খাটের নিচ থেকে মায়ার বের হতে দেরী, ওর গালে শুভ্রর দেওয়া থাপ্পরটা পরতে এক মুহূর্তও দেরী হয়নি। তারপরের ঘটনা তো সবাই জানেন।
একে তো বাঁধনের সাথে রাগ করে সারাটা দিন অনাহারে থেকেছে, তারউপর কান্নাকাটি। মায়ার মাথাটা কিরকম ভারী ভারী লাগছে। মনে হচ্ছে উঠে দাঁড়ালেই বুঝি মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু দাঁড়াতে তো হবেই। বহুকষ্টে হেঁটে হেঁটে ওয়াশরুমে যায় মায়া। চোখেমুখে পানিরছিটা দিয়ে কোমড়ে আঁচল বেঁধে রান্না করতে দাঁড়ায়। যদিও রান্নার ‘র’ ও পারে না ও। তথাপি আজ মায়া রান্না করতে ঢুকেছে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে, আমাকে পারতে হবে। যে করেই হোক আমাকে পারতেই হবে।
সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে বাঁধন। ব্রাশ হাতে ওয়াশরুমের দিকে এগুনোর সময় চোখ যায় কিচেনের দিকে। বটিতে বসে চোখ বন্ধ করে হাতে পেয়াজ নিয়ে বসে আছে। চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে ওর। মায়া রান্নায় অভ্যস্ত না সেটা বাঁধনসহ ওর পরিবারের সবাই জানে। আর জানে বলেই ওরা কখনো ওদের
পুত্রবধূকে রান্নার জন্য চাপ দেই নি। যদিও মায়া ৮মাসের বৈবাহিক জীবনে হাতে গোনা কয়েক দিন শ্বশুর বাড়িতে থেকেছে। আর যে কয়দিন থেকেছে মায়া সে কয়দিন ঐ বাড়িতে মেহমানের মতই ছিল। আজই প্রথম মায়া নিজ ইচ্ছেতে কিচেনে ঢুকেছে। আর প্রথম দিনেই এই অবস্থা। হেসে দিল বাঁধন। ব্রাশটা রেখে তাড়াতাড়ি চোখে মুখে পানিরছিটা দিয়ে বাঁধন এগিয়ে যায় মায়ার দিকে। হয়ছে তোমার রান্না আমার খাওয়া হয়ে গেছে, এবার আমাকে দাও দেখি আমি পারি কি না। কথাটা বলে বাঁধন মায়ার হাতের পেয়াজটা নিতে যাচ্ছিল। মুহূর্তেই মায়া চোখ খুলে বাঁধনের দিকে তাকাই। তারপর ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে চোখের জল মুছে পেয়াজ কাটতে শুরু করে। বাঁধন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরে মায়ার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে। বাঁধনের বলা রাতের ঐ কথাগুলোই মায়ার ফর্সা মুখটাকে অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় করে দেয়। রাগে একটার পর একটা পেয়াজ কাটতেই থাকে মায়া। কাজের অসাবধানতায় মায়ার আঙ্গুলের ক্ষাণিকটা কেঁটে যায়। ওহ স্বরে কুঁকিয়ে উঠতেই দাঁড়ানো থেকে বসে মায়ার হাতটা ধরে ফেলে বাঁধন। কিছুক্ষণের জন্য মায়া রাতের ঘটনাটার কথা ভুলে গিয়ে বাঁধনের চোখের গহীনে হারিয়ে যায়। ভেঁজা চোখে বাঁধন তখন মায়ার আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে।উৎকন্ঠার সাথে বাঁধন বলে উঠে, কি যে করনা তুমি! ২দিনের জন্য আমার কাছে এসেছ, এতেই কিচেনে ঢুকে গেছ। বাঁধনের কথায় ঘোর কাটে মায়ার। বাঁধন যখন আঙ্গুল কতটুকু কাটছে এটা দেখায় ব্যস্ত, মায়া তখনই একঝটকায় ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয় বাঁধনের থেকে। তারপর আবার কাজে লেগে যায়। পিছন থেকে বাঁধনের হাজারো নিষেধ, হাজারো কথা কোনোটাই শুনেনি মায়া। রান্না শেষে খাবারগুলো থরে বিথরে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখছিল মায়া, তখনি সেখানে উপস্থিত হয় বাঁধন। চেয়ার টেনে টেবিলের কাছে বসে মায়ার দিকে অশ্রুভেঁজা চোখে তাকিয়ে আছে বাঁধন। মায়ার সেদিকে একটুও ক্রক্ষেপ নেই। একমনে পাক্কা গৃহিনীদের মত মুখটা ভার করে প্লেটে খাবার দিয়ে তরকারীর বাটিগুলো সামনে রাখে। বাঁধন খাবারের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই চুপিসারে অভিমানী মায়া সে স্থান ত্যাগ করছিল। নিচের দিকে তাকিয়েই মায়ার হাতটা ধরে ফেলে বাঁধন।
মায়া বাঁধনের হাত থেকে ওর হাতটা ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো ভাবেই পেরে উঠছে না। বাধ্য মায়া মুখ খুলে, ছাড়ুন! কিন্তু বাঁধন আগের মতই শক্ত করে ধরে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা দেখে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। অন্যদিকে তাকিয়েই ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, আমি এখন খাবো না। বাঁধন এবার বসা থেকে উঠে যায়। একটানে মায়াকে কাছে নিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, স্যরি লক্ষ্মী! মায়া কোনো কথা না বলে চোখ বন্ধ করে আছে। দু’চোখের লোনাজলে মায়ার গাল ভিঁজে একাকার। বাঁধন মায়াকে দু’বাহু ধরে ওর দিকে ফিরায়। চোখের জল মুছে দিয়ে বলে, ভালোবাসি তো লক্ষ্মী! মায়া চোখ মেলে বাঁধনের চোখের দিকে তাকায়। জল ছলছল চোখে কিরকম করুণ দৃষ্টিতে বাঁধন মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখেরই মায়ায় বাঁধা পরার আগেই চোখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, আমি খাব না এখন। ছাড়ুন আমাকে। বাঁধন ছাড়ার পরিবর্তে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়াকে। একটানে ওর কাছে নিয়ে জোর করে মায়ার নাকে, মুখে, গালে, কপালে ভালোবাসার এক উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। তারপর মায়ার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে, স্যরি! আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ আমায় মাফ করে দাও। আর কখনো এমনটি হবে না। মায়া কোনো কথা না বলে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। বেশকিছু ক্ষণ পর বাঁধন ওর চোখ মুছে বলে, আচ্ছা! মাফ করতে হবে না। বসো এখন খাবে। টেবিলে বসাতে দেরী, কিন্তু বাঁধনের হাতে কামড় দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করতে এক মুহূর্তও দেরী হয়নি মায়ার।
রুমভর্তি মানুষের সামনে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল বাঁধন মায়ার গালে। একে তো সারাদিনের অভুক্ত, তার উপর আবার চড়। তাল সামলাতে পারে নি মায়া। গালে হাত দিয়েই সোফায় বসে পরে সে। রুমে উপস্থিত মানুষজন আস্তে আস্তে যে যার বাসায় চলে যেতে শুরু করে।
এই মুহূর্তে মায়ার অবস্থান বাঁধনের খাটে। নিশ্চুপ মায়া খাটের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আর বাঁধন তারই পাশে। কিছুক্ষণ নিরবতা চলে দু’জনের মাঝে। বেশ কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে মুখ খুলে বাঁধন। প্রশ্ন করে মায়াকে, কি? কি মনে করো তুমি নিজেকে? চুপিসারে মাথা নিচু করে আছে মায়া। বাঁধন ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর না পেয়ে আরো জোরালো কন্ঠে বলে উঠে, চুপ করে আছো কেন? জবাব দাও। এভাবে আর কত? আমি যে আর পারছি না। পাগল হয়ে যাচ্ছি। এবার তো একটু শান্তি দাও! মানুষের মত বেঁচে থাকতে দাও। মায়া তখনো চুপ। মায়ার এই মৌনতা মেনে নিতে পারছে না বাঁধন। আর পারছে না বলেই আরো জোরে হুংকার দিয়ে উঠে সে- ” তোমার মত বয়সের/তোমার থেকেও ছোট এমন হাজারো মেয়ে আছে যারা শান্তিতে স্বামীর সংসার করছে। ওরা যদি পারে তবে তুমি কেন পারো না? কেন পারো না ৮,১০টা মেয়ের মত সংসার করতে? কেন আমার জীবনটাকে এভাবে শেষ করে দিচ্ছ ?” শেষ কথাটা শুনে অশ্রুভেঁজা চোখে বাঁধনের দিকে তাকাই মায়া। হয়তো এখনি কেঁদে দিবে। কিন্তু নাহ! মায়া কাঁদল না। শুধু খাট থেকে একটু নড়েচড়ে বসল। আর বাঁধন?!!! ওর রাগটা তখনো ছিল। ও জানে ও যদি এ রুমে থাকে মায়াকে আরো উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ও সেটা চাচ্ছে না। চাচ্ছে না বলেই ও সোজা রুম থেকে বের হয়ে বাহিরে চলে যায়। বাঁধন চলে যাওয়ার পর ধীরপায়ে মায়া বারান্দায় চলে যায়।
ঘন্টাখানেক পর বাসায় আসে বাঁধন। রাগটা এতক্ষণে সম্পূর্ণ চলে গেছে ওর। নিজেকে সম্পূর্ণ কন্ট্রোলে নিয়ে এসেছে ও। বাঁধন বুঝতে পারে রাগের বশবর্তী হয়ে ও কতটা জঘন্যভাবে আঘাত করেছে মায়াকে। যার চোখের একফোঁটা জল দেখলে পাগল হয়ে যেতাম, দিশেহারা হয়ে যেতাম, আজ তাকে খুব নির্মমভাবে আঘাত করলাম। অনেক কটুকাব্য শুনিয়ে দিলাম। যেই আমি ওর এই পাগলামীর প্রেমে পরে ভালোবেসেছিলাম ওকে, সেই আমি আজ এই পাগলামীর জন্য ওকে আঘাত করলাম? ওর মনে কষ্ট দিলাম? কি করে পারলাম আমি এতটা নির্দয় হতে? বাসায় ঢুকে উন্মাদ বাঁধন মায়াকে এদিক, ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ রুম, ওরুম, বাথরুম, কিচেন। সব, সব জায়গায় খুঁজ করেছে বাঁধন মায়ার। কোথাও মায়াকে খুঁজে পায়নি। নিচের তলায় ভাবীর কাছে গিয়েছে কি? আমি কি দেখে আসব নিচে? দেখেই আসি একবার।ছাঁদ থেকে খুঁজে এসে বাঁধন নিচতলায় ওর মামাত ভাই-ভাবির বাসায় খুঁজ করে। নাহ, এখানেও আসেনি। তবে কোথায় গিয়েছে ও? দিশেহারা বাঁধন দোতলায় ছুটে আসে আবারও। রুমটা ভালো করে খুঁজে কি মনে করে যেন বারান্দায় যায় সে। ওখানেই আবিস্কার করে বাঁধন তার স্ত্রী মায়াকে। বাঁধন চলে যাওয়ার পর হয়তো খুব করে কেঁদেছে, তারপর এখানে হেলান দিয়ে বসেই ঘুমিয়ে পরেছে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুকণা তারই জানান দিচ্ছে। কোনো কথা না বলে কোলে করে বাঁধন মায়াকে বিছানার কাছে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর কপালে আলতু করে চুমুর পরশ এঁকে দেয়।ফ্যানটা চালিয়ে গায়ে পাতলা চাদর টেনে দেয়।
বারান্দার গ্রিল ধরে একদৃষ্টিতে বাহির পানে তাকিয়ে আছে বাঁধন। চোখের কোণে জমে থাকা জলগুলো চিকচিক করছে ওর। আনমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেকেই গালি দিচ্ছে বাঁধন। এ আমি কি করলাম? সামান্য কারণে ওর গায়ে হাত তুললাম? ইচ্ছে হচ্ছে হাতটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে।
সারারাত ছটফট যন্ত্রণায় কাটিয়ে মাঝ রাত্রে ঘুমানোর জন্য বিছানায় যায় বাঁধন। হাতে ভর দিয়ে ঘুমন্ত মায়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাঁধন। এভাবে রাত্রি কাটিয়ে শেষ রাত্রিতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় বাঁধন।
ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যায় মায়ার। ঘুম ভাঙলে নিজেকে আবিষ্কার করে বাঁধনের খাটে। পাশেই বাঁধন শুয়ে। ঘুমন্ত বাঁধনের দিকে একবার তাকিয়ে বাঁধনের হাতটা আস্তে আস্তে মায়া ওর উপর থেকে সরিয়ে ফেলে। বিছানা থেকে উঠার সময় মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠে। দাঁড়াতে চেয়েও বসে পরে বিছানায়। মনে করার চেষ্টা করে কি হয়েছিল রাত্রে। মায়ার খুব ভালো করেই মনে পড়ে যায় গত রাত্রের ঘটনা।
প্রতিদিনকার মত সেদিনও বাঁধনের চেম্বার থেকে ফিরতে দেরী হয়। আর এতেই রেগে গিয়ে বাঁধনের রুমের খাটের নিচে লুকিয়ে পরে মায়া বাঁধনকে শায়েস্তা করার জন্য। এদিকে বাঁধন? অফিস থেকে এসে দরজা খোলা পেয়ে ব্যাগটা রুমে রেখে ওয়াশরুমে চলে যায় বাঁধন। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতেই বাঁধন মায়াকে ডাকে। মায়ার সাড়া না পেয়ে ও রুমে যায়। কিন্তু ঐ রুমে তো মেহমান শুয়ে আছে। এভাবে দরজা ফাঁকা রেখে কোথায় গেল তাহলে ও? প্রথমে ছাদ, বারান্দা, কিচেন, বাথরুম তারপর উপরতলা, নিচতলার প্রতিটি বাসা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে বাঁধন। যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছিল বাঁধন ততই পাগল হয়ে যাচ্ছিল। উন্মাদের মত চিৎকার করতে করতে বাঁধন ওর মায়াকে ডাকতে থাকে। বাঁধনের চিৎকারে উপরতলা, নিচতলার সব ভাড়াটিয়ারা এসে হাজির হয়। উপস্থিত হয় বাঁধনের আপন মামাতো ভাই এবং ভাবি। যাদের ফ্ল্যাটে বাঁধন থাকে। সবার মুখেই শুধু এক কথা, কোথায় গেছে এই পাগলী? এ তো শহরের কিচ্ছু চিনে না। আচ্ছা, ঝগড়া হয়ছিল নাকি তোমাদের মাঝে? বাঁধন তুই কি মায়ারে কিছু বলছিস? মানে কোনো কারনে ওর সাথে রাগ দেখায়ছিস? একেকজনের একেক প্রশ্ন। পারছিল না বাঁধন। চেঁচিয়ে উঠে বলে, আমি কিচ্ছু জানিনা। আমার মায়াকে চাই, মায়া। ওকে ছাড়া আমার চলবে না। খাটের নিচে বালিশ পেতে শুয়েছিল মায়া। বাঁধনের কথা শুনে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল ওর। হাসি হাসি মুখে ভাবছে, ঠিকই আছে। আচ্ছা জব্দ হয়েছে ব্যাটা। মায়া এবার বেরিয়ে পর। সময় হয়েছে তোর ব্যাটা বজ্জাতের সামনে নিজেকে হাজির করার। সবাই যখন একে অপরের সাথে কথা বলছে মায়া তখন একটু একটু করে খাটের নিচ থেকে মাথা বের করে উঁকি দেয় ওর বাঁধনের দিকে। উপস্থিত জনতার চোখ বড় বড় হয়ে যায় খাটের নিচের দিকে তাকিয়ে। বাঁধনের দৃষ্টিও সেদিকে যায়;
ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১৯(অন্তিম পর্ব)
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
শুভ্রর পরশে ক্ষাণিক’টা কেঁপে উঠে লাবণ্য কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টা’ই করেনি। প্রিয় মানুষের স্পর্শ, ভালো’ই তো লাগছে। থাকুক না এভাবে, চুপচাপ, নিরবে। লাবণ্য পূর্বের ন্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কোনো কথা নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুধু রাতের শহরটাকে দেখছে। বেশকিছু ক্ষণ এভাবে থাকার পর নিরবতা ভাঙে শুভ্র। একইরকমভাবে লাবণ্যকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখে’ই প্রশ্ন করে, হঠাৎ কেন এই জরুরী তলব বললে না তো? প্রশ্ন শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে শুভ্রর থেকে পিছিয়ে যায় লাবণ্য কিন্তু মুখে কোনো কথা বলে না। শুভ্র এতক্ষণে লাবণ্যর দিকে ফিরে তাকাই। প্রশ্ন করে আবারো, কি হলো? বললে না যে? কেন ডেকেছ আমায়? চুপচাপ লাবণ্য একহাত দিয়ে অন্য হাতের নখ কাটায় ব্যস্ত। শুভ্র আবারো প্রশ্ন করে, কি বলছি বলছি শুনতে পাচ্ছো? ডেকেছ কেন আমায়?
শুভ্রর প্রশ্নের উত্তরটা লাবণ্যর মুখস্ত থাকলেও, জড়তার কারণে এই মুহূর্তে সেটা বলতে পারছে না। আর পারছে না বলেই লাবণ্য তখনো একমনে নখ কেটেই যাচ্ছে। এদিকে শুভ্র?!!! লাবণ্যর থেকে মৌনতা ছাড়া কোনো জবাব না পেয়ে লাবণ্যর একদম কাছে চলে যায়। কাছে গিয়ে দু’হাত দিয়ে আলতু করে লাবণ্যর গালে স্পর্শ করে। লাবণ্যর মুখটা উপরের দিকে তুলে প্রশ্ন করে শুভ্র, শুনো! এদিকে আমার চোখের দিকে তাকাও। লাবণ্য ভয়ে ভয়ে শুভ্রর চোখের দিকে তাকালো।
শুভ্র রাগী কন্ঠে বলে, ” আমি তোমাকে নখ কাটতে বলিনি লাবণ্য। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি, প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তরটা দাও। কেন ডেকেছ তুমি আমায়?”
শুভ্র দু’হাত দিয়ে তখনো লাবণ্যর মুখটা ওর দিকে রেখেছে। অসহায় লাবণ্য দু’চোখের পাতা বন্ধ করে আমতা আমতা স্বরে বলে উঠে, আ আ আমি আপনাকে…..(……)…..????
পরম আগ্রহের সাথে শুভ্র বলে, হ্যাঁ! বলো লাবণ্য। তুমি আমাকে কি? লাবণ্য ঢোক গিলে আবারো আমতা আমতা করে বলে, আমি আপনাকে…..(….)…..???
এভাবে যতবার শুভ্র লাবণ্যকে প্রশ্ন করেছে, বলো লাবণ্য! তুমি আমাকে কি? ততবারই লাবণ্য আমি আপনাকে বলে থেমে গেছে। সর্বশেষে বুকে সাহস সঞ্চয় করে ঢোক করে চোখটা বন্ধ করে একনিশ্বাসে বলে ফেলে লাবণ্য, আমি আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যাব বললাম তো।
শুভ্রর হাসি মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে যায়। লাবণ্যর থেকে শুভ্র এটা প্রত্যাশা করেনি। শুভ্র ভেবেছিল আজ লাবণ্য বুঝি ওকে বলেই দিবে না বলা ভালোবাসার কথা। কিন্তু সে গুড়েবালি। শুভ্রর সব ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে লাবণ্য জানায় ও ঘুরতে যেতে চায়।
লাবণ্যর দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে শুভ্র, ঘুরতে যেতে চাও না? ঘুরতে যাওয়ার জন্য কি এ বাড়িতে কেউ ছিল না? আমাকেই ডেকে আনতে হলো? আমাকে কি তোমার এতটাই অকর্মা মনে হয়ছে? আমার কি কোনো কাজ নেই? তুমি জানো তুমি আমার কতটা মূল্যবান সময় নষ্ট করেছ? একনিশ্বাসে করা একগাদা প্রশ্ন। নিচু কন্ঠে লাবণ্যর জবাব, ভেবেছিলাম আপনি…..(…….)……???
পুরো কথা বলতে পারেনি লাবণ্য। তার আগেই শুভ্র আটকিয়ে দেয়। রাগ দেখিয়ে লাবণ্যর থেকে কিছুটা দুরে সরে গিয়ে বলে, থাকো তোমার ভাবনা নিয়ে। আমি গেলাম।
দু’লাফে ছাঁদ থেকে নেমে যায় শুভ্র। ছাদে সেই একই জায়গায় স্টেচুর মত দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্য। ওর গাল গড়িয়ে অজস্র অশ্রুকণারা নিচে পরছে।
অতিবাহিত হয়ে যায় ৩টা দিন। এই ৩দিনে শুভ্র একটা বারের জন্যও এ বাসায় আসেনি। লাবণ্যকে ফোন দেয়নি। লাবণ্যও কোনো এক অজানা অভিমানে শুভ্রকে কল দেইনি। ৩দিন পর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন হাতে নিয়ে শুভ্রর নাম্বারে কল দেয়। শুভ্র যেন সে ফোনেরই অপেক্ষায় ছিল। লাবণ্য কল দেওয়ার সাথে সাথে ছোঁ মেরে সেই কল রিসিভ করে শুভ্র। কল রিসিভ করে দু’জনেই নিরব। কেউ কোনো কথা বলছে না। দু’তিন মিনিট পর নিরবতা ভেঙে মুখ খুলে লাবণ্য। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে__
হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম…..
ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে শুভ্রর ওয়ালাইকুম আসসালাম।
আবার নিরব…..
মিনিট দুয়েক নিরব থাকার পর আবারো মুখ খুলে লাবণ্য, একটা কথা বলব?
এবার কিছুটা নরম স্বরে শুভ্রর জবাব, জি, বলো। লাবণ্য ভয়ে ভয়ে বলে, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। প্লিজ না করবেন না। শুধু ৫মিনিট, ৫মিনিট সময় আপনি আমায় দিবেন। আমি একটা কথা বলেই চলবে আসব। প্লিজ, আমার এই কথাটা রাখুন।
গম্ভীর কন্ঠে শুভ্র বলে, সকাল ৯টায় গলির মোড়ে এসো তাহলে। ৫মিনিট না হয় ওখানেই কাটাবো। অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুমাবো। রাখলাম। আল্লাহ হাফেজ।
লাবণ্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয় শুভ্র। পরদিন সকাল নয়টা বাজা’র আধঘন্টা আগেই লাবণ্য সেই গলির মোড়ে একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াই। শুভ্রও সেদিন তাড়াতাড়ি’ই বাসা থেকে বের হয়ছিল। তাই লাবণ্যকে ওর জন্য বেশীক্ষণ ওয়েট করতে হয়নি।
লাবণ্যকে দেখে ঘড়ির দিকে তাকাই শুভ্র।
ওহ, এসে গেছ তাহলে? ভালো’ই হলো। আমার আর অপেক্ষা করতে হলো না।
লাবণ্য মৃদু স্বরে বলে, হুম।
তারপর? কি অবস্থা? কেমন চলছে দিনকাল? শুভ্রর প্রশ্নের জবাবে ঠোঁটের কোণে একটা শুকনো হাসির রেখা টেনে লাবণ্য বলে উঠে,
” আছি এরকম। আপনি? আপনি কেমন আছেন?”
স্মিতহাস্যে শুভ্রর জবাব, মন্দ না! ভালো’ই আছি। মনে মনে শুভ্রকে বকে ওর বংশ উদ্ধার করে লাবণ্য। ব্যাটা! অন্যের মনে আগুন জ্বালিয়ে বেশ ভালো’ই আছিস! তোর ভালো থাকার ১২টা বাজাবো আজ আমি। ভালোবাসি বলে আড়ালে লুকিয়ে যাব আমি। এমন আড়ালে যে কেঁদে কেঁদে তুই অর্ধেক শেষ হয়ে যাবে।
ঘোর কাটে শুভ্রর ডাকে। ওহ, হ্যালো! কোথায় হারিয়ে গেলেন? চমকে উঠে শুভ্রর দিকে তাকাই লাবণ্য। শুভ্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাবণ্যর মুখের দিকে তাকাই। কি হলো? বলো? কি বলবা? ৫মিনিট যে হয়ে গেল। লাবণ্য ঢোক গিলে বলে, ইয়ে মানে আমি আপনাকে…..(…..)…..???
হ্যাঁ, বলো। তুমি আমাকে কি? লাবণ্য বার কয়েক কথাটা বলে। কথাটার একই জায়গায় প্রতিবারই লাবণ্য থেমে যাচ্ছে। এবার রেগে গিয়েই শুভ্র বলল, তুমি আমাকে নিয়ে আজও কোথাও না কোথাও ঘুরতে যেতে চাও, তাই তো? কিন্তু মাফ চাচ্ছি লাবণ্য। আমি পারব না। আমার অনেক কাজ আছে। ঘুরার মত টাইম এই মুহূর্তে আমার হাতে নেই। আমি গেলাম। কথাগুলো বলেই শুভ্র হনহনিয়ে রিক্সা দিয়ে চলে যায়। নিশ্চুপ লাবণ্য ফ্যালফ্যালিয়ে শুভ্রর সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
কেটে যায় আরো ১টা সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে শুভ্র একটা বারের জন্য লাবণ্যকে কল দেয়নি। লাবণ্যও শুভ্রকে কল দেওয়ার সাহস পায়নি। সেদিন ছিল শুক্রবার। যেদিন লাবণ্য শুভ্রকে আবারো কল দিয়ে দেখা করতে বলে। শুভ্র রাজি হয়ে যায়। লাবণ্যর কথামতো সেদিন বিকেলে বাসার অদূরে’ই একটা পার্কে শুভ্র লাবণ্যর সাথে দেখা করতে যায়। কথা বলার এক পর্যায়ে শুভ্র প্রশ্ন করে লাবণ্যকে, তুমি না কি বলতে চেয়েছিলে? যদিও না বলাটা বলার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল শুভ্র। কিন্তু শুভ্রর মায়া মাখা মুখ, হাসি, কথা বলায় তন্ময় হয়ে থেকে সেসব কিছু গুলিয়ে ফেলে লাবণ্য। শুভ্রের প্রশ্নের কাঙ্খিত উত্তর লাবণ্য দিতে পারেনি সেদিন। এদিকে শুভ্র প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে, লাবণ্যর মুখ থেকে ঐ চার অক্ষরের একটি শব্দ শুনার জন্য। শুভ্রর মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে লাবণ্যর মুখের ঐ ভালোবাসি কথাটা শুনার জন্য। কিন্তু বোকা লাবণ্য করলো কি জানেন?
শুভ্রর প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। শুভ্র ধমক দিয়ে লাবণ্যকে ওর দিকে ফিরায়। কি হলো? ঐ দিকে কি দেখছ? লাবণ্য বোকার মত শুধু হাসে। শুভ্র রেগে গিয়ে বলে, হাসার কিছু বলছি আমি? লাবণ্য আবারো হাসে। একগাল হেসে দুরে এক কাপলের দিকে আঙ্গুল ইশারা করে যারা ওদের বাচ্চা দু’দিক দিয়ে ধরে পার্কের ভিতর হাটাহাটি করছে।
শুভ্র গম্ভীর হয়ে বলে, ওরা হাটাহাটি করছে। তো এখানে হাসার কি হলো? লাবণ্য আবারো বোকার মত একগাল হেসে বলে, চিন্তা করতেছি এরকমই কতগুলো বাচ্চা যখন আপনাকে জাপটে ধরবে, আপনার ব্যাগ, সানগ্লাস, টাই নিয়ে যখন দৌঁড়াদৌঁড়ি করবে তখন আপনি কিভাবে হসপিটালে যাবেন। What nonsense!
এগুলো আমার প্রশ্নের উত্তর….??? শুভ্র রেগে গিয়ে লাবণ্যর দিকে তাকাই। লাবণ্য ভয় পেয়ে মুখটা বাচ্চাদের মত করে ফেলে। তারপর ঢোক গিলে বলে, রাগ করলেন? আমি তো আপনাকে বন্ধু ভেবেই কথাগুলো বলছি। শুভ্র হাতে থাকা সানগ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বসা থেকে উঠে পরে। তারপর রাগান্বিত দৃষ্টিতে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলে, আমাকে তোমার পাগল মনে হয়, না? তাই এভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছো, তাই না? কিন্তু মিসেস লাবণ্য! অনেক হয়েছে। আর নয়। আর কখনো যাতে আমায় কল না দেওয়া হয়। আজ থেকে মনে করবা, শুভ্র নামের কেউ ছিল না তোমার জীবনে। যে ছিল সে মারা গেছে। হনহনিয়ে লাবণ্যর সামনে দিয়ে শুভ্র চলে যাচ্ছে রাগ দেখিয়ে। পিছন থেকে লাবণ্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে শুভ্রকে আটকানোর। এই শুনোন, শুনোন বলছি, আমি আপনাকে কথাটা বলব। একটু এসে বসুন, প্লিজ। আমায় একা রেখে যাবেন না। আপনি চলে গেলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম। আমি কিন্তু এখানে আপনার জন্য বসে থাকব। রাগ কমলে চলে আসবেন, মনে থাকে যেন! চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাগুলো বলছিল লাবণ্য শুভ্রকে। কিন্তু শুভ্র সেই কথাগুলো শুনেও না শুনার ভাব করে লাবণ্যকে একা রেখে বাসায় চলে যায়।
সন্ধ্যা ০৭টা__
পার্ক থেকে এসে একঘুম দিয়ে উঠে পরেছে শুভ্র।ঘুমের জন্য মাগরিবের নামাজও মিস হয়ে গেছে ওর। বাহিরে প্রচুর ঝড় বইছে। জানালাগুলো কেমন উল্টে পাল্টে একটার সাথে আরেকটা ধাক্কা খাচ্ছে। আর সেই ধাক্কাতে প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে। এদিকে কারেন্টও চলে গেছে।বহুকষ্টে জানালাগুলো লাগিয়ে এসে অন্ধকার রুমে হাতড়ে হাতড়ে ফোন খুঁজছে শুভ্র। মৃদু শব্দে তখনো কল বাজছে। বাসা থেকে কল দিয়েছে। আশ্চর্য! এ সময় বাসা থেকে কেন কল দিচ্ছে? মায়ের কি শরীর খারাপ হয়েছে নাকি? সাত, পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে যায়। কল কেটে যাওয়ার পর চক্ষু চড়কগাছ শুভ্রর। ১০০এর উপরে কল দিয়েছে বাসা থেকে। কারো কিছু হয়ে গেল নাতো? ভিতরটা শিউরে উঠে শুভ্রর। কল ব্রেক করবে ভাবতেই শিশিরের নাম্বার থেকে কল। তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করে শুভ্র। উৎকন্ঠার সাথে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে শিশির? সব ঠিকঠাক আছে তো?! কান্নাজড়ানো কন্ঠে রোকসানা বেগমের জবাব, আমি শিশির না, তোর মা। শুভ্রর গলাটা শুকিয়ে যায়। মা, কাঁদছ কেন তুমি? কি হয়েছে? বাবা, শিশির ওরা ঠিক আছে তো? রোকসানা বেগম কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলে, লাবণ্য ওর বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বের হয়েছিল বিকেলে, তারপর আর ফিরে আসেনি। এদিকে ওর বান্ধবীকে কল দিলাম, ওর বান্ধবী জানায় লাবণ্য ঐ বাসায় যায় নি। ঐ বাসায় যায়নি, ওদের গ্রামের বাড়িতেও যায়নি। কোথায় গিয়েছে তাহলে ও? বাবা, ও কি তোর কাছে গিয়েছে? আমরা তোর বাসায় খুঁজ করতে গিয়েছিলাম। খুঁজ নিয়ে জানলাম ওখানে তুই নেই। বাবা, লাবণ্য কি তোর কাছে? তুই নিয়ে গেছিস ওকে? মায়ের কথা শুনে শুভ্রর গলাটা কেমন শুকিয়ে যায়। অনেক কষ্টে মাকে বলে, মা! আমি রাখছি। পরে কথা হবে। ফোনটা কেটে শুভ্র তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়। বাইকটা নিয়ে রাস্তায় যখন বের হয় শুভ্র ততক্ষণে ঝড়ো হাওয়া থেমে যায়। আকাশ একটু একটু পরিষ্কার হতে থাকে। তবে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি থেমে নেয়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিঁজে বাইক নিয়ে শুভ্র এগিয়ে যাচ্ছে ঐ স্থানে, যে স্থান থেকে বিকেলে ও রাগারাগি করে চলে আসছিল। বাইকটা রাস্তার পাশে রেখেই ঝুপের আড়ালের ঐ স্থানটিতে চলে যায় শুভ্র, যে স্থানে বেঞ্চে বসে লাবণ্য বোকার মত হাসছিল, পাগলামি করছিল। বেঞ্চের কাছে ঝুপের ভেতরে তাকাতেই শুভ্রর চোখ ছানাভরা হয়ে যায়। শুভ্র স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, লাবণ্য গায়ের ওড়না জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। শুভ্রের কান্নাভেঁজা কন্ঠের লাবণ্য ডাক শুনে উপরের দিকে মাথা তুলে তাকায় ও। শুভ্রকে একনজর দেখে নিচের দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় লাবণ্য। আচমকা লাবণ্যর একটা হাত ধরে ফেলে শুভ্র। তারপর টানতে টানতে ঝুপ থেকে বের করে। অভিমানী কন্ঠে লাবণ্যর জবাব, আমি বৃষ্টিতে ভিঁজতেছি। আমায় এভাবে টেনে আনলেন কেন? তখনি ঠাস শব্দে লাবণ্যর গালে একটা থাপ্পর পরল। আশ্চর্য! আপনি আমাকে থাপ্পর কেন মারলেন? কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না আমি। আসো, আমার সাথে আসো। শুভ্র লাবণ্যকে টানতে টানতে বাইকের কাছে নিয়ে যায়। লাবণ্য মুখভার করে বলে, এখানে কেন আনলেন আমায়?
রাগান্বিত দৃষ্টিতে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে শুভ্রর জবাব, আর একটা কথাও যাতে না শুনি। জেদি কন্ঠে লাবণ্য বলে উঠে, কি করবেন? আরেকটা কথা বললে কি করবেন? দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয় শুভ্র, এই যে হাতটা দেখছ? এটা দিয়ে থাপ্পর মারব। এমন থাপ্পর দিব, সারাজীবনেও ভুলতে পারবে না।
অভিমানের সাথে কিছুটা রাগ মিশিয়ে লাবণ্যর জবাব, পারেন তো শুধু এটাই। আর কিছু পারেন রাগ আর থাপ্পর দেওয়া ছাড়া?
এবার আর না হেসে পারল না শুভ্র। লাবণ্যর বাচ্চাদের মত ওমন নাক ফুলিয়ে কথা বলা দেখে হেসে দিল শুভ্র। তারপর মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলল, এর ছাড়াও আমি অনেক কিছুই পারি। শুধু পাবলিক প্লেস দেখে কিছু করিনি এখনো। বাসায় থাকলে এতক্ষণে বুঝিয়ে দিতাম আমি কি পারি না পারি। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল লাবণ্য। নরম স্বরে বলল, আমি কি ঐভাবে বলছি নাকি? শুভ্র মুচকি হেসে বলে, হয়ছে! আর লজ্জা পেতে হবে না। বাইকে উঠো। লাবণ্য লজ্জায় আর কোনো কথা বলতে পারেনি। চুপচাপ বাইকে উঠে পরে লাবণ্য।
এদিকে মোড় নিয়েছেন কেন? শুভ্র সিরিয়াস মুডে বলে, তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে লাবণ্য, আমার স্বপ্ন? সেটা আবার কি? দুষ্টু হাসি দিয়ে শুভ্রর জবাব, এই যে অনেকগুলো বাচ্চা থাকবে আমার বাসায়। একজন আমার নাক ধরে তো আরেকজন কান ধরে, একজন চুল ধরে তো, আরেকজন সানগ্লাস ধরে টানবে। একজন কোর্ট ধরে তো আরেকজন টাই ধরে টানবে। ওহ, হ্যাঁ! আমি যাতে হসপিটালে যেতে না পারি এই জন্য আমার আরেক বাচ্চা আমার ব্যাগ ধরেও টানবে। এসব কিছুই তো তোমার তো তোমার স্বপ্ন, তাই না? শুভ্রর কথায় লজ্জায় চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে লাবণ্যর। মনে মনে তখনকার বোকামির জন্য নিজে নিজেকে গালি দিচ্ছে লাবণ্য।
কি হলো? আমার বউটা চুপ হয়ে গেল যে? কিছু বলতেছ না যে? নিচু স্বরে লাবণ্যর জবাব, কি বলব? শুভ্র মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলে, এই যে! প্রস্তুত নাকি ক্রিকেট টিম তৈরির জন্য? লাবণ্য মুখে হাসি চোখে জল নিয়ে শুভ্রকে কিলাতে শুরু করে। একটা বৃহৎ ভুলের পরিসমাপ্তি হয় যেখানে ভালোবাসার সূচনাটা সেখানে’ই। বেঁচে থাকুক ভালোবাসারা যুগ, যুগ ধরে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে।
ফোনটা কেটে বন্ধ করে টেবিলে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে উঠে লাবণ্য। মাথার নিচে খোলা বইয়ের পাতাগুলো একটু একটু করে ভিঁজে একাকার হয়ে যাচ্ছে লাবণ্যর চোখে জলে। গোসল সেরে রুমে আসে শিশির। এই অসময়ে ভাবিকে এভাবে টেবিলে ঝিমুতে দেখে ভাবির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় শিশির।
” ভাবি তোমার শরীর খারাপ?”
চমকে উঠে মাথা তুলে তাকাই লাবণ্য। শিশিরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখের জলটুকু মুছে নেয় সে। শিশির ওর ভাবির মুখটা ওর দিকে ফিরিয়ে নেয়। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, সেকি! তোমার চোখে জল? তুমি কাঁদছ ভাবি?!!! কান্না লুকিয়ে লাবণ্যর জবাব, কই! না তো। আসলে চোখে কি যেন পরছিল তাই…..(….)…..????
তাই চোখ থেকে গড়িয়ে অশ্রু পরছে। আর সেই সব অশ্রুকণা দিয়ে বইয়ের পাতা ভিঁজে একাকার, সাথে চোখ দুটোও ফুলে তালগাছ হয়ে গেছে। এইসব তুমি বললে, আর আমি বিশ্বাস করে নিব তাই না?
লাবণ্য শিশিরের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। লাবণ্যর চোখ থেকে এখনো একটু একটু করে অশ্রু ঝরছে। শিশির সেটা লক্ষ করেছে। আর তাইতো লাবণ্যর মুখটা ওর দিকে ফিরিয়ে নেই আবারো। দু’গাল গড়িয়ে পরা জলটুকু মুছে দিয়ে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে তোমার? বলবা না আমাকে? আমাকে না তুমি তোমার বোনের মত দেখো। এই তার নমুনা? শিশিরের দিকে তাকিয়েই লাবণ্য কেঁদে দেয়। অনর্গল বলতে শুরু করে, আমি ওকে ভালোবাসি না, একদম না। আমি তো শুধু এমনিই দেখা করতে বলছিলাম। আর ও কি না মিটিমিটি হাসছিল আমার কথা শুনে। আচ্ছা, তুমিই বলো শিশির আমি কি জোকার? আমাকে কি তোমার জোকার মনে হয়? শিশির টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, নাহ! একদম না। আমার ভাবি কেন জোকার হবে? জোকার তো ঐ ব্যাটা যে আমার ভাবিকে জোকার বলে। কাঁদায়। লাবণ্য টেবিল থেকে উঠে গিয়ে গম্ভীর হয়ে খাটে বসে। লাবণ্যর ঠিক পাশে গিয়ে শিশিরও বসে। শিশির মুচকি হেসে বলে, তারপর কি হয়েছে ভাবি? লাবণ্য কিছু একটা বলতে গিয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে। মেজাজটা চরম পর্যায়ে উঠে যায় ওর। রাগে অভিমানে রুম ত্যাগ করে ও। লাবণ্য চলে যাওয়ার পর ভাইকে কল দেয় শিশির। ভাই বোনে মিলে অট্টহাসিতে মেতে উঠে।
হুহ, আমাকে কি মনে করে? ছেঁড়া পলিথিন? আমার কোনো’ই মূল্য নেই? সব মূল্য শুধু ওনার’ই? হুহ! খুব প্রায়োরিটি দেই তো, তাই এতো উপরে উঠে গেছে। উপর থেকে যে কিভাবে নামাতে হয় সেটা আমি জানি। কল দিব না আর ওকে। এই ফোনটা অফ করে আলমারিতে রাখলাম। আগামী ৩০দিনে ফোন হাতে নিব না।
মনে মনে জটিল প্রতিজ্ঞা করে লাবণ্য নিজেই নিজের সাথে। ফোনটা আলমারিতে রাখছে বিকেল ৫টা নাগাদ। এখন ৬টা বেজে ১৯মিনিট। এরই ভিতর বার কয়েক আলমারির কাছে গিয়েও কি মনে করে যেন ফিরে এসেছে লাবণ্য।
সন্ধ্যা ৭টা। খুলবে না খুলবে না করেও অবশেষে খুলেই ফেলে আলমারিটা। ফোন হাতে নিয়ে ওপেন করে চাতকের ন্যায় ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে লাবণ্য। কিন্তু কোনো কল বা এসএমএস আসেনি। ফোনটা বন্ধ করে আবারো আলমারির ভিতর রেখে দেয়। এবার মনে মনে এই বলে রাখে, যত যায় হোক ফোনে আর হাত দিবে না। ফোন আলমারিতে রেখে কিছুক্ষণ পর পর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে লাবণ্য। কোনো রকম ২০মিনিট চুপসে থেকে সন্ধ্যে ৭টা ২১মিনিটে আলমারিটা আবারো খুলে। ফোনে হাত দিবে না দিবে না করেও দিয়ে ফেলে। তারপর ওপেন করে হাতে নিয়ে চাতকের ন্যায় একটা ফোন কলের আশায় বসে আছে। রাত্রি ১১টা। শুভ্রর ফোনটা বেজে উঠে। ভাব নিয়ে হ্যালো বলে শুভ্রর প্রশ্ন- কিছু বলবে? নরম স্বরে লাবণ্যর জবাব, খুব বিজি?
— সেরকম বিজি না।
লাবণ্য এবার কিছুটা উঁচু কন্ঠে বলে, কালকে কয়টায় হসপিটালে যাবেন? শুভ্র ভেবে বলে, প্রতিদিনই তো ৯টায় যায়, কিন্তু কালকে একটু জলদিই যেতে হবে। একটু দরকার আছে। লাবণ্য একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, তারপর কখন ফ্রি হবেন? শুভ্র কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলে, ফ্রি বলতে লাঞ্চ টাইমে যতটুকু সময় পাই আর কি।
এবার কন্ঠ কিছুটা নীচু করে লাবণ্যর প্রশ্ন, রাত্রিতে তো আপনি ফ্রি’ই থাকেন। আমি রাত্রে আপনার সাথে দেখা করতে চাই যদি আপনি চান….
– আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার কষ্ট করতে হবে না। আপনি আসব কালকে। তুমি প্রস্তুত থেকো। পরে কথা হবে। এখন রাখি। টেইক কেয়ার। শুভ রাত্রি।
কল কেটে দিয়ে শুভ্র হো, হো করে হেসে উঠল। হাসি দেখে মনে হবে যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে সে।
বিছানার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গড়াগড়ি করতে করতে বালিশ বুকে নিয়ে একটা সময় ঘুমিয়ে পরে শুভ্র।
পরদিন__
লাবণ্যর সময় যেন কাটছে’ই না। কখন রাত্রি হবে, আর কখন শুভ্র আসবে। ওর শুভ্রকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। সারাটা দিন বহুকষ্টে কাটল লাবণ্যর। কখনো খাটে বসে, কখনো শুয়ে, কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, কখনো বারান্দায় গিয়ে, কখনো ছাদে, কখনো বা টিভির সামনে বসে থেকে। সারাটা দিন এভাবেই কাটল লাবণ্যর। সন্ধ্যে ৮টা নাগাদ লাবণ্যকে নেওয়ার জন্য এ বাসায় আসে শুভ্র। বাসায় এসে মায়ের সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারল সেটা হলো, এই রাত্রের বেলা মা কিছুতেই ওর সঙ্গে লাবণ্যকে দিবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যেটা সেটা হলো, রোকসানা বেগম এখনো ছেলের প্রতি প্রচন্ড রেগে। আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার মেয়ে, আই মিন তোমার বান্ধবীর মেয়েকে তুমি সারাজীবন এভাবেই ঘরে বসিয়ে রেখো। অনেকটা রাগ দেখিয়ে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে শিশিরের রুমের দিকে পা বাড়াই শুভ্র। রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করে শুভ্র, আসতে পারি? ভিতর থেকে শিশিরের জবাব, এখানে এসে কি করবি? ছাদে চলে যা। ছাদে পাবি তোর মানুষকে…..
শুভ্র আর কোনো কথা না বলেই ছাদের দিকে পা বাড়াই। ছাদে পা দিতেই শুভ্রর মাথা ঘুরার উপক্রম। গোলাপী কালার শাড়ি পরিহিত, হাতে সেইম কালার চুড়ি, আর খোলা চুলে এক অপূর্ব সুন্দরী রমনী ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে। এহেম কাশি দিতেই পিছু ফিরে সুন্দরী রমনী। এ যে আর কেউ নয়। তারই লাবণ্য। চোখ ফেরাতে পারছে না ওর থেকে শুভ্র। শুভ্রর এমন পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকায় কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায় লাবণ্য। আমতা আমতা করে বলে,
” ইয়ে মানে ঘুরতে যাব ভাবছিলাম তো, তাই…….. (…..)….???
ঘোর কাটে শুভ্রর। মুচকি হেসে জবাব দেয়, শুধু কি ঘুরতে যাওয়ার জন্য’ই এ সাজ নাকি এর পিছনে বড় কোনো কারন আছে?
লাবণ্যর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তুতলিয়ে তুতলিয়ে বলে, কা কা কারন?
শুভ্র কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলে, হুম কা কা কারন কি? শুভ্রর কথায় লাবণ্য লজ্জা পেয়ে যায়। নাক মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলে আসলে শাঁড়িতে অভ্যস্ত নেই তো তাই….(…..)…..???
হা, হা। জীবনভর শুনে এসেছি শাঁড়িতে অভ্যস্ত না থাকলে মেয়েরা হোচট খেয়ে পরে যায়, প্যাঁচ লেগে পরে যায়। আজ এও শুনার ছিল? শাঁড়িতে অভ্যস্ত নাই বিধায় তুতল্লাচ্ছে। সাথে চোখ মুখ ফ্যাকাশেও হয়ে গেছে। থ্যাংক্স গড! আমাকে এখানে আসার তৌফিক দান করার জন্য। নতুন একটা অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। কথাগুলো বলে শুভ্র হাসছে, আর লাবণ্য লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র হাসি থামিয়ে লাবণ্যর কাছে যায়। তারপর ছোট্ট করে বলে, স্যরি! মজা করলাম একটু।
লাবণ্য তখনো কোনো কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। নিরবতা ভাঙার জন্য শুভ্র লাবণ্যের কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আস্তে করে বলে, tnx a lot….
মাথা তুলে তাকাই লাবণ্য। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে, কিসের থ্যাংক্স? শুভ্র মুচকি হেসে বলে, এই যে ঘুরতে যাওয়ার বাহানায় আমার জন্য শাঁড়িটা পরছ…..!!!!
লজ্জায় লাবণ্যর মুখ থেকে কথা সরছে না। এভাবে এত তাড়াতাড়ি ও ধরা খেয়ে যাবে বুঝতে পারেনি। যে লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য ঘুরতে যাওয়ার মিথ্যে অজুহাত দেখিয়েছিল ও, সেই লজ্জাটাই পেয়ে গেল। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে লাবণ্যর।
তোমার ঠোঁটগুলো খুব সুন্দর, আরো বেশী সুন্দর দেখায় যখন তুমি লজ্জা পাও। লাবণ্য! তুমি কি জানো তুমি লজ্জা পেলে তোমার নাক ঘামে, ঠোঁটগুলো কাঁপে। লাবণ্য যেন শুভ্রর বলা এক একটা কথায় লজ্জাবতী পাতার মতই একটু একটু করে চুপসে যাচ্ছে। লাবণ্যর সেই করুণ অবস্থার সুযোগটাই নিয়েছে শুভ্র। বার বার শুভ্র লাবণ্যকে একেক কথা দ্বারা খোঁচা দিচ্ছে। লাবণ্য না পারছে সেখান থেকে যেতে, না পারছে কিছু বলতে।
আচমকা শুভ্র লাবণ্যর একটা হাত ধরে ফেলে। কাঁপা দৃষ্টিতে লাবণ্য শুভ্রর দিকে তাকাই। শুভ্র মুচকি হেসে বলে, আমার সাথে রাগ করে হাতের আঙুল কি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছ নাকি?
ইয়ে, না, মানে আসলে….. আমি তো…..(….)……????
শুভ্র একগাল হেসে বলে, বুঝতে পারছি ইয়ে না মানে তুমি আসলে আমার কথায় লজ্জা পেয়েছ। আর তাই বোবার মত চুপসে শুধু একহাত দিয়ে আরেক হাতের আঙুল মুচড়াচ্ছিলে। তাই না?
লাবণ্য কোনো কথা না বলে নিরব থাকে।
নিরব দৃষ্টিতে ছাদের কর্ণারে দাঁড়িয়ে দুর, বহুদুর তাকিয়ে আছে। শুভ্র মুচকি হেসে লাবণ্যর পাশে দাঁড়িয়ে একটা হাত দিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ১৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম “অন্তরা”
লাবণ্যর সঙ্গে শুভ্রর কখনো সেভাবে চোখাচোখি হয়নি। শুভ্র যখনই লাবণ্যর চোখের দিকে তাকাতো, তখনই ও চোখ ফিরিয়ে নিত।
আবার শুভ্র যখন এদিক-ওদিক তাকাতো, তখন লাবণ্য শুভ্রর দুই চোখে বিচরণ করত। শুভ্র আড়চোখে দেখত। লাবণ্য কখনো কখনো ধরা পড়ে যেত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছালো ওরা। নদীর পাড়ে কোলাহল মুক্ত একটা জায়গায় গিয়ে বসল।
নদীর তীরে চুপচাপ বসে আছে একজোড়া কপোত-কপোতী। কারো মুখেই যেন কোনো কথা নেই, যদিও অনেক কথায় জমা আছে দু’জনের মনে।
পাশাপাশি বসলেও দুজনের মধ্যে বেশক্ষাণিক’টা দূরত্ব বজায় রাখা। শুভ্র চুপচাপ নদীর ঢেউগুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। আর লাবণ্য? লাবণ্য পলকহীন দৃষ্টিতে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও শুভ্রর দৃষ্টি নদীর দিকে তথাপি সে লাবণ্যর কৃর্তিকলাপ আড়চোখে লক্ষ্য করছে।
মনে মনে লাবণ্য শুভ্রকে একশ একটা গালি দিল। শয়তান একটা, খাটাশ একটা! ভদ্রতা দেখাতে আসছে। একটু কাছাকাছি বসলে কি এমন ক্ষতি হতো?
লাবণ্যর খুব ইচ্ছে হচ্ছে শুভ্রর পাশে বসে ওর কাঁধে মাথা রাখতে। কিন্তু তাতো আর সম্ভব নয়! আচ্ছা, কাঁধে মাথা নাইবা রাখলাম হাতটা তো ধরতে পারি। মনের এই ছোট্ট চাওয়ার প্রাধান্য তো দেওয়াই যায়।
লাবণ্য দুর থেকেই শুভ্রর হাতের দিকে ওর একটা হাত বাড়িয়ে দিল। কাঁপা, কাঁপা দুটি হাত শুভ্রর হাতের খুব কাছে নিয়ে গেলেও রাখতে পারল না। লাবণ্য ওর হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে এসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুর অজানার দিকে।
আড়চোখে এতক্ষণ সব লক্ষ্য করছিল শুভ্র। এইমুহূর্তে লাবণ্যর মনটা যে খুব বেশী ভালো নয় সেটাও বুঝতে পেরে গেছে সে। তাইতো দুর থেকেই শুভ্র ওর একটা হাত লাবণ্যর হাতের উপর রাখে। মৃদু কেঁপে উঠে লাবণ্য হাতের দিকে তাকাই। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
মনে মনে হাসছে শুভ্র। মুখে কিছু না বলেই দুর থেকে লাবণ্যর অনেকটা কাছে, পাশাপাশি গাঁ ঘেষে বসে যায়। লাবণ্যর পুরো শরীর শিহরণ দিয়ে উঠে শুভ্র যখন শক্ত থেকে আরো শক্ত করে ওর হাতটা চেপে ধরে।
বেশকিছু ক্ষণ চুপ থাকার পর নিরবতা ভাঙ্গে শুভ্র। লাবণ্য, সুন্দর না জায়গাটা? লাবণ্য মৃদুস্বরে জবাব দেয়, হুম। লাবণ্য চলো আমরা ওপাশে গিয়ে বসি। শুভ্র লাবণ্যকে নিয়ে নদীর অপর পাশে চলে যায়।
সত্যিই জায়গাটা অনেক সুন্দর। নদীর ধারে ফুটন্ত কাশফুল সেই সৌন্দর্যকে আরো বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। জায়গাটা এতই সুন্দর যে লাবণ্য বিমোহিত হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে লাবণ্য প্রজাপতির পিছনে দৌঁড়াচ্ছে আর তাকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শুভ্র সেই মুহূর্তকে তার কাছে থাকা গোপন ক্যামেরা’ই বন্দি করে ফেলে।
সারাটা দিন এভাবেই কেটে যায়। কখনো নৌকায় চড়ে, কখনো বা নদীর আশেপাশের সৌন্দর্য দেখে। এক ফাঁকে দুপুরের খাবারটাও খেয়ে নেয় ওরা পার্শ্ববর্তী হোটেল থেকে। বিকেল হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে চায় লাবণ্য। শুভ্র রিকশায় করে লাবণ্যকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। যাবার সময়ও দু’জন বেশ চুপচাপ। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। নিশ্চুপ লাবণ্যর ইচ্ছে হচ্ছিল শুভ্র ওর হাতটা ধরুক, কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছে তো আর পূর্ণ হয় না। সেদিন লাবণ্যকে অবাক করে দিয়ে শুভ্র একহাতে লাবণ্যর দুটো হাত আলতু করে চেপে ধরে আরেকহাত দিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। লাবণ্যর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠে। ব্যাপারটা শুভ্রর নজর এড়ায় না।
লাবণ্যকে বাসার সামনে পৌঁছে দিয়ে শুভ্র রওয়ানা হয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। নিশ্চুপ লাবণ্য বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ভেঁজা চোখে শুভ্রর সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
লাবণ্য বরিশাল থেকে শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে ঢাকায় ফিরে আসছে একসপ্তাহ হলো,
এর ভিতরে একটা বারের জন্য শুভ্র ওকে কল দেয়নি। আজকাল খুব বেশী এড়িয়ে চলছেন ওনি আমাকে। আগের মত কলও দেই না। বোধ হয় সময়ের সাথে সাথে আমার প্রতি টানটাও কমে গেছে। ধূর! কি ভাবছি এসব? ওনি তো ব্যস্তও থাকতে পারেন। আর তাছাড়া কিসের টানের কথা বলছি আমি? কোন সম্পর্কের টানে ওনি আমার কাছে আসবেন? আমাদের মধ্যে আদৌ কি কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে? লাবণ্য নিজের মাথায় নিজেই আঘাত করে এই ভেবে যে, ধূর!কি ভাবছি এসব?
সেদিন সারা রাত্রি বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে লাবণ্য। হাজার চেষ্টা করেও কেন ঘুমাতে পারছিল না। বার বার হৃদয়ের ক্যানভাসে শুধু একটি নাম ভেসে উঠে, সে শুভ্র। তবুও লাবণ্য নিজে নিজেকে এই বলে বাঁধা দেয় যে, না, না! এ হতে পারে না। আমি ওর বন্ধু। স্রেফ বন্ধু হয়েই থাকতে চাই।
সকাল সকাল লাবণ্য কলেজের দিকে রওয়ানা হয়। উদ্দেশ্য একটাই আর সেটা হলো মাস্টার্সে ভর্তির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কলেজে জমা দিয়ে আসা। কলেজ থেকে আসবার কালে লাবণ্য ওর শ্বশুরের পরিচিত একটা দোকানে যায়। কয়দিন আগে একটা ফোন দেখে গিয়েছিল লাবণ্য, আজ আসছে সেই ফোনটা নিতে। অনেক কষ্টে, শ্বশুর শাশুড়ির দেওয়া টাকা থেকে কিছু কিছু জমিয়ে আজ এসেছে ফোনটা কিনতে। যদিও ওর শ্বশুর বলে দিয়েছে, ওর পছন্দমত সেট নিতে। টাকা ওনিই দিবে। কিন্তু লাবণ্য ওর জমানো টাকার মধ্যেই একটা ফোন কিনল। সাথে একটা সিমকার্ড। রিচার্জ করে নিয়েছে ১০০টাকা। ফোন হাতে পেয়ে লাবণ্যর খুশি আর দেখে কে? খুশিতে আত্মহারা লাবণ্য মনে মনে ভাবছে, যাক! এখন আমার যখন ইচ্ছে তখন’ই শুভ্রকে কল দিতে পারব। ওর সাথে কথা বলতে পারব। দোকান থেকে বেরিয়ে পরম খুশি মনে শুভ্র লাবণ্যকে কল দেয়। ব্যস্ত শুভ্র ব্যস্ততার মাঝেও কল রিসিভ করে। কানে নিয়ে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে লাবণ্য লম্বা করে সালাম দেই। সালামের জবাব জানিয়ে কুশল বিনিময় করে শুভ্র। সবকিছুর জবাবই আজ লাবণ্য হেসে হেসে দিয়েছে।
কি ব্যাপার? আজ ম্যাডামকে এত খুশি খুশি লাগছে? শুভ্রর এই কথায় লাবণ্য কোনো জবাব দেয় না। শুধু বোকার মত একটা হাসি দিল। এদিকে রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যস্ত শুভ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে, আচ্ছা! আমি পরে কথা বলছি, এখন ব্যস্ত আছি। লাবণ্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয় শুভ্র। হাসিমুখটা নিমিষেই কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। গুমড়া মুখে বাসায় ফিরে যায় লাবণ্য।
ওহ, নিজেকে কি মনে করে? বোম্বের নায়ক? হুহ, আমি ওকে কল’ই দিব না। রাগে দুঃখে ফোনটা বন্ধ করে রাখে লাবণ্য। এদিকে শুভ্র? সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাসায় এসে রান্না করে খেয়ে’ই বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেয়। একে তো ক্লান্ত শরীর, তারউপর সেই ক্লান্ত শরীরে এসে রান্না করে খাওয়া। নিদ্রাদেবী চোখে তাড়াতাড়িই ভর করে। আর শুভ্র তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।
লাবণ্য ফোন বন্ধ করেছে দুপুরের দিকে। এখন রাত্রি ৯টা বাজে। আচ্ছা, ওনি তো এখনো মায়ের ফোনে কল দিচ্ছে না। তবে কি ওনি আমার নাম্বারেই শুধু ট্রাই করছে। আচ্ছা, আমার নাম্বারে কল দিয়ে ওতো ফোন বন্ধ পেয়েছে। তারপর কি ও কল দিয়েছিল? কল দিলে তো তখনো নাম্বার বন্ধ পেয়েছে। বন্ধ পেয়ে কি ওনি চিন্তিত হয়ে পরেছিল? আমায় মেসেজের পর মেসেজ দিয়েছিল? ইস! আমি তো মনে হচ্ছে আজকে ব্যাটাকে জব্দ করে দিয়েছে। এখন তো মনে হয় ওনার অবস্থা নাজেহাল। নিশ্চয় কান্না করে করে শেষ? খুশিতে লাফিয়ে উঠে বিছানায় উঠে বসে লাবণ্য। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা এনে চালু করে সেটা। পরম কৌতূহলের সাথে স্ক্রিনে মেসেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে আছে লাবণ্য। ৫মিনিট হয়ে গেল, এখনো একটাও মেসেজ আসছে না। আচ্ছা, তবে কি ওনি একটা মেসেজও দেয়নি? না, না! এ হতে পারে না। ওনি নিশ্চয় এসএমএস দিয়েছে। হয়তো নেট প্রবলেমের কারনে এসএমএস আসছে না। লাবণ্য বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ফোন হাতে রুমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো কখনো ফোনটা উপরের দিকে তুলছে নেটের জন্য। মনে মনে হাজারটা বকাও দিয়ে দিয়েছে অলরেডি গ্রামীণফোনের নেটকে।
গালি দিতে দিতে বারান্দায় চলে যায় লাবণ্য। সেখানে গিয়েও ফোনটা মাথার উপর নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছে। তখনই রিংটনের আওয়াজ হয়। খুশিতে লাফিয়ে উঠে ফোন রিসিভ করে উৎকন্ঠার সাথে বলে, হ্যাঁলো….
ওপাশ থেকে ভেসে আসে এক মধ্য বয়স্ক লোকের কন্ঠ। “মা” এত রাত্রে বারান্দায় কি করো? লাবণ্যর হাসোজ্জল মুখটা মলিন হয়ে যায় শ্বশুরের কন্ঠ শুনে। ওর কিছু বলার আগেই শ্বশুর বলে উঠো, এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ ফোনে তোমার সম্পূর্ণ নেট আছে! যাও এবার নিশ্চিন্তে রুমে যাও। কল/মেসেজ দিলে রুমেও আসবে। জি, বাবা…. বলেই কলটা কেটে দেয় লাবণ্য।
আমি এখানে মাথার উপর ফোন ঘুরাচ্ছি, এটা নিশ্চয় বাবা দেখে গেছে। ইস! কি লজ্জা! সব’ই ঐ ব্যাটা হারামির জন্য। মনে মনে একশ একটা গালি দিল লাবণ্য শুভ্রকে। তারপর রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরল।
ভোরে ঘুম ভাঙ্গে লাবণ্য। ঘুম চোখে ফোনটা চোখের সামনে এনে দেখে কোনো কল আসছে কি না ফোনে। একটাও কল এসএমএস আসেনি দেখে মুখটা কালো হয়ে যায় ওর। ফোনটা বিছানায়া রেখে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজ আদায় করে নেয় লাবণ্য। নামাজটা কোনো মতে শেষ করেই দৌঁড়ে আসে ফোনের কাছে। নাহ, একটাও কল আসল না। ওনি বোধ হয় আমায় ভুলেই গেছে। ওনি বোধ হয় আমাকে আর কল দিবে না। এসব ভেবে ভেবেও লাবণ্য বার বার ফোনের দিকে চাতকের ন্যায় শুভ্রর ফোন আসার প্রতিক্ষায়। সারাদিন গেল। শুভ্র একটা বারও কল দিল না। রাত্রিতে সাত, পাঁচ ভেবে লাবণ্য নিজেই কল দিয়ে ফেলে। ২,৩বার কল বেজে যাওয়ার পর রিসিভ করে শুভ্র।
– হ্যাঁলো…..
এপাশে লাবণ্য নিশ্চুপ……
– হ্যাঁলো, কে বলছেন?
লাবণ্য তখনো নিশ্চুপ………..
– হ্যাঁলো, কথা বলুন……….
এভাবে মানুষ, মানুষকে পর করে দেয়, সেটা আপনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
– ওহ, লাবণ্য তুমি? এটা তোমার নতুন ফোন নাকি?
শুভ্রর প্রশ্নে লাবণ্য অভিমানী স্বরে বলে, থাক! চিনতে হবে না আর। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ। রাগ দেখিয়ে কল কেটে দিয়ে লাবণ্য নিজেই বোকা হয়ে গেছে, ভাবছিল শুভ্র কল ব্যাক করে ওর রাগ ভাঙাবে। কিন্তু তা আর হলো কই? উল্টো ওকে শুভ্রর ফোনের প্রতিক্ষায় সারা রাত ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হলো। সকালের দিকে লাবণ্য শুভ্রকে কল দেয়। ঘুম চোখে শুভ্র কল রিসিভ করে। হ্যাঁ, বলো লাবণ্য। লাবণ্য কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে ইয়ে মানে বলছিলাম কি আপনি কি আজকে ফ্রি আছেন? শুভ্র বিছানায় উঠে বসে, কোনোরকম হাসি আটকিয়ে বলে হুম, কেন? লাবণ্য নিচু গলায় বলে, আমরা কি আজকে দেখা করতে পারি? হাসি আটকিয়ে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে শুভ্রর জবাব, দেখা করাটা খুব কি বেশী দরকার? মানে আজকে তো অফ ডে, আমার একটু ঘুমাতে হবে আর কি। কথাটা বলে জিহ্বায় কামড় দেয় শুভ্র। লাবণ্য কি বলবে বুঝতে পারতেছে না। আসলে এ প্রশ্নের উত্তর কি হওয়া উচিৎ ওর নিজেরও জানা নেই। তবুও বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করে বলল, ওহ! আচ্ছা। সমস্যা নাই। আপনি ঘুমান। ঘুম না আসলে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমান। তবুও ঘুমান। আসতে হবে না আপনার। কথাগুলো একনিশ্বাসে বলে কলটা কেটে ফোনটা বন্ধ করে ফেলে লাবণ্য।
ইতোমধ্যে’ই ইনজেকশনটা দেওয়া শেষ। এই মুহূর্তে শুভ্র লাবণ্যর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য এখনো দু’চোখ বন্ধ করে মুখটা বাচ্চাদের মত করে আছে। নিশ্চুপ শুভ্র একবার লাবণ্যর মুখের দিকে তো আরেকবার ওর কাঁধের দিকে তাকাচ্ছে। বেশ ক্ষাণিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর চোখ খুলে লাবণ্য। চোখাচোখি হয় দু’জনের। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুটা সময় একজনের আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ চোখ যায় শুভ্রর কাঁধের দিকে। লাবণ্য তাড়াতাড়ি হাতটা নিয়ে আসে কাঁধ থেকে। শুভ্রর থেকে চোখ সরিয়ে অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে লাবণ্য। শুভ্রও কোনো কথা না বলে অনেকক্ষণ লাবণ্যর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
মিনিট পাঁচেক পর নিরবতা ভেঙে মুখ খুলে শুভ্র। প্রশ্ন করে লাবণ্যকে, কেন এমনটি করেছ? লাবণ্য বুঝেও না বুঝার ভান করে অনেকটা দুরে সরে যায়। লাবণ্যর সাথে সাথে শুভ্রও দাঁড়িয়ে পরে। লাবণ্যর দু’বাহু ধরে মুখটা শুভ্র ওর নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। তারপর আবারো প্রশ্ন করে, কি হলো? বলছ না যে? কেন কেঁটেছ হাত? চুপ করে থেকো না, উত্তর দাও। লাবণ্য বিষণ্ন মনে শুভ্রর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নেয়। শুভ্র চেঁচিয়ে বলে উঠে, চোখ সরিয়ে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না লাবণ্য। লাবণ্য শুভ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দুরে সরে গিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলে, আমি হাত কাটিনি, অসাবধানতায় কেটে গেছে। শুভ্র লাবণ্যর দু’বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলে, তবে চোখ কেন ফিরিয়ে নিয়েছ তুমি? কেন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতেছ না? তুমি কি ভেবেছ? আমি কিচ্ছু বুঝি না? কিচ্ছু না?!!! আরে এতটা বোকা আমি নয়, যতটা তুমি ভেবেছ। আমায় তুমি ভালোবাসো এটা তোমার মুখ নয়, তোমার চোখ জানান দিচ্ছে। অনুভূতিগুলো যতই লুকানোর চেষ্টা করো না কেন, তোমার এই চোখের ভাষা কিন্তু আমি ঠিক পড়ে নিয়েছি। তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো সেটা তোমার চোখ দেখেই বুঝে গেছি। লাবণ্য অসহায় চোখে একবার শুভ্রর দিকে তাকালো, তারপর ওর দু’বাহু থেকে শুভ্রর হাত দুইটা সরিয়ে নিয়ে ক্ষাণিকটা দুরে গিয়ে দাঁড়ায়।
হা, হা, হা…..
দুরে দাঁড়িয়ে’ই শুভ্র হেসে উঠে। তারপর লাবণ্যর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, শুনো! তুমি শুধু আমার থেকে এতটুকু দুরেই যেতে পারবা, এর চেয়ে বেশী নয়। কি মনে করেছ তুমি? দুরে গেলেই আমি তোমাকে দুরে যেতে দিব? ভালোবাসি তোমাকে। বড্ড বেশী ভালোবাসি। কি করে আমি সে ভালোবাসার মানুষটাকে দুরে সরে যেতে দেই, বলো? আর লাবণ্য! আমি তো তোমাকে স্যরি বলেছি, আমার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছি, ভুল স্বীকার করেছি। তবুও কেন তুমি আমার থেকে এভাবে দুরে দুরে থাকতেছ? লাবণ্য চোখ মুখ শক্ত করে বলে, কারন আপনি ভালোবাসলেও আমি আপনাকে ভালোবাসি না। ভালোবাসতে পারব না? শুভ্র লাবণ্যর দু’বাহু ধরে বলে, কেন ভালোবাসতে পারবে না? লাবণ্য আবারো ওর বাহুদ্বয় থেকে শুভ্রর হাতটা সরিয়ে নেয়। তারপর কিছুটা সামনে এগিয়ে বলে, কারন- আমার সব অনুভূতিগুলো অনেক আগেই ভোতা হয়ে গেছে। আমি আর এখন ভালোবাসতে পারব না আপনাকে। শুভ্র দু’হাত দিয়ে লাবণ্যর একটা হাত আকড়ে ধরে বলে, প্লিজ লাবণ্য! এমন করো না। বললাম তো আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও লাবণ্য। প্লিজ, আমায় একটা বার তোমায় ভালোবাসার সুযোগ করে দাও। লাবণ্য হ্যাচকা টানে ওর হাতটা সরিয়ে নেয় শুভ্রর থেকে। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, হুহ! ভালোবাসা? সেতো কবে’ই গলে পঁচে গেছে। আমার অনুভূতিগুলো মরা বকুলের মতো শুকিয়ে শেষ হয়ে গেছে। শুভ্র লাবণ্যর দিকে একধাপ এগিয়ে বিনয়ী স্বরে বলে উঠে, আমাকে আর একটা সুযোগ দাও না প্লিজ? লাবণ্য কিছুটা পিছুহটে পূর্বের ন্যায় গম্ভীর কন্ঠে বলে- ঝরা ফুল, যার পাপড়িগুলো শুকিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, যার সুভাস প্রায় নেই বললেই চলে; আপনি পারবেন সে ফুল দিয়ে মালা গাঁথতে? শুভ্র কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে, আমায় একটা সুযোগ দাও লাবণ্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাতের কালো অন্ধকার কেটে গিয়ে আমাদের জীবনেও একদিন সোনালী আলোর রেখা উঁকি দিবে। এর জন্য দরকার তোমার একটু বিশ্বাস। লাবণ্য প্লিজ তুমি আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখো। লাবণ্য ক্ষাণিকটা দুরে সরে গিয়ে বলে, পারব না। যে ভুল একবার করছি, সে ভুল দ্বিত্বীয় বার করে আমি আমার জীবনটাকে এভাবে নিজ হাতে শেষ করে দিতে পারব না। আমি আর বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চাই না। কোথায় আমি, আর কোথায় আপনি? লাবণ্য যেন শুভ্রর বলা কথাগুলো দিয়েই শুভ্রকে খোঁচা দিল। শুভ্র তবুও লাবণ্যকে বুঝালো। লাবণ্য বুঝতে চাইলো না। লাবণ্যর এক কথা, আগের মতো আবারো আপনি আমায় ভুল বুঝে তাড়িয়ে দিবেন। আর আমি? ঝরা ফুলের পাপড়ির মতো কিংবা পার্কে ছড়িয়ে থাকা বাদামের খোসার মতো পড়ে থাকব। লাবণ্যর কথায় শুভ্র অবাক হয়ে গেল এই ভেবে, ওহ! আমার প্রতি এই তাহলে তোমার বিশ্বাস?
একটু থেমে লাবণ্য আবার বলল, আমার প্রতি আপনার যত ভুল ছিল সব যদি দুর হয়ে গিয়ে থাকে, আমাকে যদি আপনার সত্যিই ভালো লাগে তাহলে আমাকে বন্ধু হিসেবে পেতে পারেন। তাতে না পাওয়ার বেদনা থাকবে না। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ও থাকবে না।
লাবণ্যর এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলার কাছে শুভ্র হেরে গেল। শুভ্রর অন্তরাত্মা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। তার পরও শুভ্র হাল ছাড়লো না।
ডাক্তারদের আবার ঈদ। কোনোরকম ঈদের দিনটা গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন’ই ঢাকার উদ্দেশ্যে একা একা রওয়ানা দেয় শুভ্র। আসার সময় লাবণ্যকে অনেক রিকোয়েস্ট করেছে ওর সাথে ওর বাসায় যাওয়ার জন্য কিন্তু লাবণ্য ওর সিদ্ধান্তে অটল। ও শুভ্রর বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। আর সেটা শুভ্রর সাথে নয়, শুভ্রর বাবা মায়ের সাথে ঢাকায় আলাদা বাসায়। শুভ্র লাবণ্যর কথায় মেনে নিল। প্রতি শুক্রবার লাবণ্যর সাথে দেখা করার জন্য শুভ্র ওর বাবা মায়ের বাসায় চলে আসত। তাছাড়া ওদের ইউনিয়নের কোনো ওয়ার্ডে রোগী দেখতে গেলেও শুভ্র দেখা করত লাবণ্যর সাথে।
লাবণ্যর নিজস্ব যে ফোন ছিল সেটা ভেঙে ফেলেছে। মায়ের ফোন দিয়ে লুকিয়ে লাবণ্য শুভ্রর সাথে কথা বলত। তবে সেই কথাটা প্রতিদিন নয়, মাঝেমধ্যে হতো।
কথা বলার ফাঁকে শুভ্র বুঝতে পারল, লাবণ্যর মনে ওর প্রতি যে অভিমানের পাহাড় ছিল, সেটা একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে। লাবণ্য ওকে নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছে।
শুভ্র ওকে একটা ফোন কিনে দিতে চাইল। কিন্তু লাবণ্য পড়াশুনার ক্ষতি হবে ভেবে নিতে চাইল না।
কেটে যায় আরো একটা বছর। এরই মাঝে লাবণ্যর অনার্স কমপ্লিট হয়ে যায়। শুভ্র একদিন ঠিক করলো লাবণ্যকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। বিশেষ কারনে লাবণ্যর শশুর শাশুড়ি সেদিন বরিশাল গিয়েছিল লাবণ্যকে সাথে নিয়ে। পাগল শুভ্রও সেখানে ছুটে যায় প্রিয়তমার সাথে দেখা করার জন্য। লুকিয়ে দেখা করল প্রাণের প্রিয়ার সাথে। তারপর রিকশায় চেপে দু’জন রওয়ানা দিল একটা স্টিমার ঘাটের দিকে।
রিকশায় বসে লাবণ্যর একটা হাত ধরলো শুভ্র। লাবণ্য ছাড়িয়ে নিতে চাইল। কিন্তু পারল না।
কখন যেন হাত দুটির উপর লাবণ্যর আরেকটি হাত এসে ভর করল। শুভ্র লক্ষ্য করল, লাবণ্যর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে আরো খেয়াল করল, ওর হাতের মধ্যে রাখা লাবণ্যর হাত দুটো মৃদু কাঁপছে।
লাবণ্য একটু একটু করে পিছনে যাচ্ছে আর শুভ্র একটু একটু করে সেদিকেই এগুচ্ছে। এ ঘটনা সুমন- নাইমা এবং হিমেল- লামিয়ার চোখও এড়ায় না। পলাশ মৌরির সাথে সাথে ওদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে দুই,দু’জোড়া কপোত কপোতী তাকিয়ে আছে। এসব কিছুই টের পায়নি শুভ্র। খাবার টেবিল থেকে আচমকা এহেম বলে একটা মেকি কাশি দিয়ে উঠে পলাশ। লাবণ্য কাঁপা দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। হায় আল্লাহ! ওনারা এভাবে তাকিয়ে আছেন। ইস! কি লজ্জা…..
ভাসুরা’রা এবং ওনাদের বউদের সামনে এভাবে ধরা খেলাম! আমার তো লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। একহাতে লাবণ্য শুভ্রকে ধাক্কা দেয়। ধাক্কা খেয়ে লাবণ্যর থেকে সরতে যাওয়ার সময় শুভ্রর কনুই থেকে কনুইয়ের নিচ থেকে গায়ে জড়ানো তোয়ালে’টা সরে যায়। মুহূর্তেই ব্যান্ডেজে জড়ানো হাতটা সকলের চোখে পরে।
চোখ বড় বড় করে-
” ওরে আল্লাহ! তোর হাতের এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে তোর? এক্সিডেন্ট’টা হলো কিভাবে? কখন এ অবস্থা হইছে? আল্লাহ, শুভ্র এ অবস্থা কিভাবে করছ? আম্মা জানে? একটু দেখে কাজ করতে পারো না?”
পলাশ আর লাবণ্য বাদে উপস্থিত সকলে শুভ্রর দিকে একঝাক প্রশ্ন ছুড়ে দেই। নিশ্চুপ শুভ্র মাথা নিচু করে আছে। কি করে বলবে এসব? হাজার হোক ওরা তো বড় ভাই ভাবি। ওদের সামনে কিভাবে লাবণ্যর কথা বলে। ওকে ছোট করে? সবচেয়ে বড় কথা ঘরের খবর বাইরে যাক এটা শুভ্র চাচ্ছে না। চাচ্ছে না এ নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক। আর তাই চাচ্ছে না বলেই শুভ্র ওর ভাইদের দিকে তাকিয়ে বলে, সে কিছু না! একটু কেটেছে। বাদ দাও তো তোমরা! শুভ্রর ভাই ভাবি খাবার রেখে শুভ্রর পাশে এসে ঝেকে বসল। ওহ গড! এত্তখানি জায়গা জোড়ে ব্যান্ডেজ আর তুই বলছিস কিচ্ছু হয়নি? শুভ্র ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে বলে, কেবল ব্যান্ডেজ করে ফিরছি। ছাড়ো তো, ব্যাথা পাচ্ছি। পাশ থেকে পলাশ বলে উঠে, সে তো পাবে’ই। বলছিলাম না ডাক্তার কিছু ঔষধ দিবে সেগুলো নিয়ে আসতে! আনিস নি, ভালো হয়ে যাবি বলে চলে আসলি। এখন কি? ব্যাথা সেরে গেছে, তাই না? শুভ্রর কাছ থেকে সরে এবার সবাই পলাশের দিকে আসলো। ” পলাশ! তুই জানিস কি হয়ছে?”
পলাশ শুভ্রর দিকে একনজর তাকাই। শুভ্র তখন মাথা নাড়িয়ে ইশারা করতেছে যাতে না বলে। কিন্তু পলাশ?!!! মুচকি হাসি দিয়ে গড়গড় করে বলা শুরু করে,
” আমাদের শুভ্র বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল, ভাইয়া- ভাবি! গড়াগড়ি’টা এতটাই বেশী হয়ে গেছে যে খাট থেকে’ই ধপাস করে পরে গেছে। আমরা যে জিনিসগুলো বড় আম্মাকে দিয়ে এসেছি, মানে দা, বটি,ছুড়ি ঐগুলো কাকিমা ফ্লোরে রেখেছিল। দূর্ভাগ্যক্রমে আমাদের ভাইটা সেখানেই গিয়ে গড়িয়ে পরেছে। এই আর কি…..”
সকলের দৃষ্টি তখন লাবণ্যর দিকে। লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল সবাই।
” গড়াগড়ির আর সময় পাইলা না। ফজরের নামাজের সময় গেছো বিছানায় গড়াগড়ি করতে, কথাটা বলেই একটা রহস্যজনক হাসি দিল শুভ্রর দুই ভাবি।”
পলাশ ভাবিদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিপ্পনী কাটলো, আরে ভাবি’রা! বুঝো না কেন? এখন সময় ভালো…..!
পলাশের কথায় আর সবাই হো, হো করে হেসে উঠল। লজ্জায় কষ্টে লাবণ্যর চোখ’জোড়া ছলছল করে উঠল। লজ্জা পাচ্ছে ভাসুর বউ মানে ভাবিদের টিপ্পনী শুনে, আর কষ্ট হচ্ছে খাট থেকে ও নিজেই তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে! আর ওর কারনে আজকে শুভ্র এতটা কষ্ট পাচ্ছে। ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে লাবণ্য। আজ যেন চোখের জলও বাধ মানছে না। অঝোরে গড়িয়ে পরছে চোখ থেকে অশ্রকণারা। অজস্র জলকণারা ভীড় করছে লাবণ্যর নেত্রকোণে। খাবার সামনে থেকেও কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না লাবণ্য। চোখ দুটো যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। হাতধূয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে যায় লাবণ্য। ভাসুর বউরা চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে, সেকি লাবণ্য! ঝালমুখ না করেই চলে যাবে? লাবণ্য মাথা নাড়িয়ে কিছু একটা বলল, যেটা কেউ বুঝতে পারল না। কিচেনে চাচী শাশুড়িকে কিছু একটা বলে বিদায় নিল লাবণ্য।
” কিরে! তোর বউ আবার কি হলো?”
হিমেলের প্রশ্নে শুভ্রর জবাব, হয়তো পেট ভরে গেছে হিমেল ভাই।”
পাশ থেকে সুমন বলে উঠে,
” পেট ভরে গেছে নাকি নাইমা, লামিয়া ভাবির কথা শুনে কিছু মনে করল?”
শুভ্র জোর গলায় বলে উঠে, কি যে বলো না সুমন ভাই। ও এরকম মেয়ে না। লামিয়া বলে বলে উঠে, তাহলে কিরকম মেয়ে? শুভ্র ঢোক গিলে বলে, ভাবি! ওর একটু বেশী লজ্জা। সেখানে ভাসুরদের সামনে রেখে এভাবে মজা করছ, তাই বোধ হয় লজ্জা পেয়ে চলে গেছে। পলাশ শুভ্রর কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠে, হ্যাঁ ভাবি! সেটাই। দেখো নি খাবার সময় কেমন পেছন দিকে যাচ্ছিল? স্মিতহাস্যে নাইমার জবাব, পেছনে যাবে না? তোমার ভাই লাখে একটা বলতে হয়। ঘরভর্তি মানুষ রেখেও খাবার সময় আসছে রোমাঞ্চ করতে। শুভ্র মাথা নিচু করে ফেলে। ” ইয়ে মানে আমি আসছি….”
সবাই হেসে উঠে শুভ্রর আমতা আমতা করে কথা বলা দেখে। সবাই যখন হাসাহাসিতে ব্যস্ত শুভ্র তখন কেটে পরে ঐ স্থান থেকে।
সকাল সাড়ে ৮টা। ঈদের নামাজের সময় গেছে। আশেপাশের ঈদগাহ ময়দানের মাইক থেকে সে স্বর’ই ভেসে আসছে। সমস্ত মুসলমান ভাইদের ঈদগাহে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান করা হচ্ছে। নতুন পাঞ্জাবী পাজামা গায়ে জড়িয়ে, কাঁধে জায়নামাজ’টা নিয়ে বাপ, চাচা, চাচাতো, জ্যাঠাতো ভাইদের সাথে এগিয়ে চলছে শুভ্র ঈদগাহের দিকে। বাড়ি থেকে বের হয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় ওরা। বাড়ির মুরুব্বী’রা যাচ্ছে বাড়ির কাছের নতুন ঈদগাহে আর ছেলেপিলেরা যাচ্ছে কিলোখানেক দুরে ওদের স্কুলের ঐ পুরনো ঈদগাহে। রাস্তায় গিয়ে পিছু ফিরে তাকায় শুভ্র। বিশাল জামগাছের আড়াল থেকে মুখ বের করে শুভ্রকে দেখছিল একজোড়া চোখ। শুভ্রর পিছনে তাকানো দেখে গাছের আড়ালে লুকিয়ে যায় মানুষটা।
” কিরে! বার বার পিছনে কি দেখছিস?”
কাজিনের প্রশ্নে সে কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে পথচলতে থাকে শুভ্র। ওরা সকাল ১১টা নাগাদ ঈদগাহ থেকে নামাজ এবং একটা ছোট্ট আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরল। ঈদগাহ থেকে বাড়ির ছেলেরা সরাসরি শুভ্রদের বাসায় চলে আসে। কারণ, ঈদগাহে যাওয়ার আগে বাড়ির মুরুব্বি বড় আম্মা মানে একমাত্র জ্যাঠিমা বলে দিয়েছে, নামাজ শেষে যেন এ বাসায় চলে আসা হয়।
আর সেই মতেই ওরা এখানে এসে উপস্থিত হলো। বাড়িতে পা রাখতেই শুভ্রর কানে ভেসে মায়ের কন্ঠ। কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে ভিষণ রেগে আছে। শুভ্র ওর কাজিনদের রুমে বসতে বলে কেইসটা কি জানার জন্য মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রুমে প্রবেশ করা মাত্র’ই আঁতকে উঠে শুভ্র। মায়ের রুমের বিছানার চাঁদরের অনেকাংশ ফোঁটা ফোঁটা রক্তে ভেঁজা। আর তার ঠিক পাশেই মাথা নিচু করে বসে আছে লাবণ্য। তারপাশেই ডাক্তারসহ ওর বাবা মা এবং বোন। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে শুভ্র,
শিশির! এত রক্ত কিসের এখানে? শিশির ভেঁজা গলায় বলে উঠে, ভাবি পেয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেঁটে ফেলেছে। শুভ্রর ভিতরটা মুচড় দিয়ে উঠে। চোখ চলে যায় লাবণ্যর হাতের দিকে। ডান হাতের ৪টা আঙ্গুল ব্যান্ডেজে জড়ানো। চোখ বড় বড় করে শুভ্রর প্রশ্ন, পেয়াজ কাটলে কারো এভাবে হাত কাটে? তুই আমাকে শিখাতে আসছিস? শিশির কাঁপা গলায় বলে, কিন্তু ভাবিতো পেয়াজ’ই কাটতেছিল……!
” কাটতেছিল কিন্তু পেয়াজ কাটায় হাতের এ অবস্থা হয়নি ওর। রক্ত দেখছিস? দেখে মনে হচ্ছে গরু জবাই করা হয়ছে এখানে।”
লাবণ্য তখনো মাথা নিচু করে চুপটি করে বসে আছে। শুভ্র অশ্রুভেঁজা চোখে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জানি লাবণ্য। তুমি পেয়াজ কেটে নয়, অন্যভাবে হাত কেটেছ।
দেখি বাপ! সরতো…..
ডাক্তারের কথায় হুশ হয় শুভ্রর। হাতে একটা ইনজেকশন নিয়ে ডাক্তার দাঁড়িয়ে। সেটা দেখে পথ সরে দাঁড়ায় শুভ্র। ডাক্তার কাকা লাবণ্যর দিকে ইনজেকশনের সিরিজ নিয়ে এগুতো থাকে। ভয়ে চিৎকার দিয়ে খাটের একপাশ থেকে মধ্যিখানে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে লাবণ্য। ডাক্তার একটা হাসি দিয়ে বলল, আরে মা! কিচ্ছু হবে না তোর। তুই খুঁজও পাবি না। আয়। এদিকে আয়….
লাবণ্য নিজেকে গুটিয়ে আরো জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে খাটের মধ্যিখানে। শুভ্রর বাবা বলল, লাবণ্য! এদিকে আসো। তুমি একটুও ব্যাথা পাইবা না। লাবণ্য চোখ বন্ধ করে বলতেছে, না বাবা! আমি পারব না। আমি ইনজেকশন দিব না। লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি, ডাক্তার চাচা, কারো কথা শুনেনি লাবণ্য। সেটা দেখে খাটে লাবণ্যর কাছে যায় শিশির। ভাবি! তোমার কিচ্ছু হবে না। ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই ভাবি। ইনজেকশনটা দিয়েই দেখো না ভাবি। মনে হবে যেন পিঁপড়া কামড় দিয়েছে। ব্যাস, এটুকুই। আর ব্যাথা পাবে না। লাবণ্য দাতে দাত চেঁপে বলল, বললাম তো আমি আমি দিব না ইনজেকশন। লাবণ্যর শাশুড়ি রাগে কটমট করে বলে উঠে, ” অনেক শিশির! আর না…
তুই উঠ ওখান থেকে। আর একে রুমে নিয়ে যা। এর যা ইচ্ছা তা করুক। সেসব আমার দেখার বিষয় না।”
শিশির ওর ভাবিকে নিয়ে রুমে চলে যায়।
” আসলে যেভাবে রক্তক্ষরন হয়েছে ইনজেকশনটা দেওয়া খুব জরুরী ছিল। এই বলে ব্যাগ গুছিয়ে ডাক্তার চলে যাচ্ছিল। শুভ্র পিছন থেকে ডাক দেয়, কাকা!
ডাক্তার দাঁড়িয়ে পরে। শুভ্র ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে, কাকা! ইনজেকশনটা আমার কাছে দিয়ে যান। আমি বুঝিয়ে শুনিয়ে এটা পুষ করে দিব। ডাক্তার শুভ্রর হাতে ইনজেকশনটা দিয়ে যায়। শুভ্রর মা কিচেনে চলে যায়। শুভ্র শিশিরের রুমের দিকে পা বাড়ায়। শুভ্র গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। ভাইকে দেখে শিশির রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ” ভাইয়া কিছু বলবি?”
শুভ্র লুকিয়ে রাখা ইনজেকশনের দিকে চোখ ইশারা করে। লাবণ্য সেটা দেখে মুচকি হাসে। শুভ্র জানায়, শিশির! ওরা সবাই খেতে আসছে। যা, মায়ের সাথে গিয়ে হেল্প কর। আমি আছি তোর ভাবির পাশে। মুচকি হেসে শিশির সেখান চলে যায়।
ইনজেকশনের সিরিজ হাতে পিছনে হাত রেখে রুমে প্রবেশ করে শুভ্র। শুভ্রকে দেখে কিছুটা ইজিলি বসে লাবণ্য। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, আহ্! বাঁচা গেল। ভোরের ঘটনাটার জন্য স্যরি বলার এখন’ই উপযুক্ত সময়। লাবণ্য খাটের মধ্যিখানে বসেই শুভ্রর দিকে তাকায়। তারপর নিচু স্বরে বলে, স্যরি…..
শুভ্র লাবণ্যর দিকে তাকায়। লাবণ্য ভেঁজা কন্ঠে বলে, আসলে আমি জানতাম না নিচে দা, বটি রাখা আছে। আমি সত্যি’ই দুঃখিত তখনকার ঘটনাটার জন্য। শুভ্র একটা অট্টহাসি দেয়। বোকার মত লাবণ্য শুভ্রর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি হলো?
শুভ্র নীচু স্বরে বলে, আরে বোকা মেয়ে! আমার তো কোনো হাত’ই কাটেনি। লাবণ্য চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে, মানে? শুভ্র ব্যান্ডেজে জড়ানো হাতটা লুকিয়ে অন্য হাত লাবণ্যর সামনে উপস্থাপন করে। এই দেখো। কিচ্ছু নেই। কোনো ব্যান্ডেজ নেই।
” আমি বিশ্বাস করি না বলেই লাবণ্য খাট থেকে নেমে শুভ্রর অন্য হাতের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর শরীর তোয়ালে টা ফেলে দেয়। শুভ্রর তখন পাঞ্জাবী গায়ে ছিল, তাই লাবণ্য ব্যান্ডেজ’টা দেখতে পায়নি। তবে যা দেখতে পায় তা দেখে ওর শরীরটা শিউরে উঠে। শুভ্রকে কিছু না বলেই দৌঁড়ে পালাতে চাচ্ছিল লাবণ্য। দরজার সামনে আড়ি পেতে ছিল শিশির। লাবণ্যর রুম থেকে বের হওয়ার আগেই দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয় শিশির। অট্টহাসিতে মেতে উঠে ডাক্তার শুভ্র। ইনজেকশন হাতে লাবণ্যর দিকে এগুতে থাকে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম লাবণ্যর। দেয়ালের সাথে একদম মিশে যায় সে। ধীরপায়ে শুভ্র সেদিকেই এগুচ্ছো। একটু একটু করে পৌঁছে যায় দরজার পাশে, লাবণ্যর কাছে। একহাত দিয়ে প্রাণপণে লাবণ্য শুভ্রকে দুরে সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু শুভ্রর সাথে কিছুতেই পেরে উঠতে পারছে না। চোখ দুটো বন্ধ করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠে লাবণ্য, আমি ইনজেকশন দিব না। তবুও আপনি কেন এমন করতেছেন আমার সাথে? কেন এভাবে আমার পিছু লেগেছেন? কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার? চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলছিল লাবণ্য। জবাবে শুভ্র বলে উঠে, ভুলিনি এখনো ভোরের ঘটনা। এখনো হাতটা ব্যাথা করতেছে। শুভ্রর এমন কথা শুনে চোখ মেলে তাকায় লাবণ্য। জল ছলছল চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে, স্যরি বলছি তো।
—- তাহলে ইনজেকশনটা দাও, স্যরি একসেপ্ট করব, প্রমিজ।
লাবণ্য শুভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে গায়ের জোর ছেড়ে দেয়। এইমুহূর্তে একদম ইজিলি দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্য। শুভ্র সেই সুযোগটাই কাজে লাগালো। জলদি ইনজেকশনটা রেডি করে লাবণ্যর দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে, তাহলে প্রস্তুত? লাবণ্য মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি জানায়। শুভ্র লাবণ্যর হাত ধরে খাটে নিয়ে বসায়। লাবণ্য তখনো শুভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে। ধারালো সুচ দেখে ঘোর কাটে লাবণ্যর। শুভ্র ততক্ষণে কাজ সেরে ফেলতেছে। একহাতে লাবণ্য শুভ্রর কাঁধের কাপড় চেপে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে।
কম্বলের ভিতর প্রবেশ করে আস্তে আস্তে শুভ্র ওর লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রর শীতল হাতের ছোঁয়ায় ঘুমের মাঝেই লাবণ্য ক্ষাণিকটা কেঁপে উঠে। লাবণ্যকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও কি মনে করে যেন ধরে নি। ঘুমের ঘোরে কম্বল’টা গাঁ থেকে ফেলে দিয়ে শুভ্রর বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে পরে লাবণ্য। শুভ্রর চোখে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। শীতের প্রকোপ ভুলে প্রেয়সীকে দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরে শুভ্র। হাতে ভর দিয়ে শুয়ে মাথা ক্ষাণিকটা উঁচু করে মুগ্ধ নয়নে শুভ্র তাকিয়ে আছে ওর প্রেয়সীর মুখপানে। লাবণ্য তখনো অঘোরে ঘুমুচ্ছে। শুভ্র দুষ্টু হাসি দিয়ে ওর হাতের শীতল পৃষ্ট’টা লাবণ্যর গালে ছুঁয়ায়। শীতে কেঁপে উঠে লাবণ্য শুভ্রমুখী হয়ে শুইলো। পূর্বের ন্যায় এখনো শুভ্র হাতে ভর দিয়ে প্রেয়সীকে দেখায় ব্যস্ত। মুগ্ধ শুভ্র কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর এগিয়ে যেতে থাকে লাবণ্যর দিকে। লাবণ্য তখনো ঘুমের ঘোরে। শুভ্র লাবণ্যর কাছ থেকে আরো কাছে চলে যায়। তারপর লাবণ্যর নাকে ঠান্ডা আঙ্গুল পরশ বুলিয়ে দেয়। লাবণ্য কেঁপে উঠে, ঘুমের মাঝেই শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে। মৃদু হেসে শুভ্র লাবণ্যকে ওর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। কপালে ভালোবাসার এক উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। লাবণ্যকে বুকে জড়িয়ে কল্পনার গভীরে হারিয়ে যায় শুভ্র। নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসে ওর। লাবণ্য জেগে উঠে। চোখ মেলে শুভ্রর বুকে এভাবে মুখগুজে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় লাবণ্য। একি! ওনি এখানে এভাবে? শিশির?! শিশির কোথায়? আমি তো শিশিরের সাথে ঘুমিয়েছিলাম। তবে কি রাত্রে ওনি শিশিরকে সরিয়ে…..(….)….???
না, না, এ হতে পারে না।
শুভ্রর কিছু বুঝে উঠার লাবণ্য শুভ্রকে খাট থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। বেচারা শুভ্রর হাত গিয়ে পরল ঐখানে, যেখানে কিছুক্ষণ আগে ওর কাজিনরা দা,বটি,ছুড়ি রেখে গেছে গরুর মাংস প্রস্তুত করা শেষে। ধারালো কিছুর সাথে হাত লেগে শুভ্রর হাতের অনেকটা কেঁটে যায়। শুভ্রর হাতে কোনো খেয়াল নেই। বেচারা শুভ্র তখনো লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা কি হলো সেটা বুঝার চেষ্টা করছে। লাবণ্য শুভ্রর দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, ” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ধাক্কা মেরেছি, ধাক্কা। আমি আপনাকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়েছি। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন বিষয়টা? প্লিজ এখন আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যান…..”
শুভ্র ওর কনুইয়ের দিকে তাকালো। ফুল হাতার শার্টের অনেকাংশে ইতিমধ্যে রক্ত ছড়িয়ে গেছে। শুভ্রর এতে বিন্দুমাত্র
কু-ক্ষেপ নেই। নিশ্চুপ শুভ্র নিজের কাটাস্থানের পরোয়া না করে লাবণ্যকে বুঝানোর জন্য উঠে দাঁড়ালো। লাবণ্যর চোখে মুখে বিরক্তির ছাঁপ সুস্পষ্ট। শুভ্র ওর দিকে এগুতোই একরাশ বিরক্তির স্বরে বলে উঠে লাবণ্য, আপনাকে আমি যতটা ভালো ভেবেছিলাম না, আপনি ঠিক ততটা ভালো নয়। আপনি আসলে একটা লু…… (…..)….???
শুভ্র কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে, হ্যাঁ! বলো আমি কি? লাবণ্য কিছুটা ভড়কে যায়। ঢোক গিলে বলে উঠে, আ আ আপনি এভাবে এদিকে আসছেন কেন? শুভ্র আবারো বলে, আমি জানি কি বলছ? আমি লুচ…….(…)…??? শুভ্রর মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় লাবণ্য, না, না! আমি আপনাকে সে কথা বলিনি। আমি তো আপনাকে……….
– হ্যাঁ, বলো! তুমি তো আমাকে কি???
লাবণ্যর আর প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় নি। তার আগেই দরজায় কড়া নাড়ে শিশির। লাবণ্য মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে বিছানায়। দরজায় একের এক নক পরতেছে দেখে দরজা খুলে শুভ্র। শিশিরকে দেখে ভ্রু কুচকে রুম থেকে চলে যায় শুভ্র।
রুমে প্রবেশ করেই ভাবির সাথে হাসি মসকারা’ই মেতে উঠে ননদ শিশির।
” এই ছিল তোমাদের মনে, নাহ?”
লাবণ্য মাথা উচু করে শিশিরের দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকালো। শিশির পেত্নী মার্কা হাসি দিয়ে বলল, হয়ছে! আর বুঝতে হবে না। আমি যা বুঝার বুঝে গেছি। তাইতো বলি ব্যাটা এবার প্রথমে আমায় কেন ডাকল? ও আমায় জাগিয়ে দেওয়ার জন্য জাগেনি, ও ডেকেছে ওর কাজে………
কথাটা বলেই হো হো করে হেসে দেয় শিশির। রাগান্বিত চোখে ননদের দিকে তাকাই লাবণ্য। এটা দেখে ওর হাসি থেমে যায়। কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলে, স্যরি! স্যরি,ভাবি! আর মজা করব না। এই মুখে পিন মারলাম। দু’জনেই চুপচাপ, স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই প্রথম ঈদ, যে ঈদে শিশির গোসল করে ২য় স্থান অধীকার করেছে। ব্যাপারটা লাবণ্যর সাথে শেয়ার করার জন্য ওর দিকে এগিয়ে গেল। ভাবি জানো…..(….)…..???
কথাটা বলেই স্তব্ধ হয়ে যায় শিশির। লাবণ্য শিশিরের দিকে তাকালো। হ্যাঁ, বলো…..
শিশির কিছুক্ষণ লাবণ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হো হো করে হেসে দিল। এমন হাসি, যা থামতেই চাইছে না। লাবণ্য বিরক্তিকর স্বরে বলল, কি হলো? বলছ না কেন? অনেক কষ্টে হাসি থামায় শিশির। তারপর- ” ভাবি তোমার লিপ…(….)…?””
কথা পুরো বলতে পারেনি। তার আগেই হাসতে হাসতে রুম ছাড়ে শিশির। বেচারী লাবণ্য কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাল রাত্রে শিশির বায়না ধরেছিল লাবণ্যকে বউ সাজে দেখবে। তারই কথা মত সাজতে সাজতে অনেক রাত হয়ে গেছে। তাই এগুলো না ধুয়েই ঘুমিয়ে পরেছিল ওরা। এখন তো সেসব সাজের মধ্যে লিপস্টিক’টা লেপ্টে আছে। আর এটা দেখেই না জানি শিশির উল্টাপাল্টা কি ভাবছে। ইস! কি লজ্জা….
আয়নার সামনে থেকে সরে যায় লাবণ্য। চটজলদি কাপড় এনে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে সে।
লাবণ্যর রুমে থেকে বের হয়ে সরাসরি কাজিন পলাশের কাছে চলে যায় শুভ্র। কেননা, এ এলাকার কম বেশী সবাই জানে পলাশের ঘরটা ছোট খাটো ফার্মেসীর মতই। কোনো ছোট খাটো এক্সিডেন্ট হলে সবার আগে সবাই পলাশের কাছে ছুটে আসে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। আর হসপিটালে রোগীদের নিয়ে আসা যাওয়া করতে করতে অনেক কিছুই ওর রপ্ত হয়ে গেছে। শুভ্র অনেক খুঁজে কাজিন পলাশকে বের করল। ততক্ষণে শুভ্রর সাদা শার্টের হাতা পুরোটাই রক্তে ভিঁজে গেছে। শুভ্রকে এভাবে দেখে পলাশ হেসে বলে উঠল,
” ডাক্তার সাহেবেরই যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে আমরা সাধারণ মানুষের কি হাল হবে?” শুভ্র ব্যাথায় কিছুটা কুকিয়ে উঠে বলল, পরামর্শ পরে দিস আগে আমায় কি করবি কর! ব্যাটা, তোর থেকে দেড়মাসের বড় আছি। সম্মান দিয়ে কথা বল। কথাটা বলেই পলাশ শুভ্রর গা থেকে শার্ট’টাই খুলে ফেলে। তারপর কাটাস্থান ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে পলাশের সারা শরীর শিউরে উঠে। ” এমনভাবে কাজ করিস না?”
উফ, করে ব্যাথায় আর্তনাদ দিয়ে উঠে শুভ্র। পলাশ ভালো ভাবে ক্ষতস্থান ধৌত করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। শুভ্র উঠে চলে যাচ্ছিল, পলাশ ধরে ফেলে পিছন থেকে। পিছু ফিরে শুভ্রর জবাব, আর কি? চোখ বড় বড় করে পলাশ বলে উঠে, আর কি মানে? ইনজেকশন দিতে হবে। এখন আমার সাথে ফার্মেসীতে চল। পলাশ ওর ভাই শুভ্রকে নিয়ে যায় ফার্মেসীতে। সেখান থেকে ইনজেকশন দিয়ে তবেই ছাড়ে ওকে। ছাড়ার আগে বলে দেয়, শুন! আজকে কোথাও যাবি না আর। এখন গিয়ে বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিবি। শুভ্র মৃদু হেসে বলে, পাগল! সামান্য আঘাতে এত কেয়ার……
বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল শুভ্র, তার আগেই রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায় ওকে ওর ছোট চাচী মরিয়ম। শুভ্র বার বার বলতেছে, কাকী মা! আমি বাসা থেকে দেখা দিয়ে আসি একবার। ওর কাকীমার একটাই জবাব, দেখা পরে করবি। আর ঈদের দিন ওরা কিছু বলবে না। আগে আমাদের বাসা থেকে খেয়ে তারপর যাবি। শুভ্রকে একরকম জোর করে ওর কাকীমা কাকার বাসায় নিয়ে যায়। পিঠা পায়েস এবং নানা রকম মিষ্টান্ন শুভ্রর সামনে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। শুভ্র চোখ বড় বড় করে কাকীমাকে প্রশ্ন করে, আমাকে কি খাবারের ভিতর ডুবিয়ে মারবে তোমরা? শুভ্রর কাকীমা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, তুই একা খাবি নাকি? বউমাও আসছে। ওকে আনতে পাঠিয়েছি আমি। শুভ্র মনে মনে বলে, ওহ! সব আয়োজন তাহলে একমাত্র বউয়ের জন্য। বড় খাদক তাহলে মেমসাহেব!
ভাবতে ভাবতেই মেমসাহেব হাজির। শুভ্র সেদিকে না তাকানোর ভান করে খাওয়া শুরু করে। এদিকে লাবণ্য?!!!
শুভ্রকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। ” এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আনিনি। এই যে সামনে খাবার রাখা, এগুলো খেতে হবে। ডাক্তারসাহেব খাবার দেখেই পালিয়ে যাচ্ছিল, তোমার কথা বলে বসিয়ে রাখলাম।
লাবণ্য মাথা নিচু করে খাটের একপাশে পা দুলিয়ে বসলো। কাকীমা লাবণ্যর পাশে এসে দাঁড়ালো। এভাবে পা দুলিয়ে বসলে হবে না। পা উঠিয়ে শুভ্রর পাশে গিয়ে বসো। পলাশ, পলাশের বউও আসছে। আরো আসছে সুমন আর বউ, হিমেল আর ওর বউ। ওদেরও দাওয়াত আজকে। ওরা সবাই এখানে টেবিলে খাবে, শুধু পলাশ আর ওর বউ তোদের সাথে বসবে। শুভ্র এতক্ষণে চোখ তুলে তাকায়। কাকীমা! নতুন বউয়ের সামনে আমরা খাবো? ব্যাপারটা কেমন কেমন না?
– ব্যাপার আবার কেমন কেমন হবে? পলাশ তোর বড়। হতে পারে বিয়েটা পরে করেছে, কিন্তু বয়সে পলাশ তোর চেয়ে বড়। শুভ্র আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ জানি। কিন্তু তবুও কেমন যেন লাগছে। কথা শেষ না হতেই পলাশ ওর বউকে নিয়ে হাজির। হাসি হাসি মুখ নিয়ে পলাশ বলে উঠে,
” কি ব্যাপার? কি নিয়ে কথা চলছে এখানে?”
শুভ্র কথা ঘুরিয়ে বলল, সে কিছু না ভাইয়া।
ইতিমধ্যে হিমেল সুমনও ওদের বউ নিয়ে হাজির। কাকীমা লাবণ্যকে উপরে উঠে শুভ্রর পাশে গিয়ে বসতে বলল। নিশ্চুপ লাবণ্য শুভ্রর পাশে গিয়ে বসল। একপাশে লাবণ্য শুভ্র, আরেক পাশে পলাশ-মৌরি। আর রুমে টেবিলে বসে খাচ্ছে সুমন-নাইমা, হিমেল-লামিয়া। সবাই বেশ চুপচাপ খেয়ে চলছে। শুধু লাবণ্যই ইতস্তত করতেছে। শুভ্র বারবার ওর হাঁটু দ্বারা লাবণ্যর হাঁটুতে মৃদু আঘাত করছে। আর লাবণ্য একটু একটু করে পিছনের দিকে সরতেছে। আড়চোখে পলাশের বউ পলাশকে সেটা দেখায়। দু’জনেই বেশ কৌতূহলের সাথে খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র-লাবণ্যর দিকে তাকাচ্ছ।
এতক্ষণে সময় হলো গোসলখানা থেকে আসার? ড্রেসিংটেবিলে আয়নার সামনে বসে ভেঁজা চুলগুলো আচড়াচ্ছিল লাবণ্য। শাশুড়ির কথায় পিছু ফিরে তাকাই সে।
– ইয়ে না মানে মা….(….)….
হয়ছে! আর আমতা আমতা করতে হবে না। টেবিলে খাবার দিয়েছি। খেয়ে যা।
– কিন্তু মা আমি তো রোজা রা….(….)…..?
চলে যাচ্ছিল লাবণ্যর শাশুড়ির, ওর কথা শুনে থেমে যান তিনি। পিছু ফিরে তাকান।
হাসি দিয়ে বলেন, এ রোজা নয় এ উপুষ। দু’দিন ধরে কিচ্ছু খাস না, এভাবে না খেয়ে শুধু শুধু কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস? রোজা রাখলে নামাজও পড়তে হয়, কাল সেহরির পর থেকে এ পর্যন্ত কয় ওয়াক্ত নামাজ পড়েছিস শুনি?
লাবণ্য লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। সত্যি’ই কাল সেহরির পর থেকে একওয়াক্ত নামাজও পড়িনি। যে আমি এক ওয়াক্ত নামাজ যদি ঘুমের জন্য মিস হতো, কান্না শুরু করে দিতাম কেন জাগিয়ে দেয়নি, সেই আমি কি করে দু’দু’ওয়াক্ত নামাজ মিস করলাম? কিভাবে আমায় শয়তান ধরলো?
লাবণ্যর শাশুড়ি ওর কাছে গিয়ে বলে, হয়ছে থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। টেবিলে খাবার দিয়েছি, খেয়ে যান। খেয়ে উপুষটা ভঙ্গ করেন। শাশুড়ি চলে যাওয়ার পরও লাবণ্য একমনে আয়নার দিকে তাকিয়ে ভেঁজা চুলগুলো আঁচড়াচ্ছিল। তখন’ই সেখানে উপস্থিত হয় শিশির। জোরগলায় বলে উঠে, “ভাবি! তুমি এখনো বসে আছ? মা ডাকতেছে তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না?”
ননদ শিশিরের কথায় সম্ভিত ফিরে লাবণ্যর। আয়নার সামনে থেকে চটজলদি উঠে পরে।
মৃদু হাসি দিয়ে ননদকে বলে, তুমি যাও! আমি আসছি। শিশির মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে শুভ্রর রুমের দিকে পা বাড়ালো। লাবণ্য গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। খাবার সামনেই রাখা, কিন্তু কেন যেন ও মুখে দিতে সাহস পাচ্ছে না! কেমন যেন লাগছে ওর! এই কেমন লাগাটা কি ওর রোজার জন্য? হবে হয়তো!
” কি হলো? খাবার নিয়ে আবার ধ্যানে বসছিস নাকি? শুন রোজা রাখছি। বেশী কথা যাতে না বলতে হয় আর। লাবণ্য শাশুড়ির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো।
“মা, আমি রোজা রাখব, না খেলে হয় না?”
লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য পূর্বের ন্যায় বিনীত ভঙ্গিতে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলতেছে, ” মা! প্লিজ…..”
শাশুড়ি এবার চেঁচিয়ে উঠল,
“তুই আমার কথা শুনবি কি না?”
লাবণ্য মনে মনে আল্লাহর কাছে দু’হাত তুললো। এ আল্লাহ মাফ করো আমায়। তারপর কোনো কথা না বলে বিসমিল্লাহ বলে ঢোক গিলে একের পর এক লঙ্কা গিলতে লাগল। ভয়ে শাশুড়ির দিকে মুখ তুলে তাকানোরও সাহস পাচ্ছে না লাবণ্য। সেই কখন থেকে শুধু গিলেই যাচ্ছে তো, গিলেই যাচ্ছে। ঠিক সে সময় শিশিরের সাথে উপস্থিত হয় শুভ্র। খাবার টেবিলের সামনে এসে লাবণ্যর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে শিশির- শুভ্র। শিশির ওর মাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাত ইশারায় মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলেন ওনি ওনার মেয়েকে। শুভ্রকে ইশারায় পাশে বসতে বলে শিশির সেখান থেকে চলে যায়। শুভ্রর সামনে খাবার আর পানির জগ এবং গ্লাস দিয়ে শুভ্রর মা ও সেখান থেকে চলে যায়। পুরো একপ্লেট ভাত খেয়ে তবেই মাথা উঁচু করল লাবণ্য। সামনে তাকাতেই দেখে শুভ্র গালে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। লাবণ্য চোখ ফিরিয়ে নেয় শুভ্রর থেকে। শুভ্র গ্লাসে পানি ঢেলে ভরে, নাও! খাও। না হলে যে হারে খেয়েছ গলায় আটকে যাবে। লাবণ্য কিছু না বলে ঢকঢক করে দু’তিন গ্লাস পানি খেয়ে নেয়। সবশেষে প্লেটে পানি ঢালতে গেলে শুভ্র চোখ বড় বড় করে বলে উঠে, আরে আরে! একি করছ? আম্মা তোমার জন্য এই যে আরো একপ্লেট ভাত দিয়ে গেছে। এগুলো না খেয়ে হাত ধুচ্ছো যে? লাবণ্য চোখ বড় বড় করে বলে, এগুলো আমার নাকি আপনার? মা আপনাকে দিয়ে গেছে! শুভ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে, তওবা, তওবা! রোজাদার ব্যক্তির এসব শুনাও যে পাপ।
– কি? আপনি রোজা?!!!(লাবণ্য)
~ হ্যাঁ, তুমি জানো না? আমি রোজা ভাঙ্গি না জীবনেও। (শুভ্র)
শুভ্রর কথা শুনে লাবণ্য কিছুটা লজ্জা পেল। তারপর নিচের দিকেই তাকিয়ে বলল, না মানে আপনার তো রোজা হবে না, তাহলে আপনি রোজা রাখলেন কিভাবে? শুভ্র চোখে মুখে গাম্ভীর্য্যের ছাপ এনে বলে, শুনো! আমি ছেলে। আমি মেয়ে না যে আমার একসাথে ৩টা, ৫টা, ৭টা রোজা কাযা হবে। কি লজ্জা! আমি কি বুঝাতে চাইলাম আর ওনি কি বুঝলেন! লজ্জায় চোখ মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে লাবণ্য। আর তাইতো অন্যদিকে তাকিয়েই বলে, ইয়ে মানে আমি এসব বুঝাতে চাইনি। আমি তো বলতে চাইছিলাম…..(……)…..???
– রোজা ভঙ্গের যতগুলো কারণ আছে শুভ্র এবার সেগুলো গড়গড় করে বলা শুরু করল। লাবণ্যর লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার অবস্থা। শুভ্র সেটা লক্ষ করে মিটিমিটি হাসছে আর বলতেছে, এসব কারণের মধ্যে কোনটা আমাদের সাথে আই মিন আমার সাথে হইছে বলো? তাহলে আমার রোজা কেন হবে না?
লাবণ্য এবার তাড়াতাড়ি হাত ধূয়ে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াল। শুভ্র স্মিতহাস্য পিছু ডাকল, কি হলো? বলে তো যাও আমার রোজা ঠিক কোন কারণে হবে না? লাবণ্য কোনো কথা না বলে চটজলদি সে স্থান পরিত্যাগ করে। খাবারগুলো ঢেকে রেখে উঠে যাচ্ছিল শুভ্র, সামনে বাবার মুখোমুখি হয়। মুচকি হাসি দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে ওর বাবার জবাব, সাবাস ব্যাটা! এভাবেই পিছনে আঠার মতো লেগে থাক। শুভ্র মাথা চুলকিয়ে সে স্থান ত্যাগ করে।
আসরের নামাজের আযান দিয়েছে। সবাই যে যার মত নামাজ আদায় করতে চলে গেল। নামাজ শেষে এদিক ওদিক ভালো ভাবে দেখে লাবণ্য যে রুমে থাকে সে রুমে ঢুকে পরে শুভ্র। ফ্লোরে জায়নামাজ পেতে সেখানে বসেই কুরআন তেলওয়াত করছিল লাবণ্য। শুভ্রকে দেখে কুরআন শরীফটা বন্ধ করে বক্সের ভিতর রেখে দেয়। কাশি দিতে দিতেই দরজার বাহির থেকে রুমের ভিতরে ঢুকে সে। লাবণ্য খাটের একপাশে মাথা নিচু করে বসেছিল, শুভ্র তার ঠিক সামনের সোফায় বসে। একটা কাশি দিয়ে বলে উঠে শুভ্র, তা মিসেস লাবণ্যর রোজা তো আজকে দিনেই মনে হয় ১৭টা পূর্ণ হলো তাই না? লাবণ্য কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে আছে। শুভ্র হেসে বলল, আল্লাহ! আম্মা তোমায় খাওয়ানোর জন্য একটু মিথ্যে বলল, আর তাতেই তুমি খেয়ে উঠলে?! তুমি তো দেখছি ছোট বাচ্চাদের মতই। ছোটবেলায় রোজা রাখতাম বলে মা কত্ত কিছু বলে রোজা ভাঙাতো। বলত যে, খেয়ে নে। একরোজা হয়ে যাবে। ডাক না দিলে না খেয়েই রোজা রাখতাম, আর আম্মা কত কথা যে বলত। সেসব কথা আজকে তোমায়ও বলছে। আর বাচ্চা মেয়ে সেটা বিশ্বাস করে দিনের বেলায় ইফতার করে ফেলেছে। যাকগে, চিন্তা একটা হয়ে গেছে তোমার। হি, হা, হা, হা……..
শুভ্র হাসছে। লাবণ্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে হাসির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,
ইস! কত সুন্দর করে হেসে, হাসিয়ে অনর্গল কথা বলতেছে। কি করে পারে মানুষ এতসুন্দর করে কথা বলতে? এতই সুন্দর যে সারাজীবন ধরে সে কথা শুনলেও মুগ্ধতার রেশ কাটবে না। এই মুখ, এই হাসি, এই কথায় বিভোর হয়েই তো একদিন ওর প্রেমে মজেছিলাম। তারপর? কি পেলাম আমি বিনিময়ে? লাঞ্চনা-গঞ্চনা আর একবুক বেদনা। লাবণ্যর সুন্দর ফর্সা মুখটা নিমিষেই কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। মনে মনে, আমি যে ওর প্রতি দিনকে দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। না, না! এ হতে পারে না। ওর দেওয়া আঘাত, ক্ষত এখনো বুকের ভেতরে তাজা হয়ে রয়ে গেছে। সেই সব ক্ষতের দাগ এখনো শুকাইনি। না, না! আমি এভাবে হেরে যেতে পারি না। ওর প্রতি আমার কোনো মায়া, কোনো টান থাকতে পারে না। লাবণ্য একলাফে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বিড়বিড় করে কি যেন বলে সে রুম ত্যাগ করল।
চোখের পলকে মাহে রমজান বিদায় নিল। আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। চিরাচয়িত নিয়মে আজও সবার আগে মানে কাকপক্ষী জাগার আগে শুভ্র জেগে যায়। যেহেতু প্রতিবছর ওরা গ্রামে দাদার বাড়িতে ঈদ করে সেহেতু প্রতিযোগীতাটা শুভ্র ওর বোন এবং কাজিনের সাথেই করত। কার আগে কে গোসল করতে পারে সেই প্রতিযোগীতা। প্রচন্ড শীতের মধ্যে কেঁপে কেঁপে গোসল করার মাঝেও আনন্দ আছে, যদি সেটা কোনো উৎসব বিশেষ করে ঈদের জন্য হয়। শীতে রীতিমত কাঁপছিল শুভ্র, তবুও গোসলটা সেরে আসে। সবার আগে গোসল করতে যেয়ে মনে হচ্ছে এতটাই আগে গোসল করে ফেলেছে যে এখনো ফজরের আযান’ই দিচ্ছে না। কাঁপা কাঁপা শরীরে শুভ্র ওর বোন শিশিরকে ডাক দেয়। শিশির ঘুম থেকে উঠে চিৎকার দিয়ে বলে, আজও তুই প্রথম হয়ে গেলি? এ্যাহেেএ্যাএ্যাএ্যা…….
শুভ্র কাঁপা কাঁপা স্বরেই বোনকে ব্যঙ্গালো ব্যা ব্যা……. শিশির রাগে গজগজ করে মাকে গালগাল দিতে দিতে কাজিনদের ডেকে উঠানোর জন্য বাহিরে চলে যায়। শুভ্র ঠিক এ সুযোগটার জন্য’ই ছিল। শিশির রুম থেকে চলে যাওয়ার সাথে সাথে শুভ্র ঐ রুমে প্রবেশ করে দরজা ভিতর থেকে আটকে দেয়। কম্বল গায়ে লাবণ্য তখনো অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ধীর পায়ে শুভ্র বিছানার দিকে এগুতে থাকে। এই মুহূর্ত লাবণ্যর বিছানার একদম পাশে দাঁড়িয়ে শুভ্র। মনে মনে ভাবছে, আমার কি কাজটা করা ঠিক হবে? ও যদি রেগে যায় কিংবা ভুল বুঝে?! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই শুভ্রর দাঁতে দাঁত লেগে যায়। প্রচন্ড শীতে দাঁতের দাঁতের ঘর্ষণে কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে। শুভ্রর শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে। না, না! আর একমুহূর্তও ভাবতে পারব না। যা হয় হোক। আমি আগে আমাকে বাঁচায়। এই বলে আগেপাছে কিচ্ছু না ভেবেই শুভ্র লাবণ্যর কম্বলের ভিতর ঢুকে যায়।
অবশেষে দরজা ভেঙে’ই রুমে প্রবেশ করা হলো। একসাথে দু’দুটো দরজা ভাঙবে এটা সত্ত্বেও শুভ্রর বাবা মনে মনে হাসছিলেন আর ছেলেকে বাহবা দিচ্ছিলেন আর মনে মনেই বলছিলেন-
” সাবাস ব্যাটা! এতদিন পর একটা কাজের মত কাজ করছিস। বউ নিয়ে পালাইছিস।”
কিন্তু একি?! এ ছেলে যে এখনো রুমে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। শুভ্রকে রুমে দেখে বাপ মাইয়্যা দুজনের মুখ’ই অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। ঘুমড়া মুখে শিশির শুভ্রর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রর মা মনে মনে আল্লাহর অশেষ শোকরিয়া আদায় করলেন। যাক বাবা! রুমে’ই আছে তবে। কাছে গিয়ে ছেলেকে ধাক্কা দিলেন রোকসানা বেগম। কারো হাতের ধাক্কা পেয়ে চমকে উঠল শুভ্র। চটজলদি বিছানা ছেড়ে উঠে বসল সে। চতুর্দিকে সবাইকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ ছানাভরা হয়ে যায় শুভ্রর। চোখ কচলে প্রশ্ন করে,
” তোমরা? তোমরা এ ঘরে কেন? আর এভাবে তাকিয়ে কেন আছ?”
কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে কাজের মেয়ের দিকে তাকাই শুভ্র। কাজের মেয়ে চোখ ইশারায় ঘড়ির দিকে তাকাতে বললো। শুভ্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে যায়। Oh, my god! তিনটা বাজে? এতবেলা অবধি ঘুমালাম? ইনোসেন্ট লুক নিয়ে বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকালো শুভ্র। তারপর ছোট্ট বাচ্চাদের মত বলতে শুরু করল-
” Sorry, baba.Sorry, Maa.I am extremely sorry…..”
আসলে সারাদিনের অভুক্ত শরীর তো। তাই এমন হয়েছে। আর কেউ না জানুক তোমরা তো জানো না খেয়ে ঘুমোলে আমি আর সেদিন বিছানা থেকে উঠতে পারি না। আমাকে ধরে উঠাতে হয়। এখানে আমার কিবা করার আছে বলো?!”
কেউ কিচ্ছু না বলে নিরবে রুম ত্যাগ করে লাবণ্যর রুমে যায় ওর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। থাকার মধ্যে শুধু শুভ্রর বাবা’ই শুভ্রর রুমে থেকে গেল। সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলে ছেলের পাশে গিয়ে বসেন ওনি। পাশে বসে ছেলের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যে, মনে হচ্ছে পারলে এখনি গিলে খেত। ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে শুভ্র ওর বাবার দিকে তাকাই।
” সেই কখন থেকে এমনভাবে তাকিয়ে আছ মনে হচ্ছে আমি যেন মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলছি।” ?
শুভ্রর বাবা আরো ভয়ংকর দৃষ্টি নিয়ে শুভ্রর দিকে তাকালো।
” কি হলো? এভাবে রাগ দেখাচ্ছ কেন?”?
মুখ খুলে শুভ্রর বাবা, গর্দভ কোথাকার! এতকিছুর পরও এখানে পরে আছিস কি করে? বউ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারিস না?
শুভ্র অবাক চোখে বাবার মুখের দিকে তাকান। কি বলছেন এসব ওনি? প্রশ্ন করেন বাবাকে, কিন্তু বাবা ও যদি না যায় আমার সাথে??
একরাশ বিরক্তি নিয়ে ছেলের দিকে তাকান মিস্টার চৌধুরী। তারপর গম্ভীর গলায় বলেন, ব্যাটা বোকা কোথাকার! যেতে না চাইলে জোর করে তুলে নিয়ে যাবি। প্রথম প্রথম নাক ফুলিয়ে, মুখ ফুলিয়ে থাকবে। পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। শুভ্র মৃদু হেসে বাপের দিকে তাকাই। ওর বাবা বলতে থাকে, ” তোর মায়ের সাথে আমার একবার গন্ডগোল হয়ছিল। তোর মা আমায় ছেড়ে তোর নানাবাড়ি চলে যায়। তোর নানাবাড়ির সবাইও একসাথে জোট বেঁধে লাগে যে, তোর মাকে আর আমার কাছে দিবে না।”
তো আমি কি করলাম জানিস? আমি আমার চাচা শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেই। তোর চাচাতো মামি ছিল একটা অনেক ভালো। ওনি তোর মাকে মিথ্যে অজুহাতে বাইরে বের করে আনে। গ্রাম এলাকা। তখন বিদ্যুৎও ছিল না। চারদিকে অন্ধকার। সেই অন্ধকারটাকেই আমি কাজে লাগালাম। তোর মামিকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে তোর মাকে কাঁধে তুলে দৌঁড়’ই দৌঁড়। তোর মা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে যায় আমার গলার আওয়াজ শুনে। হাজার হোক স্বামী তো। স্বামীর সম্মান বাঁচাতে চিৎকার আর দিলো না। তবে হাত পা ছুড়াছুড়ি করেছিল অনেক।”
শুভ্রর বাবা এটুকু বলে থেমে যায়। বাপ- ব্যাটা দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠে। রুমে উপস্থিত হয় শুভ্রর মা। ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” বলি রং কি বেয়ে বেয়ে পরতেছে? এত হাসাহাসি কিসের?”
বাপ পুত্র দু’জনেই চুপসে যায়।
” সে কিছু না। লাবণ্যর রুমে গিয়েছিলা?”
শুভ্রর বাবার প্রশ্নে ওর মা বলে, হুম গিয়েছিলাম। ঘুম আসছিল না, সেই জন্য ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুম দিয়েছিল নাকি। এখনো মনে হয় ঘুম পুরোটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছে সেহরি খাওয়ার টাইম হইছে। আমায় বলতেছে মা, তোমরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? সেহরির সময় যে চলে যাচ্ছে? খাবে না নাকি আজকে? আমি বলে এসেছি, হাত মুখ ধূয়ে পারলে গোসলটাও করে আসিস। সেহরির সাথে আজকে ইফতারটাও করতে পারবি।”
এই অবস্থা? হা, হা করে হেসে দিল শুভ্রর বাবা। শুভ্রর মা ভ্রু কুচকে বলেন, হুম। এখন তুমি উঠে আসো। আর হ্যাঁ, ওকে বলে আসো ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে আসতে। রোজা’তো আজকে দু’দিন ধরে রাখতেছে। ইফতারটাও না হয় তিনঘন্টা আগ থেকেই করা শুরু করবে। শুভ্রর মা চলে যায়।
” যা ব্যাটা! গোসল করে আয়। পরে বুদ্ধি যা করার করা যাবে। মনে রাখিস, এমনি এমনি কোনো কিছু তোর হাতে ধরা দিবে না। অধিকারের সাথে সাথে জোরটাও খাটাতে হবে।” বাবার কথায় অনেকটা শক্তি পেল শুভ্র। তাইতো বাবার দিকে তাকিয়ে একটা ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াই শুভ্র।
এদিকে লাবণ্য। শিশিরের থেকে যখন শুনলো যে এটা রাত নয়, দিন। এখন দিনের সাড়ে তিনটে বাজে। তখন থেকেই লাবণ্যর দৌঁড়ানোর শুরু। একবার ব্রাশ নিয়ে ওয়াশরুমে যাচ্ছে তো, আবার ফিরে এসে জামা কাপড় নিয়ে যাচ্ছে গোসলের জন্য। একবার তোয়ালে তো আরেকবার শ্যাম্পুর জন্য রুমের দিকে দৌঁড়াচ্ছে। তাড়াহুড়ো কাজ করলে যা হয় আর কি! তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গোসলখানার দরজা আটকাতেই ভুলে গেছে লাবণ্য। দরজা খুলা রেখে লাবণ্য যখন ওর চুলে শ্যাম্পু করতেছিল তখন’ই পিছন থেকে একজন বলে উঠে, কয়টা খেয়েছিলে ট্যাবলেট? লাবণ্য পিছু না ফিরেই আঙুল উচিয়ে দেখায়, তিনটা। তারপর আর কোনো কথা নেই। চুলে শ্যাম্পু করা শেষে চুল ভালো ভাবে ধূয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় লাবণ্য। শাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়াতেই খেয়াল হয়, কি ব্যাপার? কে প্রশ্ন করেছিল আমায় ঔষধের ব্যাপারে? আর আমি কাকে উত্তর দিলাম? শাওয়ারের নিচ থেকে ক্ষাণিকটা সরে ভেঁজা শরীরেই পিছু ফিরে তাকাই লাবণ্য। গোসলখানার দরজার সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে একমনে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে শুভ্র। খালি গা, শরীরে কাপড় বলতে একটা তোয়ালে ঝুলানো আছে গলায়। শুভ্রকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে ফেলে লাবণ্য। মনে মনে-
” ওনি? কখন এলেন চেম্বার থেকে? আর এভাবে খালি গায়ে এখানে কেন দাঁড়িয়ে? আমি ঘুমের ঔষধ খেয়েছি এটা ওনি কিভাবে জানেন? আর ওনি এভাবে হাসছেন কেন?” এলোমেলো সব প্রশ্ন নিজে নিজেকেই করে যাচ্ছে লাবণ্য।
” কি হলো? এভাবে দাঁড়িয়ে’ই থাকবা নাকি আরো যে মানুষ রয়েছে ওদেরকে জায়গা দিবা?” পানির ট্যাব বন্ধ করে ঢোক গিলে লাবণ্যর জবাব, আমি এখন কাউকে জায়গা দিতে পারব না। আমি গোসল করব। কিছুটা রাগী গলায় শুভ্রর পাল্টা প্রশ্ন, তো আমি কি এখানে নাচতে এসেছি? আমিও গোসল করতেই এসেছি। আর শুনো! গোসলখানা’টা কারো একার সম্পত্তি না…… শুভ্র দরজা ঠেলে গোসলখানায় প্রবেশ করল। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে লাবণ্য। শুভ্র ছিটকিনিটা ভালো ভাবে আটকিয়ে শাওয়ারটা ছেড়ে নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। লজ্জায় লাবণ্য না পারছে কিছু বলতে না পারছে কিছু করতে। শুধু নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। শুভ্র শরীরে সাবান লাগাচ্ছে আর আড়চোখে লাবণ্যর দিকে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে না দেখার ভান করে ইচ্ছে করে’ই পানিরছিটা দ্বারা লাবণ্যকে ভিঁজিয়ে দিচ্ছে।
এতক্ষণ ধরে সব সহ্য করে গেলেও এবার মুখ খুলে লাবণ্য। ধীর গলায় বলে-
” কি করছেন এসব? আমি যে ভিঁজে যাচ্ছি!”
আচমকা শুভ্র বালতি থেকে এক মগ পানি এনে, লাবণ্যর মাথায় ঢেলে দেই। লাবণ্য মুখটা অন্ধকারের মত করে বলে-
” এটা কি করলেন?”
মুচকি হেসে শুভ্রর জবাব, এতক্ষণ পুরোপুরি ভিঁজনি, তাই এখন পুরোপুরি ভিঁজিয়ে দিলাম। এখন আসো গোসল করিয়ে দেই।
লাবণ্য কিছুটা পিছু সরে যায়। শুভ্র লাবণ্যর দিকে এগিয়ে যায়। কি হলো? এভাবে পিছনে যাচ্ছ কেন? লাবণ্যর শেষ সীমানা দরজাতে গিয়ে মিশে যায়। শুভ্র লাবণ্যর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। লজ্জায় লাবণ্য শুভ্রর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। আবার ভেঁজা শরীর নিয়ে বাইরেও যেতে পারছে না। নিরুপায় লাবণ্য তাই মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। লাবণ্যর লজ্জা রাঙ্গা মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চট করে হাতটা ধরে একটানে শাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। লাবণ্য তখনও মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে। থুতনি ধরে মুখটা উপরের দিকে তুলে মুখের দিকে একটা আঙ্গুল নিয়ে যায় শুভ্র। লজ্জায় চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে লাবণ্য। গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁটজোড়াতে মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে। ভীরু চোখের পাতা দুটি কাঁপছে। লাবণ্যর পুরো মুখ লজ্জায় লাল বর্ণ ধারণ করেছে। শুভ্র দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে সে দৃশ্য’ই দেখছে। কিছু করছে না দেখে চোখ খুলে লাবণ্য। শুভ্র তখনো লাবণ্যর মায়া মায়া মুখপানে’ই তাকিয়ে ছিল। লাবণ্যর ডাকে ঘোর কাটে ওর। ছাড়েন….. শুভ্র ওর একহাত দ্বারা লাবণ্যর কোমড়ে ধরে রেখেছিল। লাবণ্যর কথায় কোমর ছেড়ে দু’হাতে শুভ্র লাবণ্যর গাল চেপে ধরে। লাবণ্য ফ্যালফ্যাল করে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে ভাবছে, আজ এমন কেন করতেছেন ওনি? আর ওনার এত সাহস এলো কোথা থেকে আজকে? শুভ্র লাবণ্যর দু’গাল চেপে ধরে বলতে শুরু করে-
” আমি স্যরি লাবণ্য। আমি আসলে জানতাম না তোমার আব্বু আম্মু নেই। আর তুমিও তো আমাকে জানাওনি। জানালে এতকিছু হতো না। জানো আমি তোমায় কিভাবে খুঁজেছি? তোমার নাম্বার বন্ধ পেয়ে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। এদিকে আমি তোমার ঢাকার বাসার ঠিকানাও জানতাম। তোমাকে এ শহরে কত জায়গায় যে খুঁজেছি, যদি তুমি বুঝতে পারতা! সবসময় একটা ভয় আমায় তাড়িয়ে বেড়াতো, ও ঠিক আছে তো?! আমি তোমার সব বান্ধবীদের কাছে তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি, ওরা কিচ্ছু বলেনি। আমি তোমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাও চেয়েছিলাম ওদের কাছে, ওরা ঠিকানাটাও দেয়নি। তখন যে আমার কেমন অবস্থা হয়ছিল যদি তখন দেখতা তাহলে বুঝতে পারতা! লাবণ্য আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি। আমার বন্ধুরা আমায় পাগল বানিয়ে দিয়েছিল। তোমায় নিয়ে বাজে কথা বলত। বলত-
” আরে ব্যাটা! ঐ মাইয়্যা তো মনে হয় সুখেই দিন কাটাচ্ছে, তুই কেন এমন দেবদাস মার্কা চেহারা বানিয়েছিস? খুঁজ নিয়ে দ্যাখ! ও হয়তো নতুন কাউকে পেয়ে গেছে।”
এরকম হাজারো কথা প্রতিনিয়ত ওদের থেকে শুনতে হতো আমার। একটা সময় ওদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই। তবুও ওদের কথা পাত্তা দেইনি। কিন্তু সেদিন যখন হসপিটাল থেকে ফিরার সময় তোমাকে একটা অচেনা ছেলের সাথে দেখি, তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি জানতাম না এ তোমার কাজিন ছিল। জানলে এমন ধারণা মনে পোষতাম না। লাবণ্য জানো তোমার সাথে এই যে আমি এত খারাপ ব্যবহার করতাম, আমার খুব কষ্ট হতো। খুব বেশী কষ্ট হতো। তবুও কষ্ট দিতাম। কারণ, তোমার দেওয়া কষ্ট গুলো আমি বুকের মধ্যে পুষে রেখে দিয়েছিলাম। যতবারই চেয়েছি তোমার কাছে যেতে, ততবারই মনে পরে গেছে এ তো সেই মেয়ে! যে তোর স্বাভাবিক জীবন নষ্ট করে দিয়েছিল। রেগে গিয়ে তখনি তোমার সাথে উল্টাপাল্টা আচরণ করতাম। লাবণ্য জানো, তুমি চলে আসার পর থেকে একটা রাতও আমি শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি। অজানা এক শূন্যতায় ভেতরটা কেমন খাঁ, খাঁ করেছে। ছন্নছাড়া পাখির মত আমি শুধু ডানা ঝাপটাইতাম। তুমি চলে আসার পর থেকে একটা রাতও আমি ভালো ভাবে ঘুমোতে পারিনি লাবণ্য। সেদিন শিশিরের থেকে যখন জানতে পারলাম তোমার এবং পরিবারের কথা, তখন আমার সব, সব ভুল কেটে গেছে লাবণ্য। আমি বুঝতে পারছি লাবণ্য আমি অনেক বড় ভুল করেছি, যার কোনো ক্ষমা নেই। এখন তুমি যদি আমায় ক্ষমা করতে না চাও তাহলে করো না। এতে আমার একটুও আফসোস নেই। কিন্তু প্লিজ লাবণ্য তুমি আর এভাবে মুখ ফিরিয়ে থেকো না। আমার কষ্ট হয়। ভালোবাসা না দাও, শাস্তিটুকু দাও লাবণ্য। তবুও প্লিজ এভাবে আর এমন করে থেকো না।”
লাবণ্যর চোখ জলে টলমল করছে। শুভ্রর হাতের মুঠো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ” মা ডাকতেছে। তাড়াতাড়ি বের হোন। আমি চেঞ্জ করব।”
শুভ্র মায়ের ভয়ে তাড়াতাড়ি গোসল সেরে চলে যায়। শুভ্র চলে যাওয়ার পর শুকনো মুখে একটা হাসির রেখা টেনে লাবণ্যর জবাব,
” হা, হা শাস্তি! সেতো আপনাকে দিব’ই, এমন শাস্তি যা আপনি কখনো কল্পনাও করতে পারবেন না।”