Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 243



কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-১০

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১০
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

(অনুমতি ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ)

“আপনি নাকি টাকার সমস্যার জন্য নেত্রী কে পরতে দেবেন না?’

মেহবিনের কথায় তাজেলের সৎ মা মুখ বাঁকিয়ে বলল,,

“বাবাহ এ কথাও তোমারে বইলা দিছে। হ আমি টাহার জন্য ওরে পড়ামু না। আমাগো ভাতই চলে না ঠিক মতো ওরে আবার স্কুলে পড়ামু কেমনে?”

“আমার জানামতে গ্ৰামের সরকারি স্কুলে পড়তে তেমন টাকা লাগে না। শুধু ভর্তি হওয়ার সময় পঞ্চাশ একশো টাকা লাগে। তারওপর সরকারি ফান্ড থেকে উপবৃত্তি দেওয়া হয় প্রত্যেক স্টুডেন্ট কে। তারপরেও ওকে কেন পড়াবেন না আপনি?”

“দেহো আমগো পরিবারে তুমি কথা কইবা না। ইস্কুলে নাহয় টাহা লাগলো না বুঝলাম। ওরে ইস্কুলে যাওয়ার জন্যে ইস্কুল ড্রেস বানাইতে টাহা লাগবো। আবার ইস্কুল ব্যাগ কিনা দিতে হইবো সেই টাহা আমি পামু কোনে? তাছাড়া এহনকার পুলাপাইন গো আবার প্রাইভেট পড়ানো লাগে হেয় ছোট থেইকায় সেই টাহা পামু কোনে তাই তো ওর পড়া বন্ধ করছি।”

“তারমানে শুধু স্কুল ড্রেস একটা স্কুল ব্যাগ আর প্রাইভেট পড়ানোর জন্য ওকে স্কুলে পাঠান নি তাই তো?”

“হ তাই!”

মেহবিন মনে মনে হাসলো এরকম লেইম এক্সকিউজ শুনে। মূলত উনি চান না তাজেল পড়াশোনা করুক। এমনিতে তাজেলদের পরিবার খুব ভালো না চললেও একেবারে খারাপ ও চলে না। সপ্তাহে বা পনেরো দিনে তাজেলের বাবা মুরগি কেনে খাওয়ার জন্য।যদিও তাজেলের ভাগ্যে সেগুলো তেমন ভাবে জুটেনা। এগুলো তাজেলই বলেছে মেহবিন কে। তাই মেহবিন বলল,,

“যদি স্কুল ড্রেস, স্কুল ব্যাগ আর প্রাইভেট পড়ানোর টাকা হয়ে যেত তাহলে ওকে পড়াতেন ?”

“অবশ্যই পড়াতাম সতিনের মাইয়া বইলা কি ওরে অশিক্ষিত কইরা রাখতাম নাকি।”

“ওকে সমস্যা নেই আমি নেত্রীর স্কুল ড্রেস বানিয়ে দেব। স্কুল ব্যাগ ও কিনে দেব। আর হ্যা নেত্রী আমার কাছে প্রাইভেট পরবে। এখন কোন সমস্যা নেই তো।”

তাজেলের সৎ মা একবার মেহবিনের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,,

“আপনে যদি সব দেন তাইলে আমার আপত্তি থাকবো কোন থেইকা। এমনিতেও সারাদিন আকাম কুকাম করে আর ঘুইরা বেড়ায় স্কুলে গেলে ভালোই হইবো। দ্যাখ তাজেল দ্যাখ আমি দেইহা তোরে পড়ানোর সুযোগ কইরা দিলাম। অন্য কোন সৎমায় হইলে সব পাইয়াও কইতো সতিনের মেয়েরে শিক্ষিত করা লাগবো না।”

এ কথা শুনে তাজেল হেঁসে বলল,,

“তুমি কোনে সুযোগ দিলা? সুযোগ তো ডাক্তার কইরা দিল আর আমি নিলাম।”

তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো। তাজেলের মা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। মেহবিন সকাল হতেই রান্না শেষ করে তাজেলের বাড়ি এসেছে ওর পড়াশোনার জন্য কথা বলতে। তাজেলের বাবার সাথে কথা বললে তিনি বলেন তাজেলের মায়ের সাথে কথা বলতে তিনি এখন কাজে বেরুবেন। তবে তিনি বলেছিলেন তাজেলের নাকি পড়ায় মন বসেনা তাই তাজেলই স্কুলে যায় না । একথা শুনে মেহবিন অবাক হলেও পরে বুঝেছে হয়তো তাজেলের মা বলেছে এই কথা। তাই সে পড়ার ব্যাপারে বলল তাজেলের বাবা মেহবিন এর কথা শুনে বলল তাজেল যদি যেতে চায় তাহলে তার আপত্তি নেই। এই সব কথা তাজেলের মা শুনেছিল তাই স্বামীর কাছে ভালো হওয়ার জন্য তাজেলকে পড়ানোর কথা বলল। যদিও নিজের লাভটাও দেখে নিয়েছে সে। তাজেলের পেছনে তার কোন খরচ হচ্ছে না। বরং লাভ হয়েছে এখন তাজেলের কথা বলে তিনি টাকা নিতে পারবেন। মেহবিন তাজেলকে বলল,,

“আমার নেত্রী ও তাহলে স্কুলে যাবে। বিকেলে তৈরি থেকো তোমায় নিয়ে দোকানে যাবো স্কুল ড্রেসের কাপড় আর ব্যাগ কিনতে তারপর দর্জির দোকানে যাবো। কাল সকাল থেকে তুমি আমার কাছে পরবে ঠিক আছে। কিন্তু তোমাকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবে কে? আমি তো এখন হাসপাতালে যাবো।”

“তুমি চিন্তা কইরো না দুপুরে আমার বাপ কাম থিকা বাড়ি আসবো তহন বাপরে কইলে নিয়া যাইবোনে স্কুল তো দূরে না পাঁচ মিনিট এর পথ। এই বিষয়ে আমার বাপে ভালো আছে এহনো। তুমি বাড়ি যাও আমি কুলসুম রে কইয়া আসি আমিও স্কুলে যাইতে পারুম এহন থিকা।”

বলেই তাজেল একটা দৌড় দিল। মেহবিন ও হেঁসে বাড়ির দিকে গেল। গিয়েই দেখলো সেদিনের মহিলাটা যে মেহবিনের ফ্রিজে দুধ রেখে গিয়েছিল এখন নিতে এসেছে। মেহবিন তাকে দুধ দিয়ে রেডি হয়ে নিল। তারপর খাওয়া শেষ করে ঘর তালা দিয়ে রাস্তায় এলো। পাকা রাস্তায় উঠতেই দেখলো মুখর পুলিশের জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহবিন কে দেখেই সে মুচকি হাসলো।আর বলল,,

“আসসালামু আলাইকুম। অবশেষে আপনি এলেন?”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেন আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন বুঝি?

“তা তো একটু করছিলাম। আজকে একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে বিশেষ পদে বসতে যাচ্ছি। কিন্তু আপনার সাথে দেখা না করেই চলে যাবো ব্যাপারটা কেমন দেখায় না।”

মেহবিন হেঁসে ব্যাগ থেকে দু’টো জবা ফুল বের করলো। এগুলো ওর ঘরের পেছনের গাছ থেকে এনেছে। মেহবিন হেঁসে জবা ফুল গুলো মুখরের সামনে ধরে বলল,,

“আপনাকে অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। এবং নতুন দায়িত্ব পালনের জন্য শুভকামনা রইল।”

“ইনশাআল্লাহ আমি আমার দায়িত্ব অবশ্যই পালন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”

“হুম তাহলে আপনি যান আপনার কাজে।আর আমি যাই আমার কাজে।”

মুখর হেঁসে বলল,,

“বিহঙ্গিনী কি কিছু ভুলে যাচ্ছে?”

মেহবিন আশেপাশে তাকালো এই সময় কেউ নেই। আজ সে আগেই বের হয়েছে। মেহবিন জিপের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফ্রন্ট সিট থেকে মুখরের পুলিশি ক্যাপ নিয়ে এলো । মুখর হেঁসে মাথা নিচু করলো মেহবিন মুখরের মাথায় ক্যাপটা পড়িয়ে দিল। আর বলল,,

“আল্লাহ তায়ালা আপনাকে এই হ্যাটের মর্যাদা রক্ষা করার তওফিক দান করুক।”

মুখর মুচকি হেসে বলল,,

“আমিন। তো আপনাকে হাসপাতালে ড্রপ করে দিই।”

“আমার হাসপাতাল উল্টো পথে। আপনি আপনার গন্তব্যের দিকে যান মিস্টার মুখর শাহরিয়ার। আমি আমার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।

“আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ।”

“ইনশাআল্লাহ।”

বলেই মেহবিন হাঁটা ধরলো। তা দেখে মুখর হেঁসে গাড়ি থেকে নরমাল একটা কালো ক্যাপ আর ফুল নিয়ে দৌড়ে মেহবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেহবিন বলল,,

“কি?”

মেহবিনের হিজাবের ওপর দিয়ে মুখর ওকে ক্যাপ পরিয়ে দিল।আর হাতে ফুল দিয়ে বলল,,

“ফুল না নিয়েই কোথায় যাচ্ছো আমার কথা আমি সবসময় রাখি। যাই হোক আর এটা আমার তরফ থেকে একটা উপহার। পারলে এটা নিয়েই সবসময় চলাফেরা করবে আমার ভালো লাগে তোমায় এভাবে দেখতে। ফাইনাল আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ।”

বলেই মুখর আবার দৌড়ে চলে গেল আর গাড়ি স্টার্ট করে ওখান থেকে চলে গেল। তা দেখে মেহবিন হেঁসে ফেললো। তারপর ক্যাপটা খুলে নিজের হাতে নিল ক্যাপের ওপরে সোনালী রঙের ছোট ছোট করে ইংরেজি তে লেখা KABBER BIHONGGINI। মেহবিন বুঝতে পারলো মুখর এটা অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে।আর কেউ যাতে সরাসরিই বুঝতে না পারে কাব্যের বিহঙ্গিনী তাই ইংরেজি তে লিখেছে। মেহবিন হেঁসে মাথায় ক্যাপ টা পরে নিল। তারপর হাঁটা ধরলো আজ সে আগেই বেরিয়েছে তার মুডটাও ভালো তাই আজ হেঁটেই যাবে। হাসপাতালে যেতে একটা মাঠ পরে সেখানে তিনটি আট নয় বছরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে ছিল। মেহবিন ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় একজন গেয়ে উঠলো,,

” বোরখা পড়া এক মাইয়া
আমার মনটা নিল যে কাইরা।

তার সাথে বাকি দুজন ও গেয়ে উঠলো একই গান। মেহবিন একবার ওদের দিকে তাকালো ও বুঝতে পারল না ওকে টিজ করছে না এমনিই মজা নিচ্ছে। বাচ্চা দেখে কিছুই বললো না চলে গেল।

হাসপাতালে গিয়ে দেখলো আজ বেশ বড় একটা লাইন। ও সব রেখে পেশেন্ট দেখতে শুরু করলো। দুপুরের দিকে নওশিকে দেখতে গেল ওকে আজ রিলিজ দেওয়া হবে। মেহবিন ওকে বিদায় দিয়ে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।

_____________

“তা ডক্টর বাবুল আপনি একটা কথা বলুন তো! ডক্টর মেহবিনের সাথে আপনার শত্রুতা ছিল নাকি যে আপনার কৃতকর্মের জন্য ওনাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইলেন। আর সুস্থ মানুষদের অসুস্থ করে কি লাভ পান সেটাও বলুন। কে আছে আপনার মাথার ওপর।

ডক্টর বাবুল কোন কথা বললো না। মুখর এসেই ওনার চেহারার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। নতুন এসেছে একটু রয়ে সয়ে কর কিন্তু না আজকেই সব করতে হবে। পুলিশ স্টেশনের সবাই এটা দেখে অবাক হয়েছে মুখর সবার সাথে হাঁসি মুখে কথা বলেছে তারা ভেবেছে মুখর হয়তো অপরাধীদের সাথেও একইরকম হবে। কিন্তু কে জানতো অপরাধীদের সাথে তার এতো কঠোরতা। এস আই ও কনস্টেবলরা ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারন যেভাবে মুখর বাবুল কে মেরেছে সেভাবে কোনদিন কোন পুলিশকে তারা মারতে দেখেনি। ডক্টর বাবুল বলল,,

“আমি একাই এই কাজ করি আমার মাথার ওপরে কেউ নেই।”

“ওহ আচ্ছা তাহলে এস এস হাসপাতাল কি তোর নাকি। যে তুই পেশেন্ট দের ওখানে যেতে বলিশ।

একথা শুনে ডক্টর বাবুল চমকে উঠলো। আর বলল,,

“হ্যা ওটা আমারই।”

মুখর হেঁসে উঠল আর বলল,,

“তোকে দেখে মনে হয় আমি গাধা। ওটা যে শেখ শাহেনশাহ ওনার নামকরণে এস এস হাসপাতাল দেওয়া হয়েছে সেটা আমি জানি না। আর ওটা সম্পূর্ণ শেখ পরিবারের হাসপাতাল এটা আমি জানি না। এখন বল ঐ হাসপাতালের কার সাথে তোর আঁতাত।”

বাবুল ঢোক গিলতে লাগলো। তা দেখে মুখর শান্ত স্বরে বলল,,

“ভালোই ভালোই বলে দিন নাহলে আপনার সাথে কি করবো আমি নিজেও জানি না।”

তখন ডক্টর বাবুল অসহায় স্বরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,,

‘ না বললে হয়তো শুধু আমি মরবো। কিন্তু বলে দিলে আমার পরিবার শেষ হয়ে যাবে। নিজের পরিবারকে শেষ হতে দেখার চেয়ে নিজে মরাই উত্তম। আপনি আমায় মেরে ফেলুন তবুও আপনি আমার মুখ থেকে তার কথা জানতে পারবেন না।”

মুখর রেগে তার দিকে এগুবে এমন সময় বাবুল অজ্ঞান হয়ে গেল। মুখর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেল থেকে বের হলো। নিজের কেবিনে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেল। তখনি ওর টেবিলের ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো ও ধরে কিছু বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,,

“এই জুমাত তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তুই কোন সাহসে বাবুলকে গ্রেপ্তার করেছিস। ওকে তাড়াতাড়ি বের কর।”

মুখর হেঁসে বলল,,

‘দুঃখিত আপনার কথায় ডক্টর বাবুল কে ছাড়তে পারলাম না।

ওপাশের লোকটা বোধহয় হকচকিয়ে গেল। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,,

‘কে?”

“এই থানার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মুখর শাহরিয়ার।”

‘জুমাতের ট্রান্সফার হয়েছে আর আমি জানলাম না।”

“হয়তো আপনাকে জানানোর সুযোগ হয় নি।”

“হয়তো বা যাই হোক বাবুলকে ছেড়ে দিন।”

“কোনভাবেই না।”

“আপনার কতো লাগবে শুধু বলুন আপনার টেবিলে পৌঁছে যাবে।”

এবার মুখর রেগে গেল আর চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলো,,

‘আমাকে কি আপনার ঘুষখোর মনে হয়। যে ঘুষ নিয়ে একজন অপরাধী কে আপনার কথায় ছেড়ে দেব।

ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সুদ এমন বস্তু যার পরিণাম হচ্ছে সংকুচিত হওয়া যদিও তা বৃদ্ধি মনে হয়’ (ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৮২৭)।
আরেকটা হাদিস এ রয়েছে ‎আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘সুদের পাপের ৭০টি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হচ্ছে মাতাকে বিবাহ করা’ (ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৮২৬, হাদীছ ছহীহ)।

যদিও আপনাকে বলে কোন লাভ নেই। তবুও আমার বলার দরকার ছিল তাই বললাম। আমাকে যদি আর পাঁচটা পুলিশ অফিসারের মতো মনে করেন তাহলে আপনি ভুল। বাই দা ওয়ে আপনার নামটা বলেন একটু শুনি তো আপনার নামে তেমন কিছু আছে কি না যাতে ভয় পেয়ে আমি বাবুলকে ছেড়ে দিই।”

বলেই মুখর একটু শব্দ করে হাসলো। তা দেখে ওপাশের লোকটা রেগে বলল,,

‘এই তুই কে? তুই কার সাথে কথা বলছিস তুই জানিস ?”

“আরে আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমিও তো জানতে চাইছি আপনি কে?”

‘আমি তো সেই যার নাম তো সবাই শুনেছে কিন্তু কেউ দেখে নি। আমি হলাম ‘নিশাচর’ যার অস্তিত্ব শুধু অন্ধকারে।”

মুখর একটু থমকালো কারন এই নামটা ও পুলিশে ঢোকার পর থেকেই শুনে আসছে। অন্ধকার জগতের মাস্টার বলা যায় তাকে। একেই ধরার জন্য কতো পুলিশ অফিসার নিজেদের জীবন আর পরিবার হাড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মুখর সব কিছু কে সাইডে রেখে বলল,,

“বাহ বাহ এতো সুন্দর পারফেক্ট নাম কোথা থেকে রাখলেন বলুন তো। আপনার সাথে কতো কথা বলার ইচ্ছে ছিল আমার। এখানে আসতে না আসতেই পুরন হয়ে যাবে বুঝতে পারি নি।”

“আমার সাথে যেহেতু কথা বলার ইচ্ছে ছিল তারমানে আমাকে নিশ্চয়ই জানিস।”

“আরে জানবো না কেন? পুলিশে ঢোকার পর থেকে প্রত্যেকটা পুলিশ অফিসারের মুখে আপনার মতো বড় অপরাধীর কথা শুনেই তো এতদূর এসেছি ।”

“এই তুই অপরাধী কাকে বলছিস?

“কেন আপনাকে মানে নিশাচর কে।”

“তোকে তো আমি!! যাই হোক তুই বাবুলকে ছাড়বি কিনা?”

“কদাচিৎ নহে!”

‘তাহলে জীবনের কথা ভুলে যা। তোর ধারনা নেই আমি কি কি করতে পারি আমার কথা না শুনলে।”

“আরে ভাই দুনিয়ায় জীবনই তো মেন। যদি এটার কথা ভুলে যাই তাহলে কি করে হবে।”

মুখরের এরকম হেঁয়ালি পনা কথা শুনে ওপাশের লোকটা রেগে গেল আর বলল,,

“অতি বার বেরো না ঝড়ে পড়ে যাবে। এই বাক্যটা নিশ্চয়ই জানিস।”

“কথাটা আপনার জন্যেও প্রযোজ্য মিস্টার নিশাচর।”

“জীবনের মায়া আর এখানে থাকার ইচ্ছে থাকলে আমার কথা মতো চলতে হবে নাহলে এগুলোর কথা ভুলে যা।”

‘দেখা যাক না কি হয় তবে আমি যে আপনাকে ভুলে যাবো এটা সিওর।”

‘প্রথমদিনই আমার সাথে টেক্কা নিতে এসেছিস। কতোদিন টিকতে পারবি আমিও দেখে নিব।”

‘আইচ্ছা দেইখেন। যেদিন আমাদের দেখা হবে সেদিন কিন্তু আমার থেকে চোখ সরাবেন না বলে দিলাম।”

‘তোকে আমি কি করবো আমি নিজেও জানিনা।”

‘আমিও তোর সাথে কি করবো আমি নিজেও জানি না।”

শেষের কথাটা মুখর রেগেই বলল আর ফোন রেখে দিল। এতক্ষন দরজার আড়াল থেকে দুজন মানুষ মুখর কে পর্যবেক্ষন করেছিল। মুখর তা টের পেয়ে বলল,,

“আপনারা দুজন ভেতরে আসুন।”

তখন এস আই আর এক কনস্টেবল এলো ভেতরে তারা এসেই সরি বলল। মুখর তাদের কতোগুলো কথা বলল তারপর চলে যেতে বলল তারাও মাথা নিচু করে চলে গেল। এদিকে মুখর অন্য কিছু ভাবতে লাগলো।

_______________

মেহবিন ওর ডিউটি শেষে বের হয়ে দেখলো আরবাজ দাঁড়িয়ে তা দেখে মেহবিন বলল,,

“এখন এখানে কেন আপনি?”

“কালকের কাজটার জন্য শুভেচ্ছা জানাতে এলাম।”

“ওহ আচ্ছা।”

“এখন এই চকলেট গুলো নিন।”

মেহবিন আরবাজের হাত থেকে চকলেট নিল তার থেকে একটা ছিঁড়ে খেতে লাগলো। এক বাইট দিয়ে বলল,,

‘কালকে সরষের মধ্যে ভুতটাকে খুঁজে পেয়েছেন চকলেট বয়?”

“কাকে কি বলবো বলেন তো? তখন রান্না ঘরে মিসেস চেয়ারম্যান, তার ভাইয়ের বউ এবং আমার কাকার বউ ছিল তিনজন মানুষের মধ্যে কাকে সন্দেহ করবো। আর বুঝবোই বা কিভাবে কে কি করেছে বাড়িতে তো আর সিসি টিভি ক্যামেরা নেই। তাছাড়া মিশুকে বলে ওর থেকেও কোন কথা বের করতে পারলাম না কারন ঐ কথা শুনেই ও হায়পার হয়ে যায়।”

“ওহ আচ্ছা। তা তাদের এর বউ ওর বউ না বলে নিজের সম্বোধনেই ডাকতে পারতেন।

‘আপনি যদি না চেনেন তাই!”

“ওহ আচ্ছা। কালকে প্রথমে মিশু আমাকে ফোন করেছিল তখন কে ছিল সাথে?”

‘মিশুকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে সে বলতে নারাজ।”

“ওহ আচ্ছা শুনলাম আপনার দাদুভাই বাড়ি ফিরেছেন?”

‘হ্যা কালকেই ফিরেছেন ইস্তেমায় গিয়েছিলেন।”

“তা আপনার দাদুভাই নিজেকে শুদ্ধ করে ফিরেছেন তো। নাকি থাক আর বললাম না।”

মেহবিনের কথায় আরবাজ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। আর বলল,,

“মানে? ”

“কিছু না আপনি বাড়ি যান আমার কাজ আছে।”

“আপনি সবসময়,,

“শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ আপনি এখন আসতে পারেন আমার তাড়া আছে।”

“আজ ও কি আমার গাড়িতে যাবেন না।”

তখন মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘আপনার তো আর সরকারি গাড়ি না যে, আপনার গাড়িতে চড়ে আমি ট্যাক্সের টাকা উসুল করবো।”

বলেই মেহবিন হাঁটা ধরলো একটু এগিয়ে রিক্সা পেতেই সে রিক্সায় উঠে বসলো। আরবাজ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল আর নিজেও হেঁসে গাড়িতে করে চলে গেল। সকালে মুখর ওকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে মেহবিনের কাছে এসেছিলো। পরে আরবাজের বাবা আরবাজের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির রাস্তার সামনে মেহবিন রিক্সা দিয়ে আসতেই দেখলো তাজেল দাঁড়িয়ে আছে। মেহবিন দেখলো তাজেল রেডি হয়েই দাঁড়িয়ে আছে তাই ওকে রিক্সায় তুলে নিয়ে বাজারের দিকে গেল। মেহবিন জিজ্ঞেস করল,,

“নেত্রী স্কুলে ভর্তি হয়েছো?”

“হ দুপুরে কওয়ার পর বাপে নিয়া গেছিল। এই ক্যাপে তোমারে অনেক সুন্দর লাগতেছে ডাক্তার।”

“তাই বুঝি।”

“হ তোমার পাঞ্জাবিওয়ালা দেহি পাঞ্জাবি ব্যাচে না হেয় দেহি পুলিশ।”

“তুমি তাকে কোথায় দেখলে?”

“যহন তুমি ওনারে ফুল দিতাছিলা তহন থেইকা তোমার যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সব দেখছি।”

তাজেলের কথা শুনে মেহবিন মাথা চুলকিয়ে হাসলো। সে তো সবদিক দেখেই নিয়েছিল তাও তাজেল দেখলো কিভাবে? মেহবিন বলল,,

“তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখছিলে?”

“লুকায় দেখুম ক্যান আমার চোখ তো সামনাসামনি দেখছে। খালি আমার শরীর লুকাইয়া আছিল। তোমারে আশেপাশে তাকাইতে দেইখা আমি আমার শরীর লুকাইছিল কিন্তু আমার চোখ ঠিকই দেখছে।’

তাজেলের এরকম কথায় মেহবিন এর কিরকম রিয়াক্ট করা উচিৎ ওর জানা নেই। কিন্তু ও হেঁসেই ফেলল। তা দেখে তাজেল বলল,,

“কাল কেউ আইলেও দেখতে পারুম না কাল থেইকা আমি ইস্কুলে যামু। এমনিতে তো আমি প্রতিদিন আইয়া দেখতাম তুমি কেমনে যাও একদিন রিক্সায় যাও হাইটা যাও। ”

“তারমানে তুমি আমাকে চোখে চোখে রাখো নাকি নেত্রী।”

“তুমি যে সুন্দর যদি কেউ উঠায় নিয়া যায় হের লাইগাই তো চোহে চোহে রাহি। তুমি আসার সময় হইলে আমি তোমার বাড়ির সামনে দাড়াই থাহি। তোমারে দেখলেই বাড়ি যাইগা। যেইদিন তুমি চেয়ারম্যান গেছিলা হেইদিন খালি দাড়াই নাই।রাত হইয়া গেছিল দেইখা।”

মেহবিন তাজেলের কথায় হাসলো ওর জন্য তার নেত্রীর কতো চিন্তা। যেন তাজেল ওর অভিভাবক । বাজার এসে গেল তাই মেহবিন তাজেলকে নিয়ে ওর প্রয়োজনীয় সব কিনে নিল। দু’টো ভালো জামাও কিনে দিল একজোড়া জুতো ও কিনেদিল। তাজেল তো নেবেই না যদি ওর সৎমায় কিছু বলে এই জন্য। কিন্তু মেহবিন তো মেহবিন ও কিনে দিল। আবার সেগুলো সমেত ওকে বাড়ি দিয়ে এলো। তাজেলের সৎমা আড় চোখে কয়েকবার দেখে কিছু বলতে নিয়েছিল কিন্তু সেদিনকার কথা মনে পড়লো নওশির বাবাকে কি বলেছিল। এমনিতেও কেন যেন তিনি মেহবিন কে ভয় পায়।

পরেরদিন মেহবিনের সকালে হাঁটতে ভালোই লাগে তাই মনস্থির করলো। আজকেও হেঁটে যাবে আজকে তার সঙ্গী হলো তার নেত্রী মানে তাজেল তার সাথেই বেরিয়েছে। স্কুলে যাবে সে। আজকেও বাচ্চা তিনটাকে দেখলো মেহবিন আজ তো সরাসরিই একজন বলে দিল ,,

“আই লেবু!”

কাল না দাড়ালেও আজকে মেহবিন দাঁড়ালো এদিকে ওকে দাঁড়াতে দেখে তাজেল ও দাঁড়ালো। মেহবিন ওদের দিকে আগাতে দেখে ওখানের একজন বলল,,

” আজকে তোরে মারবো দেখিস। কাল গান গাইছিলি আজ আইলেবু কইছোস তুই আইজকা শেষ।”

কথাটা শুনে ছেলেটা বোধহয় ভয় পেল। মেহবিন ঐ ছেলেটার কাছে গিয়ে হেঁসে বলল,,

“আই লেবু মানে কি?”

ছেলেটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,,

“আপনে আইলেবু মানে জানেন না?”

তখন তাজেল বলল,,,

“আই তো গ্ৰামের মানুষ নিজেরে কয় আর লেবু মানে তো লেবু তাই ডাক্তার ওইডার মানে হইলো আমি লেবু।”

বলেই তাজেল হাসলো তা দেখে মেহবিন ও হাসলো তখন ঐ ছেলেটা বলল,,

“ঐ তাজেল চাপা কম নাড়। আই লেবু হইলো আই লাভ ইউ এর শর্টকাট। মানে আমি তোমারে ভালোবাসি।”

তখন মেহবিন বলল,,

“তারমানে আমারে তোমার পছন্দ হইছে? কাল ও গান গাইছিলা আমি নাকি তোমার মন কাইরা নিছি।

‘আপনেরে আমার বালা হাতুনের মতো লাগে খুব ভাললাগে আপনেরে।”

“বালা হাতুন কে?”

“কি জানি বড় ভাইয়ের ফোনে একদিন এক মাইয়ারে দেখছিলাম আপনার মতো বোরকাটাইপ কিছু পরে আবার মাথায় ও কি যেন পরে। পরে বড় ভাইরে জিগাইছিলাম সে কিডা হেয় কইলো বালা হাতুন কোন ওসমানের বউ। আমি তো মাঝে মাঝেই তাগো ভিডিও তে দেহি।

মেহবিন বুঝতে পারলো কুরুলুস ওসমানের কথা বলছে। মেহবিন হেঁসে বলল,,

“আমায় বিয়ে করবে?”

“এহ আপনে কতো বড় আপানারে বিয়ে করুম ক্যান।”

“তাহলে এভাবে গান গাইছিলে কেন কাল? আবার আজ তো আইলেবু বলেই দিলা।”

‘আরে এইডা তো আমি বড় ভাইয়ের থিকা শিখছি ওনারা তো কতো মাইয়ারে দেইখা কতো গান গায় আইলেবু কয় তারা কতো মজা করে।”

মেহবিন বুঝতে পারলো বড়দের দেখে টিজ করা শিখছে। তাই বলল,,

“তা মেয়েরা কি করে?”

“মাইয়ারা তো তাড়াতাড়ি ভাইগা যায়।”

“ওহ আচ্ছা তবে শুনো এরকম করতে হয় না। এগুলো খারাপ অভ্যাস। তোমার বড় ভাইরা ভুল করছে। এগুলো করলে মেয়েদের খারাপ লাগে।”

“কই বড় ভাইগো তো কেউ কিছু কয় না।”

মেহবিন বুঝতে পারলো এদের বলে লাভ নেই। এদের বড় ভাইদের কিছু করতে পারলে তাহলে ওরা বুঝবে। মেহবিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাজেল কে নিয়ে চলে গেল ।মেহবিন দুপুরের দিকে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে একটা কল পেল মিশুর নাকি গাছ থেকে পরে পা কেটে গেছে। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে সে হাত চিকিৎসা করাবে না। তাই তাকেই যেতে হবে মেহবিন তড়িঘড়ি করে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে ঢুকলো তখন কারো আওয়াজে সে থেমে গেল,,,

“বাড়ির ব্যক্তিগত মাইয়া ডাক্তার থাকতে আবার মিশুর জন্য অন্য ডাক্তার লাগবো কেন? ঐ ডাক্তার কি ওরে মাইরা ফেলবো যতসব পাগল।”

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০৯

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৯
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

কমিশনার সাহেব বাড়িতে এসেই দেখলো তার ভাই খবর দেখছে। তাকে দেখে তার ভাই আছলাম শাহরিয়ার বললেন,,

“ভাইয়া আজ খবর দেখেছো?’

ভাইয়ের কথায় মাহফুজ শাহরিয়ার হেঁসে বলল,,

‘পুলিশদের কি খবর দেখার সময় আছে? খবর তো বেশিরভাগ তারাই তৈরি করে।”

“মহুয়াপুরের ডাক্তার সম্পর্কিত হাসপাতালের খবর দেখেছো?”

“না দেখিনি তবে আমি পুরোটাই জানি। ও আমাকেই প্রথমে জানিয়েছে এ ব্যাপারে। প্রথমে তো সেই ডাক্তারটা ওকেই ফাঁসিয়ে দিয়েছিল পরে ও ওর বুদ্ধিমত্তায় জোরে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করেছে। তা হোম মিনিস্টার কোথায়??

“নিজের ঘরে তাই তো তোমাকে এখন এসব বলছি নাহলে তো জেনে যেতো মুখর আর সে এক জায়গায়ই আছে।”

মাহফুজ শাহরিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আর বললেন,,

“মেয়েটার সাথে বারবার এমন হয় কেন? ওর তকদিরে কি আছে সেটা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। ও নিজেও একটু আঁচ করতে পারলেও ও নিজেও জানে না ওর ভেতরে কি চলে আর ও কি চায়।”

বলেই তিনি চলে গেলেন। তার ভাই ও কিছু বললো না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

______________

“কি হয়েছে আমার মিশুমনির?”

মিশু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। কারো আওয়াজে মুখ তুলে তাকে দেখে আবার উপুড় হয়ে শুয়ে রইলো। তা দেখে আরবাজ বলল,,

“পেট নিচে রেখে উপুড় হয়ে শোয়ার ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে রাসূল (সঃ) এক ব্যক্তিকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে বললেন” এভাবে শোয়া আল্লাহ তায়লা পছন্দ করেন না ”
(মুসনাদে আহমদ ২/২৮৭-৩০৪)

অন্য এক হাদিসে এসেছে ” উপুড় হয়ে শোয়া হলো জাহান্নামীদের শোয়া”
(ইবনে মাজা-৩৭২৫;
শামায়েলে তিরমিযী হাদিস ২৫৪)

এ কথা শুনে মিশু উঠে বসলো আর বলল,,

‘আমি আর এভাবে শুবো না বাজপাখি। আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করেন এভাবে শোয়া তাহলে আমি শুবো না। এভাবে শুলে আল্লাহ আমাকেও অপছন্দ করবেন তাই না। আমি তো আল্লাহর প্রিয় হতে চাই।”

“হুম! তো কি হয়েছে মিশুর যে বাজপাখি কে দেখেও সে উঠলো না?”

“বন্ধু খুব পচা! বন্ধু একটুও ভালো না বাজপাখি।”

“কেন কেন ভালো না কেন? আর সে পচা কেন?”

“কারন বন্ধু আমায় বকেছে।”

“তুমি কি করেছো যে তোমায় বকেছে?”

“তুমি জানো আমি বন্ধুকে ফোন দিয়েছিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে কেন আমায় ছেড়ে গিয়েছিল? সে বলল প্রয়োজন ছিল তাই গেছিল।আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম কেন গিয়েছিল সে বললো মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়েছিল ‌ আমি আবার ও বললাম বারবার বললাম তারপর সে আমায় বকে দিয়েছে। আমি আর বন্ধুর সাথে কথা বলবো না।”

“তুমি একটা কথা বারবার বললে সে তো রাগ করতেই পারে তাই না। তা তুমি ওকে বারবার এক প্রশ্ন করছিলে কেন? সে তো কয়েকবার উত্তর দিয়েছে তারপরেও কেন জিজ্ঞেস করেছিলে?”

“আমাকে তো ম ক না না সেটা বলা যাবে না সেটা সিক্রেট রাখতে বলেছে।”

“কে সিক্রেট রাখতে বলেছে?”

“বললাম তো বলা যাবে না। বলা গেলে কি সিক্রেট থাকতো নাকি‌।”

“বললেই বলা যাবে তুমি বলো আমায়!”

“না বলবো না। আচ্ছা বন্ধু তো আমার বন্ধু হয় তাহলে বকলো কেন? আমি আর বন্ধুর সাথে কথা বলবো না বন্ধু অনেক পঁচা।”

তখন পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,,

“বন্ধুদের মধ্যে সব জায়েজ বন্ধুদের ওপর রাগ , অভিমান, অভিযোগ সব করা যায়। তুমি একই প্রশ্ন বারবার করছিলে দেখে তোমার বন্ধুর রাগ হয়েছিল একটু তাই তোমার ওপর রাগ ঝেড়ে ফেলেছে।

“রাগ কি ঝেড়ে ফেলার জিনিস নাকি পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি?”

মুখর মিশুর কথা শুনে হাসে। মিশু মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কি হলো বলো?”

“আচ্ছা যখন তোমার রাগ হয় তখন তোমার কি করতে ইচ্ছে হয়?”

“মনে হয় সবকিছু ভেঙে ফেলি।”

“ভেঙ্গে ফেলার পর শান্তি লাগে তাই না।”

“হ্যা শরীরে আর রাগ থাকে না তো।”

“তাহলে এখানে কি হলো তোমার সব রাগ জিনিসগুলোর কাছে গেল তাই না। এটাই হলো রাগ ঝেড়ে ফেলা।”

“ওহ আচ্ছা তাহলে বন্ধু আমার ওপর রাগ করেছিলো?”

“হ্যা করেছিল হয়তো। দেখো আমি যদি বারবার জিজ্ঞেস করি আকাশে চাঁদ কেনো উঠে তাহলে তোমার কেমন লাগবে?”

“আমার তো মনে হয় ভালোই লাগবে। তুমি জিজ্ঞেস করো তো কেমন লাগে দেখি।”

আরবাজ মুখরের দিকে তাকিয়ে হেঁসে উঠলো। আর বলল,,

“জিজ্ঞেস করেন পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি !”

মুখর হেঁসে জিজ্ঞেস করলো প্রথম প্রথম কয়েকবার মিশু ভালোভাবে জবাব দিলেও পরে বিরক্ত লাগলো‌ শেষমেশ বলেই দিল,,

“ধুর আমি আর উত্তর দেবই না। তুমি একই প্রশ্ন বারবার কেন করছো? আমার কিন্তু বিরক্ত লাগছে।”

এ কথাটা শুনেই মুখর এর মুখে বিশ্বজয়ের হাঁসি ফুটলো। তখনি শেখ শাহনাওয়াজ এলেন মিশুর ঘরে।তিনি এসেই বললেন,,

‘মিশু তুমি কি তোমার বন্ধুকে ফোন দিয়েছিলে আমার ফোন থেকে?”

মিশু মাথা নাড়িয়ে বলল,,

“হ্যা দিয়েছিলাম তো। কিন্তু বন্ধু আমায় বকেছে?”

মিশুর কথায় শেখ শাহনাওয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলল,,

“তুমি কিভাবে জানলে ওটা তোমার বন্ধুর নাম্বার?

‘ওটা তো আমি জানি না। ওটা তো ম না বলা যাবে না কে দিয়েছিল পরে আমার কোন কাজে সে সাহায্য করবে না।”

“বলো না একটু কে বলেছিল?”

“বলবো না। এখন যদি আবার জিজ্ঞেস করো তাহলে কিন্তু আমি তোমার সাথে কথা বলবো না।”

‘আচ্ছা ঠিক আছে আর জিজ্ঞেস করবো না। এখন বলো বন্ধু তোমায় কেন বকেছে?”

“আমি একটা কথাই বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম তাই বকে দিয়েছে।”

“তুমি একটা কথা বারবার কেন জিজ্ঞেস করবে। তুমি জানো তোমার বন্ধুর কতো কাজ থাকে। তুমি একটা কথা বারবার বলছিলে বলে তোমার বন্ধু তোমার ওপর রাগ করেছে তাই বকে দিয়েছে।”

“বন্ধু আমার ওপর রাগ করেছে বাবা? আমি তো বুঝতেই পারিনি। কিন্তু বন্ধু তো বলল আমার রাগ উঠিও না। তারমানে বন্ধু সত্যি সত্যি আমার ওর রাগ করেছে। তুমি বন্ধুকে একটা কল দাও আমি সরি বলবো।”

তখন আরবাজ বলল,,

“তুমি না বন্ধুর সাথে কথা বলবে না।”

“আরে আমি তো বুঝতে পারি নি বন্ধু আমার ওপর রাগ করেছে। আমি শুধু ভাবছি বন্ধু আমায় বকে দিয়েছে। বাবা তুমি ফোন দাও আমি কথা বলবো। বন্ধু যদি এখনো বকা দেয় তবুও আমি কথা বলবো। বন্ধুর সাথে কথা না বললে ভালোই লাগে না।”

‘আজ আর দিতে হবে না মিশু আবার কাল দিও।”

“না আমি এখন দেব!”

শেখ শাহনাওয়াজ মেয়ের কাছে হার মেনে মেহবিনকে ফোন করলো। এদিকে মেহবিন ভাবছিল হয়তো মিশুর সাথে এভাবে রুড হওয়া উচিত হয় নি। হুট করে মেহবিনের ফোনে চেয়ারম্যান সাহেব এর ফোন আসে এবার মেহবিন বিরক্ত না হয়েই ফোন রিসিভ করে সালাম দিল।

‘আসসালামু আলাইকুম!”

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। মিশু আপনার সাথে কথা বলবে?”

“দিন।”

শেখ শাহনাওয়াজ মিশুর কাছে ফোনটা দিল। মিশু ফোন কানে নিয়ে বলল,,

“সরি বন্ধু!”

“সরি কেন?”

“তুমি আমার ওপর রাগ করেছো তাই।”

‘আমি রাগ করি নি বরং আমি সরি তখন তোমার ওপর রুড হয়েছিলাম।”

“আরে না না আমিই তোমাকে বিরক্ত করছিলাম।সরি!”

“সরি বলতে হবে না।”

“তুমি কেমন আছো বন্ধু?”

হুট করে এমন প্রশ্নে মেহবিন হকচকিয়ে উঠলো। কারন এই প্রশ্নের উত্তর সবসময় তার জন্য কঠিন হয়ে পরে। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?

“আমিও ভালো আছি। তুমি জানো আমার না তোমাকে না দেখলে আমার ভালো লাগে না। তাই তো তোমায় ফোন দিয়েছিলাম।”

“আমি যখন থাকবো না তখন কি করবে তুমি?”

মেহবিনের এমন প্রশ্নে মিশু থমকে গেল। কিছু একটা মনে পরলো ওর ও উত্তেজিত হয়ে বলল,,

“না না তুমি আমার সাথে থাকবে তুমি কোথাও যাবে না। তুমি আমার সাথেই থাকবে সবার মতো হাড়িয়ে যাবে না।

মিশু কথায় মেহবিন ঠিকই বুঝলো মিশু উত্তেজিত হয়ে গেছে। তাই বলল,,

“রিল্যাক্স আমি এখন কোথাও যাচ্ছি না। তুমি খেয়েছো রাতে?”

‘না খাইনি। তুমি খেয়েছো?

“না খাবো !”

“তুমি কি করছিলে?”

“আমি তো শুয়ে ছিলাম তারপর বাজপাখি এলো তারপর পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি এলো তারপর বাবা এলো তারপর আমি তোমার সাথে কথা বলছি এখন।”

মিশুর এরকম কথায় মেহবিন হাসলো। কিন্তু একটা প্রশ্ন ওর মনে উকি দিল। তাই ও বলল,,

“পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি কে?”

“কি জানি এই পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি তোমার নাম কি?”

মুখর হেঁসে বলল,,

“মুখর শাহরিয়ার!”

“তার নাম মুখর শাহরিয়ার।”

“ওহ আচ্ছা। তাহলে আমি এখন ফোন রাখি।”

“তুমি আমার সাথে দেখা করবে কবে?’

“সামনে শুক্রবার।”

“আচ্ছা আমি কিন্তু তোমায় রোজ ফোন দেব। কারন তোমার সাথে কথা না বললে আমার ভালো লাগে না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। রাখছি আল্লাহ হাফেজ।’

“আল্লাহ হাফেজ।”

মেহবিন ফোন কেটে দিল। মিশু তো সেই খুশি। সে ফোন রেখেই একগাল হেসে বলল,,

“বন্ধু আমার সাথে রাগ করে নেই বাবা। সে শুক্রবার আমার সাথে দেখা করবে। আর রোজ আমার সাথে কথাও বলবে।”

মিশুর হাঁসি দেখে সবাই খুশি হলো। তারপর এক এক করে বেরিয়ে গেল মিশুর ঘর থেকে।

_______________

“মিস্টার মুখর শাহরিয়ার আপনার জয়েন কবে থেকে? বলেছিলাম আপনাকে আজ থেকেই জয়েন হতে। আপনার জন্য মেহবিনের কতটা সমস্যায় পরতে হয়েছে জানেন? আপনি যদি আজকে থেকে জয়েন হতেন তাহলে মেহবিনের জন্য সুবিধা হতো।”

“এখানে কি বলা উচিত জানা নেই স্যার। তবে একদিন বেশি ছুটি কাটানোর জন্য দুঃখিত।”

“যার জন্য আপনাকে ওখানে পাঠিয়েছিলাম তার প্রথম ধাপে মেহবিন আপনাকে পৌঁছে দিয়েছে।আশা করি এর পর আপনাকে কি করতে হবে? সেটা ভালো মতোই জানেন।”

“জি স্যার। আমি ওর থেকে সব কালেক্ট করে নেব।”

‘গাধা তোর জন্য ওর কতোটা সমস্যা ভোগাতে হয়েছে তুই জানিস। ও যদি আমায় মেসেজ করে সব না জানতো তাহলে ওকে পুলিশে ধরে নিয়ে যেতে পারতো।”

“সরি স্যার!”

‘রাখ তোর সরি স্যার আমি এখন তোর স্যার নয় তোর বাপ হয়ে কথা বলছি।”

‘সরি বাবা আমি জানি নাকি আজকেই কিছু হবে।”

“হুম প্রথম ভুল দেখে কিছু বললাম না। এরপর যদি তুই থাকতে কোন অসুবিধা হয় তাহলে তোর খবর আছে।”

“ওকে বাবা।”

“স্যার বল এখন!”

‘ওকে স্যার! আপনার বাবা আর স্যারের চক্করে আমি যেন কবে অক্কা পাই।”

এ কথা শুনে মাহফুজ শাহরিয়ার হাসলেন। ছেলের মন একটু খারাপ ছিল তিনি ফোনে কথা বলতেই বুঝেছিলেন । তাই তো ছেলের মন ভালো করার জন্য একটু মজা করলেন। মুখর ও হাসছে। হুট করেই মুখর বলল,,

“বাড়ির সবাই কেমন আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো তোর খবর বল?”

“ভালোই চলছে।”

“ও শোন নাফিয়া কে একটা ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে। সে পারিবারিক ভাবে সবার সাথে দেখা করে বিয়ের কথা বলতে চায়।

এ কথা শুনে মুখর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“সে ছেলেটা কি নাফিয়ার ব্যাপারে সব জানে বাবা?”

ওপাশ থেকেও একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,,

“হয়তো বা না!”

‘সব জেনে যদি নাফিয়াকে রিজেক্ট করে সবার সামনে তাহলে নাফিয়া খুব কষ্ট পাবে বাবা। এমনিতেও ও কষ্ট পায় আমার কথা ভেবে আমি চাই না ও আরও কষ্ট পাক।”

“তাই বলে হাল ছেড়ে দেব নাকি। তিন তিনটা জীবন একসাথে কষ্ট পাচ্ছে শুধু মায়ের ঐ একটা কথার জন্য। তোদের দুই ভাইবোনের কথা ছাড় তোরা তো তাও ফ্যামিলির সাথে থাকিস। কিন্তু ও, ওতো ভিশন একা তাই না।”

“ওর কথা ভেবেই আমার বুকটা ভার হয়ে আসে বাবা। কিন্তু কিছুই করার নেই। তুমি আগে ছেলেটাকে নাফিয়ার সমস্যার কথা জানাও তারপর দেখো ছেলেটা কি বলে। যদি বলে সব মেনেই সে নাফিয়াকে বিয়ে করবে তাহলে ঠিক আছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

“আচ্ছা রাখছি বাবা আল্লাহ হাফেজ। নিজেদের খেয়াল রেখো।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই মাহফুজ শাহরিয়ার ফোন রেখে দিলেন। মুখর ফোনটা রেখেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“তাওয়াক্কালতু আলাল্লহ্ ইনশাআল্লাহ সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। তবে সে আর আমি সেই অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। এ কথা আমাকে সেই বলেছে।

______________

মুখরের আজ প্রথম দিন। সে একবারে পুলিশের ইউনিফর্ম পরে তারপর নিচে এলো। নিচে আসতেই মিশু বলল,,

‘ও বাবাহ!! পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি তুমি দেখি পুলিশ?”

মুখর হেঁসে মাথা নাড়ালো। তা দেখে মিশু বলল,,

‘তাহলে আজ আমরা চোর পুলিশ খেলবো ঠিক আছে। তোমার বন্ধুক দিয়ে সব লুকানো চোরকে ডিসকাউ ডিসকাউ করে মেরে ফেলবো।”

“আজ তো আমায় যেতে হবে পুলিশ স্টেশনে আমরা বরং রাতে খেলবো ঠিক আছে।”

“ঠিক আছে।”

তখন আরবাজ বলল,,

‘আমাকে একটু স্টেশনে নামিয়ে দিস আমার কাজ আছে।”

‘কেন তোর গাড়ি করে যা না?”

‘আরে তোর সরকারি পুলিশি গাড়ি। আমরা সরকারকে কতো ট্যাক্স দিই সেগুলো তো উশুল করতে পারি না।এখন যখন সরকারি গাড়ি পেয়েছি তাহলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করবো।”

‘আচ্ছা ঠিক আছে।”

“বাবা কাকা কে কয়েকদিন যাবৎ বাড়ি দেখছি না দাদুভাই ও এসে গেছে কিন্তু কাকা কোথায় সে?”

ছেলের কথায় শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“পুরো একটা হাসপাতালের দায়িত্ব ওর ওপর। একজন বড় ডাক্তার সে । কাজের চাপ ছিল তাই এই সপ্তাহে বাড়ি আসেনি। তবে বলেছে খুব তাড়াতাড়িই আসছে।”

‘ওহ আচ্ছা।”

“তুমিও তো আমাদের হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসতে পারো আরবাজ।”

“হাসপাতাল কোন ঘোরার যায়গা হলো নাকি? আমি ব্যারিস্টার মানুষ আমি হাসপাতালে গিয়ে কি করবো? তোমাদের হাসপাতাল তোমরা দেখো আমার কি?”

“তাই বলে নিজেদের হাসপাতাল একটু দেখবে না।”

“না দেখার ইচ্ছে নেই।”

তখন মুখর বলল,,

“আপনাদের হাসপাতালের নাম কি আঙ্কেল?”

মুখরের জবারে শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“এস এস হাসপাতাল।!”

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০৮

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৮( বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

(অনুমতি ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ)

বহিস্কার করার কথা শুনে মেহবিন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ওর এর রিয়াকশনের মানে কেউ বুঝতে পারলো না। ডক্টর বাবুল এর মুখে হাসি তা দেখে মেহবিন বুঝতে পারলো উনিই কিছু ঝোল পাকিয়েছে। মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

‘আমার অপরাধ?”

তখন ডক্টর বাবুল বলল,,

“প্রথমত আপনি সিনিয়রের কথা শুনেন নি। আর দ্বিতীয়ত কালকে ইমার্জেন্সি হয়েছিল বলে হাসপাতালে এসে আপনি পেশেন্ট কে ইনজেকশন দিয়েছিলেন সেই পেশেন্ট টা আপনার ভুল ইনজেকশন দেওয়ার কারনে কোমায় চলে গেছে।”

মেহবিন এবার বুঝতে পারলো সমস্যা কোথায় হয়েছে। কিন্তু ও এখনো শান্তই ও বলল,,

“আমার তো মনে পরছে না আমি কোন ভুল ওষুধ দিয়েছি যার জন্য উনি কোমায় চলে যেতে পারেন?”

“যেতে পারেন না ডক্টর মেহবিন। উনি কোমায় চলে গেছেন এবং আপনার ইনজেকশন দেওয়ার কারনেই উনি কোমায় চলে গেছেন।”

মেহবিন মুচকি হাসলো এবার আর হাঁসি বজায় রেখেই বলল,,

“উনার যতদূর শরীরের অবস্থা সেই হিসেবে কেউ কোমায় চলে যাওয়ার ওষুধ না দিলে উনি ভুলভাল ইনজেকশনেও কোমায় যাবেন না।”

তখন হেড সিনিয়র ডক্টর বললেন,,

“দেখুন ডক্টর মেহবিন কাল বন্ধ ছিল ইমার্জেন্সি ছিল বলে আপনাকে এখান থেকে কল করা হয়েছিল কারন পেশেন্টকে আপনি আর ডক্টর বাবুল দেখছিল। ডক্টর বাবুল তো আসেন নি আপনি এসেছিলেন। আর একটা ইনজেকশন ও দিয়েছিলেন যার দরুন এরকমটা হয়েছে। সকালেই ডক্টর বাবুল বোর্ড কে ব্যাপারটা জানিয়েছেন। আর সব শুনে বোর্ড এই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সব শুনে মেহবিন শান্ত ভাবেই বলল,,

“আপনি সিওর যে আমার ইনজেকশনেই এমনটা হয়েছে?”

তখন ডক্টর বাবুল বলল,,

“হ্যা আমি সিওর আপনার ইনজেকশনের কারনেই এমনটা হয়েছে। আমার পেশেন্ট আমি ভালোমতোই জানবো তাই না।”

“ওহ আচ্ছা। তাহলে সেদিন আপনার পেশেন্ট থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন তাকে অন্য হাসপাতালে পাঠাচ্ছিলেন ডক্টর বাবুল?

এ কথা শুনে ডক্টর বাবুল সিনিয়র ডক্টরের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। এদিকে সবাই এখন ডক্টর বাবুলের দিকেই তাকিয়ে আছে তা দেখে তিনি আমতা আমতা করে বলল,,

“আস্ সলে পে পেশেন্ট এর অবস্থা এখান থেকে ঠিক হচ্ছিল না তাই অন্য জায়গায় শিফ্ট করতে বলেছিলাম। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা এটা নয় এখানে ব্যাপারটা হলো ডক্টর মেহবিনের গাফিলতির জন্য একজন কোমায় চলে গেছে।”

তখন সিনিয়র ডক্টর বললেন,,

‘হ্যা ঠিক এটাই। তো ডক্টর মেহবিন আপনি আপনার জবাব পেয়েছেন । এই কারনেই আপনাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। যদিও লাইসেন্স বাতিল এখনো হয় নি শুধুমাত্র বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে হতেও পারে আপাতত সেটা বলতে পারছি না। আপনার এরকম ইরেসপন্সিবল কাজের জন্য একটা মানুষের কি পোহাতে হতে পারে এটা ভেবে আপনার লাইসেন্স ও বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে বোর্ড। বোর্ড থেকে আজ বন্ধের জন্য সবাই নেই এখানে তবে এখানে পুরো বোর্ডের মতামত নেওয়া হয়েছে।

তখন ডক্টর বাবুল বললেন,,

‘এইটুকুতেই থেমে নেই ডক্টর মেহবিন। পেশেন্ট এর বাড়ির লোক আপনার নামে কেস করেছে পুলিশ এলো বলে।”

মেহবিন ছোট্ট করে বলল,,

“ওহ আচ্ছা!”

মেহবিনের এরকম দায়সারা ভাবে দেখেই সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মেহবিন খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু ঘাটছে। তখন হেড সিনিয়র ডক্টর বললেন,,

“ডক্টর মেহবিন আপনি কি কিছু বলবেন আপনার কি একটুও অনুশোচনা বা ভয় নেই।”

মেহবিন ফোন ঘাটতে ঘাটতেই বলল,,

‘ভয় আমার কোনদিনও ছিল না। আর অনুশোচনা সেটা মানুষ ভুল করলে তার অনুশোচনা হয়। আমার মতে আমি কোন ভুল করিনি যার জন্য অনুশোচনা হবে।”

“আপনি বলছেন পেশেন্টের এই অবস্থায় আপনার কোন দায় নেই।”

‘মনে তো হচ্ছে না তবে একটা জিনিস বলতে পারি ওনার কপালে এরকমটা ছিল তাই হয়েছে। আপনারা আপনাদের কাজ করেছেন আমাকে আমার কাজ করতে দিন। পুলিশ কখন আসবে ডক্টর বাবুল?”

মেহবিনের এরকম কথায় ডক্টর বাবুল একটু চমকেই উঠলেন। বাকি দুজন মেহবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ পর্যন্ত এমন কাউকে তারা দেখেনি কারো ডাক্তারি লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেছে তবুও কি শান্ত ভাবে রয়েছে কষ্টের ছিটেফোঁটাও নেই এমনকি ভয় বা রাগ ও নেই। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এলো। মেহবিন ভেবেছিল মুখর হয়তো জয়েন করেছে কিন্তু গাধাটা রেস্ট এর চক্করে আজকেও জয়েন করে নি কাল বোধ হয় করবে। এসেছেন একজন এস আই। তার সাথে পেশেন্ট এর বাড়ির একজন লোক এসেছে। কেবিনে ঢুকেই লোকটা আর ডক্টর বাবুল তাকে বলল,,

‘উনিই ডক্টর মেহবিন উনার জন্যই একজন মানুষ কোমায় চলে গেছেন। আপনি ওনাকে এরেস্ট করুন অফিসার।”

মেহবিন কাউকে ফোন করে এস আই এর দিকে এগিয়ে দিল। তা দেখে এস আই বলল,,

“এটা কি? আর কে আছে কলে আমি এখানে ফোনে কথা বলতে আসি নি। আমি আপনাকে এরেস্ট করতে এসেছি।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“ফোনটা না ধরলে কিভাবে বুঝবেন কলে কে আছেন?”

লোকটা মেহবিনের কথায় ফোনটা কানে নিলেন ওপাশের আওয়াজ শুনতেই সে সোজা হয়ে স্যার স্যার করতে লাগলেন।

“সরি স্যার!
জি স্যার আমি এখনি দেখছি।
জি স্যার অপরাধী অবশ্যই শাস্তি পাবে।
জি স্যার আমি সব ব্যাবস্থা করছি।
নো স্যার এরপর থেকে আমাকে এ অবস্থায় আর পাবেন না।
জি স্যার ওকে স্যার!
সরি স্যার এড থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”

এদিকে লোকটার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তার অবস্থা দেখে ডক্টর বাবুল এর গলা শুকিয়ে আসছে কিছু তো খারাপ হতে চলেছে তার সাথে সে বুঝতে পারছে। বাকিরা অবাক চোখে মেহবিন কে আর অফিসার কে দেখছে। কথা শেষ করে লোকটা মেহবিনের দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,,

‘সবকিছুর জন্য দুঃখিত ম্যাম।”

তখন ডক্টর বাবুল বললেন,,

“একজন অপরাধী কে সরি বলছেন কেন? আর ফোনেই কে ছিল?”

তখন এস আই বলল,,

“আপনার থেকে জানতে হবে না কাকে কি বলতে হবে। আপনি চুপ থাকুন। আর ফোনটা আমাদের কমিশনার স্যারের ছিল।”

এ কথা শুনে সকলে বিস্ফোরিত চোখে মেহবিনের দিকে তাকালো। মেহবিনের এখনো শান্ত দৃষ্টি। মেহবিন তখন নিজের ফোন বের করে সবাইকে দেখালো কাল মেহবিন বের হওয়ার প্রায় তিন ঘন্টা পর রাতে ডক্টর বাবুল আসেন একজন নার্সের সাথে কথা বলে একটা ইনজেকশন পুশ করে । তারপর পেশেন্ট টা ছটফট করে একটু তার এক মিনিট পরেই নিস্তেজ হয়ে পরে। তারপর থেকেই ওনার আর কোন আর কোন রেসপন্স নেই মানে উনি কোমায় চলে গেছেন। এমনকি মেহবিন সেদিনের একটা ভিডিও দেখালো এর আগেও ডক্টর বাবুল একটা ইনজেকশন দিয়েছিলেন যার জন্য লোকটার অবস্থার অবনতি হয়। কিন্তু ইনজেকশন পুশ করার সময় কেউ ওনার সাথে ছিল না। সব দেখে ডক্টর বাবুলের ঘাম ঝড়তে থাকে। ভিডিও দেখানো শেষ হলে মেহবিন বলল,,

“এখন কি বলবেন ডক্টর বাবুল?”

ডক্টর বাবুল তড়িঘড়ি করে করে বলল,,

‘এগুলো ইডিট করা এটা হতেই পারে না।”

“কেন হতে পারে না এটা তো স্পষ্ট এখানে আপনার চেহারা রয়েছে পেশেন্ট ও একজনই এমনকি হাসপাতাল ও এটাই। সিসি টিভি ক্যামেরা থেকে সহজেই এই ভিডিও গুলো নেওয়া যায়।”

“না সহজে নেওয়া যায় না কারন সিসিটিভি ফুটেজ সবাইকে দেখানো হয় না কিছু নির্দিষ্ট মানুষ ছাড়া এগুলো কেউ দেখতেও পারে না। আর ফুটেজ নেওয়া তো দূর। কারন আমি না করেছি ওর ওতো সাহস নেই কাউকে ফুটেজ দেখাবে। কারন ফুটেজ দেখলেই আমি সবার কাছে,,

জোশে হুশ হাড়িয়ে ফেলেছে ডক্টর বাবুল। তাই তো নিজেই সব বলে দিচ্ছিলেন। মেহবিন হেসে বলল,,

“সবার কাছে ধরা পরে যাবেন এই তো! তবে সত্যি ফুটেজ গুলো নিতে আমার খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। যাস্ট সিসিটিভি কন্ট্রোল রুমটা একটু হ্যাক করতে হয়েছে।সেদিন আপনার অস্বাভাবিক আচরন দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম আপনার ভেতরে কিছু একটা তো আছে সবথেকে বড় কথা আপনি নিজে একজন সিনিয়র ডাক্তার হওয়া সত্বেও অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। তখনই সন্দেহ হয়েছিল তাই তো সিসিটিভি কন্ট্রোল রুমে গিয়েছিলাম কিন্তু ওখানে গিয়ে আপনার বুলি শুনালো তখন সন্দেহ আরো গাঢ় হলো। তাই তো হ্যাক করে দেখে নিয়েছিলাম কাল এই বিষয়ে বলতাম সিনিয়র স্যার কে। এছাড়া এই হাসপাতালের সবার অগোচরে আপনি অনেক সুস্থ লোককে অসুস্থ করেছেন শুধু অন্য হাসপাতালে পাঠাবেন বলে। সেদিন আমার জন্য আপনি অন্য হাসপাতালে পেশেন্ট কে পাঠাতে পারেন নি। তাই আমাকে জব্দ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আপনার খুব তাড়া ছিল আমাকে জব্দ করার তাই নিজেই একদিন আগে করলেন। একটা কথা মনে রাখবেন ডক্টর বাবুল,,

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সত্য একটি পুণ্যময় কাজ। আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্যের উপর দৃঢ় থাকে, তাকে আল্লাহর খাতায় সত্যনিষ্ঠ বলে লিখে নেয়া হয়। পক্ষান্তরে মিথ্যা হচ্ছে পাপকাজ। পাপাচার জাহান্নামের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাকে আল্লাহর খাতায় মিথ্যুক বলে লিখে নেয়া হয়’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত বাংলা ৯ম খণ্ড হা/৪৬১৩)।

আবূ সিরমাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করবে, আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন এবং যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দিবে, আল্লাহ তাকে কষ্ট দিবেন। ”
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৩৪২)

নিজের কষ্টের জন্য তৈরি থাকুন যাই হোক অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেলেছি। অফিসার এরেস্ট হিম।”

ডক্টর বাবুল সব শুনে কিংকর্তবিমূড় হয়ে রইলো। তারমানে এতো দিনের সাজানো গোছানো সাম্রাজ্যে প্রথম ফাইলটা তার মধ্যে দিয়েই হলো। একদিন গোটা সাম্রাজ্যই একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে সেটা ডক্টর বাবুল বুঝতে পারছেন। এস আই ডক্টর বাবুল কে এরেস্ট করলেন। ডক্টর বাবুলের কথা পুরো বোর্ড কে জানানো হলো। তারা তার লাইসেন্স বাতিলের জন্য মনস্থির করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেন ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেল বাবুল এর কথা। হেড সিনিয়র ডক্টর মেহবিনের কাছে ক্ষমা চাইলেন। আর বললেন,,

‘আই এম রেইলি সরি ডক্টর মেহবিন আমরা কেউ বুঝতেই পারি নি রক্ষকই ভক্ষক। কিন্তু আপনি বুঝলেন কিভাবে? পেশেন্ট কোমায় যাওয়ার জন্য আপনার ইনজেকশন দায়ী নয়।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘এমনি এমনি বাইরের দেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তার হইনি। এ দেশের থেকে বাইরের দেশের সবকিছুই উন্নত এটা জানেন তো। আমি এমবিবিএস সেকেন্ড ইয়ার এখানে শেষ করে তারপরে বাইরের দেশে গিয়ে পুরো ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করেছি। ছয়মাস সেখানেও ডক্টর হিসেবে ছিলাম।আর এটুকু বুঝতে পারবো না। আর হ্যাকিংটাও আমি বিদেশে থেকেই শিখেছি।”

মেহবিনের কথা শুনে ডক্টর দুজন অবাক হয়ে গেল। মেহবিন আর কিছু না বলে ওখান থেকে চলে এলো।
মেহবিন সব কাজ শেষ করে বাইরে বের হলো। রাস্তায় দেখলো ফুচকা তাই সে ওখানে গেল গিয়ে মনের সুখে ফুচকা খেতে লাগলো। মুড টা এখন অনেক ভালো আছে। একটা কোন আইসক্রিম কিনে মেহবিন একটা রিক্সায় উঠলো। রিক্সাচালক বেশ বয়স্ক মানুষ। হুট করেই রিক্সাচালক বললেন,,

“এই মালাই মেলা স্বাদ তাই না?”

মেহবিন এক পলক তার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“হঠাৎ এরকম প্রশ্ন কেন করলেন?”

“আমার নাতি খুব খায় এইগুলা তাই মনে হইলো মেলা স্বাদ।”

“আপনি কখনো খেয়েছেন?”

“না খাই নাই তবে অনেক খাওয়ার শখ আছে। কিন্তু খাওয়ার কথা মনেই থাহে না। আর যহন মনে থাহে তহন ট্যাকা থাহে না।”

এ কথা শুনে মেহবিন একটা দোকান দেখে রিক্সা থামাতে বলল। মেহবিন দোকানে গিয়ে একটা কোন আইসক্রিম আনলো আর হেঁসে রিক্সাচালক এর হাতে দিয়ে বলল,,

” খেয়ে দেখেন তো মেলা স্বাদ কি না?”

“তুমি আবার মালাই কিনতে গেলা কেন? আমি তো এমনিই কইছি।”

“আমিও তো এমনিই দিয়েছি। আমার তাড়া নেই আপনি ধীরে সুস্থে খান তারপর চলেন। ভয় নেই আমি ভাড়া দেব। এটা আপনাকে উপহার হিসেবে দিলাম।”

মেহবিনের কথা শুনে লোকটার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে একটা হাঁসি দিয়ে খেতে লাগলো এতোদিন সবাইকে দেখেছে খেতে আজ নিজে খাচ্ছে মুহুর্তটা অন্যরকম। সে ওপরের কাগজ ছিঁড়ে খেতে লাগলো মেহবিন ও মুচকি হেসে খেতে লাগলো। দুজনের খাওয়া শেষ হলে তিনি বললেন,,

‘তুমি যেমনে আমার শখ পুরন করলা তেমনে আল্লাহ জানি তোমার সব শখ পুরন করে।”

‘আমিন!”

“মালাই ডা মেলা স্বাদ আছিল। আইজকা বাড়ি যাওয়ার সময় আমার বউয়ের জন্য নিয়া যামু। আইজকা আমার কাছে ট্যাকা আছে।”

সব শুনে মেহবিন হাসলো। ভালোবাসা সুন্দর। সন্ধ্যার আগে মেহবিন বাড়ি পৌঁছালো।

__________________

মাগরিবের নামাজ শেষ করে উঠতেই ওর ফোনটা বেজে উঠল ও দেখলো সেই চেয়ারম্যান সাহেবের কল। মেহবিন ফোন ধরেই বলল,,

‘আপনার সমস্যা টা কি বলবেন? যখন তখন ফোন করেন কেন? আপনি আবার,,

‘বন্ধু!”

মেহবিন বুঝতে পারলো মিশু ফোন করেছে। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে বলল,,

‘হ্যা বলো।”

“বাবা তোমায় ফোন দিয়েছিল না।”

‘হ্যা দিয়েছিল।”

“তাহলে তুমি এলে না কেন?”

‘আমার কাজ ছিল তাই।”

“আমি তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম।”

‘কেন?”

“জিজ্ঞেস করতে কাল তুমি আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলে কেন?”

“কখন!”

“ঐ বিকেলে বাজপাখি আমায় ধরলো আর তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে।”

‘কারন তখন প্রয়োজন ছিল যাওয়ার তাই গিয়েছিলাম।”

“তুমি আমায় ছেড়ে কেন গিয়েছিলে?”

‘আমি তো বললাম প্রয়োজন ছিল।”

“তুমি কেন গিয়েছিলে?”

এবার মিশুর কথায় মেহবিনের মেজাজ গরম হলো। তবুও নিজেকে যথআসম্ভব শান্ত রাখলো। মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

“আমি তখন না গেলে একটা মেয়ে মরে যেত। তাই গিয়েছিলাম তখন গিয়েছিলাম বলেই মেয়েটাকে বাঁচাতে পেরেছিলাম।”

“তবুও তুমি আমায় ছেড়ে কেন গেলে?’

মেহবিন বুঝতে পারছে না মিশু বারবার একই কথা বলছে। মেহবিন নিজেকে শান্ত করে বলল,,

“তোমার বাবা কোথায়?”

“জানি না এখানে নেই।”

“তুমি কোথায়? আর তুমি কিভাবে জানলে এটা আমার নাম্বার?”

“আমাকে তো ম ক নানা সেটা বলা যাবে না সেটা সিক্রেট । তুমি এ কথা বাদ দাও তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে কেন?

মিশুর এমন হেঁয়ালি পনা কথায় মেহবিন একটু রেগেই বলল,,

‘তুমি কে যে তোমার সাথে থাকতে হবে। চেয়ারম্যান এর মেয়ে হয়েছো বলে তোমায় মাথায় করে রাখতে হবে। ফোন রাখো তুমি শুধু একটাই প্রশ্ন কেন ছেড়ে গিয়েছিলাম। আরে তোমায় তখন ছেড়ে না গেলে একটা মেয়ে মরে যেতো।”

ওপাশ থেকে মিশুর কাঁদো কাঁদো গলা শোনা গেল।

“বন্ধু তুমি?”

‘মিশু এখন প্লিজ আমার মাথা গরম করিও না।”

‘তুমি একটুও ভালো না বন্ধু তুমি অনেক পঁচা তুমি আমায় বকেছো। তুমি আমার সাথে আর কথা বলবে না।”

‘ঠিক আছে।”

বলেই মেহবিন ফোন রেখে দিল। এদিকে মিশু ও ফোনটা রেখে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। তা দেখে একজনের মুখে পৈশাচিক হাঁসি ফুটে উঠলো। সে ঠিক এটাই চেয়েছিল।

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০৭

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৭
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“আমার কেউ নেই ‘ কতো ছোট্ট একটা বাক্য তাইনা। কিন্তু এই কথাটা বলতে কতটা শক্তি প্রয়োজন হয় সেটা কি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে? সারা শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে তারপর বলতে হয় ‘আমার কেউ নেই!”

ফেসবুকের সাদা স্কিনে লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। পোস্ট টা পাচ মিনিট আগেই করা হয়েছে “কাব্যের বিহঙ্গিনী” পেজ থেকে। কতোশত স্যাড রিয়াক্ট আর কমেন্ট এর ছড়াছড়ি। বিহঙ্গিনী পেজের মেয়েটার কি হয়েছে সবাই জানতে চাইছে। কিন্তু এই কমেন্টের কোন রিপ্লাই আসবে না সেটাও সবাই জানে। মুখর পোস্ট টা দেখা মাত্রই কমেন্ট এ কিছু লিখতে নিল কিন্তু লিখে আবার মুছে ফেললো। চোখগুলো জ্বলতে লাগলো হয়তো পানিগুলো জমা হচ্ছে চোখে। তখনি আরবাজ এলো ওর রুমে। ফোন হাতে ওর চোখেও পানি ছলছল করছে। হয়তো কিছু হয়েছে কিনা এটা জানার জন্য নাকি তাঁদের কোন কাজে সে কষ্ট পেয়েছে এটা বলার জন্য।

_____________

সবেই চোখ বন্ধ করেছে মেহবিন এমন সময় একটা নোটিফিকেশন এলো। মোবাইল টা হাতে ধরতেই দেখলো ‘বিহঙ্গিনীর কাব্য’ আইডি থেকে নতুন পোস্ট হয়েছে।

“কতো সহজে ‘আমার কেউ নেই’ এই কঠিন কথাটা বলে দিল সে। কিন্তু সে কি জানে না অপ্রকাশিত সবার সামনে হলেও একজন তাকে অসম্ভব ভালোবাসে।”

মেহবিন মুচকি হেসে কমেন্ট লিখলো,,

‘অসম্ভব ভালোবাসে দেখেই তো বোধহয় সঙ্গটাও অসম্ভব হয়ে পরেছে।”

‘সে কি জানে? তার পরিপূর্ণ সঙ্গ পাওয়ার জন্য কেউ অতন্দ্র প্রহরীর মতো অপেক্ষা করে আছে।”

“বিহঙ্গিনীর সাথে সন্ধিও যেমন জরুরি ছিল সাথে বিচ্ছেদ ও বোধহয় জরুরি ছিল।”

“এই বিচ্ছেদ কি তার মনকে বিষাদে ভরে দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ায়?”

“উঁহু,,
আমি বিষাদ নিয়েছি কিন্তু অশ্রু নয়!
আমি সম্পর্ক গড়েছি কিন্তু সঙ্গ নয়!
সবশেষে আমি বিচ্ছেদ নিয়েছি
তবে একেবারে সম্পর্ক ছিন্ন করে নয়।”

ওপাশ থেকে অনেকক্ষন কোন রিপ্লাই আসলো না। তা দেখে মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ঘুম আসলো না । মনে পরলো ইয়ারফোন টা ব্যাগে রয়েছে একটু সূরা শোনা যাক। মেহবিন উঠে ব্যাগে হাত দিতেই দু’টো ফুল দেখতে পেল তার সাথে একটা চিরকুট। মেহবিন ফুল দু’টো বের করে চিরকুট টা খুলল তাতে লেখা,,

“ফুল কে ফুল না দিতে পারার কষ্ট হলেও পরে তা প্রশমিত হলো। কথা ছিল প্রতিটা সাক্ষাতেই ফুল দিতে হবে। কিন্তু আজ আর হাতে দেওয়া হলো না। তাই ব্যাগে রেখে দিলাম। তোমার জীবন ফুলের মতোই কোমল হোক।”

মেহবিন হাসলো মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। তারপর ইয়ারফোনটা নিয়ে বিছানায় এলো সূরা রহমান ছেড়ে ইয়ারফোন কানে গুজলো। এক সময় ঘুমিয়েও পরলো।

__________________

প্রতিটা দিনের মতো আজ ও সকাল হলো। কিন্তু মেহবিনের কিছু ভালো লাগছে না।
আজ শনিবার আজ ও তার ডিউটি নেই। ফজরের নামাজ পড়ে আবার শুয়ে রইলো। ঘুম ও আসছে না কিছু ভালোও লাগছে না হুট করেই মনটা অশান্ত হয়ে আছে। খাওয়ার জন্য কিছু বানাবে তাও ভালো লাগছে না। সকাল আটটা বাজে এমন সময় কেউ ওকে ডাকছে। কি আর করার বাইরে বের হলো বারান্দার কেচিগেইট এর তালা খুলে দেখলো একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“কিছু বলবেন?”

“হ ”

“জি বলুন?”

“তোমার তো ফ্রিরিজ আছে তাই না। আমার এই দুধটুকু রাখবা দুইদিন পর নিয়া যামুনে।”

“আচ্ছা রেখে যান। তবে হ্যা আমি কিন্তু সারাদিন বাড়ি থাকবো না। সকাল আটটার আগে না হয় সন্ধ্যায় নিতে হবে যেদিনই নেন।”

“আইচ্ছা।”

মেহবিন ওনার হাত থেকে দুই লিটারের বোতল টা রেখে দিল। ক্ষুদাও লেগেছে রাতে আর খায় নি সে। দুপুরের খাবার গুলো এখনও আছে ফ্রিজে । কিন্তু এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। রান্নাঘরে গিয়ে কাপ নুডুলস বের করলো একটু গরম পানি করে নুডুলস বানিয়ে নিল। ঘরে গিয়ে বাবু হয়ে বসে খেতে লাগল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে। একটা টুল নিয়ে রোদে বসে রইলো। বেশ শীত করছে তার। রোদে বসে বসে নানান জিনিস ভাবছে সে। তখন ওর ফোনটা বেজে উঠলো কালকের আন নোন নাম্বার থেকে মানে চেয়ারম্যান সাহেব। ও ফোন কানে ধরে সালাম দিল,,

“আসসালামু আলাইকুম!”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

“তো কি বলার জন্য ফোন দিয়েছেন?”

“আজকে যদি আপনাকে দাওয়াত দিই আপনি কি গ্ৰহন করবেন?”

“আপনার কি মনে হয় না আপনাদের সাথে আমার যোগাযোগ টা বেশী অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাচ্ছে। এতো তাড়াতাড়ি এতো ফ্রি হওয়া ঠিক নয়। মিশু না হয় অসুস্থ আপনি তো নন।”

“আমার মেয়েটা চাইছে বলেই তো!”

“সবসময় সব ইচ্ছে কে প্রশ্রয় দিতে নেই চেয়ারম্যান সাহেব।”

“যে কখনো ইচ্ছে করে না সেই যদি কিছু ইচ্ছে করে তবে তা করা উচিৎ নয় কি?”

“সেটা আপনাদের পারিবারিক বিষয় আমাকে জরাচ্ছেন কেন?’

“আপনি না চাইলেও তো জরিয়ে যাচ্ছেন। আপনি দাওয়াত টা রাখবেন কি না।”

“আপাতত আমি আজ কোথাও যেতে চাচ্ছি না। সবথেকে বড় কথা দাওয়াত টা কি উপলক্ষে?”

“তেমন কোন উপলক্ষ নেই আজ বাবা আই মিন মিশুর দাদু বাড়ি ফিরছেন।”

“ওহ আচ্ছা। দুঃখিত আপনার দাওয়াত গ্ৰহন করতে পারছি না। আর সবকিছুতে আমাকে জড়ানো বন্ধ করুন। কাল আপনারাই পারতেন মিশুকে শান্ত করতে হুদাই আমাকে নিলেন। আজকে আমাকে ফোন না করলেও পারতেন নিজেদের মতো দিনটা উদযাপন করতে পারতেন। আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে আমাকে টানবেন না প্লিজ।”

“কালকে আরিফা ঐ কথাটা বলেছে বলে এমন করছেন ডাক্তার?”

“না আমি শুধু সত্যি কথা বলছি।”

“আপনি জানতে চাইছিলেন না অনু কে?”

“হুম চেয়েছিলাম কারন তার কথা জানতে পারলে হয়তো মিশুর ব্যাপারে আমি আরেকটু সাহায্য করতে পারতাম। তবে এখন মনে হচ্ছে আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে না জড়ানোই উত্তম। এক সপ্তাহ হয় নি আমি এখানে এসেছি। চেয়ারম্যান বাড়ির সাথে এতো সখ্যতা নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না মানুষ।”

“আপনি মানুষের কথা ভেবে চলেন ডাক্তার।”

“আমি আমার কথা বলছি না চেয়ারম্যান সাহেব। আমি আপনাদের কথা বলছি স্পেশালি আপনার কথা বলছি। আপনি চেয়ারম্যান মানুষ আপনার একটা সম্মান আছে।”

“এতো সম্মান দিয়ে কি হবে? যদি নিজের মানুষদেরই খুশি রাখতে না পারি। এতো সম্পদ এতো সম্মান আমার , কিন্তু মানুষের এতো সম্মানের পরেও আমার মেয়ের খেতাব চেয়ারম্যানের পাগল মাইয়া। আপনাকে জড়াই কারন আমার মেয়ের আপনি পছন্দ, তার বন্ধু আপনি। তাই আমি আমার মেয়েকে খুশি রাখতে আপনার সাথে সখ্যতা গড়ছি। লোকে কি বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”

“আপনি খুব স্বার্থপর একজন মানুষ। আপনি আপনার মেয়ের ভালোর জন্য আমাকে ব্যবহার করছেন চেয়ারম্যান সাহেব।”

“তেমন টা নয় আপনি ভুল বুঝছেন।”

“আপনাকে নতুন করে আমায় বুঝতে হবে না চেয়ারম্যান সাহেব।”

“মিশু ঘুম থেকে উঠেই আপনার কথা বলছিল তাই ফোন দিয়েছিলাম।”

“তাকে সামলান চেয়ারম্যান সাহেব যদি আমি একবার শক্ত করে ওর হাত ধরে তাকে সবসময় সামলানোর দায়িত্ব নিই। নাহলে কিন্তু আপনার পরিবারের জন্য খারাপ হয়ে যাবে। কারন আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।”

“আমি তো চাই আপনি ওর হাত ধরুন ডাক্তার।”

“কিন্তু আমি চাই না চেয়ারম্যান সাহেব। আমি আপনাদের ঐ চেয়ারম্যান বাড়ির ত্রী সীমানায় যেতে চাই না। কিন্তু ভাগ্য কি আমার প্রথম দিন থেকেই ও বাড়ির সাথে জুড়ে গেছে।”

‘ডাক্তার প্লিজ!”

“অনু কে চেয়ারম্যান সাহেব?”

ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। তারপর আবার শোনা গেল,,

“মিশুর হাজবেন্ড অনু মানে অনুভব খান। যে চার বছর আগে এক্সিডেন্ট এ মারা গেছে। এবং ঐ এক্সিডেন্টের পরেই মিশুর এই অবস্থা। মিশু এরকম ছিল না সে একজন শিক্ষিতা পড়াশোনা শেষ করা বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিল। কিন্তু একটা এক্সিডেন্ট সব এলোমেলো করে দিল।”

“তার এক্সিডেন্ট কিভাবে হয়েছিল আর সেদিন কি মিশু সাথে ছিল?”

“জানিনা কিভাবে হয়েছিল কিন্তু মিশু অনুভবের সাথেই ছিল।”

“কাল কেন এসব বললেন না আমায়?”

“এতো বছর পর অনুভবের কথা শুনে একটু চমকে গিয়েছিলাম। আর মিশুও তিন বছর যাবত অনুভবের নাম নেয় নি কালকেই নিয়েছিল তাই একটু থমকে গিয়েছিলাম। তারপর যে বলবো আপনার আর আরিফার মাঝে একটা কথাকাটাকাটি হলো তারপর তো আপনি চলেই এলেন।”

“অনুভব কি মারা গেছে?”

“শুনেছি মারা গেছে কিন্তু দেখার সাহস হয় নি। ওর মুখটা রক্তে রাঙানো ছিলো। আমি ওকে খুব ভালবাসতাম ওকে ঐ অবস্থায় দেখার সাহস হয় নি।”

“ওহ আচ্ছা। রাখছি!

“আপনি কি মিশুর সাথে দেখা করতে আসবেন না।”

“আমায় হাসপাতালে যেতে হবে নওশি কে দেখতে।”

“সারাদিন কি ওখানেই পার করে দেবেন নাকি? বিকেলে আসিয়েন?”

“আমি যাবো না চেয়ারম্যান সাহেব। আপনার পরিবার থেকে যত দূরে থাকা যায় সেটাই ভালো।’

“আপনার কাছে কিছু চাই না শুধু একটা কথা চাই দেবেন?”

“কি?”

“আপনার বন্ধের দিনগুলো তে মিশুকে যাস্ট এক ঘন্টা করে সময় দেবেন। ও আপনার সাথে সময় কাটালে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি উনি বলেছে যার সাথে মিশু ফ্রি তার সাথে বেশি থাকতে। আপনার সাথে তো মিশু অনেকটাই ফ্রি আপনাকে বন্ধু ভাবে সে। শুধু এইটুকু করুন আমি আপনাকে আর কোনদিন ও কিছু বলবো না।”

“আমি পারবো না!”

“প্লিজ ডাক্তার!”

“আমি পারবো না চেয়ারম্যান সাহেব। দয়া করে যখন তখন আপনাদের প্রয়োজনে আমায় ফোন করবেন বা ডাকবেন না।”

বলেই মেহবিন ফোন রেখে দিল। এমনিতেই ওর ভালো লাগছে না তারওপর চেয়ারম্যান সাহেব এর কথাগুলো ওর মেজাজ হুট করেই গরম করে দিয়েছে। ও নিজেও জানে না ওর মেজাজ এতো গরম হচ্ছে কেন? ও রুমে এসে ফ্রিজ থেকে দশটার মতো বড় চকলেট নিল। তারপর আবার গিয়ে রোদে বসলো বড় বড় বাইট দিয়ে চকলেট খেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর একটু ভালো লাগলো। তখন তাজেল এলো মেহবিনের কাছে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

“নওশি আপারে দেখতে যাবা ডাক্তার?”

“তুমি যাবে নেত্রী?”

“তুমি গেলে তোমার সাথে যাইতাম।”

“নওশি তোমার কেমন বোন হয় নেত্রী?”

“আমার কাকাতো বোন।”

“নওশি তোমায় অনেক আদর করে তাই না।”

“মা যাওয়ার পর তো দাদি আর নওশি আপাই আমারে দেইখা রাখে আদর করে।”

“তোমার মা কোথায় গেছে?”

“এক জনের লগে ভাইগা গেছে যহন আমার চার বছর আমারে আর আমার বাপেরে থুইয়া।”

বলতে বলতেই তাজেলের চোখ ছলছল করে উঠলো। মেহবিন তাজেলকে ওর কাছে এনে ওকে কোলে বসালো। তখন তাজেল বলল,,

“জানো ডাক্তার আমার বাপ আমারে ভালোবাসেনা কিন্তু আগে ভালোবাসতো যহন মা গেল গা তহন আমারে জরাই ধইরা কতো কানতো। আমারে কতো আদর করতো। কিন্তু যহন হেয় আরাটা বিয়া করলো তহন থেইকা আমার বাপ বদলাইইতে লাগলো। প্রথম প্রথম আমার সৎমায় আমার লগে ভালো ব্যবহার করতো কিন্তু তার কয়েকদিন পর থিকাই বাপে কামে গেলে আমারে বকা দিতো আর আমারে মারতো। আমার মায়রে নিয়া বাজে কথা কইতো। বাপের কাছে আমার নামে মিছা কতা কইতো আমার বাপেও আমারে বকতো। তুমি জানো আমার সৎবইন আর ভাই ও আছে ওই বইনের বয়স পাঁচ বছর আমার সৎমায়ের মাইয়া আর ভাই আমার বাপের ঘরে অইছে। আমি তারে আদর করি কিন্তু আমার সৎমায়ে ওরে ধরতে দেয় না।”

বলতে বলতেই তাজেলের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো। মেহবিন তা মুছে দিল। মেহবিন তাজেলের মাঝে নিজেকে দেখতে পেল তাজেলের যেমন ওর পরিবার থেকেও কেউ নেই। তেমন ওর ও কেউ নেই। মেহবিন তাজেলকে চকলেট দিয়ে বলল,,

“নেত্রী একদম কান্না না এখন!

‘আমি তো কানতে চাইনা কিন্তু আইসা পরে।”

“আচ্ছা কিন্তু আর কাদবে না এখন নাও চকলেট খাও।

মেহবিনের কথায় তাজেল চোখ মুছে বলল,,

“তুমি নওশি আপারে দেখতে যাইবা না?”

“এমনিতেও কাজ নেই চলো তুমি যখন যেতে চাও তাহলে যাই। এমনিতেও আমি যেতাম। তো তুমি কি রেডি?

‘হ আমার এইডাই ভালো জামা। আমি জানতাম তুমি আমার কথা হুইনা আমার সাথে যাইবা তাই রেডি হইয়া আইছি।”

“কাউকে বলে এসেছো?”

“আমার খবর কেউ রাখে না। খালি আমার বাপে রাইতে একবার জিগাইবো আমি কোনে আর আমার দাদি একটু খবর নিব আমি কোনে আছি। তাও সন্ধ্যার আগে আমার দাদিও আমারে খুজবো না। আর নওশি আপা থাকলে হেয় একটু খবর নিতো।”

মেহবিন তাজেলের দিকে তাকালো ওর ঠোঁটে মুচকি হাঁসি। তা দেখে মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘তুমি দাঁড়াও আমি তৈরি হয়ে আসি। ততক্ষণে তুমি চকলেট খাও।”

মেহবিন ভেতরে চলে গেল তারপর বোরকা হিজাব পরে বের হলো। তারপর তাজেল কে নিয়ে বের হলো। তাজেলের পা আগের থেকে অনেকটাই ঠিক। তাই তাজেল বলল হেঁটে হেঁটে যাবে। কিন্তু মেহবিন শুনলো না ও একটা রিক্সা নিল। হাসপাতালে গিয়ে সোজা নওশির ওখানে চলে গেল। মেহবিন তাজেলকে কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। নওশি শুয়ে আছে ওর মা নেই আশেপাশে। হয়তো বাড়িতে খাবার আনতে গেছে বা কোন কাজে গেছে। মেহবিন কে দেখেই নওশি উঠতে চেষ্টা করলো মেহবিন ওকে শুয়ে থাকতে বলে তারপর বলল,,

‘নওশি এখন কেমন লাগছে?”

নওশি মুচকি হেসে বলল,,

“এখন তো ভালো লাগছে। কিন্তু কাল মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো। আব্বার আর কোন চিন্তা থাকতো না।”

“উঁহু এরকম কথা বলতে হয় না নওশি। রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন,
পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, তোমরা কখনই নিজের মৃত্যু কামনা করো না।
(সহীহ_বুখারী, ৫৬৭১)

নওশি বলল,,

“আমি তো মরতে চাই না ডাক্তার আপা। পরিস্থিতি বাধ্য করে এমন কথা বলতে।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘আল্লাহ কে বিশ্বাস করো? তার ওপর ভরসা করো তো?”

‘তার ওপর বিশ্বাস আর ভরসা করি বলেই তো এতদূর আসতে পেরেছি।”

“তাহলে এরকম কথা কিভাবে বলছো। আমরা বলি, “আমি ব্যর্থ।”
কোরআন বলে, “অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফল হয়।”
(সুরা : মুমিনুল, আয়াত : ১)

আমরা বলি, “আমার জীবনে অনেক কষ্ট।”
কোরআন বলে, “নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে আছে স্বস্তি।”
(সুরা : ইনশিরাহ, আয়াত : ৬)

আমরা বলি, “আমাকে কেউ সাহায্য করে না।”
কোরআন বলে, “মুমিনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।” (সুরা : রুম, আয়াত : ৪৭)

আমরা বলি, “আমার সঙ্গে কেউ নেই।”
কোরআন বলে, “তোমরা ভয় করো না, আমি (আল্লাহ) তো তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি শুনি এবং আমি দেখি।” (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৪৬)

আমরা বলি, “আমার পাপ অনেক বেশি।”
কোরআন বলে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন।” (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২২)

আমরা বলি, “কোনো কিছু আমার ভালো লাগে না।”
কোরআন বলে, “তোমার জন্য পরবর্তী সময় পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে শ্রেয়।” (সুরা : দুহা, আয়াত : ৫)

আমরা বলি, “বিজয় অনেক দূরে।”
কোরআন বলে, “জেনে রেখো, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য নিকটে।” (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২১৪)

আমরা বলি, “আমার জীবনে কোনো খুশি নেই।”
কোরআন বলে, “শিগগির তোমার রব তোমাকে (এতো) দেবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে।”
(সুরা : দুহা, আয়াত : ৫)

আমরা বলি, “আমি সব সময় হতাশ।”
কোরআন বলে, “আর তোমরা হীনবল হয়ো না এবং দুঃখিতও হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও।” (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৯)

আমরা বলি, “আমার কোনো পরিকল্পনা সফল হয় না।”
কোরআন বলে, “আল্লাহ সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।”
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৫৪)

এখন বলো এতকিছুর পরেও তোমার মনে হয় তোমার মরে যাওয়া উচিত ছিল।”

নওশি মুচকি হেসে বলল,,

“তাজেল ঠিকই বলে তুমি জাদু জানো।”

মেহবিন এবার হাসলো আর বলল,,

‘নেত্রী তো নেত্রীই! এসব ছাড়ো এখন বলো তোমার বাবা তোমার সাথে এরকম করলো কেন?’

“আসলে আমি পরতে চাই। কিন্তু আমার বাপের সেটা পছন্দ নয়। সে আমার বিয়ে দিতে চায় আমার সমস্যা নেই বিয়ে করতে কিন্তু আমার একটাই কথা বিয়ের পর পরতে দিতে হবে। আমার অনেকদিনের স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবো। আর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবো। কিন্তু সে একটা বুরো লোকের সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছিল। লোকটা তার সাথেই মদ গাঁজা খায়। তাই কালকে উনারা আসতেই ওনাদের আমি মুখের ওপর না করেছি বলে আজ এই অবস্থা কারন ঐ বুরো লোকটা তারে দুই লক্ষ টাকা দিতো‌। মুদ্দা কথা আমার বাপে আমারে বিক্রি করছিল তার কাছে। আমার থেকে বাধা পেয়েছে তাই আমাকে মেরেছে।”

মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“ওনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম উনি ড্রাগ এডিক্টেড। তুমি চিন্তা করো না আমি তোমার স্বপ্নপূরন করতে সাহায্য করবো।”

‘দেখি আমার স্বপ্ন কোন দিকে যায়। পরিস্থিতির চাপে পরে কখনো কখনো স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে হয় ডাক্তার আপা।”

‘একটা কথা মনে রেখো নওশি প্রয়োজনে স্বপ্ন বদলে নিও কিন্তু স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো না। নাহলে বেঁচে থাকার আশা থাকবে না। নিজের জন্য হলেও স্বপ্ন দেখতে হবে আর বাঁচতে হবে। সবশেষে তুমি তোমার স্বপ্ন নিয়ে প্রানখুলে বাঁচবে। কি আশা নিয়ে বাঁচবে তো?

মেহবিনের কথা শুনে নওশির চোখ চকচক করে উঠলো ও হাঁসি মুখে বলল,,

‘আমি বাঁচবো ডাক্তার আপা। আমি স্বপ্ন দেখবো অতঃপর আমি বাঁচবো আমি প্রানখুলে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচবো।”

মেহবিন হাসলো। তারপর আরো কিছু কথা বলতে লাগলো। নওশি তাজেলের সাথেও কথা বলল । নওশির মা এলে মেহবিন আর তাজেল ওদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো। এখন তাজেল জেদ ধরেছে হেঁটেই ফিরবে। মেহবিনের ওর কাছে হার মেনে তাজেলের হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। হুট করে তাজেল বলল,,

“ডাক্তার তুমি কি নওশি আপার মতো আমার একটা ইচ্ছা পূরন করবা?”

“যদি পারি তাহলে অবশ্যই পূরণ করবো নেত্রী।”

“সত্যি তুমি পূরন করবা?”

“বললাম তো যদি পারি তাহলে অবশ্যই করবো। তো শুনি কি ইচ্ছে?

তাজেল দাঁড়ালো তা দেখে মেহবিন ও দাঁড়ালো। তাজেল বলল,,

“আমি পরবার চাই ডাক্তার। আমিও নওশি আপার মতো বড় কিছু হইতে চাই।”

‘মানে তুমি স্কুলে যাও না?”

“না ডাক্তার ও আমারে স্কুলে যাইতে দেয় না। আমি পরবার চাই ডাক্তার কিন্তু ঐ সৎমায় আমারে পরতে দেয় না । আমারে পরাইতে নাকি তার টাহা লাগবো এই কইয়া আমার পরা বন্ধ কইরা দিছে। এক বছর আগে। আমি বড় হইয়া তোমার মতো হইতে চাই সবার সাহায্য করবার চাই ডাক্তার। সেদিন তোমারে বললাম না বড় হইয়া নেতা হমু এই জন্যই যে সবাই জানি আমার কথা হুনে আমি যেন সবাইরে তোমার মতো সাহায্য করবার পারি। আমি সবসময় এইডা কইয়া নিজেরে শান্তনা দেই আমি বড় হইয়া নেতা হমু।

বলতে বলতেই তাজেল এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠলো। মেহবিন বুঝতে পারলো ও তাজেলের ভরসায় জায়গা করে নিয়েছে তাই তো এতো সহজে সব বলে দিলো। মেহবিন তাজেলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জরিয়ে ধরলো। তাজেল শান্ত হতেই মেহবিন ওকে সামনে দাড় করিয়ে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে গালে হাত রেখে বলল,,

‘কেঁদো না নেত্রী তুমি পরতে পারবে। আমি তোমার পড়ার ব্যবস্থা করবো। তুমি বড় হয়ে যা ইচ্ছে তাই হতে পারবে।”

‘সত্যি কইতেছো?”

“একদম সত্যি। না পরলে তুমি যোগ্য নেত্রী কিভাবে হবে বলো তো। আমার নেত্রী সবথেকে এগিয়ে থাকবে। আর এই নেত্রীকে এগোতে সাহায্য করবে এই নেত্রীর ডাক্তার ঠিক আছে।”

মেহবিনের কথায় তাজেল হেঁসে বলল

“ঠিক আছে! তুমি অনেক ভালো ডাক্তার।”

‘তাই বুঝি?”

“হুম তাই।”

‘এতো ভালো দেখেই তো কেউ আমায় তার সাথে রাখে না।সবাই একা ছেড়ে দেয়।”

“কি বললা?”

তখনি মেহবিনের ফোন বেজে উঠল। মেহবিন দেখলো হাসপাতালের সবথেকে সিনিয়র ডক্টর ফোন দিয়েছে সালাম দিয়ে ফোন ধরতেই সে বলল মেহবিনকে হাসপাতালে যেতে। বাড়ি প্রায় এসেই গেছে তাই তাজেল কে বলে ও আবার হাসপাতালে গেল । হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পেল সিনিয়র ডাক্তারের কেবিনে ডক্টর বাবুল সহ আরো একজন ডাক্তার আছেন। ও ভেতরে গিয়ে বসতেই সিনিয়র ডাক্তার বললেন,,

“ডক্টর মেহবিন মুসকান আমরা আপনাকে ডক্টর পদ থেকে বহিষ্কার করছি।”

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০৬

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৬
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন বুঝতে পারছে না এই পঞ্চাশ মিনিটে এমন কি হলো । যে মিশু রক্ত রক্ত করছে। তাজেল কোথায় ওকে তো দেখে রাখতে বলেছিল। রাস্তার ওপাশের বাড়ি থেকে কিছু শব্দ ও আসছে কেউ চিৎকার চেঁচামেচি করছে বোধহয়। সেসব পরে দেখা যাবে আগে মিশুকে শান্ত করতে হবে। মেহবিন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,,,

“মিশুমনি চোখ খুলো দেখো এখানে রক্ত নেই।”

“রক্ত! রক্ত! বন্ধু ঐ মেয়েটা!”

“কোন মেয়েটা কি হয়েছে চোখ খুলো দেখো রক্ত নেই।”

মিশু চোখ খুললো কিন্তু মেহবিন কে ছাড়লো না। ওর চোখ খুলতে দেখে মেহবিন বলল,,

“দেখেছো রক্ত নেই। কিন্তু তাজেল কুলসুম ওরা কোথায়?”

“ওরা তো ঐ মেয়েটার কাছে।”

ও কিছু বলবে তার আগে তাজেল কাঁদতে কাঁদতে মেহবিনের বাড়িতে এলো মেহবিন কে দেখে বলল,,

“ডাক্তার তুমি আইছো তাড়াতাড়ি চলো কাকা নওশি আপারে মাইরা ফালাই লো। নওশি আপারে খুব মারতেছে কাকা রক্ত ও বাইর হইতেছে তাড়াতাড়ি চলো নাইলে নওশি আপা বাঁচবো না।”

এ কথা শুনে মেহবিন বুঝতে পারলো মিশু কোনভাবে নওশির রক্ত দেখেছে। চিৎকার চেঁচামেচি এগুলোর মানে এখন বুঝতে পারলো মেহবিন। নওশির কথা শুনে উঠতে নিল । কিন্তু মিশু ওকে ছাড়ছে না। কি একটা মুশকিল তখনই আরবাজ আর মুখর এলো। এসেই আরবাজ বলল,,

“সরি দেরি হয়ে গেল।আর,,

ওকে বলতে না দিয়ে মেহবিন বলল,,

“সেসব বাদ দিন আগে মিশুকে ধরেন। ও বোধহয় রক্ত দেখে ভয় পেয়েছে আমার এখনি যেতে হবে। আর হ্যা আপনারা বাড়ি চলে যান।

মেহবিনের কথা শুনে আরবাজ মিশুকে ধরলো। মেহবিন ছাড়া পেয়েই কোনদিকে না তাকিয়ে দৌড় দিল। তাজেল ও সাথে গেল। মেহবিন রাস্তার ওপাশের দ্বিতীয় বাড়ি যেতেই দেখলো নওশিকে মাটিতে ফেলে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে‌ একজন। সকলে তাকিয়ে দেখছে কেউ থামাচ্ছে না। তার মধ্যে একজন আঁচল চেপে কাঁদছে। তা দেখে মেহবিন এর মেজাজ চরম গরম হলো ও গিয়ে আগে লাঠি ধরলো। কারো বাঁধা পেয়ে নওশির বাবা পেছনে ঘুরলো দেখলো মেহবিন লাঠি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে তিনি একটা গালি দিয়ে বলল,,

“**** মাইয়া তোর সাহস কতো বড় তুই আমার লাঠি ধরোস। ওর সাথে আজ তোরেও মাইরা ফালামু।”

ওনার কথার ধরন দেখে মেহবিন বুঝতে পারলো লোকটা স্বাভাবিক নয় বোধহয় নেশাখোর ড্রাগ এডিক্টেড।তা চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মেহবিন নওশির দিকে তাকালো হাত দিয়ে মাথা দিয়ে রক্ত পরছে সারা শরীরে মারের দাগ। মেহবিন লাঠিটা ফেলে নওশিকে ধরে বলল,

“আপনি কি মানুষ এভাবে কেউ মারে।”

“ঐ তোরে কইতে কইছি আমার মাইয়া আমি বুঝুম তোর তাতে কি *** মাইয়া *** ?”

“আর একটা বাজে কথা বললে এখানেই মেরে পুঁতে ফেলবো একদম।”

মেহবিনের এমন কথায় সকলে অবাক হয়ে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। এতো কঠিন করে কোন মেয়ে হুমকি দিতে পারে সেটা বোধহয় মেহবিন কেই প্রথম দেখলো। নওশির অবস্থা দেখে মেহবিন বলল,,

“নওশি কে হাসপাতালে নিতে হবে।”

তখন নওশির বাবা বলল,

“ওরে আবার হাসপাতালে নেওয়া লাগবো কেন? ও মরুক ওর মরাই উচিত যে মাইয়া বাপের কথা হুনে না তার বাইচা থাহুনের অধিকার নাই। আমি ওর পিছে আর এক টাহাও খরচ করুম না। মইরা যাক ও।”

“লাগবে না আপনার টাকা। আমি এমনিতেই ওর চিকিৎসা করতে পারবো।

নওশির বাবা রেগে চলে গেল ওখান থেকে। মেহবিন বুঝতে পারলো এদের দ্বারা কিছুই হবে না। মেহবিন কিছু না বলে নওশিকে সোজা করে দার করালো তখন দুইজন মহিলা ধরতে এলে তখন মেহবিন বলল,,

“যদি মার খাওয়া থেকে নাই বাঁচাতে পারেন তাহলে এখন কিসের জন্য এসেছেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠিকই মার খাওয়া দেখতে পারলেন অথচ কেউ ঐ পশুর মতো মানুষ টাকে থামাতে পারলেন না।”

তখন একজন মহিলা বলল,,

“প্রথমে সবাই থামাইতে গেছিল। দুইবার মার ও খাইছে একজন। তাও থামাইতে গেছে তারপর ওর বাপের কথা হুইনা আর কেউ আগায় নাই। তার মাইয়া তার থিকা আমগো নাকি বেশি পুরে।আরো অনেক খারাপ কতা কইছে।”

“এই জন্য কেউ মেয়েটার কাছে আসলেন না। আজ শুধু আমি বাড়ি ছিলাম না। নাহলে নওশিকে এতোগুলো মার খেতে হতো না। এখন সরুন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।

নওশির এতোক্ষণ জ্ঞান থাকলেও এখন অজ্ঞান হয়ে গেল। তা দেখে মেহবিন আর দেরি না করে ওর রোগাপাতলা শরীরটাকে কোলে তুলে তাড়াতাড়ি হাটা ধরলো। এটুকু নিতে সে পারবে তাজেল নওশির পা ধরলো। নওশির মা কাঁদতে কাঁদতে ওদের পেছনে এলেন। রাস্তায় আসতেই মেহবিন দেখলো মুখর দাঁড়িয়ে তাই মেহবিন বলল,,,

“পাঞ্জাবিওয়ালা তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলুন নওশিকে হাসপাতালে নিতে হবে। আর নেত্রী বারান্দায় আমার ব্যাগ আছে সেটা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো।

মুখর আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি গাড়ির কাছে গেল। তাজেল গেল ব্যাগ আনতে। মেহবিন নওশিকে গাড়িতে তুললো নওশির মা আর মুখর সাহায্য করলো। তাজেল আসতেই মুখর গাড়ি ছাড়লো মেহবিন ব্যাগ থেকে তুলা বের করে নওশির রক্ত মুছতে লাগলো। হাসপাতাল আসতেই তাড়াতাড়ি করে ভেতরে নিয়ে মেহবিন ওর চিকিৎসা শুরু করলো। মুখর তাজেল আর নওশির মা বাইরে রইলো। নওশির মা কাঁদছে দেখে তাজেল নওশির মায়ের হাত ধরে বলল,,,

“কাইন্দো না কাকি নওশি আপা ভালো হইয়া যাইবো। ডাক্তার দেখতেছে তো ডাক্তার খুব ভালো দেখবা নওশি আপারে একদম সুস্থ কইরা দিব। তুমি কাইন্দো না।”

“তাজেল আমার মাইয়া বাঁচবো তো। ঐ পাষাণ, বাপ হইয়া কেমনে পারলো মাইয়ারে ঐভাবে মারতে। ওনার মনে একটুও ও দয়ামায়া নাই।”

“চিন্তা কইরো না ডাক্তার আছে তো সব ঠিক কইরা দিব।”

নওশির মা আর কিছু বললো না। একটু দুর থেকে মুখর এগুলো দেখলো। মেহবিন কে সে যতো দেখে তত অবাক হয়। ও বাড়ির সবকিছুই সে দেখেছে তাইতো আরবাজ কে হেঁটে যেতে বলেছে মিশুকে নিয়ে। আর ও রয়ে গেছে গাড়ি নিয়ে যদি দরকার হয় তো। কিছুক্ষণ পর মেহবিন বের হলো ওর বোরকায় নওশির রক্ত। মেহবিন বের হয়ে ওর মাকে বলল চিন্তার কারন নেই নওশি সুস্থ হয়ে যাবে। একদিন হাসপাতালে রাখতে হবে। নওশির মা বলল সে থাকবে মেহবিন কিছু বললো না। মেহবিনের কিছুই আর ভালো লাগছে না। সে তাজেলকে বলল বাড়ি যাবে কি না সে বলল নওশিকে দেখে তার আরেকটু পর যাবে। মেহবিন বলল তাজেলকে নিয়ে ফিরবে। আজ শুক্রবার হাসপাতালে বেশি মানুষ জন নেই হয়তো ডাক্তার নেই বলে। ও বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল আর অস্ফুট স্বরে বলে,,,

“আজ আর আমি দেরি করি নি মা।”

তখন মুখর ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,,

রাসুল ﷺ বলেছেন,
সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।
~সহীহুল জামে:-৩২৮৯

মুখরের কথা শুনে মেহবিন মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“মানুষ হয়ে যদি মানুষের উপকারই না করতে পারলাম তাহলে কিসের মানুষ। সবথেকে বড় কথা আমি একজন ডক্টর। যে ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তি সাহায্য করে তাকে আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেন। তাছাড়া আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন মুমিনের দুঃখ দূর করে দেয়, আল্লাহ্ কেয়ামতের দিন তার দুঃখ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ্ দুনিয়াতে ও আখেরাতে তার বিপদ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। যে বান্দা আপন ভাইকে সাহায্য করবে, আল্লাহ্ সে বান্দাকে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি জ্ঞান লাভের জন্য কোন রাস্তা গ্রহণ করে, তার অসীলায় আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দিবেন। যেসব লোক আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোন ঘরে (অর্থাৎ মসজিদে) সমবেত হবে, কুরআন পড়বে, সকলে মিলিত হয়ে তার শিক্ষা নেবে ও দেবে, তাদের উপর অবশ্যই প্রশান্তি অবতীর্ণ হবে, রহমত তাদের ঢেকে নেবে, ফেরেশতাগণ তাদের ঘিরে থাকবে আর আল্লাহ্ তাদের কথা এমন সকলের মধ্যে উল্লেখ করবেন যারা তাঁর কাছে উপস্থিত। যে ব্যক্তি তার আমলের কারণে পিছিয়ে পড়বে, তার বংশ পরিচয় তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।
[মুসলিমঃ ২৬৯৯]”

মুখর সব শুনে মুচকি হেসে বলল,,

“তা ঠিক বলেছেন তো আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন ডক্টর?”

“এই আকাশ টা কতো বিশাল।”

“এটা কি আমার প্রশ্নের উত্তর?”

“আপনি বলেছেন আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন? তার উত্তর তো এটাই হওয়া উচিত আর হয়েছেও তাই।”

“সরি মাই মিস্টেক কি ভাবছিলেন?”

“এই পৃথিবী কতো বিশাল। প্রতিদিন কতো রকমের ঘটনা ঘটে ধরনীর বুকে।

“তা তো ঘটেই।”

“মিশুমনি স্বাভাবিক হয়েছে?”

‘তুমি যাওয়ার পর একটু হায়পার হয়ে গেছিল তুমি চলে গেছো বলে। তবে আরবাজ সামলে নিয়েছে। সব ঠিক আছে সেই জন্যই তো দু’জনে হেঁটে হেঁটে বাড়ি গেল।

‘ওহ আচ্ছা ও কি অভিমান করেছে আমার ওপর।”

“কি জানি করতে পারে।”

“সবার অধিকার আছে আমার ওপর অভিমান করার। আমার নেই কেন মুখর?”

মেহবিনের মুখে মুখর শুনে আর এরকম কথা মুখর একটু থমকালো। কারন এই সম্মধোন টা ওর কাছে নতুন। আর এরকম কথাও। মুখর নিজেকে সামলে বলল,,

‘তোমারও অধিকার আছে বিহঙ্গিনী!”

“না আমার অধিকার নেই কারন এই বিহঙ্গিনী একা সে মুক্ত ভাবে নিজের মতো উড়ে বেরায়। তার নির্দিষ্ট নীড় বলতে কিছুই নেই। তার কেউ নেই?”

“বিহঙ্গিনীর সবাই আছে!”

“কেউ নেই বিহঙ্গিনীর বিহঙ্গিনী একা। আচ্ছা আপনি বললেন সবাই আছে তাই না উঁহু তার কেউ নেই। এই যে বিহঙ্গিনী কে দেখছেন এর হাত ধরে জনসমক্ষে কেউ বলতে পারবে না এই বিহঙ্গিনীর সাথে তাদের সম্পর্ক কি? না আপনি আর না আরবাজ না আমার জন্মদা থাক বাদ দিন। পরিশেষে এই বিহঙ্গিনীর আপাতত কেউ নেই মুখর। বিহঙ্গিনী এক মুসাফিরের মতো এখানে ওখানে সফর করে । এতদিন নিজের মঞ্জিল খোঁজার জন্য সে সফর করতো কিন্তু মঞ্জিল খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে হাড়িয়ে ফেলেছে এখন সে নিজেকে খুঁজতে সফরে বেরিয়েছে। যার সঙ্গী সে আর তার সৃষ্টিকর্তা মহান রব।

এবার মুখর করুন চোখে তাকিয়ে রইল। কারন এর উত্তর তার কাছে নেই। মেহবিন মুচকি হেসে মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কি হলো জবাব নেই?”

“মেহবিন!”

“আমায় বাড়ি যেতে হবে।”

তখনি তাজেল এলো । মুখর কিছু বলতে নিচ্ছিল তাজেল কে দেখে চুপ মেরে গেল। তাজেল মুখরকে দেখে বলল,,

“ডাক্তার ইডা কিডা? তহন নওশি আপারে গাড়িতে কইরা নিয়াইলো।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“নেত্রী উনি আমার পরিচিত!”

‘তোমার জামাই নাকি ডাক্তার! যদি অয় তাইলে আমার পছন্দ হইছে কি সুন্দর ফর্সা একদম দুধের মতো। কিন্তু তোমার মতো এতো সুন্দর না।”

তাজেলের কথায় মেহবিন একটু আওয়াজ করেই হাসলো। মেহবিন মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আপনি আমার জামাই নাকি পাঞ্জাবিওয়ালা?”

“পাঞ্জাবিওয়ালা হেয় কি পাঞ্জাবি ব্যাচে ডাক্তার?”

তাজেলের কথায় এবার মুখর হাসলো আর বলল,,

“না গো আমি পাঞ্জাবি বেচি না। এই নাম টা তোমার ডাক্তার আমারে দিয়েছিল যেভাবে তোমাকে নেত্রী নামটা দিয়েছে।”

“ও তাইলে তোমারও নাম ডাক্তার দিচে। কিন্তু তুমি ডাক্তারের কি লাগো।

মেহবিনের এবার তাজেলের পায়ের দিকে নজর গেল কালকের ব্যান্ডেজটা রক্তে ভিজে গেছে। তা দেখে মেহবিন তাড়াতাড়ি করে ওকে কোলে তুলে বলল,,

“নেত্রী পায়ের এই অবস্থা কখন হলো?”

“নওশি আপারে যহন মারছিল আমি ফিরাইবার গেছিলাম তহন কাকা আমারে ধাক্কা দিছিল। তহন আবার লাইগা রক্ত বাইর হওয়া শুরু করছে।”

মেহবিন ওকে নিয়ে নিজের কেবিনে গেল তাজেলের ব্যান্ডেজ খুলে আবার নতুন ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল।এর মধ্যে মুখর আর ওর সম্পর্কের কথা চাপা পড়ে গেল। মেহবিন বলল,,

“আমাকে বলো নি কেন এতোক্ষণ?”

“আমার নিজেরই তো মনে ছিল না।”

“পাগল একটা! চলো বাড়ি যাই আমরা।”

তখন মুখর বলল,,

“আমি নামিয়ে দিই!’

“লাগবে না আপনি চলে যান! আমি নেত্রীকে নিয়ে রিক্সায় আসবো।”

“প্লিজ!”

“না আপনি চলে যান।”

মুখর আর কিছু বললো না। চলে গেল ও জানে এখানে বলে লাভ নেই। মেহবিন নওশিকে আবার দেখে এলো ওর মাকে আর একটা নার্সকে সব বুঝিয়ে দিল। সবকিছুর টাকা মেহবিনই দিয়েছে। মেহবিন তাজেলকে কোলে করে বের হলো। একটা রিক্সা পেতেই সেটায় চরে বসলো। মেহবিন তাজেলের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমি যাওয়ার পর কি হয়েছিল নেত্রী?”

“তুমি যাওয়ার পর তো আমরা সুন্দর কইরা চকলেট খাইতেছিলাম আর কার্টুন দেখতেছিলাম। কিছুক্ষণ দেহার পর দেহি আমগো বাড়ির এদিক থেইকা চিৎকার চেঁচামেচি করতেছে। কুলসুম তো দিল এক দৌড় তুমি আমারে তোমার বন্ধুরে দেইখা রাখতে কইছিলা আর কইছিলা কুলসুম গেলেও আমি জানি না যাই। তাই আমি যাই নাই। তহন তোমার বন্ধু কইলো যেইহানে চিৎকার চেঁচামেচি অয় ওনে যাইবো আমি মানা করলাম পরে জেদ ধরলো তহন কুলসুম আইসা কইলো নওশি আপারে মারতেছে ব্যস আমার আর কি আমিও নওশি আপার কথা হুইনা তোমার বন্ধুরে রাইখাই দৌড়। যাইয়া দেহি নওশি আপারে ইচ্ছা মতো মারতেছে নওশি আপার শরীর দিয়া রক্ত ও পরতেছে পরে আমি ফিরাইতে গেছিলাম কাকা দিল এক ধাক্কা পরে আর সাহস অয় নাই পরে দেহি তোমার বন্ধু ও গেছে ওনে। নওশি আপারে দেইহাই রক্ত রক্ত কইরা দৌড় দিল আমিও আইলাম হে তোমার বাড়ি ঢুকলো দেইখা আমি আবার মারামারির ওনে গেলাম আবার তোমার বন্ধুর কথা ভাবলাম ডরাইলো নাকি হেই ভাইবা আইয়া দেহি তুমি আইছো পরে তোমারে খবর দিলাম।”

সবকিছু মেহবিন মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর বলল,,

“বুঝলাম তবে মিশু সত্যি রক্ত দেখে ভয় পায়। রক্ত সহ্য করতে পারে না। কিন্তু নওশি কে মারলো কেন ওর বাবা?

“আজ তো নওশি আপারে দেখবার আসার কথা আছিল। সবতো ঠিকই আছিল আমি জানি না।”

“ওহ আচ্ছা!”

তখনি মেহবিনের আন নোন নাম্বার থেকে কল আসলো। মেহবিন ফোন উঠিয়ে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে বলল,,

“ডাক্তার তাড়াতাড়ি আমার বাড়িতে আসেন মিশু দরজা আটকে বসে আছে। ডেকেও বের করা যাচ্ছে না।”

“চেয়ারম্যান সাহেব!”

“আমি জানি না আপনার বাড়িতে কি হয়েছে? তবে আপনার থেকে এটা আশা করিনি যে আপনার বাড়ি থেকে ফিরে মিশু হায়পার হয়ে যাবে। এই জন্য আমি ওকে বাইরে কোথাও নিয়ে যেতে সাহস পাইনা। কিন্তু আমি আপনার ওপর ভরসা করে ওকে আপনার বাড়ি দিয়ে এসেছিলাম।”

“আপনি যতোই বলেন আমার এতে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। কারন এটায় আমার হাত নেই পুরোটাই একটা এক্সিডেন্ট। যাই হোক আসছি আমি।”

মেহবিনের এরকম কথা শুনে শেখ শাহনাওয়াজ থম মেরে বসে রইলেন। মেহবিন বাড়ির মোর আসতেই তাজেলকে দিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে রওনা দিল। কিছুক্ষণ এর মধ্যে পৌঁছে গেল বাড়িতে ঢুকতে সবাইকে নিচেই দেখলো। শুধু আরবাজ শেখ শাহনাওয়াজ আর মুখর নেই। ও কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা মিশুর রুমে গেল। মিশুর রুম বন্ধ। রুমের সামনে তারা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। মেহবিন বলল,,

“কখন থেকে দরজা আটকে বসে আছে।”

তখন আরবাজ বলল,,

“আমি তো তখন ওকে শান্ত করে বাড়ি নিয়ে এলাম। সব ঠিকই ছিল কিন্তু আধঘন্টা আগে কি হলো ও রান্না ঘরে গেল তারপর দৌড়ে ওপরে চলে এলো।তারপর থেকেই দরজা আটকে বসে আছে ঘরে ভাঙচুরের আওয়াজ ও এসেছে।”

“রান্নাঘরে কিছু দেখে কিছু হয়েছে নাকি কেউ কিছু বলেছে?”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“তেমন কিছুই নয়।”

“আপনি সিওর কিভাবে? কারন ব্যতিত কখনো কিছু হয় না। কিছু তো হয়েছেই তাই এই অবস্থা।”

“আপনার বাড়ি থেকে কিছু হয়েছিল আরবাজ বলেছে সেটাই হয়তো মনে পরে গেছে।’

“তারমানে আপনি বলছেন এটা আমার দোষ। আপনি এখান থেকে চলে যান এদিকে আমি দেখছি। ভাঙচুরের আওয়াজ শুনেছেন তার মানে মিশু ঠিক নেই। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। এই ঘরের কি চাবি নেই দরজা খোলার জন্য।”

এ কথা শুনে তিনি মাথা নিচু করলেন। ওনার মেয়ের চিন্তায় মনেই ছিলনা।তিনি চলে গেলেন চাবি আনতে তখন মেহবিন দরজায় টুকা মেরে বলল,,

“বন্ধু কি হয়েছে তোমার ? দরজা খুলো!”

ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ এলো না।তাই ও আবার ও বলল,,

“বন্ধু তুমি ঠিক আছো? দরজা খুলো প্লিজ বন্ধু তোমার সাথে খেলতে এসেছে।”

…….এবার ও চুপ

“বন্ধু কিন্তু এবার চলে যাবে।”

তখনি শেখ শাহনাওয়াজ চাবি নিয়ে এলেন মেহবিন দরজা খুলল কিন্তু ওদের আসতে বারন করলো। মেহবিন রুমে ঢূকে দেখলো ঘরের সমস্ত জিনিস পত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মিশু দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু বিরবির করছে। মেহবিন কাছে গিয়ে শুনলো,,

“ও অনুর মতো মরে যাবে অনুর মুখে কতো রক্ত ছিল। ঐ মেয়েটাও মরে যাবে ওর মুখেও তো রক্ত ছিল। না না ওকে কেও বাঁচাও মরতে দিও না। ও মরে যাবে কতো র’ক্ত! র’ক্ত! র’ক্ত!”

এটুকু শুনেই মেহবিন মিশুর কাঁধে হাত রাখলো ও মেহবিনকে দেখেই ওকে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে উঠলো আর বলল,,

“আমার অনুকে বাঁচাও কতো র’ক্ত! কতো র’ক্ত! ওর মুখে। ঐ মেয়েটাকে বাঁচাও ওর মুখেও তো কতো র’ক্ত।”

মেহবিন ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলো মিশু কিছু বিরবির করে জ্ঞান হারালো। মেহবিন ওকে ধরলো। তখন মেহবিন ওদের ভেতরে ডাকলো আরবাজ এসে ওকে বিছানায় শুয়িয়ে দিল মেহবিন সব চেক করলো । তারপর বলল একটা ইনজেকশন আনতে। শেখ শাহনাওয়াজ ওষুধ আর ইনজেকশন আনতে পাঠালেন কুদ্দুস কে। মেহবিন মিশুর হাত ধরে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল। মাথায় ঘুরছে এই অনু কে? ইনজেকশন আনতেই মেহবিন সেটা পুশ করে দিল। তারপর নিচে আসলো সবাই নিচেই ছিল। ও সোজা গিয়ে শেখ শাহনাওয়াজ কে বলল,,

“অনু কে চেয়ারম্যান সাহেব?”

এ কথা শেখ শাহনাওয়াজ সহ সবাই চমকে উঠলেন। উনি কিছু বলবে তার আগে আরিফা জামান বললেন,,

“আমাদের পারিবারিক বিষয় এটা। তোমার না জানাই ভালো। আর আজ যা হলো এর জন্য কিন্তু তুমি দায়ী। তোমার ওপর ভরসা করেই চেয়ারম্যান সাহেব মেয়েকে তোমার বাড়ি পাঠিয়েছিল। কিন্তু তুমি ওর খেয়াল না রেখে কি করছিলে যার জন্য মিশুর এই অবস্থা। তুমি তো জানো মিশুর রক্তে ফোবিয়া আছে তারপরেও কেন ওকে একা ছাড়লে যদি কিছু একটা হয়ে যেতো তাহলে কি করতে। আরবাজ যেতেই তুমি আবার তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছো। মিশু চেয়ারম্যান সাহেব এর মেয়ে এটা ভুলে গেলে তুমি।

মেহবিন মুখ শক্ত করে বলল,,

“তো কি করতাম? আপনার মেয়ের হাত ধরে বসে থেকে আরেকটা মেয়েকে মরতে দিতাম। কারন সে চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে নয়। একজন সাধারণ মেয়ে।

‘তোমারে যে মানুষ টা বাড়িতে থাকতে দিয়ে সাহায্য করলো। তার মেয়েকে তুমি ঐ অবস্থায় কিভাবে ছেড়ে দিতে পারলে এতটা অকৃতজ্ঞ তুমি।”

“চেয়ারম্যান সাহেব এর মেয়ে শুধু ভয় পেয়েছিল আর ঐ মেয়েটা মরতে বসেছিল। এই অবস্থায় সেই মেয়েটার থেকে আপনার মেয়ের দাম বেশি হয়ে গেল নাকি। আর যদি অকৃতজ্ঞ এর কথা আসে তাহলে বলবো তিনি ব্যবস্থা না করে দিলেও আমি এই গ্ৰামে কোথাও না কোথাও থাকতে পারতাম। উনি আমার একটা সাহায্য করেছে বলে একদম জান দিয়ে দিতে হবে উনার জন্য তেমনটা নয়। তাছাড়া আমি তো এমনি এমনি বাড়িটা নিই নি ভাড়ায় নিয়েছি তাহলে এই কথা আপনি বলতে পারেন না।

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আহ আরিফা কি হচ্ছে কি? এটা কেমন ধরনের ব্যবহার।”

“আপনি তার পরেও এই কথা আমাকে বলেছেন। আজ মিশুর এই অবস্থার জন্য কিন্তু এই মেয়েটাই দায়ী।”

“মিশুর জন্য উনি দায়ী হলেও মিশুকে শান্ত আর স্বাভাবিক করার পেছনেও ওনার হাত রয়েছে।”

একথা শুনে মেহবিনের মুখ আরো শক্ত হয়ে গেল। ও চোখ মুখ শক্ত করেই বলল,,

“ভুল বললেন চেয়ারম্যান সাহেব আপনার মেয়ের এখনকার অবস্থার জন্য আমি দায়ী নই। তার অবস্থার জন্য দায়ী আপনাদের রান্নাঘর সেখানে কিছু তো ঘটেছে।”

এ কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু লোকের চেহারায় ভয় ও ফুটে উঠলো। তখন মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“বুঝলেন চেয়ারম্যান সাহেব সরষের ভেতরেই ভুত আছে। আজ আমি চলি তারপর না হয় আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে কথা বলুন।”

“সন্ধ্যা আরো আগেই নেমেছে আপনাকে কেউ দিয়ে আসুক।’

“দরকার নেই চেয়ারম্যান সাহেব আমি একাই চলে যেতে পারবো।”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে পরলো। পেছনে আরবাজ আর মুখর ও বের হলো আস্তে আস্তে সবার অগোচরে। মেহবিন ফোনে টর্চ অন করে আগাতে লাগলো। আরবাজ আর মুখর ওর পেছন পেছন চলতে লাগল। হুট করে মেহবিন বলল,,

“অনু কে বাজপাখি?”

কথাটা শুনেই মুখর আর আরবাজ থেমে গেল। মেহবিন পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। আরবাজ কিছুই বললো না। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“অধিকার নেই তাই না। আর আসতে হবে না আমি যেতে পারবো। বাড়ি এসেই গেছে।

বলেই মেহবিন ঘুরে আবার হাঁটতে লাগলো। তখন আরবাজ দৌড়ে গিয়ে বলল,,

“অনু হলো মিশুর প্রিয়জন! যার জন্য আজ চার বছর ধরে মিশুর এই অবস্থা।”

বলেই আরবাজ দ্রুতগতিতে আবার পেছনে এলো আর মুখর কে নিয়ে চলে গেলো। মেহবিন একবার ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বাড়ির পথে রওনা দিল দুই মিনিট পর বাড়িতে ঢুকলো দেখলো বারান্দা খোলা হয়তো মিশু আর আরবাজ খোলা রেখেই গেছে কিন্তু দরজা ভালোভাবে আটকানো আবার তালা দেওয়া। তালা দিল কে আবার এসব ভাবতে ভাবতেই তাজেল এলো চাবি নিয়ে। ও নাকি ব্যাগ নিতে এসে তার পাশে তালা দেখে মনে পরেছে বাড়িতে কেউ থাকবে না তাই তালা দিয়ে গেছে। ও চাবি নিয়ে সেই সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছিল ও আসতেই ওকে দিল। মেহবিন হাসলো তাজেল এর বুদ্ধি দেখে। বাহবা ও দিল তারপর তাজেলকে বাড়িতে যেতে বলে নিজের ঘরে ঢুকলো আজ সারাটাদিন তার কি গেছে সেটা একমাত্র সেই জানে। তবুও তার মাথায় দিনশেষে একটা কথা,

“অনু মিশুর প্রিয়জন ! যার জন্য মিশুর এই অবস্থা। কি হয়েছিল চার বছর আগে?

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০৫

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

তাজেলের বাড়ি গিয়ে দুজন মহিলার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুনতে পেয়ে মেহবিন থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। মুহুর্তেই মেহবিনের কান গরম হয়ে উঠলো কারন এর আগে ও এতো গালি কখনো শুনেনি । তাজেল এর দিকে মেহবিন তাকালো ও চকলেট খাচ্ছে আর মেহবিনের কোলে চড়ে ঝগড়া দেখছে মনে হচ্ছে তাজেল ব্যাপারটা বেশ ইনজয় করছে। হুট করে এক মহিলার তাজেল আর মেহবিনের দিকে নজর যেতেই বললেন,,

“ঐ যে নবাবজাদী বাড়িতে ফিরছে। তাও আবার নতুন মাইয়ার কোলে চইরা ও বাবা আবার কি যেন খাইতেছে। হাতে দেহি ফুল ওই তোর মনে এত রঙ কেন হুনি। এত কান্ড কইরা মন ভরে নাই তোর। কোল থিকা নাম তুই আজ চ্যালাকাঠ তোর পিঠে ভাঙুম আমি। *** মাইয়া*** ** ঝি ওই তুই নাম আজ তোর খবর আছে।”

তাজেলের জন্য গালি শুনে মেহবিন আর চুপ না থেকে বলল,,

“দয়া করে আপনার ভাষা ঠিক করুন।”

‘তোমার কাছ থিকা শিখতে হইবো আমি আমার মাইয়ার সাতে কেমনে কথা কমু। ”

তখন তাজেল বলল,,

‘মাইয়া না কও সৎ মাইয়া।”

“ভালো বুলি ফুটছে তোর! তোর ঐ মুখ আমি একদিন সেলাই করে দিমু। তখন দেহুম তোর বুলি কই থেইকা আসে।

তাজেলের কথা শুনে মেহবিন তাজেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল এতক্ষন মুখটা প্রানোচ্ছল থাকলেও সৎ মাইয়া বলতে বলতে তাজেলের মুখটাও শক্ত হয়ে উঠেছে। হুট করে তাজেলের কথায় মেহবিনের ধ্যান ভাঙে। ও বলল,,

“ডাক্তার আমারে নামাই দেও।

তখন মেহবিন তাজেলকে না নামিয়ে তাজেলের সৎমায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আসলে নেত্রী মানে তাজেলের পা কেটে গিয়েছিল। তাই আমি ব্যান্ডেজ করে কোলে করে নিয়ে এলাম। যদি ভুল না হই তাহলে আপনি কুলসুমের মায়ের সাথে ঝগড়া করছিলেন। তাজেল মেরেছে বলে উনি বিচার দিতে এসেছিলেন। আপনিও তাজেলের কোনোকিছুর দায় নেবেন না বলে ঝগড়া করছিলেন। কিন্তু এতকিছুর মাঝেও যার জন্য এই ঝগড়াটা সেটাই কারো মনে নেই। এখানে আমি বলবো কুলসুমের বড় ভাইয়ের দোষ কারন সে তাজেলের মায়ের বিষয়ে কথা বলেছে যেটা তার ভালো লাগেনি তাই সে ধাক্কা মেরেছিল। এরপর দুজনের হাতাহাতি মানে মারামারি এক পর্যায়ে কুলসুমের ভাইয়ের ধাক্কা খেয়ে তাজেল পরে যায় সেখান থেকেই তাজেলের পা কেটেছে।”

নিজের পরিচয় পেয়ে কুলসুমের মা অবাক হলেও বললেন,,

‘তুমি দুইদিন এনে আইসা তাজেলরে চিনা ফেলছো‌। ও তোমার কাছে মিথ্যা কথা কইছে। কুলসুমের ভাই ওরে খেলতে নেয় নাই বইলা তাজেল কুলসুমের ভাইরে মারছে। আর কোন থিকা পা কাটছে তার ঠিক নাই দিয়া দিছে আমার পোলার দোষ।”

“দু’দিন ধরে এখানে আসলে কি হবে মানুষ চেনার ক্ষমতা আমার আছে। তাজেল দুষ্টু হতে পারে কিন্তু মিথ্যা কথা আমায় বলবে না। তাছাড়া ও কিন্তু আগ বাড়িয়ে আমাকে বলে নি আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম বলে বলেছে। আচ্ছা ও সত্যি বলছে না মিথ্যা বলছে আমি প্রমান করে দিচ্ছি। কুলসুম এদিকে আসোতো।”

কুলসুম এলো তখন মেহবিন বলল,,

“কুলসুম তুমি তো সবসময় নেত্রীর সাথে খেলো তোমার মা যা বললো সত্যিই কি তাই হয়েছিল।”

তখন কুলসুম বলল,,

“সত্য কইলে ভাই মারবো!”

তখন তাজেল বলল,,

“আর সত্য না কইলে আমি তোরে মারুম কুলসুম। কোনদিন খেলা নিমু না। আমার লগে কোন জায়গায় যাইতে পারবি না। এই যে দ্যাখ ডাক্তার বিদেশি ফুল আর চকলেট দিছে ভাবছিলাম তোরে দিমু এইডাও দিমু না।”

“না না তুই না খেললে আমি কার লগে খেলমু। মা এই ডাক্তার সব সত্য কথা কইছে এনে ভাইয়ের ভুল আছিল। ভাই তাজেলের মাইরে অনেক খারাপ কথা কইছে। ভাইয়ের ধাক্কা খাইয়াই তাজেলের পা কাটছে।

তখন মেহবিন বলল,,

“দেখেছেন এই প্রমান করে দিলাম। আশাকরি ছেলে মেয়ের কথায় সত্যি যাচাই না করে অন্যের বাড়িতে ঝগড়া করতে আসবেন না। সবথেকে বড় কথা বাচ্চাদের ঝগড়া তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দিন তারা ঝগড়াও করবে আবার একসাথে খেলবেও। বাচ্চাদের ঝগড়া মারামারির মাঝে বড়দের না ঢুকাই উত্তম তবে সেটা বাড়াবাড়ি হলে অন্য বিষয়। আর তাজেলের মাকে বলছি অন্যের কথায় নিজের মেয়েকে ভুল ভাববেন না। সৎ হোক একবাড়িতেই তো থাকেন।”

মেহবিনের কথায় কুলসুমের মা তাড়াতাড়ি করে চলে গেল দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে। এতোক্ষণ বেশ ভালো একটা জটলা ছিল এখানে এমনিতেও মেহবিন আসছিল দেখে সবাই কৌতুহল দেখিয়ে ওর পেছনে এসেছে। আর ঝগড়া হচ্ছিল দেখে ওখানে আগেই কিছু মহিলা বিন্দু ছিল। সবাই অবাক চোখে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। এমনিতে তাজেলকে নিয়ে কেউ কিছু বললে তারা কেউ কিছু বলে না। যার মেয়ে সে শ্বাসন করুক তাতে কার বাপের কি। কিন্তু মেহবিন তো তেমন নয়। মেহবিন বুঝতে পারলো আজ ও না এলে তাজেল সত্যি সত্যি মার খেতো। হুট করে তাজেল হেঁসে বলল,,

“ডাক্তার ফাটাই দিছো ঐ কুলসুম এনে আয় চকলেট নিয়া যা। আর ডাক্তার আমারে নামাই দেও।”

তখন একটা মেয়ে এসে বলল,,

“ওরে আমার কাছে দেন।”

মেহবিন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলো কমদামি একটা থ্রিপিস পরে একটা মেয়ে। হয়তো এবার কলেজে পরে এরকম বয়স হবে। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“তুমি বুঝি নেত্রীর নওশি আপা।”

মেয়েটা অবাক হয়ে বলল,,

“আমি নওশি আপনি কি করে জানলেন? আর নেত্রী কে?

তখন তাজেল বলল,,

“ডাক্তার আমারে নেত্রী বলে নওশি আপা।”

“ওহ আচ্ছা কিন্তু আমাকে?”

“নেত্রী তোমার কথা প্রায়ই বলে এতো মানুষ থাকতে তুমি ওর কাছে এলে মানে তুমি ওকে অনেক আদর করো। আর তাই ও তোমার কথা বলে ওর মুখে কুলসুম আর নওশি আপা ছাড়া আর কারো নাম শুনিনি তাই আন্দাজ করলাম। তাছাড়া তোমার আচরন বেশ মার্জিত নেত্রী সবসময় বলে তুমি অনেক সুন্দর করে কথা বলো তুমি তো কলেজে পড় তাই না।”

“হু এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।”

“ওহ আচ্ছা!”

“ডাক্তার তুমি আমারে নামাও না কেন? তোমার হাত ব্যাথা করে না।এই যে ছোট একচালা ঘর দেহো এইডাই আমার ঘর। আমি আর আমার দাদি এইহানে থাহি।”

“এতদূর এসেছি চলো তোমায় ঘরে নিয়েই নামিয়ে দিই। যদি আবার পায়ে ব্যাথা পাও।”

মেহবিন তাজেলকে না নামিয়ে একেবারে ঘরে গিয়ে নামিয়ে দিল। ঐ ঘরে কাঠের চকি ছাড়া আর কিছু নাই কাপর রাখার জন্য একটা দড়ি লাগানো। বিছানাটায় দুটো শক্ত বালিশ আর একটা ল্যাপ ভেতরে লাল ওপরের কভার সাদা রঙের হয়তো এই শীতের জন্য। তাও কভারটা ছেঁড়া দেখে মেহবিন বুঝতে পারলো ভেতরে লাল রঙের। মেহবিন দু’টো ওষুধ দিয়ে নওশি কে বলল,,

“এই যে এখানে ওষুধ আছে রাতে খাবারের পর। বেশ খানিকটা কেটে গেছে। ওষুধ খেলে কাল সকালেই ব্যাথাটা চলে যাবে। ওর মায়ের কাছে দেওয়ার সাহস হলো না তাই তোমাকেই দিচ্ছি।”

“সমস্যা নাই আমি খায়িয়ে দেব।”

তখনি মাগরিবের আজান শোনা গেল । মেহবিন ওদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো নামাজ পরতে হবে। মেহবিন যেতেই সবাই মেহবিনের প্রশংসা করলো। কিছুজন মুখ বাকালো তাদের মধ্যে সবার শীর্ষে তাজেলের মা।

_____________

“আরে মুখর যে কেমন আছো?”

“এই তো আঙ্কেল আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনি?”

“আমিও ভালো আছি।”

তখন আরবাজ বলল,,

“বাবা মুখরের এখানে পোস্টিং হয়েছে ইনচার্জ সে এখন।”

“বাহ মাশাআল্লাহ। এতোদিন কতোবার আসতে বললাম এলে না। কিন্তু দেখেছো ভাগ্য ঠিকই এনে দিল।”

মুখর মুচকি হেসে বলল,,

“সত্যি আঙ্কেল ভাগ্য একটা বড় ব্যাপার। কখন কোথায় কাকে কিভাবে কোথায় নিয়ে যায় বলা যায় না।”

তখন কোথা থেকে মিশু এসে “বাজপাখি’ বলে চিৎকার করে আরবাজের ঘাড়ে উঠে ওর চুল ধরে টানতে লাগলো আর খিলখিল করে হাসতে লাগলো। তা দেখে আরবাজ বলল,,

‘মিশু কি করছিস আমার চুল গুলো সব উঠে যাবে।”

“বাজপাখি এই তোমার আসার সময় হলো। আমি কবে থেকে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। সেই পুরশুর পুরশু তার পুরশু গেলে আর এলে না আজকে এলে।”

“একজন অতিথি কে আনতে গিয়েছিলাম । এই দ্যাখ নিয়ে এসেছি তার সামনে তুই আমার ঘাড়ে উঠেছিস সে কি ভাববে বলতো?”

“কি!”

বলেই মিশু নেমে পরলো। মুখর ওর দিকে হাঁসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে ব্যাগ থেকে এক বক্স চকলেট বের করে বলল,,

‘মিশুমনি এগুলো তোমার জন্য।”

মিশু এক দৃষ্টিতে মুখরের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ ভেবে হাত থেকে চকলেট নিয়ে বলল,,

“তুমি কিভাবে জানলে আমার চকলেট এত্তগুলা প্রিয়। হুম হুম কিভাবে জানলে? আচ্ছা আমি কি তোমাকে চিনি? আচ্ছা তুমি আমার নাম জানলে কি করে?”

‘হুম চিনো তো আমাকে। একসময় আমরা তো বন্ধু ছিলাম।”

‘বন্ধু ছিলে তাহলে এতোদিন কোথায় ছিলে। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তোমাকে দেখলাম না কেন? আর বন্ধুরা কি হারায় নাকি আমার বন্ধু তো হারায় না কাল ও এসেছিল।”

তখন আরবাজ বলল,,

“কাল কে এসেছিল?”

“আমার বন্ধু!”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“মিশু তুমি যাও এখন। ঘরে যাও অতিথিদের এতো প্রশ্ন করতে হয় না। এখন তো চকলেট পেলে এগুলো ঘরে গিয়ে রেখে এসো।”

“না আমি এখন এখানে বসে খাবো।”

“রুমে গিয়ে খাও যদি আরবাজ তোমার চকলেট নিয়ে যায় তখন কি করবে?”

“এগুলো আমার চকলেট ঐ পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি দিয়েছে । আমি এগুলো কাউকে দেব না।”

বলেই এক ছুট দিল। মুখর আর আরবাজ ‘পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি’ শুনে হাসলো। একটা সময় মুখর আরবাজ আর মিশু ছিল বেস্ট ফ্রেন্ড। সময়ের সাথে কি থেকে কি হয়ে গেছে। হুট করে আরবাজ আবার বলল,,

“মিশুর নতুন বন্ধু কে বাবা?”

তখন ফট করেই আরিফা জামান বললেন,,

“দুদিন হলো এক ডাক্তার এসেছে গ্ৰামে। প্রথম দিন মিশুর সিঁড়ি থেকে পরে মাথা ফেটে গেছিল সে খবর পেয়ে এসেছিল। মিশু ওনার সাথে খুব তাড়াতাড়ি মিশে বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে তাই তার থাকার জন্য বাড়ি ছিল না বলে তোমার বাবা গ্ৰামের ঐ বাড়িটা তাকে থাকতে দিয়েছে!”

“কি ঐ বাড়িতে থাকতে দিয়েছে।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আহ আরিফা ছেলেটা আসতেই সব তোমার তার কানে তুলতে হলো। এখানে মুখর ও আছে পারিবারিক আলোচনা না হয় পরে করা যাবে। মুখরের জন্য খাবার সাজাও।”

“আঙ্কেল এতো ব্যস্ত হতে হবে না।”

তখন আরবাজ বলল,,

“মিশুর মাথা ফেটে গিয়েছিল আর কেউ আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না। আবার একজন ঐ বাড়িতেও থাকতে দিয়েছো।”

“তুমি চিন্তা করবে বলে জানাই নি।আর বাড়িটায় যে থাকছে সে যত্ন করেই রাখবে বাড়িটাকে। ডক্টর মেহবিন মুসকান নাম তার।”

মেহবিনের নাম শুনে আরবাজ আর কিছু বললো না। শুধু বলল,,

“এই মুখর চল ফ্রেশ হয়ে নিই ক্ষুদা লাগছে।”

মুখর আর আরবাজ ওপরে চলে গেল। যেতে যেতে মুখর বলল,,

“সব জেনেও ঢং কিভাবে করতে হয় এটা তোর থেকে কেউ শিখুক।”

“এরকম রিয়াক্ট না করলে সবাই সন্দেহ করতো না। বাদ দে।”

“পুরোনো মিশুকে মিস করছি ইয়ার।”

“আমিও চারটি বছর ধরে মিস করছি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে। যার কাছে আমার সবকিছুর উত্তর থাকতো। কি থেকে কি হয়ে গেল মুখর আমি মিশুকে এভাবে দেখতে পারি না।”

‘ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে মিশু।”

“আল্লাহর কাছে সেই দোয়াই রোজ করি।”

_________________

রাতে ফোন ঘাটতে ঘাটতে একটা পোস্ট নজরে এলো মেহবিনের ‘বিহঙ্গিনীর কাব্য” আইডি থেকে যাস্ট নাও পোস্ট করা হয়েছে।

“তার প্রতিটা সাক্ষাৎ এতো মধুর কেন হয়!
মন বলে তাকে একটু ছুঁয়ে দিই তবুও সে দূরে রয়!”

মেহবিন মুচকি হেসে কমেন্ট করলো,,

“মনকে বেঁধে রাখুন আজকাল বেশ ছটফট করে সে!”

কমেন্টের রিপ্লাই আসলো,,

“আমার মনের মালিক তো আপনার মতো ভদ্র জালিম নয়। যে না চাইলেও জোর করে মনকে বেঁধে রাখবে।’

“জালিম তো কেউ আর জন্ম থেকে থাকে না। পরিস্থিতির চাপে পড়ে জালিম হতে হয়।”

ব্যস আর কোন উত্তর নেই। তা দেখে মেহবিন কিছু বললো না শুধু মুচকি হাসলো। এই ব্যক্তির পাগলামো দেখে সবসময় সে হাসে। এই আইডিটা শুধুমাত্র মেহবিনের জন্য খোলা। বিহঙ্গিনীর কাব্যের আইডিতে শুধু তার বিহঙ্গিনী আছে আর কেউ নেই। প্রফাইল লক আর একটাই ফ্রেন্ড সে হলো মেহবিন তার সকল অনুভূতি সে পোস্ট করে মেহবিন কে জানান দেয় আর মেহবিন মুচকি হেঁসে তার অনুভূতির সাথে হাডু ডু খেলে। শেষ মেষ ওপারের উত্তর না পেয়ে মেহবিন আর আগায় না। এভাবেই একটা আইডিতে কতোগুলো পোস্ট কতোগুলো কমেন্ট একা একাই পরে থাকে অন্যকেউ দেখে না শুধু দুজন মানুষ তাদের অবসরে এগুলো দেখে মুচকি হাসে।

__________

আজ শুক্রবার মেহবিনের ছুটি এবং এই হাসপাতালে আসার পর প্রথম ছুটির দিন। এর আগে আবুল বাজার করে দিয়েছিল আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে নিজেই বাজার করবে। সকাল বেলা আবুল কে ফোন করে বলেছে বাজারে নিয়ে যেতে। আবুল এলেই ওরা বেরিয়ে পরলো বাজারের উদ্দেশ্যে। বাজারে খুব সকালে এসেছে যাতে ভীরে পরতে না হয় আবুলের থেকে জেনেছে আজ শুক্রবার ভীর বেশি থাকবে নয়টায় বেশি ভীর হবে তাই সে আটটায় এসেছে। একটা বড় ইলিশ মাছের দিকে নজর যেতেই মেহবিন জিজ্ঞেস করলো,,

“এই বড় ইলিশটার দাম কতো?”

“এইটা একদাম দুই হাজার টাকা।”

“ওহ আচ্ছা তাহলে এটা আমাকে দিন।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ এলেন ঐ মাছের দোকানে আর বললেন,,

“নিমাই বড় ইলিশ মাছটা ব্যাগে দাও!”

“চেয়ারম্যান সাব আপনি আগে কইবেন না। আমি অহনি দিতাছি।”

বলেই লোকটা মেহবিনের বলা মাছটা ওনার ব্যাগে দিতে নিলেন তখন মেহবিন মুখ শক্ত করে বলল,

“এই মাছটা আমাকে দেওয়ার কথা ছিল আপনার। এটা ওনার ব্যাগে ঢুকাচ্ছেন কেন?”

কোন শক্ত মেয়েলি কথায় শেখ শাহনাওয়াজ পাশে তাকালেন এতোক্ষণ সে খেয়াল করেনি মেহবিন ওখানে আছে। আজ সে বোরকা আর হিজাবের সাথে মাস্ক ও লাগিয়েছে তাই বোধহয় চিনতে পারে নি। নিমাই নামের লোকটা বলল,,

“আমগো বাজারের বড় মাছ সবসময় চেয়ারম্যানসাব এর বাড়িতেই যায়।”

“তাই আমি কি করবো বলুন? আমি আগে ওটা দিতে বলেছি। আপনার উচিত ওটা আমাকে দেওয়া।”

“আপনে অন্য আরেকটা নেন চেয়ারম্যানসাব চাইছেন তাই এটা ওনার।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,,

“বাড়িতে মেহমান এসেছে তাই তাকে বড় ইলিশ মাছটাই খাওয়াতে চাই আপনি যদি ছেড়ে দিতেন তাহলে ভালো হতো।”

“আপনার বাড়িতে মেহমান এসেছে তো আমি কি করবো?”

“ঐ মাইয়া আপনে চেয়ারম্যানসাব এর মুখে মুখে তর্ক করেন আমি আপনার কাছে মাছ বেছুম না। যান দেখি অন্য খানে যান।”

“নিমাই এটা কেমন ব্যবহার? খদ্দেরের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করতে হয় না। তাছাড়া উনি ঠিকই বলেছেন উনি আগে চেয়েছেন তাই এটা তোমার ওনাকে দেওয়া উচিত। চেয়ারম্যান দেখে কি সে যা বলবে তাই দিতে হবে এমন কোন কথা নেই। তুমি ওনাকে ইলিশ মাছটা দিয়ে দাও।”

“কিন্তু চেয়ারম্যানসাব!”

“আমি বলছি তো!”

তখন মেহবিন বলল,,

“লাগবে না আমার। আপনি নিয়ে যান আপনার বাড়িতে না অতিথি এসেছে। যাই হোক এটা দেখে ভালো লাগলো সবাই আপনাকে বেশ মানে।”

বলেই মেহবিন অন্য কোথাও যেতে নিল তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আজ দুপুরে আমার বাড়িতে আপনার দাওয়াত রইল ডাক্তার?”

“দুঃখিত আপনার দাওয়াত গ্ৰহন করতে পারলাম না। আজ দুপুরে আমার বাড়িতে একজনের দাওয়াত আছে।”

“তাহলে আপনার বাড়িতেও অতিথি আসছে?”

“হুম তাও আপনার বাড়ি থেকেই!”

“কে?”

“বাড়িতে গিয়ে খোঁজ লাগান তাহলেই জানতে পারবেন।’

বলেই মেহবিন চলে গেল কিছুক্ষণ ঘুরে সে বাজার করলো একটা ইলিশ মাছ ও কিনলো তবে অন্য দোকান থেকে। চেয়ারম্যান কে সম্মান করে ঠিক আছে তবে তার আচরন মোটেও পছন্দ হয়নি মেহবিনের। ইলিশ মাছ কিনলো কারন ঐ একজনের পছন্দের তাই।

________________

“এই যে কুলসুম নেত্রী কই?”

“হেতির নাকি জ্বর আইছে তাই আজকে বাইর হয় নাই।”

“পায়ের ব্যাথা কমছে?”

“সকালে তো দেখলাম দৌড়াইতেছে।”

“ওহ আচ্ছা কাল তোমার মা বকে নাই তো তোমার সত্যি বলার জন্য।”

“না কিন্তু ভাইরে অনেক বকা দিছে।”

“ওহ! নেত্রীর জ্বর কি অনেক?”

“আরে না ভং ধইরা পইরা রইছে।”

“মানে?”

“আজ ওর বাপ বাড়ি থাকবো সারাদিন। ও ওর বাপের কাছে যাইবো না দেইখা ভং ধইরা পইরা রইছে আর কইতেছে আমার জ্বর আইছে আমি ঘুমামু আমারে কেউ ডাক দিবা না।”

“ওহ আচ্ছা তাহলে নেত্রী কে গিয়ে বইলো দুপুরে আমি তারে ডাকছি।সে যেন আসে আর হ্যা তুমিও আইসো।”

“আইচ্ছা!”

বলেই কুলসুম চলে গেল। বাজার থেকে ফেরার পথে কুলসুমের সাথে দেখা তাই ওর কাছে থেকে তার নেত্রীর খবর নিল।

______________

“মিশুমনি দেখো কত বড় ইলিশ মাছ আনছি বাজার থেকে!”

বড় মাছ দেখা মিশুকে ভিশন আনন্দ দেয়। আর ইলিশ মাছ মিশুর সবথেকে পছন্দের। তাই ওর বাবাকে সবসময় বলে বড় ইলিশ আনতে। মিশু গেল মাছ দেখতে মুখর আর আরবাজ ও গেল মিশুর পেছনে। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

” মিশুমনি বলোতো ইলিশ দিয়ে কি পদ রান্না হবে তুমি কোনটা খেতে চাও? ভাজা নাকি সরষে ইলিশ।”

তখন মিশু বলল,,

“আমি আজ কিছুই খাবো না। আমার দাওয়াত আছে।”

দাওয়াত এর কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ এর মেহবিনের কথা মনে পড়লো। আরবাজ জিজ্ঞেস করল,,

“দাওয়াত কোথায় আবার?”

“আমার বন্ধুর বাড়ি। আমি বলেছি ওর বাড়িতে যাবো ওর বাড়ি চিনে রাখবো যাতে আমি যাওয়া আসা করতে পারি। ও শুক্রবারে বাড়ি থাকবে তাই আমি দাওয়াত রেখেছি।”

এ কথা শুনে আরিফা জামান বললেন,,

“ঐ মেয়েটার সাথে এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না। মেয়েটা কি ভাববে বলো তো মিশুর ব্যাপারে।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“কিছুই ভাবছে না কারণ সে অলরেডি মিশুর জন্য বাজার করে ফেলেছে। এমন কি এই বড় ইলিশ মাছটাও সে মিশুর জন্য কিনছিল। কিন্তু আমি যাওয়াতে জেলে আমাকে দিচ্ছিল আর সে আমার বাড়ির অতিথির কথা শুনে প্রথমে না দিতে চাইলেও পরে আমাকে দিয়ে দিল। অবশ্য আমি তাকে দাওয়াত দিয়েছিলাম সে বলেছে তার বাড়িতে আমার বাড়ির একজনের দাওয়াত আছে। এখন বুঝলাম কে!

“আমি কিন্তু যাবো বাবা।”

“ঠিক আছে তুমি কোথাও যেতে চাও না আজ যেহেতু যেতে চেয়েছো আমি নিজে তোমায় নিয়ে যাবো।”

“তুমি যাবে কেন তোমাকে দাওয়াত দেয় নি তো।”

“তোমার বন্ধু আমি গেলে ঠিকই খাওয়াবে । তবে আমি শুধু তোমাকে দিতে যাবো বিকেলে আবার নিয়ে আসবো।”

তখন আরবাজ বলল,,

“তোমার যেতে হবে না আমি আর মুখর গিয়ে নিয়ে আসবো। আর কতোদিন ঐ বাড়িতে যাওয়া হয় না বাড়িটাও দেখে আসবো।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

দুপুর হতেই মিশু রেডি হয়ে নিল। সুন্দর করে একটা থ্রিপিস পরলো একটা হিজাব নিয়ে মাথায় বাধার চেষ্টা করলো কিন্তু হলোই না শেষে মাথা ভালো করে ঢেকে গলায় কাছে গিট্টু মেরে দিল। ব্যস আমাদের মিশু রেডি। সে নিচে এলো ওকে দেখে ওর কাকাতো বোন জিনিয়া আর মুনিয়া হেঁসে উঠলো। তা দেখে মিশু বলল,,

“এই তোরা হাসছিস কেন?”

“তুমি এটা কি করেছো আপু হিজাব টা ঠিক করে পড়।”

“ধুর হয় না তো! কতো চেষ্টা করলাম হলোই না তাই তো গিট্টু মারলাম।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ এসে বললেন,,

“চলো আমি ঠিক করে দিচ্ছি।”

তিনি যত্ন করে মেয়ের হিজাব বেঁধে দিলেন। তারপর মেয়েকে নিয়ে মেহবিনের বাড়িতে এলেন। মেহবিন নামাজ শেষ করে উঠলো মাত্র। তখনি গেইট খোলার আওয়াজ পেল। বাইরে বেরিয়ে দেখলো মিশু আর শেখ শাহনাওয়াজ। মেহবিন কে দেখেই মিশু বন্ধু বলে এগিয়ে গিয়ে হাত সামনে ধরলো মেহবিন হাত বাড়ালেই সেদিনের মতো হাতের ওপর দিয়ে তুফান উঠলো।
মেহবিন মুচকি হেসে হাত ছাড়িয়ে বলল,,

“চেয়ারম্যান সাহেব বোধহয় না খেয়েই এসেছেন আপনিও ভেতরে আসুন।”

শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আপনাকে এখনো আমার বাড়ির এক গ্লাস পানি ও খাওয়াতে পারি নি। যেদিন খাওয়াতে পারবো সেদিন নিশ্চয়ই আপনার বাড়িতে খাবো। আচ্ছা আমি যাই আল্লাহ হাফেজ। মিশুর খেয়াল রাখবেন বিকেলে আমার ছেলে এসে মিশুকে নিয়ে যাবে।”

“আপনার ছেলের নাম কি?”

“শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ!”

তখন মিশু দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“ওরফে বাজপাখি।’

মিশুর কথায় মেহবিন হাসলো। শেখ শাহনাওয়াজ চলে গেলেন। ওরা বাড়ির ভেতরে গেল তখন মিশু বলল,,

“বন্ধু তুমি এতো বড় বাড়িতে একা থাকো? ভয় করে না তোমার।”

“না ভয় করে না আর আমি একাই থাকি।”

“কেন তোমার পরিবার নেই।”

“আমার কেউ নেই আবার সবাই আছে ।”

“এটা কেমন কথা হলো আমি তো কিছুই বুঝলাম না।’

তখন বাইরে থেকে আওয়াজ শোনা গেল দ্য গ্ৰেট শেখ তাজেলের। মেহবিন বাইরে গিয়ে তাজেল কে ঘরে নিয়ে এলো ওর হাতে একটা প্লেট ওপরে ঢাকনা দেওয়া। মেহবিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,

“দাদি খিচুড়ি পাঠাইছে তোমার লিগা। আজ শুক্রবার আছিল না তাই মসজিদে দিছিল।”

মেহবিন প্লেটটা রেখে দিয়ে বলল,,

“পা সেরে গেছে নেত্রী।”

“এইটুকুতে আমার কিছু অয় না। অনেকটাই শাইরা গেছে সকাল বেলা উইঠা দেহি ব্যাথা নাই। পুরো দুইটা দৌড় লাগাইছি।পরে দেহি হালকা হালকা ব্যাথা করে তখন খাবার খাইয়া তোমার ওষুধ খাইলাম তারপরে সারাদিন শুইয়া আছিলাম কুলসুম যাইয়া তোমার খবর কইলো তাই দুপুরে নাইয়া তোমার বাড়ির দিকে আসলাম তহন দাদি এইটা ধরাই দিলো‌।

এটুকু বলেই মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“এডা চেয়ারম্যান এর মাইয়া না?”

তা শুনে মিশু গোল গোল করে তাকিয়ে বলল,,

“তুমি আমাকে চিনো? আচ্ছা কিভাবে চিনো?”

“এর আগে আমার বাপের লগে তোমাগো বাড়ি গেছিলাম ‌। তোমারে জোর কইরা ওপরে নিয়া গেল না তাই দেখছিলাম।”

“ওহ্!”

“ডাক্তার এদিকে আসো তো!”

মেহবিন ওর কাছে গেলে তাজেল হাত দিয়ে নিচু করে ফিসফিস করে বলল,,

“চেয়ারম্যান এর পাগল মাইয়া তোমার কাছে কি করে?”

মেহবিন ফিসফিস করে বলল,,

“আমার বন্ধু সে! আর সে পাগল না একটু অবুঝ তুমি কিন্তু ওকে পাগল বলবা না।”

“সারা গ্ৰামের মানুষ কয়।”

“বলুক তবুও তুমি বলবা না।”

“আইচ্ছা।”

মেহবিন মিশুর কাছে গিয়ে বলল,,

“চলো হাত ধুয়ে নাও আমি খাবার দিচ্ছি আর নেত্রী তুমি আজকে আমাদের সাথে খাবে।”

“না না দাদির কাছ থিকা খিচুড়ি খাওয়া লাগবো খিচুড়ি আমার খুব ভালো লাগে।”

তখন মিশু বলল,,

“আমিও তাহলে খিচুড়ি খাবো বন্ধু।”

মেহবিন বলল,,

“আচ্ছা। নেত্রী তুমি আজ আমাদের সাথেই খাবে।বসে পড় বিছানায়।আমি সব খাবার নিয়ে আসছি।”

মেহবিন বিছানায় একটা ওরনা বেছালো এক এক করে সব রাখলো পোলাও, রোস্ট,ইলিশ মাছ ভাজা আর গরুর মাংস। পাশে খিচুড়ির প্লেট ও রাখলো। সব দেখে তাজেল বলল,,

“এ তো বিয়া বাড়ির খাওন।”

“এখনো তুমি খিচুড়ি খাবা?”

“না আমি এই বিয়া বাড়ির খাওন খামু। ইশশ কুলসুম তোরে আইতে কইলাম আইলি না দ্যাখ কতবড় মিস করলি।

“আমি তো কুলসুম কেও আসতে বলেছিলাম।’

“ওরে ওর মায় আইতে দেয়নাই তোমার বাড়ির কতা হুইনাই রাইখা দিছে তাই কুলসুম ও আসে নাই। দাদির বাড়িতে চুপচাপ খিচুড়ি খাইতেছে।

“ওহ আচ্ছা বন্ধু তুমি কি খাবে?”

“আমি দুইটাই খাবো তুমি আগে খিচুড়ি দাও।”

মেহবিন ওদের বেড়ে দিলো নিজের জন্যও বাড়লো। কিন্তু মিশু ঠিকভাবে খেতে পারছে না। একটু মাখিয়ে যাচ্ছে আর পরেও যাচ্ছে। তা দেখে তাজেল খাওয়া বাদ দিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে মেহবিন বুঝতে পারলো একা ভালো মতো মিশু খেতে পারে না তাই ও গিয়ে বলল সে খায়িয়ে দেবে। মেহবিন যত্ন করে খায়িয়ে দিলো মিশু ও চুপচাপ খেল তাজেল এক পলক দেখে নিজে খেতে লাগলো। মেহবিন তাজেল আর মিশুকে সব থেকে বড় পিচ টাই দিয়েছে। অতঃপর সবার খাওয়া শেষ। মেহবিন তাজেলকে আর মিশুকে নিয়ে বারান্দায় গেল । মিশু অনেক গল্প করলো মেহবিন সব শুনলো। তাজেল আর মিশুর বেশ ভাব হয়েছে তারা দু’জন ঘরের ভেতর ছোটাছুটি করে অনেকক্ষন খেললো। খেলা শেষ করে তাজেল বাড়ি চলে গেল তখন মেহবিনের ফোনে ফোন এলো ইমার্জেন্সি হাসপাতালে যেতে হবে কালকের রোগীর অবস্থা আজও অনেক খারাপ। এখন কি করবে মিশুও রয়েছে ও তখন তাজেল আবার এলো কুলসুম কে নিয়ে মিশুর সাথে আরো খেলবে বলে। এটা দেখে মেহবিনের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো সে সবাইকে বলল কার্টুন দেখবে কি না। সবাই বললো দেখবে ও ল্যাপটপ এনে কার্টুন ছেড়ে দিল।যা তিন ঘন্টা চলবে সবাইকে বললো ওর হাসপাতালে যেতে হবে তারা তিনজন যেন একসাথে থাকে। তাজেলকে বলল মিশুর খেয়াল রাখতে মিশুকে যেন না ছাড়ে আর ওদের সামনে কতোগুলো চকলেট রেখে দিল পানিও এনে দিলো। কুলসুম চলে গেলেও যেন তাজেল না যায় সেটাও বলে গেল। অবশ্য এই জন্য আরবাজ কে একটা মেসেজ পাঠিয়ে হাসপাতালে গেল। ওদের একা রেখে গেল দেখে রাস্তায় গিয়ে রিক্সা পেতেই সেটায় চরে বসলো হাসপাতাল তার অবস্থা স্বাভাবিক করে আবার তাড়াতাড়ি রিক্সায় চড়ে বাড়ি আসলো। পাকা রাস্তায় নেমে তাড়াতাড়ি করে বাড়ির সামনে আসতেই দেখলো মিশু বারান্দায় বসে মাথায় দুই হাত দিয়ে চেপে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বলছে। ওর শরীর ও কাঁপছে তা দেখে মেহবিন দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরলো মিশু ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,,

“রক্ত! রক্ত! রক্ত!

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০৪

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

(অনুমতি ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ)

‘আপনারে যদি একখান কথা জিজ্ঞেস করি আপনে কি উত্তর দেবেন?”

ড্রাইভারের কথায় মেহবিন গাড়ি থেকে নামতে গিয়েও আবার থেমে তার দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘আপনার কেন মনে হলো? আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিব না।”

“এমনিই সবাই তো আর ড্রাইভারের প্রশ্নের উত্তর দিবার চায় না তাই আর কি?” আপনে তো ডাক্তার তাই না?

“হুম ডাক্তার। আপনি প্রশ্ন করেন না আমার জানা থাকলে অবশ্যই দেব।”

“ঠান্ডা জ্বর লাগলে কি শুধু নাপা খাইলেই শাইরা যায়।”

“ওটা জ্বরের অবস্থা বুঝে। তবে এটা কে বলল শুধু নাপা খেলেই সেরে যায়।”

“আর বইলেন না আমার বউ এর অনেক জ্বর আইছে কতোদিন ধইরা। আমি কই ডাক্তাররে দেখাইতে হে খালি কয় নাপা খাইলেই শাইরা যাইবো। আমি আবার মুর্খ মানুষ লেহাপড়া করি নাই তাই ভালো জানি না।”

“কতোদিন ধরে জ্বর?”

“এই তো সাতদিন এহন তো আবার কাশি ও বাড়ছে।”

“কাল আপনার বউকে নিয়ে হাসপাতালে যাবেন। আমি দেখে ওষুধ লিখে দেব সেগুলো খেলে ইনশাআল্লাহ তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।”

‘আইচ্ছা।”

মেহবিন এবার গাড়ি থেকে নেমে গেল তখন ড্রাইভার আবারো বলল,,

‘গেরামের বেশিরভাগ মানুষেরই খালি নাপা খাইলেই জ্বর শাইরা যায়। খালি জ্বর না সব অসুখ ই মনে অয় নাপা খাইলে শাইরা যায়। আমারও শাইরা যায় কিন্তু আমার বউয়ের শারতেছে না।”

মেহবিন মুচকি হেসে পেছনে ঘুরে বলল,,

‘গ্ৰামের মানুষরা ডাক্তার দেখে ভয় পায় আর ডাক্তারের কাছে গেলেই টাকা লাগবে তাই যায় না। তারা নিজেদের ওপর টাকা খরচ করতে চায়না। সেই জন্য নাপাকে সব রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে। শুধু নাপা খেলে সব রোগ সারে না হয়তো একটু আরাম পাওয়া যায় স্বল্প সময়ের জন্য।

“কথাটা অবশ্য আপনে সইত্য কইছেন।”

‘কাল হাসপাতালে আইসেন।”

বলেই মেহবিন ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে সামনে আগাতে লাগলো। দুই মিনিট পর বাড়ির ভেতরে গেল সব অন্ধকার ও গিয়ে আগে ঘরের আর বাইরের লাইট জ্বালালো। বাইরে একটা লাইট লাগিয়েছে যে বাল্বটা পুরো বাড়িকে আলোকিত করে রাখে। মেহবিন রান্না ঘরে গিয়ে দেখলো কিছুই নেই রান্না করা। ও রাতে রান্না করতে চেয়েছিল কিন্তু তখন চেয়ারম্যান বাড়িতে গিয়ে সব ঘেটে ঘ হয়ে গেছে। তখনি বাইরে থেকে মহিলার কর্কশ আওয়াজ আসলো,,,

“নতুন মাইয়া বাড়িতে ফিরছো নি একটু বাইর হও তো।”

মেহবিন রান্না ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল দুজন মহিলা আর একজন পুরুষ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে । হাতে টর্চ লাইট আর কিছু একটা আছে তাদের। মেহবিন দোয়া দরুদ পরে বাইরে বের হলো মোবাইল টা নিয়ে। ঘর থেকে বেরিয়ে বলল,,

‘আপনারা ভেতরে আসেন গেট তো খোলাই আছে।”

মেহবিনের সম্মতি পেয়ে তারা ভেতরে আসলো। মহিলা দুজন এগিয়ে এসে বলল,,

‘আমি তোমার বাড়ির সামনের রাস্তার ঐপাশে থাহি। আজ আমগো বাড়ি দুপুরে অনুষ্ঠান আছিল। তুমি তো দুই দিন আগে আইছো দাওয়াত দিতে মনে আছিল না। আর সারাদিন বাড়ি আছিলা না। আবার সন্ধ্যায় ও চেয়ারম্যান সাহেব লইয়া গেলেন তাই তোমার জন্যে খাওন আনছি খাইয়া নিও।নাকি চেয়ারম্যান বাড়ি থেইকা খাইয়া আইছো।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘খেয়ে আসলে কি দিবেন না?”

‘এমা তা কেন হইবো? আমি এমনিই জিগাইছি। এই লও তোমার জন্য সেই সন্ধ্যা থেইকা অপেক্ষা করতেছি।”

‘এতক্ষন অপেক্ষা করার দরকার ছিল না। আর এখন এগুলো আনারও দরকার ছিল না। আগে বললে আমি সন্ধায়ই এগুলো নিয়ে রাখতাম শুধু শুধু কষ্ট করলেন।”

“কষ্টের কি হইলো তুমি হইলা আমগো প্রতিবেশী। প্রতিবেশী রে না দিয়া কি থাহুন যায়। তুমি আমগো বাড়ি বেরাইতে যাইও। এহন আসি।”

‘আচ্ছা ধন্যবাদ।”

“ও হুনো?”

“জি বলেন?”

‘কাল ধান সেদ্ধ করুম তোমার দুয়ারে খুব রোদ উঠে। তোমার দুয়ারে কি ধান দিবার পারুম। যদি তোমার সমস্যা না অয়।”

‘সমস্যা নেই দিয়েন। আমি এমনিতেও গেইট খোলা রেখেই যাই।”

“আচ্ছা তাইলে ঠিক আছে। তাইলে যাই একা একা থাকো কোন সমস্যা হইলে আমগো ডাক দিও। আর সাবধানে থাইকো।”

‘আচ্ছা ঠিক আছে সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ।”

ওনারা চলে গেলেন। মেহবিন মুচকি হেসে গেইট আটকে ঘরে এলো। বাইরের বারান্দার কেচিগেইট এ তালা ঝুলিয়ে এলো। এটা সে প্রতিদিনই করে। মেহবিন খাবার গুলো বিছানায় রেখে হাত ধুয়ে এলো ঢাকনা টা খুলতেই দেখলো তেহারী আর পায়েস। মেহবিন অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,,

“আলহামদুলিল্লাহ সত্যি রিজিক আল্লাহ প্রদত্ত বড় নেয়ামত। কোথায় কিভাবে কার রিজিক আছে সেটা আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন। এই জন্যই তো আল কুরআন এ বলেছেন,,

আর পৃথিবীতে কোন বিচরণশীল নেই, তবে সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে রয়েছে।
(সূরা হুদ-৬)

বলেই মেহবিন খেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। এরপর মোবাইল এ কিছু কাজ করে ঘুমিয়ে পড়লো।

_________________

“কোনভাবে কি ট্রান্সফার টা আটকানো যায় না নাতি?’

রাতে ডিনার টেবিলে আছিয়া খাতুন মুখর কে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন। তা শুনে মুখর বলল,,

“আটকানো গেলে তো আটকাতাম না দাদিজান। তোমারে ছাড়া কি আর মন টিকবো ঐহানে।”

“এহন রসের কথা বাদ দে। যা জিগাইলাম হেইডার কথা ক।”

“ঐ যে বললাম আটকানো যাবে না। তাছাড়া আমি কি জানি ওপর থেকে যা আদেশ দেবে আমাকে তাই মানতে হবে।”

“মাহফুজ!!”

‘আমি এসবের ভেতরে নাই মা।”

“তুইই তো যতো নষ্টের গোড়া। পোলাডারে যদি নিজের কাছে নাই রাখতে পারোস তাইলে কিসের কমিশনার তুই।”

“নিজের কাছে রাখার জন্য আমি ওকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বানাইনি মা। দেশের সেবা করার জন্য বানিয়েছি।”

“হইছে তোর ডায়লগ বাদ দে। নিজে তো পুলিশ পোলাডারে কেন পুলিশ বানাইতে হইবো। অন্য কিছু বানাইলে হইতো না।”

“তোমার নাতি চেয়েছে তাই হয়েছে এখানে আমার হাত নেই।”

“আহ হা দাদিজান কাল সকালে আমি চলে যাবো আর তোমরা কি শুরু করলে। মা, কাকাই, কাকিমনি তোমরা কিছু বলছো না কেন বলো তো।”

মুখরের কথা শুনে মুখরের মা নাদিরা খানম বললেন,,

“আমরা কি বলবো তুই বল এখানে একজন হোম মিনিস্টার আর একজন প্রাইম মিনিস্টার। আমরা নিরব জনগণ। জনগনের সামান্য কথা কি এই মিনিস্টার রা শুনবে।”

একথা শুনে মুখরের কাকাই আছলাম শাহরিয়ার বললেন,,

“ভাবি একদম ঠিক বলেছে।”

“হয়েছে আর ড্রামা করতে হবে না কাকাই। তোমার সাহস কতোদূর জানা আছে এতো বড় রাজনৈতিক নেতা হয়েও দাদিজান আর বাবার সামনে ভয় পেয়ে চুপ করে থাকো।”

“এটা ভয় নয় মুখর এটা সম্মান প্রদর্শন। আমি তাদের সম্মান করি তাই চুপ থাকি।”

“রাজনৈতিক নেতারা আর কিছু পারুক আর না পারুক জনগনের মন কথা দ্বারা কিভাবে গলাতে হয় তা ভালো করেই জানে।”

“এই মুখর রাজনীতি নিয়ে কিছু বলবি না।”

তখন মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

“হয়েছে এখন সবাই চুপচাপ খাও । কাল সকালে আমরা সবাই স্টেশনে ছাড়তে যাবো মুখর কে ছাড়তে।”

“কিরে নাফিয়া তুই এতো চুপচাপ কেন আজ এমনিতে জ্বালিয়ে মারিস।”

ভাইয়ের এরকম কথা শুনে নাফিয়া অভিমান করে বলল,,

“কাল থেকে আর কেউ তোমায় জ্বালাবে না ভাইয়া। থেকো তুমি সারাদিন আরামে।”

মুখর বুঝতে পারলো নাফিয়ার মন খারাপ তাই বোনের সাথে কাছে গিয়ে বলল,,,

“আমি চলে যাচ্ছি বলে মন খারাপ।”

“আমি কেন মন খারাপ করবো তুমি চলে গেলে আমার ভালোই হবে। সারা বাড়িতে আমি রাজত্ব করবো।”

“তা হোম মিনিস্টার কি তার পদ থেকে নেমে তোকে বসাবে।”

“ভাইয়া তুমি একদম মজা করবে না আমার একটুও ভালো লাগছে না। ভাবি আসলে আমি কিন্তু বলে দেব।

তখন মুখর মুচকি হেসে বলল,,

‘তুই গেলে না তোর ভাবি আসতে পারবে নাফি।”

মুখরের কথা শুনে হুট করেই পুরো পরিবেশ টা থম মেরে গেল। মুখর ওর দাদিজানের দিকে তাকিয়ে একটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,,

“যাই হোক মা কাল কিন্তু আমার ফেবারিট খাবার রান্না করবে। আর নাফি তুই পায়েস রান্না করবি।”

নাফিয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে ওর মায়ের কাছে গেল। মুখর পরিবেশটা ভালো করার জন্য নাফিয়ার পেছন পেছন গেল বোনের সাথে কিছুক্ষণ খুনশুটি করে ওর মন ভালো করে দিল। নাফিয়া আর মুখর এক বছরের ছোট বড়। পড়াশোনা শেষ আপাতত সে একটা বোরকার বিজনেস চালু করেছে। আছলাম শাহরিয়ার একজন রাজনৈতিক নেতা সামনের নির্বাচন এ এম পি এর জন্য দাঁড়াবে। তার এক ছেলে এক মেয়ে ছেলে আলভি আর মেয়ে মারিয়া। ছেলে বিজনেস করছে আর মেয়ে কলেজে পড়ে। আর বাকি মহিলাবিন্দু হাউজ ওয়াইফ।

_________________

আজানের ধ্বনি কানে যেতেই ঘুম থেকে উঠে ঘুম থেকে ওঠার দোয়া পরে বিছানা ছাড়লো মেহবিন। গ্ৰামের একটা আজান হয় যা মনকে প্রশান্তি দিচ্ছে শহরের মতো চার পাঁচ টা আজান মিক্সড নয়। যদিও দূরের গ্ৰামের আজান ও কানে ভেসে এলো তবুও ব্যাপারটা মন্দ না। ওয়াশরুম থেকে উযু করে ফজরের নামাজ আদায় করে নিল মেহবিন। সামনের বারান্দায় আসতেই দেখলো সামনের বাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে বোধহয় ধান সেদ্ধ করছে। আলো ফুটতে শুরু করেছে তাই বারান্দার কেচিগেইট খুলে বাইরে বের হলো সে। একটু হাঁটাহাঁটি করলো তারপর পুরোপুরি আলো ফুটতেই ওর কানে আওয়াজ এলো মসজিদের ইমাম সাহেবের,,,

“”মক্তবের ছাত্র ছাত্রীরা তোমরা অতি তাড়াতাড়ি মক্তবে চলে আসো। (!!) গ্ৰামের সম্মানিত মা ও বোনেরা আপনারা আপনাদের ছেলে মেয়েদের কুরআন শিক্ষার জন্য মসজিদে পাঠিয়ে দিন।(!!) মক্তবের ছাত্র ছাত্রীরা!!!!

আজকেই প্রথম শুনলো মেহবিন হয়তো দুদিন ইমাম সাহেব ছিলেন না। তবে এভাবে কুরআন শিক্ষার জন্য ডাকাটা ওর ভালো লাগলো। এভাবে শহরে ডাকে না। মেহবিন হেঁসে রান্না ঘরের চলে গেল। আপাতত নিজের এখনের জন্য রুটি ডিম ভাজি আর আলু ভাজি করবে। দুপুরের জন্য ভাত আর মাছ রান্না করে নিয়ে যাবে। ও তাড়াতাড়ি করে রান্না শেষ করলো তারপর গোসল করে রেডি হয়ে নিল। এদিকে কালকের মহিলারা ধান দিয়ে ফেলেছে মেহবিন এক পলক দেখলো এগুলো তার কাছে নতুন। সে বের হলো তারপর শুধু ঘরে তালা মারলো বারান্দা টা এমনিই আটকে দিল আজ আর কেচিগেইট এ তালা দিল না তারপর মহিলাদের কাছে গিয়ে বলল,,

“বারান্দায় টুল রাখা আছে দুটো। আপনারা ওখানে গিয়ে জিরিয়ে নিয়েন আজ খোলাই রাখলাম বারান্দা।

“তুমি আমাগো জন্য বারান্দা খোলা রাখছো কেন?”

“আপনাদের একটু স্বস্তির জন্য।”

“যদি কেউ ঘরের থন কিছু নিয়া যায় তাইলে কি করবা।”

“কিছুই না শুধু পুলিশ ডাকবো।”

এ কথা শুনে মহিলা দুটো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল যা থেকে মেহবিন হেঁসে বলল,,,

“আরে চিন্তার কোন কারন নেই। এই ঘরে রাখার মতো কিছুই নেই। ঘরে তালা মেরেছি শুধু বারান্দা খোলা। তাছাড়া আপনারা দুজন আছেন তো পাহাড়া দেবেন আপনাদের ধানের সাথে। তবে আমি আসার আগে আপনাদের কাজ হয়ে গেলে চলে যাবেন সমস্যা নেই।আসছি আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই মেহবিন চলে গেল। মহিলা দুটো ওর দিকে তাকিয়ে রইল হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো মেয়েটা কেমন। মেহবিন রাস্তায় যেতেই দেখলো আবুল দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“আবুল ভাই আপনি?”

“তুমি তো এইসময়ই হাসপাতালে যাও তাই নামাই দিতে আইলাম।”

“ওহ আচ্ছা চলেন তাহলে। তবে হ্যা এই সময় আমার একার জন্য আপনি আবার অন্যদের রিক্সায় নেবেন না। এমনটা করবেন না এতে কিন্তু আমার খারাপ লাগবে।”

“আরে না আজ কেউ আছিল না দেইখা নিতে আইছি তোমারে।”

“বিশ্বাস করে নিলাম আজ।”

“আমি কিন্তু সইত্য কইলাম।”

“আচ্ছা আমিও বিশ্বাস করছি।”

_________________

সকালে হাসপাতালে যেতেই মেহবিন দেখলো কালকের চেয়ারম্যান বাড়ির ড্রাইভার তার বউকে নিয়ে এসেছেন। মেহবিন চেক আপ করে ওষুধ লিখে দিল। আর বলল ঠিক হয়ে যাবে অনেকদিন ধরে ঠান্ডা লাগার কারনে সর্দি বুকে বসে গেছে তাই এমনটা হয়েছে। দুপুরের খাবার খাওয়ার পর একটা রোগীর খুব সিরিয়াস অবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু কাল আর আজ সকালেও ভালো দেখে গিয়েছিল কিন্তু হুট করে এমনটা হওয়ার কারন খুঁজে পেল না মেহবিন। ও তাড়াতাড়ি করে সেই রোগীর কেবিনে গেল। মেহবিনের সাথে একজন সিনিয়র ডক্টর ও গেল । পেশেন্ট কে দেখে সিনিয়র ডাক্তার বললেন,,,

“রোগীর তো খুব সিরিয়াস কন্ডিশন ওনাকে এখানে রাখা ঠিক হবে না। আপনি বরঞ্চ ঢাকায় এস.এস. হাসপাতালে নিয়ে যান।”

তখন মেহবিন বলল,,

“ওখানে কেন যাবে? এখানেই তো ওনাকে সুস্থ করা সম্ভব এখন না হয় অবস্থা একটু ক্রিটিকাল।”

“আপনি বুঝতে পারছেন না ডক্টর মেহবিন। এখন এখানে রাখাটা ঠিক হবে না কখন কি হয় সম্পূর্ণ দায় আমাদের পরবে। তাছাড়া এসব.এস. হাসপাতাল ভালো হাসপাতাল ওখানে গেলে উনি সুস্থ হয়ে যাবেন।”

“ওনার যে অবস্থা ওখানে গেলে ঠিক হয়ে যাবে এর গ্যারান্টি কি? তাছাড়া দায় এড়ানোর জন্য আমরা কেন অন্য হাসপাতালে যেতে বলবো। এখন তো ওনার জন্য ট্রাভেল করা বেশ রিস্কি।”

“ডক্টর মেহবিন আমি আপনার সিনিয়র আমি নিশ্চয়ই আপনার থেকে এ সম্পর্কে ভালো জানি‌। আমি যেহেতু বলছি নিশ্চয়ই পেশেন্ট এর ভালোর জন্যই বলছি।”

“কিন্তু স্যার ওনাকে এখানে রেখেই সুস্থ করা সম্ভব। শুধু একটা ইনজেকশন লাগবে। আমি ওটা আনতে পাঠিয়েছে ইনজেকশন টা দেওয়ার পাঁচ মিনিট পরেই ওনার সব নরমাল হয়ে যাবে।”

“আমি আপনার সিনিয়র। কই আপনি তো আমায় বলেন নি।”

‘আমি ভেবেছিলাম আমার বলার প্রয়োজন হবে না। আপনি সিনিয়র আপনিই নিশ্চয়ই বলবেন ওটা আনার কথা। কিন্তু আপনার মাথায় তো এটাই ঘুরছে কিভাবে ওনাকে এস.এস. হাসপাতালে শিফট করা যায়।”

“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করেছেন?”

“মোটেই না আমি শুধু সত্যি বলছি। দেখি সরুন ইনজেকশন এসে গেছে।”

বলেই মেহবিন ওয়ার্ডবয় এর থেকে ওষুধ টা নিয়ে সিরিন্জ এ ঢুকালো। ইনজেকশন টা পুশ করবে এমন সময় সিনিয়র ডক্টর বাবুল বলে উঠলো ,,

“আমি আপনার সিনিয়র আপনি আমাকে না জানিয়ে পেশেন্টকে কোন ইনজেকশন দিতে পারেন না।”

“আমি কোন প্যাক্টিসিং ডক্টর নই স্যার । আমি একজন ডক্টর আমি নিশ্চয়ই জানি কোন ওষুধে কি রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাছাড়া আপনার সাথে কথা বলে আমার সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু হচ্ছে না।”

বলেই মেহবিন ইনজেকশন পুশ করে দিল। ডক্টর বাবুল রেগে মুখ শক্ত করে রইলো। পাঁচ মিনিট পরেই লোকটার কন্ডিশন স্বাভাবিক হয়ে গেল। মানে অসুস্থ অবস্থায় যতটুকু হওয়া আর কি। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“দেখুন মিস্টার সিনিয়র ডাক্তার বাবুল সব ঠিক আছে এমনি এমনি তো আর ডাক্তার হইনি। বাই দা ওয়ে এস.এস. হাসপাতাল কি আপনার বা আপনার কোন আত্মীয়ের নাকি। বারবার বলছিলেন সেই হাসপাতালে নিতে। শুনুন একটা কথা মনে রাখবেন যে হাসপাতালে আছেন সেটাকে সম্মান করতে শিখুন। নিজের কাজের জায়গা কে একদম নিজের করে নিন। এখানে এসেছে মানে আপনাদের ওপরে ভরসা করে এসেছে নিজের সর্বচ্চোটা দিন যখন আপনার হাতের একদম বাইরে তখন কোন হাসপাতাল রেকোমেন্ট করুন। আগেই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে হবে।

ডক্টর বাবুল শক্ত মুখে বলল,,

“তোমায় আমি দেখে নেব। তুমি আমাকে অপমান করেছো।”

“আমি তো দাঁড়িয়েই আছি দেখেন তবে হ্যা দৃষ্টি সংযত করে। নাহলে কিন্তু চোখের যিনা হয়ে যাবে।আর হ্যা আমি তো আপনাকে কিছুই বলিনি আপনি যদি অপমানবোধ করেন তাহলে আমার কি!”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে আসলো। কার সাথে কিরকম ব্যবহার করা উচিৎ সেটা সে ভালো করেই জানে। বিকেলে মেহবিন সিসি টিভি ক্যামেরা রুমে গেল তার সন্দেহ হচ্ছে কিছু তো ঘটেছে দুপুরে তার জন্য প্রায় সুস্থ হওয়া পেশেন্টের এরকম অবস্থা হলো। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখলো তাকে দেখানো যাবে না এই হাসপাতালের এমডি এর পারমিশন ছাড়া আর কাউকে সিসি ফুটেজ দেখানো নিষেধ। এটা দেখে মেহবিনের মনে সন্দেহ আরো গাঢ় হলো। তবে ও লোকটাকে বুঝতে দেয় নি কিসের জন্য এসেছে শুধু বলেছে একটা পেশেন্ট হাঁটতে বেরিয়েছে পাঁচ মিনিট আগে কোথায় ছিল সেটা দেখে দিতে। সে বলেছে এখন কোথায় আছে সেটা দেখিয়ে দেবে কিন্তু আগের ফুটেজ পারমিশন ছাড়া দেখাবে না। মেহবিন ঝামেলা না করেই আচ্ছা ঠিক আছে বলে চলে এসেছে। বিকেলে পাঁচ টায় মেহবিনের ডিউটি শেষ হলেই ও বাইরে বেরিয়ে বাড়ির পাকা রাস্তায় উঠতেই দেখলো দুজন ব্যক্তি ফুল আর চকলেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চেহারা দেখে মেহবিনের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। তাদের মধ্যে একজন প্রথমে সামনে এসে বলল,,

“আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন ডক্টর ম্যাডাম?”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনারা দুজন কেমন আছেন?”

তখন পাশ থেকে আরেকজন বলল,,

“যে জিজ্ঞেস করেছে শুধু তাকেই জিজ্ঞাসা করলেই হবে। কারন আরেকজন আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করবে তখন না তাকেও জিজ্ঞেস করা যাবে।”

এ কথা শুনে মেহবিন তার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“মিস্টার মুখর শাহরিয়ার আপনার কি আমার যৌথভাবে বলা পছন্দ হয় নি।”

“না পছন্দ হলে কি করবেন?”

“তাহলে আর কোনদিন ও যৌথভাবে বলবো না।”

কথাটা শুনে মুখরের মুখের হাসিটা আরো বিস্তৃত হলো। আর বলল,,

“মিস্টার আরবাজ দেখেন সি! সি!”

“এই মুখর তোর ঢং বাদ দে তো। এই যে ডক্টর ম্যাডাম আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”

“এখানে ঢং এর কি দেখলি।”

“তোকে পরে দেখছি তো মিস বিহঙ্গিনী কথা ছিল প্রতিটা সাক্ষাতেই আপনাকে চকলেট দিতে হবে। তাই
এই যে আপনার চকলেট আর নতুন হাসপাতালে জয়েন হয়েছেন তাই এই ফুলগুলো। শুভকামনা রইলো।”

“শুকরিয়া চকলেট বয় না না বাজপাখি।”

“বাজপাখি?”

“মিশুমনির বাজপাখি নামটা পছন্দ হয়েছে তাই আজ থেকে আর চকলেট বয় নয় বাজপাখি বলে ডাকবো।”

“মিশু কিন্তু পারফেক্ট নাম দিয়েছে আরবাজ।”

“মুখর তুই চুপ থাক। শুনুন বিহঙ্গিনী বাজপাখি বলতে চান তা ঠিক আছে কিন্তু বাজপাখি বললে কিন্তু একটু সমস্যা হবে বাজপাখি কিন্তু ছোট ছোট পাখির জন্য বিপদজনক কোনসময় হুট করেই হামলা করে বসে একদম তুলে নিয়ে যাবে তার ঠিক থাকবে না।”

“পাখিদের তুলে নেওয়া সহজ হলেও বুদ্ধিমতী পাখিকে তোলা সহজ হবে না। কারন সে জানে টিকে থাকতে হলে কি করা প্রয়োজন বুঝলেন বাজপাখি।”

“এই জন্যই তো তুলতে পারি নি এখনো।”

একথাটা শুনে মুখর শব্দ করে হেঁসে উঠল। মেহবিন মুচকি হাসলো। তা দেখে আরবাজ বলল,,

“একদম হাসবি না মুখর তোর এই হাঁসি আমার ভাল্লাগে না।”

‘হাঁসি পেলে হাসবো না। কি আজব কথাবার্তা বলিশ।”

আরবাজ কিছু বলবে তার আগেই ওর ফোন এলো ও ফোনে কথা বলতে বলতে দূরে চলে গেল। তা দেখে মুখর ওর হাতের লাল অর্কিড ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল,,

“কথা ছিল প্রতিটা সাক্ষাতেই এই ফুলের জন্য ফুল আনতে হবে। তাই এই ফুল গুলো নিয়ে আমাকে ধন্য করুন।”

মেহবিন মুচকি হেসে ফুলগুলো নিয়ে বলল,,

“শুকরিয়া! হাতে তো চকলেট দেখছি এগুলো কার জন্য?”

“বিহঙ্গিনী চকলেট খেতে পছন্দ করে তাই চকলেটগুলো দেখে যেন আমার কথা মনে পড়ে তাই এনেছি।”

বলেই হাতের বড় চকলেট বক্সটা মেহবিনের দিকে এগিয়ে দিল । মেহবিন সেগুলোও নিল। হাত ফুল হয়ে গেছে আরবাজ আর মুখরের ফুল আর চকলেট দিয়ে।

“সব ঠিক আছে। বাই দা ওয়ে ইন্সপেক্টর মুখর শাহরিয়ার এর ইউনিফর্ম এ আরো একটা স্টার যুক্ত হয়েছে শুনলাম কনগ্ৰাচুলেশন।”

“শুকরিয়া ডক্টর।”

“আচ্ছা আমি তাহলে যাই বাড়ি যাবো। আপনি নিশ্চয়ই আপনার বন্ধুর বাড়ি উঠবেন।”

“কয়েকদিনের জন্য তাই ই। কিন্তু পরে থানার আশেপাশে বাড়ি ভাড়া নেব। এখান থেকে অনেকটা দূরে। কোন সমস্যায় পরলে আমাকে জানাবেন কিন্তু।

‘অবশ্যই!”

“মেহবিন?”

“হুম!”

“কেমন আছেন?”

‘আলহামদুলিল্লাহ জীবন তো জীবনের মতোই চলছে।”

“এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।”

“আপনার অজানা থাকার কথা নয় মিস্টার মুখর শাহরিয়ার। যাই হোক আপনি কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ সব ঠিকঠাক।”

“পাঞ্জাবিওয়ালা আজ ইউনিফর্ম এ নেই তবুও গায়ে পাঞ্জাবি নেই কেন?”

কথাটা শুনে মুখর হাসলো কারন সামনের মানুষটার কাছে তার নামকরন ও ডাকের সম্মোধন পাঞ্জাবিওয়ালা। যেভাবে আরবাজ চকলেট বয়। মুখর হেঁসে বলল,,,

“এভাবেই!”

“এই মুখর চল বাবা ফোন করেছিল তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।”

আরবাজের কথায় দুজনেই তার দিকে তাকালো। আরবাজ বলল,,

“ডাক্তার ম্যাডাম তাহলে চলুন ড্রপ করে দিই।”

“যেখানে আমি চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে যাই না। সেখানে চেয়ারম্যান এর ছেলের সাথে কি যাবো।”

“কেন চেয়ারম্যান আর চেয়ারম্যান এর ছেলে কি আপনাকে খেয়ে ফেলবে।”

“খেয়ে ফেলবে না তার থেকেও আচ্ছা বাদ দিন। আপনারা যান আমি গেলাম। আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই মেহবিন হাঁটা ধরলো মুখর আর আরবাজ দু’জনেই শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। তারপর গাড়িতে করে চলে গেল। এখানে মানুষ জন নেই বললেই চলে তাই এতোক্ষণ কথা বললো ওরা। ওদের সাথে কথা বলতে বলতে মেহবিনের অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে । বাড়ির সামনে যেতেই দেখলো ওর বাড়ির সামনের গাছের নিচে তাজেল বসে আছে। তা দেখে মেহবিন হেঁসে বলল,,,

“কি ব্যাপার নেত্রী এসময় এখানে কেন?”

মেহবিনের কথায় তাজেল উঠে দাঁড়ালো আর বলল,

“তোমার বাড়ি পাহারা দিচ্ছিলাম। বাড়িতে গেলেই আজ মা মারবো তাই।”

“কেন মারবে কেন?

বলতে বলতেই মেহবিনের নজর গেল তাজেলের পায়ে গোড়ালিতে অনেক খানিক কেটে রক্ত পরছে । তা দেখে মেহবিন তাড়াতাড়ি করে ওর কাছে গিয়ে বলল,,

“পা কাটালো কিভাবে? বিরোধী দলের সাথে মারপিট করেছো নাকি? আমার সাথে চলো ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। হাঁটতে পারবা?

“অনেক ব্যাথা।”

“দাঁড়াও আমি এখনি আসছি!”

বলেই মেহবিন তাড়াতাড়ি করে গিয়ে বারান্দায় ওর ব্যাগ ফুল আর চকলেট গুলো রেখে এলো। তারপর আবার এসে তাজেলকে কোলে তুলে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। বারান্দায় বসিয়ে ঘরের তালা খুলে আবার কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল । তারপর পানি আর ওষুধ এনে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিল। কিন্তু তাজেল কিছুই বললো না ওষুধ লাগানোর সময় হালকা আওয়াজ করেছিল। ব্যান্ডেজ শেষ করে মেহবিন বলল,,

“ব্যাথা কমেছে?”

“হুম আচ্ছা ডাক্তার তুমি কেমনে জানলা আমি মারামারি করছি।”

“তারমানে সত্যি সত্যি মারামারি করেছো?”

“হ ঐ কুলসুমের বড় ভাই আছে না ও আমার মায়রে নিয়া খারাপ কথা কইছে।তাই আমি ওরে ধাক্কা দিছিলাম তারপর মারামারি শুরু কিন্তু ও হুট কইরা আমারে ধাক্কা দেয় হেনেই চারাতে (মাটির পাত্রের ভাঙ্গা টুকরো)লাইগা পা কাইটা গেছে গা।”

“বুঝলাম কিন্তু বাড়ি না গিয়ে আমার বাড়ির সামনে কি করছিলা?”

“এই অবস্থা মা দেখলে আমারে মারবো আর যদি হুনে আমি মারামারি করছি তাইলে আমি শেষ। হেই জন্য এনে আইছিলাম পরে দাদি কইলো তোমার বাড়ি পাহারা দিতে তারে নাকি কইছিলা পাহারা দিতে।

” পাহারা দিতে বলছিলাম ঠিকই কিন্তু আবার চলেও যেতে বলেছি । আচ্ছা বাদ দাও এখন বলো এতখানিক পা কেটে গেছে তাও মারবে।”

“হেই জন্য না মারলেও মারামারি করছি এইডা হুইনা নিশ্চিত মারবো। আমার জন্য মাইনসের কথা শোনা লাগবো যে। ঐ কুলসুমের মায় মনে অয় এতোক্ষণে আমগো বাড়ি চইলা গেছে বিচার দিতে।”

“আচ্ছা চলো আমি তোমাকে কোলে করে বাড়ি দিয়ে আসি এই অবস্থায় তো হাঁটতেও পারবে না।”

“তোমারে এই বিদেশি ফুল দিছে কিরা? আবার দেহি বিদেশি চকলেটও দিছে।”

“তুমি খাবে চকলেট?”

‘আমার না বিদেশি চকলেট খুব ভালো লাগে। আমারে কয়ডা বিদেশি ফুল ও দিও বাড়ি গিয়া কুলসুম আর নওশি আপারে দেহামু নওশি আপা খুব খুশি হইবো।”

মেহবিন চকলেট বক্সগুলো ফ্রিজে রেখে দিল। আর ফ্রিজ থেকে পাঁচটা কিটক্যাট চকলেট তাজেল কে দিল। তাজেল একটা নিতে চাইলে মেহবিনের কথায় পাঁচটিই নিল। তারপর আরবাজ এর ওখান থেকে কতোগুলো আর মুখরের ওখান থেকে ফুল এনে আলাদা করে বেঁধে এক তোরা বানালো আর তাজেলের হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর ওকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পরলো তাজেলের বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তার ওপাশে যে বাড়িগুলো তার ভেতরের সবথেকে শেষের বাড়িটা তাজেল দের। ওকে কোলে নিয়ে যেতে দেখে সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল সবথেকে অবাক হয়েছে তাজেলের হাতে ফুল আর চকলেট দেখে। কিন্তু তাজেলের বাড়ি গিয়ে মেহবিন নিজেই অবাক হয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।

~চলবে,,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০৩

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

(অনুমতি ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

“বন্ধু চলে গেছে?”

মিশুর প্রশ্নে আরিফা জামান একটু চিন্তিত হলেন যদি একবার হায়পার হয়ে যায় তাহলে সর্বনাশ। তিনি মিশুর কথা সামাল দিতে বললেন,,

‘হ্যা বাড়ি চলে গেছে!”

‘বন্ধু আমাকে না বলেই চলে গেল।”

“তোমার বন্ধুর একটু কাজ ছিল তাই।”

“বন্ধু আর আসবে না তাই না ? আমায় ছেড়ে চলে গেছে।”

‘না না আসবে তো । এখন থেকে তোমার বন্ধু এই গ্ৰামেই থাকবে।”

“আমি বন্ধুর কাছে যাবো।”

‘তুমি না অসুস্থ একটু সুস্থ হয়ে নাও তারপরে যেও।”

‘না আমি এখনি যাবো!”

‘এখন যাওয়া যাবে না।”

এবার মিশু চিৎকার করে টেবিলে থাকা ফুলদানি টা ফেলে দিয়ে বলল,,

“না আমি যাবো! যাবো! যাবো!”

‘মিশু চিৎকার করো না এখন যাওয়া যাবে না।”

‘না আমি এখনই যাবো।”

মিশুর চিৎকারে শেখ শাহনাওয়াজ চলে এলেন। ততক্ষণে মিশু বিছানা ছেড়ে নেমেছে। তিনি এসে মিশুর মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,,

‘কি হয়েছে আমার মিশুমনির?”

‘আমি বন্ধুর কাছে যাবো। কিন্তু আমাকে যেতে দিচ্ছে না বাবা।”

‘আচ্ছা এই ব্যাপার। আজ আর যেতে হবে না কাল যেও। কারন তোমার বন্ধু সেই শহর থেকে এসেছে এখন বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিচ্ছে। আমরা কাল যাবো ঠিক আছে।”

‘আমি এখন যাবো বাবা!”

‘তুমি কি চাও তোমার বন্ধু কষ্ট পাক।”

“আমি গেলে বন্ধুর কষ্ট লাগবে নাকি। বন্ধু আমায় দেখে খুশি হবে তো যেভাবে আমি খুশি হলাম বন্ধুকে বন্ধু বানিয়ে।

“আসলে তোমার বন্ধু এখন রেস্ট নিচ্ছে। যদি এটুকু রেস্ট না নেয় তাহলে তোমার বন্ধুর শরীর খারাপ করবে।”

“আচ্ছা তাহলে আমি আজ যাবো না। কাল যাবো ঠিক আছে।

“এই তো গুড গার্ল। চলো চলো এখন একটু ঘুমিয়ে নাও বন্ধু কি বলেছিল ঘুমাতে।”

‘আমি ঘুমিয়ে গেলে তুমি আবার চলে যাবে না তো?”

‘না না আজ আমি কোথাও যাবো না। কারন আজ আমার কোন কাজ নেই। চলো তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

“হুম হুম চলো।”

মিশু গিয়ে শুয়ে পরলো শেখ শাহনাওয়াজ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আজ প্রথম তার মেয়েটা কারো কাছে যাওয়ার জন্য জেদ করেছে। যে কিনা অপরিচিত মানুষ দেখলে ভয় পায়। বাড়ি থেকে কোথাও যেতে চায় না। তার মেয়েটা তো এমন ছিল না বুদ্ধিমতী একটা প্রানোচ্ছল মেয়ে ছিল। কি থেকে কি হয়ে গেল ভাবতে ভাবতেই ওনার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। আজ খুব করে নিজেকে ভিশন অপরাধী লাগছে তার।

________________

‘ঐ তুই কেরা লো?”

হুট করে এমন কারো কথায় মেহবিন পাশে তাকালো । সেখানে তাকিয়ে সাত বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলো। প্রশ্নটা সেই করেছে । অবশ্য তার পেছনে আরো একটা মেয়ে ছিল তার সমবয়সী। মেহবিন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। আসলে ও বোঝার চেষ্টা করলো প্রশ্নটা তাকেই করেছে নাকি। মেয়েটা আবার বলল,,

‘তাকাই রইছোস কেন? তুই কাগো বাড়ি আইসোস? আমারে চিনোস?”

মেহবিন মাথা নাড়িয়ে মুখ দিয়ে বলল,,

‘না তো চিনি না।”

‘কইলাম না আমি তাজেল তুই চিনোস না ক্যা! আমার গ্ৰামে আইসা আমারে চিনোস না।

“আপনি কখন বললেন আপনি তাজেল? তাছাড়া আমি আপনাকে চিনবো কিভাবে? আমি তো নতুন আজকেই এসেছি।”

‘ও কুলসুম দ্যাখ হেতি আমারে আপনি কইরা কয়।”

বলেই মেয়েটা একটু বোকার মতো হাসতে লাগলো। সাথে অন্য মেয়েটাও তাল মেলালো। তখন মেহবিন বলল,,

“এই আপনারা হাসছেন কেন?”

“তুই আমারে আপনি কইরা কইলি দেইখা।”

‘ওহ আচ্ছা তাই বুঝি। এটা তো আপনার গ্ৰাম আপনার একটা সম্মান আছে না। তাই সম্মান প্রদর্শন করলাম।”

“এতো ভারি ভারি কথা আমার মগজে ঢুকবো না।”

“বড়দের তুই করে বলা ব্যাড ম্যানার্স।”

“বাঁধ মানার!! এনে বাঁধ আবার আইলো কোন থেইকা ?

মেয়েটার এরকম কথা শুনে মেহবিন হাসলো। আর বলল,,

“ব্যাড ম্যানার্স মানে খারাপ আচরন বোঝায়। বড়দের তুই করে বলা উচিৎ না। বড়দের তুমি বা আপনি করে বলতে হয়।”

“তুই তো দেহি নওশি আপার মতো কথা কইতেসোস। নওশি আপাও কয় বড় গো আপনি নাইলে তুমি কইরা কইতে। আচ্ছা তাইলে আমি তোরে তুমি কইরা কমু ঠিক আছে।

“আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু নওশি কে?”

“আমার এক আপা। জানো হে কলেজে পরে।”

“ওহ আচ্ছা!”

“তুমি কি ম্যাডাম? কতো সুন্দর কইরা কতা কও।”

“না আমি ডাক্তার।”

“ওহ তুমি ডাক্তার! ঐ যে সুই দেয়।”

‘ডাক্তাররা কি শুধু ইনজেকশন দেয় আর কিছু করে না।”

“ঐ একটা হইলো আইচ্ছা তুমি কাগো বাড়ি আইছো।”

‘কারো বাড়ি না আমি এখানের হাসপাতালের ডাক্তার ঐ যে বাড়িটা দেখতেছেন ওখানে আমি থাকবো। আজকেই উঠেছি।”

তাজেল নামের মেয়েটা মাথা উঁচু করে দেখলো তারপর বলল,,

‘তুমি ঐ বাড়িতে থাকবা। ঐ বাড়িতে আগে কেও থাকতো না‌।তা তুমি এই হানে ক্যান বাড়ি ছাইড়া।”

“একটু দোকানে যাবো কিছু জিনিস কিনতে তাই রাস্তায় এসেছি। আপনি যাবেন আমার সাথে আপনাকে চকলেট কিনে দেব।”

“চকলেট কি? তুমি যদি লজেন কিনা দাও তাইলে যামু।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“আচ্ছা ঠিক আছে লজেন্স দেব।”

“ঐ কুলসুম তুই যাবি চল ডাক্তার লজেন দেব কইছে।”

“হ তাইলে আমিও যামু।”

বলেই মেয়েটা হেঁসে তাজেলের কাছে এলো। মেহবিন হেঁসে ওদের নিয়ে গেল। প্রয়োজনীয় কিছু কিনলো আর ওদের চিপস চকলেট কিনে দিল। ওদের খুশি আর দেখে কে। কুলসুম নামক মেয়েটা চলে গেল চকলেট পেয়ে মেহবিনের অনেক বেশি ব্যাগ হলো দেখে তাজেল বলল,,

“দুইটা ব্যাগ আমারে দাও আমি নিয়া যাইতেছি।”

“লাগবে না আমি পারবো। আচ্ছা আপনার নাম যেন কি বলছিলেন?’

“আমার নাম হইলো শেখ তাজেল! শেখ আমি লাগাইছি আর আব্বা আম্মায় তাজেল রাখছিল।”

“কেন তুমি শেখ লাগিয়েছো কেন?”

“আমি বড় হয়ে নেতা হমু ঐ শেখ হাসিনার মতো তাই। আমগো শেখ হাসিনা দেশ শাসন করে। আমিও দেশ শাসন করুম সবাই আমার কথা হুনবো। তাই শেখ লাগাইছি। তাছাড়া আরেকটা কারনে লাগাইছি আমগো চেয়ারম্যান এর নাম শেখ কি জানি অনেক বড় নাম।আমগো গ্ৰামের সবাই তার কথা হুনে।

“শেখ শাহনাওয়াজ তোমাদের চেয়ারম্যান এর নাম। তা আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে কি করবেন? আর চেয়ারম্যান সাহেব এর নাম শেখ দেখে কেন লাগিয়েছেন।”

“শখ হইছে আমার তাই । তাছাড়া তাগো সাথে আর আমার সাথে অনেক মিল খালি আমার এই জায়গায় না আছে।”

“মানে?”

“মানে হইলো সবাই তাগো কথা হুনে কিন্তু আমার কথা কেউ হুনে না। এই হইলো আমার কাছে না আছে। আর তুমি আমারে তুমি কইরা কোন কেন জানি আমার শরম করতাছে।

“তুমি আবার লজ্জা পাও আচ্ছা তাহলে তুমি করেই বল। আর হ্যা তুমি তো নেতা হতে চাও তাহলে আমি তোমায় নেত্রী বলে ডাকবো।

“আমি তো নেতা হমু তুমি নেত্রী ডাকবা কেন নেতাই ডাকবা। তাছাড়া আমার নাম তাজেল তুমি নেত্রী ডাকবা কেন?

“নেতা বলে নেতা ছেলেদের কিন্তু মেয়ে নেতাদের নেত্রী বলে তাই ডাকবো। তুমি যদি শখ করে শেখ লাগাইতে পারো। তাহলে আজ থেকে আমিও শখ করে তোমায় নেত্রী ডাকবো ঠিক আছে।”

তাজেল দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“তাইলে আইচ্ছা।”

মেয়েটা যে কথা গুলো বললো আদতেও এর মানে বোঝে কিনা সেটা জানা নেই মেহবিনের। মেয়েটাকে ভালো করে দেখলো মেহবিন গায়ের রঙ শ্যামলা চুলগুলো এলোমেলো একটা সুতির জামা আর ওপরে সোয়েটার পরে আছে। তবে মেয়েটাকে বেশ লেগেছে তার। মেয়েটার ভেতরে নেতা নেতা একটা ভাব আছে তাই তো সে নেত্রী নাম দিল। বাড়ি এসে যাওয়াতে তাজেল চলে গেল। মেহবিন ও ঢুকলো বাড়িতে। এখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলো। এখানে গ্যাসের চুলা নেই তাই শুকনো খাবার নিয়ে এলো। কাল আনতে হবে সব প্রয়োজনীয় জিনিস সবার আগে একটা ফ্রিজ লাগবে। ভাবতে ভাবতেই ভেতরে ঢুকলো। গ্ৰামের প্রথম রাত টা অন্যরকম একটা অনুভুতি দিল একা দেখে একটু অনুভূতি টা অন্যরকম।

_________________

পরের দিন সকাল বেলা আবুল আর ওর বউ আসলো মেহবিন এর জন্য খাবার নিয়ে। মেহবিন প্রথমে দেখে অবাক হলেও মুখে হাঁসি ফুটে উঠল আর বলল,,

“আবুল ভাই এসবের কি দরকার ছিল?”

“এই বাড়িতে চুলা নাই কাল ফাতেমার মা কইছে আমারে। আর সকালে হেই রান্না কইরা আনছে নাও খাইয়া নাও। দুপুরের জন্য ও আনছি রাতের টা বিকেলে ফাতেমা দিয়া যাইবোনে।”

“ভাবি এসবের আবার!”

“কোনসব আবার তুমি না খাইয়া থাকবা নি। আর একটাও কথা না নাও খাইয়া লও। বিকেলে ফাতেমা আসবোনে আমি অহন যাইগা বাড়িতে কাম আছে।”

“বিকেলে ফাতেমার আসতে হবে না। কিছুক্ষণ পর আমার জিনিসপত্র চলে আসবে সব। আবুল ভাই আপনি একটু থাকেন সাহায্য লাগবে তারা এসে পরছে স্টেশনে।”

“আচ্ছা তাইলে ফাতেমার মা তুমি বাড়ি যাও আমি আফার কাম কইরা একেবারে স্টেশনে যামু।”

যাওয়ার আগে মেহবিন ফাতেমা আর ওর ভাইয়ের জন্য চকলেট দিয়ে দিল। তার কিছুক্ষণ পর একটা মিনি ট্রাকে একটা ফ্রিজ গ্যাসের চুলা মাইক্রোওভেন আরো কিছু জিনিস পত্র এলো মহুয়াপুরে। মেহবিন কে দিতে এসেছে এগুলো। মেহবিনের বাড়ির পাকা রাস্তায় গাড়িটা থামতেই আশেপাশের কিছু মানুষ এগিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে জানতে পারলো মেহবিনের বাড়িতে এসেছে । কিছুক্ষণ পর মেহবিন একটা ফোন কানে নিয়ে রাস্তায় আসলো। দুই জনের সাহায্য নিয়ে ওগুলো ভেতরে ঢুকানো হলো। সকলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো কিন্তু কেউ কিছু বললো না। গ্ৰামের মানুষদের এটাই নিয়ম তারা সবকিছু খুব মনোযোগ দিয়ে দেখবে। কার বাড়ি কে এলো আর কি জিনিসপত্র ঢুকলো।

বিকেল বেলা মেহবিন ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল তখন একজন এলো বাইরে থেকে কেউ ডাকছে। মেহবিন বাইরে বের হয়ে দেখলো ওর নামে পার্সেল এসেছে। একটা ছোট্ট বক্স মেহবিন পার্সেলটা নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। পেছনের বারান্দায় একটা দোলনা আছে সেখানে গিয়ে খুললো প্রথমেই কয়েকটা লাল গোলাপ আর চকলেট দেখতে পেল। তার নিচে চিঠি ফুল গুলো একবার ছুঁয়ে তারপর চিঠিটা খুললো তাতে লেখা,,

প্রিয় বিহঙ্গিনী,

“অবসর সময়ে যদি আমায় মনে পড়ে!! তাহলে একটা চিঠি লিখিও, আর যত্ন করে রেখে দিও, যখন আমাদের দেখা হবে তখন না হয় দিয়ে দিও।

~ ইতি তোমার নামকরনে রাঙানো কাব্য

এটাকে চিঠি বলবে না চিরকুট জানা নেই মেহবিনের। কিন্তু যাই হোক না কেন মেহবিনের মুখে হাঁসি ফোটাতে যথেষ্ট। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

প্রিয় কাব্য,,

“আপনি কি জানেন আপনি আমার অবসরে নয়! আমার সবসময়ে বিরাজ করেন। আপনাকে নিয়ে ভাবার অসীম সময় আমার। আর চিঠি তা তো আছেই অগুনিত।”

_____________

আজ মেহবিনের প্রথম হাসপাতালে যাওয়ার দিন। আবুল কে বলে রেখেছিলো সে এসেছে নিতে। ঘরে তালা মারলো কিন্তু গেট এ তালা না এমনি খোলা রেখেই গেল। হাসপাতালে যাওয়ার পর কয়েকজন বেশ ভালোভাবেই তাকে স্বাগতম জানালো। মেহবিন ভেবেছিল গ্ৰামের হাসপাতাল বেশ ছোট হবে কিন্তু না এই হাসপাতাল বেশ অনেকটাই বড় প্রথমে এটা দেখে অবাক হয়েছে। প্রথম দিনেই বেশ চাপ মেহবিনের যাওয়ার পরেই রুগী দেখতে লাগলো বাকি ডাক্তাররা বলেছিল আজ প্রথম দিন থাক কাল থেকে দেখবে না হয়। মেহবিন তা শোনার মানুষ নাকি সে ঠিকই দেখলো। বড় সরকারি হাসপাতাল দেখে অনেক দূর থেকেও এখানে আসে সকলে। সারাটা দিন বেশ চাপেই গেল তার ডিউটি সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।

“ঐ ডাক্তার তাড়াতাড়ি আসো?

পাকা রাস্তার সামনে তাজেল কে দেখে মেহবিন বলল,,

“কেন নেত্রী তাড়াতাড়ি গিয়ে কি হবে?”

“তোমার খোঁজে চেয়ারম্যান আইছে। তোমার লাইগা অপেক্ষা করতাছে অনেকক্ষণ ধইরা।”

“ওহ আচ্ছা!”

তাজেলের কথায় মেহবিন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আসলো। সে হাসপাতাল থেকে হেঁটেই আসছিল ওখান থেকে পঁচিশ মিনিট হাঁটলেই বাড়ি। মেহবিন এসে দেখলো শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। তিনি মেহবিন কে দেখে বললেন,,

“আপনাকে আমার সাথে একটু যেতে হবে। মিশু দুদিন ধরে আপনার কাছে আসতে চাইছিল কিন্তু বাড়ি থেকে বের করা একটু রিস্ক।”

“কাউকে দিয়ে খবর পাঠাতে পারতেন আমি এমনিই চলে যেতাম। আপনার আসার কি দরকার ছিল চেয়ারম্যান সাহেব। একটা কথা মনে রাখবেন সব কাজ সবাইকে মানায় না।”

“অনেক সময় না মানালেও পরিস্থিতির চাপে পড়ে অনেক কিছু করতে হয়।”

“হুম বুঝলাম!”

“কি বুঝলেন?”

“অনেক কিছুই বাদ দিন আপনি যান আমি আসছি।”

“মিশুকে বলেছি আমিই আপনাকে নিয়ে যাবো। তাই আমার সাথে গেলে উপকার হয়।”

“আপনি যাওয়ার পাঁচ মিনিট পর ওখানে পাবেন আমাকে। হাসপাতাল থেকে এলাম ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে আসি‌।”

“ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করছি।”

“অপেক্ষা করতে হবে না আপনি যান।”

“এখানে আপনি নতুন একা যাওয়া ঠিক হবে না।”

“একজন চেয়ারম্যান এর সাথে একজন নতুন মেয়ে একসাথে যাওয়াও ঠিক হবে না চেয়ারম্যান সাহেব।”

শেখ শাহনাওয়াজ একবার মেহবিনের দিকে তাকালেন। মেহবিন মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে উনি সামনের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। তা দেখে মেহবিন ভেতরে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে আবার বের হলো যদিও টায়ার্ড লাগছে কিন্তু কিছুই করার নেই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে এই জন্যই বোধহয় চেয়ারম্যান নিয়ে যেতে চাইছিলো। এই বাড়ি থেকে চেয়ারম্যান বাড়ি বেশি দূরে নয় দশ মিনিটের রাস্তা। মেহবিন তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো। ভেতরে ঢুকতেই মিশু বলল,,

“এই তোমার আসার সময় হলো বন্ধু! আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“হাসপাতালে গিয়েছিলাম। একটু আগে এলাম তারপর চেয়ারম্যান সাহেব বলল তুমি আমার সাথে দেখা করতে চাও তাই এলাম।”

“ভালো করেছো বাবা আমার সব কথা রাখে এই জন্যই তো আমি বাবা কে অনেক ভালোবাসি।”

“তাই বুঝি!”

“হুম এখন চলো। আমি তোমাকে আমার ঘর দেখাই। তারপর আমরা অনেক কথা বলবো আর খেলবো ঠিক আছে।”

“ঠিক আছে।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আপনি মিশুর মনের মতো ওকে সময় দেন রাত হলেও সমস্যা নেই। আপনাকে ভালোভাবে পৌঁছে দেওয়া হবে। আপনার সাথেই আমার মেয়ে এতো তাড়াতাড়ি সহজ হয়েছে আর এটা ভালো লক্ষণ এভাবে চলতে থাকলে আমার মেয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। তাই আপনার যদি একটু কষ্ট ও হয় একটু মানিয়ে নিয়েন।”

মেহবিন কিছু না বলে মুচকি হেসে চলে গেল। ওরা যাওয়ার পর আরিফা জামান বললেন,

“এই মেয়েটাকে মিশুর সাথে মিশতে দেওয়া কি ঠিক হলো। চেনা নেই জানা নেই যদি কোন খারাপ মতলব থাকে।’

“এসব তোমার ভাবতে হবে না আমার মেয়ের কিসে ভালো সেটা একসময় না জানলেও এখন জানি।”

“আচ্ছা বাদ দেন এসব কথা বাবা কবে ফিরবেন?”

“আমি জানি না ওনার সাথে কথা হয় নি।”

“আরবাজ কবে ফিরবে?”

“ওর যখন সময় হবে তখন আসবে।”

“ওহ আচ্ছা!”

______________

ফেসবুকে স্কল করার সময় নতুন এক পোষ্ট সামনে হলো । “কাব্যের বিহঙ্গিনী” পেজ থেকে নতুন এক পোষ্ট করা হয়েছে। সেখানে লেখা ,,,

“মানুষ কি অদ্ভুত তাইনা নিজেরাই কষ্ট দিয়ে বলে কষ্ট হলেও মানিয়ে নিয়েন।”

লেখাটা মাত্রই পোস্ট করা হয়েছে তবুও ধীরে ধীরে যেন লাইক কমেন্টের বন্যা বইয়ে যাচ্ছে। হয়তো সত্যি কথা লিখেছে বলে। মুহুর্তেই চোখটা যেন ভরে উঠতে চাইলো। তখন আওয়াজ এলো ,,,

“কিরে মুখর এতো মনোযোগ দিয়ে কি ভাবিস?”

“বিহঙ্গিনী খুব কষ্টে আছে।”

“কি বললি!”

“আব কিছু না! বিহঙ্গিনীর নতুন পোস্ট দেখেছিস আরবাজ।”

“হুম মাত্রই করেছে মুক্ত নীড় হারা বিহঙ্গিনী বোধহয় ভালো নেই মুখর!”

মুখর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“এ আর নতুন কি? এতো কিছুর পরেও নিজেকে সবথেকে সুখী ভাবে সে! যাই হোক বাড়ি যাবি কবে?

‘এখন তো তাড়াতাড়িই যেতে হবে মনে হচ্ছে।”

“দুই দিন পর কাজ কম্পিলিট হয়ে যাবে তারপরেই যাবো। বেশিদিন তার অপেক্ষা করতে হবে না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আমি যাই হ্যা আজ দুই বন্ধু অনেক আড্ডা হলো।”

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।ফি আমানিল্লাহ!

“ইনশাআল্লাহ আল্লাহ হাফেজ!”

বলেই সে চায়ের দোকান থেকে উঠে এলো। তখনি একটা ফোন এলো সালাম দিয়ে ধরতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,,

“মুখর কমিশনার স্যার তোমাকে দেখা করতে বলেছে ইটস্ আর্জেন্ট।”

“ওকে স্যার আমি এখনি যাচ্ছি।”
_____________

“মে আই কাম ইন স্যার?”

“ইয়েস কাম!”

“স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?”

“হ্যা মূখর! বসো।

মূখর বসলো তারপর কমিশনার স্যার বললেন,,

“তোমার ট্রান্সফার হয়েছে মূখর!”

“কিন্তু কেন স্যার?”

“অপরাধীদের শাস্তি দিতে। মহুয়াপুর গ্ৰামে কয়েকমাস আগে একটা ডাক্তারের খুন হয়েছে কিন্তু ওখানকার পুলিশ এখনো এর অপরাধী কে ধরতে তো দূর শনাক্ত করতে পারে নি। এমনকি ঐ এলাকার সুইসাইড কেস ও বেড়ে গেছে । গোপন সুত্রে জানা গেছে ওখানে কিছু লোক উধাও ও হচ্ছে। আরো অনেক কিছু ঘটছে কিন্তু ওখানকার পুলিশের এটা নিয়ে কোন হেলদোল নেই। আমি যদি ভুল না হই ওখানের পুলিশ স্টেশনে কোন ঘাপলা আছে তাই ঐ গ্ৰামভুক্ত থানায় তোমাকে প্রমোশন দিয়ে ঐ পুলিশ স্টেশনের ইনচার্জ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। এরকম একটা জায়গায় তোমার থেকে যোগ্য কাউকে পাইনি আমি। আশা করি নিরাশ হবো না।”

“ইনশাআল্লাহ স্যার।”

“আমি জানতাম তুমি এমনটাই বলবে।”

“দোয়া করবেন স্যার আমি যাতে ঐ থানার সকল অপরাধকে মুছে দিতে পারি।”

“ইনশাআল্লাহ তুমি জয়ী হবে।”

“ধন্যবাদ স্যার।”

বলেই মুখর স্যালুট দিল । কমিশনার মুচকি হেসে বলল,,

“মুখর শাহরিয়ার এর ইউনিফর্ম এ আরো একটা স্টার যুক্ত হলো। এটা কিন্তু কমিশনার নয় তোমার বাবা বলছে।”

“বাবা তুমিও না।”

“এটা আমার অফিস তোমার বাড়ি না।”

“সরি স্যার।”

“আরে মজা করছিলাম আয় বুকে আয় আজ বড় একটা প্রাপ্তি তোর। আই এম প্রাউড অফ ইউ।

মুখর হেঁসে ওর বাবাকে জরিয়ে ধরলো। আর বলল,,

“তুমি কি খুশি দিলে তোমায় বোঝাতে পারবো না। না চাইতেও কতো বড় উপকার করেছো তার বিন্দুমাত্র ধারনা তোমার নেই।”

মাহফুজ শাহরিয়ার ছেলেকে সামনে দার করিয়ে বলল,,

“আছে আছে ধারনা আছে তাই তো আরো আগে পাঠাচ্ছি।”

“তার মানে তুমি জানো?”

‘তার বিশেষত্ব এটা এই কারনেই আমি তাকে এতো স্নেহ করি। কিন্তু আপনার ট্রান্সফারের কথা শুনে আপনাদের বাড়ির চিফ হোম মিনিস্টার কিন্তু সেই ক্ষেপে যাবে আর দোষ টা তার ঘাড়ে চাপাতে চাইবে দেখে নিয়েন।

মুখর হেঁসে বলল,,

“দাদিজান না এখন আর আগের মতো নেই সেদিনের পর এই চার বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। হয়তো নিজেকে দোষী ভেবে তার ওপর ঝেড়েছে ভূলে যেও না আমাদের সন্ধির কারন সে!”

“হুম এখন বাড়ি চলো বাড়ি দুদিন ছুটি তারপর ব্যাগপত্র গুছিয়ে যাও শ্বশুরবাড়ি।”

“বাবা তুমিও না। চলো বাড়ি গিয়ে দেখি কিভাবে সব সামলানো যায়। তবে হ্যা আমি তার কাছে যাচ্ছি এটা যেন তোমার চিফ হোম মিনিস্টার ভুলেও না জানতে পারে।”

‘আমি পাগল নাকি মস্তিষ্ক ফাঁকা।”

বলেই মাহফুজ শাহরিয়ার হেঁসে উঠলেন সাথে মুখর ও হাসলো। অতঃপর দু’জনে বাড়ির দিকে রওনা হলো।

____________________

মেহবিনের সাথে কথা বলতে বলতে আর খেলতে খেলতে খেলতে মিশু ঘুমিয়ে পরেছে। মেহবিন না চাইতেও মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। চারিদিকে তাকাতেই দেখলো অনেকগুলো টেডিবিয়ার পুরো ঘরটা অগোছালো অবশ্য মিশু ও অগোছালো থাকে। এক পাশে বুকশেলফ আছে অনেক বই আছে তাতে। মেহবিনের মাথায় কিছুতেই আসছে না । রুমটা দেখতে ভালো একজন কারোর মনে হচ্ছে একটা সময় এই ঘরটা গোছানো ছিল এখন নেই। মেহবিনের বারবার মনে হচ্ছে মিশু আগে এরকম ছিল না কয়েক বছর ধরে এরকম হয়েছে বোধহয়। ওর কথাবার্তার বেশ মার্জিত শুধু একটু অবুঝ তাই। মেহবিন মিশুর চুলগুলো সরিয়ে দিল মুখ থেকে তারপর কপালে একটা চুমু খেল আর বলল,,

“জানিনা তুমি অসুস্থ কিভাবে হলে? তবে তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে বন্ধু। তোমার বন্ধু খুব করে চেষ্টা করবে তোমাকে সুস্থ করে তোলার।”

এটুকু বলেই মেহবিন বের হলো রাত আটটা বাজে। মিশুর থেকে শুনেছে এই বাড়িতে তার মা বাবা ছাড়াও তার একটা ভাই আছে ওর বয়সের ওরা টুইন নাম বলেছে বাজপাখি। এটা শুনে মেহবিনের খুব হাসি পাচ্ছিল তবুও থামিয়েছে। তাছাড়াও এ বাড়িতে মিশুর মামার পরিবার থাকে আরিফা জামানের ভাই আরিফ জামান তার পরিবার মোট চারজন। মিশুর দাদা আছে তার নাম শেখ শাহেনশাহ তাকে দেখে মিশু ভয় পায়।সে আপাতত বাড়ি নেই। শেখ শাহেনশাহ এর ভাইয়ের ছেলে আছে একটা এখানে থাকে। শেখ শাহনাওয়াজ এর কাকাতো ভাই শেখ আমজাদ তার আরবাজ এর থেকে এক বছরের ছোট একটা ছেলে আছে শেখ সায়িদ তিনি বিয়ে করে ছয়মাসের জন্য বিদেশে গেছে কাজে। আর দুইটা মেয়ে জিনিয়া আর মুনিয়া আছে তারাও এইবার কলেজে পরছে সবাই এই বাড়িতেই থাকে । বলতে গেলে চেয়ারম্যান সাহেব এর ভরা সংসার। মেহবিন নিচে আসতেই সবাইকে দেখলো সে একেবারে চেয়ারম্যান সাহেব এর সামনে গিয়ে বলল,,

“আমাকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”

“রাত অনেক হয়েছে খাবারটা খেয়ে যান । গাড়ি দিয়ে আপনাকে পৌঁছে দেওয়া হবে।

‘দুঃখিত আপনার প্রস্তাব গ্ৰহন করতে পারছি না। আমার যেতে হবে অনেক রাত হয়েছে গ্ৰামে এটাই অনেক রাত তাই না। রাত বেরুতে বাড়ি ঢুকলে আপনার গ্ৰামের মানুষজন নিশ্চয়ই আমাকে ভালো বলবে না। এমনিতেই একা থাকি বুঝতেই পারছেন আমি কি বলেছি।”

“তাহলে তো আমাকেই যেতে হয় আপনার সাথে।”

‘আপনাকে কষ্ট করতে হবে না আমি গাড়ি করে এমনিই চলে যেতে পারবো।”

‘কুদ্দুস ড্রাইভারকে বল ওনাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে।”

‘জি আচ্ছা চেয়ারম্যানসাব।”

কুদ্দুস চলে গেল এই বাড়ির কেয়ার টেকার তাকে বলা যায় বাইরের সকল কাজ সেই দেখে। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘আসেন পুরো পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে ও হলো আরিফা আমার স্ত্রী।”

মেহবিন শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমি পরে একদিন এসে পরিচিত হয়ে নেব। রাত হয়ে গেছে বুঝতেই পারছেন।”

মেহবিনের কথায় চেয়ারম্যান দমে গেলেন। আর কিছু বললেন না অন্য দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমনিতেও সবাই এ দুদিনে দেখেছে তিনি এই মেয়েকে বেশ সমীহ করে চলেন। মেহবিন আরিফা জামানের দিকে তাকিয়ে বলল,,,

“মিশু ঘুমিয়ে পরেছে পারলে উঠিয়ে খাবারটা খায়িয়ে ওষুধ খায়িয়ে দিবেন। মাথার ব্যান্ডেজটা ভিজিয়ে ফেলেছিল আমি নতুন করে আবার করে দিয়েছি। আশাকরি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।”

আরিফা জামান একটু মাথা কাত করে বললেন,,

‘ঠিক আছে।”

মেহবিন গায়ে শালটা ভালোভাবে জরিয়ে বের হলো। বাইরেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ও গিয়ে গাড়িতে বসে পরলো। ও যেতেই সকলে প্রশ্ন করল উনি কে? কারন সেদিন তেমন কেও ওকে দেখেনি আজকেও যখন এসেছে তখন সবাই ঘরে ছিল। এমনিতে মিশুর থেকে শুনেছে ওর বন্ধু হয়েছে। আরিফা জামান সকলকে মেহবিনের পরিচয় দিলেন। কিছু লোক মেহবিনের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল। বোরকা হিজাব পরিহিতা একটা মেয়ে শালটা ভালোভাবে জরিয়ে ছিল। গাড়িতে উঠে ফোন স্কল করতেই মেহবিন দেখতে পেল “বিহঙ্গিনীর কাব্য” নামের আইডি থেকে মেসেজ এসেছে তাতে লেখা,,

“মানুষ কি অদ্ভুত তাইনা নিজের কষ্ট না হলেও একান্ত মানুষটার দুঃখে দুঃখবিলাশ করতে ইচ্ছে হয়। শুনো বিহঙ্গিনী প্রকৃতিও বোধহয় চায় কাব্যের বিহঙ্গিনীর কাছে তার কাব্য পৌঁছে যাক। তাইতো এতো আয়োজন আর কিছু ক্ষনিকের অপেক্ষা।”

~ চলবে,,

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্বে নিয়ে কিছু বলে যান।

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০২

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

(অনুমতি ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

চলন্ত ট্রেনটা থেমে যাওয়ায় মেহবিন পুরোনো এক তিক্ত স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো। সেদিনের পর তার জীবনটা আরো ছয় বছর এগিয়েছে। এখন মেহবিন মুসকান নামের আগে ডক্টর যুক্ত হয়েছে। সে এখন ডক্টর মেহবিন নামে পরিচিত। বেলা এগারোটায় ট্রেনটা থেমেছে। সে আস্তে ধীরে তার ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নামলো গন্তব্য তার মহুয়াপুর নামক গ্রামে। সেখানের সরকারি হাসপাতালের ডক্টর হিসেবে দুদিন পর তার জয়েন হওয়ার কথা। এখানে তার পরিচিত কেউ নেই তাই সকাল সকাল এসেছে যদি আজ ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। নাহলে আবার ফিরে যেতে হবে। আর বাধ্য হয়ে কোয়াটারে থাকতে হবে কিন্ত সে চায়না সেখানে থাকতে। তাইতো দুদিন আগেই এসেছে। হাতের ট্রলি ব্যাগ আর কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে সে রিক্সা খুঁজতে লাগল। একটা জায়গায় কয়েকটা রিক্সা দেখে সেখানে গিয়ে একজন রিক্সাচালক কে জিজ্ঞেস করল,,

“মহুয়াপুর গ্ৰামে যাবেন?”

রিক্সাচালক দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“হ যামু তয় পঞ্চাশ টাহা ভাড়া।’

“সমস্যা নেই চলুন।”

তখন পাশ থেকে আরেকজন রিক্সাচালক বললেন,,

“আফা ও আপনার কাছে বেশি টাহা চাইতেছে মহুয়াপুরের ভাড়া ত্রিশ টাহা।আপনি নতুন দেইখা ও আপনার থেইকা বেশি চাইছে। আমি এহন ঐদিকেই যামু।আপনে আমারটায় আসেন আমি আপনারে পৌঁছায়ে দিতাছি।”

“তোর রিক্সায় যাইবো কেন ? উনি আমারে জিগাইছে তাই আমিই যামু। আফা আপনে ত্রিশ টাহাই দিয়েন।”

মেহবিন এতোক্ষণ দুজনের কথা শুনছিল। বুঝতে পারলো নতুন দেখে টুপি পরানোর চেষ্টা করছিল। তবে আরেকজন সৎ রিক্সাচালক কে দেখে ওর মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। মেহবিন প্রথম জন কে বলল,,

“নিঃসন্দেহে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মানে আপনার রিক্সাতেই যেতাম। কিন্তু আপনি একটু লাভ করতে গিয়ে আমাকে নেওয়ার সুযোগ টা হাত ছাড়া করলেন। আমি ওনার রিক্সায় যাবো এটা ওনার সততার পুরস্কার। তবে আপনাকে একটা কথা বলি দয়া করে এই জিনিসটা করবেন না। নতুন দেখে তার কাছে থেকে বেশি টাকা নেবেন না। কারণ সে যদি জানতে পারে আপনি তার থেকে বেশি টাকা নিয়েছেন। তাহলে তার মনে আপনাকে নিয়ে একটা বিরুপ ধারনা হবে। এরপরে আপনাকে দেখলেও আপনার রিক্সায় যেতে চাইবে না।কারন তারা আপনার প্রথম ব্যবহার ভুলবে না। আমাদের সাথে ভালো বা খারাপ কিছু হলে আমরা খারাপটাই বেশি মনে রাখি। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

এ কথা শুনে রিক্সাচালকটা মাথা নিচু করলেও বাকি রিক্সাচালকদের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। যার রিক্সায় যাবে সেই লোকটা মেহবিনের কাছে গিয়ে বলল,,

“আফা ব্যাগটা আমারে দেন। আমি উঠাই দিতাছি আপনে বসেন।”

মেহবিন হেঁসে লোকটাকে ব্যাগ দিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো। লোকটা ব্যাগ উঠিয়ে দিয়ে রিক্সা চালাতে লাগলো। হুট করেই রিক্সাচালক বলল,,

“আপনে কিছু মনে কইরেন না আফা। ও একটু ঐরকমই নতুন কেউরে দেখলে একটু টাকা বাড়ায় নেয়। এমনিতে ভালো মানুষ । আসলে খালি রিক্সা চালায় খায় তো যদি দশ বিশ টাহা কইয়া বেশি নিতে পারে।”

মেহবিন মুচকি হাসলো গ্ৰামের মানুষেরা এরকমই সহজ-সরলই হয়। সে একজন রিক্সাচালক হয়েও আরেকজন রিক্সাচালক এর গুনগান করছে। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“আপনার নাম কি ভাই?”

“আমার নাম আবুল মিয়া!”

“আচ্ছা আবুল ভাই আপনিও রিক্সা চালান আপনি তো টাকা বাড়িয়ে বললেন না। উল্টো টাকা বাড়িয়ে বলাতে প্রতিবাদ করলেন।”

“আমার এতো টাহার দরকার নাই। আমি একজন কৃষক আমার একটু জমি আছে ক্ষেতের কামের পাশাপাশি রিক্সা চালাই। কারন ঐটুকু জমিতে তেমন ভালো আয় হয় না। রিক্সা চালাইয়া আর ঐ জমি থেইকা যা আয় হয় তা দিয়াই সংসার ভালো মতো চইলা যায়। তাছাড়া আমার আব্বা আমারে ছোটবেলায় একবার কইছিলো। জীবনে চাইলে অনেক রোজগার করতে পারবি কিন্তু অসৎ পথে কিছু করলে সেটা ধইরা রাখতে পারবি না আর সুখী ও হবি না। সৎ পথে রোজগার করলে হয়তো কম টাকা রোজগার করতে পারবি কিন্তু দিনশেষে সুখী হবি। অসৎ পথ বাইছা নিবি মানে আল্লাহ তোর ওপর নারাজ হইবো। সৎ পথে থাকবি আল্লাহ তোর ওপর খুশি হইবো। এরপর থেইকা আমি নিয়্যত করছি জীবনে নুন ভাত খাইলেও অসৎ পথে রোজগার করুম না। জীবন তো আল্লাহ একটাই দিছে অসৎ পথে না কামাইয়া, সৎ পথে একটু কম খাইয়া আল্লাহরে খুশি কইরা নিজেও একটু সুখী হইয়াই মরলাম।”

কথাটা শুনে মেহবিনের মনে প্রশান্তি ছেয়ে গেল। মেহবিন বলল,,

“আল্লাহ তায়ালা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করবেন ইনশাআল্লাহ।রাসূল(সাঃ) বলেছেন,
“সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল,আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে!
[সহীহ বুখারী:০১]

“এইডা আমি জানি ছোটবেলায় পরেছিলাম এহন সময় নাই পরার। আইচ্ছা আপনি কাগো বাড়ি যাইবেন?”

“আসলে আমি এখানের কাউকে চিনি না ঢাকা থেকে এসেছি । এখানের হাসপাতালে আমি ডাক্তার হিসেবে জয়েন করবো দুদিন পর। যদি বাসা ভাড়া পাওয়া যায় এই জন্য দুদিন আগেই আসলাম।”

“তারমানে আপনে ডাক্তার।”

“জি !”

“কিন্তু আমগো গ্ৰামে তো কোন বাড়ি ভাড়া দেয় না।”

“তাহলে কি করে হবে? একটা বাসার দরকার আমার। এখানে তো আর পরিচিত কেউ নেই।”

“আরে আপনি চিন্তা কইরেন না আমগো চেয়ারম্যান খুব ভালো। শহর থেইকা কেউ দুই দিনের জন্য আইলে হেগো বাড়িতেই থাকে। হেগো বাড়িও অনেক বড় সেই আগেকার জমিদার গো মতো।”

“আমি তো আর দুদিন থাকবো না আবুল ভাই। এখানেই থাকবো কতদিন তার ঠিক নেই। অন্যের বাড়িতে থাকাটা ভালো দেখায় না। আপনি একটু দেখেন না কেউ বাসা ভাড়া দেবে কি না।”

“আইচ্ছা সমস্যা নাই আমি খোঁজ লাগামু নে। ভাই যখন ডাকছেন তাহলে এই ভাই আপনারে সাহায্য করবো। ততক্ষণ আপনে বরং আমার বাড়ি চলেন পরাই আইসা পরছি আর পাঁচ মিনিট লাগবো।”

এই মুহূর্তে ওর কি করা উচিত জানা নেই। হুট করে এভাবে অপরিচিত মানুষের বাড়ি যাওয়া কি ঠিক হবে। ভাবতে ভাবতে আবুল মিয়া বলে উঠলো,,

“এই কুদ্দুস দৌড়াইয়া কই যাস?”

মেহবিন দেখলো চল্লিশ বছর বয়সি এক লুঙ্গি আর ফতুয়া পরিহিত লোক আবুল মিয়ার কথা শুনে দাঁড়িয়ে পরলো। আর কুদ্দুস নামক লোকটা বলল,,

“আর কইস না ঐ চেয়ারম্যানসাবের এর পাগল মাইয়া আজ আবার সিড়ি থেইকা পইরা মাথা ফাটাই ফালাইছে। কিন্তু তারে যে ডাক্তার দেহে হে শহরে গেছে। তাই হাসপাতালে যাইতেছি ডাক্তার আনতে হেতিরে তো আর হাসপাতালে নিবো না ডাক্তারই আনা লাগবো। হেতি তো আবার সব ডাক্তার আর রক্ত সহ্য করবার পারে না।মেলা রক্ত পরতাছে কি যে করি?”

“ও আইচ্ছা তোর আর হাসপাতালে যাওয়া লাগবো না আমার রিক্সায় যে আছে হেও একজন ডাক্তার শহর থেইকা আইছে। আমি চেয়ারম্যান বাড়ি লইয়া যাইতেছি। কি আফা পারবেন তো।”

মেহবিন তখন বলল,,

“জি পারবো। আমার কাছে সবকিছুই আছে। আপনি চেয়ারম্যান বাড়ি চলেন আবুল ভাই। আর আপনি আমার বড় আবুল ভাই আমাকে তুমি বা তুই করে বইলেন।

“হেইডা কওয়া যাইবোনে। লও এহন যাই আর কুদ্দুস তুই ও যা আমরা আসতেছি।”

কুদ্দুস নামক লোকটা এক দৌড়ে চলে গেল। আবুল ও চলল মেহবিন কে নিয়ে কয়েক মিনিটের মাথায় ওরা পৌঁছে গেল। মেহবিন রিক্সা থেকে নেমে সামনে তাকাতেই দেখলো আবুল ঠিকই বলেছিল কোন জমিদার বাড়ির থেকে কম না। আগেকার জমিদারদের বাড়ির মতো বাড়িটি দুই তালা বিশিষ্ট। মেহবিন আবুল এর সাথে চলতে লাগলো । সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই কতগুলো মুখকে দেখতে পেল সবাই বেশ চিন্তিত বোঝা যাচ্ছে। যার মাথা ফেটে গেছে সে সোফায় বসে আছে তার পাশে একজন কাপড় দিয়ে রক্ত পড়া যায়গায় চেপে ধরে রেখেছে। মেহবিন ঢুকতেই কুদ্দুস বলল,,

“ওই যে চেয়ারম্যানসাব ডাক্তার আইসা পরছে।”

চেয়ারম্যান সদর দরজায় তাকালেন। রিক্সাচালক আবুলের সাথে একটা কালো বোরকা হিজাব পড়া একটা মেয়ে। মেহবিন মেয়েটাকে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো। তখন চেয়ারম্যান বললেন,,

“সাবধানে মিশুর রক্তে ফোবিয়া আছে‌। আর ও কিন্তু সবাইকে ওর ট্রিটমেন্ট করতে দেয় না আঘাত ও করতে পারে।”

মেহবিন ওর ব্যাগ খুলে সব বের করতে করতে বলল,,

“চিন্তা করবেন না আমি পারবো। আপনার মেয়ে কি অজ্ঞান হয়ে গেছে না এখনো জ্ঞান আছে।”

তখন মিশু নামক মেয়েটা থেমে থেমে বলল,,

“আম্ আমমি এত্ টটাও দূররর্বল না আররর ভীতততউ ও না শু শুধু রররক্ত সহ্য ককককরতে পারিহ্ না। তাআআই চো’চোখ বব্ বন্ধ করর্ রে
আ আছি।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“বাহ তাহলে তো তুমি বেশ সাহসী। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ভীতু। তো দেখি তুমি কেমন সাহসী একটু চোখ খুলো তো।”

মেহবিনের কথা শুনে মিশু নামক মেয়েটার কেন যেন ভয়টা কমে গেল। তবুও রক্তে যেহেতু ফোবিয়া তাই ভালোভাবেই না তুতলিয়ে বলল,,

“না না আমি চোখ খুলবো না। রক্ত রক্ত রক্ত!”

“ওকে ওকে রিল্যাক্স চোখ খুলতে হবে না। আমি তাহলে রক্ত মুছে ফেলি তারপর তুমি চোখ খুলো ঠিক আছে।”

তখন মিশু আদুরে গলায় বলল,,

“আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু তুমি কিন্তু ব্যাথা দেবে না। আর হ্যা ওষুধ ও দেবে না খুব জ্বালাপোড়া করে আমার একটু সহ্য ও হয় না।”

“আরে তুমি না সাহসী এই একটু জ্বালাপোড়া সহ্য করতে পারবে না। সাহসী মেয়েরা যাই হয়ে যাক না কেন কোন কিছু তে ভয় পায় না। ভয় পায় তো ভীতুরা সাহসী মেয়েরা কোন কিছুতে ভয় পায় না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আমিও ভয় পাবো না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

মেহবিন যে কাপড় ধরে রেখেছিল তাকে বলল মাথাটা সোজা করে ধরতে। আঘাত পেয়েছে কিন্তু গভীর ক্ষত হয় নি এই জন্য চিন্তার কারণ নেই। মেহবিন আস্তে আস্তে রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলো যেই না ওষুধ লাগালো মেয়েটা চিৎকার করে মেহবিনের বা হাতে কামড় দিয়ে ধরে রইলো হুট করে এমন হওয়ায় বাড়ির সবাই হতভম্ব। মেহবিন একটু আওয়াজ করে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল। তখন চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,,,

“মিশু কি করছো কি? ডাক্তার ব্যাথা পাচ্ছে তো ছাড়ো ওনাকে।”

বাবার কথা কানে যেতেই মিশু ছেড়ে দিল। হাত ছাড়া পেতেই মেহবিন দেখলো হাতে কামড়ের দাগ বসে গেছে রক্ত ও বের হচ্ছে হালকা হালকা। মেহবিন একবার হাত বুলিয়ে তারপর বলল,,

“তো এবার কি ওষুধ দিয়ে তোমার ব্যান্ডেজটা করতে পারি।”

মেহবিনের এমন কথায় সকলে ওর দিকে অবাক চোখে তাকালো। মিশু নিজেও এখন চোখ খুলে মেহবিনের দিকে তাকালো। মেহবিন কে দেখে মিশু একদম শান্ত হয়ে গেলো। মিশুর কি হলো মেহবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। মেহবিন যত্ন সহকারে ওষুধ লাগিয়ে দিলো মিশু আর একটা শব্দও করলো না।এটা সবাইকে বেশ অবাক করলো কারন মিশু আঘাত সহ্য করতে পারে না। মেহবিন চেয়ারম্যান সাহেব কে একটা কাগজে ওষুধের নাম লিখে দিয়ে ওগুলো আনিয়ে নিতে বলল। সব কাজ শেষে মিশুকে বলল,,

“বাহ তুমি তো দেখি সাহসী হয়ে গেলে!”

তখন মিশু বলল,,

“হুম তোমায় দেখে।”

মেহবিন হাসলো আর বলল,,

“ভালো তো এখন কিছু খেয়ে ওষুধ খাও তারপর একটা ঘুম দাও দেখবে ব্যাথা অনেক কমে যাবে।”

“উঁহু আমি যাবো না তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো তুমি কতো সুন্দর।”

“তাই বুঝি কিন্তু তুমি আমার থেকেও সুন্দর শুধু একটু অগোছালো। এখন নিজের রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।

“আচ্ছা নেব যদি তুমি আমার বন্ধু হও তবে!”

“যদি না হই তাহলে?”

“তাহলে আমি কিছুই করবো না এই যে বসে রইলাম।”

“আচ্ছা ঠিক আছে হবো তোমার বন্ধু।”

“তাহলে হাত মেলাও।”

বলেই মিশু হাত এগিয়ে দিল। মেহবিন ও এগিয়ে দিল কিন্তু মিশু মেহবিনের হাত ধরে জোরে জোরে নাড়াতে লাগলো আর খিলখিল করে হাসতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মেহবিনের হাত ছেড়ে বলল,,

“এটাকে বলে মিশুর হ্যান্ডশেক। এখন তাহলে আমি রুমে যাই আর হ্যা তুমি আমার বন্ধু হলে আমার সব কথা শুনবে ঠিক আছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

মিশু হেঁসে উঠল হয়তো কেউ ওর কথা শুনবে এই জন্য। তখন চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,,

“আরিফা যাও মিশুকে নিয়ে ওপরে যাও। আর ওকে কিছু খায়িয়ে দাও।”

আরিফা নামক মহিলা মিশুকে নিয়ে চলে গেল। মেহবিন একবার ভালো করে মিশুকে দেখলো বয়স উনত্রিশ কি ত্রিশ হবে কিন্তু মনে হলো একটা পাঁচ বছরের অবুঝ বাচ্চা। যদিও ওর মনে আছে কুদ্দুস বলেছিল চেয়ারম্যান এর পাগল মাইয়া তাই তো কামড় খেয়েও কোন রিয়াক্ট করেনি। চেয়ারম্যান সাহেব হুট করে বললেন,,

“আপনাকে ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য এবং দুঃখিত ও সবকিছুর জন্য! আসলে ও একটু অসুস্থ।

“এটা আমার দায়িত্ব ছিল। ডাক্তারদের দায়িত্বই মানুষের সেবা করা। তাছাড়া আপনার মেয়ের কথা শুনেই বুঝেছিলাম সে স্বাভাবিক নয়। তাই দুঃখিত হওয়ার কারন নেই।”

“তা আপনাকে তো এর আগে কোনদিন এ গ্ৰামে দেখিনি? আপনার নাম?

“আমি ডক্টর মেহবিন আজই এসেছি গ্ৰামে। আপনি তো এই এলাকার চেয়ারম্যান তাই না?

“হুম এই এলাকার চেয়ারম্যান শেখ শাহনাওয়াজ। তবে আমি সবার কাছে চেয়ারম্যানসাহেব নামেই পরিচিত।

“ওহ আচ্ছা। তাহলে আজ উঠি।”

তখন আবুল এগিয়ে এসে বলল,,

” চেয়ারম্যান সাব একটা কথা ছিল। আসলে এই উনি দুইদিন পর আমগো হাসপাতালে ডাক্তারি করবো। এহানে ওনার চেনা জানা নাই তাই আগেই আইছে যদি কোন ঘর ভাড়া পাওয়া যায় হের লাইগা।”

“তাহলে আপনার এখানে আসা উচিত হয় নি। আপনাকে দেখে শহরের মনে হচ্ছে। শহরে ছেড়ে এখানে আসাটা আমার উচিত হয় নি। কয়েক মাস আগেই এখানের হাসপাতালের একজন ডাক্তার খুন হয়েছিল। তাছাড়া হাসপাতালের ডাক্তারদের কোয়াটারের ব্যবস্থা আছে তো।

এ কথা মেহবিন বলল,,

“আসলে আমার শহরের থেকে গ্ৰামের মানুষদের সেবা করার বেশি ইচ্ছে। তাছাড়া যে ডক্টর খুন হয়েছে নিশ্চয়ই কারো বারা ভাতে ছাই দিয়েছিল তাই তার সাথে এরকম হয়েছে। আমি এসেছি মানুষের সেবা করতে। সবথেকে বড় কথা আমি কোয়াটারে থাকতে চাইনা তাই একটা বাসা খুঁজছি।”

“আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আপনি আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে থাকতে পারেন। এখান থেকেই হাসপাতালে যাবেন। আমাদের বাড়িতে অনেক গুলো রুম ফাঁকা আছে।”

“দুঃখিত আপনার প্রস্তাব গ্ৰহন করতে পারছি না । আপনার আপত্তি না থাকলেও আমার আপত্তি আছে এখানে থাকতে। আপনি যদি অন্য কোথাও একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে বেশ উপকৃত হতাম।

তখন চেয়ারম্যান সাহেব এর পাশে এসে আরিফা নামক মহিলা বললেন,,

“একা একটা মেয়ে গ্ৰামে একা থাকাটা ভালো দেখায় না। তাছাড়া গ্ৰামে একা একটা মেয়ে থাকাটাও রিক্স।কখন কি হয়ে যায়।

“আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি একা থাকতে পারবো। আমার অভ্যেস আছে‌। আল্লাহর রহমতে এটুকু সাহস আছে রাতে একটা গাছের নিচেও থাকতে পারবো। তাছাড়া আমার সুরক্ষার জন্য আমি নিজে যথেষ্ট। চেয়ারম্যান সাহেব যদি সাহায্য করতে পারেন তাহলে করবেন নাহলে আমি নিজেই খুঁজে নিচ্ছি। এতো বড় গ্ৰাম একটা না একটা ঘর তো নিশ্চয়ই পাবো থাকার জন্য। যদি তাও না হয় তাহলে বাধ্য হয়ে কোয়াটারে থাকতে হবে এই আর কি।

কথাটা বলেই মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকালো। ওকে তাকাতে দেখে শেখ শাহনাওয়াজ চোখ নিচু বললেন,,

“আপনি আজ যা করলেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আপনার বাড়ি খুঁজতে হবে না। যেহেতু আপনি এখানে থাকতে চাইছেন না তাহলে আমার আরেকটা বাড়ি আছে। হাফ ওয়াল ওপরে টিনশেড বাথরুম সব ভেতরেই টিনশেড হলেও বাড়িটা বেশ সৌখিনভাবেই বানিয়েছিলাম। ওখানে কেউ থাকে না আপনি চাইলে সেখানে উঠতে পারেন।

একথা শুনে চেয়ারম্যান বাড়ির সকলে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল‌। কারন বাড়িটা তার অনেক শখের সে এখন অব্দি কাউকে ও বাড়িতে থাকতে দেয় নি। আর আজ একটা অচেনা মেয়েকে সেই বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে। এ কথা শুনে আরিফা বেগম বললেন,,

“ও বাড়িতে কেন? আজ পর্যন্ত এই বাড়ির কাউকে ও বাড়িতে থাকার অনুমতি দেন নি। তাছাড়া একটা মেয়ে একা কিভাবে ও বাড়িতে থাকবে।”

“দিই নি বলে মনে দেব না তা তো কোন কথা নেই তাই না। আচ্ছা বাদ দাও তুমি। এবার আপনি বলুন আপনার আপত্তি নেই তো?”

“না কোন আপত্তি নেই বরং এটা আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। কারন ওটা যদি আপনার বাড়ি হয়ে থাকে তারমানে দ্বিতীয় চেয়ারম্যান বাড়ি।আমি ওখানে একা থাকলেও আপনার কথা ভেবেই কেউ আমাকে ডিসটার্ভ করবে না। তবে হ্যা বাড়ি ভাড়া কিন্তু নিতে হবে আপনাকে। কতো দিতে হবে সেটা যদি বলতেন?

তখন চেয়ারম্যান সাহেব হেঁসে বললেন,,

“না দিলেও সমস্যা হতো না কারন ওটা এমনিই পরে আছে। আপনি যেহেতু দিতেই চাইছেন তাহলে দুই হাজার টাকা দিয়েন।”

“মাত্র দুই হাজার?”

“কেন কম হয়ে গেল বুঝি!”

“ঢাকার তুলনায় তা একটু হলো আর কি! যাই হোক শুকরিয়া সবকিছুর জন্য ‌।

“পেমেন্ট মাস শেষে করলেই হবে এডভান্স করতে হবে না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

“দুপুর তো হয়েই এলো আপনি বরং এখানে দুপুরের খাবার খেয়ে নিন । আপনার বাড়ি পরিস্কার করাই আছে শুধু ঝাড়ু দিতে হবে টেনশন করবেন না।”

“ধন্যবাদ কিন্তু আমার খিদে পায় নি। আমি বরং আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখি কতটা করতে হবে। আপনি বরং বাড়ির চাবিটা দিন আমাকে।

শেখ শাহনাওয়াজ নিজের রুম থেকে চাবি নিয়ে এলেন আর বললেন,,

“আমার শখের একটা অংশ ঐ বাড়ি। আশা করছি বেশ যত্নেই থাকবে।”

এ কথা শুনে মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“আমি কোন বাচ্চা নই চেয়ারম্যান সাহেব। ভয় নেই আপনার বাড়ি ভেঙ্গে ফেলবো না। তবে হ্যা কোন সময় আমি থাকতে যদি ভূমিকম্পে বাড়ি ভেঙ্গে যায় তাহলে তার দায় আমি নিতে পারবো না। আসছি সবকিছুর জন্য শুকরিয়া।”

বলেই মেহবিন আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। পেছনে আবুল ও বের হলো। মেহবিন যেতেই সবাই চেয়ারম্যান বাড়ির সকলে তাকিয়ে রইল শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে। তা দেখে শাহনাওয়াজ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“ও বাড়িটা এমনিতেও পরে থাকে তার থেকে যদি কেউ থাকে তাহলে বাড়িটার একটু যত্ন হবে। সবথেকে বড় কথা মেয়েটা মিশুর জন্য যেটুকু করেছে তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। মিশুর বন্ধু হয়েছে তার জন্য এটুকু করাই যায়।”

তখন আরিফা জামান বললেন,,

“আচ্ছা আজ পর্যন্ত আপনার কথা মেনে নিই নি কখনো হয়েছে আজ ও মেনে নিলাম। কিন্তু আরবাজ ও কি মেনে নেবে?”

“আরবাজ শাহনাওয়াজ আমার সন্তান। সব শুনে নিশ্চয়ই মেনে নেবে।”

“আপনাদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার আমি বুঝি না। আর কুদ্দুস আসেনা কেন মিশুকে তো ওষুধ খাওয়াতে হবে। মেয়েটার যে স্বভাব না খেয়েই ঘুমিয়ে পরে নাকি।”

_________________

আবুল এসেই রিক্সা চালাতে শুরু করলো কিছু দূর যেতেই আবুল বলল,,

“এতো ভালো বাড়িতে থাকবার কথা কইছিল চেয়ারম্যানসাহেব তাও আবার আপত্তি করলা কেন তুমি ‌‌?

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“আসলে আবুল ভাই আমার একটা ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। ওনাদের বাড়িতে থাকলে নিশ্চয়ই না চাইতেও একটা নিয়মের ভেতরে থাকতে হবে। সব থেকে বড় কথা একটা ভুল পেলে তখন উনারা কথা শোনাতে ছাড়বেন না। যেটা আমার পোষাবে না কারন আমি নিজেই আমার মর্জির মালিক।”

“হুম বুঝছি তোমার বাড়ি পরিস্কার করতে হইবো না আমি আমার বউরে কইয়া দিতাছি হেই পরিস্কার কইরা দেবনে। এমনিতেও অনেক দূর থেইকা আইছো তুমি একটু আরাম করো।”

“শুধু শুধু ভাবিকে কেন কষ্ট দিবেন আবুল ভাই আমি পারবো।”

‘তুমি না আমারে ভাই ডাকো তাইলে আমি আমার বইনের জন্য এইটুকু পারুম না। নামো আমার বাড়ি আইসা পরছে তুমি কয়টা খায়া লও আজ আমার বউ সকালে কই মাছ রানছিল। তার রান্ধন অনেক মজা।”

আবুলের কথা বলার ভঙ্গিতে মেহবিন হেঁসে ফেললো। আবুল রিক্সা থেকে ব্যাগ নিয়ে ডাকতে লাগল,,

“ফাতেমার মা ও ফাতেমার মা! কই গেলা তুমি দেহো কেরা আইছে তোমার বাড়ি।”

আবুলের হাঁক ডাকে ওনার বউ বের হয়ে আসলো। আর বের হয়ে তার স্বামীর সাথে ব্যাগ আর একটা মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন আর কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললেন,,

“আপনে আরেকটা বিয়া কইরা নিয়াইছেন। আপনে এমনটা করতে পারলেন। ঐ ফাতেমা কোনে গেলি দ্যাখ তোর বাপ তোর জন্য নতুন মা নিয়াইছে এহন আমারে এই বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দিব।”

বলেই মহিলাটা কেঁদে উঠলেন। এটা দেখে মেহবিন আর আবুল দু’জনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। এদিকে মায়ের কথা শুনে ফাতেমাও বের হয়ে এসেছে। আবুল ব্যাগ রেখে দৌড়ে গিয়ে ফাতেমার মাকে বলল,,

“আসতাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ কি কও এইসব আমি কেন বিয়া করুম? তুমি কি মরছো নাকি।”

‘তারমানে আমি মরি নাই দেইখা বিয়া করেন নাই‌। ওরে নিয়াইছেন আমি মরলে ওরে বিয়া করবেন।”

“আসতাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ কি কও এইসব।”

মেহবিন না চাইতেও হেঁসে ফেললো গ্ৰামের মেয়েরা কি এরকমই সহজ সরল। মেহবিন এবার এগিয়ে গিয়ে বলল,,

“ভাবি চিন্তা করবেন না আমাকে আবুল ভাই বিয়ে করার জন্য আনে নি। সে তার বউকে অনেক ভালোবাসে তাই অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাববেও না। আসলে আমি আজই গ্ৰামে এসেছি চেয়ারম্যান বাড়ির আরেকটা বাড়িতে ভাড়ায় উঠেছি। আবুল ভাই আমার সাথেই ছিল তাই এখানে নিয়ে এসেছে।”

তখন ফাতেমার মা হেঁসে বলল,,

“তুমি সইত্য কইতেছো?”

“হুম সত্যি বলছি।”

“ফাতেমার বাপ আপনের আগে কইবেন না আমারে।’

‘তুমি কইতে দিলা কখন। তোমার মাথায় যে গোবর আছে হেইডা জাইনাই তো আমি তোমারে বিয়া করছিলাম।

“আপনে আবার আমারে,,

“আচ্ছা বাদা দাও যাও খাওন বাড়ো। ডাক্তার আফায় আমগো লগে খাইবো। তারপর তুমি আর ফাতেমা গিয়া বাড়িঠা পরিস্কার কইরা দেও। ততক্ষনে ডাক্তার আফায় আরাম করুক।”

তখন ফাতেমা নামক মেয়েটা বলল,,

“তারমানে আপনি ডাক্তার?”

‘হুম!”

“আপনি জানেন আমারও শখ একদিন ডাক্তার হমু।”

“বেশ তো মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো ইনশাআল্লাহ একদিন ডাক্তার হবে। তা কোন ক্লাসে পড়?”

“ক্লাস এইটে ।”

তখন আবুল বলল,,

‘হইছে আবার পরে গপ্পো করিস। ফাতেমা যা ওনারে কলপারে নিয়া যা।”

মেহবিন হাত মুখ ধুয়ে ওদের সাথে খেতে বসলো। মেহবিন জানতে পারলো আবুলের একটা ছেলেও আছে ক্লাস থ্রিতে পরে এখন সে স্কুলে আছে। খাওয়া শেষ করে মেহবিন ও গেল তাদের সাথে নিজের ঘর নিজেও না হয় একটু পরিস্কার করুক। আবুল আর ওনার বউ মানা করেছিল কিন্তু ও শুনেনি। আবুল ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। পাকা রাস্তা থেকে একটা গলির মতো কাঁচা রাস্তা আছে সেদিক দিয়ে দুই তিন মিনিট গেলেই চেয়ারম্যানসাহেব এর বাড়ি। চারদিকে সিমেন্ট এর বর্ডার করা একটা বাড়ি। হাফওয়াল ওপরে টিনশেড গেটের সামনে দাড়াতেই মেহবিনের ভেতরে একটা শীতল বাতাস বয়ে গেল। ওর বাড়ির সামনেই রাস্তার ওপাশে অনেক গুলো বাড়ি সবগুলোই টিনশেড এর। কিন্তু এই বাড়ির ডানে বামে আর কোন বাড়ি নেই। মেহবিন চাবি দিয়ে প্রথমে গেটের তালা খুললো এই বাড়ির তালা খুলতে দেখে রাস্তার ওপাশে থেকে কিছু মহিলাবিন্দু বের হয়ে এগিয়ে এলেন। মেহবিন বাড়ির ভেতরে ঢুকলো তখন পেছন থেকে এক মহিলা ফাতেমার মাকে জিজ্ঞেস করলেই মেহবিন এর কথা জানালো আর এখানে থাকবে বলল। মেহবিন আর দাড়ালো না সে গিয়ে বাড়ির তালা খুললো সামনে বারান্দা চারদিকে লোহার গ্ৰিল দেওয়া। দুটো রুম করা বাড়িটায় বারান্দায় একপাশে বাথরুম আরেক পাশে রান্না ঘর বলতে গেলে গ্ৰামের মধ্যে শহরের ছোঁয়া। রুমের তালা খুলে মেহবিন বুঝলো বাড়ির পেছন দিকেও বারান্দা আছে আর পেছনে বড় একটা পুকুর আছে। তাছাড়াও বাড়িটা বেশ পরিস্কার মাসে বা পনেরোদিনে পরিষ্কার করা হয়। গ্ৰামের মাঝে এরকম একটা জায়গায় বাড়ি সত্যি চমৎকার। সবশেষে মেহবিনের মনে হলো রেডিমেট ফ্ল্যাটের মতো। দুই ঘরে দুইটা খাট একরুমে চেয়ার টেবিল আলমারি। আরেকটা রুমে ড্রেসিং টেবিল আর আলনা। চেয়ারম্যান সাহেব সৌখিন ভাবে যে বানিয়েছে তাই এরকম। তিনজন মিলে বাড়িটা পরিস্কার করে নিল। ফাতেমা আর ফাতেমার মা চলে গেল। মেহবিন পুরো বাড়িটা আরো একবার দেখলো। ফোনে একটা মেসেজ আসতেই মুচকি হেঁসে রিপ্লাই করলো,,

“আমি আমার গন্তব্যের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গিয়েছি।”

~ চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০১

0

কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“তুমি যেই মেয়ের জন্য আমার মেয়েকে রিজেক্ট করছো। কিন্তু সত্যি তো এটাই সেই মেয়েটা এই বাড়ির কেউ নয়। ও আমার মেয়ে নয়। এমনকি ওর সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্কও নেই।’

যাদের এতকাল নিজের মা বাবা বলে জানতো। হুট করেই এতবছর পর সে আসল সত্য জানতে পারলো। আসলে এরা তার আপন মা বাবা নয়, এই বাড়িটা তার নয়, এমনকি এ পরিবার টাও তার নয়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে একটা মানুষের কি আচরণ করা উচিত। এটা জানা নেই মেহবিনের? কিন্তু সে নিজের সম্পর্কে জানার পরেও দুই হাত ভাঁজ করে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের মানুষ গুলোর দিকে। এই মানুষগুলোই তার পরিবার হিসেবে সকলে জানতো। যে পরিবার কে এতকাল নিজের পরিবার হিসেবে জানলো, যে বাড়িটা কে নিজের বাড়ি বলে জানলো,যাদেরকে এতকাল নিজের বাবা মা বলে জানলো। আসলে তারা মেহবিনের আপন কেউ নয়‌। হুট করেই এত বড় সত্য জানতে পেরে পুরো আহমেদ ভিলা একদম শান্ত হয়ে গেছে। অথচ এই বাড়িটায় আজ সকাল থেকেই অনুষ্ঠানের আমেজ ছিল। এখন সবার দৃষ্টি মেহবিনের দিকেই কিন্তু তার কোন রিয়াকশন নেই। হুট করেই মেহবিনের মা সাবিনা আহমেদ বললেন,,

“এসব কি বলছেন আপনি? দয়া করে চুপ করুন।”

এ কথা শুনে মিস্টার আলম আহমেদ ক্ষিপ্ত কন্ঠে আবার ও বললেন,,

“কেন ? আমি কেন চুপ করবো। এটা তো সত্যি এই মেয়েটা আমাদের কেউ নয়। এই মেয়েটাকে আমরা রাস্তায় পেয়েছিলাম। আমাদের গাড়ির সাথে ভুলবশত ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্ট হয়েছিল। যার জন্য ওকে আমরা আমাদের সাথে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওকে এনে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। ওকে না আনলে নিজের মেয়ের এতো বড় সর্বনাশ দেখতে হতো না। আজ এই মেয়ের জন্য আমার মেয়ের হওয়া বিয়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ ছেলে জানালো তার আমার মেয়ে শিলাকে নয় এই মেয়েটাকে পছন্দ।”

“এখানে ওর দোষ কোথায়? মেহবিন তো বলেনি তাকে পছন্দ করতে। এখানে মেহবিনের কোন দোষ নেই।”

“তুমি চুপ করো। রাস্তার মেয়ের জন্য তুমি আমার সাথে তর্ক করছো।”

“মেহবিন রাস্তার মেয়ে নয়। ও আমার মেয়ে শুনেছেন আপনি।’

বলতে বলতেই সাবিনা আহমেদ মেহবিনের সামনে গিয়ে কেঁদে উঠলেন। মেহবিন ছিল সবার থেকে দূরে ড্রাইনিং টেবিলের ওখানে। মেহবিন এখনো চুপচাপ হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার মা নামক মানুষটার দিকে। মিসেস সাবিনা মেহবিনকে জরিয়ে ধরে আবার ও কেঁদে দিলেন আর কান্না মাখা কন্ঠে বললেন,,

“তুই আমার মেয়ে মেহবিন! কি হয়েছে আমি তোকে জন্ম দিই নি? কিন্তু আমি তো তোকে তোর সাত বছর বয়স থেকে লালন পালন করেছি। আমি তোর মা মেহবিন। যে যাই বলুক তুই আমার সন্তান।”

বাকি সবাই কি বলবে সকলেই ব্যাপারটায় হতভম্ব হয়ে আছে। একটু আগেই যে মেয়েটাকে নিয়ে সবাই রাগ পোষন করছিল এখন তার জন্য মায়া কাজ করছে। কিন্তু এর মাঝে সব থেকে খারাপ লাগছে প্রতীকের তার জন্যই এতোবছরের রাজ সামনে এসেছে । সে যদি মেহবিন কে না পছন্দ করে শিলাকে পছন্দ করতো তাহলে এই ঘটনা ঘটতোই না।

ফ্ল্যাশব্যাক,,,

আলম আহমেদ আর প্রতীকের বাবা বিজনেস পার্টনার। তারা এই সম্পর্ক টাকে মজবুত করার জন্য ঠিক করে তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবেন। মেহবিন আর শিলা এক বছরের ছোট বড়। আলম আহমেদ তার মেয়ে শিলার সাথে প্রতীকের বিয়ের কথাবার্তা বলেন। প্রতীক মেয়ের সাথে আলাদা দেখা করতে চায় এটা নিয়ে কেউ দ্বিমত করেনি । মেয়েকে একা কিভাবে পাঠাবে তাই মেহবিন কেও শিলার সাথে পাঠায়। মেহবিন প্রথমে রাজি না হলেও মায়ের জোরাজুরিতে রাজি হয়ে যায়। মেহবিন ভালোমতো বোরকা হিজাব নিকাব বেঁধে যায়। আর শিলা একটা সুন্দর থ্রিপিস তার সাথে হিজাব। প্রতীক ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল প্রতীকের প্রথম নজর যায় মেহবিনের দিকে যদিও তার চেহারা দেখেনি তবে ধার্মিক মেয়ে দেখে তার ভালো লাগে। অতঃপর ওদের পরিচয় হয় প্রতীক আর শিলা কথা বলতে থাকে। মেহবিন ফোন বের করে কিছু একটা করতে থাকে। এমনকি একবার তাকিয়ে প্রতীকের দিকে আর তাকায় নি। খাওয়ার অফার করলে মেহবিন জানিয়ে দেয় সে কিছু নেবে না শুধু এক কাপ কফি ছাড়া। তাই বাধ্য হয়ে প্রতীক ওর জন্য কফি আর নিজেদের জন্য খাবার অর্ডার করলো। কফি আসলেই ওদের কে কথা আর খেতে বলতে বলে ও রেস্টুরেন্টের অন্য জায়গায় চলে গেল। খাওয়া হয়ে গেলে যেন ওকে ফোন করে সেটাও বলে গেছে। শিলা নিজের অনেক কথাই বললো কিন্তু প্রতীক কেন যেন সেই স্বল্পভাষী মেহবিনের কথাই ভাবলো। কিন্তু পরক্ষনে নিজেকে ধাতস্থ করতে ভাবলো তারা বাবা শিলার সাথে বিয়ের কথা বলেছে মেহবিনের সাথে নয়। এভাবেই চলতে লাগলো কিন্তু বারবার মেহবিনের আচরণগুলোই চোখের সামনে ভেসে উঠতো। এই জন্য প্রতীক শিলার সাথে বেশি ফোনে কথা বলতে শুরু করল । তবুও মেহবিন কে মাথা থেকে বের করতে পারছিল না। দশ দিন পর আজ একেবারে পাকা কথা বলার দিন ছিল।সবাই আজ আহভেদ ভিলায় আলম আহমেদ এর ভাই বোন ও তাদের পরিবারের লোকজন ছিল। কিন্তু প্রতীকের পক্ষে শিলাকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাই হুট করেই সে বলে উঠলো তার শিলাকে নয় মেহবিন কে পছন্দ। এতেই যেন আহমেদ ভিলায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। শিলা আর আলম আহমেদ রেগে গেলেন। এরপর প্রতীক আর আলম আহমেদ এর মাঝে কথা কাটাকাটি হলো একপর্যায়ে তিনি বলে উঠলেন মেহবিন ওনার নিজের মেয়ে নয়।”

বর্তমান,,

সাবিনা আহমেদ মেহবিন কে জরিয়ে ধরে কাঁদছেন কিন্তু মেহবিনের কোন প্রতিক্রিয়া নেই সে স্তব্ধ হয়েই আছে। শিলা এতক্ষন রেগে থাকলেও মেঘের জন্য তার এখন খারাপ লাগছে। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছে দুজনে শিলার চোখ দিয়েও দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। কিন্তু প্রতীকের দিকে তাকাতেই মেহবিনের জন্য কষ্টটা রাগে পরিনত হলো। এতদিনে শিলা প্রতীককে ভালোবেসে ফেলেছিল ও ভাবলো মেহবিনের জন্যই এমনটা হলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকার পর মেহবিন সাবিনা আহমেদ কে ধরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল। সাবিনা আহমেদ কান্না মাখা কন্ঠে বলল,,

“মেহবিন তুই কষ্ট পাচ্ছিস? একদম কষ্ট পাবি না।আর তুই স্তব্ধ হয়ে আছিস কেন?”

মেহবিন সাবিনা আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,,

“স্তব্ধ হয়ে কোথায় আছি? আমি তো শুধু চুপ হয়ে আছি। কারন এই বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। সবথেকে বড় কথা কি জানো মামনি? সত্য থেকে কখনো পালানো যায় না। আর কিছু সত্য থেকে তো একেবারেই নয়। আমি কিছু ভুলি নি মামনি সাত বছরের বাচ্চা কিছু ভুলে না। এক্সিডেন্ট হয়েছিল তো কি হয়েছিল? এক বছর কথা বলতে পারছিলাম না তো কি হয়েছিল? পুরোনো কথা মনে করতে গেলে একটু হায়পার হয়ে যেতাম কারন পুরোনো কিছু আমার সহ্য হতে চাইতো না। সব মনেছিল আমার কিন্তু যখন স্বাভাবিক হলাম তখন তোমরা এই আমাকে জানতে চাও নি। তাই আজ এই অবস্থা।

এই মুহূর্তে মেয়েটা মুচকি হাসছে ব্যাপারটা সবাইকে অবাক তো করলো বটে কিন্তু সাবিনা আহমেদ এর বুকে যেন আরো আগুন জ্বালিয়ে দিল। তিনি বুঝতে পারলেন মেয়েটা ভেতরে ভেতরে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। মেহবিন মায়ের দিকে তাকিয়ে তার চোখ মুছিয়ে দিল। আর বলল,,

“উঁহু কান্না নয় আমার খুব ঘুম পাচ্ছে এখন। এদিকে একটু মিটিয়ে নিই তারপর একটা ঘুম দিব। এই সময়টায় একটু ঘুমের প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। ”

সবার থেকে দূরে দেখে কেউ কিছু শুনতে পেল না‌। মেহবিন এবার প্রতীকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,,

“আমি যদি ভুল না হই তাহলে আমাদের দেখা একবার হয়েছিল তাও আবার আপুর সাথে। আর আজ হলো। সেদিন আমার চেহারা টা অব্দি আপনি দেখেন নি। আজ দেখলেন তাহলে আমায় কিভাবে পছন্দ করতে পারেন আপনি? সবথেকে বড় কথা এই দশদিন এ কি করে বুঝলেন আপনার আপুকে নয় আমাকে পছন্দ। এতো তাড়াতাড়ি কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে এটা আমার মনে হয় আপনার মোহ ছাড়া কিছু নয়।”

প্রতীক মাথা নিচু করে বলল,,

“তুমি ঠিক বলেছো কিন্তু আমি প্রথম দেখাতেই তোমাকে পছন্দ করে ফেলেছি। তোমার চেহারা দেখিনি ঠিকই কিন্তু তোমার ব্যবহারে আচরনে মুগ্ধ হয়েছি । যা শিলার ক্ষেত্রে একবার ও আসেনি। আমি ওর সাথে কথা বলতাম কিন্তু ফিল,,

“আমি আর কিছু শুনতে চাই না মিস্টার আপনি যা বলছেন তা সম্ভব নয়। তাছাড়া,,

তখন আলম আহমেদ বললেন,,

‘হয়েছে আর ভালোগিড়ি দেখাতে হবে না। তুমি এখন এখান থেকে চলে গেলেই আমি খুশি হবো। নিজের রুমে যাও। আমরা আমাদের পারিবারিক বিষয় বুঝে নেব তোমায় ভাবতে হবে না।”

মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওপরে চলে গেল। সাবিনা আহমেদ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন। এরপর শিলা প্রতীকের সামনে গিয়ে ইচ্ছে মতো অপমান করলো আলম আহমেদ ও বাদ রইলেন না। প্রতীক তার পরিবার নিয়ে চলে গেল। আলম আহমেদ স্তব্ধ হয়ে সোফায় বসে পরলেন বড়রা সবাই ব্যাপারটা জানতো তাই কোন রিয়াক্ট করলো না। কিন্তু ছোটরা কিছু জানতো না শিলা ওর বাবার সামনে গিয়ে বলল,,

“আজ এটা কি বললে তুমি পাপা মেহবিন আমার বোন নয় ,তোমার সন্তান নয়। তাহলে ছোটবেলায় কেন বলেছিলে ও আমার বোন। কেন বলেছিলে ও একটা জায়গায় থেকে হাড়িয়ে গিয়েছিল কয়েকবছর পর তোমরা ফিরে পেয়েছো। আমি তোমাদের মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম ওর সাথে আমাদের কোন কিছু মিল নেই কেন? তোমরা কেন বলেছিলে ব্যতিক্রম হয় তাই এরকম। আজ বুঝতে পারছি সব। ও যদি আমার বোন না হয়েই থাকে তাহলে তোমরা ওকে এখানে এনেছো কেন?”

তখন আলম আহমেদ বললেন,,

“আমার ভুলের জন্য!”

“মানে?”

“মানে আমি আর সাবিনা একটা কাজ থেকে ফিরছিলাম। একটু বেখেয়ালে গাড়ি চালাচ্ছিলাম ।আর মেহবিন আমার গাড়ির সামনে পরেছিল। কিভাবে কি হয়েছিল সেটা আমি নিজেও জানি না। ও খুব মাথায় আর পায়ে আঘাত পেয়েছিল। ওকে হাসপাতালে নিলে ডাক্তার দেখে কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মেহবিন কিছু বলতে পারে না। কিন্তু ডাক্তার বলে ও বোবা নয় হয়তো অতিরিক্ত টেনশন আর ভয় থেকে কথা বলতে পারছে না। ওকে সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতে হবে। নাহলে হয়তো আর কোনদিন কথা বলবে না। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটাকে চিনি না জানি না । মেহবিন তোমার মায়ের আঁচল খুব শক্ত করে ধরেছিল তোমার মায়ের খুব মায়া হয় তাই তোমার মা বলে ওকে নিয়ে আসতে আমাদের সাথে। এমনিতেও সাবিনা আর মা হতে পারবে না বলে আমি ওকে নিয়ে আসি। তোমাকে বললে তুমি কিভাবে রিয়াক্ট করো তাহলে মেয়েটার ওপর খারাপ প্রভাব পরতে পারে। মেয়েটার অবস্থার জন্য আমরা দায়ী ছিলাম। তাই তার ভালোর জন্য তোমাকে বলেছিলাম তোমরা বোন। ”

সব শুনে শিলা একটু কষ্ট পেল তবে মুখ ফুটে বলল,,

“মেহবিন এসব জানতো তাইনা? তাই তো আজ কোন রিয়াক্ট করলো না তাই না।”

“আমি জানি না। ডাক্তার বলেছিল ও ওর নাম ছাড়া বাকি সব হয়তো ভুলে গেছে। কারন ও যখন কথা বলতে পারতো না তখন ওকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর পরিচয় কি লিখে দিতে কিন্তু ও ওর নাম ছাড়া আর কিছু লিখতে পারতো না। মা বাবার কথা শুনলেই হায়পার হয়ে যেত।তাই ডাক্তার ওকে পুরোনো জিনিস মনে করাতে না করেন এতে ওর ক্ষতি হতো। তাই ওকে পুরোনো সব বাদ দিয়ে আমরা ওর মা বাবা হিসেবে পরিচিত হই আর তুমি ওর বোন এটা ওর পরিবার ব্যস এটুকুই।

শিলা আর কিছু বললো না ওপরে চলে গেল। সকলে নিজেদের উত্তর এমনিতেই পেয়ে গেল। শিলা রুমে যাওয়ার আগে মেহবিনের রুমে উকি দিল মেহবিন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ দিয়ে। এই মুহূর্তে শিলার মেঘকে সহ্য হচ্ছে না তাই আর ভেতরে গেল না। রাতে সকলকে খাবার খাওয়ার জন্য ঠিক দেওয়া হলো বাদ যায়নি মেহবিন ও। কিন্তু মেহবিন আসেনি বলেছে সে খাবে না।কেউ জোর ও করেনি। তবে সাবিনা আহমেদ মেহেবিনের রুমে গেলেন ওর সাথে থাকবে বলে। সাবিনা আহমেদ গিয়ে দেখলেন মেহবিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তিনি গিয়ে বললেন,,

“মেহবিন তুই কি ঘুমিয়ে গেছিস?”

“আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না প্লিজ একা ছেড়ে দাও।”

“খিদে পায়নি তোর ?”

“খিদে পেলে নিশ্চয়ই নিচে গিয়ে খেতাম তাইনা। ”

“তুই এতো সহজে সব কিভাবে মেনে নিতে পারিস?”

“কারন আমি সহজ জীবন পছন্দ করি।”

“তোর পরিচয় কি মেহবিন? আমি জানতে চাই। তোর যদি সব মনেই থাকে তাহলে কেন তুই আমাদের বললি না?”

এবার মেহবিন চোখ খুললো । এতক্ষন চোখ বন্ধ করেই সে জবাব দিচ্ছিল। এখন সে উঠে সাবিনা আহমেদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল,,

” আমার পরিচয় যদি বলি তাহলে আমি মেহবিন মুসকান নামক একজন মানুষ। আর তোমরা যদি তার মা বাবা না হও তাহলে সে এতিম। এই পৃথিবীতে এখন তার জানামতে হয়তো আপন বলতে কেউ নেই।”

“সেদিন কি হয়েছিল মেহবিন তুই রাস্তায় ওভাবে এসেছিলি কেন?”

“একটু বাঁচার আশা নিয়ে। যাই হোক মাথায় হাত বুলিয়ে দাও আমি ঘুমাবো। তখন ঘুম আসেনি আমার এখন একটু ঘুমাতে দাও।”

সাবিনা আহমেদ আর কিছু বললেন না। মেহবিন ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু সত্যি কি ঘুমালো নাকি ঘুমের ভান ধরে পরে রইলো কে জানে।

অতঃপর এক নতুন সকালের আগমন। মেহবিন ফজরের নামায আদায় করে নিল সাবিনা আহমেদের সাথে। মেহবিন গিয়ে তার পড়ায় মনোযোগ দিল এবার সে ঢাকা মেডিকেল এ পড়ছে এবার এমবিবিএস ফাস্ট ইয়ার তিনমাস হলো ভর্তির। দেখতে দেখতে এভাবেই তিন দিন কেটে গেল। সব আত্মীয় স্বজন সবাই চলে গেছে নিজেদের বাড়ি। এ তিনদিনে মেহবিনের সাথে সাবিনা আহমেদ ছাড়া আর কেউ কথা বলেনি। এমন কি একসাথে বসে খাবারও খায় নি। মেহবিনই সবার শেষে খেয়েছে হয়তো অন্যদের কে ফেস করতে চায় নি। আজ সকালে ব্রেকফাস্ট করার জন্য মেহবিন কে ডেকেছেন আলম আহমেদ। মেহবিন ও চুপচাপ এসেছে সবাই চুপচাপ খাচ্ছে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শিলা হুট করেই বলল,,

“একজন অনাথের আঠারো বছর হয়ে গেলে তার আর অনাথ আশ্রমে থাকার নিয়ম নেই। তাই না পাপা?”

শিলার কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো শুধু চমকালো না মেহবিন। আলম আহমেদ বললেন,,

“হুম আমি তো সেটাই জানি। কিন্তু হুট করে তুমি এটা কেন বলছো?

“না এভাবেই কিছু না।”

তখন মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

“কথা টা দ্বারা কি বোঝাতে চাইছো আপু?”

“তুই তেমন কোন ইম্পোর্টেন্ট মানুষ নস যে তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। রাস্তার মানুষ রাস্তার মানুষের মতোই থাক। একদম আমার সাথে কথা বলতে আসবি না।”

তখন সাবিনা আহমেদ মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,,

“শিলা ভদ্র ভাবে কথা বল।”

“রাস্তার মেয়ের সাথে কিভাবে কথা বলবো তা নিশ্চয়ই তোমার থেকে শুনবো না। অবশ্য তোমাকে কি বলবো তুমি তো আবার রাস্তার মেয়েটাকেই বেশি ভালোবাসো কি না। আমার তো মনে হয় তুমিও ওর মতো রাস্তাতেই থাকতে কোন এক সময় তাই তো এতো খাতির।”

মেহবিন একথা শুনে রেগে শিলার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

“মুখ সামলে কথা বলো উনি তোমার মা এটা ভুলে যেও না।”

“আমার মুখের ওপর কথা বলার সাহস তোকে কে দিল। আমার নখের যোগ্যও নস তুই। এতোদিন আবার বাবার টাকায় ফুটানি মেরেছিস। সেদিন মাকে বলছিলি তুই অনাথ আমি শুনেছি তখন তুই অনাথ। তারমানে তোর সব মনেছিল। মানে তুই ভালো একটা জীবন পাওয়ার জন্য মিথ্যা বলেছিস আর অভিনয় করেছিস তোর নাম ছাড়া কিছুই মনে নেই। এতো লোভ তোর এতো লোভ। যার জন্য লোভে পরে তুই প্রতীককেও নিজের হাতে করে নিলি। সেদিন আবার ভালো সাজলি।”

“না জেনে কোন কথা বলবে না আপু।”

“তোর মতো অনাথের কাছে থেকে আবার কি জানতে হবে। লোভী একটা তোদের রাস্তার মেয়েদের লোভ তো হবেই নিশ্চয়ই তোর মাও তোর মতো লোভী ছিল আর রাস্তার মেয়ে ছিল।

মেহবিন এতক্ষন শান্ত স্বরে কথা বললেও এবার রেগে শিলার গাল চেপে ধরলো। আর চিৎকার করে বলল ,,

“এই শিলা আহমেদ আমার মায়ের আজেবাজে কিছু বলবে না। নাহলে এখানেই পুতে রেখে দেব।”

সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হলো যে কেউ কিছু ঠাহর করতে পারল না। এদিকে শিলার গাল মনে হচ্ছে এখনি শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে। শিলার মা এলেন মেহবিন কে ছাড়াতে কিন্তু মেহবিন ছাড়লো না। আলম খান বেশ রেগে গেলেন তিনি শক্ত হাতে মেহবিন কে ছাড়িয়ে ছুড়ে মারলেন। কিন্তু কোথায় মারলেন সেটা দেখলেন না। ওখানে একটা অ্যাকুরিয়াম ছিল একটা। মেহবিন অ্যাকুরিয়ামের সাথে গিয়ে ধাক্কা লেগে মাথা ফেটে একটু রক্ত পরতে লাগলো। তা দেখে মিসেস আহমেদ দৌড়ে গিয়ে মেহবিনকে ধরেন। রক্ত দেখে সবাই একটু হতভম্ব হয়ে যায় তবুও শিলার আর আলম আহমেদ এর রাগ কমে না। আলম আহমেদ রেগে বললেন,,

“ভুলে যেও না তুমি কে? তোমার সাহস কি করে হয় আমার মেয়েকে আঘাত করার?”

মেহবিন এ কথা শুনে মিসেস আহমেদ কে ছাড়িয়ে আলম আহমেদ এর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

“না আমি ভুলে যাই নি আমি কে! ভুলে যাই নি বলে আপনাকে আমি কখনো আপুর মতো তুমি করে সম্মোধন করতে পারি নি। ভুলে যাই নি বলে আপনাকে আপুর মতো কোনদিন জরিয়ে ধরিনি। ভুলে যাই নি বলেই আপনার কখনো আদর স্নেহ না পেলেও একটা টু শব্দ করি নি। ভুলে যাই নি বলে আপনার সব ভুল আর অবহেলা মেনে নিয়েছি। ভুলে যাই নি বলে কখনো আপনার কাছে কোন কিছু আবদার করি নি।”

আলম আহমেদ মেহবিনের কথা শুনে ভাবতে লাগলো সত্যি মেহবিন আগ বাড়িয়ে কিছু চায় নি। মিসেস আহমেদ সর্বদা মেহবিনের প্রয়োজনীয় জিনিস এর বন্দোবস্ত করে রাখতেন। প্রয়োজন ছাড়া মেহবিন কখনো শখের জন্য চেয়ে টাকাও নেয় নি। কিন্তু তিনি দমতে চাইলেন না। তাই তিনি বললেন,,

“সবকিছু ঠিকঠাক পেলে আবদার কে করে?”

তখন মেহবিন তাচ্ছিল্য হেঁসে বলল,,,

“সত্যিই কি সবকিছু পেয়েছি আমি। আবদার বলতে বোঝেন তো পছন্দের জিনিস তাদের তৎক্ষণাৎ চাই। আর সেটা যেন পাওয়া যায় তাই ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মায়ের কাছে আবদার করে। কিন্তু মনে করুন তো আপনি আমার পছন্দের জিনিস আগ বাড়িয়ে কখনো দিয়েছেন। আমার তো মনে পরে না। আপুর আইসক্রিম খেতে মনে চেয়েছে বলে আমারও যে আইসক্রিম খেতে মনে চাইবে এটা ধারনা করা ভুল। শপিং এ গেলে সবাই পছন্দ করে যেটা ধরিয়ে দিতো আমি সেটাই নিতাম এর মানে এটা নয় যে আমার ঐ জিনিস গুলোই পছন্দ অন্য পছন্দ হয় নি। সবার পছন্দ এক কখনোই হয় না। যাই হোক সেসব বাদ দিন।

এবার শিলা বলল,,

“তোকে এতো ভালো একটা জীবন দিয়েছে সেটাই যথেষ্ট নয় কি?”

“কেন দিয়েছে সেটা তোমার পাপাকে জিজ্ঞেস করোনি? তোমার পাপা নিজের স্বার্থপরতার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তার গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়েছিল আর মামনির জন্য এখানে আনে নি। সত্যি তো এটাই তোমার পাপা একটা স্বার্থপর!

একথা শুনে শিলা হতভম্ব হয়ে গেল। আলম খান ও একটু ভয় পেল কিন্তু তিনি দমলেন না। তিনি বললেন,,,

“আমি কি স্বার্থপরতা করেছি এখন দেখছি কারো ভালো করাও ভুল।”

“নিয়ত সঠিক হলে ভালো করা ভুল নয় কিন্তু সত্যি তো এটাই আপনি স্বার্থপরতার জন্য এখানে এনেছিলেন। গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট হলে আপনারা হাসপাতালে নিয়ে যান ঠিকই কিন্তু তার কিছুক্ষণ পর পুলিশ ওখানে গিয়ে আপনাদের জেরা করলে আপনি পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে মিথ্যে বলেন যে আমি আপনার সন্তান। কিন্তু পুলিশ এর বিশ্বাস হয় না তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে আপনি তার আগে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আপনার কথা মানতে বলেন এমনিতেও কথা বলতে পারছিলাম না। এই সুযোগ এ আপনার আমার মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলাটাই তার জন্য প্লাস পয়েন্ট ছিল। তারা যাওয়ার আগে আপনাকে ওয়ারনিং দিয়ে যায় বাসায় গিয়েও চেক করবে আপনি মিথ্যা বলছেন কি না। আর করেছিলোও তাই। এই জন্যই আপনি এই নাটক সাজান আমার ভালোর জন্য নয় নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য। আমি যেন নিজের পরিচয় কাউকে না বলি এর জন্য আপনি আমাকে বলেছিলেন সব মনে থাকলেও যেন আমি মা বাবার নাম না উচ্চারণ করি । তাদের কথা শুনে হায়পার হয়ে যেতাম এটা আপনার শেখানো বুলি ছিল। যদিও আপনার কথায় আমি হায়পার হতাম না সত্যি সত্যিই হায়পার হয়ে যেতাম। আপনি কি ভেবেছেন আমি আমার ব্য্যাপারে সব শুনেও চুপ থাকবো শুধু ভালো জীবন পাওয়ার জন্য না এটা আমি না। কারন আমার মা আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে সত্যের মোকাবেলা করতে হয়। শুধু আপনার কথা ভেবেই আমি চুপ ছিলাম কারন কোথাও না কোথাও গিয়ে আপনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আর শিলা আহমেদ তুমিও তোমার পাপার মতোই একটা স্বার্থপর যখন তোমাদের স্বার্থে আঘাত লাগলো তখন দেখিয়ে দিলে তো নিজেদের বাবা মেয়ের আসল রুপ। আর হ্যা আমার মা কোন লোভী নয় আর রাস্তার মেয়েও নয়। সে ছিল রানী আর আমার আইডল কারন সে আর যাই হোক নিজের স্বার্থপরতার জন্য কাউকে ইউস করতে শেখায় নি।”

এটুকু বলেই মুচকি হেঁসে কপালে হাত দিল মেহবিন এখন রক্ত পরছে না কিন্তু রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। সে ওপরে চলে গেল কিন্তু নিচে তিনটি মানুষ সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। শিলা রেগে তার বাবার দিকে চাইলো। আলম আহমেদ মাথা নিচু করে রইল কারন মেহবিনের সব কথাই সত্য ‌ কিছুক্ষণ পর মেহবিন বোরকা হিজাব নিকাব বেঁধে একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে নিচে নামলো। এটা দেখে কারোরই বুঝতে বাকি নেই মেহবিন চলে যাচ্ছে। মিসেস আহমেদ মেহবিনের সামনে গিয়ে বলল,,

“এসব কি মেহবিন? তুই কোথাও যাবি না।”

” যে স্থানে অপমান হয় সেই স্থান থেকে প্রস্থান করাই উত্তম।”

তখন শিলা বলল,,

“তোর মনে হয় না তুই এখান থেকে বেরিয়ে বড় একটা ভুল করছিস।”

তখন মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“মেহবিন তার জীবনে বড় ভুল দুবারই করেছিল। সেই ভুল মেহবিন আর করবে না। বরঞ্চ আজ এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমার সবথেকে ভালো একটা সিদ্ধান্ত। বারো বছর আশ্রয় দেওয়ার জন্য শুকরিয়া সবাইকে। আর সবকিছুর জন্য ও শুকরিয়া।

মেহবিন দুই পা বাড়ালো মিসেস আহমেদ গিয়ে মেহবিন কে জরিয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। আর বললেন,,

“তুই কোথায় যাবি কিভাবে থাকবি?”

মেহবিন তাকে ছাড়িয়ে বলল,,

“চিন্তা করো না সেদিন আলম আহমেদ এর কথা শুনেই বুঝেছিলাম এই বাড়িতে আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিছু না কিছু করে এই খারাপ সময় টা কাটিয়ে নিতে পারবো। তবে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো তো আমি। আমি কি আমার মামনি কে ভুলে যেতে পারি। সবকিছুর জন্য শুকরিয়া মামনি। নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ আর হ্যা আমার জন্য দোয়া কোরো।”

“আমার দোয়া সবসময় তোর সাথে আছে। কিন্তু তুই কিভাবে,,

“আল্লাহ ভরসা মামনি। আল্লাহ তায়ালা উত্তম কর্মবিধারক। আল্লাহর ওপর ভরসা করা মানুষগুলো কখনোই খালি হাতে ফিরে আসে না –
”অবশ্যই বিশ্বাসীরা সফল হয়েছে”
( সূরা মুমিনুন-০১)।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

যে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। (সূরা আত-তালাক্ব:৩)

নিশ্চয় আল্লাহ (তার উপর) নির্ভরকারীদের ভালবাসেন। (সূরা আলে-ইমরান:১৫৯)

আপাতত কিছু দরকার নেই,আল্লাহ আমাকে
অনেক ধৈর্যশীল করে দিক, খা’রাপ মুহূর্তগুলো
সহ্য করার জন্য। একদিন তো আমিও প্রশান্তির হাসি হাসবো ইনশাআল্লাহ।

বলেই মেহবিন চলে গেল। তিন জোড়া চোখ শুধু দেখেই গেল কিছু বলতে পারলো না। মেহবিনের গন্তব্য এখন কোথায় সেটা মেহবিনই শুধু জানে হয়তো কোন অজানা গন্তব্যের দিকে।

~ চলবে,,,