Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 385



কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১০

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১০

‘নাম অর্ণব চৌধুরী, বাবার নাম আতাহার চৌধুরী, মায়ের নাম ময়না আগে পরে নতুন স্বামীর নাম এখন৷’

– এই ডিটেইল কে চেয়ছে তোর কাছে? তোকে বলেছি খোঁজ নে অর্ণবের চলাফেরা। কোথায় যায় কি করছে, কার সাথে দেখা করছে? আর হ্যাঁ কোর্ট-কাচারীর দিকটা বেশি খেয়াল রাখবি৷ এ মাসের শেষেই আমি সব কাগজ জমা দিব ব্যাংকে তার আগে অর্ণব কিছুতেই যেন সন্ধান না পায় দলিলপত্রের।

সাখাওয়াত সারোয়ার নিজের কথা শেষ করে সামনের ব্যক্তিটিকে বিদায় দিলেন৷ কোম্পানির নতুন লোন স্যাংশনের পেছনে পরিশ্রমের শেষ নেই তবুও শেষ মুহূর্তে এসে নজর পড়েছে অর্ণবের ওপর। লোভের ওপর তার পুরো জীবন কটে গেছে এখন সেই লোভ পাপে পরিণত হচ্ছে। অর্ণব যে সম্পত্তির মালিক হতে পারে সে সম্পত্তি তো তারও হতে পারে! এমন ভাবনা যেদন থেকে মাথায় চড়েছে সেদিন থেকেই পাপ পূণ্য ভুলে বসে আছেন৷ অর্ণবের পেছনে লোক লাগানোর অনেক গুলো কারণও আছে আপাতত প্রথম কারণ অর্ণবের সঙ্গ যাচাই করা।
______

‘এ্যাই বৃষ্টি তোর ফোন বাজছে ধরিস না কেন?’

-আম্মু কাজটা শেষ হয়ে আসছে তারপর ধরছি।

হাতের আইসক্রিম বক্সটা অর্নির ব্যাগে ভালো করে পলিতে মুড়িয়ে দিল বৃষ্টি। আজ অর্নি ও বাড়ি চলে যাবে দু, তন দিনের জন্য তাই বৃষ্টি নিজের বানানো আইসক্রিম দিয়ে দিচ্ছে সাথে। অর্নি বারবার বলছিলো লাগবে না এগুলো কে খাবে? বৃষ্টি জেদ ধরেছে নিতেই হবে৷ অর্নি এক বিছানায় এক সঙ্গে থেকেও বৃষ্টি আপুর মন বোঝে না এ নিয়ে বড় আক্ষেপ বৃষ্টির। কিন্তু মুখ ফুটে সে বোঝাতেও চায় না কিছু৷ একবার অর্ণব ভাই তার হোক তারপর বুঝবে গাধীটা। জবরদস্তি আইসক্রিমটা দিয়ে অর্নিকে বিদায় করে বৃষ্টি নিজের ঘরে গেল। ফোনটা তখন মায়ের ঘরে ফেলেই সে নিচে গিয়েছিল। মা বলল কল আসছে তাই আবার মায়ের ঘরে গিয়ে ফোন নিলো। পাঁচটা মিসড কল অচেনা নম্বর থেকে কে হতে পারে! বান্ধবীরা কেউ তো অচেনা নম্বর থেকে দেয় না তবুও ব্যাক করল সে। সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যেই ওপাশের ব্যক্তির আওয়াজ এলো, থ্যাংক গড!

-নাহিয়ান!

-অফকোর্স, চিনতে সময় লাগছে?

-সেটাই কি স্বাভাবিক না!

-হু
একটু থামলো নাহিয়ান তারপর আবার বলল, কেমন আছো?

-এটা জানতে কল করেছো?

-আরও অনেক কিছু। মিস করছিলাম তোমায়৷

-গত দু বছর করোনি?

-বৃষ্টি! আমাকে ক্ষমা করে দাও। পরস্থিতি তখন সত্যিই এমন ছিল যার কারণে তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়েছে৷ বিশ্বে করো প্রতিটা দিন কি নিদারুণ কষ্টে কেটেছে আমার তা বলে বোঝাতে পারব না।

-হু, সেই কষ্টে তোমাকে পাশের বাড়ির এক মেয়ের সাথে প্রেম করতে হয়েছে। সস্তা হোটেলে ঢুকে চুমু খেতে হয়েছে……

-বৃষ্টি!

-কি বৃষ্টি হ্যা! আরও কি কি করেছো বলবো? থাক একজন সম্মানিত ব্যাংক অফিসারের আন্ডারপার্ট আর না খুলি। এতে তুমি লজ্জা না পেলেও আমি নিজেই পাব৷

নাহিয়ান সত্যিই এমন সব কুরুচিপূর্ণ কিছু কাজ করেছে গত দু বছরে৷ আবার পজিশন রক্ষায় বৃষ্টির থেকে দূরে থেকে শান্তিও পায়নি৷ একসময় সত্যিই ভালোবাসত এই মেয়েটাকে কিন্তু বাশার সাহেব কখনোই নিজের মেয়ের পাশে ছাপোষা জীবনধারণকারী ছেলে চান না। এখনো টের পেলে হয়তো নাহিয়ানের ওপর ঝড় বইবে৷ তবে নাহিয়ান এখন যথেষ্ট বুদ্ধি খাটিয়ে আগাতে চাইছে। তার বৃষ্টিকে চাই আবার বৃষ্টির বাবার শীতল দৃষ্টিও। কিন্তু তাকে পাগলের মত ভালোবাসত যে মেয়েটা সে এখন বদলে গেছে বলে মনে হচ্ছে । দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বৃষ্টিকে কিছু বোঝাতে চাইলো কিন্তু বৃষ্টি সে সুযোগ দেয়নি৷ কল কেটে নম্বরটা ব্লক করে দিল। যে ঝড় অনেক আগে থেমে গেছে তা আর না উঠুক৷ সময়ের সাথে সাথে মনের ঘা দূর হয়েছে৷ সে ঘায়ের জায়গায় নতুন প্রলেপ পড়েছে অর্ণব ভাই নামের। এই প্রলেপ আজীবন থাক এখন এটাই চাওয়া।

__________

অফিসের ছোট্ট কামরায় বসে এ মাসের বিলের বাজেট চেক করছে৷ মাস শেষ হলেই যে টাকার বাজেটগুলো দেয় ম্যানেজার সাহেব তা নিয়ে বছর তিনেক হলো অর্ণবের খুব খাটতে হয় না। ছোট দাদার খুব কাছের একজন বন্ধুর ছেলে তার একাউনট্যান্ট ম্যানেজার হওয়ার সুবাদে অনেক কাজ সহজ হয়েছে। ভরসার জায়গায় তার জীবনে খুব কম মানুষের নামই আসে তার মধ্যে তার একাউন্ট ম্যানেজার বদরুদ্দীন একজন৷ খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল অর্ণব তখনই ম্যানেজার আঙ্কেল এসে দরজায় কড়া নাড়লেন। অর্ণব চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো কাঁচদরজার ওপাশে ম্যানেজার আঙ্কেল।
-আসুন আঙ্কেল স্যরি ম্যানেজার সাহেব।

অফিস রুলস ফলো করতে ভুল হয় প্রায়ই তবুও অর্ণব চেষ্টা চালায়। নিজ সম্রাজ্যে নিজকেই প্রথম নিয়মে ডুবতে তাছাড়া সমৃদ্ধ হওয়া নিষ্ফল। বদরুদ্দীন সাহেব ভেতরে ঢুকতেই কিঞ্চিৎ বিষন্ন চোখে তাকায় অর্ণবের দিকে।

– বসুন।

– এবার তোমার সাবধান হওয়া উচিত।

-কোন ব্যাপারে?

– কাল তুমি কারখানায় ঢোকার পথে দারোয়ান খেয়াল করেছে একজনকে। তোমার বাইকের পেছনেই ছিল আরেকটা বাইক৷

-ওহ আপনারাও তাহলে টের পাচ্ছেন সবাই।

-হেলায় নিও না সব৷ সামনেই বড় একটা কাজে হাত দেবে৷ অল্পকদিনের মাঝেই কোটি টাকা ঢুকবে তোমার একাউন্টে৷ বাড়িটা ছাড়া তোমার বাবার সকল সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে অলরেডি জমা হয়ে গেছে আবার দ্বিতীয় আরও একটা সম্পত্তি রাখার চেষ্টায় আছো৷ বুঝতে পারছো কি হচ্ছে বা হতে পারে!

ম্যানেজার সাহেব ফরমাল আচরণ বাদ দিয়ে সরাসরি কথা বলছেন অর্ণবের সাথে অর্ণব অনুভব করে বদরুদ্দীন সাহেব চিন্তিত তাকে নিয়ে। বাবা না হোক বাবার মত স্নেহে জড়িয়ে রাখছেন তাকে মানুষটা।

– কি করার আছে তাতে বলুন তো! আমি যে ব্যাংক পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করি সে খবরটা যদি হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় আমার কি করার আছে?এখন কি হাওয়াকে বলব দরজা বন্ধ করে বোস যতক্ষণ না আমার কাজ শেষ হয়! কে বা কারা আমায় এত পছন্দ করে লেজের মত পিছে লাগল সেসব নিয়ে ভয় পেলে তো কাজকর্ম করতে পারব না।

অর্ণবের কথার পর বদরুদ্দীন সাহেব আর এ কথায় আগালেন না। অফিশিয়াল আলাপ সেরে তিনি চলে গেলেন৷ অর্ণবও হাতের ঘড়িতে সময়টা দেখে ফোন হাতে নিলো। অর্নির আজ বাড়ি আসার কথা এলো কিনা জানা দরকার। অর্নির নম্বরে কল করতেই সে জানালো রিমন পৌঁছে দিয়ে গেছে তাকে স্বস্তি পেল জেনে। নিজের পেছনে শত্রু লেগেছে এ নিয়ে ভয় নেই খুব একটা কিন্তু এই শত্রু কে বা কারা তা জানা জরুরি হয়ে পড়ছে এখন৷ নিজের সাথে অর্নি আর দাদীর কথাটাই মাথায় আসে তার সর্বপ্রথম। এখন তো চিন্তা হচ্ছে বাড়িতে একজন নিয়মিত সিকিউরিটিও দরকার। দাদার আমলের বয়স্ক দারোয়ান কতটুকু নজরে রাখতে পারবে কে জানে!

_______

আষাঢ়ের বাদলা দিন আজ না থাকলে রাতের শুরু বৃষ্টিধোয়া। অর্নি যখন বাড়ির গেইটে পা দিল তখনই নামলো ঝমঝমিয়ে একঝাঁক বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে গেল তাকে। সারাদিন মনের মধ্যে চাপা আতঙ্ক ঘোরে আজকাল বিয়ে নিয়ে। বিকেলটা তার একবারেই ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল মেজো খালামনির ফোন কল পেয়ে। কল করেই কেমন প্রশ্ন করছিলো, আমার বউমাটা কি আমাকে ভুলে গেছে? একটুও খোঁজ নিস না কেন অর্নি!

অর্নির কেমন খারাপ লাগছিল খালামনির আচরণে। আজকাল ফোন করেই বউমা বলে সম্মোধন করেন। এত কিসের তাড়া! আর শ্বাশুড়ি, বউমাই কেন হতে হবে? সে তো মেয়েরই মতন মেয়ে হিসেবেই ডাকুক না। খালামনি আজ জোর করে শিবলী ভাইয়ের ফোন নম্বরটাও দিলেন৷ বার কয়েক বলেও দিলেন অর্নি যেন কল দেয় শিবলী ভাইকে। এমনটাই কি হওয়ার কথা? কল করে সে কি বলবে শিবলী ভাইকে কি কথা বলতে হয় তাইতো জানে না অর্নি৷ বাড়ি এসে সেই ভাবনাগুলোয় লাগাম এঁটেছে ছোট দাদীর সান্নিধ্যে বসে৷ রাতের জন্য ভাপা ইলিশ রান্না করবেন দাদী আজ নিজ হাতে৷ তাই অর্নি দাদীর পাশে বসে পেঁয়াজ কাটছিল আর দাদী নিজ হাতে ইলিশ ধুয়ে নিচ্ছেন। রান্নাঘরেই পুরনো এক টেবিলের ওপর রাখা সকল মশলার পাশেই বেজে উঠেছে অর্নির ফোন। সে দেখলো ভিডিও কল করেছে নুপুর তাই রিসিভ করে পাশেই তাক করে রেখে কাজ চালালো।

-ওই কি করস?
চটপটে স্বরে নুপুর জানতে চাইলো। অর্নির ছুঁড়ি চালানোর ফাঁকে এক পলক দেখে নিলো বান্ধবীকে।

-পেঁয়াজ কাটছি।

-তুই কোথায়?

-আমাদের বাড়ি এসেছি।

-ওহ, তা পেঁয়াজ দিয়ে কি হবে? তুই রাঁধতে পারিস নাকি কিছু অকর্মা ঢেঁকি!

-নাহ্ তুই এসে রেঁধে দে।

-সিরিয়াসলি! আমি কিন্তু সত্যি আসব বল কি রাঁধতে হবে?

-এমন করে বলছিস যেন তুই সব পারিস?

-আরে ধ্যাত, রান্না পারতে হয় নাকি? রাঁধতে গেলে আপনাআপনি হয়ে যায়।

উচ্ছল হেসে জবাব দেয় নুপুর৷ বৃষ্টি একটু হেসে কুচি করা পেয়াজ চপিংবোর্ড থেকে বাটিতে তোলে। কাচা মরিচ নিয়ে কাটতে কাটতে আরও কিছু বলতে নেয় তার আগেই দাদী উঁকি দেয় ফোনের কাছে।

-আসসালামু আলাইকুম দাদী। কেমন আছেন আপনার পায়ের কি অবস্থা এখন?

দম নেয় না নুপুর একটানা বলে যায় কথা। দাদীর ভালো লাগে এই মেয়েটাকে। তিনি হেসে সালামের জবাব দেন।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি ঠিক আছি বইন তোমার কি খবর?

-আমি একদম ঠিক আছি দাদী শুধু পড়ার চাপে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যাচ্ছি গো।

-এখন তো হইবাই পড়া ছাড়া কি আছে জীবনে আর?

-আছে গো দাদী পড়া ছাড়া জীবনে নাগর আসবে, বিয়াশাদী হবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে তোমার মত নাতিপুতির দাদী হব আরও কত কি!

-‘ইশ এর যে এহনই কত রঙ্গ মনের মধ্যে! তা আসো না একদিন আমাগো বাড়ি। তোমার লগে কথায় কথায় মেলা জমাইতে পারি। আমার নাতিনডা তো একেবারেই মরা মাছ।’ কথাটা বলতে বলতে দাদী তাকান অর্নির দিকে। নুুপুরের সাথে দাদীর পরিচয় হয়েছিল হাসপাতালের কেবিনে। দাদী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো যেবার অর্নি তখন কলেজে। খবর পেল এক টিচার মারফত কিন্তু সে তখনও একা রাস্তায় চলতে জানে না৷ নুপুর নিজেও খুব চেনে তা নয় তবুও সেদিন অর্নিকে কেমন আগলে নিয়ে ছুটে গেল হাসপাতালে। খু্ঁজে খুঁজে কেবিন বের করে নিলো। তারপর দাদীর সামনে বসে দু চার কথায় আলাপ জমিয়ে ঘন্টাখানেকেই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল দাদীর। এরপর আর সামনাসামনি দেখা না হলেও অর্নি এ বাড়ি এলেই তাদের গল্প জমে মুঠোফোনে। আজ আর গল্প খুব জমে ওঠার আগেই নুপুর বদায় নিলো ফোনকল থেকে৷ দাদী হঠাৎ বলে বসলেন, নুপুরকে নিয়া আয় কাল সারাদিন এক সঙ্গে থাকমু।

অর্নিরও মন বলছিলো একটা কলেজ বাদ দিয়ে বাড়িতে কাটাবে। নুপুর সঙ্গে থাকলে বেশ হয়। তাই সে আবারও ফোন করে নুপুরকে বলল কালকে চলে আয়। নুপুর এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে পরে জানাবে বলে ফোন রেখে দিলো।

_________
ভেজা ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে রিদওয়ান। গায়ে মাথায় বৃষ্টি শেষের শীতল হাওয়ার দাপট তার গা কাঁপিয়ে জানান দিচ্ছে বর্ষা এসেছে বরণ করো বাহু ফেলে। সেও বরণ করার নিমিত্তেই যেন বসে আছে এই রাত দুপুরে। ফোনের নেটওয়ার্ক এই পাহাড়ের গায়ে বড্ড দূর্বল তবুও একটু একটু যা আছে তাতে দু একটা ছবি স্পষ্ট। আজ বিকেলেই রিমন কিছু ছবি আর ভিডিও পাঠিয়েছ তাকে৷ সারা সন্ধ্যা বৃষ্টি, লোডশেডিং আর দূর্বল নেটওয়ার্ক তাক আচ্ছামত জ্বালিয়ে সবে দুটো ছব ডাউনলোড হলো। ছবি দুটো যেন তার কলিজা বরফকারী হয়ে স্পষ্ট হয়েছে। এক ধ্যানে বসে সে ভাবছে সে কি খুশি হবে নাকি দুঃখ পাবে! শিবলী ভাই আর রূপা! রিমনের প্রেমিকার কাজিন রূপা! তবে এত নাটক কেন করছে শিবলী ভাই! কিসের দায়ে নাকি অন্য কোন কারণ! যাইহোক, রিদওয়ানের আজ চাঁদ রাত সে তো সেলিব্রেট করবে৷ কিভাবে করবে? বৃষ্টি নামুক বৃষ্টিবিলাস করবে আজ রাত ভর। হঠাৎ দু হাত ছড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রিদওয়ান, হে প্রকৃতি বর্ষণ করো আজ মন খুলে আমি তোমার তরে তলিয়ে যাব আজ মেঘমেদুর সেই মেয়েটির নামে।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০৯

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৯

ঝিরিঝিরি বাতাসে ভেসে আসছে মৃদুমন্দ বুনোফুলের সৌরভ। ভোরের আলো ফোটেনি তখনও তবুও চারদিক ফ্যাকাশে হয়ে আছে। রাতের ঘুম গাঢ় হয়েছে ভোরের আগেই হঠাৎ কোন পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে গেল রিদওয়ানের। চঞ্চল পায়ে কোথা থেকে একটা কাঠবিড়ালি এসে বসলো জানালার কপাটে৷ পাহাড়ঘেরা সৌন্দর্যে এ এক চমৎকার সকাল হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু হলো না। কাল বাড়ি থেকে বেরোবার মুখে মায়ের দেখা অসুস্থ চেহারাটা মনে পড়লো। নিজের মন তাকে বারংবার বলছিলো, তুই একটা স্বার্থপর৷ তুই বড়ই স্বার্থপর। তোর জন্যই তোর মায়ের এই অসুস্থ ভাব। যে মেয়েটা কখনো জানলোই না তোর অনুভূতি, যার হাতের রেখায় শুরু থেকেই ছিল অন্য পুরুষের নাম সেই মেয়ের জন্য তুই কেন পালিয়ে বেড়াস এই জগৎ-সংসারে! যে মা তোকে জন্ম দিল, এ ধরায় যার কাছে তোর আমৃত্যু ঋণ তাকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?
তাহলে আমি কি করব! নিজেই যেন নিজেকে প্রশ্ন করলো রিদওয়ান। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, ভুলে যা মেয়টাকে জড়িয়ে যা অন্য কারো মায়ায়।
এতই সহজ! এবারের প্রশ্নে প্রশ্ন কম যেন জিজ্ঞাসাটাই বেশি। উত্তরহীন সব তার প্রশ্ন। রিদওয়ান ছটফটায় বিছানায় গড়িয়ে৷ বাঁশের মাচার ছোট্ট রিসোর্টে কাল রাতেই এসে উঠেছিল সে৷ বাড়ি থেকে অনেকটা দূর এই পাহাড়ে এসে ঠাঁই নিতেই মনের মেঘ পাতলা হয়েছে। অর্নিতাকে নিয়ে অনুভূতির জাল অনেকটাই ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম সে। কয়েকটা দিন নিজেকে সময় দিলেই আবার সামলে যাবে অনেকদিনের জন্য৷ এমনটাই তো হচ্ছে সেই প্রথমবার মায়ের কাছে অনুভূতির খোলাসা করার পর থেকে। কাঠবিড়ালিটা এবার জানালা ছেড়ে ঘরের মেঝেতে নেমেছে। হাতে তার পাহাড়ি কোন ফল কেমন কুটুস কুটুস করে খাাচ্ছে৷ ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলো ওটা আস্ত এক কাঠবাদাম। রিদওয়ান গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা ছাড়লো। প্রচণ্ড গরমের পর বর্ষার আগমনী হাওয়ার শীতল ঝাপটা চোখ মুখে লাগতেই পেটে খিদের টান পড়লো। মুখ হাত ধুয়ে দ্রুত রিসোর্ট ছেড়ে বাইরে এলো সে। এদিকটায় খাওয়ার আয়োজন আলাদা নেই রিসোর্টটেই খাবারের জন্য বলে সে বেরিয়ে পড়লো লতায় মোড়ানো পাহাড়ি সীমান্তে। হেঁটে বেরিয়ে খিদেটা আরেকটু চড়ুক তারপর না হয় পেটপুরে খেয়ে নেবে।

____________

রোজকার নিয়মে সকালে উঠে বাড়ির পেছন দিকটার আরও কিছু গাছ কেটে নিলো অর্ণব৷ আজ প্রায় মাস খানেক ধরে সে একটা একটা করে মাঝারি আকারের কড়ই আর কাঠগাছ গুলো কেটে রাখছে। লোক লাগিয়ে বিশাল আকারের কড়ই দুটো কাটিয়ে নিলেও মোটামুটি রকমগুলোতে সে নিজেই হাত লাগাচ্ছে। এ পরিশ্রম তার ইচ্ছাকৃত৷ কেন এমন ইচ্ছা নিজেও জানে না। দাদী প্রায়ই রাগ করেন এ নিয়ে ভয়ও পান বেকায়দা কোন আঘাত না লেগে যায় তার। অর্ণব কান দেয় না সে কথায়। প্রতি সকালে ব্যায়ামের পরিবর্তে এই কাজটাই তার ভালো লাগে। এতে নাকি শরীরের সাথে মনেরও একটা ব্যায়াম চালায় সে। অতিরিক্ত চিন্তার সময়গুলো একাগ্রচিত্তে এমন কোন কঠিন কাজে মন দিলে তার অনেক সমস্যাই দূর হয়ে যায়। হয়তোবা সত্যিই নইলে এখনও সে রিলিফ পেতো না তার পেছনে লাগা মানুষটার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে পেরেও। একটা কাঠের গুঁড়ি সম্পূর্ণ উপরে ফেলার পর অর্ণব বসে পড়লো মাটিতে। ট্রাউজার পরিহিত, উদোম ফর্সা বুকে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ ঘামের বিন্দু৷ চোয়াল বেয়েও গড়াচ্ছে স্বেদজলের একই ধারা। দু চোখ বুঁজে লম্বা শ্বাস নেয় সে কয়েকবার আর ভাবে সেই বাইকারকে সে প্রথম কখন দেখেছে! হ্যাঁ মনে পড়েছে প্রথম দেখেছে মতিঝিলে। কারখানারই কোন কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে একজনের সাথে দেখা করেছিল সে। কিন্তু সেদিনের দেখাটা তখন মনে লাগেনি যা লেগেছে পরশু সারাদিনের দেখায়। তার জমির কাগজগুলো এখনো তার হাতে আসেনি৷ কাগজপত্রের জন্য সাধারণ একটা জিডির কথা বলেছেন এসপি আঙ্কেল। অর্ণব আরও কিছু ভাবতে বসেছিল কিন্তু সুযোগ হলো না৷ রুজিনা খালা খবর দিলেন বাড়িতে একটা চিঠি এসেছে। এত সকালে চিঠি! অর্ণব বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো সোফার ওপর একটা সাদা খাম৷ চিঠির খাম নয় বরং অতি সাধারণ একটা খাম। হাতে তুলে খামের এপিঠ ওপিঠ দেখে সে রুজিনা খালাকে প্রশ্ন করলো, এটা কে দিলো?

– গেইটের সামনে একটা বাচ্চা আইয়া কইলো এইটা অর্ণব ভাইয়ের চিঠি একটা লোক দিয়া গেছে।

-বাচ্চাটা কে?

-ওই যে রাস্তার ওইপার বাড়ি আবিদ না কি নাম।

রুজিনা খালা স্পষ্ট জবাব দিতে পারলেন না। অর্ণবও চিনতে পারলো না আবিদটা কে। সে খামটা নিয়ে নিজের ঘরে এলো। আপাতত গোসল দরকার নাশতা সেরে অফিসে যাবে। খামটার দিকে আরেকবার নজর বুলিয়ে রেখে দিলো খাটের ওপর।গোসল শেষে তৈরি হয়ে নিচে নেমে নাশতা খেয়ে সোজা বেরিয়ে পড়লো অফিসের জন্য। মনে রইলো না আর সে চিঠির কথা তার তবে অফিসে কাজের ফাঁকে অনেকবার মনে পড়লো কাল রাতের ছোট ছোট বার্তাগুলো। সকল পরিশ্রমের ক্লান্তির মাঝে তাকে শৈত্য প্রবাহের মত শীতল করে গেল সেসব বার্তা। না চাইতেও মনে পড়তে লাগলো শ্যামবরণ মুখের চঞ্চল দুটি কৃষ্ণকালো চোখ।

-গোফওয়ালা জল্লাদ নামটা কেমন বলেন তো!
প্রথম বার্তা এটাই ছিল কাল রাতের। দ্বিতীয়টা এলো একটু পরই লেখা ছিল, মরুভূমি এত শুকিয়েছে কেন বলেন তো আমার না আপনাকে একটু কা়ঁদাতে ইচ্ছে করছে কাঁদবেন?

অর্ণব চায় না তাকে প্রশ্রয় দিতে কিন্তু কাল রাতের একাকীত্বে ওই বার্তাগুলো তাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো খুব৷ পরের কিছু বার্তা ছিল, রাতের খাবারে কি খেয়েছেন?

– আমি আজকে কাঁচকলার ভর্তা করেছি যা টেস্ট ছিল ইশ দেখলেই জিভে জল আসবে আপনার।

-আমি সংসারের কাজ জানি না কিন্তু জেনে নেব ভাবছি।

একের পর এক লিখেই চলছিল মেয়েটা। ঘড়ির কাটা বারো ছুঁতেই অর্ণবের রাগ হলো। পড়াশোনা বাদ দিয়ে মেয়েটা এসব কি করছে! অনেকগুলো বার্তার পর অর্ণব একটি জবাব লিখল, ‘আর একটা যদি বাজে মেসেজ আসে তো বাড়ি এসে চাবকে যাব মনে রেখো।’

ব্যস, কাজ হলো তবে অবশ্যই একটা শেষ মেসেজ এসেছিল।

-শুভরাত্রি, বাজে নয় এটা সমাপ্তি মেসেজ। প্লিজ বাড়ি আসবেন না।

এটা পড়েই হাসতে হাসতে শেষ হয় অর্ণব৷ কতদিন পর কে জানে মন খুলে হাসতে পেরেছিল সে। দোতলার একলা ঘরটায় গুমোট হাওয়ার পরিবর্তে জায়গা নিয়েছিল হাসির ফোয়ারা৷ ভালো লাগার একটা পলকা মেঘ ঘিরে নিয়েছিল অর্ণবকে তা সকাল হতেই আবার মিলিয়ে গেছে। এখন আবার শুরু হলো যান্ত্রিক এক দিনের৷

______________

আজকের দিনটায় কাজের চাপ কম। রিদওয়ান ভাই না থাকলেও কাজের প্রেশার খুব একটা পড়ে না রিমন বা বাবার ওপর। তারা দুজনই ভীষণ পরিশ্রমী আর কাজের ক্ষেত্রে কঠোর৷ আজ কাজের পরিমাণ কম মানে কয়েকঘন্টা সময় হাতে এক্সট্রা আছে৷ হাতে সময় থাকা মানেই প্রেমিকার একটা অবসর গচ্ছিত প্রেমিকের হাতে। রিমনের ক্ষেত্রেও তাই আজ প্রেমিকার অর্ধদিবস গচ্ছিত। অফিস থেকে দুপুরে বের হয়েই প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল রমনায়। কথা ছিল একসাথে দুপুরে খাবে বিকেলটা গাজীপুরে কোথাও ঘুরে কাটিয়ে রাত নাগাদ বাড়ি ফিরবে। রমনায় খুবই অল্প সময় পার করে রিমন বেরিয়ে পড়লো প্রেমিকা নাজনীনকে নিয়ে। গাজীপুরের রাস্তায় গাড়ি চলতেই নাজনীন জানালো তার কাজিনও যাচ্ছে গাজীপুর তার প্রেমিকের সাথে। রিমন প্রথমে কথাটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও পরে মনে পড়লো নাজনীনের কোন কাজিন? শিবলী ভাইয়ের প্রেমিকাও তো নাজনীনের এক কাজিন! দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগলো না যখন নাজনীন নিজেই বলল, ‘শিবলী ভাইয়া ভীষণ রোমান্টিক। আজ রূপার একুশতম জন্মদিন উপলক্ষে একুশটা কেক, একুশটা শাড়ি আর গুণে গুণে একুশটা ফ্লাওয়ার বুকে গিফট করেছে এই দেখো তাদের ভোরের ছবি।’

প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে নাজনীন আগলে ধরলো ফোনখানা। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে পলক ফেলল রিমন। এতেই যেন মাথায় বিদ্যুতের মত ঝিলিক দিলো এক বুদ্ধি। আপন খালাতো ভাই শিবলী এক মুহূর্তে আপন শত্রুসরূপ মনে হলো তার। অর্নিকে পেলেপুষে বড় করছে তারা এই ষাঁড়ের হাতে দেওয়ার জন্য! আর তার ভাই একটা গাধা! বাপকে হাত করতে জানে না, নিজের মনের বাসনা পূরণ করতে জানে না শুধু জানে বোহিমিয়ান ঢঙ ধরে দুনিয়া ছেড়ে হারিয়ে যেতে। দুনিয়া ছাড়লেও চলত একটা গাধা দুনিয়া থেকে কম হতো। জঞ্জাল! শুধুই দুনিয়ার জঞ্জাল সেসব মানুষ যারা অনুভূতির জানাজা তোলে। রিমন এদের একদম পছন্দ করে না। তার বড় ভাই, তার মা আর অর্নি এদের কাউকেই সে পছন্দ করে না৷ এরা জীবনকে বাংলা সিনেমার নায়িকা শাবানা বানিয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় প্রতি মুহুর্তে।

-জান, এই ছবিগুলো আজকের?

-হ্যা সকালেই এই সেলব্রেশন ছিল তাদের বেইলি রোডে একটা ক্যাফেতে আর বাকিটা রাতে৷ আমরা আসার আগে কিন্তু সারপ্রাইজ দেব তাদের একটা কেমন!

-নিশ্চয়ই। আচ্ছা ছবিগুলো আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করো পরে দেখব আমি। ইন্টারেস্টিং লাগছে ছবিগুলো পরে কখনো তোমার জন্যও আয়োজন করব।

নাজনীন ছবিগুলো সেন্ড করতে করতে বলল, “আমার এত কিছু লাগবে না জান। এসব লোক দেখানো আয়োজন না তুমি তোমার সাধারণ আয়োজন রেখো আমি তাতেই হ্যাপি।”

রিমন হাসলো একটু৷ মেয়েটা বড্ড বেশি ভালোবাসে তাকে সে খবর তার অজানা নয়। কখনো কখনো বড় বড় আবদার আবার কখনো ছোট ছোট শব্দেই সুখী হয়। কিন্তু এ মুহূর্তে মাথায় ঘুরছে ছবিগুলো। প্রত্যেকটা ছবিতে শিবলী ভাই আর তার প্রেমিকার সম্পূর্ণ চেহারা দেখা যাচ্ছে। কাজে লাগবে খুব কিন্তু তার আগে রোমিও ফিরুক সন্ন্যাস ছেড়ে।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০৮

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৮

প্রবল প্রণয়ঘোর বিপদসীমা পেরিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে এটাই নিয়ম৷ বৃষ্টির জীবনেও তেমনই এক বর্ষণ ছিল কলেজ জীবনে নাহিয়ান নামে। সে বর্ষণ থেমেছে আজ বছর দুই পেরিয়ে। বৃষ্টি ভুলে গেছে সে সময়গুলো কিংবা খুব একটা মনে পড়ে না নতুন প্রেমের আগমনে। প্রেমই বটে তার জীবনে অর্ণব। সে প্রেমে পড়ে গেছে ওই গম্ভীরমুখো, নীরব, শীতল চরিত্রটার। সৌম্যদর্শন অর্ণব ভাই যেদিন প্রথম খুব কাছে এসেছিল তার বিপদ মুহূর্তে সেদিন থেকেই ভালো লাগার শুরু। তার আগ পর্যন্ত তার জীবনের অসমাপ্ত ভালোবাসার প্রেমিকপুরুষ ছিল একমাত্র নাহিয়ান৷ নিজ ভুলে নাহিয়ান তাকে হারিয়েছে। আজ বছর দুই পর সে ভুল উপলব্ধি করে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু এখন যে বৃষ্টি আর চায় না তাকে! চাওয়ার কথাও না আর৷ কোন মানুষ তার নিজের অপমান সহ্য করে নিতে পারলেও ভালোবাসার অপমানটা কখনোই নিতে পারে না তবে কিছু সাইকোপ্যাথের হিসেব আলাদা। বৃষ্টি অন্তত সে পথের পথিক নয়। আজ ভার্সিটিতে আসার পরই আকষ্মিক ঝড়ের মত উপস্থিত হয় নাহিয়ান৷ আটাশ বছরের তাগড়া ব্যাংকার যুবক দারুণ ভাব নিয়েই সামনে এসেছিল তার। মিনিট কয়েক সময় নিয়ে বৃষ্টি তাকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করেছিল যেন মানুষ নয় কোন পন্য দেখছে সে৷ তার মুখের ভাব ছিল, এত পরিশ্রমে এইটুকুই পরিবর্তন! নাহিয়ান টলেনি পুরনো প্রেমিকার মনোভাবে উল্টো গলা ঝেড়ে কেশেছে সে।

– এভাবে দেখার কিছুই নেই আমি যথেষ্ট পরিমার্জিত রূপে এসেছ বৃষ্টি।

-আসলেই!
মুখ বাঁকিয়ে জবাব দেয় বৃষ্টি।

-একটু কি বসবে কোথায় আমার সাথে?

-প্রয়োজনবোধ করছি না।

-কথা ছিল আমার।

-আমার তো নেই।
কাটকাট সুরে জবাব দেয় বৃষ্টি।

-প্লিজ বৃষ্টি।

-বড়লোক বাপের বেটি আমি আবার না তোমাকে গোলাম টাইপ প্রেমিক বানিয়ে ফেলি ভয় করো নাহিয়ান।

বৃষ্টির এ কথাটা নাহিয়ানেরই এক সময়কার কটাক্ষ। বৃষ্টির খাঁটি ভালোবাসাকে নাহিয়ান তুচ্ছ করেছিল এমন কিছু অপমানজনক কথা বলেই। বৃষ্টির বাবা তাকে এমন কিছুই বলেছিল মেয়ের হয়ে অথচ বৃষ্টি জানতো না সেসব৷ হাজার বলার পরও নাহিয়ান মুখের ওপর বলেছিল, বাবা যেমন মেয়ে তেমন হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই আজ থেকে তোমার আমার পথ আলাদা। বৃষ্টি অনেক বুঝিয়েছিল সে জানে না এসব৷ বাবা কি বলেছে কেন বলেছে সেসব বাদ দাও আমি ঠিক করে দেব সব ৷ নাহিয়ান সে কথায় কান দেয়নি পাছে তার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়! বড়লোক বাপের মেয়েকে বিয়ে করা মুশকিল তাই প্রেমের ইতি টেনেছিল।আর তাই বৃষ্টিও কষ্ট পাচ্ছে না আজ বরং মুখের ওপর অপমানের হুল ফুটিয়ে চলে গেল নিজ গন্তব্যে। বাড়ি ফিরে চমক পেল দারুণ। অর্ণব ভাই এসেছে! কই সে তো জানতো না আজ আসবে তিনি। ইশ, আগে জানলে নিশ্চয়ই সে বাড়ি থাকতো।কিছু একটা বানিয়ে খাওয়ানো যেত৷ কিন্তু কি বানাতো! রান্না-বান্নায় একদমই পারদর্শী নয় সে। শখের বশে সেমাই রেঁধেছে মায়ের কাছে জেনে নিয়ে। কিন্তু আজ কি করবে! ভাবতে ভাবতেই মাথায় এলো পাস্তা করা যায়। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে জামা-কাপড় বদলে নিচে এলো সে।অর্ণব তখন বা হাতে চিবুক ছুঁয়ে কিছু কাগজপত্রে চোখ বুলাচ্ছে। অর্নি এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি এদিকে লান্চ টাইম বলে অর্ণব সময় নিয়ে খালার বাড়ি এসেছে।কাগজপত্র নিয়েই কিছু আলাপ ছিল খালুর সাথে।মাথার ওপর বড় বট ছায়া এখন খালুই আছেন বিশ্বাসযোগ্য। বাকিরা তো সবাই ওঁৎ পেতে আছে হায়েনার মত৷ কখন সুযোগ পাবে আর তাকে খুবলে খাবে। ভয়টা তার নিজের জন্য একটুও নেই কিন্তু বোনটাকে নিয়ে বেজায় টেনশন। হাতের কাগজপত্র টি টেবিলটায় ছড়িয়ে নিতেই খালু ফিরলেন বাড়ি। সকাল থেকে রিদওয়ান নেই বাড়িতে খালুর সাথে রিমনই আছে। আজ লাঞ্চ বাড়ি করবেন বলেই কিনা অর্ণবকে ডাকা। মিনিট দশেক পার হতেই খালু সাহেব এসে উপস্থিত হলেন অর্ণবের সামনে। কাগজ সংক্রান্ত কথাবার্তায় জানতে পারলেন গত রাতে অর্ণবকে অনুসরণকারীর কথা৷ খালু বুদ্ধিমান, চতুর আর অভিজ্ঞ মানুষ। বেশি সময় নিলেন না ঘটনা বুঝতে।

– তুমি যেটা বলছো তা বিপদের কথা। বাপ-দাদার সম্পত্তিতে বাপ-চাচারাই শত্রু হয়৷ তোমার চলাফেরায় সতর্ক থাকতে হবে।

-বুঝলাম না খালু।

-তুমি বলছো তোমার ছোট দাদার সম্পত্তির মালিক তোমার ছোট দাদী। আর ছোট দাদী নিঃসন্তান৷ তার দেখভাল চলছে তোমার কাছে। মানে বিগত চৌদ্দ পনেরো বছর ধরে সে তোমার সাথেই আছেন এমনকি সুখে আছেন৷ তাই আন্দাজ করা যায় ভদ্রমহিলা তার সম্পদের ভাগ তুমি ছাড়া কাউকে দেবেন না। আর তোমার বড় দাদার ছেলেপুলেতে ভরা ঘর। তাদের যতোই সম্পদ থাক নজরটা বেশ ছোট দাদার সম্পদেও রাখছে। হতে পারে তারা তোমার ক্ষতি করে সবটা নিতে চেষ্টা করবে। আমি যতদূর জানি তোমার বড় চাচা মানে আনিস সাহেব ধূর্ত লোক। হতে পারে সে তোমাকেই পথ থেকে সরিয়ে দিতে……. খালু সাহেব থেমে গেলেন এক মুহূর্তেই। বৃষ্টি এসে দাঁড়িয়েছে সোফার সামনে।

-আব্বু লাঞ্চ করবে না! টেবিলে খাবার দিয়েছে।

-আসছি মা তুমি যাও বসো।

বৃষ্টি একবার তাকালো অর্ণব ভাইয়ের দিকে। মনে মনে প্রার্থনা করলো অর্ণব ভাইও একটু তাকাক। তার জন্যই তো এখন গোসল সেরে দারুণ একটা স্কার্ট পরেছে। চোখের কোলে কাজল আর ঠোঁট রাঙিয়েছে হালকা রঙের লিপস্টিকে। কিন্তু মানুষটার তো নজরই নেই তাকে দেখার মত। বৃষ্টির মন চঞ্চল হলো, সে উসখুস করলো নিজেকে একটু ধরিয়ে দেওয়ার জন্য অথচ অর্ণব ফিরেও তাকাচ্ছে না৷ এদিক বাশার সাহেব টের পেয়ে গেলেন মেয়ের মনোভাব তাইতো তিনি লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

-চলো অর্ণব খাবার খাই। ভয় পেয়ো না শুধু একটু সাবধান থেকো তবেই হবে।

কথাটা বলেই বাশার সাহেব প্রস্থান করলেন অর্ণব বসে রইলো আগের মতই। আর বৃষ্টি দাঁড়িয়ে রইলো মেঘাচ্ছন্ন চক্ষু নিয়ে।

______________

– শোন অর্নি আমি যা বুঝি তুই তা বুঝিস না।

-তাই নাকি!
আইসক্রিম কোণে জিভ ঠেঁকিয়ে নরম শীতল পরশ নেয় অর্নি।

-তবে আর বলছি কি? ওই শিবলী ভাই বয়সে বড় শুধু তা নয় স্বভাবেও খাইষ্টাই হবে ।
অভিজ্ঞ ব্যক্তির মত করে বলে নুপুর।

-তুই কি করে বুঝলি?

-সিম্পল একটা ব্যাপার৷ যে ছেলের অনেক বছর ধরেই কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সে ছেলে সুযোগ পেয়েও একটু কথা বলতে চায় না৷ এমনকি ফোন নম্বরটা পর্যন্ত নেয় না সেই ছেলেতে ঘাপলা আছেই আছে। দ্যাখ অর্নি তুই আমার একমাত্র বান্ধবী তোর জীবন নিয়ে হেলাফেলা আমি একদম সহ্য করব না বলে দিলাম।

-তাহলে কি করবি?
অর্নির ছোট্ট প্রশ্ন।

-যা একজন সচেতন বান্ধবীর করা উচিত। ওই শিবলীর নারী-নক্ষত্র জানব এবং অবশ্যই ঘাপলা পেলে নাক ভেঙে দিয়ে আসব।

-থাক তোর কিছু করতে হবে না। কোন ত্রুটি পেলে আমার ভাই নিজেই দেখে নেবে৷

দু বান্ধবীতে কথার পর্ব চলল অর্নির রিকশা পাওয়ার আগ পর্যন্ত। অর্নি রিকশায় চড়তেই নুপুরও স্কুটিতে বসল৷ প্র্যাকটিকেলের খাতার পেছনে আজ অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে বলে দুপুরে খাওয়ার সুযোগ হলো না নুপুরের। কিংবা আজকেই যেন পেটের খিদে মোচড় দিচ্ছে খুব করে৷ দুপুর এখন আড়াইটার বেশি স্টুডেন্ট এর বাড়িতে থাকতে হবে তিনটেয়৷ ভেবে দেখলো তার পৌঁছুতে সময় লাগবে পনেরো মিনিট মানে হাতে এক্সট্রা পনেরো মিনিট আছে৷ ক্ষুধা নিবারণ জরুরি হয়ে পড়ায় স্কুটি থামালো রাস্তার পাশে এক টঙ দোকানের সামনে। ইচ্ছে তো হচ্ছে ভারী কিছু খাওয়ার কিন্তু এমন করে রোজ রোজ বাইরে খেলে টাকা জমাবে কেমন করে! মনের ক্ষিদে বাদ দিয়ে আপাতত পেটের খিদে মেটাতে একটা পাউরুটি, কলা কিনলো নুপুর৷ ব্যাগে পট ভর্তি পানি আছে তাই পানির টাকা বেচে গেল। স্কুটিতে বসেই দু চার কামড়ে অর্ধেক রুটি আর কলাটা শেষ করে গন্তব্যে রওনা হলো সে। দুটো টিউশন শেষে বাড়ি ফিরতেই চমক পেল নুপুর বসার ঘরে মেহমান দেখে। কপাল কুঁচকে উপস্থিত প্রত্যেকটা মুখ দেখার পর বুঝতে পারল এগুলো সব ছোট মায়ের আত্মীয় স্বজন৷ ছোট মাও নুপুরকে দেখে এগিয়ে এলেন সামনে। মুখে তার জ্বলজ্বলে এক নকল হাসি।

-আসো মামনি সালাম দাও সবাইকে।

নুপুর সালাম দিলেও ভদ্রতা দেখানোর কোন আগ্রহ দেখালো না মেহমানদের সামনে। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে চাইলে জাকির ডাকল, আরেহ নুপুর কই যাও৷ মেহমানের সামনে আসো তোমারে একটু দেখব ওরা।

-আমাকে দেখার কি আছে?
নুপুর মুখ গম্ভীর করে প্রশ্ন ছুড়তেই একজন মহিলা বলে উঠলো, তোমাকেই দেখব মা আমার ছেলের জন্য।

– বুঝলাম না।

-নুপুর তুমি ঘরে গিয়া জামা বদলাইয়া একটু সাজো আমি বলতেছি সব।

-বাবা কই?

-নিজের কাজে আছে তুমি যাও।

ছোট মা তাড়া দিয়েই নুপুরকে ভেতরে পাঠালেন৷ এই মেয়ে জন্মের ঘাড়ত্যাড়া একে কাঁধ থেকে নামানো মুশকিল সে কথা ভেবেই ছোট মার ঘাম ছোটে। নুপুর নিজের ঘরে ঢুকে পোশাক বদলে নেয় তবে ঘর থেকে আর বের হয় না। রাতে বাবা এলে কিছু একটা ঝামেলা সে পাকাবেই আজ। এ বাড়িতে সে ছোট মায়ের কিংবা ভাইয়ের ভাগের অন্ন গিলছে না তবে কেন ছোট মায়ের এত তাড়া তাকে বিদায় করার! নুপুর চুপ থাকার মেয়ে নয় সে। আজ বাবা বাড়ি এলেই একটা ঝামেলা পাকাবে বলে ঠিক করে নিলো। সন্ধ্যের আগ মুহূর্তে মেহমান বাড়ি ছাড়লে নুপুর ঘর থেকে বের হলো। পেট আজকাল খাওয়ার পরিমাণ হুট করেই যেন দ্বিগুণ করেছে তার। আগে ছিল রোগা-পাতলা খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম আর এখন তার পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তন মূলত মন থেকেই তৈরি৷ মন চায় নিজেকে সুন্দরী, সুহাসিনী তৈরি করতে সেজন্যই সবটা বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অবচেতন মন অপেক্ষা করে নিজেকে সুন্দর দেখার, অন্য একটা মানুষের চোখে সুন্দর দেখার। গায়ের রঙ বদলে নিতে ইচ্ছে করে নুপুরের খুব বেশিই আজকাল। বারংবার মনে হয় ওই মানুষটা অনেক সুন্দর, মানুষটার গায়ের রঙও সুন্দর৷ তার পাশে দাঁড়াতে গেলে নুপুরকে লাগবে আকাশ জুড়ে এক টুকরা কালো মেঘ৷ ছিহ! কি ভাবছে সে? লজ্জা লাগলো ভীষণ সে অর্নির ভাইকে এত গভীরে কেন ভাবছে!

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০৭

0

কোথাওহারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৭

দিনর আলো তখন নিভে গেছে। বসার ঘরটা হিম শীতল হয়ে আছে অনেকটা সময় ধরে। মাগরিবের আগ মুহূর্তে বাড়ি ছেড়েছে শিবলীরা। রায়না বেগম আদর আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখেননি শেষ পর্যন্ত। শিবলীর দাদী তাই মহাখুশি হয়ে নিজের গলার চেইনটা পরিয়ে দিয়েছিলেন অর্নিকে৷ এক কথায় বলা যায় হবু নাতবউয়ের স্বীকৃতি দিয়েছেন। আকস্মিক এ বাগদানে অর্নি ছাড়া কেউই চমকালো না। সকলেই যেন প্রস্তুত ছিল আজকের এই বাগদানের জন্য। অর্নিরও কি প্রস্তুত থাকার কথা না! অবশ্যই। অবশ্যই তার প্রস্তুত থাকার কথা ছিলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে কিন্তু তার মুখভঙ্গি বলছে অন্যকথা। সে মানসিক দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে আছে অনেকগুলো দিন ধরে। শিবলী ভাই মানুষ ভাল, দেখতে সুদর্শন, প্রতিষ্ঠিত। বয়সটা বেশি তাতেও সমস্যা নেই আমাদের দেশে দশ থেকে পনেরো বছরের পার্থক্যের সম্পর্কটাকেও স্বাভাবিক ভাবেই নেই আমাদের পরিবারগুলো৷ অর্নি ভেবে দেখলো তার মেজো খালামনি আর খালুর বয়সের পার্থক্যও অনকটা এমন তাই শিবলী ভাইয়ের জন্য তারটাও বাড়িতে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে। কিন্তু কোথাও তবুও একটা বাঁধা রয়ে গেছে। তার মন ঠিকঠাক উপভোগ করছে না এই আয়োজন। বসার ঘরে সোফায় একা বসে এসবই ভাবছে অর্নি। আনমনেই তার হাত চলে গেল গলায় থাকা চেইনটাতে। আলতো হাতে সেটা ধরে ভাবছে এতোটা তাড়া না থাকলে কি হতো না! অর্নির ভাবনার মাঝেই মূল দরজায় পা রাখলো রিদওয়ান। সেই যে দুপুরে বেরিয়েছিল ভেবেছিল ক’টা দিন সে আর ঘরমুখোই হবে না৷ অথচ যাওয়ার সময় হাতে ফোনটা ছাড়া কিছু না নেওয়ায় এখন আবার বাড়ি ফিরতে হলো তাকে। বাড়ি ছাড়তে গেলেও কিছু টাকার দরকার তাই ফিরে আসা। দরজায় ঢুকতেই সে দেখতে পেয়েছে সোফায় পিঠ হেলিয়ে বসে আছে অর্নি। পরক্ষণেই চোখে পড়লো তার হাতে থাকা সোনালি রঙের চকচকে বড় চেইনটা।বুকের ভেতর ধ্ক করে উঠলো মুহূর্তেই। গলায় চেইন পরেছে অর্নি! সে কি আগেও চেইন পরত নাকি আজকে তার হবু বর দিয়ে গেল! ছিহ কি লেইম ভাবনা ভাবছে সে! নিজের মনেই নিজেকে বকলো রিদওয়ান। এগিয়ে এসে সোফায় বসতেই অর্নির হুঁশ এলো। সে ফিরে তাকালো রিদওয়ানের দিকে।

-এক গ্লাস পানি দে তো অর্নি

-আচ্ছা

বসা থেকে উঠে অর্নি চলে গেল পানি আনতে৷ রিদওয়ান এক পলক দেখেছিল অর্নির মুখটা। সেজেছে মেয়েটা আজ তাই চোখের ওপর নিচ গাঢ় কাল হয়ে আছে৷ অর্নি পানির গ্লাস হাতে ফিরতেই রিদওয়ান প্রশ্ন করলো, ‘খালামনিরা চলে গেছে?’

-জ্বী

-বিয়ের তারিখ ফিক্সড হলো?

কথাটা জিজ্ঞেস করার সময় রিদওয়ান ভালো করে তাকালো অর্নির মুখে। জবাবটার সাথে অর্নির প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? অর্নি তার চোখে না তাকিয়ে জবাব দিল, না।

-ওহ!

অধৈর্য্য হলো রিদওয়ান এবার আরও কিছু জানতে। কিন্তু সামনের মানুষটার জবাবভঙ্গি পছন্দ হচ্ছে না বলে আর কিছু জানতে না চেয়ে বলল, আম্মু কোথায়, বলতো খাবার দিতে।

সন্ধ্যা মুহূর্ত ; রায়না বেগম নামাজে ছিলেন। দোয়া কালাম শেষে ঘর থেকে মাত্রই বেরিয়েছিলেন। দোতলার সিঁড়ি গোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখলন ছেলেকে। দুপুরে না খেয়ে কোথায় গিয়েছে রিদওয়ান তা তিনি জানেন না। কিন্তু কেন গেছে তা অজানা নয় একদমই৷ এ বাড়িতে রিমন আর রায়না বেগম রিদওয়ানের মনের অবস্থা পাই টু পাই সব জানেন৷ জেনে বুঝেও মুখের ওপর আঠার প্রলেপ লাগিয়ে রেখেছেন সুন্দর সংসারটার খাতিরে। রিদওয়ানের বাবা মানুষটা দুনিয়ার সামনে একজন মহৎপ্রাণ পুরুষ যার দুনিয়া কাজ আর সন্তানের মাঝেই সীমাবদ্ধ। অথচ রায়না বেগম জানেন এই মানুষটাই আবার স্বামী হিসেবে, সংসারের কর্তা হিসেবে ঠিক কতোটা রূঢ়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিচে নামলেন রায়না। অর্নি তাকে দেখে কিছু বলার আগে তিনিই বললন, অর্নি তুই ঘরে যা আমি খাবার দিচ্ছি রিদওয়ানকে।

অর্নি চলে যেতেই রিদওয়ানও সোফা ছেড়ে ডাইনিংয়ে গেল। রায়না বেগম খাবার সাজিয়ে চেয়ার টেনে বসে গেলেন ছেলের পাশে। রিদওয়ান মায়ের দিকে একদমই না তাকিয়ে খাওয়া শুরু করল।

-বিদেশে চলে যা না কোন এক কাজের বাহানায়।

-কত দিনের জন্য?

– যতদিন ইচ্ছা।

-বিয়ের তারিখ কবে?

-আপাতত হচ্ছে না।

মায়ের মুখে, আপাতত হচ্ছে না শুনে রিদয়ানের হাত থেমে গেল। চমক লাগল ক্ষণিকের জন্য আবার তা মিলিয়েও গেল মায়ের পরবর্তী কথায়, ‘ অর্নির শখ মেডিকেলে পড়ার৷ অর্ণব তাই এডমিশন পর্যন্ত সময় চেয়েছে।’

-যদি মেডিকেল চান্স পায়?

-চান্স পাওয়া বা না পাওয়া পরের বিষয়। তার আগে যেন চেষ্টায় ত্রুটি না আসে তাই আপাতত বিয়ে হবে না।

-ওহ!

পেটের খিদে মরে গেছে রিদয়ানের তবুও জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাতের খাবার শেষ করার। মাও পাশে বসে অসহায়ের মত দেখছে তাকে। এ দৃষ্টি থেকে পালাতে হবে তাকে খুব শিগ্রই। ক’টা দিন দূরে খুব দূরে থাকতে হবে তাকে যেন কেউ না বোঝে তার হৃদয়ের মরণদশা।

______________

রাঙা গৌধূলির রঙিন আলোয় শাড়ি জড়িয়ে ছবি তোলার ইচ্ছে হয়েছিল আজ। বিকেল নামতেই নুপুর শাড়ি পরে ছাদে উঠেছিল। বাড়ির সামনে পেছনে কোথাও একটু সুন্দর জায়গা নেই যেখানটায় বসে দুটো ছবি তোলা যায়। নতুন নতুন ফেসবুক একাউন্টে বিভিন্ন সব ছবি পোস্ট করতে তার দারুণ লাগে। কখনো তার নিজের কোন ছবি লাগায়নি তাই আজ শখ হয়েছে নিজের একটা ভাল ছবি তুলবে। সে ছবিতে চমৎকার কোন ক্যাপশন দিয়ে প্রোফাইল লাগাবে। শখটুকু পূরণ করতেই ছোট ভাইকে দিয়েই তুলিয়ে নিলো ছবি কয়েকটা। আজান পড়তেই সে ঘরে ঢুকে নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে ঢুকলো। নুপুরদের বাড়িতে রোজ রোজ চা হয় না কিন্তু আজ ভীষণ চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে নুপুরের। ছোট মা বোধহয় নিজের ঘরেই বসে কিছু করছে তাই সে আর কিছু না ভেবে চা বানালো সাথে নিলো দুটো টোস্ট। এ বাড়িতে সবচেয়ে বড় বারান্দাটা ছোট মায়ের কব্জায় তাই ছোট বারান্দাটা নুপুরের ভাগ্যে। বসার ঘরের সাথে লাগোয়া যে বাড়তি ঘরটা সভ্য ভাষায় গেস্টরুম সেটার বারান্দাটাও অনেক বড় কিন্তু ছোট মা তাকে দেননি সে ঘর। বাবা বলার পরও ছোট মা বলেছিলেন, ‘একা মাইয়া এক ঘরে থাকব তাও আবার বারিন্দার লগেই দেয়ালের পরে রাস্তা। বয়স হইতাছে পোলারা খোঁজ পাইলে মাইয়া খারাপ করব।’

মন খারাপ করতে নেই এমনটাই ভাবে নুপুর। প্রিয় বান্ধবী অর্নিকে সে লক্ষ্য করে সবসময়৷ ছোট বেলায় পাওয়া কিছু আঘাত তাকে বাকরুদ্ধই করে দিয়েছে প্রায়। মেয়েটা হাসে না, প্রয়োজনের বাইরে কথা বলে না৷ জীবন এত তিক্ত তার কাছে নুপুরের মাঝেমধ্যে মনে হয় অর্নির বোধহয় বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে হয় না। আর তার ভাই…… ভাবনায় লাগাম টানা দরকার নুপুরের। সে চা আর বিস্কিটের বাটি নিয়ে চলে এলো নিজের ঘরে। নিজেরই ছোট্ট বারান্দায় বসে গরম চায়ে চুমুক দিলো। এ সপ্তাহে পড়া আছে অনেকগুলো যা আগে থেকে না পড়লে ভাল রেজাল্ট হবে না৷ অর্নি ডাক্তারি পড়তে চায় তাই তার পড়াশোনার হিসব আলাদা। নুপুর তো ভাবছে কোনমতে অনার্স করে একটা চাকরি পেলেই হলো। আর সাথে চমৎকার জীবনসঙ্গী স্বচ্ছল হলেই হলো প্রয়োজনে সে লক্ষী মন্ত বউটি হয়ে সংসার করবে।

___________

সারাদিনের কাজকর্ম আর খালার বাড়িতে যাওয়ার দরুণ অর্ণবের আজ গোসল হয়নি৷ রাতে বাইক নিয়ে বাড়ি ফিরতেই হঠাৎ কেউ একজন তার পিছু নিয়েছে। প্রথমটায় সে বুঝতে পারেনি পেছনে একজন বাইকার তার সাথেই পথ বদলাচ্ছে। ব্যাপারটা চোখে পড়েছে গলির মোড়ে বাইকারের গায়ের রঙচটা শার্টটা দেখে। বাড়ি ফেরার আগ মুহূর্তে অর্ণব ঔষধের দোকানে ঢুকেছিল জ্বরের ঔষধের জন্য তখন লোকটা ঠিক রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিল বাইকের পাশে। রঙচটা শার্ট বলেই হয়ত তখন রাস্তার আলোয় চোখে লেগেছিল আর এখনও ঠক তাই। মনের ভেতর খচখচানি লেগে রইলো বাড়ির ভেতর ঢোকার পরও। কে নিলো পিছু আর কেনইবা! তবে পেছনে যেই থাকুক না কেন তাকে আঘাত করতে নয় শুধুই নজরে রাখতে নিয়েছে। নইলে মোড় পেরিয়ে বাড়ির রাস্তায় শুনশান ছিল জায়গাটা। বাইকের গতিও ছিল শ্লথ সে অবস্থায় চাইলেই তাকে আঘাত করা সহজ হতো।

– দাদাভাই ভাত খাবি না?

নিচ থেকে দাদীর গলা ভেসে এলো। ভবনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে প্রস্তুতি নিলো রাতের খাবার খাওয়ার। সেই সাথে ভাবছে দাদীকে কিভাবে কি বলবে। আজ সকালে খুব করে ধরেছিলো দাদী তাকে অর্নির বিয়েটা যেন ক্যান্সেল করে। কেন যেন দাদী তার শিবলী ভাইকে একদমই পছন্দ করেন না। এ নিয়েও আলাদা এক চিন্তা আছে মনের ভেতর। রাতের খাবার খাওয়া হলো দাদীর ঘরে বসে। টুকটাক গল্প জুড়লো দাদী নাতি মিলে সঙ্গী তাদের রুজিনা খালাও ছিল। এ বাড়িতে মূল সদস্য তারা তিনজনই৷ মাসে দু চারদিনের জন্য শুধু দেখা মিলে অর্নির আবার কখনো কখনো দু মাসেও আসা হয় না তার। দাদী অবশ্য অনেকবার বলছেন অর্নিকে বাড়িতে থাকতে বল। সোমত্ত মাইয়া বড় বড় পোলা আছে ওই বাড়ি রাখা খারাপ দেখায়।
অর্ণব কানে তোলেনি সে কথা। তার ধারণা এখানে এলে সে একাকীত্বে ভুগব। এমনিতেই সে আত্মকেন্দ্রিক তাই ও বাড়ি বৃষ্টি আর খালামনির সঙ্গ তার জন্য বেশি প্রয়োজন৷ আর তাছাড়া সেই কতটুকু বয়স থেকে খালার ছত্রছায়ায় আছে মা না হয়েও তার মায়ের জায়গাটা ওখানেই। খাওয়ার পাট চুকিয়ে দাদীকে ঘুমুতে বলে অর্ণব চলে গেল নিজের ঘরে৷ মাথায় জটলা বেঁধে আছে হাজারো চিন্তা এখন ঘুম চোখে কিছুতেই ধরা দেবে না। পকেট হাতড়ে সিগারেট আর লাইটার বের করল৷ তার ঘরের বারান্দাটা অনেক বড়, সামনে অনেকটা খোলা জায়গা হওয়ায় আলো-বাতাসের কমতি খুব একটা হয় না বললেই চলে। সিগারেট একটা জ্বালিয়ে নিয়ে মুখে পুরতেই একটা মেসেজ এলো৷ ফোন তুলে মেসেজ দেখতেই কুঁচকে এলো ভ্রুর মধ্যভাগ।

‘ রাত গাঢ় হলে অন্তরের হাওয়ায় রিমঝিম এক ছন্দ বাজে৷ এমন ছন্দ আগে কখনো বাজতো না৷ যেদিন দেখলো এক জল্লাদ মুখশ্রী সেদিনই হলো সর্বনাশটা আ….’

শেষের শব্দটা অসম্পূর্ণ রেখেই সমাপ্ত হলো মেসেজটা। নম্বরটা চেনা বলে বুঝতে সমস্যা হলো না কে পাঠিয়েছে এই শব্দতরঙ্গ। কয়েক মুহূর্ত অর্ণব ডুবে রইলো এই শব্দমালার অর্থ খুঁজতে। তাতেই যেন স্বস্তি মিলল বৈষয়িক, আর্থিক সকল টানাপোড়েনের অসুস্থতা থেকে।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০৬

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৬

জৈষ্ঠ্যের শেষ সপ্তাহ চলছে৷ সূর্যের তেজ যেন ভষ্ম করতে চায় প্রকৃতির প্রতিটি কোমল প্রাণকে। অর্থের প্রতাপে প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চ পর্যায়ের মানুষজন আরামের সু ব্যবস্থা করতে পারলেও মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের জন্য তা অধরা শুয়ে শুয়ে এসব নিয়েই ভাবছিলো নুপুর। তাদের বাড়িতে ছাদ উঠলেও এয়ার কন্ডিশন অবধি এখনো পৌঁছুতে পারেনি। আজ ছুটির দিন হওয়ায় ভেবে রেখেছিল সকালটা সে ঘুমিয়ে কাটাবে। কিন্তু লোডশেডিংয়ের বেয়াড়াপনা শান্তি দিলো না কিছুতেই৷ পূর্ব দিকের জানালার কপাট খোলা বলেই রোদের হলকা এসে পড়ছে তার শ্যামল বরণ মুখটাতে। আর তাতেই ছুটে পালিয়েছে সাধের ঘুম, ভাবতে বসেছে এয়ারকন্ডিশন নিয়ে। অস্বস্তি নিয়ে বিছানা ছাড়ল। ঘড়িতে চোখ রেখে তড়িঘড়ি পায়ে বাথরুমের দিকে ছুটলো এবার । হঠাৎ করেই মনে পড়লো আজও তার টিউশনি আছে একটা৷ বাড়ি গিয়ে পড়ানোর হ্যাপা অনেক৷ টাকার পরিমাণ যত বেশি, যন্ত্রণাও ঠিক ততো বেশি৷ তড়িঘড়ি মুখ হাত ধুয়ে নাশতার জন্য রান্নাঘরের কাছে গেল নুপুর। বাইরে থেকেই কানে এলো জাকির ভাইয়ের গলা। তারমানে আজ আবার এসেছে বদমাশটা নিশ্চয়ই কোন বুদ্ধি নিয়ে উহু, কুবুদ্ধি নিয়ে ৷ টিউশনির তাড়ায় যতটা না খাওয়ার রুচি ছিল ঠিক ততোটাই অরুচি ধরে গেল শয়তানটার গলা শুনে। নুপুর আর নাশতার জন্য এগোলো না। ঘরে গিয়ে পার্স আর ফোন নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। টিউশনিতে স্কুটি নেওয়ার কথা ভাবতেই মনে পড়লো এ ছাত্রের বাড়ি রাস্তার পাশেই৷ সাবধানে রাখা মুশকিল তাই আপাতত স্কুটি ফেলে রিকশা ধরতে হবে। মনে মনে বিরক্তও হলো, কেন যে স্কুটি কিনলো! গলির মোড়েই রিকশা পাওয়া গেল তাই পৌঁছুতে বেশি সময় লাগেনি। দেড়টা ঘন্টা ছাত্র পড়িয়ে খিদেয় পেটের অবস্থা খারাপ। এদিকে ছাত্রের মাও ভদ্রতা সরূপ কোন নাশতা দেননি৷ তার সকল স্টুডেন্টের মাঝে একমাত্র এই একজন অভিভাবক যিনি কখনো এক গ্লাস পানিও সেধে দেন না। নুপুরও আর আক্ষেপ না রেখে বের হলো পড়ানো শেষে। পেটে খিদে, পার্সেও আছে টাকা আর জাকির ভাইয়ের উপস্থিতি বলেই হয়ত তার মন টানলো না বাড়িতে যাওয়ার জন্য। অনেক ভেবে ঠিক করলো কলেজ রোডের পাশেই কিছু ক্যাফে আছে সেখানে বসবে। একা একা বসতে ভালো লাগে না তবুও সময় কাটাতে এর চেয়ে ভাল উপায় নেই। নুপুর জানে আজ অর্নির খালারা আসবে বিয়ের আলোচনা করতে তাই অর্নিকেও সে ডাকতে পারবে না। দু চার কথা ভাবতে ভাবতেই নুপুর এসে পৌঁছুলো কলেজের সামনে। ডানে-বামে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো পরিবেশ৷ ছুটির দিন বলেই কিনা কে জানে আজ ক্যাফেগুলো মানুষজনে ভরে আছে। কই কলেজ খোলা সময়ে তো এত মানুষ চোখে পড়ে না! এতক্ষণ ধরে খিদের যে তান্ডব ছিল হঠাৎ করেই যেন তা মিলিয়ে গেল৷ নাকি অত মানুষের ভীড় দেখে? একা একা ক্যাফেতে বসে খাওয়ার অভিজ্ঞতা আজ অব্দি হয়নি তার। সবসময়ই অর্নিকে নিয়ে তবেই এসেছে। দোনোমোনো করছিলো নুপুর ক্যাফের ভেতর ঢুকবে কিনা ঠিক তখনই চোখ আটকে গেল একটু দূরে অন্য এক ক্যাফের দরজায়৷ সোনালি রোদের তীব্র আলোয় শুভ্ররঙা শার্টটা যেন ঝলসে দিলো চোখ৷ চোখ, কপাল কুঁচকে ফেলে দেখতে দেখতে মিলয়ে গেল মানুষটা। মাথার ওড়নাখানা টেনেটুনে নুপুরও এগোলো সেই ক্যাফেতে। ভেতরে ঢুকে এক মুহূর্তে খুঁজে নিলো মানুষটার অবস্থান। ক্যাফের একদম শেষের সাড়িতে বসে আছে অর্ণব। অর্ণবকে দেখেই এসেছে নুপুর এই ক্যাফেতে। নিজে এবার জায়গা খুঁজে নিলো নিজের জন্য প্রথম সাড়ির এক টেবিলে। দু জনের অবস্থান একে অপরের বিপরীত। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই অর্ণবের সাথে আর দু’জন যুক্ত হয়েছে। নুুপুর বুঝলো কাজের জন্যই অর্ণবের আসা। ততক্ষণে ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গেল নুপুরের। কফি, চিকেন শর্মা আর ডবল লেয়ারের চিকেন স্যান্ডউইচ অর্ডার করে আয়েশি ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো দূরের মানব গোঁফওয়ালা জল্লাদের দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো ওই মানুষটার চোখ, মুখ, নাক আর কণ্ঠমণি৷ এত তীক্ষ্ণ সে কণ্ঠমণি যা কয়েক হাত দূরত্বেও দাম্ভিকতার সাথে স্পষ্ট হয়ে আছে৷ আচমকাই চোখ বুঁজে নেয় নুপুর৷ কানের কাছে ভ্রমরের গুণগুণ, বুকের ভেতর ডামাডোল এ সবটাই হয় শুধু ওই একটি মাত্র পুরুষকে দেখলেই। আনমনে তাকিয়ে থাকে অর্ণবের দিকে৷ ওয়েটার তার অর্ডারকৃত খাবার টেবিলে রাখার পরও যখন সে খেয়াল করলো না তখন ওয়েটার ছেলেটি টেবিলে আঙ্গুল চালিয়ে শব্দ করল, ‘আপনার খাবার।’

-ওহ!

ছেলেটি চলে যেতেই নুপুর খাবারের দিকে দৃষ্টি দিলো আর তাতেই হলো সর্বনাশ।

-আল্লাহ! এত্তো খাবার?
নুপুরের আর্তনাদ ক্যাফেতে উপস্থিত প্রায় সকলেরই কানে গেল৷ প্রত্যেকেই কেমন অবাক চোখে তার দিকে তাকালো। তাকালো শেষের দিকে বসা অর্ণব আর তার সঙ্গীরাও৷ হঠাৎ দেখায় অর্ণব চিনতে পারলো না মেয়েটিকে। বার দুয়েক তাকাতেই ধরে ফেলল মেয়েটি নুপুর৷ বেশ বুঝতে পারলো পোশাকের জন্যই প্রথমে চেনেনি৷ নুপুরকে সে সবসময়ই কলেজের পোশাকে, দু বেনী করা, মাথাটা বরাবরই খোলা থাকে এমন অবস্থায় দেখেছে। কিন্তু আজ একদম ভিন্ন বরং আগের চেয়ে বড়ই লাগছে ভীষণ৷ সুতির সেলোয়ার-কামিজ পরা, হিজাব না করলেও ওড়না দিয়ে মাথার প্রায় অধিকাংশই ঢাকা৷ কে বলবে এই মেয়ে কলেজে পড়ে! দেখতে তো বিবাহোপযোগী কুঁড়ির ছুড়ি লাগছে। একেবারে ভিন্নরূপ কিন্তু পথে ঘাটে সব জায়গাতেই কি পাগলামি করে নাকি! এমনটাই ভেবে অর্ণব মনে মনে বলল, ছিটিয়াল একটা!

অর্ণব এসেছিল তার উকিলের সাথে জমির কিছু কাগজপত্র হাতে পেয়েছে সেগুলো দেখাতে । উকিল সাহেব সময় মিলিয়ে উঠতে পারছিলেন না তাই আজ হুট করেই বাইরে ডাকলেন। সকালের নাশতাটা ঠিকঠাক করা হয়নি বলে অর্ণবই ক্যাফেতে বসার ইচ্ছে জানিয়ে এখানে এসেছে৷ কিছু সময় নুপুরের দিকে তাকিয়ে থেকে পুনরায় কাজের কথায় ফিরল সে, ‘আঙ্কেল এই কাগজগুলো বাড়ির জমির । এগুলো দিয়ে হয়ে যাবে না?’

-দেখো অর্ণব অলরেডি কোম্পানির লোন ডিটেইলে সাবমিট করা হয়েছে একবার । সময়মত নোটশ পেলেই তোমাকে দলিলপত্র হ্যান্ডওভার করতে হবে সেইসাথে টাকা তোমার হবে। এখন নতুন করে যদি বাড়ির কাগজপত্র সাবমিট করো সেক্ষেত্রে হোম লোন আসবে তাতেও পরিমাণ অনেক কম এমনকি সময়ও পুনরায় দীর্ঘ হবে।

উকিল সাহেব নিজের কথা শেষ করতেই উনার এসিস্ট্যান্ট বলে উঠলেন, স্যার এ কাগজ তো কপি। এটাও অরিজিনাল না।

অর্ণব অবাক হলো৷ ছোট দাদী নিজে এগুলো পুরনো লকার থেকে বের করে দিয়েছেন৷ বছর কয়েক আগেই দাদা কাগজপত্র গুলো ব্যাংক লকার থেকে তুলে বাড়ি নিয়েছিলেন। এরপর দাদার মৃত্যুর জন্য পুনরায় এগুলোর সুরক্ষা ব্যবস্থা দাদীই নিজের কাছেই করেছেন।

-এগুলো অরিজিনাল না! কিন্তু সব দাগ, নং তো…..

– সব একই থাকে কপি বলে কথা।

উকিল সাহেব আরও বিস্তারিত বলে বোঝালেন অর্ণবকে। কাগজটা সত্যিই নকল ছিল তা বুঝে আবারও হতাশ হলো সে৷ এটা ছোট দাদার সম্পত্তির কাগজ৷ লোনের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না কিছুতেই৷ কোম্পানি লোন যতদিনে পাশ হবে ততদিনে বেশ পিছিয়ে যাবে তার কাজ। বাড়িতে রোজই দাদীর সাথে সময় কাটিয়ে টুকটাক শেয়ার করে তার কাজের কথা। সেই সুবাদেই দাদী জানে অর্ণব জমির কাগজপত্র জমা দিলে ব্যাংক তাকে টাকা দেবে৷ তাই তিনি নিজেই এসব কাগজপত্র বের করে দিয়েছেন৷ কিন্তু এখানেও যে গলদ লেগেছে শুরর পথেই! আর ভাবতে পারছে না সে কিছু তাই উকিলের সাথে মিটিং সমাপ্তি টানলো৷ উকিল সাহেব৷ আগেই বেরিয়ে গেলেন৷ বিল মিটিয়ে অর্ণবও বের হওয়ার মুখে নুপুর তখনো নিজ টেবিলে নাশতা করছে। কফি আর স্যান্ডউইচটা তখনো অস্পর্শ্য তার। ‘মেয়েটার মাথায় বোধহয় বুদ্ধির ব’টাও নেই’ কথাটা অর্ণব বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেল ক্যাফে থেকে। নুপুরও আর বসতে চাইলো না বলে ওয়েটারকে ডেকে কফিটা খেয়ে স্যান্ডউইচটা ভাইয়ের জন্য নিলো।
___________

আগুনে তেতে সকাল সকাল রান্না করছেন রায়না বেগম। মেজো বোনটা আসবে আজ শ্বাশুড়ি, ননদ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে৷ অর্নি হলো ময়নার মেয়ে কিন্তু ছোট্ট থেকে নিজের হাতে বড় করেছেন মেয়ের মত৷ তাই তার বিয়ের সকল আলাপ -আয়োজনটা তিনি জাঁকজমকপূর্ণ করবেন বলে ঠিক করেছেন৷ মেহমানদারির সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সকাল থেকে তিনি রান্নাঘরে। বৃষ্টি আর কাজের একজন মেয়েকে দিয়েছেন ঘরদোর ঝকঝকে করার দায়িত্ব আর অর্নি! সকাল থেকে বসিয়ে দিয়েছেন রূপচর্চা করতে। সল্পভাষী, খুব সাধারণ অর্নি পড়েছে বিরাট যন্ত্রণায়৷ শ্বাসকষ্ট না হয় আবার এই সৌন্দর্যচর্চা করতে গিয়ে । ভয়ে ভয়ে সে খালামনিকে বলেছে, রূপচর্চা করতে হবে না অসুস্থ হয়ে যাব। খালামনি তাই আরও সহজ পথ বলে দিলো, তবে পার্লারেই চলে যা হালকা একটা মেকআপ করে শাড়ি পরে আসিস।
অর্নি বুঝলো খালামনির উত্তেজনা ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু তার পক্ষেও অত সাজগোছ সম্ভব নয়। উপায় না পেয়ে রূপচর্চা করবে বলেই সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু এমন কি জিনিস আছে যা অল্প সময়েই উজ্জ্বল করবে! বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পেলো, তোর তো গায়ের রং ফর্সাই না লাগালেও হয়। আচ্ছা থাক ডিম কিংবা দইয়ের কোন প্যাক লাগিয়ে নে। অর্নির পছন্দ হলো না এই সমাধান৷ আরেকটু ভেবে মাথায় এলো বান্ধবীর কথা। নুপুর আজকাল নিজের ত্বকের যত্ন করে খুব। তাকেই সে কল করে জানতে চাইলো কি করা যায়?

– কফি কিংবা মুলতানি মাটি লাগা দশ মিনিটের জন্য দারুণ গ্লো পাবি ত্বকে।

অর্নি তাই করল। নুপুরের কথামত কফি পাউডারেই দশ মিনিটের চর্চা শেষে গোসলে ঢুকে গেল। দুপুর হতেই বাড়ি হয়ে উঠলো সরগরম। মেজো খালা আর তার পরিবার এসে পৌঁছুতেই রিমনের কপাল কুঁচকালো। ছুটির দিন তার কাটে বন্ধু-বান্ধব আর প্রেমিকার সঙ্গে সে ছেলে আজ সকাল থেকে বাড়ির ভেতর ঘাপটি মেরেছিল। ভেবেছিল শিবলী ভাই আজ আসবেই না আর তা নিয়ে খুব হাঙ্গামা হবে। মা-খালাতে লড়াইও হতে পারে সেই লড়াইয়ে রেফারি হওয়ার চমৎকার একটা চান্সও আসতে পারে। বিধবাম! এখানে তো সম্পূর্ণ সিনই বদলে গেছে। দুই দুইটা গাড়ি করে শিবলী ভাই এসেছে। সাথে এসেছে মেজো খালা, খালু, খালার শ্বাশুড়ি, ননদ, জা এমনকি তাদের বাড়ির কাজের মেয়েটিও চলে এসেছে। রিদওয়ানও বুঝি রিমনের মত তেমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিল৷ তাইতো হাস্যজ্বল শিবলীকে দেখতেই তার মেজাজ চড়ল। বসার ঘরে মিনিট পাঁচেকে কুশল শেষে বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে। আজ আর ফিরবে না সে এ বাড়িতে। বহুদিন সে নিরুদ্দেশ হয় না আজ হলে মন্দ কি! প্রকৃতি টানে তাকে খুব করে অথচ পার্থিব সব নিয়মনীতির ঘেরে আটকে পড়তে হয় রোজ রোজ। আম্মুর মুখের হাসি তাকে প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করার শক্তি দিলেও আজ শক্তিতে টান পড়ছে খুব৷ রিদওয়ান সত্যিই বেরিয়ে পড়লো গন্তব্যহীন। বাড়ির সকলে ব্যস্ত হলো আপ্যায়নের কাজে। অর্ণব এখনো এসে পৌছায়নি খান বাড়িতে তাই আপাতত কথাবার্তা তোলার আগ্রহ কেউই দেখাচ্ছে না। শায়নার নিজের বোনের বাড়ি তবুও সে আজ এসেই কেমন ফরমাল আচরণ দিচ্ছে সবাইকে। বৃষ্টি অনেকক্ষণ ধরেই বিষয়টা লক্ষ্য করেছিল৷ ভালো লাগলো না এমনটা তাই সে মুখের ওপরই বলে বসল, ‘এখনো তো ছেলের বিয়ে দাওনি খালামনি এখনই কন শ্বাশুড়ি শ্বাশুড়ি রিয়াকশন দিচ্ছো?’

রান্নাঘরে বড় বোনের সদ্য বানানো জালি কাবাবের বাটি খানা হাতে তুলতেই বৃষ্টির কথায় থমকে গেলেন শায়না বেগম। ভাগ্নির কথার অর্থ তিনি পছন্দ না করলেও কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। আজকে থেকে অর্নি হবে তার ছেলের অফশিয়ালি হবু বউ। আর আজকে থেকেই তনি অফশিয়ালি হবু শ্বাশুড়ি। তার বিয়ের পর শ্বাশুড়ি মায়ের আচরণগুলো যেমন ছিল সেও ঠিক তেমনই হতে চায়। ভাগ্নির কথাটাতে পাত্তা দিতে চান না তিনি তবে মারমুখো স্বভাবের এই ভাগ্নিটার জন্যও কায়মনোবাক্যে এমন কিছুই আশা করেন। সকাল -বিকাল কথার চালে ধুতে থকবে এমন একটা শ্বাশুড়ি জুটুক৷ কায়দা করে বলেও ফেললেন, ‘বড় আপা বৃষ্টির বিয়ে নিয়ে কি ভাবলে বলো তো! বিয়ে হলে একটুখানি কথার আনন্দ টের পেত সে। ‘

-আমার বিয়েতে এখনো অনেক দেরি খালামনি৷ আমার বরের শিবলী ভাইয়ের মত অত তাড়া নেই।

-তোর বর মানে!

– ‘মানে… মানে হবু বর’ কথাটা বলেই বৃষ্টি বোকার মত শব্দ করে হাসলো। মুখ ফসকে যা ইচ্ছে বলার এই এক জ্বালা। মন তো সেই কবেই বর খুঁজে নিয়েছে বাড়ির মানুষ তো আর তা জানে না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে সে আরও কিছু না বলেই ফেলে সে ভয়ে দ্রুত রান্নাঘরের সামনে থেকে চলে গেল। বৃষ্টির প্রস্থান স্বস্তি দিলো রায়না বেগমকে৷ মেয়েটা আজকাল বাপের মত কথা বলে। যখন তখন যে কাউকে অপমানও করে বসে এই নিয়েই যত ভয় আজ নয় কাল বিয়ে দিতে হবে লোকজন আসবে, মেয়ে দেখবে। মেয়ে যদি চ্যাটাল চ্যাটাং কথা বলে তাহলে কি ভাল ঘরে বিয়ে দেয়া যাবে?

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০৫

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৫

রাতভর ঘুম নামেনি দু চোখের পাতায় কখনো এ পাশ কখনো ওপাশ করে রাত কেটে গেল অর্ণবের। সকাল সকাল হাঁটতে বেরিয়ে বাজার করলো কিছু৷ ব্যাগ ভর্তি সবজি আর মাছ এনে সে ডেকে তুলল দাদীকে। ফজর পড়ে ঘুমিয়ে পড়া দাদীর নিত্য নিয়ম। এদিকে রক্তের চিনির মাত্রার আধিক্য তাঁকে দিনকে দিন কাবু করছে চরমভাবে। হাঁটাচলা মুশকিল বলে নিয়ম করে দু বেলা ইনসুলিন তার আসল ঔষধে পরিণত হয়েছে। দাদীর ঘুম ভাঙিয়ে উঠোনের এক কোণে এনে বসিয়ে দিল চেয়ার পেতে। রুজিনা খালাও ততক্ষণে মাছ কাটার প্রস্তুতি নিয়েছেন।

-কি কি মাছ আনলি ভাই?

– তুমিই দেখো কি কি আছে বলেই অর্ণব মাছের ব্যাগ উপুড় করলো বড় এক ঝুড়িতে।

-ওমা! এত বড় চিতল মাছ! আর ওইগুলান কি?

ছোট ছোট পাঁচমিশালি মাছ দেখালেন ছোটদাদী।

-আমি তো সবগুলার নাম জানি না তুমি দেখে বলো তো!

অর্ণব মিটিমিটি হেসে দাদীকে বলল। দাদীও খুব মন দিয়ে দেখলেন। গ্রামের মানুষ তিনি সেই ছোট থেকেই মাছ ধরা, কাটা-বাছা সবই জানেন।চোখের দৃষ্টি এখনো যথেষ্ট থাকায় সময় লাগল না চিনতে। তিনিই একে একে বললেন, ট্যাংরা, বেলে, বাইন, ছোট টাকি আর কিছু ছোট চিংড়ি। দাদী অবশ্য নামগুলো বলল সব আঞ্চলিক ভাষায়৷ তাই চিংড়ির নাম ইছা মাছ শুনে অবাক হলো খুব। এর আগে হয়ত কখনো মাছ নিয় অত মাথা ঘামায়নি বলে জানে না অথবা ছোট থেকে ঘরের ঘরণী মা মানুষটা ছিল না বলেই অনেক কিছু জানা নেই তার। যে ঘরের কত্রী না থাকে সে ঘরের বাচ্চারা এর চেয়েও সাধারণ অনেক কিছুই জানতে পারে না। মন খারাপ হয় না অর্ণবের তবে ভাবুক হয় সে এমন ছোট বড় অনেক কিছু জানতে পেরে। রুজিনা খালার মাছ কাটার এখনো অনেক বাকি। নাশতার আয়োজনে বেশ ঢিল হবে বোঝা যাচ্ছে। এদিকে বাড়িতে আজ অনেকগুলো মানুষ তাই নাশতার জন্য সহজ কোন ব্যবস্থা করা দরকার। দাদীর কাছে অনুমতি নিয়ে অর্ণব আবার বের হলো৷ অর্নি যাবে কলেজে, রিমন, রিদওয়ান আর খালু যাবে অফিসে তাই তাদের নাশতা পরোটা, সবজি আর ডিমের ব্যবস্থা করলো। দাদী শক্ত খাবার খুব একটা খান না বলেই ঘরে থাকে পাউরুটি, দুধ আর কলার ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে তাই নিশ্চিত থাকা গেল৷ সকাল আটটার আগেই নাশতার আয়োজন সম্পন্ন হলো সেই সাথে ঘটল সকলের ঘুমের সমাপ্তি৷ নয়টার মধ্যেই পুরুষেরা সকলে চলে গেল নিজ নিজ গন্তব্যে।

অর্নির মধ্যে তাড়া নেই কলেজে যাওয়ার অথচ ভাইয়া বলে গেল, তোর বান্ধবীকে ট্রিট দিয়ে দিস। হাতে গুঁজে দিয়েছিল হাজার টাকার একটা নোট। রাতে ভাইয়ার সাথে কিছুটা মনোমালিন্য থাকায় ভাইয়া তাকে কিছু কথা বলেছে, কিছু বিষয় খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছে। অর্নি বুদ্ধিমতী তাই অল্প কথাতেই বুঝতে পেরেছে কিন্তু ট্রিট দেয়াটা কি নুপুরের জন্য প্রশ্রয় হয়ে যাচ্ছে না! ভাইয়ের কথার সারমর্ম কালই টের পেয়েছে অর্নি৷ নুপুর তার ভাইয়াকে খুব পছন্দ করে এজন্যই বোধবয় সামনাসামনি পড়লে লজ্জাতেই পালায়। অর্নির মন ভালো হয়ে যায় ভাইয়ার কথা ভাবতে গিয়ে। কচ্ছপ গতিতে তৈরি হয় কলেজে যাবার জন্য। বৃষ্টি আপু আজ ইউনিভার্সিটিতে যাবে না বলে এ বাড়িতেই থাকবে খালার সাথে। দুপুর, রাত খাওয়া শেষে পরেই ফিরবে সবাই রিদওয়ান ভাইদের বাড়ি।
______

রাতভর ঘুমের আভাস মাত্র ছিল না দুটি চোখে নুপুরের৷ কাল সন্ধ্যায় এক ঝাঁক বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ছাদে বসে কেক কেটেছে, চকলেট বিলিয়েছে তারপরই বাচ্চাদের নিয়ে কিছু চাপার জোর প্রমাণ করে বেলুন ফুলিয়ে একসঙ্গে সব ফুটো করেছে। বেলুন ফাটানোর ফটাস ফটাস শব্দে নুপুরের সৎ মা কয়েকদফা ধমকেও গেছেন তাকে। মহিলা তাকে সব সময় বকেন না তবে মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলে নাক-মুখ কুঁচকে দু কথা শোনাতে ছাড়েন না। ইদানীং আবার মাথায় ঢুকেছে বিয়ের পীড়া তাই একটু বেশিই রুক্ষ আচরণ করেন৷ কে বা কারা খুঁচিয়ে গেছেন এই বলে, ‘নুপুরের যে গায়ের রঙ দাম থাকতেই বিয়ে দাও৷ নইলে বাড়িঘর বেঁচেও তাকে পার করতে পারবে না।’

এ কথা শোনার পর থেকেই মহিলা কারণে অকারণে ক্ষেপে উঠেন৷ নুপুর একটুও কষ্ট পায় না এ নিয়ে। তাই কালকের বকাঝকাও কানে না তুলে হল্লা করেছে রাত আটটা পর্যন্ত। এরপর বাচ্চাগুলোকে বিদায় দিয়ে অনেক রাত অবধি বসে ছিল ছাদে। কালো আকাশ, ঝিরিঝিরি বাতাস আর বাতাসে বকুলের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে ভেবেছে অর্ণবকে নিয়ে। বহুদিন পর ফাঁকা হৃদয়ে এক ঝাঁক শঙ্খচিলের ডানা মেলা দিন এসেছে অর্ণবকে দেখে। ফরফরানি আওয়াজ তোলা প্রজাপতির মত নুপুরের বুকেও বাজে ধড়ফড়ানি আওয়াজ। কল্পনায় বিভোর হয়ে অনেকটা রাত কাটিয়ে যখন ঘরে ঢুকলো তখন পেল অর্নির ফোনকল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এসেছিল চমৎকার একটি বাক্য, ‘তুই কি ভাইয়াকে পছন্দ করিস?’

বান্ধবীর এমন প্রশ্নে রক্তিম হলো নুপুরের গাল। মনে মনে লজ্জায় নুইয়ে পড়ললেও বান্ধবীর সামনে ঠাট রেখে বলল, ‘ধ্যাত কি বলিস এগুলা? ওরকম ভিলেন সুরত কেউ পছন্দ করে নাকি!

মুখের কথায় মনের কথার মিল কোথাও নেই। অর্নি আবার জানতে চাইলো, গিফট যে দিলি….

-ওরে গাধী, তুই আমার বান্ধবী তোর ভাইয়ার জন্মদিন ভাবলাম হয়ত দাওয়াত করবি না মানে গিফট দেখে হয়ত করবি৷ কিন্তু কি বলতো আমার মন্দ কপাল দাওয়াত তো পেলামই না উল্টো ঝাড়ফুঁক দিয়ে দিলো জল্লাদটা।

শেষের বাক্যটা বিড়বিড়িয়ে বলেই প্রসঙ্গ বদলে ফেলল নুপুর। অর্নি এমনিতেও খুব একটা ঘাটে না তাকে। দু বান্ধবী আরও কিছু গল্প শেষে ফোন রাখলেও নুপুরের চোখে ঘুমের দেবীর দেখা মেলে না। তার ফলস্বরূপ সকালের ঘুম ভাঙলো অতি বিলম্বে। এই দের দুরস্ত ঘুমের দরুণ নাশতা বিনা কলেজে এসে পৌঁছুলো সে। টানা তিনটে ক্লাসের পর ক্যান্টিনে এলো নুপুর, অর্নি৷

_______

দিনরাত পরিশ্রম; বাক্যটা পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে অর্ণবের জীবনে। ছোটখাটো একটা ব্যবসা ছিল বাবার সময়ে। সে ব্যবসা অনেকগুলো বছর ছোট দাদা নজের মত করে আগলে রেখেছেন শুধুই প্রয়োজনের খাতিরে৷ তাতে লাভ থাকলে অধিক লাভ শব্দটা জায়গা নেয়নি৷ নেওয়ার সুযোগও ছিলো না। তিনি নিজের কারবারও করতেন বলে মোটামুটি লাভের ওপর টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন সময় বদলেছে, বদলেছে উত্তরসূরী আর তার চিন্তাধারা৷ অর্ণব ব্যবসাটাকে বড় করতে চায় আর তার জন্য মূলধনের পরিমাণটাও হবে বড়। লোন ছাড়া সে ব্যবস্থা তার নেই এদিকে লোনের জন্য তার জমিজিরাতের কাগজপত্রেরও দরকার আছে৷ আজ সকাল সকাল অফিসে এসে প্রথম মিটিং ছিল উকিল সাহেবের সাথে। বড় খালুর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা, নিজস্ব উকিলও আছে। অর্ণবের সহায়তার জন্য তাই খালুই এগিয়ে আছেন৷ লাখ পঞ্চাশের লোনের জন্য বড়রকম একটা সম্পত্তির প্রমাণ দিতে হবে ব্যাংককে। আর সেই প্রমাণ হলো কারখানার জায়গার দলিলপত্র। অর্ণব নিজেও ভেবেছে এভাবেই লোন নেবে কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো সম্পত্তির কাগজপত্রে। একটা সপ্তাহ ধরে কোট-কাচারি করেও সে তাদের সম্পত্তির অরিজিনাল কোন কপি উদ্ধার করতে পারেনি৷ দাদুরা বেঁচে নেই, বাবাও বেঁচে নেই। বড় দাদার ছেলেরা আছেন কিন্তু তারা অর্ণবকে এটা সেটা বলে কথা ঘুরিয়ে নিচ্ছে। আজ দুপুরে বাড়িতে খাওয়ার আয়োজন তাই আজও একটু ঢিল দিতে হচ্ছে এ ব্যাপারে। এদিকে মনের ভেতর অর্নির বিয়েটা নিয়েও ভাবনা আছে। জীবনের এই রঙ বেরঙের, ভাবনা -পরিকল্পনায় জড়িয়ে গিয়ে কান্না পায় অর্ণবের। তার শক্তপোক্ত বুকের ছাতিতে হাহাকার বাসা বেঁধে আছে গোপনে৷ বাবার শক্তি না থাকলে জীবনটা কত যে অসহায় তা একমাত্র এতিমরাই বোঝে আর প্রশান্তির নিঃশ্বাসও একমাত্র মা থাকলেই নেয়া যায়৷ জীবনের সকল জটিল সমীকরণ এইটুকু বয়সেই অর্ণবকে ষাটোর্ধ বৃদ্ধার ন্যায় নুইয়ে দেয়। শুধু মাত্র বোনের মুখটি কল্পনা করে সে পুনরায় মাথা উঁচায়। উকিলকে বিদায় করে টুকটাক কাজ এগিয়ে নিলো সে। দুপুরে সবাই তার বাড়ি যাবে খেতে তাই আগেই বের হওয়া চাই। পথিমধ্যে আবার দই কিনবে বলে ভেবে রাখলো সে। কথা ছিল রাতেই খাবে কিংবা খালামনি তাড়া দিলো বাড়িতে নাকি কাজ আছে।

দিনের মধ্যভাগে সূর্যের তেজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সকল রান্না করলো ছোট দাদী। দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল বলে উঁচু টুলে বসে বসে রান্না করেছেন তিনি৷ আর তার সহকারী গগ কাজ করেছে রায়না বেগম। রুজিনা খালা ততক্ষণে ঘরদোর ঝাড়াপোছ করে নিয়েছেন৷ বৃষ্টির একা সময় খুব একটা ভাল কাটছেনা বলে চুপটি করে চলে গেছে দোতলায় অর্ণবের ঘরে। অনেকটা দ্বিধা আর ভয় নিয়েই পুরো ঘরটাকে দেখলো। গোছালো, পরিপাটি একটা যার এপাশ, ওপাশ কোথাও যেন এক ছিটে ধূলো নেই৷ সাদা রঙের বহু পুরনো ফ্যাকাশে দেয়ালের একপাশে একটি মাত্র ফটোফ্রেম। একপাশে বহু বছরের পুরনো একটা স্টিলের আলমারি পাশেই একটা বছর কয়েক আগের কেনা ওয়্যারড্রোব। খাটটাও বেশ পুরনো আর বারান্দার দরজার কাছাকাছি থাকা টেবিলটাও৷ নতুন বলতে এ ঘরে একটা ছোট্ট সিন্দুকের মত লকার। বৃষ্টির হঠাৎ মনে হলো এ ঘরটা যদি তার হয়ে যায়! কত কি দিয়ে সাজাবে সবটা। নিঁখুত হাতে আসবাব থেকে শুরু করে দেয়ালের রংটা অবধি বদলে নেবে। সেই সাথে বদলে দেবে অর্ণব ভাইকে৷ আপনমনে আগামী সাজানোয় ব্যস্ত বৃষ্টি টের পেলো ঘরের মানুষের উপস্থিতি৷ অর্ণব বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে ঢুকতেই চমকে গেল ভীষণ।

-তুই এখানে?

ভরাট স্বরের গম্ভীর প্রশ্ন অর্ণবের। বৃষ্টি তৎক্ষনাৎ কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে মাথা নোয়ালো। তারপরই বলল, ‘তোমার ঘর ঝাঁড়ু দিতে এসেছিলাম।’

-কেন?

-রুজিনা খালা ব্যস্ত তাই।

-দিতে হবে না তুই যা। আর শোন অর্নিকে কল করিস তো কখন আসবে?

অর্ণব ঝটপট মুখ হাত ধুয়ে নিচে নামতেই দেখলো খালু, রিদওয়ান, রমন সবাই ফিরে এসেছে। তাই আর দেরি না করে একসাথে খেতে বসলো৷ এরই মাঝে খবর নেওয়া হলো অর্নির ফিরতে আরেকটু দেরি তাই আর কেউ অপেক্ষার করলো না। খাওয়ার মাঝেই পুরুষগুলো তুলে দিলো কাজের কথা। রায়না বেগম বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলতে পারলেন না। বৃষ্টি মায়ের মুখের ভাব টের পেতেই প্রসঙ্গ বদলাতে তুলে দিলো শিবলীর কথা।

-আম্মু মেজো খালামনির না আসার কথা!

এই এক কথাতেই প্রসঙ্গ ঠেকলো অর্নির বিয়েতে। আট সদস্যের টেবিলটাতে উপস্থিত সকলের পাঁচ জনেতখন চারজনের মাঝেই উত্তেজনা, আগ্রহ পরবর্তী পরিকল্পনায়। রিদওয়ান শুধু নিশ্চল রইলো আলোচনার মাঝে। যা হবে সব দেখে যাবে তার বলার কিছু নেই, করার কিছু নেই। কথায় কথায় অর্ণব বলে দিলো বিয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো সে একদম চায় না৷ কথাটা রিদওয়ানের কানে এমন ঠেকলো, বিয়েটা সে শিবলী ভাইয়ের সাথেই চায় না! রিদওয়ান নিজেই নিজের এমন ভাবনায় ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। আজকাল সে সব কিছুতেই বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় প্রদর্শন করে। কিংবা এই মুহূর্তে এমন কিছু একদমই কাম্য নয়। নিজেকে সামলাত দ্রুত হাতে খাবার গিলতে লাগল। বেশি সময় তাকে এই গিলে ফেলার অভিনয়ে থাকতে হয়নি। ভাগ্যিস ফোনটা এসেছিল! কল এটেন্ডের বাহানায় সে টেবিল ছেড়ে একটু দূরে গেল। ফোন রিসিভ করে গলার স্বর নিচু করে প্রথমেই প্রশ্ন করল, ‘কি সমস্যা খালামনি? বলেছি না তোমাকে আজ কল দিও না!

ওপাশের ব্যক্তিটি জবাব দিতেই রিদওয়ানের রাগ হলো খুব৷ সে আগের চেয়েও বেশি উত্তেজিত স্বরে বলক উঠলো, ‘কালকেও বারংবার ভিডিও কল করেছ আজ আবার! অর্ণব টের পেলে ভীষণ ঝামেলা করবে কিন্তু।’

রিদওয়ানের কথা আমলে নিলো না ওপাশের মানুষটি৷ আবারও অনুরোধ করলো অর্ণবকে দেখবে বলে। রিদওয়ান শুনলো না সে কথা উল্টো জবাব দিল, এখন কেন এত দেখতে ইচ্ছে করে? যখন দেখার কথা তখন তো দেখলে না! যখন তার দূর্বল কাঁধ জড়িয়ে ধরার কথা তখন কোথায় ছিলে? এখন তো সে তোমায় ছাড়া থাকতে জানে ফিরে আসছ বলো তো!’

অভিযোগের মত করে মুখের ওপর শুনিয়ে দিল রিদওয়ান। কালও রাতে তাকে ফোন করে আবদার করেছিলো ময়না ছেলে-মেয়েকে একটু চোখের দেখা দেখবে বলে। রিদওয়ান অনেক বার বারণ করেও শেষ পর্যন্ত ভিডিও কলে যুক্ত করেছে অর্ণবের মাকে। বিপদে পড়ে আজকাল একটু বেশিই মায়া জন্মেছে সন্তানের প্রতি! হাহ! আদিখ্যেতা লাগে রিদওয়ানের কাছে এমন মায়া। ঠুনকো এমন ভালোবাসা। মায়েরা কি এমন হয়! কই তার মা’তো কখনো স্বার্থ খুঁজতে তাদের কষ্ট দেয়নি৷ তবে খালামনি কেন পারলো না একটু গুছিয়ে, মানিয়ে থেকে যেতে! অর্ণব, অর্নির জীবনে তাদের মায়ের দরকার নেই এমনটাই মনে করে রিদওয়ান। সে আর সুযোগ দিতে চায় না খালামনিকে কোন সদ্ব্যবহার করার। আর তিনি যে অবস্থায় আছেন সে খবরটাও অজানা থাক অর্ণব, অর্নর কাছে।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০৪

0

কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৪

সূর্য ডুবছে পশ্চিমে ; কমলাভ বিকেলটা টুপ করে গড়িয়ে পড়েছে এই মাত্রই। নুপুরের হাতের মধ্যে ছোট্ট একটা বিড়ালছানা গুটি পাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। ছাদের কার্নিশে পড়ে আছে ম্যাজিক বলের বাটি। কাল রাতেই খুব জেদ ধরে বাবাকে দিয়ে আনিয়েছে এগুলো। আরও জেদ ধরেছিল জন্মদিনের একটি কেক, কিছু ছোট ছোট মোমবাতি আর কিছু চানাচুর, বিস্কিট। বাবা সবটাই দিয়েছেন এনে কিন্তু মেয়েটা আজ টিউশনি ছেড়ে কেন বাড়িতে তাই বুঝতে পারছেন না। বাড়ির আশপাশের কিছু ছোট বাচ্চা-কাচ্চাদের নাকি ডেকেছে। বাচ্চাদের মত যখন তখন বায়না কেন যে ধরে সে নিজেই বোধহয় জানে না। আজ তো বাড়ির কারো জন্মদিনও নয় তবে এসবের জেদ কেন! বাবা অবশ্য মেয়েটাকে প্রচণ্ড স্নেহে আগলে রাখতে সব কথাই মেনে নিচ্ছেন। না নিয়ে উপায় নেই মা ম/রা মেয়েটা কখনো অন্যা/য় আবদার করেনি আজ অবধি। করার মধ্যে ওই একবার বলেছে কলেজে ওঠে টিউশনি করবে যেটা কিনা নাজিম সাহেবের পছন্দ হয়নি। তিনি অঢেল টাকা-পয়সা কামান না এ কথা ঠিক, তবে যা ইনকাম দোকান ভাড়া, বাড়ি ভাড়া আর নিজের চাকরি মিলিয়ে সংসার স্বচ্ছন্দে চলছে। সৎ মায়ের সংসারে বোধহয় কখনো কালচোখের সম্মুখীন হতে চায় না বলেই হয়ত এখন থেকেই নিজের পথ নিজে দেখতে চাইছে মেয়েটা। তাই প্রথম বছরই টিউশনি শুরু করল। এইতো সেদিন বায়না ধরলো স্কুটি কিনবে নাজিম সাহেব জমানো টাকা দিয়ে দু দিন আগে কিনে দিলেন স্কুটি। কোথায় কার কাছে যেন চালানোও শিখে নিয়েছে। তবে মেয়েটা এমনি এমনি নিলো না স্কুটিটা আর বাবা কষ্ট পাক এটাও চায়নি সে। নিজের জমানো টিউশনির হাজার বিশেক টাকা দিলো, ‘এটা তুমি নিয়ে নাও বাবা। আমার খুব শখ নিজের টাকার গাড়িতে ঘুরব সে শখ তো পূরণ করতে অনেক দিন লাগবে। তাই একটু একটু করে আমি যা দিব তোমায় নিতেই হবে।’

শুকনো মুখে অল্প হেসে তিনি মেনে নিয়ছেন সে কথা। টাকা গুলো তিনি মেয়ের নামেই জমিয়ে রাখছেন সাথে নিজের সাধ্যমতও জমিয়ে তা মেয়ের ভবিষ্যত গোছাবেন। বাড়িতে বউ আছে, আছে আরও একটি ছেলে সন্তান৷ কে জানে কবে তাদের মন ঘুরে যায় তখন মেয়েটাকে যেন জলে না ভাসাতে হয় সে কারণেই গুছিয়ে, লুকিয়ে রাখছেন কিছু কিছু। সময় হলে মেয়ের হাতে তুলে দিবেন সেগুলো সেই সাথে খুঁজতে হবে পোক্ত একটা হাত যে হাতে তাঁর মেয়ে সর্বদা থাকবে সুরক্ষিত। নুপুর আচরণে যতই চঞ্চল প্রজাপতির মত হোক না কেন মন থেকে সে যথেষ্ট পরিপক্ক। তাই বাবা হয়ে নাজিম সাহেব মেয়েকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করেন না।

_________________

‘কাঠগোলাপে সাদার মায়া মিশিয়ে দিয়ে ভাবি’
‘আবছা নীল তোমার লাগে ভাল…..

সন্ধ্যের আকাশে কালচে মেঘের ঘনঘটা। দিনের প্রচণ্ড দাবদাহে জ্বলতে থাকা ত্বকে এখন হালকা বাতাসের কোমল আদর। ফুরফুরে মন নিয়ে গলা ছেড়ে একই গানের কয়েকটা লাইন বারংবার গেয়ে যাচ্ছে রিদওয়ান। একটু আগেই রিমন এসেছে আব্বু-আম্মুকে নিয়ে অর্ণবদের বাড়ি৷ রিদওয়ান আর অর্ণব ফিরেছে তখন৷ বাড়ি এসে গেইট দিয়ে ঢুকতেই তারা দেখতে পেল উঠোনের এক কোণে বড় আম গাছটার নিচে চলছে রান্নাবান্না। রিদওয়ান একটাই চুলা বানিয়ে দিয়েছিলো বাচ্চারা নিজেরাই আরও একটা বানিয়েছে। কথা ছিল মুরগী বিরিয়ানি আর পায়েস করবে। কেমন করে যে আইটেম গুলো বদলে গিয়ে মোরগ-পোলাও, ডিমের কোর্মায় পরিবর্তন হলো রিদওয়ান বুঝতে পারছে না। সে গান গাইতে গাইতে এদিক সেদিক তাকিয়ে নিলো। যার খোঁজে দৃষ্টি ঘুরছে সে মানুষটা এখানেই নেই৷ থাক, সে দূরেই থাকুক তাতেই মঙ্গল। রিদওয়ান আবারও গানে মন দিলো চোখ বুঁজে । তার পাশেই এসে গা ঘেঁষে বসল রিমন৷ দ্রুত হাতে দু তিনটে টোকা দিলো রিদওয়ানের বা হাতের উল্টো পিঠে। ভাইয়ের এমন আচরণে রিদওয়ান গান থামিয়ে প্রশ্ন করলো, কি হলো!

‘একটা জরুরি কথা বলার ছিল।’
‘বল।’

‘এখানে না ছাদে চলো।’

‘এখানে কি সমস্যা?’ বিরক্ত হলো রিদওয়ান।

‘সিক্রেট ব্যাপার বোঝো না কেন?’

‘দূর হ’ কথাটা বলে রিদওয়ান নিজেই উঠলো। রিমনও উঠতেই দু ভাই মিলে বাড়ির ভেতর ঢুকল।

‘এবার বল।’

‘শিবলী ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে।’

‘তো!’ কথাটা বলেই রিদওয়ান চোখ বড় বড় করে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড বোধহয় তার মস্তিষ্ক অচল হয়ে রইলো। সে কি ঠিক শুনলো? আশ্চর্য! কথাটা শুনতেই কেমন বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেল রিদওয়ানের। যেন বহু বছরের চাপা পড়ে থাকা নিঃশ্বাসটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল স্তব্ধতায় তারপরই রিদওয়ান বলল, ‘গার্লফ্রেন্ড আছে তো কি হয়েছে?’

‘বিয়ে হবে, বাসর হবে, বাচ্চা হবে আমরা চাচা হব এই আরকি! হুহ’

ভেংচি কে/টে চলে গেল। রিদওয়ান তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অর্নিদের বসার ঘরটায়। কানের কাছে অনুভূতিরা শীতল হাওয়ায় ভাসিয়ে নিচ্ছে তাকে। কবে, কখন, কিভাবে কে জানে তার মনটা টুপ করে ডুবে গিয়েছিলো পুঁচকে বাচ্চা অর্নিতার মাঝে৷ তারপর ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল শিবলী ভাইয়ের নামের সমন্ধের আড়ালে। চোখের সামনে বড় হতে লাগল অর্নি আর রিদওয়ানও মনের ঘরে পর্দা টেনে গু/ম হয়ে রইলো। শিবলী ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে শুনে রিদওয়ান যখন নির্ভার ঠিক তখন দোতলার একটি ঘরে অর্নি বসে আছে মন খারাপ করে। একটু আগেই ভাইয়া তাকে ধমকে দিয়েছে। অর্ণব বাড়ি ফিরে প্রথমেই নিজের ঘরে ঢুকে গোসল করেছিল। সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় শরীরটাও বেশ ক্লান্ত থাকায় গোসলের চেয়ে ভাল আর কিছুই হতো না কিন্তু গোসল শেষে বডি স্প্রের জন্য ড্রয়ার খুলতেই চোখে পড়লো সুন্দর একটা গিফট বক্স। বোন এনেছে নিশ্চয়ই তা ভেবে বক্সটা হাতে নিলো। ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি রেখে গিফটটা বের করতেই ফোন বেজে উঠলো অর্ণবের। এক হাতে ব্রেসলেট, অন্যহাতে ফোন৷ স্ক্রীণে ভাসছে অর্ধপরিচিত মেয়েটির নাম্বার৷ আজ এতবার কেন কল দিচ্ছে সে! বিকেলেও কতক্ষণ বকাবকি করল কল দেখে মেয়েটা কি ঠিকঠাক শোনেনি তখন? কলটা পুনরায় রিসিভ করতে করতেই অর্ণব বোনকে ডাকলো, ‘অর্নি!’

পাশের ঘরে বসেই বেলুন গুলো ফুলিয়ে রাখছে অর্নিতা তার সাথে ছিল চাচাতো বোন প্রিয়া। ভাগ্যিস রিমন ভাই মনে করে বেলুন ফোলানোর যন্ত্রটা আনলো নইলে অত অত বেলুন কি করে ফুলাতো সে! রিদওয়ান ভাইটা একদম অমনোযোগী সকল কাজেই৷ একটা কাজও তিনি ঠিকঠাক করতে পারেন না এজন্যই বোধহয় খালু তাকে সবসময় কথা শোনায়৷ মনে মনেই ভাবছিলো অর্নি কথা গুলো তখনই কানে এলো ভাইয়ার ডাক।সে প্রিয়াকে রেখে চলে গেল ভাইয়ের ঘরে।

-ডেকেছিলে ভাইয়া!

অর্ণব ফোন কানে তখন প্রশ্ন করছে, ‘কল দিচ্ছো কেন বারবার?’

হাতের ইশারায় বোনকে বক্সটা দেখালো। ওপাশে নুপুর তখন মিহি সুরে বলতে লাগল, ‘শুভ জন্মদিন৷ উইশ করব বলে দিচ্ছলাম একবারও শুনলেন না তাই আবারও কল দিলাম।’

নুপুরের কথা কানে পৌঁছুলেও অর্ণব আগে বোনকে জবাব দিলো, ব্রেসলেটটা পছন্দ হয়েছে থ্যাংকস।’

অর্নি মুচকি হাসলো। নুপুরও শুনতে পেল অর্ণবের প্রশংসা। তার ঠোঁটেও ফুটলো পবিত্র এক হাসির ছটা। অর্ণি ভাবছে যাক, ভাইয়া আর কিছু জানতে চায়নি এই ঢের তাই সে চলে যাচ্ছিলো। তখনি ফোনের ওপাশে নুপুর চেঁচালো, ‘সত্যি পছন্দ হয়েছে! আমি জানতাম গাব্বার সিং এমন একটা জিনিস পছন্দ না করে থাকতেই পারে না।’

-কিহ!

অর্নি থেমে পেছনে ফিরলো ওপাশে বুঝি নুপুরও চমকে গেল অমন ভারিক্কি স্বরে ‘কিহ’ শুনতেই। কপালের মধ্যাংশে রেখার উদয় হলো অর্ণবের৷ সে একবার বোনকে দেখে আরেক বার ফোনে তাকালো।

-এই গিফট তুই আনিসনি?

-ইয়ে মানে ভাইয়া…

– ইয়েস অর নো!

-নো

– কে দিলো?

-নুপুর

-কে হয় নুপুর?

-আমার বান্ধবী।
এ কথা বলার সময় অর্নির চোখ জলে থৈ থৈ। অর্ণব তাকালো না সেদিকে। আগের চেয়ে ভারী স্বরে বলতে লাগল, তাহলে আমার বার্থডে গিফট তার কাছ থেকে কেন আসে?আমার বান্ধবী সে!’

নুপুর তখনো কলেই ছিলো। সে শুনছে সব আর বিড়বিড় করে চলছে, আপনার নই তো কি হয়েছে হয়ে যাব… বান্ধবী।

-স্যরি ভাইয়া ও জোর করল….

-জোর করলেই আনতে হবে কেন? তোকে যদি জোর করে ভাইয়ের বউ করে নিয়ে আয় সেটাও করবি নাকি!

এ পর্যায়ে কণ্ঠস্বর আগের চেয়েও উঁচু আর গাঢ় হলো অর্ণবের। অর্নি বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ভাইয়ার এমন আচরণে। অভ্যস্ত নয় সে এমন রুক্ষ আর রূঢ়ভাষী ভাইকে দেখে। ভাইয়া বরাবরই কম কথা বলে, গম্ভীর হয়ে থাকে এসব তার নিজের স্বভাবেও আছে কিন্তু কারো দেয়া উপহারে এমন করাটা ভালো লাগলো না৷ চুপচাপ চলে গেল ভাইয়ের ঘর ছেড়ে। অর্ণব নিজেও এবার অপ্রস্তুত হলো। অর্নিকে কেন ধমকালো! তার অবচেতন মন অনেক কিছু দেখছে, বুঝতে পারছে তাই সতর্ক থাকাটা জরুরি কিন্তু এখানে অর্নির কি দায়! মাথা গরম করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় তবুও হয়েই যায়। আজ দেড়টা বছরের মত হয়ে এলো অর্নির বান্ধবীর দৃষ্টি সে পড়তে পারছে। অল্পবয়সী মেয়েরা একটু উড়নচণ্ডী হবে, কাউকে দেখলে ভাল লাগবে এগুলো স্বাভাবিক হিসেবেই নিয়েছে সে। কিন্তু বাড়ি অবধি বিশেষ দিনে উপহার পাঠানো আজ নয় কাল নিজেই হয়ত আসা যাওয়া করতে চাইবে৷ এতে না চাইতেও কিছু প্রশ্রয় পেয়ে যাবে মেয়েটা। যে জীবনে সবটাই বাঁধাধরা সে জীবনে অবাধ্য কারো উপস্থিতি অর্ণব একদমই চায় না। খালামনি আর খালুর একটি মাত্র কন্যা বৃষ্টি। অর্ণব আর অর্নিতার উপর আজন্মকালের অসীম এক ঋণ তাদের কাছে। তাই মন জানে একদিন তাকে ওই মানুষদুটোর খাতিরে হয়ত বৃষ্টিকেই জড়াতে হবে নিজের সাথে। যেমনটা এখন অর্নিকে জড়াতে হচ্ছে শিবলী ভাইয়ের সাথে! অর্ণব আর ফোনে দৃষ্টি দেয় না৷ হাতের ফোন বিছানায় ছুঁড়ে কালো রঙের একটা টি শার্ট গায়ে জড়ালো৷ ঘরের বাতি বন্ধ করে চুপচাপ চলে গেল নিচে খালামনির কাছে। ফোনে তখন কল লগ বেড়ে চলছে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টায়৷ নুপুরও বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলো নিজেদের বাড়ির শূন্য ছাদটায়। আঁধারঘেরা রাতের শূন্য ছাদ সঙ্গ দিলো তার বুক ভাঙানিয়া সময়টাতে।

_______

ঝিরিঝিরি বাতাস আর একটা দুটো ঝিঁঝির ডাক। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে অর্ণবদের ছাদ আজ আলোর ঝলকে ভাসিয়ে নিচ্ছে চারপাশ। ছাদের মধ্যভাগে ছোট্ট একটা টেবিল তার ওপর সাজিয়ে রাখা পাউন্ড তিনের চতুষ্কোণ কেক। ছোট ছোট মোমের মাঝে অর্ণবের একটা ছবি। কেকটা দেখে প্রথমেই মুখ খুলল রিদওয়ান, ‘এই ছবিটা দারুণ লাগছে। মনে হচ্ছে তামিল মুভির কোন হিরোকে বসিয়ে দিয়েছে।’

-‘ইশ, ভাইয়া এগুলো বলো না পরে দেখা যাবে হিরোসাহেব কেকটাই কাটবে না।’ বৃষ্টি সতর্ক করলো ভাইকে৷

রিমন হঠাৎ পাশ থেকে বলল, ‘আসলেই! শেষে দেখা যাবে কেক না কেটে আমাদের কাটছে।’

-‘একদম ঠিক বলছেন রিমন ভাই’ পাশ থেকে সায় জানালো অর্ণবের এক চাচাতো বোন আয়রা। একে একে প্রত্যেকেই বলতে লাগল এমন ধারার হাজারো কথা। অর্ণব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ঘেঁষে। ছাদের মধ্যভাগ বেলুনে বেলুনে ভরিয়ে ফেলেছে অর্নিতা। চারপাশে আলোরও যেন কমতি নেই৷ ছোট বড় কয়েক রঙের নকল বাতিও সাজিয়ে রেখেছে। অর্ণব ভেবে পায় না এ বয়সে এমন করে জন্মদিন কেন পালন করতে হবে! সে তো মেয়ে নয় আর না ছোট বাচ্চা। তার ধারণা এমন করে জন্মদন শুধু মেয়ে কিংবা বাচ্চাদেরই হওয়া উচিত। সকলের উপস্থিতি তাকে মোটেও স্বস্তি দিচ্ছে না এদিকে বোনটাকে তখন এমন ধ/মকালো যে এখন আর ভালোই লাগছে না কিছু। সকলের উপস্থিত পূর্ণ করতেই রিদওয়ান চলে গেল নিচে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠা দুঃসাধ্য বলে ছোটদাদী একাই নিচে থাকতে চাইলেন। অর্ণব মানলো না সে কথা তাই নিজেই যাচ্ছিলো দাদীকে আনতে। তাকে আটকে রিদওয়ানই গেল। মিনিট পাঁচেক পর দাদীকে কোলে তুলে ফিরে এলো সে। সকলের উপস্থিতি পূর্ণ হতেই অর্ণব বোনকে ডাকলো, ‘অর্নি!’

-জ্বী!

দু ভাই-বোন হাত মিলিয়ে কেক কাটতে উদ্যত হলো। সমস্বরে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো জন্মদিনের গান৷ ওদিকে রিদওয়ান আড়ালে দাঁড়িয়ে ভিডিও কলে তাদের সাথে শামিল করলো আর একজনকে৷

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০৩

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩

‘রসুই ঘরের রান্না তো সারাবছরই খাই আজ ভিন্ন হোক!’
হাতের ব্যাগপত্র সব সোফার ওপর ফেলেই গা এলিয়ে বসলো রিদওয়ান৷ আজও সে অফিস কামাই করেছে তবে আজকেরটা ছুটির তালিকায় যুক্ত হবে। বৃষ্টির জন্য ছুটিপত্র গ্রহণ হয়েছে। তাই সকাল সকালই বৃষ্টি আর অর্নিতাকে নিয়ে সে চলে এসেছে অর্নিতাদের বাড়ি। তাদের উপস্থিতি টের পেতেই ছোটদাদী ধীরে হেঁটে বসার ঘরে এলেন।

‘আসসালামুআলাইকুম দাদী।’ তিনটি স্বরে একত্রেই বেজে উঠলো সালাম ধ্বনি।

ছোট দাদীও উচ্চ আওয়াজে সালামের জবাব দিয়ে বসলেন সোফায় রিদওয়ানের পাশে।

‘ওই রুজিনা শরবত বানায়া দে নাতিনগোরে।’

কাজের বুয়া জরিনা খালা তখন শরবতই বানাতে ব্যস্ত। দরজা খুলে অর্নিতাদের দেখেই বুঝেছেন এখন শরবত লাগবে। এ বাড়িতে শীত হোক বা গরম মেহমান এলেই দাদী সবসময় শরবতের কথাই বলেন তাই রুজিনাও নিজ কাজে সদা প্রস্তুত থাকেন। দ্রুত হাতে তিন গ্লাস শরবত এনে টি টেবিলে রাখলন তিনি৷ এর মাঝেই অর্নি চলে গেছে ভাইয়ের ঘরে। এক পলকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো ঘরটা। ভীষণ পরিপাটি, ঝকঝকে ঘরটা সর্বদাই একরকম থাকে।ভাইয়া বরাবরই নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করে আজও বোধহয় অফিসে যাওয়ার আগে গুছিয়ে গেছে ঘরখানা। অর্নি আসার সময় নুপুরের দেয়া গিফটটা নিয়ে এসেছিল। হাতেই আছে পার্সটা। সেটা খুলে বের করলো এন্টিকের একটা চকচকে ব্রেসলেট বক্স। ব্রেসলেটটা একদমই কারুকাজহীন তবে উপরিঅংশে ইংরেজি বর্ণ এ লেখা। খুব সাদামাটা তবুও ছেলেদের হাতে দারুণ মানাবে বলে মনে হলো অর্নির৷ সে নিতে চায়নি গিফটটা কিন্তু নুপুর এমন করে বলল যে না নিয়ে উপায় নেই। সে বারংবার বলছিলো, ‘নে না অর্নি এই ব্রেসলেটটা গোঁফওয়ালা গাব্বার সিং অর্ণব ভাইয়াকে মানাবে বেশ।’

মুখের ওপর ভাইয়ার প্রশংসা করলো নাকি নিন্দা বুঝলোই না অর্নি শেষমেশ নিয়েই নিলো গিফটটা। কিন্তু ভাইয়া যদি না নিতে চায়! বক্সটা অর্নি তার ভাইয়ার ঘরের বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলো। ঘর ছেড়ে বেরুবার মুখে পড়লো রিদওয়ান।

‘তুই এ ঘরে কি করছিস নিচে গিয়ে দ্যাখ বৃষ্টি কি শুরু করেছে।’

-আচ্ছা

অর্নি পা বাড়ালো নিচে যাওয়ার জন্য রিদওয়ান তা দেখে ডাকলো, অর্নি শোন!

অর্নি ফিরে তাকালো অথচ মুখে টু শব্দ করলো না। হতাশ হলো রিদওয়ান। ডাকলে কি সাড়া দিতেও বাঁধে মেয়েটার! প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল, ‘কিছু না যা তুই।’

অর্নি চলে গেল নিঃশব্দে। নিচে গিয়ে দেখতে পেলো হুলস্থুল কান্ড। কথা ছিল আজকের আয়োজনে শুধু রিদওয়ানদের পরিবার আর অর্ণবের বাড়ির মানুষ থাকবে। কিন্তু বৃষ্টি নাকি উঠোনে দাঁড়িয়ে বড় দাদীর বাড়ির সকল বাচ্চাকে দাওয়াত করে ফেলেছে। বাচ্চা বলতেও একেকটা কলেজ, ভার্সিটি পড়ুয়া ভাইবোন। অর্নি কিছু বলতে চেয়েও বৃষ্টির হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখে থেমে গেল৷ ভাইয়াকে সে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করে নিবে। আপাতত বৃষ্টির কথামত দুপুরের জন্য ভাত -তরকারির কথা বলতে হবে রুজিনা খালাকে। বাকি আয়োজন বিকেলে হবে। অর্নি তাই আবারও বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
______________

অর্ণব, অর্নির দাদারা ছিলেন তিন ভাই। ছোট দাদা নিঃসন্তান ছিলেন তাই অর্ণবের মা-বাবার বিচ্ছেদের পর তারা দুজনই গ্রামের আবাস গুটিয়ে শহরে এসেছিলেন৷ অর্ণবের দাদার একমাত্র সন্তান তার বাবা ছিলেন সেও পরপারে গেছেন বছর চৌদ্দ আগে। এখন পাশাপাশি বাড়িতে আছে বড় দাদা আর তার সন্তান এবং নাতি-নাতনীরা। তাদের পরিবার বিশাল বড়। এ শহরে অর্ণবের আত্মীয়ের সংখ্যা অনেক তবুও সে একলা। দূরত্বসীমা অনেক রাখলেও আনন্দ- উৎসবে না চাইতে যোগ দিতে হয় তাদের সাথে অর্ণব- অর্নিতাকে। অর্নিদের এটা পুরনো ধাঁচের দোতলা বাড়ি তার দাদার আমলে গড়া। বাবা তেমন যোগ্য সন্তান ছিলেন না বলেই পরবর্তীতে এ বাড়ির কোন মেরামত হয়নি৷ অর্ণবও সবে ব্যবসা জীবনে নিজেকে গেড়েছে তাই তার পক্ষেও পুনরায় সংস্করণ সম্ভব নয়। তবে এ বছর নভেম্বরে বাড়িটার খসে যাওয়া পলেস্তারা সরিয়ে রঙের প্রলেপ দেবে। বাড়ির সামনে, পেছনে মিলিয়ে অনেকটা জায়গা খালি পড়ে আছে সেগুলোর যথাযথ উন্নতি করবে৷ ভেবে তো রেখেছিল আস্তে ধীরে আরও বছর দুই পরে করবে সবটা কিন্তু শিবলী ভাইয়ের তাড়া দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা আরও জলদি হবে বোনের। তাই সবটাই আরও আগে করে নেবে বলে আপাতত ছোট্ট পরিসরে লোনের আবেদন করেছে ব্যাংকে। জলদি বলতে জানুয়ারির আগে একদমই নয়। বাবা-মায়ের ডিভোর্সটা যেদিন অফিসিয়ালি কার্যকর হলো সেদিনই কোর্টে আলাদা হলো দু ভাই-বোন। তবুও অর্ণব জোর করেই চলে গেল মায়ের সাথে নানার বাড়ি। দুটো মাস ভালোই কেটেছিলো মা আর বোনের সাথে। এরপর একদিন হুট করেই জানতে পারলো মায়ের আবার বিয়ে হবে। এগারো বছর বয়সটা তখন বড্ড কাঁচা তবুও যেন মনের ভেতর গভীর এক ভাবনার বাস। দিন রাত ভয় জমতে লাগল অর্ণবের বুকের ভেতরে। শ্বাস-প্রশ্বাসে টান লাগালো মাকে হারানোর । পড়াশোনা, বইপত্র কিছুতেই তার আর মন লাগলো না। সকাল-দুপুর- বিকেল গড়াতে লাগলো বদ্ধ ঘরে বন্দী হয়ে। নানার বাড়ির আদর যত্নে তখনো ভাটা পড়েনি তবে আড়ালে আড়ালে বাজতে থাকা কথাগুলো ঠিক কানে প্রবেশ করতো। তারপর একদিন হুট করেই মায়ের বিয়ে হলো সঙ্গে হলো বোনের সাথে সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ। মা হীন জীবন কত বিতৃষ্ণাময় টের পেতে লাগলো অর্ণব বাবার কাছে ফেরার পর। একটা বছর সে কাটিয়ে দিলো একা বাড়িতে কাজের বুয়ার সাথে। বাবা থেকেও যেন ছিলো না তখন। সকাল -দুপুর, রাত্রি বাবার কা/টতে লাগলো বাজে পাড়ায় আর দাদার ব্যবসায়। টাকা পয়সার জলাঞ্জলি অল্পতেই হয়ে গেল। ততদিনে জানা গেল বোনটিও ভালো নেই। তিন বছরের ওইটুকুনি মেয়েটি নাকি রাত কাটায় একা বিছানায়। নিজে থেকে যে ওয়াশরুমে যাওয়া বুঝতো না, খাবার পাতে নিয়ে খেতে জানে না, স্পষ্ট করে যে দুটি বাক্য বলতে পারে না সেই বাচ্চাটি নাকি দিনের পর দিন একাই পার করছে। অর্ণব নিজেও একদিন জেদ ধরে মায়ের নতুন সংসারে থাকতে গেলে দেখতে পেল মায়ের নতুন রূপ৷ এখনো মনে পড়ে অর্ণবের সে দিন দুপুরের খাবারের মুহূর্ত।মা তাকে একলা এক ঘরে প্লেটে করে ভাত-পানি দিল। কিছুক্ষণ পরই অর্নিকেও আনলো সে ঘরে হাতে তারও একখানা ভাতের থালা। বসিয়ে দিলো মেঝেতে। প্লেটে ছিল ডাল দিয়ে মাখা ভাত আর অর্নি সেগুলো তার ছোট ছোট আঙ্গুলে তুলতে না পেরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলতে লাগলো চারপাশে। অথচ দু দন্ড বসে মা তাকে এক লোকমা ভাত তুলে দিলো না মুখে। ওভাবে যেটুকু পারলো খেয়ে রেখে দিলো। অর্ণব সেদিন সারাটা সময় মাকে দেখলো পলক ভরে৷ হাতে -পায়ে ফোলাভাব, চোখে-মুখে অসুস্থতা সেসবের মাঝেও দিব্যি বাড়ির হাজারটা কাজ করছে। ও বাড়ির অবস্থা অতোটাও খারাপ নয় তবুও যেন কাজের লোক একমাত্র তার মা’ই ছিল। অথচ অর্ণবের মনে পড়ে না তাদের বাড়ি থাকাকালীন মা কখনো কাপড় ধুয়েছে কিংবা ঘর মুছেছেন! তার বাবা মানুষটা খুব ভালো না হলেও অর্থবিত্তের কার্পণ্যতায় রাখেনি মাকে৷ মায়ের সাথে সে বাড়ি সেদিন রাত কাটানোর জন্য থাকতে চেয়েও হতাশ হয়েছিল অর্ণব৷ দিন শেষে রাত্রি হতেই মা নিজের বুকে টেনে নিলো অর্নিকে। দশটা বাজার আগেই তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গেল এক ঘরে অর্ণবের থাকার ব্যবস্থাও সে ঘরেই করা হলো। অর্ণব ভেবেছিল মা বোধহয় একটু পরই ফিরে এসে বুকে নিয়ে বলবে, আয় বাবু তোকেও ঘুম পাড়িয়ে দেই। কিন্তু নাহ, তেমন কিছুই হয়নি সেদিন। এগারো বছরের বাচ্চা ছেলেটা মায়ের অপেক্ষায় ঢুলতে ঢুলতে অর্ধরাত কা/টিয়ে ফেলল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে অর্নি কাঁদতে লাগলে ছুটে পালালো অর্ণবের আলগোছে আসা নিদ্রাদেবী। বোনের কান্নায় অস্থির হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে দরজার কাছে যে ঘরটাতে মাকে দেখেছিলো দিনের বেলায়। পাগলপ্রায় অর্ণব দরজা ধাক্কিয়ে মাকে ডাকলো৷ কেউ এলো না সেখান থেকে শুধু ভেসে আসলো মায়ের কেমন অসহায় কণ্ঠ, ‘তুই যা অর্ণব বোনকে দেখে রাখ। দরজা ধাক্কাবি না আর।’

সেটাই ছিলো অর্ণবের শেষ ধাক্কা মায়ের দরজায়, হয়তো নিজের মনের দরজায়ও। কোন কিছু পাওয়ার আশায় কড়া নাড়েনি সে আর কোথাও। সে রাতের পর অর্ণব ফিরে এসেছিল মাতাল বাবার কাছেই। তার আর মাকে দরকার পড়েনি। ভাগ্যও যেন জানতো তার আর কারোই দরকার পড়বে না। তাইতো বছর ঘুরতেই বাবার মৃ/ত্যু হলো। অতিরিক্ত মদ্যপান, উচ্চরক্তচাপ আর কোন এক চিন্তায় চুপচাপ দম ছাড়লেন তিনি। আপন মা পর হলেও মায়ের বোনেরা ঠিক আপনই রইলো। বড় খালামনি, মেজো খালামনি দুজনেই অর্ণবের দ্বায়িত্ব নিতে চাইলেন৷ কিন্তু অর্ণবের তখন মনে আঁচড় পড়েছে অসংখ্য। না চাইতেও সে এড়িয়ে গেল কারো সান্নিধ্যে যাওয়া। বয়স তখন বারো ছোটদাদা একদিন হুট করেই এলেন দাদীকে নিয়ে। অথৈ সাগরে ডুবতে গিয়েও একখানি ভেলা পেয়ে গেল অর্ণব। আর তারপরের কয়েকটা বছর ঢাল হয়ে ছিলেন দাদা আর দাদী সেই সাথে বড় খালু্। পড়াশোনা চলল কলেজ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে কারণ দাদা তখনও ঢাল হয়ে তাদের ব্যবসা দেখছেন। এতে অবশ্য খুব বেশি লাভবান হওয়া গেল না জ্ঞাতিগুষ্টির চরম ধোঁ/কাবাজিতে। বড় দাদা মানুষ ভালো হলেও তার সন্তানেরা প্রচণ্ড লোভী। পুরো বংশে অর্থবিত্তে তারাই উচ্চপদে তবুও যেন তৃপ্ত নয় তারা। কত ছল-চাতুরী, কত ভেলকিবাজি করে গেল টানা কয়েকটা বছর শুধু মাত্র অর্ণব আর নিঃসন্তান ছোটদাদার সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে৷ ওপরওয়ালা বরাবরই তার সৃষ্টির জন্য পরিপূরক ব্যবস্থা রাখেন অর্ণবের মনে হয়। তাইতো অবুঝ সময়ে ছোটদাদা কেমন বাবার মত আগলে নিলো। অথচ যখন অর্ণব কোমল লতা থেকে শক্ত ঢাল হয়ে উঠলো তখন সেই মানুষটা পাশে নেই৷ অর্ণবের জীবনের পরিবর্তনে অবহেলার জায়গা আর অর্নির! মায়ের নতুন সংসারে টুকুর টুকুর পায়ে একটি বছর পার করেছে তিন বছরের বাচ্চাটা। কখনো জ্বরে ভুগে বেহুশ হয়েছে একলা ঘরে কখনো আবার পানির বালতিতে পড়ে গিয়ে জমে- মানুষে টানাটানি করে মৃ/ত্যু থেকে ফিরিয়ে এনেছে৷ সেই থেকে অর্নি শ্বাস কষ্টের রোগী। ঠান্ডার প্রকোপ বাড়লেই সে অর্ধমৃত হয়ে যায়। অর্নির যখন পানির বালতিতে ডুবে মর/ণদশা তখনই বড় খালামনি জোর করে নিজের কাছে নিয়ে এলেন তাকে। মা তখন নতুন সন্তানের আগমনের দিন গুণছে। গর্ভাবস্থার শেষ সময় বলেই কিনা কে জানে মাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো অর্নিকে আলাদা করতে পেরে। সেই থেকেই বিচ্ছেদ মায়ের সাথে অর্নি, অর্ণবের। বেশ তো কেটে গেছে চৌদ্দ বছর মা-বাবাহীন জীবন তাদের। তবে আল্লাহ কখনো তাদের অভিভাবকহীন রাখেননি কোন পর্যায়ে। পঁচিশ পেরিয়ে ছাব্বিশে পা রাখা অর্ণব এবার নিজেই অভিভাবক হয়ে উঠবে ছোট্ট বোনটার৷ শিবলী ভাইয়ের সাথে অর্নির বিয়েটা খালারাই ঠিক করেছে তাই বলে কি সময়টাও তারাই ঠিক করবে? অর্নির সাথে শিবলী ভাইয়ের বয়সের ফারাক অনেক লম্বা এ কথা জেনেও সবাই বিয়ে ঠিক করে রেখেছে৷ তাই বলে কি অর্নির পড়াশোনা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববে না! অর্ণব এ বিষয়ে কঠোর হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে৷ এ সপ্তাহেই কথা পাড়বে এ বিষয়ে।

ঘড়ির কাটা টিকটিক করে চলে এসেছে তিনের ঘরে। বৃষ্টি আর রিদওয়ান মিলে অর্ণবদের উঠোনের একপাশে ইট দিয়ে চুলা বানিয়েছে। অর্নি আর বড় দাদার কয়েকজন নাতনি মিলে মুরগি কাটছে। কথা ছিলো তারাই সকলে মিলে মশলা পিষবে, পেয়াজ কাটবে কিন্তু কাজের বেলায় প্রত্যকেই বলল, পেয়াজ কাটতে জানি না, মশলা বাটতে জানিনা। শেষ পর্যন্ত পেয়াজ কাটছেন রুজিনা খালা, মশলা পিষবে বৃষ্টি। রিদওয়ান চুলা ঠিক করে গাছের ডালের ব্যবস্থা করল৷ বাড়ির পেছনেই পেয়ে গেল গাছের কে/টে ফেলে রাখা ডালপালা। প্রচণ্ড গরমে শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে একদম৷ কাজের ফাঁকে বার দুয়েক সে তাকিয়েছিল অর্নির দিকে। ওড়না পেঁচিয়ে আঁচলের মত করে গুঁজে রাখা কোমরে, পিঠ সমান চুলগুলো খোঁপায় বেঁধে কাঠি গুঁজেছে। চোখের চশমা আলগোছে এসে ঠেকেছে নাকের ডগায়। তাপমাত্রার চরম অবস্থায় স্বেদজল এসে জমপেছে নাকে, চিবুকে বিন্দু বিন্দু শিশিরকণার মত৷ দিনের উজ্জ্বল আলোয় চিকচিক করছে সে বিন্দু মোহনীয় সৌন্দর্য হয়ে। বেশিক্ষণ আর তাকিয়ে থাকলো না সে। আত্মসংযম, আত্মসম্মান দুটোই বড় দামী হওয়া উচিত প্রত্যেকটা মানুষের। রিদওয়ান তাই চেষ্টা করে নিজের আত্মপ্রবৃত্তিকে তুষ্ট রাখতে। যতটা সম্ভব দৃষ্টির আড়ালই রাখে ওই আদুরে মুখটাকে। এমনিতেই আজকে দিনে অপরিমিত হারে দেখা হয়ে গেছে৷ একদিনেই এত দেখলে লোভ বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। লাকড়ির ব্যবস্থা করে সে আর থাকলো না বাড়িতে। বৃষ্টিকে বলে গেল সন্ধ্যায় আসবে একবারে অর্ণবের সাথে।

এদিকে অর্ণবটা সকালে দাদীকে ফোন করেই টের পেয়ে গেছে বাড়িতে আজ আসর জমেছে। বৃষ্টিদের তৈরি সারপ্রাইজ অনেক আগেই তার কাছে ধরা পড়লেও সে কাউকে কিছু বলেনি। করুক যা করছে অযথা তাদের আনন্দ আর মাটি করবে না সে। কিন্তু সকাল থেকে যে ওই বাচ্চা মেয়েটা জ্বালিয় মা/রছে! কিছু একটা করা দরকার নইলে অল্প বয়সেই ধা/ক্কা খাবে ভীষণরকম।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০২

0

কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব -২

‘এ কেমন পাগলামি? বয়স কত তোমার?’

বজ্রকণ্ঠের মাত্র দুটি বাক্য অথচ নুপুরের ভেতর-বাহির সবটাই পাল ভাঙা নৌকার মত ভাঙতে লাগলো চুরচুর করে। মাত্র একটি সপ্তাহ, পাঁচটি কল এবং পঞ্চম বারেই ধ/রা পড়ে গেল। এ বড় ভুল হয়ে গেল যে! দেড় বছরের উত্তাল আকর্ষণ, প্রচণ্ড আবেগী টান যে মানুষটার প্রতি তিল তিল করে তৈরি হয়েছে তা কি আজই শেষ করে দিতে হবে? একদমই না! নিজেই নিজেকে শাসায় সে। কলেজে ভর্তি হওয়ার দ্বিতীয় দিনই দেখতে পেয়েছিল সে অর্ণবকে৷ লম্বা, চওড়া কাঁধের, ধারালো চোয়াল, লম্বা পাপড়িওয়ালা চোখের সুদর্শন, সুপুরুষ যার শুভ্র মুখশ্রীতে রাজকীয় গোফ। জীবনে সেই প্রথম নুপুরের কোন গোঁফওয়ালা পুরুষ চোখে লেগেছিল। তাছাড়া তো গোঁফওয়ালা মানেই তার চোখে বাংলা সিনেমার ফাঁ/সির মঞ্চের ভুড়িওয়ালা জ/ল্লাদই ভাসে। নিজের মনের বদল ভাবনায় ভীষণ চমকেছিল সেবার পরে অবশ্য মনকে বোঝাল সুন্দর মানেই ভ/য়ংকর সুন্দর মানেই চোখ ধাঁধানো। আসলে প্রেমে পড়ে ভাবনাগুলোই গোঁজামিল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রেমের চলছে ক্রা/ন্তিলগ্ন। নিজেকে ধরিয়ে দেবে নাকি আলগোছে এড়িয়ে যাবে! বেশিক্ষণ ভাবতে হয়নি অর্ণব নিজেই পুনরায় কথা বলল, ‘ নামটা কি যেন তোমার? এমন ফাজলামো আর করবে না।’

-‘বড্ড মেপে কথা বলেন জনাব আপনারা দু ভাই-বোন আরেকটু বাড়িয়ে বলুন না। শুনতে শুনতে ম/রে যেতে ইচ্ছে করছে।’

একাই বিড়বিড় করে চলছে নুপুর। অর্ণবও টের পেল ওপাশের বিড়বিড়ানি। মেয়েটা কি একটু ছিটিয়াল নাকি! কল কেটে দিল সে। অত সময় নেই কোন মেয়ের বকবক শোনার। দাদীর খোঁজ নেয়া জরুরি তাই এবার বাড়ির নম্বরে কল দিল অর্ণব। বার দুয়েক রিং হতেই কল তুলল কাজের মহিলা। অর্ণবের ফোন শুনতেই আলেয়া খাতুন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘ওই বেটি ফোন কাইট্টা দে আমি কারো লগে কথা কমু না। জামাই মরছে বইলা কেউ আর আমার কথা ভাবে না।’

অর্ণব শুনলো দাদীর সেই চেঁচানো সুর। বুঝতে পারলো আজও অভিমান করেছে বুড়ি। সময়, ব্যস্ততা সব মিলিয়ে দিনে দু বার কল না পেলে এভাবেই অভিমান করে। বাপ-মা হীন জীবনে তার ছোটদাদী আর অর্নিতার জীবনে বড় খালামনিই একমাত্র আশ্রয়স্থল, একান্ত সম্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে এখন সে নিজের ব্যবসায় চূড়ান্ত মনোযোগী হতেই দাদীর আবদার বাড়িতে বউ লাগবে। অর্নিতা মাসে দু,চার দিনের বেশি থাকে না সেখানে তাতেই দাদীর অভিযোগ একলা বাড়ি সঙ্গী লাগবে। আসল কথা, লুকিয়ে লুকিয়ে ঘটক ডেকে মেয়েও দেখেন অর্ণব জানে সে কথা। কিন্তু বোনকে না পার করে নিজের চিন্তা করবে না সে। একলা জীবনে তারও একাকীত্বে কাউকে প্রয়োজন পড়ে কিন্তু সেই প্রয়োজন সারতে গিয়ে বোনের প্রতি যদি অবহেলা হয়! সেই ভয়ে ভাবছে না আর আগে পিছে। দাদীর মান ভাঙাতে সময় লাগবে তাই এখন আপাতত থাক অভিমান। কাজের বুয়া খালাকে বলে ফোন রেখে দিল অর্ণব। তার ছোট্ট ব্যবসা, পরিশ্রম অনেক আশা আছে উন্নতি হবেই হবে। বড় খালু আর ছোট দাদার সাহায্যেই পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার টাকা-পয়সাগুলো ব্যবসায় লাগিয়েছিল। পরিশ্রম, মেধা দুটোই সমান থাকায় একলা কাঁধেই সামলে চলছে সবটা। সন্ধ্যে হতে বাকি নেই বেশি। পিয়নকে ডেকে চা আনিয়ে ফাইলপত্র ছড়িয়ে বসলো।
___________

শার্টের হাতা গুটিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখতেই মনে পড়লো মোবাইলটা নিজের কেবিনেই ফেলে এসেছে রিদওয়ান । অফিসে এসে বাবার সাথে লাঞ্চ করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে। চোখের কোলে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়েছে টানা কর্মব্যস্ততায়। নিজেদের ব্যবসায় ঢুকেও প্রচুর ছুটি কাটানোর দায়ে তার প্রমোশন আটকে আছে। বসের ছেলে হয়েও তার কর্মদক্ষতা আর ঢিলেমির শা/স্তিস্বরূপ বাবা তার পদবী উপরে তুলছেন না। এদিকে রিমনটা বয়সে ছোট, পড়াশোনাও শেষ হয়নি তবুও কাজের প্রতি দারুণ ডেডিকেটেড হওয়ায় এ মাসেই প্রমোশন পেল উপরি হিসেবে মা’কে পটিয়ে নতুন গাড়ি হাতিয়ে নিয়েছে। রিদওয়ানের কিছুতেই কিছু হয়ে উঠছে না আর হবে বলে তার মনেও হয় না। ছোট থেকে মন আটকে ছিল তার ফুটবলে। এ দেশে নাকি ফুটবল মানে বিশ্ব দরবারে পৌছানোর সুযোগ নেই এমন কথা বলে বাবা ক/টাক্ষ করতো। মা অবশ্য বলতো খেলাধুলা বয়সের দোষ কাজে নামলে ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হলো কি! দীর্ঘ তিন বছরের কর্ম জীবনে সে আজও ভুলে যায় অফিস টাইম তার ঠিক নয়টায়। কখনো কখনো অফিস ফেলে চলে যায় ক্লাবে যেখানটায় শখের বশে কখনো গিটার বাজাতো বন্ধুরা মিলে। কখনো আবার বাড়ি ফিরে মায়ের ঘরে ঘাপটি মারতো মায়ের কোলে মাথা রেখে একটু আরাম করতে। বোহেমিয়ান স্বভাবের রিদয়ানের জীবনের মায়ের কোলে মাথা রাখা এই একটা ব্যাপারই ভিন্ন শুধু। বাবার বক্তব্য এই ছেলেটার জীবনে গভীরতা নেই সে আবেগে ভরপুর ছোট্ট এক ডিঙি নৌকা। হালকা ঝড়েই কু/পোকাত হয়ে যাবে। রিদওয়ান হাসে বাবার বাণী শুনে কখনো জবাব দেয়নি। তার গভীরতা কতটুকু সে খবর কাউকে দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে না সে। তবে এ কথা সত্যি হালকা ঝড়ে বহুবার ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া নৌকাই তো হয়েছে। বারংবার নিজেকে মেরামত করে টিকে আছে জগত সংসারে। গাড়িতে বসে আলগা ভাবনাতেই কাটিয়ে ফেলল দশ মিনিট। নাহ্ এভাবে চলে না আর নিজেই নিজেকে বলে বের হলো গাড়ি থেকে। মোবাইলটা এনে আবারও বসলো ড্রাইভিং সিটে গন্তব্য তার হাট- বাজার। বৃষ্টির ভাষায় সুপারশপ।
______

‘অর্নিতা পড়তে বসিসনি এখনো?’

মেয়েদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্য করছিলেন রায়না বেগম কে কি করছে। বৃষ্টি ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বেলকোনির দরজায় হেলান দিয়ে মুভি দেখছে বোধহয়। মাথার চুল এলোমেলো গায়ের ওড়নাটাও আশেপাশে নেই৷ তারপরই দৃষ্টি ফেরালেন অর্নিতার দিকে। নীল রঙা কামিজে সাদা ওড়নায় হলদে রঙা মুখটা কেমন আদুরে বেড়ালের মত কোমল লাগছে। খাটের ওপর পা গুটিয়ে আলতো হাতে নেইল পেইন্ট করছে ভীষণ মন দিয়ে৷ নিয়মমাফিক সে সন্ধ্যের চা শেষ করেই বই নিয়ে বসে পড়ে আজ ভিন্নতা দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন মেয়েটিকে৷ তৎক্ষনাৎ হাতের নেইল পলিশ পাশে রেখে জবাব দিলো, ‘আজকে পড়ব না খালামনি।’

‘ওমা কেন!’ কথাটা বলেই তিনি ঘরে ঢুকে বিছানায় বসলেন অর্নির ঠিক পাশেই।

‘কালকে নাকি কলেজেও যাবে না ও।’

ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই বলল বৃষ্টি। রায়না বেগম বিষ্ময়ে চক্ষু বড় বড় করলেন। আগামীকাল সোমবার না ছুটির দিন না দিবসগত কোন উৎসব। যে মেয়ে জ্বরে পড়ে কাঁপতে কাঁপতে কলেজে উপস্থিত থাকে সে হঠাৎ এত আয়োজন করে বসে নখ রাঙাচ্ছে, আবার বলছে কলেজেও যাবে না। ঘটনা কি! খালামনির কৌতূহলী নজর চশমার আড়াল থেকেই দেখে নিয়েছে অর্নিতা তাই এবার সোজা হয়ে বসল।

‘খালামনি এবারও ভুলে গেছো তুমি তাইনা!’

-কি ভুলে গেলাম?

-‘কাল ভাইয়ার জন্মদিন আর সে উপলক্ষে আমাদের একটুখানি আয়োজন করার ছিল।’
কথাটা বলতে গিয়ে আক্ষেপে মুখ ফোলাল অর্নি। রায়না সত্যিই ভুলে গিয়েছিলেন অর্ণবের জন্মদিনের কথা। বৃষ্টি অবশ্য এক সপ্তাহ আগেই একবার স্মরণ করিয়েছিল পরে তিনি বিভিন্ন কারণে ভুলে গেছেন।

– এই রে তোরা না বলেছিলি কোথাও দূরে বেড়াতে যাবি এবার? আমি তো তোর খালুকে জানাতেই ভুলে গেছি।

আফসোসের সুরে বললেন রায়না বেগম৷ বৃষ্টি এবার ল্যাপটপ বন্ধ করে বিছানায় বসলো। মায়ের গায়ে গা ঘেঁষে ছোট বাচ্চাটি হয়ে বলল, ‘ থাক আর আফসোস করতে হবে না। তোমাদের নবাবজাদা দু দিন আগেই অর্নিকে বারণ করে দিয়েছে এ ব্যাপারে।’

– কে! অর্ণব?

-হ্যা খালামনি। ভাইয়া বলেছিল এ বছর যেন কোন রঙ তামাশা না করি। আর অবশ্যই এ বিষয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞা তোমার ওপর।

-যাহ বাবা! আমার ওপর কড়া কেন?

-গত বছর তোমার জন্যই তো তোমার সেই বান্ধবী আর তার কন্যারা এসেছিল ভাইয়ার বার্থডেত….

‘তারপর আন্টির ছোট কন্যা অর্ণব ভাইয়ার প্রেমে পিছলে পড়ে কি যন্ত্র/ণাই না দিলো সবাইকে।’

অর্নিকে থামিয়ে নিজেই কথাটা বলে খিলখিলিয়ে হাসলো বৃষ্টি। রায়না বেগমের মনে পড়লো সে ঘটনা। এ নিয়ে বহুদিন বান্ধবীর সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলল। কিছুদিন ধরে পুনরায় ভাব হলো দুজনে সে কথা ভাবতেই মনে মনে তওবা করলেন, আর কখনো অর্ণবের উপস্থিতিতে বান্ধবীকে ডাকবেন না।

‘কিন্তু কাল যদি ঘুরতে নাই যাবে তবে কলেজ বন্ধ করবে কেন?’

এ প্রশ্নের জবাবও বৃষ্টিই দিয়ে দিল, ‘কাল আমরা অর্ণব ভাইয়ার বাড়ি যাব সকাল সকাল। সারাদিন সেখানে থেকে নিজেদের মত রান্না-বান্না করব, ঘর সাজাব তারপর রাতে কেক কেটে ফিরে আসব। আর হ্যাঁ আম্মু তুমি আর আব্বু কিন্তু রাতে যাবে দিনে আমরা আমরাই থাকব।’

মেয়ের কথা শুনে অল্প হেসে সম্মতি জানালেন রায়না বেগম । এরপর আরও কিছু সময় মা, মেয়েরা গল্প আড্ডায় মজেছিলেন নির্বিঘ্নে। রাত আটটার ঠিক পাঁচ মিনিট পরই বাড়ি এসে পৌঁছুলো রিদওয়ান। পরনে ফরমাল শার্টের ওপর ঢিলে টাই, উসকোখুসকো চুল। দাঁড়িবিহীন ধারালো চোয়াল। দু হাতে ব্যাগ ভর্তি কিছু শুকনো খাবার আর বেলুনের প্যাকেট। সবটাই বৃষ্টির দেয়া লিস্ট মোতাবেক নিয়ে এসেছে হতে পারে কিছু বাদ পড়েছে ঠিক খেয়াল করেনি সে৷ ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে আসতে চাইছে তার অনেকক্ষণ যাবৎ। আজ দুপুরে খাওয়া ঠিকঠাক হয়নি বিকেলে এক মগ কফি আর এ বেলা মার্কেটে শপ খুঁজে খুঁজে অর্নির বলে দেওয়া লাইট না পেয়ে আরও বেশি ক্লান্ত সে। বাড়ি ফিরেই চেঁচিয়ে ডাকলো, ‘বৃষ্টি, অর্নি এদিকে আয়।’

বৃষ্টি মুখে মাত্রই প্যাক লাগিয়েছিল বিধায় অর্নিকে বলল, ‘তুই গিয়ে দ্যাখ সবকিছু ঠিকঠাক এনেছে কিনা!’

অর্নি বসে বসে ফোনে কিছু দেখছিল। বৃষ্টির কথা শুনে চুপচাপ চলে গেল রিদওয়ানের ঘরের দিকে।

‘রিদওয়ান ভাই আসব?’

– ‘আয়’ বলেই রিদওয়ান খাটের ওপর ব্যাগগুলো ইশারা করে অর্নিকে দেখতে বলে চলে গেল ওয়াশরুমে৷ সারাদিনের ক্লান্তি শুধু মাত্র গোসলেই দূর হবে তার এই ভেবেই গোসল করা। অর্নি আলগোছে ব্যাগগুলো তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বৃষ্টি আর অর্নির ঘর একটাই সে ঘরে সব নিয়ে উপস্থিত অর্নি।

‘আপু এই যে ব্যাগগুলো এনছি।’

‘এ ঘরে কেন?’

‘তুমি দেখবে না!’

‘ওরে গাধি ভাইয়ার ঘরেই তো দেখতে পারব এখানে কেন আনলি? ভাইয়া বলছে?’

সন্দিহান চোখে তাকায় বৃষ্টি।

‘না’

চোখের পাতায় রাখা শশার টুকরো দুটো সরিয়ে ফেলল বৃষ্টি। দু হাতে টেনে ব্যাগগুলো এক এক করে খুলে দেখলো কি কি এনেছে। খাবার বলতে, কিছু কুকিজ, ফ্রোজেন কিছু স্ন্যাকস আর অনেকগুলো বেলুনের প্যাকেট। হতাশ চোখে তাকায় বৃষ্টি। সে তো বলেছিল অর্ণব ভাইয়ের মাপ অনুযায়ী একটা শার্ট আর পারফিউম সেটের কথাও। রাগ হচ্ছে তার অর্নিকে জানালো বৃষ্টি। অর্নি অবশ্য তার ভাইয়ের জন্য গিফট দু দিন আগেই কিনে রেখেছিল। হঠাৎ মনে পড়লো গিফট তো নুপুরও কিনেছে ভাইয়ার জন্য সেটাও তারই কাছে আছে অথচ নুপুরকে তো সে দাওয়াতই করেনি৷

-আপু নুপুরকে দাওয়াত করতে ভুলে গেছি।

-নুপুর তোর ওই আধপাগল বান্ধবীটা না! ওকে কি দরকার আমাদের ছোট্ট আয়োজনে দাওয়াত করার? বাদ দে।

-আচ্ছা!

অর্নির মন খারাপ হলো একটু তবে তা মুখাবয়বে প্রকাশ পেলো না। সল্প বাক অর্নি এটাও বলতে পারলো না যে নুপুর একটা গিফট দিয়েছে ভাইয়াকে সে খাতিরেই না হয় বলা যাক!

রিদওয়ান গোসল শেষে বেরিয়ে দেখলো রুম ফাঁকা। সে জানতো এ ঘরে অর্নি এক দন্ডও বসবে না। তবুও ইচ্ছে করেই ডেকেছিল এখানে আসুক। শান্ত স্বভাবের বাচ্চা মেয়েটা এত কেন গম্ভীর আর চুপ থাকে! অতীত কি আর কারো মন্দ হয় না? সবাই কি জীবনটাকে খোলসে গুটিয়ে পার করে দেয়! কই আশপাশে কত অভাগা, নিঃস্ব মানুষ দেখছে তারা তো কেউ এমন নিরব রাত্রি হয় না। রিদওয়ান চায় না ভাবতে তবুও ভাবনা আসে অর্নিকে নিয়ে। নিজের থেকে অনেকটা ছোট্ট অর্নির স্বভাব তাকে অবাক করে। শীতল দীঘির মত তিরতিরিয়ে বয়ে চলা এক নীরব স্রোতস্বিনী যার কলরব কেবল কান পাতলেই শোনা যাবে দূর থেকে সে বড় শান্ত। রিদওয়ানের ইচ্ছে করে সেই স্রোতধ্বণি শোনার অথচ সাধ্য নেই। আর মাত্র দিন কয়েক তারপরই সে ধ্বনির একমাত্র, একান্ত স্রোতা হবে শিবলী ভাই। হায়! এ যে নীরব আঘা/ত হৃদপিণ্ডে চলছে রিদওয়ানের।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-০১

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#সূচনা_পর্ব
-রূবাইবা মেহউইশ

‘দুইটা বাচ্চা রেখে এই বিয়েটা করিস না ময়না। তোর ছেলে মেয়ে দুটো অনাথ হয়ে যাবে।’

অশ্রুসজল চোখে আকুল আবেদন বড় বোন রায়নার। ময়না সে কথায় পাত্তা দিলো না। একটু পরই তামিম আসবে তার বন্ধুকে নিয়ে। দেখা সাক্ষাৎ আগেই হয়েছে আজ শুধু বিয়েটা হবে। এই মুহূর্তে বড় আপার কান্না দেখে আবেগে মত পাল্টানো সম্ভব না।

‘উফ্ বড় আপা চুপ করো তো। তোমার যদি বেশিই দরদ লাগে তো নিয়ে যাও বাবুদের দেখি কতদিন রাখতে পারো!’

বিরক্তির রেশ ময়নার গলায়। এরই মধ্যে আবারও বলল, ‘পারলে তামিমদের সামনে আমাকে মোনা ডেকো আর না পারলে নামটাই উচ্চারণ কোরো না।’

বোনের মুখের কঠোর অভিব্যক্তি তাজ্জব করে দিল রায়নাকে। সাত বছরের ছোট বোন ময়না স্বভাবে চঞ্চল ছিল সর্বদা কিন্তু এতোটা ঔদ্ধত্য কবে হলো!

সন্ধ্যে নাগাদ ময়না আর তামিমের বিয়ে হয়ে গেল ঘরের সদস্যদের সাক্ষী রেখে। সাক্ষী ছিল ময়নার দুই সন্তান অর্ণব আর অর্নিতাও। তিন বছরের অর্নিতার বোধগম্য হয়নি মায়ের বিয়ে কিন্তু এগারো বছরের অর্ণবের মনে দাগ পড়লো আজন্মকালের মত। ঘরোয়া এবং দ্বিতীয় বিয়ে বলেই বিদায় পর্বও আয়োজন করে হয়নি। নিঃশব্দে প্রস্থান করেছে ময়না মেয়েটাকে নিয়ে ছেলেটাকে ফেলে গেছে বাপের বাড়িতে অবহেলা আর অনাদরের ছত্রছায়ায়।
______________

চৌদ্দ বছর পরের এক সকাল; মাথার ওপর উত্তপ্ত রোদ। ফল পাকা মৌসুমে হলদে ফর্সা মুখটায় চশমার পেছনে চোখের নিচ, নাকের ডগা আর চিবুকে ঘামের স্বচ্ছদানার রাজত্ব অনেকটা মুক্তোদানার মতন। দ্বিতীয় বছরের প্রথম সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষা হলো আজ অর্নিতার। ভর দুপুরে কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে থেকে রিকশার অপেক্ষা বড্ড কষ্টদায়ক। করার আর কিছুই নেই তবুও রিমন ভাই ফ্রী থাকলে বলা যেত গাড়ির কথা। মনে মনে এ কথা ভাবতেই পাশে এসে দাঁড়ালো নুপুর৷

‘রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছিস? চল আমার সাথে স্কুটিতে করে নামিয়ে দেব।’

‘একদম না। কাল কিনে আজই প্রথম চালিয়ে এসেছিস তাও আবার হাত-পা ছুলে! আমার অত মরার শখ নাই তুই একাই যা।’

-ভয় পাস না জানু এখন কিচ্ছু হবে না। তখন তো তোর ভা…. নুপুর কথা শেষ করতে পারলো না। হুট করেই একটা গাড়ি এসে থেমেছে তাদের সামনে। অর্নিতা দেখলো গাড়িতে রিদওয়ান ভাই আর তার ভাইয়া এসেছে। নুপুরও দেখলো তাদের দুজনকে তাতেই তার কণ্ঠ রোধ হলো। উত্তপ্ত দুপুর আচমকাই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়ে ঝলসে দিলো যেন নুপুরকে। সে আর একটি কথাও না বলে চুপচাপ স্কুটিতে গিয়ে বসলো। নুপুরের পলায়ন আন্দাজ করতেই রিদওয়ান ডাকলো, এ্যাই পিচ্চি চলে যাচ্ছ কেন?

নুপুর জবাব দিলো না উল্টো স্কুটি ছুটিয়ে পালাল সে। অর্নিতা বলল, ‘ও তোমাদের ভয় পায় রিদওয়ান ভাই।’

-কেন? রিদওয়ানের প্রশ্ন। অর্নিতা জবাব দেওয়ার আগেই অর্ণব বলল, ‘গাড়িতে ওঠ অর্নি মার্কেটে যাব।’

অর্নিতাও চুপচাপ উঠে বসলো গাড়িতে। অর্নিতা, অর্ণব দু ভাই বোনই অনেকটা চুপচাপ স্বভাবের তাই হয়ত দুজনে আর কোন কথা বলল না। রিদওয়ান যে খুব কথা বলে তেমনও নয় তবে তার এই দুই খালাতো ভাই,বোনের চেয়ে ভাল কথা বলে। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই রিদওয়ান আবার কথা বলল, ‘ অর্ণব আজ কিন্তু বাড়ি যাবি আমাদের সাথে। আম্মু জানে তুই আমার সাথে আছিস।’

অর্ণবের দৃষ্টি জানালার কাঁচ গলে পথের দিকে স্থির। সাঁই সাঁই করে পিছে চলে যাচ্ছে পথ আর পথের পথিকেরা তারা এগিয়ে যাচ্ছে সামনে এমন দৃশ্যে ভাবুক হয়ে আছে সে। রিদওয়ান জবাবের অপেক্ষা করে না সে তার মতই আবারও বলে চলে, ‘শিবলী ভাই ফোন করেছিল কথা বলতে চায় তোর সাথে।’

এ কথার পর মুখ ফেরালো অর্ণব। সে জানে শিবলী আর মেজো খালা কেন ফোন করছেন কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া মুশকিল। তাই ইচ্ছে করেই তাদের ফোনকল এড়িয়ে চলছে তাই বোধহয় তারা বড় খালাকে ধরেছে এবার। ঘাড় ফিরিয়ে একবার পেছনের সিটে বসা বোনটিকে দেখলো। গত মাসে আঠারোয় পা দিয়েছে এখনো কলেজ শেষ হয়নি আর এই মুহূর্তে বিয়ে! নাহ আর ভাবতে পারে না সে। গাড়ি এসে থেমেছে মৌচাক একটি মোবাইল শো রুমের সামনে। রিদওয়ান তার পরিচিত শো-রুমে নিয়ে এসেছে বলে অল্প সময়েই চমৎকার একটি হ্যান্ডসেট ডিসকাউন্টে পেয়ে গেল। অর্নির নিজস্ব কোন এন্ড্রয়েড ফোন ছিল না এতদিন৷ অর্ণব আর খালামনি দুজনেই চাইতো না অল্প বয়সে ফোন থাকুক অর্নির হাতে। প্রয়োজনে বাটন ফোন আছে আর অন্যান্য কাজে খালামনি, বৃষ্টি আপার ফোনই চলে। কিন্তু আজকাল কোচিংয়ের ক্লাস রুটিন, বিভিন্ন পড়ার অংশ মেসেজে শেয়ার করেন টিচাররা তাই অর্ণব এবার নিজে থেকে তাগিদ পেলো। কতবার আর খালামনি, বৃষ্টিকে জ্বা/লাবে! কিন্তু অর্নিতার জানা ছিলো না আজকের এই সারপ্রাইজ এর কথা অথচ মেয়েটা এখন জেনে অবাক হয়নি। রিদওয়ান নিজেই ফোন পছন্দ করে দিয়েছে দামটা অর্ণব মেটালো। ফোন হাতে পেয়ে অর্নি কোন উচ্চবাচ্য করলো না এমনকি ভাইকে ধন্যবাদটাও দিলো না তা দেখে রিদওয়ান চটাস করে একটা থাপ্পড় বসালো অর্নির মাথায়।

‘বেয়াদব! ভাই যে একটা সারপ্রাইজ দিলো থ্যাংকস দিলি না কেন?’

‘থ্যাংকস’

-আজব! জোরেই বলল রিদওয়ান ।
___________

-এ্যাই বৃষ্টি টেবিল গোছা জলদি অর্ণব আবার কারখানায় যাবে।

রায়না বেগম গোসলে ঢুকতে ঢুকতে মেয়েকে বলে গেলেন খাবার বাড়তে। অর্নিতা ফিরেই বৃষ্টির রুমে গোসলে গেছে। অর্ণবের আপাতত কিছু করার নেই বলে ড্রয়িংরুমেই বসে রইলো। সেখান থেকেই চোখে পড়লো বৃষ্টির তাড়াহুড়ায় টেবিলে খাবার বাড়া।

‘এত তাড়া কিসের তোর?’

-কই নাতো অর্ণব ভাই।

-তবে এমন ছুটোছুটি করে খাবার বাড়ছিস কেন?

-কই নাতো!

একই জবাবে বিরক্ত হলো অর্ণব৷ কিন্তু আর কিছুই বলতে ইচ্ছে করলো না তার। অর্ণব জানে এ বাড়িতে তার উপস্থিতি বৃষ্টিকে এলোমেলো করে দেয়। অবুঝ নয় সে তাই ইচ্ছে করেই খালার বাড়ির সীমানায় খুব একটা পা রাখে না সে। নেহায়েতই বোনটাকে এ বাড়ি রাখায় কৃতজ্ঞতায় মাসে দু একবার হাজির হয়। বোনের খরচটা জবরদস্তি খালার হাতে গুঁজে দেয়।

টেবিলে খাবার সাজানো হতেই বৃষ্টি রান্নাঘরে ঢুকে গেল। সেখান থেকে আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে মন ভরে দেখা যাবে প্রিয় মুখটাকে। বৃষ্টির সে চিন্তা মুহূর্তেই উবে গেল চোখের সামনে মাকে দেখে।

– এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছিস?

-আম্মু আজকে খাবারে কোন মিষ্টি আইটেম নাই আমি একটু সেমাই রাঁধি?

রায়না বেগম বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে৷ তারপর বিরক্তি নিয়ে বললেন, এই ভর দুপুরে ভাত রেখে তোর সেমাই কে খাবে!

আবেগি মনের আবেগের চাওয়া অর্ণব ভাইকে নিজের তৈরি কিছু একটা খাওয়াবে কিন্তু এ কথা মাকে কি করে বলবে! রায়না বেগমও বুঝি মেয়ের খায়েশ বুঝে গেলেন তাই নিজেই আবার বললেন, রেঁধে ফ্যাল দেখি অর্ণবটা খায় কিনা!

চৈত্র্যের খর দুপুরটা অকস্মাৎ হিমালয়ের শীতল, স্নিগ্ধ বেলায় পরিবর্তিত হলো যেন বৃষ্টির কাছে। ঝটপট হাত চালিয়ে তৈরি করে নিলো সেমাইটুকু৷ ততক্ষণে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার পর্ব অনেকটাই এগিয়ে গেছে। রিদওয়ান বাড়ি এসেও দুপুরের খাবারে থাকতে পারেনি অফিসের জন্য৷ জরুরি বার্তা পেয়ে অর্ণবদের পৌঁছে দিয়েই সে চলে গেছে৷ রিমন আর খালুও নিজ কাজে বাড়ির বাইরে তাই অর্ণবকে খালামনি আর অর্নিতার সাথেই খেতে হলো। বৃষ্টিকেও ডাকতে ভোলেনি কিন্তু মেয়েটা তো অর্ণবকে দেখে সেই যে হাওয়ায় ভাসছে এখনো তেমনই৷ সেমাইয়ের ওপর কাজু, কিশমিশ ছড়িয়ে গরম দুধ ঢেলে চটপট হাতে ডাইনিংয়ে এলো সে। অর্ণবের সামনে বাটি রাখতেই খালামনি বলল, খেয়ে দ্যাখ সেমাইটা।

-আচ্ছা।

এক চামচ সেমাই মুখে তুলে অর্ণব খালামনির দিকে তাকালো। বৃষ্টি তখনো তার চেয়ারের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে।

– ‘সেমাই ভাল হয়েছে।’ এই একটা বাক্য শুনতেই কিনা কে জানে অধীর আগ্রহে কর্ণদ্বয় বড় সজাগ বৃষ্টির কিন্তু না মন্দ ভাগ্য তার। অর্ণব ভাই সেমাইটা শেষ করলেও প্রশংসনীয় একটি শব্দও বললেন না। চোখের কোণে বিষাদ জমাট বাঁধলো বৃষ্টির। চুপচাপ সরে গেল ডাইনিং স্পেস থেকে। অর্ণব তা টের পেতেই খালার দিকে তাকালো, ‘শিবলী ভাই নাকি কথা বলতে চায়?’

অর্নিতার খাওয়া শেষ। ভাইয়া আর খালামনি এখন কি নিয়ে কথা বলবে তা বুঝতে পেরে সেও বসা থেকে উঠে এঁটো প্লেট বাটি নিয়ে কিচেনে গেল। এখন আর তার কোন কাজ নেই এখানে।

রায়না বেগম ভাগ্নের কথা শুনে প্রস্তুতি নিলেন মেজো বোনের বার্তাটা ঠিকঠাক উপস্থাপন করতে।

– শিবলী আর তোর মেজো খালামনি দুজনেই লাগাতার ফোন করছেন অর্ণব। তারা বিয়ের ব্যাপারে এবার আগাতে চায়। পি এইচ ডি করতে যাবে ছেলেটা তাই শায়না তাকে একা দিতে চায় না। আর বিয়ে যেহেতু আমরা আগেই মোটামুটি ঠিক করে রেখেছি তখন দেরি করে লাভ কি!

অর্ণব খালামনির কথা শুনে রাগ করলো না তবে মেজো খালার প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট হলো। কারণ, এই বিয়ে নিয়ে কথা শুরু থেকে খালামনিই নিজেই এগিয়ে চলছে। নিজেদের মানুষ বলে অর্ণব কিংবা বড় খালামনি কেউই খুব একটা আপত্তি তোলেনি তবুও অর্ণবের পক্ষ থেকে জবাব ছিলো, অর্নির কলেজ শেষ হওয়ার আগে বিয়ে হবে না। অথচ এখন তারা তাড়া দেখাচ্ছে! অর্ণব ঠিক করলো মেজো খালার সাথে সরাসরি কথা বলবে এবার। রায়নাকে সে কথা জানাতে তিনিও বললেন, ‘ঠিক আছে এই শুক্রবার শায়নাদের আসতে বলি তুইও আসিস।’

-আচ্ছা খালা মনি আমি এখন যাই কাজ আছে একটু।

‘হু’

-অর্নি!

অর্ণব বোনকে ডেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আর সবটাই দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দেখলো বৃষ্টি। কত পাষাণ এই মানুষটা ভেবে পায় না সে। বোঝে তো সবই তবুও কেন এত অবহেলা করে তাকে? সেকি একটুও ভালো নয় দেখতে? অক্ষিযুগল জল ছলছল বুকের ভেতরটাও ফেঁপে উঠলো। সেই কবে মন ডুবেছিল অর্ণব ভাইয়ে এখন সে মন ডুবে ডুবে মরণের দোরগোড়ায় তবুও মায়া হয় না মানুষটার একটু৷

সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততায় ছোট দাদীর খোঁজ নেওয়া হয়নি অর্ণবের। তাই তার ছোট্ট অফিসটায় ফিরেই সে দাদীকে কল দিতে ফোন বের করল পকেট থেকে। স্ক্রীণে কন্টাক্ট বের করার আগেই তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রীণে ভেসে ওঠা নম্বরটা অর্ধপরিচিত। আজ প্রায় সপ্তাহখানেক থেকে কল আসছে এই নম্বর থেকে অথচ রিসিভ করে হ্যালো বলার কয়েক সেকেন্ডেই কেটে যায়। প্রথম প্রথম ধারণা ছিল তার মা বোধহয় কল দেয় কিন্তু কথা বলার সাহস পায় না। দু দিন হয় ধারণা পাল্টেছে গত পরশু যখন হ্যালোর জবাবে কোন মেয়ের কাশির শব্দ শুনলো। আন্দাজ করে ফেলল কোন চেনা মেয়ে করছে কাজটা। কিন্তু কে!

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#সূচনা_পর্ব
-রূবাইবা মেহউইশ