Friday, August 15, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 241



খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৮+৯

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

নিস্তব্ধতার রেশ যখন সবাইকে ঘিরে ধরতে ব্যস্ত। তখনই প্রাপ্তি সুযোগ পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে চলে যাবার জন্য অগ্রসর হলো। সবাই মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তখনই মেহেভীনের নজর যায় প্রাপ্তির দিকে, প্রাপ্তি দৌড় দিতে চাইলে মেহেভীন খপ করে প্রাপ্তির হাত ধরে ফেলে। রক্তিম আঁখিযুগল প্রাপ্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আল্লাহ তায়ালা যদি চোখ দিয়ে খু’ন করার শক্তি দিত। তাহলে প্রাপ্তি এতক্ষণে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতো।

–কোথায় পালাচ্ছ আপু? এত সহজে তোমাকে ছেড়ে দিব ভাবছ! আমার সবকিছুর হিসাব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে, তারপরে এখানে থেকে পালাবে। এর আগে পালানোর চেষ্টা করলে পা ভে’ঙে রেখে দিব। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে প্রাপ্তি মেহেভীনের গালে প্রহার করতে চাইলে, মেহেভীন প্রাপ্তির হাত ধরে ফেলে। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীন ভেতর থেকে দিগুণ শক্তি অনুভব করল। নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ প্রাপ্তির গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। মেহেভীনের মতো মেয়ে এমন কাজ করতে পারে! তা সবার ধারণার বাহিরে ছিল। প্রাপ্তি মেহেভীনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। মেহেভীন পড়ে যেতে চাইলে শেহনাজ এসে তাকে ধরে ফেলল। মেহেভীন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গিয়েছে। সমস্ত শরীর ভূমিকম্পের ন্যায় কাঁপছে। রাগান্বিত হয়ে প্রাপ্তির দিকে ছুটে যেতে চাইছে। কিন্তু শেহনাজ তাকে ধরে রাখায় যেতে পারছে না। তাকে আঁটকে রাখার যুদ্ধে নেমে পড়ল নাকি শেহনাজ।

–তুই কাকে ক্ষমতার পাওয়ার দেখাচ্ছিস মেহেভীন? তুমি জানিস আমি চাইলে তোর কি করতে পারি৷ আজ তুমি সফল হয়েছিস কার জন্য শুধু মাত্র আমার জন্য। সেই তুই আমার গালে প্রহার করলি! এর ফলাফল কতটা ভয়ংকর হতে চলেছে। তা তোর ধারণার বাইরে তোর সবকিছু কেঁড়ে নিব আমি৷ অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে দেখে, আয়মান দৌড়ে প্রাপ্তি কাছে গেল। প্রাপ্তিকে টানতে টানতে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে নিতে চাইলে, প্রাপ্তি হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে নেয়। কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয় প্রাপ্তি। মেহেভীন ও শেহনাজকে ছাড়িয়ে দেয় নিজের থেকে। মেহেভীন সামনের দিকে অগ্রসর হতেই, একজোড়া হাত এসে মেহেভীনকে ধরে ফেলে। মেহেভীন তাকিয়ে দেখে ফরিদ রহমান তার হাত ধরে আছে। বাবাকে দেখে সমস্ত রাগ নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল৷ চুপসে এল রণচণ্ডী রুপ ধারণ করা মুখশ্রী।

–তুই এখানে কার অনুমতি নিয়ে এসেছিস?

–আব্বু আমি আম্মুর থেকে অনুমতি নিয়ে আসছি।

–চুপ কর বে’য়াদব মেয়ে! আবার গর্ব করে বলছে। দূরে গিয়ে অভদ্রতা শিখে এসেছিস। দোষ তো তোর তুই কেন আমাদের সাথে যোগাযোগ করিসনি। নিজের দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে বেঁচে যেতে চাইছিস? আজকে বাসায় চল আগে, তারপরে তোর একটা ব্যবস্থা করব আমি। বাবার কথায় লজ্জাবতী পাতার ন্যায় মাথা নুইয়ে গেল। বাবার প্রতি ভিষণ অভিমান জমলো মনের গহীনে। সে তো স্বীকার করছে। দোষ তার ও আছে। তাই বলে যে বেইমানি করেছে। তাকে তো আর ছাড় দেওয়া যায় না৷ সুযোগ পেয়ে সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে ভুললেন না সাহেলা চৌধুরী।

–দেখেছেন ভাই মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। কেমন করে নিজের বড় বোনের গায়ে হাত তুলল। আবার বড় বড় কথা বলছে। আপনার মেয়ের কত টাকা চাই। আমাদের বললে আমরা দিয়ে দিতাম। এভাবে কোন সাহসে আমাদের বাড়ির বউয়ের শরীরে প্রহার করে।

–আপনি-ও আপনার বাড়ির বউকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। তা-না হলে এভাবে ছোট বোনের টাকা চুরি করে নেয়। আমার মেয়েকে আমি কথা শোনাব৷ বাহিরের কাউকে কথা বলতে বলিনি আমি।

–এই পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে নিয়ে এত অহংকার! না জানি কার সাথে কি করতে গিয়েছিল। আবার আপনাদের মুখ পোড়াতে আসছে।

–সাবধানে কথা বলবেন। আমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি আপনাকে দেইনি। আপনি নিজের চরিত্র দেখুন। অতীতের কাহিনি বলব কেঁচো খুঁজতে গিয়ে কেউটো বের না হয়ে আসে আবার। আপনার বাড়ির বউকে বলেন। আমার মেয়ের টাকা গুলো যেন ফেরত দেয়৷ ফরিদ রহমানের কথায় সমস্ত মুখে আঁধার ঘনিয়ে আসে সাহেলা চৌধুরীর। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না। বাকরুদ্ধতা যেন তাকে সম্পূর্ণ রুপে গ্রাস করে ফেলছে। প্রাপ্তি মুখটা ছোট করে নিজের কক্ষ থেকে টাকা গুলো বের করে নিয়ে আসলো। সবার সামনে মাফ চেয়ে টাকা গুলো ফেরত দিল। মেহেভীন ছাড় দিতে চাইনি। ফরিদ রহমান অজানা কারনে প্রাপ্তিতে শাস্তি দিতে নিষেধ করেছে। ভেতরটা তার ভয়ে কাবু হয়ে আসছে।

আঁধারকে বিদায় জানিয়ে প্রভাতের আলোয় আলোকিত হয়েছে সমস্ত ধরনী। কালকে মেহেভীন মলিন মুখশ্রী নিয়ে বাসায় ফিরেছে। ক্রোধে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। নিজের ওপরে ভিষণ রাগ হচ্ছে, কেনো সে এত বোকামি করল। কথায় থাকে না কঠিন মুহূর্তে বুদ্ধি কাজে আসে না। সেই মুহুর্ত চলে যাবার পর হাজার রকমের বুদ্ধি বের হয়৷ কিন্তু তা অকেজো হয়ে যায় কেনো কাজেই আসে না। মেহেভীনের সফলতার খবর পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে। সবাই প্রশংসা করছে। এমন সময় খবর আসলো। প্রাপ্ত ছাঁদ থেকে পড়ে গিয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভালো না। আয়মানকে রাস্তার কিছু ছেলে ধরে মা’র’ছে। দু’জনের অবস্থা খুব একটা ভালো না৷ এক রাতের ব্যবধানে এতকিছু হয়ে গেল। সবকিছুই কি কাল্পনিক ভাবে হয়েছে! নাকি এর পেছনে কারো হাত আছে। কথা গুলো মেহেভীনকে ভিষণ করে ভাবাচ্ছে। প্রাপ্তির জন্য এতটুকু ও মায়া লাগছে না৷ মেহেভীনের বাবা প্রাপ্তির বাবার সাথে হসপিটালের চলে গিয়েছে। প্রাপ্তির মায়ের সাথে মেহেভীনের আম্মু হাসপাতালে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেহেভীনের সবকিছু বিষাদ লাগছে। সে বাসায় থেকে বের হয়ে গেল। প্রাপ্তি নামক অশান্তি তার জীবনের সব শান্তি কেঁড়ে নিয়েছে। এই মেয়েটা কেই সে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। অথচ মেয়েটা তার প্রতি কতটা অবিচার করল! কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মেইন রোডে চলছে আসছে মেহেভীন।

মাশরাফি স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাসার দিকে আসছিল। তখনই চায়ের দোকানের সামনে হিমেলের সাথে দেখা। হিমেল হাতে সি’গা’রে’ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাশরাফিকে দেখে সি’গা’রে’ট’টা মাশরাফির দিকে এগিয়ে দিল। মাশরাফি প্রথমে ভয়ে নাকচ করে দিল। সেদিনের মারের কথা মনে হলে এখনো দম বন্ধ হয়ে আসে। হিমেল অনেক করে বোঝানোর পরে, নিতে রাজি হলো। কাঁপা কাঁপা হাত বাড়ালো সিগারেট হাতে নেওয়ার জন্য। আশেপাশে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিল। অথচ রাস্তার ওপাশে একজোড়া রক্তিম আঁখিযুগল তার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে৷ সেদিকেই তার নজর পড়েনি। আচমকা সেদিকে নজর যেতেই কলিজা শুকিয়ে আসলো। মুনতাসিমের কিছু বলতে হলো না৷ চোখের গরমেই কাবু হয়ে গেল মাশরাফি। দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। মাশরাফি চলে যেতেই মুনতাসিম নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

চারিদিকে টুংটাং প্রতিধ্বনিত মুখরিত। এত কোলাহলের মধ্যে মেহেভীন একটু নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ খুঁজছে। মনের মধ্যে শান্তি নেই তার৷ অশান্ত হৃদয় নিয়ে ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। বাবা-মা বাসায় আসলে তবে তার শান্তি মিলবে। বাবা কথা বলছে না। কথাটা স্মরন হতেই বুকটা চিনচিন করে উঠলো। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে গিয়ে কখন যে রাস্তার মাঝে চলে আসছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। শতশত গাড়ির চলাচল চারদিকে। একটা গাড়ি মেহেভীনের দিকে ধেয়ে আসছিল। তখনই কেউ একজন হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে। আকষ্মিক ঘটনায় মেহেভীন স্তব্ধ হয়ে গেল। পেছনে ফিরে চেনা মুখশ্রী দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো মেহেভীন।

–জামাই হারিয়ে গিয়েছে ম্যাডাম। এভাবে দেউলিয়া হয়ে রাস্তার মাঝে নেমে এসেছেন কেন? মনে খুব বেশি ব্যথা করছে? আমাকে বললেই পারতেন। আমি নিজ দায়িত্বে আপনার স্বামীকে আপনার হাতে তুলে দিতাম। মুনতাসিমের কথা রাগান্বিত হয়ে গেল মেহেভীন। এই মানুষটা এতটা বেশি কথা বলে কেন! বেশি কথা বলা মানুষ তার একদম পছন্দ না। সে তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে বলে, তাকে যা খুশি তাই বলবে!

–আমাকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ। প্রাণে বাঁচিয়েছেন বলে, নিজেকে কি মনে করেন? আমাকে যা খুশি তাই বলা যায়৷ বেশি কথা বলা মানুষ একদম পছন্দ না আমার৷ এরপরে আমার সামনে বেশি কথা বলার চেষ্টা ও করবেন না।

–বেশি কথা বলা মানুষটা যখন চুপ হয়ে যাবে। সেই নিরবতা টা আপনি নিতে পারবেন না ম্যাডাম। নিরবতা বড্ড ভয়ংকর। আপনার মানতে কষ্ট হবে। দম বন্ধ হয়ে আসবে। আগের মানুষটাকে ফিরে পেতে চাইবেন৷ কিন্তু শত চেষ্টা করে আগের রুপে ফেরাতে পারবেন না। মানুষ একবার পরিবর্তন হয়ে গেলে, তার মনে জায়গা দখল করার মতো কঠিন কাজ ধরণীর বুকে নেই।

–আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?

–সব কথা যদি সবাই সহজে বুঝে যেত। তাহলে হৃদয়টা জ্বলে পুড়ে এতটা দগ্ধ হয়ে যেত না। বলতে না পারার আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। হারিয়ে ফেলার ভয় সমস্ত শরীরকে কাবু করে ফেলছে৷ মেহেভীন তাকিয়ে দেখল মুনতাসিম অদ্ভুত ভাবে ঘামছে। শরীর জুড়ে অস্থিরতা কাজ করছে। শরীরের শিরা-উপশিরা ভয়ে কাঁপছে। মানুষটার এত অস্থিরতা, ভয় হয়ে কাবু হয়ে আসা, তার সামনে এত কথা বলা। মানুষটার এই একটাই রুপ নাকি আরো কোনো রুপ আছে। যে রুপের কথা মানুষটা তার সামনে বলতে চাইছে না৷

–আপনি এত ঘামছেন কেন?

–প্রচন্ড গরম পড়েছে তাই।

–আপনার বাসা এখানে? আপনি কোথায় থাকেন? এদিকে কি করতে আসছেন?

–আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। চাইলে আমাকে কোলে নিয়ে আপনার বাসায় যেতে পারেন। আমি আপনার কোলে বসে খেতে খেতে উত্তর দিব। মেহেভীন নিজের ললাটে নিজেই প্রহার করল। একটা পাগলের সাথে কথা বলছে সে। এমন উল্টা পাল্টা কথা ছাড়া তার থেকে ভালো কিছুই আশা করা যাবে না। মেহেভীনকে নিরব দেখে মুনতাসিম আবার বলে উঠলো,

–যদি-ও আপনার বয়সটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু আপনার তো বাচ্চা নেই। তাই আপনি চাইলে আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরবার চেষ্টা করতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।

–আপনার মতো আস্ত একটা হাতিকে কোলে নিতে হলে, আমাকে আবার জন্ম নিতে হবে। আমার ভুল হয়েছে আপনার সাথে কথা বলা৷ কেন যে বারবার আপনার সাথে আমার দেখা হয়। বিরক্ততে মুখশ্রী কুঁচকে এল মেহেভীনের। তখনই মাতাল করা সুগন্ধি এসে ঠেকল মেহেভীনের নাকে। গন্ধটা তার পূর্ব পরিচিত সে এই ফুলটা ভিষণ ভালোবাসে। ছোট বেলায় এই ফুলের জন্য কতশত পাগলামি করত।
মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম শিউলি ফুলের মালা মেহেভীনের সামনে ধরে বলল,

–ফুলের জন্য ফুল নিয়ে এসেছি৷ আপনার শিউলি ফুল ভালো লাগে৷ মেহেভীন ফুল দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। আবেগে উৎফুল্ল হয়ে গেল। চট করে মুনতাসিমের হাত থেকে শিউলি ফুলের মালাটা হাতে তুলে নিল। মেহেভীনের হাসোজ্জল মুখশ্রী দেখে, মুনতাসিমের বুকটা প্রশান্তিতে ভয়ে গেল। তোলপাড় করা হৃদয়টা শান্ত নদীর ন্যায় স্থির হয়ে গেল। প্রেয়সীর মুখশ্রীতে এক টুকরো হাসি তুলে দিতে পেরেছে। এটাই তার কাছে সবথেকে বড় পাওয়া। মনটা নিজের হয়েও অন্যের ভালো থাকার উপরে নিজের ভালো থাকা নির্ভর করে। মেহেভীন মালাটা খোঁপায় পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মুনতাসিম মেহেভীনের হাত থেকে মালাটা নিয়ে পড়িয়ে দিল। মেয়েরা অল্পতেই খুশি মেয়েদের খুশি করার বেশি কিছু লাগে না। আর সবচেয়ে যেটা পেলে খুশি হয়। সেটা হচ্ছে ফুল। যে মেয়ে ফুল ভালোবাসে না৷ সে মেয়ে কোনো মেয়েই না। মুনতাসিম মনোমুগ্ধকর হয়ে বলল,

“ফুলের সুন্দর্য কেও হারিয়ে মানিয়ে দিবে। আমার ব্যক্তিগত ফুল। ফুলের চেয়েও বেশি সুন্দর। আমার ব্যক্তিগত ফুল। ”

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অভিমান যেন শরীরের শিরায়-উপশিরায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিনের আলো বিদায় নিয়ে চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। মেহেভীন নিজের কক্ষে কিছু একটা করছিল। রাতে খাবে না বলে দিয়েছে সে। মেয়ের অভিমানের ভাষা বুঝতে বাবার মন এতটুকু সময় নিল না। পরিস্থিতি আমাদের এমন বানিয়ে দেয়। যে-সময় টাতে নিজের মেয়ের থেকে, অন্যের মেয়েকে বেশি প্রাধান্য দিতে হয়। কাল কেও সে নিরুপায় ছিল। মেয়ের ভালোর স্বার্থে মেয়েকে দমিয়ে রাখতে হয়েছে। বাবাদের অল্পতে মাথা গরম করতে নেই। তাদের প্রতিটি কথা বলার পেছনে একটি করে দায়িত্ব থাকে। তাই তাদের এক একটা কথা হিসাব করে বলতে হয়। বাবারা হুটহাট রাগ করতে জানে না। কিন্তু আগলে রাখার ব্যাপারে তাদের তুলনা হয় না৷ ফরিদ রহমান মেহেভীনের কক্ষে আসলো। মেয়ের পাশে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

–অভিমান তো আমার করার কথা! তুই আমার সম্মানের কথা না ভেবে পালিয়েছিস। আবার বিয়েও করেছিস। বাবা-মায়ের কথা একটা বার ভাবলি না। আমাদের সাথে যোগাযোগ না করে, তুই মস্ত বড়ো অন্যায় করেছিস। আমি প্রাপ্তিকে দোষ দিব না। আমি মনে করি দোষ টা তোর। তুই নিজের বাবা-মায়ের থেকে চাচাতো বোনকে বেশি বিশ্বাস করেছিস। আজ আমার সাথে এমন করছিস তো। একদিন ঠিক বুঝবি বাবা কি জিনিস। আমি যদি একবার চোখ বন্ধ করি। তাহলে এখানে একটা দিন টিকতে পারবি না। দেখতে পাবি চেনা মানুষের অচেনা রুপ। সেসব সহ্য করতে পারবি না। তোর পছন্দের চিংড়ি মাছ নিয়ে আসছি। তুই খাসনি বলে আমরা সবাই না খেয়ে বসে আছি। তুই কি চাস আমি না খেয়ে নিদ্রা চলে যাই। বাবার কথায় বুকটা ভারি হয়ে এল। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। বাবা থাকবে না কথা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা নামক বৃক্ষের ছায়া মাথার ওপরে থেকে সরে গেলে, মাথার ওপরের উত্তপ্ত সূর্য খানা সোজা মাথার মগজে এসে অবস্থা করবে। সে কি ব্যথা অসহনীয় যন্ত্রনা সহ্য করার মতো নয়। কথা গুলো কল্পনা করলেই সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে উঠছে।

সময় স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে চলে যায়। দেখতে সাতদিন হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনকে নিতে গাড়ি আসছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রৌদ্রের প্রখরতা দিগুণ ভাবে বেড়ে চলেছে। মেহেভীনের মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ফরিদ রহমান মেয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিল। মেহেভীন মুগ্ধ নয়নে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সত্যি বাবা চরিত্র টা অতুলনীয়। বাবার ব্যাখ্যা করতে গেলে শুরু হবে। কিন্তু শেষ হবে না। এতটাই সুন্দর বাবা নামক বটগাছের ছায়া। মেহেভীন সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাইমা বেগম মেয়ের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। রুপা আগেই বাসায় চলে আসছে। সকাল থেকে পুরো বাসা পরিষ্কার-পরিছন্ন করেছে সে। মেহেভীন একটু খুঁত খুঁতে ধরনের মেয়ে। তার সবকিছু পরিষ্কার চাই। রুপা সবে মাত্র বসেছিল। তখনই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। রুপার অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠলো। এই বুঝি আপা চলে এসেছে। কতদিন পর সে আপাকে দেখবে। মেহেভীনকে না দেখলে রুপার মনের গহীনে অজানা বিষাদ এসে ধরা দেয়। দরজা খুলে মেহেভীনকে দেখে, আবেগে উৎফুল্ল হয়ে পরে রুপা। মেহেভীনকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে। রুপার পাগলামি দেখে মেহেভীন হেসে দিল।

–রুপা এবার ছাড় বাহিরে থেকে এসেছি। রাস্তায় কত ধুলাবালির ছিল। আমাকে এখন স্পর্শ করিস না।

–আপা আমার এসবে অভ্যাস আছে। আমার আপনাকে ছাড়া একদম ভালো লাগে না। আমার আপনি ছাড়া কে আছে বলেন। আমার পুরো ধরণীটাই হচ্ছে আপনি। আমার এক টুকরো আবেগ আপনি। আমার সুখ, শান্তি, ভালো থাকা, আমার আহ্লাদ করা, আমার শখ পূরন করে দেওয়া, আমার সবকিছু শুধু আপনাকে ঘিরে। এত ভালোবাসা পাওয়ার পরে ভালোবাসার মানুষ টিকে ছাড়া থাকা ভিষণ দুষ্কর আপা। হাসোজ্জল মুখশ্রী খানা মুহুর্তের মধ্যে মলিনতায় ছেয়ে গেল। বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেল চঞ্চল হৃদয়। সমস্ত আঁধার ঘনিয়ে ধরলো মেতে ওঠা মস্তিষ্কের আনন্দ গুলোকে। মেহেভীন রুপার মলিন মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,

–এই যে বিষাদ রাণী! আপনি মাঝে মাঝে বিষাদের শহরে হারিয়ে যান। মনকে এত বিষাদগ্রস্ত করে তুলছেন কেন? আমি কি বিষাদিত হবার মতো কোনো কাজ করেছি। মা অনেক খাবার পাঠিয়েছে। সেগুলো বের কর আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাব। কথা গুলো বলেই চলে গেল মেহেভীন। মা শব্দটা অতি আবেগের মা শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। যে ভালোবাসার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। যার মা নেই সে বুঝে ধরনীর বুকে টিকে থাকার কতটা কঠিন। রুপা যেন মেহেভীনের মায়ের রান্না করা খাবারে, নিজের মায়ের ভালোবাসার স্বাদ খুঁজে পেল। এই রান্নার মধ্যে মেয়ের জন্য মায়ের কত ভালোবাসা আছে। ভাবতেই বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। আজ যদি তার মা বেঁচে থাকত তাহলে তাকে-ও এভাবে রান্না করে খাওয়াত। রুপার আঁখিযুগল অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। তখনই একটা হাত তার মুখের সামনে এক লোকমা খাবার ধরল। রুপার তড়িঘড়ি করে অশ্রুকণা গুলো মুছে নিল। মেহেভীনকে দেখে কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করল।

–তোর আপা আছে না। তোর আপা থাকতে তোকে একদম কষ্ট পেতে দিবে না। আমার ভুল হয়েছে। তোকে আমার সাথে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। আমি একটু ভয়ে ছিলাম। তাই তোকে রেখে গিয়েছিলাম। এরপরে যখন যাব। তখন তোকে নিয়ে যাব। জানি মায়ের কথা স্মরণ করে কষ্ট পাচ্ছিস। আর কয়দিন পরে আমার মা আমার কাছে আসবে। আমার মা অনেক ভালো জানিস। আমার মাকে নিজের মা মনে করবি। আমার অনেক কাজ আছে। কয়টা দিন অনেক ব্যস্ত থাকব। তোকে বলেছিলাম না। বেআইনি ভাবে জমি নিজের নামে নিতে চাইছে। শুধু মাত্র আমার একটা সাইনের জন্য পারছে না। সে আমার ওপরে খুব রাগান্বিত হয়ে আছে বুঝছিস। যেকোনো সময় ক্ষতি করে দিতে পারে। বাসা থেকে একা একা বের হবি না। কিছু লাগলে দারোয়ানকে বলবি। কাউকে না পেলে আমাকে কল দিবি। আমি আসার সময় নিয়ে আসব। আর বেশি কথা বলিস না। চুপচাপ খেয়ে নে আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে নিস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ। মেহেভীন নিজে একবার খাচ্ছে। আরেকটা রুপাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এজন্য মেহেভীনকে রুপা এতটা ভালোবাসে। মেয়েটা এতটা দায়িত্ববান আর যত্নশীল যা দেখে রুপা প্রতিবারই মুগ্ধ হয়। মানুষটার প্রতি ভালোবাসা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এই মানুষটা যদি তার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তাহলে কিভাবে সমাজের বুকে সাহস নিয়ে বেঁচে থাকবে। সবাই তাকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য শেয়াল কুকুরের মতো অত পেতে থাকবে।

মেহেভীন ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। তখনই রুপা এসে জানান দিল। জুনায়েদ খান এসেছেন। মুহূর্তের মধ্যে মেহেভীনের মুখশ্রী বিরক্তিতে কুঁচকে এল। এই লোকটা বাসা পর্যন্ত চলে আসছে। মেহেভীন ভদ্রতা সুলভ রুপাকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলল। রুপা চা সহ আরো বিভিন্ন ধরনের নাস্তা নিয়ে এসে সামনে হাজির হলো। জুনায়েদ খান বিরক্তি মাখা হাসি দিয়ে বলল,

–আমার কথা কি ভুলে গিয়েছেন ম্যাডাম। কতদিন ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। এই সাতটা দিন পাগলের মতো অফিসে গিয়ে আপনাকে খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি এভাবে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?

–আমি কোথায় যাব না যাব। সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয় এটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে যেতে হবে না। আপনি এখানে কি কাজে আসছেন। সেই আলোচনায় আসা যাক।

–আমার বেশি কিছু চাই না ম্যাডাম। আপনি শুধু দলিল টাই সাইন করে দিবেন। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ম্যাডাম। আপনি সাইন করে দিলে, আপনিও মুক্ত আর আমিও খুশি।

–দেখুন জুনায়েদ আমি আপনাকে আগেও বলেছি। আজকে আবারও বলছি। আপনি যেটা চাইছেন। সেটা কখনোই সম্ভব নয়। আমি মেহেভীন কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করিনি। আর এই দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় করব ও না। এটা সব সময় মাথায় রাখবেন। আপনি এবার আমার সামনে থেকে চলে যেতে পারেন।

–আমি জানতাম সোজা কথা শোনার মতো মানুষ আপনি না। তাই আমি আপনাকে রাজি করানোর জন্য একটা জিনিস নিয়ে আসছি। যেটা দেখলেই আপনার মস্তিষ্ক সচল হয়ে যাবে। আর বুদ্ধিমানের মতো আপনি সাইন করে দিবেন। কথাগুলো বলে বিলম্ব করল না জুনায়েদ খান। সে একটা টাকার ব্যাগ রাখল মেহেভীনের সামনে। টাকা গুলো দেখে মেহেভীন ক্রোধের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। জুনায়েদ বিশ্রী হেসে জবাব দিল,

–এবার নিশ্চয়ই আপনার কোনো আপত্তি নেই। এখানে একদম পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আছে। আপনি যদি চান। তাহলে আপনাকে আরো টাকা দিতে রাজি আছি। আপনি শুধু সাইনটা করে দিন ম্যাডাম। আমি সারাজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।

–খোঁজ নিয়ে জেনেছি। আপনার অর্থসম্পদের অভাব নেই। এত অর্থ সম্পদ থাকার পরেও অন্যের জিনিসের প্রতি এত লোভ লালসা কেন? আমাকে জবাব দিন জুনায়েদ খান। সুস্থ অবস্থায় যদি থাকতে চান। তাহলে এখনই আমার বাসা থেকে বের হয়ে যান। আপনি পঞ্চাশ লক্ষ কেন পঞ্চম কোটি টাকা দিলেও আমি সাইন করব না। এখনই যদি আমার সামনে থেকে চলে না যান। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে জুনায়েদ খান মেহভীনের পা জড়িয়ে ধরল। সাইন করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। মন গলল না মেহেভীনের সে দারোয়ানকে ডেকে জুনায়েদকে বাসা থেকে বের করে দিল।

চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। জুনায়েদ অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেভীনের বাসার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকটা তার খাঁ খাঁ করছে। মেহেভীনের প্রতি ক্ষোভ জমেছে মনে। সে মেহেভীনের শেষ দেখে ছাড়বে। কাউকে একটা কল দিয়ে কিছু একটা বলল জুনায়েদ। ওপর পাশ থেকে হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে গেল চারপাশ।

মেহেভীনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা যুবক। চোখে তার শত জনমের ব্যথা। বুকে জমে আছে টুকরো হয়ে যাওয়া হাজারো স্বপ্ন। এলোমেলো কেশগুলো বিরতিহীন ভাবে উড়ে চলেছে। ফুলের মতো চেহারাটা আজ নেশায় জর্জরিত হয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মুখশ্রীতে সব সময় হিংস্রতার প্রকাশ পায়। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন হয়ে আছে। মনটা ভালো নেই। যে মানুষ গুলো মনে থাকে, সেই মানুষ গুলোই মনে আঘাত করে। যুবকটি মেহেভীনের ছবির দিকে হিংস্র নয়নে তাকিয়ে আছে। চোয়াল শক্ত হয়ে এল যুবকের। সে ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল,

–তোমার জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে, আমি যেমন জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে যাচ্ছি মেহেভীন। ঠিক এমন করেই তোমার জীবনটা আমি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিব মেহেভীন। আমার আঁখিযুগলের দিকে কখনো চেয়েছ? যদি চাইতে তাহলে দেখতে এই চোখ কতটা তৃষ্ণা জমে আছে। তোমাকে দেখার তৃষ্ণা। তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আমি কতটা আকুল হয়ে থাকতাম। একটু দেখার জন্য কতটা ছটফট করতাম। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলতে চাইছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে বানিয়েছ চরিত্রহীন। আদরের ছেলেটাকে হতে হয়েছে বাড়ি ছাড়া। আমার প্রতিটি কষ্টের প্রতিশোধ আমি নিব মেহেভীন। তোমার জীবনটা নরক বানিয়ে ফেলব। তুমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হও। আমি আসছি।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৬+৭

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সোনালী আলোয় চারদিক মনোমুগ্ধকর করে হয়ে উঠেছে। মেয়েকে পেয়ে রাইমা বেগমের খুশির শেষ নেই। ধরণীর সমস্ত আনন্দ রাইমা বেগমের মুখশ্রীতে রাজত্ব করছে। মায়ের ভালোবাসা পেয়ে মেহেভীনের বুকটা শীতল হয়ে গেল। বাবার ভয়ে ভেতরটা কাবু হয়ে আছে। এখনো বাবার সাথে কথা হয়নি। মেহেভীন কথা বলতে চাইলে দূরে সরে গিয়েছে। মেহেভীন অপরাধীর ন্যায় বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেভীনের বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারে চলে গেল। মেহেভীন মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন কণ্ঠে বলল,

–আম্মু আব্বু আমার সাথে কথা বলবে না।

–সাময়িক ভাবে রেগে আছে। তোর বাবার হাটের দিন ছাড়া বাজারে যায় না। দেখলি না তোকে দেখে বাজার গেল। নিশ্চই তোর পছন্দের সব খাবার নিয়ে আসবে।

–আমার খাবার চাই না আম্মু। আমার আব্বুর ভালোবাসা চাই।

–তুই শুধু খাবার নিয়ে আসতে যেতে দেখলি। বাবার ভালোবাসি আর দায়িত্ব দেখলি না। এতগুলো দিন আমাদের ছেড়ে দূরে ছিলি। ক’জন তোকে দায়িত্ব নিয়ে খাইয়েছে? তুই চিন্তা করিস না। আমি তোর বাবাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। সারারাত জার্নি করে এসেছিস। এবার একটু ঘুমিয়ে নিবি চল।

–প্রাপ্তি আপুর কাছে থেকে একটু ঘুরে আসি।

–সে তো বাসায় নেই। তাকে গিয়ে বাসায় পাবি না। তাহলে কার কাছে যেতে চাইছিস।

–মানে?

–কেনো তোর প্রাণ প্রিয় বোন বলেনি সে বিয়ে করেছে। মায়ের কথায় বিস্ময় নয়নে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে মেহেভীন। মানুষ কতটা জঘন্য হলে, দিনের পরে দিন এতগুলো মিথ্যা কথা বলতে পারে। কথা গুলো ভাবতেই ঘৃণায় পুরো শরীর রি রি করছে। তবে ভেতর থেকে অদ্ভুত এক খারাপ লাগা কাজ করছে৷ তার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। বাস্তবতা তাকে শিখিয়ে দিল। চাচাতো বোনরা কখনো আপন বোন হতে পারে না। মেহেভীন গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–তা কার সাথে বিয়ে হয়েছে আপুর?

–আয়মানের সাথে বিয়ে হয়েছে। খবর পেয়েছি প্রাপ্তি আর আয়মানের আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল। দু’জন দু’জনকে ভিষণ ভালোবাসত। কিন্তু পরিবারের ভয়ে কেউ তা প্রকাশ করতে পারেনি। মূলত আমাদের সন্মান নষ্ট করার জন্যই তারা এসব করেছে। প্রাপ্তির বাবার থেকে তোর দাদা তোর বাবাকে বেশি জমি দিয়েছে। সেজন্য প্রাপ্তির বাবার তোর বাবার ওপরে ভিষণ রাগ। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই জমি জামার চক্করে তোর বাবাকে না হারিয়ে ফেলি।

–একদম বাজে কথা বলবে না আম্মু। ভুলে যেও না আম্মু তোমাদের মেয়ে আর আগের মতো বোকা নেই। আমি থাকতে আমার আব্বুর কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

–আম্মু তুমি আমার সফল হবার গল্প শুনবে না।

–না।

–কেনো?

–কারণ আমি প্রথম থেকেই সবকিছু জানি। তোর একটা বার মনে হলো না। হুট করে একজন মহিলা তোর কাছে এল। তোর পাশে দাঁড়াল। তোর দুঃসময়ে তোকে ভরসা দিল। টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করল। এগুলো কি সে এমনি এমনি করেছে। মায়ের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। তার মা এসব কিছু জানল কিভাবে! সে তো এসব কথা কারো সাথে গল্প করেনি। মেহেভীনের ছোট্ট হৃদয়ে সন্দেহের দানা বাঁধে। সে মায়ের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল,

–এতকিছু তু্মি জানলে কিভাবে?

–প্রাপ্তি তোকে আগে পিছে কখনোই পছন্দ করত না। কিন্তু সেটা বাহিরে প্রকাশ করত না। তোকে পালিয়ে যেতে সে এ-কারণে সাহায্য করেছে। যেন রাস্তার কিছু নরপিশাচ তোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। আমাদের সন্মান নষ্ট করে সে সুখী হতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি যে তোর মা৷ তোকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছি। তোর বেড়ে ওঠা, কথা বলা, হাঁটা চলা সবকিছু আমার হাত ধরে হয়েছে। সেই মেয়েকে আমি কিভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি৷ সেদিন তোর চিঠিটা আমি পেয়েছিলাম। তোর ফোনের লোকেশন ট্র্যাকিং করাই আমি। তুই যেখানে গিয়েছিলি সেখানে আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সামিরাকে পাঠাই। তোর যত টাকা পয়সা সব সামিরা দিয়েছে ভেবেছিস। সবকিছু আমি দিয়েছি। তোর নানা আমাকে যে জমিটুকু দিয়েছিল। সেটা বিক্রি করে তোকে টাকা দিয়েছি৷ যেন তুই ভালো থাকিস৷ সামিরার থেকে তোর খোঁজ খবর নিয়েছি। তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পেরেছি। তোর বাবাকে ভরসা দিয়েছি। তোর বাসার কাজের মেয়েটাকে দিয়ে রোজ আমার খবর নিতি। সেটাও আমি জানতাম। কিন্তু কখনো বুঝতে দিতাম না৷ আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম। তুই কবে নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলিস। সাফল্যের অর্জনের পরে যদি আমাদের ভুলে যেতি৷ তাহলে ভাবতাম একটা কুসন্তান জন্ম দিয়েছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোকে জন্ম দিয়ে ভুল করিনি। আমাদের মুখ তুই উজ্জ্বল করেছিস। ভাবিস না তোর টাকা পয়সা খেতে পারব জন্য এসব বলছি৷ বাবা-মা তার সন্তানের সাফল্য চায়। এতেই তাদের সুখ, শান্তি, তৃপ্তি। তোর টাকার আমার দরকার নেই মা। আমাদের যা আছে তা দিয়ে জীবন চলে যাবে। তুই আমাকে জিনিস কিনে খাওয়ার জন্য যে টাকা গুলো পাঠাতি। আমি সেগুলো জমিয়ে রাখতাম। তোর বাবার হাতের সমস্যা হলে সেগুলো দিতাম। তোর বাবাকে আজ-ও জানাতে পারিনি। তবে জানানোর সময় এসে গিয়েছে। এভাবেই জীবনে এগিয়ে যা আর সমাজের কিছু কটু লোকের মুখ বন্ধ করে দে। এখানেই আমার প্রাপ্তি। আমি জানতাম আমার মেয়েটা বড্ড বোকা আর সরল। সেজন্য আড়াল থেকে পাশে থেকেছি। তুই যেন শক্ত হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়াতে পারিস। লক্ষ্য অর্জনের পথে আপন মানুষের দেখা পেলে মানুষ শক্তিহীন হয়ে যায়। দুর্বল হয়ে পড়ে আমি তোকে দুর্বল করতে চাইনি। মায়ের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। কণ্ঠনালি দিয়ে এক বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না৷ সে আসলেই বোকা ভিষণ বোকা। স্বার্থের পৃথিবীতে কেউ এক পা লড়ে না। সেখানে একটা অচেনা মহিলা তাকে সাহায্য করল৷ সেটা সে বিশ্বাস করল। এর পেছনে মা নামক যোদ্ধার এতবড় অবদান রয়েছে। সেটা সে গুন অক্ষরেও টের পেল না। নিজের মাকে নিয়ে ভিষণ গর্ব হচ্ছে মেহেভীনের।

–সেজন্য সামিরা আন্টি আমার কাছে বেশিদিন থাকেনি। প্রয়োজন মতো থেকে ছিল। তুমি আমার জন্য এতকিছু করেছ। আমাকে জানাওনি কেন আম্মু? আমি আসলেই বোকা। প্রথমে তাকে নারী পাচারকারী ভেবেছিলাম। সব সময় ভয়ে থাকতাম। প্রাপ্তি আপু আমার সাথে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করল! আমি যে তার কাছে প্রতি মাসে তোমাদের জন্য টাকা পাঠাতাম। সে টাকা গুলো কি তোমাদের দেয়নি?

–তিন মাসের মতো আমাদের টাকা দিয়েছিল। কিসের টাকা বলেনি। রোজ বলতাম তোর সাথে কথা বলিয়ে দিতে। কিন্তু সে আজেবাজে কথা বলত। আমি যে তোর বিষয়ে সবকিছু জানি। এটা কাউকে বুঝতে দিতাম না৷ সবার সাথে অভিনয় করে যেতাম। তুই আমার নিজের মেয়ে। তোকে রেখে নিশ্চয়ই প্রাপ্তিকে বেশি বিশ্বাস করব না।

–মাঝেমধ্যে প্রাপ্তি আপুকে আমার সন্দেহ হতো। কিন্তু কাজের চাপে সেগুলোকে গুরুত্ব দিতাম না। এবার বাসায় এসেছি। প্রাপ্তি আপুকে সামনে বসিয়ে নিয়ে সবকিছু ফায়সালা হবে।

–সে এখন অনেক বড় বাড়ির বউ। তাকে কিছু বলার সাধ্য আমাদের আছে। এসব বিষয়কে ইস্যু করে তোকে হারাতে চাইনা। উপরে একজন আছে। সবকিছু দেখছেন বিচার করে দিবেন। কিন্তু তুই প্রাপ্তির কাছে টাকার হিসাব চাইবি। তোর পরিশ্রমে ফল সৎ মানুষকে খেতে দিস। অসৎ মানুষকে ভোগ করতে দিস না। কথা গুলো বলতে গিয়ে বুকটা ভারি হয়ে আসলে রাইমা বেগমের৷ তিনি আর কোনো কথা বলতে পারলেন না৷ মনের গহীনে বহু ব্যাথা লুকিয়ে আছে। দুঃখ কষ্ট দিয়ে ভেতরটা ভিষণ ভারি হয়ে আছে।

মুনতাসিম নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে আছে। তখনই শেহনাজ মুনতাসিমের কক্ষে প্রবেশ করে। শেহনাজের উপস্তিতি টের পেয়ে মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–কারো কক্ষে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নিতে হয়। এটা কি তুমি জানো না। তোমাকে আবার নতুন করে শিখাতে হবে।

–সেটা অন্য মানুষের কক্ষে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নিতে হয়। নিজের ভাইয়ের কক্ষে না। সে তুমি আমাকে আপন বোন ভাবতে না-ই পারো। কিন্তু আমি তোমাকে মনে প্রাণে নিজের ভাই মনে করি।

–আজকাল ভার্সিটিতে একটা ছেলের সাথে তোমাকে বেশি দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা কে শেহনাজ?

–ভাইয়া তুমি যেমনটা ভাবছ আসলে তেমনটা না। সে আসলে আমার জাস্ট ফ্রেন্ড।

–শেহনাজ তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি কার সাথে কথা বলছ? আমাকে তোমার বাচ্চা ছেলে মনে হয়। আমাকে দায়িত্বহীন ভাই বা ছেলে মনে করবে না। কে কোথায় যাচ্ছে কে কোন পয়েন্টে চলছে। সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। আমি চুপ করে থাকি তার মানে এই না যে আমি কথা বলতে জানিনা। পরবর্তীতে ঐ ছেলের সাথে তোমাকে দেখলে ছেলের জান যাবেই। সাথে তোমার অবস্থাও আমি খারাপ করে দিব।

–আহির অনেক ভালো ছেলে ভাইয়া। আমি আহিরকে অনেক ভালোবাসি। আহিরকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মুনতাসিম রক্তিম চোখে শেহনাজের দিকে দৃষ্টিপাত করল। বোনকে সে ভিষণ ভালোবাসে শেহনাজের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, তাকে এখনই ধংস করে ফেলত। শেহনাজ ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়ের সামনে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস নেই। কথায় আছে মানুষ প্রেমে পড়লে তার সাহস দিগুন বেড়ে যায়। শেহনাজ তার জলজ্যান্ত প্রমান। মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে বলল,

–তুমি আমার থেকে মানুষ বেশি চিনো? তুমি যদি একজন সৎ রিকশাওয়ালাকে ভালোবাসতে, তাহলে আমি নিরদ্বিধায় তোমাকে তার হাতে তুলে দিতাম। কিন্তু তুমি এমন একজনকে ভালোবেসেছ। যার হাতে তোমাকে তুলে দেওয়া কখনোই আমার পক্ষে সম্ভব না। মস্তিষ্ক গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি রেগে যাবার আগে আমার কক্ষ থেকে বের হয়ে যাও শেহনাজ। ভাইয়ের কথার ওপরে কথা বলার সাহস হয়ে উঠলো না শেহনাজের। সে নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বেয় হয়ে গেল। তার ভাই কারন ছাড়া কোনো কথা বলে না। তাহলে কি আহিরের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু আহিরকে যে আমি ভিষণ ভালোবাসি। আমি আহিরকে ছাড়া থাকব কিভাবে। কথা গুলো ভাবতেই শেহনাজের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। ভেতরটা হাহাকারে ভরে উঠছে। মনটা ভিষণ করে জ্বলে উঠলো। তবে তাকে সারাজীবনের জন্য আহিরকে হারাতে হবে। কথা গুলো ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে শেহনাজের।

সূর্য বিদায় নিয়েছে। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। দূর থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। চারদিক মৃদু হাওয়া বইছে। শীতল হাওয়া এসে মেহেভীনের শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। মেহেভীন মায়ের অনুমতি নিয়ে প্রাপ্তির সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। দীর্ঘসময় হাঁটার পরে অবশেষে চৌধুরী বাড়িতে এসে পৌঁছালো। রাজপ্রাসাদের মতো দেখতে বাড়িটা। বাড়ির চারপাশে বলিষ্ঠ দেহের কালো পোশাক পড়া লোক ঘিরে রেখেছে। বাড়ির চারপাশে এত গার্ড দেখে মেহেভীনের মুখশ্রী কুঁচকে এল। মেহেভীন পরিচয় দিয়ে চৌধুরী বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। প্রাপ্তি সবার জন্য চা নিয়ে আসছিল। হাত কাঁপছে প্রাপ্তির কাজের মেয়েটাকে একটা কাজে বাহিরের পাঠানো হয়েছে। এতগুলো চায়ের কাপ কেউ একসাথে নেয়। এখনই সব পড়ে যাবে। মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে প্রাপ্তির দিকে অগ্রসর হলো। মুনতাসিম বাহিরে যাবার জন্য বের হয়েছিল। মেহেভীনকে দেখেই দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। তার হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গিয়েছে। মেহেভীন প্রাপ্তি হাত ধরতেই প্রাপ্তি মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। ভয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। হাত-পা শীতল হতে শুরু করেছে। প্রাপ্তিকে ভয় পেতে দেখে মেহেভীনের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে। অজানা আনন্দে অনুভূতিরা মেতে উঠেছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

মানুষ যেখানে থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। বাস্তবতা তার সামনেই তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রাপ্তি এখন সেই বাস্তবতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদস্পন্দনের গতিবেগ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। ভেতরটা ভয়ে কাবু হয়ে আসছে। মস্তিস্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও একটু আশার আলো দেখল প্রাপ্তি। চায়ের ট্রে টা টেবিলে রেখে মেহেভীনকে আলিঙ্গন করল। নিখুঁত দারুন অভিনয়ের সুরে বলল,

–মেহেভীন বোন আমার কেমন আছিস? তুই কবে এসেছিস? তুই যে এখানে আসবি আমাকে জানাসনি তো! আগে জানলে তোর জন্য ভালো মন্দ রান্না করে রাখতাম। চাচি নিশ্চয়ই তোকে সবকিছু বলেছে। আমি ইচ্ছে করে তোর থেকে সবকিছু আড়াল করে গিয়েছি। আমি কখনো চাইনি তুই এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে, তোর লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়িস। তোর জন্য আমি আমার জীবনটা নষ্ট করেছি। তবুও তোকে এতটুকু চিন্তা মাথায় তুলতে দেইনি। আমাকে তুই ভুল বুঝিস না বোন।

–আমি তোমাকে কিছু বলেছি আপু! কথায় আছে না চোরের মন পুলিশ পুলিশ।

–তুই কি আমাকে অপমান করছিস?

–তোমার অপমান আছে আপু।

–তোকে কেউ দেখার আগে তুই এই বাসা থেকে বের হয়ে যা। তোকে কেউ দেখলে অনেক বড় সমস্যা হয়ে যাবে। তুই সেদিন পালিয়ে গিয়েছিলি। সেজন্য সবাই তোর ওপরে রেগে আছে।

–কোথায় ডাকো সবাইকে, আমি আজকে সবার রাগ দেখতে এসেছি। মেহেভীনের কথায় ক্রোধে ললাটের রগ গুলো ফুলে উঠছে প্রাপ্তির। এই মেয়ে এতটা ধুরন্ধর হলো কিভাবে! প্রাপ্তি শক্ত হাতে মেহেভীনকে ধরতে চাইলে, মেহেভীন দূরে সরে আসলো। কিছুটা গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,

–তুমি রান্না ঘর থেকে এসেছ। তোমার এই নোংরা হাত দিয়ে আমাকে একদম স্পর্শ করবে না। আগে হাতটা ভালো করে ক্লিন করে আসো। তারপরে না হয় আমাকে স্পর্শ করার মতো দুঃসাহস দেখাবে। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে আমান চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হয়। মেহেভীনকে দেখে অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। মেয়েটা আগের থেকে দিগুণ সুন্দর্যের অধিকারীনি হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার মুখশ্রীতে অদ্ভুত এক মায়া লেগে থাকে সব সময়। এই মায়াভরা মুখশ্রী দেখেই মেহেভীনকে পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু তার অপদার্থ ছেলে সেটা আয়ত্ত করতে পারল না। চাঁদের সাথে অমাবস্যার রাতের তুলনা দিল। মেহেভীন কিছুটা ভীরু দৃষ্টিতে আমান চৌধুরীর দিকে তাকালো। ভেতরে ধীর গতিতে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশটা শীতল হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে সবাই নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে, ড্রয়িং রুমে আসতে শুরু করেছে। মেহেভীন দমে গেল না। সে ধীর পায়ে আমান চৌধুরীর দিকে এগিয়ে গেল। কিছুটা ভাবলেশহীন ভাবে সালাম দিয়ে বলল,

–কেমন আছেন আংকেল? অনেক দিন পর আপনার সাথে দেখা। শরীর স্বাস্থ্য ভালো আছো তো। আপনাদের বাসার সবাই কোথায়? এবার সবাইকে ডাকুন। আপনাদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে এসেছি। একজন ও যেন বাদ না থাকে। আমার সবাইকে এক সাথে চাই মানে, সবাইকে একসাথে চাই। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে মাশরাফির মা সাহেলা চৌধুরী বললেন,

–এই তুমি সেই মেয়েটা না। যার সাথে আয়মানের বিয়ে হবার কথা ছিল। কিন্তু তুমি বিয়ে না করে পালিয়ে গিয়েছিল!

–একটা কা’পু’রু’ষ’কে বিয়ে করার থেকে, পালিয়ে যাওয়া ঢের ভালো।

–সাবধানে কথা বল মেয়ে! আমাদের বাসায় এসে, আবার আমার সাথেই বাজে ব্যবহার করা!

–আমি তো আপনার সাথে আগে কথা বলতে যাইনি আন্টি। আমি এখানে আপনার সাথেও কথা বলতে আসিনি। আপনি পুরোনো কথা টেনে আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছেন। কেউ আমাকে অপমান করার চেষ্টা করলে, তাকে আমি এক চুল পরিমাণ ছাড় দিব না। সে যদি হয় আমার নিজের মায়ের পেটের বোন সে-ও ছাড় পাবে না।

–আয়মান সঠিক কাজ করেছে। তোমার মতো বেয়াদব মেয়েকে বিয়ে করলে, আয়মানের জীবনটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যেত। সাহেলার ব্যবহার দেখে রিয়াদ চৌধুরী বজ্রকণ্ঠে সাহেলাকে ধমক দিল। স্বামীর ধমকে চুপসে যায় সাহেলা। রাগান্বিত হয়ে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন সাহেলার দৃষ্টি উপেক্ষা করে, সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মুনতাসিমের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তবুও গভীর আগ্রহ নিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। তখনই তাইয়ান এসে মুনতাসিমের পাশে এসে নিজের স্থান দখল করল। মুনতাসিমের কর্ণের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,

–স্যার আপনার হৃদয় হরণ হয়ে গিয়েছে। মেহেভীন নামক রমনী আপনার হৃদয় হরণ করেছে। না হলে আপনার মতো নিষ্ঠুর মানুষের মনে, সাধারন এক রমনীকে দেখে, আপনার হৃদয়ের গহীনে এতটা ঝড় উঠে, আপনার ভেতরটা যে উথাল পাথাল হয়ে যাচ্ছে। আপনার অশান্ত বুকটাকে কে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলবে। এই মেয়েকে আমি চিনি। এই মেয়ের সাথে আয়মান স্যারের বিয়ে হবার কথা ছিল। আয়মান স্যার কি একটা ভুল করল। পূর্নিমার চাঁদকে ঘরে তুলে সমস্ত ঘর আলোকিত করা বাদ দিয়ে, অমাবশ্যার রাতকে ঘরে তুলে ঘরকে করেছে আঁধার। আয়মান স্যার একদিন বহু পস্তাবে। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম রক্তিম চোখে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে। তাইয়ান তার ব্যক্তি বডিগার্ড সব সময় বেশি কথা বলে, আর উপহার স্বরূপ মনুতাসিমের ব’কা শুনতে হয়। ছেলেটা ভিষণ ভালো। সব সময় মুনতাসিমের সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। মুনতাসিমের বিপদে সবার আগে সে এগিয়ে আসে। মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে বলল,

–তুমি এখানে থেকে যাবে নাকি মা’থাটা দেহ থেকে আলাদা করে দিব। মুনতাসিমকে দেখে সে ভিষণ ভয় পায়। মুনতাসিম একবার রেগে গেলে, তার সামনে কোনো বাক্য আসে না ভেতর থেকে। নিঃশব্দে তাইয়ান চলে গেল। তাইয়ান চলে যেতেই মুনতাসিন অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠলো। কি স্নিগ্ধ সেই হাসি! প্রতিটি নারীর হৃদয়ে ঝড় তোলার জন্য এমন এক মনোমুগ্ধকর হাসিই যথেষ্ট। ” আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সেদিন আয়মান তোমাকে বিয়ে না করে, আমার অনেক বড় উপকার করেছে মেহেভীন। কারন তুমি যে অন্য কারো ভাগ্যে লিখা আছ। তুমি আয়মানের হও সেটা বিধাতাও চাইনি। তোমাকে আমার হতেই হবে। তোমাকে পাবার জন্য যদি আমাকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যেতে হয়। তাহলে আমি সেখানেই চলে যাব। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে, তোমাকে আমার নামে লিখিত ভাবে দলিল করে যাব। আমি ছাড়া যেন কেউ তোমায় স্পর্শ করতে না পারে। তোমার পাশে অন্য কেউ থাকবে। কথাটা কল্পনা করলেই, আমার হৃদয়ের গহীনে ভীষণ ব্যথা করে। তুমি কি সেটা উপলব্ধি করতে পারো। আমার অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করার জন্য হলে-ও তোমাকে আমার চাই মেহেভীন। কথা গুলো ভাবতেই বুকটা হাহাকারে ভরে গেল। ভালোবাসা মানুষকে এতটা ভালোবাসার পরেও, বলতে না পারার যে ব্যাপারটা। তার মতো বাজে অনুভূতি দু’টো নেই। বুকের ভেতরটায় অসহনীয় যন্ত্রনা করছে। মনটা ভিষণ ভাবে জ্বলছে। হারিয়ে ফেলার ভয় সব সময় কাবু করে রাখে। অনুভূতিরা নেতিয়ে যায়। আনন্দরা মেতে উঠতে ভুলে যায়। তুমি আমার হলে পৃথিবীর সমস্ত সুখ, আনন্দ, অনুভুতি, আবেগ সবাই আমার হবে মেহেভীন। আমি হয়ে উঠব ছোট বাচ্চা ন্যায় করব শিশুসুলভ আচরণ। কথা গুলো ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

চারদিকে পিনপতন নীরবতা সবাই গভীর আগ্রহে মেহেভীনে দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। প্রাপ্তির সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। এক ঝাঁক ভয় এসে মনের মধ্যে হানা দিয়েছে। ভয়ে জড়সড় হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান এতক্ষণ ছিল না। সবে মাত্র বাসার মধ্যে প্রবেশ করেছে। মেহেভীনকে দেখে তার আঁখিযুগল স্থির হয়ে যায়। পুতুলের ন্যায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। সেদিন রাতের আলোয় ভালোভাবে দেখতে পাইনি সে। মেহেভীনদের বাসা তাদের বাসার থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেক ছোট৷ তাদের বাসার মধ্যে চারদিকে রশ্মি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মেহেভীনদের বাসায় তেমন আলো ছিল না। মুগ্ধ নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেহেভীন ভুল করেও আয়মানের দিকে নজর দেইনি। সে আমান চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলল,

–এড বড় বাড়ি আপনাদের এলাকায় নাম ডাকও বেশ ভালো। তা বউয়ের হাত খরচ দিতে পারেন না নাকি। আপনার বাড়ির বউ যে অন্যের মেয়ের টাকা মেরে খায়। সে খবর কি রাখেন। মেহেভীনের কথায় আমান চৌধুরী বিস্মিত হয়ে যায়। সে বিস্ময় নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে কিছু কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল,

–এসব তুমি কি বলছ! তোমার মাথা ঠিক আছে। আমাদেরকে তোমার কি মনে হয়! আমরা অন্যের টাকা মেরে খাই। আমাদের বাড়ির প্রতিটি ছেলে প্রতিষ্ঠিত। আমি আর আমার ভাই ব্যবসা করি। আমাদের কোনো দিকে কমতি নেই। তাহলে আমরা কেন তোমার টাকা মেরে খাব। তখনই আয়মান বলে উঠলো।

–এক হাতে কোনোদিন তালি বাজে না মেহেভীন। তুমি প্রাপ্তির কাছে টাকা পাঠিয়েছো কেন? প্রাপ্তি তোমার কাজের লোক নাকি যে তুমি প্রতি মাসে টাকা পাঠাবে। সেগুলো তোমার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দিবে। তুমি কেমন মেয়ে নিজের বাবা-মায়ের হাতে টাকা তুলে না দিয়ে, নিজের চাচাতো বোনের হাতে তুলে দাও। তুমি শেয়ালের কাছে মুরগী বাগি দিবে। আর শেয়াল মুরগী টা খেয়ে ফেললেই দোষ। আয়মানের কথায় জ্বলে উঠলো মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে বলল,

–যার স্বভাব গিরগিটির মতো রঙ বদলানো। তার থেকে এসব ছাড়া বেশি কিছু আশা করা যায় না৷ আমি না হয় বাবা-মায়ের সুসন্তান হতে পারিনি। কিন্তু আপনি-ও একজন আদর্শ স্বামী হয়ে উঠতে পারেনি। আপনি তো একদম চোর স্বামী হয়েছেন। বউ অন্যের টাকা চুরি করে মেরে দিচ্ছে। আপনিও সেই টাকায় মজা লুটছেন। পরিস্থিতি আমাদের এমন জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয়। অনেক সময় সহজ কিছুও কঠিন হয়ে যায়। আপনার মতো কাপুরুষের সাথে আমার বাবা বিয়ে ঠিক করেছিল। সেদিন আমি বাবা-মায়ের সন্মানের কথা চিন্তা না করে, আমার স্বপ্ন পূরন করতে চলে গিয়েছিলাম। একটা বার ভেবে দেখেছেন? আমি কোন মুখ নিয়ে বাবার সামনে আসতাম। আপনার বউ টাকা নিয়েই থেমে থাকেনি। আমার নামে বাবা-মায়ের কাছে নানারকমের মিথ্যা কথা বলেছে। আবার আমার কাছে বাবা-মায়ের নামে মিথ্যা বলেছে। আমি মানছি আমি খারাপ। আপনার বউ না হয় ভালো ছিল। সে চাইলই পারতো আমাকে আর বাবা-মাকে এক করে দিতে। সে দেয়নি। কেন দেয়নি জানেন সে আমার থেকে আর টাকা লুফে নিতে পারবে না। আপনি আর প্রাপ্তি আপু দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতেন। দু’জন বুদ্ধি করে বিয়ে করলেন। মাঝখানে থেকে আমার বাবা-মায়ের সন্মান আর আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলেন। আমি বাসায় এসেছি একদিন হয়নি। মানুষ আমায় নিয়ে কটু কথা শোনাচ্ছে। আমাকে আঁড়চোখে দেখছে। আমার যে সন্মান নষ্ট হয়েছে। সেগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবেন। বউকে চুরি করার শিক্ষা দিচ্ছেন। সে তো আমার বোন ছিল৷ আমি তাকে ভিষণ ভালোবাসতাম। ভরসা আর বিশ্বাস থেকেই তাকে টাকা পাঠাতাম৷ এমনি এমনি পাঠালে আব্বু আম্মু টাকা গুলো ঠিক পাঠিয়ে দিত। সে এভাবে আমার সরলতার সুযোগ নিল! আজকে আপুকে জবাব দিতেই হবে। কেনো সে আমার সাথে এমন করল। আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে, সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ করে দিব। জানের পরোয়া মেহেভীন করে না। আজকে আপনার বউকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বেইমানি করার অপরাধে আপনার বউকে এমন শান্তি দেওয়া উচিৎ। তা দেখে যেন শহরের প্রতিটি অলিগলি কেঁপে ওঠে। মেহেভীনের কথায় পুরো পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে গেল। এ যেন নিরতার মেলা বসেছে। প্রাপ্তি সুযোগ বুঝে পালাতে চাইল।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৪+৫

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৪
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

বিষন্ন মন ছন্নছাড়া রাত বিষাদের ছোঁয়ায় আসক্ত শরীর। ক্লান্ত দেহটা ধীর গতিতে ব্যাগের মধ্যে সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। বাহিরে থেকে গাড়ির কোলাহল কর্ণকুহরে ভেসে আসছে৷ মেহেভীন আজকে অফিসে ছুটি নিতে গিয়েছিল। কালকে নিজ জন্ম ভূমিতে যাবে। রুপা মেহেভীনের বিষাদগ্রস্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন করতে পারছে না। সে সবকিছু নিরবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। মেহেভীন নিজের মুঠোফোনটা হাতে তুলে নিল। ফোন হাতে নিতেই মায়ের নাম্বারটা জ্বল জ্বল করে উঠলো। বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে আসছে মেভেভীনের। আচমকা দম বন্ধ হয়ে আসার ব্যাপার টা মেহেভীন ভিষণ ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। আজকে সে মাকে ফোন দিবে কালকে বাসায় যাবে। সে কথা জানানোর জন্য অফিসে ছুটি নিতে গিয়েছিল মেহেভীন। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না৷ মায়ের নাম্বারে কল যাচ্ছে। মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ তড়িৎ গতিতে ছুটে চলেছে। ভেতরে দারুন অস্থিরতা কাজ করছে।

–হ্যালো কে বলছেন?

–মা আমি মেহেভীন।

–মেহেভীন! তুই এতদিন কোথায় ছিলি? আমাদের খোঁজ খবর নিসনি কেন? তোকে কত খুঁজেছি। আমরা কি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলছি। যে তুই আমাদের এত বড় শাস্তি দিচ্ছিস। তুই তোর স্বামী সহ বাসায় চলে আয় মা। আমি তোদের মেনে নিব। এভাবে আর বাবা-মায়ের ওপরে রাগ করে দূরে সরে থাকিস না। তোর চিন্তায় তোর বাবা আর আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি রে মা। রাইমা বেগম মেয়ের কল পেয়ে যেন উন্মাদ হয় গিয়েছে। মেহেভীনকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে না। মেহেভীন বিস্মিত হয়ে মায়ের কথা শুনছে। সে বিয়ে করেছে! অথচ সে নিজেই জানেনা। তার মা কি সবকিছু নিজের মন মতো বানিয়ে নিয়েছে। সে পালিয়ে এসে বিয়ে করে সংসার করছে। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,

–আম্মু তুমি উত্তেজিত হবে না। তুমি উত্তেজিত হয়ে গেলে এখনই অসুস্থ হয়ে পড়বে। তখন আমার সাথে কিভাবে কথা বলবে। সে কথা কি একবারও ভেবে দেখেছ? আমি তোমার সব কথা শোনার জন্যই তোমার কাছে এসেছি। তাহলে এত তাড়াহুড়ো কিসের। মেহেভীনের কথায় শীতল হলো মায়ের হৃদয়। শান্ত নদীর মতো স্থীর হয়ে গেল রাইমা বেগম। মেহেভীন আবদারের সুরে বলল,

–মা আমি কালে বাসায় আসি। কতদিন হয়ে তোমাদের দেখি না। তোমাদের ভিষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি তোমাদের বাসায় গেলে, আমাকে তোমাদের ঘরে তুলে নিবে। নাকি ছুরে রাস্তায় ফেলে দিবে।

–এসব তুই কি বলছিস মেহেভীন। নিজের সন্তানকে কেউ কোনোদিন রাস্তায় ফেলে দিতে পারে। আজকে বুঝবি না। একটা সন্তান তার বাবা-মায়ের কাছে কি? যেদিন মা হবি সেদিন বুঝতে পারবি।

–আমি যে অন্যায় করেছি মা। তোমাদের সন্মান নষ্ট করেছি। আমার কি ক্ষমা হবে। আমাকে আবার আগের মতো ভালোবাসবে তো।

–আমি মনে করি আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। আমাদের থেকে ভালো পরিকল্পনা কারী আল্লাহ। আমরা যা হারিয়েছি। তার থেকে দ্বিগুন আমাদের ফিরিয়ে দিবেন। প্রাপ্তির কাছে কত করে বলেছি। তোর সাথে কথা বলিয়ে দিতে প্রাপ্তি একদিনও কথা বলিয়ে দেয়নি। তুই নাকি আমাদের মুখ দেখতে চাস না। আমরা যেন তোকে না খোঁজার চেষ্টা করি। এবার বুঝতে পারছিস আমার ব্যাথাটা কোথায়। মায়ের কথায় মেহেভীন আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল!

–আম্মু আমি এসব কিছু বলনি। প্রাপ্তি আপু আমাকে বলেছে তোমরা আমার মুখ দেখতে চাও না। আমি বাসায় গেলে আমাকে ত্যাজ্য কন্যা করে দিবে। আমি তোমাদের হারাতে চাইনি আম্মু। সেজন্য এতদিন তোমাদের থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি। মেহেভীনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে পরিবেশটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মা-ও মেয়ের চারপাশে যেন নিস্তব্ধ রাজত্ব করছে। দু’জনের বুঝতে বেগ পেতে হলো সমস্যাটা কোথায়। নিরবতা ভেঙে রাইমা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–তোর সাথে এমন হবার দরকার ছিল। না হলে জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতি না। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। বাবা-মায়ের থেকে যেমন চাচাতো বোনকে বেশি আপন ভাবতে গিয়েছিল। সে তোকে তোর ভালোবাসার উপকার দিয়েছিল। তা এখনই সব শুনবি নাকি বাসায় আসবি সেটা বল আগে।

–আম্মু রাগ করছ কেন?

–রাগ করব না তো কি আদর করব। বাড়ি আগে আয় আগে পাজি মেয়ে একটা।

–সে আমাকে যা খুশি করার কর। কিন্তু আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না আম্মু। তোমাদের ভালোবাসা ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। ছোট বেলা থেকে এত কষ্ট করে মানুষ করেছ। আমার সাফল্যে অর্জনের পর তোমরা সুখ করবে না। তাহলে কে সুখ করবে আম্মু?

–তোর সাফল্য মানে?

–তোমাদের জন্য সারপ্রাইজ আছে।

–কালকে কখন আসবি?

–আজকে রাতে যাব আম্মু। সকালে পৌঁছে যাব। আব্বুর কি অবস্থা আম্মু। আব্বু কি আমার ওপরে খুব রেগে আছে। আমাকে যদি বাসা থেকে বের করে দেয়।

–তোর কি আমাদের এত খারাপ বাবা-মা বলে মনে হয়। তুই না জানিয়ে বিয়ে করেছিস। সেজন্য তোর বাবা রাগ করে আছে। তুই সামনে আসলে সব রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।

–তুমি একটু বুঝিয়ে বলো আব্বুকে, আব্বু যেন আমার ওপরে রাগ না করে থাকে। রাইমা বেগম আর মেহেভীন দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলল। বহুদিন পরে মেয়ের সাথে কথা বলে রাইমা বেগমের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। কালকে তার মেয়ে আসুক। প্রাপ্তির বাবাকে ডেকে প্রাপ্তির সব কুকীর্তি কথা জানাবে। মেহেভীন রুপাকে ডেকে বাসায় যেতে বলল। কয়টা দিন মেয়েটা বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিক। সে রাতেই চলে যাবে। সে একটু মুক্ত পাখির ন্যায় চারদিকে উড়ে বেড়াতে চায়। তাই নিজের গাড়ি থাকা সত্বেও বাসের টিকিট কেটেছে সে। রাত বারোটায় গাড়ি। বাসায় যেতে যেতে প্রভাতের আলো ফুটে যাবে। বাসায় তালা লাগিয়ে এক ঘন্টা আগেই প্রাপ্তি বেড়িয়ে পড়লো।

শহরের পরিবেশ টা গ্রামের বিপরীত চিত্র। গ্রামের পরিবেশ রাত গভীর হবার সাথে সাথে মরুভূমিতে পরিনত হয়। আর শহরের অলিতে-গলিতে রাতভর গাড়ি চলাচল করে। মানুষ নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত থাকে। সোডিয়ামের হলুদ আলোয় পুরো শহর আলোকিত হয়ে থাকে। মেহেভীন বাসে উঠে বসলো। জানালার কাছে বসতে তার ভিষণ ভালোলাগে। কিন্তু ভাগ্য বসত তার সীট জানালার কাছে পড়েনি। তবুও সে জানালার কাছে গিয়ে বসলো। তার পাশের জনের সাথে কথা বলে ম্যানেজ করে নিতে হবে। মেহেভীন রাস্তার মানুষজন দেখতে ব্যস্ত তখনই কেউ বলে উঠলো,

–কাউকে না জানিয়ে তার সীটে বসতে হয় না। এটা আপনি জানেন না ম্যাডাম।

–আপনি এখানে।

–ভয় পাবেন না আজকে কিছু চাইতে আসিনি।

–সে কথা বলেছি আমি৷ আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

–আমাদের বাসায় একটু ঝামেলা হয়েছে। আব্বু ফোন করে বাসায় যেতে বলছে। আপনি আমার সীটে বসে আছেন। সরে আসুন। আমি সেখানে বসব।

–আপনি আমার সীটে বসুন। আমার জানালার কাছে বসতে ভালো লাগে।

–সব জায়গায় ক্ষমতার প্রয়োগ করবেন না ম্যাডাম।

–আশ্চর্য! আমি কখন ক্ষমতার প্রয়োগ দেখালাম। আচ্ছা বেশ উঠে যাচ্ছি। আপনি বসুন আপনার জায়গায়। মেহেভীনকে রেগে যেতে দেখে মুনতাসিম বুকে হাত রেখে বলল,

–সর্বনাশ! এভাবে কেউ রেগে যায়। আপনি রেগে যাবেন না ম্যাডাম। আমার ক্রোধের আগুনে আমি শেষ হবে যাব।

–আপনি আমার সাথে ফ্লার্ট করছেন।

–আপনি কি ফ্লাট করার জিনিস ম্যাডাম। আমার এত সাহস আছে। আপনার সাথে কথা বলতে পারছি। আমার পাশে বসতে পারব। এটাই আমার ভাগ্য। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম কাঁধ থেকে ব্যাগ রেখে বসলো।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মেহেভীনের ছোট ছোট কেশ গুলো মেহেভীনকে বিরক্ত করে যাচ্ছে। মেহেভীন গাড়ির জানালার নিচে চিবুক ঠেকিয়ে রাতের সুন্দর্য উপভোগ করছে। রাতের শীতল হাওয়া মেহেভীনের মুখশ্রী স্পর্শ করে যাচ্ছে। তা দেখে মুনতাসিমের ভিষণ ঈর্ষা হচ্ছে। ইশ সে যদি এভাবে তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারত। সে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা সামনে আসলেই তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মেয়েটা সামনে আসলে তার ক্রোধ, অহংকার, আত্মসম্মান সবকিছু কোথায় জানি হারিয়ে যায়। আজ ভিষণ করে বাবার কথা মনে পড়ছে। ধরনীর বুকে চলার পর এমন একজন মানুষ আসবে। যার কাছে তোমার ক্রোধ, অহংকার, আত্মসম্মান কিছুই থাকবে না। সবকিছু লুটে নিয়ে যাবে মানুষটা। তোমাকে করে তুলবে বেহায়া। সবকিছুর পরেও তুমি মানুষটাকে চাইবে। মানুষটাকে দেখার জন্য পাগলামি করবে। মানুষটার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য ছটফট করবে। মানুষটার শূন্যতা তোমার ভেতরটাকে অস্থিরতায় কাঁপিয়ে তুলবে। যাকে ছাড়া তোমার নিজেকে শূন্য মনে হবে। অর্থহীন মনে হবে। এমন একটা সময় আসবে তুমিও পরিবর্তন হবে। তুমিও কারো বাধ্য হয়ে যাবে। তবে কি বাবার কথা সত্যি হয়ে যাবে। কথা ভাবতেই ভেতর থেকে ক্রোধ নিয়ে আসার চেষ্টা করল মুনতাসিম। নাহ আজ তার ক্রোধ তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে কিছুতেই ধরা দিতে চাইছে না। ভেতর থেকে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। অনুভূতিরা আনন্দ মেতে উঠেছে। মনের শহরে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে। মনের অলিতে-গলিতে মিছিল করে বলছে। তোমাকে ভালোবাসার যুদ্ধে হারিয়ে দিব মুনতাসিম ফুয়াদ। তোমার ছন্নছাড়া জীবন গুছিয়ে দিব। কারো ভালোবাসার চাদের মুড়িয়ে দিব। সেদিন আর বেশি দেরি নেই। একা থাকার সব অহংকার মাটির সাথে মিশিয়ে দিব। মুনতাসিমের ভাবনার মাঝেই অনুভব করল। একটা মাথা তার কাঁধ দখল করে নিয়েছে। মুহুর্তের মাঝে মুনতাসিম নিজের কাঁধের দিকে দৃষ্টিপাত করল। এই তো সেই চেহারা যে চেহারা দেখে তার মনের দারুন সর্বনাশ হয়েছিল। কি আছে এই চেহারার মধ্যে যা তাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে। এতগুলো বছরে যা কেউ করতে পারলো না। তা এই মেয়েটা কয়েক দিনে করে দেখালো। মুনতাসিম অনুভব করল মেহেভীন তার কাঁধে মাথা রাখায় তার ভিষণ আনন্দ লাগছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি শরীরে বয়ে যাচ্ছে। মুনতাসিম নড়াচড়া করল না চুপ করে বসে আছে। যেন মেহেভীনের নিদ্রা না ভেঙে যায়।

চারিদিকে প্রভাতের আলো ফুটে গিয়েছে। গাড়ি এসে নিজ গন্তব্যে থেমে গিয়েছে। মুনতাসিম সারারাত ঘুমোয়নি। সে ঘুমালে যদি মেহেভীনের ঘুম ভেঙে যায়। অদ্ভুত একটা টান তৈরী হয়ে গিয়েছে মেয়েটার প্রতি। মেহেভীন সজাগ হবার আগেই খুব সাবধানে মুনতাসিম তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল। আস্তে আস্তে সব যাত্রী নামতে শুরু করেছে। মেহেভীন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একজন বৃদ্ধা মহিলা মেহেভীনকে সজাগ করে দিয়ে গেল। মেহেভীনের আঁখিযুগল মেলতেই আঁখি জোড়া বড় বড় হয়ে গেল। রজনী কিভাবে পার হয়ে গেল সে টেরই পাইনি। পাশে তাকিয়ে দেখলো মুনতাসিম নেই। আচমকা মেহেভীনের একটু মন খারাপ হলো। সে মন খারাপকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লো। মনের মধ্যে ভালো লাগার শিহরণ বয়ে গেল। কতদিন পর নিজের জন্ম স্থানে আসলো। সবকিছু বদলে গিয়েছে। মেহেভীন হাঁটতে শুরু করল সামনেই তাঁদের বাসা পাঁচ মিনিটের রাস্তা। সে ভাবলো হেঁটে চলে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। চারদিকে সবুজ ধানক্ষেত আর মাঝখানে পিচ ঢালাই করা রাস্তা। দেখলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। মেহেভীন যত বাসার দিকে অগ্রসর হচ্ছে ততই পুরো শরীর কাঁপছে। ভেতরটা ভয়ে কাবু হয়ে আসছে। তার বাবা যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়। তাহলে সে কি করবে? ভালোবাসার মানুষের অবহেলা সে সহ্য করতে পারবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই বাসার কাছে চলে আসলো। দরজার কলিং বেলে চাপ দিল মেহেভীন। ভেতরে দারুন অস্থিরতা কাজ করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার বাবা যদি এসে দরজা খুলে দেয়। তখন সে কি করবে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি মানুষের মুখশ্রীতে বিষাদের স্বাদ এসে ধরা দিয়েছে। পুরো বাড়ি শীতল হয়ে আছে। কারো মুখে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। তখনই মুনতাসিম বাসার মধ্যে প্রবেশ করল। মুনতাসিমকে দেখেই সবার মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। মুনতাসিম কারো সাথে কথা না বলে নিজের কক্ষে চলে গেল। একটু পরে ফ্রেশ এসে হয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলো। মুনতাসিমের সামনে বসে আছে রিয়াদ চৌধুরী। সে মুনতাসিমের গম্ভীর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–কিসের জন্য ডেকেছেন আব্বা? আপনাদের জন্য একান্তে কিছু সময় কাটাতে পারব না। আমাকে ছাড়া আপনাদের জীবন বেশ চলে যায়। প্রয়োজন পড়লে আমাকে স্মরন করেন। তা আজ কে কি অন্যায় করেছে। যার জন্য আমাকে জুরুরি তলব করে ডাকা হলো। ছেলের কথায় বুকটা ভারি হয়ে আসলো। মনের মধ্যে হাহাকার নেমে এল। সে কি সত্যি ছেলেকে ভালোবাসে না। শুধু কি প্রয়োজনেই ছেলেকে কাছে ডাকে! ছেলে শুধু প্রয়োজন টাই দেখল। তার ভালোবাসা দেখল না। বুকটা খাঁ খাঁ করছে রিয়াদ রহমানের সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

— মাশরাফি আবার বাজে ছেলেদের সাথে গিয়েছিল। সেখানে ধুমপানসহ নেশাদ্রব্য শরীরের মধ্যে নিয়েছে। এলাকার বৃদ্ধ দেখে আমার কাছে বিচার দিয়েছে। আয়মান তার ছোট ভাইকে শাসন করতে দেয় না। এভাবে চলতে থাকলে পরিবারের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নেও। তুমি কি করবে শাসন করবে নাকি আয়মানের মতো নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ভাই হিসেবে গন্য হবে। রিয়াদ চৌধুরীর কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই মুনতাসিমের শিরা-উপশিরা কেঁপে উঠলো। মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠলো। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ণ ধারণা করেছে। হুংকার ছেড়ে মাশরাফিকে ডাকল। মুনতাসিমের হুংকারে কেঁপে উঠলো চৌধুরী বাড়িরর প্রতিটি দেওয়াল। মুহুর্তের মধ্যে মাশরাফি, আয়মান, প্রাপ্তি এসে হাজির হলো ড্রয়িং রুমে। মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে মাশরাফিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তুমি আবার এলাকার বখাটে ছেলেদের সাথে মিশেছো? তোমার সাহস কি করে নিষিদ্ধ জিনিস স্পর্শ করার! আমাদের পরিবারের একটা সন্মান আছে। আমার দাদার আমল থেকে কেউ এসব করার সাহস পেল না। তুমি কিভাবে এত সাহস পেলে!

–আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। আমি কখন কোথায় কি করব? সেটার কৈফিয়ত আপনাকে দিতে বাধ্য না। আপনি সৎ ভাই আছেন। আপনি সৎ ভাইয়ের মতো থাকবেন। একদম ভাইয়ের অধিকার দেখাতে আসবেন না। মাশরাফির এই একটা বাক্যই ছিল আগুন ঘি ঢালার মতো। মুনতাসিম এক সেকেন্ড বিলম্ব করল না। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে মাশরাফির গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। মুনতাসিমের প্রহারের প্রখরতা এতটাই তীব্র ছিল। যে মাশরাফি তাল সামলাতে পারে না৷ পুরো ধরনী তার চারপাশে ঘুরতে থাকে। সে ছটফট করতে করতে ফ্লোরে পড়ে যায়। মাশরাফির মা রাগান্বিত হয়ে মুনতাসিমের দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে, মুনতাসিম বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলো,

–এই মহিলা যদি ভুল করেও আমার কাছে আসার চেষ্টা করে। আল্লাহর কসম এই মহিলাকে ধংস করে ফেলব। আপনি আপনার অর্ধাঙ্গিনীকে সতর্ক করুন আব্বা। সে কি জানেনা মুনতাসিম যখন কারো বিচার করে। তখন কেউ ব্যাঘাত ঘটাতে আসলে, তার পরিনাম কি হয়।

–আশ্চর্য! তুমি আমার ছেলেকে প্রহার করছ? আর আমি তোমাকে বাঁধা দিব না। মা হয়ে ছেলের কষ্ট পাওয়া দেখবো। এটা আদৌও মায়ের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যায়। আমার ছেলেকে প্রহার করার অধিকার আমি তোমাকে দেইনি মুনতাসিম।

–আমিও আপনার ছেলে আমার পরিবারের সন্মান নষ্ট করার অধিকার দেইনি। ছেলেকে অধঃপতনে যেতে দিবেন। তবুও শাসন করতে দিবেন না। এমন মা থাকার থেকে না থাকা অনেক ভালো। আপনার মতো মায়ের কোনো সন্তানের দরকার নেই। আমি আপনার সাথে কথা বলতে আসিনি। নিজের ভালো চান তো সামনে থেকে সরে যান। মিলি ওর মুখে পানি ছিটিয়ে দে। সে যে অভিনয় করছে এটা আমাকে বোঝানোর দরকার নেই। ওর মতো বয়স অনেক আগেই পার দিয়ে আসছি। তখনই শেহনাজ কক্ষ থেকে হয়ে আসে। মুনতাসিমকে দেখে মুখশ্রীতে আনন্দের রেশ ঘিরে ধরে। মাশরাফিকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে, অজান্তেই শেহনাজের মুখশ্রী খুশিতে চকচক করে উঠে। শেহনাজ হুংকার তুলে বলে,

–এই এতটুকু মা’র’লে’ন কেন ভাই? ওকে রক্তাক্ত করে ফেলুন। দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আব্বু মান সন্মানের ভয়ে কিছু বলতেও পারে না। মায়ের প্রশ্রয়ে বেশি বিগড়ে গিয়েছে। মাশরাফির সাথে মাকে-ও কয়টা লাগিয়ে দিন। রুপালি চৌধুরী মেয়ের কথায় রক্তিম চোখে মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তার যদি সাধ্য থাকতো। তাহলে চোখ দিয়েই মেয়েকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতো। মুনতাসিম আঁড়চোখে শেহনাজকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপরে ফ্লোরে বসে মাশরাফিকে তুলে বসালো। আয়মান তাকে যতটুকু সাহস দিয়েছিল। সবকিছু হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গিয়েছে। হৃদস্পন্দনের গতিবেগ তড়িৎ গতিতে ছুটে চলেছে। সমস্ত মুখশ্রী ভীত হয়ে আছে। আঁখিযুগল ছোট ছোট করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে মাশরাফি। মুনতাসিম রক্তিম চোখে মাশরাফির দিকে দৃষ্টিপাত করেছে। সমস্ত ক্রোধ যেন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে। সে মাশরাফির দুই গাল এক হাতে চেপে ধরলো। মাশরাফি সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে মুনতাসিমের হাত সারানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মুনতাসিমের সুঠাম দেহের সাথে মাশরাফির ছোট্ট দেহটা পেরে উঠলো না। মাশরাফি কেমন ছটফট করতে লাগলো। মুনতাসিম ধাক্কা দিয়ে মাশরাফিকে দূরে সরিয়ে দিল। মাশরাফি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।

–এবার বল তুমি কাকে কৈফিয়ত দিবে মাশরাফি? আজকের পরে যদি আর দ্বিতীয় দিন এমন কথা শুনি। তাহলে তোমাকে জ্যা’ন্ত পুঁ’তে ফেলবো।

–আপনার ক্ষমতার প্রয়োগ আপনি বাহিরে দেখাবেন মন্ত্রী সাহেব। আপনার কথা জনগণ মানতে পারবে। কিন্তু আমি এই মাশরাফি কোনোদিন আপনার কথা মানবো না। আপনি যেটা করতে নিষেধ করবেন। আমি সেটাই বেশি করে করব। আমারে মেরে যদি ভাবেন দমিয়ে রাখবেন। তাহলে আপনার ধারণা ভুল। আমি আপনাকে ভয় পাই না। কথা গুলো বলেই দৌড়ে গিয়ে আয়মানের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো। মাশরাফির কথা শুনে মুনতাসিম শব্দ করে হেসে উঠলো। সে কি ভয়ংকর হাসি। যে হাসির শব্দে পুরো পরিবারের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো।

–আয়মান সামনে থেকে সরে যা। ছেলেটার বড্ড বেশি কলিজা হয়েছে। আজকে আমি ওর কলিজা বের করে দেখব। সে কতবড় কলিজার মালিক হয়েছে। আয়মান প্রথম সরতে চাইলো না। কিন্তু মুনতাসিমের হুংকারে সরে দাঁড়াল। মাশরাফি দুই পাশে তাকিয়ে দেখলো। তাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। মাশরাফি অসহায় দৃষ্টিতে আয়মানের দিকে তাকালো। সে তো আয়মানের ভরসায় এতগুলো কথা বলল৷ সেই আয়মান তার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। এখন সে হারে হারে উপলব্ধি করছে পারছে। এতদিন সে ভুল মানুষকে বিশ্বাস করেছে। এবার তাকে কে বাঁচাবে? ভয়ে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসতে শুরু করল। থরথর করে কাঁপছে মাশরাফি। মুনতাসিম মাশরাফির গলা চেপে ধরলো। মাশরাফি ছটফট করতে লাগলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। কাশি শুরু হয়ে গিয়েছে। কাশির সাথে রক্ত আসছে। মুনতাসিম দম নেওয়ার জন্য একটু ছেড়ে দিল। মুনতাসিম ছেড়ে দিতেই মাশরাফি যেন প্রাণ ফিরে পেল। মুনতাসিম আবার মাশরাফির দিকে অগ্রসর হতেই মাশরাফি মুনতাসিমের চরণের কাছে বসে পড়লো। দু’টি চরণ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিল। শরীরটা কেমন নেতি আসছে না৷ ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল,

–আমাকে মাফ করে দিন ভাই। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি আর এমন ভুল কখনো করব না। আমাকে আর মা’র’বে’ন না। আমি আর নিতে পারছি না। এবার শরীরে হাত দিলে দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা বের হয়ে যাবে। আপনার সাথে আর কখনো বেয়াদবি করব না। শেষ বারের মতো একটা সুযোগ দিন। কথা দিচ্ছি আর কখনো অভিযোগ করার সুযোগ পাবেন না। আপনি এত নিষ্ঠুর কেন? বাহিরে সবার সামনে নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করেন। ঘরের লোকের সাথে তো একটু নরম হতে পারেন। মাশরাফির কথায় মুনতাসিম ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। হয়তো নিজের অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। ঝাড়ি দিয়ে নিজের দু’টি চরণ মাশরাফির থেকে ছাড়িয়ে নিল। আস্তে করে সোফায় গিয়ে পায়ের ওপরে পা তুলে বসলো। তারপরে শান্ত মস্তিষ্কে জবাব দিল,

–আমি নিষ্ঠুরদের সাথেই নিষ্ঠুর হই। নিষ্ঠুরদের সাথে নিষ্ঠুর না হলে ভালো মানুষ গুলো ভিষণ ভাবে ঠকে যাবে। তোমার বয়স কত কখনো ভেবে দেখেছো? তুমি সবে মাত্র দশম শ্রেণিতে পড়ো। কিন্তু তোমার কথাবার্তা বলে না তুমি এত ছোট! কিসের ক্ষমতা দেখাও তুমি। তুমি যদি ভুলে না যাও আমি তোমার সৎ ভাই। তাহলে আমিও ভুলে যাব না। তোমার সাথে আমার পরিবারের সন্মান জড়িয়ে আছে। আর আমার পরিবারের সন্মান যে নষ্ট করার চেষ্টা করবে। তার প্রতি আমি এতটা ভয়ংকর হব। যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আমাকে আরো কঠিন ও নিষ্ঠুরতম হতে বাধ্য কর না মাশরাফি বাঁচতে পারবে না। অন্যায়ের সাথে আমি মুনতাসিম ফুয়াদ কখনো আপস করিনি। আর ভবিষ্যতেও করব না। আমার পরিবারের নিয়ম নীতি মেনে চলতে পারলে আমাদের বাসায় থাকবে। আর না হলে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে গিয়ে যা খুশি করার করবে। আব্বাকে বলে দিব আব্বা যেন তোমাকে ত্যাজ্যা পুত্র করে দেন। মুনতাসিমের কথা শেষ হবার সাথে মাশরাফি ফ্লোরে ঢলে পড়লো। সবাই মাশরাফিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রুপালি চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে রিয়াদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তোমার ছেলের হাত আমি চূর্ণবিচূর্ণ করে দিব৷ তার সাহস কি করে হয়! আমার সামনে আমার ছেলেকে রক্তাক্ত করে ফেলছে। সে তো বুঝিয়ে বলতে পারতো৷ তুমি একটা টু শব্দ করলে না। কেমন বাবা তুমি! ঐ অমানুষের বাচ্চাকে আমি শেষ করে ফেলব।

–রুপালি কথা সাবধানে বলবে। তুমি নিজের ছেলেকে শাসন করতে ব্যর্থ হয়েছো। তাই বলে তার বড় ভাই তাকে শাসন করতে পারবে না। মুনতাসিম যা করেছে একদম সঠিক কাজ করেছে। এবার যদি মাশরাফি একটু ভালো হয়। রুপালি চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে রিয়াদ চৌধুরীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। রিয়াদ চৌধুরী রুপালি চৌধুরীর দৃষ্টি উপেক্ষা করে মাশরাফিকে নিজের কক্ষে নিয়ে চলে গেল।

প্রাপ্তি নিজের কক্ষের দিকে যাচ্ছিল। তখনই মুনতাসিম প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–প্রাপ্তি কেমন আছ? মুনতাসিমকে নিজ থেকে কথা বলতে দেখে, প্রাপ্তি বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে আছে! বিয়ে হয়ে আসা বয়সে কখনো মুনতাসিমকে আগে কথা বলতে দেখেনি সে। মুনতাসিমের সাথে তার দু’বার কথা হয়েছে। সেটাও প্রাপ্তি নিজে যেচে বলেছে। আজ হঠাৎ করে কি মনে করে মুনতাসিম তার সাথে কথা বলছে। প্রাপ্তি কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলল,

–আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

–আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো আছি। দিনকাল কেমন যায়? ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছ তো। শরীরে কিন্তু প্রচুর শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সামনে অনেক কিছু হবার বাকি। সামনে যে ধাক্কা গুলো আসবে। সেগুলো কিন্তু অল্প শক্তিতে খেয়ে সামাল দিতে পারবে না। তাই বেশি বেশি শক্তি সঞ্চয় কর। আর ধাক্কা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকো।

–এসব কি বলছেন ভাইয়া?

–সে কিছু না তোমার সাথে মজ করলাম। বলা তো যায় না। কখন কার মুখোশ সামনে চলে আসে। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম নিজের কক্ষে চলে গেল। প্রাপ্তি অদ্ভুত দৃষ্টিতে মুনতাসিমের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে শুনেছে মুনতাসিম অনেক বুদ্ধিমান আর প্রচন্ড চালাক। সে কারণ ছাড়া কোনো কথা বলে না৷ তবে কি মুনতাসিম সবকিছু জেনে গেল। ভয়ে কাবু হয়ে আসছে প্রাপ্তির সমস্ত শরীর। সে হন্তদন্ত হয়ে নিজের কক্ষের দিকে চলে গেল।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-২+৩

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সময় স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে যায়। রজনীর আঁধার কেটে গিয়ে সূর্যের রশ্মি ধরনীর বুকে আচঁড়ে পড়েছে। দেখতে দেখতে দু’টি বছর কেটে গিয়েছে। বাবা-মাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত যে মেয়েটা থাকতে পারতো না। আজ সেই মেয়েটা বাবা-মা, পরিবার, আত্নীয়-স্বজন সবকিছু ছেড়ে দূর চলে এসেছে। কতগুলো প্রহর বাবা-মাকে ছাড়া কাটিয়ে দিয়েছে। সেদিনের পরে বাবা-মায়ের সামনে যাওয়ার আর সাহস হয়ে উঠেনি। মাঝেমধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। বাসার সব থেকে আদরের মেয়েটা আজ আদরহীনতায় ভুগছে। মেহেভীন এক কাপ কফি নিয়ে খোলা জানালার দিকে গেল। জানালার কাছে আসতেই প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রুপ সে দেখতে পেল। এই মন খারাপের সঙ্গী হলো প্রকৃতি। তার সুন্দর্য দিয়ে মেহেভীনের মন ভালো করে দেয়। মেহেভীনের গভীর আঁখিযুগল #খোলা_জানালার_দক্ষিণের বাসাটার দিকে স্থীর হয়ে আছে। দীর্ঘ দুই বছর ধরে দক্ষিণের বাসাটা বন্ধ পড়ে আছে। সে এই বাসাটাই নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি। এই বাসাটা নাকি কোনো এক স্পেশাল মানুষের জন্য সে ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। মেহেভীন ভিষণ অবাক হয়েছিল বটে! কে সেই মানুষ যার জন্য তার এই বাসায় ঠাঁই হলো না। মানুষটার মুখশ্রী দেখার জন্য মেহেভীনের ভিষণ আগ্রহ। কবে যে মেহেভীনের অপেক্ষার অবসান ঘটবে। সব চিন্তা ভাবনা ফেলে রেখে মেহেভীন প্রাপ্তিকে ফোন দিল,

–আসসালামু আলাইকুম ম্যাজিস্ট্রেট ম্যাডাম। কেমন আছেন? অবশেষে এই অধমকে মনে হলো আপনার? ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আমাদের একদম ভুলেই গিয়েছেন। তা আজ কতদিন পরে ফোন দিলেন। সে খবর কি রাখেন। মেহেভীন সালামের উত্তর নিয়ে, মলিন কণ্ঠে বলল,

–আব্বু আম্মু কেমন আছে আপু? তাদের কি আমার কথা একবারও মনে পড়ে না। আমায় কি একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না। তারা সত্যিই কি কখনো আমার মুখ দেখবে না। আমার তাদের জন্য ভীষণ মন পুড়ে আপু। তাদের কণ্ঠ স্বর শোনার জন্য আমি মরিয়া হয়ে আছি। তাদের ভালোবাসা পাবার জন্য আমি কাঙাল হয়ে গিয়েছি। আমি সবকিছু ছেড়ে তাদের কাছে চলে যাব আপু। তাদের বলো আমি আর চাকরি করব না। তারা যা বলবে যেখানে বলবে। আমি সেখানেই বিয়ে করব আপু। আমাকে শুধু তাদের বুকে আগলে নিতে বলো।

–এই মেহেভীন কি বলছিস এসব? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে! তুই চাকরি ছেড়ে দিবি মানেটা কি? তুই চাকরি ছেড়ে দিলে চাচাকে কে দেখবে? আমাকে প্রতি মাসে টাকা দিবে কে? তুই না অনেক শক্ত মনের অধিকারীনি হয়ে গিয়েছিলি। তবে আজ হঠাৎ এমন পাগলামি কেন করছিস? তুই জানিস না চাচা অনেক অসুস্থ। চাচা আগের মতো কাজ করতে পারে না। তুই টাকা না দিলে চাচার অনেক কষ্ট হবে। মেয়ে হয়ে বাবার কষ্ট দেখবি।

–টাকা দিয়ে সবকিছু কেনা গেলে-ও কখনো সুখ, শান্তি, ভালোবাসা, আদর কেনা যায় না আপু। আমি টাকা দিয়ে সবকিছু কিনতে পারছি। কিন্তু বাবা-মায়ের ভালোবাসা, আদর কিনতে পারছি না। আমি বাবা-মায়ের কাছে যেতে চাই আপু। এভাবে আর পালিয়ে থাকতে পারব না। আমার যা হয় হবে। আমি বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবোই। আমি তো কোনো ভুল করিনি। তাহলে আমি কেনো এভাবে লুকিয়ে থাকব। আমি একটা কাপুরুষকে বিয়ে করতে পারিনি ঠিকি৷ কিন্তু আমি একটা ক্ষতি করে আরেকটা সফলতা অর্জন ঠিকি করেছি। আমি আমার সফলতা দিয়ে সবার মন জয় করে নিব।

–শোন মেহেভীন তুই এখন বাসায় আসিস না। আমি আগে চাচা চাঁচির মন নরম করে নেই। তারপরে তোকে বাসায় আসতে বলব। তোকে দেখে চাচা চাঁচি যদি অসুস্থ হয়ে যায়। তখন তুই কি করবি? নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি তো মেহেভীন।

–আমার ভাগ্যে যা আছে। আমি মেনে নিয়েছি আপু৷ আমি যাব না আব্বু আম্মুর কাছে তুমি বলার পরেই যাব। কথা গুলো বলেই মেহেভীন নিরাশ হয়ে ফোন রেখে দিল। মানুষ একটা জায়গায় এসে ভিষণ অসহায় হয়ে পড়ে। আর সেই জায়গাটা হচ্ছে ভালোবাসা মানুষ পৃথিবীর সব জায়গায় পাথর হাতে পারলেও, ভালোবাসার জায়গায় এসে হেরে যায়। ভালোবাসা পেলে হয়ে যায় অবুঝ বাচ্চা। মেহেভীন ও তার ব্যতিক্রম নয়।

চারিদিকে বৃষ্টি পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস বইছে। মেহেভীন খোলা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বৃষ্টির পানির ফোঁটা এসে মেহেভীনকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। মেহেভীন আঁখিযুগল বন্ধ করে আছে। তখনই এক জোড়া চোখ মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। আঁখিযুগল যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে। স্থীর নয়নে মেহেভীনকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। মেহেভীন আচমকা চোখ মেলতেই দু’জনের চোখাচোখি হয়ে যায়। মেহেভীন একজন সুদর্শন যুবককে দেখে বিস্ময় হয়ে পড়ে। দু’টো বছর পরে অবশেষে খোলা জানালার দক্ষিণের বাসাটায় কেউ আসলো। মুহুর্তের মধ্যে মেহেভীন আঁখিযুগল নামিয়ে নিল। দ্রুত হাতে জানালা লাগিয়ে দিল। তখনই কাজের মেয়েটা মেহেভীনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–আফা আপনি আপনার বোনের কথা শুনবেন না। আমার কেনো জানি আপনার বোনকে পছন্দ হয় না। মহিষের শিং যেমন মহিষের কাছে ভারি হয় না। ঠিক তেমনই বাবা-মায়ের কাছে সন্তান কোনোদিন বোঝা হয় না। আপনি সামনে গেলে আপনার বাবা-মায়ের সব রাগ পানি হয়ে যাবে। মেহেভীনের মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করল৷ সে রাগারাগি হয়ে বলল,

–রুপা তোমাকে কতবার বলেছি। আমার বোনের নামে বাজে কথা বলবে না। আমি যে এতদূর এসেছি। সেটা কার জন্য এসেছি। অবশ্যই প্রাপ্তি আপুর জন্য এসেছি। রুপা আর কিছু বলল না। মুখটা কালো করে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।

দীর্ঘদিন পরে নিজের চিরচেনা কক্ষে এসে শান্তির নিঃশ্বাস গ্রহণ করছে মুনতাসিম ফুয়াদ। মুখশ্রীতে তার একরাশ মুগ্ধতা। সে আরিয়ানকে দেখে শান্ত কণ্ঠে বলল,

–খোঁজ নাও মেয়েটা কে? কালকের মধ্যে আমার সবকিছুর খবর চাই।

–আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। কালকের মধ্যে সব খবর আপনার সামনে চলে আসবে।

–তোমরা আমার সাথে থাকবে না। সব সময় আড়ালে থাকবে।

–স্যার এটা কিভাবে সম্ভব?

–আমি বলেছি মানে সবকিছু সম্ভব। মুনতাসিমের কথায় আরিয়ান দমে গেল। কোনো কথা না বলে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মুনতাসিম ফ্রেশ হয়ে এসে হাতে একটা বাটি নিয়ে মেহেভীনের বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল। দরজায় কলিং বেল বেজে উঠতেই রুপা এসে দরজা খুলে দিল। রুপাকে দেখে কিছুটা নারাজ হলো মুনতাসিম। সে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বাসার মধ্যে প্রবেশ করল। রুপা রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আপনার মাথায় কি কোনো সমস্যা আছে। ভেতরে ভদ্রতা বলতে কিছু নেই। একটা মানুষের বাসায় হুট করে ঢুকে পড়লেন।

–আমি আপনার কাছে আসি নাই। তাই আপনার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। আপনি আপনার বাসার মালকিনকে ডাকুন। তার সাথে আমার কথা আছে।

–যা বলার আমাকে বলুন। আপাকে বলা মানে আমাকে বলা। আমি আর আপা দুই দেহ এক আত্মা।

–আমি তোমার আপাকে চুমু খেতে এসেছি। গালটা এগিয়ে দাও। তোমাকে চুমু খেয়ে চলে যাই। তুমি তোমার আপাকে বলে দিও। একজন এসেছিল আপনাকে চুমু খেয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের কথায় রুপা আঁখিযুগল গোল গোল করে তাকালো। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–অসভ্য লোক আপনি জানেন আপনি কার বাসায় এসেছেন। আমি চাইলে আপনার কি অবস্থা করতে পারি। সে সম্পর্কে আপনার কোনো ধারনা নেই। চিৎকার চেচামেচি শুনে মেহেভীন কক্ষ থেকে বের হয়ে আসলো। মেহেভীনকে দেখে মুনতাসিম সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। মুনতাসিমের গিরগিটির মতো রঙ বদলে যেতে দেখে, রুপা বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেভীন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–কিছু বলবেন ভাইয়া? মেহেভীনের মুখে ভাইয়া ডাকটা পছন্দ হলো না মুনতাসিমের। সে মুখশ্রী গম্ভীর করে ফেলল। কিন্তুটা থমথমে মুখে বলল,

–আপনার পাশের বাসায় আজকেই আমি এসেছি। সবকিছু নিয়ে এসেছি৷ বাসায় এসে দেখি লবন নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছি। যদি আমাকে একটু লবন দিতেন। তাহলে আমার উপকার হতো। আমি কালকে সকালেই আবার দিয়ে যাব। তখনই রুপা হুংকার ছেড়ে বলল,

–মিথ্যা কথা আপা সে আপনাকে চুমু খেতে এসেছে। আমার অনুমতি না নিয়ে বাসার মধ্যে চলে আসছে। রুপার মিথ্যা কথা বলার স্বভাব আছে। সেটা মেহেভীন জানে, সেজন্য মেহেভীন রক্তিম চোখে রুপার দিকে তাকালো। রুপা থামলো না বলতেই থাকলো,

–শুধু তাই না আপা সে আমাকে বলেছে। গাল এগিয়ে দাও। আমি চুমু খেয়ে চলে যাই।

–রুপা আর একটা বাজে কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

–আপনি আপনার কাজের মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। কখন কোথায় কি বলতে সেটা জানে না। আমি বোধহয় ভুল জায়গায় ভুল করে চলে এসেছি। মেহেভীন ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,

–বাচ্চা মেয়ে বুঝতে পারেনি। আপনি আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে লবন দিচ্ছি। মুনতাসিম রুপার দিকে তাকিয়ে বলল,

–আপনি না তখন বললেন। আপনারা দুই দেহ এক আত্মা। তাহলে আপনার ব্যবহার এত বাজে কেন? আপনার আপার থেকে কিছু শিখতে পারেন না। কথা গুলো বলেই মেহেভীনের সাথে রান্না ঘরে চলে গেল। রুপা মনতাসিমের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল। মানুষটাকে তার একদম পছন্দ হয়নি। মুনতাসিম ও যেন রুপাকে পছন্দ করেনি।

বহুদিন পরে প্রাপ্তি আসলো মেহেভীনদের বাসায়। প্রাপ্তিকে দেখেই রাইমা বেগম আর ফরিদ রহমান এগিয়ে আসলেন। রাইমা বেগম অসহায় কণ্ঠে বলল,

–কি রে মেহেভীনের কোনো খোঁজ পেয়েছিস? কতদিন হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখি না। মাঝেমধ্যে মেয়েটার কথা ভাবলে দম বন্ধ হয়ে আসে। যে মেয়েটা একটা রাত আমাকে ছাড়া ঘুমোতে পারতো না। সেই মেয়েটা আজ কতগুলো দিন ধরে আমাকে রেখে দূরে আছে। তোর সাথে মেহেভীনের কথা হলে মেহেভীনকে বলে দিস। মেহেভীনকে আমরা মাফ করে দিয়েছি। সে যেন বাড়ি ফরি আসে। আমরা আমাদের মেয়েকে চাই। আমাদের আর কিছু চাই না। ফরিদ রহমান প্রাপ্তির হাত ধরে বলল,

–তোর সাথে মেহেভীনের গভীর সম্পর্ক। আমি জানি তোর আর মেহেভীনের যোগাযোগ আছে। মেহেভীন আমাদের সাথে কথা না বললেও তোর সাথে বলবেই। তুই মেহেভীনকে বাসায় চলে আসতে বল। কতদিন মেয়েটাকে দেখি না। না জানি কোথায় আছে মেয়েটা আমার। কি খায় কেমন আছে এসব কিছুই জানি না। প্রাপ্তি মলিন গলায় বলল,

–আমার মেহেভীনের সাথে কথা হয়েছে চাচা৷ মেহেভীনের সাথে কথা শেষ করেই তোমাদের বাসায় ছুটে এসেছি। আমাদের মেহেভীন অনেক ভালো আছে। সে তোমাদের মুখ দেখতে চায় না। আমাকে কি বলেছে জানো। বলেছে যে বাবা-মা তাদের সুখের জন্য আমাকে একটা কাপুরুষের হাতে তুলে দিতে পারে। সেই বাবা-মা তাদের স্বার্থের জন্য আমাকে খু’ন ও করতে পারবে। আমি আর তাদের কাছে ফিরে যাব না। আমি আমার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে সুখী আছি। তোমার চাচা চাঁচিকে বলে দিও। তারা যেন আমাকে বৃথা খোঁজার চেষ্টা না করে। রাইমা বেগম উত্তেজিত হয়ে বললেন,

–মেহেভীন তো চাকরি করার জন্য পালিয়েছিল। সে বিয়ে কবে করল? সে যদি বিয়ে করেই থাকে। তাহলে তাকে বল ফিরে আসতে। আমরা ওর সবকিছু মেনে নিব। শুধু আমার মেয়েকে আমার বুকে দেখতে চাই মা৷

–চাঁচি তুমি তোমার মেয়েকে চাইলেই তো হবে না। তোমার মেয়েকেও তোমাদের চাইতে হবে। তোমার মেয়ে তোমাদের মুখ দেখতে চায় না। এসব কথা বলে আমাকে ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েছে। অন্য নাম্বার দিয়ে কল দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে সীম অফ করে রেখে দিয়েছে। এখন তুমি বলো আমি কি করব? মুনিয়া বেগমের শ্বাসকষ্ট আছে। মেয়ে তার মুখ দেখতে চায় না কথাটা কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছাতেই সমস্ত শরীর অস্থির হয়ে পড়ছে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে রাইমা বেগম মাটিতে বসে পড়লেন।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

বৃষ্টি হয়ে চারিদিকে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। গাছের মরা ডালপালা গুলো রাস্তায় পড়ে আছে। মেহেভীন নামাজ শেষ করে প্রতিদিন হাঁটতে বের হয়। আজকেও হাঁটতে বের হয়েছে। আজকের সকালটা একটু অন্য রকম কেমন স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। মনটা কাল থেকে ভিষণ খারাপ। কেন জানি ভেতর থেকে শান্তি পাচ্ছে না সে। তখনই পেছনে থেকে কারো কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছল,

–এত সকাল বেলা কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম? মেহেভীন তাকিয়ে দেখলো কালকের ছেলেটা। সে ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,

–হাঁটতে বের হয়েছি।

–আমি কি আপনার যোগদান করতে পারি?

–না।

–কেনো?

–আশ্চর্য! আমি আপনাকে চিনিনা জানি না। আমি কেনো আপনার সাথে হাঁটতে যাব। আপনার কি নিজের পা নেই। একা একা চলতে পারেন না৷ যে অন্যের সাথে আপনাকে হাঁটতে যেতে হবে। এমন গায়ে পড়া মানুষ আমার একদম পছন্দ না। আমার আশেপাশে যেন আপনাকে না দেখি। কথা গুলো বলেই মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মুনতাসিম মেহেভীনের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

মেহেভীন বাসায় এসে দম নিয়ে বিছানায় বসল। কণ্ঠস্বর কুসুমের ন্যায় কোমল করে রুপাকে ডাকলো। রুপা এসে মেহেভীনের পাশে বসল। রুপা ভালো মতোই জানে মেহেভীন এখন তাকে কি করতে বলবে। তবুও রুপা প্রশ্ন করল,

–কিছু বলবেন আপা?

–তোকে এখন মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। কালকে মনটা খারাপ থাকায় কল দেওয়া হয়নি।

–দিয়ে কি বলব আপা। আপনি আমাকে সবকিছু শিখিয়ে দেন। না হলে ভুলভাল কিছু বলে ফেলবো।

–আজকে বেশি কিছু বলতে হবে না। মায়ের ভালো মন্দ খবর নিবি। কথা গুলো বলেই রাইমা বেগমের নাম্বারে ফোন দিল। একবার ফোন বেজে কেটে গেল। দ্বিতীয় বার ফোন দিতেই ফোনটা রিসিভ হলো। একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর কথা বলে উঠলো। মানুষটার কথা কর্ণকুহরে আসতেই বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো মেহেভীনের। বিষাদে ছেয়ে গেল মনটা চেয়েও মাথা উঁচু করে বলতে পারছে না। আব্বু আমি তোমাদের হতভাগা মেয়ে মেহেভীন। কথা বলার সাহস হয়ে উঠলো না। সে রুপাকে বলতে শিখিয়ে দিল। রুপা সালাম দিয়ে বলল,

–বাবা কেমন আছেন? মা কোথায় মায়ের ফোন আপনি তুললেন যে!

–এই মেয়ে তোমাকে কতবার নিষেধ করেছি। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনীর ফোনে ফোন দিবে না। তোমার উদ্দেশ্য কি বলো তো? এই নিষ্ঠুর ধরণীর বুকে নিজের স্বার্থ ছাড়া কেউ এক কদম হাঁটে না। সেখানে তুমি একটা অপরিচিত মেয়ে হয়ে আমার অর্ধাঙ্গিনীর জন্য এত দরদ দেখাও। এটা আমি মোটেও ভালো নজরে নেই না। আমার অর্ধাঙ্গিনী নির্ঘাত ভালো মানুষ ধরনীর মার প্যাচ বুঝে না। সরল মনে তোমাকে বিশ্বাস করে কথা বলে। আজকের পর থেকে তাকে ফোন দিলে আমি অন্য ব্যবস্থা নিব।

–আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমার মনে কোনো পাপ নেই। আমার আল্লাহ জানে আমি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে মায়ের সাথে কথা বলি না। আমি মায়ের আদর, ভালোবাসা পাবার জন্য মায়ের সাথে কথা বলি। আজ যদি আমার নিজের মা থাকতো। তাহলে কি আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনীর কাছে ফোন দিতাম বলেন। আমাকে একটা বার মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দেন। আমি আর বিরক্ত করব না।

–তাকে দেওয়া যাবে না। কাল থেকে সে ভিষণ অসুস্থ। শুনেছ এবার রাখো আর কখনো ফোন দিবে না। কথা গুলো বলেই কল কেটে দিল। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে মেহেভীনের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। যন্ত্রনায় কেমন ছটফট করতে লাগলো। মেহেভীনের মন খারাপ দেখে রুপারও মন খারাপ হয়ে গেল। সে মলিন কণ্ঠে বলল,

–দেখেছেন আপা আমি আপনাকে বলে ছিলাম না। আপনার চাচাতো বোন ভালো না। সে আপনার ভালো চায় না। আপনার মা অসুস্থ সে খবর আপনাকে জানায়নি কেন? রুপার কথায় মেহেভীন রুপার থেকে ফোনটা নিয়ে নিল। প্রাপ্তির নাম্বার বের করে ফোন দিল।

–হ্যাঁ মেহেভীন বল এত সকালে কি মনে করে ফোন দিলি?

–আপু আম্মু কেমন আছে?

–চাঁচি তো ভালোই আছে। সকালেও চাঁচির সাথে কথা হয়েছে।

–একটু আম্মুর কাছে নিয়ে গিয়ে ফোনটা দিবে।

–চাঁচি তোর সাথে কথা বলতে চায় না। তোর মুখ ও দেখতে চায় না।

–সে কথা আমি আম্মুর মুখে শুনতে চাই।

–তোর নাম শুনলেই চাঁচি রেগে যাবে।

–বেশ ভালো তো তুমি তাহলে ফোনটা লাইনে রাখো। আমি কলে আছি সে কথা আম্মুকে বলবে না। তুমি আম্মুর কাছে গিয়ে আমার কথা তুলো। আমি দেখতে চাই আম্মু কি বলে। মেহেভীনের কথায় প্রাপ্তি অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়ে। মাথা কাজ করছে না। বুদ্ধিরা জোট বেঁধে পালিয়েছে। এখন সে মেহেভীনকে কি জবাব দিবে। প্রাপ্তির নিরবতা মেহেভীনকে ভাবাচ্ছে গভীর ভাবে ভাবাচ্ছে। প্রাপ্তি কি তার থেকে কিছু আড়াল করছে। নিজের ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে তবে কি সে পরিবারের থেকে দূরে সরে এসেছে। নিজের সাফল্য অর্জনের আশায় সে এতটাই ব্যস্ত পরিবারের দিকে তাকানোর সময় হয়নি। তার সুযোগই কি প্রাপ্তি নিতে চাইছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই প্রাপ্তি বলে উঠলো,

–আমি একটা জব পেয়েছি। তোকে জানানো হয়নি। আমি তো অফিসে আছি৷ এখন কিভাবে চাঁচির সাথে কথা বলতে যাব।

–তুমি আবার কবে চাকরি পেলে? সারাদিনই বাসায় বসে থাকো। এরমধ্যেই তোমার চাকরি হয়ে গেল!

–তুই আমাকে এভাবে পুলিশের মতো জেরা করছিস কেন? আমাকে তোর চোর মনে হয়। নিজের বোনকে বিশ্বাস করিস না।

–আম্মু যে অসুস্থ আমায় জানাওনি কেন? মিথ্যা কথা বললে কেন আমায়? তুমি আবার বিশ্বাসের কথা বলছ! এদিকে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত আমি। সেজন্য আমি নিজের পরিবারের দিকে তাকাইনি৷ আর তুমি সেই সুযোগটা নিলে আপু।

–মেহেভীন তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি তোকে জানাইনি তার একটা কারন আছে। চাঁচির শ্বাসকষ্ট আছে। সেটা তুই ভালো মতোই জানিস। চাঁচির অসুস্থতার কথা শুনলে তুই চিন্তা করবি। তাই তোকে জানাইনি। তেমন গুরুতর কিছু না। গুরুতর কিছু হলে সবার আগে আমি তোকেই জানাতাম।

–আচ্ছা আমি তোমাকে প্রতি মাসে টাকা পাঠাই। সে টাকা গুলো তুমি কি বলে আব্বু আম্মুর হাতে তুলে দাও।

–তুই তো বলেছিস। এই টাকা গুলো তুই দিস। এ কথা চাচা চাঁচি যেন না জানে। সেজন্য চাচা চাঁচিকে বলি আমি জব করে তাদের টাকা দেই।

–তারা তোমাকে কোনো প্রশ্ন করে না। এত গুলো টাকা তুমি কেন ওদের দাও। তোমার বাবা-মা কিছু বলে না। তোমাদের ও সংসার আছে।

–তোর যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয়। তাহলে তুই এখানে এসে দেখে যা।

–সেটা তুমি বললেও যাব আর না বললেও যাব। আমি তোমাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করি আপু। এমন কোনো কাজ করো না। যাতে তোমার প্রতি আমার সব ভালোবাসা ঘৃণায় রুপ নেয়৷

–চাঁচি অসুস্থ এখন তোর না আসাই ভালো। মেহেভীন নিঃশব্দে কল কেটে দেয়। মেহেভীনের মধ্যে সন্দেহের দানা বাঁধে। কাউকে বিশ্বাস করা ভালো। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস একদমই ভালো না৷ এই কথা গুলো এতদিন মাথায় আসেনি কেন আমার। সারাদিন বাহিরের শত্রু খুঁজতে গিয়ে, ঘরের শত্রু চিনতেই ভুল করলাম আমি। মেহেভীনের মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। কোনো বুদ্ধিই তার মস্তিষ্কে এসে ধরা দিচ্ছে না। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে।

অন্ধকার রুমের মধ্যে বসে আছে প্রাপ্তি। তার সামনে বসা আগন্তুক। প্রাপ্তির মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। আগন্তুক প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–মেহেভীনের মনে তুমি নিজেই সন্দেহের বীজ রোপণ করে দিয়েছ। তাই চাইলেও মেহেভীনের মনে আগের স্থান নিতে পারবে না। কি দরকার ছিল মিথ্যা কথা বলার। তুমি কি জানতে না মেহেভীন তার কাজের মেয়েটার মাধ্যমে রোজ তার বাবা-মায়ের খবর নেয়।

–সে কথা কি আপনি আমাকে বলেছিলেন। আমি তো জানতাম না। মেহেভীন তার বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নেয়। আমি ভেবেছিলাম বোকা মেয়েটা জীবনে কিছু করতে পারবে না। কে জানতো জীবনের সফলতার শীর্ষে পৌঁছে যাবে। আমি মনে করেছিলাম। বাসার বাহিরে হলে কিছু নরপশু মেহেভীনকে শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে খাবে। ধরনীর বুক থেকে মুছে যাবে মেহেভীন নামক রমনীর ছোট্ট দেহটা। আমার সবকিছু যে ব্যর্থ হয়ে গেল। এখন আমি কি করব? সব দোষ আপনার আপনি যদি আমাকে একটু সর্তক করে দিতেন। তাহলে আজে এতবড় ধরা খেতাম। মেহেভীন এবার কাজের পাশাপাশি পরিবারের দিকে নজর রাখবে। আগে আমায় ভরসা করত। তাই পরিবারের দিকে সেভাবে নজর দিত না। আজ মিথ্যা বলার কারনে আমাকে আর বিশ্বাস করবে না। মেয়েটা ভিষণ চালাক আর ধুরন্ধর হয়ে গিয়েছে।

–মেহেভীন কিছু করার আগেই ফরিদ রহমানের দেহটা ছয় টু’ক’রো হয়ে যাবে। সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি মেহেভীনের বাবা-মায়ের কানে বি’ষ দিতে থাকো। তারা যেন মেহেভীনকে ঘৃণা করতে থাকে।

–ওর বাবা-মা এতটা মেয়ে ভক্ত মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে কথা জেনেও তাদের মেয়েকে চাই।

–তাহলে আমি যেই ঔষধ টা দিয়েছি। সেটার ডোজ বাড়িয়ে দাও। মেহেভীন চাইলেও কিছু করতে পারবে না।

–আমি দেশে আসছি সেটা তোমার বাবা জানে?

–না আমি ছাড়া কেউ জানে না।

–বেশ ভালো কাউকে বলার দরকার নেই। তুমি এখানে থেকে চলে যাও। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। প্রাপ্তি কোনো কথা না বলে আস্তে করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

মেহেভীন সকালে কাজের উদ্দেশ্য বের হয়ে গিয়েছে। কখন বাসায় ফিরে ঠিক নেই। সবকিছু কাজের ওপর নির্ভর করে। রুপা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে। এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। রুপা গিয়ে দরজা খুলে দেখতে পায় কয়েকজন কালো পোশাক পড়া লোক দাঁড়িয়ে আছে। রুপা কিছু বলার আগেই তারা রুপাকে সেন্সলেস করে ফেলে। তারা রুপাকে নিয়ে চলে যায়। রুপাকে নিয়ে চলে যাবার এক ঘন্টা মেহেভীন আসে। দরজা খোলা দেখে মেহেভীন অস্থির হয়ে বাসার মধ্যে আসে। একটা জমির দলিল সাইন কারনো নিয়ে একজন লোকের সাথে মেহেভীনের ভিষণ ঝামেলা চলছে। দু’বার বাসায় এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছে। সমস্ত বাসা খুঁজেও রুপাকে দেখতে না পেয়ে মেহেভীনের ললাটে চিন্তার ভাজ পড়ল। সে চিন্তিত হয়ে দরজার কাছে আসলো। দরজার কাছে এসে মুনতাসিমকে দেখতে পেল। মুহুর্তের মধ্যে মেহেভীনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মেহেভীন কিছু বলার আগেই মুনতাসিম বলল,

–কিছু খুঁজছেন ম্যাডাম। মুনতাসিমের নম্র ব্যবহারে শান্ত হলো মেহেভীন। বিরক্ততে তার মুখশ্রী কুঁচকে এলো। সে বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে জবাব দিল,

–আমার কাজের মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছি না।

–আমি তাকে ছাঁদে ঘুমোতে দেখেছি। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন নিজের ললাটে দু’টো চাপড় মারল। এই মেয়েটাকে নিয়ে সে অসহ্য হয়ে গিয়েছে। একদম ছন্নছাড়া যেখানে যায় গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে। ছাঁদে কাপড় তুলতে গিয়ে নিশ্চয়ই কারো সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছিল। সেখানেই ঘুমিয়েছে। রুপার স্বভাব সম্পর্কে সবাই অবগত।

–আপনার বাসায় একটু হলুদের গুঁড়ো হবে? আসলে আমি রান্না করতে গিয়ে ময়লা ভেবে ফেলে দিয়েছি। কিনে নিয়ে আসলে দিয়ে যাব।

–আপনি রান্না করতে পারেন না। তাহলে রান্না করতে যান কেন? এতবড় ছেলে হয়ে হলুদ গুঁড়ো কোনটা চিনেন না। নাকি আমার সাথে আপনি ফ্লাট করছেন?

–এসব আপনি কি বলছেন ম্যাডাম। আপনি কত বড় মাপের মানুষ। আপনার সাথে ফ্লাট করার মতো দুঃসাহস আমার আছে। মেহেভীন কিছু বলে না হলুদের গুঁড়ো দিয়ে ছাঁদে চলে যায় রুপাকে আনতে। মুনতাসিম মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে বলল, এই মেয়েটা আমাকে একদম শেষ করে ফেলবে।

চলবে…..

খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-০১

0

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

“আমি এই খ্যাত মেয়েকে বিয়ে করবো না আব্বা। আগে যদি জানতাম আপনারা এই গাইয়া মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করছেন। তাহলে কোনোদিন এই বিয়েতে রাজি হতাম না। আমি তো ভেবে ছিলাম। মেহভীনের চাচাতো বোন প্রাপ্তির সাথে, আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। প্রাপ্তিকে কল্পনা করেই এই বিয়ে বাড়িতে আসছি। বিয়ে করলে আমি প্রাপ্তিকেই করবো।” আয়মানের কথায় পুরো বিয়ে বাড়ি স্তব্ধ হয়ে গেল। কোলাহলে পরিপূর্ণ পরিবেশটা মুহুর্তের মধ্যে শীতল হয়ে উঠলো। সবাই আয়মানের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে রেখেছে। বধু সাজে মেহেভীন আঁখি জোড়া ছোট করে আয়মানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। শেষ মুহুর্তে এসে মানুষটা কি বলছে! মেহভীনের ভাবনার মাঝেই আয়মানের বাবা আমান চৌধুরী বজ্রকণ্ঠে বললেন,

” তোর সাহসের তারিফ করতে হয়! তুই বিয়ে করতে এসেছিস। কাকে বিয়ে করতে এসেছিস? সেটা তুই জানিস না! আমাদের সাথে মজা করছিস। আমার কথার ওপরে কথা বললে, তোর দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দিব। প্রাপ্তিকে নয় মেহেভীন কেই তোকে বিয়ে করতে হবে। আমার কথাই শেষ কথা। আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। ” বাবার কথা কর্ণকুহরে আসতেই জ্বলে উঠলো আয়মান। সে রাগান্বিত হয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আপনি আমাকে চিনেন না আব্বা। আপনার ছেলে একবার যেটা চায়। সেটা না পেলে সবকিছু ধংস করে দেয়। আমি প্রাপ্তিকে ভালোবাসি প্রাপ্তি ও আমাকে ভালোবাসে। আপনারা সবাই মিলে আমাদের পথের কাটা হলেন কেনো? প্রাপ্তিকে রেখে মেহেভীন কে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ” আয়মানের কথা শেষ হবার সাথে সাথে প্রাপ্তি এসে ক’ষে আয়ামের গালে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। আকষ্মিক ঘটনায় সবার চক্ষু চরগাছে। আয়মান মুগ্ধ নয়নে প্রাপ্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মেয়েটা এতটা সুন্দর যে তাকে দেখলেই আয়মানের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। অনুভূতিরা আনন্দে মেরে উঠে। পুরো শরীর শীতল হয়ে আসে। আয়মান গালে হাত দিয়ে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে প্রাপ্তিকে দু’নয়ন ভরে দেখছে। আয়মানের মুগ্ধতার মাঝে প্রাপ্তি ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলল,

“আপনার সাহস হয় কি করে? আপনি আমার নামে মিথ্যা কথা বলছেন! আমি কবে বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি? আপনি আমার ছোট বোনের হবু স্বামী। সেখানে আপনাকে ভালোবাসা তো দূর আপনাকে নিয়ে কল্পনা করা-ও পাপ। আমি জেনেশুনে কেনো পাপ কাজ করতে যাব! ” প্রাপ্তি অসম্ভব ভাবে রেগে গিয়েছে। মেয়েটা সত্যি কথা বলতে ভালোবাসে মিথ্যার সাথে কোনোদিন আপস করেনি। আজকে ও মিথ্যার সাথে আপস করবে না বলে, প্রতিবাদ করতে শুরু করে দিল। আয়মান প্রাপ্তির দিকে দৃষ্টিপাত করেই বলল,

“তোমার আমাকে ভালোবাসতে হবে না প্রাপ্তি। আমি তোমাকে ভালোবাসবো তাহলেই হবে। আমি তোমাকে এতটা ভালোবাসা দিব যে, তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা ও করতে পারবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি মানে, আমাকে তোমার বিয়ে করতেই হবে। আমাকে বিয়ে না করলে তোমার পরিনতি কি ভয়াবহ হবে। তা তুমি কল্পনা ও করতে পারছো না। আমার সোজা কথায় রাজি হয়ে যাও। না হলে আমি বাঁকা পথে হাঁটতে বাধ্য হব। ” আয়মানের কথায় প্রাপ্তির মস্তিষ্ক ঘৃণার রি রি করে উঠলো। প্রাপ্তি আয়মানকে প্রহার করতে যাবে। তার আগেই আয়মানের বাবা আয়মানকে লোহার রোড দিয়ে মা’র’তে শুরু করল। আয়মান মা’র খেতে খেতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তবুও তার মুখে একটাই কথা আমি প্রাপ্তিকে বিয়ে করবো। প্রাপ্তি ছাড়া আমার শহরে অন্য কোনো নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। আয়মানের নাক দিয়ে গলগল করে র’ক্ত ঝাড়ছে। আমান চৌধুরী হুংকার ছেড়ে বলল,

“কু’লা’ঙ্গা’র আমি তোকে জন্ম দিয়েছি। এসব দিন দেখার জন্য! আমার মান-সন্মান বলতে কিছু রাখবি না। ফরিদ ভাইকে এখন আমি কি জবাব দিব? তোর জন্য এত গুলো মানুষের মুখের হাসি নিমিষেই বিষাদে পরিনত হবে। ” আমান চৌধুরীর কথায় আয়মান গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,

“আমি কাকে বিয়ে করতে চাই। সেটা তোমরা আমার থেকে জেনে নাওনি। এটা কি আমার দোষ অবশ্যই তোমাদের দোষ। তোমরা না জেনেশুনে কেনো মেহোভীনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলে? ” আয়মানের কথা শেষ হবার সাথে সাথে আমান চৌধুরী আয়ামের বুকের ওপর লা’থি দিয়ে বলল,

“তোমাকে বারবার করে বলেছি। আমরা তোর বিয়ে ফরিদ ভাইয়ের মেয়ের সাথে ঠিক করেছি। তোর মনে যদি প্রাপ্তিই ছিল। তাহলে তখন কেনো বলিসনি কু’লা’ঙ্গা’র?” আয়মানের সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। সে নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,

“আমি তো ভেবেছিলাম ফরিদ চাচার মেয়েই প্রাপ্তি। তাই খুশিতে কিছু বলি নাই। নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাবার মতো সুন্দর অনুভূতি দু’টো নেই। আমার অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছিল। তাই জানার সুযোগ পায়নি প্রাপ্তি আসলে কার মেয়ে। আজকে বিয়ের আসরে জানতে পারলাম প্রাপ্তি মেহভীনের বড় চাচার মেয়ে। এখানে আমার দোষ কোথায় আব্বা? আয়মানের কথায় ফরিদ রহমান এগিয়ে আসলেন। গম্ভীর মুখশ্রী করে বললেন,

” তুমি কাকে ভালোবাসো সে কার মেয়ে সেটা তুমি জানো না। আবার বলছো তোমার দোষ কোথায়? তুমি সবকিছু না জেনেশুনে কেনো বিয়ে করতে আসছো? তুমি কি ছোট বাচ্চা তোমাকে জোর করে বিয়ে করাতে নিয়ে আসছে। কাকে তুমি গ্রামের খ্যাত মেয়ে বলো! আমার মেয়ের পায়ের নখের যোগ্যতা-ও তোমার নেই। সেই ছেলের মুখে এমন কথা মানায় না। আমার মেয়ের যে সন্মান নষ্ট হলো তা আপনারা ফিরিয়ে দিতে পারবেন? যে ছেলের বাবার বিরুদ্ধে কথা বলে, এমন কা’পু’রু’ষে’র সাথে, আমিও আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই না। তবে রহিম ভাই যদি চায়। তাহলে তোমার মতো কু’লা’ঙ্গা’রের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন। ” ফরিদের কথা শেষ হবার সাথে সাথে রহিম রহমান ফরিদের দিকে এগিয়ে আসলেন। ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে ভাইকে রেগে যেতে নিষেধ করলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়া’লা উত্তম পরিকল্পনা কারী। তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন। হয়তো আয়মানের সাথে বিয়ে হলে, মেহভীন সুখী হতে পারতো না। তাই আল্লাহ তায়ালা নিজ দায়িত্বে বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছেন। রহিম রহমান একটু ধর্মীয় ধরনের মানুষ। তিনি সবকিছু ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দেন। তিনি বিশ্বাস করেন আল্লাহ যা কেঁড়ে নিয়েছেন। তার থেকে দিগুণ অতি শীঘ্রই ফিরিয়ে দিবেন। রহিম রহমানের ভাবনার মাঝেই প্রাপ্তি বলে উঠলো,

“যে ছেলের মাথায় সামান্য বুদ্ধিটুকু নেই। ঢাকা শহর থেকে পড়াশোনা করে এসে এত অহংকার দেখায়। সেই ছেলের হাতে আমাদের পরিবারের কোনো মেয়েকে তুলে দেওয়া হবে না। ” মেহেভীন পুতুলের ন্যায় বসে আছে। আজকে সত্যিই মেহেভীনকে পুতুলের মতো লাগছে। ফর্সা শরীর টায় মেরুন রঙের লেহেঙ্গা টা দারুণ মানিয়েছে। গা ভর্তি সোনার অলঙ্কার যা মেহেভীনের সুন্দর্য দিগুন বাড়িয়ে তুলেছে। মেহেভীন বাবা-মায়ের ওপরে একটা কথা বলতে পারে না। বলতে গেলে একটু বোকা ধরনের মেয়ে মেহেভীন। তবে আজকের পরে কি আদৌও বোকা থাকবে মেহেভীন। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই প্রাপ্তি এসে মেহেভীনের পাশে বসে মেহেভীনের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

“দেখ মেহেভীন তোর বিসিএস পরীক্ষার মেসেজ এসেছে। কালকে তোর পরীক্ষা তোর না অনেক স্বপ্ন ছিল। তুই একদিন ম্যাজিস্ট্রেট হবি। তোর স্বপ্ন পূরণের সময় এসে গিয়েছে। আমি জানি তুই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবি। তোর যথেষ্ট প্রস্তুতি নেওয়া আছে। এই ছেলেকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না। আমান চৌধুরী এত বোকা নয়। ঠিক কৌশলে ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ফেলবে। তুই এই বিয়ে করলে কোনোদিন সুখী হতে পারবি না৷ একজনকে মনে রেখে অন্য জনের সাথে সংসার করা যায় না রে। ” প্রাপ্তির কথায় মেহভীন অসহায় দৃষ্টিতে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। সে যদি বিয়ে রেখে পালিয়ে যায়। তাহলে তার পরিবারের সম্মানের কি হবে? সমাজ যে তার বাবাকে কটু কথা শোনাবে। পরিবারের অসন্মান যে সে সহ্য করতে পারবে না। আজকে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে মেহেভীনের। এক চোখে পরিবার অন্য চোখে নিজের এত বছরের স্বপ্ন। ভেতর থেকে ভিষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে মেহেভীন। আঁখি জোড়া ভিজে আসছে। পুতুলের ন্যায় চেহারায় মলিনতা এসে ধরা দিয়েছে। মেভীনের ভাবনার মাঝেই মেহেভীনের মা রাইমা বেগম বললেন,

“যে ছেলে ভরা লোকজনের সামনে আমার মেয়েকে ছোট করতে পারে। সেই ছেলে বিয়ের পরে আমার মেয়ের কি অবস্থা করবে। সেটা আমাদের ভালো করে জানা হয়ে গিয়েছে। আমার মেয়ে তো ফেলে দেওয়ার জিনিস নয়। যে যার তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যাব। আপনার ছেলে যাকে পছন্দ করে, তার সাথেই আপনার ছেলের বিয়ে দিন। ” রাইমা বেগমের কথা শুনে আমান চৌধুরী নরম কণ্ঠে বললেন,

“আমার মেহেভীনকে পছন্দ। আমার বাড়ির বউ হলে মেহেভীনই হবে। আয়মানকে বিয়ের জন্য রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আমিও দেখবো আয়মান কিভাবে মেহেভীনকে বিয়ে না করে। ” আমান চৌধুরীর কথায় জ্বলে উঠলো ফরিদ রহমান। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

“আপনার ছেলের সাথে জোর করে আমার মেয়ের বিয়ে দিবেন। আর বিয়ের পরে আপনার ছেলে আমার মেয়ের ওপরে অত্যাচার করবে। এটা আমাদের দেখতে হবে। সেটা যদি ভেবে থাকেন। তাহলে আপনার ধারনা ভুল। ” ফরিদ রহমানকে আশ্বস্ত করে আমান চৌধুরী বললেন,

“আপনার মেয়ের ভালো থাকার দায়িত্ব আমি নিলাম। বিয়ের পরে আমার ছেলে যদি আপনার মেয়ের শরীরে একটা ফুলের টোকা দেয়। তাহলে আপনি আমাকে যা শাস্তি দিবেন। আমি আপনার সব শাস্তি মাথা পেতে নিব। ” আমান চৌধুরীর কথায় পরিবেশে প্রাণ ফিরে এলো। আয়মান প্রাপ্তিকে ছাড়া কাউকে বিয়ের করতে চাইছে না। তবুও জোর করে বিয়ে ব্যবস্থা করা হলো। বিয়ের জন্য পাত্রীকে নিয়ে আসার জন্য বলা হলে, কক্ষে গিয়ে কেউ মেহেভীনকে পায় না। মেয়েটা তো বিয়ের আসরেই ছিল৷ তাহলে মুহুর্তের মধ্যে কোথায় গেল। মেহেভীনের কক্ষ ভালো করে দেখতে গিয়ে বিছানার ওপরে বিয়ের সব শাড়ি গহনা দেখতে পেল রাইমা বেগম। শাড়ির ওপরে একটা চিঠি রাইমা বেগম চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল,

“প্রথমেই আমি তোমাদের থেকে মাফ চেয়ে নিচ্ছি আব্বু আম্মু। তোমরা আমার সাথে এমন একটা ছেলের বিয়ে করেছো। যে আমাকে সন্মান দিতে জানে না। আমি জানি আমি ভিষণ বোকা। তবে এতটাও আত্মসম্মান হীন না যে আমাকে সন্মান করে না। তাকে আমার বিয়ে করতে হবে। জীবনে কখনো তোমাদের কথার বাহিরে যাই নাই। বলতে পারো পরিবারের মধ্যে আমি একমাত্র বাধ্য মেয়ে ছিলাম। তোমাদের বাধ্য মেয়েটা ও আজ ভিষণ অবাধ্য হয়ে গিয়েছে আম্মু। বাবার সামনে কথা গুলো বলার সাহস ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে চিঠি লিখলাম। চিঠটা যেই পাক না কেনো আশা করি সে আমার বাবা-মা পর্যন্ত চিঠিটা পৌঁছে দিবে। নিজেকে এতটা নিতে নামাতে পারলাম না। আমার পক্ষে এই বিয়েটা করা সম্ভব নয়। অনেক তো হলো অন্যের ইচ্ছে কে প্রাধান্য দেওয়া। এবার না হয় নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিলাম। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চলে গেলাম। কেউ আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করবে না। একটা কথা সব সময় মনে রাখবে। যে নিজের অজান্তেই হারিয়ে যায়। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু যে নিজ থেকে হারিয়ে যায়। তাকে কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। ” (ইতি মেহেভীন)

চিঠিটা পড়ে রাইমা বেগমের মুখশ্রীতে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো। সে খুব সাবধানে চিঠিটা লুকিয়ে ফেলল। মুহুর্তের মধ্যে বাসার মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল।

চলবে….

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৬০ এবং শেষ পর্ব

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#সমাপ্তি_পর্ব
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“একটা কল করে আসতে বলেছি বলে,আসার সময় তাড়াহুড়োয় জুতোটাও কি খেয়াল করেন নি চেয়ারম্যান সাহেব?”

মেহবিনের কথায় শেখ শাহনাওয়াজ তার পায়ের দিকে তাকালেন। আর তাকিয়ে দেখলেন সে বাড়ির জুতো জোড়াই পড়ে এসেছেন। শেখ শাহনাওয়াজ হেঁসে বললেন,,

‘অতিরিক্ত খুশিতে মানুষ মাঝে মাঝে অনেক কিছুই ভুলে যায়।”

‘আপনি কি খুশি আপনাকে এখানে ডেকেছি বলে?”

“তা নয়তো কি আজ আমার ঈদের দিন।”

মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকালো তার চোখটা ছলছল করছে। মেহবিন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,,

‘বাবা!”

বাবা বলতেই শেখ শাহনাওয়াজ এর চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। তিনি বললেন,,

“এই দিনটার জন্য কতো বছর ধরে অপেক্ষা করছি আম্মা।”

মেহবিন তার বুকে মাথা রেখেই বলল,,

‘জানি তো!”

মেহবিন তাকে ছেড়ে মুচকি হেসে বলল,,

‘হুম অনেক হয়েছে এখন চলুন আমাকে বেলুন আর হাওয়াই মিঠাই কিনে দিন। ছোটবেলার মতো বেলুন নিয়ে হাটবো আর খাবো। যদিও দাঁড়িয়ে খাওয়া উচিত নয়। তবুও আজ খাবো আমি।”

মেয়ের আবদারে শেখ শাহনাওয়াজ হাসলেন। তিনি পকেটে হাত দিলেন তা দেখে মেহবিন আদুরে গলায় বলল,,

‘এবার খুশিতে আবার ওয়ালেট রেখে আসেন নি তো! যদি আসেন তাহলে কিন্তু আমার মনটা ভেঙে যাবে আব্বা।’

আব্বা ডাক শুনে এবার শেখ শাহনাওয়াজ আরো জোরে হাসলেন। কারন যখন ও একটু আদুরে আদুরে ভাব থেকে কথা বলে তখন আব্বা বলে। এটা ছোট বেলায় বলতো। বহু বছর পর আব্বা শুনে তার মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। তিনি হেসে বললেন,,

‘না ওয়ালেট রেখে আসি নি নিয়েই এসেছি।”

“যাক আলহামদুলিল্লাহ!”

মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর ফোনে ওদের পুরোনো বাড়ির ঠিকানা পাঠিয়েছিল। এখানে কেউ না থাকলে কি হবে শেখ শাহনাওয়াজ এ বাড়ির দেখভাল করার জন্য কেয়ার টেকার রেখে দিয়েছিলেন। কারন এই বাড়িতেই মেহের আর মেহবিনের শেষ স্মৃতি রয়েছে। মেহবিন তার পাঁচ ঘন্টা পর লোকেশন পাঠিয়েছিল। কারন ওর সাজেক থেকে আসতে সময় লাগবে তো তাই। তখনি ও গাড়ি বের করে রওনা দিয়েছিল। পরে লোকেশন পাঠিয়েছে দেখে মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর আগেই পৌঁছে গেছে। মেহবিন ওর বাবার এক আঙুল ধরলো যেভাবে ছোটবেলায় ধরতো। শেখ শাহনাওয়াজ হেঁসে রাস্তায় বের হলেন মেয়েকে নিয়ে। সময়টা বিকেল রাস্তার ধারেই বেলুন আর হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মেহবিনকে বিশটা বেলুন আর দুটো হাওয়ার মিঠাই কিনে দিল। মেহবিন বাচ্চাদের মতো সেগুলো হাতে নিয়ে হাঁটতে আর খেতে লাগলো। শেখ শাহনাওয়াজ মেয়েকে মন ভরে দেখতে লাগলেন।

রাতে মেহবিন আর শেখ শাহনাওয়াজ একসাথে রান্না করলেন। শেখ শাহনাওয়াজ আজ মেয়েকে খায়িয়ে দিলেন। দু’জনে মিলে ঠিক করলো চাঁদ দেখবে তাই দুজনে ছাদে উঠে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ দোলনায় বসলেন মেহবিন ও তার পাশে বসলো। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আমার কাঁধে একটু মাথা রাখবেন আম্মা!”

মেহবিন মুচকি হেঁসে তার কাঁধে মাথা রাখলো। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আপনাকে ভিশন ভালোবাসি আমি!”

মেহবিন বলল,,

“আপনার ওপর কোনদিন অভিমান করি নি শুধু অভিযোগ করেছি আমি। আপনি জানেন কেন?”

‘কেন?”

“কারন আমার যদি কারো ওপর অভিমান হয় তখন সেটা আকাশ সম হয়। আর কেউ সেটাকে ভাঙতে পারে না। কিন্তু যদি অভিযোগ থাকে কারো ওপর তাহলে যার ওপর অভিযোগ সে অনুতপ্ত সাথে মাফ চেয়ে নিলেই অভিযোগ শেষ হয়ে যায়। আপনার থেকে আমি সব শুনিনি কেন জানেন কারন আমি চাইছিলাম আপনার ওপর থেকে আমার অভিযোগ শেষ না হোক।যতক্ষন পর্যন্ত না আমি চাই।”

‘আমার ওপর আপনার কি কি অভিযোগ ছিল?”

‘আপনার ওপর আমার এক আকাশ অভিযোগ ছিল বলে শেষ করা যাবে না। তবে মুল অভিযোগ টা হলো, আপনি আমাকে ওভাবে রাস্তায় ছেড়ে না দিয়ে কি নিজের কাছে রেখে আগলে রাখতে পারতেন না।”

কথাটা শুনে শেখ শাহনাওয়াজ এর চোখ ছলছল করে উঠলো।তিনি একটা ঢোক গিলে বললেন,,

“ঐটুকু সময়ের মধ্যে আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি সঠিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। মাথার মধ্যে হাজার খানেক চিন্তা বুকে ভয় এমন সময় একটা মানুষ কখনোই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কি না সন্দেহ। তবে এই সিদ্ধান্ত গ্ৰহনে কতটা কষ্ট হয়েছে আমার সেটা বোঝানোর মতো নয়। তবে যখন পরে বুঝতে পারলাম ভুল হয়ে গেছে। তখন আপনার কাছে গেলাম কিন্তু আপনি আমাকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে পরতেন আপনার অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এই জন্য একেবারে দুই বছর পর আপনি সুস্থ হলে আপনার সামনে যাই কিন্তু তখন আপনি আমার কথা শুনতে নারাজ। তারপর তো যাই হোক সবকিছুর জন্য আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমার ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত গ্ৰহনের জন্যই আপনার জীবনে এতো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।”

“হুম এখন বাদ দিন এসব। এখন না হয় আমরা বাবা মেয়ে মিলে একটু চাঁদ দেখি।”

“এখন কি সব অভিযোগ শেষ!”

“যদি শেষ না হতো তাহলে আমি এখানে থাকতাম না।”

“ভালোবাসি!”

“হুম আমিও বাসি!”

‘কি বাসেন?”

“ঐ তো ভালোবাসি!”

“আপনি এমন কেন?”

“কেমন?”

‘একটু বেশিই বুদ্ধিমতি।”

কথাটা শুনে মেহবিন আর শেখ শাহনাওয়াজ একসাথে হেঁসে উঠলো। অবশেষে বাবা মেয়ের দূরত্ব শেষ হয়ে কাছাকাছি এলো। এভাবেই দু’টো দিন কেটে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ বাড়ি চলে গেলেন ছেলের বিয়ে বলে কথা। মেহবিন ও সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কোথায় গন্তব্য সেটা একমাত্র সেই জানে।

_______________

শেখ শাহনাওয়াজ তিন ছেলেমেয়ের বিয়ে একসাথে দেবেন আর যেহেতু একসাথে তাই তিনি মাহফুজ শাহরিয়ার আর মেহরব চৌধুরীর সাথে কথা বলে একটা রিসোর্ট বুক করেছিলেন। তবে জায়গা টা মেহবিন চুজ করে দিয়েছিল এটা অবশ্য শেখ শাহনাওয়াজ ছাড়া আর কেউ জানে না। রিসোর্ট এ আসা হয়েছে বিয়ের আগের দিন। সবাই কতো আনন্দ মজা করছে কিন্তু দুজনের মধ্যে আনন্দের রেশ নেই সেটা হলো নেত্রী আর নেত্রীর পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা। সবাই ছাদে নিজেদের মতো রয়েছে। মুখর একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি পরেছে আর তাজেল একটা নীল রঙের ফ্রক। তাজেল আর মুখর সুইমিং পুলের একপাশে চুপ করে বসে আছে। মুখর গালে হাত দিয়ে বসে আছে দেখে তাজেল বলল,,

‘এই যে পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা গালে হাত দিছাও ক্যান? হাত নামাও গালে হাত দেওয়া ভালো না। দাদি কইছিলো অশুভ ?”

মুখর গাল থেকে হাত নামিয়ে বলল,,

“উঁহু কোনকিছুকে নেত্রী অশুভ বলবে না। ‎এটা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। শিরক মানে বুঝোতো আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা।

‘আবদুল্লাহ্ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন : কোন কিছুকে অশুভ মনে করা শির্‌ক। (আহমাদ হা/৩৬৮৭, শায়খ আলবানী ও ইবনু হিব্বাস একে সহীহ বলেছেন)

‎‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ কোন বস্তুকে কুলক্ষণ মনে করা ‘শিরক’, কোন বস্তুকে কুলক্ষন ভাবা শিরক। একথা তিনি তিনবার বললেন। আমাদের কারো মনে কিছু জাগা স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করলে তিনি তা দূর করে দিবেন।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৯১০)

আর তুমি জানো শিরক ভয়াভহ একটা গুনাহ।
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস’উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, অন্য বর্ণনায় রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শারীক করে মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আমি বলি, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শারীক না করা অবস্থায় মারা যায় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।{ (ই.ফা. ১৭০; ই.সে. ১৭৬),সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৬৯}

সব শুনে তাজেল বলল,,

“তোমার এতোকিছু বুঝি নাই আমি খালি বুঝছি শিরক করা যাইবো না। এইডা বড় গুনাহ।”

মুখর বলল,,

“হুম বুঝেছো তবে শিরক থেকে বাঁচতে,‎

ফারওয়াহ ইবনু নাওফাল (রাঃ) হতে তার পিতার সূত্র থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাওফাল (রাঃ)-কে বলেনঃ তুমি “কুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূন” অর্থাৎ সূরা কাফিরুন সূরাটি পড়ে ঘুমাবে। কেননা তা শিরক হতে মুক্তকারী।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৫০৫৫)

কথাটা শুনে তাজেল বলল,,

“আইচ্ছা আমি সুরা কাফিরুন পারি ডাক্তার শিখাইছিল। এহন কও তুমি চুপচাপ বইসা আছো কেন সবাই না মজা করতেছে?

‘তুমি কেন বসে আছো?”

‘ডাক্তাররে ছাড়া ভাল লাগতেছে না।”

“আমার ও তোমার ডাক্তাররে ছাড়া ভালো লাগতেছে না।”

“তাইলে এহন কি করুম?”

“চলো গানছাড়া নাচি?”

“কোন খুশিতে?”

“আজ খুশিতে না দুঃখে!

‘ধুরু দুঃখে কেউ নাচে নাকি। ডাক্তার একবার কইছিল তুমি নাকি অনেক খুশি হইলে গান ছাড়া নাচো?”

মুখর হেঁসে বলল,,

‘হুম নাচি তো। আজ তো কাজ নাই তোমার আর আমার তাই চলো নাচি।”

‘সত্যি?”

“হ সত্যি কাল তোমার ডাক্তার আইলে তোমার ডাক্তাররে নিয়ে নাচবো।”

‘আইচ্ছা। কিন্তু আমার তো শরম করে।”

‘ধূর আজকে শরম কে বাদ দাও নেত্রী।”

মুখরই আগে শুরু করলো আর তাজেলের হাত ধরে ঘোরাতে লাগলো। তাজেল ও খিলখিল করে হেসে উঠলো। দুজনে হাত উঁচু করে সেই নাচ দিল। সবাই ওপরে দেখে কেউ দেখলো না ওদের নাচ। তবে একজন দেখে হাসতে লাগলো। সে হলো মেহবিন সে সিসিটিভির মাধ্যমে দুজনকে এতোক্ষণ দেখছিল। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘মাশাআল্লাহ এদের ওপর কারো নজর না লাগুক।’
_________________

অতঃপর আজকে মুখর আর মেহবিনের জীবনে কাঙ্ক্ষিত দিনটা এসেই পড়লো। আজ মুখর আর মেহবিনের বিয়ে সেই সাথে আরবাজ আর নাফিয়া এবং মিহির ওরফে অনুভব আর মিশুর বিয়ে। কাল চুপচাপ বসে থাকলেও আজ সারা বাড়ি দৌড়াচ্ছে তাজেল। সঙ্গী হিসেবে আদরকে নিয়েছে আজ। বিয়ের সময় হয়ে আসছে কিন্তু সবার মাঝে আলাদা উত্তেজনা কাজ করছে। কারনটা মেহবিন কারন সে বিয়ের সময় একেবারে এন্ট্রি নেবে। মন্ত্রী, কমিশনার, চেয়ারম্যান এর ছেলে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এটা কি আর যে সে বিয়ে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। প্রেসের লোক ও আছে এখানে এছাড়াও বিজনেস ম্যান নেতাকর্মীদের আনাগোনা। মুখর কাজ করা ক্রীম কালারের পাঞ্জাবি পড়েছে এটা মেহবিন দিয়েছে কুরিয়ার বক্সে। আর তাজেলের জন্য লাল লেহেঙ্গা। তাজেল লেহেঙ্গার সাথে সে লাল রঙের হিজাব পরেছে। সবাই রেডি হয়ে নিচে নামলো। মিশু আর অনুভব নীল রঙের পাঞ্জাবি আর লেহেঙ্গা পরেছে। আরবাজ আর নাফিয়া সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর লেহেঙ্গা পড়েছে। মেয়েরা অবশ্য সবাই মানে কনেরা লেহেঙ্গার সাথে হিজাব নিকাব পরেছে কারন অনেক লোক। অতঃপর শোনা গেল মেহবিনের গাড়ি এসে পরেছে। কথাটা শুনে মুখর এর হার্টবিট বেড়ে গেল। মুখরের হাত ধরে আছে তাজেল। অতঃপর দরজা দিয়ে মেহবিন কে দেখা গেল লাল বেনারসি শাড়ি মাথায় লাল হিজাব আর মুখে নিকাব। শাড়িটা দুই হাত ধরে আস্তে আস্তে আসছে। সবার নজর সেদিকেই। মুখর বুকের বাম পাশে হাত দিল। মেহবিন দূর থেকে তা দেখে হেঁসে ফেললো। মুখর এগিয়ে গেল ওর দিকে তাজেল ও পেছনে পেছনে গেল। মুখর ওকে কিছু বলবে তার আগেই মেহবিন “নেত্রী বলে তাজেলকে কোলে নিল। তা দেখে মুখর মাথায় হাত দিয়ে হেঁসে ফেললো। তাজেল মুখরকে বলল,,

“পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা দেহো আইজ আমি জিতছি। আইজ ডাক্তার আমার কাছে আগে আইছে তোমার কাছে যায় নাই।”

মুখর হেঁসে ওদের দিকে এগিয়ে এসে তাজেলের গাল টিপে দিয়ে বলল,,

‘এই খুশিতে নাচা যাক একটু।”

“হ !”

তাজেল কোল থেকে নেমে গেল। আর মুখরের হাত ধরে নাচতে লাগলো। তা দেখে পুরো হলের মানুষের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। মুখর মেহবিনের হাত ধরে নাচতে লাগলো। আজ মেহবিন ও হেঁসে তাজেল আর মুখরের সাথে তাল দিল। গান নেই তবুও সবার মনে হচ্ছে এর থেকে সুন্দর নাচ বোধহয় হয় না। একটু পর মেহবিন দুজনকে থামিয়ে বলল,,

“অনেক হয়েছে এবার স্টেজে যাওয়া যাক। আমাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। আর কাব্য আজ আপনার বিয়ে এরকম পাগলামো করলে চলে। আর নেত্রী তুমিও।”

তখন তাজেল বলল,,

“আমি কি করুম পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালার সাতে থাকতে থাকতে পাগল হইয়া গেছি গা।”

‘এই তুমি আমায় পাগল বললে?”

দু’জনের ঝগড়ার আগেই মেহবিন থামিয়ে দিল। মুখর এক হাত দিয়ে মেহবিনের হাত ধরলো আরেক হাত দিয়ে তাজেলের। দুজনে স্টেজে উঠলো। মেহবিন সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। আছিয়া খাতুন তো কেঁদেই ফেললেন। মেহবিন হেঁসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। অতঃপর মহা ধুমধামে আরবাজ আর নাফিয়ার বিয়ে হলো। কারন তাদের বিয়েটাই মুল আকর্ষন বাকিদের তো আগেই হয়েছে। তবুও বাকিদের বিয়েটাও ধুমধাম করে হয়ে গেল। সবার বিয়ে ডান। মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর কাছে গিয়ে বললেন,,

“বাবা খুদা লাগছে খায়িয়ে দেন?”

হুট করে এমন কথা বলায় চমকে ওর দিকে তাকালো। ওদের মধ্যে যে সব ঠিক হয়ে গেছে এটা কেউ জানে না। ওর কথা শুনে আরবাজ আর মিশু এগিয়ে গেল। আর বলল,,

‘ফুল?”

‘কি ?”

‘কি বললি বাবাকে?”

‘বাবাই তো বললাম? আমি কি আংকেল বললাম নাকি?”

“না তুই বাবাকে কি করতে বললি?”

“খায়িয়ে দিতে বললাম। এমন ভাবে বলছো যেন আমি কোনদিন বাবার হাতে খাইনি দুদিন আগেও তো খেলাম বাবা বলেনি তোমাদের?”

কথাটা শুনে সবাই শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকালো তিনি সবার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,,

“আমি খাবার নিয়ে আসছি!”

উনি যাবেন তার আগেই মিশু আর আরবাজ তাকে আটকে ধরলো। আর এমনভাবে তাকালো যেন খেয়েই ফেলবে। তিনি বললেন,,

“আসলে?”

আরবাজ হেঁসে বলল,,

‘হয়েছে আসলে নকলে ছাড়ো এখন শাস্তি হিসেবে আমাদের দুজনের জন্যও খাবার নিয়ে এসো। আর আমরাও তোমার হাতেই খাবো।”

তিনি হেঁসে চলে গেলেন। এদিকে সবাই মেহবিন কে ঘিরে ধরলো। এতদিন কোথায় ছিল কি করেছে। ও কিছুই বললো না। হেঁসে তাজেলকে নিয়ে বসে রইলো। আর কথা বলতে লাগলো। তাজেল ও হেঁসে হেঁসে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসলো। মুখর ওর পাশে বসে ওদের দুজনকে দেখতে লাগলো। শেখ শাহনাওয়াজ এসে সবাইকে খায়িয়ে দিলেন। ওদের খাওয়া শেষ হলে মেহবিন মুখরকে খায়িয়ে দিল। সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেহবিন আর মুখর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে মুখর মেহবিনের কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,,

“আমার এই হৃদমাজারে তোমায় রাখিব যতন করে, সে তো জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া কাব্যের বিহঙ্গিনী, সে তো রূপকথার পরী নয়,নয় কোনো আর্মি,সেতো নিরব শান্ত আমার বিহঙ্গিনী,কাব্যের বিহঙ্গিনী।

~ আইভি শিকদার (বিহঙ্গিনীর পাঠক বিহঙ্গিনীর জন্য লিখে পাঠিয়েছেন)

মুখরের কথা শুনে মেহবিন হেঁসে বলল,,

“নিশ্চয়ই রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনীকে জেনে গেছেন?”

“হুম কারন কাব্যের বিহঙ্গিনী তার জীবন কাহিনী বিহঙ্গিনীর কাব্যের কাছে লেখিকা আজরিনা জ্যামির গল্পের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। এ কয়েকদিনে কাব্যের বিহঙ্গিনী পেজ থেকে গল্প পোস্ট হয়েছে আর কেউ না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝেছি সেটা আমার বিহঙ্গিনীর গল্প রুপকথার বিহঙ্গিনীর।”

মেহবিন কিছু বললো না শুধু হাসলো। অতঃপর যেহেতু সব এখানেই হবে আর পুরো রিসোর্ট বুক করা। তাই বাসর ঘরের ব্যবস্থা এখানেই করা হয়েছে। কিন্তু বাসর ঘর ধরা হলো ঠিকই মাইশা আর মেহবিন মিহিরের থেকে ঠিকই টাকা নিয়েছে। আর মিশু মেহবিন মাইশা জিনিয়া মুনিয়া নিসা আরবাজ এর থেকে। শেখ শাহনাওয়াজ আরিফ জামান আর শেখ আমজাদের জন্য ওদের কে হেলা করেন নি। ঠিকই ওদের ন্যায্য মর্যাদা দিয়ে রেখেছেন। অতঃপর এবার পালা মুখরের এদিকে মুখর আর তাজেল দুজনে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। বিষয়টা মেহবিন মুখর বলল,,

“নেত্রী এমন করো কেন?”

“ডাক্তার মেলা দিন পর আইছে হেতি আমার সাতে থাকবো।”

“না আমার সাথে!”

“না কইলাম না আমার সাতে।”

‘না আমার সাথে থাকবে। আজ আমাদের বিয়ে হলো না আজ আমার কাছে থাকবে। আজ এমন করে না নেত্রী?

“তাইলে তোমারে নাফিয়া আপা টাকা দিতে কইতেছে তুমি দিতাছো না ক্যা? এই জন্যই তো আমি এহন কইতেছি আমার সাতে থাকবো!”

‘আরে ওরা তো একবার আমার থেকে পাঁচ বছর আগে টাকা নিয়েছিল তাই এবার দেবো না।”

“তুমি দিবা নাকি আমি ডাক্তার এর কাছে যাইয়া ঘর আইকাই দিমু। ”

“আরে না দাড়াও দিচ্ছি।”

মুখর বিরস মুখে ওয়ালেট বের করলো আর টাকা নাফিয়ার হাতে দিয়ে বলল,,

‘নিশ্চয়ই তোরা নেত্রীকে এসব শিখিয়ে দিয়েছিস। এখানে কিন্তু নেত্রীর ভাগ বেশি ওর জন্যই টাকাটা পেলি।”

নাফিয়া দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“তা আর বলতে?”

তখন তাজেল বলল,,

‘যাও আইজ তোমার বিয়া দেইহা ছাইড়া দিলাম নাইলে?”

‘নাইলে তুমি তোমার ডাক্তারের কাছে থাকতা। যাও আজকের মতো আমাগো হোম মিনিস্টার বুড়ির কাছে থাহো গা। পারলে দুই জন কাইজা করো গা। ”

“পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা!”

কথাটা শুনেই মুখর দরজার ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। আর তাজেল সহ সবাই হেঁসে উঠল। আর চলে গেল। মুখর সামনে তাকাতেই মেহবিনকে দেখলো লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে আছে। মেহবিন কে দেখে সালাম দিল,,

‘আসসালামু আলাইকুম বউ।”

বউ শুনে মেহবিনের বুকটা ধক করে উঠলো। সে বলল,,

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম!”

‘মাশাআল্লাহ ফুলের সমারোহে আমার একান্ত ফুলকে অনেক প্রেমময়ী লাগছে।”

মেহবিন মুচকি হাসলো কিন্তু কিছু বললো না। তখন মুখর বলল,,

‘আমাকে কেমন লাগছে বললে না তো?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আপনাকেও প্রেমময় কম লাগছে না।”

‘তাই বুঝি?’

“হুম তাই! এখন কথা বাদ দিয়ে ওযু করে আসুন সালাত আদায় করবো।”

মুখর ওযু করে এলো। মেহবিন জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর দুজনে সালাত আদায় করলো। এরপর মুখর মেহবিনকে নিয়ে বেলকনিতে গেল। ওখানে দুটো বেতের টুল রাখা। মুখর মেহবিনকে নিয়ে সেখানে বসলো। মুখর হেঁসে বলল,,

“বিহঙ্গিনী কখনো তোমার থেকে ভালোবাসি শোনা হয়নি। ”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“সব কথা কি মুখেই বলতে হবে? কিছু না হয় থাক অপ্রকাশিত।”

“তার না বলা ভালোবাসার অনুভূতি এতোটা সুন্দর, না জানি তার মুখে ভালোবাসি শোনার অনুভূতি কেমন হবে?”

“সে না হয়, না বলা ভালোবাসার অনুভূতি নিয়েই থাকুক।

‘তার চোখের ভাষা আমায় বুঝিয়ে দেয় সে আমায় ভালোবাসে। কিন্তু মনের আকাংখা মিটাতে সে কি বলবে সে আমাকে ভালোবাসে?”

“যদি না বলি?”

“তাহলে পূর্নতার মাঝেও একটা বড় অপূর্ণতা রয়ে যাবে। ”

“তাহলে তার জীবনে কোন অপূর্নতা না থাকুক।”

“তাহলে সে বলুক মুখ ফুটে সে আমায় ভালোবাসে।”

‘অতঃপর আমি তাকে ভালোবাসি!”

“কে কাকে ভালোবাসে?”

“বিহঙ্গিনী তার কাব্যকে ভালোবাসে।”

“অতঃপর শুনে নাও বিহঙ্গিনী আমি রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনীকে ভালোবাসি।’

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“এভাবেই আপনার জীবনের সকল ইচ্ছে পূর্নতা পাক।”

“যদি তার আর আমার ভালোবাসা নিয়ে যদি দুই লাইন বলি তাহলে, এতোকিছুর পরও কাব্যের বিহঙ্গিনীর এক হয়েছিল আর পূর্নতা আমাদের ও হয়েছিল তবে সাক্ষাৎ কম ছিল কিন্তু অপেক্ষাটা বেশি ছিল।”

‘অপেক্ষা যদি হয় হালালের প্রতি তাহলে তো পূর্নতা পেতেই হবে তাই না।”

“হুম! আমার মনের রানী আমার রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনী। অতঃপর ভালোবাসি আমার বিহঙ্গিনী!”

~~~~ সমাপ্ত~~~

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৫৯

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫৯
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিনকে কেউ কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না পাঁচদিন হতে চললো। এই নিয়ে সবার টেনশনের শেষ নেই। অথচ মুখর আর তাজেল বেশ মজায় আছে। এদের দেখে মনে হয় তেমন কিছু হয় নি। মেহবিন ব্যাগপত্র গুছিয়ে পরের দিনই চলে গেছে। না সে কাউকে নেয় নি। শুধু মাত্র চলার সঙ্গী হিসেবে একটা গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। ও কোথায় গেছে বা যাবে সেই সম্পর্কে মুখর কিছুই জানে না। শুধু এইটুকু জানে মেহবিন ওদের বিয়ের দিন বধুবেশে আসবে ওকে বিয়ে করতে। মুখর মেহবিন যাওয়ার পর তাজেলকে নিয়ে শাহরিয়ার ভিলায় এসেছে। যদিও তাজেল প্রথমে আসতে চায় নি। কিন্তু মুখর অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়েছে আর নিয়ে এসেছে। মুখর আগেই বলেছে ওকে যেন ভালোভাবে ওয়েলকাম করা হয় সবাই করেছেও তাই। এই পাঁচদিনে সে হয়ে উঠেছে শাহরিয়ার পরিবার এর মধ্যমনি। সকাল বেলা খাবার টেবিলে বসে মুখর আর তাজেল খাচ্ছিল তখন আছিয়া খাতুন বললেন,,

“ঐ মুখর তুই না পুলিশ। তুই কি তোর পুলিশের টিমরে কাজে লাগাইয়া নাতবউ কোনে হেইডা দেখবার পারোস না?”

মুখর ওর মুখের খাবারটা গিলে বলল,,

“চাইলে তো পারি দাদিজান। তবে আমি জানতে চাইই না যে তোমার নাতবউ কোথায়? সে যখন বলেছে সে আসবে মানে আসবে।”

“হে তো কইছিলো হেতির অনুষ্ঠানে আইবো হে কি আইছিল।”

“সেটার বিষয় আর এটার বিষয় আলাদা।”

তখন তাদের বলল,,

“এই যে দাদি তুমি কি ছোট কাল থেইকাই আমার মতো কতা কও।”

তাজেলের কথায় মেহবিনের কথা ছেড়ে তাজেলের দিকে মনোনিবেশ করলেন আর বললেন,,

“আমি তোর মতো কথা কমু ক্যান? বরং তুই আমার মতো কতা কস।”

“এ তোমারে কইছে আমি তোমার মতো কতা কোম ক্যা? আমি তো আমার মতো কতা কই।”

“ঐ হইলো আমাগো কতা একি পদের।”

“হ হেইডাই তো দেখতাছি। আইচ্ছা তোমাগো বাড়ি কি আমাগো গ্ৰামে আছিল নাকি?”

“না তোগো গ্ৰাম থেইকা মেলা দূর আমাগো বাড়ি আছিল।”

“আইচ্ছা এইগুনা বাদ দাও আর ডাক্তাররে নিয়া চিন্তা কইরো না। ডাক্তার কইছে ঠিক সময় আইয়া পরবো। তুমি চিন্তা কম করো নাইলে কবে জানি স্টক কইরা মইরা যাইবা। অবশ্য তোমার মতো বুড়ি এতদিনে যহন মরে নাই নাইলে সহজে মরবোও না।”

তাজেলের এই কথায় পুরো শাহরিয়ার পরিবার ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। কিন্তু মুখর হেঁসে উঠল।তখন আছিয়া খাতুন বললেন,,

“ঐ তুই আমারে কি কইলি আমি বুড়ি? তুই বুড়ি তোর চৌদ্দ গুষ্টি বুড়ি। আর আমার মতো কইতে তুই কি বুজাইলি?”

তাজেল দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“তোমার মতো ভালো মানুষ আর কি? ভালো মানুষ মেলা দিন বাঁচে তাই না পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা?”

মুখর হেঁসে বলল,,

“হ্যা নেত্রী তাই।

“হ এহন নও আমার খাওয়া হইয়া গেছে। তুমি না আমারে নিয়া কোনে জানি যাইবা।”

বলেই তাজেল দৌড়ে চলে গেল। তখন সবাই হেঁসে উঠলো। আছিয়া খাতুন মেকি রাগ দেখালেও পরে নিজেও হেঁসে বললেন,,

“মাইয়া ডা সত্যিই অনেক ভালো। এ পাঁচদিনেই এই বাড়িটাকে কতটা আনন্দে রাখছে। আর কি সুন্দর তোতাপাখির মতো কথা কয়।”

মুখর হেঁসে বলল,,

“এই কারনেই সবাই আমাদের নেত্রী কে পছন্দ করে। এর পরেও কি তোমাদের কারো আপত্তি আছে ওকে এ বাড়িতে রাখতে?”

সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল,,

“না!”

মুখর হেঁসে বলল,,

“নাফি নেত্রীকে রেডি করিয়ে দে। ওকে নিয়ে আজ একটু বেরুবো?”

“কোথায় যাবে?”

“মেহবিন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নেত্রীর জন্য কিছু জিনিস পাঠিয়েছে ওগুলোই আনতে যাবো। আর ওকে নিয়ে একটু ঘুরেও আসবো‌। পাঁচদিন হলো এখানে এসেছে কোথাও নিয়ে যেতে পারলাম না।”

“আমরাও যাই তাহলে?”

“আজ না তোরা শপিং এ যাবি। আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি তোর বিয়ের। এখন ঘুরা ঘুরি সব বন্ধ। নিজের বিয়েতে মন দে।”

“এমনভাবে বলছে যেন আমার একার বিয়ে?”

“তো তোরই তো প্রথম বিয়ে আমার কি আর প্রথম বিয়ে? আমি তো আগেই বিয়ে করেছি।”

“হুম হইছে বলে দাও নেবে না। এতো জ্ঞান ঝাড়ার কি আছে।”

“এই তো ঠিক বুঝছোস।”

নাফিয়া একটা হু বলে উঠে গেল। পেছনে মুখর ও গেল। তাজেল নাফিয়ার সাথে নাফিয়ার ঘরে থাকে। আর ওর সব জিনিসপত্র ওখানেই। নাফিয়া আর মুখর যেতেই দেখলো তাজেল কি যেন একা একাই বলতেছে ,,

“তুমি যেমনভাবে কইছিলা আমি তেমনভাবেই সবার সাতে মিশতে চাইতেছি ডাক্তার। তুমি তাড়াতাড়ি চইলা আইসো । আমার তোমারে ছাড়া ভাল্লাগে না। এনে তো সবাই আছে কিন্তু তুমি নাই। কিন্তু তুমি নাই দেইহাই এতোজন থাকতেও আমার ভাল্লাগে না।”

“এই তো নেত্রী খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে আর পাঁচটা দিন। তারপরেই তোমার ডাক্তার তোমার কাছে থাকবে।”

মুখরের কথায় তাজেল পেছনে তাকালো। আর বলল,,

“হ হ জানি তোমার কওন লাগবো না। এই পাঁচটা দিন মনে হইতেছে পাঁচ বছর। আর পুলিশ পাঞ্জাবি ওয়ালা তাও তুমি রেডি না হইয়া এনে কি কর?”

তাজেলের কথায় মুখর হেঁসে বলল,,

“দেখতে এলাম তুমি কি রঙের ড্রেস পড় আজ তোমার সাথে ড্রেস মিলিয়ে পড়বো আমি।”

“আমি তো ডাক্তারের মতো কালা কালারের বোরকা পড়ুম।”

“তাহলে আমিও কালা কালারের পাঞ্জাবি পরুম ‌।”

“তুমি এমনে কতা কও ক্যা আমার শরম করে না।”

এবার নাফিয়া আর মুখর দুইজনেই হেসে উঠল। আর বলল,,

“আহ ভাইয়া যাও তো তাজেল লজ্জা পাচ্ছে।”

“বুঝলি নাফি এই কথা টা শোনার জন্যই এতো গুলো কথা খরচ করলাম।”

“হুম।”

মুখর হেঁসে চলে গেল। নাফিয়া কালো বোরকা বের করলো। মেহবিনকে বোরকা পরতে দেখে তাদের একদিন বায়না করলো ওর মতো বোরকা পড়বে তাই মেহবিন নাফিয়ার কাছ থেকে তিনটা বোরকা অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিল। সেখান থেকেই একটা আজ পরবে। নাফিয়া ওকে বোরকা পড়িয়ে হিজাব বেঁধে দিল। পায়ের জুতাও পড়িয়ে দিল। আয়নার সামনে তাজেল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলল,,

“দ্যাখ তাজেল আইজকা তরে ডাক্তারের মতো লাগতেছে মাশাআল্লাহ।”

বলে নিজেই হেঁসে উঠল। তাজেল বোরকা ধরে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নামলো। এটা ওর অভ্যেস সিড়ি দেখলেই লাফিয়ে লাফিয়ে নামবে সে। মুখর এসেই তাজেলের অনেক প্রশংসা করলো। এতে তো আমাদের নেত্রী লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মুখর ওকে কোলে নিয়ে বের হলো।

______________

এদিকে মেহবিন দাঁড়িয়ে আছে মেঘের দেশে । সে এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে হাত বাড়ালেই মেঘ ধরা যায়। কালকেই এসেছে এখানে। মেহবিন চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিলো। পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে বলল,,

“তো এখন তোমার অনুভূতি কি?”

“এই মেঘের মতো যেন হাওয়ায় ভাসছি।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“খুশি হয়েছো আমাকে এভাবে দেখে।”

“অতঃপর আমার বিহঙ্গিনী ভালো থাকবে।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“যদি না থাকি?”

“থাকবে সে এটা আমার বিশ্বাস।”

“এই বিশ্বাসের জোরেই কি আমায় ছেড়ে দিয়েছিলে।’

“না তখন বিশ্বাস করেছিলাম তাকে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। তবে সময়ের ব্যবধানে এখন বলছি সে ভালো থাকবে।”

“তাহলে বলছো ভালো থাকবো?”

“যেখানে মুখর শাহরিয়ার এর মতো একজন জীবনসঙ্গী আছে আর নেত্রীর মতো বিশ্বস্ত ভালো বন্ধু আছে সেখানে তো ভালো থাকতেই হবে।”

মেহবিন মুচকি হাসলো আর বলল,,

“সবাই থাকলেও কারো না থাকার শূন্যতা সবসময়ই রয়ে যায়। সবাই বলে সব শোকের তীব্রতাই সময় চলে যাবার সাথে সাথে কমে আসে। কিন্তু আমার ওপর সেটা হয়নি সময় ঠিকই চলে গেছে কিন্তু শোকের তীব্রতা কমে নি। একজনের শূন্যতা বারবার আমাকে গভীর অসহ্যকর যন্ত্রনা দেয়।”

“এতটা ভালো না বাসলেই কি হতো না আমায়?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“না হতো না! কারন এই একটা মানুষকেই যে খুব বাজে ভাবে হাড়িয়েছি। আর হাড়িয়েছি বলেই হয়তো এতো ভালোবাসি।”

“আমি তো তোমাকে এতটা কঠিন হতে বলিনি তবুও কিসের এতো কঠোরতা? যে দুঃখের কথা বলতেই মুখে হাঁসি থাকে। এতোটা কঠোরতা তো চাইনি।”

‘আমার মুচকি হাঁসি কি তোমায় পীড়া দেয়?”

‘ভয়ঙ্কর রকমের পীড়া দেয়।”

“কই কখনো কাঁদতে দেখলাম না তো? তোমাকেও তো সবসময় মুচকি হাসিতে দেখি। তাহলে আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো আমার মুচকি হেঁসে কষ্টের বলা কথাগুলো তোমায় পীড়া দেয়।”

কথাটা শুনে মানুষটার মুখে হাঁসিখানা প্রসারিত হলো। আর বলল,,

‘এতটা বুদ্ধিমতিও ঠিক না কিন্তু? তবে আমি তো কাঁদতে চাইলেও কাঁদতে পারবো না। কারন এই আমি শুধু তোমার। তুমি যেমনটা আমাকে দেখতে চাও তেমনটাই দেখতে পাবে। আমি চাইলেও নিজের মতো করে কিছু প্রকাশ করতে পারবো না।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“তোমার মুখে সর্বদা হাসিটাই মানায় বুঝলে?”

“আপু আপনি কার সাথে কথা বলছেন?”

হুট করে অপরিচিত কারো আগমনে মেহবিন একটু চমকে গেল। ও দেখলো একটা মেয়ে । ও কিছু বললো না দেখে মেয়েটা আবারও বলল,,

“কি হলো আপু আপনি কার সাথে কথা বলছেন? বললেন না তো?

মেহবিন মুচকি হেঁসে পাশে তাকিয়ে বলল,,

‘নিজের অস্তিত্বের সাথে।”

“কি অস্তিত্ব! অস্তিত্ব কারো নাম হয় না কি? তাছাড়া আমি তো আপনার আশেপাশে কাউকে দেখছি না।”

মেহবিন কিছু বললো না সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা কোন জবাব না পেয়ে মেহবিন কে পাগল উপাধিতে ভূষিত করে চলে গেল। মেহবিন সামনে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘মেহবিন মুসকান নামক মানুষটাকে সবাই কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলে জানে। অথচ কেউ জানেই না মেয়েটার একটা মানসিক রোগ আছে। যাকে নরমালি বলা যায় পাগল। সে তার মাকে দেখতে পায় তার সাথে কথা বলে তার মাকে নিয়ে তার আলাদা জগৎ। এই যে সবাইকে ছেড়েছুড়ে সে তার মায়ের সাথে ঘুরতে এসেছে। এই যে পাগল মেয়েটার মা তুমি কি মেয়েটাকে দেখে লুকিয়ে গেলে নাকি?

তখন মেহবিনের মা মুচকি হেসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,

“না তো লুকাই নি। আমি তো তোমার সাথেই আছি। আর সর্বদা তোমার সাথেই থাকি। কখনো তোমার থেকে দূরে যেতে পারি না।

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“যেতে দিলে না যাবে তুমি। তুমি তো সর্বদা আমার সাথেই থাকবে।”

‘হুম সেটা তো আছিই আমি। তবে আমি তোমার জীবনে এমন একজন মানুষ যাকে ছায়ায় মতো ধরতে গেলেই নেই।”

“এই জন্যই তো কখনো ধরতে যাইনি। এখন চলো অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। এখন যে কাজের জন্য এখানে এসেছি সেটা করা যাক।”

মেহবিন কিছুক্ষণ একা একাই ওর মাকে কথা বলে চলে গেল। এটা বলতে গেলে মেহবিনের একটা আলাদা জগৎ যা ওর মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তৈরি। মেহবিন যখন একা একা থাকতো তখন ও ওর মায়ের সাথে কথা বলতো। যেহেতু ওর জীবনে বেশি মানুষের আগমন নেই তাই বেশিরভাগ সময়ই ও একা একা ওর মায়ের সাথে কথা বলতো আর সময়ের ব্যবধানে এটাই ওর জীবনে রয়ে গেছে। এমন কি মেহবিনের ধারনা ও ওর জীবনের সবকিছু ওর মায়ের সাথে ডিসকাস করে সিদ্ধান্ত নেয়। আসলে তো সে নিজেই নিজের সব ডিসিশন নেয়। যদিও ও নিজের সবকিছু অনেক ভালোভাবে মেইনটেইন করে এই জন্য কেউ বুঝতেই পারবে না ওর এমন একটা মানসিক রোগ আছে। হয়তো কেউ কোনদিন জানতেও পারবে না এই বিষয়ে।
____________

মুখর কুরিয়ার অফিসে গিয়ে দেখলো শুধু তাজেলের জন্য নয় মুখরের জন্যও একটা বড় বক্স আছে। মুখরের কিছু একটা আন্দাজ করে মুখে মুচকি হাঁসি ফুটে উঠল। ও তাজেল কে কোলে নিয়ে বলল,,

“বুঝলে নেত্রী এখনকার যুগে বর বউকে কে পড়ার জন্য জিনিসপত্র দেয়‌। কিন্তু তোমার ডাক্তার বউ হয়ে বরের জন্য পড়ার জিনিসপত্র পাঠিয়েছে।”

তাজেল হেঁসে বলল,,

“আমার ডাক্তার সবসময় আলাদা।”

‘হুম তা তো বটেই কার বউ দেখতে হবে না আমার বউ।”

‘মোটেই না আমার ডাক্তার দেইহা এমনে। তোমার বউ তো কি হইছে? তোমার তো এনে কোন দাম নাই।”

‘তাহলে তো বলবো তোমার ডাক্তার তো কি হইছে? তোমার ও দাম নাই।”

“না থাকলো আমার দাম। তোমারও তো নাই এইডাই বড় কথা।”

‘নেত্রী!”

‘কি হইছে চিললাও ক্যা?”

ব্যস দুজনে লেগে গেল। এদিকে ওদের এরকম ঝগড়া দেখে কুরিয়ার অফিসের সকলে হাসছে। আজ তো মেহবিন নেই যে দুজনকে সামলাবে। ওরা দুজনে দুজনের মতো ঝগড়া করে আবার একসাথেই চলে গেল মুখে হাঁসি ফুটিয়ে। সবাই ভাবলো এরকম ও মিষ্টি সম্পর্ক হয়।

___________

“কি মিস ফারজানা? বয়ফ্রেন্ড রেখে আরেক জনের সাথে সাজেক ভ্যালি এসে মার খেলেন এইভাবে। আরে আমার একটু ভুল হলো অবশ্য এটাও তো বয়ফ্রেন্ড ছিল তাই না।”

মেহবিনের কথায় মুখরের মামাতো বোন ফারজানার মনে হলো কেউ ওর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ও চিৎকার করে বলল,,

“আবার তুই? তুই এখানে কিভাবে এলি?”

“ঐ তো গাড়ি দিয়ে। আমার তো ডানা নেই যে উড়ে উড়ে আসবো।”

আজ ফারজানা তার এক বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে রুমে ঢুকে রুমডেট করতে যাচ্ছিল। এমন সময় তার আরেক বয়ফ্রেন্ড এসে তাকে হাতেনাতে ধরে। হুট করে তার এক বয়ফ্রেন্ডকে দেখে ও চমকে উঠে আর ভয় পেয়েও যায়। কারন ও বলে এসেছে বন্ধুদের সাথে সাজেক ট্যুর এ এসেছে। আর তার সাথে থাকা বয়ফ্রেন্ড জানে সেই তার একমাত্র বয়ফ্রেন্ড। ব্যস লেগে গেল দুজন বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে ঝগড়া। এদিকে ফারজানা পরেছে ফান্দে কাকে রেখে কার দিকে যাবে দু’জনেই পয়সাওয়ালা ছেলে। একটাকে বিয়ে করতে পারলে লাইফ সেট। যদিও তার বাবা নিজে খুব একটা নিচুশ্রেনির মানুষ নন। একটা সময় পর দুই বয়ফ্রেন্ডই বুঝতে পারে যে আসলে ফারজানাই ওদের ধোঁকা দিয়েছে। দুজনই ফারজানা কে ইচ্ছে মতো মারতে থাকে। মার সহ্য করতে না পেরে ফারজানা নিচে পড়ে যায়। তবুও তারা থামেনা তাদের দেওয়া ধোঁকার মূল্য তাকে তো দিতেই হবে। মার খেয়ে ফারজানা কোথাও আঘাত পেল সে জোরে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলে তারা দু’জনেই ভয় পেয়ে যায় আর তাড়াতাড়ি করে ওকে রেখেই চলে যায়। এদিকে মেহবিন তার পাশের রুমটাতেই ছিল তাদের বের হতে দেখে মেহবিন ফারজানার রুমে গিয়ে মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। মেহবিন ফারজানা কে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাতে জ্ঞান ফিরতেই মেহবিন মুচকি হেঁসে ঐ কথাগুলো জিজ্ঞেস করলো। ফারজানা রেগে উঠতে চাইলো কিন্তু প্রচন্ড ব্যাথায় সে আবার শুয়ে পড়লো। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“কেউ সাহায্য করলে তার শুকরিয়া আদায় করা শিখুন মিস ফারজানা। আমি যদি ঠিক সময় আপনাকে হাসপাতালে না আনতাম তাহলে এতক্ষনে আপনি পরপারে চলে যেতেন।”

তখন ডক্টর এসে বলল,,

“উনাকে কিছু জানিয়েছেন?”

মেহবিন বলল,,

“না সময় পেলাম না এখনি বলতাম।”

তখন ফারজানা বলল,,

“কি বলবে ও?”

“এই যে আপনি কখনো মা হতে পারবেন না। আপনি পেটে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছেন। নিচে কিছু একটা ছিল আপনি হয়তো খেয়াল করেন নি। সেখান থেকেই আপনার জড়ায়ু,,

আর বলতে পারলো না ডাক্তার তার আগেই ফারজানা না বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ডাক্তার চলে গেল। তখন মেহবিন বলল,,

“আল্লাহ তায়ালা কিছু কিছু শাস্তি দুনিয়াতেই প্রদান করেন। নাফিয়া আপুর তো দুই পার্সেন্ট ছিল কিন্তু আপনার তো তাও নেই।”

মেহবিনের কথা শুনে ফারজানা ওর দিকে তাকালো। আর বলল,,

‘মানে?”

“মানে টা খুব সহজ মিস ফারজানা। আমাকে দাদি জানের কাছে খারাপ বানিয়ে নিজেকে অনেক বুদ্ধিমতি ভেবেছিলেন না। যদিও আপনি শুধু তুলে আনতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি আর নাফিয়া আপু তাদের আঘাত করলে আপনার লোকেরা ভুল করে নাফিয়া আপুর পেটে আঘাত করে যার জন্য নাফিয়া আপুর মা হওয়ার চান্স থাকে না। আর আপনি সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আপনি দাদি জানের কাছে এডিট করা ছবি পাঠিয়ে আমায় সেই কাজের জন্য দায়ী করেছিলেন না। ”

ফারজানা অবাক হয়ে বলল,,

“এসব তুমি জানলে কিভাবে?”

“বাহ তুই থেকে তুমি তে চলে গেলেন। তার মানে স্বীকার করলেন যে আপনিই সবকিছুর জন্য দায়ী।”

মেহবিনের কথা শুনে ও বুঝতে পারলো কি বলে ফেলেছে। চোর ধরে পড়ার ন্যয় নজর লুকালো। তখন মেহবিন বলল,,

“যাই হোক তা এসব কিছু কিসের জন্য করেছিলেন বলুন তো?”

ফারজানা মুখ ছোট করে বলল,,

“আমি মুখর কে বিয়ে করতে চাইছিলাম। তোমার কথা জানার পর এরকম সিদ্ধান্ত নিই।”

“কি!!শুধু মুখর কে বিয়ে করতে। সব থেকে বড় কথা সবকিছু না বলে করার কথা ছিল। তাহলে আপনি জানলেন কি করে যে মুখরের সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে?”

‘ফুপি একদিন মাকে বলছিল একটা মেয়ে পেয়েছে মুখরের জন্য। আর আমিও একটা মেয়েকে মানে তোমাকে মুখরের সাথে দেখেছিলাম বেশ কয়েকদিন। মুখর কোন মেয়ের সাথে মেশা তো দূর চোখ তুলেও তাকাতো না। অথচ তোমার সাথে কি সুন্দর হেঁসে হেঁসে কথা বলতো। আমি ছোট থেকেই ওকে পছন্দ করতাম। ওকে ভালোবাসতাম ওর সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতাম কিন্তু তুমি আসায় আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল তবে থেকেই মনে মনে পন করলাম তোমায় মুখরের বউ হতে দেব না। এই জন্য তোমায় তুলে নিয়ে চেয়েছিলাম দুদিন পর ফেরত দিয়ে বলতাম তোমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু তোমার সাথে নাফিয়া ছিল। তাই ওরা না বুঝতে পেরে ওকেও তুলতে চাইলো কিন্তু বাঁধা পেল। নাফিয়ার আঘাতে আহত একজন ওর ওপর ক্ষেপে গেল তাই ওভাবে মেরেছে। পরে জানলাম নাফিয়া মা হতে পারবে না পেটের আঘাতের কারনে। কথাটা শুনে খারাপ লেগেছিল কারন আমি এটা চাইনি আমি তো শুধু মুখরের বউ হতে চেয়েছিলাম। তবে পরে মাথায় বুদ্ধি আসে এভাবে তোমাকে ফাঁসাতে পারি। এই জন্য আছিয়া খাতুন কে সব পাঠালাম আর তোমার সাথে বিয়ে ক্যানসেল করে দিল। সেদিন রেস্টুরেন্টে তোমাকে দেখেই চিনে ফেলিছিলাম কিন্তু কেউ কিছু বলছে না দেখে আমিও চুপ করে রইলাম।

সব শুনে মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“এতো কিছু করেও তুমি মুখরের বউ হতে পারলে না। অথচ পারবে কি করে মুখর ছিল সুন্দর চরিত্রের অধিকারী কিন্তু তুমি নও। আর কুরআন এর সূরা আন নুর এর ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে,,

“দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা নারীদের জন্য। আর সচ্চরিত্রা নারীরা সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষরা সচ্চরিত্রা নারীদের জন্য; লোকেরা যা বলে, তারা তা থেকে মুক্ত। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক।” (আন নূর -২৬)

আর আমার মনে হয় তুমি মুখরকে কখনো ভালোইবাসোনি যদি বাসতে তাহলে তোমার দুই দুইটা বয়ফ্রেন্ড থাকতো না। তুমি শুধু ওকে পেতে চাইছিলে কিন্তু ওকে ভালোবাসে না। আর তোমার জন্য একটা মেয়ের এতো বড় ক্ষতি হলো ছিঃ। জানি তুমি চাও নি তবুও তুমিই তো কারন টা তাই নয় কি? শুধু মাত্র মুখরকে পাওয়ার জন্য?

“আমি আগে এমন ছিলাম না তোমার বিয়ে ক্যানসেল হওয়ার আমি মুখর কে প্রপোজ করি। তখন না বলে আমি কয়েকবার বলেছি ও আমায় রিজেক্ট করেছে। তখন একটা ছেলে আসে আমার কাছে আমাকে নানা কথা বলে ওর থেকে ভালো ছেলে ডিজার্ভ করি আরো অনেক কথা। আমাকে অপমান জনক ও কথা বলে পরে আমি একজনের সাথে রিলেশনে যাই। আমার পুরুষ সঙ্গ ভালো লাগতে লাগে। এরপর থেকেই আমি এসবে জড়িয়ে তাই এর থেকে বের হতে পারি না।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“ওহ আচ্ছা। তবে যার জন্য তুমি এসব করলে এতে কিন্তু তোমার লাভ হলো না। কারন আমাদের বিয়ে আরো পাঁচ বছর আগেই হয়ে গেছে। তবে আছিয়া খাতুন কাউকে জানান নি। উনি তোমার কথা বিশ্বাস করেছিলেন ঠিকই তবে আমায় একেবারের জন্য তাদের থেকে দূর করে দেন নি। এক মাস আগে আমার জন্যই অনুষ্ঠান রাখা হয়েছিল।আর পাঁচ দিন পর আমার সাথেই মুখরের বিয়ে। আর হ্যা তোমার সাথে যা হলো তা তোমার কর্মফল। ইচ্ছে তো ছিল তোমায় মেরে ফেলি কিন্তু যেহেতু এতো বড় একটা শাস্তি পেয়েছো তাই কিছু বললাম না। এখন ও সময় আছে সুদরে যাও নাহলে ভবিষ্যতে তোমায় অনেক ভুগতে হতে পারে। আর হ্যা আমার পরিবার থেকে দূরে থাকো যা করেছো তার সাথে এই শাস্তি টা কম। ”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে গেল। কিছুদিন আগেই আছিয়া খাতুন সবকিছু মেহবিন কে জানিয়েছে যে কিসের জন্য মুখরদের এই বিচ্ছেদ। মেহবিন মনোযোগ দিয়ে শুনে শুধু বলেছিল,,

‘আপনি একবার শুধু আমার কাছে জিজ্ঞেস করতেন নাহলেই এসব কিছু হতো না।”

আছিয়া খাতুন কেঁদে কেটে অস্থির। পরে মেহবিনই তাকে সামলেছে। উনি আগে থেকেই অনুতপ্ত ছিলেন এই জন্য মেহবিন তেমন কিছু বলে নি। আর এসবের পেছনে যে ফারজানা এটা মারিয়ার জন্য হয়েছে। যেদিন তাজেলের এক্সিডেন্ট হলো সেদিন মেহবিনের জন্য যে অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে মুখরের বউ এর কথা শুনেই ফারজানা নিজের রুমে রেগে এসব বলছিল কি কি করেছে। মারিয়া ওকে ডাকতে গিয়ে এসব শুনে ফেলে। সব শুনে মারিয়া তো পুরো থম মেরে ছিল। কাউকে বলার তেমন সাহস পায়নি। তবে মেহবিনের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক এই জন্য ওকে আগে জানিয়েছে। এ কথা শুনে মেহবিন বলেছে কাউকে কিছু না বলতে ও সব ব্যবস্থা করবে। মারিয়াও আর কাউকে কিছু বলেনি। মেহবিন ফারজানার ওপর নজর রেখেছিল ও জানতে পেরেছে ফারজানা এখানে আসবে তাই সে এখানে এসেছে। যদিও নিজের সাথে সময় কাটানোর জন্য দশদিন সময় নিয়ে বেরিয়েছে। মাঝে কাজটাও সেরে নিল। ও শুধু ওর বয়ফ্রেন্ড কে খবরটা জানিয়েছিল বাকি সব কিছু একাই হয়েছে ওর কিছু করতে হয় নি। কথায় আছে না ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এসব ভেবে মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ও ফোনটা নিয়ে একজন কে ফোন দিয়ে বলল,,

“আপনার মেয়ের সাথে যদি দুদিন সময় কাটাতে চান তাহলে আমি একটা লোকেশন পাঠাচ্ছি সেখানে চলে আসুন। তবে খবরদার কেউ যেন কিছু ভুলেও জানতে না পারে। আর যদি জানে তাহলে আপনার মেয়েকে ভুলে যান।”

~চলবে

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৫৭+৫৮

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫৭ (বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন শান্ত হয়ে বসে আছে শাহরিয়ার পরিবারের সামনে। কাল হুট করেই মাহফুজ শাহরিয়ার এসেছিলেন তার কলেজে এই বলতে কালকে তার বাড়িতে যেতে হবে। মেহবিন মানা করেছিল তবে সে অনেক অনুরোধ করার পর মেহবিন রাজি হয়েছে। তবে সে এটাও বলেছে কাউকে পাঠাতে হবে না সে নিজেই চলে যাবে শাহরিয়ার ভিলায়। মাহফুজ শাহরিয়ার আর কিছু বলেন নি। অতঃপর মেহবিন আজ এসেছে শাহরিয়ার ভিলায়। সে আসতেই সবাই খুশিতে গদগদ হয়ে পরেছে। আছিয়া খাতুন আর মিসেস মাহফুজ পারলে তো মেহবিন কে কোলে বসিয়ে রাখে। তাদের এই অতিরিক্ত জিনিস দেখে মেহবিন মনে মনে ভাবলো কিছু তো একটা আছে। তবে প্রকাশ করলো না। আসার পর থেকে একবার ও মুখরের সাথে দেখা হয়নি। এই নিয়ে মেহবিন অবশ্য মনে মনে হাফ ছেড়েছে। দুপুর বেলা হতেই সবাই খেতে বসেছে তখন আগমন ঘটে মুখরের। মুখর আজ মেহবিনের দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খেতে বসলো। আছিয়া খাতুন খুব যত্ন সহকারে মেহবিনকে খাবার খাওয়ালেন। খাওয়া শেষে সকলে সোফায় বসলো। মুখর ও বসলো। আছিয়া খাতুন মেহবিনের পাশে বসলো। আর বলল,,

“মেহু! মেহুই কইতাছি তুমি আবার কিছু মনে কইরো না।তুমিও তো আমার নাতনির মতোই।”

‘সমস্যা নেই দাদি আপনি বলুন।”

‘আসলে তুমি বুদ্ধিমতী বিচক্ষণ মাইয়া। তাই সরাসরিই কই। আমরা সবাই মিলা সিদ্ধান্ত নিছি মুখরের সাথে তোমার বিয়ার।”

আছিয়া খাতুনের কথা শুনে মেহবিন মনে হয় থমকে গেল। ও আগে মুখরের দিকে তাকালো মুখর নিজের মনে কি যেন দেখছে। তা দেখে ও চোখ সরিয়ে আছিয়া খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“এসব এখন আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।

‘আরে সমস্যা নাই আমরা তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি তুমি হয়তো পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চাইছিলে। তোমার কথা ভাইবা আমরা সিদ্ধান্ত নিছি এখন আকদ করে রাখমু তোমার পড়াশোনা শেষ হলে না হয় একেবারে ধুমধাম করে ঘরে তুলবো।”

“আসলে দাদি আমি,,

‘আরে আমার নাতির বয়স হইছে তো বিয়ার। পড়াশোনা শেষ কইরা এহন পুলিশ হইছে। আমার নাতি পুলা খারাপ না। তোমারে সুখেই রাখবো তাছাড়া আমরাও তো আছি। তুমি তোমার মা বাবারে খবর দেও তাগো সাথে আমরা কথা কমু।

মেহবিন এবার শান্ত স্বরেই বলল,,

‘আমার কেউ নেই আমি এতিম। ”

মেহবিনের এই শান্ত স্বরে বলা কথাটা কেউ সহজ ভাবে নিতে পারলো না। আছিয়া খাতুন অদ্ভুত ভাবে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখরও এবার তাকিয়েছে। সবাই কিছুক্ষণ মৌন রইলো। তখন মেহবিন আবার বলল,,

“আমি জানতাম না এবং বুঝতেও পারিনি। এ বিষয়ে কথা বলতে আপনারা আমাকে এখানে ডেকেছেন।”

তখন মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

‘মেহবিন! তোমার পরিবার নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমরা তোমার জন্য আমার ছেলের সাথে প্রস্তাব রেখেছি। তোমার পরিবার দেখে নয় তাই না। এখন বলো তোমার গার্ডিয়ান কি কেউ আছে তার সাথে কথা বলে আমরা তোমাদের বিয়ের কথা পাকা করতে পারি।

তখন মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আমার কেউ নেই আংকেল। আমার আমিই সব! এবং আমার নিজের দায়িত্ব আমার সবকিছু আমি নিজেই বহন করি।”

“তাহলে তুমিই বলো তুমি রাজি কি না?”

মেহবিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,,

“আমার কিছুদিন সময় লাগবে আমি কয়েকদিন পরে আপনাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি। আসছি আংকেল।”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে গেল। এদিকে ড্রয়িংরুমে সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তখন মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

“মা তুমি কোন কথা বললে না যে?”

আছিয়া খাতুন বললেন,,

‘শেষমেষ আমার নাতির বউ একজন এতিম মাইয়া।”

‘মানে কি বলতে চাইছো তুমি?”

‘আরে তেমন কিছুই না আমি ভাবছিলাম আমার নাতি শ্বশুরবাড়িতে মেলা আনন্দ করবো খাইবো দাইবো। কিন্তু কপালে নাই‌। যাই হোক যা হয় ভালোর জন্য হয় আমার কোন আপত্তি নাই।”

বলেই তিনি চলে গেলেন। তিনি ভেতরে ভেতরে খুব একটা রাজি নন। তিনি মেহবিনকে এ কয়েকদিনে বেশ অনেকটাই আপন করে নিয়েছে। কিন্তু তার কেউ নেই শুনে তাকে মুখরের বউ হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার ধারনা একটা পরিবার হীন মেয়ে কখনো পরিবারের সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝবে না। তারওপর একা একা থাকে সে তো আরো বুঝবে না। যদি ওর কারনে পরিবারে ভাঙন সৃষ্টি হয়। উনি ভেতরে ভেতরে মেহবিনকে বউ করা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। এখন তো পেছাতেও পারবে না। কারন সবার আগে উনিই বলেছেন মেহবিনকে নাতবউ করবে। কিন্তু এখন তিনি মনে মনে বলছে মেহবিন যাতে রাজি না হয়।

এদিকে মুখর ভাবছে অন্যকিছু যদি মেহবিন রাজি না হয়। ওর মুখ দেখে কিছু বোঝাও গেল না। ও মেহবিনের সাথে দেখা করতে চাইলো। তার আগে ওর ফোনে একটা মেসেজ এলো। মেহবিন একটা লেকের ধারে ওকে ডেকেছে। মুখর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লো। পড়ন্ত বিকেল মুখর লেকের ধারে গিয়ে দেখলো মেহবিন বেঞ্চে বসে আছে। ও গিয়ে ওপর পাশে দাঁড়ালো মেহবিন মুখরের অস্তিত্ব টের পেয়ে বলল,,

“বসুন!”

মুখর বসলো তখন মেহবিন বলল,,

‘আমাকে বিয়ের করার জন্য পরিবারকেও জানিয়েছেন। আপনি কি ভেবেছেন আপনার পরিবার প্রস্তাব দিলে আমি নাকচ করতে পারবো না।”

মুখর মনে মনে হাসলো ও কিছুটা সেরকমই ভেবেছে। তবে বিয়ের বিষয়টা তো জানায় নি। মুখর বলল,,

“না আমি পরিবারকে জানাই নি বরং তারাই আমাকে জানিয়েছে যে তারা আমার বউ হিসেবে আপনাকে পছন্দ করেছে।”

“আর এই বিষয়ে আপনি কিছুই বলেন নি? যে আপনি আমায় প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমি নাকচ করে দিয়েছি।”

‘না আসলে?”

‘আপনাকে কেউ নাকচ করেছে এটা বলতে আপনি নিজেকে ছোট ভেবেছেন। যে আপনার মতো মানুষ কে কেউ রিজেক্ট করে পারে। এটা আপনার জন্য অসম্মানের।”

“ব্যাপারটা পুরোপুরি তেমন না তবে কিছুটা আছে। আমি আপনাকে আমার প্রাপ্তির খাতায় রাখতে চাই বিহঙ্গিনী।”

“অপ্রাপ্তিকে আপনি এতো ভয় পান কেন? আপনাদের কিসের এতো তাড়া প্রাপ্তির? কই আমি তো কখনো প্রাপ্তি নিয়ে তাড়াহুড়া করিনি। সারাজীবন তো অপ্রাপ্তি নিয়েই কাটিয়ে দিলাম। অপ্রাপ্তি তো কঠিন কিছু না। দিব্যি হেঁসে খেলে নিঃসঙ্গতায় জীবন কেটে যায়।”

মেহবিনের এরকম কথায় মুখর একটু থমকালো। ও কস্মিনকালেও ভাবে নি মেহবিন ওকে এরকম কিছু বলবে। ও বলল,,

“আপনার কিসে ভয় ? আপনি কেন কোন সম্পর্কে জড়াতে চান না। কেন অন্যের দায় নিতে চান না?”

মেহবিন কিছু বললো না এ বিষয়ে তবে এইটুকু বলল,,

“আমাকে প্রাপ্তির খাতায় না রাখলে কি খুব ক্ষতি হবে আপনার?”

“এটা তো আমিও বলতে পারি আমাকে প্রাপ্তির খাতায় রাখলে কি খুব ক্ষতি হবে আপনার?”

মেহবিন মুখরের দিকে তাকালো।মুখর মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহবান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই মানুষটা ওকে যে খুব ভালোবাসে এটা ও মুখরের চোখ দেখেই উপলব্ধি করতে পারছে। মুখরের মুখে হাঁসি থাকলেও চোখ দু’টো ছলছল করছে। মেহবিন কিছু বলবে তার আগে মুখর বলল,,

“আমাকে আপনার প্রাপ্তির খাতায় নাম লেখাতে চান, না অপ্রাপ্তির খাতায় এটা সম্পূর্ণ আপনার ওপর নির্ভর করে। যদি চান প্রাপ্তির খাতায় নাম লেখাতে তবে আমি আমার সর্বোচ্চটা দেব আপনার হতে। কিন্তু যদি অপ্রাপ্তির খাতায় নাম লেখাতে চান তাহলে আমি নিজ থেকেই চলে যাব।

বলেই মুখর চলে গেল। মেহবিন কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারলো না। মেহবিন নিজের সম্পর্কে আর তার জীবন নিয়ে কি ভাবে সেটা একমাত্র ও নিজেই বলতে পারবে। ওর আজ ভিশন অসহায় লাগছে মুখর ওকে ভালোবাসে এটা ও প্রথমদিনই বুঝতে পেরেছিল কিন্তু এই ছন্নছাড়া বিহঙ্গিনীর সাথে ও মুখরের জীবনটা জড়াতে চায় না। ওর নিজের জীবনের কোন ভরসা নেই। তাছাড়া ও বিচ্ছেদ এ ভিশন ভয় পায়। ওর মাকে হারানোর পর থেকে ও তেমনভাবে কাউকেই আপন করতে পারে নি রাইকে করেছিল ও ছেড়ে চলে গেছে।সাবিনা আহমেদ কে করেছিল তিনি চেয়েও মেহবিনের সাথে থাকতে পারে নি। এরপর আলম আহমেদ ও এতো বছর পর ওকে ছুড়ে ফেলেছে এটাও ও ভুলেনি। ওর প্রিয় মানুষ গুলোই ওকে ছেড়ে চলে যায়। এই জন্যই প্রিয় মানুষ বানাতে চায় না। তখনি ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। মেহবিন উঠলো না। সেখানেই বসে বসে ভিজতে লাগলো। বেশ ঘন্টাখানেক ভিজলো তখন হুট করেই বুঝতে পারলো বৃষ্টি ওর মাথার ওপর পরছে না। ও পাশে তাকাতেই দেখলো শেখ শাহনাওয়াজ ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেহবিন সেদিকে তাকিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“কি মেহবিন মুসকান ভয় পেয়ে গেল নাকি?”

মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর কথায় তার ভ্রু কুঁচকে তাকালো আর বলল,,

“মানে?”

“মানে এটাই মেহবিন মুসকান সম্পর্কে জড়াতে ভয় পাচ্ছে। কারন সে তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। সে সম্পর্ক মানেই বুঝে না।”

“একদম ভুলভাল কথা বলবেন না।”

“তাহলে সম্পর্কে জড়াতে এতো ভয় কিসের? সত্যি তো এটাই আপনি ছন্নছাড়া পাখি। আপনি পরিবার সম্পর্ক এগুলো বোঝেন না।’

মেহবিন কিছুই বললো না। চুপ করে রইলো। শেখ শাহনাওয়াজ অনেক কিছু বললেন। মেহবিন তবুও রিয়াক্ট করলো না। সে শান্ত মস্তিষ্কে কথাগুলো শুনলো। মেহবিনকে অপমান ও করলো মেহবিন তবুও কিছু বললো না। সবশেষে মেহবিন মুচকি হেঁসে শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তা এই মেয়েটাকে পরিবারহীন ছন্নছাড়া কে করেছে শেখ শাহনাওয়াজ? আরে বাপরে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম কেউ ভুলে আমাকে রাস্তায় মরার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। আচ্ছা এক্সিডেন্ট এ যদি আমি শুধু আহত না হয়ে একেবারে মরে যেতাম তাহলে কি হতো বলুন তো? বলুন না কি হতো তাহলে আর এই মেয়েটাকে ছন্নছাড়া পাখির মতো বাঁচতে হতো না ঠিক বললাম তো? ইশশ মেয়েটা সম্পর্কের মানে বোঝে না। সে কি করে একটা সম্পর্ক গড়তে পারে বলুন তো?”

লাস্টের কথাগুলো মেহবিন ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে বলল। শেখ শাহনাওয়াজ হতভম্ব হয়ে দেখলো শুধু। মেহবিন উঠে দাঁড়ালো আর লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগলো। ওকে দেখে মনে হচ্ছে পাঁচ বছরের কোন বাচ্চা বৃষ্টির মজা নিচ্ছে। মেহবিনের ঠান্ডা মাথায় করা অপমানে শেখ শাহনাওয়াজ এর মাথা নিচু হয়ে গেল। সে অস্ফুট স্বরে বলল,,

“ঠান্ডা মাথায় মুচকি হেসে অপমান করা আর ঠান্ডা মাথায় খুন করা একই ব্যাপার। আর আপনি ঠান্ডা মাথায় খুন করতে বেশ ভালোই পারেন আম্মা।

আমি তো এসেছিলাম আপনাকে রাগিয়ে দিতে যেন।আপনি রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত নেন মুখর কে বিয়ে করার। মুখর খুব ভালো ছেলে আর এই মুহূর্তে আপনার একটা ছাদ দরকার আর তাছাড়া মুখর আপনাকে অনেক সুখে রাখবে। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম আপনি তো সবার মতো নন। যে রাগের মাথায় কথা বলবে বা সিদ্ধান্ত নেবে।তবে আমি তো বুঝতেই পারলাম না আপনি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনি এমন কেন আম্মা আপনার কি আমার ওপর একটুও ভরসা নেই।”

রুমে ফিরেই মেহবিন বুঝতে পারলো ওর জ্বর আসছে। ও দু’টো নাপা খেয়ে শুয়ে পড়লো। বাকিটা না হয় কাল দেখা যাবে। মেহবিন দুদিন সময় নিল অনেক ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল যে ও মুখরের প্রাপ্তির খাতায় নাম লেখাবে। ও চোখ বন্ধ করলেই মুখরের ছলছল চোখটা দেখতে পায় যা ওকে অসহ্যকর পীড়া দেয়। মেহবিন মাহফুজ শাহরিয়ার কে ফোন করে বলল সে রাজি। তবে সে অনুষ্ঠান করতে রাজি নয় এখন। মুখর তো খুশিতে প্রায় কেঁদেই ফেললো। তবে আছিয়া খাতুন বললেন ওদের বিয়ের কথা শুনে বলল কাউকে কিছু আগেই না জানাতে আর আকদের ডেটটা দুই মাস পর করার কথা বললেন। আর একদম কাছের আত্মীয়দের পনেরো দিন আগে না হয় বলা যাবে। আছিয়া খাতুনের এরকম কথায় সবাই অবাক হলো কিন্তু কেউ কিছু বললো না। যেহেতু অনুষ্ঠান মেহবিনের পড়াশোনা শেষ হলে করা হবে তাই। এদিকে এসব বিষয়ে মেহবিন কে কিছু বলা হলো না। মেহবিন রাজি হয়েছে দেখে মুখর ওকে একটা রেস্টুরেন্টে ডাকলো। মেহবিন আর না করলো না। সে চলে গেল। মুখর একটা কেবিন বুক করেছে মেহবিনের জন্য। মেহবিন কেবিনের ভেতরে ঢুকে যেতেই মুখর মেহবিনের হাত ধরে নাচতে লাগলো আর গানের সুরে বলতে লাগলো,,

‘পাঞ্জাবি ওয়ালা,, পাঞ্জাবিওয়ালা তোমার বিয়া লাগছে।”

মুখরের এরকম আচরনে মেহবিন হতভম্ব হয়ে গেল। মেহবিন বলল,,

‘এসব কি?”

মুখর বলল,,

‘ওহ তোমার ভালো লাগছে না নাচতে।”

বলেই মেহবিন কে ছেড়ে দিল আর নিজে একা একাই নাচতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর পর বলছে,,

“পাঞ্জাবিওয়ালা, পাঞ্জাবিওয়ালা !”

মুখরের এমন পাগলামো দেখে না চাইতেই মেহবিনের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। অতঃপর মুখরের নাচ শেষ হলে মুখর বলল,,

“বুঝলে বিহঙ্গিনী এটা হলো মুখর শাহরিয়ার এর খুশির বহিঃপ্রকাশ।”

মেহবিন মুখরের মুখে তুমি শুনে তেমন একটা ভাবান্তর হলো না। তবে সে হেঁসে বলল,,

“আপনি পাগল হয়ে গেছেন মুখর শাহরিয়ার!”

“তা তো একটু হয়েছিই। শুনো বিহঙ্গিনী এই মুখরের মাঝে ছোট্ট একটা অবুঝ বালক আছে। যা সবার কাছে অপরিচিত । কিন্তু তোমার কাছে পরিচিতি পাবে। একে কিন্তু তোমাকেই সামলাতে হবে।”

মেহবিন মুচকি হাসলো। মুখর ওকে নিয়ে বসিয়ে দিল আর বলল,,

“আমার আলুওয়ালা কাচ্চি ভিশন পছন্দের আর আমি এটা শুধু পছন্দের মানুষদের সাথে খাই। তোমার আমার প্রথম খাবারটা না হয় আলুওয়ালা কাচ্চি দিয়েই হোক।”

“আপনি কাচ্চি খাওয়ার জন্য এখানে ডেকেছেন?”

‘না আমার আনন্দ দেখাতে আজকে আসতে বলেছি। যতোটুকু তোমায় চিনি তুমি ট্রিপিক্যাল প্রেমিক প্রেমিকা ওগুলো পছন্দ করো না।”

‘হুম!”

‘যাই হোক ঐ যে চলে এসেছে খাবার খাওয়া শুরু করো।”

মেহবিন আর মুখর খাওয়া শেষ করলো। মুখর অনেক কিছু বললো আর মেহবিন মনোযোগ দিয়ে শুনে গেল। শেষে বলল,,

‘বিহঙ্গিনী আমি তোমার কাব্য হতে চাই এবারও কি বাঁধ সাধবে?”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“না এবার আর বাধ সাধবো না। বিহঙ্গিনীর জীবনে না হয় একজন রুপকথার কাব্যের আগমন ঘটুক।”

মুখর হাসলো প্রাপ্তির হাঁসি। মুখর মেহবিনকে বলল সবসময় কাব্য বলেই ডাকতে নয়তো পাঞ্জাবি ওয়ালা। মেহবিন বলল ঠিক আছে। এরপর যে যার গন্তব্যে চলে গেল।

তার দু’দিন পর নাফিয়া ওর কিছু কেনার জন্য মার্কেটে গেলে মেহবিনের সাথে দেখা হয়। নাফিয়া মেহবিনের ডাকে মেহবিন ও ওর কাছে যায়। মেহবিন একাই এসেছিল আর নাফিয়াও। দুজনে একসাথে শপিং করতে লাগলো। মেহবিন আর নাফিয়া নিচে আসতেই মেহবিন আর নাফিয়া কে উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মেহবিন বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে। মেহবিন আশে পাশে খুঁজতে গিয়ে দু’টো লাঠি দেখতে পায়। মেহবিন একটা দিয়ে যে নাফিয়াকে উঠানোর চেষ্টা করে তাকে আঘাত করে। সে একটু সরে গেলেই মেহবিন হাতের লাঠিটা নাফিয়াকে দেয়। আর নিজে আরেকটা লাঠি দিয়ে মারতে থাকে এমন সময় কেউ পেছন থেকে মেহবিনের হাতে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। ও হাত চেপে ধরে। তখন সামনে তাকাতেই ও দেখতে পায় নাফিয়াকে নিচে ফেলে একজন পেটে বারবার লাথি মারছে। নাফিয়া চিৎকার করছে জোরে জোরে কিন্তু কেউ আগাচ্ছে না। মেহবিন নিজের সব ভুলে সেই লোকটাকে গিয়ে মারতে থাকে। ও মারামারিতে এক্সপার্ট তাই সেই তিনজন ওর সাথে পেরে উঠে না। ওরা তিনজন পালিয়ে যায়। মেহবিন সবার দিকে তাকিয়ে নাফিয়ার দিকে তাকালো ও ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। মেহবিন দেরি না করে নাফিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ও মুখরকে ফোন করে সব জানালো। নাফিয়ার কথা শুনে পুরো শাহরিয়ার পরিবার হাসপাতালে চলে গেল। মেহবিন যে হাতে আঘাত পেয়েছে এটা ও কাউকে দেখালো না ওরনা নিয়ে ঢেকে রইলো। মুখর মেহবিনের কাছে জানতে চাইলো কারা ছিল মেহবিন বলল সে চেনে না। মুখর মেহবিনকে কাউকে কিছু জানাতে বারন করলো। ও ওর পরিবার কে বলেছে নাফিয়ার ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। ডাক্তার বেরিয়ে বলল,,

“নাফিয়া পেটে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে আর এমন জায়গায় আঘাত পেয়েছে যার জন্য ওর মা হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। মাত্র দুই পার্সেন্ট।”

সব শুনে শাহরিয়ার পরিবারের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। সবাই খুব ভেঙে পড়ে। মেহবিন শান্ত ভাবে সবাইকে শান্তনা দেয়। নাফিয়ার জ্ঞান ফিরলে নাফিয়া সবকিছু বলে দেয়। মেহবিনকে সবাই ধন্যবাদ জানায় ওকে বাঁচানোর জন্য। আছিয়া খাতুন মেহবিনকে অনেক আপন করে নেয়। তবে নাফিয়াকে আগেই জানানো হয় না ও মা হওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। সে কয়েকদিনে মেহবিনের ও বাড়িতে যাওয়া আসা হয়।তবে হুট করে একদিন আছিয়া খাতুনের কাছে একজন ছবি পাঠায় যেখানে মেহবিন লাঠি দিয়ে নাফিয়ার পেটে আঘাত করছে। এটা মুলত লাঠি দেওয়ার ছবি সেদিনকার এডিট করে এমনভাবে করা হয়েছে যেন মেহবিনই মারছে। আর ফোন করে জানায় লোকগুলো মেহবিনকেই ধরতে এসেছিল আর নাফিয়া কে দেখে ওকেও তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। আছিয়া খাতুন ধরে নেয় মেহবিনের কারনেই এসব হয়েছে। কারন মেহবিন কে ধরতে না এলে নাফিয়ার সাথে এসব হতো না। তিনি সবকিছুর জন্য মেবিনকেই দায়ী করে। নাফিয়া শুধু বলেছিল গুন্ডারা এটাক করেছিল কিন্তু এটা বলেনি ওর পেটে আঘাত করেছিল। উনার সবকিছু মাথায় তালগোল পাকায়। মেহবিনের জন্য নাফিয়ার এই অবস্থা উনি মানতে পারছেন না। উনি কেঁদে ফেলেন কাকে কি বলবে ও। তাই তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু মেহবিনের জন্য হয়েছে সেহেতু মেহবিনকেই চুকাতে হবে। নাফিয়া মা হতে পারবে না শুনে কোন ছেলেই ওকে বিয়ে করতে চাইবে না। তাই ওর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ও নিজেও স্বামী নিয়ে সংসার করতে পারবে না। এটাই মেহবিনের শাস্তি রাখেন। কিন্তু তিনি কাউকেই বলেন না বিষয়টা এমন কি মেহবিনকেও না। পরেরদিন তিনি সবাইকে ডাকেন এমনকি মেহবিন কেও। উনি মুখর আর মেহবিন কে শর্ত দেন ওদের আকদ হওয়ার পর কেউ যেন না জানতে পারে ওরা বিবাহিত। আর নাফিয়ার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত মেহবিনের এই বাড়িতে বউ হিসেবে আসা চলবে না। তবে এ বাড়িতে তার আসা যাওয়া চলবে। মানে টোটালি বউ হিসেবে শাহরিয়ার পরিবারের সাথে ওর কোন সম্পর্ক থাকবে না। আর বিয়েটা একদম সিমপল নরমাল ভাবে হবে। শুধু শাহরিয়ার পরিবার জানবে আর কেউ না। শর্তটা যদি না মানে তাইলে বিয়া হবে না। আর যদি বিয়া করতেই হয় তাহলে শর্ত মেনেই বিয়ে করতে হবে।

এরকম শর্ত শুনে সবাই অবাক হয়। সবাই এটার মতবিরোধ করে কিন্তু মেহবিন চুপচাপ মেনে নেয়। তবে ও বলে ওর দিক থেকে দুজন মানুষ ওর পক্ষ থেকে থাকবে। মেহবিনের কথা শুনে আছিয়া খাতুন রাজি হয়ে যায়। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে মেহবিন আর মুখরের বিয়ে হয়ে যায়। আর বিয়েতে মেহবিনের পক্ষ থেকে দুজন আর কেউ না তারা হলো আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ। তারা দুজন মাস্ক পরে এসছিলেন। সাক্ষী হিসেবে সাইন করে আবার চলে যান। কেউ তাদের সম্পর্কে জানতে পারে না। সেদিনের জন্য আছিয়া খাতুন ওদেরকে শাহরিয়ার বাড়িতে নিয়ে যান। মেহবিন আর মুখরের রাত গল্প করেই কাটে। মেহবিন পরের দিন হলে ফিরে যায়। মুখরের ইচ্ছে হলেই সে মাস্ক ক্যাপ পরে মেডিকেলের বাইরে তার বউয়ের জন্য অপেক্ষা করে। আর মেহবিন বের হলেই তাকে নিয়ে ঘুরতে যায়। এভাবে কতোদিন কতবার ঘুরেছে তার ইয়ত্তা নেই। তবে এর মাঝে আরবাজ মিশু কে জানায় ওদের বিয়ের ব্যাপারটা তবে শর্তের কথা জানায় না। যদি জানাতো তাহলে আরবাজ হয়তো বোনের জন্য আরো আগে নাফিয়াকে বিয়ে করতো। মেহবিন ও মাঝে মাঝে সবার সাথে ফোনে কথা বলে এর মধ্যে মেহবিনের ওর মামার সাথে পরিচয় হয়। মেহবিন সে বিষয়ে মুখরকে জানায় এও জানায় তার মামা তাকে বাইরের দেশ থেকে পড়াশোনা করতে বলছে। যাতে সে উন্নত ভাবে সবকিছু শিখতে পারে। আর এটাও বলে আরবাজ ওর ভাই আর শেখ শাহনাওয়াজ ওর বাবা। তবে ও কেন ওনাদের সাথে থাকেন না এটা জানায় না। মেহবিনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা কয়েকদিন পর। এখন ফর্মফিলাপ চলছে। মুখরের মা ওকে যেতে বলেন। মেহবিন ও খুশিমনে যায়। মুখরের মা তাকে আদর যত্ন করে খাওয়ান । মুখরও বাড়িতে ছিল। হুট করে মুখর বলে,,

“তোমার পরীক্ষার ফর্মফিলাপ কবে করবে? ডেট তো পুরশুদিন শেষ।

মেহবিন বলল,,

“এই তো করবো কাল?”

তখন আছিয়া খাতুন বললেন,,

“তা এই জন্য মনে হয় আজ এখানে টাকা নিতে আইছো? সেই জন্যই তো কই এতো দিন দেখলাম না এহন এনে আইছো?

হুট করে আছিয়া খাতুনের কথায় সকলে চমকে উঠে। তিনি জানেন না মুখরের মা ওকে ডেকেছে। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“না দাদি জান এর জন্য আসি নি। মা ডেকেছিলেন তাই এসেছি।”

“হ সবই বুঝি তোমার মতো এতিম মাইয়া বিয়া করছেই তো তার খরচ চালানোর লাইগা। প্রথমে তো খুব দাম দেহাইলা দুইদিন সময় নিলা। তারপর রাজি হইলা। সব বুঝি আমি চুলগুলা এমনিই পাক ধরে নাই। নিজে তো হলে থাকো টিউশনি করো শুনলাম পার্ট টাইম জব ও করো। পড়াশোনার লাইগা এইসব যাতে না করতে হয় এই জন্য রাজি হইছাও আমার নাতিরে বিয়া করার লাইগা। এতো বড় লোক বাড়ি টাকা পয়সার কোন অভাব নাই‌। এই জন্য শর্ত দিলাম তোমারে তাও তুমি রাজি হইলা। লোভে পইরা আমার নাতিরে বিয়া করলা।”

অপমানে মেহবিনের হাত শক্ত হয়ে আসে। সে এক মিনিট মৌন থেকে বলল,

“আচ্ছা মেনে নিলাম লোভে পড়ে বিয়ে করেছি। তাহলে আপনার নাতিকেই জিজ্ঞেস করুন আপনার নাতি আমার পেছনে আমার ভরন পোষনের জন্য কতটাকা খরচ করেছে। আর হ্যা আপনি বোধহয় জানেন না আমি এখনো টিউশনি আর জব দুটোই করি। আমার নিজের খরচ আমি নিজে চালাই। কয়েক মাস তো হলো জিজ্ঞেস করুন আপনার নাতি কে? কতটাকা আমি তার কাছে থেকে নিয়েছি?”

মেহবিনের কথায় আছিয়া খাতুন একটু দমলেন। নাফিয়ার ব্যাপারটা জানার পর থেকে কেন যেন মেহবিনকে উনার সহ্য হয় না। তাই তিনি বলল,,

‘নাও নাই সামনে নিবা এহন ভালোগিড়ি দেহাইতেছো। বছর ঘুরলেই নিজের আসল রুপ দেহায় দিবা। তোমাগো মতো পরিবারহীন মাইয়া গো ভালো কইরা চেনা আছে আমার। তোমরা সবার সাথে ভালো ব্যবহার কইরা তাগোর কাছে ভালো সাজো। যেমনে আমার আর মাহফুজের কাছে সাজছিলা। তোমাগো কাছে সম্পর্কের কোন দাম নাই তোমাগো কাছে টাকায় সব। একজন এতিম মাইয়া সম্পর্কের গুরুত্ব কিভাবে বুঝবো। কোনদিন পরিবার আছিল নাকি বুঝবো।

মেহবিন শান্ত ভাবে আছিয়া খাতুনের দিকে তাকালো আর মুচকি হেসে বলল,,

“আজ বুঝলাম সব! নিজের খেয়াল রাখবেন আসছি।

বলেই মেহবিন চলে গেল। মুখর ওর পেছনে গেল আর পুরো শাহরিয়ার পরিবার শুধু দেখে গেল। মুখর মেহবিনের হাত ধরে বলল,,

“বিহঙ্গিনী?”

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫৮
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“যেই স্থানে অপমান হয় সেই স্থান ত্যাগ করাই উত্তম। এটা আমি আমার জীবনের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিয়েছি। আমি অন্য কারো মতো সতী সাবিত্রী নই কাব্য। আমার কাছে আমার আত্মসম্মান সবার আগে। আর আমি সুখের লোভী নই যে একটু স্বামীর সাথে সুখী থাকার জন্য সব অপমান সহ্য করবো।

আত্মসম্মানবোধ মানে, অহংকারপূর্ণ নাকউঁচু স্বভাব নয়, আত্মসম্মানবোধ মানে যা কিছু আমাকে ছোট করে, তা থেকে দূরে থাকা!

~আতিক উল্লাহ (হাফি.)

মেহবিনের কথায় মুখর ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমি সেসব কিছুই বলতাম না তোমায়।”

মেহবিন শান্ত স্বরে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তাহলে কি বলতেন আপনি আমায়?’

“যেখানে আমার স্ত্রীর অপমান হয় আমিই চাইনা সেখানে আমার স্ত্রীকে রাখতে। আমি জানিনা দাদিজানের কি হয়েছে যার কারনে উনি এসব বললেন। তবে আমি এইটুকু জানি দাদিজান তোমায় ভিশন স্নেহ করতেন আর এইটুকুও বুঝতে পারছি আজ আমার স্ত্রীর অপমান হয়েছে।”

“আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন বলুন তো!”

“তেমন কিছু না এই মুহূর্তে তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে আমি তোমার সাথে আছি। মনে রেখো বিহঙ্গিনী এই কাব্য তার বিহঙ্গিনীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।তাই যাই হোক না সে সবকিছু মেনে নেবে তবুও বিহঙ্গিনীকে ছাড়বে না।”

মেহবিন শান্ত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমাদের সাময়িক বিচ্ছেদ এর সময় হয়ে এসেছে কাব্য । এই বাড়িতে আমি সেদিনই পা রাখবো যেদিন নাফিয়া আপুর বিয়ে হয়ে যাবে আর আমাকে সসম্মানে গ্ৰহন করা হবে। এখন আর বাঁধা দেবেন না । আসছি আমি।

বলেই মেহবিন চলে গেল। মুখর ভাবলো এখন ওকে একটু একা ছেড়ে দেবে। যাতে ও সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মেহবিন শান্ত ভাবে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলো। সবশেষে ও এটাই পেল ও বলল,,

“তুমি তোমার মামার কথামতো নিজের টাকার ভাগ থেকে খরচ করে বিদেশ চলে যাও মেহবিন মুসকান। যদিও এটা তোমার নয় তোমার মায়ের সুত্রে পেয়েছো। কিন্তু এর হকদার তো তুমি তাহলে তো তোমার কারো সাহায্য লাগছে না। এটা তোমার মামার টাকা নয় এটা তোমার মায়ের টাকা। আর মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে এবার তোমাকে তোমার মায়ের টাকা থেকেই তোমার সাহায্য নিতে হবে ‌। এর মাধ্যমেই তুমি নিজের পড়াশোনা কম্পিলিট করো আর নিজের পায়ে দাঁড়াও মাথা উঁচু করে। এতে দাদিজান কে উচিত জবাব দেওয়া হবে। তবে একটা জিনিস খুব খারাপ হলো এই প্রথম মেহবিন মুসকান একজন মানুষ কে চিনতে ভুল করলো। আচ্ছা সত্যিই কি ভুল করলো যদি সে ভুল করেই থাকে তাহলে আছিয়া খাতুনের চোখ ছলছল কেন করছিল তখন। উনি কি সত্যিই আমাকে এরকম ভাবেন নাকি অন্য কোন কিছু আছে। এই মুহূর্তে এসব ভাবার সময় নেই সে তোমার আত্মসম্মান এ আঘাত করেছে এর উচিৎ জবাব তো দিতেই হবে।”

মেহবিন আর বেশি কিছু চিন্তা করলো না। মনোযোগ পুরো পরীক্ষায় দিলো। এদিকে মুখর শুধু এইটুকুই জানালো মেহবিন ওর থেকে টাকা পয়সা এখনো অব্দি নেয় নি। আর কিছু বলেনি। দাদির সাথে কথাও বলেনি।দেখতে দেখতে মেহবিনের পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেল। এর মাঝে মেহবিন শাহরিয়ার পরিবারের কারো সাথেই কথা বলে নি। মেহবিনের পরীক্ষার শেষের দিন। মেহবিন পরীক্ষা দিয়ে বের হতেই দেখলো মুখর পাঞ্জাবি মাস্ক আর ক্যাপ পরে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। মেহবিন মুচকি হেঁসে সেদিকে গেল।ও এই মানুষটাকে খুব যত্ন করে কারন এই মানুষটা ওকে বিশ্বাস করে আর ভালোবাসে। মেহবিন যেতেই মুখর বলল,,

‘মিসেস বিহঙ্গিনী আজকের দিনটা কি আপনি আপনার কাব্যের নামে করতে পারবেন?”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘কেন নয়!”

মেহবিন আর মুখর সারাদিন একসাথে ঘুরলো। ফুচকা খেল মেহবিনের ফুল অনেক পছন্দ তাই ফুল কিনে দিল। বিয়ের পর প্রথম ঘুরতে যাওয়ার দিন মেহবিন বলেছিল,,

‘আপনার কাছে বেশি কিছু চাইনা শুধু এইটুকু চাই। কথা দিন আমাদের প্রতিটা সাক্ষাতে আপনি আমার জন্য ফুল আনবেন?”

মুখর সেদিন মুচকি হেসে কথা দিয়েছিল। এরপর থেকে যতোবার দেখা হতো মুখর ওর জন্য ফুল আনতো। মেহবিন মুখর কে ওর বিদেশ যাওয়ার কথাটা বলল। প্রথমে কথাটা শুনে মুখর থমকে গিয়েছিল তবে মুচকি হেসে বলেছিল,,

‘আমি জানি তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে বুঝে শুনেই নেবে। সমস্যা নেই আমি তোমার সাথে আছি। কবে যাবে আমাকে বোলো আমি এয়ারপোর্ট এ যাবো তোমাকে ছাড়তে। তবে হ্যা যাওয়ার আগে তোমার কাছে পুরোদিন আর রাতটা কিন্তু আমার চাই।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“ঠিক আছে।”

এরপর কয়েকদিন পর মেহবিনের যাওয়ার সময় হয়ে এলো। মেহবিন আর মুখর দু’জনে মিলে প্ল্যান করলো সারাদিন পাঞ্জাবি আর শাড়ি পড়ে দুজনে কাটাবে। হলোও তাই মুখর আর মেহবিন সারাটা দিন তাদের নিজের মতো কাটালো। রাতটাও মুখরের আবদারে ভালোবাসাময় ভাবেই কাটলো।

অতঃপর মেহবিনের বিদেশ যাওয়ার দিন। মুখর মেহবিন কে ছাড়তে এসেছে এয়ারপোর্টে। মেহবিন মুখরের পরিবারের বাকি সবাইকে ফোন করে বলেছে সে বিদেশ যাচ্ছে পড়াশোনার জন্য। বিষয়টা আছিয়া খাতুনের কানেও গেছে তবে মেহবিন তার সাথে কোন কথা বলেনি। চৌধুরী পরিবার তাকে এয়ারপোর্টৈ ছাড়তে চাইছিল কিন্তু মেহবিন তাকে সাফ মানা করে দেয়। ওর মানা করার জন্য তারা চেয়েও আসতে পারেনি। মুখর গাড়ি থেকে নেমে মেহবিন কে হাত ধরে নামালো। মুখর আজ কালো পাঞ্জাবি পরে এসেছে মুখে অবশ্য মাস্ক ও আছে। সারাটা রাস্তা মুখর একটা কথাও বলেনি ড্রাইভ এর পাশাপাশি কালো বোরকা আর হিজাব পরিহিতা মেহবিন নামক মেয়েটাকে দেখে গেছে। মুখর চুপচাপ দেখে মেহবিন হেঁসে বলল,,

“আজ আপনি শোক দিবস পালন করছেন নাকি কাব্য? যে আমাকে বিদায় দিতে কালো পাঞ্জাবি পরে এসেছেন।”

মুখর মেহবিনের কথায় ওর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,,

বিহঙ্গিনী বাঁধিছে বাসা
আমার গাছের প্রান্তরে,
খাই দাই ঘুড়ে বেড়াই
মনের সুখে গান করে।

আচমকা এক কালবৈশাখী ঝড়ে
ভাঙ্গিয়া গিয়াছে বাসা
উড়িয়া গিয়াছে বহু দূরে
আমায় করিয়া নিরাশা।

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“এর জন্য কি আমি দায়ী কাব্য?”

মুখর মাথা দিয়ে না করলো। তখন মেহবিন মুচকি হেঁসে আবার বলল,,

“আল্লাহ তায়ালা বলেন,,

” আমি তোমাদের পরস্পরকে পরস্পরের জন্য পরীক্ষার মাধ্যম বানিয়েছি। তোমরা কি সবর করবে? তোমাদের রব সব কিছু দেখেন। ”
( আল ফুরকানঃ২০ )
ধৈর্য্য ধারন করুন ইনশাআল্লাহ শেষটা সুন্দর হবে। লেখক খায়রুজ্জামান খান সানি এর একটা উক্তি আছে,,
❝ভালোবাসা সুন্দর। ভয়ংকর রকমের সুন্দর।কেউ পেয়ে ভালোবাসতে জানে না।কেউ হারিয়ে ভালোবাসতে জানে।আবার অপূর্ণতাই যেনো ভালোবাসার পূর্ণতা এনে দেয়।❞

কিন্তু আমাদের মাঝে পূর্ণতা তো আছে তবে সাময়িক অপূর্নতার মধ্যে দিয়ে।”

মুখর মেহবিনের গালে হাত রেখে বলল,,

‘আমি জানিনা তোমার ভেতরে কি চলছে তবে আমি জানি তুমি নিজ ইচ্ছায় যাচ্ছো না। যাই হোক ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে। নিজের খেয়াল রেখো আর হ্যা অবসর সময়ে যদি আমায় মনে পড়ে তাহলে না হয় আমাকে একটা কল করে নিও। আর হ্যা এটা ভুলে যেও না আবার ভালোবাসি বিহঙ্গিনী।

মুখরের চোখ দু’টো ছলছল করে উঠলো। মুখর দুই পা পিছিয়ে এলো। আবার মেহবিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেহবিন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ও এগিয়ে এসে মেহবিন কে টাইট করে জড়িয়ে ধরল। মেহবিন এবার ও কোন রিয়াক্ট করলো না তবে ও নিজেও জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর মেহবিন কাঁধে ভেজা অনুভব করলো ও বুঝতে পারল মুখর কাঁদছে। মেহবিন মনে মনে বলল,,

“তার সাময়িক বিচ্ছেদেই এতো অশ্রু না জানি তার একেবারে বিচ্ছেদ এ কি হতো? তার ভালোবাসা এতোটা গভীর যে তার সাথে আমায় সবসময় আঁটকে রাখে। তার যত্ন আমায় বারবার মুগ্ধ করে। তার সাক্ষাৎ আমায় বারংবার আনন্দ দেয়। তার বিচ্ছেদ ও আমাকে ততটাই পীড়া দিচ্ছে। আর তার অশ্রু গুলো আমায় ভয়ঙ্করভাবে পীড়া দিচ্ছে।

আমি প্রকাশ করি না তাই বলে এমন নয় যে আমি ভালোবাসি না। আমি কাঁদি না তার মানে এই নয় আমাদের বিচ্ছেদ এ আমার কিছু যায় আসে না।’

মনে মনে বললেও মুখ ফুটে বলা হলো না। কিছুক্ষণ পর মুখর মেহবিন কে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালো। মেহবিন হেঁসে বলল,,

“বিহঙ্গিনীর কাব্যকে অশ্রুতে মানায় না মিস্টার মুখর শাহরিয়ার। তাকে সর্বদা হাসিমুখেই মানায়।”

মুখর চোখের পানি মুছে হাঁসি ফুটিয়ে বলল,,

“মুখর শাহরিয়ার তো অবুঝ বালক। তাই না চাইতেও কেঁদে ফেলে। বুঝোই তো বাচ্চা মানুষ।”

মুখরের কথায় মেহবিনের হাঁসিটা প্রসারিত হলো। আর বলল,,

“আমার এই হাঁসি খুশি বাচ্চা মানুষটাকেই ভালো লাগে। আর শুনুন যখন কোন কারনে আপনি অনেক খুশি হবেন তখন আমায় ফোন দেবেন আপনার গানবাজনা ছাড়া নাচ দেখবো। আর হ্যা আলুওয়ালা কাচ্চি খেতে গেলে দুই প্লেট নেবেন। একটা আমার আরেকটা আপনার। আপনি আমার প্লেট থেকে সব আলু নিয়ে নিবেন ঠিক আছে।”

মুখর হেঁসে বলল,,

“ঠিক আছে।”

মেহবিন কে এখন যেতে হবে। তাই মুখর ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,,

‘নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“ইনশাআল্লাহ!

মেহবিন কয়েকপা এগিয়ে গেল আবার পেছনে তাকালো দেখলো মুখর নিচু হয়ে চোখ মুচছে। ও মুখরকে ডাক দিল,,

‘কাব্য?”

ও মেহবিনের দিকে তাকালো। মেহবিন হাত দিয়ে দেখাতে লাগলো,,

‘যদি কখনো আমায় মনে পড়ে তখন একটা চিঠি লিখিয়েন। আর হ্যা তাতে তার সাথে ফুল রাখতে ভুলবেন না কিন্তু। আমি যখন ফিরে আসবো তখন গুনে গুনে সব চিঠি নেব আর মনোযোগ সহকারে পড়বো। তখন দেখবো আপনার ভালোবাসা।”

মেহবিনের হাত দিয়ে দেখানো লিঠি লেখার দৃশ্য মুখরের মন কাড়লো। ওর মুখে না চাইতেও হাঁসি ফুটে এলো। তখন মুখর চিৎকার করে বলল,,

“ভালোবাসি বিহঙ্গিনী।”

মেহবিন হেঁসে ভেতরে ঢুকে গেল। মুখর সেদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। অতঃপর বাড়ি চলে এলো। সোজা নিজের রুমে চলে গেল। ওকে আজ কেউ ডিস্টার্ব করলো না। রাত হতেই মেহবিন কে ভিশন মনে পরতে লাগলো। ও ছাদে গেল চাদ উঠেছে আজ। মুখর কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখর আনমনে বলে উঠলো,,

রাতের আকাশ রাতের শহর
চাঁদের আলো নির্জন প্রহর।
ঘুমন্ত জাগরণী মন আমার
দূরন্ত স্ফুলিঙ্গ প্রেম তোমার।

ভোরের আলো ভোরের আকাশ
নির্জল নিষ্ফলা শীতলা বাতাস।
চাইলেই ধরা যায় না ভালোবাসা
নির্বাস নিষ্পেষীত কাছে আসা।

উত্তপ্ত বেলা উত্তপ্ত এই শহর
ক্লান্ত মন অলস এই দুপুর।
বলতে গিয়েও কথারা যায় থেমে
জমা হয়ে যায় উড়ন্ত চিঠির খামে।

বলতে পারো কিসের এতো জ্বালা
তোমার ভালোবাসা না প্রেমের খেলা।
ফেরারী মন খুঁজে বেড়ায় ঠিকানা
তোমার কথা ভেবেই একা দিন গোনা।
~শাকিল হোসেন (কাব্যের বিহঙ্গিনীর পাঠক বিহঙ্গিনীর জন্য লিখে পাঠিয়েছেন)

_____________

বর্তমান,,,

মুখর মেহবিন কে বাড়ি এনে অন্যরুমে ঢুকলো। আর বলল,,

‘মিসেস বিহঙ্গিনী আজ আপনার কাব্য আপনাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে দেবে।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“অতঃপর সে চাদর আমায় ঢেকে দিক।”

____________

‘এই যে পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা তুমি কাইল রাইতে এতো দেরি কইরা ঘুমাইছো ক্যা? রাইতে কি চুরি করবার গেছিলা?

মুখর সবে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় আসতেই তাজেলের কথায় ও ভ্যাবলার মতো ওর দিকে তাকালো। ও উঁকি দিয়ে রান্নাঘরে তাকালো মেহবিন মুচকি হাসছে। মুখর বলল,,

“কেন নেত্রী তোমার কেন মনে হলো আমি চুরি করতে গিয়েছিলাম?”

‘সকাল হইছে কুনশুম আর তুমি উঠলা এহন। রাইতে কি করছো তুমি?”

“আরে তেমন কিছু না নেত্রী। কোথাও যাই নি রাতে তেমন ঘুম হয়নি তো তাই।”

“কেন ঘুম হয় নাই?”

মেহবিন এবার জোরেই হেঁসে ফেলল মেহবিনের হাঁসি দেখে মুখর বলল,,

“এই যে তোমার ডাক্তারের জন্য?”

তাজেল ছোট ছোট করে চোখ করে বলল,,

“কেন ডাক্তার কি করছে? ডাক্তার তুমি কি করছাও পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালারে?”

“এবার নেত্রীর জবাব দাও নেত্রীর ডাক্তার?”

মেহবিনের হাঁসি মুখটা মুখর আর নেত্রীর কথা শুনে নিভে গেল। মেহবিন বলল,,

“আমি কিছু করি নি নেত্রী। নতুন জায়গা দেখে তোমার পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা ঘুমাতে পারেনি। এখন তুমি চুপ করে বসো আমি ডিম নিয়ে আসছি।”

মুখর বিরবির করে বলল,,

‘এরকম কথাটা আমার মাথায় কেন এলো না। আর বিহঙ্গিনী কি সুন্দর করে নেত্রীকে বুঝিয়ে দিল। এই না হলে মুখর শাহরিয়ার এর বউ।”

ডিমের কথা শুনে তাজেল বলল,,

“আমার ডিম ভাল্লাগে না।”

“ভালো না লাগলেও খেতে হবে।”

“ধরু আমার পাওডা খালি ঠিক না। তাইলে তুমি ক্যা তোমার চৌদ্দ গুষ্টি আমারে ডিম খাওয়াইতে পারতো না। কারন আমি পলাই যাইতাম।”

মেহবিন হেঁসে ডিমটা এগিয়ে দিয়ে বলল,,

‘খুব তাড়াতাড়ি তোমার পা ঠিক হয়ে যাবে। আপাতত ডিম খাও যখন তোমার পা ঠিক হবে তখন পালিয়ে যেও।”

মেহবিন তাজেলের হাতে ডিমটা ধরিয়ে দিল। মেহবিন ভোরে উঠেই গোসল সেড়ে নামাজ পরে রান্না করতে লেগে গেছে। এতো কিছুর মধ্যে মুখর কে তোলা হয়নি। তাজেল ভোরেই উঠেছে। মুখর কে না দেখতে পেয়ে ওর কথা জিজ্ঞেস করতে মেহবিন বলেছে কাল রাতে দেরি করেছে ঘুমাতে তাই উঠে নি। এই জন্যই মুখর কে দেখে তাজেল প্রশ্ন করলো। মেহবিন ঘরে গিয়ে গোসলের জামাকাপড় এনে মুখরের হাতে দিয়ে বলল,,

“নিন ফরজ গোসল শেষ করে আসুন তারপর ফজরের কাযা নামাজটা পরে নিন।”

মুখর বলল,,

“আমাকে ডাকলে না কেন?”

“এমনি এখন যান।”

বলেই মেহবিন রান্না ঘরে চলে গেল। তাজেল হুইলচেয়ার এ বসে আছে। আর সে রান্নাঘরে মেহবিনের সাথে আছে। মুখর গোসল শেষ করে নামাজ পরে নিল। রান্না শেষ তাই মেহবিন মুখরকে খেতে ডাকলো। তিনজন মিলে একসাথে খাবার খেয়ে নিল। তাজেল আর মুখর মেহবিনকে নিয়ে ঝগড়া করতে লাগলো। মেহবিন হেঁসে তা ইনজয় করতে লাগলো। হুট করে মেহবিন বলল,,

“এই যে পুলিশ পাঞ্জাবি ওয়ালা আর নেত্রী আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

মেহবিনের কথায় দুজনেই ওর দিকে তাকালো। মুখর বলল,,

“কি কথা?”

“আপনারা কি আজীবন আমাকে নিয়েই ঝগড়া করবেন?”

“হ্যা করবো তাতে তোমার কি সমস্যা!”

“কোন সমস্যা নেই। ”

‘আজ কিন্তু তোমায় ঘুরতে যাওয়ার কথা আমার সাথে। আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি এবার তোমার পালা।”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“ঠিক আছে যাবো।”

তখন তাজেল বলল,,

“আমারে থুইয়া পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালার সাতে যাইবা ডাক্তার?”

তখন মুখর বলল,,

“না আজ নেত্রী তার ডাক্তার আর পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা একসাথে যাবে।”

“সত্যি?”

‘হুম সত্যিকারের সত্যি।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে মুখরের দিকে তাকিয়ে রইল। তাজেল এর হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ এই জন্য বেশি ঘুরাঘুরি করলো না। বিকেলে মুখরের একটা ইমার্জেন্সি করে কল আসতেই ও চলে গেল। আর এভাবেই আরো পনেরো দিন চলে গেল। এতো দিনেও মুখরের সময় হয়নি কাব্যের বিহঙ্গিনী কে জানার। এদিকে মেহবিনের কাছে শেখ শাহনাওয়াজ ফোন করে আরবাজ মিশু আর ওর বিয়ের কথা বললেন। এদিকে আছিয়া খাতুন ও বললেন। ওদের বিয়ে দশদিন বাদে। মেহবিন কিছু্ই বললো না শুধু বলল ঠিক আছে। তাজেলের হাত পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে। সে এখন আস্তে আস্তে হাঁটতে পারে। মেহবিন মুখর কে বলল ওর সাথে দেখা করতে চায়। মুখর সেদিন রাতে মেহবিনের বাড়িতে আসলো। তাজেল তো সেই খুশি। তিনজন এ একসাথে খাবার খেলো। তাজেল ঘুমিয়ে পরলো। মেহবিন মুখরকে নিয়ে পেছনের বারান্দায় গেল। মুখর বলল,,

“আজ কি রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনীর গল্প বলার জন্য এখানে ডাকলে?”

“না।”

‘কিন্তু আজ যে আমার ভিশন জানতে ইচ্ছে করছে কাব্যের বিহঙ্গিনী কে?”

“তাহলে অপেক্ষা করতে হবে আরো দশদিন। কারন বিহঙ্গিনী মুক্ত পাখির মতো কাটাবে দশটা দিন। সে নিজের মতো ঘুরতে চায়। যেখানে থাকবে না কোন ইন্টারনেট কানেকশন না থাকবে কোন সম্পর্ক। বিহঙ্গিনী থাকবে একা। সে নিজেই তার সেরা সঙ্গী হিসেবে থাকবে।এটাই জানাতে আপনাকে এখানে ডাকা।

“মানে?”

‘মানে হলো কাব্যের বিহঙ্গিনী খুব তাড়াতাড়ি দায়িত্বের আর কাব্যের ভালোবাসায় আটকে যাবে। তাই সে কারো সাথে আটকানোর আগে নিজের সাথে কাটাতে চায়।”

‘আর নেত্রী?”

‘তার দায়িত্ব আমি আপনাকে দিলাম কাব্য। দশদিন পর আমাদের আবার বিয়ে হবে। আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন বরবেশে আর আমি আসবো বধু বেশে লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পরে একদম আপনার মনের মতো সেজে। কি থাকবেন তো অপেক্ষা করে?”

মুখর মুচকি হেসে বলল,,

“তোমার জন্য দশদিন নয় বিহঙ্গিনী, দশ যুগ অপেক্ষা করতে পারবো।”

~চলবে,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৫৫+৫৬

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫৫(বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

শেখ শাহনাওয়াজ এর মুখে সব শুনে শাহরিয়ার পরিবারের সবাই অবাক। সকলে আছিয়া খাতুন এর দিকে তাকালেন। কারন মেহবিনের পরিবার নেই বলে তিনি তার আর মুখরের ওপর শর্তারোপ করেছিলেন। তার রেশ ধরেই মুখর আর মেহবিনের এই বিচ্ছেদ। শেখ শাহনাওয়াজ আর মেহরব চৌধুরী নিজেদের মধ্যে সবকিছু মিটিয়ে নিলেন। আছিয়া খাতুন স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তখন মুখর ফোন করে বলল সে মেহবিনের সাথে আছে। তারা যেন বাড়ি চলে যায়। শাহরিয়ার পরিবার চলে গেল। তখন মিশু আরবাজ কে মারতে লাগলো। তা দেখে আরবাজ বলল,,

“আরে মিশু মারছিস কেন?”

“কান কাটা জ্বীন বাজপাখি তুই আগেই ফুলের সম্পর্কে জানতি কিন্তু আমায় বলিস নি। আমি তো ফুলকে চিনতাম মুখরের বউ হিসেবে আর তুই আমাকে কিছুই বলিস নি।”

“আরে কি করবো বল? ফুলই তো আমার ওপর এক হাজার ধারা জারি করেছিল আমি ওর সম্পর্কে তোকে বা বাড়ির কাউকে বললে ও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে। আর ও কোথাও চলে যাবে কেউ জানবে না।”

“হুম তোরা সবাই পচা!”

‘তা ঠিক হওয়ার পর তোকে কে বলল সে ডক্টর মেহবিন মুসকান তোর বোন।”

“প্রথমে আমিই বুঝেছিলাম মায়ের চোখের মতো চোখ। যখন পাগল ছিলাম ও আমায় বলেছিল আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। ও ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে পরেছি পরে ও মায়ের, আমার আর ওর কথা কিছু বলছিল। আর আমাকে ভালো হতে বলছিল। তারপর ফুলের এক্সিডেন্ট হলো তখন তো সব ফিরেই পেলাম। ফুল সুস্থ হয়ে ফিরে এলে ওর সন্দেহ হলো আমি ঠিক হয়ে গেছি। আমাকে চেপে ধরতেই সেদিন ফুলকে সব বললাম আর ও বলেদিলো ও আমার বোন। আর ও বললো অনুভবের ব্যাপারে ওকে সব নির্দ্বিধায় বলতে।”

“ওহ আচ্ছা! আমি তোকে ফুলের কথা বলিনি আর তুই আমাকে তোর ঠিক হওয়ার কথা বলিশ নি শোধবোধ।”

‘মোটেই দু’টো এক নয়।”

বলেই মিশু মেহরব চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলল,,

“এই যে মামা শুনো আমি তোমার বিধবা ছেলে মিহিরকে বিয়ে করতে চাই। এখন তুমি বলো রাজি কি না?”

হুট করে মিশুর কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো। এদিকে বাড়িতে শোক চলছে আর ও বিয়ের কথা বলছে। তাও এমনভাবে প্রপোজাল রাখলো যেন বিয়ে করা কোন ব্যাপারই না। এদিকে মিহির হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তখন আরবাজ বলল,,

‘এই মিশু একটু রয়ে সয়ে আর এটা কি হলো?”

‘আদর রাজি আমাকে মা করতে এখন মিহির আর মিহিরের বাপ রাজি থাকলেই হলো।”

মেহরব চৌধুরী বললেন,,

‘মিশু এটা কি ধরনের কথা। এভাবে হুট করে বিয়ে মানে এসব কি করে? শাহনাওয়াজ তুমি কিছু বলো?”

শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘ঠিকই তো মিশু এটা কি ধরনের কথা হলো।”

মিশু এবার শান্ত চোখে মিহিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“বাবা ও মিহির নয় ও আমার অনু। মানে অনুভব।”

এ কথা শুনে মনে হলো একটা বজ্রপাত হলো। শেখ শাহনাওয়াজ আর আরবাজ বলল,,

“কি বলছো এসব?”

তখন মিশু মিহিরের সামনে গিয়ে বলল,,

“আজ ও কি সবাইকে সত্যিটা বলবে না অনু? এবার যদি তুমি স্বীকার না করো তাহলে বলে দিচ্ছি সারাজীবনের জন্য তুমি তোমার মিশুমনি কে হারাবে। আর এমনভাবে হারাবে তুমি চাইলেও মিশুমনিকে ছুঁতে পারবে না।”

মিহির মেহরব চৌধুরীর দিকে তাকালো। মেহরব চৌধুরী বুঝতে পারলেন বিষয়টা তিনি বললেন,,

“তোমার স্মৃতি ফিরে এসেছে এটা বলোনি কেন আমাদের?”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“এখানে কি হচ্ছে কেউ বলবে প্লিজ?”

মেহরব চৌধুরী বললেন,,

“চার বছর আগে আমার ছেলে মিহির মারা গেছে।ও নিজেও রাজনীতি করতো। আমার ডান হাত ছিল মিহির।‌ ও মাফিয়া টাইপ ছিল কিছুটা ওকে সবাই ভয় পেত। মিহিরের একটা কাজ থেকে ফেরার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় একটা এক্সিডেন্ট করা গাড়ি দেখতে পায়। আর সেটা কে আমরা জানি না। ছেলেটার জ্ঞান ছিল ও আস্তে আস্তে অস্ফুট স্বরে বলছিল মিশুকে ছেড়ে দিতে। আমরা তো মিশুকেও চিনতাম না এই মিশুই যে সেই মিশু হবে আমরা বুঝতে পারিনি। এটা মিহির বুঝতে পারে যে কেউ ইচ্ছে করে এটা ঘটিয়েছে। তবে ছেলেটার মুখটা থেঁতলে যায়। ও তাড়াতাড়ি করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। তখন ওর একটা ইমার্জেন্সি কল আসে ও পার্টি অফিসের দিকে যাচ্ছিল তখন ভোটের সময় ছিল বিরোধী দলের নেতা আমাকে দূর্বল করার জন্য মিহিরের ওপর এটাক করে। ও কোন রকমে ওখান থেকে পালিয়ে যায় সবাই ওর পিছু ধাওয়া করে। ও দৌড়াতে দৌড়াতে ও আমায় ফোন দেয়। আমি ফোনে কথা বলবো তার আগে ও বলল,,

“বাবা আমার কথা শুনো তোমার বিরোধী দলের নেতা আমাকে মারার জন্য গুন্ডা পাঠিয়েছে। আমি বোধহয় বাঁচবো না তবে হ্যা তোমরা মিহিরকে মরতে দিও না। মিহিরকে মরতে দিলে ওরা তোমায় আঘাত করার সুযোগ পেয়ে বসবে। মিহিরকে একদল ভিশন ভয় পায় বাবা। মিহির যেই হোক না কেন ওর বেঁচে থাকাটা এই সবার জন্য জরুরি।”

“এসব কি বলছিস মিহির?”

“এখনি**** হাসপাতালে যাও ওখানে একটা ছেলে আছে। আমি কিছুক্ষণ আগে ওকে ভর্তি করেছি। ওর মুখটা বাজে ভাবে থেতলে গেছে তবে ডক্টর বলেছে ও বাঁচবে। ওকে বাঁচাও আর মিহিরকে গড়ে তুলো। বাবা আদরকে পিতৃহারা হতে দিও না‌। এমনিতেই ছেলেটার আমার মা নেই। যদি বাবাও না থাকে তাহলে ও এতিম হয়ে যাবে। আমি জানি তোমরা ওকে কখনো ফেলে দেবে না। তবে আমি চাই ওর বাবা হয়ে কেউ থাকুক। প্লিজ বাবা মিহিরকে মরতে দিও না।”

তারপরেই আমার ছেলেটা আর্তনাদ করে উঠে আর আমি চুপচাপ আমার ছেলের আর্তনাদ শুনতে থাকি। ছেলেটার বুকে ওরা ছুরি বসিয়েছিল আর পা দিয়ে পিষে ধরেছিল গলাটা। নিজেকে কতটা অসহায় মনে হচ্ছিল তা কেউ বুঝতে পারবে না। তারপর আমরা তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে যাই আর অনুভবকেই মিহির হিসেবে তৈরি করি। সেই মিহিরের স্মৃতি ছিল না। যা আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। তবুও আমার কানে তো শুধু মিহিরের কথাগুলো বাজছিল কতোটা অসহায় ছিল আমার ছেলেটা।

সব শুনে শেখ শাহনাওয়াজ মেহরব চৌধুরী কে জড়িয়ে ধরলেন। মিহির যে মারা গেছে এটা চৌধুরী পরিবার জানে। তাই তেমন রিয়াক্ট করলো না। কিন্তু ছেলের কথা ভেবে মিসেস মেহরবের চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো। তা দেখে মিহির মানে অনুভব তার হাত ধরে বলল,,

“একদম কাঁদবে না মা? আমি তো তোমার ছেলে বলো। ছোটবেলা থেকে মা বাবাকে পাইনি। অনুভব থেকে মিহির হওয়ার পর সেটা পেয়েছি। আর আমি কোনোকিছুর মূল্যে আমি তাদের হারাতে চাই না। আমার মন্ত্রীর ছেলে নাম ষশ টাকা পয়সা কিচ্ছু চাইনা। আমার শুধু একটা পরিবার চাই আমার মা বাবাকে চাই।”

মেহরব চৌধুরী মিহিরকে জড়িয়ে ধরলো আর বলল,,

“আমাদের ও শুধু আমাদের ছেলেকে চাই আর কাউকে চাইনা।তুমি নিঃসন্দেহে একজন আদর্শ ছেলে মিহির। এতো দিন ধরে আছো আমাদের সাথে কখনো মিহিরের অভাব বুঝতে দাও নি। ও যেভাবে আমাদের খেয়াল রাখতো তুমিও তার থেকে কম নয় বরং বেশি করো। ”

তখন মাইশা কাশি দিয়ে বলল,,

“মেলোড্রামা পড়ে কোরো মিহির ভাইয়া কোথাও যাচ্ছে না। আমি তো অন্তত যেতে দিচ্ছি না। মন্ত্রী আর মন্ত্রীর বউয়ের কথা জানি না। ”

মিহির মাইশার কান মলে বলল,,

“তবে রে তোকে বাবা মা কিছু বলে না দেখে পেকে গেছিস।”

‘আহ ভাইয়া ছাড়ো এখন বলো তোমার স্মৃতি এলো কবে?”

“আমি তো নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছিলাম ছয়মাস আগে হুট ছোট একটা এক্সিডেন্ট হলো আমি মাথায় আঘাত পেলাম তখন মনে পরেছে।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“কিন্তু আমরা তো অনুভবের বডি পেয়েছিলাম সেটা?”

তখন অনুভব বলল,,

‘শেখ আমজাদ আর আরিফ জামান আমাকে পায়নি দেখে মনে করে হয়তো কেউ আমাকে নিয়ে গেছে। তাই একটা বডি রেখে দেয় যাতে আপনারা বিশ্বাস করে নেন আমি এই পৃথিবীতে নেই। তবে এটা নিয়ে তারা ভয়েই থাকতেন যে অনুভব না আবার কখনো ফিরে আসে।”

“তোমাকে এসব বললো কে?”

“আপনার মেয়ে মেহবিন মুসকান বলেছে। ও সব জানে আমার ব্যাপারে। মিশুর প্রতি তাকিয়ে থাকা ওর প্রতি কেয়ারিং দেখে আর মিশুর চোখের ভাষা দেখে ওর সন্দেহ হয় এরপর আমাকে চেপে ধরে আমিও বলে দিই সব।”

‘ওর তীক্ষ দৃষ্টির জন্যই ওকে কেউ হারাতে পারে না।”

তখন আরবাজ বলল,,

“আচ্ছা তবে মিশু জানলো কিভাবে এটাই অনুভব। ফুল বলেছে?”

তখন মিশু বলল,,

‘না ফুল বলেনি। চোখ দেখেই সন্দেহ হয়েছিল কয়েকদিন আগে মামা বাড়ি গেলাম। তখন উনি আমার বিরহে আমার হাত ধরে কাঁদছিলেন। আমি ওনার জন্য পাগল হয়েছি সেই জন্য। আমার তো বেশি ঘুম আসে না ঘুম আসার ভান ধরে পরে থাকি যাতে ঘুম আসে সেদিন ও তাই হয়েছিল।”

তখন আরবাজ বলল,,

‘বাপরে মিশু তোর ঘুম তো দেখি সেই ডিটেক্টটিভ তুই তোর ঘুমের মধ্যেই সব জানতে পারিস।”

“সব বাদ এহন কও আমার বিয়া কবে দিবা? এই বিধবা মিহিরের সাথে। রেডিমেট বাচ্চাও পাইছি এইবার। পোলাডাও আমার মেলা কিউট। আমার সাথে খুব ভাব। নামটাও আদর দেখলে খালি আদরই করতে মন চায়।”

মিশুর কথা শুনে সবাই হেঁসে ফেললো। মিশু নিজেও হাসলো। এ কয়েকদিন পাগলের একটিং করে এখন পাগলামো তার শরীরে মিশে গেছে। অতঃপর শেখ শাহনাওয়াজ ভাবলেন তিন ছেলে মেয়ের বিয়ে একসাথেই দেবেন তিনি। দুই মেয়ের বিয়ে তো আগে থেকেই হওয়া এখন নতুন করে আবার একটু তাই।

_____________

“এই যে নেত্রী দেখো পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা আইসা পরছে ?”

তাজেল হুইলচেয়ার বসে ছিল মুখরের কথায় ওর দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। ওর এক হাতে আর পায়ে ব্যান্ডেজ। মাথার ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে গতকাল এখন নেই। নেত্রীর ভাব দেখে মুখর একটু দমলো। মেহবিন তাজেলের সামনে গিয়ে বলল,,

‘নেত্রী ঘুরতে যাবা আজ!”

তখন মুখর বলল,,

“এই আমিও যাবো।”

‘নেত্রী বললে আপনাকে নেব না হলে নেব না।”

“এই নেত্রী তুমি নেবে আমায়?”

তাজেল এবারও মুখরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো কিছু বললো না। তা দেখে মুখর বলল,,

“নিরবতা সম্মতির লক্ষণ তাহলে আমি যাবো । তবে ভাবছি আমি আর ডাক্তার যাবো নেত্রীকে নেব না।”

বলেই মুখর ভয়ে ভয়ে তাজেলের দিকে তাকালো তাজেল রাগে ফুঁসছে। তা দেখে মুখর দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“সত্যিই নেত্রীকে রেখে যাবো?”

তখন তাজেল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,,

‘ডাক্তার পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালারে কইয়া দাও আমি হেতিরে নিমু না। ডাক্তার আমার লগে যাইবো খালি।”

তাজেলের রাগ দেখে মুখর আর মেহবিনের হাঁসি পাচ্ছে তবে এখন হাসির সময় না। মুখর অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,,

“কেন কেন? আমায় নিবে না কেন?”

“আমি কিছু কইতাছি না দেইহা ডাক্তার আমারে নিয়া ঘুরতে যাইতে চাইছে। আর তুমি আমারে বাদ দিয়াই ঘুরবার যাইতে চাইতেছো? যাও তুমারেই নিমু না। আমি আগে ভাবছিলাম তুমি ভালা তা দেহি তুমি ভালা না।”

“আরে ওমন করো কেন আমি তো মজা করছিলাম তোমার সাথে? নাও না একটু?

“না নিমু না তুমি আমারে রাইখা যাইতে চাইছো তুমারেই নিমু না।”

“আরে নেত্রী আমি তো পুরোনো নেত্রীরে আনার জন্য এসব বলছি। মনে মনে আমি ওসব কইনাই বিশ্বাস করো।”

‘যতোই ঢপ মারো আইজ এনে চিরা ভিজবো না।”

“এখন তোমার ডাক্তারকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেও তুমি কিছু করতে পারবা না। তুমি তো চেয়ারেই থাকবা।”

“ডাক্তার ভালো হইবো না কইলাম। কুন সময় জানি হেতির মাথা পেইছা আমি বাড়ি মারুম। ”

‘লাঠি কোথায় পাবা? যে বাড়ি মারবা? তুমি তো উঠতেও পারবা না।

মুখরের কথা শুনে মেহবিন ওর দিকে তাকিয়ে রইল। আর তাজেল রেগে বলল,,

‘আমি খালি ঠিক হই পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা আমার হাত থেইকা তোমারে ডাক্তার ও বাচাইতে পারবো না। আমি উঠবার পারতেছি না দেইহা তোমার আনন্দ লাগতাছে তাই না।”

এইবার মুখর সিরিয়াস হয়ে গেল। ও তাজেলের সামনে গিয়ে ওর হাত ধরে বলল,,

“বিশ্বাস করো নেত্রী তোমাকে এইভাবে দেখতে আমার একটুও আনন্দ লাগছে না। কিন্তু কষ্ট লাগছে আমি তো ছি নেত্রীকে কখনো দেখিনি । আমি তো সেই নেত্রীকে দেখেছি যে সবসময় লাফালাফি করে। তার ডাক্তারের জন্য আমার সাথে ঝগড়া করে। ডাক্তারের সবসময় খেয়াল রাখে। আমি এই নেত্রী কে দেখে একটুও আনন্দ পাই না। আমি তো আগের নেত্রীকে দেখে আনন্দ পেতাম। আমি আমার পুরোনো নেত্রীকে চাই যে আমার সাথে ঝগড়া করবে তার ডাক্তারের জন্য।

সব শুনে তাজেল ওর দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল তারপর বলল,,

“আমার দিকে ওরমভাবে তাকাই রইছো ক্যা? আর হাত ছাড়ো পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা আমার শরম করে।”

কথাটা শুনে মুখর হা হা করে হাসতে লাগলো। মেহবিন মুচকি হাসলো। মুখর বলল,,

‘তুমি জানো এই কথাটাই আমি সবথেকে বেশি মিস করেছি পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা আমার শরম করে।”

তাজেল হেঁসে ফেলল তারপর বলল,,

“আইজ মাস্ক পড় নাই ক্যা?”

‘এখন থেকে আর পরতে হবে না নেত্রী এখন সবাই জানে আমি তোমার ডাক্তারের জামাই।”

তাজেল হাসলো।তখন মেহবিন তাজেলের গালে হাত দিয়ে বলল,,

“এভাবেই সবসময় হাসিখুশি থেকো নেত্রী। তোমার যেমন তোমার ডাক্তারের হাঁসি মুখটা পছন্দ।আমার ও তেমন আমার নেত্রীর হাঁসি মুখটা পছন্দ। তোমাকে চঞ্চলতায় মানায় নিরবতায় না। যা হয়েছে সব ভুলে যাও শুধু মনে রেখো তোমার ডাক্তার আছে তোমার সাথে আর সবসময় থাকবে। তোমাকে নিজের আকাশ তৈরি করতে সাহায্য করবে। সবশেষে আমার নেত্রী সবসময় আমার সাথে আর হাসিখুশি ভাবে থাকবে।”

তাজেল হেঁসে বলল,

“তোমার শ্বশুরবাড়ি ও আমারে নিয়া যাইবা নাকি?”

‘হ্যা তো! না হলে আমি শ্বশুরবাড়ি যাবোই না।”

‘কেউ কিছু কইবো না। তুমি জানো ঐ বাড়ির কাকি তার বইনেরে আইনা রাখছিল এক বছর পরে কাকা আর দাদি অনেক কিছু কইছে পরে ঐ খালা চইলা গেছে।”

তখন মুখর বলল,,

“যেখানে নেত্রীর ডাক্তার আর নেত্রীর পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা আছে সেখানে কে কি বলবে। তাছাড়া জানো আমার বাড়ির হোম মিনিস্টার বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে।”

তাজেল একটু রাজি না বুঝতে পেরে মেহবিন আর মুখর অনেক ভাবে বোঝালো। পরে সে মানলো তারপর বলল,,

‘ডাক্তার যেনে আমিও হেনে থাকুম।”

এটা শুনে মেহবিন আর মুখরের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। বিকেলটা ওরা সারা গ্ৰাম চক্কর দিল। রাতে মুখর তাজেলের খুশির জন্য কাচ্চি নিয়ে এলো। মেহবিন খায়িয়ে দিল। তিনজনেই একসাথে খেল। মেহবিন তাজেলকে ঘুম পারিয়ে দিল। তাজেল ও টেডিবিয়ার ধরে ঘুমিয়ে পড়লো। রাত নয়টা মুখর মেহবিনকে পেছনের বারান্দায় ডাক দিল। মেহবিন গেল সেখানে। মুখর ওর হাত ধরে ওর পাশে বসিয়ে দিল আর বলল,,

“আমি কিন্তু তোমার কাজে জয়ী হয়েছি আমার পুরস্কার এর জন্য প্রস্তুত হও।”

তোমার চোখে এই নগরীর ঘুমন্ত রাত,
আধারগুলির মৃত্যু ঘটে রাঙা প্রভাত!
গন্ধে তোমার ছুটছে কুমার তোমার বাড়ি
হাত বাড়ালে ধরছি তোমার প্রেমের শাড়ি।
তোমার প্রেমে সিক্ত মনের শহরতলি,
সেই শহরে মুচড়ে নিলাম বিষাদথলি!
এই সেই শাখা আমি তুলসীপাতা,
আমার নামে গেথে নিলাম আবার নকশিকাঁথা
~রোজ (কাব্যের বিহঙ্গিনীর পাঠক বিহঙ্গিনীর জন্য লিখে পাঠিয়েছেন।

মেহবিন কবিতা শুনে মুচকি হেঁসে বলল,

“আপনার পুরস্কার প্রস্তুত কাব্য! কারন আজ আপনার বিহঙ্গিনী হয়তো খুব খুশি।

মুখর মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘ চলো না বিহঙ্গিনী একটু নির্জনে হেঁটে আসি। অনেকদিন হলো তোমার হাত ধরে হাঁটা হয় না। নির্জনে হাঁটা সুন্নত চলো আজ না হয় একটু সুন্নত পালন করি। নেত্রী ঘুমিয়ে পরেছে সমস্যা নেই।”

‘চলুন!”

মেহবিন আর মুখর সাবধানে বের হলো সব আটকিয়ে। আজকে পুরো চাঁদ আছে। রাস্তাঘাট পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ওরা কিছুক্ষণ হাত ধরে হাটলো। হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা মাঠের কাছে এসে পরেছে । আর ওখানেই মুখরের গাড়ি রাখা। মুখর মেহবিন কে বলল,,

“একটু চন্দ্রবিলাশ করা যাক গাড়ির ওপর বসে?”

মেহবিন হেঁসে সায় জানালো। অতঃপর দুজনে গাড়ির ওপরে উঠে বসলো। দুজন কিছুক্ষণের জন্য মৌন রইলো। মেহবিন চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর মুখর মেহবিনের দিকে। হুট করে মেহবিন মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আপনি জানেন কাব্য আমার একাকীত্বের শহর আমার খুব যত্ন করে গড়া। তার দেয়াল এতটাই শক্তিশালী যে সহজে কেউ আঘাত করে ঘায়েল করতে পারে না। আমার আমিকে খুব যত্ন করে একাকীত্বের শহরে পুষি। যার দুঃখ প্রকাশ পায় না। আজ কেন যেন আমার দুঃখ প্রকাশ করতে ইচ্ছে করছে আজ ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে চাইছে। আমি চেয়েও আমার সহনশীলতা কে ধরে রাখতে পারছি না কাব্য। যা আমি এতোকাল ধরে করে এসেছি ধীর স্থিরতার সাথে আজ সেই হিসেবে আমি বিজয়ী।

মেহবিনের কথা শুনে মুখর বলল,,

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,,
“তোমাদের মধ্যে এমন দুটি অভ্যাস রয়েছে, যা স্বয়ং আল্লাহ্’ও পছন্দ করেন। একটি হলো ধৈর্য ও সহনশীলতা, অপরটি হলো ধীর-স্থিরতা।” [সুনানে আত-তিরমিজি, ২০১১]
সেই জন্যই তুমি আজ সফল বিহঙ্গিনী।”

মেহবিন বলল,,

“তবে আমি এতদিন ধৈর্য্য আর সহনশীল হয়ে থাকলেও। আজ ভেতরের চাঁপা কষ্ট গুলো আর চাপা থাকতে চাইছে না। ঐ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন কি কখনও ঠিক কতোটা বিশালতা বিরাজমান? যখন রাতের নিস্তব্ধতা আর সাথে থাকে অসংখ্য তারা আর একটি মাত্র শুভ্র রাঙা জোসনা মাখা চাঁদ । কখনও কি সাগরের দিকে তাকিয়ে ভেবেছেন তার গভীরতা ঠিক কতোটা ? আমার সবাই থেকেও কেউ নেই কাব্য । কাব্য আজ কি আপনি আমার এক টুকরো চাঁদ হবেন ? যার কাধে মাথা রেখে আমি আমার সকল কষ্ট বেদনা ভুলে একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেব ? একটুখানি আগলে নিবেন কি আপনার বিহঙ্গিনী কে ?

মেহবিনের কথায় মুখরের চোখ ছলছল করে উঠলো‌। মুখর বুঝতে পারলো চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে এতোক্ষণ নিজের জীবনের হিসাব মিলাচ্ছিল। মুখর মেহবিনকে খুব শক্ত করে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মেহবিন মুখরের কাঁধে মাথা রাখলো। আর বলল,,

“তোমার কাব্য সবসময় আছে তোমার সাথে বিহঙ্গিনী।
আর সারাজীবন তোমায় আগলে নেবে।”

মেহবিন পাশে তাকালো আর বলল,,

‘অনেক রাত হয়ে গেছে চলুন বাড়ি যাই কাব্য!”

বলেই মেহবিন গাড়ির ছাদ থেকে নামার জন্য এগুলো।মুখর কিছু একটা আন্দাজ করে ওকে নামতে সাহায্য করলো আর নিজেও নামলো। কিছুদূর আসতেই মুখর মেহবিন কে কোলে তুলে নিল। আর বলল,,

“এই মুখর শাহরিয়ার কাব্য কখনো তার বিহঙ্গিনীকে কষ্ট পেতে দেবে না। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবে সর্বদা।”

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫৬
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

অতীত,,

“এই যে পাঞ্জাবি ওয়ালা আপনি কি সবসময় পাঞ্জাবি পরেই থাকেন?”

মেহবিনের কথায় মুখর অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি ব্রেক করলো।সে আর নাফিয়া এসেছিল তার দাদিকে চেক আপ করানোর জন্য। এখানে মেহবিন কে দেখতেই দাদিজান তার আছে কথা বলতে লেগে গেল। মেহবিন সৌজন্যতার খাতিরে কথা বলতে লাগলো। এরপর মেহবিন বলল তার একটু নীলক্ষেত যেতে হবে কিছু বইয়ের জন্য। কথাটা শোনা মাত্রই দাদিজান বলল মুখর কে ওকে নীলক্ষেত পৌঁছে দিতে। ওখান দিয়েই মুখর একটা কাজে যাবে এই জন্য নাফিয়া কে ও এনেছে যাতে দাদিজান ওর সাথে বাড়ি যেতে পারে। দাদিজানের কথায় মুখর না করলো না। তবে মেহবিন করলো দাদিজান অনেক বলে কয়ে তাকে রাজি করালো। অতঃপর মেহবিন মুখরের সাথে গেল। বরাবরের মতো এবারও মেহবিন পেছনে বসলো। আজ মুখর কিছুই বললো না। তবে অনেক বার আড় চোখে তাকে আয়নার দেখেছে। আবার পড়াশোনার বিষয়ে কথাও বলেছে। তারপর কথার প্রেক্ষিতে হুট করে মেহবিন উক্ত কথাটা বলে দিল। গাড়ি থেমে গেছে। মুখর বলল,,

“হুট করে এমন প্রশ্ন কেন আপনার মনে উদয় হলো?”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“আজ পর্যন্ত যতোবার আপনাকে দেখেছি ততবারই পাঞ্জাবিতে দেখেছি তাই বললাম।”

“হ্যা আসলে আমার পাঞ্জাবি পরতে অনেক ভালো লাগে। এই জন্যই কোথাও বেরুলে পাঞ্জাবি পড়ি। তবে পাঞ্জাবি ওয়ালা নামটা বেশ ভালো লাগলো। এরপর থেকে না হয় এই নামেই ডাকলেন।

মেহবিন হেঁসে বলল,,

“হুম এখন গাড়ি স্টার্ট করুন।”

মুখর গাড়ি স্টার্ট করলো। অতঃপর নীল ক্ষেত পৌঁছালো। মেহবিন আজকে গাড়ি থেকে নেমে বলল,,

‘ধন্যবাদ আজকে। কারন আপনার জন্য আমার ভাড়াটা বেঁচে গেল। আর সেটা দিয়ে আমি আরো একটা বই কিনতে পারবো।”

“যাক বই কেনার জন্য হলেও আপনি আমায় ধন্যবাদ তো দিলেন।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“হুম দিলাম তবে বই কিনতে পারবো দেখেই নাহলে দিতাম না। কারন এটা আপনার,,

‘হ্যা হ্যা জানি কারন এটা আমার দায়িত্ব।কারন দাদিজান আপনাকে জোর করে পাঠিয়েছে।”

মেহবিন উল্টো দিকে ঘুরে গেল।তখন মুখর বলল,,

“আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ!”

মেহবিন না ঘুরেই বলল,,

“ইনশাআল্লাহ!”

মেহবিন চলে গেল। তবে আজ মুখরের ভালো লাগলো। ও উঁকি দিয়ে দেখলো মেহবিন কি বইগুলো দেখছে। ও দেখলো একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি কিছু গল্পের বই ও দেখছে। কিন্তু ওর আজ নামার সময় নেই। তাই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ও চলে গেল। এটা ছিল মেহবিন আর মুখের তৃতীয় দেখা।

এভাবেই কেটে গেল আরো তিন মাস। মেহবিন পুলিশ স্টেশনে এসেছে একটা মেয়েকে নিয়ে। আর রিপোর্ট লেখানোর জন্য পুলিশ অফিসারের কেবিনে ঢুকতেই দেখলো মুখর কে। তাকে দেখে ও বলল,,

“পাঞ্জাবি ওয়ালা আপনি এখানে? তারমানে আপনি একজন পুলিশ অফিসার?”

মেহবিনের কথায় মুখর অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। তিনমাস পর আবারোও ও সেই মুখটা দেখতে পাবে এটা ও ভাবতে পারেনি। মুখর আজ ইউনিফর্ম এ আছে। মুখর হেঁসে বলল,,

‘জি আমি একজন পুলিশ অফিসার। আপনি এখানে? দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন!

মেহবিন আর মেয়েটা বসলো। তখন মুখর বলল,,

“চা না কফি?”

“আপাতত কোন কিছুই না একটা রিপোর্ট লেখাতে এসেছি।”

মুখর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“জি। কি রিপোর্ট?”

‘ও হচ্ছে আমাদের দারোয়ান কাকার মেয়ে লতা ওর বোন আর আমি একই সাথে পড়ি। ওর বোনের মুখে গতকাল একটা ছেলে এসিড নিক্ষেপ করেছে। এই জন্যই রিপোর্ট লেখাতে এসেছি।”

“আপনি কি ছেলেটার চেহারা দেখেছেন?”

“জি দেখেছি। আর তাকে চিনিও!”

“ছেলেটা কে?”

“একজন নেতার ছেলে। আর সে আমাদের কলেজেই পরে।

‘আপনি তার বিষয়ে সকল ডিটেলস দিয়ে যান। ইনশাআল্লাহ কালকের মধ্যে সে লকাপের ভেতরেই থাকবে।”

মেহবিন সবকিছু দিয়ে গেল। আর পরেরদিন মুখর গেল মেডিকেলে মেহবিন ছেলেটাকে দেখিয়ে দিল। মুখর ছেলেটাকে এরেস্ট করলো। তখন ছেলেটা চিৎকার করে উঠল কে করেছে তার নামে রিপোর্ট। আর কোন প্রমান আছে কে দেখেছে কে। মুখর জানালো সরাসরি দেখেছে এরকম প্রমান আছে। অতঃপর ছেলেটাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো‌। কেস কোর্টে উঠলে মেহবিন বলল সে সাক্ষী দেবে ততদিনে ছেলেটার বাবা জেনে গেছিল মেহবিন সব করেছে। তাই পরেরদিন কলেজে সবার সামনে ওকে অপমান করার চেষ্টা করে আর ওর হাত ধরে হিজাব নিয়ে টানাটানি করে এসব দেখে মেহবিন আর সহ্য করতে না পেরে সব কটাকে মেরে শুয়িয়ে দিল। সেদিন মাহফুজ শাহরিয়ার হাসপাতালে গিয়েছিলেন একটা কাজে তিনি সব দেখতে পান। তিনি মুখর কে ফোন করে । মুখর তাড়াতাড়ি করে চলে আসে। ছেলেগুলোকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মুখর মেহবিনের দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল,,

“নিন পানি খান অনেকটা হাঁফিয়ে উঠেছেন?”

মেহবিন তার দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘দরকার নেই আমি ঠিক আছি।”

‘আপনাকে একা ছাড়া উচিৎ হবে না। যতোদিন ধরে ঐ নেতার ছেলের কেসটা শেষ হয়।”

‘সমস্যা নেই আমার কিছু হবে না।”

‘কাল কেস কোর্টে উঠবে আমি নিয়ে যাবো আপনাকে।একা যাওয়ার দরকার নেই কারন আপনিই হচ্ছেন এই কেসের মুল প্রমান। আর মেয়েটাকেও আমি সেফটি দিয়ে রেখেছি।”

“ঠিক আছে।”

যখন মুখরের নজর গেল মেহবিনের হাতে । হাত দিয়ে রক্ত পরছে হয়তো কেটে গেছে। মুখর ওর হাত ধরে বলল,,

‘আপনার হাত তো দেখি অনেকখানি কেটে গেছে। ব্যান্ডেজ করতে হবে তো!

মেহবিন হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,,

“কোন পুরুষ মানুষ আমার হাত ধরুক এটা আমার পছন্দ নয়। আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আমি নিজের কাজ নিজেই করে নিতে পারি।

বলেই মেহবিন চলে গেল। মুখর ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। পরেরদিন মুখর এলো ওকে নিতে মেহবিন সাক্ষী দিল তার কারনে ছেলেটার সাজা হলো। নেতা মেহবিন কে অনেক কথা শোনালো। আর একটা সামান্য দারোয়ানের মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের রিস্ক নিল। ওকে ছাড়বে না এসব বলতে বলতেই এক সময় মেহবিন সবার সামনে নেতার হাত ধরে নিয়ে গেল হাসপাতালে পেছনে মুখর ও গেল। মেহবিন সেই এসিড নিক্ষেপ করা মেয়েটার কেবিনের সামনে গিয়ে তাকে দেখিয়ে বলল,,

” এই মেয়েটাকে দেখেছেন। সে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। আপনি জানেন এই মেয়েটা কতোটা কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। সে একজন দারোয়ানের মেয়ে এই জন্য তাকে কেউ দাম দিতে চায় না। তবুও সে দিনশেষে একটা মেডিকেল স্টুডেন্ট। আপনার ছেলে যে কাজটা করেছে আপনি তার ওপর কোন কিছু না করে আমার ওপর কালকের মতো একটা জগন্য কাজ করলেন। আচ্ছা কেউ যদি আপনার মুখে এসিড দেয় বা আপনার মেয়ের ওপর এসিড নিক্ষেপ করে তাহলে আপনার কেমন লাগবে। দেখুন এই মেয়েটাকে কিভাবে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। সে কি সুস্থ স্বাভাবিক একটা জীবন পাবে সমাজে তাকে কি চোখে দেখবে মানুষ। আপনিই বলুন যে এসিড মারে তাকে তো সবাই এক সময় ভুলে যায়। কিন্তু যার গায়ে এসিড লাগে সে কি ভুলতে পারে, না সমাজ ভুলতে দেয়। এসিডে মুখ জ্বলসে যাওয়া মেয়েকে সবাই আঙুল তুলি দেখিয়ে দেয়। তার যায়গাটা কোথায়? আমি জানি আপনার আমার ওপর অনেক রাগ কিন্তু আমি মনে করি এই মেয়েটার কষ্টের কাছে এসব কিছুই না। আপনি তো একজন নেতা আপনার কাজ মানুষের সেবা করা। কিন্তু আপনি কি করছেন নিজেকে একবার প্রশ্ন করুন তো? আপনার ছেলে, ছেলে আর ও দারোয়ানের মেয়ে বলে ওর কোন দাম নেই। একটা কথা মনে রাখবেন যার পেশা যেমনই হোক না প্রত্যেকটা বাবার কাছে তার সন্তান তার কলিজা।

বলেই মেহবিন ওখান থেকে চলে গেল। সেই নেতাটা ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। একটা সময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো। সে দারোয়ানের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলো। আর বলল ঐ মেয়েটার সব দায়িত্ব সে নেবে। মুখর মুগ্ধ হয়ে গেল মেহবিনের কাজে এভাবে হয়তো সেও বোঝাতে পারতো না। এভাবেই কেটে গেল কয়েকদিন কিন্তু এ কয়েকদিন মুখর ঠিকঠাক ভাবে ঘুমাতে পারলো চোখ বুঝলেই মুখরের মেহবিনের চেহারা ভেসে উঠে। মেহবিনকে দেখা যেন তার অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে সে পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার সময় মেহবিন কে এক নজর দেখার জন্য অপেক্ষা করে। মুখর বুঝতে পারছে ও মেয়েটার মায়ায় পরে গেছে। মুখর সাহস করে একদিন মেহবিনের কাছে গেল। সেদিন সে পাঞ্জাবি পরে গেল। মেহবিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,

‘মিস মেহবিন আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে?”

মেহবিন মুখরকে একদম আশা করেনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ও বলল,,

“আপনি এখানে?”

‘হুম আপনার সাথে কিছু কথা আছে চলুন।”

“কোথায় যেতে হবে?”

“আপাতত কোন রেস্টুরেন্ট বা কোন খোলামেলা জায়গা যেখানে একান্তে আপনার সাথে কথা বলা যাবে। ভয় নেই শুধু কথাই বলবো।

‘আপনার সাথে একান্তে কথা বলার জন্য কোন সম্পর্ক কি আমাদের আছে? তাছাড়া একটা ছেলেমেয়ের একান্তে কথাবার্তা বলা বা মেলামেশা উচিত নয়।”

“তাহলে না হয় একটু দূরত্বেই চলুন আশেপাশে মানুষ থাকবে। তবে কেউ আমাদের কথা শুনতে পাবে না।”

মেহবিন চারদিকে একবার তাকালো। সবাই ওর দিকে অড়চোখে তাকিয়ে আছে। ও এখানে না থাকাই ভালো মনে করলো। ও কলেজের পেছনে একটা জায়গা আছে ওকে নিয়ে সেখানে গেল। মেহবিন একবার মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল ,,

“বাহ পাঞ্জাবি ওয়ালা দেখি আজ পাঞ্জাবি পরে এসেছে।

মুখর হেঁসে বলল,,

‘নামটাই দিয়েছেন পাঞ্জাবি ওয়ালা তাই পাঞ্জাবি পরে আসাটাই ভালো মনে করলাম।”

“তা কি বলবেন বলুন?”

মুখর মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“দেখুন আমি তেমনভাবে মনের কথাগুলো সাজিয়ে বলতে পারি না। আমি বোধহয় আপনাকে পছন্দ করি এবং হয়তো ভালোবাসি। কারনে অকারণে আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করে। আমি চাই এই অনুভূতিটা খারাপ দিকে যাওয়ার আগে আমাদের নতুন এক হালাল সম্পর্ক হোক ‌ তাই বলছি আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন বিহঙ্গিনী?

মুখরের বিয়ের প্রস্তাবে মেহবিন অবাক হলো আর সবথেকে বেশি অবাক হলো বিহঙ্গিনী শুনে। ও বলল,,

“বিহঙ্গিনী?”

‘হুম বিহঙ্গিনী আপনার ডায়রির ওপরে তো কাব্যের বিহঙ্গিনী লেখা ছিল। তাই আমিও আমার একান্ত পছন্দের মানুষটির নামকরণ করেছি বিহঙ্গিনী ।”

“আপনি আমার ডায়রি কোথায় পেলেন?”

“পাইনি আপনার হাতে দেখেছি বহুবার আপনি আনমনে কিছু লেখেন তাতে।”

“আপনি আমার ওপর নজর রাখেন?”

মুখর মাথা চুলকিয়ে বলল,,

‘না মানে আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হতো তখন একটু? সেসব বাদ দিন আপনি বলুন না আপনি আমার কথায় রাজি কি না?”

মেহবিন চোখ মুখ শক্ত করে বলল,,

“না!”

মুখরের মুখটা ছোট হয়ে গেল তবুও বলল,,

‘কেন আপনি কি আমায় অপছন্দ করেন?”

‘এখানে পছন্দের অপছন্দের ব্যাপার নয়। ব্যাপার হলো আমার আমার জীবনে কাউকে জড়াতে চাই না। আর বিয়েও করতে চাই না এখন?”

“আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো বিহঙ্গিনী! যতোদিন অপেক্ষা করতে হয় ততদিন না হয় অপেক্ষা করবো। আপনার জীবনে যখন আপনি আপনার জীবনসঙ্গীকে গ্ৰহন করবেন। আর জীবন সঙ্গী যেই হোক না কেন সেই মানুষটা নাহয় আমিই হবো।

‘আমি চাইনা কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করুক। আপনি যতোবারই বলুন না কেন? আমার উত্তর “না” হবে। আশা করি আপনি আমার উত্তর পেয়ে গেছেন।”

বলেই মেহবিন ওখান থেকে চলে গেল। মুখরের চোখটা ছলছল করে উঠলো‌। জীবনের প্রথম কোন মেয়ের ওপর ওর অনুভূতি তৈরি হলো আর সেই মেয়েটা কতোটা সহজেই না ওকে রিজেক্ট করে দিল। মুখর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে গেটের কাছে এলো। মিশু আর আরবাজ বন্ধুর জন্য এখানে এসেছে। ওকে দেখেই মিশু আর আরবাজ বলল,,

“এই কি বললো রে মেয়েটা?”

মুখর ছোট করে বলল,,

‘রিজেক্ট তোদের বন্ধু। জীবনে কোন মেয়ের ওপর মুখর শাহরিয়ারের অনুভূতি তৈরি হলো।আর সেই মেয়েটা ওকে রিজেক্ট করে দিল।”

মুখরের কথায় আরবাজ আর মিশুর মুখটা ছোট হয়ে গেল। মিশু বলল,,

‘মেয়েটা তোকে অপছন্দ করে নাকি?”

“আরে না সে তার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে চায় না। আর এখন বিয়েও করতে চায় না।”

তখন আরবাজ বলল,,

“আরে এটা তো একবার। হাল ছাড়িস না বন্ধু লেগে থাক একদিন ঠিকই রাজি হবে।”

“উনি সবার মতো নয় উনি একদম আলাদা।”

‘আরে ভাই চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই তাই না। এখন এসব বাদ দে মেয়েটাকে দেখা।”

মুখর সামনে তাকালো দেখলো মেহবিনই ওদের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। মুখর তাকাতেই ও দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মেহবিন আরবাজকে মুখরের সাথে দেখে অবাক হয়ে গেছিল তাই এতোক্ষণ ধরে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুখরের নজর পরতেই মেহবিন ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল। মুখর ডাক দিল,,

“মিস মেহবিন?”

মেহবিন পেছনে ঘুরে মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমাদের মধ্যে তেমন কোন সম্পর্ক নেই যে আপনি যখন তখন এভাবে ডাকবেন। আপনার উত্তর তো আপনি পেয়ে গেছেন আশা করি এরপর থেকে আপনার আর আমার সম্পর্ক পানির মতো পরিস্কার হয়ে গেছে। আল্লাহ হাফেজ!”

বলেই মেহবিন চলে গেল। তখন মিশু বলল,,

“এই মেয়েটাই মেহবিন বাপরে বাপ যেন তুই ওকে ডাকিস নি ওকে তুলে এনেছিস।”

‘হ্যা মিশুমনি এটাই সেই মানুষটি। যাকে প্রথমবার তার এরকম ব্যবহারের জন্য অসামাজিক বলেছিলাম।”

‘আর এখন সেই অসামাজিক মেয়ের জন্যই মেডিকেলের সামনে পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্সপেক্টর মুখর শাহরিয়ার।”

কথাটা শুনে মুখর হাসলো। কিন্তু আরবাজ মেহবিনকে দেখেই থমকে গেছে। ও চুপচাপ হয়ে রইলো। ওরা সবাই নিজেদের জায়গায় চলে গেল। রাতে “কাব্যের বিহঙ্গিনীর” পেজ থেকে একটা পোস্ট হলো।

“মানুষ কতটা সহজেই না প্রাপ্তির জন্য আবদার করে বসে‌। অথচ তারা জানে না কখনো কখনো প্রাপ্তির থেকে অপ্রাপ্তিই শ্রেয়।”

পোস্ট টা সামনে আসতেই মুখর একটু অবাক হলো। মেহবিনের কাব্যের বিহঙ্গিনী ডায়রিতে লেখা দেখে ও ফেসবুকে সার্চ দিয়েছিল। তখন একটা পেজ আসে‌ ওর ঐ নামে‌। পেজটা বছর খানেক আগে খোলা হয়েছে। এবং ফ্যান ফলোয়ার ও বেশ আছে। ও মনোযোগ দিয়ে তার পেজটার প্রত্যেকটা পোস্ট দেখলো। দেখতে দেখতে ও একটা পোস্ট এ থমকে গেল।

“একটা মানুষ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে কখনো অন্যের পরিস্থিতি বুঝতে পারে না। অথচ মানুষ কতো সহজেই না একটা মানুষকে তার কাজের পরিচয় দিয়ে ‌বিচার করে বসে। কেউ দারোয়ান তো কেউ নেতা কিন্তু দারোয়ানকে দেখে যেন নেতা সাহেব দারোয়ান কে মানুষের কাতারে ফেলতে চায় না। এভাবেই উচুস্তরের মানুষেরা নিচু স্তরের মানুষ কে বাঁচতে দিতে চায়না।

মুখর ডেট টা দেখলো আর মনে করার চেষ্টা করলো এসিড পরা মেয়েটার কেসটা কোর্টে ওঠার ডেট। একই দিনে পোস্ট টা করা‌। ওর এটা দেখে সন্দেহ হলো পেজটা মেহবিনেরই। এছাড়া মেহবিন পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে পোস্ট করে। এরপর ও কয়েকদিন ওর নজর রাখলো ও ওর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকেই পোস্ট করে ও সিওর হয়ে গেল। আজকের পোস্ট দেখে আলট্রা শিওর। তবে ওর মনে খচখচ করলো এই কাব্য টা কে? কাব্য নামের কারো সাথে কি ওর জীবন জড়িত এই জন্যই কি রিজেক্ট করলো। এদিকে আরবাজ মেহবিনের সাথে কথা বললো মুখরের ব্যাপারটা নিয়ে মেহবিন সাফ না করে দিল। ও এখনি কারো সাথে জড়াতে চায় না। আরবাজ অনেক বোঝানোর পরেও ব্যর্থ হয়ে চলে গেল।

সময় পেরিয়ে গেল আরো একমাস মুখর একটা কাজে এসেছিল তবে ওর হাঁটতে ইচ্ছে হচ্ছিল দেখে এমনিতেই হাঁটছিল। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো ও একটা বাস্ট স্টপ এ আশ্রয় নিল। পাশে দাঁড়াতে দেখলো মেহবিন ও ওখানে। ও আশে পাশে দেখলো না আর কেউ নেই‌। রাত আটটা মেহবিন একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার অন্য দিকে তাকালো। তখন মুখর বলল,,

‘মিস মেহবিন দেখছেন প্রকৃতিও বোধহয় চায় আমরা এক হই। তাই তো দেখে দেখে এই সময়ই বৃষ্টি নামিয়ে আমাদের এক জায়গায় এনে দিল। আর কি অদ্ভুত দেখুন এখানে আমি আর আপনি ছাড়া কেউ নেই।”

মেহবিন মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“নিজের মনমতো প্রকৃতিকে ভেবে নেওয়া বোকাদের কাজ। প্রকৃতি নিজের নিয়মে চলে অন্যদের নয়। তবে এটা ঠিক কোন কিছুই কারন ব্যতিত হয় না। এমনকি প্রকৃতিও না।”

‘হুম সেটাই তো বলছি প্রকৃতিও চায় আমরা এক হই। তো বলুন না মিস এই বৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে আপনি কি আমার হবেন?

মেহবিন এবার কঠোর স্বরেই বলল,,

“আপনি বাংলা বুঝেন না মুখর শাহরিয়ার। একটা মেয়ে তখনি না বলে যখন তার উত্তর পুরোপুরি সিওর ভাবে না হয়। দেখুন আপনি একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ আপনাকে এসবে মানায় না। দয়া করে এসব করবেন না।”

মেহবিনের কথায় মুখর মুচকি হেসে বলল,,

কাঁদিছে গগন, বহিছে পবন
কহিতেছে কানে কানে
কি এমন যন্ত্রণা তোমার
বলিয়া যাও গানে গানে।

বিহঙ্গ কহিল,
উড়িয়া গিয়াছে পিঞ্জিরার বিহঙ্গিনী
করিয়া গিয়াছে একা
আর কি কভু পাবো
আমি বিহঙ্গিনীর দেখা।

পবন কহিল,হে বিহঙ্গ
হাল ছাড়িলে হয়
বক্ষে বল আর অন্তরে বিশ্বাস রাখিলে
তব আসিবে জয়।
~শাকিল হোসেন (কাব্যের বিহঙ্গিনীর পাঠক কাব্যের কাছে থেকে তার বিহঙ্গিনীর কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য লিখে পাঠিয়েছেন)

মুখরের কবিতায় মেহবিন শান্ত ভাবে তার দিকে তাকালো। বিহঙ্গ বলতে ও নিজেকেই বুঝিয়েছে। আর এটাও বুঝিয়েছে ও হাল ছাড়ার পাত্র নয়। কিন্তু মেহবিন কিছু বললো না। তখন হুট করে মুখর আবার বলল,,

‘আপনার জীবনে কি কাব্য নামের কেউ আছে। যার জন্য আমাকে রিজেক্ট করছেন?”

মেহবিন মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমার জীবনে কেউ নেই। আমি একা আমার কেউ নেই আর কোনদিন ছিলোও না।”

হুট করে এমন কথায় মুখর হতভম্ব হয়ে যায়। ও কিছু বুঝতে পারেনা ‌ তবু ও বলল,,

“তাহলে এই কাব্য মানে কাব্যের বিহঙ্গিনীর উৎপত্তি কোথায়?”

“কাব্য মানে কি বলুন তো?”

‘কবিতা বা ক্ষুদ্র আকারে লেখা কিছু গল্প।”

মেহবিন হাসলো আর বলল,,

“আপনারটা হয়েছে তবে জানেন? কাব্য অর্থ আরো আছে। যেমন নির্দোষ সারল্যের কাহিনী ও নির্দোষ সুখের কাহিনী। আর আমি এই দুটি অর্থেই নামকরণ করেছি। আর বিহঙ্গিনী মানে পাখি আমার মা আমাকে বিহঙ্গিনী হতে বলেছে। মুক্ত পাখির মতো আমার সবখানে বিচরন। আমার জীবনে অন্যকারো জন্য কোন দায় নেই। আমার আমিই আমার কাছে সবার আগে। ”

মুখর মেহবিনের কথায় অদ্ভুতভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। ও বুঝতে পারলো এই মেহবিনকে যেমন দেখতে তেমনটা সে মোটেই নয়। ও ভিশন জানতে ইচ্ছে হলো এই বিহঙ্গিনীকে। মুখর ওর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,,

‘আপনি কারো কোন দায় রাখবেন না বলেই কি আমাকে গ্ৰহন করছেন না‌।”

মেহবিন হাসলো আর বলল,,

‘কাব্য অর্থ আরেকটা আছে সুখী জীবন। তাহলেই বুঝুন।”

“আমি বিহঙ্গিনীর কাব্য হতে চাই। আর সেই সাথে বিহঙ্গিনী কে জানতে চাই। তবুও কি আপনি বাঁধ সাধবেন?”

মেহবিন বৃষ্টির মধ্যেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবার পেছনে মুখরের দিকে তাকিয়ে একটু চিৎকার করে বলল,,

“এই বিহঙ্গিনীকে জানতে চাইবেন না মুখর শাহরিয়ার! তাহলে শূন্য হাতে ফিরতে হবে আপনাকে।”

বলেই মেহবিন বৃষ্টির মধ্যে চলে গেলো। মুখর অদ্ভুত ভাবে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ও নিজেও বেরিয়ে পড়লো নিজের গন্তব্যে।

_____________

বাড়িতে সবাই মুখরের বিয়ের কথা বলছে। মুখর বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরলো ওকে দেখে সবাই চুপ হয়ে গেল। তা দেখে মুখর বলল,,,

“আমি আসার সাথে সাথে সবাই চুপ হলো কেন?”

তখন মুখরের মা বলল,,

“কিছু না তুই আগে ফ্রেশ হয়ে আয়। তারপর বলছি।”

“ঠিক আছে।”

মুখর ওপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। মিসেস মাহফুজ কফি দিলেন ওকে। ও সোফায় বসে বলল,,

“হুম এখন বলো কি ব্যাপার?”

তখন আছিয়া খাতুন বললেন,,

“নাতি তোমার জন্যে নাতবউ পাইয়া গেছি।”

মুখর আছিয়া খাতুনের কথায় ড্যাবড্যাব করে ওনার দিকে তাকিয়ে রইল। আর বলল,,

“মানে?”

“তোমার মেহবিন কে কেমন লাগে নাতি?”

মেহবিনের কথা শুনে ওর মনে তো লাড্ডু ফুটতে লাগলো। তবুও মুখে বলল,,

“ভালোই তো কেন?”

মুখর সবে কফিটা মুখে দেবে এমন সময় আছিয়া খাতুন বলল,,

“নাতবউ হিসেবে মেহবিনকেই আমাদের সবার পছন্দ হয়েছে।”

মুখর কথাটা শুনে যেন কফি গেলার কথা ভুলে গেল। ও কোনরকমে কফি গিলে বলল,,

‘মানে কি?”

‘মানে হলো এটাই আমর মেহবিনকে তোমার জন্য পছন্দ করছি।”

“ওহ আচ্ছা!”

‘তুমি খুশি হইছো তো না মানে তোমার পছন্দ হয় ওরে।”

“তোমরা যখন পছন্দ করেছো তাহলে এখানে আর না করার কি আছে?”

বলেই মুখর উঠে চলে এলো। ও আসতেই সবাই হেঁসে ফেললো। কারন উনারা জানেন মুখর মেহবিনকে পছন্দ করে। আর বাড়ির সবারই মেহবিন কে পছন্দ। কিন্তু মুখর এমন ভাব ধরলো যেন ওর কিছু যায় আসে না। এদিকে মুখর এসে নিজের ঘরে একাই গানবাজনা ছাড়াই নাচতে লাগলো। আর বলল,,

“পাঞ্জাবিওয়ালা তোমার এখন বিয়ের রঙ লাগবে। এবার আর বিহঙ্গিনী নিশ্চয়ই না করতে পারবে না। শুকরিয়া আল্লাহ। ”

মুখর মুচকি হেসে ফেসবুকে ঢুকলো। আর ঢুকে কাব্যের বিহঙ্গিনী পেজের পোস্ট দেখে কিছু টা অবাকই হলো।

“আমাকে অন্যদের সাথে গুলিয়ে ফেলো না। নাহলে শূন্য হাতে ফিরতে হবে তোমায়।”

~চলবে ,,,

কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-৫৩+৫৪

0

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫৩(বোনাস পার্ট)
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“নাম্বার শেখ আমাজাদের নামে করা । অথচ কথা বলেন আরিফ জামান যদিও ভয়েজ চেন্জার দিয়ে। যদিও আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি প্রথমে শেখ আমজাদকেই ভেবেছিলাম। তবে মগজের ধোলাই করে কললিস্ট চেক করতেই ধরা পরে গেলেন দ্য গ্ৰেট নিশাচর। মানে দুইজনই এই সিম ব্যবহার করতেন আর ভয়েজ চেঞ্জার করেছেন যেই কথা বলুক না কেন সবার মনে হবে একজনই করেছে। মানে নিশাচর সবার কাছে একজনই কিন্তু মুলত নিশাচর একটা না দু’টো। দুজনেরই বাইরের দুনিয়ার কাছে আলাদা পরিচয় আছে। দুজনে সময় মতো একইসাথে করতে পারবেন না বলে এটা করেছেন। আর দুজন যেহেতু একসাথে রাজা হতে পারে না। তাই একজনের নাম দিয়ে রাজা হয়েছেন আপনাদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। তো এখন বলুন ফেলুন তো শেখ আমজাদ ও আরিফ জামান থেকে নিশাচর হওয়ার গল্প।

মেহবিনের কথায় শেখ আমজাদ বলতে লাগলেন,,

“যেহেতু সব জেনেই ফেলেছো তাহলে লুকিয়ে কি লাভ? আমি শেখ বংশের ছেলে হলেও আমার বাবা একজন কৃষক ছিল। তার পড়াশোনা ভালো লাগতো না তাই তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল না। অথচ কাকা শেখ শাহেনশাহ ছিলেন শিক্ষিত মানুষ তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে দাদা উনাকে ঢাকায় পরিয়ে শিক্ষিত করেছিলেন। কিন্তু কাকা যখন শিক্ষিত হয়ে প্রথমে চাকরি আর পরে ব্যবসা করে অনেক আয় উন্নতি করলো। তখন দাদা মারা গেল দাদি তো আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমার বাবা কৃষক দেখে আমাদের সাথে থাকা সেটা কাকির পছন্দ ছিল না। তাই তিনি কাকাকে আলাদা হতে বলেন আর কাকাও আলাদা হয়ে যায়। এই শেখ বাড়িটা দাদার বাবা বানিয়েছিলেন। সে জমিদার ছিলেন। এরপর একা দাদা ছিলেন সেই সুবাদে আমার বাবা ও কাকা এই বাড়িটার সমান ভাগিদার। বাড়ি আলাদা হয়ে গেল। তবে যেহেতু কাকারা বেশি টাকা ইনকাম করতো। তাই তারা ভালোমন্দ খেতো। আর আমার বাবা কৃষক ছিল সে রকম আয় রোজগার আসতো না তাই আমরা ভালো খেতেও পেতাম না। এগুলো দেখে আমার খুব রাগ হতো এক বাড়িতে আছি তবুও কতোটা বৈসাদৃশ্য। শাহনাওয়াজ কতোকিছু নতুন দামি দামি জিনিস পেত আমি শুধু দাড়িয়ে দেখতাম। একদিন আমি ওর একটা জিনিস দিয়ে খেলার সময় ওটা ভেঙে যায় তাই কাকি আমাকে ভিশন মারে আর বকাবাজি করে। আর বাবা মাও আমাকে মারে। তাই মনে মনে পন করি আমিও একদিন অনেক টাকার মালিক হবো। বাবা বুঝতে পেরেছিলেন ওদের এইসব ভালো সবকিছু আমার সহ্য হচ্ছে না। তাই বাবা আরেকটা বাড়ি ছিল ওখানে উঠে যায় ওটা টিনের ছিল। আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। ওদের প্রতি রাগ আরো বেড়ে গেল।কয়েকদিন বাদেই গ্ৰামে কলেরা এলো আর সেইখানে কাকি মারা যায় কি যে খুশি হয়েছিলাম তা বোঝাতে পারবো না। কিন্তু তার পরের দিন বাবা মা দু’জনেই কলেরায় মারা গেল ‌। তখন আমি এতিম আমার কথা শুনে শেখ শাহেনশাহ আমাকে তার কাছে নিয়ে এলো। আমি আর শাহ দুজন একসাথেই বড় হতে লাগলাম মিথ্যা বলবো না কাকা কখনো আমাদের মাঝে কখনো বড় বৈসাদৃশ্য করেনি। তবুও অনেক বিষয়ে তিনি শাহের ব্যাপারে বেশি করতেন যা আমার পছন্দ হতো না। সবকিছুর মধ্যে ছোটবেলায় কাকির কথা আর মার গুলো আমার ভেতর বড় ক্ষত সৃষ্টি করেছে। শাহ কে দেখলেই আমার রাগ হতো ওর জন্যই আমি কাকির থেকে মার খেয়েছিলাম আর বাবা মায়ের থেকেও মার খেয়েছিলাম। আমি আর শাহ দু’জনেই মেডিকেল এ ভর্তি হই।যখন কলেজে পড়ি আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম কিন্তু সেই মেয়েটা শাহ কে পছন্দ করতো। তুমি জানো সেটা কে?সেটা হলো তোমার মা। শাহ ও মেয়েটাকে পছন্দ করতো। ওদের দেখি বুঝতে পারছিলাম ওরা দুজন দুজনকে চায় যদি এভাবেই হতে থাকে তাহলে দুজনের বিয়ে নিশ্চিত। তাই আমিই গিয়ে শাহেনশাহ কে বলি ছেলের বিয়ে দিতে। আমার কথা শুনেই শেখ শাহেনশাহ আরিফার সাথে বিয়ে ঠিক করেন শাহের মতামত না নিয়ে। আমি ভেবেছিলাম মেহের কে আমি পেয়ে যাবো। এই জন্য মেহেরের বাবার কাছে প্রস্তাব ও দিয়েছিলাম কিন্তু মেহের বিয়ে করতে রাজি নয়। তাই বিয়ে হলো না। এদিকে পড়াশোনা শেষ এই জন্য কাকা আমার জন্য মেয়ে দেখলেন ওনার কাছে ভালো থাকার জন্য আমি আর না করতে পারলাম না। এদিকে মেহের ও বিয়ে করবে না। আমার বিয়ে হয়ে গেল।তখন আরিফ জামানের বাবা মারা যায় আরিফা জামান ইনিয়ে বিনিয়ে তার ভাইকে এই বাড়িতে আনেন। মেহের ও আমার আর শাহের সাথে এস.এপ. হাসপাতালে যোগ দিল। আমি মেহের কে পেতে চাইতাম তাই একদিন সুযোগ বুঝে ওর কেবিনে গেলাম সেদিন মেহের আমায় থাপ্পড় মারলো। আরব দল এরপর ওর দিকে তাকালে কাকাকে বলে দেবে। কাকার ভয়ে কিছু বললাম না। তার কয়েক বছর চলে গেল শাহের বাচ্চা হলো না তখন শাহের বিয়ের কথা বলল আর মেহেরের সাথে হয়েই গেল যা আমার মনে রাগ ঘৃনা দুটোই হচ্ছিল। আমি এতো কিছু করেও পেলাম না অথচ শাহ একটা বিয়ে করেও ওকে পেয়ে গেল। শাহ আর কাকার ওপর ভিশন রাগ হলো। ওকে কি করে শেষ করবো সেটাই ভাবছিলাম। তবে মনে মনে একটা ভাবলাম টাকা আর বাবা থাকলে পৃথিবীতে সব সম্ভব।

এইটুকু শেষ করে তিনি থামলেন তখন মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“ঠিক বলেছেন শেখ আমজাদ টাকা আর বাবা থাকলে সব সম্ভব। তারপর?

“আমি টাকা কামানোর জন্য রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। অন্য একটা হাসপাতালে আমার সিনিয়র অপারেশন এর জন্য আমায় ওনার সাথে নিলেন। কিন্তু আমি জানতাম না অবৈধভাবে উনি কারো হার্ট পেশেন্ট এর গায়ে দিচ্ছে। পরে আমি জানতে পারি আমি ওনার সাথে কথা বলতে গেলেই উনি বিষয়টা জানান। আর বলেন এই কথা কাউকে জানালে আমাকে ফাঁসিয়ে দেবেন। উনি অফার দেন আমি যদি এভাবে কাজ করি তাহলে আমি টাকা পাবো। টাকার জন্য আমি এই লাইনে আসি। আর তার কিছুদিন পরেই জানতে পারি অর্গানের ব্যবসায় আরিফ ও রয়েছে। এরপর থেকেই আমাদের একটা বড় চক্র এই অবৈধভাবে অর্গানের ব্যবসায় কাজ করে‌। আমরা দুজন যেহেতু দুজন কে চিনি খুব ভালো কাজের জন্য আমরা বসের নজরে পরি। তিনি অনেক প্রাইভেট জায়গায় আমাদের নিয়ে যেতেন।সবার সাথে পরিচিত হলাম।অনেক টাকা আয় হচ্ছিল। মেহের মরার পর শেখ শাহনাওয়াজ ডাক্তারি ছেড়ে দিল। আমি এস এস হাসপাতালের অনেক পেশেন্ট কে ভুল ওষুধ দিয়ে অসুস্থ করতাম তারা কোমায় চলে যেত গ্ৰামের ভেতর হওয়ায় তারা বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে পারতো না এই জন্য কাজটা সহজ হলো। আমি আর আরিফ প্ল্যান করলাম যেহেতু আমরা দুজনেই সবকিছু জানি তাহলে আমরাই ব্যবসা করবো। দুজনে একসাথে হাত মেলালাম তবে দুজন তো রাজা হতে পারে না‌। তাছাড়া কেউ যাতে কোনদিন আমাদের ধরতে না পারে তাই দুজন এক হলাম। হয়ে উঠলাম সবার ট্রাস নাম দিলাম নিশাচর। যার মাধ্যমে কাজ শিখলাম তাঁকেও পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে গেলাম। তার কিছুদিন পর সেই বস ধরা পড়লো যা আমাদের উচ্চ চূড়ায় পৌঁছিয়ে দিল। বসের সাথে থাকা সব লোকদের আমরা কিনে নিলাম। সাথে আরো মানুষ যুক্ত করলাম। কিছু জন আমাদের গ্ৰামের হাসপাতাল এর ওপর অর্গান পাচারের সন্দেহ করছিল তাই ওখান থেকে শাহেনশাহ কে বলে এস.এস. হাসপাতাল ঢাকায় শিফট করলাম। যাতে আমরা সন্দেহ তালিকা থেকে বাদ পরি। সরকারি হাসপাতাল হলো বাবুলকে রাখলাম কাজে।ও ভুল ওষুধ দিয়ে আমাদের হাসপাতালে লোক পাঠাতো।‌ হাসপাতাল থেকে আমরাই মেরে ফেলতাম আর অর্গান নিতাম। আমাদের গ্ৰামে যতো মেয়ের ধর্ষন হতো সব আমরা করাতাম।শাহ কে আমিই বলেছিলাম গোসলের জন্য লোক রেখে দিতে সে তাই করলো আমরা তাদের টাকা খায়িয়ে নিজেদের দলে নিলাম। নুপুরের বাবা সহ আমরা অনেক হাসপাতাল আর ডক্টর কিনে নিয়েছিলাম। তোমার আগে যে ছিল সে ডক্টর বাবুল এর সাথে আমাকে দেখে নিয়েছিল তাই তাকে মরতে হলো। এভাবে আরো কতোজন মরেছে আমাদের কাজে তার ইয়ত্তা নেই।

সব শুনে মেহবিনের হাত শক্ত হয়ে গেল। ইচ্ছে তো করছে কুঁচি কুঁচি করে তাদের কেটে ফেলতে। কিন্তু এই মুহূর্তে মাথা গরম করা চলবে না। ও শান্ত স্বরে বলল,,

“শেখ আমজাদ এর থেকে তো সব শোনা হলো। তো আরিফ জামান আপনি বলুন আমার মা কি ক্ষতি করেছিল যে তাকে এই দুনিয়া ছাড়তে হলো‌ আর আমিই বা আপনাদের কি ক্ষতি করেছিলাম যে আমাকেও দুনিয়া থেকে উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন?

আরিফ জামান বললেন,,

“আমার বোনের তোমার মাকে আর তোমাকে সহ্য হতো না। আরিফা শাহ কে অনেক ভালোবাসতো কিন্তু একটা সন্তানের আশায় তোমার মাকে বিয়ে করলেন। তবে তোমার বাবা আমার বোনকে ফেলে তাকেই বেশি সময় দিতো। আমার বোনের চোখের সামনে তোমার মাকে নিয়ে রাত কাটাতেন সেটা ওর সহ্য হয় নি। আর তুমি বড্ড দূরন্ত আর তোমার মায়ের সবথেকে প্রিয় ছিলে বলে তোমাকেও তার সহ্য হতো না। আমার কাছে আবদার করে তাকে সরিয়ে ফেলতে তাই এসব করেছি? আর ওকে বলেছি নিশাচর নামের কেউ আছে যে এসব কাজ খুব ভালো করে তার সাথে কথা বলে তোমাদের খতম করে ফেলবো। আর তোমাকেও করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি কুসুমের হাত থেকে পালিয়ে যাও।

“তারমানে আরিফা জামান জানেন না নিশাচর কে?”

‘না!”

“ওহ আচ্ছা তো এখানে শেখ শাহেনশাহ কিভাবে সব জানলেন উনিও তো জানতেন?”

“আমি আর আরিফা এই বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম উনি বাইরে থেকে সব শুনেন। হুট করে উনি ঘরে ঢুকে আসেন। আরিফা অনেক কান্নাকাটি করে আর বলে তিনি মেহের কে এতো সুখী দেখতে পারছেন না। তাছাড়া ওনারা তো স্বার্থের জন্য বিয়ে দিয়েছিলেন। এখন তো ওনার ওয়ারিস আছে তাহলে মেহের কে রেখে কি লাভ। তাছাড়া মেহেরের মেয়ে মানে তুমি কোন কথা শুনতে চাওনা। তোমাকে রেখেও কি লাভ। আরবাজ ওয়ারিস তাই তাকে কিছু করা যাবে না। মিশু আরিফার কথা শুনে তাই সে থাকলেও আরিফার ক্ষতি নেই। সব শুনে তিনি বলেছিলেন না মরতে তবে আমরা শুনি নি। আরিফা আরো অনেক কিছু বোঝায় এরপর উনি আর কিছু বলেন নি।

মেহবিন সব শুনে শান্ত স্বরে বলল,,

“এখানে তো শেখ আমজাদ আপনিও ছিলেন আপনি তো আমার মাকে ভালোবাসতেন। তাহলে কি হয়েছিল আপনার।আপনি ভোগ করতে পারেন নি বলে তাকে আপনার সহ্য হতো না তাইনা এসবে ছিলেন?”

শেখ আমজাদ বলল,,

“হ্যা এর জন্য আমি ওকে ভোগ করতে পারি নি তাই। ও যখন আমার না তাহলে কারো না। তাছাড়া ও আমাকে থাপ্পর মেরেছিল যা আমি আজ ও ভুলতে পারি নি। তাছাড়া ওর পাশে আমার শাহনাওয়াজ কে সহ্য হতো না। তাই করেছি আমার তো ইচ্ছে হতো শাহকে মেরে দিই। কিন্তু ওকে মারতে পারতাম না আমি কিভাবে যেন বেঁচে যেত। তুমি জানো কয়েকবছর আগেও ওর গাড়ি একদম ট্রাক দিয়ে পিষে ফেলেছিলাম তবুও মরেনি। সাতদিন খবর নাই তারপর দেখি কে যেন ফোন করে বলল হাসপাতালে। শালার কই মাছের জান। এতো কিছু করি তবুও মরে না।

কথাটা বলতেই মেহবিন একটা সুইচ টিপ দিল সাথে সাথে কারেন্ট খেল। তা দেখে পার্টনার হেঁসে ফেললো। মেহবিন তার দিকে তাকিয়ে আবার শেখ আমজাদের দিকে তাকালো। আর বলল,,

‘বুঝলাম এখন বলুন অনুভব কে কেন মারা হলো? মিশুকে কেন পাগল করা হলো?

“ও আমাদের বিষয়ে সব জেনে ফেলেছিল তাই। মিশু ও জেনেছিল ওদের বাড়ির কেউ ওর মায়ের পেছনে আছে। তাই যাতে ও এই বিষয়ে কখনো কারো সামনে মুখ না খুলতে পারে এই জন্য পাগল করে রেখেছি।”

মেহবিন বলল,,

‘ বাপরে বাপ এই কেউ চকলেট আনো। এরা এমন সহজভাবে সব বলছে মনে হচ্ছে এগুলো করা কোন ব্যাপারই না।”

মেহবিনের কথা শুনে আরিফ জামান বলল,,

“তোমাকেও দেখে মনে তুমি আগে থেকেই সব কিছু জানতে? তবে এতো কিছুর পরেও এটা ভুলে যেও না। শাহ কিন্তু তোমায় খুঁজে নি। তোমার মায়ের কারন হিসেবে কিন্তু তোমাকেই দায়ী করে। তাছাড়া তাজেল নামের বাচ্চাটার এই হাল কিন্তু তোমার জন্যই এটা ভুলো না। তোমার জন্য বাচ্চাটা তার বাবা হাড়িয়েছে।

মেহবিন কিছুই বললো না শুধু মুচকি হাসলো। আর বলল,,

“তোরা তো বলদ দেখছি। দুনিয়াতে কি সব মানুষ তোদের মতো পশু নাকি যে তাদের দ্বারা কারো খারাপ হবে অথচ তাদের কিছুই যায় আসবে না।”

‘মানে?”

“মানে হলো এই নেত্রীর এক্সিডেন্ট তোদের জন্য হয় নি। একজন ট্রাক চালকের গাড়ি ব্রেকফেল হয়েছিল তাই ওটা হয়েছে। এই জন্য গাড়ি চালক ও আরো সামনে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছিল তাই একটু সুস্থ হতেই চারদিন পর এসে নিজের ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করে গেছে এবং দশ লাখ টাকাও দিয়ে গেছে তাজেলের বাবা মারা যাওয়ার জন্য। আমাকে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে তোদের খুব দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু আফসোস পারলাম না তোদের ইচ্ছে পূরণ করতে।”

তখন একজন দশটার মতো চকলেট এনে রাখলো। মেহবিন একটা হাতে নিয়ে বলল,,

“পার্টনার হাঁপিয়ে উঠেছেন নিশ্চয়ই! নিন একটা চকলেট খান।”

পার্টনার চকলেট নিল ছিঁড়ে মাস্ক টা সরালো। পার্টনারের চেহারা দেখে শেখ আমজাদ ও আরিফ জামানের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। দুজনেই একসাথে বলল,,

“শাহনাওয়াজ!”

মেহবিন আর শেখ শাহনাওয়াজ হেঁসে ফেললো। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“কি বললি আরিফ আমি মুসকান কে খুজিনি? তাহলে বলি কেউ হাঁড়িয়ে গেলে না তাকে খোঁজে মানুষ ।আমি তো মুসকান কে আমার চোখের আড়াল করি নি। তার প্রত্যেকটা খবর আমার কাছে পৌঁছে যেতো‌। আর আমি তাকে ঘৃনা নয় ভালোবাসি।”

“তুই! তুই! এখানে?”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘এই কেউ আরেকটু কারেন্ট খাওয়াও যদি তাহলে একটু বুদ্ধি খোলে।”

শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘আপনার হাতেই সুইচ টা?

“এখন তো আমি চকলেট খাবো তাই একটু বিজি। তাহলে চকলেট চিয়ার্স করে খাওয়া যাক পার্টনার।”

দুজনে চকলেট চিয়ার্স করে খেতে লাগলো। এদিকে এই দুই বাপ মেয়ে কে দেখে ওদের দুজনের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। চকলেট খাওয়া শেষ হলে মেহবিন বলল,,

“নিশ্চয়ই তোদের প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে এখানে উনি কেন? তাহলে শোন যেদিন রাতে আমার মাকে মারার কথা প্ল্যান করিছিলি সেদিন আরিফা জামানের কুসুমের সঙ্গে বলা সব কথা তিনি শুনে ফেলেন। আর এটাও বলেন যদি আমি বেঁচেও যাই তাহলে এই বাড়িতে আনলেও আমাকে মেরে ফেলবে। আর নিশাচর নামের কারো হাতে আমায় তুলে দেবে তারা আমার অর্গান নিয়ে নেবে। আর এখানে যা হয়েছে সব নাকি নিশাচরই করিয়েছে। কুসুম কে হায়ার করা থেকে মাকে বিষ খাইয়ে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেওয়া পর্যন্ত সব নাকি নিশাচর করেছে। আর নিশাচর এর নজর পরেছে আমার ওপর আমাকে সে কোনমতেই ছাড়বে না। আমার সবকিছু নাকি ডিল করে ফেলেছে নিশাচর। ততক্ষণে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি দৌড়ে বের হোন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে কোন হাসপাতালে তিনি জানতেন না। আমাদের ঢাকার বাড়ি থেকে যতোগুলো হাসপাতাল ছিল সব ক’টায় আমাদের খুজেন। খুঁজতে খুঁজতে আমাকে দেখেন রাস্তায়। নিশাচর এর কথা শুনে তিনি ভয় পেয়ে যান এই জন্য আমাকে ইচ্ছে করে হাড়িয়ে ফেলেন। তবে এরপর থেকে আমার ওপর নজর ও রাখেন। আমি যেন সেফলি ঐ বাড়িতে থাকি তাই পুলিশের মাধ্যমে মিস্টার আলমকে ভয় দেখালেন। যাতে আমাকে তার বাড়িতে রাখে।

এইটুকু বলে মেহবিন থেমে শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘কি ঠিক বললাম তো? এই গল্পটাই তো শুনিয়েছিলেন আমাকে।”

শেখ শাহনাওয়াজ মেয়ের দিকে তাকালেন তা মেহবিন উল্টো দিকে ঘুরে গেল। আর বলল,,

“অনেক হয়েছে এবার শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আর শেখ আমজাদ আপনাকে তো একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি। আপনার ছেলের এই অবস্থার জন্য দায়ী কিন্তু আরিফ জামান?

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৫৪
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিনের কথায় শেখ আমজাদ চমকে উঠেন আর বলেন,

“মানে?”

“মানে হলো, উনি আপনার ছেলেকে একজন ধর্ষক বানিয়েছেন। উনি আপনার ছেলেকে এমন একটা ওষুধ দিতো যার কারনে সায়িদ নারী সঙ্গ ছাড়া থাকতে পারতো না। এবং রাতের অন্ধকারে হিংস্র পশুর মতো হয়ে উঠতো। আর ওর জন্য কতো মেয়েরা যে এ ধর্ষনের স্বীকার হয়েছে আপনি জানেন না। আর সেই মেয়েগুলোর আলাদাভাবে উনি অর্গান সেল করেন। আর এক সময় সায়িদ ওনার বিষয়ে জেনে গেলে। তখন উনি সায়িদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ বার নিশাচর হিসেবে তো উনিই আমার সাথে কথা বলেছিলেন। আর একটা গোপন খবর জানেন কি? আরিফ জামান এর কিন্তু আপনার বউয়ের ওপর নজর ছিল ফাঁক পায়নি তাই কিছু করতে পারেনি।

মেহবিনের কথায় শেখ আমজাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। কিন্তু আনফরচুনেটলি এখন আরিফ জামানের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তা দেখে মেহবিন হাসলো। পর্দা উঠানোর আগে তাকে একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। যার কারনে তার ত্রিশ মিনিট পর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে তিনি চিৎকার অবশ্যই করতে পারবেন। আরিফ জামান চিৎকার করছে আর মাথা দিয়ে না না করছে। তবে তিনি সত্যি সত্যি সায়িদের সাথে এটা করেছিল। আর সত্যিই আমজাদের বউয়ের দিকে নজর ছিল। এমনিতে তো মেহবিনের মায়ের দিকেও ছিল ‌। মেহবিন শেখ আমজাদের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কি শেখ আমজাদ এখন কি করতে ইচ্ছে করছে? হাজার হোক নিজের ছেলে আর ছেলেরা সবসময়ই বাবাদের কাছে প্রিয় হয়।”

“আমি খারাপ কাজ করেও সায়িদকে এসব থেকে দূরে রেখেছি। কিন্তু ও কি করে পারলো এমনটা করতে। ওকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারলে শান্তি লাগতো। আফসোস হয়তো পারবো না।”

শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“পারবি আমজাদ পারবি। আমরা দেব তোকে সুযোগ।”

মেহবিন বলল,,

“আপনি তো ডক্টর এতো দিন কতো মানুষের অর্গান বের করেছেন। আজ না হয় একটা একটা করে উনার শরীর থেকে সবকিছু বের করুন। মানে একটা চোখ, একটা কিডনি, পারলে দুই টা হাত ,দুইটা পা কেটে দিন আর হার্ট না হার্ট টা থাক ওটা নিয়ে বাঁচতে হবে তো। তবে হ্যা এসব কিন্তু কোন অবশ করার ইনজেকশন দিয়ে হবে না। এমনিই করতে হবে।”

মেহবিনের কথা শুনে শেখ আমজাদ আঁতকে উঠলেন। এরকমটা একটা মানুষের সাথে করলে বাঁচবে তো। মেহবিন বলল,,

“আরে ভয় পাবেন না আরিফ জামান মরবে না। সেই ব্যবস্থা আমি করবো।”

শেখ আমজাদের সামনে সব রাখা হলো। তিনি চোখ বুঝলো তখন সায়িদের মুখটা আর ওর অবস্থা মনে পড়লো। তিনি চিৎকার করে উঠলো। ছেলের ঐ অবস্থা কোন বাবাই সহ্য করতে পারবে না। তিনি এগিয়ে গেলেন ততক্ষণে মেহবিন এর লোক একটা টেবিলের ওপর আরিফ জামান কে শুয়িয়ে দিয়েছে আর টেবিলের সাথে হাত পা লোহার শেকলের মতো কিছু দিয়ে আটকে দিয়েছে। যদিও ওটা একটা সুইচের মাধ্যমে আটকানো ও খোলা হয়। যার মাধ্যমে আরিফ জামান কিছুই করতে পারছেন না। উনি মাথা দিয়ে না না করছে‌ । শেখ আমজাদ প্রথমে কিডনি বের করলো আর আরিফ জামান গগন বিদারক চিৎকার করতে লাগলো। মেহবিন আর শেখ শাহনাওয়াজ সেদিকে শান্ত ভাবে দেখলেন। এরপর চোখ ও তুলে ফেলল। আরিফ জামান এর চেহারা দেখে আমজাদ ভয় পেল ওর আর সাহস হলো না। তখন হুট করেই আরিফ জামানের হাত পা খুলে গেল। আরিফ জামান হিংস্র পশুর মতো হয়ে উঠলো। সামনে যা পেল তাই দিয়েই শেখ আমজাদ কে ছুড়ে মারতে লাগলো। শেখ আমজাদ নিজেকে বাঁচাতে তার ওপর হামলা করলো। কারন তারা এখন যে রুমে আছে সেই রুমটা বন্ধ। আরিফ জামান ও কম নন সে ও একটা ছুরি নিয়ে শেখ আমজাদের কিডনি বরাবর ঢুকিয়ে দিল। তিনি অনেক জোরে চিৎকার করে উঠলো‌। এতোক্ষণ এগুলোই মেহবিন আর শেখ শাহনাওয়াজ আয়নায় বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে দেখছেন। মেহবিন বলল,,

“এরা নিজেকে বাঁচানোর জন্য একে অপরের সাথে লড়াই করছে। অথচ এতো দিন এতো গুলো মানুষ কে নির্ধিদ্বায় মেরে ফেলেছে। এই জন্যই বলে মানুষ বড্ড স্বার্থপর।”

শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“এভাবেও শাস্তি দেওয়া যায় হাত না দিয়েও!”

“সবসময় হাত দিয়ে শাস্তি দিতে পারলেই যে আপনি অনেক বড় কিছু একটা করে ফেললেন তেমনটা কিন্তু নয়। বুদ্ধি খাটিয়েও কিছু করতে হয় আল্লাহ তায়ালা এমনি এমনিতো আমাদের মস্তিষ্ক দেয় নি তাই না। মা বলেছে শাস্তি দেবে কিন্তু অন্যায়ভাবে নয়। এখানে আমি কোন অন্যায় দেখছি না। আমি শুধু সত্যি গুলো সামনে তুলে ধরেছি যা করার এরা নিজেরাই করছে। তবে আমি নিজের হাতে শাস্তি দিলে এরা নিশ্চয়ই মরে যেত। কিন্তু আমি তা চাইনা। আমি চাই তারা বাঁচুক কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে নিজের মৃত্যকামনা করুক। ঐ যে দেখেন শেখ আমজাদ আরিফ জামানের হাত কেটে ফেলেছে। আর আরিফ জামান শেখ আমজাদের পা। পুরো শরীরে জখম।এর থেকে পচন ধরবে আর দুজনে বেড রেস্ট থাকতে থাকতে এভাবেই দুজনে একদিন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে।”

মেহবিন ভেতরে কিছু লোক পাঠালো তাদের থামিয়ে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। তাদের সরিয়ে ফেলা হলে। শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“এরপর?”

“মুখর শাহরিয়ার ওদের দুজনকে গ্ৰেফতার করবেন এবং রিভিল করবেন। প্রমান সব পৌঁছে গেছে মুখর শাহরিয়ার এর নিকট। কালকের ব্রেকিং নিউজ নিশাচর নামক চুরাবালিকে উড়িয়ে নিয়েছে কোন ঝড়। এদের দুজনের কোনকিছু নিয়ে কথাকাটাকাটি হয় এর পর হাতাহাতি এরপর খুনাখুনি‌। তখন মুখর শাহরিয়ার গিয়ে ওনাদের থামিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে।

“অতঃপর আপনাকে শুভেচ্ছা আপনি আপনার মনজিলে পৌঁছে সেটাকে জিতে গেছেন ।”

“আমার আর আপনার পার্টনারশিপ এখানেই ভেঙ্গে গেল শেখ শাহনাওয়াজ ওরফে চেয়ারম্যান সাহেব।”

“এখনো একজন কে শাস্তি দেয়া বাকি এখনি কিভাবে ভাঙে?”

“তার শাস্তিটা না হয় আপনার ওপরেই ছেড়ে দিলাম।”

“আপনি কি ফিরবেন না আম্মা?”

“কেন ভালোবাসি, কেন কষ্ট পাই
আপনিও যেমন জানেন আমিও তো তাই!
তবুও তো ভালোবাসি, তবু ভেজে চোঁখ
এভাবেই বেঁচে থাকা, এভাবেই শোক!

~নূর মহল ( কাব্যের বিহঙ্গিনীর পাঠক মেহবিনের কষ্ট তুলে ধরার জন্য লিখে পাঠিয়েছেন)

বলেই মেহবিন সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শেখ শাহনাওয়াজ এর চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। মুখরকে মেহবিন আগেই জানিয়েছিল সে তাই বাইরেই অপেক্ষা করছিল। ওনাদের নিয়ে যাওয়া হলে মুখর ও তাদের সাথে চলে যায়। মেহবিন বাড়ি ফিরেই দেখলো তাজেল টেডিবিয়ার জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। কালকেই মেহবিন তাজেলকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। এই তিনদিনে মেয়েটা আগের মতো একটাও কথা বলেনি। আজ মেহবিন একটা টেডিবিয়ার এনে দিয়েছে। আর যাওয়ার আগে ঘুম পারিয়ে দিয়ে গেছে। মেহবিন তাজেলের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,,

“আল্লাহ তায়ালা উত্তম পরিকল্পনাকারী নেত্রী। তাই তো ডাক্তারের কাছে তার নেত্রীকে পার্মানেন্ট ভাবে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন এই নেত্রী নিজের আকাশ নিজে তৈরি করবে মুক্ত বিহঙ্গিনীর মতো উড়ে বেড়ানোর জন্য। আর পেছনে থাকবে নেত্রীর ডাক্তার যাতে নেত্রীর পথে কোন বাঁধা না আসে।”

তাজেল মেহবিনের হাত জড়িয়ে ধরলো। তার আজ আনন্দে কাঁদার কথা থাকলেও সে কোন রিয়াক্টই করছে না। মেহবিন শুয়ে পড়লো কিন্তু ঘুম কি আসবে। উঁহু আজ তার রাতটা নির্ঘুম যাবে। এই মুহূর্তে ওর মুখরকে দরকার ছিল। ওর মানসিক শান্তি। কিন্তু এখন সম্ভব নয় তবে তার নেত্রী তো আছে। মেহবিন নেত্রীকে ওর বুকের ওপর উঠালো আর ওকে জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

_____________

সকাল বেলা টিভি অন করতেই সারা দেশ বাকরুদ্ধ। নিশাচর তার নাম সবাই শুনে এসেছে তার কৃর্তিকলাপ সব ফাঁস। আরিফা জামান দেখেই পরে গেলেন সাতদিন ধরে দুজন নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তি দুজন শেষ মুহূর্তে এই। তার ভাই এসব করতো ভেবেই আরিফা জামান স্তব্ধ হয়ে গেলেন। শেখ বাড়িতে শোকের ছায়া। অথচ চারিদিকে মুখর শাহরিয়ার এর জয়জয়কার। তবে সে বলেছে তাকে দুজন মানুষ সাহায্য করেছে কে করেছে সেটা কাউকে বলে নি‌।পুলিশ থেকে মুখর কে সম্মাননা দেওয়া হবে সেই সাথে সেই আরো দুজনকে‌। মুখরের আবারো প্রমোশন হয়েছে সে এখন ওসি থেকে ডিসি হয়েছে। যা দেখে শাহরিয়ার পরিবারে খুশির জোয়ার। তবে শেখ শাহনাওয়াজ এর পরিবারের জন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে। তাই বলে সেই পরিবারের এতোবড় স্ক্যাম দেখে তারা কিন্তু বিয়ে ভেঙে দেয় নি।

আরিফা জামান খবর দেখে স্তব্ধ হয়ে নিচে বসে আছে। তখন শেখ শাহনাওয়াজ তার সামনে বসে মুচকি হেসে বললেন,,

“ওরা তো ওদের শাস্তি পেয়ে যাবে আরিফা তবে তোমার? তোমার কি শাস্তি হওয়া উচিত বলো তো? তুমিও তো খুনী আমার মেহেরের।”

আরিফা জামান চমকে শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকালো। আর পুরো শেখ পরিবার চমকে উঠলো। মিশু আর আরবাজ ও বাদ যায় নি। মিশু বলল,,

“বাবা এসব মামনি মানে?”

শেখ শাহনাওয়াজ এতো বছরের রাজ সবাইকে বলে দিল। মিশু আর আরবাজ কাঁদতে লাগলো। মিশু আরিফা জামান এর সামনে গিয়ে বলল,,

“কেন মামনি? আমি তো তোমায় মামনি বলি আর মায়ের আসনেই বসিয়েছিলাম তাহলে তুমি একজন মা হয়ে কি করে আরেক মা কে মেরে ফেললে? আচ্ছা মা কি ক্ষতি করেছিল তোমার যার জন্য তার ইতি এভাবে ঘটলো? আচ্ছা আমার ছোট বোনটা কি দোষ করেছিল কেন ওকে এতিমের মতো বড় হতে হলো? জবাব দাও?”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বলল,,

‘আমি সবজানি আরিফা সেই উনিশ বছর ধরেই আমি জানি ‌। আর এই সব তিক্ত অভিজ্ঞতা নিজের মনে চেপে রেখেছিলাম শুধুমাত্র আমার মেয়ের জন্য। আচ্ছা তুমি তো নিজ ইচ্ছেতে মেহেরকে আমাদের সাথে জড়িয়েছিলে তাহলে কেন তার সাথে এমনটা করলে? কি ক্ষতি করেছিল ও তোমার। ও তো চায় নি আমাদের সাথে ওর জীবন জড়াতে তোমরাই জোর করে এনেছো ওকে। তাহলে নিজের স্বার্থ হাসিলের পর ওকে ছুড়ে ফেললে কেন? ও তো তোমায় নিজের বড় বোন মনে করতো তাহলে তুমি কি করে পারলে তার বড় বোনের জায়গা নিয়ে তাকে মেরে ফেলতে?”

তখন আরিফা জামান চিৎকার করে বললেন,,

“তাহলে কি করতাম আমি‌। আপনি তো আপনার ভালোবাসাকে অন্য কারো সাথে দেখেন নি। আপনি কি করে বুঝবেন ভালোবাসার মানুষের ভাগ দেওয়া কতোটা যন্ত্রনার। কতোদিন আমি আপনাদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর ভেতরে আপনাদের প্রেমের আলাপ শুনতাম। আপনি কি করে বুঝবেন এতটা কতোটা ভয়ঙ্কর যন্ত্রনা দেয়। শুধু কি আমি জড়িয়েছিলাম সেখানে তো আপনার ও স্বার্থ ছিল ‌ আপনিও তো আপনার ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার জন্য বিয়ে করেছিলেন। একটা পুরুষ কে বিয়ের বিষয়ে কেউ কোনদিন জোর করতে পারে না। যারা ভাবে যে পরিবারের চাপে পরে করেছে এটা ভুল। একটা পুরুষকে কেউ কোনদিন জোর করতে পারে না। আপনি আমার থেকে মেহেরকে ভালোবাসতেন এটা আমি কি করে সহ্য করতাম। তবুও ও তো ওকে আমি বারো বছর মানে এক যুগ সহ্য করেছি। সহ্য হচ্ছিল না আমার ওকে ‌। আমি মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার জন্য ওকে এনেছিলাম। কিন্তু তখন বুঝিনি ভালোভাসার ভাগ দেওয়ার কথা যতটা সহজ ভাবে বলা গেলেও করা কতটা কঠিন। আপনি ওর সাথে কত সুন্দর ভাবে কথা বলতেন তেমনি ভাবে কোনদিন করেছেন। হ্যা আপনি সমতা রক্ষা করে চলতেন তবুও আমার মনে হতো মেহেরের দিকে ভারী। নিজেকেই নিজের কাছে ছোট মনে হতো। আপনি যখন ওর সঙ্গে রাত কাটাতেন সারারাত আমি ছটফট করতাম। কখন সকাল হবে আর আপনাকে আমি দেখবো। আমি তো আপনাকে ভালোবাসি আমি কি করে আপনাকে কারো সাথে ভাগ করতাম। নিজের ভালোবাসার মানুষ কে একান্ত করে একেবারে নিজের করে চাওয়া টা কি অন্যায়?

তখন পেছন থেকে কারো আওয়াজ আসলো,,

‘না অন্যায় নয়, কাউকে একান্ত করে একেবারে নিজের করে চাওয়া টা অন্যায় নয়। তবে এর জন্য কাউকে পৃথিবী থেকে উচ্ছেদ করা অন্যায়।”

সবাই পেছনে তাকাতেই দেখলো মেহবিন সে চকলেট খেতে খেতে আসছে। মেহবিন এসেই সোফায় বসলো আর আয়েশ করে চকলেট খেতে লাগলো। ব্যপারটা সবাইকে অবাক করলো। মেহবিন চকলেট খেতে খেতে বলল,,

“আপনার বিষয়টা আমি বুঝলাম আরিফা জামান। তবে চেয়ারম্যান সাহেব আপনার দোষ ছিল একটু বই কি? আপনার মেহেরুন্নিসার প্রতি গভীর ভালোবাসার জন্য তাকে জীবন হারাতে হলো। সেই হিসেবে আপনিও দোষী।”

তখন আরিফা জামান চিৎকার করে বলল,,

“এই মেয়ে তুমি আমার পারিবারিক বিষয়ে কথা বলবে না।”

“বিষয়টা তখন পারিবারিক থাকে যখন সেটা শুধু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু আপনার পারিবারিক বিষয়টা তো কতো জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। এই ধরুন চেয়ারম্যান সাহেব এর শ্বশুরবাড়ি। শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ এর হবু শ্বশুরবাড়ি।”

তখন এন্ট্রি নিল মুখরের পরিবার ও মেহরব চৌধুরীর পরিবার। শেখ শাহনাওয়াজ তাদের আসতে বলেছেন তাই। আরিফা জামান সব দেখে ভয় পেলেন। তার পেছনেই পুলিশ। যা দেখে আরিফা জামানের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। তার হাত পা অস্বাভাবিক কাঁপতে লাগলো। মেহবিন মুচকি হেঁসে আরিফা জামান কাছে গিয়ে বসলো আর এর কানে কানে বললেন,,

‘যেই দূরন্ত মেয়েটাকে আপনি সহ্য করতে পারতেন না। মেহেরুন নিসার সাথে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। সেই মেয়েটা কে জানেন? এই আমি মেহবিন মুসকান শাহনাওয়াজ। আর হ্যা নিশাচর এর সাথে সায়িদের সাথে যা হয়েছে সবকিছু আমি করেছি। নুপুর নুপুরের বাবার সব ধ্বংস করার পেছনেও আমি আছি। আপনার সবকিছু সবার সামনে আসার পেছনেও আমি। আর হ্যা এখন যা হবে এটার পেছনেও আমি।”

কথার সুযোগে মেহবিন কখন ইনজেকশন পুশ করেছে আরিফা জামান টেরই পান নি। সব শুনে আরিফা জামান মেহবিন কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে আর ওর গলা চেপে ধরলো। আকস্মিক ঘটনায় সবাই কিংকর্তবিমূড় হয়ে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ কোনদিন যা করে নি আজ তাই করলেন। আরিফা জামানকে উঠিয়ে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মারলেন। এদিকে মুখর তাড়াতাড়ি করে মেহবিন কে ধরলো ওর মুখে অদ্ভুত হাঁসি। মুখর গিয়ে বলল,,

‘ঠিক আছো?”

মেহবিন মাথা নাড়লো। এদিকে আরিফা জামান অস্বাভাবিক আচরন করতে লাগলেন। সবাইকে মেরে ফেলার জন্য তেড়ে গেলেন। মেহবিন আর শেখ শাহনাওয়াজ বুঝতে পারলেন ওনাদের কাজ সম্পূর্ন। পুলিশ এসে আরিফা জামান কে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর আরিফা জামান অজ্ঞান হয়ে গেল। পুলিশ তাকে নিয়ে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ নিজের ঘরে গেলেন দু’টো চকলেট নিয়ে এলেন। একটা মেহবিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,,

“লাস্ট চকলেট চিয়ার্স ফর আওর ভিক্টরি পার্টনার।”

না চাইতেও মেহবিন হেঁসে ফেললো। ও চকলেট নিল প্যাকেট খুললো তারপর শেখ শাহনাওয়াজ এর সাথে চকলেট চিয়ার্স করে খেতে লাগলো। এদিকে ওদের দুজনকে এভাবে দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। চকলেট খাওয়া শেষ করে মেহবিন বলল,,

‘তাহলে আমি আসি চেয়ারম্যান সাহেব। আপনাদের পারিবারিক ডিসকাশন না হয় এখন করে নিন।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘মুসকান আম্মা এটা আপনার বাড়ি আপনি কোথায় যাচ্ছেন। আর আপনাকে ছাড়া পারিবারিক ডিসকাশন সম্পূর্ণ হবে কি করে?’

শেখ শাহনাওয়াজ এর এই কথাই মুখরের পরিবার চমকে উঠে। মাহফুজ শাহরিয়ার বললেন,,

“শাহনাওয়াজ ভাইসাব এসব কি?”

শেখ শাহনাওয়াজ মুচকি হেসে বললেন,,

“আপনি একবার বলেছিলেন না আমি মেহবিনের মতো কথা বলি। কারন তো এটাই ও আমার মতো কথা বলে আর ও আমার মেয়ে মেহবিন মুসকান শাহনাওয়াজ। আমার সর্ব কনিষ্ঠ আর আদরের মেয়ে।”‘

মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আপনার মেয়ে বুঝি? তাহলে এতো দিন কেন বলেন নি?”

‘সবকিছুই আপনার ভালোর খাতিরে?”

“থাক আমাকে আর কিছু বলতে হবে না। আমি গেলাম?”

বলেই মেহবিন হাঁটা ধরলো। শেখ শাহনাওয়াজ সহ সবাই ডাকলো কিন্তু মেহবিন থামলো না। মুখর গিয়ে হাত ধরলো। মেহবিন তার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“এমন কোন আবদার করবেন না। যার জন্য আমাদের মাঝে কোন মতপার্থক্য তৈরি হয়। আমার হাত ছাড়ুন। আপনার খুব ইচ্ছে ছিল না রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনী কে জানার। যান ভেতরে যান চেয়ারম্যান সাহেব এর থেকে অনেকটাই জানতে পারবেন। কারন তিনি এই বিহঙ্গিনীকে ভালোভাবেই জানেন।”

মেহবিনের কথায় মুখর হাত না ছেড়ে আরো শক্ত করে বলল,,

“আমি তো রুপকথার কাব্যের বিহঙ্গিনীর সম্পর্কে আমার বিহঙ্গিনীর থেকেই শুনবো। আজ রাতটা না হয় বিহঙ্গিনী তার কাব্যের নামে লিখে দিক।”

“আজকেই কেন?’

“যাতে আজ আমার ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বিহঙ্গিনীর সব দুঃখ ঘুচে যায়।”

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

‘আজ আপনি ভার্সেস নেত্রী যে জিতবে আমি তার সাথে থাকবো।”

“মানে?”

“মানে নেত্রী তো আমার সাথেই থাকে। এবং আমি ছাড়া সে এক পাও ফেলে না। ওর বাবার কথা জানার পর একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। আর আমাদের পুরোনো নেত্রী কে আমার ফেরত চাই। এই জন্য আজ আপনি নেত্রীর পুরোনো ভার্সন ফেরাতে সাহায্য করবেন। যদি করতে পারেন। তাহলে কালকের পুরো দিন ও রাত আপনার নামে লিখে দেব প্রমিস।”

‘তাহলে তো করতেই হবে। হাজার হোক বউ আমার বলেছে।”

“ব্যাপারটা যতোটা সহজ ভাবছেন ততটা নয়।”

‘চেষ্টা করা যেতে পারে।”

“ওকে আমি গেলাম নেত্রীকে বলেছি ত্রিশ মিনিটের মধ্যে আসছি।”

“আমিও যাবো।”

“আমি নেব না !”

“তুমি নেত্রীর টোনে কথা কেন বলছো?”

“আমার ইচ্ছে সরুন তো এখন সরুন বাড়ি যেতে হবে।”

“আমি যাবো?”

‘আমি নেব না।”

বলেই মেহবিন হাঁটা ধরলো। মুখর ও পাশে পাশে চলতে লাগলো ‌ আর বলল,,

‘আমার বউয়ের বাড়ি আমি যাবো তাতে কার বাপের কি?”

মেহবিন না চাইতেই হেঁসে উঠলো। মুখর জানে আজ তার বিহঙ্গিনী ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পরেছে। যদিও প্রকাশ করছে না কিন্তু মুখর বুঝতে পারছে। তাই সে আজ তার বিহঙ্গিনীকে একা ছাড়বে না।

___________

শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিন কে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে আলম আহমেদ এর বাড়িতে উঠান। এবং পুলিশ দিয়ে তিনিই ভয় দেখান যার কারনে আলম আহমেদ বাধ্য হয়েই তাকে রাখে। কুসুমকেও ধরে কিন্তু ও শুধু নিশাচর এর নাম বলেই মারা যায়। এতে শেখ শাহনাওয়াজ দিশেহারা হয়ে পরে। মেয়েকে ভালো রাখার জন্য শেখ শাহনাওয়াজ ও মেয়েকে নজরে রাখে। তার কোন অসুবিধা হয় কিনা। দুই বছর পার হওয়ার পর শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের সাথে দেখা করে। এবং ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মেহবিন রাজি হয় না। মেহবিন দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। উনি ওকে বোঝাতে থাকে সবকিছু কিন্তু মেহবিন ওনাকে সুযোগই দেয় না। এভাবে মেহবিন বড় হতে থাকে যখন ওর তেরো বছর তখন একজন ছেলে মেহবিনের সাথে অসভ্যতামি করে । তখন শেখ শাহনাওয়াজ ওকে বাচায় আর বলে এসবের জন্য হলেও নাকি তার শেখ শাহনাওয়াজ এর দরকার পরবে। কারন মেহবিন একটা মেয়ে ও একা কিছুই করতে পারবে না। এতে মেহবিনের মনে রাগের সঞ্চার করে যখন ওর সবাইকে দরকার ছিল তখন কেউ ওর সাথে ছিল না। এখন ও ওর কাউকে দরকার নেই। পরে একদিন আরেকটা ছেলে মেহবিনের সাথে অস্যতামি করে শেখ শাহনাওয়াজ এগিয়ে আসবে তা দেখে মেহবিন নিজেই ছেলেটার হাত ভেঙ্গে ফেলে। এভাবেই মেহবিন ওর বাবার সাহায্য যাতে না নিতে হয় একা একা সব শিখছিল। মুলত একা একা নয় শেখ শাহনাওয়াজ ওকে বাস্তবতার মাধ্যমে শেখাচ্ছিলেন। উনি মেহেরুননিসার মৃত্যুর পর এই কারনেই ডাক্তারি ছেড়ে দেন যাতে মেহবিনের ওপরে নজর রাখতে পারে। তবুও কিছু তো করতে হবে। শেখ শাহেনশাহ জিজ্ঞেস করে কিসের জন্য ছাড়লো তখন তিনি বলেন রাজনীতি করবে তাই ছেড়ে দিয়েছে। তার পরেরবার তিনি চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ান আর হয়েও যান।

আরবাজ ঢাকায় পড়াশোনা করতো একদিন ওর বাবাকে দেখে মেহবিনের কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন মেহবিন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পরতো।আরবাজ এগিয়ে যায় আর তার বাবাকে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। যদিও মেয়েটাকে ওর চেনা চেনা লাগে কিন্তু চিনে উঠতে পারে না। এভাবে বেশ কয়েকবার ও ওর বাবার ওপর নজর রাখে। দুই মাসে চারবার দেখার পর সরাসরি বাবার সাথে কথা বলে। তখন তিনি জানান এটাই মেহবিন তিনি খুঁজে পেয়েছে কয়েকদিন ধরে। আরবাজ কে পুরো সত্যি জানায় না। আরবাজ বলে বাড়ি কেন যাচ্ছে না তখন বলে মেহবিনই বাড়ি ফিরতে চায় না। পরে একদিন আরবাজ চকলেট নিয়ে মেহবিনের সাথে দেখা করে মেহবিন ভাইকে দেখে খুশি হয় কিন্তু এটা বুঝতে দেয় না। তবুও আরবাজ জেদ ধরে কয়েকদিন ওর কলেজে যায়। সবাই ভাবে হয়তো ওর বয়ফ্রেন্ড তাই বাধ্য হয়ে মেহবিন আরবাজের সাথে খোলাখুলি কথা বলে। আর এটাও বলে ও যেন না আসে আর ও বাড়ি ফিরবে না। এরপর থেকে আরবাজের সাথে যোগাযোগ হয়। আরবাজ ফোনের মাধ্যমে ওর সাথে যোগাযোগ রাখে আবার মাঝে মাঝে দেখাও করে। মেহবিন কে যখন আলম আহমেদ বের করে দেন। তখন শেখ শাহনাওয়াজ আর আরবাজ অনেকবার চেষ্টা করেছে ওকে টাকা দিতে বা বাড়ি নিয়ে যেতে কিন্তু মেহবিন নারাজ সে কিছুতেই তাদের কোনোকিছুতে হাত লাগাবে না। সে হলে উঠে টিউশনি করিয়ে আর পার্ট টাইম জব করে পড়াশোনা করতে থাকে। এভাবে প্রায় একবছর কেটে যায়। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বাধ্য হয়ে মেহরব চৌধুরী কে মেহবিনের ব্যাপারে জানান। মেহরব চৌধুরী ভাগনির খোঁজ পেতেই ছুটে যায় সেখানে। মেহবিনের সাথে কথাও বলে কিন্তু মেহবিন প্রথমে তার কথায় গলে না। পরে মেহেরুনিসা কে নিয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে। মেহেরের তাকে নিয়ে অনেক আশা ইচ্ছে। আর তার ভাগের সব সম্পত্তি তিন ভাগের এক ভাগ মেহবিনের নামে উইল করে দেয়। তবুও সে বলে তাদের সাথে থাকবে না। মেহরব চৌধুরী বলে না থাকুক ও যেন টিউশনি না করে আর জব টা ছেড়ে দেয়। মেহবিন তাতেও প্রথমে রাজি হয় না। তবে যখন মুখর আর ওর বিচ্ছেদ হয় তখন সে তার ভাগের টাকার ওখান থেকে বিদেশে চলে যায় পড়াশোনা করতে। তার সাথে ছোটখাটো একটা বিজনেস ও করে। দেশে ফিরতেই শেখ শাহনাওয়াজ ওর সাথে দেখা এবার মেহবিন সব ঠান্ডা মাথায় শোনে। এবং তার মায়ের মৃত্যুর পেছনে যারা দায়ী তাদের শাস্তির কথা বলে। এরপর থেকেই দুই বাবা মেয়ে হয়ে যায় একে অপরের পার্টনার। যদিও উনি গ্ৰামে যেতে মানা করেছিলেন কিন্তু মেহবিন নিজেই যায় তাই দেখেই শেখ শাহনাওয়াজ প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। মেহেরের টিনের ঘর খুব পছন্দের ছিল তাই তিনি মেহেরের জন্য নতুন ঘর দিয়েছিল। কিন্তু মেহের সে ঘরে থাকতে পারেনি। তার আগেই মারা যায় তাই তিনি ঐ বাড়িটাকে আলাদা করে যত্ন করতেন। তিনি জানতেন মেহবিন তার বাড়িতে থাকবে না তাই ঐ বাড়িটার কথা বলেন। মেহবিনের রাগের কারন সে কি তার কাছে নিয়ে তাকে আগলে রাখতে পারতো না। দূর থেকেই কেন ওকে আগলাতে হলো ‌। ওকে যে অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছিল তখন সবথেকে বেশি মেহবিনের ওনার দরকার ছিল। আর সেই রাগ থেকেই মেহবিন মুখ ঘুরিয়ে থাকে। এমনকি ও বাড়িতে খাবার অব্দি খায় না। কারন রান্না টা আরিফা জামান করে আর বাজার টা শেখ শাহনাওয়াজ করে। তাছাড়া শেখ পরিবারের জন্য ও ওর মাকে হাড়িয়েছে। মেহবিন তাকে শর্ত দিয়েছিল শুধু ওর মায়ের মৃত্যুর পেছনে যারা আছে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্যই তার সাথে মিলিত হয়েছে অন্য কোন কারন নেই। যেদিন সব শেষ হবে সেদিন ওদের পার্টনারশিপ ও শেষ হয়ে যাবে। আর আজ হলোই তাই। মেহবিন সব ভুলে গেলেও তার মায়ের কথা আর তার বাবার না এগিয়ে আসা ভুলে নি। তাই আজ ও তাদের মধ্যে এতটা দূরত্ব।

~চলবে,,