Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2427



ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ২৬ এবং অন্তিম পর্ব

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ২৬ এবং অন্তিম পর্ব
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বিছানার পাশে কলাগুলো রেখে শুয়ে পরে আবির। মিনিট ত্রিশেক পর শুনতে পায় চপচপ শব্দ। শব্দটা ঠিক পাশ থেকেই আসছিল। মনে হচ্ছে আদিরার কলার উপর ইঁদুর হামলা করেছে। আস্তে আস্তে ফোনটা হাতে নিয়ে টর্চটা জ্বেলে দেয়। কিন্তু একি?
” এ যে ছোট ইঁদুর….”
হেসে দেয় আবির। ঘুমে ঢুলুঢুলু আদিরা মিটমিট চোখে কলা খাচ্ছে……
‘ওরে আমার পিচ্চি কলা পাগলী’টা….’
হাত থেকে ফোনটা রেখেই আবির আদিরাকে জাপটে ধরে। নাকে, মুখে, কপালে চুমু দেয়। আদিরা প্রচন্ড রাগান্বিত ভঙ্গিতে জানান দিচ্ছে, ‘ওর কলা খাওয়াতে আবির বিঘ্ন ঘটিয়েছে।’ সরে যায় আবির। সরে গিয়ে সুযোগ করে দেয় কলা খেতে। আদিরা আপনমনে কলা খেয়ে চলছে।

পরদিন___
সকাল সকাল’ই জেগে উঠে আবির। বলতে গেলে বলতে হয় অনেকটা বাধ্য হয়েই উঠেছে। না হলে ছুটির দিনে এত তাড়াতাড়ি উঠার লোক আবির না। আসলে ফজর নামাজ শেষে একটু শুয়েছিল, কিন্তু পিচ্চি আদিরার কলকলানির আওয়াজে আর টিকতে পারল না।
‘ বাপরে বাপ!’ এত্ত কথা পারে কিভাবে? কথাটা বলেই আবির ঘুম ঘুম চোখে আদিরাকে নিয়ে পাশের যে রুমে নীলিমা শুয়েছে সে রুমে যায়। আদিরাকে কোলে নিয়ে’ই ওরুমের দরজা আংশিক ফাঁকা করে উঁকি দেয়। কিন্তু একি?!
নীলিমা যে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে ভেঁজা চুল আঁচড়াচ্ছে! দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে আবির। চোখ বড় বড় করে নীলিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘কি ব্যাপার? সকাল সকাল গোসল, ঘটনা কি?’ আবিরের দিকে তাকায় নীলিমা-
” ঘটনা মানে?”
আবিরের কোল থেকে নেমে আদিরা দৌঁড়ে নীলয়ের কাছে চলে যায়। নীলিমা তখনো জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা চুলকায় আবির।
” ইয়ে, না মানে আমি তো কালকে তো আমি ঐ রুমে ছিলাম! তবে কি তুমি স্বপ্নে…..(…)….???”
রেগে যায় নীলিমা। কথার মাঝখানে থামিয়ে দেয় আবিরকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে, ‘স্বপ্নে নয় বাস্তবে! আপনার গুনধর পুত্র প্রস্রাব করে পরনের জামা ভিঁজিয়ে দিয়েছে।’ মুখে দুষ্টু হাসির রেখা ফুটে আবিরের।
” উহ! আমি ভাবলাম কি না কি হয়েছে।”
কিছু বলতে গিয়েও বলেনি নীলিমা। প্রচন্ড রাগে রুম থেকে হনহনিয়ে বের হয়ে যায়।

ব্রেকফাস্টের পর___
আবির রুমে বাচ্চাদের সাথে খেলতেছে আর নীলিমা কিচেনে বাচ্চাদের জন্য খাবার তৈরি করতেছে। পাশে এসে দাঁড়ায় নীলিমার শাশুড়ি। পিছনে না ফিরেই প্রশ্ন করে নীলিমা- “মা! কিছু লাগবে?”
বাঁকা মুখে শাশুড়ির জবাব,
নাহ! আদিবার শ্বশুর বাড়ি থেকে কল এসেছে। ওর ননদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওরা বলেছে, বিয়ের কেনাকাটা করতে হবে। আদিবা যেন আদিত্যকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। আর আমাদেরও দাওয়াত দিয়েছে, বিয়ের দু’দিন আগে বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত থাকতে হবে। আমার শরীরটা’তো বেশী ভালো যাচ্ছে না। তাই আমি কোনো বিয়েটিয়েতে যেতে পারব না। কিন্তু তোমরা যেও। না হলে ব্যাপারটা খারাপ দেখা যায়। আর হ্যা, বিয়ের যেহেতু এখনো ১৫দিন বাকি তাই মুখে একটু ক্রিম-ট্রিম মেখে দেখো একটু সাদা হওয়া যায় কি না। বাজারে তো আজকাল অনেক ক্রিম’ই বিক্রি করে। একটা ক্রিম কিনে দেখো, রঙ’টা একটু ফর্সা হয় কি না।
কথাগুলো বলে’ই নীলিমার শাশুড়ি চলে যায়। নিঃশব্দে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে বাচ্চাদের খাবার নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায় নীলিমা।

নীলিমা রুমে ঢুকে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে আর আবির নীলিমাকে হেল্প করছে। খাওয়ানো শেষে বসা থেকে উঠে পরে আবির। হাটতে হাটতে দরজার কাছে চলে যায়। পিছন থেকে ডাক দেয় নীলিনা-
” শুনছেন?”
পিছনে ফিরে তাকায় আবির। তারপর—
আবির:- কিছু বলবে?
নীলিমা:- কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
আবির:- হুঁ, মায়ের রুমে।
নীলিমা:- আচ্ছা, তবে যান।
আবির:- কিছু লাগবে তোমার?
নীলিমা:- না, আপনি যান।
আবির:- না, আগে তোমার কথা বলো। কি বলতে চাইছিলে? কিছু লাগবে কি?

মাথা নিচু করে নীলিমা। তারপর নিচু স্বরেই বলে, আমার একটা জিনিস আনা খুব দরকার ছিল। ভাবলাম আপনি বাজারে যাচ্ছেন……
আবির:- ওহ! এই কথা? কি জিনিস?

‘দাঁড়ান, আমি কাগজে লিখে দিচ্ছি।’
নীলিমা কাগজে ছোট্ট অক্ষরে ত্বক ফর্সাকারী একটা ক্রিমের নাম লিখে দিল। কলেজে থাকাকালীন সময়ে অনেক মেয়েরা নীলিমাকে কটাক্ষ করে, ওকে নিয়ে ঠাট্টা করে বিভিন্ন ক্রিম ব্যবহার করার কথা বলত। তখন ওদের কথায় অপমানিত হলেও কষ্ট পায়নি। কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনলে আরেক কান দিয়ে বের করে দিত। আজ শাশুড়ির কথাটা ভিতরে গিয়ে আঘাত করেছে। মনে কষ্ট পেয়েছে নীলিমা। তাই সেদিন বান্ধবীদের সাজেস্ট করা ক্রিমের থেকে একটা ক্রিমের নাম লিখে দেয়। আবির কাগজটা ভাঁজ করে প্যান্টের পকেটে রেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, ঠিক আছে! আমি তবে এখনি নিয়ে আসছি….

কথাটা বলেই আবির বাজারের দিকে পা বাড়ায়। পুরো বাজারের কসমেটিকসের দোকান ঘুরে সবশেষে একটা দোকানে ক্রিমটার খুঁজ পাওয়া যায়। ক্রিমটা হাতে নিয়ে আবির বাসায় ফিরছিল। রাস্তায় বোন আদিবার সাথে দেখা হয়। ছেলে নিয়ে রিক্সাতে করে চলে যাচ্ছে বাসস্টপের দিকে। আবিরকে দেখে রিক্সাওয়ালাকে থামায়। প্রশ্ন করে আদিবা-
“দেখি তো ক্রিমটা?”
আবির বোনের দিকে ক্রিমটা এগিয়ে দেয়।
ক্রিমটার দিকে একনজর তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আদিবা। প্রশ্ন করে ছোট ভাইকে- ‘ নীলিমা নিতে বলেছে?’
মাথা ঝাকায় আবির। অনেকটা জোরেই হেসে দেয় আদিবা।
‘ আচ্ছা, নিয়ে দে ওকে।
দ্যাখ, এটা দিয়ে একটু সাদা হতে পারে কি না। শাশুড়ির মন রক্ষা করতে পারে কি না।কথাটা বলেই আদিবা চলে যায়।’

আবির এতক্ষণে বুঝতে পারল তখন দোকানের ছেলেটা কেন বলছিল, বাব্বাহ! ভাবিও রূপচর্চা করে তাহলে? রাগে পুরো শরীর কাপছে আবিরের। ৭মিনিটের রাস্তাও ৫মিনিটে গেল। ড্রয়িংরুমে বসে নীলিমা তখন টিভিতে রূপচর্চা বিষয়ক একটা অনুষ্ঠান দেখছিল। আবিরকে দেখেই চ্যানেলে পাল্টে টিভি বন্ধ করে ফেলল। নীলিমাকে কিচ্ছু না বলে আবির হনহনিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। নীলিমা নিচে বাচ্চাদের রেখেই আবিরের পিছু নেয়। আবির ওর রুমে না ঢুকে সরাসরি মায়ের রুমে ঢুকে। নীলিমাও পিছু নেয়। রুমে কাউকে না দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করে, মা কোথায়? নীলিমার জবাব, এইতো পাশের বাসায় গেছে। ওহ, বলে রুমে চলে যায় আবির। আবিরের পিছু পিছু নীলিমাও রুমে যায়। আবির হাত থেকে ক্রিমটা ড্রেসিংটেবিলের দিকে ছুঁড়ে মারে। নীলিমা ক্রিমটা ধরতে গেলে আবির বাঁধা দেয়। ‘খবরদার! ক্রিমে হাত দিবা না।’
চমকে যায় নীলিমা। হাত দিব না মানে? উগ্র মেজাজে আবিরের জবাব, হাত দিবা না মানে হাত দিবা না। প্রশ্ন করে নীলিমা, তবে এটা এনেছেন কেন? নির্লিপ্ত কন্ঠে আবিরের জবাব, এটা মায়ের জন্য। মাকে দিব। বুঝতে পারছ এবার? ভ্রু-জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে নীলিমার প্রশ্ন, মানে? মায়ের জন্য এনেছেন মানে? ক্রিমটা হাতে নিয়ে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে আবির জবাব দেয়, মানে খুব সহজ। এই ক্রিমটা মায়ের জন্য এনেছি। নীলিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, উফ! আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? এই ক্রিমটা ত্বক…..(…..)….???
পাশ থেকে আবিরের জবাব, ফর্সা করে তাইতো? আমি এ ক্রিমটা আমার মাকে ফর্সা করার জন্য’ই দিব। তবে সেটা বাহ্যিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য নয়। আমি এটা মাকে দিব অভ্যন্তরিন সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য। আমি এটা ওনাকে দিব। তবে মুখের নয়, মনের কালো দুর করার জন্য। এটুকু বলে আবির রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কলার চেপে ধরে নীলিমা-
নীলিমা:- কি করছেন কি?
আবির:- ছাড়ো, ছাড়ো বলছি….
নীলিমা:- মাথা নষ্ট হয়ে গেছে আপনার?
আবির:- হ্যা, আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। আমাকে ছাড়ো তুমি, ঐ মহিলার সাথে আজ’ই আমার শেষ দিন।
নীলিমা:- খবরদার! আর কখনো যাতে এরকম বাজে কথা না শুনি।(মুখ চেপে)
আবির:- আর কখনো বলতেও চাইনা। আজই শেষ বুঝাপড়া হবে ঐ মহিলার সাথে।
নীলিমা:- এবার কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আরেক বার যদি মহিলা শব্দটা শুনি না তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। আর আপনার একটুও বিবেকে বাঁধছে না নিজের জন্মদাত্রী মাকে ঐ মহিলা মহিলা করে বলতে? কেন এভাবে রেগে যাচ্ছেন? কি করেছেন ওনি?
আবির:- আজ ওনার পরামর্শেই তুমি ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমটা আনছ তাই না?
নীলিমা:-……. (স্তব্ধ হয়ে)
আবির:- কি হলো? মুখের বুলি শেষ হয়ে গেল এখনি?
নীলিমা:- দেখুন, আপনি অযথায় রাগ করছেন। ওনি আমাকে জাস্ট ক্রিমটা সাজেস্ট করছেন, এটুকুই। ওনি আমাকে ছোট বা অপমান করার মত কিছুই বলেননি। তাই প্লিজ শান্ত হোন।

রেগে যায় আবির। নীলিমার থেকে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। তারপর জোর গলায় বলতে শুরু করেন-
এতকিছুর পরও তুমি বলছ অপমান করেনি? দিনের পর দিন তোমার বংশ নিয়ে, তোমার গায়ের রঙ নিয়ে কথা শুনিয়েই যাচ্ছে, তারপরও বলছ অপমান করেনি? একটু কাজে ভুল না হতেই মা বাবা তুলে গালি দেয়, তাও বলছ অপমান করেনি? বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে সামান্য একটু খেতে চাইতা, তার জন্য কথার আঘাতে জর্জরিত হতে হয়েছে। তারপরও বলছ অপমান করেনি? আদিরা একটু কালো হয়েছে, এই জন্যও তুমি দায়ী। কথা শুনতে হয়েছে তোমাকে। নীলি, নিজেকে খুব চালাক আর আমাকে খুব বোকা মনে করো, তাই না? ভেবেছ আমি কিছু’ই জানি না? বাচ্চাদের ১ম জন্মদিনে মায়ের তিক্ত কথা সহ্য করতে না পেরে আদিরার মুখ পরিষ্কার করার জন্য সাবান দিয়ে মুখ ঘষতে ঘষতে রক্ত বের করে দিয়েছিলা, তুমি কি মনে করেছ? আমি সেসব জানি না? তোমার কি মনে হয়, আমি সুদুর ঢাকা থেকে প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার দিন বাসায় শুধু বাচ্চা দেখতেই আসি? তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে আড়ালে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে দেখিনি? তোমার কি মনে হয় আমি দেখিনি বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায়ও মা তোমার সাথে কিরকম বাজে ব্যবহার করত? তোমার কি মনে হয় আমি তোমার হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কষ্টকে অনুভব করতে পারি না? আমি সব জানি, সব বুঝি, সব দেখি। কিন্তু কিচ্ছু বলিনি এতদিন। মনে করেছিলাম, যাক না কিছুদিন! তারপর ভালো হয়ে যাবে আমার মা। শুধরে নিবে নিজেকে। কিন্তু নাহ। আমার মা ভালো হয়নি। পরিবর্তন হয়নি দৃষ্টি ভঙ্গির। আসলে কি জানো? ওনি কখনো শুধরাবার নয়। আজ তাই আমি ওনাকে কিছু কথা শুনাতে চাই। তারপর ওনাকে গুডবাই জানিয়ে আমি আমার বউ বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকা চলে যেতে চাই।

চলে যাচ্ছিল আবির। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আবিরের পথ আগলে দাঁড়ায় নীলিমা। প্লিজ, আপনি শান্ত হোন। একটু শান্ত হোন। রাগের বশবর্তী হয়ে এত বড় অন্যায় করবেন না। যত যায় হোক, আপনি ওনার সাথে এমন করতে পারেন না। কারন, ওনি আপনার মা। আপনাকে জন্ম দিয়েছেন। মানুষ করেছেন। আজ সামান্য কারনে আপনি ওনার সাথে এমন করতে পারেন না। এত বড় পাপ করতে পারেন না। মানছি ওনি আমাকে অনেক সময় অনেক কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছেন তার মানে এই নয় ওনি আমাকে ভালোবাসেন না! ওনি আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন। বিশ্বাস করেন ওনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন। আর ভালোবাসেন বলেই আমার সাথে রাগ দেখাতে পারেন। আর তাছাড়া ওনিও আমার মতো একটা জীবন অতিক্রম করে এসেছেন। যে জীবনে ওনিও আমার মতই বউ ছিল। আপনি একটা কথা বুঝতে পারছেন, এই যে ওনি আমাকে বলত এটা খাবে না, ওটা খাবে না। বেশী খাবে না। এগুলো আমার প্রতি কোনো রাগ থেকে বলেনি। এগুলো বলেছে কারণ ওনার সাথেও এরকম হয়েছে। ওনিও একসময় মুরুব্বীদের এসব কথা শুনেছে, মেনেছে। আর আমাকে এসব বলেছে বাচ্চার ভালোর জন্যই। কারন, ওনি এখনো মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন বেশী খেলে বাচ্চা জন্ম দেয়ার সময় কষ্ট হয়। টাকি মাছ খেলে বাচ্চার গায়ের রঙ কালো হয়। এগুলো কুসংস্কার। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এসব চলে আসছে। তাই এসব বিষয়ে এককভাবে ওনাকে দোষারোপ করা যায় না। আর সবচেয়ে বড় কথা যেটা সেটা হলো ওনার বয়স হয়েছে। এই সময় মানুষের মস্তিষ্কের..(………..)……পরিবর্তন ঘটে। যার ধরুন বুড়ো মানুষরা বেশী কথা সহ্য করতে পারে না, প্যানপ্যান করে। ওনার অনেক বয়স হয়েছে। তাই ওনার এসব করাটাই স্বাভাবিক। এখন আমরা যদি ওনার এসব কথাকে মনে নিয়ে বসে থাকি, তাহলে তো হবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি ওনাকে আমার মা বলে মেনে নিয়েছি। তাই আমি বেঁচে থাকতে, একজন মেয়ে বেঁচে থাকতে তার মাকে কেউ কষ্ট দিতে পারে না, আপনিও পারবেন না। দয়া করে শান্ত হোন। প্লিজ……

আবির চুপ হয়ে যায়। এত্ত সুন্দর কথা শুনার পর, আর কি বা কথা থাকতে পারে। রাগটা এতক্ষণে অনেকটা কন্ট্রোলে চলে আসে আবিরের। নীলিমাকে সরানোর চেষ্টা করে বলে, তবুও প্লিজ তুমি একটু সরো। আমি জাস্ট মাকে দুটো কথা বলে আসব।
বাঁধা দেয় নীলিমা। ‘কোথায়ও যাবেন না আপনি। একটা কথাও বলতে পারবেন না আপনি ওনাকে।’ আবির নীলিমাকে সরানোর চেষ্টা করছে, নীলিমা যেতে দিচ্ছে না। একপর্যায়ে নীলিমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ছিটছিনিতে হাত দেয় আবির, তখনি বসা থেকেই কাঁদতে শুরু করে নীলিমা। আবির তাকিয়ে দেখে নীলিমা ফ্লোরে পরে আছে। আমি ছিটকিনি না খুলে নীলিমাকে উঠায় আগে। ‘স্যরি….’
কাঁদতে থাকে নীলিমা। কাঁদতে কাঁদতেই আবিরের একটা হাত চেপে ধরে।
” দয়া করে আপনি ওনাকে কিছু বলবেন না। আপনাকে ওনি অনেক ভালোবাসেন। মেনে নিতে পারবেন না ওনি আপনার কথাগুলো। কষ্ট পাবেন ওনি, ভিষণ কষ্ট। প্লিজ, নিজেকে একটু শান্ত করেন। এভাবে রাগ দেখাবেন না। এতে সংসারে ফাঁটল ধরবে। আপনি একটু বুঝার চেষ্টা করেন। মাকে এভাবে কথা শুনালে আমার নিজেকে বড্ড ছোট মনে হবে। এরপর আমি মায়ের সামনে দিয়ে হাঁটতেই পারব না। তাই আমার কথাটা শুনুন…..
আবির নীলিমার হাত থেকে ওর হাতটা সরিয়ে নিয়ে নীলিমার চোখের জল মুছে দেয়। তারপর মুখে জোর করে হাসির রেখা টেনে বলে, ঠিক আছে! আমি কিচ্ছু বলব না। তুমি যাও রেডি হয়ে নাও। ঢাকায় যাব আমরা।

আবির চলে যাচ্ছিল। পিছন থেকে নীলিমার প্রশ্ন, পালিয়ে যাচ্ছেন? পিছনে তাকায় আবির। নীলিমা বলে উঠে, কিন্তু পালিয়ে কিংবা এড়িয়ে গেলে যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। আঘাতের বদলে আঘাত নয়, ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে হয়। কবি জসীমউদ্দীনের ‘প্রতিদান’ পড়েননি? কবিতায় ওনি বলেছেন,
ওনার ঘর যে ভেঙেছে ওনি তার ঘর বাঁধে, ওনাকে যে পর ভেবে দুরে সরিয়ে দিয়েছে, তাকেই আপন করার জন্য কাঁদে। যে ওনার দিকে বিষে ভরা তীর ছুঁড়ে দিয়েছেন, ওনি তাকেই বুক ভরা গান দেন। যে কুল ভেঙেছেন, ওনি তারই কূল বাঁধেন। যে ওনাকে বুকেতে আঘাত করেছে, ওনি তারই জন্য কাঁদেন। প্রকৃতপক্ষে জীবনের সার্থকতা তো এখানেই বুড়ো। দরজার সামনে থেকে আবারও ফিরে আসে আবির। নীলিমাকে বুকে টেনে নেয়। কপালে উষ্ণ ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে বলে, ঠিক আছে আমার পাকনা বুড়ি’টা। আমি পালিয়ে যাব না। তবে কাল কিন্তু যেতেই হবে। বাচ্চারা মোটামুটি বড়’ই হয়েছে, আর ওখানে শ্যালিকা শাশুড়ি মাও আছেন। তাই আর কিন্তু না করা যাবে না। হেসে দেয় নীলিমা। ঠিক আছে। কাল যাব। আজকে রাত্রে বাবা আসলে মা-বাবাকে কথাটা জানাবো আগে। কেমন? একটা মৃদু হাসি দিয়ে আবির বলে, ওকে।

সেদিন রাত্রে শ্বশুরের অনুমতি নেয়ার পর নীলিমা ওর শাশুড়ি মায়ের রুমের দিকে যাচ্ছিল। দরজার সামনে গিয়ে থমকে যায় নীলিমা। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ওর শাশুড়ি কাঁদছে। খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে আস্তে, আস্তে কাঁদছে। বুকের ভেতরটায় কিরকম হাঁহাকার করে উঠল। এতবছরের বৈবাহিক জীবনে আজই প্রথম নীলিমা ওর শাশুড়ির চোখে পানি দেখছে। এখন ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না এই ভেবে নীলিমা দরজার সামনে থেকে বিদায় নিচ্ছিল, ডাক দেয় শাশুড়ি। ” ভিতরে আসো….”
নীলিমা ভীরু পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
“বসো….”
বিছানার পাশে বসে আমতাআমতা করতেছে নীলিমা। ইয়ে না মানে মা আমরা….(……)…..???
“কালকে চলে যাবে, তাই না?”
শাশুড়ির দিকে হা করে তাকায় নীলিমা। কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই নীলিমার একটা হাত চেপে ধরে শাশুড়ি।
‘ মারে! আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ইচ্ছে করে তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি, তোকে কাঁদিয়েছি। গালি দিয়েছি মা বাপ তুলে। আমি বড্ড ভুল করেছিরে মা। ছাই ভেবে আমি হিরাকেই দুরে সরিয়ে দিয়েছি। খুব অন্যায় করে ফেলেছি আমি, আমায় মাফ করে দে মা। আমাকে একা করে দিয়ে যাস না। আমি আমার নাতি-নাতনিকে নিয়ে জীবনের শেষ সময়টা কাটাতে চায়।”

শাশুড়ির মুখ থেকে এমন কথা শুনে বড্ড মায়া হয় নীলিমার। কিন্তু কিচ্ছু করার ছিল না চোখের দু’ফোঁটা জল ফেলা ছাড়া। কারন, নীলিমা আবিরকে কথা দিয়ে ফেলেছে কাল চলে যাবে ওর সাথে।
‘মা! আমাদের কাল যেতে হবে। সকাল সকাল’ই রওয়ানা দিব।’
কথাটা বলেই নীলিমা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আবিরের মা চোখের জল ছেড়ে দেয়। এ জল অনুশোচনার। একটা খাটি হিরার টুকরাকে হাতের কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলল, সেই অনুশোচনায়। সকালে পাশের বাড়ি থেকে ফিরে আদিরা নীলয়কে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখে প্রচন্ড রেগে ওদের নিয়ে যাচ্ছিল আবিরের রুমের দিকে নীলিমার কাছে। তখন’ই ওদের কথা শুনতে পায়। বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দিয়ে সব কথা শুনে নেয় আবিরের মা। অনুশোচনার জন্মটা ঠিক তখন থেকেই। পরদিন সকালে আবির ওর বউ বাচ্চা নিয়ে রওয়ানা হয়ে যায় ঢাকার দিকে। ছোট্ট নীলয় বার বার দাদীর দিকে ফিরে তাকিয়ে চিৎকার করছিল কোলে উঠার জন্য, দাদীও ছুটে আসছিল কোলে নিতে কিন্তু আবির দেয়নি। জোর করে বাচ্চাদের নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। হু, হু করে কেঁদে দেয় আবিরের মা। দু’চোখের লোনাজলে গাল ভিঁজে একাকার। এ কান্নার শেষ কোথায় ওনি নিজেও জানেন না…..

দেখতে দেখতে ৭বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। ছোট্ট আদিরা-নীলয় ৯বছর বয়সে পদার্পণ করে। আবির নীলিমার বিবাহের বয়স তখন আঠারো। নভেম্বরের কোন এক তারিখে আবির ওর কলেজ স্টার্ভদের সাথে সফরে বের হয়। পুরো ৭দিনের সে সফর।

নভেম্বরের ১৩ তারিখ ছিল ওদের ১৮তম বিবাহবার্ষিকী।
নীলিমা ফোন দিল, ১৮তম বিবাহবার্ষিকী পালন করার জন্য বাসায় আসতে হবে। আবির তখন সিলেট সফরে গিয়েছিল। বলল, ৭দিনের সফর। তার আগে আসা যাবে না। তাই এবার বিবাহবার্ষিকী পালন করা হবে না। সত্যি বলতে নীলিমার জন্য একটা হার বানাতে দিয়েছিল আবির। বিশ হাজার টাকা বাকি ছিল। চিন্তা করল, হারের বকেয়া টাকাটা পরিশোধ করে নীলি বুড়িকে আঠারো তম বিবাহবার্ষিকীর একটা চমক তো দেয়া যায়। আইডিয়া অনুযায়ী বেতনসহ কলিগ মারুফের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করল। সফরে কলিগদের থেকে বিদায় নিয়ে চারদিন আগেই রাতে বাড়ির দিকে রওনা হলো। নীলির হার তৈরি করতে দেয়া হয়েছিল ওর বাবার বাড়িতে। আবির শ্যালিকাকে ফোন করে বলল, লিমা, তুমি বকেয়া টাকা পরিশোধ করে হারটা বানিয়ে রাখো, আমি গিয়ে টাকা দিয়ে নিয়ে আসব। কিন্তু তোমার বোন যেন না জানে। এদিকে আবির ওর বোন আদিবাকে ফোন করে বলল, আদিরা-নীলয়কে যেন ২দিনের জন্য ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়। ভাইয়ের কথামতই আদিরা নীলয়কে নিয়ে গেল আদিবা। ১২ তারিখে খুব ভোরে গিয়ে দরজায় নক করল আবির।

কে?
আমি, দরজা খুলো।
নীলিমা প্রথমে দরজা খুলতে চাইল না।
তারপর শিউর হওয়ার পর দরজা খুলে আবিরকে জড়িয়ে ধরতে এলে আবির ওকে থামিয়ে দিল। নীলিমার তো অনেক প্রশ্ন, কেন ফোন দিলেন না? সফর রেখে হঠাৎ চলে এলেন যে? নাকি শরীর খারাপ… ইত্যাদি।

আবির শুধু বলল, আমি তো আর আকাশপথে আসিনি? আমি সারারাত জেগে বাসে করে এসেছি। একটু ঘুমাতে হবে। নীলিমা খুব মন খারাপ করল। আবির শুয়ে পড়লে নীলিমাও শুয়ে পড়ল।
একটু পর আস্তে আস্তে আবিরের দিকে এগিয়ে এসে আবিরের শরীরের সঙ্গে লেগে গেল। আবির ওকে একঝটকায় সরিয়ে দিয়ে রাগত স্বরে বলল, একটু ঘুমোতে দেবে? নীলিমা খুব ভয় পেল। কিছু না বলে রান্না করার জন্য উঠল। টুকটাক শব্দে আবিরের ঘুম ভাঙল। তখন সকাল প্রায় দশটা। ঘুম থেকে উঠে আদিরা-নীলয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে গোসল সেরে রুমে এল আবির। নীলিমা ভাত বেড়ে টেবিলে বসে ছিল। আবির রুমে আসতেই নীলিমা আবিরের হাত জড়িয়ে ধরে বলল, বলুন, আমি কি অপরাধ করেছি, আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন? বলেন, কি ভুল করেছি আমি। পাশ থেকে আবির বলে উঠল, দোষ তোমার না, ভুল-দোষ সবই আমার। আমার এই পোড়া কপালের।
“ভাত খান।”
যদি তোমার ক্ষিধে লাগে আর যার জন্য রান্না করেছ তাকে খাওয়াও। এই বলে ভাত না খেয়ে শার্ট-প্যান্ট পরে রওনা দিতেই নীলিমা পা ধরে জোর গলায় কাঁদতে লাগল। নীলিমা শেষবারের মত বলল, একবার বলুন, কোথায় যান?
আবির বলল, সুখের খুঁজে।

ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে শ্যালিকাকে ফোন দিল আবির। জিজ্ঞেস করল, কোথায় আছ? লিমা বলল, ভাইয়া এইতো বাজারের কাছাকাছি।
লিমা, নীলি যেন কোনোভাবেই না জানে। আমি কিন্তু বাসা থেকে রাগারাগি করে এসেছি। ফোন দিলে বলবা না যে আমি তোমাদের বাড়িতে আসছি। আর হারের কথা তো বলবেই না।

ওদের শ্যালিকা-দুলাভাইয়ের খেলা আবিরের শাশুড়িও জানতেন না। দুপুর দুটোর দিকে শ্বশুর বাড়িতে গেল আবির। শাশুড়ি তো অবাক।
বাবা, তুমি? নীলিমা কই?
আবির কোনো কথা না বলে ঘরে গিয়ে বসল। আবিরের শাশুড়ি পিছু পিছু গিয়ে আবিরের পাশে বসে বলল, বাবা, আমাকে বলো কি হয়েছে? আবির কিছু না বলে চুপ করে থাকল। শ্যালিকা হারটা এনে মাকে দেখালো। আবিরের শাশুড়ি বললেন, এই তাহলে শ্যালিকা-দুলাভাইয়ের খেলা? আবির শাশুড়িকে বলল, মা, এই কথা নীলিমাকে বলবেন না। খাওয়া-দাওয়া করার সময় শাশুড়ি বললেন, ভাগ্যিস লিমা ঢাকা থেকে আসার সময় মাংস এনেছিল। তা না হলে আলু ছানা দিয়ে ভাত খাওয়া লাগত।

তারপর আবির ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সরাসরি বাসায় না গিয়ে বাজারে দেরী করে রাত আটটায় বাসায় গেল। সারাদিন ফোনও বন্ধ ছিল। বাসায় এসে না খেয়েই শুয়ে পড়ল আবির। নীলিমা আবার পায়ের কাছে এসে প্যানপ্যানানি শুরু করল, কি দোষ আমার? কেন এমন করলেন? আপনার ফোনও সারাদিন বন্ধ। আমি সারাদিন কিছুই খাইনি। একটু পর বলল, ঠিক আছে, কথা না বললে না বলেন, চলেন খাবেন। আবির তবু গেলো না। ঘুমানোর ভান করে শুয়ে থাকল। ঘন্টাখানেক পর নীলিমা কেঁদে শুয়ে পড়ল। তবে আবিরের শরীর ঘেষে নয়। এভাবে রাত এগারোটা পঞ্চাশ মিনিট পর্যন্ত ছিল। নীলিমা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল। নীলিমাকে জাগিয়ে ঠিক এগারোটা ঊনষাট মিনিটে আবির বলল, চোখ বন্ধ করো। নীলিমা চোখ বন্ধ করতেই আবির হারটা বের করে নীলিমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল, চোখ খুলো।
চোখ খুলে নীলিমা তো অবাক। প্রায় পাঁচ মিনিট আবিরের দিকে চেয়ে থেকে কেঁদে ফেলল। তারপর আবিরের বুকে মুখ লুকাল। আবির নীলিমার মাথায় হাত রেখে ডাকল। নীলিমা এমন হাসি দিল, মনে হলো সারা ঘর ওর হাসিতে কেঁপে উঠল। দালান ঘরে হাসিটা চার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। আবির বিশ্বাস করতে পারছিল না, নীলিমা এভাবে হাসতে পারে। সেদিনই মানল, নীলিমার মতো পৃথিবীতে আর কেউ হাসতে পারে না। আবির মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখছিল। তা দেখে নীলিমা লজ্জা পেয়ে আবিরের বুকে মাথা রাখল। আবির নীলিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। তারপর আচমকায় গেয়ে উঠল-
সানাইটা আজ বলছে কি
আমি জানি সেই কথা
রাত জেগে কেউ শুনছে কি
আমি শুধু শুনছি তা
কি করে বলি এই প্রাণ চায় যা।
আজ মধুর রাত আমার ফুলশয্যা….

লজ্জায় ক্ষাণিকটা দুরে সরে গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল নীলিমা। আবির চুপিচুপি বলল, ওঠো, খেয়ে নেই। আজ তোমাকে অনেক ভালোবাসা দেব। আর তা নিতে তো শক্তির প্রয়োজন আছে, তাই না? নীলিমা হেসে বলল, চলেন খেয়ে নিই। তারপর আবার সেই হাসি।

♪সমাপ্ত♪

ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ২৫

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ২৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

” আল্লাহর রহমতে মা এবং সন্তান তিনজন’ই সুস্থ আছেন।”

মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠে আবিরের। বিনীত প্রশ্ন করে ডাঃ নুসরাতকে-
” আমরা এখন ভিতরে যেতে পারি?”

ডাঃ নুসরাত মিষ্টি হেসে বলেন,
কেন নয়? রোগীকে কেবিনে নেয়া হয়েছে। আপনারা এখন যেতে পারেন সেখানে। অত্যন্ত খুশি মনে থ্যাংক ইউ মেডাম বলেই আবির দৌঁড় দেয়। আবিরের পিছু পিছু আর সবাই আসে। বেডের উপর চুপটি করে নীলিমা শুইয়ে আছে। বাচ্চা দুটি তার ঠিক পাশের একটা দোলনায় শুয়ে আসে। ধীর পায়ে আবির এগিয়ে যায় দোলনার দিকে। আদিবার ছেলে আদিত্য তো পাগল বানিয়ে দিয়েছে বাবু দেখব, বাবু দেখব বলে। আদিত্যকে কোলে তুলে নেয় আবির। তারপর দোলনার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দুটো নিস্পাপ বাচ্চা দোলনায় একসাথে শুয়ে পা নাড়াচ্ছে। খিলখিল শব্দে হেসে উঠে আদিত্য-
” আম্মু ২বাবু, আম্মু ২বাবু….”
আদিত্যর এমন হাসি এবং আবিরের অপলক চাহনীর রহস্যটা বোধ হয় ছোট্ট দুই বাচ্চা জেনে গিয়েছিল। আর তাইতো পায়ের পাশাপাশি এখন হাত উপরের দিকে দিচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো-
দুটি বাচ্চায় একসাথে একই ভঙ্গিতে পা নাড়াচ্ছিল, এখন সেই একই ভঙ্গিতে হাত উঁচু করে নাড়াচ্ছে। আবিরের কাছে মনে হচ্ছিল যেন, বাচ্চা দুটো ওকে হাত বাড়িয়ে কোলে নেয়ার জন্য বলছে। আবির ধরতেও চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।
” ভাইয়া সরেন তো!
অনেক দেখছেন। পরে দেখবেন আবার। এখন আমাদের দেখার সুযোগ করে দেন।”

নীলিমার বোন লিমা কথাটা বলেই আবিরকে সরিয়ে দেয়। আবিরের বোন দুলাভাই, হিয়া, লিমা সবাই হুড়মুড়িয়ে দোলনার কাছে যায়। উপর থেকে বাচ্চার হাত পা ধরে নাড়িয়ে মুরুব্বীদের সুযোগ করে দেয় দেখার জন্য। আবির এবং নীলিমার মা দুজনেই যেন খুশিতে আত্মহারা। দুই বেয়াইন’ই বাচ্চার কাছে গিয়ে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বাচ্চা কোলে তুলে নেয়।
” ওরে আমার ভাইটারে”
কথাটা বলেই আবিরের মা ছেলেটাকে কোলে তুলে নেন। বাচ্চাকে নিয়ে হেঁটে, ঝাকিয়ে নিজে নিজেই কথা বলতে শুরু করেন। মেয়েটাকে কোলে নেন নীলিমার মা। পলকহীনভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপালে চুমুর পরশ এঁকে দেন। সেই কখন থেকে মা তার সন্তানদের বুকে জড়িয়ে নেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন। নীলিমার মা ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। মেয়েটাকে নীলিমার কাছে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন ওনি। কোলের কাছে মেয়েকে পেয়ে পরম আবেশে বুকে জড়িয়ে নেয় নীলিমা। চুমু খায় মেয়ের নাকে, কপালে। এদিকে মা ছোট বোনকে আদর করছে এটা যেন সহ্য’ই করতে পারছিল ছোট্ট ছেলেটা। তাইতো আচমকায় ঠোঁট ভেঙে কান্না শুরু করে। শত অভিনয় করেও দাদী তার নাতির কান্না থামাতে পারেনি। এদিকে নীলিমার কোলে থাকা মেয়েটাও অনর্থক ভ্যাঁ, ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে। এ ঘটনায় সবাই অবাক। অবাক হয়নি হিয়া। তাইতো নীলিমার শাশুড়ির কাছে গিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন-
” আন্টি! ওদের মনে হয় খিদে পেয়েছে।”

“ওহ, হ্যা….”
কথাটা বলেই নীলিমার শাশুড়ি ছেলেটাকে নিয়েও নীলিমার পাশে শুইয়ে দেয়।
আবির ছাড়া বাকি সবাই বের হয়ে যায় রুম থেকে। নীলিমার কাছে যায় আবির।
জিজ্ঞেস করে, কেমন বোধ করছ এখন?
ধীর কন্ঠে ভালো বলে মাথা ঝাকায় নীলিমা। আবির নীলিমার কপালে উষ্ণ পরশ এঁকে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে-
” Thank you.Thank you so much,
আমাকে এত মূল্যবান দুটো গিফ্ট দেয়ার জন্য।”

মৃদু হাসে নীলিমা। বাচ্চা দুটোকে খাওয়ানো হলে দুটো বাচ্চার কাছে যায় আবির। দু’হাতে বাচ্চা দুটোকে আদর করে আলতো করে নাকে, মুখে চুমু খায়।

আবির মনে মনে ভাবে আমাকে তো বলা হয়েছিল এক বাচ্চা হবে। মেয়ে বাবু। আমি তো ছেলে বাবুর নাম রাখিনি…..
আচ্ছা, বাবুদের নাম কি….(…)…???
পুরো কথা বলতে পারেনি আবির। তার আগেই পাশ থেকে বলে উঠে নীলিমা-
” নীলয়, আদিরা…”
বিস্মিত দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে ফিরে তাকায় আবির। প্রশ্ন করে-
” মানে তুমি আগে থেকেই…..(…..)….???”
হুঁ, তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য বলিনি। হেসে দেয় নীলিমা। নীলিমার সাথে আবিরও হেসে দেয় পরম সুখে।

৭দিন পর রাত্রে__
বাচ্চাদের কাপড় চোপড় গুছিয়ে চেয়ার টেনে এসে বিছানার পাশে বসে আবির।
” তাহলে বাচ্চার নাম কি স্থির হলো?”
পাশ থেকে নীলিমার জবাব, ওদের নানী মেয়ের নাম রাখছে নুহা, দাদী রাখছে ছেলের নাম আশফাক।

চিন্তিত মনে গালে আঙুল টুকে বিজ্ঞের মত বলে উঠে আবির-
সার্বিক দিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে-
আমার বাবার নাম___
আশফাক মাহমুদ ‘নীলয়’
আর মায়ের নাম__
আদিরা মাহমুদ ‘নুহা’…..

নীলিমা:- হুঁ! আশফাক, নুহা…
আবির:- নাহ। নীলয়, আদিরা…
নীলিমা:- বললাম তো আশফাক, নুহা…
আবির:- বললাম তো নীলয়, আদিরা।
নীলিমা:- না, না! আশফাক, নুহা।
আবির:- বললাম তো নীলয়, আদিরা….
নীলিমা:- উফ, বুইড়া! বাদ দেননা, পাঠকের উপর ছেড়ে দেন।
আবির:- হা, হা! ঠিক আছে…..

দেখতে দেখতে বাবুদের বয়স একমাস পূর্ণ হয়ে যায়। এদিকে আবিরের ছুটির দিনও শেষ হয়ে আসে। ফিরে যায় আবির ঢাকায়। যাওয়ার আগে নীলিমা ও তার বাচ্চাদের যাতে কোনো অযত্ন না হয় সেজন্য আবির গ্রাম থেকে নীলিমার মাকে এনে রেখে যায়। যদিও নীলিমার মা দিন পনেরো এখানেই ছিল। যায় হোক! গ্রাম থেকে নীলিমার মা এসে সারাক্ষণ বাচ্চাদের পিছনেই পরে থাকত। এটাই যেন ওনার একমাত্র কাজ। এর ছাড়া বাসায় তেমন কাজও ছিল না। রান্নাবান্নার কাজ করার জন্য আবির আগেই আলাদা মহিলা রেখে দিয়ে গেছে। সেদিন বিকেলে বাচ্চারা ঘুমালে রুমে খোলা জানালার পাশে গিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে দেয় নীলিমা। তখনি কেউ একজন বলে উঠে-
” মারে!
এই জাহেলকে কি কখনো’ই কি
আর ক্ষমা করা যাবে না?”
কিছুটা চমকে পিছনে ফিরে তাকায় নীলিমা। মাকে দেখে স্বাভাবিক হয়। নীলিমার মা আবারো বলে উঠেন-
” জেদের বশে এ আমি কি করলাম?
কিভাবে পারলাম আমি এটা করতে? তরতাজা একটা আঙ্গুল’ই কেটে ফেললাম আমি? এ জীবনে কখনোই যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না! এই একটা অপরাধের জন্য সারাটা জীবন প্রস্তাতে হবে। নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না। বিবেকের কাছে অপরাধী হয়েই থেকে যাব মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।”

মৃত্যু কথাটা শুনা মাত্রই মায়ের হাতটা চেপে ধরে নীলিমা। চুপ হয়ে যায় মা। মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। জল ছলছল দৃষ্টিতে নীলিমা তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। আবার একই কথা শুরু করলে কথার মাঝখানে থামিয়ে দেয় নীলিমা।
” মা! জন্মের পর থেকেই দেখেছি আপনি বাবা, চাচা-চাচি, ফুফু, দাদা-দাদী, নানা-নানীকে কিরকম শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন, সম্মান করতেন। উচ্চস্বরে কথা তো দুরে থাক, শত কিছুর পরও কখনো ওনাদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন না। তার’ই মেয়ে আমি। যে আমাকে আপনি নিজে নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন, সেই আমি আপনার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলেছি। শুধু চোখে রাঙ্গিয়েই ক্ষান্ত হইনি, আপনাকে তুই তুকারি করে গালিগালাজ করেছি। মাগো, যেখানে আমার কথা ছিল পুরো ঘটনা আপনাকে খুলে বলা, সেখানে আমি তা না করে আমার জামাইকেও গালিগালাজ করেছি। একজন আদর্শ পরিবারের সন্তান হয়ে, আদর্শ মায়ের সন্তান হয়ে আমি এরকম কাজ করছি। মা আপনি তো আমার আঙ্গুল কেটেছেন, এখানে অন্য কোনো মা হলে হাতটাই কেটে দিত। মা, আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি। আর এটাও বুঝতে পারছি আমি আমার দোষেই আঙ্গুল হারিয়েছি, আমার পাপের সাজা পেয়েছি। মা, এখানে আপনার কোনো হাত নেই। তাই দয়া করে ‘ক্ষমা কর, ক্ষমা কর’ করে আমার পাপের বোজাটা ভারী করে দিবেন না। হাতজোর করছি আপনার কাছে, দয়া করে আর কখনো ক্ষমা করার কথা বলে আমাকে ছোট করে দিবেন না।”

আনন্দে দু’চোখের জল ছেড়ে দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন নীলিমার মা। মসজিদ থেকে আসরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসলে ওজু করে নামাজ পড়ে নেয় নীলিমার মা। নামাজ শেষে মোনাজাতে বসে অনেকটা গর্বের সাথে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায় নীলিমার মত মেয়ে যাতে বাংলার প্রতিটি ঘরে জন্ম নেয়।

মাসখানেক থাকার পর খবর আসে নীলিমার ছোট ভাই লিমন হোস্টেল থেকে ফিরে এসেছে বাসায়। ও নাকি অনেক অসুস্থ। নীলিমার মা নীলিমার থেকে বিদায় নিয়ে গ্রামে চলে যায়। এদিকে আদিবা আপুর হাজবেন্ডও ব্যবসায়ের কাজে বিদেশে চলে যায়। আদিবা তাই ছেলে আদিত্যকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। বাসায় আদিবার কোনো কাজ ছিল না বিধায় নীলিমার বাচ্চা নিয়ে বসে থাকত। বাসায় শ্বশুর ননাসের ভরসায় আবারো চেম্বারে বসতে শুরু করে নীলিমা। এক দুপুরে আদিবা সোফায় ওর মা এবং ছোট্ট নীলয়ের পাশে আদিরাকে রেখে মিনিট দশেকের জন্য রান্নাঘরে যায়। ঠিক তখনি আবিরের কাজিন রুবেলের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী লিজা আসে বাচ্চা দেখতে। আবিরের মা খুশিতে গদগদ হয়ে নাতি নীলয়কে লিজার কোলে তুলে দেন। লিজাকে যেন ছেলে নীলয়ের চেয়ে মেয়ে আদিরা’য় বেশী টানছিল। সোফায় আদিত্যর পাশে বসেও কিরকম মায়াবী চাহনীতে লিজার দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা হাসি দিয়ে নীলয়কে দাদীর কোলে দিয়ে লিজা আদিরাকে কোলে তুলে নেয়। দু’গালে, নাকে চুমু দিয়ে অনর্গল কথা বলতে থাকে বাঁচাল প্রকৃতির লিজা। হাপিয়ে উঠলে বিরাম নেয়ার জন্য থেমে যায়। থেমে গিয়েও প্রশ্ন করে আবিরের মাকে-
” কাকিমা! আদিরা কার মত হইছে?”

কার মত আর হবে? মা যখন কালো তখন আর কার মত হবে? মায়ের রং’ই পাইছে। রাখো তো ওকে কোল থেকে। তোমার নতুন বিয়ে হয়েছে। কয়দিন পর বাচ্চা হবে। এখন এরকম কালো বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিও না। এখন যত পারো সুন্দর সুন্দর ছেলে বাচ্চা দেখবা, সুন্দর ছেলে বাচ্চাদের ক্যালেন্ডার টানিয়ে রাখবা ঘরে। তবেই না সুন্দর ছেলে হবে। অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আবিরের মা রুবেলের বউ লিজাকে কথাগুলো বুঝাচ্ছিল। এর মাঝে কখন যে ছোট্ট আদিরা আদিত্যর কোল থেকে পরে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে কিছুই টের পায়নি। টের পায় তখন যখন আদিবা বলতেছে-
” এই নীলিমা! কি হয়েছে তোর? এভাবে ঠাপাচ্ছিস কেন ওকে?”

আবিরের মা এবং লিজা দুজনেই পাশে ফিরে তাকায়। ততক্ষণে ছোট্ট আদিরা চিৎকার দেয়। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হু, হু করে কেঁদে উঠে নীলিমা। আজ ওনারা যেভাবে আমার বাচ্চাটাকে আদিত্যর কোলে তোলে গল্প মশগুল ছিল, আজ আমি আসলে বোধ হয় আমার মেয়েটা মরেই যেত। কথাটা বলেই মেয়েটাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে নীলিমা।
আদিবা আদিত্যকে ধমক দিলে আদিত্য গড়গড় করে বলতে থাকে-
” আমার কি দোষ! নানু’ই তো ওকে ঐ নতুন মামির কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে। তারপর সোফায় ঠাস করে বসিয়ে রেখে দিছে। নতুন মামীকে বলতেছে বোন নাকি কালো, ওর মায়ের মত। ওরে যাতে কোলে না নেয়।”

আদিত্যর কথা শুনে থ হয়ে যায় আদিবা।
নীলিমা চোখের জল ছেড়ে দিয়ে দৌঁড়ে রুমে চলে যায়।
” ছি, মা! ছি!
তুমি এখনো শুধরাতে পারো নি।”

কথাটা বলেই মায়ের কোল থেকে ছোট নীলয়কে নিয়ে রুমে চলে যায় আদিবা।

২বছর পর__
সেদিন রাত্রি ৮টার দিকে ঢাকা থেকে আবির আসে। হন্যে হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই দেখে সবাই বসে টিভি দেখছে। আবির সে অবস্থায়’ই ওর বাবার কোল থেকে ছেলে নীলয়কে নেয়। কিছুক্ষণ আদর করে বলে, আপু আদিরাকে যে দেখছি না? ও কোথায়? আদিবা কিছুটা মলিন মুখে বলে, উপরে নীলিমার সাথে নিজের রুমেই আছে। আবির দৌঁড়ে উপরে উঠে।
দরজার বাইরে থেকেই বলে উঠে,
মামনি! আমি এসে গেছি…..
কিন্তু একি?!!!
আদিরা কাঁদছে কেন? আবির দৌঁড়ে রুমে ঢুকে দেখে আদিরাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে আছে নীলিমা। এমন শক্ত যে ওর নিশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছিল। ‘এসব কি করছ? ওকে এভাবে কেন জাপটে ধরে আছ?’ কথাটা বলেই নীলিমার হাতটা সরিয়ে আদিরাকে কোলে নিতে চাচ্ছিল আবির। নীলিমা এক ধাক্কায় আবিরকে ফেলে দিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে।
” আশ্চর্য! তুমি এমন করছ কেন?”
নীলিমা আরো শক্ত করে ধরে রাখছে আদিরাকে। আবির আবারো কোলে নিতে গেলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে অন্য রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে রাখে।

আশ্চর্য!
এর আবার কি হলো?
কথাটা বলতে পিছনে ফিরতেই দেখে আদিত্য দাঁড়িয়ে।
” মামা, মামা!
জানো, আজকে নীলি মামীরে নানু বকছে। মামী কেন কালো এজন্য নাকি আদিরাও কালো হয়েছে। আদিরাকে আদর করে না নানু। নানু আরো বলছে, আদিরা’কে নাকি টাকা দিয়ে বিয়ে দিতে হবে।

মোটামুটি বড়’ই হয়েছে আদিত্য। যা শুনে, যার বিরুদ্ধেই শুনে তাকে গিয়েই লাগিয়ে দিতে পারে কথা। আবির ক্ষেপে যায়। জার্নি করে বাসায় ফিরছে, তবুও একদন্ডের জন্যও বিশ্রাম নেয়নি। বাজারে চলে যায়। বাজার থেকে ফিরে আসে। নীলিমাকে জোর করে ভাত খাইয়ে দিয়ে নিজেও কিছু খেয়ে নিল। তারপর আদিরাকে দখল করে নিল। কিচ্ছু বলেনি নীলিমা। চুপচাপ নীলয়কে কোলে নিয়ে অন্য রুমে গিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। কথা বাড়ায়নি আবির। যা হবার সকালেই হবে। বাজার থেকে কিনে আনা কলার মধ্যে কিছু কলা দরজার ফাঁক দিয়ে নীলিমার বিছানার উপর ছুঁড়ে দেয়। তারপর আদিরাকে নিয়ে অন্যরুমে শুয়ে পরে। মাঝরাত্রে বিছানায় প্রস্রাব করে দেয় আদিরা। বিছানা থেকে প্রস্রাব মুছে শুয়ে পরছিল আবির, তখনই কান্না শুরু করে আদিরা। কিছুক্ষণ কোলে রেখে পিঠে হাত বুলিয়ে, কান চুলকিয়ে দিলে ঘুমিয়ে পরে আদিরা। বিছানার পাশে কলাগুলো রেখে শুয়ে পরে আবির। মিনিট ত্রিশেক পর শুনতে পায় চপচপ শব্দ। শব্দটা ঠিক পাশ থেকেই আসছিল। মনে হচ্ছে আদিরার কলার উপর ইঁদুর হামলা করেছে। আস্তে আস্তে ফোনটা হাতে নিয়ে টর্চটা জ্বেলে দেয়। কিন্তু একি?
” এ যে ছোট ইঁদুর….”
হেসে দেয় আবির। ঘুমে ঢুলুঢুলু আদিরা মিটমিট চোখে কলা খাচ্ছে……

[বিঃদ্রঃ- গল্পের সর্বশেষ পর্ব পেতে সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ।]

চলবে…..

ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ২৪

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ২৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

“আর যায় হোক!
এম.বি.বি.এস নীলিমার সন্তান কখনো অপুষ্টিতে ভুগতেই পারে না…..”

কথাটা বলে একটা রহস্যজনক হাসি দেয় নীলিমা…..

সারাটা ক্ষণ ক্লান্ত নীলিমাকে আবির আরো ক্লান্ত করে দিত এটা খাও, ওটা খাও করে। রান্না করার সময় হলে নীলিমা যখন ধীর পায়ে রান্না ঘরে যেত আবির তখন চেয়ার হাতে পিছনে এসে দাঁড়াত। নীলিমাকে জোর করে রান্নাঘরের এককোণে চেয়ারে বসিয়ে নিজেই রান্নায় লেগে পরত। রান্নাটা আবির বেশ পারে কারণ ঢাকায় থেকে আবির যখন পড়াশুনা করত তখন বন্ধুরা মিলে রান্না করে খেত। তারপর আবিরের চাকরী হলো, এদিকে ওর বাবাও ফ্ল্যাট কিনল। নতুন বাসায়ও আবির নিজে নিজেই রান্না করে খেয়ে কলেজে যেত। যদিও ওর বাবা বলেছিল কাজের জন্য কোনো লোক রাখতে। অন্তত পক্ষে রান্নাটা যাতে করে দিতে পারে। কিন্তু আবির একটু অন্যরকম। উচ্চবংশে জন্ম নিয়েও খুব অনাড়ম্বর জীবন যাপন করত। সর্বোপরি, নিজের কাজ নিজে করে খেতে পছন্দ করত। আবির ছুটি নিয়ে বাসায় আসার পর নীলিমা হাতে গুনা কয়েকদিন রান্না করেছে। বাকিদিনগুলো বলতে গেলে বলতে হয় আবির’ই রান্না করেছে। মায়ের নজর এড়িয়ে আড়ালে লুকিয়ে আবির নীলিমাকে রান্নায় হেল্প করেছে। কখনো তরকারী কুটে দিয়েছে, কখনো বা মাছ কেটে দিয়েছে। কারো পায়ের শব্দ পেলে কিচেন থেকে দৌঁড়ে বের হয়ে বাথরুমে ঢুকে যেত আবির আর নীলিমা রান্নায় দাঁড়িয়ে পরত।

দিন এভাবেই কাটছিল__
সেদিন নীলিমাকে দেখতে ওর বান্ধবী হিয়া এসেছিল। নীলিমার ছোট বোন লিমা ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কোচিং করত ঢাকা, ফার্মগেইট। হিয়া আসার সময় লিমাকেও সাথে করে নিয়ে আসে। প্রিয়জনদের পেয়ে খুশিতে আত্মহারা নীলিমা ভুলেই যায় ওরা অনেক দুর থেকে এসেছে। ওদের ফ্রেশ হওয়া দরকার, আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা দরকার। সব ভুলে খুশিতে আত্মহারা নীলিমা এক বিরাট গল্প জোড়ে দেয় বান্ধবী এবং বোনের সাথে। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় নীলিমার শাশুড়ি। দুর থেকে ইশারায় ডাক দেয় নীলিমাকে। শাশুড়ির ডাকে সাড়া দেয় নীলিমা। নীলিমার শাশুড়ি ফিসফিসিয়ে বলেন, গল্প যে জুড়ে দিয়েছ বাসায় রান্না করার মত কিছু আছে? নীলিমা নিচু স্বরে না-বোধক জবাব দেয়। অনেকটা রাগ দেখিয়ে বলেন-
কিছুই নাই, এদিকে বাসায় মেহমান এসেছে। কোথায় আবিরকে ফোন দিবা, তা না করে গল্প জুড়ে দিয়েছ? ওরা কতদুর থেকে এসেছ জানো? এবারো নীলিমা নিচু স্বরে বলে উঠে, দিচ্ছি কল মা। নীলিমা আবিরের নাম্বারটা ডায়াল করতেই ওর শাশুড়ি হাত থেকে ফোনটা নিয়ে গিয়ে নিজের কানের কাছে ধরে। নীলিমা তো পুরা’ই থ। কানে ফোন রেখেই গম্ভীর মুখে শাশুড়ির প্রশ্ন-
“কি হলো? এখানে দাঁড়িয়ে কেন আছ? ওদেরকে শরবত দাও। আমি ফ্রিজে রেখে আসছি। আর নুডলস রান্না করছি দেখো। এগুলোও সামনে এনে দাও।”
দিচ্ছি বলে নীলিমা কিচেনের দিকে পা বাড়ায়….

নীলিমার শাশুড়ি এমনিতে ওকে যত তিক্ত কথায় শুনাক না কেন, বাসায় মেহমান আসলে দৌঁড়াতে থাকে কি খাওয়াবে না খাওয়াবে। এটা একটা ওনার বিশেষ গুন।
আবির সওদা করে তাড়াতাড়ি’ই ফিরে আসে। আবির ফিরে আসলে ওর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত রান্না ঘরে চলে যায় নীলিমার শাশুড়ি। নীলিমা চুপসে দাঁড়িয়ে আছে শাশুড়ির পিছনে আর ওর শাশুড়ি রান্না করছে। পিছনে ফিরে নীলিমার শাশুড়ি-
” কি হলো? এখানে দাঁড়িয়ে কেন আছ? ফ্রিজে দেখো ফল রাখা আছে, ভালোভাবে ধূয়ে ঐগুলো ওদের সামনে দাও।”
নীলিমা শাশুড়ির কথা মত ফ্রিজ থেকে ফল বের করে নিঃশব্দে রান্নাঘর ত্যাগ করে।

রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর নীলিমা ওর বান্ধবী হিয়া এবং বোন লিমাকে নিয়ে গেস্টরুমে যায়। ফিরে আসছিল নীলিমা, পিছন থেকে বলে উঠে লিমা-
” আমি দুনিয়াতে অনেক অনেক মানুষ দেখেছি কিন্তু আমার আপুর মত মানুষ দেখিনি।”
পিছনে ফিরে তাকায় নীলিমা। গড়গড় করে বলতে থাকে লিমা-
” তুই কিরে আপু? একজন শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত মেয়ে হয়ে কি করে তুই তোর শাশুড়ির এত অত্যাচার সহ্য করছিস?”
রেগে যায় নীলিমা-
” খবরদার! আর একটাও কথা বলবি না।”
পাশ থেকে বলে উঠে হিয়া-
” কেন? বললে কি করবি? ও কি মিথ্যে কিছু বলছে নাকি?”
বান্ধবীর কথায় চেহারায় বিরক্তি ফুঁটে উঠে নীলিমার। মুখে বিরক্তি ভাব নিয়েই প্রশ্ন করে, চুপ করবি?
—– কেন চুপ করব? আর কত? আর কত ঐ মহিলার অত্যাচার সহ্য করবি? এমনভাবে মানসিক অত্যাচার চলতে থাকলে তুই তো পাগল হয়ে যাবি! আর তুই একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে কি করে এসব সহ্য করছিস? কেন প্রতিবাদ করছিস না? তুই বুঝতে পারছিস খাওয়ার অভাবে, শুধুভাবে খাওয়ার অভাবে তোর কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে? তুই বুঝতে পারছিস পরিবর্তিতে এটা বাচ্চার উপর কতবড় প্রভাব ফেলতে পারে?

হিয়া থামতে না থামতেই লিমা বলে উঠে-
” কাকে কি বুঝাচ্ছ আপু? ওনি তো তোমার আমার মত সাধারণ কোনো মানুষ না যে আমাদের কথা বুঝবেন! ওনি হচ্ছেন নায়িকা সাবানা। সেই মহৎ হৃদয়ের সাবানা যিনি শাশুড়ির অবর্নণীয় অত্যাচার সহ্য করেও কিচ্ছু বলবে না। ওনি মহান হিয়া আপু। তোমার কি মনে হয় এরকম মহান হৃদয়ের অধিকারী নায়িকা সাবানা আমাদের কথা শুনবে? শাশুড়ি যদি ওনাকে তিনবেলা ভাত নাও দেয় তবুও ওনি মুখ খুলবেন না।”

হিয়া লিমাকে থামিয়ে দিয়ে নীলিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে বলেন-
” নীলিমা! আমার মনে হয় তোর শাশুড়ির ব্যাপারটা আবির স্যারকে খুলে বলা দরকার। এভাবে তো চলতে পারে না। আর কত? আর কত দিন অভুক্ত থাকবি? শুধু তো কথায় মারেন না ওনি, ভাতেও মারেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে তো তোর বাচ্চার ক্ষতি হবে। তাই বলছি প্লিজ স্যারকে খুলে বল সবটা।”

কথাগুলো বলে নিশ্বাসও ফেলতে পারেনি হিয়া, তার আগেই পেছন থেকে বলে উঠে আবির,
“ওর বলতে হবে না, আমি সব জানি।”

চমকে উঠে পিছনে তাকায় হিয়া। আবিরকে এভাবে রুমে এগিয়ে আসতে দেখে কলিজার পানি শুকিয়ে যায় হিয়াসহ লিমার। নীলিমারও অবস্থা যায় যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে পেছনে না ঘুরলে ও বুঝতে পারে আবির সব শুনে নিয়েছে।

আমতা আমতা করে হিয়া যখন আবিরকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখন থামিয়ে দেয় আবির। তোমরা ক্লান্ত। কথা না বাড়িয়ে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ো। আবির নীলিমার কাঁধে হাত রেখে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে। “চলো……..”

নীলিমা ধীরগতিতে আবিরের সাথে হাঁটতে থাকে।

রাত্রি অনেক হয়েছিল, আর তাছাড়া নীলিমার শরীরটাও বেশী ভালো যাচ্ছে না আজকাল। তাই আবির মায়ের কথা তুলে নীলিমাকে উত্তেজিত করতে চায়নি। আর চায়নি বলেই বিছানা পরিষ্কার করে নীলিমাকে ধরে শুইয়ে দেয়। নীলিমা কথা বলতে চাইলে আবির থামিয়ে দেয়।
” চুপ! আমি আর এ সম্পর্কে কোনো কথা এখন শুনতে চাই না। যা শুনব, বাচ্চাটা ভালোভাবে হওয়ার পর। আর মায়ের সাথে শেষ বোঝাপড়াটা সেদিন’ই হবে।”

কথা বাড়ায়নি নীলিমা। চুপটি করে আবিরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে যায় নীলিমার। বিছানায় উঠে বসে। আবিরও জেগে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে লাইট জ্বেলে নীলিমার কাঁধে হাত রাখে। ঘুমে ঢুলুঢুলু নীলিমা বসে বসেই ঘুমুচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে খাবারের নানা আইটেম নীলিমার সামনে এনে রাখে। নীলিমা তখনো বসে বসে ঝিমুচ্ছে। বিভিন্ন খাবারের নাম বলে বলে প্রশ্ন করে আবির-
” খাবে?”
প্রত্যেকবার’ই মাথা ঝাঁকিয়ে না-বোধক জবাব দেয় নীলিমা। প্রশ্ন করে-
” তাহলে….. কলা খাবে?”
” উম্মমমম কলা বলে মাথা নাড়ে নীলিমা।”
হেসে দেয় আবির।
ওরে কলা পাগলীটা আমার….!
তোমার কলা খাওয়ার খিদে পেয়েছে সেটা বলবা না? কলা খেতে নীলিমা ভালোবাসে। ফলের মধ্যে এই একটা ফল’ই বলা ছাড়া খায় নীলিমা। আবিরও তাই প্রত্যেকদিন রাত্রে মোড়ের দোকান থেকে কলা নিয়ে এসে টেবিলে’ই রেখে দেয়। মাঝরাত্রে অন্য খাবার খাওয়ার আগে কলাটা ওর চাই’ই চাই।
কিন্তু আজতো নীলিমা ঘুমে ঢুলুঢুলু তাই আবির কলাগুলো দু’বালিশের ফাঁকে রেখে নীলিমাকে শুয়ে দেয়। নীলিমার কপালে আলতো করে চুমুর পরশ এঁকে দেয় আবির—
” তোমার চোখে ঘুম। কলাটা ঘুম থেকে উঠে খেও।”

বাধ্য বালিকার মতো চোখ বোজে নীলিমা।
লাইটটা নিভিয়ে পাশ বালিশে শুয়ে পরে আবির। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই আবির মাথার পাশেই কুটকুট শব্দ শুনতে পায়। অনেক খেয়াল করে শুনার পর আবির সিদ্ধান্তে এলো এটা ইঁদুরের শব্দ। নিশ্চয় কলার উপর হামলা। ওরে ইঁদুর আজ তোর একদিন কি আমার একদিন মনে মনে কথাটা বলেই আবির নিঃশব্দে লাইট জ্বেলে দেয়। রাগান্বিত মুখে হাসি ফুটে উঠে আবিরের। “এ যে বড় ইঁদুর….”
ঘুমন্ত চোখজোড়া মিটমিট করে নীলিমা শুয়ে শুয়েই কলা খাচ্ছে। চোখগুলো ঘুমের কারণে খুলতে পারছে না, তারপরও কলা খাচ্ছে…..

দেখতে দেখতে নীলিমার বাচ্চা প্রসবের দিন এগিয়ে আসে। আবির এখন একমুহূর্তের জন্যও নীলিমাকে চোখের আড়াল করে না। সবসময় নীলিমার পাশে পাশে থাকে। গোসল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়। সেদিন আবিরের বাবাকে বিশেষ একটা কারণে দেশের বাহিরে যেতে হচ্ছিল। আবিরের মা ছেলেকে বলেন, বাবাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিয়ে আসতে। আবির যেতে চাচ্ছিল না নীলিমাকে ছেড়ে।
নীলিমার গম্ভীর জবাব-
” সময় এখনো দেরী আছে। আজ মাত্র ৪তারিখ। ডাক্তার এ মাসের ১৭তারিখ আর ২৩তারিখের কথা বলেছে। আপনি প্লিজ বাবাকে দিয়ে আসেন। আমার জন্য টেনশন করবেন না। আর তাছাড়া গাড়ি তো আছে’ই। আপনি যাবেন আর আসবেন।”

নীলিমার জোড়াজুড়িতে আর মায়ের কথায় শেষমেষ আবির বাবাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে রাজি হয়। বাবাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে একমুহূর্তও দেরী করেনি আবির। বাসায় আসতেই নীলিমার চাপা আর্তনাদ শুনতে পায়। শব্দটা নিচ তলার’ই এক রুম থেকে আসছে। কিন্তু ও রুমে নীলিমা কেন আসল? আর ও এভাবে কাঁদছে কেন? ওর কিছু হলো নাতো? ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে আবিরের। দৌঁড়ে দরজার কাছে যেতেই পাশ থেকে বাঁধা দেয় আবিরের মা। আবির ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে আবিরের মায়ের জবাব,
” তোর বউ অসুস্থ। ভিতরে যাওয়া যাবে না। ভিতরে দাই মহিলারা গেছেন মাত্র।”

চমকে গিয়ে প্রশ্ন করেন আবির-
” What?”
উত্তর দেয় আবিরের মা,
” ঘন্টা খানেক হলো বউ অসুস্থ হয়ে পরছে। তোর উত্তর পাড়ার জ্যাঠি তো দাইয়ের কাজ করেন। ওনাকে আনছি। ওনারা তিনজন কেবল ভিতরে গেছেন বউকে দেখতে। আল্লাহকে ডাক।”

অবাকের চূড়ান্ত সীমায় আবির। একঘন্টা ধরে ও অসুস্থ, আর তুমি মাত্র মানুষ ডেকে এনেছ। তাও দাই। যাদের হাতে আমার ২ভাই মরেছে তুমি নার্স না ডেকে তাদের ডেকে এনেছ? তাদের হাতে আমার বউকে ছেড়ে দিয়েছ? তুমি পারো নি লোক ডেকে ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে? একঘন্টা হয়ে গেল আমাকে কল কেন দাওনি….?

আবিরকে থামায় ওর মা।
” দ্যাখ, আবির। আমাদের বংশে কারো সিজার হয়নি। নীলিমারও হবে না। নীলিমার নরমাল ডেলিভারি হবে।”

উত্তেজিত হয়ে উঠে আবির,
” কারো হয়নি, কিন্তু নীলিমার হবে। ডাক্তার বলেছে ওর শরীরের যা কন্ডিশন ওর নরমাল ডেলিভারি হতে পারে না।”

” কিন্তু…..”

আবির একমুহূর্তও এখানে দাঁড়ায়নি। মাকে সরিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। মহিলাদের সরিয়ে কোলে তুলে নেয় নীলিমাকে। গাড়ির পেছনে শুইয়ে দিয়ে আদিবা আপুকে ফোন করে আসতে বলে দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। নীলিমাকে অটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আবিরের মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। চিন্তিত মনে বাইরে পায়চারি করছে। মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে হসপিটালে পৌঁছে যায় আদিবা ও তার স্বামী। তারাও চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে। কিছুক্ষণ পর অটি থেকে বেরিয়ে আসে একজন নার্স।
উতলা কন্ঠে প্রশ্ন করে আবির, কি হলো সিস্টার? উত্তরে নার্স বলে,
” রোগীর রক্ত লাগবে। জরুরী ভিত্তিতে রোগীর রক্ত লাগবে।”
আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল আদিবা।
” আমি, আমি দিব রক্ত। আমার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ।”

আসুন, টেস্ট করে দেখি….
নার্স আদিবাকে চলে যায়। রক্ত দেয়া হলে আদিবা চলে আসে, কিন্তু নীলিমার কোনো খুঁজ নেই। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম সবার। খবর পেয়ে নীলিমার মা চলে আসছে, চলে আসছে বোন লিমা ও বান্ধবী হিয়া। চিন্তিত মুখে হিয়ার প্রশ্ন-
” এতক্ষণ ধরে ওরা কি করছে? এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়।”

হিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে ডাক্তার নুসরাত। মিষ্টি হেসে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে-
” Double Congratulation, Mr. Abir.”

চমকে যায় আবির। Double Congratulation মানে?
হেসে দেয় ডাঃ নুসরাত। মুখে হাসির রেখা নিয়েই বলে উঠে, আপনি একসাথে দু’সন্তানের বাবা হয়ে গেলেন। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। খবরটা শুনার পর চারদিকে খুশির বন্যা বয়ে গেল। সবার মুখেই হাসি। শুধু হাসি নেয় আবিরের মুখে। চিন্তিত মুখেই আবারো প্রশ্ন করেন ডাঃ নুসরাতকে-
” আর নীলিমা? ও, ও কেমন আছে?”

” আল্লাহর রহমতে মা এবং সন্তান তিনজন’ই সুস্থ আছেন।”

চলবে….

ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ২৩

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ২৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

কুটকুট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আবিরের। কি হলো? আলমারির কাছে কি শব্দ হচ্ছে? ইঁদুর নয়তো? হুট করে লাইটটা জ্বালিয়ে দেয় আবির। আলমারির দিকে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে যায় আবির। আলমারির পাশেই ছোট্ট সোফায় বসে কলার খোসা ছাড়িয়ে আপনমনে কলা খাচ্ছে নীলিমা।

হেসে দেয় আবির, তুমি? ভড়কে যায় নীলিমা। তাড়াতাড়ি ফলের কার্টুনটা পিছনে লুকিয়ে ফেলে।

আবির হাঁটতে হাঁটতে নীলিমার কাছে চলে যায়। ‘কি ব্যাপার? অন্ধকারে বসে আছো যে?’ মুহূর্তেই বলে উঠে নীলিমা, আমি কিছু খাইনি। হা, হা করে অট্টোহাসিতে মেতে উঠে আবির। এ যেন সেই পুরনো প্রবাদ, ‘ঠাকুর ঘরে কে’রে, আমি তো কলা খাইনি’ কথাটার মতই। কথাটা বলে থতমত খেয়ে যায় নীলিমা। আবিরের হাসি শুনে টের পায় কত বড় বোকামীর পরিচয় দিয়েছে। বোকামীর জন্য আনমনে নীলিমা নিজে নিজেকেই গালি দিচ্ছে।

হাসি থামালো আবির। নীলিমার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পরল। মৃদু হেসে প্রশ্ন করল- ‘খিদে পেয়েছে, খাবে। এজন্য এত ভয় পাওয়ার কি আছে?’
লাইট’টা জ্বালিয়ে ধীরে সুস্থে বসে খেলেই তো হতো। অত্যন্ত নীচু গলায় নীলিমার জবাব, না মানে আপনি ঘুমুচ্ছিলেন তো তাই ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবে লাইটটা জ্বালাইনি।
ওকে, ফাইন। হয়েছে তো। এবার তো কার্টুনটা সামনে আনো…..!!!

নীলিমা কার্টুন’টা সামনে এনে আপনমনে খাওয়া শুরু করছে, আবির চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে নীলিমার খাওয়া দেখছে। একটা সময় তৃপ্তির ঢেকুর তুলে উঠে দাঁড়ায়। বসা থেকে উঠে নীলিমার একটা হাত ধরে আবির। ধীর পায়ে নীলিমা বিছানার দিকে এগুচ্ছে।

বিছানায় শুইয়ে দেয় আবির নীলিমাকে। তারপর লাইটটা অফ করে নিজেও গিয়ে শুয়ে পড়ে নীলিমার পাশে। অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে আবির। মিনিট ত্রিশেক এভাবে শুয়ে থেকে ঘুরে শুয়ার জন্য নীলিমার দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে যায়। ড্রিমলাইটের মৃদু আলোয় আবির দেখতে পায় নীলিমা কেমন ঢ্যাবঢ্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে। ‘ঘুমাওনি এখনো?’
মাথাটা আংশিক তুলে প্রশ্ন করে আবির।
‘উহু, ঘুম আসছে না উত্তর দেয় নীলিমা।’
মৃদু হেসে আবির এগিয়ে যায় নীলিমার দিকে। স্পর্শ করে নীলিমার গাল, এলোমেলো চুলগুলো গুজে দেয় কানের পাশে। কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দিয়ে টেনে নেয় বুকে, ভালোবাসার সাথে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। ঘুমিয়ে পড়ে নীলিমা, ওর ভারী হয়ে গরম নিশ্বাসগুলো তার’ই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একহাতে আবির ওর পাশে রাখা চাদরটা নীলিমার গায়ে জড়িয়ে দেয়। মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে আবির নীলিমার কপালে আবারো ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়েই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে আবিরও।

নীলিমার গর্ভের সময়কাল ৭মাস__
হাত পা গুলো অসম্ভব রকমের ফুলে যায় ওর। পা’গুলো ফুলে তো তালগাছের মতই হয়ে গিয়েছিল। নড়াচড়া করতে খুব কষ্ট হতো বিধায় কিচেনে কোনো রকম রান্না বসিয়ে দিয়ে বেশীর ভাগ সময় রুমে এসে বসে থাকত। কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে আবিরের কিনে আনা ফলমূল, দুধ কখনো বা মায়ের পাঠানো গম+ডাল+চাল+চিনি মিশ্রিত গুড়ো খেতো। নজর এড়ায় না শাশুড়ির। এ নিয়ে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দেয় নীলিমাকে। ওনার এক কথা, মা ওনিও হয়েছেন। এভাবে খাই, খাই করেননি কখনো। একবেলা খেয়ে আরেকবেলা না খেয়ে থেকেছেন। নীলিমার ভাষ্যমতে, খাওয়া নিয়ে আমার শাশুড়ি আমাকে যতগুলো কথা শুনিয়েছেন ততগুলো কথা বোধ হয় আমি কালো হয়ে জন্ম নেওয়া’তেও শুনিনি।”
সেদিন নীলিমার শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছিল। এই সময় বাসার কাজের লোক তাড়িয়ে দেয়ার জন্য মনে মনে বাসার সকলকে বকে এক করে ফেলে আবির। চাল, ডাল, গম, চিনির যৌথ মিশ্রণে তৈরি পুষ্টিকর খাবার নীলিমাকে খাইয়ে দিয়ে, প্লেটে কিছু ফল ধুয়ে নীলিমাকে খেতে বলে, সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরি করার জন্য দ্রুত কিচেনের দিকে পা বাড়ায় আবির। দ্রুত বাবা মায়ের পছন্দের খাবার তৈরি করে নীলিমার জন্য ভাত বসিয়ে দেয়। নীলিমার আবার ভাত হলে কিচ্ছু লাগে না। বড্ড খেতে চায় মেয়েটা। কিন্তু খাবার সামনে নিলে একমুঠো ভাতের বেশী খেতে পারে না। যাও খায় সেটা আবিরের জুড়াজুড়িতে। ভাত বসিয়ে দিয়ে দ্রুত তরকারী কুটছিল আবির। পিছন থেকে কিচেনে ঢুকে ওর মা। আবির তরকারী কুটে চুলোয় তরকারী বসিয়ে দিয়েছে। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে মা, ছেলের পাক্কা রাধুনীর মত রান্না করার দৃশ্য দেখে নিঃশব্দেই আবার কিচেন থেকে প্রস্থান করেন। কিচেন থেকে বেরিয়ে উগ্র মেজাজ নিয়ে সোজা আবিরের রুমে ঢুকেন। নীলিমা তখন খাটে হেলান দিয়ে বসে এক একটা করে আঙুর মুখে দিচ্ছিল। হঠাৎ’ই পায়ের শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকায়। আচমকা শাশুড়িকে থেকে থতমত খেয়ে যায় নীলিমা। হাত থেকে ফলটা পরে যায়। কাছে আসেন আবিরের মা। তাচ্ছিল্যের হাসি এসে বলেন, কালে কালে আরো কত কি দেখতে হবে! বউ নবাবজাদির মত পালংকে শুয়ে থাকবে আর জামাই গিয়ে রান্না করবে….!!!
হায়রে, একটা বাচ্চা পেটে ধরে মনে হচ্ছে বিশ্বজয় করে ফেলেছে। ভয়ে ঢোক গিলে নীলিমার জবাব, মা! শরীর’টা খুব দুর্বল দুর্বল লাগছিল তাই……
হাত উঁচু করে নীলিমার শাশুড়ি ওরফে আবিরের মা। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলে,
” এ্যা, দুর্বল লাগে…!
সারাদিন শুয়ে বসে থেকে বলে দুর্বল লাগে। ওরে, পেটে আমিও বাচ্চা ধরেছিলাম। তোমার মত এত পায়ে পা তুলে শুয়ে থাকিনি। ৭মাসের বাচ্চা পেটে রেখেও রান্না করছি, কুয়া থেকে পানি তুলে আনছি, ঢেকিতে ধান বানছি। অথচ কোনো নিচু বংশ থেকে আসিনি আমি। নামকরা পুরনো ধনী ছিলেন আমার দাদা। তার’ই সন্তান আমার বাবা। মঠখোলাতে বিরাট বড় কাপড়ের দোকান ছিল ওনার। বছর শেষেও ঢুলি ভরা ধান, গম থাকত’ই। এত বড় খানদানি বংশের মেয়ে হয়েও শ্বশুর বাড়িতে দিন কাটিয়েছি খেয়ে না খেয়ে। আর ওনি খাবারের নিচে ডুবেই থাকেন সব সময়। কাজের বেলায় যত অজুহাত।”

অনেকগুলো তিক্ত কথা শুনান আবিরের মা নীলিমাকে। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে দ্রুত বের হয়ে যান রুম থেকে। খাটে মাথা রেখে দু’চোখের নোনাজল ছেড়ে দেয় নীলিমা। রুমে প্রবেশ করে আবির। আবিরের আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখের জল মুছে নেয় নীলিমা।
“কি ব্যাপার? এভাবে শুয়ে আছ কেন?”
বলেই কাছে আসে আবির। ফলের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলেন, কি হলো? এগুলো খাওনি যে? ভেঁজা গলায় নীলিমার জবাব- খেয়েছি, আর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটু পরে খাই? মুখে হাসির রেখা ফুঁটিয়ে তুলে আবির, ঠিক আছে। এখন একটু রেস্ট নাও। একটু পর ভাত খাইবা। তারপর ভরা পেটে ফলগুলো খেয়ে নিও। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় নীলিমা। ‘আচ্ছা, আমি মা বাবাকে বলে আসি ব্রেকফাস্ট করে নিতে।’

চলে যাচ্ছিল আবির, ফিরে আসে।
‘ আচ্ছা! মাকে দেখলাম এদিকে থেকে যেতে।” মা কি রুমে আসছিল নাকি? মাথা নাড়ে নীলিমা, ‘জ্বি, আসছিলেন।’
উতলা কন্ঠে প্রশ্ন করেন আবির-
“মা, আজকেও তোমাকে প্রাচীনকালের কাহিনী বলে চড়া কথা শুনিয়েছে?”
হেসে দেই নীলিমা,
” কি যে বলো না! ওনি কেন কথা শুনাবেন? ওনি তো আসছিলেন বলতে এভাবে শুয়ে বসে না থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। এতে আমার ভালো হবে।”
মুখ থেকে চিন্তার ছাপ সরে যায় আবিরের। কারণ- ও জানে ওর নীলিমা কখনো ওকে মিথ্যে বলবে না, বলতে পারেই না। মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়ে নীলিমার কপালে একটা আলতো করে চুমুর পরশ এঁকে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় আবির।

আবির চলে যাওয়ার পর প্রত্যেক বারের পর আজও নীলিমা বলে উঠে,
” ক্ষমা করো আমায়। এ নিয়ে শতেক বার মিথ্যে কথা বললাম তোমায়। কিন্তু কি করব বলো? আমার যে এর ছাড়া কোনো তোমায় নেই। এসব কথার জের ধরে সংসারে ভাঙোক ধরোক এটা আমি কোনো কালেই চাইতে পারব না। হাজার হোক শাশুড়ি তো। শাশুড়ি তো মায়ের’ই সমান। মা সন্তানকে কতকিছুই তো বলতে পারে, সেগুলো মনে ধরলে চলবে কিভাবে? আর তাছাড়া ওনি বুড়ো হয়ে গেছেন। বয়স হয়েছে। এখন একটু আধটু এসব বলবে। এসব মনে নিয়ে বসে থাকলে যে হয় না। কারণ, আমরা মেয়েজাত…”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নীলিমা। ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে দেয়, দুর অজানায়…..

ক্ষাণিক বাদে’ই মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে নীলিমার। টেবিলের উপর ঢেকে রাখা দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে একচুমুকে সবটুকু দুধ খেয়ে ফেলে।
“আর যায় হোক!
এম.বি.বি.এস নীলিমার সন্তান কখনো অপুষ্টিতে ভুগতেই পারে না…..”

কথাটা বলে একটা রহস্যজনক হাসি দেয় নীলিমা…..

চলবে…..

ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ২২

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ২২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

কিহ?!!!
ট্রিপল বেবি মানে?
নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আবির, মানে আমার তিনটা বেবি হবে।

নীলিমা চোখ বড় বড় করে আবিরের দিকে তাকায়। মুখটাও কেমন হা হয়ে আছে। হওয়ার কথা’ই। আবির যা বলেছে তা শুনে শুধু নীলিমা নয় পাঠকরাও ‘থ’ হয়ে গেছে।
যায় হোক, পাঠকদের কথা রেখে এখন আসা যাক ওদের প্রসঙ্গে। আবিরের গ্রামের বাড়ি থেকে কল করেছে আবিরের বাবা। সুখবরটা শুনার পর থেকেই উতলা হয়ে আছেন ওনি কখন নীলিমাকে দেখবেন আর ওকে বাসায় নিয়ে যাবেন। আবিরের বাবা এত বেশী খুশি হয়েছেন যে ওনার আর তর সইছিল না সাথে সাথেই রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে শহরের উদ্দেশ্যে। ওনি চাচ্ছেন ওনার পুত্রবধূ গ্রামের বাড়িতে ওনাদের চোখের সামনে থাকুক। হ্যা, নীলিমা হসপিটালেও যাবে, রোগী দেখবে তবে সেটা ঢাকা নয়, গ্রামের নিকতস্থ ক্লিনিকে বসে।

কথা অনুযায়ী আবিরের বাবা ঢাকায় এসে পৌঁছে। সেখানে একদিন থেকে পরদিন সকাল সকাল রওয়ানা দিয়ে দেয় পুত্রবধূ্কে নিয়ে। নীলিমা যেতে চাচ্ছিল না কিন্তু আবিরের জোরাজুরিতে যেতে বাধ্য হলো। আবির নিজে গিয়ে ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আসে। ওদের বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরে আসে। খুব খারাপ লাগছিল আবিরের। বাসাটাও কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। সেদিন আর কলেজে যায়নি আবির। পুরো দিনটাই কাটিয়ে দিয়েছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। কিন্তু শত ব্যস্ততার পরও আবির যখন বাসায় ফিরে আসে তখন শূন্যতারা ওকে গভীর ভাবে আকড়ে ধরে। বারান্দায় ঝুলে থাকা নীলিমার ওড়না, ড্রেসিংটেবিলের উপর পরে থাকা দুটো চুড়ি, আয়না, চিরুনি আর কাজল দেখে আবিরের ভেতরটা গুমড়ে কেঁদে উঠে।

যেদিকে তাকায়, সেদিকেই শুধু শূন্যতা। এই শূন্যতার সাথে আবির বেশী দিন লড়াই করতে পারেনি। ৫মাস অতিবাহিত হতে না হতেই আবির কলেজ থেকে ছুটি নেয়। স্ত্রীর অসুস্থতার কথা শুনে এবং প্রিন্সিপালের আন্তরিকতায় আবিরের দরখাস্ত মঞ্জুর হয়ে যায়। আবির ছুটি পেয়ে যায় ৬মাসের। যদিও এই ৫মাসের ভিতর আবির অনেক বার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নীলিমাকে দেখে এসেছে কিন্তু আজ কেন জানি আবিরের অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করছে। টানা ৪ঘন্টা জার্নি শেষে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আবির গ্রামের রাস্তায় পৌঁছে। নামাজ শেষে শাশুড়ির জন্য চা তৈরি করতে গিয়েছিল নীলিমা। অকস্মাৎ পেটের ভিতর কি যেন মোচড় দিয়ে উঠে। ওহ, মাগো করে পেট চেপে ধরে নীলিমা। খুব খারাপ লাগছিল নীলিমার, তাই চোখ বোজে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। পরমুহূর্তে শাশুড়ির ডাক পরাতে তাড়াতাড়ি কাপে চা ঢেলে শাশুড়ির রুমে যায়। চা দিয়ে নীলিমা ধীর পায়ে দরজার কাছেও পৌঁছাতে পারেনি, তার আগেই নীলিমা শাশুড়ির ঝারি শুনতে পায়।
” এসব কি চা নাকি অন্য কিছু?”
ভয়ে কেঁপে উঠে নীলিমা। কাঁপা গলায় বলে- মা! আসলে আমার পেটে একটু খারাপ লাগছিল তাই চা’টা একটু লেগে গেছে। ধমক দেয় শাশুড়ি। বাচ্চা আমরাও পেটে ধরেছি। কিছু না হতেই তোমার মত ওহ, আহ করিনি। বলি পেটে কয় বাচ্চা ধরেছ যে এখনি হাপিয়ে উঠেছ?
কোনো কথা বলেনি নীলিমা। নিঃশব্দে শাশুড়ির রুম থেকে বিদায় নেয়। দরজার সামনেই আবির দাঁড়িয়ে। চমকে যায় নীলিমা। আআআআআপনি?
গম্ভীর মুখে জবাব দেয় আবির, হুম আমি।

আবিরের মুখ দেখে নীলিমা বুঝতে পারে ওদের বউ শাশুড়ির কথোপকথনগুলো অন্তঃরাল থেকে শুনে নিয়েছে আবির। নীলিমা চাচ্ছে না এসব নিয়ে এখন সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হোক, মা ছেলের মধ্যে মনো-মালিন্য হোক। আর ঠিক সে কারনেই আবিরের সামনে থেকে কেটে পরার জন্য ধীরপায়ে নীলিমা সামনের দিকে এগুচ্ছে। ‘দাঁড়াও’ পিছন থেকে ডাক দেয় আবির। থেমে যায় নীলিমা। দৌঁড়ে গিয়ে ব্যাগটা রুমে রেখে এসে নীলিমার কাঁধে হাত রাখে আবির। তারপর সাবধানে নীলিমাকে নিয়ে রুমে পৌঁছে। বিছানার একপাশে নীলিমাকে বসিয়ে ব্যাগ থেকে আঙুর, আপেল বের করে। নীলিমা ক্লান্ত চোখে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। “কি হলো? নাও…..”

নীলিমা কথা বাড়ায়নি। আবিরের হাত থেকে কয়েকটা আঙুর নেয়। নীলিমা আঙুর খাচ্ছে আর আবির ফ্লোরে নীলিমার পায়ের কাছে বসে নীলিমার খাওয়া দেখছে। বড্ড খিদে পেয়েছিল নীলিমার। তাইতো হাতেরগুলো খাওয়া শেষ হলে আবিরের আর কিছু বলতে হয়নি। নীলিমা নিজে নিজেই আবিরের হাত থেকে আঙুর নিয়ে খাওয়া শুরু করে। হঠাৎ’ই আবিরের চোখের দিকে চোখ পরতেই লজ্জা পেয়ে যায় নীলিমা। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে উঠতে চাইলে আবির হাত টেনে ধরে। নীলিমা আবারো বসে। তবে এবার আবিরের দিকে তাকায়নি। অন্যদিকে তাকিয়েই বলে আমি আর খাব না। আবির ধমক দেয়। একদম না করতে পারবা না। এটা খাও বলেই আবির নীলিমার হাতে একটা আপেল ধরিয়ে দেয়। তারপর ফ্রেস হতে চলে যায়। আবির ফ্রেস হয়ে আসে। ততক্ষণে নীলিমার অর্ধেক আপেল খাওয়া শেষ। আবিরকে দেখেই বিনীত ভঙ্গিতে নীলিমা বলে উঠে, আমি আর খেতে পারছি না, একদম খিদে নেই। এটা ফেলে দেই???
নীলিমা জানালা দিয়ে আপেলটা ছুঁড়ে ফেলার জন্য হাত উঁচু করতেই আবির হাতটা ধরে ফেলে। আপেলটা নীলিমার হাতে থাকা অবস্থাতেই আপেলে আলতো করে কামড় দেয় আবির। খেতে শুরু করে আপেল। নীলিমার হাতে রেখেই আবির নীলিমার অর্ধ খাওয়া আপেলটা খেতে শুরু করে। সবশেষের অংশটি নীলিমার একদম হাতের তালুতে চলে যায়। আবির সেটা নিয়েও খেয়ে ফেলে। নীলিমা ঢ্যাবঢ্যাব করে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে, তোমার খিদে নেই কিন্তু আমার খিদে ছিল।

তাই বলে আপনি, পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা তার আগেই থামিয়ে দেয় আবির। এটা মাকে দিয়ে আসি বলেই ফলের একটা কার্টুন নিয়ে আবির রুম থেকে বেরিয়ে যায়। একটু আগে আবির শুনেছে ওর মা অত্যন্ত বাজেভাবে নীলিমার সাথে কথা বলেছে। এই জন্য আবিরের মনটা খুব খারাপ। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না ওর তারপরও মা তো। মনের কষ্ট মনেই চাপা রেখে আবির ওর মাকে সালাম দিয়ে, কুশল বিনিময় করে। সবশেষে ফলের কার্টুনটা মায়ের সামনে রেখে চলে আসে।

রাতের খাবার খাওয়ার জন্য খাবার টেবিলে বসেছে আবির এবং ওর বাবা-মা। নীলিমা ধীর পায়ে সবার দিকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রান্না করার ফলে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল নীলিমা। তাই একটু ধীর পায়েই এগুচ্ছিল শ্বশুরের দিকে। এরই মাঝে শাশুড়ির মন্তব্য, আবার কি ঘন্টাখানেক পরে তরকারী দিবা নাকি?
ক্লান্ত নীলিমা মলিন মুখে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, আসছি মা।
পাশ থেকে আবির বলে উঠে, কি ব্যাপার? সবাইকে যে খাওয়াচ্ছ তুমি কখন খাবে? নীলিমার ওর শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে, আপনারা খেয়ে উঠুন। আমার এখন খিদে নেই। আমি পরে ধীরে সুস্থে খাবো। ব্যাপারটা ভালো ঠেকেনি আবিরের কাছে।

রাত্রে সবার খাওয়া শেষে নিচে মাদুর পেতে বসে নীলিমা। প্রতিদিনের মত সেদিনও নীলিমার শাশুড়ি প্লেটের মাঝখানে করে কিছু ভাত আর তরকারী এনে দিয়ে যায়। প্রচন্ড খিদে পেটে গপগপ করে খাওয়া শুরু করে নীলিমা। নিমিষেই শেষ হয়ে যায় প্লেটের সকল ভাত। ধীরে ধীরে উঁঠে দাঁড়িয়ে নীলিমা এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে। কিচেনে দাঁড়িয়েই তাড়াতাড়ি করে কয়েকমুঠো ভাত মুখে পুরে দেয়। মাছের ভাজা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি নীলিমা। মাছের ভাজিটা হাতে নিয়ে খাবার টেবিলের কাছে ফিরে যাচ্ছিল নীলিমা, অমনি থমকে দাঁড়ায়। ওর চোখের সামনে শাশুড়ি অগ্নিমূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে। শাশুড়িকে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম নীলিমার। আমতা আমতা করা শুরু করে নীলিমা।
” ইয়ে না মানে মা আমার খিদে….”
পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা। তার আগেই হাত থেকে মাছের ভাজিটা ছিনিয়ে নেয় শাশুড়ি। গড় গড় করে বলতে থাকে।
” কত বার করে বলেছি কৈ মাছ,
টাকি মাছ এসব খাবি না। এসব খেলে বাচ্চা কালো হয়। তুই আমার কথা কানেই নিস না। নিবি কেন? তোর তো খাওয়া হলে কিচ্ছু লাগে না। না হলে আমি তোকে কতবার করে বলছি, বেশী খাবি না। বেশি খেলে সন্তান বড় হয়ে যাবে। প্রসবের সময় কষ্ট হবে। বান্দার জানের ভয়ও নাই। খালি খাই, খাই।”

মা, টাকি মাছ বলেন,কৈ মাছ বলেন এসবে গর্ভবতীর কোনো ক্ষতি হয় না। এসব গর্ভের শিশুর জন্য ভালো, পুষ্টিকর। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে ৬মাস পর্যন্ত শিশুর….. পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা। মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নেয় ওর শাশুড়ি। বেয়াদবের মতো মুখে মুখে তর্ক করবে না। বাচ্চা আমরাও প্রসব করছি। তাই কিসে বাচ্চার ভালো, কিসে মন্দ সে বিষয়ে আমরা একটু বেশীই জানি। যাও, হাত ধূয়ে ঘুমোতে যাও…..

হাতটা ধূয়ে নিঃশব্দে নিচের দিকে তাকিয়ে সে স্থান ত্যাগ করে নীলিমা।

মাঝ রাত্রে ঘুম ভেঙে যায় নীলিমার। প্রচন্ড খিদের জ্বালায় ভিতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। শুয়া থেকে উঠে বসে নীলিমা। ড্রিমলাইটের আলোয় হাতড়ে হাতড়ে আবিরের আনা ফলের কার্টুনটা খুঁজে বের করে।

কুটকুট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আবিরের। কি হলো? আলমারির কাছে কি শব্দ হচ্ছে? ইঁদুর নয়তো? হুট করে লাইটটা জ্বালিয়ে দেয় আবির। আলমারির দিকে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে যায় আবির। আলমারির পাশেই ছোট্ট সোফায় বসে কলার খোসা ছাড়িয়ে আপনমনে কলা খাচ্ছে নীলিমা।

হেসে দেয় আবির, তুমি? ভড়কে যায় নীলিমা। তাড়াতাড়ি ফলের কার্টুনটা পিছনে লুকিয়ে ফেলে।

চলবে…..

ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ২১

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ২১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আবির নীলিমার নরম অধরে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। সেই মুহূর্তে নীলিমাকে একান্তভাবে পাবার ইচ্ছে জেগে উঠল মনে। বাতাসের শোঁ, শোঁ, বজ্রপাতের গুড়ুম গুড়ুম কোনো কিছুই এখন তার কানে যাচ্ছে না। এত তীব্র আকর্ষণ এর আগে আবির কোনোদিন অনুভব করে নি। কাঁধ থেকে খসে পড়ল আঁচলটা….

সকালে ব্রেকফাস্ট রেডি করছিল নীলিমা। এদিকে আবির ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ডাক দেয় নীলিমাকে। “কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি রেডি হও। সকালের খাবার আর দুপুরের খাবার একসাথে না হয় নরসিংদী গিয়েই করো।”
ব্রেকফাস্ট রেডি করে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে নীলিমা। মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় করে রেখেছে। সেটা দেখে মৃদু হাসল আবির। ডায়াল করে শাশুড়ি মায়ের নাম। রিসিভ করে শ্যালিকা লিমা। আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে ওদের কথোপকথনগুলো নিন্মে তুলে ধরা হলো-

আবির- আসসালামু আলাইকুম, মা…
লিমা- ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইয়া।
আবির- ওহ, লিমা? কেমন আছ?
লিমা- ভালো আর থাকলাম কোথায়?
আবির- মা কেমন আছে?
লিমা- কিছুটা ভালো। আপুকে নিয়ে কখন আসছেন?
আবির- আঁকাশ ঘোর কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে লিমা। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। তাই বলছিলাম কি তোমরা চলে আসো লিমা।
লিমা- মানে কি ভাইয়া? আপু কি…..

পুরো কথা বলতে পারেনি লিমা। তার আগেই আবির রুম থেকে সরে বারান্দায় গিয়ে ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে জবাব দেয়, বোন আমার। বেশী কথা বলো না। তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিয়ে দাও তোমরা। আমি রাস্তা থেকে তোমাদের গিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসব। এখন বেশী কথা বলা যাবে না। তোমরা আগে আসো, তারপর মজার ঘটনা বলব।
রাখলাম, বাই।

কল কেটে রুমে ফিরে আসে আবির। নীলিমা তখন কোমড়ে হাত দিয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সেটা দেখেও না দেখার ভাব করে বিছানায় ফোনটা রাখতে রাখতে আবির বলে, খিদে পেয়েছে। খাবার দাও।
নিঃশব্দে নীলিমা খাবার দিয়ে রুমে চলে আসে। খাওয়া শেষে স্টাডিরুমে তাকাতেই আবির নীলিমাকে রেডি দেখতে পায়। চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করে আবির-
” সে কি? কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
জবাব আসে, বাপের বাড়ি।
—- যেতে হবে না। আম্মাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তো? লিমা, আম্মাকে নিয়ে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে মনে হয়। নীলিমা আর কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে চলে যায়।

রাত্রি ৮টায় বাসায় পৌঁছে নীলিমার বোন ও মা। যদিও দুপুর ২টায় রওয়ানা দিয়েছিল কিন্তু রাস্তায় অত্যাধিক মাত্রায় জ্যামের কারনে আসতে এত দেরী হলো। মায়ের প্রতি অভিমান কিংবা রাগ যতই থাকুক না কেন মা আসবে এ খবর পাওয়ার পর থেকে বাহারি নানা ধরনের খাবার রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলিমা। মা বোন বাসায় ঢুকতেই কি খাওয়াবে না খাওয়াবে সেসব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওরা ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকতেই সামনে এনে দেয় ঠান্ডা পানিয় জাতীয় কিছু। বোনের এককথা,
” আপু! এখন শীতকাল। এ শরবত টরবত কেন আনছিস?”
নীলিমার পাল্টা জবাব, সারাদিন জার্নি করে এসেছিস। খেয়ে নে। ভালো লাগবে। নীলিমা যেন নাছোড়বান্দা। বাধ্য মা মেয়ে পানিয় জলটা পান করেই নেয়। তার কিছুক্ষণ পর সামনে আনে পায়েস। পায়েস খাওয়া শেষ হতে না হতেই ঝালমুখ করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে সারাদিন ধরে রান্না করা সকল আইটেম পরিবেশনের। নীলিমা কিচেন থেকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে আর আবির দৌঁড়ে দৌঁড়ে সেগুলো নিয়ে বিছানায় শ্যালিকা এবং শাশুড়ির সামনে রাখছে। ওদের এ হেন ব্যস্ততা দেখে হেসে দেয় নীলিমার বোন লিমা। টিপ্পনী কেটে বলে,
এমন ভাবে খাবার দিচ্ছেন, মনে হচ্ছে আমাদের চেয়ে বড় খাদক পৃথিবীতে আরেকটাও নেই। ক্ষাণিক হাসে আবির।
“তোমরা শুরু করো। আমরা দুজন পরে একসাথে খাবো।”

নীলিমার মায়ের মন খারাপ।
‘এতদিন পর মেয়ের জামাইয়ের বাড়ি আসলাম আর এখনো কি না মেয়ের মুখটা’ই দেখতে পেলাম না।’
অনেকটা আক্ষেপের সাথে অভিমান মিশ্রিত করে নীলিমার মায়ের কথাটা ছিল। আবির কিচেনে গিয়ে অনেকটা রাগান্বিত স্বরে বলে, এই তোমার আদব? মেহমান বাসায় আসছে ওদেরকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করবে না? নিশ্চুপ নীলিমা মাথা নিচু করে বলে, আমি তো ভাবছিলাম পরে বলব।
“পরে নয়, এখনি বলবা। ওরা বসে আছে খাবার মুখে না দিয়ে। এখনি মাকে সালাম করে কুশল বিনিময় করবা।”
আবির একহাতে কিচেন থেকে দুইটা প্লেট নিয়ে আরেক হাতে নীলিমাকে টানতে টানতে শাশুড়ি মায়ের সামনে উপস্থিত হয়। নীলিমা মাথা নিচু করে মাকে সালাম দেয়,
” আসসালামু আলাইকুম, মা।”
ফিরে তাকায় নীলিমার মা। মেয়েটা কিরকম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সবই হয়েছে আমার বুঝার ভুলের জন্য। চোখে জল এসে যায় নীলিমার মায়ের। বহুকষ্টে সে জল আটকে মুখে হাসি এনে মেয়ের সালামের জবাব সরূপ বলে,
” ওয়ালাইকুম আসসালাম….”
তারপর মা মেয়ে দুজনেই চুপচাপ। আবির পাশ থেকে ধাক্কা দেয় নীলিমাকে।
“মাকে জিজ্ঞেস করো, কেমন আছে?” নীলিমা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
মা আপনার শরীর ভালো তো?
নীলিমার মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ, এখন ভালোই আছি। তো দাঁড়িয়ে আসিস কেন? জামাইকে নিয়ে বসে পর। রাত তো আর কম হয়নি।”
” জ্বি, আম্মা। আমরা বসছি বলেই আবির দুইটা চেয়ার টেনে একটাতে নীলিমাকে বসিয়ে তার পাশেরটাই বসে পরে।

সবাই খাওয়া শুরু করছে। নীলিমার মা ফ্যালফ্যাল করে নীলিমার হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছেন। নীলিমাও যেন একটা বিব্রতিকর অবস্থায় পড়ে গেল। মায়ের সামনে না বসে থাকতে পারছে না বাম হাতে খাবার মুখে দিতে পারছে। ব্যাপারটা আবির লক্ষ করে। বিষয়টা ধামাচাপা দেয়ার জন্য নীলিমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, তোমার না গতকাল হাত কেটে গেছে। এখন ভাত মাখবে কিভাবে? প্লেট রাখো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
………………………………..
কি হলো? হা, করো…!!!
নীলিমা কোনো কথা বাড়ায়নি। আবিরের কথা মতই হা করে। আবির নীলিমাকে খাইয়ে দিচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে নিজেও মুখে দিচ্ছে। ওদের দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়েছিল নীলিমার মা। মুচকি হেসে পাশ থেকে ধাক্কা দেয় লিমা। ফিসফিসিয়ে বলে, কি হলো মা? ঐদিকে তাকিয়ে আছ কেন? খাও…..
চোখের জল মুছে নীলিমার মা খাওয়া শুরু করে।

কয়েকদিন পর সকালে__
সকালের খাবার রেডি করে সবাইকে খাইয়ে নিজেও খেতে বসছিল নীলিমা। তখনি গড়গড় করে বমি করে দেয়। পেটে এতক্ষণ ধরে যা ভাত দিয়েছিল সব বেরিয়ে আসে বমির সাথে। নীলিমা দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুমে আবির কলেজে যাবে বলে ফ্রেশ হচ্ছিল, নীলিমা আবিরের পায়ের উপর গড়গড় করে বমি ছেড়ে দেয়। বিরক্তিকর ভঙ্গিতে ভ্রু-কুঁচকে আবির পিছনের দিকে তাকায়। নীলিমাকে এ অবস্থায় দেখে সব বিরক্তি নিমিষেই উদাও হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি নীলিমার কাছে গিয়ে নীলিমার মাথায় চেপে ধরে। নীলিমা বমি করতে করতে একসময় হাপিয়ে উঠে, ক্লান্ত হয়ে যায়। আবির নিজ হাত দিয়ে নীলিমার মুখ পরিষ্কার করে ডাক দেয় শ্যালিকা লিমাকে। দৌঁড়ে আসে নীলিমার ছোট বোন লিমা। আবিরের কথামতো একগ্লাস পানি এনে দেয়। নীলিমা গড় গড় করে কুলি করলে ওকে ধরে রুমে নিয়ে যায়।

” কলেজে যেতে হবে আমার। লিমা, তুমি একটু নীলিমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও। আর হ্যাঁ, তোমরা আজকে যেতে পারবে না। নীলিমা তোমারও আজকে চেম্বারে যাওয়ার দরকার নেই। আর তোমরা কিন্তু যাচ্ছো না। নীলিমার কি হয় না হয়। তাই তোমরা কিছুদিন থাকবে।”
আবির লিমার হাতে একহাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে কলেজে চলে যায়।
” আপা চলো তো!
ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”
নীলিমা ওর বোনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিচেনে চলে যায়। সবকিছু গুছিয়ে রেডি হয়ে নেয় চেম্বারে যাওয়ার জন্য। ছুটে আসে লিমা।
” আপা, তোমায় যে ভাইয়া বলে গেছে আজকে চেম্বারে যেতে হবে না! তারপরও কেন যাচ্ছ?”

দ্যাখ, লিমা। বাঁধা দিস না। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। বমি আমার কয়েকদিন ধরেই হচ্ছে। আজকে হসপিটাল থেকে চেকআপ করে আসব নে। তুই একদম চিন্তা করিস না। মা নিচতলা থেকে ফিরলে মাকে পিঠা পায়েস দিস। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমি গেলাম। কথাগুলো বলেই নীলিমা চেম্বারে চলে যায়। বিকেলে ফেরার পথে দোকান থেকে টিউব কিনে আনে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা করার জন্য। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আগে পরীক্ষা করে নেয়। তার পরদিন বিকেলে চা তৈরি করার সময় টিউবটা কিচেনের জানালা দিয়ে ফেলে দিতে গেলে পেছন থেকে হাতটা ধরে ফেলে কেউ।
” কি হলো? পজিটিভ না নেগেটিভ?”
নীলিমা ফিরে তাকায়। স্মিতহাস্যে আবির দাঁড়িয়ে পিছনে।
” কি হলো? চুপ কেন?রিপোর্ট কি বলছে?”

লজ্জায় নীল হয়ে গেছে নীলিমা। মাথা নিচু করে বলে, জানি না। স্মিতহাস্যে জবাব দেয় আবির, কিন্তু আমি জানি। চমকে উঠে আবিরের মুখের দিকে তাকায় নীলিমা। “মানে?”
একটু কাশি দিয়ে নেয় আবির। তারপর সুরে সুরে বলে, আমি টিউবটা চুরি করে নিয়ে……. ফার্মেসীতে……গিয়ে……ছিলাম। বাদল ভাই বলল……..(…….)……???

পিছন থেকে লিমা বলে উঠে, কি বলল?
আবির চোখ বড় বড় করে পিছনে তাকায়। লিমা, তোমার কি কমন সেঞ্চ বলতে কিচ্ছু নেই। এমন সময়’ই আসতে হলো তোমার?
” স্যরি, ভাইয়া। আমি সত্যিই স্যরি।”
কথাটা বলে মাথা চুলকাতে চুলকাতে সে স্থান ত্যাগ করে লিমা। নীলিমা তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। আবির আবারো সুরে সুরে বলা শুরু করে, বাদল ভাই…. বলে….ছে……. আমার…..বউ….টা……(……)…..???

“আপনার বউটা মা হতে চলেছে।”

নীলিমার মুখ থেকে কথাটা শুনে আবির চোখ বড় বড় নীলিমার দিকে তাকায়। নীলিমা অন্য দিকে তাকিয়ে বলে কথাটা এভাবে ঘুরিয়ে বলে লজ্জা না দিলেই কি নয়? চলে যাচ্ছিল নীলিমা, হাতটা ধরে ফেলে আবির।
” আমি যে কত্ত খুশি হয়েছি সেটা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না নীলিমা। উফফ! আমার অনেকদিনের শখ ট্রিপল বেবির। এবার বুঝি ইচ্ছেটা পূরণ হতে চলেছে।”

কিহ?!!!
ট্রিপল বেবি মানে?
নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আবির। মানে আমার তিনটা বেবি হবে।

চলবে….

ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ২০

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ২০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

একি করছ?!!!
দৌঁড়ে গিয়ে নীলিমার পাশে বসে আবির। ঠোঁট থেকে কাঁচগুলো সরিয়ে নিতেই আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠে নীলিমা। “ওমাগো, জ্বাল।
মরে গেলাম গো, জ্বলে যাচ্ছে গো…..”
আবির ওর ময়লা হাতের দিকে তাকায়। হাতে তখনো হলুদ, মরিচের গোঁড়া লেগে আছে। দিগ্বিদিক শূন্য আবির তখনি নীলিমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। শুষে নেয় নীলিমার ঠোঁটের সবটুকু জ্বাল। কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল নীলিমা। হুশ ফিরে যখন তখন আবির ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

তোমার ঠোঁটের কাটাস্থানে অসাবধানতাবশত মরিচের গোড়া লেগে গিয়েছিল তাই, পুরো কথা বলতে পারে নি আবির। নীলিমা হাত উঁচু করে আবিরকে থামতে বলে। আবির থেমে যায়। রাগে হনহনিয়ে স্টাডিরুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয় নীলিমা।

রান্না শেষে ভিঁজানো চাদর এবং কম্বল ধুয়ে ছাদে নিয়ে যায় আবির। এরই মাঝে নীলিমা ভাত নিয়ে খেতে বসে পরে। ছাদ থেকে ফিরে আবির আলমারি থেকে একটা নতুন চাদর বের করে বিছানা করে নেয়। বারান্দা থেকে বালিশ দুটো এনে ময়লা পরিষ্কার করে খাটে রাখে। খাটের নিচ থেকে কোলবালিশটা এনে খাটের একপাশে রাখে। সবশেষে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে।

আবির ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসে। ততক্ষণে নীলিমার খাওয়া শেষ। পরনে তোয়ালে চেঞ্জ করে নীলিমার দিকে তাকায়। ” ভালো’ই হলো খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়েছেন। এবার রেডি হন। আমি আপনাকে নরসিংদী দিয়ে আসি।”

চলে যাচ্ছিল নীলিমা, আবিরের কথা শুনে থমকে দাঁড়ায়। চোখ বড় বড় করে তাকায়।
” এভাবে তাকিয়ে কেন আছেন? আমি কি বলছি বুঝতে পারেন নি? নাকি বাংলা বুঝেন না? আপনাকে আমি নরসিংদী আপনার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাচ্ছি, তাই দয়া করে রেডি হোন। কোনো কথা না বলে স্টাডিরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় নীলিমা। অভিমানে গুমড়ে কেঁদে উঠে। লাঞ্চ সেরে আবির স্টাডিরুমের দরজায় নক করে। আবিরের শব্দ শুনেই হো, হো শব্দে অভিনয় করে কেঁদে উঠে নীলিমা।
” ওহ,মাগো। মরে গেলাম গো। ব্যথা।”
ভড়কে যায় আবির। নীলিমার কান্নায় ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠে। নীলিমাকে দরজা খুলার জন্য একের পর এক দরজায় কড়াঘাত করছে আবির। কিন্তু ভুলে দরজা খুলছে না নীলিমা। যদি নরসিংদী নিয়ে রেখে আসে সেই ভয়ে দরজা খুলার সাহস পাচ্ছে না।

অনেকক্ষণ পর দরজা খুলে নীলিমা। আবির তখনো দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। নীলিমা হন্যে হয়ে রুমে ঢুকে আবির।
” কি হয়েছে নীলিমা? কোথায় ব্যথা করছে? খুব ব্যথা করছে? এটা সেটা আরো কত কি।” আবিরের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি নীলিমা। শুধু গাল থেকে আবিরের দু’হাত ছাড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পরে। আবির বিছানার পাশে বসে কিছুক্ষণ নীলিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, তারপর ঘুমানোর কথা বলে চলে আসে।

রাত্রের খাবার শেষে স্টাডিরুমে চলে যায়।
স্টাডিরুমের দরজা আংশিক মিশিয়ে শুয়ে পরে নীলিমা।
একি?! ওনি আজকে আমাকে এ রুম থেকে নিচ্ছেন না কেন? তবে কি ওনি সকালের ঘটনায় সত্যি সত্যি রেগে গেছেন? ওনি কি সত্যি সত্যি আমায় নরসিংদী রেখে আসবেন? না, না। এ হতে পারে না। শুয়া থেকে উঠে বসে নীলিমা।
আস্তে আস্তে দরজা ফাঁকা করে আবিরের রুমের দিকে উঁকি দেয়। কপালে হাত দিয়ে আনমনে কি যেন ভাবছে আবির।

যাই,
কাছে গিয়ে শুই,
আমার কারণেই তো এরকম করছেন আজকে। আমি’ই গিয়ে রাগটা ভাঙায়।
নীলিমা স্টাডিরুমের দরজা মিশিয়ে আবিরের রুমে ঢুকে। আবির তখনো আনমনে ভেবেই চলছে। দরজাটা লক করে আবিরের গা ঘেষে শুইলে হুশ ফিরে আবিরের। ক্ষাণিকটা সরে আসে আবির। কিছুক্ষণ চুপ থাকে নীলিমা। তারপর আবারো আবিরের কাছে গিয়ে ওর উপরে একটা হাত উঠিয়ে দেয়। হাত সরিয়ে দেয় আবির। আবারো হাত রাখে নীলিমা, হাত সরিয়ে দেয় আবির। এবার একহাতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে তাকায়। আবির তখন বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে। পিছন থেকে আবিরকে জড়িয়ে ধরে আবিরের গালে হাত রাখে নীলিমা। এবার অনেকটা ভ্রু কুঁচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে আবির নীলিমার হাতটা ছাড়িয়ে নীলিমার দিকে ফিরে তাকায়। মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় কালো করে নীলিমা দুরে সরে যায়। আবিরের থেকে অনেকটা দুরত্ব রেখে মাঝখানে কোলবালিশ রেখে শুয়ে পরে নীলিমা। বাকি রাতের মধ্যে একবারও আবিরের কাছে ঘেষার চেষ্টা করেনি। তবে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজটা শুনেছে আবির। ভোরে টুংটাং আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে আবিরের। আবিরের জন্য রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলিমা। খাওয়া দাওয়া মিস করেনি আবির, তবে নীলিমার সাথে কথাটা বলেনি। সারাদিনে একটা কথাও বলেনি। খাওয়া দাওয়া করেই বাইরে চলে যায় আবির। নামাজের টাইমে ফিরে আসে। ওজু করে আবার বাইরে চলে যায়।

কতভাবে নীলিমা আবিরের কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছে, কিন্তু নীলিমাকে পাত্তাই দেয়নি আবির। রাত্রে খাওয়া দাওয়া করে নিজ রুমে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল আবির। তখনি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে নীলিমা। পরনে গোলাপী কালার শাঁড়ি, তার মিলিয়ে হাতে একগোছা চুড়ি, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে গাঢ় কালো কাজল।
ব্যস এটুকুই…..
চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে আবির শুধু একবার দরজার দিকে তাকিয়েছে, নীলিমাকে একনজর দেখে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে আবির। লাইটটা অফ করে কম্বলে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ে আবির। ভিতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যায় নীলিমার। সবকিছু সহ্য করা গেলেও প্রিয় কারো অবহেলা সহ্য করা যায় না। নীলিমাও পারে নি। বাইরে প্রচন্ড বেগে ঝড় বইছে ঠিক তেমনি ভেতরটাও অজানা ঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। দৌঁড়ে স্টাডিরুমে চলে যায়। বিছানার মাঝখানে গিয়ে বসে নীলিমা। হাতের চুড়িগুলো একটা একটা করে খুলে ফেলে। খুলে ফেলে শাঁড়ির সাথে মিলিয়ে পরা কানের লম্বা লম্বা দুল আর গলার মালা। শাঁড়িটাও চেঞ্জ করতে হবে। আর শাঁড়িটা চেঞ্জ করার জন্য আঁচলটা সরিয়ে রাখে। ঠিক তখনি রুমে প্রবেশ করে আবির। পায়ের শব্দ পেয়ে আঁচল দিয়ে দ্রুত শরীর ঢেকে নিল নীলিমা। কিন্তু ততক্ষণে যা দেখার দেখে ফেলেছে আবির।

আবির টের পেল ওর সমস্ত রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। সে আস্তে করে গিয়ে বসল নীলিমার পাশে।
নীলিমা বলল, ‘ আমি বড্ড বেশী করে ফেলেছি, না?”
অবাক হলো আবির। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
নীলিমা তাকিয়ে রইল আবিরের দিকে। আপনি খুব ভালো মানুষ মি. আবির। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। কাল আমি চলে যাব। তবে আপনাকে কোনোদিন ভুলতে পারব বলে মনে হয় না। দরজার দিকে পা বাড়াল নীলিমা, ঘুরে দাঁড়ালো আবার। গুড নাইট মি. আবির। দরজা বন্ধ করে চলে গেল নীলিমা।

আবির তাকালো নীলিমার দিকে।
” ও কি বলে গেল- কোন দিন ভুলতে পারবে না। মানে কি এ কথার?” নীলিমাকে ম্লান আর বিষণ্ন লাগল। উত্তর দিল,
‘জানি না আমি।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দু’জনে। বাতাসের আর্তনাদ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। আবির চেষ্টাকৃত হাসি দিল। বৃষ্টিতে ভিঁজবে? মাথা নাড়ল নীলিমা। ভিঁজবে না। চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াচ্ছে, ওর হাত ধরে ফেলল আবির।
” যেয়ো না। তুমি জানো এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম আমি। তোমার সাথে কথা বলতে চাই। তোমার মিষ্টি কন্ঠটা শুনতে চাই।”
আবির উঠে বাতি নিভিয়ে দিল। শুধু ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় আলোকিত হয়ে থাকল ঘর। আবির বসল নীলিমার গা ঘেঁষে।
” এখন আরো রোমান্টিক লাগছে না?”
আবির দু’হাত দিয়ে নীলিমার গাল স্পর্শ করে কথাটা বলল। হাতটা সরিয়ে দিল নীলিমা। ‘আমি ঘুমাবো।’ জবাব আসে, রাত তেমন বেশি হয়নি। বাহির ভিতর একসাথেই মাতাল হাওয়া বইছে। পরস্পরকে জেনে নেয়ার এই সুযোগটা হারাতে চাচ্ছি না।

এবারও আবিরের হাত দুটো সরিয়ে দিল নীলিমা। ‘ আমি যাই। সত্যি মি. আবির, আপনার সঙ্গে আমার থাকা সম্ভব নয়। এটা- এটা ঠিক না।’

মিস্টার বাদ দাও। আমাকে স্রেফ আবির বলে ডাকতে পারো না? আমি তো তোমার’ই বুড়ো। আর তাছাড়া বাহিরে ঝড় বইছে, ভিতরে আমরা দু’জন অন্ধকারে বসে আসি। ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর লাগছে না তোমার কাছে? আমার কাছে তো রূপকথার মত মনে হচ্ছে।

আমি বুঝতে পারছি আবির। কিন্তু আমি আর এখানে থাকতে চাচ্ছি না। আমার ঘুম পাচ্ছে। নীলিমার মাথার পিছনে হাত চালিয়ে দিল আবির, ঝুঁকে এল ওর দিকে। ঘুম গোল্লায় যাক। একটা ঘন্টা অন্তত সময়টাকে স্থির করে দিতে পারো না? তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটা আমাকে বলতে দাও। বলতে দাও এই কুৎসিত পৃথিবীতে তুমি’ই একমাত্র সুন্দর মানবী। তোমার সৌন্দর্যের কাছে ম্লান হয়ে গেছে ঝড়ের শক্তি। আমার দিকে তাকাও, নীলিমা। একটা ঘন্টার জন্য কি আমরা রূপকথার রাজ্য থেকে ঘুরে আসতে পারি না? সব ভুলে আমরা কি এক হতে পারি না? নীলিমাকে নিজের কাছে টেনে আনল আবির। রাগে কাঁপছে নীলিমা। কাঁপতে কাঁপতেই নিজেকে সমর্পণ করল আবিরের কাছে।

আবির নীলিমার নরম অধরে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। সেই মুহূর্তে নীলিমাকে একান্তভাবে পাবার ইচ্ছে জেগে উঠল মনে…..

চলবে…..

ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ১৯

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ১৯
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

” খেলে তো ধরা সবদিক থেকে….!”

পিছনে ফিরে তাকায় নীলিমা। গম্ভীর মুডে আবির দাঁড়িয়ে। কথা বলেনি কোনো। রিক্সাওয়ালাকে নীলিমার ভাড়াসহ ঐ স্যারের ভাড়াটাও দিয়ে দেয়।

রিক্সা চলে যায়। হাঁটা শুরু করে আবির। আবিরের পিছু পিছু নিঃশব্দে হাঁটছে নীলিমা। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। নীলিমা অবশ্য এরই মাঝে বার কয়েক আবিরের দিকে ফিরে তাকিয়েছে, কিন্তু আবিরের সেদিকে একটুও খেয়াল নেই। বরাবরের মতই মাথা নিচু করে চুপচাপ হাঁটছে আবির। বাসায় পৌঁছে দু’জনেই।
” ব্যাগে টাকা আছে, ভাড়া বাবদ যত টাকা লাগে নিয়ে নিও।” নীলিমার হাতে আবির ওর মানিব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে বাহিরে চলে যায়। নীলিমা সেদিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে আছে।

আবির চলে গেলে ব্যাগ হাতে বিছানায় বসে নীলিমা। মানিব্যাগের একপাশে দুটো এক হাজার টাকার নোট, আর ৫টা একশ টাকার নোট রাখা। ৫টা একশ টাকার নোট ব্যাগ থেকে বের করে টাকাগুলো ছোট করে ভাঁজ করে নীলিমা ওর আঁচলে বেধে রাখে। তারপর শাঁড়িটা ঠিক করে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নেয়। আবির তখনো আসেনি, তাই ওর আসার আগেই বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নীলিমা বের হয়ে যায় বাসা থেকে।

দুপুর ১টা__
সিএনজির অপেক্ষায় বাসার সামনে দাঁড়িয়ে নীলিমা। সেই সাড়ে ১২টা থেকে এখানে দাঁড়িয়ে, এখবো অবধি কোনো খালি সিএনজি কিংবা রিক্সা আসার নাম নেই। মেজাজ গরম হয়ে যায় নীলিমার। রাস্তার ওপাশের ছোট্ট বেঞ্চে বসার জন্য এগিয়ে যেতেই নীলিমা ছেলেদের হাসির শব্দ শুনতে পায়। বেঞ্চে বসে হাসিটা কোথা থেকে আসছে সেটা বুঝার চেষ্টা করে। পাশেই একটা বিল্ডিং মেরামতের কাজ চলছে। সেই বিল্ডিংয়ের ছাদের উপর কিছু ছেলেপুলে বসে গল্প করছে, হাসিটা সেখান থেকেই আসছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার আগে আবারো ছেলেদের দিকে তাকায়। ৫,৬টা ছেলের মাঝে আবিরও বসে ছিল সেখানে। অপলক ভাবে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে নীলিমা। হঠাৎ’ই রিক্সাওয়ালার ডাক পরে,
ও আপা যাবেন? যাব বলে নীলিমা রিক্সার কাছে যায়। রিক্সার কাছে গিয়ে আবারো বিল্ডিংটার ছাদের দিকে তাকায়। আবির তখনো গল্পে মশগুল। রিক্সাওয়ালা আবারো বলে, আপা দাঁড়িয়ে ক্যান? কেউ আইব? কোনো উত্তর না দিয়ে নীলিমা আবারো ঐ বিল্ডিংটার ছাদে তাকায়। আবির তখনো গল্পে মগ্ন। ইস! একবার নিচে তাকা, শুধু একবার তাকা। মনে মনে কথাগুলো বলছিল নীলিমা।
আজব লোক’ তো…..!!!
এটা বলে রিক্সাওয়ালা চলে যায়। ফিরে তাকায় নীলিমা। ততক্ষণে রিক্সাওয়ালা চলে গেছে। উফ! চলে গেল বলে নীলিমা পুনরায় বেঞ্চে গিয়ে বসে। আরেকটা সিএনজি আসে। নীলিমা সিএনজিকে না করে দেয়। তারপর আবারো উপরে আবিরের দিকে ফিরে তাকায়। আবির তখনো গভীর গল্পে মশগুল। এরই মধ্যে আরো একটা সিএনজি আসে। এবার নিঃশব্দে নীলিমা সিএনজির কাছে যায়। শেষ বারের মত ফিরে তাকায় উপরে। ততক্ষণে আবিরের দৃষ্টিও নীলিমার দিকে চলে এসেছে। মনে মনে একটা হাসি দিয়ে সিএনজিতে উঠে বসে নীলিমা। আবির দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবারো গল্পে মন দেয়।

দুপুর ১টা বেজে ৪৫মিনিট__
নীলিমা বাসস্টপের ছোট্ট বেঞ্চে চুপ করে বসে আছে। বাস চলে যাওয়ার হুইসেল দিচ্ছে তবুও নীলিমা টিকিট কাটেনি। বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। প্রায় মিনিট দশেক পর বাস ছেড়ে দেয়। নীলিমা তখনও রাস্তার এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ২টা বেজে গেছে। মনটা কালো অন্ধকারের ন্যায় করে ওপাশে তাকাতেই দেখে আবির আসছে। মুখে হাসি ফুটে উঠে নীলিমার। তাড়াতাড়ি বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ায়।

কিন্তু একি?!!!
ওনি আমার কাছে আসছেন না কেন? এদিকে কোথায় যাচ্ছেন???
মিনিট ত্রিশেক পর হাতে একগাদা সওদা নিয়ে আবির ফিরে। এবার নিশ্চয় আমার কাছে আসবে আমায় বাসায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য? ভাব নিয়ে দাঁড়ায় নীলিমা।
কিন্তু মুহূর্তেই ‘থ’ হয়ে যায় নীলিমা যখন দেখল আবির ওকে কিছু না বলে বাজার সওদা করে আপনমনে বাসায় চলে যাচ্ছে। রাগ হয় নীলিমার কিন্তু প্রকাশ করেনি। কিছুক্ষণ বেঞ্চে বসে থেকে পা বাড়ায় বাসার দিকে। মিনিট দশেক বছর বাসায় পৌঁছে নীলিমা। দরজা খোলায় ছিল তাই কলিং বেল আর চাপতে হয়নি। ভিতরে প্রবেশ করে নীলিমা। আঁচল থেকে টাকাগুলো খুলে বিছানার নিচে রেখে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। আবির তখন গভীর মনোযোগের সাথে রান্না করছে। কিছুক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নীলিমা। তারপর মুখ খুলে_
” আমি চলে যাচ্ছি…..”
আবির চুপচাপ থেকে রান্না করে চলেছে। নীলিমা আবারো বলে উঠে, আমি গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি। আবির এবারো চুপচাপ। নীলিমা আবারো বলে উঠে, শুনতে পাচ্ছেন আমি নরসিংদী চলে যাচ্ছি। রান্না করা অবস্থায়’ই জবাব দেয় আবির, সেতো আমি দেখেই আসছি আপনি চলে যাচ্ছেন। তো ফিরে আসলেন যে? কিছু রেখে গেছেন নাকি? এত কষ্ট করে আবার আসতে গেলেন কেন? আমায় কল করে বলতেন। আমি দিয়ে আসতাম।

” কোথায় আমাকে আটকাবে তা না,
উনি আমায় চলে যেতে হেল্প করবেন।”

প্রচন্ড রাগে কাঁপতে শুরু করে নীলিমা। ফেলতে থাকে ঘনঘন নিশ্বাস। দাঁতে দাঁত চেপে আবিরকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। ফিরে যায় রুমে। এত শীতের মধ্যে ঘামছে নীলিমা। ফুলস্পিডে ফ্যানটা ছেড়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পরে। চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে নীলিমার। হঠাৎ’ই অস্পষ্ট গানের স্বর ভেসে আসে। বিছানা থেকে উঠে বসে নীলিমা। মনে হচ্ছে কিচেন থেকেই শব্দটা আসছে। কিন্তু কে গায়ছে? বন্ধ করে ফেলে ফ্যানটা। নীলিমা স্পষ্ট শুনতে পায় আবির গান গাচ্ছে-
” চলে গেছো তাতে কি, নতুন একটা পেয়েছি।”

” ওহ, এই জন্য’ই বুঝি আমায় এভাবে যেতে দেয়া?”
মেজাজ বিগড়ে যায় নীলিমার। প্রচন্ড রাগে নিজের মাথার চুল নিজে’ই দু’হাত দিয়ে এলোমেলো করে ফেলে। খামচে ধরে মুখ। নিজে নিজেই নিজের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। গালে দু’য়েক জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে আর হাতে দাঁতের দাগ বসে গেছে। রাগ তবুও কমছে না। বিছানার পাশেই ছিল আবিরের সদ্য কিনে আনা একটা ছোট্ট সুন্দর ডায়েরী। ডায়েরী কামড়ে ধরে নীলিমা। ডায়েরীর কিচ্ছু হয়নি, কিন্তু ডায়েরীর শক্ত অংশ দাঁতের মাড়িতে লাগার সাথে সাথে মাড়ি থেকে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়। এতেও রাগ কমেনি নীলিমার। হাতের কাছে পেল বালিশ, তুলতুলে নরম সুন্দর বালিশটা নিয়ে নীলিমা বারান্দায় ঝুড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। আরেকটা বালিশ ছুঁড়ে মারে বারান্দায়, কোল বালিশটা এক ধাক্কা দিয়ে খাটের নিচে ফেলে দেয়। রাগ তাতেও কমছে না দেখে বিছানা থেকে নেমে চাঁদরটা জড়ো করে বাথরুমে পানি ভর্তি বালতি’তে ডুবিয়ে রেখে আসে, সাথে কম্বলটাও ফ্লোরে ময়লার মধ্যে ঘষে পানিতে ভিঁজিয়ে রেখে আসে। আবিরের চশমাটা ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখা ছিল। চশমা হাতে চোখের সামনে এদিক ওদিক করে চশমার একটা গ্লাস কামড়ে ধরে নীলিমা। তেজি মেয়ের এক কামড়ে চশমার ফ্রেম ভেঙে কাঁচগুলো ঠোঁটে গিয়ে বিধে। ওহ, মাগো বলে চশমাটা হাত থেকে ফেলে ঠোঁট ধরে প্রচন্ড জোরে চিৎকার দেয় নীলিমা।

নীলিমার চিৎকার আবিরের কান অবধি বুঝতে বেশী সময় নেয়নি। কেঁপে উঠে আবিরের কলিজা। রান্না রেখে ছুটে আসে রুমে। নীলিমার এ হেন অবস্থা থেকে আবির ভড়কে গেলেও পাশে পরে থাকা ভাঙা চশমা আর রুমের অবস্থা দেখে আবির খুব শিগ্রয়ই বুঝে যায় আসল ঘটনা। একি করছ?!!!
দৌঁড়ে গিয়ে নীলিমার পাশে বসে আবির। ঠোঁট থেকে কাঁচগুলো সরিয়ে নিতেই আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠে নীলিমা। “ওমাগো, জ্বাল।
মরে গেলাম গো, জ্বলে যাচ্ছে গো…..”
আবির ওর ময়লা হাতের দিকে তাকায়। হাতে তখনো হলুদ, মরিচের গোঁড়া লেগে আছে। দিগ্বিদিক শূন্য আবির তখনি নীলিমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।

[বিঃদ্র:- খুব সমস্যায় আছি, তাই তিন তিনটা দিন আপনাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। এজন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। তবে এখন থেকে গল্পের পর্বগুলো সকাল এবং রাত্রে দু’বার করে দিয়ে আপনাদের ক্ষতিটা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ]

চলবে……

ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ১৮

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ১৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আবিরের কথা শুনে দৌঁড় দিচ্ছিল নীলিমা, ধরে ফেলে আবির। একটানে কোলে তুলে নেয়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নীলিমা। দুষ্টু হেসে আবিরের প্রশ্ন-
পালাবে কোথায়?

খুব ক্লান্ত, ঘুমোতে চাই আমি। প্লিজ যেতে দিন আমায়। অনেকটা অসহায়ের মত আবিরের মুখের দিকে তাকায় নীলিমা। দুষ্টু হেসে আবিরের জবাব, ঘুম এখনি উদাও হয়ে যাবে, সাথে ক্লান্ত ভাবটাও। তাই কোনো কথা হবে না…..
“দেখুন! আপনি কিন্তু এখন বেশি বেশি করছেন। জোর করে উঠিয়ে নিয়ে আসছেন, তারউপর এখন এভাবে তেড়ে আসছেন। একবার যদি ছাড়া পাই না খুব খারাপ হয়ে যাবে। আপনার নামে মামলা করব।”
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আবির।
“আচ্ছা, তাই নাকি? কিসের ভিত্তিতে মামলা করবে? মানে কোন অপরাধে আমার নামে মামলা করবে?”
জবাব আসে, নারী নির্যাতন। আপনার নামে আমি নারী নির্যাতনের মামলা ককক……
হাসতে থাকে আবির। আচ্ছা, নারী নির্যাতনের মানেটা জানো তো?

রাগে কিচ্ছু বলতে পারে নি নীলিমা। দু’চোখের পাতা এক করে ফেলে। বিছানায় শুইয়ে দেয় আবির নীলিমাকে। দরজাটা বন্ধ করে রুমের লাইট’টা অফ করে দেয়। ড্রিমলাইটের মৃদু আলোয় আবির এগিয়ে যায় নীলিমার দিকে। নীলিমা তখনও চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কাছে যায় আবির। হাতটা ছুঁয়ে দেয়। কেঁপে উঠে নীলিমা কিন্তু কিচ্ছু বলেনি। বুকের কাছে নিয়ে দু’হাতে নীলিমার হাতটা মুঠোয় বন্দি করে। প্রায় মিনিট ত্রিশেক হয়ে গেল আবিরের কোনো সাড়া না পেয়ে পাশ বালিশে ফিরে তাকায় নীলিমা। চোখ যায় আবিরের মাথার দিকে। কিরকম বালিশবিহীন শুয়ে আছে। আস্তে আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নীলিমা ওর মাথার নিচের বালিশটা আবিরের মাথার নিচে দিয়ে দেয়। চলে যাচ্ছিল নীলিমা, পিছন থেকে হাতটা টেনে ধরে আবির।
” পালিয়ে কোথায় যাবে?”
অনেকটা রাগান্বিত কন্ঠে জবাব দেয় নীলিমা, আজব! পালাবো কেন? এ রুমে বালিশ নেই তাই ঐ রুমে যাচ্ছিলাম বা….
থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে আবির, বালিশ তো এ রুমেই আছে।
সেটা তো আপনার মাথার নিচে দিয়ে দিলাম।
মৃদু হাসে আবির- সেটা তো ছোট বালিশ। এর চেয়েও বড়সড় বালিশ কিন্তু তার উপর পড়ে আছে।
মানে?!!!
মানে সেই বড় বালিশে শুধু মাথা নয়, অনায়াসে তুলে দিতে পারবে হাত-পা’ও। এমনকি জাপটেও ধরতে পারবে। ইচ্ছে হলে চুমুও খেতে পারবে। জীবন্ত বালিশ কি না….?
রেগে যায় নীলিমা, আপনি এত খারাপ ক্যা?
হেসে দেয় আবির, তুমি এত ভালো ক্যান?
দেখুন, আপনি কিন্তু বেশী বেশী করছেন।
দেখো, তুমি কিন্তু কম কম করছ!

বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় নীলিমা। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ইয়া আল্লাহ! উঠিয়ে নিচ্ছ না কেন আমায়?
বিছানায় উঠে বসে আবির, ইয়া আল্লাহ! নিচে রাখছ কেন আমায়?
এবার কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে…!
এবার কিন্তু ভালো কিছু ঘটে যাবে।
উফফ! মরেই গেলাম বুঝি …..
জীবন্ত করে তোলার জন্য পাশেই রয়েছি আমি। আঙুল নাচিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল নীলিমা, একটানে বিছানায় নিয়ে যায়। হুড়হুড়িয়ে আবিরের বুকের উপর গিয়ে পরে নীলিমা। কিছুক্ষণ ঢ্যাবঢ্যাব করে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে যেই ঝগড়া শুরু করতে চাচ্ছিল ওমনি আবির নীলিমাকে একটানে ওর খুব কাছে নিয়ে যায়। নীলিমার মুখ আবিরের মুখের খুব কাছে। নীলিমার খোলা চুল দুপাশে ছড়িয়ে যেন এক পর্দা তৈরি করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলিমার নিশ্বাস ধীরে ধীরে ঘন থেকে আরো ঘন হচ্ছে। খুব কাছ থেকে আবির নীলিমার নিশ্বাসের শব্দগুলো শুনছে। সেই নিশ্বাস আবিরকে মাতাল করে দিচ্ছে। আচমকায় উপর থেকে একটা ইঁদুর ছিটকে পড়ে। ভয়ে চিৎকার দেয় নীলিমা। জাপটে ধরে আবিরকে। দু’হাত খামচে আবিরের শার্টের কলার ধরে আছে। নীলিমার নখের আচড়ে আবিরের গলার ক্ষাণিক জায়গা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। কিছু একটা পরে আছে আমার উপর, দেখুন না প্লিজ…. আরো জোরে খামচে ধরে নীলিমা আবিরের ঘাড়। আবিরের শরীরের অনেকাংশে ক্ষত হয়ে জ্বলছে। তারপরও আবির নড়ছে না। এ যেন এক অন্যরকম সুখ। নীলিমার নিশ্বাস ক্রমে ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে। হাত দিয়ে নীলিমার ঘাড়ের উপর পড়ে থাকা সদ্য জন্ম নেয়া ইঁদুরের বাচ্চাটাকে পাশে টেবিলের উপর রাখে আবির। একবার শুধু সেদিকে তাকায় নীলিমা। মনে মনে ভাবে, বিচ্ছু জাতীয় কিছু নয়তো?!!!
ভয়ে জাপটে ধরে আবিরকে। প্লিজ, প্লিজ লাইটটা জ্বালান। ঐটা বিচ্ছু। প্লিজ, লাইট জ্বালান। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

মনে মনে হাসে আবির।
ওহ! ম্যাডাম তাহলে বিচ্ছুকে ভয় পায়? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা…..
” নীলি! প্লিজ কথা বলো না এখন। আমার খুব ভয় করছে। তোমার ঘাড়ে একটা নয়, দুটো বিচ্ছু পরছিল। লাইট জ্বালাতে হবে না। তাড়াতাড়ি উঠো। আজকে এ রুমে থাকা নিরাপদ হবে না। আমাদের স্টাডিরুমে’ই ঘুমোতে হবে আজকে।”

লাইট না জ্বালিয়ে নীলিমাকে টানতে টানতে অন্য রুমে নিয়ে যায় আবির। তারপর লাইট জ্বালিয়ে তাড়াতাড়ি করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা। কি করবে বুঝতে পারছে না আবার শুইতেও পারছে না। শুবে কোথায়? স্টাডি রুমের বেডটা এত ছোট যে একজনের থাকতে কষ্ট হবে। নীলিমা শুকনো এবং খাটো বিধায় ওর শুতে তেমন অসুবিধে হতো না। আজ সেই বিছানায় শুয়েছে বিশাল বড় সুঠামদেহের অধিকারী আবির।
” বুইড়ার’ই জায়গা হচ্ছে না, আমি আর কোথায় থাকব?”

লাইট’টা অফ করে চুপ করে ছোট্ট সোফার উপর পা তুলে ওড়না দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসে নীলিমা। তখনি আবির বিছানা থেকে উঠে একটা টানে বুকে নিয়ে যায় নীলিমাকে।

কিছুক্ষণ পর-
” গলায় হাত দিবেন না একদম। কাতুকুতু লাগে আমার।”
চুপ! কোনো কথা হবে না…..
” এই অনাচার আল্লাহ সইবে না। এর বিচার একদিন ঠিক করবে আল্লাহ….”
বড্ড জ্বালাচ্ছো তুমি। দাঁড়াও তোমার মুখ আমি বন্ধ করছি। অতঃপর……..

সকালে__
বাজার থেকে কেবল পরোটা আর সবজি নিয়ে বাসায় ফিরছিল আবির। রুমে ঢুকে’তো রীতিমতো ‘থ’ হয়ে যায়। এ আমি কি দেখছি? এও কি সম্ভব? চোখ কচলায় আবির। চোখ কচলিয়ে আবারো সোফার দিকে ফিরে তাকায়-
” আবিরের পাঞ্জাবি পাজামা পরে সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে নীলিমা।”

খাবার টেবিলে পরোটার প্যাকেজ রেখে চুপটি করে সোফায় নীলিমার পাশে গিয়ে বসে। চরম হাসি পাচ্ছে আবিরের কিন্তু হাসছে না। কারণ, এ অবস্থার জন্য যে আবির নিজেই দায়ী। রাত্রে একটু বেশী ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছিল কি না…!! এখন এ বাসায়ও নীলিমার কোনো কাপড় নেই। যার কারণে ওর এই বেহাল দশা….!!!
যায় হোক….
বহু কষ্টে হাসি আটকায় আবির-
” নীলি! চলো খাবে….”
—- নীলিমা নিশ্চুপ…!
—- কি হলো, চলো……(আবির)
—- নীলিমা এবারো নিশ্চুপ।
—- কি হলো? খাবে না???(আবির)
—– নীলিমা এবারো পূর্বের ন্যায় মাথা নিচু করে বসে আছে। সেটা দেখে শরীরে ধরে নাড়া দেয় আবির। প্রশ্ন করে- কি হয়েছে? এভাবে বসে আছ কেন?
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নীলিমা। অগ্নি চোখে আবিরের দিকে তাকায়। একদম শরীরে হাত দিবি না শয়তান, ইন্দুর, বান্দর, ফাজিল, তেলাপোকা…..

–এসব কি ভাষা বলছ? চলো, খাবে…

ওরে শয়তান! আমার কথা কি তোর কানে যায়নি? আবার কেন শরীরে হাত দিয়েছিসরে বদমাইশ?!!! আর কি জানি বলছিস, ভাষা? তোর মত লুচ্চার জন্য এসব’ই পারফেক্ট। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তুই রাত্রে আমার সাথে যা করছস তার বিচার ঐ আল্লাহ করবে……
” নীলি প্লিজ শান্ত হও।”

বাঘের মত হুংকার নেয় নীলিমা। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে, আপনি আমার সামনে থেকে যান।
ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।
তোমার জন্য কাপড় কিনে আনি। ততক্ষণে তুমি ব্রেকফাস্ট’টা সেরে নাও। কথাটা বলে আবির চলে যাচ্ছিল, দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে আসে। মুচকি হেসে বলে-
“তোমায় কিন্তু বেশ কিউট লাগছে।”

দাঁতে দাঁত চেপে অগ্নিচোখে আবিরের দিকে তাকায় নীলিমা। ভয়ে ঢোক গিলে আবির। না, মানে যাচ্ছি বলে তাড়াতাড়ি রুম থেকে কেটে পড়ে। সকাল ১১টা নাগাদ হাতে বেশ কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে বাসায় ফিরে আবির। বার কয়েক কলিং বেল চাপার পরও দরজা খুলছে না নীলিমা।
” আহারে বেচারি! পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় কে না কে দেখে ফেলে সেজন্য ভয়ে দরজাও খুলছে না।”
জোর গলায় বলে উঠে আবির- বুড়া মানুষকে আর কত দাঁড় করিয়ে রাখবা? এবার তো দরজাটা খুলো।
এবারো কোনো সাড়া নাই। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবারো ডাক দেয় আবির।
“নীলি! প্লিজ দরজাটা খুলো….”
সাড়া নেই এবারো। কলিং বেলে চাপ দিয়ে ডাক দেয় আবার। সাথে সাথে দরজা খুলে যায়। পুরো শপিং ব্যাগ এখনো বিছানায় রাখেনি, তার আগেই দরজার ছিটকিনি আটকানোর আওয়াজ পায়। পিছনে ফিরে তাকায় আবির। ‘থ’ হয়ে যায়। মুখ হা হয়েছে তো হয়েছে। আর বন্ধ হচ্ছে না। সেটা দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে জবাব দেয় নীলিমা-
” বাথরুমে গিয়েছিলাম।
পাজামার ফিতায় গিট্টু লাগছে। গিট্টু খুলতে পারিনি। ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলেছি। আলমারির চাবি খুঁজে পাইনি। বারান্দায় এ লুঙ্গিটা পেয়েছি। তাই……..”
ঘোর কাটে আবিরের। ও মাই গড!শেষমেষ তুমি লুঙ্গি পরলে? হা, হা করে হাসতে শুরু করে আবির। হাত থেকে শপিং ব্যাগ নীলিমাকে দেখেই পড়ে গিয়েছিল, এখন আবির নিজেই পড়ে গেছে। পড়ে গিয়েও হা, হা, হু, হু করে হেসেই যাচ্ছে আবির। বিছানা থেকে ফ্লোরে পড়ে যায় আবির। ফ্লোরে পড়ে গিয়েও হাসতে থাকে। একপর্যায়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে থাকে।
রাগে কান্না চলে আসছে নীলিমার। আবিরকে ফ্লোর থেকে টেনে তুলে ওর পরনের শার্টের কলার ধরে টানা শুরু করে। টানতে টানতে শার্টের বোতাম ছিড়ে ফেলেছে কয়েক জায়গায়। উন্মুক্ত হয়ে যায় আবিরের বুক। খামচে ধরে সেখানে। খামচে, খামচে বুকের বেশ কিছু জায়গা থেকে রক্তও বের করে দিয়েছে। সেদিকে আবিরের কোনো খেয়াল’ই নেই। আবির তখনো হেসেই যাচ্ছে। ধাক্কা মেরে আবিরকে বিছানায় ফেলে দেয়া হয়।আবির তখনো হেসে চলছে। এবার বিছানা থেকে উঠিয়ে কলার ধরে টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। দরজা খুলে নীলিমা। তারপর এক ধাক্কা দিয়ে আবিরকে বাইরে ফেলে দেয়। বাইরে গিয়েও হাসতে থাকে আবির। হাসতে হাসতেই দরজায় টোকা দিতে থাকে-
” নীলি! প্লিজ দরজা খুলো। একটা সেল্ফি তুলব দুজনে….”

দরজায় ছিটকিনি আটকে ফ্লোর থেকে শপিং ব্যাগ গুলো তুলে বিছানায় রাখে। সবগুলো ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে। মেজাজ চরম খারাপ হয়ে যায় নীলিমার। একটা থ্রি-পিছ কিংবা লেহেঙ্গা কিচ্ছু আনেনি। যা এনেছে সব শাঁড়ি। রাগে দুঃখে দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে ওর। বহু কষ্টে রাগকে কন্ট্রোল করে। ৫টা শাঁড়ির মধ্যে থেকে একটা শাঁড়ি বেছে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে নীলিমা। কিছুক্ষণ পর পাঞ্জাবি লুঙ্গি পাল্টে গায়ে কোনোরকম শাঁড়ি জড়িয়ে রুমে ঢুকে। আবির তখনো দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে হাসছে আর বলছে-
” প্লিজ নীলি!
একটা, জাস্ট একটা সেল্ফি তুলবো তোমার সাথে। প্লিজ, দরজাটা খুলো।”

মুহূর্তেই দরজাটা খুলে যায়।
কিছু একটা বলতে যাবে আবির তখনি চোখ যায় নীলিমার দিকে। ‘থ’ হয়ে যায় আবির। হা করে তাকিয়ে আছে নীলিমার দিকো।
” এ আমি কি দেখছি?
এ যে স্বর্গের অপ্সরিকেও হার মানাবে।”
মনে মনে বলে উঠে, সুবহানআল্লাহ!
— দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে নীলিমা,
এখানে হাবার মত এভাবে দাঁড়িয়ে কেন আছেন? বের হোন রুম থেকে। স্টাডি রুমে যান। আমি এখন শাঁড়ি’টা ভালো ভাবে পরব।
—– ইয়ে না মানে টিভিতে নিউজ দেখব। কথাটা বলেই ভেঁজা বিড়ালের মত সোফায় গিয়ে বসে আবির। ভ্রু- কুচকে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় নীলিমা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাঁড়ির আঁচল ঠিক করছিল নীলিমা, এরই মাঝে চুরের মত বার কয়েক সেদিকে তাকিয়ে ফেলেছে আবির। দৃষ্টি এড়ায় না নীলিমার। প্রথম কয়েকবার পাত্তা দিলেও একসময় তেড়ে যায় আবিরের দিকে।
” আপনি যে শিক্ষকতার পাশাপাশি লুচু কোম্পানির ম্যানেজার পদে আছেন সেটা কি আপনার কলেজে জানে?”
—- What???(আবির)
বার বার এভাবে চুরের মত আমার দিকে কেন তাকাচ্ছেন?(নীলিমা)
জবাব আসে, তোমাকে নয় আমি তো আয়না দেখছিলাম…..
পাল্টা জবাব নীলিমার- আর সেই আয়নার ভিতর আপনাকে না, আমাকে দেখা যাচ্ছিল।
কি সাংঘাতিক! আমি তোমার দিকে তাকাবো কেন?(আবির)
নীলিমার জটপট উত্তর, কারণ আপনি লুচ্চা….
ধমক দেয় আবির, কিসব আজেবাজে বকে যাচ্ছ সকাল থেকে। এসব কি ধরনের ভাষা? একজন শিক্ষিত, ভদ্র মানুষ হয়ে এসব ভাষা বলো কি করে?
চুপসে যায় নীলিমা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে স্থানেই। ভ্রু-কুঁচকে রুম ত্যাগ করে আবির।

রুম থেকে বের হয়ে সোজা ছাদে চলে যায় আবির। তখনি ওর ফোনে শ্বশুর বাড়ি অর্থাৎ নীলিমার গ্রামের বাড়ি থেকে কল আসে। রিসিভ করে আবির-

লিমা- আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
আবির:- ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছে আমার বোনটা?(শ্যালিকা)
লিমা- ভালো নেই ভাইয়া….
আবির:- কেন? কি হয়েছে?
লিমা- মায়ের শরীর’টা খুব খারাপ। অচেতন হয়ে বিছানায় পরে আছে। বার বার আপুর নাম নিচ্ছে। আপুকে ফোন দিয়ে বলছিলাম মা কথা বলবে, না শুনেই কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। প্লিজ, ভাইয়া একটা বার আপুকে বুঝিয়ে নিয়ে আসুন না। মা খুব খুশি হবে।
আবির:- কিন্তু ও কি আসবে?
লিমা- হ্যা, আসবে ভাইয়া। আপনি শুধু ওকে একটু ভালো করে বুঝিয়ে বলবেন মা ওর….(….)…..???
আবির:- লিমা আমি তোমার সাথে পরে কথা বলছি। রাখি এখন…

পুরো কথা বলতে পারেনি লিমা, তার আগেই কল কেটে দেয় আবির। কারণ, ছাদে দাঁড়িয়ে ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নীলিমা নিচে দাঁড়িয়ে চলন্ত সিএনজি থামানোর চেষ্টা করছে। তার মানে ও বাড়ি থেকে পালাতে চাচ্ছে। দৌঁড়ে নিচে নামে আবির। ততক্ষণে একটা সিএনজিকে দাঁড় করিয়ে ফেলছে নীলিমা। আবির হাত ইশারায় পিছন থেকে সিএনজি ড্রাইভারকে চলে যেতে বলে। সিএনজি চলে যায়। উফ, চলে গেল বলে পিছনে তাকাতেই চমকে উঠে আবির। আআআআপনি….?!!!

– জ্বি, আমি। এভাবে পালিয়ে আমার থেকে পাড় পেয়ে যাবে ভাবছ?(আবির)
-………. (নীলিমা)
– এত সহজে তোমার নিস্তার নেয়ার। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আমার কাছ থেকে তোমায় কেউ আলাদা করতে পারবে না। সো, বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। চলো…..
আবির নীলিমার হাত ধরে টান দেয় আবির। হ্যাচকা টানে সে হাত ছাড়িয়ে নেয় নীলিমা। ভ্রু-কুঁচকে ফিরে তাকায় আবির।
” কি হলো? কথা কি কানে যাচ্ছে না? ভিতরে চলো। ”
আমি যাব না। কিছুতেই যাব না। যায় হোক, আজ আর আপনি আমায় জোর করে নিয়ে যেতে পারবেন না। ভুলে যাবেন না কালকে রাত ছিল বিধায় আমি নিরুপায় ছিলাম। কিন্তু এখন দিন। এখন আপনি আরেকবার জোর করেই দেখেন না, চিল্লিয়ে মানুষ জড়ো করে ফেলব। আপনার ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে দিব।

আচ্ছা, তাই নাকি? দেখা যাক কি করতে পারো। আবির নীলিমাকে কোলে তুলে নেয়। নীলিমা চিৎকার করতে থাকে কিন্তু কেউ আসছে না। দুর থেকে যারা দেখেছে তারা হাসছে। কারণ, ওরা আবিরকে শিক্ষক এবং একাধারে বাড়িওয়ালার পুত্র বলে খুব ভালো করেই জানে। সেই হিসেবে নীলিমাকেও ওরা বেশ চিনে। আবির কোলে করেই নীলিমাকে রুমে নিয়ে যায়। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তার পাশে বসে। রাগে থরথর করে কাঁপছে নীলিমা, কিচ্ছু বলতে পারছে না।
নীলিমার পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছে আবির, কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাও চেয়েছে। বাথরুমের ডাক পড়ে আবিরের। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাথরুমে যায়। এবারো দরজা খুলে দু’লাফে রুম থেকে বেরিয়ে যায় নীলিমা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে আবির। আবারো পালিয়েছে?!!!
মেজাজ প্রচন্ড বিগড়ে যায় আবিরের। বারান্দায় গিয়ে দেখতে পায় নিচে কিচ্ছু না পেয়ে হাঁটা শুরু করেছে নীলিমা। দৌঁড়ে নামে আবির। নীলিমাকে ডাক দেয়, শুনেনি সে। এবার না ডেকে দৌঁড় দিয়ে নীলিমাকে ধরে।
” থাপ্পর খাওয়া হয় না অনেকদিন ধরে, তাই না?”

আবির শক্ত হাতে নীলিমাকে ধরে রাখে। নীলিমা সেই হাত মুচড়াতে থাকে। ছাড়াতে পারছে না। হঠাৎ’ই একটা রিক্সা পাশ কাটিয়ে চলে যায়। পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে নীলিমা, স্যার! প্লিজ দাঁড়ান। এই বখাটে আমায় নিয়ে যাচ্ছে। রিক্সায় বসে থাকা যাত্রীটা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় সাথে রিক্সাওয়ালাও। সেদিকে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দেয় আবির। একদৌঁড়ে নীলিমা রিক্সায় অচেনা ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসে। রিক্সা চলছে। ভদ্রলোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পিছনে তো আরেকবার নীলিমার দিকে তাকাচ্ছে__
” উফ! ভাগ্যিস বুদ্ধি খাটিয়ে লোকটাকে স্যার ডাকলাম……”
হঠাৎ’ই পাশ থেকে ভদ্রলোকটির প্রশ্ন,
” তোমাকে মনে হয় আমি দেখেছি কিন্তু খেয়াল নেই। আচ্ছা তুমি কোন ব্যাচের?”
জিহ্বায় কামড় দেয় নীলিমা, খাইছেরে! এতো দেখছি সত্যি সত্যি শিক্ষক। জোর করে মুখে হাসির রেখা টানে নীলিমা। হেসে বলে আমি অমুক কলেজের ২০** সালের ব্যাচের স্টুডেন্ট ছিলাম। আপনি আমাকে চিনবেন না স্যার। ক্ষণিক হাসে ভদ্রলোকটি। সানগ্লাস’টা চোখ থেকে নামিয়ে পরিষ্কার করে পরে নেয়। নীলিমা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
” তুমি সিউর ঐ লোকটা লোকটা তোমাকে ডিস্টার্ব করে?”
ঢোক গিলে নীলিমা। মনে মনে ভদ্রলোকের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলেছে ছেলেকে শিক্ষক বানানোর জন্য।
“কি হলো? বলো….”
বুকে সাহস সঞ্চয় করে নীলিমা, হ্যা! ওনি শুধু আজ নয় আমায় রোজ ডিস্টার্ব করে। আমায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। মাঝেমাঝে তো হাতও ধরে ফেলে।

নীলিমার কথা শুনে মিনিট খানেক নীলিমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন লোকটা। তারপর হঠাৎ’ই রিক্সা থামায়-
” ভাই একটু দাঁড়াও তো আমি একটু ফোন করে নেই। আমাদের কলেজের মেয়েকে ডিস্টার্ব করা ব্যাটার সাহস কত….!!!”
পকেট থেকে ফোন বের করে ভদ্র লোকটি নীলিমার দিকে ফিরে তাকায়। নীলিমা আমতাআমতা করে বলে, আআআআআমাদের কলেজ???
জবাব আসে, হু! আমাদের কলেজ। ঢাকা *** কলেজের স্টুডেন্ট না তুমি?
অচেনা শিক্ষকের মুখে নিজ কলেজের নাম শুনে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম নীলিমার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায়। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে, আপনি আমায় চিনেন?
হেসে দেয় লোকটি। কি যে বলো না। কলেজের সেরা স্টুডেন্ট নীলিমা একাধারে এম.বি.বি.এস’কে কে না চিনে? প্রসপেক্টাসে তোমার ছবি আমি বহুবার দেখেছি, তুমি আমায় চিনবে না। আমি কলেজে জয়েন করেছি তুমি আসার পর।
ইয়া আল্লাহ! তাহলে তো ইনি আবিরকে চিনে ফেলছে। আর ঘাড় ঘুরিয়ে সেই জন্য’ই বার বার পিছনে তাকাচ্ছিল। আচমকা রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ায় নীলিমা। মনে মনে, নীলিমা তুই কেটে পর।
রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটাতে গিয়ে ধরা খায় নীলিমা। এইরে! আমার কাছে তো টাকা নেই। স্যার মানে ভদ্রলোকটার দিকে দিকে করুণ চোখে তাকায় নীলিমা। ভদ্রলোকটা তখন মেসেজ চালাচালিতে ব্যস্ত। উফ! কি করব আমি….!!!
কি হলো ভাই? দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো। আমার এমনিতেও দেরী হয়ে গেছে।
” আপা তো ভাড়া দিচ্ছে না যাব কিভাবে?”
নীলিমার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যজনক হাসি দেয় ভদ্র লোকটা। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে, ও আমার ছাত্রী। দাঁড়াও ওর ভাড়া আমি দিয়ে দিচ্ছি। এটা বলে মানিব্যাগ বের করে ভদ্রলোক। উফ! মানিব্যাগে তো ভাংতি নেই।
পাশ থেকে রিক্সাওয়ালা, আমার কাছে এত টাকার ভাংতি হবে না।
অসহায়ের মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা। কি করবে বুঝতে পারছে না। পিছন থেকে কাধে হাত রাখে কেউ –

” খেলে তো ধরা সবদিক থেকে?!!!”

চলবে……

[বি:দ্র:- আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত বন্ধুরা রাত্রে হঠাৎ’টি অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম, তাই এফবিতে আসতে পারিনি। আর কথামতো গল্পটাও দিতে পারিনি।]

ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ১৭

0

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ১৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

” বাপ তুই নাম।
আমি কিছুক্ষণ হাইসা লই।”

কথাটা বলে হু, হু করে হেসে উঠে আদিত্যর বাবা। তার সাথে সাথে হেসে উঠে আদিত্যর দাদা-দাদী, হেসে উঠে আদিত্যর ছোট কাকা ও তার স্ত্রী। মোটামুটি সবার মুখেই হাসি, শুধু হাসি নেই আদিবার মুখে। ভাই আবির যে এমন কান্ড করবে সেটা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। অথচ তাই হয়ে গেল, শেষমেষ বউ চুরি করে নিয়ে গেল। লজ্জায় কুঁকড়ে যায় আদিবা কিন্তু হেরে যেতে রাজি নন। দৌঁড়ে বাড়ির পিছনে জাম গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান। ততক্ষণে আবির নীলিমাকে কোলে নিয়ে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাছে চলে গেছে। আদিবা একদৌঁড়ে গাড়ির কাছে যায়। আবির ততক্ষণে গাড়ির ভিতরে বসিয়ে দিয়েছে নীলিমাকে।
” ঐ বদমাইশ! তুই বউরে নিয়া কই যাস? নীলিমা বেরিয়ে আসো।”
গাড়ির ভিতরে হাত দিয়ে আবিরের বোন আদিবা নীলিমাকে টানছে কিন্তু নীলিমার কোনো সাড়া নেই। সাড়া দিবে কিভাবে? পিছন থেকে হঠাৎ মুখ বেধে ফেলা, তারপর আচমকা পিছনে তাকিয়ে আবিরের গায়ের সাদা গেঞ্জিতে কঙ্কাল এবং তার সাথে লাল জিহ্বার ছাপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল নীলিমা। যদিও ভূত-প্রেতে ওর বিশ্বাস নেই কিন্তু গত পরশুদিন দুপুরে পুকুরপাড়ে ঘুরতে গিয়ে এক অচেনা যুবকের ঝুলন্ত ভয়ানক লাশ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আজ তাই মুখ বাধার পর আবিরের গেঞ্জির কঙ্কাল এবং লাল জিহ্বার ছাপ দেখে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারায়। আদিবা যখন নীলিমাকে ধরে টানাটানি করছিল, তখন পিছন থেকে আদিত্যর বাবা এসে স্ত্রীকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে শ্যালক আবিরের উদ্দেশ্যে বলে-
” ওরে গাধা! তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দে।”

আবির গাড়িতে উঠে তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দেয়। বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে বেশ ক্ষাণিকটা দুরে গিয়ে গাড়ি থামায়। বোতল থেকে পানি নিয়ে নীলিমার চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়। জ্ঞান ফিরে নীলিমার। আবিরের দিকে একবার তাকিয়ে গেঞ্জির দিকে তাকায় সে। তারপর’ই কেমন ঢোক গিলে। মূল কাহিনী বুঝতে পারে আবির। শরীর থেকে গেঞ্জিটা খুলে ফেলে আবির। গাড়ি পুনরায় স্টার্ট দিবে আবির, তখনি একটান দিয়ে মুখ থেকে বাধনটা খুলে ফেলে নীলিমা। এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারে এখনো তেমন রাত হয়নি। গ্রামের বাজারে টং দোকানে তখনো মানুষজন বসে চা খাচ্ছিল। তারমানে আমি এখন চিৎকার দিলে মানুষ আসবে!

আবিরের দিকে একবার তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে নীলিমা,
কেউ আছেন….!!!
পানি খাচ্ছিল আবির। মুখ থেকে পানি ছিটকে পরে যায়। মুখ চেপে ধরে নীলিমার-
” চুপ! একদম চুপ!”
বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে নীলিমা। আবির তখনো মুখটা চেপে ধরে আছে। নীলিমা কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হাতটা সরিয়ে নেয় আবির। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে নীলিমা। গাড়ি স্টার্ট দেয় আবির। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলে নীলিমা-
” আমায় নামিয়ে দেন নতুবা আমি লোক ডাকব।”
গাড়ি থামায় আবির,
নীলিমাকে অবাক করে দিয়ে চেঁচাতে থাকে আবির-
” বাঁচান! বাঁচান! হেল্প! হেল্প! এক বদমাইশ আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ, হেল্প মি।”

চোখ বড় বড় করে তাকায় নীলিমা।
একটা শয়তান মার্কা হাসি দিয়ে বলে,
কি হলো? লোক ডাকো। আমি তো শুরু করে দিলাম….. রাগে দুঃখে দাঁতে দাঁত চেপে অন্য দিকে মুখ করে তাকায় নীলিমা। জয়ের হাসি হেসে গাড়ি চালাতে শুরু করে আবির। মাঝ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ’রা আবিরের গাড়ি থামায়। সামনে আরো অনেক গাড়ি, সিরিয়ালের সবচেয়ে শেষে আবিরের গাড়িটা। ঘন্টা দু’য়েক যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সেটা আবির বেশ বুঝতে পারছে। এদিকে চারিদিকে যেন বরফ পরছে। গাড়ির কাঁচ ভেঙে মনে হচ্ছে সেগুলো ভেতরে চলে আসবে। নীলিমার গায়ে শীতের চাদর ছিল বিধায় দিব্যি বসে আছে কিন্তু বেচারা আবির? শীতে ওর যায় যায় অবস্থা….

শীতে দু’হাত একসাথে করে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। প্রচন্ড শীতে কুকড়ে যাচ্ছে আবির। একবার হাতে হাত ঘষাচ্ছে তো আরেকবার পাশে রাখা ঐ হাতাকাটা গেঞ্জি দিয়ে শরীর ঢাকার চেষ্টা করছে। পাশ থেকে অফার করে নীলিমা।
” এটা নিন।”
ফিরে তাকায় আবির। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে-
” চাদর তো একটা। এটা নিয়ে নিলে তুমি কি গায়ে দিবে?”
মাথা নিচু করে জবাব দেয় নীলিমা, আমার আসলে তেমন শীত করছে না এখন। আপনি গায়ে দিন।
জবাব দেয় আবির-
” চাদরটা নিতে পারি এক শর্তে…”
জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকায় নীলিমা। ক্ষাণিক মাথা চুলকিয়ে আবির বলে- না মানে তুমি যদি আমার সাথে চাদরের নিচে আসো,
তবেই আমি তোমার চাদর নিব।
” Impossible….!”
কথাটা বলেই অন্যদিকে মুখ করে বাইরে তাকায় নীলিমা। আবিরও আর কিছু বলেনি। শুধু জড়োসড়ো বসে আছে। কেটে যায় মিনিট দশেক। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে নীলিমা। এদিকে রাত যত বাড়ছে শীতের প্রকোপটাও ততই বাড়ছে। শীতের দাপটে দাঁতে দাঁত লেগে আসে আবির।

প্রচন্ড শীতের যন্ত্রনায় “উহ” করে উঠে আবির। পাশ থেকে একটু একটু করে এগিয়ে আসে নীলিমা। আসতে আসতে আবিরের একদম কাছে চলে আসছে। সেটা দেখেও আবির না দেখার ভান করে বিপরীতমুখী তাকিয়ে আছে। গায়ের চাঁদর’টা নিজহাতে আবিরের শরীরে জড়িয়ে দিয়ে তার ভিতরে গিয়ে চুপটি করে বসে। নড়ে বসে আবির। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে। জাপটে ধরে নীলিমাকে। আবিরের ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় শিহরিত হয়ে উঠে নীলিমা। কিন্তু মুখে কোনো রাগ দেখায়নি। কারন, রাগ দেখালে আবির যদি চাঁদরের নিচ থেকে বেরিয়ে যায় তাই। এদিকে আবির?!
এক হাতে নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে নীলিমার মুখের উপর সরিয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুজে দেয়। তারপর মুখটা নীলিমার ঘাড়ের কাছে নিয়ে যায়। নাক ডুবিয়ে দেয় নীলিমার ঘাড়ে। কেঁপে উঠে নীলিমা কিন্তু সরে যায় নি। আবির যেন সেই সুযোগের’ই সদ্ব্যবহার করছে। ঘাড় থেকে মুখটা সরিয়ে নেয় আবির। একটানে নীলিমাকে ওর দিকে ফিরিয়ে নেয়। নীলিমার গালের পাশে আবির ওর আঙুল দ্বারা ভালোবাসার রেখা টেনে দিচ্ছে, শিহরিত নীলিমা পরম সুখে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। নীলিমাকে কাছে টানে আবির। কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। চোখ খুলে আবিরের দিকে তাকায় নীলিমা। একটা হাসি দিয়ে বুকে টেনে নেয়।

গাড়িতে জোরে জোরে টোকা দেয়া হচ্ছিল বাহির থেকে। ঘোর কাটে নীলিমার। আবিরের থেকে ক্ষাণিকটা দুরে সরে মাথা নিচু করে রাখে। চেঁচিয়ে উঠে গাড়ি থেকে মাথা বের করে আবির-
” ও ভাই! কি শুরু করছেন? শান্তি মতো একটু রোমাঞ্চও করতে দিবেন না নাকি?”
কথাটা বলে পুলিশের দিকে তাকাতেই চমকে যায় আবির, আরে সজিব? তুই?
আবিরও মতো বন্ধু সজিবও চমকে উঠে প্রশ্ন করে-
” আরে আবির না? কেমন আছিস? আর তুই এত রাত্রে এখানে?”
পুরো ঘটনা সংক্ষেপে সজিবকে জানায় আবির। নীলিমার সাথে কথা বলার জন্য গাড়ির ভিতরে তাকায় সজিব_
” আরে ভাবি?! কি করছেন? ঠোঁটে কি চুইংগাম লাগছে নাকি? এভাবে ঘষাচ্ছেন কেন?”
প্রচন্ড রাগে আবিরের দিকে তাকিয়ে কেঁদে দেয় নীলিমা। সজিব ঘটনা কি বুঝার জন্য আবিরের দিকে তাকায়। আবির ইঙ্গিতে ওর ঠোঁটে হাত দিয়ে চোখ টিপ মারে সজিবকে। বিষম খায় সজিব। হাসি আটকিয়ে বলে- আসলে খবর পেয়েছি এ এলাকা থেকে মাদকদ্রব্য চালান হয়। তাই এভাবে জেরা করা আর কি….
আচ্ছা তুই ভিতরে গিয়ে বস। আমি ওদের গিয়ে বলছি তোকে তাড়াতাড়ি দেখে ছেড়ে দেয়ার জন্য।

সমস্ত ঝামেলা কাটিয়ে রাত্রি আড়াইটার দিকে বাসায় গিয়ে পৌঁছে আবির।
আহ! ফ্রেস হয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয় নীলিমা। এদিকে আবির?
ওর দুলাভাইকে ফোন করে বাসায় আসার কথা জানিয়ে রুমে প্রবেশ করে। রুমে এসে নীলিমাকে না দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। স্টাডিরুমে কেবল শুয়েছিল নীলিমা। দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে একটানে নীলিমাকে উঠিয়ে দেয়। চোখ বড় বড় করে তাকায় নীলিমা। কোনো কথা না বলে টানতে টানতে আবির নীলিমাকে ওর রুমে নিয়ে যায়। হাতটা ছাড়িয়ে ‘আমি ঘুমাবো’ এটা বলে চলে যাচ্ছিল নীলিমা। পিছন থেকে ওড়নায় টান দিয়ে ধরে আবির। একহাতে গলার কাছে চলে আসা ওড়নার মাথায় ধরে বিপরীতমুখী হয়েই প্রশ্ন করে নীলিমা-
” কি করছেন এসব?”
উত্তর আসে, করিনি তবে করব।
ঢোক গিলে নিচু গলায় নীলিমা বলে, ছাড়ুন! আমি ঘুমাবো…..
অনেক ঘুমিয়েছ আর নয়, আবির নীলিমার ওড়না ধরে টানতে টানতে কাছে নিয়ে আসে। কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে নীলিমা, কেন এমন করছেন? কেন এভাবে আমায় জ্বালাচ্ছেন?
জবাব আসে,
অন্যের বাচ্চা নিয়ে আর যাতে তারা গুনতে না হয় সেই জন্য এমন করছি। তোমায় জ্বালানোর জন্য আরো একজন সদস্য আনার প্রয়োজন বোধ করছি আমি।

আবিরের কথা শুনে দৌঁড় দিচ্ছিল নীলিমা, ধরে ফেলে আবির। একটানে কোলে তোলে নেয়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নীলিমা। দুষ্টু হেসে আবিরের প্রশ্ন, পালাবে কোথায়?

চলবে….