Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2424



ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ১১

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আমি কি এখন রুমে যাব? ভাবির সামনে গিয়ে দাঁড়াব? আমি কি রুমে গিয়েই ভাবির হাত থেকে শাঁড়িটা কেড়ে নিব? আমি কি সত্যি সত্যি শাঁড়িটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসব? না, না! এ আমি পারব না। এ আমার দ্বারা সম্ভব না। আপন মনেই কথাগুলো বলে দরজার সামনে থেকে সরে যায় শিশির। তারপর চোখের জল মুছে দরজা থেকে ক্ষাণিকটা দুরে সরে গিয়ে ডাক দিল শিশির-
” ভাবি! কোথায় তুমি? আম্মু ডাকছে তোমায়। খেতে আসো।”
আগেভাগেই কারো আগমনী বার্তার সংকেত পেয়ে সাবধান হয়ে যায় লাবণ্য। ফ্লোর থেকে উঠে চটজলদি শাঁড়িটা লুকিয়ে ননদের কথার স্বাভাবিক জবাব দেয়-
” আসছি শিশির! তুমি যাও…..”

আমি তো যাব’ই। তার আগে আমার যে একটা কাজ আছে ভাবি। ঐ কাজটা করে তবেই যে আমি নিচে নামব। মনে মনে কথাটা বলে শিশির ওর রুমের আলমারি থেকে একটা পুরনো কাপড় বের করে নেয়। মোড়কে আবৃত কাপড়টা নিয়ে শিশির যখন সিড়ি বেয়ে নিচে নামছিল তখন সবাই শিশিরের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নিচে নেমে কাউকে কিছু না বলে সরাসরি দরজার সামনে চলে যায় শিশির। দরজার কাছে গিয়ে পিছু ফিরে তাকায় শিশির। কতগুলো চোখ তখনো ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার কৌতূহল মেটানোর জন্য শিশির জবাব দেয়-
” মোড়কে আবৃত জিনিসটা আর কিছু নয় শুভ্র ভাইয়ার কেনা ঐ শাঁড়িটা ছাড়া। তুমি বলছিলা না এটা কালকে ডাস্টবিনে ফেলে দিবে? তাই আমি এখন আমি এটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসতেছি।”
শুভ্রর মা গম্ভীর গলায় বলেন, হ্যাঁ, যা! ফেলে দিয়ে আয়। শিশির যাচ্ছি বলে বাইরে চলে যায়। খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পরে শুভ্র। জল ছলছল চোখ আর মনে ব্যথা নিয়ে কিছু পেটে না দিয়েই সে স্থান পরিত্যাগ করে শুভ্র। শাশুড়ির বারংবার ডাকে ক্ষাণিক বাদেই খেতে আসে লাবণ্য। টেবিলে বসে মলিন মুখে লাবণ্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চাতকের ন্যায় ঐ দুটি আঁখি যেন কাউকে খুঁজছে! কিন্তু মুখ খুলতে পারছে না।অনেকক্ষণ এদিক ওদিক তাকানোর পর লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলে লাবণ্য-
” শুভ্র ভাইয়া কে যে দেখছি না! ওনি কি খাবে না?!”

ভাইয়া!!!
খাবার মুখে তুলে হাসতে হাসতে কাশি উঠে যায় শিশিরের। লাবণ্যর শাশুড়ি একধমকে শিশিরের হাসি থামিয়ে হাতে একটা পানির গ্লাস ধরিয়ে দেয়। তারপর লাবণ্যর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে জবাব দেন-
” খাবার টেবিলে বসছিস, খেয়ে চলে যা। এসব শুভ্র টুভ্রর খাবার নিয়ে চিন্তা তোকে করতে হবে না। যার ইচ্ছে হবে নিজে নিয়েই খেতে পারবে। আর ইচ্ছে না হলে না খাবে। এই নে! তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ।”
লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যর দিকে একটা প্লেট এগিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পরে খেতে। জলে টলমল চোখ নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে থাকে লাবণ্য। তারপর যখন বুঝতে পারে দু’চোখে অন্ধকার দেখছে, তখন কাউকে কিছু না বলে ড্রয়িংরুম থেকে দৌঁড়ে চলে যায় লাবণ্য। লাবণ্যর চলে যাওয়ার পর শিশির উত্তেজিত গলায় বলে উঠে-
” হলো তো এবার?
মা! আর কত? আর কত কষ্ট দিবা ভাইয়াকে? তোমার নিজ পেটের ছেলে। একটুও কষ্ট হয় না ওর জন্য? একটা বছর ধরে ওকে এভাবে দিনের পর দিন ব্যথার তীরে জর্জরিত করে আসতেছ। আর কত জর্জরিত করবা ওকে? এবার তো ক্ষতটা শুকাতে দাও…”
মেয়ের কথা শুনে রেগে গেলেও কিছুই বললেন না রোকসানা বেগম। তবে মুখ খুলেন বাবা। রাগান্বিত স্বরে ধমক দিয়ে বলেন-
” চুপ! একদম চুপ! ছোট হয়ে বড়দের ব্যাপারে কথা বলার সাহস তোকে কে দিয়েছে?”
“বাবা তুমিও?”
অবাক বিস্ময়ে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে খাবার প্লেটে পানি ঢেলে হনহনিয়ে রুমে চলে যায় শিশির।

রাত্রি সাড়ে বারো’টার মত বাজে। সবাই আরো একটাদিন সেহরী খাওয়ার অপেক্ষায় নিদ্রাজগতে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু সবাই ঘুমিয়ে গেলেও ঘুম নেই শুভ্র লাবণ্যর চোখে। একজন মেয়েদের মত হাউমাউ করে ফ্লোরে বসে কান্না করতেছে, আরেকজন বালিশে মুখ গুজে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদতেছে। একজন কাঁদতেছে ওর কৃতকর্মের জন্য, ওর করা ভুলের জন্য।
আরেকজন কাঁদতেছে অনর্থক।
হ্যাঁ, অনর্থক’ই বটে।
না হলে এভাবে কাঁদবে কেন?
কি মানে আছে এই কান্নার? আর কেন’ই বা কাঁদবে? কিসের জন্য কাঁদবে? কার জন্য কাঁদবে?
সব প্রশ্নের একটাই উত্তর, আর সেটা হলো ভালোবাসা। আপনার আমার কাছে যেটা অনর্থক, ওর কাছে সেটা ভালোবাসার কান্না।
আমরা মানুষগুলোই এরকম। প্রচন্ড রকম দুঃখবিলাসী। না হলে যার থেকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট পায় কেন তার কাছে এভাবে ফিরে ফিরে যায়?

সেদিন সেহরীর সময় শুভ্র কিংবা লাবণ্য কেউ ঘুম থেকে উঠেনি।
শুভ্রর মা এবং শিশির দুজনের রুমের দরজায় অনেকক্ষণ নক করেছে, কিন্তু কেউ দরজা খুলেনি। ফজরের নামাজের আজান ধ্বণি ভেসে আসতে লাগল দুরের সব মসজিদ থেকে। কিন্তু ওরা? তখনো ঘুমুচ্ছে।
সকাল ৯টা। শুভ্র বাসা থেকে এই সময়ই বের হয়ে যায়, কিন্তু আজ? সে ঘুমুচ্ছে। সকাল ১০টা। লাবণ্য কলেজে প্রাইভেট পড়তে যায়। অথচ আজ? ও ঘুমুচ্ছে। বেলা ১২টা। এখনো এরা ঘুমুচ্ছে। দুপুর ১টা বেজে ৩৫মিনিট। এখনো এরা ঘুমুচ্ছে।

শিশির:- মা….
আর কত ওয়েট করবা? এবার তো দরজা দুইটা ভাঙো।
মা:- আর একটু ওয়েট কর। তোর বাবা আসতেছে।
কাজের মেয়ে:- ঐ তো আংকেল এসে গেছে।
,
দুইটা সুঠামদেহী যুবক নিয়ে শুভ্রর বাবার আগমন হলো ২য় তলায় রুমের সামনে।
,
,
শিশির:- বাবা! দেখো না ওরা দরজা খুলতেছে না।
শুভ্রর মা:- এসেছ তুমি? এবার তাড়াতাড়ি দরজা ভাঙো।
শুভ্রর বাবা:- সরো তোমরা। আমি ডেকে দেখি।

শুভ্রর বাবা শুভ্র এবং লাবণ্য দু’জনের দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ল কিছুক্ষণ। তারপর জোর গলায় বলতে শুরু করল-
” শুভ্র দরজা খুল। বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য। ”
” লাবণ্য মা! দরজা খুলো। অনেক বেলা হয়েছে। এবার তো উঠো।”
” কি হলো শুভ্র? দরজা কেন খুলতেছিস না?”
” লাবণ্য! তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? দুপুর আড়াইটা বাজে। নামাজ পড়বা কখন? দরজা খুলো তাড়াতাড়ি।”
” শুভ্র! এবার কিন্তু আমার রাগ উঠে যাবে। দরজা খুল বলছি।”
” লাবণ্য মা! দরজাটা খুলো।”

নাহ!
কোনো কাজ হলো না। এবার মনে হচ্ছে দরজাটা ভাঙতেই হচ্ছে। কামাল, কাশেম!
তোমরা দরজা ভাঙার জন্য প্রস্তুত হউ। প্রচন্ড রাগে ফুসছে শুভ্রর বাবা। এভাবে লোক হাসানোর কোনো মানেই হয় না। আজ দরজাটা ভাঙোক, তারপর দুটোকেই বাড়ি থেকে বের করে দিব। এ বাড়িতে থেকে কোনো নাটক চলবে না। ???

আগে তো দরজা ভাঙোক……???

চলবে……..

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ১০

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মায়ের প্রশ্নের পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে থেমে যায় শুভ্র। কারণ ওর মায়ের মুখ থেকে বখাটে কথাটা শুনার পর থেকে লাবণ্যর খুব হাসি পাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে উচ্চস্বরে হাসতে কিন্তু সেটা না পেরে মুখে হাত চেপে লাবণ্য হাসতেছে। আর শুভ্র তন্ময় হয়ে সেই হাসি হাসি মুখপানে তাকিয়ে আছে।
আহ্, কি মিষ্টি!
হ্যাঁ, খুব মিষ্টি করে লাবণ্য হাসতে পারে। গালের দুইপাশের টোল যেন সেই হাসির সৌন্দর্য্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। মুগ্ধ শুভ্র লাবণ্যর হাসিতে বিভোর। ঘোর কাটে মায়ের ডাকে। “পাগল হয়ে গেছিস? মাথাটা কি একেবারে গেছে? এভাবে একা একা হাসছিস কেন? কি হয়ছে তোর?”
একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে যায় শুভ্রর দিকে ওর মা। ইয়ে না মানে আসলে আমার একটু কাজ আছে। আমি আসি বলে শুভ্র প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই কোনোরকম কেটে পরে।

রমজানের মাঝামাঝি সময়। সন্ধ্যায় হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরে শুভ্র। বাসায় ঢুকে দেখে ওর পুরো ফ্যামিলি আলোচনাসভায় বসছে।
আলোচ্য বিষয়- “ঈদ কেনাকাটা”……
শুভ্রর টনক নড়ে। ওহ্, নো! আমি তো ভুলেই গেছিলাম সামনে ঈদ। আচ্ছা, ঈদ উপলক্ষ্যে আমি যদি লাবণ্যকে কিছু দেই, তবে কি সে এটা গ্রহন করবে? নাকি আমার মতই আমার দেওয়া গিফ্টও ছুঁড়ে ফেলে দিবে? না, না ছুঁড়ে কেন ফেলে দিবে? আজ না বাসুক কোনো একসময় তো ও আমায় ভালোবাসতো। শত অবহেলার পরও ভালোবাসতো। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও আমার ভালোবাসার দান গ্রহন না করে পারবে না। ও ঠিক গ্রহন করবে। শুভ্র বাসায় এসেও সাথে সাথে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যায়। ড্রয়িংরুমে আলোচনাসভায় বসা প্রত্যেকেই অবাক বিস্ময়ে শুভ্রর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর বলতেছে, এর আবার কি হলো? বাসায় আসতে না আসতেই বের হয়ে গেল?
এদিকে শুভ্র মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে মার্কেটে পৌঁছে যায়। মার্কেটে গিয়ে শুভ্রর মাথা বিগড়ে গেছে প্রায়। হায়রে! এ আমি কোথায় এলাম শপিং করতে? এখানে তো সব কাপড় নজর কাড়া, আমি কোনটা রেখে কোনটা নিব? শুভ্র মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এমন হয় পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠে- Any problem, sir?
শুভ্র মাথা তুলে তাকিয়ে দেখতে পায় ওর পাশে একজন অতিকায় সুন্দরী রমনী দাঁড়িয়ে। শুভ্র স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে বলল, না, না! তেমন কিছু না। রমনী মিষ্টি হেসে বলল, আপনি না বললেও আমি কিন্তু বুঝতে পেরে গেছি প্রবলেমটা কি? আপনি সঠিক কাপড় নির্বাচনে দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগছেন? সঠিকটা চোজ করতে পারতেছেন না, তাই তো?!!! মৃদ্যু হেসে মাথা নাড়ে শুভ্র। রমনী আবারো একটা মিষ্টি হাসি দেয়। তারপর শুভ্রর পাশের একটা চেয়ার টেনে বসে কর্মচারীকে বলে, এই যে ভাইয়া! এই ডিজাইনের মধ্যে কিছু শাড়ি নামান তো! জি, মেডাম নামাচ্ছি বলে অনেকগুলো সুন্দর নিউ ডিজাইনের শাড়ি নামিয়ে দেয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রমনী দুইটা শাড়ি শুভ্রর সামনে রাখে। ” আমার মনে হয় এই ডিজাইনের মধ্যে যেকোনো একটা নিলে ভালো হবে। এমনিতে নতুন ডিজাইন, তারপর মিষ্টি একটা কালার। মেডামকে খুব মানাবে। শুভ্র শাড়ির দুইটার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে। সত্যিই তো! অনেক সুন্দর! চোখ যেন ফেরানোই যাচ্ছে না। শুভ্র রমনীটির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বলে, আমি আর কি বাছাই করব? আমার দুটোই পছন্দ হয়েছে। তবে আমার মনে হয় মিষ্টি কালারটা খুব বেশী মানাবে ওকে। শুভ্র লাবণ্যর জন্য মিষ্টি কালারটা বাছাই করে ঐ রমনীটিকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় ফিরে।

বাসায় ফিরতে ফিরতে ফিরতে রাত্রি সাড়ে ৯টা বেজে গেছে। শুভ্রর বাবা মসজিদে তারাবীহ নামাজ আদায় করতে চলে গেছে। আর বাকিরা যে যার রুমে চলে গেছে। এই সুযোগ শাড়িটা লাবণ্যর হাতে পৌঁছে দেওয়ার। শুভ্র বাসায় ঢুকে সরাসরি লাবণ্যর রুমে চলে যায়। লাবণ্য তখন মোনাজাত করছিল। শুভ্র তাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পরল। মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজটা তুলে ডানে তাকাতেই চমকে যায় লাবণ্য। আপনি? ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? শুভ্র তখনই রুমে প্রবেশ করে। ব্যাগ থেকে শাড়িটা বের করে মেলে ধরে লাবণ্যর সামনে। মুগ্ধ নয়নে শাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে লাবণ্য।। এই মুহূর্তে কোনো কথা’ই যেন ওর মুখ থেকে সরছে না। শুভ্র লাবণ্যর এমন নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে বলল,
” নাও! এটা তোমার জন্য…… ”
লাবণ্য তখনও স্টেচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। এটা দেখে শুভ্র’ই লাবণ্যর হাত দুটো উঁচু করে সেই হাতে শাড়িটা তুলে দেয়। শাড়ি হাতে পেয়েও লাবণ্যর কোনো রিয়েক্ট নেই। ওভাবে স্টেচুর মত হাত দুটো উঁচু করে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে শুভ্রর মা?!!!
লাবণ্যকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে ডাকতে লাবণ্যর রুমেই পৌঁছে যায়। আচমকা শাশুড়ির রুমে প্রবেশে কিছুটা হকচকিয়ে যায় লাবণ্য। হাতে রাখা শাড়িটা লুকোনোর আগেই দেখে ফেলেন ওনি। শুভ্রর দিকে একবার তাকিয়ে লাবণ্যর হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে নেন ওনি।
” এটা? এটা কোথায় থেকে পেয়েছিস?”
নিশ্চুপ লাবণ্য শাশুড়ির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শাশুড়ি জোর গলায় বলেন, কি হলো? চুপ করে আছিস যে?
” মা! এটা আমি এনেছিলাম। লাবণ্যর জন্য।” পিছন থেকে ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে উঠে শুভ্র। শুভ্রর মা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে শুভ্রর দিকে তাকান। তারপর হাত থেকে শাড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠে,
” কে বলেছে তোকে শাড়ি দিতে? কে বলেছে? তোর সাহস হলো কিভাবে ওর হাতে শাড়ি তুলে দেওয়ার? আর কখনো যাতে তোকে এ কাজ করতে না দেখি।”
আর লাবণ্য! তোর সাহস হলো কিভাবে একে এ রুমে জায়গা দেওয়ার? লাবণ্য চুপসে গেছে শাশুড়ির রাগী গলার আওয়াজ শুনে। এদিকে শুভ্র?! ওর ইচ্ছে হচ্ছিল মায়ের প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব দিতে। বলতে যে, ” আমার বউকে আমি যা ইচ্ছে তা দিব। তার জন্য সাহসের কি দরকার? আর তুমিই বা এমন কেন করতেছ?”
কিন্তু কি মনে করে যেন শুভ্র বলল না।
শুভ্রর মা এবার চেঁচিয়ে উঠল, কি হলো? এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুম ত্যাগ করে শুভ্র। লাবণ্যকে খাবার টেবিলে আসতে বলে শাশুড়ি রোকসানা বেগম নিচে চলে যায়। নিচে গিয়ে মনে হলো শাড়িটা তো ঐ রুমেই ফেলে রেখে এসেছি। ওটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসা দরকার ছিল। মেয়ে শিশির খাবার পরিবেশন করছিল। রোকসানা বেগম মেয়েকে বলেন,
” সর! আমি খাবার দিচ্ছি তোর বাবাকে। তুই গিয়ে একটা কাজ করে আয়! লাবণ্যর রুমে যে শাড়িটা পরে আছে, ঐটা আপাতত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে আয়। সকাল হলে না হয় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসবি।”
জি, আচ্ছা বলে শিশির লাবণ্যর রুমের দিকে পা বাড়ায়। দরজার সামনে গিয়ে থমকে যায় শিশির। দেখতে পায় কিছুক্ষণ আগে যে শাড়িটা ওর মা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, সেই শাড়িটা’ই লাবণ্য বুকে জড়িয়ে ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে।
এতকিছুর পরও এত ভালোবাসা মনের ভেতর পুষে রেখেছে? অজান্তেই শিশিরের চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ০৯

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ০৯
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় শুভ্রর বাবা ও মা। শুভ্র তখনো লাবণ্যর দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে ছিল। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যকে বলে উঠে—
” কাল তোর পরীক্ষা! সে খেয়াল আছে?” শাশুড়ির কথা শুনে মাথা তুলে লাবণ্য।
— কি হলো? এখনো দাঁড়িয়ে আছিস যে? পড়তে হবে না?
” যাচ্ছি মা……..”
লাবণ্য ওর রুমে চলে যায়। শুভ্র তখনো প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে।
—- তুই আবার এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা নিচে টেবিলে গিয়ে খা।
মায়ের কথায় শুভ্র নিচে চলে গেল। সাথে শুভ্রর বাবা এবং বোন। খাবার টেবিলে খাবারে হাত দিয়ে চুপসে বসে আছে শুভ্র। এখন পর্যন্ত একমুঠো খাবারও পেটে যায়নি ওর। যাওয়ার কথাও নয়। মন যেখানে ভরপুর, খাবারের সেখানে পেটে না যাওয়ারই কথা। বাবা, বোন খাওয়া শেষে চলে যাওয়ার পর, ভরা প্লেটে পানি ঢেলে শুভ্রও রুমে চলে যায়। রুমে গিয়ে একবার বিছানায় তো আরেক বার সোফায়, একবার দাঁড়িয়ে তো আরেকবার বসে লাবণ্যর কথা ভাবছে। শুভ্রর কোনো কিছুতেই শান্তি লাগছে না। ছন্নছাড়ার মত এখান থেকে সেখানে যাচ্ছে। কোনো কিছুতেই ওর ভালো লাগছে না। এদিকে লাবণ্য?!!!
বই হাতে একের পর এক পৃষ্টা উল্টাচ্ছে। পৃষ্টা উল্টিয়ে যখনই পড়বে বলে স্থির করে তখনই শুভ্রর মুখখানা হৃদয়ের ক্যানভাসে ভেসে উঠে। লাবণ্য বইয়ের পাতায় কোনো লেখা দেখতে পাচ্ছে না। সব পাতা জোড়েই শুধু শুভ্র, শুভ্র, শুভ্র_____
উফফ! এসব কি হচ্ছে আজকে?
ভ্রু কুচকে পড়ার টেবিল থেকে উঠে পরে লাবণ্য। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরে।
কিন্তু একি?!!!
শুয়ে থেকেও লাবণ্যর ভালো লাগছে না। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। ছটফট করছে ভিতরটা। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ লাবণ্য। কিছুক্ষণ বিছানার এপাশ ওপাশ করে শুয়া থেকে উঠে বসে। অন্ধকারে হাঁটুতে ভর দিয়ে চুপটি করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। এমন সময় রুমে আগমন ঘটে ওর শাশুড়ির। আলোটা জ্বেলে ওনি লাবণ্যর মাথায় হাত রাখেন। লাবণ্য মাথা তুলল তাকায়।
” অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পর।”
শাশুড়ির কথায় হুম বলে শুয়ে পরে লাবণ্য।
ডিমলাইট’টা জ্বালিয়ে আলো নিভিয়ে রুম ত্যাগ করেন লাবণ্যর শাশুড়ি।
নির্ঘুম শুভ্র ধীরপায়ে লাবণ্যর দোয়ারে এসে দাঁড়ায়। জানালার পর্দাটা আংশিক ফাঁক করে ভেতরের দিকে তাকায় শুভ্র। ডিমলাইটের মৃদু আলোয় শুভ্র দেখতে পায় ওর লাবণ্য পরম নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত লাবণ্যর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজ রুমের দিকে পা বাড়ায় শুভ্র।

পরদিন পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরছিল লাবণ্য। কলেজ গেইটের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় শুভ্র দাঁড়িয়ে। শুভ্রকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিছু হটে লাবণ্য। শুভ্র অবাক বিস্ময়ে লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছে-
” এভাবে চলে গেল কেন ও?”
ক্ষাণিক বাদেই ফিরে আসে লাবণ্য। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় শুভ্র। কারণ, এই মুহূর্তে ওর পিছনে ওর মা স্বয়ং দাঁড়িয়ে। লাবণ্যর পিছু হটার কারণ বুঝতে পারে শুভ্র। বুঝতে পারে ওকে দেখে লাবণ্যই ফোন করে মাকে এনেছে। লাবণ্যকে নিয়ে বাসায় যাওয়ার আগমুহূর্তে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে রোকসানা বেগম ছেলে শুভ্রকে__
” তুই? তুই এখানে কি করছিস?”
আমতা আমতা করে শুভ্রর জবাব, কাজ! একটু কাজ ছিল মা……………

লাবণ্যর পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন শুভ্র কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে থাকত। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করত লাবণ্যর ফিরে আসার, লাবণ্যর সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু লাবণ্য?!!!
যতবারই শুভ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখত, ততবারই শাশুড়িকে ফোন করে আনত। ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে প্রতিদিন’ই শুভ্র বাসায় ফিরে যেত। সেদিন ছিল লাবণ্যর পরীক্ষার শেষ দিন। প্রতিদিনকার মত শুভ্রও সেদিন গিয়েছিল লাবণ্যর সাথে কথা বলার প্রত্যাশায়। তবে সেদিন আর শুভ্র কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল না। শুভ্র লুকিয়ে ছিল কলেজ গেইট থেকে ক্ষাণিকটা দুরে, আড়ালে। লাবণ্য যখন দেখল শুভ্র নেই, তখন নিশ্চিন্তে সামনের দিকে এগুচ্ছিল। গেইট পেরিয়ে একটু সামনে আসতেই চলার সেই গতি থেমে যায় ওর। মাথা নিচু করে একজায়গায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্য। আর শুভ্র?!!!
শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্যর ঠিক সামনেই পথ আটকে।

— লাবণ্য!
তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। প্লিজ এখান থেকে একটু চলো। লাবণ্য পূর্বের ন্যায় মাথা নিচু করে আছে।

— লাবণ্য! এটা পাব্লিক প্লেস। আর পাবলিক প্লেসে আমি কোনো বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছি না। তাই প্লিজ, লাবণ্য! তুমি আমার সাথে চলো।
লাবণ্য মাথা নিচু করে আছে, তবে ওর মুখ থেমে নেয় আর। মাথা নিচু করে লাবণ্য অনর্গল বলা শুরু করে-
” আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমার এখন বাসায় যেতে হবে। না হলে মা টেনশন করবে।”

– লাবণ্য প্লিজ তুমি আমার সাথে চলো। আমাকে তোমার বেশীক্ষণ সময় দিতে হবে না। শুধু ৩০মিনিট। ৩০মিনিট সময় দান করো তুমি আমায়।
” Impossible….
৩০মিনিট কেন? ৩০সেকেন্ড সময়ও আমি কাউকে দিতে পারব না। প্লিজ, রাস্তা ছাড়ুন।”

— লাবণ্য! প্লিজ এমন করে না। আমার কথাটা শুনো একটু….(….)….???
” রাস্তা ছাড়ুন বলছি….”

—- না, আমি এখন রাস্তা ছাড়ব না।
” আমি কিন্তু এবার চিল্লিয়ে মানুষ জড়ো করব। ”

— যদি পারো, তবে তাই করো। আমিও শুনতে চাই তোমার গলার জোর কতটুকু?
লাবণ্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাজির শুভ্রর মা। দুর থেকে শাশুড়ি দেখেই হেসে উঠে লাবণ্য। বলে উঠে— ” মা তুমি?”

হ্যাঁ, আমি। তোর আর মানুষ জড়ো করতে হবে না। চল, সামনে রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে।
কথাটা পিছন থেকে শুভ্রর মা বলে উঠে। শুভ্র লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। লাবণ্যর মা সেদিকে তাকিয়ে বলে-
” আর আপনি? আপনি কি ডাক্তারি পেশা ছেড়ে অন্য কোনো পেশা গ্রহন করেছেন?”

মাথা তুলে তাকায় শুভ্র।
– মা! তুমি আমাকে বলছো???
শুভ্রর মা গম্ভীর কন্ঠে বলেন, জি! আমি আপনাকেই বলছি। এই পেশা গ্রহন করেছেন কবে?
শুভ্র অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে মাকে, কিসের পেশা?!!!

এই যে প্রতিদিন মহিলা কলেজের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকিস সেই পেশা।

অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায় শুভ্র। অবাক বিস্ময়ে বলে উঠে-
” মানে???”
শুভ্রর মা শান্ত গলায় বলেন-
মানে ডাক্তারি পেশা ছেড়ে বখাটে পেশায় কবে থেকে নাম লিখিয়েছিস???

শুভ্র:- কি???
মা:- জি…………

চলবে…….

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ০৮

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ০৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

শুভ্র পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বের হয়ে পরল লাবণ্যর খুঁজে। এখানে সেখানে, অলিতে গলিতে, পথে-ঘাটে, পার্ক, ক্যাফে-রেস্তোরায় সব, সব জায়গায় শুভ্র লাবণ্যর খুঁজ করেছে। কিন্তু কোথাও লাবণ্যকে খুঁজে পায়নি। লাবণ্যর বন্ধুমহলের কেউ লাবণ্যর সন্ধান দিতে পারে নি। সেদিন মনমরা হয়ে চেম্বার থেকে ফিরছিল শুভ্র। পথে দেখা হয় লাবণ্যর বন্ধু সুমনের সাথে। দুর থেকে দেখেই চিনে ফেলে শুভ্র। এ তো সেই ছেলে যাকে আমি ছবিতে লাবণ্যর পাশে দেখেছিলাম। থমকে যায় শুভ্র। পিছন থেকে ডাক দেয় সুমনকে- এই যে শুনছেন?
পিছু ফিরে সুমন। প্রাণের বান্ধবী লাবণ্যর বরের ছবি সুমন আগেও অনেক বার দেখেছে। তাই শুভ্রকে চিনে নিতে কষ্ট হয়নি।
হাসি হাসি মুখে বলে উঠে সুমন-
” শুভ্র ভাইয়া যে! কি অবস্থা আপনার? লাবণ্য কেমন আছে?”
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে শুভ্র, “আপনি? আপনি আমাকে চিনেন?”
শুভ্রর কথা শুনে হা, হা করে হেসে উঠে সুমন- ” কি যে বলেন না! আপনি হচ্ছেন সেই মেয়ের হাজবেন্ড যে আমাদের কলেজের সেরা রূপবতী ছিল। আর তাছাড়া আপনি হচ্ছেন আমার বেস্টফ্রেন্ডের কলিজা, যার কথা উঠতে বসতে শুনতে হতো আমায়। আপনাকে না চিনে উপায় আছে কি? শুভ্র বলে উঠে-
” আপনি আর লাবণ্য একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করছেন?”
সুমন জবাব দেয়, হ্যাঁ! আমরা একই কলেজের স্টুডেন্ট ছিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুভ্র বলে, কথা হয় না লাবণ্যর সাথে?
সুমন বলে, হয়! তবে আগের মত আর হয় না। লাবণ্য আগের থেকে কেমন যেন বদলে গেছে। গম্ভীর হয়ে গেছে। আগে ও এমন ছিল না। ঐতো সেদিন! আন্টির সাথে শপিংয়ে গিয়েছিল ও। কাকতালীয়ভাবে আমিও আমার বউকে নিয়ে সেখানে হাজির। ওকে সেদিন কত যে প্রশ্ন করলাম, ও শুধু হ্যাঁ, না জবাব দিল। নিজ থেকে একটা প্রশ্নও করেনি আমাদের।

ওহ! আপনি বিয়ে করেছেন?
স্মিতহাস্যে সুমনের জবাব, হ্যাঁ! ২বছর ৬মাস হলো বিয়ে করলাম।
___” Late Congratulation…..”
সুমন অট্টহাসি দিয়ে বলে, tnx… সুমনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল শুভ্র, আচমকা মনে হলো সুমনের বলা সেই কথাটি, ” ঐতো সেদিন আন্টির সাথে ও শপিংয়ে গিয়েছিল….”
পিছু ফিরে তাকাই শুভ্র। প্রশ্ন করে সুমনকে। কি যেন বলছিলেন, লাবণ্য আন্টি মানে আমার মায়ের সাথে শপিংয়ে গিয়েছিল?”
সুমন ভ্রু কুচকে বলে, হ্যাঁ! আপনার মা’ই তো ছিল। কেন বলুন তো?! হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
শুভ্র কথা ঘুরিয়ে বলল, সে কিছু না। আচ্ছা আসি তাহলে। আল্লাহ হাফেজ।

রাত্রি ১১টা ৩৫মিনিট__
শুভ্র ওদের নতুন বাসার গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দাড়োয়ান গেইট খুলে দেয়। বাসার দরজায় কড়া নাড়ে শুভ্র। দু’তিনবার কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে শুভ্রর বোন। এত রাত্রে ভাইকে এভাবে দেখে চমকে উঠে শিশির। প্রশ্ন করে ভাইকে। ” ভাইয়া! তুই ঠিক আছিস তো?”
ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল শুভ্রর বাবা মা। ওখান থেকে উচু গলায় শুভ্রর মায়ের প্রশ্ন- কে এসেছেরে শিশির? শিশিরের জবাব, তুমি দেখে যাও কে এসেছে? শুভ্রর মা দরজার সামনে এসে মুখ কালো করে ফেললেন। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
” তুই? তোকে না বলে দিয়েছি লাবণ্য এ বাসায় নেই? তো আবারো কেন এসেছিস?”

গম্ভীর গলায় শুভ্রর জবাব, ” লাবণ্য থাকে না বলে আমি কি এ বাসায় আসতে পারব না? নাকি এ বাসায় আসা আমার বারণ? ”
ড্রয়িংরুম থেকে শুভ্রর বাবা প্রশ্ন করেন, কে এসেছে শুভ্রর মা? কার সাথে কথা বলছ? শুভ্রর মা কোনো কথা না বলে কিচেনের দিকে চলে যান। শুভ্র রুমে প্রবেশ করে বাবাকে সালাম দেয়। মাথা উঁচু করে শুভ্রকে দেখে মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় করে সালামের জবাব দেন। শুভ্র ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছে কিন্তু জবাব পায়নি। তাই চুপ করে রুমে চলে গেছে। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরে শুভ্র।
রাতটা কোনোমতে পোহাক। তারপর চিৎকার কান্নাকাটি করে হলেও ওদের থেকে লাবণ্যর ব্যাপারে জানতে হবে। কপালে হাত দিয়ে কথাগুলো ভাবছিল শুভ্র। তখনই রুমে প্রবেশ করে শিশির। “ভাইয়া চল! খাবি…”
আমি খাব না বলে বিদায় করে দেয় শুভ্র তার বোনকে। একটু পর রুমে প্রবেশ করে শুভ্রর বাবা। ” কি হলো? তোর মা খাবার নিয়ে বসে আছে। যাচ্ছিস না কেন?”
গম্ভীর গলায় শুভ্রর জবাব, খিদে নেই আমার। তোমরা খেয়ে নাও। শুভ্রর বাবা কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে শুভ্র ওর বাবা মাকে লাবণ্যর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ওরা ওকে উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়ে দেয়। রাগে কষ্টে ব্রেকফাস্ট না করেই রুমে যায় শুভ্র। দুপুর ১২টার দিকে শুভ্রর বাবা শুভ্রর রুমে প্রবেশ করে। শুভ্র তখন জানালার গ্রিল ধরে চুপটি করে বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শুভ্রর বাবা এসে জিজ্ঞেস করে, “কিরে? হসপিটালে যাবি না?” শুভ্র স্থির গলায় জবাব দেয়, না।
বাবা বুঝতে পারল ছেলের মনের অবস্থা ভালো নই, তাই আর কোনো কথা না বলে রুমে থেকে বের হয়ে গেলেন ওনি। পরদিন শুভ্র আর বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। পড়তে পারেনি ফজরের নামাজ। পড়বে কিভাবে? না খেতে পেয়ে শরীর যে একদম দুর্বল হয়ে গেছে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। সারাদিনের ভেতর ছেলেকে একবারও রুমের বাইরে না দেখে ভয় পেয়ে যান রোকসানা বেগম। শুভ্র বিছানায় শুয়ে খিদের অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। একমাত্র ছেলের এমন করুণ অবস্থা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল মায়ের। শিশিরের সহযোগীতায় ওনি শুভ্রকে জোর করে খাবার টেবিলে নিয়ে যায়। তারপর একদম জোর করেই খাইয়ে দেয়। রাত্রে শুভ্রকে আর ডাকতে হয়নি। শুভ্র নিজেই যাচ্ছিল ডিনার করতে। সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় দেখা হয় শিশিরের সাথে। হাতে ভাতের প্লেট আর তরকারীর বাটি নিয়ে উপরের রুমের দিকে যাচ্ছে। অবাক শুভ্র প্রশ্ন করে, ” কিরে? খাবার নিয়ে উপরে কোথায় যাচ্ছিস?”
প্রশ্ন শুনে আঁতকে উঠে শুভ্র। আমতা আমতা করে বলতে শুরু করে-
” ইয়েমানেনামানেআমি_ আসলে……”
শুভ্র চোখ বড় বড় করে বলে, কাঁপতেছিস কেন? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? শিশির ঢোক গিলে বলে, আমি___ খাব, খাব এগুলো….
বিস্ময়ে হতবাক শুভ্র প্রশ্ন করে, তুই খাবি? তো নিচে কি হয়ছে? শিশির বার বার আটকে যাচ্ছিল তবুও কাঁপা গলায় বলল, আমার রুমে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই…..
শিশিরের জবাব শুভ্রর কাছে সুবিধার মনে হলো না। তবুও বলল, যা তাহলে…..
শুভ্র নিচে চলে গেল।
শিশির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। দু’লাফে রুমে গিয়ে হাত থেকে প্লেট আর বাটি রেখে ছিটকিনি এটে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে শিশির। লাবণ্য চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে শিশিরকে। ” কি হয়েছে শিশির?”
শিশির ঢোক গিলে বলে, কিছু না ভাবি। তুমি খাও তো….

৭দিন পর_
প্রতিদিনকার মত সেদিনও হসপিটাল থেকে সোজা এ বাসায় চলে আসে শুভ্র। এসেই ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসে সে। রোকসানা বেগম প্লেটে খাবার দেওয়া মাত্রই প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে পরে শুভ্র। এভাবে প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলি যে? বাবার প্রশ্নের জবাবে ছেলের উত্তর, আজকে শিশিরের সাথে রুমে খাব। শুভ্র সামনের দিকে পা বাড়ায়। পিছন থেকে বাবা মায়ের কারো কথা কানে না নিয়ে শুভ্র এক পা দু’পা করে সিড়ির ধাপ অতিক্রম করছে। উপরে শিশিরের রুমের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় শিশির। ডাক দিতে গিয়েও ডাক দেয়নি বোনকে। কারন, ইতিমধ্যে শুভ্র বুঝে গেছে এ রুমে শিশির ছাড়াও আরো একজন আছে।
আজ শুভ্র ঐ ২য় জনের সাথে পরিচিত হবে। তাই খাবার হাতে নিশ্চুপ শুভ্র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট দশেক পর দরজা খুলে শিশির। দরজার সামনে শুভ্রকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। শিশির চমকে উঠে। কাঁপা গলায় আমতা আমতা করে বলে উঠে-
” তু…..তু……..তু……তুই……?”

কি হয়েছে শিশির? কার সাথে কথা বলছ? বলেই এগিয়ে আসছিল লাবণ্য। শুভ্রকে এখানে এভাবে দেখে চমকে যায় লাবণ্য। শুভ্রর চোখ এতক্ষণে শিশিরের থেকে লাবণ্যর দিকে চলে যায়। লাবণ্য শুভ্রর থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।

চলবে…….

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ০৭

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ০৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মানে আবার কি হবে? তুই তো বললি ভাবি ওনার বাবা মায়ের সাথে ২বছর ধরে আছে। তার মানে এটা দাঁড়ায় না যে তুই ভাবিকে ওনাদের সাথে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসছিস!
বোনের কথা শুনে চেঁচিয়ে উঠে শুভ্র। কি উদ্ভট কথা বার্তা বলছিস তুই? কবরে কেন শুয়ে থাকবে? ওদের বাবা মা আছে না? ওদের সাথে বাসায় থাকবে।

এখানেই ভুল করছেন আপনি ডা: শুভ্র। লাবণ্যর বাবা মা তো তখনই মারা যায় যখন ও অনার্স ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছিল। তাহলে ওরা কিভাবে কবর ছেড়ে বাসায় থাকবে? পিছন থেকে বলে উঠে লাবণ্যের কাজিন সোহেল।
চমকে উঠে পিছনে তাকালো শুভ্র। আপনি?
ডাঃ সোহেল জবাব দেন, হ্যাঁ আমি। লাবণ্যের কাজিন। পেশায় একজন ডাক্তার। সেদিন লাবণ্যের শরীরে অনেক জ্বর ছিল, ও হাঁটতে পারছিল না। তাই আমি ওকে শক্ত করে ধরে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। আর আপনি সেটা দেখেই ভুল বুঝলেন।
ভুল না বুঝে উপায় আছে? ও হঠাৎ করে যোগাযোগ কেন বন্ধ করে দিল? ওর বাবা মা মারা গেছে সেটা তো আমায় বলতে পারত। নিজে না পারুক, তুষারকে দিয়ে তো বলতে পারত। জানাতে পারত সমস্যার কথা।
মানুষটা স্বাভাবিক জীবনে থাকলে তো এতকিছু ভাবতো। আর কার কথা যেন বলছিস? তুষার?!!!!
হা, হা, দুঃখের মাঝেও হাসি পেল।
তুষার বেঁচে থাকলে তো খবর নিয়ে যাবে!
শিশিরের কথা শুনে আঁতকে উঠে শুভ্র। কাঁপা গলায় বলে, মানে? তু তু তু……..ষা…..র নেই?
সোহেল জবাব দেয়, না নেই। সেদিন কার এক্সিডেন্টে শুধু লাবণ্যর বাবা মা মারা যায়নি, তুষারও মারা গিয়েছিল।
ওদের কথা শুনে শুভ্রর পুরো পৃথিবী ঘুরছে। মনে হচ্ছে, এখনি যেন মাথা ঘুরে পরে যাবে। শুভ্র মনে মনে বলছে, হায় আল্লাহ! একি শুনালে আমায়?
” শুধু ওরাই মারা যায়নি। মারা যাওয়ার সাথে সাথে নিয়ে গেছে একটা মেয়ের মুখের হাসি। বেঁচে থাকার স্বপ্ন। নিয়ে গেছে একটা মেয়ের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। সেদিন চোখের সামনে পরিবারের এতগুলো মানুষের মৃত্যু মেনে নিতে পারে নি মেয়েটি। তাই তো সে সব হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যায়।”
শিশির থেমে গেল। সোহেল বলতে শুরু করল, মেয়েটি ঢাকায় যে বাসায় থাকত সে বাসার বাড়িওয়ালা ও আশেপাশের বাসার লোকজনেরা ওকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। কারন, ওকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছিল না। খবর পেয়ে ছুটে আসে মেয়েটির গ্রামের বাড়ির আত্মীয় এবং সেই সাথে মেয়েটির মায়ের বান্ধবী। মানসিক হসপিটালে ভর্তির পরও অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না দেখে মেয়ের মায়ের সেই বান্ধবী ও ওনার হাজবেন্ড মেয়েটিকে দেশের বাহিরে নিয়ে যান।
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে শুভ্র, মা?!!!

সোহেল জবাব দেয়, হ্যাঁ। আপনার মা’ই ছিল লাবণ্যর মায়ের একমাত্র কাছের বান্ধবী। লাবণ্যকে আপনার মা অনেক আগে থেকেই আপনার জন্য পছন্দ করে রেখেছিল।

ভাইয়া, এই ভাইয়া! দাঁড়া….. কোথায় যাচ্ছিস এভাবে?
সোহেলের পুরো কথা না শুনে শুভ্র ছুঁটতে থাকে। শিশির বার বার ডেকেও থামাতে পারল না ভাইকে।
শুভ্র ছুটছে তো ছুটছে’ই……………

শিশির! ওকে পিছু ডেকো না। যেতে দাও ওকে। ওকে ওর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও। ওর প্রায়শ্চিত্তের সময় এসে গেছে শিশির। পিছু ফিরে তাকাই শিশির। প্রশ্ন করে সোহেলকে, কিন্তু সেই প্রায়শ্চিত করার সুযোগ আদৌ কি ও পাবে? ভাবি কি এখনো আপনাদের বাড়িতে আছে?
লাবণ্যকে ওখানে রেখে আসার পরদিন’ই তোমার বাবা মা ওকে ঢাকায় তোমাদের নতুন বাসায় নিয়ে গেছে। ও ওখানেই আছে এখন। অনার্স ২য় বর্ষে পড়ে। ও এখন বেশ ভালোই আছে।
শিশির কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, মানে? ভাবি এখন আমাদের বাসায় আব্বু আম্মুর সাথে আছে? সোহেল স্মিতহাস্যে জবাব দেয়, হ্যাঁ। ও তোমাদের বাসায়’ই আছে। এইতো আমি তো তোমাদের বাসা থেকেই আসলাম ওকে দেখে।
শিশির আনন্দে লাফিয়ে উঠে শুভ্রর নাম্বার ডায়াল করে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে, ভাইয়াকে তাহলে খবরটা দিতে হয়!

সোহেল হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। শিশির চোখ বড় বড় করে সোহেলের দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকায়। সোহেল গম্ভীর কন্ঠে বলে, লাবণ্যর কথা এখন শুভ্রকে বলা যাবে না।
শিশির অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, কেন বলা যাবে না? মুচকি হেসে সোহেল বলে, খুঁজোক না! খুঁজোক আর একটু একটু করে পুঁড়তে থাকুক বিরহের অনলে। তবেই না ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হবে।
শিশির মন খারাপ করে বলে, কিন্তু ভাইয়া তো কষ্ট পাবে?!!!
প্রশ্নোত্তরে সোহেলের জবাব, আরে বোকা মেয়ে! কষ্টের পরই তো ভালোবাসার অধ্যায় শুরু হবে। একটু তো ধৈর্য্য ধরো!!!
শিশির সোহেলের কথামতো শুভ্রকে আর কল দিল না।

এদিকে শুভ্র?!!!
লাবণ্যর জন্য পাগলপ্রায়। এখানে ওখানে করে অসংখ্য জায়গায় লাবণ্যর খুঁজ করেছে, কিন্তু কোথাও ওকে পায়নি। লাবণ্যর গ্রামের লোকজন ভিষণ অপমানজনক ও কটু কথা বললো শুভ্রকে। কিন্তু শুভ্র একটুও অপমানিত হয়নি।
কারণ- ও জানে এ হবে, এ হওয়ার কথা ছিল। রাত্রি ১২টা বাজে।
শুভ্রর চোখে ঘুম নেই।
সারাটা দিন লাবণ্যকে খুঁজে ক্লান্ত শুভ্র বাসায় ফিরে যায়। ফ্রেমে বন্দি লাবণ্যর ছবিটা লাবণ্যর খাটের নিচে অযত্নে অবহেলায় পরে ছিল, আজ শুভ্র সেই ময়লায় ঢাকা ছবি বুকে নিয়ে কাঁদতেছে আর ছবির গায়ে চুমুর পর চুমু দিচ্ছে।
এমন সময় দুরের কোনো এক দোকান থেকে ভেসে আসছে-

” তোর কাছে আমার
অনেক কথা বলার ছিল,
তোর সাথে আমার
স্বপ্ন দেখার আলাপ ছিল!!
তুই শুধু দুরে যাস, দুরে যাস
পাবি না আমাকে!!
.
তোর কাছে আমার
অনেক কথা বলার ছিল,
তোর সাথে আমার
স্বপ্ন দেখার আলাপ ছিল।

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ০৬

0

ভুল এবং ভালোবাসা

পর্ব- ০৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

একপা দু’পা করে লাবণ্য পৌঁছে যায় কবরস্থানে। কবরস্থানে ক্লান্ত লাবণ্য ঐ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে জায়গায় ওর বাবা- মা আর স্নেহের একমাত্র ছোট্ট ভাইটি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। লাবণ্য তখনো নির্জন জায়গায় বাবা মায়ের কবরের পাশে চুপটি করে বসে ছিল। দু’দিনের অভুক্ত শরীর নিয়ে লাবণ্য বেশীক্ষণ কবরস্থানে বসে থাকতে পারে নি। একটা সময় লাবণ্য জ্ঞান হারায়। সেদিন মাগরিবের নামাজ শেষে মাদ্রাসার কিছু ছাত্র নিয়ে লাবণ্যর চাচা কি কারনে যেন কবরস্থানে গিয়েছিলেন। কবরস্থানে ভাই ভাবির কবরের পাশে একমাত্র ভাতিজিকে নিথর হয়ে পরে থাকতে আঁতকে উঠেন। একটা বিকট চিৎকার দিয়ে ওনি বসে পরেন। রাস্তার আশেপাশের বাড়ির মানুষজন ওনার চিৎকার শুনে ছুটে আসেন। ছুটে আসেন লাবণ্যর চাচি ও চাচাতো ভাই বোনেরা। লাবণ্যকে ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। পাশেই একটা হসপিটালে রোগী দেখতে বসত লাবণ্যের কাজিন। খবর পেয়ে ছুটে আসে ওর কাজিন। লাবণ্যর পালস চেক করে জানায়, নাহ! কিচ্ছু হয়নি। শুধু জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান ফিরার পর লাবণ্যকে সবাই প্রশ্ন করে, কি হয়েছে? লাবণ্য বিছানা থেকে গর্জে উঠে। ও কিছুতেই বিছানায় শুয়ে থাকতে চায় না। লাবণ্য কবরস্থানে বাবা মায়ের সাথে থাকবে বলে স্থির করে। জোর করে ধরেও ওকে কেউ খাওয়াতে পারছে না। অস্থির লাবণ্য হাত পা ছুড়াছুড়ি করা শুরু করে কবরস্থানে যাওয়ার জন্য। অবস্থা বেগতিক দেখে লাবণ্যর চাচা চাচি ফোন করে ঢাকায় লাবণ্যর শ্বশুর বাড়িতে। খবর পেয়ে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি ছুটে আসেন। রাত্রি তখন আড়াইটা। পুরো এলাকা ঘুমিয়ে গেলেও এ বাড়ির কেউ দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। ওরা ভেবে নিয়েছে লাবণ্য বুঝি পূর্বের ন্যায় পাগল হয়ে গেছে। তাই লাবণ্যর হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে রেখেছে। লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি এসে দেখে অসহায় লাবণ্য শিকল পায়ে ছটফট করছে। লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যর কাছে ছুটে যান। মাথায় হাত রাখেন। উপরের দিকে মুখ তুলে তাকায় লাবণ্য। শ্বশুর শাশুড়িকে দেখে চোখের জল ছেড়ে দেয় লাবণ্য। শাশুড়ি লাবণ্যকে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করে লাবণ্যর হাত পায়ের শিকল খুলে দেন ওনি। শিকলবিহীন লাবণ্যকে শাশুড়ি একটি আলাদা রুমে নিয়ে একরকম জোর করে খাবার খাইয়ে দাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেন। ছোট্ট বাচ্চাদের মত খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরে লাবণ্য। সকালে ঘুম থেকে উঠলে আবার সেই পাগলামী শুরু হয়- আমি বাবা মায়ের সাথে থাকব, আমি কবরস্থানে থাকব। এলাকার লোকজন কানাঘুষা শুরু করে এবারো বুঝি মাথাটা গেল। লাবণ্যর শ্বশুর সবাইকে ধমক দিয়ে থামায়। তারপর লাবণ্যর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, মা! কি হয়ছে তোমার? কে তোমায় কি বলছে? তুমি আমাদের বলো। আমরা ওর বিচার করব। লাবণ্য অনর্গল বলতে শুরু করে বিয়ের পর থেকে গতকালের ঘটে যাওয়া কাহিনী পর্যন্ত সব, সব বলে লাবণ্য। পুরো কথা শুনে রেগে যায় লাবণ্যের চাচা চাচিসহ এলাকাবাসী। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় লাবণ্যর শাশুড়ির। লাবণ্যর শ্বশুর বলে উঠে, শুভ্র ভুল করেছে। শুধু ভুল না, ভয়ংকর ভুল। ওর সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত ওকে করতে হবে। এখন আমাদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে দে মা। আমরা নিজ হাতে তোমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছি। আমরা অনেক বড় ভুল করছি। এখন সেই ভুলের প্রায়শ্চিত করতে চাচ্ছি। মা তুমি আমাদের সাথে চলো। লাবণ্যর চাচা চাচি এমনকি এলাকার কেউ লাবণ্যকে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে দিতে চায় না। পরিস্থিতি প্রতিকূলে দেখে শাশুড়ি ছুটে যায় লাবণ্যর কাজিন ডাক্তার সোহেলের কাছে। মায়ের সমতুল্য মহিলার অনুরোধ ফেলতে পারেনি ডাক্তার সোহেল। বাবা মাকে অনেক চেষ্টা করে বুঝিয়ে লাবণ্যকে ওর শ্বশুর শাশুড়ির হাতে তুলে দেওয়া হয়। শর্ত একটাই- যে ছেলের কারনে ওনাদের মেয়ের এই অবস্থা হয়েছে সেই ছেলের ছায়াও যাতে ওনাদের মেয়েকে স্পর্শ না করে। শর্ত মেনে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি লাবণ্যকে নিয়ে ঢাকায় ওদের বাসায় চলে যায়।

কেটে যায় ২বছরেরও অধিক সময়। সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা লাবণ্য এরই মধ্যে লাবণ্য পুনরায় পড়াশুনা শুরু করেছে। অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী এখন লাবণ্য। পড়াশুনার পাশাপাশি একটা ছোট্ট কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চাদের পড়া’ই ও। বাকিটা সময় শ্বশুর শাশুড়ির সাথে গল্পে আর আড্ডাবাজিতে কেটে যায়।
সবমিলিয়ে গল্পের নায়িকা লাবণ্য বেশ ভালো ভাবেই ওর দিন কাটাচ্ছে।
এদিকে গল্পের নায়ক শুভ্র…!!!
ওর কি খবর? ও কি আদৌ ভালো আছে????
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের যেতে হবে শুভ্রর কাছে। তো চলুন বন্ধুরা ঘুরে আসা যাক শুভ্রর বাড়ির আঙ্গিনা থেকে।
শুভ্র——————
লাবণ্যকে গ্রামের বাড়িতে দিয়ে আসার পর থেকেই শুভ্র কিরকম উদাসীন হয়ে গেছে। অজানা এক শূন্যতায় শুভ্রর ভিতরটা সবসময় হাহাকার করে। একটা অজানা অপরাধবোধ শুভ্রর ভিতরটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। সারাদিন হসপিটালে থাকত শুভ্র। দিনশেষে হসপিটালের চেম্বার থেকে যখন বাসায় ফিরত তখন কেমন যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করত শুভ্র। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠত ওর। যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য প্রতিরাত্রে শুভ্র স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমাতো। কিন্তু কাজ হতো না। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে যেত শুভ্রর। স্মৃতিরা এসে মনের জানালায় কড়া নাড়ত। শুভ্রর মনে হতো শূন্য রুমে কেউ যেন গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। শুধু কাঁদছে না, মাঝে মাঝে অস্ফুট স্বরে কেউ যেন বলছে- আমার খুব কষ্ট হচ্ছে শুভ্র। আমায় একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে।
শুভ্র রুম জুড়ে খু্ঁজে বেড়াতো। কিন্তু কাউকে দেখতে পেত না ও।
ঠিক সে সময় বুকের বামপাশে চিনচিনে এক ব্যথা অনুভূত হতো।

সেদিন উন্মাদের মত রাস্তায় হাঁটছিল শুভ্র। পিছন থেকে কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় ওকে। রাস্তা থেকে উঠে ডানে তাকাতেই দেখে লাগেজ হাতে শিশির দাঁড়িয়ে। কিছু বলার আগেই শিশির বলে উঠে- ” সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম। আর সেজন্য বাবা-মা-ভাই-ভাবি কাউকে জানাইনি দেশে ফিরতেছি। কিন্তু এখন তো দেখি সারপ্রাইজ দিতে এসে আমি নিজেই ভয়ংকর রকম সারপ্রাইজ পেয়ে গেলাম।”
ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসিরর রেখা টেনে শুভ্র জিজ্ঞেস করে- কেমন আছিস?
প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন করে শিশির। আমার’টা না হয় পরেই বলি। আগে বল তুই কেমন আছিস? আর দেবদাসমার্কা চেহারা নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন?
– – – – – – – – – – – – –
কি হলো ভাইয়া? চুপ করে আছিস কেন?
– – – – – – – – – – – – –
আচ্ছা, বাদ দে! ভাবি কেমন আছে সেটা বল……
কি হলো? চুপ করে আছিস কেন?

নিচু কন্ঠে শুভ্রর জবাব, জানি না…….

জোর গলায় শিশির বলে উঠে, কিহ? জানিস না মানে? শুভ্র আবারো বলে, ও আমার কাছে নেই দু’বছর ধরে। তাই বলতে পারব না ও কেমন আছে? ভাইয়ার মুখ থেকে এমন সব কথা শুনে চুপ থাকতে পারে নি শিশির। ও এবার চেঁচিয়ে উঠে- ” ভাইয়া! কি বলছিস এসব? দু’বছর ধরে ভাবি তোর কাছে নেই? তাহলে ভাবি কোথায় আছে?
শান্ত গলায় শুভ্রর জবাব, বাবা মায়ের কাছে রেখে আসছি। খুব সম্ভবত ও বাবা মায়ের সাথেই আছে দু’বছর ধরে।

শিশির এবার আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠে।
” What? তুই কি ভাবিকে কবরে ওনার বাবা মায়ের সাথে শুইয়ে দিইয়ে আসছিস?”

শুভ্র:- মানে????

চলবে………..

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ০৫

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। শুভ্র আর বাসায় ফিরছে না। টেনশনে অস্থির লাবণ্য ফোন হাতে নাম্বার তুলেও কল দেওয়ার সাহস পায়নি। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। শুভ্রর তখনো ফেরার নাম নেই। অস্থির লাবণ্য বারান্দা থেকে রুম, রুম থেকে গেইটের সামনে, গেইটের সামনে থেকে বারান্দায় এভাবেই ঘুরঘুর করছে আর অধির আগ্রহে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু শুভ্রর ফেরার কোনো নাম নেই। নিরুপায় লাবণ্য সাহস করে এবার শুভ্রর নাম্বারে কল দিয়েই ফেলল। এদিকে বারবার কল দেওয়ার পরও শুভ্র কল রিসিভ করছে না। টেনশনে উদ্ভিগ্ন লাবণ্য একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। একটা সময় ওপাশ থেকে সুরেলা কন্ঠে ভেসে উঠে, “আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, একটু পর আবার চেষ্টা করুন।” ফোন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও লাবণ্য একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। বার বার ওপাশ থেকে একই কন্ঠ ভেসে আসছে। বাধ্য হয়ে লাবণ্য হসপিটালে কল দেয়। জানা যায়, শুভ্র সারাদিনে একবারও হসপিটালে যায় নি। হসপিটালে যায়নি, এদিকে ফোনও বন্ধ। শুভ্রর কিছু হয়নি তো? অজানা আশঙ্কায় লাবণ্যর ভিতরটা শিউরে উঠে। নিরুপায় লাবণ্য শুভ্রর খুঁজে বের হয়ে পরে বাসা থেকে। বাসার সামনের টঙ দোকান, চেনা জানা অলিগলি, ক্যাফে, রেস্তোরা কোথাও, কোথাও বাদ পরেনি খুঁজতে। কিন্তু শুভ্রর সন্ধান আর মিলাতে পারেনি লাবণ্য। রাত্রি তখন দশটা। সারাদিনের অভুক্ত লাবণ্য অসুস্থ্য শরীরে যখন হেলেদুলে রাস্তা হাঁটছিল তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরূপী জানোয়ারগুলো ওর দিকে বিভিন্ন বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছিল। কাকতালীয় ভাবে সে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল লাবণ্যর কলেজ ফ্রেন্ড সুমন। ছেলেদের বাজে মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে এসে বুঝতে পারে এ আর কেউ নয় তারই প্রাণের বান্ধবী লাবণ্য ছাড়া। সুমন দৌঁড়ে যায় লাবণ্যর কাছে। জিজ্ঞেস করে, কিরে কি অবস্থা দোস্ত? এত রাত্রে তুই এখানে যে? লাবণ্য কথা ঘুরিয়ে জবাব দেয়, রাতের শহর দেখতে এসেছিলাম। তুই? তুই এখানে কি করছিস? স্মিতহাস্যে সুমনের জবাব, বান্ধবীদের সাথে রাত্রিবেলা শপিং করার শখ জাগছে। একটা বউ বলে কথা। ফেলতে পারিনি আবদার। নিয়ে এলাম শপিংয়ে। মেয়েদের শপিং। বুঝতেই তো পারছিস সময়ের ব্যাপার… তাই বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসির রেখা টেনে লাবণ্যর জবাব, ওহ, আচ্ছা! বুঝতে পারছি। আজ তাহলে আমি আসিরে। অন্য আরেকদিন কথা হবে। ভালো থাকিস। লাবণ্য রাস্তা পার হচ্ছিল, পিছন থেকে লাবণ্যর হাত ধরে হ্যাচকা টানে সুমন লাবণ্যকে ওর কাছে নিয়ে যায়। লাবণ্য চোখ বড় বড় করে সুমনের দিকে তাকিয়ে আছে। সুমন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে, আরেকটু হলে তো উপারে চলে যাইতি। চল, তোকে রাস্তা পাড় করিয়ে দিচ্ছি।

রাত্রি সাড়ে ১০টা।
শুভ্র বাসায় পায়চারি করছে আর বার বার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। অস্থির শুভ্র ফোন করে বন্ধু আতিক’কে। “আতিক! তোর ভাবি তো এখনো ফিরেনি। তুই কি বাসা থেকে বের হইবি একটু?” সিরিয়াস কন্ঠে আতিকের জবাব, আর দেখতে হবে না দোস্ত। যা দেখার দেখে নিয়েছি। শুভ্র! আজ সত্যি বুঝতে পারছি তুই আসলেই সত্যি কথা বলতি। আর আমি ব্যাটা ভাবছি তুই’ই ভুল। শুভ্র অস্থির ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে আতিককে, কি? কি বলছিস তুই? কার কথা বলছিস? আতিক সাথে সাথে একটা এমএমএস পাঠায় শুভ্রর ফোনে। এমএমএসটা ওপেন করে শুভ্রর চোখ কপালে। একটা অচেনা ছেলের সাথে ওর বউ হাত ধরাধরি অবস্থায় হাঁটতেছে। ভুলের পাহাড় ছোট্ট থেকে মুহূর্তেই বিকট আকার ধারণ করে। সত্যি’টা অনুধাবন না করেই লাবণ্যর প্রতি একরাশ ঘৃণা পুষে ফেলে শুভ্র। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে শুভ্র যখন সোফায় বসেছিল তখন ভীরু পায়ে রুমে লাবণ্যর আগমন। শুভ্রকে বাসায় দেখে লাবণ্যর মুখে হাসি ফুটে উঠে। শুকনো হাসি মুখে এনে বলে, “এসেছেন?”
সোফায় হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসে শুভ্র। তারপর লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি না এলেই তো হ্যাপি থাকতি, তাই না?” অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে লাবণ্য, এসব কি বলছেন আপনি? সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় শুভ্র। চটজলদি লাবণ্যর চুলের গোছা ধরে ফেলে। মুঠোভর্তি চুলের গোছা ধরে বলে উঠে শুভ্র, ” বুঝতে পারছিস না? সত্যি কি তুই বুঝতে পারছিস না?” আচমকা শুভ্রর এধরনের আচরণে অবাক লাবণ্য বলে উঠে, ” আমি কি কোনো অন্যায় করেছি শুভ্র?” চুলের মুঠি আরো শক্ত করে ধরে শুভ্র। তারপর লাবণ্যর চোখে চোখ রেখে বলে, খবরদার! তোর ঐ পাপ মুখে আর কখনো আমার নাম নিবি না। লাবণ্য অবাক বিস্ময়ে আবারো প্রশ্ন করে, ” আমার অন্যায়টা কি সেটাতো বলুন আপনি!” রাগে আগুন শুভ্র লাবণ্যর চোখের সামনে আতিকের দেওয়া সেই এমএমএসটা মেলে ধরল। একপলক তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসির রেখা টেনে বলে উঠে লাবণ্য, এটা? উচ্চস্বরে শুভ্রর জবাব, অবাক হয়েছিস যে কিভাবে এটা আমি পেলাম? আরে সত্য কখনো চাপা থাকে না, সত্যকে হাজার চেষ্টা করেও ঢেকে রাখা যায় না। তুই ধরা পড়ে গেছিস। সময় হয়ে গেছে তোর মুখ ও মুখোশ উন্মোচনের।
দেখুন আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। এই ছেলে আমার…..(…..)….???
চুপ, একদম চুপ! কোনো কথা বলবি না। অনেক সয়েছি, আর না……….

লাবণ্য সেদিন অনেক চেষ্টা করছে সত্যিটা বলার, কিন্তু শুভ্র তা শুনতে নারাজ। অসহায় লাবণ্য সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করে শেষরাত্রে যখন ঘুমানোর জন্য চোখ বুজল তখন হ্যাচকা টানে শুভ্র ওকে বিছানা থেকে তুলে বসায়। অনেক ঘুমিয়েছিস, আর না! এবার চল আমার সাথে। শুভ্র লাবণ্যকে একরকম টানতে টানতে গেইটের সামনে ওর গাড়ির কাছে দাঁড় করায়। প্রশ্ন করে লাবণ্য, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? রাগে আগুন শুভ্রর জবাব, তোর বাপ-মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আজ থেকে ওদের কাছে থাকবি। কিন্তু আমার বাবা- মা তো…….. (…..)….??? কোনো কিন্তু নেই। তুই ওদের কাছে থাকবি, এটাই ফাইনাল। লাবণ্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর গ্রামের বাড়ির রাস্তায় চলে আসে। আসবার কালে অসহায় লাবণ্য জল ছলছল চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়েছিল। পিছু ফিরে শুভ্র যখন তাকিয়ে ছিল তখনো অবধি লাবণ্যর বিশ্বাস ছিল শুভ্র মনে হয় মজা করছে। এখন দৌঁড়ে এসে আমার কাছে এসে বলবে স্যরি, আমি আসলে মজা করছি তোমার সাথে। নাহ! শুভ্র এসব কিছুই বলেনি। বলেছিল শুধু- মনে আছে তো আমি কি বলছি? কাঁদো কাঁদো গলায় লাবণ্যর জবাব, হুম! আজ থেকে আমি আমার বাবা মায়ের সাথে থাকব। জোর গলায় শুভ্রর জবাব,
Good…মনে থাকে যেন…..

দেখতে দেখতে শুভ্রর গাড়ি দুরে, বহুদুরে মিলিয়ে যায়। ক্লান্ত লাবণ্য একটু একটু ওর বাবা মায়ের কবরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে……..

চলবে………………

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ০৪

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

৩দিন পর_
যেহেতু লাবণ্য এখন কিছুটা সুস্থ্য তাই লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি বাসায় ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। ওরা বাসায় চলে যাবেন তবে লাবণ্যকে একা রেখে নন। যদিও শুভ্র বাসায় আসে তবুও ওরা কেন জানি ভরসা পাচ্ছে না। রেডি হওয়ার আগ মুহূর্ত লাবণ্যর শাশুড়ি আবারো লাবণ্যর কাছে যায়- কিরে? এখনো রেডি হসনি? তোকে না সেই কখন বললাম রেডি হতে? তাড়াতাড়ি রেডি হো! আমি শাড়িটা চেঞ্জ করে আসি। এসে যাতে দেখি তুই রেডি। লাবণ্যর শাশুড়ি রেডি হয়ে এসে দেখে লাবণ্য তখনো চুপটি করে বারান্দার গ্রিল ধরে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। দেখো তো মেয়ের কান্ড! এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আয়, তোকে আমি নিজেই রেডি করিয়ে করিয়ে দিচ্ছি। লাবণ্যর হাত ধরে টানতে টানতে ওর শাশুড়ি যখন ওকে বেডরুমে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন লাবণ্য বলে উঠে, “আমি যাব না মা….”
লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যর হাতটা ছেড়ে দেয়। লাবণ্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, যাবি না মানে? লাবণ্য মাথা নিচু করে বলে,
” আমি আমার সংসার ছেড়ে কোথাও যাব না মা।” কিন্তু লাবণ্য ও তো তোকে…(….)….???
পুরো কথা বলতে পারে নি রোকসানা বেগম, তার আগেই লাবণ্য ওনার মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নেয়। লাবণ্য অকপটে বলে উঠে, দিক কষ্ট। তুমি দেখো মা, কষ্ট দিতে দিতে ও যেদিন ক্লান্ত হয়ে যাবে, সেদিন ও আমার কাছে ফিরে আসবে। ওর সব ভুলের পরিসমাপ্তি সেদিন ঘটবে। সেদিন ও আমায় ঠিক বুঝবে! আমি না হয় একটু কষ্ট করে সেদিনটির অপেক্ষায় থাকব।
লাবণ্যর মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, তোর যা ভালো মনে হয়। তবে হ্যাঁ, জীবনের সাথে লড়াই করতে করতে কখনো যদি ক্লান্ত হয়ে পরিস, তাহলে চলে আসিস! চলে আসিস এই মায়ের কাছে। পৃথিবীর আর কোথাও তোর জায়গা না হলেও এই মায়ের আঁচলের ছায়াতলে ঠিক তোর জায়গা হবে। ভালো থাকিস। আমরা আসি।

লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি চলে যায়। যাওয়ার আগে লাবণ্য ওর শ্বশুর শাশুড়ির পা ছুঁয়ে সালাম করে। লাবণ্যর শ্বশুর লাবণ্যর মাথায় হাত রেখে বলে, দোয়া করি! জয়ী বেশে ফিরে আসুক আমার মা’টা….
লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি চলে যায়। সেদিন লাবণ্যর সাথে ওর বাবা মায়ের কথোপকথনের সবটা আড়াল থেকে শুনে নেয় শুভ্র। সব শুনে একটা বিকট হাসি দেয় শুভ্র। জয়ের মুকুট তোর জন্য নয়রে মেয়ে। এ খেলায় তোর পরাজয়। তুই হেরে যাবি এ খেলায়। শোচনীয়ভাবে তোর পরাজয় ঘটবে। এমন পরাজয় যে লজ্জায় মুখ লুকানোর স্থান পাবি না। আমি তোর মুখ ও মুখোশ তুলে ধরব সবার সামনে। সেদিন কোথাও মুখ লুকানোর স্থান পাবি না তুই। কোথাও না।

সেদিন শুভ্রর মন খারাপ ছিল। কেন জানি ভালো লাগছিল না কিছুই।
তাই হসপিটালে যায়নি। শুভ্র ওর রুমে শুয়ে আছে চুপটি করে। অজানা কারনে ওর মনটা খারাপ ছিল। বেডে শুয়ে গভীরভাবে শুভ্র যখন ওর মন খারাপের রহস্য বের করতে ব্যস্ত তখন লাবণ্য চুপটি করে এসে শুভ্রর পাশে বসে। কপালের উপর হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন শুভ্রর চোখ মুখ দেখে লাবণ্য বুঝতে পারে শুভ্রর মনটা বোধ হয় খুব খারাপ। লাবণ্যর মনে পড়ে যায় শুভ্রর বলা সেই কথাগুলো, লাবণ্য জানো? আমার যখন মন খারাপের সময় তুমি যখন আমার মাথায় হাত রাখ, তখন আমার সব চিন্তা দুর হয়ে যায়। বছর পাঁচেক আগের কথা লাবণ্যর আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল। আর তাই কোনো সংকোচ না করে লাবণ্য শুভ্রর মাথায় হাত রাখে। আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য শুভ্র ওর মনের সব যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছিল। পরক্ষণে যখন মনে হলো এ তো তারই ছোঁয়া, যাকে আমি মনে প্রাণে ঘৃণা করি। এ তো সেই ছলনাময়ীর ছোঁয়া, যে ছলনাময়ী একদিন অন্য একটা ছেলের জন্য আমায় ভুলে গিয়েছিল। শুভ্র লাফিয়ে উঠে বিছানা থেকে। অগ্নিচোখে লাবণ্যর দিকে তাকাই। লাবণ্য রীতিমত কাঁপছিল শুভ্রর ঐরকম লাল আগুনের মত চোখ দেখে। আচমকা লাবণ্যর কিছু বুঝে উঠার আগেই শুভ্র লাবণ্যর হাতটা ধরে ফেলে। লাবণ্য স্থির দৃষ্টিতে শুভ্রর মুঠোর দিকে তাকিয়ে আছে। কেননা, বিয়ের পর এই প্রথম শুভ্র লাবণ্যর হাত স্পর্শ করল।

” সমস্যা কি তোমার? এভাবে কেন আমার পিছু লেগে আছ? কেন আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছ না? কেন একমুহূর্তও তোমার জন্য আমি শান্তিতে থাকতে থাকতে পাচ্ছি না? কেন? কেন? কেন?”

একনিশ্বাসে করা একরাশ প্রশ্ন শুভ্রর। ভীরু কন্ঠে লাবণ্যর জবাব, আপনি খুব চিন্তিত ছিলেন মনে হয়। তাই আপনার…(….)…????
পুরো কথা বলার আগেই শুভ্র চেঁচিয়ে বলে উঠে, আমি তোমাকে ঘৃণা করি লাবণ্য, ঘৃণা করি। সেখানে তুমি ভাবলে কিভাবে তোমার ছোঁয়াতে আমি শান্তি খুঁজে পাবো?
লাবণ্য শুভ্রর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি জানি এসব আপনার অভিমান থেকে বলছেন। আপনি কখনো আমাকে ঘৃণা করতে পারেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আসল সত্যিটা শুনলে আপনার সব ভুল ভেঙ্গে যাবে। আমি আপনাকে আজ সব বলব। আপনি আমায় একটু সহ্য করেন। ধৈর্য্য নিয়ে আমার কথাগুলো শুনেন….

শুভ্র একলাফে খাট থেকে উঠে পরে। তারপর শার্ট গায়ে দিয়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। লাবণ্য শুভ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শুভ্র রাগী গলায় বলে, আমার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে দিও না লাবণ্য। তাতে কিন্তু তোমার’ই খারাপ হবে। আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাই। আর তার জন্য আমি একটু একা থাকতে চাচ্ছি। দয়া করে আমায় একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
লাবণ্য শুভ্রর পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। শুভ্র বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে অশ্রুভেঁজা দৃষ্টিতে লাবণ্য শুভ্রর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে…..

ভুল ও ভালোবাসা পর্ব- ০৩

0

ভুল ও ভালোবাসা
পর্ব- ০৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মা, আমার জরুরী কাজ আছে। তাই আমায় হসপিটালে যেতে হচ্ছে। দয়া করে আমায় পিছু ডেকো না।
পিছু ডাকবে না মানে? বউটা অসুস্থ্য। আর ওকে ফেলে তুই হসপিটালে চলে যাচ্ছিস? তুই কিরে? তোর ভিতর কি মায়া দয়া বলতে কিচ্ছু নেই? একটুও মানবতা নেই?
” বাবা, শুনো! আমাকে তোমরা মানবতা শিখাতে এসো না। কারন, মানবতা শেখার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমাদের আদরের বউ মা অসুস্থ্য। সমস্যা কি? তোমরা তো আছ মানবতাবোধ সম্পূর্ণ ব্যক্তি। তো আর দেরী কেন? এখনি লেগে পরো কাজে। আমার এত মানবতা দেখানোর টাইম নাই। আমি গেলাম।”
বাবার কথার মুখে মুখে জবাব দিয়ে চলে যায় শুভ্র। জনাব শফিকুল ইসলাম মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পরেন। রোকসানা বেগমও রীতিমত অবাক ছেলের এমন আচরণে। জনাব শফিকুল ইসলাম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেতেছে, আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম রোকসানা। আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম। একটা সময় যেই ছেলেকে নিয়ে গর্ববোধ করতাম, আজ সেই ছেলে আমায় ব্যর্থ করে দিয়েছে। আমি একজন ব্যর্থ বাবা হয়ে গেলাম। আমি পারলাম না আমার ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে। আমার সারাজীবনের পরিশ্রম আজ ব্যর্থ হয়ে গেল। হু, হু করে কেঁদে উঠল শুভ্রর বাবা। এই মুহূর্তে কিছু সান্ত্বনার বানী বলা দরকার বুঝতে পারছিল শুভ্রর মা। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিল না ওনার। অনেক চেষ্টা করে রোকসানা বেগম কাঁপা গলায় শুধু এটুকু বলল, শান্ত হও!
সেদিন রাত্রে বাসায় ফিরে কারো সাথে কথা বলেনি শুভ্র। লাবণ্যের সাথে কথা নাইবা বলল, নিজের বাবা মায়ের সাথে তো কথা বলতে পারত। কিন্তু তাও বলেনি। একটা বারের জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেনি, খেয়েছ তোমরা? যেহেতু সেদিন শুভ্রর বাবা মা এসেছিল তাই তাদেরকে লাবণ্যর ঘরটা ছেড়ে দিতে দিয়ে শুভ্রর রুমে থাকতে হলো। লাবণ্য রুমে প্রবেশ করা মাত্রই খাট থেকে একটা বালিক নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেয় শুভ্র। লাবণ্য বুঝতে পারে ওর জায়গা খাটে নয়, ফ্লোরে। সে শুয়ে পরে ফ্লোরে। একে তো অসুস্থ্য শরীর, তারউপর ঠান্ডা ফ্লোর। রাত্রে আবারো হাড় কাঁপিয়ে জ্বর আসে লাবণ্যর। উপয়ান্তর না পেয়ে বালিশ নিয়ে উপরে উঠে সে। শুভ্রর পিছনে বালিশ পেতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে লাবণ্য। ঘুমিয়ে পরে সে। জ্বরের ঘোরে কাঁপতে কাঁপতে কখন যে শুভ্রর চাদরের নিচে চলে যায় কিছুই টের পায় না লাবণ্য। খেয়াল হয় যখন হ্যাঁচকা টানে কেউ একজন ওকে খাট থেকে ফেলে দেয়। শুভ্রর রক্তবর্ণ চোখ দেখে ভড়কে যায় লাবণ্য। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “আসলে খুব শীত…(…)….???
পুরো কথা বলতে পারে নি লাবণ্য। তার আগেই শুভ্র হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে ছাদে চলে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের কোণে জড়ো হওয়া জলটুকু মুছে নেয় লাবণ্য।

সকালে হসপিটালে যাবার প্রাক্কালে শুভ্রর পথ আগলে দাঁড়ায় ওর মা। রাত্রের পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ওনি। দরজার আড়াল থেকে সব, সবটা শুনেছেন ওনি। আজ তাই কিছু প্রশ্ন নিয়ে ছেলের সম্মুখীন হলেন। আজ ওনি ওনার সব প্রশ্নের উত্তর শুনে তবেই একটা সিদ্ধান্তে আসতে চান। প্রশ্ন করেন ছেলেকে, লাবণ্যর প্রতি তোর কেন এত বিতৃষ্ণা? কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস অসহায় মেয়েটাকে? মায়ের প্রশ্নের জবাবে চিৎকার করল বলে উঠে শুভ্র, আমার ওকে ভালো লাগে না কথাটা শুনা সত্ত্বেও কেন আমায় জোর করে বিয়ে করালে? কেন? কেন? দুনিয়াতে কি এই মেয়ে ছাড়া আর কোনো মেয়ে তোমাদের চোখে পরেনি? এই মেয়ের মধ্যে কি পেয়েছ তোমরা? এই মেয়ে কি জাদু করেছে তোমাদের যে এই মেয়ের জন্য তোমরা আমায় ব্ল্যাকমেইল করেছ???

রোকসানা বেগম ছেলের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেন,কি বললি ব্ল্যাকমেইল করেছি আমরা তোকে?
শুভ্র উঁচু গলায় জবাব দেয়, তা নয়তো কি? বাবার ইচ্ছে এই মেয়েকে পুত্রবধূ করার। এখন ওকে বিয়ে না করলে বাবা মনে কষ্ট পাবে। স্ট্রোক করবে…..
উত্তেজিত হয়ে শুভ্রর মা বলেন, চুপ কর শুভ্র। শুভ্র ব্যঙ্গাত্বক স্বরে বলে, এই মেয়ের সম্পর্কে আমারও কোনো কথা বলতে ভালো লাগে না মা। তুমি প্রশ্ন করছ তাই জিজ্ঞেস করলাম, কি জাদু করেছ ও তোমাদের?
শুভ্রর মা শান্ত গলায় বলেন, শুভ্র! এই মেয়ে আমাদের কোনো জাদু করেনি। ওর মা আমার বান্ধবী। আমার খুব ভালো একটা বান্ধবী ছিল লুবনা মানে লাবণ্যর মা। কয়েকবছর আগে লাবণ্যর বাবা, মা, ভাই একটা…..(…..)…..???
Enough! অনেক হয়েছে মা। এবার বন্ধ করো তোমার সিনেমাটিক ডায়লগ। আমার সময় বয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম। আল্লাহ হাফেজ। শুভ্র ওর মায়ের পুরো কথা না শুনে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

পর্দার আড়াল থেকে মা ছেলের কথোপকথনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুনে নিয়েছে একজন।

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ০২

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ০২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

একে তো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, তারউপর সারাদিনের অভুক্ত। শরীরটা একদম নেতিয়ে পরছিল। কোনো রকমে খাবারগুলো ফ্রিজে তুলে রেখে শুয়ে পরে লাবণ্য। অন্যদিন বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ঘুম চলে আসলেও আজ কেন জানি হাজার চেষ্টার পরেও ঘুম চোখে আসছে না। লাবণ্য পারছে না ঘুমোতে। সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করল লাবণ্য। মাঝরাত্রে হাড়কাঁপিয়ে জ্বর আসে ওর। ছটফট লাবণ্য বিছানা থেকে উঠে শুভ্রর রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নক করে শুভ্রর রুমের দরজায়। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম চোখে দরজা খুলে শুভ্র। দরজা খুলে লাবণ্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ চরমে উঠে যায় ওর। ভ্রু বাকিয়ে রাগী স্বরে বলে উঠে সে, ” রাত বিরাতে কি শুরু করছ এসব? আমায় কি শান্তিতে একটু ঘুমুতেও দিবে না?”
কাঁপা গলায় লাবণ্যর জবাব, ” সকাল থেকে আমার খুব জ্বর, ঔষধও আনতে পারিনি। আপনার কাছে কি জ্বরের ট্যাবলেট হবে?”
গলার আওয়াজ কিছুটা নিচু হয় কথাটা শুনে কিন্তু রাগটা কমেনি। রাগান্বিত স্বরে শুভ্রর পাল্টা জবাব, ” তো আমি কি ঔষধের ফার্মেসী খুলে বসেছি যে আমার কাছে ঔষধের জন্য এসেছ?!!! যত্তসব”
না, মানে আপনার কাছে ঔষধ থাকে তো তাই…..(……)…..????
পুরো কথা বলতে পারেনি লাবণ্য। তার আগেই মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দেয় শুভ্র। জ্বরে কাতর লাবণ্য অশ্রুভেঁজা চোখে ফিরে যায় রুমে। পরনের ওড়নার একপাশ পানিতে ভিঁজিয়ে নিজে নিজেই কপালে দিয়ে রাখে একটু ভালো লাগার আশায়। অসুস্থ্য শরীরেরও নামাজটা মিস করেনি। কাঁপা কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়ায় লাবণ্য। শুভ্রর রুমের সামনে গিয়ে কড়া নাড়ে। শুভ্রকে নামাজের জন্য জাগিয়ে দিয়ে নিজেও নামাজটা আদায় করে নেয়। অন্যান্য দিনের মতো কুরআন তেলওয়াতটা আর করা হয়ে উঠেনি। একে তো জ্বর, তারউপর শরীরটা একদম নেতিয়ে পরেছিল। নামাজের বিছানায়’ই শুয়ে পরে লাবণ্য। এদিকে নামাজ পড়ে একটু শুয়েছিল শুভ্র। অন্যান্য দিনের মত সেদিন আর লাবণ্য ডাকতে পারেনি শুভ্রকে। যার কারনে শুভ্রর ঘুমটাও ভাঙেনি। যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল সাড়ে ১০টা। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে হুড়মুড়িয়ে বাসা থেকল বের হয় শুভ্র। একবারও জানার প্রয়োজন মনে করল না, পাশের রুমে এত বেলা অবধি কি করছে মেয়েটা? কেন জাগিয়ে দেয়নি ওকে?

অসুস্থ্য লাবণ্য ছটফট যন্ত্রণায় সারাটা দিন বিছানায় ছটফট করেছে আর আল্লাহ, আল্লাহ করেছে। আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল লাবণ্যর উপর। সেদিন সন্ধ্যায় কাকতালীয় ভাবে বাসায় আগমন ঘটে শুভ্রর বাবা-মায়ের। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অথচ বাসায় কোনো আলো নেই, নেই কোনো সাড়া শব্দ। তবে কি বাড়িতে কেউ নেই নাকি? শুভ্রর বাবার প্রশ্নের জবাবে ওর মা বলে উঠে, তা কি করে হয়? বাসার মেইন দরজায় যে খুলা। চলো তো একটু ভিতরে গিয়ে দেখি! দরজা ঠেলে লাবণ্য, লাবণ্য করতে করতে শুভ্রর রুমে প্রবেশ করে ওর বাবা- মা। পুরো রুম জুড়ে ময়লা আর বিছানাটাও কেমন অগোছালো। লাবণ্য কি আজকে ঘরদোয়ার পরিষ্কার করো নি? বলতে বলতে পাশের রুমে প্রবেশ করে শুভ্রর মা। রুমে প্রবেশ করতেই শুভ্রর মায়ের একটা চিৎকার ভেসে উঠে। চিৎকার শুনে শুভ্রর বাবার ছুটে যান। স্ত্রীর মতো তিনিও আঁতকে উঠে একমাত্র আদরের বউমাকে বিছানায় নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই লাবণ্যর পাশে বসে লাবণ্যকে ডাকতেছে আর বলতেছে-
” মা! কি হয়ছে তোমার? মা চোখ খুলো। মা, ও মা? কি হয়ছে তোমার? জ্বরে যে গাঁ পুড়ে যায় শুভ্রর বাপ! এখন কি করব?”
লাবণ্য একটু একটু করে চোখ মেলে তাকায়। শ্বশুর শাশুড়ি দু’জনের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দেয়। শুভ্রর বাবা মা লাবণ্যকে বিছানায় উঠিয়ে শুইয়ে দেই। লাবণ্য আলতো করে ওর শ্বাশুড়ির হাতটা চেঁপে ধরে আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ” আমায় কিছু খেতে দাও। খুব ক্ষিদে পেয়েছে মা”…..
বহু চেষ্টা করে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি বুঝতে পারল লাবণ্য খেতে চাচ্ছে। বাসা থেকে রান্না করে আনা খাবারগুলোই মুখে তুলে খাইয়ে দেয় লাবণ্যকে। তারপর সাথে থাকা জ্বরের ট্যাবলেট থেকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। খাওয়া-দাওয়া শেষে লাবণ্য নিথর হয়ে শুয়ে থাকে বিছানায়। ওর শ্বশুর ছুটে যায় হসপিটালে। কান ধরে টেনে আনে ছেলেকে।
বাসায় আসার পর শুভ্রর কি মেজাজ!
বাবা! আজকে রোগীর অনেক ভীড়। আমায় হসপিটালে যেতে হবে। দয়া করে আমায় যেতে দাও।

” হসপিটালে আজ আর যেতে হবে না। তোর আসল রোগী বিছানায় শুয়ে আছে, ওর কাছে যা। ওর চিকিৎসা কর।”
পিছন থেকে কথাটা বলে উঠে শুভ্রর মা।

মায়ের কথা শুনে থমকে দাঁড়ায় শুভ্র;

চলবে……