Thursday, July 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 36



রূপার পালঙ্ক পর্ব-০৪

0

🔴রূপার পালঙ্ক(৪ পর্ব)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

আজ মোবারকের বসার জায়গা হয়েছে অন্য একটা ঘরে। প্রমোশন না ডিমোশন বোঝা যাচ্ছে না। এই ঘরটা আগেরটার চেয়ে বড়। তবে মেঝেতে কার্পেট নেই, দেয়ালে পেইনটিং নেই। সোফা আছে। সোফার কভার ময়লা। প্রথমবারের ঘরে মোবারক একা বসে ছিল। এই ঘরে আরো লোকজন আছে। সবার মধ্যে এক ধরনের ব্যস্ততা। মোবারক কিছুক্ষণ বসতেই বড় ট্রে ভর্তি চা নিয়ে একজন ঢুকল। সে সবাইকে চা দিচ্ছে। গণ-চা হয় খুব কুৎসিত হবে, আর নয়তো খুব ভাল হবে। এই চা-টা ভাল। শুধু চা না, দেখা গেল আরেকজন প্লেট ভর্তি কেক নিয়ে এসেছে। কেকের প্লেট রাখা হয়েছে সামনের টেবিলে। কেউ কেক নিচ্ছে না। মনে হচ্ছে দ্রতা করছে। মোবারক উঠে গিয়ে দুই পিস নিয়ে নিল। একটা আপাতত জমা থাকুক চায়ের কাপের পিরিচে।

কিছুক্ষণ পর পর ম্যানেজার সাহেব ঢুকছেন। একজন দুজন করে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। ম্যানেজার সাহেব আজ স্যুট পরেছেন। ভদ্রলোককে স্যুটে একেবারেই মানাচ্ছে না। টাই-এ ইস্ত্রী নেই বলে টাই এর মাথা উঁচু হয়ে আছে। মনে হচ্ছে টাইটা মাথা উঁচু করে আশে পাশে কি হচ্ছে দেখার চেস্টা করছে। কোনো কারণে ম্যানেজার সাহেবের মনও মনে হয় খারাপ। তাঁকে মিয়ানো মুড়ির মত লাগছে।

ম্যানেজার সাহেব মোবারকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বোঝাই যাচ্ছে ডাক পড়েছে। এক পিস কেক এখনো রয়ে গেছে, খাওয়া হয় নি। থাক ফিরে এসে খাওয়া যাবে।

মোবারক সাহেব কেমন আছেন?

জ্বি ভাল।

আসুন আমার সঙ্গে।

কোথায় যাব? বড় সাহেবের কাছে?

আপাতত আমার ঘরে।

আপনি নিজে এলেন কেন? কাউকে দিয়ে ডেকে পাঠালেই হত।

ডেকে পাঠানোর লোক নেই। অফিস স্টাফের দুইজন আজ আসেই নি। একজন গেছে ছুটিতে।

স্যার, আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি— আপনার উপর চাপ বেশি পড়েছে। আপনার বিশ্রাম দরকার।

ম্যানেজার সাহেব এই গভীর আন্তরিকতায় অভিভূত হলেন না। বিষাদময় মুখ করে মোবারককে অফিসে নিয়ে গেলেন। মোবারককে তার সামনের চেয়ার বসতে বললেন।

মোবারক বলল, স্যার, ডাক্তারের রিপোর্ট কি এসেছে?

হ্যাঁ এসেছে। রিপোর্ট পজেটিভ।

আপনার এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়?

হ্যাঁ যায়।

মোবারক সিগারেট ধরাল। ম্যানেজার সাহেব বললেন, ঝামেলা যখন ঘাড়ে এসে পড়ে একসঙ্গে আসে। আমার হয়েছ মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। কোন হেল্পিং হ্যান্ড নাই— অথচ আজকের মধ্যে আপনার পাসপোর্ট করাতে হবে। ভিসার জন্যে কাল পাসপোর্ট জমা দেব। কোথায় যাওয়া হবে সেটা নিয়ে ফ্যাকড়া বেঁধেছে।

কী ফ্যাকড়া?

স্যারের বড় মেয়ের জামাই বলছে অপারেশনটা ইংল্যান্ডে করাতে–কুইনস হসপিটাল। তার নাকি চেনা জানা আছে। এদিকে মেজো মেয়ের জামাই থাকেন সুইজারল্যান্ডে; তিনি সেখানে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

কোথায় যাওয়া হবে এখনো ঠিক হয় নি?

ঠিক হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে যাওয়া হবে। আসগর সাহেব এটা নিয়ে খুবই আপসেট। স্যারের সঙ্গে উনার যাবার কথা। উনি মনে হয় যাবেন না।

অজগর সাহেব কি উনার বড় মেয়ের জামাই?

জ্বি। অজগর না-আসগর। চলুন উনার সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেই।

উনার সঙ্গে কথা বলে কী হবে?

আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলেন।

চলুন যাই।

বসুন এক কাপ চা খেয়ে যাই। সকালে বাসা থেকে যে বের হয়েছি এক কাপ চা পর্যন্ত খেতে পারি নি। আপনি খাবেন?

অবশ্যই খাব। আপনি একা একা চা খাবেন এটা হয় না। এক্সকিউজ মি স্যার আপনিও কি বড় সাহেবের সঙ্গে যাবেন?

এখনও বুঝতে পারছি না। একবার ঠিক হচ্ছে যাব। একবার ঠিক হচ্ছে যাব না। টোটেল কেওস।

আপনি গেলে খুব ভাল হয়।

কেন?

আমিতো আর কাউকে চিনি না। শুধু আপনাকেই চিনি। আপনাকে নিয়ে দেশটা ঘুরে ফিরে দেখতাম। শুনেছি সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোহর।

ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। দ্রুত চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন।

চলুন আসগর সাহবের কাছে নিয়ে যাই। ভদ্রলোক খুবই মুডি। উনি কী কথা বলেন, না বলেন শুধু শুনে যাবেন। কোনো আগুমেন্টে যাবেন না।

জ্বি আচ্ছা।

আপনার ছবি তুলতে হবে। পাসপোর্টের জন্যেও ছবি লাগবে। ভিসার জন্যে ছবি লাগবে। গাড়ি দিয়ে দেব, ছবি তুলে নিয়ে আসবেন। পাসপোর্ট ফরমে সই করে যাবেন।

জ্বি আচ্ছা।

আপনি বরং এক কাজ করুন স্যারের বাড়িতে আপনাকে একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। জিনিসপত্র নিয়ে উঠে আসুন। কখন কোন প্রয়োজন হয়। এ বাড়িতে থাকতে কোনো অসুবিধা আছে?

জ্বি না।

চলুন আসগর সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসি। কথাবার্তা সাবধানে বলবেন। উনার মেজাজ আজ অত্যন্ত খারাপ।

আসগর সাহেব বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। তাঁর সামনের ছোট্ট টি টেবিল ভর্তি রাজ্যের পত্রিকা। মোবারককে দেখে ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকালেন। মোবারক ভদ্রলোককে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল। উনি সেই মানুষ যিনি প্রথম দিন অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে মোবারককে জিজ্ঞেস করেছেন আনিস সাহেব কি চলে গেছেন?

এই মুহূর্তে ভদ্রলোক যে খুব রেগে আছেন তা মনে হল না। রাগ থাকলেও খবরের কাগজে ধর্ষণ জাতীয় খবর পড়ে মনে হয় রাগ পড়ে গেছে। ম্যানজোর সাহেব তাঁর বিখ্যাত মিনমিনে গলায় বললেন, স্যার ইনিই মোবারক হোসেন।

মোবারক হোসেনটা কে?

কিডনি ডোনার।

ও আচ্ছা আচ্ছা। আপনি বসুন। ম্যানেজার সাহেব আপনি চলে যান। আপনার দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।

জ্বি আচ্ছা।

আসগর সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ইদানীং লক্ষ করছি আপনি কুঁজো হয়ে হাটছেন? Why? আপনার বাথরুমে আয়না আছে না?

জ্বি আছে।

দয়া করে একটু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুন— স্যুট পরা লোক যখন কুঁজো হয়ে থাকে তখন তাকে কেমন দেখায়। Please do that.

জ্বি আচ্ছা।

মোবারক লক্ষ করল ম্যানেজার সাহেব বারান্দা থেকে যাবার সময় সত্যি সত্যি কুঁজো হয়েই যাচ্ছেন। আগে কুঁজো হয়ে হাঁটছিলেন না। আসগর সাহেবের কথা শোনার পর থেকে কুঁজো হয়ে হাঁটছেন।

আসগর সাহেব হাত থেকে পত্রিকা নামিয়ে বললেন, আপনি হলেন কিডনি ডোনার!

জ্বি স্যার।

ভেরি গুড। হিউমেন বডির দুটা কিডনির কোনো প্রয়োজন নেই। একটাই মোর দ্যান সাফিসিয়েন্ট। একটা কিডনিতে বাকি জীবন আপনি হেসে খেলে পার করতে পারবেন। আপনি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন না।

মোবারক তার মুখ হাসি হাসি করে দেখাবার চেষ্টা করল যে সে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত না। তবে মনে মনে বলল, একটা কিডনিই যদি মানুষের জন্যে যথেষ্ট হয় তাহলে তুই তোর দুটা থেকে একটা দিয়ে দিচ্ছিস না কেন? তুই জামাই মানুষ। শ্বশুরের জীবন রক্ষার জন্য তুই কিছু করবি না? তোর একটা দায়িত্ব আছে? শ্বশুরের সম্পত্তিতো তোরা জামাইরাই হাতাবি। এক কাজ কর— তুই একটা কিডনি দে আর সুইজারল্যান্ডের জামাই দিক একটা। শ্বশুর পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাক।

আসগর সাহেব বললেন, অপারেশন যেটা হবে সেটাও রুটিন অপারেশন। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট এত হচ্ছে যে ব্যাপারটা টনসিল তোলার মত সহজ হয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগেও কোনো ফরেন বডি শরীর এক্সসেপ্ট করত না। শরীরের Immune systems allow করত না। নতুন একটা ড্রাগ এই প্রবলেম একশ ভাগ সলভ করেছে। ড্রাগটার নাম…।

জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হচ্ছে। ইচ্ছা থাকলেও এই জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় অংশ গ্রহণ করা মোবারকের পক্ষে সম্ভব না। হাসি হাসি মুখে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।

অপারেশনটা সুইজারল্যান্ডে হচ্ছে শুনেছেন বোধহয়?

জ্বি।

A very wrong decision. সুইসরা ঘড়ি বানানো ছাড়া আর কিছু পারে। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টতো আর ঘড়ি বানানো না। জটিল মেডিক্যাল প্রসিডিউর। ঠিক না?

অবশ্যই ঠিক।

অপারেশন এমন হসপিটালে হওয়া উচিত যেখানে সকাল বিকাল এই অপারেশন হচ্ছে। যেমন ধরেন ব্যাংককের আমেরিকান হসপিটাল। কিংবা ইন্ডিয়ার মাদ্রাজ। আমার ফার্স্ট চয়েস ছিল মাদ্রাজ। অবশ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে এ ধরনের অপারেশনের কিছু রিস্ক আছে। পোস্ট অপারেটিভ কেয়ারটা হয় না। যে কারণে আমি ইংল্যান্ডের কুইনস হসপিটালের কথা বলেছিলাম।

স্যার আপনি খুব ভাল কথা বলেছেন। অতি ভাল সাজেশন।

আসগর সাহেব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, এ বাড়ির সমস্যা হচ্ছে— এই বাড়ির লোকজন ভাল কথা, ভাল সাজেশন বলে কিছু বিশ্বাস করে না। কেউ একটা ভাল সাজেশন দিলে এরা ইমিডিয়েটলি সেটা কমোডে ফেলে ফ্ল্যাস করে দেবে। সেই আইডিয়া বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে চলে যাবে সিউয়ারেজে।

মোবারক মুখ হাসি হাসি করে রাখলেও মনে মনে বলল, ব্যাটা শুধু তোর সাজেশনস না, তোকে শুদ্ধ কমোডে ফেলে ফ্ল্যাস করে দেয়া দরকার। আমি এখানে বসার পর থেকে তুই সমানে কথা বলে যাচ্ছিস। তুইতো কথা বলেই কুল পাস না। তুই সাজেশনস কখন দিবি?

আসগর সাহেব মোটামুটি হতাশ গলায় বললেন, আমার একটা সাজেশন ছিল— দুজন ডোনার নিয়ে যাওয়া। যাতে একজন ডোনারের ব্যাপারে শেষ মুহূর্তে কোনো কমপ্লিকেশন হলে অন্য একজন স্ট্যান্ডবাই থাকে। এমনতো না যে ডোনার পাওয়া যাচ্ছে না বা টাকার অভাব হয়েছে। আমি কি কিছু ভুল বলছি?

অবশ্যই না। স্যার আপনিও কি যাচ্ছেন?

আমাকেতো যেতেই হবে। রুমা যেতে পারবে না। কারণ রুমার ছেলে স্কলাসটিকায় পড়ে। স্কুল থেকে ওরা একটা ড্রামা করছে ছেলে সেখানে সুযোগ পেয়েছে। চার্লস ডিকেন্সের আলিভার টুইস্ট। আঠারো তারিখে স্টেজ হবে। চিফ গেস্ট হলো আমেরিকান এ্যাম্বেসেডর। এত বড় একটা অনুষ্ঠানে বাবা-মা কেউ থাকবে না— তাতো হয় না।

মোবারক বলল, অবশ্যই হয় না। এতে শিশুমনের উপর একটা চাপ পড়ে। চাপের কারণে পরবর্তি সময়ে এইসব ছেলেপুলে গাধা টাইপ হয়ে যায়। স্যার আমি উঠি? আমার আবার পাসপোর্টের জন্যে ছবি তুলতে হবে।

আসগর সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন, এখনো পাসপোর্ট হয় নি? কুঁজো ম্যানেজারটা করছে কী? একেতো কানে ধরে উঠবোস করানো দরকার।

মোবারক অতিরিক্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার যাই। আপনার সঙ্গে কথা বলে এত ভাল লেগেছে।

আসগর সাহেব জবাব না দিয়ে হাতে আরেকটা খবরের কাগজ তুলে নিলেন।

মোবারক পাসপোর্টের ফরমে সই করতে করতে বলল, সুইজারল্যান্ড জায়গাটিতে শীত কেমন পড়ে?

ম্যানজোর সাহেব বললেন, ভাল শীত। বরফ পড়ে। সারা ইউরোপ থেকে লোকজন স্কী করতে সুইজারল্যান্ডে আসে।

শীতের কাপড় চোপড়তো সঙ্গে নেয়া দরকার।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, হুঁ।

মোবারক চিন্তায় পড়ে গেল। হুঁ বলে চুপ কলে গেলেতো হবে না। শীতের কাপড় কেনার টাকা পয়সা লাগবে না! গরম কাপড় ছাড়াওতো কিছু কাপড় দরকার। বিদেশ যাত্রা বলে কথা। মহাত্মা গান্ধী হলে নেংটি পরে প্লেনে উঠে পড়া যেত। সঙ্গে দড়ি বাঁধা দুর্বল ছাগী থাকলেও কেউ কিছু বলত না। ছাগীটাকে তার পাশের সীটে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করত। প্লেনের মধ্যেই ছাগলের দুধ দোয়ানোর ব্যবস্থা হত। এয়ার হোস্টেসরা হেল্প করতেন।

লজ্জা করে চুপ করে থাকা বিরাট বোকামি হবে। টাকা চেয়ে ফেলা দরকার। কাপড় চোপড়ের জন্যে আলাদা টাকা যদি না দেয় তাহলে বরং এই টাকাটা কিডনির দামের সঙ্গে এডজাস্ট করে দেবে। কিডনির দাম কখন দেবে সেটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার। বড়লোকের কারবার— এরা জিনিস হাতে না পেয়ে দাম দেবে বলে মনে হয় না। খোদা না করুক অপারেশন টেবিলে সে যদি মারা যায় তাহলে কী হবে। টাকাটা পাবে কে?

মোবারক খুক খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে নিচু গলায় বলল, ম্যানেজার সাহেব, কাপড় চোপড় কেনার জন্যে আমার কিছু টাকা দরকার।

ম্যানেজার মুখ তুলে তাকাল। মনে হচ্ছে এমন অদ্ভুত কথা সে জীবনে শুনেনি।

মোবারক তেলতেলে মুখ করে বলল, হাতে তো সময় বেশি নেই। কাপড় চোপড় এখনি কেনা দরকার।

ম্যানেজার এখনো তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলছে না। মোবারক হাই তোলার ভঙ্গি করতে করতে বলল, বন্ধু বান্ধবের কাছে কিছু ধারদেনা আছে। যাওয়ার আগে শোধ করে যেতে চাই। কিছুতো বলা যায় না, ধরেন। উল্টা-পাল্টা কিছু যদি হয়।

উল্টা-পাল্টা মানে?

আপনার স্যার কিডনি নিয়ে বেঁচে উঠলেন— আমি গেলাম ফুটে।

আপনি ফুটে গেলেন মানে?

ফুটে গেলাম মানে মরে গেলাম। ফুল ফোঁটা আর মানুষ ফোঁটা আলাদা ব্যাপার।

এখন আপনার কত টাকা দরকার?

মোবারক বিপদে পড়ে গেল। এটা একটা ঝামেলার প্রশ্ন। কত টাকা এরা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত তা না জেনে টাকা চাওয়াটা ঠিক হবে না। এরা কত টাকা দিতে পারে সেটা জানারও তো কোনো বুদ্ধি নেই।

মোবারক ক্ষীণ গলায় বলল, সেটা আপনার বিবেচনা। আর গরম কাপড় চোপড়ে কত লাগে তাও জানি না। কাপড় বানানো হয় না অনেক দিন।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনাকে একটা বুদ্ধি দিচ্ছি— নতুন গরম কাপড় কিনতে যাবেন না। বঙ্গবাজার চলে যান, সস্তায় প্রচুর ভাল কাপড় পাবেন। ফিটিং-এ সমস্যা হলে দরজি দিয়ে ফিটিং করিয়ে নেবেন। হাজার খানিক টাকায় সব কাপড় হয়ে যাবে।

জ্বি আচ্ছা। আর বন্ধু-বান্ধবের কাছে কিছু ঋণ ছিল। ঋণ রেখে মরতে চাই না।

মরবেন কেন?

মোবারক বলল, দুদিন থেকে মনের মধ্যে কুডাক শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে মারা যাব। এই জন্যে ঠিক করেছি আত্মীয়-স্বজন সবার সঙ্গে দেখাও করে যাব। আমার নিকট আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। দাদিজান বেঁচে আছেন। থাকেন নেত্রকোনায়। উনাকে দেখতে যেতে হবে। ভাবছি উনার জন্যে একটা শাড়ি, আর গরম চাদর নিয়ে যাব। বুড়ি খুশি হবে। ভাল একটা গরম চাদরের দাম কত হবে ম্যানেজার সাহেব জানেন?

জানি না।

সস্তায় পুরনো গরম চাদর অবশ্যই পাওয়া যাবে। পাওয়া গেলেও বুড়িকে নতুন চাদরই দিতে চাই। দাম যতই হোক। বুড়ির দিন শেষ। মরেইতো যাবে। নতুন গরম চাদর গায়ে দিয়ে মরুক। মৃত্যুর সময় ঠাণ্ডা কম লাগবে।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, কিছু ক্যাশ আমি দিচ্ছি। কেনাকাটা যা করার করুন। যে কাজগুলি আপনাকে করতে হবে তা হল— প্রথমেই বার কপি ছবি তুলবেন। পোলারয়েড ক্যামেরায় ছবি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেবে। আপনার সঙ্গে লোক দিয়ে দিচ্ছি, সে ছবি নিয়ে চলে যাবে। গাড়ি আপনার সঙ্গে থাকুক।

গাড়ি মানে?

আপনাকে একটা গাড়ি দিয়ে দিচ্ছি। ইচ্ছা করলে সারাদিন গাড়ি রাখতে পারেন। সন্ধ্যার দিকে গাড়ি এবং আপনার কাপড় চোপড় নিয়ে চলে আসবেন। এখানে আপনার জন্যে রুম রেডি করে রাখব। সুইজারল্যান্ড যাবার আগ পর্যন্ত আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।

মোবারকের অস্বস্তি লাগছে। ব্যাপার বোঝা যাচ্ছেনা। এরা কি তাকে বন্দি করে ফেলছে? এদের চোখের নজর থেকে বাইরে যাওয়া যাবে না এই অবস্থা।

স্যার আমার তো একটু দাদির সঙ্গে দেখা করা দরকার।

দাদির সঙ্গে আপনি তো আর আজই দেখা করছেন না। ভিসা হয়ে যাক, তারপর স্যারকে বলে একদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসবেন।

মোবারক ইতস্তত করে বলল, আজ থেকেই এই বাড়িতে থাকার আমি প্রয়োজন দেখি না। শেষ কয়েকটা দিন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, গল্প করে কাটাতে পারলে ভাল হয়।

ম্যানেজার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, মোটেই ভাল হয় না। আপনার জন্যে সব ব্যবস্থা করা থাকবে। সন্ধ্যার মধ্যে আপনি অবশ্যই এ বাড়িতে ফিরে আসবেন। আজ সন্ধ্যার পর স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।

একবার তো কথা হয়েছে। আর কথা বলাবলির কী আছে?

ম্যানেজার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, স্যার বলেছেন সন্ধ্যার পর আপনার সঙ্গে কথা বলবেন এই জন্যেই আপনাকে আসতে হবে। নিন এইখানে সই করুন।

মোবারকের বুক ধক করে উঠল, কোথায় সই করিয়ে নিচ্ছে কে জানে। আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়— এই জাতীয় কোনো লেখা নাতো?

মোবারক বিড়বিড় করে বলল, সই করব কেন?

টাকা নেবেন, সই করবেন না? অডিটের কাছে আমাকে হিসাব দিতে হবে না? গরিব মানুষের টাকা পয়সার হিসাব থাকে না, কিন্তু ধনী মানুষের প্রতিটি পয়সার হিসাব থাকে।

মোবারক সই করল। কত টাকা তাকে দেয়া হচ্ছে পাশে লেখা আছে। লেখা অংকটা বিশ্বাস হচ্ছে না। পঁচিশ হাজার টাকা। মোবারকের মনে হচ্ছে টাকা আসলে দুই হাজার পাঁচশ। একটা শূন্য বেশি লেখা হয়েছে। দশমিকের ফুটা বসাতে গণ্ডগোল হয়ে গেছে। এই টাকায় ম্যানেজার সাহেবের কোনো কমিশন আছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। কমিশন তো থাকবেই। টাকা পয়সার লেনদেন হবে, কমিশন থাকবে না। তা হয় না।

মোবারক গাড়িতে বসে আছে। গাড়ির মালিক যেভাবে বসে সে সেইভাবেই বসেছে। পেছনের সীটে বসেছে। একটা হাত ছড়িয়ে দিয়ে একটুখানি কাত হয়ে বসা। মোবারকের পকেটে সত্যি সত্যি পঁচিশ হাজার টাকা। একশ টাকার দুটো ব্যান্ডেল, পঞ্চাশ টাকার একটা বান্ডেল। প্যান্টের পকেট ফুলে আছে। গাড়ি থেকে নামার সময় ভাল করে চেক করতে হবে। একটা বান্ডেল পড়ে গেলে সর্বনাশ।

মোবারক বলল, ড্রাইভার সাহেব আপনার গাড়িতে তেল আছে তো?

ড্রাইভার বলল, জ্বি আছে।

মোবারক উদাস গলায় বলল, না থাকলেও সমস্যা নেই। তেল নিয়ে নেব। গাড়িতে গান শোনার ব্যবস্থা কি আছে?

জ্বি আছে।

দিন গান দিন।

ইংরেজি না বাংলা?

ইংরেজি বাংলা হিন্দি একটা দিলেই হয়। আর শুনুন গাড়ি একটু স্লো চালান। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। প্রথমে একটা ফটোগ্রাফারের দোকানে যেতে হবে, ছবি তুলতে হবে।

গাড়ি চলছে। গান বাজছে। ইংরেজি গান— কী অদ্ভুত গানের কথা—

চলবে।

রূপার পালঙ্ক পর্ব-০৩

0

🔴রূপার পালঙ্ক (পর্ব :৩)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

তারা তাদের জায়গায় চলে এসেছে।

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পুলিশ ফাঁড়ির একটু পেছনে ঝাকড়া বাদাম গাছের নিচটাই তাদের জায়গা। একদিকে শিশু পার্ক, একদিকে পুলিশ ফাঁড়ি, বাকি দুদিকে ঘন ঘাছপালা। বাগানের এই অংশটা ঠিক বাগান বলে মনে হয় না । মনে হয় জংলা জায়গা। ছাতিম গাছটাকেও জংলা গাছের মতই লাগে। গাছটা নিচু, দাঁড়ালে ছাদের মত ছড়ানো ডালে মাথা লেগে যাবে। কিন্তু বসতে কোনো অসুবিধা নেই। গাছটা এমনভাবে ছড়িয়েছে যে মাথার উপর প্রকাণ্ড ছাতা ধরে আছে এমন মনে হয়। শুধু মনে হওয়া-হওয়ি না। গাছটা আসলেই ছাতার কাজ করে। একবার তারা গাছের নিচে বসে আছে নামলো ঝুম বৃষ্টি। একটা ফোঁটা পানি তাদের গায়ে পড়ল না।

মোবারকদের পছন্দের জায়গার আরো কিছু বিশেষত্ব আছে। প্রথম বিশেষত্ব হচ্ছে— সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সন্ধ্যার পর থেকে নানান ধরনের লোকজন এবং মেয়ে মানুষ ঘোরাফেরা করে কিন্তু এই দিকে কেউ আসে না। জায়গাটা ভাল না; গরম— এমন কথা প্রচলিত আছে। মাস দুএক আগে আঠারো উনিশ বছরের একটি মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তারও আগে বর্ষার সময় মাথা নেই একটা পুরুষের শরীর পাওয়া গেছে। শরীরটা বস্তায় ভরে মুখ সেলাই করে এই ছাতিম গাছের নিচেই ফেলে রাখা হয়েছিল। মৃতদেহ পচে গলে বিকট গন্ধ ছড়ানো শুরু করার পর পুলিশ এসে বস্তা নিয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়।

মুণ্ডুহীন লাশ শিরোনামে কয়েকটা প্রতিবেদন ছাপা হবার পর পাঠক এবং পত্রিকা দুইই ক্লান্ত হবার কারণে ব্যাপারটা থেমে যায়। তবে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে চা এবং চায়ের সঙ্গে অন্যসব বস্তু যারা বিক্রি শুরু করে তারা জমাটি এক ভূতের গল্প চালু করে দেয়। নিশুতি রাতে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ নাকি মাথা নেই একটা মানুষ দেখা যায়। মানুষটা বাগানের লোকদের কাছে তার মাথাটা কোথায় তা জানতে চায়।

সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। প্রেমিকা বাড়ি ফিরতে চাচ্ছে, প্রেমিক দিচ্ছে না। অন্ধকারে প্রেমিকাকে যতক্ষণ পাশে রাখা যায়। দুজনেরই ঝিম ঝিম অবস্থা। তখন মাথা নেই লাশ গাছের আড়াল থেকে শরীরটা বের করে বলবে, এক্সকিউজ মি আপা। আমার মাথাটা কোথায় বলতে পারেন?

এই ধরনের গল্প কেউ বিশ্বাস করে না, তবে পুরোপুরি অবিশ্বাসও করে না। মানুষের মনের একটা অংশ উদ্ভট এবং বিচিত্র গল্প বিশ্বাস করতে পছন্দ করে।

রাত দশটা। মোবারক, জহির এবং বজলু— তিনজনই আছে। বজলু যথারীতি গম্ভীর হয়ে আছে, কথা বলছে না। ছাতিম গাছের নিচে বসার সময় একবার শুধু বলেছে, আমার কাজ আছে। আমি দশ পনেরো মিনিট থাকব।

জহির বলেছে, থাকিস না। তোকে কি আমরা শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি? যার যার শিকল তার তার হাতে। তুই তোর শিকল বাজাতে বাজাতে চলে যা।

বজলু বলেছে, আজ কিছু খাবও না। তোরা খাওয়ার জন্যে পাছরা পাছরি করিস না।

জহির বিরক্ত হয়ে বলেছে, তুই কি কচি খোকা যে ফিডিং বোতলে করে তোকে মদ খাওয়াতে হবে? না খেলে না খাবি। চলে যেতে চাইলে চলে যা। এখনি চলে যা।

বজলু বলেছে, চলে যাব?

জহির বলেছে, অবশ্যই চলে যাবি। তোর মত বন্ধু আমি ‘ ’ দিয়েও পুছি না।

বজলু সঙ্গে সঙ্গে উঠে হাঁটা দিয়েছে। জহির বা মোবারক এটা নিয়ে মোটেও ব্যস্ত হয়নি। কারণ দুজনই জানে বজলু ফিরে আসবে। কতক্ষণে ফিরবে এটা বলা যাচ্ছে না। পাঁচ মিনিটেও ফিরতে পারে আবার ঘণ্টা দুই পরেও ফিরতে পারে। তবে কিছুদিন হল বজলু বদলাচ্ছে। অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। তাকে কয়েকদিন না-কি ছোট রফিকের সঙ্গে দেখা গেছে। তার বন্ধুরা বজলুকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে আজ হয়ত মোবারক জিজ্ঞেস করবে। রাগ করে বজলুর চলে যাওয়া বা ফিরে আসা কোনো ঘটনা না। তবে এ রকম ঘটনা ঘটলে খুবই রাগ লাগে। নেশার জন্যে রাগটা খারাপ। যে রেগে থাকে তাকে কোনো কিছুতেই ধরে না। নেশার খরচ জলে যায়।

জহির কাঁধের ব্যাগ থেকে বোতল বের করল। জমাটি নেশা করার কিছু নিয়ম কানুন আছে। নেশার সব কিছু চোখের সামনে রাখতে হয়। ভাগ্য ভাল থাকলে সুন্দর করে সাজানো বোতল দেখলেই নেশা হয়ে যায়। নেশা তো আর কিছু না— মনের একটা বিশেষ ভাব। সেই বিশেষ ভাবে হুট করে উঠা যায় না। একতলা থেকে দোতলায় উঠতে হলে যেমন অনেকগুলি সিঁড়ি পার হতে হয়। এক ভাব থেকে আরেক ভাবে যেতেও সিঁড়ি টপকাতে হয়। কেউ দুটা তিনটা সিঁড়ি এক সঙ্গে টপকায়। কেউ সিঁড়ি টপকানোর সময় পা পিছলে পড়ে যায়, উপরের তলায় উঠতেই পারে না। আসল ভাবের জায়গায় যারা উঠবে তারা প্রতিটি সিঁড়ি আস্তে আস্তে পার হবে। কারণ প্রতিটি সিঁড়ির কিছু আলাদা মজা আছে। আলাদা ভাব আছে।

জহির বলল, পুড়িয়াও আছে। দিব?

মোবারক বলল, এখন না।

আয় ডাইল দিয়ে শুরু করি। বজলু ফিরে আসুক তখন পুড়িয়া। ডাইরেক্ট একশন।

মোবারক জবাব দিল না। তার মানে ডাইল দিয়ে শুরুর ব্যাপারে তার আপত্তি নেই। ডাইল হল ফেন্সিডিল। ইদানীং চালু হয়েছে ফেন্সিডিলের বোতলে একটা দশ মিলিগ্রাম ইউনিকট্রিন ট্যাবলেট ছেড়ে দেয়া। ট্যাবলেটটা পুরোপুরি গুলে না। আধাগলা হয়ে তলায় পড়ে থাকে। সেই পড়ে থাকা অংশটা খাওয়ার নিয়ম নেই।

ভাবে বসার প্রথম পনেরো মিনিট বেশ জটিল। একেক জন একেক মুডে থাকে। কেউ কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ বিরক্ত হয়ে যায়। কেউ রাগ করে। কেউ ধুম করে বলে বসে, না আজ শরীর ভাল না। আজ কিছু খাব না। তখন একজনকে থাকতে হয় যে সবাইকে সামলে সুমলে রাখে। সে হল সামালদার। তাকে মেজাজ খারাপ করলে চলবে না। ভাবের আসর নষ্ট হয়ে যাবে। প্রথম দশ পনেরো মিনিট কষ্ট করে পার করে দিলে বাকি সময়টা নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না। প্রথম পনেরো মিনিটের ধাক্কাটা সব সময় সামলায় জহির। কোনো বিষয়ে তার ধৈর্য নেই কিন্তু ভাবের আসরে তার ধৈর্য অসীম।

জহির ফেন্সিডিলের একটা বোতলের মুখ খুলে মোবারকের দিকে এগিয়ে দিল। মোবারক হাত বাড়াল না। বরং ছাতিম গাছে হেলান দিয়ে উদাস হয়ে গেল। জহির চিন্তিত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা করছে না?

মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না।

ঘটনা খারাপ। শুরুতেই কেউ বেঁকে বসলে সমস্যা। জহির শান্ত গলায় বলল, খেতে ইচ্ছা না করলে খাস না। রোজই এই বিষ খাওয়া লাগবে তার কোনো কথা নেই। ইচ্ছা না হলে খাবি না।

জহির নিজেই বোতলে চুমুক দিল। গলা করুণ করে বলল, অনেক কষ্টের টাকায় এই বিষ কিনেছি। একজন রাগ করে চলে যাবে। একজন খাবে না। ভাল কথা। আমি খাব। আমার হল কষ্টের টাকা। আমি ছাগল কোরবানি দিয়েছি। আমি না খেলে হবে?

জহির পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করল। দলামচা সিগারেট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাধারণ সিগারেট না। বিশেষ সিগারেট। তামাকের সঙ্গে জিনিস মেশানো হয়েছে। সিগারেটে মিশানোর জিনিসও কয়েক পদের আছে। একটা আছে সামান্য টানলেই মাথার তালু জ্বলে। আরেকটায় হাই প্যালপটিশনের মত মাথায় প্যালপিটিশন। এই দুইটাই খারাপ। জিনজির নামে একটা পাওয়া যায়— এক্সপোর্ট কোয়ালিটি। বাজারের সেরা। জহির ওস্তাদ লোক। সে জিনজির ছাড়া অন্য কিছু আনবে না। টাকা পয়সা না থাকলেও জহিরের নজর উঁচা।

জহির বলল, সিগারেটও না?

মোবারক বলল, না।

পান খা একটা। মিষ্টি পান আছে। জর্দা দিয়ে একটা পান খেলে ভাল লাগবে। ময়মনসিংহের মিকচার জর্দা। বেহেশতী জিনিস।

মোবারক না-সূচক মাথা নেড়ে নিজের সিগারেট বের করল। জহির ধরালো তার বিশেষ সিগারেট। দুজনের সিগারেটের আগুন ওঠানামা করছে। শীত শীতও লাগছে। মোবারকের গায়ে দামি শাল, মাথায় পশমি টুপি তারপরেও তারই শীতটা বেশি লাগছে। জহির তার বোতলে একবারই চুমুক দিয়েছে। একা একা ভাবের আসর শুরু করা যায় না। সঙ্গী লাগে। ভাল কাজ মানুষ একা করতে পারে। বেশির ভাগ সময় তাই করে। কিন্তু কোনো মন্দ কাজই মানুষ একা করতে পারে না। মন্দ কাজে সঙ্গী সাথি লাগে, উৎসাহদাতা লাগে। তালি বাজানোর নোক লাগে।

মোবারক বলল, তুই দেখি আজ মেলা খরচ করেছিস। এক হাজার টাকার পুরোটাই শেষ?

জহিরের মুখে সামান্য হাসির আভা। মোবারক কথা বলা শুরু করেছে। এটা ভাল লক্ষণ। এখন যদি বজলু চলে আসে তাহলেই আসর জমে যাবে। আজকের সাপ্লাই ভাল। শুধু ভাল না, খুবই ভাল। জহিরের কাপড়ের ব্যাগে ভদকার একটা বোতল আছে। পুরো বোতল না, অর্ধেকেরও কম আছে। এটা জহির ইচ্ছা করে রেখে দিয়েছে ফিনিশিং দেয়ার জন্যে। ফিনিশিং-এর জন্য ভদকার মত জিনিস হয় না। যে জাতি ভদকার মত আসলি চিজ বের করেছে সেই জাতি আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারল না। পাছায় লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল এটা ভাবাই যায় না।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে কে যেন আসছে। তার মুখেও জ্বলন্ত সিগারেট। হ্যাঁ বজলুই ফিরে আসছে। জহির নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। ভাবের আসর এখনি শুরু হবে।

বজলুকে আসতে দেখেই মোবারকের মনে হয় মুড ভাল হয়ে গেছে। সে জহিরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি একটা বোতল। সামান্য খাব। দুই চুমুক।

জহির নিজের বোতল এগিয়ে দিল। এবং অতি দ্রুত আরেকটা বোতলের মুখ খুলল। বোতলের টিনের মুখায় লেগে হাত মনে হয় কেটেছে। রক্ত বের হচ্ছে। বের হোক। এত কিছু দেখলে চলবে না। বজলু এসে দাঁড়ানো মাত্র তার হাতে বোতল তুলে দিতে হবে। জহিরের এত আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে।

জমিয়ে কুয়াশা পড়ছে। চারপাশ ঝাপসা। ছাতিম গাছের পাতায় শিশির জমেছে। মাঝে মাঝে দুএকটা ফোঁটা এদের গায়ে পড়ছে। যার গায়েই ফোঁটা পড়ছে সেই বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বলছে, গাছ মুতে দিয়েছে। এই রসিকতায় হেসে তিনজনই গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভাবের রাজ্যে কোনো রসিকতাই পুরনো হয় না। প্রথমবার যেমন হাসি হাসে সপ্তমবারেও তেমন হাসি হাসে। বরং বেশি হাসে। এই হাসি এই আনন্দ যে-কোনো মুহূর্তে গভীর বিষাদে রূপান্তরিত হতে পারে। এদের এখনো হচ্ছে না কারণ এরা তিন জন। আনন্দের ভাব প্রবল থাকে যখন সংখ্যায় তিন বা তিনের বেশি থাকে। দুজন থাকলে উল্টোটা হয়।

এদের পোষাক আশাকেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মোবারকের শাল এবং মাথার টুপি জহির গায়ে দিয়ে বসে আছে। মোবারক বসে আছে গেঞ্জি গায়ে কারণ তার শার্টে ডাইল পড়ে গেছে। জহির বসে আছে, বাকি দুজন মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে আছে।

মোবারক বলল, ক্ষিধে লেগেছে।

বজলু উঠে বসতে বসতে বলল, ক্ষিধে লেগেছে।

জহির বলল, ক্ষিধার চোটে পেট জ্বলে যাচ্ছে।

ভাবের রাজ্যে ভিন্নমতের স্থান নেই। সবাই সব বিষয়ে একমত হয়। এখানেও তাই। একজনের ক্ষিধে লাগলে সবার লাগতে হবে।

বজলু বলল, ক্ষিধে লাগলে মাকড়সা কী করে জানিস?

মোবারক উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইল, কী করে?

যদি পোকা মাকড় না থাকে তাহলে নিজের একটা দুটা পা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। ক্ষিধা মিটায়।

বলিস কী?

হুঁ। পা খেয়ে ফেললেও সমস্যা নেই। মাকড়সাদের পা আবার গজায়। টিকটিকির মত। টিকটিকির যেমন লেজ গজায়। মাকড়সারও পা গজায়।

জহির সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, দোস্ত সত্যি কথা বলছিস তো?

বজলু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কোনদিন মিথ্যা বললাম? তোরা বুকে হাত দিয়ে বল, মিথ্যা কোনদিন বলেছি?

না, তা অবশ্যি ঠিক।

মাকড়সার পা খাওয়ার বিষয়ে যা বললাম, এটাও ঠিক। আমরা মাকড়সা হলে ভাল হত। নিজেদের পা নিজেরা খেয়ে বসে থাকতাম। কিংবা আমি খেতাম মোবারকেরটা। মোবারক খেত আমারটা।

মোবারক ঘেন্নায় মুখ কুঁচকে বলল, অসম্ভব। আমি মরে গেলেও মানুষ খাব না।

খাওয়ার ব্যবস্থা নেই বলে তুই খাচ্ছিস না। খাবার ব্যবস্থা থাকলে তুই খেতি।

খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও খেতাম না।

তুই নিজেকে বেশি চিনে ফেলেছিস?

আমাকে আমি চিনি না আর তুই চিনে ফেললি?

অবশ্যই আমি তোকে চিনি। চোর চিনতে সময় লাগে না। তুই একটা বিরাট চোর। থিফ নাম্বার ওয়ান। থিফ অফ বাগদাদের মত তুই হলি থিফ অফ ঢাকা।

মোবারক হতভম্ব গলায় বলল, আমি চোর?

বজলু বলল, অবশ্যই চোর। তুই বুকে হাত দিয়ে বল যে শালটা তুই গায়ে দিয়েছিস এটা চুরির মাল না?

মোবারক বুকে হাত দিয়ে বলল, এই শালটা আমার এক দূর সম্পর্কের মামার। মামার কাছে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় মামা বললেন, আমার একটা পুরনো শাল আছে। নিয়ে যা।

এ রকম দিলদরিয়া মামা তোর আছে? এক কথায় শাল দিয়ে দিল?

হার্ট বড় লোকজন পৃথিবীতে আছে না? আমার এই মামার হার্ট খুবই বড়। সব সময় না। মাঝে মাঝে বড়। মনে কর আমার একশ টাকার দরকার। আমি যদি মামার পায়ে ধরে কেঁদে পা ভিজিয়েও দেই কোনো লাভ হবে না। আবার কোনোদিন চলে আসার সময় হুট করে বলবে–ধর রিকশা ভাড়া নিয়ে যা। বলেই একটা একশ টাকার নোট ধরিয়ে দেবে।

তুই যে শুধু চোর তাই না, তুই মিথ্যা কুমার। সমানে মিথ্যা কথা বলছিস।

আমি যদি মিথ্যা বলে থাকি তাহলে আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান।

জহির বলল, আহা তোরা কী শুরু করলি। চুপ কর না। সামান্য ভদকা আছে এক ঢোক করে হবে। ফিনিশিং টাচ। এখন খাবি না পরে খাবি?

বজলু বলল, এখনই খাব। পরে আবার কী?

জিনিস কিন্তু শেষ। আর কিছুই নাই।

লাগবে না। ভদকা পেটে এক ফোঁটা পড়লেই হবে।

জহির বলল, তোরা চাইলে আমি ব্যবস্থা করি। আমার কাছে টাকা আছে।

মোবারক বলল, কত টাকা আছে?

বজলু বলল, খবরদার কত টাকা আছে বলবি না। মোবারক হাপিস করে দেবে। হারামজাদা বিরাট চোর। থিফ অফ ঢাকা।

মোবারক চোখ লাল করে বলল, আমি যদি চোর হয়ে থাকি তাহলে এই মাটি ছুঁয়ে বলছি— আমি অসতী মায়ের গর্ভের জারজ সন্তান।

জহির বলল, তোরা একটু চুপ করবি? চেঁচামেচি শুরু করলি কেন?

মোবারক বলল, তাতে তোর অসুবিধা হচ্ছে? তুই ঝিম মেরে বসে আছিস বসে থাক।

জহির বলল, কোলকাতার একটা গল্প মনে পড়েছে।

জহির বছর তিনেক আগে চারদিনের জন্য কোলকাতায় গিয়েছিল। সেই গল্প তিন বছরেও শেষ হয় নি। কোনোদিন শেষ হবে বলেও মনে হচ্ছে না। যে-কোনো পরিস্থিতিতে যে-কোনো উপলক্ষে তার কোলকাতার একটা গল্প থাকে। জহির উৎসাহের সঙ্গে শুরু করল।

হয়েছে কী— রাত তখন দুটা, আমি আর শিবেন ট্যাক্সি করে যাচ্ছি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। যাচ্ছি গড়িয়াহাটার দিকে। গড়িয়াহাটা জায়গাটা কোথায় বলি…

গড়িয়াহাটা জায়গা কোথায় বলতে হবে না। তুই গল্প শেষ কর।

আমাদের ট্যাক্সির ড্রাইভার পাঞ্জাবি। শিখ। মাথায় পাগড়ি…।

মাথায় কী বলার দরকার নাই। শিখরা মাথায় পাগড়ি পরে সবাই জানে। গল্প শেষ কর।

ট্যাক্সি যাচ্ছে। আমার ঝিমুনির মত এসেছে।

ঝিমুনির মত আসবে আবার কী? তোরতো ঝিমুনি লেগেই আছে।

প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ হার্ড ব্রেক। আমার ঘুম গেল ভেঙে। শিখ ড্রাইভার বলল, সে আর যাবে না।

মোবারক বলল, যাবে না মানে। মাঝপথে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দেবে? ইয়ারকি? লাথি মেরে হারামজাদাকে ট্যাক্সি থেকে ফেলে দেয়া দরকার। তুই কী করলি?

আমি ভদ্রভাবে বললাম, ভাই কেন যাবেন না। সমস্যা কী?

বাংলায় বললি?

হিন্দিতেই বলেছি। ভুল হিন্দি। ট্যাক্সি ড্রাইভাররা আবার ভুল হিন্দিটাই ভাল বুঝে। সব সময় ভুল হিন্দি শুনেতো।

হিন্দিটা কী?

ভাইয়া! কেউ নাহি জায়েগি। প্রবলেম কিয়া হুয়া?

ড্রাইভার কী বলল?

ড্রাইভার বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া।

কী বলল আবার বল।

বলল— বিল্লি মে কাট দিয়া।

এর মানে কী?

জহির রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, মানে হচ্ছে তার গাড়ির সামনে দিয়ে একটা বিড়াল চলে গেছে। বিড়ালটা রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক পাশে গিয়েছে।

তাতে সমস্যা কী?

সমস্যা আছে। শিখ ড্রাইভাররা বিশ্বাস করে গাড়ির সামনের রাস্তা যদি বিল্লি মে কাট দেয় তাহলে মহাবিপদ। এ্যাকসিডেন্ট হবেই। তখন তারা কিছুতেই গাড়ি ঐ রাস্তা দিয়ে চালাবে না। গাড়ি রাস্তার এক পাশে নিয়ে অপেক্ষা করবে। অন্য কোনো গাড়ি যদি পার হয় তাহলেই বিল্লি কাটার দোষ কাটা যাবে।

বাক্যটা কী?

বিল্লি মে কাট দিয়া।

তিনজনই একসঙ্গে হাসতে শুরু করল। এর পরের ঘটনা অতি বিচিত্র। কিছুক্ষণের জন্যে হাসি থামে, তখন একজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত হাসি শুরু হয়। সেই হাসি থামতেই আরেকজন বলে, বিল্লি মে কাট দিয়া। আবারো হাসি শুরু হয়। হাসতে হাসতে এদের চোখে পানি এসে গেল। তাতেও হাসি থামে না।

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে পুলিশ টহলে আসে রাত একটার দিকে। টহল মানে চাঁদা তোলা। নিশিকন্যাদের রোজগারের একটা অংশ পুলিশকে দিতে হয়। এদের সঙ্গে যে সব কাস্টমার থাকে, ধমক ধমক দিয়ে তাদের কাছ থেকেও কিছু আদায়ের চেষ্টা করা হয়। তবে নেশারুদের এরা ঘটায় না।

হাসির শব্দে আকৃষ্ট হয়ে দুজন টহল পুলিশ এগিয়ে এল। ওদের গায়ে টর্চের আলো ফেলে বলল, কী হয়েছে?

তিনজনই হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, বিল্লি মে কাট দিয়া। বিল্লি মে কাট দিয়া।

পুলিশ টর্চ নিভিয়ে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ তার আধবুড়ো এক লোককে দেখা গেল। ভীত চেহারা। সে সঙ্গে মেয়ে নিয়ে এসেছে। নিরিবিলি জায়গা খুঁজছে। বজলু বলল, এই যে ওল্ড ব্রাদার, অন্য জায়গায় যান। এই জায়গাটা ভাল না। এই জায়গা বিল্লি মে কাট দিয়া।

রাত অনেক হয়েছে। তিন বন্ধুই পাশাপাশি শুয়ে আছে। তাদের গায়ে মোবারকের শাল। জহির ঘুমুচ্ছে। শান্তির গাঢ় ঘুম। জেগে আছে মোবারক এবং বজলু। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাদের আলোয় কুয়াশা চকচক করছে। মোবারকের কাছে কুয়াশাটাকে মনে হচ্ছে হালকা শাদা পশমে বোনা বিশাল এক চাদর। কেউ একজন যেন পৃথিবীতে বিশাল এক চাদর পাঠিয়েছে। যে চাদর দিয়ে পৃথিবীর সব দুঃখী মানুষকে ঢেকে দেয়া যায়।

মোবারক একটা হাত রাখল বজলুর গায়ে।

বজলু বলল, কিছু বলবি?

মোবারক বলল, দোস্ত তোকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। আমি আসলেই চোর। এই শালটা আমি চুরি করে এনেছি।

বাদ দে।

না দোস্ত বাদ দিব কেন? আমি চোর। বিরাট চোর। আমি অসতী মায়ের জারজ সন্তান।

আহ্ বাদ দে না।

মোবারক কাঁদতে শুরু করল। জহির বলল, দোস্ত কাঁদিস না। কান্না থামা। তোর পায়ে ধরি কান্না থামা।

মোবারক কাঁদছে। মোবারকের কান্না দেখে বজলুরও কান্না পেয়ে গেছে। সেও কাঁদছে। তাদের গায়ে গাঢ় হয়ে কুয়াশা পড়ছে। কান্না থামানোর জন্যে জহির একবার মোবারকের পায়ে ধরছে আরেকবার ধরছে বজলুর পায়ে।

চলবে। 📌

রূপার পালঙ্ক পর্ব-০২

0

🔴রূপার পালঙ্ক (পর্ব :২)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

মাফলার পরার মত শীত পড়েনি, কিন্তু মোবারকের গলায় মাফলার। মাথায় পশমি টুপি। গায়ে উলের চাদর। পশমি টুপি এবং চাদরের কারণে তার চেহারা বদলে গেছে। আয়নায় সে তার নতুন চেহারা দেখেনি, না দেখলেও চেহারা যে বদলেছে এটা নিশ্চিত। চায়ের দোকানের মালিক কুদ্দুস মিয়া কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, কেডা মোবারক না?

মোবারক জবাব না দিয়ে হাই তুলল। পোশাক মানুষের আচার আচরণও বদলে দেয়। টুপি এবং উলের চাদর গায়ে দেয়ার পর থেকে মোবারকের অন্য রকম লাগছে। খাতির জমানো টাইপ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কুদ্দুস মিয়া তার বন্ধুস্থানীয় মানুষ। সে একটা প্রশ্ন করবে আর মোবারক জবাব দেবে না— এ রকম আগে কখনো হয়নি।

চা খাইবা মোবারক?

মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। চায়ের স্টলে ঢুকলে। চায়ের স্টলের

কোনো নাম থাকে না, এর নাম আছে— মদিনা রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের নামের সঙ্গে মিল রেখেই বোধ হয় কুদ্দুসের লেবাসেও ইসলামী ভাব আছে। পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করে এ রকম তিনটা পাঞ্জাবী তার আছে। তার মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি। মাথায় সব সময় কিস্তি টুপি। তার পাশ দিয়ে হাঁটলে আতরের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে তার এই পোশাকের সঙ্গে ধর্মকর্মের সম্পর্ক নাই। নবীজী তাকে স্বপ্নে এ ধরনের পোষাক পরতে বলেছেন বলেই সে পরে। এর বেশি কিছু না। নবীজীর কথা শুনে এ ধরনের পোশাকে পরা শুরু করার পর থেকে নাকি তার ব্যবসার সুবিধা হয়েছে। তবে চা বিক্রি ছাড়াও তার অন্য ব্যবসা আছে। সেই ব্যবসা নবীজীর পছন্দ হবার কোন কারণ নেই।

মোবারকের মেজাজ সামান্য খারাপ। সে যে চেয়ারে বসে সেখানে একজন কাস্টমার বসে আছে। কাস্টমার যেভাবে চা খাচ্ছে তাতে মনে হয় চা শেষ করতে ঘণ্টাখানিক সময় লাগাবে। আরে ব্যাটা পিরিচে ঢেলে লম্বা টান দে। এক টানে ঝামেলা শেষ। তুই বিড়াল নাকি? বিড়ালের মত চুকচুক করে চা খাচ্ছিস। এক কাপ চা খেতে যদি এক ঘণ্টা লাগিয়ে দিস অন্য কাজ কখন করবি?

অত্যন্ত বিরক্ত মুখে মোবারক কাস্টমারের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, ব্রাদার একটু সরে পাশের চেয়ারে বসেন।

কাস্টমার চায়ের কাপ নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, কেন?

এই চেয়ারটায় আমি বসব।

খালি চেয়ার তো আরো আছে সেখানে বসেন।

অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা। চায়ের দোকান প্রায় ফাঁকা। যে-কোনো জায়গায় বসা যায়। যে আরাম করে বসে চা খাচ্ছে তাকে সরিয়ে তার জায়গাতে বসতে হবে কেন? কাস্টমারের কথায় মোবারকের রাগ হবার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু রাগ লাগছে। ইচ্ছা করছে হারামজাদাটার বিশেষ জায়গায় কোঁৎ করে একটা লাথি মারতে। দুটা বিচির যে কোনো একটায় লাগলেই খবর আছে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে। মোবারক নিজেকে সামলালো। এইসব ঝামেলায় একা যাওয়া ঠিক না। একা মানে বোকা। সে উদাস ভাব নিয়ে কাস্টমারের পাশে বসল।

পরিচিত চায়ের দোকান থাকার সুবিধা আছে। মুখে অর্ডার দিতে হয় না। ইশারায় কাজ হয়। অনেক সময় ইশারাও লাগে না। বয় বাবুর্চি, কাস্টমার দেখলেই বুঝে কার কী লাগবে।

চায়ের স্টলের বয় বটু মোবারকের সামনে কাচের গ্লাসে এক গ্লাস মালাই চা রেখে চলে যাচ্ছিল। মোবারক কঠিন গলায় বলল, এই বটু শুনে যা।

বটু থমকে দাড়াল। মোবারক বলল, ইটা মাইরা গ্লাস ফেললি। আদব কায়দা জানস না? চড় দিয়া চাপার দুইটা দাঁত ফেইল্যা দেই। বজ্জাতের বাচ্চা বজ্জাত। বেয়াদবি সবের সাথে করা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে করা যায়।

বটু চায়ের গ্লাসটা খপ করে নামিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য এতটা রাগ করা যায় না। রাগটা মোবারক করেছে পাশের কাস্টমারকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। অনেকটা ঝিকে মেরে বউকে শিখানোর মত। শিক্ষাটা মনে হয় কাজে লেগেছে। পাশে বসে থাকা কাস্টমার তার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাটার চোখে ভয়। চুক-চুক চা খাওয়া বন্ধ করেছে।

মোবারক বটুকে বলল, এই চা নিয়ে যা, খাব না। মোবারক চাদরের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সাধারণ সিগারেট না। বিদেশী সিগারেট— মারলবোরো। মোবারকের ইচ্ছা করছে সিগারেটের প্যাকেটটা কাস্টমারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মধুর গলায় বলে, ব্রাদার নেন একটা সিগারেট নেন।

কাজটা সে করেই ফেলত, তার আগেই চায়ের স্টলের মালিক কুদ্দুস মিয়া গলা খাকাড়ি দিল এবং চোখের ইশারায় তাকে ডাকল।

মোবারক বিরক্ত মুখে উঠে গেল। চোখের ইশারায় ডাকাডাকি এটাও তার পছন্দ না। এও এক ধরনের বেয়াদবি। মোবারক সব সহ্য করতে রাজি আছে, বেয়াদবি সহ্য করতে রাজি না।

কুদ্দুস গলা নিচু করে বলল, ঝামেলা কী?

মোবারক বলল, কোনো ঝামেলা নাই।

তোমার ডান পাশে যে বসছে তার সাথে কিছু হইছে?

না।

তারে চিনছ?

মোবারকের চোখ ছোট হয়ে গেল। কুদুসের গলা যেন কেমন কেমন। পাশের লোকটা কি বিশেষ কেউ? কুদ্দুস গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, সে হইল ছোট রফিক। কথাবার্তা, খুব সাবধান। খুবই সাবধান। তার সাথে বেয়াদবি কিছু কইরা থাকলে মাফ নিয়া নাও। সাপের মাথায় পাড়া দিলে অসুবিধা নাই। লেজে পাড়া দিলে খবর আছে।

মোবারক মুখ শুকনো করে আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। অন্য কোথাও বসতে পারলে ভাল হত। তবে সেটাও ঠিক হত না। ছোট রফিক ঠিকই লক্ষ্য করতো; মনে মনে ভাবত, লোকটা একটু আগে আমার পাশে বসেছে। এখন জায়গা বদলেছে।

আল্লাহ পাকের অসীম দয়া যে সে ছোট রফিকের সাথে ঝামেলা করেনি। সে শুধু বলেছে, এই চেয়ারটায় আমি বসব। তবে ছোট-রফিককে এই কথা বলাও বিরাট বেয়াদবি।

একজন যে চেয়ারে বসে আছে সেই চেয়ারে তুমি বসবে কেন? তুমি কোন দেশের লাট বাহাদুর? তুমি হলে মোবারক। তোমার দাম তিন পয়সা।

ছোট রফিক চা খাওয়া শেষ করেছে। পাঁচ টাকার একটা নোট চায়ের কাপের পাশে রাখতে রাখতে উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে চায়ের দাম এবং বখশিশ একসঙ্গে দিয়েছে। ছোট রফিক মোবারকের দিকে তাকিয়ে বলল, জায়গা ছেড়ে দিলাম বসেন। আরাম করে চা খান।

মোবারক মুখ হাসিহাসি করার একটা চেষ্টা করল। ছোট রফিক সেই হাসিমুখ দেখার জন্যে অপেক্ষা করল না। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে। কুদ্দুস মিয়া ক্যাশবাক্স ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সালাম দিল। ছোট রফিক সেদিকে না তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সালাম নিল। কোনো দিকে না তাকিয়েও চারদিকে কী হচ্ছে বুঝতে পারা বিরাট ব্যাপার। মোবারক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বটু চা দে। মালাই চা না, নরম্যাল চা।

বটু গলা নামিয়ে বলল, উনারে চিনেছেন? ছোট রফিক। একবার আমারে পঞ্চাশ টাকার চকচকা নোট বখশিশ দিছিল।

মোবারক উদাস গলায় বলল, ভাল।

তার এখন বেশ ভালও লাগছে।

নিজের চেয়ারে আরাম করে পা তুলে বসে এখন মারলবোরো সিগারেট টানতে টানতে চা খাওয়া যায়। আজ অল্পের উপর দিয়ে ফাড়া কেটেছে। মোবারকের সামান্য আফসোসও হচ্ছে। ছোট রফিককে চেয়ার ছাড়তে না বলে সে যদি ভদ্রভাবে পাশে বসত এবং সিগারেট সাধত তাহলে কত ভাল। হত। সে রকম খাতির হলে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করা যেত, ভাইজান আপনাকে ছোট রফিক বলে কেন? আপনি যদি ছোট রফিক হন— বড় রফিকটা কে? হা হা হা। ভাইজান রসিকতা করলাম। কিছু মনে করবেন না।

ছোটখাট মানুষ হলে ছোট রফিক ডাকা যায়। কিন্তু মানুষটা মোটেই ছোটখাট না— লম্বা। তবে রোগা। গাল বসে গেছে। চেহারা ভাল। দেখে মনে হয় কোনো ব্যাংকে ট্যাংকে কাজ করে। মানুষটার গলার স্বরে রাগ আছে, কিন্তু চেহারায় কোনো রাগ নেই। বয়স কত হবে— চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের বেশি হবে না। মোবারকের বয়স আটত্রিশ। কিন্তু তাকে দেখা যায় পঁয়তাল্লিশের মত। সব চুল পেকে যাওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে। নিয়মিত কলপ করাও সমস্যা। একেকবার কলপে ত্রিশ টাকা লাগে। পশমি টুপিটা পাওয়ায় বিরাট কাজ হয়েছে। মাথা ঢেকে ঘোরাঘুরি করলে কে বুঝবে টুপির নিচের চুল কাঁচা না পাকা? টুপিটাও সুন্দর! এই টুপি আল্লাহ পাকের তরফ থেকে সরাসরি পাওয়া উপহার। আল্লাহপাক তার নাদান বান্দাদের জন্য মাঝে মাঝে সামান্য উপহার পাঠান। বান্দা ভাল না মন্দ সেদিকে তাকান না। এত কিছু দেখলে তার চলে না।

দোতলা বাসের দোতলায় বসে মোবারক আসছিল মীরপুর থেকে। তার আগারগাঁয়ে নেমে যাবার কথা। বসে থাকতে ভাল লাগছিল বলে নামল না। যতদূর যাওয়া যায় যাওয়া থাক। এর মধ্যে আল্লাহ পাকের একটা ইশারা অবশ্যই আছে। বাস যখন প্রেসক্লাবের কাছাকাছি তখন তার পাশের একজন যাত্রী তাড়াহুড়া করে নেমে গেল। মোবারক দেখে সিটের উপর একটা নীল আর শাদা রঙের মিশেল দেয়া পশমি টুপি। মোবারক চট করে জায়গা বদল করে পাশের সিটে চলে এল। টুপির উপর খানিকক্ষণ বসে থাকা অত্যন্ত জরুরি। টুপির মালিক ফিরে আসতে পারে। যদি ফিরে আসে তাহলে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলতে হবে— আরে এইতো আপনার টুপি! জিনিস পত্র সাবধানে রাখবেন না?

টুপি নিতে কেউ এল না। মোবারক টুপি হাতে গুলিস্তানে নেমে পড়ল। নেমে পরার আগে ছোটখাট একটা বাণিজ্যও হয়ে গেল। সে বাসের

বাসের কন্ডাকটার চোখ গরম করে বলল, কীয়ের টাকা? কন কী?

মোবারক বলল, দশ টাকার একটা নোট দিলাম। আপনি বললেন— এখন ভাংতি নাই পরে দিবেন।

কন্ডাকটার চোখ আগের চেয়েও গরম করে বলল, কী কন? দিল্লেগী করেন? ধাক্কা দিয়া চাক্কার নিচে ফেলাইয়া দিমু…।

মোবারক শান্ত গলায় অন্য পেসেঞ্জারদের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইসাব দেখলেন কী বলে? ধাক্কা দিয়ে চাকার নিচে ফেলে দেবে। তখনি আমি টাকা দিতে চাই নাই। আমি বলেছি ভাংতি নিয়ে আস তারপরে নোটটা নাও। তখন সেটা করবে না।

এক যাত্রী ক্ষিপ্ত গলায় বলল, শুওরের বাচ্চার গাল বরাবর একটা চটকনা দেন। হারামজাদার কত বড় সাহস।

চটকনা দিতে হল না। তার আগেই কন্ডাকটার একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল।

মোবারক বলল, এক টাকা ভাড়া কেটে রাখেন। নয় টাকা দেন।

কন্ডাকটার বিরস গলায় বলল, থাউক ভাড়া লাগব না। আফনের ভাড়া TIPI

মোবারক দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলল, ভাইসাবরা দেখলেন, কীভাবে অপমান করে আমার ভাড়া নাকি মাফ।

অন্য এক ক্রুদ্ধ যাত্রী বলল, হারামজাদারে একটা চড় দেন না। দেখেন। কী? মার না খেলে শিক্ষা হবে না।

মোবারক জোরেসোরে এক চড় বসিয়ে হেঁটে চলে এল। পিছনে ফিরল না। পিছনে ফিরলে হয়ত দেখা যাবে, কন্ডাকটার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তবে চড় মারাটা বাড়াবাড়ি হয়েছে। আল্লাহপাকের হিসাবের খাতায় নাম উঠে গেছে। এমন একটা চড় কোনো না কোনো সময় মোবারককে খেতে হবে। চড়ে চড়ে কাটাকাটি হবে। সবার হিসাবে ভুল হয়, আল্লাহপাকের হিসাবে ভুল নাই। বাসের কন্ডাকটার যেমন অনেক লোকের সামনে চড় খেয়েছে, সেও অনেক লোকের সামনেই খাবে। হয়ত আজই খেত। ছোট রফিকের হাত থেকে খেত। কপাল গুণে বেঁচে গেছে।

মোবারক চা খাচ্ছে। তার নিজের পছন্দের চেয়ারে বসে খাচ্ছে। চেয়ারটা এই জন্যে পছন্দ যে এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তার লোকজন তাকে এত সহজে দেখবে না। চেয়ারটা মদিনা রেস্টুরেন্টের এক কোণায়। রাস্তার লোক দোকানের দিকে তাকায়, দোকানের কোণার দিকে তাকায় না।

সন্ধ্যা হয় হয় করছে। সন্ধ্যাবেলাটা মোবারকের খারাপ লাগে। বিশ্রী একটা সময়, দিনও না, রাতও না। এই দুয়ের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। দিনের এক রকম মজা, রাতের আরেক রকম মজা। এই দুয়ের মাঝামাঝি সময়ের কোনো মজা নেই। সন্ধ্যা একা কাটানো যায় না। সন্ধ্যার জন্যে বন্ধু লাগে। মোবারকের মেজাজ দ্রুত খারাপ হচ্ছে। জহিরেরও দেখা নেই, বজলুরও দেখা নেই। মনে হচ্ছে এরা দুজন যুক্তি করে হাওয়া হয়ে গেছে। বজলুর জন্যে ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সে প্রায়ই ড়ুব মারে। দু তিন দিন পরে হঠাৎ উদয় হয়। এই দু তিন দিন সে কোথায় ছিল, কী করেছে সে সম্পর্কে কিছুই বলে না। প্রাইভেট কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। সব মানুষেরই কিছু না কিছু প্রাইভেট ব্যাপার থাকে। কিন্তু জহিরের ব্যাপারটা কী? আবার কোনো অসুখ বিসুখ হয়নি তো?

জহিরের হল অসুখ রাশি— এই জ্বর, এই কাশি, এই হাম। মানুষের হাম হয় একবার ছোটবেলায়। গা ভর্তি হাম বের হল। হাম ডেবে গেল, মামলা ডিসমিস। সেই হাম জহিরের হয়েছে তিনবার। জন্ডিস হল চারবার। শেষবারে এমন অবস্থা যে, কলাবাগানের জামে মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে এনে তওবা পড়ানো হল। তওবা পড়ানোর পর মিলাদ হল। বজলু সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে জহিরকে বলল— তুই এখন শিশুর মত নিস্পাপ হয়ে গেলি। বাম কাঁধের ফিরিশতা এতদিন তার খাতায় যা লিখেছে সব মুছে গেছে। আগের সব পাপ কাটাকাটি হয়ে গেছে। যে অসুখ বাঁধিয়েছিস এর মধ্যে নতুন পাপ আর কিছু করতে পারবি না। যদি মারা যাস— স্ট্রেইট বেহেশত নসিব হবে। হুরপরীরা তোকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেবে।

আল্লাহপাকের বোধহয় ইচ্ছা না জহির বেহেশতে দাখিল হয়। সে তওবা পড়ানোর দিন তিনেকের মধ্যে উঠে বসে চি চি করে বলল— তার সরষে শাক দিয়ে ফ্যান ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। লোকজনের কানের পাশ দিয়ে গুলি যায়। জহিরের গুলি গেছে বগলের তলা দিয়ে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেবার সময় ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন— আপনার লিভার মারাত্মক ড্যামেজড হয়েছে। আপনি যে বেঁচে আছেন এইটাই মিরাকল। বাকি জীবন আপনাকে খুব রেগুলেটেড লাইফ মেইনটেইন করতে হবে। মাংস পারতপক্ষে খাবেন না। মাছ ভাত খাবেন। মদ্যপান করবেন না। ঈদে চান্দেও না। ড্রপার দিয়ে এক ফোঁটাও না। বুঝতে পারছেন কারো কারো জন্যে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ। আপনার জন্যে মদের গন্ধ শোকাও নিষিদ্ধ।

বজলু এবং মোবারক দুজনই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। এবং এক সঙ্গে বলল, জ্বি আচ্ছা।

ডাক্তার সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি পেশেন্টকে জিজ্ঞেস করছি। আপনারা দুজন মাথা নাড়ছেন কেন? আপনারা কে?

স্যার আমরা জহিরের ফ্রেন্ড।

আপনারা সামনে থেকে যান। আমি আপনাদের বন্ধুকে কিছু কঠিন কথা বলব। দাঁড়িয়ে থাকবেন না। চলে যান।

ডাক্তার সাহেব অনেক কঠিন কথা বললেন। জহির ঝিমঝিম চোখে হাই তুলতে তুলতে কঠিন কথা শুনল। তাকে খুব বিচলিত মনে হল না। সে কখনোই বিচলিত হয় না।

বন্ধুর রোগমুক্তি উপলক্ষে ছোটখাট উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। আজরাইলের হাত থেকে বাইম মাছের মত পিছলে বের হয়ে আসা কোনো সহজ ব্যাপার না। যে মানুষ এমন অসাধ্য সাধন করতে পারে তার জন্যে বড় উৎসবই করা দরকার। বড় উৎসবের সামর্থ্য কোথায়? ভদকার একটা বোতল যে জোগাড় হয়েছে এটাই যথেষ্ট। এক বোতল ভদকা, খাসির চাপ, হাজির বিরিয়ানি। আসর বসেছে বজলুর ঘরে। মোবারক এবং বজলু অতি দ্রুত বোতল শেষ করছে। জহির শুকনো চোখে তাকিয়ে আছে। তার শুকনো চোখ দেখে মায়া লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই। আগে প্রাণে বাঁচতে হবে। জহিরের গন্ধ শোঁকা নিষিদ্ধ বলেই তারা ভদকা এনেছে। ভদকার গন্ধ নেই।

মোবারক বলল, নিয়ম রক্ষার জন্য এক ফোঁটা খাবি নাকি রে জহির। জাস্ট ওয়ান ড্রপ। জিভ বের কর। জিভের আগায় এক ফোঁটা দিয়ে দেই।

জহির না-সূচক মাথা নাড়ল। মোবারক বলল, থাক কোনো দরকার নেই। তুই শুয়ে থাক। বিরিয়ানি গরম আছে। গরম গরম খেয়ে শুয়ে পড়। আমি মাথা বানিয়ে দেব।

বজলু বলল, ডাক্তার যে মৃত্যুর ভয় দেখাল, কাজটা কি ঠিক করল? মৃত্যুর কথা বলার তুমি কে? মৃত্যুর মালিক হলেন আল্লাহ্। তিনি ইচ্ছা করলে মৃত্যু হবে। ইচ্ছা না করলে দশ বোতল ভদকা খেলেও কিছু হবে না। জহিরের কি বাঁচার আশা ছিল? ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছিল না? তারপরেও বাঁচল কীভাবে? আরে বাবা তুমি ডাক্তার হয়েছ বলে যা ইচ্ছা তাই বলবে? তোমার মত ডাক্তার আমি দিয়েও পুছি না। রোগ যদি হয়, অষুধ দিয়ে রোগ সারাবে। বড় বড় কথা কী জন্যে? আমি বজলুর রহমান তোমার কথার উপরে পেচ্ছাব করি।

মোবারক বলল, আমি পেচ্ছাব করে দেই।

আধা বোতল ভদকা শেষ হবার পরেও দেখা গেল নেশা যে ভাবে হওয়া উচিত সেভাবে হচ্ছে না। ছাড়া ছাড়া নেশা হচ্ছে। এই ভাব আসছে, এই চলে যাচ্ছে। নেশার ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত। কোনো কোনো দিন কিছু খেতে হয় না, বোতল দেখেই নেশা হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো দিন যতই খাও কিছু হবে না। মাথা ঝিম ঝিম করবে, বমি ভাব হবে কিন্তু আসল যে জিনিস—‘ভাব’ সেটা আসবে না।

বজলু বিরক্ত মুখে বলল, নেশা হচ্ছে না। ব্যাপারটা কী? মোবারক তোর অবস্থা কী?

মোবারক বিরস মুখে বলল, মনে হয় পানি খাচ্ছি। মিনারেল ওয়াটার।

এতদিন পর হাসপাতাল থেকে বন্ধু রিলিজ পেয়েছে। সেই আনন্দে যদি একটু নেশাও না হয় তাহলে বন্ধুর ফিরে আসার দরকার কী ছিল? বজলু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাজকর্ম সব সময় তিনজন একত্রে করেছি। আজ দুইজন, একজন থেকেও নেই। এই জন্যেই কিছু হচ্ছে না। বোতল শেষ করে লাভ নেই, বাদ দে।

জহির তখন ক্ষীণ গলায় বলল, বেশি করে পানি মিশিয়ে সামান্য একটু দে। তিন চার ফোঁটার বেশি না। নিয়ম রক্ষার জন্যে খাওয়া।

দরকার নেই। বাদ দে। এতবড় অসুখ থেকে উঠলি।

খাই এক ফোঁটা। এক ফোঁটায় আর কী হবে?

জহিরকে সামান্য দেয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে দুই বন্ধুর নেশা কঁকিয়ে এল। বজলু বলল, বোতলতো শেষ হয়ে আসছে। তিন বোতল ফেন্সি নিয়ে আসি। ভদকার পরে ফেন্সি— উড়াল দেয়া নেশা হবে। ফেন্সি জহিরও খেতে পারবে। ডাক্তার মদ খেতে নিষেধ করেছে ফেন্সি খেতে নিষেধ করেনি। তাছাড়া ফেন্সি অষুধের মত— কফ সিরাপ। কীরে জহির ফেন্সি খাবি একটা?

জহির বলল, না।

আমোদ ফূর্তিই যদি না করলি বেঁচে থেকে লাভটা কী? সকালে চিড়া ভিজানো পানি এক গ্লাস চিরতার রস, বিকালে জাউ ভাত। রাতে এক পিস আটার রুটি। সিগারেট না, মদ না, গাঁজা না। এই ভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী— নায়লনের একটা দড়ি কিনে নিয়ে আসি, ঝুলে পড়।

মোবারক উদাস গলায় বলল, এটা মন্দ না। দুই বোতল ফেন্সি আন আর তিন গজ নায়লনের দড়ি। ব্লু কালার।

ব্লু কালার কেন?

বজলু গম্ভীর গলায় বলল, মৃত্যুর রঙ নীল। এই জন্যে।

এত কিছুর পরেও জহির এক ফোঁটা মুখে দিল না। দুই বন্ধুরই খুব মেজাজ খারাপ হল। সাতশ টাকার বোতলে সাত টাকার নেশা হল না। ধরে যাওয়া নেশা একবার চটে গেলে কিছুতেই কিছু হয় না। ঝিম ভাব হয়— ঝিম ভাব আর নেশা এক না। পর পর তিন রাত অঘুমো থাকলেও ঝিম ভাব হয়।

মোবারক নড়ে চড়ে বসল। চায়ের স্টলের বাইরে জহির এসে দাঁড়িয়েছে। ইঁদুরের মত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাকে খুঁজছে বলাই বাহুল্য। গাধার গাধা— সে জানে না মোবারক কোথায় বসে? তুই পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিক দেখে ফেললি— আসল দিক দেখলি না? তোর কি ব্রেইনে সমস্যা হয়েছে? নাকি সন্ধ্যাবেলাতেই কিছু খেয়ে এসেছিস? দাড়ি শেভ নাই। চুল উস্কুখুস্কু। একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে যার পাঁচটা বোতামের মধ্যে দুটা নাই। শার্টের ফাঁক দিয়ে বুকের লোম বের হয়ে আছে। তুই ভেবেছিস কী? তোর বুকের লোম দেখে মেয়েরা মূৰ্ছা যাবে? কাঁধে আবার বাহারি ব্যাগ। ব্যাগের পেট ফুলে আছে। কে জানে কী আছে ব্যাগে।

জহির মোবারককে দেখেছে। জহিরের মুখ ভর্তি হাসি। যেন দশ বছর পরে পুরনো বন্ধুর দেখা পাওয়া গেল। মোবারকের মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল, তোর হাসি মুখে আমি পেচ্ছাব করে দেই। আরে শুওরের বাচ্চা গত দুই দিন তুই ছিলি কোথায়? এমন তো না যে বিয়ে করেছিস শাশুড়িকে সালাম করতে যেতে হবে। শালীর গালে ধরে রং ঢং করতে হবে।

জহির এসে মোবারকের সামনে বসল। বসেই মোবারকের মারলবোরো সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে সিগারেট বের করল। যেন তার শ্বশুরের টাকায় কেনা সিগারেট। শ্বশুর চায়ের স্টলের টেবিলে ফেলে রেখে গিয়েছিল। এখন জামাইকে পাঠিয়েছে খুঁজে নিয়ে যাবার জন্যে। বন্ধুর সিগারেট খাচ্ছে— আচ্ছা ঠিক আছে খাক। এত দামি বিদেশী সিগারেট, একবার জিজ্ঞেস করবে না সিগারেটের এই প্যাকেট কোত্থেকে পাওয়া গেল? নাকে মুখে কেমন ধুঁয়া ছাড়ছে, যেন তার শ্বশুর বাড়ির সস্তা ধুঁয়া।

জহির বলল, আছিস কেমন?

মোবারক জবাব দিল না। তার কথা বলতেই ইচ্ছা করছে না। সবচে ভাল হত যদি উঠে চলে যেতে পারত। উঠে চলে যাওয়া এক সপ্তাহের জন্যে ড়ুব মারা। তোরা দুই দিনের জন্যে ড়ুব দিতে পারলে আমিও এক সপ্তাহের জন্যে ড়ুব দিতে পারি।

জহির বলল, তোর গায়ে উলের চাদর?

মোবারক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। যদিও তার ইচ্ছা করছে বলতে— উলের চাদর না। পাটের কোস্টার চাদর। চাদরও না, গামছা।

জহির বলল, চাদর পেয়েছিস কোথায়?

মোবারক গম্ভীর গলায় বলল, আমার নিজের চাদর। এর মধ্যে পাওয়া পাওয়ি কী?

জিনিস ভাল।

মোবারক বলল, জিনিস যে ভাল তোকে সেই সার্টিফিকেট দিতে হবে না। আমার জিনিস আমি জানি ভাল না মন্দ।

রেগে আছিস কেন?

মোবারক জবাব না দিয়ে টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট চাদরের নিচে ঢুকিয়ে ফেলল। জহিরের স্বভাব খারাপ। সামনে সিগারেটের প্যাকেট থাকলে ক্রমাগত খেয়ে যাবে। দুই মাসও হয়নি এতবড় অসুখ থেকে উঠেছে কিছু সাবধান হওয়াতো দরকার। মদের চেয়েও ক্ষতি করে সিগারেট।

জহির বলল, গরমের মধ্যে চাদর গায়ে ঘুরছিস কেন?

ইচ্ছা হয়েছে ঘুরছি। তাতে তোর কোনো সমস্যা হয়েছে?

গরমের মধ্যে উলের চাদর। তোকে দেখে আমার নিজেরই গরম লাগছে।

গরম লাগলে শার্ট প্যান্ট খুলে ন্যাংটা হয়ে যা।

জহির গলা নামিয়ে বলল, চাদরের নিচে কিছু আছে?

না।

না থাকলেও অসুবিধা নাই। আমি জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি। সাতটা বোতল। এক নম্বরী ডাইল। সিগারেটের প্যাকেট সামলে ফেললি কেন? দেখি প্যাকেট বের কর।

মোবারক সিগারেটের প্যাকেট বের করল। জহিরের উপর তার রাগটা অতি দ্রুত কমছে। এই তার এক সমস্যা। সে রাগ ধরে রাখতে পারে না। অতি দ্রুত কমতে থাকে। শুধু যে রাগ কমছে— তা না। এখন আবার মায়াও লাগতে শুরু করেছে। কী অবস্থা করেছে শরীরের। এত বড় একটা অসুখ থেকে উঠেছে— নিজের শরীরের দিকে তাকাবে না? মনে হচ্ছে দুপুরে সে কিছু খায়ওনি। কেমন পা টেনে টেনে হাঁটছিল। পায়ে কী কিছু হয়েছে?

মোবারক বলল, দুপুরে ভাত খেয়েছিস?

না।

না কেন?

সময় পাই নাই।

সময় পাস নাই কেন? তুই কি মিনিস্টার যে মিটিং মিছিল করে দম ফেলতে পারছিস না।

মোবারক চোখের ইশারায় বটুকে ডেকে দুটা পরোটা আর শিক কাবাব দিতে বলল।

জহির হামলে পড়ে খাচ্ছে। দেখে মায়া লাগছে।

এই দুই দিন ছিলি কোথায়?

নারায়ণগঞ্জ।

সেখানে কী?

ছোট খালু মারা গেছে। খবর পেয়ে দেখতে গিয়ে বিরাট ক্যাচালের মধ্যে পড়ে গেলাম।

কী ক্যাঁচাল?

আরে টাকা নাই, পয়সা নাই। দশ গজ কাফনের কাপড় কিনতে গিয়েছে তাও টাকা শর্ট পড়েছে। খালা আমাকে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করা শুরু করল–-ওরে কই যাব রে? তুই বলে যা কই যাব রে?

আমার নিজের যাওয়ার নাই ঠিক, আমি কী করে বলব— কই যাবে? দাফন করতে যাবে, আমি বললাম, খালা আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দেন। চা খাবার নাম করে আসছি। চা খেতে বের হয়ে ফুটলাম।

ভাল করেছিস।

ঘর ভর্তি বাচ্চা কাচ্চা। এর মধ্যে একটার আবার উঠেছে জ্বর। মাথায় পানি ঢালাঢলি হচ্ছে। বিশ্রী অবস্থা।

মোবারক বলল, তুই গেলি কেন খামাখা। যাওয়াটাই ভুল হয়েছে।

জহির থমথমে গলায় বলল, বিরাট ভুল হয়েছে। যাওয়া উচিত হয় নাই। আমার যাবার কোন ইচ্ছা ছিল না, বাবা বলল, জহির যা দেখে আয়। আমি নড়তে পারছি না। নয়ত আমি যেতাম। আমি ভাবলাম যাই। ছোটবেলা কিছুদিন খালার সঙ্গে ছিলাম। খালা খালু দুইজনই খুব আদর করত। খালার চেয়ে বরং খালুর আদর ছিল বেশি। এই জন্যই চলে গেছি। গিয়ে পড়লাম কাঁচালে। এমন মনটা খারাপ হয়েছে কিছুই ভাল লাগে না। কাদলে মনটা হালকা হত। কান্নার চেষ্টা করেছি। কান্না আসে না–এখন করব কী বল? নেশা করলে যদি চোখে পানি আসে এই জন্যেই ছয়টা বোতল নিয়েছি।

টাকা কই পেয়েছিস?

জহির জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল।

মোবারক আবার বলল, টাকা কোথায় পেয়েছিস?

জহির কথা শুনতে পায়নি এমন ভাব করে আরেকটা সিগারেট ধরাল।

কেউ কোনো কথা বলতে না চাইলে সেই কথা শোনার জন্যে চাপাচাপি করা ঠিক না। মোবারক চুপ করে গেল। বলার হলে সে নিজেই বলবে। পেটে জিনিস পড়লেই হড়বড় করে কথা বের হবে। জিনিস পড়ার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সেটাই হল কথা। বজলুর এখনো দেখা নাই। বজলু থাকে তার ছোট বোনের সঙ্গে ঝিকাতলায়। ঠিকানা আছে। কিন্তু বজলুর কঠিন নিষেধ যেন তার খোঁজে কখনো যাওয়া না হয়। নিষেধ হোক যাই হোক একবার যাওয়া দরকার। মানুষটার অসুখ বিসুখও তো হতে পারে। বন্ধু যদি বন্ধুর খোঁজ না করে কে করবে? পাড়ার লোকে করবে? পাড়ার লোকের কী দায় পড়েছে?

মোবারক বলল, তোর পায়ে কী হয়েছে?

জহির বলল, রগে টান পড়েছে মনে হয়।

ল্যাংড়া হয়ে যাবি তো।

হুঁ।

তোর তো দেখি শরীর একেবারে গেছে।

গেলে কী আর করা? শরীর দিয়ে কী হয়? এত বড় যে গামা পালোয়ান শরীর দিয়ে সে করলটা কী?

তোর জিহ্বা কালো হয়ে গেছে। তোর মধ্যে একটা সাপ সাপ ভাব চলে এসেছে।

জহির হঠাৎ বিরাট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দোস্ত মনটা খারাপ, খুবই খারাপ।

কী জন্যে মন খারাপ বলে ফেল। শুনলে তোরও মন খারাপ হবে। তাহলে বাদ দে।

জহির কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল, ছোটখালা এক হাজার টাকা দিয়েছিল। তার কাছে তো ছিল না। ধারধোর করে এনে দিয়েছে। চা খাওয়ার নাম করে ঐ টাকা নিয়ে ফুটে গেছি।

জিনিসপত্র ঐ টাকায় কিনেছিস?

হুঁ। দোস্ত খুবই খারাপ লাগছে। একবার ভাবলাম লাফ দিয়ে কোনো ট্রাকের নিচে পড়ে যাই।

পড়লি না কেন?

ট্রাকের সামনে ঝাপ দিতে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই না। ছাদে উঠে ঝাপ দিয়ে নিচে পড়তে ইচ্ছা করে, ঝাপ দেই না। সাহস নাইরে দোস্ত, সাহস নাই। এই দুনিয়ায় আসল জিনিসের নাম— সাহস। যার সাহস আছে তার সবই আছে। যার সাহস নাই তার কিছুই নাই।

ক্যাশ বক্স ফেলে কুদ্দুস উঠে এসে মোবারকের পাশে বসল। গলা নামিয়ে বলল, গায়ের শাল কি বিক্রি হবে?

মোবারক উদাস গলায় বলল, দামে পুষালে বিক্রি।

কুদ্দুস শাল পরীক্ষা করতে করতে বলল, সেকেন্ড হ্যান্ড ব্যবহারী জিনিস। তিনশ টাকা। যদি পুষায় জিনিস রেখে যাও, কাল দাম নিবা।

পুষাল না।

পুষালে নাই। আমারটা আমি বললাম। তিনশ।

ভাল বলেছ। এখন ফুটে যাও।

কুদ্দুস যেভাবে এসেছিল সেইভাবে চলে গেল। হাসিমুখে বসল ক্যাশবাক্সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, দুনিয়াটা বড়ই আনন্দময়।

চলবে।

রূপার পালঙ্ক পর্ব-০১

0

🔴রূপার পালঙ্ক (পর্ব :১)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

আয়নায় নিজেকে দেখে ছেলেরা সাধারণত মুগ্ধ হয় না। অতি বুদ্ধিমান ছেলেকেও আয়নায় খানিকটা বোকা বোকা লাগে। কিন্তু মোবারক মুগ্ধ। তার মনে হচ্ছে সে নিজেকে দেখছে না, অন্য কাউকে দেখছে। তার কোনো জমজ ভাইকে। যে ভাই কলেজে অধ্যাপনা করেন। এবং যে ভাই-এর কলাবাগান টাইপ জায়গায় একটা বাড়ি আছে। বাড়ির সামনে বাগান আছে। যে ভাই তার স্ত্রী দুই ছেলেমেয়েসহ বাগানে বসে বিকালে চা খায়। চায়ের সঙ্গে হালকা নাশতা থাকে। কোনোদিন নিমকি, কোনোদিন সমুচা।

চুল আচড়ানোই ছিল, তারপরেও মোবারক আচড়ানো চুলের উপরই কয়েকবার চিরুনী চালালো। চুলের স্টাইলটা অন্যরকম করবে কি-না ভাবল। শেষে মনে হল অন্যরকম করা ঠিক হবে না। হঠাৎ করে নতুন স্টাইলে চুল বসবে না। খাড়া খাড়া হয়ে থাকবে। যা আছে তাই ভাল। শুধু ভাল না–বেশ ভাল, যাকে বলে উত্তম।

নিজেকে উত্তম করার জন্যে মোবারককে বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে— ভোর সাতটায় গোসল। শীতের শুরুতে সকালবেলা গোসল কঠিন আজাবের একটি। সেই আজাবকে সহনীয় করার জন্যে মেসের বয় মনু মিয়াকে দুটা টাকা দিয়েছিল। কথা ছিল, দুটাকার বিনিময়ে মনু মিয়া এক কেতলি টকটকে গরম পানি বালতিতে ছেড়ে দেবে। মনু মিয়া দাঁত বের করে বলেছে, চিন্তা নাই দুই কেতলি পানি ছাড়তাছি। বলক তুলা পানি। শইল্যে ফুসকা পইড়া যাইব।

মোবারক সেই পানি মাথায় ঢেলে শিউরে উঠল। হিমালয়ের বরফগোলা পানি। মনু এক ফোঁটা গরম পানিও দেয় নি। হারামজাদাটাকে এই পানিতে চুবিয়ে দিতে পারলে মন শান্ত হত। মোবারককে বরফগোলা পানি দিয়ে গোসল সারতে হল। এক প্যাকেট লেমন শ্যাম্পু কিনেছিল। প্যাকেটে চা চামুচের এক চামুচের বেশি শ্যাম্পু হবে না। তার দামই নিল চার টাকা। শ্যাম্পু দুই নম্বরী কি-না কে জানে। মাথায় ফেনা হচ্ছে না, চোখ জ্বালাপোড়া করছে। এই শ্যাম্পু দেয়ার কারণে মাথায় আরো আধাবালতি বরফ-পানি বেশি ঢালতে হল। ভদ্র সাজার এ-কী যন্ত্রণা!

মোবারকের গায়ে ইস্ত্রী করা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ডান হাতায় পানের পিকের দাগ আছে। লাল দাগ ছিল। ধোপাখানায় পাঠানোর পর লাল দাগ হলুদ হয়েছে, এবং আরো কড়া হয়েছে। হারামজাদা ধোপার পাছায় একটা লাথি মারতে পারলে ভাল হত। ভাগ্য ভাল দাগটা এমন জায়গায় যে চট করে চোখে পড়ে না। পায়জামা ছিল না বলে প্যান্টের উপর পাঞ্জাবি পরতে হয়েছে। সেই প্যান্টও সে গতকালই ইস্ত্রী করে আনিয়েছে। সবই ভাল, শুধু স্যান্ডেলজোড়া ইজ্জত মেরে দিয়েছে। স্যান্ডেলের দিকে তাকানো যায় না। মোটরগাড়ির টায়ার দিয়ে হাফসোল করোনোটা বোকামি হয়েছে। দেখেই মনে হয় ফকিরের স্যান্ডেল। ভিক্ষার জন্যে প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হবে— এটা মাথায় রেখে বানানো।

একটাই ভরসা— বড়লোকরা সাধারণত পায়ের দিকে তাকায় না। এটা অবশ্যি সাধারণ বড়লোকের কথা। অতি অতি বড়লোকরা কী করে মোবারক জানে না। আজ হয়ত জানবে। একজন অতি অতি বড়লোকের কাছে যাবার জন্যেই সকাল থেকে এই কষ্ট। শ্যাম্পুর চোখ জ্বলুনি এখনো যায় নি।

বড়লোকদের কাছে ভাল সাজ পোশাকে যেতে হয়। সাধারণ প্রচলিত ধারণা— মলিন পোশাকে উপস্থিত হলে করুণা পাওয়া যায়। মোবারক নিশ্চিতভাবে জানে ধারণা ভুল। ময়লা পোশাকে লেবেনডিস সেজে গেলে বড়লোকরা নাক কুঁচকে তাকান। ভাবটা এরকম যেন পোশাক থেকে মুরগির গুয়ের গন্ধ আসছে। এই দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্যে কথাবার্তা দ্রুত শেষ করে হাতটা এমনভাবে নাড়ান যেন মুরগি তাড়াচ্ছেন। মুরগি হবার দরকার কী? একটু না হয় ঝামেলা করে ফিটফাট হওয়া গেল। তবে শ্যাম্পুটা না দিলেও হত। চোখ শুধু যে জ্বালা করছে তাই না, একটু লাল লালও হয়েছে। তার মত মানুষের লাল চোখ মানায় না। লাল চোখ মানায় শুধু মেথরদের আর অতি অতি বড়লোকদের। তাদের জন্মই হয়েছে চোখ লাল করে রাখার জন্যে।

আজ সকাল সাড়ে নটায় মোবারকের এ্যাপয়েন্টমেন্ট। দেখা হবে মুখোমুখি। এই মুখোমুখি দেখা হবার জন্যে ঝামেলা কম করতে হয় নি। টেলিফোন করতে হয়েছে পাঁচবার। যে ফার্মেসী থেকে সে টেলিফোন করে, তারা একটা কলের জন্যে পাঁচ টাকা করে নেয়। যাকে বলে দুপুরে ডাকাতি। পাঁচটা কলে পঁচিশ টাকা চলে গেল। পঁচিশ টাকা কোনো খেলা কথা না। পঁচিশ টাকায় তিনবেলা খাওয়া হয়ে যায়। টেলিফোন করাও কোনো সহজ ব্যাপার না। সব সময় সাবধান থাকা। বেফাস কিছু যদি মোবারক বলে ফেলে তাহলে সব কেঁচে যাবে। বাণিজ্যের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এক ঝাকিতে সব শেষ। প্রথম টেলিফোনটা একটা বাচ্চা মেয়ে ধরল। মিষ্টি গলা। অতি ভদ্র ব্যবহার। আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

মোবারক থতমত খেয়ে বলল, আমার নাম মোবারক। মোবারক হোসেন।

আপনি কার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন?

মোবারক পড়ে গেল বিপদে। আসলেইতো সে কার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে? শুরুতেই দেখি সব কেচে যাচ্ছে। মোবারক হড়বড় করে বলল,

পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছি।

ও আচ্ছা। আপনাকে ম্যানেজার চাচুর সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ম্যানেজার সাহেব কি আছেন?

জ্বি আছেন। ডেকে দেব?

আচ্ছা দাও। তবে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলে নেই। তোমার নাম কী?

আমার নাম আয়না।

বাহ্ কী সুন্দর নাম আয়না। কোন ক্লাসে পড়?

কেজি ওয়ান।

আমার নাম মোবারক ঈদ মোবারকের মোবারক। খুকি এখন তুমি ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে দাও।

আপনি টেলিফোন ধরে থাকুন। আমি ডাকছি।

মোবারক ধরে থাকল। খুবই কায়দার টেলিফোন। নানান রকম বাজনা বাজছে। একটা শেষ হয়তো আরেকটা শুরু হয়। ম্যানেজার চাচু এসে আর টেলিফোন ধরেন না। এক সময় ধরলেন এবং ম্যানেজার টাইপ লোকদের স্বভাব মত গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, কে?শব্দটা মওলানা সাহেবদের কাফ উচ্চারণের মত। নাভি থেকে আসছে।

মোবারক নরম স্বরে বলল, স্যার আমার নাম মোবারক হোসেন। পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছি। বিজ্ঞাপনটা গতকালের দুটা দৈনিক পত্রিকায়…

মোবারকের কথা শেষ করতে না দিয়েই ম্যানেজার বললেন, আপনি ইন্টারেস্টেড পার্টি?

জ্বি স্যার।

বয়স কত?

স্যার, পয়ত্রিশ। থার্টি ফাইভ ক্রস করেছে।

এটা মোবারকের আসল বয়স না। সে পাঁচ বছরের মত কমিয়েছে। কেন কমিয়েছে নিজেও জানে না।

এখন আমি ব্যস্ত আছি, কথা বলতে পারছি না। আমি কি স্যার কিছুক্ষণ পরে করব?

এক ঘণ্টা পরে করুন। তবে এই নাম্বারে না— আমি নাম্বার দিচ্ছি। কাগজ কলম আছে?

আপনি বলুন। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। মনে থাকবে।

ম্যানেজার সাহেব নাম্বার বলেই খট করে টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। ভাবটা যেন তিনি মহাব্যস্ত। নিঃশ্বাস ফেলার সময়ও নাই।

এরপর থেকে শুরু হল ঝামেলা— মোবারক যতবারই টেলিফোন করে বুড়ো মানুষের মত গলায় কে একজন বলে, ম্যানেজার সাহেব মিটিং-এ আছেন। পরে করেন। মোবারকের মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেল। আরে তুই ব্যাটা ম্যানেজার, তোর এত কী মিটিং। তুই কি মন্ত্রী না-কি যে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে মিটিং শুরু করবি। রাত বারটার সময় মিটিং শেষ করে ঘুমুতে যাবি। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখবি মিটিং করছিস। তুই হচ্ছিস চার পয়সা দামের ম্যানেজার।

যাই হোক ম্যানেজার সাহেব এক সময় টেলিফোন ধরলেন। ধমকের স্বরে বললেন, কে? আবারো সেই কাফ মার্কা কে?

মোবারক বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, স্যার আমার নাম মোবারক। মোবারক হোসেন। সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলেছি।

সকাল থেকেতো অনেকের সঙ্গেই কথা বলছি। আপনার ব্যাপারটা কী বলুন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে টেলিফোন করছেন?

জ্বি স্যার।

আপনি কি ইন্টারেস্টেড পার্টি?

জ্বি স্যার।

আপনার বয়স কত?

পয়ত্রিশ।

আপনি এক কাজ করুন, বুধবার সকাল সাড়ে নটায় চলে আসুন। মুখোমুখি কথা হওয়া দরকার।

কোথায় আসব?

সঙ্গে কাগজ কলম আছে? ঠিকানা বলছি, লিখে নিন। কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাড়ে নটায় চলে আসবেন। ইন্টারেস্টেড পার্টিতো আপনি একা না। আরো অনেকেই আছে। স্যার সরাসরি কথা বলবেন।

ম্যানেজার সাহেবের এই কথায় মোবারক খুবই দমে গেল। ইন্টারেস্টেড পার্টি আরো আছে মানে কী? তার ধারণা ছিল সে-ই একমাত্র ইন্টারেস্টেড পার্টি। যেহেতু সে একা, তার সুযোগ থাকবে জায়গা মত মোচড় দিয়ে দাম বাড়াতে। এখন দেখা যাচ্ছে এখানেও ইন্টারেস্টেড পার্টি। দেশটা যাচ্ছে কোথায়?

কিডনীর মত একটা জিনিস বিক্রি করতে লোকজন হামলে পড়বে এটা কী করে হয়? তোর শরীরে আছেই দুটা কিডনী। একটা বিক্রি করে দিলি, বাকিটা যদি নষ্ট হয়ে যায়– তুই যাবি কোথায়? তুইতো আর পয়সা দিয়ে এই জিনিস কিনতে পারবি না।

মোবারক স্পষ্ট কল্পনায় দেখল বুধবার সকাল সাড়ে নটা। একটা হলঘরের মত ঘরে সে বসে আছে। তার সঙ্গে মেয়ে পুরুষ মিলিয়ে আরো ত্রিশজনের মত আছে। সবার হাতে নম্বর ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। নম্বর অনুসারে ডাক পড়ছে। চাকরির ইন্টারভর মত ইন্টারভু হচ্ছে। কারো ইন্টারভু ভাল হয়েছে। সে বের হয়ে এসেছে হাসি মুখে। সবাই তাকে ঘেঁকে ধরেছে। সবার প্রশ্ন কী জিজ্ঞেস করল? কী জিজ্ঞেস করল? আবার কারো ইন্টারভু খুব খারাপ হয়েছে, বের হয়ে এসেছে কাঁদো কাঁদো মুখে। সে শুকনো গলায় বলল, ইজি ইজি কোশ্চেন জিজ্ঞেস করেছে। উত্তরও জানা ছিল, বলতে পারি নি। উত্তরটা মাথায় ছিল। মুখে আসে নি।

কী ধরনের প্রশ্ন হতে পারে? জেনারেল নলেজের দু একটা প্রশ্নতো থাকবেই।

পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কত?

কোন তারিখে চাঁদে মানুষ প্রথম নামে?

বর্তমান পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য কী কী?

বিজ্ঞানের উপরও কিছু প্রশ্ন থাকবে। যুগটাই বিজ্ঞানের। সেই বিজ্ঞানের উপর প্রশ্ন না থাকলে হবে কীভাবে?

পেনিসিলিন কে আবিষ্কার করেন?

ফাউন্টেন পেন এবং বল পয়েন্টের মধ্যে তফাৎ কী?

লুই পাস্তুর কোন দেশের নাগরিক?

কিছু থাকবে পলিটিক্যাল প্রশ্ন।

কোল্ড ওয়ার কী?

তৃতীয় বিশ্ব মানে কী?

ইটালীর প্রেসিডেন্টের নাম কী?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন?

এটা একটা ট্রিকি প্রশ্ন। বোর্ডের চেয়ারম্যান আওয়ামী-পন্থী না বিএনপি-পন্থী তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আওয়ামীপন্থী হলে সঙ্গে সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলতে হবে— জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বিএনপি-পন্থী হলে বলতে হবে মেজর জিয়া।

বোর্ডে একজন ডাক্তারও নিশ্চয়ই থাকবেন। ডাক্তার পেট টিপেটুপে দেখবেন মাল ঠিক আছে কি-না। পেট কেটে দেখতে চাইলেও অনেকে হয়ত আপত্তি করবে না। কাস্টমার জিনিস কিনবে না দেখে কেন কিনবে? দেখে শুনে কিনবে। সাইজ পছন্দ করবে, রঙ পছন্দ করবে।

মেস থেকে বেরুবার মুখে মনু মিয়ার সঙ্গে দেখা। কোকের বোতল ভর্তি গরম চা নিয়ে কোনো বোর্ডারের ঘরে যাচ্ছে। হারামজাদার সাহস কত বড় তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে আছে। মনে হয় হাসছে। হারামজাদাটাকে লাথি দিয়ে কোকের বোতলসহ মেঝেতে ফেলে দেয়া উচিত। মোবারক তা করল না। শুভ কাজে যাচ্ছে, এ সময় মারামারি করা ঠিক না। গলা নামিয়ে বলল, সামনের দরজা দিয়া যাইয়েন না। বাবু আছে।

বাবু মানে পরিমল সাহা। মেসের মালিকের শালা। এবং মেসের ম্যানেজার। মোবারকের ছয়মাসের মেস ভাড়া বাকি। পরিমল বাবু তাকে দেখলে বাঘের মত ঝাপ দিয়ে পড়বেন। এই সুযোগ তাকে দেয়া ঠিক হবে না। মোবারক পেছন দরজা দিয়ে বের হল এবং তাকে যথা সময়ে সাবধান করে দেবার জন্যে মনু মিয়ার ঠাণ্ডা পানি বিষয়ক অপরাধ প্রায় ক্ষমা করে দিল।

অতি বিস্ময়কর ব্যাপার হল মোবারক দেখল ইন্টারেস্টেড পার্টিতে ঘর ভর্তি না। সে একা। যে ঘরে তাকে বসানো হয়েছে সেই ঘরও হলঘর না। ছোট ঘর। তবে বসার ঘর। সোফা আছে, মেঝেতে কার্পেট আছে, দেয়ালে পেইনটিং আছে। বড়লোকদের বসার ঘর একটা থাকে না। কয়েকটা থাকে। তাদের কাছে নানান ধরনের লোক আসে। সবাইকে এক জায়গায় বসানো হয়। না। অবস্থা বুঝে বসার ব্যবস্থা হয়।

ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে মোবারকের কথা হয়েছে। টেলিফোনে তাঁকে যেমন গম্ভীর এবং রাগী মনে হয়েছিল বাস্তবে তাঁকে মিনমিনেটাইপ মনে হল। চেহারা, চলাফেরা এবং কথাবার্তায় লজ্জিত ভঙ্গি। একটু তোতলামী আছে। মনে হয় টেলিফোন হাতে পেলে উনি বদলে যান। বন্দুক হাতে পেলে মানুষ যেমন বদলে যায়, উনিও বোধহয় টেলিফোন হাতে পেলে বদলান। ম্যানেজার সাহেবের নাম জগলু। নাম বগলু হলে ভাল হত। লম্বা বলে তাঁর মধ্যে বগা বগা ভাব আছে। জগলু সাহেবের সঙ্গে মোবারকের কিছু কথা হল।

আপনি মোবারক সাহেব?

জ্বি স্যার।

আপনি কী করেন?

কিছু করি না।

একেবারেই কিছু করেন না তা কী করে হয়? আগে কী করতেন?

শিক্ষকতা করতাম।

কথাটা পুরোপুরি ভুল না। এনজিও-ওয়ালাদের এক স্কুলে মোবারক সর্বমোট এগারো দিন পড়িয়েছে। বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র। গোটা বিশেক থুড়থুড়ো বুড়ো-বুড়ি বই-খাতা নিয়ে বসা। তাদেরকে কিছুক্ষণ স্বরে অ, স্বরে আ করানো। বুড়োবুড়িরা যে শিক্ষার মহান আলোয় আলোকিত হতে এসেছে তাও না। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুবাদে তাদের নাম রেজিস্ট্রি হয়েছে। সবাই একটা করে ছাতা পেয়েছে। ছাতায় এনজিওর নাম। ছাতা ছাড়া মাঝে মধ্যে টুকটাক উপহারের ব্যবস্থা আছে। অক্ষরজ্ঞান শেষ হলে সবাই শাড়ি লুঙ্গি পাবে এরকম গুজব শোনা যাচ্ছে। এগারো দিন পড়ানোর পর মোবারক ঈ পর্যন্ত আগালো। কিন্তু দেখা গেল ছাত্রছাত্রীরা শুরুর স্বরে অ ভুলে গেছে। মোবারক এগারো দিনের দিন এনজিও-ওয়ালাদের তিনটা ছাতা নিয়ে সড়ে পড়লো। কাজেই সে শিক্ষকতা করেছে এটা বলা ভুল হয় নি। যে একদিন পড়িয়েছে সে শিক্ষক। সারা জীবনই শিক্ষক। আবার যে একদিন চুরি করেছে সে কিন্তু সারাজীবনই চোর না। তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই চোর হত।

আপনি তাহলে শিক্ষকতা করতেন?

জ্বি স্যার।

এখন কিছু করেন না?

করলে কি কিডনী বিক্রি করতে আসতাম?

তা ঠিক। আপনি বসুন। চা-টা খান। স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। সামান্য দেরি হবে।

কিডনী কার জন্যে দরকার?

স্যারের জন্যে। উনার দুটা কিডনী নন ফাংশানাল হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস করে করে এতদিন চলেছে, এখন ডাক্তাররা কিডনী ট্রান্সপ্লান্টের কথা বলছেন। আত্মীয়-স্বজনরা অনেকেই ডোনেট করতে রাজি। কিন্তু স্যার তা চান না।

মোবারক হাসি মুখে বলল, আমরা থাকতে আত্মীয়-স্বজনরা কেন কষ্ট করবে? আমরা আছি কী জন্যে?

ম্যানেজার সাহেব কিছুক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে থেকে আগের মত মিনমিনে গলায় বললেন, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি যথাসময়ে ডেকে নিয়ে যাব।

মোবারক বিনীত গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা স্যার। একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করি, এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়?

হ্যাঁ খাওয়া যায়। ঐ যে এসট্রে।

স্যার অনেক ধন্যবাদ।

মোবারক সিগারেট ধরালো। বড় সাহেবের কাছে যাবার আগে হাত-মুখ ধুতে হবে। মুখ কুলকুচা করতে হবে। অসুস্থ মানুষরা দূর থেকে সিগারেটের গন্ধ পায়। তাদের মেজাজ খারাপ হয়। বড় সাহেবের মেজাজ খারাপ করা একেবারেই ঠিক হবে না।

মোবারক যে চেয়ারে বসেছে তার দুটা চেয়ারের পরের চেয়ারেই সুন্দর একটা উলের চাদর পড়ে আছে। চাদরের ওপর মারলবোরো সিগারেটের একটা প্যাকেট। মনে হছে তার মত কেউ একজন এখানে বসেছিল। সে-ও কিডনী বেচতে এসেছে। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছে। তবে যে এমন দামি চাদর গায়ে দেয় এবং মারলবোরো সিগারেট খায় সে কিডনী বেচবে কেন? তার উচিত দুএকটা কিডনী কিনে ফ্রীজে রেখে দেয়া। প্রয়োজনে ব্যবহার করবে। প্রয়োজন না হলে কালোবাজারে বেচে দেবে।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। রাজপুত্র রাজপুত্র চেহারা। হাতে তলোয়ারের বদলে লম্বা স্কেল। কমপ্লিট স্যুট পরা। গলায় লাল টাই। জুতাজোড়াও সম্ভবত নতুন হাটলেই মুড়ি খাওয়ার মত মচমচ শব্দ হচ্ছে। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই মোবারককে বললেন, আচ্ছা আনিস সাহেব কি চলে গেছেন?

মোবারক বিনীত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি স্যার চলে গেলেন।

যদিও আনিস সাহেব কে মোবারক কিছুই জানে না। এ বাড়ির একজনকেই সে চেনে। ম্যানেজার জগলু।

কখন গেছেন বলতে পারেন?

এগজাক্ট টাইম বলতে পারব না। দশ এগারো মিনিট হবে। কমও হতে পারে।

আনিস সাহেবের সঙ্গে কি কোনো ফাইলপত্র ছিল?

স্যার আমি লক্ষ করিনি।

আপনার অবশ্য লক্ষ করার কথাও না। থ্যাংকস এনিওয়ে।

ভদ্রলোক যেমন ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকেছিলেন তারচেয়েও ব্যস্ততার সঙ্গে চলে গেলেন। মিথ্যা কথাগুলি বলার জন্যে মোবারক তেমন দুশ্চিন্তা করছে না। এই নিয়ে পরে যদি প্রশ্ন করা হয় সে বলবে, সে আসলে বুঝতে পারে নি। সে ভেবেছে ভদ্রলোক ম্যানেজার সাহেবের কথা জানতে চেয়েছেন। ম্যানেজার জগলু সাহেব এই ঘরে কিছুক্ষণ ছিলেন, তারপর চলে গেছেন। এই অংশতো মিথ্যা না। পুরোপুরি সত্যি কথা বলা ঠিকও না। সোনার মধ্যে যেমন খাদ মিশাতে হয়। সত্যি কথার মধ্যেও সামান্য মিথ্যা মিশাতে হয়।

মোবারক চেয়ার বদলে পাশের চেয়ারে গেল। এই চেয়ার থেকে হাত বাড়িয়ে মারলবোরোর প্যাকেটটা নেয়া যায়। প্যাকেট খুলে দেখা যেতে পারে মোট কটা সিগারেট আছে। প্যাকেট ভর্তি থাকলে কিছু করার নেই। আধাআধি থাকলে একটা সিগারেট খাওয়া যেতে পারে। সিগারেটের মালিক যদি চলেও আসে তাকে বলা যাবে, ভাই একটা সিগারেট নিয়েছি। কিছু মনে করবেন না।

তেরটা সিগারেট আছে। মোবারক একটা সিগারেট ধরালো। ম্যানেজার চায়ের কথা বলে গিয়েছিলেন। সেই চা এখনো আসে নি। বিদেশী সিগারেট চায়ের সঙ্গে খেতে পারলে আরাম হত। উপায় কী? মোবারক হাত বাড়িয়ে উলের শালটা পরীক্ষা করল। হাত দিলেই বোঝা যায় দামি জিনিস। এক চাদরে মাঘ মাসের শীত পার করে দেয়া যাবে। শালের নিচে গেঞ্জি বা শার্ট কিছু না থাকলেও সমস্যা হবে না। শালের মালিককে পেলে জিজ্ঞেস করা যেত শালটার দাম কত।

মোবারক সাহেব।

ম্যানেজার জগলু এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। এই মিনমিনে লোক হাঁটেও বিড়ালের মত। টেলিফোনে হাঁটার ব্যবস্থা থাকলে বুট পরে ধপ ধপ শব্দ করে হাঁটতো।

আসুন স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন।

মোবারক ভেবেছিল স্যার এক বিরাট পালংকে শুয়ে আছেন। তাকে ঘিরে সেবা করার লোকজন। পাশের টেবিল ভর্তি ফলমুল। দুজন নার্স এবং একজন ডাক্তার একটু দূরে শুকনো মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। স্যার ঠিকমত নিঃশ্বাসও নিতে পারছেন না। কাতলা মাছ পুকুর থেকে তোলার পর যেভাবে থেমে থেমে দম নেয় সেভাবে দম নিচ্ছেন। এই সময়ে তাঁর প্রিয়তমা পত্নী কপালে ভেজা রুমাল ঘসে দিচ্ছেন।

দেখা গেল সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি। অফিস ঘরের মত ঘর। স্যার বসে আছেন চেয়ারে। তার সামনে প্রচুর ফাইলপত্র। তিনি ফাইলপত্রে সিগনেচার করছেন। তার ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। তিনি সিগারেট হাতে নিয়ে টানছেন না। ঠোঁটে রেখেই টানছেন। ঠোঁটে রেখেই অদ্ভুত কায়দায়, একটু মাথা ঝুঁকিয়ে ছাই ফেলছেন। কায়দাটা ইন্টারেস্টিং। শিখে রাখতে হবে। তাহলে সিগারেট খাবার সময় দুটা হাত খালি রাখা যায়। স্যারের গায়ে সিল্কের শার্ট। সুন্দর মেরুন রঙ। তবে তিনি লুঙ্গি পরে আছেন। প্রিয়তমা পত্নীর মুখ বিষাদময়।

স্যার সিগনেচার বন্ধ রেখে টেবিলে রাখা সোনালি চশমা চোখে দিয়ে মোবারকের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি মোবারক?

মোবারক বলল, জ্বি।

বসুন।

মোবারক বসল।

আপনি এক সময় শিক্ষকতা করতেন?

জ্বি।

আমিও এক সময় শিক্ষকতা করতাম। একটা প্রাইভেট কলেজে তিন মাস পড়িয়েছি। তিন মাসে এক মাসের বেতন পেয়েছি। যাই হোক, আপনি কিডনী বিক্রি করতে চান কেন?

মোবারক বলল, টাকার জন্যে চাই স্যার। শখ করেতো আর কেউ কিডনী বিক্রি করে না।

আপনার টাকা দরকার?

জ্বি স্যার।

কত টাকা চাচ্ছেন?

আমার দরকার দুই লাখ টাকা।

আরো কিছু মানুষ এসেছে যারা আপনার মত কিডনী বিক্রি করতে চায়। তবে তারা চাচ্ছে পঞ্চাশ হাজার। আপনি এত চাচ্ছেন কেন? আপনার কিডনীর কোয়ালিটি কি ভাল?

খুব ভাল হবারতো কথা না। আপনারটা হল মেড ইন বাংলাদেশ। মেড ইন বাংলাদেশের জিনিস সাধারণত ভাল হয় না।

মোবারক চুপ করে রইল। ভদ্রলোক রসিকতা করছেন। রসিকতায় মজা পেয়ে তার হাসা উচিত কিনা সে বুঝতে পারছে না। বোকা সেজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। সেটাই মনে হয় ভাল হবে।

দুই লাখ টাকা দিয়ে কী করবেন?

একটা ব্যবসা করার ইচ্ছা।

কী ব্যবসা?

এখনো চিন্তা করি নাই। আগেভাগে চিন্তা করে তো কোনো লাভ নাই।

বিবাহ করেছেন?

জ্বি-না।

আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে আমার কথা শেষ হয়েছে। আপনাকে জগলু একজন ডাক্তারের ঠিকানা দেবে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ডাক্তার বোধহয় কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করবেন। তারপর তিনি যদি ok বলেন, তখন কিডনীর দরদাম নিয়ে আমরা বসব।

জ্বি আচ্ছা।

থাকেন কোথায়?

একটা মেসে থাকি?

দেশের বাড়ি কোথায়?

নেত্রকোনা।

আপনাদের নেত্রকোনায় বিশেষ এক ধরনের মিস্টি পাওয়া যায়। মিষ্টিটার নাম বালিশ। বালিশ মিষ্টি কখনো খেয়েছেন?

জ্বি স্যার।

খেতে কেমন?

চমচমের মত।

এখন আপনি যেতে পারেন।

মোবারক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব স্যার?

বলুন।

আপনাকে দেখে মোটেই অসুস্থ মনে হচ্ছে না।

আমিতো অসুস্থ না। শরীরের একটা যন্ত্র কাজ করছে না। এটাকে অসুখ বলা ঠিক না।

স্যার যাই। স্লামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

স্যার আবার সিগনেচারে মন দিলেন। মানুষটার বয়স পঞ্চাশ। দেখে অনেক কম লাগছে। কিডনী নষ্ট হয়ে গেলে চেহারা সুন্দর হয় কি-না কে জানে। ভদ্রলোককে সুন্দর লাগছে। চোখে মুখে গোলাপী আভা। দীর্ঘদিন ভাল ভাল খাবার খেলেও হয়ত চোখে মুখে গোলাপী আভা আসে।

আবার পুরনো জায়গায় ফিরে আসা। ম্যানেজার সাহেব না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা। পাশের চেয়ারে চাদর এবং সিগারেট আগের মতই আছে। আশ্চর্য! মালিক কোথায়? বারোটা সিগারেট থেকে আরেকটা কমলে তেমন ক্ষতি কী হবে?

মোবারক একটা সিগারেট ধরালো। একটা পকেটে রেখে দিল। রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে একটা ধরাতে হবে। ভাল সিগারেটের সত্যিকার স্বাদ তখন পাওয়া যাবে।

ম্যানেজার সাহেব আসতে দেরি করছেন। টেবিলে বেশ কিছু ম্যাগাজিন আছে। যে-কোনো একটা হাতে নিলে ধর্ষণের কোনো সচিত্র প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। সময় কাটানোর জন্যে খুন এবং ধর্ষণ বিবরণের তুলনা হয় না। মোবারকের ম্যাগাজিন পড়তে ইচ্ছা করছে না। সে চাদরটা হাতে নিয়ে সুন্দর করে ভাজ করে সামনে রাখল। ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে উঠে যাবার সময় খুব সহজ ভঙ্গিতে চাদরটা নিয়ে উঠে যাওয়া যাবে। যেতে হবে ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে করতে। তখন কেউ যদি কিছু বলে, তাহলে অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বলতে হবে— কী সর্বনাশ, কার চাদর আমি নিয়ে যাচ্ছি। এই দীর্ঘ সময়ে কেউ যখন চাদরটার খোঁজ করেনি তখন আশা করা যায় যে শেষ পাঁচ মিনিটও কেউ খোঁজ করবে না। বাকিটা কপাল।

ম্যানেজার সাহেব ঢুকলেন। হাতে একটা কাগজ। কাগজে ডাক্তার সাহেবের ঠিকানা লেখা। ম্যানেজার সাহেব পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ডাক্তার সাহেবকে সব জানানো আছে। আপনি উনার কাছে কার্ডটা শুধু দেবেন। নিন কার্ডটা রাখুন। হারাবেন না।

মোবারক বলল, জ্বি আচ্ছা।

ম্যানেজার সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আপনাকে একটা ভাল পরামর্শ দেই। কিডনীর দাম নিয়ে দরাদরিতে যাবেন না। এটা স্যারের হাতে ছেড়ে দিলে আপনার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। বুঝতে পারছেন?

জ্বি পারছি।

স্যার যদি আপনার উপর খুশি হন, তাহলে বাকি জীবনের জন্যে আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট কোথায় হবে জানেন?

জ্বি-না।

সুইজারল্যান্ড। বিনা খরচায় সুইজারল্যান্ড দেখে চলে আসবেন।

পাসপোর্ট কি করিয়ে ফেলব?

আগে সব ঠিকঠাক হোক।

মোবারক বলল, আমার উপর একটু দোয়া রাখবেন ভাই সাহেব। যেন বাণিজ্যটা হয়।

ম্যানেজার সরু চোখে তাকান। মোবারকের বাণিজ্য কথাটা তার মনে হয় পছন্দ হল না।

মোবারক বলল, স্যার উঠি? বলতে বলতেই চাদর হাতে সহজ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। সিগারেটের প্যাকেট আগেই পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। চাদর নিয়ে লোকটা চলে যাচ্ছে এটা মনে হয় তার চোখে পড়ছে না।

হাঁটতে হবে স্বাভাবিক ভাবে। গল্পগুজবে ম্যানেজার সাহেবকে ভুলিয়ে রাখতে হবে। মোবারক বলল, আয়না কোথায় ম্যানেজার সাহেব।

জগলু ভুরু কুঁচকে বলল, আয়না কোথায় মানে কি?

আয়না নামের মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে।

আয়না নামে কেউ এ বাড়িতে নেই।

অবশ্যই আছে। আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। কেজি ওয়ানে পড়ে।

ম্যানেজার বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে। তাকিয়ে থাকুক। মোবারক এগুচেচ্ছ। আর একটু গেলেই মুক্তি।

শেষ বাধা গেট। গেটের দারোয়ান কিছু জিজ্ঞেস না করলেই হয়। মনে হয় জিজ্ঞেস করবে না। দারোয়ান দুই জনেরই বয়স অল্প। অল্প বয়েসী দারোয়ানরা সন্দেহপ্রবণ হয় না। বুড়োগুলি হয়।

মোবারক কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই গেট পার হল। এখন কেউ গেট খুলে বের হয়ে আসবে এবং তার কাছে ছুটে এসে বলবে, আমার কাশ্মিরী শাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। কার্তিক মাসের শুরু, বাতাসে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব থাকলেও শাল গায়ে দেয়ার মত না। তাতে কী? মোবারক শাল গায়ে দিয়ে ফেলল। চৈত্র মাসেও কমপ্লিট স্যুট পরা লোক দেখা গেলে সেও শাল গায়ে দিতে পারে। জিনিসটা খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে। বিক্রির আগে কিছুদিন ব্যবহার করা। অনেকটা ধোপর মত। ধোপার দোকানে শাড়ি ধুতে পাঠালে, ধোপার বউ সেই শাড়ি এক দুবেলা পরে। ধোপর বাড়িতে শাড়ি গেছে, ধোপার বউ সেই শাড়ি পরেনি এমন কখনো হয়

চলবে। 📌

কষ্টের স্ট্যাটাস | Sad status | koster status

0

নিচে ১০০টি কষ্টের স্ট্যাটাস একসঙ্গে দেওয়া হলো:

1. “যে হৃদয় ভালোবাসতে জানে, সে কষ্ট পেতে বাধ্য।”

2. “চোখের জল লুকানো যায়, কিন্তু মনের ব্যথা নয়।”

3. “যার জন্য কাঁদি, সে কখনো জানতেও চায় না।”

4. “ভালোবাসা আসলে শুধু পাওয়া নয়, হারানোর কষ্টও।”

5. “সবাই ভুলে যায়, কিন্তু স্মৃতিগুলো কখনো যায় না।”

6. “অপেক্ষা কষ্টদায়ক, কিন্তু তা ছাড়া আর কিছু করার নেই।”

7. “প্রতিটা কষ্টই মনে করিয়ে দেয়, ভালোবাসার দাম দিতে হয়।”

8. “তুমি চলে গেছ, কিন্তু আমি এখনও আটকে আছি তোমার মধ্যে।”

9. “ভালোবাসা শেষ হয় না, শুধু মানুষ হারিয়ে যায়।”

10. “যে কষ্ট বোঝে না, সে ভালোবাসতেও পারে না।”

11. “মনের কষ্ট শরীরের ব্যথার চেয়েও বেশি গভীর।”

12. “কিছু সম্পর্ক কষ্ট দিয়েই শেষ হয়ে যায়।”

13. “ভালোবাসা কখনো কখনো সবচেয়ে বড় শাস্তি হয়ে দাঁড়ায়।”

14. “আমার অনুভূতিগুলো বোঝার মতো কেউ নেই।”

15. “প্রত্যাশা করলেই কষ্ট বাড়ে।”

16. “ভালোবাসা দেওয়ার মানুষ না থাকলে, তা একতরফা থেকে যায়।”

17. “আমার প্রতিটি চোখের জলই তোমার জন্য।”

18. “স্মৃতিগুলো যত মধুর, তা হারানোর ব্যথা তত বেশি।”

19. “যে চলে যায়, সে আর ফিরে আসে না।”

20. “কষ্ট পেতে পেতে মনে হয়, জীবনে সুখ বলে কিছু নেই।”

21. “ভালোবাসার মানুষটাকে ভুলে যাওয়াটা সবচেয়ে কঠিন কাজ।”

22. “ভালোবাসা যখন একতরফা হয়, তখন হৃদয় ভাঙে।”

23. “তুমি আমার হাসির কারণ ছিলে, এখন তুমি আমার অশ্রুর কারণ।”

24. “ভুল বোঝা সম্পর্কের সবচেয়ে বড় শত্রু।”

25. “আমার ব্যথা শুধু আমিই বুঝি।”

26. “মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ভালোবাসাকে ধ্বংস করে দেয়।”

27. “যে যায়, সে ফেলে যায় অনেকগুলো কষ্টের স্মৃতি।”

28. “ভালোবাসা হলো এমন কিছু, যা গভীর কষ্ট দিয়ে যায়।”

29. “কেউ কারও কষ্ট বুঝতে চায় না।”

30. “আমার হৃদয়ে আজও তোমার নাম লেখা।”

31. “যে চলে যায়, সে সুখী; যে থাকে, সে কষ্ট পায়।”

32. “আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে তোমার স্মৃতি বয়ে যায়।”

33. “যার জন্য হাসতাম, আজ সে আমার কান্নার কারণ।”

34. “ভালোবাসা মানেই কষ্ট নয়, কিন্তু কখনো কখনো সেটাই সত্য হয়।”

35. “তুমি না থাকলে, আমার দিনগুলো ফাঁকা।”

36. “কিছু মানুষ কষ্ট দিয়েও স্মৃতিতে বেঁচে থাকে।”

37. “আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার আগে, একবার ভেবে দেখো।”

38. “তোমার অবহেলা আমার হৃদয় ভেঙে দিয়েছে।”

39. “ভালোবাসার সবচেয়ে কঠিন অংশ হলো, ভুলে যাওয়া।”

40. “তোমার কাছ থেকে দূরে থাকা মানে প্রতিদিন কষ্ট পাওয়া।”

41. “আমি তোমার ছিলাম, কিন্তু তুমি আমার হতে পারলে না।”

42. “ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়, তা কষ্ট দেওয়াও শেখায়।”

43. “আমার কষ্টটা শুধু আমি বুঝি।”

44. “যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে অবহেলা করে।”

45. “স্মৃতিগুলো কেন এত ব্যথা দেয়?”

46. “আমি তোমাকে আজও ভালোবাসি, যদিও তুমি তা জানো না।”

47. “প্রতিটা হারানো মুহূর্তে আমি তোমাকে খুঁজি।”

48. “আমার হৃদয়ে তুমি একবার আসলে, আর ফিরে যাওনি।”

49. “তুমি আমাকে বুঝতে চাওনি, এটাই আমার কষ্টের কারণ।”

50. “তোমার অবহেলাটা আমাকে ভেঙে দিয়েছে।”

51. “মনের কষ্টগুলো কাউকে বলা যায় না।”

52. “ভালোবাসা মানে শুধু হাসি নয়, তা চোখের জলও নিয়ে আসে।”

53. “আমার কষ্টটা তুমি কখনো বোঝনি।”

54. “তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা আমার ভুল ছিল।”

55. “ভালোবাসা ভুল হলে, তা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়।”

56. “যে ভালোবাসে, সে হারানোর কষ্ট পায়।”

57. “তুমি আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই ভালোবেসেছিলে?”

58. “প্রতিটা ব্যথার পিছনে একটা না বলা গল্প থাকে।”

59. “আমার ভালোবাসা হয়তো তোমার কাছে মূল্যহীন।”

60. “যার জন্য রাত জেগে থাকি, সে ঘুমিয়ে থাকে।”

61. “আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে শুধু তোমার নাম।”

62. “তুমি যখন চলে গেলে, আমার জীবনের সব আলো নিভে গেল।”

63. “ভালোবাসা মানে কষ্টের মধুর স্মৃতি।”

64. “কষ্টগুলো সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হয়।”

65. “তোমার জন্য আমার সব কিছু ছিল, কিন্তু আমি তোমার কিছুই ছিলাম না।”

66. “তোমার কাছ থেকে দূরে থাকাই আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট।”

67. “আমার হৃদয় তোমার জন্য ব্যথায় ভরা।”

68. “তুমি কি কখনো ভেবেছ, আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি সুখী হতে পারবে?”

69. “ভালোবাসার নামেই সব ব্যথা মেনে নেই।”

70. “তুমি যখন চলে গেলে, আমার জীবন ফাঁকা হয়ে গেল।”

71. “কিছু ব্যথা কখনোই ভুলে যাওয়া যায় না।”

72. “ভালোবাসা মানেই সব সময় সুখ নয়।”

73. “তোমার স্মৃতিগুলো আমার হৃদয়কে জ্বালিয়ে দেয়।”

74. “আমার চোখের জল তুমি কখনো দেখনি।”

75. “ভালোবাসা কষ্টের আরেক নাম।”

76. “তোমার অভাবটা আমি প্রতিদিন অনুভব করি।”

77. “কিছু সম্পর্ক কষ্ট দিয়েও মনে গেঁথে থাকে।”

78. “আমার প্রতিটা শ্বাস তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকে।”

79. “তুমি আমায় ভেঙে দিয়েছ, কিন্তু আমি তোমাকে ভাঙতে পারিনি।”

80. “তুমি আমাকে ফেলে গেলে, আমি আজও তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।”

81. “যে ভালোবাসে, সে সবকিছুই মেনে নেয়।”

82. “তোমার প্রত্যেকটা অবহেলা আমাকে আরও ভেঙে দিয়েছে।”

83. “তুমি আমাকে হারিয়ে দিয়েছ, কিন্তু আমি তোমাকে হারাতে পারিনি।”

84. “আমার ভালোবাসা হয়তো তোমার কাছে মূল্যহীন।”

85. “তুমি ফিরে আসবে কি কখনো?”

86. “ভালোবাসা কখনো কখনো অভিশাপ মনে হয়।”

87. “তোমার একটা হাসি আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিত।”

88. “যে স্মৃতি কষ্ট দেয়, সেটাই হৃদয়ে গেঁথে থাকে।”

89. “আমি ভালোবেসে ভুল করেছি, কিন্তু তোমাকে ভুলতে পারিনি।”

90. “আমার মন তোমারই কাছে পড়ে আছে।”

91. “তোমার ফিরে আসার অপেক্ষা আজও করি।”

92. “তুমি যেদিন চলে গেলে, সেদিন আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল।”

93. “ভালোবাসা মানে শুধু দেওয়া নয়, তা ব্যথাও বহন করে।”

94. “তোমার প্রতিটা স্মৃতি আমাকে কাঁদায়।”

95. “আমার হৃদয় ভেঙে দিয়ে তুমি সুখী?”

96. “ভালোবাসা মানে কষ্ট, যদি তা সত্যি হয়।”

97. “তুমি আমাকে না বুঝে চলে গেলে।”

98. “আমার জীবনে তুমি একটাই গল্প ছিলে।”

99. “তোমার জন্য আজও আমি অপেক্ষা করি।”

100. “কষ্ট দিয়েও ভালোবাসা যায়, যদি তা সত্য হয়।”

বৃষ্টি ভেজা দিন | রোমান্টিক ছোট গল্প

0

গল্প: বৃষ্টি ভেজা দিন

তানিয়া আর অয়ন একই অফিসে কাজ করত। অয়ন ছিল শান্ত, সংযত প্রকৃতির। আর তানিয়া ছিল প্রাণোচ্ছল, সব সময় হাসিখুশি। অফিসের সবার মধ্যেই তানিয়া ছিল বেশ জনপ্রিয়। অন্যদিকে অয়ন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত, কারো সঙ্গে বেশি মিশত না।

একদিন বিকেলে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। অফিস শেষ হওয়ার পর সবাই ছাতা নিয়ে বের হয়ে গেল, কিন্তু তানিয়ার ছাতা ছিল না। সে অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির থেমে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল।

অয়ন হঠাৎ দেখল তানিয়া একা দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তুমি কি বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছো?”
তানিয়া একটু হাসল, “হ্যাঁ, ছাতা আনতে ভুলে গেছি। তোমার ছাতা আছে?”
অয়ন বলল, “আছে। চল, একসঙ্গে বের হই।”

তানিয়া একটু দ্বিধায় পড়লেও অয়নের সঙ্গে ছাতা শেয়ার করে রাস্তায় নামল। সেই দিন প্রথমবার তানিয়া অনুভব করল, অয়ন আসলে অনেক ভালো মানুষ। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তারা অনেক কথা বলল। অয়ন তার পরিবারের গল্প বলল, তানিয়া বলল তার শৈশবের স্মৃতি।

বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল, আর তানিয়ার মিষ্টি হাসি অয়নের মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। সেই দিনই অয়ন বুঝল, তার মন তানিয়ার জন্য কেমন জানি অন্যরকম অনুভব করছে।

পরের দিন অফিসে তানিয়া অয়নকে বলল,
“কালকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি না থাকলে তো ভিজে একাকার হয়ে যেতাম।”
অয়ন লজ্জায় মৃদু হেসে বলল,
“তেমন কিছু না।”

এরপর থেকে তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হলো। প্রায়ই লাঞ্চ ব্রেকে তারা একসঙ্গে বসে কথা বলত। তানিয়া হাসিখুশি মেয়ে হলেও, তার জীবনে অনেক কষ্ট ছিল। তার মা মারা গেছেন ছোটবেলায়, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এই গল্পগুলো অয়নের সঙ্গে শেয়ার করার সময় তানিয়ার চোখে জল চলে আসত। অয়ন তার পাশে বসে শান্তভাবে তাকে সান্ত্বনা দিত।

একদিন তানিয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“অয়ন, তুমি এত চুপচাপ কেন? তোমার কি কখনো কারো সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে?”
অয়ন বলল,
“আমার জীবনেও খুব বেশি রঙ নেই। তবে তোমার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়, জীবনে রঙ যোগ হচ্ছে।”

তানিয়া একটু অবাক হলো, কিন্তু কিছু বলল না।

কয়েক মাস কেটে গেল। তানিয়া বুঝতে পারছিল, অয়ন তার প্রতি আলাদা কিছু অনুভব করে। তবে সে নিজে থেকে কিছু বলছিল না। একদিন তানিয়া সাহস করে বলল,
“অয়ন, তুমি কি কিছু বলতে চাও আমাকে?”
অয়ন অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“তানিয়া, তুমি আমার জীবনে এমন একটা জায়গা নিয়েছ, যেটা আমি আগে কখনো অনুভব করিনি। তোমার হাসি, তোমার কথা, সবকিছু আমার খুব প্রিয়। আমি হয়তো তোমাকে ভালোবাসি।”

তানিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“তুমি জানো, আমার জীবনে অনেক জটিলতা। তুমি কি সত্যি এই ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত?”
অয়ন দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“তোমার পাশে থাকতে হলে আমি সবকিছু মেনে নিতে রাজি।”

তানিয়ার চোখে জল এল, তবে সেটা আনন্দের। সেই দিন তারা দুজন একসঙ্গে হাঁটল, যেমন বৃষ্টি ভেজা দিনটায় হাঁটছিল। তবে এবার তাদের হাঁটার পথে ছিল ভালোবাসার ছায়া।

শেষ।

প্রথম দেখা | রোমান্টিক গল্প

0

গল্প: প্রথম দেখা

রোদেলা এক সকাল। আরিফ বসে আছে ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে। তার সামনে একটা মোটা বই, কিন্তু মনটা একদমই বইয়ের পাতায় নেই। পাশের টেবিলে হঠাৎ করেই একটা মৃদু গলার আওয়াজ—”এই চেয়ারটা খালি?”

আরিফ মুখ তুলে দেখল, একটা মেয়ের চোখে-মুখে মিষ্টি হাসি। মেয়েটি বসার অনুমতি চাইলো। আরিফ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। মেয়েটি বসে পড়ল এবং নিজের বই খুলে পড়তে শুরু করল।

কিছুক্ষণ পর, মেয়েটি হেসে আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার নাম কী?”
আরিফ একটু হকচকিয়ে উত্তর দিল, “আরিফ। আর আপনি?”
মেয়েটি বলল, “আমি রাফা।”

সেদিনের সেই কথোপকথন ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে রূপ নিল। প্রতিদিন তারা লাইব্রেরিতে দেখা করত, গল্প করত, কখনো বই নিয়ে, কখনো জীবনের নানা বিষয় নিয়ে।

একদিন রাফা জিজ্ঞেস করল,
“আরিফ, তুমি এত চুপচাপ কেন? তোমার কি কখনো মনে হয় যে, জীবনে আরও রঙ থাকা দরকার?”
আরিফ মুচকি হেসে বলল,
“রঙ তো আসছে। তুমি যেদিন এই টেবিলে এসে বসল, আমার জীবনে রঙ তখন থেকেই শুরু হয়েছে।”

রাফা অবাক হয়ে তাকাল। তারপর লাজুক হাসি দিয়ে বলল,
“তুমি এত দিন কিছু বললে না কেন?”
আরিফ চোখ নামিয়ে বলল,
“তোমাকে হারানোর ভয় পাই।”

রাফা একটু হেসে বলল,
“বোকা, ভালোবাসা হারায় না, যদি সেটা সত্যি হয়। আর তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, ভালোবাসা সত্যি।”

সেইদিন থেকেই তাদের গল্পটা প্রেমের পথে যাত্রা শুরু করল। লাইব্রেরির টেবিল যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, সেটা হয়ে গেল তাদের ভালোবাসার স্মৃতির কেন্দ্র।

শেষ।

কাগজের নৌকা | রোমান্টিক ছোট গল্প

0

গল্প: কাগজের নৌকা

ছোট্ট এক গ্রামের নাম ছিল শান্তিপুর। সেখানে একটা ছোট্ট নদীর ধারে রোজ বিকেলে কাগজের নৌকা ভাসাতে যেত রিহান। সে শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে এসেছে। তার কাগজের নৌকা বানানোর দৃশ্য একদিন দেখে ফেলল নদীর পাশের বাড়ির মেয়েটি, নীলা।

নীলা এগিয়ে এসে বলল,
“তুমি এখানে কী করো?”
রিহান হেসে বলল, “কাগজের নৌকা ভাসাই। জানো, আমি চাই নৌকাগুলো নদীর সঙ্গে দূরে কোথাও চলে যাক।”
নীলা বলল, “আমারও স্বপ্ন—একদিন আমিও নদীর মতোই দূরে কোথাও চলে যাব।”

তাদের এই ছোট্ট আলাপ থেকেই শুরু হলো এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব। রোজ বিকেলে নীলা আর রিহান একসঙ্গে নৌকা ভাসাতে বসত। একদিন রিহান নীলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নীলা, জানো, আমি চাই তুমি আমার জীবনের অংশ হয়ে থাকো। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
নীলা লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল,
“রিহান, তুমি শহরের মানুষ। তোমার জীবন ব্যস্ততায় ভরা। আমি তো স্রেফ গ্রামের এক সাধারণ মেয়ে। তুমি আমার জন্য কেন এত কিছু ভাবো?”

রিহান মৃদু হেসে বলল,
“তুমি গ্রামের মেয়ে বলে নয়, বরং তোমার সরলতাই আমাকে টানে। তোমার হাসি আমাকে শান্তি দেয়।”

কিন্তু সময় থেমে থাকে না। রিহানকে শহরে ফিরে যেতে হলো। বিদায়ের দিন নদীর ধারে এসে নীলা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“তুমি কি ফিরে আসবে?”
রিহান তার হাতে একটি কাগজের নৌকা দিয়ে বলল,
“এই নৌকাটা যতবার দেখবে, আমার কথা মনে করবে। আমি ফিরে আসব, কথা দিচ্ছি।”

বছর ঘুরে গেল। নীলা প্রতিদিন নদীর ধারে এসে অপেক্ষা করত। একদিন বিকেলে হঠাৎ করে রিহানকে নদীর ধারে দেখতে পেল। রিহানের হাতে সেই নৌকা। সে নীলার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“নীলা, আমি ফিরে এসেছি। এবার চলো, আমাদের জীবন একসঙ্গে শুরু করি।”

নীলার চোখে জল, কিন্তু সেই জলে আনন্দের ঝিলিক। কাগজের নৌকা এবার সত্যি তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে গেল।

শেষ।

ভালোবাসার শেষ পৃষ্ঠা | ছোট গল্প

0

গল্প: ভালোবাসার শেষ পৃষ্ঠা

রাফি ও সারা একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। সারা হাসিখুশি, সবসময় মিষ্টি কিছু বলার জন্য পরিচিত ছিল। আর রাফি ছিল শান্ত স্বভাবের, কিছুটা লাজুক। রাফি সারার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করলেও কখনো প্রকাশ করতে পারেনি।

একদিন, এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে, রাফি সাহস করে সারাকে বলল,
“সারা, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।”
সারা মিষ্টি হেসে বলল, “বলো রাফি, শুনছি।”
রাফি কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”

সারা একটু চুপ থেকে বলল, “রাফি, ভালোবাসার জন্য সাহসের দরকার। তোমার সাহস আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু সময়ের আগে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে ভুল হতে পারে। আমরা বন্ধু হয়ে থাকি, সময় আমাদের উত্তর দেবে।”

এরপর দিনগুলো কেটে যেতে লাগল। রাফি ও সারা বন্ধু হিসেবে থেকে গেল। তবে রাফি কখনো হাল ছাড়েনি। তার ভালোবাসা সারার প্রতি আরও গভীর হলো।

দশ বছর পর, এক চায়ের আড্ডায় সারা হঠাৎ বলল,
“রাফি, মনে আছে, তুমি একদিন সাহস করে আমাকে কিছু বলেছিলে? আমি মনে মনে উত্তর রেখেছিলাম। আমি তখন থেকেই তোমাকে ভালোবেসেছি, শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম।”

রাফি হেসে বলল,
“ভালোবাসা অপেক্ষা করতে জানে, আর সময় তার সঠিক উত্তর দেয়।”

তাদের গল্পটা এখানেই শেষ হলো না। বরং, এটা হলো নতুন শুরুর সূচনা। ভালোবাসা যে সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হয়, এটাই তাদের গল্পের শিক্ষা।

শেষ।

অপেক্ষা পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0

#অপেক্ষা
#Mariam_akter_juthi
#অন্তিম_পর্ব

[অনুমতি ব্যতীত কপি করে গঠনভাবে নিষিদ্ধ]

“সাব্বাস এই না হলো আমার মেয়ের কথা, ভালোবাসার মানুষ টাকে নিজের সাথে জুড়ে নেওয়া, তার হাত আঁকড়ে ধরে থাকা, তার সুখ দুঃখের সাথী হাওয়া” ‘মুচকি হেসে কথা গুলো বললেন আরমান চৌধুরী’

শাহরিয়া— এসব কি বলছো তুমি আব্বু, সামিরা কে পেয়েছি এখন ওকে নিয়ে চলো এখান থেকে।

আরমান কিছু বলতে যাবে তার আগেই সামিরা সবার উদ্দেশ্য বললো।

— আমি আমার স্বামীর সাথে থাকতে চাই, এবং কি বিয়ে টা আমাদের যেমন ভাবেই হোক না কেন, যতই তোমাদের কে আমরা না জানাই, বিয়েটা কিন্তু আমাদের সত্যি হয়েছি, তাই আমি চাইবো না তোমারা আমার স্বামীর থেকে আমাকে আলাদা করো,

— কিসের বিয়ে, ও নিশ্চয়ই তোকে ভয় দেখিয়েছে? তার জন্য তুই এরাকোম মিথ্যা বলছিস? কিন্তু তোর কোন ভয় নেই, তোর ভাই আছে তো? ‘শাহরিয়া’

— না ভাই কেউ আমাকে ভয় দেখায়নি, যা বলছি সব সত্যি, এইটুকু বলে কিছুক্ষন থেমে আবার বললো

~~ ৭ তেই জানুয়ারি তোমার গায়ে হলুদের দিন সকাল ১১.৪৩ মিনিটে আমারা বিয়ে করেছি, আমার ভয় ছিল বিয়ের বিষয়টা তুমি জানতে পারলে কি করবে, মেনে নিবে কিনা, আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে কিনা?? তাই আমি সেদিন তোমাদের কাউকে ভয়ে বলতে পারিনি,

আরমান চৌধুরী মেয়ের কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়, তার মেয়ে তাদের কে না জানিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে নিল??আর রিহান?? সে কিভাবে পারলো? তাদেরকে না জানিয়ে তাদের মেয়েকে বিয়ে করে নিতে? রিহান যদি তার কাছে একটা বার মন খুলে বলতো, সে সামিরা কে বিয়ে করবে, তাহলে কোনদিনও না বলতো? আরো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করে মেয়েকে তার হাতে তুলে দিতো, কিন্তু এরা কি করলো? তার একটা মাএ মেয়ে কত ইচ্ছা ছিল, কত ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিবেন, এই সব আশায় জল ঢেলে ছেলে মেয়ে দুটো লুকিয়ে বিয়ে করে নিল? তাই তিনি আফসোসের ন্যায় রাগী রাগী হয়ে বললো।

~~ রিহান আমার জানামতে তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, তাহলে তুমি এমন একটা কাজ কিভাবে আমাদের না জানিয়ে করতে পারো??তুমি যদি আমাদের একটা বার বলতে তুমি সামিরা কে বিয়ে করতে চাও , আমার কি নিষেধ করতাম?? ‘আরমান’

রিহান যেন একের পর এক শক খাচ্ছে, প্রথমে সামিরার কথায় পরে আরমান চৌধুরী কথা,রিহান যে একাই শক খাচ্ছে এমন না ঠিক একই ডিগ্রির শক শাহারিয়া ও খাচ্ছে, তার বাবা সামিরা কে রিহানের সাথে বিয়ে দিতো?আর সামিরা ও রিহানের সাথে থাকতে চায়? তার মাথায় কিছুই আসছে না, এই রিহান টা কখন তার বাপ’বোনকে পটিয়ে নিল? যেখানে তার বাপ’বোন রিহান কে মেনে নিয়েছে, সেখানে সে ভাই,ভাই সম্পর্কে ফাও’ফাও শত্রুতা বারালো?কি আজব,

“আরমান চৌধুরী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন”

— কি আর করার বিয়ে যখন করে নিয়েছো, দুজনে যখন একে অপরের সাথে থাকতে চাও, তাহলে এখানে তো আর কিছু বলার নেই, তবে রিহান আমি এখন সামিরা কে আমার সাথে বাসায় নিয়ে যাবো, জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেব, এই কয়দিন ও আমাদের সাথে থাকবে।

শাহরিয়ার এখন কি আর বলার তাই বাবার কথার সায় মিলিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল।

— যদি আমার বোন রিহানের সাথে থাকতে চায় তাহলে তো আমারো কিছু বলার নেই, আমিও তাহলে বাবার কথার একমত।

রিহান কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না, সবাই তার ধারণা থেকে পাল্টি খাচ্ছে, এভাবে সামিরা কে নিয়ে আসলে যে তুফান না হয়ে মাখামাখি একটা বিষয় হয়ে যাবে,শয়ং শাহারিয়া‌ রাজি হবে,আহহহ আর মাথায় আর নিতে পারছে না, এবং কি সামিরার মনে যে তার জন্য সফট কর্নার আছে সেটাও সে ধারণাতে আনেনি,যাই হোক তুফান না হয়ে যে সব কিছু এতো সুন্দর মিটমাট হয়ে গেছে এটাই অনেক, তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনুতপ্ত কন্ঠে বললো

— আপনাদের যা ভালো মনে হয় , ‘রিহান’

********************************************

সময় তার নিতান্ত গতিতে এগিয়ে যায়,কাল বেধ, দেখে না,না কারো জন্য অপেক্ষা করে? সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় সব পুরোনো মুহূর্ত, স্মৃতি সব সম্পর্ক।কেরো কেরো সম্পর্ক হয়ে যায় বিছিন্ন আবার কারো সম্পর্ক‌ হয়ে উঠে বিশ্বস্ত তা ও মধুর , ঠিক তেমনি অরু সেদিন সামিরাকে বাসায় নেওয়ার পর সামিরার কাছে আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চেয়েছিল, সামিরা প্রথমে অভিমান করলেও, পরে প্রিয় বান্ধবী কে আবারো আপন করে নিয়েছিল, তাদের কে কেউ দেখলে বলবে না, তাদের মধ্যে ননদ ভাবীর সম্পর্ক জাতীয় কিছু আছে, সাড়া বাড়ি খুনসুটি করে মাতিয়ে রাখে তাঁরা দুজন। তাদের কেই খুনসুটি নিয়েই বাড়ির সকলের দিন রাত পার হয়ে যায়।

“আজ শুক্রবার,পুরো বাড়ি সুন্দর জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে সামিরার বিয়ে উপলক্ষে, কিছুক্ষণ পরেই রিহান রা চলে আসবে,কাজী সাহেব সহ,সকলে উপস্থিত। সময় খনের ভিতর সামিরার পুনরায় বিয়েটা সম্পুর্ন হয়।”

প্রত্যেক টা বাবা-মায়ের, মেয়ে বিদায়ের কষ্ট টা যেন একটু বেশি থাকে, কিছু মুহূর্ত আগেও যেই মেয়েটা কত সুন্দর বাড়িটা হৈচৈ করে মাতিয়ে রাখতো,আজ সেই মেয়েটা বাড়ির সকলকে কাঁদিয়ে স্বামীর সংসার করতে চলে যাচ্ছে, বাস্তবতার কি আযব নিয়ম, যদিও সামিরা দের বাড়ি থেকে রিহানের বাড়ির দুরুতো ৩০ মিনিটের, তবুও বিদায় টা ভিশন কষ্ট কর,

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

ফুল সজ্জিত বিছানায় গুটি’শুটি হয়ে বসে আছে সামিরা, তার মনে রিহান কে নিয়ে কোন অভিযোগ না থাকলেও, কেমন আনেজি লাগছে,আজ সবার অনুমতি নিয়ে তারা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে,রিহান নামক মানুষটা তার, ভাবলেই কেমন কেমন একটা অনুভুতি হয়, কিছু সময় হতেই রিহান রুমে আসে, তার সাধ্য হওয়া পুরোনো বউ কে বিছানায় গুটি’শুটি হয়ে বসে থাকতে দেখে অপরাধী কন্ঠে বললো।

— ভয়ের কোন কারন নেই, আমি তোমাকে কোন বিষয় জোর করবো না, তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো, এটুকু বলে আবার বলো।

~~তখন তোমাকে নিয়ে আমার ভয় ছিল, আমি যদি তোমাকে না পাই?? তোমাকে যদি হারিয়ে ফেলি, তোমার ভাই যেভাবে আমার বিপাকে ছিল, আমার ক্ষণে ক্ষণে ভয় হতো, তোমাকে নিজের করার আগে হারিয়ে না ফেলি? তাই তখন তোমাকে বিয়ে টা জোর করে করেছিলাম,আর সেদিন ওই ছেলেটার সাথে তোমাকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে আমার মাথা ঠিক ছিল না,তাই তোমর সাথে,,

আর কিছু বলার আগে সামিরা রিহান কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে,বললো।

~~ আমি কোন এক্সেপেলেন শুনতে চেয়েছি,আপানার কাছ থেকে,না জানতে চেয়েছি। তাহলে কেন পুরোনো মুহূর্তের কথা বলছেন? ‘সামিরা’

রিহান সামিরার কথায় ওর দিকে ঘুরে মধু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

~~ সেইদিন তোমার সাথে ওই রকম ভিয়াইবিহার কারার পরেও তা খারাপ বদ মেজাজি আমি টাকে ভালোবাসা দিলে কবে থেকে? ‘রিহান’

~~ আপনার জন্য আমার মনে অনেক আগে থেকেই সফট কর্নার ছিল, যেদিন আমাকে আপনি বিয়েটা করেছিলেন, নিজের ভিতর একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল, কিন্তু সেদিন যখন আপনি ওইভাবে আমাকে জোর করে নিয়ে আসলেন, তখন আপনার উপর একটু রাগ হয়েছিল, তারপর যখন দেখলাম সেদিন আপনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করার পর আমি যখন কষ্ট পেয়ে কান্না করছিলাম, তখন আমার কষ্টে আপনিও কষ্ট পাচ্ছিলেন, আমার কান্না আপনার ভিতর একটা অনুতপ্ত ফিল হচ্ছিল, তারপর যখন আর কিছু না করে আমাকে ওইভাবে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন থেকেই বুঝেছিলাম আপনি আমাকে ভালবাসেন, শুধু ভালোবাসেন না মারাত্মক ভালোবাসেন, আমি বুঝতে পেরেছিলাম,তাইতো সেদিন আমাকে হারানোর ভয়ে অমনটা করেছিলেন। আমি নিজের চোখে এমন নিজের প্রতি এত ভালোবাসার একটা মানুষকে দেখতে পেয়ে কিভাবে হারিয়ে ফেলি বলুন। আপনার মত হয়তো আমাকে এমন মারাত্মক কেউ ভালোবাসবে না। হ্যাঁ আপনার সেই দিনের পদক্ষেপটা ভুল ছিল, তবে আপনার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। শুধু আছে এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা। হ্যাঁ স্বামী আমি আপনার, অর্ধাঙ্গিনী। একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে ভুল কাজ করতেই পারে, আর সেটা কে শুধরে দেওয়াই আদর্শবান একজন স্ত্রীর কাজ। কোন আদর্শবান স্ত্রীর এমন কাজ নয় স্বামীর অন্যায় টাকে মনে রেখে তার থেকে দূরে চলে যাওয়া। তাকে একলা ফেলে চলে যাওয়া, অন্তত এমন স্ত্রী আমি নই। আমি আপনার সবকিছু ভুলে আপনার হাতটা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই।

রিহান সামিরার কথা শুনে সামিরার কে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে, বিশ্ব জয় করা হাসি দিয়ে কণ্ঠে মধুময় সুরে বলল।

অনেক বছরের সাধনা, তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। দিন শেষে পরিশ্রম, আজ তোমাকে নিজের জীবনে পেয়ে পূর্ণতা পেলাম। ভালোবাসি সামু রানী, তোমাকে ভীষণ রকম ভালোবাসি।

[দুজনের এক গভীর ভালোবাসা সাক্ষী হয়ে রইল ওই দূর আকাশের বাস উজ্জ্বল চাঁদ]

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

[দুই বছর পর]

হিম’শীতল, বহি’কুল এক বাতাসের সূচনা। পড়ন্ত এক গোধূলিরগ্ন, হাঁটতে বের হয়েছিল, শাহারিয়া’অরুপিতা। দুজন একে অপরের হাত ধরে গুটি গুটি কদম ফেলে প্রকৃতি উপভোগ করছিল। সাথে ছিল তাদের ভালোবাসার সাক্ষী, ১ বছর ৩ মাসের ছেলে। তিনজন মিলে খুব আনন্দে প্রকৃতিকে উপভোগ করছিল। কিছুদূর যাওয়ার পরে হঠাৎই অরুর সাথে ধাক্কা লাগে সামনে একটা লোকের গায়ে,অরু তাড়াহুড়ো করে লোকটার দিক ফিরে যাই ক্ষমা চাইতে নিবে তখনই চোখ দুটো যেন ছনা বরাদ্দা হয়ে যায়। একি দেখছে ও। এই মানুষটা কত সুন্দর পরিপাটি ছিলেন। আজ তার এমন বেহাল অবস্থা কেন?অরুর মাথায় আসছে না। অরুর সামনে থাকা লোকটা আর কেউ না স্বয়ং হৃদয় ছিল, তার সাথেও ছিল ১. দেড় বছরের একটা ছেলে।
কি বিভ্রস্থ অবস্থা তার, চোখমুখ কেমন শুকিয়ে রয়েছে। কি মায়াময় চেহারাটা, আজ অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছে, অরু আরো কিছুক্ষণ হৃদয়ের দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে আশ্চর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।

— আপনার এই অবস্থা কেন ভাইয়া??

“হৃদয় অরুপিতার দিকে কিছুক্ষণ শুকনো চোখে তাকিয়ে, তাচ্ছিল্যের ন্যায় একটা হাসি দিয়ে আফসোসের কন্ঠে বললো”

— জানো তো তুমি সেই দিন ঠিকই বলেছিলে, আর আমি একটা বোকা, চকচক দেখতে আমি সেইদিন কয়লা কে বেছে নিয়েছিলাম, সামনে থাকা মুক্ত কে নয়। মুক্ত আমি পেয়েও হারালাম। ওই যে কথায় আছে না,

All that glitters is not gold.

অরু তুমি সেই দিন আমাকে একটা দোয়া দিয়েছিলে মনে আছে, যেদিন আমি তোমাকে ঠকিয়ে নিশিকে বেছে নিয়েছিলাম?

~~ চিত্তে ঠকে যাওয়া এক নারীর সতিত্বে মিশেছিলে তুমি নামক এক ব্যক্তি সেই নারী হৃদয়ের কোটা থেকে তোমায় দোয়া করছে , আমারে ঠকিয়ে বাধিলা তুমি অন্য কারো সাথে ঘর, তবে দেইখো সেই নারী হয়না যেন তোমার পর।
কলমে~ মারিয়াম জুথি

~~ হ্যাঁ অরু আমি পারিনি, পারিনি সেই নারীকে ধরে রাখতে। সেই নারী পর হয়ে গেছে আমার। ‘কান্না কে আটকানোর চেষ্টা করে’

— মানে, কোথায় নিশি? ‘অরু’

— সে তার দেহকে বিক্রি করে দিয়েছে,

— মানে??

— কখনো রেলস্টেশনে বা বাসস্ট্যান্ডে টুকাই ছেলেমেয়েদের বোতল ঢোকাতে দেখেছো?? ‘হৃদয়’

— বুঝলাম না?

— যাইহোক বাদ দাও সাথে কে তোমার, সাথে নিশ্চয়ই তোমার উনি,আর বাচ্চা টা নিশ্চয়ই তোমার বাবু?’হৃদয়’

— হ্যাঁ, তবে আপনি যেন কি বলছিলেন? নিশি কোথায় ও ভালো আছে??

“হৃদয় অরুর দিকে কিছুক্ষণ মায়াভরা দৃষ্টি তে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো”

— কি আশ্চর্য তুমি ঠিক আগের মত রয়ে গেলে। তবে বদলে গেলাম আমরা, বদলে গেল আমাদের জীবন। তুমি পেয়ে গেলে এক চিরন্তন সুখের ঠিকানা, আর আমি পেলাম তোমাকে ঠকানোর তার শাস্তি। ‘হৃদয়’

“অরুপিতা হৃদয়ের ঘুরপাক কথায় এখন বুঝতে পারছে। নিশি হয়তো এখন আর এই সম্পর্কে নেই। হয়তো হৃদয় কে ছেড়ে চলে গিয়েছে? কিন্তু কেন গিয়েছে? সেটা ধারণাতে আসছে না। তাই আবারও জিজ্ঞেস করল”

—নিশি আপনাকে কেন ছেড়ে গিয়েছে?? ওতো আপনাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল?? আর আপনিও তোকে ভালোবাসেন,তাহলে??

— আমি তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম এটা ঠিক, তবে সে আমাকে ভালোবেসে নয় আমার টাকাকে বিয়ে করেছিল, আমার টাকা ফুরিয়ে গেছে সেও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। আজ আমার কাছে আমার ছেলেকে টাকে নিয়ে দুদিন খাবার পয়সা ঠিকমতো হয় না, যদি কাজ জোটাতে পারি তো সেই কাজটা করার পর টাকা পাবো তারপর আমার ছেলেটাকে নিয়ে খাব। এমন সংসার কেইবা থাকতে চাই বলো??

— বাচ্চাটা??

— হ্যাঁ এটা নিশির আর আমার ভালোবাসারই চিহ্ন। তবে সেই সব কিছু ছিন্ন করে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।

“অরুর বেশ খারাপ লাগল হৃদয়ের জন্য। তাকে ঠকিয়েছে তাতে কি হয়েছে, সে তো একজন আদর্শবান ব্যক্তিকে পেয়েছে। কিন্তু সে তো এমনটা চাইনি হৃদয়ের জন্য। সে তো হৃদয়কে দোয়া করেছিল সে যেন সুখে শান্তিতে নিশিকে নিয়ে থাকতে পারে। তাহলে কেন হৃদয়ের জীবনটা আজ এমন হয়ে গেল? ওর ভীষণ খারাপ লাগছে, অরু আর হৃদয়ের কথা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিল শাহরিয়া ও তার ছোট্ট ছেলে শাহার সীমান্ত , হঠাৎ করেই শাহারিয়া অরুকে জিজ্ঞেস করলো”

— উনি কে অরু?

“অরুপিতা শাহরিয়ার কাছে গিয়ে, ওর মানি ব্যাগ থেকে ৫০০০ টাকা নিয়ে, হৃদয়ের ছোট্ট ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল”

— উনি হচ্ছে আমার প্রান্তক, উনার জন্যই আজ আমি আপনার বউ? অর ওনার জন্যই আমি পেয়েছি আপনার মত একজন আদর্শবান স্বামী।

~~ হৃদয় ভাইয়া আমি আমার ভাইয়ের ছেলেকে কিছু টাকা দিলাম, আশা করি এটা আপনি ফিরিয়ে দিবেন না। আপনাকে আমি ছোট করছি না আমার জানা ছিল না আপনার একটা ছেলে হয়েছে। তো আমি গিয়ে দেখে আসতাম আর আমার থেকে প্রাপ্ত পাওনাটা ওকে দিয়ে আসতাম। এই মুহূর্তে সেটা তো দিতে পারলাম না সামান্য টাই দিলাম , দয়া করে ফিরিয়ে দেবেন না।

‘হৃদয় টাকাটা ফেরত দিবে, করে পারল না অরুপিতার কথায়। একপ্রকার বাধ্য হয়েই কিছু না বলে, টাকাটা গ্রহণ করল। তারপর কিছুটা লজ্জাবোধ ও সংকোচ নিয়ে বলবো’

আমার তোমার সামনে দাঁড়ি থাকতে লজ্জা লাগছে। লজ্জা লাগছে তোমার সাথে কথা বলার। ঘেন্না আছে নিজের প্রতি নিজের। যদি সময়টাকে স্তব্ধ করা যেত। তবে আমি সেই দিনের সময়টাকে ফিরিয়ে স্তব্ধ করে তোমার হাতটাই বেছে নিতাম। তবে আমি ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না অরু, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছি। তুমি সুখে থেকো। জীবনে যা হারিয়েছো তার থেকে দ্বিগুণ পাও। ভালোবাসার মানুষকে আগলে রেখো আজ আসি, ফের যদি কোনদিন দেখা হয় আর যদি তখন আমার সমর্থ্য হয়ে থাকে তো তোমার ছেলেকেও আমার থেকে যে প্রাপ্ত পাওনাটা পায় সেটা দেব।

[নিদারুণ এ ভাগ্য, কাউকে ঠকিয়ে কেউ কোনদিন জিততে পারেনি আর না পারবে। হয়তো তার কর্ম তাকে পৃথিবীতে শাস্তি দেবে,নয়তো আল্লাহতালা মৃত্যুর পর তাকে তার যোগ্য শাস্তিটা দিয়ে দেবে]

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

সুন্দর এক সকালের সূচনা, জালনার কাঁচ ভেদ করে রুমটাকে রোদের আলোয় আলোকিত করে দিচ্ছে। চারদিক মুক্ত পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। অনুকূল পৃথিবীকে মুগ্ধ করে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি এক সকালে অরুপিতা শাহরিয়ার বুকে মাথা রেখে তার কোলে রাখা বাচ্চা ছেলেটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো।

~~ হয়তো কোনো ভালো কাজ করেছিলাম। তার বিনিময় আল্লাহ আপনার মত একজন জীবনসঙ্গী আমায় দান করেছেন। যে আমার সুখে দুখে সব সময় আমাকে সাপোর্ট করে, দুঃখকে সুখে ভরিয়ে দিতে পারে। দুঃখটাকে নিজের সাথে ভাগ করে নিতে পারে। এবং কি ঠকে যাওয়া এই মেয়েটাকে এত সুন্দর একটা জীবন দিতে পারে। সত্যি স্বামী ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে, আর অমৃত ভালবেসে যাব।

~~ শাহরিয়া অরুকে নিজের সাথে সজোরে জড়িয়ে আগলে নেয় বুকের সাথে, এ যেন এক চিরস্থায় সুখের ঠিকানা। পরম শান্তি। নিবেদিত এক পূর্ণিমার ঝকঝক করা এক পূর্ণাঙ্গ চাঁদ, তার বুকে শুয়ে আছে তার আর কি চাই, তাই ছোট করে স্লো বয়সে বললো।

~~আমিও ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি আমার
মায়াবতী কে~~

______সমাপ্ত________