__ একে তো শীত তার উপর বৃষ্টি তে কাক ভেজা হয়ে ভিজে গাড়িতে গুটিশুটি মেরে বসে কাঁপছে নিরু, শুভর কথা শুনে জোরে জোরে কান্না শুরু করে দেয়। শুভ মনে মনে চরম বিরক্ত হয়ে গিয়েছে মেয়েটার উপর। এ কিসের টান এ পড়েছে শুভ, না পারছে রাস্তায় ছাড়তে না পারছে কাছে রাখতে।
__ শুভর বলা যায়গায় ড্রাইভার গাড়ি থামায়। শুভ গাড়ি থেকে নেমে আসে আগে।
__ ” এইযে, এবার নামুন, চলে এসেছি। ”
__ ” না, আমি আপনার সাথে যাবো না। আপনি আমার ক্ষতি করবেন। ”
__ ” কি বললে তুমি যাবে না। ” বলতে বলতে গাড়ি থেকে টেনে বের করে কোলে তুলে নিয়ে একটা বাসায় ঢুকে। নিরু ও একের পর এক কিল মারতে থাকে শুভর পিঠে তাও শুভ থামে না। বাসার গেট এ কলিংবেল দিতে একজন ভদ্রলোক বের হয়ে আসেন।
__ “তোমরা কে বাবা, এতো রাত্রে দুইজন, তাও দুজনে। ”
__ ” এইখানে কাজী সাহেব কে? তাকে ডাকুন। ” শুভ একটু কড়া মেজাজ এ বলে।
__ ” আরে আমিই তো কাজী, কি দরকার বাবা? ”
__ ” আমরা কি কাজীর কাছে লুডু খেলতে এসেছি নাকি? জলদি বিয়ের ব্যবস্থা করুন। ”
__ ” এইভাবে, এতো রাতে বিয়ে, সাক্ষী কোথায়। ”
__ ” আপনার বাড়িতে লোক নাই, ওদের সাক্ষী দিয়েন দিবেন, বাকিটা ব্যবস্থা করেন তাড়াতাড়ি। ”
শুভ নিরুকে এবার নামিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে ভিতরে গিয়ে বসে পড়ে। নিরু হতবাক হয়ে গেছে বিয়ের কথা শুনে।
__ কাজী সাহেব বলেন ” আচ্ছা আপনারা কি পালিয়ে এসেছেন?? ”
__ ” তা জেনে আপনি কি করবেন। ”
__ ” ওহহ আচ্ছা আচ্ছা! বরের নাম কি?
__ ” আসাদুজ্জামান শুভ ”
__ ” কনের নাম কি? ”
__ ” এই তোমার নাম কি বলো? ” নিরু কে উদ্দেশ্য করে শুভ বলে।
__ ” এ কেমন কথা! বিয়ে করতে এসেছেন বউয়ের নাম জানেন না? ” কাজী সাহেবের তাচ্ছিল্যের হাসি।
__ কাজীর উদ্দেশ্যে বলে ” এই আপনার প্রব্লেম কি? আপনি কথা কম বলুন আর কাজ বেশি করুন। ” এবার নিরুর দিকে তাকিয়ে
” এই মেয়ে তোমার নাম বলো? ”
__ ” জ্বী নিরুফার জাহান, সবাই নিরু বলেই ডাকে। ”
বিয়ের সব কাজ কম্পলিট করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নিরু কি বলবে বুঝতে পারছেনা, তাই চুপচাপ থাকে।
বাসায় পৌঁছে শুভর সাথে নিরু কে দেখে সবার চোখ কপালে উঠে। বিয়ে বাড়িতে ঝামেলা হবার পর বাসর ঘরে বউ পাঠিয়ে দিয়ে সবাই ড্রইং রুমে আলোচনা করছিলো। তখনি শুভ বউ নিয়ে বাড়ি ঢুকে।
__ ” এই শুভ, সাথে এটা কে? আর এইভাবে ভিজলি কিভাবে? ঠান্ডা লাগবে তো। ” শুভর মা বলে।
__ ” এই মেয়েকে নিয়ে এসেছিস যে? কি প্রব্লেম তোর “। শুভর ভাই সাগর বলে।
__ ” কিরে কিছু বলছিস না কেনো? ” শুভর বাবা
__ ” তোমাদের ছোট ছেলের বউ নিরু। আর কিছু কারোর জানার আছে? এবার সামনে থেকে সরো। ”
এ কথা বলে নিরুর হাত ধরে টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে যায় শুভ। বাসার সবাই আর শুভর সামনে কথা বললো না, কারণ শুভর রাগ আর জেদ সবার জানা আছে। শুভ চোখের আড়াল হতেই
__ ” এই পেত্নী টা শুভ ঘাড়ে টুপ করে পড়লো, আর শুভ ওকে নিয়ে চলে এলো। ” শুভর খালামণি বলে।
__” আহহহ স্নেহা! অনাথ মেয়ে, দেখতেও ভালো, শুভ যদি মানিয়ে নিতে পারে আমাদের আপত্তি কোথায়। ” শুভর বাবা ধমকের শুরে বলে।
__ ” ওহহহ তাহলে আমাদের কোন কথাই বলার থাকেনা, হুহহহ” বলে রুম থেকে বের হয়ে আসে শুভর ছোট খালামনি স্নেহা।
__ ” ওই মেয়েটাকেই ওর বিয়ে করা লাগতো বাবা? এমনিতেই একটা মেয়েকে এনে ফেঁসে গেছি, ওই মেয়েটা কেও কি আনা লাগতো। ” সাগর বলে।
__ ” মেয়েটা দেখতে কিন্তু সুন্দরী, বউমা পছন্দ হয়েছে, শুভর চোখ আছে বলতে হয়। ” শুভর মা
শুভ নিরুকে ঘরে নিয়ে এনে হাত ছেড়ে দেয়। শুভর নিজের একটা শার্ট, আর প্যান্ট এগিয়ে দেয় নিরুর দিকে
__” যাও আজকের মতো এগুলো ই পড়ে আসো। কাল নতুন জামাকাপড় সব পাবে। ভিজা কাপড়ে এতক্ষণ থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। ” নিরুকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে নিজেও চেঞ্জ করে নেয়। একদম ঠান্ডায় জমে গেছে। নিরু ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই শুভ বলে
__ ” প্রচুর ঠান্ডা বাইরে, আমারও ঠান্ডা লেগেছে খুব। তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসো,
আমিও যাবো ওয়াশরুমে। ”
__ নিরু তাও দাড়িয়ে আছে।
__ শুভ গিয়ে নিরুর হাত দিয়ে টান দিয়ে বের করে ” কি ব্যাপার, কথা শুনতে পাও না? ”
__ নিরু শুধু শার্ট পড়ে, তাই লজ্জা করে বের হচ্ছিলো না। শুভর কাছে আসাতে মাথা নিচু করে ফেলে। উত্তর না পেয়ে নিরুকে সরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় শুভ। কিছুক্ষণ পর শুভ বের হয়ে দেখে নিরু দাঁড়িয়ে আছে।
__ ” কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ”
__ ” কোথায় যাবো? ”
__ ” এতো বড় বিছানা দেখতে পাচ্ছোনা, নাকি কানা। ”
__ ” আসলে ”
__ ” কি আসলে ”
__ ” ভয় লাগছে? কখনো ছেলে মানুষের ঘরে থাকিনি তো! ”
__ ” কি বললে তুমি? এসো আমি তোমার ভয় ভাঙায়। ” বলে শুভ এগিয়ে আসে। নিরু পিছনে সরতে থাকে ভয়ে, শুভ এসে নিরুকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে ” সবাই আমাকে ভয় করে আর তুমি আমার মুখে মুখে তর্ক করছো তাইনা। ” বলে হাত ধরে টেনে এনে বিছানায় ফেলে দেয়। বিছানার মাঝে কোলবালিশ দিয়ে বলে ” তোমাকে বিয়ে করেছি বলে স্ত্রীর অধিকার চাইতে এসোনা কখনো। মরতে চাইছিলে বিধায় বাঁচিয়েছি, এই বাসায় রাজরানী হয়ে থাকবে কিন্তু স্ত্রী মর্যাদা আমার কাছে পাবেনা। যাও বিছানা ভাগ করে দিলাম, ভাগ ক্রশ করার চেষ্টা করবেনা। আজ প্রচুর ঠান্ডা, কম্বল একটা সো এখানেই থাকতে তুমি বাধ্য। কাল থেকে সোফায় ঘুমাবে। ” কথাগুলো খুব রাগের সাথে বলে শুভ। নিরু ভয়ে আর কথা না বলে শুয়ে পড়ে। শুভ আর কথা না বাড়িয়ে অপরপাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে যায়। নিরু কাঁদতেও পারছেনা ভয়ে কিন্তু প্রচুর ঠান্ডায় জমে গেছে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে শুভ। রাত্রে হটাৎ শুভর ঘুম ভেঙে যায় বিছানা কাঁপছে খুব। পাশ ফিরে দেখে নিরু খুব কাঁপছে। বুঝতে পারে জ্বর এসেছে নিরুর। এতক্ষণ ভিজেছে, একটু মায়া জাগে মেয়েটার উপর। বুকের সাথে জড়িয়ে নেয় নিরুকে। নিজের শরীরের গরমে যেন মেয়েটা একটু আরাম পায়। শুভ ও খেয়াল করে কাঁপুনি একটু কমেছে। আরোও চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে শুভ।
_____ নিরু কাউকে না জানিয়ে বাসায় ফিরে আসাতে তার সৎ মা একটা রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়েই বললো ” কিরে অলক্ষ্মী, কাউকে না জানিয়ে বাসায় ফিরলি কিসের জন্য? আজ আমার মেয়েটার বিয়ে , আর তোকে কি আজকেই আসতে হলো, এখন আমি সবার সামনে তোর পরিচয় দিবো কিভাবে? তোর জন্য আমার মেয়ের বিয়ে যদি ভাঙে তাহলে তোকে জ্যান্ত খুন করে পুতে দিয়ে আসবো মনে রাখিস। ” কথাগুলো রাগে গজগজ করতে করতে বলে।
__ ” আসলে আজ কলেজে মারামারি হয়েছে। তাই সবাই কে হোস্টেল ছাড়তে বলেছে? বাসায় না আসলে আমি কোথায় যেতাম আম্মু। আমার তো যাওয়ার আর যায়গা নেই। ” মাথা নিচু করে কথা গুলো বলে নিরু।
__ ” হয়েছে থাক, তোকে আর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলতে হবেনা। তুই তো একটা কুলক্ষ্মী, আমার মেয়ের যদি কিছু হয় তাহলে তোর খবর খারাপ করে দিবো। ” রাগের জন্য ফরসা গাল পুরোই লাল হয়ে গেছে লুতফা বেগমের।
__ ” আমি আব্বু কে জানিয়েই এসেছি আম্মু, আর আমি তোমাদের কারোও ক্ষতি করবোনা। চিন্তা করিওনা তোমরা আমি সন্ধ্যার আগেই ছাদে যাবো। যতক্ষণ আপুর বিদায় না হবে ততক্ষণ আসবোনা নিচে। ” কাঁদতে কাঁদতে বলে কথাগুলো।
__ ” আহহহ ন্যাকা হুহ। ” বলে জোরে দরজা খুলে বের হয়ে যান।
__ আজ নিরুর বোনের বিয়ে, ” ইশ যদি লিজা আপু আপন বোন হতো তাহলে বিয়েতে কত্ত মজা করতাম। আমার যদি একটা মা থাকতো তাহলে যে কতো আদর করতো । আজ আমার আপনজন বলে কেউ নেই। আমার মা নাই বলে কি কখনো সুখ পাবোনা। ” এইসব ভেবে কান্না করতে থাকে নিরু।
” কি নেই আমার বাবার, সব কিছু আছে। বাড়ি গাড়ি সম্পত্তি সব তো আছে তোমার। তাহলে কেনো তোমার এই মেয়েটার দুঃখ বুঝোনা? বাবা কোথায় তুমি? একটু দেখে যাও না আমায়। কখনো তো একটু ও আদর করোনা। আমার মা নেই বলে আমাকে এতো কষ্ট দাও কেনো? ” বুকের ভিতর এক চাঁপা কষ্ট নিরু কে চিরেচিরে খাচ্ছে।
এরই মাঝে মাগরিবের আজান হচ্ছে। নিরু ফ্রেশ হয়ে ওজু করে মাগরিবের নামাজ পড়ে বাড়ির পেছনের সিড়ি বেয়ে ছাদে চলে যায়। দোতলার ফ্লাট টা কি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারিদিকে এতো লাইটিং, আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক। ” আহ! সবার জীবন কতো ই রঙিন, শুধু আমার জীবন টাই আঁধার। ” বিরবির করে বলে নিরু। কিছুক্ষণ পর গাড়ির হর্ণ শুনতে পায় নিরু, বুঝতে পারে বর এসেছে। ” সবাই মিলে বর এর সাথে কতো মজা টাই না করছে। ইশ আমি যদি মজা করতে পারতাম । ” এক চাঁপা যন্ত্রণায় ভিতর টা হুহু করে উঠে।
কিছুক্ষণ পর কারো পায়ের শব্দ শুনতে পায় নিরু, চোখ টা মুছে ফেলে, খুব স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে।
__ ” কিরে নিরু, একা একা ছাদে কি করছিস ” বলতে বলতে ছাদের দরজা টা লাগিয়ে দেয় রাকিব। রাকিব নিরুর ফুপাতো ভাই। স্বভাব চরিত্র নিরুর মোটেও ভালো লাগেনা তাই সাধারণত এড়িয়ে চলে। আর আজ সুযোগ পেয়েই চলে এসেছে।
__ ” আমি এখানে আছি তোমাকে কে বললো ? ” রাগী স্বরে বলে নিরু।
__ ” আরে, এতো রাগ করার কি আছে। সবাই তো বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত, তাই আমি তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে চলে আসলাম। ” শয়তানি হাসি দিয়ে কথা গুলো বলতে বলতে এগিয়ে আসছে রাকিব।
__ ” আর এক পা এগুলেই আমি কিন্তু চিৎকার দিবো। ” কিছুটা ভয় পেয়ে যায়, পিছনের দিকে সরে যেতে যেতে ছাদের কিনারে চলে আসে।
__ ” বিয়ে বাড়ি, এতো জোরে গান বাজছে, এতো হৈচৈ চারিদিকে, তোমার চিৎকার টা শুধু আজ আমিই শুনবো আর উপভোগ করবো। হা হা হা ” পৈশাচিক আনন্দ রাকিবের মনে।
__ নিরু পেছনে সরতে সরতে বলে ” একদম ভালো হবেনা কিন্তু আ আ আ আ আ আ ” রেলিং খুবই অল্প ছিলো বলে ছাদ থেকে পড়ে যায় নিরু।
চিৎকারের শব্দে মাথা টা উপরে করতেই কাউকে পড়ে যেতে দেখে শুভ। কিছু বোঝার আগেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে ধরে ফেলে মেয়েটিকে। নিরু কিছুক্ষণ গলা জড়িয়ে ধরে থাকে ছেলেটির। কিছুক্ষণ দুজনের নিরবতা। নিরু বুঝতে পারছেনা সে ছাদ থেকে পড়ে মরে গেছে না বেঁচে আছে। আর শুভ বুঝতে পারেনি এটা কি হলো কিন্তু মেয়েটার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে শুভ।
চারিদিকে হৈচৈ এ দুজনে বাস্তবে ফিরে আসে, নিরু বুঝতে পারে সে মরেনি এই যাত্রায় বেঁচে গেছে। কোল থেকে নামে কিন্তু খেয়াল করে গায়ে ওড়না টা নাই। দুই হাত সামনে নিয়ে আনে, জানুয়ার টা পড়ে যাবার সময় ওড়না টা নিয়ে নিয়েছে, দাঁড়িয়ে থাকতেও ইতস্তত বোধ করছে। এতক্ষণ ছেলেটার বুকের সাথে লেপ্টে ছিলো কিন্তু এখন দাঁড়াতে ও পারছেনা। শুভ খেয়াল করে নিজের শেরওয়ানির সাথে থাকা কোর্ট টা খুলে পড়িয়ে দেয় নিরুকে। চারিদিকে বিভিন্ন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। একেকজন একেক কথা বলছে।
__ ” কি কুলক্ষ্মী মেয়েরে বাবা, বিয়েতে কোন অশান্তি হবে না তো। ”
__ ” তা কোথেকে উড়ে আসলো এই মেয়ে, আমরা তো চিনি না।”
__ ” হবে হয়তো কোন ভিখারী, বড়লোকদের বিয়েতে চলে আসছে। ছেলে পছন্দ হয়েছে বলে পেত্নীর মতো ঝুলে পড়েছে। ”
এতক্ষণে নিরুর সৎ মা এসে নিরুকে মারতে থাকে।
__ ” অলক্ষ্মী, শেষ পর্যন্ত বিয়েতে অশান্তি করেই ফেললি। মরিস না কেন মুখপুরি। তুই মরলে এই সংসার এ শান্তি ফিরবে, তার আগে না। ”
এতক্ষণে শুভ মুখ খুলে
__ ” স্টপ ইট, হচ্ছেটা কি? মগের মুল্লুক নাকি, যে যা খুশি করতে থাকবেন? ”
__ ” আহ লুতফা! বেশি সিনক্রিয়েট করো না। ওকে ওর ঘরে বন্দী করে রাখো। ” এতক্ষণে নিরুর বাবা আফজাল হোসেন এসে কথা গুলো বলে।
লুতফা নিরুকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলে শুভ বলে
__ ” আগে বলুন মেয়েটা কে? কি হয়েছিলো? এরপর ওকে নিয়ে যাবেন। ”
__ ” আসলে ও ওও আমার ছোট মেয়ে। ” মুখ নিচু করে বলে আফজাল হোসেন।
__” বাহ বাহ! আপনাদের নাকি একমাত্র মেয়ে, এখন আরেকটা উদয় হলো কিভাবে? আর কতো কি লুকিয়েছেন? ” খুব গম্ভীর ভাবে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে শুভ।
একেএকে বরপক্ষের সবাই বের হতে থাকে। ঘটনা শুনে দেখে সবাই ছিঃ ছিঃ করছে। কিন্তু ততক্ষণে বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে। কিন্তু বরপক্ষের সবাই মেয়ে নিয়ে যেতে চাইছেনা।
__ ” আসলে নিরু হোস্টেলে থাকে তো , তাই ওর কথা মনেই থাকে না।” হাসতে হাসতে বলে আফজাল হোসেন।
__ কি সুন্দর গুছিয়ে মিথ্যে বলেন আপনি, ছিঃ ছিঃ, নিজের মেয়ের নাম্বার বলতেও ভুল করেন। ” বরের বাবা আব্দুর রহমান সাহেব বলেন।
__ ” নাহ দুলাভাই, এই বাড়ির মেয়ে ঘরে তুলবো না। ” বরের খালা বলে।
__ ” অসম্ভব ব্যাপার, যেই বাড়িতে এতো ঘাপলা সেই বাড়ির সাথে কিসের আত্মীয়তা? ” বরের চাচা বলে এই কথা।
সবার চোখেমুখে রাগ দেখা যাচ্ছে, বর ও বের হয়ে এসেছে, নিরুর বোন ও বের হয়ে এসেছে ।
__ ” এতো বছর প্রেম করে বিয়ে করতে আসলাম, আর এই বাড়িতে এতো গলদ, ছিঃ আগে জানলে রিলেশন ই করতাম না। ” বর বলে বরের বাবার উদ্দেশ্যে।
নিরু বুঝতে পারছে যার উপরে পড়েছে সে বরের বাড়ির লোক। সবার সামনেই দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার পা জড়িয়ে ধরে। বলতে থাকে
__ ” প্লিজ, আমার বোনকে একলা রেখে আপনারা যাবেন না। ” কান্না করতে থাকে।
__ ” আরে কি করছেন পা ছাড়ুন। ”
__ ” আমার জন্য আমার বোনের কোন ক্ষতি হোক আমি তা কখনোই চাইনা। দয়া করে আপনারা কেউ আমার বোন কে রেখে যাবেন না। ”
__ ” আরে কি আশ্চর্য, আপনি উঠুন বলছি, আচ্ছা আপনারা সবাই কি ন্যাকা। পর পুরুষ এর পা ধরতে লজ্জা করে না? বাপ মা কিছুই শিখায়নি নাকি?
”
__ এতো খারাপ কথা শুনে পা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে ” আমার মা নেই। জন্মের সময় মরে গেছে, তাই সবাই আমায় অলক্ষ্মী বলে। ক্ষমা করবেন ” কথাগুলো কান্নায় জড়িয়ে যাচ্ছিলো।
__ এভাবে আসলেই বলা উচিৎ হয়নি শুভর। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে, সরি বলতে যাবে তার আগেই মেয়েটা অনেকটা দূরে চলে গেছে। ওর সৎ মা ওকে জোরে একটা চড় মারে, এতে মেয়েটা পড়ে যায়। শুভর কেনো জানি মনে হলো চড় টা ওর গায়ে লাগলো।
__ ” অলক্ষ্মী মেয়ে, আজ তুই হয় নিজে এই বাড়ি ছেড়ে বের হবি না হয় আমি তোকে জানে মেরে ফেলবো। ” সৎ মায়ের গলা দিয়ে কথা গুলো বের হচ্ছে।
__ শুভ সবটা ই শুনতে পাচ্ছে , ওর বাবা কে গিয়ে বলে ” বাবা, যা হবার হয়ে গেছে, বউ তুলে নাও, এই বাড়ির সাথে সম্পর্ক রেখোনা তাহলেই হবে। ” বর কে গিয়ে বলে ” যা হবার হয়ে গেছে, এবার বউ নিয়ে বাড়ি চল ”
__ ” এই মেয়ের সাথে ঘর করবো কিভাবে বল? ” বর
__ ” দেখতেই তো পাচ্ছো সৎ বোন বলে বলেনি। ”
__ ” হুম তুই যখন বলছিস তখন মেনে নিবো কিন্তু ওর বাবা মা কে কখনো মানছি না। ” রাগী গলায় বলে শুভর ভাই সাগর।
শুভ খেয়াল করে মেয়েটি নাই, আর মায়া না করে সবাইকে বের হতে বলে। বর বউ এক গাড়িতে উঠলো কিন্তু বউ এর মা বাবা কাউকেই কাছে আসতে দেয়নি শুভর পরিবার। সবাইকে গাড়িতে উঠিয়ে নিজে উঠার সময় খেয়াল করে একটা মেয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে বাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাচ্ছে। শুভর কিছুটা সন্দেহ হয়, তাই গাড়িতে না উঠে সবাই কে চলে যেতে বলে পিছু নেয় মেয়েটার। মেয়েটা টা কি করছে দেখার জন্য জোরে জোরে হাটতে থাকে। শীতকাল হবার পরও নিম্নচাপ এর কারণ এ আবহাওয়া খারাপ, বৃষ্টি হতে পারে যেকোনো মুহুর্তে। প্রচুর শীত পড়েছে, এতো ঠান্ডার মাঝে শুধুমাত্র একটা জামা পড়ে কিভাবে মানুষ থাকে। মনে মনে কথা বলছে শুভ। শুভর হটাৎ মনে হলো মেয়েটা আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে টেনে আনে। হটাৎ টানে মুখের কাপড় সরে যায়।
__ মেয়েটার দুই হাত ধরে জোরে করে চিল্লিয়ে বলে ” কি ব্যাপার , এতো আত্মহত্যা করার শখ হলো কেনো? মরার এতো শখ তাহলে একদিন আমার মনঃরঞ্জন করেই মরো। ” কয়েকটা চড় মেরে দেয় শুভ রাগের বশে।
__ ” ছাড়ুন আমাকে, আমি খারাপ, যার জীবনে যায় তার ক্ষতি করে দিই। আমি আমার মা কে মেরেছি, বাবাকে দূরে সরিয়েছি, আর কি চাই আমার। সৎ মায়ের খোটা, বাবার অবহেলা আমি আর নিতে পারছিনা। এর চেয়ে আমি মরে গেলেই ভালো হবে। কারোও কষ্ট হবেনা তখন। এই দুনিয়ায় আমার কেউ নাই, ছোট তে বড় হয়েছি অনাথ আশ্রমে, বড় হয়ে হোস্টেলে। আজ হোস্টেল ও বন্ধ তাই বাড়ি এসেছিলাম কিন্তু উপহার পেয়ে গেছি। ” বলতে বলতে কান্না করতে থাকে। এরই মাঝে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, কোনটা চোখের জল আর কোনটা বৃষ্টির পানি বুঝা যাচ্ছেনা।
__ ” তাহলে মরবেই তাইনা, তো চলো আমার সাথে “। কোলে তুলে নেয় মেয়েটি কে, বাড়ির দিকে হাটতে থাকে। একটু শুকনো যায়গায় এসে ফোন বের করে ড্রাইভার কে গাড়ি আনতে বলে। নিরুর চিল্লাচিল্লি শুনে এক ধমক দেয় শুভ। একে তো শীত তার উপর বৃষ্টি, হাড় কাপুনি ঠান্ডা তে দুজনেই জমে গেছে। ড্রাইভার আসতেই নিরুকে গাড়িতে জোর করে ঢুকিয়ে এক যায়গায় যেতে বলে শুভ।
__ ” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? ”
__ ” জাহান্নামে ”
__ ” প্লিজ আমার ক্ষতি করবেন না। ”
__ এই কথা শুনে শুভর মেজাজ বিগড়ে গেলো ” একশো বার করবো, পারলে ঠেকাও।। ”
ভোরের দিকে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সাদা বক, পানকৌড়ির দেখা পাওয়া যায়। ফারিয়া মনযোগ দিয়ে এদের উড়াল দেয়া, মাছ স্বীকার করা দেখে। পানকৌড়ি ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকতে পারে। এক ডুবে বেশ খানিক নদী পথও অতিক্রম করে।
ফারিয়া অবশ্য কতটা পথ এক ডুবে অতিক্রম করে সেটা মেপে বের করতে পারেনি। প্রায়ই ইচ্ছা হয় মেপে দেখার কিন্তু সে তো সাঁতার জানেনা। পানকৌড়ির মাছ স্বীকার করা, ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ পর উঠে আসাকে সে একটা নাম দিয়েছে।খুব সাধারণ একটা নাম – খেলা। পানকৌড়ির খেলা দেখার সময় ফারিয়া তার কষ্ট গুলো বেমালুম ভুলে যায়। তখন নিজেকে তার খুব সুখী মনে হয়। তার মনেই থাকেনা কী ভয়ংকর স্বপ্ন তার চারপাশে ঘিরে আছে!
মনেই থাকেনা এখনো নাকে সেই গন্ধটার তার পেটের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যায়।
এই একটা সময়, কিছু মুহূর্ত তাকে সুখী করে তোলে! অসহ্য হয়ে ওঠে যখন এই একঘেয়েমি জীবন তখন চোখ বুঝে সকালের এই নদীর পাড়ের দৃশ্য তাকে স্বস্তি দেয়। কেনো এতো ভালো লাগে, তার জানা নেই! কখনো জানতেও চায়নি সে।
ফারিয়া জানে তার মা জানার জন্য অধীর হয়ে থাকে, কেনো ভালো লাগে? তার মায়ের সব বিষয়ে কৌতুহল ! ডাক্তার সাহেবকে নিয়েও! রশীদ আলম কে কেনো ডাক্তার বাসায় ডেকেছেন এর উত্তর অনেক বার শুনেছে তারপরও তার কৌতুহল কমেনি।
ফারিয়া কখনো চায়না তার মা – বাবা, ফাহাদ তাকে নিয়ে চিন্তা করুক। কিন্তু তারা করে। ছোট্ট ফাহাদও বড় আপুকে কানে কানে জিজ্ঞেস করে
– তুমি সুস্থ হবে কবে?
ফারিয়া হেসে বলে
– আমি তো সুস্থ!
– কই? দাদী বলে তুমি সুস্থ হবে না।
– মা বলে হবো।
– সত্যি মা বলেছে?
– হ্যাঁ রে!
এখন প্রায়ই নিজের মাকে দেখার স্বাদ জাগে! তার মা কি দেখতে তার মতোই ছিলো? বাবার সাথে ফারিয়ার তেমন মিল নেই। তাই সে ধরেই নিয়েছে, মায়ের সাথে তার মিল বেশি।
এইযে মাঝেমধ্যে আমি মায়ের কথা মনে করি, আমার মাও কি তাই করে? তারও আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে?
যখনই ফারিয়া নিজের মাকে নিয়ে ভাবতে থাকে তখনই লিমা তার ঘরে আসে গল্প করতে।
নিজের মায়ের বদলে তখন এই মাটাকে নিয়ে সে ভাবতে থাকে। এই মা কতো ভালো! কতো না ভালোবাসে তাকে। এই লিমা মায়ের সাথে যদি তার মিল থাকতো!
এই মায়ের ডান গালে বেশ বড় একটা তিল আছে। যখন হাসে সেই তিল টা আরো বেশি সুন্দর লাগে!
ইশ, যদি এরকমই একটা তিল তার বাম গালে থাকতো! মাকে জোর করে আয়নার সামনে নিয়ে বলতাম
– দেখো মা, তোমার মতো আমারও তিল আছে!
মা হেসে বলতেন
– কী যে বলিস! আমার মতো হবে কেনো? তোর মতোই হয়েছে।
ফারিয়া মনে মনে ভাবে তখন সে মন খারাপ করে বসে বসে কাঁদার ভান করবে। মা অস্থির হয়ে পড়বেন, কীভাবে কান্না থামানো যায়। তখন স্বীকার করে নিবেন
– তুই ঠিকই বলেছিস তোর আর আমার তিলটা পুরোপুরি এক। ফটোকপি। আজকাল চোখে একটু কম দেখিতো তাই হুট করে কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা।
ফারিয়া শুনে মুচকি হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে। তার মা খুব ভালো মিথ্যা বলতে জানেনা। মা জাতটাই অদ্ভুত !
যখন তার শারীরিক কষ্টটা বাড়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে তার মাও কষ্ট পাচ্ছেন। আসলে তিনিই আমাকে শুধু পেটেই রাখেননি তাছাড়া সে আমার সবকিছু, সবকিছু।
রশীদ আলম ভরদুপুরে ডাক্তারের ফোন পেয়ে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
– জি, আমি ফারিয়ার বাবা।
– ভালো আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
– এইতো আছি। আপনার সাথে আমার একটু দেখা করা দরকার। আর ফারিয়ার সাথেও।
– তাহলে কটায় আসবো আপনার চেম্বারে?
– আমি আপনার বাসায় আসবো আমার স্ত্রীও সাথে থাকবে। সন্ধ্যার দিকে। আপনার বাসার পরিবেশ টাও আমার দেখা দরকার। বুঝতেই পারছেন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা দ্রুত চালাচ্ছি।
– আচ্ছা আসুন।
– বাসার ঠিকানা টা বলুন। আমার স্ত্রীকে সাথে নেয়ার কারণটা আপনাকে বলি। রেহানা আমাকে দীর্ঘ ক্ষণ না দেখে থাকতে পারেনা। আপনার বাসায় আমার অনেক সময় ব্যয় হবার সম্ভাবনা আছে তাই আমার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে আসছি।
– আচ্ছা আপনারা আসুন।
রশীদ আলম বিপদে পড়ে গেলেন। তার মা জানেন না যে মেয়েকে ডাক্তার দেখানো হচ্ছে। জানতে পারলে কী হবে তার জানা নেই!
জানুক তো, সত্যি কথা সে বলে দেবে।
রশীদ আলম মায়ের ঘরে গিয়ে বিছানার পাশে চেয়ারে বসলেন। দুপুরে তার মা ঘুমান। কিন্তু আজকে ঘুমান নি। বিছানায় শুয়ে আছেন আর পান চিবাচ্ছেন।
রশীদ আলম সাহস করে বললেন
– মা, আজকে বাসায় সন্ধ্যায় দু’জন মেহমান আসবে।
– কে কে আসবে? তোর বন্ধুরা?
– নাহ, আফতাব হোসেন আর তার স্ত্রী।
– ইনি আবার কে রে রশীদ?
– ফারিয়ার ডাক্তার।
রশীদ আলমের মা কঠিন স্বরে বললেন
– যা ইচ্ছা হয় করো। আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে আসবা না। ডাক্তার দেখানোর আগে তো জিজ্ঞেস করতে আসো নাই। আজকে ক্যান আসছো? টাকা লাগবে এই আমার কাছে?
– না। বললাম যাতে তুমি তাদের সাথে ঝামেলা না করো।
– আমিই তো ঝামেলা করি। আর ওই নবাবজাদি তো বসে বসে গুদাম ভরছে।
রশীদ আলম সাহেব মায়ের ঘর ছেড়ে বের হয়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে পানির ট্যাব ছেড়ে দিলেন। তারপর জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন।
জীবন টা তার কাছে খুব অসহ্য হয়ে উঠছে দিন দিন।মরে যেতে ইচ্ছে করে। বড় বড় ট্রাক যখন দ্রুতগতিতে ছুটে যায় তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেই হয়। মেয়েটা আর ছেলেটার জন্য চিন্তা হয়। লিমার জন্যও হয়। খুব অসহ্য সময় চলছে তার। হয়তোবা খুব দূরেই এই সময়ের সমাপ্তি ঘটবে।
রেহানা বেগম বেঁকে বসেছেন। রশীদ আলমের বাসায় তিনি যাবেন না। ওই বাড়ি তিনি পা রাখতেই নাকি অশুভশক্তি তাকে গ্রাস করবে। রেহানা এরকম কথাবার্তা কখনোই বলেন না। কুসংস্কার কে তিনি তার মনে কখনো স্থান দেননি। রশীদ আলমের কথাবার্তায় তার মনে হুট করে কুসংস্কার বিঁধে গেছে। কিছুতেই তিনি উপরে ফেলতে পারছেন না। আফতাব হোসেন ও বেশ ঝামেলায় পড়েছেন। ওই বাড়ি দীর্ঘক্ষণ থাকতে হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে তার স্ত্রী ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। খুব বেশি ভালোবাসলেও সমস্যা আবার খুব কম ভালোবাসলেও সমস্যা। একটা মধ্য পর্যায়ে থাকলেই ভালো। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় খুব বেশি আর কম ভালোবাসাটাই মানুষের মধ্যে থাকে। স্বাভাবিক মাত্রার ভালোবাসা পাওয়া ভার।
আফতাব হোসেনের মনে হলো, সে নিজেই স্বাভাবিক মাত্রায় ভালোবাসতে পছন্দ করেন। স্ত্রীকে কি আগের মতো ভালোবাসেন? প্রশ্ন টার উত্তর হবে না। ভালোবাসা আগের মতো নেই। বদলে গেছে। বদলে যাওয়ার কারণ সে নিজেই। সেই স্ত্রীকে বিভিন্ন অজুহাতে সময় দেন নি। যেকোনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে, সময় ব্যয় করতে হয়। সময়ের অভাবে কতো সম্পর্ক যে নষ্ট হয় তার পরিসংখ্যান ব্যুরোর লোকেরা দেখলে ভয় পেয়ে যেতেন। এইজন্য এই পরিসংখ্যান করা হয়না। রেহানা যেতে না চাওয়াতেই ভালো হয়েছে। সবসময় স্ত্রী সাথে থাকতে হবে এমন কেনো হবে? নিজেরও তো জীবন আছে। আনন্দ আছে, সুখ আছে। আফতাব হোসেন মন খারাপের ভান করে স্ত্রীকে বললেন
– আচ্ছা, তুমি যেহেতু যেতে চাচ্ছো না সেহেতু বাসায় থাকো। আমিই যাই। যাওয়াটা জরুরি, আমার কিছু তথ্যের খুব প্রয়োজন।
রেহানা বললেন
– অনেক রাত হবে?
– তা তো হতেও পারে।
ফজরের আজান দিচ্ছে লিমা বুঝতে পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন নিশ্বাস ঠিকঠাক মতো নিচ্ছেন কিনা? লিমার রাতে ঘুমাতে যাবার আগে মনে হয় পাশে শুয়ে থাকা মানুষ টাকে সকালে মৃত ব্যক্তি হিসেবে দেখবে। উষ্ণ শরীর হঠাৎ করে খুব ঠান্ডা হয়ে যাবে। ভাবতেই কেমন শরীর শিওরে উঠে লিমার। বিছানা ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে বাথরুমে গিয়ে ওজু করে নেয়।
ফজরের নামাজ পড়ে তসবিহ হাতে ফারিয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ফাহাদের জন্য তার তেমন চিন্তা হয়না। কারণ সে সুস্থ আর চটপটে ছেলে। চিন্তা হয় তার সতীনের রেখে যাওয়া মেয়েটাকে নিয়ে! যদি ওর নিজের মা থাকতো তাহলে ওর সাথেই ঘুমাতো। ওকে সবসময় আগলে রাখতো। লিমা কি তার নিজের মায়ের মতো করতে পেরেছে?
রশীদ আলম বলেন
– তুমিই ওর মা।
কথাটা শুনতে লিমার খুব ভালো লাগে। তিনি প্রায়ই কথাটা শোনার জন্য রশীদ আলম কে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করেন। এমনভাবে প্রশ্ন করেন যাতে উত্তর ওই একটাই হয়
– তুমিই ওর মা।
ঘুমন্ত অবস্থায় প্রত্যেক মানুষকে হয়তোবা খুব সুন্দর লাগে। যেমন তার স্বামী, মেয়ে আর ছেলেটা কে খুব সুন্দর লাগে।
ফারিয়া গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। হয়তোবা তার ক্লান্তি খানিকটা বেশি।
ওকে কি ডেকে তুলবে? নাকি ঘুমুতে দিবে? কতো দিন পর গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে মেয়েটি সে খবর লিমা জানে।
প্রথম যেদিন মেয়েটা স্বপ্নের কথা সবাইকে বলল, কেউই বিশ্বাস করেনি। কিন্তু লিমা করেছিলেন। তার বিশ্বাস ফারিয়া কখনো মিথ্যা বলবে না। আজকাল অবশ্য মেয়েটা তার বাবাকে মিথ্যা কথা বলে। বাবাকে সে হাসি মুখে বলবে
– বাবা, ভালো আছি আমি। খুব ভালো বাবা।
লিমা সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েকে ডাকবেন না। আজকে একটু ঘুমাক, একদিন না দেখতে বের হলে তেমন কিছু ঘটবে না।
রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি চুলায় দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোর হওয়া দেখার জন্য বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। আজকের ভোর বেলাটা অন্যদিনের চেয়ে অন্যরকম! কিন্তু অন্যদিনের সাথে কোনো পার্থক্য তো নেই। তাহলে? আজকে মন ভালো তাই সকালটাকেও ভালো লাগছে। এমন কিছু হবে হয়তো। তার ভালো লাগা একটা ভোর ফারিয়া দেখতে চেয়েছিলো!
বেশ তাড়াহুড়ো করে চায়ের পাতিলে পানি একটু বেশি দিয়ে দিলো। মেয়েকে ডেকে উঠানোর জন্য বেশ দ্রুত মেয়ের রুমে ঢুকলেন……
রিয়াদ ও রায়াদ কে রেহানা বেগম বারান্দায় কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। রেহানা বেগম প্রায়ই এমন করেন। যখন তার ছেলে দুটো কথা শুনতে চায়না, পড়াশোনায় মন দেয়না তখন তিনি কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। রাতের বেলা বিধায় তারা বারান্দায় স্থান হয়েছে। দিন হলে বাড়ির মেইন গেটের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে দুই ভাই।
দুই ভাইয়ের এখন আর লজ্জা লাগেনা। প্রথম প্রথম লাগতো এখন সহ্য হয়ে গেছে। এখন তারা এই শাস্তিকে উৎসব হিসেবে পালন করে।
আফতাব হোসেন স্ত্রীকে ডেকে বললেন
– ছেলেদেরকে অনেক শাস্তি দিয়েছো এখন পড়তে বসাও।
রেহানা বেগম কোনো উত্তর দিলেন না। মাথা নিচু করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ছেলেদের নিয়ে সে চিন্তিত। পড়াশোনা তেমন করতে চায়না।
আফতাব হোসেন তার নতুন খাতাটিতে পেন্সিল চালিয়ে যাচ্ছেন। কলম দিয়ে জটিল সমস্যার সমাধান করা ঠিক না। জটিল সমস্যা গুলো এমনিতেই জটিল হয়। তার উপর যদি খাতা জুড়ে কাটাকাটি থাকে তাহলে বিষয়টা আরো জটিলে রূপ নেয়। পেন্সিল দিয়ে লিখলে রাবার ব্যবহার করে ভুল টাকে মুছে ফেলা যায়। তাই কাটাকাটি হবার সম্ভাবনাও নেই। আফতাব হোসেন এটাই মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করেন।
মেয়েটা অল্প বয়সে কি ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখে। কিন্তু উচিৎ ছিলো সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখার। যে স্বপ্নে খেলার সাথীদের নিয়ে মজা করছে বা দূরে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে এরকম ঘটনা ঘটবে। স্বপ্নে বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি, জোনাকী পোকা দেখবে। তা না স্বপ্নে অন্ধকার আর রক্ত মাংস দেখে!
স্বপ্নে ঘ্রাণ পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু মেয়েটি পাচ্ছে! মেয়েটি যখন স্বপ্নের বর্ণনা দিচ্ছিলো তখন তার বলার ভঙ্গিতেই বুঝতে পারা যায় সে একবিন্দুও মিথ্যে বলছেনা। মেয়েটি সত্যি কথা বলেছে। এবং স্বপ্নের প্রভাব তার বাস্তব জীবনে ফেলছে। অন্ধকার রাস্তায় হাঁটছে।সূক্ষ্ম আলোর রেখা আস্তে আস্তে আরো বেশি সূক্ষ্ম হতে থাকে তারপর……
– খাবেনা রাতে?
রেহানার প্রশ্নে বিরক্ত হলেও আফতাব হোসেন প্রকাশ না করে মুচকি হেসে বললেন
– আমি আসছি।
মাঝেমধ্যে বিরক্তি প্রকাশ করা যেমন প্রয়োজন তেমনই মাঝেমধ্যে বিরক্তি প্রকাশ না করাও প্রয়োজন। এতে প্রিয় মানুষ গুলো দূরে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
ফারিয়া নামের মেয়েটির সমস্যা দ্রুত সমাধান করা উচিৎ। শারীরিক সমস্যার জন্য ভালো মেডিসিন ডাক্তার দেখাতে হবে। রশীদ আলমকে বলে দেয়া উচিৎ ছিলো।
রশীদ আলম ঘুম থেকে উঠে মায়ের চিল্লাচিল্লি তে বুঝতে পারলেন তার স্ত্রী আর মেয়ে আবারও ঘুরতে বেড়িয়েছে। প্রায়ই দুজন ভোর বেলা ঘুরতে বের হয়। মা ব্যাপারটা একদমই সহ্য করতে পারেন না। আসলে মা তার মেয়ের ভালো হয় এমন বিষয় সহ্য করেন না। মনে মনে বিরক্ত হলেও প্রকাশ করেন না। মা কষ্ট পাবেন।
ফারিয়া আর লিমা এঁকে বেঁকে চলা কুমার নদের পাশের উঁচু ঢিবিতে দাঁড়িয়ে আছে। ভোরের দিকে নদীর পাড়টা দেখতে অপূর্ব সুন্দর লাগে ফারিয়ার কাছে। লিমার কাছে খুব সাধারণ কিন্তু মেয়েটার আনন্দে তার ভালো লাগে। এই দুনিয়াতে কিছু মানুষ থাকে যাদের কাছে অন্যের সুখ টাই বড়, নিজের টা না। অল্প বয়সে মা – বাবা জোর করে বউ চলে যাওয়া এক বাচ্চার বাপের সাথে তাকে বিয়ে দেন। লিমা প্রথনে রাজি ছিলেন না। মা – বাবা তার সিদ্ধান্তে কষ্ট পাচ্ছিলেন তাই বিয়েতে রাজি হলেন।
স্বামীর সাথে আসার আগে তার বাবা ডেকে আদুরে কণ্ঠে বুঝালেন
– তোমার স্বামীর ছোট্ট একটা মেয়ে আছো জানো?
লিমা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলেন।
– তাকে নিজের মেয়ের মতো জানবে। আর আল্লাহর কতো রহমত যে তুমি একজন অসহায় মেয়ের মা হতে যাচ্ছো। এই দুনিয়াতে যার মা নেই সেই অসহায়। বুঝতে পারছো কি বলছি।
– হ্যাঁ আব্বা।
সেই ছোট্ট ফারিয়াকে দেখে লিমার বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠেছিলো। মেয়েটার যে ভরপুর অযত্ন হয়েছে সেটা তার চোখে আর শরীরে ভেসে উঠেছে। ১০ মাসের বাচ্চা দাঁড়াতে জানে একটু একটু করে হাঁটতে শেখে কিন্তু এই মেয়ে অপুষ্টির কারণে ঠিকঠাক মতো দাঁড়াতে পারেনা।
আফতাব হোসেন বিব্রতবোধ করছেন। ছোট্ট একটা প্রশ্নে মানুষের কতো বড় আর বিষাদের অতীত প্রকাশ পেয়ে যায় আজকে তিনি বুঝতে পারলেন। প্রিয় মানুষের হারিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে কেউই মেনে নিতে চায়না। হয়তোবা সময়ের স্রোতে অনাদিকালের নিয়মকে বাঁচিয়ে রাখতে পথ চলতে হয়। আসলে পথ চলতে হয় বেঁচে আছে তাই। সবাই খুব সহজে নিজেকে ধ্বংস করে দিতে পারেনা। নিজেকে ধ্বংস করার ক্ষমতা সবার থাকেনা।
আফতাব হোসেন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ৭ টা বেজে ৪০ মিনিট। কতো দ্রুত সময় বয়ে চলেছে।
রেহানা বেগম নাস্তার ট্রে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন। রশীদ আলমের সামনে রাখা ছোট্ট টি টেবিলে নাস্তার ট্রে রেখে চলে গেলেন। ভদ্রলোক কাঁদছেন ব্যাপারটা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো। মানসিক ডাক্তারের কাছে কেউই সুখে থাকতে আসেনা।মনের বিশাল সমুদ্রের ন্যায় রোগ গুলোকে জমিয়ে আনে।
আফতাব হোসেন বললেন
– নাস্তা খেয়ে নিন। তারপরে না হয় আবার শুরু করা যাবে।
রশীদ আলম নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
– এতো কিছুর দরকার ছিলোনা। সামান্য চায়ে হতো।
– সামান্য নাস্তা দিয়েছি। পাকোড়া, নুডুলস আর র চা। খান তো আপনি।
আফতাব হোসেন নিজের জন্য আনা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তার লেখাগুলো পড়ছিলেন। কোথাও কোনো সমস্যা খুঁজে পাওয়ার উদ্দেশ্যে লেখাগুলো বারবার পড়ছিলেন।
– আপনার স্ত্রী চলে যাবার পর তার দেখাশোনা কে করেন?
– আমার মা।
– তিনি মানুষটা কেমন? আপনি তো তার ছেলে আপনি ভালোভাবেই মা সম্পর্কে বলতে পারবেন।
– মা তেমন পছন্দ করতেন না। স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্কও তেমন ভালো ছিলোনা।
– আপনার মা কি কুসংস্কার মনা? বা ভূত প্রেতাত্মার গল্প বলতে পটু?
– আগের যুগের মানুষ। কুসংস্কার তাদের রক্তে মিশে গেছে। সেসব গল্প ছাড়া ও যুগের মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়।
– আপনার মেয়েকে সে কেমন জানে? আপনি আর বিয়ে করেননি?
– খুব একটা ভালো জানেনা। ছোটো বেলায় আমার জন্য ফারিয়াকে পালছে। জোর করে মা ভূইতা গ্রামের এক মেয়েকে বিয়ে করান। তারপর থেকে সেই ফারিয়াকে দেখা শোনা করেছে।
– যখন বিয়ে করেন তখন ফারিয়ার বয়স কতো ছিলো?
– ১০ মাস হবে আরকি।
– সৎ মা হিসেবে কেমন?
– ফারিয়া ৯ বছর অব্দি বিশ্বাস করতো এই তার মা।
– তারপর কী হলো?
– আমার মা কথায় কথায় বলে দিলেন, লিমা ওর সৎ মা। তাতে অবশ্য মা মেয়ের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসেনি। দুই একদিন লিমা আর ফারিয়া বেশ কান্নাকাটি করছে এই আরকি।
– জন্মের পর ফারিয়ার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখেছেন? যেমন ধরুন কথা বলা শুরু করাটা একটু দেরিতে। হাঁটতে শেখা দেরিতে এসব কিছু?
– না।
– স্বপ্নটা দেখা শুরু করেছে আনুমানিক কবে থেকে?
– ৫ বছর আগে হঠাৎ ভোর বেলা চিৎকার করে উঠে কাঁদতে শুরু করে।
– ফারিয়া তো বললো ৫-৬ বছর?
– কেনো বলেছে জানিনা। হয়তোবা ৬ বছর আগে থেকেও দেখতে পারে।
– ও চঞ্চল চড়ুই স্বভাবের নাকি চুপচাপ?
– আগে ছিলো চঞ্চল স্বভাবের। আর এখন শুধু দিন রাত তার ঘরে লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকে। ঘুম যখন আটকে রাখতে না পারে তখন ঘুমায়।
– আচ্ছা আজকে এই পর্যন্ত থাকুক। আপনার মোবাইল নাম্বার টা দিয়ে যান কোনো প্রশ্নের উত্তর জানার প্রয়োজন হলে জানাবো। আর ফী টা?
রশীদ আলম চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে পকেটের আধা ছেঁড়া মানিব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার চকচকে নোট টা আফতাব হোসেনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
– একটু তাড়াতাড়ি করবেন। মেয়েটা বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে!
– দেখুন আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো।
ফারিয়ার পানির পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিল অব্দি যাওয়ার শক্তি তার নেই। ১ ঘণ্টা আগে বমি করে তার ঘরের ফ্লোরের কিছু অংশ নষ্ট করেছে। লিমা ফ্লোর পরিষ্কার করে, লিমাকে গোসল করিয়ে রান্নার কাজে মন দিয়েছে।
মা এখন ব্যস্ত, পানি কে দিবে? দাদীকে তার ঘরের আশপাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার কাছে পানি খেতে চাওয়া মানে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া।
আজকে ৩ বার বমি করেছে দিন রাত্র মিলিয়ে। কিন্তু তার মা একটুও বিরক্ত হয়নি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। দাদী অবশ্য স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি।তার বিষয়ে ভালো জিনিসগুলোও তার দাদী স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেন না। সবকিছুতে দোষ তিনি খুঁজে বের করবেনই। আর কথায় কথায় মাকে খুঁচিয়ে বলবেন
– সতীনের মেয়েকে কেউ এতো প্রশ্রয় দেয় নাকি? বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াচ্ছো আর আলসের কুমড়ো বানাচ্ছো।
তখন ফারিয়ার খুব কষ্ট হয়। সে যদি সুস্থ হতো অন্যদের মতো তাহলে সেও মাকে একা কাজ করতে দিতো না। মা কতো রাতে ঘুমুতে যায়।
লিমা দুকাপ চা নিয়ে ফারিয়ার ঘরে ঢুকলেন।
ফারিয়া উঠে বসলো। লিমা এক কাপ চা ফারিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন
– চায়ের সাথে বিস্কুট খাবি? তোর বাবা আজকে দুপুরে ক্রিম বিস্কুট এনেছেন। খাবি?
– হা, মা আনো। ফাহাদ কী করে মা?
– ওকে স্কুলের হোম ওয়ার্ক করতে দিয়েছি। ডেকে আনবো?
– না, আজকে ওর সাড়াশব্দ তেমন পেলাম না তো।
– পড়াশোনার চাপ বেড়েছে তো……
লিমা বিস্কুট আনতে তার শোবার ঘরে গেলেন। মিথ্যা বলতে বেশি পটু না লিমা। শাশুড়ী আম্মা ফাহাদকে ফারিয়ার সাথে মিশতে দিতে চান না। ওর সাথে মিশলে একই রোগ ধরবে। কীসব বাজে কথা!
মনের রোগ আবার ছোঁয়াচে হয় নাকি?
তবে মন খারাপ ছোঁয়াচে। ফারিয়ার বাবার, ফারিয়ার, ফাহাদের মন খারাপ হলে তারও হয়। কিন্তু ফাহাদের দাদীর মন খারাপ হলে মনে মনে তিনি শান্তি পান। খুব জ্বালানী টাইপের মানুষ, খুবই!
রশীদ আলম চলে যাবার পর রেহানা বেগম স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন
– ওনার মেয়ের সমস্যা তাই না?
– হ্যাঁ।
– ওনার প্রথম স্ত্রী মনে হয় ভালো না। তা না হলে বাচ্চা রেখে যায় নাকি।
আফতাব হোসেন ঠান্ডা স্বরে বললেন
– কোনো মানুষকে একজনের বর্ণনায় বা বিচারে বিচার করা উচিৎ না। একজন নারী যখন তার সংসার ছেড়ে পালায় তখন তার পিছনে অনেক কারণ জড়িত থাকে। আর সেখানে সন্তান রেখে পালিয়েছে! বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? আর মনে করো আমি, এই আমাকে অনেকেই পাগল বলে। কিন্তু তুমি কি তাই বলো?
রেহানা বেগম বললেন
– মাথা খারাপ!
– অনেকে আমাকে ছ্যাচড়াও বলে। তাই বলে কি আমি তাই? হয়তোবা তার সাথে এমন কিছু করেছি যার কারণে সে আমাকে ছ্যাচড়া বলে। তাই বলে তো আমি সবার সাথে করিনি। এক পক্ষের কথা শুনে কোনো মানুষকে বিচার করবে না। মনে থাকবে?
রেহানা বেগম প্রশ্নের উত্তরটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললেন
– ওনাকে রাতে খেয়ে যেতে বলতা?
– নাস্তাই তো দিতে চাওনি। হাজারটা অভাবের কথা বলে কান ঝালাপালা করে দিলা। আবার বলছো রাতে খেয়ে যাওয়ার কথা? তাহলে তো আমার কান বয়ড়া হয়ে যাবে!
আহা! নারী, তুমি জাতটাই বড় অদ্ভুত! তোমায় বোঝার ক্ষমতা কোনো নরের নেই, সত্যি নেই।
আফতাব সাহেব বসার ঘরে পাটিতে আসন পেতে বসে আছেন। বসার ঘরে সোফার সেট থাকা সত্ত্বেও তিনি পাটিতে আসন পেতে বসতেই পছন্দ করেন। ছোটো বেলায় তার বাবা পাটিতে তিন ভাইবোন কে আসন পেতে বসে পড়াতেন।
তার বাবার তিন জনের জন্য পড়ার টেবিল চেয়ার কেনার সামর্থ্য ছিলো না।
আফতাব হোসেন বসার রুমের দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন ৭ টা বেজে ১০ মিনিট। লোকটার ৭ টায় চলে আসার কথা কিন্তু আসছে না। বাড়ির ঠিকানা কি ভুল দিয়েছেন? তার যতটুকু মনে পড়ে বাড়ির ঠিকানা ঠিক লিখেছিলেন। তাহলে? এটা তো ঢাকা শহর না যে কোনো বাড়ি খুঁজে বের করতে ঘাম ছুটে যাবে। ফরিদপুর একটি মফস্বল, এখানে কোনো বাড়ি খুঁজে বের করা কঠিন বিষয় না।
তবে কি লোকটা অসুস্থ নাকি মেয়েটা অসুস্থ?
তার বাসায় আসতে বলাতে হয়তোবা লোকটার কাছে খারাপ লেগেছে। ফী টা নেয়া উচিৎ ছিলো।
আফতাব হোসেন নিজের উপরই বিরক্ত হলেন। আজকে তার দিনটাই বিরক্তিকর। শুধু এর উপর ওর উপর বিরক্ত হচ্ছেন। তার বন্ধু দিনু ঠিকই বলেছিলো।
– শোন আফতাব খবরদার তুই মনোবিজ্ঞান নিস না।
আফতাব অবাক হয়ে বলেছিলেন
– কেনো রে?
– তুই এমনিতেই পাগল আরো পাগল হয়ে যাবি।
কথাটা বলে দিনু উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করেছিলেন। দীনু ছেলেটা এমনিতেই হাসে। কারণে অকারণে হাসে তার হাসির কোনো কারণ লাগে না তার হাসতে। আর যদি কারণ পেয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। দীনু টার সাথে অনেক দিন কথা হয়না। যোগাযোগ কেন যেন বন্ধ হয়ে গেলো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ৭ টা বেজে ১৫ মিনিট। এতোক্ষণে মাত্র ৫ মিনিট পার হয়েছে? আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র কাজ করছে। সময় বিষয়ক একটা সূত্র। সূত্রটা যেন কী?
অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বাসা – মা কথাটা ঠিকই বলতেন।
কোনো একটা কিছু করা দরকার। আফতাব হোসেন তার স্ত্রীকে ডেকে বললেন
– রেহানা আমার নতুন খাতাটা নিয়ে আসো তো।
রেহানা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন
– কীভাবে বুঝবো কোনটা নতুন খাতা?
– আমার বিছানার উপর ইংরেজিতে ইউনিভার্সিটি লিখা একটা চকচকে ২৫০ পৃষ্ঠার নীল রঙের খাতা আছে। সাথে একটা পেন্সিল ও রাবার রাখা আছে। বুঝেছো রেহানা?
রেহানা বেগম কিছু না বলে শোবার ঘরে গিয়ে বিছানার উপর খাতা পেলেন সবই ঠিকঠাক কিন্তু রঙটা মিলেনি। খাতাটার রঙ লাল।
ছেলে দুটো এখনো পড়তে বসেনি। লুডু খেলছে। এই দাইন শেষ করে মা আমরা দুজনেই পড়তে বসবো। কিন্তু তাদের দাইন আর শেষ হচ্ছে না।
– আসলে আমার অভ্যাস এভাবে বসার। চেম্বারে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে চেয়ারে বসে থাকতে হয়। আপনি কিছু মনে করবেন না।
ফারিয়ার বাবা বললেন
– আপনার সাথে বসলে কি রাগ করবেন?
– তা করবো না কিন্তু আপনি নিচে বসতে পারেন না। আপনি আমার অতিথি। হিন্দুরা অতিথি কে বলে লক্ষী আর নিজেদেরকে বলে প্যাঁচা! আর ইসলাম ধর্মে আল্লাহ তায়া’লা খুব খুশি হলে কোনো লোকের উপর তখন তাদের বাসায় অতিথি পাঠায়! আল্লাহ আমার উপর আজ অনেক খুশি।
– আমার একটু তাড়া আছে। মানে মেয়েটা……
আফতাব হোসেন লাল রঙের খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে ফারিয়া নাম টা লিখলেন।
– আপনার নাম?
ফারিয়ার বাবা প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
– রশীদ আলম।
– বয়স ৩৬
– বিয়ে করেছেন কতো বছর আগে?
– প্রায় ১৫ বছর।
– মাত্র ২১ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন? আর ওই সময় বেকার ছিলেন?
– না বাবার মুদির দোকানে বাবার সাথেই থাকতাম।
– এখন কী করেন? পড়াশোনা মনে হয় তেমন করেননি?
– এখন ওই মুদির দোকানেই আছি। পড়াশোনা হয়নি।
– ফারিয়ার বয়স কতো?
– ১১ বছর।
– ওর জন্মের আগে বা সময় বা পরে ওর মায়ের কোনোরকম শারীরিক বা মানসিক সমস্যা হয়েছিল?
– বাচ্চা পেটে আসলে তো সব মেয়েরই শারীরিক সমস্যা হয়।
– না না সেরকম কিছু বুঝায়নি। ধরুন স্বাভাবিক সমস্যা গুলো বাদে অস্বাভাবিক কিছু?
– না।
আফতাব হোসেন খেয়াল করলেন রশীদ আলমের অস্বস্তি বোধ টা বেড়ে গেছে। কোনো প্রশ্নের উত্তরই তিনি সহজ ভাবে দিচ্ছেন না। কিছু প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যা বলছেন।
আফতাব হোসেন গম্ভীরস্বরে বললেন
– দেখুন মানসিক রোগ গুলোর সমাধানের ক্ষেত্রে আমাদেরকে রোগীর পরিবার, কাছের লোক, আশেপাশের পরিবেশ, অতীতের ঘটনা সহ অনেক কিছুই জানতে হয়। তাছাড়া আমরা সঠিক সমাধান দিতে ব্যর্থ হই। আর আপনার মেয়ের অবস্থা খুব বেশি খারাপ। সে একটা স্বপ্ন আজ ৬ বছর যাবত দেখে যাচ্ছে। একই নিয়মে, একই স্বপ্ন।স্বপ্নটা তার বাস্তব জীবনেও প্রভাব ফেলেছে। এই বয়সে তার স্কুলে যাবার কথা কিন্তু সে যেতে পারছেনা। বুঝতে পারছেন কি বলেছি?
রশীদ আলম মাথা নিচু করে বললেন
– অল্পবয়সে প্রেম করে ধনীর দুলালীকে বিয়ে করেছিলাম। খুব ভালোবাসতাম সেও বাসতো। বিয়ের ৪ বছরে মেয়েটা জন্ম নেবার পর আমাদের সংসারে বেশ টানাটানি চলে আসে। বাবা অনেক দেনা ছিলেন। দেনা মেটানোর জন্য দোকান টা বিক্রি করে দিলেন। পুরো বেকার কিন্তু মাথার উপর ৫ জনের সংসার। বাচ্চা হওয়ার পর মেয়েদের অনেক যত্ন দরকার হয় কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি। ফারিয়ার বয়স যখন ১ মাস তখন ওর মা চলে যায়। ফারিয়ার ছোট্ট বালিশের নিচে চিঠি লিখে রেখে চলে গিয়েছিল।
রশীদ আলম আর কিছুই বলতে পারলেন না।
আফতাব হোসেন জিজ্ঞেস করলেন
– কী লিখা ছিলো চিঠিতে?
– রশীদ,
আমি চলে যাচ্ছি। ফারিয়াকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। বাবা আমাকে গ্রহণ করলেও ফারিয়াকে করবে না। আমাকে ফেরানোর চেষ্টা করবেনা। তুমি আমাকে পারলে ক্ষমা করো!
– আপনি তাকে আনতে যাননি?
– গিয়েছিলাম। দারোয়ান আমাকে গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেয়নি। কয়েকবার ফারিয়ার মা বারান্দায় এসে আমাকে দেখে গিয়েছে কিন্তু……
রশীদ আলম নীরবে কাঁদতে লাগলেন মাথা নিচু করে। জীবন টা শুধুই বিষাক্ত স্মৃতি তে পরিপূর্ণ তার।
আফতাব হোসেন রাস্তায় হাঁটছিলেন। ফোন বেজে উঠাতে বিরক্ত হলেন। আজকে তাকে বিরক্তিতে ধরেছে। সবকিছুতেই বিরক্ত হচ্ছেন। তার স্ত্রী রেহানা ফোন করেছেন। রিসিভ করার ইচ্ছা না থাকলেও করতে হবে। সকালে বেশ হালকা ধরনের কথা কাটাকাটি হয়েছে দুজনের মধ্যে। ঠিক ২ টা বেজে ১০ মিনিটে বাসায় পৌঁছে যান আফতাব হোসেন। কিন্তু আজ ২ টা বেজে ৫৫ মিনিট কিন্তু বাসায় আসেননি। রেহানা বেগম সকালের কথা কাটাকাটিকে মনে রেখেই ৪৫ মিনিটে কোনো কল করেননি কিন্তু ৪৫ মিনিটের মাথায় তার ধৈর্য্যচ্যুত হলো এবং স্বামীকে ফোন করলেন।
আফতাব সাহেব ফোন রিসিভ করে বললেন
– কিছু বলবে?
– এখনো বাসায় আসছো না ক্যানো?
– এইতো আসছি।
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিয়ে রিক্সায় চড়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। তার মনে পড়তে লাগলো প্রায় ১৫ বছর আগে এই রেহানাকে নিয়েই নিতে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। দুই পরিবারের কেউই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। অবশ্য পালিয়ে যাওয়ার দুদিন পরেই আফতাব সাহেব বাসায় স্ত্রীসহ ফিরে আসেন।
তার বাবার খুব রাগ করার কথা ছিলো কিন্তু বাসার সবাইকে চমকে দিয়ে সে শান্তস্বরে ছেলেকে বলেছিলেন
– যেহেতু এই মেয়ের জন্য বাড়ি ছেড়েছিলে সেহেতু এই মেয়েকে কখনো কাঁদাবা না। মনে থাকবে কথা?
– হ্যাঁ।
কথাটা সে আজও ভুলেনি কিন্তু কথাটা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারেননি। সে প্রায়শই বুঝে না বুঝে স্ত্রীকে কাঁদান খুব ভালোভাবেই কাঁদান। কারণ তিনি জানেন তার স্ত্রীর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
মেয়েরা বিয়ের আগে থাকে মায়াবতী আর বিয়ের পরে হয় রাষ্ট্রপতি। বিয়ের পরে তারা সংসারের সকল ভাড় কাঁধে তুলে নিবে। রাষ্ট্রপতি শাসিত দেশে যেমন সকল ভাড় রাষ্ট্রপতির ঘাড়ে ঠিক তেমনভাবে স্ত্রীর ঘাড়েও থাকে।
ফারিয়া তার ছোটো ঘরটাতে চুপচাপ বসে আছে। নাকের কাছে সেই গন্ধটা এখনো আছে। বমি আসছে পেট গুলিয়ে কিন্তু বমি হচ্ছেনা। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। ব্যথাটা বাড়ছেনা। দুপুরে এখনো খাওয়া হয়নি। বাবা আসবে তাই তার খাওয়া হবে। বাবা হাসি হাসি মুখে বলবে
– মামনী হা করো তো….
সেও হাসার ভান করে লোকমা টা মুখে পুড়ে নিবে।
তবে আজব ব্যাপার হচ্ছে ওই ডাক্তার টাও তাকে মামনী বলে ডেকেছে। এই পৃথিবীতে মোট দুজন মানুষ পেলো ফারিয়া যারা তাকে মামনী বলে ডেকেছে। তার কাছে একটা ডায়েরি আছে। বাবা কিনে দিয়েছিলেন তাকে। সেই ডায়েরিতে তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা লিখে রাখে। শরীর যখন একটু ভালো লাগে তখন ডায়েরি লিখতে বসে ফারিয়া। কষ্ট গুলোকে সে এখন আর ডায়েরির পাতায় লিখে রাখেনা। কারণ তার বাবা।
তার বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে তার ডায়েরি পড়ে। কষ্টের কথা গুলো পড়ে সে বাচ্চাদের মতো কেঁদে চোখ ভেজায়। অশ্রুপাতের এই বিষয় টা তার ঠিক পছন্দ না।
তার বয়সী ছেলে মেয়েদের সে নকুলের মাঠে খেলতে দেখে। তারও খুব ইচ্ছা জাগে ওদের সাথে খেলতে কিন্তু সে পারেনা। ওর ভয় হয় যদি একই সমস্যা ওদের মাঝেও ঢুকে যায়? তখন কী হবে?
পেটের মধ্যে থেকে গুলিয়ে কী যেন একটা বিশ্রী জিনিস তার বমির সাথে বের হয়ে আসলো! একটা আস্ত মাকড়সা যার পুরো শরীরে অতি সুক্ষ্ম সাদা রঙের রেখা আঁকা বাঁকা হয়ে গেছে।
আফতাব হোসেন বাসায় পৌঁছে গোসল সেরে নিলেন। রেহানা বেগম স্বামীর জন্য খাবার বেড়ে টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে ছিলেন।
আফতাব হোসেন খুব গম্ভীর মুখে চেয়ারে বসে খেতে শুরু করলেন। রেহানা বেগম যে সামনে বসে আছেন সেটা সে বুঝতে পারছেন না।
রেহানা বেগম বললেন
– এখনো রেগে আছো? আচ্ছা স্যরি আফতাব।
আফতাব হোসেন বললেন
– তুমি তো খাওনি। আসো একসাথে খেয়ে নেই। আর ওই প্রসঙ্গে আর একটাও কথা বলবেনা। যা যাবার সকালেই চলে গেছে ওটাকে টেনে এনে বিরক্ত করার কিছুই নেই।
আর আজকে আমার সেই স্পেশাল সালাদ কই?
রেহানা বেগম মাথা নিচু করে বললেন
– তোমার উপর রাগ করে আজকে ওটা করিনি।
– পারোই তো ওই এক কাজ। সালাদ করা বন্ধ করে দাও। তোমাকে ৫ মিনিট দিলাম। এর মধ্যেই সালাদ করে নিয়ে আসবা।
– একটা কথা বলি রাগ করবেনা তো?
আফতাব হোসেন বললেন
– বলো
– ডালে অনেক ঝাল দিয়েছি। খেয়ো না তোমার আবার পেট জ্বালা করবে।
– যাও সালাদ করে আনো।
সন্ধ্যার দিকে একজন মানুষ বাসায় আসবে। তার জন্য ভালো কোনো নাস্তা রাখা দরকার। যদিও তার ছেলেদের জন্য খাবার থাকে। তারপরও একজন মেহমান তাকে ভালো কিছু না দিলেই নয়। আর তার কাছ থেকে ফী টা নিতেই হবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ গুলোর আত্মসম্মান বোধ তীব্র থাকে। এদেরকে আর যাইহোক আত্মসম্মানে আঘাত করা ঠিক না। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন তার বাবা।
আফতাব হোসেন তার চেম্বারে বসে বৃষ্টি দেখছিলেন। বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য তিনি জানালার গ্লাস সরিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু পানির ছিটা এসে দরকারী কাগজপত্র গুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। তাই তাড়াতাড়ি করে আবার গ্লাস লাগিয়ে দিয়েছেন। কী সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে! ঝুম বৃষ্টি যাকে বলে।
এখন দুপুর ২ টা বেজে ১০ মিনিট। তার রোগী দেখা প্রায় শেষ। লাস্ট একজন রোগী আছে। বাইরে বসে ছিলো তার সিরিয়াল আসার আগেই মেয়েটা বমি করতে শুরু করলো। এখন নাকি ওয়াশরুমে আছে। পিএ ইউনুস তো তাকে এরকমই একটা ঘটনা শোনালো। অল্পবয়সী একটা মেয়ে নাকি। খুব মায়া হলো তার। তাই সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও সে রোগীর অপেক্ষায় আছেন। এমনিতে ২ টা বাজার সাথে সাথেই চেম্বার ছেড়ে বাসার উদ্দেশ্যে বের হন।
ইশ বৃষ্টির শব্দ টা যদি শোনা যেত। এককালে তাদের টিনের দোচালা ঘর ছিলো। বৃষ্টির শব্দ তখন বিরক্ত লাগতো আর এখন তার উল্টো! হিউম্যান ক্যারেক্টার যে কতোটা অদ্ভুত বলে বোঝানো যাবেনা।
দরজায় পরাপর তিনটা টোকা পড়ার পর ইউনুস দরজা খুলে বললেন
– স্যার রোগীকে আসতে বলবো?
– আসতে বলো।
আফতাব হোসেন ভাবছিলেন অল্পবয়সী মেয়েরা আজকাল পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি যে তার কাছে আসছে? এই মফস্বলে সাইক্রিয়াট্রিস্ট দের বলা হয় পাগলের ডাক্তার। সেখানে পাগল ছাড়া আসার সম্ভাবনা খুব কম।
দরজা দিয়ে যে মেয়েটি প্রবেশ করলো তাকে দেখে অবাক হলেন আফতাব হোসেন। একেবারেই অল্পবয়সী বয়স ১১-১২ বছর হবে। মেয়েটি খুব ফরশা তা না উজ্জ্বল শ্যামলা হবে কিন্তু ফ্যাকাসে গায়ের রঙটা। মেয়েটা হেলেদুলে হাঁটছে, মনে হচ্ছে এখনি পড়ে যাবে। সাথে ৩০-৩৫ বছরের একজন পুরুষ। দুজনের ব্যবহারে মনে হচ্ছে সম্পর্কটা বাবা – মেয়ে।
আফতাব হোসেন ধীর কণ্ঠে বললেন
– বসুন।
মেয়েটা বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। স্বাভাবিক পাগলের ডাক্তারের কাছে কেউই আসতে চায়না।
মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন
– তোমার নাম মামনী?
মেয়েটা তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো।
– তোমার নাম বলো মা। তোমার যতো সমস্যা আছে সব বলো মা।
মেয়েটি ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।
ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলতে শুরু করলো। ছাড়া ছাড়া ভাবে।
– আমি একটা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নটাতে আমি নিকশ অন্ধকার এক রাস্তায় হাঁটতে থাকি।
তারপর কিছুটা থামলো।
হোসেন সাহেব খেয়াল করলেন মেয়েটার কপালে মৃদু ঘাম। কিন্তু বেশ ঠান্ডা আবহাওয়া এখন। নিকশ কালো এই ধরনের বিশেষণ এতো অল্পবয়স্ক মেয়ের জানার কথা নেই। যদি সে বড়দের গল্পের বা উপন্যাসের বই না পড়ে থাকে।
মেয়েটি আবার বলতে শুরু করলো
– হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটা সূক্ষ্ম আলোর রেখা দেখতে পারি। যতো কাছে এগোই আলোর রেখা ক্রমশ সূক্ষ্মতর হতে থাকে কিন্তু হঠাৎ করে আলোর রেখা বিস্ফারিত হয়ে যায় এবং একটি পাথর বাহি ট্রাক আমার উপর উলটে এসে পড়ে। আমার পুরো শরীর পিষে যায়। কানে ক্রমাগত পাথরের শব্দ বাজতে থাকে। আমার দেহটা রাস্তার পিচের সাথে একদম মিশে যায়।
এমন অবস্থা হয় যে, বেলচা দিয়ে অবশিষ্টাংশ উঠাতে হয়। আর রক্ত মাংসের গন্ধ নাকে ভুরভুর করে ঢোকে।
মেয়েটা চুপ হয়ে গেলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম
– স্বপ্নটা কি একবার দেখেছো?
– নাহ, সপ্তাহে দুদিন দেখি।
– কবে থেকে দেখছো?
– ৫-৬ বছর যাবত।
– স্বপ্নটা দেখো ঠিক কোন সময়ে? মানে রাতে ঘুমানোর সাথে সাথে নাকি ভোরের দিকে? নাকি মাঝরাতে?
– ভোরের দিকে। স্বপ্নটা দেখেই ঘুম ভেঙে যায় আর ঘুম ভাঙার পরপর পুরো শরীরে ব্যথা থাকে। নাকের কাছে সেই রক্ত মাংসের গন্ধটা!
– বমি হয় খুব?
– হ্যাঁ
– আজকে ভোরে সেই একই স্বপ্ন দেখেছো?
– হ্যাঁ, কিন্তু কীভাবে বুঝলেন?
– খুব সোজা মামনী। তুমি ঠিকঠাক মতো হাঁটতে পারছিলে না। তোমার বাবা না কী হন সে তোমাকে ধরে রেখেছিলেন। আর একটু আগেই তুমি বমি করে এসেছো। আমার পিএ ইউনুস বললো।
– আমার বাবা।
– গন্ধটা কতদিন থাকে?
– স্বপ্ন দেখার তিন দিনের মধ্যেই গন্ধটা থাকেনা একদম। আবার স্বপ্ন দেখি আবার গন্ধটা ফিরে আসে।
– তিনদিন গন্ধটা একইরকম থাকে নাকি পরিবর্তন আসে?
– আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
– পুরো শরীরে ব্যথা হয় নাকি নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গে?
– পুরো শরীরে কিন্তু মাথায় বেশি ব্যথা হয়। প্রথম দিন স্বপ্নের পরে বেশি ব্যথা থাকে।
– আচ্ছা। কোন ক্লাসে পড়ো মামনী?
– পড়াশোনা করিনা।
– তোমার নামটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি। নাম কী তোমার মামনী?
– ফারিয়া।
ফারিয়ার বাবাকে কিছু প্রশ্ন করা দরকার। কী কী প্রশ্ন করতে হবে তারা জানা কিন্তু করতে ইচ্ছে করছেনা। স্বপ্নটা নিয়েই ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে। স্বপ্নটা দেখার পিছনে কারণ অবশ্যই আছে। আর এই কারণ জানতে হলে তাকে ফারিয়ার বাবার সাথে কথা বলাটা জরুরি। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেতেও তার ইচ্ছে নেই।
ফারিয়ার বাবাকে বললেন
– কিছু মনে করবেন না একটা রিকুয়েষ্ট করি?
ফারিয়ার বাবা অপ্রস্তুত ছিলেন এরকম কথা বলতেও পারে ডাক্তার সাহেব। তিনি সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালেন।
– আপনি সন্ধ্যার পরে আমার বাসায় আসুন। আমার এখন খুব বিরক্ত লাগছে।
– আমাকে দরকার?
– জি, আমার বাসার ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। আপনি সন্ধ্যা ৭ টায় পৌঁছে যাবেন। আজ আমার ভালো লাগছেনা।
– আমরা যাবো?
– অবশ্যই, আর ফারিয়াকে একটু দেখে রাখবেন।
ফারিয়ার বাবা মানিব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার পুরাতন নোট বের করে ডাক্তারের হাতে দিতে গেলেন। আফতাব হোসেন বললেন
– আজকে নিবোনা। নিতে ইচ্ছে করছে না। মানে আজকে আমার কিছুই করতে ইচ্ছে করছেনা। বাসায় গিয়ে আমি টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবো।
কথা না বাড়িয়ে ফারিয়ার বাবা কালাম সাহেব চুপচাপ মেয়েকে নিয়ে চেম্বার ছেড়ে বের হয়ে এলেন। মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ তিনি। খুব কষ্টে সংসারের খরচ বাড়িয়ে তিনি এখানে এসেছেন। মেয়েটাকে তিনি খুব ভালোবাসেন। হয়তোবা এই পৃথিবীর সব বাবাই তার মেয়েকে ভালোবাসেন।
মৃদু হেসে ধীরধীরে চোখটাও স্থীর করে বন্ধ করে নিলো,শান্তি লাগছে হঠাৎ রাহুলের এই ভেবেই যে স্নেহাকে আর কখনোই কষ্ট দিবে না সে,শান্তি লাগছে এটাও ভাবতেই যে স্নেহার সাথে করা এই অভিমানই তার জীবনের শেষ অভিমান,
____ এইদিকে, খাবার সামনে থেকে সরিয়ে রেখে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে আছে দাদী,
গীতালি : পুরা দিনটাই তো বিশ্রাম করেননাই দাদী, তাই মনে অয় খারাপ লাগতাছে,ঔষধ খাইয়া শুইয়া পড়েন ভালাই লাগবো!
দাদী : তাই তো বলছি, ঔষধ গুলো দে,খেয়েনি!
গীতালি : নট পাসি্বল দাদী! ঔষধ এর আগে কিছু খাবার তো খাওন লাগবোই, তারপরই ঔষধ পাইবেন!
দাদী : আরে স্নেহা ওসব ওর রাগ উঠলে তখন করতো আরকি, মানে ঐযে আসিফ আর রিদোয়ান, ওদের কারো বাসায়ই থেকে যেতো,
– তবে এখন আর করবে না আমার বিশ্বাস ও চলেই আসবে!
স্নেহা : দাদী! ও আমাকে কল করেছিলো, আমাকে সরি আর আই লাভ..
গীতালি : হুম, কোওননা ভাবী, ভাইয়া আই লাভ ইউ কইছে তাই না? হিহি!
স্নেহা : [ কাদো কন্ঠে ] ও আমাকে বাই না বলে ফোন কখনোই কাটে না দাদী!
– কিক..কিন্তু আজ কথার মাঝেই হুট করে ফোন কেটে দিলো,
দাদী : হতে পারে মোবাইলের চার্জ চলে গিয়েছিলো স্নেহা!
স্নেহা : নাহ! দাদী! ও..ওর মোবাইল যখন আমি দেখছিলাম তখনও অনেক চার্জ ছিলো!
গীতালি : এইডাও হইতে পারে মোবাইল হঠাৎ নষ্ট হইয়া গেছে!
স্নেহা : তা কিভাবে হবে গীতালি, এমনটা হয় নাকি? আ..আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে রাহুলের সাথে,
– দাদী ট্রাষ্ট মি! আমার মন বলছে রাহুল হয়তো কোনো কষ্টে আছে!
দাদী : আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হোও স্নেহা! আমি বুঝছি সব!
– এভাবে টেনশন করলে তো তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে!
স্নেহা : দাদী! আমি ফোন বেক করছিলাম, কিন্তু ও..ওর ফোন হঠাৎ করেই সুইচড অফ আসছে,
দাদী টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে স্নেহার দিক এগিয়ে দিয়ে,পানি পান করতে বললো স্নেহাকে, গলা দিয়ে তো পানি গুলোও নামবে না স্নেহার, তাই খাবেনা বলেই মাথা নাড়ালো স্নেহা,
দাদী : এভাবে ভেংগে পড়লে কি চলবে? তুমি তো জানোই ওর কান্ড গুলো বাচ্চাদের মতোই,
– হয়তো কোনো ফ্রেন্ডসদের সাথে আড্ডায় পড়ে গেছে,
স্নেহা : দাদী! ও আমায় বাই না বলে কখনোই..
দাদী : হ্যাঁ! তা করেছে কেনো আজ? বাই না বলে ফোনো কেনো কাটলো ও? এটার জন্য আজ বিচার হবে ওর!
– আসুক শয়তানটা!
– বিয়ের তিনটা দিন যাচ্ছে মাত্র এরই মধ্যে মেয়েটাকে কাদিয়ে ছাড়ছে,কতো বড় সাহস!
গীতালি : ভাবী আপনি টেনশান কইরেন না, ভাইয়া চইলাই আসবো, আপনি পানি খান আর মাথা ঠান্ডা রাখেন,
দাদী : নাও স্নেহা! চিন্তা করোনা ও চলে আসবে, [ কি আর করার স্নেহার ও দাদীর কথায় মনকে বুঝ রেখে গ্লাসটি এগিয়ে নিয়ে কিছু পানি খেয়ে নিলো ]
দাদী : ও তোমায় অনেক চাই স্নেহা! নিজের চেয়ে ও বেশি চাই!
– জীবনটাকে কষ্টের চাপা থেকে সরিয়ে এনেছে শুধুমাত্র তোমার ভালোবাসা পেয়ে! নিজেকে বদলে নিয়েছে তোমার কারণে,
– শুধু রাগটা উঠলে একটু সামলে থাকতে পারেনা আরকি, এতে মন খারাপ করার কিছু নেই, মাথা ঠান্ডা হলে ঠিকই চলে আসবে,
গীতালি : স্যার তো দুনিয়ার সব কাগজপত্র নিয়াই বইছে কাজ করতো, তাই ডিনার রুমেই পাঠাইয়া দিতে কইছে,
দাদী : এই তিনদিনের জমানো কাজ সব আজই নিয়ে বসে গেছে হয়তো, আচ্ছা ঠিকাছে তুই গিয়ে ডিনার পৌছে দিয়ে আয়!
[ বলেই আবার স্নেহার দিক তাকাতে দেখে চেহেরাটা এখনো কাদো কাদো করে রেখেছে স্নেহা, দাদীর ও টেনশন হচ্ছে রাহুলের জন্য, কিন্তু তাও কি করার সাহস তো দিতেই হবে স্নেহাকে ]
দাদী : স্নেহা! তুমি যাও রুমে গিয়ে বিশ্রাম করো, ভালো লাগবে, আর হ্যাঁ ওকে নিয়ে চিন্তা করোনা ও চলেই আসবে,
[ কিন্তু রাহুলের চিন্তার ধ্যান তো ছুটছিলোই না স্নেহার মাথা থেকে, তাও দাদীর কথার সম্মতি দিয়ে উঠে চলে এলো রুমে, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলের স্ক্রিনের দিক তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে ]
____ এইদিকে গাড়ীতে বসে স্টেয়ারিং এর উপর এখনো মাথা রেখে ভেবে যাচ্ছে রাহুল,
স্নেহা তো তার ভালোবাসা,বেচে থাকার আস্থা, এই স্নেহাই তো সেইসব ভালোবাসা এনে দিয়েছে তার জীবনে, যেইসব ভালোবাসার বঞ্চিত হকদার ছিলো রাহুল, জীবনটা পেড়িয়ে যাচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু এই জীবন উপভোগ করতে শিখিয়েছেই তো তার স্নেহা,
এতোদিন স্নেহাকেই প্রমিস করেছিলো সে, কিন্তু আজ নিজের কাছেই প্রমিস করছে রাহুল, দূঃখ্যকে কাছে ঘেষতে দিবে না আর তার স্নেহার, লড়াই করে যাবে সে সবকিছুর সাথেই,
স্নেহা যদি তবুও ভুল বুঝে, বলবে ভালোবাসি,
স্নেহা যদি অভিমান করে, তাও বলবে ভালোবাসি,
স্নেহা যদি দূরেও ঠেলে দেই তখন ও বলে যাবে ভালোবাসি, ভালোবাসবো, ভালোবেসেই যাবো!
সস্থির একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথাটা গাড়ীর স্টেয়ারিং থেকে তুলে জানালার গ্লাসের দিক তাকালো, গ্লাসটি সম্পূর্ণ ধূসর হয়ে গেছে, এতো তাড়াতাড়ি কুয়াশা জমে যাওয়ার ওতো কথা না, গাড়ী এখনো স্টার্টে রয়ে গেছে, তা খেয়াল করে গিয়ারটা টেনে পেছনে বেক দিতে চাইলো, কিন্তু গাড়ী পেছনে বেক যাচ্ছিলো না, ক্লান্ত অনুভব করে সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়লো আবারো, মনের মধ্যে করে ফেলা ভুলটিই বারবার নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, স্নেহার সাথে যা রাগ দেখানোর দেখিয়েছে তবে প্রমিস ভংগ করে ড্রিংক্সটা না করলে হয়তো গাড়ীটাও আজ সেইফলি চালানো যেতো, ঘাড় থেকে কিছু রক্ত হাতে নিয়ে তাকাতেই কষ্টটা যেনো আরো বেড়ে উঠলো রাহুলের, ভাবছে স্নেহার সাথে রাগ দেখিয়ে চলে আসাতে স্নেহা যতোটুকুইনা যন্ত্রণা ভোগ করছে তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা তো তখনি পাবে মেয়েটা, যখন সে রাহুলকে এই রক্ত মাখানো অবস্থায় দেখবে,
হেল্পার : স্যার আপনে এই অবস্থায় গাড়ী কিভাবে চালাইবেন? আইয়েন আমরা পৌছায়া দেই, আর গাড়ীর অবস্থাডাও ভালো মনে হইতেছে না,
রাহুল : মরতে মরতে বেচে গেলাম, দ্যাট মিনস্ ও নিজের জানের বদলে আমার জান ভিক্ষার প্রে করছে,
– কতটা চাই আমাকে, আর আমি স্টিল ইডিয়ট একটা, ওকে হার্ট করেছি, কাদিয়েছি, [ ড্রাইভার আর হেল্পার দুজনেই হতভম্বের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহুলের দিক, চোখে পানি এসে জমে গেছে রাহুলের ]
রাহুল : হস্পিটাল যেতে হবে না, আ..আমার হস্পিটাল তো ওই, ওর চেহেরার দিক তাকাতেই শান্তির আহবান চলে আসবে, ওর হাতের স্পর্শে সব ক্ষতই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, ইউ নোও দ্যাট? শি ইজ অ্যা ম্যাজিক্যাল লাভ!
[ বলেই পাশ মুরে তাকালো ড্রাইভার আর হেল্পারটির দিক, তাদের চেহেরার অবস্থা দেখে বুঝতে পারলো রাহুল,এরা তার কথায় কিছুই বুঝে উঠেনি, তাই মৃদু হেসেই রাহুল তাদের জিজ্ঞাসা করলো ]
রাহুল : বাসায় বউ আছে?
হেল্পার : [ একটু লজ্জা পেয়ে ] আমার তো বিয়াই হইলো না স্যার বউ কেমনি থাকবো? কিন্তু উ..উনার আছে, [ বলেই আংগুল দিয়ে ড্রাইভার এর দিক ইশারা করে দেখিয়ে দিলো ]
ড্রাইভার : জ্বি সাহেব! আ..আছে!
রাহুল : ঝগড়া করে?
ড্রাইভার : হো সাহেব! মাঝে মাঝে মাল দিয়া বাসায় যাইতে দেরী অয়, তহন অনেক ঝগড়া করে,
রাহুল : তুমিও করো?
ড্রাইভার : করমু না? আমারে কয় এতো দেরী অয় কেন? বিয়া আরেকটা করছোনি যে ঐ ঘরের বউরে ও টাইম দিয়া আইতে অয়! আরো কতো কি সাহেব প্যানপ্যান করতে তাহে খালি, তাই আমিও কয়ডা হুনায়া দেই!
রাহুল : নো স্টুপিড! ও সারাদিন একা থাকে, তোমায় মিস করে বলেই এমন কথাটা বলে, আর এমন কথাগুলো বলার মানে এই না যে তোমার উপর ওর বিশ্বাস নেই,
– এ..এমন ওতো হতে পারে যে ও চাইনা ওর ভালোবাসার অন্য কেউ ও ভাগ নিক!
– সো্! কখনো হার্ট করে আ..আই মিন কষ্ট দিয়ে কথা বলবা না, ওরা তো ওদের সবকিছু ছেড়ে, আমাদের ভালোবাসার ভরসায় হাত রেখে জীবনসংগী হয়ে আসে,
– [ মুচকি হেসে ] সকালে রিদকে এসবই বুঝাচ্ছিলাম জানো? আর এখন আমি নিজেই একই ভুল করে বসে আছি,
– এক্সুলি আমি না একটা বিগেষ্ট স্টুপিড!
– [ কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ] ওকে গাইস্ নাও আই হেভ টু গো! কপালে যদি থাকে, তাহলে নেক্সট টাইম আবারও দেখা হবে!
ড্রাইভার : কিন্তু সাহেব আপনি যাইতে পারবেন এই অবস্থায়?
রাহুল : [ হেসে ] ইয়াহ! এক্সুলি আমার গাড়ী আমার মতোই স্ট্রং! সো্ ডোন্ট ওয়ারি! [ ড্রাইভার আর হেল্পার দুজনই মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো ]
রাহুল : বাই দ্যা ওয়ে! কষ্ট করে আমাকে একটা হেল্প করো!
– আসলে! গাড়ীর ফ্রন্ট টায়ারটা গাছের শেকড়ের সাথে আটকে গেছে, তাই একটু সামনে থেকে যদি ধাক্ষা দাও, আ..আমি পেছনে বেক দিচ্ছি অতোটাও বেশী শক্তি ব্যয় হবে না!
হেল্পার : আরে স্যার! কি কইতাছেন এসব? কিসের কষ্ট, দাড়ান এহনি দিতাছি, [ বলেই ড্রাইভার আর হেল্পার দুজন মিলেই রাহুলের গাড়ীটা সামনে থেকে ধাক্ষা দিলো, এতে রাহুল তার গাড়ী সহজেই পেছনে নিয়ে আসে, দুজনকে,ধন্যবাদ জানিয়ে, বাড়ীর উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো রাহুল ]
___ এইদিকে, রাহুলের রুমের দরজায় কড়া নেড়ে ভেতরে ঢুকলো দাদী, স্নেহাও শব্দ পেয়ে চোখ মুছে বারান্দা থেকে রুমে এগিয়ে এলো,
দাদী : স্নেহা! আমি আমার রুমে যাচ্ছি, তোমাদের দুজনের ডিনার টেবিলে রাখা আছে, রাহুল আসলে একত্রে খেয়ে নিও, আর হ্যাঁ তোমার যদি কিছু লাগে তাহলে গীতালি থেকে চেয়ে নিও!
স্নেহা : জ্বি! দাদী!
দাদী : টেনশন করোনা কিন্তু! এইভাবে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে তাই না? [ মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো স্নেহা, দাদী ও স্নেহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনিও চিন্তিত চেহেরায় নিজের রুমে চলে গেলো ]
কান্না ভেংগে আসছে স্নেহার, নিজেকেই শেষ করে দিতে মন চাইছে, এতোটাও কষ্ট না দিলে পারতো রাহুলকে, গিটারটির দিক চোখ যেতেই আটকে রাখতে পারলো না আর চোখের জল গুলো, ফুফিয়েই কেদে উঠলো, রাহুলকে ছাড়া যে বড্ড একা একা লাগছে নিজেকে, খুব কাছে পেতে মন চাইছে রাহুলকে,
তবে রাহুলের ও কি মন চাইছে না? তার স্নেহাই তো, আর কখনোই করবে না এমন প্রমিস ওতো করেছে, তাও কেনো রাহুল ফিরে আসছে না? ও কি জানেনা ওকে ছাড়া স্নেহার কষ্ট হয়?
চোখ মুছে শালটা গায়ে দিয়ে,ধীরেধীরে রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে এসে পড়লো স্নেহা, মনটাও ছটফট করছে, এই ভেবে যে এখন তো অন্তত চলে আসার কথা রাহুলের,কিন্তু তাও কেনো আসছে না?
মনকে আর মানিয়ে রাখতে পারলো না স্নেহা, তাই এদিকওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে, মেইন ডোর খুলেই বেড়িয়ে গেলো, ধীরো পায়ে গার্ডেনের দিক এগিয়ে এলো, রাহুলের গাড়ীটি নেই দেখে চোখটা ভিজে আসলো আবারো, আশেপাশে চোখ বুলাতেই যেনো হাজারো ভালোবাসার সৃতি উকি দিচ্ছিলো তাদের,
একই ভুল সেইদিনও বুঝে ছিলো স্নেহা, সব বাধা পেড়িয়ে এই গার্ডেনের দিকই রাহুলের বুকে ঝাপটে পড়েছিলো সে, গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে দিতেই মনে পড়ছে এইদিকটা দাড়িয়েই সবার সামনে প্রপোজ করেছিলো রাহুল,
হঠাৎ গাড়ীর হর্ণের শব্দ ভেসে আসলো কানে, তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে দারোয়ান গেইট খুলে দিয়েছে, সাথেসাথেই হাই স্পিডে, ঝঞ্জার হয়ে যাওয়া সাদা রঙের একটি গাড়ী প্রবেশ করলো গেইট দিয়ে, গাড়ীটি গভীর চেনাই মনে হচ্ছিলো স্নেহার, তবে গাড়ীর অবস্থা দেখে হৃদস্পন্দনগুলো যেনো অতি দ্রুতই কাপতে শুরু করে দিলো তার,
স্নেহার সামনে বরাবর কিছুটা দূরত্ব রেখেই গাড়ীটি এসে থামলো, গাড়ীর দরজা খুলেই বেড়িয়ে দাড়ালো রাহুল, স্নেহার দিক তাকাতেই দেখে চোখের জলে ভিজিয়ে চুপসে রেখেছে মুখটা,
মূর্তি হয়েগেছে স্নেহাও, রাহুলের হাল দেখে, হাত-পা সবই কেপে চলছে তার, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধীটাই মনে হচ্ছে আজ,
দাঁড়িয়ে থাকার সব শক্তি হারিয়ে হঠাৎ মাটিতেই লুটিয়ে বসে পড়লো স্নেহা,
গাড়ীর দরজা লাগিয়ে ধীরো পায়ে এগিয়ে এসে, হাটু গেড়ে স্নেহার বরাবরই বসে পড়লো রাহুল ও, নিস্তব্ধ হয়ে আছে দুজনই, দুজনের চোখে দুজনই অপরাধী আজ! কান্না ভেঙে আসছে রাহুলের ও হঠাৎ, স্নেহা অনেক কষ্ট পেয়েছে আজ, তা স্নেহার চোখের দিক তাকিয়েই বুঝতে পারছে রাহুল, পলক ঝুকিয়ে স্নেহার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাদো কন্ঠে বলে উঠলো,
রাহুল : এভাবে চুপ করে থেকোনা স্নেহা! তোমার নিরবতা আমার বুকে আরো ক্ষত করে চলছে, [ চোখ বুজে জল চেপে ফেললো স্নেহা, রক্ত মাখানো রাহুলের চেহেরাটি দেখার সাহস হচ্ছিলো না তার ]
রাহুল : তোমার থেকে দূরে গিয়ে বু..বুঝেছি আজ স্নেহা! তোমাকে কষ্ট দিয়ে বুঝেছি, আ..আমি কতটা খারাপ আসলে, আমি মোটেও ভালো হাজবেন্ড না, বিয়ের দিন তোমায় প্রটেক্ট করতে পারিনি, হাতের যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়েছিলে তুমি, গতকাল রাত তোমায় না বলে চলে গিয়েছিলাম,আর সারারাত কেদেছো তুমি, আর আজ আবারো তোমার উপর রাগ দেখিয়ে চলে গিয়েছি, তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো, কেদেছো, এখনো সেই কষ্টেই কেদে চলছো আমি জানি!
– কিক..কিন্তু স্নেহা! ট্রাষ্ট মি, আমার তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইন্টেনশন থাকেনা, আ..আমি তো তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলাম, আমি তোমাকে শুধু ভালোবাসতে চেয়েছি! কষ্ট গুলো তোমার আড়ালে সরিয়ে নিতে চেয়েছি,
– কিন্তু সবকিছুতেই আমি ব্যর্থ স্নেহা! তো..তোমার এতোটা ভালোবাসা আমি ডিজার্ব করিনা! শাস্তি দাও তুমি আমায় স্নেহা! নাহলে আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না, সত্যি কখনোই পারবো না, [ বলেই কান্নায় ভেংগে পড়লো রাহুল, দু’হাত দিয়ে রাহুলের মুখ তুলে ধরে চোখের জল গুলো মুছে দিলো স্নেহা, চুল সরিয়ে কপালের রক্ত গুলো হাতে ছুতেই, রাহুল খুব কষ্ট পাচ্ছে ভেবেই বুকটা কেপে উঠলো স্নেহার ]
রাহুল : স্নেহা! আ..আমি তোমাকে দেওয়া প্রমিস ভেংগেছি, ড্রিংক্স করে ড্রাইভ করেছি আমি, [ কপাল থেকে কিছু রক্ত হাতে নিয়ে ] এগুলো দেখে মোটেও কেদো না, এসব তো তারই শাস্তি!
রাহুল : এন্ড স্নেহা! তুমি চিন্তা করোনা, নেহাকে আমদের মাঝে আর কখনোই আসতে দেবো না, আ..আমি এক্ষুণিই নেহার নাম্বারটা ব্লক করছি তোমার সামনেই! [ বলেই রাহুল তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ীর দিক এগিয়ে গিয়ে মোবাইল খুজতে লাগলো, স্নেহা ঐদিকটা বসেই রাহুলের কান্ড দেখছে, কিছু সময় পরই রাহুল গাড়ীর দরজা বেধে কাতর দৃষ্টিতে তাকালো স্নেহার দিক ]
রাহুল : এ..এক্সুলি গাড়ী যখন এক্সিডেন্ট হয়েছিলো তখন নিশ্চয়ই মোবাইলটা কো..কোথাও পড়ে গিয়েছে, [ কোনো জবাব দিলো না স্নেহা, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফুফিয়ে কেদে দৌড়ে এসে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো রাহুলকে, রাহুল ও মৃদু হেসে আগলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিলো স্নেহাকে ]
স্নেহা : আই লাভ ইউ রাহুল!
রাহুল : আ..আই লাভ ইউ স্নেহা!
শীতল বাতাসে কুড়িয়ে মুড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেই আছে স্নেহা, সাথে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেদে ও চলছে, সবই ফিরিয়ে পাওয়া সুখের কান্না স্নেহার, সৃতি ভেসে উঠলো রাহুলের চোখেও, ঐদিনও ঠিক স্নেহা এই জায়গাতেই এভাবে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছিলো তাকে, মনে পড়তেই মুচকি হাসলো রাহুল, সাথে চোখটাও ভিজে গেছে, তবে তাও নিজেকে কন্ট্রোল করে দু-হাত দিয়ে স্নেহার চুল গুলো কানে গুজে দিয়ে মুখ-খানি তুলে ধরলো, লালচে স্নেহার চেহারাটা রাহুলের মনটাকে যেনো মাতালই করে দিচ্ছে, দীর্ঘশ্বাস নিয়ে স্নেহার কপালে একটু চুমু দিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া স্নেহার শালটা কুড়িয়ে নিলো,
আবেগময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নেহা, রাহুল স্নেহার গায়ে পেছিয়ে দিলো শালটা,
স্নেহার চোখের অশ্রুর বাধাহীন অবস্থা দেখে মৃদু হেসে রাহুল আবারো স্নেহার চোখের নিচটা দু-হাতে মুছে দিলো,স্নেহাও তার ঝাপসানো চোখ দুটো দিয়ে মিটমিট করে চেয়ে যাচ্ছে রাহুলের দিক,
আর না ভেবে রাহুল স্নেহার হাত ধরে পাশমুড়িয়ে দিয়ে হুট করেই কোলে তুলে নিলো,
গীতালি : রু..রুমেই আছে, আর আপনি আইয়েননা দেইখায় টেনশন করতাছে, আ..আমি ইনফাম কইরা আসি,
রাহুল : শুনো!
গীতালি : হুম?
রাহুল : এক্সিডেন্ট এর কথাটা বলতে হবে না, [ গীতালি ঠিকাছে বলে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো ]
রাহুল ও স্নেহাকে নিয়ে রুমের উদ্দেশ্যে শিরি দিয়ে উঠে গেলো, শিরির ফাষ্ট স্টেপ পেড়ুতেই হঠাৎ স্নেহা নেমে যাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করতে লাগলো,
রাহুল : হোয়াট?
স্নেহা : রাহুল! আপনার বাবা আসছে, দোহাই লাগে প্লিজ নামান!
রাহুল : তো কি হয়েছে? আমার বাবাই তো!
স্নেহা : বা..বাবাই তো মানে? প্লিইজ রাহুল..
বাবা : আরে রাহুল? কি হয়েছে তোর?
রাহুল : নাথিং বাবা! জাষ্ট অ্যা লিটল-মিষ্টেক!
বাবা : লিটল মিষ্টেক হোয়াট ডু ইউ মিন? রাহুল, ব্লিডিং হচ্ছে তোর হেড থেকে,
রাহুল : এক্সুলি গা..গাড়ী কনফ্রন্ট হয়েছিলো, তাই হেড এ হিট বেশি লেগেছে,
বাবা : কেয়ারফুল থাকবি না?
রাহুল : আই ওয়াজ ড্রাংক বাবা! [ বলতেই রাহুলের বাবা আড়চোখে স্নেহার দিক তাকালো, রাহুল ও তার বাবার চাহনি বুঝে মৃদু হাসলো ]
স্নেহা : [ ফিসফিসিয়ে ] লাজলজ্জা কিছু নেই আপনার, একটু আগে তো অনেক ভদ্র সাজছিলেন!
– প্লিজ নামিয়ে দিন,
রাহুল : আরে স্নেহা! বাবার সময় বাবাও এমন অনেক করেছে মা কে নিয়ে [ স্নেহা তাড়াতাড়ি রাহুলের মুখ চেপে ধরে মাথা নুয়ে গুটিয়ে যায় রাহুলের বুকে, রাহুল স্নেহার হাতে কামড় দিতেই স্নেহা হাত সরিয়ে নেই তাড়াতাড়ি ]
স্নেহা : আরে আরেহ! এতো সিরিয়াস কেনো আপনি! ঠি..ঠিকাছে বন্ধ করছি, [ রাহুল মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করিয়ে নিলো, স্নেহা আড়চোখে তাকিয়ে আছে রাহুলের মুখের ফুটন্ত হাসিটির দিক, রাহুল হেটে গিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিলো স্নেহাকে ]
স্নেহা : আপনার হাসিটা অনেক সুন্দর! [ রাহুল মৃদু হেসে ভোর কুচকে তাকালো স্নেহার দিক ]
স্নেহা : স..সত্যি! [ বলেই রাহুলের চাহনীর লজ্জা পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো তাড়াতাড়ি, কিছু বললো না রাহুল ও, ব্লাশিং হয়ে, নিজের ঠোটটি নিজেই দাত দিয়ে কামড়ে ধরে ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে হেসে ড্রেসিং এর দিক চলে গেলো, ডেক্স খুলে কি কি যেনো খুজছিলো, স্নেহাও কনফিউজড হয়ে দূর থেকে তাকিয়ে বলে উঠলো ]
– কি খুজছেন আপনি? এইদিকে বসেন আ..আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি,
রাহুল : চুপ করে বসে থাকো, আমি আসছি,
বলেই কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে ফার্ষ্ট এইড বক্সটা নিয়ে বিছানার দিক এগিয়ে এসে স্নেহার সামনে রাখলো বক্সটা, জ্যাকেটটাও খুলে বিছানায় ছিটকে ফেলে স্নেহার বরাবর বসে পড়লো, কিছু বললো না স্নেহা, গায়ের শালটা খুলে একপাশ রেখে দিলো সেও, তাকিয়ে আছে রাহুল তা দেখে স্নেহাও মৃদু হেসে বক্স থেকে কটন নিয়ে রাহুলের কপালের ব্লাড মুছে মেডিসিন লাগাতে শুরু করলো, আর রাহুল স্নেহার সামনে বারবার চলে আসা চুল গুলো কানে গুজে দিতে ব্যস্ত!
মাথার ব্যান্ডেজ শেষ করে স্নেহা, রাহুলের ঘাড় বেয়ে পড়া রক্ত গুলোও মুছে দিতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলো রাহুল তার চোখ দুটো কুচকে বটে নিলো,
স্নেহা : আপনার ঘাড়ে ও হিট লেগেছে তাই না?
রাহুল : অ..অল্প একটু!
স্নেহা : ব্যথা করছে আপনার?
রাহুল : তোমার ছোয়াকে ব্যথাও ভয় পাই স্নেহা!
স্নেহা : [ কাদো কন্ঠে ] ঢং কম করেন, আমি জানি আপনি ব্যথা পাচ্ছেনকি পাচ্ছেন না,
রাহুল : [ স্নেহার চোখের পানি মুছে দিয়ে ] এই পাগলী কাদছো কেনো? বললাম তো আম ফাইন!
স্নেহা : সব আমার কারণেই হয়েছে, তখন যদি আমি..
রাহুল : শিসসস! স্নেহা ডোন্ট ক্রাই!
চুপ করে গেলো স্নেহা, রাহুল স্নেহার কপালে একটি চুমু দিয়েই, শার্টের বাটন গুলো ছুটিয়ে দিলো স্নেহাকে, স্নেহা ও চোখ মুছে কাদো কাদো চেহেরা নিয়ে রাহুলের বুকের ধারে বেয়ে পড়া ব্লাড গুলো মুছে দিলো, হঠাৎ রাহুল স্নেহার হাত থেকে কটোনটা ছুটিয়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো, অবাক হয়ে তাকালো স্নেহা!
রাহুল : [ ফিসফিসিয়ে ] আজকের রাতটা আমাদের জীবনের সৃতিময় রাত করতে চাই স্নেহা!
স্নেহা কিছু বললো না আহ্লাদিত চোখে তাকিয়ে আছে রাহুলের চোখের দিক, পলক ঝুকিয়ে স্নেহার ঠোটে আলতো একটি চুমু খেয়ে বলে উঠলো,
রাহুল : বলো? দিবা তো?
কোনো জবাব না দিয়ে, স্নেহা ও ধীরেধীরে রাহুলের গলার ধারে মুখ এগিয়ে নিয়ে গভীর একটি চুমু বর্ষণ করলো, চোখ বন্ধ করে মৃদু হাসলো রাহুল! স্নেহার আদর গুলো ও যে এতো মধুময় হয়,তখন নিজেকে নিজের কাছ থেকেই হারিয়ে ফেলতে মন চাই রাহুলের!
স্নেহা সরে আসতেই, রাহুল তার শার্টটা এক্কেবারে খুলে ছুড়ে রাখলো বিছানায়, দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছে স্নেহা, রাহুল ও মুখ এগিয়ে তার নাকের সাথে স্নেহার নাকটা চেপে রাখলো,
চোখ বন্ধ করে রাহুল স্নেহার ঠোট জোড়া নিজের ঠোটের দখলে নিয়ে নিলো, কিছু মুহুর্ত পরেই রাহুল তার হাত দিয়ে স্নেহার কাধ থেকে শাড়ীর আঁচলটাও সরিয়ে নিলো,
লজ্জায় স্নেহা রাহুলের ঘাড়ে হাত দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, স্নেহার কান্ড দেখে রাহুল ও মুচকি হেসে, নিজের ঘাড় থেকে স্নেহার দু-হাত দু-দিক থেকে টেনে নিয়ে বিছানায় চেপে ধরে বলে উঠলো,
রাহুল : জানো স্নেহা!
– নেপুলিয়ান বলেছে, তোমরা আমায় একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো,
– আর আজ রাহুল কি বলছে জানো?
– স্নেহা! তোমার আজকের রাতটা আমার নামে করে দাও, আমি তোমায় একটা কিউট বেবী উপহার দিবো,
চোখ মেলাচ্ছিলো না স্নেহা, হাসতে লাগলো, দীর্ঘশ্বাস নিয়ে লজ্জায় মাথাটা পাশ ফিরিয়ে নিলো তাড়াতাড়ি, রাহুল ও মুচকি হেসে ধীরেধীরে স্নেহার খালি গলাটি তার ঠোটের গভীর চুমুর স্পর্শে ছুয়ে দিতে লাগলো,
সময় ঘনাতে লাগলো, মান-অভিমান সব ভুলে এই রাতটিতেই রাহুল তার স্নেহাকে নিজের করে নিচ্ছিলো,
রাহুল : এতো কিউট করে তাকিয়ে থেকোনা স্নেহা! আমার কিন্তু তোমার এই কিউট এক্সপ্রেশন গুলোতে আনলিমিটেড কিস্ দিতে মন চাই, [ মৃদু হাসলো স্নেহা রাহুলের কথা শুনে ]
রাহুল : এভাবেই হাসবা অলোয়েজ সুট করে তোমার ফেইসে্!
মাথা নাড়ালো স্নেহা, দূর থেকে বাকিরা তাকিয়ে আছে,কেউ কেউ ছবিও তুলছে, মুখে বিস্ময়কর একটি হাসি ঝুলিয়ে লিনিসা ফুফি এগিয়ে এলো রাহুল আর স্নেহার দিক,
রাহুল : আরে ফুফি ও তো ডান্স টিচার তাই সুন্দর ডান্স পারে, উমম আমার ডান্সের ব্যপারে কিছু বলতে পারো, আম হেয়ারিং?
লিনিসা ফুফি : তোর আর নতুন করে কি বলবো!
রাহুল : আরে! নতুন করে কি বলবে মানে, অন্তত মিথ্যা মিথ্যা তারিফ ওতো করে দিতে পারো! [ লিনিসা ফুফি হেসে রাহুলের মাথায় আলতো করে একটি বারি দিলো, হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাক দিলো ফুফিকে ]
লিনিসা ফুফি : হ্যাঁ! তুই এখন থেকে বাদ! [ বলেই ফুফি হেসে স্নেহাকে টেনে নিয়ে চলে গেলো, স্নেহা ও মাথা ঘুরিয়ে রাহুলের বেচারা চেহেরার দিক একবার তাকিয়ে মুচকি একটি হাসি দিলো ]
রাহুল : [ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ] ইয়াহ, রাহুল! তুই তো এখন এমনিতেই বাদ! বিকজ আফটার ম্যারেজ ছেলেদের তো কোনো পাত্তাই থাকে না, ইউ হেভ টু বুঝতে হবে! [ নিজে নিজে কিছুক্ষণ বকবক করতে লাগলো এভাবে, আর না পেরে এদিকওদিক তাকিয়ে আবার ফ্রেন্ডসদের আড্ডায় গিয়ে জয়েন করলো ]
____ আর এইদিকে, প্রোগ্রাম শুরুর সময় ক্যামেরা বন্ধি করা, স্নেহা আর রাহুলের কিছু ভালোবাসার মুহুর্তের ছবি স্লাইড হচ্ছিলো, স্ক্রিন টিভিতে, আর দূর থেকে পপকর্ণ হাতে নিয়ে খেতে খেতে মৃদু হেসে ছবিগুলো তাকিয়ে যাচ্ছে মার্জান, হঠাৎ আসিফ এসে দাড়ালো পাশে,তাতে ও কোনো খবর হলো না মার্জানের, ছবি গুলোর ভেতরেই যেন একদম ঢুকে পড়েছে!
আসিফ : [ গলা ঝেড়ে ] বাহ! কি রোমাঞ্চকর মুহূর্ত! মাঝে মাঝে রাহুল স্নেহাকে দেখে অনেক হিংসে হয়, জানো? [ মার্জান অবাক হয়ে তাকালো ]
আসিফ : [ হেসে ] ওদের বন্ডিংটা অনেক স্ট্রং! খুবই ভাগ্যশালীদের কপালেই এমন ভালোবাসা জুটে! [ কিছু বললো না মার্জান, মৃদু হেসে মুখটা অন্যপাশ ফিরিয়ে নিলো ]
আসিফ : কার কপালে ছিলো এই রাহুল কে জানতো! ঠিকই স্নেহা জিতে নিয়েছে!
মার্জান : এক্সকিউজ মি!
আসিফ : [ মনে মনে ] উমমম! গায়ে লেগেছে! এবার,
মার্জান : আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন, রাহুলের পেছনে অন্যান্য মেয়েরা যেভাবে ভাগদৌড় করে জেতার ট্রাই করেছে,
– স্নেহাও তেমনটাই করেছে? হুম?
আসিফ : নাহ! তা না বাট..
মার্জান : বাট? বাট কি আবার হ্যাঁ? লিসেন্ট রাহুলই স্নেহার কাছে এসেছিলো ওকে? স্নেহা যায়নি! সো্ আদার গার্লসদের সাথে আমার ফ্রেন্ড এর কমপেয়ার করবেন না! হুহ!
আসিফ : ও হ্যালো! তোমার ফ্রেন্ডস্ ফ্রেন্ড আর আমার ফ্রেন্ডস্ কিছুইনা তাই না?
মার্জান : হোয়াটেভার!
আসিফ : আসলে আমি বুঝাতে চাইছিলাম যে রাহুলের পেছনে কিন্তু অনেক মেয়েরাই পাগল! বাট কেউই এন্ট্রি নিতে পারেনি একমাত্র স্নেহা ছাড়া!
– এ..এতো মেয়ে পাগল মানে বুঝোতো ব্যপারটা, যার তার ভাগ্যের দ্বারা পসিবল হয় না কিন্তু এসব,
মার্জান : হিহি! তাহলে তো স্নেহা ডাবল ভাগ্যবতি তাই না? যে ছেলের পেছনে এতো মেয়ে পাগল! আর ঐ ছেলেই স্নেহার পেছনে পাগল! ওয়াও!
আসিফ : [ হেসে ] মানে হারতে চাইবে না কখনো তাই না?
মার্জান : নেভার!
আসিফ : আর যদি আমার কাছ থেকে হারো?
মার্জান : হোহহো! ইম্পসিবল! [ কথাটি বলে আর থামতে পারলো না মার্জান, হুট করে আসিফ মার্জানের গালে একটি চুমু বসিয়ে দিলো, সাথেসাথেই মার্জানও চারশো চল্লিশ ভল্টের একটি শকিং এক্সপ্রেশন নিয়ে মূর্তি হয়ে গেলো ]
আসিফ : [ মার্জানের কানের দিক ফিসফিসিয়ে ] যদি আমাকে হারাতে চাও! তাহলে তোমার থেকে আমায় দুটো দিতে হবে মিস্ এংড়ি বার্ড! [ বলেই মার্জানের হাতের পপকর্ণের প্যাকেট থেকে একটি পপকর্ণ মুখে ঢুকিয়ে হেসে হেসে চলে গেলো, ধীরেধীরে আড়চোখে চারদিক চোখ বুলাতে লাগলো মার্জান ও,কেউ দেখেছে কিনা ও বুঝতে পারছে না,মুখটা বিরক্তিকর করে পপকর্ণের প্যাকেটটা টেবিলে ছুড়ে রেখে সেও সরে গেলো ওপাশ থেকে ]
বিকেল ৪টা থেকেই গেষ্টরা বিদায় নিতে শুরু করে দিয়েছে,৫ টা বাজতে বাজতে প্রোগ্রাম শেষই হয়ে গেছে, গেষ্টরাও সবাই চলে গেছে, সারভেন্টরা পরিস্কার করার কাজে লেগে পড়েছে, রাহুল তার বাকি ফ্রেন্ডসদের বিদায় দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখে নেহাল চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে, ড্রিংক্স খেয়ে গ্লাসটি কপালের উপর কাত করে লাগিয়ে রেখেছে, তা দেখে রাহুল ও মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো,কপালের উপর থেকে গ্লাসটা হাতে নিয়ে নিতেই চোখ খুলে তাকালো নেহাল!
নেহাল : [ কিটকিটিয়ে হেসে ] দেবদাস হয়নি ব্রো! দেখ হাসছি আমি এই দেখ হিহি!
রাহুল : তারমানে পাগল হয়ে গেছিস?
নেহাল : [ নাকফুলিয়ে ] হ্যা পাগল হয়ে গেছি দেখছিস না? [ কাদো কন্ঠে ] ব্রো আর মাত্র দু-ঘন্টা! আর ওর কোনো রেস্পন্সই নেই! গিভ মি সাম আইডিয়া ব্রো! এভাবে চলতে থাকলে আমার তো সুইসাইড করতে হবে!
রাহুল : ওয়াও নেহাল! আমি না সরাসরি কাউকে সুইসাইড করতে দেখিনি! এই উইশটা আমার বাকি আছে ব্রো!
নেহাল : ওও ইয়াহহ! ইডিয়ট! কোথায় আমাকে বাচার আইডিয়া দিবি তা না, তুই তো আমায় মেরে তোর উইশ পূরণ করার ড্রিম দেখছিস! [ হাসতে লাগলো রাহুল নেহালের অবস্থা দেখে ]
নেহাল : [ মুখ গোমড়া করে ] আমার না তোর বিয়েতে আসাই উচিৎ ছিলোনা!
– না আসলে আর ওর সাথেও দেখা হতো না, এন্ড নাও মরার প্লান ও করতে হতো না!
রাহুল : আরে মেয়েদের মতো কথাবার্তা বলছিস কেনো স্টুপিড! ভেতরের জোশটা কোথায়? ফরেন মেয়ে পটাতে তো আমার চেয়ে ওস্তাদ বেশি ছিলি তুই! আর দেশী মেয়ে পটাতে এই অবস্থা?
নেহাল : পটিয়েছিলাম এঞ্জয় করার জন্য! এসব ট্রু লাভ-টাভ হয়নি কখনো!
রাহুল : এটাও কিন্তু ঠিক বলেছিস তুই!
– আরে ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটেগ্রাম, ভার্সেটিতে মেয়েরা পেছনে লাইন লেগে থাকতো আর আমার কোনো রেসপন্সই থাকতো না! বাট যখনিই এই ট্রু লাভের চক্করে পড়েছি বস্ তারপর আমি বুঝলাম,রেসপন্স না পেলে কতোটা পেইন লাগে!
– [ মৃদু হেসে ] কতো ঝামেলা গেছে এই ভালোবাসার উপর! সবশেষে স্নেহা এখন আমার!
___এইদিকে রাহুলের রুমে,শায়লা দাঁড়িয়ে আছে জানালার একপাশে,
মার্জান : ঐ! মন খারাপ? একা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
শায়লা : নাহ! এ..এমনিতেই!
মার্জান : আচ্ছা চল রাহুলের কাজিনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি, ওরা সবাই আজই চলে যাবে! আর নেহালকে ও সরি বলেদিস ঐদিনের রোং বিহেইভিয়ার এর জন্য! বেচারার কোনো দোষ ছিলো না কিন্তু! আমরা তো ওর উপর শুধু শুধুই রাগ দেখিয়েছিলাম!
শায়লা : হুম!
মার্জান : চল! [ বলেই দুজন গিয়ে রাহুলের কাজিনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলো, নিচের হল রুমে আসতেই দেখে রাহুল, আসিফ, রিদোয়ান পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে বসে আছে, আশেপাশে সারভেন্টরা পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত, রাহুল তাদের দেখে হাত নাড়ালো, তাই দুজনই এগিয়ে গেলো ]
রাহুল : শুনো! আমার বউ কোথায়?
মার্জান : উপরেই আছে! আর আপনি বলুন আপনাদের দলের আরেকজন কোথায়?
রাহুল : কে? আসিফ? ঐতো! [ মার্জান আড়চোখে তাকাতেই আসিফ ও হেসে ঠোট উচু করে চুমুর মতো করে দেখালো, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো মার্জান, তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে রাহুলের দিক তাকিয়ে ফেললো, রাহুল ও মুচকি মুচকি হাসছে মার্জান এর রিয়েক্ট দেখে, মজা নিচ্ছিলো আসিফ ও ]
মার্জান : [ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ] আ..আমি নেহালের কথা বলছি!
আলিসা : উফফ! ভাইয়া একটা সেকেন্ড এর জন্যও ভাবীকে দূরে রাখতে চাইনা কি যে ভালোবাসাআআআ.. [ হুট করে রাহুল বারি দিলো আলিসার মাথায়, আলিসা ও হেসে চুপ হয়ে গেলো, ব্লাশিং হতে লাগলো রাহুল ও, স্নেহার দিক তাকাতেই দেখে সেও হাসছে মুচকি মুচকি ]
দাদী : তবে রাহুল! এটাই কিন্তু নিয়ম! রিসিপশানের দিন বউ তার বাপের বাড়ী চলে যাবে! বিয়েটা যেহেতু তাড়াহুড়োতে হয়েছে তাই আমিও স্নেহার বাবাকে বলে দিয়েছি!
– যেভাবেই হোক স্নেহাকে কিন্তু আজ নিয়ে যেতে পারবেন না! [ স্নেহার বাবাও হেসে দিলো দাদীর কথা শুনে ]
রাহুল : ওয়াও দাদী! আমার মনের কথা চুরি করে নিলা! এক্সুলি আমার দাদী বলে কথা! [ হাসতে লাগলো দাদী ও ]
স্নেহার মা : আচ্ছা! স্নেহা আমরা এবার আসি তাহলে! [ স্নেহা মাথা নাড়িয়ে,রাহুলের হাত ছেড়ে তার মায়ের দিক এগুতেই যাবে, তখনি ]
রাহুল : একমিনিট! [ বলেই স্নেহার ছেড়ে দেওয়া হাতটা আবারও শক্ত করে ধরে নিয়ে ]
রাহুল : এক্সুলি তোমাকে বিশ্বাস করলেও এই নটি কোম্পানির দলের উপর মোটেও বিশ্বাস নেই! যদি আবার তোমাকে টেনে নিয়ে চলে যায়! [ বাকিদের সাথে সাথে স্নেহার বাবা-মা ও হেসে দিলো রাহুলের কথা শুনে, স্নেহার ও কি আর করার রাহুলের হাত ধরে রেখেই তার মা কে গিয়ে জড়য়িে ধরলো, আর এইদিকে জারিফা স্নেহাকে টেনে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে, বারবার রাহুলকে ভয় লাগাতে লাগলো ]
রাহুল : তোমাকে তো আমি পড়ে দেখে নেবো! [ বলেই মুচকি হেসে আবার স্নেহার দিক তাকালো, কাদছে স্নেহা, তার মাকে জড়িয়ে ]
রাহুল : [ মাথা ঝুকে আংগুল দিয়ে স্নেহার চোখের পানি মুছে নিয়ে ] আরে স্নেহা! ডোন্ট ক্রাই, বেবী! তুমি চাইলে যেতে পারো আমি তো জাষ্ট…মানে…
জারিফা : জাষ্ট! মানে?
রাহুল : তুমি চুপ করো!
হাসলো স্নেহা রাহুলের কথা শুনে, বাকিরাও হেসে চলছে রাহুলের একেক কান্ডে, অবশেষে স্নেহার বাবা-মা ও স্নেহাকে রাহুলের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে, স্নেহার ফ্রেন্ডসদের সাথে নিয়ে চলে গেলো!
৬টা বাজতে চলছে, সন্ধ্যাটাও ঘনিয়ে আসছে প্রায়! আর এইদিকে, গেষ্ট হাউজের শিরির চৌকাটে বসে আছে, রাহুল,রিদোয়ান এবং আসিফ! আর নেহাল এদিকওদিক হাটাহাটি করছে অস্থিরতা হয়ে!
রাহুল : আরে ইডিয়ট এতো অস্থির হচ্ছিস কেনো?
নেহাল : যদি প্লানটা কাজে না আসে?
রিদোয়ান : [ হেসে ] না আসলে নেই!
নেহাল : নেই মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন?
রাহুল : উফফ! ইডিয়ট, রিলেক্স থাক! প্লান কাজে আসবে! আমি দিচ্ছি গ্যারান্টি!
আসিফ : এবার যাবি?
নেহাল : [ রাহুলের দিক তাকিয়ে ] মম!
রাহুল : আমি করবো হ্যান্ডেল! তুই শুধু যেভাবে করতে বলছি সেভাবেই করে যা!
নেহাল : [ মুখ গোমড়া করে ] ওখে! [ বলেই নেহাল আর আসিফ এক গাড়ীতে উঠে চলে যায়, আর রিদোয়ান রিদোয়ানের গাড়ী করে বেড়িয়ে যায় ]
রাহুল ও তাদের বিদায় দিয়ে এগিয়ে এলো রুমে, দরজা লক করে ড্রেসিং এর দিক তাকাতেই যেনো চোখ ঝলসে গেছে রাহুলের! ডার্ক অলিভ কালারের একটি তাতের শাড়ি পড়ে, টাওয়েল দিয়ে ভেজা চুল গুলো মুছতে লাগলো স্নেহা! তবে রাহুল ও নিজেকে সামলাতে পারলো কই, ধীরেধীরে এগিয়ে গিয়ে স্নেহার পেছনে গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো,
গা শিরশির করে উঠলো স্নেহার, কোমোড়ে রাহুলের হাতের স্পর্শ, চুল মুছা থামিয়ে দিয়ে আয়নার দিক তাকালো স্নেহা, আর রাহুল নেশাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তার দিকই তাকিয়ে আছে, চুলে জমে থাকা বিন্দু জলের একটি ফোটা কুড়িয়ে নিয়ে স্নেহার মুখের উপরই ছিটকে মারলো রাহুল, মুচকি হেসে চোখ কুচকে বন্ধ করে ফেলেছে স্নেহা!
রাহুল : ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কিছু বানাতে পারি আর নাই পারি স্নেহা! তোমার হৃদয়ে পৌছাবার ফ্লাইওভারটা অবশ্যই বানিয়েই ফেলেছি!
স্নেহা : আ..আপনার কাপড় বের করে রেখেছি, ফ্রেশ হয়ে পড়েনিন!
রাহুল : আফসোস ফেব্রুয়ারী ও যদি থার্টি ডেইস্ এর হতো, তাহলে বছরে আরো দু-দিন এক্সট্রা মিলে যেতো তোমার এই নূরানী চেহারাটা দেখার!
স্নেহা : [ রাহুলের গাল টেনে দিয়ে ] এবার রোমান্টিক ডায়লগ ছেড়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়েনিন! আপনার আবার ওদের সি-অফ করতে এয়ারপোর্ট ওতো যেতে হবে তাই না?
রাহুল : ভেজা চুলে তোমাকে কিনা লাগছে স্নেহা!
– আচ্ছা একটা জিনিষ খেয়াল করেছো কখনো, তুমি যখন কথা বলো না? তখন তোমার ঠোট দুটো.. [ বলেই রাহুল তার মুখ স্নেহার কাছাকাছি আনতেই স্নেহা হেসে রাহুলকে ঠেলে সরিয়ে দেই ]
রাহুল : আরে স্নেহা! আমার কথাটা তো শুনো!
স্নেহা : হ্যাঁ শুনতে হবে না আমি জানি আপনার মতলব কি! [ বলেই রাহুলের হাতে টাওয়েলটা ধরিয়ে দিয়ে বাথরুমের দিক যেতে ইশারা করলো, রাহুলের ও কি আর করার, মুখটা গোমড়া করে চলে গেলো, স্নেহাও হেসে ড্রেসিং এর উপর থেকে চিরুনিটা নিতে যাবে তখনিই হঠাৎ ঘাড়ের উপর কারো গরম নিশ্বাস উপভোগ করলো, পাশফিরে তাকাতেই,
রাহুল : [ ফিসফিসিয়ে ] আর কতোক্ষণ ভাগবা স্নেহা! [ বলেই চোখ টিপ মেরে চলে গেলো ওয়াসরুমে,স্নেহা নিশ্চুপ হয়ে কানে চুল গুজে আয়নায় নিজের চেহেরার দিক তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, হঠাৎ ব্লাশিং করা একটি হাসি দিয়ে চিরুনীটা এগিয়ে নিয়ে চুল আচড়াতে শুরু করে দিলো ]
খানিক্ষণ পর রাহুল ফ্রেশ হয়ে বেরুলো ওয়াসরুম থেকে, এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলো রুমের, স্নেহা নেই কোথাও, তারমানে বুঝতে পারলো ফুফিদের কাছেই গেছে! স্নেহার রেখে যাওয়া খাটের উপর থেকে কাপড় গুলো নিয়ে পড়ে নিলো রাহুল,ড্রেসিং এর ধারে এসে পার্ফিউম লাগাচ্ছে ঐটাইমেই স্নেহা ঢুকলো রুমে!
রাহুল : বারবার কোথায় গায়েব হয়ে যাও বলো তো?
স্নেহা : সবাইকে বাই বলতে গিয়েছিলাম! আর সবাই আমাকেই ঠেলেঠুলে রেষ্ট করতে পাঠিয়ে দিয়েছে!
রাহুল : ঠিকই তো করেছে সব এনার্জি এখন শেষ করে দিলে হবে? আমার জন্য ওতো কিছু রাখো!
স্নেহা : ছিঃ রাহুল! আপনি সব কথাকে অলোয়েজ নিগেটিভ সাইড নিয়ে চলে যান কেনো বলেন তো?
রাহুল : [ স্নেহার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে ] নিগেটিভ সাইডে ভালো করে এখনো নিয়ে যেতে দেখেছো কোথায় স্নেহা?
রাহুল : রোমান্টিক মুড বিগড়ে দেওয়ার নোবেলটা তুমিই প্রাপ্তি স্নেহা! [ বলেই খাটের উপর থেকে জ্যাকেটটা এগিয়ে নিয়ে হুটহাট করে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে, জিহবায় কামড় খেয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো স্নেহা ও ]
৮ টা বেজে ৩০ মিনিট, স্নেহা গা হেলিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো বিছানায়, তবে রাহুলের দুষ্টুমির স্বরণে মনটা ছটফট করেই চলছে, আর না পেরে উঠে বসে ফোন দিলো রাহুলের মোবাইলে, কিন্তু মোবাইলটা ড্রেসিং এর উপর থেকেই বেজে উঠলো, দীর্ঘ একটি বিষন্নতার নিশ্বাস ফেলেই মনে মনে ভাবতে লাগলো স্নেহা!
– আবার ও ফেলে গিয়েছে মোবাইলটা! আমাকে কেয়ারলেস্ বলেন একবার নিজের দিকটাও তো দেখুন মিষ্টার তেডি স্মাইল! হুহ!
কি আর করবে ভেবে পাচ্ছিলো না স্নেহা! তাই উঠে ড্রেসিং এর দিক এগিয়ে গেলো, নিজের চেহেরার দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আয়নায়! রাহুলের দুষ্টু-মিষ্টি কান্ডগুলো ভেবে ভেবেই মৃদু হাসছে, হঠাৎ কাজলের পেন্সিলটা উঠিয়ে নিয়ে দু-চোখ ভরে লাগিয়ে নিলো, রাহুলের দেওয়া টিপের পাতাটাও সংগে করে নিয়ে এসেছে স্নেহা! তাই ওখান থেকেই সাদা স্টোনের ছোট্ট একটি টিপ লাগালো কপালে, হালকা গোলাপী রঙের লিপস্টিকটাও মেখে নিলো ঠোটে! মাথার চুলগুলোও চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে সেট করে নিচ্ছে, হঠাৎ ঐসময় রাহুলের ফোনের মেসেজ টোনটা বেজে উঠলো, স্ক্রিনের বাতিটা একবার জ্বলে আবার নিভে গেছে!
নিজ হাতে এগিয়ে নিলো স্নেহা মোবাইলটা, কোনো এক আননোওন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে! তাও আবার এক-দুটো নয় ৬৩টা মেসেজ এসেছে একই নাম্বার থেকে একইদিনে, কৌতুহল জাগলো স্নেহার তাই মেসেজে ক্লিক করেই দিলো!
১ম মেসেজ ওপেন করতেই, লিখা ছিলো,
– হোয়াই আর ইউ ডোন্ট রিপ্লায়িং মি রাহুল!
২য় মেসেজ,
– ঐ চাম্বুস আন্টির সাথেই বসে আছো নিশ্চয় তাই তো আমার সাথে কথা বলছো না!
৩য় মেসেজ,
তোর সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো আমায় এখনো কষ্ট দিচ্ছে রাহুল! তোর কি একটিবার ও মনে পড়ে না এসব? মোবাইলের এলভামের ছবি গুলো শুধু সৃতি করেই সাজিয়ে রেখে দিয়েছি, তোকে মনে পড়তেই শুধু সৃতিটুকু দেখে মনকে শান্তনা প্রদান করি! তোর কি একটিবারও মনে পড়ে না আমায়?
৪র্থ মেসেজ,
– আমি জানি স্নেহাকে অনেক হার্ট করেছি বলে তুই আমার উপর খুবই রেগে আছিস! কিন্তু আমারও কি দোষ বল? আমার ভালোবাসার অধিকারটুকু ওতো আমি পেতে পারি তাই না?
স্নেহা আমাদের সম্পর্কের সবকিছু জেনেও তোকে মেনে নিয়েছে তাই ওর ভালোবাসা ভালোবাসা আর আমার যে ভালোবাসা তোকে বিলিয়ে দিয়ে দিয়েছিলাম তা কিছুই না?
মেসেজ পড়ে,হাত,পা, শরীর সবই কাপছিলো স্নেহার! এর আগে আরও কিছু পড়বে সেই সাহসটুকু হচ্ছে না আর! মোবাইলটা আলতো করেই ড্রেসিং এর উপর রেখে দিলো, না চাইতেও কেনো যেনো অজস্র অশ্রু ঝড়ে যাচ্ছিলো স্নেহার চোখ বেয়ে,
সময় পেড়িয়ে রাত ৯টা বেজে চলছে, স্নেহা ড্রেসিং এর চেয়ারে এখনো ঐবসায় বসে রয়েছে, চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে টইটুম্বুর হয়ে গেছে, নাকের আগায় চোখের পানিগুলো ও এসে জমে রয়েছে,
হঠাৎ দরজা খোলার টুকটাক শব্দ ভেসে এলো,শিসের আওয়াজে স্নেহারও বুঝতে কষ্ট হলো না রাহুলই এসেছে! চোখের পানি মুছে দাড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো স্নেহা! হাসি ঝুলানো রাহুলের চেহেরাটিও মুহুর্তে গোমড়া হয়ে যায় স্নেহার চেহেরা দেখে! তাড়াতাড়ি স্নেহার কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে দুহাতে স্নেহার মুখটা হাতে তুলে ধরলো! পলক ঝুকিয়ে রেখেছে স্নেহা!
রাহুল : কি হয়েছে স্নেহা! কাদছো কেনো?
স্নেহা : [ কাদো কন্ঠে ] নেহাকে আপনার এখনো অনেক মনে পড়ে মাঝে মাঝে তাই না?
রাহুল : হোয়াট? ও..ওকে মনে পড়তে যাবে কেনো আমার?
স্নেহা : তাহলে গ্যালারীতে নেহার সাথে জুড়ানো সৃতি গুলো এখনো সাজিয়ে রেখে দিলেন যে? [ রাহুল আড়চোখে ড্রেসিং এর উপরে পড়ে থাকা তার মোবাইলটার দিক তাকালো ]
স্নেহা : রাহুল! প্রথম ভালোবাসা নাকি কেউই ভুলতে পারে না! ত..তবে আমি তো আপনাকে জোড় করিনি যে আমাকে ভালোবাসতেই হবে!
রাহুল : কি বলছো কি এসব স্নেহা? প্রথম ভালোবাস মানে?
– লিসেন্ট! ভালোবাসা মানে আমি শুধু তোমাকেই চিনি স্নেহা! আমার জীবনে কাউকে ভালো লেগেছে বললে সেটা তুমিই, আর কাউকে প্রথম ভালোবেসেছি বললে সেটাও তুমি!
– [ স্নেহার দুহাত মুঠি করে ধরে ] এন্ড! স্নেহা! আমি লাষ্ট কবে গ্যালারির ছবি চেক করেছি আমি নিজেও জানিনা! হয়তো নেহার সাথে কিছু পিক রয়েগেছে গ্যালারীতে, তবে এটার জন্য তোমার খারাপ লেগে থাকলে আম সরি! [ ফুফিয়ে কেদে চেয়ারে বসে পড়লো স্নেহা ]
রাহুল : [ হাটু গেড়ে বসে ] আরেহ! এভাবে কাদছো কেনো স্নেহা? আ..আমি এক্ষুণি ডিলিট করে দিচ্ছি সব! [ বলেই মোবাইলটা হাতে এগিয়ে নিতেই বলেই উঠলো ]
স্নেহা : রাহুল আমাদের মাঝে এখনো তেমন কিছুই হয়নি! তাই আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবো!
রাহুল : মা..মানে?
– কি মিন করতে চাচ্ছো?
স্নেহা : রাহুল! নেহার আপনাকে দরকার! আমি জানিনা আপনি আমার কাছ থেকে কি লুকাচ্ছেন! তবে আমি নেহার কথায় সব স্পষ্টই বুঝে নিয়েছি!
[ বিষন্ন চোখে তাকিয়ে রইলো রাহুল স্নেহার দিক, কিছু মুহুর্তের জন্য তো রাহুলের বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা কি তারই স্নেহা? নাহ তার স্নেহা তো কখনোই এভাবে বলতে পারবে না তাকে ]
স্নেহা : সরি রাহুল! আমি আপনার পার্মিশন ছাড়াই নেহার মেসেজগুলো সিন করেছি বলে! [ রাহুল তাড়াতাড়ি মোবাইল অন করে মেসেজে ঢুকলো, হ্যাঁ সত্যিই তো নেহার অনেক মেসেজ এসেছে এইখানে, তা দেখে রাহুলের মাথাটাও ঘুরে গেছে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য ]
রাহুল : স্নেহা! এই পর্যন্ত নেহার অনেক নাম্বারই আমি ব্লক করেছি, কিন্তু ও আবারও এসব নতুন নতুন নাম্বার নিয়ে আমাকে টেক্সট করতে থাকে!
– ট্রাষ্ট মি!
স্নেহা : ও..ঐরাতে যা কিছুই হয়েছে রাহুল! একটা মেয়ের পক্ষে এসব ভুলে থাকা অনেক কষ্টকরই হবে! তা..তাই হয়তো নেহাও..
রাহুল : [ চেচিয়ে ] স্টপ ইট স্নেহা!
– সিরিয়াসলি? তোমার মনে এখনো এই সন্দেহ রয়েগেছে?
– সরি! আমি সন্দেহ বলছি! তুমিতো নিসন্দেহে সব কথা বলে ফেলছো!
মাথায় হাত দিয়ে নিজের চুল নিজে মুঠি করে ধরে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রাহুল, দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হাত নামিয়ে আবার দু-হাত কোমোড়ে রাখলো, চোখের পলক নাড়াতে লাগলো এদিকওদিক, পানি এসে জমে যাচ্ছে রাহুলের চোখেও, স্নেহা বুঝতে পেরে রাহুলের হাতটা ধরতেই এক ঝাড়ি দিয়ে রাহুল স্নেহার হাতটা সরিয়ে দরজা খুলে ধাম করে বেধে বেড়িয়ে গেলো, স্নেহা রাহুল বলে চেচিয়ে উঠলো কিন্তু তাও! শুনলো না রাহুল, চলে গেলো,
তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরুলো স্নেহা, রাহুল শিরি দিয়ে নেমে একদম মেইন ডোরের দিকই চলে যাচ্ছে, দৌড়ে আবার রুমে এগিয়ে এসে স্নেহা মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল দিতে লাগলো রাহুলকে কিন্তু রিসিভ করছে না রাহুল! কয়েকবার রিং যেতে না যেতে একদমই বন্ধ করে দিলো রাহুলের ফোনটা,কান্না যেনো এবার স্নেহার আরো ভেংগে এলো, জানালা দিয়ে এগিয়ে গেলে দেখে গেইট দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে রাহুলের গাড়ীটা, মুখে হাত দিয়ে চেপে রেখে ফুফিয়ে কেদে উঠলো স্নেহা ও, মাথায় কিছু আসছিলো না আর, রাহুল এই প্রথমই তার সাথে এভাবে অভিমান করে চলে গিয়েছে, নিশ্চয় আজ অনেক কষ্টই পেয়েছে সে! কলিজাটা যেনো ছিড়ে যাচ্ছে স্নেহার! চিৎকার করে করে কাদতে মন চাইছে, ঘৃণাও আসছে নিজের উপর, মনে মনে ভাবছে,
– রাহুল যা বলছে তাই সত্যি হবে,
– যদি রাহুলের এমন কোনো ইন্টেনশন থাকতো তাহলে তো মোবাইলটা ও ওর সাথেই রাখতো,
– রাহুল আমাকে কতো ট্রাষ্ট করে, আর আমি ওকে ট্রাষ্ট না করে নেহাকেই ট্রাষ্ট করতে চলছি!
– ঐ নেহা তো এমনই আ..আমার রাহুলকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে!
দীর্ঘক্ষণ এভাবে ভেবে ভেবেই কেদে চলছে স্নেহা!
__আর এইদিকে, হাইওয়েতে ফুলস্পিডে গাড়ী চলছে রাহুলের! এক হাতে গাড়ীর স্টেয়ারিং ঘুরাচ্ছে আরেকহাতে বেয়ার এর বোতোল ধরে রেখেছে, কোনো সিগন্যাল লাইট ইউজ করা ছাড়াই বড় বড় গাড়ী ওভারটেইক করে যাচ্ছে রাহুল,কানে স্নেহার কথা গুলোই বাজছে বারবার, চোখ গুলো পানিতে ঝাপসা হতে না হতেই আবার হাতের কবজি দিয়ে মুছে ফেলছে, চারদিক থেকে লাইটিং ফোকাসে্ মাথাটাও ঘুরঘুর করে চলছে এবার, মনকে শুধু এসব প্রশ্নই করছে রাহুল,
– স্নেহার কি কোনো বিশ্বাসই নেই আমার উপর? আমি তো নিজের চাহিদার থেকেও বেশি ভালোবাসি স্নেহাকে, চোখ বন্ধে বিশ্বাস করে নিতে পারবো স্নেহার সবকিছু, তবে স্নেহাই কেনো বা পারবে না? এখনো নেহার ব্যপার নিয়ে মনে সন্দেহ রেখে দিয়েছে,
– তবে তো ঐদিন ভার্সেটিতে আমি সব খুলে বলেই দিয়েছিলাম, যদিও বা মনে এসব সন্দেহ থেকেই থাকতো তাহলে তখনিই কেনো বললো না, আজ এতোটা ভালোবাসার পর এসব কিভাবে মেনে নিবো?
হঠাৎ গাড়ীর পেছনের বেক সাইড সজোড়ে বারি খেলো কিছুর সাথে, তাড়াতাড়ি গাড়ী থামালো রাহুল, পাশ থেকে আরেকটি গাড়ীর ড্রাইভার চেচিয়ে চেচিয়ে কি কি যেনো বলে চলে গেলো, আজ আর সেসব কিছুই মাথায় নিলো না রাহুল, কারণ এই মাথাটা শুধু এখন স্নেহাকেই ভাবছে,
মনটাও খুব খারাপ হয়ে গেছে রাহুলের, গাড়ীটা আবারও স্টার্ট দিয়ে চালাতে লাগলো, আসার সময় স্নেহার হাত ঝাড়ি দিয়ে চলে আসার ব্যপারটা মনে পড়ে পড়ে ভেতরটা জ্বালিয়ে কয়লা করে দিচ্ছে রাহুলের, চোখ থেকেও অজস্র অশ্রু ঝড়ে যাচ্ছে, এইবার আর থামছেই না অশ্রু গুলো, স্নেহাকে যে বড্ড মনে পড়ছে রাহুলের, সে তো এতোক্ষণ রেগে থাকতে পারে না স্নেহার সাথে, তবে আজ কেনই বা দরকার ছিলো স্নেহার উপর এভাবে রাগ করার, হয়তো মেয়েটাও একটু ভুল বুঝে নিয়েছে আরকি, তাতে কি? সব বুঝিয়ে দিলে তো সে আবার বুঝেই যাচ্ছে,
নিজের উপরই বেশি রাগ হচ্ছে এবার রাহুলের, স্নেহাও হয়তো তার এই রাগে এতোক্ষণে কেদে মরছে, এতোটাই খারাপ রাহুল, সে তো প্রমিস করেছিলো স্নেহাকে কখনো কষ্ট দিবে না, দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মোবাইলটা হাতে এগিয়ে নিয়ে অন করে কল দিলো স্নেহার ফোনে, রিং যাচ্ছে!
হঠাৎ, ফোনের ওপাশ থেকে স্নেহার কান্নার ভয়েসে রাহুল! শব্দটা শুনতেই বাচ্চা ছেলের মতো ফুফিয়ে কেদে উঠলো রাহুল ও,
স্নেহা : আম সরি রাহুল! আ..আমার আপনাকে হার্ট করার কোনো ইন্টেনশন ছিলো না, আমি তো নেহার মেসেজ গুলো পড়ে মাথায় গুলিয়ে ফেলেছি,
– আ..আমার আপনার কথায় পুরো বিশ্বাস আছে, আ..আমি আসলে স্টুপিড একটা,
– আপনি যে শাস্তিটাই দিবেন আমি মেনে নেবো,কিন্তু প্লিজ এভাবে রাগ করে থাকবেন না..
রাহুল : শিসসসস!
– স্নেহা!
স্নেহা : হু!
রাহুল : আম সরি!
স্নেহা : [ কাদো সূরে ] আপনি কেনো সরি বলছেন! দোষ তো আমি করেছি ঐনেহার কথা গুলো মাথায় নিয়ে,
– বাট নাও ইউ ট্রাষ্ট মি আমি আর কক্ষনোই আপনাকে ভুল বুঝবো না রাহুল! প্রমিস!
রাহুল : [ মুচকি হেসে ] আই লাভ ইউ!
স্নেহা : আ..আই লাভ ইউ টু রাহুল! [ বলেই ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাদতে লাগলো আরো ]
রাহুল : স্নেহা! প্লিজ ডোন্ট ক্রাই!
স্নেহা : [ ফুফিয়ে ] আ..আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে রাহুল! প্লিজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন! আমি প্রমিস করছি আর কক্ষনোই আপনাকে ভুল বুঝবো না!
রাহুল : [ কাদো কন্ঠে ] ওকে রিলেক্স! আম কামিং
বলতেই হঠাৎ সামনে থেকে চোখের উপর গাড়ীর হলুদ ফ্লাশ লাইট এসে পড়লো, কান থেকে ফোনটা সরিয়ে রাহুল গাড়ীর স্টেয়ারিংটা আর ঘুরাতে পারলো না, সামনের ট্রাকের সাথে মুখোমুখি হয়ে ধুমড়েমুচড়ে গাড়ী দুই ডং খেয়ে আবারো সোজা হয়ে এক কোণে গাছের সাথে লেগে পড়লো, নিরিবিলি হাইওয়ে মানুষজন কেউই নেই, শুধু গাড়ীগোড়াই চলাচল করছিলো,
হেল্পার : মইরা গেছে নাকি কোনো বেরুইনা কেন? চলেন দেহি!
ড্রাইভার : মরতে যাছ? দেহছ না গাড়ীর বনাট খুইল্লা ধুয়া বেরুইতাছে, যে কুনো মুহুর্তেই গাড়ী ফুটবো!
__কিন্তু এই গাড়ীর ভেতর তো এখনো ছটফটাচ্ছে রাহুলের মতো জীবন্ত একটি লাশ, স্টেয়ারিং এ মাথা হেলিয়ে রেখেছে রাহুল, মাথা থেকে ঘাড়ে এসে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে অনবরত রক্ত!
হয়তো আজ এটাই প্রাপ্য ছিলো রাহুলের, স্নেহাকে কষ্ট দিয়ে কাদানোর শাস্তি, নয়তো ঝাড়ি দিয়ে স্নেহার হাত সরিয়ে চলে আসার শাস্তি, আর নয়তো স্নেহার সন্দেহের পেছনে লুকিয়ে থাকা সেই ভালোবাসাটিকে না বুঝার শাস্তি,
স্নেহার ভালোবাসা তো তার জন্য কখনোই মিথ্যে হবে না, এটা শুধু রাহুলের নিজেরই নয় তার ভালোবাসারই বিশ্বাস এবং আস্থা! স্নেহা তাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, এতোটাই ভালোবাসে বলেই তো তাকে সন্দেহ করেছে, যেখানে সন্দেহ নেই সেখানে তো ভালোবাসা ও নেই! হ্যাঁ তবে একটু কষ্ট ও হয়, তবে এসব কষ্টকে আর কষ্ট মনে হচ্ছে না রাহুলের,কারণ স্নেহাই তো বললো,
মুচকি হাসলো রাহুল, স্নেহার সব কথায় যে এতো ভালোবাসা মাখানো আছে এটাও প্রুভ করে দিলো আজ স্নেহা!
মৃদু হেসে ধীরধীরে চোখটাও স্থীর করে বন্ধ করে নিলো,শান্তি লাগছে হঠাৎ রাহুলের এই ভেবেই যে স্নেহাকে আর কখনোই কষ্ট দিবে না সে,শান্তি লাগছে এটাও ভাবতেই যে স্নেহার সাথে করা এই অভিমানই তার জীবনের শেষ অভিমান!
তবে তাও এই রাহুল, ভালোবেসে যাবে স্নেহাকে, মৃত্যুর শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত,