Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 241



কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৪৭+৪৮

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪৭
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“কালকের দিনটা কি বিহঙ্গিনী তার কাব্যের নামে লিখে দিতে পারবে?”

অনেকদিন পর”বিহঙ্গিনীর কাব্য” আইডি থেকে মেহবিনের জন্য পোষ্ট করা হয়েছে। রাতে শোয়ার বন্দোবস্ত করছিল মেহবিন এমন সময় নোটিফিকেশন এর আওয়াজ পেতেই নোটিফিকেশন টা অন করতেই উক্ত পোস্টটি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মেহবিন বাবু হয়ে বসে তারপর মুচকি হেসে বলল,,

“কালকের দিনে কি আছে? যে বিহঙ্গিনী কে তার কাব্যের নামে দিনটা লিখে দিতে হবে।”

ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসলো,,

“কালকের তারিখেই বিহঙ্গিনীর কাব্য তার বিহঙ্গিনীর সাথে হালাল , লিখিত ও বৈধভাবে জুড়ে গিয়েছিল।”

“তাই বুঝি! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম?”

“ভুলে গিয়েছিল দেখেই তো কালকে হাসপাতাল থেকে সে ছুটি নিয়েছে। তাছাড়া আমার বিহঙ্গিনী কিছু ভুলে না। আর সে ভুলে না দেখেই তো সে এরকম সবকিছু নিজের ভেতরের চাদরে মুড়িয়ে রাখে।”

মেহবিন হাসলো কাল যে হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছে সে খবর ও নেওয়া হয়ে গেছে তার কাব্যের। কালকের দিনটা দুজনের জন্যই স্পেশাল। বিয়ে হওয়ার পর থেকে এই দিনটা তারা তাদের নিজেদের মতো কাটায়। এমন কি যখন বিদেশে ছিল তখন ও তারা দুই জায়গা থেকে ভিডিও কলে সারাদিন থেকে নিজেদের মতো সময় কাটাতো। মেহবিন হেসে লিখলো,,

“যান কালকে বিহঙ্গিনী তার কাব্যের নামে দিনটা লিখে দিল।”

ওপাশ থেকে খুশির ইমুজি আসলো। তার সাথে আরেকটা কমেন্ট আসলো,,

“তার খেয়াল যখন আসে মনে। জানি না কেমন লাগে অদ্ভুত সুন্দর যন্ত্রনা হয় তবে এইটুকু বুঝি অদ্ভুত খুশিও অনুভব হয়।

বিহঙ্গিনীর প্রতিটা সাক্ষাৎ যেন,
কাব্যের মনে ঈদ বয়ে আনে!
সে কি জানে বিহঙ্গিনীর কাব্য তার জন্য কতটা
অপেক্ষা নিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো
মুখিয়ে থাকে বিহঙ্গিনীর পথের পানে!

এটুকু দেখে মেহবিন হেঁসে লিখলো,,

“অপেক্ষাটাও এক অদ্ভুত ভয়ঙ্কর আনন্দ দেয় কাব্য। যখন এই অপেক্ষা শেষ হবে তখন এই অপেক্ষার আনন্দ টা আর পাওয়া যাবে না।”

তখন ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসলো,,

“তার যত্ন আর অপেক্ষা এতটা সুন্দর!
না জানি তার প্রাপ্তি ও ভালোবাসা কতোটা সুন্দর।
সবশেষে কথা দিয়ে কথা রাখা ব্যক্তিগত মানুষটা ভয়ঙ্কর সুন্দর।”

মেহবিন হাসলো কিন্তু আর কিছু লিখলো না। সে খুশিমনে শুয়ে পড়লো। কে জানে আজ অপেক্ষায় ঘুম হবে কি না।

________________

পরের দিন সকাল বেলা শেখ পরিবারের সবাই ব্রেকফাস্ট করছিল। পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সেদিনের পর দুদিন পার হয়ে গেছে। শেখ শাহেনশাহ কে বাড়ি আনা হয়েছে তার জন্য একটা নার্স রাখা হয়েছে। হুট করে মিশু বলল,,

“আমি আমাদের আরেক মামাবাড়িতে যাবো বাবা?”

মিশুর কথায় সবাই ওর দিকে তাকালো। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘হুট করে সেখানে যাওয়ার কথা তোমার মাথায় এলো কিভাবে? তাছাড়া ওনারা তো আরবাজের অনুষ্ঠানে আসে নি তোমার পরিচয় ও নেই। যেতে হবে না।

“না আমি যাবো। আর হ্যা আমি আমাদের মামাবাড়িতে বেড়াতে যাবো। যেয়ে তাদের জিজ্ঞেস করবো তারা কেন বাজপাখির অনুষ্ঠানে এলো না।”

“না মিশু? তুমি তো তাদের চেনো না তাই না।”

“আমি না চিনলাম বাজপাখি তো চেনে। ও দিয়ে আসবে। আমি মামাবাড়িতে যাবো ব্যস আমার এই বাড়িতে আর থাকতে ভালো লাগছে না।”

আরিফা জামান বললেন,,

“অন্য কোথাও যাও ওখানেই কেন যেতে হবে।”

“না আমি আমার মামাবাড়িতেই যাবো। আমার কতোদিনের ইচ্ছে আমি মামা বাড়িতে যাবো। তাছাড়া জসীমউদ্দীন এর কবিতা আছে না,,

আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই

তাই আমিও মামাবাড়ি যাবো বাবা। বাবা তুমি ব্যবস্থা করো?”

শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘আচ্ছা ঠিক আছে আরবাজ তোমায় দিয়ে আসবে।”

তখন আরিফা জামান বললেন,,

‘মিশুর কি দরকার ওখানে যাওয়ার তাছাড়া মিশুর অবস্থাও তো বুঝতে হবে ও কি সামলে থাকতে পারবে। তাছাড়া এতো বছর ধরে যোগাযোগ নেই। যতোই তাদের ভাগনি হোক ওর অবুঝতা কি তারা সহজে নিতে পারবে।”

“ওখানে আরবাজ ও যাবে দু’জনেই থাকবে। আমি মিশুকে একা ছাড়ছি না তো। দু’দিন থেকেই চলে আসবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

মিশু তো মামার বাড়ি যাবে শুনে ইয়াহু বলে উঠলো। তখন ওদের বাড়ির সামনে এসে কেউ আরবাজ কে ডাকতে লাগলো তার পার্সেল এসেছে। আরবাজের খাওয়া শেষ তাই সে উঠে সেদিকে গেল। পার্সেল কালেক্ট করলো।একটা বক্স আছে আরবাজ বক্সটা দেখে অবাক হলো। সবাই জিজ্ঞেস করতেই ও বলল জানে না। ও ঘরে চলে গেল পেছন পেছন মিশুও গেল। বক্সটা খুলতেই কতো গুলো সাদা গোলাপ দেখতে পেল। এই ফুলটা ওর পছন্দের। ফুল দেখে ওর মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। ও ফুল গুলো উঠিয়ে বিছানায় রাখলো। তারপর কতো গুলো চকলেট পেল তার ওপরে একটা চিঠি। ও চিঠিটা খুলতেই ওপরের সম্মধোন দেখে অবাক হয়ে গেল তবে খুশিও হয়ে গেল। ও পরতে লাগলো,,

প্রিয় চকলেট বয়,,

কি অবাক হয়েছো তাই না। তুমি বাড়ি থেকে বের হলে আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসতে এই জন্য তোমায় তখন চকলেট বয় বলে ডাকতাম। ছোটবেলায় তোমার সাথে আমার ডিল হয়েছিল কোথাও গেলে আমার জন্য চকলেট আনতে হবে। আর তুমি আনতেও তাই। তোমাকে কখনো বাজপাখি কখনো চকলেট বয় ডাকতাম। কখনো ভাইয়া বলে ডাকা হয় নি। কারন তুমি আমার বড় ভাইয়া এটা কখনো ফিল হয় নি। সবসময় মনে হতো তুমি আমার বন্ধু।

এইটুকু পরতেই আরবাজের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। তবুও মুখে অদ্ভুত হাঁসি। ও চোখ মুছে আবার পরতে নিল,,

সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম তোমার কথায়। কারন তুমি তো আমার বন্ধু ছিলে আমায় বিশ্বাস করতে তাহলে সেদিন কি হয়েছিল তোমার। তুমি আমার কোথায় আঘাত করেছিলে তুমি বুঝতেই পারোনি। তোমায় আমি কঠিন শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরেরদিন যখন বললে তুমি আরিফা জামান আর আরিফ জামানের কথা শুনে আমায় ওগুলো বলেছো তখন ভাবলাম তোমায় যেন তেন শাস্তি দিলে হবে না। তোমাকে বোঝাতে হবে অন্যের কথায় নিজের বোনকে কষ্ট দেওয়ার ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে। এমনিতেও অনুশোচনায় দগ্ধ ছিলে তাতে আরেকটু ঘি ঢেলে তোমার কষ্টটা বাড়ানোর জন্য তোমাকে আমার কথা জানালাম নিজের চোখে নিজেকে নিচু করে দিলাম তুমি নিজের জন্য শাস্তি চাইছিলে অথচ আমি তোমায় ক্ষমা করে দিলাম যা তোমাকে কষ্টের অথৈ সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আশা করি এই কয়েকদিন নিজের শাস্তিটাকে ইনজয় করেছো। তোমার এই ছোট্ট বোনটা তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছে মন থেকে এখন আর নিজের চোখে নিচু হতে হবে না। তোমার এই কয়েকদিনেই শাস্তিই তোমার জন্য যথেষ্ট। তোমার ছোট্ট বোনটা তোমার থেকে আর মুখ ফিরিয়ে নেবে না। আর হ্যা মিশু মনি মামা বাড়িতে যাচ্ছে আমিও যাবো তবে আজ না আজকের দিনটা নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার। কাল যাবো দেখা হবে আর হ্যা আমার জন্য চকলেট নিতে কিন্তু ভুলো না। আমার অনেক চকলেট চাই কিন্তু।
অতঃপর ভালোবাসি ভাইয়া আমার বাজপাখি ও চকলেট বয়।

~ ইতি তোমার আদুরে ছোট্ট বোনটা

আরবাজের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। মুখে তৃপ্তির হাঁসি ও চিঠিটাতে চুমু খেয়ে বলল,,

“আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি ফুল। আমি তোর জন্য অনেক অনেক চকলেট নিয়ে যাবো। আর কোনদিন তোকে কোন অভিযোগ করার সুযোগ দেব না। আমার ছোট্ট বোনটা খুব ভালোবাসি । ভাইয়া খুব ভালোবাসে তোকে ফুল।”

মিশু আরবাজের কাঁধে হাত রাখলো। ও মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“মিশু ফুল আমায় ক্ষমা দিয়েছে একেবারে। জানিস ও চিঠি, চকলেট আর ফুল পাঠিয়েছে। ও লিখেছে ও আমায় ভালোবাসে ওর জন্য যেন আমি চকলেট নিয়ে যাই মামা বাড়ি।”

আরবাজ বাচ্চাদের মতো মিশুকে বলতে লাগলো। মিশু হেঁসে বলল,

“মামার বাড়ি যাওয়ার প্ল্যান তো ফুলেরই বাজপাখি?”

আরবাজ মিশুর দিকে তাকালো। আর বলল,

“ফুলের?”

“হুম!”

আরবাজ মিশুর দিকে তাকালো তারপর চোখের পানি মুছে বলল,,

‘মিশু তুই কি ঠিক হয়ে গেছিস? তোকে আমি আগের মিশুর মতো দেখতে পাচ্ছি।”

মিশু হাসলো তা দেখে আরবাজ বুঝলো ও যা ভাবছে তাই। ও বলল,,

“তারমানে সত্যি সুস্থ মিশুমনি ব্যাক!”

মিশু হেঁসে মাথা নাড়ালো। আরবাজ খুশিতে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ও চিৎকার করে কিছু বলতে চাচ্ছিল তখন ও আরবাজের মুখে হাত দিয়ে চুপ করালো। আর বলল,

“বাজপাখি সরষের মধ্যে ভুত আছে । তাই এখনি সবাইকে জানালে চলবে না। ”

“মানে?”

“মানে সব পরে হবে? শুধু শুনে রাখ অনুকে মেরে ফেলার পেছনে আমাকে পাগল করার পেছনে এবং মায়ের মৃত্যুর পেছনে এই বাড়িরই কেউ আছে। তবে কে আছে সেটা সিওর না‌।”

“তুই কি বলছিস এসব?”

“হুম এখন বাদ দাও‌।”

“আচ্ছা তবে তুই সুস্থ হলি কিভাবে?”

“ফুল আমাকে সুস্থ করার ওষুধ দিতো। যার কারনে আমি অনেকটাই ভালো হয়ে উঠছিলাম। তারপর ফুলের সেই এক্সিডেন্ট এর রক্ত দেখে আমার পুরোনো জিনিস মনে পরতে থাকে‌ । সেদিনই সব ক্লিয়ার হয়ে যায় আমার সব মনে পরে আর আমি সুস্থ ও হয়ে যাই।তবে আমি কাউকে বলি নি। তবে ফুল জানে আমি সুস্থ। আর কয়েকদিন আগে বাবা জেনেছে আমি সুস্থ।”

“এতো দিন ধরে তুই সুস্থ আর আমাকে বলিস নি।”

‘আরে চুপ থাক দেয়ালেরও কান থাকে। ফুল মামাবাড়ি যেতে বলেছে ওখান থেকে কি যেন আমাদের দুজনকে বলবে।”

“আচ্ছা। তাহলে গেট রেডি গোয়িং টু মামাবাড়ি।”

আরবাজের কথায় মিশু হেঁসে উঠল। আর বলল,,

“এখান থেকে অর্ধেক চকলেট আমার !”

বলেই মিশু চকলেট এর প্যাকেট টা নিল। তা দেখে আরবাজ বলল,,

“মোটেই না এগুলো আমার বোন আমায় দিয়েছে তাই এই সবগুলো আমার।”

‘দেব না।”

বলেই মিশু দৌড় পেছন পেছন আরবাজ ও দৌড়। এতোক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শেখ শাহনাওয়াজ ছেলেমেয়ের কথা শুনছিল। মুখে তার তৃপ্তির হাঁসি কতো বছর পর আরবাজ আর মিশু আগের মতো দৌড়াদৌড়ি করছে যা শেখ শাহনাওয়াজ কে প্রশান্তি দিচ্ছে। এক পর্যায়ে আরবাজ মিশুকে ধরে ফেলল আর দু’জনেই খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। সবকিছু রুমের ভেতর হওয়ায় কেউ কিছু শুনলো না আর দেখলো না।

______________

মেহবিন নয়টার দিকে গোসল সেড়ে ফুল হাতা সাদা ব্লাউজের সাথে একটা নীল রঙের শাড়ি পড়লো। সে আয়নার সামনে বসে হিজাব বাঁধবে তখনি আগমন ঘটলো আমাদের শেখ তাজেলের মেহবিন কে শাড়িতে দেখে তাজেল বলল,,

“ডাক্তার তুমি দেহি শাড়িও পড়? আইজ প্রথম দেখলাম।”

তাজেলের কথায় মেহবিন ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘নেত্রী তুমি এখন স্কুল ড্রেস পরে এই সময়। স্কুলে যাবে না?”

“যামু তো তার আগে এই দুধটুকু ফিরিজে রাইহা দেও।”

“এটা রাখতেই এসেছো?”

“হ! তা কোনোহানে যাইবা নাকি?

“হুম যাবো।”

“পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালার সাথে ঘুরতে যাবা বুঝি?”

কথাটা শুনে মেহবিন তাজেলের দিকে তাকালো। তা দেখে তাজেল দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“ঐ যে দেহো পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা আর নীল কালারের পাঞ্জাবি পইরা আসতেছে। মুখে আবার মাস্ক লাগাইছে তাও চিনছি দেহো চাইয়া।”

মেহবিন গেটের দিকে তাকালো মুখরই আসছে নীল রঙের পাঞ্জাবি সাদা রঙের পায়জামা মুখে কালো মাস্ক। হাতে গোল্ডেন ঘড়ি দুর থেকেও মুখরকে অনেক সুন্দর লাগছে। তাজেল বলল,,

“দেহো ঐডাই তো পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা তাই না।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“হুম!”

ততক্ষণে মুখর ঢুকলো বাড়িতে তাজেলকে দেখেই মুখর বলল,,

“কি ব্যাপার নেত্রী স্কুলে যাও নি?”

তাজেল হেঁসে বলল,,

‘না আজ ভাবতেছি ডাক্তারের লগে ঘুরতে যামু। দেহো ডাক্তার রেডি ও হইতেছে।”

তাজেলের কথায় মুখর থমকে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। এদিকে মেহবিন তাজেলের কথা শুনে হেঁসে ফেললো। মুখর নিজেকে সামলে বলল,,

‘না আজ আমার সাথে তোমার ডাক্তার ঘুরতে যাবে।”

‘না আমার সাতে যাইবো। আমি আইসা খাড়াই রইছি আগে থাকতে তুমি দেহো না। তুমি পরে আইছো তাই তোমার সাতে ঘুরতে যাইবো না। আমার সাতে যাইবো।”

‘না তোমার ডাক্তার আমার সাথে যাবে। আমাদের আগেই কথা হয়েছে।”

“তো কি হইছে? ডাক্তার আমার সাতে যাইবো তাইনা ডাক্তার কও তুমি।”

মেহবিন এবার জোরেই হেঁসে উঠল। তা দেখে তাজেল ও হেঁসে উঠল। তখন মুখর বলল,,

“এই তোমরা দুজন হাসতেছো কেন?”

মেহবিন বলল,,

‘পাঞ্জাবিওয়ালা আপনিও না। দেখছেন তাজেল স্কুল ড্রেস পরে আছে। তবুও ওর কথা শুনে ওর সাথে ঝগড়া করতে লেগে গেলেন।আপনি পারেন ও বটে।”

তখন তাজেল বলল,,

‘ডাক্তার তোমার জামাই বুকদা।”

মুখর মুখ ঘুরিয়ে বলল,,

‘মোটেও আমি বোকা নই। আমি আগে থেকেই জানতাম তুমি যাবা না তবুও একটু মজা করলাম তাই।”

“হ এহন মজার কথা বইলা নিজের বুকদামি ঢাকতেছো?”

‘না আমি সত্যি কথাই বলছি।”

“হইছে হইছে শেখ তাজেল এহন আর ছোট নাই পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা। শেখ তাজেল এহন বড় হইছে আর সে স্কুলেও যায় বুঝছো?”

‘হুম বুঝলাম। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তুমি স্কুলে যাবে না।”

“হ যাইতেছি আমারে খেদানের জন্যে আবার আমার স্কুলের তাড়া দেহায়তেছো?”

‘আমি কোথায় তোমাকে তাড়াতে চাইলাম। আমি তো তোমার স্কুলে দেরি হবে বলে বললাম।

“আমি সব বুজি আমি শেখ

এইটুকু বলার পর মুখর ওর সাথে তাল মিলিয়ে বলল,,

“হ হ তুমি শেখ তাজেল আর ছোট নাই।”

মেহবিন কি বলবে এদের দু’জনের কথা শুনে হাঁসিই থামছে না। যদিও এ হাসির শব্দ নেই। তাজেল আর মুখর ও এবার হাসলো। তাজেল মেহবিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,

“স্কুলে গেলাম ডাক্তার। আল্লাহ হাফেজ!”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“আল্লাহ হাফেজ!”

‘আর পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা ডাক্তাররে দেইহা রাইহো কেউ জানি আবার ডাক্তাররে নিয়া যায় না। আইজক্যা ডাক্তাররে শাড়িতে মেলা সুন্দর লাগতেছে।”

তখন মুখর বলল,,

“তা আর বলতে নেত্রীর ডাক্তার তাকে না দেখলে চলবে। যদি কিছু হয় তাহলে তো ডাক্তারের নেত্রী আমার গর্দান নেবে।”

‘হ মনে জানি থাহে আমি গেলাম। আল্লাহ হাফেজ আর সাবধানে যাইয়ো।”

‘হুম তবে নেত্রী আজ কিন্তু তোমার ডাক্তার বাড়ি ফিরবে না।”

মুখরের কথায় মেহবিন ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তখন তাজেল বলল,,

“কেন তোমার সাতে থাকবো?”

“হুম আমার সাথে থাকবে।”

“আইচ্ছা।”

তাজেল হেঁসে চলে গেল। মুখর তাজেলের দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘তুমি খুব লাকি বিহঙ্গিনী যে তোমার জীবনে তোমার নেত্রী আছে।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“হুম তা তো বটেই।”

“আমিও খুব লাকি যে আমার জীবনে বিহঙ্গিনীর মতো উত্তম জীবনসঙ্গী আছে।”

মেহবিন হাসলো কিছু বললো না। মুখর দেখলো মেহবিনের কুচি ঠিক নেই। তাই ও ওর সামনে বসে ওর কুঁচি ধরলো। মেহবিন হেঁসে ওর কুঁচি ঠিক করলো। তারপর মুখর সাদা রঙের হিজাবের সাথে সাদা রঙের নিকাব বেঁধে দিল। । সম্পুর্ন রেডি হওয়া শেষে মুখর মেহবিনের গালে হাত রেখে বলল,,

‘মাশাআল্লাহ মনে হচ্ছে এক টুকরো নীল আকাশ আমার সামনে দাঁড়িয়ে।”

বলেই কপালে একটা প্রেমের পরশ একে দিল। মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘শুকরিয়া জনাব। আপনাকেও অনেক সুন্দর লাগছে কাব্য মাশাআল্লাহ!”

“হুম শুকরিয়া তো এখন যাওয়া যাক! তা প্রথমে কোথায় যাবে?

‘আজকের দিনটা আপনার নামে আপনি যেথায় ইচ্ছা সেথায় যান।’

মুখর হাসলো তারপর মেহবিনের হাত ধরে সব তালা দিয়ে বের হলো। এখন ওদের একসাথে দেখলেও সমস্যা নেই সবাই জানে সে বিবাহিত। পাকা রাস্তায় আসতেই দেখলো গাড়ি দাঁড় করানো। মুখর গাড়ির দরজা মেহবিন কে বসতে বলল। মেহবিন বসলো এরপর মুখর নিজেও উঠলো। কিন্তু মুখর গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে না দেখে মেহবিন বলল,,

“কি হলো?”

“এক মিনিট!”

বলেই মুখর পেছনের সিট থেকে দু’টো সাদা ক্যাপ বের করলো। সোনালী রঙের KABBER BIHONGGINI লেখা ক্যাপটা মেহবিনের মাথায় পড়িয়ে দিল। আর BIHONGGINIR KABBO লেখা ক্যাপটা মেহবিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে পরিয়ে দিতে বললো। মেহবিন হেঁসে পরিয়ে দিল। মাঝে মাঝে এর বাচ্চামো দেখে মেহবিন হাসে। অতঃপর মুখর গাড়ি স্টার্ট করলো। ঘন্টা দুয়েক পর মুখর ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো। তা দেখে মেহবিন হেঁসে বলল,,

“এই প্রথম কাউকে দেখলাম যে এরকম একটা দিনে সেজেগুজে হাসপাতাল ঘুরতে আসে।”

মুখর হেঁসে বলল,,

‘এইখানেই তো কাব্য তার বিহঙ্গিনীর দেখা পেয়েছিল। তাই এখানেই আসলো।”

মুখর বের হলো তারপর মেহবিনের পাশের দরজা খুলে হাত বাড়ালো মেহবিন মুচকি হেসে মুখরের হাত ধরে নামলো। বেশ কয়েকবছর পর মেহবিন এখানে এলো। মুখর ওর হাত ধরে ভেতরে ঢুকলো। সবাই আড়চোখে ওদের দেখছে তাতে এদের দুজনের কিছু যায় আসে না।মুখর একটা জায়গায় থেমে বলল,,

“ঠিক এই যায়গাতেই মুখর শাহরিয়ার কাউকে দেখে থমকে গিয়েছিল।জানো দাদিজানের ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল রাস্তায় একটা মেয়ে তাকে হাসপাতালে আনে। আমিও খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসি। তাড়াতাড়ি করে আসতে গিয়ে একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগে। মেয়েটার হাতে কিছু জিনিসপত্র ছিল ওগুলো পরে যায়। আমি সরি বলে উঠিয়ে দিই মেয়েটাও ইটস্ ওকে বলে। তার এই সহজতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি তার দিকে তাকাই দেখি এক বোরকা হিজাব পড়া মেয়ে। আমি তাড়াতাড়ি করে দাদিজানের কাছে যাই। তার কিছুক্ষণ পর দেখি মেয়েটা দাদিজানের কেবিনে এলো পরে জানতে পারি সেই যে দাদিজান কে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। তাকে ধন্যবাদ জানাবো এমন সময় তার ফোন আসে। সে বলে তার যেতে হবে বলেই সে বাইরে আসে আমিও পেছনে বের হই পরে দেখি সে দৌড়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম হয়তো কোন অসুবিধায় পরেছে আমিও গেলাম। দেখলাম সে ঢাকা মেডিকেল ক্যাম্পাসে ঢুকছে আমিও ঢুকলাম সে সোজা কলেজের স্টোর রুমের দিকে গেল। মেয়েটা গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো তখন একটা মেয়ে কোন রকমে বের হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা সেই মেয়েটাকে শান্ত করলো কি যেন জিজ্ঞেস করলো তারপর মেয়েটার হাত ধরে কোথাও নিয়ে যেতে লাগলো। সোজা থামলো একটা ছেলের সামনে মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো এই ছেলেটায় কি না। মেয়েটা ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ালো। মেয়েটা কোনকিছু না ভেবে ছেলেটাকে থাপ্পড় মারলো। ছেলেটা মারতে এলেই মেয়েটা ঘুষি মেরে দিল। মুহুর্তেই সেখানে ছোটখাটো একটা জটলা বেঁধে গেল। মেয়েটা ছেলেটাকে মারতে লাগলো তখন কতো গুলো মেয়ে এসে ঐ মেয়েটাকে ছাড়ালো। পরে জানলাম ঐ ছেলেটা তার রুম মেটের মানে ঐ মেয়েটা যে স্টোর রুমে ছিল তার সাথে মিসবিহেব করেছিল। আর আমি মেয়েটার সাহসিকতা ও সহজতায় আটকে গিয়েছিলাম। তুমি জানো সেই মেয়েটা কে?

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“না!”

তখন মুখর বলল,,

“সেই মেয়েটা তুমি বিহঙ্গিনী?”

‘তাই বুঝি আপনি না বললে তো জানতেই পারতাম না।”

“মজা করছো?”

‘না তো!”

“তুমিও না!”

“তা এখন কি এখানেই থাকবেন নাকি যাবেন?”

“হুম চলো।”

মুখর আর মেহবিন ঢাকা মেডিকেল ক্যাম্পাস ঘুরলো। তারপর ওখানে থাকা দোকান থেকে ফুচকা খেল। ফুচকা খাওয়ার সময় মুখর মেহবিনের নিকাব ধরে রেখেছিল। তা দেখে কতোজনে মুচকি মুচকি হাসছিল। দুপুর হয়ে যাওয়াতে মেহবিন আর মুখর একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো আলুওয়ালা কাচ্চি খেতে। মুখর আজকেও মেহবিন কে খায়িয়ে দিল আজ অবশ্য মেহবিন মুখরকেও খায়িয়ে দিল। এরপর ওরা একটা ফুলের দোকানের সামনে গেল । অনেকগুলো অর্কিড আর গোলাপ ফুল কিনলো একটা বেলি ফুলের মালাও কিনলো‌। বেলি ফুলের মালা হাতে জড়িয়ে দিল মুখর। আর ফুলগুলো দিয়ে বলল,,

“এ কয়েকমাসে আমাদের অনেকবার দেখা হয়েছে কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পরে ফুল দেওয়া হয় নি। আজকেও দেওয়া হয়নি। তাই এখন সব সুদে আসলে দিয়ে দিলাম।”

ফুলগুলো এতোই বেশি ছিল যে মেহবিনের হাতে জায়গা হলো না। ও পেটের সাথে মিশিয়ে দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো। তখন পাশেই একটা কাপল ছিল মেয়েটা ছেলেটাকে গুতো মেরে দেখালো যে এভাবে ভালোবাসতে হয়। বেচারার আর কি সে একবার মানিব্যাগের দিকে তাকালো আবার মেয়েটার দিকে। মেয়েটার দিকে ছেলেটা হেঁসে বলল,,

‘আপাতত এই একমুঠো ফুলেই সন্তুষ্ট হও প্রিয়তমা। একটু ধৈর্য্য ধর যখন তোমার প্রিয়তমের অনেক টাকা হবে। তখন তোমার প্রিয়তম এর থেকেও বেশি খুশি তোমায় কিনে দেবে প্রমিস।”

ছেলেটার কথায় মেয়েটা হেঁসে ফেলল আর বলল,,

“আমি কি বলেছি কিনে দিতে আমি তো বলছিলাম তাদের ভালোবাসা দেখতে। তোমার এই একমুঠো ফূলেই আমি সন্তুষ্ট । আমি জানি তো আমার প্রিয়তমের যখন অনেক টাকা হবে তখন সে আমায় অনেক খুশি কিনে দেবে।”

এই সবকিছুই মেহবিন আর মুখর শুনলো। মুখর হেঁসে আরো কতগুলো ফুল কিনলো আর মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,

‘এই ফুলগুলো সুন্দর চিন্তা রাখার মানুষটার জন্য।”

মেয়েটা ছেলেটার দিকে তাকালো ছেলেটা হেঁসে মাথা নাড়ালো। মেয়েটা তার দেখে ফুলগুলো নিয়ে ধন্যবাদ জানালো। মেহবিন হাসলো তারপর এগিয়ে গিয়ে ফুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলল,,

‘এগুলো ধরুন। এখন আমি গাড়ি ড্রাইভ করবো।”

বলেই মেহবিন চলে এলো তখন মেয়েটা বলল,,

“আপু মনে হয় রাগ করলো ভাইয়া? তাই চলে গেল এভাবে?

মুখর হেঁসে বলল,,

“না আপু সে রাগে নি বরং খুশি হয়েছে কারন এই ফুলের জন্য আপনার মুখে হাঁসি ফুটেছে। সে ফুলগুলো আমায় দিল কারন তার ক্যারি করতে কষ্ট হচ্ছিল আর গাড়ি সে চালাবে কারন আমি আজ অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চালাচ্ছিলাম।”

“না ভাইয়া আপু জেলাস থেকেই এরকম করেছে। আমিও একটা মেয়ে তাই আমি বুঝি।’

তখন পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,,

“যে মানুষটার সমস্তটা জুড়ে আমি‌ । তার কাউকে কয়েকটা ফুল দেওয়া তে কি জেলাস হবো নাকি। মানুষটাই যেখানে আমার সেখানে জেলাসি রেখে সম্পর্কের কেন অবনতি ঘটাবো বলুন। সবথেকে বড় কথা আমরা একে অপরকে আমি বিশ্বাস করি। এখন যদি আমার সবগুলো ফুল ভাইয়াকে দিয়ে দিই তবুও সে কিছুই করবে না। বরং সে হেঁসে আমায় দোকান থেকে আরো ফুল কিনে দেবে। কাব্য আসুন আমরা আমাদের যেতে হবে।”

মেহবিনের কথায় মুখর হাসলো আর বলল,,

“কাব্যের বিহঙ্গিনীর আলাদা বিশেষত্ব আছে আপু। সবার মতো তাকে ভাবলে শূন্য হাতে ফিরতে হবে। যাই হোক আসছি।”

ছেলেটা হেঁসে বলল,,

“আপনার নামকি কাব্য?”

“না সে আমায় কাব্য বলে ডাকে। ”

মুখর ওখান থেকে চলে এলো। গাড়িতে এসে বলল,,

‘ফুলগুলো ছেলেটাকে দিয়ে আসলেই পারতে তাহলে!”

“দিলে আপনি খুশি হতেন বুঝি?”

‘হতাম তো আমার বউ হয়ে অন্য একজন কে ফুল দিচ্ছো খুশি হতামই তো। আমি তো আর তুমি নই আমার জেলাসি আছে।”

‘তাহলে ওখানে যে ডায়লগ দিলাম সেটা ভুল হয়ে গেল।”

“আরে তুমি সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছো? আমি তো মজা করছিলাম।”

“হুম হুম বুঝি আমি। আমি আর শেখ তাজেলের মতো আর ছোট নাই।”

কথাটা শুনে মুখর ওর দিকে তাকালো ওর দিকে তাকাতেই মেহবিন ও তাকালো আর দুজন একসাথেই হেঁসে ফেলল। বাইরে থেকে ঐ ছেলেমেয়ে দুটো দেখলো। যদিও ওদের কারোরই মুখ দেখেনি তারা তবে উপলব্ধি করেছে অনেক সুন্দর চিন্তাধারার মানুষ তারা। মেহবিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। বিকেল হয়ে এসেছে ওরা ফুটপাতে নামলো হাতে হাত রেখে অনেকক্ষণ ঘুরলো। তারপর একটা শুনশান লেকে ওদের গাড়ি থামলো। এটা একটা নির্জন এলাকা মানুষ জন নেই। আর এই লেকে বেঞ্চ ও নেই। মেহবিন নেমে বড় গাছটার নিচে ঘাসের ওপর বসলো। মুখর ও বসলো। মুখর মেহবিনকে বলল নিকাব খুলে ফেলতে ও নিকাব খুলে ফেলল। মুখর হেঁসে মেহবিনের হাতে হাত রাখলো। মেহবিন মুখরের কাঁধে মাথা রেখে বিকেলটা অনুভব করতে লাগলো। সন্ধ্যে হয়ে এলো। আজ মেহবিন কিছুই বলছে না যে ওদের ফিরতে হবে।কারন আজকের দিনটা মুখরের নামে। সন্ধ্যা হতেই মুখর মেহবিন কে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিল। তারপর গাড়িতে উঠলো। তারা মহুয়াপুরে ফিরে গেল তবে মেহবিনের বাড়িতে নয়। মুখরের বাড়িতে ওরা বাড়িতে পৌঁছালে মুখর একটা লাল শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলল ফ্রেশ হয়ে পরে আসতে। মেহবিন হেঁসে শাড়িটা নিয়ে চলে গেল। ও শাড়িটা পরতে বেরুতেই এদিকে মুখর ক্যান্ডেলাইট ডিনার এরেন্জ করে ফেলল।টেবিলে ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে খাবার সার্ভ করলো নিজেও ফ্রেস হয়ে একটা সাদা পাঞ্জাবি পরে এলো। মেহবিন রুম থেকে বের হতেই দেখলো অন্ধকার একটু আগাতেই দেখলো মুখর ক্যান্ডেল হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। মুখর মেহবিনের হাত ধরে টেবিলে বসিয়ে দিল। ওখানে যেতেই মেহবিন অবাক হয়ে গেল টেবিলটা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো সেই সাথে ক্যান্ডেল জ্বালানো। মুখর হেঁসে বলল,,

“ফর মাই বিহুঙ্গিনী।”

“ক্যান্ডেলাইট ডিনার ইন হোম। ডেকোরেড বাই মুখর শাহরিয়ার।”

“অনলি ফর ইউ।”

মেহবিন হাসলো তখন মুখর বলল,,

“লাল শাড়িতে মোমবাতির আলোতে অদ্ভূত সৌন্দর্য গ্ৰাস করছে তোমায় বিহঙ্গিনী।”

‘শুকরিয়া এবং সাদা পাঞ্জাবিতে মোমবাতির আলোতে আপনাকেও দারুন লাগছে।”

“হুম শুকরিয়া। তো খাওয়া শুরু করা যাক।’

ওরা দুজনে একসাথে খাবার খেল। মুখর সব কিচেনে রেখে এলো। মুখর হুট করেই মেহবিনকে কোলে তুলে নিল। আর অন্য একটা রুমে নিয়ে গেল। সেই রুমটাও আজ মোমবাতি দিয়ে সাজানো। ড্রেসিং টেবিলে ফুল রাখা। মুখর বিছানায় নিয়ে বসালো। তারপর মেহবিনের বরাবর বসে তারপর মেহবিনের চোখে চোখ রেখে বলল,,

“তুমি যদি আকাশ হও,
আমি না হয় মেঘ হয়ে তোমাতেই বিচরণ করবো।
তুমি যদি চাঁদ হও,
আমি না হয় তোমার জোসনা হয়ে আলো ছড়াবো।
তুমি যদি মেঘ হও,
আমি না হয় তোমার বৃষ্টি হয়ে ঝরবো।
তুমি যদি ঝর্ণা হও,
আমি না হয় তোমার ধারা হয়ে বয়ে চলবো।
তুমি যদি সাগর হও,
আমি না হয় তোমার ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়বো।
তুমি যদি পাহাড় হও,
আমি না হয় আরোহী হয়ে তোমাকে জয় করবো।
তুমি যদি ফুল হও,
আমি না হয় ভ্রমর হয়ে গুনগুনিয়ে তোমায় গান শোনাবো।
তুমি যাই হও না কেন,
আমি শুধু তোমারই হবো।

~ শাকিল হোসেন
(কাব্যের বিহঙ্গিনী গল্পের একজন পাঠক বিহঙ্গিনীর জন্য লিখে পাঠিয়েছেন।)

কবিতাটা শুনে মেহবিন মুগ্ধ হয়ে গেল। ও কিছু বলবে তার আগে মুখর বলল,,

“আজ যদি বিহঙ্গিনীকে রাতটাও তার কাব্যের নামে করে দিতে বলি তাহলে কি সে করবে?”

মেহবিন হেঁসে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,,

“যদি না বলি তাহলে কি সে মানবে?”

মুখর হেঁসে বলল,,

“জানি সে না বলবে না। তাই আমার ও মানা না মানার কোন দায় নেই‌।

মুখর মেহবিনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,,

” দিনশেষে আজ বিহঙ্গিনীর কাব্যের ইচ্ছে, বিহঙ্গিনী তার কাব্যের ভালবাসার রঙ দ্বারা রঙিন হোক।”

মেহবিন ও হেঁসে ফিসফিস করে বলল,,

“অতঃপর বিহঙ্গিনীর কাব্যের তার ইচ্ছের পূর্নতা পাক।”

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪৮
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

সকালে মুখের ওপর হালকা পানি পড়তেই চোখ খুললো মুখর। চোখ খুলে তার বিহঙ্গিনীকে কালো শাড়িতে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সে। চুল দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। আর তার বিহঙ্গিনী এক হাত দিয়ে চুল মুচছে ইশশ কি নিদারুন দৃশ্য। চুল মুছতে মুছতে মেহবিনের নজর পড়লো মুখরের দিকে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে মুখর। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“উঠে পরেছেন আমি এখনি আপনাকে ডাকতাম!

মুখর হেঁসে বলল,,

“না ডেকেই ভালো করেছো । তুমি ডাকলে কি আর এই চুল মুছার নিদারুণ দৃশ্য দেখতে পেতাম। আবার ডাকলেও আলাদা এক দৃশ্য হতো চোখ খুলতেই তোমার মুখটা একদম কাছ থেকে দেখতে পেতাম। দুটোই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তবে এর আলাদা আলাদা বিশেষত্ব আছে। ”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“কি সকাল সকাল শুরু করে দিলেন তো? শুনুন পছন্দের মানুষটার সবকিছুই সুন্দর মনোমুগ্ধকর লাগে আমাদের। শুধু তার সঙ্গটা প্রয়োজন ব্যস।”

“তা আমার এই ঘুম থেকে উঠার দৃশ্যটা কি তোমার মনোমুগ্ধকর লাগছে বিহঙ্গিনী?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“হুম অনেক হয়েছে এবার ফরজ গোসলটা সেরে ফেলুন। সূর্য মামা উঠে পরেছে বেশ খানিকটা আগেই । ফজরের নামাজ কাযা হয়ে গেছে।”

“কথা ঘুরাচ্ছো তুমি।”

“হ্যা ঘুরাচ্ছি এই যে টাওয়াল যান গোসলে যান। আমি অপেক্ষা করছি একসাথে ফজরের কাযা সালাত আদায় করবো।”

“নামাজ পরতে হবে বলে এই যাত্রায় বেঁচে গেলে।”

বলেই মুখর মেহবিনের থেকে টাওয়াল নিয়ে চলে গেল। মেহবিন আয়নায় নিজেকে দেখলো। কাল ওদের দুজনের ভালোবাসাময় একটা রাত গেছে। এতক্ষন যাবৎ নিজেকে অনেকটাই সামলে রেখেছে মেহবিন কিন্তু মুলত তার লজ্জা লাগছে মুখরের দিকে তাকাতে। মুখর গোসল শেষ করে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে আসতেই দেখলো মেহবিন জায়নামাজ বিছিয়ে হাতে মুখরের টুপি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখর গিয়ে মুচকি হেঁসে মেহবিনের কপালে ছোট্ট প্রেমের পরশ দিল তারপর হাত থেকে টুপি নিয়ে নামাজে দাঁড়ালো। দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করে নিল ‌। মেহবিন রান্না ঘরে গেল রান্না করবে বলে। কাপড়ে একটু সমস্যা হচ্ছে দেখে ও আঁচলটা কোমরে গুঁজে নিল। চুল ভেজা থাকলেও খোঁপা করে নিল। এই দৃশ্যটা মুখর দেখলো আর এই দৃশ্যটা ওর অন্যরকম সুন্দর লাগলো। কারন এইরকম দৃশ্য সে আজ প্রথম দেখলো। মেহবিন পেঁয়াজ মরিচ কাটতে লাগল ফ্রিজে মাংস ছিল সেটা সে আগেই বের করে ‌ ভিজিয়ে রেখেছিল। রুটি বানাবে আর কষা মাংস রান্না করবে সে‌। কাটাকাটি শেষ করে কড়াইতে তেল দিল একটু গরম হতেই তখন মুখর পেছন দিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো আর বলল,,

“এই রকম দৃশ্য দেখতে যে কতোদিন অপেক্ষায় ছিলাম তা বলার মতো না। কোমরে কাপড় গুঁজে হাতখোপা করে রান্না করা।ইশশ কি নিদারুন দৃশ্য!

“হুম অনেক হয়েছে এখন ছাড়ুন। তেল গরম হয়ে গেছে‌।”

“হুম সরো সরো আজ রান্না আমি করবো।”

বলেই মেহবিনকে সরিয়ে সে দাঁড়ালো। মুখর রান্না জানে। সে পেঁয়াজ আর মরিচ তেলের ভেতরে দিয়ে দিল। তারপর বলল,,

“দেখবে তোমার জামাই আজ কি রকম রান্না করে।”

“হুম তা তো দেখবোই। তবে সে এই রান্নাটা করতে পারলেও, সে কি রুটি গোল করতে পারবে হুম?”

“তুমি রুটি বানাতে চেয়েছিলে?”

“হুম গরম গরম রুটি আর কষা মাংস ইশশ কি দারুন খেতে‌। যদিও চালের আটা হতো তাহলে আরো বেস্ট হতো।”

“আরো দুই টা রুটি দেই তোমায়? দেখো কি স্বাদ।”

মুখরের এমন কথায় মেহবিন হাসলো। আর বলল,,

“হুম অনেক হয়েছে আপনি মাংস রান্না করুন আর আমি রুটি করছি।”

“হুম কাজকাম ভাগ করে করলে ভালোবাসা বাড়ে।”

মেহবিন হেঁসে ময়দা নিল । মুখর মাংস রান্না করছে আর মেহবিন রুটি বানাচ্ছে দুজন খুনসুটিও করছে। মুখর আর মেহবিনের মুখে তৃপ্তির হাঁসি। রান্না করা শেষ হলো দু’জনে খেতে বসলো। মুখর মেহবিনকে খায়িয়ে দিল। মুখর আজ পুলিশ স্টেশনে যাবে। মুখর বলল,,

“তোমার তো আজ ও ছুটি কারন শুক্রবার। তো তোমায় বাড়ি নামিয়ে দিয়ে যাবো?”

“না আমি মামাবাড়িতে যাবো। বাজপাখি আর ফুল ওখানে। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসবো।”

“আচ্ছা তা সেদিন তো তোমার মামাবাড়ি থেকে কেউ এলো না?”

“এসেছিল কিন্তু ওখানে যায় নি। যাই হোক আগেরবার পরার জন্য কিছু ছিল না দেখে পাঁচটা শাড়ি আর দুইটা বোরকা এনে রেখেছেন যা দেখে আই এম ইমপ্রেজড।”

“তো আমার বউ মাঝে মাঝে আসবে সবসময় কি আমার জিনিস পরবে নাকি।”

“কেন আপনার টা পড়াতে আপনার সমস্যা হয় নাকি।”

“তা হবে কেন? তবে আমি আমার বউকে শাড়িতেই দেখতে বেশি পছন্দ করি।”

“হুম এখন রেডি হোন আমিও হবো। মামা স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে বলেছে।”

দু’জনেই রেডি হলো। মেহবিন কালো শাড়ির ওপরে বোরকা আর হিজাব বাঁধলো শুধু। মুখর মেহবিন কে মুগ্ধ চোখে দেখছিল তা আয়নায় দেখতে পেয়ে মেহবিন মাথা উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো,,

“কি?”

মুখর হেঁসে মেহবিনের পাশে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে বলল,,

“সবাই বলে স্থানের দূরত্ব নাকি মনের দূরত্ব বাড়ায়। অথচ আমি বলি তার দূরত্বের জন্য অপেক্ষাটা আমার মুগ্ধতা বাড়ায়। চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল নয়। সে তো সবসময় মনেই থাকে তাহলে দূরত্ব তৈরি হবে কোথা থেকে।”

মেহবিন মুচকি হাসলো । তা দেখে মুখর আবার বলল,,

“তার এই মুচকি হাসির কারন আমি এইটা ভেবেই বুকে প্রশান্তি ছেয়ে যায়।”

মেহবিন মুখরের দিকে ঘুরলো। মুখর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘তাকে প্রথমবার দেখি মনে আনন্দ হয় এরপর বারবার দেখি মনটা আনন্দে নেচে উঠে। মনে হয় শুধু তাকে দেখতেই থাকি দেখতেই থাকি,,,

মেহবিন মুখরের ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল,,

“অনেক হয়েছে এখন বন্ধ করুন কাব্য।”

মুখর মুচকি হেঁসে আঙ্গুল সরিয়ে বলল,,

“তোমায় নিয়ে বললে শেষ করতেই ইচ্ছে করে না। যেমনভাবে ভালোবাসা শুরু কর,,

এবার মেহবিন মুখরের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তা দেখে মুখর হাসলো। আর মেহবিন কে জড়িয়ে ধরলো। মেহবিন ও মুখরের বুকে লুকালো। মুখর বলল,,

“কালকের মতো দিন আর রাত আমাদের জীবনে বারবার আসুক বিহঙ্গিনী!”

মেহবিন কিছু বললো না। সে মুখরকে ছেড়ে রেডি হয়ে নিল। মুখর মেহবিন কে স্টেশনে নামিয়ে দিতেই দেখলো মেহবিনের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। মেহবিন হেঁসে আল্লাহ হাফেজ বলে চলে গেল।

_______________

“আজ কিন্তু আমি ঘুম থেকে উঠেই আসিনি ফুলের মামাতো ভাই। আজ আমি ফ্রেশ হয়ে ভালোভাবে এসেছি।”

প্রতিদিনের মতো আজ ও মিহির ফুল গাছে পানি দিচ্ছিল। মিশুর কথায় ও সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কাল রাতেই মিশু আর আরবাজ এসেছে। মেহরব চৌধুরী আরবাজের ওপর একটু রেগে থাকলেও মেহবিনের কথায় সব ভুলে ভাগ্নে কে আপন করে নিয়েছে। কাল রাতে মিহিরের সাথে ওদের দেখা হয় নি। কারন মিহিরের অফিস থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছিল। মিহির অবাক হয়ে বলল,,

“তুমি এখানে কিভাবে? মেহু এসেছে নাকি? কই আমায় তো কেউ কিছু বললো না।”

মিশু হেঁসে বলল,,

“না ফুল আসেনি আমি আর আমার ভাই এসেছি আমাদের মামাবাড়ি।”

“তারমানে তুমি জেনে গেছো এটা তোমার ও মামাবাড়ি?”

“হুম সেই সাথে আরো অনেক কিছু জেনেছি। আচ্ছা তোমার চোখ কি এটা পরে লাগিয়েছো?

মিশুর কথায় মিহির অবাক হয়ে যায়। ও নিজেকে সামলিয়ে বলল,,

“চোখ আবার পরে লাগায় কিভাবে? চোখ তো সবার জন্ম থেকেই থাকে।”

“তাহলে কি মুখ পাল্টিয়েছো?”

এবার মিহির থমকে গেল। ও প্রসঙ্গ বদলে বলল,,

“এতো সকাল সকাল তুমি এখানে কি কর?”

“তুমি জানো আমার অনুরও ফুল গাছ খুব পছন্দের ছিল। সেও প্রতিদিন নিয়ম করে তার ফুল গাছে পানি দিতো।”

“তোমার অনু এখন কোথায়?”

“ঐ যে তোমার চোখে!”

মিহির ফট করে মিশুর দিকে তাকালো। মিশু হেঁসে বলল,,

“তোমার চোখদুটো একদম আমার অনুর মতো।”

মিহির অন্য দিকে ঘুরে গেল। তখন আরবাজ এলো। আরবাজ এগিয়ে গিয়ে মিহিরের সাথে কুশল বিনিময় করলো। আরবাজের সাথে আদর ও এসেছে ও গিয়ে মিশুর হাত ধরে নিচে নিয়ে গেল। মিহির অবশ্য আড় চোখে সবটাই দেখলো। ওঁরাও নিচে এলো ব্রেকফাস্ট করার সময় হয়ে গেছে। মেহরব চৌধুরী তার ভাগ্নে ভাগনির জন্য এলাহী আয়োজন করেছে। মেহরব চৌধুরী বললেন,,

“মিশুমনি আজ তো ফুল নেই আর বাবাও নেই আজ আমি তোমায় খায়িয়ে দিই।”

মিশু হেঁসে বলল,,

“আমাকে খায়িয়ে দিলে তোমার ছেলেমেয়েরা আবার রাগ করবে না তো মামা।”

তখন মাইশা বলল,,

“না মিশু আপু রাগ করবো না কারন তোমার সাথে আমিও খাবো বাবার হাতে।”

তখন আরবাজ আর মিহির বলল,,

“তাহলে আমরা দুজন বাদ যাবো কেন শুনি?”

সবার কথা শুনে মেহরব চৌধুরী হাসলেন আর বললেন,,

“ঠিক আছে চারজন কেই খায়িয়ে দেব।”

তখন আদর বলল,,

“এই যে তোমরা চারজন কি কুট্টি বাবু নাকি যে তোমাদের খায়িয়ে দিতে হবে।”

তখন মেহরব চৌধুরী হেঁসে বললেন,,

“বাবা মায়ের কাছে তার ছেলে মেয়েরা কখনো বড় হয় না।”

“আচ্ছা তাহলে আমায় খায়িয়ে দেবে কে?”

মিশু আদরকে নিজের কাছে নিয়ে বলল,,

“আজ মনি তোমায় খায়িয়ে দেবে আদর?”

“তুমি পারবে সিওর তো!”

“হুম সিওর পারবো‌।”

“তাহলে ঠিক আছে।”

মেহরব চৌধুরী চারজন নিয়ে নিচে বসলেন মিসেস মেহরব চৌধুরী পাটি বিছিয়ে দিলেন। তিনিও তাদের সাথে বসলেন মেহরব চৌধুরী চারজনকে খাওয়ালেন আর মিশু আদরকে খায়িয়ে দিল। মেহরব চৌধুরী আর মিসেস চৌধুরী সবার পরে একসাথে খেলেন। সবাই বেশ খুশি তবে যারা কাজের লোক গার্ডস ছিল তারা সবাই অবাক হয়েছে একজন মন্ত্রী হয়েও কোন অহংকার নেই। তার ভাগনে ভাগনি আর ছেলে মেয়েদের জন্য সে মেঝেতেই পাটি বিছিয়ে বসেছে। আজ মিহির আর মাইশার অফিস বন্ধ। তারা কেউ অফিস যাবে না।

ঘন্টাখানেক পর মেহবিন আসলো। মেহবিনকে দেখে আদর দৌড়ে তার কোলে উঠলো। মেহবিন সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। মিশু এসে মেহবিন কে জরিয়ে ধরলো। মেহবিন আড় চোখে একবার আরবাজের দিকে তাকালো। তারপর নিজের বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো আরবাজ হাঁটু গেড়ে বসে এক হাত দিয়ে কান ধরে রয়েছে আরেক হাতে বড় এক বক্স চকলেট ধরে রয়েছে। মেহবিন মুচকি হেঁসে সেদিকে এগিয়ে গেল আরবাজ কান ধরে বলল,,

“সরি আমার মিষ্টি বোনটি!”

মেহবিন হেঁসে আরবাজকে উঠিয়ে ওর হাত থেকে চকলেট নিয়ে বলল,,

“ইটস্ ওকে!”

“সরি বললাম তো একবার জড়িয়ে ধরবি না।”

মেহবিন হেঁসে আরবাজ কে জড়িয়ে ধরলো। তখন পেছন থেকে কেউ বলল,,

“এই যে দুই ভাইবোন আমিও কিন্তু আছি।”

আরবাজ হেঁসে এক হাত বাড়িয়ে দিল। মিশু দৌড়ে এসে আরবাজ কে জড়িয়ে ধরলো। তিন ভাইবোন একসাথে হেঁসে ফেলল। তিন ভাইবোন মিলে কিছুক্ষণ খুনসুটি করলো। দুপুর হয়ে এলে সবাই একসাথে খাবার খেল। মেহবিন এক ফাঁকে মিশু কে নিয়ে নিজের রুমে গেল। তারপর মিশুর কোলে শুয়ে বলল,,

“আজ আমি মিশুমনি আর অনুভবের কাহিনী শুনতে চাই।”

“এই জন্যই কি মামারবাড়ি আসার প্ল্যান করেছিস?”

“কিছুটা এখন ওসব বাদ দিয়ে বলো তো! মিশু তার অনুভবের সাথে কোথায় কিভাবে পরিচয় হলো। আর তাদের শেষই বা কোথায় হলো।”

মিশু মেহবিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে শুরু করলো,,

“অনুভব ছিল আমার তিন বছরের সিনিয়র। নতুন ভার্সিটিতে উঠে প্রথমদিনই সিনিয়রদের র্যাগিং এর স্বীকার হলাম। আর তখন অনুভব এসে আমায় বাঁচিয়ে নিল সাথে যারা র্যাগ দেওয়া সিনিয়রদের ও অপমান করলো। সে ছিল ভার্সিটির পরিচিত মুখ। প্রথমদিনই তার ওপর মুগ্ধ হলাম। এভাবেই দিন চলতে লাগলো। বছর দুয়েক পার হয়ে গেল। মাঝখানে কতোবার চোখাচোখি হলো কতোবার কথা হলো কতোবার আমায় সাহায্য করলো। তার ব্যক্তিত্ব সবার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো আমায় সবসময় মুগ্ধ করতো।এভাবেই একটা সময় দু’জনেই দুজনের প্রতি কিছু ফিল করলাম। কিন্তু কেউ কাউকে নিজের অনুভূতি জানালাম না। অনুভবের মাস্টার্স শেষ হলো ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে একটা চাকরি ও পেয়ে গেল। সে একজন মেয়েকে ভার্সিটিতে ভর্তি করার জন্য নিয়ে এসেছিল । তার সাথে একটা মেয়েকে দেখে ভাবলাম হয়তো অনুভবের কাছের কেউ রাগে দুঃখে আমি কেঁদেই ফেললাম আর সরাসরি তাকে গিয়ে বললাম আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।

মেহবিন মনোযোগ দিয়ে শুনছিল হুট করে বোনের এতো সাহস দেখে ও অবাক হয়ে বলল,,

“তুমি মেয়ে হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য প্রপোজ করলে?’

‘তো মেয়ে হয়েছি তো কি হয়েছে তাদের কি আগে ফিলিংস শেয়ার করার অধিকার নেই। তাছাড়া আমি কি হারাম রিলেশনশিপ এ জড়াবো নাকি তাই তো হালাল ভাবে পাওয়ার জন্য বিয়ের প্রপোজাল দিলাম।”বিয়ের ক্ষেত্রে নারী নিজেই পুরুষকে বিয়ে প্রস্তাব দেয়া বা আগ্রহ প্রকাশ করা একটি সুন্নাত কাজ। কারণ উম্মাহাতুল মুমিনিন হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ ও উত্তম চরিত্রের অধিকার। তাঁর আখলাক ও দ্বীনদারী দেখেই হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেলেন। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,,

“বিয়ের ক্ষেত্রে নারী নিজেই পুরুষকে প্রস্তাব দেয়া সুন্নত.!

তাই একসাথে দুই কাজ করেছি সুন্নত ও আদায় করলাম আবার মানুষটাকে জানালাম ও।”

“হুম হুম বুঝেছি তারপর ?

“আমি বিয়ের প্রস্তাব দিলাম দেখে তার কি যে লজ্জা। এদিকে সে তখন রাজি ছিল না। আমায় সবার থেকে আলাদা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বলল এসব কি পাগলামি। সে আমায় নাকচ করলো আমি কারন জানতে চাইলে সে বলল সে বিয়ে করবে না। আমি তবুও কারন জানতে চাইছিলাম কারন তার চোখ স্পষ্ট বলছিল সে আমায় পছন্দ করে। বেশ জোরাজুরির পর সে জানালো তার পৃথিবীতে কেউ নেই। এরকম একটা ছেলের সাথে কেউ মেয়ে দেবে না। ব্যস বাবাকে কল লাগালাম বললাম তার মেয়ের জামাই পেয়ে গেছি। পরে বাবা আর বাজপাখির সাথে দেখা করালাম।বাবা আলাদা নিয়ে কি কি জানি বলল তারপর আমাদের বিয়ে ফাইনাল। হয়তো বাবা ছেলে পরখ করছিল। আমাদের বিয়ে ঘরুয়া ভাবে হয়ে গেল। বাবা ওকে আমাদের হাসপাতালের ডাক্তার না হওয়া সত্ত্বেও এম ডি বানালেন। আমাদের বাড়িতেই থাকতো সে। আমাকে খুব ভালোবাসতো অনুভব এই ভাবেই ভালোবাসাময় ছয় মাস পেরিয়ে গেল। আমি আর অনুভব গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে বের হলাম।তখন,,

এইটুকু বলতেই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো,,

অতীত,,

“অনুভব তুমি এই রাত করে এতোদূর কেন এলে বলো তো?”

অনুভব মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তোমায় কিছু বলার ছিল মিশুমনি তাই এতো দূর আসা।”

‘কি বলবে যে যার জন্য এতো দূর আনলে? আমার জন্য সারপ্রাইজ বুঝি।”

তখন অনুভবের মুখটা করুন দেখালো। আমি ওর মুখে হাত দিতেই ও বলল,,

‘আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি মিশুমনি। আমি তোমায় কষ্ট দিতে চাই না।”

বলেই ও গাড়ি থেকে নেমে গেল। গাড়িটা একটা ব্রিজ এ থামিয়েছিল। অনুভব ব্রিজের কোনায় গিয়ে দাঁড়ালো। ওকে নামতে দেখে মিশুও নামলো। মিশু অনুভবের কাঁধে হাত রেখে বলল,,

“কি হয়েছে অনু?”

অনুভব বলল,,

“যদি কোনদিন জানতে পারো তোমার মাকে তোমার আপনজনই কেউ মেরে ফেলেছে। তাহলে তুমি কি করবে মিশুমনি?”

কথাটা শুনে মিশু থমকে গেল ওর চোখ ছলছল করে উঠলো‌।ও দুই পা পিছিয়ে গেল। ও কিছু বলবে তার আগে অনুভবের বুকে কেউ গুলি করলো। আর রক্ত এসে লাগলো মিশুর মুখে। মিশু তাড়াতাড়ি করে অনুভবের কাছে যেতে চাইলো তখন কতো গুলো মুখোশধারী লোক ওকে ধরে ফেললো। আর কিছুজন অনুভব কে ধরলো। আর অনুভবকে ইচ্ছে মতো মারতে লাগলো। একজন বলল,,

“তোর খুব কৌতুহল না শেখ বাড়ির রহস্য জানার। এখন তো জেনে গেছিস এখন মৃত্যকে আলিঙ্গন কর।”

এদিকে মিশু চিৎকার করছে অনুভব কে ছেড়ে দিতে।নিজেও ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। অনুভব কে মারতে মারতে আধ মরা করে ফেলেছে। তখনি একটা গাড়ি এলো আর লোকটা অনুভব কে সেই গাড়ির সামনে ফেলে দিল। মুহুর্তেই অনুভবের রক্ত দ্বারা রাস্তা ভিজে উঠলো। তখন মিশুকে ছেড়ে দিল। মিশু দৌড়ে গিয়ে অনুভবকে জড়িয়ে ধরলো আর চিৎকার করতে লাগলো। সাহায্যের জন্য বলতে লাগলো। আর বলল,,

‘কেউ আছেন অনুকে হাসপাতালে নিতে হবে। অনেক রক্ত পরছে ওর শরীর থেকে। প্লিজ সাহায্য করুন। কেউ আছেন।”

তখনি কেউ হাসতে হাসতে মিশুর পেছনে দাঁড়ালো। আর মিশুর মাথায় রড দিয়ে খুব জোরে আঘাত করলো। মিশু রাস্তায় পরে গেল। ওর মুখে তখনো একটাই কথা ।

‘কেউ আছো আমার অনুকে কেউ বাঁচাও। ওর শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হচ্ছে। কেউ আমার অনুকে বাঁচাও।”

বলতে বলতেই মিশু সামনে তাকাতেই দেখলো। কতো গুলো লোক অনুভব কে ওদের গাড়ি তে উঠাচ্ছে। ওকে গাড়িতে উঠিয়ে অনুভবের পা গিয়ারে আর হাতে স্টেয়ারিং এ রেখে “হ্যাপি জার্নি” বলে গাড়ি স্টার্ট করে দিল। অনুভবের জ্ঞান নেই। গাড়ি চলতে শুরু করলো কিছু দূর যেতেই ব্যালেন্স হাড়িয়ে গাড়িটা খাদে পরে গেল। মিশু অনু বলে চিৎকার করে উঠলো। আর কিছুক্ষণ পর সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গেল।

বর্তমান,,

মিশুর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে। মেহবিন ওকে জরিয়ে ধরলো। মিশু মেহবিনকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আর বলল,,

“আমি অনুকে খুব ভালোবাসি ফুল। আমি তো ওকে হারাতে চাই নি তাহলে এমন কেন হলো ফুল? আমরা তো একসাথে কতোকিছু করার প্ল্যান করেছিলাম।তাহলে আমাদের সাথে এরকম কেন হলো?

মেহবিন বলল,

“অনুভব ভাইয়া নিশ্চয়ই এমন কিছু জানতে পেরেছিল তার জন্য তাকে প্রান দিতে হলো‌। আপু একদম কাঁদবে না তুমি। এখন যে তাদের শাস্তি দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। তোমার এক্সিডেন্ট এর পর তুমি এক জায়গাতেই থেমে ছিলে তখন বাড়ির কেউ তোমায় ঠিক না হওয়ার ওষুধ দিতো। এর জন্যই তুমি ঠিক হওনি‌ । এর শাস্তি তো পেতেই হবে আর মাত্র কয়েকটা দিন।”

মেহবিন মিশুকে শান্ত করলো। তখন মিহির আর আদর এলো। মিহিরের হাতে অনেকগুলো হাওয়ার মিঠাই। মিহির এসে বলল,,

‘এই যে ফুল আর ফুলের বোন এই যে দেখো তোমাদের জন্য অনেকগুলো ভালোবাসা নিয়ে এসেছি। নাও নাও ভালোবাসা খেয়ে একটু হাসো দেখি।”

মিহির এমন ভঙ্গিতে বলল যে সবাই হেঁসে উঠলো। মিশু বলল,,

‘এই হাওয়ার মিঠাইকে শুধু আমি ভালোবাসা বলি। তুমি তোমাদের কেন বললে ফুলের মামাতো ভাই?

‘ভুল হয়ে গেছে ফুলের বোন আমায় ক্ষমা করুন। আর আপনার ভালোবাসা গ্ৰহন করুন।”

মিহিরের কথা শুনে মিশু হেঁসে উঠলো। মেহবিন একবার মিশু আরেকবার মিহিরের দিকে তাকালো। তারপর সে নিজেও হাসলো। তখন আরবাজ আর মাইশা এলো। সবাই মিলে একসাথে হাওয়ার মিঠাই খেলো। বিকেল হওয়াতে এখন মেহবিন বাড়ি ফিরবে সবাই থেকে যেতে বললেও মেহবিন থাকলো না‌। মিহিরকে যেতে বললেও মেহবিন বলল ড্রাইভার দিয়ে আসবে এতো কষ্ট করে মিহিরের যেতে হবে না। অতঃপর ড্রাইভারের সাথে মেহবিন ফিরলো। গাড়িতে উঠতেই মেহবিনের ফোন বেজে উঠল ফোনটা মুখরের। ও কানে নিতেই শুনলো,,

‘অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে বিহঙ্গিনী। অতঃপর কাব্য ও তার বিহঙ্গিনী তাদের সাময়িক বিচ্ছেদ কাটিয়ে পূর্নতা পেতে চলেছে।”

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৪৫+৪৬

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪৫
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

আরেকটা স্নিগ্ধ সকাল রাইফা চোখ খুলেই দেখলো মেহবিন নেই। ঠিক তখনি মেহবিন আসলো মাথায় ওরনা ও বুঝতে পারল নামাজ পরেছে মেহবিন এসে কিছু দোয়া পড়ে ওর গায়ে ফু দিয়ে দিল। রাইফা হাসলো মেহবিন রাইফাকে উঠিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দিল। সকাল সাতটা বাজে। মেহবিন রাইফার হাত ধরে বলল,,

‘আমি যা বলবো মন দিয়ে শুনবি ঠিক আছে। আজ তোর কিডনির অপারেশন হবে ।”

কথাটা শুনে রাইফা ভয় পেল ও ছোটবেলা থেকেই এসব কাঁটা ছেড়া ভয় পায়। ও বলল,,

‘না না আমি অপারেশন হবো না। তুই ওষুধ দে ইনজেকশন দে তাও কিছু বলবো না। কিন্তু অপারেশন না মেহু?

“আমার পুরো কথাটা তো শোন অপারেশন ছাড়া কোন উপায় নেই রাই। কারন একটা কিডনি পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ওটা ওষুধ দিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। আর তো ব্রেন টিউমারের অপারেশন করার জন্য তুই বাইরের দেশে যাবি আমি পাঠাবো। অপারেশন করলে তুই ঠিক সময়ে যাবি।”

‘আমি বাঁচতে চাই না মেহু। বাঁচলে আবারও সেই জগন্য অবস্থায় পরতে হবে।”

কথাটায় মেহবিন থমকে গেল। তারপরও ওর হাতে হাত রেখে বলল,,

‘চিন্তা নেই রাই যতো যাই হোক না কেন তোকে আর সেই অবস্থায় কখনোই ফিরতে হবে না রাই।”

‘আমি যদি আর না ফিরি তো কেমন হবে মেহু?

মেহু অদ্ভুত ভাবে ওর দিকে তাকালো। তারপর বলল,,

‘যতো যাই হোক না কেন? তোকে মায়ের মতো কারো স্বার্থপরতার কাছে বিলীন হতে দেব না ।”

‘মেহু!”

‘না তুই কারো স্বার্থপরতার কাছে বিলীন হবি না। আমি হতে দেব না মাকে বাঁচাতে পারি নি কিন্তু তোকে তো পারবো।”

“মেহু তুই কি বলছিস?’

মেহবিনের হুস আসলো ও বলল,,

“কিছু না রাই তুই রেস্ট কর আমি আসছি। আর হ্যা তুই দু’টো অপারেশনই করবি আমি কিছু জানিনা আর শুনতেও চাই না। তোকে বাঁচতে হবে। তুই বাঁচবি প্রানখুলে। কারো স্বার্থপরতার জন্য তুই বিলীন হবি না।”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে গেল। রাই শুধু দেখে গেল। ও বেরুতেই মেহবিনের কল এলো সেই লোকটা ফোন দিয়েছে যাকে ও নিশাচর এর নাম্বারের ব্যাপারে খবর নিতে মেহবিন সালাম দিতেই ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিয়ে বলল,,

‘আপনার ই-মেইল বক্সে আমি সব পাঠিয়ে দিয়েছি দেখে নিন। আপনার সেই কাঙ্খিত জিনিস টা আছে।”

‘শুকরিয়া!”

মেহবিন নিজের কেবিনে ল্যাপটপ খুলল। আর মেইলবক্স চেক করতে ওর মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। ও কারো নাম্বারে ফোন করে বলল,,

‘আসসালামু আলাইকুম পার্টনার!”

ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

“অতঃপর আমাদের লক্ষ্যের চুড়ায় আমরা পৌঁছে গেছি। এতো বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমরা এখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে।”

‘আলহামদুলিল্লাহ!”

‘আপনার ফোনে সব পাঠিয়ে দিচ্ছি দেখে নিন।”

‘হুম আমাদের কবে দেখা হচ্ছে পার্টনার?”

‘দেখা তো হবে তাড়াতাড়িই তবে পার্টনার হিসেবে কবে হবে জানি না।”

‘ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেখা হোক।”

‘ইনশাআল্লাহ!”

‘আপনাকে আপনার লক্ষ্যপূরনের জন্য শুভেচ্ছা।”

‘শুকরিয়া এবং আপনাকেও অনেক শুভেচ্ছা।”

‘শুকরিয়া! রাখছি!”

‘হুম তবে বিষয়টা দেখে থমকে যায়েন না আবার। আর হ্যা এবার কিন্তু পেছালে চলবে না। এবার তাদের কৃতকর্মের শাস্তি তাদের অবশ্যই দিতে হবে।”

‘ইনশাআল্লাহ তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।”

‘এবার আপনার দায়িত্ব বেশি।”

“হোক তবুও এবার আমি আমার দায়িত্ব পালনে কোন কাপণ্য করবো না।”

‘হুম ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ।”

“হুম আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ।”

“ইনশাআল্লাহ!”

বলেই মেহবিন ফোন রেখে দিল। তার মুখে আজ অদ্ভূত সুন্দর হাসি। সে বের হলো খুশি মনে কেবিন থেকে করিডোর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। তাজেলের মাকেও দেখে এলো। ওর মা অবাক হলেও বেশ খুশি হয়েছে। সে তাজেলের বাবার হাতে দুই হাজার টাকা দিল। এটা দেখে তাজেলের মা একটু আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। তাজেলের সৎ নানি ও ছিল সেখানে। তিনি জানতে চাইলেন কে সে বলল তার মেয়ে তাজেলের বন্ধু । এটা দেখে মেহবিন হাসলো যখন বলল আমার মেয়ে তাজেল। তাজেলের বাবাকে মেহবিন গিয়ে বলল চিন্তা কম করতে। দুদিন হাসপাতালে থেকে তারপর বাড়ি চলে যাবে বাড়ি গিয়ে ঠিকঠাক সেবা যত্ন করলেই আর কোন সমস্যা হবে না।মেহবিন ওখান থেকে চলে এলো। ওখান থেকে রাইফার কেবিনে আসতেই দেখলো পুরো শেখ পরিবার এখানে। শেখ শাহেনশাহ ও আজ এখানে এসেছে। মেহবিন কে দেখে মিসেস আমজাদ বললেন,,

” মেহবিন আমার ছেলের বউয়ের জন্য এতকিছু করছো এর জন্য ধন্যবাদ। এসো তোমাদের দুজনের জন্য খাবার এনেছি খেয়ে নাও।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘না আমি আপনার ছেলের বউয়ের জন্য কিছু করছি না। করছি আমার বন্ধুর জন্য।”

“যার জন্যই করো সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। এসো এখন খেয়ে নাও।”

তখন পেছন থেকে কেউ বলল,,

“ডাক্তার!”

মেহবিন পেছনে তাকিয়ে দেখলো তাজেল হাতে টিফিন বক্স। দেখেই মেহবিন বুঝতে পারলো ওর জন্য এনেছে। মেহবিন বলল,,

“ধন্যবাদ তবে দরকার নেই । আপনি রাইকে খাওয়ান।

বলেই তাজেলকে কোলে তুলে নিল‌। আর বলল,,

“নেত্রী এসবের কি দরকার ছিল?”

তাজেল হেঁসে বলল,,

‘আইজ তো আমাগো বাড়ি গোস্ত রানছে। হাসপাতালে নিয়া আইছে মায়ের নিগা আমিও তোমার জন্য তাই একটু গোস্ত আর ভাত আনছি‌। এনে তো তোমার কেউ নাই যে তোমার জন্য খাওয়ারতা নিয়া আসবো। তাছাড়া তোমার হাত ও তো ঠিক হয় নাই তোমারে খাওয়ায় দিবো কিরা‌?

মেহবিন হাসলো তারপর ওকে নিয়ে বের হলো। তারপর বলল,,

‘কাল যে রাত হলো কেউ কিছু বলেছে?”

“না আমি কইছি তোমার কাছে আছিলাম।
এইডা হুইনা আর কিছু কয় নাই।”

“তোমার বাবা তো দেখলাম সকালে এখানেই। রাতে কি আসছে নাকি সকালে।”

“আজ সকালেই ভোরে ঊইডা আইছে। রাইতে থাহে নাই রাইতে তো নানি আছিল।”

“ওহ আচ্ছা! তা তুমি একাই এসেছো হাসপাতালে?”

“না দাদিও আইছে তারে দেখতে।”

“ওহ আচ্ছা!”

মেহবিন কেবিনে গিয়ে ওকে বসিয়ে দিল। তাজেল বলল ওকে চুপচাপ বসতে। মেহবিন চুপচাপ বসলো তাজেল তার ছোট ছোট হাত দিয়ে ভাত মেখে ওকে খায়িয়ে দিতে লাগলো। মেহবিন ওর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল। তা দেখে তাজেল বলল,,

“ডাক্তার তুমি আমার দিকে এমনে তাকাই রইছো ক্যা?

“আমি তোমার কে নেত্রী?

“তুমি আমার ডাক্তার!”

“আমার দিকে তোমার এতো খেয়াল কেন? আমি খাই বা না খাই তাতে তোমার এতো চিন্তা কিসের?”

“আমি জানি না কিসের চিন্তা কিন্তু তোমারে আমার কষ্ট পাইতে দেখতে মন চায় না। তুমি জানো তুমি আসার আগে আমারে কেউ ভালোবাসতো না। আমি তো মাঝে মাঝে সারাদিন না খাইয়াও থাকতাম। তাও কেউ খোঁজ নিতো না। আমারে তো জামাও কিনা দিতো না। যহন তুমি আইলা তহন তো আমার খোঁজ তুমি ঠিকই নেও আবার আমার যা দরকার সব করো। আর হেইদিন তো তোমার জন্যে আব্বাও আমারে কতো ভালোবাসে। তাইলে আমি কেন তোমার যত্ন নিমু না কও তো। যারা আমাগো ভালোবাসে তাগোও তো আমাগো ভালোবাসা উচিত না। তুমি না একদিন পরাইতে যাইয়া কইছিলা আমারে‌। আমি তোমার জন্যই তোমারে এতো ভালোবাসি ডাক্তার আর তোমার কষ্ট আমার সহ্য হয় না। নেও অনেক কতা কইছাও এহন হা করো?

মেহবিনের মুখে তৃপ্তির হাঁসি ফুটে উঠলো। মেহবিন হেঁসে হা করল তাজেল খায়িয়ে দিল। মেহবিন বলল,,

“তুমি খেয়েছো নেত্রী?”

“হ খাইছি খাইয়া দাইয়াই আইছি।”

“তোমার মাকে দেখতে গেছিলে?”

‘হ একবার দেইহা আইছি। আর দাদিরে কইয়া আইছি বাড়ি যাওয়ার আগে আমারে জানি নিয়া যায়।”

“ওহ আচ্ছা!”

“ডাক্তার কও তো এইডা কেমন হাসপাতাল?”

“কেমন আবার সরকারি হাসপাতাল।’

‘উহুম এইডা অর্ধেক সরকারি অর্ধেক বেসরকারি হাসপাতাল।”

‘না নেত্রী হাসপাতাল কখনো অর্ধেক সরকারি আর অর্ধেক বেসরকারি হাসপাতাল হয়না। হলে পুরোটা সরকারি নাহয় তো পুরোটা বেসরকারি। তবে তোমার মাথায় এরকম একটা প্রশ্ন আসলো কিভাবে?”

“চেয়ারম্যান বাড়ির সবাইরে দেইখা। এইডা আগে চেয়ারম্যান বাড়ির ওনাগো হাসপাতাল আছিল। তিন বছর আগে এইডা পুরাডা ওনাগো হাসপাতাল আছিল। তারপর উনারা নাকি সরকারের কাছে হাত মিলাইছে তারপর এনে এই যে এতবড় হাসপাতাল দেহো এইডা নুতন কইরা হইছে। তাইতো আমাগো গ্ৰামের সবাই কয় এইডা অর্ধেক সরকারি আর অর্ধেক বেসরকারি হাসপাতাল। তুমি জানো ওনাগো আরাটা হাসপাতাল আছে। আমার আব্বায় তো আগে এই হাসপাতালেই কাম করতো।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“না নেত্রী তোমার গ্ৰামের মানুষ ভুল জানে। এটা পুরোটাই সরকারি হাসপাতাল। চেয়ারম্যান সাহেব এটা বিক্রি করে দিয়েছিল সরকারের কাছে। এখন আর এটা ওনাদের নেই বুঝেছো।”

‘হ তুমি কওয়ায় বুঝলাম।”

শেখ বাড়ির সবাই মেহবিনের সাথে রাইফার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিল। এসেই দেখলো তাদের মেহবিনকে খায়িয়ে দিচ্ছে। মেহবিন জানালো সে খেয়ে তারপর আসছে। মেহবিন খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে গেল। ওনাদের সাথে কথা বলল। সায়িদ ও এসেছে এখানে মেহবিন ওর দিকে একবার তাকিয়ে অন্য দিকে তাকালো। সে আজ ও বলছে তাদের হাসপাতালে নিতে। মেহবিন তো মেহবিনই কারো কথার ধার ধারে না সে। তাজেল চলে গেল। দুপুরেই রাই চলে এলো। মেহবিন ওর সাথে সবকিছু ডিসকাস করলো ও নিজেও থাকবে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে। রাইফা তো কতো কান্না সে করবে না। একটা সবাই মেহবিনের ধমক খেল। ওর ধমক খেয়ে আরো কতো কান্না। রাইফার মা বাবাও বোঝাচ্ছে। অতঃপর মেহবিন আবার বোঝালো শেষ মেষ সে রাজি হলো। আর এটাও বলল অপারেশন থিয়েটারে যেন মেহবিন ও থাকে। ডোনার এলো। বিকেল পাঁচটায় রাইফার অপারেশন ও ভিশন ভয় পাচ্ছে। এখন ওর কেবিনে রাই আর মেহরিন। মেহবিন ওর হাত ধরে আছে। হুট করে রাইফা বলল,,

“মেহু আমি যদি আর না ফিরি?”

তা শুনে মেহবিন রেগে বলল,,

“ফাউল কথা বললে আমিই তোকে মেরে দেব।”

তখন রাই বলল,,

‘আরে মেহু তুই বকছিস কেন? ও ভয় পাচ্ছে তাই নার্ভাসনেসে এসব বলছে। তুই কি পেশেন্টদের সম্পর্কে জানিস না। তারওপর রাইফা কে তো তুই ভালোমতো চিনিস।”

“ভালোমতো চিনি বলেই তো এভাবে বলছি। দ্যাখ রাই একটা মানুষের সুস্থতা অনেকটাই তার মনের ওপর। তুই যদি মনে করিস তুই সুস্থ তাহলে তুই যতই অসুস্থ হোক না কেন তোর অসুস্থতার মধ্যেও মনে হবে আমার ওতো কষ্ট হচ্ছে না। আর তুই যদি নিজেকে সুস্থ থাকতেও মনে করিস অসুস্থ তাহলে তুই সুস্থ থাকলেও মনে হবে শরীর দূর্বল লাগছে। নিজেকে শক্ত করে আর ভাব তুই ফিরবি এতো নেগিটিভিটি কেন? তোকে অলওয়েজ পজিটিভ ভাবতে বলেছি তো। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ ইনশাআল্লাহ কিছুই হবে না। তাছাড়া এখানে তো দু’টো কিডনিই নষ্ট নয় শুধু একটা তাহলে ভয় কিসের।”

মেহবিন আরো কিছু জিনিস বলল অতঃপর রাইফা শান্ত হলো। পাঁচটা বাঁচতেই ওকে অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো মেহবিন ও সাথে গেল। রাইফার অপারেশন সাকসেসফুল হলো। ও বেরিয়ে ফ্রেশ হলো। রাইয়ের সাথে কথা বলল। বেরিয়ে এসে জানতে পারলো সায়িদ আর নুপুর কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তা শুনে মেহবিন হাসলো। রাইকে মেহবিনের কেবিনে নিয়ে বলল ওকে থাকতে এখন মেহবিনের একটা কাজ আছে ও বের হবে। রাইকে কিছুটা আগেই বলেছিল তাই ও আর কিছু বললো না। ও রইলো রাইয়ের জন্য। রাইফার অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে শেখ বাড়ির সকলে চলে গেল হাসপাতালে রইলো রাইফার মা বাবা। এদিকে সায়িদ কে পাওয়া যাচ্ছে না দেখে ওরাও কিছু বললো না। মেহবিন বেরিয়ে গেল। একটা গাড়ি এসে ওকে নিয়ে গেল। মেহবিন একটা কালো প্যান্ট কালো হুডি আর মুখে মাস্ক পড়লো। একটা ঘরে ঢুকতেই ওরই মতো আরেকজন কে দেখলো। সেও হুডি প্যান্ট আর মাস্ক পড়া তাকে দেখেই ও বলল,,

‘পার্টনার আপনি এখানে? আপনাকে কে বলল আমি আজ এখানে আসবো?”

“লোক কি শুধু আপনার পার্টনার আমার ও তো তাই না। আপনি যদি কেন আমায় ছাড়া কাউকে শাস্তি দেবেন তাই খবর পেতেই চলে এলাম। ”

‘এখানে কাদের তুলে আনা হয়েছে জানেন আপনি?”

“হুম জানি আর এটাও জানি তারা তাদের অন্যায়ের সীমারেখা পার করেছিল। তাই তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন।”

‘ওকে তাহলে চলুন যেহেতু আপনি এসেছেন আপনাকেও কাজে লাগাবো।”

বলেই দুজনে ভেতরে ঢুকলো। সামনেই নুপুর আর সায়িদকে বেধে রাখা হয়েছে। ওদের দেখেই ওরা চিৎকার করে ছেড়ে দিতে বলল । ওদের কথায় মেহবিনদের কোন ভ্রুক্ষেপ হলো না। মেহবিন বলল ছেড়ে দেবে যদি ওদের কথামতো কাজ করে। তারা বলল করবে না। তখন মেহবিন এসিড নিয়ে এলো দুজনেই দিকে ছুড়বে এমন সময় বলল তারা রাজি। মেহবিন বলল তারা দু’জনেই ডাক্তার তাহলে একটা কাজ করা যাক। মেহবিন দুজনকে দু’টো ওষুধে ভরা ইনজেকশন এর সিরিঞ্জ এগিয়ে দিয়ে বলল একে অপরের শরীরে পুশ করতে। ওরা করলো ওরা খুশি হয়ে গেল যে এখন বোধহয় ছাড়া পেয়ে যাবে। এদিকে ওদের খুশি দেখে মেহবিনের মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো।

ওদের আবার বেঁধে দেওয়া হলো। মেহবিন জানতে পেরেছে এখানে নুপুরের তেমন বিশেষ দোষ নেই। ও শুধু নিঃস্বার্থ ভাবে সায়িদকে ভালোবাসতো আর ওকে পেতে চাইতো এই জন্য ও রাইফাকে মেরে ফেলার কাজে ছিল তবে বুদ্ধিটা সায়িদের ছিল। ও শুধু সায়িদের কথামতো কাজ করেছে। এমন কি নুপুর এটাও জানে না ও রাইফাকে ধর্ষণ করেছে এমন কি সায়িদের আরো কয়েক জায়গায় রিলেশনশিপ আছে এবং সবার সাথে শারীরিক মেলামেশাও আছে। ও ভাবলো আগে নুপুর কে ব্যাপারটা জানাবে ও এক এক করে সব জানালো। এবং কিছু ভিডিও দেখালো সব শুনে ও দেখে নুপুর চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। ও চিৎকার বলল,,

“সায়িদ কেন করলে আমার সাথে এরকম? আমি তো তোমায় নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতাম তাহলে কেন করলে। ইশ আমি কতো বোকা আমি ভাবতাম তুমি আমায় ভালোবাসো কিন্তু এখন বুঝলাম তুমি আমায় নও আমার শরীরকে ভালোবাসো। না না শুধু আমার শরীরকে না তুমি তো মেয়েদের শরীরকে ভালোবাসো তাই তো এতো গুলো মেয়েদের সাথে এসব করেছো? আমি যদি পারতাম তাহলে আমি তোমায় এর জন্য কঠিন শাস্তি দিতাম।”

মেহবিন শান্ত স্বরে তার ভয়েজ পাল্টিয়ে বলল,,

“তুমি চাইলেই তা করতে পারো নুপুর। আমি দেব তোমায় সুযোগ।”

নুপুর খুশি হয়ে গেল। ও বলল সে করবে ওকে শাস্তি দেবে। মেহবিন নুপুরের হাত ছাড়িয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল,,

“তোমরা যেহেতু শারীরিক সম্পর্ক করেছো তাহলে তো লজ্জা নেই তাই না। ওখানে এসিড রাখা আছে ওর প্যান্ট খুলে সেখানে এসিড মেরে দাও। তোমাকে ধোঁকা দিয়ে ও অন্যদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে তাই না। এটাই একজন প্রথম নিম্নস্তরের ধর্ষকের শাস্তি।”

মেহবিনের কথা শুনে নুপুর থমকে গেল এটা ওর মাথায়ই আসেনি। ভাবতেই ওর শরীর কাঁপতে লাগলো। মেহবিন তার পার্টনারকে নিয়ে অন্যদিকে ঘুরলো। নুপুর কাঁপা কাঁপা হাতে এসিড নিল। এদিকে সায়িদ বুঝতে পারছে ওর সাথে কি হচ্ছে ও চিৎকার করছে আর নুপুরকে থামতে বলছে। নুপুরের চোখে অদ্ভুত হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। ওর চোখের সামনে ভিডিও গুলো ভাসছে। ও সত্যি সত্যি প্যান্ট খুলে ওখানে এসিড মেরে দিল। সায়িদ দিল এক গগন বিদারক চিৎকার। ওর চিৎকার শুনে নুপুরের আনন্দ হলো। সায়িদ অজ্ঞান হয়ে গেল। মেহবিন নুপুরকে বলল আরেকটা ইনজেকশন দিতে নুপুর দিল। তখন মেহবিন তাড়াতাড়ি করে সায়িদকে ট্রিটমেন্টের জন্য পাঠিয়ে দিল। যাতে করে ও মরবে না। তারপর নুপুর বুঝতে পারলো ওর চোখ নিভু নিভু হয়ে আসছে। নুপুর অজ্ঞান হয়ে গেল। মেহবিন ওকেও পাঠালো। সব দেখে তার সাথে থাকা পার্টনার বলল,,

“এরকম কিছু আমার কখনো মাথায় আসেনি?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘আমার তো মনে হয় ধর্ষকের শাস্তি এমনটাই হওয়া উচিৎ।”

“ও বাঁচবে তো?”

“জানি না তবে মরবেও না। এরকমভাবেই একটা ইনজেকশন লাগিয়েছি আমি। আজীবন প্যারালাইজডস হয়ে থাকবে যেটা সবার শেষে নুপুর দিল। আর শরীরে এইচআইভি ও দিয়ে দিয়েছি। যেটা নুপুর আর সায়িদ একে অপরের শরীরে পুশ করেছে। যার মধ্যে দিয়ে নুপুরেও শরীরেও এখন এইচ আইভি বর্তমান।

“কাউকে শাস্তি দেওয়া কেউ আপনার থেকে শিখুক। আপনি দুজনকেই শাস্তি দিয়েছেন কিন্তু আপনি নিজে হাত লাগান নি । দুজনের মাধ্যমেই দুজনকে শাস্তি দিয়েছেন।

“মা বলেছিল কাউকে শারীরিক ভাবে শাস্তি দিতে হলে তাকে অবশ্যই দেবে কিন্তু অন্যায়ভাবে নয়। এর জন্য হাত লাগাই নি। আমি হাত দিলে আমার অন্যায় হতো।তাই ওরা দুজনে যেহেতু অপরাধী আরো দুয়েকটা অপরাধ করলে কিছুই হবে না। তাই দুজনের দ্বারাই দুজনকে শাস্তি দিলাম।আমি ভেবেছিলাম নুপুরকেও কঠিন শাস্তি দেব। কিন্তু পরে জানতে পারলাম ও নিজেও একজন ভুক্তভোগী। তাই অল্পের ভেতর দিয়েই দিলাম সারাজীবন এইচআইভি শরীরে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। খুব বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক করার ইচ্ছা না ওর তাই এরকম শাস্তি দিলাম। কাল দুজনের লাইভ টেলিকাস্ট হবে বিয়ের পর পরকীয়া করতে গিয়ে বনিবনা না হওয়ায় ডক্টর নুপুর ডক্টর সায়িদের এই অবস্থা করেছে। এমনকি দুজনের শারীরিক সম্পর্ক ও ছিল ডক্টরের সায়িদের এইচ আইভি ছিল শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে ডক্টর নুপুরের শরীরেও তা ঢুকেছে। নুপুরকে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ। ও রাইকে মারার চেষ্টা করেছিল তার জন্য এটা।”

বলেই মেহবিন হাসলো তাকে দেখে তার পার্টনারও হাসলো। অতঃপর ওরা দুজন চলে গেল। পরের দিন সকালে সবাই সায়িদ আর নুপুরের খোঁজ পেল সেই সাথে মেহবিন যেমনটা চেয়েছিল তেমনটাই খবরে দেখানো হলো। সব শুনে এবং দেখে শেখ বাড়ির সকলে স্তব্ধ। খবরটা দেখে মেহবিন নিজেই নিজের মনে আওরালো,,

“এটা তো শেখ বাড়ির রহস্য উন্মোচন এর প্রথম ধাপ। এখন দেখবে সব রহস্য কি করে একে একে সামনে আসে। নিশাচর গেট রেডি আই এম কামিং।

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪৬ (বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

সায়িদের খবরটা শুনেই রাইফার মা বাবা ভিশন ভেঙে পরেছেন। এমনিতেই মেয়েটার এতো বড় অপারেশন হলো তার মধ্যে এইরকম একটা ঘটনা মেয়েটাকে না জানি কতবড় আঘাত পেতে হবে। তারা তো আর জানে না এই খবরটাই তার মেয়ের মনে কতটা খুশি এনে দেবে। শেখ পরিবার থেকে শেখ শাহনাওয়াজ আর মিসেস আমজাদ রাইফার মা বাবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। রাইফাকে এখনো খবরটা জানানো হয় নি। সবাই ভাবছে যদি রাইফা জানতে পারে তাহলে খুব ভেঙে পরবে। তাই কেউ রাইফাকে জানায় নি। এমনকি মেহবিন ও জানায় নি। এভাবেই পার হয়ে গেল সাত দিন। সেদিনই রাই ফিরে গেছে। সাত দিন ধরে রাইফা হাসপাতালে আজ সে বাড়ি ফিরবে। শেখ বাড়ির অবস্থা বেশ করুন। রাইফার মা বাবা বলেছে ওকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাবে এতে রাইফা অবাক হলেও কিছু বলেনি। মেহবিন কাগজ করতে দিয়েছে সেগুলো তৈরি হয়ে গেলে তিনজনেই বিদেশে চলে যাবে রাইফার চিকিৎসার জন্য। রাইফারা বেরুবে কিন্তু শেখ বাড়ির কেউ আসেনি এটা দেখে রাইফার একটু মন খারাপ হলো। ও মেহবিনের দিকে তাকালো মেহবিন সবাইকে বাইরে যেতে বলল । সবাই চলে গেলে মেহবিন নিউজটা রাইফাকে দেয়। ও প্রথমে অবাক হলেও পরে খুশি হলো যে মানুষ টা ওকে এতটা টর্চার করেছে তার শাস্তি পাওয়া উচিৎ সবথেকে বড় কথা ও পরকীয়ার লিপ্ত ছিল। সারাজীবনের জন্য প্যারালাইজড হয়ে গেছে আর যা ঘটনা ঘটে গেছে ও প্রতিটা মুহূর্তে নিজের মৃত্যকামনা করছে। নুপুরের নুপুরের শাস্তি হয়েছে দেখে সে খুশি হয়েছে। তার সাথে আফসোস ও করেছে। এরকম করুন অবস্থা দেখে। এভাবে ওদের অবস্থা সবার সামনে আসবে ও ভাবেও নি। তখন শেখ বাড়ির সকলে এলো শেখ শাহেনশাহ আর শেখ আমজাদ ছাড়া মিসেস আমজাদ কেঁদে দিয়ে রাইফার কাছে মাফ চাইলো। তিনি এটাও বলল তাদের ডিভোর্স করাবে কিছুদিন পর পাঠিয়ে দেবে আরও বলল তুমি বাঁচবে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করতে বলল ভয় পেতে বারন করলো। পরে অনেকক্ষণ মেলোড্রামার পর রাইফারা বেরুবে। রাইফা বলল,,

“এই মেহু তুই আমার সাথে যাবি?”

“নারে তোরা যা আমার অনেক কাজ আছে।”

“প্লিজ মেহু! যদি আর না ফিরি। আমার ভিশন ভয় করছে। ”

“এতো ভয় পাস না ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না। এখন তোর এখানে থাকা টা ঠিক হবে না। তুই ঢাকায় ফিরে যা। তাছাড়া আমি দেখা করে আসবো তো।”

মেহবিন বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাইফাকে বাড়ি পাঠানোর জন্য রাজি করালো।ওরা গাড়িতে উঠবে এমন সময় রাইফার বাবা মেহবিনের মাথায় হাত দিয়ে বলল,,

“আমার মেয়ের জন্য যা করলে তার জন্য অনেক অনেক শুকরিয়া মেহু মা।

মেহু হেঁসে বলল,,

“আরে আঙ্কেল এসব কি বলছেন। রাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আর এইটুকু করা একজন ডক্টর হিসেবে আমার দায়িত্ব।

“আমি জানি তবুও একজন বাবা হিসেবে তোমার শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। আমি জানি তুমিই আমাদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাচ্ছো তা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই মেহু মা। আর আমি জানি তুমি এখানে আমাদের নিচু দেখাচ্ছো না শুধু বেস্ট ফ্রেন্ড এর জন্য কিছু করছো। তবুও সেখানের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমি দেব। আমার একটাই মেয়ে সব ওর জন্যই এই জন্যই আমি সব নিজের হাতে করতে চাই মেহু মা।

মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘ সমস্যা নেই আঙ্কেল করুন আপনি আপনার মেয়ের জন্য। এতে আমি হস্তক্ষেপ করবো না কিন্তু কোন সমস্যায় পড়লে সবার আগে যেন আমার কাছেই ফোনটা আগে আসে।”

“তা আর বলতে। নিজের খেয়াল রেখো সাবধানে থেকো আসছি। আল্লাহ হাফেজ।”

“হুম আল্লাহ হাফেজ।”

ওরা সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এ কয়েকদিন তাজেলের সাথে সময় কাটানো হয় নি মেহবিনের বেশীরভাগ সময় হাসপাতালেই কেটেছে মুখরের সাথেও তেমন যোগাযোগ হয় নি। ক’দিন বাদেই আলভি আর মাইশার বিয়ে। মেহবিন আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা দিল। বাড়ির সামনে আসতেই তাজেলের সাথে দেখা। তাজেল একবার ওর দিকে তাকালো আবার অন্য দিকে তাকি হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। তা দেখে মেহবিন বলল,,

‘নেত্রী কেমন আছো?”

তাজেল আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দাড়ালো আর মেহবিনের উল্টো দিকে ঘুরে রইলো। তা দেখে মেহবিন একটু ভরকালো। ও তাজেলের সামনে দাঁড়ালো আর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,,

“কি হয়েছে এতো রাগ কিসের শুনি?”

তাজেল পাশ ফিরে দাঁড়ালো আর বলল,,

“কেউ জানি আমার সাতে কথা না কয়। তার জন্যে আমার একটা পশাল দিন খুব খারাপ গেছে।”

মেহবিন কিছুই বুঝতে পারলো না। ও বলল,,

“তা ঐ একটা স্পেশাল দিনে ছিল। আর ঐ স্পেশাল দিনটা কবে ছিল। যে নেত্রীর তার ডাক্তার কে ছাড়া খারাপ গেছে।”

“তুমি তো আমার সাতে কথাই কইয়ো না। কাল আমার জন্মদিন আছিল। আমি চাইছিলাম তোমার সাথে ঘুইরা জন্মদিনের কেক কাটুম আর খামু। এই জন্য আব্বারেও কইছিলাম আব্বা ও কইছে ট্যাহা দিবো। কিন্তু তুমি বাড়িই আইলা না তোমার জন্য আমি কতোক্ষন অপেক্ষা করছিলাম।”

‘এই ছোট্ট একটা জিনিসের জন্য তুমি রাগ করেছো?”

“হ তোমার কাছে তো তোমার বন্ধুই বড় আমি তো আর কেউ না।”

মেহবিন তাজেলকে ওর দিকে ঘুরালো আর বলল,

“আজ আমার বন্ধু চলে গেছে। তাই তো কাল আসতে পারি নি সব গোছগাছ করে দিয়ে আসতে হতো তো। রাত হয়ে গেছিল আমার বন্ধুও বলল ওর সাথে থাকবে ভাবলাম কাল চলে যাবে তাই ওর সাথে থেকে গেলাম।”

‘তোমার জন্য আমি জন্মদিনের কেক কাটতে পারলাম না। আবার খাইতেও পারলাম না। আব্বা সবাইরে খিচুড়ি খাইয়াইছে আমার জন্মদিনের জন্যে আমার অনেকদিনের শখ আছিল কুলসুমের ভাইয়ের মতো সবাইরে দাওয়াত দিয়া খাওয়ামু আর মোমবাত্তি নিভাইয়া কেক ও কাটুম। তুমি আইলে তুমারে নিয়া কেক কিনতে যামু বাজারে কিন্তু তুমি আইলাই না আমার কেক ও কিনা হইলো না। পরে আব্বা কইছিল হে আনবো আমি তোমার জন্য না কইরা দিলাম।”

মেহবিন তাজেলকে কোলে তুলে নিল। আর বলল,,

“সরি নেত্রী আমার জন্য তুমি কেক খেতে পারলে না। তবে তুমি কি জানো এসব জন্মদিন পালন করা হারাম।জন্মদিন পালন করা খুবই কমন কালচার আমাদের সমাজে। আজ আমরা পাপকে পাপই মনে করি না তবে জন্মদিন খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় কালচার। আর ইসলামে অমুসলিমদের অনুসরণ-অনুকরণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তা ইবাদতের ক্ষেত্রে হোক অথবা আচার-আচরণ, , রীতি-নীতি বা কৃষ্টি-কালচারের ক্ষেত্রে হোক।
অন্য ধর্মের কোন সিম্বল মুসলমান ধারন করতে পারেনা।
খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করে ঈসা আঃ জন্মদিন তাদের জন্য বিশেষ রহমত বয়ে আনে, তাই এই দিন তাদের জন্য রহমতময়, এই রহমতকে তাদের জীবনে ধরে রাখার জন্য তারা নিজেদেরো জন্মদিন পালন করে থাকে,,আর তাদের এই উৎসব আজকে আমরাও পালন করি,,,!

অথচ জেনে না জেনে কত বড় ঈমানহানীকর কাজ আমরা করছি নিজেরাই বুঝতে পারছিনা,,,,!
আর আমরা যদি জন্মদিন পালন করি, তবে খ্রিষ্টানদের কালচার গ্রহন করলাম।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে।”
[সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছেদ হা/৪০৩১-হাসান সহিহ]

আল্লাহ তাআলা সকলকে সঠিক বুঝ দান করুক আর এইসব জিনিস থেকে দূরে রাখুক। যারা আমরা জন্মদিন পালন করি তারা মন থেকে তওবা করি এবং এসব কাজ থেকে বিরত থাকি। আমিন।”

সব শুনে তাজেল বলল,,

“তুমি কি কইলা কিছুই বুঝিনাই আমি। খালি এইটুকু বুঝলাম জন্মদিন পালন করা যাইবো না।”

“হুম ঠিক বুঝেছো।”

‘তাইলে কি কেক ও খাওয়া যাইবো না।”

“কেক খাওয়া যাবে তবে জন্মদিনের নিয়তে খাওয়া যাবে না। তোমার জীবনের সবকিছুই তোমার নিয়তের ওপর নির্ভর করে। তুমি এমনে কেক খাও সবাইকে খাওয়াও তাতে সমস্যা নেই।”

“ধূরু আমি কিছুই বুঝি না তো।”

‘তুমি কেক খেতে চাও তাই না চলো আমি আর তুমি আজ কেক খাবো। তবে এটা জন্মদিনের জন্য না কেক খেতে ইচ্ছে হয়েছে তাই খাবো ঠিক আছে।”

‘হ ঠিক আছে। ট্যাহা কিন্তু আমি দিমু কারন আমি খাইতে চাইছি।”

‘না আজ টাকা আমি দেব আমি এখনি অর্ডার করছি।”

মেহবিন ফুড পান্ডায় একটা কেক অর্ডার দিল। ও দেখেছে এখান দিয়ে ফুড পান্ডার একটা ইউনিট আছে। মেহবিন ওকে নিয়ে বাড়িতে গেল। বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হলো। হাত ঠিক হয়ে গেছে ওর। তাজেল আর মেহবিন গল্প করলো এই কয়দিনের সব কিছু তাজেল বলছে ঘন্টাখানেক এর মধ্যে ওদের কেক এলো। মেহবিন তাজেলকে বলল কেক কেটে খেতে। তাজেল কাটলো অনেকগুলো পিচ করলো ওর ভালো লাগছে। মেহবিন একটা প্লেটে একটু উঠিয়ে রেখে বাকিটা তাজেল কে বলল খেতে। ও তাদের খেতে গিয়ে ক্রিম দিয়ে মুখ মেখে গেল। তা দেখে মেহবিন হাসলো তাজেলের হাত ও পুরোটা কেকের ক্রীম দিয়ে মেখে গেছে। মেহবিন ওর সামনে একটা আয়না ধরলো নিজের মুখ দেখে সে নিজেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আর বলল,,

“ডাক্তার দেহো আমারে ভুতের লাগান লাগতেছে।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“হ দেখতাছি তো?”

“তুমি দেহি আমার মতো কথা কইতেছো?”

‘হ তাই তো দেখতাছি!”

তাজেল খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। মেহবিনের ওপর রাগ কখন ভুলে গেছে ও নিজেও জানে না। মেহবিন বাকি কেকটুকো ফ্রিজে রেখে দিল। তাজেলের হাত মুখ ধুয়ে দিল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে তাই তাজেল খুশিমনে বাড়ি চলে গেল। তখন শেখ শাহনাওয়াজ এর ফোন এলো শেখ শাহেনশাহর কি যেন হয়েছে। উনি অজ্ঞান হয়ে পরে গেছে। এই মুহুর্তে কোন ডাক্তার বাড়িতে নেই। তাই ওকে ফোন দিয়েছে। মেহবিন চেয়ারম্যান বাড়িতে গেল । মেহবিন চেক আপ করে দেখলো প্রেসার অনেকটাই হাই প্রেসারের ওষুধ খান না কয়েকদিন ধরে নিয়মিত তারসাথে উনি বোধহয় ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না। মিসেস আমজাদ ছেলের চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পরেছে তাই এখন সে হাসপাতালে যার জন্য শেখ আমজাদ মুনিয়া দুজনেই ওখানে। এখন আরিফা জামান তার ভাইয়ের বউ, নিসা,মিশু,আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ বাড়িতে। সবাইকে দেখে মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘উনি কয়েকদিন যাবৎ ওনার কোন ওষুধ খাচ্ছেন না। যার জন্য প্রেসার অনেকটাই হাই এমনকি নিয়মিত খাবার খাচ্ছেন না। মানসিক চাপ দুশ্চিন্তা এই জন্য আজ আর শরীর উনার সাথে পেরে উঠেন নি।

মিসেস আরিফ বললেন,,

“বাড়ির যে অবস্থা এই সময় কি খাওয়া দাওয়া ঠিক থাকে। ”

“ঘরটা খালি করার ব্যবস্থা করুন। ওনার একটু আবহাওয়ার দরকার এখন। আর হ্যা কিছু খাবারের ব্যবস্থা করুন।”

মেহবিনের কথা শুনে সবাই বেরিয়ে গেল শুধু রইলো শেখ শাহনাওয়াজ আর মেহবিন। সবাই বের হতেই বলল,,

“চেয়ারম্যান সাহেব আপনি একজন ডক্টর। এর পরেও আপনার আমায় ডাকার প্রয়োজন কেন পড়লো বুঝলাম না।”

মেহবিনের কথায় শেখ শাহেনশাহ ওর দিকে তাকালেন ঐ চোখে প্রশ্ন মেহবিন কিভাবে সব জানলো। তিনি বললেন,,

“তুমি কেমনে জানলা?”

“সেটা আপনার না জানলেও চলবে তো চেয়ারম্যান সাহেব আপনি বলুন?”

“আমি ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছি সেই উনিশ বছর আগেই?’

“কেন?”

শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের দিকে তাকালো। আর বলল,,

“কিছু পার্সোনাল কাজের জন্য?”

“কাউকে না বাঁচাতে পারার আক্ষেপ থেকে নাকি?”

শেখ শাহনাওয়াজ আর শেখ শাহেনশাহ দুজনেই বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকালো। মেহবিন হেঁসে বলল,

“যাই হোক যেভাবেই ছাড়ুন ওসব বাদ। তো শেখ শাহেনশাহ আপনাকে সেদিন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আপনার সবথেকে প্রিয় জিনিস কি? আপনি বলেছিলেন আপনার বংশের সম্মান ও গৌরব। তা আপনার বাড়ির সম্মান আর গৌরব দেখছি মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।”

শেখ শাহেনশাহ মাথা নিচু করলেন। তা দেখে মেহবিন হেঁসে বলল,,

“এই বংশের সম্মান আর গৌরব এর জন্য কত কি না করেছেন। আপনার ছেলেকে কেউ যেন নিঃসন্তান না বলে নিজের বংশের প্রদীপ জ্বালানোর জন্য অন্যকাউকে স্বার্থের জন্য এবাড়িতে নতুন করে জড়িয়েছেন। আবার স্বার্থ শেষ হয়ে গেছে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন।আর এমনভাবে ছেড়ে দিয়েছেন যে পৃথিবী ছেড়েই চলে গেছে।”

শেখ শাহেনশাহ বড় বড় চোখ করে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,,

‘কে তুমি এতকিছু জানলে কিভাবে?”

‘তারমানে আপনিও একজন যে মেহেরুন নিসা কে মারার প্ল্যানে যুক্ত ছিলেন।”

শেখ শাহেনশাহ এবার উঠার চেষ্টা করলেন আর বললেন,,

“এই কে তুমি এতকিছু কিভাবে জানো?”

মেহবিন একটু উঠে গেল তারপর তার সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,,

‘আমি সে যাকে মেহেরুন নিসার সাথে এই পৃথিবী থেকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। মুসকান আমি শেখ শাহনাওয়াজ এর ছোট মেয়ে মেহবিন মুসকান শাহনাওয়াজ।”

এইটুকু শুনেই শেখ শাহেন শাহ ছটফট করতে লাগলেন। তার মুখ বাকা হয়ে যাচ্ছিল হাত ও কেমন যেন করছিলেন। শেখ শাহনাওয়াজ ও অদ্ভুত ভাবে দেখলেন উঠে আসতেই শেখ শাহেনশাহ অজ্ঞান হয়ে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ বাবা বলে তাকে তাড়াতাড়ি করে ধরলেন। তিনি বুঝতে পারলেন স্ট্রোক করেছে। এখন তিনি নিজেই উনিশ বছর পর ডাক্তারি চিকিৎসা করলেন তাও প্রাথমিকভাবে। শেখ শাহনাওয়াজ এর চিৎকার এ শেখ বাড়ির সকলে ঘরে এলো। মেহবিন চুপ করে একপাশে শেখ শাহেনশাহ এর দিকে তাকিয়ে রইল। শেখ শাহনাওয়াজ আর আরবাজ মিলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। মেহবিন ও গেল। ওখানে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করার পর ডাক্তার জানালো এক তিনি স্ট্রোক করেছিলেন যার জন্য তার দেহের ডান সাইড প্যারালাইজড হয়ে গেছে। মুখটাও বাকা হয়ে গেছে তার জন্য উনি কথা বললেও কিছু বুঝতে পারবে না কি বলছে। শেখ বাড়ির সকল মহিলারা কেঁদে উঠলো। আরিফা জামান কেঁদে উঠলো তিনি বললেন কার নজর লেগেছে যে এসব হচ্ছে। এমনিতেও বাড়ির এই অবস্থা এখন আবার এসব। শেখ শাহনাওয়াজ করিডরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। মেহবিন পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মেহবিনের অস্তিত্ব টের পেয়ে শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আল্লাহ তায়ালা কিছু কিছু পাপের শাস্তি দুনিয়াতেই প্রদান করেন। তিনি কতোই না উত্তম কর্মবিধায়ক।
আপনি নিজেকে ছোট ভাববেন না আপনার জন্য কিছু হয় নি। আপনি তো শুধু কিছু সত্যি বলছিলেন এটা তার ব্রেন সহ্য করতে পারেনি তাই আজ এই অবস্থা।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“এসবের জন্য নিজেকে নিয়ে কিছুই ভাবছি না আমি। এটা নিয়ে আমার অনুশোচনাও নেই।তবে আমি জানতাম এই অবস্থায় তিনি এগুলো সহ্য করতে পারবেন না। তবে,,

“তবে কি?”

“আপনি কষ্ট পাচ্ছেন?”

‘আপনার কষ্টের কাছে এগুলো কিছুই না। আমার বাবা তো একেবারে মারা যায় নি তবুও ভেতরটা কতটা হাহাকার করছে আর আপনি তো তখন বাচ্চা ছিলেন তাও সব সামলে নিয়েছেন। আমাকে ক্ষমা করবেন আমি জানতাম আপনার মাকে মারার সাথে উনিও ছিলেন তবে উনি মারতে বলেন নি। উনি শুধু জানতেন মারা হবে। কিভাবে কে মারবে এসব কিছুই জানতেন না।তবে উনি একবার বলেছিলেন না মারলে হয় না। কিন্তু তারা তার কথা কানেই নেয় নি। আপনি বলেছিলেন না আমি বাবার বিষয়ে সব জেনেও কেন চুপ করে থাকি। ঠিক এই কারনে কারন তিনি ছিলেন না সেই কাজে শুধু জানতেন। কিন্তু এর মেইন মাথা কে সেটাও তিনি জানেন না। আমি যেভাবে আপনার চোখের দিকে তাকাতে পারিনা ঠিক তেমনভাবেই সেও আমার চোখে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। অদ্ভুত অনুশোচনা তার। ”

মেহবিন অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমাদের জীবন অনেক অদ্ভুত চেয়ারম্যান সাহেব। আমরা যেটাকে জটিল ভাবি সেটা কখনো কখনো অনেক সহজ হয়ে যায় আর যেটাকে সহজ ভাবি সেটা আমাদের ভাবনার তুলনায় কঠিন হয়ে পরে। যাই হোক আসছি আমি! আল্লাহ হাফেজ।

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৪৩+৪৪

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪৩ (বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

বর্তমান

মেহবিন চোখ বন্ধ করে টেবিলে হাত রেখে মাথা ধরে রেখেছে। আচংকা ক্ষত জায়গায় ওষুধ লাগতেই মেহবিন চমকে উঠলো। ও সামনে তাকাতেই দেখলো তাজেল দাঁড়িয়ে আছে। পাশে তাকাতেই দেখলো নার্স এর হাতে তুলো। ও যা বোঝার বুঝে গেল। তাজেল বলল,,

“এই যে নার্স আপা থাইমা গ্যালা ক্যান? লাগাও ওষুধ হাতের রক্তের মতো ছিটাছিটা দেহো না তুমি।”

তাজেলের কথা শুনে মেহবিনের মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো। ও বলল,,

“নেত্রী এখানে কি করছো?”

তাদের দাঁত কেলিয়ে বলল,,

‘কিছু না হাসপাতাল দ্যাখবার আইছিলাম একটু। পরে দেখলাম তুমি আইলা কারে জানি নিয়া ঐ চেয়ারম্যান বাড়ির। তারপর দেখলাম তুমি তার চিকিৎসা করলা। বাইরে মেলা মানুষ দেইহা ওনে যাইনাই। পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালাও তো আছিল। তুমি বাইর হইয়া কি জানি কইলা পরে দেহি তোমার হাত দিয়া রক্ত বাইরেতেছিল তো তাই দেইহা নার্স আপারে নিয়া আইলাম। এহন কথা কম কও নার্স আপা তুমি কাম করো।”

মেহবিন নার্সের দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল ওষুধ লাগাতে। তারপর মেহবিন তাজেলের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তোমার সৎমায়ের কি হয়েছে নেত্রী? যার জন্য তুমি তাকে দেখতে এসেছো হাসপাতালে?

মেহবিনের কথা শুনে তাদের বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তুমি এইডাও জানো?

“আমার স্পেশাল পাওয়ার আছে।”

“তোমার পশাল পাওয়ার তোমার কাছেই রাহো। আমি হাসপাতাল দেখবার আইছি কতো বড় হাসপাতাল। এমনি তো দেহা অয় নাই। তাই মন চাইলো চইলা আইলাম আমগো বাড়ি থিকা তো বেশি দূর না।

“ওটা পশাল নয় স্পেশাল। আর আমাকে মিথ্যা বলতে হবে না আমি জানি তুমি তাকেই দেখতে এসেছো।

তাজেল মাথা চুলকিয়ে বলল,,

“ঐ হইলো।”

“কি হয়েছে তার?”

“পিত্তিতে পাথর অইছে বলে। আমি যে এনে আইছি তুমি কিন্তু কাউরে কইও না।

তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো। ও বুঝতে পারলো তাজেলের মনে তার মাকে নিয়ে আলাদা কিছু একটা আছে। হয়তো একই বাড়িতে থাকে বলে। মেহবিন বলল,,

‘আচ্ছা।”

“এহন কও তুমি বাড়ি যাইবা নাকি? আমি বাড়ি যামু। আমি যে এনে আইছি কেউ জানে না। ভাবছিলাম সন্ধ্যার আগেই বাড়ি যামু কিন্তু তোমার জন্যে আন্দার অইয়া গেল।”

“আমি আজ বাড়ি যাবো না।”

“এইডা কি কও তুমি এনে থাকবা?”

নার্সের হয়ে গেছে তাই সে চলে গেল। মেহবিন তাজেল কে ডাকলো আর ওকে কোলে বসিয়ে বলল,,

“হুম আজ এখানে থাকবো। আমি যাকে নিয়ে এসেছি সে আমার বন্ধু ছিল অনেক আগে। সে এখন অসুস্থ আমি আমার দায়িত্বে তাকে এখানে এনেছি। তাই তার সবকিছু আমাকেই দেখতে হবে এই জন্য আমাকে এখানে থাকতে হবে।”

‘অনেক আগে বন্ধু ছিল এহন নাই।”

“হুম এখনো আছে তবে মনে মনে।”

“ওহ আইচ্ছা তোমার কতো বন্ধু ডাক্তার। কয়দিন আগেই আইছিল কি জানি নাম রাই না খাই।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘ওর নাম রাই ছিল। তুমি জানো আমি যাকে আজ হাসপাতালে আনলাম তার নাম ও রাই।”

“তুমি দুই রাইরে একলগে পাইলা কেমনে?”

“সে অনেক কথা এসব রাখো। আমি তোমার বাড়ি যাবার ব্যবস্থা করছি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো।”

‘তোমারে রাইতে খাওয়ায় দিবো কি রা ডাক্তার? আর খাওনই আইনা দিব কিরা?

তাজেলের কথায় মেহবিন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। এই ছোট্ট মেয়েটা ওর খাওয়ার চিন্তা করেছে। সকাল বেলা তাজেলই বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার এনে ওকে খায়িয়ে দিয়েছিল। আর দুপুর বেলাও তাই কারন সে আজ ও হাতের জন্য ছুটিতে ছিল শুধু কুদ্দুস এর জন্য তিনবার হাসপাতালে এখানে এসেছিল। মেহবিন ওকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,,

“খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমার ড্রয়ারে কাপ নুডুলস আছে রাতে গরম পানি করে নুডুলস বয়েলড করে চামচ দিয়ে খেয়ে নিতে পারবো।”

“সত্যি তো দেহি কোনে লুডুস?”

মেহবিন ড্রয়ার খুলে দেখালো সেখানে চকলেট চিপস আর তিনটা কাপ নুডুলস রাখা। মেহবিন এগুলো রাখে মাঝে মাঝেই খায়। মেহবিন একটা চকলেট তাজেলের হাতে দিয়ে খেতে বলল তারপর ওকে নিয়ে বের হবে এমন সময় মুখর ঢুকলো একজন নার্সকে নিয়ে সে এসেছিল মেহবিনের হাতে ওষুধ লাগাতে। মুখর দেখলো তার দরকার নেই। মেহবিন ওকে নিয়ে বের হলো‌। বাইরে বেরিয়ে দেখলো কেউ যায় নি। তাই দেখে মেহবিন বলল,,

“চেয়ারম্যান সাহেব আপনারা কেউ বাড়ি যাবেন না নাকি?”

তখন মিসেস আমজাদ বলল,,

“আমার ছেলের বউকে এই অবস্থায় রেখে আমরা বাড়ি যাবো নাকি।”

‘ওহ আচ্ছা তাহলে এখানের কেউ কি বাড়ি যাবেন না।”

শেখ শাহনাওয়াজ তাজেলকে দেখে বললেন,,

‘কেন আপনার কোন দরকার নাকি। তাছাড়া এখন মুখরের পরিবার চলে যাবে। ওনাদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করছি আমি।

তখন মুখরের বাবা মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

“না ভাইসাব আগে রাইফার জ্ঞান ফিরুক ওকে দেখে ওর সাথে দেখা করে তারপর যাবো। আজকে বাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও তো যেতে পারলাম না। কাল সকালে বাড়ি যেতে হবে আর দেখা হবে না।

মেহবিন বুঝতে পারলো এখন কেউ বাড়ি যাবে না। হয়তো একেবারে রাতে যাবে। মেহবিন তাজেলের দিকে তাকালো তাদের বলল নিচু হতে ও নিচু হলো তা দেখে সবাই ওদের দিকে তাকালো। তাজেল ফিসফিস করে বলল,,

“পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালারে দিয়াইতে কও। আব্বা আর দাদি মনে হয় আমারে খুজতেছে।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“ঠিক আছে।”

মেহবিন ফোন নিয়ে মুখরকে টেক্সট করলো তারপর মুখের দিকে তাকালো। মুখর টেক্সট টা দেখে মাথা নাড়ালো। মুখর সবাইকে বলল,,

“তোমরা একটু থাকো আমার একটা ইম্পোর্টেন্ট কল করার আছে‌ করে আসছি। আসার সময় তোমাদের জন্য চা ও নিয়ে আসছি।”

বলেই মুখর ওখান থেকে চলে গেল। মেহবিন তাজেলের হাত ধরে ওকে নিয়ে বের হলো। বাইরে বেরুতেই মুখর দরজা খুলে তাজেলকে কোলে নিয়ে সেখানে বসিয়ে দিল। মেহবিনকে বলল ওকে নামিয়ে দিয়ে আসছে। মুখররা চলে গেল। মেহবিন ওপরে গিয়ে দেখলো রাইফার বাবা মা এসেছে মেহবিনকে দেখেই চিনে ফেলল। রাইফার মা মেহবিনকে জরিয়ে ধরলো আর ধমক দিল তাদের না বলে হাওয়া হলো কেন। আসলে সেদিনের পর আলম আহমেদ বাসা চেঞ্জ করেছিল তাই ওকে পায় নি কেউ। রাইফার মা মেয়ের জন্য কাঁদলো। মেহবিন তাকে শান্তনা দিয়ে নিজের কেবিনে গেল। ঘন্টাখানেক পর শুনলো রাইফার জ্ঞান ফিরেছে ও তখন কফি খাওয়ার জন্য কেটলিতে গরম পানি করছিল। মেহবিন সেটা দিয়ে কফি না বানিয়ে কাপ নুডুলস বের করে তাতে ঢেলে বের হলো। মেহবিন বাইরে গিয়ে বলল কাউকে না ঢুকতে সে বের হলে যেন সবাই যায়। মেহবিন কেবিনে গিয়ে দেখলো রাইফা আধশোয়া হয়ে বসে আছে। মেহবিন টুলে ভালো করে বসে নুডুলস কাঁটা চামচ দিয়ে নাড়াতে লাগলো। রাইফা সেদিকে তাকালো মেহবিন ওর দিকে না তাকিয়ে নুডুলসের দিকে তাকিয়ে নেড়ে চেরে মুখে পুরে নিল। দুই দিন বার নেওয়ার পর তারপর বলল,,

‘এভাবে তাকাস না রাই আমার পেট খারাপ হবে ।”

রাই মেহবিনের থেকে চোখ সরিয়ে বলল,,

“আমার বয়েই গেছে তোর দিকে তাকাতে?”

“তাহলে কে তাকাচ্ছিল শুনি শেখ সায়িদের বউ রাইফা আফনূর নাকি।”

কথাটা শুনে রাইফার মুখে অন্ধকার হয়ে এলো। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“তুই কিছু বলবি নাকি আমি কিছু বলবো। আচ্ছা তোর হয়েছে টা কি বলবি? যদি তুই জেনে থাকিস তাহলে আমায় বল।”

রাইফা কিছু বললো না। মেহবিন বুঝলো ও কিছু বলবে না। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“নুডুলস খাবি রাই? কেউ কিন্তু এই নুডুলস কে কখনো না করতো না।”

রাইফা মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘কারো এইটুকুতে পেট ভরবে না। তাই এটুকু খেয়ে তার মুখ নষ্ট করবে না।”

মেহবিন হেঁসে ফেললো তা দেখে রাইফাও হাসলো। কতোদিন পর রাইফা এভাবে হাসলো তা রাইফা নিজেও জানে না। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আপাতত এটা খা আমি আরেকটা নিয়ে আসছি।”

“আরেকটায় হবে না মেহু।”

“আচ্ছা আরো দু’টো নিয়ে আসছি হ্যাপি।”

রাইফা ওপর নিচ করে হাসলো। মেহবিন হেঁসে বের হলো আর বলল,,

‘রাইফা এখন খাবে কেউ যেন ভেতরে না ঢুকে।”

তখন সায়িদ বলল,,

“আমরা তো কতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি ওর জন্য। ওকে দেখতে পেলে আমাদের ভালো লাগতো তাইনা।

মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘আপনারা তো ওকে দেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা ভাবছেন তাই না। ওর জন্য কনসার্ন আমাকে দেখাতে আসবেন না। আপনাদের সবাইকে চেনা শেষ আমার।”

বলেই মেহবিন চলে গেল কিছুক্ষণ পর দুইটা কাপ নুডুলস নিয়ে ফিরে গেল। রাইফার ওটা খাওয়া শেষ মেহবিন একটা ওকে দিল একটা সে নিল একটা। রাইফা বলল,,

“অনেকদিন পর শান্তি মতো নিজের পছন্দের নুডুলস খেলাম। শুকরিয়া মেহু।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“তোর মরার এতো তাড়া এখন মরলে কি এই নুডুলস খেতে পেতি।”

‘সত্যি কথাই বলেছিস তুই। সত্যি সত্যি মরলে মিস করতাম এটা।”

বলেই রাইফা হাসলো। মেহবিন কিছু বললো না বাইরে এসে সবাইকে দেখা করতে সবাই এক এক করে দেখা করলো। তখন রিপোর্ট এলো মেহবিন রিপোর্ট টা খুলে দেখতেই ওর মাথা ঘুরে গেল। তখন সবাই ওখানেই ছিল। রিপোর্ট এসেছে শুনে শেখ শাহনাওয়াজ শেখ আমজাদ আর সায়িদ মেহবিনের দিকে গেল। মেহবিন রাইফার কেবিনের বাইরে বসে ছিল বেঞ্চে আর চিন্তিত অবস্থায় রিপোর্ট দেখছিল। ওর চেহারা দেখে শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“কি আছে রিপোর্ট এ?”

মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

“রাইয়ের ব্রেন টিউমার যা এখন সময়ের সাথে বেশ বড় আকার ধারন করেছে। খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে আর অপারেশনটাও বেশ রিস্কি। তাছাড়া ,

এইটুকু বলেই মেহবিন থামলো শেখ আমজাদ বললেন,,

“তাছাড়া কি?”

“রাইফার একটা কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে আরেকটা ড্যামেজের পথে। খুব তাড়াতাড়ি করে অপারেশন করতে হবে। আর দুটো অপারেশনই জরুরি। কিন্তু ওর শরীর দুটোর ধকল সহ্য করতে পারবে কিনা এটা নিয়ে যথেষ্ট ভয় আছে। কিন্তু ওকে দেখে এতটা অসুস্থ মনে হচ্ছিল না। ওকে দেখে সুস্থ স্বাভাবিক লাগছিল।

সব শুনে রাইফার মা বাবা কেঁদে উঠলো। সবারই খারাপ লাগছে। মেহবিন সায়িদের দিকে তাকালো। তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মেহবিন বলল,,

“ওর এখন বেস্ট ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন।”

তখন সায়িদ বলল,,

“রাইফাকে এখানে রাখা ঠিক হবেনা। ওকে এখনই আমাদের হাসপাতালে বেস্ট কেবিনে শিফট করতে হবে। আর হ্যা ওখানে গিয়ে আমরা আবার ওর টেস্ট করাবো। তারপর শিওর হয়ে চিকিৎসা নেব।”

“আপনারা ভাবলেন কি করে? আমি রাইফার ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা আপনাদের ওপরে ছেড়ে দেব।”

কথাটা শুনে সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। সায়িদ বলল,,

“তো তুমি করবে? তুমি এই সরকারি হাসপাতাল থেকে কি করবে। তাছাড়া কয়টাকা আছে তোমার ? আমাদের হাসপাতাল নামকরা হাসপাতাল ওখানের ট্রিটমেন্ট ও বেস্ট। তাছাড়া বেস্ট ডক্টরদের সাথে কনসার্ন করে রাইফার চিকিৎসা করাতে হবে। আমি ওর জন্য বেস্ট ডক্টর আনবো। রাইফা ভালো হয়ে যাবে।”

মেহবিন কিছু বলবে তার আগে মেহবিনের ফোন এলো ও ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে বলল,,

” ম্যাডাম রিপোর্ট এ একটা জিনিস দেওয়া হয় নি। ভুল হয়ে গেছে একটা।

‘কি দেওয়া হয় নি।”

“মিসেস রাইফা আফনূর এর শরীরে একটা কেমিক্যাল পাওয়া গেছে। ”

“কি কেমিক্যাল?”

লোকটা কেমিক্যাল এর নাম বলতেই মেহবিনের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো আর লোকটা এটাও বলল বেশ কয়েকবার এই কেমিক্যাল রাইফার শরীরে দেওয়া হয়েছে। শুনেই মেহবিন দেয়ালে একটা ঘুষি মেরে বলল,

“আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। কিছু একটা তো চোখের আড়ালে হচ্ছে।

বলেই মেহবিন ফোন রেখে দিল। ওর শরীর রাগে জ্বলছে আর ওর মনে হচ্ছে শেখ পরিবার কে মেরে ফেলতে। রাইয়ের শরীরে এমন কেমিক্যাল পাওয়া গেছে যা কিডনি ড্যামেজ করে ফেলে। আর ঐ কেমিক্যালের জন্যই ওর একটা কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি কিছু না করলে আরেকটাও হয়ে যাবে। মেহবিন সায়িদের দিকে তাকালো । মেহবিন বড় বড় শ্বাস নিল। তখন শেখ শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“কি হয়েছে আপনি এরকম রেগে যাচ্ছেন কেন?’

মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

“কিছু না আপনাদের তো রাইফাকে দেখা হয়ে গেছে এখন বাড়ি চলে যান।”

তখন শেখ আমজাদ বলল,,

‘আমরা রাইফাকে নিয়ে যাবো এখান থেকে। এই সরকারি হাসপাতালে রাখবো না। রাইফার জন্য এক একটা মুহুর্ত খুব দামী। শরীরের যে কন্ডিশন? কোন ভালো স্পেশালিস্ট দিয়ে ওর অপারেশন করাতে হবে। আমার পরিচিত ভালো ডক্টর আছে আমি তাদের সাথে কথা বলছি। আমাদের হাসপাতালে নিয়ে ওর বেটার ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। যা আপনার ভরসায় আমি ফেলে রাখবো না। আপনি আর কয় টাকায় রোজগার করেন আমাদের মতো ভালো ডাক্তার ট্রিটমেন্ট তো দূরে থাক আপনি তো ভালো হাসপাতালে ওর এডমিট ও করতে পারবেন না। তাছাড়া কিডনি ও তো লাগবে সেটা দেবে কে আপনি। ব্রেন টিউমার এর জন্য বেস্ট ডাক্তার লাগবে আপনার মতো নগন্য সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার বেস্ট ডাক্তারের কি বেস্ট ডাক্তারের সাথে পরিচয় আছে আর থাকলেও ওনার ফিস দিতে পারবে তুমি। আমরা ওকে বাইরের দেশে পাঠাবো চিকিৎসার জন্য। আমরা ওর পরিবার আর আপনি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়তো আগে ছিলে এখন দেখে মনে হয় নও। আমরা তোমার ভরসায় ওকে ফেলে রাখবো না। তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারো না। তাছাড়া যার কোন ফ্যামিলি নেই সে ফ্যামিলির মানে বুঝবে না।

শেখ আমজাদের এমন কথায় রাই শান্ত ভাবেই তার দিকে তাকালো। তারপর শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তারপর মুখরদের পরিবারের দিকে তারা সবাই ওর দিকে অসহায় চোখে তাকালো। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আমার বুঝতেও হবে না এইসব ফ্যামিলির মানে। আর বাকিটা না হয় আমার হাতেই ছেড়ে দিন‌। আপনারা যতো যাই বলুন না কেন আমি আপনাদের হাতে রাইকে তুলে দেব না। ”

বলেই ফোন বের করে মেহবিন রাই মালিকের নাম্বারে ফোন করলো। ওপাশ থেকে রাই ফোন ধরতেই বলল,,

“কাল বাংলাদেশ সময় দুটোর আগে তোকে আমার এখানে দেখতে চাই। আর হ্যা তোকে মেইল পাঠাচ্ছি একজনের সেটা দেখে অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিবি।”

“মানে তুই থাকতে আমি!”

‘আমার হাতের অবস্থা ভালো নয় আর আমি রাইয়ের ব্যাপারে কোন রিস্ক নিতে রাজি নই। রাখছি কাল দেখা হচ্ছে।”

বলেই মেহবিন ফোন কেটে দিল। তারপর আরেকজনকে আরেকটা কল দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিছুক্ষণ পর আবার দিল এখন ফোনটা রিসিভ হলো ও ইংলিশ এ বলল,,

“হ্যালো ডক্টর ইলিয়ানা ফার্নান্দেজ আমি ডক্টর মেহবিন মুসকান। আপনার একটা সাহায্য লাগবে। একটা পেশেন্ট তার ব্রেন টিউমার হয়েছে এবং বড় আকার ধারণ করেছে। ব্যাপারটা খুব রিস্কি। আপনি যদি তার অপারেশন টা করতেন। আমি ওখানে তাকে পাঠাবো।আমি ডিটেলস পাঠাচ্ছি আপনাকে।

তিনি জানালো সে পারবে। মেহবিন বলল সে বিশ দিনের মধ্যে তাকে পাঠাবে। তিনি যেন তার অবস্থা দেখে অপারেশনটা করে। কথা বলা শেষ করে মেহবিন শেখ আমাজাদের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“সি শেখ আমজাদ দুটো বেস্ট ডক্টর রেডি। রাই মালিক কে তো চিনেন। আর ডক্টর ইলিয়ানা ফার্নান্দেজ কেও চেনার কথা। এমন কোন রেপুটেডেড ডক্টর নেই যে ইলিয়ানা ফার্নান্দেজ কে না চিনে এবং অপারেশনের ডেট ও প্রায় রেডি। হয়ে গেছে সব দেখা এখন আপনারা যে যার মতো বাড়ি যেতে পারেন।

সবাই সব দেখে অবাক হয়ে গেল কে কি বলবে। মুখরের পরিবার ও কম অবাক হয় নি। শুধু অবাক হয় নি মুখর আর শেখ শাহনাওয়াজ। তখন সায়িদ বলল,,

“সব বুঝলাম কিন্তু কিডনি! কিডনি পাবে কোথায়? আর টাকা এতো গুলো টাকা কি উরে উপরে আসবে নাকি‌?”

“টাকার ব্যাপারটা না হয় আমার ওপর ছেড়ে দিন। আর কিডনি সে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। আর যদি না পারি তাহলে নিশাচর কে ফোন করবো কিডনির জন্য।”

বলেই মেহবিন হেঁসে ওখান থেকে চলে এলো। একবার রাইকে দেখলো ও ঘুমাচ্ছে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। শেখ বাড়ির সকলে চলে গেল। মেহবিন কাউকে কিডনির কথা বলে রাইফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। পাচ মিনিট পর ফোনে একটা ফোন এলো। মেহবিন ফোন উঠালো ও কিছু বলবে তার আগে ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,,

“শুনলাম তুমি তোমার বান্ধবীর জন্য নাকি আমার কাছে কল করবে? তুমি বোধহয় ব্যস্ত আছো খুব। তাই ভাবলাম আমিই করি।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“ভালো করেছেন কল দিয়ে। ‌ কি করবো বলুন এতকিছু কি আর একসাথে করা যায়।”

‘আমার কাজকে বেআইনি অবৈধ বলো আবার অন্যায় বলো। দেখলে তো এই কাজ মানুষের কতো সাহায্যে আসে। এখন তুমি ইমার্জেন্সি কিডনি কোথায় পাবে সেই আমার দ্বারস্থ হতে হলো। তো বলো তোমার বান্ধবীর কিরকম কিডনি লাগবে ডিটেলস বলো। আমি পাঠিয়ে দেব সমস্যা নেই আমি টাকা নেব না। শুধু একটা কথা দেবে তুমি আমার দূরে থাকবে।”

মেহবিন হাঁসি মুখেই বলল,,

“সেদিন আমার সাথে কথা বললেন তবুও আপনার এতো ভয় আমাকে নিয়ে। বাহ বেশ লাগলো তো! তবে আপনাকে কে বলল আমি অবৈধ অন্যায়ভাবে নেওয়া কিডনি আমার বান্ধবীর শরীরে ঢুকাবো।”

‘মানে?”

“মানে আমি তখন এমনিই বলেছিলাম যে নিশাচর কে ফোন করবো। তার মানে এই নয় সত্যি সত্যি আপনাকে কল করে বলবো কিডনির জন্য। আমার কিডনি রেডি কালকেই এসে পরবে। তবে আপনাকে ধন্যবাদ।”

বলেই মেহবিন ফোন রেখে দিল। ফোনের দিকে তাকাতেই ওর মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো। ও কাউকে ফোন করে বলল,,

“নাম্বারটার ঠিকুচি গুষ্টি সব আমার চাই।”

বলেই ফোন রেখে হেঁসে বলল,,

“আপনাকে এতটা বোকা ভাবিনি আমি নিশাচর। আপনার নাম বলতেই আপনি খুশিমনে আমাকে কোন ননট্র্যাকার প্রাইভেট নাম্বার ছাড়াই আমাকে ফোন করবেন আমি ভাবতেও পারিনি। একে বলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা আমি তো ইচ্ছে করেই আপনার নাম নিয়েছিলাম।”

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪৪
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন রাইফার দিকে তাকাতেই দেখলো ও অদ্ভুত ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে দেখে মেহবিন বলল,,

“তুই ঘুমাস নি?”

রাইফা বলল,,

‘ঘুমিয়েছিলাম কিন্তু হুট করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। তোর দিকে তাকাতেই একটা অদ্ভুত ইচ্ছে হচ্ছে।”

“কি ইচ্ছে?”

“আজ চাঁদ উঠেছে তাই না?”

মেহবিন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল,,

‘হুম উঠেছে।”

“তোর কাঁধে মাথা রেখে চন্দ্রবিলাশ করতে ইচ্ছে করছে খুব। কে জানে হয়তো আর কোনদিন এই সুযোগটা পাবো কিনা?”

মেহবিন ওর দিকে তাকালো আর বলল,,

“কেন পারবি না এখনো অনেকটা সময় বাকি আছে তোর।”

‘কেন মিথ্যা বলছিস বলতো?আচ্ছা যাই হোক এখন পুরোনো কথা বাদ। এখন তুই বল আমার ইচ্ছেটা পূরন করবি কিনা?

মেহবিন বুঝতে পারলো ও একটু ভালো থাকতে চাইছে তাই কিছু বললো না। ও এগিয়ে গিয়ে আয়াতুল কুরসি আর তিন কুল পাঠ করে ফু দিল। নিজেও পড়লো নিজের জন্য তারপর বলল,,

“হাঁটতে পারবি?”

‘না হাঁটতে পারলে কি তুই কোলে নিবি? তখন তো ঠিকই এনেছিলি। আচ্ছা আমায় বল তুই এতো শক্তি পাস কোথায় বলতো। যদিও আমি মোটা না তবুও একটা ব্যাপার আছে তো?”

মেহবিন কিছু বললো না হেঁসে ওর হাতের ক্যানুলা থেকে স্যালাইন এর পাইপটা খুলে ফেলল তারপর ওকে কোলে নিল। হাঁটা ধরলো লিফট দিয়ে সোজা ছাদে চলে গেল। যদিও সবার যাওয়ার অনুমতি নেই তবে মেহবিনের আছে। রাত দশটা বেশ মানুষের আনাগোনা এখনো আছে। একজন মেয়ে আরেকজন মেয়েকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে সবাই ওদিকে তাকিয়ে ছিল তাতে মেহবিনের কি সে তার কাজ ঠিকই‌ করলো। ছাদে দু’টো বেঞ্চ রাখা উঠে তার একটাতে রাইকে বসিয়ে দিল।সাথে নিজেও বসলো মেহবিন একটু হাঁপিয়ে গেছে ও বড় বড় করে শ্বাস নিল। তারপর বলল,,

“নিন এবার মাথা রেখে চন্দ্রবিলাশ করুন ম্যাডাম। চাঁদটা যে আপনার দেখারই অপেক্ষায় ছিল আজ।”

রাইফা মুচকি হেসে মেহবিনের দিকে তাকালো। রাইফা মাথা রাখলো তারপর একটু চাঁদের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘এই চাঁদটাও কি অদ্ভুত মেহু প্রথম প্রথম দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে জীবনের কিছু স্মৃতি মনে করিয়ে অসহায় করে দেয়। মনে করিয়ে দেয় তার একাকীত্বতা।”

“কিছু কিছু জিনিসের একাকীত্বতাই তার সৌন্দর্য!”

“আমাদের বিচ্ছেদের কারন কি মেহু?’

মেহবিন রাইফার দিকে তাকালো। রাইফা নিজেও সোজা হয়ে বসে মেহবিনের দিকে তাকালো। মেহবিন মুচকি হাসলো আর বলল,,

“সেটা তো আমার থেকে ভালো তুই জানিস?”

‘তোকে বিশ্বাস না করে সেদিন সাগরিকাকে সঙ্গ দেওয়াই হয়তো কারন টা।”

মেহবিন হাসলো আর বলল,

“আচ্ছা সেসব তো পরের কথা আর আগের কথাগুলো বল তোকে সাগরিকার রাই ডাকা‌। ওর সাথে বেশি সময় কাটানো ওর সাথে বাড়ি ফেরা আমাকে একটাও ফোন না করা ওগুলো কি ছিল রাই?

“সেগুলো করাই আমার ভুল ছিল। ওকে রাই বলাতে কিছু বলি নি ও মায়ের সামনে একদিন বলেছিল আমরা তো বন্ধু তাহলে ও তো রাই বলে ডাকতেই পারে । মা বলেছিল কেন নয় তাই কিছু বলিনি। তবে ওর সাথে কথা বলা ও নিজেই কথা দিয়ে ব্যস্ত রাখতো। আর বাড়িতেও তেমনই সবসময় চিপকে থাকতো আমি সৌজন্যতার খাতিরে কিছুই করতে পারতাম না। ”

“ভুল বললি রাই? একটা মানুষ চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত থাকে না। তখন ওর নতুন নতুন জিনিস তোকে মুগ্ধ করতো‌। তোকে মাঝে মাঝে গিফট করতো এটা তোর ভালো লাগতো‌ । ওর প্রতি তোর সফট কর্নার তৈরি হয়েছিল। সবথেকে বড় কথা কিছু সময়ের জন্য হলেও আমার থেকে ওর সঙ্গ তোর ভালো লাগতো। তাই তুই ওর সাথে থাকতি। আমি তোকে ভালোভাবেই চিনি রাই আমাকে দয়া করে কোন এক্সিউজ দিস না।”

সব শুনে রাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠলো। এই মেয়েটা এখনো ওকে ভালো মতো চেনে।

“আমি তোকে বিশ্বাস করি মেহু?”

মেহবিন কিছু বললো না শুধু হাসলো। তা দেখে রাইফা বলল,,

“তুই ভাবছিস অবিশ্বাসের জন্য বিচ্ছেদ হয়েছে কিন্তু আমার কাছে তা অভিমানের জন্য। সেদিন সেসব কথা শুনে অনেক রাগ হয়েছিল কিন্তু আমি পুরোপুরি তোকে অবিশ্বাস করিনি। আমি মনে মনে কতোবার ধোঁকাবাজ বলার জন্য মাফ চেয়েছি তুই ভাবতেও পারবি না। আমি মনে মনে শুধু বলতাম প্লিজ মেহু তুই একবার আমার সাথে কথা বল একবার আমার কাছে আয় আমি তোকে আবার আমার বন্ধু করে নেব। কিন্তু তুই করলি না আমার অভিমানের পাহাড় বাড়তে লাগলো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম সত্যিই তুই করেছিস নাহলে এতো দিনে তুই আমার কাছে ফিরে আসতি। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম তুই না আসলে আমিও যাবো না তবে তুই একবার এসে সব বললে আমি আবার তোর কাছে চলে যাবো। সেই জন্য তোকে ইগনোর করে দেখিয়ে দেখিয়ে সাগরিকার সাথে কথা বলতাম সেই ঘটনার পর। যাতে তুই রেগে গিয়ে সব প্রমান করে দিস কিন্তু সেসব কিছুই করলি না। তবুও আমি অপেক্ষায় ছিলাম তুই আয় আর সবকিছু মিথ্যে প্রমান করে দে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার বন্ধুর ব্যক্তিত্ব কে,সে কাউকে মানাবে না। যারা তার জীবনে থাকবে তাকে বিশ্বাস ভরসা করেই থাকতে হবে সে কাউকে ফেরাবে না মানাবে না। আর আমি এটাও জানতাম আমি যদি তোর কাছে যাই তাহলে তুই আমায় আগলে নিবি। আর এখানেই সবথেকে বড় ভুল করে বসি অভিমানে তোর কাছে না গিয়ে আমি তোর থেকে দূরে সরে গেলাম।

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“এই একটা কারনেই তুই আজ এখানে? যদি সত্যি সত্যি আমায় অবিশ্বাস করতি তাহলে তুই এখানে তো দূর মরে যাওয়ার আগে আমার দেখাটাও পেতি না। আমি তো তোর চোখ দেখেই বুঝতাম তুই কি চাইছিস তবে এবার আমার অভিমান ছিল তোর ওপর যে তুই আমার জন্য সবার সামনে বলতে পারলি না যে আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে চিনি তোদের ঠুনকো কাউয়ার কথায় আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে অবিশ্বাস করি না। আমার অভিমান এ আরেকটু ঘি ঢেলে তুই আমার জন্য আনা ফুল চকলেট ওকে দিলি। তবে থেকেই আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করি আমি নিজ থেকে তোকে মানাবো না। আমিও ভাবতাম আর মনে মনে বলতাম ফিরে আয় রাই আমার গলা জড়িয়ে ধরে একবার বল আমি তোকে বিশ্বাস করি সেদিন যা ছিল সব ভুল ছিল। যদি তুই একবার বলতি আমি তোকে আগলে নিতাম কিন্তু তুই বললি না। আমি ভেবেছিলাম এবার আমি নয় সব তুই বের করবি কিন্তু তুই তো কিছুই করলি না সব সবসময় এর জন্য আমার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলি।

রাইফা হেঁসে বলল,,

“তুই আমার পথ চেয়েছিলি আর আমি তোর যার জন্য আমাদের এই বিচ্ছেদ। ”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“এটাই আজকাল কার একটা বড় সমস্যা। আমরা ভাবি আমরা কেন এগিয়ে যাবো আমাদের ইগো হার্ট হবে অপরজন আসুক তাহলেই আমরা সম্পর্ক ঠিক করে নেব। ঠিক এই কারনেই দুজন দুজনের দিক থেকে এগোয় না যার দরুন এই বিচ্ছেদ। যদি একজন এগুতো তাহলেই কিন্তু সম্পর্ক টা থেকে যেত।কিন্তু মিসেস রাইফা আফনূর আপনি আপনার এই অভিমানের আর অপেক্ষার দরুন তৃতীয় ব্যক্তিকে জিতিয়ে দিয়েছেন।

“মাফ করে দে মেহু। লাস্ট পরীক্ষার দিন তুই চলে যাওয়ার পর আমি দুঃখী মনে বাড়ি ফিরি। বিকেলে ছাদে উঠে দেখি সাগরিকা আর একটা ছেলে আমাদের নিয়ে কথা বলছে আমাদের ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে সেদিনের সেই চিঠি সেই ছেলেটা লিখেছিল আর লাস্ট ক্লাসের দিন যারা সাগরিকার সাথে তোর নামে বলেছিল তাদের ওরা পাঁচশ টাকা করে একেকজন কে দিয়ে বলিয়ে ছিল যাতে আমি তোকে অবিশ্বাস করি । আর আমাদের ফ্রেন্ডশীপ ভেঙে যায়। সব কিছু শুনে আমার পায়ের নিচ মাটি চলে যায়। আমি যার জন্য তোকে দায়ী করতাম সেটা ছিল ওরা। আমি সব অভিমান ভুলে দৌড়ে নিচে এসে মায়ের কাছে বলে তোদের বাড়ি গেলাম গিয়ে দেখি তালা তোরা নেই চলে গেছিস। তুই জানিস না মেহু সেদিন চিৎকার করে আমি কেদেছিলাম তোর বাড়ির সামনে আমি আমার একটু অভিমানের দরুন তোকে হাড়িয়ে ফেললাম। নিজের কাছে নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছিল। এরপর আমি আর কাউকে বন্ধু বানাইনি মেহু আমার জীবনে তুই ছাড়া আর কোন বন্ধু নেই মেহু।

রাইয়ের চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। মেহবিন তা মুছে দিল। তারপর মুচকি হেসে বলল,,

“তারপর তারপর কি হয়েছিল সাগরিকার কিছু কি হয়েছিল?”

“বাড়ি গিয়ে দেখি আঙ্কেল ইচ্ছে মতো সাগরিকা কে পেটাচ্ছে। সাগরিকা চিৎকার করছে আর কাঁদছে।আমি তো থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি নিজেই নিয়ত করেছিলাম দু’টো থাপ্পড় হলেও ওকে মারবো। পরে জানতে পারলাম ও একটা ছেলের সাথে লিপ কিস করছিল আর সেটা কেউ ছবি তুলে ওর বাবাকে পাঠিয়েছে এই জন্য পেটাচ্ছে। বাড়ির মানসম্মান ভুলে এসব করেছে দেখে। সেটা আবার মুহুর্তেই পুরো মহল্লায় ছড়িয়ে পরেছে সবাই ছি ছি করছিল। শেষে বাধ্য হয়ে পরের দিন ওরা এলাকা ছাড়লো।”

মেহবিন এবার একটু জোরেই হাসলো আর বলল,,

“বাহ কেয়া সিন হে!! ইস মিস্টার আলম সেদিন বাসা না চেন্জ করলে এই দৃশ্যটা দেখতে পেতাম।”

“এক মিনিট এক মিনিট তুই বললি সাগরিকার কি হয়েছিল তার মানে তুই?”

মেহবিন হেঁসে মাথা নাড়িয়ে বলল,,

“আমাদের বন্ধুত্ব ভেঙে দিল আর আমি ওকে ছাড়বো নাকি। আমাকে তো ভালো করেই চিনিস আমার সাথে কেউ অন্যায় করলে আমি অবশ্যই তাকে শাস্তি দিই।”

এবার রাইফাও হাসলো একটু পর বলল,,

“আচ্ছা এইসবে সাগরিকার কি স্বার্থ ছিল। ও কিসের জন্য আমাদের এতো সুন্দর সম্পর্ক টা নষ্ট করলো?

“তোর তোদের এলাকার এক নামধারী নেতার ছেলে শফিক কে মনে আছে রাই? যে ছেলেটা তোকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছিল আর অসভ্যতা করেছিল বলে আমি মেরে ওর বাবার কাছে বিচার দিয়েছিলাম।”

“হুম মনে আছে তো? এই সবের সাথে এটার কি সম্পর্ক?”

“সেই ছেলেটাকে সাগরিকা পছন্দ করতো।”

“ওয়াক থু ঐ মেয়ের এইরকম থার্ড ক্লাস পুলাপাইন পছন্দ।”

রাইয়ের কথায় মেহবিন হাসলো আর বলল,,

“যে যেরকম তার চয়েজ তো সেরকমই হবে। সেই ছেলেটাকে ও জানায় ওর মনের কথা‌। পরে সেই ছেলেটা আমাদের ফ্রেন্ডশীপ ভাঙার কথা বলে। যদি ভাঙতে পারে তবেই ও রাজি হবে। আমি না থাকলে তুই কিছুই না। তাই আমাদের ফ্রেন্ডশীপ ভাঙার জন্য ওকে পাঠায়। কিন্তু মেয়েটা ছেলেটার জন্য এতটাই পাগল যে এই কাজটাও করে ফেলল যেদিন আমাদের ফ্রেন্ডশীপ ভাঙলো সেদিন ছেলেটা খুশি মনে ওর সাথে রিলেশন এ জড়িয়েছে। এমন কি?”

রাইফা ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তা দেখে ও বলল,,

“না কিছু না?”

“এই কি তারপর বল?”

“না ওসব বড় মাইনষের কথা তোর শোনা লাগবে না?”

রাইফা ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকায়। আর বলে “তুই বলবি?”

“তাদের ওষ্ঠদয়ের মিলনায়তন ও হয়েছিল।”

“আস্তাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। এইডা কি কইলি তুই ধুর ধুর ঐ রহম একটা মাইয়ার লগে আমি আছিলাম তোরে দেখাইয়া দেখাইয়া আবার হাত ও ধরছি। আল্লাহ মাফ করো। একে তো হারাম রিলেশনশিপ তারপর আবার কঠিন যেনা। আল্লাহ এর থেকে সবাইকে রহম করুন।

“সাগরিকা এক বছর আগে মারা গেছে রাই?”

হুট করে এমন কথায় রাই থমকে গেল। আর বলল,

“কি কিভাবে? আর তুই জানলি কিভাবে?”

‘আমি আগে যে হাসপাতালে ছিলাম সেই হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ব্লাড ক্যান্সার হয়েছিল। আমাকে দেখে চিনতে পেরে আমার কাছে সবকিছুর জন্য মাফ চায়। শেষে এটাও বলেছিল ওর পাপের জন্যই নাকি ওর এই অবস্থা। আমি আর কিছু বলিনি।”

সব শুনে রাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর বলল,,

“আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না এটাই তার প্রমান?”

‘তুই ভালো নেই কেন রাই? আমি সবকিছু শুনতে চাই।আমি এও জানি তুই অনেককিছুই জানিস।”

রাই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“সেইসব বলতেই তোকে এখানে নিয়ে আসা আমার একটু খোলা আকাশ আর একজন মানুষ দরকার ছিল যাকে আমি সব বলতে পারবো। আমার ভিশন দমবন্ধ লাগে। বোধহয় কত যুগ ধরে আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিই না।

রাইফা মেহবিনের কাঁধে মাথা রাখলো তারপর হাত জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলতে শুরু করল,,

“পড়াশোনা শেষ বাবা বিয়ের কথা কথা ভাবছিল। তখন শেখ পরিবার থেকে আমার জন্য প্রপোজাল যায়। এতো ভালো পরিবার ডাক্তার ছেলে দেখে সবাই রাজি হয়ে যায়। আমিও সায়িদের সাথে কথা বলে মনে হয় ভালোই তবুও কোথাও একটা কিন্তু রয়ে যায়। আমি ওকে পুরোপুরি ভাবে ভরসা করে বিয়ে করতে পারছিলাম না। কিন্তু মা বাবা রাজি বিধায় আমি কিছু বলি নি। আমিও রাজি হয়ে যাই। সবকিছু ঠিকঠাক বিয়েটাও হয়ে গেল আমি নিজেকে মানালাম। বাসর ঘরে ঢুকেই আমি দেখলাম সেখানে নুপুর বসে আছে।

“ডক্টর নুপুর?”

“হুম! ডক্টর নুপুর সে আমায় জানালো ওর আর সায়িদ রিলেশনে আছে। কিছুক্ষণ পর সায়িদ ও ঢুকলো ওকে দেখে বোঝা গেল ও নুপুরকে আশা করেনি। ওর দিকে তাকিয়ে সায়িদ ও ওদের ব্যাপারে জানালো। পরে আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম তাহলে বিয়েটা করলো কেন? সে জানালো বাবা কাকারা ওপরে নাকি বলতে পারেনি। দুজনে মিলে আমায় শাসাচ্ছিল আমি যেন কাউকে কিছু না বলি। আমি কি বলবো আমার ভেতর থেকে কোন আওয়াজই বের হচ্ছিল না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। তখন সায়িদ আমাকে বলল আমি যেন ওর ওপর কোন আশা না রাখি আর কাউকে যদি কিছু বলি তাহলে নাকি বাবার ব্যবসা ডুবিয়ে দেবে একটা ভিডিও দেখালো যেখানে আমার বাবার সব ডকুমেন্ট এর ফাইল। আর বলল আমার পরিবার কে শেষ করে ফেলবে। আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি বলি কিছু বলবো না। তখন নুপুর ওকে জড়িয়ে ধরে আবার ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বুঝিয়ে দিয়ে গেল এই মানুষটি আমার। এসব দেখে আমার একটুও সহ্য হচ্ছিল না
আমি তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে চলে যাই আমি সেদিন চিৎকার করে কেঁদে ছিলাম তবে মুখে কাপড় দিয়ে যাতে আওয়াজ বাইরে না যায়।”

মেহবিন নিজের কাঁধে তরল কিছু অনুভব করলো ও বুঝতে পারল রাইফা কাঁদছে। ও একহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আবার রাইফা বলল,,

“ঘন্টাখানেক কান্না করে বের হলাম। আমি কোনদিকে না তাকিয়ে জামাকাপড় নিয়ে ফ্রেশ হলাম তারপর সোফায় ঘুমিয়ে পরলাম। আর সায়িদ এলোমেলো ভাবে বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। তার দিকে তাকিয়েই বলতে ইচ্ছে করলো সে আমার সাথে এমন কেন করলো। পরের দিন জানতে পারলাম বিদেশে যেতে হবে সায়িদের ডক্টর রিলেটেড কাজের জন্য। ও বলল চুপচাপ মেনে নিতে। এদিকে নুপুর ওকে যেতে দিতে চাইলো না। ও বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাকে নিয়ে বিদেশে গেল। প্রথম প্রথম ভালো ব্যবহারই করছিল আমি বললাম বিয়ে যেহেতু হয়েছে মানিয়ে নিতে কিছু ইসালামিক পরকীয়ার বিষয়েও বললাম ও বলল ওনাকি নুপুরকে ধোঁকা দিতে পারবে না যতোই হারাম রিলেশনশিপ হোক । ওনার ভালোবাসা দেখে আমিও মুগ্ধ হতে লাগলাম তবে ঐ যে হারাম ইজ হারাম। এই জন্য বিভিন্ন ভাবে বোঝাতে লাগলাম। কিন্তু কাজ হলো না। আমিও হাল ছেড়ে দিলাম। এভাবেই একমাস পার হয়ে গেল। আমি এক ঘরে ঘুমাতাম ও এক ঘরে। রোজ নিয়ম করে নুপুরের সাথে কথা বলতো নুপুরই ফোন দিতো মুলত। একদিন খাবার খাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমার শরীরটা ভার ছেড়ে দিচ্ছে । আমি কোন রকমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলাম। সকালে উঠে দেখি আমি এলোমেলো আর সায়িদ আমার পাশে। আর এটা সায়িদের ঘর। যা ঘটার রাতেই ঘটে গেছে। সকালে উঠে সায়িদ এমন একটা ভান করলো আমি গিয়েছি ওর রুমে। কিন্তু আমার মনে ছিল আমি আমার রুমেই শুয়ে ছিলাম। আমাকে নানা কথা বলতে লাগলো আমি নাকি ওর কাছে গিয়েছি ও পুরুষ মানুষ ঘুমের ঘোরে নুপুরকে ভেবে এসব করে ফেলেছে মানে আমারই দোষ। নিজের ওপরেই সেদিন নিজের ঘৃনা লাগছিল। এভাবেই চার পাঁচ দিন গেল আমি ওর মুখোমুখি হলাম না। সেদিন রাতে সায়িদই ডাকে যা হওয়ার হয়ে গেছে আমরা তো হাজবেন্ড ওয়াইফ বৈধতা আছে নিজেকে ছোট ভাবার কারন নেই আরো কতো কিছু। আমি কিছুই বলি নি একসাথে খাবার খেতে বললে আমিও খেলাম। কিন্তু খাবার খেয়ে উঠতেই দেখি আমার নিজের ওপর কোন কন্ট্রোল নেই। গলা শুকিয়ে আসছে হাত পা অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে।তখন সায়িদ এসে আমাকে কোলে নিয়ে বলল সেদিন তুমি অজ্ঞান অবস্থায় অনেক আনন্দ লেগেছিল ভাবলাম অজ্ঞান অবস্থায়ই এতটা আনন্দ তাহলে সজ্ঞানে থাকলে না জানি কি পেতাম। বলেই বিছানায় ফেলে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো আর আমি কিছুই করতে পারলাম না। সেদিন কতটা অসহায় ছিলাম তোকে বোঝাতেও পারবো না মেহু।

রাইফা জোরেই কেঁদে উঠলো। মেহবিন রাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রাইফা বলল,,

“কি ভাগ্য আমার নিজের স্বামীর কাছেই ধর্ষিত হলাম আমি মেহু ! কারন ওটায় তো আমার সম্মতি ছিল না আমাকে ওষুধ খায়িয়ে জোর করেই করেছে তাহলে তো ওটা ধর্ষণই বলে তাই না।”

মেহবিনের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ঐ সায়িদকে শেষ করে ফেলতে। ও মনে মনে কিছু একটা ভেবেও ফেলল। তখন রাইফা বলল,,

“এভাবেই ও কতোবার জোর করে শাসিয়ে আমাকে ধর্ষণ করেছে তার হিসেব নেই। তখন তো আরেকটা ভয় ছিল। ও নিজের বউয়ের ভিডিও বানিয়েছিল। আমি মুখ খুললেই নাকি ও ওগুলো ভাইরাল করে দেবে। আর নুপুরকে তো জানতেই দেওয়া যাবে না। ও আমাকে বিদেশ থাকতে কি কি যেন ওষুধ খাওয়াতো জোর করে। যার জন্য বাচ্চা ও হবে না । আবার কয়েকবার শরীরে কিসের ইনজেকশন পুশ করতো আমি বুঝতেই পারতাম না ওর আমার সাথে ঠিক কি করতে চাইছে। বিদেশে ঐ ছয়মাসে নুপুর ও গিয়েছিল দুইবার ঐ দুইবারে নুপুর ও ওর সাথে শারীরিক মেলামেশা করতো। আমি ওখান থেকেই জানলাম সায়িদ আর নুপুর আগে বিদেশে এক জায়গায়ই পড়াশোনা করতো আর ওরা লিভ ইন এ ছিল। পড়াশোনা করতো আগে তখন ও সে এরকমই ছিল। এসব নুপুরই জানায়।আমার নিজের ওপরই নিজের রাগ হতো যে এই রকম মানুষের সাথে আমার জীবন জড়িয়ে গেছে। একদিন মাথা ঘুরে পরে যাই সায়িদ বাসায় ছিল না। আমাকে কাজের লোক হাসপাতালে নিয়ে যায় ওখানে গিয়ে টেস্ট করাতেই ব্রেন টিউমার ধরা পরে। আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি অন্তত মরে গেলে এসব থেকে বেঁচে যাবো।তাই তো সব জেনেও আমি কিছু করতাম না ডাক্তার দেখাতাম না। নিজে সম্পূর্ণ চেষ্টা করতাম যাতে কেউ না বুঝতে পারে আমি অসুস্থ।

মেহবিন আজ নিজেকে অসহায় বোধ করলো। ওর ভেতরে অদ্ভুত যন্ত্রনা হচ্ছে। রাইফা ভাবছে মরে গেলেই এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। ভাবতেই ওর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। রাইফা আবার বলল,,

তারপর দেশে এলাম নুপুরের জন্য সায়িদ আমার সাথে মিশতে পারতো না। দুজনে মিলে কি করতো কে জানে। প্রায়ই সায়িদ গেস্ট রুম সবার থেকে লুকিয়ে ওর কাছে থাকতো আরবাজ ভাইয়ার বিয়ের কথা বলতেই আমি ভয় পেয়ে যাই। এদের দুজনের প্ল্যান ছিল নুপুরকে এবাড়িতে পার্মানেন্ট আনার। ওর সাথে আরবাজ ভাইয়ার বিয়ে দুজনের পরকীয়া করতে সুবিধা হবে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আরবাজ ভাইয়ার জন্য বিয়েটা হয় না। সেদিন দু’জনে জোর করে ধরে আমাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে দিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আজ সকালে জানতে পারলাম দু’জনে কথা বলছিল আমি লুকিয়ে তাদের কথা শুনছিলাম তারা আমার শরীরে কিডনি ড্যামেজ হওয়ার ওষুধ দিয়েছে। আমাকে মেরে ফেলার জন্যই এই প্ল্যান। অন্য ভাবে মেরে ফেললে কেউ সন্দেহ করতে পারে আর যদি এভাবে মারা যাই তাহলে কেউ সন্দেহ করবে না। কারনটা হবে আমার দু’টো কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। সব শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। বিকেল বেলা খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার মনে হচ্ছিল আর কাউকে না বলতে পারলেও আমি তোকে সব বলতে পারি। তোকে ভিশন দেখতেও ইচ্ছে করছিল তাই ফোন দিয়েছিলাম তোকে।

সব শুনে মেহবিন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রাইফা কে শক্ত করে ধরে বসে রইলো‌। তখন কাঁদলেও এখন রাইফা শান্ত। মেহবিন কিছু বললো না কিছুক্ষণ পর রাইফার দিকে তাকাতেই দেখলো ও ঘুমিয়ে পরেছে। মেহবিন রাইফার কপালে চুমু দিয়ে বলল,,

“তোর কিছু হবে না রাই আমি তো আছি। ইনশাআল্লাহ ঠিক তুই সুস্থ হয়ে যাবি। কষ্ট পাস না রাই তোকে যারা কষ্ট দিয়েছে তারা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি পাবে। আমি করবো সেই ব্যবস্থা।

মেহবিন রাইফাকে কোলে তুলে নিয়ে এসে কেবিনে শুয়িয়ে দিল। এবার মেহবিনের কষ্ট হলো বেশ। তবুও ও কিছু মনে করলো না। ও কাউকে ফোন দিয়ে বলল,,

‘ডক্টর সায়িদ আর আর ডক্টর নুপুরকে তোলার ব্যবস্থা করো কালকের মধ্যে। তাদের শাস্তির সময় ঘনিয়ে এসেছে। কালকে রাতেই তাদের শাস্তি প্রদান করা হবে।”

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৪১+৪২

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

পরদিন ,,

মুখরদের পরিবারের যাওয়ার কথা থাকলেও শেখ শাহেনশাহ কাউকে যেতে দেয় নি। তার বাড়ি এখন মেহমান দিয়ে ভর্তি। আজ বাড়িতে পিঠেপুলির উৎসব রেখেছে শেখ শাহেনশাহ। তাই সবাই আজ ও রয়েছে। সন্ধ্যার ট্রেন এ সবাই চলে যাবে। সবাই সকালের খাবার খেতে বসেছে তখন আরবাজ এলো। আরবাজের চোখমুখ দেখে মিশু বলল,,

“বাজপাখি তোমার চোখমুখ এমন লাগছে কেন?”

আরবাজ মুচকি হেসে বলল,,

“নিজের জন্যই নিজের এই অবস্থা।”

তখন নাফিয়া বলল,,

‘মানে কিছু হয়েছে?”

“কাল রাতে একদম ঘুম হয় নি। একটা জানালা খোলা রেখেছিলাম সেটা দিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকা ঢুকেছিল ঘরে বারবার একই আওয়াজ করছিল। আমি উঠে খুঁজেও পাচ্ছিলাম না। তাই না ঘুমানোর জন্য এই অবস্থা।”

আরবাজের কথা শুনে আর কেউ কিছু বললো না। সবাই খাওয়া শুরু করবে। তখন শেখ শাহনাওয়াজ এর ফোনটা বেজে উঠলো তিনি দেখলেন মেহবিন ফোন করেছে। তিনি তাড়াতাড়ি করে ধরলেন মেহবিন বলল,,

‘একটু বাইরে আসুন দরকার আছে।”

তিনি খাবার না খেয়ে সবাইকে খেতে বলে উঠে তাড়াতাড়ি করে বাইরে এলেন। বাইরে এসেই দেখলেন মেহবিন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গিয়ে বললেন,,

“কিছু হয়েছে?”

“হুম আমার দুই লাখ টাকা ক্যাশ লাগবে বিকেলেই দিয়ে দেব। খুব জরুরী হাসপাতালে দিতে হবে নাহলে চাইতাম না এখন চেক ভাঙানোর সময় নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার কথাও শুনছিল না তারা বলেছে না হলেও অপারেশন এর আগে আশি হাজার দিতে হবে। যার জন্য একজনের অপারেশন ও করতে সমস্যা করছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু না করতে পারলে তাকে বাঁচাতে পারবো না। যার জন্য আমি বলে এসেছি তার অপারেশন করতে আমি এক ঘন্টার মধ্যে পুরো টাকা জোগাড় করে নিয়ে যাবো। পরের ওষুধ পত্র আর বাকি টাকাও তো দিতে হবে তাই একেবারে দুই লাখ নিয়ে যাচ্ছি। আপনার কাছে তো সবসময় ক্যাশ থাকে।তাই এসেছি।”

‘হুম আমিও জানি আপনি খুব প্রয়োজন না হলে আমার কাছে আসবেন না। তারওপর সেদিন যা হলো আপনি তো আমার ত্রিসীমানায় ও আসবেন না বলেছিলেন। তবুও আল্লাহ তায়ালা চায় আমরা একসাথে থাকি তাই একটা না একটা অলৌকিক ঘটিয়েই দিলেন আলহামদুলিল্লাহ।”

‘এসব রাখুন এখন টাকাগুলো দিন।”

‘হুম আমি এখনি নিয়ে আসছি।”

শেখ শাহনাওয়াজ তাড়াতাড়ি করে নিজের ঘরে গেলেন তারপর একটা ব্যাগে ভরে দুই লাখ টাকা নিয়ে এলেন। মেহবিন টাকাটা নিয়ে বলল,,

‘শুকরিয়া আপনাকে আসছি।”

“লোকটা কে? যার অপারেশন এর জন্য টাকা লাগবে?”

‘লোকটা কুদ্দুস আপনার বাড়িতে কাজ করে। ছেলের এঙ্গেজমেন্ট এর অনুষ্ঠানে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পরেছেন যে বাড়ির কাজের লোককে কেউ কয়েক ঘা ছুরি বসিয়ে কিছু জায়গায় জঘম করে মেরে ফেলতে চাইছিল সেটা টেরই পান নি।”

“কি কুদ্দুস এখন হাসপাতালে?”

“হুম সকাল বেলা আমার বাড়ির সামনের পাকা রাস্তায় পরেছিল। কেউ দেখে আমাকে জানায় প্রথমে ভেবেছিলাম মারা গেছে পরে দেখি হালকা হালকা পাল্স চলছে। ব্যাপারটা বেশি কেউ জানে না খুব সকালে ছিল তাই কয়েকজন ওখানে ছিল তাদের সবাইকেই বলেছি কাউকে না বলতে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে বলেছি ওকে কেউ মারতে চাইছিল মেরে ফেলতে পারে পরে কথাটা শুনেই সবাই রাজি হয়েছে। আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে ডাক্তার ছিল তিনি বলেছেন খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে। কিন্তু টাকা জমা না দিতে পারলে নাকি করবেন না। কারন অপারেশন এর জন্য এটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটা রুলস উনি কিছু করতে পারবেন না। আমি বলেছি তার টাকা আমি আনছি এক এক ঘন্টার মধ্যে আপনারা ওনার অপারেশন শুরু করুন। আমার এক ঘন্টার মধ্যে টাকা দেওয়ার কথা বলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজি হয়েছে‌ এতো সকালে ব্যাংক খোলা থাকবে না আর ব্যাংক আশেপাশেও নেই তাই বাধ্য হয়ে এখানে আসা।”

“তারমানে এখন কুদ্দুস?”

“তার অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। চিন্তা করবেন না তবে হ্যা এটা কিন্তু নিশাচর এর একটা কাজ। এখন কুদ্দুস এর মাধ্যমে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো‌ । আমি যদি ভুল না হই তাহলে কুদ্দুস নিশাচর কে দেখে ফেলেছে। এই জন্যই ওর এই অবস্থা। বাড়ির কাউকে কুদ্দুস এর ব্যাপারটা জানাবেন না আপনি। আর এমন ভাব করবেন আপনিও কিছু জানেন না।”

‘হুম! আমি হাসপাতালে আসছি।

‘ ভুলেও এখন এই বোকামী করবেন না। আমি দেখে নেব ফোনে তার আপডেট দেব। আসছি আর হ্যা বিকেলে আমি নিজেই আসবো টাকাটা ফেরত দিতে‌।’

“আপনার টাকা ফেরত দিতে হবে না।”

‘আপনি আমায় ভালোভাবেই চেনেন তাই কথা বলে লাভ নেই।”

বলেই মেহবিন চলে গেল। এখনো অনেকটা সময় আছে তাই পুরো ব্যাপারটা বলে গেল তাকে। শেখ শাহনাওয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আরিফা জামান বললেন,,

“এতো সকালে এতোগুলো টাকা নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?”

হুট করে প্রশ্নটা করায় তিনি একটু চমকালেও পরে নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন,,

‘তুমি দেখেছো আমি টাকা নিয়েছি। আমার সবকিছু নজরে রাখো তুমি।”

‘না ব্যাপারটা তেমন নয় আপনাকে ঘরে যেতে দেখে আমিও গিয়েছিলাম তখনি দেখেছিলাম। এতোগুলো টাকা লাখ খানেক তো হবেই। ”

তখন পেছন থেকে সায়িদ বলল,,

‘আমি তো কাকাকে দেখলাম ডক্টর মেহবিন কে একটা ব্যাগ দিতে। ব্যাগের মধ্যে টাকা ছিল বুঝি।”

ব্যস হয়ে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ সায়িদের দিকে তাকালেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,,

“সবার প্রশ্নের আগে আমিই জবাব দিচ্ছি। একটা ইমার্জেন্সি কাজে ডাক্তারের দুই লাখ টাকার প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি আমার থেকে ধার নিলেন বিকেলেই ফেরত দিয়ে যাবেন।”

কথাটা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। বাদ যায়নি মুখরের পরিবার তারাও অবাক হয়ে গেছে। হুট করে তখন শেখ আমজাদ বললেন,,

“ভাইয়া তুমি এক কথায়ই মেয়েটাকে দুই লাখ টাকা দিয়ে দিলে। এটা কিরকম কথা যদি,,

তখন শেখ শাহনাওয়াজ তাকে না বলতে দিয়ে বললেন,,

‘মানুষ চেনার ক্ষমতা আমার আছে। সে তো বলেছে বিকেলে দিয়ে দেবে আগে বিকেল হোক তারপর না হয় কথাগুলো বলিস। আগেই এই অহেতুক কথা বলে লাভ নেই। তাছাড়া কারো সম্পর্কে না জেনে কথাও বলতে নেই‌। বিকেলের আগে তার সম্পর্কে আমি কোন কথাই শুনছি না।”

তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“দুদিন আগেও যে তোর পোলারে বিনা কারনে মারলো। তারে তুই টাহা দিয়া সাহায্য করতাছোস শাহ কিরম বাপ তুই।”

শেখ শাহনাওয়াজ মুচকি হেসে বললেন,,

“সত্যিই বাবা কিরকম বাপ আমি। আমার সন্তান আঘাত পায় কারো দ্বারা তবুও আমি কিছু করতে পারিনি।”

বলেই তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে এদিকে ওনার কথার মনে কেউ বুঝতেই পারলো না। আরবাজ আর মিশু ছাড়া। দুপুরে মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ কে ফোন করে জানালো অপারেশন সাকসেসফুল। তবে অবস্থা খুব একটা ভালো না তবুও আশা আছে সুস্থ হয়ে উঠবে। সব শুনে শেখ শাহনাওয়াজ একটু স্বস্তি পেলেন। শেখ শাহনাওয়াজ কাউকেই কিছু বললেন না সকালের দিকে আরিফা জামান খোঁজ করেছিল ওনার উনি বলেছেন ও নাকি ছুটিতে গেছে। এই নিয়ে আরিফা জামান রাগারাগী করলেও শেখ শাহনাওয়াজ একটা টু শব্দ ও করেন নি। বিকেল সাড়ে চারটা সকলে মেহবিনের বিষয় নিয়েই কথা বলছে। মুখরের পরিবার সবাই মুখরকে জিজ্ঞেস করেছিল কিসের জন্য মেহবিন টাকা নিয়েছে মুখর জানিয়েছে সে কিছু জানে না। তারা আজ সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যাবে শেখ শাহেনশাহ তাদের কথা শুনে আজ আর না করেনি। বিকেলে সবাই ড্রয়িংরুমে কথা বলছিল হুট করে শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“কিরে শাহ বিকাল তো হইয়া আইলো কো তোর ডাক্তার কো?”

তখন পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,,

“সাবেক চেয়ারম্যান সাহেব শেখ শাহেনশাহ আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল বুঝি। হুট করে আমার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে দেখি।”

মেহবিনের কথায় সকলেই পেছনে তাকায়। মেহবিন মুচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ব্যান্ডেজটা নেই খুলে রেখে এসেছে। তাই হাতের দিকে তেমন কারো নজর পরলো না। মেহবিন কে দেখে শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“আসলে,”

“আসলে নকলে ছাড়ুন চেয়ারম্যান সাহেব এদিকে আসুন তো!”

শেখ শাহনাওয়াজ উঠে মেহবিনের সামনে এলেন মেহবিন টাকাগুলো ব্যাগ থেকে বের করে উনার দিকে এগিয়ে দিলেন। তখন শেখ আমজাদ বলল,,

“ভাইয়া ভালো করে গুনে নাও।”

শেখ শাহনাওয়াজ মুচকি হেসে বললেন,,

“আমি যখন টাকা ওনাকে দিয়েছিলাম তখন উনি গুনে নেয় নি। তাহলে আমার ও দরকার নেই গুনার। তাছাড়া আমি ওনাকে বিশ্বাস করি।”

তখন মিশু এসে বলল,,

“ফুল তুই আমার সাথে আয়?”

মিশুর আগমনে টাকার টপিক ঢাকা পরে গেল। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“কোথায় যাবো?”

“তুই জানিস আমি পিঠে বানিয়েছি। তোর জন্য নিয়ে যেতাম কিন্তু তুই আমাদের বাড়িতে এলি।”

তখন মুনিয়া বলল,,

“মেহবিন আপু মিশু আপু সত্যি পিঠা বানিয়েছে। তবে সেগুলো তুমি খেতে পারবে কিনা জানা নেই।”

“একদম আমার পিঠে নিয়ে কিছু বলবি না মুনিয়া। ফুল তুই খাবি না চল না একটু টেস্ট করে দ্যাখ কেমন হয়েছে। তুই জানিস আমার পিঠে দেখে কেউ টেস্ট ও করেনি। শুধু বাজপাখি ছাড়া কিন্তু বাজপাখি তো কিছু বললোই না।”

তখন নিসা বলল,,

“আরবাজ ভাইয়ার তোমার পিঠে খেয়ে মুখ বন্ধ হয়ে গেছে তাই কিছু বলে নি।”

মিশু একটা ইনোসেন্ট ফেস করে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“ফুল তুই খাবি না।”

মেহবিন একবার সবার দিকে তাকালো তারপর মিশুর দিকে ও বুঝতে পারলো মিশু ইচ্ছে করে এসব করছে ওকে খাওয়ানোর জন্য। যাতে ও খায় এই জন্য নিজে বানিয়েছে। মেহবিন মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর কিছু বলবে এমন সময় তখন আরিফা জামান বললেন,,

“আজ পর্যন্ত এই বাড়িতে তোমার ফুল কিছু খেয়েছে যে আজ খাবে? তুমি বানালেই কি আর না বানালেই কি?

এই কথা শুনে মিশু কোমরে হাত দিয়ে বলল,,

“এতোদিন না খেলে কি হবে। আজ তো ওর ফুল ওর জন্য পিঠে বানিয়েছে ও নিশ্চয়ই খাবে। তাই না ফুল? আর ফুল যদি না খায় তাহলে আমিও খাবো না।

বলেই মিশু দাঁত কেলালো। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“ঠিক আছে খাবো তবে অল্প।

মিশু ইয়াহু বলে লাফিয়ে উঠলো। মিশু ওর হাত ধরে ড্রাইনিং টেবিলে বসালো । মিশু কিচেন থেকে পাটিসাপটা আর ভাপাপিঠা নিয়ে এলো। এই দুটোই মিশু বানিয়েছে। তবে একটার চেহারাও সঠিক হয়নি। মেহবিন একবার পিঠার দিকে তাকালো আবার মিশুর দিকে। মিশু ওর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে একটা পাটিসপটা ধরে মুখে পুরে দিল। মেহবিন কামর দিল ও বুঝতে পারলো চেহারা ভালো না হলে কি হবে স্বাদ ঠিকই আছে। অন্যদের পারেনা দেখানোর জন্য চেহারা এরকম। মেহবিন বলল,,

“ভালো হয়েছে ফুল বাকিটা আমি নিজেই খেতে পারবো। আচ্ছা ফুল রাইফা উনি কোথায় আসার পর তো দেখলাম না।”

“রাইফার শরীরটা বেশি ভালো না তাই ঘরেই আছে।”

“ওহ আচ্ছা।”

তখন মুনিয়া বলল,,

“মেহবিন আপু বলো তো কেমন খেতে? না মানে আমরাও একটু টেস্ট করতাম।”

মেহবিন মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তোমরা না খেলে দারুন কিছু মিস করবে মুনিয়া।”

“তাই নাকি তাহলে তো টেস্ট করতেই হয়।”

বলেই মুনিয়া এলো একটা পাটিসাপটা মুখে দিয়ে বলল,,

“মেহবিন আপু সত্যি বলেছো তুমি। এটা তো মা কাকিদের থেকেও বেশি মজার হয়েছে।”

মিশু হাসলো । তখন মেহবিন বলল,,

“এই যে মিশুর বাজপাখি মিশুকে বলেন নি কেন? তার পিঠে এতো মজা হয়েছে।”

হুট করে আরবাজকে ডাকায় আরবাজ হকচকিয়ে উঠলো। ও মেহবিনের দিকে তাকালো। ওর চোখ ছলছল করে উঠলো তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে হাঁসি ফুটিয়ে বলল,,

“এতো মজার হয়েছে যে আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না। তাই তো কিছু বলিনি।”

মেহবিন কিছু বললো না শুধু হাসলো। তারপর ভাপাপিঠা একটু নিয়ে খেলা খেতেই ও বুঝতে পারলো ছোটবেলায় যেমনটা খেতে চাইতো বেশি নারকেল দিয়ে তেমনটাই বানিয়েছে মিশু।ও মিশুর দিকে তাকালো মিশু হেঁসে বলল,,

“পছন্দ হয়েছে ফুল।”

“হুম।”

বলেই মেহবিন খেতে লাগলো। শেখ শাহনাওয়াজ এর মুখে তৃপ্তির হাঁসি। তখনি মেহবিনের ফোন এলো আননোন নাম্বার থেকে। মেহবিন ফোন উঠাবে তখন মিশু বলল উঠাতে হবে না। মেহবিন বলল ইমার্জেন্সি কিছু হতে পারে। মিশু বলল ও খেতে থাক স্পিকারে দিলেই তো হয়। মেহবিন তাই করলো ফোন ধরে কিছু বলবে তার আগে ওপাশ থেকে বললো,,

“কেউ একজন বলেছিল ‘যদি একশো বছর পরেও তুই আমার কাছে আসিস আর আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলেও সব ছেড়েছুড়ে আমি তোকে আগলে নেব।”

কথাটা শুনে মেহবিনের খাওয়া থেমে যায়। ও তাড়াতাড়ি ফোন নিয়ে বলল,,

‘রাই!”

তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেল তবুও একটা টু শব্দ করলো না। শেখ বাড়ির সবাই ভাবলো হয়তো ইন্ডিয়ার রাই। মেহবিন স্পিকার অফ করে দিল। তারপর বলল,,

‘রাই!”

‘কতো বছর পর এই নামটা তোর মুখ থেকে শুনতে পেলাম। জানিস আমার সবসময় মনে হতো আমি মরার আগে তোর সাথে দেখা করতে পারবো না। কিন্তু ভাবিই নি আল্লাহ তায়ালা আমাকে এতো বড় উপহার দিয়ে দেবে। তুই জানিস আমি না তোকে খুব মিস করি। শুধু মনে হয় তুই থাকলে আমার সাথে এসব হতো না। সবসময় কার মতো আমার মেহু আমার জীবনের সব সমস্যা সল্ভ করে দিতো। আমি ভালো নেই মেহু? তোর রাই কতোদিন হলো মনখুলে হাসে না। ওরা তোর রাইয়ের মুখের হাঁসি কেড়ে নিয়েছে? আর এখন তো তোর রাইকেও।

মেহবিন উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,,

“কি হয়েছে তোর? কোথায় তুই?”

রাই কাঁশতে লাগলো আর তারপর বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলল,,

“আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে মেহু। মনে হচ্ছে আমি মারা যাবো মেহু। তবে শেষবার তোকে ভিশন দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি তোকে ভিশন ভালোবাসি মেহু। তোর সাথে যা করেছি তার জন্য আমাকে মাফ করে দিস মেহু। আমি তোকে খুব ভালোবাসি।

“কিছু হবে না তোর আমি এখনি আসছি।”

বলেই মেহবিন দৌড় দিয়ে সিঁড়ি উঠতে লাগলো। সবাই প্রথমে অবাক হলেও ওকে উঠতে দেখে সবাই ওর পেছনে গেল। মেহবিন ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল রাইফা বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে আর বিছানায় ছটফট করছে । মেহবিন জোরে “রাই” বলে ওকে জরিয়ে ধরলো। ওর হাতের অবস্থা খারাপ তবুও ওর নিজের দিকে খেয়াল নেই। ওকে দেখেই রাই ওকে আঁকড়ে ধরলো। ও বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে তা দেখে মেহবিন ওকে কোলে তুলে নিল। রোগা পাতলা শরীরকে ওঠাতে ওর কোন সমস্যা হলো না। সবাই ঘরে ঢুকবে এমন সময় সবাই দেখলো মেহবিন ও ওকে কোলে নিয়ে বের হচ্ছে আর একটা কথা বলছে,,

“তোর কিছু হবে না রাই। তোর মেহু আছে সবসময়কার মতো এইবার ও সব ঠিক করে দেবে। তোর মেহু তোকে কিছু হতে দেবে না।”

মেহবিন কারো দিকে না তাকিয়ে কষ্ট হলেও সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। ওকে রাইফাকে কোলে নিতে দেখে সবাই চমকে উঠলো। মেহবিন বলল,,

” প্লিজ কেউ গাড়ি বের করুন। রাইকে এখনি হাসপাতালে নিতে হবে।”

রাইকে মেহবিনের কোলে দেখেই আরবাজ আর মুখর গাড়ি বের করেছে। মেহবিন কারো তোয়াক্কা না করে ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ওর সাথে মিশু মুনিয়া ওরা দুজন ও উঠলো। গাড়ি গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। বাকিরা তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে রইল সবথেকে বেশি সায়িদ। শেখ শাহনাওয়াজ সায়িদ কে রওনা দিলেন অন্য গাড়ি করে। মেহবিন শক্ত করে রাইফাকে জরিয়ে ধরলো। রাইফাও মেহবিনের কোলে গটিশুটি মেরে রইলো শ্বাসকষ্ট অনেকটাই কমেছে। তবে রাস্তাতেই রাইফা অজ্ঞান হয়ে গেল। মেহবিন হাসপাতালে গিয়েই রাইফার চিকিৎসা শুরু করলো। হাতের অবস্থা ভালো নয় তাই একটা কাপড় পেঁচিয়ে নিল। সবকিছু এখন নরমাল মেহবিন কিছু রিপোর্ট করতে দিল ওগুলো আসলেই কিছু বলতে পারবে। মেহবিন বের হলো ও বেরুতেই দেখলো পুরো শেখ পরিবার দাঁড়িয়ে আছে সেই সাথে মুখরদের পরিবার ও শুধু বাদ আছিয়া খাতুন মিসেস আছলাম আর শেখ শাহেনশাহ আর আরিফ জামানের পরিবার। মেহবিন সবাইকে সাইড করে চলে আসতে নিল তখন সায়িদ বলল,,

“কি হয়েছে রাইফার?”

মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

‘আপতত অজ্ঞান হয়েছে আর কিছু না।”

‘আমরা রাইফাকে এই সরকারি হাসপাতালে রাখবো না। আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাবো।”

‘রাইকে এখানে আমি এনেছি। আমি বুঝবো আমার রাইকে কোথায় কিভাবে ট্রিটমেন্ট করতে হবে।”

“তোমার রাই?”

“হ্যা আমার রাই। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার রাই। এখানে কি করতে এসেছেন আপনারা এতোদিন তো আপনাদের বাড়ি ছিল দুদিন অজ্ঞান ও হয়ে গিয়েছিল। একটা ডক্টর দেখাতে পারলেন না আপনারা কেউ। আর এখন এসেছেন আদিখ্যেতা দেখাতে। কি দেখতে এসেছেন ও মারা গেছে কি না।”

‘আপনি এভাবে আমার সাথে কথা বলছেন কেন? আমি তো বলেছিলাম ওকে যেতে ও যায় নি।”

‘শুধু বললেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না করে দেখাতে হয়। আপনারা এখান থেকে চলে যান রাইয়ের জন্য যা ভালো হয় সেটা আমি দেখে নেব। ওর জন্য এখানে কারো থাকার দরকার নেই।”

তখন শেখ আমজাদ বললেন,,

“তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো আমরাও ডাক্তার?”

“এরকম ডাক্তার হয়ে কি লাভ যদি নিজেদের লোকের কাজেই না আসে। আমি আপনাদের এতো কথা বলছি কেন? আমার তো আপনাদের ওপর কোন দায় নেই।”

বলেই মেহবিন ওখান থেকে আসতে নিল তখন মুখর বলল,,

“আপনার হাত থেকে রক্ত পরছে ?”

মেহবিন মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“এসব তো কিছুই নয় তবে,,

এইটুকু বলে ও নিজের কেবিনে চলে গেল। মেহবিন কেবিনে গিয়ে ওর টেবিলে রাখা সবকিছু ফেলে দিল। ওর ভিশন রাগ হচ্ছে কিন্তু কার ওপর শেখ পরিবারের ওপর নাকি রাইফার ওপর নাকি নিজের ওপর। ও চেয়ারে বসে মাথা ধরে পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে করতে লাগলো।

অতীত,,

আলম আহমেদ মেহবিন কে নতুন স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। মেহবিন কোন বাচ্চার মিশতো না। একা একা থাকতো কারো সাথে কথা বলতো না। এভাবেই ক্লাস টু থেকে ক্লাস থ্রি তে উঠলো। হুট করে একদিন একটা মেয়ে বলল,,

“এই তুমি কথা বলতে পারো না?”

মেহবিন কিছু লিখছিলো কারো কথায় ও মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। মেহবিন কিছু বলছে না দেখে মেয়েটা আবার বলল,,

“সত্যি তুমি কথা বলতে পারো না।”

মেহবিন এবার বলল,,

“পারি!”

“তাহলে কথা বলো না কেন?”

‘এমনি।”

“আমার নাম রাইফা আফনূর। তুমি আমার বন্ধু হবে। আমি না চকলেট খেতে খুব ভালোবাসি তোমায় চকলেট দেব।”

“লাগবে না।”

“হবে না আমার বন্ধু?”

“না।”

“কেন হবে না?”

“এমনিই!”

রাইফা উদাস হয়ে চলে গেল। নিজের বেঞ্চ এ বসলো তখন দুজন বাচ্চা রাইফাকে মারতে লাগলো কারন ওরা রাইফার কালারিং কলম চেয়েছিল কিন্তু ও দেয় নি। মেহবিন তা দেখে ওখানে গিয়ে ঐ দুটো বাচ্চাকে সরিয়ে দিল। আবার এগুতে এলে ও বলল ওকে যদি মারে নাহলে ম্যাডামের কাছে বিচার দেবে। বাচ্চা দুটো ভয় পেয়ে ওখান থেকে চলে গেল। তারপর মেহবিন বলল,,

“তুমি এতো বোকা কেন? তোমাকে মারছিল আর তুমি কিছু না করে মার খাচ্ছিলে?”

রাইফা বলল,,

‘আমি তো মারতে পারি না। এই তুমি আমার বন্ধু হয়ে যাও না। তাহলে ওরা আমাকে আর মারবে না শুধু ওরা না তুমি থাকলে কেউ কিছু বলতে পারবে না। তোমার অনেক বুদ্ধি তাই তো ম্যাডামের কাছে বিচার দেওয়ার কথা বলে ওদের ভাগিয়ে দিলে।”

মেহবিন কিছু না বলে ওখান থেকে চলে গেল। সেদিনের পর রাইফা মেহবিনের পেছনে পরলো প্রতিদিন এসে ওর সাথে বসতো অনেক কথা বলতো । প্রায় দুই মাস পর রাইফা মেহবিনের বন্ধু হতে পারলো। এরপর থেকেই শুরু হয় রাইফা আর মেহবিনের বন্ধুত্ব। সময়ের সাথে ওরা হয়ে ওঠে একে অপরের বেস্ট ফ্রেন্ড। তাদের জোরা কবুতর বলে সব স্যার ম্যাডামরা ডাকতেন। ওদের দুজনকে সবাই ওদের বন্ধুত্বের জন্য চিনতো। ক্লাস টেন এ উঠার পর এই জোরা কবুতরের মধ্যে এক কাউয়া আসে নাম তার সাগরিকা।

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“এই তোমরা দুজন তো অনেক ব্রিলিয়ান্ট আমাকে একটু নেবে তোমাদের দলে।”

হুট করে সাগরিকার কথায় দুজনেই ওর দিকে তাকায়। মেহবিন আর রাইফা দু’জনেই ক্লাসের ফাস্ট আর সেকেন্ড গার্ল। রাইফা ফাস্ট আর মেহবিন সেকেন্ড। আর সাগরিকা নিম্নস্তরের প্রথম সারির ছাত্রী মানে টেনেটুনে পাশ এমন টাইপ। ওর কথায় রাইফা বলল,,

“আমাদের দলে নিলেই কি? তোমার গোবর মাথায় পদ্ম ফুটবে সাগরিকা?”

তখন মেহবিন বলল,,

“এসব কি ধরনের কথা রাই। আর শুনো সাগরিকা আমরা কোন দল করি না যে তুমি আমাদের দলে আসবে।”

তখন সাগরিকা বলল,,

“আসলে আমি তো খুব একটা ভালো স্টুডেন্ট না। তোমরা দুজন যদি আমাকে একটু সাহায্য করতে তাহলে আমি পড়াশোনায় একটু আগাতে পারতাম।”

তখন রাইফা বলল,,

“পড়াশোনা নিয়ে সাহায্য করাই যায়। তবে হ্যা আমাদের মধ্যে একদম ঢোকার চেষ্টা করবে না।”

“তোমরা যে আমায় সাহায্য করবে এতেই খুশি। আমি তাহলে তোমাদের সিটে বসি?

মেহবিন বলল,,

“ঠিক আছে।”

এরপর থেকে সাগরিকা ওদের সাথে বসতো। কয়েকদিন পর সাগরিকা রাইফাদের বিল্ডিং এ রাইফাদের সামনের ফ্ল্যাটে ভাড়া উঠে। ওদের ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া হতো রাইফা আর সাগরিকার। দু’জনের বেশ ভাব ও হয়ে যায়। এভাবে প্রথম প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা এসে পরে সাগরিকা তো পারলে ওদের বাড়িই থাকে। পড়াশোনা দেখে রাইফাও কিছু বলে না সেই সাথে ওদের মায়েরাও না। ভালোই ভালোই পরীক্ষা টা হয়ে যায়। পরীক্ষায় মেহবিন ফাস্ট হয় রাইফা সেকেন্ড। সাগরিকাও অনেক ভালো নাম্বার পেয়ে খুশি। রাইফা ফাস্ট হতে পারে নি দেখে রাইফার একটু মন খারাপ হয় কারন ও ফাস্ট হলে ওর বাবা ওর পছন্দের একটা ঘড়ি দেবে।তবুও নিজের প্রানপ্রিয় বান্ধবী ফাস্ট হয়েছে এই খুশিতে মন খারাপ চলে যায়। রাইফা বলল,,

“এই মেহু তুই তো ফাস্ট হয়েছিস ট্রিট দে!”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“চল কি খাবি বল? তিনশো টাকার ভেতরে যা খাবি তাই খাওয়াবো বাজেট এতটুকুই।”

“ধুরু কি বলিশ তিনশো টাকায় কি আর দুজনের পার্টি হবে তাই মন চায় সব খাবো আজ।”

“আরে বললাম তো বাজেট এতটুকুই আমি তো আর রোজগার করি না। পাপা যা দেয় তাই।”

“হুম হইছে চল তাহলে।”

তখন সাগরিকা এসে বলল,,

“এই যে জোরা কবুতর তোমাদের জন্য আমি এতো ভালো নাম্বার পেয়েছি বলে। আজ তোমাদের মন খুলে ট্রিট দেব।”

রাইফা খুশি হয়ে বলল,,

“তাই!”

মেহবিন কিছু বললো না। ওর আজকাল সাগরিকা কে ভিশন অদ্ভুত লাগে। ওর মনে হয় ও সব স্বার্থের জন্য করছে। মেহবিন বলল,,

“আজ আমাদের সময় হবে না তুমি বরং অন্য দিন দিও।”

তখন রাইফা গুঁতা মেরে ফিসফিস করে বলল,,

“আরে অফ যা এতোবড় ট্রিট মিছ দেওয়া যায় নাকি। আজ জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হবে আমার বান্ধবী ফাস্ট হয়েছে। যদিও অন্যের টাকায় তোরটা কাল খাবো এখন চল।”

রাইফার জোরাজুরিতে ও আর কিছু করতে পারলো না। ওদের সাথে গেল আর বেশ ভালো একটা রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিল। সবশেষে রাইফার জন্য সাগরিকা একটা ঘড়ি দিল যেটা রাইফা কিনবে বলে ওর বাবার কাছে আবদার করেছিল তবে ঘড়িটা বেশ দামী তাই তার বাবা বলেছে পরীক্ষায় ফাস্ট হলে কিনে দেবে । কিন্তু ওতো ফাস্ট হয় নি।ঘড়িটা পেয়ে রাইফা খূ্শিতে লাফিয়ে উঠে‌। কিন্তু তা দেখে মেহবিনের মুখে হাঁসি ফুটে উঠে না‌। রাইফা খুশি হয়ে মেহবিনকে দেখাতে থাকে। সাগরিকা মেহবিন কে একটা কলম দেয় যদিও সেটা খুব দামী নয় তবে একটু ভালো ওটা দিয়ে বলল,,

“আসলে রাইফার ওটা পছন্দের এটা জানতাম তাই ওর জন্য ঘড়িটা এনেছি। তোমার পছন্দ জানি না তো তাই এই ছোট্ট উপহার।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“ধন্যবাদ।”

কিছুক্ষণ পর সাগরিকা ওদের রেখে চলে গেল। মেহবিন আর রাইফা একটা রিক্সায় উঠলো। রাইফার মুখে হাঁসি তা দেখে মেহবিন বলল,,

“আজ খুব খুশি তুই তাই না?”

“হুম খুব খুশি । তুই জানিস আমি ফাস্ট হইনি বলে খুব খারাপ লাগছিল কারন বাবা বলেছিল আমি ফাস্ট হলে এই ঘড়িটা কিনে দেবে। কিন্তু এখন ফাস্ট না হয়েও পেয়ে গেলাম খুশি হবো না বল তুই।”

“ওহ আচ্ছা।”

মেহবিন একটা ছোট চকলেট বক্স দিয়ে বলল,,

“নে এটা তোর জন্য কিনেছিলাম।”

“ও মাই আল্লাহ চকলেট। আজ তো আমার ঈদ লাগছে দোস্ত।”

বলেই মেহবিনের গালে একটা চুমু দিল। তা দেখে মেহবিন হাসলো। এই মেয়েটার পাগলামি ওর মুখে হাঁসি ফুটায়। এভাবেই চলতে লাগলো কিছুদিন হুট করেই মেহবিন বুঝতে পারলো রাইফা ওর সাথে আগের মতো থাকছে না। ওর সাথে থাকলেও সাগরিকার সাথে বেশি কথা বলছে । আসলে রাইফা আর সাগরিকা একই বিল্ডিং এ হওয়ায় নানা গল্প তারা স্কুলে এসে করে। এই জন্য মেহবিন একদিন ছুটির সময় বলল,,

“এই রাই আজ তুই আমার রিক্সায় বাড়ি যাবি।”

তখন সাগরিকা বলল,,

“এই রাইফা তোমাকে আজ আন্টি তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে না। আমাদের সাথে মোটর সাইকেল এ চলো।”

তখন রাইফা বলল,,

“সরি মেহু আজ ওদের সাথেই যাই। মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।”

মেহবিন কিছু বললো না‌। ও নিজের মতো চলে গেল। দেখতে দেখতে দ্বিতীয় প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা এলো। রাইফা আর মেহবিন বেশ ভালোই পরীক্ষা দিল। এবার রাইফা ফাস্ট আর মেহু সেকেন্ড। এ নিয়ে মেহবিন একটুও মন খারাপ করলো না। ও রাইফা কে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানালো। রাই ও ভিশন খুশি। এই জন্য সে বলল কেক ট্রিট দেবে। রাই মেহবিনের সাথে সাগরিকাকেও নিল সেই সাথে আরো দুই তিনজন ক্লাসমেট। চকলেট কেক কাটতে দেখে সাগরিকা বলল তার ভিশন পছন্দের বলেই প্রথম পিচ টা রাইয়ের হাত থেকে সে খেয়ে নিল। ব্যাপারটাতে মেহবিন আর রাইফা দু’জনেই হতভম্ব গেল। রাইফা বলল,,

“এই তুমি আগে কেকটা খেলে কেন ওটা তো সবসময় মেহুর জন্য ‌।”

“আরে রাই চিল এটা আর কি বড় ব্যাপার। তোকে বললাম না আমার চকলেট কেক ভিশন পছন্দের।তাই লোভ সামলাতে পারি নি‌। নে এখন তুই মেহবিন কে খাওয়া।”

মেহবিন সাগরিকার মুখে রাই শুনে থমকে গেল কারন রাই শুধু ঐ বলতো আর ওর বাবা মা। রাইকে অন্য কেউ রাই বললে রাই রেগে যেত। কিন্তু আজ কিছুই বলছে না‌। রাইফা মেহবিনের সামনে গিয়ে বলল,,

“সরি দোস্ত ঐ সাগরিকার জন্য তোকে প্রথমে খাওয়াতে পারলাম না।”

মেহবিন মুচকি হাসি ফুটিয়ে খেয়ে বলল,,

“ইটস ওকে।”

বলে রাইফাকেও খায়িয়ে দিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অন্যরকম যন্ত্রনা তৈরি হলো। কিন্তু ও বুঝতে দিল না কাউকে ভেতরে ভেতরে ও বুঝতে পারছে ওর রাই ওর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সবাই চলে গেল খেয়ে দেয়ে রাইফাও চলে গেল তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে বলে ।শুধু রয়ে গেল মেহবিন একা। ও অস্ফুট স্বরে বলল,,

“মানুষের জীবন কি অদ্ভুত তাইনা? কিছু জিনিস খুব অপছন্দের থাকা সত্বেও সৌজন্যতার খাতিরে হাঁসি মুখে সহ্য করতে হয়!”

কিছুদিন এভাবেই কেটে গেল টেস্ট পরীক্ষার পাঁচ দিন বাকি। এই কয়েকদিনে মেহবিন ঠিক বুঝে গেছে ও ওর বেস্ট ফ্রেন্ড কে হারাতে চলেছে। রাইফা আগের মতো আর মেহবিনের সাথে থাকে না কথাও বলে না। তবে সাগরিকার সাথে তার বেশ ভাব । আজকাল মাঝে মাঝে মেহবিন মনে করে রাইফা ওর জন্য বিরক্তবোধ হচ্ছে। এসবই আনমনে ভাবছিল মেহবিন হুট করে রাইফা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,,

“তুই যদি আমার বান্ধবী না হতিস? তাহলে তোর গালে আমি কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারতাম।”

হঠাৎ এ কথায় মেহবিন ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশে সাগরিকা কে দেখতে পেল। তা দেখে মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

“আমি কি করেছি?”

রাইফা মেহবিনের সামনে একটা চিঠি রাখলো। মেহবিন পরে দেখলো তাতে ওদের ফিজিক্স এর স্যারের নামে প্রেমপত্র লেখা হয়েছে। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“এটা এটার জন্য কি হয়েছে?”

“এটা আমার ফিজিক্স এর অ্যাসাইনমেন্টের খাতার ভেতর এলো কি করে?”

“মানে কি?”

“মানে এটা আমার হাতের লেখা আর তুই ছাড়া আমার হাতের লেখা কেউ কপি করতে পারে না।”

“তো কি হয়েছে?”

“আমি তো লিখিনি তাহলে তুই তুই লিখেছিস এটা। আর আমার অ্যাসাইন্টমেন্টের ভেতরে রেখেছিস।”

এটা শুনে মেহবিন রেগে গেল আর বলল,,

“তুই এসব কি বলছিস? তুই কি পাগল হয়েছিস।”

তখন সাগরিকা বলল,,

“এখন কিছু না জানার ভান ধরা হচ্ছে। তুমিই এটা রেখেছো যাতে স্যারের মনে রাইকে নিয়ে বিরুপ ধারনা হয় আর স্যার যাতে ওকে কম নাম্বার দেয়। প্রথম পরীক্ষায় তুমি ফাস্ট হয়েছিলে আর দ্বিতীয় পরীক্ষায় রাই হয়েছে যাতে টেস্ট পরীক্ষায় ও তুমি ফাস্ট হতে পারো তাই এসব করেছো তাই না। তুমি জানো এই নোংরা খেলার জন্য স্যার ওকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করেছে‌‌ । সেই সাথে তো প্রিন্সিপাল স্যারের কাছেও নালিশ দিতে গিয়েছিল। আমরাই কতো অনুরোধ করে বলেছি এসব ভুল আরো কতোকিছু করে মাফ চেয়েছি। রাই তো দেখেই বুঝেছিল এটা তোমার হাতের লেখা তারপরও তোমার নাম বলেনি আর তুমি তার বন্ধুত্বের এই দাম দিলে ছিঃ!”

সব শুনে মেহবিন স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর নিজের ভেতরে খুব অনুশোচনা হচ্ছিল এই কারনে যে ওর খারাপ সময়ে ওর পাশে থাকতে পারে নি। তবে ওর অভিযোগ আনা শুনে ও ঠান্ডা মাথায় বলল,,

“তুই আমাকে ক’বছর ধরে চিনিস রাই?”

হুট করে এমন প্রশ্নে রাই চমকে উঠলো। তখন সাগরিকা বলল,,

“তুমি এসব কি বলছো নিশ্চয়ই কথা ঘুরাতে চাইছো।”

মেহবিন এবার রেগে বলল,,

“ইডিয়ট আমি তোমায় নয় রাইকে জিজ্ঞেস করেছি।”

একথা শুনে রাই বলল,

“তুই ওকে ইডিয়ট বলছিস কেন?’

“আমার উত্তর আগে দে তুই?”

“তার আগে তুই বল তুই ওকে ইডিয়ট বললি কেন? ও কি বলেছে তোকে ওতো যা দেখেছে তাই বলেছে।”

মেহবিন রাইয়ের খুব কাছাকাছি চলে গেল ওর চোখে চোখ রেখে বলল,,

“আমায় বিশ্বাস করিস রাই?”

রাই বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারলো না। অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,,

“আগে নিজের থেকেও বেশি করতাম। কিন্তু এগুলো দেখে করতে পারছি না।”

মেহবিন চিঠির দিকে তাকিয়ে ওর মুখে মুচকি হাসি ফুটলো তা দেখে সবাই অবাক হলো। রাই নিজেও ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। মেহবিন কোনদিকে না তাকিয়ে চিঠিটা নিয়ে ফিজিক্স স্যারের রুমে গেল। কি যেন বলল তাকে তারপর বেরিয়ে এলো কিছুক্ষণ পর স্যার ক্লাসে এসে রাইকে সবার সামনে সরি বলল আর যাওয়ার আগে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তোমার ভাগ্য খুব ভালো যে তুমি মেহবিনের মতো বান্ধবী পেয়েছো।”

কথাটা শুনেই রাইফার চোখ ছলছল করে উঠলো। স্যার যেতেই মেহবিন বলল,,

“আমার জন্য সব হয়েছিল না। নে আমিই সল্ভ করে দিলাম। এবার হ্যাপি।”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে গেল। পরে রাইফা গেল স্যারের কাছে জানতে চাইলো মেহবিন কি বলেছে। বলে সে বলল সে এসে জানালো তুমি এই কাজ করোনি কেউ তোমাকে খারাপ বানানোর জন্য এসব করেছে । আমরা বিশ্বাস করিনি পরে ও বলল ও নিজেও তোমার হাতের লেখা নকল করতে পারে। এই বলে কিছুটা লিখলো তবে চিঠিতে এমন কিছু জিনিস ছিল তা তোমাদের দুজনের কারোটাই মিল ছিল না। এটা ও প্রুভ করে দিয়ে গেল আর বুঝিয়েও দিল তাই বুঝতে পারলাম ওটা কেউ ইচ্ছে করে তোমার নামে করেছে। সব শুনে রাইফা কেঁদে উঠলো ও মেহবিনকে খুঁজতে লাগলো একটা সময় পেয়েও গেল ও ওকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। আর বলল,,

“সরি রে আমি আজ বড় একটা ভুল করে ফেলেছি।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার সব সমস্যার সমাধান তুই। প্রথমে সাগরিকার কথা কানে না নিয়ে যদি তোর সাথে কথা বলতাম তাহলে কোন সমস্যাই হতো না। আই এম রেইলি সরি।”

মেহবিন তো আর এক কথায়ই কাউকে ক্ষমা করে দেওয়ার পাত্রী নয়। ও কিছু না বলে বাড়ি চলে গেল‌‌। এদিকে সাগরিকা এসে ন্যাকা কান্না করতে লাগলো। রাইফা গলে গেল‌। দুদিন ধরে রাইফা মেহবিনের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু মেহবিন বলছে না। আজ ক্লাসের শেষদিন তাই আজ সে মেহবিনের জন্য চকলেট আর ফুল নিয়ে এলো আজ রাগ ভাঙিয়েই ছাড়বে। কিন্তু স্কুলে এসেই দেখলো মেহবিন সাগরিকাকে পরপর দু’টো থাপ্পড় মারলো। তা দেখে রাই দৌড়ে ওখানে চলে গেল মেহবিন আরেকটা থাপ্পড় মারবে এমন সময় রাই হাত ধরে ফেলল আর বলল,,

“কি করছিস তুই পাগল হয়ে গেছিস? ওকে মারছিস কেন?

মেহবিন রেগে বলল,,

“সেটা ওকেই জিজ্ঞেস কর?”

“কি হয়েছে সাগরিকা?”

তখন সাগরিকা বলল,,

“মেহবিন স্কুলের সবাইকে বলছিল তুই নাকি মেহবিনের টা দেখে দেখে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করিস। তোর নাকি কোন যোগ্যতা নেই ওর রেজাল্ট এর সমান করার। আবার ও সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে তোর নাকি কোন বড় ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক আছে সে তোকে প্রশ্নপত্রের ব্যাপারে হেল্প করে । এটা শুনে আমি প্রতিবাদ করতেই ও আমায় থাপ্পড় মারলো।”

সব শুনে রাই মেহবিনের দিকে তাকালো মেহবিন শান্ত চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। রাই বলল,,

“এসব সত্যি মেহবিন?”

তখন সাগরিকা বলল,,

“তোর বিশ্বাস না হয় ওদের জিজ্ঞেস কর?”

সাগরিকার সাথে থাকা সবাই বলল সাগরিকা সত্যি কথা বলছে। রাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠলো ও মেহবিনের কাছে গিয়ে বলল,,

“মেহু এসব কি?”

“সেদিন তোকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম তুই আমায় বিশ্বাস করিস কি না তোর মনে হয় আমি এসব করবো। আমি ওকে এই কারনেই থাপ্পড় মেরেছিলাম কারন চিঠিটা ও রেখেছিল।”

তখন সাগরিকা বলল,,

“এখন আমার ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। তাছাড়া আমি ওর মতো কোনদিন লিখতেই পারবো না। আমার হাতের লেখা ওতো সুন্দর নাকি। সবথেকে বড় কথা আমি তোমার মতো বন্ধুরূপী শত্রু নই আমি সত্যি সত্যি রাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষী। আচ্ছা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না রাই আমি তোকে প্রমান দিচ্ছি।

সাগরিকা খাতা বের করে রাইয়ের মতো লেখার চেষ্টা করলো হলো না। তখন সাগরিকা মেহবিন কে নিয়ে বলতে লাগলো তখন কিছুজন সাগরিকার সাথে তাল মেলালো। সব শুনে রাইফা বলল,,

“আমি ভাবতেও পারিনি মেহু তুই আমার নামে এসব বলে বেড়াবী। তোকে বন্ধু ভাবতেই আমার কেমন যেন লাগছে।

মেহবিন কিছুই বললো যে ওকে বিশ্বাস করেনা তার কাছে নিজের সম্পর্কে সে কিছু সাফাই দেবে না। তখন সাগরিকা বলল,,

“মেহবিন আমার নামে ওসব বলল আমাদের দুজনের মাঝে সম্পর্ক নষ্ট করতে। এই মেহবিন একদম আমাদের দুজনের মাঝে আসবে না।

তখন মেহবিন উচ্চ স্বরে হেঁসে উঠলো আর বলল,,

“তোমাদের মাঝে বাহ বেশ ফানি তো । আমি তোমাদের মাঝে আসছি না তুমি আমাদের মাঝে এসে পরেছো। এতো সুন্দর একটা বন্ধুত্ব কতো সহজেই না ভেঙে দিলে তুমি। এই জন্য তোমাকে স্যালুট দেওয়া উচিত। কি সুন্দর জোরা কবুতর কে ভেঙে দিল এক কাক অরফে কাউয়া।”

এ কথা শুনে সাগরিকা রেগে বলল,,

“এই মেহবিন মুখ সামলে কথা বল। নাহলে তোর মুখ আমি ভেঙে দেব।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“এই মেহবিন কে আঘাত করা এতো সহজ নয়। যেখানে এতোকিছুর পরেও রাই নিজেই আমার কিছু করতে পারলো না সেখানে তুই কি করবি।”

মেহবিনের কথার মানে রাই বুঝলো আর বলল,,

“আমি তোকে এই কারনেই আঘাত করি নি কারন আমি তোকে নিজের বান্ধবী মনে করি। আমার এখন তোকে দেখে ভাবতেও ঘৃনা হচ্ছে তুই আমার বান্ধবী।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“তাহলে ভেঙে দে না বন্ধুত্ব। ট্রাস্ট মি আমি কিছুই বলবো না।”

মেহবিনের মুচকি হাসির বলা কথাটা রাইয়ের মনে ঝড় তুলল। ও ব্যাগ থেকে ফুল আর চকলেট বের করলো আর বলল,,

“এসব এনেছিলাম তোর রাগ ভাঙাবো বলে কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম এসব তুই ডিজার্ভ করিস না।”

“ওহ আচ্ছা আমি করি না। তো কে করে ঐ সাগরিকা?”

রাই ওর দিকে অশ্রুশিক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,,

“হ্যা ঐ ডিজার্ভ করে । তোর মতো ধোঁকাবাজ নয়।

বলেই রাই সবকিছু সাগরিকাকে দিয়ে দিল। মেহবিন দেখলো সাগরিকার মুখে অদ্ভুত ক্রুর হাঁসি। সবাই চলে গেল শুধু রইলো মেহবিন। মেহবিনের মুখে অদ্ভুত হাসি। ও ব্যাগ থেকে দু’টো দামি কলম আর ডায়রি বের করলো যা ও আজ রাইফাকে দেবে বলে এনেছিল। ও ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে বলল,,

“যখন সাগরিকা নামক মেয়েটা আমাদের কাছে আসে তখনই বুঝেছিলাম যে কিছু একটা হবে। কিন্তু বুঝতে পারি নি আমাদের সম্পর্কই শেষ করে ফেলবে। যবে থেকে তুই আমাকে বাদ দিয়ে ওর সাথে বেশি কথা বলতে লাগলি তবে থেকেই বুঝতে পারছিলাম তুই আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস যেদিন রেস্টুরেন্টে তোকে ও রাই বলে সম্বোধন করলো কিন্তু তুই কিছু বললি না সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম তুই নিজেও ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস। সম্পর্ক কখনো তৃতীয় ব্যক্তির কারনে নষ্ট হয় না, সম্পর্ক তো নষ্ট হয় তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য। আর তুই সেটা দিচ্ছিলিস। দিন যাচ্ছে তুই কেন আমাকে ভুলেই যাচ্ছিস মানে সম্পর্ক অসুস্থ হয়ে পরছে তৃতীয় কারো আগমনে অথচ তুই বুঝতেই পারছিস না। কি অদ্ভুত তাইনা তৃতীয় একজন তোর গালে এতো জোরে থাপ্পর মেরে গেল তুই বুঝতেই পারলি না। আমি তো খুব করে বুঝতে পারছিলাম তোর আর আমার বিচ্ছেদ খুব নিকটে অথচ তুই কিছু আচই করতে পারছিস না। মানে তোর এই আমি কাউকে পেছনে ফেলে আসা তোর জীবনে কোন ইফেক্টই পরছে না। তুই এই কয়েকমাস ভেবে দেখতো একটু আমাকে কতটুকু সময় দিয়েছিস যে মেয়েটা আমাকে বন্ধের দিন তিনবার করে ফোন দিতো সেই মেয়েটা সেই ঘটনার আগের তিন মাস যাবৎ আমাকে ফোনই দেয় না কি অদ্ভুত তাইনা।

সাত বছরের সম্পর্ক আমাদের। দুজন দুজনকে খুব ভালোমতো চিনি তবুও মনে হচ্ছে কোথাও কমতি ছিল। তাই তো আজ তুই আমায় অবিশ্বাস করলি। তুই তো বলতি আমাদের কেউ ভাঙতে পারবে না। অথচ কত ছোট্ট কারনেই না তুই সম্পর্ক ভেঙে দিলি। হয়তো অন্য কেউ হলে সে সাফাই দিতো কিন্তু আমি তো অন্যদের মতো নই। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে সম্পর্ক রাখা বোকাদের কাজ। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর জিনিস হলো চেনা মানুষের অচেনা রুপ যা তৃতীয় ব্যক্তির কারনে হয়ে থাকে। আর আজ তা আমার চোখের সামনে।

এইটুকু বলেই মেহবিন ক্লাসে গেল। ওখানে গিয়ে দেখলো রাইফা কাঁদছে আর সাগরিকা ওকে আগলে রেখেছে কিন্তু মুখে অদ্ভুত হাঁসি। মেহবিন কিছু বললো না অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসে পরলো। সেদিনের মতো সবাই ক্লাস করে চলে গেল।অথচ এই শেষ দিন নিয়ে দুই বান্ধবীর কতো প্ল্যান ছিল। অতঃপর পরীক্ষা শুরু হলো দু’জনের চোখাচোখি হলো কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বললো না। মেহবিন শান্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো আর রাইফা সাগরিকার সাথে গল্প করতো চলাফেরা করতো ওকে ইগনোর করে। এমন একটা ভাব ওর জীবনে মেহবিন নামের কেউ নেই। সবগুলো পরীক্ষা এভাবেই দিল। রেজাল্ট ও প্রায় সেম সেমই করলো। রাইফাই বেশি পেল বরং একটু। এটা নিয়ে সাগরিকা মেহবিন কে নিয়ে অনেক কথা বলল রাইফাও সেদিন তাল দিল। মেহবিন একটা টু শব্দ করে নি সেদিন। ও তো শুধু দেখছিল চোখের সামনে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড এর ও কেউ বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাচ্ছে। দুজনে একজনের কাছেই কোচিং করতো কিন্তু ওদের দেখে মনে হতো কোন নিরব যুদ্ধ চলছে। এভাবেই চলে এলো এস এস সি পরীক্ষা। দুজনেই সিট আগে পিছে কিন্তু ওদের মাঝে মনে হয় কতো মাইলের দূরত্ব। ওদের দুজনকে এভাবে পরীক্ষা দিতে দেখে স্যার ম্যাডামের কতো প্রশংসা পেয়েছে। দেখতে দেখতে সবগুলো পরীক্ষা শেষ হলো আজ লাস্ট পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর মেহবিন রাইফাকে ডাকলো।

“মিস রাইফা আফনূর একটু শুনবেন? আজকের পর থেকে এই মেয়েটা আপনাকে আর ডিস্টার্ভ করবে না। কারন আপনার সঙ্গ সে ডিজার্ভ করে না।”

এতোদিন পর প্রানপ্রিয় বান্ধবীর ডাকে রাইফা না চাইতেও দাঁড়িয়ে পরলো মেহবিন রাইফার সামনে দাঁড়ালো তার মুচকি হাঁসি ফুটিয়ে তুলল আর বলল,,

“পরীক্ষা কেমন হলো আপনার?”

রাইফা মুচকি হেঁসে বলল,,

“আপনারটা না দেখে দিলে তো আমি ভালো রেজাল্ট করতেই পারতাম না তাই না। সেই হিসেবে বলতে পারি বেশ ভালো হয়েছে ইনশাআল্লাহ রেজাল্ট আপনার থেকে ভালোই আসবে।”

“ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আপনার মনের সকল আশা পুরন করুক।”

কথাটা শুনে রাইফা থমকে গেল ও ভাবেও নি মেহবিন ওর সাথে এভাবে কথা বলবে। ও কিছু বলবে তার আগে। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘আমরাও একটা সময় অনেক কথা বলতাম, একসাথে কতো সময় কাটাতাম। তাহলে আমাদের সাথে তেমন কি হয়েছে যে আজ হাজার মাইলের দূরত্ব তৈরি হয়েছে।”

মেহবিনের কথা শুনে রাইফাও বলল,,

“তখন তো আর জানতাম না নিজের সবথেকে প্রিয় বান্ধবী ধোঁকা দিয়ে দেবে।”

মেহবিন আবারও মুচকি হাসলো আর বলল,,

“আমাকে সবথেকে ভালো তুই চিনতিস যদি তোর মনে হয় আমি তোকে ধোঁকা দিয়েছি। তাহলে হয়তো সত্যিই দিয়েছি।”

মেহবিনের এইটুকু শুনে রাইফা ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মেহবিনের মুচকি হাসি বরাবরই রাইফাকে মুগ্ধ করে কিন্তু আজ অদ্ভূত যন্ত্রনা দিচ্ছে। ওর চোখ ছলছল করে উঠলো‌ ও বলল,,

‘হয়তো আমি তোকে সবথেকে ভালো চিনতাম কিন্তু আমি ধোঁকাবাজ মেহবিন কে চিনি না। আমি চিনি না তাকে। আর এই ধোঁকাবাজের সাথে আমি সম্পর্ক রাখতে চাই না।

‘সেদিনের পর কোন সম্পর্ক ছিল বুঝি। উঁহু ছিল না কোন সম্পর্ক। তাই তো আজ আপনি সম্মধোন করতে হচ্ছে।

“এই সবকিছুর জন্য তুই দায়ী।”

“মানুষ বরাবরই স্বার্থপর এটা আমার মা বলেছিল একদিন। তবে আমার মা এটাও বলেছিল নিজেকে এমনভাবে তৈরি করবে যাতে কেউ তোমাকে স্বার্থপরতার কাজে না লাগাতে পারে। ”

রাইফা অবাক হয়ে বলল ,,,

“মানে কি?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে আবার বলল,,

“আমি একটা রিয়ালাইজ করেছি জানিস সেটা হলো ‘বন্ধুত্বের সম্পর্ক যতো গভীরই হোক না কেন? যখন সেই বন্ধুত্বে তৃতীয় ব্যক্তি ঢুকে পরে তখন তার বন্ধুত্বের বিশ্বাস আর তৃতীয় ব্যক্তির মাঝে সবসময় তৃতীয় ব্যক্তিরই জিত হয়।”

এটা শুধু বন্ধু্ত্ব নয় যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়।সেদিন কি যেন বলছিলি আমাকে তোর বন্ধু ভাবতে ঘৃনা হচ্ছে তাই না। তবে আমার কিন্তু এতো সুন্দর বন্ধুত্ব সম্পর্কটার ওপর ঘৃনা আসছে না কিন্তু সহ্য ও হচ্ছে না। আমি চাইতাম যুগের পর যুগ চলে যাক তবুও আমাদের বন্ধুত্ব যাতে নষ্ট না হোক। তোকে আমি আমার হয়ে কোন সাফাই দেব না। তবে একটা কথা মনে রাখিস একটা সম্পর্ক নষ্ট করতে অনেকের দরকার হয় না একজনই যথেষ্ট। তবে হ্যা আরেকটা কথা ‘একশো বছর পরেও যদি তুই আমার কাছে আসিস আর আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলেও সব ছেড়েছুড়ে আমি তোকে আগলে নেব।’ যাই হোক অনেক কথা বললাম নিজের খেয়াল রাখিস আসছি হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না আমাদের।

মেহবিন হেঁটে চলল সামনের দিকে। রাইফা মেহবিনের কথার কিছুই বুঝতে পারলো না। কারন ওর সবকিছু গোলমেলে লাগছে। তবুও বলল,

“মেহু আমার কথাটা শোন?”

মেহবিন পেছনে ফিরে মুচকি হেঁসে বলল,,

“বিচ্ছেদ মানেই সবসময় অসমাপ্ত নয়, কখনো কখনো বিচ্ছেদ মানে এক সুন্দর সমাপ্তি!”
~আজরিনা জ্যামি

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৩৯+৪০

0

কাব্যের বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩৯
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

সবকিছু চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মেহবিন নিজেকে আবারও কঠোরতার চাদরে ঢেকে নিল। এতোক্ষণ বসে বসে সেই আগের তিক্ত অভিজ্ঞতা সে মনে করছিল। সে চোখের পানি পড়া আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।হাতের রক্ত গুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে তবুও ক্ষতটা গভীর হওয়ায় হালকা হালকা লাল বর্ন ধারন করছে বারবার। বৃষ্টি নেই এখন থেমে গেছে আরো আগেই। মেহবিন চারপাশটা একবার দেখে নিল সে বাড়ির পথে না গিয়ে চলে এসেছে রেলস্টেশনের দিকে। ও উঠে দাঁড়ালো তখনি পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেল ভেতরটা চমকে উঠলেও মানুষটার আওয়াজ পেয়ে সে শান্ত হলো।

“বিহঙ্গিনী তুমি ঠিক আছো তো?”

মেহবিন পেছনে ফিরে মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘হুম ঠিক আছি।”

মুখর ভালো করে মেহবিনের দিকে তাকালো। বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে পুরো চাঁদটার জন্য চারদিক আলোকিত হয়ে আছে। চাঁদের আলোতে
অদ্ভুত লাগছে মেহবিন কে ওর কাছে। শুভ্র রঙের গাউনটার দিকে নজর যেতেই মুখর নিজের সোনালী রঙের কোটি খুলে ওকে পরিয়ে দিল। মেহবিন কে খুঁজতে প্রথমে সে দৌড়ে মেহবিনের বাড়ি গিয়েছিল যখন দেখলো ওখানে নেই তখন মুখর প্রায় পাগল পাগল হয়ে গেল। ও গ্ৰামের রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে লাগলো। একটা সময় গাছের নিচে শেখ শাহনাওয়াজ কে দেখলো কিন্তু সে ওদিকে না গিয়ে মেহবিনকে খুঁজতে লাগলো ওখান দিয়ে একটাই রাস্তা স্টেশনের দিকে ও আর দেরি না করে সেদিকে দৌড় দিল। মিনিট দশেক দৌড়াতেই কাউকে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখলো রাস্তায় দেখেই বুঝতে পারলো ওটা মেহবিন। স্টেশনের কাছাকাছিই মুখরের ভাড়ার বাড়ি। তাই মুখর বলল,,

“চলো বাড়ি যাই অনেকক্ষণ ভিজেছো এর পরে অসুস্থ হয়ে পরবে। এমনিতেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হওনি তুমি।”

“হুম।”

মুখর কিছু না বলেই মেহবিনকে কোলে তুলে নিল তারপর ওকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। তা দেখে মেহবিন প্রথমে হকচকিয়ে উঠলেও পরে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,,

‘আমি হাঁটতে পারবো আমার কিছুই হয় নি তো।”

“আমি জানি হাঁটতে পারবে। কিন্তু আমার ইচ্ছে হলো তোমাকে কোলে নেওয়ার তাই নিলাম। এখন একটা কথা কথাও বলবে না তুমি।

মেহবিন ও কোন শব্দ না করে ওর গলা জড়িয়ে রইলো। মুখর কোলে না নিয়ে যদি হাতের আঙুলের ভাঁজে হাত রাখতো তবে হয়তো কোন রক্তাত্ব হাতের অস্তিত্ব পেতো। কিন্তু সে পায় নি কোলে নেওয়াতে।রাস্তার দিকে নজর যেতেই মেহবিন বুঝতে পারলো মুখরের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে ওকে তবুও কোন কথা বললো না সে।মুখর এক তলা এক বাড়িতে ভাড়া থাকে। সেখানে সবকিছু শহরে ফ্ল্যাটের মতোই। মুখর বাড়ি ঢুকে মেহবিন কে নামিয়ে সব লাইট অন করতেই ওর নজর গেল মেহবিনের হাতের দিকে দুটো হাতই থেঁতলে বাজে অবস্থা। ও তাড়াতাড়ি করে হাত ধরে বলল,,

“এসব কখন হলো? আর কিভাবে হলো? তুমি কি নিজেকে আঘাত করেছো?’

মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

“হুম আঘাত করেছি। এসব ছাড়ুন আমার ঠান্ডা লাগছে চেন্জ করতে হবে।”

মেহবিনের কথায় মুখর ওকে তাড়াতাড়ি করে চেন্জ করতে বলল তবে পরক্ষনেই ভাবলো। এখানে তো মেহবিনের পড়ার জন্য কিছু নেই। তাই বলল,,

“তোমার পড়ার মতো তো আমার কাছে কিছু নেই।”

মেহবিন বলল,,

“আপনার আলমারি কি লক?’

“না।”

মেহবিন আলমারি খুললো নরমাল টাউজার। একটা টিশার্ট আর একটা হুডি নিল। তারপর টাওয়াল নিয়ে বলল,,

“আমি এসব পরে নিচ্ছি। আপনি আরেকটা ওয়াশরুম থেকে চেন্জ করে আসুন নাহলে আপনার ঠান্ডা লাগবে।’

বলেই ওয়াশরুমে চলে গেল। মুখর ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল ও বোঝার চেষ্টা করলো এই মেয়েটা এমন কেন? কিছুক্ষণ ভেবে ও নিজেও ড্রেস নিয়ে অন্য ওয়াশরুমে গেল। মুখরের সবকিছুই মেহবিনের বড় লাগলো। টাউজারের নিচে চিকন হওয়ার সব মোটা খানিক পায়ের কাছে গিয়ে থেমেছে। নিচে টিশার্ট ওপরে হুডিটা অনেক সুন্দর লাগছে বাইরে দেশের মেয়েদের মতো যদিও হুডির হাতাটা বড় দেখে মেহবিন হাতা ভাঁজ করেছে ওকে পুরো টমবয়দের মতো লাগছে। মেহবিন ড্রয়ার থেকে দু’টো ঘুমের ওষুধ নিল খাবে দেখে। তখন মুখর ওষুধ হাতে দেখে বলল,,

“এগুলো কিসের ওষুধ?”

“ঘুমের ওষুধ এর আগেরবার আমি রেখে গিয়েছিলাম।”

“তুমি ঘুমের ওষুধ দিয়ে কি করবে?”

“আমার একটা ঘুমের প্রয়োজন।”

“তোমার হাতে ব্যান্ডেজ করতে হবে তো। তাছাড়া চুলটাও তো দেখি ভালোভাবে মুছোনি।”

মেহবিন পাশ থেকে পানি নিয়ে ওষুধ উটো খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো আর বলল,,

“আমি ঘুমিয়ে গেলে আমার হাতের ব্যান্ডেজ করে দিয়েন। আর আপনার শখ হলে চুল মুছিয়ে দিয়েন। আর হ্যা আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে আমার কাছে আসবেন না। আর হ্যা আমার মনে হয় ওদের এঙ্গেজমেন্টটা হবে আমার হাতে ব্যান্ডেজ করে রেডি হয়ে চলে যায়েন চেয়ারম্যান বাড়ি। নাফিয়ার এমন ইম্পোর্টেন্ট একটা দিনে আপনার ওর পাশে থাকা উচিৎ। সকালে উঠি যদি দেখি আপনি যান নি তাহলে আমার খুব খারাপ লাগবে। আজ সবাই বোধহয় ঐ বাড়িতে থাকবে আপনিও থাইকেন আমি সকাল হলে চলে যাবো বাড়িতে। এখন একটাও কথা বলবেন না আপনি আমি ঘুমাবো খুব ঘুম পাচ্ছে।

কথাটা শুনে মুখর স্তব্ধ থম হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।মেয়েটা এমন কেন? অতঃপর দশ মিনিট অপেক্ষা করলো। মেহবিন অসুস্থ ছিল সেই সাথে আজ দূর্বল আর ওষুধ দুটোও ভালো কাজে দিয়েছে আজ দশ মিনিটেই ঘুমিয়ে পরেছে ও। মুখর আস্তে আস্তে করে মেহবিনের কাছে গেল তারপর যত্ন করে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগলো। ঘুমের মাঝে মেহবিন অবশ্য একটু কপাল কুঁচকে ছিল কিন্তু মুখ দিয়ে একটু আওয়াজ ও বের করে নি। ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে মুখর মেহবিনের মাথা মুছিয়ে দিল। তারপর ওকে বুকে জড়িয়ে বলল,,

“বিহঙ্গিনী আমি জানি তুমি বোধহয় আরবাজের কোন কথায় অনেক কষ্ট পেয়েছো। তাই তো তার গায়ে হাত তুলেছো। কারন তুমি তো কাঁদতে পারো না এই জন্য কষ্টগুলো খুব তাড়াতাড়ি রাগে পরিনত হয়। জানি না তোমার সাথে কি ঘটেছিল আগে তবে আমার মনে সবসময় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায় শেখ শাহনাওয়াজ তোমার বাবা আরবাজ তোমার ভাই তবে তোমাদের কিসের এতো দূরত্ব। কিসের জন্য তুমি আলাদা হয়েছিল আর কেন তুমি এরকম। আমার যে রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনী কে খুব জানতে ইচ্ছে করে। জানি না তোমার ভেতর কিসের এতো দুঃখ কিসের এতো বিষন্নতা তবে যাই হয়ে যাক না কেন তোমার কাব্য তোমায় সবসময় আগলে রাখবে আর খুব ভালোবাসবে। আর এতো ভালোবাসবে যে দুঃখরা তোমায় ছুঁতে পারবে না। সবশেষে ভালোবাসি বিহঙ্গিনী।”

_______________

এদিকে শেখ শাহনাওয়াজ অনুভূতিহীন হয়ে বসে আছে। আরবাজ আর মিশু খুঁজতে খুঁজতে একটা সময় ওনাকে পেয়ে গেল। আরবাজ আর মিশু ওনাকে বসে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি করে ওনার কাছে গেল। মিশু বলল,,

“বাবা ফুল কোথায়? আর তুমি এভাবে বসে আছো কেন?

শেখ শাহনাওয়াজ শান্ত স্বরে বললেন,,

“আমি আমার আম্মাকে একেবারের জন্য হাড়িয়ে ফেললাম মিশু। ও আর আসবে না আমাদের কাছে।”

“কি হয়েছে বাবা ফুল কোথায়?”

“জানি না ও চলে গেছে। আর বলে গেছে কখনো আমাদের বাড়িতে আর আমার ত্রিসীমানায় আসবে না।”

আরবাজের ভিশন কষ্ট হচ্ছে। ও শেখ শাহনাওয়াজ এর হাত ধরতেই তিনি আরবাজকে খুব জোরে একটা থাপ্পড় মারলেন। আর বললেন,,

“কেন তুমি মুসকান কে ঐসব বলতে গেছো। তুমি কি জানতে সেদিন কি হয়েছিল? তুমি কি জানো সেদিন সেই সাত বছরের ছোট্ট মেয়েটা কি কি সহ্য করেছিল। তুমি কি জানো সারাজীবন ধরে ও কি বয়ে যাচ্ছে। সে তার পর থেকে এই উনিশ বছরে এক ফোঁটাও পানি আনেনি চোখে। আজ তোমার জন্য তার চোখে পানি এসেছে। কি বলেছিলে ও তোমার মায়ের মৃত্যুর কারন তাই আমি ওকে ঘৃনা করে ওর দিকে তাকাই না। আর তোমাদের মতো তাকে তুমি করে বলি না। আর কি বলেছিল তাকে তাকে আমি খুজেনি সেই কারনে।

কি করে তাকাতাম আমি তার দিকে তার কাছে যে মস্ত বড় অপরাধী আমি। যে অন্যায় করেছি তার সাথে এই জন্য তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাই না আমি। তাই তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলি না আমি। আর তাকে তুমি করে বলি না কেন কারন সে শ্রদ্ধার পাত্রী তাকে সর্বদা ভালোবাসার সাথে শ্রদ্ধা করি আমি। আর ছোটবেলা থেকেই আমি ওর সাথে আপনি বলতাম সেটা হয়তো তুমি ভুলে গেছো। সবশেষে তুমি বলেছিলে সে তোমার মায়ের মৃত্যুর কারন তাই না তাহলে বলবো সে তার মাকে বাঁচানোর সবটুকু চেষ্টা করেছিল ঐটুকু বয়সেই কতটা তার মাকে আঁকড়ে ধরেছিল। তুমি জানো সে তার মৃত মায়ের বুকে ঘুমিয়েছেও তার হাতটা ধরে সারাক্ষণ ছিল। তোমরা তো খবর পেয়েছিলে তোমার মা মারা গেছে আর সে প্রথম থেকে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তার মায়ের সাথেই ছিল। কতটা ছটফট করেছে তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। আমি শুনেই সহ্য করতে পারছিলাম না আর ঐ মেয়েটা সব একাই সহ্য করে গেছে। আর সবথেকে বড় কথা সে হাঁড়িয়ে যায় নি আমি তাকে হাড়িয়ে ফেলেছিলাম ইচ্ছে করে আমাদের জীবন থেকে। তুমি তাকে কোন সাহসে এইসব বলো তোমার সাহস কি করে হয় মুসকান কে ঐসব বলার।

বলতে বলতে তিনিও আরো দু’টো থাপ্পড় দিল আরবাজকে । আরবাজ কাঁদতে লাগলো মিশুও কাঁদছে। আরবাজ বলল,,

“আমায় যতো ইচ্ছে মারো বাবা। আমি এটা ডিজার্ভ করি আমি চাইনি ওকে বলতে এইসব। আমি চাইনি আমি তো ওকে বিশ্বাস করি আর ভালোওবাসি। সকালে বড় মা আর তার ভাই কথা বলছিল এই নিয়ে যে আজ বড় ছেলের এঙ্গেজমেন্ট ওদের মামাবাড়ির লোকজন ও আসছে তারা এসে ফুলের কথার প্রসঙ্গ তুলবে তখন কি বলবে আরবাজদের বাবা। সে তো সেদিনের পর মুসকান কে খোঁজেনি। তখন বড় মা বলল তুমি নাকি ফুল নাকি মায়ের মৃত্যুর কারণ বলো এই জন্যই নাকি তুমি ওর খোঁজ করো নি। এই কথাটাই সারাদিন আমার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছিল। এরপর তোমার আর ফুলের সবকিছু মনে করলাম তখন দেখলাম তুমি ওর সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলো না। সবকিছু মাথায় এমনভাবে ঘুরছিল যে আজ খুব ডিসটার্ভ ছিলাম তখন ফুল তোমার ব্যাপারে খারাপ কথা বলতেই ভেতর থেকে সকালের কথাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আমি এক মুহুর্তের জন্য ভুলে গেলাম আমার বোনকে তাই তো এসব বলে ফেলেছি তবে আমি চাইনি ঐসব বলতে বিশ্বাস করো। আমি ফুলের পা ধরে মাফ চাইবো বাবা।

বলতে বলতেই আরবাজ জোরে কেঁদে উঠলো। ছেলেরা নাকি কাঁদেনা এটাই হলো প্রমান। শেখ শাহনাওয়াজ ছেলেকে ধরলেন না। মিশুও সব শুনে ওর দিকে গেল না। শেখ শাহনাওয়াজ আরবাজের কাঁধে হাত রেখে বলল,,

“বাড়িতে অনেক মেহমান এসেছে চলো বাড়ি চলো। আর এইসব কান্নাকাটি বন্ধ করো। কারন যার জন্য কাঁদছো তার সামনে এভাবেও কাঁদলে তার ক্ষমা পাবে কিনা সন্দেহ। কারন সে আবেগী নয় সে বাস্তববাদী। কথার তীরের ক্ষত তরবারির আঘাতের থেকেও গভীর হয়।”

“বাবা আমি?”

“আর একটাও কথা না তবে সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি কিভাবে সামলাবে সেটা ভাবো। মুসকান কে কি তার পরিচয় আপতত সেটা থাক এতোদিন যেভাবে ছিল। আমরা আমাদের লক্ষ্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি এখন কোন ভাবেই তীরে এসে তরী ডুবতে দেব না আমি।”

“কি বলছো তুমি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“তোমাদের না ভাবলেও চলবে‌। এখন চলো। আর মিশুমনি তুমি তো গুড গার্ল এখানে যা হলো তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না।

তিনি জানেন না মিশুর সুস্থ হওয়ার কথা। তাই তিনি এভাবে বললেন। মিশুও বাবার কথায় তার মেলালেন।

ওরা তিনজন বাড়ি ফিরে গেল। ওরা বাড়ি ফিরতেই সবার প্রশ্নের ঝড় উঠলো‌। নাফিয়া অদ্ভুত ভাবে আরবাজের দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে আরবাজ আর ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। তখন মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

“শাহনাওয়াজ ভাইসাব আপনারা আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। তারপর আমরা ঠান্ডা মাথায় কথা বলি।”

শেখ শাহনাওয়াজ তাতে সম্মতি জানিয়ে ওপরে গেলেন। আরবাজ আর মিশুও গেল তিনজনে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো। আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ নরমাল একটা পাঞ্জাবি পরে এলো আর মিশু নরমাল থ্রিপিচ। কেউ কিছু বলবে তার আগে মিশু বলল,,

“সবাই হয়তো ভাবছেন আমার ভাইকে কেন মারা হলো তাই না? সে কি কোন অসভ্যতামি করছিল ফুলের সাথে। না সেরকম কোন কিছুই সে করে নি আমার ভাই মেয়েদের যথেষ্ট সম্মান করতে জানে। এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে‌। বাজপাখি ফুলের সাথে আমায় নিয়ে কথা বলছিল কিন্তু তাদের মিল হচ্ছিল না তাই বাজপাখি রেগে ভুলে ফুলের হাত ধরে‌। এখানে তার খারাপ কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু এটা ফুলের পছন্দ হয় নি এই জন্য সে আমার ভাইকে মেরেছে। কারন ফুলকে কোন পুরুষ মানুষ স্পর্শ করুক এটা তার পছন্দয নয়। ফুল খুব রেগে গিয়েছিলো এই জন্য বৃষ্টির মধ্যে চলে যায়। এই জন্য বাবা ফুলকে বোঝাতে গিয়েছিলেন বাবাকে যেতে দেখে বাজপাখি আর আমিও গিয়েছিলাম তাকে বাবা আর বাজপাখি বুঝিয়ে এসেছে এখন কোন সমস্যা নেই। সে এখন বৃষ্টিতে ভিজে এখন আর আসবে না তাই আসে নি‌। তবে সে সবকিছুর জন্য সবাইকে দুঃখিত জানিয়েছে।

মিশুর সেই আগেকার মতো গোছানো কথা দেখে শেখ শাহনাওয়াজ আর আরবাজ দু’জনেই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বাকিরাও অবাক হয়েছে। মিশু এমনভাবে প্রেজেন্ট করলো তাছাড়া মিশু কিরকম এখন সেটা সবাই জানে আর ও মিথ্যা বলবে না এই ভেবে সবাই বিশ্বাস করে নিল। সবশেষে আরবাজ বলল,,

“সত্যিই আমি ভাবতে পারি নি এরকম আমার দ্বারা ভুল হয়ে যাবে। আঙ্কেল বা নাফিয়া এখন যদি আপনারা এ বিয়েতে রাজি না থাকেন তাহলে সমস্যা নেই। এই বিয়ে
হবে না।”

হুট করে আরবাজের বিয়ে ভাঙার কথা শুনে সবাই আরো বেশি অবাক হলো। নাফিয়া দেখলো এখনো তার চোখে পানি অনুতাপের জন্য চোখ তুলে কারো দিকে তাকাতেও পারছে না। মাহফুজ শাহরিয়ার মেহবিন কে ভালো মতোই চেনে এরকমটা হওয়া অসম্ভব কিছু নয় এর ডেমো তিনি দেখেছেন এর আগে। তাই তিনি নাফিয়ার দিকে তাকালেন। নাফিয়া চোখ দিয়ে ইশারা করলো তার কোন সমস্যা নেই তাই তিনিও বললেন তার সমস্যা নেই এই বিয়ে হবে। অতঃপর জানানো হলো এঙ্গেজমেন্ট হবে। হুট করে জিনিয়া আর মুনিয়া বলল,, মুখর ভাইয়া কোথায় তার বোনের এঙ্গেজমেন্ট এ কি সে থাকবে না। ওদের কথা শুনে সবাই মুখরকে নিয়ে ভাবলো সেই ঘটনার পর সবার আগে মুখরই বেরিয়েছে। মাহফুজ শাহরিয়ার মুখরকে ফোন করলো। ফোন পেয়ে মেহবিন কে যত্ন করে শুয়িয়ে দিল কপালে একটা চুমু দিয়ে দরজা আটকিয়ে চলে এলো। ড্রেস চেঞ্জ করলো ফরমাল শার্ট আর প্যান্ট ড্রেস আপ করে ও চলে এলো। মুখর আসতেই সবাই বলল কোথায় গিয়েছিল তখন সে বলল একটা ইম্পোর্টেন্ট কাজে গিয়েছিল ওকে আবার যেতে হবে ইমার্জেন্সি আছে। শুধু নাফিয়ার এঙ্গেজমেন্ট এর জন্য এসেছে। মুখর আসার পর আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকায় নি। অতঃপর নাফিয়া আর আরবাজের এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেল। এখন খাওয়ার পালা সবাই খেতে বসলো তবে আরবাজ শেখ শাহনাওয়াজ মুখর আর মিশুর গলা দিয়ে খাবার নামলো না। মিশু না খেয়ে ওপরে চলে গেল শেখ শাহনাওয়াজ কিছু বললেন না। মুখর কাজের বাহানা দিয়ে ও বাড়ি থেকেই চলে এলো। ও বলল আবার সকালে আসবে একবার এখন খুব জরুরী কাজ আছে যেতেই হবে। মুখরের এমন কথা শুনে কেউ আর বাঁধা দিলো না। হুট করে মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

“আপনি আজ স্পেশাল কাদের সাথে দেখা করাবেন বলেছিলেন?”

শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“হুম বলেছিলাম তবে দুঃভাগ্যবসত তারা আসে নি। তাই দেখা হলো না।”

“তারা কারা ছিল?”

“আরবাজের আরেক মামা ও তার পরিবার।”

“ও আচ্ছা হয়তো অনেক ব্যস্ত ছিলেন এই জন্য আসেন নি নাহলে ভাগ্নের অনুষ্ঠানে কে না আসে।”

“হয়তো।”

“ইনশাআল্লাহ পরে আমাদের আবার দেখা হবে।”

“হুম ইনশাআল্লাহ।”

_________________

মুখর বাড়ি এসে দেখল মেহবিন বালিশ সরিয়ে বিছানায় মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে এরকমটা ও প্রায়ই দেখে ও বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমায় না। তবে এটা নিয়ে কখনো ওকে জিজ্ঞাসা করে নি। মুখর চেন্জ করে নরমাল ড্রেস পরে এলো। যেখানে ওর বউটা খায়নি এতো কষ্ট পেয়েছে আজ সেখানে ওর গলা দিয়ে ভাত নামবে কিভাবে। ও মেহবিনের কাছে গিয়ে ওকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো মেহবিন ও আজ গুটি শুটি মেরে ঘুমিয়ে রইল হয়তো অনেক দিন পর যে কারো ঢিপঢিপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।

অতঃপর নতুন সকালের আগমন। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার অভ্যেস আছে তাই সকালেই উঠে পরলো।মেহবিন চোখ খুলেই দেখলো মুখর ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মেহবিন হাত দিয়ে সরাতে গেলেই দেখলো ওর হাতে ব্যান্ডেজ। কালকে রাতের কথা মনে পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সকাল ছয়টা মেহবিন মুখরকে ডাকলো মুখর উঠেই বলল,,

“উঠে পড়েছো?”

“হুম এখন একটু মুখটা মুছিয়ে দিন তো বাড়ি যাবো। নেত্রী পরতে আসবে ওকে পড়াতে হবে।”

“তুমি এই অবস্থায় বাড়ি যাবে?”

“তো আমার কি হয়েছে শুনি? শুধু হাতে ব্যান্ডেজ।”

“না মানে এই ড্রেস এ।”

“হ্যা যাবো আপনার একটা ক্যাপ আর না ইউজ করা মাস্ক দেন । কিভাবে যেতে হবে সে আমি ভালো করেই জানি। এখন তাড়াতাড়ি করুন।”

মুখরের আর কি তার বিহঙ্গিনীর কথা শুনতেই হবে। ও মেহবিনকে মগ দিয়ে কুলি করতে বললো তারপর মুখটা ধুয়িয়ে দিল‌। মুছিয়েও দিল। ঘরে কাপ নুডুলস ছিল গরম পানি করে ওটাকে বয়েলড করে নিল। তারপর মেহবিনের হাত ধরে বসিয়ে বলল,,

“কাল রাতেও কিছু খাও নি এখন না বললেও শুনবো না। তাড়াতাড়ি হা করো।”

মেহবিন আর কোন কথা বললো না চুপচাপ খেয়ে নিল। এরপর শুধুমাত্র নিজের জুতো ছাড়া আর সবকিছু মুখরের পরে নিল চুলগুলো খোপা করে নিল যদিও কষ্ট হলো। তারপর ক্যাপ পড়লো ক্যাপের ওপর দিয়ে হুডি টেনে দিল । মুখে মাস্ক পরে নিল ব্যস রেডি। তখন মুখর বলল,,

“একেবারে পারফেক্ট লাগছে। আমি গাড়ি করে দিয়ে আসি।”

“আপনার ইচ্ছা।”

মুখর নিজেও একটা হুডি আর মাস্ক পরে নিল তারপর গাড়ি নিয়ে বের হলো। মেহবিন কে পাকা রাস্তায় নামিয়ে দিল। সকাল বেলা কেউ বাজারে যাচ্ছে নয়তো ক্ষেতে তাই যাদের নজরে মেহবিন পড়লো সবাই অবাক হলো বাইরের দেশের মেয়েদের মতো ড্রেসাপ দেখে তবুও এগিয়ে এসে কিছু বললো না। মেহবিন বাড়ি এসে গেট খুলবে তখন আমাদের দ্য গ্ৰেট শেখ তাজেলের আগমন ঘটলো তিনি এসেই বললেন,,

“ঐ মিয়া তুমি আমার ডাক্তারের বাড়ি চুরি করবার ঢুকতেছো। আমারে চেনো তুমি তোমার সাহস তো কম না আমার ডাক্তারের বাড়ি চুরি করতে আইছো।”

না চাইতেও মেহবিনের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। ও গলার স্বর চেন্জ করে বলল,,

“হ্যা চুরি করতে এসেছি তোমার ডাক্তাররে।”

“কি এতো বড় চোর তুমি। তুমি আমার ডাক্তাররে চুরি করবা তার আগে আমি খাড়াও তুমি।

বলেই তাজেল এদিক ওদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো । একটা সময় একটা লাঠি পেয়েও গেল ও দৌড়ে ওকে মারতে এলো তা দেখে মেহবিন এবার নিজের স্বরেই বলল,

“নেত্রী।”

নেত্রী শুনেই তাজেল থেমে গেল। আর বলল,,

“তুমি ডাক্তাররে চুরি কইরা নিজের ভেতর ঢুকালাইছো। তাড়াতাড়ি ডাক্তাররে বাইর করো। না হইলে এই লাঠি মাইরা তোমার মাথা ফাটাই দিমু।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে তাজেলের দিকে এগিয়ে গেল আর কন্ঠ চেন্জ করে বলল,,

“আচ্ছা তোমার ডাক্তারকে নেব না কিন্তু তার বদলে তোমাকে নিয়ে যাবো রাজি।”

“এহন আইছে আমি তো আমার ডাক্তাররে যাইতে দিমু না আর নিজেও যামু না। কারন আমি ডাক্তাররে ছাড়া ভালো থাকবার পারি না। এহন তুমি তাড়াতাড়ি ডাক্তাররে বাইর করো নাইলে বাড়ি মারলাম।”

বলেই লাঠি উঁচু করলো তা দেখে মেহবিন হেঁসে উঠলো। আর মাস্ক সরিয়ে বলল,,

“এই যে নেত্রী আমিই তোমার ডাক্তার। তুমি আমাকে মারবা।

মেহবিনের চেহারা দেখেই তাজেল লাঠি ফেলে দিল আর বলল,,

‘ওহ এইডা তুমি তাইলে আগে কইলা না ক্যা? তোমারেতো আজক্যা আমি চিনবার পারি নাই তোমার চোখ যে দেখতে পাই নাই তাই । তোমার চোখ দেখলেই বুঝবার পারতাম এইডা তুমি।”

“তাই বুঝি?”

“হ তাই তোমারে তো আজ অনেক সুন্দর লাগতাছে। যদিও একটু ঢুলাঢালা তাও মেলা সুন্দর লাগতেছে। আমি ভিডিও তে দেখছিলাম একবার বিদেশি মাইয়া গো মতো।’

“হুম হয়েছে এবার পরতে আসো‌।”

‘আমিতো চেক করতে আইছিলাম তুমি বাড়ি আছাও কিনা?

“বাড়ি ছিলাম না এখন এলাম। এখন পরতে আসো।”

“আইচ্ছা কিন্তু তোমার হাত কই দেহি না ক্যান? এতো বড় হাতা ক্যান?হাত দেহাই যায়না।”

বলেই তাজেল ওর হাতাটা উঠাতে লাগল। উঠাতে উঠাতে হাত বের করলো হাতে ব্যান্ডেজ দেখে বলল,,

“ও আল্লাহ তোমার হাতে ব্যান্ডেজ ক্যান ডাক্তার? দেহি ঐ হাত দেহি।

ও আরেকটা হাত ও দেখলো তারপর দেখে বলল,,

“কোনে গেছিলা তুমি ? কাইল না তুমি চেয়ারম্যান বাড়িতে গেছিলা তাইলে এই অবস্থা হইলো কেমনে? কেউ কি তোমারে মারছে নাম কও খালি আমিও মারুম ওরে । ঐ পাগল মাইয়া মারছে না কও তুমি?”

তখন মেহবিন মুচকি হেঁসে তাজেলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,,

“না নেত্রী আমায় কেউ মারেনি। আর ফুল পাগল হলেও আমাকে ভালোবাসে আর পাগল রা নিজেদের স্বার্থ বোঝেনা এই জন্য তাদের প্রিয় মানুষদের আঘাত করে না। আঘাত তো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষরাই করে যখন তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে।”

“তুমি কি কইলা আমার মগজে কিছুই ঢুকলো না।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“তোমার ঢুকাতেও হবে না শুধু এইটুকু ঢুকাও আমাকে কেউ মারে নি।”

“তাইলে এমন কেমনে হইলো?”

“ওটা একটা এক্সিডেন্ট বুঝছো।”

“আইচ্ছা এহন তুমি ঘরে যাও আমি দাদিরে কইয়া আসি তোমার রান্দার কতা। তারপর পরতে আসতেছি।”

বলেই তাজেল দৌড়। মেহবিন ও হেঁসে ঘরে চলে এলো এই মেয়েটাও না হাত কাঁটা দেখেই বুঝতে পেরেছে রান্না করতে কষ্ট হবে তাই দৌড়ে বাড়ি চলে গেল। কিন্তু বারান্দার সামনে এসে ও অবাক হয়ে গেল গেট এ তালা নেই । ও বারান্দায় গিয়ে দেখলো কয়েক জোড়া জুতো। ও তাড়াতাড়ি করে ঘরে ঢুকতেও দেখলো মেহরব চৌধুরী, মিহির, মাইশা আর মিসেস মেহরব ‌ বসে আছে আর আদর ঘুমিয়ে রয়েছে। মেহবিন কে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালো। মেহরব চৌধুরী মেহবিনের কাছে এসে বলল,,

“মেহু তুই ঠিক আছিস তো?”

মেহবিন অবাক হয়ে বলল,,

“তোমরা এখানে? ও বাড়িতে যাও নি।”

তখন মেহরব চৌধুরী বললেন,,

“ওখানে গিয়েছিলাম আমরা বৃষ্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর। কিন্তু যখনি ঢুকবো তখন দেখি তুই আর আরবাজ কথা বলছিস আমরা আরবাজের সব কথাই শুনেছি। এমনকি ওখানে তুই যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। সব দেখে ভেতরে ঢোকার রুচি হয়নি। বেশ অন্ধকার আর বৃষ্টির জন্য কেউ আমাদের খেয়াল করে নি। মিহির আর মাইশা তো তোর বাড়ি চেনে আমরা ভেবেছিলাম তুই বাড়ি আসবি তাই এখানে এসেছিলাম কিন্তু দেখলাম তুই এলিনা তখন মিহির তোকে খুঁজতে বেরিয়েছিল পেয়েও ছিল তখন দেখলো মুখর তোকে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে তাই ও আর ওদিকে না গিয়ে ফিরে আসে।”

সবশুনে মেহবিন দুই হাত ভাঁজ করে বলল,,

“তোমার ভাগ্নের এঙ্গেজমেন্ট আর তোমরা সেখানে না গিয়ে আমার জন্য এখানে এসেছো?”

‘আমরা না যাওয়াতে খুব একটা সমস্যা হতো নাতো। তাছাড়া ওখানে যাওয়ার প্রয়োজন দেখছি না।

“তোমার গার্ডস গাড়ি ওগুলো কোথায়? মন্ত্রী হয়ে তো ওগুলো ছেড়ে আসার কথা নয়।”

‘গার্ডস আনিনি তবে গাড়ি এনেছি মিহির একটু দূরে রেখে এসেছে।”

“কি গার্ডস আনোনি।”

“না ওগুলো স্টেশনে রেখে এসেছি। যদিও আনতে চাইছিলাম না তবুও মিহির নিয়ে এলো।

‘ওহ আচ্ছা। মামী তোমরা কিছু খেয়েছো? আদর কে ওঠাও আমি কিছু বানিয়ে দিচ্ছি ওর তো খিদে পেয়েছে। আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি।

তখন পেছন থেকে কেউ বলল,,

“এই হাত নিয়া তুমি রান্না ঘরে যাইবা?”

মেহবিন পেছনে ফিরে দেখলো কোমরে দুই হাত দিয়ে তাজেল দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে মেহবিন হাসলো তখন মাইশা বলল,,

” কি হয়েছে হাতের দেখি হাত দেখি।”

মাইশা এসে মেহবিনের হাতের হাতা উঠালো দুই হাত উঠিয়ে দেখলো দুই হাতেই ব্যান্ডেজ। তা দেখে মামী বললেন,,

‘এই সব কি মেহু মা?”

“ধূর বাদ দাও নেত্রী ভেতরে এসো।”

তাজেল ভেতরে ঢুকলো হাতে একটা বাটি। মেহবিন হেঁসে বলল,,,

“এখানে কি আছে?”

“এইহানে মুড়ি মাখা আছে দাদি তোমার কথা শুইনা মাখাই দিল। রানতে মেলা সময় লাগবো তাই এইগুলা পাঠাইছে। কিন্তু এনেতো দেহি মেলা মানুষ এইটুকুতে হইবো না আমি দাদিরে যাইয়া কই আবার।”

‘না না কিছু করতে হবে না মা আমি রান্না করবো।”

মেহবিনের মামীর কথায় তাজেল ওনার দিকে তাকালো তারপর মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“ডাক্তার?”

মেহবিন বুঝতে পারলো ও জানতে চাইছে নতুন মানুষ গুলা কারা। মেহবিন বলল,,

‘এরা হলো আমার মামা মামী সেদিন মিহির ভাইয়া আর মাইশা আপু এসেছিল এই যে এই দুজন ওদের মা বাবা। আর যে শুয়ে আছে সে হলো মিহির ভাইয়ার ছেলে। আর মামা মামী এই হচ্ছে আমার নেত্রী।

“ওহ আইচ্ছা।”

মেহরব চৌধুরী তাজেলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,,

‘শেখ তাজেল তুমি জানো আমিও কিন্তু একজন মন্ত্রী।”

‘তাতে কি তুমি তো আর শেখ হাসিনার মতো প্রধানমন্ত্রী না।”

তাজেলের কথায় সবাই হেঁসে উঠলো। এই মেয়েটা এমন যে কেউ না হেঁসে থাকতেই পারে না। মেহরব চৌধুরী তাজেলকে কোলে নিল। মিসেস মেহরব বলল,,

‘এই প্রথম কেউ এই মন্ত্রীকে সঠিক কথা বলছে। মন্ত্রী দেখে যে ভাব যেন সে প্রধানমন্ত্রী।

মেহরব চৌধুরী হেঁসে বললেন,,

“হুম সেই জন্য এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার জন্য আফসোস হচ্ছে।”

সবাই আরো একবার হেঁসে উঠলো। মেহবিন কে দেখে মাইশা বলল,,

‘এই যে মেহু তুই কি জামাইয়ের পোশাকেই থাকবি। নাকি চেন্জ করবি।”

এই কথা শুনে তাজেল বলল,,

“এইগুলা পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালার ড্রেরেস হেই জন্যই তো কই এতো বড় ক্যা।”

তাজেলের বলার ভঙ্গিতে সবাই আরো একবার হাসলো। মেহবিন মুচকি হেঁসে তার নেত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটা ওর জীবনে না আসলে বোধহয় অনেক বেশি কিছু মিস করতো সে।

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪০(বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন মুচকি হেঁসে তার ড্রেস নিয়ে চেন্জ করে এলো। তার আগে মাছ মাংস সব ভিজিয়ে রেখে গেল। মিসেস মেহরব চৌধুরী রান্না করবেন। আদর উঠে দেখলো তাজেল মেহরব চৌধুরীর কোলে তা দেখে ও নেমে বলল,,

‘এই তুমি আমার দাদুর কোলে উঠেছো কেন?”

তাজেল একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“উঠছি তো কি হইছে তোমার দাদুর কোল কি খইসা পরছে।”

‘এগুলো কিরকম কথা।”

“এগুলো এমনই কথা। আমি উঠি নাই তোমার দাদুই আমারে কোলে নিছে।”

“এখন নামও আমার দাদুর কোলে আমি শুধু উঠবো।”

“উঠো আমার কি ডাক্তার তুমি কোনে?”

বলেই তাজেল নেমে গেল। আদর আর সবাই ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহবিন আসলেই ও বলল,,

‘ আজ আর পরা লাগবো না আমি বাড়ি গেলাম।”

‘কেন তুমি তো একেবারে খেয়ে দেয়ে যাবে।”

“মেলা দেরি হইবো আমি স্কুলে যামু।”

‘আজ স্কুলে যেতে হবে না। আজ তুমি আমার সাথে থাকবে। ওরা খেয়ে দেয়েই চলে যাবে।”

“স্কুলে না যাইতে তুমি কইতেছো? আল্লাহ কি কও তোমার শরীর ঠিক আছে? সত্যি তুমি কইতেছো?”

“হুম আমি বলছি আজ সারাদিন আমি তোমার সাথে থাকবো।”

“ক্যান?”

“এমনিই।”

তাজেল দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“আচ্ছা আমি এহন বাড়ি গেলাম পরে আসমুনি।”

‘না থাকো তুমি।”

‘আমার নতুন মানুষ ভাল্লাগে না শরম করে ।”

‘ তাই নাকি নেত্রী তবে শরম পায়।”

“ধুরু তুমি না ডাক্তার আমি গেলাম।”

বলেই তাজেল দৌড়। তখন মেহবিন একটু চিৎকার করে বলল,,

‘খাবার খেয়ে যেও কিন্তু নেত্রী আজ বিয়ে বাড়ির খাবার আছে তোমার পছন্দের।”

তখন তাজেল থেমে বলল,,

“দুপুরে খামুনি তারা যায়া নিক।”

বলেই ও হাওয়া মেহবিন ঘরে আসলো। তখন আদর ওকে বসতে বলল। ও বসলেই আদর ওর গলা জড়িয়ে ধরলো আর বলল,,

‘তোমাকে অনেকগুলা মিস করেছি মনি।”

‘তাই বুঝি মনিও তোমায় মিস করেছে।”

“এই পাকা মেয়ে তোমার বন্ধু হলো কিভাবে? আমায় কি বলল জানো?”

বলেই আদর সব খুলে বলল। তখন মেহরব চৌধুরী বললেন,,

“আমি ওর মাঝে তোকে দেখতে পাই মেহু।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘আমিও ওর মাঝে আমার ছোটবেলার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। তবে যাই হোক না কেন আমি ওর ভবিষ্যৎ আমার মতো হতে দেব না। ”

“এখনো এখানেই থাকবি?”

“দেখি তবে বেশি দিন না আর কিছু মাস থাকবো। সব মিটিয়ে তারপর এখান থেকে চলে যাবো তোমার হাসপাতালে জয়েন করবো যেটা তুমি মায়ের নামে খুলেছিলে।”

‘হুম!”

মেহরব চৌধুরী আর কিছু বললেন না রান্না শেষ হলে ওনারা সবাই একসাথে খেলেন। তারপর একটু সময় কাটিয়ে যার যার মুখ ঢেকে চলে গেলেন। মিহির ফোন করে গাড়ি এনেছিল ওরা গাড়ি করে চলে গেল। কেউ ওদের চিনতে পারলো না তাই দেখলেও কিছু বললো না। ওনারা চলে গেলে মেহবিন তাজেলদের বাড়ি গিয়ে ওকে নিয়ে এলো। মেহবিন বলল,,

“আজ কিছু খেলবো নেত্রী। দুজনে মিলে কি খেলা যায় বলো তো?”

“তুমি হাসপাতালে গেলা না ক্যান?”

‘ছুটি নিয়েছি সকালে। আমার হাতে তো ব্যান্ডেজ আমি এই হাত দিয়ে কিছু করতে পারবো না তাই।এখন বলো কি খেলা যায়।”

“সবাই তো স্কুলে গেছে সবাইরে নিয়া আজ বরফ পানি খেলা যাইতো। দুইজন যহন তাইলে কুতকুত খেলাই নাইলে খুঁটি মুচি?”

“খুটি মুচি কি?”

‘ঐ যে ছোট ছোট তইলা পাতিলায় মিছিমিছি রান্না করে ঐগুলা।”

“ওহ আচ্ছা রান্না বাটি।”

“তারমানে শুদ্ধ ভাষায় রান্না বাটি।এই নামডা রাখলো কেরায় বাটি কি রানদে নাকি। এই তোমাগো শুদ্ধ ভাষার নামগুলো সব ফাউল একটারও মিল নাই‌।”

“তা তোমার খুটিমুচি মিল আছে নাকি।”

‘না থাকলো তাও আমাগোডাই সুন্দর। এহন কি খেলবা কও।”

“চলো কুতকুত খেলবো আমি কখনো খেলি নি।

‘আইচ্ছা!”

তাজেল একটা চারা এনে কোটের দাগ কাটলো। তারপর শিখিয়ে দিল কিভাবে খেলতে হয়। মেহবিন খুব তাড়াতাড়ি শিখে গেল। প্রথমে চারা মারতে হয় তারপর একপা উঠিয়ে কুতকুত বলে দম নিতে হয়। মেহবিনের খেলাটা ভালো লাগলো। ওরা দুজনে মিলে খেলতে লাগলো। ওদের কুতকুত খেলতে দেখে কিছু মানুষের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মিশু এসেছে মেহবিনের কাছে ওকে আসতে শুনে সব ইয়াংস্টাররাই এসেছে সেই সাথে নাফিয়া মারিয়া আলভিও । মুখর ছুটি নিয়েছিল আগেই তাই সেও এসেছে ‌। সবাই বলেছে ওর বাড়ির সাথে সাথে গ্ৰাম ও ঘুরবে। ওরা দুপুরেই ঢাকা ফিরে যাবে তাই এখন এসেছে। ওদের খেলতে দেখে ‌ মিশু পেছন থেকে বলল,,

“ফুল?”

মেহবিন আর তাজেল পেছনে তাকালো। ওদের সবাইকে দেখে মেহবিন একটা মুচকি হাসি দিল। যা দেখে আরবাজ আর মিশুর ভেতরটা পুরতে লাগলো। মেহবিন বলল,,

“আরে সবাই আমার মতো নগন্য একজনের বাড়িতে। আসুন ভেতরে আসুন।”

সবাই ভেতরে ঢুকলো মেহবিনের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে মিশু ওর হাত ধরে বলল,,

‘তোর হাতে কি হয়েছে ফুল?”

“তেমন কিছু না । এসো বসো না তোমরা।”

মেহবিনের কথা শুনে ও আর কিছু বললো না। তখন মুখর বলল,,

“আমরা একটু গ্ৰাম দেখতে চেয়েছিলাম মিশু বলল এখানে আসবে তাই আমরাও চলে এলাম। তারপর গ্ৰামটাকেও না হয় দেখবো।”

“ভালো এখন ভেতরে চলুন।”

সবাই ভেতরে গেল। মিশু সুযোগ বুঝে মুনিয়া আর নিসাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। এখন শুধু আরবাজ, মিশু, মুখর, মারিয়া, নাফিয়া আর আলভি। মেহবিন তাজেলকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মেহবিন ওদের সামনে নাস্তা দিয়েছে। হুট করেই নাফিয়া বলল,,

“কালকে যা,

নাফিয়াকে বলতে না দিয়ে মেহবিন বলল,,,

“কালকেরটা কালকে চলে গেছে সেই বিষয়ে কথা না বলাই উত্তম আমি চাই না তোমরাও বলো। আর নাফিয়া আপু তোমার যদি মনে হয় তোমার হবু বরকে মেরে আমি ভুল করেছি তাহলে তুমি ভাবতে পারো তবে এই বিষয়ে আমার একটুও অনুশোচনা নেই আর আমি এর জন্য দুঃখিতও না।”

“না মানে উনি ইচ্ছে করে তোমার হাত ধরেনি?”

এটুকু শুনে মেহবিন বুঝতে পারলো। ওরা অন্যকিছু গল্প বানিয়ে বলেছে। তাই ও বলল,,

“বললাম তো আমি কিছু শুনতে চাই না। সেসব থাক না।

তখন আরবাজ বলল,,

“আমার ডক্টর মেহবিন এর সাথে একটু কথা আছে তোমরা সবাই একটু বাইরে যাবে।”

তখন মেহবিন বলল,,

‘আমি আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ। এখানে নেত্রী আছে আমি চাচ্ছি না কোন সিন ক্রিয়েট করতে। কাল যা হয়েছে আমি ভুলে গেছি আপনিও ভুলে যান।

এইটুকু আলভির দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘বিয়ের জন্য অনেক শুভকামনা আলভি ভাইয়া। ”

সবাই বুঝতে পারলো মেহবিন সে বিষয়ে কথা বলতে চাইছে না। তাই মুখর প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,,

‘আর শুভকামনা বেচারা মন্ত্রীর মেয়ের সাথে ঠিক ভাবে করা বলতেও পারে না।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“মন্ত্রীর মেয়ে কি খুব ব্যস্ত থাকে আলভি ভাইয়া?

আলভি মুচকি হেসে বলল,,

“দু’জনেই বিজনেস করি দিনশেষে দু’জনেই বেশ টায়ার্ড হয়ে পরি। ও ভিশন ঘুমকাতুরে তাই বলেছে এসব রাত জেগে কথাবার্তা একদম পোষাবে না। বিয়ের পর চুটিয়ে প্রেম করবে নাকি জামাইয়ের সাথে।”

কথাটা শুনে মেহবিন হাসলো তখন তাজেল মেহবিনকে টান দিল মেহবিন নিচু হতেই তাজেল ফিসফিস করে বলল,,

‘ডাক্তার এহন পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা রে কি পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা কওয়া যাইবো।”

মেহবিন ও ফিসফিস করে বলল,,

‘কেন বলে কি করবে?”

“ওহ হো তুমি আগে কও কওয়া যাইবো নাকি।’

“যাবে।”

তখন তাজেল হেঁসে জোরে বলল,,

‘পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা তুমি আমার সাথে আইসো তোমার সাথে কথা আছে।”

হুট করে তাজেলের কথায় সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। মুখর হেঁসে বলল,,

‘বাহ নেত্রীর তাহলে আমার দিকে নজর পরলো।”

‘তুমি এমনে কথা কও ক্যা আমার শরম করে তো।”

‘আরে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম নেত্রী আমায় দেখে শরম পায়।”

‘হ আইসো তুমি।”

তাজেল হাঁটা ধরবে এমন সময় মুখর হেঁসে ওকে কোলে তুলে নিল। আর বলল,,

“কি এমন কথা যে আলাদা করে বলতে হবে চলো যাই।”

তাজেল কোলে নেওয়ার জন্য কিছু বলতে পারলো না।মুখর চলে গেল। তখন নাফিয়া বলল,,

“ও চিনে মুখর কে?”

‘হুম এদের গল্প না হয় পরে জেনে নিও আপু। এখন খাও তোমরা। তোমরা তো কিছু নিচ্ছো না।”

‘তোমার হাতের এই অবস্থা কি করে হলো বলো তো? এই অবস্থা খাওয়া দাওয়া রান্না করা সব ঝামেলার হবে তো।”

“হবে না নেত্রী আছে তো ঠিক তার ডাক্তারকে সামলে নেবে।”

‘এর কথাই কি বলেছিলে কাল।”

“হুম!”

“মেয়েটা বেশ।”

“হুম।”

এদিকে তাজেল ওকে বাইরে নিয়ে বলল,,

“তুমি তো পুলিশ তাইনা?”

“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”

‘হুনো কাইল ডাক্তার চেয়ারম্যান বাড়ি গেছিল। আর ঐহান থিকা হাতে ব্যান্ডেজ নিয়া আইছে। এহন তোমার কাম ডাক্তাররে কষ্ট দিছে কিরা যার জন্য হাতের এই অবস্থা তারে ধরা আর জেলে ঢুকান আর শাস্তি দেওয়া।”

তাজেলের মুখে এরকম কথা শুনে মুখর স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা এমন কেন? তার ডাক্তারকে কেউ কষ্ট দিতে পারবে না এই কথাই যেন সে বলছে। মুখর হেঁসে বলল,,

‘আমার শাস্তি দিতে হবে না নেত্রী। তোমার ডাক্তারই তারে শাস্তি দেবে।”

‘তাই নাকি ঐ শামীমরে যেমনে দিছিল?’

‘কি জানি হয়তো তার থেকেও কঠিন কিছু অথবা মাফ ও করে দিতে পারে।”

“ক্যান?”

‘জানিনা তুমি কি শুধু এই কথা বলতেই এনেছো?”

“হুম এহন ঘরে নও।”

‘হুম চলো।”

ওরা ঘরে চলে এলো। তাজেল গিয়ে মেহবিনের কোলে বসলো। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ওরা বেরিয়ে এলো। আরবাজ শুধু অসহায় চোখে সব দেখলো কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। সারাদিন তাজেল মেহবিনের সাথেই ছিল। দুপুরে খায়িয়েও দিয়েছে সে মেহবিন মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। এমনকি রাতে থাকবে বলেছে মেহবিন বলেছে দরকার নেই থাকার। কাল সকালে আবার আসতে। তাজেল আর জেদ করেনি। রাতে বারান্দায় দরজায় তালা দেবে এমন সময় একজন দৌড়ে এসে দরজা ধরলো। মেহবিন তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এটা কে তাই ও বলল,,

“এখানে কেন এসেছেন শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ?”

আরবাজ ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো আর দরজা আটকে দিল। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“এসব কি ধরনের অভদ্রতা।”

আরবাজ অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,,

‘কথা আছে ফুল বোস!”

মেহবিন শান্ত চোখে ওর দিকে তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। আরবাজ ওকে একটা চেয়ারে বসালো। মেহবিন অন্যদিকে ঘুরে বসলো। আরবাজ আস্তে আস্তে করে মেহবিনের সামনে গিয়ে পায়ের কাছে বসলো তারপর বলতে শুরু করল,,

“ক্ষমা চাওয়ার কোন মুখ নেই আমার তবুও বলবো আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইনি ফুল। আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি চাইনি ঐ তিক্ত কথাগুলো তোকে বলতে। আমি তো রেগে গিয়েছিলাম তখন বাবাকে নিয়ে ঐ কথাটা শুনে।

মেহবিন শান্ত ভাবেই বলল,,

“রাগের মাথায় সবাই সত্যি কথাই বলে।রেগে গেলে মানুষ নিজের ভেতরে থাকা সামনের মানুষটার প্রতি যে মনোভাব সে সেটাই প্রকাশ করে। আপনি চলে যান আমি কিছু শুনতে চাই না শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ।

‘তুই যা শাস্তি দিবি আমি মাথা পেতে নেব। তবুও দূরে সরিয়ে দিস না ফুল।”

মেহবিন আরবাজের দিকে তাকালো তারপর একটা মুচকি হেঁসে বলল,,

“বুলেটের আঘাতের থেকেও কোন আঘাত আমাদের বেশি যন্ত্রনা দেয় জানেন? কথার আঘাত। আপনি জানেন? সত্যি আমি মায়ের মৃত্যুর কারন ।

কথাটা শুনে আরবাজ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মেহবিনের দিকে। মেহবিনের ঠোঁটে মুচকি হাঁসি। মেহবিন আবার বলল,,

“জানেন আমি আমার মাকে সঠিক সময় হাসপাতালে নিতে পারি নি। এটা ডাক্তার বলেছিল যদি আরো আগে হাসপাতালে নেওয়া হতো তাহলে হয়তো মা বেঁচে থাকতো। এখন বলুন তো হলাম না মায়ের মৃত্যুর কারন?”

কথাটা শুনেই আরবাজের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। মেহবিন আবারও বলল,,

“আপনি জানেন সেই ছোট্ট সাত বছরের বাচ্চাটা হাসপাতালে নেওয়ার পরও তার মায়ের হাত ধরেছিল। এক মুহুর্তের জন্যও ছাড়েনি। ডাক্তার কতো বলেছিল সরে যেতে কিন্তু সে যায় নি। অতঃপর তার মায়ের জ্ঞান ফিরলো তখন সেই ছোট্ট মেয়েটা মায়ের কথা মতো তার বুকে শুলো। তার মা তাকে অনেকগুলো কথা বলল সে সব মনোযোগ দিল। অতঃপর সে বলল তার ঘুম পাচ্ছে তার মাকে ঘুমাতে বলল কারন তার মায়ের ঘুমানো প্রয়োজন সাথে মেয়েটারও ঘুম পাচ্ছিল। তাই তার মাকে কথা বলতে বারন করে ঘুমাতে বলছিল। তার মা তার কথা শুনেছে ঘুমিয়েছিল কিন্তু একেবারের জন্য। মেয়েটার কথা শুনেই সে ঘুমিয়েছিল। তাহলে এখন বলুন তো হলাম না মায়ের মৃত্যুর কারন?

এবার আরবাজ একটু শব্দ করেই কেঁদে উঠলো। মেহবিন মুচকি হাসলো তা দেখে আরবাজের কান্না বেড়ে গেল তা দেখে মেহবিনের হাসিটা যেন আরো প্রসারিত হলো। মেহবিন মুচকি হেঁসে আবার বলল,,

“জানেন মেয়েটা তার মায়ের বুকে শুয়েছিল কারো টেনে উঠানোতে তার ঘুম ভাঙলো। তার মনে হলো সে কোন স্বপ্ন দেখে উঠেছে সামনে তাকাতেই দেখলো তার মায়ের মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে। সে দৌড়ে সেখানে গেল আর আটকালো কারন তার মা মুখ ঢেকে ঘুমাতে পারতো না। ডাক্তার জানালো তার মা আগেই মারা গেছে সে নাকি তার মৃত মায়ের বুকেই শুয়েছিল এতোক্ষণ। সে মানতে নারাজ তার মায়ের বুকে নাকি ঢিপঢিপ আওয়াজ হয় সেটা শোনা মেয়েটার খুব পছন্দ ছিল। সে বলল তার মায়ের বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ হয় সে রোজ শুনে। এখনো হবে এই বলে মেয়েটা জোর করে তার মায়ের বুকের ওপর শুয়ে পরলো। অনেকক্ষণ যাবৎ খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো কিন্তু শুনতেই পেলো না। তখন সে বলল তার মাকে ইনজেকশন দিয়ে ঠিক করতে যাতে তার মা চোখ খুলে আর তার মায়ের বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ হয়। তখন ডাক্তার তাকে খুব করে বোঝালো তার মা মারা গেছে। মেয়েটার সে কি তার মাকে আঁকড়ে ধরে কান্না। তার একটাই কথা সে তার মাকে কোথাও যেতে দেবে না। অতঃপর জানেন মেয়েটাকে সব নার্স ডাক্তাররা জোর করে মায়ের থেকে আলাদা করে দিল।

এইটুকু শুনে আরবাজ মেহবিনের হাত ধরলো। মেহবিন সেদিকে না তাকিয়ে আবার বলল,,

“তারপর মেয়েটা হুট করেই শান্ত হয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর সে জানতে পারলো তার মা সিঁড়ি থেকে পরে গিয়ে মারা যায় নি। তার মাকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছিল। কথাটা শুনে মেয়েটা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর যখন শুনলো এখন মেয়েটাকেও মারা হবে। কথাটা শুনতেই মেয়েটা দিক বেদিক ভুলে দৌড়ালো। একটা সময় দৌড়াতে দৌড়াতে দেখলো রাস্তার উল্টো পাশে তার বাবাকে। তার বাবাকে দেখেই মেয়েটা তার বাবাকে ডাক দিল। কিন্তু মেয়েটার বাবা মনে হয় ডাকটা শুনলো না। মেয়েটা রাস্তা পার হতে নিল তখন একটা গাড়ি এসে মেয়েটাকে ধাক্কা মারলো। মেয়েটা প্রথমে তার বাবার দিকেই তাকালো কিন্তু তার বাবা তাকে দেখে এগোলো না ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটা তার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একটা সময় অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর সে নিজেকে পেল হাসপাতালে তারপর থেকেই তার জগত আলাদা।

কথাগুলো শুনেই আরবাজ হাওমাও করে মেহবিনের হাত ধরে কেঁদে উঠলো কিছুক্ষণ পর শক্ত হয়ে বলল,,

‘মাকে মেরে ফেলা হয়েছিল?”

মেহবিন বলল,,

‘হুম তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল কারো স্বার্থপরাতর কাছে তাকে বিলীন হতে হয়েছিল।”

‘কে সেই ব্যক্তি তুই শুধু নাম বল। আমি তাকে কঠিন শাস্তি দেব আমার মায়ের খুনীকে আমি কঠিন শাস্তি দেব। তার সাথে আমার বোনের জীবনকে যারা এরকম গড়ে তুলেছে আমি তাদের কাউকে ছাড়বো না। তুই শুধু নাম বল ফুল।তাদের কঠিন শাস্তি হবে।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘আমি না বললে কখনো জানতেন আপনি যে আপনার মাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। আপনি তো জানতেন আমি আপনার মায়ের মৃত্যুর কারন।”

কথাটা শুনেই আরবাজ স্তব্ধ হয়ে গেল। ও অসহায় কন্ঠে মেহবিনের হাত ধরে বলল,,

“আমায় শাস্তি দে ফুল। আমি ক্ষমার অযোগ্য তুই আমায় শাস্তি দে। তবে আমি বুঝতে পারি নি আমি তোকে এতটা আঘাত করে ফেলবো।আমি জানতাম না আমার ফুল সেদিন এতটা কষ্ট পেয়েছিল। ঐ আরিফা জামান আর আরিফ জামানের কথায় আমি প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিলাম তাই তোকে ওগুলো বলে ফেলেছি। ওনারা বলেছিল বাবা তোকে এই কারনে খোঁজে নি কারন বাবা তোকে মায়ের মৃত্যুর কারন মনে করে তাই নিয়েই আমি ভিশন ডিস্টার্ব ছিলাম। তখন রাগের মাথায় ওগুলো বলেছি যেভাবেই হোক বলেছি তুই আমায় শাস্তি দে ফুল। আমি কথা দিচ্ছি তুই যা শাস্তি দিবি আমি মাথা পেতে নেব। তবুও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকিস না তুই শাস্তি দে ফুল।

সবশুনে মেহবিন বলল,,

“যদি শাস্তি পাওয়ার জন্য এখানে আসেন শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ তবে আপনি ভুল আমি আপনাকে কোন শাস্তি দেব না। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনি আমার থেকে শাস্তি নয় ক্ষমা পেয়েছেন। এখন আপনি আসতে পারেন শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ।”

এতো সহজে ক্ষমা করে দেওয়ায় আরবাজের কেন যেন বুক চিড়ে কান্না এলো । এর থেকে কঠোর শাস্তি দিলেও বোধহয় এতটা কষ্ট হতো না। এতো সহজে ক্ষমা ওর জন্য নয়।ও অসহায় চোখে বলল,,

‘ফুল!”

‘আপনি এখন আসতে পারেন শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ। আমার শরীরটা খুব একটা ভালো নয় আমি ঘুমাবো।”

‘আমি!”

‘যেতে বলেছি আপনাকে। না আমি এখন এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো।”

এ কথা শুনে আরবাজ অসহায় চোখে তাকিয়ে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে মেহবিন বলল,,

“আমার মা আমাকে একটা কথা বলেছিল তোমাকে কেউ আঘাত করলে তাকে অবশ্যই শাস্তি দেবে। তবে সবসময় মারামারি করে নয় মাঝে মাঝে এমনভাবে শাস্তি দেবে যেন সে সে নিজেই নিজের চোখ না মেলাতে পারে। শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ আপনি তো খুব সহজে আমার থেকে ক্ষমা পেয়ে গেলেন কিন্তু নিজের কাছ থেকে পাবেন তো। আপনার অবস্থা দেখে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে তবে উর্দুতে। যদি উর্দুতে বলি তাহলে হলো,,,

Mere Apne Mujhe Dard de Usko Hum Aise Nhi Jane de te. Hum to hat Nhi uthate or Mafi bhi De dete. Per Nazro Se Gira De te Hai.

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৩৭+৩৮

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩৭
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

আছিয়া খাতুন হুট করেই মেহবিনের হাত ধরলেন। হুট করে ধরায় ও একটু অবাক হলো। তবুও বলল,,

‘কিছু বলবেন?”

আছিয়া খাতুন মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ দুটো ছলছল করছে তা দেখে মেহবিন বলল,,

“কি হয়েছে দাদিজান?”

‘আমি বোধহয় অনেক বড় একটা ভুল কইরা ফালাইছি নাতবউ।”

নাতবউ শুনে মেহবিন একটু থমকালেও পরক্ষনেই নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,,

“কি ভুল করেছেন? আর হঠাৎ করে আজকে কেন মনে হচ্ছে আপনি ভুল করে ফেলেছেন।”

“আমি আজ তোমায় সব,,

তখন আচংকা মুখর এলো এসেই বলল,,

“মেহু তোমায় আরবাজের বাবা ডাকছে?”

হুট করে ওর আসাতে মেহবিন আর আছিয়া খাতুন দু’জনেই চমকে উঠলো। মেহবিন বলল,,

‘আসছি দাদিজানের সাথে কথা শেষ করে।”

‘উনি এখনি যেতে বলেছে।”

‘নাতবউ তুমি যাও।”

আছিয়া খাতুনের কথায় মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“কোথায় আছেন চেয়ারম্যান সাহেব?”

“ঐ তো সদর দরজার সামনে দেখো।”

মেহবিন তাকিয়ে দেখলো ওখানেই আছে। মেহবিন সেদিকে গেল। সদর দরজায় কেন যেতে বললো না মেহবিন বুঝলো না। মিশু আর মেহবিনের কথা বলার পরে মুনিয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সব স্বাভাবিক করে নেয়। তার সাথে সবাই ও স্বাভাবিক হয়। মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,

“আমায় ডাকছিলেন চেয়ারম্যান সাহেব।”

শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“হুম চলুন বাগানে যাই।”

‘আপনার ছেলের এঙ্গেজমেন্ট এর অনুষ্ঠান চলছে চেয়ারম্যান সাহেব। এখানে আলাদা করে বাগানে আমার সাথে কথা বলা খুব একটা ভালো চোখে দেখা যায় না।”

“আমি আর পারছি না।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“সব জেনেশুনেই আপনি আপনার পথ বেছে নিয়েছিলেন চেয়ারম্যান সাহেব। তবে আজ কেন?”

“আমার বুকে বড্ড যন্ত্রনা হয় আজকাল তেমন সহ্য করতে পারি না।’

‘আপনার তো সবাই আছে তাও যদি এইরকম অবস্থা হয় তাহলে ভাবুন আমার কি অবস্থা হয়। তবে আমি দুর্বল নই চেয়ারম্যান সাহেব।
যে দূর্বল সে অল্প আঘাতেই ঘায়েল হয় কিন্তু যে মেন্টালি অনেক শক্ত সে যতই ক্ষতবিক্ষত হোক তার দূর্বলতা প্রকাশ পায় না সেই হিসেবে সে ঘায়েল ও হয় না।

কথাটা শুনে শেখ শাহনাওয়াজ এর চোখ ছলছল করে উঠলো। তখনি বাইরে হুট করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। হুট করে বৃষ্টিটা বোধহয় কেউ আশা করেনি। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আপনার কথায় বাগানে গেলে এখন ভিজে যেতাম চেয়ারম্যান সাহেব।”

এমনিতেও দূরে দেখে কেউ কিছুই শুনতে পাচ্ছে না তার ওপর ঝুম বৃষ্টি সেদিকের কোন কথাই ভেতরে যাচ্ছে না। চেয়ারম্যান সাহেব মেহবিনের কথায় কথা পাল্টালো না। তিনি তার প্রসঙ্গে থেকেই বললেন,,

“আপনি এতো কঠিন কেন? আমি তো আপনার মতো নই।”

“আপনার যে অবস্থা সেটা আপনি ডিজার্ভ করেন।”

“এতটাও কি আমার প্রাপ্য!”

“যদি বলি হ্যা।”

তখন আরবাজ এলো ওখানে এসে বলল,,

‘না এতটা তার প্রাপ্য নয়।”

তখন মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘আপনিও আপনার বাবার দেখানো পথেই হাঁটছেন। যদি খুব একটা ভুল নাই হই আপনিও শেখ শাহনাওয়াজ এর মতো একই অতীত পুনরাবৃত্তি করবেন।”

মেহবিনের কথায় আরবাজ বুঝতে পারলো ও কি বুঝাতে চাইছে। তাই ও বলল,,

‘”বাবাকে নিয়ে আর একটা কথাও বলবি না তুই।”

“কেন এখানে মিথ্যের কি দেখলেন আপনি। আর তুই তোকারি করছেন কেন আপনি?

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘এসব কি হচ্ছে আরবাজ তুমি এরকম ব্যবহার করছো কেন?”

“ও কি বলছে তুমি শুনতে পাচ্ছো না।”

“আমি সব শুনতে পাচ্ছি। তবে এটাও বুঝতে পারছি এখানে আমার অগোচরে কিছু হয়েছে তার ইঙ্গিত বারবার দিচ্ছে সে।”

তখন মেহবিন বলল,,

‘কিছু না চেয়ারম্যান সাহেব আপনি এখান থেকে চলে যান। আমার উনার সাথে কিছু কথা আছে।”

“না আমি কোথাও যাচ্ছি না আরবাজ তুমি এখানে থেকে যাও।”

“চেয়ারম্যান সাহেব আপনাকে কি বললাম আমি। আপনি এখান থেকে যান উনার সাথে কথা আছে আমার।”

মেহবিনের দৃঢ় কন্ঠে বলা কথাটা শুনে শেখ শাহনাওয়াজ চলে গেলেন। তখন মেহবিন বলল,,

“নাফিয়া আপুকে খুব ভালোবাসেন তাই না?”

হুট করে এমন প্রশ্নে আরবাজ একটু চমকালো তবুও শান্ত হয়ে বলল,,

“হুম।”

‘তার হাত কখনো ছাড়বেন না তাই না।”

“আমৃত্যু পর্যন্ত না।”

‘যদি কোনো এমন পরিস্থিতি আসে যা সামলাতে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”

‘দরকার পরে নেব তবুও নাফিয়ার গাঁয়ে একটা আঁচ লাগতে দেব না।”

“শুনে ভালো লাগলো। আসছি তাহলে?

‘আপনি কি কোন কারন নিয়ে ভয় পাচ্ছেন ?”

“হুম একটু তো হচ্ছে কে জানে শেখ বাড়ির অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না।”

“তা কোনদিন ও ঘটবে না। যাই হোক না কেন সেই অতীতের কখনো পুনরাবৃত্তি হবে না।”

“আরিফা জামান কিন্তু শেখ শাহনাওয়াজ কে কম ভালো বাসেনি। তবুও তার স্বার্থপরতার জন্য আরেকজন কে শেখ শাহনাওয়াজ এর সাথে জড়াতে হয়েছে।”

“না তবুও এইসব কিছুই হবে না।”

“তার গ্যারান্টি আপনি দিতে পারবেন না‌। কারন শেখ শাহেনশাহ তার বংশবৃদ্ধির জন্য একজনকে ঢুকিয়ে ছিল তিনিও কিন্তু খারাপ মানুষ নন। কে বলতে পারে শেখ শাহনাওয়াজ ও এমন করবে না। শেখ বাড়ির সব মানুষ কিন্তু স্বার্থপর । তাদের স্বার্থপরতার জন্য কখনো কখনো অনেক দাম দিতে হয়েছে।”

“বাবার নামে কোন কথা বলবি না তুই।”

“কেন বলবো না? না বলার কারন কি?

‘দেখ আমি তোকে ভালোমতো বলছি।”

“আপনার বাবা একটা স্বার্থপর মানুষ।”

“তিনি স্বার্থপর কিভাবে হলেন?”

“সেটা না হয় আপনার বাবার থেকেই জেনে নিয়েন।”

“না আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চাই।”

“তার একটা স্বার্থপরতার কথা যদি বলি তাহলে আপনি। আপনাকে পাওয়ার জন্য তিনি আরেকজন কে নিজের সাথে জড়িয়েছিলেন।”

‘মেহু!”

“একদম চিৎকার করবেন না চিৎকার করলেই সত্য পাল্টে যাবে না।”

“বাবা মাকে ভালোবাসতো।”

‘আচ্ছা মেনে নিলাম তাহলে বুকে হাত দিয়ে বলুন তো তাকে বিয়ে করেছিল কিসের জন্য ভালোবাসার জন্য নাকি তার ওয়ারিসের দরকার ছিল। যেই আপনি আছেন তখন তাকেও আর দরকার নেই সেই সাথে আরেকজনকেও।”

আরবাজ মেহু বলে হাত ধরলো কিন্তু মেহবিনের দিকে তাকাতেই সে হাত নামিয়ে ফেলল। দূর থেকে সবাই দেখছে ওর হাত ধরার কারন কিছুই বুঝতে পারলো না কেউ। কারন কেউ কিছু শুনতেই পাচ্ছে না। আরবাজ কিছু একটা ভেবে বলল,,

“একদম না জেনে কোন কথা বলবি না। মায়ের মৃত্যু তে সবথেকে কিন্তু সেই ভেঙে পরেছিল তুই ছিলিস না। তুই থাকবি কি করে তুই তো পালিয়ে গিয়েছিলি।

কথাটা শুনেই মেহবিনের হাত শক্ত হয়ে এলো। তখন আরবাজ বলল,,

‘আমার কি মনে হয় জানিস মায়ের মৃত্যুর কারন তুই। তাই বাবা তোকে খোঁজেনি। সবাইকে বলেছে মায়ের ওখানে গিয়ে তোকে কোথাও পায় নি। এই জন্য বাবা তোকে আমাদের মতো তুমি করে ডাকে না। এই জন্যই বাবা তোকে ঘৃনা করে আর তোর দিকে তাকিয়ে কথা বলে না।

মেহবিন নিজেকে যথআসম্ভব সামলে বলল,,

“শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ মুখ সামলে কথা বলুন।”

‘কেন এখন কেন? আমি তো মনে হয় বলেছিলাম এখন তো মনে হচ্ছে তুই সত্যিই মায়ের মৃত্যুর কারন।”

মেহবিন এবার নিজেকে সামলাতে পারলো না। ও আরবাজের নাক বরাবর ঘুষি মেরে দিল। আর বলল,,

‘আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে এসব বলার।”

“আমাকে মারলে সত্যি মিথ্যে হয়ে যাবে না।”

মেহবিন আরেকটা ঘুষি মারলো এবার আরবাজ মাটিতে পরে গেল। প্রথম ঘুষির সময়ই সবাই চমকে দরজার দিকে তাকিয়েছিল। আরেকটা ঘুষি মারতেই সবাই ও দিকে এগিয়ে যেতে নিল। তার আগে শেখ শাহনাওয়াজ তিনি আসেপাশেই ছিলেন। তিনি সকলকে নিষেধ করলেন সেখানে যেতে তিনি যাচ্ছেন। কেউ যেন ওখানে না যায়। তিনি আলাদা কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন বলেই সবাইকে মানা করলো
তাই কেউ ওদিকে এগুলো না। মেহবিন আরবাজের কলার ধরলো আরেকটা ঘুষি মারবে তখন শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের হাত ধরে চিৎকার করে বললেন,,

‘ডক্টর মেহবিন মুসকান আপনার সাহস হয় কি করে আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার।”

মেহবিন রেগেই শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘যেভাবে উনার সাহস হলো আমার সম্পর্কে বলার। হাত ছাড়ুন আপনি আমার একদম আমাকে ছুঁবেন না। আমাকে ছোঁয়ার কোন অধিকার নেই।”

কথাটা শুনে তিনি বললেন,,

‘শান্ত হোন আপনি।”

মেহবিন হাত ঝাড়া দিয়ে বললেন,,

‘হাত ছাড়তে বলেছি আমি।”

মেহবিনের কথায় সকলেই চমকে উঠলো। আর কিছু না শুনলেও মেহবিনের এই চিৎকার টা জোরেই ছিল তাই সকলের কানে পৌঁছেছে। এতটাই জোরে ছিল যে শেখ শাহনাওয়াজ ও চমকে ওর হাত ছেড়ে দিলেন।আরবাজ ও চমকে গেছে ও ভাবেই নি এখানে এরকম কিছু হবে ও উঠে দাঁড়ালো। এদিকে মেহবিনের ঝাড়ি শুনে তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন,,

“মুসকান।”

কথাটা মেহবিনের কানে যেতেই মেহবিন শান্ত চোখে ওনার দিকে তাকালো। ওর একটু আগের কথা মনে পরে মায়ের মৃত্যুর পর ওর এই উনিশ বছরে প্রথমবার চোখ ছলছল করে উঠলো ও শেখ শাহনাওয়াজ খুব কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে বলল,,

“আমার দিকে তাকিয়ে আপনি কেন কথা বলতে পারেন শেখ শাহনাওয়াজ। কি করেছেন আপনি আমার সাথে? শুনেছি মানুষ কারো সাথে অন্যায় করলে নাকি তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। আপনিও তেমন নাকি আপনি আমায় ঘৃনা করেন।

শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন কারন তিনি সেদিনের পর কখনোই ওর চোখে পানি দেখেনি। তবে আজ কেন সে কি খুব কষ্ট পেয়েছে। মুহুর্তেই তার চোখ দুটো ভিজে উঠলো সেই সাথে গড়িয়েও পড়লো। আর কথাগুলো যেন তার বুকে আরো বেশি আঘাত করছে। তিনি বললেন,,

“মুসকান আম্মা কি হয়েছে আপনার? আপনি ,,

তিনি আর কিছু বলতে পারলো না তার আগে মেহবিন মুচকি হাঁসি ফুটিয়ে বলল,,

“আচ্ছা আপনি আমায় তুমি করে কেন বলেন না । আপনার বাকি ছেলেমেয়েদের মতো। আরে বলবেন কি ভাবে আমি তো আপনার বউকে মেরে পালিয়ে গিয়েছিলাম তাই না। এই জন্যই কি আপনি আমায় খুঁজেন নি সবার কাছে হারিয়ে গেছি বলে ঘোষনা করেছেন। এই কারনেই ঘৃনায় আপনি আমার দিকে তাকাতে পারেন না তাই না।”

চোখে পানি মুখে অদ্ভুত মুচকি হাঁসি এটা দেখে একটা মানুষের কিরকম অনুভুতি হওয়া উচিত। এতোক্ষণ যে মানুষটা মেহবিন কে নিয়ে বলছিল সেই মানুষটাও মেহবিনের কথা শুনে থমকে গেল । সে তো জানে না কি হয়েছিল আন্দাজে কয়েকটা কথা বলেছিল সে কিন্তু এখন বুঝতে পারছে তার মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে। সব শুনে শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“মুসকান আম্মা এসব কি কথা বলছেন আপনি?”

“একটু আগে এই কথাগুলোই শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ আমাকে বলেছেন।

মেহবিনের চোখের পানি গড়াতেই মেহবিন তাতে হাত দিয়ে বলল,,

‘সেদিনের পর আমার চোখে কোনদিন পানি ছলছল করেনি । তাহলে আজ কেন? না না আমার চোখের পানি কেউ দেখতে পারবে না। মা বলে গেছে আমায় না কাঁদতে।”

বলতে বলতেই মেহবিন এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে চলে গেল। পেছন থেকে শেখ শাহনাওয়াজ ডাকতে লাগলো

“মুসকান আম্মা দাঁড়ান।”

বলতে বলতে তিনিও বেরিয়ে গেল। মেহবিন দৌড়ে একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়ালো। বারবার ওর পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ছে। চোখ দু’টোও বারবার ঝাঁপসা হয়ে আসছে‌। ও গাছে ধরে বলল,,

‘না মুসকান তোমার কান্না মানায় না। তুমি তো সবার মতো নও। তোমার মা বলেছে তুমি princess। আর Princess Doesn’t Cry … একদম কাঁদবে না তুমি।”

তবুও বারবার কান্নারা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ও গাছে ইচ্ছে মতো ঘুষি মারতে লাগলো। আর চিৎকার করে বলতে লাগলো,,

‘মা! মা! কোথায় তুমি তোমার প্রিন্সেস কে দেখতে পাচ্ছো আজ। আজ তার ভাই তাকে বলেছে আমি তোমার মৃত্যুর কারন।”

বলেই আরও জোরে জোরে ঘুষি মারতে লাগলো গাছে। হাত দুটো থেঁতলে যাচ্ছে এতে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই। তখনি কেউ মেহবিন কে শক্ত করে ধরে জড়িয়ে ধরে বলল,,

‘আম্মা শান্ত হোন আপনি।”

মেহবিন তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। সে আবারও ধরলো আর বলল,,

‘প্লিজ আপনি শান্ত হোন নাহলে আপনার ক্ষতি হবে।”

মেহবিন আবারো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,,

“একদম না শেখ শাহনাওয়াজ আপনি আমায় ধরবেন না। আপনি আমার মায়ের খুনীদের জেনেও কোন শাস্তি দেন নি। আপনার আমাকে ছোঁয়ার কোন অধিকার নেই। আপনার জন্য আমি নীড়হীন আপনার জন্য আমি এতিম হয়েছি । আমার জীবনের সবকিছুর জন্য আপনি দায়ী।”

‘আমার কথাটা শুনুন?”

‘কি শুনবো আমি? কি শুনাবেন আপনি? আপনি কি আপনার প্রথম স্ত্রীর আর বাবার হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন। আপনি আমার মাকে ধোঁকা দিয়েছেন।”

“আমি আপনার মাকে অনেক ভালোবাসি মুসকান?”

‘না ভালোবাসেন না আপনি? যদি বাসতেন তাহলে এর একটা বিহিত আপনি করতেন কিন্তু আপনি তা করেন নি।”

‘আমি আপনাকে আর আপনার মাকে দুজনকেই অনেক ভালোবাসি আমি। সেই জন্যই আপনাকে আমি দূরে রেখেছিলাম।”

‘আমি আর কিছু শুনতে চাই না। চলে যান আপনি আমার কাউকে দরকার নেই। আমার কাউকে লাগবে না। চলে যান এখান থেকে আপনাকে আমার একটুও সহ্য হচ্ছে না চলে যান আপনি। যেভাবে তখন ছেড়ে দিয়েছিলেন এবারো ছেড়ে দিন। আর এই মেহবিন মুসকান কখনো আপনার আর আপনার বাড়ির ত্রী সীমানায় পা রাখবে না। আর হ্যা ভুলেও আমার পেছনে আসার চেষ্টা করবেন না নাহলে আমার চেহারাও কোনদিন দেখতে পাবেন না আপনি।”

বলেই মেহবিন দৌড়ে চলে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ ওখানেই দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। যা উনার জীবনে কোনদিন হয় নি। তিনি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,,

“আমাকে মাফ করে দিও মেহের। আমাদের সবথেকে প্রিয় আদরের কলিজাকে আগলে রাখতে পারি নি। আমি একজন ব্যর্থ পিতা মেহের। আমাদের মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে আজ মেহের। আজ তার চোখে পানি এসেছে তোমায় ভেবে নিশ্চয়ই তার ভয়ঙ্কর অতীত তার চোখে ভাসছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি কিছুই করতে পারছি না। আমায় মাফ করে দিও তুমি। তোমার ভালোবাসার মর্যাদা আমি রাখতে পারি নি।”

মেহবিন বেরিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে যাতে ওর পিছু কেউ না নিতে পারে। কিন্তু শেখ শাহনাওয়াজ বুঝতে পেরেছিলেন তাই তিনি ওর পেছনেই আসে। ওনাদের বের হতে দেখে মুখর দৌড়ে আসে ও কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে ও নিজেও বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে যায়। কিন্তু ও রাস্তা খুঁজে পায় না কোন রাস্তায় গিয়েছে।আর বাড়ির সবাইকে বলে এখানে থাকতে। সবাই একপ্রকার থমকে গেছে কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। এতক্ষন যে মানুষ টা থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিল সে হলো আরবাজ মিশু এসে ওর হাত ধরতেই ও মিশুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো আর বলতে লাগলো,,

‘আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি মিশু।”

“বাবা আর ফুল কোথায় গেল বাজপাখি?”

কথাটা কানে যেতেই ওর মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো। ও দৌড়ে বেরিয়ে গেল। এদিকে কি হচ্ছে এখানে কিছুই কেউ বুঝতে পারছে না। মিশু নিজেও আরবাজের পেছনে বের হলো আজ আর কোন ভয় কাজ করছে না ওর ভেতরে। ওরা বেরিয়ে গেল কিন্তু পেছনে বাড়ির ভেতর রেখে গেল একঝাঁক প্রশ্ন।

রাত সেই সাথে ঝুম বৃষ্টি রাস্তায় কাক পক্ষি কেউই নেই। মেহবিন পাকা রাস্তায় বসে পরলো আর চিৎকার করতে লাগলো। উনিশ বছরের যতো কষ্ট আছে আজ সব যেন চিৎকারের মাধ্যমেই বের করতে চাইলো। ঝুম বৃষ্টি দেখে কেউ ওর বুকফাটা আর্তনাদে ভরা চিৎকার শুনতে পেল না। দুই জায়গায় দুই বাবা মেয়ের আর্তনাদের সাথে কি প্রকৃতিও চলতে চাইছে তাই তো থামার নাম নিচ্ছে না।

~ চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩৮
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

শেখ শাহনাওয়াজ আর মেহেরুন নিসা ছিলেন ক্লাসমেট। দুজন দুজনের সাথে চোখাচোখি হতো মাঝে মাঝে একটু কথাও হতো দুজন দুজনকে পছন্দ করতো। শেখ শাহনাওয়াজ ভেবেছিলেন পড়াশোনা শেষ করে তারপরে মেহেররুনিসার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। মেহেরুননিসার পরিবার ছিল শিক্ষিত মার্জিত ও রাজনৈতিক পরিবার। রাজনীতি পছন্দ করতো না বলে মেহেরুননিসা তার পরিবারের সাথে থাকতো না‌ হলে থাকতো। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই শেখ শাহেনশাহ তার বন্ধুর মেয়ে আরিফা জামান কে পছন্দ করে তার ছেলের জন্য বিয়ে ঠিক করেন। তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। বাবার বাধ্যগত সন্তান আর যেহেতু ঠিক করে ফেলেছে আবার মেহেরুননিসা কে মনের কথা জানানোও হয় নি। সবদিক বিবেচনা করে শেখ শাহনাওয়াজ দেখলেন ওনার বাবার কথা মেনে নেওয়া ছাড়া পথ নেই। তাই তিনি না করতে পারলেন না। পড়াশোনা চলাকালীন তৃতীয় বর্ষে থাকতেই উনার বিয়ে হয়ে গেল। বলা বাহুল্য তিনিও শেখ শাহনাওয়াজ এবং মেহেরুননিসা ও ডাক্তারি পরছিলেন। ছেলের জন্যই শেখ শাহেনশাহ এস.এস. হাসপাতালটি খুলেছিলেন। শেখ শাহনাওয়াজ এর বিয়ের কথা শুনে মেহের ভেতরে ভেতরে অনেক ভেঙে পড়ে কিন্তু ওপরে বুঝতে দিতে চায় না। কিন্তু এই বিষয়ে তারই বা কি করার যেখানে শেখ শাহনাওয়াজই কিছু বলছেন না। আরিফা জামান আর শেখ শাহনাওয়াজ এর বিয়ে হয়। শেখ শাহনাওয়াজ সব ভুলে তার দায়িত্ব পালন করছিলেন। মেহের এর থেকে মন সরিয়ে আরিফার দিকে দিয়েছিলেন। এভাবেই একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তৈরি হয় তাদের। আরিফা জামান বাচ্চার চেষ্টা করেন কিন্তু হয় না অতঃপর তিনি ডক্টরের শরনাপন্ন হলে তিনি জানান আরিফা জামান কখনো মা হতে পারবে না। ব্যস এতেই তিনি অনেক ভেঙে পরেন। এদিকে শেখ শাহনাওয়াজ এর পড়াশোনা শেষ হয়ে যায়। শেখ শাহনাওয়াজ ও মেহেরুননিসা এস.এস. হাসপাতালের ডাক্তার হন। মেহেরুননিসা চাইতেন শেখ শাহনাওয়াজ এর আশেপাশে থাকতে তাই তিনিও শেখ হাসপাতালের ডাক্তার হন। আরো একটা বছর কেটে যায় কিন্তু আরিফা জামান নিজেকে শান্ত করতে পারে না এরপর শেখ শাহেনশাহ তিনবেলা সমানে বলেন তার ছেলে ওয়ারিস চাই। তার বংশ এগিয়ে নেওয়ার জন্য। আরিফা জামান সহ্য করতে পারলেন না। একদিন তো বলেই ফেললেন তিনি শেখ শাহনাওয়াজ কে আবার ও বিয়ে করাবেন। শেখ শাহেনশাহের সাথে তিনি কথা বললেন। ওয়ারিসের জন্য তিনি শুনেই রাজি হয়ে গেলেন। শেখ শাহেনশাহ এই জন্য দুই তিন জন মেয়েও দেখলেন ব্যস হয়ে গেল ।

আরিফা জামান কোন ভাবে শেখ শাহনাওয়াজ যে মেহেরুননিসা কে পছন্দ করতেন এটা জানতে পারেন। তিনি শেখ শাহনাওয়াজ কে মেহেরুননিসার সাথে কথা বলতে বলেন। শেখ শাহনাওয়াজ ও মেহেরকে মনে মনে ভালোবাসতেন তাই রাজি হয়ে যায়।তখনও মেহেরুননিসা তার পছন্দের মানুষ কে পায়নি বলে অবিবাহিত ছিলেন। মেহরব চৌধুরীর বাবা বা তিনি ও কখনো জোর করেনি তবে ছেলে দেখেছিলেন কোনটাই ঠিকঠাক হচ্ছিল না এই জন্য বিয়ে হয় নি। তবে শেখ শাহনাওয়াজ প্রস্তাব টা রাখবেন কি না এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। তিনি এমনিই মেহরব চৌধুরীর বাড়ি যান। তিনি নিজে সাহস যুগিয়ে কিছু বলতে পারলো না চলে এলো। আরিফা জামান কে জানালে তিনি পরের দিন মেহেরের হাসপাতালে গেল ওর সাথে কথাবার্তা বললো একটা পর্যায়ে বলেই ফেলল কথাটা। তিনি না করে দিলেন একসময় যতোই পছন্দ করুক না কেন স্বার্থের জন্য তিনি কোন সম্পর্কে জড়াবেন না। আরিফা জামান জানান তিনি তার সকল দায়িত্ব পালন করবেন। তবুও তিনি রাজি হলেন না।

কিন্তু বিয়ে নিয়ে মেহেরুননিসা আর আর ওনার বাবার মাঝে এক সময় তর্কবিতর্ক হয় তাদের কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে তিনি রাগে সিন্ধান্ত নিলেন তিনি শেখ শাহনাওয়াজ কে করবেন।এই জন্য বলা হয় রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত কখনো সঠিক হয় না। তিনিই মানা করেছিলেন কিন্তু তার বাবার জন্য তিনিই আবার রাজি হলেন। এটা অবশ্য শেখ শাহেনশাহ আর আরিফা জামান লাগিয়েছিলেন তিনি মেহের কিছু কথা ওনার কানে তুলেছিলেন। এই জন্য তিনি রেগে মেয়ের সাথে বিয়ের কথা তুলেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হয় তার তো কথা খাটেই না উল্টো আরিফা জামানের ফাদে পা দিয়ে মেয়েকে রাজি করেন। পরে অবশ্য বিষয়টা তিনি বুঝতে পারেন।মেহরব চৌধুরী জানতেন মেহের শেখ শাহনাওয়াজ কে পছন্দ করেন তাই তিনি বাঁধা দেন না। অতঃপর মেহেরুননিসা জানান শেখ শাহনাওয়াজ কে বিয়ে করবেন। মেহেরের সাথে শেখ শাহনাওয়াজ এর বিয়ে হয় তখন মেহরব চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। আরিফা জামান প্রথমে হাঁসি মুখে মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে সহ্য করতে পারতেন না। তবুও তিনি সন্তানের আশায় মুখিয়ে ছিল। অতঃপর এক বছর পর আরবাজ আর মিশু হয়। ছেলে হয়েছে এই খুশিতে আরিফা জামান তার নামের সাথে মিলিয়ে রাখেন আরবাজ। এই নিয়ে শেখ শাহনাওয়াজ কিংবা মেহের কিছুই বলে নি। কারন আরিফা জামান এর অনুভূতি বুঝতে পেরেছিলেন। মেহেরুননিসা তার মেয়ের নাম রাখলো মিশুমনি।

বাচ্চা হওয়ার পর থেকে আরিফা জামান শুধু তাদের নিয়েই থাকতেন। এদিকে শেখ শাহনাওয়াজ আগে থাকতেই মেহের কে ভালোবাসতেন বাচ্চা হওয়ার পর থেকে যেন তা ভালোবাসাটা যেন বেড়ে গেল। তা আরিফা জামানের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তবুও তিনি কাউকে বুঝতে দিতেন না। মেহের ও আরিফা জামান কে আপা বলতো তাদের দেখে কেউ বলতেই পারবে না তারা সতিন ছিল বরং তারা দুই বোন ছিল। তার চার বছর পর মেহবিন আসে কোল আলো করে‌। মেহবিন নাম রাখে মেহেরুননিসা আর মুসকান রাখে শেখ শাহনাওয়াজ। তারা দু’জনেই মেহবিন কে আদর করতো সেই সাথে আরবাজ আর মিশু তো আছেই। আরবাজ কে মামনি বলতে শেখালেও আরবাজ কখনো আরিফা জামান কে মামনি বলেনি বড় মা বলেছে কিন্তু মিশু মায়ের কথা শুনে মামনিই বলেছে। আরবাজকে আর মিশুকে এক বছর পর স্কুলে দেওয়া হবে তাই আরিফা জামান শেখ শাহেনশাহ কে বলেন । শেখ শাহেনশাহ নাতি কী গ্ৰামের স্কুলে পরবে নাকি তাদের শহর স্কুলে পড়ানো উচিৎ। এ কথা শুনে তিনিও তাই মনস্থির করেন। উনি এই কারনেই বলেছিলেন যে মেহেরকে তার পছন্দ নয় সে ওনাকে সহ্য করতে পারছিলেন না। তাই সুযোগে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলেন। শেখ শাহনাওয়াজ পরে যান বিপদে ( তখন হাসপাতাল মহুয়াপুর গ্ৰামেই ছিল পরে সেটা অন্য জায়গায় শিফ্ট করা হয় গল্পে এখনো সেটা উল্লেখ করিনি।) তাছাড়া দুই বউ ওনার থাকারও তো একটা সাম্যতা রাখতে হবে। অতঃপর তিনি মনস্থির করেন পনেরোদিন আরিফার কাছে থাকবে পনেরোদিন মেহেরের কাছে। এক কথা শুনে দুজনেই রাজি হয়।

এভাবেই চলতে থাকে সাত বছর। ঢাকায় আসার পর মেহেরুননিসা আরবাজদের ঠিকমতো মানুষ করার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু এই সাত বছরে আরিফা জামান আর মেহেরুন মুখোমুখি খুব কমই হয়েছে। মেহবিন পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছে। বেশিরভাগ সময়ই তার শেখ শাহেনশাহ এর সাথে ঝগড়া লাগতো। আরিফার পেছনেও বড়মা বড়মা বলে লাফালাফি করতো। সবথেকে দুরন্ত বাচ্চা ছিল মেহবিন তবে এই নামটি শুধু তার মা বলতো আর সবাই মুসকান বলতো। এই জন্যই মেহবিন নামটা সবার অপরিচিত। আর ভুলে গেছে সবাই। আরবাজ আর মিশু মেহবিন কে ফুল বলতো। মেহবিনই ছোটবেলায় আরবাজকে নাম দিয়েছিল বাজপাখি। মিশুকে ও সবসময় ফুল আপু বলতো‌। তিন ভাইবোন পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো।

সেবার স্কুল ছুটি বিধায় মিশু আর আরবাজ ওর বাবার সাথে গ্ৰামে আসে। মেহবিন আর ওর মা ঢাকায় রয়ে যায়। মেহবিন পড়ার সময় বলল,,

“আচ্ছা মা বড়মা আমায় বাজপাখির মতো এতো আদর করে না কেন?”

মেহের মুচকি হেসে বলল,,

“মানুষ স্বার্থপর স্বার্থ হাসিল হলে কেউ কারো পরোয়া করে না।”

“তাহলে কি আমিও স্বার্থপর মা? তুমিও কি স্বার্থপর? বাবাও বাজপাখি ফুল আপু সবাই কি স্বার্থপর?”

“তুমি আরবাজ মিশু স্বার্থপর কি না তা এখনো বুঝিনি কারন তোমাদের মাঝে আমি এখনো স্বার্থপরতা দেখিনি। তবে আমি আর তোমার বাবা স্বার্থপর। আমরা একে অপরের স্বার্থের জন্য একে অপরের সাথে জড়িয়েছি। আমি জরিয়েছি আমার পছন্দের মানুষটাকে প্রাপ্তির খাতায় রাখবো বলে। আর তোমার বাবা জড়িয়েছে এই তোমাদের কে পাবে বলে।”

“তুমি কি বললে আমি কিছুই বুঝলাম না।”

“তোমার এইটুকু মাথায় এতকিছু বোঝাতে হবে না পাকুন্নি। শুধু একটা কথা মাথায় রাখবে মেহবিন তোমার জন্য যেন কারো কখনো ক্ষতি না হয়। সবসময় যেন ভালো হয়।

“আচ্ছা। আজ তো কেউ নেই চলো আমি আর তুমি মিলে কানামাছি খেলবো।”

“এই রাতে?”

“আমাদের বাড়ি কি অন্ধকার নাকি যে রাত দিন আলাদা করতে হবে চলো তো তুমি।”

“তোমার কুসুম আপু ( কাজের মেয়ে)কোথায়? ওকেও ডাকো তিনজনে একসাথে খেলবো।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

মেহবিন তাকে গিয়ে নিয়ে এলো। অতঃপর তিনজনে মিলে কানামাছি খেললো। রাতে খাবার দাবার সেড়ে নয়টার দিকে ওরা শুতে গেল মেহবিন দুষ্টুমি করছিল ওর মায়ের সাথে। শেখ শাহনাওয়াজ ফোন করলে তারা দুজন সবার সাথে ফোনে কথা বলে। ফোন রেখে মেহবিন কে শুয়াবে এমন সময় তখন কুসুম নিচে ডাক দিল তিনি মেহবিন কে শান্ত হয়ে বসে থাকতে বলল। তিনি মেহববিনকে চুপচাপ শুয়ে থাকতে বলে বের হন।। মেহের সিঁড়ির কাছে আসতেই কুসুম মেহেরের হাত ধরে বলল,,

“আপনার সময় ফুরাই আইছে কিছুজনের আপনারে এক ফুটাও সহ্য হয় না।”

বলেই দিল ধাক্কা। উনি ব্যাথাতুর আওয়াজ করতে করতে একদম নিচে চলে যায়। এদিকে মেহবিন মায়ের আওয়াজ পেতেই দৌড়ে আসে। সিঁড়ির কাছে আসতেই ও দেখলো ওর মা নিচে পরে আছে মাথা দিয়ে রক্ত পরছে। ও “মা; বলে চিৎকার করে নিচে নামলো তারপর কুসুম কে ডাকতে লাগলো কিন্তু পুরো বাড়িতে কেউ নেই মনে হলো। তিন চার মিনিট পর তখনি আল্লাহ বলে কুসুম এলো। মেহবিন বলল,,

“কুসুম আপু তাড়াতাড়ি মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

সে বলল,,

“তুমি খাড়াও আমি তো নিতে পারুম না ড্রাইভাররে আর দারোয়ান রে ডাইকা নিয়া আসি।”

কুসুম যেতেই মেহবিন ওর মায়ের হাত ধরে বলল,,

“তোমার কিছুই হবে না মা আমরা হাসপাতালে যাবো।”

উনি কিছু বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। শুধু মেয়ের কান্না দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর কুসুম এলো দুজনকে নিয়ে অতঃপর হাসপাতালে নেওয়া হলো ততক্ষণে মেহের অজ্ঞান হয়ে গেছে। মেহবিন ওনার হাত ধরে রইল এক মুহুর্তের জন্যও ছাড়লো না। ডাক্তাররা কতো বলল তবুও মেহবিন জেদ ধরে মায়ের হাত ধরেই রইলো। কিন্তু সব ট্রিটমেন্ট করার পর এতক্ষনে মেহেরের জ্ঞান ফিরে আসার কথা কিন্তু আসছে না দেখে ডাক্তাররা একটু চিন্তিত হলেন। উনারা একটা ইনজেকশন দিলে মেহেরের জ্ঞান ফিরে আসে।প্রথম চোখ খুলেই তিনি দেখতে পান তার সেই ছোট্ট কলিজাটা তার হাত ধরে কাঁদছে। মুহুর্তেই তার মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। তিনি মেয়ের হাত ধরে বলল,,

“মেহবিন?”

মেহবিন মাথা উঁচু করে মায়ের দিকে তাকালো চোখ মুখ ফুলে গেছে ফর্সা চেহারাটা লাল বর্ন ধারন করেছে‌।‌ মেহবিন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“মা তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে।”

“যেখানে আমার মেহবিন আমার সাথে আছে সেখানে কষ্ট কিসের?”

“তুমি জানো মা কুসুম আপু সেই যে গেল আর এলো না।কাউকেই দেখছি না আমি কুসুম আপুকে বলেছি বাবাকে খবর দিতে দিয়েছে কিনা। বাবাও তো এলো না মা।”

“তোমার বাবা খবর পেলে ঠিকই আসবে মেহবিন।”

মেহেরুননিসা মেহবিন কে তার বুকের ওপর শুয়ালেন ডাক্তার নার্স মানা করল তবুও তিনি শুনলেন না। মেহেরুননিসা ডাক্তারদের বলল ওখান থেকে চলে যেতে তিনি তার মেয়ের সাথে থাকবেন। তারা চলে গেল। মেহের বলল,,

“মেহবিন?”

মায়ের বুকে শুয়ে শুয়েই বলল,,

“হুম!”

“আমি যা বলবো একদম মন দিয়ে শুনবে। আর আমি যখন থাকবো না তখন আমার এই কথাগুলো মনে রাখবে।”

“তুমি কোথায় যাবে মা আমি তোমায় যেতেই দেব না। তোমার বুকে না শুলে তো আমার ঘুমই আসে না। তোমাকে ছাড়া আমি ঘুমাবো কিভাবে? তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে।”

“আল্লাহ চাইলে থাকবো তো মা।এখন মন দিয়ে শুনো।

এই দুনিয়ায় কেউ কারো না সবাই নিজেদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে একটা সময় ছুড়ে ফেলতে পারে। নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করবে যাতে কেউ তোমাকে তার স্বার্থের জন্য কাজে লাগাতে না পারে। এই দুনিয়ায় মুখোশধারী ভালোবাসার অভাব নেই। তবে সবার আগে তুমি মানুষ চিনতে চেষ্টা করবে কে কেমন সহজেই কাউকে বিশ্বাস করবে না। তুমি নিজেকে ভালোবেসো আর নিজের ওপর সবসময় বিশ্বাস ভরসা রেখো আর আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ভরসা করে চলবে জীবনে ধোঁকা খাবে না। নিজের দূর্বলতা কারো কাছে প্রকাশ করবে না তাই কেউ তোমার দূর্বলতা জানবে না আর আঘাত ও করতে পারবে না। যতো যাই হয়ে যাক না কেন কখনো কাঁদবে না। কারন কান্না মানুষ কে দূর্বল করে দেয়। আর কাদলে কি কখনো সব ঠিক হয়ে যায় নাকি হয়না তো তাহলে শুধু শুধু চোখের পানি ঝড়িয়ে কি লাভ। কেউ তোমার সাথে অন্যায় করলে তাকে তুমি অবশ্যই শাস্তি দেবে তবে সবসময় মারামারি করে নয় মাঝে মাঝে এমন ভাবে দেবে সে নিজেই যেন নিজের চোখে চোখ রাখতে পারে না। যাতে সে নিজেই বুঝতে পারে সে কি ভুল করেছে। আর যদি তাও না বুঝে তাহলে তুমি তাকে কঠিন শাস্তি দেবে যেটা তোমার মনে চায় তবে কখনো অন্যায়ভাবে নয়। আমি জানি তুমি বুঝতে পারবে কখন কাকে কিভাবে শাস্তি দিতে হবে। নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করবে তোমাকে ছুঁতেও যেন কেউ দশবার ভাবে।

তুমি থাকবে মুক্ত বিহঙ্গিনীর মতো বিহঙ্গিনী বুঝোতো মেয়ে পাখি। তুমি থাকবে বিহঙ্গিনীর মতো তার নিজের মর্জির মালিক সে নিজে থাকবে। একটু অবাধ্য হবে অন্যের মন যুগিয়ে চলার জন্য কিছু করবে না। কারো মনমতো হওয়ার তার কোন দায় থাকবে না। সে থাকবে তার নিজের মতো। তার কাছে তার আত্মসম্মান সবার ওপরে থাকবে। সে এতটাই শক্ত থাকবে যে কেউ সহজে তাকে ভাঙতে পারবে না। নিজের পায়ের তলার মাটি সবসময় শক্ত রাখবে যাতে চাইলেও সহজে তোমার পায়ের তলার মাটি সরিয়ে না ফেলতে পারে। কখনো অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করবে। তোমার চোখের সামনে কেউ যেন অন্যায় করে পার না পায়‌। সবসময় মাথা ঠান্ডা রাখবে ঠান্ডা মাথায় কিভাবে সব সামাল দেওয়া যায় সেটা ভাববে। তাড়াহুড়ো করে কোনদিন সিদ্ধান্ত নেবে না। আর রাগের মাথায় তো কোনোদিন ও না। কারন রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত গ্ৰহন করলে সেই সিদ্ধান্ত কখনো সঠিক হয় না। তার প্রমান আমি নিজেই।কেউ কিছু বললে সাথে সাথেই তার জবাব দেবে না। এক মিনিট সময় ব্যয় করে তারপর জবাব দেবে দেখবে জবাব পাল্টে গেছে আর তুমি তাকে এমন একটা জবাব দিয়েছো যার প্ররিপেক্ষিতে সে আর কিছুই বলতে পারছে না। নিজেকে খুশি থাকার উপায় নিজেই খুঁজবে সর্বদা হাসিমুখে সব সামাল দেবে। কারো কথা ভেবে বা দুই কথা শুনে ভেঙে পরবে না। নিজেকে শক্ত ভাবে তৈরি করবে। জীবনে যাই হোক না কেন কেউ যেন বিহঙ্গিনী কে বুঝতে না পারে। নিজের চারপাশে একটা গন্ডী টানবে সবাইকে বিশ্বাস করতে সময় নিবে। যেখানে তোমার অসম্মান হবে সেই স্থান ত্যাগ করবে।

আর এটা মনে রাখবে তোমার জীবনে যা হবে তা তকদিরে লেখা ছিল যাই হোক না কেন কখনো আফসোস করবে না। আল্লাহর ওপর ভরসা আর তাওয়াক্কুল রাখবে। কারন কেউ তোমার সাথে না থাকলেও ঐ একজন সবসময় তোমার সাথে থাকবে। সবশেষে যারা তোমায় নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসবে তাদের নিজের সবটা উজাড় করে ভালোবাসবে। তোমার দ্বারা যেন অন্যের ভালো ছাড়া ক্ষতি না হয়। অন্যায়ের জন্য কঠোরতা রাখলেও মন থেকে যেন কোমলতা হাঁড়িয়ে না যায়। অসাধারণ ব্যক্তির অধিকারী হবে তুমি। যাকে কেউ ভাঙতে পারবে না। নিজেকে আগুনের ন্যয় তৈরি করবে যাকে ছোয়া তো দূর কাছে আসতেও যেন আশংকা সে যেন ঝলসে না যায়। অতঃপর যাই হোক না কেন তুমি বাঁচবে প্রানখুলে। তোমাকে বাঁচতে হবে আমার জন্য।

সবশুনে মেহবিন অনেক কিছুই বুঝতে পারলো আবার কিছুই বুঝতে পারলো না তেমন করে। তবুও সে মায়ের কিছুটা বুঝতে পেরে ও বলল,,

“আমি সব করবো মা তুমি শুধু আমার সাথে থেকো।”

মেহেরুননিসার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। এতোক্ষণ খুব কষ্ট করে শান্ত ভাবে মেয়েকে কথাগুলো বলেছিল। তিনি বললেন,

‘আল্লাহ চাইলে থাকবো মা। আমি সবসময় তোমার সাথে থাকবো।”

“হুম আর কোন কথা বলো না মা। ডক্টর আন্টি বললো না বেশি কথা না বলতে। তুমি এখন ঘুমাও কুসুম আপু মনে হয় বাবাকে ফোন করেছে বাবা এসে পরবে মা।”

‘হুম তুমিও ঘুমাও মা অনেক রাত হয়ে গেছে।”

‘হুম।”

“মেহবিন?”

“হুম!”

“আমি তোমায় অনেক ভালবাসি মেহবিন। হয়তো সবসময় আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো না। কিন্তু তুমি মনে রেখো তোমার মা তোমায় অনেক ভালোবাসে। আর যখন আমাকে খুব মনে পরবে তখন চোখ বন্ধ করে ভাববে আমি তোমার পাশেই আছি।”

“এসব কেন বলছো মা।”

“কিছু না এমনিই।”

“ঘুমাও এখন তুমি। আমার ও খুব ঘুম পাচ্ছে মা।”

“আচ্ছা আমি আর একটা কথাও বলবো না। তুমি ঘুমাও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

মেহেরুননিসা মেয়েকে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। মেহবিন ঘুমিয়ে পরেছে‌। তিনি মাথায় একটা চুমু দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,,

“আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি মেহবিন মা। জানিনা তোমার সাথে থাকতে পারবো কিনা। আরবাজ আর মিশু ঠিক থাকবে কারন তারা শাহের কাছে এখন। কিন্তু তোমাকে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি আমার কিছু করার নেই। এই জন্য ক্ষমা করে দিও আমায়। তোমায় অনেক শক্ত হতে হবে মা। নাহলে ওরা যে তোমায় বাঁচতে দেবে না। কারো কারো স্বার্থপরতার কাছে আমাকে বিলীন হতে হলো কিন্তু আমি চাই না তুমিও হও। অনেক ভালো থাকবে তুমি মা এই দোয়াই করি। সবশেষে ভালোবাসি আমার কলিজা।”

বলতে বলতেই ওনার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। তিনি আস্তে আস্তে চোখ বুঝলেন। ঘন্টাখানেক পর কারো টান পরায় মেহবিনের ঘুম ভেঙে গেল। ও চোখ খুলেই দেখলো ওর মায়ের মুখটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে ডাক্তার। তা দেখে মেহবিন নার্সের কোল থেকে নেমে দৌড়ে এসে বলল,,

“ডাক্তার আন্টি তুমি মায়ের মুখ ঢাকছো কেন? মা তো ঘুমাচ্ছে আর মা মুখ ঢেকে ঘুমাতে পারে না‌। মায়ের দমবন্ধ হয়ে আসে। কাপড় সরাও মুখ থেকে।”

মেহবিনের কথায় ডাক্তারের চোখ ছলছল করে উঠলো। তিনি আজ পর্যন্ত এমন বাচ্চাকে দেখেনি যে সবটা সময় তার মায়ের হাত ধরে বসেছিল। এমনকি মায়ের মৃত্যুর পরও তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল। এই মেয়েটাকে তিনি কি করে বলবেন তার মা ঘুমের মাঝেই চলে গেছেন। আর এতোক্ষণ তার মৃত মায়ের বুকে শুয়ে ছিল। তিনি মেহবিন কে কোলে নিয়ে বলল,,

“তোমার মা একেবারে ঘুমিয়ে গেছে আম্মু। তোমার আম্মু আল্লাহর খুব প্রিয় ছিল তো তাই আল্লাহ তায়ালা তার কাছে নিয়ে গেছে।”

ডাক্তারের কথায় মেহবিন গোল গোল করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল। আর বলল,,

“তুমি মিথ্যা কথা কেন বলছো? একটু আগেও মা আমার সাথে কথা বলছিল কতো কিছু বলছিল। আমি মায়ের বুকের ওপর শুয়ে ছিলাম। মায়ের বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছিলো আমার তো সেটা শুনতে ভালো লাগে। সেই আওয়াজ টা হচ্ছিল তো।”

“আর হবে না আওয়াজ আম্মু ।”

“হবে আমাকে নামাও আমি শুনছি।”

মেহবিন জোর করে নেমে আর মেহেরুননিসার ওপর থেকে কাপর সরিয়ে বুকের ওপর শুয়ে পড়লো আর বলল,,

‘মা দেখো তো ডাক্তার আন্টি কি বলছে তোমার বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ নাকি শোনা যাবে না। আমি তো সবসময় শুনি বলো। একটু আগেও শুনছিলাম।”

মেহবিন চুপ করে ওর মায়ের বুকের বুকের মাঝে লেপ্টে রইলো আর খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো তার মায়ের বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও তখন শুনতে পেল না। তখন ও মাথা উঠিয়ে বলল,,

“ডাক্তার আন্টি দেখো তো মায়ের কি যেন হয়েছে আওয়াজটা হচ্ছে না। ইনজেকশন লাগাও একটা হবে তবে আস্তে দিও মা কিন্ত ইনজেকশন এ ভয় পায়।”

ডাক্তার এখন কেঁদেই দিলেন মেহবিনের কাজে তিনি নিজেকে সামলে বললেন,,

“তোমার মা মারা গেছে আম্মু। ঐ আওয়াজ কখনোই হবে না। তোমার মা তোমায় ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে গেছে।

“কি মারা গেছে?”

“হুম।ওনাকে হাসপাতালে আনতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। যদি আরো আগে আনা হতো তাহলে হয়তো তোমার মা বেঁচে থাকতো।”

এইকথাটা শুনে মেহবিন গোল গোল তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ও মনে মনে আওয়ালো আরো আগে আনলে মা বেঁচে থাকতো। তারপর বলল,,

“উঁহু আমি বিশ্বাস করি না একটু আগেও আমার মা আমার সাথে কথা বলেছিল।

মেহবিন ওর মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আর বলল,,

‘দেখো না মা ডক্টর আন্টি কি বলছে। তুমি নাকি মারা গেছো। তুমি একটু আগে বললে আমার সাথে সবসময় থাকবে। তাহলে তাছাড়া তোমার বুকে না শুলে তো আমি ঘুমাতেই পারি না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকবো কিভাবে? আচ্ছা মা তুমি উঠছো না কেন আচ্ছা তুমি কি আজ তুমি ডক্টর ডক্টর খেলছো আজ খেলতে হবে না। তুমি তো সবসময় পেশেন্ট থাকো আজ তোমায় থাকতে হবে না। উঠো না মা। তুমি উঠে বলে দাও তুমি আমায় ছেড়ে যাও নি।”

ডাক্তার সামনে এগিয়ে গিয়ে মেহবিনকে উঠানোর চেষ্টা করলো। মেহবিন শক্ত করে ওর মাকে জড়িয়ে ধরলো। টপ ডাক্তার বলল,,

“উঠো আম্মু তোমার মাকে নিয়ে যেতে হবে।”

‘না না আমি মাকে কোথাও যেতে দেব না। মা আমার আমার সাথেই থাকবে।”

এবার মেহবিন চিৎকার করে কেঁদে উঠলো মাকে জড়িয়ে ধরে। যা দেখে ওখানে থাকা নার্স ডাক্তার সবার চোখেই পানি চলে এলো।এক নার্স গিয়ে মেহবিনকে জোর করে ছাড়াতে চাইলো মেহবিন বলল,,

“না আমি মাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। মা আমার সাথে থাকবে।”

ডাক্তার আর নার্স মিলে জোর করে ওকে ছাড়ালো।আর শক্ত করে জরিয়ে ধরলো ডাক্তার। মেহেরুননিসাকে নিয়ে যাওয়া হলো যতোক্ষন পর্যন্ত না মেহবিনের চোখের আড়াল হলো সেই পর্যন্ত ও তাকিয়ে রইল। তাকে চোখের আড়াল করতেই মেহবিন কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। ওর মায়ের কথাগুলো মনে করতে লাগলো। ও চোখ মুছে নিল। হঠাৎ করে এমন হওয়ায় ডাক্তার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর ওখানে কুসুম আসলো ওকে দেখে ডাক্তার চলে গেল।সে মেহবিনকে বলল,,

“তোমার বাবাকে আসতে বলেছি তিনি আসছে। তোমার মা কোথায় মুসকান?”

মেহবিন কোন কথা বললো না চুপ করে বেঞ্চে বসে রইলো। কুসুম তা দেখে অবাক হলো। ওর একটা ফোন আসতেই ও চলে গেল। তারপর একটা কেবিনে ঢুকলো তখন মেহবিনও কেন যেন ওখানে গিয়ে দাঁড়ালো। ও কেবিনে ঢুকবে এমন সময় ও শুনতে পেল একজনের গলা।

“এতোক্ষণ কোথায় ছিলে আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।”

তখন কুসুম বলল,,

“ভয়ের কি আছে এখানে তো ঐ ছোট বাচ্চা ছাড়া পেশেন্ট এর বাড়ির আর কেউ নেই। আর আসবেও না আর যে আসার সে জানেও না এখানে কি হয়েছে। আমি যে ওনাকে বিষ দিয়েছিলাম আগে তিন ঘন্টা পর পর সেই বিষ কাজ শুরু করে। আর সেটা করেছেও মেহেরুননিসা মরে গেছে। কিন্তু আফসোস সেটাও কেউ জানবে না। সেটার রিপোর্ট পাল্টাতে গিয়েই তো আসতে দেরি হয়ে গেল। ঐ ডাক্তার খুব চালাক সে মুসকানের মায়ের ভাব দেখেই টেস্ট করতে দিয়েছিল। সেই টেস্টের আসল রিপোর্ট এলে তো সবাই জেনে যেতো তার মৃত্যু সিঁড়ি থেকে পরে যাওয়ার কারনে হয় নি বিষের কারনে হয়েছে। এখন মুসকানকেও সরাতে হবে। এই মেয়েও খুব ধরিবাজ। এই জন্যই তো স্যার আর ম্যাডাম সরাতে বলেছে।”

‘ঐ বাচ্চা মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগছে। মেয়েটা কতো কাঁদছিল ওকে না মারলে হয় না।”

“না হয়না ঐ মেয়েকে এখন তাদের দরকার নেই। কেন যেন ঐ মেয়েকে তারা সহ্য করতে পারে না তাই তো তাকে মেরে ফেলতে বলেছে। এখন অনেক হয়েছে এখন যাই ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এই হাসপাতাল থেকে বের করতে হবে। বাইরেই গাড়ি রেডি আছে।”

এই সবকিছু মেহবিন আড়াল থেকে শুনলো ওর মায়ের একটা কথা ছিল। অতঃপর তুমি প্রানখুলে বাঁচবে। তোমায় বাঁচতে হবে আমার জন্য। কথাটা মস্তিষ্কে আসতেই ও ওখান থেকে চলে আসলো। ও খুব ভয় পেয়েছে সদ্য মা হারা মেয়ে এখন নিজের বাঁচার তাগিদে দৌড়াচ্ছে। এদিকে কুসুম বাইরে এসে মেহবিন কে খুঁজতে লাগলো। কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করলো তখন একজন বলল বাইরে বেরিয়ে গেছে। মেহবিন দৌড়াতে দৌড়াতে অনেক দূরে এসে পড়লো রাত প্রায় একটা এখন ও রাস্তায় হালকা গাড়ি চলছে। হুট করেই মেহবিন দেখলো ওর বাবা এক হাসপাতাল থেকে বের হচ্ছে। তা দেখেই মেহবিন জোরে ডাক দিল।

“বাবা!

প্রথম ডাকটা শেখ শাহনাওয়াজ এর কানে গেল না। মেহবিন জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। মেহবিন রাস্তা পার হওয়ার জন্য এগুতেই একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগলো ও রাস্তায় পরে গেল। চোখ সামনের দিকে মেহবিন দেখলো ওর বাবা ঠায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর দিকে আসছেও না। তখন গাড়ি থেকে দুজন মানুষ নামলো তারা আর কেউ নয় আলম আহমেদ আর মিসেস সাবিনা। মিসেস সাবিনা ওকে কোলে তুলে নিল মাথা দিয়ে রক্ত পরছে তবুও ওর দৃষ্টি শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে। ওনাকে দেখতে দেখতেই মেহবিন চোখ বুঝলো। চোখ বোঝার আগে একবার অস্ফুট স্বরে বলেছিল “আমার বাবা!’আলম আহমেদ ওকে তাড়াতাড়ি করে সামনের হাসপাতালে নিয়ে গেল। তারপর নিজের বাড়িতে এভাবেই শুরু হয়েছিল মেহবিনের জীবনের আরেকটা অধ্যায়।

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৩৫+৩৬

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩৫
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

রাইয়ের কথায় সবাই ভুত দেখার মতো মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। কারন এতোদিন তো তারা অন্য কিছুই শুনেছিল। কেউ কিছু বলবে তার আগে মেহবিন বলল,,

“আমার পার্সোনাল বিষয়ে আপনারা না ঢুকলে খুশি হবো। আমি যেভাবেই আমার লাইফ লিড করি না কেন? তাতে আপনাদের কিছু যায় আসে না। আর আমি চাইও না আমাকে আমার জীবনের যাপনের ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন করুক। তাই দয়া করে প্রশ্ন করবেন না আর করলেও আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই।”

একথা শুনে রাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মেহবিনের দিকে। তবে এই মুহূর্তে চুপ থাকাই ভালো তাই কোন কথা বললো না। বাকিরা আর কি বলবে মেহবিনের কথা শুনেই মুখ বন্ধ। তখন মেহবিন বলল,,

“কার কি হয়েছে এ বাড়িতে?”

তখন আরিফা জামান বললেন,,

“আসলে নুপুরের মায়ের একটা কিডনি অকেজো ধরা পরেছে সেটারই অপারেশন এর জন্য ওনাকে ডাকা।

“এটা তো ডক্টর নুপুরই করতে পারতেন ? তিনিও তো এই বিষয়ের ডক্টর।

তখন নুপুরের মা বলল,,

“আমার মেয়ে করবে কিভাবে শুনেই তো আমার মেয়েটা আধমরা হয়েছে একটু পর পর কাঁদছে। যদি আমার কিছু হয়ে যায় সেই জন্যই তো আরবাজের সাথে আমার মেয়েটার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তো হলো না।”

মেহবিন নুপুরের দিকে তাকালো দুঃখের কিছুর ছিটেফোঁটাও দেখতছ পেল না মেহবিন। ও বলল,,

“ওহ আচ্ছা। চিন্তা করবেন না রাই খুব ভালো ডক্টর ইনশাআল্লাহ আপনার অপারেশন সাকসেসফুল হবে।”

“ও যে বলল তুমি ওর থেকেও ভালো তাহলে তুমিই করো না।”

“আমি ভালো এর মানে এই নয় যে রাই খারাপ। ওকে সেই সুদূর ইন্ডিয়া থেকে এখানে এনেছেন। আর এখন ভালো পেয়ে গেলেন দেখে ওর কোন মুল্য নেই নাকি। ডেকে এনে অপমান করা বলে এটাকে।”

তখন রাই মেহবিনের হাত ধরে বলল,,

“ধুর আমি কিছুই মনে করিনি। উনারা করাক না তোকে দিয়ে এতে আমি খুশিই আছি।”

“তুই চুপ থাক।”

“যার যার প্রাপ্য মর্যাদা তার পাওয়া উচিৎ। পৃথিবীতে এতো ডাক্তার থাকতে তোকেই কেন সিলেক্ট করলো সেটাও তো ভালোর কথা শুনেছে বলে তাই। আর এখানে এসে তুই বললি আমি ভালো ওমনে আমার কাছে করাতে চাইছে। এটাতে তোর সম্মানহানি হচ্ছে না নাকি। মানুষ কে তার সঠিক মর্যাদা দিতে শিখুন মিসেস ( নুপুরের মা)।”

তখন নুপুরের মা বলল,,

“আমি সেটা মিন করে বলি নি। নিজেকে নিয়ে ভিশন টেনশনে আছি ভয় হচ্ছে তাই আমায় মাফ করে দিন। আমার অপারেশন রাই মালিকই করবেন।”

“হুম বুঝলাম। যাই হোক আসছি আমি।

তখন রাই বলল,,

“আরে দাঁড়া আমিও যাবো তো তোর সাথে!”

“তোর না ফ্লাইট আছে।”

“ক্যানসেল করে দিয়েছি তোর কাছে থাকবো দুদিন।”

“কি!”

“হ্যা এখন কথা না বলে চল তোর বাড়ি।”

“তুই এখন ইন্ডিয়া তোর বাড়ি যাবি আমি রাখবো না তোকে।”

“আমি থাকবো।”

“এখানে কিন্তু তোর ইলাহী রুম নেই সাথে এই আবহাওয়ার সাথে তুই কমফোর্টেবল হবি না। অসুস্থ হয়ে পরবি আমি চাই না দুদিন এখানে থাকতে গিয়ে দশদিন বিছানায় পরে থাকিস।”

“আরে কিছু হবে না তুই আছিস না আমার ডাক্তার বন্ধু।”

“রাখবো না তোকে তাছাড়া দাদান দিদান চিন্তা করবে না।”

“আরে কেউ কিছু করবে না দাড়া ফোন দিচ্ছি বুড়োবুড়িকে।”

“রাই!”

“সরি সরি দাদান দিদান কে।”

রাই ফোন দিল মেহবিনের কথা শুনেই তারা রাজি সাথে বলল ওর কাছে দিতে। মেহবিন ফোন ধরে সালাম দিল ওর রাইয়ের দাদা দাদি রাইয়ের থেকেও বেশি ড্রামাবাজ এখন বলছে তারাও নাকি আসবে। তা শুনে মেহবিন বলল,,

“তোমরা কি রাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে পাগল হলে নাকি। তোমাদের আসতে হবে না তোমার নাতজামাই পেয়ে গেলে আমিই চলে যাবো তোমাদের ওখানে।”

কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দিল মেহবিন তখন রাই ভ্রু নাচিয়ে বলল,,

“এবার এবার!

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“হুম চলুন এখন!”

শেখ পরিবার বলবে কি ওদের দিকেই এতোক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। রাই আর মেহবিন বের হবে। তখন রাইফা বলল,,

“আপনারা দুজন কি বেস্ট ফ্রেন্ড?”

তখন রাই পেছনে ফিরে হেঁসে বলল,,

“না বেস্ট ফ্রেন্ড না কারন মেহবিন বেস্ট ফ্রেন্ড নামক শব্দটাকে সহ্য করতে পারে না। তবে আমাদের সম্পর্কের নাম দেওয়া যেতে বন্ধু কম বোন বেশি।”

মেহবিন পেছনে ঘুরলো না ঘুরলে হয়তো দেখতে পেত অন্য কিছু। মেহবিন যাচ্ছে দেখে রাই ও পেছনে দৌড় দিল। বাকিরা শুধু দেখেই গেল। তবে সবার মনেই প্রশ্ন রয়েছে কিন্তু করতে পারলো না। রাইফা শান্ত চোখে মেহবিন কে যেতে দেখল তারপর সে নিজেও আস্তে আস্তে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। নুপুরের বাবার এই অবস্থায় নুপুরের মা অসুস্থ তাই ওনাকে এখানে আনা হয়েছে। এখানেই থাকবে এখন থেকে কিছুদিন। থাকাটা যাতে পার্মানেন্ট হয় এই জন্য মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। অবশ্য মেয়েও দুই পায়ে রাজি।
______________

“ডাক্তার তুমি আবার এই আপদ টারে পাইলা কই?”

তাজেলের কথা শুনে মেহবিন ওর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো। তখন রাই বলল,,

“এই তুমি আমাকে আপদ বলছো কেন?”

“আপদ কওয়া ভুল হইছে তোমারে বিপদ কওয়া দরকার আছিল।”

“কি হয়েছে নেত্রী সে কি করেছে?”

“কি করে নাই আমি কুলসুম রাস্তায় হাঁটতে ছিলাম। হেয় গাড়ি থামাইয়া জিগাইলো চেয়ারম্যান বাড়ি কোন দিকে আমরা কইয়া দিলাম আর হেয় যাইয়া আমাগো রাস্তার ধারে রান্দার জন্যে বাদাইল বাইর করুম দেইখা কাটা কলা গাছ রাস্তায় উঠাইছিলাম উনি গাড়ি নিয়া যাওয়ার সময় ধাক্কা মাইরা আবার নিচে ফালাই দিছে আর হেইডা একদম ঝোড়ে গিয়া পরছে। আমি আর কুলসুম ঐডা নিচ থেইকা উডাইয়া দা আনবার গেছিলাম বাড়ি আর ঐডাই নেওয়ার জন্য আসতেছিলাম। হেয় আইসা আমাগো সব কষ্ট বিফলে দিছে।

তখন মেহবিন রাইয়ের দিকে তাকালো তখন রাই বলল,,

“আমার দিকে তাকাস কেন? আমি কি গাড়ি চালাইছি নাকি গাড়ি তো ড্রাইভার চালাইতে লাগছিল। আর কলা গাছের সময় আরেকটা গাড়ি যাচ্ছিল তাই সাইড দিয়ে যাওয়ার সময় লেগে গেছে হয়তো।”

“তুমি কোন কথা কইবা না তুমি গাড়িতে আছিলা মানে দোষ তোমার ।”

“আচ্ছা সরি।”

“তোমার সরিতে কি এহন কলা গাছ হাইটা আমার কোলে আসবো।”

তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো আর বলল,,

“বাদ দাও ও কিছু করে নি নেত্রী। কাল আমার বাড়ির পেছন থেকে তোমায় কলা গাছ কেটে বাধাল বের করে দেব।”

“কাল তো কাটা লাগবো আইজ কাটা আছিল ওই রাস্তার নিচে কাকা কাটছিল।”

“সমস্যা নেই কাল আমি কেটে দেব।”

“আইচ্ছা। দাদি কয়দিন ধইরা বাদাইল বাদাইল করতেছে। হের নাকি বাদাইল ভাজা খাইতে মন চাইছে।”

“এখন তো সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে নাহলে আজই কেটে দিতাম।”

“সমস্যা নাই।”

“হুম এখন গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নাও আর মাগরিবের নামাজ পড়ে পরতে বসো।”

“আইচ্ছা কিন্তু ইডা কিরা হেইডা তো কইলা না?”

“ওর নাম রাই আমার বন্ধু আমার সাথে দু’দিন থাকবে।”

কথাটা শুনে তাজেল এমন লুক দিল যেন ওর চোখ বলছে আমার ভালোবাসায় তুই ভাগ বসাইতে আইছোস তোরে আমি ছাড়ুম না। তাজেল মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আইচ্ছা। তাইলে আমি গেলাম।”

“হুম!”

তাজেল চলে গেল যেতে যেতে পেছনেও তাকালো দুই তিন বার। ও যেতেই রাই বলল,

“ও কে?”

“ওর নাম তাজেল আমি নেত্রী বলি।”

“কেন?”

“সে বিরাট কাহিনী ভেতরে চল।”

“বাধাল কি? মেয়েটা বার বার বলছিল।”

“কলা গাছের ভেতরে থাকে সাদা রঙের শক্ত কাল দেখাবো তোকে। অনেক খোসা ছাড়িয়ে তারপর ভেতরে পাওয়া যায়।”

“ওহ আচ্ছা!”

মেহবিন ওকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ওকে এক সেট থ্রিপিস দিয়ে বলল ফ্রেস হয়ে নিতে। রাই ফ্রেস হয়ে বের হতেই দেখলো মেহবিন কফি চকলেট আর নুডুলস এক ট্রে তে সাজিয়ে রেখেছে। দেখেই রাইয়ের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল।কারন এই তিনটা জিনিসই ওর পছন্দের। ও গিয়ে বলল,,

‘এহসাব মেরে লিয়ে?’

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘নেহি পারোসি কি স্যাহিলি কে লিয়ে।”

‘ইটস্ মিনস মেরে লিয়ে।”

‘ঐ তোর হিন্দি বাদ দে আর চুপচাপ খেয়ে নে।”

“হুম দোস্ত খুব ক্ষুদা লাগছে।”

ও বিছানায় বাবু হয়ে বসে নুডুলসের বাটিটা হাতে নিয়ে আয়েস করে খেতে লাগল আর বলল,,

“এই জিনিসটাই বিগত দেড় বছর আমি খুব মিস করেছি ইয়ার।”

“আমিও মিস করেছি তোর এই ঢং।”

‘হ হইছে এখন জিজুকে কল দাও। এইবার জিজুরে না দেখে আমি দেশে যাইতেছি না।”

‘সে এখানেই আছে কল দিলেই চলে আসবে এতো চিন্তা করতে হবে না। কালকে বিকালে দেখা করিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ।”

‘হুম এখন তুই খাবি নাকি নুডুলস?”

“না আমি কফি খাচ্ছি এই ঠিক আছে। এখন আর কিছু খাবো না।”

‘আইচ্ছা।”

তার কয়েকমিনিট মাগরিবের আজান দিল। মেহবিন ওযু করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিল। ওরা এসে গল্প করতে লাগলো। মেহবিন আর রাই ক্লাসমেট সেই সাথে রাইদের দাদাদাদির বাসায় পেং গেস্ট থাকতো। রাইয়ের মা বাবা নেই দাদাদাদির কাছেই মানুষ। উনাদের বিদেশেও একটা বাড়ি আছে কিন্তু পৈত্রিক বাড়ি ইন্ডিয়ায়। রাইয়ের পড়াশোনার জন্য ওখানেই তিনজনে গিয়েছিল। ছেলে বউমার মৃত্যুর পর দাদাদাদির বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল রাই তাই ওকে কখনো কাছছাড়া করেন না তারা। মেহবিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল যেদিন ও সবকিছু জানলো। যদিও প্রথমে মেহবিন রাইয়ের সাথে সম্পর্ক করতে চায় নি কারন ও বন্ধু বানাতে চায় না। মেহবিন পড়াশোনা ছাড়া রুম থেকেই বের হতো না। অবশ্য মাঝে মাঝে ওর দাদা দাদির সাথে গল্প করতো। কিন্তু রাইকে তেমন একটা সুযোগ দিতো না। রাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তারপর বন্ধু হয়েছে। বন্ধু না হওয়ার আরেকটা কারন ওর নাম রাই। আর ও বেস্ট ফ্রেন্ড নামক শব্দটাকে পছন্দ করে না। অতঃপর আস্তে আস্তে রাই হয়ে উঠে মেহবিনের হাসির কারন। যতো ফালতু কাজ আছে সবগুলো করে মেহবিন কে হাসাতো। অতঃপর মেহবিন ওকে জানায় ওরা কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড নামক শব্দটাকে ইউজ করতে পারবে না। অতঃপর মেহবিন কিছু ঘটনা বলে। রাই তারপর থেকে ঐ শব্দটার ব্যবহার করে না। দুই বান্ধবী অনেক গল্প করলো তারপর ঘুমিয়ে পড়লো। সকাল সকাল তাজেল হাজির হাতে বড় একটা দা নিয়ে। মেহবিন সকালে রাইকেও উঠিয়েছে যদিও রাইয়েই একটু অসুবিধা হচ্ছিলো এখানে খাপখায়িয়ে নিতে। তবুও সে সামলে নিয়েছে তাছাড়া মেহবিন তো আছে। তাজেলের হাতে দা দেখে রাই বলল,,

“তুমি দা হাতে কি করছো?”

তাজেল একটা দাঁত কেলানি দিয়ে বলল,,

‘তোমার ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করুম তো তাই নিয়া আইছি।”

তাজেলের কথা শুনে রাই মেহবিনের পেছনে গিয়ে ওর হাত ধরলো। তা দেখে তাজেল খিলখিল করে হাসলো আর মেহবিন মুচকি হাসলো। তাজেল হাঁসি থামিয়ে বলল,,

“ডাক্তার তোমার বন্ধু তো বুকদা। এই দাও দিয়া কি হেতির গলা কাটা যাইবো ঠিকমতো পোসই লাগবো না।বাদাইল বাইর করুম হের লাইগা এইডা আনছি।”

রাই পেছন থেকে বের হয়ে বলল,,

‘আগে বলবে না হুদাই আমাকে ভয় দেখাইলা।”

“তুমি এই বাচ্চা পুলাপাইন দেইখা ডরাইবা তা কি আমি জানি নাকি। ডাক্তার এহন নও আবার রানবো এহন।”

মেহবিন বাড়ির পেছনে গিয়ে একটা কলাগাছ কাটলো। ওপর থেকে কলা গাছের খোসা ছাড়ালো তখন তাজেল বলল বাকিটা সে ছাড়াবে। কিন্তু পারলো না অনেক শক্ত তাই মেহবিন ওকে খোসা ছাড়িয়ে বাধাল বের করে দিল। অতঃপর তাজেল বাড়ি চলে গেল। আজ শনিবার তাই মেহবিনের হাসপাতাল নেই। ও রাইকে নিয়ে পুরো গ্ৰাম ঘুরলো সাথে তাজেলকেও নিল। রাইয়ের অভ্যাস মেহবিনের সাথে বের হলে ওর হাত ধরে হাঁটবে। এদিকে তাজেলের ও সেইম। রাইকে হাত ধরতে দেখে তাজেলের মন চাইলো এখনি ওকে গিলে ফেলতে মেহবিন কে বলল,,

‘ডাক্তার আমার পাও বিষ করতেছে আমারে একটু কোলে নেও তো।”

তাজেলের কথায় মেহবিন ওর দিকে তাকালো। তাজেল অদ্ভুত ভাবে রাইয়ের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে মেহবিন বুঝতে পারলো আমাদের নেত্রীর জেলাসি। মেহবিন ভেবে পায়না এই মেয়েটা এমন কেন সে মেহবিনের ভাগ কাউকে দিতে রাজি নয়। মেহবিন হেঁসে ফেললো তাজেল দুই হাত উঁচু করে বলল,,

“নিবা না নাকি? না নিলে কইয়া দেও আমি বাড়ি যাইগা আস্তে আস্তে।”

মেহবিন হেঁসে ওকে কোলে নিল। এদিকে বেচারা রাই কি হলো কিছু বুঝতে পারলো না। কিছুদূর যাওয়ার পর তাজেল বুঝলো মেহবিনের একটু কষ্ট হচ্ছে তাই ও বলল,,

‘ডাক্তারের বন্ধু এহন তুমি নেও ডাক্তারের কষ্ট হইতেছে।”

তা শুনে রাই বলল,,

“আমার নিজেরই হাঁটতে কষ্ট হয় তোমাকে কোলে নিয়ে কিভাবে হাটবো আমি?”

“হ তাও ঠিক। তুমি যে চিকনা আমারে নিলে তোমার হাড্ডি মরমর কইরা ভাইঙ্গা পরবো। ডাক্তার আমারে নামাই দেও পায়ে বিষ কইমা গেছে।”

মেহবিন হেঁসে ওকে নামিয়ে দিল। এদিকে রাই তাজেলের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। ওকে এত বড় একটা কথা বলল। ও কিছু বলবে তার আগে মুখর এলো মাস্ক পরে মেহবিন ওর সাথে রাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিল। এক ফাকে মাস্ক খুলে চেহারাটাও দেখিয়ে দিল। কিছুক্ষণ কথা বলে মুখর চলে গেল। মেহবিনরাও বাড়ি ফিরে এলো। রাতে রাইকে মেহবিন তাজেলের ব্যাপারে জানালো তা শুনে রাই হাসলো আর খুশিও হলো এরকম মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। পরের দিন সকালে রাই চলে যাবে কারন এখানে ও মানিয়ে নিতে পারছে না। শহর হলেও একটা কথা ছিল এটা গ্ৰাম মেহবিনই পাঠাচ্ছে ওকে ও আরো তিন-চার দিন থাকতে চাইছিল একেবারে অপারেশন করে যেতে চাইছিল। যাওয়ার আগে তাজেলের গাল টেনে বললো মেহুর থেকেও তাজেলের কর্মকাণ্ড ও বেশি মিস করবে। সাথে এটাও বলল এভাবেই মেহবিন কে ভালোবেসো। রাই চলে গেল পাঁচ দিন বাদে আবার আসবে বাংলাদেশে নুপুরের মায়ের অপারেশন করতে। আরবাজদের হাসপাতালে।

_______________

আরবাজ বসে আছে পুরো শাহরিয়ার পরিবারের সামনে পাশে মুখর। একটু আগেই সে জানিয়েছে নাফিয়ার ব্যাপারে সবাই অবাক হলেও পরে আরবাজের পরিবার আর আরবাজ কে দেখে রাজি হয়েছে কারন সবাই আরবাজকে খুব ভালোভাবেই চেনে। মুখর মাহফুজ শাহরিয়ার কে আগেই বলেছে আরবাজ সব জেনেই এই প্রস্তাব দিয়েছে তাই তিনি কিছু বলেন নি। তবে ব্যাপারটা নাফিয়া জানে না। তখন হুট করে নাফিয়া বলল,,

“আমি ওনার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই।”

আরবাজ নাফিয়ার সাথে ছাদে গেল। ওখানে গিয়ে নাফিয়া বলল,,,

‘দেখুন আপনি হয়তো আমার ব্যাপারে না জেনেই এই প্রস্তাব দিয়েছেন?”

তখন আরবাজ বলল,,

“আমি সবটা জানি মিস নাফিয়া।”

আরবাজের কথা শুনে নাফিয়া ওর দিকে তাকালো। আর বলল,,

‘তবুও আপনি প্রস্তাব দিলেন?’

আরবাজ হেঁসে বলল,,

“পৃথিবীতে বাচ্চাই সবকিছু নয়। সবথেকে বড় জিনিস টা কি জানেন মানসিক প্রশান্তি আর যদি থাকে পছন্দের মানুষটি তাহলে তো কথাই নেই।”

নাফিয়া সেদিনের ছেলেটার কথা ভাবলো সে কি বলেছিল আর আরবাজ কি বলছে। ও বলল,,

‘যদি একটা সময় মনে হয় বাচ্চাটাও একটা বড় ফ্যাক্ট।”

তুমি কিন্তু বাচ্চাটাকে বড় করে দেখছো কিন্তু আমি না। সবথেকে বড় কথা নাফিয়া একটা মানুষ সবদিক দিয়েই পারফেক্ট নয়। তবুও যদি বলো বাচ্চার কথা তাহলে বলবো এখানে ২% চান্স রয়েছে। অনেক সময় ০.৯৯% এও অনেক কিছু হয়ে যায় আর এখানে ২% আছে। তুমি জানো নাফিয়া বহু নবী নিঃসন্তান ছিলেন। হজরত জাকারিয়া (আ.) বার্ধক্য পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন। তাছাড়া আল কুরআন এ সন্তান লাভের জন্য বিশেষ দোয়া রয়েছে। ইনশাআল্লাহ দুজন মিলে আমরা সেগুলো আমল করবো। হযরত মরিয়ম (আ) তিনি তার সময়ে যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ আসে তার জন্য তখন তিনি এই বিশেষ দোয়া করেছিলেন,

‘রব্বি হাবলি মিল্লাদুনকা জুররিয়্যাতান ত্বইয়্যিবাতান, ইন্নাকা সামিউ’দ দুআ।

অর্থ : হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার পক্ষ থেকে আমাকে পূত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা কবুলকারী।’
(সুরা : আল ইমরান, আয়াত : ৩৮)

হজরত ইবরাহিম (আ.) একসময় নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে এ মর্মে দোয়া করেছেন—

‘রব্বি হাবলি মিনাস সলেহিন।
অর্থ: হে আমার প্রভু! আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করো।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০০)।

উত্তম নেক জীবনসঙ্গী ও সন্তানের জন্য আল কুরআন এ দোয়া রয়েছে।

“রব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্বুররতা আ’ইয়্যুন ওয়াজাআলনা লিল মুত্তাক্বীনা ইমামা”। (সূরা ফুরকান:৭৪)

“অর্থ: ইয়া আল্লাহ আপনি আমাকে এমন স্বামী/স্ত্রী এবং সন্তান দান করুন যাদের দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।আর আপনি আমাকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন”

মহান আল্লাহ সময়ের মাধ্যমে তাঁর বহু নৈকট্যশীল বান্দাকে সন্তান নামক নিয়ামত না দিয়েও পরীক্ষা করেছেন, তাঁরা যথারীতি উত্তীর্ণও হয়েছেন। হজরত জাকারিয়া (আ) স্ত্রী বন্ধ্যা ছিলেন, অনেক ধৈর্য ও দোয়ার পর মহান আল্লাহ শেষ বয়সে একজন সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আইয়ুব (আ) অনেক সন্তান-সন্ততি দিয়ে আবার তাদের কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। ইবরাহিম (আ) এর জীবনী থেকে জানা যায়, তাঁদেরও অনেক বছর নিঃসন্তান রাখা হয়েছিল। এমন অনেক উদাহরণ ইসলামে পাওয়া যাবে। তাই সন্তান না হলে হতাশ হওয়ার কারন নেই। (এখানে কিছু কথা সংগৃহীত)

সব শুনে নাফিয়া আরবাজের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। এই মানুষটা কতো করে ওকে চায় সেটা ওর কথার ধরনেই বুঝতে পারছে নাফিয়া। যেখানে কিনা ওকেই বিয়ে করার জন্য অন্যকে মানানো উচিত। সেখানে একজন ওর সমস্যার জন্যই ওকে মানাচ্ছে। ও অবাক হয়েই অস্ফুট স্বরে বলল,,

“ভালোবাসেন আমাকে?”

আরবাজ মুচকি হেঁসে বলল,,

‘ভালোবাসি কিনা জানিনা তবে তোমাকে আমার উত্তম জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই। হয়তো ভালোবাসি বলেই পেতে চাই। তাই তো অনুভূতি খারাপ দিকে যাওয়ার আগে হালালভাবে তোমায় পেতে চাইছি।”

‘আমাকে পেয়ে কখনো আফসোস করবেন না তো। ভাববেন না আমার থেকে অন্য কাউকে পেলে ভালো হতো একটা সন্তান প্রাপ্ত হতো।

আরবাজ মুচকি হেঁসে বলল,,

“লেখিকা আজরিনা জ্যামির ছোট্ট একটা লেখা আছে,,

“প্রাপ্তি আর তৃপ্তির মাঝে বিস্তর ফারাক। সব প্রাপ্তি তৃপ্তি দেয় না। আবার জীবনের সব ইচ্ছে প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয় না।”

এই কথাটার মানে হলো আমরা কিন্তু সব প্রাপ্তিতে তৃপ্তি হতে পারি না। যেখানে তুমি প্রাপ্তিতে নেই সেখানে তৃপ্তি পাবো কিভাবে। আর জীবনের সব ইচ্ছে কিন্তু সত্যিই আমাদের জীবনে প্রাপ্তির খাতায় হয়না । কিন্তু আমি আমার এই ইচ্ছেকে প্রাপ্তির খাতায় যোগ করতে চাই।”

সব শুনে নাফিয়ার মুখে হাঁসি ফুটে উঠল ও বলল,,

“আমি রাজি।”

“অতঃপর দুলহান তাহলে রাজি হলো আমার।”

আরবাজের কথায় নাফিয়ার হাঁসিটা যেন আরো প্রসারিত হলো। আরবাজ হেঁসে নিচে চলে গেল। নাফিয়াও গেল। নাফিয়া আসলে মাহফুজ শাহরিয়ার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন বিয়ের জন্য সে জানালো তারও আপত্তি নেই। আরবাজ আসলে মুখর বলল,,

‘কি বলল নাফি?”

‘যা বলার তাই বললো তোকে বলবো কেন? আমাদের পার্সোনাল কথা।”

‘এখন পার্সোনাল কথা হয়ে গেল।”

‘হুম!”

আরবাজ সবার উদ্দেশ্যে একটা কথা বলল,,

‘আংকেল আমি আপনাদের আরো একটা কথা বলতে চাই।”

মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

“হ্যা বলো বাবা।”

‘আংকেল আমি চাই নাফিয়ার সমস্যার কথা আমার বাড়ির কেউ না জানুক।”

‘এটা কি করে হয় পরে জানতে পারলে ওনারা কষ্ট পাবেন সেই সাথে আমাদের এবং নাফিয়ার প্রতি উনাদের বিরুপ ধারনা হতে পারে। তাছাড়া এটা একপ্রকার ধোঁকা দেওয়াও বলা যায়।

‘ধোঁকা তখন হতো যখন আমি জানতাম না। নাফিয়ার সাথে আমার জীবন জুড়তে যাচ্ছে তাই আমি জানাটাই যথেষ্ট নয় কি। আর বাকি সবকিছু আমার ওপর ছেড়ে দেন। তারা কখনো নাফিয়ার সমস্যার কথা জানবেন না। সবথেকে বড় কথা আমার ওপর বিশ্বাস করুন যাই হয়ে যাক না কেন আমি ওর হাত ছাড়ছি না।”

আরবাজের কথা শুনে সবার মুখে প্রশান্তি ছেয়ে গেল মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন আরবাজ যা চায় তাই হবে। তিনি এটাও বলল মাহফুজ শাহরিয়ার অসুস্থ থাকার কারনে আলভির বিয়েটা এখনো হয় নি। এখন বাড়ির মেয়ে ছেলের বিয়েটা একসাথে ও দেওয়া উচিত হবে কি না। যদি আরবাজের পরিবার রাজি থাকে তাহলে বিয়ে বউভাত কোন রিসোর্ট এ গিয়ে করা যাবে। আরবাজ বলল এ বিষয়ে ওর পরিবারের সাথে কথা বলতে। আরবাজ কথা শেষ করে চলে গেল মুখর কে নিয়ে ও ও ফিরবে আরবাজের সাথে।
________________

নুপুরের মায়ের অপারেশন সাকসেসফুল হলো। সেই ফাকে সবাই নাফিয়াদের বাড়ি গিয়ে সব ফাইনাল করতে গেল। সবার নাফিয়াকে অনেক পছন্দ হলো সেই সাথে পরিবার ও। তবে বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে শেখ শাহেনশাহ এতে বেকে বসলেন বিয়েটা তার বাড়িতেই হবে কোন রিসোর্ট এ না কারন তার নাতির বিয়েতে পুরো মহুয়াপর খাবে। আর ধুমধাম করে দেবে নাতির বিয়ে দেবে। এ কথা শুনে আলভি বলল নাফিয়ার বিয়েটাই তাহলে আগে দিতে। ওদেরটা নয় পরে দেওয়া যাবে ও নিজেও নাফির বিয়েতে মজা করতে চায়। এ কথা শুনে মাহফুজ শাহরিয়ার বাঁধ সাধলো এমনিতেও দেরি হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে এক খরচেই দুই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আছলাম আর মাহফুজ শাহরিয়ার। আলভির বিয়েটা দেরি হচ্ছে তাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটাও তারা জানালেন পরে সব শুনে শেখ শাহনাওয়াজ বললেন আলভির বিয়েটা সেরে ফেলতে আর আরবাজ আর নাফিয়ার এখন এঙ্গেজমেন্ট করে রাখুক পরে বিয়ের অনুষ্ঠান করা যাবে। কথাটা শুনে সবাই রাজি হলো। অতঃপর দশদিন পর আরবাজ আর নাফিয়ার এঙ্গেজমেন্ট। শেখ শাহেনশাহ চান তার বাড়িতেই হবে। তারমধ্যে তারাও ঘুরে আসুক মেয়ের কোথায় বিয়ে হচ্ছে। শাহরিয়ার পরিবার রাজি হলো এতে। অতঃপর দশ দিন পর আরবাজ আর নাফিয়ার এঙ্গেজমেন্ট ঠিক করা হলো। রাতে মেহরব চৌধুরী কে সব জানালে তিনি আছলাম আর মাহফুজ শাহরিয়ার মিলে বিশদিন পর আলভি আর মাইশার বিয়ের ডেট ফিক্সড করলেন।

_____________

রাতে বাড়ি ফিরে সবাইকে নিয়ে বসে শেখ শাহনাওয়াজ আরবাজকে বললেন,,

“আরবাজ তোমার নানাবাড়ি বলা উচিৎ নয় কি?”

তখন আরিফা জামান বললেন,,

‘আবার তাদের কেন?”

তখন আরবাজ বলল,,

‘বড়মা তাদের জানার অধিকার আছে তাদের বাড়ির মেয়ের ছেলের বিয়ে হচ্ছে এবং বিয়ে কোথায় আর কার সাথে হচ্ছে।”

অনেকদিন পর বড়মা শুনে আরিফা জামানের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। আরবাজ তাকে সহজে ডাকে না। তবে আজ কেন? ডেকে কি বুঝিয়ে দিল তার সাথে ওর সম্পর্ক কি। আরিফা জামান নিজেকে সামলিয়ে বললেন,,

“না আমি বলতে চাইছিলাম অনেক বছর ধরে তো তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই তাই বলছিলাম।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘অনেক বছর নেই তো কি হয়েছে? এখন হবে হাজার হোক তারা আমাদের আত্মীয়। আর তাদের বাড়ির মেয়ের ছেলের বিয়ে সম্পর্কে তাদের মতামত দেওয়ার অধিকার রয়েছে।”

তখন আরিফা জামান কষ্টমিশ্রিত হেঁসে বললেন,,

‘হুম বলুন তাদের সমস্যা নেই। তাদের বরঞ্চ দুদিন আগে আসতে বলুন।”

বলেই তিনি উঠে চলে গেলেন। তখন মিশু বলল,,

“আমাদের মামাবাড়ি আছে বাবা? কই কখনো নো তো বলোনি। আগে বললে আমিও মামাবাড়ি বেড়াতে যেতাম কতো কত মজা করতাম। আরিফ মামা তো আমাদের বাড়িতেই থাকে তাই আমি ভেবেছিলাম আমাদের মামাবাড়ি নেই।”

তখন আরবাজ বলল,,

‘আমাদের মামাবাড়ি আছে মিশু আর মামাও আছে আরেকজন।”

‘বাহ দুইটা মামা?”

‘হুম দুইটা মামা।”

‘আমাদের মায়েদের মতো কিন্তু এক মা তো নেই বাজপাখি। এক মা তো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এখন শুধু মামনি আছে।

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩৬
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“আপনি কি এই দাওয়াতটাও রাখবেন না ডাক্তার?”

শেখ শাহনাওয়াজ এর কথায় মেহবিন মুচকি হাসলো আর বলল,,

“যদি না রাখি তো?’

‘এবার তো কোন অসুবিধা নেই।”

‘আমি যদি যাই তাহলে এবার আপনার অসুবিধা হবে না তো চেয়ারম্যান সাহেব?”

মেহবিনের হুট করে করা প্রশ্নটায় শেখ শাহনাওয়াজ থমকে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন মেহবিন কি ইঙ্গিত করেছে তাই উনি বললেন,,

“আপনি দাওয়াতটা গ্ৰহন করলে খুশি হব আমি। কিছু খান আর না খান আপনি উপস্থিত থাকুন এটাই চাইছি।”

“দাওয়াতে যদি যাই না খেয়ে বাড়ি আসতে বলেন নাকি। দাওয়াত রক্ষা করে মানুষ খাওয়ার জন্য আর আপনি আমাকে না খেয়েই আসতে বলছেন।”

একথায় শেখ শাহনাওয়াজ একটু লজ্জিত হলেন তবুও তিনি বললেন,,

‘না আপনি তো খান না যদি এই কারনে দাওয়াত না রাখেন তাই আর কি?”

‘এইবার যাবো।’

কথাটা শুনে শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের দিকে তাকিয়ে আবার অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,,

‘শুকরিয়া দাওয়াতটা গ্ৰহন করার জন্য। এইবার আমি আসি।’

বলেই তিনি ঘুরে হাঁটবেন এমন সময় মেহবিন বলল,,

‘শেখ বাড়ির পুরোনো অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি আমি চেয়ারম্যান সাহেব।”

হুট করে মেহবিনের এমন কথায় তার পা থেমে গেল‌। তিনি ঘুরে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,,

‘মানে কি বুঝাতে চাইছেন?”

‘আপনার ছেলের ভবিষ্যত আমি আপনার মতো দেখতে পাচ্ছি।”

‘মানে ?”

‘কিছু না তবে এটা বলতে পারি আপনারা শেখ পরিবারের পুরুষ গুলো খুব স্বার্থপর। কে জানে ভবিষ্যতে আপনার স্বার্থপরতার জন্য আপনিই আপনার অতীত ছেলের মাধ্যমে আবার পুনরাবৃত্তি করলেন।”

“আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ডাক্তার।”

“কিছু না আপনি বাড়ি যান ছেলের এঙ্গেজমেন্ট এর প্রস্তুতি নিন। হাজার হোক সাবেক চেয়ারম্যান শেখ শাহেনশাহ এর একমাত্র নাতি এবং চেয়ারম্যান শেখ শাহনাওয়াজ এর একমাত্র ছেলের এঙ্গেজমেন্ট বলে কথা কিছু ধামাকা তো হতেই হবে। তাছাড়া আপনারা উচ্চ বংশীয় লোক আপনাদের মর্যাদা কতো ওপরে সবাইকে দেখাতে হবে না। আমার কথা ভাববেন না আমি ঠিক সময় পৌঁছে যাবো।”

বলেই মেহবিন ঘরের ভেতর ঢুকে পরলো। শেখ শাহনাওয়াজ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেলেন। আরবাজের এঙ্গেজমেন্ট এর সাতদিন বাকি আজ সকালে এসেছিলেন মেহবিন কে দাওয়াত দিতে। প্রতিবারের মতো এবার আর মেহবিন না করেনি সে রেখেছে তার দাওয়াত।

__________________

“আসসালামু আলাইকুম!’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম!”

‘তুমি কি যাবে আরবাজের এঙ্গেজমেন্ট এর অনুষ্ঠানে?”

‘না যাওয়ার তো কারন দেখছি না।”

‘আমাদের ফ্যামিলির সবাই কিন্তু থাকবে।”

‘তো আমি কি ভয় পাই নাকি কাউকে দেখে নাকি আপনাদের জন্য আমার আলাদা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। মাইশা আপুর পার্টিতে যেমন ছিলাম তেমনটাই যাবো। আমি শুধু ভাবছি আপনার দাদিজান কি রিয়াক্ট করবে?”

মেহবিনের কথায় মুখর হেঁসে উঠলো আর বলল,,

‘চেহারাটা এক্কেরে চাঁদের মতো উজ্জ্বল হইয়া যাইবো।”

‘ফাজলামি বন্ধ করেন কাব্য।”

“আমি আবার কি করলাম?”

‘কিছু না রাখছি।”

‘আরে দাঁড়াও রাখো কেন? সেদিন কিন্তু তুমি শুভ্র রঙের গাউন পরবে।”

“আমি আনিনি কোন গাউন এখানে।”

‘সমস্যা নেই আজকেই তোমার গাউন পৌঁছে যাবে।”

‘মানে আপনি অর্ডার করেছিলেন নাকি?”

‘না আমি নিজ হাতে কিনেছি তোমার জন্য শুভ্র গাউন সোনালী রঙের হিজাব আর শুভ্র রঙের নিকাব। আর আমার জন্য সাদা রঙের পাঞ্জাবি ওপরে সোনালী রঙের কোটি।”

মুখরের বাচ্চামো দেখে মেহবিন হাসলো এই লোকটাও না সবসময় ম্যাচিং করে জামাকাপড় পরতে চায়। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘আপনি কি টিনেজার নাকি যে টিনেজারদের মতো ম্যাচিং ড্রেস পরতে চাইছেন।”

“উঁহু টিনেজার হতে যাবো কেন? এটাও অদ্ভুত একটা শখ বলতে পারো। শুধু আমার না বেশি সংখ্যক কাপলদের দেখবে এরা ম্যাচিং করে ড্রেস পরতে চায় কিন্তু অনেকে মুখ ফুটে বলে না। কিছু সংখ্যক বলে আমার মতো।”

“হুম বুঝলাম।”

‘কি?”

‘এই যে কাপলরা ম্যাচিং করে ড্রেস পরতে চায়। কিন্তু আমরা তো এখানে কাপল হয়ে যাচ্ছি না।”

‘তো কি হয়েছে আমরা কাপল তো সবার সামনে হই আর আড়ালে।”

“আচ্ছা বেশ পরবো হ্যাপি।”

‘আমি হ্যাপি না তো খুশি।”

“এতো ফাউ কথা পান কোথায়?”

‘তোমার কাছে আসলেই কেন যেন এইগুলো কোথা থেকে আসে।”

‘হয়েছে রাখছি এখন নেত্রীকে পড়াচ্ছি আমি।”

‘নেত্রীর কাছে দাও তো একটু।”

মেহবিন তাজেলের কাছে ফোন দিল। তাজেল সালাম দিল ,,

‘আসসালামু আলাইকুম পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তা নেত্রী তোমার দেশের কি অবস্থা সবকিছু ঠিক ঠাক আছে তো?”

‘আর অবস্থা ধুরু এই পড়াশোনারে কেরা বানাইছিল তারে সামনে পাইলে মনে হয় আমি কিছু করতাম।”

তাজেলের কথায় মেহবিন ওর দিকে তাকালো আর মুখর হাসলো। তখন মেহবিন বলল,,

“নেত্রী তার মানে সত্যিই তোমার পড়াশোনা ভালো লাগে না। আর তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলে পড়াশোনা শুরু করছো।”

তাজেল জ্বিভ কেটে দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“আরে না আমি তো পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালার সাথে মজা করতে ছিলাম। আর পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা তুমি আমার পড়ার সময় ফোন দিবা না। তোমার জন্য আমি ফ্যাসাদে পইরা যাই শান্তিতে মজাও করতে পারি না।”

এ কথা শুনে মুখর হাসলো মেহবিন ও বুঝতে পারল তার নেত্রী কথা কাটাচ্ছে। মুখর বলল,,

“তা হুট করে পড়াশোনা নেত্রীর এতো কঠিন কেন লাগছে?”

“আর কইয়ো না ছোট হাতের b লেখবার যাইয়া হয় d … আর d হইয়া যায় b আবার p খালি q হইয়া যায় আর q খালি p হইয়া যায়। এইডা ঠিক হইতেছেই না এই জন্য ডাক্তার আমারে এই গুলা বিশবার কইরা লেখবার দিছে।”

সব শুনে মুখর হাসলো মেহবিন ও হাসলো বেচারির দুঃখের কথা শুনে মেহবিন আর মুখরের হাঁসি পাচ্ছে। মুখর বলল,,

“আরে এই ব্যাপার ছোটবেলায় আমারও এরকম কতো হতো এটা ব্যাপার না। তুমি এক কথা শুনো যখন তোমাকে বি লিখতে বলবে তখন তুমি মনে মনে ডি ভাববা তারপর লিখে দিবা দেখবে বি হয়ে গেছে এই ভাবেই ঠিক হয়ে যাবে।”

“এই যে বিদ্যাধর মুখর শাহরিয়ার বাচ্চাকে ভালোভাবে না শেখাতে পারলে শেখাবেন না তবুও ফাউল শেখাবেন না। এখানে বি লিখতে বললে ডি ভাবতে বললেন এমনটা ভাবতে ভাবতে একদিন নেত্রী পরবেও বি কে ডি তখন কি করবেন। এতে আরো ঝামেলা হবে আসছে পড়াইতে।”

“আরে এটা তো আমি ভেবেই দেখিনি।”

“আপনি ভবিষ্যৎ ভাবেন কখন ? বর্তমান নিয়েই অলওয়েজ লাফালাফি করেন।”

“তুমি কি কোন ভাবে আমাকে খোঁচা মারছো?’

“না এখন ফোন রাখেন আমাদের ডিসটার্ভ হচ্ছে।”

“নেত্রীকে পড়াচ্ছো বলে কিছু বললাম না নাহলে,,

“নাহলেও কিছু করতে পারতেন না। আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই মেহবিন ফোন কেটে দিল। এদিকে ওদের দুজনের ভাব দেখে তাজেল হাসলে। তাজেল বলল,,

‘পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা তো ভালো বুদ্ধিই দিছিলো।”

“হ মেলা ভালো বুদ্ধি দিছিল যাতে তুমি ভুল পড়। হুম অনেক হইছে কথাবার্তা এখন লেখ।”

“এইবার ভুল হইলে আমার দোষ নাই কিন্তু কইয়া দিলাম।”

“আজ সবগুলো ঠিক না করে কোথাও যেতে পারবা না।”

“আমার স্কুল আছে তো তোমারও হাসপাতাল আছে। কাইলক্যা বাড়ি থেইকা আনমুনি এহন আসি।”

মেহবিন তাজেলের হাত ধরে বলল,,

“না নেত্রী আজ থেকেই সব শেষ করবে।’

“আমারে ছাইড়া দেও ডাক্তার আইজক্যা। আমি আর পরুম না আইজক্যা।”

“না আজ পরতেই হবে সবসময় ব্যাগ নিয়ে পালালে হবে।”

“আজকের মতো মাফ করো ডাক্তার আবার কাইল আসমুনি।”

“মাফ করলাম না।”

“আমার সোনা ডাক্তার ওমবা কইরো না আইজ আমি আর পরুম না। আমার ভাললাগতাছে না।”

কথাটা শুনে মেহবিনের কেন যেন খুব হাঁসি পেল। ও বুঝতে পারল তাজেল আজ বি ডি নিয়ে খুবই বিরক্ত। তাই ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,,

“ওকে আজ ছেড়ে দিলাম কাল ঠিক না হলে স্কুলে যেতে দেব না।”

তাজেল দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“তোমারে সোনা ডাক্তার কইলাম দেইহা ছাইড়া দিলা
কাইল আইসাই সোনা ডাক্তার কমু। তাইলে আর ধরবা না।

বলেই তাজেল এক দৌড়। তাজেলের কান্ডে মেহবিন হাসলো। এই মেয়েটাও না।

_______________

অতঃপর আজ শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ এবং নাফিয়া মাহফুজ শাহরিয়ার এর এঙ্গেজমেন্ট। রাত আটটায় তাদের আংটিবদল হবে। মেহবিন কে বিকেলেই মিশু গিয়ে নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা গড়ালো একটু আগেই এখনো শাহরিয়ার পরিবার এসে পৌঁছায় নি। তবে জিনিয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসে পরেছে অর্থ্যাৎ আহমেদ পরিবার আজ শিলার হাজবেন্ড ও বাদ যায় নি‌। সবাই এসেছে হয়তো মেহবিন কে দেখতে। মেহবিন মিশুর হিজাব বেঁধে দিচ্ছে। মিশুও একটা হালকা গোলাপি রঙের গাউন পরেছে আর শুভ্র রঙের হিজাব। ওর সবকিছু শেষ হলে মিশু বলল,,

“এই ফুল আজ আমি তোকে হিজাব বেঁধে সাজিয়ে দিই।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“ঠিক আছে।”

অতঃপর মিশু মেহবিন কে সুন্দর করে শুভ্র রঙের গাউনের সাথে সোনালী রঙের হিজাব বেঁধে দিল হালকা সাজিয়েও দিল। কিন্তু নিকাব দিল না তা দেখে মেহবিন বলল,,

“নিকাব কেন দিলে না?”

“এমনিই এখন নিচে চল সবাই এসে পরেছে।”

“ফুল এটা কিন্তু ঠিক না।”

“আর একটা কথা বললে আমি কিন্তু নিচে যাবো না।”

“এই তোমার অহেতুক অধিকার খাটানো কিন্তু আমার পছন্দ নয়।”

“অধিকার আর খাটাতে পারলাম কই তার আগেই তো।”

মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“হুম চলো এখন নিচে যাই।”

“এই এঙ্গেজমেন্ট এ কিন্তু আমার মামাবাড়ি থেকেও লোক আসবে।”

“জানি আমি।”

বলেই মেহবিন হাঁটা ধরলো তা দেখে মিশুও দৌড়ে মেহবিনের হাত ধরলো। মেহবিন আর মিশুকে একইরকম অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। দুজনে হেঁসে কথা বলতে বলতে আর সিঁড়ি দিয়ে নামছে সবার নজর যেন ওদের দিকেই‌। ওদের একসাথে দেখে দুই জন মানুষের চোখ ছলছল করে উঠলো‌। তারা মাশাআল্লাহ বলল। এদিকে মেহবিন কে এখানে এভাবে দেখে শাহরিয়ার পরিবার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একটু আগেই তারা এসেছে। মেহবিন তাদের দেখেও ইগনোর করে মিশুর হাত ধরে অন্য জায়গায় চলে গেল। মিশু সোজা গিয়ে মুখরের সামনে দাঁড়ালো। মুখর আগে থাকতেই হেঁসে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মেহবিনের চোখ পরতেই ও হাত দিয়ে মাথা উঁচু করলো তা দেখে মেহবিন হাসলো। মিশু বলল,,

‘পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি দেখো তো আমাদের কেমন লাগছে?”

মুখর হেঁসে বলল,,

“মাশাআল্লাহ দুইজনকেই অনেক সুন্দর লাগছে।”

“আমার থেকেও ফুলকে বেশি সুন্দর লাগছে তাই না।”

“সত্যি বলবো মিশু তোমার ফুলের থেকে তোমাকেই বেশি সুন্দর লাগছে।”

“আরে তুমি তো আমার দিকে তাকাচ্ছোই না তুমি দেখলে কিভাবে আমাকে বেশি সুন্দর লাগছে?”

এ কথা শুনে মুখর ভরকে গেল ও তাড়াতাড়ি করে মেহবিনের থেকে নজর সরালো তা দেখে মেহবিন হাসলো। মেহবিন বলল,,

“তোমার বাজপাখির বউয়ের সাথে আলাপ করিয়ে দেবে না।”

“হ্যা দেব তো।”

মিশু হেঁসে নাফিয়ার সামনে গিয়ে বলল,,

“এই যে ফুল ও হলো বাজপাখির বউ টুনিপাখি।”

মিশুর মুখে টুনি পাখি শুনে নাফিয়া ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। আর যারা শুনেছে মিশুর কথা শুনেছে সবাই অবাক হয়ে গেল। তখন আরবাজ এসে বলল,,

“এই মিশু তুই এটা কি বললি?”

“কি বললাম আমি তো বললাম ও বাজপাখির বউ টুনি পাখি। আরে তোমায় আমি বাজপাখি বলি এখন তোমার বউকেও তো কোন পাখি বলতে হবে। তোমার বউতো টুনি পাখির মতো এইটুকুনি আর কতো কিউট তাই আমি ওর নাম দিয়েছি টুনিপাখি। ফুল সুন্দর লাগছে না নামটা।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“হুম অনেক সুন্দর লাগছে। দারুন জুটি বাজপাখি আর টুনিপাখি।”

মেহবিনের কথায় নাফিয়া লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তা দেখে মেহবিন ফিস ফিস করে নাফিয়ার কানে কানে বলল,,

“হইছে আপু আর লজ্জা পেতে হবে না। তবে ফুলের নাম সিলেক্ট কিন্তু দারুন।”

তখন মুনিয়া মাইক নিয়ে বলল,,

“অ্যাটেনশন এভ্রিওয়ান। আরবাজ ভাইয়া ও নাফিয়া আপু সরি ভাবির আংটিবদল অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম। যাই হোক গান বাজনা হারাম এই জন্য এখানে কোন গানবাজনা হবে না তবে তাই বলে কি আমরা অনুষ্ঠানটা পানসে যেতে দেব নাকি। তাই আমরা ইয়াংস্টাররা অনুভুতি প্রকাশের জন্য ছোট্ট একটা ফাংশন রেখেছি। এখানে কিছু মানুষ কে ডাকা হবে তাদের সম্পর্কে বা তাদের কিছু অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করবে।”

সবাই স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল অনুষ্ঠানটি খুব বড়ও না আবার ছোটও না সব আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে। সবকিছু শেখ বাড়ির ড্রয়িংরুমেই করা হয়েছে। মুনিয়ার কথায় সবার আকর্ষণ ওর দিকেই । মুনিয়া প্রথমেই বলল,,

“তো এখন সবার আগে আমাদের সবার বড় দাদুভাই অরফে শেখ শাহেনশাহ কে দিয়েই শুরু করি। দাদুভাই এখানে চলে এসো‌।

শেখ শাহেনশাহ ওখানে গেল তখন মুনিয়া বলল,,

“তো দাদুভাই বলো তোমার কাছে সবথেকে প্রিয় কি ?”

শেখ শাহেনশাহ বললেন,,,

“আমার বংশের সম্মান ও তার গৌরব।”

কথাটা শুনে মেহবিনের হাঁসি পেল কেন যেন তবুও সে হাসলো না। তবে সে হাত তালি দিল সাথে মিশু ও দিল আর সবাই দিল তারপর তখন মেহবিন বলল,,

“মাশাআল্লাহ অনেক ভালো উত্তর সাবেক চেয়ারম্যান সাহেব। আপনার কথা শুনে মনে হলো আপনি আপনার বংশের সম্মান আর গৌরব ধরে রাখতে যে কোন কিছু পার করতে পারেন। কোন এক সময় আপনি তা করেছনও মনে হয়।”

মেহবিনের কথায় তিনি ওর দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। উনি নেমে এলেন দেখে কেউ কিছু বললো না তবে সবাই অবাক হয়েছে এই মেয়েটার কথায়। মুনিয়া মাইক নিয়ে বলল,,

“এরপর আসি জিনিয়া আপু তোমার কাছে। তো তুমি বলো নতুন বিয়ে হলে সবার প্রথমে মেয়েদের কি বদলায়?”

জিনিয়া মুচকি হেসে বলল,,

“অনেক বছরের পুরোনো অভ্যাস।”

এই ছোট্ট কথাটায় কি ছিল জানা নেই তবে কিছু একটা তো ছিল। মুনিয়া ওকে আর কিছু বললো না। এরপর মুনিয়া বলল,,

“মুখর ভাইয়া এবার তুমি। একটু হলেও তোমায় চিনি তো তাই।”

মুখর হেঁসে মুনিয়ার কাছে গেল মুনিয়া বলল,,

“তোমার কাছে সবথেকে সুন্দর মুহুর্ত কি?”

মুখর মুচকি হেসে বলল,,

“একজনের সাথে হাসিখুশিভাবে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত।”

মুখরের কথা শুনে ইয়াংস্টাররা সবাই হইহই করে উঠলো। মেহবিন মুচকি হাসলো মুখর যে তাকেই বলেছে এটা ও বুঝতে পারলো। তখন মুনিয়া বলল,,

“আর পূর্নতা?”

“সে তো অপেক্ষা!”

আর,,

“হয়েছে অলরেডি দু’টো করেছো সবাইকে একটা করে করেছো। ”

বলেই মুখর সরে এলো। এবার ডাক পড়লো আরবাজের । আরবাজ গেল তখন মুনিয়া বলল,,

“তোমার কাছে প্রাপ্তি কি?”

আরবাজ মুচকি হেঁসে বলল,,

“আপাতত নাফিয়া মাহফুজ শাহরিয়ার।”

ব্যস আর লাগে কি চারদিকেই বেশ হই হই পরে গেল। আর নাফিয়া বেচারি পরে গেল লজ্জায়। মেহবিন খুশি হলো সেই সাথে অন্যকিছুও মাথায় হানা দিল। তখন মিশু বলল,,

“এখন বন্ধু যাবে মুনি ?”

“ঠিক আছে মিশু আপু। মেহবিন আপু এখানে আসো।”

মেহবিন প্রথমে না যেতে চাইলেও মিশুর জন্য গেল। মেহবিন যেতেই সবাই ওর দিকে তাকালো কারন ও সবার কাছে এ যাবৎ ধাঁধা। তখন মুনিয়া বলল,,

“তো মেহবিন আপু তুমি এমন একটা মানুষ যাকে জানার জন্য সবার মনেই একটা কৌতুহল আছে। এবার কি তুমি তোমার সম্পর্কে কিছু বলবে?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আমার সম্পর্কে তেমন কিছু বলার নেই।”

“তবেও বলো না আপু।”

মেহবিন আবার ও মুচকি হাসলো সবার দিকে তাকাতেই দেখলো সবাই উৎসুক জনতার মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথমে সে আছিয়া খাতুন এর দিকে তাকালো তারপর তার পরিবার। এরপর আরবাজ মিশু আর রাইফার দিকে। সবার শেষে শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

‘আমার সম্পর্কে যদি কিছু বলি তাহলে বলবো ‘
আমি একা আমার কেউ নেই কোনদিন ছিলোও না। সবাই এটা বলে অনুভবে কিন্তু আমি বলছি অভিমানে। কারন আমি এমন একজন মানুষ যার সাথে সম্পর্ক তো অনেক মানুষের আছে কিন্তু হাত ধরে কেউ জনসম্মুখে বলতে পারবে না তার সাথে আমার কি সম্পর্ক। উঁহু তার মানে এই নয় হয়তো অবৈধ সম্পর্ক আছে দেখে।না কোন অবৈধ সম্পর্ক নেই সব বৈধ সম্পর্ক। তবুও আমার ওপরেই যতো বাধ্যবাধকতা। সবশেষে যদি বলি তাহলে আমার কেউ নেই কোনদিন ছিলোও না।

কথাটা শুনে অনেকের চোখ ছলছল করে উঠলো। সেখানে থাকা নতুন মানুষগুলোরও। মুখরের ভেতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে সেই সাথে আরো কয়েকজনেরও। আছিয়া খাতুনের আজ বড় অনুশোচনা হচ্ছে। তিনি এগিয়ে যেতে নিলেন তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“সত্যিই কি কেউ নেই আপনার?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আছে একজন আমার নেত্রী তার নাম শেখ তাজেল। সেই একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আমাকে সবসময় প্রশান্তিতে ভরিয়ে রাখে।”

“তাহলে একটু আগে যে বললেন?”

“এক মুহুর্তের জন্য এতো স্বার্থপর মানুষের মাঝে আমি তাকে ভুলে গিয়েছিলাম। ওগুলো কিছু স্বার্থপর মানুষের জন্য ছিল। কিন্তু দিনশেষে আমার নেত্রী আমার। আমার ভালোবাসা আমার হাসির অন্যতম প্রধান কারন।

বলেই মেহবিন ওখান থেকে নেমে দরজার দিকে গিয়ে দাঁড়ালো। মিশু ওর কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। আর বলল,,

“টেনে মারবো এক থাপ্পড় তুই আমার ফুল ।”

মেহবিন ওকে ছাড়িয়ে বলল,,

“তাহলে চলো স্টেজ এ গিয়ে আমার হাত ধরে বলো আমি তোমার কে হই? পাগল হলে বলতে পারতে কিন্তু সুস্থ দেখে কোথাও গিয়ে বাঁধলো তাই না। এই জন্য মাঝে মাঝে পাগলরাই ভালো তাই না ফুল।

মিশু একবার মেহবিনের দিকে তাকালো। আজ তার পাগল নিয়ে কোন সমস্যা নেই। মিশু আবার মাথা নিচু করে রইল তখন মেহবিন মুচকি হেঁসে মিশুর কানে কানে ফিসফিস করে বলল,,

“সত্যি তো এটাই আমি মরহুম মেহেরুননিসা এর মেয়ে।আর মেহেরুননিসার মৃত্যুর সাথে সাথেই আমার সব সম্পর্কের ইতি ঘটেছে। কালের বিবর্তনে আবার কিছু মানুষের সাথে যোগাযোগ হয়েছে তাই বলে এটা নয় পুরোনো সম্পর্ক একদম জুড়ে গেছে।’

মেহবিনের কথায় মিশুর চোখ ছল ছল করে উঠলো।ও বলে উঠলো,,

‘ফুল!”

“কি সত্যি বললাম তো।”

মিশু এবার কেঁদেই দিলো আর বলল,,

“তুই খুব খারাপ ফুল তুই খুব খারাপ।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“এই জন্যই তো আমায় তার সাথে কেউ রাখে না। যেমন আমার বাবা সেই কিন্তু আমাকে প্রথমে ছেড়েছিল।”

মিশুকে কাঁদতে দেখে সবাই উৎসুক জনতার মতো ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। যেখানে মিশু কাঁদছে আর মেহবিন না থামিয়ে হাসছে। যেখানে কিনা ওর কাদা উচিত। অতঃপর মেহবিন এবার মিশুকে জড়িয়ে ধরে বলল,,

“তবে এর মাঝে সব থেকে সত্যি কথা কি জানো যে তোমার ফুল তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”

কথাটা শুনে মিশুর আপনাআপনি কান্না থেমে হাঁসি ফুটে উঠল। ও হাঁসি মুখেই বলল,,

“আমিও তোকে খুব ভালোবাসি।”

‘হুম হুম এখন ভালোবাসা উতলে পরছে।”

মিশু এবার খিলখিল করে হাসতে লাগলো। এদিকে ওরা কি বলেছে দূরে দেখে কেউই শুনতে পায়নি। তবে যারা মেহবিন কে কাছ থেকে চেনে তারা সবাই ভাবছে মেয়েটা এমন কেন। মুহুর্তেই কাউকে কাঁদাতে পারে আবার মুহুর্তেই হাসি ফোটাতে পারে।

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৩৩+৩৪

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

কোন কিছুর আওয়াজ পেয়ে মুখর আরবাজ সহ সবাই মেহবিনের কেবিনে গেল। ওখানে যেতেই ওরা দেখল টুলটা উল্টে পরে আছে। মেহবিনের দিকে তাকাতেই দেখল মেহবিন চোখ খুলে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আর কেমন যেন হাঁসফাঁস করছে বোধহয় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখর তাড়াতাড়ি করে ডক্টর ডাকলো ডক্টর এসেই মেহবিনকে দেখে একটা ইনজেকশন দিল। মেহবিন আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে চোখ বুঝলো। ডাক্তার জানালো আউট অফ ডেন্জার মেহবিন চিন্তার কোন কারন নেই। কথাটা শুনে সবাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। তবে আরবাজ খুশি হওয়ার সাথে এটাও বুঝতে পারলো টুলটা মেহবিনের হাত লেগে পরেনি কেউ এসেছিল এখানে। অতঃপর অ্যাম্বুলেন্স আসতেই মেহবিন কে সেখানে উঠানো হলো। গন্তব্য কোন এক ভালো হাসপাতালে ‌। এদিকে মেহবিন জানতেও পারলো না কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে সে আর কাদের পেছনে ফেলে যাচ্ছে ‌সে।
______________

সকাল আটটায় তাজেল আসলো নওশিকে নিয়ে মেহবিন কে দেখতে। এখানে এসে জানতে পারলো মেহবিন এখানে নেই রাতেই ওকে ট্রিটমেন্ট এর জন্য ওর হাজবেন্ড অন্য হাসপাতালে নিয়ে গেছে কিন্তু কোথায় গেছে তারা জানে না। সব শুনে তাজেল একদম চুপ হয়ে গেল। তখন নওশি বলল,,

“চল তাজেল আমরা বাড়ি যাই এখন।”

তাজেল কিছু বললো না ও হাঁটা ধরলো বাড়ির দিকে। হেঁটেই বাড়ি যাবে সে। নওশি বুঝতে পারলো তাজেলের খুব খারাপ লাগছে সাথে রাগ ও লাগছে। তাই নওশি তাজেলের কাছে গিয়ে বলল,,

“ডাক্তার আপার জামাইয়ের ওপর রাগ করিস না তাজেল। ডাক্তার আপার ভালোর লাইগাই তো ডাক্তার আপারে নিয়া গেছে অন্য জায়গায়।”

তাজেল এবার ও কিছু বললো না। সে হাঁটতেই লাগলো।
___________

“কিরে আরবাজ তুই আসলি কখন? তোর না হাসপাতালে থাকার কথা।”

সকালের খাবার খাওয়ার জন্য নিচে আসতেই উক্ত প্রশ্নটি শেখ আমজাদ করলেন। শুক্রবার সে বাড়ি ফিরেছে আজ যাবে আবার। আরবাজ চেয়ারে বসতে বসতে বলল,,

“কাল রাতেই ফিরেছি সবাই ঘুমিয়েছিল তাই কাউকেই জাগাইনি।”

“কেন? চলে এলি কেন?”

“ডক্টর মেহবিন এর হাজবেন্ড ওনাকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেছে তাই ।”

“কোথায় নিয়ে গেছে?”

“তা জানি না উনি বলেন নি।”

“ওহ আচ্ছা।”

তখন রাইফা বলল,,

“আরবাজ ভাইয়া ডক্টর মেহবিন এখন কেমন আছে?”

“কালকে রাতেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল বলে ডক্টর বলেছে আউট অফ ডেন্জার চিন্তার কোন কারন নেই। তিনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। তা সবাই তো এসে পরেছে বাবা আর মিশু কোথায়?”

“ঐ তো আসছে দুজন।”

মিশু প্রতিদিনের তুলনায় আজ অনেকটা শান্ত সে চুপচাপ এসে তার বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসে পড়লো। শেখ শাহনাওয়াজ ও বসলেন। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আরবাজ ডাক্তারের কি খবর?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো বাবা। ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

তখন মিশু বলল,,

“আমি ফুলকে দেখতে যাবো বাবা।”

তখন আরবাজ বলল,,

“তোমার ফুল এখানে নেই। তোমার ফুলের জামাই তাকে নিয়ে গেছে অন্য জায়গায়।”

“ফুলের জামাই ও আছে বাজপাখি?”

“হুম আছে।”

“কই এতোদিন তো দেখলাম না।”

“কাল হাসপাতালে এসেছিল।”

তখন আরিফা জামান বললেন,,

“মেয়েটা যে বিবাহিত বুঝতেই পারি নি। কখনো বলেও নি আমাদের।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার সে কিভাবে কতটা নিজের জীবনবৃত্তান্ত অন্যদের জানাবে। এখন সবাই কথা বন্ধ করে খাবার খাওয়া শুরু করো।”

________________

মেহবিনের এক্সিডেন্টের বিশ দিন পার হয়ে গেছে আজ মাহফুজ শাহরিয়ার এর ওপর বড় একটা হামলা হয়। তিনি কোথাও থেকে অফিসে ফেরার পথে উক্ত ঘটনা ঘটে। এখন তিনি অপারেশন থিয়েটারের ভেতর রয়েছেন অবস্থা খুবই খারাপ তিনটে গুলি লেগেছে ওনার। পুরো শাহরিয়ার পরিবার থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি মুখর নিজেও পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস মাহমুজ সেই কখন থেকে কাঁদছেন মিসেস আছলাম তাকে সামলাচ্ছেন। নাফিয়াকে নিসা সামলাচ্ছে। আছলাম শাহরিয়ার তার মাকে অর্থাৎ আছিয়া খাতুন কে। আলভি ওষুধ পত্র রক্তের সবকিছু ব্যবস্থা করছে। এই সময় মুখরের পাশে কেউ নেই সে একা দেয়ালের সাথে চেপে দাড়িয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে আছে। ভিশন কান্না পাচ্ছে তার কিন্তু সে কাঁদলে তার মা আর বোনসহ পুরো পরিবার আরো ভেঙে পরবে তাই শক্ত হয়ে রয়েছে। মিসেস আছলাম , আছলাম শাহরিয়ার এর কাছে এসে বললেন,,

“এখানে মেহবিনের থাকা উচিৎ নয় কি। পরিবারের এই অবস্থা তারওপর যে হাসপাতালে সে সম্পর্কে তার শ্বশুর তার ওপর কি মেহবিনের কোন দায়িত্ব নেই। মানলাম ও আমাদের বাড়ি থাকে না ওকে উঠিয়ে আনা হয়নি। কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নি। মা ওর ওপর কিছু শর্তারোপ করেছেন।তাই বলে কি খারাপ সময়েও সব ছেড়ে দেবে। পরিবারের পাশে থাকবে না।

কথাটা ওখানে থাকা সবাই শুনলো। মুখর ওর মা ওর বোনের কানেও গেল। মুখর পুরোটা শুনে আরো পাথর হয়ে গেছে। সব শুনে আছলাম শাহরিয়ার মুখরের কাছে গিয়ে বলল,,

“মেহবিন কিছু জানে? ও যদি,,

হুট করেই আছিয়া খাতুন আছলাম শাহরিয়ার কে না বলতে দিয়ে মুখরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,,

“সারা শহর জানে হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিক পুলিশগো অভাব নাই। আর ও জানবো না।তোমার বউ কই মুখর। বাড়ির বউ হে পরিবারের ওপর এতোবড় একটা ঝড় যাইতেছে সে কই? নাকি আসবো না। সে কি তার শ্বশুরের মরার জন্য অপেক্ষা করতেছে নাকি এখন আসবার পারতেছে না। সারা শহর জানে মাহফুজ এর এই অবস্থা তোমার বউকি শুনে নাই কিছু। আবার বড় বড় ডায়লগ দেয় সে সবাইরে আপন ভাবে সে মাহফুজ রে নিজের বাবা মনে করে। বাপের এইরকম খবর শুইনা কোন মেয়ে কি বইসা থাকতে পারে। নাকি সে কোন ঝামেলায় পরবো না দেইহা আসতেছে না। তার কি কোন দায়িত্ব নাই। এহন তো মনে হইতেছে তার সাথে তোমার বিয়া দেওয়ায় ভুল হইছে। যদিও আমার আগেই মনেই হইছিল একটা পরিবারহীন মাইয়া কখনো পরিবারের মূল্য বুঝবো না। ও বুঝতে পারবো না সম্পর্ক কেমন হয় সম্পর্ক এর গুরুত্ব ও,,

উনি আর কিছু বলতে পারলো না কারণ মুখর এক দৃষ্টিতে কড়িডোরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখরের থমকানো চেহারা দেখে তিনি মুখরের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। আর তাকিয়েই থমকে গেল। কেউ একজন আসছে এক হাতে স্কাউচে ভর দিয়ে মাথায় ব্যান্ডেজ ওরনা এমনিতেই মাথায় দিয়ে রেখেছে তার ওপর কালো ক্যাপ মুখে মাস্ক। থ্রি কোয়ার্টার হাতার গোল জামায় হাতের ব্যান্ডেজ ও স্পষ্ট। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার পেছনে একজন ছেলে আর আর একজন মেয়ে। তা দেখে মুখর বলল,,

“কাব্যের বিহঙ্গিনী তার দায়িত্ব কখনো ভুলে না। আর সম্পর্কের কথা বললেন না দাদিজান তার থেকে ভালো সম্পর্কের মানে এবং সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝতে আমি আর কাউকে বুঝতে দেখিনি।

বলেই সে দৌড়ে মেয়েটার সামনে গেল। আর তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে তার হাত ধরে বলল,,

“তোমাকে এই অবস্থায় এখানে আসতে কে বলেছে বিহঙ্গিনী?”

মেহবিন মুখরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমার দায়িত্ব আর আমার এই পরিবারের থেকে পাওয়া স্নেহ ভালোবাসা।”

মুখর কিছু বললো না ওকে আস্তে আস্তে করে ধরে আনতে লাগল । পেছনে মিহির আর মাইশা। এদিকে মেহবিন কে এই অবস্থায় দেখে সকলে চমকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহবিন সোজা এসে মুখরের মায়ের পাশে বসে তার হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলল,,

“ভরসা রাখুন আল্লাহর ওপর মা। ইনশাআল্লাহ আল্লাহর রহমতে বাবার কিছু হবে না। ইনশাআল্লাহ বাবা খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। বাবার জন্য দোয়া করুন।আর আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের মন থেকে খুব করে চাওয়া জিনিসটা থেকে কখনো নিরাশ করেন না।”

মেহবিন কে দেখেই ওনার কান্না থেমে অবাকতা ফুটে উঠেছে। তিনি সেসব বাদ দিয়ে বলল,,

“তোমার এই অবস্থা কেন মেহু?”

“তেমন কিছু না যাস্ট ছোট একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আমার কথা ছাড়ুন তো আমি এখন ঠিক আছি।”

মেহবিনের কথা শুনে মুখর অবাক হয় না। কারন সে ভালোমতোই চেনে তার বিহঙ্গিনীকে। মেহবিন একবার মুখরের দিকে তাকালো ঐ চোখে কতটা অসহায়ত্ব তা ও টের পেল। সে যে কতটা কষ্টে নিজের কান্না চেপে রেখেছে সেটা ও ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো। মেহবিন মুখরের মাকে কিছুক্ষণ শান্তনা দিয়ে আছিয়া খাতুনের কাছে গিয়ে তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। আছিয়া খাতুন মেহবিন কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। মেহবিন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,,

“কাঁদবেন না দাদিজান ইনশাআল্লাহ বাবার কিছুই হবে না। উনি খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন বাবার জন্য যাতে তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে।”

কথাটা শুনে আছিয়া খাতুন আরো বেশি করে কান্না জুড়ে দিল। মেহবিন কোন রকমে তাকে শান্ত করলো। এরপর মুখরের হাত ধরে ওকে নিয়ে একটু দূরের বেঞ্চে বসলো। মেহবিন বলল,,

“আমার কাঁধে মাথা রাখুন কাব্য!”

মুখর বাধ্য ছেলের মতো রাখলো। মেহবিন নিজের মাথার ক্যাপ খুলে মুখরের মাথায় পরিয়ে দিয়ে এমনভাবে নিচু করে দিল যাতে মুখরের মুখ না দেখা যায়।সব শেষে মেহবিন বলল,,

“এবার আর আপনার দূর্বলতা কেউ দেখবে না কাব্য।”

মুখরের চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি পরতে লাগলো। মুখর বলল,,

“তুমি এখানে কেন এলে বিহঙ্গিনী?”

“আমি কাউকে বলেছিলাম তার জীবনের সাথে আমি যেমনভাবেই জড়িয়ে যাই না কেন? তার সুখে দুঃখে আমি তার সাথে থাকবো। আর কেউ একজন কথা দিয়েছিল আমার সব সুখে দুঃখে সে আমার সাথে থাকবে। কয়েকদিন আগেও সে তার কথা রেখেছে তাহলে আমি কেন নয়। ইনশাআল্লাহ বাবার কিছু হবে না আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন।”

“তুমি জানো আমার এতোক্ষণ কতটা অসহায় লাগছিল। আমার পরিবার জানে আমি একজন কঠোর ব্যক্তিত্বের মানুষ আমার কারো সঙ্গ প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার কি করতে ইচ্ছে করছিল জানো চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। আমার বাবা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আজ সেই অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল বিহঙ্গিনী। দেখো না সবার জন্য কেউ না কেউ শান্তনার জন্য ছিল। মায়ের জন্য কাকিমনি, নাফির জন্য নিসা,দাদির জন্য কাকাই কিন্তু কেউ আমার কাছে আসে নি বিহঙ্গিনী। এই সময়টায় আমারও একটা কাঁধ প্রয়োজন এটা কেউ ভাবে নি। আমার ভিশন দমবন্ধ লাগছিল চোখের অশ্রু গুলো বার বার চিৎকার করছিল বাইরে বের হবার কিন্তু আমি দিই নি মায়ের আর বোনের দিকে তাকিয়ে। আমার মতো কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পূর্ন মানুষ যদি কাঁদে তাহলে তারা আরো ভেঙে পরবে।কারন আমাকে তারা কোন পরিস্থিতিতে ভেঙে পরতে দেখেনি। আমি আমার বাবাকে খুব ভালোবাসি বিহঙ্গিনী। আমার বাবার এই অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বিহঙ্গিনী। কারন ঐ একজন মানুষ সবসময় আমার ওপর বটগাছের মতো ছিল। আমার আইডল আমার শক্তি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বিহঙ্গিনী।

“বাবার কিছু হবে না প্লিজ নিজেকে শান্ত করুন। আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে এটা একটা পরীক্ষা মাত্র। আল্লাহর ওপর ভরসা করুন তাকে ডাকুন বাবার জন্য দোয়া করুন ইনশাআল্লাহ বাবা ভালো হয়ে যাবে।”

মুখরের কান্নায় মেহবিনের জামার হাতা ভিজে যাচ্ছে তবুও সে নিশ্চুপ। মুখর বলতে লাগলো,,

“একটু আগে সবাই তোমার ব্যাপারে কতোকিছু বলছিল। তখন আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল আর বলতে ইচ্ছে করছিল আজ বাবা যে অবস্থায় ভেতরে রয়েছে তুমিও বিশদিন আগে সেরকম অবস্থায়ই ছিলে। কিন্তু আমি বলতে পারিনি বিহঙ্গিনী আমি ওদের কথার জবাব দিতে পারি নি। ওরা বলছে তোমার দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে আমি তখনও মুখ ফুটে বলতে পারি নি তোমার দায়িত্ব পালনের গভীরতা কতটা। তারা দূর থেকে টেনশন করবে বলে তুমি সবাইকে মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন খবর না জানানোর জন্য ওয়াদা করিয়ে রেখেছো। এরা তো তোমার কোন দুঃখে তোমার পাশে থাকে নি তাহলে তারা কেন আজ তোমার,,

মেহবিন মুখরকে না বলতে দিয়ে বলল,,

‘আমার কথা ছাড়ুন মুখর আমার কারো প্রতি কোন প্রত্যাশা নেই এটা নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। প্লিজ শান্ত হন আপনি।”

মুখর আর কিছু বললো না চুপচাপ মেহবিনের কাঁধে মাথা রেখে নিজের অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। মেহবিন মুখর কে নিয়ে বসলে সবাই সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। মেহবিন মুখরের মুখটা ক্যাপ দিয়ে ঢেকে দিলে ওরা বুঝতে পেরেছিল মুখর কিছু বলছে কিন্তু কি বলছে বা ও কাঁদছে কিনা এটা কেউ দেখেনি। মুখর সোজা হয়ে বসলো কিছুক্ষণ পর এখন অনেকটাই শান্ত সে। তখন মুখরের মামার বাড়ির লোকজন এলো। আরো কিছু লোকজন এলো। কয়েকজন পুলিশ ও আগে থেকেই ছিল। মেহবিন আজ কিছুই করলো না মাস্ক আছে তো। তাছাড়া মাইশারাও তো আছে। অতঃপর আধ ঘন্টা পর ডক্টর বের হলো সবাই এগিয়ে গেল। ডাক্তার জানালেন আউট অফ ডেন্জার চিন্তার কোন কারন নেই তবে দুই মাস ফুল বেড রেস্ট এ থাকতে বললো। সকলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। মিহির আর মাইশা যেহেতু আছে মুখর বলল মেহবিন কে মাস্ক খুলে ফেলতে। কারন মাস্কে ওর নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে অসুস্থ দেখে। মেহবিন মাস্ক খুলে ফেলল। মাহফুজ শাহরিয়ার কে কেবিনে দেওয়া হলে সকলে একবার করে মাহফুজ শাহরিয়ার কে দেখে এলো। মুখরের মামার বাড়ির সকলে চলে গেল । মাইশারা অনেকক্ষন রইল এখন বের হবে কারন রাত হয়েছে অনেক এখন দুই জনের বেশি অ্যালাও না। মেহবিন অসুস্থ দেখে মুখর বলল তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে। মেহবিন চলে গেল এখন মুখরের মা আর মুখর বাদে সবাই বাড়ি যাবে। তখন তিনজন নার্স মেহবিনের নামে আর ওদের নামে কিছু বলাবলি করছিল তা দেখে নাফিয়া বলল,,

‘এই আপনারা আমাদের সম্পর্কে কি কথা বলছেন?”

তখন একজন বলল,,

“না আপু আপনাদের নামে তেমন কিছু বলছিলাম না । ঐ যে ক্যাপ পড়া আপু এতক্ষণ ছিল না আপনাদের সাথে। ওনাকে দেখে ও বলছিল আপনারা সবাই কতো কাঁদলেন কিন্তু উনি সবাই কে শান্তনা দিলেন কিন্তু একটুও কাঁদলেন না। উনি কি দিয়ে তৈরি । তাই আমি বলছিলাম উনি সিমেন্ট দিয়ে তৈরি। বছর খানেক আগে উনি এসেছিলেন একজন কে নিয়ে উনার অবস্থা আপনার বাবার থেকেও খারাপ ছিল উনার তো বাঁচার চান্সই ছিল না। পাঁচ দিন কি খারাপ অবস্থা ছিল। উনি এক ফোঁটাও চোখের পানি ফেলেন নি। এবং যা প্রয়োজন সব একাই করেছিলেন এমনকি ঐ পাঁচ দিন ঠিক মতো খাওয়া তো দূর তিনি ঘুমানওনি। ওনার পাশে কেউ ছিল না তবুও তিনি ভেঙে পরেন নি। আল্লাহর রহমতে পাঁচ দিন পর ওনার পেশেন্ট আউট অফ ডেন্জার হয় । আমি জিজ্ঞেস ও করেছিলাম ওনাকে আপনার কি একটুও কান্না পায় নি উনি বলেছিল ‘কান্না করলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কান্না করে ভেঙে পরলে কি পেশেন্ট সুস্থ হয়ে যাবে। আর কান্না করলে সে অসুস্থ হলে তার দৌড়াদৌড়ি কি আমি করে দেব নাকি। আর এটাও বলেছিল আবেগে ভেসে দায়িত্ব ভুলে যেতে নেই। আবেগ কান্না মানুষ কে দূর্বল করে দেয়। আর সে দূর্বল নয়।” এটা শুনে আমি তো ওনাকে সিমেন্ট আপু বলে আখ্যা দিয়ে ছিলাম। প্রথমে চিনতে পারি নি কিন্তু যখন মাস্ক খুললো তখন ওনাকে দেখেই চিনেছি আমি আর সারাজীবন মনেও রাখবো আমি।”

সব শুনে পুরো শাহরিয়ার পরিবার থ হয়ে গেলেন পরে আলভি বলল,,

“হয়তো তার চেনা কেউ ছিল না তাই কাঁদেনি?”

তখন নার্সটা বলল,,

“আরে কি বলেন উনি তো আপুর বাবা ছিলেন।”

কথাটা শুনে যেন শাহরিয়ার পরিবারের ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। আছলাম শাহরিয়ার বললেন,,

“আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে তার বাবা আসবে কোথা থেকে? ”

‘না স্যার কোন ভুল হচ্ছে না। তার বাবাই ছিল এমনকি তাদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে দুজনের একই রকম।”

‘আপনারা পেশেন্ট এর নাম ঠিকানা দিতে পারবেন।”

‘সরি স্যার এ বিষয়ে আমি আপনাকে কিছু বলতে পারছি না আসছি।”

বলেই নার্সগুলো চলে গেল সকলে মুখরের দিকে তাকালো। ও বলল,,

‘সবাই বাড়ি চলে যাও অনেক রাত হয়েছে।”

“তুই কিছু জানিস মুখর?”

“না! তোমরা বাড়ি যাও।”

মুখর সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল কেউ কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু মেহবিন কে নিয়ে সবার কৌতুহল দিনকে দিন বেড়েই চললো। সবথেকে বেশি আছিয়া খাতুন এর।

************

দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরো একমাস দশ দিন। এখন কেউ মেহবিনের উঠানে খেলে না। সেদিনের পর তাজেলকে খেলতে দেখা যায় না, না দেখা যায় তার মুখের হাঁসি। সে যেন সব ছেড়ে দিয়েছে তার ডাক্তারের জন্য। সকাল বেলা উঠে নিজেই পড়াশোনা করে স্কুলে যায় আবার ফিরে এসে ঘরেই থাকে বিকেল হলে ডাক্তারের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এটাই তার সেদিনের পর দুই মাসের রুটিন। একটা বাচ্চা মেয়ের মেহবিনের প্রতি এতটা ভালোবাসা দেখে সবাই অবাক হয় বয়সই বা কতো এই ছোট্ট মেয়েটার ডাক্তারের অবর্তমানে যেন তাকে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। সেদিন যাওয়ার দুদিন পর মুখর এসেছিল মেহবিনের বাড়িতে সে এসে তাজেলকে তার ডাক্তারের খবর দিয়ে গেছে। এই দুই মাসে মুখর চারবার এসেছিল তাজেলের কাছে মেহবিনের অবস্থা জানিয়ে গেছে। দুইবার মেহবিনের মতো ঘুরতে নিয়ে গেছিল। কিন্তু মুখর সেই আগের তাজেলকে পায় নি। তবে একটা ব্যাপার হলো মুখর ওকে বলেছে ফোনে কথা বলবে কি না ও সাফ না করে দিয়েছে বলেছে তার ডাক্তারকে সামনাসামনি দেখেই সে তার সাথে কথা বলবে। মুখর অবাক হয়েছিল মেহবিন আর তাজেলের বন্ডিং দেখে। মেহবিন যখন চোখ খুলেছিল নিজেকে অন্য জায়গায় আবিষ্কার করে তখন ও বলেছিল তাজেলকে বলে এসেছে কি না যে ওকে নিয়ে আসা হয়েছে। ও না জানাতেই ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিল তাজেলের কাছে তার খবর জানাতে। এরপর মেহবিনের কথা মতোই ও আসতো তাজেলের কাছে।

প্রতিদিনের মতো আজ ও বিকেলবেলা তাজেল মেহবিনের বাড়ির সামনে বসে আঁকিবুঁকি করছে মাটিতে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ বলল,,

“শেখ তাজেল এখানে বসে কি করছেন?”

তাজেল তার দিকে না তাকিয়েই আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল,,

‘হাডুডু খেলছি এখানে বসে। তুই খেলবি?”

এ কথা শুনে পেছনের মানুষ টা হাসলো। সে বলল,,

” না খেলবো না। আরে বাহ! একা একা হাডুডু খেলেন আপনি। তা খেলছেন কিভাবে? আমি তো দেখছি মাটিতে বসে আঁকিবুঁকি করছেন।”

‘দেখতেছোস আঁকিবুঁকি করতেছি তাইলে আবার জিগাস করোস কেন?”

বলতে বলতেই সে পেছনে ঘুরলো পেছনে ঘুরে কাঙ্খিত মানুষ টাকে দেখে তাজেল হেঁসে চিৎকার করে বলল,,

‘ডাক্তার!”

বলেই ঝাঁপিয়ে পরলো মেহবিনের ওপরে মেহবিন টাল সামলাতে না পেরে মাটিতেই পরে গেল। মেহবিন তাজেলকে আর তাজেল মেহবিনকে খুব শক্ত করে আকড়ে ধরলো। মেহবিন আর তাজেলের মুখে তৃপ্তির হাঁসি। এই হাঁসি তাজেলের মুখে এই দুই মাসে কেউ দেখেনি। এসব দেখে পেছনের মানুষ গুলো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে শুধু একজন বাদে সে হলো মুখর। তাজেলের চিৎকার শুনে নওশিদের ওখানের প্রায় সবাই বেরিয়ে এসেছে। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘নেত্রী তুমি আসতে না আসতেই আমাকে ফেলে দিলে।”

তাজেল হেঁসে বলল,,

‘তোমার সাতে আমিও পরলাম হেইডা দেখলা না।”

তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো তখন মুখর এসে তাজেলকে কোলে করে উঠালো তারপর মেহবিন কে উঠালো। মুখর তাজেলকে বলল,,

‘নেত্রী তোমার ডাক্তার এখন সম্পূর্ণ সুস্থ বুঝলে তবুও,,

মুখর কে আর না বলতে দিয়ে মেহবিন বলল,,

‘আমি ঠিক আছি। কিছুই হয় নি আমার।”

তখন তাজেল বলল,,

“কিমুন আছাও ডাক্তার?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘আমার নেত্রীকে দেখে এখন ভিশন ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

‘তুমারে দেইখা মেলা ভালো আছি।”

তখন নওশি বলল,,

‘ডাক্তার আপা আপনার এক্সিডেন্টের পর আজ প্রথম তাজেল এভাবে হাসলো। আপনি যাওয়ার পর ওর হাসির বাত্তি বন্ধ হইয়া গেছিল আপনি আসতেই তা আবার জ্বলে উঠলো।”

মেহবিন হাঁটু গেড়ে বসে তাজেলকে জড়িয়ে ধরে বলল,,

“আমায় এতো কেন ভালোবাসো নেত্রী?”

‘তুমি আমারে ভালোবাসো তাই।”

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩৪
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

সবার শেষে মেহবিনের সাথে আসা মুখর বাদে আরো দুজন নতুন মানুষ দেখে তাজেল বলল,,

“ঐ দুইজন কিরা ডাক্তার?”

এতোক্ষণ মিহির আর মাইশা অবাক হয়ে সব দেখছিল। হুট করে তাজেলের প্রশ্নে ওরা এগিয়ে এলো। দু’জনেই মুখ ঢাকা মিহিরের মুখে মাস্ক মুখরের মতো আর মাইশার মুখে হিজাব নিকাব। মেহবিন কে দিতে এসেছে ওরা। মেহবিন হেঁসে ওদের সাথে তাজেল এর পরিচয় করিয়ে দিল। মেহবিনের মুখে যখন তাজেলের কথা শুনেছিল তখন ওরা অবাক হয়ে গেছিল আজ চোখের সামনে এসব দেখে বুঝলো মেহবিন ওর সম্পর্কে যা বলেছে কমই বলেছে। মেহবিন গ্ৰামের আসা সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। ওরা বাড়ির ভেতরে ঢুকলো মেহবিন তাজেলকে ও নিয়ে ঢুকলো। দুই মাস বাড়িতে কেউ ছিল না। তাই বেশ ময়লা তখন নওশি আর দুইজন মহিলা এলো ঝাড়ু হাতে ওদের বসতে বলে বলল ওরা পরিস্কার করে দিচ্ছে মেহবিন মানা করলেও তারা শুনলো না। তাজেলকে বলল নওশিদের বাড়িতে নিয়ে যেতে। নওশি ওদের বলল যেতে ওরা বলল সমস্যা নেই ওরা বাইরে দাঁড়াচ্ছে। মুহুর্তেই মহুয়াপুর গ্ৰামে ছড়িয়ে গেল ডক্টর মেহবিন মুসকান আবার গ্ৰামে ফিরে এসেছে। মহিলারা ঘর পরিষ্কার করে বের হতেই মেহবিন সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। যেদিন শেষ এই ঘরটায় ছিল সেদিন সকালেও সবাই কি সুন্দর খেলছিল গল্প করছিল খেয়েছিল। কি থেকে কি হয়ে গেল। মেহবিন কিচেনে যেতে চাইলে মাইশা বারন করলো সে কিচেনে গিয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে এলো। তখন তাজেল মাইশা কে বলল,,

“ডাক্তার তাইলে তোমাগো বাড়িতে আছিল?”

মাইশা হেঁসে বলল,,

“হুম। মেহু তোর নেত্রী তো দেখি সেই। এইবার ভাবছি ওকেই নির্বাচনে দাঁড়া করাবো ওকে দাঁড় করালে আমাদের বাড়ির মন্ত্রীসাহেব ও ডাব্বা মারবে। তোর নেত্রী এতো কিউট যে সবাই ওকেই ভোট দেবে।”

তখন তাজেল বলল,,

“তোমাগো বাড়ি কি শেখ হাসিনা থাহে নাকি? আর আমি ভোটে দাড়ামু না আমার বয়স হয় নাই এহনো আগে আমি বড় হইয়া নেই।

“এই মেয়েটা এতো কিউট কেন মেহু?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“মাইশা আপু ভাগ্যিস কিউট বলেছো কিউটের ডিব্বা বলোনাই নাহলে সে বলতো সে ডিব্বা না সে মানুষ। আর আপু তুমি যে মজাটা করতে চাচ্ছো ও বুঝছে না তাই বলে লাভ নেই। আর নেত্রী ওদের বাড়িতে শেখ হাসিনা থাকে না। আর বাকি কিছু তোমার চিন্তা করতে হবে না।

অতঃপর ওরা আরো কিছুক্ষণ গল্প করলো। এখন মুখর মিহির আর মাইশা চলে যাওয়ার জন্য উঠবে এমন সময় কেউ দৌড়ে এসে মেহবিনকে জরিয়ে ধরলো আর কেঁদে উঠলো। মেহবিন বুঝতে পারলো এটা কে ও বলল,,

“ফুল কাঁদছো কেন? এই দেখো এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।”

মিশু বলল,,

“ফুল তোমার কতো রক্ত পরছিল তুমি জানো?”

“তুমি দেখেছিলে? নাকি ফোবিয়ার জন্য আমার ওখানে যাও নি।”

“গিয়েছিলাম তো আমি তাই জন্যই তো !”

এইটুকু বলেই মিশু থেমে গেল ও সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তখন ঘরে রাইফা, মুনিয়া ,শান্তা ,আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ ঢুকলো। মিশু বলল,,

“কেমন আছো তুমি?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো তুমি?”

“আমিও ভালো আছি।”

মেহবিন সবাইকে বসতে বলল তখন মিহির বলল,,

“সাবধানে থাকিস মেহু আমরা আসছি আল্লাহ হাফেজ।”

মেহবিন মাথা নাড়ালো ওরা কাউকে কিছু না বলতে দিয়ে বেরিয়ে গেল। তখন মুনিয়া বলল,,

“এরা কারা ছিল আপু?”

মেহবিন বলল,,

“আমার হাজবেন্ড আর আমার দুজন শুভাকাঙ্ক্ষী। ওনাদের একটু তাড়া ছিল তাই এভাবে বেরিয়ে গেল। কিছু মনে করো না।”

“ওহ আচ্ছা!”

সকলে একে একে ওর অবস্থা জিজ্ঞেস করলো। শেখ শাহনাওয়াজ রাইফা আর আরবাজ শুধু দেখে গেল। তারাও কিছুক্ষণ পর চলে গেল। মিশু বলে গেল শুক্রবার যেন মেহবিন ওদের বাড়ি যায় মেহবিন বলল সে যাবে। সবাই গেলেও রয়ে গেছে তাজেল সে বাড়িতে বলে এসেছে আজ ডাক্তারের সাথে থাকবে। মেহবিনের জন্য ওর মামী খাবার প্যাক করে দিয়েছে তাই খাবার নিয়ে টেনশন নেই। তাজেল বিছানায় বসে মেহবিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তা দেখে মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“কি দেখছো নেত্রী?”

“তোমারে পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা হাসপাতাল থেইকা নিয়া গেছে শুইনা আমি ভাবছি তুমিও আমার মায়ের মতো আমারে ধোঁকা দিবা ডাক্তার।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“তা ধোঁকা দিয়েছি কি?”

“তারপর দুইদিন পর যহন দেখলাম পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা আইলো তহন বুঝলাম তুমি আমারে ধোঁকা দিবা না ডাক্তার।’

“ডাক্তার কি তার নেত্রীকে ধোঁকা দিতে পারে হুম?”

“কি জানি দিবার পারো যেনে আমার মায়ের রক্তের সম্পর্কও থাহার পরেও আমারে ধোঁকা দিছে। হেনে তো তোমার সাতে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নাই।”

মেহবিন বুঝতে পারলো এই কথাটা তাজেলের নয় অন্য কেউ মাথায় ঢুকিয়েছে। এই জন্যই তাজেল ওর খবর পাওয়ার পরও মনমরা হয়ে থাকতো। মেহবিন তাজেলকে নিজের কোলে বসিয়ে বলল,,

“একটা কথা সবসময় মনে রাখবে নেত্রী। সবসময় রক্তের সম্পর্কই যে বড় হয় তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো রক্তের সম্পর্কগুলো আমাদের ধোঁকা দেয়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক থাকে না তাদের সাথে তৈরি হয় আত্মার সম্পর্ক। তা কখনো কখনো রক্তের সম্পর্কগুলো থেকেও অনেক গভীর হয় এবং অনেক রক্তের সম্পর্ক থেকেও উর্ধ্বে হয়।”

“তোমার ভারী ভারী কথা কতসময় আমার মগজে ঢুকে না।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“ঢুকাতে হবেও না শুধু এই মনে রেখো মাঝে মাঝে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও আমাদের অন্য মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে। যেমন তোমার আর আমার একটা আত্মার সম্পর্ক।”

তাজেল ঘুরে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমার আত্মা কি তোমার শরীরে গেছে নাকি আর তোমার আত্মা আমার শরীরে আইছে নাকি।”

“মানে?”

“আমাগো আত্মার সম্পর্ক কেমনে হইলো যদি আমাগো আত্মা অদলবদল না হয়।”

এবার মেহবিন বুঝতে পারলো তাজেল কি বলতে চেয়েছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মেহবিন হেঁসে উঠল আর বলল,,

“নেত্রী তুমিও না!”

“আরে কওনা কেমনে হইলো?”

“আমিও জানি না কেমনে হইলো কিন্তু সম্পর্ক তো হয়েছেই তাইনা নেত্রী।”

“হুম! ও আল্লাহ মেলা রাইত হইয়া গেছে এহন খায়া নও। পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা কইছে তাড়াতাড়ি খাইয়া ওষুধ খাইতে‌।”

“হুম যাবো তো!”

“যাও আগে তুমি!”

তাজেলের জোরাজুরিতে মেহবিন খাবার নিয়ে এলো তাজেলকে খেতে দিল আর নিজেও খেল। অতঃপর তাজেল এই দুই মাসের জমানো সব বলতে লাগলো মেহবিন ও হেঁসে মনোযোগ শ্রোতার মতো শুনতে লাগলো।

_______________

অনেকদিন পর রাতে কাব্যের বিহঙ্গিনী পেজ থেকে নতুন পোস্ট করা হলো,,

“রক্তের সম্পর্ক থেকেও উর্ধ্বে কিছু মানুষের সাথে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয় আমাদের। আর কখনো কখনো সেই সম্পর্কগুলোর সমস্ত স্বার্থপরতার উর্ধ্বে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জন্যই পৃথিবী এতো সুন্দর লাগে।”

অনেকদিন পর পোস্ট হওয়াতে লাইক কমেন্ট করে সবাই যেন বিহঙ্গিনীর খোঁজ নিচ্ছে। তার সাথে সবাই তার বেস্ট ফ্রেন্ডদের মেনশন দিচ্ছে “***** যেমন তুই’ লিখে কেউ কেউ তার প্রিয় মানুষটাকে ও মেনশন দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ শেয়ার ও দিচ্ছে নানান প্রিয় মানুষদের ট্যাগ দিয়ে।

তার আধ ঘন্টা পর বিহঙ্গিনীর কাব্য আইডি থেকে নতুন পোস্ট হলো সেটা হলো কাব্যের বিহঙ্গিনীর পেজের আজকের করা পোস্ট শেয়ার করার ওপরে ক্যাপশন

“আপনি ঠিক বলেছেন এডমিন মহাদয়া যেমন কাব্যের বিহঙ্গিনীর সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জন্য পৃথিবী শুধু সুন্দর নয় সে পাশে থাকলে অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগে।”

নোটিফিকেশন এর শব্দে মেহবিন পাশে তাকালো ও দেখলো তাজেল ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিতে ওর পেটের ওপর হাত দিয়ে। এতোক্ষণ মেহবিন এই নোটিফিকেশন এর অপেক্ষায় করেছিল ও জানতো আসবে এটা। মেহবিন মুচকি হেসে ফোনটা হাতে নিল আর সাইলেন্ট করে নোটিফিকেশন খুললো। পোস্ট টা দেখে ওর মুখের হাঁসিটা আরো প্রশস্ত হলো। সে মুচকি হেসে কমেন্ট করলো,,

“হুম বুঝলাম!”

ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসলো,,

‘কি বুঝলেন ম্যাডাম?”

“এই যে আপনার পৃথিবী অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগে।”

“তা, পৃথিবী অনেক অনেক বেশি সুন্দর কখন আর কে সাথে থাকলে লাগে সেটা বুঝোনি?”

” না বুঝিনি আমি বোকার বউ বোকী কি না।”

ওপাশ থেকে অবাক হওয়ার ইমুজি এলো। কাব্য বুঝতে পারলো সেদিনের রিভেঞ্জ নিচ্ছে। এদিকে মেহবিন হাসছে। বিহঙ্গিনীর কাব্য আইডি থেকে আবার রিপ্লাই আসলো,,

“থাক আপনার বুঝতে হবে না আমার বিহঙ্গিনী বুঝলেই হলো।”

‘হুম সেটাই তো!”

“আমার বিহঙ্গিনীর জন্য দুইটা লাইন লিখেছি এখনি দেখাবো কি?”

“না দেখিয়ে সারারাত ঘুমাতে পারবেন?”

‘সেটাই তো!”

‘হুম!”

“আসিও বৃষ্টি হয়ে ,
ভিজিবো তোমার বর্ষনে!
দূরত্ব আছে হয়ত বা
তবুও ভালোবাসা বাড়ছে ক্রমশে!

মেহবিন এটা দেখে মুচকি হাসলো। সে দু’টো ফুলের ইমুজি পাঠিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলো। এমতাবস্থায় ও আর কিছু বলতে চাইছে না।
_______________

পরদিন মেহবিন কে অনেকেই দেখতে এলো। মেহবিন মুচকি হেসে সবার সাথে কথা বলল। তারপর দিন থেকে মেহবিন হাসপাতালে গেল সকলে ফুল দিয়ে ওকে সাদরে শুভেচ্ছা স্বাগতম জানালো। দেখতে দেখতে তিনদিন পর শুক্রবার চলেই এলো। মেহবিন বেলা তিনটার দিকে চেয়ারম্যান বাড়িতে গিয়ে শেখ পরিবারের সাথে আরো একজন নতুন মানুষ দেখতে পেল । মেহবিন কে দেখে মিশু এগিয়ে এলো। আরিফা জামান মিসেস আমজাদ যারা মেহবিন কে দেখতে যায় নি তারা সবাই মেহবিনের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। মেহবিন সবাইকে তার অবস্থা জানালো। তখন শেখ আমজাদ বললেন,,,

“ডক্টর মেহবিন তোমাকে আবার এভাবে এবাড়িতে দেখতে পাবো ভাবতেই পারি নি।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘কেন?”

“আমরা তো ভেবেছিলাম তোমার হাজবেন্ড যখন তোমায় হাসপাতাল থেকে নিয়ে গেল। তখন তোমাকে এখানে আর পাঠাবে না।”

মেহবিন মুচকি হাসলো আর বলল,,

“জীবনে অনেক সময় অনেক বাধা বিপত্তি আসে তাই বলে কি মানুষ জীবন যাপন করা ছেড়ে দেয় নাকি। হ্যা হয়তো একটু পরিবর্তিত হয় এই যা।’

‘হ্যা তা তো বটেই?”

“তা আপনার মেয়ে জিনিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে?”

‘হুম আরো পনেরো দিন আগে।”

‘আলহামদুলিল্লাহ শুনে বেশ খুশি হলাম।”

‘ভাইজান বলেছিল আরো এক মাস পর করতে। পরে আমি ভাবলাম এঙ্গেজমেন্ট করে এতোদিন রাখাটা ঠিক হবে না। ভাইজান ও আমার কথা একটু ভেবে করে দিলেন।”

‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘আপনিও বসুন না ডাক্তার।”

‘আমি মিশুর জন্য এখানে এসেছি তাই ওর সাথে থাকাটাই বেটার আপনারা আপনাদের মতো কথা বলুন।”

“হুম আসুন পরিচয় করিয়ে দিই উনি হচ্ছে নুপুরের মা।”

“ওহ আচ্ছা।”

মেহবিন সালাম দিয়ে মিশুর কাছে গেল তখন সিঁড়ি দিয়ে আরবাজ এলো। আরবাজ মেহবিন কে দেখে হেঁসে ওর দিকে গিয়ে কিছু বলবে তার আগে নুপুরের মা বলল,,

‘ঐ তো আরবাজ বাবা এসে পরেছে এখন তাহলে কথা বলা যাক।”

আরবাজ কথাটা শুনে মেহবিনের দিকে না গিয়ে অবাক হয়ে ওর বাবার পাশে বসলো তখন মেহবিন মিশুকে নিয়ে সিঁড়িতে পা রাখবে এমন সময় আরিফা জামান বললেন,,

‘আরবাজ আমরা নুপুরের সাথে তোমার বিয়ের কথা ভাবছি তুমি এই বিষয়ে কি বল?”

কথাটা শুনে মেহবিন দাঁড়িয়ে পড়লো। ও পেছনে ঘুরলো ওর দেখাদেখি মিশুও দাঁড়ালো। আরবাজের দিকে তাকাতেই দেখলো আরবাজ কথাটা শুনে মেহবিন এর দিকে তাকিয়ে আছে। আরবাজ শান্ত স্বরে বলল,,,

‘এটা সম্ভব নয়!”

কথাটা শুনে শেখ পরিবারের সবার মুখ অবাকতায় ছেয়ে গেল। শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

‘কেন সম্ভব নয় নুপুর ভালো মাইয়া একজন ডাক্তার সে। তুমি কি ওর বাবার জন্য এরকমটা কইতেছো আরবাজ।”

“দেখুন দাদুভাই আমি কখনো কারো পরিবারের জন্য কাউকে বিচার করিনা। নুপুরের বাবা যা করেছে তাতে নুপুরের দোষ নেই তবে ব্যাপারটা এখানে সেটা না। ব্যাপার হলো আমি আগে থেকেই নুপুরকে বোনের নজরেই দেখে এসেছি।”

তখন নুপুরের মা বলল,,

“তো কি হয়েছে কাজিন কাজিন অনেক বিয়ে হয় এ আর নতুন কি ? আগে বোনের নজরে দেখতে বিয়ের পর বউয়ের নজরে দেখবা।”

‘সরি তাও আমার দ্বারা সম্ভব নয়।”

এবার শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,,

“যা বলার পরিস্কার করে বলো আরবাজ তোমার কি অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ?”

এবার সবাই উৎসুক হয়ে আরবাজের দিকে তাকায়। সে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,,

‘জি!”

সবাই আরেকদফা অবাক। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,,

‘কে সে? যদি সব ঠিক থাকে তাহলে তোমার বিয়ে তার সাথেই হবে।

তখন আরিফা জামান বললেন,,

‘এ আপনি কি বলছেন?”

“আরবাজ আমার সন্তান আরিফা আমি জানি কোনটায় আমার ছেলেমেয়ের জন্য ভালো হবে। আর তাছাড়া বিয়ে একটা বড় ব্যাপার যদি অমতে বিয়ে হয় তাহলে সারাজীবনেও কেউ সুখী হতে পারবে না। আমি তো আমার ছেলের বিয়ে তার পছন্দের মানুষের সাথেই দেব। আর আরবাজ তুমি বলো সে কে?”

শেখ শাহনাওয়াজ এর কথায় আরিফা জামান চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু দুজন রাগে ফোঁস ফোঁস করছে ভেতরে কিন্তু দেখাতে পারছে না। তখন মেহবিনের পাশ থেকে রাইফা আস্তেকরে বলে উঠলো,

“আলহামদুলিল্লাহ! বিয়েটা তাহলে নুপুরের সাথে হবে না। ”

আর কথাটা আস্তে হলেও মেহবিনের পাশেই রাইফা ছিল বলে ও শুনে ফেলল মেহবিনের রাইফার দিকে তাকালো মেয়েটার মুখে অদ্ভুত খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে তা দেখে মেহবিন একটু অবাক হলো বটে। তখন আরবাজ বলল,,

‘কমিশনার মাহফুজ শাহরিয়ার এর একমাত্র মেয়ে নাফিয়া শাহরিয়ার।’

এ কথা শুনে মেহবিন পুরোপুরি অবাক হয়ে গেল। ব্যাপারটা মোটেও আশা করে নি সে। ও কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু কি ভেবে আবার চুপ রইলো। ও মিশুর হাত ধরে ওপরে চলে গেল। এদিকে আরবাজ এর কমিশনার এর মেয়েকে পছন্দ শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ খুশি হয়েছেন আরবাজের কথা শুনে তিনি বললেন,,

“মুখরের বোন নাফিয়া!

“জি বাবা!”

তখন সায়িদ বলল,,

‘মুখর এর বাবা কমিশনার?”

আরবাজ হেঁসে বলল,,

‘হুম পুলিশ কমিশনার মাহফুজ শাহরিয়ার এর একমাত্র পুত্র মুখর শাহরিয়ার। এখন আমাদের থানার ওসি মুখর শাহরিয়ার।”

কথাটা শুনে অবাক হলেও কেউ কিছু বললো না। কারন তারা মুখরের ব্যাপারে কিছুই জানতো না। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“ওনাদের সাথে আমি কথা বলছি।”

‘না বাবা তুমি আগেই বলো না। তার আগে আলাদা করে আমি ওনাদের সাথে কথা বলতে চাই।”

“ঠিক আছে।”

________________

মেহবিনের কেমন যেন আরবাজের কথাটা শুনে অস্থির লাগছে। ও কিসের আশঙ্কা করছে ও নিজেও জানে না। তখন মিশু বলল,,

‘ফুল কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন লাগছে কেন?”

“কিছু না ফুল আমি ঠিক আছি।”

‘তুই কি মনে করেছিস আমাকে না বললে আমি কিছু বুঝতে পারবো না।”

হুট করে এমন কথায় মেহবিন চমকে উঠলো। আর মিশুর দিকে তাকালো তখন মিশু বলল,,

‘তোমাকে তুই করে বললে কি তুমি রাগ করবে ফুল?”

মেহবিন ফ্যালফ্যাল করে মিশুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে মিশু হেঁসে বলল,,

“তোমার এক্সিডেন্টের পর দেখি তুমি বদলে গেছো ফুল। অন্যরকম লাগছে তোমায়। এখন বলো তোমায় তুই করে বললে কি তুমি রাগ করবে। আমার না তুই করে বলতে খুব ভালো লাগে। আমার যদি একটা ছোট বোন থাকতো তাহলে আমি তাকে তুই করে বলতাম অনেক ভালোবাসতাম জানো।”

মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

‘সমস্যা নেই তুমি তুই করেই বলো।”

‘তাহলে আজ থেকে তোকে আমি তুই করে বলবো ঠিক আছে।’

‘ঠিক আছে।”

“তাহলে এখন চল আমার সাথে খেল। আর হ্যা গল্পও করবো তোর সাথে এই দুই মাসে কি কি হয়েছে সব।”

‘আচ্ছা।”

মেহবিন বসে বসে মিশুর কথা শুনতে লাগলো। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর ও নিচে নামতে লাগলো তখন নতুন কন্ঠে কাউকে কিছু বলতে শুনলো,,,

“এখন এক মিনিট ও দেরি করা যাবে না। আসলে আমাকে এখনি বেরুতে হবে নাহলে ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে। আমার দেশে ফেরাটা খুব দরকার। বাকিটা আমি ই-মেইল এর মাধ্যমে সব সেন্ট করে দেব।”

তখন মেহবিনের ফোনটা বেজে উঠলো ও ফোন ধরে নিচে আসতেই মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হলো। মেয়েটা মেহবিন কে দেখে মনে চরম অবাক প্লাস খুশি হয়েছে সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মেহবিন ও মেয়েটাকে দেখে খুশি হলো তবে ফোনে ইম্পোর্টেন্ট কিছু নিয়ে কথা বলছে তাই ও কোন রিয়াক্ট করলো না। মেয়েটা মেহবিন কে ঠিক দিল,,,

“এই মেহু তুই এখানে?”

মেহবিন হাত দিয়ে বলল পাঁচ মিনিট ও আসছে। মেহবিন একটু দূরে গেল। মেয়েটা দাড়িয়ে রইল। তা দেখে পুরো শেখ পরিবার যেন আকাশ থেকে পড়লো। একটু আগে খাওয়ার জন্য বলেছিল সবাই তাকে কিন্তু সে বলল তার এক মিনিট ও দেরি করা চলবে না। আর এখন, মেয়েটা কাউকে ফোন করে বলল ফ্লাইট ক্যানসেল করে দিতে। এটা দেখে সবাই আরেক দফায় অবাক। অতঃপর মেহবিন পাঁচ মিনিট পর এলো মেয়েটাকে আর পায় কে সে দুই হাত উঁচু করে দৌড়ে মেহু বলে জাপটে ধরলো। মেয়েটার কান্ডে মেহু হাসলো আর বলল,,,

“কি করছিস রাই ছাড় এভাবে ধরলে আমি তো চ্যাপ্টা হয়ে যাবো।”

‘আহ হা ওমন করিস কেন কতোদিন পর দেখা এতদিনের সবকিছু উসুল করতে হবে না।”

‘তুই ও না রাই পাগল একটা।”

“আমি রাই মালিক তো পাগল না পাগলি।তাও শুধু তোর কাছে।”

মেহবিন রাইয়ের কথায় হাসলো। রাই বলে মেয়েটা মেহবিন কে ছেড়ে দিল । আর সবার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

“আপনাদের বাড়িতে এতো ভালো ডক্টর থাকতে আমাকে ইন্ডিয়া থেকে আনালেন হাউ ফানি।”

তখন সায়িদ বলল,,

“মানে?”

“আমি আর মেহু বিদেশে একসাথে ডাক্তারি পাশ করেছি। আর আমাদের ব্যাচের মধ্যে সবথেকে ভালো ডক্টর হচ্ছে এই ইনি ডক্টর মেহবিন মুসকান।”

~ চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৩১+৩২

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

দেখতে দেখতে কেটে গেল আরো তিন চারদিন। আজ শুক্রবার নাস্তা করেই সকাল সকাল তাজেল হাজির তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে মেহবিনদের বাড়িতে। সবাই একই বয়েসের সাত অথবা আট বছর হবে। তাজেল এসেই মেহবিন কে ডাকতে লাগল,,

“ডাক্তার ও ডাক্তার।”

তাজেলের ডাক শুনে মেহবিন বেরিয়ে দেখলো পাঁচ ছয়জন বাচ্চা কুলসুম আর তাজেল দাঁড়িয়ে। ওদের দেখে মেহবিন বলল,,

“কি ব্যাপার নেত্রী? বন্ধের দিন সকাল সকাল সবাই আমার বাড়িতে?”

“কালক্যা না তুমি কইছিলা জুতা চোর খেলবা। তাই সকাল সকাল সবাইরে লইয়া আইছি।”

তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো। কাল বিকেলে ওরা জুতা চোর খেলছিল রাস্তায় মেহবিন বলে সে কোনদিন এগুলো খেলে নি তাই খেলতে চায় কিন্তু আজকেই যে তাজেল সবাইকে নিয়ে হাজির হবে তা বুঝতে পারে নি ও। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘ঠিক আছে খেলবো। ”

তখন তাজেল সবাইকে বলল,,

‘আমি আর কুলসুম রাজা রানী তোরা বাইটা আয়। আমরা দুইজনে তোগোরে নিমু তয় ডাক্তার আমার দলে হেতির বাটা লাগবো না।”

তখন কুলসুম বলল,,

“এ ডাক্তার কতো বড় দেখছোস তুই। উনি তো একাই সব জুতা নিয়া আইবো আমরা ধরবার পারুম নাকি তারে।”

‘ডাক্তার জীবনে নাকি জুতা চোর খেলে নাই। হে বড় হইলে কি হইবো হেতি তো আর পারে না।”

‘তাও তোমার ডাক্তাররে বাইটা আইতে ক। উনি একা আর দুইজন থাকবো উনার বদলে দলে।”

“উঁহু ডাক্তার বাটবো না ডাক্তার আমার দলে তুই বাকি দুইজন রে নিয়া যা।”

মেহবিন তাজেলের কর্মকাণ্ড দেখে হাসে এই মেয়েটাও না। সবসময় ওকেই লাগবে। কুলসুম সব থেকে ভালো দুইটা বাচ্চা কে নিজের দলে নিল। বাকি চারজন দুই জন দুই জন করে নিজেদের নাম নিয়ে এলো। তাজেল আর কুলসুম এর কাছে এসে বলল,,

‘আম না জাম?

তাজেল আম নিল । তখন একজন হেঁসে তাজেলের দলে চলে এলো। আরেকজন কুলসুম এর কাছে মেহবিন বুঝতে পারলো ওদের আম জাম নাম রেখেছিলে রাজা রানী যাকে চাইবে সেই জন ঐ দলে। পরের দুইজন এলো আকাশ না বাতাস বলে এইবার কুলসুম চাইলো আকাশ একজন ওর দলে চলে গেল। তাজেলের দলে চারজন আর কুলসুমের দলে পাঁচ জন। এবার টস করা হবে। তাজেল একটা পাতা নিয়ে এলো কুলসুম কে বলল কোন পাশে সে নেবে শিরওয়ালা নাকি শির ছাড়াওয়ালা কুলসুম শিরওয়ালা পাশ চাইলো তাজেল ছেড়ে দিল। টসে জিতলো তাজেল। তাজেলের খুশি আর দেখে কে। তাজেল রা জুতো নেবে। তাজেল মেহবিনকে শিখিয়ে দিল কিভাবে খেলে। মেহবিন ও হেঁসে সব শিখে নিল। অতঃপর শুরু হলো খেলা মেহবিন অনেকে ভালো খেলছে বাচ্চারা ওকে ধরতে পারছে না। মেহবিন সব জুতো নিয়ে এলো ওরা জিতেছে তখন কুলসুম বলল,,

“কইছিলাম আমি উনার হাতে কেউ পারবো না এহন?”

তখন তাজেল বলল,,

‘যা সবাইরে তোরে দিয়া দিলাম । আমাগো দলে আমি আর ডাক্তার খালি এহন দেহুম।”

তাজেলের এতো আত্মবিশ্বাস দেখে মেহবিন হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তখন তাজেল বলল,,

‘এহন হারলে কিন্তু মান সম্মান থাকবো না ডাক্তার ভালো কইরা খেলবা।”

মেহবিন মাথা নাড়ালো মানে সে ভালো করে খেলবে। মেহবিন আর তাজেল অর্ধেক এর বেশি জুতো নিয়ে এলো তখন মেহবিন আউট হয়ে গেল। যদিও কুলসুমের দলের তিনজনকে মেহবিন আর তাজেল আউট করে দিয়েছে। তাজেল এখন একা ও মেহবিনের দিকে রেগে তাকালো তা দেখে মেহবিন বলল,,

“আমার দোষ নেই নেত্রী। আমি দেখিনি কুলসুম আমার পেছনে ছিল। তাছাড়া তুমি আছো তো তুমি সব জুতা নিতে পারবে।”

‘তুমি দেখছো ওরা চারজন আর আমি একা।”

“তো কি হয়েছে শক্তির থেকেও বুদ্ধি দিয়ে খেলাটা সহজ। তোমার বুদ্ধি দিয়ে তুমি খেলবে তাহলেই জিততে পারবে।”

মেহবিনের কথায় তাজেল বুদ্ধি দিয়ে খেললো। আর জিতলোও তাজেল এর খুশি দেখে কে। ও সোজা গিয়ে মেহবিনের কোলে উঠে পরলো আর চিৎকার করে বলল,,

‘আমরা এই দাইন ও জিতা গেছি ডাক্তার।”

তখন কুলসুম আর বাকি সবাই বলল,,

‘আমরা তোমাগো হাতে আর খেলুম না। তোমরা দুইজনেই ভালো খেলো।’

তাজেল মেহবিনের কোলে থেকে নেমে বলল,,

‘হাইরা গেছোস দেইহা খেলবি না।”

তখন কুলসুম বলল,,

‘এমবাই খেলুম না। আমি গেলাম।

তখন তাজেল বলল,,

“কাউ খাইটা বাড়ি গেল
ব্যাঙবাজা দিয়া ভাত খাইলো
ব্যাঙ গেল ঝোরে
কুলসুম চিল্লায়া মরে।

তাজেলের মুখে এরকম ছন্দ শুনে মেহবিন বলল,,

“এটা কি ছিল?”

তখন কুলসুম রেগে তাজেলের হাতে চিমটি দিল তখন তাজেল হেঁসে বলল,,

“চিমটি দিলি ক্যা
দুক্কু পাইলাম ক্যা
মাচার তলে বায়া ব্যাঙ
তোর নানির চার ঠ্যাং

কিছু করতে না পেরে কুলসুম রাগে দুঃখে কেঁদে উঠলো। মেহবিন কি বলবে ও তো তাজেলের ছন্দ শুনেই থমকে গেছে। মেহবিন নিজেকে সামলে কুলসুম কে গিয়ে ধরে বলল,,

‘নেত্রী এসব কি বলতো কুলসুমকে কাদাচ্ছো কেন?”

‘কুলসুম খেলা থুইয়া যাইবো কেন?”

তখন কুলসুম নাক টেনে বলল,,

‘না পারলে খেইলা কি হইবো। তোগো দুইজনের জন্য তো আমরা দাইনই পামু না তোগোডি শুধাম কহন আর দিমুই কহন।”

‘ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার নেত্রী চলো এবার ওদের জুতো নিতে দাও। ওরা এবার জুতো নেবে।”

মেহবিনের কথায় তাজেল বাঁধা দিয়ে বলল,,

‘ওগো এতো যুক্তা ওরা খেইলা নিক। আমরা দাইন দিমু ক্যা।”

“নেত্রী!”

‘তুমি খালি কইলা দেইখা নাইলে জীবনেও দাইন দিতাম না। এই যে কুলসুম এহন খুশি হইছোস যা খেল। দেখবি তোরা জুতাও নিতে পারবি না। আর জিততেও পারবি না।”

‘দেহা যাইবো তোরেই আগে মারুম তাজেল দেহিস তুই।”

‘এই তাজেল রে মারা সহজ না কুলসুম। ভুইলা যাইস না আমাগো দলের লিডার কিন্তু আমিই। যা কথা বাদ দিয়া খেলা শুরু কর।”

খেলা শুরু হলো অর্ধেক জুতো নিতেই পাঁচজন আউট। চারটা তাজেল করছে আর একটা মেহবিন। সবার আগে আউট কুলসুম সেই জন্য তাজেল খুব খুশি। ওরা খেলছিল তখন গেটের সামনে থেকে বলল,,

‘আমিও খেলবো জুতা চোর।”

সবাই খেলা বন্ধ করে সেদিকে তাকালো । মেহবিন দেখলো রাইফা আর মিশু পেছনে অবশ্য জিনিয়া মুনিয়া,আর মিশুর মামাতো বোন শান্তা ও আছে। মেহবিন ওদের দেখে এগিয়ে গেল আর বলল,,

“ফুল তোমরা এই সময় এখানে ?”

‘সববার তো তুমি আমাদের বাড়িতে যাও তাই এইবার আমি এলাম। সারাদিন ইজ তোমার বাড়ি থাকবো।বাবা কে বললে বাবা বলল একা যাওয়া যাবে না তাই সবাইকে নিয়ে এলাম।”

‘ভালো করেছো এসো ভেতরে এসো।”

‘তুমি জুতা চোর খেলছিলে?”

‘হ্যা!”

“আমিও খেলবো।”

তখন সবার ছোট শান্তা বলল,,

“আমিও খেলবো।”

তখন জিনিয়া বলল,,

‘এগুলো ছোটবেলায় খেলতাম আজ সবাইকে দেখে ভালো লাগছে। কয়েকদিন পর আমার বিয়ে হয়ে যাবে আজ একবার স্মৃতিচারন করবো আমিও খেলবো।’

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘খেলো না এমনিতে সমস্যা নেই চারদিকে তো দেয়াল আছে।”

তখন মুনিয়া বলল,,

“তাহলে আমিও খেলবো।”

তখন মেহবিন রাইফার দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘সবাই যখন খেলবে আপনি বাদ যাবেন কেন? খেলাধুলা করলে মন ভালো থাকে আপনিও আসেন রাইফা।”

তখন কুলসুম বলল,,

“হেতিগো বাইটা আসতে কন ডাক্তার আর একজন বেশি আছে হইবো না। আরেকজন লাগবো তাও বড়।

তখন মেহবিন বলল,,

“নেত্রী যাও গিয়ে নওশি কে ডেকে নিয়া এসো।”

তাজেল গেল নওশি কে আনতে। মেহবিন কি মনে করে ঘরে গেল আর ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখলো। ঘড়ির কাঁটা এখন সারে দশটা দুপুরের রান্নাটা আজ ভালোভাবেই করতে হবে। সবাইকে খাওয়াতে হবে তো। ততক্ষণে নওশি ও এসে গেছে অতঃপর সবাই নিজেদের মতো করে আসলো মিশু মুনিয়া আর রাইফা তাজেলের দলে। নওশি জিনিয়া আর শান্তা কুলসুমের দলে। তারপরেই শুরু হলো খেলা বেশ ঘন্টা খানেক খেলা চললো সবার মুখেই তৃপ্তির হাঁসি। মেহবিন রাইফার দিকে তাকালো ওকে দেখার পর আজকেই প্রথম মেয়েটাকে মন খুলে হাসতে দেখলো সে। যা দেখে ওর মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মেহবিন সবাইকে বলল সে ভুনা মাংস আর খিচুড়ি রান্না করবে দুপুরে সবার দাওয়াত। সবাই যেন দুপুরে গোসল করে নামাজ শেষ করে চলে আসে। বাচ্চারা সবাই খুশি মনে চলে গেল বাড়িতে। মেহবিন সবাইকে হাত মুখ ধুয়ে আসতে বলল সবাই এলে মেহবিন কফি আর স্ন্যাক্স রাখলো ওদের সামনে। তখন জিনিয়া বলল,,

‘ভাগ্যিস তোমার বাড়িতে এসেছিলাম। অনেক দিন পর আবার ছোটবেলার মতো এতো আনন্দ করলাম।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘তোমরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দাও। আমি রান্না শেষ করি দুপুর বেলা কিন্তু এখানেই খেতে হবে।”

তখন মিশু বলল,,

“আমি তো সন্ধ্যার আগে যাবোই না।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে রান্না ঘরে চলে গেল। আর নিজের মতো করে রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। তখন রাইফা এলো রান্না ঘরে ও বলল,,

‘হেল্প করবো কিছু?”

‘লাগবে না সব জোগাড় শেষ এখন শুধু রান্নাটা বাসাবো।”

‘আহমেদ পরিবার তাহলে আপনার পরিবার নয়।”

“সব তো সেদিন জেনেছেনই তাহলে আবার প্রশ্ন কেন?”

রাইফা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো হুট করে মেহবিন বলল,,

‘আপনি আপনার দাম্পত্য জীবনে সুখী তো মিসেস রাইফা আফনূর?”

মেহবিনের কথায় রাইফা ওর দিকে চমকে তাকালো। বলল,,

“হয়তো আমি একজন সুখী মানুষ।”

মেহবিন স্থির চোখে রাইফার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কিন্তু লোক চক্ষুর অন্তরালে হয়তো বা বিপরীত কিছুও থাকতে পারে।”

রাইফা কিছু বললো না ওখান থেকে চলে এলো। ও যেতেই জিনিয়া গেল মেহবিনের কাছে ওর পাশে দাঁড়াতেই মেহবিন ওর দিকে তাকালো। তা দেখে জিনিয়া হাসলো মেহবিন কিছু একটা বুঝতে পেরে বলল,,

‘শান ভাইয়া খুব ভালো মানুষ জিনিয়া। যাকে আপন করে নেয় তাকে নিজের পুরোটা দিয়েই সুখী করতে চায় সে। চিন্তা করো না তুমি।”

মেহবিনের কথা শুনে জিনিয়া অবাক হয়ে বলল,,

‘তুমি জানলে কিভাবে আমি শানের কথাই জিজ্ঞেস করবো?”

‘কিছু না এমনিই মনে হলো। যাই হোক এখন যাও আমি রান্নাটা মনোযোগ দিয়ে শেষ করি।”

জিনিয়া আর কিছু বলতে পারলো না । ও চলে গেল এরপর মিশু এলো একটা চেয়ার নিয়ে সে মেহবিনের রান্না দেখবে। মাংস হওয়ার আগে মিশু জানালো সে চেক করবে তার এটা ভালো লাগে। অতঃপর মেহবিনের রান্না শেষ হলো। আজ যেহেতু শুক্রবার তাই আধা ঘন্টা আগে আজান দিয়েছে এখন একটা বাজে মেহবিন ওদের কে নামাজ পরতে বলে গোসলে গেল পরে সে পরে নেবে। সবার সাথে আজ মিশুও নামাজ পরলো। মেহবিন শেষ করে বের হলো। খাবার গুলো বেড়ে রাখলো কিন্তু ওর কাছে প্লেট আছে বারোটা মানুষ হবে ষোলো সতেরজন বাকি প্লেট কোথায় পাবে এখন। ভাবতে ভাবতেই সবার নামাজ শেষ হলো। মেহবিন ভাবলো আগের ওদের খায়িয়ে দেওয়া যাক। মেহবিন সবাইকে খেতে ডাকলো সবাই বসলো মেহবিন সবাইকে দিয়ে মিশুকে খায়িয়ে দিল। সবার খাওয়া শেষ হলে তাজেল আর নওশি এলো সবাইকে নিয়ে। কাজটায় মেহবিন নিজে নিজেই হাসলো। ও প্লেট গুলো ধুয়ে সবাইকে খেতে দিল তাজেল মেহবিনকে জিজ্ঞেস করল ও খেয়েছে কি না মেহবিন বলল ওদের সাথেই বসবে। মেহবিন ওদের সাথে খেয়ে নিল সবাই কষা মাংস আর খিচুড়ি আয়েশ করে খেল যা দেখে মেহবিনের ভালো লাগলো। ওদের খায়িয়ে মেহবিন নামাজ পরে নিল। তারপর রাইফাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। বিকেল হতেই ওরা এখন বাড়ি যাবে ওরা পাকা রাস্তায় উঠলো। ওরা মেহবিনের থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা ধরলো। তখনি পেছন থেকে তাজেল ডাক দিল। মেহবিন পাশ ফিরে বলল,,

‘নেত্রী!”

তখনি মেহবিনের একটা ফোন এলো ও ফোন রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগে ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,,

‘ফাইভ…. ফোর…থ্রি…. টু…. ওয়ান!!”

মেহবিন তাকাতেই দেখলো একটা গাড়ি আসছে আর তার মধ্যে থেকে একজন রিভলবার তাক করে রেখেছে। তা দেখে ও তাড়াতাড়ি করে সরে গেল সরে যাওয়ায় গুলিটা বুকে না লেগে হাতে লাগলো। তখনি পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে মেহবিন কে ধাক্কা মারলো। মেহবিন রাস্তায় পরে গেল মুহুর্তেই ওর রক্ত দিয়ে রাস্তাটা ভিজে উঠলো। সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি হলো যে কেউ গাড়ির কুল কিনারা পেল না। তখন মেহবিনের কানে আওয়াজ এলো কেউ ডাক্তার ডাক্তার বলে চিৎকার করছে। মেহবিন চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো মিশুরা সবাই ওর দিকে দৌড়ে আসছে।

গুলির আওয়াজে সবাই পেছনে তাকাতেই রাইফারা দেখলো মেহবিনের পেছনে একটা গাড়ি খুব জোরে আসছে আর মুহুর্তেই মেহবিনকে ধাক্কা মারলো। মেহবিনের পেছনে কাঁচা রাস্তায় তাজেল ছিল ঐ ডাক্তার ডাক্তার বলে চিৎকার করে উঠেছিল। তাজেল দৌড়ে গিয়ে মেহবিনের সামনে বসলো। রাইফা দৌড়ে এসে মেহবিনের মাথাটা কোলে তুলে নেয় আর কাঁদতে থাকে আর ডাকতে থাকে ,,,

‘মেহু মেহু একদম চোখ বন্ধ করবি না। কিছু হবে না তোর।কেউ আছেন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন প্লিজ মেহুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

রাইফার হুট করে মেহু আর তুই শুনে ওরা অবাক হলো। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা ভাবার সময় নেই। এদিকে মিশুর মেহবিনের রক্ত দেখে হাত পা কাঁপছে পুরোনো কিছু তিক্ত স্মৃতি মনে পরছে ও অনু অনু রক্ত রক্ত করতে বসে পরলো। এই মুহূর্তে কে কি করবে বুঝতে পারছে না কাকে রেখে কাকে সামলাবে। মুহুর্তেই এলাকার সব মানুষ জরো হয়ে গেছে। সবাই মিলে একটা গাড়িতে উঠিয়ে দিল রাইফা মেহবিনের মাথাটা নিজের কোলে নিল। জিনিয়াও উঠে বসলো তাজেল ও উঠে বসে ওকে রেখে যেতে চাইলেও তাজেল বলে সে যাবেই তাজেল মেহবিনের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে আর বলে,,

‘ডাক্তার চিন্তা কইরো না । তোমার কিছুই হইবো না আমরা তোমারে হাসপাতালে নিয়া যামু।”

মেহবিনের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। তাজেল আর রাইফা কতোকিছু বলছে কিন্তু ও শুনতে পারছে কি না বোধগম্য হচ্ছে না। অতঃপর হাসপাতাল আসতেই মেহবিন কে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে নার্সরা ডাক্তার কে ডাকে। মেহবিনকে দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। শুক্রবার মেহবিনের বন্ধ থাকলেও দুজন ডাক্তার থাকে হাসপাতালে ইমার্জেন্সির জন্য। আর সবথেকে বড় মহিলা ডাক্তার আজ কোথাও যায় নি তার পরিচিত একজন হাসপাতালে ভর্তি ছিল বলে তিনি হাসপাতালেই ছিলেন। তাই মেহবিন কে দেখে বলে তিনিই অপারেশন টা করবেন যা মেহবিনের গুড লাক বলা যায়। কাঁদতে কাঁদতে তাজেলের মাথায় এলো মুখরের কথা। কিন্তু কিভাবে জানাবে ওকে। তখনি একজন মাস্ক ক্যাপ পরিহিত একজন দৌড়ে এলো। তাজেল কে দেখেই সে তাজেলের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,,

“নেত্রী!”

মুহুর্তেই তাজেল বুঝে ফেললো এটা মুখর। ও মুখরকে দেখে কেঁদে উঠলো আর জড়িয়ে ধরে বলল,,

‘পাঞ্জাবিওয়ালা আমার ডাক্তার!”

মুখরের চোখ থেকেও দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। ও তাজেলকে শক্ত করে দুই হাত দিয়ে জরিয়ে ধরলো। এতটা অসহায় ও বোধহয় কখনো হয় নি। রাইফা আর জিনিয়া একবার ওদের দিকে তাকালো ওরা বুজতে পারলো না তাজেল কাকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে। তখনি আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ কে দেখা গেল হাসপাতালে। রাইফা সেই তখন থেকে একটা বেঞ্চে বসে অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে আছে। জিনিয়া ওর পাশে বসে আছে। ওনারা আসতেই একজন নার্স বলল রক্ত লাগবে ও নেগেটিভ। কথাটা শুনে শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘আমি দেব রক্ত আমার ব্লাডগ্ৰুপ ও নেগেটিভ।”

তখন নার্সটি বলল,,

‘স্যার আপনার অনেক বয়স হয়েছে। এই সময় রক্ত দেওয়াটা একটু রিস্ক। তাই আমরা আপনার রক্ত নিতে পারবো না।”

‘দেখুন আমি একদম সুস্থ আমার তেমন কোন রোগ ও নেই ।”

“তবুও স্যার আমরা পারবো না।”

তখন আরবাজ বলল,,

“বাবা শান্ত হও তোমার এখন রক্ত দেওয়াটা ঠিক হবে না। আমি দেখছি রক্ত কোথায় পাওয়া যায়।”

“তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করো আরবাজ।যেভাবেই হোক ডাক্তারের কিছু হতে দেওয়া যাবে না।

রক্তের কথা শুনে মুখর বেরিয়ে গেছিল আরবাজ যাবে এমন সময় মুখর এলো একজন কে নিয়ে। ও এসেই বলল,,

‘কাউকে কোথাও যেতে হবে না। রক্তের ব্যবস্থা হয়ে গেছে উনি দেবেন।”

মুখরের কথা শুনে নার্সটা তাড়াতাড়ি লোকটাকে নিয়ে চলে গেল। মুখর মেহবিনের খবর শুনেই বুঝেছিল রক্ত লাগতে পারে তাই ওর এখানের পরিচিত একজন কে নিয়ে এসেছিল সাথে করে। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আপনি কে?”

তখন মুখর বলল,,

‘আমি ডক্টর মেহবিন মুসকান এর হাজবেন্ড।”

তখন জিনিয়া বলল,,

‘মেহবিন আপু ম্যারিড।”

মুখর বলল,,

“জি তবে এগুলো ভাবার সময় এখন নয়।”

কেউ আর কিছু বললো না। শেখ শাহনাওয়াজকে আরবাজ নিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে দিল। তার চোখ দুটো অপারেশন থিয়েটারের দিকে। কিছুক্ষণ পর গ্ৰামের বেশ কয়েকজন ও এলো। তাজেল নওশিকে দেখে ওকে জরিয়ে কাঁদতে লাগলো। ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার বের হলে মুখর গিয়ে জিজ্ঞেস করল,,

‘ডক্টর মেহবিনের কি অবস্থা?”

“অপারেশন সাকসেসফুল তবু ওনার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। প্রথমত উনার হাতে গুলি লেগেছিল যা প্রথমে বুঝতে পারিনি পরে বুঝেছি তারওপর ঐ এক্সিডেন্ট মাথায় হাতে পায়ে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। উনার জ্ঞান না ফেরা কিছুই বলতে পারছি না আমরা। তবে আশা আছে ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি উনার জ্ঞান ফিরবে কারন উনি খুব স্ট্রং।”

‘ইনশাআল্লাহ তাড়াতাড়িই যেন জ্ঞান ফিরে আসে। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ ডক্টর।”

‘সবকিছুর মালিক আল্লাহ তাই আগে উনার শুকরিয়া আদায় করুন। এক্সকিউজ মি।”

বলেই ডক্টর চলে গেল। মুখর ধাপ করে বসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। ভেতরে ভেতরে কি চলছে এটা শুধু ঐ জানে ও কাউকেই ওর অবস্থা বোঝাতে পারছে না। মাস্ক ক্যাপ পরে আছে ও উঠে চলে গেল মনকে শান্ত করার জন্য আর ওর বিহঙ্গিনীর জন্য সুস্থ হয়ে উঠার জন্য নামাজ পরতে হবে। সবার অগোচরে নিজের মাস্ক ক্যাপ রেখে উযু করে করে আবার সব পরে মসজিদে ঢুকলো। এই সময়টা কোন নামাজের সময় নয় তাই মুয়াজ্জিন ছাড়া আর কেউ নেই । ও নামাজে দাঁড়িয়ে পরলো।

রাত নয়টা সবাই বাড়ি চলে গেছে শুধু রয়ে গেছে মুখর আর আরবাজ। তাজেল থাকতে চেয়েছিল মুখর ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ঐ একজন মানুষ যে মন মতো তার দুঃখ আর মেহবিনের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। বাকিরা তো কেউ কিছু প্রকাশ করেনি তাই বলতেও পারছি না। শেখ শাহনাওয়াজ আরবাজ কে মুখরের সাথে থাকতে বলেছিল। ও বলেছে ওর কারো দরকার নেই একাই থাকতে পারবে। আর কেউ না জানলেও আরবাজ জানে মেহবিনের হাজবেন্ড কে তাই ও মুখরের না সত্বেও থেকে গেছে। শেখ শাহনাওয়াজ সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। মুখর মেহবিনের কেবিনের সামনের বেঞ্চে বসে আছে সবাই আরবাজ এতোক্ষণ মুখরের কাছে আসার সাহস পায় নি। এবার সাহস করে মুখরের কাঁধে হাত রাখতেই মুখর আরবাজ কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। এটারই বোধহয় অপেক্ষা করছিল মুখর। একটা কাঁধ পেতেই নিজের এতোক্ষণ জমানো অশ্রুগুলো ঢেলে দিল।

~ চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

আরবাজের চোখ দিয়েও দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। মুখরের কান্নার জন্য আরবাজের আরো বেশি খারাপ লাগছে। আরবাজ মুখরের পিঠে হাত রেখে বলল,,

“শান্ত হ মুখর এতোটা ভেঙে পরলে চলবে?”

মুখর কাঁদতে কাঁদতেই বলল,,

“কি করে শান্ত হবো আরবাজ? যে মানুষটাকে আমি সবসময় আগলে রাখতে চাই। একটা কাঁটাও ফুটতে দিতে রাজি নই। সেই মানুষটা এখন নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে। এটা কি করে আমি সহ্য করবো আরবাজ?”

“প্লিজ মুখর এভাবে ভেঙ্গে পরিস না। ডাক্তার তো বলেছে আশা আছে ইনশাআল্লাহ মেহবিন খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।

মুখর আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ পর ও নিজেকে সামলিয়ে উঠলো। ও সোজা হয়ে বসলো। তখন আরবাজ বলল,,

“এখন কেবিনে চল মাস্ক আর ক্যাপ খুলে রাখ। আমি খাবার নিয়ে আসি নাহলে তুই নিজেই অসুস্থ হয়ে পরবি।”

“না আমি ঠিক আছি আমি ভেতরে যাবো না। বিহঙ্গিনীকে ঐ অবস্থায় দেখতে পারবোনা। আর আমার খিদে পায় নি খাবো না আমি।”

‘একদম পাগলামি করবি না সেই কখন থেকে মাস্ক ক্যাপ জড়িয়ে আছিস। বেশিক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে তোর সাফোকেশন হয়। বিহঙ্গিনী কে সুস্থ করতে হলে আগে নিজেকে সুস্থ থাকতে হবে তো। তাছাড়া আমি তোকে মেহবিনের কেবিনে যেতে বলছি না আমি সব ভেবে আলাদা করে কেবিন নিয়েছি তোর থাকার জন্য।এখন সেখানে চল।”

“আমার কিছু ভালো লাগছে না।”

আরবাজ জোর করে মুখরকে কেবিনে নিয়ে গেল। তারপর ওখানে গিয়ে মাস্ক ক্যাপ খুলে ফেললো। সেগুলো খুলতেই আরবাজ দেখলো মুখরের মুখটা লাল হয়ে গেছে। ও ওকে হাত মুখ ধুয়ে আসতে বলল। শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের খবর শুনে কুদ্দুস কে দিয়ে খাবার আনিয়ে ছিলেন বাড়ি থেকে। মুখর হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখল আরবাজ খাবার বেড়ে বসে আছে‌। আরবাজ গিয়ে মুখরের হাত ধরে বসালো নিজের হাতে ভাত মেখে তুলে বলল,,

“আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক।
[সূরা আলি-ইমরান, আয়াত ১৭৩]
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোবাসেন তাঁর উপর ভরসাকারীদেরকে।”
[সূরা আল-ইমরান ১৫৯]”

এই আয়াত দ্বারা কি বুঝলি যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাদের আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন এবং তিনি তার বান্দাদের নিরাশ করেন না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে। আল্লাহ তায়ালা মাঝে মাঝে আমাদের পরীক্ষা করেন আমাদের খারাপ অবস্থায় ফেলে। এটাও তেমন একটা পরীক্ষা মনে কর ধৈর্য্য ধরে এই সময়টা পার করতে পারলেই তুই সফল।”

সব শুনে মুখর বলল,,

“এই সবকিছু তুই বলছিস ?”

আরবাজ মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“বছর খানেক আগে কাব্যের বিহঙ্গিনী পেজ থেকে একটা পোস্ট করা হয়েছিল,,

“আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা শিখুন তার ওপর ভরসা রাখুন। ইনশাআল্লাহ জীবন সহজ হয়ে যাবে।”

মুখর আর কিছু বললো না। মুখর হা করছে না দেখে আরবাজ বলল,,

“নে এবার হা কর!”

মুখর হা করলো । আরবাজ খুব একটা ওকে খাওয়াতে পারলো না। হালকা খেয়ে মুখর পানি খেয়ে বলল,

‘আমাকে জ্ঞান ঝাড়লি নিজে খাচ্ছিস না কেন । তাড়াতাড়ি খেয়ে নে আমি কিন্তু তোকে খাওয়ার জন্য তোয়াতে পারবো না।”

মুখরের কথায় আরবাজের একটু ভালো লাগলো ও যে টেনশন কম করতে চাইছে সেটা বুঝতে পারলো। আরবাজ বলল,,

‘আমি তোর মতো নাদান বাচ্চা নই যে এইটুকুতেই কান্নাকাটি করবো।”

‘এতো কিছুকেও তুই এইটুকু বলছিস। তুই কেমন রে তোর একটুও মায়া মোহাব্বত নাই।”

মুখরের কথা শুনে আরবাজ কিছু বললো না ও অন্যদিকে ঘুরে গেল। মুখর সামনে আসলো তখন আরবাজ খেতে শুরু করলো। তা দেখে মুখর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাস্ক পরে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ডাক্তারের সাথে কথা বলে মেহবিনের কেবিনে গেল । ওখানে গিয়েই ওর চোখটা ছলছল করে উঠলো। মেহবিনের মুখে অক্সিজেন মাস্ক হাতে ক্যানুলা স্যালাইন চলছে। ও আস্তে করে টুলে বসলো আর মেহবিনের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। আর একটা চুমু দিয়ে বলল,,

“তুমি তো খুব স্ট্রং তাই না বিহঙ্গিনী। তুমি নিশ্চয়ই ফিরবে তোমার কাব্যের কাছে। তুমি জানো এই কম সময়েই তুমি আরো একজনের খুব কাছের হয়ে গেছো। জানো তোমার নেত্রী আজ তোমার জন্য কতো কেঁদেছে। তোমার জন্য বাড়িই যেতে চাইছিল না। ও কি বলছিল তুমি জানো ও বলছিল আমি যেন তোমায় আটকে রাখি যাতে তুমি ধোঁকা দিতে না পারো। ও বারবার একটাই কথা বলছিল ডাক্তার যেন আমারে ধোঁকা না দেয় পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা। আমি ওর ধোঁকা কথাটার মানে বুঝিনি বিহঙ্গিনী। তবে ওর কথাটার মাঝে কতটা যন্ত্রনা ছিল তা ঠিকই বুঝেছি। তুমি প্লিজ আমাকে আর তোমার নেত্রী কে ধোঁকা দিও না বিহঙ্গিনী।

বলতে বলতেই মুখরের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। ও আবার বলতে লাগলো,,

“আমাদের এখনো সংসার করা বাকি বিহঙ্গিনী। আমাদের দুজনের সাজানো স্বপ্নগুলো তো একসাথে পূরন করতে হবে তাই না। এই জন্য তো তোমায় তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। প্লিজ বিহঙ্গিনী খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।

মুখর আর কিছু বললো না হাতটা ধরে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। পেছনে দাঁড়িয়ে আরবাজ সেটা দেখলো ওর চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পরলো ও ওখান থেকে চলে গেল।

_________________

“বাড়িতে কোন শোক লাগছে নাকি যে সবাই না খাইয়া নিজের ঘরে ঘাপটি মাইরা রইছে।”

শেখ শাহেনশাহ এর কথায় আরিফা জামানসহ সবাই তার দিকে তাকালেন। মিসেস আমজাদ বললেন,,

“ভাইজানের শরীরটা বেশি ভালো না তাই উনি খাবে না। আর মিশু তো বাড়ি এসেই থম মেরে আছে। যতো যাই বলি মেয়েটাকে তো মিশু অনেকটাই আপন করে নিয়েছে। আমাদের থেকেও ঐ মেয়েটার কথা বেশি শুনে। আর রাইফা জিনিয়া ওরা তো সবটাই নিজের চোখের সামনে দেখেছে তাই ওদের গলা দিয়ে খাবার নামবে না বলেছে তাই আসেনি।”

“সবটাই সামনে দেখছে তাই গলা দিয়া ভাত নামবো না কেন? ঐ মাইয়া আমাগো কিরা তার জন্য বাড়িতে শোক সভা লাগাই লইছে। শাহের ও বলিহারি তার জন্য নাকি আবার আরবাজ রে রাইখা আইছে।”

তখন আরিফা জামান বললেন,,

“আমারও মনে হয় আরবাজকে রেখে আসা উচিৎ হয় নি।

তখন কেউ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল,,

‘সত্যিই ঠিকই বলেছে ওখানে আরবাজ রেখে আসা উচিত হয় নি। বরং আমারই থেকে আসা উচিত ছিল। কারন যে মেয়েটা আমার মেয়ের জন্য এতো কিছু করে তারজন্য আমার নিজেরই উচিত ছিল ওখানে থাকা।”

শেখ শাহনাওয়াজ কে দেখে আরিফা জামান বললেন,,

“ব্যাপারটা আসলে তেমন নয় আমি এই জন্যই বলছিলাম, মেয়েটারও মনে হয় শত্রুর অভাব নেই সেদিন তুলে নিয়ে যেতে চাইছিল আজ আবার এরকম ঘটনা ঘটলো। মেয়েটার মধ্যেই কোন ঘাপলা আছে যদি তারা কিছু করে এতো ঝামেলার মধ্যে আরবাজ কে ওখানে রেখে আসা উচিত হয় নি তাই বলছিলাম আর কি।”

“মেয়েটার মধ্যে ঘাপলা নয় বরং সততা আছে। মানুষের ভালো করতে গিয়েই তার শত্রু হয়েছে তাই আজ এই অবস্থা ডাক্তারের।

“আপনি কি করে জানলেন। আমার তো মেয়েটাকে দেখেই কেমন লাগে সুবিধার মনে হয় না । তাছাড়া সে কোন কথা ফেলতে দেয় না সবার মুখের ওপর জবাব দেয়।”

“তার স্পষ্টবাদীতায় কি তোমার সমস্যা হয় । সে স্পষ্টভাষী তাই সবকিছু স্পষ্টভাবেই বলে এবং করে। আর কি বললে তাকে সুবিধার মনে হয় না আমি তো তার মধ্যে তেমন কোন গুনই দেখতে পেলাম না যার জন্য মনে হতে পারে তার মধ্যে অন্যকিছু থাকতে পারে। সবথেকে বড় কথা হলো,,
‘না জেনে তোমরা কারো ওপর খারাপ ধারণা রেখো না। এটা সবচেয়ে বড় গুনাহ ।
– সহীহ বুখারী –৫১৪৩

আরেকটা হাদিসে ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা (মন্দ) ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। কারণ, (মন্দ) ধারণাই হচ্ছে সব থেকে বড় মিথ্যা।” (বুখারী ৬০৬৬, মুসলিম ০২৬৩)

সে আসার পর থেকেই দেখছি তুমি তার ব্যাপারে অনেক সমালোচনা করছো কথা বলছো কখনো তোমার জায়ের কাছে কখনো তোমার ভাবির কাছে। শুনে রাখো আরিফা হযরত আলী (রা) বলেছেন,,

“অতিরিক্ত সমালোচনা করবেন না। অতিরিক্ত সমালোচনা ঘৃ*ণা এবং খারাপ চরিত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।”

যাইহোক আর কিছু ভালো লাগছে না। তাছাড়া ওখানে আরবাজ একা নেই ডাক্তারের হাজবেন্ড ও আছে।”

সবশুনে আরিফা জামান মাথা নিচু করলেন আর বললেন,,

‘আমি সেভাবে বলি নি যে আপনি আমায় এতোকিছু বলবেন।”

“এটা শুধু ডাক্তারের জন্য বলি নি। তোমায় স্ত্রী হিসেবে কিছু নসিহত করলাম এখন। যাই হোক মনে কষ্ট পেলে মাফ করে দিও।”

বলেই শেখ শাহনাওয়াজ এক গ্লাস পানি খেয়ে ওপরে চলে গেলেন। নিজের রুমে যাওয়ার আগে মিশুর রুম চেক করলেন মিশু নামাজ পরছে দেখে উনি একটু অবাক হলেন। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে নিজের রুমে চলে গেলেন।
___________________

“তোমার কেউ মারা গেছে নাকি রাইফা?”

হুট করে সায়িদের কথায় রাইফা চমকে উঠলো। সবেই নফল নামায শেষ করে ঘুরলো। আর এখনি এরকম কথাটা শুনে যে কেউ চমকে উঠবে। রাইফা নিজেকে সামলে বলল,,

“আপনি কখন এলেন?’

‘যখন তুমি মুনাজাতে বসে কাঁদছিলে। বোধহয় কারো ভালোর জন্য কিছু চাইছিলে আল্লাহর কাছে আমি ঠিক শুনতে পাইনি।”

রাইফা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,,

‘তেমন কিছু না।”

তখন সায়িদ হুট করেই এসে রাইফার গাল চেপে ধরে বলল,,

‘আমি কখনো অসুস্থ হলে তো এভাবে জায়নামাজ এ পরে কাঁদতে দেখি না। আজ ঐ দুই টাকার ডাক্তারের জন্য মুনাজাতে নদী বানাচ্ছিস। ও কে হয় তোর শুনি?”

রাইফা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কোন রকমে বলল,,

‘সায়িদ আমাকে ছাড়ুন আমার লাগছে।”

‘লাগুক লাগার জন্যই তো ধরেছি। খুব দরদ তোর ডাক্তারের প্রতি।”

রাইফা এ ঝটকায় সায়িদকে সরিয়ে দিল। আর বলল,,

“একজন মানুষ হাসপাতালে ভর্তি তার জ্ঞান নেই আর আপনি তাকে নিয়ে কি সব বলছেন। আমি তো আপনার মতো নই। আর কি বললেন আপনার জন্য কিছু করেছি কিনা তাহলে তো আমিও বলছি আপনি কখনো আপনাকে একটু আপনার ওপর সম্মান ভালোবাসা জাগানোর কারন দিয়েছেন কি না। যে কিনা বিয়ে করেও অন্য নারীতে আসক্ত থাকে তার জন্য জায়নামাজ এ পরে কাঁদবো আমি। যে কিনা আমার ওপর দিনের পর দিন মানসিক শারীরিক টর্চার করে তার জন্য কাঁদবো আমি। বাড়িতে একটা কুকুর থাকলেও নাকি তার ওপর মায়া তৈরি হয়ে যায় আর আমি তো মানুষ একই ছাদের নিচে থাকি। তবুও তো কোনদিন আমার ওপর একটু দয়া মায়া দেখান নি। তাহলে আমার ওপর এইটুকু আশা করাও বোকামি ছাড়া কিছু নয়।”

সব শুনে সায়িদ রেগে বলল,,

‘তোর খুব চাপা হয়েছে তাই না? এই চাপা কি করে ভাঙতে হয় সেটাও আমি জানি। শুধু কাকার জন্য তোকে কিছু করতে পারি না। নাহলে এতোদিনে তোকে জ্যন্ত পুতে দিতাম আমি।”

বলেই সায়িদ ফোন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আজ কেন যেন এরকম করায় রাইফার চোখ দিয়ে পানি পরলো না।

____________________

মুখর কেবিন থেকে বেরিয়েই দেখলো দুই জন ক্যাপ মাস্ক পরিহিত পুরুষ আর একজন বোরকা হিজাব নিকাব পরিহিতা মহিলা এদিকেই আসছে। মুখরকে দেখেই একজন বলল,,

‘মেহু কেমন আছে এখন?”

মুখর বুঝতে পারলো এটা মেহরব চৌধুরী। বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মিহির আর মাইশা। তখন আরবাজ এলো তাদের দেখে একটু অবাক হলো তবুও এগিয়ে গেল। মুখর ওনাদের সবকিছু জানালো

আর এটাও বলল,,

“আপনাদের খবর কে দিল?”

তখন মেহরব চৌধুরী বললেন,,

‘দিয়েছে কেউ সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।তুমি তো আর দাওনি।”

‘আসলে স্যার মেহু আমাকে দিয়ে একটা ওয়াদা করিয়ে নিয়েছে। ওর মৃত্যু ছাড়া আর যাই হোক না কেন আমি যেন ওর অনুমতি ছাড়া আমার পরিবার আর আপনাদের কে না জানাই। এখানে আমি ওয়াদা বদ্ধ তাই আপনাদের জানাই নি। এমনকি আমার পরিবারও ওর বিষয়ে কিছু জানে না।”

তখন মাইশা বলল,,

‘এই মেয়েটা কি দিয়ে তৈরি আল্লাহ ভালো জানেন। এটা কোন কথা ওর মৃত্যুর খবর ছাড়া আর কোন খবর!”

মাইশা কে না বলতে দিয়ে তখন মিহির বলল,,

‘এসব কথা ছাড় মাইশা আমরা এমনিতেও জানি ও কিরকম। এখন কথা হলো মেহুকে এখানে রাখাটা সেফ নয়। এমনিতেই এটা সরকারি হাসপাতাল সিকিউরিটি তেমন জোরালো নয়। যদি মেহুর ওপর অ্যাটাক হয় তাহলে কিছুই করার থাকবে না। এমনিতেও এই অবস্থায় এখানে রাখা রিস্ক।”

‘আমিও তাই ভাবছি মিহির ভাইয়া। কাল সকালেই শিফট করবো।”

‘না যা করার রাতের অন্ধকারেই করতে হবে সবার আড়ালে।”

তখন মেহরব চৌধুরী বললেন,,

‘মিহির ঠিক বলেছে। যা করার রাতেই অন্ধকারেই করতে হবে। আমি যদি ভুল না হই তাহলে মেহবিনের ওপর আবার অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দিনের বেলায় কেউ মেহবিনের ওপর নজর রাখতে পারে। তাছাড়া সে তো জানে মেহবিন অনাথ ওর কেউ তাই সে আমাদের বিষয়ে ভাববে না। কেউ যে মেহবিন কে এখান থেকে রাতে সরাতে পারে সেটা তার মাথাতেও আসবে না। মুখর তুমি ডাক্তারের সাথে কথা বলো আমরা সব ব্যাবস্থা করে ওকে নিয়ে যাবো জানি এটা রিস্ক তবুও এই রিস্কটা নিতেই হবে।”

‘ঠিক আছে স্যার আমি কথা বলে দেখছি।”

‘আমরাও যাচ্ছি সাথে চলো।”

সবাই ডাক্তারের কাছে গেল। কিন্তু তিনি জানালেন মেহবিনের জন্য এখন রিস্ক কোথাও শিফট করা। সবাই মিলে তাকে অনেক রিকুয়েস্ট করলো আর এটাও বলল ওর লাইফ রিস্ক আছে এখানে। তাছাড়া তারা সবথেকে ভালো হাসপাতালে ওকে শিফট করবে। সব শুনে তিনি রাজি হলেন। তাকে সবাই বলল তিনি যেন কাউকে কিছু না বলেন। তিনি এতেও রাজি হলেন।তিনি মেহবিন কে অনেক স্নেহ করে তার খারাপ হোক এটা তিনি চান না। মিহির বেরিয়ে অ্যাম্বুলেন্স কল করলো এখানের অ্যাম্বুলেন্স ওরা নেবে না। ওরা কোন কিছুতেই কিছু বিশ্বাস করবে না। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আরও ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে। মেহরব চৌধুরী মিহির আর মাইশা মেহবিন কে একবার দেখে এলো। মেহরব চৌধুরীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো আজ ভিশন অসহায় লাগছে নিজেকে তার। ওরা বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। ওরা সবাই অন্য কেবিনে গিয়ে বসলো আর অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। তখন সবার অগোচরে একজন মেহবিনের রুমে ঢুকলো। মেহবিন কে দেখেই কে দেখেই তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে আস্তে করে মেহবিনের হাত দু’টো নিজের মুঠোয় নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে বললেন,,

“আমার আম্মা! আমার আম্মা! আপনি আমায় ক্ষমা করবেন আমি আপনাকে রক্ষা করতে পারি নি। আপনাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আপনাকে নিজের থেকে দূরে রেখেছি। তবুও আজ নিজেকে ভিশন ব্যর্থ মনে হচ্ছে আম্মা। আমি জানি আমার ওপর আপনার অনেক অভিযোগ আর এটা জায়েজ ও। কিন্তু সবটাই আপনার সুরক্ষার জন্য। ওরা যে মেহেরের মতো আপনাকেও বাঁচতে দিতো না আম্মা। আমি যে আপনাকে অনেক ভালোবাসি আম্মা তাই তো আপনাকে একেবারের জন্য হারাতে চাইনি। আমি জানি আপনি কোন একদিন ঠিক ফিরবেন আমার কাছে আমি সেদিনটারই অপেক্ষায় আছি।

লোকটার চোখের পানি মেহবিনের হাতে পরলো। তিনি মেহবিনের হাত ধরে চুমু খেলেন মাথাটা উচু করতেই তখন তিনি শুনতে পেলেন,,

“বাবা!”

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-২৯+৩০

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_২৯
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“অনেক রাত হয়েছে মামা ঘুমিয়ে পড়ো এখন।”

মেহবিনের কথায় মেহরব চৌধুরী মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“আজ বোধহয় ঘুমটা হবে না আমার।”

“আজাইরা কথা রাখো তো। যাও ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। ঘরে গিয়ে দেখবে তোমার জন্য মামীও না ঘুমিয়ে আছে।”

“হ্যা তা তো থাকবেই। তবুও উঠে এসে বলবে না চলো ঘুম আসছে না যখন তাহলে চন্দ্রবিলাশ করি।”

মেহরব চৌধুরীর কথায় মেহবিন হাসলো। ও বুঝতে পারল ওর মামা ওর মুড ঠিক করতে এগুলো বলছে। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“তাহলে মামীকে ডেকে নিয়ে আসি?”

“তোর মামী যে নিরামিষ মহিলা। তোর মামী আবার চন্দ্রবিলাশ করবে।”

“কেন তোমার মতো বুড়ো বয়সে এসে নির্লজ্জ হতে বলছো নাকি?”

পেছনে কারো কথায় দুজনেই পেছনে তাকায়। মেহরব চৌধুরী নিজের স্ত্রীকে দেখে বললেন,,

“এই মেহু এটা সত্যি তোর মামী তো নাকি কোন জ্বীন তাড়াতাড়ি আয়াতুল কুরসি পাঠ কর।”

মেহরব চৌধুরী সত্যি সত্যি আয়াতুল কুরসি পাঠ করলেন আর বললেন,,

“আরে তুমি তো দেখি আমার বউ কোন জ্বীন না। আয়াতুল কুরসি পাঠ করছি যেহেতু গায়েব হও নাই তার মানে এইটা সত্যি সত্যি তুমি।”

“এখন আর একটা কথা বললে ছাদ থেকে ফেলে দেব বলে দিলাম। রাত বেরাতে আমাকে জ্বীন বলা হচ্ছে।”

মেহরব চৌধুরী তার মিসেস এর কাছে গিয়ে বললেন,,

“আরে রাগ করো কেনো? এটা তো সত্যি বেশি রাত করে ঘরের বাইরে বা ছাদে থাকতে নেই। রাতের অন্ধকারে জ্বীনদের আনাগোনা শুরু হয়। তাই ছাদে এসেছো একবার পরখ করে নিলাম। যদিও তিন কুল পরেই এসেছিলাম তবুও সাবধানের মার নেই।”

“হয়েছে এখন ঘরে যাবে নাকি জ্বীনদের সাথে চন্দ্রবিলাশ করবে?”

“বউ থাকতে আবার জ্বীনদের লাগে নাকি। তাছাড়া বউয়ের সাথে সময় কাটানো ভালো কথা।”

মেহবিন এতক্ষন তার মামামামির কথোপকথন শুনে হাসছিল এখন একটু কাশি দিয়ে বলল,,

“এই যে লাভ বার্ডস এখানে কিন্তু বাচ্চা পুলাপাইন আছে।”

তখন মেহবিনের মামি বললেন,,

“এই যে মেহু তুই যদি বাচ্চা পুলাপাইন হস। তাহলে আদর এখনো মায়ের পেটে আছে।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“তা ঠিক যাই হোক তোমরা চন্দ্রবিলাশ করো আমি আসছি।”

“আরে তুই ও বোস না আমরা আড্ডা দিই।”

“বিরিয়ানি তে এলাচি হয়ে লাভ নেই।”

“তুই কি কালকেই চলে যাবি?’

“হ্যা সকালের খাবারের পর!”

“আরে কাল না তোর বন্ধ সকালে গিয়ে কি করবি একেবারে রাতে যাস মিহির পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

মিহিরের কথা শুনে মেহবিনের মিশুর কথা মনে পড়লো। তাই ও বলল,

“তোমরা কোন অনুকে চেনো? আই মিন অনুভব।”

দুজন একসাথেই বলল,,

“অনুভব কে?কই না তো কেন?”

মেহবিন বলল,,

” না তেমন কিছু না এমনিই। আচ্ছা তোমরা থাকো আমি গেলাম।”

বলেই মেহবিন নিচে এলো। নিজের রুমে ঢুকতেই দেখল মিশু মাথার বালিশ মাথায় না দিয়ে তা জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। মেহবিন গিয়ে বালিশ ঠিক করে মিশুর মাথার নিচে দিয়ে দিল। আর পাশেই শুয়ে পড়লো তখন ও মিশুর থেকে শুনতে পেল,,

“অনু! অনু! আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।”

এটুকু শুনেই মেহবিন মিশুর দিকে তাকালো নিঃসন্দেহে মিশু তার অনুকে অনেক ভালোবাসে। নাহলে কেউ অন্যকারো চোখের মাঝে নিজের অনুকে খুঁজে। নাকি সবাইকে ভুলে গিয়ে শুধু তার অনুকেই মনে রাখে। ও আর না ভেবে শুয়ে পড়লো। তার কিছুক্ষণ পরেই মিশু মেহবিন কে কোলবালিশ বানিয়ে জড়িয়ে ধরলো মেহবিন চেয়েও কিছু করতে পারলো না। একটা সময় পর সেও ঘুমিয়ে পড়লো।

________________

“এই ফুলের মামা তো ভাই তুমি এখানে কি করো?”

মিহির সকাল বেলা ছাদের ফুল গাছ গুলো তে পানি দিচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে মেহবিন কে না পেয়ে সোজা ছাদে চলে আসে । কাল আদর ওকে দেখিয়ে গিয়েছিল তাই অসুবিধা হয় নি। মিহির মিশুর দিকে তাকিয়ে দেখলো বিছানা থেকে নেমে সোজা এখানে এসেছে ও বুঝতে পারল। চোখ দু’টো ফোলা চুলগুলো এলোমেলো। ওরনাটা ঠিকঠাক আছে তবুও এভাবে আসাটা উচিত নয়। মিহির অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,,

“দেখতেই তো পাচ্ছেন ফুলগাছে পানি দিচ্ছি। তা সকাল সকাল আপনি এখানে কেন? এভাবে ফ্রেশ না হয়ে ছাদে আসা ঠিক হয় নি আপনার। আর যেখানে একজন ছেলে আছে সেখানে একা আসা আরো উচিত হয় নি আপনার।”

“কেন একা আসলে কি তুমি খেয়ে ফেলবে নাকি। তাছাড়া আমি তো ফুলকে খুঁজতে এসেছি। আমি একা একা ফ্রেশ হতে পারি নাকি মাইশার জামা নষ্ট হয়ে যাবে না।”

মিহির মিশুর কথার মানে বুঝতে পারলো কিন্তু মিশু যে ওর কথার মানে বুঝেনি এটাও বুঝতে পারলো। তাই ও বলল,,

“ঠিক আছে আপনি নিচে যান আপনার ফুলকে পেয়ে যাবেন?”

“আচ্ছা। তবে একটা কথা?”

“কি?”

“তুমি আমার থেকে বড় হয়েও আপনি বলছো কেন? আমার কেমন যেন লাগে তুমি করে বলতে পারো না।”

“আপনার অসুবিধা না হলে তুমি করেই বলবো।”

“তুমি করেই বলবে । তুমি করে বলো এখন?”

“তুমি।”

“হুম ঠিক আছে। তবে আরেকটা কথা?”

“তুমি তো বলেছিলে একটা কথা।”

“আছে আরেকটা শুনোই না।”

“কি?”

“সবাইকেই দেখলাম কিন্তু আদরের মা মানে তোমার বউকে তো দেখলাম না।”

“আদরের মা আদরের তিন বছর থাকতে মারা গেছে।”

এ কথা শুনে মিশু একটু নরম স্বরে বলল,,

“ওহ আচ্ছা।”

তখনি মেহবিন এলো দৌড়ে বোঝায় যাচ্ছে মিশুকে না পেয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পরেছিল মিশুকে পেতেই ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর মিশুর হাত ধরে নিচে নিয়ে গেল। ফ্রেশ করিয়ে দিল তারপর নিচে গেল সবাই ব্রেকফাস্ট করবে। মিশু বসতেই দেখতে পেল সব তার ফ্রেবারিট খাবার। সে খুশি হয়ে গেল তখন আদর বলল,,

“এই যে তোমাকে আমি কি বলে ডাকবো।’

আদরের কথায় মিশু আদরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমার নাম মিশুমনি। তুমি আমায় মিশুমনি বলেই ডাকবে।”

‘বড়দের নাম ধরে ডাকতে হয় না। দাদু বলেছে আমায়।”

তখন মেহরব চৌধুরী বললেন,,

“আদর তুমি মিশুকে মনি বলেই ডেকো।”

‘আচ্ছা।”

সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করলো খাওয়ার শেষে মেহবিন মিশুকে একটা ওষুধ দিল। মিশু প্রথমে ওষুধ দেখে অবাক হলেও মেহবিনের দিকে তাকিয়ে খেয়ে নিল। সবাই মিলে একটু গল্প করবে তারপর মেহবিন রা রওনা দেবে। সবাই বসলো সোফায় কিন্তু মিশুর নজর বারবার মিহিরের চোখের দিকেই যাচ্ছে। ও চেয়েও ফেরাতে পারছে না।কাল রাতে মেহবিন একটা গোলজামা পায়জামা ওরনা আর হিজাব অর্ডার করেছিল মিশুর জন্য। সেগুলো আসলেই মেহবিন বলল রেডি হতে নতুন জামা পেয়ে মিশুর খুশি আর দেখে কে। এগারোটার দিকে ওরা রওনা হলো মেহরব চৌধুরী মিহির কে পাঠাতে চাইলেও মেহবিন বলল দরকার নেই। ও নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাবে আর মিশুকে ঘুরাবে। বিকেল চারটায় যেন মেহরব চৌধুরী একজন ড্রাইভার পাঠিয়ে দেয় গাড়ি আনানোর জন্য। প্রথমে সম্মতি দিতে না চাইলেও পরে দেয়। আদর মিশুকে এক বক্স চকলেট গিফট করে। মিহির একটা বড় মাঝারি সাইজের টেডিবিয়ার দেয় যা কিনা মিশুর বুক পর্যন্ত। টেডিবিয়ার আর চকলেট পেয়ে মিশু খুশিতে লাফিয়ে উঠে। টেডিবিয়ার টা ওর খুব পছন্দ হয়েছে। মাইশা একটা হিজাব আরোকিছু জামা গিফট করে আর মেহরব চৌধুরী ও তার মিসেস একটা স্বর্নের চেইন গিফট করে। স্বর্নের চেইন গিফট পেয়ে মিশু প্রথমে নিতে চায় না পরে মেহবিনের আর মেহরব চৌধুরীর কথায় নেয়। মেহবিন নিজে হেঁসে চেইন পরিয়ে দেয়। এরপর বেরিয়ে পরে বাড়ির উদ্দেশ্যে। একটু ঘুরাঘুরি করে ফুচকা খায় ওরা এরপর দুপুর আড়াইটার দিকে চেয়ারম্যান বাড়িতে পৌঁছায়। গাড়ি থেকে নামার আগে মেহবিন বলল,,

“ফুল তোমায় কি বলেছি তো মনে থাকবে?”

“হুম মনে থাকবে। এখন তুমি চকলেট আর শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে আসো। আমি টেডিকে নিয়ে যাচ্ছি।”

“হুম!”

মেহবিন সব নিয়ে বের হলো ও বাড়িতে ঢুকে দেখলো এখনো আহমেদ পরিবার যায় নি। তবে আজকে চেয়ারম্যান বাড়ির ও সবাই বাড়িতেই। মিশুর হাতে টেডি দেখে সকলেই অবাক হলো। মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,

“এই যে আপনার মেয়েকে সহি সালামতে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম। আর এগুলো ওর উপহার! আমায় বাড়ি যেতে হবে আসছি।

বলেই মেহবিন ওগুলো টেবিলে রাখলো। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“এতদূর থেকে জার্নি করে এসেছেন কিছু খেয়ে রেস্ট নিয়ে তারপর যান।”

তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“আমার নাতিনের শ্বশুরবাড়ির সাথে পরিচয় হও।”

মেহবিন বুঝতে পারলো তিনি ওকে নিচু দেখানোর একটা চেষ্টায় আছে। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“সেদিন যেহেতু মামনিকে জড়িয়ে ধরেছিলাম তখনই আপনাদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। আমার মনে হয় না সেই প্রশ্ন আপনারা আমি আসার অপেক্ষায় আর করেন নি। নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে জেনে গেছেন। তাই পুরোনো কাসুন্দি ঘেটে কি লাভ।”

মেহবিনের মুচকি হেসে কথার জবাবে সবাই এক প্রকার অবাক হলো। তখন শিলা বলল,,

“তা শুনলাম ডাক্তার হয়েছিস এতোদিন ছিলিস কোথায়? তাছাড়া তোর বেশভুষায় বুঝলাম বেশ উন্নতি হয়েছে তোর।

“তোমাদের দেখা পেয়ে বুঝতে পারলাম সত্যিই দুনিয়াটা গোল।”

তখন কুদ্দুস বাড়ি বুকে বলল,,

“বাইরে নতুন গাড়ি কার? আরবাজ ভাইজান আইছে গাড়ি নিয়া ঢুকতে পারতেছে না।”

তখন মেহবিন বলল,,

“চেয়ারম্যান সাহেব আমায় যেতে হবে। আর গাড়িটাও আমারই এখন বাড়ি যাবো বলে ভালোমতো পার্ক করা হয় নি।”

তারপর মেহবিন সাবিনা আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“মামনি যদি তোমরা থাকো তাহলে বিকেলে আমি যেখানে থাকি সেখানে যেও। যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে।”

মেহবিন বেরিয়ে এল। গাড়ির সামনে আসতেই দেখলো আরবাজ দাঁড়িয়ে আছে। আরবাজ মেহবিন কে দেখে বলল,,

“কাল কেমন কাটলো?

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘আপনিও না হয় আমার সাথে গিয়ে দেখতেন কেমন কেটেছে?”

‘আমি যেতে পারলে তো যেতামই।”

‘চাইলেই যেতে পারতেন শুধু যাওয়ার মন থাকলেই হতো।”

‘তো মামাবাড়িতে গিয়ে মামার সাথে সময় কাটিয়েছেন নিশ্চয়ই।”

“হুম তা তো কাটিয়েছিই। আমার মামা মন্ত্রী হলেও নিজের পরিবারের ওপর দায়িত্ববোধ ভুলেন না।”

মেহবিনের কথায় আরবাজ আর সে বিষয়ে কিছু বললো না। বলল,,

“গাড়িটা কি আপনার ?”

‘না মামার।”

“একেবারের জন্য এনেছেন?’

“না বিকেলে মামার ড্রাইভার আসবে।”

“ওহ আচ্ছা!”

বলেই মেহবিন গাড়ি তে উঠে বসলো আর বাড়ি চলে গেল। আরবাজ ভেতরে যেতেই মিশু দৌড়ে এসে ওকে সব দেখাতে লাগল। আরবাজ এসেছে শুনে ও আর ওপরে যায় নি। মিশু এটাও বলল ওকে মেহবিন যে বাড়িতে নিয়ে গেছিল সে বাড়ি ওদের বাড়ির থেকেও বড়। সবাই সব শুনে অবাক হলো তারপর মিশু কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে ওপরে চলে গেল। একে বলে কিছু না বলেও মুখের ওপর জবাব দেওয়া।

_______________

পাকা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে মেহবিন নেমে দাড়াতেই একজন লোক এসে বলল,,

“আপনার এতো দেরি হলো কেন ম্যাম? আজ তো দুপুর দুইটায় আপনার কাজ ছিল একটা হাসপাতালে।”

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩০(বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

লোকটার কথায় মেহবিন তার দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘ডক্টর মেহবিন তার কাজকে কখনো ভূলে না। সামান্য একটা কারনে আপনি আমার বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছেন দেখে অবাক হলাম আমি। কাইন্ডলি এখানে না এসে আপনার ইমেইল বক্স চেক করতেন তাহলে এমনিতেই সব পেয়ে যেতেন। এখানে আসার দরকার পরতো না।”

‘তারমানে আপনি আগে থেকেই সব যোগাড় করে রেখেছিলেন?”

‘হুম এখন যান এখান থেকে। কাল হাসপাতালে দেখা হবে।”

” হুম।”

বলেই লোকটা চলে গেল। মেহবিন বুঝতে পারলো না তার এখানে আসার কারন এতো দেখি মেহবিনের থেকেও ডেসপারেট কাজের বিষয়ে। মেহবিন এগুতে দেখলো ওর গাড়ি দেখে সবাই তাকিয়ে আছে । মেহবিন করে চলে এলো। বাড়ি এসে ফ্রেস হয়ে নিল আসার সময় কাচ্চি নিয়ে এসেছিল রাস্তা থেকে এখন সেটাই খাবে সে। অবশ্য মিশুকেও অফার করেছিল। কিন্তু সে খাবে না বলে জানিয়েছে। মেহবিন খাবার খেতে বসতেই মুখরের ফোন এলো। ও ফোন ধরে সালাম দিল,,

“আসসালামু আলাইকুম!”

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনি?”

আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো। একটা কথা কালকে কিন্তু ফুলকে ফুল দেওয়া হয় নি?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“এটা আপনার দোষ আমার কি?”

“এমন ভাবে বলছো যেন আমি ফুল দেওয়ার স্কোপ পেয়েছি।’

‘দিলে কে না করতো শুনি? আমার দাদি শাশুড়িও কাল কিছু বলতো না‌।”

‘হুম পরেরবার কালকেরটা সহ আরো বেশি করে ফুল নিয়ে যাবো ঠিক আছে।”

‘ঠিক আছে।”

‘তা কি করছো?”

“কাচ্চি খাচ্ছি তাও আবার আপনার পছন্দের আলুওয়ালা।”

‘কি!”

“হুম!”

“তুমি কি আমায় লোভ দেখাচ্ছো?”

“আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই।”

‘তাহলে এতো ঘটা করে কেন বলছো আমার আলুওয়ালা কাচ্চি।”

“ওটা এমনিই বললাম।”

‘আমি কিন্তু শুধু তোমায় নিয়ে আলুওয়ালা কাচ্চি খাই কিন্তু তুমি আমাকে রেখেই খাচ্ছো।”

‘মুড হলো তাই।”

‘এটা ঠিক না।”

“আমার তো মনে হচ্ছে এটাই ঠিক। যাই হোক বাদ দিন এই সময় ফোন দিয়েছেন কেন?”

“তুমি বাড়ি পৌঁছে গেছো কি না এই জন্য?’

‘হুম পৌঁছে গেছি এখন খেতে বসেছি।”

“ওহ আচ্ছা তাহলে খাও।”

“আপনি খেয়েছেন?”

‘হুম সেই দুপুরবেলা।”

‘আচ্ছা।”

‘তাহলে রাখছি?”

‘আচ্ছা! আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ।”

‘ইনশাআল্লাহ।”

বলেই ফোনটা রেখে দিল। মেহবিন খাবার শেষ করলো। তারপর বাইরে বের হতেই দেখলো তাজেল দাঁড়িয়ে আছে। তাজেল কে দেখে মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘এই যে নেত্রী এদিকে আসো?”

তাজেল এগিয়ে গেল কিন্তু কিছু বললো না। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“কেমন আছো?”

তাজেল হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে ঘুরে গেল। এমন দেখে মেহবিন বুঝতে পারলো না আসলে কি হয়েছে। তাই ও বলল,,

“আমার সাথে কথা বলবে না।”

তাজেল ও দিকে ঘুরেই বলল,,

“ডাক্তার তুমি কিছু ভুইলা গেছো?”

মেহবিন কথাটা শুনে ভাবতে লাগলো কি ভুলে গেছে। মনে পরতেই ও মাথায় হাত দিল। আর বলল,,

“সরি নেত্রী দেরি হওয়ার জন্য যাই নি।”

‘হরো তুমি কথা নাই তোমার সাথে।”

“আহা নেত্রী আমি ভুলে যাই নি মনে ছিল তো। আজ তোমার বাড়িতে দুপুরে আমার দাওয়াত ছিল। এখন তো তিনটা বাজে তাই যাই নি।”

‘তোমার সকালে বাড়ি আসার কথা আছিল আর তুমি এহন আইলা। আর আইসা তুমি আমাগো বাড়ি না যাইয়া বাড়িতে খাইতে বইসিলা।”

মেহবিন বুঝতে পারলো ও যে খেয়েছে এটা তাজেল দেখেছে বলেই এতো অভিমান করেছে। তাই বলল,,

‘আমি কি জানতাম নাকি দুপুরের দাওয়াত তিনটা পর্যন্ত থাকে।”

“আমাগো গ্ৰামে সন্ধ্যাতুরিও থাহে।”

‘আচ্ছা সরি। তুমি খেয়েছো দুপুরে?

তাজেল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,,

“হুম খাইছি। রাতে কিন্তু আমাগো বাড়ি খাইবা। যদিও নতুন রান্ধা না দুপুরের রান্দাতাই খাইবা এইডা তোমার শাস্তি।”

‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আর রাগ নেই তো তোমার ডাক্তারের প্রতি।

” না! আমি জানি তো আমার ডাক্তারের হেই রহম কাম না থাকলে আমার ডাক্তার দেরি করতো না। তা হুনলাম তুমি নাকি গাড়ি নিয়া আইছো।”

“হুম তুমি উঠবে তাহলে চলো ঘুরে আসি।”

“হু যামু পাশের গ্ৰামে মেলা লাগছে। তোমারে ফুচকা খাওয়ানোর লাইগা চল্লিশ টাহা রাখছি আব্বার কাছে থিকা। হেনে যামু এহন চলো।

“চল্লিশ টাকা তোমার কাছে রেখে দাও। পরে তুমি কিছু খেয়ে নিও। আজ আমার নেত্রীকে আমিই মেলা ঘুরাবো।”

‘না আমি রাখছি আব্বার থিকা তাই আমিই খাওয়ামু।”

“থাক না।”

‘আমি কিন্তু মেলায় যামুনা ডাক্তার।”

মেহবিনের আর কি তার নেত্রীর কথা তাকে মানতেই হবে। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘ঠিক আছে আমি রেডি হয়ে আসি। তুমিও রেডি হয়ে আসো। আর হ্যা কুলসুম আর নওশি কেও নিয়ে এসো।”

“ওগো খাওয়ানোর টাহা কিন্তু আমি দিমু না কইলাম।”

“আচ্ছা আমিই দেব তোমার চল্লিশ টাকার ভাগ আমি ছাড়া আর কেউ নেবে না খুশি।”

‘মেলা খুশি।”

বলেই তাজেল তার বাড়ির দিকে দৌড় দিল। আজ তাজেল ওকে দাওয়াত করেছিল দুপুরে। তাড়াতাড়ি আসতে চেয়েও পারে নি মেহবিন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনটা বেজে যায় তাই ও যায় নি। আর রাস্তা থেকেই বুঝতে পেরেছিল ও ঠিক সময় পৌঁছাতে পারবে না। তাই এখন রান্না করবে না বলেই কাচ্চি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ও এখানে এসে বুঝতে পারলো এটা কমিউনিটি সেন্টার নয় এটা গ্ৰাম এটা দুই ঘন্টা কেন সারাদিন লেট করলেও কিছু হবে না। মেহবিন রেডি হয়ে নিল রেডি হয়ে বছর হতেই দেখলো নওশি, তাজেল আর কুলসুম দাঁড়িয়ে। নওশিসহ তাজেল আর কুলসুম খুব ইচ্ছে ছিল গাড়িতে উঠার তাই একবার শুনেই রাজি হয়ে গেছে। ওরা গাড়ির সামনে আসতেই দেখলো দুই তিন জন বাচ্চা ছেলে গাড়ির ছাদের ওপর উঠেছে। তা দেখে সবার আগে তাজেল দৌড়ে গিয়ে বলল,,

“ঐ রানা গাড়ির ওপরে ওঠছোস কেন? তাড়াতাড়ি নাম আমার ডাক্তারের গাড়ির যদি কিছু হইছে আমার হাত থেইকা তোগোরে কেউ বাচাইতে পারবো না।”

“না নামলে কি করবি হুনি?”

তাজেল পাশে থেকে একটা ইটের টুকরো উঠিয়ে বলল,,

‘এইডা ফিক্কা তোর মুখে মারুম আগে তারপর একটা লাঠি দিয়া বাবলা গাছের সাথে বাইন্দা পিটামু।”

ততক্ষণে সবাই গাড়ির কাছে এলো। মেহবিন কে দেখে বাচ্চাগুলো নেমে গেল। মেহবিন তাজেলের সব কথাই শুনেছে এই মেয়েটাও না তার ডাক্তারের কোন কিছু মানে তার কাছে মহামূল্যবান কেউ কিছু করতে পারবে না। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

‘হইছে নেত্রী তোমার আর কিছু করতে হবে না ওরা নেমে গেছে।”

তখন রানা নামের ছেলেটা বলল,,

“আমরা তাজেলের কথায় নামি নাই আপনারে দেইহা নামছি। আপনে যদি কিছু কন বা মারেন এই জন্য।”

“গাড়ির ওপরে কি করছিলে?”

“কিছু না এমনিই শখ হইছিলো তাই।”

“গাড়িতে উঠবে তোমরা।”

কথাটা শুনেই তিনজনের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। আর তাড়াতাড়ি করে বলল হ। কিন্তু তাজেল ওদের উঠতে দেবে না ওরা আগে বেয়াদবি করেছে তাই। মেহবিন তাজেলকে বুঝিয়ে উঠালো ওদের। মেহবিন সবাইকে নিয়ে মেলায় গেল। মেহবিন তাজেলের টাকায় ফুচকা খেল। বাকি সবার টাকা ও নিজে দিল সবাইকে হালকা কিছু জিনিস কিনে দিল। ওরা পুরো মেলা ঘুরলো। নাগরদোলা তারপর নৌকা সব জায়গায় উঠলো। তখন ফোন এলো ড্রাইভার এসে পরেছে ওনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলল মেহবিন। ওরা বাড়ি চলে এলো।আজ তাজেল কে অনেক খুশি দেখাচ্ছিল। গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির চাবিটা ড্রাইভারের হাতে দিলে উনি গাড়ি নিয়ে চলে গেল। তাজেল মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আইজকা আমি মেলা খুশি ডাক্তার।”

“তোমাকে খুশি করতে পেরে আমি ধন্য নেত্রী।

“রাইতে কিন্তু আমার বাড়ি খাইতে হইবো ভুইলো না কিন্তু।”

“আচ্ছা।”

কথা বলতে বলতেই ও বাড়ির সামনে এসে দেখলো আহমেদ পরিবার এখানে। না পুরো আহমেদ পরিবার বলা যায় না, সাবিনা আহমেদ, শিলা, শান, শানের মা আর ওর বোন এসেছে। ওদের দেখে তাজেল বলল,,

“এইগুলা কারা ডাক্তার?”

“আমার পরিচিত তুমি এখন বাড়ি যাও।”

“আইচ্ছা।”

তাজেল চলে যেতে নিল তখন মেহবিন আবার ডাক দিল ,,

“নেত্রী?”

তাজেল পেছনে ঘুরে বলল,,

“কি?”

“এগুলো কে নেবে?”

তাজেল দেখলো মেহবিনের হাতে ওর ভাইবোনের জন্য কেনা খেলনা যা মেহবিন কিনে দিয়েছে। তাজেল হেঁসে এগিয়ে এসে বলল,,

“ভুইলা গেছিলাম।”

“হুম নিয়ে যাও।”

তাজেল ওগুলো নিয়ে চলে গেল। মেহবিন মুচকি হেসে সাবিনা আহমেদ কে বলল,,

“কখন এসেছো মামনি?”

“বেশি না দুই মিনিট।”

“ওহ আচ্ছা ভেতরে এসো।”

মেহবিন গিয়ে বারান্দার তালা খুললো সবাইকে নিয়ে ঘরে বসতে দিল। সাবিনা আহমেদ মেহবিনের গালে হাত দিয়ে বলল,,

“কেমন আছিস?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আমাকে কি খারাপ দেখছো?”

তখন শিলা বলল,,

“কোথায় গিয়েছিলি?”

“মেলায় গিয়েছিলাম। তা মামনি তোমরা কয়েকদিন থাকছো নাকি এখানে?

তখন মিসেস সাবিনা বললেন,,

“না আজ সন্ধ্যায় রওনা হবো। ভাবলাম যাওয়ার আগে তোর সাথে দেখা করে যাই।”

তখন শিলা বলল,,

“বাড়ি থেকে বেরিয়ে তো হলে উঠেছিলি শুনেছিলাম। তার বছর খানেক পর কোথায় লাপাত্তা হয়েছিলি?”

“বাহ আমার এতো খোঁজ তুমি নিয়েছো বলে অবাক হলাম। যাই হোক আমি তোমাকে কিছুই বলতে চাইছি না। এখন বলো বিয়ে করেছো?

“কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছিস নাকি?”

“না শুধু জিজ্ঞেস করছি।”

“হ্যা করেছি।”

“তা জামাইকে আনলে না এখানে?”

“আমার জামাই কি যেন তেন লোক নাকি সে মস্ত বড় বিজনেস ম্যান। সময় নেই তার বেশিরভাগ সময়ই সে ব্যস্ত থাকে।”

“তা তোমায় সময় দেয় তো ?”

কথাটা শুনে শিলা একটু থমকে গেল। তবুও বলল,,

“দেবে না কেন।”

“যাক খুশি হলাম।”

সবাই আরো কিছু কথাবার্তা বললো মেহবিন ওদের জন্য কফি বানিয়ে আনলো সবাই খেল । মেহবিন সবার আলাদা হয়ে সাবিনা আহমেদ কে কিছু বললো। এখন সবাই বাড়ি যাবে যাওয়ার আগে। শান সুযোগ বুঝে মেহবিন কে একা পেয়ে বলল,,

“তুই কোথায় ছিলিস এতোদিন জানিস আমি কতো খুঁজেছি?”

“কেন? বিয়ে করার জন্য বুঝি?”

মেহবিনের কথায় শান অবাক হলো তখন মেহবিন বলল,,

“অবাক হওয়ার কিছু নেই শান ভাইয়া। তুমি যে আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করতে এটা আমি বুঝতাম। এখন যা হচ্ছে তা ভালোর জন্যই হচ্ছে। ”

“জিনিয়াকে দেখার আগে যদি আমি তোকে পেয়ে যেতাম তাহলে হয়তো কিছু করতে পারতাম।”

“তবুও কিছুই করতে পারতে না তুমি। যে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল সেই মেয়েটাকে তোমার বউ হিসেবে কেউ আপন করতে পারতো না। তাছাড়াও সেটা সম্ভব নয় সবথেকে বড় কথা আমি ম্যারিড। জিনিয়া খুব ভালো মেয়ে তোমাকে সুখী করতে পারবে।”

মেহবিনের কথায় শান অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। আর বলে,,

“সত্যিই কি তুই ম্যারিড নাকি আমায় মিথ্যা বলছিস।”

“সত্যি বলছি আমি ম্যারিড। আর তুমি তো জানো আমি কিরকম এরকম কথা নিশ্চয়ই আমি মিথ্যে বলবো না। তাছাড়া আর কেউ না জানলেও মামনি জানে আমার বিয়ে হয়েছে।”

শান আর কিছু বললো না। ওখান থেকে নিজের মায়ের কাছে গেল। অতঃপর তারা সকলেই চলে গেল।

রাত হলে তাজেল আর ওর দাদি এলো মেহবিনকে নিতে। তা দেখে মেহবিন হাসলো এখন একেবারে নিতেই এসেছে। মেহবিন কতোগুলো চকলেট আর চিপস বিস্কুট নিয়ে ওদের বাড়িতে গেল। তাজেলের বাবা ওকে বসতে বলল তাজেল আর ওর দাদি মেহবিন কে খাবার খাওয়ার জন্য নিচে পাটি বিছিয়ে দিল। হাঁসের মাংস আর চিতই পিঠা মেহবিনের সামনে রাখলো। তখন মেহবিন বলল,,

“তাজেল তোমার মা কোথায়?”

“হেতি এনে আইবো না ঘরেই রইছে।”

“তোমরা সবাই খেয়েছো?”

তখন তাজেলের দাদি বলল,,

“হ সবাই দুপুরেই গোস্ত দিয়া পিঠা খাইছে খালি তাজেল তোমার জন্য বইসা আছিল। এইগুলো তোমার জন্য আমারে উঠাই রাখতে কইছিল তাজেল আর ওর বাপে তাই তোমাগো দুজনের জন্যই উঠাই রাখছি। আর রাইতেও সবাই খাইছে খালি তাজেল বাদে।

মেহবিন এ কথা শুনে তাজেলের দিকে তাকালো। মেহবিনের চোখের ভাষা তাজেল বুঝতে পারলো ও চুপটি করে মেহবিনের পাশে বসলো একটা প্লেট নিয়ে তরকারি নিল তারপর মেহবিনের খাওয়া শুরু করার আগেই পিঠে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। আর বলল,,

“এহন তুমি শুরু করো?”

মেহবিন হেঁসে খাবার খাওয়া শুরু করলো। মেহবিন নিজের প্লেট থেকে মাংস তুলে তাজেলের প্লেটে উঠিয়ে দিল। তা দেখে তাজেল বলল,,

“আমার পেট ভরা কিছু দিও না আমারে।’

“দুই পিস মাংস খেলে কিছুই হবে না নেত্রী।”

“মেলা থেইকা কতো কিছু খাইছি মনে নাই তোমার।”

“আরে খাও তো।”

তখন তাজেলের দুই ভাইবোন ওখানে এলো। তাজেল ওদের ডেকে এক টুকরো করে মাংস দিল দু’জনকে। তা দেখে মেহবিন হাসলো এটাই বোধহয় বড় বোন ভাইবোন যেমনই হোক না কেন তাদের প্রতি আলাদা একটা দায়িত্ববোধ কাজ করে সব বড় ভাইবোনদের।

_________________

দুদিন পর দুপুরে,,

ব্রেকিং নিউজ,,

মহুয়াপুর ২৫০ শয্যা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সুলেখার মৃত্যু তদন্তে অতঃপর তার মৃত্যুর ছয় মাস পর পুলিশ একটা সুরাহা করতে পেরেছে। জানা যাচ্ছে যে তার খুনের পেছনে রয়েছে নিশাচর এবং খুনটা ডক্টর বাবুলের দ্বারা করিয়েছিলেন তিনি। ডাক্তার সুলেখা নিশাচর কে দেখতে পেয়েছিলেন এবং অবৈধ কার্যকলাপের একটা সাক্ষী হয়েছিলেন দেখে নিশাচর তাকে হত্যা করেন। কাল মারা যাওয়ার আগে ডাক্তার বাবুল এ কথা স্বীকার করে গেছেন। হুট করেই জেল থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন এবং ওনার অবস্থার অবগতির জন্য ওনাকে মহুয়াপুর ২৫০ শয্যা সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয় ডক্টর মেহবিন মুসকান এর আন্ডারে। ওনার সকল ট্রিটমেন্ট উনিই করছিলেন। মারা যাওয়ার আগে ডক্টর মেহবিন মুসকান ও ওসি মুখর শাহরিয়ার এর সামনে ডক্টর বাবুল জবানবন্দি দেন। জবানবন্দির কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যু ঘটে।

খবরটা দেখেই নিশাচর চেয়ারটা উঠিয়ে টিভির স্কিনে ছুড়ে মারলো আর চিৎকার করে বলল,,

“এই ডাক্তার আর পুলিশ এরা আসার পর থেকেই আমার একটা একটা করে সব বের হচ্ছে।যতবার ভাবি এদের ছেড়ে দেব ততবারই এরা নতুন নতুন কারন দেয় ওদের শেষ করার জন্য। আচ্ছা এই দুইজন কি একসাথেই আমাকে এক্সপোজ করার রাস্তায় নেমেছে নাকি আলাদা আলাদা। যেভাবেই হোক এদের কে আর ছাড়া যাবে না। আমার পেছনে লাগার জন্য এদের মূল্য চুকাতেই হবে।

______________

‘এভাবে কয়েকদিন পর পর অসুস্থ হলে চলবে নিজের যত্ন নিতে হবে তো রাইফা! তুমি যদি একটুও আমার কথা শুনো। সবসময় শুধু নিজের মন মর্জি মতো চলো।”

সায়িদের কথায় রাইফার তেমন ভাবান্তর হলো না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহবিনের দিকে। মেহবিন ও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বিকেলবেলা বাড়ি ফিরতেই ওর ফোন এলো সেদিনের মতো আজকেও রাইফা অজ্ঞান হয়ে পরে গেছে। মেহবিন শুনেই তাড়াতাড়ি করে চলে আসে। বাড়ি এসেই দেখে ওর জ্ঞান ফিরেছে এখন ড্রয়িংরুমের সোফায় শোয়া। বাড়িতে শেখ শাহেনশাহ ছাড়া পুরুষেরা কেউ বাড়ি নেই তাই বোধহয় মহিলারা এখানে এনে শুয়িয়েছে। মেহবিন চেক আপ করে দেখলো একই অবস্থা সেদিনের মতো। ও কিছু বলবে তার আগেই তখনি শেখ সায়িদ , নুপুর ,আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ আসে বাড়িতে। রাইফা কে ওভাবে দেখে তাড়াতাড়ি করে ওখানে যায়। মেহবিন ওকে জায়গা ছেড়ে দেয়। কিন্তু সায়িদ যা বললো তা শুনে কেন যেন মেহবিনের বিশ্বাস হচ্ছে না। মেহবিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“আমার মনে হয় একবার হাসপাতালে গিয়ে ওনার পুরো বডি টেস্ট করা উচিৎ। উনি তেমন ভাবে কিছু বলছেও না আবার এভাবে কয়েক দিন পরপর অসুস্থ হওয়াটাও স্বাভাবিক নয়।”

তখন সায়িদ বলল,,

“আমি কালকেই তোমাকে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাবো। কোন কথা না।”

তখন রাইফা বলল,

‘এতো ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিক আছি কিছু হয় নি আমার। দুপুরে খাবারটা খাইনি তাই এমন হয়েছে আর কিছু না।”

‘তুমি সিওর তো না খাওয়ার জন্যই।”

“হ্যা আমি সিওর গ্যাসের সমস্যার জন্য না খেয়ে এরকম হয়েছে।”

“আচ্ছা তাহলে ঠিক আছে। মা ওর জন্য খাবার আনো খেয়ে ওষুধ খাক। আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।

বলেই সায়িদ ওপরে চলে গেল। তখন আরিফা জামান নুপুরকে দেখে ওর দিকে এগিয়ে গেল সেদিনের পর আজই প্রথম এবাড়িতে এলো নুপুর। জিনিয়ার অনুষ্ঠানেও আসে নি।সবাই ওদিকে এগিয়ে গেল। সায়িদ যেতেই মেহবিন রাইফার পাশে বসলো আর বলল,,

‘যে মেয়েটা অল্পতেই কেঁদে ভাসাতো। সেই মেয়েটা এতো কিছুর পরেও কথাদ্বারা সব সামলে নিচ্ছে কি অদ্ভুত।”

রাইফা মেহবিনের দিকে তাকালো। মুহুর্তেই রাইফার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো । মেহবিন রাইফার চোখের ভাষা বুঝতে পারলো ঐ চোখে কতটা অসহায়ত্ব দেখা যাচ্ছে ও উপলব্ধি করতে পারছে। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তখন রাইফা বলল,,

‘হয়তো এগুলো তার একসময়ের ভুলের মাসুল।”

~ চলবে,,