খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-২+৩

0
180

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সময় স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে যায়। রজনীর আঁধার কেটে গিয়ে সূর্যের রশ্মি ধরনীর বুকে আচঁড়ে পড়েছে। দেখতে দেখতে দু’টি বছর কেটে গিয়েছে। বাবা-মাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত যে মেয়েটা থাকতে পারতো না। আজ সেই মেয়েটা বাবা-মা, পরিবার, আত্নীয়-স্বজন সবকিছু ছেড়ে দূর চলে এসেছে। কতগুলো প্রহর বাবা-মাকে ছাড়া কাটিয়ে দিয়েছে। সেদিনের পরে বাবা-মায়ের সামনে যাওয়ার আর সাহস হয়ে উঠেনি। মাঝেমধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। বাসার সব থেকে আদরের মেয়েটা আজ আদরহীনতায় ভুগছে। মেহেভীন এক কাপ কফি নিয়ে খোলা জানালার দিকে গেল। জানালার কাছে আসতেই প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রুপ সে দেখতে পেল। এই মন খারাপের সঙ্গী হলো প্রকৃতি। তার সুন্দর্য দিয়ে মেহেভীনের মন ভালো করে দেয়। মেহেভীনের গভীর আঁখিযুগল #খোলা_জানালার_দক্ষিণের বাসাটার দিকে স্থীর হয়ে আছে। দীর্ঘ দুই বছর ধরে দক্ষিণের বাসাটা বন্ধ পড়ে আছে। সে এই বাসাটাই নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি। এই বাসাটা নাকি কোনো এক স্পেশাল মানুষের জন্য সে ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। মেহেভীন ভিষণ অবাক হয়েছিল বটে! কে সেই মানুষ যার জন্য তার এই বাসায় ঠাঁই হলো না। মানুষটার মুখশ্রী দেখার জন্য মেহেভীনের ভিষণ আগ্রহ। কবে যে মেহেভীনের অপেক্ষার অবসান ঘটবে। সব চিন্তা ভাবনা ফেলে রেখে মেহেভীন প্রাপ্তিকে ফোন দিল,

–আসসালামু আলাইকুম ম্যাজিস্ট্রেট ম্যাডাম। কেমন আছেন? অবশেষে এই অধমকে মনে হলো আপনার? ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আমাদের একদম ভুলেই গিয়েছেন। তা আজ কতদিন পরে ফোন দিলেন। সে খবর কি রাখেন। মেহেভীন সালামের উত্তর নিয়ে, মলিন কণ্ঠে বলল,

–আব্বু আম্মু কেমন আছে আপু? তাদের কি আমার কথা একবারও মনে পড়ে না। আমায় কি একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না। তারা সত্যিই কি কখনো আমার মুখ দেখবে না। আমার তাদের জন্য ভীষণ মন পুড়ে আপু। তাদের কণ্ঠ স্বর শোনার জন্য আমি মরিয়া হয়ে আছি। তাদের ভালোবাসা পাবার জন্য আমি কাঙাল হয়ে গিয়েছি। আমি সবকিছু ছেড়ে তাদের কাছে চলে যাব আপু। তাদের বলো আমি আর চাকরি করব না। তারা যা বলবে যেখানে বলবে। আমি সেখানেই বিয়ে করব আপু। আমাকে শুধু তাদের বুকে আগলে নিতে বলো।

–এই মেহেভীন কি বলছিস এসব? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে! তুই চাকরি ছেড়ে দিবি মানেটা কি? তুই চাকরি ছেড়ে দিলে চাচাকে কে দেখবে? আমাকে প্রতি মাসে টাকা দিবে কে? তুই না অনেক শক্ত মনের অধিকারীনি হয়ে গিয়েছিলি। তবে আজ হঠাৎ এমন পাগলামি কেন করছিস? তুই জানিস না চাচা অনেক অসুস্থ। চাচা আগের মতো কাজ করতে পারে না। তুই টাকা না দিলে চাচার অনেক কষ্ট হবে। মেয়ে হয়ে বাবার কষ্ট দেখবি।

–টাকা দিয়ে সবকিছু কেনা গেলে-ও কখনো সুখ, শান্তি, ভালোবাসা, আদর কেনা যায় না আপু। আমি টাকা দিয়ে সবকিছু কিনতে পারছি। কিন্তু বাবা-মায়ের ভালোবাসা, আদর কিনতে পারছি না। আমি বাবা-মায়ের কাছে যেতে চাই আপু। এভাবে আর পালিয়ে থাকতে পারব না। আমার যা হয় হবে। আমি বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবোই। আমি তো কোনো ভুল করিনি। তাহলে আমি কেনো এভাবে লুকিয়ে থাকব। আমি একটা কাপুরুষকে বিয়ে করতে পারিনি ঠিকি৷ কিন্তু আমি একটা ক্ষতি করে আরেকটা সফলতা অর্জন ঠিকি করেছি। আমি আমার সফলতা দিয়ে সবার মন জয় করে নিব।

–শোন মেহেভীন তুই এখন বাসায় আসিস না। আমি আগে চাচা চাঁচির মন নরম করে নেই। তারপরে তোকে বাসায় আসতে বলব। তোকে দেখে চাচা চাঁচি যদি অসুস্থ হয়ে যায়। তখন তুই কি করবি? নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি তো মেহেভীন।

–আমার ভাগ্যে যা আছে। আমি মেনে নিয়েছি আপু৷ আমি যাব না আব্বু আম্মুর কাছে তুমি বলার পরেই যাব। কথা গুলো বলেই মেহেভীন নিরাশ হয়ে ফোন রেখে দিল। মানুষ একটা জায়গায় এসে ভিষণ অসহায় হয়ে পড়ে। আর সেই জায়গাটা হচ্ছে ভালোবাসা মানুষ পৃথিবীর সব জায়গায় পাথর হাতে পারলেও, ভালোবাসার জায়গায় এসে হেরে যায়। ভালোবাসা পেলে হয়ে যায় অবুঝ বাচ্চা। মেহেভীন ও তার ব্যতিক্রম নয়।

চারিদিকে বৃষ্টি পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস বইছে। মেহেভীন খোলা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বৃষ্টির পানির ফোঁটা এসে মেহেভীনকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। মেহেভীন আঁখিযুগল বন্ধ করে আছে। তখনই এক জোড়া চোখ মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। আঁখিযুগল যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে। স্থীর নয়নে মেহেভীনকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। মেহেভীন আচমকা চোখ মেলতেই দু’জনের চোখাচোখি হয়ে যায়। মেহেভীন একজন সুদর্শন যুবককে দেখে বিস্ময় হয়ে পড়ে। দু’টো বছর পরে অবশেষে খোলা জানালার দক্ষিণের বাসাটায় কেউ আসলো। মুহুর্তের মধ্যে মেহেভীন আঁখিযুগল নামিয়ে নিল। দ্রুত হাতে জানালা লাগিয়ে দিল। তখনই কাজের মেয়েটা মেহেভীনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–আফা আপনি আপনার বোনের কথা শুনবেন না। আমার কেনো জানি আপনার বোনকে পছন্দ হয় না। মহিষের শিং যেমন মহিষের কাছে ভারি হয় না। ঠিক তেমনই বাবা-মায়ের কাছে সন্তান কোনোদিন বোঝা হয় না। আপনি সামনে গেলে আপনার বাবা-মায়ের সব রাগ পানি হয়ে যাবে। মেহেভীনের মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করল৷ সে রাগারাগি হয়ে বলল,

–রুপা তোমাকে কতবার বলেছি। আমার বোনের নামে বাজে কথা বলবে না। আমি যে এতদূর এসেছি। সেটা কার জন্য এসেছি। অবশ্যই প্রাপ্তি আপুর জন্য এসেছি। রুপা আর কিছু বলল না। মুখটা কালো করে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।

দীর্ঘদিন পরে নিজের চিরচেনা কক্ষে এসে শান্তির নিঃশ্বাস গ্রহণ করছে মুনতাসিম ফুয়াদ। মুখশ্রীতে তার একরাশ মুগ্ধতা। সে আরিয়ানকে দেখে শান্ত কণ্ঠে বলল,

–খোঁজ নাও মেয়েটা কে? কালকের মধ্যে আমার সবকিছুর খবর চাই।

–আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। কালকের মধ্যে সব খবর আপনার সামনে চলে আসবে।

–তোমরা আমার সাথে থাকবে না। সব সময় আড়ালে থাকবে।

–স্যার এটা কিভাবে সম্ভব?

–আমি বলেছি মানে সবকিছু সম্ভব। মুনতাসিমের কথায় আরিয়ান দমে গেল। কোনো কথা না বলে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। মুনতাসিম ফ্রেশ হয়ে এসে হাতে একটা বাটি নিয়ে মেহেভীনের বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল। দরজায় কলিং বেল বেজে উঠতেই রুপা এসে দরজা খুলে দিল। রুপাকে দেখে কিছুটা নারাজ হলো মুনতাসিম। সে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বাসার মধ্যে প্রবেশ করল। রুপা রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আপনার মাথায় কি কোনো সমস্যা আছে। ভেতরে ভদ্রতা বলতে কিছু নেই। একটা মানুষের বাসায় হুট করে ঢুকে পড়লেন।

–আমি আপনার কাছে আসি নাই। তাই আপনার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। আপনি আপনার বাসার মালকিনকে ডাকুন। তার সাথে আমার কথা আছে।

–যা বলার আমাকে বলুন। আপাকে বলা মানে আমাকে বলা। আমি আর আপা দুই দেহ এক আত্মা।

–আমি তোমার আপাকে চুমু খেতে এসেছি। গালটা এগিয়ে দাও। তোমাকে চুমু খেয়ে চলে যাই। তুমি তোমার আপাকে বলে দিও। একজন এসেছিল আপনাকে চুমু খেয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের কথায় রুপা আঁখিযুগল গোল গোল করে তাকালো। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–অসভ্য লোক আপনি জানেন আপনি কার বাসায় এসেছেন। আমি চাইলে আপনার কি অবস্থা করতে পারি। সে সম্পর্কে আপনার কোনো ধারনা নেই। চিৎকার চেচামেচি শুনে মেহেভীন কক্ষ থেকে বের হয়ে আসলো। মেহেভীনকে দেখে মুনতাসিম সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। মুনতাসিমের গিরগিটির মতো রঙ বদলে যেতে দেখে, রুপা বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেভীন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–কিছু বলবেন ভাইয়া? মেহেভীনের মুখে ভাইয়া ডাকটা পছন্দ হলো না মুনতাসিমের। সে মুখশ্রী গম্ভীর করে ফেলল। কিন্তুটা থমথমে মুখে বলল,

–আপনার পাশের বাসায় আজকেই আমি এসেছি। সবকিছু নিয়ে এসেছি৷ বাসায় এসে দেখি লবন নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছি। যদি আমাকে একটু লবন দিতেন। তাহলে আমার উপকার হতো। আমি কালকে সকালেই আবার দিয়ে যাব। তখনই রুপা হুংকার ছেড়ে বলল,

–মিথ্যা কথা আপা সে আপনাকে চুমু খেতে এসেছে। আমার অনুমতি না নিয়ে বাসার মধ্যে চলে আসছে। রুপার মিথ্যা কথা বলার স্বভাব আছে। সেটা মেহেভীন জানে, সেজন্য মেহেভীন রক্তিম চোখে রুপার দিকে তাকালো। রুপা থামলো না বলতেই থাকলো,

–শুধু তাই না আপা সে আমাকে বলেছে। গাল এগিয়ে দাও। আমি চুমু খেয়ে চলে যাই।

–রুপা আর একটা বাজে কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

–আপনি আপনার কাজের মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। কখন কোথায় কি বলতে সেটা জানে না। আমি বোধহয় ভুল জায়গায় ভুল করে চলে এসেছি। মেহেভীন ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,

–বাচ্চা মেয়ে বুঝতে পারেনি। আপনি আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে লবন দিচ্ছি। মুনতাসিম রুপার দিকে তাকিয়ে বলল,

–আপনি না তখন বললেন। আপনারা দুই দেহ এক আত্মা। তাহলে আপনার ব্যবহার এত বাজে কেন? আপনার আপার থেকে কিছু শিখতে পারেন না। কথা গুলো বলেই মেহেভীনের সাথে রান্না ঘরে চলে গেল। রুপা মনতাসিমের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল। মানুষটাকে তার একদম পছন্দ হয়নি। মুনতাসিম ও যেন রুপাকে পছন্দ করেনি।

বহুদিন পরে প্রাপ্তি আসলো মেহেভীনদের বাসায়। প্রাপ্তিকে দেখেই রাইমা বেগম আর ফরিদ রহমান এগিয়ে আসলেন। রাইমা বেগম অসহায় কণ্ঠে বলল,

–কি রে মেহেভীনের কোনো খোঁজ পেয়েছিস? কতদিন হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখি না। মাঝেমধ্যে মেয়েটার কথা ভাবলে দম বন্ধ হয়ে আসে। যে মেয়েটা একটা রাত আমাকে ছাড়া ঘুমোতে পারতো না। সেই মেয়েটা আজ কতগুলো দিন ধরে আমাকে রেখে দূরে আছে। তোর সাথে মেহেভীনের কথা হলে মেহেভীনকে বলে দিস। মেহেভীনকে আমরা মাফ করে দিয়েছি। সে যেন বাড়ি ফরি আসে। আমরা আমাদের মেয়েকে চাই। আমাদের আর কিছু চাই না। ফরিদ রহমান প্রাপ্তির হাত ধরে বলল,

–তোর সাথে মেহেভীনের গভীর সম্পর্ক। আমি জানি তোর আর মেহেভীনের যোগাযোগ আছে। মেহেভীন আমাদের সাথে কথা না বললেও তোর সাথে বলবেই। তুই মেহেভীনকে বাসায় চলে আসতে বল। কতদিন মেয়েটাকে দেখি না। না জানি কোথায় আছে মেয়েটা আমার। কি খায় কেমন আছে এসব কিছুই জানি না। প্রাপ্তি মলিন গলায় বলল,

–আমার মেহেভীনের সাথে কথা হয়েছে চাচা৷ মেহেভীনের সাথে কথা শেষ করেই তোমাদের বাসায় ছুটে এসেছি। আমাদের মেহেভীন অনেক ভালো আছে। সে তোমাদের মুখ দেখতে চায় না। আমাকে কি বলেছে জানো। বলেছে যে বাবা-মা তাদের সুখের জন্য আমাকে একটা কাপুরুষের হাতে তুলে দিতে পারে। সেই বাবা-মা তাদের স্বার্থের জন্য আমাকে খু’ন ও করতে পারবে। আমি আর তাদের কাছে ফিরে যাব না। আমি আমার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে সুখী আছি। তোমার চাচা চাঁচিকে বলে দিও। তারা যেন আমাকে বৃথা খোঁজার চেষ্টা না করে। রাইমা বেগম উত্তেজিত হয়ে বললেন,

–মেহেভীন তো চাকরি করার জন্য পালিয়েছিল। সে বিয়ে কবে করল? সে যদি বিয়ে করেই থাকে। তাহলে তাকে বল ফিরে আসতে। আমরা ওর সবকিছু মেনে নিব। শুধু আমার মেয়েকে আমার বুকে দেখতে চাই মা৷

–চাঁচি তুমি তোমার মেয়েকে চাইলেই তো হবে না। তোমার মেয়েকেও তোমাদের চাইতে হবে। তোমার মেয়ে তোমাদের মুখ দেখতে চায় না। এসব কথা বলে আমাকে ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েছে। অন্য নাম্বার দিয়ে কল দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে সীম অফ করে রেখে দিয়েছে। এখন তুমি বলো আমি কি করব? মুনিয়া বেগমের শ্বাসকষ্ট আছে। মেয়ে তার মুখ দেখতে চায় না কথাটা কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছাতেই সমস্ত শরীর অস্থির হয়ে পড়ছে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে রাইমা বেগম মাটিতে বসে পড়লেন।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

বৃষ্টি হয়ে চারিদিকে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। গাছের মরা ডালপালা গুলো রাস্তায় পড়ে আছে। মেহেভীন নামাজ শেষ করে প্রতিদিন হাঁটতে বের হয়। আজকেও হাঁটতে বের হয়েছে। আজকের সকালটা একটু অন্য রকম কেমন স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। মনটা কাল থেকে ভিষণ খারাপ। কেন জানি ভেতর থেকে শান্তি পাচ্ছে না সে। তখনই পেছনে থেকে কারো কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছল,

–এত সকাল বেলা কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম? মেহেভীন তাকিয়ে দেখলো কালকের ছেলেটা। সে ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,

–হাঁটতে বের হয়েছি।

–আমি কি আপনার যোগদান করতে পারি?

–না।

–কেনো?

–আশ্চর্য! আমি আপনাকে চিনিনা জানি না। আমি কেনো আপনার সাথে হাঁটতে যাব। আপনার কি নিজের পা নেই। একা একা চলতে পারেন না৷ যে অন্যের সাথে আপনাকে হাঁটতে যেতে হবে। এমন গায়ে পড়া মানুষ আমার একদম পছন্দ না। আমার আশেপাশে যেন আপনাকে না দেখি। কথা গুলো বলেই মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মুনতাসিম মেহেভীনের যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

মেহেভীন বাসায় এসে দম নিয়ে বিছানায় বসল। কণ্ঠস্বর কুসুমের ন্যায় কোমল করে রুপাকে ডাকলো। রুপা এসে মেহেভীনের পাশে বসল। রুপা ভালো মতোই জানে মেহেভীন এখন তাকে কি করতে বলবে। তবুও রুপা প্রশ্ন করল,

–কিছু বলবেন আপা?

–তোকে এখন মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। কালকে মনটা খারাপ থাকায় কল দেওয়া হয়নি।

–দিয়ে কি বলব আপা। আপনি আমাকে সবকিছু শিখিয়ে দেন। না হলে ভুলভাল কিছু বলে ফেলবো।

–আজকে বেশি কিছু বলতে হবে না। মায়ের ভালো মন্দ খবর নিবি। কথা গুলো বলেই রাইমা বেগমের নাম্বারে ফোন দিল। একবার ফোন বেজে কেটে গেল। দ্বিতীয় বার ফোন দিতেই ফোনটা রিসিভ হলো। একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর কথা বলে উঠলো। মানুষটার কথা কর্ণকুহরে আসতেই বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো মেহেভীনের। বিষাদে ছেয়ে গেল মনটা চেয়েও মাথা উঁচু করে বলতে পারছে না। আব্বু আমি তোমাদের হতভাগা মেয়ে মেহেভীন। কথা বলার সাহস হয়ে উঠলো না। সে রুপাকে বলতে শিখিয়ে দিল। রুপা সালাম দিয়ে বলল,

–বাবা কেমন আছেন? মা কোথায় মায়ের ফোন আপনি তুললেন যে!

–এই মেয়ে তোমাকে কতবার নিষেধ করেছি। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনীর ফোনে ফোন দিবে না। তোমার উদ্দেশ্য কি বলো তো? এই নিষ্ঠুর ধরণীর বুকে নিজের স্বার্থ ছাড়া কেউ এক কদম হাঁটে না। সেখানে তুমি একটা অপরিচিত মেয়ে হয়ে আমার অর্ধাঙ্গিনীর জন্য এত দরদ দেখাও। এটা আমি মোটেও ভালো নজরে নেই না। আমার অর্ধাঙ্গিনী নির্ঘাত ভালো মানুষ ধরনীর মার প্যাচ বুঝে না। সরল মনে তোমাকে বিশ্বাস করে কথা বলে। আজকের পর থেকে তাকে ফোন দিলে আমি অন্য ব্যবস্থা নিব।

–আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমার মনে কোনো পাপ নেই। আমার আল্লাহ জানে আমি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে মায়ের সাথে কথা বলি না। আমি মায়ের আদর, ভালোবাসা পাবার জন্য মায়ের সাথে কথা বলি। আজ যদি আমার নিজের মা থাকতো। তাহলে কি আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনীর কাছে ফোন দিতাম বলেন। আমাকে একটা বার মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দেন। আমি আর বিরক্ত করব না।

–তাকে দেওয়া যাবে না। কাল থেকে সে ভিষণ অসুস্থ। শুনেছ এবার রাখো আর কখনো ফোন দিবে না। কথা গুলো বলেই কল কেটে দিল। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে মেহেভীনের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। যন্ত্রনায় কেমন ছটফট করতে লাগলো। মেহেভীনের মন খারাপ দেখে রুপারও মন খারাপ হয়ে গেল। সে মলিন কণ্ঠে বলল,

–দেখেছেন আপা আমি আপনাকে বলে ছিলাম না। আপনার চাচাতো বোন ভালো না। সে আপনার ভালো চায় না। আপনার মা অসুস্থ সে খবর আপনাকে জানায়নি কেন? রুপার কথায় মেহেভীন রুপার থেকে ফোনটা নিয়ে নিল। প্রাপ্তির নাম্বার বের করে ফোন দিল।

–হ্যাঁ মেহেভীন বল এত সকালে কি মনে করে ফোন দিলি?

–আপু আম্মু কেমন আছে?

–চাঁচি তো ভালোই আছে। সকালেও চাঁচির সাথে কথা হয়েছে।

–একটু আম্মুর কাছে নিয়ে গিয়ে ফোনটা দিবে।

–চাঁচি তোর সাথে কথা বলতে চায় না। তোর মুখ ও দেখতে চায় না।

–সে কথা আমি আম্মুর মুখে শুনতে চাই।

–তোর নাম শুনলেই চাঁচি রেগে যাবে।

–বেশ ভালো তো তুমি তাহলে ফোনটা লাইনে রাখো। আমি কলে আছি সে কথা আম্মুকে বলবে না। তুমি আম্মুর কাছে গিয়ে আমার কথা তুলো। আমি দেখতে চাই আম্মু কি বলে। মেহেভীনের কথায় প্রাপ্তি অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়ে। মাথা কাজ করছে না। বুদ্ধিরা জোট বেঁধে পালিয়েছে। এখন সে মেহেভীনকে কি জবাব দিবে। প্রাপ্তির নিরবতা মেহেভীনকে ভাবাচ্ছে গভীর ভাবে ভাবাচ্ছে। প্রাপ্তি কি তার থেকে কিছু আড়াল করছে। নিজের ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে তবে কি সে পরিবারের থেকে দূরে সরে এসেছে। নিজের সাফল্য অর্জনের আশায় সে এতটাই ব্যস্ত পরিবারের দিকে তাকানোর সময় হয়নি। তার সুযোগই কি প্রাপ্তি নিতে চাইছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই প্রাপ্তি বলে উঠলো,

–আমি একটা জব পেয়েছি। তোকে জানানো হয়নি। আমি তো অফিসে আছি৷ এখন কিভাবে চাঁচির সাথে কথা বলতে যাব।

–তুমি আবার কবে চাকরি পেলে? সারাদিনই বাসায় বসে থাকো। এরমধ্যেই তোমার চাকরি হয়ে গেল!

–তুই আমাকে এভাবে পুলিশের মতো জেরা করছিস কেন? আমাকে তোর চোর মনে হয়। নিজের বোনকে বিশ্বাস করিস না।

–আম্মু যে অসুস্থ আমায় জানাওনি কেন? মিথ্যা কথা বললে কেন আমায়? তুমি আবার বিশ্বাসের কথা বলছ! এদিকে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত আমি। সেজন্য আমি নিজের পরিবারের দিকে তাকাইনি৷ আর তুমি সেই সুযোগটা নিলে আপু।

–মেহেভীন তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি তোকে জানাইনি তার একটা কারন আছে। চাঁচির শ্বাসকষ্ট আছে। সেটা তুই ভালো মতোই জানিস। চাঁচির অসুস্থতার কথা শুনলে তুই চিন্তা করবি। তাই তোকে জানাইনি। তেমন গুরুতর কিছু না। গুরুতর কিছু হলে সবার আগে আমি তোকেই জানাতাম।

–আচ্ছা আমি তোমাকে প্রতি মাসে টাকা পাঠাই। সে টাকা গুলো তুমি কি বলে আব্বু আম্মুর হাতে তুলে দাও।

–তুই তো বলেছিস। এই টাকা গুলো তুই দিস। এ কথা চাচা চাঁচি যেন না জানে। সেজন্য চাচা চাঁচিকে বলি আমি জব করে তাদের টাকা দেই।

–তারা তোমাকে কোনো প্রশ্ন করে না। এত গুলো টাকা তুমি কেন ওদের দাও। তোমার বাবা-মা কিছু বলে না। তোমাদের ও সংসার আছে।

–তোর যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয়। তাহলে তুই এখানে এসে দেখে যা।

–সেটা তুমি বললেও যাব আর না বললেও যাব। আমি তোমাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করি আপু। এমন কোনো কাজ করো না। যাতে তোমার প্রতি আমার সব ভালোবাসা ঘৃণায় রুপ নেয়৷

–চাঁচি অসুস্থ এখন তোর না আসাই ভালো। মেহেভীন নিঃশব্দে কল কেটে দেয়। মেহেভীনের মধ্যে সন্দেহের দানা বাঁধে। কাউকে বিশ্বাস করা ভালো। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস একদমই ভালো না৷ এই কথা গুলো এতদিন মাথায় আসেনি কেন আমার। সারাদিন বাহিরের শত্রু খুঁজতে গিয়ে, ঘরের শত্রু চিনতেই ভুল করলাম আমি। মেহেভীনের মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে। কোনো বুদ্ধিই তার মস্তিষ্কে এসে ধরা দিচ্ছে না। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে।

অন্ধকার রুমের মধ্যে বসে আছে প্রাপ্তি। তার সামনে বসা আগন্তুক। প্রাপ্তির মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। আগন্তুক প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–মেহেভীনের মনে তুমি নিজেই সন্দেহের বীজ রোপণ করে দিয়েছ। তাই চাইলেও মেহেভীনের মনে আগের স্থান নিতে পারবে না। কি দরকার ছিল মিথ্যা কথা বলার। তুমি কি জানতে না মেহেভীন তার কাজের মেয়েটার মাধ্যমে রোজ তার বাবা-মায়ের খবর নেয়।

–সে কথা কি আপনি আমাকে বলেছিলেন। আমি তো জানতাম না। মেহেভীন তার বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নেয়। আমি ভেবেছিলাম বোকা মেয়েটা জীবনে কিছু করতে পারবে না। কে জানতো জীবনের সফলতার শীর্ষে পৌঁছে যাবে। আমি মনে করেছিলাম। বাসার বাহিরে হলে কিছু নরপশু মেহেভীনকে শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে খাবে। ধরনীর বুক থেকে মুছে যাবে মেহেভীন নামক রমনীর ছোট্ট দেহটা। আমার সবকিছু যে ব্যর্থ হয়ে গেল। এখন আমি কি করব? সব দোষ আপনার আপনি যদি আমাকে একটু সর্তক করে দিতেন। তাহলে আজে এতবড় ধরা খেতাম। মেহেভীন এবার কাজের পাশাপাশি পরিবারের দিকে নজর রাখবে। আগে আমায় ভরসা করত। তাই পরিবারের দিকে সেভাবে নজর দিত না। আজ মিথ্যা বলার কারনে আমাকে আর বিশ্বাস করবে না। মেয়েটা ভিষণ চালাক আর ধুরন্ধর হয়ে গিয়েছে।

–মেহেভীন কিছু করার আগেই ফরিদ রহমানের দেহটা ছয় টু’ক’রো হয়ে যাবে। সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি মেহেভীনের বাবা-মায়ের কানে বি’ষ দিতে থাকো। তারা যেন মেহেভীনকে ঘৃণা করতে থাকে।

–ওর বাবা-মা এতটা মেয়ে ভক্ত মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে কথা জেনেও তাদের মেয়েকে চাই।

–তাহলে আমি যেই ঔষধ টা দিয়েছি। সেটার ডোজ বাড়িয়ে দাও। মেহেভীন চাইলেও কিছু করতে পারবে না।

–আমি দেশে আসছি সেটা তোমার বাবা জানে?

–না আমি ছাড়া কেউ জানে না।

–বেশ ভালো কাউকে বলার দরকার নেই। তুমি এখানে থেকে চলে যাও। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। প্রাপ্তি কোনো কথা না বলে আস্তে করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

মেহেভীন সকালে কাজের উদ্দেশ্য বের হয়ে গিয়েছে। কখন বাসায় ফিরে ঠিক নেই। সবকিছু কাজের ওপর নির্ভর করে। রুপা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে। এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। রুপা গিয়ে দরজা খুলে দেখতে পায় কয়েকজন কালো পোশাক পড়া লোক দাঁড়িয়ে আছে। রুপা কিছু বলার আগেই তারা রুপাকে সেন্সলেস করে ফেলে। তারা রুপাকে নিয়ে চলে যায়। রুপাকে নিয়ে চলে যাবার এক ঘন্টা মেহেভীন আসে। দরজা খোলা দেখে মেহেভীন অস্থির হয়ে বাসার মধ্যে আসে। একটা জমির দলিল সাইন কারনো নিয়ে একজন লোকের সাথে মেহেভীনের ভিষণ ঝামেলা চলছে। দু’বার বাসায় এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছে। সমস্ত বাসা খুঁজেও রুপাকে দেখতে না পেয়ে মেহেভীনের ললাটে চিন্তার ভাজ পড়ল। সে চিন্তিত হয়ে দরজার কাছে আসলো। দরজার কাছে এসে মুনতাসিমকে দেখতে পেল। মুহুর্তের মধ্যে মেহেভীনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মেহেভীন কিছু বলার আগেই মুনতাসিম বলল,

–কিছু খুঁজছেন ম্যাডাম। মুনতাসিমের নম্র ব্যবহারে শান্ত হলো মেহেভীন। বিরক্ততে তার মুখশ্রী কুঁচকে এলো। সে বিরক্তি মাখা মুখশ্রী করে জবাব দিল,

–আমার কাজের মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছি না।

–আমি তাকে ছাঁদে ঘুমোতে দেখেছি। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন নিজের ললাটে দু’টো চাপড় মারল। এই মেয়েটাকে নিয়ে সে অসহ্য হয়ে গিয়েছে। একদম ছন্নছাড়া যেখানে যায় গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে। ছাঁদে কাপড় তুলতে গিয়ে নিশ্চয়ই কারো সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছিল। সেখানেই ঘুমিয়েছে। রুপার স্বভাব সম্পর্কে সবাই অবগত।

–আপনার বাসায় একটু হলুদের গুঁড়ো হবে? আসলে আমি রান্না করতে গিয়ে ময়লা ভেবে ফেলে দিয়েছি। কিনে নিয়ে আসলে দিয়ে যাব।

–আপনি রান্না করতে পারেন না। তাহলে রান্না করতে যান কেন? এতবড় ছেলে হয়ে হলুদ গুঁড়ো কোনটা চিনেন না। নাকি আমার সাথে আপনি ফ্লাট করছেন?

–এসব আপনি কি বলছেন ম্যাডাম। আপনি কত বড় মাপের মানুষ। আপনার সাথে ফ্লাট করার মতো দুঃসাহস আমার আছে। মেহেভীন কিছু বলে না হলুদের গুঁড়ো দিয়ে ছাঁদে চলে যায় রুপাকে আনতে। মুনতাসিম মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে বলল, এই মেয়েটা আমাকে একদম শেষ করে ফেলবে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে