Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 274



মেঘের আড়ালে রোদ পর্ব-০৩

0

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#পর্ব_3
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

ছোঁয়া মহুয়া কে জিজ্ঞেস করলো,’ কি হয়েছে এভাবে ভয় পেয়ে আছে কেনো…?’
মহুয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
~ আরেএ মেহু বলবে তো কি হয়েছে..?
মহুয়া ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ছোঁয়া হেঁসে বললো,’ এতো বড় নাম ডাকতে ভালো লাগে না, তাই ছোটো করে মেহু ডাকবো।’
এই প্রথম মহুয়া মুচকি হাসলো।
ছোঁয়া মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বললো,’ মেহু তোমাকে হাসলে ভীষণ কিউট লাগে, সব সময় হাসবে।’
মহুয়া ছোঁয়া কে কিছু বলার আগেই ছোঁয়া বলে উঠলো, ‘ চলো আজ থেকে আমাদের রুম পাশের রুমটা। এই রুম স্পেশাল কারো জন্য। ‘
মহুয়া একবার দরজার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো নিজের নতুন রুমে।

______

রাতে এক এক করে বাসায় সবাই আসলো।

বাসার সবাই ব্যস খুশি আহনাফের আশাতে। ছোঁয়া গাল ফুলিয়ে নিজের রুমে বসে আছে। এখনো রুম থেকে বের হয়ে আহনাফের সাথে দেখা করেনি।
আহনাফ দাদাজান, আব্বু, চাচ্চু সবার সাথে কোশল বিনিময় করে বসলো।

শ্রাবণ আহনাফের সাথে কথা বলে ফ্রেশ হতে নিজের রুমে গেলো।

আহনাফ সবার জন্য গিফট নিয়ে এসেছে। এক এক করে সবার গিফট বের করে দিলো।

ছোঁয়ার জন্য গিফট বের করে আশেপাশে খুঁজলো।

আহনাফঃ ছোঁয়া কি বাসায় নেই.?
হালিমা বেগমঃ ছোঁয়া তোমার জন্য সারপ্রাইজ সাজিয়ে রেখে ছিলো। কিন্তু তুমি নিজেই সবাই কে সারপ্রাইজ দিতে না জানিয়ে চলে আসলে তাই হয়তো রাগ করে নিজের রুমে বসে আছে।

নির্জনঃ ভাই এই মেয়ে শুধু শুধুই গাল ফুলাবে। বেশি না গিফটের কথা শুনলেই দেখবে নাচতে নাচতে গিফটের সামনে চলে আসবে। যতসব ঢং।

আহনাফঃ নির্জন ছোঁয়া আমাদের ছোটো বোন রাগ, অভিমান করলে আমাদের সাথেই করবে। যে ওকে নিয়ে আয়।
নির্জনঃ সরি ভাই এই বেয়াদব মেয়ের সামনে আমি যেতে চাই না। ছোটো বোন না ছাই, ওকে আমি কোনো বোন মানিনা, কিসের বোন সারাদিন আমার পেছনে বাঁশ দেওয়ার জন্য পরে থাকে বেয়াদব মেয়ে একটা।

শ্রাবণ রেগে নির্জনের মাথা গাট্টি মারতেই নির্জন চুপ হয়ে গেলো।

শ্রাবণ আহনাফের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ আহনাফ তুই এখনো ছোঁয়ার সাথে কথা বলিসনি.?
আহনাফঃ আমি বাসায় আশার পর তো ছোঁয়ারাণী বাসায় ছিলো না।

আনোয়ার চৌধুরী বসে বসে ভাইদের কথা শুনলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘ ছোঁয়া রুমে আছে গিয়ে নিয়ে আসো।’

আহনাফ দাদাজানের কথা শুনে ছোঁয়ার রুম কোনটা জিজ্ঞেস করলো।

নির্জন মোবাইল বের করে গেইমস খেলতে লাগলো। এইসব ড্রামা দেখার থেকে গেইমস খেলা ভালো। এমনিতেই একটু পর নতুন গার্লফ্রেন্ড কল দিবে।

আহনাফ রুমের সামনে গিয়ে কয়েক বার কড়া নাড়লো। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ঠেলে রুমে আসলো।
বেলকনিতে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝলো ছোঁয়া রাগ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আস্তে আস্তে ছোঁয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, ‘ আমাদের ছোট্ট ছোঁয়ারাণী দেখি ভীষণ বড় হয়ে গেছে! এই যে ভাইয়া সরি বলছি রাগ কি কমেছে..? নিচে আসো ভাইয়া তোমার জন্য চকলেট এনেছি।

মহুয়া কফি হাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো৷ পেছন থেকে কোনো ছেলের এমন কথা শুনে বুঝলো কেউ ওকে ছোঁয়া ভাবছে। হয়তো ছোঁয়ার ভাই। মহুয়ার চোখ জলে ভরে উঠলো, ঠিক এমন ভাবে মহুয়া রাগ করলে ওর ভাই রাগ ভাঙাতো,ঘুরতে নিয়ে যেতো, আইসক্রিম, চকলেট নিয়ে আসতো মন খারাপ থকলে। আজ ওরা নিশ্চয়ই সব জায়গায় ওকে খুঁজছে তবে ভালোবেসে নয় ঘৃণা ভরা চোখ দিয়ে ।

মহুয়া মাথার ওড়না ঠিক করে পেছন ফিরে তাকালো।
আহনাফ ছোঁয়া রুমে অন্য কাউকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেলো। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে বলে উঠলো, ‘ সরি আমি ছোঁয়ার রুম ভেবে আপনার রুমে প্রবেশ করে ফেলেছি।’
মহুয়া আহনাফের দিকে একবার তাকালো ছেলেটা অন্য দিকে তাকিয়ে চলে যাচ্ছে।
~ ছোঁয়ার রুম এটা।
আহনাফ থামলো। কিন্তু পেছন ফিরে তাকালো না।
~ ছোঁয়া কে বলবেন আহনাফ চৌধুরী নিচে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। বলেই দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

ছোঁয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় বসলো।
মহুয়া আহনাফ চৌধুরী রুমে এসেছে বলতেই চোখ বড় করে তাকালো। এক ছুটে রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসলো।
আফরোজা বেগম ছোঁয়াকে এভাবে আসতে দেখে বলে উঠলো, ‘ কি হয়েছে..? ‘
ছোঁয়া ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলো, ‘ কি ব্যাপার সুন্দরী এভাবে বউ সেজেছো কেনো.?
আফরোজাঃ কেনো তোর হিংসে হচ্ছে!
ছোঁয়াঃ এ্যাঁহ আমি কোন দুঃখে তোমাকে হিংসে করতে যাবো! নানাজান আজ তোমাকে দেখলে আবার তোমার প্রেমে পিছলে পড়বে। লাল শাড়ি পড়ে নতুন বউ সেজে বসে আছো।

ড্রয়িং রুমে সবাই হেঁসে উঠলো।
নির্জন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,’ তুই এভাবে সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস..?’
বিরক্ত হয়ে তাকালো ছোঁয়া। বেয়াদব ছেলে একটা। সব জায়গায় নাক না গলালে পেটের ভাত হজম হয় না!..

ছোঁয়া শ্রাবণের পাশে গিয়ে বসলো। আহনাফ কে অনেকটা ভয় পায় ছোঁয়া। এই বাড়ি দিয়ে আহনাফ ভীষণ রাগী আর গম্ভীর। শুধু মাত্র আফরোজা বেগমের সাথেই একদম ফ্রী।

ছোঁয়া আড়চোখে আহনাফের দিকে তাকাতেই আহনাফ ওর সামনে অনেকগুলো চকলেটের বক্স আর সাজগোজের জিনিস রাখলো।
ছোঁয়া অভিমানী সুরে বলে উঠলো, ‘ আমি কতো প্লেন করে রেখে ছিলাম আর তুমি সব শেষ করে দিলে!..

নির্জন বিড়বিড় করে বলে উঠলো ‘ ড্রামা শুরু।’

আহনাফঃ কাল আবার নতুন করে বাসায় আসবো তুমি সব সারপ্রাইজ করে রাখবে তাহলেই হয়।

ছোঁয়াঃ ধুর জেনেশুনে কিভাবে সারপ্রাইজ হয়..’
ছোঁয়া হঠাৎ বলে উঠলো, ‘ মহুয়ার জন্য কি এনেছো.??’
সবাই ছোঁয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। সবার তাকানো দেখে ছোঁয়া হেঁসে বলে উঠলো, ‘ মনে ছিলো না ভাই তো ওকে চিনে না।’
আহনাফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,’ মহুয়া কে.?’
নিরুপমা কোথায় থেকে ঝড়ের গতিতে এসে বলে উঠলো, ‘ আমি বলছি।’

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা শুনে নির্জন হাসতে হাসতে বলে উঠলো, ‘ আমরা তো আরেকটা নতুন দাদি পেতে যাচ্ছিলাম, আফরোজা বেগম বুড়ি হয়ে গেছে এখন একটা যুবতী দাদি দাদাভাইয়ের জন্য প্রয়োজন। এখন ওই মেয়েকে বলো রাজি হলে কাজী ডাকি।

শ্রাবণ ভীষণ বিরক্ত হলো নির্জনের এমন কথা শুনে। মহুয়াকে নিয়ে কোনো কথাই ওর পছন্দ হয় না। একবার সামানা সামনি দেখলে নিজের জন্য কাজী ডাকতে শুরু করবে সেই ছেলে দাদার জন্য ডাকবে ভাবতেই আবার হাসি পেলো।

সবাই হেঁসে উঠলো নির্জনের কথা শুনে আফরোজা বেগম গম্ভীর হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আহনাফ আর কোনো আগ্রহ দেখালো না ওই মেয়ের বিষয়।
শ্রাবণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছোঁয়ার রুমের দরজার দিকে। একবার যদি মহুয়াকে দেখতে পারে সেই আশায়।

মহুয়া মোবাইলটা বের করলো। একমাত্র এই মোবাইল ওর কাছে আছে। তাও সিম নেই। সিমটা খুলে পানিতে ফেলে দিয়ে ছিলো।

মাথা ভীষণ যন্ত্রণা করছে,চোখ জ্বলছে, কয়েকবার মাথায় পানি দিলো।

____

আমেনা বেগম রান্না শেষ করে সবাই কে ডাকলেন টেবিলে।

সোফায় নির্জন আর আহনাফ বসে আছে। কিছুটা দূরে ছোঁয়া টিভি দেখছে।

নির্জনঃ আচ্ছা ভাই ইউরোপের মেয়েরা অনেক সুন্দর তাই না.?
আহনাফঃ হুম..
নির্জনঃ তোমার তো নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ড আছে..?
ছোঁয়া কান খাঁড়া করে ওদের কথা শুনছে।
আহনাফঃ নাহ্..

ছোঁয়া খুশি হয়ে মনে মনে নেচে নিলো।

নির্জনঃ কি বলো.? আজকাল এমন ছেলে আছে যে গার্লফ্রেন্ড নেই! তুমি নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছো।আমি দেখেছি ইউরোপের মেয়েরা একদম ফর্সা,কি সুন্দর ফিগার।
আহনাফ নির্জনের দিকে তাকাতেই নির্জন চুপ হয়ে গেলো।
ছোঁয়া সুযোগ পেয়ে বলে উঠলো, ‘ ভাইয়া তোমার কেমন মেয়ে পছন্দ..?
আহনাফ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ছোঁয়ার কথা শুনে বলে উঠলো, ‘ এখনো ভেবে দেখিনি।’
ছোঁয়াঃ বলো না ভাইয়া।সবার তো একটা পছন্দ আছে।

আহনাফ চুপ করে কিছু একটা ভেবে বললো,’ শ্যামবর্ন গায়ের রং, চোখ বেশি বড় নয় আবার ছোটো না,চুল গুলো কোমর পর্যন্ত, হাইট ৫.৪-৫ এমন হলেই হবে।’

ছোঁয়া মন খারাপ করে নিজের দিকে তাকালো, ছোঁয়া উজ্জ্বল ফর্সা, চোখ বেশি বড় না তবে ওর সাথে একদম ঠিক আছে, চুল কাঁধের একটু নিচে পড়ে, হাইট ৫.২-৩।

নির্জন হেঁসে বললো, ‘ ভাই যদি মেয়ে ফর্সা হয়, চোখ বড় হয়, চুল হাঁটু অব্দি হয়, হাইটে ৫.৫ হয় তাহলে তুমি কি করবে..?

আহনাফ নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আচ্ছা তুই মনে কর এমন মেয়ের সাথে তোর বিয়ে হলো। তুই কোনো এক কারনে ঝগড়া লাগলি তোর বউ হঠাৎ রেগে গেলো, হাতে একটা চাকু নিয়ে তোর সামনে দাঁড়ালো বড় বড় চুল গুলো বাতাসে উড়ছে, রেগে বড় বড় চোখ লাল করে তোর দিকে তাকিয়ে আছে, ফর্সা মুখ সাথে এমন ভয়ংকর অবস্থা ঠিক দেখতে কেমন লাগবে তোর বউকে..?

ছোঁয়া চোখ বন্ধ করতেই সামনে মহুয়ার এমন ছবি ভেসে উঠলো ভয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,” ডাইনী!!”

নির্জন আর আহনাফ হুঁ হুঁ করে হেঁসে উঠলো।

ছোঁয়া রেগে উঠে চলে আসলো।

_________

সবাই খাবার টেবিলে বসে আছে।
আনোয়ার চৌধুরী ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,’সুইটহার্ট মহুয়া কোথায়..?’
ছোঁয়াঃ সুইটহার্ট মেহুর মাথা ব্যথা।
আনোয়ার চৌধুরীঃ ওকে নিয়ে আসো খাবার খেয়ে মেডিসিন খেয়ে নিলেই ব্যথা কমে আসবে।
ছোঁয়া উঠতে নিলে নিরুপমা বলে উঠলো, ‘ আব্বা মেয়েটার জন্য উপরে খাবার পাঠিয়ে দেই।’
নিরুপমা কিছুতেই চান্না মহুয়া নিচে আসুক।

আফরোজা বেগমঃ কেনো মাথা ব্যথা, পা তো আর ব্যথা না যে নিচে এসে খেতে পারবে না৷ ছোঁয়া নিয়ে আসো।

আহনাফ একটু কিছু মুখে দিয়ে উঠে গেলো।খেতে ইচ্ছে করছে না। একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।

ছোঁয়া মহুয়াকে নিয়ে নিচে নেমে আসলো।
শ্রাবণ মহুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা সব সময় ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে রাখে। এটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগে।
শ্রাবণকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নির্জন সিঁড়ির দিকে তাকালো।

নির্জন শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ এটা আবার কে..?’
শ্রাবণঃ মহুয়া..
নির্জনঃ মেয়েটা তো অনেক সুন্দর।
শ্রাবণঃ ভাবির চোখে দেখ।
নির্জন খাওয়া থামিয়ে ভাইয়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
শ্রাবণঃ এভাবে না তাকিয়ে খাবার গিল।
নির্জনঃ কি ব্যাপার ভাই। ভাবির চোখে কেনো দেখবো..?
শ্রাবণঃ আমার তো মনে হয় না ভেঙে ভেঙে তোকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
নির্জন মন খারাপ করে মহুয়ার দিকে আরেক বার তাকালো। এতো সুন্দর মেয়েটাকে সে পটাতে পারবে না ভাবতেই খাবার আর গলা দিয়ে নামছে না!। যতোই হোক ভাই এই প্রথম কোনো মেয়েকে পছন্দ করেছে ভাবির নজরে কেনো কষ্ট হলেও আজ থেকে ভাবি বলে ডাকবে সে। হঠাৎ মন খুশি হয়ে গেলো ভাবি এতো সুন্দর ভাবির কোনো বোন থাকলে নিশ্চয়ই এর থেকে আরও বেশি সুন্দর হবে! আর তখন সে নিজের পাওয়ার দিয়ে পটিয়ে বিয়ে করে নিবে। তার চগে মহুয়ার সাথে ভাব করতে হবে তারপর কৌশলে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে বোন আছে কি না।

মহুয়া বসতেই আনোয়ার চৌধুরী এটা সেটা জিজ্ঞেস করলো৷ শ্রাবণ কে বললো ওর জন্য মেডিসিন নিয়ে আসতে।

শ্রাবণ তো মহা খুশি। ভালোবাসা বুঝি এমনি হয়, হুট করে জীবনে চলে আসে, বসন্তের মতো সর্বক্ষন মনে এক আনন্দের বাতাস বইতে থাকে। প্রিয় মুখটা একবার দেখলেই হৃদয় শীতল হয়ে যায়। মানুষটার সাথে একটু কথা বলার জন্য হাজারটা অজুহাত খুঁজতে থাকে।

আফরোজা বেগম মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ সারাদিন রুমে আঁটকে না থেকে সবার সাথে বসে কথা বলতে পারো, ছাঁদে যেতে পারো। সারাক্ষণ রুমে আঁটকে থাকলে নিজেকে আরও একা মনে হবে। সবার মাঝে বসে নিজের মনকে শান্তি দেওয়ার জন্য টুকটাক কথা বলতে পারো।

মহুয়া একবার আফরোজা বেগমের দিকে তাকায়। মহিলাটাকে যতোটা কঠিন ভেবেছিলো ততোটাই কঠিন নয়।

নির্জন হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘ হায় আমি নির্জন চৌধুরী.. ‘
সবাই খাবার থেকে চোখ তুলে নির্জনের দিকে তাকালো। বেচারা সবার তাকানো দেখে হাত মুছতে মিছতে বলে উঠলো, ‘ আমার খাওয়া শেষ। ‘
আনোয়ার চৌধুরী,’ তাহলে রুমে যাও, চাকরি খুঁজো,আর কতো এভাবে বসে বসে খাবে..? তোমার দুই ভাই নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে তুলছে আর তুমি কি করছো..??
নির্জন বিরক্ত হয়ে আনোয়ার চৌধুরীর কথা গুলো শুনলো। মহুয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা নিচের দিয়ে তাকিয়ে খাচ্ছে। মানে কি সবাই এতো আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে আর এই মেয়ে একবারও তাকালো না। কি আজব মেয়ে।

_____

রাত গিয়ে সকালের আলো ফুটে উঠেছে৷ মহুয়া নামাজ পড়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।
কালো হুডি পড়ে কোনো একটা ছেলেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলো।

সকাল ৮টা। আমেনা বেগম, হালিমা বেগম, নিরুপমা সবাই মিলে নাস্তা তৈরি করছে। এই বাড়িতে দুইটা কাজির লোক। দুইটাই ছুটিতে গেছে।যার কারনে সবাই মিলে কাজ করছে।

মহুয়া এই প্রথম রুম থেকে বের হয়ে নিচে আসলো।
হাঁটতে হাঁটতে রান্নাঘরের সামনে থামলো৷
আমেনা বেগম মহুয়াকে দেখে হেঁসে বললো,’ কিছু লাগবে..?’
মহুয়াঃ না আন্টি।

সবাই নিজের কাজ করছে হঠাৎ মহুয়া বলে উঠলো, ‘ আন্টি আমি হেল্প করি..?’
আমেনা কিছু বলার আগেই নিরুপমা বলে উঠলো, ‘ করতে পারো কিছু..? ‘
মহুয়া কি বলবে সে তো কিছুই পারে না। তবুও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো।
নিরুপমা কতোগুলো সবজি ওর সামনে রেখে বললো তাহলে এইগুলো একটু কেঁটে দাও।
আমেনা বেগম রেগে বলে উঠলো, ‘ এইসব কি! মহুয়া তোমার কিছু করতে হবে না রুমে যাও।রান্নাঘরের কাজ শুধু মহিলাদের। ‘
মহুয়াঃ আমি পারবো আন্টি।
নিরুপমাঃ মেয়েটা কাটতে চাচ্ছে নিষেধ কেনো করছেন ভাবি।
আমেনা বেগম আর কিছু বললেন না। সখ করে বলেছে মেয়েটা কাটুক তাহলে।

মহুয়া হাতে চাকু নিয়ে একটা পেঁয়াজ নিলো। কিন্তু কিভাবে শুরু করবে..? সে তো বাড়িতে বটি দিয়ে কাটতো কিন্তু এখানে চাকু।

তখনি ছোঁয়া ওকে খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরে দেখতে পেয়ে আসলো।
ছোঁয়াঃ এইসব কি আম্মু! মহুয়াকে কেনো কাজ করতে দিয়েছেন..?
নিরুপমাঃ মেয়েটা নিজেই করতে চাইলে আমার কি দোষ।
ছোঁয়া মহুয়ার হাত থেকে চাকু নিয়ে পাঁচ মিনিটে সব সবজি কেঁটে ওর আম্মুর সামনে রাখলো৷
মহুয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এতো দ্রুত একটা মেয়ে কিভাবে সবজিগুলো কাটলো!.?

নিরুপমা মেয়ের হাত থেকে চাকু নিয়ে বলে উঠলো, ‘ তোমাকে সব সময় বলি ধীরে ধীরে কাটবে কিন্তু না তুমি আমার কথা শুনবে কেনো! একদিন হাত কেঁটে বসে থাকবে।

আমেনা বেগম হাসলেন ছোঁয়ারদিকে তাকিয়ে। মেয়েটা ব্যস গুণবতী।

নির্জন ড্রয়িং রুম থেকে বলে উঠলো, ‘ ফুপিমণি আমি ভাবছি একটা রেস্টুরেন্ট খুলবো আর রাধুনি হিসেবে তোমার মেয়েকে সিলেক্ট করবো। দাদার ইচ্ছেও পূরণ হবে তোমার মেয়েও একটা জব পাবে। দারুণ আইডিয়া না.?’

ছোঁয়া কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে নির্জনের দিকে টমেটো ছুড়ে মারলো।

________

ছোঁয়া মহুয়াকে রেডি হতে বললো। দাদাজান বলেছে আজ ছোঁয়ার কলেজে মহুয়াকে ভর্তি করাবে।

মহুয়া চুপচাপ রেডি হয়ে নিলো৷ কালো বোরকা সাথে হিজাব দিয়ে সুন্দর করে মুখ ডেকে নিলো।

ছোঁয়াঃ এভাবে কেনো?
মহুয়াঃ আমি এভাবে চলাফেরা করতে পছন্দ করি।
ছোঁয়া আর কিছু বললো না। মহুয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

ছোঁয়া কলেজ এসেই দেখা পেলো শ্রাবণের।
শ্রাবণ মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,’ আসুন, ফাস্ট ইয়ার না..?’
মহুয়াঃ জ্বি..

ভর্তি করিয়ে শ্রাবণ ছোঁয়াকে বললো সাবধানে মহুয়াকে নিয়ে বাসায় চলে যেতে ওকে আবার অফিস যেতে হবে।

শ্রাবণ ওদের বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।

ছোঁয়া গেইটের কাছে এসে দেখলো ভুলে ব্যাগ ক্লাসে রেখে এসেছে। মহুয়াকে এখানে দাঁড়াতে বলে জলদি আবার কলেজের ভেতর গেলো।

মহুয়া দাঁড়িয়ে আছে তখনি একটা মেয়েকে কাঁদতে দেখলো। সে না চাইতেও জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে..?
~ এক ছেলে আমার শরীরে বাজে ভাবে হাত দিয়েছে, আমার ওড়না নিয়ে গেছে…
মেয়েটা কথা শেষ করার আগেই মহুয়ার চোখ অস্বাভাবিক লাল হয়ে গেলো। রাগে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে জিজ্ঞেস করলো। ছেলেটা কোথায়..?
মেয়েটা কান্না করে বলে উঠলো, ‘ একটা ভাইয়া এসে ছিলো হেল্প করতে, ছেলেটাকে বুঝিয়ে ছিলো কিন্তু ছেলের বন্ধু গুলো আর ছেলেটা মিলে ওই ভাইয়ার গায়েও হাত তুলেছে। আমি ভয়ে চলে এসেছি।

মহুয়াঃ কি আজব একটা ছেলে তোমাকে হেল্প করতে এসেছে, তোমার জন্য ছেলেদের হাতে মাইর খাচ্ছে আর তুমি পালিয়ে যাচ্ছো!.?তোমার প্রয়োজন ছিলো ছেলেটাকে হেল্প করা! ছেলেটা কোথায়..?

তখনি সামনে গন্ডগোল শুনতে পেলে৷ মহুয়া বুঝলো এখনো হয়তো ছেলেটাকে মারছে।
মহুয়া এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলো। ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখলো একটা ছেলে আরেকটা ছেলেকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছে ভীষণ রাগ হলো৷ নিজেকে এই ছেলের মাঝে দেখতে পেলো। ঠিক এভাবে তাকেও মেরে ছিলো নরপিশাচরা রেগে সামনের ছেলেটার কলার পাকড়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে গালে পর পর দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। সেকেন্ডের মাঝে নিস্তব্ধতায় ছড়িয়ে গেলো চারপাশ। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই৷ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এক বোরকা পড়া সাধারণ মেয়ের দিকে সবাই।

ভীড় ঠেলে ছোঁয়া মহুয়ার পিছু পিছু এসে ছিলো এমন কিছু দেখতে পাবে কখনো আশা করেনি। নিরবতা ভাঙে ছোঁয়া বলে উঠলো, ” আহনাফ ভাই!! ”

চলবে…
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

মেঘের আড়ালে রোদ পর্ব-০২

0

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#পর্ব_2
লেখিকা#Sabihatul_Sabha

কালো ওড়না দিয়ে মাথা অর্ধভাগ ডেকে এক হাতে ওড়না ধরে ছোঁয়ার পিছে দাঁড়িয়ে আছে মহুয়া।

শ্রাবণ কিন্তু সময় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। কালো সেলোয়ার-কামিজ পড়া, হাতে চিকন চুড়ি, ভীতু চোখে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব সুন্দরী রমনী।ছোঁয়ার ডাকে হুস ফিরলো শ্রাবণের।

স্বাভাবিক ভাবে দাদাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,’ মেয়েটি কে..?’
আনোয়ার চৌধুরীঃ আগে মার্কেট থেকে আসো।
শ্রাবণঃ দাদিজান কোথায়.?
আনোয়ার চৌধুরীঃ রুমে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে ঘুমাচ্ছে।
শ্রাবণ আবার জিজ্ঞেস করলো,’ দাদিজান তাহলে উনার কথা বলে ছিলো.?
আনোয়ার চৌধুরীঃ হুম।
শ্রাবণ বিড়বিড় করে বলে উঠলো, ‘ দাদিজান সব কিছু কমিয়েই বলেন।দাদিজান বললো এক সুন্দরী মেয়ে নিয়ে এসেছে দাদাজান কিন্তু বলা উচিত ছিলো এক রুপকথার রাজকন্যা নিয়ে এসেছে দাদাজান।

ছোঁয়া বেস বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘ ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছো…??’

শ্রাবণ দাদাভাইকে বলে বেরিয়ে গেলো।

আনোয়ার চৌধুরী মহুয়ার মাথায় হাত রেখে বললো,’ ভয় নেই শ্রাবণ আমার বড় নাতি। ওর সাথে সাথে থাকবে। যা যা প্রয়োজন নিয়ে আসবে। দুই একদিনের মধ্যে কলেজে ভর্তির ব্যাবস্থা করে দিবে শ্রাবণ।

মহুয়া মাথা নিচু করে সবটা শুনলো। সে এখানে বেশিদিন থাকবে না, কলেজে ভর্তি হয়ে ছোটো খাটো একটা জব খুঁজবে। পেয়ে গেলেই এখান থেকে চলে যাবে।

ছোঁয়া মহুয়ার হাত ধরে তাড়া দিলো। আনোয়ার চৌধুরী মহুয়ার দিকে ইশারা করতেই ছোঁয়ার পিছু পিছু গেলো মহুয়া।

শ্রাবণ মোবাইলে কারো সাথে কথা বলে পেছন ফিরে দেখলো ছোঁয়া ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মেইন দরজা থেকে বের হচ্ছে মহুয়া। শ্রাবণ চোখ সরিয়ে নিতে চাইলো কিন্তু চোখ আঁটকে গেলো মহুয়ার মুখে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কাঁটা দাগ গুলোর দিকে, জেনো চাঁদের গায়ে কেউ আচঁ কেঁটেছে।

মহুয়া ছোঁয়ার সাথে পেছনে বসতেই শ্রাবণ বলে উঠলো,’ আমাকে কি তোর ড্রাইভার মনে হয় ছোঁয়া..?? ‘
ছোঁয়া মহুয়ার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলে উঠলো, ‘ আজকের জন্য হয়ে যাওও ভাই। ‘

শ্রাবণ ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে হেঁসে মেনে নিলো ছোটো বোনের আবদার।

মহুয়া চুপচাপ তাকিয়ে রইলো বাহিরের দিকে।
ছোঁয়া এটা সেটা বলেই চলছে আর মহুয়া তা বসে বসে শুনছে।
ছোঁয়ার ভীষণ ভালো লেগেছে মহুয়া কে। মেয়েটা কম কথা বলে, হাজারটা কথা বললে একটা উত্তর দেয়। আজ পাঁচ দিনে এক মিনিটের জন্য হাসতে দেখেনি ছোঁয়া। ভীষণ অবাক হয় একটা মানুষ রোবটের মতো কিভাবে চলাফেরা করতে পারে!..?

__________

নিরুপমা রান্না ঘরে যেতে যেতে বলে উঠলো, ‘ আমার তো সন্দেহ হচ্ছে! আসলেই কি মেয়েটা আব্বার পরিচিত কিনা..? এতো সুন্দর মেয়ে আমি আগে কখনো দেখিনি। এই মেয়েনা আবার এই পরিবারের ধ্বংশ ডেকে আনে।
হালিমা বেগমঃ শশুর আব্বা যাকে তাকে বাসায় আশ্রয় দেয়। কেনো মেয়ের অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিলেই হয়। বাড়িতে দুইটা ছেলে আজ বাদে কাল আরেক ছেলে আসবে কি দরকার খাল কেটে কুমির নিয়ে আশার।
নিরুপমাঃ আজ আবার মার্কেট করাতে শ্রাবণ কে পাঠিয়েছে।
হালিমা চৌধুরীঃ সুন্দরী মেয়েরা খুবই ভয়ংকর হয়। মেয়েটার মুখের কাঁটা দাগ গুলো দেখে মনে হয় কেউ ভীষণ মেরেছে। আমার তো আব্বার কথা একটুও বিশ্বাস হয়নি।

আমেনা বেগম রান্না ঘরে এসে ধমকে বলে উঠলো, ‘ চুপচাপ কাজ করো। মেয়েটাকে নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ । বিপদে পড়ে এসেছে। বাড়িতে রুম কি কম পড়েছে থাকলে সমস্যা কি! নিজের মেয়ের মতো দেখতে শুরু করো।
নিরুপমাঃ ভাবি আমরা তো মেয়েটিকে বেরিয়ে যেতে বলছি না। শুধু নিজের ছেলেদের সাবধানে রেখো যেই আগুন সুন্দরী। এমন মেয়েরা কিন্তু ভয়ংকর, যেখানে যায় ধ্বংস ডেকে আনে।
আমেনা বেগমঃ হয়েছে বলা!.? মেয়েটার মুখ দেখলেই বুঝা যায় খুব ভদ্র পরিবারের। আমাদের ছোঁয়া কি কোনো অংশে কম..? আমাদের ছোঁয়াও ভীষণ সুন্দর কই সে তো ধ্বংস ডেকে আনছে না। এইসব আলোচনা বন্ধ করো, কাল আমার ছোটো ছেলে আসছে ওর জন্য কি কি আয়োজন করবো!..? কতোগুলো বছর পর বাড়িতে ফিরছে। বলতে বলতে চোখে জল জমা হলো। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে রান্নায় হাত বাড়ালো তখনি দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো।

আমেনা বেগম হাতের মাছটা রেখে হালিমা বেগমকে দিতে বলে দরজা খুলতে গেলেন।

দরজা খুলতেই থমকে গেলেন তিনি। খুশিতে কি করবেন তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। চোখ কি আজকাল ভুল দেখতে শুরু করলো.?
কেউ একজন উনাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমেনা বেগম খুশিতে কাঁদতে শুরু করলেন। পাঁচটা বছর পর চোখের সামনে ছেলেকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়ে ছিলেন।

আহনাফ চৌধুরী মা’ কে জড়িয়ে ধরে কান্না থামাতে বললো।
আমেনা বেগম ছেলের মুখে হাত রেখে তাকিয়ে রইলেন জেনো কতো, কতো যোগ পরে ছেলেকে দেখছেন।

আহনাফ মা’কে শান্ত করিয়ে বলে উঠলো, ‘ সারপ্রাইজ আম্মু।’

আমেনা বেগম কে আসতে না দেখে নিরুপমা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। চোখের সামনে আহনাফ চৌধুরী কে দেখে অবাক হয়ে বলে উঠলো, ‘ আহনাফ বাবা তুমি!!.’?
নিরুপমার মুখে আহনাফ ডাক শুনে ভ্রু কুঁচকে বের হয়ে আসলো হালিমা বেগম। কিছু সময়ে মধ্যে বাড়িতে খুশির বর্ষা ভয়ে গেলো।
আহনাফ সবার সাথে দেখা করেই চলে গেলো দাদিজানের রুমে।
আনোয়ার চৌধুরী বাড়িতে নেই। নেই উনার দুই ছেলে। সবাই হয়তো রাতে আসবে।

নিরুপমা ভাবতে লাগলেন। কতো সারপ্রাইজ রেডি করে রেখে ছিলো ছোঁয়া আহনাফের জন্য। এসে যদি দেখে ওর সারপ্রাইজের আগেই আহনাফ নিজেই সারপ্রাইজ দিতে চলে এসেছে মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পাবে।

আহনাফ আফরোজা বেগমের সামনে গিয়ে বসলো।
আফরোজা বেগম নাতিকে দেখেই কাঁদতে শুরু করলো। উঠে বসতে চাইলে আহনাফ সাহায্য করলো।
আফরোজা বেগমঃ আমি তো ভেবে ছিলাম বউ বাচ্চা নিয়ে ফিরবে।
আহনাফ হেঁসে ফেললো দাদিজানের এমন অদ্ভুত কথা শুনে।
আফরোজা বেগমঃ হেঁসো না, আমি বুঝি মৃত্যুর আগে নাতির বউ দেখে যেতে পারবো না। তোমার বড় ভাই আমার কথা শুনছে না।
আহনাফঃ দাদিজান আমি চলে এসেছি খুব জলদি বড় ভাইকে বিয়ে দিয়ে আপনার ইচ্ছে পূরণ করে দিবো। আপাতত নিচে চলুন আপনার জন্য বেনারসি এনেছি।
আফরোজা বেগম লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলে উঠলেন,’ তুমি ভীষণ পাঁজি হয়ে গেছো।’
আহনাফঃ কি করবো বলেন আমার আফরোজা বঁধুকে বউ সাজে দেখার ভীষণ সখ জেগে ছিলো।
আফরোজা বেগম চমৎকার হাসলেন। এখনো হাসলে কি ভীষণ মুগ্ধতা মিশে যায় উনার হাসিতে।

আহনাফঃ আপনি জানেন, আপনি এখনো সেই আফরোজা সুন্দরী রয়ে গেছেন। দাদার সাথে দেখা না হয়ে আপনার আমার সাথে প্রথম দেখা হওয়া প্রয়োজন ছিলো। ওই বুড়ো লোকটার পাশে এতো সুন্দরী নারী কিভাবে মানায় বলুন!!..?
আফরোজা বেগম আহনাফের কান মুচড়ে ধরে বলে উঠলেন,’ আমার সাথে ফ্লার্ট করছো!..?
আহনাফ হেঁসে উঠলো সাথে আফরোজা বেগম ও হেঁসে উঠলেন।

আফরোজা বেগমের সব থেকে প্রিয় নাতি আহনাফ। আর আহনাফের প্রানপ্রিয় তার দাদিজান। আর এই নিয়ে যুদ্ধ চলে দাদা নাতির মধ্যে।

আহনাফ আফরোজা বেগম কে সাথে নিয়ে নিচে আসতেই। আমেনা বেগম শাশুড়ীকে দেখে হেঁসে বললো, ‘ আম্মা চা করে দিবো..?’
~ নিয়ে আসো।
আমেনা বেগমঃ আহনাফ আব্বু তুমি ফ্রেশ হয়ে নাওও। বাড়িতে সবাই চলে আসলে আর রুমেও যাওয়ার সুযোগ পাবে না। তুমি আসবে শুনে বিকেলে সবাই চলে আসবে বলেছে। উপরের রুম তোমার জন্য।

____

বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে ছিলো নির্জন। আজ ১৫দিন পর বাসায় ফিরলো।
বাসায় এসেই আফরোজা বেগম কে এতো খুশি দেখে সোফায় ঘা এলিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,’ কি বুড়ি এতো খুশি কেনো.?? ‘
আফরোজা বেগম চোখ গরম করে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস! একদম বুড়ি বলবি না!!..।

আফরোজা বেগম কে রাগীয়ে বেস মজা পেলো নির্জন।
~ তাহলে কি কচি খুকি বলবো..!? তোমার যেই হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কচি খুকি বলা উচিত ছিলো বুড়ি বয়সে যত ভীমরতি! ।
~ আফরোজা বেগম আর রেগে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ আমি এখনো অনেক সুন্দরী। ‘
হুঁ হুঁ করে হেঁসে উঠলো নির্জন।
~ তা বুড়ি এখন কি পাত্র খুঁজবো.? বুড়ো তো তোমার রুপের জ্বলকানিতে চোখে দেখে কম।
আফরোজা বেগম চা মুখে দিয়ে বলে উঠলো,
~বাসায় এসেছো নিজের রুমে যাও।
~ বুড়ো কই.?? বাসায় এতো আয়োজন কিসের..? মনে হচ্ছে মহিলারা রান্নার প্রতিযোগিতা লেগেছে! বেপার কি.? সত্যি কি তোমাকে দেখতে আসছে নাকি.?

আফরোজা বেগম হেঁসে বললেন,’ আহনাফ এসেছে। ‘
নির্জন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো, ‘ সত্যি বুড়ি!..? সেই জন্য এভাবে কচি সেজে বসে আছো!.?
আফরোজা বেগম কটমট চোখে তাকালেন। নির্জন পাত্তা না দিয়ে ছুটলো ভাইয়ের রুমের দিকে।

_____

ছোঁয়া যেটা দেখছে সেটাই নিচ্ছে।
মহুয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে তা দেখছে।
ছোঁয়াঃ মহুয়া আমি দেখতে দেখতে ক্লান্ত তুমি দেখো এখন।
মহুয়াঃ আর কতো নিবে.?
ছোঁয়াঃ টাকা ভাই দিবে বুঝতে পারছো!! এমন সুযোগ আর কবে না কবে পাই। হাত ছাড়া করা যাবে না।
মহুয়া ছোঁয়ার কথা শুনে হাতের দিকে তাকালো। এতোগুলো নিয়েছে তাও নাকি আরও নিবে!

শ্রাবণ পকেটে এক হাত দিয়ে অন্য হাতো মোবাইল দেখছে। মোবাইল নয় সে তো আঁড়চোখে বার বার আয়নার মধ্যে মহুয়াকে দেখছে।

ছোঁয়ার পাঁচ ঘন্টার শপিং শেষ হলো।

ওরা বাড়িতে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

শ্রাবণ ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে চলে গেলো। অফিস থেকে কল আসছে জলদি যেতে হবে।

ছোঁয়া সব শপিং সোফায় রেখে বসে পড়লো। নিরুপমা মেয়ের দিকে এগিয়ে আসলো৷ আফরোজা বেগম গম্ভীর মুখে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।
মহুয়া চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে আসলো।
নিজের রুমে প্রবেশ করেই অবাক হয় মহুয়া। রুম এতো অন্ধকার কেনো!.?

মোবাইলের ফ্লাশলাইট অন করে রুমের লাইট জ্বালায়। আশেপাশে তাকিয়ে বেস অবাক হয়। রুমে ওর কোনো জিনিসপত্র নেই!সাথে ছোঁয়ার ও কিছু নেই!।
বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা শার্ট। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। মহুয়া বাহিরে এসে একবার দরজার দিকে তাকায় এটাই তো তার রুম।
আবার রুমে এসে ফ্যান ছেড়ে বিছানায় বসতেই কারেন্ট চলে গেলো খট করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো একটা ছেলে।
মহুয়া রুমে আবছা ছেলের অবয়ন দেখেই ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। দ্বিতীয় বার ছেলেটার দিকে আর তাকালো না।
এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ভয়ে চুপসে গেলো মুখ,কাঁপতে থাকলো শরীর। তারাও কি সেই মানুষগুলোর মতো..? ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসলো।

আহনাফ বিড়বিড় করে বলে উঠলো এটা কি কোনো মানুষ ছিলো নাকি পেত্নী!.?

চলবে…

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

মেঘের আড়ালে রোদ পর্ব-০১

0

#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#সূচনা_পর্ব
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

স্বামীর পাশে লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা পড়ে ঘোমটা দেওয়া এক মেয়ে দেখেই জ্ঞান হারায় আফরোজা বেগম। সাথে সাথে উনার দুই ছেলের বউ উনাকে আগলে ধরেন।
আনোয়ার চৌধুরী গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে তার প্রানপ্রিয় প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী আফরোজা বেগমের দিকে।

এই বাড়ির বড় কর্তা আনোয়ার চৌধুরী। যার দুই ছেলে এক মেয়ে।
আনোয়ার চৌধুরীর সামনে কেউ উঁচু গলায় কথা বলতে পারে না। উনি যা বলবে তাই মেনে চলতে হবে৷

আফরোজ বেগমকে উনার বড় ছেলে রুমে নিয়ে গেলো। ছোটো ছেলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তিতি খুব ভালো করেই জানেন তার বাবা কখনো ভুল কিছু করবে না৷ যেখানে দুইদিন পর নাতি-নাতনীদের বিয়ে দিবে সেখানে নিজে বিয়ে করে বউনিয়ে আসবেন এটা অসম্ভব।

আনোয়ার চৌধুরী গম্ভীর মুখে ছেলের বউদের বলে উঠলো, ‘ রাস্তা ছাড়ো, শাশুড়ীর কাছে যাও’

আমেনা বেগম হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে ইশারায় দূরে সরে যেতে বলে নিজে শাশুড়ীর রুমে ছুটলেন।

_______

ড্রয়িংরুম জুড়ে পিনপিন নিরবতা।
আনোয়ার চৌধুরী কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তার দুই ছেলে, মেয়ে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলের বউ।

আনোয়ার চৌধুরী নিরবতা ভাঙে বলে উঠলো, ‘ আমার পাশে যেই মেয়েটা বসে আছে তার নাম মহুয়া। আমি কাল গ্রামে গিয়ে ছিলাম কিছু কাজে তখন আমার বন্ধু আজমিরের সাথে দেখা। জোর করে গ্রামের বখাটে দলের লিডার ওকে বিয়ে করতে চায় আমি পুলিশ নিয়ে ওদের ধরিয়ে দেই। এখন থেকে ও এখানেই থাকবে।’ আশা করি তোমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।

আমেনা বেগম কে ইশারা করে বললো, ‘ ওকে নিয়ে যাও। দুইতলার ডান পাশের রুমটা আজ থেকে ওর।’

কথাগুলো সবার বিশ্বাস হলেও আনোয়ার চৌধুরী মেয়ে নিরুপমা আর হালিমা বেগমের বিশ্বাস হয় না। ডাল মে কুচ তো কালা। ছেলেটাকে পুলিশে ধরিয়ে দিলে এখানে মেয়েটাকে এই ভাবে নিয়ে আশার মানে কি..? অন্তত কাপড় চেঞ্জ করে আনতো! বেস কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খেলো তাদের মাথায়।

আনোয়ার চৌধুরী দুই ছেলে, আজাদ চৌধুরী আর মিরাজ চৌধুরী। এক ছেলে বিজনেসম্যান, নিজের কোম্পানি সামলাচ্ছে আরেক ছেলে পুলিশ।

আমেনা বেগম একটু হেঁসে মহুয়ার সামনে গিয়ে বললো’ চলো আমার সাথে ‘

হালিমা চৌধুরীর ভীষণ বিরক্ত লাগলো। যাকে তাকে বাড়িতে জায়গা দেওয়াটা তিনি একদম পছন্দ করেন না। আর এই মেয়ের তো মুখও দেখা যাচ্ছে না, মুখ কাপড় দিয়ে ডেকে রাখা অবশ্য গ্রামের মেয়েরা আর কেমন-ই বা হবে!।

আনোয়ার চৌধুরী গম্ভীর মুখে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন এখনো প্রানপ্রিয় প্রিয়তমার কাছে যাওয়া হয়নি। নিশ্চয়ই আরও অসুস্থ হয়ে গেছে আফরোজ বেগম। স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসেন সাথে কোনো নারী দেখে হজম করতে পারেননি।

আমেনা বেগম মহুয়া কে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো। ফিরে আসতে নিলেই মিষ্টি একটা কন্ঠ ভেসে আসলো।
আমেনা বেগমের কাছে মনে হলো উনি ভুল শুনলেন এতো সুন্দর কারো কন্ঠ হতে পারে!!..??
মহুয়া দ্বিতীয় বার আবার ডেকে উঠলো” আন্টি ”
আমেনা বেগম পেছন ফিরতেই, মেয়েটা মাথা নিচু করে বলে উঠলো, ‘ আন্টি একটা ড্রেস হবে.? আমার সাথে তো কোনো কাপড় নিয়ে আসিনি।’
আমেনা বেগম কিছু একটা ভেবে বললেন , ‘ তুমি শাড়ি পড়তে পারো..? আমাদের বাসায় একটাই মেয়ে ছোঁয়া এখন ও বাসায় নেই, বাসায় আসলে ওর কাছ থেকে নিয়ে নিবো।’

মহুয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

আমেনা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই মহুয়া দরজা ভেতর দিয়ে লাগিয়ে দিলো। আয়নার সামনে গিয়ে মুখ থেকে কাপড় সরালো সারা মুখে মারের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । ফর্সা মুখে দাগ গুলো জেনো আরও ভেসে উঠেছে। দুইহাতে মুখ চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো মহুয়া, কি থেকে জীবন কি হয়ে গেলো!! জীবনে ঘটে গেলো কিছু অবিশ্বাস্য ঘটনা!! এই জীবনের শেষ কোথায়..? সামনে ওর সাথে কি হবে জানা নেই! নিজের পরিবারের কাছে কোন মুখে ফিরে যাবে!.?? এর থেকে তো মৃত্যু অধিক ভালো ছিলো!!..

___________

ভরা কলেজের মাঠে রাফির গালে স-জোরে থা*প্প*ড় মেরে বসলো ছোঁয়া।
স্তব্ধ হয়ে সবাই তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। একটা মেয়ে থাপ্পড় মারলো কলেজের ফেমাস বয় রাফি কে!!..?এটা জেনো কারো বিশ্বাস হচ্ছে না!..

ছোঁয়া হাত বাড়িয়ে একটা চিরকুট দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,’ এইগুলো কি..? তোর সাহস হয় কিভাবে আমাকে এইসব লেখার..? একবার নয়, দুইবার নয় এই নিয়ে দশবার তোকে রিজেক্ট করেছি তাও তোর লজ্জা হয় না..? আর একবার যদি আমার আশেপাশে তোর কোনো চেলাফেলা কিংবা তোকে দেখি এর থেকেও খারাপ কিছু হবে!!..
রাফি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে। রাগে মুখ লাল হয়ে আছে ছোঁয়ার।

হাতের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেলো।
রাফি সেই আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো ছোঁয়ার যাওয়ার দিকে।

মেয়েটা কি কখনো তার ভালোবাসা বুঝবে না..? সেই ক্লাস সেভেন থেকে ভালোবাসে কিন্তু ছোঁয়া ওকে একটা ভালো বন্ধু ছাড়া আর কিছুই কখনো ভাবেনি আর আজ তো সেই বন্ধুত্ব ও ভেঙে গেলো।

_________

মহুয়া গোসল করে চুলগুলো ছেড়ে দিলো জেনো ঘারের দাগ গুলো দেখা না যায়। আয়নার সামনে গিয়ে মুখের দাগ গুলোর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। যতোই দাগ লুকাতে চায় না কেনো উপরের দাগ গুলো মুছে গেলেও অন্তরের দাগ কিভাবে মুছবে..? গায়ে লেগে যাওয়া কলঙ্ক কিভাবে লুকাবে..? কয়দিন লুকিয়ে রাখবে..?এই সমাজে যে ওর মাথা উঁচু করে চলার স্বাধীনতা নেই!!।

এইগুলো ভাবতে ভাবতে ডুকরে কেঁদে উঠলো মহুয়া। সে বাঁচতে চায় নিজের পরিবারের সামনে একবার যাওয়ার জন্য, বাবার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। সে বাঁচতে চায় সেই নরপিশাচটার সামনে একবার যাওয়ার জন্য, কঠিন থেকে কঠিন মৃত্যু দেওয়া জন্য তাকে বাঁচতে হবে।

বাহির থেকে কয়েকবার দরজা আঘাত করতেই দরজা খুলে দিলো।

আমেনা বেগম এসেছে। মহুয়ার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন তিনি। মুগ্ধ চোখে চেয়ে বলে উঠলেন মাশাল্লাহ।

মহুয়া লজ্জায় এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। অপরিচিত জায়গা, মানুষ। কেমন হবে..? যদি তারাও ওর সাথে একি কাজ করে ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে মহুয়ার, চোখ জলজল করে উঠে এখনি বুঝি বৃষ্টি ঝড়বে চোখ দিয়ে।

আমেনা বেগম মহুয়ার চুলের দিকে তাকালো, ‘ হাঁটু অব্দি ভিজা চুলগুলো থেকে টপটপ পানি পড়ছে। মুখে কাঁটা দাগ, কিসের দাগ এইগুলো..? মনে তো হয় কেউ ভীষণ মেরেছে!!..কি ভীষণ মিষ্টি চেহারা জেনো আল্লাহ নিজ হাতে তৈরি করেছেন।

আমেনা বেগমঃ চলো আমার সাথে আব্বা তোমার জন্য বসে আছে।

মহুয়া আমেনা বেগমের পিছু পিছু নিচে যেতেই সবার দৃষ্টি গেলো মহুয়ার দিকে।

এই প্রথম আনোয়ার চৌধুরীও মহুয়ার মুখ দেখলেন।
হালিমা চৌধুরী শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো, মনে মনে বলে উঠলো, ‘ মেয়েটা দেখতে মাশাল্লাহ তবে মুখে এতো কিসের দাগ..? মনে হচ্ছে প্রচুর মেরেছে কেউ!..গ্রামের মেয়েও এতো সুন্দর হয়!..? চুল,চোখ,ফেইস, সৌন্দর্য সব মিলিয়ে অপুর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী।

নিরুপমা বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালো তিনি একদম পছন্দ করেন না কোনো মেয়েকে আর যদি হয় উনার মেয়ের থেকে বেশি সুন্দর তাহলে তো বিষের কাঁটা মনে করেন। আর এই মেয়েকে দেখলে তো মনে হয় এক টুকরো চাঁদ সামনে দাঁড়িয়ে। নিজের মেয়ের থেকেও সুন্দর ভাবতেই বিষিয়ে গেলো মন।

আনোয়ার চৌধুরীঃ বসো..
মহুয়ার পেটেও ভীষণ খিদে আজ দুইদিন ওরা কেউ এক ফোঁটা পানিও দেয়নি পালিয়ে আশার সময় এক টং দোকান থেকে পানি খেয়ে ছিলো।

চুপসে যাওয়া মুখটা দেখেই আনোয়ার চৌধুরী বুঝলেন মহুয়ার খিদে লেগেছে। মেয়েটার কথায় যেমন মায়া মুখেও ভীষণ মায়া।আনোয়ার চৌধুরী মহুয়ার মাঝে আফরোজা বেগম কে খুঁজে পেলেন৷ ঠিক এতোটাই সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন আফরোজা বেগম। জেনো ভুল করে চলে আশা চাঁদের পরী।

ছোঁয়া রেগে বাসায় এসে ব্যাগ সোফায় রেখে সবার দিকে তাকালো। নিরুপমা মেয়ের মুখ দেখে খাওয়া ছেড়ে উঠে আসলেন। আমেনা বেগম ছোঁয়ার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,’ কি হয়েছে..? ‘
ছোঁয়াঃ কিছু না মামুনি এক গ্লাস পানি দাও।

আমেনা বেগম পানি দেওয়ার আগেই নিরুপমা পানি নিয়ে আসলো মেয়ের জন্য।
ছোঁয়া আনোয়ার চৌধুরী কে দেখেই গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, ‘ নানাভাই তোমার তো আরও দু’দিন পড়ে আশার কথা ছিলো..?
আনোয়ার চৌধুরীঃ কেনো সুইটহার্ট তুমি খুশি হওনি আমি চলে আশায়!!
ছোঁয়াঃ ভীষণ খুশি হয়েছি।

নিরুপমাঃ বাবা আপনার আরও দু’দিন পড়ে আশার কথা ছিলো..??
আনোয়ার চৌধুরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলে উঠলো, ‘ কাজ জলদি শেষ হয়ে গেছে। ‘

ছোঁয়া বাড়ির একমাত্র মেয়ে অবশ্য এই বাড়ির মেয়ে নয় ছোঁয়া। নিরুপমা চৌধুরীর মেয়ে ছোঁয়া চৌধুরী। নিরুপমার স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাপের বাড়িতেই থাকে নিরুপমা।

এই বাড়ির বড় ছেলে আজাদ চৌধুরীর দুই ছেলে। বড় ছেলে শ্রাবণ চৌধুরী উনার সাথে বিজনেস সামলাচ্ছে আর ছোটো ছেলে আহনাফ চৌধুরী ইউরোপে আছে এক সপ্তাহ পর দেশে ফিরবে ডাক্তার হয়ে।

ছোটো ছেলে মিরাজ চৌধুরীর এক ছেলে নির্জন চৌধুরী যার কাজ হলো বাবার টাকা উড়ানো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া আর মেয়ে পটানো।

দুই ভাইয়ের কোনো মেয়ে নেই সেই জন্য ছোঁয়া সবার ভীষণ আদরের। তবে এই বাড়ির একজন ছোঁয়াকে তার শত্রু মনে করে সে আর কেউ নয় নির্জন চৌধুরী।

______

ছোঁয়ার চোখ যায় মহুয়ার দিকে।
ছোঁয়াঃ এই মেয়ে কে..?
আমেনা বেগমঃ মহুয়া আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়।

ছোঁয়া একবার মহুয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। নিরুপমা মেয়ের পিছু পিছু চলে গেলেন।

আমেনা বেগম আর হালিমা বেগম মিলে সব গুছিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন।

এতোটা সময়ে একবারও মহুয়া কারো দিকে তাকায়নি। নিচের দিকে তাকিয়ে নিজের খাবার শেষ করে বসে আছে।

আনোয়ার চৌধুরীঃ মহুয়া আজ থেকে এটা তোমার নতুন বাড়ি। একদম স্বাধীন ভাবে চলবে কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে! আর এখন চলো তোমাকে আফরোজার সাথে দেখা করিয়ে আনি। ভীষণ রাগী তবে মনটা ভীষণ নরম।

________

সন্ধ্যায় নিজের রুমে বসে ছিলো মহুয়া তখনি ছোঁয়া ওর দরজায় টুকা মারলো।

মহুয়া দরজার দিকে তাকাতেই ছোঁয়া বিরক্ত মুখে বলে উঠলো, ‘ নানাভাই বললো আজ থেকে তুমি আমি এক রুমেই থাকবো। আমি আমার জিনিসপত্র নিয়ে আসছি!’

___

সময় থেমে থাকে না মহুয়া এসেছে আজ পাঁচ দিন। শুধু মাত্র খাবারের সময় হলে মাথা নিচু করে নিচে গিয়েছে আবার শেষ হলে নিজের রুমে। প্রয়োজনের বাহিরে কোনো কথাও বলে না। এখনো এই বাড়ির কোনো পুরুষের সাথে ওর দেখা হয়নি আর না কোনো ছেলের সাথে। ছোঁয়ার সাথে একটু আধটু কথা বলে।

আজ নিচে যেতেই আনোয়ার চৌধুরী ছোঁয়াকে বলে উঠলো, ‘ মহুয়া কে নিয়ে শপিং মলে যাও, তোমার আর ওর যা যা প্রয়োজন নিয়ে আসবে।

ছোঁয়া খুশিতে মহুয়ার হাত ধরে বলে উঠলো, ‘ ঠিক আছে সুইটহার্ট.। ‘

আনোয়ার চৌধুরীঃ তোমাদের সাথে আরও একজনকে বলেছি যেতে।
ছোঁয়াঃ যদি সেটা তোমার বজ্জাত নাতি নির্জন হয় তাহলে কখনো এই বেয়াদব কে সাথে নিয়ে যাবো না!!..

আনোয়ার চৌধুরীঃ তোমাদের সাথে আমি শ্রাবণ কে বলেছি যেতে সে কিছু সময়ের মধ্যে চলে আসবে জলদি রেডি হয়ে নাও।

ছোঁয়া মহুয়ার হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলো৷ একি রকম দুইটা ড্রেস বের করে মহুয়ার সামনে রাখলো৷
মহুয়া কিছু বলার আগেই ছোঁয়া বলে উঠলো, ‘ একটা ফ্রেন্ডের জন্য নিয়ে ছিলাম আজ তুমি পড়ে নাও।’এক রকম দুইজন পড়ে যাবো।

শ্রাবণ বাড়িতে সোফায় বসে আনোয়ার চৌধুরীর সাথে কথা বলছে। সবার কথা ফেলতে পারলেও আনোয়ার চৌধুরীর কথা সে ফেলতে পারে না। নিজের ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ফেলে দাদা ভাইয়ের ডাকে ছুটে এসেছে। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
আনোয়ার চৌধুরী শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বলে উঠলো, ‘ ওদের দিকে খেয়াল রাখবে, চোখে চোখে রাখবে।’
শ্রাবণঃ সব সময় ছোঁয়া একাই মার্কেটে যায় ওর সাথে অন্য কেউ থাকতেও বডিগার্ড হিসেবে আমাকে কেনো লাগবে দাদাভাই..?

আনোয়ার চৌধুরী কিছু না বলে চুপ করে রইলেন, শ্রাবণ বুঝলো প্রশ্ন করে লাভ নেই এখন কিছু বলবে না আনোয়ার চৌধুরী। কিন্তু এমন কে সে যার জন্য আমাকে বডিগার্ড হতে হচ্ছে!। ভীষণ রাগ হলো সেই মেয়ের উপর যার জন্য তাকে ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ফেলে আসতে হয়েছে!বডিগার্ড হতে হচ্ছে ! আজ কতোগুলো টাকার পজেক্ট লস হলো।

” আমরা রেডি শ্রাবণ ভাইয়া”

শ্রাবণ বিরক্ত হয়ে সামনে তাকালো। স্তব্ধ হয়ে গেলো।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছোঁয়ার পেছনে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে।

চলবে…..

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

যদি তুমি বলো পর্ব-৬৪ এবং শেষ পর্ব

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৬৪(শেষ)
আফনান লারা

পান্নাকে পাবার জন্য কত বছর পরিশ্রম করে আজ এই পর্যায়ে গিয়ে কিনা পান্নার বিয়ে দেখতে হবে অন্য কারোর সাথে?
সকলে এমন ভাব করছে যেন রিদম এখনও সেই ছোট রিদমই আছে,যে নিজেকে রিত্তিক,সালমান খান,শাহরুখ খান মনে করতো।আজ তার মাঝে বিদ্যমান ম্যাচিউরিটি,সুবোধ,আবেগের বদলে বাস্তুবিকতা।এই পর্যায়ে এসে কি সে দেখবে পান্না অন্য কারোর?
সেইদিন সারাটা রাত ধরে রিদম ঘুমায়নি।তার অসহ্য লাগছে সব।সহজ করে দেখলে বিষয়টা সহজ হবে কিন্তু মনে হয় সহজ সহজ করেও বিষয়টা বড়ই জটিল।
গিয়াস সাহেবকে ব্যাংক ব্যালেন্স শুনিয়ে রাজি করাটা এক মিনিটের ব্যাপার।কিন্তু জানা দরকার পান্না কি চাইছে।সে কি রিদমকে পেলে খুশি নাকি সাবিদ হলেও তার চলে।
রিদমকে তার স্পেশালি কেন লাগবে সেটা জানা খুব দরকার।কিন্তু আগের চেয়ে পান্নার লজ্জাবোধ একটু বেশিই হয়ে গেছে বলে মনে হয়।
ইশান দুলাভাই থাকলে এটা খুব ইজিলি ক্লিয়ার করা যেতো,এখন এটা সম্ভব না কারণ ইশান ভাইয়াকে না জানিয়ে সে দেশে এসেছে।নিশ্চয় উনি রেগে আগুন হয়ে আছেন।কি করা যায়!
ভাবতে ভাবতেই রিদম ঘুমিয়ে পড়ে।তখন বাজে ভোর পাঁচটা।
জাপানের একটি বিমান বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় সেই মূহুর্তে।
তানিয়াকে তিথি জানিয়েছে তাদের আসার কথা।কিন্তু রিদমকে জানাতে মানা করে দেয়া হয়।
তিথি আগে ওর শ্বশুর বাড়ি যাবে।শাশুড়ি অসুস্থ
তাকে দেখা জরুরি।
সকাল দশটা বাজার পরেও রিদম উঠছিলনা বলে,তানিয়াই ওকে উঠিয়ে দেয়।রিদম ঘুম থেকে ওঠার পর তার হুশ আসে পান্নার সাথে কথা বলার কথা।
তড়িঘড়ি করে সে তৈরি হয়ে নেয়।কিছু না খেয়েই বেরিয়ে পড়ে পান্নাদের বাসার দিকে।কিছুদূর যেতেই সে দেখে মাইক্রো কতগুলা আসছে এদিকে।সম্ভবত গাড়ীগুলো পিংকির শ্বশুর বাড়ি যাবে,আজ তো তার বৌভাত।
রিদম একটা গাড়ীর ভেতর সামনের সিটে পান্নাকে দেখতে পায়। ওমনি সে গাড়ীটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ীটাকে থামিয়ে দেয়,এরপর পান্নার পাশের দরজা খুলে ওকে গাড়ী থেকে বের করিয়ে গাড়ীর ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দেখে পান্নার দুইজন খালা আর খালু, আরও অন্যান্য আত্নীয়ারা বসে আছেন।

‘সবাইকে হাই/হ্যালো।আমি রিদম,পাশের বাসায় থাকি।পান্নার সাথে আমার বিবাহসূত্রীয় কিছু আলাপ আছে,আমি তাকে যথাসময়ে পাঠিয়ে দিব।এই খবর যেন গাড়ীর বাহিরে না যায় তার জন্য এই নিন দু হাজার টাকা।আঙ্কেল এই টাকা দিয়ে গাড়ীর সবাইকে এক প্লেট করে ফুচকা খাওয়াই দিবেন।টাটা’

এটা বলে রিদম সবাইকে চলে যেতে বলে পান্নাকে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা ধরে।

‘আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি?এটা কি ঠিক হলো?’

‘হ্যাঁ,খুব খারাপ হলো।আর কিছু বলবে?’

‘নাহ’

রিদম হাঁটতে থাকে।যতদূর গেলে নির্জনতা পাওয়া যাবে ঠিক ততদূর।পান্না ভারী লেহেঙ্গা পরেছিল বলে হাঁটতে পারছিলনা ঠিকমত, কিন্তু রিদম ওসব ভাবছেনা,তার দুচোখ প্রশান্ত পথ খুঁজে চলেছে।

একটুদূর আসার পর রিদম থামে,ফলে পান্নাও থেমে যায়।
আশেপাশে কেউ নেই, জনমানবশূন্য পথ।রিদম পান্নার দিকে হঠাৎ করে তাকায়।পান্না ভয় পেয়ে গেলো আবারও।রিদমকে আগে এতটা ভয় লাগতোনা যতটা এখন ভয় লাগছে।ও এমন কেন?সুন্দর করে,মায়া চোখেও তো তাকানো যায়,আশ্চর্য!

‘আমাকে বিয়ে করবে?’

‘কিই???’

‘কিই?এটার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না তে দিবে। কিই আবার কি?’

‘না আসলে….’

‘না?জানতাম!একজনকে দশ পনেরো বছর খাটিয়ে পরে রেডিমেড কাউকে বিয়ে করাই হলো তোমাদের মেয়েদের কাজ!’

‘আরেহ ক্ষেপছেন কেন?আমি বুঝতেছিনা এখন এটা কেন জানতে চাইছেন?’

‘এখন জানতে চাইবোনা তো কি তোমার বিয়ে হয়ে যাবার পর জানতে চাইবো?’

পান্না পা দিয়ে কঙ্করের পথটাতে ঘঁষতে থাকে,নিরব পরিবেশ থাকলেও হুট করে একটা যক্ষ্মা রুগী ওখানে এসে হাজির।হাওয়া খেতে এসেছেন।কপোত কপোতী দেখে আর যাবেন না।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন আর কথা শুনবেন আর কাশবেন।
রিদম কাশিতে বিরক্ত হয়ে ছেলেটার গলা চেপে ধরে বললো,’যক্ষ্মাতে শুনেছি রোগী মরেনা,চিকিৎসা করলে ভাল হয়ে যায়।কিন্তু আমি তো তোকে এখানেই মেরে দিবো।সুন্দর একটা সময়,জরুরি কথার সময় ডিস্টার্ব করতে ভাল লাগে তোর?’

ছেলেটা রিদমের থেকে ছাড়া পেতেই কাশতে কাশতে চলে গেলো এক দৌড়ে।পান্না অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল।উত্তর তার মুখের কাছেই চলে এসেছে কিন্তু সে বলবেনা।

ঐ সময়ে পান্নার হাতে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে।বাবার কল,রিদম কলটা দেখে চুপ করে থাকে,পান্না রিসিভ করার পরপরই শোনা গেলো,’পান্না রে জলদি আয়,সাবিদের চেয়ে জাক্কাস একটা ছেলের সন্ধান পেয়েছি।তারা এই বৌভাতের অনুষ্ঠানেই আসছে,পিংকির শ্বশুর বাড়ির আত্নীয় সম্ভবত,তোকে দেখলেই নাকি বিয়ে পাকা করবে।তাদের ছেলের পছন্দ অপছন্দ নাই,তারা যেটা বলবে সেটা।’

পান্না রিদমের দিকে তাকায়।রিদমের মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে সবটা শুনেছে।কলটা কাটা যেতেই রিদম ওকে ধরে একটা সিএনজিতে উঠলো।পান্না ভাবলো এই বুঝি পালিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে।কিন্তু নাহহ,সে দেখতে চায় পান্না তার বাবার মুখের উপর না করার সাহস পায় কিনা,বাবার পছন্দ আর রিদমের মাঝে কোনটাকে সে বেছে নিতে পারে সেটাই দেখতে রিদম ওকে নিয়ে পিংকির শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে।

পুরোটা পথে কোনো কথাই বলেনি রিদম।ঐ বাসার কাছে আসতেই সে নেমে যায় ভাড়া দিতে।
পান্না চুপচাপ বাসার ভেতরে ঢোকে,ঢুকতেই মা পেছন থেকে এসে ওর গায়ের ওড়না মাথায় তুলে দিলেন,এরপর হাসতে হাসতে সোফায় বসা সাতজনের একটা দলকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন এই হলো পান্না,তাদের আদরের ছোট মেয়ে।সাতজনের মাঝে তিনজন মেয়ে আর চারজন ছেলে।সকলকে দেখে বাহিরের দেশের মনে হচ্ছিল,পোশাক আশাকে অন্যরকম ভাব।ছেলেদের বড় বড় দাঁড়ি আর মেয়েদের মাথায় বড় বড় ঘোমটা।
পান্না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো নিঃশব্দে।সোফা থেকে উঠে এসে একজন হঠাৎ করেই ওর আঙ্গুলে রিং ও পরিয়ে দেয় এক মিনিটের ব্যবধানে।পান্নার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকলো।চোখে পানি থাকতেই সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় মেঝেতে।রিদম বাহিরে থেকে ভেতরের হট্টগোল শুনে দেখতে এসে দেখে সবাই পান্নাকে নিয়ে ব্যস্ত।

‘এ কেয়া হুয়া,লারকি জ্ঞান কিঁও হারাইয়া’🐸

‘আপ চুপ রাহিয়ে,আপকি বাজাছে এসাব হুয়া।কেয়া দরকার থি রিং পরানেকি’

কাপলটির আবোলতাবোল হিন্দি শুনে রিদম ওদের মুখের দিকে তাকায়।কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
তাও ওসব বাদ দিয়ে সে হাঁটু গেড়ে বসে পান্নার পাশে।
এরপর তাচ্ছিল্য করে বলে,’এমনই হবার কথা ছিল।বাবার বিরুদ্ধেও যাবেনা আর আমাকেও না বলতে পারবেনা।পারবে শুধু জ্ঞান হারাতে।করো তুমি বাবার পছন্দের বিয়ে।আমি গেলাম,বিদেশে সুন্দরীর অভাব নাই,তাও করলাম না বিয়ে।বিয়ে না করলো তো আর মরে যাবোনা’

এই বলে রিদম উঠে দাঁড়াতে যেতেই পান্না চোখ মেলে হাত বাড়িয়ে ওকে আটকায়,এরপর উঠে বসে ওকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে বলে,’নাহ!আমি পারবোনা এটা।আমি অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা কখনও ভাবিনি বিশ্বাস করুন।তারপরেও দেখেন সবাই কি তোড়গোড় করছে।বাবাকে বুঝাতে পারছেন না???আপনি নিজেও তো বাবাকে ভয় পান।আর দোষ কেবল আমাকে দিয়ে চলেছেন।এটা অন্যায়’

পান্নাকে দেখতে আসা সেই পরিবারের একজন বলে ওঠে,’হা এ বহুত বাড়া অন্যায় হুয়া।আব উচিত সাদি কারওয়াকে দোনোকো বিদায় দে দেনা’

‘উফ!আপনি থামুন তো,তখন থেকে উল্টোপালটা হিন্দি বলেই যাচ্ছেন।কেমন পাত্রপক্ষ আপনারা?মেয়ে দেখতে এসে দেখলেন মেয়ের আরেক জায়গায় লাইন আছে।মেয়ের বাবাকে দু চার লাইন কথা শোনাতে পারেননা?আবার আমাদের বলছেন চলে যেতে বিয়ে করে!’

গিয়াস সাহেব তখন রেগে মেগে বললেন,’আমি কিছুতেই রিদমের সাথে আমার কলিজার টুকরার বিয়ে দিবো না।এ হতে পারেনা’

‘আগার,, ও হামারা শালা হুয়া তো??’

এ কথা শুনে গিয়াস সাহেব পেছনে মুড়ে দেখলেন পাত্রের দুলাভাই পরিচয় দেয়া লোকটি তার নকল দাঁড়ি,পাগড়ী খুলছেন।

‘ইশান?’

‘জ্বী,আর এই রিদমই আমার সেই শালা যার গুনকীর্তন এতক্ষণ গাইছিলাম’

রিদম ওদের সবার আসল রুপ দেখে পান্নার পাশে বসে গেছে মেঝের উপর।সব মাথার উপর দিয়ে গেলো।তবে এত সবের মাথে একটা কাজ হলো,তা হলো পান্না স্বীকার করেছে তার ভালবাসার কথা।
যদি তুমি বলো নামটা সার্থকতা পেয়েছে সবেমাত্র।
গিয়াস সাহেব গাল ফুলিয়ে বসে পড়লেন ইশানদের সাথে আসা বাকি লোকজনদের পাশে।

‘আপ বহুত আচ্ছা হে,হামারা লারকে কো ইতনি জালদি মান লিয়া’

‘কচু মান লিয়া!আমি এখনও মান লিয়া করি নাই।’

ইশান হাত ভাঁজ করে বললো,’রিদমের কিছু নাই বলে,ওর চালচুলো নাই বলে ছোট থেকেই ওকে অবহেলা করেছেন।তাই আমি ওকে অল্প বয়স থাকতেই নিয়ে গিয়েছিলাম সবার থেকে দূরে।এত গুলো বছর শুধুমাত্র আপনার মেয়ের জন্য সে পরিশ্রম করে গেছে।আপনি আমায় বলেছিলেন আমার আনা সেইই ছেলেটির সাথেই পান্নার বিয়ে দিবেন।এখন রিদম সেই ছেলে শুনে আপনি পিছু হটছেন?’

গিয়াস সাহেব অনেক ভেবে বললেন,’আমার মেয়েকে দেখতে পারবোনা বছরের পর বছর।তাই রাজি হতে মন সাঁই দিচ্ছেনা’

ইশান পকেট থেকে একটা খাম বের করে ওনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’মেয়েরা যৌতুক দেয় শুনেছিলাম,আমি না হয় ছেলের হয়ে যৌতুক দিলাম’

গিয়াস সাহেব ভ্রু কুঁচকে খামটা খুলে দেখলেন ভেতরে পাসপোর্ট আরও কতগুলো কাগজপত্র।

‘এগুলা তো পেন্ডিং ছিল এত বছর।কে রিনিউ করলো?
আচ্ছা আমি জাপান যাবো নাকি?’

‘যখন ইচ্ছা তখনই ফ্লাইট ধরে চলে আসবেন,তাও আন্টিকে সাথে নিয়ে।খরচ আপনার হবু মেয়ে জামাই দিবে।বেতন তো তারে কম দেই না’

‘তাও আমি রাজিনা😏,আমাকে কি আপনাদের লোভী মনে হয়?আমার এত লোভ নাই।
কিন্তু আমার কর্মচারী কুদ্দুসকে বিদেশ না নিলে আমি বিয়া দিতাম না’

হাসির হট্টগোল পড়ে গেলো।রিদম পান্নার হাতটা ধরতেই তার ডান হাতে কলম দিয়ে লেখা একটা লাইন দেখতে পায় পান্না।তাতে লেখা “যদি তুমি বলো”

♥সমাপ্তি♥

যদি তুমি বলো পর্ব-৬৩

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৬৩
আফনান লারা

‘আচ্ছা যদি আমি ভুল না হই,তুমি কি রিদম?তিথির ছোট ভাই?ঐ যে কাইল্লা করে,এখন তো সাদা।ঐ যে পিচ্চি করে এখন যদিও লম্বা হইছো ‘

‘জ্বী,আমিই সেই’

‘বাহ বাহ,মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ!দেশে এসেছো ভাল করেছো। তা আর কটাদিন পর আসতে পারলেনা?পিংকি আর তোমাকে নিয়ে আমার যে সন্দেহ ছিল তা দূর হতে আজকের দিনটাই দরকার ছিল’

‘ওসব কিছুনা,আমি পিংকিকে বোনের চোখে দেখি’

‘তাই নাকি,বেশ বেশ!তবে খুব ভাল।তবে আজ বিয়েতে আসার দরকার নাই,বোন থেকে অনেকে বউ বানিয়ে ফেলে।যুগের বিশ্বাস নাই কোনো’

রিদম হাসি দিয়ে চলে যাওয়া ধরতেই গিয়াস সাহেব ওকে ঝাপটে ধরে বললেন,’আহা মজা করেছি,চলো তো!আজ তোমায় স্পেশাল বাঙালিয়ানা খাবার খাওয়াবো।বিদেশের সাদা খাবার খেয়ে খেয়ে তোমার চামড়াও সাদা হই গেছে।আচ্ছা ওরা কি তরকারিতে হলুদ দেয়না?হলুদ খেলে ফর্সা হয় জানতাম কিন্তু হলুদ না খেয়ে এত ফর্সা হওয়া যায় সেটা তো জানতাম না।আজ থেকে আমি হলুদ ছাড়া তরকারি,ডাল খাবো’

‘না ব্যাপারটা তা নয়।তারা হলুদ খাবার খায় তো!কে বলেছে খায় না?’

‘আরে খায়না ওরা।আমি জানি।এসো ভেতরে এসো।তোমার সাথে আলাপ করে দিবো আমাদের পান্নার হবু জামাইর সাথে’

এটা শুনে রিদমের পা আটকে যায়।সে আর কদম ফেলেনা।চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ওখানেই।

‘কি হলো?এসো’

গিয়াস সাহেব জোর করে ওকে টেনে সাবিদের কাছে নিয়ে আসলেন এরপর সাবিদের ঘাড়ে হাত রেখে বললেন,’সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সে।আমার ভীষণ পছন্দ ছেলেটা।মজার কথা বলে,আর বড় কথা হলো সে আমার পান্নাকে বড়ই পছন্দ করে।’

রিদম চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে,সাবিদ হাত বাড়িয়ে ওর সাথে হাত মেলালো এরপর ওর পরিচয় জানতে চাইলো।

‘আমি রিদম……’

‘চিনলাম না,পিংকি ভাবীর কি হন?’

‘আরেহ আমাদের প্রতিবেশী সে,খুবই কাছের তারা।’

“ওহ হো!নাইস টু মিট ইউ রিদম,তা আপনি কি করছেন এখন?’

‘সিনিয়র ম্যানেজার ‘

“কোন কোম্পানি? ‘

রিদম কিছু বলতে যাবে তার আগেই গিয়াস সাহেব বলে উঠলেন,’ইশানের কোম্পানিতে না তো?ওমাগো!এত বড় পর্যায়ে চলে গেছো তুমি?গাড়ী কয়টা তোমার?’

রিদম কোনো কিছু না বলেই চলে যাওয়া ধরলো ঠিক তখনই তার সামনে দিয়ে পান্নাকে যেতে দেখে,হাতে ডালা নিয়ে সে বাসার ভেতর যাচ্ছিল।রিদম রাগ করে ওদের বাসা থেকে চলে গেছে।তানিয়া বাসায় সাজছিল বিয়েতে আসার জন্য।রিদমকে হনহনিয়ে এসে রুমে ঢুকে দরজা লাগাতে দেখে সে বাইরে থেকে জানতে চাইলো কি হয়েছে।রিদম কোনো উত্তর দেয়না।
তানিয়া ও আর জানতে চায়নি,তবে বুঝতে পেরেছে পান্নাদের বাসায় কিছু একটা হয়েছে।মা বলেছিল রিদম তখন পান্নাদের বাসার দিকে গিয়েছিল।
—-
‘রিদম কোথায়?’

‘দরজা বন্ধ করে বসে আছে’

‘পান্নাকে নিয়ে কিছু হয়েছে?জানিস?’

‘না রে টুকু!আচ্ছা আমি এখন যাব তো বিয়ে খেতে,গিয়ে খবর আনবো।তোরা কবে আসবি?’

‘আসবো,তোর ভাইয়া সময় করে নিক’
——–
পান্না এতই ব্যস্ত ছিল যে সে তখন রিদমকে দেখতে পায়নি।কিন্তু সে জানতে পেরেছে রিদম এসেছিল,তার মানে নিশ্চয় সাবিদকেও দেখেছে।সে কি জেনেছে সাবিদের সাথে ওর বিয়ে হবার কথা চলছে?’

‘পান্না?’

‘আপু!এসেছো।এত দেরি করলে কেন?’

‘ওসব ছাড়ো।আগে বলোতো রিদমের কি হয়েছে?

‘কি হয়েছে?’

‘সে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রেখেছে।বুঝলাম না কি হলো,কিছু বলছেও না।’

পান্না বুঝে গেলো রিদম সব খবর পেয়ে গেছে।সে হাতের কাজ সেরে রিদমদের বাসায় চলে আসলো ওর সাথে এই নিয়ে কথা বলতে।কলিংবেল চাপার অনেকক্ষণ পর বুয়া এসে দরজা খুলে দেয়।পান্নাকে দেখেই বুয়া অন্য কাজে চলে গেছে।পান্না বুয়ার পিছু পিছু এসে জানতে চাইলো রিদমের আম্মু কোথায়।বুয়া জানায় রিদমের আম্মু ছাদে গেছেন।

পান্না এবার রিদমের কথা জানতে চায়।বুয়া বলে সে জানেনা।তাই পান্না নিজেই ওকে খুঁজতে থাকে।রিদমের রুমের বিপরীতে একটা করিডোর আছে,যেটা সোজা বাসার পিছনের দরজা অবধি যায়।পান্না রিদমকে খুঁজতে খুঁজতে সেই করিডোর দিয়েই চলছিল।

‘আমাকে খুঁজছো?’

রিদমের গলার স্বর খুব কাছ থেকে পেয়ে পান্না আমচকা ভয় পেয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।করিডোরের মাঝ থেকে রিদমের বারান্দা।সে বারান্দাতেই ছিল।

‘না মানে হ্যাঁ,’

রিদম রুম থেকে বের হয়ে আরও কাছে এসে দাঁড়ায় এর কিছুক্ষণ পর পান্নার সামনের দোয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

‘তুমি এত হাঁপাচ্ছো কেন?আমি তো এখনও তোমায় ধরলামই না’

এটা শুনে পান্না ঢোক গিললো।রিদম হাত ভাঁজ করে বলে,”চুমু ও খেলাম না আর গলা শুকিয়ে গেলো?’

পান্না এবার চোখ বড় করে রিদমের সামনে থেকে একটুখানি সরে দাঁড়ায়।

‘একা একটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে খুঁজতে,একা বাসায় এসেছো।এসব হওয়া কি স্বাভাবিক নাহ?’

‘হ্যাঁ,না মানে না।আপনি তো আত্নীয়’

‘নাহ,আমি তোমার আত্নীয় না।প্রতিবেশী।’

‘আপনি রাগ করেছেন কেন?’

‘কেন?কেন বলোতো?আমার কি রাগ করা উচিত না?’

‘আপনি ওভাবে কথা বলছেন কেন?আমি কি করে…….’

রিদম পান্নার দুপাশে দুহাত দিয়ে দাঁড়ায় এরপর বলে,’বলো!কথা শেষ করো’

‘আমি কিছুই করিনি,তবে আমার উপর রাগ……’

রিদম তার ঠোঁট পান্নার শুস্ক চুলে বোলাচ্ছিল।এরপর আবার বললো,’কথা শেষ করো পান্তুয়া ‘

‘আমার উপর রাগ করে আছেন কেন?’

‘তোমার দোষটা কি সেটা আগে খুঁজে বের করো এরপর আমায় খুঁজতে এসো’

এটা বলে রিদম পান্নাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।পান্না দম ফেলে ওর পিছু পিছু এসে বলে,’বিয়েতে আমার মত নেই,বাবা তার পরেও জোর করছেন’

‘তোহ?অন্য মেয়েদের মতন পরিবারের চাপে বিয়ে করে নেবে?আমাকে দেবদাস বানাবে?তা তো হবেনা,আমি দেবদাস নই আর তুমিও পারও না।আমি রিদম!আমাকে যদি বিয়ে নাই করো তবে চিরজীবন কুমারিই থেকে যাবে কোনো সাবিদের ঘরের বউ আর হতে পারবেনা।কি করে হও আমিও সেটা দেখবো’
—-
‘কে এসেছে আসমা?’

‘ঐ বাসার পান্না এসেছে রিদম ভাইকে খুঁজতে’

মায়ের গলা শুনে রিদম পান্নাকে রেখেই নিজের রুমে চলে যায়।পান্না তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়।

‘একি পান্না?কখন এলে?’

‘এই তো অল্প কিছুক্ষণ হলো,আমি আসি আন্টি’

এটা বলেই পান্না দৌড়ে চলে গেলো।আর থামলোনা।
——–
‘রিদম?পান্নার সাথে কথা হয়েছে তোর? সে নাকি তোকে খুঁজতেই এসেছিল ‘

‘জানিনা’

মা রুমের ভেতরে এসে রিদমের কপালে হাত বুলিয়ে বললেন,’তুই ফোন করেছিস কিনা,তোর কি অবস্থা,কদিন পর পর বাসায় এসে ইনিয়েবিনিয়ে জানতে চাইতো।মেয়েটার সাথে এসেই এত রাগ দেখাচ্ছিস কেন?’

‘ও খুব খারাপ’

‘খারাপ হতে পারে,জঘন্য তো নয়।যা মনমালিন্য হলো সব সমাধা করে নে।যোগ্য প্রার্থী হারালে,কাঁদতে হবে আড়ালে, বুঝেছিস?’

এ কথা বলে মা হাসতে হাসতে চলে গেলেন।রিদম বালিশ বুকের নিচে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলো আর ভাবতে থাকলো অনেককিছু।
——-
পিংকি আর সায়ানের বিয়েটা হয়ে গেছে।এখন তার চলে যাবার পালা।পান্নাকে দেখে পিংকি কান্না শুরু করে দিলো।যতই হোক,বোন তো!
সাবিদ লজ্জায় লাল হয়ে আছে পান্নাকে দেখে।সে পারছেনা ওখানেই লুকিয়ে পড়তে সবার সামনে থেকে।যেদিন থেকে মায়ের মুখে শুনেছে পান্নার সাথে তার বিয়ে হবে,সেদিন থেকে সে আর ধৈর্য্য রাখতে পারছেনা।কবে ভাইয়ার বিয়ে হবে আর কবে সে বিয়ে করবে।

পান্না চোখ মুছে বাসায় চলেই যাচ্ছিল ঐ সময় বাবা বললেন তাকে নাকি পিংকির সাথে ওর শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে।

পান্না অবাক হয়ে বলে,’আমি তো যেতে পারবোনা বাবা’

‘কেন?’

‘গেলে আগুন লাগবে’

‘কোথায় আগুন লাগবে?’

‘আমার শরীরে।আমি অসুস্থ বাবা,আমার ভীষণ জ্বর,কাশি,সর্দি’

‘সেকি?কবে থেকে?’

‘এখন থেকে ‘

পান্না কাশতে কাশতে বাসার ভেতর চলে আসে।
—–
সাবিদ বুঝতে পারলো পান্না ওর ভয়ে আসেনি,পান্নার জায়গায় তার খালাতো বোন নিশি গেছে পিংকির সাথে।পান্না রুমে এসে যেন দম ফেললো শান্তির।আজ যদি সে ঐ বাড়িতে যেতো তবে আগুন লাগতো রিদমের গায়ে,আর এই বাসায়।আজ ওর যে রুপ সে দেখে এসেছে,এর চাইতে বাজে রুপ সে দেখতে চায়না কখনও।

চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-৬১+৬২

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৬১
আফনান লারা

সেই এলার্ম ঘড়িটার দিকে চেয়েই রিদম চলে গেছে।পান্নাকে শেষবার দেখারও ইচ্ছা পোষণ করে নাই,একই অনুভূতি কাজ করছিল ওপার থেকেও।পান্না বুঝি জেনে গেছিলো,রিদম ও তার মতই শেষবার দেখা করা নিয়ে ভীত!
পিংকি তার বাবার সাথে ঠিকই এয়ারপোর্ট অবধি পৌঁছে গেছে।রিদম,তিথি,ইশানকে বিদায় ও জানিয়েছে।রিদমের মা অনেক কেঁদেছিলেন,দেশে তার কাছে থাকলো শুধু তানিয়া।বুকের দুটো ধনই একসাথে চলে গেলো বিলেত।
তিথির প্রথমবার যেতে কষ্ট লাগছিল এবার আর সে কষ্ট লাগেনি,তবে রিদমকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল এই বিদায়বেলার এফেক্ট তার উপর পড়েছে সব চাইতে বেশি।মা বাবা বুঝলেন তাদের ছাড়া যেতে বুঝি ওর কষ্ট হচ্ছে,কিন্তু নাহ,তার মন অন্য কিছু বলছিল।সে জানে এই যাওয়া অনেক দীর্ঘ হবে!
মা বলেছেন দু তিন বছর পর পর এসে দেখা করতে তিথি ইশানের সাথে।কিন্তু রিদম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যাচ্ছে সে ঠিক সেইসময়ে ফিরবে যে সময়ে তার ফেরা দরকার।

জাপানে পাড়ি জমানোর পর তিথি আর ইশান তাদের সংসারটাকে গুছিয়ে নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।রিদমের এডমিশন হয় তাদের বাসা থেকে অনেক দূরে।স্কুলটা অনেক নাম করা হওয়ায় ইশান সিদ্ধান্ত নেয় রিদমকে সেখানে ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিবে।রিদম এখন আর বাচ্চা নয় যে এত ভাবার কিছু আছে,তাছাড়া এ বয়স থেকেই তাকে শক্ত হতে হবে।সব জানতে হবে,শিখতে হবে।ঐ স্কুলে বোর্ডিং নেই বলেই ঝামেলাটা বেড়ে গেলো।
তার পরেও ইশান নিজ দায়িত্বে সবটা করে ওকে সেখানে ভর্তি করায়,তার পেছনে একমাত্র কারণ ছিল রিদমের সম্মতি।সে চেয়েছিল একা থাকতে।
রিদমকে একা ছেড়ে দিয়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিল তিথি আর ইশানের,কিন্তু তাদের তো এটা করতেই হতো।

সেইদিনটা ইশানের জন্য এত ব্যস্ততার একটা দিন ছিল যে সে বাসায় এসেই বিছানায় শুয়ে পড়েছিল।খাবার ও খায়নি।পরেরদিন সকাল সকাল তিথি প্লেটে করে কি যেন একটা এনে ইশানের বেডের সামনে টেবিলে রেখে চলে যায়।তিথির ডাক শুনে ইশান উঠে বসে,মনে পড়ে যায় আজ তার ফ্যাক্টরিতে যাবার কথা।তাই দেরি না করে দ্রুত উঠে বসে সে।এরপর পায়ে জুতোটা পরে দু কদম ফেলতেই তার চোখ গেলো টেবিলের উপর রাখা প্লেট টার উপর। সেটাতে প্রেগনেন্সি কিট রাখা।ইশান শুরুতে বুঝতে পারেনি এটা আসলে কি ছিল।সে চোখ ডলে ভাল করে ঘুরিয়ে দেখে এরপর তার হুশ আসলো এটা আসলে কি।
দুটো দাগ দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেছে।
পাশের রুম থেকে খিলখিল করা হাসি শোনা যাচ্ছে।ইশান পেছনে ফিরতেই তিথি দিলো এক দৌড়।

ইশান ওমনি বাহিরে এসে বলে,’গুড নিউজ জানিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?ধরা দিবিনা?’

তিথি হাসি আটকিয়ে দূরে থেকে বলে,’শেষ প্রতিশোধ এমন হবে তা ভেবেই হাসি পাচ্ছে অনেক,কি করি বলুন?’
——
হাসির ছটা দিয়ে কেটে গেছে পনেরোটা বছর।ইশান আর তিথির কোলজুড়ে এখন দুজন সন্তান।লেজিন ও ইকরা।
দুজন রাজকন্যা তাদের।তাদের স্কুল, তাদের লেখাপড়া, বিনোদন সব মিলিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে ইশান আর তিথির।
তানিয়ার সংসারে টানা এক বছর টক ঝাল লেগে থাকলেও দু বছরে পা রাখার পর মিষ্টির দেখা মিলেছে। তার একটি রাজকন্যা আর একটি রাজপুত্র ও আছে।
তার সেই রাজকন্যার নাম আবার মিষ্টি রাখা হয়েছে।আর রাজপুত্র সে তো সবার ছোট সদস্য। বয়স চার বছর, নাম তার ভুলু।সে সব ভুলে যায়।ডাক্তার বলেছে আস্তে আস্তে এ রোগ সেরে যাবে,ছোট কালে এমনটা হতেই পারে,এই টুকুন ছেলের কি এরিস্টটলের তত্ত্ব মনে থাকবার কথা?

ভুলুর ভাল নাম আদিত্য।আদর করে তাকে সবাই আদি বলে ডাকে।যাই হোক শুরু করা যাক ইশান আর তিথির সংসার থেকেই।
ইশান অফিসের কাজ হোল্ডে রেখে লেজিনকে আনতে ওর স্কুলে গেছে,ওর এখনই ছুটি হবে।বাহিরে গেটের কাছে দাঁড়িয়েই সে অপেক্ষা করছিল ঠিক ঐ সময়ে তার ফোনে কল আসে অফিস থেকে।
ব্রাঞ্চ ম্যানেজার জানায় সিনিয়র ম্যানেজার কাল থেকে অফিস আসছেনা,আজও আসেনি।
ইশান ঠিক আছে বলে অবসর সময়টাকে কাজে লাগাতে কল করে সিনিয়র ম্যানেজারকে।এই সিনিয়র ম্যানেজারই হলো রিদম।
সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে,গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে সে ইশানের ফ্যাক্টরিতে ভাল বেতনের চাকরি করছে।
রিদম ফোন ধরছেনা,তার ফোন বন্ধ,চারদিন আগে তার রিদমের সাথে কথা হয়েছিল,তখনও রিদমের কথায় মনে হয়নি সে ফোন বন্ধ করতে পারে, হঠাৎ কি এমন হলো যে ফোনই বন্ধ করে দিলো?
——–
রিদম বাংলাদেশে চলে এসেছে,তাকে একজনে খবর দিয়েছে আজ নাকি পান্নার বিয়ে।সে এসেই পান্নাদের বাসার সামনে হাজির হয়েছে।তাকে দেখে এখন কেউই চিনবেনা।
থ্রি কোয়াটার আর হাফ হাতা শার্ট পরা ছেলেটা এখন সাহেব হয়েছে,পরনে তার জিন্স আর টি শার্ট।হাতে ঝুলিয়ে রেখেছে ব্লেজার।আসার সময় কোনো ব্যাগও সে আনেনি।
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে।মনের ভেতর আগুন জ্বলছে তার।
বিদেশ থেকে কত টাকা খরচ করে সে পান্নার জন্য কার্গোতে পার্সেল পাঠিয়েছিল,যাতে গিফট ছিল আর লেখা ছিল ‘আমার জন্য অপেক্ষা করবা পান্তুয়া’

আর সেই মেয়ে কিনা আর কটা দিন অপেক্ষা করতে পারলোনা!এর জন্য এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে সে রিজেক্ট করে আসছিল!নাহ!এভাবে সে ঠকাতে পারেনা!
রিদম ভেতরে ঢুকে যায়,এরপর পান্নাদের বারান্দা আর সুপারি গাছটা দেখতে থাকে।
—–
‘আম্মু,গাঁদা ফুলের পলিথিনটা আমি ফ্রিজের উপরে রেখেছি, জিসান ভাইয়াকে বলো’

‘ইশ আমি শাড়ীটা যে পরলাম খুলতেই ভুলে গেছি কাজের চাপে,নতুন বউয়ের শাড়ী পরে দেখার শখ ছিল বলে পরেছি আর খোলার কথাই মনে থাকলোনা,বউ দেখলে আমার উপর খুব রাগ করবে’

এই বলে শাড়ীর আঁচলের উপর থেকে সেফটিপিন খুলতেই পেছন থেকে কেউ একজন জড়িয়ে ধরে মুখ চেপে ধরেই মুখে কিছু একটা বেঁধে দিয়ে রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে ফেললো।এটা রিদমই ছিল।
রিদমের চোখে আগুন জ্বলছে।।সে দরজা লাগিয়ে এক হাতে মেয়েটার গলা আর অন্য হাতে দুহাত একত্রে চেপে ধরে বললো,’এই রিদমের জন্য অপেক্ষা করলে মরে যাইতা তুমি?’

রিদম নাম শুনে মেয়েটার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।আজ বিয়ে হচ্ছে সেটা ঠিক হবে সেটা আসলে পিংকির,পান্নার নয়।রিদমকে যে খবর দিয়েছে সে ভুল খবর দিয়েছে,সে ভেবেছে এই বাড়ির মেয়ে মানেই পান্না,পিংকির কথা সে জানেনা,পিংকিকে চিনেও না।
পান্না চুপচাপ রিদমকে দেখছিল, বিদেশে থেকে সুন্দর হয়ে গেছে রিদম,আর কত যে লম্বা হয়ে গেছে সে!
পান্না মুগ্ধ হয়ে রিদমকে দেখেই যাচ্ছে,পান্নার শাড়ীর সেফটিপিন খোলা ছিল বলে ওর গায়ের থেকে আঁচল সরে যেতেই রিদম ওর হাত ছেড়ে অন্য দিকে ফিরে দাঁড়ায়,এরপর চোখের পানি মুছে বলে,’কি লাভ হলো এত অপেক্ষা করে?এই প্রতিদান পেলাম আমি?’

পান্না আঁচল ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে মুখের বাঁধনটা খোলে।তার খুশির হাসি থামছিলই না।
রিদম আবার পেছনে ঘুরে বলে,’এটা ঠিক করলেনা!’

ওমনি ওপাশ থেকে পিংকি দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললো,’পান্না দরজা খোল!আমার বিয়ের শাড়ীটা পাচ্ছিনা,তুই নিয়েছিস?যদি এখন তোর গায়ে দেখি তবে খুব খারাপ হয়ে যাবে!’

এ কথা শুনে রিদম যেন আকাশ থেকে পড়লো।পান্না মুচকি হাসি দিয়ে বলে,’না বুবু!পরি নাই।এই তো গুছিয়ে দিচ্ছি’

রিদম ওমনি ছুটে এসে পান্নাকে খুব শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে।যতটা শক্ত করে ধরলে তার পনেরো বছরের বাসনার অবসান ঘটবে ততটা শক্ত।
পান্নার মুখ ডুবেছিল রিদমের বুকে।পান্নার শরীর আগে যেমন তুলতুলে ছিল এখনও তাই।রিদমের ইচ্ছে করছিল তখনই ওকে বিয়ে করে কোলে তুলে নিয়ে আসতে আর সব ভালবাসা আজই ওকে বুঝিয়ে দিতে। পান্না যখন দেখলো পিংকি দরজাটাই ভেঙ্গে ফেলছে চেঁচামেচি করে, তখন সে রিদমকে নিজ থেকে সরানোর চেষ্টা করে ।কিন্তু রিদম ছাড়ার পাত্র নয়।সে পান্নাকে আরও শক্ত করে ধরে বললো,’ইংকি পিংকি,পংকি দূর হয়ে যাক,বিয়ে হয়ে যাক,বাচ্চা হয়ে যাক!আর আমার পান্তুয়ার বিয়ের সিরিয়াল শুরু করে যাক!’

চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৬২
আফনান লারা

পিংকিকে দরজা খুলে দেবার পর পিংকি সবার আগে নিজের শাড়ীটা ভাল ভাবে দেখে নিচ্ছে তাতে কোনো ছেদ কিংবা ত্রুটি আছে কিনা যা দিয়ে এখন পান্নাকে আচ্ছামতো বকা যাবে।কিন্তু নাহ,শাড়ী যেমন করে ছেলেপক্ষ পাঠিয়েছিল তেমনই আছে,রঙটা বেশ দারুণ।লাল জবা ফোটার আগে কলি অবস্থায় যে রঙটা থাকে,একেবারে সেই রঙের শাড়ী তারা পাঠিয়েছে।এটা অবশ্য পিংকির কথায় নয়।
পান্না বলেছিল এই রঙে পিংকিকে অসাধারণ লাগবে। পিংকির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পান্নার কথায় প্রাধান্য দেয়,তার কারণ পান্নাকে তাদের অনেক পছন্দ,এদিকে পিংকিকেও পছন্দ।অন্যদিকে তাদের আবার দুটো ছেলে অবিবাহিত।বড় ছেলের বিবাহ সম্পন্ন হলেও বাকি দুজন এখনও আবিয়াতি।তাই মেজোকে দিয়েই তারা নামলো।মনে মনে অবশ্য ভেবে রেখেছে,ছোট টার বউ হয়েই পান্না এ ঘরে আসবে।তাকে হাতছাড়া করা যাবেনা।
কানাঘুষোয় বাবা জানতে পারে পিংকির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পান্নাকেও তাদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চায়।তিনি জানতেন ইশানের প্রস্তাবের সেই ছেলের কথা। কিন্তু হঠাৎই মত বদলে ফেললেন।দুটো মেয়েকে চোখের সামনে দেখে রাখতে চান আর যতটা সময় তার কাছে বাকি আছে।আদরের পান্নাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিলে বছর বছরেও তার দেখা পাওয়া যাবেনা।তাই তিনিও মনে মনে রাজি।

পিংকি শাড়ীটা দেখা শেষ করে খেয়াল করলো পান্নার গাল দুটো লাল লাল হয়ে আছে।পিংকি ওমনি ওর গাল টিপে ধরে বললো,’কিরে কি হলো তোর?আমার ব্লাশ লাগিয়েছিস?’

‘না তো’

‘দেখি? ‘

পিংকি পান্নার গায়ের গন্ধ শুঁকে বললো,’কি রে!এত সুন্দর ঘ্রাণ আসছে কেন!উমমম এটা তো দেশি পারফিউম মনে হচ্ছেনা। কে দিলো তোকে বিদেশী পারফিউম? ‘

‘আহা বুবু,তৈরি হয়ে নাও না!দেরি হয়ে
যাচ্ছে।আমাকে নিয়ে ইনভেস্টিগেশন না করে নিজের কাজে মন দাও তো”

পিংকি ব্রু কুঁচকে শাড়ীটা তুলে চলে যায়।পান্না দম ফেলে ছুটে বারান্দায় এসে দেখে নিচে রিদমের সাথে একটা লোক কথা বলছে।মনে হয় রিদমকে চিনে ফেলেছে।
পান্না মিটমিট করে হাসছিল ওকে দেখে।
—–
‘তোর আদরের ছোট ভাই,কাউকে কিছু না বলে বাংলাদেশ চলে গেছে।ঐ টুকুন ছিল,এখান থেকে ওখানে একা যেতে পারতোনা।আর সে এখন একা একা ফ্লাইট ধরে দেশে পৌঁছে গেছে’

‘পৌঁছাবেই তো!পিংকির বিয়ে শুনলাম’

‘তো?রিদম তো পান্নাকে ভালবাসে,ওর কেবিনে পান্নার ছোটকালের ছবি দেখতে দেখতে আমি তিক্ত হয়ে ওর কেবিন চেঞ্জ করিয়েছি এক মাস হলো।’

‘বুঝেন নাই,সেই বলদ মনে করেছে হয়ত পান্নার বিয়ে’

‘ভেরি ইন্টারেস্টিং,আমাদের উচিত আগুনে তুষ ঢেলে দেয়া’

‘আপনার আর কাজ নেই?’

‘নেই তো তিথি, আপাতত কোনো ব্রিফিং নেই।হাতে ছুটি আছে।আওনের হাতে কাজটা সঁপে কদিনের জন্য সাপলুডো খেলে আসতে চাই,যাবি আমার সাথে?’

‘যেতে পারি,পান্নাকে দেখার ইচ্ছা করে।রিদম তো মনে হয় এই প্রথম দেখবে।এত গুলা বছরে আমরা গিয়ে গিয়ে ঘুরে আসলেও সেই গাধাকে একবারও নিতে পারিনি।সে পণ করেছিল গেলে চাকরি পেয়েই যাবে।কথাটা রেখেই ছেড়েছে।’
——
তানিয়া মাকে নিয়ে শপিং করতে এসেছে,পিংকির বৌভাতে পরার জন্য একটা শাড়ী কিনবে বলে।তার সব ওকেশানে নতুন শাড়ী লাগে।

‘ভাইয়া এটার দাম কত?’

‘এটা নিয়ে নিন ম্যাম,বিল পে হয়ে গেছে’

‘ওমা কে দিলো?রকিব?কিন্তু সে তো অফিসের কাজে কুষ্টিয়া গেছে।ওহ হো আমার কোনো গুপ্ত প্রেমিক আসলো নাকি?🙈’🐸

‘না ম্যাম,লোকটা আপনার ভাইয়ের বয়সী ছিল’

‘ভাইয়ের বয়সী!আমাকে কি আপনার আন্টি মনে হয়?আমার ভাই কি লোক হবে?আমার ভাই হবে পাঁচ বছরের শিশু,বুঝেছেন?’

‘তানিয়া চুপ করবি?তোর সিজারের পরে পেট যতটা বের হয়েছে,তার উপর তাড়াহুড়া করে বাসার জামা পরে এসেছিস।তোকে তো আমার চাইতেও বেশি বুড়া লাগছে দেখতে।’

দোকানদার মুখে হাত দিয়ে হাসছিল।

‘আপনারা হাসি বন্ধ করেন,নাহয় শাড়ী ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে চলে যাবো’
—-
শাড়ীটা প্যাকেট করে তানিয়া ওর মাকে নিয়ে শপিং মল থেকে বের হতেই দেখে একটা ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে,ড্রাইভার ওদের বসতে বলছে।

‘না ভাই,আমরা এরকম উড়ে এসে জুড়ে বসা ক্যাবে উঠিনা।আপনি অন্য লোক দেখেন।’

‘আরে উঠ না,কত দেরি হয়ে গেলো। ভুলুকে ডে-কেয়ার থেকে আনতে হবে’

‘ঠিক আছে চলো,অবশ্য আমাকে আর কিডন্যাপ করেই বা কি হবে।আমার কাছে তো কিছুই নাই’

দুজনেই গাড়ীতে উঠতে গিয়ে দেখলো আগে থেকে একজন বসে আছে মুখের সামনে খবরের কাগজ ধরে।
কি আর করবে চেপেচুপে বসলো দুজন।লোকটা আসলে রিদম ছিল।

‘মা দেখো,ছেলেটার চুল আমাদের রিদমের মতন কাট করা দেখো ‘

‘এত জোরে ফিসফিস করিস না,ড্রাইভার ও শুনছে’

“ওহ আচ্ছা,মা দেখো ছেলেটার হাতের আঙ্গুল ও রিদমের মতন চিকন চিকন’

‘তুই মাইকিং করা বন্ধ করবি?লোকটা কি ভাববে?’

‘আচ্ছা ভাইয়া আপনার মুখটা দেখতে পারি?’

‘সরি টুকু’

‘আচ্ছা’

তানিয়া আচ্ছা বলে ভাবতে থাকে,টুকু নামটা তার খুব পরিচিত । এতই পরিচিত যে!
ও মাই গড!

তানিয়া এক লাফে জড়িয়ে ধরে রিদমকে।এরপর কান্না করতে থাকে।মা তখনও কিছু বুঝতে পারলেন না।

‘কিরে?লোকটা কে?’

‘তোমার অকর্মার ঢেঁকি!’

এটা শুনে মাও জড়িয়ে ধরলেন কাঁদতে কাঁদতে’

ড্রাইভার লুকিং গ্লাসে এই অবিশ্বাস্য চিত্র দেখে আপলুত হয়ে বললেন,’কি আস্টচ্ছ!কি আস্টচ্ছ!’

তানিয়া কান্না থামিয়ে বলে,’আস্টচ্ছ না আশ্চর্য হবে!’
——-
‘ভাল আছেন? ‘

‘জ্বী’

‘আমার বউ না হয়েই এত ভাল আছেন?’

‘আপনার বউ না হলে আরও বেশি ভাল থাকবো।’

‘আচ্ছা পান্না আমাকে দিয়ে তোমার এত কি সমস্যা? ‘

‘যে ঘরে আমার বোন বউ হয়ে গেছে,সেই ঘরে আমাকেও যেতে হবে এমন তো কোনো বিধিবিধান নেই’

‘অবশ্যই আছে,কিরোরেট বিবাহ করিবো আমরা দুজন’

‘কিরোরেট বিবাহ কি আবার?সরোরেট শুনেছিলাম’

‘কিরোরেট মানে ভাবীর ছোট বোনকে বিবাহ’

‘মা দেখোনা,এইই লোকটা আমাকে জ্বালাচ্ছে’

পান্না বিরক্ত হয়ে চলে গেলো।এক পাগলের ভাত নাই আর নতুন পাগলের আমদানি!

‘ভাইয়া তোমার শালিকে পটানো আমার পক্ষে সম্ভব নাহ,এমন ভাবে কথা বলে যেন তার বিয়ে হয়ে গেছে,তাই চোখে মুখে সর্ষেফুল দেখছে।আর কোনো ছেলের প্রতি তার আগ্রহ কাজ করছেনা,করবেও না’

‘এত অধৈর্য্য হলে কি করে হবে সাবিদ?আমরা আছি তো।হয়ত সে লজ্জা পাচ্ছে’

পান্না গাল ফুলিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে হাতে বাটি নিয়ে সামনের দিকে চলছিল,মা বলেছে রুবি আন্টির বাসা থেকে কাঁচা হলুদ আনতে।কি কাজে যেন লাগবে।
সেটা নেয়ার জন্য পথ চলছিল পান্না হঠাৎ ওড়নায় টান লাগায় চেঁচিয়ে উঠে পান্না বলে,’আপনি এত বেয়াদব কেন? ছেসড়ার মতন পিছে পিছে ঘুরতে লজ্জা করেনা আপনার?’

এই বলে ওড়না ছাড়িয়ে পিছনে চেয়ে দেখলো রিদম দাঁড়িয়ে আছে’

‘আপনি?’

‘কাকে বললে এসব?কে বিরক্ত করে?’

‘নাহ কেউ না,’

‘বলো আমায়’

‘নাহ কেউ না।আপনি তানিয়া বুবুর সাথে বিয়েতে আসবেন না আজকে?বরপক্ষ তো এসে গেছে’

‘আসছিনা,আমার একটু কাজ আছে।তার আগে বলো কে বিরক্ত করে?’

‘কেউ না’

রিদম পান্নার কোমড়ে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে বলে,’আসলাম সবে,এখনই যাই যাই করছো?’

‘মানুষ দেখলে কি বলবে?’

‘বলবে ঐ দেখো রিদমের বউ যাচ্ছে,রিদমকে নিয়ে’

পান্না মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে।রিদম চলতে চলতে বলে,’যেই বিরক্ত করুক,অনুরক্ত করতে পারবেনা।বহুকাল আগে রিদম অনুরক্ত করে রেখে গেছে।’

‘খামোশ!!!!!’

পান্না আর রিদম থেমে গেছে।সামনে গিয়াস সাহেব দাঁড়িয়ে।
পান্নার চোখ কপালে,
রিদম ওর কোমড় থেকে হাত সরিয়ে সেও রোবট হয়ে আছে।মনে হয় মাটির তলার পা থুক্কু পায়ের তলার মাটি সরে গেছে।

‘উহঃ!চশমাটা কই!এই মেয়ে আমার চশমাটা খুঁজে দেবে?’

রিদম ফিসফিস করে বলে,’একি?আঙ্কেল তোমায় চেনেন না?’

‘বাবার চোখে ভাল দেখেন না দু বছর হলো,চশমা না থাকলে কিছুই দেখেন না’

রিদম দাঁত কেলিয়ে কাছে এসে গিয়াস সাহেবকে খপ করে ধরে চুমু একটা দিলো কপালে,এরপর চশমাটা তুলে ওনাকে পরিয়ে দিলো।

‘একি তুমি কে!বড় চেনা চেনা লাগছে।আচ্ছা এখানে তো একটা মেয়েও ছিল মনে হয়’

পান্না পালিয়েছে ততক্ষণে।

রিদম পান্নার ওড়না টান দিয়ে রেখে দিয়েছিল,মুচকি হাসি দিয়ে সে বললো,’নাহ তো!আমিই ছিলাম।এই যে আমার ওড়না’

‘এই ওড়নাটাও চেনা চেনা লাগছে।’

চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-৫৯+৬০

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫৯
আফনান লারা

তিথি ইশানের রুমে এসে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছিল ঠিক সেখানেই ছিল ইশানের একটা পাঞ্জাবি।
এটা ইশান বের করে রেখেছে বুয়াকে দিয়ে ধোয়ানোর জন্য।
এটা সে কয়েকবার পরেছে,তাই পাঞ্জাবিটা থেকে ওর গায়ের তীব্র মিষ্টি একটা পারফিউমের ঘ্রাণ আসছিল।
তিথি পাঞ্জাবিটা তুলে নিয়ে নাকের কাছে ধরে চোখ বন্ধ করে রাখে।তার মনে হলো ইশান ওর সামনেই আছে।মুখের হাসিটা তার আরও গাঢ় হলো।
ইশান ওকে ধরতে রুমে এসে দেখে সে পাঞ্জাবি জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে রেখেছে।তাই সে ওর কাছে এসে দৃশ্যটা প্রাণ ভরে দেখে চলেছে। তিথি যে ওকে ভালবাসলে সবটা দিয়েই বাসবে এই নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না ইশানের।তাই এত কিছুর পরেও সে তিথিকেই বউ করে এনেছে,এত বাধা বিপত্তির পরেও।
ইশান তিথির হাতটা ধরে টান দিয়ে ওকে কাছে নিয়ে আসে।তিথি আচমকা ইশানকে দেখে হাত থেকে পাঞ্জাবিটা ছেড়ে দিলো।

‘কি??আমার পাঞ্জাবিতে কি আছে?’

‘না তো,কিছুই না’

‘তাহলে ওরকম করে গন্ধ শুকার মানে কি বুঝায় বল,আমিও একটু বুঝি’

‘না দেখছিলাম বাজে গন্ধ আসে কিনা,বুয়ার দিক ও তো ভাবতে হবে।উনি যদি দেখে তার মালিকের পাঞ্জাবি থেকে এরকম দূর্গন্ধ আসে তাহলে কি ভাববে?পুরা কলোনি করবে এই কথা দিয়ে।জানেন?’

‘তাই না??’

ইশান এবার তিথির দুহাত চেপে ধরে বলে,”আবার বল তো,কি কি বলছিলি?আসলেই কি এরকম গন্ধ আসছে?’

‘না না,মজা করলাম,সত্যি।ছেড়ে দেন।আর বলবোনা’
——
দুই দফা পলাশীর যুদ্ধ শেষ করে বাবা মা ঘুমোতে যাওয়ার পর তানিয়া আর রকিব ও রুমে চলে আসে।
তানিয়া আগের মতই শুয়েছিল, রকিব বসে বসে তার ফোনে ফ্ল্যাটটির সব ছবি দেখছিল আবারও।কাল যেহেতু টাকা জমা দিবে তাই ভাল করে শিউর হয়ে তারপরই টাকা হস্তান্তর করবে।

সকালে খুব ভোরে তানিয়া উঠে যায়।রকিব তখন ঘুমাচ্ছিল,রকিবকে সে এ একটা মাসে প্রচণ্ড রকমের ভালবেসেছিল,কিন্তু ও যে এমন কিছু করবে তা সে ভাবতেও পারেনি।এখন সে নিজেকে ২ রাস্তার মুখে আবিষ্কার করেছে,কোনদিকে গেলে ভাল হবে তাই ভাবছে সে।বাবা তাকে একবার বলেওনি এ কথা।বাবার কথা কি বলবো!ইশান ভাইয়াই তো বলেনি।পুরো ফ্ল্যাটের টাকা ইশান ভাইয়ার দেয়ার কথা ছিল।
আমাকে না জানিয়ে এটা করে তারা অন্যায় করেছে।অনেক বড় অন্যায়।আমি মাফ করবোনা তাদের।আর রকিবকে তো কোনোদিন ও না।

তানিয়া এসব ভাবতে ভাবতেই রুম থেকে বেরিয়ে দেখে মা আর খালা রকিবের জন্য সকাল সকাল খিচুড়ির আয়োজন করছেন।

‘বুঝছো মতি,আমার এই মেয়ের জামাইটাও একেবারে ইশানের মতই ভাল,কম কথা বলে।’

‘ভাল আর কিসের,যৌতুক চেয়ে বসছে’

‘সেটা তো বুঝলাম,এত বড়লোক ছেলে,এগুলা তো চাইবেই’

‘আপা ইশান ও কিন্তু বড়লোক,রকিবের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পয়সা ওয়ালা।কই সে তো এক টাকাও চায় নাই,আরও গহনা শাড়ী দিয়ে তিথিকে মুড়িয়ে নিছিলো।রকিবরা এসব কি দিছে একবার নজর দিছেন?’

‘তাও ঠিক,তানিয়াকে যে নেকলেস টা দিছে ওটা একেবারে পাতলা।যাক ওসব আমরা চাইনা,তানিয়াও চায়না কিন্তু তারা যে এত দামী একটা কিছু চেয়ে বসলো এ কথা কি তানিয়ার জানার প্রয়োজন নেই?’

‘এখন জানালে,আপনার যে মেয়ে আপা!যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিবে’

‘কি যুদ্ধ বাঁধাবো খালা?’

এ কথা শুনে সবাই চুপ।মা হেসে কথাটাকে উড়িয়ে দিয়ে বললেন,’তুই এই পোশাকে থাকবি? কেমন বুড়া বেডির মতন লাগছে।যা এইসব বদলে গোসল করে সুন্দর একটা শাড়ী পরে রকিবের পাশে বসে থাক।

‘থাক! এত যত্নের কোনো কারণ আমি দেখছিনা তো’

‘ওমা আপা,আপনার মাইয়া কয় কি!নতুন জামাইকে নাকি যত্নের প্রয়োজন নাই।’

তানিয়ার আম্মু কাছে এসে ওর কান টেনে ধরে বললেন,’যা!যেটা বলছি ওটা কর।মানুষের কাছে হাসিরপাত্র বানাইস না আমাকে’
——
রকিব চোখ মেলে চশমা খুঁজতে থাকে।ঝাপসা ঝাপসা চোখে দেখে তার প্রিয়তমা ড্রেসিং টেবিলের কাছে গুন গুন করে গান গাইছে।গানটা তার পরিচিত,নতুন রিলিজ হয়েছে তবে ওর প্রিয়তমা যে লিরিক্সে গাইছে তা আসল গান নয়।সে গাইছিল,’যদি বিয়ে তোমায় কাঁদায়,তবে সংসারই কোথায় আর স্বামীই বা কোথায়’

রকিব উঠে বসে তাকায়।ঝাপসা চোখে গোলাপি রঙটাই বুঝতে পারলো আর তানিয়ার কালো চুল,এই দুইটা রঙ বুঝতে পারলেও ডিজাইন বোঝা মুশকিল হলো তার জন্য।তাই সে হাতিয়ে হাতিয়ে চশমা খুঁজতে ব্যস্ত এবার,
অনেক খোঁজার পর অবশেষে সে চশমা পেয়ে চোখে পরে দেখে এক নতুন তানিয়াকে।বিয়ের সাজেও তাকে এত সুন্দর লাগেনি,যতটা এখন লাগছে।তার ভেজা চুল দেখে রকিবের কাল রাতের কথা মনে পড়লো।সেও জানে কিছু হয় নাই,তানিয়াও জানে কিছু হয় নাই।কিন্তু সবাই জানে কিছু হইছে তাই হয়ত জোরপূর্বকই সে গোসল করে নিয়েছে।

তানিয়া গান গাইতে গাইতে পেছনে ফিরে দেখে রকিব বসে বসে ওকে দেখছে।তানিয়া এবার গান বন্ধ করে ওর কাছে এসে বলে,’আজকে সকালে জামাই বাজার করে দিয়ে সোজা আপনার বাসায় চলে যাবেন,আর হ্যাঁ!আমি কিন্তু যাচ্ছিনা’
—–
‘তিথি?’

‘হু’

‘উঠ,তোদের বাসায় যেতে হবে তো আমাদের।’

‘আমার শরীরটা ভাল নেই,আপনি যান বরং’

‘কেন ভাল নেই?দেখি,জ্বর?কই জ্বর তো নেই।তবে কিসের শরীর খারাপ?’

‘এমনি ভাল লাগছেনা,আপনি যান,গিয়ে ঘুরে আসুন।আমি ঘুমাই’

‘আচ্ছা তবে আমিও যাব না,তোকে একা রেখে যাওয়ার এতটাও দরকার পড়েনি।তুই ঘুমা আমি বাগান থেকে ঘুরে আসি,সকালে কি খাবি বল,বুয়াকে বলে যাই’

‘বেগুন ভাজি আর ইলিশ মাছ ভাজা’

‘ইলিশ মাছ আর তুই?’

‘হ্যাঁ,লাইফে ফার্স্ট টাইম ট্রাই করার ইচ্ছা জাগলো’

‘তবে তাই হবে মহারাণী’

এটা বলে ইশান ফোন নিয়ে বাগানে চলে আসে।তার আসলে তানিয়ার বাবার সাথে কথা আছে।রকিবদের ফ্ল্যাটের টাকা ট্রান্সফার করার আগে ওনার থেকে সিউর হয়ে নিতে হবে।তিথি এখনও জানেনা এসবের কথা।জানবেও না,সেও তার বোনের মতই।যৌতুকের কথা শুনলে হুলস্থুল করবে।

‘ইশান টাকা পাঠিওনা’

‘কেন?’

‘রকিব আমার কাছে এসে মাফ চাইলো,ও নাকি এসব জানতো না।এখন সে ফ্ল্যাট কিনলে নিজের টাকাতেই কিনবে,এবং সেটা আজকেই’

‘এটা তো খুব ভাল একটা নিউজ’

‘হ্যাঁ বাবা,ঠিক বললে।আমার এখন দুটো মেয়ে জামাইকে নিয়েই গর্ব হচ্ছে ভীষণ ‘
——-
রকিব নাস্তা খেতে বসে দেখে সবাই আসলেও তানিয়া আসেনি।মা তানিয়াকে টিভির সামনে থেকে টানতে টানতে এনে ওর পাশে বসালেন,ধমকালেন ওর এরকম ব্যবহারের জন্য।কিন্তু তানিয়াকে কেউ বোঝাতে পারেনা।সে পারেনা রকিবকে বাসা থেকে বের করে দেয়।
রকিব সব বুঝতে পারছে,তাই সে এসবে রাগ না করে আরও অনুতপ্ত। কারণ চঞ্চল সেই মেয়েটি যে তাকে খুব ভালবাসতো সে কিনা এখন এরকম আলগা আলগা থাকছে!

তানিয়া গাল ফুলিয়ে রেখে রকিবের পাশে বসে।তার ইচ্ছা করছে সবাইকে চিৎকার করে বলে দিতে এত আদর যত্নের কিছু নাই।এই লোকটা খারাপ!এর মতলব খারাপ!

ইশান বাসায় ফিরে এসে দেখে তিথি তখনও ঘুমায়।বুয়া বললো তার রান্না করা শেষ।ইশান সে কারণে বুয়াকে চলে যেতে বলে নিজে তিথির কাছে আসে।তিথির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আগেকার দিনগুলোর কথা ভাবতে থাকে।তিথিকে নিয়ে সবসময় ইশান এইসবই ভাবতো।তার বাড়ি হবে,গাড়ী হবে।তিথি তার বউ হবে।তাদের অনেকগুলো বাচ্চা হবে।সুন্দর একটা সংসার হবে।

তিথির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ইশানের কেমন যেন খটকা লাগলো।তিথির মুখটা চেয়ে দেখে সে ভাল করে।যেটার আন্দাজ করছে যদি সেটা হয় তবে খুব তাড়াতাড়ি তাদের জাপানে পাড়ি জমাতে হবে।
——-
রকিব বাজার করে দিয়ে চলে যাবার সময় তানিয়ার সাথে দেখা করতে আসে,তানিয়া নিজের রুমে বসে বসে ফোন টিপছিল। রকিব ওর কাছে এসে বালিশের তলা থেকে নিজের ফোন নিয়ে বলে,’আমি যাচ্ছি,বাসাটা আজকেই উদ্ভোধন করবো,তবে একা একা।যদি তোমার ইচ্ছা হয় তবে এসো। আমার অনেক ইচ্ছা তোমাকে নিয়ে নতুন বাসায় আলাদা সময় কাটাবো,একা একা।আমাকে মাফ না করো!অন্তত এক সাথে নতুন কিছুর শুরু তো করতে পারো!
বিশ্বাস করো!তোমার পারমিশন ছাড়া তোমায় আমি ছুঁবো না”
চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৬০
আফনান লারা

রকিব ফ্ল্যাট কিনে কিছু মোমবাতি,গোলাপফুল দিয়ে সাজিয়ে এরপর বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল আরও কিছু জিনিস কেনার জন্য,কিন্তু দরজা খুলতেই সে মা,বাবা,খালা,ফুফু সবাইকে দেখে অবাক হয়ে যায়।সবাই তাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে।মা বাবা মনে করেছেন রকিব ও তাদের সারপ্রাইজই দিতে এসেছিল নতুন বাসায়।

‘কিরে রকিব?তানিয়া কই?ওর বাবা মা কই?’

রকিব চুপ করে তাকিয়ে থাকে বাবা মায়ের দিকে।মা ফোন নিয়ে বললেন তানিয়াকে ডাকতে,কারণ তিনি মনে করছেন তানিয়ার পরিবারের টাকাতেই এই ফ্ল্যাট কেনা।তাই তো তার এত আদর আসছে।

রকিব জানায় তারা পরে আসবে।মা খুশি খুশি পুরো ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখে বললেন সে যেন তানিয়াকে নিয়ে আজকে এখানে থাকে।এই বলে সবাই চলে গেলো।রকিবের খারাপ লাগছে কারণ সে মা বাবার যৌতুক চাওয়ার কথা সবার আগে তানিয়ার থেকে জানলো।এটার মতন কষ্টের আর কিছু হয়না।

সবাই চলে যাবার পরে রকিব আরও কিছু সাজানোর জিনিসপাতি এনে ফ্ল্যাটটাকে যতটা পেরেছে রাঙিয়েছে।এরপর মেঝেতে বসে বসে ফোন টিপছিল,আর তানিয়ার অপেক্ষা করছিল।কেন জানি মনে হয় তানিয়া আজ আসবেনা।
রকিবকে এই মেঝের বিছানায় একাই ঘুমাতে হবে।
——
‘টুকু এবার বল আমার কি করা উচিত?বেডা মানুষ এরকম হয় কেন?সে যৌতুক নিয়ে বিয়ে করেছে এটা ভাবতেই আমার ইচ্ছা করে কাবিন নামা ছিঁড়ে ফেলি,আসলে সব বেডা খারাপ!’

তানিয়ার কথা শুনে ফোনের ওপাশ থেকে তিথি উঠে বসে।যৌতুকের কথা সে মাত্র জানলো।তার সামনেই ইশান বসে বসে ওর নুডুলসের বাটিতে ফু দিচ্ছে,ঠাণ্ডা হলেই খাওয়াবে।

তিথি ইশানের ঐ নিষ্পাপ চোখজোড়ারর দিকে চেয়ে থেকে বলে,’সব বেডা মানুষ খারাপ না রে টুকু।বুঝতে পারলে তারা দারুণ মানুষ। ‘

‘আমি হয়ত রকিবকে বুঝতেই পারি নাই।এখন কি করবো?আমাকে আজ যেতে বলেছে ‘

‘গিয়ে দেখ!ভাল না লাগলে চলে আসবি।কিন্তু এভাবে না যাওয়াটা ঠিক হবেনা’

কলটা রেখে তিথি ইশানের দিকে গম্ভীর চাহনিতে চেয়ে বলে,”আপনি যৌতুকের কথা জানতেন?’

ইশান নিশ্চুপ।

‘কি হলো?বলুন?’

‘জানতাম’

‘আমাকে বলার কি দরকার নাই?’

‘না নাই,তুই জানলে তানিয়াও জেনে যেতো’

‘এখন যে জেনে গেলাম আমরা দুজনেই?’

‘লাভ নেই,কারণ বিয়েটাও হয়ে গেছে আর রকিব ও যৌতুক নেয়নি’

‘সত্যিই?’

‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্য’
——–
তানিয়া রকিবের অপছন্দের টপস আর জিন্স পরে,ওর অপছন্দে চুল বেঁধে সেই ফ্ল্যাটে চলে আসে।এরপর কলিংবেলে চাপ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।রকিব যেন এটারই অপেক্ষায় ছিল।

‘তুমি এসে,,,,,’

‘সুন্দর লাগছেনা?’

‘একদম না’

‘নতুন বউকে অসুন্দর বলতে রুহু কাঁপে নাই আপনার মিঃ রকিব?’

‘নতুন বরের অপছন্দের পোশাক পরতে শরীর কাঁপে নাই তোমার মিসেস তানিয়া?’

‘না কাঁপে নাই,আমি ইচ্ছা করেই পরেছি।কোনো প্রবলেম?’

‘নাহ! প্রবলেম ছিল তবে তুমি এসেছো যখন তখন আর কোনো প্রবলেম হতেই পারেনা।এসো এসো’

রকিব ভেতরে আসার পথ দেখিয়ে দিলো।তানিয়া ভেতরে ঢুকে বলে,’ফার্নিচার নাই,কিছু নাই।এখানে পুরো রাত থাকবো কি ভাবে?’

‘আমার রুমকে থাকার মতন বানিয়ে নিয়েছি। চলো দেখাই’

রকিব তানিয়ার হাত ধরতে যেতেই তানিয়া হাতটা সরিয়ে বলে,’থাক,আমি নিজে নিজে হাঁটতে পারি’

রকিবের রুমে এসে সে তো অবাক।বাহিরে সদরঘাট আর ভিতরে ফিটফাট!
হা করে শুধু দেখেই যাচ্ছিল সে।
রকিব দেয়ালে হেলান দিয়ে দেখছিল সব।তানিয়া একটা গোলাপ হাতে নিয়ে বলে,’ডেকোরেশন সুন্দর হলো’

‘থ্যাংক ইউ’

তানিয়া এবার কোমড়ে হাত রেখে বলে,’তবে আমি যাই?আমার খিধে পেয়েছে।বাসায় গিয়ে বিরিয়ানি খাবো’

‘আমি বিরিয়ানি আনছি ‘

তানিয়া ব্রু কুঁচকে ধপাস করে মেঝেতে বিছানো বিছানায় বসে পড়ে।ওকে বসতে দেখে রকিব ফোন নিয়ে খাবার অর্ডার করে।

দুজনেইই বসে থাকে চুপচাপ।রকিব নিজের ল্যাপটপে গান ছাড়ে।
‘জারা জারা বেহেকতা হে’

তানিয়া নড়েচড়ে একটু সরে বসে।রকিব গানটা দেখছে মনযোগ দিয়ে,তানিয়া আড় চোখে দেখছিল। গানটা শেষ হয়ে অন্য গান শুরু হয়।
রকিব হাতটা নিয়ে তানিয়ার হাতের উপর রাখতেই তানিয়া রেগে গিয়ে বলে,’ওল্ড ফ্যাশন ছেলেদের মতন আগে হাত পরে ঠোঁট এসব শুরু করছেন কেন?’

রকিব তানিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে এরপর বলে,”কোনো ছেলে আগে হাত ধরেছিল ঠোঁট ধরার আশায়?’

‘হ্যাঁ,তারপর থাপ্পড় খেয়েছিল’

রকিব আস্তে করে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। খাবার এসে যায়।দুজনে খাবারটা খেয়েও নেয় চুপচাপ।তানিয়া এবার বললো,’তবে আমি যাই?ঘুম আসছে’

রকিব মাথা নাড়ায়।তানিয়া এবার রেগে গিয়ে বলে,’আজব!আমাকে থাকতে বলবেন না?’

‘এই বিছানায় ঘুমাতে হয়ত তোমার কষ্ট হবে’

‘না হবেনা’

এটা শুনে রকিব ওকে বিছানা খালি করে দেয়।তানিয়া ও চুপচাপ শুয়ে পড়ে।
রকিব লাইট বন্ধ করে সেও এক পাশে শোয়।

‘ভাল আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ‘

‘আর কিছু বলবেনা?’

‘গুড নাইট’

‘আর কিছু না?’

‘আর কি?আসেন আবার বিয়ে করি’

‘না সেটা না,বলতে চাইছি গল্প টাইপের কিছু’

‘আপনার আম্মু আপনাকে রাজা রাণীর কাহিনী বলে ঘুম পাড়াইতো?’

‘আগে’

‘তাহলে আমি ও শুনাই।এক ছিল রাজা এক ছিল রাণী।তারপর তারা ঘুরতে যায় বনে।এরপর সিংহ ওদের দুটোকে চিবিয়ে খেয়ে নেয়।কাহিনী শেষ’

‘তুমি খুব রুড’

‘রুড হবো না তো কি হবো?একটু বলবেন?আমার কেমন রিয়েক্ট করা উচিত যৌতুকের কথা শুনে’
——-
সকাল সকাল রিদম নিজের ব্যাগ গুছাচ্ছিল,এতদিন দুলাভাই বলছিলেন তাকে নেয়ার সঠিক সময় এটা না।কিন্তু এখন বলছেন যেতেই হবে।
রিদমের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে পান্নাকে নিয়ে।ওর কথা সব চাইতে বেশি মনে পড়বে।
কি আর করার,সয়ং দুলাভাইর আদেশ,তাছাড়া জাপানে গিয়ে পড়াশুনা স্টার্ট করা,ক্যারিয়ারে ফোকাস করা তার জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দাঁড়াবে।তাই সময়টাকে কাজে লাগাতেই হবে যে করে হোক।

ইশান তিথিকে জানায় যেহেতু তানিয়া আর রকিবের বিয়েটা শেষ হলো তাহলে তাদের আর এখানে থাকতে হবেনা,অনেক কাজ পড়ে আছে।
তিথি জানতে চাইলো কি কাজ কিন্তু ইশান তার জবাব দেয়নি।কল আসায় চলে গেছে।

তিথি সেইসময় বাসায় কল দিয়ে রিদমকে বলাতেই রিদম তড়িগড়ি করে তৈরি হয়ে নিচ্ছে সেইসময়ে পান্না আসে ওদের বাসায়।
পান্নাকে দেখে রিদমের আম্মু মিষ্টি দিলেন খাওয়ার জন্য।পান্না চামচ দিয়ে মিষ্টি কাটছিল আর দেখছিল রিদম এমন ভাবে মিষ্টিটার দিকে চেয়ে আছে যেন সে ওভাবেই পান্নাকে নয়ত অন্য কাউকে কাটবে।

‘কি হলো ভাইয়া?’

‘তোমার হবু জামাই ভাল আছে?’

এ কথা শুনে পান্না ফিক করে হেসে মিষ্টি খেতে থাকে।রিদমের খুব রাগ হলো।সে আর একটু সময়ও অপেক্ষা না করে পান্নার সামনে থেকে চলে গেলো।
পান্না এর মানে মতলব কিছুই বুঝলোনা।সে আসলে বুঝতেই পারলোনা এখানে হচ্ছিল টা কি!

রিদম বাবার রুমে এসে তার ফোন হাতে নেয়,এরপর ইশানের নাম্বার বের করে কল দেয়

‘হ্যালো বাবা বলুন,কেমন আছেন?’

‘আমি রিদম বলছি ইশান ভাইয়া’

‘তুমি?কি হলো?সব ঠিক আছে তো?’

‘ভাইয়া আমরা কবে যাব?’

‘এই তো পরশুদিন’

‘ঠিক আছে’

লাইনটা কাটা গেলো।এতদিন রিদমের গাল ফুলা ছিল সে যাবে বলে আর এখন সে নিজ থেকেই তারিখটা জানতে চাইছে,যেন তার জাপান যাবার ইচ্ছে সবার চাইতে বেশি।
ফোন রেখে রিদম আবারও ড্রয়িং রুমে এসে দেখে পান্না নেই।রিদম কিছুই আর করলোনা।গাল ফুলিয়ে তার বেডে বসে থাকলো।

তখন ভেতরের রুম থেকে মা এসে রিদমের হাতে একটা বক্স দিয়ে বললেন,’পান্না দিয়ে গেলো,তোকে দেয়ার জন্য’

‘সে দিতে পারে না?’

‘তার বাবা বাসার নিচে এসেছিলেন ওকে নিতে’

রিদম বক্সটা খুলে দেখে ভেতরে একটা ঘড়ি। সম্ভবত এলার্ম ঘড়ি।আর একটা চিরকুট।তাতে লেখা সময়ের মূল্য অপরিসীম।

রিদম ঘড়িটাও ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে।সময়ের গুরুত্ব সে অবশ্যই দিবে।তার জন্যই তো বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে।কিন্তু যে কাজের জন্য এত কিছু করবে সেটা থাকবে তো!
চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-৫৭+৫৮

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫৭
আফনান লারা
.
ইশানের ইচ্ছা ছিল না রিদমকে এত তাড়াতাড়ি জাপান নিয়ে যাওয়ার।কারণ সে চেয়েছিল রিদমের এসএসসিটা অন্তত শেষ করে তারপর যাবে।কিন্তু তার একটা বিশেষ কারণে সে রিদমকে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়,এর মানেটা শুধু তিথি জানে।আর কেউ না।

তিথি ইশানের দেয়া কালো শাড়ীটা পরেই তানিয়ার বৌভাতের অনুষ্ঠানে আসে।আজ ইশান আর তিথিকে এতটাই ভাল লাগছিল যে বর বউকে ছেড়ে বেশিরভাগ মানুষই তাদের খেয়াল করছিল।কারণ তিথির সাথে মিলিয়ে ইশান কালো রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছে।তিথি বসে বসে একটা খালি রোস্ট খাচ্ছিল,কারণ রোস্ট তার খুব প্রিয়,খাবার সে আগেই খেয়ে নিয়েছে এখন সাগরানা দেখে ওখান থেকে একটা রোস্ট নিয়ে এক পাশে বসে বসে খাচ্ছে সে।ওর পাশেই রকিবের চাচাতো বোন টুম্পা বসে খাচ্ছিল,টুম্পা সেই কখন থেকে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে।সে তখনও জানেনা ছেলেটা আসলে কে হয় রকিবের।এত ভাল লাগছিল তার,একেবারে ক্রাশ খেয়ে গেছে সে ইশানের উপর।ইশান রকিবের সাথে একটা কথা নিয়ে আলাপ করছিল তার এদিকে খেয়াল ছিল না।
টুম্পা তার পাশে বসা মেয়েটিকে বলে,’এই দেখ না,ছেলেটা কি সুন্দর তাই না?’

এ কথা শুনে হাঁড় চিবোতে চিবোতে তিথিও তাকায় সেদিকে।
দেখে ওমা এ তো তার বিয়ে করা বর।টুম্পা বলে,’চল না একটু কথা বলি,দেখ তো আমার লিপস্টিক ঠিক আছে কিনা?’

তিথি এবার মেয়েটাকে দেখে,মোটামুটি দেখতে ভাল!তিথি হা করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।মেয়েটার টানা টানা চোখ তার উপরে সুন্দর করে আই লাইনার লাগানোই বিয়ে বাড়ির সুন্দরী লাগছিল তাকে।তিথির একবারের জন্য মনে হলো ইশান একে দেখলে ক্রাশ খাবে।
তাও ইশানকে একবার বাজিয়ে দেখার ইচ্ছা হলো তিথির।
সে হাত থেকে মুরগীর হাঁড় রেখে দিয়ে বলে,’আপু!আপু?’

‘কি?’

‘এই ছেলেটাকে তো আমি চিনি’

‘সত্যি?আপনার কে হয়?’

‘আমার ছোট ভাইয়ের ছোট বোনের জামাইর শালার বেয়াইন তামিয়ার বড় ভাইয়া হয়’

‘ওহ তাই!আচ্ছা প্লিজ প্লিজ আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন?’

‘কেন নয়!গিয়ে শুধু বলবে যে উনাকে তুমি পছন্দ করো,ডেইটে যেতে চাও।সিম্পল,উনি তো মেয়ে খুঁজতেছে বিয়ে করার জন্য।মেয়ে পেলে জাপান নিয়ে যাবে’

মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলে ‘তাই?ঠিক আছে দাঁড়াও’

এই বলে মেয়েটা ইতিউতি আর না ভেবে রকিবের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।ইশান আচমকা মেয়েটিকে দেখে রকিবের সাথে কথা বন্ধ করে দেয়।

‘কিরে টুম্পা?কিছু বলবি?খাবার খেয়েছিস’

‘খেয়েছি রকিব ভাইয়া,আসলে উনার সাথে একটু কথা বলতাম’

‘ইশানের সাথে?তুই ওকে চিনিস?’

‘না ঐ যে আমার পাশে একটা আপু বসা ছিল,উনি চিনে।উনার নাকি ছোট ভাইয়ের ছোট বোনের জামাইর শালার বেয়াইনের বড় ভাইয়া হয়’

‘কিহ!!ওয়েট ওয়েট!ছোট ভাইয়ের ছোট বোনের হাসবেন্ডের বেয়াইনের বড় ভাই!তার মানে তিথির হাসবেন্ড!ওহ হো টুম্পা,সামান্য লজিক বুঝলিনা।ইশান হলো তিথির হাসবেন্ড,মানে তোর ভাবীর বড় বোনের জামাই।বুঝেছিস?’

‘কিহ?উনি ম্যারিড?’

‘হ্যাঁ রে পাগলি!’

‘এই যে ভাইয়া,এইদিকে তাকান,এত লজ্জা পাবার নাটক করতে হবেনা।আপনি যখন একজন বিবাহিত পুরুষ তখন এত সেজেগুজে ফিট ফাট হয়ে আসার কি দরকার ছিল?কাকে ইম্প্রেস করার জন্য এত গরজিয়াস সেজে এসেছেন?আমার মতো মেয়েদের ইমোশান নিয়ে খেলতে ভাল লাগে আপনার?’

তিথি যখন দেখলো ঐ মেয়েটা ইশানকে বকেই যাচ্ছে তখন সে এসে সামনে দাঁড়ায় এরপর বলে,’বাসায় তো আমাকে ধরে উত্তমমধ্যম দেন,এখানে কিছু করতে পারেন না?পারবেন কিভাবে!প্রতিশোধ তো শুধু তিথির সাথেই নেয়া যায়।আর এই মেয়ে!তুমি দেখো!ভাল করে দেখো, আমার হাসবেন্ডের হাতে মোটা করে এঙ্গেজমেন্টের রিং।ছেলেরা সচরাচর রিং পরেনা।এই কমন সেন্স তোমার নাই?আর সুন্দর ছেলেরা সাজার দরকার নাই।একশোটাকার গামছা পরলেও তাদের রনভীর কাপুর লাগবে।বুঝছো!আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম আমার গুণধর স্বামী রুপসী রমনী দেখে কেমন রিয়েকশান দেয়।কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম আস্ত গাধা একটাকে বিয়ে করেছি।সে শুধু কাহিনী দেখে যাচ্ছে!’

ইশান এবার রেগে গেলো তিথির উপর।সে ওদের সামনে থেকে তিথিকে বাহিরে নিয়ে আসে।

‘কি হলো?এমন করলেন কেন?’

‘তোর কি কমন সেন্স নাই?এরকম করে মানুষ?মেয়েটা তোকে কি ভাবলো?ছেঁসড়া ছাড়া কিছুই না।এরকম ফান মানুষ হাই স্কুলে থাকতে করে।মাস্টার্স কিংবা অনার্স লেভেলের মেয়েরা এসব করেনা।সব চাইতে বড় কথা হলো তুই আরাফাত বাড়ির বউ,একমাত্র বউ।রকিব তোকে কি ভাবলো সেটা বুঝতে পেরেছিস?’

‘আশ্চর্য, আমি কি এমন অপরাধ করে ফেললাম যে আপনি আমায় এরকম বকছেন!’

‘শুরু থেকে দেখছি,ম্যাচিউরিটি বলতে তোর কাছে কিছু নাই,কিচ্ছু না।আমার সাথে মজা কর প্রবলেম নাই,কিন্তু অন্য মানুষকে নিয়ে মজা করবি কেন?তানিয়ার হাসবেন্ড হয় রাকিব,তোর এই সব পাগলামিতে সে হয়ত কিছু বলেনি কিন্তু মনে মনে কতটা নিচ ভাবছে জানিস?বড় বোন হয়ে এসব করা কি শোভা পায়?’

তিথি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
ঐদিকে রকিব লক্ষ করেছে তানিয়া ওর সাথে ভালভাবে কথাই বলছেনা।রকিব স্টেজে এসে ওর পাশে বসে বলে,”তানিয়া?কি হলো তোমার?’

‘কি হবে?’

‘কথা বলছোনা ঠিক মতন।কিছু কি হয়েছে?’

তানিয়া কিছু বলেনা,নিজের শাড়ীর কুচি হাত দিয়ে গুনতে থাকে বসে বসে।
অনুষ্ঠান শেষ হবার পর রকিব আর তানিয়া বাসায় ফিরে আসে।রিদম আর ওর কিছু কাজিনরা মিলে তানিয়ার রুমটাকে সাজিয়ে রেখেছিল। রকিব আজ মহাখুশি।তানিয়াকে বোঝার চেষ্টা করবে,তার সাথে ভাল একটা সময় কাটবে আজকের রাতটাতে।

সে রুমে ঢুকেই দেখে ফুলে ভরিয়ে রাখা রুমটা,যেন আজ তাদের আবারও বাসর।
সে হেসে হেসে ভেতরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে তানিয়ার দিকে তাকায়।তানিয়া গাল ফুলিয়ে রেখে হাতের চুড়ি খুলছিল।
রকিব ওর কাছে এসে কাঁধে তার ঠোঁটজোড়া ছোঁয়ায়।এরপর তানিয়ার কাঁধের উপর থেকে ওর শাড়ীর আঁচলের সেফটিপিন টা খুলতে শুরু করতেই তানিয়া ওর দিকে ফিরে তাকায়।রকিব কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে বলে,’সরি আসলে শুরুতেই এমনটা!!”

‘ইটস ওকে!”

তানিয়া আবারও ঘুরে হাতের চুড়ি খুলতে থাকে।রকিব বিছানায় বসে ওর অপেক্ষা করতে থাকলো এবার।দশ মিনিট পার হয়ে যাবার পরেও যখন তানিয়া আসছিল না তখন রকিব বললো,’তোমার হাতের চুড়ি খোলা কি শেষ হবেনা?’

‘হবে,কেন বলুন তো?’

রকিব চট করে উঠে দাঁড়ায়।তানিয়া তখনও হাতের চুড়ি খুলছিল।রকিব ওর খুব কাছে ঘেঁষে ওর পিঠে নাক ডুবাতেই তানিয়া ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায়।যেন তাকে জন্তু ধরেছে।

রকিব ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছুটা গম্ভীর গলায় বলে,’আমি জানতে চাই তোমার এরকম ব্যবহারের কারণ কি?আমরা দুজনেই বিবাহিত। তবে আমাকে তোমার কাছে আসতে দিচ্ছো না কেন?কি অপরাধ আমার?’

‘কি অপরাধ?নিজেকে প্রশ্ন করুন।প্রশ্ন করুন আপনার ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কেন লাগবে?ইউ নো হোয়াট?আমি আপনাকে চিনতেই পারি নাই!আমি বেকুবের মতন আপনার সাথে সেই ফ্ল্যাট দেখতে গিয়েছি যার টাকা আমার বাবা দিবে,সরি সরি।বাবা দিবেনা,বাবাকে দিয়ে দেওয়ানো হবে।
আমার কি দোষ বলতে পারবেন?আমি টুকুর চেয়ে কম ফর্সা বলে?টুকুর চেয়ে কম মোটা বলে?শুকনা বলে?আমার তো মনে হয় টুকু আপনার বউ হলেও আপনারা একই যৌতুক চাইতেন।আপনাকে আমি আপনার পরিবার থেকে আলাদা মনে করতাম।আমি মনে করতাম অন্তত আপনি তাদের মতন না,আপনি আমাকে বুঝবেন।কিন্তু নাহ!সব এক ঘাটের মাঝি।এখন আমার আপনার সাথে একই রুমে বাসর ঘরের নামের এইসব অনুষ্ঠান পালন করতে ঘৃনা লাগে।আপনি একটা কাপুরুষ!যদি এটা আগে জানতাম তবে কখনওই আমি কবুল বলতাম না,সই করতাম না জীবনের সেই সবচাইতে দামী কাগজে!’

রকিব চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো।তানিয়া এবার খোঁপার সেফটিপিন খুলতে থাকে বসে বসে।আর কোনো কথা বলেনা।
ফ্ল্যাট টা রকিব নিজের টাকায় কিনবে বলে ঠিক করেছিল,টাকাও ব্যাংকে জমা আছে,কিন্তু তখনই মা বেঁকে বসলেন।তিনি বললেন টাকা গুলো ফিউচারের জন্য সেভিংসে রাখতে আর এই ফ্ল্যাট তানিয়ার বাবা গিফট করবেন।রকিব কিছুতেই মানতে চায়নি,কিন্তু মা বললেন ওনারা নাকি জোর করেছেন।কিন্তু এই সত্যটা রকিব আসলেই জানতোনা।’

চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫৮
আফনান লারা

তানিয়া চেঞ্জ করে একটা বাসার জামা পরে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়েছে।রকিব তখনও খাটের অন্যপাশে আগের মতই বসা ছিল।তানিয়া তখন শেষবার একটা কথা বলে।সে বলে পরশু রকিব যেন একাই চলে যায়,সে রকিবের সাথে যাবেনা।
রকিব চুপ করে কথাটা শুনে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

ঐদিকে তিথি ইশানের সাথেই তার বাসায় উঠেছে।ইশান তাকে যেভাবে বকেছিল সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত সে ইশানের সাথে কোনো কথা বলেনি,ইশানও বলেনি।দুইজনেই চুপ করে পুরোটা সময় ছিল।
বাসায় আসার পর ইশান ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখে তিথি রুমে নেই, তিথির যে মাথার তার ছিঁড়া এটা ইশান জানে তাই সে আগে থেকেই সদর দরজা লক করে রেখেছে।তাহলে গেলো কোথায়? দোষ নিজেই করবে আবার রাগটাও নিজেই দেখাবে।

তিথি তামিয়ার রুমে বসে আছে,তামিয়াও নেই।সেও তার মায়ের সাথে গ্রামে গেছে। তামিয়ার রুমে ওদের কাপল পিক দেখছিল তিথি।কত খুশি মনে হচ্ছে দুজনকে।ওদের এরকম খুশি দেখে তার চোখে পানি এসে যায়।আচ্ছা হাসান ভাই ও কি তামিয়া আপুকে এরকম বকা ঝকা করে?যদি তাই করে তবে আপু কিরকম রিয়েক্ট করে?
এই ভেবে তিথি কাঁদতে থাকলো।কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ভিজে গেছে তার।হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সে ইশানের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছিল ঐ সময়ে নিজের কোলে কারোর মাথার স্পর্শ পেয়ে সে কান্না থামিয়ে তাকিয়ে দেখে ইশান ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।

তিথি রাগের কারণে কিছু বললোনা,ধীরে ধীরে নিজেই সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু ইশান তাকে সরতে দিলোনা,সে আরও চেপে ধরে তিথিকে।

‘কি বুঝাতে চাইছেন আপনি?’

‘এটাই যে এই কোলটা আমার মাথা রাখার ব্যাক্তিগত জায়গা’

‘নাহ,তা নয়।যদি তাই হতো তবে এই কোলের মানুষটিকে অনেক যত্নে রাখতেন।অপমান অবহেলা করতেন না’

ইশান উঠে বসে বলে,’তোর দোষ ছিল বলেই ঝাড়ি খেয়েছিস। আমি এমনি এমনি কাউকে কিছু বলিনা’

তিথি এবার আরও রেগে গিয়ে বিছানা থেকে নেমে চলে যায় হনহনিয়ে।
——–
তানিয়া একা বিছানায় শুয়ে থাকার সময় রুমের দরজা খোলা খেয়াল করে উঠে বসে।হাই তুলতে তুলতে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে সাড়ে বারোটা বাজে।রকিব এত ভাব কেন দেখাচ্ছে!
তাই সে বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বের হতেই দেখে ড্রয়িংয়ে রকিব বসে বসে টিভিতে খেলা দেখছে।

তানিয়া রেগে গিয়ে বলে,’এরকম নাটক দেখিয়ে সবাইকে বুঝাতে চান আমি আপনাকে কাছে আসতে দেইনা?’

রকিব সাউন্ড কমিয়ে বলে,’পুরুষ মানুষ রাত জেগে খেলা দেখবে,এটাই কি স্বাভাবিক না?’

‘নাহ,বিয়ের পরেরদিন কেউ রাত জেগে খেলা দেখেনা’

‘তবে আর কি করবো বলো?বউ তো প্রেম প্রেম খেলা খেলতে দিচ্ছেনা তাই অন্যের খেলা দেখছি।আমি অবলা পুরুষ জাতি কিনা!অজীবন স্ত্রী শাসন চলবে।আমার তো সবে দুইদিন হলো।’

তানিয়া এগিয়ে এসে টিভিটা অফ করে দিয়ে বলে,’এসব করে লাভ নেই।আমার মন থেকে আপনার সেই বাজে রুপটা কোনোদিনই সরাতে পারবেন না,আজীবনের জন্য কালার হয়ে গেছেন।এসব করে আমাকে আপনি আপনার বাসাতেও নিতে পারবেন না’

‘আমি জানি কি করলে তুমি বাসায় ফিরবে।সেটাই করবো,তোমায় এত ভাবতে হবেনা’

এটা বলে রকিব রুমে চলে যায়।তানিয়ার মনে ভয় জাগলো,রকিব আবার তার সাথে জোরজবরদস্তি কিছু করবে না তো?
ভয়ে ভয়ে সে টেবিলের উপর থেকে কাঁটাচামচ তুলে চুপিচুপি রুমে প্রবেশ করে।রকিব ওয়াশরুমে ছিল।তানিয়া কাঁটাচামচ টা নিয়ে বালিশের তলায় লুকাবে নাকি কোথায় লুকাবে তাই পরিকল্পনা করছিল সেই সময়ে রকিবের হাত তার কোমড়ে স্পর্শ পেতেই তানিয়া পেছনে মুড়ে কাঁটাচামাচ দিয়ে রকিবের হাতে আঘাত করে।

‘আআআআহহহহ!!এটা কি করছো!’

‘আপনাকে না বলছি আমাকে এসব আদর দেখাবেন না!লজ্জা করেনা আপনার?’

‘হাত মুছার জন্য গামছা নিতাম আমি,তুমি তো গামছা কোমড়ে বেঁধে রেখে ঘুরছো।উফ! দিলে তো হাতটা কেটে!’
——
পান্না তাদের বাসার ছাদে বসে রিদমের দেয়া সেই মালাটিকে অত্যন্ত যত্নের সাথে গেঁথে চলেছে।রুমে করলে পিংকি দেখে নিতো তাই তো তার এইখানে আসা।
মালাটা পুরো গেঁথে সেটাকে ওড়নার সাথে লুকিয়ে নিচে চলে আসে সে।রিদম চলে যাবে বলে ওর জন্য বাদামের বিসকিট যেগুলা মা বানায় সেগুলা এক বক্স আলাদা করে রেখেছে।ও চলে যাবার সময় দিয়ে দিবে বলে।

ইশান পুনরায় তিথির কাছে এসে ওর হাতটা ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয় এরপর বলে,’যদি তুমি বলো তবে ভুলে যাব তোমার সব দোষ,আমি জানি যত দোষ সবে নন্দঘোষ😜’

তিথি অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।ইশান ওকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে রেখে বলে,’তুই জানিস না তোকে আমি কতটা চাই,কতটা ভালবাসি।যদি জানতি তবে আমার বকা শুনে নিজের দোষটাকে বুঝতি,তা না করে উল্টে রাগ দেখাচ্ছিস।আমি কি তোর খারাপ চাই?’

তিথি চুপ করে ইশানের বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে।ওর গায়ের গন্ধটা তার দারুণ লাগছে।
তিথিকে চোখ বুজে থাকতে দেখে ইশান ওর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।এরপর বলে,’আচ্ছা আর কখনও বকবোনা,কারণ আমি জানি তুই আর এই ভুল করবিনা’

তিথি ওমনি মাথাটা উঠিয়ে বলে,’করবো! একশতবার আমি সেই আগের ভুল করবো’

এটা বলে সে এক ছুট লাগালো ইশানকে ছেড়ে অন্য রুমে।
——-
রকিব একা একা বসে হাতে মলম লাগাচ্ছে,মলমটা অবশ্য তানিয়াই এনে দিয়েছিল,কিন্তু সে লাগিয়ে দিবেনা কারণ সে রকিবকে ঘৃনা করে।

‘আমার জমানো টাকা গুলোই কাল সেই ফ্ল্যাটের মালিকের কাছে জমা দিতে যাবো,কাল বৃহস্পতিবার।ঐ লোক কাল সন্ধ্যায় দেশের বাড়ি চলে যাবে।তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’

‘এখন এসব করে লাভ আছে?’

তানিয়া বিছানায় হেলান দিয়ে বসা ছিল।তানিয়ার এমন কথায় রকিব হাতটাকে নাড়াতে নাড়াতে বলে,’লাভ আছে,নিজের টাকার বাসস্থল ‘

‘আমাকে বলছেন কেন? ‘

‘কারণ তুমিও আমার সাথে সেই ফ্ল্যাটে উঠবে’

‘বিয়ের পর ছেলেরা বউ ভক্ত হয়ে যায় তা ঠিক তবে এতটা ভক্ত ভাল না।ক্ষতিকর!আপনার ইমোশনাল মা এইসব জানলে উল্টো সিধে কিছু একটা করে বসবেন।পরে দোষটা আমার ঘাড়ে এসেই পড়বে’

‘তা হবেনা,মাকে আমি মানিয়ে নিবো। তুমি শুধু আমার সাথে যাবে কিনা তা বলো’

‘না যাব না।আর কিছু?’

রকিব মলমটার ছিপি আটকে উঠে দাঁড়ায়,এরপর বলে,’তোমাদের রান্নাঘরে চা পাতা,চিনি কোথায় আছে তা দেখিয়ে দিবে?’

তানিয়া চট করে কাঁথা টেনে শুয়ে ঘুমানোর ভান ধরে থাকে।
রকিব মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায়।

তানিয়া অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পরেও তার ঘুম আসছিল না বলে সে উঠে বসে।কাঁথা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে সে দেখতে যায় রকিব করছে টা কি।
বাহিরে বের হতেই রকিবের বুকের সাথে ধাক্কা লাগে ওর।রকিব হাতে চায়ের কাপটা নিয়ে বলে ‘আস্তে আস্তে,সাবধানে।আর একটু হলে চা পড়তো’

‘এর মাঝে বানিয়েও ফেললেন?’

‘না আসলে আমার শাশুড়ি বানিয়ে দিলো’

‘কিহ!আপনি এত রাতে মাকে এসব জানিয়েছেন?’

‘না, আসলে উনি পানি খেতে উঠে আমাকে চা বানাতে দেখে উনিই বানিয়ে দিয়েছেন’

রকিব কথা শেষ করার আগেই তানিয়ার আম্মু পেছন থেকে এসে বললেন,’এটা কেমন কথা তানিয়া?তুই রকিবকে দিয়ে চা বানাইছিস?মাথা কি পুরাই নষ্ট হয়ে গেছে তোর?নতুর জামাইকে দিয়ে মানুষ এত রাতে কাজ করায়?তোর এইসব স্বভাব আর কোনোদিন ভাল হবেনা বুঝি?’

তানিয়া চোখ বড় বড় করে রকিবকে দেখছিল,তখন রকিব বলে,’না মা ও তো মাত্র জাগছে।আমি তো ওরে একবারও বলিনি চা বানাই দিতে।একা একাই গেছিলাম ‘

‘তাও ওর দোষ। জামাইর ঘুম নাই,সে কিভাবে ঘুমায়?আমার জামাই,আমাদের বিবাহিত জীবনের সাতাশটা বছর ধরে এখন অবধি না ঘুমালে আমি ঘুমাইনা,আর তুই বিয়ের প্রথমেই এসব শুরু করছিস!’

সেইসময় তানিয়ার আব্বু হাই তুলতে তুলতে এসে বললেন,’কোথায় যেন মিথ্যা কথার ভাষণ শুনলাম?’

‘তোমার কাছে আমার কথা মিথ্যা মনে হলো?’

‘আজকেও তো আমি এসে দেখি খাটে তুমি চিটপটাং হয়ে ঘুমাচ্ছো।তারপর তোমাকে সরিয়ে আমায় ঘুমাতে হয়েছে আর এখানে এসে বলো আমার আগে তুমি ঘুমাও না।আসলে কি জানো?তুমি যেরকম তোমার মেয়েও হয়েছে সেরকম।জামাইর কোনো কদর নাই,নিজের কদরই বোঝে’

রকিব মাথা নাড়িয়ে বলে,’আব্বু ঠিক বলেছেন’

‘চুপ শা…..’

তানিয়া মুখে হাত দিয়ে ফেললো।ওর আম্মু তখন দাঁত কেলিয়ে বলে,’আমি বলতে চাইছিলাম চুপ করো শান্ত ছেলে!! বড়রা কথা বলছে তো।তোমার কথা বলতে হবেনা”

চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-৫৫+৫৬

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫৫
আফনান লারা

তানিয়ার সাথে বোন বা নানুদের যাওয়ার নিয়ম।তানিয়ার নানু নেই,এদিকে তিথি যেতে পারবেনা,ইশান দিবেনা ওকে।তাই সিদ্ধান্ত হলো পান্না যাবে।গিয়াস সাহেব নিজেই বলেছেন যাতে পান্নাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
পান্না যেতে চাইছিল না,তাও কি আর করার বাবার আদেশ,তানিয়াও চাইছে সে যাতে ওর সঙ্গে আসে।তানিয়া পান্নার মন খারাপ দেখে গাড়ীতে বসে বলে,’বাবা রিদমকে বলো আমার সাথে আসতে,ও মনে হয় বেশি ইমোশনাল হয়ে গেছে।ওকেও নিয়ে যাবো তাহলে ওর মনটা ভাল থাকবে’

রকিবের মা সামনের সিটে বসে ছিলেন তিনি বিড়বিড় করে বললেন,’যত্তসব ঢং!পারছেনা গুষ্টিশুদ্ধ সকলকে নিয়ে শশুর বাড়ি যাবে!যেন আমাদের বাসা ফাইভ স্টার হোটেল পাইছে!

‘আন্টি সত্যিই বলছেন?তাহলে তিথি আপু আর ইশান ভাইয়াকেও নেই?’

রকিবের মা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন,ঐ সময় রিদম কারের জানালা দিয়ে এসে বলে,’আন্টি আপনি পিছনের গাড়ীতে যাবেন?এই গাড়ীতে আমি টুকুর সাথে বসবো ড্রাইভারের পাশের সিটে,আর পান্না তো টুকুর পাশে বসেছে,জায়গা নেই’

‘এহ!আমার ছেলের গাড়ী।আমি কেন আরেক গাড়ীতে যাবো?আমি এই পিচ্চি মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ঢের বসতে পারবো’

এটা বলে তিনি উঠে এসে তানিয়ার পাশে বসে পান্নাকে কোলে নিলেন।
——-
ইশান তিথিকে নিয়ে তার বাসায় ফিরছে,বাসা খালি জেনে সে ঠিক করে তিথির সাথে আলাদা সময় কাটাবে।তাই আজ আর তিথিকে সেন্টার থেকে বাবার বাড়িতে যেতে দিলোনা সে।

‘হঠাৎ বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?কোনো প্ল্যান আছে?’

‘তা আছে,কিন্তু বলা যাবেনা’

তিথি আড় চোখে তাকায়,ইশানকে সুবিধা ঠেকছেনা,এদিকে কিছু করার ও নাই।তার যা কূল আছে সব ইশানকে ঘিরেই।ওকে ইগনর করে কোথাও ঠাঁই পাবেনা সে।সে কারণে চুপচাপ গাড়ীতে বসে থাকাটাই শ্রেয়।

ইশানের বাসায় ফেরার পর তিথির আবারও মনে পড়ে যায় এ বাসায় তার পরার মতন কিচ্চু নাই।
সে মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে থাকে আধ ঘন্টা।ইশান ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে একা একা তার স্পেশাল নতুন লঞ্চ হওয়া নুডুলস বানাচ্ছে দুজনের জন্য।তিথি সোফায় শুয়ে শুয়ে বলে,’আন্টির কোনো শাড়ী পরতে পারি আমি?’

‘নাহ’

‘কেন?’

‘আমার মায়ের একটা রোগ আছে,ওনার জিনিস অন্য কেউ পরলে সেটা আর তিনি ইউজ করেন না।তোকে যে ওনার একটা শাড়ী দিয়েও দিবো তার ও উপায় নাই।মা নতুন আনা শাড়ী পরতে পারেন না,তার রাতে ঘুম হয়না।নরম কোমল কামড় যেগুলা সেগুলাই উনি পরেন।’

‘তোহ?কি করবো আমি?আপনি নাহয় ওনাকে কোমল কাপড় একটা এনে দিয়েন’

‘তা হবেনা কারণ মায়ের জন্য সেই কোমল কাপড়গুলা যে তাঁতি তৈরি করে তিনি গত হয়েছেন।তার বংশে এখন তার মেজো ছেলে ঐ কাপড় বুনে।কিন্তু তার একটা শাড়ী বানাতে ১মাসের বেশি সময় লাগে।সে কারণে তাকে দু মাস আগে জানিয়ে দিতে হয় যে মায়ের জন্য শাড়ী লাগবে’

‘এখন কি করবো আমি?’

‘আমার শার্টের অভাব?’

‘আপনার শার্ট পরবো?রিয়েলি?ওদিনের মতন বকবেন না তো?’

ইশান হাসি দিয়ে কাজ করতে থাকে চুপচাপ।
——–
‘মা আমার খুব ঘুম আসছে,আর কত মিষ্টি খাওয়াইবা?’

রকিবের কথা শুনে খালা বললেন,’দেখ রে বনু!তোর ছেলে বউকে একা পাওয়ার জন্য ঘুমের ভান ধরছে কেমন!”

‘হ্যাঁ তাই তো দেখছি,বউকে দিলে তখন আর তার কোনো ঘুম পাবেনা’

রকিব চশমা ঠিক করে বসে থাকলো। তানিয়া ওর চোখে এক রাশ ঘুমের ক্লান্তি দেখে বললো,’আন্টি উনি যাক ঘুমাইতে,আমি নাহয় আপনার এই কাজগুলা করছি বসে বসে।উনি না থাকলে তো সমস্যা নাই,আমাকেই তো থাকতে হবে’

রকিব দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে,সে ঘুমের নাটক করছিল যাতে সবাই ওদের ছাড়ে আর তারা বাসর ঘরটা উপভোগ করে।

‘এখনই এত দরদ লাগবেনা,বিয়ে দুইজনকে দিয়ে হয়,অনুষ্ঠান ও দুইজনকে দিয়েই হয়।দুুজনে বসে থাকো, রকিব তেঁতুলের জুস খাবি?’

‘না নাহ,এই তো আমার ঘুম পাচ্ছেনা,আমি বেশ আছি’

পান্নাকে রকিবের খালাতো বোনদের সাথে এক রুমে শুতে দেয়া হলো,আর রিদম রকিবের খালুর সাথে ঘুমাতে গেছেন।অবশেষে রকিব আর তানিয়াকে রুমে যাবার পারমিশনটা দেয়া হয়।

রকিব খুব এক্সাইটেড ছিল,খুশি তার আর ধরছিল না।সে আস্তে করে দরজা লাগিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে তানিয়া এক এক করে গয়না গাটি খুলছে আর একটা একদিকে ছুঁড়ছে।

‘আরে আরে করছো কি!আমি খুলবো তো”

এটা শুনে তানিয়া চোখ বড় করে পেছনে তাকিয়ে বলে,’কিরকম অসভ্যর মতন কথা বললেন!আপনি খুলবেন মানে?’

‘না মানে গয়না গুলো আমি খুলে দিবো,তোমার তো একা একা করতে কষ্ট লাগার কথা’

‘ওহ! না থাক।আমিই পারবো।গয়না খুলতে একটা সেটিসফেকশান কাজ করে!আপনি খুলে দিলে সেই সেটিসফেকশানটা আসবেনা’

রকিব শরবতের গ্লাস নিয়ে পুরো গ্লাসটা খালি করে চেয়ারে বসে।তানিয়া সব গয়না খুলে বলে,’মাগো মা!আমাকে মুখেশ আম্বানির বেয়াইন বানাই রাখছিল!যেন হিন্দি সিরিয়ালের বউ গুলার মতন!
এবার এই শাড়ীটা কেমনে খুলবো!যে সেফটিপিন লাগাইছে ঐ পার্লারের মেয়েটা।থাক! যা হবার তা কাল সকালে দেখা যাবে।আমি বরং ঘুমাই’

এটা বলে তানিয়া ধপাস করে ফুলে সাজানো বিছানায় শুয়ে পড়ে।

‘একি!এটা কি হলো।তানিয়া?শুনছো?ঘুমালে?হোয়াট দ্যা হেল!বিয়ে করেছি বাসর রাতের এই অবস্থা দেখার জন্য?তানিয়া?উঠো!’

‘আরে উঠবোনা এখন, বললাম না সেফটিপিন কাল সকালে খুলবো?এখন আর আমার শক্তি নেই।ঘুমিয়ে নিই,সকালে এনার্জি পাবো সেফটিপিন খোলার’

‘খুলিওনা থাক,উঠে তো বসবা একটু।আজকে আমাদের বাসর রাত,কত প্রতিক্ষিত রাত এটা সেটা জানো?’

‘জানবোনা কেন! আজ কয়েকদিন ধরে দাদি,মামি রা আমার মাথা খেয়েছে বাসর ঘরের সিনেমার কাহিনী বলতে বলতে’

‘তোহ!তুমি এখন সেই সিনেমা রি-ক্রিয়েট করবানা?’

‘নাহ!আমি যে করবোনা সেটা কি ওনারা দেখবে?না জানবে?আপনার উপর আমার বিশ্বাস আছে।আপনি সিওর এগুলা বলবেন না কাউকে। ‘
—–
পিংকি বাসার ফেরার পর থেকে শুয়ে শুয়ে কান্না করছে।পান্না আর রিদম যে এক সাথে তানিয়ার শশুর বাড়ি গেছে এটা নিয়ে সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।
গিয়াস সাহেব ওকে কাঁদতে দেখে ভাবলেন পিংকি হয়ত পান্নার বিয়ে ঠিক হবার কথা জেনেছে তাই কাঁদছে,ওনার বেশ খারাপ লাগলো।আসলেই বড় মেয়ের আগে ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে ব্যাপারটা একেবারে বেমানান লাগে।
উনি নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করে বললেন,’মা রে!এভাবে কাঁদিস না।তোকে যে আমি কত ভালবেসে বড় করেছি,কখনও তোকে কাঁদতে দিই নাই।সেই তুই এভাবে অঝরে কেঁদে চলেছিস।আমার না ভীষণ খারাপ লাগছে।চিন্তা করিস না মা,পান্নার জন্য যেমন ছেলের প্রস্তাব এসেছে,তোর এর চেয়ে ভাল একটা আসবে ‘

এ কথা শুনে পিংকি কান্না বন্ধ করে চোখ মুছে পেছনে তাকায়,এরপর বলে,’বিয়ের প্রস্তাব?পান্নার জন্য?’

‘হ্যাঁ রে,ওর খুব ভাল একটা ছেলের সাথে বিয়ের পাকা কথা বলেছি আমি ইশানের সাথে।ছেলেটা জাপানে পড়াশুনা করে’

‘ওমা তাই নাকি! ‘

পিংকি খুব খুশি হলো।কারণ তার মনে হলো রিদমকে নিয়ে আর কোনো চিন্তা তার নাই
——-
রকিব বসে বসে ঘড়ির কাঁটা দেখছে।বারোটা বাজছে সেই কবেই তাও বারোটা দশ এখনও বাজছেনা,সময় এত ধীরে কেন চলছে!
প্রকৃতি তাকে বোনাস সময় দিছে বাসর রাত উপলক্ষে কিন্তু তার বউ সব কিছুতে পানি ঢেলে দিলো।
তানিয়া উপুড় হয়ে শাড়ী পেঁচিয়ে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে,তার কোনো খবর নাই কিছুর।

‘তানিয়া একটু উঠোই না!একটু গল্প করো তাও তো দিনটা স্মরণীয় করে রাখতে পারবো’

‘যা বেডা বেদ্দপ!কইছিনা দশ টাকার বেশি একটা টাকাও দিতাম না! আমার টাকা মারি কি তুমি বিল্ডিং বানাইবা!’

‘মানে?কাকে কি বলছো?’

তানিয়া ঘুমে থেকে রিকশওয়ালা মামাকে ধুয়ে দিলো ভাল করে,এদিকে তার নতুন বরের এই রাতটা স্মরণীয় হয়ে গেলো নতুন বউয়ের গালি খেয়ে
চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫৬
আফনান লারা

তিথি ইশানের শার্টের খোঁজে ওর আলমারিটা খুলতেই একটা ঝুলন্ত প্যাকেটের দেখা পেলো।এই প্যাকেট যে তার জন্যই রাখা তা নিশ্চিত করার জন্য সে প্যাকেটের বাহিরে ভালভাবে দেখে এবার ভেতরটা দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠে।ধীরে সুস্থে প্যাকেটটা খুলতেই দেখতে পায় কালো রঙের তুঁতির কাজ করা একটা শাড়ী,চিকচিক করছিল ওর হাতে।এমনিতেও তিথির কালো রঙটা অনেক বেশি প্রিয় তার উপর যদি এরকম ঝকমকে শাড়ী হয় তাহলে তো আর কথাই নেই।
তিথি বুঝতে পারলো ইশান ওর জন্যই শাড়ীটা রেখেছে।
সে আর দেরি না করে দ্রুত শাড়ীটা পরে ফেলে।
ইশান আসলে শাড়ীটা রেখেছিল কাল বৌভাতে পরার জন্য। কিন্তু তিথি তো এত ধৈর্য্য ধরার মেয়ে নয়।সে শাড়ীটা পরে নিয়ে ইশানকে দেখাতে চলে আসে।ইশান নুডুলসের বাটি নিয়ে এদিকেই আসছিল।
আচমকা কালো শাড়ীটাতে তিথি এসে হাজির ওর সামনে।ইশান তো অবাক হয়ে যায় এই দৃশ্য দেখে।তিথি যে এখনইই শাড়ীটা পরবে তা সে ভাবতেও পারেনি।

‘কি?কেমন লাগছে?’

‘পোড়া লাল মরিচের মতন’

‘আবার ফান?সিরিয়াসলি বলুন না’

‘হুম, শাড়ীটা যেহেতু আমার পছন্দ করা তার মানে সুন্দর তো হবেই’

‘ আমাকেওও তো আপনি পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন’

‘তাহলে বুঝে নে উত্তর কি হবে?’

তিথি মুচকি হাসি দিয়ে ইশানকে জড়িয়ে ধরে এরপর বলে,’আমার প্রিয় রঙ টাও মনে রেখে দিছেন? ‘

‘বাটিগুলো পড়ে যাবে,রোমান্টিক হবার একটা সময় থাকে।এখন সেই সময় পার হয়ে গেছে’

‘কই পার হয়েছে?সবে তো রাত দেড়টা বাজে’

‘এখন ঘুমানোর সময়’

এই বলে ইশান তিথিকে নুডুলস খেতে বসিয়ে দিলো।
———-
রকিবের মা এসে দরজা ধাক্কাচ্ছেন,সকাল সাড়ে নয়টা বাজে অথচ নতুন বউ কিংবা বর কারোর দেখা মিলে নাই।

‘রকিব দরজা খোল!এত দেরি করে তো তুই নবজাতক কালেও উঠিসনি।আর আজ!’

‘আপা বুঝেন না কেন,কাল বাসর রাত গেছে।’

‘তো গেছে তো কি হইছে?সকালেও কি বাসর সকাল?’

রকিব চশমা ঠিক করতে করতে এসে দরজা খোলে।তানিয়া তখনও ঘুমাচ্ছিল।রকিবের মা ভেতরে ঢুকে দেখলেন তানিয়া লম্বা হয়ে শুয়ে আছে,গায়ের শাড়ীটাও বদলায়নি।তবে যেমনি কাল সেজেছিল এখনও সেরকমই আছে।রকিবের মা কিছু একটা আঁচ করতে পেরে ওর কাছে গিয়ে জোরে জোরে ওর নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন।
‘এই যে নবাবজাদি! উঠেন!’

‘মা প্লিজ!আজ আমার টিউশান নাই,একটু ঘুমাতে দাও’

‘রকিব আমাকে শরবতের গ্লাস টা দে তো’

‘কেন? ‘

‘ সেটা তোর জানার প্রয়োজন নেই,দিতে বলছি দে’

রকিব গ্লাসটা এনে দিতেই আন্টি পুরো গ্লাসের শরবত তানিয়ার মুখে ঢেলে দিলেন।তানিয়া তখনও ঘুমাচ্ছিল,শরবত ঢালার পর সে বললো,’উমমম হেব্বি মজা তো!তবে নোনতা কেন?কোন ছাগলে শরবতে নুন দেয়?ঐ খবিশদের আমার একেবারে ভাল লাগেনা’

‘সেই খবিশ তোমার শাশুড়ি লাগে!’

রকিব তানিয়ার পিঠে হাত দিয়ে ওকে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো।তানিয়া এবার চোখ মেলে রকিবের মাকে দেখে বলে,’আন্টি আপনি এখানে?ওহ সকাল হই গেছে?সরি সরি!আমি তো এলার্ম দিছিলাম বাজলোনা কেন?ওমা ঘড়িতে তো মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। আমি দশটার এলার্ম দিছিলাম। কিছু কি হইছে নাকি?’

‘কিহ!নতুন বউ দশটায় উঠে?’

‘তো কয়টায় উঠে?’

‘রকিব তোর বউকে ঠিক কর নাহয় আজ রফাদফা হই যাবে’

রকিব তানিয়াকে টেনে নামিয়ে বললো,’ও সারা রাত ঘুমায়নি,ওর মাথা ব্যাথা ছিল মা।এই তো এখনই রেডি হয়ে আসবে’

আন্টি কিছু না বলেই হনহনিয়ে চলে গেলেন।

‘তানিয়া?কি হয়েছে তোমার?এরকম কেন করছো?’

‘আমার ক্লান্তি থাকলে এরকম হয়।এই রোগের নাম ক্লান্তিমিয়া রোগ’

‘ফাজলামি বন্ধ করে রেডি হয়ে আসো যাও’

‘এরকম দেমাগ দেখাচ্ছেন কেন?ও আচ্ছা বাসর রাতে আদর সোহাগ করিনি বলি?দাদু ঠিকই বলেছে’

‘কি বলেছে?’

‘বেডা মানুষকে রাতে আদর করতে না দিলে পরেরদিন সকালে তারা হুদাই মেজাজ দেখায়।দোষ না থাকলেও ক্যাচ ক্যাচ করে’
——–
পান্না এক কোণায় বসে পিঠা খাচ্ছে।আজকে সকালের নাস্তা পিঠা ছিল।রিদম তখনও ঘুমে।পিঠা খেয়ে সে রিদমকে দেখতে যেতে চাইলেও পিংকির কথা মনে পড়ায় আর গেলোনা।চুপ করে যেখানে একটু জায়গা দেখছে ওখানেই বসে থাকছে।
তার মন টিকছেনা,কেউ তার বয়সী নাই যে তার সাথে একটু কথা বলবে।রিদম বললে তাও তার সময় টা কাটতো।

রিদম তখনই ঘুম থেকে উঠে এদিকটায় এসে পান্নাকে দেখে বলে,’টুকু কই?’

‘জানিনা,এখনওও দেখলাম না’

‘তুমি খেয়েছো?’

‘হ্যাঁ’

রিদম মাথা নাড়িয়ে তানিয়াকে খুঁজতে চলে যায়।তানিয়া টিয়া রঙের শাড়ী পরে গয়না গাটি পরছিল সেসময় রিদম এসে বলে,’টুকু তোমার ব্যাগটা খুলো তো’

‘কেন রে?’

‘আমি তোমার গয়নার বাক্সে আমার একটা জিনিস রেখেছিলাম,সেটা এখন লাগবে ‘

তানিয়া ব্যাগটা দেখিয়ে দেয় ওকে।রিদম নিচে বসে ব্যাগ খুলে তানিয়ার গয়নার বাক্স থেকে পান্নার জন্য আনা ব্রেসলেট টা নিয়ে নেয় তারপর চলে যাওয়া ধরতেই তানিয়া ওকে ধরে ফেলে বলে,’এত যে বন্ধুত্ব গাঢ় করছিস,জাপানে গেলে মনে পড়বেনা?’

‘যাব বলেই গাঢ় করছি,যেন শেষ অবধি ফ্রেন্ডশিপ বজায় থাকে’
—–
‘আপা সব মেন্যু তো বললাম,তাও কেন জানি মনে হয় কিছু একটা বাদ গেছে গা!সেটা কি!’

রকিবের মা আর খালা বৌভাতের মেন্যু নিয়ে আলোচনা করছিলেন।তারা সেন্টারে খাওয়াবেন না,বাসার ছাদে খাওয়াবেন।

পান্না ওনাদের কথা শুনছিল,তখন সে এগিয়ে এসে বলে,’চিংড়ি মাছ বাদ গেছে’

‘আরে হ্যাঁ তাই তো!পিচ্চি মেয়েটা ঠিক ধরেছে।আপা চিংড়িও তো লাগবে’

পান্না মুচকি হাসছিল ঐ সময়ে রিদম ওকে ফিসফিস করে ডাকে।নিজের নাম শুনে পান্না পেছনে তাকাতেই দেখে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রিদম ওকে ডাকছে।

‘কি হয়েছে ভাইয়া?’

রিদম পান্নার হাত ধরে বাসার বাহিরে নিয়ে আসে।এরপর দম ফেলে বলে,’আন্টি দেখলে কত কথা বলবে তাই এখানে আসলাম।এই নাও ধরো’

‘এটা কার?’

‘আমি তোমার জন্য এনেছিলাম পিকনিক থেকে আসার সময়’

পান্না ব্রেসলেট টার দিকে চেয়ে থেকে তার মনে পড়ে পিংকি ওকে অনেক কথা শুনিয়েছিল রিদমের উপহার নিয়ে তাই সে বলে এটা নিবেনা।

‘কেন?এটা নিলে কি হবে?’

‘আপনি এটা অন্য কাউকে দিয়ে দিন।আমার লাগবেনা’

‘তোমার লাগবেনা?’

‘না’

রিদমের খুব রাগ হলো।সে পান্নার সামনেই ব্রেসলেটটা ছিঁড়ে ফেলে চলে গেলো বাসার ভেতর।
এ প্রথম পান্না রিদমের এই রুপটা দেখেছে।
রিদম চলে যেতেই পান্না মুক্তা গুলা কুড়িয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়।পিংকির ভয়েই সে এটা নিতে চাইছিল না,এটা যদি রিদম জানতো তাহলে এরকম রাগ দেখাতোনা।
——-
রকিব তানিয়াকে নিয়ে বের হয়ে বলে,’সবাইকে সালাম দিবা,কাউকে বাদ দিবানা।এখানে সবাই মুরব্বি ‘

‘ওকে!’

তানিয়া সোফার রুমে এসে লাজুক সুরে বলে,’আসসালামু আলাইকুম সবাইকে’

রকিব মাথায় হাত দিয়ে ফেলে। রকিবের মা তো রেগে আগুন,যেন লাভা উপচে পড়লো রুমে।তিনি রাগে কটমট করছিলেন ঐ সময়ে।রকিব তানিয়াকে ধীরে ধীরে বলতে থাকে সবাইকে আলাদা করে সালাম দিতে।

‘ওকে’

‘আসসালামু আলাইকুম আপনাকে খালা,আসসালামু আলাইকুম আপনাকে খালু,আসসালামু আলাইকুম আপনাকে চাচা,আসসালামু আলাইকুম আপনাকে চাচি,আসসালামু আলাইকুম আপনাকে জেঠা,আসসালামু আলাইকুম আপনাকে জেঠি😎’

‘থামো তানিয়া ‘

‘যাক বাবা,আপনি তো বললেন সবাইকে আলাদা করে দিতে’

‘রকিব তোর বউকে ঠিক কর নাহয় আজ খুব খারাপ হই যাবে।’

‘তানিয়া তুমি যদি আর একবার দুষ্টামি করছো তো!’

‘তো?আপনি যদি আর একবার আমাকে বকছেন তো আজ রাতেও ঘুমাই যাবো জলদি’

রকিবের মুখটা শুকনা পাতার মতন হয়ে গেলো।সে আর কিছু বলছেনা।তানিয়ার খুব জোর হাসি আসছিল তাও সে হাসিটাকে আটকে রাখে।সে এরকম টা করছে কারণ কাল বিয়ের পরে সে শুনতে পেয়েছে রকিবের মা যৌতুক চেয়েছেন ইনিয়েবিনিয়ে। তাই তানিয়া এরকম করছে কালকের পর থেকে।বিষয়টা তার হজম হয়নি,সে মানতে পারছেনা এরকম বংশের মানুষ হয়ে কি করে এই যুগে এসে যৌতুক চাইতে পারে।এতদিন আলাপ চারিতা করেও সে মানুষগুলোকে ভালভাবে চিনতেই পারেনি।
চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫২
আফনান লারা

গায়ে হলুদ শেষে তানিয়া পরিশ্রান্ত শরীরে এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ে।ঘুমে চোখ জোড়া খুলতেই পারছিল না সে।পান্না ওখানেই বসে বসে জানালা দিয়ে বাহিরের ঝিলিক বাতি দেখছিল।তানিয়াকে ওভাবে এসে শুয়ে পড়তে দেখে সে কাছে এসে ওকে ভালভাবে পরোক করে নেয়।হলুদের সাজটাও সে তোলেনি।তখন ছাদে গিয়ে তানিয়াকে ভাল করে দেখতে পারেনি পান্না।বড় জোর ৫মিনিটের জন্য থেকেছিল ওখানে।তানিয়াকে সুন্দর লাগছে বলে পান্না মুচকি হাসি দেয়,এরপর রুমের খোলা দরজা দেখে ওদিকে আসে সে।এখন কেউ আসবেনা বলে সে বের হয় রুম থেকে। রিদম গায়ের পাঞ্জাবি খুলে গামছা গায়ে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে।সম্ভবত ভিতরে বাবা।

‘দরজা খোলো বাবা!আমি গোসল করবো।ঘামে চুলের ভেতরে ঘামাচি হয়ে গেছে।সাবান দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে সব উঠাইতে হবে।দরজা খোলো বাবা!’

‘আরে আর দশ মিনিট অপেক্ষা কর।আমারও সেম অবস্থা,মাথায় শেম্পু দিচ্ছি’

‘তোমার রুমের ওয়াশরুমের কি হয়েছে বাবা?’

‘ওটাতে তোর মা মনে হয় কাঁথা বালিশ নিয়ে ঘুমাচ্ছে’

‘আজিব!’

রিদম গামছা দিয়ে মুখ মুছে পেছনে তাকাতেই দেখে পান্না ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
লজ্জায় লাল হয়ে রিদম গামছা দিয়ে গা ঢেকে বলে,’তুমি এখানে?’

‘নাহ আসলে রুমে থাকতে থাকতে ভাল লাগছিল না।তিথি আপুর রুমে আমি ওয়াশরুম দেখেছি,ওখানে গিয়েও তো করতে পারেন’

‘নাহ,ওখানে ইশান ভাইয়া গোসল করে।বুঝিনা আজ এত গোসল করছে কেন সবাই!অবশ্য আমিও তো গোসল করতেছি!’

পান্না হাসি দিয়ে সোফার রুমে গিয়ে টিভিটা চালু করে বসে।
তারপর কার্টুন দেখতে থাকে।
——-
ইশান গোসল করছে কারণ তিথি ওর মুখের সাথে সাথে গলার সাইডেও হলুদ লাগিয়েছিল,গায়ে কিছু লেগে থাকলে গোসল না করা অবধি ওর ভাল লাগেনা,তাই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে সে।তখন থেকে তিথিকে সে এখনও দেখেনি,মেয়েটা গেলো কোথায়!মায়ের কথায় আবার রাগ করেনি তো?
মাথার চুল মুছে তোয়ালেটা রেখে ইশান বাহিরে বেরিয়ে রিদমকে দেখে জিজ্ঞেস করে সে তিথিকে দেখেছে কিনা।রিদম ও জানেনা তিথির খবর।
ইশানের এবার চিন্তা হলো,সে যে ফোন নিয়ে তিথির বাংলাদেশী নাম্বারটাতে কল করা শুরু করে।
অনেকক্ষণ রিং হবার পর তিথি রিসিভ করে।

‘হ্যালো?তুই কোথায়?গাড়ীর আওয়াজ আসছে কেন?আমাকে না বলে কোথায় গেছিস?’

‘আরে আপনার মা তানিয়াকে একটা কাতান শাড়ী গিফট দিবে গহনার সাথে মিলিয়ে, সেটা কিনতে এসেছি।মা তো একা আসতে পারতেন না।’

‘আমাকে নিয়ে যাওয়া যেতোনা?’

‘নাহ!মেয়েদের শপিংয়ে আপনার কি কাজ?আপনাকে না আনি আপনার গাড়ীটা ঠিকই এনেছি।’

‘তোরা কই এখন? আমি আসতেছি, লোকেশান বল”

‘আমরা চৌধুরী টাওয়ারে,শাড়ী কেনা হলেই মা আপনার নানু বাড়ি যাবে,মামা তো অসুস্থ ‘

‘আচ্ছা আমি আসছি,মাকে গাড়ীতে উঠিয়ে দিবো’

‘আপনার গাড়ীতেই ড্রাইভার দিয়ে আসবে’

‘তো?মাকে দেখতে আসতেছি আমি, তোর কোনো সমস্যা আছে?’

‘সমস্যা নাই,আসার সময় আপনার বাসার গাড়ীটা নিয়ে আসিয়েন বরং।তা নাহলে দি গ্রেট ইশানকে লোকাল বাসে চড়তে হবে।’

‘চড়লাম!সমস্যা কোথায়?’
—–
ইশান আর দেরি না করে শপিংমলে চলে আসে।সেখানে এসে দেখে মা কাতান শাড়ী কিনে এখন আরেকটা শাড়ী দেখছে।

‘কি এত শপিং কেন?আমার বিয়ে তো শেষ’

‘দেখ তো ইশান,এইই শাড়ীটা কেমন?’

‘কার জন্য?তিথি?’

তিথি আইসক্রিম খেতে খেতে একটা ছোট বাবুকে দেখছিল।মা মাথা নাড়িয়ে বললেন ওটা তিথির জন্য দেখছেন।
ইশান শাড়ীটা সরিয়ে বলে,’এটা না,কমলা রঙেরটা নাও।আচ্ছা তুমি এত আদর করছো কেন ওকে?বাহিরের মানুষের সামনে দেখতে পারোনা আর একান্তে এত আদর?’

‘একমাত্র ছেলের বউ বলে কথা!’
———-

‘হ্যালো?’

‘আসসালামু আলাইকুম আব্বা’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।কি বলবি বল!আমার এখন গাছের আগাছা পরিষ্কার করার সময়,জানিস না?’

‘রাতের ১টার সময়?’

‘হ্যাঁ,তো?তোর তাতে কোনো সমস্যা আছে গিসু?’

‘আব্বা!গিসু বলিয়েন না তো!আমার নাম গিয়াস। নাম তো আপনার আদরের পত্নীই রেখেছিল ‘

‘হুম!তা বটে।তোর মা জীবনে আমার কথায় চলেনা।কত করে বলছিলাম হিয়াস রাখবো।হিয়াস উদ্দিন,সে কয় হিয়াস নাকি হাঁসের মতন লাগে তাই রাখলো গিয়াস।আমিও কম না।আদর করে তোকে ডাকি গিসু’

‘আব্বা যদি হিয়াস রাখতে তাহলে কি এখন হিসু ডাকতেন🥴?’

‘বেয়াদবের বা…..’

‘বলেন বলেন!বেয়াদবের বাচ্চা বলেন!থামছেন কেন?’

‘না বলবোনা কারণ গালিটা আমার উপর এসেই পড়বে।তা কিসের জন্য ফোন করেছিস সেটা বল,সবসময় আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে উল্টা পাল্টা সময়ে কল করিস’

‘আমার পান্না মামণি কেমন আছে?’

‘আর কেমন থাকবে! বেয়াদব দুইটা আসি ওকে নিয়ে গেছে’

‘কে তারা?কখন এলো!কখন নিলো?আপনি যে আমাকে বললেন না!’

‘আমি ফোনে টাকা ঢুকাই যে তোকে কল দিবো?ছয় মাস আগে ইমার্জেন্সি লোড নিয়ে সেটাও শেষ দিছি।কল দিতাম কি করে?’

‘কারা নিছে?দেখতে কেমন?’

‘একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।ছেলেটা ফর্সা মতন,মেয়েটাও ফর্সা।ছেলেটাকে দেখে বড়লোক মনে হয়েছে।কিন্তু তারা দুজনেই প্রচণ্ড রকমের বেয়াদব।আমার কত গুলো গাছ নষ্ট করে দিয়েছে’

‘পান্না কি তাদের চিনেছে?আপনি বাধা দেননি কেন?’

‘আমি বাধা দিব কেন?তোর মেয়েই তো ডেং ডেং করে চলে গেছে’

‘কিহ!এতবড় ঘটনা ঘটলো!হুমমম!ফর্সা ছেলে মেয়ে!
ঐ রিদম তো কাইল্লা।তাহলে কে!ওহ আচ্ছা তাহলে ঐ ইশান আর তিথি!
তাদের আমার পান্নার সাথে কি কাজ যে এতদূর থেকে নিয়ে আসে!পান্না কোথায়?ওকে তো দেখলাম না অনুষ্ঠানে।’
——-
‘আপনাকে কতবার করে বলেছি গিয়াসকে গিসু বলবেন না।কত সুন্দর নাম গিয়াস দিছি আমি।সারাক্ষণ গিসু গিসু কেমন লাগে শুনতে?
আমাদের মেজো ছেলে কাদেমকেও আপনি সারাদিন কেদু কেদু ডেকে বেড়ান।’

‘এটা আদর।তুমি বুঝবেনা,দেখি মাথার একটা চুল ছিঁড়ে দাও তো’

‘আপনার কারণে চুলগুলা লম্বাই করতে পারিনা,এখন আবার কি দোষ করলাম যে চুল ছিঁড়তে হবে?’

‘আজ বিকালে বাগান দেখতে গিয়ে যে ধপাস করে পড়ে আমার সূর্যমুখী গাছ নষ্ট করেছো ভেবেছো আমি দেখি নাই?’

‘নিজের বউকেও শাস্তি দিবেন?’

‘হ্যাঁ দিবো,বউ বলে শাস্তি একটু বেশিই দিবো’
——-
মাকে বিদায় দেয়ার পর ইশান আর তিথি লোকাল বাসে উঠেছে।সিট এলোমেলো হওয়ায় তিথি সামনের সিটে বসেছে আর ইশান পিছনের সিটে।তিথির পাশে একটা মেয়ে বসা ছিল,মেয়েটা নেমে যাওয়ায় ইশান উঠে আসবে তখনই একটা ছেলে এসে তিথির পাশে বসে যায়,
এরপর তিথির দিকে তাকিয়ে ফোন বের করে কানে ধরে।

‘হ্যাঁ মামা!ভাবতে পারবিনা কি জিনিস একটা পাইছি’

তিথি চোখ বড় করে বসে থাকলো।ইশানের সাথে একটা লোক বসা তাই সে উঠে তিথিকে সরাতেও পারছেনা।এদিকে ছেলেটা তিথিকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার বন্ধুর সাথে যা পারছে,যত পারছে বাজে বাজে কথা বলে চলেছে।

একটা সময়ে ছেলেটা কল রেখে তিথির গায়ের সাথে ঘেঁষে বসে।ইশান উঠে কেলাবে তখনই তিথি ঠাস করে চড় একটা বসিয়ে দিলো।এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’কি বললি?আমি জিনিস?আর কি বললি আমাকে পাচার করতে ৫০হাজার টাকা লাগবে?ওজনে ভারী আমি?বেয়াদব ছেলে!’

‘আজব তো!কথা নাই হুটহাট চড় মেরে দিলেন?আপনি জানেন আমি কি নিয়ে কথা বলছিলাম?আমি এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের বিজনেস করি।মালামাল নিয়ে কথা বলছিলাম’

তিথি আরেকটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,’তোর মালামালের ফিগার হট হয় তাই না?’

ছেলেটা এবার থতমত খেয়ে যায়।ইশান আর কি কেলাবে,তার বউই ছেলেটাকে উত্তম মধ্যম দিয়ে চলেছে।
তিথি এবার ইশানের দিকে চেয়ে বললো,’কেমন স্বামী আপনি?মারামারি পারেন না?আমাকে যে ছেলেটা ডিস্টার্ব করতেছে এতক্ষণ খেয়াল করেননি?আমাকে কোলে করে নিয়ে যাবার পর একশান নিবেন?’

ইশান যে তিথির বর এটা দেখে ছেলেটা চলন্ত বাস থেকেই নেমে পড়েছে।ইশান উঠে এসে তিথির পাশে বসে বলে,’আমার আগেই তো তুই পেটালি,আমাকে আর সুযোগ দিলি কই?’
—–
‘গিসু’🐸

‘পিংকির মা তুমিও শুরু করছো?’

‘আপনার বাবা ছোট থেকেই আপনাকে গিসু ডাকে?’

‘নাহ বড় থেকে ডাকে,ছোট থাকতে গোদা ডাকতো।ঐ যে নারকেল গাছের ঢালের লম্বা লম্বা করে লাকড়ি বানায় না? সেটাকে গোদা বলে।তাও ভাল এখন আর গোদা ডাকেনা,গিসু ডাকে।শুনতে অদ্ভুত হলেও গোদার চেয়ে ভাল’

চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫৩
আফনান লারা

বাস থেকে নেমে একা পথে হাঁটছিল দুজন,হাঁটতে হাঁটতে ইশান হঠাৎ থেমে যায়। তিথি ভাবে ঐদিন রাতের মতন বুঝি আবারও সেরকম করে স্পর্শ করবে নির্জন এই রোডে।
কিন্তু নাহ!ইশানের মুখের গড়ন আর কুঁচকানো ব্রু অন্য কিছুর ইঙ্গিত করছিল,মনে হচ্ছিল খুব কঠিন ধাঁচের কথা বলবে সে।
ঠিক তাই হলো।ইশান বললো,’আমার যদি আজ এই সময়ে এসেও এতকিছু না থাকতো,তাহলে কি তুই সেই আগের দিনের মতই ব্যবহার করতি?নাকি বাসর রাতের মতন আকুতি মিনতি করতি?যেমনটা করেছিল সেদিন?’

‘আমি যদি বলি আমি ক্ষমা চাইতাম আগের ব্যবহার নিয়ে তবে কি বিশ্বাস করবেন?’

‘ক্ষমা চাইতি কিন্তু বিয়েটা করতিনা’

‘বিয়ে করতাম না সেটা সঠিক,কারণ আমি যদি জানতাম আপনি এত বড় একজন লোক হয়ে গেছেন তবে কখনওই আপনার বউয়ের জায়গায় নিজেকে বসাতাম না,কারণ আমি তখন আপনার যোগ্য থাকলেও আজকের এই দিনে সেই যোগ্যতা আমার নেই।কুয়িনার মতন মেয়েই সেই যোগ্যতা রাখে।আমি তো আমার মতামত প্রকাশ করবার সুযোগই পাইনি।হুট করে বিয়ে হলো,যার সাথে হবার কথা ছিল তার সাথে হলোনা!বিয়ের আগে যার ছবি দেখেছিলাম,যার সাথে কথা বলেছিলাম,বাসর ঘরে অন্য একটা মানুষকে দেখতে পেলাম’

ইশানের ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে ওঠে।এই উত্তরটাই সে তিথির মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিল।হাসি মুখে কাছে এসে তিথিকে টেনে নিজের গায়ের সাথে লাগিয়ে ধরে আবারও হাঁটতে থাকে দুজনে।
——
রাত ২টার সময় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে রিদম চোখ ডলতে ডলতে আসে দরজা খুলতে।সে ভেবেছিল ইশান আর তিথি এসেছে।কিন্তু নাহ,এসেছেন গিয়াস সাহেব।রিদমের চোখ ভর্তি ঘুম ছিল বলে সে শুরুতে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে গিয়াস সাহেব এসেছেন।সে মনে করেছে ভুল দেখছে।কিন্তু গিয়াস সাহেবের ধমকে তার সব হুশ ফিরে আসলো।

‘আঙ্কেল আপনি?এতো রাতে?’

‘আমার মেয়ে কোথায়?’

এটা বলেই গিয়াস সাহেব ভেতরে ঢুকে গেলেন।রিদম তখনও চোখ ডলতেছিলো।গিয়াস সাহেব রুমের আলো জ্বালাতে বললেন ওকে।
রিদম দ্রুত গিয়ে আলো জ্বালায়।গিয়াস সাহেব আঙ্গুল তুলে বলে,’তোমার বড় আপু আর দুলাভাইকে ডাকো,আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে বলবো।আর এটাও জানতে চাইবো আমার মেয়েকে দিয়ে তাদের কি কাজ।’

সেইসময় তিথি আর ইশান চলে আসে।গিয়াস সাহেবকে দেখেই তারা টের পেয়েছে উনার এত রাতে এখানে আসার কারণ।

‘আঙ্কেল বসুন,বলছি আমি’

এটা বলেই তিথি ওনাকে সোফায় বসিয়ে রিদমকে ইশারা করে।রিদম যায় মিষ্টি আর শরবত আনতে।

‘কি বলবে তোমরা?পিংকিকে নিয়ে আমার চিন্তা থাকলেও,পান্না কিন্তু কম নয়।পান্নাকে বরং আমি পিংকির চাইতেও বেশি ভালবাসি।সে কোথায়?কেনোই বা তোমরা ওকে ওর দাদুর বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছো?’

ইশান ওনার পাশে বসে বলে,’পান্না অভিমান করে ওর দাদুর বাড়ি গেছে।এ কয়েকদিনে সে আমাদের খুব কাছের এবং আদরের হয়ে গেছে।বাসার এত বড় একটা অনুষ্ঠানে সে থাকবেনা তা কি হয়?তাই নিয়ে এলাম।আর আপনার থেকে লুকিয়ে রাখার কারণ সে তার বড় বোনের উপর অভিমান করেছে।কারণটা আমরা কেউ জানিনা,আপনার ও জানার প্রয়োজন নেই।দুই বোনের ব্যাপার তারাই মিটিয়ে নিবে।এখন পান্নার কথা যাতে পিংকি না জানে,কারণ পিংকি জানলে সে পান্নার সাথে আবার বিবাদ করবে’

‘সে কই এখন? আমি তাকে একবার দেখবো’

তিথি ওনাকে নিয়ে তানিয়ার রুমের কাছে আসে,দরজা ঠেলে ভেতরে দেখায় ড্রিম লাইটের আলোয় তানিয়ার পাশেই ঘুমাচ্ছে পান্না,তানিয়ার নাইট ড্রেস পরে কাঁথা টেনে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে সে।গিয়াস সাহেবের চোখ জোড়া জুড়িয়ে গেলো আদরের ছোট মেয়েকে এত শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে।
তিনি চোখের কোণার পানি মুছে বললেন,’আমি তাহলে যাই?’

‘বিয়ে বাড়ি থেকে খালি মুখে যেতে নেই’

এটা বলে তিথি ওনাকে নাস্তা দিলো।উনি মিষ্টি মুখে দিয়ে বললেন,’ইশান বাবা,কোনো ছেলে দেখেছো?’

‘দেখেছি’

গিয়াস সাহেব অনেক আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন ছেলে কি করে।

‘ছেলে জাপানেই থাকে,পড়াশুনা করছে।পড়াশুনা শেষ হলে আমার কোম্পানিতে যাবে এরপর লাইফ সেটেল’

‘সেকি!এত বড় খবর আমায় বললেনা?’

‘তবে একটা আর্জি আছে’

‘কি?’

‘ছেলের আপনার বড় মেয়েকে নয় বরং ছোট মেয়েকে পছন্দ’

‘তা বেশ!একটা মেয়েকে যদি ভাল জায়গায় বিয়ে দিতে পারি তাহলেও মনটাকে বুঝাতে পারবো আমি’

রিদম ইশানের দিকে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ।এত বড় কথা কিনা সে এখন জানছে।ভালই!খারাপ না!পান্নার বিয়ে হবে,লাল টুকটুকে বউ সাজবে!টুকুর মতো করে ওর ও বিয়ে হবে।ইশান দুলাভাইয়ের মতন ওর বর হবে।ওকে অনেক আদর করবে!
এটাই তো কামনা।

‘এই ছেলে!’

‘জ্বী আঙ্কেল’

‘আমাকে একটু বাসা অবধি দিয়ে আসো তো।আমি একা যেতে পারবোনা।ভয় করে’

রিদম মাথা নাড়িয়ে ওনার সাথে চললো।পথে যেতে যেতে গিয়াস সাহেব বললেন,’যাক আমার ছোট মেয়েটার একটা ব্যবস্থা তাহলে হয়েই গেলো।এখন পিংকিটাকে নিয়ে যে কি করবো।ওকে এত করে বলি সাধারণভাবে চলাফেরা করতে পান্নার মতন।এখন হলো তো!মানুষ সাধারণটাকেই বেছে নিলো।এত হাবিজাবি করার কোনো মানে আছে?
আজ গিয়ে বলবো সে যেন পান্নার মতন হয়,চুপচাপ ভদ্র,অমায়িক আর মিষ্টি’

‘হুম।খুব মিষ্টি’

‘কিছু বললে?’

‘নাহ!বললাম বাসা এসে গেছে’

‘ঠিক আছে,আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।তুমি যাও নাহয় তুমি তো আবার বারান্দা দিয়ে উঁকি দিবা।সব পিংকির সাথে দেখা করার ধান্ধা! ‘

রিদম চলে আসে।মনটা কেমন যেন হয়ে গেলো।পান্নার বিয়ে একটা ভাল ছেলের সাথে হবে এটা জেনে তার এত মন খারাপ করার কি আছে?
——
তিথি আর ইশান চলে গেছে তাদের রুমে।পান্নার খুব পানির পিপাসা পেয়েছিল তাই সে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে পানি নিয়ে খাচ্ছিল,ঐ সময়ে রিদম বাসায় ঢোকে।
পান্না ওকে দেখে অবাক হয়ে জানতে চায় এত রাতে সে কোথায় গেছে।
রিদম কিছু না বলেই রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।

‘কি হলো?’

পান্না ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে,রিদম কিছুই বলছেনা দেখে সে চলে যায়।বুঝতে পারলোনা তার দোষটা কোথায়।

পরেরদিন সকাল সকাল কাজের ব্যস্ততা শতগুণে বেড়ে গেছে।পান্না হলুদে তিথির শাড়ী পরলেও আজ কি পরবে?দাদুর বাসা থেকে যেগুলো এনেছে সেগুলোর মাঝে তো ভাল নাই।
আজ তো তিথির জামা পরতে পারবেনা।তাই ওকে একবার হলেও বাসায় যেতে হবে।বুকে সাহস নিয়ে সে বাসায় আসে।ভয়ে ভয়ে কলিংবেলে চাপ দেয়।

দরজা খোলে পিংকি।সে পান্নাকে দেখে একটুও আশ্চর্য হয়নি,যেন সে জানে পান্না আসবে।
সে দরজা খুলেই রুমে চলে গেছে।পান্না মায়ের সাথে দেখা করে সেও রুমে আসে,এরপর ওয়ার ড্রোবের ড্রয়ার খুলে নিজের পছন্দের একটা জামা হাতে নেয়।

‘এত কথা শুনালাম তাও আসলি?’

পান্না কিছু বলেনা।চুপ করে জামার ওড়না ভাঁজ করতে থাকে।

‘কি হলো কথা বলছিস না কেন?তোর কি গায়ে চামড়া নাই?আবার এসে পড়েছিস?বাবাকে কি জ্ঞান দিছিস?বাবা সকাল থেকে আমার মাথা খারাপ করে রেখেছে এক কথা বলতে বলতে”পান্নার মতন হতে হবে””
আমি হবো তোর মতন?আমার ঠ্যাকা পড়ে নাই।তোর মত ন্যাকা করে ভাল সাজতে পারিনা আমি। ”
——-
রিদম লাল পাঞ্জাবি পরে তানিয়ার জন্য গাড়ীতে বসে আছে।বিয়েটা কমিউনিটি সেন্টারে হবে।সেখানেই যাবে ওরা।
তানিয়া এসে বসতেই পান্না আর পিংকি চলে আসে।পান্নাকে দেখে রিদমের মন আবার খারাপ হয়ে যায়।তানিয়া পান্না আর পিংকি বলে ওর সাথে বসতে।পিংকি আগেভাগে উঠে তানিয়ার পাশের খালি সিটে বসে যায়।
এদিকে অন্যান্য মেহমান এসে পিছনের সিট দখল করে ফেলে।
তখন পিংকি বলে,’তুই তিথি আপুদের সাথে আসিস।এখানে তো আর জায়গা নেই’

কিন্তু সেইসময় তানিয়া পান্নাকে দাঁড়াতে বলে।

‘পান্না,তুমি ছোট মানুষ,আসো আমার কোলে বসবে।আমি তোমায় কোলে নিতে পারবো’

পান্না খুশি হয়ে এসে তানিয়ার কোলে বসে।এবার সে রিদমের খুব কাছাকাছি হয়ে গেলো।পিংকি তো জ্বলে আগুন,এদিকে রিদম এক দৃষ্টিতে পান্নার কোঁকড়ানো চুলগুলো দেখছিল।বাজারে যে পুতুল বিক্রি হয়,কিছু পুতুলের চুল এরকমই কোঁকড়ানো থাকে।পান্নাকে সেই পুতুল গুলোর মতন লাগছে আজকে।রিদমকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তানিয়া একটা খোঁচা দিয়ে বললো সামনে তাকাতে।
——
পেছনের গাড়ীতে গিয়াস সাহেব আর তার স্ত্রী বসেছেন।আজকে গিয়াস সাহেবের ডান পাশে বসেছেন তানিয়ার খালু।

গিয়াস সাহেব দাঁত কেলিয়ে বললেন,’আসসালামু আলাইকুম ভাই’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।কে আপনি?আপনাকে তো আমাদের বংশের কারোর চেহারার মতন লাগছেনা!বিনা দাওয়াতে খেতে আসছেন মিয়া!’

‘আহা সালাম নিয়েই কেউ এত চটে যায়?শান্ত হোন😘।’

চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫৪
আফনান লারা

‘আচ্ছা আপনি কি আদালতের মুরি পদের চাকরি করেন?’

‘হ্যাঁ,আপনি কি করে জানলেন?’

‘আসলে মুরিরাই দরকারি কথা বাদ দিয়ে বেদরকারি কথা বেশি বলে’

‘আপনি কি আমাকে খোঁচা দিলেন?’

‘না তো,আমি তো গুতা দিলাম’

‘আপনি সত্যি করে বলুন তো,তানিয়ার কি হোন আপনি?’

‘আমরা ঐ যে আপন প্রতিবেশী।আচ্ছা ওসব বাদ,আপনার কোনো ছেলে আছে?’

‘কেন বলুন তো?’

‘শুনতে চান?তবে বলি।আমার না খুব কিউট,সুইট দুটো মেয়ে আছে।একটার বিয়ে ঠিক হইছে,এখন আরেকটা খালি আছে।আমি সেন্টারে গেলে ওকে দেখাবো আপনাকে ‘
——–
বিয়ের অনুষ্ঠানে গাড়ী থেকে নেমে যাবার পর পিংকি পান্না রিদম সব আলাদা আলাদা হয়ে গেছে। কাউকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা,একসাথে দেখাও যাচ্ছেনা।পান্না অবশ্য রিদমকে খুঁজার চেষ্টা করেনি,কিন্তু পিংকি খুঁজে বেড়াচ্ছে কারণ সে পান্নাকে দেখিয়ে দিবে রিদম কেবল ওকেই কেয়ার করে,পছন্দ করে।
কিন্তু সে তো পাচ্ছেই না।এদিকে পান্না তিথির খালামনির সাথে খেতে বসেছিল।রিদম কোথা থেকে এসে পান্নাদের টেবিলে খাবার দাবার ঠিক ভাবে ব্যবস্থা করা শুরু করে দিলো।খালামণি খুশি হয়ে ওকে শিখিয়ে দিচ্ছেন কি কি লাগবে।রিদম ওনাদের খাওয়া শেষ হওয়া অবধি টেবিলের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।
পিংকি তন্নতন্ন করে খুঁজে অবশেষে দেখা পেলো ওর।

‘একি রিদম?তুমি কোথায় হারাই গেছো?তোমাকে কত যে খুঁজলাম।কি করছিলে এতক্ষণ?’

‘টুকুর বিয়ে।অনেক বেশি ব্যস্ত জানোই তো’

পান্না খাবার খেয়ে তানিয়ার কাছে গিয়ে বসে আছে,রকিবরা এখনও আসেনি।এদিকে রিদম ব্যস্ততার কথা বলে আবার গায়েব হয়ে গেছে।
পিংকি ওর পিছু পিছু চলছিল ওমনি গিয়াস সাহেব ওকে ডাকলেন এসে খেতে বসার জন্য।
——
তিথি আর ইশান এখনও আসছেনা তার মোক্ষম কারণটি হলো তিথি ইশানের কথার অবাধ্য হয়ে তানিয়ার সাথে পার্লারে সেজেছে আর তাই ইশান ওকে পুনরায় গোসল করিয়ে আনতেছে,এই জন্য এত দেরি।

‘আপনি খুব অন্যায় করলেন আমার সাথে।এটা ঠিক হলোনা’

‘ঠিক তো তুই আমার সাথে করিসনি।তোকে বলেছি মেকআপ করা আমার পছন্দ না।তার পরেও এত ভারী মেকআপ করেছিস।’

‘এখানে দশ হাজার টাকার মেকআপ ছিল’

‘আমি তোকে দশ হাজার টাকা দিবো,তাও এত পেনপেন করিস না তো।আমাকে ড্রাইভ করতে দে’

‘আপনার কারণে আমার নিজের বোনের বিয়েতে যেতে দেরি হয়ে গেলো।’

‘তাই?আমার কারণে?’
——–
রকিব তানিয়ার পাশে বসার পর চারিদিক খেয়াল করে বলে,’আচ্ছা তিথি আর ইশান ভাই কোথায়?’

‘তিথি আপু মেকআপ করেছিল তাই ভাইয়া ওনাকে গোসল করিয়ে আনতেছে’

‘এরকমই হওয়া উচিত সব হাসবেন্ডকে’

‘তাই নাকি?আমি কিন্তু তিথি আপুর মতন না,আমাকে আপনি শীতকালে ১০দিন ছাড়া গোসল করাতে পারবেন না’

‘ফরজ গোসল বলে কিছু জানো?’

তানিয়া ব্রু কুঁচকে তাকায়।রকিব হাসি দিয়ে বলে,’নামাজ পড়তে হলে গোসল তোমাকে করতেই হবে।এবার ভাবো তুমি দশ দিনের রেকর্ড ধরে রাখবা নাকি নামাজ পরার জন্য ফরজ গোসল করবা’

‘দূরে থাকবেন আমার থেকে।’

রকিব হাসছে মিটমিট করে।ঐ সময়ে ইশান তিথিকে নিয়ে হলে প্রবেশ করে।তিথির আম্মু ওকে খুব বকাঝকা দিলেন এত দেরি করে আসার জন্য। এদিকে তিথি মুখ ফুটে বলতেও পারছেনা ঠিক কি কারণে এত দেরি হলো।
——
‘বড়টাই সুন্দর ছিল গো আপা,সবই কপাল!আমরা গেছিলাম ওরে দেখতে তখন সে ছিল না,আমার ছেলে ছোটটাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে।দুজনের চেহারায় অনেক মিল কিনা!আমরা শুরুতে বুঝতে পারিনি যে আমরা ভুল পাত্রীকে দেখছি। মনে হয় যেন জমজ বোন।অবশ্য জামাই একটাও সুন্দর পাইছে।দুজনকে বেশ মানাইছে!’

‘এটাও তো সুন্দর বইন,বড়টার চেয়ে একটু লম্বা বেশি।এটা তো ভালই!’

‘লম্বা ধুই পানি খাব আমি?’

রিদম এসে রকিবের মায়ের পাতে রোস্ট এক্সট্রা একটা দিয়ে বলে,’সুন্দর ধুই পানি খাবেন আন্টি?আনি দিবো?’

তানিয়ার শাশুড়ি চটে গেলেন এ কথায়।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন শুধু।

পান্না একা একা স্টেজের দিকে তাকিয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল,পিংকি ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,’আবার কবে দাদুর বাড়ি ফিরছিস?’

‘এই তো তিথি আপুরা জাপান চলে গেলেই’

‘ওনারা জাপান যাওয়ার সাথে তোর দাদুর বাড়িতে যাওয়ার কি সম্পর্ক?’

‘আপুরাই বলেছে ততদিন থাকতে’

‘শুন!এসব করে না কোনো লাভ নাই।রিদম তোর না,আমার ফ্রেন্ড’

‘আমি জানি কোনো লাভ নাই, তাই আমি কিছুই করছিনা’
——-
তিথি তানিয়ার শাড়ীর সেফটিপিন ঠিক করছিল।ইশান রকিবের সাথে ছবি তোলা শেষে রকিব বলে,’ভাই ভাগ্য কি জিনিস দেখলেন?কার বউ কে পেয়ে গেছে’

ইশান হাসি দিয়ে বলে,’কে জিতছে?’

‘আমরা দুজনেই মনে হয় জিতছি।আপনি যেমন চাইলেন,তেমনই পাইলেন।আর আমিও পেলাম ‘

‘নাহ!আমি চাইছি একটু বুদ্ধিশুদ্ধি ধাঁচের,কিন্তু আমার জনের মাথায় একটুও বুদ্ধি নাই।

‘আমার জনের আবার মহা বুদ্ধি কিন্তু কি লাভ হইলো বলেন!আমাকে এক হাটে বেচে আবার এক হাটে কিনে’

‘নিজের মতন বউ জীবনেও হাসবেন্ডরা পায়না,বিপরীতে পায়।থাক ভাই কাঁদিস না,আমাদের কপালই এমন’

‘আমাদের মতন বউ পেয়ে কপাল এরকম খারাপই যদি হয় তা হলে চুম্মাইতে আসেন কেন?’

তিথির কথা শুনে রকিব লজ্জায় লাল হয়ে তানিয়ার কাছে চলে গেছে এদিকে ইশান তিথির কান টেনে ধরে বলে,’কপাল খারাপ যে সেটা বুঝতে শিখেছি বলি আদর করি।কারণ হাতে আর অপশান নাই’

‘অপশান নাই মানে?’

‘কারণ এরকম বলদের ভেতরে ভাল মানের প্রোডাক্ট আর নেইই তাই’

‘আপনি আমাকে বলদ বললেন?’

‘না সরি,ভুল হলো।বলদি হবে’
——-
বিয়েটা হয়ে যাবার পর যখন বিদায়ের সময় আসলো তখন সবাই কাঁদছিল কিন্তু তানিয়া বাদে।সে ওদের কান্না দেখছিল।সে কাঁদছেনা কারণ তার মেকআপ নষ্ট হই যাবে। মা বাবা, রিদম সবাই কেঁদেছে তাও তানিয়ার চোখ দিয়ে এক ফোটা পানিও বের হয়নি।

রিদম চোখ মুছতে মুছতে সেন্টারের বাহিরে চলে গেছিলো,তার এত বেশি কান্না আসছিল,তিথির বেলায় ও এতো কাঁদেনি সে।তানিয়াকে সে একটু বেশি ভালবাসে,কারণ তানিয়া ওর মতই দুষ্টুমি করতো,দুজনে একসাথে সব জায়গায় ঘুরতো।
হঠাৎ সামনে টিস্যু দেখতে পেরে রিদম টিস্যুটা নিয়ে বললো,’থ্যাংকস পান্তুয়া ‘

‘আমি পিংকি’

রিদম চোখ মুছে পেছনে তাকায়।পিংকি রাগান্বিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।এরপর রিদম অন্যদিকে ফিরে বলে,”সরি আমি ভাবলাম পান্না’

‘পান্নাকে পান্তুয়া ডাকো,আমাকে কি ডাকবে শুনি?’

‘তোমার নাম পিংকিই সুন্দর’

‘দাও না একটা নাম,যেটা তুমি ডাকবে’

রিদম বিরক্ত হচ্ছিল,তাও মুখে হাসি ফুটিয়ে সে বলে,’পিংকিই সুন্দর,এর বেশি বাড়ানো কমানো ঠিক না।অতিরিক্ত হয়ে যাবে’

এটা বলে সে সেন্টারের ভেতরে চলে যায়।আসলে পান্না টিস্যু নিয়ে আসছিল রিদমের কাছে কিন্তু পিংকি ওর হাত থেকে টিস্যু নিয়ে নিজেই আগে চলে আসে এখানে।
—–
সবশেষে তিথি তানিয়াকে ধরে কাঁদার সময় ওর কানের কাছে বলে,’কাঁদ একটু বলদি!মানুষ কি বলবে!’

‘তুমি কাঁদো আমি ঠোঁট নাড়াচ্ছি’

‘একটা চড় দিবো।ফাজলামি করিস কেন!খালারা কটু কথা বলবে’

‘খালাগো!!হুহুহু হেহে হেহে😂!!’

তানিয়া কান্নার অভিনয় করতে গিয়ে হেসে দিলো।

গিয়াস সাহেব দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তানিয়ার খালুকে জোর করে ধরিয়ে বললেন,’দেখেন!কি সংস্কার আপনাদের মেয়ের!বিদায়বেলা হে হে করে হাসছে।আর ঐ দেখেন পিংক কালারের জামা পরা আমার মেয়ে পিংকি।কত আদবকায়দা আমি ওকে শিখিয়েছি।আপনার ছেলের ঘরের বউ বানালেই বুঝতে পারবেন।’

‘ওটা আপনার মেয়ে?আরে ঐ তো কিছুক্ষণ আগে আমার পাঞ্জাবিতে মাংসের ঝোল ফেলে একবার সরি তো বলেইনি উল্টে বলে গেলো আমি নাকি চোখে দেখি হাঁটিনা,চোখ আকাশে রেখে হাঁটি’

‘আরেহ না,আমার মেয়ে এমন করতেই পারেনা’

‘তার মানে আপনিও বুঝাতে চাইছেন আমি চোখে কম দেখি?’

‘না না,তা কখন বললাম?’

‘তবে শুনুন,আমার কোনো ছেলে নেই।পাঁচটা মেয়ে আমার।বুঝেছেন?’

চলবে♥