাবেন!”

“ওহ, তো এখন কিসে পড়ে আছি জনাব?”

নাহিয়ান গলা ঝেড়ে বললো, “যেহেতু নর্দমা আশেপাশে নেই, তাই বলতে পারলাম না কিসে পড়ে আছেন।”

নীতি নাহিয়ানের হাতে চিমটি কেটে বললো, “মারাত্মক ফাজিল আপনি!”

নাহিয়ান হাসলো কেবল। আশেপাশে দেখে বলে উঠলো, “মামা এখানে রাখেন।”

রিকশা থামতেই নাহিয়ান নামলো। নীতিকেও সাবধানে নামালো। ভাড়া মিটিয়ে হাঁটা শুরু করলো দুইজন। নির্জন রাস্তা। বেশ দূরে দূরে কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট আছে। জনমানবশূন্য এই রাস্তায় ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও নীতির ভয় লাগছে না। কারণ পাশে থাকা মানুষটা সাথে থাকলেই সে নিরাপদে থাকবে সব সময়!

“দিনের শহর তো অনেক ঘুরলাম প্রিয়। এবার না হয় রাতের শহরটাও দেখা যাক?”

নীতি হাসলো।

“বাড়ির সবাই কি ভাববে?”

“ওখানে এখন নাচ গান হবে, আমাদের কথা কারোর মাথায় থাকবে না। ওদের মাথায় আমাদের কথা আসতে আসতে আমরা বাড়ি পৌঁছে যাবো।”

নীতি আর কিছু বললো না।

হুট করেই নাহিয়ান নীতিকে ফুটপাতের উপরে বসিয়ে দিয়ে নিজে রাস্তায় ওর সামনে বসে পড়লো। নীতি ভ্রু কুঁচকে বললো, “এটা কি হলো?”

“বসা হলো!”

“সেটা আমিও জানি। হাঁটবো বলে বসলেন কেনো?”

“একটু বসি, পরে হাঁটা যাবে।”

নীতি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মানুষটা এমন হুটহাট কাজ করে কেনো? আকাশের দিকে তাকালো নীতি।

“আজকের আকাশে চাঁদ নেই।”

“কে বললো নেই?”

নীতি নাহিয়ানের দিকে না তাকিয়েই বললো, “আকাশের তাকিয়ে দেখুন নেই!”

“তোমার আকাশে চাঁদ নেই, কিন্তু আমার আকাশে তো আছে!”

এবার তাকালো নীতি!

“আপনার আকাশ?”

“হুমম আমার মনের আকাশ!”

“তো সেই আকাশের চাঁদ আমি কি করে দেখবো জনাব? আমিও চাঁদ দেখতে চাই!”

“দেখবে? ওয়েট!”

বলেই ফোন বের করলো। নীতির একটা ছবি তুলে বললো, “এই দেখো!”

নীতি অবাক চোখে নাহিয়ানকে দেখলো। নাহিয়ান আবার নিজের দিকে ফোন ঘুরিয়ে ছবিটা দেখে বললো, “আমার ব্যাক্তিগত চাঁদ!”

নীতি হাসলো। নাহিয়ান গালে হাত দিয়ে বললো, “এই হাসিটাও আমার ব্যাক্তিগত!”

নীতি এবার শব্দ করে হাসলো। একটু ঝুঁকে বললো, “আর আপনি নামক মানুষটা আমার ব্যাক্তিগত!”

নাহিয়ান হাসলো নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো নীতির দিকে। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় নীতির হাস্যজ্বল মুখ দেখে নাহিয়ানের মন কেমন শান্তি অনুভব করলো। ইশ ভাবতেই অবাক লাগে তার, এই মানুষটা তার!

“ভালোবাসেন প্রিয়?”

“উহু, বাসি না!”

“আমিও বাসি না!”

“সত্যি বাসেন না?”

“উহু, মিথ্যে বাসি না!

নীতি আবারও হাসলো। নাহিয়ান একটু এগিয়ে বসলো। নীতির হাত দুটো নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

“তুমি আমার, তাই না প্রিয়?”

“হুমম!”

“তোমাকে হারানোর ভয় হচ্ছে প্রিয়!”

“কেনো?”

“জানা নেই, তবে হচ্ছে। তুমি আমার না হলে আমার কি হবে?”

নীতি চুপ করে নাহিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। নাহিয়ান আবার বলে উঠলো, “ভালোবাসি প্রিয়!”

“ভালোবাসি আমার ব্যাক্তিগত মানুষ! আমার প্রিয় অনুভব!”

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৫

“কোথায় ছিলি নীতি?”

মায়ের প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে গেলো নীতি। চুপি চুপি বাড়ি ঢুকছিলো সে। নাহিয়ান এখনও বাইরেই আছে। কিছুক্ষণ পর সেও ঢুকবে। একসাথে আসলে কারোর নজরে পড়লে সমস্যা!

“কোথায় আবার? এইতো বাগানে!”

“আমাকে মিথ্যে বলছো? ওখানে তোমাকে আমি পাইনি।”

নীতি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। বলবে কি এখন?

“এই রাতে কোথায় গিয়েছিলে নীতি?”

মায়ের শান্ত কণ্ঠ শুনে হাত পা ঠাণ্ডা হতে লাগলো নীতি। মায়ের এই কণ্ঠের সাথে পরিচিত সে। এখনই ঝড় উঠবে।

“আমার সাথে গিয়েছিল আন্টি!”

নাহিয়ানের কথা শুনে চমকে উঠলো নীতি। নাহিয়ান এসে জোহরার সামনে দাঁড়ালো। জোহরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ”তোমার সাথে?”

“হ্যাঁ, আসলে প্রীতি আর আনাফের জন্য গিফট কেনার ছিল। ওদেরকে তো নীতি ভালো চেনে, তাই আরকি!”

জোহরা কিছু একটা ভাবলেন। অতঃপর বুকে হাত গুজে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহ, তাহলে কি গিফট কিনলে?”

নীতি আড়চোখে নাহিয়ানের দিকে তাকালো। সে আমতা আমতা করতে করতে বলল, “টাকা ভুলে রেখে গিয়েছিলাম। দামাদামি করে আসছি। কাল গিয়ে নিয়ে আসবো!”

জোহরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন নাহিয়ানের দিকে। নাহিয়ান অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে নীতিও হাসফাস করছে। কিছুক্ষণ পর নীতির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোথাও গেলে জানিয়ে যেও। মা আমি, টেনশন হয়!”

নীতি মাথা নাড়লো। জোহরা আরেকবার নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের বয়স আমার পার হয়ে গিয়েছে বাবা। তাই বাহানাগুলোতে একটু নতুনত্ব এনো!”

বলেই আবার বাগানের দিকে গেলেন উনি! নাহিয়ান বুঝতে না পেরে নীতিকে জিজ্ঞেস করলো, “মানে?”

নীতি ঠোঁট চেপে হেসে বললো, “মানে মা সব বুঝেছেন!”

নাহিয়ান ভ্রু নাচিয়ে বললো, “বাহ, আমার শাশুড়ি তো সেই!”

“সেই দেখেই বেচেঁ গেলেন, নয়তো ঠাস করে খেতেন!”

“ভয় দেখাও কেনো?”

“আমার ইচ্ছে!”

নাহিয়ান চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকাতেই নীতি হেসে দিলো। অতঃপর ওর একটু কাছে গিয়ে বললো,

“ধন্যবাদ একটা সুন্দর মুহূর্ত দেয়ার জন্য!”

নাহিয়ানও হাসলো। অতঃপর চোখে চোখ রেখে বললো,

“আর তোমায় ধন্যবাদ নিজের সঙ্গ দিয়ে এই সুন্দর মুহূর্ত বানানোর জন্য!”

বার্তাহীন কয়েকপলক দৃষ্টি বিনিময় হলো দু’জনার। ভালোবাসায় পূর্ণ সেই দৃষ্টি ওখানেই থমকে রইলো।

__________________________________

“এত মেসেজ করছো কেনো তুমি?”

“এমনই, বোর হচ্ছিলাম!”

“আমার পছন্দ না মেসেজে কথা বলা।”

“তাহলে কলে আসেন!”

“কারণ?”

তূর্ণা ভাবলো। কারণ কি বলবে এখন? কিছু একটা ভেবে বললো,

“ওইযে আপনি যেই ভিডিও দিয়েছিলেন ওখানে একটা টপিকে সমস্যা হচ্ছিলো। বুঝছি না আমি!”

“তুমি পড়ছো ওখানে?”

তূর্ণা বুঝলো আরহাম অবাক হয়েছে।

“কিছু করার নেই এখন, তাই আরকি!”

বেশ কিছুক্ষণ পর রিপ্লাই এলো, “আমাকে স্ক্রিনশট দিয়ে দেও, আমি ভয়েসে পাঠিয়ে দিবো!”

তূর্ণা আর কিছু বললো না। ভীষণ শুনতে ইচ্ছে করছে তার মানুষটাকে! আচ্ছা হঠাৎ এমন হবার কারণ কি?

__________________________________

“নাহিয়ান!”

রাদিয়ার আওয়াজ শুনে ওর দিকে তাকালো নাহিয়ান। রাত আটটা। একটু পরই শুরু হবে প্রীতি আর আনাফের বিয়ে। নিচে নামছিলো সে। এমন সময় রাদিয়া ডাকলো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু বলবে?”

“আপনার পছন্দ করা লাল শাড়ি পড়েছি, কেমন লাগছে?”

নাহিয়ান ভরকে গেলো। এই মেয়ে এমন কেনো?

“ভালো!”

“শুধু ভালো?”

বলেই ওর দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে যেতে নিলো সে। নাহিয়ান তৎক্ষণাৎ ওর একটা হাত শক্ত করে ধরে পড়া থেকে বাঁচালো। হুট করে এভাবে পড়ায় নাহিয়ান তাল সামলাতে পারলো না। ফলস্বরূপ রাদিয়া ওর বেশ কাছাকাছি এসে পড়েছে । করিডোরের দিকে ছিলো তারা। উপরে এখন তেমন কেউ নেই। সবাই নিচে। তাই ভেবে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো নাহিয়ান। নয়তো নীতি দেখলে কি যে হতো! কিন্তু কথায় বলে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়!’ এমনটাই হয়েছে নাহিয়ানের ক্ষেত্রে। নীতি সেই মুহূর্তেই উপরে আসছিলো। ওদেরকে এভাবে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো ও। ওকে দেখা মাত্রই নাহিয়ান রাদিয়ার হাত ছেড়ে দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালো। নাহিয়ানের এমন ছিটকে সরে যাওয়ায় রাদিয়া আবার পড়ে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নিলো। একবার নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নীতির দিকে তাকালো। তড়িঘড়ি বলে উঠলো, “নীতি আপু, তুমি যেমন ভাবছো তেমন কিছু নয়। আসলে আমি শাড়িতে পা বেজে পড়ে যাচ্ছিলাম আর তখন নাহিয়ান ধরলো আমায়।”

নীতি কিছু না বলে ওদের কাছে আসলো। রাদিয়ার সামনে দাঁড়াতেই রাদিয়া আবার বলতে লাগলো, “সত্যি বলছি আপু!”

“আমি তোমার এক কি দুই বছরের বড় হবো। আর নাহিয়ান তোমার চার কি পাঁচ বা তার বেশি বড় হবে। তাহলে আমায় আপু, তাকে ভাইয়া বলো না কেনো?”

রাদিয়া ভরকে গেল। কিসের মধ্যে কি প্রশ্ন?

“না মানে, উনি অপরিচিত তাই…”

নীতি ওকে বলতে না দিয়ে নিজে বলে উঠলো, “অপরিচিত আমিও ছিলাম। তাই আপু সম্বোধন করেছিলে!”

রাদিয়া চুপ করে রইলো। নীতি আবার বলতে শুরু করলো,

“জানো কিছু কিছু মেয়ে আছে, যারা একটা ছেলে সম্পর্কে আছে জানা সত্বেও তার গায়ে ঢলে পড়বে, কথার ধরন এমন করবে যেনো ছেলেটা তার প্রতি আকর্ষিত হয়। মেয়েটার মূল উদ্দেশ্য ছেলেটাকে তার দিকে টেনে নিবে!”

“আপু তুমি ভুল বুঝছো!”

“ভুল বোঝার কিছু নেই। বাড়ীতে আরো অনেকেই আছে যাদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারতে তোমাকে কেমন লাগছে। কিন্তু না, তুমি কাল আর আজ দুবারই ওকে জিজ্ঞেস করেছো। ভেবো না এসব আমার অজানা থাকবে। আমি নিজের জিনিস নিয়েই অনেক যত্নশীল, সেখানে এটা তো আমার নিজের মানুষ। প্রথম প্রথম তোমায় কিছু বলতাম না, কারণ তুমি জানতে না। কিন্তু জানার পরেও এভাবে ছ্যাছরামী করার মানে কি?”

“আপু!”

রাদিয়ার ধমক শুনে নীতি দ্বিগুণ ধমকে বললো, ”চুপ! তুমি কি ভেবেছো, তুমি এমন ঢং করে নাহিয়ানকে নিজের দিকে নিতে পারবে? তাহলে বলে দেই ভুল! নাহিয়ান আমি থাকি বা না থাকি, আমার অনুপস্থিতিতেও কোনো মেয়েকে ভিন্ন নজরে দেখবে না। তাই আমাকে এটা বলার প্রয়োজন নেই যে এখানে কি হয়েছিলো। কেননা আমি জানি, নাহিয়ান এমন কিছু কখনো করবে না যাতে তার নীতি কষ্ট পাক। আর রইলো তোমার কথা, মেয়েদের চরিত্র এমন হওয়া উচিত নয় যেখানে তোমাকে আমার ছ্যাছরা বলে সম্বোধন করা লাগে। আশা করি তোমার ছোট্ট মাথায় এসব ঢুকেছে। আর এই শাড়িটা নাহিয়ান নয়। আমি পছন্দ করে তোমায় দিয়েছিলাম, খুব তো ওর পছন্দের জিনিস কিনতে চেয়েছিলে। এখন আমার পছন্দই ওর পছন্দ। আজকের কথাগুলো মাথায় থাকলে, নেক্সট টাইম অন্যের জিনিসে আশা করি নজর দিবে না!”

রাগে, অপমানে ধপাধপ পা ফেলে নিচে গেলো রাদিয়া। নাহিয়ান অবাক হয়ে বললো, “একটু আগেই তো উ’ষ্টা খেয়ে পড়ছিলো। এখন এত জলদি নামছে কি করে?”

নীতি দাঁত কিড়মিড় করে জিজ্ঞেস করলো, “কেনো? আবার ও পড়তে নিলে আপনি ধরবেন?”

“আরে না। তা কেনো হবে?”

“দেখেছি কেনো হবে।”

“আশ্চর্য, একটু আগে না ওকে বললে আমায় বিশ্বাস করো!”

“তো এই জন্য কি অন্ধ বিশ্বাস করবো না? কেনো, ওকে ঝাড়ি দিয়ে বলতে পারতেন না আপনার থেকে দূরে থাকতে? নাকি পিছে ঘুরাতে খুব ভাল্লাগে?”

নাহিয়ান হাসি আটকে বললো, “হুমম, খুব ভাল্লাগে!”

নীতির রাগ যেনো আরো বাড়লো।

“বেশ, তাহলে যান। গিয়ে ওকে বলুন আপনার পিছে আরো ঘুরতে। আমি গেলাম!”

নীতি ওকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই নাহিয়ান ওর হাত ধরে ফেললো। হেচকা টানে ওকে নিজের কাছে এনে দাঁড় করালো।

“হাত ছাড়ুন!”

“উহু!”

“উহু কেনো? যান ওর হাত ধরুন গিয়ে। ওকে বলুন ওকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। আমার কাছে কি? ছাড়ুন!”

নাহিয়ান হাসলো। নীতির কপালে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো পিছে সরিয়ে দিয়ে বললো, “আমার মায়ের পরে তুমিই সবচেয়ে সুন্দর নারী প্রিয়!”

নীতি শান্ত হলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। নাহিয়ান নিষ্পলক নীতিকে পর্যবেক্ষণ করলো। তার পরনে নাহিয়ানের পছন্দের সেই শাড়িটা। নীতির ডান হাত নিজের বুকের বাম পাশে রেখে বললো, “এই বুকের বা পাশে তুমি আছো প্রিয়। আমার সত্যি পৃথিবীর আর অন্য কোনো নারীর প্রতি আগ্রহ নেই। আমার সকল আগ্রহ তোমার প্রতি! আমার প্রিয়র প্রতি। যাকে আমি ভালোবাসি আর যে আমাকে ভালোবাসে।”

নীতি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। হেসে বললো, “এইজন্য সুন্দর ভাষী মানুষদের প্রেমে পড়তে নেই। এটা এদের সুন্দর কথা দিয়ে ঠিকই কাবু করে নেয় আমার মতো অসহায় মেয়েকে।”

“কি করবো ম্যাম? আপনাকে দেখলেই আমার কথার মাঝে শব্দগুলো আপনাআপনি সেজে উঠে। আর মুখ সেগুলো আটকে না রেখে বলে ফেলে।”

নীতি হাসলো। ওর চোখে চোখ রেখে বললো, “শব্দগুলো আর কারোর জন্য সাজাবেন না। এগুলো কেবল যেনো আমার জন্যই আমার হয়ে থাকে!”

নাহিয়ান হাসলো।

“তোমাদের রোম্যান্স শেষ হলে নিচে যাওয়া যাক?”

বর্ষার কথা শুনে চট জলদি সরে দাঁড়ালো দুজন! বর্ষা এসেছিলো নীতিকে ডাকতে। প্রীতি ওকে খুঁজছে। ওর সাজ এখনও কিছুটা বাকি। কিন্তু এখানে এসে ওদের দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ যাওয়ার পরেও এদের কথা শেষ হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে ওদের মাঝে আসতে হলো। বর্ষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “প্রীতি ডাকছে তোকে। ওর সাজ নাকি আরো বাকি। আয়!”

নীতি কিছু না বলে এগিয়ে গেলো। লজ্জা লাগছে তার, বর্ষা কি ভাবলো? নাহিয়ানও নিচে নেমে গেলো। বর্ষা দুইজনের দিকে তাকালো। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আজ কেউ নাই বলে!”

__________________________________

অবশেষে প্রীতি আর আনাফের বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। সবাই এখন ওদের নিয়ে ব্যস্ত। নীতি একাকী দাঁড়িয়ে ছিল বর্ষার সাথে। সেই মুহূর্তেই একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ওর নিকট এলো। নীতির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কি মা?”

“নীতি!”

মহিলা হেসে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ে হয়েছে?”

নীতি ভরকে গেল। এসব কি প্রশ্ন? তবুও হাসার চেষ্টা করে বললো, “না, কিন্তু…”

মহিলা ওকে কিছু বলতে না দিয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ, তোমার মা বাবা কোথায়? এসেছেন? নাকি একা তুমি? আচ্ছা তোমার নাম্বার দেও!”

“নাম্বার কেনো?”

মহিলা হেসে বললেন, “আমার ছেলের জন্য আসলে মেয়ে খুঁজছি। তুমি তো ভারী মিষ্টি, তাই আরকি তোমার মা বাবার সাথে কথা বলতাম!”

নীতি অবাক হয় তাকিয়ে রইলো। এ কি আবার? কিছু বলবে তার আগেই নাহিয়ান পাশে এসে দাঁড়ালো। তাকে হেসে বললো, “ওর তো বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে আন্টি!”

মহিলা অবাক কণ্ঠে শুধালো, “কি বলো?”

“হ্যাঁ, আমার সাথেই হয়েছে।”

অতঃপর নীতির দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “এটা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো তাই না?”

সিরিয়াস মুহূর্তেও নাহিয়ানের কথা শুনে হাসি পেলো নীতির। ঠোঁট চেপে মাথা নিচু করে হাসি আটকালো সে। ভদ্র মহিলা কিছুক্ষণ আফসোস করে বর্ষার দিকে তাকালেন। বর্ষা ঢোক গিললো। তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কি মা?”

“জী, বর্ষা!”

“তুমিও ভারী মিষ্টি, তোমার মা বাবা এসেছেন?”

বর্ষা মাথা নাড়লো।

“ওহ, তোমার তো আর বিয়ে ঠিক নেই তাই না?”

এবারও বর্ষা ডানে বামে মাথা নাড়লো। ভদ্র মহিলার হাসি আরো চওড়া হলো।

“তোমার বা তোমার বাবা মায়ের নাম্বারটা দেও তো তাহলে!”

বর্ষা কিছু বলবে তার আগেই হুট করে রাদিফ এসে বললো, “ওর বিয়ে ঠিক নেই, বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”

বর্ষা, নীতি আর নাহিয়ান চমকে তাকালো। বর্ষা রাদিফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিহ?”

ভদ্র মহিলা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “ওর হাজব্যান্ড কোথায়?”

রাদিফ ওর হাত ধরে বললো, “এই যে আমি! এভাবে বিয়ে বাড়িতে মেয়ে না খুঁজে বিজ্ঞাপন দিলেই পারেন। যান খাবার খেয়ে নিন! আমিও আমার বউকে নিয়ে যাই!”

বলেই বর্ষাকে নিয়ে এগিয়ে গেলো। বর্ষা এখনও শকের মাঝে আছে। এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি?

#চলবে

প্রিয় অনুভব পর্ব-২২+২৩

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২২

“ইশ, এত সুন্দর ফুলদানীটা ভেঙ্গে গেলো। নাহিয়ান দাঁড়ান, আমি কাউকে পরিষ্কার করতে বলে আসি।”

বলেই রাদিয়া চলে গেলো। নাহিয়ান আশেপাশে দেখে জলদি সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। নীতির ঘরে ঢুকে আস্তে করে দরজা আটকে দিলো। যদিও এভাবে একটা মেয়ের ঘরে ঢোকা ঠিক নয়, তবুও নাহিয়ান এখন নিরুপায়।

বিছানায় চুপচাপ বসে আছে নীতি। পায়ে র’ক্ত। অত গভীর ক্ষত না হলেও কমও হয়নি। নাহিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “ফার্স্ট এইড কিট আছে?”

নীতি মুখে উত্তর না দিয়ে বিছানার পাশে থাকা ড্রয়ার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। নাহিয়ান সেটা বের করে অ্যান্টিসেপটিক নিলো তুলোতে। অতঃপর হাঁটু গেড়ে বসে নীতির পায়ে লাগিয়ে দিতে লাগলো।

“ওটা ভেঙ্গেছো কেনো?”

“রাগ নিয়ন্ত্রণ হয়নি বলে!”

“এত রাগ কিসের তোমার?”

“আপনি ওকে সুন্দর কেনো বলবেন?”

নাহিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

“আমি সবাইকেই এটা বলি নীতি। আগেও বলতাম, এখনও! নতুন কিছু নয়!”

নীতি চুপ করে রইলো।

“সব কিছু এভাবে অস্বাভাবিকভাবে নিলে চলবে?”

“তূর্ণাকে তো নেই নি আমি!”

“মানে?”

“তূর্ণা কে নিয়ে কিছু বলেছি কখনো?”

নাহিয়ান চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলো।

“রাদিয়া আপনাকে পছন্দ করে। একটা মেয়ে অন্য একটা মেয়ের চোখের ওই ভাষাটুকু ভালোভাবে বুঝতে পারে। বুঝেও অবুঝ কি করে হই? আমি জানি আপনি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেন, আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু ওদের না। নিজের জিনিসে কারো ছায়া কি আপনি সহ্য করতে পারবেন? সেদিন ওই ভাইয়াকে দেখে আপনি কি বলেছিলেন মনে আছে? প্রিয় মানুষগুলো এমনই হয়, তাদেরকে কারো সাথে ভাগ করা যায় না। তাদের আশেপাশে অন্য কোনো নারী বা পুরুষকে সহ্য করা যায় না। একদম না!”

নাহিয়ান তুলো দিয়ে রক্ত সব পরিষ্কার করে আবার আরেকটা তুলোতে অ্যান্টিসেপটিক নিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলো।

“সবার ক্ষেত্রে আমি এমন করি না নাহিয়ান। যারা আপনাকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করতে চায় বা আপনাকে চায়! তাদের ক্ষেত্রেই করি আমি!”

“আমার কাছে আমার প্রিয় ই সব নীতি! অন্য কেউ নয়, এটা বুঝো না?”

“বুঝি, বিশ্বাস করুন সব বুঝি। বুঝি দেখেই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। কিন্তু পারি না আমি, অদ্ভুতভাবে কষ্ট হয় আমার। খুব কষ্ট হয়!”

নাহিয়ান একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো।

“তুমি বড্ড উন্মাদ প্রিয়!”

“আপনাকে ভালোবেসে হয়েছি অনুভব!”

নাহিয়ান সরাসরি নীতির চোখের দিকে তাকালো। নীতি হেসে বললো,

“আপনাকে ভালোবেসে প্রচন্ড রকমের উন্মাদ হয়েছি আমি। অদ্ভুতভাবে আমি আমার আগের আমি’র সাথে এখনকার আমি’র মিল পাই না। যেই মেয়েটা সবার থেকে বেশি নিজেকে ভালোবাসতো, আজ সেই নিজের থেকে বেশি তার সামনে থাকা মানুষটিকে ভালোবাসে। আশ্চর্যের বিষয় না?”

নাহিয়ান পলকহীন ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। নীতি মলিন চাহনি দিয়ে বললো, “মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনার সাথে আলাপ না হলেই হয়তো ভালো হতো। না আপনাকে নিজের সাথে অনুভব করতাম আর না আপনাকে ভালো বাসতাম। তাও এতটা!”

“ভালোবেসে আফসোস হচ্ছে?”

“হুমম!”

“আফসোসের কারণ?”

“ভয়!”

“কিসের ভয়?”

“আপনাকে হারানোর ভয়!”

“হারাবে না!”

“মন বোঝে না!”

”বোঝাও!”

“সম্পূর্ণ আমার হয়ে তাকে বুঝিয়ে দিন না আপনি!”

নাহিয়ান চুপ করে গেলো। নীতির দু গাল ধরে কপালে তার অধর গভীরভাবে ছুঁয়ে দিলো। অতঃপর নীতির কপালে কপাল ঠেকালো। দু জন চোখ বন্ধ করে আছে। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর নাহিয়ান বললো,

“ভালোবাসি!”

নীতি হাসলো।

“ভালোবাসি!”

বেশ কিছু সময় পর আবার বললো, “পাশের বাড়ির ছেলেকে!”

নাহিয়ান সঙ্গে সঙ্গে মাথা সরিয়ে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নীতি ওর তাকানো দেখে ফিক করে হেসে দিলো। নাহিয়ান বিরক্ত হয়ে বললো, “এই পাশের বাড়ির ছেলে আবার কে?”

নীতি ঠোঁট চেপে হেসে বললো, “তার নাম সাইমুন!”

নাহিয়ান দাঁত কিড়মিড় করে বললো, “বাহ নামও জানো?”

“জানবো না কেনো? বাড়িতেও তো আসে!”

নাহিয়ান চোখ বড় বড় করে তাকালো। নীতি হেসে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললো, “সিনথীর ক্লাসমেট!”

নাহিয়ান আড়চোখে ওর বামে তাকালো। নীতি এখনও ওভাবেই আছে। কানের কাছে ঝুঁকে আসায় ওর ঠোঁট নাহিয়ানের খুবই নিকটে ছিল। হুট করেই নীতির ঠোঁটের কোণে একটা চুমু এঁকে উঠে দাঁড়ালো সে। মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলল,

“নিচে চলো!”

বলেই সাবধানে বেরিয়ে গেলো সে। আর নীতি? সে হতভম্ব হয়ে তার ঠোঁটের কোণে নাহিয়ানের স্পর্শকৃত জায়গায় হাত দিয়ে ওভাবেই ঝুঁকে আছে। তার পুরো শরীর ঠাণ্ডা হতে লাগলো। কপালেরটা তাও মানা যায়, কিন্তু এমন অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ! স্পর্শটা কেবল এক সেকেন্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবুও নীতি ভীষণভাবে চমকে গিয়েছে!

__________________________________

নীতিদের বাড়ির সামনে আসতেই তূর্ণা আরহামের দিকে তাকালো। নাহিয়ান আর শাফিন আজকেই এসেছে। কিন্তু সেটা আরহামকে বলে নি সে। প্রথমে সে জানতো না। কিন্তু জানার পরেও আরহামকে বলে নি সে। তার মন খুব করে চাইছিলো, আরহামের সাথে আসবে। আরহামের সঙ্গ আরেকটু পাবে। কিন্তু এখন তো যেতেই হবে। কাল অব্দি যেই মেয়ের এই বাড়িতে আসার জন্য এত অস্থিরতা ছিল, আজ তার এখানে থাকার ইচ্ছেও নেই। নিজের এমন মনোভাবের জন্য নিজেই ক্ষণে ক্ষণে থমকাচ্ছে তূর্ণা। এ কেমন অনুভূতি? সে বুঝতে পারছে না তার হঠাৎ করেই এত উদাসীনতা আসছে কেনো?

“নামছো না যে?”

“আপনি যাবেন না?”

“আমি কেনো যাবো?”

“না, কেমন ভয় ভয় করছে!”

“দেখো এখানের কাউকে আমি চিনি না। হুট করেই এমন অপরিচিত পরিবেশে আমাকে দেখলে ওরা কি ভাববে? আর তুমি তো এখানে আসার জন্যই মন দিয়ে পড়ালেখা করলে। এখন কিসের ভয়? মানুষগুলো কি তোমার অপরিচিত?”

তূর্ণা চুপচাপ নেমে গেলো। একবার উঁকি দিয়ে বললো,

“সাবধানে যাবেন!”

আরহাম কিছু বললো না। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে গেলো। তূর্ণা ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। এত অদ্ভুত লাগছে কেনো তার? যেনো আরহাম না, তার নিজের কিছু তার থেকে দূরে যাচ্ছে। দুপাশে মাথা নেড়ে মন মস্তিষ্ক শান্ত করলো তূর্ণা। অতঃপর নীতিদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি এসে গিয়েছি! নীতি, প্রীতি, রীতি ভাবী!”

বলেই হাক ছেড়ে ভিতরে ঢুকলো সে। চঞ্চল চিত্তের মেয়ে সে। সবকিছুকেই যেনো চঞ্চলতার মাঝে দাবিয়ে রাখতে জানে সে।

__________________________________l

তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে নিচে নামলো বর্ষা। অ্যাসাইনমেন্টের চক্করে তার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল আজ মেহেন্দী অনুষ্ঠান। বিকেলে যখন নীতি ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এখনও আসিস নি কেনো?”

সেই মুহূর্তে খেয়াল হলো তার। অতঃপর তখন থেকেই রেডি হতে হতে প্রায় ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গিয়েছে। নিচে নামতেই রাদিফকে দেখে পা থেমে গেলো বর্ষার। নীতি তো বলেছিলো গাড়ি পাঠাবে! তবে ইনি কেনো? ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে। রাদিফ বাইকে হেলান দিয়ে ফোন দেখছে। সামনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ তুলে তাকালো ও। মুচকি হাসি দিয়ে বললো, “চলো!”

বর্ষা কিছু বললো না। রাদিফের সাথে উঠে বসলো। বেশ কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো,

“নীতি তো বলেছিলো গাড়ি পাঠাবে!”

”কেনো? বাইকে সমস্যা হচ্ছে তোমার?”

“না, মানে ড্রাইভার আসবে বলেছিলো!”

“আমি থাকতে ড্রাইভার আসবে কেনো?”

“আপনি এত কষ্ট করতে যাবেন কেনো?”

“তুমি বুঝবে না। ধরে বসো, পড়ে যাবে নয়তো!”

বর্ষা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। আজব, না বললে বুঝবে কি করে?

__________________________________

দু হাত ভর্তি মেহেদী দিয়ে বসে আছে প্রীতি। কতশত ছবি তুলছে সে। নীতি ওকে দেখে হাসলো। মেয়েটা ভীষণ খুশি। অবশ্য প্রিয় মানুষকে একেবারে নিজের করে পেয়ে গেলে খুশি হবে না কে? নাহিয়ানকে খুঁজলো আশেপাশে। কিন্তু তার দেখা নেই!

“কেমন আছো নীতি?”

সালেহার কণ্ঠ শুনে তার দিকে তাকালো নীতি। মুচকি হেসে সালাম দিয়ে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ!”

সালেহা নীতিকে একবার পর্যবেক্ষণ করে বললেন, “মাশাআল্লাহ!”

বলেই চোখের কোণ থেকে কাজল নিয়ে নীতির কানের পিছে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, “কারো নজর না লাগুক!”

নীতি হাসলো। যদিও এসব সে বিশ্বাস কর না, তবুও ভালো লাগে!

সালেহা আবার বললেন, “আন্টিকে ভুলে গেছো দেখছি!”

“না তো!”

“এসে থেকে খোঁজ নিলে না যে?”

“ছিলাম না এখানে!”

নীতির একটু অস্বস্তি হচ্ছে কথা বলতে। তার সাথে বরাবরই কম কথা হয় নীতির। সালেহা হয়তো বুঝলেন! তিনি হেসে বললেন,

“এত জড়তা রাখতে নেই। একবার সবাইকে একটু চিনে নেও, পরবর্তীতে অসুবিধা হবে না!”

“কিসে অসুবিধা?”

সালেহা আবার হাসলেন।

“দেখো সরাসরি বলা গেলেও সরাসরি বলতে চাইছি না। তবুও একটু বলি, নাহিয়ান আর তোমাকে নিয়ে আমার ইচ্ছের কথা তো জানোই। একটু নিজেদের সময় দেও, জানো! আশা করি মনের মত উত্তর পাবো!”

নীতি চুপ রইলো। সালেহা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। সেই মুহূর্তেই নাহিয়ান ওর সামনে এলো।

“মা কি বলছিলো?”

নীতি ওর দিকে তাকালো। হেসে ওর নাক টেনে বললো, “বলেছে একজনের বউ করবে আমায়। তাকে একটু জেনে নেই আর সময় দেই!”

নাহিয়ান চমকে উঠে বললো, “কার বউ করবে?”

“তার ছোট বাঁ’দর নামক ছেলের!”

বলেই প্রীতির কাছে গিয়ে বসলো। নীতির কথার মনে কয়েক সেকেন্ড পরে বুঝলো নাহিয়ান। ঝটপট সেও নীতির কাছে গিয়ে বসলো।

“তুমি আমাকে বাঁ’দর বললে?”

“না, পাশের বাসার ছেলেকে বলেছি!”

“এত প্যাচাল করো কেনো তুমি?”

“আমি কি করলাম!”

মেহেদী দিয়ে দেয়া মেয়েটি ওদের কথার মাঝেই জিজ্ঞেস করলো,

“কোনো ওয়ার্ড দিয়ে ডিজাইন করবে আপু?”

নীতি একপলক নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়লো। মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করলো, “কোন ওয়ার্ড?”

নীতি ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। অতঃপর বললো, “এক হাতে এন আরেক হাতে এ!”

ওর কথা শুনে প্রীতি বললো, “পি বাকি রেখেছিস কেনো? ওটাও দিয়ে দে!”

নীতি ঠোঁট চেপে হাসলো। নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার ঠোঁটের কোণেও হাসি। বেচারা প্রীতি কি বুঝবে? নামের ওয়ার্ড সেম হওয়ার সুবিধা কতটা!
নাহিয়ানের ডাক আসায় সে উঠে অপর দিকে গেলো। কোথা থেকে রাদিয়া এসে বসলো। মেহেদী দেয়ার জন্য আরেকটা মেয়েও ছিল। তাকে বললো, “আমাকে এন দিয়ে ডিজাইন করে দেও এই হাতে!”

কথাটা শোনা মাত্রই মাথায় রাগ চেপে বসলো নীতির। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার নাম কি এন দিয়ে নাকি?”

রাদিয়া আমতা আমতা করতে লাগলো। প্রীতি বলে উঠলো, “আরে নীতি বুঝিস না? নাহিয়ান ভাইয়ার উপর সেই রকম ফিদা ও!”

রাদিয়া যেনো লজ্জা পেলো। নীতির রাগ এখন প্রীতির উপর গেলো। আশ্চর্য মেয়েটা জানে তো নাহিয়ানের সাথে নীতির বিয়ের কথা চলছে, তাহলে এসব করতে নিষেধ করছে না কেনো? পরমুহূর্তেই মনে পড়লো শুরুর দিকে ওদের সম্পর্কই তো এমন ছিল, যার কারণে প্রীতি ধরেই নিয়েছে এই বিয়ে হবে না। নীতি না পারছে বলতে, না পারছে সহ্য করতে। হুট করেই রাদিয়ার মা আসলো সেখানে। মেয়ের পাশে বসে বললো, “ওরে সুন্দর করে মেহেদী দিয়ে দিবা। ওই মেয়েদের দেখলাম নামের অক্ষর দিয়েছে। ওরেও ‘আর’ অক্ষর দিয়ে করে দেও।”

মেয়েটা কিছু বলবে তার আগেই রাদিয়া ওকে নিষেধ করলো কিছু বলতে। নীতির খুশি দেখে কে? উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,

“থ্যাংক ইউ!”

__________________________________

অনুষ্ঠান শেষে ছোটরা সব ছাদে এসে বসেছে। বর্ষা দু হাতের মেহেদী শুকাচ্ছে। এসেছে দেরিতে, তাই মেহেদী দিয়েছেও দেরিতে। তাই সবারটা শুকিয়ে গেলেও, তারটা এখনও একই রকম। এদিকে সবাই ফ্রি হয়ে গিয়েছে মেহেদী থেকে। সবার আড্ডার মাঝেই নাহিয়ান গিটার হাতে নিলো! তা দেখে রীতি বলে উঠলো, “গান গাইবি নাকি?”

নাহিয়ান হেসে বললো, “কেনো? গাইলে দোষ হবে?”

“দোষ হবে না, তবে নাহিয়ান তো কখনো সবার সামনে গান গায় না।”

“সামনে স্পেশাল মানুষ থাকলে গাওয়াই যায়!”

কথাটা নীতির জন্য বললেও সবাই ভাবলো রাদিয়ার জন্য বলেছে।

একসাথে রাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “ওহো!”

নাহিয়ান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নীতির দিকে তাকালো। সে মুখ ভার করে বসে আছে। বর্ষা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “স্পেশাল মানুষটা কে?”

রাদিয়া লজ্জামাখা কণ্ঠে বলল, “মনে হয় আমি!”

নীতি আর ওখানে বসে থাকতে পারলো না। উঠে রাদিয়ার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। নাহিয়ান মুচকি হেসে শুরু করলো।

“কেউ তোমাকে, ভীষণ ভালোবাসুক।
তুমি আর শুধু তুমি ছাড়া, অন্য কিছু না বুঝুক।

কেউ তোমার কোলে মাথা রেখে, ভীষণ হাসুক..
তুমি একটু দূরে গেলে, লুকিয়ে আনমনে ভীষণ কাঁদুক।

তুমি তো চেয়েছিলে, ঠিক এমনই একজন
দেখো না আমি পুরোটাই, তোমার ইচ্ছে মতন।

হুট করেই থামলো নাহিয়ান। নীতির দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর সবার সম্মুখে জোড়ে বলে উঠলো,

“মিস প্রিয়োনা!”

নীতি চমকে তাকালো হঠাৎ এভাবে ডাকাতে। নাহিয়ান হেসে বললো,

“This is for you! —

তুমি আমার অনেক শখের
খুঁজে পাওয়া এক প্রজাপতি নীল,
আমি রংধনু রঙে সাজিয়েছি
দেখো এক আকাশ স্বপ্নীল!”

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৩

ঝড় আসার পূর্বে পরিবেশে যেমন শান্তি বিরাজ করে, তেমন শান্তিই আপাতত ছাদে বিরাজ করছে। এতক্ষণ যেখানে হৈ হুল্লোর হচ্ছিলো, এক মুহুর্তে সেখানে যেনো নীরবতা ধেয়ে আসলো। প্রত্যেকের চোখে মুখে বিস্ময়। একবার নাহিয়ান তো একবার নীতির দিকে তাকাচ্ছে। আবার বোঝার চেষ্টা করছে নীতির রিয়েকশন কি হবে? ওদের সামনে তো কেবল তাদের ঝগড়াগুলোই প্রকাশ পেয়েছে। নীতি নিজেও চমকে আছে। নাহিয়ান যে হুট করে এমন কিছু করবে তার ধারণার বাইরে। সবাইকে আরেকটু অবাক করে নাহিয়ান নীতির সামনে এসে দাঁড়ালো।

“চমকে গিয়েছো?”

“ভীষণ ভাবে!”

নাহিয়ান হাসলো।

“সম্পূর্ণ তোমার হওয়ার প্রথম ধাপ পূর্ণ করলাম প্রিয়!”

নীতি বলার মতো কিছু পেলো না। আড়চোখে রাদিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটা হা করে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নীতি পুনরায় চোখ ফিরালো নাহিয়ানের দিকে। ঢোক গিলে বললো,

“সবাই আছে এখানে!”

নাহিয়ান আবারও তার নজরকাড়া সেই হাসি দিলো। অতঃপর বললো, “এখনও পুরো দুনিয়ার দেখা বাকি প্রিয়। খুব তো কষ্ট পেতে, আমার জন্য! নেও তোমার সব সমস্যার সমাধান করে দিলাম!”

নীতি আবারও রাদিয়ার দিকে তাকালো।? অদ্ভুতভাবে হৃদস্পন্দন বাড়ছে তার। এক পা, দু পা করে পিছিয়ে যেতে লাগলো সে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে নির্ঘাত লজ্জায় ম’রে যাবে সে।

“শুভ্রময়ী! আপনার শুভ্রপুরুষকে ফেলে চলে যাবেন?”

নীতির পা থেমে গেলো। হুটহাট কোনো কিছু মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়, তেমনটা নীতির ক্ষেত্রেও হচ্ছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না তার কিরকম প্রতিক্রিয়া দেয়া উচিত। নাহিয়ান হয়তো বুঝতে পারলো সেটা। শান্ত কণ্ঠে বললো, ”সম্পূর্ণরূপে তোমার হওয়ার প্রথম ধাপ আমি তো পূর্ণ করলাম, তুমি কেনো পিছিয়ে যাচ্ছো?”

নীতি নিশ্চুপ।

“কিছু না বললে এবার সত্যি অন্যের কাছে চলে যাবো!”

নাহিয়ানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীতি। বুকে হাত গুজে বললো, “কার কাছে যাবেন শুনি?”

নাহিয়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

“প্রিয়োনার কাছে।”

নীতি হাসলো। স্বাভাবিক হলো একটু। নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ সবার সামনে নাহিয়ানের এভাবে বলায়। সবাই এতক্ষণ চুপ থাকলেও বর্ষা এবার বলে উঠলো,

“হচ্ছেটা কি?”

দুইজন ওর দিকে তাকালো। নাহিয়ান আবার চোখ ফেরালো নীতির দিকে। লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, “আমার প্রিয়র মুখে উদাসীনতা মানায় না। আমি চাই না আমার প্রিয় কষ্ট পাক! তাই সবার সামনেই বলছি, ভালোবাসি নীতি।”

অতঃপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “জীবনের প্রতিটা পদক্ষপে তোমায় চাই প্রিয়। থাকবে তো?”

নীতি হেসে ওর হাতে হাত রাখলো। চোখে চোখ রেখে বললো, “ভালোবাসি অনুভব!”

আর সবার বিস্ময় কাটছে না। এখনও অবাক হয়ে দেখছে। কিন্তু বর্ষা বিস্ময়তা ভরা কণ্ঠ নিয়েই বললো, “তার মানে প্রিয় আর অনুভব, নাহিয়ান আর নীতি?”

নীতি ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে মাথা উপর নিচ নাড়লো।

__________________________________

গত ত্রিশ মিনিট যাবৎ বর্ষা কেঁদে কেটে ওর অবস্থা কাহিল করে ফেলছে। ওর পাশেই নীতি গালে হাত দিয়ে দেখছে ওকে। ওদের সামনে বসেই নাহিয়ান ফোন দেখছে। ওর পাশে বসেই শাফিন ওর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। প্রীতি, রীতি, রাদিফ আর আনাফ চুপ চাপ বসে বসে আছে। রাদিয়া ঠোঁট উল্টে নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। শাফিন নাহিয়ানকে খোঁচালো। ফিসফিস করে বললো, “তুই ভিতরে ভিতরে এত অকাজ করলি, কেউ জানলোও না।”

“না জানানোর পরেও তুমি আমার লাভ লাইনে ভিলেন হয়েছিলে। জানানোর পর কি করতে আল্লাহ জানে!”

শাফিন অবাক হয়ে বললো, “আমি কি করলাম আবার?”

নাহিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ”ওর আইডি তুমিই নষ্ট করেছিলে!”

শাফিন কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো। নাহিয়ান আবার ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো, “রীতিকে সতীন বলায় যার আইডি নষ্ট করেছিলে তুমি!”

শাফিন চমকে নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “ওটা তুমি ছিলে?”

রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “কোনটা?”

“তোমাকে সতীন বলেছিলো যে!”

রীতি কিছু বলবে তার আগেই বর্ষা নাক টেনে বললো, “আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আর আমার নাই রে। শুরুতেও আমায় কিছু জানায় নাই। যাই মাঝে জানালো, তাও বললো না এই অনুভব কে! এ কেমন বেস্টফ্রেন্ড আমার!”

নীতি ঠোঁট চেপে হাসছে। প্রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।”

রাদিয়াও তাল মিলিয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, “আমারও না!”

নীতি, নাহিয়ান উত্তর দিলো না। মূলত ওরা বিনোদন নিচ্ছে এসব দেখে।

__________________________________

নীতির রুমে বসে ফোনে ক্লাস দেখছে তূর্ণা। এগুলো আরহাম তাকে দিয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে ছাদে যায়নি সে। তার ইচ্ছে করছিল না। আরহামের কথাগুলো তার মনে দাগ কেটেছে। তাই চুপচাপ আরহামের দেয়া বিভিন্ন ক্লাসের ভিডিও দেখছে। অনেক আগেই এগুলো দিয়েছিল আরহাম। কিন্তু তখন এসবে পাত্তা দেয় নি সে। হুট করেই আরহামকে মেসেজ দিতে ইচ্ছে করলো ওর। ঝটপট হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে মেসেজ দিলো, “কি করেন?”

মিনিট পাঁচেক হয়ে গেলো, রিপ্লাই এলো না। সময় দেখে নিলো একবার। একটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। এ সময় আরহাম নিশ্চয়ই জেগে থাকবে না। এসব ভাবনার মাঝেই নীতি, প্রীতি, রীতি, বর্ষাআর রাদিয়া ঘরে এলো। ওরা একসাথে ঘুমাবে। বর্ষার চোখ মুখ দেখে তূর্ণা জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে আপু?”

রীতি চুল খোঁপা করতে করতে বললো, “শক খেয়েছে।”

“কিভাবে?”

“নীতি দিয়েছে।”

তূর্ণা নীতির দিকে তাকালো। বর্ষা পাশে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, “ও মীর জাফর তূর্ণা। বিশ্বাসঘাতক ও!”

নীতি এবার বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি এমন কিছুও করিনি!”

“চুপ ফাজিল! যদি বলতি তোর অনুভবই নাহিয়ান, তাইলে কি আমি খেয়ে ফেলতাম?”

নীতি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানা করতে করতে বললো, “ফেলতেও পারিস!”

বর্ষা ঠোঁট উল্টে বললো, “দেখলে? দেখলে কি বলছে?”

তূর্ণা কিছুই বুঝছে না!

“আমাকে বলবে হয়েছে কি?”

বর্ষা কেঁদে কেটে সব বললো। সব শুনে তূর্ণা রিয়েকশন দিতে ভুলে গেলো। সেও তাল মিলিয়ে বললো, “এটা ঠিক না নীতি। আমাদেরও বলা উচিত ছিল!”

সবাই ওর কথার সাথে একমত হলেও রীতি দ্বিমত করে বললো, “ভুল কিছু করেনি ও!”

প্রীতি ভ্রু কুঁচকে বললো, “ভুল করেনি বলছো?”

রীতি প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “একটা সম্পর্কের কথা যত বেশি প্রকাশ হবে ততই সে সম্পর্কের মাঝে কোনো কোনো ঝামেলা আসবে। নজর লাগা বলতেও কিছু আছে। এই যেমন আমাকেই দেখ না, আমার আর শাফিনের কথা বাড়ির সবাই জানে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। অথচ সত্যটা তোরা জেনেছিস বিয়ের পর! আর প্রীতি, তুই নিজেও তো আনাফের কথা গোপন করেছিস। সে হিসেবে নীতিরটা আগেই প্রকাশ হয়ে গিয়েছে!”

সবাই মন দিয়ে শুনলো। বর্ষা বলে উঠলো, “তবে কি বলতে চাও, আমরা নজর দিতাম?”

“এমন নয় বর্ষা! আপন মানুষেরা সবসময় আমাদের ভালো চায়। কিন্তু এটা অনেক ক্ষেত্রেই সত্য, সম্পর্কটাকে বেশি প্রকাশ করতে নেই। নয়তো নজর লেগে যায় অনেকের!”

বর্ষা বুঝলো, তবুও গাল ফুলিয়ে বললো, “আমি তাও রাগ করেছি!”

নীতি ওর গাল টেনে ঢং করে বললো, “থাক বাবু, রাগ করে না!”

ওর কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। রাদিয়া চুপচাপ এক কোণে বসে রইলো। ভালো লাগছে না এসব তার। মোটেও লাগছে না!

__________________________________

ঘুম ঘুম চোখে গোসল সেরে বের হলো নীতি। এগারোটা বাজে। তবুও ঘুম সম্পূর্ণ হয় নি তার। অলস ভঙ্গিতে আবার বিছানায় বসলো। বর্ষা আর প্রীতি এখনও ঘুমে কাঁদা! রীতি উঠেই নিচে চলে গিয়েছে। রাদিয়ার খোঁজ জানা নেই তার, তূর্ণা গোসল করছে। ফোন হাতে নিলো সে। নাহিয়ানের মেসেজ নেই কোনো। বুঝতেই পারলো তারাও ঘুমাচ্ছে। নীতি আর বসলো না। নিচে গেলো সেও।

বড়দের সাথে টুকটাক কাজ করার মাঝেই খেয়াল করলো নাহিয়ান নামছে নিচে। নীতি ওর কাছে গেলো। কিছু বলবে তার আগেই রাদিয়া এক কাপ চা হাতে এসে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “নাহিয়ান, আপনার চা!”

নাহিয়ান হাসি মুখে হাতে নিলো।

“এটার প্রয়োজন ছিলো খুব!”

রাদিয়া মুচকি হেসে চলে গেলো। নাহিয়ান চায়ের কাপে চুমুক দিবে তার আগেই হুট করে নীতির কথা মাথায় আসলো ওর। ফট করে ওর দিকে তাকালো। হাসার চেষ্টা করে বললো, “রাতে ঠিকভাবে ঘুম হয়নি! তাই আরকি!”

নীতি হেসে বললো, “গিলেন গিলেন, ভালো মতো গিলেন।”

বলেই মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। নাহিয়ান মাথা চুলকালো। চায়ে আবার চুমুক দিতে গিয়েও দিলো না। দিলে নির্ঘাত দুঃখ আছে তার কপালে!

#চলবে

প্রিয় অনুভব পর্ব-২০+২১

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২০

শাড়ির দোকানে মুখ ভার করে বসে আছে নীতি। রীতি, প্রীতি, রাদিফ, আনাফ আর রাদিয়া নামক মেয়েটি শাড়ি দেখছে। নীতির এসবে মন বসছে না। নাহিয়ান আসবে ভেবেছিল। কিন্তু তার তো মেলা কাজ! আপাতত শাড়ির দিকে মন নেই। রাদিয়া প্রীতির খালাতো বোন। প্রীতির সমবয়সী। সে একটা টকটকে লাল রাঙা শাড়ি হাতে নিয়ে নীতির গায়ে জড়িয়ে বললো,

“লাল রঙটা তোমায় দারুন মানায় নীতি!”

নীতি প্রথমে একটু চমকে গেলেও পরক্ষণেই হেসে শাড়িটা জড়িয়ে আয়নায় দেখতে লাগলো। ভালো লাগছে, নাকি খারাপ সেটা বুঝে উঠতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। নাহ খারাপ না, তবে একটু বেশীই লাল মনে হচ্ছে তার। রাদিয়া হাসি মুখ করে বললো, “কি? দারুন না?”

নীতি দ্বিধায় পড়লো। কি বলবে? এমনটা না ওকে খারাপ লাগবে। কিন্তু আবার কেমন জানি! সব শেষে না পেরে রীতি, প্রীতিকে ডেকে বললো,

“আমাকে কেমন লাগবে এটাতে?”

শাড়ি বাদ দিয়ে নীতির দিকে তাকালো ওরা।

“ছি কি চয়েস!”

রীতি কিছু বলার আগেই পুরুষালি কণ্ঠ শুনে মৃদু কেঁপে উঠলো নীতি। না তাকিয়েও বুঝতে পারলো মানুষটা কে!
নাহিয়ান এগিয়ে নীতির সামনে দাঁড়ালো।
“বধূ তো প্রীতি, তুমি লাল শাড়ি দিয়ে কি করবে? ওর সাথে বিয়েতে বসবে নাকি? বর কে হবে তোমার তাহলে?”

নীতি নিজেকে সামলে গায়ের শাড়ি ওর মুখে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় বসলো। সবাই মুখ চেপে হাসলো। মাঝ থেকে রাদিয়া বলে উঠলো, “আমিও এটাই বলছিলাম। লাল রং বেশি বেশি হয়ে যায়!”

নীতি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো। রাদিয়া চোখ দিয়ে ইশারা করে ওকে কিছু বলতে নিষেধ করলো। এর মাঝেই রীতি জিজ্ঞেস করলো, “তুই না আসবি না বললি?”

“হাফ টাইম কাজ করে ছুটি নিয়েছি। পরে ওভারটাইম করে কভার করে নিবো!”

নীতি আড়চোখে তাকালো। ওর জন্য এখন ওভারটাইমও করা লাগবে তার!

“ভাইয়া ওই বেগুনি রঙের শাড়িটা দেখান তো!”

নাহিয়ানের ইশারা করা শাড়িটা বের করে দোকানদার সামনে রাখলো। নাহিয়ান হাতে নিলো। গাঢ় বেগুনি রঙের সিল্কের শাড়িটা বেশ সুন্দর। নাহিয়ান ওটা নীতির গায়ে জড়িয়ে ওকে আয়নার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, “এটা পারফেক্ট! তোমাকে মানাবে ভীষণ!”

অতঃপর মৃদু কণ্ঠে কেবল নীতি শোনার জন্য বললো, “আমার বউ হিসেবে!”

চমকে নাহিয়ানের দিকে তাকালো নীতি। নাহিয়ান ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি?”

নীতি উত্তর না দিলেও মুখে হাসির রেখা ফুটালো। কিন্তু এই হাসি খুব একটা স্থায়ী হলো না। ওদের মাঝে রাদিয়া ফোঁড়ন কেঁটে বলে উঠলো, “আপনার চয়েস তো দারুন! আমাকেও একটা চয়েস করে দিন না!”

“হ্যাঁ অবশ্যই!”
বলেই শাড়ি দেখতে লাগলো। ব্যাপারটা নাহিয়ান স্বাভাবিকভাবে নিলেও নীতি মানতে পারলো না। দাঁত কিড়মিড় করে নাহিয়ানের হাতে সেই লাল শাড়ীটা দিয়ে বললো, “এটা দিয়ে বলুন সেই মানাবে!”

“আরে না না, এটা মানা..”

আর কিছু বলার আগেই নীতি নাহিয়ানের হাত চেপে ধরলো। নাহিয়ান নীতির দিকে তাকাতেই ও ইশারায় বোঝালো এটাই দিতে। কারোর এদিকে তেমন খেয়াল নেই। রাদিয়া নিজ মনে শাড়ি নাহিয়ানের সামনে এনে দিচ্ছে।

“বললেন না যে কোনটা নিবো?”

নাহিয়ান উপায় না পেয়ে সেই শাড়ীটাই ওর হাতে দিয়ে বললো, “এটা নেও। ভালো লাগবে!”

রাদিয়া আপত্তি করে বললো, “আপনি না মাত্র বললেন বধূ প্রীতি!”

“আরে এটা নীতিকে মানাবে না। তুমি কিউট আছো! তোমায় দারুন লাগবে। এসব মেটার করে না!”

নাহিয়ানের কথায় রাদিয়া খুশি হলেও নীতি চরম ক্ষেপে গেলো। গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। কেনাকাটা শেষে সবাই হাঁটতে শুরু করলো। আপাতত কিছু খাবে, তারপর টুকটাক কিনে চলে যাবে। এখনও অনেক কিছুই কেনা বাকি। একসাথে একদিনে সব সম্ভব না। সবাই কথা বলতে বলতে হাটছে। নাহিয়ান আর নীতি পিছে পিছে। ওদের সাথে একটু দূরত্বে রাদিয়া!

“এমন মুখ ভার করে আছো কেনো?”

“আমার মুখ! যা খুশি করবো, আপনার কি?”

“আরে কয়দিন পর তো এই মুখে আমার অধিকার থাকবে তাই না?”

নীতি চোখ রাঙিয়ে নাহিয়ানের দিকে তাকালো। অতঃপর শাসিয়ে বললো, “আমাকে এসব কথা না বলে যান ওই রাদিয়াকে বলুন!”

“ওকে কেনো বলতে যাবো?”

“কেনো বলতে যাবেন মানে কি? একটু আগেই তো বলছিলেন ও কিউট! এখন যান ওর গলা ঝুলে বসে থাকুন!”

“তুমি এই কারণে রেগে আছো?”

“না, না। রেগে থাকবো কেনো? আনন্দে আছি! মহানন্দে!”

“আচ্ছা আচ্ছা, রাগ কমানোর জন্য কি করতে পারি ম্যাম?”

“ওকে গিয়ে বলেন তুমি পেত্নী, তোমায় কিছুতেই মানাবে না!”

“এটা বলবো?”

“হ্যাঁ, পারবেন বলতে?”

“পারবো তবে…”

“তবে?”

নাহিয়ান মুচকি হেসে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো,

“Pehle Ishq Lada Loon
Uske Baad Launga[2]
Tere Vaaste Falak Se
Main Chand Launga
Solah Satrah Sitare
Sang Bandh Laanga..”

ওর গলা শুনে সবাই ওর দিকে তাকালো। রীতি বলে উঠলো, “বাহ, আজকে কোনো কথা ছাড়াই গান গাইলেন নাহিয়ান। ব্যাপার কি?”

নাহিয়ান নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “আশেপাশে স্পেশাল মানুষ থাকলে গান তো আসবেই!”

সবাই একসাথে বলে উঠলো, “ওহো!”

কিন্তু নীতি আবার ক্ষেপে গেলো। কারণ উপস্থিত সব স্পেশাল বলতে রাদিয়াকে বুঝেছে। সে নীতির সাথেই ছিল বিধায় সবাই পকেই স্পেশাল মানুষ ভেবেছে। নয়তো নাহিয়ান আর নীতির মাঝে কি জমে? রাগে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গেলো নীতি। নাহিয়ান সহ সবাই হতভম্ব। এর আবার কি হলো?

__________________________________

মন খারাপ করে অঙ্ক করছে তূর্ণা। আরহাম কিছুক্ষণ বাদে বাদে ওর দিকে তাকাচ্ছে। মূলত তূর্ণার এই চুপচাপ পড়াটা হজম হচ্ছে না। পড়া বাদ দিয়ে বক বক করে মাথা গরম করে দেওয়া মেয়েটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, ভাবা যায়? ম্যাথ করে দিতেই আরহাম বেশ অবাক হলো। অন্যদিন সহজ জিনিস করতে দিলেও ও আটকে যায়। আর আজকে কঠিন ম্যাথগুলোও করে ফেলেছে!

“বাহ, সব ঠিক আছে দেখছি!”

তূর্ণা যেনো এটারই অপেক্ষায় ছিল।

“আমি তো সব পেরেছি, এবার মাকে বলুন আমি পড়া সব পারি!”

আরহাম বোকা বনে গেলো।

“মানে?”

তূর্ণা চুপ করে রইলো।

“কি হয়েছে? বলবে তো!”

“ঐযে শাফিন ভাইয়া আছে না? তার বউয়ের চাচাতো বোনের সাথে চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে। ভাবি তো আগেই চলে গিয়েছে। আমাকেও যেতে বলেছে। কিন্তু মা দিচ্ছে না, বলেছে আপনি যদি বলেন আমি পড়া ঠিকমত পারছি তাহলেই যেতে দিবে!”

আরহাম এতক্ষণে আসল কাহিনী বুঝলো। সে ফিজিক্স বই নিয়ে পেজ উল্টাতে উল্টাতে বললো,

“কিন্তু আমি তো বলবো না!”

“কেনো?”

“তোমার একদিনের পড়া দিয়ে আমার কোনো লাভ আছে?”

তূর্ণা মুখ ভার করে বললো, “আমি এসেও মন দিয়ে পড়বো। সত্যি!”

আরহাম কিছুক্ষণ ভাবলো। অতঃপর বললো,

“বেশ, তবে শুনো! তুমি বিয়ের তিনদিন আগে যেতে পারবে!”

“তিনদিন আগে গিয়ে কি করবো? আর শপিং কবে করবো?”

“তিনদিন আগেই যাবে। এর মাঝে চারদিন আছে। এই চারদিনে আমি প্রত্যেক সাবজেক্টের একটা করে টপিক দিবো, তুমি পড়বে। সব পড়া ঠিক মতো দিতে পারলেই আমি চাচীকে বলবো। নয়তো আশা বাদ দেও!”

তূর্ণা গাল ফুলিয়ে বললো, “আর শপিং? সেই সাথে ওরা চলে গেলে আমায় নিবে কে?”

আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

“আমি তোমাকে শপিং এ নিয়ে যাবো আর পৌঁছেও দিবো! হয়েছে?”

তূর্ণার এটা পছন্দ হলো না। তবুও রাজি হলো। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। আগে না যাক, বিয়েতে তো যেতে পারবে! এতেই চলবে!

__________________________________

“সমস্যা কি? ফোন ধরছো না কেনো?”

“ধরছি না যখন দিচ্ছেন কেনো?”

“তো তুমি চাইছো কথা না বলি?”

নাহিয়ানের কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট। নীতির অভিমান গাঢ় হলো। বিকেলে এসে থেকেই রাদিয়া সবার সাথে বলে চলেছে নাহিয়ান এই করেছে, নাহিয়ান তেমন, ওর ভালো লেগেছে। এক প্রকার বিরক্ত হয়েই নীতি সরে এসেছে সেখান থেকে ভালো লাগছে না কিছু তার। তার মাঝে নাহিয়ানের ফোন! সব রাগ এখন নাহিয়ানের উপর গিয়ে পড়লো। ফলস্বরূপ বলে উঠলো, “হ্যাঁ চাইছি!”

সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে দিলো নাহিয়ান। বিস্ময় নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো নীতি। নাহিয়ান সত্যি ই ফোন কেঁটে দিলো? বিছানায় গিয়ে বসলো ও। এত রাগ তার? আচ্ছা নীতি নাহয় একটু অভিমান করেছে। করবে না কেনো? নারী তার শখের পুরুষের ক্ষেত্রে বড্ড স্বার্থপর। শখের পুরুষের সাথে অন্য নারীর ছায়া তো দূরে থাক, অন্য নারীর নাম শুনতেও ঈর্ষা করে। যখন এসব শুনে বা দেখে, তখন তাদের মনে যে ক্ষরণ হয় তারা কি তা বোঝে না? তারা কি জানে না; এই হৃদক্ষরণ কতটা যন্ত্রণাদায়ক? সত্যি কি বোঝে না?

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো নীতি। মিনিট খানেক বাদেই আবার কল আসলো। স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে অনুভব নামটা। মুখে হাসি ফুটলো নীতির! চোখের কোণে থাকা পানিটুকু মুছে রিসিভ করলো।

“রাগ কমেছে?”

“না!”

“কি করলে কমবে?”

“বলেছি আগেই!”

“আরে ওকে তো ঠিক মতো চিনিও না, ওকে কিভাবে এসব বলবো!”

“জানি না, কেবল জানি আপনি বলবেন!”

“নীতি!”

“ভালোবাসি!”

নাহিয়ান বার কয়েক পলক ফেলে আবার জিজ্ঞেস করলো, “কি বললে?”

“ভালোবাসি!”

“কেনো?”

“কারণ লাগবে?”

“না মানে হঠাৎ কোন কথা থেকে কোথায় গেলে!”

নীতি হাসলো।

“ভালো লাগছে না অনুভব! অদ্ভুত লাগছে, ভয় করছে। এসে থেকে রাদিয়া অদ্ভুতভাবে আপনার নাম জপে যাচ্ছে। না পারছি সইতে, না পারছি বলতে। প্রিয় পুরুষটির নাম, অন্য নারী কত সহজে নিয়ে নিচ্ছে। তাকে ঘিরে অনুভূতি বলছে। এই অনুভূতি শুনে সেই পুরুষটির প্রেমময়ীর মনে যে ক্ষরণ হচ্ছে তা বুঝছেন অনুভব? অনুভব করছেন, আপনার প্রিয় কষ্ট পাচ্ছে?”

নাহিয়ান চুপ রইলো। নীতি আবার বললো,

“আপনি অবুঝ ভীষণ অনুভব! বুঝেন, তবুও বুঝেন না!”

“আমি কেবল আমার প্রেমময়ী বিরহবতীকে বুঝি। আশেপাশের কোনো নারীর অনুভূতি বোঝার আমার প্রয়োজন পড়ে না প্রিয়! একদমই পড়ে না। অনুভব কেবল তার প্রিয়কে অনুভব করে। আশপাশ জুড়ে কেবল প্রিয়র অস্তিত্ব চায়। অন্য কারোর প্রতি ইন্টারেস্ট নেই তার। বিন্দুমাত্র নেই।”

নীতি তৃপ্তির হাসি হাসলো।

“নীতির প্রতিও নেই?”

”তুমি বললে ভেবে দেখতে পারি! দেখবো?”

নীতি হেসে বললো, “দেখেন! ভালো করে দেখবেন কেমন?”

“যথা আজ্ঞা বেগম সাহেবা!”

নীতি হালকা শব্দ করে হাসলো। সেই হাসির শব্দ শুনে নাহিয়ান বলে উঠলো, “ভালোবাসি!”

__________________________________

ফোনের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো বর্ষা। সামনে রাদিফকে দেখে অসহায় মুখভঙ্গি করে বললো,

“সরি ভাইয়া! খেয়াল করি নি।”

রাদিফ হেসে বললো, “ইটস ওকে!”

বলেই পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলো। বর্ষা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা তাকে ভীষণ টানে! এই টান বাড়াতে চায় না বর্ষা! একটুও না। ভেবেই নীতির ঘরের দিকে পা বাড়ালো। গত দুই দিন ধরে ভার্সিটির অ্যাসাইনমেন্টগুলো ও একা করে ম’রছে। আর নীতি আরামে ঘুরছে! এটা ওর সহ্য হচ্ছে না। আপাতত নীতিকেও কাজে লাগানোর জন্যই এখানে আসা তার।

“আসবো ম্যাম?”

বর্ষার কণ্ঠ শুনে নীতি তাড়াহুড়ো করে কান থেকে ফোন নামালো। বর্ষা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো।

“কিরে?”

“কি?”

“কি?”

“সেটাই তো কি?”

“আমাকে দেখে ওমন ফোন রেখে দিলি কেনো?”

নীতি প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে লজ্জা লজ্জা ভাব ফুটিয়ে বললো, “আসলে তোর জন্য দুলাভাই খুঁজছিলাম।”

“কিহ?”

“জী!”

বর্ষা পাত্তা না দিয়ে বললো, “ধুর, আয় অ্যাসাইনমেন্টে সাহায্য কর।”

“তোরটা আমি করবো কেনো?”

“কারণ তুই আমার বান্ধবী! আয় না জানু, দেখ অনেক বাকি! এগুলোর জন্য আমি মজাও নিতে পারছি না। প্লিজ প্লিজ!”

নীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “বের কর, আসছি!”

বলেই বারান্দায় গেলো। ফোন আবার কানে নিয়ে বললো,

“রাখছি এখন?”

“রাখা তো লাগবেই! তোমার পরাণ এসে গিয়েছে যে।”

নীতি হেসে বললো, “আপনি কি ওকে নিয়েও জেলাস?”

“নাহ, কারণ তুমি তো আর ওমন মেয়ে নও, যে জেলাস হবো বর্ষা কে নিয়ে!”

ওমন মেয়ে – কথাটার মানে বুঝতে কয়েক সেকেন্ড নিলো নীতির মস্তিষ্ক। বুঝতে পেরেই ধমকে বলে উঠলো,

”অসভ্য, বজ্জাত!”

নাহিয়ান হাসতে হাসতে বললো, “তোমারই সব!”

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২১

পাশাপাশি বসে আছে বর্ষা আর নীতি। ক্লাস করার ইচ্ছে নেই বলে মাঠে এসে বসে আছে ওরা।

“তোর অনুভবের সাথে আর যোগাযোগ হয়?”

চুপচাপ বসে থাকার মাঝে এমন প্রশ্ন শুনে ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে নিলো নীতি। অতঃপর একটু ভেবে বললো,

“হয়!”

“সব ঠিক তোদের মাঝে?”

“বলতে পারিস!”

“বলতে পারিস মানে কি?”

নীতি ঠোঁট চেপে হাসলো। আপাতত এই বিষয়ে সে বলতে চায় না বর্ষাকে। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
“আচ্ছা তোর কোনো ক্রাশ নেই?”

ক্রাশের কথা শুনে বর্ষা ভরকে গেল।

“হুর, আমার কি ক্রাশ খাওয়ার বয়স আছে?”

“তো কিসের বয়স এখন তোর?”

“বিয়ে করার বয়স! তোরও!”

“তো বিয়ে করবি কাকে?”

“আমার জামাইকে!”

“জামাইটা কে?”

“তোর জামাই!”

“ঠাস করে দিবো আমার জামাইয়ের দিকে নজর দিলে। আপন ভাই লাগে তোর! বুঝলি?”

বর্ষা শব্দ করে হেসে দিলো। নীতি গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। বেস্ট ফ্রেন্ড হোক বা বোন, ওর পারসোনাল মানুষের দিকে নজর কেনো দিবে? সেই মুহূর্তে ফোন বেজে উঠলো তার। নাহিয়ান কল করেছে। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করলো।

“ভার্সিটিতে আছো?”

“হুমম!”

“বের হতে পারবে?”

“আপনি কোথায়?”

“বাইরেই আছি!”

“আসছি!”

বলেই রেখে দিল। বর্ষা ওর পানে তাকিয়ে আছে।

“কে ফোন দিয়েছে?”

“ভাইয়া!”

“ভাইয়াকে আপনি কবে থেকে বলিস? আর কোন ভাই?”

“আমার যখন যা মন চায় বলি! তুই থাক, আমি আসছি!”

বর্ষা চমকে উঠে বললো, “আমি একা থাকবো?”

“হুম বেবি, ক্লাস করে নোটগুলো পাঠিয়ে দিও। টাটা!”

বলেই হাঁটা শুরু করলো। বর্ষা বেকুব বনে গেলো।

“এটা ঠিক না নীতি!”

__________________________________

ভার্সিটির বাইরে আসতেই রাস্তার ও পাড়ে নাহিয়ানকে দাঁড়ানো অবস্থায় পেলো। স্কাই ব্লু পরিহিত শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট পরিহিত পুরুষটিকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিলো নীতি। ঘর্মাক্ত মুখশ্রী; কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো নীতির। শার্টের উপরে দুটো বোতাম খোলা রাখার কারণে শুভ্র বুকের কিছুটা দৃশ্যমান রয়েছে। হুট করেই নীতির খেয়াল হলো, সে ফরমাল গেটআপে আছে। তবে কি অফিস থেকে এসেছে?

দ্রুত পা ফেলে রাস্তা পার হলো নীতি।

“অফিস থেকে এসেছেন?”

নীতির কন্ঠ শুনে ওর দিকে তাকালো নাহিয়ান। এতক্ষণ ফোনে ছিলো তার নজর। নীতিকে দেখেই ক্লান্তি মাখা হাসি দিলো।
“হুম। ক্লাস করবে নাকি হাঁটবে?”

নীতি কথার উত্তর না দিয়ে নাহিয়ানের হাত মুঠোয় নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতেই বললো, “আজও কি হাফ টাইম করে ছুটি নিয়েছেন?”

“নাহ, এখানে অফিসের কাজে এসেছিলাম। হাতে অফুরন্ত সময়। ভাবলাম দেখা করে যাই।”

“ওহ! আচ্ছা চলুন লাইব্রেরী যাবো। বই কেনা লাগবে।”

নাহিয়ান প্রত্যুত্তর করলো না। লাইব্রেরীতে গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় বই নেয়ার মাঝেই কেউ নীতিকে ডাক দিলো।

“হাই নীতি!”

পুরুষালি কণ্ঠ শুনে নীতি, নাহিয়ান দুইজনই তাকালো। নীতি সৌজন্যমূলক হাসি দিলেও, নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

“আরে ভাইয়া আপনি?”

ছেলেটি হেসে ওর পাশে দাঁড়ালো।

“এখানে কি করছো?”

“বই নিতে এসেছি। আপনি?”

“আমিও।”

অতঃপর নাহিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তোমার ভাইয়া?”

মুহূর্তেই ভ্রু আরো কুঁচকে নিলো নাহিয়ান। নীতি একবার নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “না, আত্মীয় আমাদের।”

“ওহ, হ্যালো!”

নাহিয়ান অনিচ্ছা সত্বেও হাসলো। কিছু বললো না। অতঃপর ছেলেটি নীতিকে বললো, “ভার্সিটি যাবে তো? চলো!”

“না, বাড়ি যাবো!”

“ওহ, চলো পৌঁছে দেই।”

“না, প্রয়োজন নেই। এইযে উনার সাথে যাবো। আসি ভাইয়া! আসসালামু আলাইকুম!”

বলেই বই নিয়ে বেরিয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতেই নাহিয়ান জিজ্ঞেস করলো,

“ছেলেটা কে?”

“ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। নাম কি কে জানে!”

“সবসময়ই কি এমন সেধে এসে কথা বলে?”

নীতি নাহিয়ানের দিকে তাকালো।

“হুমম!”

“তুমিও বলো?”

নীতি ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিলো, “হু!”

নাহিয়ান অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, “বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই। হাবসাব দেখেই বোঝা যায় তার মনে কিছুমিছু আছে।”

নীতি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিছুমিছু কি?”

“কিছুমিছু মানে কিছুমিছুই!”

“কিছুমিছু মানে কিছুমিছুই কি?”

“বড্ড বেশি কথা বলো তুমি!”

সেই মুহূর্তে একজন ছেলেকে নীতি ইশারা করে বললো, “ছেলেটা সুন্দর না?”

নাহিয়ান ছেলেটার দিকে একপলক তাকিয়ে নীতির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। নীতি ঠোঁট কামড়ে হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পরও সে পিছে ঘুরে ছেলেটিকে দেখতে লাগলো। নাহিয়ান ওর মাথা সামনের দিকে ঘুরিয়ে বললো, “সামনে তাকাও!”

নীতি শুনলো না। আবার পিছে তাকালো। নাহিয়ান আবার ওকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে দিলো। এভাবে বার কয়েক করার পর নাহিয়ান ওর মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে হাঁটতে শুরু করলো।

“বড্ড বেশি দুষ্টু তুমি নীতি!”

নীতি ফিক করে হেসে দিলো। নাহিয়ানকে বিরক্ত করে শান্তি পাচ্ছে সে।

__________________________________

বেশ উৎসাহ নিয়ে শপিং মল ঘুরছে তূর্ণা। সাথে আছে আরহাম। আরহাম তার কথা অনুযায়ী আজ তূর্ণাকে নিয়ে এসেছে। তূর্ণা নিজের প্রয়োজন মত জিনিস কেনা শেষে ফুচকার দোকানে গেলো। ফুচকা আসার অপেক্ষা করছে সে। আরহাম ফোন দেখছে। তুর্ণার এমন এতিমের মত বসে থাকতে বিরক্ত হচ্ছে সে। অবশেষে না পারে আরহামকে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে ভাইয়া?”

তূর্ণার প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরহাম। তূর্ণা ওর চাহুনি দেখে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে বোর হচ্ছি। এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগে নাকি?”

আরহাম হাতের ফোন পাশে রাখলো।

“তাহলে পড়া নিয়েই কথা হোক?”

তূর্ণার মুখ চুপসে গেলো। এখানেও পড়া? আরহাম ওর মুখ দেখে মৃদু হাসলো। আরহামের হাসি দেখে মুগ্ধ হলো তূর্ণা। সচরাচর হাসে না সে।

“তুমি এই কয়দিন জাস্ট বিয়েতে যাওয়ার জন্য যেভাবে পড়েছো, সেভাবে এইচ এস সি তে পড়লে কতটা ভালো করতে?”

তুর্ণা মুখ ভার করে বসে রইলো। এটা এসব আলোচনার জায়গা? আরহাম বুঝতে পারলো।
“তূর্ণা, আমি জানি এসব পড়াশোনার প্রতি তোমার ইন্টারেস্ট নেই। কারণ তোমার ধারণা তোমার মা বাবা আছে, তুমি সংসার করবে; পড়াশোনার কি কাজ? হ্যাঁ এগুলো সত্য, কিন্তু ভেবে দেখেছো কখনো তারা না থাকলে তোমার কি হবে?”

তূর্ণা নড়ে চড়ে বসলো।

“হ্যাঁ, তাদের সম্পদ হয়তো তোমায় সাহায্য করবে। কিন্তু কতটা? আর কত দিন? সেই সাথে একটা সংসারে গেলে কোনো ভেবে তোমার ভাগ্যে এমন কেউ পড়লো যার সাথে তোমার যায় না, তখন ছেড়ে দিলে কি করবে? আচ্ছা ধরেও নেও, সে ভালো মানুষ। কিন্তু যখন সে থাকবে না, তুমি কি অন্যের উপর বোঝা হয়ে থাকবে?”

তূর্ণা চুপ করে রইলো।

“মেয়েদের জীবনে পড়াশোনাটা জরুরি! হ্যাঁ শেষে সংসার সামলাতেই হয়, তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে অন্যের বোঝা হিসেবে রাখতে হয় না! তাই একটু মন দেও, অন্তত এইচ এস সি টা ভালো মতো দেও। এতটুকু পড়াশোনা থাকলেও অনেক উপকার হয়। আশা করি বুঝেছো!”

তূর্ণা কিছু বললো না। আরহাম আবার বললো,

“আমার কথাগুলো যদি মোটিভেশন হিসেবে নেও, তবেই ভালো।”

তূর্ণা কেবল মাথা নাড়লো। ফুচকা আসতেই সে তার মতো খেতে লাগলো। আরহাম ওর প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে পারলো না, আদো ব্যাপারটা সে বুঝেছে কি না!
__________________________________

হালকা গোলাপী রঙের গাউনটা পড়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে নীতি। আজকে প্রীতির মেহেন্দী অনুষ্ঠান। যদিও এত কিছু করার ইচ্ছে ছিলো না তাদের, তবুও প্রীতির আবদারে হচ্ছে এসব। বাম কাধে গাউনের সাথে ওড়নাটা ছড়িয়ে দিলো। কানে সাদা স্টোনের ছোট দুল আর গলায় নাহিয়ানের সেই পেন্ডেন্ট। দু হাতে সাদা স্টোনের দুটো দুটো করে চারটি চুড়ি পড়েছে। নাহিয়ানদের বাড়ির লোক এসে গেছে। সাজ দেয়নি নীতি। হালকার মাঝেই নিজেকে সাজিয়েছে সে। অতঃপর নিচে যাওয়ার জন্য বের হলো নিজের রুম থেকে। সিঁড়ির কাছে পা রাখতেই ভ্রু যুগল কিঞ্চিত কুঁচকে নিলো সে। নাহিয়ান হেসে হেসে রাদিয়ার সাথে কথা বলছে! আপন মনেই বলে উঠলো সে,

“কি আশ্চর্য! এতো হেসে হেসে ওর সাথে কথা বলছে কেনো লোকটা?”

ঝটপট পা ফেলে নিচে গেলো সে। গেস্টসরা আসতে শুরু করেছে কেবল। ওদের একটু কাছে যেতেই শুনতে পেলো,

“ব্ল্যাক শার্টে আপনাকে দারুণ লাগছে নাহিয়ান!”

নীতির রাগ তরতর করে বাড়লো। যেখানে নীতি নিজেই এখনও ওর নাম ধরে ডাকার মত কাজ করতে অস্বস্তি বোধ করে, সেখানে এই মেয়ে নির্বিকার চিত্তে তাকে নাম ধরে ডাকছে! নাহিয়ান হাসলো। স্বাভাবিকভাবেই মজা করে বললো,

“তোমাকেও সুন্দর লাগছে! একদম ক্রাশ খাওয়া টাইপ!”

এমন ফ্লার্ট নাহিয়ান সবার ক্ষেত্রে করলেও নীতির সহ্য হলো না। হাতের কাছে ফুলদানি পেয়ে সেটা নিচে ফেলে দিলো নীতি। কাঁচ ভাঙার শব্দে দুজনের দৃষ্টি ওর দিকে গেলো। নীতি একপলক ভেঙে যাওয়া ফুলদানী আর এক পলক নাহিয়ানের দিকে তাকালো। মিনমিনে কন্ঠে বললো, “দুঃখিত, হাত লেগে পড়ে গিয়েছে।”

এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সে। ভেঙে যাওয়া ফুলদানীর টুকরোগুলোর উপর পা রাখতেই চোখ বুজে পায়ের ক্ষত সয়ে নিলো সে। অতঃপর ধপাধপ পা ফেলে নিজের রুমে গেলো সে। সে তার রাগ প্রকাশ করতে চায় না। একদম না! নাহিয়ান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। হলোটা কি?

#চলবে

প্রিয় অনুভব পর্ব-১৮+১৯

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৮

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নীতি। নাহিয়ানরা একটু আগেই বেরিয়েছে। বর্ষা যায়নি। ওকে রীতির রুমে পাঠিয়েছে নীতি। নয়তো ওর ঘুম আজ আর আসবে না। দরজায় কেউ নক করেছে টের পেয়ে নীতি রুমে এসে দরজা খুললো। সামনেই সিনথী দাঁড়িয়ে আছে।

“কি চাই?”

“এই নেও!”

বলেই একটা মাঝারি আকারের বক্স এগিয়ে দিল। নীতি ভ্রু কুঁচকে বললো, “কি এটা?”

“তোমার গিফট!”

নীতি হাসলো। সিনথীর গিফট মানেই চকলেট। নীতি হাতে নিলো।

“ধন্যবাদ লিটল সিস্টার!”

সিনথী উত্তর না দিয়ে ভিতরে এসে বিছানায় বসলো। নীতি বক্সটা তার ড্রেসিংটেবিলের উপর বাকি গিফটগুলোর সাথে রাখলো। অতঃপর ওর পাশে এসে বসলো।

“কি হয়েছে?”

“ভালো লাগছে না আপু। রীতি আপু আজকে থাকলেই পারতো।”

“তার সংসার আছে এখন। বুঝতে হবে তো!”

“নাহিয়ান ভাইয়ার তো নেই, তাহলে সে থাকলো না কেনো?”

‘নাহিয়ান’ নাম শুনেই মুখ মলিন হয়ে গেলো নীতির।

“তার সংসার নেই, কিন্তু কাজ আছে।”

“হুমম দেখলাম। এখানেও আমার থেকে পেন, পেপার নিয়ে কি সব কাজ করলো।”

নীতি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কখন?”

“ওইতো, সবাই যখন খাচ্ছিলো আর আম্মু, চাচীদের সাথে গল্প করছিলো তখন আমার কাছে এসেছিলো। বললো একটা পেন আর পেপার দিবে। তার কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, সেটা নাকি তখনই করতে হবে!”

“ওহ!”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, “এখানে ঘুমাবি?”

“উহু!”

“তাহলে বসে আছিস কেনো? সকালে স্কুল নেই?”

“আছে।”

“যা ঘুমোতে যা!”

“আচ্ছা!”

সিনথী বেরিয়ে যেতেই নীতি দরজা আটকে দিলো। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। কোনো কারণ ছাড়াই ওর নিজেকে দেখতে ভালো লাগে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। আজকে নাহিয়ানকে কত কিছু বলে ফেললো। মানুষটা কি ভেবেছে ওকে? ভেবেই আনমনে চিরুনি নিতে গিয়ে সিনথীর দেয়া বক্সটা হাত লেগে পড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে কতোগুলো এক টাকার চকলেট ছড়িয়ে পড়লো। নীতি আগেই জানে সিনথীর গিফট সম্পর্কে। ওর বাবা প্রতিদিন পাঁচ টাকা দিয়ে পাঁচটা চকলেট আনে। একটা নীতিকে দেয়, একটা প্রীতি, একটা রীতি। আর বাকি দুটো সিনথীর। ব্যাপারটা ওরা বেশ উপভোগ করে। আর সিনথী এই চকলেট থেকে একটা করে সরিয়ে রাখে। যখন যে যেই চকলেট দেয় সেগুলো থেকেই সরিয়ে রাখে। এভাবেই জমিয়ে ওকে দেয়। তবে এবারেরটা ভিন্ন ছিল। বক্সের ভিতর আরেকটা মিনি সাইজের বক্স আছে সাথে একটা কাগজ। নীতি ওগুলো হাতে নিলো। বক্সটা খুলতেই একটা সুন্দর পেন্ডেন্ট দেখতে পেলো। সাদা পাথরের তৈরি লকেটের এই পেন্ডেন্ট নজর কাড়লো নীতির। উঠে দাঁড়ালো ও। বিছানায় বসে হাতে থাকা সাদা কাগজটা খুললো। এটা কেবল কাগজ বললে ভুল হবে, একটা চিঠি বলা যায়। নীতি মন দিয়ে পড়তে লাগলো।

“প্রিয় প্রেমময়ী,
কেমন আছো? অভিমান নাকি অভিযোগ? কোনটা আছে তোমার মনে? অনুভূতি কথনে আজ এত অপটু আমি কেনো, আমার জানা নেই। তোমার কথার প্রেক্ষিতে একটা কথা তো দূরে থাক আওয়াজও বের হয়নি আমার। ছন্দ সাজানো ব্যাক্তি আজ শব্দের অভাবে চুপ ছিলো। ‘প্রিয়’ ব্যাক্তিটি আমার প্রিয়। খুব প্রিয়। তাকে আমি ভালোবাসি। আর ভালোবাসবো, এই নিয়ে কোনো প্রকার সন্দেহ বা দ্বিধা নেই। তবে ‘নীতি’; ‘নীতি’ নামক ব্যাক্তিটি প্রথম প্রথম সত্যিই আমার ভীষণ অপছন্দের ছিলো। এর একমাত্র কারণ তার খামখেয়ালীপনা। কারণে অকারণে মানুষের জিনিস ভেঙ্গে টাকা দেয়াটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর বিষয়। তাই সে আমার খুব রকমের অপছন্দ ছিল। তবে সেদিন আমার ধারণা ভাঙলো। জিনিস ভাঙ্গা ছিল কেবল অজুহাত, এর পিছে কারণ অন্য। আর সেই মুহূর্ত থেকে সে আমার পছন্দের। খুব পছন্দের!”

নীতি থামলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবার পড়তে শুরু করলো।

“হ্যাঁ, হয়তো রাগে অনেক সময় অনেক কিছুই বলেছি; তবে সেগুলোতে সত্য ছিল না। জানো নীতি? যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছি সেদিন খুব রকমের রেগে গিয়েছিলাম তোমার উপর। কারণ তুমি আমার প্রিয় গিটার ভেঙ্গেছো, আবার তার মূল্য টাকার উপর বিবেচনা করেছো। সব মিলিয়ে পৃথিবীতে কেবল তোমাকেই অসহ্য লাগছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ধারণা বদলিয়েছে। নতুন করে চিনেছি তোমায়। অদ্ভুতভাবে তোমার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। একটা সময় উপলব্ধি করলাম আমি তোমাতে মত্ত হয়ে যাচ্ছি। মনের মাঝে অপরাধবোধ তৈরি হচ্ছিলো। আমি আমার প্রিয়কে ঠকাচ্ছি না তো? অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম দেখা করবো, প্রিয়কে নিজের করবো। তোমার থেকে নিজেকে একদম আড়াল করে ফেলবো। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তুমিই আমার প্রিয় হলে। এতে যতটা না অবাক হয়েছি, তার থেকেও বেশি খুশি হয়েছি। জানি না, কেনো খুশি হয়েছিলাম। তবে তোমার বলা প্রতিটা কথা আমায় উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে এই মানুষটাকে আমিও ভালোবাসি। তোমাকে অনুভব করেই ভালোবেসেছি। তাই ‘নীতি’ নামের ব্যাক্তিটির প্রতি এত এত অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছিলো। অতঃপর বুঝতে পেরেছি, ‘নীতি’ হোক বা ‘প্রিয়’ দু জনের জন্য আমার অনুভূতি একই ছিলো। কারণ দুজন যে একই মানুষ ছিল।”

নীতির দ্রুত নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করে বাকিটুকু পড়লো,

“প্রিয়োনা! অনেক তো হলো বিচ্ছেদের কথন। এবার নাহয় আবার নতুন করে সবটা শুরু করি? হ্যাঁ হয়তো মাঝের কিছুটা সময় তিক্ততায় ভরপুর ছিল। তবে ভেবে দেখো প্রিয়, বাকিটা সময় কেবল স্নিগ্ধতায় মাখা ছিল। নতুন করে প্রণয় কি আবার শুরু করা যাবে প্রিয়? আমাদের দেখা হলো, আমরা চমকালাম, থমকালাম; তবে আমাদের আলাপ হলো না। দৃষ্টি বিনিময় হলো না। হলো না শুভ্র সাজে চেনা শহরের অলি গলি ঘোরা। আবার দেখা করবে প্রিয়? আমাদের আবার নতুন করে আলাপ হোক। হোক মুগ্ধতাময় দৃষ্টি বিনিময়। শুভ্র সাজে ঘুরবো চেনা শহরের অলিগলি। আমাদের আবার দেখা হোক প্রিয়। হোক দেখা! এবার আর কোনো সংকোচ নেই, না আছে কোনো কষ্ট। সূচনা আবার নতুন করে ছন্দের মত সাজাবো দুজন! রাজি প্রিয়? রাজি হলে এসো কাল, একই সময়ে, একই সাজে, একই স্থানে। আমি অপেক্ষা করবো প্রিয়।

‘নতুন সাজে সাজবে আমাদের, প্রেমময় প্রেমের ছন্দ ;
অতঃপর বলবো দু’জন ভালোবাসা নয় মন্দ!’

ভালোবাসি প্রিয় দুর্নীতি। ভালোবাসি!

ইতি
তোমার অনুভব নামক কল্পমানব!”

চিঠিটা পড়া মাত্রই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো নীতি। খুশি লাগছে তার। অবশেষে মিল তাদেরও হবে।

__________________________________

গম্ভীর মুখে বসে থাকা আরহামের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তূর্ণা। আরহাম বসে বসে তূর্ণার ফিজিক্স বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলো। দেখা শেষে তূর্ণার দিকে না তাকিয়েই বললো,

”তাপগতিবিদ্যা সম্পর্কে কি রকম ধারণা আছে?”

“কোনরকম ধারণা নেই।”

আরহাম অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “দুই বছরে কি পড়েছো? মিনিমাম ধারণাও নেই?”

“নাহ!”

আরহাম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো।

“ওকে, আমি শুরু থেকে বোঝাচ্ছি!”

“বোঝান!”

“দেখো!”

“দেখছি!”

আরহাম ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। তুর্ণা টেবিলের উপর হাতের ভর রেখে গালে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আরহাম ভরকে গিয়ে গলা ঝাড়লো।

“আচ্ছা, এটা বলো আগে। তোমার লাইফের গোল কি?”

“আমার যেকোনো একটা ক্রাশের বউ হওয়া!”

আরহাম চোখ বড় বড় করে তাকালো।

“কি বললে?”

“যা শুনলেন!”

“ক্রাশ কে আবার?”

“আপনি!”

আরহাম কাশতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদে নিজেকে সামলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “পড়ায় মন দেও।”

তুর্ণা মুচকি হাসলো। আরহাম ওকে পড়ালেও ওর মনোযোগ পড়ায় কম নিজের অহেতুক আলোচনায় বেশি ছিল। আরহাম কোনো মতে ওকে এক ঘন্টা পড়ালো। অতঃপর বেরিয়ে এলো।

__________________________________
পরের দিন..

আজ আবারও সেই একই সাজ সেজেছে নীতি। সেই এক সাজে, একই রূপে রওনা হলো তার অনুভব নামক নাহিয়ানের উদ্দেশ্যে।

রমনায় পৌঁছাতেই নাহিয়ানকে দেখতে পেলো নীতি। অস্বস্তি হলো তার। যাবে কি করে সামনে? সব শেষে অনেক অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে গেলো ও। নাহিয়ানের পিছে দাঁড়িয়ে গলা ঝেড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো। নাহিয়ান ঘুরে তাকালো ওর দিকে। এক দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। নীতির অস্বস্তি যেনো আরো বাড়লো। মিনমিনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি দেখছেন?”

“আমার প্রিয়কে!”

নীতি লজ্জা পেলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করলো। নাহিয়ান হেসে বললো,

“দুর্নীতি লজ্জা পেতেও জানে?”

নীতি চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।

“কি হলো?”

“দুর্নীতি কাকে বলেন?”

“জানো না নাকি?”

নীতি বির বির করে বললো, “খোঁচা দেয়া ছাড়বে না!”

“কিছু বললে?”

“জি না!”

বলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নাহিয়ান হাসলো নীতির রাগ দেখে। অতঃপর নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “এবার যাওয়া যাক!”

নীতি অবাক কণ্ঠে শুধালো, “কোথায়?”

“কেনো? শহর ঘুরবে না তোমার অনুভবের সাথে?”

নীতি মিষ্টি করে হাসলো। হাতে হাত রেখে বলল,

“চলুন!”

অতঃপর চললো দুজন তাদের চেনা শহর ঘুরতে। অপরাহ্নে হেঁটে চললো শুভ্র সাজের দুটি মানুষ। একজন শুভ্রপুরুষ, আর অপরজন শুভ্রময়ী! শুরু হলো তাদের পথ চলার সূচনা।

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৯

সকাল থেকে মা চাচীদের আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে নীতি। আশ্চর্য! এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। অথচ এখনও কেউ ওকে জিজ্ঞেস করলো না ওর মতামত কি? এখন কেউ না জিজ্ঞেস করলে ও কি করে বলবে যে ও রাজী? ঘুর ঘুর করার পরেও তাদের এটেনশন পাচ্ছে না। সব শেষে বিরক্ত হয়ে ছোট চাচীকে জিজ্ঞেস করলো, “চাচী আনাফ আর প্রীতির বিয়ে দিবে না?”

তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“দেবো না কেনো? অবশ্যই দিবো!”

“কবে দিবে?”

মরিয়ম চোখ ছোট ছোট করে তাকালো,

“তোর এত আগ্রহ কেন এই বিষয়ে?”

“আরে আমারও তো বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে।”

নীতি বির বির করে কথাটা বললেও কিছু অংশ মরিয়মের কানে গেলো। ভ্রু কুঁচকে বললো, “কি বললি?”

নীতি আমতা আমতা করে বলল, “বিয়ে বিয়ে মহল পেতে ইচ্ছে করছে। সাজবো, খাবো! মিস করছি আরকি!”

মরিয়ম স্বাভাবিক হলো। একটু চিন্তা করে বললো, “দিবো তো! কিন্তু…”

“কিন্তু কি?”

নীতি ভেবেছিল ওর কথা উঠবে এখন । কিন্তু ওর ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে মরিয়ম বললো, “আনাফরা কোনো কিছু বলছে না। আর প্রীতিও ছোট!”

নীতি মৃদু আওয়াজে বললো, “ও ছোট? তিনবছর রিলেশন করেছে আর ও ছোট?”

মরিয়ম অবাক কণ্ঠে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে শুধালো, ”কি বললি?”

কি বলেছে খেয়াল হতেই নীতি কাশতে শুরু করলো। এই কথা কেবল ও জানে। তাও অনেক গোয়েন্দাগিরি করে জেনেছে। নয়তো প্রীতি ওকে কখনো বলতো? মেকি হাসার চেষ্টা করে বললো, “না কিছু না, ওই মুখ ফসকে আরকি। বড় চাচী ডাকছে, আসি হ্যাঁ?”

বলেই ছুটলো। মরিয়ম সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হলোটা কি মেয়ের?
__________________________________

এক ছুটে নিজের রুমের দরজার সামনে এসে হাঁপাতে লাগলো নীতি। উফ, কি বলতে কি বলে ফেলছিল। রুমের ভিতর গিয়ে এক গ্লাস পানি খেলো। অতঃপর ফোন হাতে নিলো। নাহিয়ান মেসেজ দিয়েছিল। ও রিপ্লাই দিলো,“হুমম!”

“কি করেন ম্যাম?”

“নাচি, নাচবেন?”

“এ কেমন অনাশ্চার্য কথা বার্তা?”

“হোপ!”

“মুডের এমন বারোটা বাজিয়ে রেখেছেন কেনো?”

“বারোটা বাজানোর কাজ করলে বাজবে না?”

“আমি কি করলাম?”

“আগে বললেন না কেনো আপনিই অনুভব?”

ওপাশে নাহিয়ান মেসেজ দেখা মাত্রই মুখ দিয়ে একটা কথাই বের বলো, “হোয়াট দা!”

“আশ্চর্য তুমি বলেছিলে তুমি নীতি?”

“জিজ্ঞেস করবেন না এইজন্য?”

“করি নি?”

“জোর দিতে হয় তো!”

“মাথায় সমস্যা হইছে?”

“নাহ, গন্ডগোল লাগছে!”

“হোপ মাইয়া!”

“ফুস পোলা!”

নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। অফিসের কাজের ব্রেকে নীতিকে মেসেজ করেছিলো। কিন্তু এই মেয়ের তার যে এভাবে কেটে আছে তা কি ও জানে?

__________________________________

এক হাতে জুতো নিয়ে খালি পায়ে রাস্তায় হেঁটে চলছে বর্ষা। মেজাজ তার আকাশ ছুঁয়েছে। মাঝ রাস্তায় একটা বাইক এসে ধাম করে তার বা কাঁধে থাকা সাইড ব্যাগ নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। ভাগ্য ভালো ব্যাগে আজ পঞ্চাশ টাকা এনেছিল ভাড়ার। এনেছিল বললে ভুল হবে, তার মা দিয়েছে। আর ফোনটাও রেখে এসেছে ভুলক্রমে। কিন্তু মাঝে তার পাঁচশো টাকা ব্যাগটা গেলো। ব্যাগ টান দেয়ার কারণে রাস্তায় পড়েও গিয়েছে সে। হাত পায়ে বেশ কিছু অংশ ছিলে যাওয়ার সাথে সাথে পায়ের জুতোটাও ছিঁড়েছে। এখানে এসেছিলো টিউশনির অফার পেয়ে। কিন্তু বেতন পড়ার হিসেবে কম হয়ে যায় বলে বেরিয়ে এসেছে সে। ঠিকঠাক বেতন দিলে হয়তো করতো। আর মায়ের থেকে টাকাও নেয়ার প্রয়োজন হতো না। তবে এই ঠিকঠাক মূল্য নির্ধারণ না করার জন্যই ও বেরিয়ে এসেছে। আর এখন ওর ধারণা তাদের জন্যই তার এই অবস্থা। হয়তো ওই স্টুডেন্টের মা ওকে মন প্রাণ দিয়ে গালি দিচ্ছে।

“আরে বর্ষা না?”

পরিচিত কণ্ঠ শুনে নিজের ডান পাশে তাকালো বর্ষা। বাইকে বসে আছে রাদিফ। বাইক দেখেই মেজাজ খারাপ হলো ওর।

“না বর্ষার ভুত!”

বর্ষার এহেন উত্তরে ভরকে গেল রাদিফ।

“এখানে কি করছো?”

বর্ষা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, “ফুটবল খেলছি, খেলবেন?”

রাদিফ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।

“তোমার বড় হই আমি। এসব কেমন ব্যাবহার?”

বর্ষা বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকালো। আরে এমনেই ওর মন ভালো নেই। তুই এমন ভুজুং ভাজুং প্রশ্ন কেন করবি?

“দেখছেনই তো আমি। তাহলে আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? আর দেখছেনই তো হাঁটছি এখানে। তাহলে?”

“যেমন নীতি তেমন তার বান্ধবী। ফুল টু এক কোম্পানি!”

কথাটা বিরবিরিয়ে বললো রাদিফ। অতঃপর ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার এই হাল কেনো?”

বর্ষা আফসোসের সুরে সবটা বললো। সব শুনে রাদিফ বললো, “আচ্ছা, চলো আমি তোমায় বাসায় পৌছে দেই!”

“না, না! তার দরকার নেই, তবুও এত করে যখন বলছেন যেতেই পারি।”

বলেই এগিয়ে আসলো বর্ষা। রাদিফ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ও কখন এত করে বললো? লম্বা শ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট দিলো।

__________________________________
“বড় চাচী আসবো?”

নিজের রুমে বসে ছিলেন স্মৃতি। আপাতত তার কাজ নেই। নীতিকে দেখে মুচকি হেসে বললেন, “আয় !”

নীতি সাহস নিয়ে ঢুকলো। মূলত ওর এখন বিয়ে নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু বড়রা যদি ভাবে ওর মত নেই আর না করে দেয়, তাহলে ওর কি হবে?

“কিছু না, শুয়ে আছি। কাজ নেই! তুই এখানে যে! কিছু বলবি?”

“নাহ, এমনি গল্প করতে আসলাম।”

বলেই চাচীর পাশে বসলো। টুকটাক কথার মাঝেই নীতি বলে বসলো, “আনাফ ভাইয়া আর প্রীতির বিয়ে দিবে না?”

“দেবো না কেনো?”

“কবে?”

“তোর এত আগ্রহ কেন আগে সেটা বল!”

বলতে বলতেই রুমে ঢুকলেন জোহরা। মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে বললেন, “তখন দেখলাম তোর ছোট চাচীকেও এক কথা জিজ্ঞেস করলি! মতলব কি তোর?”

দুইজনই কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। নীতি আমতা আমতা করে বলল, “আরে মতলবের কি আছে? ওরাই আফসোস করছে আমার জন্য নাকি ওদের বিয়ে আটকে আছে। এখানে আমি কি করেছি বলো? তাই তো জিজ্ঞেস করছি!”

কথাটা মিথ্যে হলেও দুইজন স্বাভাবিক হলো। স্মৃতি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললো,

“আরে না, তোর জন্য না। আমরাও ভাবছি এই নিয়ে। আজকে এমনিও কথা হতো। আর তোর বিয়ে এখন দিচ্ছি না। কারণ নাহিয়ানের মা বলেছেন তোদের বিয়ে একসাথে দিতে চান না। এতে করে একেকজনের ভাগ্যে একেক রকম অ্যাপায়ন হবে। আর যেহেতু তুই আর নাহিয়ান এখনও একে অপরের অপরিচিত তাই কেউ চাই না এখনই এসব নিয়ে চাপ দিতে। আপাতত তোরা একটু নিজেদের মাঝে কথা বার্তা চালিয়ে যা। ওদের বিয়ে শেষে তোদের মত নিবো আমরা!”

নীতি মাথা নাড়িয়ে উঠে এলো। বাইরে এসেই লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর নিজের মনে নিজেই বললো, “আমি আর নাহিয়ান অপরিচিত! আহা!”

__________________________________

“আরে এখানে আসলেন কেনো?”

বর্ষার কথার উত্তর না দিয়ে রাদিফ বললো, “নামো!”

বর্ষা চুপচাপ নেমে গেলো। ফার্মেসির সামনে নেমেছে ওরা। রাদিফ ওখানে একজনকে বর্ষার হাতে আর পায়ে ড্রেসিং করিয়ে দিতে বললো।

“এসবের দরকার নেই ভাইয়া!”

“ওখানে বসো বর্ষা!”

বর্ষা আবারও মানা করতে চাইলেই রাদিফ চোহ রাঙালো। বাধ্য হয়ে বসলো সে। ড্রেসিং শেষে আবারও রওনা হলো।
“বাসায় গিয়ে ওষুধ দিলেই পারতাম!”

“এতক্ষণ ক্ষত নিয়ে ঘোরা ঠিক না। ইনফেকশন হতে পারে।”

বর্ষা কিছু বললো না। রাদিফ ওকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

__________________________________

অবশেষে দুদিনের মাথায় নীতির কারণেই শুরু হলো প্রীতি আর আনাফের বিয়ের আমেজ।

কলিং বেল বাজতেই রীতি এসে দরজা খুললো। সামনে নীতি, সিনথী আর প্রীতির বাবাকে দেখে চমকে গেলো রীতি।

“তোমরা?”

নীতি মুখ বাঁকিয়ে বললো, “ইশ, এ বাড়ির বউয়ের কি শ্রী। মেহমান বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করছে, ‘তোমরা?’—”

সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে রাদিফ ওর মাথায় জোরে থা’প্পড় দিলো। নীতি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “ভাইয়া!”

“এসেই শুর হয়ে গিয়েছিস তুই?”

“তো আমার কি দোষ? ও তো আমাদের ভিতরে আসতেই বলছে না।”

রীতির হুস হলো।

“সরি সরি, ভিতরে এসো।”

সবাই ভিতরে ঢুকলেও নীতি রীতির কাছে এসে দাঁড়ালো। হাসি হাসি মুখ করে বললো, ”কেমন আছো বইনা?”

রীতি আগা থেকে গোড়া রীতিকে পরখ করলো। অতঃপর বুকে হাত গুঁজে জিজ্ঞেস করলো,“বিয়ে প্রীতির, অথচ খুশি তুই! কি ব্যাপার?”

নীতি রীতির গলা জড়িয়ে বুঝানোর ভঙ্গিমায় বললো, “এসব বড়দের ব্যাপার, বাচ্চারা বুঝে না!”

“বাচ্চা না?”

বলেই ওর কান টেনে ধরলো নীতির।

“আপু লাগছে!”

“আমি বাচ্চা তাই না?”

“না, না! তুমি বুড়ি!”

“কি?”

“আরে তুমি যুবতী! এবার ছাড়ো!”

রীতি ছাড়লো। নীতি ছাড়া পেয়েই একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে বললো, “ভাইয়াকেও এভাবে মা’রো নিশ্চয়ই! বেচারা ভাইয়া!”

“নীতির বাচ্চা!”

নীতিকে আর পায় কে?

সিনথীর সাথে বাড়ির ছাদে এসেছে নীতি। নিচে রাদিফ আর প্রীতির বাবা বড়দের সাথে কথা বলছেন। মূলত দাওয়াত দিতে এসেছে ওরা। অবশ্য দাওয়াত বলা চলে না এটাকে। আসলে এসেছে রীতিকে নিতে। কাছের সব মানুষ একসাথে থাকলে অনুষ্ঠানটা মজে উঠে।এই ফাঁকে নীতি সিনথীর নাম করে উপরে চলে এসেছে। উদ্দেশ্য নাহিয়ান হলেও, বেচারা নেই এখন বাড়িতে।

নীতি সিনথীকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে অন্যপাশে গেলো। ফোন ইয়ারফোন কানেক্ট করে নাহিয়ানকে ভিডিও কল দিলো। তিনবার কল দেয়ার পর রিসিভ হলো।

“খুব ব্যাস্ত?”

“ইয়েস!”

“তাহলে রেখে দেই?”

“ওকে!”

নীতি চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। নাহিয়ান হেসে দিলো ওর চেহারা দেখে।

“কি হলো?”

“সত্যিই রেখে দিবো?”

“উহু, মিথ্যে রেখে দেও!”

“আজকাল বড্ড বেশি ইয়ার্কি করতে শিখেছেন দেখছি!”

“কারণ তোমার আমার সম্পর্কই এমন ইয়ার্কি,মজা, ঠাট্টা, রাগ, কষ্ট মিলিয়ে! আর…”

“আর?”

“সেখানে রয়েছে অফুরন্ত ভালোবাসা!”

নীতি মুচকি হাসলো। নাহিয়ান একটু খেয়াল করতেই বলে উঠলো, “কোথায় তুমি?”

নীতি ঠোঁট চেপে হেসে বললো, “আমার শ্বশুর বাড়ি!”

“মজা নিচ্ছো?”

“সিরিয়াস একটা সম্পর্কও আছে আমাদের মাঝে!”

“কতক্ষণ আছো?”

“বের হবো একটু পর।”

“তাহলে আসলেও পাবো না!”

“কি?”

“আপনার দেখা!”

“হুম হুম! ব্যাপার না, কালকে দেখা হবে!”

“কালকে কি করে?”

“আরে, প্রীতির বিয়ের শপিং করবো। কত্ত কাজ! আপনি আসবেন না?”

“আমার কাজ আছে প্রিয়!”

“ছুটি নিবেন!”

“উহু নেয়া যাবে না। নতুন অবস্থাতেই এখন ছুটি নিলে রেকর্ড খারাপ হবে।”

নীতির মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। ছোট্ট করে বললো, “ওহ!”

নাহিয়ান মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “মন খারাপ হলো?”

“উহু!”

“তবে?”

“কুচ নেহি! আচ্ছা রাখি, সিনথী এসে পড়বে। আবার যেতেও হবে!”

“ওকে!”

ওকে বললেও কেউই ফোন কাটলো না। নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল, “ভালোবাসি!”

সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেঁটে দিলো নীতি। তাই দেখে হেসে ফেললো নাহিয়ান। মেয়েটার এমন হুটহাট লজ্জা, ওকে আনন্দ দেয়। খুব আনন্দ দেয়!

#চলবে

প্রিয় অনুভব পর্ব-১৬+১৭

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৬

ফোনের লক খুলে অনুভবকে কল দিলো মেসেঞ্জারে। সাথে সাথে রিসিভ হলো।

“হ্যালো?”

ওপাশ থেকে অনুভব সুর তুলে বললো,

“চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি প্রিয় শুনছো?
এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না।
সম্বন্ধটা এই বার তুমি ভেস্তে দিতে পারো,
মা-কে বলে দাও বিয়ে তুমি করছো না!”

“মজা করছেন?”

“উহু!”

“কিভাবে কি?”

“আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার এই কয়েকমাসে বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ দিয়েছি। বাট আসেনি। কয়েকদিনের আগে বাবার পরিচিত একজনের এখানে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। বলেছিলো আজ জানাবে, আর ভাগ্যবশত পেয়ে গিয়েছি।”

“দু দিন এইজন্য বলেছিলেন?”

“হুমম!”

নীতি নিরব রইলো।

“প্রিয়?”

নীতি উত্তর দিলো না।

”কাঁদছো?”

ওপাশে মৃদু কান্নার আওয়াজ পেলো অনুভব।

“এত কাঁদো কেনো তুমি?”

“আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই!”

“আমার সেই কান্না দেখতে ইচ্ছে করছে না।”

“কেনো?”

“কারণ আমি চাই আমার সে কেবল হাসুক!”

“আপনিই কাঁদাচ্ছেন বারবার।”

“কিভাবে?”

“সেদিনই যদি কারণ বলতেন যেনো দুইদিন পর হ্যাঁ বলতে বলেছেন তাহলে তো আমি কষ্ট পেতাম না!”

“তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছি!”

“আপনাকে পেয়ে গেলেই জীবনের সব চমক পাওয়া হবে আমার।”

“সত্যি?”

“না, মিথ্যে!”

অনুভব হাসলো।

“প্রিয়!”

নীতি চুপ করে রইলো।

“মন খারাপ এখনও?”

“ভয় পেয়েছি বড্ড! হারানোর ভয় বুঝি এতটা ভয়ংকর হয়?”

“হয় হয়তো! তবে সে ভয় পেয়ে কোনো লাভ নেই। ভাগ্যে থাকলে শত বিচ্ছেদের পরও আমাদের মিলন হবেই!”

নীতি কেবল শুনে গেলো।

“আজকে কথা বলছো না কেনো?”

“কথা সাজাতে পারছি না!”

”কেনো?”

“জানা নেই।”

“রেখে দিবো?”

“উহু!”

“তবে?”

“সবসময় তো আমি ই বলি, আর আপনি আমায় শুনেন। আজ আপনি বলুন আমি শুনবো!”

“যা খুশি!”

“সত্যি যা খুশি বলবো?”

“হুমম বলুন!”

“ভালোবাসি!”

ফোনটা শক্ত করে কানে চেপে ধরলো নীতি। সবসময় এমনভাবে ‘ভালোবাসি’ বলে না অনুভব। ‘ভালোবাসি’ শব্দটা দুইজন খুবই কম বলে। ‘ভালোবাসি’ না বলেও যে কথায়, কাজে তা প্রকাশ করা যায় তা ও জানে। এছাড়াও আজকের প্রসঙ্গ একটু ভিন্ন। একটু নয়, অনেকটা ভিন্ন!

“আমি বাসি না!”

“কেনো?”

“বাসি না তাই!”

“তবে নতুন কাউকে খুঁজতে হবে মনে হচ্ছে!”

“খুঁজবেন?”

“ভালো না বাসলে তো খুঁজতেই হবে।”

“খোঁজা লাগবে না। ভালোবাসি!”

“শুনতে পাইনি। কি বললে?”

“ভালোবাসি বলেছি!”

“জোরে বলেন ম্যাম!”

“না, সবাই শুনে ফেলবে!”

“শুনলে শুনুক।”

“বাড়ি আমার একটাই মশাই।”

“আপনার অনুভবের জন্য এতটুকু রিস্ক নিতে পারবেন না প্রিয়?”

“নিতে বলছেন?”

“আবদার করছি!”

নীতি হাসলো।

“ওয়েট!”

মাইক অফ করে প্রীতির রুমে গেলো। প্রীতি তখন কেবল গোসল সেরে বেরিয়েছে। নীতি মুচকি হেসে ওকে ডাকলো, “প্রীতি!”

প্রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই নীতি মাইক অন করে বেশ খানিকটা উচুঁ আওয়াজে বলে উঠলো, “ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি!”

বলেই মাইক অফ করে আবার নিজের রুমে গেলো। প্রীতি এদিকে বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও বুঝতে পারেনি, এই মাত্র হলোটা কি?

__________________________________

দিন কিভাবে পেরিয়ে যায় বলা দায়। এই তো দেখতে দেখতে এক মাস হয়ে গিয়েছে। প্রিয়, অনুভবের সম্পর্ক এখনও আগের মতোই আছে। কেবল পরিবর্তন এসেছে সময়ে। অনুভব এখন প্রায়ই ব্যাস্ত থাকে। ফোন ধরার ফুরসৎ পায় না। এই নিয়ে প্রিয়র কত অভিযোগ! যদিও প্রিয় নিজেও জানে কাজ জরুরি, তবে অভিযোগগুলোতে কেবল প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রেই আসে।

সেদিনের পর আজ দেখা হলো নাহিয়ানের সাথে। নাহিয়ানকে দেখা মাত্রই বিব্রত হলো নীতি। ওদের বিয়ে নিয়ে আলোচনা করা হলেও কেউই এখনও ওদেরকে এই বিষয়ে কোনো মতামত রাখতে দেয় নি। মূলত নীতিকে সেদিন জিজ্ঞেস করা অবদিই ছিল তাদের আলোচনা। নীতিও বেচেঁ গিয়েছে, নয়তো না করবে কিসের প্রেক্ষিতে? বলবে, তার প্রেমিক আছে?

নীতিকে দেখেই এড়িয়ে গেলো নাহিয়ান। ব্যাপারটা নীতিকে পীড়া দিলো। যতই হোক, ঝগড়ার সম্পর্ক যে ওদের! চলতি পথে তাদের কত মানুষের সাথেই দেখা হয়, কাউকে চিনে তো কাউকে না। আর দেখেও না চেনার ভাব নেয়া মানুষগুলোকে নীতি বড্ড অপছন্দ করে। বান্ধবীদের সাথে এসেছিলো আজ। বাড়ি থেকে বেশ দূরে। মূলত আজ এলাকা ছেড়ে ঘুরতে এসেছে ওরা। সেই সময়ই নাহিয়ানকে দেখেছে নীতি। নাহিয়ান ওকে দেখেও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। নীতিও ভাবলো সেরকম করবে। এমন ভাব দেখাবে যেনো দেখেই নি। কিন্তু বর্ষা তা হতে দিলো না। নাহিয়ান, সাজ্জাদ আর তাহসিনকে দেখেই সে দিলো হাঁক! নীতি ভরকে গেল।

“কি করছিস?”

“আরে ওই দেখ নাহিয়ান ভাইয়ারা।”

“থাকুক, ডাকছিস কেনো?”

“আরে আজিব, এত দিন পর দেখা; ডাকবো না? চল!”

বলেই নীতির হাত ধরে টান দিলো। বাকিদের উদ্দেশ্যে বললো, “তোরা থাক, আমরা আসছি!”

নীতি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও বর্ষা ছাড়লো না। নাহিয়ানরা রাস্তার ওপারে ছিল। বর্ষা নীতিকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে সোজা এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো। কুশল বিনিময় করলো। নীতিও ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলো।

তাহসিন হেসে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা এখানে?”

“বান্ধবীদের সাথে এসেছি।”

“বাড়ির সবাই জানে?”

বর্ষা মাথা চুলকালো।

“এটা তো ঠিক না!”

“আরে ভাইয়া, এসব দেখে শুনে কি আর ঘোরা যায়?আপনারা বলুন, এখানে কি করে?”

“আরে নাহিয়ানের চাকরি হয়েছে। মাসের প্রথম বেতন পেয়েছে, তাই ট্রিট দিবে।”

“তাই অভিনন্দন নাহিয়ান ভাইয়া!”

নাহিয়ান কেবল মুচকি হাসি উপহার দিলো। ওদের প্রত্যেকে কথা বললেও নীতি আর নাহিয়ান সম্পূর্ণ চুপ করে
আছে। না কোনো কথা, না কোনো উত্তর। এমনকি একে ওপরের দিকে তাকাচ্ছেও না। সাজ্জাদ সেসব লক্ষ্য করেই ওদের উদ্দেশ্যে বললো, “কিরে তোরা দুইটা কি মন ব্রত করেছিস?”

নাহিয়ান কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। তাহসিন অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা করে বললো, “তাই তো! দুইজন একই সাথে আছে অথচ ঝগড়া করছে না। অবাক করার বিষয়।”

বর্ষাও তাল মেলালো, “আসলেই, নীতি কি ব্যাপার? কিছু চলছে তোদের মধ্যে।”

“চুপ..”

নীতির ধমকে একটু চমকে উঠলো বর্ষা। নাহিয়ান বিরক্ত হয়ে বললো, “আজেবাজে মানুষের সাথে কথা বলে মুড নষ্ট করতে চাচ্ছি না।”

নীতির গায়ে লাগলো কথাটা।

সাজ্জাদ অবাক হয়ে শুধালো, “আজেবাজে মানুষ কোথায় পাস?”

নাহিয়ান আড়চোখে নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “আশেপাশেই কত আছে।”

নীতি তেঁতে উঠে বললো, “বর্ষা, চল!”

“আরে দাড়া!”

অতঃপর নাহিয়ানকে উদ্দেশ্য করে মজার ছলে বললো, “আমাদেরও তো ট্রিট চাই ভাইয়া। আমাদের দিবেন না?”

নাহিয়ান মেকি হেসে বললো, “হ্যাঁ কেনো না?”

নীতি ধমকে উঠে বললো, “বর্ষা, যাবি তুই?”

“আরে দাড়া, শুনলি না ভাইয়ার চাকরি হয়েছে? ট্রিট না নিয়ে যাবি নাকি?”

নীতির এবার ভীষণ রাগ হলো। একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “আজেবাজে মানুষের থেকে ট্রিট নেয়ার ইচ্ছে আমার নেই। তোর নিতে ইচ্ছে হলে তুই নে। আমি গেলাম! বাই!”

বলেই হাঁটা লাগালো। রাস্তা পার হওয়ার মুহূর্তেই এক পুরুষালি হাত ওকে নিজের দিকে টেনে নিলো। টানের ফলে নীতি সেই পুরুষের অতীব নিকট দাঁড়ালো। গিয়ে সাথে সাথে পাশ দিয়ে ফুল স্পিডে একটা বাইক ওকে অতিক্রম করে গেলো। হুট করে এমন হওয়ায় ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো নীতি।

“নীতি, ঠিক আছো?”

পুরুষালি কণ্ঠ শুনে চোখ খুলে তাকালো নীতি। পাশেই সাজ্জাদ, তাহসিন আর বর্ষা। প্রত্যেকেই ওকে ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু নীতি কেবল তার হাত শক্ত করে ধরে রাখা মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। নাহিয়ান হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। নীতি ব্যাথা পেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, “রাগে অন্ধ হলেই হয় না। চোখ, কান খোলাও রাখতে হয়। পারো তো কেবল বড় বড় কথা বলতে। আর নিজের রায়গুলো শুনিয়ে যেতে। একটু আগেই তো বললে আজেবাজে মানুষের থেকে ট্রিট নেবে না। অথচ এই আজেবাজে মানুষটাই তোমার মত আজেবাজে মানুষকে বাঁচিয়ে দিলো। এখন কি করবে? এই জীবন রাখবে? নাকি আজেবাজে মানুষ বাঁচিয়েছে বলে শেষ করবে?”

নীতির চোখ ছল ছল করে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “আল্লাহ চেয়েছে বলেই আপনি আমায় বাঁচিয়েছেন। নয়তো আপনার সাধ্যতেও নেই আমাকে বাঁচানো। আর আপনার জীবনের সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটাকে আপনি বাঁচিয়েছেন। মন মানতে পারবে তো ?”

শক্ত করে ধরে রাখা হাতের বাঁধন হালকা করে ফেললো নাহিয়ান। অদ্ভুতভাবে নীতির চোখের পানি ওকে নরম করে দিচ্ছে। তবুও সেসব পাত্তা না দিয়ে ওর হাত ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে অন্যদিকে চলে গেলো ও। নীতিও এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। এবার সাবধানে রাস্তা পার হলো সে। চোখ দিয়ে অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়ছে। ও জানে না এর মানে কি? ব্যাথায় কাঁদছে না সে, এটা ভালো করেই জানে। তবে কেনো কাঁদছে সে? নাহিয়ানের অপছন্দ মানুষ হওয়ায়? জানে না সে, কিচ্ছুটি জানে না। সাজ্জাদ, তাহসিন, বর্ষা কেবল অবাক হয়ে সবটা দেখলো। কি হচ্ছে বুঝছে না ওরা!

সেখানে আর থাকলো না। রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাসে পাশাপাশি বসে আছে নীতি আর বর্ষা। বর্ষা কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। তবে বুঝতে পারছে দু জনের মাঝে বড় রকমের ঝামেলা হয়েছে। আপাতত কিছু জিজ্ঞেস করবে না বলেই ভেবেছে। পরে স্বাভাবিক হলে জানা যাবে।

উদাস মনে বাইরে তাকিয়ে আছে নীতি। ওর মন কেনো ভালো নেই? জানালার সাথে সিট ওর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন বের করলো। অনুভবের এখন অনলাইন আসার কথা। নেট অন করতেই দেখলো অনুভব আগেই মেসেজ দিয়েছে। নীতি ওপেন করলো সেটা। কুরিয়ারের মেসেজের স্ক্রিনশট। নীতি ভ্রু কুঁচকে মেসেজ করলো, “কি এটা?”

“কুরিয়ার থেকে পার্সেল তুলে এনো।”

“কিসের পার্সেল?”

“তুললেই বুঝবে!”

“ঠিকানা পেলে কি করে?”

“তুমি ই বলেছিলে!”

“কবে?”

“মনে করে দেখো ফোনে!”

নীতি মনে করার চেষ্টা করলো। মনেও পড়লো। অনুভব জিজ্ঞেস করেছিলো সে কোথায় থাকে? তখন বাড়ির ঠিকানা না দিলেও ওদের এখানের স্কুলের নাম বলেছিলো।

“কি আছে ওতে?”

“দেখলেই বুঝবে!”

“বললে কি হয়?”

“ক্ষতি!”

“আচ্ছা, বাইরে আছি। পরে কথা বলছি!”

“ওকে!”

নীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন ব্যাগে রাখলো। ভালো লাগছে না কিছু তার। বাড়ি যাওয়ার আগে কুরিয়ারে গেলো সে। পার্সেল তুলে বাড়ি এলো।

__________________________________

বিছানা জুড়ে বিচরণ করছে পার্সেলের জিনিসগুলো। সামনে সাদা শাড়ি, গাঢ় সবুজ চার মুঠো চুড়ি, অ্যান্টিক এর ঝুমকো সাথে অ্যান্টিক এর পায়েল। সেই সাথে আছে বক্স ভর্তি চকলেট আর একটা চিরকুট। সেই চিরকুটটাই পড়ছে এখন নীতি।

“প্রিয়,
অনেক তো হলো, এবার আমাদের দেখা হোক। সাজা হোক শুভ্র রঙে। আমার শুভ্রময়ীর জন্য এই শুভ্রতার সাজ। কি প্রিয়? করবেন দেখা? সবশেষে ভালোবাসি!

~অনুভব”

নীতির হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। সত্যি ই দেখা করতে বলেছে অনুভব? ফোন হাতে নিয়ে ওকে কল দিলো।

“পার্সেল পেয়েছেন?”

“এসব কেনো?”

“বলা আছে চিরকুটে!”

“আপনি সত্যিই দেখা করতে চাইছেন?”

ওপাশে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা ছিল।

“অদ্ভুত লাগছে প্রিয়, আমার মনে হচ্ছে আমি আমার আশেপাশের মানুষের মাঝে ডুবে যাচ্ছি। আমাদের দেখা করা দরকার প্রিয়। এক হওয়া দরকার!”

কথাগুলোর মাঝেই নীতির নাহিয়ানের কথা মনে পড়লো।

“প্রিয়?”

“কোথায় দেখা করবেন?”

“রমনার বটমূলে।”

“আমি যে কিছু দিতে পারলাম না।”

“প্রয়োজন নেই।”

“আছে।”

“আমি হারিয়ে যাচ্ছি না প্রিয়। পরে দিও!”

“হু! আচ্ছা আমি চিনবো কি করে আপনায়?”

“সাদা পাঞ্জাবিতে বেলী গাজরা হাতে পুরুষকে দেখলেই বুঝে নিও!”

“ওমন অনেকেই তো থাকতে পারে।”

“আমায় তুমি চিনে নিবে, জানি আমি।”

নীতি হাসলো। সারারাত ঘুম হলো না আর। তার মন ভীষণ রকমের ভয় পাচ্ছে। সে কি যাবে?

__________________________________

অনুভবের দেয়া সেই সাদা শাড়ি পড়েছে নীতি। একেবারে সাদা নয়। মাঝে মাঝে সাদা সুতোর ফুলের কাজ। গাঢ় সবুজ রঙের, পাফ হাতার ব্লাউজ পড়েছে। দুই হাত ভর্তি চুড়ি, কানে ঝুমকো আর পায়ে পায়েল। চোখে কাজল দিলো, আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। চুলগুলো ছেড়ে দিল। অতঃপর সাইড ব্যাগ নিয়ে নিচে নামলো। নিচে নামতেই ল্যান্ড লাইনের ফোনের শব্দ শুনতে পেলো সে। ফোন উঠিয়ে হ্যালো বললো ও। ওপাশে নিরবতা। বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও উত্তর এলো না।

“রাখছি আমি। কথা বলবেন না তো ফোন কেন দেন? যত্তসব!”

“আমি নাহিয়ান।”

নীতি চমকে উঠলো। উহু, নাম শুনে নয়। কণ্ঠ শুনে! ফোনে নাহিয়ানের কণ্ঠ একদম অন্যরকম! বলতে গেলে ওর পরিচিত। ভীষণ পরিচিত! এর আগে কখনো ওদের কলে কথা হয় নি! অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো, “অনুভব!”

”হ্যালো?”

“জি বলুন!”

“আজকে বিকেলে আমার মায়ের আপনাদের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। সে যাচ্ছে না। শরীরটা একটু খারাপ। সবাইকে জানিয়ে দিবেন।”

বলেই কেটে দিল। নীতি এখনও চমকে আছে। এত মিল? নাহিয়ানের কথা সামনে থেকে শুনলেও নীতি কখনো সেভাবে বোঝার চেষ্টা করেনি। তবে আজকের কল ওকে বোঝার চেষ্টা করতে বাধ্য করছে। মাকে সালেহার অসুস্থতার কথা বলে বেরিয়ে এলো ও। এতক্ষণ মন ফুরফুরে থাকলেও হঠাৎ করে মনে অজানা ভয় হচ্ছে। রমনার বটমূলে আসতেই ভয় যেনো আরো জড়িয়ে ধরলো। লম্বা নিঃশ্বাস নিলো সে। নিজেকে নিজেই বললো,

“এমন কিছু নয় নীতি। এমন কিছু নয়!”

কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন বের করলো।

“কোথায় তুমি?”

“এসে গেছি প্রায়। পাঁচ মিনিট!”

নীতি রিপ্লাই করলো না। সাত মিনিট পর অনুভব কল করলো।

“কোথায় তুমি?”

“বটমূলের এখানে!”

“আমিও এখানেই। তোমায় দেখছি না তো!”

নীতি আশেপাশে খুঁজলো। হুট করেই সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক যুবককে দেখতে পেলো সে। হাতে তার বেলী গাজরা। নীতির হৃদস্পন্দন বাড়ছে। তবুও এগিয়ে গেলো ফোন কানে নিয়েই। ধীর পায়ে যুবকটির পিছে দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। মিনমিনে কণ্ঠে বলল,

“হয়তো পিছে!”

যুবকটি ঘুরে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো দুইজন। হ্যাঁ, চমকেছে তারা, থমকেছে সময়! তবে সেটা আনন্দে নয়, বিস্ময়ে! নাহিয়ান! যাকে কাল অব্দি আজেবাজে লোক বলেছিলো, সেই তার অনুভব? আর নীতি? আজেবাজে মেয়েটা তার প্রিয়? চোখ ছল ছল করে উঠে নীতির। নাহিয়ান স্তব্ধ! কথা বলতে ভুলে গিয়েছে সে। তার অপছন্দের মানুষই তার প্রিয়?

নীতি কোনো কথা না বলে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো। চোখের অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়বে যে। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেলো। নাহিয়ান ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। কি দরকার? এর কোনো পরিণতি নেই! আছে সমাপ্তি! তবে কি সত্যিই সমাপ্তি ঘটলো?

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৭

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত থেকে চুড়িগুলো বেশ সাবধানে খুললো নীতি। সেগুলো চুড়ির আলনায় যত্ন করে রাখলো। ঝুমকো আর পায়েলটাও যত্ন করে বক্সে রাখলো। অতঃপর আয়নায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মন, মস্তিষ্কে কেবল নাহিয়ানের কথাগুলো বাজছে। সব কথার একটাই সারমর্ম, “তার অনুভব তাকে অপছন্দ করে। ভীষণ ভীষণ অপছন্দ করে।”

দরজায় টোকা পড়ায় সেদিকে তাকালো নীতি। নিষ্প্রাণ হয়ে দরজা খুললো সে। দরজা খুলতেই বর্ষার হাসিমাখা মুখ দেখতে পেলো।

“কিরে? তোর ডেট এত জলদি শেষ? আমি তো ভাবলাম তোর বাড়ি ফেরার আগেই আমি এসে তোকে চমকে দেবো। এখন তো আমিই চমকে গেলাম। কেমন দেখলি? গল্প শোনার জন্য তর সইছে না আমার। তাই চলে এলাম। সকাল অব্দি অপেক্ষা করা ইম্পসিবল, আরে ফোনে শুনে মজা পাবো না। তাই এসে গেলাম।”

নীতি কোনো প্রতিক্রিয়া না করে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসলো। বর্ষার মনে চিন্তা জাগলো। সকালেই নীতি বলেছে আজ দেখা করবে অনুভবের সাথে। তখন কত খুশি ছিল মেয়েটা। কিন্তু এখন এত বিধ্বস্ত লাগছে কেনো?

বর্ষা ভিতরে এসে দরজা আটকে দিলো। নীতির পাশে গিয়ে বসলো।

“কি হয়েছে নীতি?”

নীতি নিশ্চুপ!

“অনুভবের সাথে তো দেখা করতে গিয়েছিলি। কি হলো সেখানে? অনুভব কি ষাট বা সত্তর বছরের বুড়ো মানুষ বের হয়েছে?”

নীতি ওর দিকে ঠোঁট উল্টে তাকালো। যেনো এখনই কেঁদে দিবে। বর্ষা ভরকে গিয়ে বললো, “সিরিয়াসলি এমন কিছুই হয়েছে?”

হুট করেই নীতি ওকে জড়িয়ে ধরলো। ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো সে। বর্ষা কি বলবে বুঝছে না। ও তো মজা করেছে, সত্যিই এমন কিছু হয়েছে?

“কি হয়েছে বলবি তো বইন!”

“অনুভব আমায় পছন্দ করে না। একদম করে না!”

“মানে?”

নীতি ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। নাক টেনে বলতে লাগলো, “তার সাথে দেখা করেছি আজকে। দেখা করার পর দেখলাম মানুষটাকে আমি চিনি। আর মানুষটার লাইফের সবচেয়ে অপছন্দের ব্যাক্তি আমি। সেও চমকিয়েছে।”

“কে সে?”

নীতি চুপ করে রইলো। বর্ষাকে নাহিয়ানের ব্যাপারে জানাতে চায় না ও। জানালেই বর্ষা উঠে পড়ে লাগবে ওদের মিল করতে।

“চিনবি না, আমি ভালো মতো চিনি!”

বর্ষা নীতির দু গাল ধরে ওকে নিজের দিকে ফিরালো।

“সেইজন্য তোর মন খারাপ?”

“হু!”

“ছেলেটা ভালোই ছিলো না, নাহলে তুই তাকে ভালোবাসিস অথচ সে তোকে অপছন্দ বলে দূরে ঠেলে দিলো? যাকে অনুভব করে ভালোবাসলি সে তোকে মায়াও করলো না?”

“সে কিছু বলেনি!”

“মানে? ভাই ক্লিয়ার করে বল তো কি হয়েছে আজকে?”

নীতি সবটা বললো নাহিয়ানের নাম গোপন রেখে। সব শুনে বর্ষা দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে বলল, “মানে কি ভাই? আরে কথা বার্তা না বলে তুই চলে আসলি? তার কথা শুনবি না?”

“শোনার কি আছে? মেইন কথা সে আমাকে পছন্দ করে না। এটাই ফ্যাক্ট!”

“নীতি! পছন্দ, অপছন্দ আর ভালোবাসা এক নয়। এটা তুই আমাকে খুব করে বলিস! তাহলে আজ কেনো এটার ফ্যাক্ট নিয়ে পড়ে আছিস!”

“জানি না আমি!”

বর্ষা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আবার ওর পাশে বসে বললো, “তুই তোর অনুভবকে কতটা ভালোবাসিস সেটা তোর থেকেও আমি জানি নীতি। আমি জানি না তোদের মাঝে কি নিয়ে পছন্দ, অপছন্দের ব্যাপার আসছে। তবুও বলবো, কথা বল! নিজেদের মনের কথাগুলো খুলে বল। সে যদি নিজ মুখে বলে সে তোকে চায় না, তাহলে সরে আয়। আর এসব অনলাইন সম্পর্কগুলোর এমনই বিচ্ছেদ হয়, খারাপ লাগলেও সত্য।”

নীতির ঠোঁট কাঁপছে। বর্ষা ওর গালে আলতো করে হাত রাখলো।

“তবে তোরটা এমন হবে না। আমার মন বলছে।”

নীতি ছল ছল চোখে তাকালো।

“কারণ তুই ই বলেছিলি অনুভবকৃত ভালোবাসা ঠুনকো নয়। অনুভব যদি তোকেও সেই অনুভব থেকেই ভালোবাসে তাহলে সে ঠিকই তোকে ছাড়বে না!”

নীতি চুপ করে রইলো।

“তো মিস প্রিয়, আপনি কি কান্না করতে চাচ্ছেন?”

নীতি উপর নিচ মাথা নাড়লো। বর্ষা দু হাত দুদিকে রেখে ওকে বললো, “তো আসেন, কেঁদে উপকার করেন!”

বলতে দেরি নীতির জড়িয়ে ধরতে দেরি হয় নি। বর্ষা আলতো হাতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। নীতি মন খুলে কাঁদতে লাগলো। আমাদের বিষণ্ণ সময়গুলোতে আমরা কাউকে পাইনা, সেখানে নীতি ছোট থেকে বর্ষাকে পেয়েছে। মাঝে হয়তো কিছুটা সময় দুরত্ব ছিল, তবুও অদ্ভুতভাবে মন খারাপ হলেই নীতি ওকে আগে খুঁজে। হয়তো এটা ওর নিজের জন্য, তবুও মাঝে মাঝে একটু নিজের কথা ভাবলে কি খুব ক্ষতি হয়?

__________________________________

“কাল থেকে আরহাম তোমাক পড়াতে আসবে তূর্ণা!”

আরহামের নাম শুনতেই চমকে উঠে তূর্ণা।

“কেনো? কোচিং করছি তো।”

“আবার জিজ্ঞেস করো কেনো? রেজাল্ট তো দেখছি কি করছো! যেখানে সবাই ভার্সিটিতে উঠে গেলো, সেখানে তুমি আবার উচ্চ মাধ্যমিক দিবে। লজ্জা আছে? মিনিমাম লজ্জাও তো নেই। আর বাসার স্যারদের কি করো ,কে জানে! একদিন পড়ালে পরদিন আর পড়াতে চায় না। অনেক কষ্ট আরহামকে রাজি করিয়েছি। যদি এবার আরহামও তোমাকে একদিন পড়িয়ে না পড়ায় আর, তাহলে আমি সত্যিই তোমার বিয়ে দিয়ে দিবো। আর কোচিং? কোচিং গেলেই পড়ার থেকে বেশি গল্প করো তুমি। তুমি কি ভাবো? এসব আমি জানি না? সব খবর আসে। ওয়ার্ন করে গেলাম। ভেবে দেখো কি করবে?”

বলেই বেরিয়ে গেলেন সেলিনা। মেয়েকে নিয়ে বড্ড চিন্তা তার, শাফিনের সাথে তো বিয়ে দিতে পারলেন না। তাহলে অন্তত নিশ্চিন্তে থাকতেন মেয়ে সুখে থাকবে। কিন্তু এবার? একমাত্র মেয়ে, নিজের পায়ে না দাঁড়ালে ওকে দেখবে কে? উনারা কি সব সময় থাকবেন?

সেলিনার কথায় কান দিলো না তূর্ণা। মুচকি হেসে ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে কলেজ গ্রুপে গেলো। সেখানে ছেলেদের ছবি দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। পড়াশোনা ওর ভালো লাগে না। ওর স্বপ্ন একটাই নিজের যেকোনো একজন ক্রাশের বউ হওয়া। যেহেতু ওর মা অপশন দিয়েই দিয়েছে তবে এবার নির্ঘাত বিয়ে হবেই। আর আরহাম? বরাবরই সে চুপচাপ মানুষ। তুর্ণা প্রথম যখন ওকে দেখেছিলো সেই রকমের ক্রাশ খেয়েছিল। কিন্তু আরহাম বরাবরই চুপচাপ আর লাজুক মানুষ হওয়ায় ওর সাথে কুশল বিনিময় ছাড়া কোনো কথা বলে নি। যার ফলে নাহিয়ানের মতো সেও লিস্টের বাইরে। তাই ও জানে কিভাবে একেও তাড়ানো যায়। আগের টিচারদের তাড়িয়েছে ওর ননস্টপ বক বক দিয়ে। এর বেলায় অত লাগবে না। হালকা হলেই হবে!

__________________________________

সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরতেই চমকে উঠলো নীতি। টিউশন করিয়ে ফিরছে সে। নতুন নিয়েছে এটা। বাসা খুব দূরে নয়, তাই ওকে বিকেলের দিকে পড়ায়। আসতে আসতে সন্ধ্যা। বাড়ির মহল দেখে অবাক হয়। চারপাশে হালকাভাবে সাজানো। বসার ঘরে সোফার কাছে যেতেই দেখতে পেলো একটা বাটিতে পায়েস করে রাখা। তার সামনেই ছোট্ট কাগজে লিখা, “শুভ জন্মদিন আমাদের নীতিরাণী দ্যা নীতিবীদ!”

আরো চমকে গেলো নীতি। এত কিছুর মাঝে ভুলেই গিয়েছিলো আজকে ওর জন্মদিন! চমক থেকে বের হওয়ার আগেই একদল একসাথে চিৎকার করে বলে উঠলো, “Happy birthday!”

নীতি দু হাতে কান চেপে বললো, “আস্তে আস্তে! আমার কানের পর্দা ছিঁড়ে যাবে তো!”

প্রীতি ঠাস করে ওর মাথায় চাটি দিয়ে বললো, “হা’রামী, কোথায় একটু অবাক হবি। ছল ছল চোখে বলবি এত্ত সুন্দর সারপ্রাইজ আগে পাইনি। তা না, কানের পর্দা নিয়ে আছিস?”

নীতি হাসলো। হুট করেই ওর চোখ গেলো দূরে থাকা নাহিয়ানের দিকে। সে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো ও! প্রীতিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এত ঢং করতে পারবো না। তবে এবার চমকেছি! কারণ এবার আমার মনেই ছিল না!”

রাদিফ অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা করে বললো,“বাহ, নীতিবীদ নিজের জন্মদিন ভুলেছে? কত বছরের পাওয়া! ইশ, তাহলে এবার এত খরচ না করলেও চলতো!”

“পরে ঠিকই উশুল করতাম। পায়েস কে করেছে?”

“আমি ছাড়া আর কে?”

নীতি হেসে রীতিকে জড়িয়ে ধরলো।

“আসলেই, তুমি ছাড়া আর কে করবে এমন? শাফিন ভাইয়া কোথায়?”

“ওর অফিস আছে। তাই আসে নি। আমি আর তুর্ণা নাহিকে নিয়ে এসেছি!”

“তূর্ণা কোথায়?”

সবাই একটু আশেপাশে তাকাতেই দেখলো তূর্ণা সোফার উপর বসে গালে হাত দিয়ে রাদিফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদিফ এতক্ষণ খেয়াল করেনি। এখন খেয়াল করতেই কাশতে লাগলো ও। রীতি, নীতি আর প্রীতি ঠোঁট চেপে হাসলো। নীতি কিছু বলবে তার আগেই বর্ষার আগমন!

“আমি এসে গিয়েছি।”

বলে তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে পায়ে পা বেঁধে গেলো। পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো ও। নিজেকে নিজেই বললো, “সরি সরি!”

তাই দেখে সবাই হেসে দিল। বর্ষা অসহায় ফেস করে তাকালো। উফ, ওর এই সরি বলার অভ্যাস যায় না কেনো?

হাসি ঠাট্টায় বেশ কিছুটা সময় কেঁটে গেলো। সবাইকে খেতে দেয়ার সময় নাহিয়ানকে নিচে পেলো না কেউ। নীতি সবাইকে বসতে বলে নাহিয়ানকে খুঁজতে গেলো। একটা সময় বাড়ির ছাদে গিয়ে ওকে পেলো। ডাকবে কি ডাকবে না এটা ভাবতে ভাবতেই মিনিট খানেক পার করলো। নাহিয়ান রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীতির মনে পড়ে সেদিনের কথা। রাত জেগে গল্প করেছিলো দুইজন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক দিল,“খেতে আসুন। সবাই অপেক্ষা করছে!”

নাহিয়ান চমকে পিছনে তাকালো। নীতি নাহিয়ানের হাতে সিগারেট দেখতে পেলো। রাগী কণ্ঠে বলল,

“আবার সিগারেট?”

নাহিয়ান হাসলো।

“খাই না, তবে চেষ্টা করি।”

“কিসের?”

“খাওয়ার!”

“কেনো?”

“স্ট্রেস কমাতে।”

নীতি কয়েক পলক ওর দিকে তাকালো। ধীর পায়ে এগিয়ে রেলিং এর কাছে দাঁড়ালো।

“আপনার স্ট্রেস কি সেটা আমি বুঝতে পারছি। হয়তো প্রিয় আর নীতির মাঝে কাকে নিবেন বুঝতে পারছেন না। আসলে কি বলুন তো? বাস্তব আর অবাস্তব দুটো আলাদা জিনিস। আর দু জায়গাতেই মানুষ দুই রকম। এই যেমন অনলাইনে আমি আপনার ভীষণ পছন্দের কেউ, তেমন বাস্তবে আমি আপনার ভীষণ ভীষণ অপছন্দের কেউ! এই কথাটা আমি বেশ ভালোভাবেই আমি উপলব্ধি করি। আপনি এখন এটাই ভাবছেন যাকে এতটা অপছন্দ করেন তার সাথে বাকি জীবন থাকবেন কি করে? এটা অস্বাভাবিক না। তাই আমি কখনোই বলবো এই সম্পর্কের ব্যাপারে!”

নাহিয়ান চুপ থেকে উত্তর দিলো, “শুধু কি আমার অপছন্দ? তোমার নয়?”

নীতি নিশ্চুপ রইলো।

“বলো!”

“উহু!”

নাহিয়ান অবাক চোখে তাকালো।

“আমি মানুষটা আমার পছন্দের। ভীষণ পছন্দের। যেদিন দেখেছিলাম আপনি রীতি আপুর জন্য আপনার খালাকে যোগ্য জবাব দিয়েছে। আর যারা আমার প্রিয় মানুষদের আগলে রাখে তারা আমার পছন্দের মানুষ। সেই হিসেবে নাহিয়ান আমার পছন্দের মানুষ! আর নাহি..”

‘নাহিয়ান’ বলতে গিয়েও বললো না নীতি। নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“অনুভব! আর অনুভব? সে তো কল্পরাজ্যে এক সজ্জিত পুরুষ, যাকে আমি আমার প্রতিটা মুহূর্তে খুব করে অনুভব করি। যাকে অনুভব করে ভালোবাসি। ‘অনুভব’ আমার জীবনের এক বিশেষ অধ্যায়, যার শুরুটা ছন্দময়, তবে শেষটা ছন্নছাড়া! আপনাকে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব না, কেননা না দেখে ভালোবাসা আর একজনকে দেখে ভালোবাসার মাঝে তফাৎ আছে। কাউকে দেখে ভালোবাসলে তাকে ছাড়া হয়তো কয়েকটা বছর থাকা যায় না সুখে, বাকিটা বছরও হয়তো উদাসী মনের মাঝেই কাটে। তবে না দেখে ভালোবাসলে ভোলা যায় না! কেননা সেখানে সম্পূর্ণটাই থাকে অনুভব করে! ভালোবাসাটা অনুভব করে হয়ে, কথাগুলো অনুভব করে হয়, এমনকি মিস করাটাও অনুভব করেই হয়!”

বলেই থামলো নীতি। আশেপাশে তাকিয়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টায় আছে। গলাটাও ভার হয়ে আসছে। একটু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বললো, “আমি ওসব মেয়েদের মত নই যে ভেঙ্গে পড়বো। তাই আমাকে নিয়ে ভাববেন না। নিচে চলুন!”

নাহিয়ান চুপ করে রইলো। নীতি আবার বললো, “একটা কথা বলবো?”

নাহিয়ান তাকালো ওর দিকে। নীতি হেসে বললো,

“আপনার আর আমার দেখা হলো এই চেনা শহরে। প্রথম দেখা প্রিয় আর অনুভব হিসেবে হলেও, প্রথম আলাপ হলো না। না হলো শুভ্রময়ী আর শুভ্রপুরুষ সাজা। সেই সাজে এই শহরের অলিগলিও ঘোরা হলো না। বিচ্ছেদের কথন এসে গেলো তার মাঝে।”

বলেই ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ালো। দরজার কাছে যেতেই থেমে গেলো ও। পিছনে ঘুরে নাহিয়ানের দিকে তাকালো ও। সে ওর পানেই তাকিয়ে আছে। হুট করেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে। নাহিয়ান স্তব্ধ হয়ে গেলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই নীতি দূরে সরে গেলো।

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো, “প্রথম দেখায় জড়িয়ে ধরার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো অনুভবকে। পূরণ করে নিলাম!”

অতঃপর মাথা নিচু করে চোখের জল আড়াল করে বললো, “আপনি ঠিকই বলেছিলেন, সফলতার আগে দেখা না হওয়া ভালো। তবে এটাও মনে হচ্ছে আপনার সাথে কখনো দেখা না হতো। তাহলে এই বারবার আপনি সামনে আসতেন না!”

কিছুক্ষণ থামলো নীতি। আবার কান্নাভেজা কণ্ঠে শুধালো, “আমাদের আর দেখা না হোক! একদম না হোক!”

বলেই ছুটে চলে গেলো। নাহিয়ান একটু শব্দও করলো না। এত পাষাণ কি মানুষ হয়? সে কি দেখেনি, তার প্রিয় কষ্ট পাচ্ছে? তবে?

#চলবে

প্রিয় অনুভব পর্ব-১৪+১৫

0

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৪

“আমার রুমে কি করছিস তুই?”

নাহিয়ানের ধমকে চটজলদি ওর দিকে ঘুরে তাকালো তূর্ণা। আমতা আমতা করে বললো, “না, মানে আমার জন্য কি গিফট এনেছো দেখতে এসেছিলাম।”

“আমাকে তোর বোকা মনে হয়?”

“না, না, তা মনে হবে কেনো? আমি তো… ”

নাহিয়ান ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “দেখ তূর্ণা তোকে আমি ছোট বোনের মতো স্নেহ করি। তাই এমন কোনো কাজ করিস না যাতে আমার চোখে তুই নেমে মাস।”

তূর্ণা মাথা নিচু করে বললো, “আমাকে অন্য চোখে দেখো না কেনো তুমি?”

“কারণ তুই আমার বোন। বের হ এখন।”

তৃণা মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো । নাহিয়ান ওর যাওয়ার পানে তাকালো। ও জানে এটা তূর্ণার আবেগ ছাড়া কিচ্ছুটি নয়। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

রুমের বাইরে তূর্ণা আসতেই মুখ বাঁকিয়ে ভেঙচি কাটলো।
“ইহ, একটু নতুন সুন্দর দেখে কত ভাব! ডোন্ট কেয়ার ইউর ভাব, নতুন ক্রাশ খুঁজবো আমি আব! লা লা লালা..”

বলেই লাফাতে লাফাতে নিচে নামলো। ওদের বাড়ি নাহিয়ানদের বাড়ির সামনেই। তাই আসা যাওয়ার বেশ সুবিধা রয়েছে।

__________________________________

মুখ গোমড়া করে বসে আছে নীতি। প্রীতি তৈরি হচ্ছে, আর বর্ষা আপাতত ওর পাশে বসে ওর এই গোমড়া মুখেই ওর সাথে ছবি তুলছে। আনাফ হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে এসে বললো, “কিরে? হলো তোদের?”

প্রীতি তাড়াহুড়ো করে বললো, “আরেকটু ওয়েট!”

আনাফের চোখ নীতির দিকে গেলো।

“তুই গোমড়া মুখে বসে আছিস কেনো?”

“আমার ফোন ঠিক করিয়ে দিলে না কেউ। আমি আজ ওখানে গিয়ে ছবি তুলবো কি করে?”

বলেই ঠোঁট উল্টালো। আনাফ হেসে ওর পাশে বসলো।

“চাচীর কাছে না বলতে বললাম?”

“বলেছি, বলে ‘তোর ফোন নষ্ট হওয়ায় আমি অনেক খুশি হইছি। বাপের ছয় বছরের ইউজ করা ফোন নষ্ট হতে এত সময় যে লাগলো। আলহামদুলিল্লাহ আমি খুশি!’—”

সঙ্গে সঙ্গে তিনজন সমস্বরে হেসে উঠলো। নীতি অসহায় মুখ করে বসে রইলো। ও জানতো ওর মা ওকে ফোন কিনে দিবে না। এই একটা কারণেই বাবার ছয় বছরের ইউজ করা ফোনটা অনেক যত্নে রেখেছিল। কালকে কেনো যে বেখায়ালী হলো।

“কি নিয়ে কথা বলছিস তোরা?”

বলতে বলতেই রাদিফ ভিতরে এলো। বর্ষা ওকে দেখে উঠে প্রীতির কাছে গেলো। রাদিফ নীতির অন্য পাশে বসে পড়লো।

“আপাতত আমার ফোনের জন্য দুঃখ প্রকাশ চলছে। তোমার হাতে কি?”

রাদিফ নিজের হাতে থাকা প্যাকেটের দিকে তাকালো। অতঃপর সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। প্যাকেটটা নীতির হাতে দিয়ে বলল, “দেখ!”

নীতি ভ্রু কুঁচকে দেখতে লাগলো। বক্স জাতীয় কিছু বের করতেই চোখে খুশির ঝলক দেখা গেলো। মৃদু চিৎকার করে বললো, “ফোন!”

বলেই রাদিফের দিকে তাকালো।

“আমার?”

“হুমম!”

“তুমি কিনেছো?”

আনাফ নীতির মাথায় চাটি দিয়ে বললো, “আমরা সবাই মিলে কিনেছি।”

নীতি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অবাক হয়ে বললো, “মানে?”

প্রীতি নীতির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, “আমরা সবাই মিলে দিয়েছি!”

“সবাই?”

“হুমম, আমি, বর্ষা, রীতি আপু, রাদিফ ভাইয়া আর আনাফ ভাই…”

‘ভাইয়া’ বলতে গিয়েও আনাফের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। উপস্থিত সবাই মুখ চেপে হাসলো। নীতি ফোন দেখতে দেখতে বললো, ”হঠাৎ গিফট কেনো?”

রাদিফ হেসে বললো, ”গিফট দেয়ার জন্য কোনো কারণ লাগে না। আর আমাদের নীতিরাণীর জন্য আরো লাগে না।”

নীতি এক পলক সবার দিকে তাকালো। ওর আশেপাশের মানুষগুলো ওকে কতটা ভালোবাসে। হুট করেই নাহিয়ানের কথা মনে পড়লো। সে তাকে অপছন্দ করে। মাথা থেকে ওকে ঝেড়ে ফেলে ওদের উদ্দেশ্যে বললো, “এত দামী ফোনের দরকার ছিল না!”

“হুস, অত দামীও না। আমার তো নতুন চাকরি হয়েছে। বেতনও পাইনি এখনও। তাই সবাই মিলে যা পেরেছি দিয়েছি।

নীতি আনাফের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

”কিপটামি না করে পাঁচজন পাঁচটা ফোন দিলেও পারতে।”

আনাফ ওর চুল টেনে বললো, “ফাজিল মাইয়া!”

সবাই একসাথে হেসে দিল। রাদিফ তাড়া দিয়ে বললো, “দেরি হয়ে যাচ্ছে, চল চল।”

বর্ষা বলে উঠলো, “বড়রা যাবে না?”

”না, মানে ওখানে সব আমাদের মতোই থাকবে, তাই বড়রা যেতে চাচ্ছে না।”

বর্ষা আর কিছু বললো না। ওকে তুর্ণাই ইনভাইট করেছে। কিন্তু এখানে ওদের সাথে একসাথে যাবে বলে এসেছে। যদিও যেতে চায় নি, তবে তুর্ণা মেয়েটা জোর করেছে বেশি। অতঃপর সবাই মিলে রওনা হলো।

__________________________________

পুরো বাড়ি ঘুরে দেখছে নীতি। নিচে সবাই আছে। কিন্তু ওর ভালো লাগছে না এই গান বাজনা ভালো লাগছে না ওর। তুর্ণাদের বাড়িতেই এখন ও। তবে ওর মন ভীষণ উদাস। করিডোরের শেষে একটা ব্যালকনি আছে। নীতি ওখানে গিয়ে দাঁড়ালো।

“কি ভাবছো? আবার লোহার মাথা দিয়ে কি দুর্নীতি করার চিন্তা করছো?”

নাহিয়ানের কথা শুনে ওর দিকে তাকালো নীতি।

“মানে?”

নাহিয়ান ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “মানে বুঝো না?”

নীতি দাঁত কিড়মিড় করে কপালের সামনের চুল সরিয়ে দেখিয়ে বললো, “আপনার থুতনিও কোনো তুলার তৈরি না। রডের তৈরি। দেখেন আমার কপালের এখানে কালো হয়ে আছে। এখনও ব্যাথা করছে!”

”মেকআপের জাদু!”

“হুর বেডা!”

অতঃপর দুইজন চুপ।

“নিচে যাচ্ছো না কেনো?”

“ভালো লাগছে না!”

“কারণ?”

“কারণ লাগে না!”

“বিনা কারণে ভালো না লাগার কি মানে?”

“আপনার এত ইন্টারেস্ট কেনো?”

“তাও ঠিক!”

নীতি হাসলো।

“আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো আমাদের এত ভালোবাসে, তবুও আমরা কেনো এমন মানুষের ভালোবাসা চাই, যাকে কখনো দেখিও নাই!”

নাহিয়ান অবাক হয়ে বললো, “মানে?”

“কিছু না!”

নাহিয়ান চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর হেসে বললো,

“আমরা না পাওয়া ভালোবাসার পিছেই বেশি ছুটি! জানিও না সেটা আদোতে সত্য নাকি মিথ্যে!”

নীতি অবাক চোখে তাকালো।

“তবে জানো, মন থেকে কিছু চাইলে, আল্লাহ একটা না একটা সময় ওই জিনিসটা দেয় আমাদের। দেরীতে হলেও দেয়!”

“মন থেকে চাইলে সব পাওয়া যায়?”

“হুমম, যদি সেটা তোমার জন্য মঙ্গলজনক হয়!”

নীতি ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।

“থাকো, নিচে গেলাম।”

বলেই চলে গেলো। নীতি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। সঙ্গে সঙ্গে ফোন বের করলো। ফেসবুক লাইটে ঢুকলো। এমবি নেই ওর ফোনে। কাঁপা কাঁপা হাতে ‘প্রিয়’ আইডিতে ঢুকলো। পোস্টে আজও কোনো কাঙ্ক্ষিত সেই ব্যাক্তিটি নেই। বের হতে গিয়েও মেসেজ অপশনে গেলো। মেসেজ রিকুয়েস্ট এসেছে। নীতির হৃদস্পন্দন বাড়ছে। ঢোক গিলে মেসেজ চেক করতে গেলো। চেক করার সাথে সাথে থমকে গেলো ও। ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে। মুখে হাত দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো। ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো ও। ওর কাঙ্ক্ষিত সে, হ্যাঁ সে! এটা সে ই! ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদছে ও। আবারও ফোনটা সামনে ধরলো ও। স্পষ্ট ওর লিখা কথাগুলো লিখেছে। বিড়বিড় করে পড়তে লাগলো!

“তুমি আমার প্রিয় প্রহরের, প্রিয় অভিমান..

তুমি আমার প্রিয় নগরের, প্রিয় ভালোবাসা!

তুমি আমার স্নিগ্ধ বিকেলের, শুভ্র রঙা লাল খামের চিরকুট..

তুমি আমার প্রিয় প্রভাতের এক ফালি রোদ্দুর!”

নীতি ঝটপট মেসেঞ্জারে ঢুকলো। কিন্তু আশেপাশে দেখে উঠে দাঁড়ালো। চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে দৌড়ে নিচে গেলো। আনাফের কাছে গিয়ে বললো, ”বাড়ি যাবে কখন ভাইয়া?”

“নীতি, এখনও কেক কাটেনি। খাওয়া দাওয়া করে তারপর!”

“কতক্ষণ লাগবে?”

নীতির বিচলিত কণ্ঠ শুনে আনাফ চিন্তিত হলো।

“কি হয়েছে নীতি?”

আনাফের চিন্তিত মুখ দেখে নীতি শান্ত হলো।

“না এমনি, আসলে ভালো লাগছে না!”

তুর্ণা ওদের কাছেই আসছিলো। নীতির কথা শুনে বললো,”কেনো নীতি? ভালো লাগছে না কেনো?”

“না, ওই একটু মাথা ধরেছে।!”

“সে-কি ওষুধ দিবো?”

“না না লাগবে না। ঠিক আছি আমি।”

বলেই ওদের থেকে দূরে সরে গেলো। এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো। এখানে কথা বলা যাবে না। বললে ও নিজেকে শান্ত রাখতে পারবে না। কিন্তু এখনও অস্থির হয়ে আছে ও।

“তুমি ঠিক আছো?”

নীতি চমকে তাকালো। নাহিয়ানের প্রশ্ন ওর কানে গেলেও উত্তর দেয়ার মত আওয়াজ আসছে না। বলতে গেলেই গলা কাঁপছে ওর।

“নীতি কি হয়েছে?”

নীতি কেঁদে উঠলো। তবে যথাসম্ভব আওয়াজ আটকানোর চেষ্টা করছে সে। নাহিয়ান ভরকে গেলো। সবাই নাচ, গান, গল্পে মত্ত। নাহিয়ান উপায় না পেয়ে নীতিকে নিচের গেস্ট রুমে নিয়ে এলো। বিছানায় ওকে বসিয়ে পানি আনতে গেলো ও। দরজা খোলাই রেখেছে। পানি এনে নীতিকে দিয়ে বললো, “খেয়ে নেও!”

নীতি বিনাবাক্যে এক নিঃশ্বাসে পুরো পানি পান করলো। অতঃপর শেষ করে গ্লাসটা নাহিয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিলো। হেঁচকি তুলছে ও।

“কি হয়েছে নীতি? হঠাৎ কাঁদছো কেনো? কেউ কিছু বলেছে? তুর্ণার কোনো ফ্রেন্ড মিসবিহেভ করেছে?”

নীতি মাথা নাড়লো।

“তাহলে?”

“আমি জানি না কেনো কাঁদছি!”

“মজা করছো?”

“না, আমি মজা করছি না।”

“তাহলে অকারণ কাঁদার কি মানে? যে কেউ দেখলে খারাপ ভাববে। ভাববে আমাদের এখানে কিছু হয়েছে তোমার সাথে!”

“আচ্ছা, অনেকদিন থেকে চাওয়া জিনিস যদি হুট করে পেয়ে গিয়ে মানুষ কাঁদে তাহলে ওটাকে কি বলে? সুখ নাকি দুঃখ?”

“অবশ্যই সুখ!”

“সেই জন্য কাঁদছি!”

নাহিয়ান কি রিয়েকশন দিবে বুঝলো না। ওর থেকে দূরত্ব রেখে ওর পাশে বসলো ও।

“সুখের কান্না এমন ম’রার মতো?”

নীতি ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “একদম মজা করবেন না!”

“আচ্ছা মজা করলাম না। শান্ত হও!”

নীতি শান্ত হতে পারলো না। নাহিয়ানকে দেখে ওর কান্না যেনো আরো বেরিয়ে আসতে চাইছে।

“আমি এখন সেই জিনিসকে ছুঁতে চাচ্ছি। আমি পারছি না অপেক্ষা করতে। আমার অশান্তি লাগছে। আমার দ্বারা অপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।”

নীতি আরো কত কিছু বলে যাচ্ছে। নাহিয়ান না পেরে ওর সামনে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলো। ওর হাতে হাত রেখে বলল, ”নীতি, প্লিজ! শান্ত হও। আমার দিকে তাকাও।”

নীতি নাহিয়ানের দিকে তাকালো।

“অনেক কাঙ্ক্ষিত কোনো জিনিস যদি হুট করে আসে আমরা আনন্দিত হই। ধরো এখন তোমার রেজাল্ট আসবে আগামী মাসে। কিন্তু তুমি আগেই কারো মাধ্যমে জেনে গিয়েছো তুমি টপ করেছো। কিন্তু এটা যদি আগেই সবাইকে বলে বেড়াও তাহলে কি আনন্দটা থাকবে? যখন সবার একসাথে রেজাল্ট দিবে তখনই তো আসল আনন্দ হবে!”

“আমি কখনো টপ করবো না। তাই ধরতে পারলাম না।”

নাহিয়ান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো।

“হওয়া লাগবে না। লোহার মাথা নিয়ে কিছু হওয়া যায় না!”

“আপনি কিন্তু…”

নাহিয়ান ওকে বলতে না দিয়ে বললো, “আমি এটাই বোঝাতে চাইছি কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেতে যদি আরেকটু অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে কেনো করবে না? অনেকদিন তো করেছো! যদিও জানি না সেটা কি, তবে আরেকটু তো করা যায় তাই না?”

নীতি মাথা নাড়লো।

“তাই শান্ত হও!”

নীতি ওর দিকে তাকালো।

“লিস্টের অপ্রিয় মানুষকে শান্ত করতে এত উঠে পড়ে লেগেছেন কেনো?”

“কারণ তুমি শান্ত হলেই এটা আমার জিত হবে। আর তোমার হার!”

“মানে?”

“মানে এটাই এই যে তুমি এখন শান্ত হয়েছো, তাও আমার কথার মাধ্যমে এটাই আমার কাছে জিত। মিস দুর্নীতি আমার কথায় শান্ত হয়েছে। সবাইকে বলে বেড়াবো।”

নীতি কয়েক পলক নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। নাহিয়ান আনমনা হয়ে সেই হাসি দেখলো। পরক্ষণেই দুইজনের মাঝে ক্ষুদ্র সময়ের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হলো।

সালেহা সবে রুম থেকে বেরিয়েছেন। বাচ্চাদের আড্ডায় তিনি যেতে চান না। তবুও রীতির বাড়ির লোক এসেছে, একটু দেখা তো করতেই হয়। তাই তূর্ণাদের বাড়িতে এসেছে। গেস্ট রুম সদর দরজার কাছে হওয়ায় চোখ যায় সেদিকে। নীতি আর নাহিয়ানকে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলেন উনি। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে মুচকি হয়েছে ভিতরে গেলেন।

__________________________________

এরপরের পুরোটা সময় শান্ত ছিলো নীতি। কিন্তু বাড়ি আসতেই এক মিনিটের অপেক্ষাও করেনি সে। সোজা রুমে এসে দরজা দিয়েছে। ‘অনুভব’ নামক আইডিতে মেসেজ দিলো। পর পর কয়েকটা। কিন্তু সিন হচ্ছে না। নীতি কল করলো। বেশ কয়েকবার কল করলো। কিন্তু ধরছে না। লাইনেই নেই সে। নীতি আবার কেঁদে উঠলো। মেসেজটা দুইদিন আগের। আর সে আজ দেখছে! চোখ মুছে আবার কল দিলো। নো রেসপন্স!
বিছানার কাছে বসে পড়লো ও। এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এখন পারছে না ও। একটুও পারছে না। বিছানায় মাথা রেখে কাঁদছে ও। পরক্ষণেই ফোন বেজে উঠে ওর। অনুভবের আইডি থেকে কল আসছে। চোখ মুখে খুশি দেখা দিলো তার। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করলো। কিন্তু কথা বলতে পারলো না। ওপাশে নিরবতা। নীতিও চুপ। সব নিরবতা ভেঙ্গে অনুভবই মৃদু স্বরে ডাকলো,

“প্রিয়!”

ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো নীতি। ফাইনালি! পেয়েছে সে। পেয়েছে….

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৫

“প্রিয়?”

নীতি কথা বলতে পারছে না। আওয়াজগুলো আটকে যাচ্ছে গলায় এসে। অনুভব বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

“কোথায় ছিলে প্রিয়?”

নীতি নাক টেনে উত্তর দিলো,

“বাসায় ছিলাম । আর কোথায় থাকবো? আমার কি শ্বশুরবাড়ি আছে, যে সেখানে যাবো?”

ওপাশ থেকে মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেলো নীতি। কান্নার মাঝে নিজেও মুচকি হাসলো।

“দূরে কেনো গিয়েছিলে?”

“ইচ্ছে করে যাইনি। আইডি নষ্ট করে দেয়া হয়েছিলো। আমি জানতাম না কখন হয়েছে। তাই…. কিন্তু আমি নতুন আইডি খুলে আপনাকে খুঁজেছিলাম পাইনি।”

অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

“কারণ ততক্ষণে আমিও আইডি ডিলিট করে দিয়েছি।”

নীতির কান্না থেমে গেলো।

“কেনো অনুভব?”

“ভেবেছিলাম তুমি উপলব্ধি করেছো তোমার অনুভূতি কেবল ভালোলাগার ছিল। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভীষণ কষ্ট হলো। ভাবলাম প্রিয় তো তার অনুভবকে ভুলে গিয়েছে। আমি তাহলে কেনো মনে রাখবো!”

নীতি বেশকিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, “একটা দিন অপেক্ষা করতেন অন্তত!”

“ভুল হয়ে গিয়েছে প্রিয়। সরি!”

নীতি চুপ রইলো।

“সরি! আমার আসলেই আরেকটু অপেক্ষা করা উচিত ছিল। কেনো যে করেছি এমন!”

“ব্যাপার না! কেমন আছো?”

“প্রিয়হীনা অনুভব কেমন থাকবে বলেছিলো?”

নীতি হাসলো।

“আমি ভালো ছিলাম।”

“সত্যি ছিলে?”

“হুমম, আমার কল্পমানবের সাথে!”

“কল্পমানব?”

“হুমম, তুমি নামক কল্পমানব!”

অনুভব চুপ রইলো। নীতি আবারও হেসে বললো,

“প্রিয় কল্পমানব,
আপনি আমার কল্পনায় সবসময় বিদ্যমান। আমার উদাস মনের বিষণ্নতার সময়ে আপনি ছিলেন আমার এক ফালি সুখ। বলে না মানুষ কল্পনায় সুখী? আপনি আমার সেই সুখ, যাকে অনুভব করি সময়ে-অসময়ে। মনের গল্প বলি। আপনাকে নিয়ে শহর ঘুরি। আপনি শুভ্রপুরুষ সাজেন, আর আমি? শুভ্রময়ী! কি ভাবছেন তো কখন হলো এসব? ওইযে বললাম, ‘কল্পনা!’ আমার কল্পমানুষকে আমি ভীষণভাবে অনুভব করি। অতঃপর ভালোবাসি। বুঝলেন?”

“খুব করে বুঝলাম!”

“কি বুঝলেন শুনি।”

“প্রিয় তার অনুভবকে ভীষণভাবে মিস করেছে।”

“এত দেরিতে বুঝলেন?”

“নাহ, অনেক আগেই। যখন পোস্ট দেখেছিলাম।”

“আগে দেখেননি কেনো?”

“আইডি আবার খুলেছি ই মাস খানেক হলো।”

“এবার দেখা করুন!”

“আমি কি বলেছিলাম প্রিয়?”

“এত কিছুর পরেও ওই একই কথায় অনড় থাকবেন?”

“দেখো প্রিয়, তোমার আমার দেখা যদি আমার সফলতার পর হয় তখন আমাদের মাঝে হারানোর কোনো ভয় থাকবে না। না থাকবে কোনো বাঁধা! যদি সফল হওয়ার আগেই আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়, আর এরপর আমাদের দেখা হয়, তখন আমরা একে অপরকে চিনবো না। তখন কষ্টও পাবো না। কারণ আমরা উপলব্ধিই করবো না আমি অনুভব আর তুমি প্রিয়! বুঝলে?”

“কিন্তু যদি বিচ্ছেদ হয় তোমাকে না দেখার আফসোস তো আমার রয়ে যাবে!”

“ভুলে যাচ্ছো কেনো? এত্তগুলো মাস যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার পরও আমাদের মিল হয়েছে আবার প্রিয়! তবে ভয় কোন বিচ্ছেদের?”

নীতি শান্ত হলো।

“তাহলে এভাবেই চলবে?”

“খুব অসুবিধে হচ্ছে?”

“উহু!”

“তবে?”

“কিচ্ছুটি নয়!”

“মন খারাপ?”

“উহু..”

“মন ভালো?”

“হুমম!”

“কেনো?”

নীতি হেসে বললো, “কারণ ফোনের ওপাশের মানুষটির সাথে আমার সকল মুহূর্ত ভালো কাটে।”

“তবে কি সব শেষ?”

“উহু, নতুন করে প্রণয় শুরু। প্রিয় আর অনুভবের প্রণয়! প্রিয় অনুভবের প্রণয়!”

অনুভব হাসলো।

“প্রিয় কথা সাজাতে শিখেছে!”

“অনুভব তাকে শিখিয়েছে!”

“আর কি শিখিয়েছে সে?”

“কাঁদানো!”

“সে কাঁদিয়েছে?”

“উহু, তার প্রণয় শিখিয়েছে!”

অনুভব গুনগুনিয়ে সুর তুললো,

“যদি বারে বারে একই সুরে প্রেম তোমায় কাঁদায়! তবে প্রেমিকা কোথায়? আর প্রেমই বা কোথায়?”

নীতি মৃদু শব্দ করে হাসলো। তার হাসির শব্দ শুনে অনুভবের মনটাও শান্ত হলো! ইশ, কবে যে আসবে তাদের দুইজনের অপেক্ষাকৃত সেই সময়!

__________________________________

এভাবেই চলে গেলো আরো কয়েকটি দিন। প্রীতি আর আনাফের বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হবে কয়েকদিনেই। তবে এর মাঝেই বড়দের মধ্যে ছোট্ট করে আলাপ আলোচনা চলছে। যার এক অংশ নিয়ে প্রীতি গেলো নীতির নিকট।

“তোর বিয়েতে কাকে কাকে দাওয়াত দিবি রে নীতি?”

নীতি সবে গোসল সেরেছে। মাথা মুছতে মুছতেই ফোন হাতে নিলো।

“তোকে দিবো না অন্তত!”

“আমাকে দেওয়াও লাগে না।”

“বিন বুলায়ে মেহমান তুই!”

“হুস! তোর আর আমার বিয়ে একসাথে হবে। কি মজা!”

নীতি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালো।

“মজা নিচ্ছিস?”

“না, সত্যি!”

“সরি, বিশ্বাস করলাম না।”

“আরে, সালেহা আন্টি নিজে তোর মাকে তোর আর নাহিয়ান ভাইয়ার বিয়ের কথা বলেছেন।”

নীতি চমকালো।

“পা’গ’ল তুই?”

“আরে, সত্যি! উফফ, তুই আর রীতি আপু একসাথে থাকবি! ইশ, যদি তাদের আরেকটা ভাই থাকতো!”

নীতির কানে ওসব কিছু যাচ্ছে না। ওর মনে ভয় ঢুকছে। অসম্ভব রকমের ভয়। ফোন হাতে নিয়ে অনুভবকে মেসেজ করলো। সে লাইনে নেই আপাতত। পরক্ষণেই নাহিয়ানের কথা মাথায় আসতেই নিজের নামের আইডিতে গেলো। নাহিয়ানকে মেসেজ করলো।

“কোথায় আপনি?”

নাহিয়ানও অফলাইনে। বিরক্ত হলো নীতি। এদিকে প্রীতি বকবক করেই যাচ্ছে। নীতি শান্ত গলায় বললো, “বের হ রুম থেকে!”

“কোন সুখে?”

“নাহলে লা’থি মে’রে বের করবো আমি!”

“আরে আশ্চর্য!”

“যা বলছি!”

“যাচ্ছি যাচ্ছি!”

প্রীতি উঠে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলো। পরক্ষণেই উকি দিয়ে বললো, “নাহিয়ান ভাইয়া খুব হ্যান্ডসাম, বাট তোর মতো পে’ত্নীর সাথে কেমনে যাবে ভাবছি!”

নীতি রেগে বালিশ নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে মা’রলো। প্রীতি তার আগেই সরে গেলো। ধপ করে বিছানায় বসলো ও। হচ্ছেটা কি? মোবাইলের নোটিফিকেশনের শব্দে তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিলো। নাহিয়ান রিপ্লাই করেছে।

“বাড়ি আছি।”

“দেখা করুন!”

“হঠাৎ?”

“দরকার!”

“আবার কোন দুর্নীতি করার প্ল্যান করছো?”

“সহজ কথা সহজ ভাবে নেন না কেনো? বলছি না প্রয়োজন?”

“তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো?”

নীতির সহ্য হলো না আর।

”বিকেলে চারটায় সেম রেস্টুরেন্টে আসবেন যেখানে আগেও দেখা হয়েছে। আমি থাকবো।”

নাহিয়ান পরে রিপ্লাই করলেও নীতি সিন করলো না। অনুভবের লাইনে আসার অপেক্ষা করতে লাগলো।

__________________________________

“বলেন মিস দুর্নীতি। হঠাৎ এত জরুরি তলব? কাঙ্ক্ষিত জিনিস কি পেয়ে গিয়েছেন নাকি?”

নীতি চুপচাপ বসে আছে।

“নীতি?”

নীতি এবার তাকালো নাহিয়ানের দিকে।

“কিছু হয়েছে?”

”দেখুন নাহিয়ান আমি জানি আপনার নিকট আমি সবচেয়ে অপছন্দের একজন মানুষ। আপনিও আমার কাছে তাই। আপনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই!”

নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

“এসব বলার জন্য আমাকে ডেকেছো?”

“ফোনে বললে ব্যাপারটা আপনি বুঝতেন না। তাই সামনাসামনি বলাই শ্রেয়।”

“আরে, কিসের ব্যাপার? কি বলছো?”

“নাটক করছেন? আপনি কিছু জানেন না?”

“কি জানবো?”

নীতির রাগ হলো। তার মা বিয়ের কথা বার্তা বলে ফেলছে আর সে কিছু জানে না? এটা ওর মানা লাগবে?

“ওহ, তাহলে আপনার মা বুঝি কলা গাছের সাথে কথা বলে আমাদের বিয়ের কথা বলেছে আমার মাকে? শুনুন মিষ্টার, আপনি যাই করুন না কেন, আপনার সাথে বিয়ে তো দূরে থাক, আপনার প্রতি আমার এক চুল পরিমাণও ইন্টারেস্ট নেই। আশা করি আপনার পরিবারকে জানিয়ে দিবেন এটা!”

কথাগুলো নাহিয়ানের আত্মসম্মানে লাগলো। আরে ও তো এর কিছুই জানে না। ধমক উঠলো সে,

“ওয় মিস! কি আমার প্রতি ইন্টারেস্ট নাই নাই করছেন। আপনার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট কোনো কালেই ছিল না। আর না আসবে..আর বিয়ের কথা, আরে রাস্তার পা’গলকেও বিয়ে করতে রাজি আমি। তবু আপনায়! এটা আগে জানলে আমি ই না করতাম।আপনার এই তলব দিয়ে ডেকে আমায় বলা লাগতো না। আর আপনি আমার অপছন্দের মানুষের লিস্টে সর্বপ্রথম ও সর্বসেরা অপছন্দের মানুষ। যত্তসব!”

বলে এক মিনিটও দাঁড়ালো না সে। বেরিয়ে গেলো। নীতি কিছু বলার সুযোগ পেলো না। হঠাৎ ই কান্না পাচ্ছে তার। উফফ! কেনো যে এসব বলতে আসতে গেলো।

__________________________________

বাড়ি ফিরেই মায়ের রুমে গেলো নীতি। বড় চাচী আর ছোট চাচীও সেখানেই রয়েছেন।

“ওইতো নীতি!”

বোঝাই যাচ্ছে ওরা তারই অপেক্ষা করছিলো। স্মৃতি ওকে নিজের কাছে ডাকলো। নিজের পাশে বসিয়ে আদরমাখা কণ্ঠে বলল,

“আমাদের নীতিরাণী কত বড় হয়ে গিয়েছে!”

নীতি মলিন হেসে বললো, “আজকে জানলে?”

”হ্যাঁ, তবুও তুই ছোটই।”

বলেই নীতির মায়ের দিকে কিছু ইশারা করলো। নীতি বুঝতে পারছে ওদের কথা কি হবে!

“নীতি, প্রত্যেক মেয়ে ই তো একটা সময় বড় হয়। আর নিজের বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়ি যায়। তো আমি বলতে চাচ্ছি যে…”

বলেই আমতা আমতা করতে লাগলো। বলবে কি? ছোট চাচী মরিয়ম বিরক্ত হয়ে নীতির সামনে এলেন।

“ধুর বড় ভাবী আপনাকে দাড়া কিছু হবে না। নীতি তুই আমার কথা শোন। দেখ প্রীতি তোর ছোট। তোর আগে ওর বিয়ে হয়ে যাবে এটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। আবার তোরা দুইজন সমবয়সীর মতোই। তাই আমি চাচ্ছি আনাফ আর প্রীতির সাথে তোর বিয়েটাও সেরে ফেলতে। কি বলিস?”

নীতি চুপ করে রইলো। স্মৃতি ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,

“কিরে? চুপ করে আছিস কেনো? তোর কি কাউকে পছন্দ আছে?”

নীতি তবুও চুপ।

নীতির মা এবার মুখ খুললেন,

“নীতি, কিছু জিজ্ঞেস করছে তো!”

“আমি এখন বিয়ে করতে চাই না মা।”

নীতির মা জোহরা ওর কাছে এলেন। ওর অন্যপাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।

“আমরা তোকে জোর করবো না। তবে তোর বাবারও বয়স হচ্ছে। এমন নয় তুই আমাদের বোঝা। কিন্তু হায়াতের কথা কে জানে? মেয়ের সংসার দেখলেই আমরা খুশি। আর তাছাড়া তুই বড় হয়েছিস, প্রাপ্ত বয়স্ক। পড়তে চাইলে বিয়ের পরও আমরাই নাহয় পড়াবো। তবুও বলবো, ইচ্ছে না থাকলে কেউ জোর করবে না। তবে সালেহা বেগম তার ছেলের জন্য তোকে চেয়েছেন। ছেলেটা যথেষ্ট ভালো আর ভদ্র। তুই ওদের সাথে থাকলে আমরা নিশ্চিন্ত একেবারে। ওখানে আবার রীতিও আছে। সব মিলিয়ে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু আমরা সম্মতিও জানাই নি। তুই একটু ভেবে দেখ।”

মায়ের কথায় চুপ করে রইলো নীতি। বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর দিলো,

“কয়েকটা দিন সময় দেও। আমি ভেবে নেই!”

মরিয়ম বিস্মিত হয় জিজ্ঞেস করলো, “কয়েকটা দিন?”

স্মৃতি ধমক দিয়ে বললো, “চুপ কর তুই! নীতি, তুই ভাব। যত খুশি! তবে একটু জলদি। প্রীতি আর আনাফের বিয়েটাও দিয়ে দিতে চাচ্ছি। যতই হোক, তুই ই বলেছিস!”

নীতি হাসলো। কিছু না বলে উঠে নিজের রুমে গেলো। দরজা আটকে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। অদ্ভুত লাগছে ভীষণ! নীতি নিজেও মানে নাহিয়ান একজন চমৎকার মানুষ। সে মেয়েদের সম্মান করতে জানে। এর থেকে বড় সত্য আর নেই। কিন্তু অনুভব? নীতি যে ওকে ভালোবাসে! তার উপর আজকে নাহিয়ানকে কত কিছু বলেছে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন হাতে নিলো। অনুভবকে লাইনে দেখে কল দিল। আজকাল কলেই বেশি কথা হয় তাদের। কল রিসিভ হতেই নীতি ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠলো,

“একটা প্রস্তাব এসেছে বিয়ের। ছেলে চেনা পরিচিত। যথেষ্ট ভালো, সবাই চাচ্ছে বিয়েতে রাজি হয়ে যাই যেনো!”

ওপাশে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা পালন পর অনুভব জিজ্ঞেস করলো, “কি বলেছো?”

“তোমার তো জানার কথা!”

অনুভব চুপ করে রইলো। নীতি উঠে বসলো,

“জানো না, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না? জানো না, তোমাকে ছাড়া শূন্য আমি? জানো না, তোমায় আমি ভালোবাসি?”

“জানি!”

“তাহলে?”

“কি করতে বলছো?”

“এখনও বুঝিয়ে বলা লাগবে?”

অনুভব নিশ্চুপ!

“আমি কি করবো অনুভব?”

“দুইদিন পর হ্যাঁ বলে দিও!”

নীতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“হ্যাঁ বলে দিবো?”

“হুমম, দুইদিন পর!”

“কি এমন হবে দুইদিন পর?”

“তোমার আমার প্রেম হবে, প্রেম কথন হবে, অতঃপর এই সম্পর্কের বিচ্ছেদ হবে!”

বিচ্ছেদের কথা শুনতেই বুক কেঁপে উঠে নীতির।

“বিচ্ছেদ হবে?”

“হুমম হবে।”

“আপনি বড় নিষ্ঠুর মানুষ।”

বলেই ফোন রেখে দিল সে। মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। ইশ, কি সহজে বলে দিলো, ‘অতঃপর এই সম্পর্কের বিচ্ছেদ হবে!’

__________________________________
দুইদিন অভিমানে কথা বলেনি নীতি। আর বলেই না লাভ কি? সে তো হ্যাঁ ই করে দিতে বলেছে।
আনমনে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে নীতি। মেসেঞ্জারে কল আসার শব্দে ফোনের কাছে গেলো সে। অনুভব কল করেছে। রিসিভ করলো না। কই, দুইদিন তো একবারও খোঁজ নিলো না ওর! তাহলে এখন কিসের তাড়া?

কল কেঁটে গেলো। নীতি ফোনের দিকেই তাকিয়ে রইলো। হুট করেই মেসেজ এলো। না চাইতেও মেসেজটা পড়ে ফেললো নোটিফিকেশন থেকে। মেসেজটা পড়া মাত্রই চমকে উঠে আরেকবার মনে মনে আওড়ালো! স্পষ্ট লিখা সেখানে,

“চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি প্রিয় শুনছো?”

#চলবে