Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2426



ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ১০

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে আছে আঁখির গলা।
” কিরে? কে এসেছে?”
ভয়ার্ত কন্ঠে নুহার জবাব, ‘ছেছেছেলে ধরা…’

ছেলে ধরা মানে? কিসব বলছিস নুহা?
এগিয়ে আসে আঁখি। দরকার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সেও।
‘ভাবি, আপনি? অনেকটা কাঁপা গলায় আঁখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটিকে প্রশ্নটা করে। চমকে যায় নুহা।
আঁখির কথার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে আঁখির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে- ‘ভাবি…?’

কিচ্ছু বলতে পারেনি আঁখি। তার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় আঁখির মা তথা হিয়া আন্টি। আঁখির মতোই চমকে উঠেন ওনি। প্রশ্ন করেন, ‘ফারহানা তুতুতুমি?’
নিচু গলায় কতিপয় ভদ্রমহিলা তথা ফারহানার জবাব, অনেক রাস্তা জার্নি করে এসেছি ফুপ্পি। মায়ের শরীরটাও খুব বেশী ভালো নেই। পুরো রাস্তা বমি করে এসেছে। মায়ের একটু বিশ্রাম দরকার। ভিতরে আসতে পারি কি?
ইতস্তত হিয়া ফারহানা এবং তার মাকে রুমে আসার অনুমতি দিয়ে দরজার সামনে থেকে সরে যায়।
ঘটনা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না হিয়া। শুভ বিশেষ দরকারে বাজারে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে বাসায় চলে আসতে পারে। আর শুভর আগমন মানেই বড়ো কোন অনর্থের ইঙ্গিত। এই মুহূর্তে হিয়া ওর হাজবেন্ডের উপস্থিতিটা বড্ড বেশী কামনা করছে। হিয়া জানে, ওর হাজবেন্ড আসলে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু সামাল দিতে পারবে। কারণ, এ বাসায় শুভ যদি কারো কথা মেনে থাকেন সে শুভর ফুপা তথা হিয়ার হাজবেন্ড। যার প্রত্যেকটা কথা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলে শুভ। ছোট থেকে এই ফুপা’ই পিতৃ আদর দিয়েছে কি না….!

ফোনে না পেয়ে হিয়া মেসেজের পর মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে ওর হাজবেন্ডকে। হিয়া জানে, পুরো সপ্তাহের মধ্যে এই একটা দিনই ওনি কাজ থেকে অবসর পান আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেন। এই সময় ওনাকে ডিস্টার্ব করতে মানা। তা সত্ত্বেও হিয়া মেসেজ দিচ্ছে। দুটোর বেশী কল দেয়নি কারণ ওনার আগে থেকেই বারণ আছে, যত জরুরীই হোক দুটো কলের বেশী যেন না দেয়া হয়। কিন্তু মেসেজ দেয়া তো বারণ করেনি তাই হিয়া একের পর এক মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে।
? “বড় এক অনর্থ ঘটে গেছে। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় চলে আসো।

? বাসায় আসো।

?প্লিজ বাসায় আসো।

?প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। বাসায় আসো….”

বন্ধুদের সাথে লুডু খেলায় ভিষণ ব্যস্ত ছিল হৃদয়। একটা সময় সাইলেন্ট করা ফোনের স্ক্রিনের দিকে কি মনে করে যেন দৃষ্টি দেয়। মুহূর্তেই ভেসে উঠে চোখে স্ত্রী হিয়ার মেসেজ। অবিরত মেসেজ আসছেই তখনো। ‘বাসায় কারো কিছু হলো না তো?’ ভয় পেয়ে যায় হৃদয়। ডায়াল করে হিয়ার নাম্বার। রিং একটু বাজতে না বাজতেই রিসিভ হয়ে যায়। চিন্তিত গলায় হৃদয় প্রশ্ন করে-
” ওহ, হ্যালো!
কি হয়েছে হিয়া? শরীর ঠিক আছে তো তোমার?”

ওপাশ থেকে ভেসে আসে আঁখির কন্ঠ।
– বাবা! আমি আঁখি…
— হ্যাঁ- মা! কি হয়েছে বাসায়?
– বাবা! ফারহানা ভাবি এসেছে।
— কিহ? শুভর ববববউ এসেছে?
– হ্যাঁ, বাবা! আমার খুব ভয় হচ্ছে বাবা।
— শুভ ভাইয়া যেকোন মুহূর্তে চলে আসতে পারে বাসায়। তখন যদি ওনাদের দেখে কি যে…
– চিন্তা করিস না মা। আমি আসছি এখনি।

জনাব হৃদয় সাহেব কল কেটে দ্রুত বন্ধুর বাইকে উঠেন। মিনিট তিনেকের মধ্যে বাসার সামনে এসে নামেন। বন্ধুকে বিদায় দিয়ে তড়িগড়ি রুমে ঢুকেন।

রান্না করছিল হিয়া। হাজবেন্ডকে দেখে চিন্তিত মুখে কাছে এসে দাঁড়ায়।
– দেখো না! কোথায় থেকে চলে আসছে এই আপদ!
— প্রশ্ন এটা নয়। প্রশ্ন হলো- কি মতলব নিয়ে এই মাইয়্যা আবার এই বাসায় এসে উঠেছে?
– মেয়ে নয় শুধু। মেয়ের সাথে মা’ও এসেছে…!
— কিহ?
– হু। মা মেয়ে দুজনই এসেছে…
— আমি কি গিয়ে জিজ্ঞেস করব মতলব কি?
– আমার মনে হয় সেটাই ভালো হবে। দ্রুত যাও। শুভ আসার আগেই দেখো কিছু করা যায় কি না…!
— আচ্ছা, দেখছি…

গেস্টরুমের দিকে যাচ্ছিল হৃদয়। পথ বেঁধে দাঁড়ায় নুহা। রান্নাঘর থেকে একরকম দৌঁড়ে আসে হিয়া।
– কি করছিস? আদিরা ওনাকে যেতে দে…
— মাফ করবেন আন্টি। ছোট মুখে বড় কথা বলছি। আসলে আপনারা যা করতেছেন তা ঠিক নয়। মেহমান বাড়ির লক্ষ্মীর ন্যায়। লক্ষ্মীকে এভাবে তাড়িয়ে দিতে নেই।
– তুই জানিস ওরা কে বা কারা?
— শুভ ভাইয়ার প্রাক্তন স্ত্রী এবং ওনার শাশুড়ি।
– জেনেও তুই নীতিকথা শুনাতে এসেছিস?
— আন্টি! আমি নীতিকথা বলিনি। হাজার হোক ওনারা এ বাড়ির অতিথি। আর অতিথিকে এভাবে তাড়িয়ে দিবেন না। এটা ঠিক না…
– তুই ছোট, আদিরা! ভুল-ঠিকের তুই বুঝবিনা…
— হয়তো। তবে এখন ওনাদের কিছু না বলে, যথাযথ আপ্যায়নের পর, রেস্ট নিয়ে, সর্বসম্মুখে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলে ভালো হয় আন্টি।
– কিন্তু শুভ….

পুরো কথা বলতে পারেনি হিয়া। থামিয়ে দেয় হৃদয়। ফিরে তাকায় হিয়ার দিকে।
– সত্যিই হিয়া! বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের বুদ্ধিও হ্রাস পেয়েছে অনেক। রাগের মাথায় কি অভদ্রতার পরিচয়’ই না দিতে যাচ্ছিলাম…
— মানে কি?
– চিন্তা করো না। যাও। রান্না করো গিয়ে।
— কিন্তু শু…
– ওর জন্য আমি আছি। ড্রয়িংরুমে বসছি। ও ভিতরে ঢুকা মাত্রই সবকিছু বুঝিয়ে বলবো।
— তারপর?
– তারপরেরটা পরে বুঝা যাবে। আপাতত তুমি যাও।

হিয়া রোজির মা তথা এ বাসার বুয়ার সাথে রান্নায় হেল্প করতে রান্নাঘরে চলে যায়।

মিনিট পাঁচেক পর রুম থেকে বেরিয়ে আসে ফারহানার মা।
– বেয়াইন এই ভর সন্ধ্যায় কি করছেনটা কি এসব?
— আরে তেমন কিছু না! খাবারগুলো গরম করছি…
– এতকিছু করার কি দরকার ছিল?
— এতদুর থেকে এসেছেন। কিছু তো একটা সামনে দেয়া দরকার…
– এত উতলা হবেন না। লাঞ্চ আমরা বাইরে থেকে করে এসেছি…

ফারহানার মা রুমে চলে গেলে মুখ ভেংচি দেয় হিয়া।
‘হুহ! বয়েই গেছে আমার উতলা হতে…’

খাবারগুলো গরম করা শেষে সেগুলো মেহমানের সামনে উপস্থাপন করা হয়। খাবার উপস্থাপন করে নুহা। খাবার সামনে আসার পর বিনা বাক্যব্যয়ে সেগুলো গলার্দকরন করে নেয় মা মেয়ে। খাওয়া শেষে মেহমানদের সামনে উপস্থিত হয় হিয়া। দৃষ্টি যায় ফারহানার দিকে।

– ওহ, ফারহানা! জিজ্ঞেস করাই তো হলো না। হুইলচেয়ারে কেন তুমি? কোন সমস্যা হয়েছে কি?
— আসলে ফুপ্পি আমার একটা পা পঙ্গু হয়ে গেছে।
– কি বলছ এসব? পঙ্গু হয়ে গেছে মানে?
— আসলে সেদিন আদনানের বাবাকে না বলেই বাসায় চলে গেছিলাম মাকে দেখার জন্য। ফেরার পথে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে আমি আমার একটা পা হারাই…
– কিন্তু আমরা তো শুনেছি…
— আপনারা ভুল শুনেছেন ফুপ্পি। ওরা আপনাকে ভুল শুনিয়েছে। আমি কোন ব্যাংকারের হাত ধরে পালিয়ে যাইনি। আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হয়েছিল।
– আচ্ছা, মানলাম! মানলাম তুমি কারো হাত ধরে পালিয়ে যাওনি। পা গিয়েছে। এজন্য তুমি এ বাসায় আসতে পারোনি। কিন্তু হাত তো ছিল। সেই হাত দিয়ে কি একটা কল দেয়ার শক্তি পাওনি?
— আসলে ফুপ্পি! ফোনটা রাস্তায় পরে ভেঙ্গে গেছিল। মায়ের ফোনেও ব্যালেন্স ছিল না।

” পুরো বাংলাদেশের কারো ফোনেই কি ব্যালেন্স ছিল না, মিসেস ফারহানা জাহিদ?”

উপরিউক্ত উক্তিটা করতে করতে রুমে প্রবেশ করে শুভ। ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে তাকায় হিয়া। শুরু হয় ফারহানা শুভর কথোপকথন।
” আসলে মা ফোন সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝে না সেটাতো তুমি জানো’ই। তারপরও সেদিন মা তোমার নাম্বারটা নিয়ে দোকানে গিয়েছিল ফোন করার জন্য।”
– তারপর?
— সেদিনই মায়ের ফোনটা ছিনতাই হয়।
– তোমার মা তো কাগজে নাম্বারটা লিখে দোকানে গিয়েছিল। ফোন কি ছিনতাইকারীরা বাসায় থেকে এসে নিয়ে গিয়েছিল?
— আরে! মায়ের হাতে ফোনও ছিল…
– ওহ, আচ্ছা, আচ্ছা! তখন ছিনতাইকারী তোমার মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে দৌঁড় দিয়েছে?
— সেরকমই। তবে মা বুড়ো মানুষ তো। তাই টের পায়নি ফোনটা কখন কে নিয়ে গেছে?
– পরে?
— মা, ফুপ্পি তোমরা একটু বাহিরে যাবে?

ফারহানার কথামতো ওর মা এবং হিয়া আন্টি বাহিরে চলে যায়। ওরা বাহিরে যাওয়া মাত্রই ফারহানা জড়িয়ে ধরে শুভর পা।
– প্লিজ, শুভ! আমায় মাফ করে দাও। আমার ভুল হয়ে গেছে।
— আরে, আরে! তোমার না এক পা পঙ্গু? ভালো হয়ে গেলো কখন?

শুভর কথায় থতমত খেয়ে যায় ফারহানা। দ্রুত ফ্লোর থেকে উঠে হুইল চেয়ারে গিয়ে বসে। হাসতে শুরু করে শুভ।
– হাঃ হাঃ হাঃ… রাগ করলে নাকি?
— না…
– Good…
— ……..
– তারপর?
— কি তারপর?
– ঐ যে কিচ্ছার বাকি অংশ শুনতে চাচ্ছি।
— তুমি অনেক বদলে গেছ শুভ।
– কি সাংঘাতিক! কিচ্ছার ভেতর আমাকে কেন টানছো?
— শুভ প্লিজ! রসিকতা করো না। আমার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নেই।
– ওহ, তাই নাকি?
— আমার জন্য তোমার কি একটুও মায়া হয়না শুভ?
– মায়া? হো হো হো….
— হাসছো যে?
– ব্যাংক ম্যানেজারের টাকায় কমতি পরেছে নাকি?
— ………..
– কি হলো? দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলে কেন? আমার দিকে তাকাও?
— কেউ মনে হয় পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে শুভ…

হাসোজ্জল মুখে দরজার পানে তাকায় শুভ। ছোট্ট একটা ছায়ার মতোন দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ছায়াটা কাঁপছে। ভ্রু- কুচকে প্রশ্ন করে শুভ।
“কে ওখানে? রুমে আসেন….”
মাথা নিচু করে রুমে প্রবেশ করে নুহা। পা দুটো তখনো কাঁপছে। কাঁপুনি এতটাই বেশী ছিল যে এক ঠ্যাং আরেক ঠ্যাংয়ের সাথে বার বার লেগে যাচ্ছিল।
বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করে শুভ-
” কি ব্যাপার? তুমি এই দিন দুপুরে এভাবে কাঁপছো কেন? শীতও তো নেই তেমন আজকে…”

মাথা নিচু থাকা অবস্থাতেই কাঁপা কাঁপা গলায় নুহার জবাব- ‘মাগরিবের আযান দিয়েছে…’
জিহ্বায় কামড় দেয় শুভ। ‘ওহহো! আযান দিয়ে দিয়েছে? যাই, যাই। আমি নামাজ পড়ে আসি…’

নুহার পিছন পিছন শুভও বাহির হয়ে চলে যাচ্ছিল নামাজের জন্য। পিছু ডাকে ফারহানা।
” বাহ! দারুণ পরিবর্তন। ঠ্যালে ধাক্কা দিয়ে দিয়েও যাকে কি না আগে জুম্মার নামাজের জন্য মসজিদে পাঠানো যেতো না, সে কি না এখন এক কথায় নামাজে চলে যাচ্ছে? সেটাও কি না বাড়ির কাজের মেয়ের কথা’য়….”

শুভ ফিরে তাকায় নুহার দিকে। নুহা দৃষ্টি নিয়ে যায় নিচের দিকে। অতঃপর ঝাপসা চোখে সে স্থান পরিত্যাগ করে।

প্রচন্ড রাগে অগ্নিশর্মা শুভ তেড়ে যায় ফারহানার দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠাস করে একটা থাপ্পর মারে ফারহানার গালে।

চলবে….

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব-০৯

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব-০৯
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মামুন নুহার পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। বাসায় ফিরে যায় নুহা। বাগানের ভেতরের ঐ ঝুপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে শুভ। পিছন থেকে ডাক দেয় মামুনকে। থমকে দাঁড়ায় মামুন। শুভ গিয়ে মামুনের ঠিক সামনে দাঁড়ায়। মেলে ধরে নিজের পরিচয়। লজ্জায়, ভয়ে শুভর দিকে তাকাতে পারছে না মামুন। ধীর গলায় শুভ জানায়,
” ভয় নেই মামুন! নেই কোন লজ্জা। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করব না। তবে তোমার প্রতি আমার একটা রিকোয়েস্ট! তোমার জীবনে ওর আগমনটাকে একটা দূর্ঘটনা ভেবে ভুলে যাও। সম্মুখে রঙ্গীন ভবিষ্যৎ তোমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তুমি বরং সেদিকেই এগিয়ে যাও। কারো পিছনে ছুটে জীবনের মূল্যবান সবাইটাকে নষ্ট করো না। বরং জীবনটাকে সুন্দরভাবে গঠন করো। দেখবে একদিন হাজারো তরুণী তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখবে। ভালো থেকো। শুভ কামনা রইল।”

” ঠিক আছে ভাইয়া। আমি আসি। আসসালামু আলাইকুম।”
শুভর থেকে বিদায় নিয়ে মামুন চলে যায়। শুভও বাসায় ফিরে যায়।

দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় নুহা মুখোমুখি হয় শুভর। প্রশ্ন করে শুভকে-
” এভাবে কারণে অকারণে আদনানের গায়ে হাত তুলেন কেন আপনি? কি সমস্যা আপনার?”
শুভর পাল্টা প্রশ্ন-
” তুমি বাসা থেকে বের হয়ে কোথায় দাঁড়িয়ে? কার সাথে? কিভাবে কথা বলো? সে সম্পর্কে আমি কি কখনো তোমাকে প্রশ্ন করেছি?”

দুপুরের কথা মনে হতেই পুরো মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় নুহার। ঘাবড়ে যায় সে। ভয়ে ঢোক গিলে নুহা। নিচের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল মুচড়াতে মুচড়াতে বলে, আমি আবার কাকাকার সাথে দাদাদাঁড়িয়ে কথা বললাম আজকে?
হাসি আটকে জবাব দেয় শুভ, সেটা তো তুমিই ভালো জানো।
আর কোন কথা বলে না নুহা। নিশ্চুপ হয়ে অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে।শুভ রুমে চলে যায়।

রাত্রে সবাই একত্রে খাবার টেবিলে খেতে বসেছে কিন্তু নুহার আসার নাম নেই। শুভর ফুপ্পি হিয়া আদনানকে জিজ্ঞেস করে, কিরে ভাই? আজকে পিরিতের মা’রে ছাড়াই যে খেতে বসলি? পাশ থেকে শুভর প্রশ্ন, হ্যাঁ, তাইতো। নুহা কোথায়? ও আজকে আসলো না যে….!
বিজ্ঞদের মতো উত্তর দেয় আদনান।
” আম্মুর আজকে মন ভালো না। তাই খাবে না…!”
বড়সড় নিশ্বাস ফেলে শুভ। ফিরে তাকায় আদনানের দিকে। আদনান তখন গম্ভীর হয়ে ভাতের উপর আঙুলের রেখা টেনে যাচ্ছে। পিছন দিয়ে ছেলের পিঠে হাত রাখে শুভ। আদনান ফিরে তাকায় বাবার দিকে। একটা মলিন হাসি হেসে শুভ ছেলেকে বলে- “মানচিত্র তো অনেক’ই আঁকলে। এবার খেয়ে নাও বাবা….”
আদনান হাতের প্লেটটা শুভর দিকে ধাক্কা দিয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে রুমে চলে যায়। যাওয়ার আগে শুভকে বলে যায়, “তুমি খাও! আমার খিদে নেই….!

কাঁথা গায়ে চুপটি করে শুয়েছিল নুহা। কাঁথা ধরে টানতে থাকে আদনান। “আম্মু! ভাত খাবো।”
কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করে নুহা। দৃষ্টি যায় আদনানের দিকে। অতঃপর ভেঁজা গলায় জবাব দেয়, ‘যাও, বাবা! খেয়ে নাও তুমি। আমার ভালো লাগতেছে না….
চোখ টিপে কাঁদতে কাঁদতে দরজাটা মিশিয়ে নুহার পাশে এসে শুয়ে পড়ে আদনান। কান্না চলে আসে নুহার। জাপটে ধরে আদনানকে। অনেকক্ষণ এভাবে জড়িয়ে রেখে দু’জনেই খাবার টেবিলের দিকে চলে যায়। খেয়ে নেয় রাতের খাবার।

খাওয়া শেষে শুভ আদনানকে ওর রুমে নিয়ে গেলে নুহা একা শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

মাঝরাত্রিতে আদনানের চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় নুহার। দ্রুত দরজা খুলে। আদনানকে কোলে নিয়ে শুভ তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে দেয় নুহা। শুভ আদনানকে নুহার দিকে এগিয়ে দিয়ে রুমে চলে যায়। আদনানকে খাটে বসানো হয়। তখনো সে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কি দিয়ে কান্না থামাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না নুহা।

” বাবা! শিমের বিচি খাইবা?”
আদনান মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ-বোধক জানান দিলে নুহা রুমে থাকা ভাঁজা শিমের বিচি থেকে কিছু বিচি এগিয়ে দেয় আদনানের দিকে।

ঘুমে ঢুলুঢুলু নুহা আদনানকে শিমের বিচি দিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে আদনানের পাশেই কাঁথা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে ছোট্ট আদনান ছোট ছোট ইঁদুরের মতো দাত দিয়ে কুটকুট করে শিমের বিচি খাওয়া শুরু করে। প্রায় ৩০মিনিটের মতো আদনান শিমের বিচি খায়। মিনিট ত্রিশেক পর শিমের বিচি খাওয়া শেষে আরো বিচি বিছানায় পড়েছে কি না সেটা দেখার জন্য হাতড়াতে থাকে। ঘুম ভেঙ্গে যায় নুহার। ফিরে তাকায় আদনানের দিকে।
‘ বাবা! খাওয়া হয়েছে?’ আদনানের ছোট্ট জবাব, হু…

নুহা আদনানকে টেনে ওর পাশে শুয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দেয়। মিনিট পাঁচেক পরের ঘটনা। নুহার চোখটা মাত্র লেগে এসেছিল। তখনি আবারো সেই কুটকুট আওয়াজ…!
চোখ থেকে ঘুম চলে যায় নুহার। প্রশ্ন করে আদনানকে, ‘আদনান! তুমি না বলছ বিচি খাওয়া শেষ?’
প্রতিউত্তরে কিচ্ছু বলেনি আদনান। চুপচাপ শুধু শিমের বিচি খেয়েই যাচ্ছে….!
তখন বিছানা হাতড়িয়ে কি তাহলে এই বিচিগুলোই পেয়েছিল….!
শব্দ করে হেসে উঠে নুহা….

পরদিন ছিল শুক্রবার। শুক্রবার ছুটির দিন। নুহাকে কলেজে যেতে হবে না। আর সেজন্যই বোধ হয় কোন রকম ব্রেকফাস্টটা সেরে নুহা বেরিয়ে পড়ে আদনানকে কোলে নিয়ে। বোরকা গায়ে নুহা আদনানকে নিয়ে পুরো এলাকা চষে ফেলেছে। ফেরার পথে এক মহিলার হাতে লিচুর প্যাকেজ দেখে আদনান কান্না করা শুরু করে-
” আম্মু! লিচু খাবো। আম্মু লিচু খাবো…..!”

নুহা আদনানকে সান্ত্বনা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করছে-
” বাবা! বাসায় চলে আসছি। লিচু পাবো কোথায় এখন? তারচেয়ে বরং ভিতরে চলো। আঁখি আন্টিকে বলি গিয়ে। ওনি তোমাকে লিচু এনে দেবে।”
আদনান কিছুতেই সান্ত্বনা মানতে রাজি নয়। লিচু,লিচু করতে করতে নেমে যায় কোল থেকে। দৌঁড়ে চলে যায় রাস্তার ওপাশে হুইলচেয়ালে বসে থাকা মহিলাটির কাছে। আবদার করে-
“আমারে একটা লিচু দিবা….?”
মহিলাটি চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে ঝাপসা চোখে ফিরে তাকায় আদনানের দিকে। অতঃপর হাতের থাকা লিচুর প্যাঁকটা বাড়িয়ে দেয় আদনানের দিকে। রাস্তার এপাশ থেকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল নুহা। তার আগেই কোথায় থেকে যেন উদয় হয় শুভ। আদনানকে একটা বিকট ধমক দিয়ে মহিলাটির দিকে ছুড়ে মারে লিচুর প্যাকেজ। প্যাকেজটি মহিলাটির পায়ের নিচে গিয়ে পরে। আদনান আবারো লিচুর জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। শুভ আদনানকে জোর করে কোলে নিয়ে বাসার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে প্রচন্ড লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে নুহা। প্রশ্ন করে শুভকে, আপনি ভদ্রমহিলার সাথে এমন না করলেও পারতেন….!

ভয়ানক দৃষ্টি নিয়ে শুভ নুহার দিকে ফিরে তাকায়। ভয়ে ঢোক গিলে নুহার জবাব, না মানে ওনি তো যেচে এসে লিচু সাধেননি কাউকে….!
শুভর কঠোর জবাব, ওনার সাধার ধরণটা অন্য রকম। আর কি যেন বলছিলে? ভদ্রমহিলা? আজকাল ছেলেধরা’রা এরকমই ভদ্রতার মুখোশ পরে আসে। আর একটাও কথা হবে না। রুমে চলো…!
পিছন থেকে ভেসে আসে ভদ্রমহিলার কন্ঠে শুভ নামের প্রতিধ্বণি।
থমকে যায় নুহা। ডাক দেয় শুভকে। এই শুনোন না। ওনি তো আপনার নাম ধরেও ডাকছে…
প্রচন্ড রাগে গর্জে উঠে শুভ। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে নুহাকে, আমি ঐ বাজে মহিলার সম্পর্কে কোন কথায় শুনতে চাচ্ছি না নুহা। তুমি বাসায় ঢুকবে কি না….!
আর কোন কথা বাড়ায়নি নুহা। শুভর পিছুপিছু বাসায় ঢুকে পরে।

বিকেলে ড্রয়িংরুমে বসেছিল নুহা। ভদ্রমহিলার প্রতি সকালে শুভর আচরণটা কেন জানি অদ্ভুত ঠেকছিল নুহার কাছে। আর তাই ডায়েরী হাতে ভদ্র মহিলার সম্পর্কে দু’কলম লিখার চেষ্টা করছে-
” আটসাট গড়ন। লম্বা টিকালো নাক। কথা বলত কাটা কাটা। খুব চটপটে। বয়স হয়েছিল ঢের। কিন্তু বয়সের ছাপ ছিল না…!”

পুরো ঘটনা লিখতে পারেনি নুহা। তার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। কিচেন থেকে হিয়া আন্টির গলার স্বর ভেসে আসে।
” আদিরা! দেখতো মা কে এসেছে….?”

নুহা দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে। স্তব্ধ নুহা দরজার ওপাশের মানুষটাকে দেখে যেন কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। কোন কথায় ওর মুখ থেকে বের হচ্ছে না। ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে আসে আঁখির গলা-
” কিরে? কে এসেছে….?”
ভয়ার্ত গলায় নুহার জবাব, ছেছেছেলে ধরা….

চলবে….

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ০৮

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো।

রেজাল্ট দিলো। 4.83 পেয়ে উত্তীর্ণ হলো নুহা। বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে এলো। সেদিন ছিল স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠান। বিদান অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র নুহাকে খাওয়ানোর জন্য মামুন ষাট জন ছাত্র ছাত্রীকে চকোলেট খাইয়েছিল। কিন্তু নুহা চকোলেট নেয়নি।

পরীক্ষা শুরু হলো। দেড় বছরের ছোট্ট আদনানের বয়স তখন চার বছরে দাঁড়ায়। এসএসসি পরীক্ষার প্রাক্কালে নুহার রুটিন করা কিছু কাজ ছিল।
সেগুলো হলো- তিনবেলা নিয়ম করে খাওয়া, গোসল, পড়াশুনা আর নিয়ম করে ঘুমানো। এর ছাড়া নুহার বেশি কোন কাজ ছিল না। নুহা যখন পড়ত, আদনান তখন চুপ করে নুহার কোলে এসে বসে থাকত। কখনো বা নিজেও স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ বই নিয়ে এসে নুহার পাশে বসে পড়তো। শুভ দুর থেকে নুহার গতিবিধি লক্ষ্য রাখতো। লক্ষ্য রাখতো আদনান নুহাকে ডিস্টার্ব করছে কি না…!

পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষার আগমুহূর্ত শুভ নুহাকে পড়াশুনার জন্য এক নতুন রুটিন করে দেয়। যেখানে পড়াশুনার চেয়ে নুহার দৈহিক সুস্থতাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। রুটিনে স্পষ্ট লিখাঃ-
” ভালো ভাবে পরীক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বশর্ত তোমার দৈহিক সুস্থতা। আর সেই দৈহিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজন নিয়ম মেনে চলা। এক্ষেত্রে ঠিক মতো খাওয়া, গোসল আর ঘুমের কোন বিকল্প নেই। তুমি একজন বুদ্ধিমতি এবং মেধাবী ছাত্রী। আশা করি, পরীক্ষার আগমুহূর্তে বই নিয়ে কোমর বেধে লেগে পরে, নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিবে না। মস্তিষ্ককে বিরাম দাও। সফল হয়ে ফিরে এসো….”

হ্যাঁ, নুহা সফল হয়েই ফিরে এসেছে।

বইয়ের সাথে পূর্বসংযোগ থাকায় নুহাকে পরীক্ষার দিনগুলোতে কোমর বেধে লাগতে হয়নি। অন্যান্য দিনের মতই স্বাভাবিক নিয়মেই নুহা ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে, খানেকক্ষণ কুরআন তেলওয়াত করেছে। অতঃপর পুরো বইয়ে একবার চোখ বুলিয়ে, সকলের থেকে দোয়া নিয়ে, আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে যেতো রুম থেকে। এভাবেই নুহা ওর পরীক্ষাগুলো দেয়।

দু’মাস পর রেজাল্ট দেয়া হয়। নুহা জি.পি.এ-০৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় এসএসসিতে। নুহার সাফল্যে সবাই খুব খুশি। শুভও খুশি। অফিসে বসে নেট থেকে রেজাল্ট জেনে নেয় সবার আগে। অতঃপর দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে মিষ্টির দোকানে চলে যায়। মিষ্টি শুভ আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। শুভ যাওয়ার পর মিষ্টি বিক্রেতা প্যাকগুলো শুধু গাড়ির মধ্যে উঠিয়ে দেয়। নুহার সাফল্য উপলক্ষ্যে পুরো মহল্লায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

মিষ্টি এবং হিয়া আন্টিকে সাথে করে নুহা দাদীমা এবং ছোট ভাইকে দেখতে যায়। ওখানে গিয়ে দেখতে পায় আরো বড় সড় উৎসব করে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে পুরো গ্রামে। নুহার ছোট ভাই নীলয় সেও এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। এটা তারই মিষ্টি। পরীক্ষার ব্যস্ততার জন্য অনেকগুলো মাস নুহা কিংবা নীলয় একে অপরের সাথে দেখা করতে পারে নি। মিষ্টি হাতে নুহাকে দেখতে পেয়ে কি যে খুশি হয় নীলয়, তা বলে বুঝানো যাবে না।

নীলয় ভিষণ মিষ্টি প্রিয়। প্রচুর মিষ্টি খায় ও। এই জন্য দাদীমার বকাও খায় অনেক। নুহাকে মিষ্টি হাতে দেখে হাত থেকে একটা কার্টুন নিয়ে নেয় সে। দেখতে দেখতে, চোখের পলকে কার্টুনের অর্ধেক মিষ্টি সাবাড় করে ফেলে নীলয়।
হেসে দেয় হিয়া। কাছে গিয়ে মুখটা মুছে দিয়ে প্রাণের বান্ধবী নীলিমার ছেলে নীলয়কে জড়িয়ে ধরে হিয়া। চুমু খায় কপালে।
হাসি মুখে নীলয় জানায়, আন্টি! আমি না পাস করেছি। ট্রিপল-4 পেয়েছি।
শব্দ করে হেসে দেয় নুহা। ট্রিপল-4? সেটা আবার কেমন রেজাল্টরে?
গর্বিত ভঙ্গিতে নীলয়ের জবাব, আরে তুই বুঝবি না। এটা আমার নতুন আবিষ্কার। ট্রিপল- 4 মানে 4.44………..
নুহা এবং হিয়া দু’জনেই হা, হা করে হেসে দেয়।

কলেজে ভর্তি উপলক্ষ্যে স্কুল থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র নিয়ে শুভদের বাসায় ফিরছিল নুহা। পথ আগলে দাঁড়ায় মামুন। থমকে যায় নুহার পথ চলা। ফিরে তাকায় মামুনের দিকে। বিনীত ভঙ্গিতে মামুন নুহার হাতে একটা খামবিহীন ভাঁজ করা চিঠি তুলে দেয়। নুহা চিঠিটা গ্রহন করলে মামুন দ্রুত সে স্থান প্রস্থান করে।

নুহা পড়ার টেবিলে বসে বসে হাদিস বইয়ের পাতা নাড়ছিল। পড়া আর হলো না। শুধু সময় অতিবাহিত হতে লাগল। নুহার মন পড়ায় নয়, ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে রাখা হাতের ঐ চিঠিটার দিকে আছে। মামুন কি লিখেছে তাতে, এটা দেখার জন্য ওর যত ব্যাকুলতা। কিন্তু পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে চিঠিটা খুলতেও পারছে না। সন্ধ্যার দিকে নুহা একা টেবিলে বসে ছিল। রুমেও কেউ ছিল না। নুহা ভাবলো এটাই সুযোগ। এই সুযোগকে হেলায় নষ্ট করতে নারাজ সে। আবারো নুহা চারিদিকটা ভালো করে পরখ করে নিল। না, কোথায় ও কেউ নেই। নুহা দ্রুত ওড়নার আড়াল থেকে হাতটা বের করলো। মেলে ধরলো চিঠিটা চোখের সামনে। নুহা মনোযোগ সহকারে পড়তে লাগল মামুনের না বলা কথাগুলোঃ-

নুহা,
প্রথমেই আমার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা গ্রহন করিও। তুমি যে খুব ভালো আছো তা তোমার চোখেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আমি ততটা ভালো নেই। যতটা ভালো থাকলে মন খুলে দুটি কথা বলা যায়। তোমার ঐ হৃদয়হরণকারী আঁখিদ্বয় আমার হৃদয়ে বার বার হানা দেয় তোমায় কিছু বলার জন্য। হয়ত তাই কাগজের বুকে কিছু না বলা কথা এঁকে দিলাম।

জানি আমার ভালো থাকা আর না থাকা নিয়ে তোমার কোন ভাবনা নেই। আর থাকবেই বা কেন? আমি তোমার কে? আর তুমিই বা আমার কে? হয়ত এই প্রশ্বদ্বয় তোমার মনের ঘরে কড়া নাড়তে পারে। কিন্তু তোমাকে ছাড়া যে আমার চলবে না। বল আমি এখন কি করব? কি করণীয় আমার?

একজোড়া চোখ দেখেই তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল। আর প্রতিনিয়ত দেখতে দেখতে একসময় নিজের অজান্তে মনের ঘরে তোমায় ঠাঁই দিয়ে ফেলি। তাই তোমার ভালোবাসা পাবার জন্যই আজ আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম।

বিশ্বাস করো নুহা, আমি তোমায় ভুলে যেতে চেয়েছি বার বার। দিবানিশি সারাক্ষণ চেষ্টা করেছি তোমায় ভুলে থাকতে। কিন্তু পারলাম না। তোমার কাছে ফিরে আসতেই হলো। এবার তুমিই বলে দাও-
কি করতে পারি আমি? এমন পরিস্থিতিতে কি করা যায়? নুহা, আমি তোমায় বলবো না যে, আমায় ভালোবাসতেই হবে। কারণ আমি জানি জোর করে ভালোবাসা হয় না। তবে শুধু এইটুকু জেনো, আমি তোমায় ভীষণ, ভীষণ ভালোবাসি। তাই বলছি, যদি পারো আমায় সামান্যতম ভালোবাসা দিও। তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমার অশান্ত মনকে শান্ত করে দিও।

ইতি,
মামুন।

চিঠি পড়ে মেজাজ পুরো গরম হয়ে গেছে নুহার। রাগ উঠে যায় নুহার। সেই মুহূর্তেই রুমে আসে আদনান। চিকন এবং টানা টানা স্বরে বলে উঠে,
“আম…..মু… কি ক……রো……”
ডাক শুনে কলিজা জড়িয়ে যায় নুহার। সমস্ত রাগ নিমিষেই পানি হয়ে যায়। নিজের কাছে টেনে নেয় আদনানকে। জড়িয়ে ধরে কপালে, গালে চুমু খায়।
অতঃপর চিঠির জবাবসরূপ কাগজের বুকে এঁকে দেয়-
” আমি বিবাহিতা, মামুন।”

পরদিন কলেজ থেকে ভর্তির কাজ সেরে ফিরছিল নুহা। আগের দিনের মতই পথ আগলে দাঁড়ায় মামুন। ভয় পেয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে নুহা। কারণ, এই মুহূর্তে নুহা ঐ বাসায় সামনেই দাঁড়িয়ে, যে বাসায় ও বিগত কয়েক বছর ধরে আছে।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। নুহার পথ আগলে দাঁড় করানো হয় শুভদের বাসার সামনেই। শুভর নিজস্ব বাসা এটা। শুভর বাবা নেই, মা নিজের সুখের জন্য অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছেন। মায়ের বিয়ের পর শুভ হয়ে গিয়েছিল একা। হিয়া তাই একমাত্র ভাইয়ার ছেলে শুভর সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে স্বামী সন্তান নিয়ে ভাইয়ার বাসায় উঠেছে। নুহও সেই বাসায়’ই থাকে।

ভয়ে যখন নুহার কলিজা শুকানোর উপক্রম, পাশ থেকে তখনই মামুনের তাড়াঃ-
” আমার চিঠির জবাব চাই….
ভালোবাসো কি না সেটা বলো?”

নুহা ব্যাগ থেকে চিরকুট’টা বের করে কাঁপা হাতে সেটা এগিয়ে দেয় মামুনের দিকে। যাতে লিখাঃ-
” আমি বিবাহিতা, মামুন।”

চিঠি পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় মামুন। যেন সে কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। বহুকষ্টে মামুন ফিরে তাকায় নুহার চোখের দিকে। মনে মনে বলেঃ-
” না। এ চোখ তো মিথ্যে বলছে না। তবে সত্যটাকে মেনে নিতে আমার কেন এত কষ্ট হচ্ছে? তবে কি আমার বুঝার ভুল হচ্ছে কোথায় ও? ও কি আমায় মিথ্যে বলছে? কিন্তু ও তো নামাজী এবং পর্দানশীন মেয়ে। আমায় কি ও মিথ্যে বলবে? যাক। জিজ্ঞেস করেই দেখি….”

মামুন ফিরে তাকায় নুহার দিকে।
” নুহা, তুমি কি আমার সাথে মজা করতেছ? তুমি তো নামাজ পড়ো। তুমি কিভা…”

পুরো কথা বলতে পারেনি মামুন। গেইটের ভেতরের বাগান থেকে দৌঁড়ে আসে আদনান। জাপটে ধরে নুহাকে। নাকের পানি, মুখের পানি নুহার বোরকায় মুছতে থাকে আর কান্না করতে থাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে-
” আম্মু, আব্বু আমায় মেরেছে।”

ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় মামুন।
“নুহা তোমার বা বা…..”
কোলে তুলে নেয় নুহা আদনানকে। আদনানের গালের সাথে গাল মিশিয়ে স্মিতহাস্যে বলে উঠে-
” জ্বি, আমার বাচ্চাও আছে…….”

চলবে…..

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ০৭

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

‘থ’ হয়ে যায় শুভ। চোখ দুটো গোল মার্বেলের ন্যায় হয়ে যায় ওর।

” ইঁদুর মারার যন্ত্রগুলো বিছানায় রাখা। আর তার পাশেই বসে ভিতর থেকে কলা বের করে চপচপ করে কলা খাচ্ছে নুহা…..”

খোলা জানালা দিয়ে ভিতর পানে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল শুভ। একে একে তিনটা মেশিন থেকেই কলা বের করে খেয়ে নিয়েছে নুহা। খাওয়া শেষে অত্যন্ত সংগোপনে নুহা ইঁদুর মারার যন্ত্রগুলো পূর্বের স্থানে রেখে দেয়। তারপর চুপ করে লাইটটা অফ করে ড্রিম লাইটের আলোয় আদনানের পাশে শুয়ে পরে। শুভও ভিষণ সাবধানে সে স্থান পরিত্যাগ করে।

সকালে স্টাডি রুমে পড়তে বসছিল নুহা। তখনি ড্রয়িংরুমে ডাক পড়ে ওর। ডাক দিয়েছে শুভ। ছুটে যায় নুহা। ইঁদুর মারার তিনটা যন্ত্র’ই সামনে নিয়ে বসে আছে শুভ। তার পাশে বসেছে হিয়া আন্টি।
বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নীচু করে নুহা গিয়ে দাঁড়ায় হিয়া আন্টির পাশেই।
প্রশ্ন করে শুভ, তিন তিনটে কলা দিয়ে আসছিলাম যন্ত্রের ভিতর। একটা যন্ত্রেও কলা অবশিষ্ট নেই। তো ইঁদুর কোথায় যন্ত্রের?
প্রশ্ন শুনে নুহার পুরো মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আসলে কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না ও।
পাশ থেকে শুভর তাড়া, তাড়াতাড়ি বলো। ইঁদুর কোথায়?
ঢোক গিলে নুহা। আঙ্গুল দিয়ে নিজের দিকেই নির্দেশ করে। চমকে যায় হিয়া। প্রশ্ন করে নুহাকে, নুহা! তোকে জিজ্ঞেস করছে ইঁদুরের কথা, তোর কথা নয়।
নিচের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় নুহার জবাব, আমি মিছে কথা বলি না আন্টি।
কিচ্ছু বলেনি শুভ। নুহাকে শুধু ভেতরে যেতে বলল। নুহা চলে গেলে শুভ ওর ফুপ্পির সাথে রাতের ঘটনাটা শেয়ার করল।
হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে হিয়ার। ‘Oh, my god!’ একি শুনালি তুই? এটাও শুনার ছিল?
হাসছিল শুভও। হাসি থামিয়ে জবাব দেয়, বড় ইঁদুর বিছানায়’ই বসে ছিল। আমি সেটা জানতাম না। উৎ পেতে ছিল কখন রাত্রি গভীর হবে।
হাত ইশারায় হিয়ার জবাব, আর বলিস না বাপ। আমি আর পারছি না…..

সকালে স্কুলে যাচ্ছিল নুহা, পথ আগলে দাঁড়ালো আদনান। “আমু যাম, আমু যাম, আমু যাম….”
শুভ, আঁখি, হিয়া কিংবা ওর হাজবেন্ড কেউ পারেনি আদনানকে শান্ত করতে। কান্নাজড়িত কন্ঠে ওর একটাই জবাব, “আমু যাম, আমু যাম….!”
বাধ্য নুহা কোলে তুলে নেয় আদনানকে। কোলে উঠে কান্না করতে করতেই নুহার বোরকার মুখোশ ধরে টানতে থাকে আদনান। নুহা একটা সেফ্টিপিন খুলে আদনানকে ওর মুখ দেখায়। মিটে যায় আদনানের কৌতূহল, থেমে যায় কান্না। পাশ থেকে সেফ্টিপিনটা যথা স্থানে লাগিয়ে দেয় আঁখি। আদনানকে কোলে নিয়ে নিচে যেতেই দেখতে পায় রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে। বিলম্ব না করে নুহা রিক্সায় গিয়ে বসে।

মিনিট দশেক পর কাঙ্খিত স্থানে গিয়ে পৌঁছে নুহা। কোল থেকে আদনানকে নামিয়ে রেখে ভাড়া মিটিয়ে আদনানের ছোট আঙুল ধরে স্কুলের গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
বাচ্চা কোলে নিয়ে কমন রুমের কর্ণারের একটা ছোট্ট বেঞ্চিতে বসে ছিল নুহা। আলাপ জমে উঠেছিল দুজনের মধ্যে। পাশে এসে দাঁড়ায় কিছু মেয়েরা। পরিচিত হয় নতুন ক্লাসমেট নুহার সাথে। দৃষ্টি যায় আদনানের দিকে। আদনানের নিষ্পাপ চাহনি আর আধো আধো বুলি বিমোহিত করল ওদের। কোলে নেয়ার টানাটানি করতে থাকে মেয়েরা। কেউ কেউ তো আদনানের মাংসালু গোল গাল দুটো ধরে টানতে থাকে।
” আমু মারে, বলে চিৎকার দিয়ে উঠে আদনান।”
চমকে যায় মেয়েরা। প্রশ্ন করে নুহাকে,
– নুহা তুমি বিবাহিতা?
সম্মতি সূচক জবাবসরূপ মাথা ঝাকায় নুহা।
” ওয়াও! আমরা খালামনি হয়ে গেছি। ওলে বাবাটা আসো…..”
আবারো মেয়েরা টানাটানি করতে থাকে আদনানকে নিয়ে।

এভাবেই নুহা নতুন স্কুলের নতুন সহপাঠীদের সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল। জুটিয়ে ফেলেছিল অনেকগুলো বান্ধবী।

নুহাদের ব্যাচে চল্লিশজন মেয়ে আর বিশজন ছেলে ছিল। বেশির ভাগ মেয়ে বোরকা পরত।

নবম শ্রেণীর ফার্স্ট বয় ছিল ‘মামুন’। একদিন মামুনকে ওর সহপাঠী মিনহাজ বলল, দোস্ত, ক্লাসে কয়েকজন সুন্দর মেয়ে আছে, লক্ষ্য করেছিস?
মামুন বলল, না।
পরদিন মিনহাজ মামুনকে তাদের দেখালো। তাদের মধ্যে একজনের চোখে মামুনের চোখ স্থির হয়ে গেল। পর্দা করার কারণে তার চেহারা দেখার উপায় ছিল না। চোখ দুটো ছিল অসাধারণ। সেই চোখ মামুনকে খুন করল। যেন নীরব ঘাতক। অনেকটা ইজিপটের রানি ক্লিওপাট্রার মতো। যার চাহনির কাছে হার মেনেছেন রোম সম্রাট সিজার ও পরে অ্যান্টনি। এমনকি অক্টোভিয়া যখন ক্লিওপাট্রার সঙ্গে কথা বলতেন তখন মেঝের দিকে চোখ রেখে কথা বলতেন। তার ধারণা ছিল, তিনি যদি ক্লিওপাট্রার চোখের দিকে তাকান, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে।

কিছুদিন যাওয়ার পর মামুনের মনে হলো সে যেন কিছু হারিয়ে ফেলেছে। হৃদয়ের প্রতিটি কোণে বোরকা পরা সেই মেয়েটির উপস্থিতি টের পাচ্ছিলো। মামুন বুঝলো, এরই নাম প্রেম। অনেক চেষ্টা করেও মামুন মেয়েটিকে তার ভালোবাসার কথা বুঝাতে পারেনি। চিঠি লিখে কাজিনের মাধ্যমে পাঠালো।
চিঠিতে লিখলোঃ-
“তোমাকে দেখার পর থেকে কিরকম পাল্টে গেল আমার আকাশ। সেখানে এখন শুধু চাঁদের বদলে তুমি উঠো, আর একটাই উঠে সন্ধ্যা তারা, সেও তুমি। বইগুলো খুলে দেখি সব গ্রন্থ জুড়ে শুধু এই একটাই শব্দ তাতে লেখা- তোমাকে দেখার পর অসম্ভব বদলে গেছে আমার ভুবন, বদলে গেছে জলবায়ু, দিন রাত্রি, ঋতু।”

চিঠিটা পৌঁছে দেয়া হলো নুহার হাতে। হ্যাঁ, নুহাই সেই মেয়ে, যার এক জোড়া চোখের কাছে হার মেনেছে একটি হৃদয়। চিঠি পড়ে নুহা খুব রাগ করল। মামুন ভয়ে ছিল, যদি প্রধান শিক্ষকের কাছে বলে দেয়। কিন্তু নুহা বলেনি। স্রস্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালো মামুন, প্রথমবারের মতো বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য।
ক্লাসে কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিল না মামুন।

কয়েকদিন পর আবার কবিতা লিখে পাঠালোঃ-
” রাগ করে একটি কথাও যদি বলো
ফেনিল সাগরে আমি ঝাপ দেবো,
ঘৃণা করে একটি কথাও যদি বলো
সহস্র ঘুমের বড়ি একসঙ্গে খাবো।
আমি শুধু ভালোবাসা চাই মেয়ে
অন্য কিছু নয়।”

অনেক আশা করেছিল মামুন, নুহা পজিটিভ উত্তর দেবে। কিন্তু নুহা কোনো উত্তর দিলো না। খুব কষ্ট পেলো মামুন স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেখে।
এক প্যাকেট সিগারেট কিনে তখনি সাবাড় করল।
নুহার ক্ষতির কোনো চেষ্টা করল না। কেননা সে শুনেছে, যাকে ভালোবাসা যায়, তার ক্ষতি করা যায় না। কারণ, প্রিয়ার দেয়া কষ্টগুলো প্রিয়ার মতোই প্রিয়।

সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। তাই পুরোদমে পড়াশুনা শুরু করলো মামুন। এমনও রাত গেছে, পড়তে পড়তে সকাল হয়ে যেত। একটুও ঘুমাতো না। যখন রাতে বিদ্যুৎ থাকতো না, তখন রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ত।

ডিসেম্বরের ৩১তারিখ রেজাল্ট বের হলো। চার নাম্বারের জন্য প্রথম হতে পারলো না মামুন। ১ম স্থান অধিকার করেছে নুহা।

দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। ঘনিয়ে আসে নুহার টেস্ট পরীক্ষার সময়। পূর্বেকার মতই বোরকা পরে, মুখ ঢেকে হলে উপস্থিত হয় নুহা। পরীক্ষা আরম্ভ হলো। স্কুলে নতুন যে শিক্ষকটি এসেছেন, ওনার গার্ড পরলো নুহাদের রুমে। খাতা সাক্ষরের সময় এডমিট কার্ডের সাথে নুহার মুখটা মিলিয়ে দেখতে চাইলে বাঁধ সাধে নুহা। ও কিছুতেই ওর এডমিট কার্ডের ছবি এবং ওর মুখ কোনো পর পুরুষকে দেখাতে রাজি নয়। রাগান্বিত শিক্ষক একসময় একটা জ্বালাময়ী মন্তব্য ছুড়ে দেয় নুহার দিকে। প্রশ্ন করে নুহাকে-
” তোমার ছবি কি তোমার জামাইরে দিয়ে উঠাইছো?”
স্তব্ধ হয়ে যায় নুহা। সেই সাথে নিস্তব্ধ হয়ে যায় পুরো রুম। সবার দৃষ্টি নুহার দিকে। নুহার চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। তবুও অনেকটা স্বাভাবিক কন্ঠে শিক্ষককে জানায়, স্যার! আপনি মেডামকে বলেন। আমি ওনাকে মুখ দেখাচ্ছি। রাগে খাতা ছুড়ে দিয়ে পিছনে চলে যায় শিক্ষকটা। পিছনে গিয়ে অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেডামকে জানায়, মেডাম, আপনি ঐ মেয়েটাকে একটু চেক করে আসুন।
মেডাম সামনে এসে দাঁড়ালে নুহা মেডামকে ওর কাছে ডেকে আনে। মুখটা আংশিক ফাঁক করে মেডাম বলে, “এই যে মেডাম! আমার এডমিট কার্ড আর আমি। মিলিয়ে দেখুন।”
স্মিতহাস্য মেডামের জবাব, ইটস ওকে। ঢাকতে পারো মুখ। কষ্ট পেয়ো না তুমি। আসলে এটা নিয়ম।
বিনীত ভঙ্গিতে নুহার জবাব, জ্বি, ম্যাডাম। বুঝতে পারছি আমি।

পাশ থেকে মামুনের জবাব, মেডামের ঐ স্যার কি হিন্দু? জিহ্বায় কামড় দেয় ম্যাডামটা। ধীর গলায় বলে, ‘আরে না! ওনি মুসলমান। ‘
দাঁতে দাঁত চেপে মামুনের জবাব, একজন মুসলমান হয়ে আরেকজন মুসলমানকে কিভাবে ওনি এমনভাবে আঘাত করতে পারলেন? মামুনের সাথে তাল মিলিয়ে অন্যান্য স্টুডেন্টসরাও একই কথা বলা শুরু করে।
কথা বাড়াননি মেডাম। কোনো মতে, দ্রুত সে স্থান পরিত্যাগ করেন।

(বিঃদ্রঃ- বাচ্চা মানুষ, বকা ঝকা দিও না বন্ধুরা। কেঁদে দেবো তাহলে। পরীক্ষা শেষ। পরের দুই পরীক্ষা একমাস পর হবে। তাই আশা করা যায়, আপনারা আপনাদের গল্প এখন থেকে নিয়মিত’ই পাবেন, ইনশআল্লাহ।)

চলবে….

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ০৬

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মোনাজাত শেষে নুহা কোরআন শরিফ নিয়ে। গুন গুন করে কুরআন তেলাওয়াত করা শুরু করে সে।পাশে বসা ছোট্ট আদনান মিনিট পাঁচেক চুপ করে ছিল। মুখ খুলে এবার। নুহার মতই গুন গুন করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে সে। সে আওয়াজ শুনে চোখ তোলে তাকায় নুহা। আদনানকে দেখেই স্মিতহাস্য নুহা পবিত্র কোরআন বন্ধ করে দেয়। কোরআন শরিফের গায়ে চুমু খেয়ে সেটা যথা স্থানে রেখে আদনানের গালেও একটা চুমু খায়। জায়নামাজটা যথা স্থানে রেখে কোলে তুলে নেয় আদনানকে। দরজার দিকে এগুতেই থমকে যায় সে। দরজার পর্দাটা আংশিক ফাঁক করে একজোড়া চোখ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চক্ষু দুইটা কার সেটা চিনে নিতে খুব বেশী কষ্ট পেতে হয়নি নুহার। আর তাই দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় সে।

প্রচন্ড ভয়ে নুহা যখন ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে, কিচ্ছু না বলে শুভ তখন সে স্থান ত্যাগ করে।

দুপুরে খাওয়ার পর সবকিছু গুছিয়ে রান্নার দাদীমা যখন চলে যায় তখনই আদনান মারফত শুভ নুহাকে ডাক পাঠায়। আদনান নুহার কাছে খবরটা এভাবে পৌঁছায় – “আমু (আম্মু) বাবাই যাইতা। আমু (আম্মু) বাবাই যাইতা।”
হেসে দেয় নুহা। বাবা! আমার নাম নুহা। আমাকে তুমি আন্টি ডাকবা।
‘ ই- তুমি আন্নি না। তুমি আমু(আম্মু)। তুমি আমু(আম্মু)। তুমি আমু(আম্মু)। তুমি আমু(আম্মু)
গম্ভীর গলায় নুহা জানায়, না বাবা! আমি তোমার আন্টি হই। আমাকে তুমি আন্টি ডাকবা। আন্টি। শুনোনি, তোমার বাবাই কাল কি বলেছে? বলেছে আমায় আন্টি ডাকার জন্য। আমায় আন্টি না ডাকলে ওনি বকবে তোমায়….!
‘ তুমি আন্নি না। তুমি আমু। তুমি আন্নি না, আমু।’

উফ্….. ব্যর্থ নুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আদনানের একটা হাত ধরে সে। ‘ ঠিক আছে, ডেকো।’
এবার চলো তো। দেখে আসি কে ডাকে?

রুম থেকে বের হতেই শুভর মুখোমুখি হয়।
দাঁড়িয়ে পড়ে নুহা। রাগান্বিত দৃষ্টিতে শুভ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ভয়ে ভয়ে নুহা শুভকে সালাম দেয়, আসসালামু আলাইকুম….
প্রতি উত্তরে শুভর জবাব ছিল, সমস্যা কোথায় তোমার? কি চাও তুমি?
কিছুটা অবাক হয় নুহা। উত্তরে জানায়, কই? আমার তো কোনো সমস্যা নেই…!
” ওহ, হ্যা! তাইতো… তোমার তো কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তো আমার। আর সেই সমস্যা সমাধানের জন্যই তোমার কাছে আসা।”

জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে নুহা ফিরে তাকায় শুভর দিকে।
অনেকটা আক্রোশের সাথে শুভর জবাব, অনুগ্রহ করে আদনানকে কোল থেকে নামাও। ওর ঘুমের সময় হয়েছে, আমি এখন ওকে ঘুম পাড়াবো।
নুহা আদনানকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। ছুঁ মারার ন্যায় তখনি শুভ আদনানকে কোলে তুলে সে স্থান ত্যাগ করে।

এক রাতের ঘটনা_
খাইয়ে দাইয়ে আদনানকে ঘুম পাড়িয়েছিল শুভ। মাঝ রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে যায় আদনানের। চিৎকার করে বিছানায় উঠে বসে। ঘুম ভেঙ্গে যায় শুভর। কোলে তুলে নেয় ছেলে আদনানকে। পুরো রুম জোড়ে ঘুরতে থাকে আর কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করে সে। কান্না থামার পরিবর্তে দ্বিগুন বেড়ে যায় আদনানের। কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় বসায় শুভ আদনানকে। বাজার থেকে কিনে আনা ডিম আর ফলমূল সামনে রাখে। এতেও কান্না থামানো যাচ্ছে না। কান্নার শব্দ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। পাশের রুম থেকে ছুটে আসে শুভর ফুপ্পি হিয়া। কোলে তুলে নেন ভাই পুত্রের ঘরের নাতি আদনানকে। জিজ্ঞেস করেন, ভাইয়া কি হয়েছে? কান্নায় নাক মুখের পানি একত্রিত হয়ে গেছে আদনানের। সেই অবস্থায়’ই বলতে থাকে সে, নু আমু যাম(নুহা আম্মুর কাছে যাব), নু আমু যাম, নু আমু যাম….
ছোট্ট আদনানের কথার আগা-গোড়া কিচ্ছু বুঝেনি হিয়া। ফিরে তাকায় শুভর দিকে।
শুভ পাল্টা প্রশ্ন করে ফুপ্পিকে, এটা কি কোন জায়গার নাম নাকি?
হেসে দেয় হিয়া। যা শুনাইলি না..! আঁখিকে ডাক।

ঘুম ঘুম চোখে আঁখি আসে। কোলে নেয় আদনানকে।
নাহ..! সেও পারছে না আদনানকে শান্ত করতে। শুভর কোলে দিয়ে ঢুলতে ঢুলতে রুমে চলে যায় আঁখি। যাওয়ার আগে বলে যায়- ভাইয়া, নু আমু আবার কোন দেশী খাবারের নাম? জীবনেও যা শুনিনি, সেই নাম গুলোই তোমার ছেলের মুখ থেকে শুনতেছি….

প্রচন্ড রাগে শুভ ছেলেকে বিছানায় ফেলে দেয়। বিছানায় পরে কান্নার মাত্রাটা আরো বেড়ে যায় আদনানের। পড়াশুনা+ডায়েরীতে লিখালিখি করে সদ্য ঘুমিয়েছিল নুহা। কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। ছুটে আসে শুভর রুমে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কান্না করতেছে আদনান। তার পাশে শুভ এবং ওর ফুপ্পি বসা। কোনো কথা বার্তা ছাড়া’ই নুহা কোলে তুলে দেয় আদনানকে।
” কি হয়েছে বাবা…? কে মেরেছে তোমায়…?”

শান্ত হয়ে যায় আদনান। নুহা পিঠে হাত বুলাচ্ছে আর রুমের মধ্যে হাটাহাটি করছে। আদনান নুহার কাঁধে নাকের পানি, মুখের লালা ছেড়ে দিয়েছে। সেই মুহূর্তে কান্নাটা নেই ওর কিন্তু ফুপাচ্ছে।

নুহা আদনানকে খাটে বসায়। তারপর পরনের ওড়না দিয়েই আদনানের নাক মুখ ভালো করে পরিষ্কার করে দেয়। পাশে রাখা ডিমটা হাতে নেয়। খোসা ছাড়িয়ে সেটা আদনানের হাতে তুলে দেয়। আদনান কামড়ে কামড়ে ডিম খেতে থাকে। খাওয়া শেষে নুহার দিকে ফিরে তাকায়। বলতে থাকে-
‘আমু কোলো, আমু কোলো।
আবারো কোলে তুলে নেয় নুহা আদনানকে। কাঁধে মাথাটা শুইয়ে দিয়ে পিঠে হাত বুলাতে থাকে। ঘুমিয়ে পরে আদনান। শুইয়ে দিয়ে নিজ রুমে চলে যায় নুহা।

ফুফু-ভাই পুত্র দু’জনেই অবাক দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানে ওরা কিছুতেই কান্না থামাতে পারেনি, সেখানে এতটুকু পুচকে মেয়ে কি না খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়েও চলে গেল। ভাবা যায়…!

সেদিনও রাত্রি আড়াইটা নাগাদ একই ভঙ্গিতে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে আদনান। সেদিনও কান্নার শব্দে নুহা ছুটে আসে, কান্না থামায়, ঘুম পাড়ায়। বিছানায় শুয়ানোর সময় সাথে সাথে কান্না করে উঠে। সজাগ হয়ে যায়। চোখ মেলে তাকায়। জাপটে ধরে নুহাকে। আদো আদো বুলিতে বারংবার বলতে থাকে, আমু তোমা থাকু(আম্মু তোমার সাথে থাকব), আমু তোমা থাকু, আমু তোমা থাকু।
পাশ থেকে হিয়ার স্বামীর জবাব, যাও আদিরা! আদনানকে আজকে তোমার রুমেই থাকতে দাও।
এমনিতে ও তোমার ভক্ত। রাত্রে খাইয়ে দাইয়ে তোমার রুমে ঘুম পাড়ালে মাঝ রাত্রে আর সকলকে এভাবে হয়রানি হতে হয় না।
বাবার সাথে তাল মিলিয়ে মেয়ের জবাব-
হ্যা, বাবা! আমিও সেটাই বলছিলাম। নুহা তুমি বরং ওকে সাথে নিয়েই ঘুমিও।
ভয়ে ভয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে নুহা।
‘ আচ্ছা, আমি তবে এখন ওকে রুমে নিয়ে যাই….’

কিচ্ছু বলেনি শুভ। সবাই চলে গেলে নুহার রুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। নুহা একটা বাচ্চা ইঁদুরকে সুতায় বেধে টানছে আর বাচ্চাদের মতো দৌঁড়াচ্ছে। তার পিছু পিছু দু’হাতে তালি দিয়ে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে আদনান।

দুঃখের মাঝেও হেসে দেয় শুভ। দ্রুত রুমে চলে যায়। ফিরে আসে তিনটা ইঁদুর মারার যন্ত্র আর তিনটা পাকা কলা হাতে করে। রুমে এনে তিনটা যন্ত্রের ভিতরই কায়দা করে তিনটা কলা গেঁথে দেয়। ইঁদুর যখনই কলা যাওয়ার জন্য ভিতরে ঢুকবে তখনি মরন ফাঁদে আটকা পরবে। রুমে ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে গেছে। সেই জন্যই মূলত এই ব্যবস্থা। যন্ত্র তিনটা সাবধানে তিন স্থানে রেখে রুম ত্যাগ করে শুভ।

রাত্রি শেষের দিকে ওয়াশরুমে গিয়েছিল শুভ। নুহার রুমের সামনে দিয়েই ফিরে আসছিল। আসার সময় কিছু একটার আওয়াজ শুনতে পায় সে। কি চলছে ভিতরে সেটা দেখার জন্য উঁকি দেয় খোলা জানালা দিয়ে। ‘থ’ হয়ে যায় শুভ। চোখ দুটো গোল মার্বেলের মত হয়ে যায় ওর।

” ইঁদুর মারার যন্ত্রগুলো বিছানায় রাখা। আর তার পাশেই বসে ভিতর থেকে কলা বের করে কুটকুট করে নুহা কলা খাচ্ছে…..’

চলবে….

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ০৫

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ছোট্ট আদনানকে কোলে নিয়ে স্বয়ং নুহা দাঁড়িয়ে। সেই নুহা যার সাথে শুভর পিকনিকে দেখা হয়েছিল।
চমকিত নয়নে শুভ তাকিয়ে আছে নুহার মুখপানে। আদনানকে বুকে চেপে ধরে নুহাও পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে শুভর মুখপানে।
নিরবতা। ঘোর নিরবতা বিরাজ করছে। কারো মুখেই কোন কথা নেই। অথচ দুজনের মনেই ভিড় করে আছে অব্যক্ত সব কথারা।

ঘটনার আকস্মিকতায় রুমে প্রবেশ করে নীলিমার বান্ধবী ডাঃ হিয়া।
ওহ, তুই এখানে? আমি তো তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি।
ঘোর কাটে নুহার। দৃষ্টি নিয়ে যায় দরজার দিকে। পিছু ফিরে তাকায় শুভও।
‘একি! তুই গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেন? যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি তো এসেই গেছি। আজ না হয় আমিই আদনানকে খাওয়াবো। আদিরা যা তুইও ফ্রেশ হয়ে আয়।’
চমকিত নয়নে শুভ ফিরে তাকায় ফুপ্পির পানে। কিছুটা টান টান কন্ঠে প্রশ্ন করে, আ…দিরা???
ক্ষাণিক হাসে হিয়া। ওহ, তোকে তো পরিচয় করানোই হয়নি। এ আমার একমাত্র বান্ধবী ডাক্তার নীলিমার মেয়ে আদিরা। যার আসার কথা কালকে রাত্রে তোদের বলেছিলাম।
বিস্ময়টা কাটেনি। তবুও স্বাভাবিক ভাবে শুভ ওর একটা হাত নুহার দিকে বাড়িয়ে দেয়। Hlw! I am Shuvo. Nice too meet you.
আদনানের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে নুহার জবাব, আসসালামু আলাইকুম। আমি আদিরা মাহমুদ নুহা।
হাতটা ফিরিয়ে নেয় শুভ। অতঃপর সালামের জবাব দিয়ে ফের ওয়াশরুমের দিকে প্রস্থান করে।

নুহার দিকে এগিয়ে আসে হিয়া। দে, আদনানকে আমার কোলে দে। ওকে খাইয়ে দেই তাড়াতাড়ি। ততক্ষণে তুই ফ্রেশ হয়ে নে। তোদের খাইয়ে দিয়ে আমার আবার চেম্বারের দিকে যেতে হবে।
আদনানকে হিয়ার কোলে দিয়ে নুহা চলে যায়।
মিনিট দশেক পর ফিরে আসে নুহা। বিছানায় বসিয়ে আহ্লাদী স্বরে কথা বলতে বলতে হিয়া আদনানের মুখে খাবার তুলে দেয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।
বৃথা চেষ্টা বললাম কারণ এখন অবধি হিয়া পারেনি আদনানের মুখে খাবারের এতটুকু অংশ তুলে দিতে। পাশে এসে বসে নুহা। প্রশ্ন করে হিয়াকে, আন্টি বাবুর মা কোথায়?
নুহার দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় হিয়া। আদনানকে খাওয়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলে, যা বলছিস তো বলছিস’ই! সাবধান এ কথা যেন শুভর সামনে না বলা হয়।
চোখ বড় বড় করে হিয়ার মুখপানে তাকায় নুহা। প্রশ্ন করে আবারো, কেন আন্টি? বললে কি হবে?
আশপাশটা একবার ভালো ভাবে দেখে চাপা গলায় হিয়ার জবাব, আদিরা! আস্তে। তোকে বলেছিলাম না আমার এক ভাইপুর কথা। যার বউ ২মাসের ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে ব্যাংক ম্যানেজারের সাথে পালিয়ে গেছে? এ সেই বাচ্চা। ওর এখনকার বয়স ১বছর ৬মাস।
মায়াবী চাহনীতে নুহা আদনানকে দেখছে। তারপর অনেকটা ভেঁজা গলায় বলে উঠে, আহারে! এমন দুধের শিশুদের রেখে মানুষ কিভাবে এসব করতে পারে? এদেরকে কি দিয়ে গড়েছে আল্লাহ? এমন একটা বাচ্চাকে রেখে চলে যাওয়ার সময় একটুও বুক কাঁপেনি ঐ মহিলার? আচ্ছা, আন্টি আপনার ভাইপু আশিক কোথায়? আসার পর থেকে দাদীমা আর শুভ ভাইকে ছাড়া তো আর কাউকে দেখলাম না।
প্রশ্নোত্তরে হিয়ার জবাব, শুভ’ই আশিক। আশিক আহমেদ শুভ।
স্তব্ধ হয়ে যায় নুহা। চমকিত নয়নে ফিরে তাকায় খাটে বসে থাকা আদনানের মুখপানে। প্রশ্ন করে হিয়াকে, মামমমমমমানে? আদনানের বাবা শুভ?
নির্লিপ্ত গলায় হিয়ার জবাব, হ্যা! আশিকের(শুভ) ছেলে আদনান।

বসা থেকে উঠে পড়ে নুহা। নিঃশব্দে প্রস্থান করে রুম থেকে।

দুপুরে টেবিলে খেতে বসেছিল শুভ। রুমে ঢুকে আঁখি। কাঁধ থেকে কলেজ ব্যাগটা খুলে ছুঁড়ে মারে ড্রয়িংরুমের সোফায়। প্রশ্ন করে শুভকে, ভাইয়া! আমাদের বাসায় আজ না নতুন অতিথি আসবে?
শুভ ফিরে তাকায় ফুপাতো বোন আঁখির দিকে। ভ্রু- কুচকে প্রশ্ন করে, তো?!
রেগে যায় আঁখি। তো মানে? কি বলেছিলাম রাত্রে? নতুন অতিথি আসলে সবাই মিলে একসাথে লাঞ্চ করব। তুমি আগে আগে খেয়ে উঠছ যে?
পানি খেয়ে গ্লাসটা যথা স্থানে রেখে শুভর জবাব, এসেছে। নতুন অতিথি এসে গেছে। কিন্তু অতিথি এখন খাবে না জানালো। আমাকে খাবার দিয়ে ফুপ্পিও তাই চলে গেছে চেম্বারে। যা। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে।
ওহ, আচ্ছা বলে মন খারাপ করে রুমে চলে যায় আঁখি।

রাত্রের খাবারের পর চুপিচুপি শুভ নুহার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। নক করে দরজায়। দরজা খুলে আঁখি। ঘাবড়ে যায় শুভ।
“কি, কিছু বলবা?”
ইতস্তত শুভ ঘুরে দাঁড়ায়। ইয়ে, না মানে আদনানকে পাচ্ছি না তো। তাই দেখতে এলাম তুই এনেছিস কি না…..!
চলে যাচ্ছিল শুভ, পিছন থেকে আঁখির জবাব- ভাইয়া! আদনান মনে হয় ছাদে নুহার সাথে গল্প করছে।

শুভ নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে ছাদে গিয়ে হাজির হয়। দেখতে পায় নুহাকে। নুহা ওর গায়ের ওড়না দ্বারা আদনানের পুরো শরীর ঢেকে ছাদের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হাঁটাহাঁটি করছে। হালকা ঝাকুনির সাথে আদনানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ছড়া বলছে। ছড়া শুনতে শুনতেই একসময় ঘুমিয়ে যায় আদনান।
“ঢাকা শহরে প্রচন্ড শীত পরেছে। শীতে রীতিমত জমে যাচ্ছে মানুষজন। কারো কারো তো ঠান্ডায় গলা জমেও গেছে। আর তুমি কি না সেই শীতের মধ্যে এ ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে এখানে হাঁটাহাঁটি করছ?”

থমকে দাঁড়ায় নুহা। ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। ‘ইয়ে! আমার তো একটুও শীত করছে না।’
কিছুটা ধমকের স্বরে শুভর জবাব, কোথায় তুমি আর কোথায় ও? কিসের সাথে কিসের তুলনা দিচ্ছ? দাও। ওকে আমার কোলে দাও।
ভয়ে ভয়ে নুহা আদনানকে শুভর কোলে তোলে দেয়।
কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠে শুভর প্রশ্ন, কি হলো? ওড়নাও কি দিয়ে দিবে নাকি?
ওড়নাটা টেনে এনে, গায়ে জড়িয়ে নেয় নুহা। অতঃপর মাথা নিচু করে ছাদ থেকে নেমে যায়।

সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা_
শুভ আপ্রাণ চেষ্টা করছে আদনানকে খাওয়ানোর জন্য কিন্তু পারছে না। যতবার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে ততবার আদনান মুখ থেকে খাবার বের করে ফেলে দিচ্ছে। রেগে যায় শুভ। ধমক দেয় আদনানকে। ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদতে থাকে আদনান।
ছুটে আসে আঁখি। কোলে তুলে নেয় আদনানকে। ভাইয়া মারছ কেন?

– মারছি না, ধমক দিয়েছি।
— সেটাই বা দিবা কেন?
– কখন থেকে বলছি খা, খা! খাচ্ছে না। যা মুখে দিচ্ছি, ফেলে দিচ্ছে সব। এদিকে আমার আবার একটা কোম্পানিতে চাকরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য যেতে হবে।

— মানে? কোম্পানিতে জব মানে? তুমি না কলেজে জব করতা?
– করতাম। তবে সেটা গেস্ট টিচার হিসেবে।
— ওহ, আচ্ছা! তুমি যাও তাহলে। তোমার তো মনে হয় লেট হয়ে যাচ্ছে।
– কিন্তু ও যে খাচ্ছে না। ওকে না খাইয়ে আমি যাই কি করে? দে, আরেকবার ট্রাই করে দেখি।

শুভ আঁখির কোল থেকে আদনানকে নিয়ে ছোট্ট চেয়ারে বসায়। তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে খাবার মুখের সামনে নিয়ে অত্যন্ত আদুরে গলায় বলে- আমার লক্ষ্মী বাবা, আমার সোনা বাবা। খাও। খেলেই তোমায় আমি ফোনে গান দেখাবো।
আরো জোরে জোরে কেঁদে দেয় আদনান। পূর্বের ন্যায় লালার সাথে মুখ থেকে খাবারগুলো বের হয়ে দেয়।
অধৈর্য্য হয়ে যায় আঁখিও। ভাইয়া! এ তো আজকে গানের কথা শুনেও শান্ত হচ্ছে না। এদিকে আম্মুর হাতেও খায়নি। কি চাচ্ছেটা কি তোমার ছেলে?

দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় নুহা। নুহাকে দেখে কান্না থামিয়ে দেয় আদনান। চেয়ার থেকে নেমে পিলপিল করে হেঁটে আদনান পৌঁছে যায় নুহার কাছে। আমু টাত খাম, আমু টাত খাম বলে নুহার আঙ্গুল ধরে টানতে থাকে আদনান।
টানতে টানতে চেয়ারের কাছে নিয়ে যায়। তারপর নিজে নিজেই চেয়ারে উঠে বসে। নুহা দাঁড়িয়ে আছে চেয়ারের পাশেই।
ছোট্ট আদনান ফিরে তাকায় নুহার মুখপানে। আদো আদো বুলিতে আবারো বলতে থাকে, আমু টাত খাম। আমু টাত খাম।
বিলম্ব না করে হাতটা ধুয়ে ভাত মেখে নুহা বসে পরে আদনানের চেয়ারের পাশে। এগিয়ে দেয় ভাত আদনানের মুখের দিকে। পরম তৃপ্তি সহকারে আদনান প্লেটের সবগুলো ভাত খেয়ে নেয়। হাত মুখ ধুতে যাবে তখনি আদো আদো বুলিতে আবারো বলে উঠে, টাত খাম। আমু টাত খাম।
নুহা অল্প কিছু ভাত নিয়ে মাছ দিয়ে মেখে এগিয়ে দেয় আদনানের দিকে। এবার আদনান কোন কথা ছাড়া’য় নিজ হাতে ভাতগুলো খেয়ে নেয়।
শুভ এবং আঁখি ২ভাই বোন এ হেন ঘটনায় একে অপরের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

নুহা…. মেয়েটাই এরকম। অতি সহজে মানুষকে নিজের মায়ায় ফেলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। অদ্ভুত সে মায়া। যে মায়া থেকে বেরিয়ে আসার সাধ্য কারো নেই। ছোট্ট আদনানেরও তাই হয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে আদনান নুহা ভক্ত হয়ে যায়। জড়িয়ে যায় নুহার মায়ায়। আজকাল শুভ নয় নুহার সাথেই সময়
কাটাতে পছন্দ করে আদনান। বিষয়টা শুভকে ভাবিয়ে তুলে। সেদিন আর বাহিরে কোথাও যায়নি শুভ। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ো দিয়ে বসে আছে শুভ। নিশ্চুপ শুভ ভাবছে গত হয়ে যাওয়ার দিনগুলোর কথা। ফারহানা চলে যাওয়ার পর ভেঙ্গে পড়েছিল একদম। দীর্ঘ ছ’মাস লেগেছে নিজেকে গুছাতে। নিজের স্বপ্নগুলোকে নতুন করে সাজাতে।
হ্যা, নতুন স্বপ্ন। শুভ চেয়েছিল একমাত্র ছেলে আদনানকে বুকে জড়িয়ে বাকি সময়টা কাটিয়ে দিতে। শুভ চেয়েছিল একজন আদর্শ বাবা হতে।
আজ কেন জানি মনে হচ্ছে ওর স্বপ্নগুলো একটু একটু করে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরকম মনে হওয়ার কোন যুক্তিসংগত কারণ শুভ খুঁজে পাচ্ছে না।

এক দুপুরবেলার ঘটনা বলছি_
শুভ খাবার টেবিলে খেতে বসেছিল আদনানকে নিয়ে। কিন্তু কিছুতেই শুভ আদনানকে খাওয়াতে পারছে না। ওর এক কথা। ও নুহার সাথে খাবে। না হয় কিছুতেই খাবে না। রাগে একটা থাপ্পর মারে শুভ আদনানকে। ভ্যাঁ, ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে আদনান নুহার রুমের দিকে চলে যায়।

আদনান চলে যাওয়ার পর ভাতের প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে শুভ রুমে চলে যায়। রুমে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে শুভ। ‘নুহা, নুহা, নুহা। খাইতে, বসতে, ঘুমুতে সব জায়গায় ও। কি পেয়েছেটা কি ঐ মেয়ে? কি চায় ও? কেন আমার ছেলেকে এভাবে দখলে নিয়ে যাচ্ছে? না, আর বসে থাকলে চলবে না। আমার জানতে হবে।’

শুভ নুহার রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজা ধাক্কা দিতেই মেলে যায়। উত্তেজিত শুভ কিছু একটা বলতে যাবে তখনি ‘থ’ হয়ে যায়। ফ্লোরে জায়নামাজে বসে নুহা যোহরের নামাজ শেষে মোনাজাত করছে। আর ঠিক সেরকমভাবেই ২বছরের ছোট্ট আদনান জায়নামাজের সামনে বসে মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত দুটো উঁচু করে রেখেছে।

চলবে….

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ০৪

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

পরদিন ভোরের ট্রেনে শুভ নুহাকে নিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। দুপুর নাগাদ নরসিংদী এসে পৌঁছে ওরা। নরসিংদী থেকে রুহুলের ফ্রেন্ডকে সাথে করে নিয়ে শুভ রওয়ানা দেয় গাজীপুরের উদ্দেশ্যে। যেহেতু শুভ ছোট্ট নুহাকে ভরসা করতে পারছিল না। পথিমধ্যে শুভ নুহাকে প্রশ্ন করে —
‘ আচ্ছা, তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’
জবাব আসে, গাজীপুরের শ্রীপুর।
তুমি কি জানো গাজীপুরের একজন কীর্তি সন্তান ছিল? যিনি তার কর্মগুনে আজো স্মরনীয় হয়ে আছেন?
শুভর এমন প্রশ্নে নুহার জটপট জবাব ছিল, তাজউদ্দীন আহমেদ।
আচ্ছা, শ্রীপুর অর্থ কি জানো?
এবারো নির্লিপ্ত কন্ঠে নুহার জবাব, এককভাবে শ্রীপুরের কোন অর্থ আমার জানা নেই। তবে আমার মতানুসারে যদি বলি তাহলে বলবো শ্রী অর্থ সুন্দর আর পুর অর্থ পরিপূর্ণ। অর্থাৎ শ্রীপুর অর্থ সুন্দরে পরিপূর্ণ।
এমন তাৎক্ষণিক জবাবে মুগ্ধ শুভ তাকিয়ে আছে নুহার দিকে। ভাবা যায় এরকম একটা পিচ্চি মেয়ে একাধারে এতগুলো গুনের অধিকারি? ঘোর লেগে যায় শুভর। এক মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই সে জড়িয়ে যাচ্ছে আরো মুগ্ধতার আবেশে। মুগ্ধতার এ রেশ কবে, কখন কাটবে সেটা শুভ নিজেও জানে না।

যায় হোক। যে কথাটি বলছিলাম। বিকেল ৩টা নাগাদ শুভ নুহাদের গ্রামে পৌঁছে। বাসার পাশে এসে নুহাকে নামিয়ে দেয়া হয়। তারপর গাড়ি উল্টো দিকে মোড় নেয়। যদিও শুভর ইচ্ছে ছিল নুহাকে বাসায় অবধি পৌঁছে দিয়ে আসা। কিন্তু রুহুলের বন্ধু আতিকের জন্য সামনে আগাতে আর সাহস পায়নি শুভ। আতিকের ভাষ্যমতে,
‘ শুভ ভাই আর সামনে যাবেন না। শুনেছি এ এলাকার মানুষ ভালো না। অনর্থক ফাসিয়ে দিবে আপনাকে। তাই সেধে সেধে এভাবে বিপদ ডেকে আনার কোন মানেই হয় না। চলুন। যাওয়া যাক।’
আতিকের কথা শুনে আর সামনে এগিয়ে যায়নি শুভ। কোন কথা না বাড়িয়ে আতিকের গাড়িতে গিয়ে বসে। গাড়ি স্টার্ট দেয় আতিক। স্তব্ধ নুহা রাস্তার পাশে তেতুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু একটু করে চোখের আড়াল হয়ে যায় গাড়িটি। বুকের ভেতর ধুরমুশ পেটাতে শুরু করে নুহার। সাহস পাচ্ছে না বাসার দিকে এগুনোর। কোন মুখে এগুবে আর কিবা বলবে সেটা ভেবেই কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে নুহার।

এদিকে কেউ একজন নুহাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাসায় গিয়ে খবর দেয়। খবর পেয়ে ছুটে আসে নুহার আশপড়শি চাচি জ্যাঠিমাসহ আপন দাদীমা। ছুটে আসে একমাত্র প্রাণের ভাই নিলয়। নুহার দাদীর চিল্লানো শুনে ছুটে আসে পাড়া প্রতিবেশী।

নুহার দাদীর একটাই প্রশ্ন ছিল। আর সেটা হলো – “সম্মান সব ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়ে এখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছিস কোন মুখে?” এছাড়াও নুহাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে পাড়া প্রতিবেশীদের অপ্রিয় কিছু প্রশ্নের। বুকে সাহস সঞ্চয় করে ভিষণ ধৈর্য্য সহকারে নুহা তুলে ধরে গত ২দিনে ওর সাথে ঘটে যাওয়া নানা অপ্রীতিকর ঘটনার কথা। তুলে ধরেনি শুধু বিয়ের কথাটা। পুরো ২দিনের ঘটনার মধ্যে একই রুমে রাত্রি যাপন আর বিয়ের কথাটা নুহা গোপন রাখে সবার থেকে। তারপরও নুহাকে শুনতে হয়েছে ভিষন অপ্রিয় কিছু কথা। যে কথা গুলো শুনে নুহা রাগে ফেটে পরছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে মাটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে। আল্লাহ, আল্লাহ করতে করতে সে স্থান ত্যাগ করে বাসায় চলে যায় নুহা।

মাগরিবের নামাজ পড়ে অনেকটা অপরাধীর ন্যায় মাথানিচু করে চুপচাপ রুমে বসেছিল নুহা। তখনি ভিতরে ঢুকে ২জন পড়শি। খুটিয়ে খুটিয়ে নুহার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বাকা দৃষ্টিতে দেখে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে। নুহা মহিলা দুজনের সবগুলো প্রশ্ন পরম ধৈর্য্য সহকারে দেয়। নুহার সুন্দর গুছানো জবাবে ওরা সন্তুষ্ট নয়। আর তাই কথার প্যাঁচে ফেলার জন্য বিভিন্ন এঙ্গেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে বাচ্চা মেয়েটাকে। ছোট্ট নুহা সুন্দর গুছানো জবাব দ্বারা প্রতিবারই পরম ধৈর্য্যের পরিচয় দেয়। সবশেষে ব্যর্থ হয়ে কানাঘুষা করতে করতে মহিলা দুটো চলে যায়।

পরদিন স্কুলে গেলে নুহাকে সম্মুখীন হতে হয় শিক্ষকদের নানান প্রশ্নের। মুখোমুখী হতে হয় ক্লাসমেটসহ বড় আপুদের টিপ্পনীমূলক বাক্যের। সেই সাথে হতে হয় সবার উপহাসের পাত্রী। দুর থেকে বান্ধবীরা ওকে দেখে হাসাহাসি করত। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর ঢলে পড়ত। ওকে নিয়ে কানাঘুষা করত। নুহা সেসব দেখেও না দেখার ভান করত। তবে ভিতরে ভিতরে ও খুব কষ্ট পেতো। কারণ ওর সকল বন্ধুরা একটু একটু করে ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। কাছের যে তিনজন বান্ধবী ছিল তাদের মধ্যে ২জনই নুহাকে নিয়ে খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে টাইপের মন্তব্য করেছে। খুব কাছের মানুষের দেয়া আঘাত সহ্য করার মত ক্ষমতা কারো নেই। নুহাও পারেনি। একটু একটু করে ও সকলের থেকে আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে গেছে বললে ভুল হবে ওকে আলাদা করে দেয়া হয়। মুখে না বললেও ওর ক্লাসমেটরা ওকে ইশারাতে বুঝিয়ে দিত, যে মেয়ে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টানা তিনদিন দু’রাত বাহির দেশে পরপুরুষের সাথে কাটাতে পারে সে আর যায় হোক আমাদের ফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্য নয়। নুহাও ওদের ইশারা বুঝে গিয়েছিল। আর তাইতো স্কুলে গেলেও কারো সাথে তেমন মিশত না। সবসময় ক্লাসমেটদের থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে চুপটি করে বসে থাকত। মন খারাপের অনেকগুলো টিফিনের মুহূর্ত নুহা কাটিয়েছে কমনরুমের কর্নারের জানালার পাশের বেঞ্চটিতে বসে বাহির পানে তাকিয়ে।

নুহার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী একমাত্র শুভাকাঙ্খী জান্নাত জানিয়েছে, “আমি আমার বান্ধবীকে একবছরের মধ্যে হাতে গুনা তিন চার দিন ছাড়া বাকি সময়গুলো আনমনে জানালার পাশে বসে ডায়েরী লিখে সময় কাটাতে দেখেছি। হাসিখুশি প্রাণ চঞ্চল মেয়ে যার কাজই ছিল ছোট বড় সবাইকে পাঁকা পাঁকা কথা দ্বারা উপদেশ দেয়া। যে সবসময় চারপাশটা মাতিয়ে রাখত। মানুষের মন মুহূর্তেই ভালো করে দেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে যে মেয়েটি জন্মেছিল। যাকে স্কুলে অনেকেই মন খারাপের ঔষধ বলে ডাকত। যার কাজই ছিল হাসাহাসি করা। নিজে হাসবে সেই সাথে অন্যকে হাসাবে। সেই মেয়েটাকে আমি দেখেছি। আমি দেখেছি সেই মেয়েটা কিভাবে একটু একটু করে বিষণ্নতাকে বরণ করে নিয়েছে। নুহার ঠোঁটের কোণের হাসিটা একেবারে ম্লান হয়ে যেতে দেখেও আমি চুপ করে ছিলাম। কিন্তু যেদিন আমাদের জেসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল সেদিন আমি স্কুল থেকে ওদের বাসার পিছন দিয়ে যাচ্ছিলাম। নুহা পুরো গাজীপুরের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। সেটা নুহাকে জানানোর জন্য আমি ওদের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। নাম ধরে ডাক দেবো তখনি শুনতে পেলাম ওর আপন দাদী ওকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেছে। আর নুহা সেটা সইতে না পেরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সেদিনই মনে হলো সময় হয়েছে এবার ওর জন্য কিছু করার। আর সেই মতেই আমি নুহার ছোট ভাই নীলয়ের থেকে আবির আঙ্কেলের নাম্বারটা যোগার করি।”

হু, যা শুনতেছিলেন। জান্নাত উপস্থিত বুদ্ধির জোরে আবিরের নাম্বারটা সংগ্রহ করে ঐ নাম্বারে একটা মিসড কল দেয়। সেদিন বিকেলেই আবির কল করে। ইতস্তত জান্নাত প্রথমেই সুন্দর করে নিজের পরিচয় দেয়। অতঃপর সকল প্রকার লজ্জা ভয়কে দুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বুকে সাহস সঞ্চয় করে। নির্লিপ্ত কন্ঠে আবিরকে জানায় নুহার সাথে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার কথা। আরো জানায় বিগত একটা বছর নুহা কিরকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে।

একমাত্র মেয়ের কাছের বান্ধবী জান্নাতের থেকে এমন ধরনের অপ্রিয় সব কথা শুনে আবির যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে আবির ওর বিশস্ত এক বন্ধুকে ওর এলাকায় ডেকে পাঠায়। আবিরের কথামত ওর ঐ বন্ধুটি শ্রীপুর আসে। বিয়ের জন্য পাত্রী হিসেবে নুহা মেয়েটা কিরকম এটা আবিরের বন্ধু আশপড়শি মহিলাদের জিজ্ঞেস করলে গ্রামের মহিলারা নুহা প্রসঙ্গে ভিষণ বাজে কথা শুনিয়ে দেয়। আবিরের বন্ধুটি ফিরে যায়। কল করে আবিরকে পুরো বিষয়টা জানায়।

চিন্তিত আবির সেদিন রাত্রে কল করে হিয়াকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে হিয়া ওর কলেজ শিক্ষক আবিরকে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দেয়। জানতে চায় বান্ধবীর বর্তমান অবস্থার কথা। হিয়ার কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবির পাল্টা প্রশ্ন করে ওকে। ” ভিষণ বিপদে পড়ে তোমার শরণাপণ্ন হওয়া। তুমি কি আমায় হেল্প করবে?”
লজ্জা পেয়ে যায় হিয়া। ছি! ছি স্যার! এভাবে কেন বলছেন? আপনি আমার গুরুজন। আর গুরুজনের জন্য কিছু করতে পারা তো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। স্যার, আপনি শুধু আদেশ করেন কি করতে হবে। আমি প্রাণ দিয়ে হলেও সে কাজটা করার চেষ্টা করব।
আবির হিয়াকে পুরো ঘটনা জানায়। আবির আরো জানায়, নুহাকে সে ঢাকায় নিরাপদে হিয়ার বাসায় রাখতে চাচ্ছে।
প্রথমে নুহার সাথে করা অন্যায়গুলোর জন্য মন খারাপ হলেও পরে যখন জানতে পারে নুহা ওর মেয়ের সাথে ওর বাসায় থাকবে তখন আনন্দে চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে হিয়ার।

স্যারকে আশস্ত করে হিয়া পরদিন ভোরে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় গ্রাম থেকে নুহাকে আনতে। আবিরের কথা মতো নুহা স্কুল থেকে সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র এনে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাখে। প্রাণের আন্টি হিয়াকে দেখা মাত্র’ই দুতলা বাসার নিচে নেমে আসে। নিচে নেমে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে হিয়ার সাথে কুশল বিনিময় করে। ‘ওরে আমার মা’টা তো দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে’ কথাটা বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে হিয়া বুকে জড়িয়ে নেয় নুহাকে।

নীলিমার শাশুড়ি ওরফে নুহার দাদীমার থেকে বিদায় নিয়ে হিয়া তারই কলিজার টুকরা জুনিয়র নীলিমাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বিকেল ৫টা নাগাদ নুহাকে সাথে করে নিয়ে ঢাকায় নিজ বাসায় এসে পৌঁছে হিয়া। নুহা গাড়ি থেকে নামলে একটা মিষ্টি হাসি দেয় হিয়া। বাসায় এসে গেছি মা। চলো, চলো। নিশ্চুপ নুহা নিঃশব্দে হিয়াকে অনুসরন করে দোতলা বাসার উপরে উঠে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপে হিয়া। পরপর কয়েকবার কলিং বেল চাপার পর দরজা খুলে কাজের মহিলা শিরি। নুহাকে দেখেই একটা হাসি দেয় মহিলাটা। ওহ, নতুন সতীন এসে গেছে আমার? হেসে দেয় হিয়া। স্মিতহাস্যে নুহার দিকে তাকিয়ে বলে, নুহা মা! ইনি তোমার দাদীমা হয়। জিজ্ঞেস করো কেমন আছে?
সালাম দিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে নুহা কুশল বিনিময় করে মহিলাটির সাথে।

হঠাৎ করেই পাশের রুম থেকে বাচ্চার কান্নার স্বর ভেসে আসে। ড্রেস চেঞ্জ করতে করতে হিয়া ডাকতে থাকে। শুভ, শুভ কইরে তুই? আদনান তো পুরো বাসা মাথায় তুলে নিয়েছে কান্না করে। একবার দেখা দিয়ে যা। প্রতিউত্তরে ওয়াশরুম থেকে ভেসে আছে- ‘আমি গোসল করতেছি ফুপ্পি। দাদীমাকে বলো একটু কোলে নিতে।’

ক্ষাণিক বাদে শরীরে কোন রকম তোয়ালে প্যাঁচিয়ে হাত দিয়ে চুল থেকে পানি ফেলতে ফেলতে রুমে ঢুকে শুভ। কোথায় আমার বাবাটা? বাসা নাকি মাথায় তুলে ফেলেছ? কথাটা বলে সামনে তাকাতেই ভূত দেখার ন্যায় চমকে যায় শুভ।

চলবে…..

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ০৩

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ০৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

কি হলো? এভাবে তাকিয়ে কেন আছেন? যান, নামাজ পড়ে আসেন।
কিচ্ছু বলেনি শুভ। ছিটকিনি আটকে চুপ করে খাটে গিয়ে বসে কম্বল মেলতে থাকে। সেটা দেখে চোখ কপালে তুলে ফেলে নুহা। প্রশ্ন করে শুভকে, কি হলো? শুয়ে পরার ব্যবস্থা করতেছেন যে? নামাজটা কে পড়বে?
রাগান্বিত দৃষ্টিতে শুভ নুহার দিকে তাকায়। ‘দেখুন মিস! একটু ভালো ভাবে কথা বলেছি তার মানে এই নয় আপনি আমার কাধে ঝেকে বসবেন। ভুলে যাচ্ছেন কেন সকাল হওয়ার পরই আমাদের দু’জনের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে। তাই দয়া করে পার্সোনাল এটার্ক করা থেকে বিরত থাকুন।
পার্সোনাল এটার্ক? তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে উঠে নুহা। যাক! বেশ ভালো বলেছেন। তবে একটা কথা স্যার। আমি মোটেও পার্সোনাল এটার্ক করিনি। একজন মুসলমান হিসেবে আরেকজন মুসলমানকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম। ইসলামের পথে আসার আহ্বান করলাম। ব্যস, এটুকুই। এখন আপনার যদি মনে হয় আমি আপনার পার্সোনাল লাইফে এটার্ক করছি তাহলে যে আমার আর কিচ্ছু বলার থাকল না। আচ্ছা, শুয়ে পরেন। আর ডিস্টার্ব করার জন্য স্যরি।

শুয়ে পড়তেছিল শুভ, নুহার শেষ কথা শুনে সোজা হয়ে বসে। দেখুন মিস নুহা আপনি কিন্তু একটু বেশিই ভুল বুঝতেছেন। আপনি কথাকে যেভাবে নিয়ে যাচ্ছেন আমি কিন্তু সেভাবে বলিনি। আমি জাস্ট এটাই বুঝাতে চাচ্ছি যে নামাজ বলেন, রোজা বলেন এগুলো ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। হ্যা, আপনি ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন সেটা ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা আপনার জানা খুব দরকার। যে ব্যক্তি আল্লাহকে কোনো ক্রমেই মানে না তার কাছে নামাজ পড়ুন, রোখা রাখুন, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এসব বলাটা অরণ্য রোদন বৈ কিছুই নয়। তাই ভবিষ্যতে কাউকে ইসলামের দাওয়াত দিতে যাওয়ার এ জিনিসটা মাথায় রেখে যাবেন।
হেসে উঠে নুহা। আপনি ভুল বলেছেন স্যার। কেউ আল্লাহকে মানে না তাই বলে কি আমি আমার দাওয়াত দেয়া বন্ধ করে দেবো? না। এটা আমি মানতে পারছি না। কারন একজন মুসলমান হিসেবে আমার দায়িত্ব আরেকজন মুসলমানের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। সেটাকে যদি মানুষ ভালোভাবে গ্রহন করে তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি ভালো ভাবে গ্রহন না করে তাহলে তার জন্য সমবেদনা। কেননা, আমি শুনেছি আল্লাহ যাদের ভালোবাসেন তাদের’ই হেদায়াত করেন তাড়াতাড়ি। আচ্ছা, বাদ দেন। আপনি একটু ঘুমান। আমি ভাবির রুমে গিয়ে দেখি ফোনটা চার্জে দিয়ে খুলতে পারি কি না। স্যারদের কাছে একটু ফোন দিতে হবে।

নুহা রুম থেকে বের হয়ে সোজা রাকিবদের রুমের দরজায় নক করে। ঘুম ঘুম চোখে স্বর্ণা দরজা খুলে। চোখ কপালে উঠে যায় নুহার। সেকি ভাবি? মাত্র ঘুম থেকে উঠছেন? নামাজ পড়েন না আপনারা? কিছুটা নিচু গলায় স্বর্ণার জবাব, ইয়ে মাঝে মধ্যে পড়া হয়।
দরজার সামনে দাঁড়ানো থেকেই প্রশ্ন করে নুহা, খাবারও কি মাঝে মধ্যে খান নাকি?
ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা হয়ে যায় স্বর্ণার। ‘মানে? বুঝলাম না নুহা।’
হেসে দেয় নুহা, না বুঝার তো কিছু বলিনি। আচ্ছা, বাদ দেন। ভেতরে কি ভাইয়া আছে।
হু, ঘুমিয়ে আছে। স্বর্ণার কথা শুনে তাড়াতাড়ি পুরো শরীর ঢেকে নেয় নুহা। আচ্ছা, আমি তবে পরে আসি।
নুহা চলে গেলে স্বর্ণা একটা মুখ ভেংচি দেয়। এতটুকু বাচ্চা মেয়ে আসছে জ্ঞান দিতে। যত্তসব। ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয় স্বর্ণা।

সকালে আবারো স্বর্ণাদের রুমের দরজায় এসে নক করে নুহা। দরজা খুলে স্বর্ণা। নুহা স্বর্ণাকে সালাম দেয়। জবাবে স্বর্ণা বলল, ‘ওহ, নুহা! আসো। ভিতরে আসো।’
রুমে রাকিব আছে কি না এ বিষয়ে ক্লিয়ার হয়েই ভিতরে ঢুকে নুহা। বন্ধ ফোনটা চার্জে লাগিয়ে খুলে নেয়। সেভ করা বান্ধবীদের নাম্বারের মধ্য থেকে প্রিয় বান্ধবী জান্নাতের নাম্বারে কল দেয়। মুহূর্তেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে, আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটু পরে আবার চেষ্টা করুন। মনটা খারাপ হয়ে যায় নুহার। বিষণ্ন মনে ডায়াল করে বাংলা মেডামের নাম্বার। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। বাধ্য নুহা জম স্যার ওরফে ইংরেজী স্যারের নাম্বারে কল দেয়। ওনি অবশ্য রিসিভ করেছেন কিন্তু কথা বুঝা যাচ্ছে না। শুনার মধ্যে কেবল বাচ্চাকাচ্চার আওয়াজ’ই শুনতে পাচ্ছে নুহা। কল কেটে প্রধান শিক্ষকের নাম্বার ডায়াল করে নুহা। এবারো ফোন রিসিভ হয়েছে। কিন্তু গাড়ির হর্ণ ছাড়া কিচ্ছু শুনতে পায়নি নুহা।
তবে কি ওরা চলে যাচ্ছে? ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে নুহার। কলটা কেটে কল দেয় বান্ধবি জান্নাতকে। বরাবরের মতই ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। বুকের ভেতর রীতিমত ধুরমুশ পেটাতে শুরু করে দিয়েছে ওর। দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে শুভর রুমে যায়। ডাক দেয়, শুনছেন? কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করে তাকায় শুভ। প্রশ্ন করে নুহাকে, কি সমস্যা?
ভেঁজা কন্ঠে নুহার জবাব, ওরা মনে হয় রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। আমার ভালো লাগছে না একদম। আমি এখন কি করব?
শুয়া থেকে উঠে বসে শুভ। হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিকঠাক করে নিয়ে নুহার দিকে তাকায়। ‘চলুন….
দৌঁড়ে গিয়ে স্বর্ণাদের রুম থেকে ফোনটা এনে রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায় নুহা। শুভর দিকে লক্ষ্য করে বলে, চলুন…..

শুভ এবং নুহা সকালের নাস্তা না করেই বিদায় নেয় রাকিব এবং তার স্ত্রী স্বর্ণার থেকে। প্রচন্ড শীতে জড়োসড়ো শুভ গাড়িতে বসে নুহার দিকে তাকিয়ে দেখে এত শীতের মধ্যে নুহা রীতিমত ঘামছে।
কিছুটা আশ্চর্য হয় শুভ। তবে কিচ্ছু বলেনি নুহাকে। মিনিট ত্রিশেক পর কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে নুহা এবং শুভ। সমুদ্র পাড়ে অসংখ্য মানুষকে দেখা গেলেও নুহা পায়নি ওর স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী কিংবা স্যার’দের।
‘আমি এখন কি করব?’ বিষণ্ন মনে নুহা শুভর দিকে ফিরে তাকায়। জবাব আসে, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি আমাদের ঐ স্যার’রা আছে ওনাদের সাথে দেখা করে আসি। নুহা বাচ্চাদের মত মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
একটু একটু করে শুভ এগিয়ে যায় স্টুডেন্টসদের দিকে। মেয়েরা কেমন আছ তোমরা? সেখানে উপস্থিত ছাত্রীরা ফিরে তাকায় পিছনের দিকে। হারিয়ে যাওয়া স্যারকে দেখা মাত্রই ঘিরে ধরে সবাই। ‘স্যার কোথায় ছিলেন? স্যার আপনি নাকি হারিয়ে গিয়েছিলেন? পরে আপনার ফ্রেন্ড নাকি উদ্ধার করেছে?’ এটা সেটা আরো কত প্রশ্ন।
স্মিতহাস্যে শুভর জবাব, আমাকে আমার বন্ধু নয় এক সুপারম্যান এসে বাঁচিয়েছে। আচ্ছা, তোমরা সমুদ্রতীরের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করো। আমি স্যারদের সাথে একটু সাক্ষাত করে আসি।

মেয়েরা যে যার মত এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলে শুভ স্যারদের মুখোমুখি হয়। টিচার্সদের মধ্যে একজন টিচার ছিল শুভর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শুভ বন্ধু রুহুলকে আড়ালে ঢেকে নিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলে হেল্প চায়। রুহুল সমবেদনা প্রকাশ করে এবং রুহুলকে আশ্বস্ত করে। রুহুল জানায়, তুই ঐ মেয়েকে নিয়ে আপাতত তোর ঐ বন্ধুর বাসায় চলে যা। কাল থেকে তো মনে হয় মেয়েটা কিছু খায়নি, তাই ওকে ওখানে নিয়ে গিয়ে জোর করে কিছু খাওয়া। তারপর সন্ধ্যার ট্রেনে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দে। নরসিংদী পৌঁছে গেলে আর সমস্যা নেই। ওখানে আমার এক ফ্রেন্ড থাকে। ও তোকে গাজীপুর যাওয়ার সব বলে দিবে। এদিকে আমি সামলিয়ে ফেলব স্যারদেরকে। স্যারদের বলব, তোর বাসা থেকে জরুরী কল আসায় তুই চলে গেছিস।
Thanks a lot, sir.(হাসি দিয়ে) আমি আপনার এ উপকারের কথা কখনো ভুলব না।(স্মিতহাস্যে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকার ইমুজি হবে।)
হেসে দেয় রুহুল। আচ্ছা, এখন তবে বের হয়ে যান স্যার। ইনশাআল্লাহ ঢাকায় পৌঁছে কথা হবে।

বন্ধুর থেকে বিদায় নিয়ে শুভ নুহার কাছে এসে দাঁড়ায়। নুহা ততক্ষণে অনেকগুলো ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে। শুভকে আসতে দেখে ওদের থেকে বিদায় নিয়ে সামনে আগায়। মুখোমুখী হয় শুভর।
আচ্ছা, চলো। আমরা আবার রাকিবের বাসায় যাই। তারপর সন্ধ্যার ট্টেনে আমি নিজে তোমাকে নিয়ে দিয়ে আসব তোমার গ্রামের বাড়িতে।

আচ্ছা, বলে পথ চলতে শুরু করে নুহা। ক্ষাণিক দুর যেতেই শুভ টের পায় নুহা ওর পিছনে নেই। দাঁড়িয়ে পরে শুভ। পিছনে তাকাতেই দেখতে পায় অদুরের পানে ঝিনুক বেঁচে ছেলেটাকে যেখানে মেয়েরা ঘিরে আছে নুহা সেখানেই তাকিয়ে আছে। দৌঁড়ে ঝিনুক বেঁচে ছেলেটার কাছে যায় শুভ। প্রশ্ন করে ছেলেটাকে বাবু কত টাকা করে এগুলো? স্যারকে আসতে দেখে সরে যায় কলেজের মেয়েরা। জবাব দেয় ছেলেটা, ২০টাকা। পকেট থেকে একটা ৫০০টাকার নোট বের করে শুভ এগিয়ে দেয় ছেলেটার দিকে। আমাকে ১০টা মালা দাও। ছেলেটা গুনে গুনে ১০টা মালা তুলে দেয় শুভর হাতে। মালার টাকা বাবদ ২০০টাকা নিয়ে ছেলেটা ৩০০টাকা শুভর হাতে দিতে গেলে শুভ টাকা নিতে অস্বীকার করে। শুভ জানায়, টাকাটা তোমার কাছেই রাখো আব্বু। এটা আমি তোমাকে এটা গিফ্ট করেছি। শীতের কাপড় কিনে নিও। হাসি ফুটে উঠে ছেলেটার মুখে। দু’চোখ জলে চিকচিক করছে। যেন সে চোখের জলের মাধ্যমেই দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছে।

মালা হাতে নুহার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় শুভ। পিছন থেকে বলে, নাও। ভয়ে কেঁপে উঠে নুহা। শুভকে বুকে থু থু দিয়ে বলে- ওহ আপনি?
হাসোজ্জল মুখে শুভ নুহার দিকে মালাগুলো এগিয়ে দেয়। নুহা হা হয়ে যায়। মুখে হাত দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে। নাও বলে শুভ আবারো মালা সাধে। ইতস্তত নুহা একসময় মালাগুলো নিয়েই নেয়। কিছুদুর এগুতেই ক্যামেরাম্যান সামনে এসে দাঁড়ায়। ছবি তোলার জন্য বিনীত অনুরোধ জানায়। শুভ নুহার দিকে ফিরে তাকায়। নুহার চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে অস্বস্তিতে ভুগছে। স্যরি, আরেকদিন বলে ক্যামেরাম্যানকে বিদায় করে দেয় শুভ।

সকাল ১১টার দিকে আবারো বন্ধু রাকিবের বাসায় গিয়ে পৌঁছে শুভ এবং নুহা। শুভ নুহাকে দেখে রাকিব এতটা খুশি হয়েছে যা বলে বুঝানো যাবে না। মুহূর্তেই বাজার থেকে এটা সেটা আনা শুরু করে দিয়েছে। হেসে দেয় শুভ। শান্ত হো বৎস, শান্ত হো। তাড়াহুড়োর কিচ্ছু নেই। আমরা সন্ধ্যার ট্রেনেই রওয়ানা দেবো। আশ্চর্য হয় রাকিব। সন্ধ্যার ট্রেন? তুই জানিস না আগামীকাল ভোরের আগে আর কোন ট্রেন যাবে না? চমকে যায় শুভ। কি বলিস তুই এসব? আমি এখন ওকে নিয়ে কোথায় যাব? রেগে যায় রাকিব। কোথায় যাবি মানে? তোরা কি বানের জলে ভেসে এসেছিস নাকি? কালকের মত আজও এখানেই থাকবি। তারপর ভোরের ট্রেনে রওয়ানা দিবি। একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে শুভ বলে, এটা ছাড়া আর কি বা করার আছে? আচ্ছা, রুমে যাই আমি।

শুভ রুমে গিয়ে বিষয়টা বুঝিয়ে বলে নুহাকে। আশ্চর্য হলো শুভ। যখন দেখল মেয়েটার চোখ মুখে বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। নেই কোন ভয়ের রেখা। আশ্চর্য! ওকি তবে আমায় বিশ্বাস করে ফেলেছে? কৌতূহল মেটাতে প্রশ্নটা করেই ফেলে নুহাকে। জবাব আসে, যেখানে স্বয়ং আল্লাহ আছেন মাথার উপর, সেখানে ভয় পাওয়ার তো কোন প্রশ্নই উঠে না। শুনেছি আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
অদ্ভুত প্রকৃতির মানবি। এমন মানবি এ ধরাতে পূর্বে দ্বিতীয়টি আর দেখিনি। আনমনেই নিজেই নিজের সাথে কথাটা বলে উঠে শুভ।

দুপুরে খাওয়ার জন্য শুভ নুহার ডাক পড়ে আবারো। নুহা এবারো খাবে না বলে জানিয়ে দেয়। স্বর্ণা রুম থেকে বেরিয়ে গেলে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে শুভ নুহার দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে নুহাকে, কি! সমস্যা কি তোমার? সকালেও এত বার করে বলল। তারপর ব্রেকফাস্ট করোনি। এখনো খাবে না বলছ। সমস্যা কি তোমার?
ধীর গলায় নুহার জবাব, সমস্যা আমার নয় সমস্যা এ বাসার গিন্নী+রাধুনী স্বর্ণা আপুর। চমকে উঠে শুভ। মানে? What do you mean?
নির্লিপ্ত কন্ঠে নুহার জবাব, আমি বেনামাজির হাতের খাবার খেতে পারি না।

পর্দার আড়াল থেকে সরে যায় স্বর্ণা। সে ভিষণ লজ্জা পেয়েছে। সেই সাথে ওর ইগুতে গিয়ে আঘাত করেছে কথাগুলো। একটা ছোট্ট মেয়ে, যে কি না আমার থেকে বছর সাতেকের ছোট হবে সে আমাকে এভাবে লজ্জা দিল? তৃতীয় চক্ষু খুলে যায় স্বর্ণার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে চলে যায় ওয়াশরুমে। দ্রুত কাপড় পাল্টে ওজু করে নামাজটা আদায় করে নেয়।

নামাজ ছেড়ে ড্রয়িংরুমে যেতেই আশ্চর্য হয়ে যায় স্বর্ণা। পরম তৃপ্তি সহকারে নিজে নিজেই খাবার নিয়ে খেয়ে চলছে নুহা।
ওজুর পানি এখনো চোখে মুখে লেগে আছে স্বর্ণার। পানি মুছতে যাবে তখনি নুহা বলে উঠে, এ পানি মুছো না ভাবি। এ পানি রহমতের পানি।
রুম থেকে বেরিয়ে আসে শুভ। হুট করে নুহার এভাবে খাবার নিয়ে বসে পরার কারন বুঝতে পারে এতক্ষণে।

চলবে….

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) ☀পর্ব- ০২☀

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
☀পর্ব- ০২☀
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

অদুরে বসে থাকা শুভর চোখ দুটিও কখন যে জলে ভিঁজে একাকার হয়ে গেছে, সে নিজেও জানে না।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে দেয় নুহা। বলতে শুরু করে আবারো। জানেন তো, আমার এসবে একদম মন খারাপ হয় না। আমার ভালোই লাগে। ওরা আমায় কটু কথা বলে আর আমি সেখান থেকে শক্তি পাই। সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পাই। নিন্দুকের কথার আঘাতে জর্জরিত আমি প্রতিবার সম্মুখ পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সঞ্চয় করি ওদের বিষমাখা কথা থেকেই। ওরা আমাকে দাবাতে চায়, কিন্তু পারে না। কারন ওরা হয়তো জানে না কালো কিংবা শ্যাম বর্ণে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। বিশ্বাস করোন গায়ের রঙ নিয়ে আমি একটুও হীনমন্যতায় ভুগি না। কারন আমার আছে অগাধ আত্মবিশ্বাস। আর সেই আত্মবিশ্বাসের জোরেই আমি সামনে এগিয়ে যাই। আমি ওদের বুঝিয়ে দিতে চাই, হেরে আমি যাইনি। হেরে গেছিস তোরা। আমি বুঝিয়ে দিতে চাই আমিও পারি।

অবাক শুভ বিস্মিত দৃষ্টিতে নুহার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, কি সাংঘাতিক মেয়ে! মুহূর্তে কাঁদাতে পারে আবার মুহূর্তেই হাসিয়ে দিতে পারে। ভাবতে ভাবতেই ভাবনার অতল গহ্বরে হারিয়ে যায় শুভ। ঘোর কাটে নুহার ডাকে।
‘ ঘুমিয়ে গেছেন?’

ফিরে তাকায় শুভ। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলে, তুমি ঘুমাবে না? রাত তো অনেক হয়েছে। মাথা নাড়িয়ে না-বোধক জবাব দেয় নুহা। তারপর প্রশ্ন করে শুভকে, কয়টা বাজে আপনার হাত ঘড়িতে? শুভ ঘড়িতে সময় দেখে জানায়, তিনটে বেজে সতেরো।

বসা থেকে লাফিয়ে উঠে নুহা। উত্তেজিত গলায় বলে, হায়! হায়! সময় যে বয়ে গেল।
পাশ থেকে প্রশ্ন করে শুভ, কিসের সময়? কিচ্ছু বলেনি নুহা। একরকম দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে মিনিট দুয়েক পর। চোখে মুখে ছিটা লেগে আছে। দু’হাতও পানিতে ভেঁজা। মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা।
প্রশ্ন করতে চাচ্ছিল শুভ, এই শীতে আপনি শরীর কেন ভিঁজিয়েছেন? কিন্তু পারেনি। কৌতূহলী শুভ পারে নি ওর কৌতূহল মেটাতে। তার আগেই নুহার প্রশ্ন, কিছুক্ষণের জন্য একটু কি বাহিরে যেতে পারবেন? আসলে আমার একটা কাজ বাকি আছে।

” Oh, sure…” বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় শুভ। দরজা বন্ধ করে দেয় নুহা। শূন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শুভ। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হলে দরজায় কড়া নাড়ে। ‘তোমার হলো?’ প্রতিউত্তরে কোনো সাড়া আসে নি ভিতর থেকে। শুভ ভাবছে, হয়তো বা চেঞ্জ করছে নুহা। তাই আবারো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কেটে যায় আরো পাঁচ মিনিট। এবার মনে হয় হয়ে গেছে। শীতে জড়োসড়ো শুভ আবারো দরজায় কড়া নাড়ে, মিস নুহা! আপনার কাজ হয়েছে কি? এবারো কোন সাড়া নেই। ব্যাপার কি? আমায় বাইরে রেখে দরজা দিয়ে ঘুমিয়ে গেল না’তো…!

জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় শুভ। পর্দাটা সরিয়ে ভিতরে দৃষ্টি দিতেই একটা স্থানে চোখ আটকে যায় শুভর। বিছানায় রেখে আসা ওর গায়ের চাঁদর বিছিয়ে গভীর ধ্যানে নামাজে বসেছে নুহা। কিন্তু এখনো তো ফজরের আজানই দেয়নি। কিসের নামাজ এটা? কোন নামাজের সময় হতে পারে এটা? ভাবতে থাকে শুভ। পিছন থেকে বাচ্চা কন্ঠে ডাক আসে, শুনছেন? ঘোর কাটে শুভর। পিছনে ফিরে তাকায়। মাথা নিচু করে নুহা দাঁড়িয়ে।
প্রশ্ন করে শুভ, ওহ! হয়ে গেল তোমার? চলো রুমে যাই। নিচু স্বরে শুভর জবাব, স্যরি। অবাক হয়ে যায় শুভ। প্রশ্ন করে নুহাকে, ‘কিন্তু কেন?’
জবাব আসে, আসলে আপনার চাদরে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ব কথাটা আপনাকে আগেই জানানো দরকার ছিল।
হেসে দেয় শুভ। ও, আল্লাহ! এই কথা? আমি ভাবলাম কি না কি…! আচ্ছা, বাদ দাও।

রুমে চলে যায় শুভ। তার পিছুপিছু নুহাও রুমে ঢুকে।

সোফায় শুয়ে ওড়না দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে নেয় নুহা। আশ্চর্য শুভ প্রশ্ন করে, এত তাড়াতাড়ি আপনার সব দুশ্চিন্তা দুর হয়ে গেল?
মাথা তুলে তাকায় নুহা। মিষ্টি হেসে বলে, বারে! আল্লাহর প্রিয় বান্দার মন খারাপ। আর সেই মন খারাপি দুর করার জন্য তার বান্দা প্রচন্ড শীতকে উপেক্ষা করে ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়েছে। তার দরবারে কিছু চেয়েছে। আল্লাহ কি তার মন ভালো না করে দিয়ে পারে?
স্তব্ধ হয়ে যায় শুভ। প্রতি পলে পলে শুভ এক নতুন নুহাকে আবিষ্কার করছে। আর সেই নতুন নুহাকে প্রত্যেকটা নতুন রূপেই লাগছে অমায়িক সুন্দর। এক মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই আরো মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে যাচ্ছে।

এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে ভাবনার অতলে হারিয়ে গিয়েছিল শুভ। ভাবনাচ্ছেদ ঘটে দরজায় করাঘাতের আওয়াজে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয় শুভ। দরজার সামনে বন্ধু রাকিব দাঁড়িয়ে। এভাবে বাথরুম- বারান্দা, বারান্দা- জানালার পাশে দৌঁড়াদৌঁড়ি কেন করতেছিস? তোদের কি এ রুমে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছে?
‘আরে না..’ বলে মাথা ঝাকায় শুভ। লাজুক হেসে বন্ধু রাকিবের আরো একটা প্রশ্ন, কিরে কেমন কাটলো মধুরাত? মধু কেমন আহরণ করলি?
ঠাস করে থাপ্পর বসিয়ে দেয় শুভ ওর বন্ধুর গালে। গালে হাত বুলাতে বুলাতে রাকিবের জবাব- স্যরি, আমি তো ভুলে গেছিলাম তুই রক্তমাংসে তৈরি মানব নয়, তুই হইলি যন্ত্র মানব। যার কোন ফিলিংস নেই। দাঁতে দাঁত চেপে কলার ধরে টানতে টানতে শুভ ওর বন্ধুকে ওর রুমে ঢুকিয়ে তার স্ত্রীকে বলে আসে, সকালে চলে যাব। তার আগ পর্যন্ত ভাবি আপনি অমানুষটারে রুমে আটকে রাখেন। হেসে দেয় রাকিবের স্ত্রী স্বর্ণা। হা, হা দেবর মশায়! মেজাজ এত চড়া কেন? মধু আহরণে কি ব্যর্থ হয়েছেন নাকি? রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে রাকিবের স্ত্রীর দিকে তাকায় শুভ। স্বর্ণা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। মুখ চেপে ধরে রাকিব। বইন শান্ত হো! আল্লাহর ওয়াস্তে বইন তুই মুখে তালা লাগা। না হলে যন্ত্রমানব আমাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিবে। স্বামীর মুখে বইন ডাক শুনে মুখ চেপে ধরে রাখা অবস্থায়’ই চোখ বড় বড় করে ফেলে স্বর্ণা। মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে উঠে শুভ, পুরো তার ছিড়া দুই মানব মানবি। রুম থেকে বেরিয়ে যায় শুভ।

দরজায় সামনে গিয়ে লজ্জায় ঘরের দিকে পা বাড়াতে পারছে না শুভ। ইস! কি লজ্জার কথাটাই না বলে গেল। না জানি কি ভেবেছে মেয়েটা। প্রচন্ড লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় শুভর। সেই মাথা নিচু অবস্থাতেই রুমে ঢুকে। দরজা আংশিক মিশিয়ে খাটে গিয়ে বসে। পাকনা বুড়ির ভাবমূর্তিটা এখন কেমন সেটা দেখার জন্য আড়চোখে সোফার দিকে তাকায় শুভ। থ হয়ে যায় সে। পা থেকে গলা পর্যন্ত পুরো শরীর সুন্দর করে ওড়না দিয়ে ঢেকে সোফায় ঘুমিয়ে আছে নুহা।
ঘাড়টা সোজা করে এবার ভালোভাবেই সোফার দিকে দৃষ্টি নেয় শুভ। নড়ে চড়ে উঠে নুহা। ফিরে তাকায় শুভর দিকে। ক্ষাণিকটা লজ্জায় শুভ ওর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় অন্য দিকে।
ধীর গলায় বলে উঠে নুহা, জানতাম একজোড়া চোখ আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই জন্যই আমার কেমন জানি লাগছিল। চোখ বোজেও শান্তি পাচ্ছিলাম না।
জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে শুভ ফিরে তাকায় নুহার দিকে। স্মিতহাস্যে নুহার জবাব, অাপনিও অবাক হলেন না? কিন্তু বিশ্বাস করেন কেউ যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি সত্যি’ই চোখ বোজা অবস্থায় সেটা টের পায়।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শুভ। কি জানি হতে পারে।

হতে পারে নয়, এটাই সত্যি। আমি সত্যিই ব….(…)..? পুরো কথা বলতে পারেনি নুহা। তার আগেই ফজর নামাজের আজান দিয়ে দেয়। পুরো আজানটা চুপ করে শুনে সোফা থেকে উঠে বসে নুহা। ফিরে তাকায় শুভর দিকে। মৃদু হেসে বাহিরে চলে যায় শুভ।
রুমে ফিরে আসে নুহার নামাজ পড়া শেষে। দরজাটা কেবল আটকাতে গিয়েছিল শুভ। তখনি পিছন থেকে বাচ্চা কন্ঠে ভেসে এলো, ওজু করে তবেই দরজা আটকান। বেনামাজির স্থান নেই আমার ঘরে। চমকে উঠে পিছনে তাকায় শুভ।

চলবে…..

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) ☀পর্ব- ০১☀

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
☀পর্ব- ০১☀
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বিয়েটা যখন হয়েই গেছে, তখন আর কেঁদে কি হবে?এখন চলুন শুরু করা যাক।

চমকে উঠে নুহা। শুভ নামের এক অচেনা যুবক, যার সাথে মাত্র কয়েক পরিচয় ওর। তার মুখ থেকে আচমকা এ ধরনের কথা শুনেছে। চমকে উঠার’ই কথা। বিস্মিত নুহা শুভ’র মুখের দিকে ফিরে তাকায়। ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করে। মানে? শুশুশুশুরু ক্কককরব মমানে? কিকিকিকিকিকিকি বুবুঝাতে চাচ্ছেন আপনি? হেসে উঠে শুভ। আশ্চর্য! শুরু করব কথাটা শুনে আপনি এত তুতলাচ্ছেন কেন? এবারো কাঁপা গলায় নুহার জবাব, তুতলাচ্ছি আপনার উদ্ভট কথা শুনে। ভ্রু’টা কিঞ্চিৎ বাঁকা করে ফেলে শুভ। Strength! উদ্ভটের কিছু তো আমি বলিনি। আমি জাস্ট বলেছি, শুরু করা যাক। কি শুরু যাক সেটা তো শুনবেন আগে, নাকি? নুহা হাত দুইটা বুকের মধ্যে নিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে দেয়ালের সাথে মিশে যায়। আমি কোন কথা শুনতে চাই না। উফফ! কপালে জমে থাকা ঘামগুলো মুছে নেয় শুভ। তারপর নুহার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, শুনোন মিস নুহা! আপনি যে ভয়টা পাচ্ছেন সেটা সম্পূর্ণ অমূলক এবং ভিত্তিহীনও বটে। আপনি হয়তো ভাবছেন, যেভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েই গেছে। এখন ওনি নিশ্চয় আমার উপর অধিকার খাটানোর জন্য ঝাপিয়ে পরবেন। না, মিস নুহা! আমার এসবে ইন্টারেস্ট নেই। বিশেষ করে আপনার মত পিচ্চি মেয়ের সাথে তো এসব করার প্রশ্নই উঠে না। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা শুরু করতে চাচ্ছিলাম। আর সেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হলো রাত পোহালে আমাদের দু’জনের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে। আজকের পরে আমার সাথে আপনার কখনো দেখা হবে না। এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকুন।

কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে নুহা। আর বিয়ে? ঐটার কি হবে? একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে শুভ। মিস নুহা! বিয়েটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। আর সে এক্সিডেন্ট’টাও আপনার কারনেই হয়েছে। আপনি মানুষ না চিনে এক বখাটের সাথে এফবিতে ফ্রেন্ডশিপ করেছেন। তারপর স্কুল থেকে শিক্ষাসফরে এসে সেই বখাটের সাথে দেখা করেছেন। বখাটে আপনাকে একটা বানোয়াট কাহিনী শুনালো। আপনি সেই কাহিনী বিশ্বাস করে ফেললেন। শুধু বিশ্বাস করেই ক্ষান্ত হননি। ফ্রেন্ডস সার্কেল আর স্যারদের সবার চোখ এড়িয়ে বখাটের সাথে চলে গেলেন বখাটের অসুস্থ মাকে দেখার জন্য। ব্যাস, হয়ে গেল। ঘটে গেল ঘটনা। আপনি ওখানে গিয়ে জানতে পারেন বখাটে আপনাকে বানোয়াট কাহিনী শুনিয়ে ফাঁদে ফেলানোর চেষ্টায় ছিল এতদিন। আজ সফল হয়েছে। এদিকে কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে নিয়ে আমিও সফরে এসেছি। সবুজের সমারোহ আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে গহীন অরণ্যে ঢুকে পরেছি, বুঝতে পারিনি। হঠাৎ করে আপনার চিৎকার শুনতে পেলাম। ছুটে গেলাম। বখাটে ছেলেটা চলে গেল দৌঁড়ে। স্থানীয় লোকজন এসে আমাকে আপনাকে নির্জন স্থানে দেখতে পেল। ঘটনা হয়ে গেল রটনা।ওরা বিয়ে পরিয়ে দিল। শুধু বিয়ে পরিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। আমাদের বাবা মায়ের ফোন নাম্বার নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। মান সম্মান অবশিষ্ট বলে যেটুকু ছিল, সেটুকু বাঁচানোর জন্য কৌশল করে বন্ধুকে ভাই বানিয়ে ফেললাম। কল করলাম ওকে। ও আসল। আমাদের উদ্ধার করে ওর বাসায় আশ্রয় দিল। বোকামি করেছেন আপনি আর তার খেসারত গুনছি আমি। এখন আবার বলছেন, বিয়ে? গুষ্টি কিলায় এমন বিয়ের। সকালটা হোক। আপনাকে আপনার স্যারদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমি আমার রাস্তা মাপতো।

এটুকু বলে লাইট জ্বালিয়েই শুয়ে পড়ে শুভ। ক্ষাণিক বাদে মাথা উঁচু করে। প্রশ্ন করে নুহাকে। আচ্ছা কিসে পড়েন আপনি? দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়েছিল নুহা। শুভর প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায়। জ্বি, আমি এইটে পড়ি। শুয়া থেকে উঠে বসে পড়ে শুভ। ‘কি? এইটে পড়েন আপনি? এইটে পড়া একটা বাচ্চা মেয়ে কি না ফেসবুক চালায়?’ দুঃখের মাঝেও হেসে দেয় নুহা। অামি তো ভালোই। এইটে পড়ি। অথচ আমাদের পাশের বাসার এক আন্টি আছে। ওনার ছেলেও এফবি চালান। ওনার ছেলে কিসে পড়ে জানেন? ভ্রু-কুঁচকে তাকায় শুভ। প্রশ্নবোধক জবাব দেয়, সেভেনে? খিলখিলিয়ে হেসে দেয় নুহা। আরে না, ক্লাস থ্রিতে। কপালে ভাঁজ পড়ে যায় শুভর। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ভেসে এলো নুহার প্রশ্ন। সাথে উত্তরও। তার কয়টা আইডি আছে জানেন? ৭টা। শুনবেন কি, কি আইডি? শুভ নুহার দিকে ফিরে তাকালো শুধু। শুভ’র উত্তরের অপেক্ষা না করে নুহা আঙ্গুল খাড়া করে গিটগুলো গুনতে লাগল-
১) অবুঝ বালক।
২) শান্ত বালক।
৩) দুষ্টু বালক।
৪) রোমান্টিক পোলা।
৫) ঢাকার কিং।
৬) বসন্ত বাতাসে, লুঙ্গি আকাশে।
৭) কিশোরগঞ্জের পোলা জিকু।

সাতটা নাম বলে নুহা আঙ্গুলের গিটগুলো আবারো প্রথম থেকে গুনা শুরু করে। শুভ সে দৃশ্য দেখে আনমনেই হেসে দেয়। প্রশ্ন করে নুহাকে। ‘তা তোমার সেই পাশের বাসার আন্টির ছেলে জিকুর সাথে তোমার কতদিনের রিলেশন?’ শুভ’র এমন প্রশ্নে নুহা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয় নুহা। তারপর লম্বা স্বরে বলে উঠে, এ্যা মা! এসব কি বলছেন? জিকু তো আমার ৫বছরের জুনিয়র। ওর সাথে আমার যায় নাকি? হেসে দেয় শুভ। আনমনেই বলে উঠে, বাব্বাহ! বেশ চতুর। প্রশ্ন করে নুহা। কিছু বলছেন? কথা ঘুরায় শুভ। ‘আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাচ্ছি। তুমি বরং আমায় পাহাড়া দাও বসে। ‘হু, আচ্ছা বলে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পূর্বের ন্যায় দু’হাঁটুর ফাঁকের ভিতর মাথা রেখে নিচু হয়ে বসে পড়ে নুহা।

শুভ চোখ দুটো বন্ধ করবে তখনি খেয়াল হয় কথার ছলে নুহাকে সে হুট করে আপনি থেকে তুমি সম্বোধন করে ফেলেছে। চোখ মেলে তাকায় শুভ। উঠে বসে বিছানায়। ডাক দেয় নুহাকে। শুনোন… মাথা তুলে তাকায় নুহা। ধীর গলায় বলে উঠে শুভ- আমি, স্যরি। চোখ দুটো মার্বেলের মত গোলগোল করে ফেলে নুহা। ‘কেন? আর কিসের স্যরি?’ জবাব দেয় শুভ। আমি তোমাকে ভুলে তুমি ডেকে ফেলেছি। সে জন্য স্যরি। খিলখিল শব্দে হেসে উঠে নুহা। আপনি তো এখনো আমায় তুমি ডাকছেন। তবে মন্দ লাগছে না। আর এমনিতেও আমি আপনার থেকে কম করে হলেও ১০,১২বছরের ছোট হবো। তাই এ হিসেবে ডাকতেই পারেন। আপনি করে ডাকলে আমার আবার নিজেকে মুরুব্বী মুরুব্বী লাগে। হেসে দেয় শুভ। ঠিক আছে। আমি তোমাকে তুমি বলেই ডাকব। আচ্ছা, গুড নাইট। প্রতিউত্তরে ‘উম্মমমম, নাইট’ বলেই আবারো পূর্বের ভঙ্গিতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে নুহা।

মাঝ রাত্রিতে ঘুম ভেঙে যায় শুভর। মনে পড়ে নুহা নামের সেই পাকনা বুড়িটির কথা। ভাবছে রাত তো অনেক হয়েছে। নিশ্চয় সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। সোফার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয় শুভ। ফ্লোরের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পায় সেই পূর্বের ন্যায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, মাথাটা হাটুর ভিতর ঢুকিয়ে বসে আছে মেয়েটি। বাচ্চা বাচ্চা হাত দুটো সামনের দিকে ছড়ানো। দীঘল কালো কেশগুলো এলোমেলো অবিন্যস্ত ভাবে এদিক ওদিক ছড়ানো। না চাইতেও ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে শুভর। বিছানা থেকে নেমে কাছে যাচ্ছিল। পায়ের শব্দে চুলগুলো আংশিক ফাঁক করে মাথা তুলে তাকায় নুহা। শুভকে এভাবে ওর দিকে আসতে দেখে ভয়ে জড়োজড়ো হয়ে যায়। ‘ওহ, জেগে আছ? আমি ভাবছি ঘুমিয়ে গেছ। এভাবে বসে ঘুমাচ্ছো, অসুবিধে হচ্ছে কি না! তাই ভাবলাম সোফায় শুইয়ে দেই।’ হেসে দেয় নুহা। না, না! আমি ঘুমাইনি। প্রশ্ন করে শুভ। এভাবে বসে থাকতে থাকতে তো মনে হয় ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে তোমার। না ঘুমালেও অন্তত সোফায় গিয়ে শুয়ে থাকো। জবাব আসে, মন খারাপের সময় আমি শুই না। এভাবেই বসে থাকি। এতে আমার চিন্তা কিছুটা সময়ের জন্য হলেও দুর হয়ে যায়। মনে মনে হেসে উঠে শুভ, ‘ওরে পাকনা বুড়িটা। এই বয়সে আবার চিন্তা।’ প্রশ্ন করে শুভ, তা এখন কিসের চিন্তা করছ? কার জন্য মন খারাপ? অপ্রত্যাশিত বিয়ের জন্য কি? গম্ভীর গলায় নুহার জবাব- মায়ের জন্য মনটা বড্ড পুড়ছে। পুনরায় প্রশ্ন করে শুভ। কোথায় থাকে তোমার মা? জবাব আসে, বিদেশ। কৌতূহলী মনে শুভ আবারো প্রশ্ন করে। সে কি! তোমার বাবা নেই? নুহার ছোট্ট জবাব, আছে। প্রশ্ন করে শুভ, তাহলে বাবা থাকতে মা কেন বিদেশ?
শুভর দিকে ফিরে তাকায় নুহা।
” আমার দাদা এক্সিডেন্টে মারা গেছে আমি যখন ফাইভে পড়ি তখন। আর এক্সিডেন্ট’টা মায়ের চোখের সামনেই হয়েছিল। সেই থেকে আমার মা পাগল। প্রথমে একটু একটু পাগলামি করত। পরে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে যায়। চিকিৎসা করিয়েছে অনেক। কিন্তু ভালো হয়নি। বাধ্য হয়ে আব্বু শিক্ষকতার চাকরী ছেড়ে দিয়ে আম্মুকে নিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য চলে যান। ২বছর হলো বিদেশে আম্মুর চিকিৎসা চলছে। এখনো আগের মতই পাগলামি করে। আমাদের ভাই-বোনদের কাউকে আর বাপজান, আম্মাজান বলে ডাকে না আম্মু। আব্বুর মুখেও আদিরা মামনি কিংবা নীলয় বাবাই ডাকটা আর আমরা শুনি না। বাসায় দাদিমা শুধু নীলয়কেই আদর করেন। আমি দেখতে মায়ের মত কালো হয়েছি। এই জন্য আমায় সহ্য করতে পারেন না ওনি। বলে কি, লেখাপড়া করে আর কি করবি? দেখতে তো একদম পাতিলের তলার মত। কে বিয়ে করবে তোকে? আমি কি করব বলুন। যে যা ক্রিমের কথা বলে, সেই ক্রিম’ই মুখে লাগাই। কিন্তু স্থায়ীভাবে ফর্সা আর হইনা। এটুকু বলে থেমে যায় নুহা। বোধ হয় গলাটা ধরে এসেছে কিংবা আর বলতে পারতেছে না। অদুরে বসে থাকা শুভর চোখ দুটিও কখন যে জলে ভিঁজে একাকার হয়ে গেছে, সে নিজেও জানে না।

চলবে….