Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 231



আমার তুমি পর্ব-২৬+২৭

0

#আমার_তুমি
#পর্ব_২৬[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ]
#জান্নাত_সুলতানা

“দুই মিনিট এর মধ্যে ছাঁদে এসো”

মেসেজ টা পড়ে সারা আরও একদফা অবাক হলো।
মানে এটা কিভাবে সম্ভব?
এই আইডির কথা একমাত্র মাইশা জানে আর কেউ না কারণ আইডি টা মাইশা নিজে খুলে দিয়েছে।
সেখানে রাহানের এমন কথায় স্পষ্ট যে রাহান সারার আইডি এটা জানে।
তাহলে কি রাহান ভাই জেনে গিয়েছে?
কিন্তু কিভাবে? মাইশা আপু?

“কি হলো আসছো না কেন?”

সারার ভাবনার মাঝেই আবারও টুং করে মেসেজ এর শব্দ হলো।
সারা শোয়া থেকে উঠে বসলো।
মাইশা পাশেই সোফায় বসে আয়ানের সাথে কথা বলছে।
সারা পা টিপে টিপে রুম হতে বেড়িয়ে যেতে নিলেই মাইশা পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে

-“এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস?”

সারা হাল্কা চমকালো।তবে নিজে কে সামলে মনে মনে একটা মিথ্যা সাজিয়ে আমতা আমতা করে জানালো

-“আপু পানি খেতে যাচ্ছি।”

মাইশা পাশে সেন্টার টেবিলে তাকালো সত্যি জগে পানি নেই।

-“তাড়াতাড়ি আসবি যা।”

মাইশার অনুমতি পেয়ে তৎক্ষনাৎ সারা মাথা নাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে রুম হতে বেড়িয়ে এলো।
রুম থেকে বেড়িয়ে লম্বা একটা শ্বাস টানে সারা।ভাগ্য ভালো জগে আজ পানি রাখে নি।
সারা চার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ছাঁদের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরে।
ছাঁদে আসতেই দেখা মিলে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অবয়ব এর।
রেলিং এর উপর এক পা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সারা আলগোছে এগিয়ে এলো।
কেশে রাহানের দৃষ্টি আকর্ষণ এর চেষ্টা করে।
রাহান ফিরলো চাঁদের আবছা আলোয় চকচক করতে থাকা সারার দিকে।
হ্যাঁ চকচকই তো করছে। এই যে রাহান এর নিকট ভীষণ মায়াবী লাগছে।
রাহান এগিয়ে এলো সারা ছোট হাত টা নিজের দানবীয় হাত টার মাঝে মুঠোয় পুরো নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।
চাঁদটার থালার মতো আকার। রাহান চাঁদ টা দিকে তাকিয়ে বলল

-“আমার জীবনেও একটা ব্যক্তিগত চাঁদ আছে।”

সারা’র বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। কে আছে রাহান ভাইয়ের জীবনে?
তবে কি আমি আসার আগে ওনার জীবনে অন্য কেউ এসে পড়েছে?
কথা টা ভাবতেই সারা’র চোখ চিকচিক করে উঠলো।বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো।
বুকে টিপটিপ শব্দ হচ্ছে।
আচ্ছা এটা জানাতেই কি আজ রাহান ভাই তাকে এখানে ডেকেছে?

-“কিছু বলবেন?”

মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে সারা।
অর অকারণেই কেন জানি কান্না পাচ্ছে।রাহান সারা দিকে তাকালো।
সম্পূর্ণ সারা দিকে ফিরে ওর মুখ টা রাহান ওর নিজের দুই হাতের আঁজলে নিলো।
সারা তৎক্ষনাৎ কেঁপে উঠল। চোখে টলমল পানি স্পষ্ট। রাহান সহসা হাসলো। এই মেয়ে নিশ্চয়ই অন্য কিছু ভাবছে।
রাহান সারা’র চোখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে শুধালো

-“আমার চাঁদের চোখে পানি?
একদম শোভনীয় নয়।”

-“মানে?”

সারা ঝটফট রাহান এর হাত গালের উপর থেকে হতে সরানোর চেষ্টা করতে করতে থমথমে কণ্ঠে প্রশ্ন করে।
রাহান ছেড়ে দিলো সারা কে।সারা সামান্য পিছিয়ে গেলো।
রাহান নিজের পরিহিত প্যান্ট এর পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

-“রাত অনেক হয়েছে রুমে যাও।
আরও একটা কথা আমার মনে শুধু দুই জন নারী আছে।
একজন আমার মা দ্বিতীয় জন না হয় নাই বললাম।
তবে এটুকু জেনে রেখে আমরা চোখ সেই নারী ছাড়া অন্য কোনো নারী এই চোখ দেখে না।”

সারা স্তব্ধ। কি বলবে বুঝতে পারছে না। ঠোঁট জোড়া অনবরত কাঁপছে।

-“আর হ্যাঁ কাল রুম থেকে বেশি বেরোবে না।”

-“কেন?”

রাহানের কথা শুনে সারা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে।
রাহান চরম বিরক্ত হলো।
এই মেয়ে সাইজে ছোট হলে কি হবে মনে কৌতুহলে ভরা।শুধু প্রশ্ন করবে পেঁচাবে। বলেছে যখন নিশ্চয়ই কারণ তো আছেই।
তবে বিরক্তি প্রকাশ না করে বলল

-“আগে এটা চেয়ারম্যান বাড়ি ছিল।
বাট এখন এটা এমপি বাড়ি।”

-“তাতে কি হয়েছে?”

সারা আগের মতো আর নার্ভাস না।
কি সুন্দর অবলীলায় প্রশ্ন করেই যাচ্ছে এককের পর এক।
রাহান হাসলো আবারও।বাচ্চা একটা মেয়ে কিন্তু কি সুন্দর নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছে।

-“সেটা না হয় কাল সকালে দেখে নিবে।”

সারা বুঝতে পারে না।
আরও কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই রাহান গম্ভীর কণ্ঠে হুকুম এর স্বরে বলল

-“আমি যেতে বলেছি।”

ব্যাস এটাই যথেষ্ট সারার জন্য। মুখ আধার দেখা মিলে।
এই লোক টা এমন কেন?
একটু ভালো করে কথা বলে না তার সাথে। সব সময় ত্যাড়া কথা বলে।
সারা অভিমান হলো নিজে ডেকে আনলো আর এখন কেমন করছে।
কথা বলবে না লোকটার সাথে।
সারা ছাঁদের দরজা দিকে পা বাড়াতেই রাহান পেছনে থেকে ওর হাত টেনে ধরে।
সারা অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই রাহান মিহি কণ্ঠে বলে উঠলো

-“অভিমান করো না মেয়ে। বুকে তীব্র যন্ত্রণা হবে।
তবে হয়তো সারা রাত ছটফট করতে করতে কেটে যাবে।”

সারা অবুঝ চোখে তাকিয়ে রইলো রাহানের দিকে।
রাহান হাত ছেড়ে দিলো।

দুই পা এগিয়ে এলো।ঠিক সারা’র বরাবর দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে বলল

-“আমার রোজ ঘুমের ঔষধ এর প্রয়োজন হয়।
যখন বাড়িতে থাকি তখন ভীষণ কষ্ট হয়। তাই ভাবছি পুরো ফার্মেসি টা আমার বাসায় নিয়ে যাব।”

সারা এবার হাসলো।
সারা কিছু আন্দাজ করতে পারছে হয়তো।
তাই তো নিজেও রাহানের মতো ফিসফিস করে বলল

-“আপনি ব্যবস্থা করুন ফার্মেসী আপনার বাড়ি যেতে আগ্রহী।”

কথা টা শেষ করে সারা আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না।
চট জলদি পা চালিয়ে নিচে চলে গেলো।
রাহান সে দিকে তাকিয়ে নিজের পাম হাত দ্বারা মাথার পেছনে চুল খামচে ধরে মুচকি হেসে বিরবির করে বলল

-“ভালোবাসার প্রথম প্রণয় হলো তবে।”

———

সাদনান সকালে ঘুম থেকে উঠে বউ কে পাশে পায় না। চোখ তার ভীষণ জ্বলছে। কয় টা বাজে তখন সকাল আটটার বেশি। কতক্ষণ ঘুমালো? এই তো হবে হয়তো ঘন্টা দুই।ঘুমিয়েছে তো একদম শেষ রাতে ভালোবাসার মূহুর্ত শেষ করে সাওয়ার নিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত তো প্রায় শেষ হলো।
ঘুমিয়ে ছিল তো বউ কে বুকে নিয়ে। তবে উঠে গেলো কখন আর সে টেরও পেলো না।
সাদনান উঠে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুম চলে গেলো।
ফ্রেশ হয়ে মিনিট দশ এক পর বেরিয়ে এলো।কিন্তু বউ তার রুমে আসে নি।সাদনান টাওয়াল টা সোফায় ছুঁড়ে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে নিলো আর ঠিক তক্ষুনি দরজায় কড়া নাড়ে কেউ।সাদনান বুঝতে পারে বউ তার আসে নি বউ আসলে দরজায় নক করতো না তাই গম্ভীর কণ্ঠে অনুমতি দেয় আসার জন্য।
একজন বুয়া এসছে হাতে ধুঁয়া উঠা কফির মগ।সে টা সেন্টার টেবিলে রেখে জানালো নিচে অনেক মানুষ এসছে তাকে ডাকছে সেখানে। তিনি কথা শেষ
আবার চলে গেলো সাদনান কফি টা হাতে নিলো।সেটায় একবার চুমুক দিয়ে নাক মুখ কুঁচকে নিলো।
সাদনানের কাছে মনে হলো এটা কফি কম শরবত বেশি। তাই আর খেলো না রেখে দিলো সেখানে। অতঃপর নিজেকে পরিপাটি করে ফোন টা হাতে নিয়ে রুম হতে বেরোতেই দেখা মিলে রাহানের। রাহান সাদনান কে ডাকতেই আসছিল। রাহান সহ সাদনান দুইজনে টুকটাক কথা বলতে বলতে নিচে চলে আসে। সাদনান নিচে আসতেই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। গেস্ট দের নিচে একটা রুম আছে সেখানে শুধু রাজনীতির বিষয়ে কোনো সমালোচনা হলে সেখানে হয়। আর তার ঠিক পাশের রুম টায় আম্বিয়া মির্জা থাকে প্রিয়তা সেই রুম হতে বেড়িয়ে আসছে আর একটা ছেলে করিডরে দাঁড়িয়ে ফোন কথা বলছিল প্রিয়তা কে দেখে ছেলে টা ফোন কানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
ছেলে টা মোটামুটি মির্জা বাড়ির সদস্য নিয়ে অবগত। কিন্তু এটা কে হতে পারে বুঝতে পারছে না।
ছেলে টার ভাবনার মাঝেই প্রিয়তা চলে গেলো। ও না দেখেছে পেছন দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে কে আর না দেখেছে করিডরের ওপাশে থাকা সাদনান রাহান কে। ছেলে টা সাদনান কে দেখতে পেয়ে ফোন টা কেটে এগিয়ে আসে রাহান বুঝতে পারে সাদনান রেগে গিয়েছে।
তাই ছেলে টা ওদের সামনে আসার আগে ফিসফিস করে বলল

-“ঝামেলা করিস না।
এমনিতেই হাওয়া বেশ গরম আর বিয়ের খবর টা পাঁচকান হলে সমস্যা হবে।”

সাদনান রাহানের কথা শুনে বাঁকা হাসলো।রাহান বুঝতে পারে এই হাসির মানে।
নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু তার বন্ধুর মাথায় চলছে।
ওদের কথার মাঝেই ছেলে টা এগিয়ে এলো মুচকি হেসে হাত টা এগিয়ে দিয়ে বলল

-“আমি ওয়াসিফ দেওয়ান এর ছেলে ওয়াজিদ দেওয়ান।
আমি দেশের বাহিরে ছিলাম। কাল রাতে ফিরেছি।”

সাদনান মুচকি হেসে নিজের হাত এগিয়ে হাত মিলায়।
সামনে দাঁড়ানো সুদর্শন পুরুষ টা আবারও বলে উঠে

-“এনিওয়ে।
Congratulations new এমপি মির্জা সাদনান শাহরিয়া।”

#চলবে…….

#আমার_তুমি
#পর্ব_২৭[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ]
#জান্নাত_সুলতানা

সকাল থেকে বাড়িতে এককের পর এক বড় বড় নেতা থেকে শুরু করে দলের সব ছেলেপেলেরা সবাই শুভেচ্ছা জানাতে আসছে।
সাদনান সবার সাথে কম বেশ কথা বলে বাকি দায়িত্ব দাদার আর বাবার উপর দিয়ে রাহান আর আর সিকিউরিটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়বে মিটিং এর উদ্দেশে।আজকে দিন টা শুধু হাতে আছে।কাল আবার অনেক কাজ। শপথ বাক্য পাঠ করতে যেতে হবে।
অনেক কিছু করা বাকি এখনো এমপি হওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়।জায়গায় না আসলে জায়গার কদর বোঝা যায় না। এটা হচ্ছে ঠিক তেমন আগে আসতে পারার জন্য কষ্ট করতে হয়েছে জণগণ তাকে ভরসা করে এই স্থানে বসিয়েছে এখন সেই বিশ্বাস ভরসার ভালোবাসার দাম রাখার জন্য কষ্ট করতে হবে। শুনেছে বিপরীত দলের প্রাক্তন এমপি নাকি কাল রাতেই দেশ ছেড়েছে।না ছেড়ে উপায় আছে। জণগণ যা ক্ষেপে আছে হয়তো আগে থেকে আন্দাজ করতে পেড়ে ছিল হেরে যাবে তাই তো আগে থেকে পথ মেপে রেখে ছিল। সাদনান এসব ভাবতে ভাবতে রেডি হয়ে নিলো।
গায়ে সফেদা পাঞ্জাবি জড়িয়ে আয়নায় দেখে নিলো। চুল গুলো সুন্দর করে আঁচড়ে নিয়ে দামী ঘড়ি টা হাতে বাঁধতে বাঁধতে দেখে নিলো ক’টা বাজে।
বেলা এখন সাড়ে নয় টার বেশি বাজে।সে নিচ থেকে নাস্তা করে আসার সময় বলে এসছে প্রিয়তা যেনো রুমে আসে।কিন্তু এই মেয়ের তো কোনো খবর নেই। অবশ্য একটু আগে যা জারিজুরি দিয়েছে না আসাটাই গ্রহনযোগ্য। সাদনান বিছানা হতে নিজের ফোন টা হাতে নিয়ে সেটা পাঞ্জাবির পকেটে পুরে নিলো।সাদনান এর ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ঠিক তক্ষুনি দরজা ঠেলে কেউ ভেতরে এলো।
সাদনান বুঝতে পারে বউ তার রুমে এসছে।
প্রিয়তা সোজা এসে সাদনান এর সোফায় ফেলে রাখা ভেজা টাওয়াল টা নিয়ে ব্যালকনিতে দিয়ে এলো।ফিরে রুমে আসার সাথে সাথে সাদনান প্রিয়তা কে নিজের কাছে টেনে নিলো।আদুরে স্পর্শে করে মাথায় গলায় মুখে। প্রিয়তা তখন দেখছে সাদনান কে।
এই লোক টা আধঘন্টা আগেও কত টা রাশভারী কণ্ঠে তাকে শাঁসালো। একটু তো শুনতে পারতো তার কথা।না শুনেই তো নিজের মতো করে মন্তব্য করে গিয়েছে।
সে কি ইচ্ছে করে নিচে গিয়েছে।
দাদি তো তাকে ডেকে ছিল ওনার নাকি সকাল সকাল পায়ে ব্যাথা করছিল।কাজের লোক সবাই কাজে ছিল বলে তাকে দিয়ে পা মালিশ করাতে।

-“সাবধানে থাকবে।”

সাদনান প্রিয়তার ললাটে ওষ্ঠ ছুঁয়ে বলে উঠলো। প্রিয়তা অভিমান হলেও তা প্রকাশ করে না। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো

-“কখন ফিরবেন?”

-“তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো।
তবে কখন ফিরতে পারবো সময় বলতে পারছি না।”

সাদনান প্রিয়তার পেট হতে কুর্তি সরিয়ে নিজের হাত দু’টো চেপে ধরে শক্ত করে সেখানে।
প্রিয়তার সারা শরীর শিরশির করে উঠলো।নিজে কে সামলাতে সাদনান এর পাঞ্জাবি বুকের কাছের অংশ খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয়।
সাদনান সহসা হাসলো।
সেই হাসি ঠোঁটে রেখেই বলল

-“সময় থাকলে অবশ্যই সুযোগ টা কাজে লাগাতাম।
এখন বেঁচে গেলে।”

সাদনান ছেড়ে দিলো প্রিয়তা কে। প্রিয়তাও সড়ে দাঁড়ায়।
সাদনান প্রিয়তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবার নিজের দিকে তাকিয়ে আলগোছে কুঁচকানো পাঞ্জাবি টা ঠিক ঠাক করে গম্ভীর মুখ করে বেড়িয়ে গেলো।

———–

তিন্নি মির্জা বাড়ি থেকে এসেই রান্না ঘরে চলে গেলো। আর কবির ফ্রেশ হতে। সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ এই নির্বাচন এর জন্য অবশ্য কাল থেকে আবার খোলা। কালাম খাঁন অফিস চলে গিয়েছে মির্জা বাড়ি থেকে। নিজের কোম্পানি সেখানে এসব নির্বাচন নিয়ে থাকলে তো আর হবে না।এখন বাড়িতে দুই জন কাজের বুয়া আছে যারা এখন তিন্নি কে রান্নার কাজে সাহায্য করছে। তিন্নি এই বাড়িতে এসছে পরে রান্না টা নিজেই করে।অবশ্য এটা কবিরের আবদার তার সাতাইশ বছর বয়স ধরে কাজের লোকের রান্না খেতে খেতে সে অতিষ্ঠ। যদিও মাঝে মধ্যে দুই বাপ ছেলে মিলে ছুটির দিনে নিজেরা রান্না করতো তবুও কেমন একটা খালি খালি লাগতো তৃপ্তি হতো না।
তিন্নি তরকারি গুলো রান্না করে ভাত বসিয়ে কাজের লোক কে বলে শাওয়ার নিতে চলে গেলো।গা টা কেমন মেজমেজ করছে কাল সকালে এই বাড়ি থেকে শাওয়ার নিয়ে ওবাড়ি গিয়েছে আর এখন দুপুর হতে চলল।তবুও কাজ
এক্কেবারে সব কমপ্লিট করে যেতে কিন্তু এর মধ্যে কবির চার বার এসে এই একটু সময়ের মধ্যে নিচে ঘুরঘুর করে গিয়েছে। তিন্নি দেখেও না দেখার মতো থেকেছে। কবির নিজের লজ্জা সড়িয়ে তিন্নি কে ডাকতে পারে নি। কিন্তু তিন্নি খুব করে চাইছিল কবির তাকে ডাকুক অধিকার নিয়ে বলুক “তিন্নি এখুনি রুমে এসো” কিন্তু কবির তো এসব কিছু বলে নি তাই তিন্নি ইচ্ছে করে রুমে যায় নি।
তিন্নি রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রয়।
বুঝতে পারছে না ভেতরে যাবে কি না।যদি কবির ধমক দেয়?
ইশ কেন যে তখন এতো সব অধিকার খুঁজতে গেলো ও তো জানে কবির ওর জন্যই নিচে আসছিল।

-“দুই সেকেন্ড এর মধ্যে ভেতরে এসো।”

হঠাৎ কবির রুম থেকে বলে উঠলো।
তিন্নি চট করে রুমে ঢুকে গেলো।কবির সোফায় বসে ফোনে স্ক্রল করছে।
তিন্নি ভ্রু কুঁচকে নিলো।ওনি তো ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহলে বোঝলেন কি করে আমি এসছে?

-“তুমি যেমন করে বুঝতে পারো।”

তিন্নির ভাবনার মাঝেই কবির কথা টা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলো তিন্নির নিকট।
অতঃপর নাক মুখ কুঁচকে বলল

-“তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিতে যাও।”

তিন্নি নিজেও ঘামের গন্ধ পাচ্ছে তবে কবির এভাবে বলাতে একটু লজ্জা পেলো।
তাই কিছু না বলে তড়িঘড়ি করে ওয়াশ রুম চলে গেলো।
কবির হাসলো।
এই মেয়ে তো কিছু না নিয়েই চলে গিয়েছে সেটা কি খেয়াল করেছে?
অবশ্য ভালোই হলো এই ফাঁকে একটু মজা করা যাবে।

কবির আয়েশ করে আবারও আগের স্থানে বসে গেলো।
নিশ্চিন্তে ফোনে স্ক্রল করতে লাগলো তার ঠিক সাত আট মিনিট এর মাথায় তিন্নির কণ্ঠ ভেসে এলো

-“আপনি একটু বাহিরে যান।”

-“কেন?”

কবির সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
তিন্নির ভেজা চুল আর গলার কিছু টা অংশ দৃশ্যমান। এতেই কবির এর হার্ট টিপটিপ শব্দ করতে লাগলো।
কয়েক সেকেন্ড এর জন্য থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।
অতঃপর আলগোছে এগিয়ে গেলো।ওয়ারড্রব এর দিকে।সেখান থেকে একটা শাড়ী আর তার সাথে সব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে এগিয়ে এলো তিন্নির নিকট।
তিন্নি নিজের হাত টা কনুই পর্যন্ত বেড় করে কাপড় হাতেই নিয়ে ভ্রুকুঁচকে নিলো।

-“কুর্তি দিন না।
শাড়ী কেন?”

-“যা দিছি পড়ো নয়তো যেভাবে আছো সেভাবেই এসে নিজের পছন্দ মতো ড্রেস নাও।
তবে হ্যাঁ আমি রুম থেকে কোথাও যাচ্ছি না।”

তিন্নি অসহায় মুখ করে ওয়াশ রুমের দরজা টা বন্ধ করে দিলো।কবির মুচকি হেঁসে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেলো।
কয় দিন পর পরীক্ষা অনেক কাজ।
কবির কাজ করছে এক মনে। এদিকে তিন্নি কোনো রকম শাড়ী টা গায়ে পেঁচিয়ে বেড়িয়ে এলো। ওয়াশ রুম কি শাড়ী পড়া সম্ভব? মোটেও না এমনিতেই হঠাৎ হঠাৎ পড়ে তার মধ্যে বারো হাত একটা শাড়ী চিকনা এই শরীর টায় সামলাতে বেশ কসরত করে হয়।
তিন্নি শাড়ী টা কোনো রকম ধরে মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে কবির এক সামনে দাঁড়াল। মিনমিন করে অনুরোধের স্বরে বলল

-“প্লিজ এখন তো যান।”

কবির শুনলো তবে আমলে নিয়েছে বলে মনে হলো না। সে ল্যাপটপ কোলে হতে নামিয়ে সাইডে রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো তিন্নির কাছে অতঃপর তিন্নির শরীরের রেখেই শাড়ীর আঁচল টা ঠিক করে দিলো আলগোছে।
তিন্নি তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে নিয়ে। সারা শরীর যেনো তার অবস হয়ে গেলো। যদিও কবিরের হাতের স্পর্শ ওর শরীর পড়ে নি তবুও কেমন একটা লাগছে ওর।কবির ধীরস্থিরে শাড়ী কুঁচি গুলো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে সে গুলো তিন্নির হাতে দিয়ে ইশারায় গুঁজে নিতে বলে।
তিন্নি আলতো হাতে কুঁচি গুলো গুঁজে নিলো।কবির এর মধ্যে গিয়ে আবার নিজের স্থানে বসে পড়ে।
তিন্নি শাড়ী টা ঠিক ঠাক করে মাথা থেকে টাওয়াল টা খুলে ব্যালকনিতে চলে এলো।

আর ঠিক তক্ষুনি রুম থেকে কবির বলল

-“শুনো।
আজ বিকেলে আমরা বেরবো।”

-“কোথায়?”

তিন্নি রুমে আসতে আসতে জিগ্যেস করে।
কবির ল্যাপটপ এর ডিসপ্লের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে উঠলো।

-“গেলই দেখতে পাবে।”

————-

-“শুনলাম মাইশার বিয়ে কথা চলছে।”

-“হ্যাঁ,ঠিক শুনেছেন।

ওয়াসিফ দেওয়ান এর কথায় জাফর মির্জা চওড়া হেঁসে জানালো।
ওয়াসিফ দেওয়ান নিজেও হাসলো জাফর মির্জা সাথে তাল মিলিয়ে বলল

-“আমার ছেলে কে তো দেখেছেন?”
কাল রাতেই ইতালি থেকে ফিরেছে।”

-“হুম। আগের চায় দেখতে কিন্তু অনেক টা বদলে গেছে।
আমি তো প্রথমে চিনতে পারছিলাম না।”

-“আমার একটা আবদার আছে।”

-“কি যে বলেন আপনি।
একবার শুধু বলে দেখুন আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে সেই আবদার পূরণ করার চেষ্টা করবো।”

-“আমি আপনার ছোট নাতনি কে আমার ছেলের জন্য চাইছি।”

জাফর মির্জা কথা টা বুঝতে সেকেন্ড এর মতো সময় লাগলো। কিন্তু বুঝতে পেরে মুখের হাসি আরও কয়েক গুণ বাড়লো।

#চলবে….

আমার তুমি পর্ব-২৫

0

#আমার_তুমি
#পর্ব_২৫[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ]
#জান্নাত_সুলতানা

বেশ রাত করে ভোট গণনা করার পর জানা গেলো বিপরীত দলের চেয়ে দিগুণ ভোটে জয় লাভ করেছে মির্জা সাদনান শাহরিয়া।
ড্রয়িং রুমে টিভির সামনে মির্জা বাড়ির প্রতি টা মহিলা সদস্য তখন বসে আছে।
এই খবর পাওয়া মাত্র সবার খুশির শেষ নেই।
আম্বিয়া মির্জা তো খুশিতে প্রিয়তা কে জড়িয়ে ধরে ফেলে।
প্রিয়তা অবাক। বিস্ময় নিয়ে সালেহা বেগমর দিকে তাকালো। তিনি মুচকি হাসে।প্রিয়তা ওনার পাশেই বসে আছে সেই সুবাদে জড়িয়ে ধরা টা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

——————-

রাত একটা নাগাদ সাদনান সহ বাড়ির প্রতি টা পুরুষ সদস্য বাড়িতে এলো।
সাথে কবির আর কালাম খাঁনও আছে।
আজ রাত টা তারা এখানেই থাকবে।বাড়ির সবাই তখন ঘুমে জুবুথুবু হয়ে আছে।
লিভিং রুমে শুধু সালেহা বেগম আর সুফিয়া বেগম বসে আছে।সবাই কে ফ্রেশ হতে বলে দুই জা মিলে কাজের লোক এর সাহায্য নিয়ে খাবার এর ব্যবস্থা করতে চলে গেলো। এতোক্ষণ
প্রিয়তা, সারা,আয়না,মাইশাও তাদের সাথে ছিল কিন্তু ওদের ঠেলেঠুলে রুম পাঠিয়ে দিয়েছে ওনারা।
কিন্তু রুমে গিয়েও কি ওরা ঘুমিয়েছে?
উঁহু, এই তো সাদনান ক্লান্ত দেহ টা টেনে নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখা মিলে বউয়ের। গুটিশুটি মেরে বসে আছে সোফায়।
প্রিয়তা পিটপিট করে সামনে তাকিয়ে সাদনান কে দেখে চট করে উঠে এলো সোফা ছেড়ে। এগিয়ে এসে
এলোমেলো হাতে পাঞ্জাবির উপর তিন টা বোতাম খুলে লোমযুক্ত উন্মুক্ত বুক অধর ছুঁয়ে দিলো।
সাদনান ঠোঁট এলিয়ে হাসে।
এটা এখন প্রিয়তা সাদনান বাড়ি ফিরলে রোজ করে।
তবে সাদনানের আজ অন্য কিছু চাই।

-“এটুকু যথেষ্ট নয়।
আরও কিছু চাই।”

কথা শেষ করে সাদনান নিজের অধর দিয়ে বউয়ের অধর চেপে ধরে।
প্রিয়তা বুঝতে সেকেন্ড এর মতো সময় লাগলো। তবে বুঝতে পরে নিজেও সঙ্গ দেয় স্বামীর।বেশ অনেক টা সময় নিয়ে সাদনান বউয়ের অধর ভালোবাসার পরশ দিয়ে ছেড়ে দেয়।
প্রিয়তা মাথা নুইয়ে দূরে সরে দাঁড়াতেই সাদনান এক টানে নিজের গায়ের সাদা পাঞ্জাবি টা খুলে সোফায় ছুঁড়ে ফেলে।
এখন গায়ে শুধু একটা চিকন ফিতার সাদা গেঞ্জি হাতের মোটা পেশিবহুল দৃশ্যমান।এই শক্ত পোক্ত পেটানো শরীর টা প্রিয়তা নিকট বেশ লাগে। প্রিয়তা এগিয়ে গিয়ে ব্যালকনি হতে টাওয়াল নিয়ে আসে সাদনান বউয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ওয়াশ রুম চলে যায়।
প্রিয়তাও গুটিগুটি পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
সে নিচে আসতেই সালেহা বেগম সাদনানের খাবার থালা টা প্রিয়তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল

-“নিচে আসার প্রয়োজন নেই।
কম দখল যায় নি সারা দিন। ”

প্রিয়তা ভীষণ খুশি হলো তবে তা প্রকাশ করে না। ওর ইচ্ছে করছিল খাবার টা রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু এটা বললে কেমন দেখায় তাই বলে নি কিছু। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার সালেহা বেগম এটা নিজ থেকে বলল।
প্রিয়তা খাবার টেবিলে বসা সবার দিকে একবার আঁড়চোখে তাকিয়ে উপরে রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরে।
তিন্নি সে দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি প্রিয়তার দেখতে অসম্ভব সুন্দর। গায়ের রঙ টা বেশি সাদা নয়। তবে যে কেউ এক দেখে পছন্দ করবে।
এই সতেরো বছর বয়সে যেই মেয়ে এতো টা সুন্দর সেই মেয়ে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী হলে কেমন লাগবে?
তিন্নি কবিরের দিকে তাকায়
কবির এক মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে কবির এর পাশেই তিন্নি দাঁড়িয়ে আছে।
কবির ওকে সব বলেছে। তিন্নির কষ্ট হয় নি বরং খুশি হয়েছে যে কবির তাকে সব সত্যি বলেছে। ঠকাতে চায় নি।
একটা সম্পর্কে বিশ্বাস থাকা জরুরি। আর কবির সেটাই রক্ষার্থেই তার সব অতীত বলে দিয়েছে যাতে করে পরবর্তীতে তিন্নি এসব জানলে ওর কক্ষণো খারাপ না লাগে মনে যেনো না হয় কবির তাকে ঠকিয়েছ। যে অন্য কাউ কে মনে রেখে ওকে ভালোবাসার অভিনয় করেছে মনের বিরুদ্ধে সংসার করেছে।যদিও এখন কবির এর মনে তেমন কিছু নেই
আর এমনিতেও ওই সব এর কোনো ভিত্তি নেই।
তবুও মন টা তো একবার না একবার সেই নিষিদ্ধ জিনিস টা বড্ড নিজের কেরে পাওয়ার জন্য উতলা ছিল।
এটা কবির কে এখন কেমন বুকের মাঝে যন্ত্রণা দেয়।
খাবার শেষ তিন্নি কবির কে নিয়ে সারা রুমে চলে আসে। সারা মাইশার সাথে থাকবে। গেস্ট রুমে কালাম খাঁন আর রাহান থাকবে।
তিন্নি রুমে এসেই বিছানা গুছিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকে।
কবির ওয়াশ রুম থেকে বেড়িয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল আয়নায় নিজে কে একবার দেখে নিলো।
তিন্নি সে দিকে তাকিয়ে রইলো।
কবির রাহাত এর একটা গাঢ় সবুজ রঙের গেঞ্জি পড়ে আছে।
আর পড়েন সেই সকালে বাড়ি থেকে পড়া আসা কালো প্যান্ট।
কবির চুল গুলো হাত দিয়ে আঁচড়ে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করে

-“ঘুমাও নি কেন?”

-“আপনি বাহিরে ছিলেন।”
ঘুম আসছিল না।”

-“এখন আসবে? ”

-“একদম।
কোনো ভুল নেই।”

তিন্নি আনমনে বলে উঠে।
কবির আঁড়চোখে সে দিকে তাকিয়ে হাসলো।
বড্ড ভালোবাসে মেয়ে টা তাকে।কোনো সন্দেহ নেই এতে।
কবির নিজেও বাসে।
কিন্তু কত টা?
যত টা হলে প্রথম অনুভূতি ভুলে থাকা সম্ভব। পুরনো সব ভুলে নতুন করে ভালোবাসতে মন চায় সুন্দর একটা জীবন চায় ভালোবেসে সংসার করা যায়।
আচ্ছা সংসার টা কি হচ্ছে তাদের মাঝে?
নাকি শুধুই তার প্রথম অনুভূতি ভুলে থাকতে?
আচ্ছা এটা নিয়ে তিন্নির কি খারাপ লাগে?
অবশ্যই লাগে বিয়ের তিন মাসেও যদি স্বামী ভালোবাসা না পায় তবে শুধু খারাপ কেন মেয়ে নিশ্চয়ই কষ্ট পাচ্ছে।
আর দিবে না আর দুই মাসেই তো।তার পর অনেক ভালোবাসা দিবে গুছিয়ে সংসার করবে।
কবির এক দৃষ্টিতে তিন্নির দিকে তাকিয়ে আছে।
সে দিন সকালে যখন ঘুম থেকে উঠার পর কবির এর রুমে নিজেকে আবিষ্কার করে তখন ভীষণ অবাক হয়েছে তিন্নি সাথে ভেবেছে ঘুমের ঘোরে হয়তো এসে পড়েছে। কিন্তু কবির যখন বলেছিল সে নিজেই এনেছে আর আজ থেকে এই রুমে থাকবে। তখন তিন্নি আরও অবাক হয়েছে।
কারণ এর আগে কবির প্রিয়তা কে নিয়ে তার মনে ভেতর এক সময় তৈরি হওয়া অনুভূতি গুলো বলে ছিল।
তিন্নির ভাবনার মাঝেই কবির এসে তিন্নি কে ঝট করে কোলে তুলে নেয়।
তিন্নি আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠে।
তড়িঘড়ি করে কবির এর বুকের কাছে খামচে ধরে।
কবির ভ্রু কুঁচকে নেয়।
তিন্নির হাতের নখ ছোট কিন্তু যা আছে এতেই বেশ বিঁধে যায়।
কবির কুঁচকানো ভ্রু জোড়া সোজা করে চোখে দুষ্ট হেসে বলে উঠে

-“এখনি এই অবস্থা।
সম্পূর্ণ সব হলে আমাকে সামলাবে কি করে? ”

তিন্নি লজ্জায় আরও একদফা গুটিয়ে গেলো।
নিজের লজ্জা রাঙা মুখ লোকায় কবির এর বুকে।
কবির ততক্ষণে সারার রুমের সাথে লাগানো ছোট ব্যালকনি টায় এসে পড়ে।
মেঝেতে থাকা কার্পেট এর উপর নিজে বসে তিন্নি কেও নিজের কোলে বসায়।
তিন্নির জামার উপর দিয়ে নিজের দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে।
তিন্নি হাল্কা কেঁপে উঠল।
কবির তিন্নির কাঁধে নিজের থুতনি ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল

-“রাত শেষ হয়ে যাবে।
আর এই শেষ রাতে আমরা চন্দ্র বিলাস করবো।”

কথা শেষ কবির তিন্নির কানে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
অতঃপর দু’জনেই দূর আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা চাঁদ টার দিকে তাকিয়ে থাকে।

————

মাইশা ফোনে কথা বলছে আয়ান এর সঙ্গে।
সারা কেও পরীক্ষার পর ফোন দেওয়া হয়েছে। সে ফোনটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মূলত রাহান এর আইডিতে একটু আগেই নিজের আগের প্রোফাইল টা চেঞ্জ করেছে রাহান। সেখানে অনেক গুলো রিয়েক্ট আর শখানেক কমেন্ট। এর মধ্যে বেশির ভাগ মেয়ে।
সারার এসব দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।ওনার ছবিতে কেন এতো মেয়ে কমেন্ট করবে?
সারাও একটা আইডি খুলেছে নিজের নাম না অন্য নাম দিয়ে। আর সেটা দিয়ে রাহান কে ফলো দিয়ে রেখেছে রাহান ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করে নি।
সারার এসব ভাবতে গিয়ে কখন যে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে বুঝতেই পারে নি।
চোখের পানি টা মুছেই ফোনের ডাটা অফ করার জন্য ডাটা অপশন অফ করতে গিয়ে টুং করে একটা মেসেজ এলো।
সারা ডাটা অফ না করে মেসেজ টা চেক করে ওর চোখ কপালে।
রাহানের আইডি থেকে মেসেজ এসছে।

———–

খাবার শেষ প্রিয়তা এঁটো থালা টা সেন্টার টেবিলে রেখে দেয়।
এতো রাতে আর নিচে যাবে না। অতঃপর হাত ধুয়ে আসে।
সাদনান সোফায় বসে তখন ল্যাপটপ কোলে কিছু করছে।
প্রিয়তা ওড়না পাশে রাখে বিছানা গুছাতে লাগলো।
আর প্রিয়তার লম্বা মোটা চুলের বিনুনি টা তখন এদিক সে দিক কাজের সাথে সাথে দোল খেয়ে যাচ্ছে।
সাদনান কাজ ফেলে সে দিকে তাকিয়ে থাকে।

-“আসুন শুয়ে পড়ুন।
বাকি সব কাজ কাল করতে পারবেন।”

সাদনান এর ঘোর কাটে।
ল্যাপটপ সোফায় রেখে আলগোছে ওঠে আসে।
পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বউ কে। প্রিয়তা অনাকাঙ্খিত স্পর্শে কেঁপে উঠল।
তবে নিজে কে সামলে নিলো।
মিনমিন করে বলল

-“ক্লান্ত আপনি শুয়ে পড়ুন।”

সাদনান শুনে না। প্রিয়তার উন্মুক্ত পেটে নিজের হাত চেপে বুকের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
কাঁধে ঠোঁট ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল

-“আমার সব ক্লান্তি তোমার এই মুখ দেখলে দূর হয়ে যায়।
তোমার এই ছোট্ট ছোট্ট হাতের স্পর্শ আমাকে হাজার অশান্তির মাঝে শান্তি দেয়।আমার মনে হাজার উতালপাতাল শান্ত করে দিতে তোমার এই মিষ্টি কণ্ঠ যথেষ্ট আমার জান।”

#চলবে……

আমার তুমি পর্ব-২৪

0

#আমার_তুমি
#পর্ব_২৪[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ]
#জান্নত_সুলতানা

তিন্নি শাড়ী টা পড়ে বসে আছে বিছানায়। আর একটু পর পর নিজের শরীরের দিকে তাকাচ্ছে। আর লজ্জা পাচ্ছে।
শাড়ী পড়েছে ঠিক তবে শরীরে প্রতি টা ভাঁজ স্পষ্ট। সাথে ব্লাউজ এর হাতা গুলো স্লিভলেস।
এখন এটা পড়ে কবির এর সামনে কি করে যাবে তিন্নি বুঝতে পারছে না।
তিন্নির ভাবনার মাঝেই কবির হাতে ঘড়ির ফিতা বাঁধতে বাঁধতে রুমে প্রবেশ করে বলে উঠে

-“আর কতক্ষণ হ,,,,,

কবির আর কিছু বলতে পারে না।
তিন্নির দিকে তাকিয়ে কবিরের চোখ আটকে যায়।তিন্নি বেশি সাজে নি খোলা চুল চোখে হাল্কা কাজল আর ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। কানে এক জোড়া ইয়ার রিং গলায় ছোট একটা লকেট যে গুলো কবির বিয়ের দিন দুপুরে তিন্নি নিজে হাতে পড়িয়ে দিয়ে ছিল।
এই রূপ কবির কে জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম এটা কি সামনে বসা রমণী জানে?
উঁহু জানবে কি করে কখনো বলা হয় নি যে।
আচ্ছা মেয়ে টা এতো টা মায়াবী আগে তো কখনো চোখে পরে নি।নাকি ভালোবাসার মানুষ টা যেমনই হোক ভালোবাসার মানুষটার কাছে সবচাইতে বেশি সুন্দর?
এদিকে তিন্নি লজ্জায় গুটিয়ে আছে।
সে চুপ করে মাথায় নুইয়ে দৃষ্টি মেঝেতে ফেলে রেখেছে।
কবির হাসলো।
একটু এগিয়ে গিয়ে তিন্নির ডান হাত টা ধরতেই তিন্নি কেঁপে উঠল।
মাথা তুলে কবিরের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও মাথা নুইয়ে নিলো।

-“মিসেস খাঁন আমাকে মারার প্ল্যান করেছে বুঝি?”

তিন্নি কবির এর কথার মানে বুঝতে পারে ছোট নয় ও।
তাই তো আরও কিছু টা গুটিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু কবির কি গুটিয়ে থাকতে দেয়।
সে তো টেনে দাঁড় করালো তিন্নি কে। অতঃপর ড্রেসিং আয়নার সামনে দাঁড়াল।
তিন্নির চাইতে কবির একটু লম্বা হওয়ার দরুনে ঘাড় নুইয়ে কবির নিজের থুতনি ঠেকিয়ে তিন্নির কাঁধে। দুই হাত রাখে তিন্নির পেটের উপর।
তিন্নি তখনো চোখ বন্ধ সাথে কাঁপা কাঁপি তো আছেই।
কবির তিন্নির অবস্থা বুঝতে পারে।
তাই তিন্নি কে স্বাভাবিক করতে ঠোঁট টিপে হেসে বলল

-“এখুনি কিছু করছি না।
তাই এতো কাঁপা কাঁপির কিছু নেই।”

কথা শেষ কবির তিন্নি কে ছেড়ে দিয়ে হো হা করে হেঁসে দিলো।
অতঃপর ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে এক জোড়া চুড়ি তিন্নির হাতে পড়িয়ে দেয়।
তিন্নি একটু স্বাভাবিক হয়।চুড়ি গুলো কবির দিয়েছে কিন্তু তিন্নি পড়ে না ওগুলো। সব সময় নরমাল চুড়ি পড়ে থাকে কারণ কবির যে গুলো দিয়েছে সে গুলো গোল্ড।
আর তিন্নি খুব সাধারণ ভাবে চলাফেরা করতে পছন্দ করে। আর তাই এগুলো ওর কাছে বিলাসিতা লাগে।
কবির চুড়ি পড়িয়ে দিয়ে আলমারি খোলে সেখান থেকে একটা চাদর বেড় করে তিন্নির গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল

-“আমি চাই না এই রূপ আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ দেখে।”

তিন্নি অবাক হল তবে মনে মনে বেশ খুশি হলো।
কারণ ওর ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল।

-“চলো যাওয়া যাক।”

তিন্নি সম্মতি দেয়।
কবির তিন্নির হাত ধরে বেড়িয়ে আসে বাড়ি থেকে।
কবির ড্রাইভার নিয়েছে।
ওরা পেছনে বসেছে। তিন্নি জানে না ওরা কোথায় যাচ্ছে একবার অবশ্য কবির কে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু কবির বলে নি শুধু জানিয়েছে গেলেই দেখতে পাবে।
গাড়ি চলছে নিজ গন্তব্যে তবে তিন্নির রাস্তা টা ভীষণ চেনা লাগছে।
লাগছে না এটাই তো সেই রাস্তা যেটা দিয়ে এতিম খানায় যায় আগে তিন্নি যেখানে থাকতো সেখানে।
তবে কি ওরা সেখানে যাচ্ছে? না যাচ্ছে না গাড়ী টা এসে এতিম খানার গেইট এ থামে দারোয়ান গেইট খুলে দেয় গাড়ী ভেতরে প্রবেশ করে।
তিন্নি কবির গাড়ী থেকে নামে।
আর অমনি ভেতর হতে অনেক গুলো বাচ্চা সহ পাঁচ জন মহিলা বেড়িয়ে আসে সেখান থেকে।
সবাই এসে এক সাথে তিন্নি কে জন্ম দিন এর শুভেচ্ছা জানায়। তিন্নি স্তব্ধ কবির ড্রাইভার কে কিছু ইশারা করতেই ড্রাইভার গাড়ি থেকে বেড়িয়ে পেছনে গিয়ে গাড়ির ডিঁকি খুলে সেখান থেকে অনেক গুলো শপিং ব্যাগ এনে তিন্নি আর মহিলা গুলোর হাতে দেয়।
কবির তিন্নির দুই বাহুতে হাত রেখে মুচকি হেঁসে বলে উঠে

-“happy birthday..

তিন্নির চোখে পানি চিকচিক করছে।
কবির বুঝতে পারে মেয়ে টা অতি খুশিতে চোখে পানি চলে এসছে।

-“এগুলো সবাই কে দাও।”

তিন্নির হাতের শপিং ব্যাগ গুলোর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বলে।

তিন্নি সব গুলো বাচ্চা কে দিলো এগুলোর ভেতর সবার জন্য এক সেট করে কাপড় আছে।
সবাই ভীষণ খুশি বাচ্চা গুলোর খুশি থেকে তিন্নি কবির কে ধন্যবাদ দিলো।
কবির মুচকি হেসে বলল

-“আর আমার পক্ষ হতে আল্লাহ কে ধন্যবাদ এতো সুন্দর মনের একজন মানুষ কে আমার জীবনে দেওয়ার জন্য।
তাও আবার আমার জীবন সঙ্গী করে অর্ধাঙ্গিনী রূপে।”

তিন্নি উত্তর করে না।
সে সবাই কে দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
মুগ্ধ হয়ে দেখছে সব বাচ্চা গুলো কে। সে-ও এক সময় এরকম ছিল এদের মতো এতিম। তিন্নি কে না-কি এখানের একজন মহিলা রাস্তায় পেয়ে ছিল কেউ ফেলে দিয়ে ছিল হয়তো তিন্নির বয়স তখন কত হয়তো দুই বা তিন দিন ছিল।
তবে ওনারা তিন্নি কে যে দিন পেয়েছে সে দিন থেকে এই দিনে তিন্নির জন্ম দিন পালন করে সাথে সার্টিফিকেট সব জায়গা এই তারিখ ব্যবহার করে।
রাত একটা নাগাদ ওরা খাবার দাবার শেষ বাড়ি ফিরে আসে।
এর মধ্যে তিন্নি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ে কবির তাই তিন্নি কে নিজের সাথে একদম মিশিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে।
বাড়িতে এসে গাড়ি থেকে নেমে কবির তিন্নি কে নিজে কোলে করে এনে নিজের রুমে শুয়ে দেয়।
আর নিজেও ফ্রেশ হয়ে এসে তিন্নি কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।

—————-

সকাল থেকে মির্জা বাড়ি শুনশান নীরবতা। কেমন থমথমে পুরো পরিবেশ আজ নির্বাচন। কবির তিন্নি আজ মির্জা বাড়ি এসছে।
মূলত কবির আর কালাম খাঁন ভোট কেন্দ্রে চলে যাবে তাই কবির তিন্নি কে এখানে রেখে যাবে।
সাদনান সেই সকালে বেড়িয়ে গেছে বাড়িতে কোনো পুরুষ লোক নেই।
কবিরও তিন্নি কে দিয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেলো।
কেন্দ্রে কিছু ঝামেলা হয়েছে বিপক্ষ দল না-কি ভুয়া ভোট দিতে এসে ধরা পড়ে গিয়েছে।
এটা নিয়ে ছেলে রা ক্ষেপেছে গিয়েছে।
এখন পরিস্থিতি স্থিতিশীল আর জয় সাদনান এর হবে বলে সবার ধারণা।
এখন বাকিটা ভোট গণনার পর বোঝা যাবে।

মির্জা বাড়ির সারা, প্রিয়তা,মাইশা বাদে সবাই গিয়েছে ভোট দিতে।
সবাই বারো টার দিকে দিয়ে চলে এসছে এখন বিকেল হয়ে গিয়েছে।
সালেহা বেগম এর শরীর খারাপ আম্বিয়া মির্জা চিন্তায় চিন্তায় সারা দিন কিছু খায় নি তাই ওনাকে এখন সুফিয়া বেগম জোর করে খাবার খাইয়ে ঘুমের ঔষধ দিয়েছে।
প্রিয়তা সারা দিন কেমন মন মরা হয়ে থেকেছে। তাই সারা, মাইশা, তিন্নি, আয়না ওর সাথে সাথে সারা দিন রয়েছে।
মাইশা ফোন হাতে এই মাত্র রুম হতে বেড়িয়ে ছাঁদে চলে আসে।
আয়ান কে মেসেজ দিয়েছে।
আয়ান বলে বলেছে মেসেজ করার মতো পরিস্থিতি নেই তবে ফোনে সর্ট কার্ট কথা বলতে পারবে।
মাইশা ছাঁদে আসার সাথে সাথে আয়ান এর ফোন আসে।
রিসিভ করতেই ওপাশ হতে আয়ান জিজ্ঞেস করে

-“প্রিয়তা খাবার খেয়েছে?”

-“নাহ সকালে মা অনেক জোর করে একটু খাইয়েছে আর খায় নি।”

-“কিছু বলছে?”

-“হ্যাঁ আপনি কি করে বোঝলেন?”

-“আমার বোন আমার জানা আছে।
তাড়াতাড়ি বলো বায়না কি ধরেছে?”

-“ভাইয়ার সাথে কথা বলতে চায়।
কিন্তু এটা কি সম্ভব?”

-“আমি দেখছি।”

আয়ান ফোন কাটে। মাইশা ফোন হাতে নিচে চলে আসে।
নিচে আসতেই হাতের ফোন টা আবারও সশব্দে বেজে উঠে।
এটাও আয়ান এর ফোন।
মাইশা ভাবে হয়তো কিছু বলবে তাই রুমে না এসে কল টা রিসিভ করে।
কিছু বলবে তার আগেই সাদনান এর গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এলো

-“ফোন টা ওর কাছে দে।”

মাইশা তৎক্ষনাৎ দৌড়ে রুমে এসে ফোন প্রিয়তার হাতে দেয়।
প্রিয়তা প্রশ্নবোধক চাহনি দেয় মাইশার দিকে মাইশা ইশারায় ব্যালকনিতে যেতে বলে।
প্রিয়তা কি ভেবে কিছু না বলে উঠে চলে যায়।
ফোন কানে নিতেই সাদনান গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে

-“খাবার কেন খাও নি?”

-“আপনার ফোন কেন বন্ধ?
কখন বাড়ি আসবেন?”

প্রিয়তা সাদনান এর করা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো অস্থির হয়ে নিজে জিজ্ঞেস করে।
সাদনান হয়তো হাসলো।
অতঃপর মৃদু কণ্ঠে জানায়

-“আসবো অপেক্ষা করো খুব শীগগির সুখবর নিয়ে।
জানো তো অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়?”

-“হুম।
অপেক্ষা করবো খুব তাড়াতাড়ি চলে আসুন।”

#চলবে….

আমার তুমি পর্ব-২৩

0

#আমার_তুমি
#পর্ব_২৩[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ]
#জান্নাত_সুলতানা

-“মানে?”

সারা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
রাহান খুব স্বাভাবিক ভাবে জবাব দেয়

-“মানে সারা দিন খারাপ লাগছিল।
এখন সব ঠিক আছে।”

সারা কুঁচকানো ভ্রু জোড়া শীতল হলো।
এ-র মধ্যে সুফিয়া বেগম এসে রাহান কে ফ্রেশ হতে বলে।
রাহান সারার দিকে এক পলক তাকিয়ে গেস্ট রুমের উদ্দেশ্য চলে গেলো। সারাও চলে গেলো।
সাড়ে আটটা বাজতে চলে সবাই চলে আসার সময় হয়েছে।
তাই সুফিয়া বেগম কাজের লোক নিয়ে খাবার দাবার গুছিয়ে নিতে লাগলো।

———-

রাতে খাবার শেষ সাদনান রুমে চলে আসে।
মিনিট দশ এক পর প্রিয়তাও কফি হাতে রুমে আসে। সাদনান তখন ল্যাপটপ কোলে রেখে সোফায় বসে কাজ করছে।
প্রিয়তা কফির মগ টা সাদনানের সামনে সেন্টার টেবিলে রেখে দেয়।
সাদনান এক পলক তাকিয়ে মুচকি হেসে কফির মগ টা হাতে তুলে সেটায় চুমুক বসায়।
প্রিয়তা তখনো দাঁড়িয়ে আছে সেভাবেই।
সাদনান বুঝতে পারে বউয়ের মন খারাপ যদিও তেমন কিছু হয় নি দাদি প্রিয়তার সাথে কথা বলে না।
এমনি কি খাবার টেবিলেও বা আজ্জম মির্জা, জাফর মির্জা কারোর সঙ্গে সন্ধ্যার বিষয়ে কথা বলে নি। তার হঠাৎ চুপ করে যাওয়ার কারণ প্রিয়তা বুঝতে পারে নি।
কিন্তু সাদনান এর এসব নিয়ে কোনো ভাবান্তর ঘটে নি।সে স্বাভাবিক যেনো সন্ধ্যা কথা সে ভুলে গিয়েছে বা এমন কিছু হয় নি।
তার কারণ টা জানার জন্য প্রিয়তা দাঁড়িয়ে আছে সাদনান বুঝতে পেরে একটু অন্যমনস্ক হয়ে সন্ধ্যা দাদির সাথে বলা কিছু কথা মনে পড়ে। দাদির তার এমন নয় সে জানে আর হঠাৎ পরিবর্তন টার মানে বুঝতে পারে নি।
তিনি আগের দিনের মানুষ সেই সুবাধে ওনার ভাষ্যমতে বউ তো বউ স্বামী সংসার সামলাবে। সে কেন বাড়ির বাহিরে রংঢং করে ঘুরে বেড়াবে?
সাদনান এর কানে আগেও এই কথা গুলো এসেছে দাদি প্রিয়তা কে বলেছে কিন্তু সে সব সূত্র ধরে কিছু বলে নি কিন্তু দাদি আজ নিজেও সাদনান এর সাথে এসব নিয়ে কথা তুলেছে।
সাদনান কিছু বলে নি।
চুপ করে দাদির অভিযোগ শুনেছে সর্বশেষ তার একটাই প্রশ্ন ছিল প্রিয়তার জায়গায় যদি সারা বা মাইশা হতো তবে কি তিনি এমন করতো?
আম্বিয়া মির্জা তখন নিশ্চুপ ছিলেন।
সত্যিই তো কিন্তু তিনি উত্তর দেয় নি শুধু জবাবে বলেছে তিনি মানিয়ে নিতে চেষ্টা করবে।

-“দাদি আজ কথা বলে নি।”

প্রিয়তার কথায় সাদনান ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে।
সে তো বেমালুম ভুলে বসে ছিল বউ তার সামনে দাঁড়িয়ে।
কিন্তু নিজে কে যথাসম্ভব শান্ত রেখে কোলে হতে ল্যাপটপ নামিয়ে পাশে সোফায় রাখে।
প্রিয়তার হাত টেনে ধরে নিজের কোলে বসিয়ে দেয় সাদনান।
প্রিয়তা হাল্কা কেঁপে উঠল। ভড়কালো হকচকিয়ে সাদনান এর শুভ্র রঙের পাতলা সার্ট এর বুকের কাছ টায় খামচে ধরে।
সাদনান হাসলো আরও কিছু টা প্রিয়তার ছোট দেহ খানার কোমড় নিজের শক্ত হাতের মাঝে আরও শক্ত করে চেপে ধরে।
সাদনান প্রিয়তার চোখ বন্ধ দেখে মৃদু কণ্ঠে বলল

-“চোখ খুলো।”

প্রিয়তা তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকিয়ে মিনমিন করে জানালো

-“আপনি অন্য দিকে তাকান।”

-“পাঁচ মাসের বেশি সময় হতে চলে।
এখনো এমন টা মোটেও আশানুরূপ আচরণ নয় মিসেস সাদনান।”

সাদনান এর এমন গম্ভীর কণ্ঠে বাণী প্রিয়তা তৎক্ষনাৎ চোখ তুলে সাদনান এর চাপ দাঁড়ি ভর্তি সুন্দর সুশ্রী মুখপানে তাকালো।
আর অমনি প্রিয়তার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।
এতো সুন্দর হতে কে বলেছে এই লোক কে?
যা পড়ে এতেই ভীষণ সুন্দর লাগে।
প্রিয়তা আনমনেই সাদনানের কপালে পড়া থাকা এলোমেলো চুল গুলো নিজের হাতের সাহায্য ঠেলে পেছনে দিয়ে দেয়।
সাদনান আচমকাই প্রিয়তার হাত টা ধরে ফেলে।
প্রিয়তা আবার মাথা নুইয়ে নিলো।
সাদনান প্রিয়তার হাত টা নিজের গালে রাখে।

-“এই হাত দু’টো দিয়ে শুধু আমাকে ভালোবাসা হবে।
মনে থাকবে?”

-“আপনার কাজ ঠিক মতো হলেই তো হলো।”

-“সংসার করার জন্য সারাজীবন পরে আছে।
বিশেষ করে আমি যতক্ষণ পর্যন্ত বাসায় থাকবো ততক্ষণ আমার সামনে থাকবে।
তার মানে এটা নয় আমি না থাকলে তুমি একা সব কাজ করবে।”

প্রিয়তা কিছু বলে না।
শুধু আগের ন্যায় মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয় যার মানে আচ্ছা।
সাদনানের মন ভরে না বউয়ের এমন মাথা নুইয়ে বসা থাকায় মুখ টা ঠিক স্পষ্ট নয়।
সাদনান প্রিয়তার মুখ টা দুই হাতের আঁজলে নিয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে কিন্তু এতেও যেনো মন ভরে না।
আরও কিছু হলে ভালো হয়।
ভাবে না সাদনান আর কিছু। মূহুর্তের মাঝে বউয়ের ওষ্ঠ জোড়া নিজের ওষ্ঠ দিয়ে চেপে ধরে ভালোবাসা দিতে থাকে।
প্রিয়তাও সাথে তাল মেলায়।সাথে সাদনানের হাতের অবাধ্য স্পর্শ তো আছেই।যা বড্ড জ্বালাচ্ছে প্রিয়তা কে। সাদনান অনেক টা সময় নিয়ে প্রিয়তা কে ছেড়ে দিয়ে নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুল দ্বারা প্রিয়তার ঠোঁট মুছে দেয়।
প্রিয়তা ছাড়া পেয়ে যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে। পিটপিট করে চোখ তুলে সাদনান এর দিকে এক পলক তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে সাদনান এর কোল হতে।
অতঃপর আলমারি খোলে সেখান থেকে রাতের পোষাক নামিয়ে ওয়াশ রুম চলে গেলো।
প্রিয়তা ওয়াশ রুম থেকে বেড়িয়ে এসে লাইট অফ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
সারা দিন মোটামুটি ভালোই খাটাখাটুনি হয়েছে তাই বিছানায় শোয়া মাত্রই নিদ্রা ভর করে।
সাদনান বেশ অনেক টা সময় পর নিজের সব কাজ শেষ ওয়াশ রুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে বউ কে টেনে নিজের বুকের উপর এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
প্রিয়তাও ঘুমের ঘোরে সাদনান এর বুকের মাঝে বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিয়ে গেলো।
সাদনান হাসলো যেই হাসিতে কোনো বিষাদ নেই আছে শুধু সুখ।

————

ভোট প্রচারণা চলছে।
সেই সাথে চলছে সাদনান এর ব্যস্ততা।
আর তিন দিন পর ভোট তাই ভীষণ গরম এলাকা।আজ কের পর ভোট প্রচারণা বন্ধ কাল থেকে তাই সাদনান আজ ভোট প্রচারণা বেড়িয়েছে সাথে ছিলেন ওয়াসিফ দেওয়ান।
আর অন্য দিকে গিয়েছে আজ্জম মির্জা জাফর মির্জা কোথাও যায় নি।
বয়স হয়েছে কিন্তু দেখতে এখনো জোয়ান।
কিন্তু দেখতে জেয়ান হলেও শরীর তার মেহনত সাথে হাঁটা চল করতে গেলে সেটা ধরা পরে।একটুতেই হাঁপিয়ে যায়।
তাই তিনি আজ পার্টি অফিস রয়ে গিয়েছে।

——————-

কবির তিন্নির হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল

-“রেডি হয়ে এসো।”

তিন্নি খাবার শেষ মাত্র রুমে এসছে এর মধ্যে কবির রুমে আসে।
তিন্নি কবির এর এমন কথায় ভ্রু কুঁচকে আসে।
কিন্তু নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে প্রশ্ন করলো

-“কি এটা?”

-“নিজে দেখে নাও।”

কথা শেষ কবির চলে গেলো।
তিন্নি প্যাকেট থেকে একটা হাল্কা গোলাপি রঙের একটা পাতলা শাড়ী বেড় করে।
যেটা দেখে তিন্নির মুখ হা হয়ে গেলো।
এটা তো ওই দিন কবির শপিংমল থেকে নিয়ে ছিল।
তিন্নি তখন অতো খেয়াল করে নি শাড়ী টা এতো পাতলা তবে ওর এটা ভালো লেগে ছিল।
কিন্তু এতো পাতলা হবে বুঝতে পারলে সে কক্ষনও এটার দিকে তাকাতো না।
আর ও না তাকাতো আর না কবির এর দৃষ্টি ওটায় যেতো আর না আজ শাড়ী টা ওর হাতে আসতো আর না পড়তে হতো।
কিন্তু এখন কি করার কবির একবার যখন দিয়ে দিয়েছে তখন এটা পড়তেই হবে কিছু করার নেই।
তার কারণ কবির যা বলে তার উল্টো হলে সে ভীষণ রেগে যায়।
এটা তিন্নি জানে তার কারণ কলেজে বহুবার দেখেছে কবির এর রূপ।
তিন্নি এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে ওয়াশ রুম থেকে শাড়ী টা পড়ে আসে।
সে এই কয়েক মাসে শাড়ী পড়া টা বেশ শিখে নিয়েছে।
তার কারণও অবশ্য কবির প্রায়শই তিন্নির নিকট আবদার জুড়ে যেনো কবির এর ছুটির দিনে তিন্নি শাড়ী পড়ে।
তিন্নি মেনে নিয়েছে তার ভীষণ ভালো লাগে কবির এর এসব ছোট ছোট আবদার গুলো।
এই যেমন হুটহাট তিন্নির হাতে খাবার খেতে চাওয়া কলেজ থেকে আসার সময় এটা সেটা নিয়ে আসা আবার কলেজ যাওয়ার সময় কপালে চুমু খাওয়া।

#চলবে…..

আমার তুমি পর্ব-২২

0

#আমার_তুমি
#পর্ব_২২[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ]
#জান্নাত_সুলতানা

-“বারণ করে ছিলাম না রান্না ঘরে না যাওয়ার জন্য?”

সাদনানের এমন ক্ষিপ্ত কণ্ঠে প্রশ্নে প্রিয়তা ভয়ে আরও একদফা ভায়ে গুটিয়ে গেলো নুইয়ে রাখা মাথা টা আরও নুইয়ে নিলো।
অতঃপর মিনমিন করে বলল

-“এখন তো পরীক্ষা শেষ।
তাছাড়া আমি তো এখন বউ এ বাড়ির।”

-“পরীক্ষা শেষ আমি যেতে বলেছি?”

সাদনান শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
প্রিয়তা এবার মাথা তুলে তাকালো সামনে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত সুদর্শন পুরুষ টার দিকে।
মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট চুল অগোছালো দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারা দিন বেশ দখল গিয়েছে মানুষ টার উপর দিয়ে।
সাদনান প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রাগ তার পড়ে গিয়েছে তবে আজ একটু শক্ত কথা বলতেই হবে।
পরীক্ষা চলাকালীনও প্রিয়তা টুকটাক কাজ করছে। সাদনান দেখেছে সেটা।
কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হলো দাদি।
সাদনান চোখে তেমন কিছু পরে নি কিন্তু সে শুনেছে সারা নিকট হতে।
দাদি প্রিয়তার পড়া লেখা নিয়ে ঝামেলা করেছে সাথে ওকে দিয়ে কাজ টাও করায়।
বউ তার ভীষণ ছোট তাই সে বউকে না হয় তাই একটু বেশি যত্ন করে এতেও তার দাদির সমস্যা।
এটাও নিয়ে নাকি সে দিন প্রিয়তা কে অনেক কথা শুনিয়েছে এটাও প্রিয়তা বলেনি সারা বলছে।
প্রিয়তা কোনো কথা সাদনান কে জানায় না।
কিন্তু সাদনান সে তো এসব জানা কোনো ব্যাপার না।
সাদনানের ভাবনার মাঝেই প্রিয়তা মিনমিন করে উত্তর দেয়

-“না। ক,,,,

-“এই আমি না করি নাই?
তাহলে কেন গিয়েছো?”

-“বউ আমি এ বাড়ির।”

-“সময় চলে গিয়েছে?
সারা জীবন পড়ে আছে। তাছাড়া মা, ছোট মা রান্নাঘরে করলে সাথে কাজের লোক সাহায্য করে।
তো তোমার সময় উল্টো কেন?
তুমি নাও না কেন?”

-“আমাকে তো দাদ,,,,

প্রিয়তা হঠাৎ থেমে গেলো।
সে চায় না কোনো ঝামেলা হোক।
তাই কথা ঘুরাতে শান্ত হয়ে সাদনানের বাম গালে নিজের ডান হাত টা রেখে ধীরে কন্ঠে বলল

-“আচ্ছা আর কাজ করবো না।
মন দিয়ে পড়বো। আর যদি কাজ করি তো কাজের লোক এর সাহায্য নেবো।”

সাদনান শুনলো। কিন্তু মনে হয় না আমলে নিয়েছে।
সে প্রিয়তার হাত টা গাল থেকে নামিয়ে ওয়াশ রুম যেতে যেতে বলল

-“কফি।”

কথা শেষ সাদনান পাঞ্জাবি এক টানে খুলে সে টা সোফায় ছুঁড়ে ফেলে চলে গেলো।
প্রিয়তাও গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে সোফা হতে পাঞ্জাবি টা তুলে সেটার নাকের সামনে ধরে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিলো।
ঘামের গন্ধ নেই।তবে পারফিউম আর সাদনানের শরীর গন্ধ টা প্রিয়তার নিকট বেশ লাগে।
সে এটা সব সময় করে তবে সেটা সাদনান এর অগোচরে।
কিন্তু আজ হয়তো আর সেটা লুকায়িত রইলো না।
সাদনান খট করে আবারও ওয়াশ রুমের দরজা খুলে তখন বেড়িয়ে এলে সে টাওয়াল নেয় নি।
কিন্তু এখানে এসে এরকম একটা দৃশ্য দেখবে সে ভাবতেও পারে নি।
প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে ছিল হঠাৎ আওয়াজ পেয়ে সে চোখ খোলে সামনে সাদনান কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোর ধরে পরে যাওয়ার মতো করে মাথা নুইয়ে কাচুমাচু
ভঙ্গিতে মিনমিন করে সাফাই গাওয়ার মতো করে বলল

-“দেখছিলাম ধুতে হবে নাকি।”

-“জিজ্ঞেস করি নি।”

সাদনান নির্লিপ্ত জবাব।
অতঃপর সে এগিয়ে গিয়ে ব্যালকনি হতে টাওয়াল নিয়ে পুনরায় ওয়াশ রুম চলে গেলো।

প্রিয়তা মুখ ভেংচি কেটে বিরবির করে বলে উঠে

-“আসার আর সময় পায় নি এখুনি আসতে হলো?”

—————-

রাহান কে সাদনান আজ সোজা মির্জা বাড়ি আসতে বলেছে।
তার কারণ রাহান ভীষণ ঘুমকাতুরে এই ছেলে যদি আজ নিজের বাড়ি যায়। তাহলে কাল দশ টার আগে ঘুম থেকে উঠতে পারবে না।
কিন্তু কাল সকাল সকাল নির্বাচন কমিশন অফিস যেতে হবে।
আর সাদনান এর বাম হাত রাহান।
সে সুবাদে রাহান কে সাদনানের সাথে থাকা জরুরি।
কিন্তু এই ছেলে আজ বাসায় গেলে আর কাল সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবে না।
তাই সাদনান রাহান কে ফোন করে আজ মির্জা বাড়ি আসার জন্য বলেছে।
সারা সোফায় বসে টিভি দেখছিল।
সাথে সুফিয়া বেগম আছে। আয়না শাশুড়ীর রুমে।
আম্বিয়া মির্জাও সেই যে রুমে গিয়েছে আর বেড় হয় নি এর মধ্যে। রাত আটটার মতো বাজে পুরুষ কেউ এখনো বাড়ি আসে নি।
আর সবাই বাড়ি এলে যে আজ একদফা করবে আম্বিয়া মির্জা এতে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু সাদনান এর সামনে টিকতে পারলে হয়।কারণ দোষ টা সম্পুর্ণ ওনার।
এই বাড়ির বউ শুধু রান্না করে আর সব কাজের লোক হাতে হাতে এগিয়ে দেয়। সেখানে আজ তিনি প্রিয়তা কে দিয়ে সব করিয়েছে। যদিও আগে ততটা কাজ করতে বলে নি এই যা।তবে আজ একটু বেশি করেছে অবশ্য একটু নয় অনেক টা বলা চলে।

সামনে টিভি চলছে ঠিক কিন্তু সারা সে দিকে ধ্যান নেই সে তো আনমনে কিছু ভেবে চলছে।
আর ওর ভাবনার মাঝেই কখন সুফিয়া বেগম চলে গিয়েছে সে টেরও পায় নি।
প্রিয়তা কে সাদনান নিয়ে যাওয়ার পর বাকি টা আয়না সুফিয়া বেগম মিলে করেছে আর সাথে তো কাজের দুই জন লোক আছেই।
সারা আনমনেই টিভির রিমোট হাতে নিয়ে বসে ছিল। এ-র মধ্যে হঠাৎ বাড়ির কলিং বেল টা সশব্দে বেজে উঠে।
সারা ভাবে হয়তো দাদা সহ বাবা, ছোট বাবাই এসছে তাই রিমোট রেখে তড়িঘড়ি করে দরজা খোলে। কিন্তু বাড়ির কেউ আসে নি এসছে রাহান।
সারা রাহান কে দেখেই বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।
কালো সার্ট কালো প্যান্ট এলোমেলো চুল।
দেখতে বেশ লাগছে।
রাহান এক পলক সারা’র দিকে তাকিয়ে বুকের কাছের একটা বোতাম খুলতে খুলতে ক্লান্ত ভরা কণ্ঠে বলল

-“একটু পানি দিবে।”

সারা ভীষণ মায়া হলো।
রাহান কথা শেষ সোফায় ধপ করে বসে গেলো।
সারা ডাইনিং টেবিলে রাখা জগ হতে আধ গ্লাস পানি নিলো তার পর ফ্রিজ খুলে সেখান থেকে বোতল হতে ঠান্ডা পানি মিশিয়ে রাহান কে দিলো।
রাহান এক পলক তাকিয়ে গ্লাস টা হাতে নিয়ে সব টা পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।
অতঃপর সামনে থাকা সেন্টার টেবিলে গ্লাস টা রেখে আবারও গা এলিয়ে দিলো সোফায়।
ইশ এখন যদি সারা ওর বউ হতো তখন কি এভাবে বসে থাকা লাগতো?
মোটেও না নিশ্চয়ই সারা কে জড়িয়ে ধরে রাখতো।
তবে একটা কথা মানতেই হবে ভালোবাসার মানুষ টাকে দেখলে সব ক্লান্তি হতাশা দূর হয়ে যায়।
এই যে সারা কে দেখে রাহানের এখন কেমন একটা ভালো লাগছে।
সারা দিন এতো এতো দৌড়াদৌড়ি কাজ এখানে সেখানে দৌড়াতে হয়। কিন্তু এখন এই ছোট্ট মুখ টা দেখার পর মনে হচ্ছে এসব কিচ্ছু না।
কেমন একটা প্রশান্তি লাগছে।
রাহান চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কয়েক বার।
সারা রাহান কে এভাবে দেখে ভাবলো হয়তো বেশি কাজ করছে।
অবশ্য কাজ বলা চলে না রাজনীতি মানেই সারা দিন বাহিরে রোদে দৌড়াদৌড়ি করা।
সারা চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছে কি বলবে বুঝতে পারছে না।
রাহানও তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
সারা আমতা আমতা করে।
শেষ মেষ কি বলবে বুঝতে না পেড়ে জিজ্ঞেস করে

-“আপনার কি শরীর বেশি খারাপ লাগছে?”

সারা প্রশ্নে রাহান মনে মনে হাসলো।
কেমন একটা শান্তি অনুভব হলো মনের ভেতর।
তবে মুখে গম্ভীর ভাব এনে জানালো

-“সারা দিন লাগছিল।
এখন সব ঠিক আছে।”

#চলবে……

আমার৷ তুমি পর্ব-২১

0

#আমার_তুমি
#পর্ব_২১
#জান্নাত_সুলতানা

পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন প্রাকটিক্যালও আজ শেষ। সারা প্রিয়তা দুইজনের পরীক্ষা বেশ ভালো হয়েছে সব গুলো। এখন বাকি টা রেজাল্ট আউট হলে বোঝা যাবে।
আজ রাহাত ওদের নিতে আসবে কারণ কাল নমিনেশন দিবে সাদনান সহ জাফর,আজ্জম মির্জা তাই আজ ওয়াসিফ দেওয়ান এর বাসায় গিয়েছে এটা নিয়ে আজ মিটিং হবে।
প্রিয়তা সারা
ওরা দুজন স্কুল এর ভেতর হতে বেড়িয়ে এসে দেখলো রাহাত গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে।
প্রিয়তা আর সারা কে এগিয়ে আসতে দেখে ফোন কেটে পকেটে নিয়ে নেয়।
এ-র পর টুকটাক কথা বলে ওরা গাড়িতে উঠে বসে।
রাহাতও গাড়ী স্টার্ট দিয়ে বাড়ির দিকে চলে আসে।

————–

মাইশা, আয়ান, তিন্নি অপেক্ষা করছে কবির খাঁন এর জন্য।
ওরা আজ চার জন এই বিকেল টা সারা এলাকা ঘুরে বেড়াবে।
তার কারণ তিন্নি। ওর ভীষণ মন খারাপ কলেজে কয়েক টা মেয়ে জেনে গিয়েছে ইলেকশন এর পর তিন্নি আর কবির এর বিয়ে হবে।
কিন্তু এটা জানে না তিন্নি আর কবির এর বিয়ে টা অলরেডি ঘরোয়া ভাবে হয়ে গিয়েছে।
তিন্নি ভাবে বিয়ে ঠিক হয়েছে জেনে মেয়ে গুলো ওকে ওই দিন এতো কথা শোনাল আর যদি জানতে পারে বিয়ে হয়ে গিয়েছে তখন কি করতো?
তিন্নি কে কয়েক টা মেয়ে মিলে ভীষণ ভাবে বাজে কথা বলেছে।
সে কেন স্যার এর সাথে কলেজ আসে স্যার এর বাড়িতে থাকে।
মাইশা তখন বলতে চেয়ে ছিল বিয়ের কথা বলে দিতে কিন্তু তিন্নি বলতে না করেছে।
তিন্নি এদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় নি।
শুধু বলেছে এটা যেনো স্যার কে জিজ্ঞেস করে।
তখন মেয়ে গুলো একটু ভয় পেয়ে যায়।
আর এই ফাঁকে মাইশা বলতে চাই বিয়ে হয়েছে কিন্তু তিন্নি কথা ঘুরিয়ে বলছে বিয়ে ঠিক হয়েছে।
বিয়ে টা এখুনি ধুমধাম করার কথা ছিল। কিন্তু মির্জা বাড়ির কোনো পুরুষ এখন সময় দিতে পারবে না বিধায় বিয়ে টা সে দিন তিন্নি কে হোস্টেল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর দিন দিয়ে দিয়েছেন।
এতে অবশ্য মির্জা বাড়ির সবাই উপস্থিত ছিল।
তিন্নি গাড়িতে জানার উপর থুতনি ঠেকিয়ে এসব ভাবছিল।
ঠিক তক্ষুনি কবির এর ডাকে ধ্যান ফিরে।
কবির এসে পেছনের সিটে ওর পাশে বসে গিয়েছে অথচ ও টেরই পায় নি।
আয়ান মাইশা সামনে বসা।
কবির বেশ দূরত্ব রেখেই বসে আছে।
বিয়ে হয়েছে কিন্তু তিন্নি কবির এর মাঝে এখনো স্বামী স্ত্রী এর মতো কোনো সম্পর্ক এখন গড়ে ওঠে নি।
সামনে তিন্নির পরীক্ষা আর তাছাড়া কবির নিজের মাঝে এখন কি এক জড়তা কাজ করে।
তিন্নি নিজেও দূরে দূরে থাকে।
ভালোবাসার মানুষ টার আশে পাশে তো থাকতে পারে আর কি চাই।
এতেই ভীষণ খুশি তিন্নি।
কবির এর বাবাও তিন্নি কে ভালোবাসে নিজের মেয়ের মতো আগলে আগলে রাখে।
কবির এর চাইতেও বেশি খেয়াল রাখে কালাম তিন্নির একজন বাবা হিসেবে যা করা দরকার সব করে কালাম খাঁন।
তিন্নি ওনাকে অল্প কয়েক দিন এর মাঝে অনেক আপন করে নিয়েছে।
তিন্নির ভাবনার মাঝেই তিন্নি একটা হাত কবির নিজের হাতের মুঠো পুরে নিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই ধীরে কণ্ঠে বলে উঠে

-“মন খারাপ করার প্রয়োজন নেই।”

তিন্নি কিছু বলে না চুপ চাপ তাকিয়ে থাকে পাশে বসা শশী কালার সার্ট পড়া সুদর্শন পুরুষ টার দিকে।
বেশ লাগছে দেখতে তিন্নির নিকট কবির কে।
যদিও কবির এর গায়ের রঙ তিন্নির চেয়ে বেশ ফর্সা। আর গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি গোলগাল মুখ চোখে কালো চিকন ফ্রেমের চশমা। সার্ট এর হাতা গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত রাখা নিঃসন্দেহে কোনো মেয়ে এক দেখায় এই পুরুষের প্রেমে পড়বে।
যেমন টা তিন্নি পড়ে ছিল।
যেটা আস্তে আস্তে ভালোবাসায় রূপ নিলো আর এখন পরিণয়।
কবির সামনে তাকিয়ে এক দৃষ্টিতে।
তার এই মেয়ে আশে পাশে থাকলে অন্য রকম অনুভূতি হয়।
খুব করে নিজের বাহুডোর আবদ্ধ করে রাখতে মন চায়।কিন্তু সেই সময় তো আর এখনো আসে নি এক্কেবারে নিজের করে পেতে যে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
ওদের ভাবনার মাঝেই আয়ান গাড়ি টা একটা রেস্টুরেন্টে এর সামনে থামায় তার পর সবাই রেস্টুরেন্টে এর ভেতর চলে যায়।
আজ সারা বিকেলে ঘুরবে ওরা।
মাইশা কেও সাথে রাখার পারমিশন আছে আর সেই জন্যই তো কবির কে বলে তিন্নি আয়ান কেও নিজেদের সাথে নিয়েছে।

——–

আজ রাতে রান্না প্রিয়তা কে করতে হবে।
আম্বিয়া মির্জা হুকুম।
ওনার কথা হলো বহুত তো হলো নাচানাচি বউ হয়ে বাহিরে। এখন তো পরীক্ষাও শেষ তাই এখন থেকে রান্না বান্না সব করতে হবে বউ বউয়ের মতো মন দিয়ে সংসার করবে ব্যাস।
প্রিয়তা রান্না মোটামুটি পাড়ে তবে অতটা পারদর্শী নয়।
ওর মনি ওকে দিয়ে এই কয় বছর কাজ করিয়েছে ঠিক তবে রান্না করে নি কক্ষণো প্রিয়তা।
হাতে হাতে এটা সেটা এগিয়ে দিয়েছে শুধু।
কিন্তু আজ এতো মানুষের রান্না একটু নার্ভাস প্রিয়তা।
সালেহা বেগম এর প্রেশার বেড়ে আছে তাই তিনি রুমে আছে এসব তিনি জানে না।
আর সুফিয়া বেগম আর আয়না আসতে পারবে না এটা আম্বিয়া মির্জার বারণ আর কাজের লোক গুলো যে যার মতো কাজ করছে তারা কেউ যেনো প্রিয়তা কে সাহায্য না করে এটাও ব’লেছে।
প্রিয়তা হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে চুলা হতে চিংড়ির তরকারি টা নামিয়ে রাখে।
ভাতের জন্য পানি বসিয়ে কেবিনেট খুলে সেখান থেকে চায়ের পাতা নামিয়ে পেছন ফিরতেই কাজের মেয়ে এসে বলে গেলো সাদনান এসছে আর প্রিয়তা কে রুমে যেতে বলেছে।
প্রিয়তা শুনলো না। ও ভাবছে রান্না টা করেই এক্কেবারে রুমে যাব।
তাই কফি করে কাজের মেয়ের হাতে দিয়ে পাঠিয়ে দিলো।
আম্বিয়া মির্জা তখনো সোফায় বসে।
প্রিয়তা কফি করে দিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।
কিন্তু সে টা আর স্থায়ী হয় না।
লিভিং রুমে ঝনঝন শব্দ তুলে কিছু ভাঙার আওয়াজ হলো।
প্রিয়তা তৎক্ষনাৎ হাতের কাজ ফেলে তড়িঘড়ি করে রান্না ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতেই সাদনান কে দেখতে পেলো আর একটু আগে সাদা রঙের কফি করে দেওয়া মগ টা টুকরো টুকরো হয়ে চার দিকে ছড়ি ছিটিয়ে নিচে পড়ে আছে।
প্রিয়তার বুঝতে সময় লাগলো না সাদনান রেগে গিয়েছে।
আয়না,সালেহা বেগম সারা সহ সবাই উপস্থিত এখানে।
আম্বিয়া মির্জা তখন প্রিয়তার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছে।
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে সাদনানের দিকে তাকাতেই সাদনান ঝড়ের বেগে এসে প্রিয়তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে টেনে দাদির সামনে দাঁড়ালো।
গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো

-“বউ হয় আমার।
কাজের মেয়ে নয়।দ্বিতীয় বার ওকে দিয়ে কাজ করাবে না। এতো কাজের লোক দিয়ে কি হবে যদি আমার বউ কে সবার জন্য রান্না করতে হয়?”

কথা শেষ সাদনান অপেক্ষা করে না বউ কে টেনে নিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরে।
প্রিয়তা স্তব্ধ।
সাদনান মিটিং শেষ পার্টি অফিস গিয়ে ছিল।
কাল নমিনেশন দিবে সেটা নিয়ে দলের ছেলেদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ছিল।
কিন্তু বাড়ি থেকে আয়নার ফোন হতে কল পেয়ে একটু ভ্রু কুঁচকে আসে।
কোনো সমস্যা হয়েছে ভেবেই ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ হতে সারা ফোন কানে বলেছিল দাদি প্রিয়তা কে আজ সবার রান্না করতে দিয়েছে।
ব্যাস এটুকুই।
সাদনান তড়িৎ গতিতে ফোন কেটে দিয়ে রাহান কে ওদিক টা সামলাতে বলে তড়িঘড়ি করে বাড়ি চলে এসছে।

#চলবে…..

আমার তুমি পর্ব-২০

0

#আমার_তুমি
#পর্ব_২০[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ]
#জান্নাত_সুলতানা

তিন্নি সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সারা রাত ঘুমুতে পারে নি হয়তো তাই।সারা মুখ জুড়ে ক্লান্ত ছাপ স্পষ্ট। আর কবির সে দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
এতোক্ষণ গাড়ি চালাচ্ছিল।কিন্তু তিন্নি ঘুমিয়ে পরেছে বিধায় কবির গাড়ি থামিয়ে তিন্নির ক্লান্ত ভরা মুখ টা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে।
কিন্তু হঠাৎ করে কোথাও মনের ভেতর হতে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে।
আচ্ছা এই মেয়ে টা আরও কয়েক বছর আগে ওর জীবনে কেন এলো না?
বেশি না আর দুই বছর আগে এলেও তো ওর প্রিয়তার প্রতি কোনো অনূভুতি হতো না।
এখনো তাহলে বুকের ভেতর সব টা জায়গায় জুড়ে ওর নিজের বসবাস হতো।
কিন্তু এখন তো কোথাও একটা প্রিয়তার জন্য সুপ্ত অনুভূতি থেকে গেলো।
হয়তো এটা সারা জীবন থাকবে।
কারণ প্রথম ভালোবাসা সবার মনে কোথাও না কোথাও থেকে যায়। যেটা চাইলেও মুছা সম্ভব হয় না।

কবির কথা গুলো ভাবতে ভাবতে তিন্নির মাথা টা সিট হতে খুব সাবধানের সহিতে আলগোছে নিজের কাঁধের উপর রেখে দেয়।
তিন্নি হাল্কা নড়েচড়ে উঠে তবে সম্পূর্ণ তন্দ্রা ছুটে না।
বরং কবিরের বাহু টা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
কবির সারা শরীর কেমন একটা অনুভূতি হলো।হয়তো এই প্রথম কোনো মেয়ের এতো সন্নিকটে এসছে তাই।

কবির বেশি কিছু না ভেবেই আবারও গাড়ী স্টার্ট দেয়।
এক হাতে ড্রাইভ করছে আর এক হাতে তিন্নির মাথা টা কাঁধে একটু পর পর হাত দিয়ে ঠিক করে দিচ্ছে।
এই রাস্তা টা বেশ নির্জন গাড়ি খুব কম চলে।
পৌঁছাতে হয়তো আর মিনিট দশ এক সময় লাগবে।
যদিও এটুকু জায়গায় পৌঁছাতে মোটেও এতো সময় লাগে না।
তবে কবির খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে।
ওরা বিকেলে রেস্টুরেন্টে থেকে বেড়িয়ে শপিং মলে গিয়েছে সেখানে গিয়ে অনেক গুলো থ্রি পিস আর দুই টা শাড়ী কিনে দিয়েছে কবির তিন্নি কে।
তিন্নি শুধু সব দেখছিল
ও যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। তিন্নি বুঝতে পারছিল না এসব কি হচ্ছে।
কবির শপিং মলে থেকে বেড়িয়ে তিন্নি কে নিয়ে পাশে একটা পার্কে গিয়ে ছিল।
আর সারা টা সময় তিন্নির হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে নিজের হাতের মুঠো নিয়ে রেখে ছিল।
তিন্নির তখন কেন জানি খুব করে কান্না পাচ্ছিল।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছিল ও বুঝতে পারছিল না হয়তো এভাবে কেউ কখনো এতো টা যত্ন করে আগলে আগলে রাখে নি, এতো টা ভালোবেসে যত্ন করে নি।
কবির তখন হটাৎ করেই তিন্নির হাত টা ছেড়ে দিয়ে নিজের পকেট হতে একটা রিং বেড় করে নিচে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলে ছিল সে সারা জীবন এভাবে তিন্নি কে আগলে রাখতে চায়।
পার্কে থাকা প্রতি টা কাঁপল আর পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা অনেকেই তিন্নি কে কবির এর প্রপোজে রাজি হয়ে যেতে বলছিল।
তিন্নি তখন কান্না ভুলে লজ্জা নুইয়ে পরে ছিল।
অতঃপর নিজের কাঁপতে থাকা বাম হাত টা কবির এর সামনে ধরে কবির সেটার অনামিকা আঙ্গুল রিং টা পড়িয়ে দিয়ে নিজের ঠোঁট জোড়া তিন্নির হাতের পিঠে ছুঁয়ে দেয়।
আর সবাই চার দিক হতে করতালি দেয়।
কবির এসব ভাবনার মাঝেই তিন্নি জোরে ডেকে উঠে

-“স্যার? ”

-“হ্যাঁ বলো।
কি হয়েছে?”

কবির তিন্নির হঠাৎ এতো জোরে ডাকা গাড়ি ব্রেক কষে জিজ্ঞেস করে তিন্নি অসহায় কণ্ঠে উত্তর দেয়

-“স্যার আমার অনেক টা পথ এগিয়ে এসছি।
হোস্টেল তো পেছনে।”

কবির তিন্নির কথা শুনে চার পাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে চাইলো।
সত্যি ওরা অনেক টা দূরে চলে এসছে হোস্টেল হতে।
আসলে কবির ভাবনার মাঝে এতোটাই বিভোর ছিল যে ও খেয়ালই করে নি। তবে
কবির নিজে কে ধাতস্থ করে বলে উঠে

-“খেয়াল করি নি।”

কথা শেষ কবির গাড়ি ঘুরিয়ে হোস্টেল এর দিকে আসে।
গাড়ি টা এসে হোস্টেল এর সামনে থামতেই তিন্নি নেমে এক সাইডে দাঁড়ায় কবিরও নেমে পেছন দরজা খুলে সেখান থেকে দুই টা প্যাকেট তিন্নির হাতে দিয়ে বলল

-“এখন এগুলো রাখো।
বাকি গুলো আমি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।
বাবা এসে এই সাপ্তাহের মধ্যে তোমাকে নিয়ে যাব।”

তিন্নি প্যাকেট গুলো হাতে নিলো।
কিন্তু ও কিছু বলতে চাইছে তবে বলতে পারছে না হয়তো।
কবির বুঝতে পারলো আর এটাও বুঝলো তিন্নি কি বলতে চায়।
তাই তিন্নি কিছু বলার আগেই কবির বলে উঠে

-“এসব নিয়ে টেনশন করতে হবে না।
বিয়ের সব ব্যবস্থা করেই বাবা তোমাকে বাড়ি নিবে।
আর সেটা এক সাপ্তাহের মধ্যে হবে।”

তিন্নি কিছু বলে না।
কবির আবারও বলল

-“সাবধানে থাকবে।”

তিন্নি মাথা নাড়িয়ে বলে উঠে

-“আচ্ছা।
আপনিও সাবধানে যাবেন।”

কবির তিন্নির দিকে তাকিয়ে আছে বেশ লাগছে দেখতে রাস্তার পাশে নিয়ন বাতি জ্বালিয়ে রাখার সেই কৃত্রিম আলোয়ে। তিন্নি ফিরে চলে যাচ্ছিল।
কিন্তু কবির পেছন থেকে আবারও ডেকে উঠে

-“শুনো।
কাল থেকে আর টিউশন যাবে না।
সবাই কে না করে দেবে।
মনে থাকবে?”

-“আচ্ছা।”

তিন্নি সেভাবে থেকেই মিনমিন করে উত্তর দেয়।
অতঃপর তিন্নি চলে যায় আর কবির সে দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে যতক্ষণ পর্যন্ত তিন্নি গেইট অতিক্রম করে হোস্টেল এর ভেতর না যায়।
তিন্নি ভেতরে চলে গেলেই কবির গাড়িতে বসে পড়ে।
তার পর চার তলা বিল্ডিং এর দোতলার তিন নাম্বার রুমের ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই রুম টায় তিন্নি থাকে কবির জানে আর কবির এটাও শিওর তিন্নি এখন রুমে গিয়ে একবার ব্যালকনিতে আসবে।
আর হলোও তাই কবিরের ভাবনার মাঝেই আবছা আলোর মাঝে তিন্নি কে ব্যালকনিতে এসে দুই হাত রেলিং এর উপর রেখে কবির এর গাড়ি টার দিকে তাকালো।
কবির সে দিকে তাকিয়ে নিজের ডান হাত টা বাহির করে ইশারা করে রুমে যাওয়ার জন্য।
তিন্নি রুমে চলে যায়।কিন্তু পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ঠিক তাকিয়ে রয় কবির এর গাড়ি টা যতক্ষণ না দৃষ্টির আড়াল হয়।

——————

প্রিয়তা সাদনান এর দেওয়া কাপড় গুলো পড়ে পা গুটিয়ে বসে আছে বিছানায়। ঘুম থেকে উঠছে মাত্র।
ওর কেমন লাগছে। যদিও এখানে তেমন লাগার কথা নয়।
স্বামী হয় ওর কিন্তু তবুও কেমন কেমন লাগছে। হয়তো এসব পড়ে অবস্তু নয় তাই।সব সময় তো লং ফ্রক বা কুর্তি এসব পড়ে।
সাদনান নেই ফ্রেশ হয় খাবার খেয়ে কোথাও গিয়েছে।
প্রিয়তা দেখছে রুম টাকে।
এই রুম টাও সাদা রঙের।বিশাল বড় একটা রুম সাথে ছোট একটা ব্যালকনিও আছে।
সেখানে বিভিন্ন রকমের ফুলের টব আর বড় বড় সবুজ পাতার টবও আছে।
কিন্তু ফুলের গাছ গুলো শুকিয়ে আছে।
যত্নের অভাব।
প্রিয়তা সে গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো। সন্ধ্যা সাত টার বেশি সময় বাজে এখন।দুপুর খাবার খেয়েছে কিন্তু এখন আবার ওর পেটে ভীষণ ক্ষুধা অনুভব করলো।
কিন্তু ও খাবে কি আর এই বাড়িতে তো প্রথম ও তো জানেও এখানে কিছু আছে কি না। আর দুপুরেতো সাদনান রুমে এনে খাইয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা যা-ই হোক একবার রান্না ঘরে যাওয়া যাক আর সেখানে কিছু আছে কি না সেটাও দেখা যাবে।
প্রিয়তা এসব ভাবতে ভাবতে রুম থেকে বেড়িয়ে এসে থম মেরে দাঁড়িয়ে রয়। এটাও সম্ভব? সাদনান রান্না ঘরে?
সাদনান রান্না ঘরে কিছু করছে।
প্রিয়তা সে দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো।
সাদনান টের পেয়েছে বউ তার পেছনে।
তাই কেবিনেট খুলে সেখানে কিছু খুঁজতে খুঁজতে বললল

-“আসার দরকার ছিল না।
দুই মিনিট এর মধ্যে আসছি।
তুমি রুমে যাও।”

প্রিয়তা শুনে না এগিয়ে গিয়ে ওভেন খোলে সেখান দেখা মিলে খাবার দিয়ে রাখা।
প্রিয়তা সেগুলো বের করে সাদনান ততক্ষণে প্লেট নামি ওভেন এর পাশে রাখে।
অতঃপর প্রিয়তার হাত থেকে খাবার প্লেট এ রাখে।
সাদনান প্লেট আর একটা পানির বোতল হাতে নিয়ে প্রিয়তা কে সাথে আসার জন্য ইশারা করে।
প্রিয়তা সাদনানের পেছনে পেছন যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে

-“খাবার কোথায় পেলেন?”

-“দারোয়ান দিয়ে আনিয়েছি।
কিন্তু সে গুলো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে তাই গরম করতে লেইট হয়ে গেলো।”

-“আমাকে বলতে পারতেন।”

-“হা করো।”

সাদনান প্রিয়তার মুখের সামনে খাবার ধরে হুকুম জারি করে।
প্রিয়তা মুখ খোলে ঝটপট খাবার খেয়ে নেয়।
সাদনান নিজেও খায়।
খাবার শেষ সাদনান প্লেট রেখে আসে রান্না ঘরে।
প্রিয়তা তখন রুমে বড় দেওয়ালের সাথে বসানো আয়নাটায় নিজে কে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। সাদা টি-শার্ট সাথে ছাই কালার থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।
খারাপ লাগছে না ভালোই লাগছে।
বলা যেতে পারে নাইকার মতোই লাগছে।
প্রিয়তা নিচের দিকে তাকিয়ে গায়ের গেঞ্জি টা হালকা উঁচু করে কোমড়ের কাছে প্যান্টা ঠিক করে মাথা তুলে আয়নায় তাকাতেই দেখা মিলে সাদনান বুকে হাত গুঁজে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।
প্রিয়তা সেটা দেখে তড়িঘড়ি করে গেঞ্জি টা টেনেটুনে ঠিক করে পেছন ফিরে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে

-“কখন এসছেন?”

-“এই তো যখন প,,,,

সাদনান আর কিছু বলতে পারে না।
প্রিয়তা তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে সাদনান এর মুখ চেপে ধরে নিজের ছোট হাতের সাহায্য।
আর সাদনান আস্তে আস্তে নিজের হাত জোড়া প্রিয়তার উন্মুক্ত কোমড়ে রাখে।
আসলে প্রিয়তা উঁচু হওয়ার কারণে ওর গায়ের গেঞ্জি টাও অনেক টা উপরে উঠে যায় তবে শরীর ঢেকে আছে।
কিন্তু সাদনান গেঞ্জি নিচ দিয়ে নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে প্রিয়তার পেট।
আর এভাবে থেকেই সাদনান প্রিয়তা কে নিয়ে হেঁটে পাশের রুমে চলে আসে।
প্রিয়তা ততক্ষণে সাদনান এর গলা জড়িয়ে ধরে নেয়।
সাদনান প্রিয়তা কে নিয়ে রুমে এসে লাইট টা অন করতেই প্রিয়তার চোখ ছানাবড়া।
পুরো রুম সুন্দর করে সাজানো।
শুধু সাদা গোলাপ ফুল দিয়ে।
প্রিয়তা অবাক হয়ে সাদনানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে

-“এসব কখন করেছেন?”

-“রাহান এসছিল সন্ধ্যা।
ওই করে দিয়েছে।”

সাদনান কথা শেষ করে প্রিয়তার গলায় মুখ গুঁজে অধর ছুঁয়ে দেয়।
প্রিয়তা কেঁপে উঠল।
কিন্তু প্রিয়তা হঠাৎ ধরে আসা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে

-“কাল বোম ছিল মিটিং এর জায়গায়?”

সাদনান শোনল অবাক হলো না।
বরং খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রিয়তার ঘাড়ে নাক ঘঁষে বলল

-“হুম।
রাহান বলেছে?”

-“না কাল রাতে আমি দাদু কে বলতে শুনেছি।”

সাদনান আর কিছু বলে না বউ কে ভালোবাসায় আর নিজের হাতের এলোমেলো স্পর্শে পাগল করে।
আর আরও একটা মধুচন্দ্রিমা রাত পাড় করে।
যার সাক্ষী হয়ে থাকে দূর আকাশের চাঁদ যার আলো কাচের জানালা দিয়ে আসছে যেটা এই অন্ধকার এর মাঝেও তাদের রুম টা কে আলো দিয়ে আলোকিত করছে।

#চলবে…….

ফ্লুজি পর্ব-২৬ এবং শেষ পর্ব

0

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব সংখ্যা ২৬ শেষ পর্ব]

আরশাদের বন্ধু সঞ্জয়ের মাধ্যমে প্রথমবার তুবার সাথে আরশাদের আলাপ হয়।সঞ্জয় ছিল ইন্ডিয়ান সনাতন ধর্মের ছেলে।
আরশাদ, সঞ্জয় এছাড়াও সাতজন ইতালিয়ান ছেলে মিলে সেবার তারা পরিকল্পনা করে কক্সবাজার ঘুরতে যাবে আর কক্সবাজার সম্পর্কে তাদের কারো তেমন কোন আইডিয়া নেই।ভিনদেশী ছেলেগুলো দেশে আসার জন্য উৎসুক ছিল।

এই ট্যুরের সকল দায়িত্বে ছিল সঞ্জয় এবং আরশাদ।তুবা তখন ঢাকায় থাকতো তবে পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে তার বেশ কয়েকবার কক্সবাজার যাওয়া হয়েছিল।তুবা এমনটাই জানিয়েছিল আরশাদকে।আরশাদের তো আর দেশ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই তাই তুবার সব কথা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য।

কক্সবাজার সম্পর্কে ধারণা নিতে গিয়ে তুবার সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় আরশাদের।যদিও তুবা নিজেই সম্পর্কটা যেচে পড়ে করেছিল।কিন্তু আরশাদ তাকে ভীষণ ভালোবাসতো সম্মান করতো।ভালোবাসার সম্মতিতে
আদর করে তুবার নাম ডাকতো ফ্লুজি।ফ্লুজি অর্থাৎ সুন্দরী।আরশাদের চোখে তার প্রেমিকাই সবচেয়ে বেশি সুন্দর।

ভালোবাসার ভ্রম জালে নিজেকে জড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব হারানো সহজ কথা নয়।ভরসা,বিশ্বাস,ভালোবাসা,সবটাই তখন এক গন্তব্যে ঠেকে যায়।
আরশাদের বেলায় ব্যপারটা ভিন্ন হয়নি সে নিজেও তুবার অস্তিত্বে নিজেকে হারিয়েছে বিলিয়েছে।

তুবাকে কেন্দ্র করে সঞ্জয় আর আরশাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।সেই সম্পর্ক আজও তাদের ঠিক হয়নি।কে কোথায় আছে কিংবা কোন পর্যায়ে আছে তারা কেউ জানে না।সঞ্জয় সম্পূর্ণ রূপে আরশাদকে ত্যাগ করেছে।

ঘুমন্ত আরশাদের পিঠে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো খুশবু।এত মাস পরেও পিঠে সেলাইয়ের দাগটা রয়ে গেছে।এসব দেখলে মেয়েটার কলিজা কাঁপে ভয়েরা হানা দেয় অন্তর জুড়ে।সেদিনের কথা ভাবলে দু’চোখ ঝাপসা হয় তার।শারীরিক ভাবে আঘাত পেলেও তা তো সেরে গেছে কিন্তু মানসিক যে আঘাত পেয়েছে তা তো এখনো সারেনি।খুশবুর মনে ভয় জমেছে বাসে উঠবে না বলে পণ করেছে।আরশাদকে একা ছাড়তে তার ভয় লাগে,এম্বুল্যান্সের সাইরেনে তার স্নায়ুর আন্দোলন বাড়ে,রক্ত দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে।একা থাকলে চোখের কোলে মৃত্যুর চিন্তা আসে, ফলে বেড়ে যায় তার ভয়।আরশাদের সেলাই করা স্থানে হাত বুলিয়ে কেঁদে ফেললো খুশবু।মেয়েটার উষ্ণ নোনা জল আরশাদের পিঠে গড়িয়ে পড়তে ছেলেটার ঘুম ছুটে যায়।পিঠে খুশবুর অস্তিত্ব বুঝতে পেরে রয়ে সয়ে পিঠ উল্টায়।

” ফ্লুজি কাঁদছো কেন?”

” জানি না।”

” কে কি বলেছে?ভয় পেয়েছো?”

” আরশাদ আপনার এই দাগগুলো….”

” থামবে তুমি?আমার থেকেও সবচেয়ে বেশি আঘাত তুমি পেয়েছো।”

” চা করেছি।”

” তুমি আবার এসব কেন করলে?আমি কি বলেছিলাম আমার কথা শুনবে না তুমি তাই না?”

” শুয়ে বসে আর কত দিন কাটবে।তাই একটু…”

” যা ইচ্ছে করো কিন্তু হাত বাড়িয়ে বিপদ ছোঁয়ার মানে নেই।”

আরশাদ চায়ের কাপটা হাতে তুলে চুমুক দিল।তৃপ্তিতে জুড়িয়ে গেল মন প্রাণ।

” চা ভালো হয়েছে।”

” আরেকটু আনবো?”

” না।বসো আমার কাছে।”

” শাশুড়ী মা একটু আগে ফোন করলেন।”

” কি কথা হলো?”

” জানতে চাইলো ইতালিতে যাব কবে।আমি কিছু জানাইনি।”

” তুমি বলো কবে যাবে?”

” চলুন আজকে যাই।”

খুশবুর বোকা বোকা কথায় আরশাদ হেসে ফেললো।চায়ের কাপে পুনরায় চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।

” বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকি আসছে।ভাবছি এবার একটা সারপ্রাইজ তাদের দেব।”

“তবে টিকেট কাটুন আমি যত দ্রুত সম্ভব যেতে চাই।”
.
খুশবু চলে যাবে শুনে সাহস করে দ্বিতীয় বারের মতো নীরা আজ খুশবুর বাসায় এসেছে।বাহারুল হক কিংবা অনিমা কেউ পছন্দ করেন না নীরাকে,তারা চাননা নীরার সাথে খুশবু কিংবা আরশাদ কেউ কোন সম্পর্ক রাখুক।কিন্তু খুশবু এসবে পরোয়া করে না নীরার সাথে তার সম্পর্ক ভীষণ ভালো।গরম গরম পকোড়া মুখে তুলে নীরা বলে,

” ধরো আমরা তিন বোন এক বাড়িতে থাকতাম।”

” আমরা একই জামা পরতাম।”

” ইসস কত সুন্দর হতো তাই না?”

” কিন্তু একজন তো মরেই গেল!আমার যে আরেকটা বোন আছে তা আমি জানলাম কিন্তু তার মৃত্যুর পর।আমাদের জীবনটা কি অদ্ভুত তাই না?”

” তুবার কোন খোঁজ আরশাদ নিয়েছিল?মেয়েটার পরিবার কোথায়?কার কাছে মানুষ হয়েছে?”

” তুবা বেশ ভালো ঘরেই বড় হয়েছে।ওর বাবা মা দুজনে সরকারি চাকরিজীবি।ওর একজন বড় ভাই আছে।এক কথায় ওঁকে নিয়ে বলা যায় মেয়েটা ভীষণ ছটফটে ছিল।”

” তুমি ওর মা বাবার সাথে দেখা করেছিলে?”

“একদমি নয়।আমার বাবা মা চাননা এসব নিয়ে চারদিকে কথা সৃষ্টি হোক।”

” হুম তোমার বাবা মা আমাকেও পছন্দ করেন না।না করাই স্বাভাবিক।”

“তুবাকেও কিন্তু ছোট বেলায় বিক্রি করা হয়েছিল।”

” জানি।শুধু আমাকেই রেখে দিল।রেখে কি হলো?আমার জীবনটা কেমন যেন হয়ে গেল।”

” নীরা তোমার কি এই পাপ থেকে বের হতে ইচ্ছে হয় না?আমি তোমায় সুন্দর জীবন দেব,মা বাবা দেব প্লিজ নীরা তুমি বেরিয়ে এসো ওই বিশ্রি জীবন থেকে।”

” সুন্দর জীবন!এতই সহজ?”

” আমাকে একটুখানি ভরসা করো।কথা দিচ্ছি আমি তোমার জীবন পালটে দেব।একটা স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে তুমি ফিরবে।”

নীরার দু’চোখ চকমক করে উঠলো।সুস্থ জীবনে বেঁচে থাকার লোভ তারো আছে কিন্তু পরিস্থিতি যে তার প্রতিকূলে।

” বলা সহজ করা কঠিন।”

” মোটেও না।প্লিজ নীরা তুমি পারবে।আমি আমার বাবা-মাকে বোঝাবো তারা তোমাকে ঠিকি মেনে নেবে।”

” দেখা যাবে।”

” তুমি ইতালি যাবে নীরা?আরশাদ তোমাকে কোন জব সেক্টরে সুযোগ করে দিতে পারে।”

” ভেবে দেখবো।”

” আমি যেদিন চলে যাব সেদিন তুমি আমাকে টেক অফ করতে আসবে?”

” আসবো।”

” আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার।”

খুশিতে নীরার হাত জড়িয়ে ধরলো খুশবু।ভাই বোন না থাকার যে আফসোসটা খুশবুর ছিল তা নীরা এসে ঘুচে দিল অতি সহজে।
.

এক্সিডেন্টের পর খুশবুর শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে অন্যদিকে আর মন ঘুরাতে পারেনি আরশাদ।নিজের শারীরের জখম নিয়েও ছুটেছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।মেয়ে জামাইয়ের অবস্থায় অনিমা ভীষণ ভাবে অসুস্থ হলেন তাকে নিয়ে শুরু হলো হসপিটাল ছোটাছুটি।তিনদিন তিনি হসপিটাল ভর্তি ছিলেন।সব মিলিয়ে আরশাদের জীবন থেকে নয় মাস কেটেছে।সে এবং খুশবু এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।আরশাদ ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে,
চোখ মুখ ঢেকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল নীরা,ছাদে দাঁড়িয়ে তা চুপচাপ দেখলো আরশাদ।তখনি অনিমা এসে আরশাদের উপর চড়াও হলেন,

” তোমাকে বারবার বলেছিলাম নীরার সাথে খুশবু যেন যোগাযোগ না করে।শুনলে না আমার কথা।”

” সরি।খুশবুর খু্শি আমি কেড়ে নিতে পারবো না।”

” যা ভালো বুঝো করো।”

অনিমা রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন নিচে।আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।আর তো বেশিদিন নয় কয়েকদিন পরেই ইতালিতে পাড়ি জমাবে ফ্লুজিকে নিয়ে।নীরার সান্নিধ্যে খুশবু আর একটা দিনেই তো।

কথায় আছে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে।আরশাদ প্রথম পর্যায়ে খুঁজে ছিল তুবাকে অথচ পেয়ে গেল খুশবুকে।দ্বিতীয় পর্যায়ে নীরা সামনে এলো, নীরার সত্যতা যাচাইয়ে দেশে এলে কয়েক মাস পর বেরিয়ে এলো তুবার পরিচয়।
তুবার মৃত্যুর দিন আরশাদ তাকে শেষ বারের মতো দেখেছে।এক্সিডেন্টের প্রথম তিন মাস তার ব্যস্তায় কেটেছে বিঁধায় তুবার সম্পর্কে তেমন কোন খোঁজ নেওয়া হয়নি।

খুশবু যখন সুস্থের পথে আরশাদ তুবার পরিবারের খোঁজ লাগালো।সেদিনের এক্সিডেন্টের প্রতিটা নিউজ সবটা ঘেটেছে সে।মৃত ব্যক্তিদের পরিচয় তালিকা থেকে আরশাদ তুবার সম্পর্কে কিছুটা তথ্য জানতে পারে।আর সেই সব ইনফরমেশন নিয়ে তুবার পরিবারকে খুঁজতে লোক লাগায়।
সেদিন গ্রাম থেকে ভাইয়ের সাথে শহরে ফিরছিল তুবা,মেয়েটা কি জানতো সেদিনি তার জীবনের ইতি টানতে চলেছ?খুশবু এবং আরশাদ যে বাসে ছিল তার বিপরীত বাসে ছিল তুবা এবং তার ভাই।মেয়েটার মৃত্যু আরশাদের কাছে কিছু অপ্রকাশিত অধ্যায় রেখে গেছে।

” সম্পর্কের একটা সময়ে এসে অযথা বাড়াবাড়িতে তুবা কেন সম্পর্ক ছিন্ন করলো?”

” আরশাদকে ছেড়ে যাওয়ার কারণ কি ছিল?”

” তুবা কি আসলেই ভালোবেসেছিল তাকে?”

” এত এত যত্ন আদরে মাখা বুলি সবটাই কি লোভ আরশাদের টাকার উপর ছিল?আরশাদ যখনি অতিরিক্ত দূর্বল হয়ে পড়লো সুযোগ বুঝে সরে গেল তুবা..কিন্তু কেন?”

এসবের উত্তর আজও অজানা আরশাদের কাছে।তুবার মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই এসব প্রশ্নের সমাধান পাওয়া মুশকিল।তুবার বন্ধুদলের কেউ আরশাদকে চেনে না।তুবা যখন আরশাদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল তখন আরশাদ নামক প্রেমিকের কথা কাউকে জানায়নি।
তুবার মৃত্যুর পর সবার কাছে আরশাদ জানতে চেয়েছে কেউ আরশাদ নামের ব্যক্তিকে চেনে কি না।যে ছেলেটা একটা সময় তুবার প্রেমিক ছিল।
এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই অবাক হয়েছে কেউ চেনে না আরশাদকে।কেউ না।সবাই বরং পালটা প্রশ্ন করেছে তুবার আবার কবে প্রেমিক ছিল?

সবশেষে ছেলেটার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া উপায় নেই।ভাগ্যিস সরল সহজ খুশবুটা ছিল তা না হলে আরশাদের কী হতো?খুশবু যদি কোন একদিন তুবার মতো হারিয়ে যায়?এসব ভাবলে আরশাদের অস্থিরতা বাড়ে দম বন্ধ লাগে।আরশাদের আর বুঝতে বাকি নেই তুবা তাকে ঠকালো।তাই তো তুবার নামটাই তার কাছে বিষাক্ত রসের মতো।নামটা শুনলেই বিরক্তে মুখ কুচকে ফেলে সে।যার বর্তমান এত মধুর,স্নিগ্ধ,সরল সে কেন অতীতের বিষাক্তকে নিয়ে ভাববে?বর্তমান নিয়ে সুখে থেকেও যারা যেচে বিষাক্ত অতীতের পেছনে ছুটে তারা সত্যি কারের বোকা,নির্বোধ।
কিন্তু সব শেষে সত্যটা তো অপ্রকাশিত, সত্যি কি তুবা ঠকিয়েছিল আরশাদকে?নাকি বিপর্যয় পরিস্থিতিতে পড়ে মেয়েটা বাধ্য হলো আরশাদকে ছাড়তে।

আরশাদ ছাদ পেরিয়ে ঘরে ফিরলো।অনিমা আর খুশবুর ভীষণ ভাবে ঝগড়া চলছে,তাদের ঝগড়া কি নিয়ে তা নিশ্চয়ই বলতে হবে না?আরশাদ মা মেয়ের পাশ কাটিয়ে নিজের কক্ষে ফিরলো।ইতিউতি করে হাঁক ছেড়ে ডাকলো খুশবুকে।

“ফ্লুজি এদিকে আসো একটা জিনিস খুঁজে পাচ্ছি না।”

খুশবুর ঝগড়া থেমে গেল।আরশাদের উদ্দেশ্যে চেচিয়ে বলে,

” কী খুঁজে পাচ্ছেন না?”

” আরে রুমেই তো ছিল।এখন খুজে পাচ্ছি না”

” কি পাচ্ছেন না বলবেন তো।”

” তুমি এসে খুঁজে দাও?”

খুশবু মায়ের সাথে আর তর্ক ছেড়ে চলে যায় আরশাদের কাছে।দরজার কাছে খুশবুকে দেখে চটজলদি মেয়েটাকে টেনে আনে সে।

” এই তো পেয়েছি।”

” কি পেয়েছেন?”

” তোমাকে।তোমাকেই তো খুঁজছিলাম হানি।”

” কেন খুঁজছিলেন?”

” তুমি ঠিক আছো?”

” হ্যাঁ আছি কেন?”

” তাহলে চলো।”

” কোথায়?”

আরশাদ প্রত্যুত্তর করলো না।তার আগেই শার্টের বোতামে হাত রাখলো।খুশবুর আর বুঝতে বাকি নেই আরশাদ কি চাইছে।মেয়েটা কপট রাগ দেখিয়ে আরশাদকে বলে,

” আরশাদ এখন না।”

“এখনি।”

” অসময়ে…”

” রোমান্সে সময় লাগে?আমি আরশাদ ইহসানের সব পরে রোমান্স আগে হোক সেটা সময় অসময়।”

” আমি বলে আপনাকে সামলাই অন্য কেউ হলে….”

” অন্য কেউ লাগবে না তুমি আছো তো।”

” না আমি নেই।”

খুশবু ছুটে পালাতে যায়।দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগেই আরশাদ তার ওড়না চেপে ধরে টেনে আনে।দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে বাঁকা হাসে।

” এমন ভাব করছো যেন আমরা নব দম্পত্তি।তুমি লজ্জায় পালিয়ে যাচ্ছো ”

” আপনিও তো এমন ভাব করছেন যেন আপনি…. ”

খুশবুর কথা থেমে যায়।আরশাদ তার কাছে এসে খোলা চুল গুজে দেয় কানে।দু’হাতের আঁজলায় দখল করে মেয়েটার দু’গাল।আরশাদের ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া খুশবু আর উপায় খুঁজে পায় না।পাবে কি করে?প্রতিবার আরশাদ তাকে উস্কে দিয়ে ইনোসেন্ট ভাব ধরে সরে যায়।
.
এয়ারপোর্টের সামনে নীরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে খুশবু।মেয়েটার আজ আসার কথা ছিল কিন্তু এখনো আসছে না ফোনটাও রিসিভ করছে না।কোন বিপদ হলো না তো?ভয়ে খুশবুর গলা শুকিয়ে আসছে।অনিমা বাহারুল এবং আরশাদ অনেকবার খুশবুকে যেতে বলেছে নীরা নিশ্চিয়ই আসবে না কিন্তু মেয়েটা জেদ ধরে বসে আছে যত যাই হয়ে যাক নীরা নিশ্চয়ই আসবে।সময় গড়িয়ে গেল আরো কিছুক্ষণ, আরশাদ আর দাঁড়ালো না ব্যাগপত্র হাতে তুলে যেতে নিলে খুশবু চোখ ঝাপসা হয় আরশাদকে অনুরোধ করে আরেকটু থাকতে।হঠাৎ একটি মেসেজের শব্দে মনোযোগ সরে খুশবুর।চেক করতে দেখতে পায় নীরা মেসেজ পাঠিয়েছে।

” এয়ারপোর্টে আসতে পারিনি বলে দুঃখিত।আমি অনেক ভেবে দেখিছি কেউ কখনো আমাকে গ্রহণ করবে না মূলত আমি এমন কোন পথে নিজেকে ধাবিত করিনি যে, যে কেউ আমাকে সাদরে গ্রহণ করবে।তোমার পরিবার নিয়ে তুমি খুশি থাকো খুশবু।আমি তোমার সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাব।মন খারাপ করেনা লক্ষ্মী বোন পরে কথা হবে।আমি এখন নতুন ক্লাইন্টের সাথে সিলেট যাচ্ছি।ভালো থেকো।”
.

প্রচন্ড ঠান্ডায় আরশাদের বুকে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে খুশবু।বিড়াল ছানার ন্যায় ঘুমের মাঝে উষ্ণতা খুঁজছে সে।ঠান্ডায় শরীর থেমে আসছে আরশাদের রুম হিটার গত রাতে চালানো হয়েছে তাহলে এত ঠান্ডা হঠাৎ লাগছে কেন?আরশাদ পিটপিট চাহনিতে চোখ খুললো।পর্দার দরুনে বাইরের দৃশ্য চোখে পড়ছে না।আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী দুদিনের মধ্যে তুষারপাত হবে।তবে কি তুষার পড়ছে?আরশাদ খুশবুকে শুইয়ে উঠে দাঁড়ালো।মেয়েটার উন্মুক্ত দেহে ব্লাঙ্কেট জড়িয়ে দিয়ে ছুটে গেল করিডোরে।
করিডোরের দরজা খুলতে হানা দিল তুলতুলে বরফেরা।চারদিকে ঘেরা তুলো পেঁজার ন্যায় বরফেরা ঘিরে রেখেছে চারিদিক।আরশাদ আনন্দে উত্তেজিত হয়ে পড়লো দ্রুত ছুটে গেল খুশবুর কাছে।মেয়েটাকে ব্লাঙ্কেট সহ পাঁজাকোলে তুলে ছুটে গেল বারান্দায়।তুলতুলে বরফেরা ছুঁয়ে দিল খুশবুর গাল গলা।ঠান্ডায় চমকে উঠে সে।চোখ খুলতে পৃথিবীর অন্যরকম সৌন্দর্যে বিমোহিত মেয়েটা।

” আরশাদ আমি কি সত্যি দেখছি?”

” হ্যাঁ সত্যি জান।ফাইনালি তুমি স্নোফলের দেখা পেলে।”

” চলুন নিচে যাই।”

বাংলাদেশ থেকে এসে আরশাদ পরিকল্পনা করে স্নোফল দেখার উদ্দেশ্যে ফ্লুজিকে নিয়ে মিলান শহরে যাবে।এর আগের বার মিলানে গেলেও তাদের সেই স্মৃতিগুলো সুখকর ছিল না কেননা নীরার আগমন সবটাই উলটে পালটে দেয়।
জীবনের আনন্দেরা আজ এই পর্যায়ে এসে থমকে যায়।টিভিতে,অনলাইনে,মুভিতে সে কত দেখেছিল স্নোফল ফাইনালি খুশবু নিজে ছুঁয়েছে দেখেছে।তুষারে ঢেকে গেছে চারদিকে।আরশাদ তার ফ্লুজিকে নিয়ে একটি হোটেলে উঠেছে।হোটেলের মাঠে তুষারের বৃষ্টিতে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা।এক দলা তুষার নিয়ে আরশাদের মাথায় ছুড়ে খুশবু আরশাদ কয়েক সেকেন্ড স্থির থেকে তুষার কুড়িয়ে খুশবুকে তাড়া করে।দুজনে ছুটতে থাকে উদ্দেশ্যহীন।একটা পর্যায়ে খুশবু ছিটকে পড়ে বরফের গোলায় সেই সাথে পড়ে যায় আরশাদ।

” আরশাদ সরি।আমি…”

খুশবু কথা শেষ করার আগেই আরশাদ বরফের গোলা নিয়ে খুশবুর মুখে ঠেসে দেয়।

” এটা কি করলেন আপনি?ঠান্ডা লাগছে তো।”

” উষ্ণতা লাগবে?”

আরশাদ চট করে খুশবুর ঠোঁটে ঠোঁট মেশায়।আশেপাশে অনেক ইতালিয়ান দম্পত্তি তাদের দেখে সিটি বাজায় কেউ বা হাসতে হাসতে ঠোঁট মেশায় তার স্ত্রী/প্রেমিকার।
.
এরপর সম্পর্কের চড়াই-উতরাইয়ে আরো তিনটে বছর পেরিয়ে গেল।এই তিন বছরে কি আরশাদ এবং খুশবুর সম্পর্ক মধুর হয়েছে?নাকি হেমলোকের বিষাক্ততা ঘিরে ধরেছে তাদের সম্পর্কে?
মানুষের সুখের সন্ধান তৃতীয় ব্যক্তির আড়ালে রাখা শ্রেয়।বদনজর বলেও তো একটা কথা আছে।
আরশাদ এবং খুশবুর সম্পর্কে কি তাই আছে?একজোড়া কপোত-কপোতীর সুখ পছন্দ হলো না তৃতীয় ব্যক্তির।নিজের হিংসাত্মক মনোভাবে একটা মেয়ের সংসার ভাঙতেও কুণ্ঠা বোধ করেনি নীরা।

শেকলের শব্দে আচমকা আরশাদের ঘুম ভেঙে যায়।পিটপিট চোখে তাকাতে দেখতে পেল খুশবু পা টিপে টিপে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।মেয়েটার বোকা বোকা কার্যক্রমে আরশাদ হাসে।বিছানার সাথে বাঁধা শেকলটা টানতে খুশবু হুমড়ি খেয়ে পড়তে যায়,অবশ্য পড়তে পড়তেও নিজেকে ধরে নেয় সে।হাতের শেকলটার দিকে তাকিয়ে ভীত চাহনিতে তাকায় আরশাদের পানে।আরশাদ তখন বাঁকা হাসছিল।

” কোথায় যাচ্ছো ফ্লুজি?”

খুশবু ভয় নিয়ে বলে,

” আমার খিদে পেয়েছে।”

” খাবার তো ডয়ারে রাখাই আছে।”

” সব শেষ।”

আরশাদ উঠে বসে।দ্রুত পায়ে তার ফ্লুজিকে টেনে এনে বসায় বিছানায়।

” একটু অপেক্ষা করো জান আমি আসছি।”

এখনো পরিপূর্ণ সকাল হয়নি।ফ্লুজির খিদে পেয়েছে বলে আরশাদ তাড়াহুড়ো করে ফ্রিজ থেকে কিছু ফ্রোজেন খাবার নিয়ে গরম করলো।

খুশবু বিছানার এক কোণে বসে রয়।মেয়েটার বাম পায়ে এবং বাম হাতে শেকল বাঁধা।অবশ্য এই দশার জন্য সে নিজেই দায়ী।নীরার প্ররোচনায় আরশাদের সাথে অনেক মনোমালিন্য করেছে সে।ঝগড়া বিবাধে লিপ্ত হয়েছে।খুশবু যখন বাবা মায়ের কাছে ফিরতে চায় আরশাদ বারণ করেনি ইমার্জেন্সি টিকেট কেটে মেয়েটাকে দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে কিন্তু দেশে গিয়ে খুশবু তার রূপ পাল্টেছে।আরশাদকে ছাড়বে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।ঝগড়ার মাঝে একদিন বলে বসলো আরশাদকে ডিভোর্স দেবে…সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেললো আরশাদ কৌশলে তার ফ্লুজিকে নিয়ে এলো ইতালিতে।
তারপরেই খুশবুকে বাঁধা হলো শেকলে।ফ্লুজি ছেড়ে যাবে মানে কী?আরশাদের কাছে ভালোবাসার সজ্ঞা ভিন্ন, ভালোবাসার মানুষকে মুক্তি দিয়ে ভালোবাসা মানে নিজে কষ্ট পাওয়া।আরশাদ কষ্ট পেতে চায় না সে চায় ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে বছরের পর বছর কাটাবে।নীরার সকল ষড়যন্ত্র আরশাদ ঠিকি বুঝলো একটা সময় পর খুশবু নিজের ভুল বুঝতে পারলো।সে যে ভুলটা করেছে এর হয়তো ক্ষমা হয়না।আরশাদের মতো মানুষকে কষ্ট দিয়ে সে ভুল করেছে।না শুধু ভুল নয় মহাভুল।

এত সবের পরেও নিশ্চয়ই প্রশ্ন থেকে যায় নীরার এসব করার কারণ কি?মূলত হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।
যেভাবে আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।মানুষের চরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ অন্যতম। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে বিষাক্ত করে তোলে।

খুশবুর জীবনে না পাওয়ার কি আছে?মেয়েটা ভালো পরিবার পেয়েছে,বিশ্বস্ত স্বামী পেয়েছে।খুশবুর এতটা সুখ নীরার আর সহ্য হলো না।নানান প্রবঞ্চনায় খুশবুকে জড়িয়ে আরশাদের নামে ইন্ধন জোগায় নীরা।সবশেষে বোকা খুশবু আরশাদকে ভুল বুঝলো সুখের সংসারটা গলা চেপে বিষময় করে তুললো।এসব নিয়ে খুশবুর এখন আফসোস হয় বড্ড বেশি আফসোস, সে কেন বোকামিটা করলো?আরশাদ এসব নিয়ে নীরার সহিত মুখোমুখি হয়নি।তার মনে একটাই প্রশ্ন জাগে তার ভালোবাসায় কী কমতি ছিল যে তার ফ্লুজি তাকে ভুল বুঝলো?ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন তুললো?

সব মিথ্যা সত্য হয়ে যাক,সুখেরা ডানা ঝাপটে মরে যাক,এই জগৎ সংসার আরশাদের বিপক্ষে যাক তবুও আরশাদ তার ফ্লুজিকে ছাড়বে না।আরশাদ বড্ড স্বার্থপর নিজের ভালোর জন্য ফ্লুজিকে তার চাই।

গরম গরম পাস্তা ফুঁ দিয়ে খুশবুকে খাইয়ে দিচ্ছে আরশাদ।এত কিছুর মাঝে আরশাদের ভালোবাসা দেখানো স্বভাবটা থামেনি কিন্তু বেড়েছে উগ্রতা, জেদ, রাগ।খুশবর শেকল বন্দি জীবন সম্পর্কে অনিমা কিংবা বাহারুল হক কেউ জানেন না।ইমরান ইহসান,আফরোজ এসব নিয়ে আরশাদের সঙ্গে যতবার আলোচনায় বসেছে ততবার আরশাদ এড়িয়ে গেছে।তার একটাই কথা তার ওয়াইফ সবটা তাকে বুঝে দেওয়া উত্তম।

খাওয়ার শেষে খুশবু পুনরায় বিছানায় শুয়ে পরে।শেকলের শব্দ তার জীবন থেকে ঠিক কবে যাবে সে জানে না।আরশাদ চুপচাপ এসে শুয়ে পড়ে তার ফ্লুজির পাশে।মেয়েটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আচমকা খুবলে ধরে সব চুল।ব্যথায় চাপা আর্তনাদে চেচিয়ে উঠে খুশবু,

” আরশাদ আমার লাগছে ছেড়ে দিন।”

” নীরা তোমায় কি বলেছিল জান?”

” আপ.. আপনি আমায় ভালোবাসেন না। আপনি তুবাকে ভালোবাসতেন আমাকে শুধু শারীরিক চাহিদার…”

” এতটা চাহিদা থাকলে তোমার মতো একটা মেয়েকে আনতাম?শুধু শারীরিক চাহিদার জন্য আমার রুচি এতটাই জঘন্য?আরশাদ ইহসানের জন্য মেয়ের অভাব নেই।”

যেদিন থেকে শেকলে বন্দি খুশবুর জীবন সেদিন থেকে আরশাদ একই প্রশ্ন করেছে এবং একই উত্তর দিয়েছে।খুশবুর ভীষণ ভাবে কান্না পায় সাজানো সংসারটা সে নিজ হাতে তছনছ করেছে। আরশাদ খুশবুর গাল চেপে পুনরায় প্রশ্ন করে,

” ছেড়ে যাবে আমায়?ডিভোর্স চাই?”

খুশবু প্রত্যুত্ত করার আগে গলগলিয়ে উগড়ে দেয় পেটের সব।মেয়েটার মাথা ঘুরছে,আরশাদ উঠে দাঁড়াতে খুশবু চেপে ধরে আরশাদের টি-শার্ট।

” আপনি যাবেন না আপনাকে আমার দরকার।আরশাদ আমার ভালো লাগছে না।আমার কেমন যেন লাগছে।”

কাঁপতে কাঁপতে আচমকা নিস্তেজ হয়ে গেল খুশবুর শরীর।আরশাদ ভীষণ ভয় পেলো।ভয়ের চোটে ছেলেটা কেঁদেই ফেললো।দ্রুত শেকল খুলে ফোন করলো আরিবকে।মেয়েটাকে ইমিডিয়েট হসপিটাল নিতে হবে।
.

খুশবু ভীত চাহনি শুধু আরশাদকে খুঁজছে।হসপিটালের একটা কক্ষে সে একাই শুয়ে।আরশাদ এলো বিধ্বস্ত অবস্থায়,খুশবু তাকে দেখে খুব চমকালো।ছেলেটা ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা,দু’চোখ লাল,চুলগুলো উষ্কখুষ্ক।

” আরশাদ আপনি ঠিক আছেন?”

আরশাদ প্রত্যুত্তর করলো না।খুশবুর পাশে বসে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে।নিরবতা ছিন্ন করে আচমকা আরশাদ কেঁদে উঠলো হুহু করে।খুশবু ভয় পেল এক হাতে আরশাদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

” আরশাদ আমার কি খুব বড় অসুখ হয়েছে?”

” আমি বাবা হতে চলেছি জান।আসো মিষ্টি মুখ করি।”

খুশবু কিছু বুঝে ওঠার আগে ঠোঁটে ঠোঁট মেশালো।মেয়েটা হাঁপিয়ে ওঠতে আরশাদ তাকে ছেড়ে উঠে বসে।

” তোমার আদরে ভাগ পড়েছে জান।না না আমার আদরে ভাগ পড়ে।বলো কী চাই?সব দেব সব।এতটা খুশি আগে কখনো হইনি আমি।এলোমেলো আমি কি না বাবা হচ্ছি!”

” আমার আগের জীবন ফিরিয়ে দিন আরশাদ আমি যা করেছি সবটাই ভুল ছিল।”

” মানছো তবে?”

” অনেক আগেই মেনেছিলাম।”

” তুমি বুঝো না?আমার সব ক্লান্তি তেষ্টা নয়নের তৃপ্তি সবটা তোমায় ঘিরে।”

খুশবু হাসে আরশাদের গালে হাত রেখে বলে,

” অভিনন্দন জনাব।আপনি অবশেষে সফল।”

” ফ্লুজি আমার জান অভিনন্দন তোমাকেও, ৭৮ কেজির ভার সহ্য করেছো বলে।

খুশবু চোখ রাঙিয়ে তাকালো আরশাদের পানে।আরশাদ মুচকি হেসে পেছনে তাকাতে দেখতে পেল আরিব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের পানে।
__সমাপ্ত__

ফ্লুজি পর্ব-২৪+২৫

0

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৪]

” চা’য়ে চিনি কম কেন আম্মু?”

বিধস্ত একটা মুহূর্তে খুশবুর এমন প্রশ্নে উপস্থিত তিনজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।সকলের প্রশ্নবিদ্ধ চোখ এড়িয়ে সে পুনরায় চায়ে চুমুক দিলো।

” চা’য়ের সাথে যে আমার টোস্ট বিস্কুট লাগে তুমি কি ভুলে গেছো?”

দ্বিতীয় বারের মতো অবাক হলো সকলে।অনিমা হতবিহ্বল হয়ে ছুটে গেলেন বিস্কুট আনতে।খুশবু বাহারুল হকের পানে চেয়ে বলে,

” আব্বু তোমার না খুব তাড়া আছে?দাঁড়িয়ে আছো কেন?যাও তবে।”

মেয়ের আচরণে বাহারুল হক কিছুই বুঝ উঠতে পারলেন না তিনি কি যাবেন নাকি থাকবেন তা নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না।আর দুই-চার না ভেবে তিনি চলে গেলেন নিজ কাজে।অনিমা বিস্কুট নিয়ে আসতে খুশবু বলে,

” আম্মু তুমিও নাস্তা করে নাও।”

আরশাদ বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো।সে ভেবেছিল খুশবু কাঁদবে,উন্মাদ হয়ে যাবে কিন্তু এই মেয়েতো স্বাভাবিক।অনিমার অপ্রস্তুত চাহনি দেখে খুশবু বলে,

” এখন কি আমায় বের করে দেবে?আমি তো তোমার মেয়ে নই।শুনো জন্ম না দিলেও তুমি আমার মা অতীতে যা হয়েছে তা নিয়ে এখন মন কষাকষি করলে আমাদের নিজেদেরি লস।শুধু শুধু সম্পর্কগুলো নষ্ট হবে।”

অনিমা মাথা দুলালেন।কি প্রতিক্রিয়া তিনি করবেন নিজেই ভেবে পাচ্ছে না।যাকে আদর যত্নে এত বছর যাবৎ লালন পালন করেছে সেই এখন তার মেয়ে নয়!বললেই হলো নাকি।
.
ম্যাজমেজে শরীরটা নিয়ে আবার কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো খুশবু।বাইরে থেকে শীতল হাওয়ায় গায়ে কাটা তুলছে।আসমানটা আজ একটু বেশি নীল।
আরশাদ বসলো খুশবুর পাশে ছেলেটা চিন্তায় মূঢ় হয়ে বলে,

” তুমি স্বাভাবিক!”

” হ্যাঁ কেন?”

” আসলে…”

” কি ভেবেছিলে?আমি কেঁদে-কেটে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিব?নাকি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাবো।আমার নিজের বাবা মা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে বুঝতে পারছেন আপনি?আমার ভাগ্য ভালো বলেই আজ এ পর্যায়ে এসেছি যদি তা না হতো হয়তো আমার নিয়তি হতো নীরার মতো।”

আরশাদ খুশবুর পাশে শুয়ে পড়লো।মেয়েটাকে শক্ত করে জড়িয়ে লুকিয়ে রাখলো নিজের বুকে।এলোপাতাড়ি চুমুতে ছুঁয়ে দিল খুশবুর গাল কপাল।

” এসব নিয়ে ভাববে না।আমি আছি তো?”

” আপনি আছেন বলেই এসব সত্যি সামনে এলো।”

” সত্য আড়াল করে লাভ নেই একদিন না একদিন ছিটকে বেরিয়ে আসবেই।”

” হুম তা ঠিক।”

” শরীর খারাপ লাগছে?”

” মাথাটা ধরে আছে।”

” ঘুম দাও তবে।”

.
বাহারুল হক বাড়ি ফিরলেন দুপুরে।স্ত্রীর মুখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই।অনিমা রান্না ঘরে ব্যস্ত।অনেকক্ষণ যাবৎ পায়চারি করে অনিমাকে হাঁক ডাকলেন তিনি।অনিমা কক্ষে ফিরে জানতে চাইলো কেন ডেকেছে? এই প্রশ্নের জবাব বাহারুল হকের কাছে নেই।তিনি কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।শ্বাস টেনে সাহস জুগিয়ে বলেন,

” সত্য প্রকাশে তোমার মতামত কী?”

” আমার মতামত আপনি জেনে কী করবেন?”

” অনিমা তুমি রেগে আছো?”

অনিমা বিছানায় বসলেন।ভেতর থেকে তার সব উজাড় হয়ে গেলেও বাইরে থেকে কেন তিনি কাঁদতে পারছেন না?

” আমি কাঁদতে পারছি না কেন?”

” অনিমা নিয়তি মেনে নাও।”

” আপনি আমাকে কেন জানালেন না?আমি কি ওই নিষ্পাপ শিশুকে ফেলে দিতাম?নাকি অস্বীকৃতি জানাতাম?”

” মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে একবারেও কি তোমার মনে হতো না সে তোমার গর্ভজাত সন্তান নয়।”

” এখন কী মনে হবে না?”

” না হবে না।নিজে সবটুকু দিয়ে খুশবুকে তুমি মানুষ করেছো সে তোমার সন্তান।”

অনিমা চুপ করে রইলেন।সত্য মিথ্যা এখন জেনে কী হবে?খুশবুকে তিনি পর কেউ ভাবতেই পারেন না।খুশবু তার নিজের মেয়ে।দু’হাতের আদর, ভরসা,যত্ন মেখে তিনি খুশবুকে বড় করেছেন।

” অনিমা তুমি আমার অনুরোধ রাখবে?খুশবুর সামনে মন খারাপ করে থেকো না।আমি জানি সত্যটা জানার পর তোমার খারাপ লাগলেও খুশবুর সামনে কখনোই তা প্রকাশ করবে না।সবসময় মাথায় রাখবে খুশবু তোমার মেয়ে।”

” খুশবু আমার মেয়ে সে শুধু আমার মেয়ে।”
.

আরশাদ কি ভেবেছিল?সত্যটা যেনে কি খুশবু থমকে যাবে?নাকি অনিমা সর্বদা খুশবুর প্রতি দূরত্বের দেয়াল তৈরি করবেন?সেই সব ভাবনাই ফিকে পড়ে গেছে।একমাস পর সবাই মাথা থেকে ঝেরে দিল সবটা।সবার জীবনের গতি ফিরলো আগের মতো।তবে খুশবুর মাথায় চলছে ভিন্ন কিছু সে চায় নীরার একটি সুন্দর জীবন হোক।মেয়েটা খুশবুর পরিবারকে নিজের পরিবার ভেবে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিক কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত ঘোর বিরোধিতা করলেন বাহারুল হক এবং আরশাদ।তারা কেউ চায় বা খুশবুর সাথে নীরার কোন সম্পর্ক থাকুক।

জীবনের ছন্দ ভিন্ন ভাবে কাটছে আরশাদের।শুয়ে বসে থাকা ছাড়া তার তেমন কোন কাজ নেই।দেশে এসেছে একমাস হতে চললো খুশবুকে নিয়ে সময়টা নিদারুণ ভালোই কাটছে।আরশাদের মনে হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো সে গ্রাম ঘুরে দেখবে।বাংলাদেশে এলেও তার গ্রাম ঘোরা হয়নি।লীলাভূমির সৌন্দর্যে ঘেরা এই দেশটাকে আরশাদের এখনো তেষ্টা মিটিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।আরশাদের গ্রাম ঘোরার এই ইচ্ছের কথা জেনে বাহারুল হক উচ্ছ্বসিত হলেন তিনি জানান গ্রামে তার একজন মামা থাকেন।বৃদ্ধ মামা সেই গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি।আরশাদের খেয়াল রাখতে তার আয়োজনের কোন কমতি হবে না।

বাহারুল হকের দেওয়া ঠিকানা মোতাবেক আজ সকালে গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয় আরশাদ।শহর থেকে সেই গ্রামে যেতে তিন ঘন্টার বেশি সময় লাগবে।আরশাদ ভেবেছিল তার গাড়ি নিয়ে যাবে কিন্তু খুশবু বাঁধ সাধলো।আরশাদকে কখনো বাসে ঘুরানো হয়নি,বাসে জার্নির যে অনুভূতি আরশাদ কখনো পায়নি।এই সুযোগটা মিস করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।খুশবুর জোরাজোরিতে আরশাদ বাসে যাওয়ার জন্য রাজি হলো।

গাড়ির গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে আরশাদের।বাকি সময়টা সে কি করে পার করবে ভেবে কোন সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না।খুশবু জানলার পাশে বসে চিপস খেতে ব্যস্ত।তার কোলে চিপস জুস চকলেট আচারের প্যাকেট।একের পর একটা সাবাড় করছে মেয়েটা।জার্নির সময় নাকি তার মুখ না চললে ভালো লাগে না।আরশাদের দিক্র তাকিয়ে সে বলে,

” খাবেন?”

” না তুমি খাও।”

” আমার পছন্দের চিপ্স মিস্টার টুইস্ট।একটা খেয়ে দেখুন অনেক মজা।”

আরশাদ একটা চিপস মুখে তুললো তবে তার ভালোলাগলো নাকি খারাপ লাগলো তা আর বোঝা গেল না ছেলেটার মুখের এক্সপ্রেশন পাল্টায়নি।
চলে গেল বেশ কিছুটা সময়।লোকাল বাসে সবার হিড়িক দেখে আরশাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।একটি পুরুষ তার পাশে দাঁড়িয়ে নিশব্দে দেদারসে বায়ু দূষণ করছে গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠছে, অপরদিকে ঘামের গন্ধে যাচ্ছে তাই অবস্থা।কিছুক্ষণ বাদে বাদে জ্যামে গাড়ি আটকে আছে।ছেলেটার গরমে সাদা চামড়া কেমন রক্তিম হয়ে উঠছে।
আরশাদের এমন দশায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো খুশবু।

” কিরে বিদেশি গরু দেশের ফিল নেবে?গ্রামের ফিল নেবে?তার আগে লোকাল বাসের ফিল নাও।”

” একদম হাসবে না।আমি উঠতে চেয়েছি বাসে?”

” এই শুনো সবকিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে বাস জ্যাম এগুলাও ফিল করার বিষয়।”

” আমার এত ফিল নিয়ে কাজ নেই শুধু তোমাকে ফিল করলেই চলবে।”

” শুনুন আরশাদ,গ্রামে যাচ্ছেন সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু ঘুরাঘুরি বন্ধ করবেন।সবাই কিন্তু এসব কটু চোখে দেখবে,খারাপ ভাববে।কেউ কেউ আপনাকে লজ্জায় ফেলতে পারে।”

” কেউ খারাপ ভাববে বলে আমি তোমার পিছু থাকবো না?তোমার আশেপাশে থাকবো না? তাহলে বিয়ে করলাম কেন? আমার বউ আমি থাকাবো তাদের কি সমস্যা?”

” সমস্যা হাজার খানেক।এই ধরুন আপনি আমার পাশে বেশি থাকবেন এটা তাদের পছন্দ হবে না।আবার আপনি আমার পাশে কম থাকবেন এটাও তাদের পছন্দ হবে না।”

” তাহলে তাদের পছন্দ হবে কি?”

” তারা সেটা নিজেরাও জানে না।”

” অদ্ভুত!”

” হু আপনার মতো।”

” আমি আবার কী করলাম?”

” আমাকে ভালোবাসলেন।”

আরশাদ প্রত্যুত্ত করার আগে তার পাশে দাঁড়ানো লোকটি আবার বায়ু দূষণ করলো।সহ্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল আরশাদ নাক চেপে খুশবুর কাঁধে মাথা আড়াল করে বসে রইল চুপচাপ।

সময় যত গড়ালো আরশাদের ভালোলাগার মাত্রা বাড়লো।মানুষ জনের চাপাচাপি কমেছে।জ্যামের মাত্রাও আগের তুলনায় অনেক কম গাড়ি ছুটছে তার আপন গতিতে।খুশবু ঘুমিয়ে আছে,তার মাথা লেপ্টে আছে আরশাদের কাঁধে।আরশাদের কাছে এই মুহূর্তটা একটু
বেশি সুন্দর।শুধু সুন্দর নয় ভালোলাগারো।অনেকক্ষণ এক রকম বসে থাকায় ছেলেটার কাঁধে ব্যথা অনুভব হচ্ছে তবুও একটুও নড়লো না আরশাদ।সে চায়না খুশবুর ঘুম ভাঙুক।
আরশাদ যখন প্রেয়সীর ঘুমন্ত মুখটা আড় চোখে দেখছিল তখনি আচমকা বাসটি ঝাকুনি দিল।আরশাদ কিছু বুঝে উঠার আগে দ্বিতীয়বার ঝাকুনি দিল বাসটি।কাঁচ ভাঙার শব্দে শিউরে ওঠলো তার শরীর।ডানে বামে তাকিয়ে বুঝে উঠার আগে আরশাদের গালে এসে বিঁধলো একটি কাচের টুকরো।একটি বাচ্চা এসে ছিটকে পড়লো আরশাদের ঘাড়ে।আরশাদ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিট থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।ব্যথায় টনটন করে উঠলো তার সমস্ত শরীর।কানের ভেতর কেমন যেন শো শো শব্দ তুলছে।হাতড়ে হাতড়ে খুশবুকে খুঁজতে গিয়ে পেল মেয়েটা সিটের নিচে পড়ে আছে।খুশবুর মাথা ফেটে গলগলে রক্ত ঝরছে।আরশাদ দিশাহীন হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলো কিন্তু তার আগে বাসটি তৃতীয়বার ঝাকুনি দিল।লোহার সাথে মাথা লেগে ফেটে গেল আরশাদের মাথা।খুশবুর কাঁচ বিঁধে থাকা হাতটার দিকে তাকিয়ে নিশব্দে দেখে চোখ বুঝলো আরশাদ।

দু’টো গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে চোখের পলকে একটি এক্সিডেন ঘটে গেল।রাস্তার মানুষজন ছুটে এলো বাসের কাছে তারা সবাই মিলে যে যাকে পারছে সাহায্য করছে।সময়ের তালে তালে এম্বুলেন্সের সাইরেনে ভারী হয়ে এলো চারপাশ।
চলবে….

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৫ ]

সেই বাসে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের কিছুনা কিছু ক্ষতি হয়েছে।কেউ হাত হারিয়েছে কারো আবার পা ভেঙেছে।বাসে থাকা দুজন ড্রাইভার ঘটনা স্থলে মারা যান।এই মৃত্যুর মিছিলে সবাই তাদের আপজনদের খুঁজতে ব্যস্ত।হসপিটালে সাংবাদিকদের ঢল নেমেছে।তারা সরাসরি সম্প্রচারে ব্যস্ত।দেশবাসী টিভির পর্দায় এই নির্মম দৃশ্য দেখে চোখের পাতা ফেলছেন।এ এক মৃত্যুর মিছিল হাহাকার।

অনিমা টিভিতে ধ্যান বসিয়েছেন আরশাদ কিংবা খুশবু কাউকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।বাহারুল হক নিশ্চিত হলেন আরশাদ খুশবু ভালো নেই তাদের কিছু তো হয়েছে।
আহত এবং নিহতদের যে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে খুশবু এবং আরশাদের খোঁজ নিতে রওনা হয়েছে বাহারুল হক এবং খুশবুর মামা শামীম।
খুশবুর বাবা মনকে যতই জোর দিক তবে তিনি ভেতর থেকে ভেঙে পড়ছেন দু’কদম গিয়ে বসে পড়লেন রাস্তায়।খুশবুর মামা বাহারুল হকের হাত ধরে টেনে বলেন,

” দুলাভাই সময় নেই অনেকদূর যেতে হবে।”

“আরশাদ,আমার কলিজা ঠিক আছে তো?”

” আল্লাহ’র উপর ভরসা রাখুন আল্লাহ আপনার বুক খালি করবেন না।”

বাহারুল হক উঠে দাঁড়ালেন তাকে এখন ভেঙে পড়লে চলবে না।তাকে তো যেতে হবে অনেকটা দূর।

আরশাদের কপাল ফেটেছে।গালে কাচ বিঁধেছে,হাতে পায়ে কেটে গেছে,বাম হাতের একটি আঙুল ভেঙে গেছে।এই ছাড়া তার আর তেমন কোন সমস্যা নেই।কপালে সেলাই করে অনন্য স্থানে প্রথমিক চিকিৎসা নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো।নার্সরা বারবার বলছিল তাকে বিশ্রাম নিতে কিন্তু সে তো তার ফ্লুজিকে খুঁজে পাচ্ছে না।সে কি করে স্থির থাকবে?
পা খুঁড়ে খুঁড়ে হসপিটালের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটছে আরশাদ।প্রতিটা মানুষের শরীরে রক্ত,মেঝেতে মৃত দেহগুলোকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।লাশের সারিতে একটি ছেলেকে দেখে আরশাদ চিনে ফেললো।এই ছেলেটা তার পাশের সারিতে বসেছিল।দীর্ঘ কয়েকমাস পর সে তার বাড়ি ফিরছে বলে মা’কে ফোন করে মনগোপনে থাকা উচ্ছ্বাস জানালো।ভাগ্যের পরিহাস মায়ের কাছে আর ফেরা হলো না ছেলেটির।মানুষের কোলাহল,এম্বুলেন্সের সাইরেন সবকিছু মিলিয়ে আরশাদের মস্তিষ্ক বার বার থমকে দিচ্ছে।মাথায় ঘুরছে নানান রকম চিন্তা।রক্তাক্ত শরীর টেনে হসপিটালের আনাচে-কানাচে খুশবুকে খুঁজছে সে।কোথাও নেই, কোথাও নেই মেয়েটা।একজন নার্স দ্রুত পায়ে অন্যদিকে যেতে নিলে আরশাদ তার পথ আটকায়,

” এক…একটা মেয়েকে দেখেছেন?ফর্সা নাম খুশবু।”

” এত মানুষের ভিড়ে সঠিক বলা মুশকিল।আপনি প্রতিটা ওয়ার্ডে খুঁজুন।”

” আমি খুঁজে পাচ্ছিনা।”

” তবে লাশের সারিতে খুঁজুন।”

বুকটা কেঁপে উঠলো আরশাদের।লাশের সারিতে খুঁজবে মানে কি?তার ফ্লুজি মারা যাবে?তাকে রেখে চলে যাবে?আরশাদ উন্মাদ হয়ে উঠলো আবারো খুঁজতে শুরু করলো তার ফ্লুজিকে।মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে এলো তার অন্তর, একটি বাচ্চা লাশের সারিতে পড়ে আছে।তার নিথর দেহটি আরশাদের বুক কাঁপিয়ে দেয়।হসপিটালের নিচতলা ছেড়ে দোতলায় আসে সেখানেও একই অবস্থা সব আহত রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছে।একে একে প্রতিটা কোন,প্রতিটা মানুষকে সে দেখলো নাহ নেই, খুশবু কোথাও নেই।

তখন বাসে আরশাদের জ্ঞান হারালে হসপিটালের বেডে তার জ্ঞান আসে এর মাঝে কি হয়েছে খুশবু কোথায় সে কিচ্ছু জানে না,কিচ্ছু না।

অন্ধকার হয়ে আসে আরশাদের পৃথিবী।কি করবে সে?কার কাছে যাবে?শরীরের সমস্ত ব্যথা খুশবুকে না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে খুব বেশি নয়।চারদিকে দ্বিতীয় বারের মতো দৃষ্টি ঘুরালো সে।কোন উপায়ন্তর না পেয়ে দ্রুত ছুটে গেলো নিচে।আরেকটি এম্বুলেন্সের গাড়ি এসেছে সেখান থেকে একে একে আহত নিহত সবাইকে হসপিটালে আনা হচ্ছে।চাতকপাখির ন্যায় এক কোনায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে আরশাদ।হঠাৎ তার চোখ যায় লাশের সারিতে থাকা একটি মেয়ের দিকে।আরশাদের চিন্তারা স্থির হয়।এই তো তার ফ্লুজি।অবশেষে সে পেয়েছে তার ফ্লুজিকে।আরশাদ ছুটে যায় তার ফ্লুজির কাছে মেয়েটার মাথা কোলে তুলতে শার্টে লেপ্টে যায় তরল রক্ত।মেয়েটি বীভৎস ভাবে আঘাত পেয়েছে।মাথার পেছনটা অনেকটা ফেটে গেছে।গলায় বিঁধে গেছে কাচের টুকরো।মুখের একপাশ কান সহ থেতলে গেছে।

” ফ্লুজি চোখ খুলো।দেখো আমি এসেছি খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?শহরের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা হবে তোমার।আরেকটু ধৈর্য ধরো আরেকটু।”

আরশাদ উন্মাদ হয়ে গেলো।মেয়েটার মাথা ঝাকিয়ে ডাকলো বারংবার।অথচ মেয়েটার কোন সাড়া শব্দ নেই।মেয়েটা নিশ্বাস অবধি নিচ্ছে না।

” কি হলো ফ্লুজি এই ফ্লুজি চোখ খোলো।আমি এখন থেকে তোমার কথা মতো চলবো তুমি যা বলবে তাই হবে শুধু একবার চোখ খুলো ফ্লুজি।”

একটি ছেলে এসে আরশাদের হাত সরিয়ে দেয়।এবং মেয়েটাকে শুইয়ে দেয় মেঝেতে।সেই ছেলেটাও কাঁদছে চোখের জলে গাল ভিজে চিবুক চুইয়ে অশ্রুপাত ঘটছে।আরশাদ রেগে যায় ছেলেটার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে,

” আমার ফ্লুজিকে আপনি সরিয়ে দিলেন কেন?”

” কে আপনার ফ্লুজি?ও আমার বোন।”

” আপনার বোন মানে?”

” আমার বোন তুবা।”

আরশাদ থমকে যায়।তুবা নামটার সাথে সে ভীষণ ভাবে পরিচিত।আরশার নজর ঘুরায় ভালোভাবে পরখ করে দেখলো মেয়েটির গায়ে একটি হলুদ রঙের জামা।অথচ খুশবু পড়েছে সাদা থ্রিপিস।আরশাদ মেয়েটির গলায় থাকা পেন্ডেন্ট দেখে চমকে যায়।তুবা নামক মেয়েটির সাথে আরশাদের যখন প্রেমের সম্পর্ক থাকে তখন এই পেন্ডেন্ট নিজের পছন্দ মতো কাস্টমাইজ করে আরশাদ বানিয়েছিল।দামি হীরের এই পেন্ডেন্টটি তুবা এখনো গলায় রেখেছে!বিধস্ত এই পরিস্থিতিতে আরশাদের মাথায় আসে সেদিনের কথা খুশবু বারবার তাকে বলেছিল সে ফ্লুজি নয় তবে তো খুশবুর কথাই সত্যি তুবা অন্য আরেকটি মেয়ে।এই পৃথিবীতে একই চেহারার তিনটে মেয়ের!আরশাদ কি কখনো ভেবেছিল তার সাথে এমনটা হবে?

” তুবা আপনার বোন?ওর চিকিৎসা করছেন না কেন?”

আরশাদ নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করলো।মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে কেঁদে উঠলো ছেলেটি,

” আমার বোন আর এই দুনিয়াতে নাই ভাই।আমার বোন আর নাই।”

আরশাদ থমকে গেল।খুশবুকে সে অবিশ্বাস করে না।অন্তত বিয়ের পর খুশবু যতবার বলেছে আরশাদের প্রেমিকা সে নয় আরশাদ তা বিশ্বাস করেছে।তুবার মৃত্যু আরশাদের কষ্ট বাড়িয়ে দিল দ্বিগুণ।তার মনে জমে থাকা প্রশ্নেরা বারবার তাকে আঘাত করে।
হঠাৎ তুবা কেন তার সাথে অযথা ঝগড়ায় লিপ্ত হয়?কেন এই দূরত্ব?তবে সেকি আরশাদকে কোনদিন ভালোবাসেনি?সবটাই তবে ছলনা।

আরশাদ শেষবার তাকালো তুবার পানে।

” আমি তোমায় ভালোবাসি না।ভালোবাসা কি আমি জানি না।তুমি আমায় শিখিয়েছিলে ছলনা।আমার ভালোবাসা আমার কাছে আছে,আমার ভালোবাসার ফ্লুজি আমার কাছে আছে।কিন্তু এই আফসোস তো আমার কখনোই যাবে না তোমার সাথে আমি মুখোমুখি হতে চেয়েছি তবে এভাবে নয় তোমায় মৃত অবস্থায় দেখার ইচ্ছে আমার কখনোই ছিল না।”
.

ব্যস্ত হসপিটালে ক্লান্ত পায়ে আরশাদ বসে যায় এক কোনায়।ছেলেটা কেমন অসহায় নজরে কাঁদছে।পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছে সে কিন্তু সবাই খুশবুর ছবি চাইছে ছবি ছাড়া মুখের বর্ননায় এত মানুষের ভীড়ে কি করে খুঁজে পাবে?আরশাদের ব্যাগ,ফোন কোথায় সে জানে না তাহলে কি করে খুশবুর ছবি সবাইকে দেখাবে?

হসপিটালে এসে উপস্থিত হন বাহারুল হক এবং খুশবুর মামা শামীম। মুহূর্তে আরশাদ বাহারুল হককে দেখতে পায়।জলের স্রোতে ভাসা আরশাদ যেন খড়কুটো খুঁজে পায় এবং আঁকড়ে ধরতে ছুটে যায়।আরশাদকে জীবিত দেখে বাহারুল হক আশ্বস্ত হন।খুশবু কোথায় আছে জানতে চাইলে সেই সম্পর্কে কোন উত্তর দিতে পারেনা ছেলেটা।

হাসপাতালের করুন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে যান বাহারুল হক।শামীম পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং খুশবুর ছবি দেয় তাদের।খুশবুকে খুঁজতে তারা তিনজন তিন দিকে ছড়িয়ে যায়।অবশেষে শামীম খুঁশবুকে পেয়েও যায়।মেয়েটা তিনতলায় একটি বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে।ব্যথায় টনটন করছে তার সমস্ত কায়া।শামীমের নির্দেশ মোতাবেক তিন তলায় এসে উপস্থিত হয় আরশাদ এবং বাহারুল হক।

খুশবুর মাথা ফেটেছে, বাম হাতটা ভেঙে গেছে।বেশ কয়েক জায়গায় পিঠের মাংস উঠে গেছে।গালে গলায় বিঁধেছে কাচ।ঠোঁট ফেটে ফুলে আছে।হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে খুশবুকে।শামীম ডাক্তারদের সাথে কথা বলেন,যত দ্রুত সম্ভব খুশবুকে ভালো একটি হসপিটালে এডমিট করতে হবে।মেয়েটার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা দু’টোই ঝুঁকিপূর্ণ।আরশাদের সমস্ত শরীরের কার্যক্রম তখনি থমকে যায় যখন দেখলো তার ফ্লুজি ভালো নেই।মেয়েটার গালে হাত বুলিয়ে আরশাদ কেঁদে ফেলে।
বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে সে বলে,

” আমি ভয় পেয়েছিলাম।আমাকে কেন ভয় দেখালে?”

চলবে….

ফ্লুজি পর্ব-২৩

0

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৩]

নীরাকে দেখার পর থেকে বন্ধুদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া চলছিল।জন যখনি জানতে পেরেছে নীরার কথা ছেলেটা আর দেরি করেনি মিলানে এসে উপস্থিত সে।বন্ধুরা সকলে তাদের ঘুরাঘুরি অব্যাহত রাখলো শুধু থমকে রইল খুশবু।একমাত্র আরশাদের কারনে বাহারুল হক কিংবা অনিমা কাউকে এই ব্যপারে জানাতে পারছে না সে।আরশাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞা নীরার ব্যপারটা ভুলেও যেন পাঁচ কান না হয় বাধ্য হয়ে খুশবু আরশাদের কথা শুনছে।তার শরীর মন ক্রমশ বিষিয়ে উঠছে এমন এক আশ্চর্যজনক পরিস্থিতিতে এর আগে কি কেউ পড়েছে?হয়তো হ্যাঁ।
বাইরে থেকে খাবার কিনে ফিরেছে আরশাদ।স্যান্ডউইচ এবং জুসের বোতল টেবিলে রেখে খুশবুর পানে তাকালো এক পলক।

” হানি।”

“হু?”

” খেয়ে নাও।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

” না ভালোলাগছে না।”

” ভালো লাগায় না লাগার সাথে খাবারের কি সম্পর্ক?”

” নীরা মেয়েটার কথা বাবাকে জানালে হয় না?আপনি জানেন কত চিন্তা,দুশ্চিন্তা আমার মাথায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।”

” তুমি নিজে চিন্তামুক্ত হতে তোমার বাবা মাকে চিন্তায় ভাসিয়ে রাখবে?”

” না তা নয়।কিন্তু… ”

” শুনো যা হবে দেশে গিয়ে দেখা যাবে।এসবের মোকাবিলা আমি দেশে গিয়ে করতে চাই।”

খুশবু আর দ্বিতীয়বার কথা বলার সাহস করে না শুকনো স্যান্ডউইচ মুখে পুরে ভাবতে থাকে নীরার কথা।
.
নীরা মেয়েটার সাথে আরশাদ অনেকবার যোগাযোগ করেছে,অনুরোধ করেছে বারবার তাদের যেন অন্তত এক ঘন্টা সময় দেয়।খুশবু নীরার সাথে কথা বলতে চায় কিন্তু নীরা আরশাদকে প্রতিবার আশাহত করেছে।তার সময় নেই সে কি করে দেখা করবে?শেষ-মেষ উপায়ন্তর না পেয়ে খুশবু নীরাকে অনুরোধ করলো, একটা পর্যায়ে মেয়েটা কেঁদেই ফেললো।নীরা আর অমত করেনি দুপুরে আসবে বলে সে জানায়।

মিলান শহরের একটি নামিদামি রেস্টুরেন্টে বসে আছে আরশাদ এবং খুশবু।তাদের অপেক্ষা নীরার জন্য।নীরা এলো প্রায় বিশ মিনিট পর।মেয়েটাকে দেখেই চোখ সরালো খুশবু।মেয়েটা একটু বেশি স্টাইলিশ।নাহ এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মেয়েটার পোশাক চালচলন ভীষণ অশালীন।খোলামেলা পোশাকে বুকের খাঁজটা সাদৃশ্যমান।আরশাদের সামনে বড্ড লজ্জায় পড়লো খুশবু।
নীরা চেয়ারে বসে বলে,

” সরি একটু দেরি হয়ে গেল।”

” ইট’স ওকে।”

শুকনো হেসে বললো আরশাদ।নীরা খুশবুর পানে তাকিয়ে আরশাদকে প্রশ্ন করে,

” বলো কি জানতে চাও?”

” তোমার আসল পরিচয় কী?”

” আমি নীরা রহমান।”

“খুশবুকে দেখার পর তোমার অনুভূতি কি?একই চেহারার জমজ বোন তোমরা।অথচ দু’জন দুই দিকে,দুই জীবনে।”

” আমার অনুভূতি শক্তি প্রখর নয়।আমরা জমজ বোন কি না আদৌ এর প্রমান আছে?”

” প্রমান!কিসের প্রমান?তোমাদের চেহারা মিল।”

” হুম তা ঠিক।তবে এসব নিয়ে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই।আমি নীরা রহমান আমার আলাদা পরিচয় প্রফেশন আছে অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করার ইচ্ছা কিংবা সময় নেই।”

” কিন্তু আমাদের তো জানতে হবে এসব কি হচ্ছে আমাদের সাথে!আমাদের আগ্রহ থাকা কি অস্বাভাবিক?”

” একদম না।এখন তোমাদের আমার সম্পর্কে কি জানার আছে?”

” তোমার বাবা অথবা মায়ের সাথে আমরা যোগাযোগ করতে চাই।”

নীরা ফিক করে হেঁসে ফেললো।তার হাসি স্থায়ী হলো।খুশবু কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো আরশাদের পানে।নীরা তার হাস্যজ্বল মুখ ধরে রেখে বলে,

” আমার বাবা মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই।তারা কোথায় আছে আদৌ বেঁচে আছে কি না আমি জানি না।”

” উত্তরটা পছন্দ হলো না।”

“তোমার পছন্দ না হলে আমার আর কি করার আছে?আমি সত্যিটা বললাম।”

” যেহেতু আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে ফেঁসে গেলাম সেহেতু নীরা প্লিজ আমাদের সাহায্য করো।তুমি তোমার সম্পর্কে আদি থেকে অন্ত সবটাই আমাদের খুলে বলো।”

” শুনো আমি এখানে ক্লাইন্ট নিয়ে এসেছি।ওই ছেলেটা আমার সময় টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে সেই হিসেবে তোমাদের এক ঘন্টা সময় দিয়েছি এতেই সন্তুষ্ট হও।”

” আমরা বুঝতে পারছি সেসব।কিন্তু প্লিজ তুমি তোমার সম্পর্কে আমাদের জানাও।”

নীরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।অতীত ঘাটতে তার ভালোলাগে না কিন্তু আজ আর কি করার?

” আমি নীরা রহমান।আমার বাবা মোশারফ রহমান।মা সীমা খাতুন।আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম তাই কোন দিক দিয়ে আমাকে খুশি রাখার যত্ন করার ক্রুটি ছিল না।শহরের সবচেয়ে নাম করা স্কুল থেকে পড়ছিলাম।বাবার ছিল ছোট্ট একটা ব্যবসা।সংসারে টানপোড়ন ছিল তবে চোখে লাগার মতো নয়।আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ছি তখনি আমার মা স্ট্রোকে মারা যান।এর তিন বছরেও বাবা বিয়ে করেননি আমার কথা ভেবে।
আমি যখন এসএসসি দিচ্ছিলাম রাত জেগে পড়ছি হঠাৎ দেখলাম বাবা একজন আন্টিক নিয়ে এলেন।সাথে ছিল আমার ফুফু চাচা চাচিরা।তারা জানালেন ওই আন্টিটা আমার সৎ মা।
সৎ মাকে যে আমি মেনে নিতে পারিনি তা কিন্তু নয় খারাপ লাগলেও আমি ভীষণ খুশি ছিলাম অন্তত এবার আর আমাকে একা চলতে হবে না।
আমার ভাবনা চিন্তারা বরাবরি ভুল বিয়ের চার মাসে বাবা পালটে যান।আমাকে কলেজে ভর্তি করানো হলো রাখা হলো হোস্টেলে।হোস্টেলে থেকে রুমমেটদের সাথে আমার ছিল ভীষণ ভাব।তারা সবসময় তাদের প্রেমের গল্প শোনাতো আমার উড়ুউড়ু মনে লেগে গেল প্রেমের বাতাস।ব্যস সকল ভয় দূরে ঠেলে একটা ছেলের সাথে রিলেশনে গেলাম।
প্রেমের এক বছর পর আমাদের মাঝে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।সেই ছেলেটা আমাকে ছেড়ে চলে যায়।এরপর আবার প্রেম করলাম ঠিক আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো।
এদিকে বাবা আমার হাত খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে পড়াশোনার খরচটা অনেক ঝামেলা করে আনতে হতো।ভার্সিটিতে পড়া কালীন আমার সৎ মায়ের বোনের ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠে।প্রেমের সম্পর্ক নয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।তার সাথে অনেক অনেক ঘুরেছি সমাজের হাই সোসাইটির ছেলেমেয়েদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় তার মাধ্যমে।এরপর ক্লাবে যাওয়া,ছন্নছাড়া চলা ফেরা সব মিলিয়ে বাবা আমাকে ত্যাজ্য করেন।আমার এই পরিস্থিতির জন্য আমার কাপুরুষ বাবা কি দায়ী না?
যাই হোক কলগার্ল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে এখন আর আমার খারাপ লাগে না।এক কথায় বলতে গেলে আমি টাকার বিছানায় ঘুমাই।আমার জীবনে সব আছে সব শুধু ভালোবাসা নেই,ভালোবাসা আমার প্রয়োজন নেই।”

” সব তো বুঝলাম তবে তোমাদের দুজনের রহস্য কী?খুশবু তোমার কী হয়? ”

” নিশ্চয়ই আমার বোন হয় তবে এর সত্যতা খুশবুর বাবা মা ভালো জানেন।এই মেয়েটা আমার কে তা জানার আগ্রহ আমার নেই,আমি যদি এই মেয়েটার আপন কেউ হই সে সমাজে আমাকে আপন বলে পরিচয় করাতে পারবে না।অন্তত ভদ্র সোসাইটিতে আমাকে কেউ মানবে না।আজ বরং আসি।”

নীরা উঠে দাঁড়ালো।খুশবুর ব্যথিত মনটা সে বুঝতে পারছে।খুশবুর গাল টেনে সে বলে,
” ইউর লুক সো প্রিটি।”

খুশবু নীরার হাত ছুঁয়ে ধরে এবং হঠাৎ হুহু শব্দে কেঁদে উঠে।

” আপু আমি যখনি আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চাইবো করবেন?”

আপু!বুকে লাগলো নীরার।অনুভূতি শূন্য নীরার মনটা হঠাৎ ছলকে উঠলো।

” যখন ইচ্ছে হবে ফোন করবে।”

” আপনি সত্যি আরশাদ ইহসানকে চেনেন না?”

” আর কতবার বলবো?উনাকে আমি এবারি প্রথম দেখলাম।”

খুশবু মাথা নাড়ালো।এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে তার নিজের মাথায় নিশ্চয়ই কোন সমস্যা আছে।কি হচ্ছে এসব?আরশাদের প্রেমিকা সে নয় অথচ নীরা বলছে সে আরশাদকে চেনে না।মেয়েটার চোখেমুখে মিথ্যার ঝলক নেই।কি হচ্ছে এসব?
রেস্টুরেন্টের সামনে জনের গাড়ি থামলো।ছেলেটা হুড়োহুড়ি করে প্রবেশ করলো রেস্টুরেন্টে।নীরা জনকে দেখেই চিনে ফেলেছে।জন এগিয়ে এসে বলে,

” হ্যালো নীরা।”

” জন!তোমাকে এখানে পাব ভাবিনি।”

” তোমার জন্য রোম থেকে মিলানে এসেছি।এবার বলো কবে সময় দেবে আমায়?”

” দুইদিন পর।চলবে?”

” ইয়েস বেব।আই নিড ইয়ু।”

জন নীরাকে জড়িয়ে চুমু খেল।দুজনের এমন আচরনে খুশবু হতভম্ব।আরশাদ নজর ঘোরালো অন্যদিকে।নীরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে জন দাঁড়ালো আরশাদের মুখোমুখি।

“আরশাদ ইহসান আমাকে মে রে তো সত্যকে মিথ্যা বানাতে চাইলে।এখন প্রমান পেলে?”

” কিন্তু আমার ফ্লুজিতো সেই মেয়ে নয়।আঙুল আমার ফ্লুজির দিকে তোলা হয়েছে।”

” আমি কী করে জানবো গোড়ায় গন্ডোগোল।”

” শুরু যখন হয়েছে এর সমাধন চাই।”

” আমি আমার সমাধান পেয়ে গেছি এবং অপেক্ষায় আছি কখন আমার জীবনে আবার মধুচন্দ্রিমা আসবে।”
.
আরশাদ রোমে ফিরলো সন্ধ্যায়।নিজ ভিলায় ফিরে খুশবুকে বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেল আরিবের সঙ্গে দেখা কর‍তে।
নীরার সব ঘটনা আরিব যখন শুনলো তখন মন চাইলো না বিশ্বাস কর‍তে।

খুশবুর জমজ বোন আছে!তাও কি না কেউ কাউকে চিনে না।আরশাদ চায়নি তার পরিবারের কাউকে কিচ্ছু জানাতে কিন্তু আরিবের মন মানলো না।আজ হোক কাল হোক সবার সামনে সত্যিটা প্রকাশ পাবেই।

আরশাদ পরিবারের সবাইকে সবটা জানালো,প্রতিবার আরশাদকে সবাই সাপোর্ট করলেও খুশবুর ব্যপারে এমন এক সত্য জেনে ক্রুদ্ধ হলেন আফরোজ।ইমরান ইহসান এসব নিয়ে কথা বাড়ালেন না মূলত তিনি চান না জল ঘোলা হোক।যা হবার হয়েছে এখন আর এসব নিয়ে কথা তুলে কি হবে?আরশাদ যাকে চেয়েছে তাকে তো পেয়েছে দিক বেদিক নিয়ে ভাবতে গেলে তাদের দম্পত্য জীবনে প্রভাব পড়বে ইমরান ইহসান তা কখনো চান না।

আফরোজের চোখে মুখে আগুন জ্বলছে।আরশাদের দিকে তাকিয়ে বলেন,

” বিয়ে করবে, তোমার খুব তাড়া তুমি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ পাগল হয়ে উঠলে।তোমাকে নিয়ে আমার ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি কত কি করলে এখন বলছো তোমার বউয়ের মতো দেখতে আরেক মেয়ে…ছিহ!এই মেয়ের বংশের খোঁজ নিয়েছিলে?”

” আমার ওয়াইফকে নিয়ে আমি হ্যাপি আছি।সেসব ছাড়ো, আমার যা জানানোর দরকার আমি জানিয়েছি।”

” কি জানিয়েছো তুমি?এসব জানার জন্য বসে ছিলাম?খুশবুর অতীত ঘেটে দেখো এই মেয়ে কি আসলেই বাহারুল হকের মেয়ে?”

ইমরাহ ইহসান আফরোজকে বাঁধা দিলেন।অনেক বছর পর আরিব মায়ের এমন রাগ দেখলো।মায়ের রাগটা আরশাদের পছন্দ হলো না।ইমরান ইহসান আফরোজের চুলে হাত বুলিয়ে বলেন,

” শান্ত হও তুমি।হতেই পারে খুশবু বাহারুল হকের দত্তক নেওয়া মেয়ে।এটাও হতে পারে নীরা নামের মেয়েটাও উনার মেয়ে হয়তো বা অতীতে এমন কিছু হয়ে…”

” তুমি চুপ করো।আমাকে আর বোঝাতে হবে না।”

আরশাদ আরিবের দিকে তাকালো চোখ গরম করে।যত ঝামেলা করার এই ছেলেটাই করেছে।কে বলেছে এত সত্যবাদী হতে?
আরশাদ সবাইকে শেষ বারের মতো বললো,

” মম ড্যাড আমি সবার উদ্দেশ্যে বলছি,যা হচ্ছে যা হয়েছে এসব নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই।তোমরা কি চাও?নিশ্চয়ই আমাকে ভালো দেখতে চাও?আমি ভালো আছি প্লিজ এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি চাই না।”
.
আরশাদ নিজ রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার অর্ডার করলো।নিজ ভিলায় ফিরে খুশবুকে না পেয়ে মুচড়ে উঠলো তার কলিজা।মেয়েটা কোথায়?আরশাদ সারা ভিলা তন্ন তন্ন করে খুঁজলো খুশবু কোথাও নেই।কোথায় গেল মেয়েটা?আরশাদের শ্বাস আটকে আসছে,কাঁপছে তার দেহ।মেন্টালি এত প্রেসার না নিতে পেরে কি মেয়েটা চলে গেছে?পাগলের মতো সারা ঘর ছুটলো ছেলেটা।নিচ তলায় এসে স্টোর রুমে প্রবেশ করতে কানে আসে পানির শব্দ।
পাশের ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে কেন?আরশাদ দ্রুত গেল ওয়াশরুমে।বাথটবে হাটু মুড়িয়ে বসে আছে খুশবু।মেয়েটা পানি নিয়ে খেলছে আর কিছু বিড়বিড় করছে।এই তো দেহে প্রাণ ফিরলো আরশাদের।

” ফ্লুজি। ”

” এক মাছলি পানি মে গায়েই ছাপাক!”

” হোয়াইট?”

” উহ,এক মাছলি পানি মে গায়েই ছাপাক।”

খুশবুর বেতাল কথায় আরশাদ অবাক হলো।নজরে এলো খুশবুর হাতে থাকা ওয়াইনের বোতল।সর্বনাশ,তার মানে খুশবু ছাইপাঁশ গিলে মাতাল হয়েছে?আরশাদ খুশবুকে টেনে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু খুশবু হাত ঝেরে বলে,

” এইই ছাড়।”

” জান একি অবস্থা তোমার।পানি থেকে উঠে আসো।”

” না না ছাপাক।”

” তোমাকে আমি খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আর তুমি ছাপাক ছাপাক করছো।উঠে আসো জান।”

ডোর বেল বেজে উঠতে আরশাদ খুশবুকে রেখে উঠে দাঁড়ায়।নিশ্চয়ই রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এসেছে।খাবারের প্যাকটগুলো নিয়ে খুশবুর কাছে পুনরায় ফিরে আরশাদ।ভেজা শরীরটা টেনে নিজের পাঁজা কোলে উঠায় সে।সিড়ি বেয়ে দোতলার ঘরে ফিরে মেয়েটাকে কপট রাগ দেখায়।

” ওয়াইন গেলার সাহস কি করে করলে?”

” এই কি বলিস?বল ভালোবাসি।”

” বাসিতো জান।তুমি যা করলে কাজটা কিন্তু ঠিক হলো না।”

” আমি ভালো না তাই না?”

খুশবু আচমকা কেঁদে উঠলো আরশাদ হতভম্ব চাহনিতে তাকিয়ে রইল।

” জান কাঁদছো কেন?”

খুশবু কান্না থামালো।আরশাদের বুকে ভেজা মাথা লুটিয়ে আদুরে গলায় বলে,

” আরশাদ।”

” বলো জান।”

” গ্র‍্যানি কি বলেছে জানো?”

” কি?”

” বাচ্চা…”

” বাচ্চা?”

“জানি না।”

” কি হয়েছে বলতো।”

খুশবু কিছুই বললো না।আরশাদ তোয়ালে নিয়ে মেয়েটার ভেজা চুল মুছতে লাগলো।নেশাগ্রস্ত খুশবু নিজের দিশ ভুলে দ্রুত আরশাদের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে।আরশাদ বাঁধা দিতে গেলে তার উন্মুক্ত বুকে কামড় বসায়।ব্যথাত কুঁকড়ে উঠে আরশাদ। সে পুনরায় বাঁধা দিতে গেলে গলায় কামড় বসায়।মেয়েটার হাত বিচরনের করে ছেলেটার সারা মুখে।আরশাদের গলায় ঝুলে ঠোঁটে ঠোঁট মেশায়।আরশাদ খুশবুকে বাঁধা দিতে গিয়ে নিজে অবাধ্য হয়ে যায়।

” ভেবেছিলাম বাংলাদেশে যাব এলাম তোমার সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।এখন তো তুমি আমায় অন্য দেশে নেওয়ার মতলব আঁটছো।লেটস গো জান।”
চলবে…

#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৩ বাকি অংশ]

ব্যথায় শরীর টনটন করছে মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আছে খুশবুর।হঠাৎ আলোর ছটাক চোখে আসতে মাথা ব্যথা ক্রমশ বাড়তে থাকে।চোখে খুলে তাকানোর সাহস করেনি সে।অপরদিকে আরশাদ তার সহিত লেপ্টে আছে।আরশাদের ভার নেওয়ার মতো সামর্থ্য তার হয়নি কিন্তু এই আরশাদ তো তার বুকে মাথা চেপে না শুয়ে ঘুমাবেই না।অবশ হওয়া পা’টা টানটান করার চেষ্টা করলো খুশবু।পিটপিট চোখে তাকানোর চেষ্টা করতে নজরে আসে আরশাদের পিঠ কাঁধ।দ্বিতীয়বার পর্যবেক্ষণ করতে দেখতে পায় সারাটা রুম এলোমেলো,কাল কে তান্ডব চালিয়েছিল?আরশাদকে সরাতে গেলে চোখে আসে ছেলেটার ফর্সা চামড়ায় লাল ছোপ ছোপ দাগ।কিছু স্থানে রক্ত জমাট বেধে কালো কালচে রঙ ধারণ করেছে।আরশাদের বাদামী দাঁড়িতে হাত বুলায় খুশবু ছেলেটার হঠাৎ কি হয়েছে?আঘাত কি করে পেল?খুশবু অস্থির হয়।এলোমেলো হাতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে আরশাদের দেহ।কামড়ের চিহ্ন দেখে পিলে চমকে উঠে সে।ছেলেটাকে সরাতে উদ্যত হয় মুহূর্তে।কিন্তু আরশাদের দেহটাকে উপড়ে ফেলতে পারে না মেয়েটা।হাঁপিয়ে উঠে বাধ্য হয়ে বলে,

” একটা পানির জগ আমার মা আমাকে তুলতে দেয়নি তার ধারণা এত ভার সহ্য করবো কি করে,আর এখন আমি ৭৮ কেজির ভার সামলাই।”

খুশবু হতাশ হলো আরশাদকে সরিয়ে উঠে বসলো সে।আরশাদের ঘুম আর স্থায়ী হলো না খুশবুর সাথে সাথে সেও উঠে বসে।ঘুম ঘুম চোখে ছেলেটা প্রশ্ন করে,

” কি হয়েছে ফ্লুজি?”

” কিছু না।উঠুন বেলা হয়েছে।”

” গত রাতে এটা কি করলে তুমি?”

” কি করেছি?”

” ওয়াইন খেলে কোন সাহসে?”

নিজের মতি ভ্রমের কথা মাথায় আসতে থমকে যায় সে।আসলেই তো কোন সাহসে এই অকাজটা সে করলো?মাথাটা এখনো কেমন ধরে আছে।আরশাদ উঠে দাঁড়ালো বিভ্রান্ত খুশবুর পানে তাকিয়ে চলে গেল কিচেনে এবং লেবুর শরবত নিয়ে ফিরলো সে।

” এটা খাও।”

” না খাব না।”

” আমাকে খাবে?”

” কি!”

” কিছু না।”

আরশাদ শরবতের গ্লাসটা ঠেসে ধরলো খুশবুর মুখে।ছেলেটার রাগান্বিত কার্যক্রম ঠিকি ধরতে পারলো খুশবু।

” আরশাদ রেগে আছেন?”

” আছি তো।কোন সাহসে ওয়াইনের বোতলে হাত দিলে?”

” আমার আসলে হুশ ছিল না।একা ঘরে ছিলাম চিন্তায় আমার পাগল পাগল লাগছিল ক্ষুদাও বেড়েছে তাই কিচেনে গেলাম।ওয়াইনের বোতল দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো,এসব খেলে নাকি চিন্তা দূর হয়।ব্যস আর কিছু জানি না।”

” জানো না?আমার শরীর দেখে বুঝতে পারছো না কি করেছো তুমি।এই রুমের হালচাল দেখো একবার।”

জিভে কামড় বসালো খুশবু।লেবুর শরবত শেষ করে আরশাদের পিঠে বুকে নজর ঘুরালো।

” আরশাদ বেশি চোট লেগেছে তাই না?”

“তোমার চুনোপুঁটি শক্তি আমার কিচ্ছু করতে পারবে না”

খুশবু চুপ হয়ে যায় আরশাদের রাগি রাগি ভাবটা এখনো কাটেনি।

” আমরা কাল সকালে বাংলাদেশ যাব।তোমার অনেক কিছু কেনা বাকি দ্রুত শাওয়ার সেরে এসো বের হতে হবে।”

দেশে যাওয়ার কথা শুনে থমকে গেল খুশবু।মা বাবার কথা মাথায় আসতে আবেগে আপ্লুত সে।কিন্তু দেশে যাওয়ার পর কোন সত্যের মুখোমুখি হবে?
.
খুশবু কিছু বিষয় লক্ষ করেছে আজ।
আফরোজের সেই দোয়ায় ভরা আদুরে হাত দুটো দিয়ে খুশবুর মাথায় হাত বুলালেন না।কেমন যেন বিরক্তিতে ঘেরা দায়সারা ভাব।সবটা খুশবুর নজরে এলো মুখ ফুটে যদিও কিছু বলতে পারলো না।প্লেনে নিজের নির্ধারিত আসনে বসে চিন্তায় মগ্ন মেয়েটা।আরশাদ খুশবুর হাত চেপে ধরে,

” জান কী ভাবছো?”

” মা আমার সাথে কোন কিছু নিয়ে রাগ?তিনি কেমন যেন আচরণ করলেন।”

” না না।মমের কর্মস্থলে কিছু ঝামেলা চলছে তো তাই আরকি উনি খুব চিন্তিত।”

অনায়াসে মিথ্যা বললো আরশাদ।সে চায় না ফ্লুজি সে রাতের ঝামেলার কথা জানুক।জেনে কি হবে?শুধু শুধু মন খারাপ করা ছাড়া কোন উপায় তো আর নেই।
.
রাতের রান্না চুলায় বসিয়ে টিভি দেখতে বসলেন অনিমা।একা একা ঘরে এখন আর ভালোলাগে না।যদিও একা থাকা তার অভ্যস হয়ে গেছে।মাঝে মাঝে মনে হয় বাহারুল হক ঠিকি বলেছেন মেয়েকে তিনি দূরে পাঠাবেন না।একমাত্র মেয়ে কী করে পারবেন দূরে সরাতে?আবার আরশাদের আদর যত্নে মুড়ানো খুশবুর কথা ভেবে নিজের একাকিত্বকে বুড়ো আঙুল দেখান।
ডোর বেলের শব্দে টিভির রিমোট রেখে উঠে এলেন তিনি।নিশ্চয়ই বাহারুল হক এসেছেন।তবে আজ এত তাড়াতাড়ি কেন?দরজা খুলে চমকে গেলেন অনিমা।শিউরে উঠলো আর সমস্ত দেহ।অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে পিছিয়ে গেলেন দু’কদম।দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে খুশবু হাসলো। আজ যে তারা দেশে আসবে এই কথা কাউকে জানানো হয়নি।সম্পূর্ণ ব্যপারটা সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছে তারা।

” আমার মা, আমার কলিজা তুই!”

” কেমন আছো আম্মু?”

খুশবু জড়িয়ে ধরলো তার মা’কে।মা মেয়ের কান্নায় কোনঠাসা হয়ে দাঁড়ালো আরশাদ।

” আমি যে এসেছি কারো কি চোখে লাগেনি?”

অনিমা আরশাদকে বুকে জড়ালেন।মেয়েকে ফিরে পেয়ে সারা বাড়ির যেন প্রাণ ফিরলো।মা’কে ছেড়ে খুশবু সারাটা ঘর ঘুরলো।হ্যাঁ সবটাই আগের মতো আছে তার চিরচেনা রুম বারান্দা কোন কিছুর সাজসজ্জা পালটায়নি।অথচ সময় পাল্টেছে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব পাল্টেছে।
.
রাতের খাওয়া শেষে আজ আর আড্ডা দেওয়ার ধৈর্য নেই খুশবুর।টানা জার্নি শেষে এখন শুধু ঘুমের প্রয়োজন।অনিমা রুমটা পরিষ্কার করে খুশবুকে ঘুমাতে পাঠালেন।আরশাদ বেশ কিছুক্ষণ বাহারুল হকের সহিত আলাপচারিতা করলো।কিছুক্ষণ বাদে আরশাদ নিজেও কক্ষে এলো।ভেবেছিল খুশবু হয়তো ঘুমে কিন্তু না মেয়েটা জেগে আছে।সিলিংএ চোখ রেখে ভাবনায় মত্ত মেয়েটা।

” ফ্লুজি কী ভাবছো?”

” সময় অপচয় হচ্ছে আরশাদ।বাবা মাকে নীরার কথা জিজ্ঞেস করা উচিত।”

” এখনি? ”

” হুম।”

” মোটেও না।অতীত টানলে নিশ্চিয়ই এমন কিছু হবে না তুমি স্থির থাকবে না তোমার বাবা মা।এটা স্বাভাবিক কোন ইস্যু নয় তাই এত তাড়াহুড়োর দরকার নেই আগামীকাল সময় পরিস্থিতি বুঝে যা করার করবে।”

” না না আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।আমি আর পারবো না।সমাধান আমি চাই।”

” অধৈর্য হলে চলবে না।”

আরশাদ খুশবুকে টেনে কাছে আনে।গায়ের উপর কাঁথা জড়িয়ে ঘুমাতে ইশারা করে।মেয়েটার মাথায় চলতে থাকা এত দুশ্চিন্তার আনাগোনা আরশাদ ভালোভাবেই বুঝতে পারে।কিন্তু সে চায় না তার ফ্লুজি এখন এসব নিয়ে ভাবুক জীবন যেভাবে চলছে চলতে থাকুক।

অন্ধকার মাড়িয়ে আলোর দেখা মিললো।বহুদিন পর বাংলাদেশের সকালটা দেখে মনটা ভরে যায় খুশবুর।চিরচেনা ছন্দ ফিরে এসেছে জীবনে।

সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই এক সঙ্গে নাস্তা সারলো।নাস্তা শেষে অনিমা চা আনলেন।খুশবু তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,

” বাবা আমার কী কোন জমজ বোন আছে?”

বাহারুল হক অবাক হলেন।হাত থেকে চায়ের কাপ সরিয়ে বলেন,

” হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”

” জিজ্ঞেস যখন করেছি এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন না কোন কারণ আছে তাই না?”

” আমি তোমার প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”

” তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?আমার প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ নাকি না তা অন্তত বলো।”

” না নেই তোমার কোন বোন।”

বাবা মেয়ের তর্ক অনিমা নিরবে দেখলেন।খুশবু এর আগে তাকেও এমন প্রশ্ন করেছিল কিন্তু মেয়েটার মাথায় হঠাৎ এসব ঘুরছে কেন?অনিমা খুশবুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়েন।

” তোর মাথায় কি ভূত ঢুকলো বলতো?আমাকেও ঘুরে ফিরে একই কথা জিজ্ঞেস করিস।”

খুশবু প্রত্যুত্তর করলো না।দ্রুত নীরার ছবি নিয়ে দেখালো বাহারুল হককে।বাহারুল হক স্কিনে নজর রাখতে দেখতে পেলেন খুশবুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি দেখতে হুবহু তার মতো।বাহারুল হক থমকে গেলেন দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লেন দ্রুত।অনিমা উত্তেজিত হলো।আরশাদের পানে তাকিয়ে বলে,

” এই মেয়েটা কে?”

” নীরা।”

” তার চেহারা আমার মেয়ের মতো কেন?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।খুশবুর বাবা তুমি বলো এই মেয়েটা কে?”

” কেউ না অনিমা।তুমি এসবে কান দিও না।”

” কান দেব না মানে?এই মেয়েটা কে?আমার খুশবুর মতো দেখতে কেন?”

বাহারুল হক সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন আরশাদের পানে।তার মেয়ের মাথায় এসব নিশ্চয়ই আরশাদ ঢুকিয়েছে!আরশাদ অনিমা এবং বাহারুল হক দুজনকে নিরবে জহুরি চোখে পরখ করলো এবং আদি অন্ত ভেবে যা বুঝলো এই রহস্যের সমাধান বাহারুল হকের কাছেই আছে।

” আমার কাজ আছে আমি গেলাম।আর খুশবু এসব মাথা থেকে ঝেরে দাও এই মেয়েটা কে আমি এবং তোমার মা কেউ জানি না।”

বাহারুল হক পালিয়ে বাঁচতে চাইলেন কিন্তু খুশবুতো ছাড়ার পাত্রী নয়।দেশে আসার মূল উদ্দেশ্য নীরার পরিচয় খুঁজে বের করা সেখানে বাহারুল হকের এড়িয়ে যাওয়া সে কি এতটা সহজে মানবে?

” আব্বু কোথাও যাবে না।আমার প্রশ্নের জবাব আমি চাই নীরা মেয়েটা কে?”

” বললাম তো জানি না।”

আরশাদ উঠে দাঁড়ালো।অভয় দিয়ে বলে,

” আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?সত্যটা প্রকাশ করুন।সত্য লুকিয়ে থাকার নয় একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই।”

” আমার মেয়েকে তুমি উস্কে দিয়েছো তাই না?”

” একদমি না।যা হয়েছে যা হচ্ছে এসব তার জানা জরুরি।আপনি ভয় পাবেন না খুশবুর যেকোন বিপদ আপদে আমি পাশে আছি।”

বাহারুল হক ঢোক গিললেন।অনিমার ঝাপসা চোখ এখনি তাকে দূর্বল করে দিচ্ছে সত্যটা জানার পর কী হবে?যা হবার হবে এখন আর লুকিয়ে রাখার সময় নয়।বাহারুল হক বলেন,

” অনিমার সাথে আমার বিয়ের আট বছর চলছিলো তখনো আমাদের ঘরে কোন সন্তান নেই।অনিমার প্রেগ্ন্যাসির ২ মাস ৩ মাসে তিনটা বাচ্চা নষ্ট হয়।সবাই বলছিল আমি যেন দ্বিতীয় বিয়ে করি এবং অনিমাকে তালাক দি।আমি এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।মূলত নেওয়ার সাহস করিনি।আমি একটি এনজিওতে চাকরি করতাম।আমার আব্বা আম্মার সাথে ঝগড়া করে অনিমাকে নিয়ে চলে আসি চট্টগ্রামে।সেখানে অনিমাকে নিয়ে নতুন বাসায় উঠি।ভাগ্যক্রমে সাত মাসের মাথায় অনিমা কনসিভ করে।সেইদিনের খুশি আর ধরে রাখতে পারিনি।একটা সন্তানের আশায় যত যা করতে হয় সব করেছি।অনিমাকে চোখে চোখে রেখেছি বাড়ির কাজ করতে আলাদা কাজের লোক রেখেছি।সব মিলিয়ে আট মাস পেরিয়ে গেল।একদিন ডাক্তারের চেকাপ সেরে আসার পথে আমাদের রিক্সায় পেছন থেকে ট্রাক ধাকায় দেয়।অনিমা ছিটকে পড়ে রাস্তায়।মাঝ রাস্তায় পড়ায় অনিমার উপর দিয়ে চলন্ত সিএনজির চাকা উঠে যায়।এরপর কি হয় তা না বলি।আশা করি বুঝতেই পারছো তোমরা।সেই বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না অনিমা তখন জীবন মরানের সন্ধিক্ষণে।বাচ্চার জন্য অনিমা যে পাগল হয়ে উঠবে আমি জানতাম।কি করবো তখন ভেবে পেলাম না।অনিমার জ্ঞান ফিরলে সে আমাদের সন্তান দেখতে চায় আমি এবং নার্সরা মিথ্যা বলে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম।
সেদিন রাতে একজন আয়া আমাকে জানালো যেদিন অনিমাকে হসপিটাল ভর্তি করা হলো সেদিন রাতে সেই হসপিটালে সিজারে এক দম্পত্তির নাকি জমজ বাচ্চা হয়েছে দরিদ্র পরিবারে তারা একটা বাচ্চা মানুষ করতেই হিমশিমে পড়বে তাই তারা বাচ্চা বিক্রি করতে চায়।ব্যস আমি আর নয় ছয় না ভেবে লক্ষ টাকার বিনিময়ে মেয়েটাকে কিনে নিয়েছিলাম।যেহেতু আমি চট্রগ্রাম একাই ছিলাম তাই এই তিক্ত সত্যটা কেউ জানলো না।শুধু আমি সবটা জেনেও ভুলে গেলাম খুশবুর জন্মদাতা পিতা আমি নই।

চলবে….