কি সমস্যা আপনার?
আরিফের রুমে রেহান ভাই ল্যাপটপে কাজ করছেন। শাওয়ার নিয়ে রুম থেকে বেরিয়েই দেখি আরিফ কোথাও যাচ্ছে।।
-রেহান ভাই কোথায়?
– আমার রুমে।
– তুই কই যাচ্ছিস? হাতে এগুলো কি?
– ভাইয়ার কি দরকারি কাগজপত্র, কুরিয়ার করতে যাচ্ছি।
কথা না বারিয়ে সোজা আরিফের রুমে চলে আসি।
আমার প্রশ্ন শুনে রেহান ভাই হা করে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বললো –
কি সমস্যা মানে?
– এখন আপনাকে মানেও বুঝাতে হবে?
আমি তো আর আপনাকে জ্বালাতন করছি না।আপনার কি এমন অনিষ্ট করেছি আমি?
– এসব কি বলছিস আর কেন বলছিস? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
– অহহহহহো…. উনি এখন কিছু বুঝতে পারছেন না!! উনি সাধু!
– দেখ, হেঁয়ালি করবি না।যা বলার সরাসরি বলবি।
– বিয়ে আপনি ঠিক করেছেন?
– হা। করেছি। তো? কি হয়েছে?
– কি হয়েছে মানে? আমার লাইফ।আমি কাকে বিয়ে করবো না করবো, সেই সিদ্ধান্ত আমি নিবো।
আমাকে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেননি? আপনার সব সিদ্ধান্ত কেন আমার উপর চাপিয়ে দিবেন?
রেহান ভাই কিছু সময় থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে, ধপাস করে বসে আবার কাজ শুরু করলেন।
উনার এই ভাবলেশহীন ব্যবহার দেখে রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে।
টান দিয়ে ল্যাপটপ সরিয়ে নিলাম।
– আরে কি করছিস!!.
ল্যাপটপ সরিয়ে অন্য যায়গায় রেখে বললাম
– আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
– কি উত্তর দিবো।বল।প্রশ্ন কর।
– আপনার প্রব্লেম টা কি জানেন?
– নাতো! কি প্রব্লেম? বল তো।
– আপনার ইগো! আর আপনার মাঝে একটা স্বৈরাচারী মনোভাব। আপনার সিদ্ধান্ত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চান সবসময়।
– তাই?
– জি।একদম তা-ই। কে বলেছে আপনাকে আমার বিয়ে ঠিক করতে?
– তোকে বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় করার জন্য বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। উত্তর পেয়েছিস?হ্যাপি? এখন ল্যাপটপ দে।
আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
রেহান ভাই একটু থমকে গেলেন।
– আমাকে পুতুল মনে হয় আপনার?
– কিসব বলছিস।তোকে পুতুল মনে করবো কেন?
– আপনি আমাকে পুতুল ই মনে করেন। না হলে আমার ও মন বলে কিছু আছে সেটা বুঝতে পারতেন।
আমার অনুভূতির কোনো মূল্য আপনার কাছে নেই সেটা জানতাম। কিন্তু আমার ভালো লাগা – মন্দ লাগা, এসবের ভাবনাও নেই।
– ওহহ… আচ্ছা। ছেলে তোর পছন্দ না হলে বিয়ে ভেঙে দেই।
– ছেলে কি করে, কেমন দেখতে, কানা,খোঁড়া যাই হোক দেখবোও না।তবে বিয়ে আমি করবো।এখানেই করবো।
– সেকি কথা। ছেলে কানা,খোঁড়া হবে কেন?? দেখ…..এই দেখ ছেলের ছবি।
মোবাইল থেকে ছবি বের করে চোখের সামনে ধরলেন। একবারও তাকিয়ে দেখিনি।
আমি উনার মুখের দিকে কঠিন মুখে তাকিয়ে দেখছি।
– আমার মনের কোনো মূল্য আপনাদের কাছে নেই। তো বিয়ে এখানেই হবে। তাতে আমি সুখী হই বা না হই!!
– ছেলে খুবই ভালো। হ্যাপি রাখবে সবসময়।
আমি আর একটা কথাও বলিনি।নিজের রুমে চলে আসে দরজা লক করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
মনে হচ্ছে কেউ আমার হৃদপিণ্ড ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে ফালাফালা করছে।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
দরজায় ধুমধাম শব্দে ঘুম ভাঙলো।
দরজা খুলে দেখি দিয়া,মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
– তোর আর কোনো কাজ নেই? আমি একটু ঘুমালে তোর কি অশুদ্ধ হয়ে যায় শুনি? সহ্য হয়না?
– এতো মেজাজ দেখাচ্ছিস কেন?
আম্মু ডাকছে। গেস্ট আসছে।
– কিসের গেস্ট?
– আরে ছেলে পক্ষের তারা বিয়ের জন্য যে রিসোর্ট বুকিং দিয়েছিলো সেখানে একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। পুলিশ ব্লক করে দিয়েছে। উনারা হোটেলে উঠতে চেয়েছিলো। কিন্তু আব্বু,ফুপ্পি তারা উনাদের জোর করে বাসায় নিয়ে আসছে।
– বাসায় নিয়ে আসছে মানে?
– আব্বু বলছে দুটো বাড়িতে এতো গুলো রুম খালি পড়ে থাকতে, গেস্ট কেন হোটেলে থাকবে!
– আজিব তো! উনাদের কি বাড়ি ঘর নাই?এসবের মানে কি!!
– তুই দেখি কিছু ই জানিস না! আম্মু বলেনি।
উনারা চিটাগং থেকে এসেছেন ৮/১০ দিন থেকে বিয়ের পরে একেবারে যাবেন। এইজন্য একটা রিসোর্ট বুকিং করেছিলেন।
– আম্মু কই?
– নিচে আছে। তুই তাড়াতাড়ি আয়।
বলে দিয়া চলে গেলো।
–
নানুবাড়ি থেকে এসে যা হচ্ছে তাতে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।
বুঝতে পারলাম বিয়ে টা চিটাগং হচ্ছে। নিশ্চয়ই মাহি আপুর হাত আছে এখানে।
ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরুতেই দেখি রেহান ভাইও নিচে যাচ্ছেন।
আমাকে দেখেই বললেন – এখনো যাসনি নিচে!!
আমি কিছু না বলে চুপচাপ নিয়ে চলে আসি।
এসে দেখি ৮/১০ জন মানুষ।
আমাকে দেখে একজন অল্প বয়স্ক মহিলা বললেন – আরে, তুমিই তো হিয়া।
আমি সালাম দিলাম।
– কেমন আছো তুমি?
– ভালো। আপনি?
– অনেক ভালো। আমার একমাত্র দেবরের বিয়ে। আর আমি ভালো থাকবো না।
বলেই মিষ্টি করে হাসলেন।
– মাহির কাছে তোমার অনেক গল্প শুনেছি।আমি রিয়াদের ভাবি।আর এই আমার মেয়ে তিথি।
৭/৮ বছরের মিষ্টি একটা মেয়েকে দেখিয়ে বললেন।।
– এসো বসো আমাদের সাথে।
আমাকে হাতে ধরে নিয়ে গেলেন সবার মধ্যে।
আমি খুব আনইজি ফিল করছিলাম। রেহান ভাই, আম্মু সবাই এখানে।পাশে বসা একটা মেয়ে বললো
– আপু,আমি রাইসা। রিয়াদ ভাইয়ের ছোট বোন।
– কেমন আছো তুমি?
– আমি ভালো আছি।সেদিন যখন এসেছিলাম, তুমি তো ছিলে না।তাই দেখা হয়নি।
– কোন দিন?
– এনগেজমেন্ট এর দিন।আমিও এসেছিলাম আব্বুর- আম্মুর সাথে।
– অহহ।।
না বুঝেই অহহহ বললাম, কিসের এনগেজমেন্ট!! মাথায় ঢুকছে না।
– মাহি ভাবি তো সব সময় তোমার কথা বলে।
– মাহি ভাবি!!!
– আরে দুদিন পরে তো ভাবি ডাকতেই হবে ।
তাই আগেই অভ্যাস করছি।
সবাই রাইসার কথা শুনে হেসে উঠলো।
সবটা ক্লিয়ার এখন। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে মাহি আপুকে খুঁজছি।।
কিন্তু এখানে নেই।রেহান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
এই হাসি দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার।
মাহি আপুর বিয়ে!! কি ভয় দেখালো আমাকে!!
রেহান কি হিয়াকে পছন্দ করে?
আব্বু আম্মুকে জিজ্ঞেস করলেন।
– এমন তো কিছু মনে হয়না।তবে রেণু আপা হিয়াকে খুব পছন্দ করেন। উনি চেয়েছিলেন রেহান হিয়াকে বিয়ে করুক।কিন্তু এই ছেলের যা মতিগতি!
– কই,আপা তো আমাকে কখনো কিছু বলেনি।
– বলার মতো কিছু থাকলে তো বলবে! রেহান বিয়ে করতেই রাজি না।এখন যদি হিয়ার সাথে বিয়ের কথা হয় আর রেহান রাজি না হয়, তখন কি একটা বিশ্রী অবস্থা হবে। আপা হিয়াকে নিজের মেয়ে থেকে কম দেখেনা কোনো দিন।হিয়াকে এমন একটা বিশ্রী পরিস্থিতিতে ফেলতে চান না।
– হুমম। এটাও ঠিক।
আব্বু গম্ভীর ভাবে বললেন।
– তবে…
আম্মুর তবে শুনে আব্বু বললেন – তবে কি?
– রেহানের মনে কি আছে জানি না,তবে তোমার মেয়ের মনে কি আছে জানি।
– হিয়ার মনে কি আছে??? হিয়া কি…?
– হিয়া রেহানকে পছন্দ করে।
– তাই নাকি? তোমাকে বলেছে কিছু?
– ধুর, আমাকে বলবে??!! মায়ের চোখ ফাঁকি দেয়া এতো সহজ না।রেণু আপাও জানেন।
– বাহ, তুমি ও জানো, আপাও জানে।শুধু আমি জানি না!!
– আরে সব সময় সব কিছু জানতে হয় না।সময়ে জানলেই চলবে তোমার।
– হা,আমি তো গাধার খাটুনি খেটে মরি! এসব জেনে কি হবে!!
– বাজে বকো না তো।আপা এবার খুব ক্ষেপে আছেন রেহানের উপর।
– সেটাই তো স্বাভাবিক। একটার পর একটা বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিচ্ছে। কি যে চায় আল্লাহ ই ভালো জানেন।
– রেহান যা-ই চাক। হিয়া বড় হয়েছে। সামনে অনার্স ফাইনাল দিবে।এবার কিন্তু আমাদের ভাবা উচিত। ভালো ছেলের খোঁজ করো।
– হুম। ঠিক বলেছো।লাইট অফ করে দাও তো।ঘুম পাচ্ছে।
আমি সরে আসলাম। আরিফের রুমে আর যাইনি।সোজা নিজের রুমে চলে আসি।
যে যা-ই ভাবুক, রেহান ভাইয়ের মনে আমি নেই!! এটাই সত্যি। আমার খারাপ লাগলেও এটা সত্যি। আমার কষ্ট লাগলেও এটাই সত্যি।উনার মনে এখনো অন্যকেউ আছে!!
বিকেলবেলা বাগানে গেলাম। খরগোশ দুটোর সাথে সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগে আমার। দোলনায় হালকা দোল খাচ্ছি আর খরগোশ দুটোর লুকোচুরি দেখছি।
বাগানের অন্যপাশে দেখলাম রেহান ভাই ফোনে কথা বলছেন।ব্লু কালার টিশার্টে উনাকে খুব বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে।
এই লোকটাকে দেখে উনার বয়স অনুমান করা অসম্ভব!
ভার্সিটির মেয়েদের ক্রাশ!!
ক্রাশ হবে না কেন? উনার মতো ব্যক্তিত্ব, কথা বলার স্টাইল, অমায়িক হাসি! যেকোনো মেয়ের মন ছুঁয়ে যাবার মতো। আমাকে দেখতে পেয়ে, ফোন রাখতে রাখতে আমার দিকে আসছেন।
– কিরে, কি করছিস?
বসে পড়লেন আমার পাশে।
– কিছু না। বসে আছি।
– তোর খরগোশ দুটো কেমন আছে?
– ভালো আছে।
– বাহ! আরও সুন্দর হয়ে গেছে এই কদিনে।
– হুম।
– মন খারাপ?
– নাতো।
– তো এভাবে কথা বলছিস কেন?
– কিভাবে বলছি?
– রাগ আমার উপর?
– নাতো।রাগ হবে কেন?
– তাহলে আগের মতো কথা বলছিস না কেন? কেমন করে যেন কথা বলছিস!আগের মতো বাসায় আসিসও না।
– আমি তো ঠিক করেই কথা বলছি।যেভাবে বলা উচিত। বলেছিলাম না জ্বালাতন করবো। তাই করছিনা।
– তাই বলে এভাবে?
– হুম।
– বেশি পাকামো করতে হবে না। আগের মতোই চলবেন। আপনার এই অদ্ভুত ব্যবহার সবার চোখে বাজবে। বুঝছিস?
– বুঝেছি।
– গুড।
হঠাৎ দেখি আমাদের বেলকনিতে আম্মু আর ফুপি কথা বলছেন। দুএকবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছেনও।।
গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল।
কি ভাবছেন উনারা ভাবতেই…
তাই নরমাল ব্যবহার করার চেষ্টা করলাম।কিন্তু ভেতর একটা অস্বস্তি হচ্ছে আম্মু আর ফুপিকে একসাথে দেখার পর।
উঠে যে চলে যাবো, সেটাও অশোভন দেখায়।
আমাকে উদ্ধার করে দিয়ে আরিফ আর দিয়া হাজির।
যাক বাবা।এবার পরিবেশ টা ঠিকঠাক লাগবে।
চারজনে সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা চললো।
ওইদিন রেহান ভাইয়ের কথা গুলো শোনার পরে, তারপর আব্বু আম্মুর আলোচনা শুনে আমি যতই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি পারছিনা।
এর মধ্যে পরীক্ষার দরজায় কড়া নাড়ছে। এই সুযোগ, এক অজুহাতে নিজের রুমেই বেশি সময় কাটাচ্ছি। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ধীরে ধীরে আমিও স্বাভাবিক হয়ে গেলাম।
দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা শেষ।।
একদম ফ্রি হয়ে বাসায় সময় কাটাচ্ছি।
এর মধ্যে ছোট মামা হাজির। ছোট মামা -মামানি দেশের বাইরে থাকেন। তিন মাসের জানা দেশে ছুটি কাটাতে এসেছেন। সাথে উনাদের পাঁচ বছরের ছেলে নুহাশ।
এখানে কয়েকদিন উনাদের সাথে খুব হইচই করে, নুহাশকে নিয়ে সময় কেটে গেলো।উনারা বাড়িতে ফিরে যাবার আগে আমাকে উনাদের সাথে নেয়ার জন্য বায়না ধরলো।
যাবার আগের দিন সন্ধ্যায় সবাই যখন এক সাথে বসলো তখন ছোট মামা বললেন
– আপা, হিয়া আমাদের সাথে যাবে।
– তোরা এতো দিন পরে এসেছিস, কত যায়গায় ঘুরাঘুরি করবে হিয়া গিয়ে কি করবে?
মামানি বললেন – ওর তো পরীক্ষা শেষ। শুধু শুধু বসে আছে বাসায়। আমাদের সাথে গেলে ঘুরাঘুরি করবে। হিয়ার সময় কাটবে, আমাদের ও অনেক ভালো লাগবে।
মামানি আমাকে একটু বেশিই আদর করেন। তাই উনিই বায়না ধরেছেন।
– আমি কিছু জানি না। ওর আব্বুকে বলো।
– দুলাভাই, হিয়া কিন্তু যাচ্ছে আমাদের সাথে।
ফুপি বললো – যাক না।সারাদিন তো বাসায় ই বসে থাকে। ঘুরে আসলে ভালো লাগবে।
ফুপির সাথে মামনি যোগ করলেন- হা।এখনই তো বেড়ানোর সময়। কদিন পরে বিয়ে হয়ে গেলে তো হিয়াকে পাবো না।
আমি সোফার হাতলের এককোনায় বসে আছি।রেহান ভাই মুচকি মুচকি হাসছে মামির কথা শুনে।
আব্বু বললো – আচ্ছা ঠিক আছে। কিছুদিন ঘুরে আসুক।
ছোট মামনির সাথে আমার খুব ভাব।উনার সাথে যাবো এতে আমিও খুব খুশি।অনেক দিন পর নানুবাড়ি যাবো।
এদিকে আরিফ আর দিয়া গাল ফুলিয়ে আছে। ওরাও যেতে চাইছে।কিন্তু আব্বু না করার আগেই রেহান সাহেব উনাদের নিষেধ করে দিয়েছেন। কারণ উনাদের পরীক্ষার পরই যাবার অনুমতি দেয়া হবে।
আর পরীক্ষা এখনো ২/৩ মাস বাকি।এতেই দুজন ফুলে আছে। ওদের মন খারাপ দেখে আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই।কারণ রেহান ভাই না করার পরে আর কেউ অনুমতি দিবে না।
নানুবাড়িতে দিনগুলো খুব আনন্দে কাটালাম সবার সাথে। প্রায় ২০/২৫ দিন থাকার পরে আব্বুর জরুরি তলবে বাসায় ফিরলাম।
এসে দিকে এলাহি কান্ড!!
বাগান থেকে শুরু করে পুরো বাড়ির চিত্র যেন বদলে গেছে। সব পরিপাটি করে সাজানো হচ্ছে।
বিষয় টা বুঝতে পারছি না।বাসায় ফেরার পর সবাই খুশি হলো। কিন্তু কেউ কিছু বললো না।
– দিয়া? বিষয় টা কিরে?
– কোন বিষয়?
– বাসার চেহারা বদলে গেছে! কিছু একটার গন্ধ পাচ্ছি।
– আছে, আছে। সিক্রেট। বলা যাবে না।
– বলা যাবে না মানে? কি হয়েছে বল!
– আহা, ধীরে বাবু ধীরে। এতোদিন পরে এসে সাথে সাথেই জেনে যাবে?
কথাগুলো শুনে পিছনে ফিরে দেখি মাহি আপু!
– মাহি আপুওওও….
দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।
– তুমি কবে আসছো?
– তোকে বলবো ক্যান? খোঁজ নিয়েছিস এই কদিন? নানু বাড়ি গিয়ে একদম সবাইকে ভুলে গেছিস।
– ইসসরে! আমার মোবাইল টা পানিতে পড়ে ৮/১০ দিন যাবত নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন মোবাইল নেয়ার জন্য আবার শহরে আসতে হবে, মামা আসতে নাই,মোবাইল ও নিই নাই।তারপর উনি নতুন একটা গিফট করলেন!
– তোমার তো সব দিকেই লাভ!
দিয়া মুখ মোড়া দিয়ে বললো। রেহান ভাই,ফুপিও আসলো।
– আপু বলো না,কি হইছে?
মাহি আপু শুধু হাসে কিছু বলে না।আম্মুকে
জিজ্ঞেস করলাম- আম্মু তুমি তো বলো!
মাহি আপু আম্মুকে ইশারায় চুপ করিয়ে দিলো।
– আমি কি বলবো? আমি কিছু জানি না। তোর বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর!
ধুর! কেউ কিছু বলছেনা।
মাহি আপু বললো- যা ফ্রেশ হয়ে, রেস্ট নে।সন্ধ্যায় আমাদের সাথে বের হবি।
– কোথায় যাবো?
ফুপি বললে – ওমা, সব শপিং করতে হবে না?আজকে জুয়েলারিগুলো নিয়ে নিবো।
– কিসের শপিং? আর কিসের জুয়েলারি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আম্মু আর ফুপি অন্যরুমে চলে গেছেন ইতোমধ্যে।
আরিফ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো- বিয়ের।
– বিয়ের? কার বিয়ে?!!
দিয়া আর মাহি আপু হাসছে।
মাহি আপু কানে কানে বললো – তোকে মামা বাড়ি থেকে বিদায় করার ব্যবস্থা করেছে।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম!
– কিহ!!
মানে কি? বলা নেই কওয়া নেই! হুট করে বিয়ে বললেই বিয়ে হয়ে যাবে? মগের মুল্লুক নাকি?
রাগে গড়গড় করতে করতে রুমে এসে, হাতের মোবাইল ছুড়ে বিছানায় ফেললাম।
দিয়া, মাহি আপু পিছনে পিছনে আসলো।
– হিয়া তুই আগে শাওয়ার নে।তারপর বলছি সব।মাথা ঠান্ডা কর।
মাহি আপু জোর করে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো।
অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিলাম।
আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চোখের পানি থামছেই না।শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখি মাহি আপু আর দিয়া এখনো আছে। মাথায় টাওয়াল জড়িয়ে বেডের এক কোনায় বসে পড়লাম। আমার চোখ লাল দেখে দিয়া চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে
– আপু তুই কান্না করছিস?!!
আমি চুপচাপ বসে আছি।
– দেখ হিয়া, আমরা এতো কিছু জানি না।
দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে ঠিক করার কাজটা ভাইয়া করেছে।
– কিহ? রেহান ভাই!!
– হুমম।ভাইয়ার পছন্দ কি খারাপ হতে পারে, বল?
চল দিয়া।আমরা গেলাম, তুই রেস্ট নে।
মাহি আপু, দিয়া চলে গেছে। রাগে,দুঃখে…
তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নিয়ে,রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।
#প্রেমে_পড়া_বারণ
# পার্ট – ৩
# Writer : Taslima Munni
– তুই যা ভাবছিস তা সম্ভব নয়।
– আমি কি ভাবছি?
আমার এমন প্রশ্নে রেহান ভাই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন।
– দেখ,আমি কিন্তু সিরিয়াস কিছু কথা বলছি।
– আমিও সিরিয়াসলি শুনছি।
– শুনছিস না।
– আপনি কি সত্যিই বিয়ে করবেন?
– জানি না।
– আচ্ছা, কেন সম্ভব না?
– তুই আমার ১২ বছরের ছোট। বাচ্চা একটা মেয়ে। দুটো পরিবার কখনো আমরা কেউ আলাদা করে দেখিনি। বুঝতে পারছিস মামা,মামি যদি এসব শুনেন, উনারা কি ভাববেন। তাছাড়া…
– তাছাড়া কি?
– তুই ভালো করেই জানিস, আমি এসব নিয়ে কিছু ভাবিনা।তোর মনে কি চলছে সেটা আমি বুঝতে পারছি বলেই তোকে সাবধান করছি।দেখ হিয়া,আমি চাই তুই ভালো থাক। মন ভাঙলে সহ্য করতে পারবি না। তোকে কষ্ট দেয়ার কোনো ইচ্ছেও নেই আমার।
তাই তোকে পরিষ্কার করেই বলে দিচ্ছি- এটা সম্ভব না।
রেহান ভাই এক শ্বাসে কথা গুলো বললেন।
উনার কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এসেছে।
– অনেক তো কারণ ব্যাখ্যা করলেন। একটা কথা সত্যি করে বলবেন?
– কি?
– আমার জন্য কি আপনার মনে কোনো যায়গা নেই?
– থাকবে না কেন? মাহি,দিয়া, আরিফের যেমন যায়গা আছে, তোর ও আছে।
আমি আফরিনকে ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারবো কিনা জানি না।।
উনার কথা শুনে আমার মুখ থেকে একটা কথাও বের হচ্ছে না।
মাথানিচু করে বসে আছি। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি চেষ্টা করছি সামলে নিতে, কিন্তু পারছিনা।
রেহান ভাই আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেন।
– হিয়া কি করছিস? আমি তো জানতাম তুই স্ট্রং একটা মেয়ে। বাচ্চাদের মতো কাঁদছিস!!
আমি নিজেকে সামলে নিলাম। রেহান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– আমি অনেক জ্বালিয়েছি আপনাকে।আর জ্বালাতন করবো না। আপনি বিয়ে করে নিন।’
রেহান ভাই মৃদু হেসে আলতো করে আমার চোখ মুছে দিলেন।
– চল, এখন যাওয়া যাক।অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আমরা বাসায় ফিরছি।আজকে আমার ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এতো দিন ভাবতাম উনি আমার অনুভূতি বুঝেন না। কিন্তু আজ! আমাকে কিছুই বলতে হয়নি।উনি সবটা জানেন,বুঝেন।আর বুঝেশুনেই উনি ফিরিয়ে দিলেন।।
আমার অনুভূতিগুলো তাকে স্পর্শ করেছে,কিন্তু তার মন স্পর্শ করতে পারেনি।
আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখছি।আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবে বোধ হয়।
আমার মনেও মেঘ জমেছে, ঝড় উঠেছে।কিন্তু চোখের বৃষ্টি থেমে গেছে।
দেখতে দেখতে চার-পাঁচ দিন কেটে গেছে। আমার হাতের অবস্থা অনেক টা ভালো। এই কয়দিন কোথাও বের হইনি।আজ নাকি রেহান ভাই অই মেয়েটার সাথে দেখা করার কথা।
সবাই খুব এক্সাইটেড। টানটান উত্তেজনা সবার মধ্যে, ঠিক যেন খেলার শেষ মুহূর্তে, শেষ বলে একটা রান অথবা একটা উইকেট দরকার!
রেহান ভাইয়ের বিয়েটা এখন এই পর্যায়ে এসে গেছে। এতো দিনে কম মেয়ে দেখেনি।কিন্তু রেহান ভাই কাউকে দেখতেই যায়নি।সব আব্বু,আম্মু আর ফুপি দেখেছে।আজ যখন রেহান ভাই দেখা করতে রাজি হয়েছে তখন সবাই এক্সাইটেড থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।
রেহান বিয়ে না করার পিছনে একটা কারণ আছে। সেটা সবাই জানে। কিন্তু এটা সবাই স্বাভাবিক ভাবে নিলেও রেহান নিতে পারেনি।তাই বিয়ে করবে না বলে জিদ ধরে আছে ।
রেহান যখন বাহিরে ছিলো তখন আফরিন নামে একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়।
তারপর বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। প্রায় পাঁচ বছরের রিলেশন। রেহান বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তার মা প্রথমে রাজি ছিলেন না,কারণ রেহান সেখানেই সেটেল্ড হবার চিন্তা করছিলো। তারপর সবাই বুঝানোর পরে, ছেলের কথা চিন্তা করে রাজি হলেন।
রেহানের মা রাজি হবার পরে রেহান তার সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করে; বিয়ে করে দেশে ফিরে আসবে।এনগেজমেন্টের এর আয়োজন হলো। রেহানের কিছু বন্ধু-বান্ধব উপস্থিত ছিলো।
কিন্তু আফরিন আসেনি।
তার ফোন সুইচড অফ। অনেক বার ট্রাই করেও আফরিনের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। সবাই অপেক্ষা করে যখন চলে যাবে তখন আফরিন এলো। এনগেজমেন্ট হলো।
রেহান খুব এক্সাইটেড ছিলো। বিয়ের শপিং শুরু করে দিলো। সেখানে একা,পরিবারের কেউ নেই। তাই সব কিছু ওকে সামলাতে হবে।
এনগেজমেন্টের আট- দশ দিন পরে হঠাৎ একদিন আফরিন এসে উপস্থিত, তাও প্রায় রাত ১১ টায়।
– আরে রিন,তুমি? এই সময় এখানে?
-রেহান, তোমার সাথে জরুরী কিছু কথা বলতে এসেছি।ভেতরে আসতে বলবে না?
– অফকোর্স! এসো,ভেতরে এসো।
কি এমন কথা সন্ধ্যায় তো দেখা হলো, তখন তো কিছু বললে না।
– অনেক ভাবলাম, কি করা উচিত আমি বুঝতে পারছিলাম না।এখন আমি মাইন্ড স্থির করে ফেলেছি।
– কি ব্যাপারে রিন( আফরিন কে সবাই রিন বলেই ডাকে) তুমি কি নিয়ে কথা বলতে চাইছো আমি বুঝতে পারছি না।
– তুমি কি সত্যিই বিয়ের পরে দেশে ফিরে যেতে যাও??
-রিন…এইটা নিয়ে আমরা আগেই কথা বলেছি, তাই না? আমার আম্মু একা সেখানে, উনি কিছুতেই এখানে আসতে রাজি হচ্ছেন না।মাহির বিয়ে হয়ে গেলে উনি একদম একা হয়ে পড়বেন।উনি আমাদের বিয়েতে মত দিয়েছেন। এখন ছেলে হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করবো না?
– ওকে! তাহলে আজ ফাইনাল ডিসিশন হোক।
– এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে, এখন আর কি ডিসিশন বাকি?
– বিয়ে তো হয়ে যায়নি।
– কি বলতে চাইছো, রিন?
– রেহান! কাম অন! বিয়ে ছোট খাটো কোনো বিষয় না।সারাজীবনের ব্যাপার। আমি যদি হ্যাপি না-ই থাকতে পারলাম, সেই বিয়ের কোনো মানে আছে?
– তুমি আমার সাথে হ্যাপি নও?
– অফকোর্স হ্যাপি। বাট, তুমি জানো আমি সেই ছোট্টবেলা থেকে এখানে। আমার পুরো পরিবার এখানে। ইনফ্যাক্ট দেশে আমাদের খুব কম আত্নীয় স্বজনই আছে।এখন আমি তোমার সাথে দেশে ফিরে কম্ফোর্ট ফিল করবো? আমি এখানে অভ্যস্ত, তুমিও বলেছিলে এখানেই থাকবে,কিন্তু এখন চাইছো ফিরে যেতে।
– আমার দিকটা কি তোমার important মনে হচ্ছে না?
– মনে হচ্ছে, তোমার দিকটাও,আমার দিকটাও।এখানে আমি এতো ভালো একটা জব করি,সেটাও ছাড়তে হবে। ফ্যামিলি ছেড়ে যেতে হবে। রেহান, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, আমি এখানেই থাকতে চাই।
– হয়তো কয়েক বছর থাকবো এখানে, কিন্তু আমার পক্ষে সারাজীবন এখানে থাকা সম্ভব না।
– এটাই ফাইনাল কথা?
– হা।এবার তুমি ঠিক করো তুমি কি করবে। এমন তো নয় তুমি দেশে গেলে আর পরিবারের সাথে দেখা করতে পারবে না। যখন ইচ্ছে আসতে পারবে।
– সরি, রেহান। আমার পক্ষে দেশে থাকা সম্ভব না।
– অহহ।তাহলে তো তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো।
– তুমিই এর সমাধান দিতে পারো।তুমি এখানে থেকে গেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। প্লিজ রেহান।
– আসলেই। আমিই সমাধান দিবো।
এনগেজমেন্ট রিং খুলে আফরিনের হাতে দিয়ে বললো – এই নাও।
– তুমি এনগেজমেন্ট ভেঙে দিচ্ছো??
বড় বড় চোখ করে আফরিন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
– ভেঙে দিচ্ছিনা।সমাধান দিচ্ছি। তোমার সিদ্ধান্তে বহাল থাকলে এই রিং নিয়ে চলে যাও।আর যদি মনে করো তুমি আমার সাথেই থাকবে যেকোনো পরিস্থিতিতে, তাহলে ফিরে এসো।আমি অপেক্ষা করবো।
– এতো বছরের রিলেশন ভেঙে দিবে?
– আমি ভাঙতে চাইছিনা, রিন। তুমি চাইছো।এখন সিদ্ধান্ত তোমার।
রিন কিছু অনেক সময় মাথা নিচু করে, দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে। তারপর উঠে বললো –
‘ ঠিক আছে রেহান,সারাজীবন অশান্তি করার চেয়ে, সাময়িক কষ্ট সহ্য করাই আমার কাছে বেটার মনে হচ্ছে। ‘
আফরিন নিজের হাতের রিং টা খুলে রেহানের হাতে দিলো।
– ভালো থেকো রেহান।
আফরিন চলে যায়। রেহান তাকে ফেরায়নি।রেহান ভেবেছিলো কিছুদিন পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে রিন ঠিক ফিরে আসবে।
কিন্তু রেহানকে ভুল প্রমাণ করে দুইমাসের মাথায় রিন বিয়ে করে ফেলে। রেহান ভাবতেই পারেনি পাঁচ বছরের রিলেশন এভাবে শেষ করে দিলো! আর রিন সত্যিই বিয়ে করে ফেলবে এটাও চিন্তাই করেনি।অভিমানে যোগাযোগ করেনি ঠিক,কিন্তু সারাক্ষণ আফরিনের কথায় ভেবেছে।
এই ঘটনার পরে রেহান খুব আপসেট হয়ে পড়ে।
দিন দিন আরও খারাপ হতে থাকে রেহানের অবস্থা। ওর মা তখন চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন,আর রেহানও বাধ্য হয়ে ফিরে আসে মায়ের জন্য। কিন্তু বিয়ে টা আর করেনি।
রেহান ভাই মেয়েটার সাথে দেখা করতে গিয়েছেন বিকালবেলা।
সন্ধ্যায় দেখি আব্বু,ফুপি,আম্মু মুখ কালো করে বসে আছেন।
– আপা,তোমার ছেলের বিয়ের আশা এই জন্মের মতো ছেড়ে দাও।আমি আর কোনো মেয়ে দেখবো না ওর জন্য।
– রেহানের কি দোষ? মেয়েই তো রাজি হয়নি।তার নাকি বিয়েতে মত নেই।
আম্মুর কথা শুনে ফুপি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।
– মেয়ে রাজি হয়নি? মেয়ের রেহানকে পছন্দ হয়নি? এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?
আমার ছেলেকে চিনো না , এর পিছনে সব কলকাঠি নেড়েছে সে।আমি সব বুঝতে পারছি।
যাহ বাবা! এই বিয়ে এতো কৌশলে ভেঙে দিলো!?অবশ্য তাতে আমি কিছু টা খুশি হইনি বললে মিথ্যা বলা হবে।
রাতে সবাই যার যার রুমে চলে গেছে ঘুমাতে।আরিফের রুমে যাচ্ছিলাম একটা কাজে। আরিফের রুমে আব্বু- আম্মুর রুমের সামনে দিয়ে যেতে হয়।।
হঠাৎ কানে আসলো আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। রেহান ভাইয়ের নামও শুনতে পেলাম।
কি কথা হচ্ছে শোনার জন্য আরেকটু এগিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালাম। দরজা সামান্য খোলা ছিলো। কথাগুলো স্পষ্টই শুনতে পেলাম।
#প্রেমে_পড়া_বারণ #
# পার্ট- ২
Writer: Taslima Munni
রেহান ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখে সবাই খুব খুশি মনে ফিরে আসলো। মেয়ে সবার পছন্দ হয়েছে।
আগামীকাল মেয়ের বাড়ি থেকে লোক আসবে। আম্মু-ফুপিকে দেখলাম এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কি কি আয়োজন হবে তার লিস্ট তৈরি করছে।
দিয়া আরিফ মেয়ের ছবি নিয়ে গবেষণা করছে।
– আপু,মেয়ের ছবি দেখবি না?
আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না,আবার আগ্রহ ও হচ্ছে। ভদ্রতার খাতিরে নাহয় দেখলাম ই!!
– সুন্দর না?
ছবি দেখার সময় বুঝলাম রেহান ভাই এসেছে। উনাকে শুনিয়েই বললাম –
– বাহ! খুব সুন্দর তো! খুব মানাবে।
রেহান ভাই কিছু বললো না।
আরিফকে ইশারা করতেই আরিফ উঠে চলে গেলো উনার সাথে।
দিয়া আবারও ছবি দেখায় মনোযোগ দিয়ে বললো – আপু, দেখ এই ছবিটা।
– ধুর,তুই দেখ।
বলেই আমি উঠে চলে গেলাম।
আরিফ আর দিয়া আমার ছোট হলেও আমাকে তুই তুই করেই ডাকে।আব্বু আম্মু অনেক চেষ্টা করেছে চেঞ্জ করতে। কিন্তু আমার ভালোই লাগে। তাই চেঞ্জ করতে দেইনি।
রাতে ফুপি আর রেহান ভাই আমাদের সাথেই খেলেন।
খেতে বসে আব্বু বললো – রেহান,কাল দুপুরে কিছু মেহমান আসবে।তুই কোথাও বের হবি না।
রেহান ভাই শুধু ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলো।
পরদিন সকালে গরমে ছটফট করতে করতে ঘুম ভাঙলো। ভেবেছিলাম ইলেক্ট্রিসিটি নেই। পরে দেখি না! আমার রুমের ফ্যান অফ!!
এই কাজ আম্মু ছাড়া কেউ করেনি।আমাকে ঘুম থেকে তোলার এই টেকনিক আম্মুর ভালো জানা আছে।
কিন্তু এতো সকাল সকাল কেন?? উঠে বসলাম। কিন্তু চোখ খুলতে পারছিনা।
ফ্যানের সুইচটা দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।
– আম্মু! আম্মু!! দেখে যাও।
চিল্লানি শুনে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। ভাবলাম কি বিপদ হলো!!
তাকিয়ে দেখি বিপদ আমার সামনে।
– কি হয়েছে? কি হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?
এর মধ্যে আম্মুও হাজির।
– আম্মু দেখো, আপু ফ্যান অন করে আবার ঘুমাচ্ছে।
– আম্মু, এতো সকাল সকাল কেন এমন করো? শান্তিতে একটু ঘুমাতে দিলে না।
– সাতটা বাজে!! আরও ঘুম বাকি আছে?
সারারাত ঘুমাসনি? ঘুমাবি কি করে? আজ থেকে তোর মোবাইল আর ল্যাপটপ আমার কাছে জমা দিয়ে ঘুমাতে আসবি।আমি খেটে মরি,উনার ঘুমাতে ঘুমাতে ক্লান্ত! সারাবছর ঘুমিয়ে…..
শুরু হয়ে গেছে আমার আম্মুর রেকর্ডিং!! সেই একই কাহিনী!!
– আচ্ছা! আচ্ছা ঠিক আছে।
এখন বলো আজ এতো সকাল সকাল তুললে কেন?
– আজ যে গেস্ট আসবে খবর আছে তোর?
– তো?আমি কি করবো?
– তুই কি করবি মানে?
– আমি কি করবো মানে উনারা জামাই দেখতে আসবে!!
কনে দেখতে আসলে বুঝতাম! সকাল সকাল উঠে রূপ চর্চায় লেগে পড়তাম!
– দেখ হিয়া, সকাল সকাল মেজাজ খারাপ করবি না আমার।
এতোগুলো মানুষের রান্না করা বাকি।কখন শেষ করবো আল্লাহ ই জানেন। আর এইসব গোছগাছ কে করবে? তোর ফুপিকে দিয়ে করাবি?
– ফুপি কেন করবে? মানুষ তো আছেই।তারা করুক।আমি ঘুমাবো, যেতে পারবো না।
আম্মু আমার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকালেন!!
– আচ্ছা বলো কি করতে হবে।
আম্মু সব কাজ বুঝিয়ে দিলেন। আমি আর দিয়া সুমি আপাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমসহ সারা বাড়ির সব গোছগাছ করবো।
সুমি বয়সে দিয়ার কাছাকাছিই প্রায়। আমাদের বাড়িতে থাকে।
মা জননীর কথা মতো কাজে লেগে পড়লাম।
রেহান ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা!!
আম্মু আর ফুপি কিচেন সামলাচ্ছে।
প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। এমন সময় আব্বু কোথা থেকে এসে আম্মুকে আর ফুপিকে থাকলেন।
আমি কিচেনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে দেখেই আম্মু ডাক দিলেন।
– এই হিয়া, একটু এদিকে আয়।
– হা,বলো।
– তোর আব্বু ডাকছে।তুই একটু মাছটা উল্টে দিস।না হলে পুড়ে যাবে।
– আচ্ছা।,আমি দিচ্ছি।যাও তোমরা।
আম্মু আর ফুপি চলে গেলো।
আচ্ছা,সত্যিই কি রেহান ভাই বিয়ে করবেন? অন্যবার তো মেয়ে দেখতে যাবার কথা শুনলেই রেগে যেতেন। এবার… ইদানীং একটু বেশিই এভয়েড করছেন আমাকে। নিজে থেকে যেন একটা গ্যাপ রেখে চলছেন।
আমার সাথে কেন এমন করে? আমার ভেতরটা কেমন করছে।
– আহহ!
গরম ফ্রাইপ্যানটা হাতে লেগে অনেকটা পুড়ে গেছে। খুব জ্বালা করছে।চোখে পানি এসে গেছে।
– কিরে হয়েছে?
– হা ফুপি।এই তুলে নিচ্ছি।
মাছগুলো তুলে রাখলাম। এগিয়ে হাত জ্বলে যাচ্ছে, সেটা ফুপিকে আর দেখাইনি।একদিকে পোড়ায় আগুনের আঁচ লেগে আরও বেশি জ্বালা করছে।
দুপুরে মেহমান আসলো। সারাদিন রেহান ভাই উনার রুমেই ছিলেন।
উনারা আসার পরেও বের হয়নি।লাঞ্চের সময় বের হয়ে আসলেন।আব্বু,আম্মু,ফুপিসহ মেহমানদের সাথে লাঞ্চ করলেন।
তারপর জরুরি কাজ আছে বলে উঠে পড়লেন।
আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রুমে যাবার সময় যখন দেখলেন আমি এখানে, উনি আসলেন।
– এখানে কি করছিস?
– কিছু না।
– হাতে কি হয়েছে?
আমার হাতটা একটু আড়ালেই ছিলো।
– তেমন কিছু না।একটু পুড়ে গেছে।
-দেখি
বলেই টেনে আমার হাত দেখলেন।
– এটা তোর একটু মনে হচ্ছে? কিভাবে পুড়লো?
– ফ্রাইপ্যান লেগেছিলো।
– আয় আমার সাথে।
– কোথায়?
– জাহান্নামে। কেন যেতে আপত্তি আছে?
এই লোকটা সোজা করে মনে হয় কথা বলতে শিখেনি।
আমাকে টেনে রুমে নিয়ে গিয়ে ফার্স্টএইড বক্স খুলে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে।
– কই থেকে কাজ করিস? হাতে লাগে কিভাবে? করতে পারিস না তো যাস কেন?
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি উনি ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছেন।
– করতে পারি না কে বললো?
আমি খুব ভালোই রান্না করতে পারি।
– জানি, জানি। একটু সাবধানে করতে পারিস না! কতটুকু পুড়ে গেলো!! নিশ্চয়ই খুব জ্বালা করছে!
– হুম। করছে তো।খুব জ্বালা করছে।
রেহান ভাই একবার শুধু তাকালেন আমার দিকে।
– রেডি হয়ে নে।
– কেন?
– আমার সাথে বের হবি।
– এখন?
– তো কখন?
– বাসায় গেস্ট আছে। এখন বের হবো কিভাবে?.
– গেস্ট আছে তো তোর কি প্রব্লেম? তোকে দেখতে আসছে? সেজেগুজে সামনে যাবি?
আবার ত্যাড়া ত্যাড়া কথা শুরু করেছে!! সোজা কথা কি বের হয়না মুখ থেকে?!!
– আমার কিছু না।তবে আমার পেটেও জ্বালা করছে।
– পেটে জ্বালা করছে কেন?
– খিদে পেয়েছে। আমি খাইনি এখনো।
– এতো সময় হয়ে গেছে খাসনি?? যা তাড়াতাড়ি খেয়ে আয়।
গেস্ট এসেছে রেহান ভাইকে দেখতে। এখন উনাদের সামনে আমাকে নিয়ে উনি বেরিয়ে যাবেন, এটা ভালো দেখায় না।উনার কি না কি ভাববেন।
যদিও রেহান ভাই কখনো কারো ভাবনার তোয়াক্কা করেন না।
কিন্তু আমার কাছে ভালো লাগবে না,তাই ইচ্ছে করেই লেইট করলাম।
গেস্টরা চলে গেছেন।উনাদের অনেক পছন্দ হয়েছে উনাদের।এখন শুধু রেহান ভাই মেয়েকে দেখবেন।তারপরই এনগেজমেন্ট হবে, আর সেই দিনই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে।
রেহান ভাই আমাকে নিয়ে বের হবার সময় বললো – মা, হিয়াকে নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।
সবাই চমকে উঠলো।
– হিয়ার কি হয়েছে?
– হাত পুড়ে গেছে। কাউকে দেখায়নি?
– ওমা! কখন পুড়লো।
আম্মু আর্তনাদ করে উঠলো।
– কিরে বললি না কেন? কিভাবে পুড়লো?
– মাছ উল্টাতে গিয়ে।
– দেখেছো! কই আমাকে তো তখন বললি না!
সবাই খুব বকাঝকা করলো।
ডাক্তার ড্রেসিং করিয়ে আরও অনেক ঔষধ দিয়ে দিলেন।
হাতের কব্জির ঠিক নিচে পুড়েছে।
ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার সময় আমি চুপচাপ বসে আছি। রেহান ভাই ড্রাইভ করছেন।
– তোকে কিছু কথা বলা দরকার।
– বলেন।
রেহান ভাই গাড়িটা রাস্তার পাশে সাইড করে রেখে,কিছু সময় চুপচাপ বসে থাকে।
আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আগ্রহ নিয়ে কথা শোনার জন্য।
উনি একবারও আমার দিকে তাকাননি।
– হিয়া,তুই বড় হয়েছিস।অনেক কিছুই বুঝিস।
– হুম।
– আমি বুঝি তোর মনে কি চলছে। তুই আমাকে নিয়ে কি ভাবিস।
– সত্যিই আপনি বুঝেন?
তোর-আমার বয়সের ডিফারেন্স জানিস?বাচ্চা একটা মেয়ে!
-আমি বাচ্চা মেয়ে!! আমি??!!
২১ পেরিয়ে ২২ এ পা দিয়েছি।আমাকে বাচ্চা মনে হয় আপনার?
– বাচ্চা নয়তো কি? মাত্র ২২! আমার এইজ সম্পর্কে ধারণা আছে তোর?
-‘ আজিব তো! আমি কি করলাম!!আর আপনি এইজের ডিফারেন্স দেখাচ্ছেন কেন বলুন তো?’
কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম। আমাকে উনি বাচ্চা মনে করেন! আমাকে!?? হুহ।
রেহান ভাই আর কিছু না বলে আবার বইয়ে মুখ গুজলো।
এই লোকটা সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুজিয়ে থাকে। আর ইদানীং একটু বেশিই থাকছে।
আমি যতই কথা বলার চেষ্টা করছি উনি হু- হা- ভালো! এই বলেই খালাস!
ভাব দেখলে গা জ্বলে যায়।
সেই কখন থেকে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে আছি।একবার বসতেও বলেনি।
আমি বকবক করেই যাচ্ছি অথচ উনি বই পড়ছেন!!
লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ? কোনটা ভালো,জিজ্ঞেস করতেই এত্তো গুলো কথা শুনালেন? এইজ ডিফারেন্স দেখালেন। কি এমন বলেছি আমি?
– যেন উনাকে বিয়ে করতে বলেছি! হুহ। আমার ঠেকা পড়েছে আধবুড়ো লোককে বিয়ে করতে! ” বিড়বিড় করে বললাম।
– উহহফ! এই, তুই একটু চুপ করে থাকতে জানিস না? সারাক্ষণ এতো কথা বলিস কেন শুনি?’
রেহান ভাই বিরক্ত হয়ে হাত থেকে বইটা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
– ঠিক আছে আর কথা বলবো না।আর আসবোও না আপনার কাছে। কফি দিতে এসেছিলাম।এখন থেকে নিজের কফি নিজে করে নিবেন।
কথাগুলো বলে হনহন করে চলে আসলাম।
আর যাবো না।জীবনেও যাবো না এই লোকটার কাছে।
রাগে,দুঃখে চোখে পানি চলে এসেছে। এই লোকটা এমন কেন? উনি কি……
আমিও ঠিক করে ফেলেছি। আর যাবোনা উনার কাছে।
পরদিন ভার্সিটিতেও যাইনি। রোজ সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে বাগানে যেতাম। সেটাও যাইনি।
রাতে ফুপি এসে বললো – কিরে হিয়া…. আসিসনি কেন আজ?তোর শরীর খারাপ?
– না ফুপি।বের হতে ইচ্ছে করেনি।সারাদিন রুমেই ছিলাম।
– অহহ.. তাই বল।আমি ভাবলাম শরীর খারাপ করলো কিনা।সারাদিন আজ অবসর পাইনি আসার জন্য।
পরদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে ঘুমাচ্ছিলাম।
বিকেলবেলা ফোনে ঘুম ভাঙলো।
– হ্যালো।
– এখনো পড়ে ঘুমুচ্ছিস?
– কেন? ঘুমাতেও মানা আছে নাকি?
– হা আছে বৈকি!! চট করে চলে আস।তাড়াতাড়ি আসবি।
বলেই রেহান ভাই ফোন রেখে দেন।
রেহান ভাই আমার কাজিন।আমাদের বাড়ি একদম পাশাপাশি । বিশাল এরিয়ায় পাশাপাশি দুটো বাড়ি। উনি একজন ভার্সিটির টিচার।তবে আমি উনার ছাত্রী নই।
মিজান আঙ্কেলের সাথে আমার একমাত্র ফুপির বিয়ে হয়।আব্বু আর মিজান আঙ্কেল দুজনেই এক সাথে আর্মিতে ছিলেন। দুজনের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। মিজান আঙ্কেলের তেমন কেউই ছিলো না।দাদু চেয়েছিলেন উনার দুটো ছেলে-মেয়ে উনার কাছেই থাকুক। উনার সব কিছু আব্বু আর ফুপির নামে লিখে দেন।
মিজান আঙ্কেল প্রথমে আপত্তি করলেও দাদুর অনুরোধে রাজি হন।তারপর দাদু ফুপির নামে যে অংশ লিখে দিয়েছেন সেখানেই একটা বাড়ি করে দিতে চান।
কিন্তু মিজান আঙ্কেল সেটা করতে দেননি। নিজে বাড়ি করেছেন।
মিজান আঙ্কেল অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।উনাদের দুটি সন্তান। রেহান ভাই আর মাহি আপু। রেহান ভাই দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছেন। আঙ্কেল যখন মারা যান তখন রেহান ভাই এসেছিলেন। মাস দুয়েক দেশে থেকে উনি আবার চলে গেছেন। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়তাম।
এর মধ্যে বেশ কিছু বছর পেরিয়ে গেছে। মাহি আপু যখন মেডিকেলে চান্স পেয়ে চট্টগ্রাম চলে গেলো ফুপি তখন একা হয়ে পড়েন; যদিও আমরা ছিলাম। আমি ফুপির কাছেই বেশি থাকতাম। আর সারাদিন সবাই এবাসা- ওবাসা আসা-যাওয়া হতো।দুটো বাড়ি যে আলাদা কখনো মনেই হয়নি। কিন্তু একটা সময় ফুপি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েন।মেয়ের চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়ে,আসার খুব একটা সুযোগ পায় না।আর ছেলেটা সেই যে বিদেশে পড়ে আছে!!
রেহান ভাই পড়াশোনা শেষ করে সেখানে একটা ভার্সিটিতে জয়েন করে। উনার না ফেরার চিন্তা ছিলো তাই ফুপিকে নিয়ে যাবার অনেক চেষ্টা করেছে।কিন্তু ফুপি কিছুতেই রাজি হয়নি। সেই চিন্তায় চিন্তায় ফুপির এই অবস্থা। যার জন্য বাধ্য হয়েই রেহান ভাই দেশে ফিরে আসেন।
তারপর আর ফিরে যাননি।প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে।দেশে ফিরে উনি একটা ভার্সিটিতে জয়েন করেছেন। রেহান ভাইয়ের বয়স ৩৪।উনার ধারণা আমি উনার হাঁটুর বয়সী!!!
রেহান ভাইয়ের ফোন পেয়ে যাবো কি যাবো না, ভাবতে ভাবতে চলেই গেলাম। দেখা যাক কেন ডেকেছেন!!
কলিং বেল চাপার সাথে সাথেই দরজা খুলে গেলো।
– ভেতরে আয়।
ভেতরে ঢুকতেই উনি আমাকে বেলকনিতে নিয়ে গেলেন।
– বস।
আমাকে বসিয়ে উনি ভেতরে চলে গেছেন।কিছুক্ষন পরেই ফিরে আসেন।
হাতে দুটো কফির মগ।একটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। হাতে নিতে নিতে বললাম-
– বাহবা! সুর্য আজ কোন দিকে উঠলো??
– কেন বল তো??
– না, এমনি। আপনি কফি করে খাওয়াচ্ছেন।তাই বললাম।
– কেন আমি কি কফি করে খাওয়াতে পারিনা? প্রতিদিন তো তুই কফি করে আমাকে খাওয়াস।আজ না হয় আমি করলাম।’
বলেই একটু মুচকি হাসলো।
ইসসস! এই লোকটা এভাবে কেন হাসে? এই হাসিটা….
ধুর! আমার কি?
– সবই বুঝলাম। কিন্তু ঘটা করে ডেকে আনা হয়েছে কেন? কফির জন্য?
– শুধু কফির জন্য বললে ভুল হবে।
– শুদ্ধটা কি শুনি?
– দাঁড়া কফিটা শেষ করে নিই।
কফি শেষ করে উনি আবার রুমে গেলেন।
– দেখ কি এনেছি।
উনার হাতের দিকে তাকিয়ে আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম।
– ইসস কত্ত সুন্দর!!
রেহান ভাইয়ের হাতে একটা পিঞ্জিরায় দুটো দবদবে সাদা খরগোশের বাচ্চা। কিযে সুন্দর!!
আমি হাতে নিলাম।
– কি সফট সফট!!!
– তোর পছন্দ হয়েছে?
– হয়েছে মানে! খুব হয়েছে।
– নিয়ে যা।
– আমার জন্য???
– দেখে ভালো লাগলো তাই নিয়ে আসলাম। তোর ভালো লেগেছে যখন তুই নিয়ে যা।
আমার এখানে দেখাশোনা করা প্রব্লেম। আম্মু এসব করতে পারবে না। আর আমার সময় কই?
আমি খরগোশ গুলোকে নিয়ে বাগানে ছেড়ে দিলাম। সারা বাগানে ছুটছে, লুকাচ্ছে!!
কচি কচি ঘাস খাচ্ছে! সত্যিই অনেক ভালো লাগছে আমার।
রেহান ভাই জানালা দিয়ে দেখছেন।
রাতের খাবার টেবিলে আব্বু আম্মুকে বললেন – একটা ভালো মেয়ের সন্ধান পেয়েছি।
– তাই নাকি?
– আব্বু, আরিফ তো এখনো বাচ্চা! ওকে এখনি বিয়ে দিয়ে দিবে?বাল্যবিবাহ হয়ে যাবে না??
আরিফ আমার দিকে তাকিয়ে কটমট করছে। আমিও চোখে টিপ্পনী কাটলাম।
– গাধী! আমার জন্য না,রেহান ভাইয়ের জন্য।
দিয়া হাসতে হাসতে বললো – তুই তো মনে মনে আফসোস করছিস! রেহান ভাইয়ার যায়গা কেন তোর হলো না!!
দিয়া, আরিফ দুজনে জমজ। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ডে ইয়ারে পড়ে।
– একটু থামবি তোরা?? সারাক্ষণ বাসা মাথায় করে রাখে।শান্তিতে কথা শুনবো তার উপায় নেই।
আম্মু আমাদের ধমকে থামিয়ে দিয়ে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলেন ।
– মেয়ে কি করে? বিস্তারিত বলো তো।
– মেয়ে একটা কলেজে চাকরি করে। ভালো ফ্যামিলি। রেনু আপা আগামীকালই মেয়ে দেখতে যেতে চাইছেন।
– তাহলে ভালোই হয়েছে। যাক বাবা।এবার যদি রেহান বিয়ে টা করতে রাজি হয়।
এসব আলোচনা শুনতে আমার ভালো লাগছে না। আমি উঠে পড়লাম।
– কিরে উঠে পড়লি কেন? খাওয়া শেষ কর।
– আমার খাওয়া শেষ আম্মু।
– আমারও শেষ।
বলে দিয়াও উঠে পড়লো।
আমি রুমে চলে আসি।রেহান ভাই এবার সত্যিই বিয়ে করে ফেলবেন??
করুক। আমার তাতে কি?
পরদিন বিকালে আব্বু-আম্মুসহ সবাই মেয়ে দেখতে চলে গেলেন।আমি যাইনি। আম্মু,ফুপি অনেক জোর করেছেন, কিন্তু সকাল থেকে আমার খুব মাথা ধরে আছে। তাই আর যেতে পারিনি। বাসায় থেকে গেলাম।
সারাদিন শুয়ে থেকে আর ভালো লাগছে না। একটু বাগানে গিয়ে খরগোশ দুটোকে ছেড়ে দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে বসে আছি। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠি। তাকিয়ে দেখি রেহান ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।
– কিরে, কখন থেকে ডাকছি।শুনতে পাস না?
ওহহহ..এটা লাগিয়ে বসে আছেন উনি!! আমার কান থেকে হেডফোন টেনে খুলে ফেললেন।
-আপনি এখানে কেন? যাননি?
– কোথায়?
-অই যে তারা সবাই গেলো মেয়ে দেখতে….
– নাহ।তুই যাসনি কেন?
বসতে বসতে বললেন।
– আমার মাথা ধরে ছিলো, তাই।
– হুম।
কিছু সময় চুপচাপ বসে দুজনেই।
– তোর পড়াশোনা কেমন চলছে রে?
– ভালো।
– পরীক্ষার বেশি দেরি নেই।ভালো করে পড়াশোনা কর।আর আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
– হুম।
– হুম কি?
– ঝেড়ে ফেলবো।
– গুড।
রেহান ভাই আর কিছু না বলে কিছু সময় চুপচাপ বসে থেকে চলে যাচ্ছেন।
কিছু দূর যাবার পর থেমে গেলেন।
আমি একটা খরগোশ কোলে নিয়ে ঘাস খাওয়াচ্ছি।
– হিয়া।
রেহান ভাইয়ের ডাক শুনে সামনে তাকালাম।
– খরগোশ দুটো তোর জন্যই এনেছিলাম।
বলেই বাসার ভেতরে চলে গেলেন।
পীর সাহেবের মৃত্যু সবাইকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল। সবার একমাত্র আশার আলো পীর সাহেবের মারা যাওয়ায় নিভে গেল। এবার বুঝি গ্রামটা ধ্বংস হবে সেটা নিশ্চিত।
কিন্তু পীর সাহেবের হাত থেকে একটা চিঠি পেলেন ইমাম সাহেব। চিঠিটা পীর সাহেব মরার পূর্বে নিজের হাতে লিখেছেন। চিঠিতে পীর সাহেব লিখেছেন,
ইমাম সাহেব, আপনার কাছে আমি এমন একটা ঘরের ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম যেখানে আমি ব্যতীত কেউ থাকবেনা। কারণ ছিল, আমি জানতাম যে আজ রাতেই আমার মৃত্যু হয়ে যাবে। যদি আমার সাথে অন্য কেউ ঘুমোতেন তাহলে তারও মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। সেই দুরাত্মা টা এতটাই শক্তিশালী যে আমার পক্ষে তাকে নষ্ট করা সম্ভব ছিলনা। কেননা সে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল। আর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা আত্মা প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হতে থাকে। ঊর্মির সাথে সাথে অনেক বড় অন্যায় হয়েছে। তার এবং তার বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য সে গোটা গ্রামের লোকজনকে দোষী মনে করে। তাই সে এই গ্রামটিকেই শেষ করে দিতে চায়। কিন্তু কেউ আসবে যে আপনাদেরকে রক্ষা করবে। তাই আশাহত হবেননা। সবথেকে শক্তিশালী হলেন সৃষ্টিকর্তা। উনার উপর আস্থা রাখুন উনিই সব ঠিক করবেন…
পীর সাহেব যখন চিঠিটা লিখে শেষ করলেন তার কিছুক্ষণ পরই পীর সাহেবের সামনে ঊর্মির দুরাত্মার আবির্ভাব ঘটে। পীর সাহেব ঊর্মির আত্মাকে দেখে একদম ভয় পাননি। স্বাভাবিক হয়ে বললেন,
তুই কেন নিষ্পাপ গ্রামবাসীদের ক্ষতি করছিস? তারা তো তোর কোনো ক্ষতি করেনি। যারা ক্ষতি করেছে তাদের সবাই তো প্রায় শেষ। তাহলে কেন তুই এই ধ্বংসযজ্ঞকে থামাচ্ছিস না?
ঊর্মি ভয়ংকর হাসি দিয়ে বলল,
সব গ্রামবাসীরাই দোষী। তাদের কাউকে আমি ছাড়বোনা। সবাইকে আমি মেরে ফেলব। আর তকেও বলেছিলাম চলে যা কিন্তু তুই যেতে চাসনি। তুই বুঝি তোর মৃত্যুই চাস।
কথাগুলো বলেই ঊর্মি তার ধারালো নখের আঘাতে পীর সাহেবকে মেরে ফেলল। কিন্তু পীর সাহেব জানতেন যে উনার মৃত্যু অবধারিত তাই উনি মৃত্যুর পূর্বেই এই চিঠিটা লিখে যান।
ইমাম সাহেব গ্রামবাসীদের সামনে চিঠিটা পড়লেন। চিঠিতে লেখা কথাগুলো শুনে তারা ভয় পেয়ে গেল। বুঝতে পারলো ঊর্মির মনে কি পরিমাণে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। আর এই আগুন তাকে অনেক শক্তিশালী করে তুলেছে। হয়তো তাকে দমন করা সম্ভব না। কিন্তু পীর সাহেব চিঠিতে লিখে গেছেন যে কেউ আসবে এই গ্রামের রক্ষার্থে। কে সে? সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কে সে? কিন্তু সবাই কথাটি বিশ্বাস করে নেয় কারণ পীর সাহেব অনেক কথাই বলেছেন যা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
দিনদিন ঊর্মির ধ্বংসযজ্ঞ সীমার বাইরে যেতে লাগল। দৈনন্দিন মেয়েরা মারা যাচ্ছে। এমনকি রবিন বাবু এবং তার মেয়েও বেঁচে নেই। গ্রামটা যেন শ্মশানে পরিণত হয়ে গেছে। সবদিকে দিনের পর দিন মৃত্যুর খবর বেড়ে চলেছে। এমন অবস্থায় গ্রামের মানুষেরা আতঙ্কিত হয়ে ঊর্মির নিকট বন্দনা শুরু করে। গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষের মনে হাহাকার আর চোখে জল। গ্রামবাসীরা ঊর্মির কাছে ক্ষমা চাইতে চাইতে বলল,
আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দাও। আমরা সবাই তো নির্দোষ! আমাদের মেয়েরা তো কিছুই করেনি। তারা তোমার ক্ষতি করেনি। তাহলে কেন তাদেরকে তুমি শাস্তি দিচ্ছ? দয়া করে এসব নির্দোষ মেয়েদের মেরোনা…!
তখনই আকাশ থেকে বিকট হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। ভয়ঙ্কর হাসি। হাসিটি ঊর্মির ছিল। তার হাসি শুনা যাচ্ছিল কিন্তু সে আকাশে অদৃশ্য ছিল। হাসতে হাসতে একপর্যায়ে সে সকল গ্রামবাসীকে বলল,
তোরা নির্দোষ? হাহাহা…! কেমন লাগছে এখন যখন তোদের মেয়েরা কষ্ট পেয়ে মারা যাচ্ছে? কেমন লাগছে? ঠিক তেমনটাই লেগেছিল আমার বাবা-মায়ের যখন তোরা আমাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলেছিলি। আমিও তো নির্দোষ ছিলাম কিন্তু তখন তো তোরা কেউ এগিয়ে এলিনা আমাকে বাঁচাতে!
গ্রামের লোকেরা আকুতি মিনতি করে বলল,
আমরা তো কেউ ই সত্যতা জানতাম না। গ্রামের প্রধানরা অপরাধীদের সাথে মিলে অন্যায় করেছে তোমার সাথে। তারা তো তাদের প্রাপ্য শাস্তি টুকু পেয়েই গেছে। তাহলে এখন এই নির্দোষ মানুষগুলোকে তো ছেড়ে দাও…
– হাহাহা…! কেউ বাঁচবে না, কেউ না!
ঊর্মি গ্রামবাসীদের কথা মেনে না নিলনা। দিনকাল যতই যেতে লাগলো গ্রামের অবস্থা ততই খারাপ হতে লাগলো। দিনের মর দিন মৃত্যুর তান্ডব চলছে। মানুষের চোখের সামনে মানুষ মরছে। গ্রামবাসীরা ভয়ে ভয়ে দিনাতিপাত করছে। আশাহীন হয়ে সবাই বেঁচে আছে মৃত্যুর অপেক্ষায়।
একদিন গ্রামে একজন সাধুর আবির্ভাব ঘটলো। বয়স প্রচুর হবে। ১০০ এর ঊর্ধ্বে। কিন্তু শরীরে এখনো ব্যপক তেজ। চোখমুখের দিকে তাকালে অদৃশ্য আলৌকিক শক্তির অনুভব হয়। সাধুবাবা গেলেন গ্রামের মন্দিরে। মন্দিরের পন্ডিত সাধুবাবা কে দেখে অবাক। এর আগে কখনো উনাকে দেখা যায়নি এই গ্রামে। সাধুবাবাকে পন্ডিত জিজ্ঞেস করলেন,
বাবা, আপনি কোত্থেকে এসেছেন? এর আগে তো কখনো এই গ্রামে আপনাকে দেখিনি!
সাধুবাবা মৃদু হেসে বললেন,
সাধু-সন্ন্যাসীদের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই পন্ডিত মহাশয়। তাঁরা একজায়গায় বাস করেনা। যখন যেখানে ইচ্ছে বিচরণ করে। কিন্তু পন্ডিত মহাশয়, এই গ্রামে ঢুকার পর একটা অশুভ অনুভূতি হল। গ্রামে মনে হচ্ছে কয়েকদিন থেকে অশুভ ঘটনা ঘটছে…
সাধুবাবার কথা শুনে পন্ডিত মহাশয়ের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। তিনি বললেন,
ঠিক বলছেন বাবা। গ্রামে অশুভ শক্তির নজর আছে। সে এই গ্রামটিকে ধ্বংস করে দিতে চায়।
পন্ডিত সাধুবাবা কে সবকিছু খুলে বললেন। সাধুবাবা তখন পন্ডিত মহাশয়কে বললেন,
ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। উনার উপরে কেউ নেই। আত্মাও পরমাত্মার অধীন। আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাইব। ঈশ্বর যদি চান তাহলে এই অশুভ শক্তির বিনাশ হবেই।
পন্ডিত মহাশয়ের মনে একটা আশার আলো জাগলো। উনি সাধুবাবা কে নিয়ে গ্রামের লোকজনের সম্মুখে গেলেন। গ্রামের মানুষ সাধুবাবার কথা শুনে বললেন,
সাধুবাবা, এই দুরাত্মা টা অনেক শক্তিশালী। সে এত সহজে নষ্ট হওয়ার নয়। তার ক্ষমতা অসীম।
সাধুবাবা আবারো মৃদু হেসে বললেন,
সব ক্ষমতার উৎস ঈশ্বর। উনিই অসীম ক্ষমতার অধিকারী। আপনারা উনার উপর বিশ্বাস রাখেন। এই অশুভ শক্তির বিনাশ নিশ্চিত।
গ্রামের মানুষের মনে সাধুবাবার কথাগুলো জায়গা করে নিল। সবাই আবার বিশ্বাসে বিশ্বাসী হলেন। সাধুবাবা মন্দিরে গেলেন সকল গ্রামবাসীদেরকে নিয়ে। তারপর সাধুবাবা পন্ডিত মহাশয়ের সাহায্যে একটা যজ্ঞের আয়োজন করলেন। শুরু হল সেই অশুভ শক্তির আহবান। যজ্ঞ শুরুর কিছুক্ষণ পরপরই চারিদিকে বিকট হাসির আওয়াজ ভেসে উঠলো। হাসির প্রতিধ্বনি এতটাই জোরালো ছিল যে গ্রামের কোণা কোণায় আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো। গ্রামবাসীরা আরেকবার ঊর্মির অশুভ অবয়বকে দেখতে পেল। ঊর্মির অশুভ আত্মাটি হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,
এখন তুই এসেছিস আমাকে বিনাশ করবি বলে! তুই জানিস না তোর আগেও একজন এসেছিল। সে ভেবেছিল আমাকে ধ্বংস করে দিবে। সে নিজেই নিজের মৃত্যুর দিকে দৌড়াচ্ছিল। আমি তাকে বলেছিলাম চলে যেতে কিন্তু সে যায়নি। তাই চিরকালের জন্যই তাকে যেতে হল। তুইও বাঁচবি না।
সাধুবাবা হাসলেন। বললেন,
সব জানি। সেই পীর সাহেবের কথা সবকিছুই আমার জানা। কিন্তু তুই জানিস না যে পীর সাহেবকে মেরে তুই নিজের ধ্বংসের বীজ বপন করেছিস। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে তুই অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিস কিন্তু নির্দোষ মানুষের প্রাণ নিয়ে তুই নিজেকেই শক্তিহীন করছিলি। তারপর যখন পীর সাহেবের মতো পুণ্যাত্মা কে তুই হত্যা করলি তখন তোর শক্তি আরোও ক্ষীণ হয়ে গেলো। তুই অশুভ শক্তি হয়ে একটা পুণ্যাত্মা কে হত্যা করে নিজের বিনাশ নিজেই করেছিস।
ঊর্মির দুরাত্মা কথাগুলো শুনে বিকট হাসি দিতে লাগলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সে নিজেকে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে দেখে আর্তনাদ করে উঠলো। হাসির আওয়াজ ততক্ষণে চিৎকারে পরিণত হয়ে গেলো। সাধুবাবা তখন বললেন,
তোর সাথে অন্যায় হয়েছে কিন্তু তুই যা করছিস তাও তো অন্যায়। তোর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় তো গ্রামবাসীদের দোষ নেই।
– কিন্তু আমার সাথে যে ছেলেগুলো জোরপূর্বক অপকর্ম করেছে তারা তো দোষী।
– তাদের সবাইকে তুই মেরে ফেলেছিস। তাদের সাহায্যকারীরাও এখন আর বেঁচে নেই। তাহলে কেন এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিস তুই?
– কারণ এই গ্রামের মানুষেরা সবাই দোষী। তারা তখন সেই মানুষের কথায় বিশ্বাস করে আমাকে আর গর্ভের সন্তানকে মেরেছিল যারা আমার সাথে অন্যায় করেছিল।
– তাদের সামনে তোকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল যার ফলে তারা তকে মারধর করেছিল।
– সেটা কি ঠিক ছিল?
– না। কিন্তু তারা তাদের ভুল মেনে নিয়েছে। এখন তাঁরা তোর কাছ ক্ষমা চাচ্ছে। আর ক্ষমাপ্রার্থী কে ক্ষমা করে দেয়াই উচিৎ।
– ঠিক আছে। কিন্তু গ্রামবাসী যদি আমার একটা শর্ত রাখে তাহলেই আমি চলে যাব।
– কি শর্ত?
– গ্রামে যদি কখনো মেয়ের সাথে জোরপূর্বক অপকর্ম করা হয় তাহলে তার যাচাই করে অপরাধীকে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। নইলে আমি আবার ফিরে আসব।
গ্রামের সবাই তখন এক হয়ে বললেন,
আমরা সবাই সেই অন্যায়কারীদেরকে কঠোর শাস্তি দিব। কিন্তু দয়া করে আমাদের কে ক্ষমা করে দিয়ে এবার চলে যাও।
ঊর্মির আত্মা যেন এবার একটু শান্তি পেল। সে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। কিন্তু সাথে এটাও বলে গেল, যদি সেইসব ছেলেগুলোকে শাস্তি না দেয়া হয় তাহলে সে আবার ফিরে আসবে।
ঊর্মি চলে গেল। গ্রাম আর গ্রামের লোকজন এখন বিপদমুক্ত। কিন্তু গ্রামবাসীরা এবারও ভীষণ অবাক হলেন। সাধুবাবা হুট করেই যেন কোথায় চলে গেলেন। একদম নিখোঁজ। কোত্থেকে উনি এসেছিলেন আর কোথায় তিনি গেলেন তার খুঁজ কেউ লাগাতে পারেনি আর।
শংকর তান্ত্রিকের মৃত্যু গ্রামবাসীকে ভয়ের সাগরে ডুবিয়ে দেয়। শংকর তান্ত্রিক তার জীবনকালে অনেক মানুষকে ভুতপ্রেতের হাত থেকে রক্ষা করিয়েছেন। তার নামের অনেক সুনাম এলাকায় এবং এলাকার বাহিরেও। তাই এত বড় তান্ত্রিকের মৃত্যু গ্রামবাসীকে আতঙ্কিত করেছে। কিন্তু তান্ত্রিকের শেষ কথাটি গ্রামবাসীকে মহা দুশ্চিন্তায় ফলে দিল। কোনো দুরাত্মা এসেছে যে খুব শক্তিশালী। সে এই গ্রামটিকে ধ্বংস করতেই এসেছে। তান্ত্রিক বলেছিলেন এটা এই গ্রামবাসীদের পাপের ফল। কিন্তু কি এমন পাপ গ্রামবাসীরা করলো যার মাশুল এত ভয়ানকভাবে দিতে হচ্ছে তাদেরকে। গ্রামের লোকজন বড্ড ভয়ে আছেন। দিনের পর দিন কোনো না কোনো মেয়ের খুব নির্মম অবস্থা হচ্ছে। পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।
গ্রামের এমন ভয়াবহ অবস্থায় ফেরেস্তা হয়ে আসেন রহমান সাহেব। গ্রামে রহমান সাহেবের সম্মান অনেক। উনি এই গ্রামের মসজিদের ইমাম। উনি যখন গ্রামের এমন পরিস্থিতির কথা জানতে পারলেন তখন অন্যদের মতো উনিও ভয় পেলেন। এর আগে এমন কোনো ঘটনা ঘটে যেতে দেখেননি বা শুনেননি। তাই একদিন গ্রামবাসীদের নিয়ে একটা বৈঠকের আয়োজন করলেন উনি। গ্রামের সবাই উপস্থিত হলেন বৈঠকে। গ্রামবাসীরা যথেষ্ট মানেন উনাকে। বৈঠক থেকে একজন ইমাম সাহেব কে সব ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে বলল,
ইমাম সাহেব, সবকিছুই তো আপনি জানেন। এই গ্রামের উপর কার যে কুদৃষ্টি পড়ল তা কেউ জানেনা। মেয়েরা তাদের অজান্তেই মা হয়ে মারা যাচ্ছে। এমনকি তাদের বাবা-মাকেও ছাড়ছেনা সেই দুরাত্মাটা। আপনি তো আলেম মানুষ, জ্ঞানী ব্যক্তি। এই সমস্যার সমাধানের কোনো পথ দেখান আমাদেরকে…
গ্রামবাসীরা সবাই একত্রে অনুরোধের আওয়াজ তুলল। ইমাম সাহেব সবাইকে প্রথমে শান্ত করলেন তারপর বললেন,
আমিও খুব আহত হয়েছি এই ঘটনাটির পর থেকে। কখনো ভাবিনি আমাদের এই গ্রামের উপর এমনভাবে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার উপর সর্বদা বিশ্বাস রাখতে হয়। উনিই তো সবকিছু করেন। উনি নিশ্চয়ই এর কোনো উপায় রেখেছেন। আমি একজন পীর সাহেবকে চিনি। উনি খুব বিজ্ঞ এবং দক্ষ মানুষ। অনেক কিছু জানেন উনি। হয়তো উনি আমাদেরকে এই বিপদ থেকে বের করতে পারবেন। যদি আপনারা সবাই বলেন তাহলে কালই আমি এই গ্রামের পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানাবো। উনি হয়তো নিরাশ করবেননা। আপনারা কি সবাই একমত?
মৃত্যু যখন সামনে, মানুষ তখন বাঁচার জন্য ছটফট করে উঠে। গ্রামের সবাই ইমাম সাহেবের মতে মত জানালেন। ইমাম সাহেব উনাদেরকে বললেন,
কিন্তু পীর সাহেবকে পাওয়াটা সহজ না। ফোন যোগে উনার সাথে যোগাযোগ করা অসম্ভব। উনি এসব ব্যবহার করেননা। তবে হ্যাঁ, কয়েকজন মিলে উনার গ্রামে গেলে উনি আমাদেরকে ফিরিয়ে দিবেননা। তাই আমার সাথে কাল কয়েকজনকে পীর সাহেবের গ্রামে যেতে হবে। আপনারা কে কে যাবেন?
গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে পাঁচজন প্রস্তুত হলেন ইমাম সাহেবের সাথে যেতে। ইমাম সাহেব আবারো আশ্বাস দিয়ে বললেন,
আপনারা আপনাদের সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রাখেন। মালিক সব ঠিক করে দিবেন ইনশাআল্লাহ…
পরদিন ইমাম সাহেব এবং গ্রামের পাঁচজন লোক মিলে পীর সাহেবের কাছে গেলেন। পীর সাহেবের ঘর দেখে সবাই বেশ অবাক। গ্রামের সবকটি ঘরই দেখতে বেশ সুন্দর এবং উন্নত। কিন্তু পীর সাহেবের ঘর সেই আগের ঘরগুলোর মতোই বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। ইমাম সাহেব অবশ্য আগে দুয়েকবার প্রয়োজনে এখানে এসেছেন তাই উনার কাছে সব পরিচিত।
ইমাম সাহেবের সাথে পাঁচজন লোককে দেখে পীর সাহেব তাদের বসতে বললেন। পীর সাহেব ইমাম সাহেবকে তো চেনেন কিন্তু এই পাঁচজনকে চেনেন না। কিন্তু একবারও তাদের পরিচয় জানতে চাননি বা এমন আচরণ করেননি যে উনারা পীর সাহেবের অপরিচিত কেউ। গ্রামবাসীরাও এটা নিয়ে ভাবেননি বা অবাক হোননি। কিন্তু গ্রামবাসীরা তখন খুব অবাক হোন যখন পীর সাহেব বললেন,
তোমরা ভাবছো গ্রামের ঘরগুলো এত সুন্দর কিন্তু পীর সাহেবের ঘর কেন এমন বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। আমার তো ঘর পরিবার সব পরম করুণাময় আল্লাহ কে নিয়েই। উনাকে ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। উনিই হলেন সবার বাবা-মা। আপনাদের চেহারায় ভেসে উঠা ভয়ের জলছাপ আমি দেখতে পারছি। এই ভয় ই আপনাদেরকে এখানে এতদূর টেনে নিয়ে এসেছে।
পীর সাহেবের কথা শুনে লোকগুলো একদম হতভম্ব হয়ে গেলো। পীর সাহেবের তো এসব জানার কথা না। কেউ তো উনাকে জানায় নি। পীর সাহেব গ্রাম থেকে আসা লোকজনদের চেহারায় বিস্ময়ের চিহ্ন দেখে একটু মুচকি হেসে বললেন,
অবাক হবেন না। আল্লাহ আমাকে উনার অশেষ মেহেরবানি করে কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন। আপনারা কেন এসেছেন তা আমি জানি।
ইমাম সাহেব জানেন পীর সাহেবের ক্ষমতা তাই উনি অবাক হলেন না মোটেও। সরাসরি সমস্যার কথা তুলে ধরলেন।
– পীর সাহেব, গ্রামের উপর আসা বিপদের খবর তো আপনি জানেনই। আমরা কেউ ই এই সমস্যার উৎপত্তি কিভাবে হল আর সমাধান কিভাবে তা বুঝতে পারছিনা তাই আপনার নিকট শরণাপন্ন হয়েছি। আপনিই পারেন আমাদেরকে এখন এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে।
জ্ঞানী ব্যক্তিরা বিপদে অস্থির হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেননা। পীর সাহেব এর প্রমাণ দিলেন। পীর সাহেব মধুর গলায়, চেহারায় একটু হাসি এনে বললেন ,
সব আল্লাহর কাছে ইমাম সাহেব। আমরা করার কেউ না সব উনিই করেন। আপনারা যতটা সহজ ভাবে নিয়েছেন বিষয়টাকে, আসলে বিষয়টা ততটাই জটিল এবং বিপজ্জনক। ভাবছেন কোনো ভুত পিশাচের কাজ এটা? ঠিকই ভাবছেন। কিন্তু এটা এতটাই শক্তিশালী দুরাত্মা যে এর সাথে লড়াই করা সহজ কথা না।
পীর সাহেবের কাছে এসে, উনার অলৌকিক ক্ষমতা দেখে লোকদের মনে একটা আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু পরক্ষণে এমন বাক্য শুনে প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু অবস্থায়। লোকগুলোর মনের এমন অবস্থা পীর সাহেব আন্দাজ করে নিলেন। বললেন,
আগেই বলেছি সবকিছুর মালিক আল্লাহতালা। তাই উনার উপর ভরসা রাখুন। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনাদের গ্রামের মানুষদেরকে রক্ষা করার।
ইমাম সাহেব মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন উনার কথাগুলো। কিন্তু এই অভিশাপ কেন উনার গ্রামকে গ্রাস করছে সেটা জানার খুব ইচ্ছে জাগলো ইমাম সাহেবের মনে। উনি পীর সাহেব কে বললেন,
ঠিক বলেছেন পীর সাহেব। আল্লাহ-ই সবকিছুর মালিক। কিন্তু পীর সাহেব আমাদের গ্রামে এরকম তো আগে কখনোই ঘটেনি। তাহলে এখন এমনটা কেন হচ্ছে? কেন গ্রামের মেয়েরা হুট করে এভাবে সন্তান জন্ম দিচ্ছে?
পীর সাহেব নিশ্চুপ বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
এটা গ্রামবাসীদেরই পাপের ফল!
লোকজনেরা পীর সাহেবের কথায় ভীষণ অবাক। কোন পাপের কথা বলছেন পীর সাহেব? মনে সবার একই প্রশ্ন। সেই পাঁচজন লোক এবার একসাথে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
বাবা, কোন পাপ?
-ঠিক ২০ বছর আগে আপনারা কয়েকজন মুরুব্বিরা মিলে একটা বিচার করে দিয়েছিলেন আপনাদেরই গ্রামের একটা মেয়ের। মেয়েটার সাথে জোরপূর্বক অপকর্ম করা হয়েছিল। করেছিল আপনাদেরই গ্রামের প্রভাবশালী বাপের কয়েকজন ছেলেরা। মনে আছে? বিচারকদের মধ্যে থেকে একজন ব্যক্তি এখানে এসেছেন।
পাঁচজন লোকের মধ্য থেকে একজন বলল,
আমি ছিলাম বিচারক।
– আপনার নাম রবিন?
লোকটা যথেষ্ট অবাক হলো। কেননা রবিন তারই নাম। কিন্তু এতক্ষণে সে পীর সাহেবের ক্ষমতা আন্দাজ করতে পেরেছে তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
হুম আমিই রবিন। বিচারে সেদিন আমিও রায় দিয়েছিলাম।
– জানি। ঘটনাটা পুরোপুরি ই আমি জানি। তবুও আমি আপনার মুখে শুনতে চাই সম্পূর্ণ ঘটনা। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলবেন কি হয়েছিল।
রবিন বলতে শুরু করলো সেই অতীতের ঘটনাটুকু পীর সাহেবের কাছে।
মেয়েটার বাবার নাম ছিল রতন আর মায়ের নাম ছিল সুমা। তার একটাই মেয়ে ছিল ঊর্মি । দেখতে খুব সুন্দর এবং বিয়ের উপযুক্ত। বাবা-মা ছিলেন নেহাৎ গরীব। সমাজে ছিল তারা নিচু জাতি। তো একদিন সেই মেয়ে ও তার বাবা-মা কাঁদতে কাঁদতে গ্রামের প্রধানদের কাছে অর্থাৎ আমাদের কাছে নালিশ নিয়ে আসলো৷ আমরা ১০ জনের একটা কমিটি ছিলাম। বিচার-আচার আমরাই সমাধান করতাম। তো মেয়েটার ভাষ্যমতে তার সাথে ৬ জন ছেলে মিলে নাকি তার ধর্ষণ করেছিল। আবার সেই ৬ জন ছেলের মধ্যে একটা ছেলে নাকি তাকে ভালোবাসতো যার সন্তান তার গর্ভে ছিল। আপনি হয়তো এটাও জানেন যে ছেলেগুলোর বাবা-মা কে ছিলো!
পীর সাহেব মাথা নাড়লেন।
– মেয়েটার দেহের কাপড় চোপড় ছেড়া ছিল। প্রায় প্রায় অর্ধনগ্ন ছিল মেয়েটা। তো আমাদের মাঝে থেকে একজন একটা চাদর দিল তাকে তার দেহটা ঢাকার জন্য। মেয়ের বাবা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলল, চাদর দিয়ে শরীর টা তো ঢাইকা দিবেন কিন্তু আমার ইজ্জত টা কি ফিরত আসব। আপনারা আমারে সঠিক বিচার কইরা দেন। ঐ ছেলেগুলারে শাস্তি দেন! তার বাবা মা কেঁদে কেঁদে পুরো এলাকা ভাসিয়ে দিচ্ছিল। পরেরদিন আমরা ছেলেগুলোকে বিচারে আসার জন্য বলি। মেয়েটা যে ছেলের নাম নিয়েছিল তাদেরকেই ডেকে আনা হয়। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় মেয়েটা যা কিছু বলছে তা কি সত্য। তখন ৬ জন ছেলের মধ্যে থেকে সুজয় যা বলল তা ছিল এমন,
আমরা এই বিষয়ে কিচ্ছু জানিনা কিন্তু আমি মেয়েটাকে পছন্দ করতাম। কিন্তু একদিন আমি শুনতে পাই যে মেয়েটার সম্পর্ক ছিল কোনো এক ছেলের সাথে। আর ঐ ছেলেটারই বাচ্চা তার পেটে। কিন্তু এখন নাকি ছেলেটা অস্বীকার করে বলছে সে এই মেয়েকে বিয়ে করবেনা। তাই ঊর্মি এবং তার বাবা-মা আমাকে ফাঁসানোর জন্য, তার মেয়ের বিয়ে যেন আমার সাথে দিতে পারে এজন্য এই ষড়যন্ত্র আঁটছেন।
কথাগুলো শুনবার পর আমরা ঊর্মির বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করলাম। তারা বলল,
আমরা বিন্দুমাত্রও মিথ্যে বলছেনা। আমরা যদি সুজয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতাম তাহলে এতজন ছেলের উপর দোষারোপ কেন করতাম বলেন?
তখনই সুজয় দাঁড়িয়ে বলল,
তোরা নিচু জাতির হলে কি হয়েছে, বুদ্ধিতে আমাদের থেকে দুই কদম এগিয়ে। তোরা তোদের কথাকে জোর দেয়ার জন্য আমাদের কে ফাঁসাচ্ছিস।
রতন আর সুমা কাঁদতে কাঁদতে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। আমরা ঊর্মি কে ধমক দিলাম, ভয় দেখালাম কিন্তু সেও একই কথা বলছিল। আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পোঁছাতে পারছিলামনা। তারপর আমরা সেই ছেলেদেরকে জিজ্ঞেস করি যে মেয়েটা যে সময়ে তার ধর্ষণ করার কথা বলেছে ঐ সময় তারা কোথায় ছিল। ছেলেরা সবাই একই সাথে থাকে। তারা পরস্পর বন্ধু। তারা সবাই বলল কোন এক হোটেলে তারা আড্ডা দিচ্ছিলো তখন। আমরা তারপর হোটেলের মালিক কে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। সেও তাদের পক্ষেই মত দিল। কিন্তু মেয়েটা হোটেলের মালিক কেও মিথ্যে বলছে বলে দোষারোপ করল। কিন্তু মিথ্যে বলে তো তার কোনো ফায়দা হওয়ার কথা না তাহলে সে মিথ্যা কেন বলবে। কিন্তু ঊর্মি নামের মেয়েটার লাভ ছিল মিথ্যে বলে। সে যাকে নিজের গর্ভের সন্তানের বাবা বলে দাবী করেছিল সে ছিল এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর ছেলে। তার বউ হতে পারলে সে রানির মত থাকতো। তাই সেই হোটেল মালিকের কথানুযায়ী আমরা মেয়েটাকে কঠোর শাস্তি প্রদান করি। মেয়েটা তার মা বাবার সাথে আত্মহত্যা করে মারা যায়।
পীর সাহেব মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন কথাগুলো। একটু মুচকি হেসে পীর সাহেব ইমামের দিকে মুখ করে বললেন,
শুনছেন ইমাম সাহেব?
ইমাম সাহেব ১০ কি ১২ বছর হবে এখানে ইমামের কাজ করছেন। আগে অন্য একজায়গায় ছিলেন। ইমাম সাহেব বললেন,
জ্বি। কিন্তু আপনার রহস্যময়ী হাসিনর পেছনের কারণ টা বুঝতে পারিনি।
পীর সাহেব আরেকটু হাসলেন। তারপর রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
রবিন সাহেব, আমি আগেই বলেছিলাম আমি সব জানি। আপনি যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন কিন্তু অসম্পূর্ণ বলেছেন।
কথাটাা শুনেই রবিনের মুখ বেঁকে গেল। পীর সাহেব বললেন,
আমি সম্পূর্ণ করছি ঘটনাটা। যে ছেলেগুলোর উপর ঊর্মি দোষারোপ করেছিলো তাদের বাবারা মিলে বিচারের আগের দিন আপনাদেরকে ১ লক্ষ টাকা নগদ দিয়েছিল এবং বলেছিল যেভাবেই হোক তাদের ছেলেদের উপর যেন কোনো দোষ না আসে। বাস্তবে ছেলেরা ঠিকই মেয়েটার সাথে কুকর্ম করেছিল। কিন্তু আজও গ্রামের মানুষেরা জানেনা যে আপনারা টাকার জন্য ঈমান বিক্রি করে দিয়েছিলেন। একটা মেয়ে কখনো নিজের ইজ্জত নিয়ে এত লোকের সামনে মিথ্যে, বানোয়াট দোষারোপ করতে আসবেনা। আজ সেই মেয়েটাই তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে এসেছে।
রবিন মাথা নত করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। তখন ইমাম সাহেব পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
কিন্তু পীর সাহেব, গ্রামের সবাইকে কেন মেয়েটা মেরে ফেলতে চায়? দোষ তো এই ১০ জন গ্রাম প্রধানরা করেছেন!
– বিচার শেষে মেয়েটাকে গ্রামের লোকজন অনেক মারধর করেন। মেয়েটার সাথে পেটের বাচ্চাটাও তখন আঘাত পেয়ে পেটের ভেতরেই মারা যায়। তাই গ্রামের প্রতিটা মানুষ তার নজরে শত্রু, বেইমান।
– কিন্তু পীর সাহেব সেই মেয়েগুলোর তো কোনো দোষ নেই যারা এসবের শিকার হচ্ছেন!
– দোষ তো ঊর্মিরও ছিলনা। কিন্তু তাকেও তো অন্যায়ের শিকার হতে হয়েছে। ঊর্মির সাথে যখন এসব ঘটে তখন সে মাত্র ১৬ বছরের ছিল। তাই সে প্রতিটি ১৬ বছরের মেয়েকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে যেভাবে সে নিজে পেয়েছে। যে সাতজন এই কয়েকদিনে এভাবে মারা গেছে তাদের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন পাঁচজন গ্রাম প্রধানের মেয়ে।
পীর সাহেব এবার রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
তোমার মেয়েও তো এবার ১৬ বছরে প্রবেশ করেছে নাকি!
রবিন কথাটা শুনেই ভয় পেয়ে যায়। তার মেয়েও এবার ১৬ তে পা দিয়েছে। রবিন ভয়ে পীর সাহেবের পায়ে গিয়ে পড়ে আকুতি মিনতি করে বলে,
পীর সাহেব আমাকে মাফ করে দেন। আমি লোভের বশে এতবড় পাপ করে ফেলেছি। কিন্তু আমার মেয়ের তো কোনো দোষ নেই। তাকে বাঁচান পীর সাহেব।
পীর সাহেব বললেন,
ক্ষমা করার মালিক ঈশ্বর। উনার কাছে ক্ষমা চাও। আমাকে আল্লাহ এসব ক্ষমতা দিয়েছেন মানবসেবার জন্য। কিন্তু কোনো পাপীকে বাঁচানোর জন্য নয়, পাক মানুষের রক্ষা করার জন্য। আপনি ঠিকই বলেছেন আপনার মেয়ের কোনো দোষ নেই। আমি সেইসব নিরপরাধ মেয়েদের কে বাঁচানোর জন্যই আপনাদের গ্রামে যাবো। জানিনা পারব কিনা, কিন্তু আমৃত্যু চেষ্টা করব। এতে আমার মৃত্যুও হতে পারে। কারণ আপনাদের সীমাহীন অন্যায়-অত্যাচারের কারণে তার আত্মা খুবই ক্রুদ্ধ যার কারণে সে অধিক শক্তিশালীও। তবুও বলছি সৃষ্টিকর্তার উপর আস্থা রাখুন। উনি সব ঠিক করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।
পরেরদিন পীর সাহেব ইমাম সাহেবের সাথে গ্রামে চলে আসলেন। ইমাম সাহেব এবং উনার সাথে যাওয়া লোকেরা পীর সাহেবের সাথে হওয়া সব কথপোকথন বিস্তারিত জানালেন। সবাই সবকিছু জেনে পীর সাহেবের ক্ষমতা কতটুকু তা বুঝতে পারলেন। গ্রামের লোকজনদের মনে একটা আশার প্রদীপ জ্বলে উঠলো। সবাই পীর সাহেবের উপর ভরসা করে আছেন।
এদিকে রবিনের জন্য একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল। গ্রামে আসতেই সে জানতে পারলো সকালে তার মেয়ের ঠিক একইভাবে পেটে ব্যথা উঠেছে। সে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে বার দুয়েক অজ্ঞান হয়ে যায়। রবিন খবরটা পেয়ে একদম দিশেহারা হয়ে যায়। সে সবকিছু ভুলে তার মেয়েকে দেখার জন্য দৌড়ে যায় ঘরে। পীর সাহেবও পেছনে পেছনে যান ইমাম সাহেবকে সাথে নিয়ে।
রবিন বাবুর মেয়ে রাত্রি যখন পীর সাহেবকে দেখলো তখন সে ভয়ে কাঁপতে লাগলো। যেন সে ভুত দেখে ফেলেছে। রাত্রি ভয়ে দূরে সরে যেতে লাগলো। পীর সাহেব রবিনকে বললেন মেয়েকে ধরতে। কিন্তু রবিন একা তার মেয়েকে সামাল দিতে পারছিলেন না। মেয়েটার দেহে তখন এতই শক্তি ছিল যে সে তার বাবাকে ধাক্কা দিয়ে দুরে ফেলে দিচ্ছিল। পীর সাহেব সাথে থাকা চারজন লোককে বললেন মেয়েটিকে ধরে রাখার জন্য। তারা মিলে মেয়েটিকে কোনোভাবে সামাল দিল। পীর সাহেব রাত্রির পেটে হাত বুলিয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে রাত্রির পেট ব্যথার উপশম হল। রবিন বাবু পীর সাহেবের কাছে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানালেন। কিন্তু তবুও রবিনের মনে ভয়ের মেঘ গর্জন করছে। সে পীর সাহেব কে জিজ্ঞেস করলো,
পীর সাহেব আমার মেয়ে তো ঠিক হয়ে গেছে? তাকে তো আর সেই আত্মা টা মেরে ফেলবে না?
পীর সাহেব বললেন,
ঠিক হয়নি রবিন সাহেব। আমি শুধু তার পেটের ব্যথাটাকে কমাতে পেরেছি। তার গর্ভে সেই সন্তানটা চলে এসেছে।
রবিন অসম্ভব ভয় পেয়ে যায়। তাহলে তার মেয়েও অন্যদের মতোই মারা যাবে? প্রশ্নের ঢেউ উঠছে রবিনের মনে। পীর সাহেবকে রবিন জিজ্ঞেস করলো,
তাহলে আমার মেয়েকে বাচানোর কি কোনো উপায় নেই পীর সাহেব?
– মরা-বাঁচা তো আল্লাহর হাতে। উনি যা চাইবেন তাই হবে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো আপনার মেয়েকে এবং এই গ্রামটাকে বাঁচানোর।
– দয়া করে দ্রুত কোনো উপায় করুন পীর সাহেব।
রবিনের করুণ কণ্ঠ তার মনের অবস্থা বলে দিচ্ছিল। তার মেয়েকে সে কতটা ভালোবাসে সেটার প্রমাণ দিচ্ছিল। পীর সাহেব বললেন,
আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন।
তারপর পীর সাহেব রবিন কে বললেন গ্রামের সবাই কে একসাথে নিয়ে শ্মশানে যেতে। ইমাম সাহেব আর পীর সাহেব আগেই শ্মশানে চলে গেলেন। ইমাম সাহেব ভীষণ অবাক শ্মশানে যাওয়ার কথায়। তাই পীর সাহেবকে ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
পীর সাহেব, শ্মশানে কেন যাচ্ছেন?
পীর সাহেব মুচকি হেসে বললেন
সেখানে গেলেই সবকিছুর মূলটার দর্শন করতে পারবেন ইমাম সাহেব।
– মানে?
– মানে খুব সোজা। ঊর্মি কে যে জায়গায় কবর দেয়া হয়েছে সেখানে গেলে মন্ত্র শক্তির কারণে তাকে সহজে দেখতে পাবেন।
– এতে হবে কি?
– এতে আমরা তার সাথে কথা বলে তার এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণ জানতে পারবো এবং সে কিভাবে এ গ্রাম ছেড়ে যাবে এটার উপায়ও বের করতে পারব।
সবাই শ্মশানে উপস্থিত হল। পীর সাহেব সবাইকে শ্মশানের বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন। পীর সাহেব রবিন বাবু, ইমাম সাহেব এবং আরো চার-পাঁচ জন লোককে নিয়ে শ্মশানের ভেতরে একটা কবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইমাম সাহেব পীর সাহেবকে কবরের পাশে দাঁড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
পীর সাহেব, এই কবরের পাশে কেন দাঁড়ালেন?
– এটাই সেই মেয়েটার কবর যে এই সব ধ্বংসের মূল। আমি এখন মন্ত্রশক্তির সাহায্যে তাকে প্রকাশ্যে আসতে বাধ্য করবো। আপনারা সবাই চুপ করে থাকবেন। আর যখন সেই মেয়েটার সাথে আমি কথা বলবো আপনারা কেউ পালাবেননা আর চুপ করে থাকবেন।
সবাই সম্মতি জানালেন। পীর সাহেব চোখ বন্ধ করে মনে মনে মন্ত্র উচ্চারণ করছিলেনন। কিছুক্ষণ পর খুব জোরে বাতাস বইতে লাগলো। গাছপালা উপড়ে পড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। গ্রামবাসীদের মনে ভীষণ ভয় জেগে উঠলো। পরক্ষণেই সবাই শ্মশানের ভেতরে আলো জ্বলে উঠতে দেখল। আলোটা সারা এলাকা এতটাই আলোকিত করে দিয়েছিল যেন মনে হচ্ছিল সূর্য উদিত হয়ে গেছে।
পীর সাহেব এবং সাথের মানুষজন দেখলো খুব ভয়ংকর একটা অবয়বের আবির্ভাব হয়েছে। প্রকাণ্ড দেহ তার। চোখগুলো লালচে। যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কণ্ঠস্বর মর্মান্তিক। অবয়ব টা ঊর্মির অতৃপ্ত আত্মা ছিল। দহনের আগুন তার মনে জ্বলজ্বল করছিল। কর্কশ গলায় ঊর্মি পীর সাহেব কে বলল,
মৃত্যু তকেও ডেকে এনেছে এখানে তাইনা? মরতে যদি না চাস তাহলে চলে যা এখান থেকে। তোর এতটা সামর্থ্য নেই যে তুই এই পাপীর দলকে বাঁচাতে পারবি।
ভয়ংকর কণ্ঠ শুনে সারা গ্রাম হাহাকার করছিল। ভয়ে সবার হৃদয় কাঁপছিল। কিন্তু পীর সাহেবের চোখেমুখে কোনো ভয়ের ছাপ নেই। হাসিমাখা চেহারায় বললেন,
তুই মারার কে? মৃত্যুর মালিক তো উপরওয়ালা। যার উপর সেই আল্লাহর নজর আছে তার অনিষ্ট কেউ করতে পারে না। তুইও না…
ঊর্মির অতৃপ্ত আত্মা যেন রেগে যায়। কণ্ঠে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। বলল,
কোথায় ছিলি তুই আর তোর আল্লাহ যখন আমার উপর, আমার বাবা-মায়ের উপর তারা অন্যায়-অত্যাচার করেছিল। তুইতো ধার্মিক মানুষ, পীর মানুষ তাহলে অন্যায়, অধর্ম করা মানুষদের বাঁচানোর জন্য কেন এসেছিস? তোর আল্লাহ কি এভাবে অন্যায়কারীদের রক্ষা করে?
– আল্লাহ পাক মানুষদের রক্ষা করেন আর পাপীদের শাস্তি দেন। আমি এসেছি সেইসব নির্দোষ মেয়েদের রক্ষা করার জন্য যাদের কোনো দোষ না থাকা স্বত্বেও তুই তাদেরকে কষ্ট দিচ্ছিস।
ঊর্মি বিকট ভাবে হাসতে হাসতে বলল,
হাহাহা, নির্দোষ? কেউ নির্দোষ না, সবাই দোষী। এই গ্রামের সবাই দোষী। আমি এই গ্রামকে ধ্বংস করে দিব।
– কেন? কি চাস তুই?
– আমি চাই আমার আর আমার বাবা-মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে। যে আগুনে আমি জ্বলেছি সে আগুনে তাদেরকে দহন হতে দেখতে চাই। তুই চলে যা এখান থেকে নইলে তুইও জ্বলে ছারখার হয়ে যাবি।
ঊর্মি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। অদৃশ্য হয়ে গেলো। জ্বলজ্বল করা অবয়বের গায়েব হয়ে যাওয়া ইমাম সাহেব পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
সে কি চলে গেছে পীর সাহেব?
পীর সাহেব গম্ভীর ভাবে বললেন,
না, সে যায়নি।
রবিন বাবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
তাহলে কি সে কখনো যাবেনা পীর সাহেব?
– চিন্তা করবেন না। সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখেন। সবকিছু ঠিক হবে।
কিন্তু পীর সাহেবের চেহারায় কিসের যেন এক ছটফটানি ছিল। চোখেমুখে গাঢ় চিন্তার দাগ। উনি ইমাম সাহেবকে বললেন, উনার থাকার ব্যবস্থা এমন ঘরে করতে যেখানে কেউ থাকেনা। ইমাম সাহেব পীর সাহেবের কথানুযায়ী ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু গ্রামের মানুষের মনে ভয় হয়ে রয়ে গেল। পীর সাহেব আশ্বাস দিলেন গ্রামবাসীকে উপরওয়ালা সব ঠিক করে দিবেন।
পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা ভীষণ বড় ধাক্কা খেল। পরদিন পীর সাহেবের বিভৎস লাশ পাওয়া গেল। দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। সারা দেহে রক্ত লেপ্টে রয়েছে। চেহারায় বাজেভাবে চিরে ফেলা হয়েছে। ইমাম সাহেব ই প্রথম গ্রামবাসীকে পীর সাহেবের মৃত্যুর খবর দেন। পীর সাহেবের হাত থেকে একটা চিঠি পাওয়া যায় যেটা তিনি নিজেই মরার পূর্বে লিখেছেন। কিন্তু পীর সাহেবের মৃত্যুর খবর শুনে গ্রামের সবাই প্রায় প্রায় আশাহত হয়ে পড়ে! এদিকে চিঠিটা আরও অবাক করে দেয় গ্রামবাসীকে।
#চলবে…..
#বিঃদ্রঃ উক্ত গল্পে পীর সাহেব ও ইমাম সাহেবের চরিত্র দ্বারা কোনো ধর্মকে আঘাত করতে চাইনি। এইটা কাল্পনিক চরিত্র মাত্র।
গ্রামের ১৬ বছরের মেয়েরা হুট করেই গর্ভধারণ করছে৷ গ্রামে এ যেন এক মহামারী দেখা দিয়েছে। ১৬ বছরের সবকটি মেয়েরা অদ্ভুতভাবে গর্ভবতী হচ্ছে এবং ১০ দিনের মধ্যেই এক ভয়ংকর আকারের বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে। জন্ম দেয়া বাচ্চার সারা দেহ রক্তাক্ত, ছেঁড়া ত্বক এবং বিভৎস কালো চেহারা। শিশুটির মৃত জন্ম হচ্ছে। এমন মনে হয় যেন গর্ভের মধ্যে কেউ শিশুটিকে ভীষণ বাজেভাবে আঘাত করেছে। গ্রামের পরিস্থিতি এখন খুবই অস্বাভাবিক। চারিদিকে ভয়ের মেঘ ছেয়ে গেছে। মানুষ রাতের আধারে যতটা ভয় পায়, দিনের আলোতেও ততটাই আতঙ্কে থাকে।
এই ভয়ংকর মহামারীর সর্বপ্রথম শিকার হয় অঞ্জন বাবুর ১৬ বছরের মেয়ে সূচনা। সূচনা দেখতে ভীষণ রকমের সুন্দরী, দেহের গঠন যে কাউকেই মোহিত করতে পারে। কালো ঘন চুলের মেঘের জালে যে কেউ আটকা পড়বে। হুট করে সকালে এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভাঙলো সূচনার। ঘুম ভাঙতেই পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলো। চিৎকার দিয়ে সম্পূর্ণ ঘর মাথায় তুলে নিল। পেটের এমন অসহনীয় ব্যথায় আর্তনাদ করতে করতে বিছানা থেকে মাটিতে ধপাস করে পড়লো। সূচনার মা সূচনার এমন অবস্থা দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে মেয়ের কাছে দৌড়ে চলে আসলেন।
– মা গো খুব পেট ব্যথা করতেছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন পেটের ভেতরের নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে ফেলছে। মা গো আমি মনে হয় বাঁচবোনা গো।
তীব্র ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে সূচনা কথাটা তার মাকে বলল। সূচনার মা এর আগে কখনো এত ভয়ঙ্করভাবে কাঁদতে দেখেননি সূচনাকে। সূচনার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে তাকে বললেন,
একটু সামলে নে মা আমি তোর বাপকে ডাক দিচ্ছি।
সূচনার মা করুণ কণ্ঠে অঞ্জন কে ডাক দিল। অঞ্জন বাহিরে বেড়া তৈরি করছিলেন উঠোন টা ঘেরাও দিবেন বলে। বউয়ের এমন চিৎকার শুনে কাজ ফেলে দ্রুত পায়ে ভেতরে এলেন। সূচনাকে কাঁদতে দেখে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
কি হইছে সূচনার মা? মেয়ে এমন করে গড়াগড়ি করতাছে কেন?
সূচনার মা কাঁদতে বললেন,
দেখেন না মেয়েটার পেটে বেজায় ব্যথা উঠছে। আপনি আগে ডাক্তার কে ডেকে আনেন। জলদি যান আপনে..!
সূচনা অসহনীয় ব্যথায় কাতরাচ্ছে আর মা, মা বলে চিৎকার করছে। পাড়াপড়শি চিৎকার শুনে দেখতে এসেছেন কি হয়েছে। অঞ্জন তড়িঘড়ি করে ডাক্তার বাবুকে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার বাবু অনেক আগে থেকেই এই গ্রামের লোকজনের চিকিৎসা করে আসছেন। নাম অশোক কর্মকার। বয়স ৫০ এর ঘরে। দাঁড়ির রঙ কালো। মাথার চুলে এখনো পাঁক ধরেনি। ডাক্তার বাবু সূচনার পেটে হাত দিয়ে টিপে টিপে দেখছেন। পেট শক্ত হয়ে আছে কিন্তু কি হয়েছে সেটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছেননা। সাধারণ পেট ব্যথার ঔষধ লিখে দিলেন। কিন্তু এই ঔষধে পেট ব্যথা সারলোনা সূচনার। অশোক বুঝতে পারল যে এটা সাধারণ কোনো পেট ব্যথা নয়। তাই অঞ্জন বাবু কে পরামর্শ দিয়ে বললেন শহরের ডাক্তারকে দেখিয়ে আসতে। শহরের একজন ভালো ডাক্তারকে উনি চেনেন। তার ঠিকানা দিলেন অঞ্জন বাবুকে। অশোক হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন কি হয়েছে সূচনার। কিন্তু নিশ্চিত হবার জন্য শহরের ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিলেন।
অঞ্জন দ্রুত মেয়েকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। হাসপাতালের ডাক্তার শফিকা উদ্দিন প্রথমে সূচনার পেট ব্যথার কারণ জানার জন্য তার পেট টিপে টিপে দেখলেন। অশোক বাবুর মতো উনিও পেট শক্ত অনুভব করলেন। সূচনাকে জিজ্ঞেস করলেন কোনো আজেবাজে খাবার খেয়েছিল কি না, অথবা ভারী কাজ-টাজ করেছিল কি না। সূচনা না-সূচক জবাব দিল। সন্দেহবশত ডাক্তার শফিকা সূচনার আল্ট্রাসনোগ্রাফী করলেন। টেস্টে ধরা পড়ল সূচনা মা হতে চলেছে। ডাক্তার শফিকা একদম অবাক হোন নি। কতশত টেস্ট করেন, কত কতজনকে মা হবার সুখবর দিয়ে খুশি করেন তার হিসেব উনি রাখেন নি। কিন্তু একটু অবাক হলেন। প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাতে হাজবেন্ড তার বউকে নিয়ে আসেন। কিন্তু বাবাকে নিয়ে আসতে দেখেননি কখনো শফিকা। কিন্তু তবুও বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে এড়িয়ে গেলেন। অঞ্জনকে নিজের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
– অঞ্জন বাবু, ঘাবড়ানোর মতো কিছু হয়নি। এটা তো সুখবর…
– কি সুখবর ডাক্তার সাহেবা?
হাস্যজ্বল মুখে সুখবরের কথা শুনে অঞ্জন বাবু জানতে চাইলেন।
– আপনার মেয়ে তো মা হতে চলেছে। আপনারার তো মিষ্টি খাওয়ানোর কথা।
সূচনার মা হবার কথা শুনে রীতিমতো অঞ্জন বাবু ঘাবড়ে গেলেন। থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। সূচনাও বড়সড় ধাক্কা অনুভব করলো। সেও অবাক ডাক্তারের মুখে এমন কথা শুনে। সূচনার মুখের হাবভাব দেখে এবং অঞ্জন বাবুর কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে দেখে ডাক্তার শফিকা জিজ্ঞেস করলেন,
কি হয়েছে? আপনার মেয়ে মা হতে চলেছে আর আপনি খুশি হননি!
তারপর ডাক্তার শফিকা সূচনার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেম,
সূচনা তুমি মা হবে। একথা শুনে তোমার চেহারার রঙ উড়ে গেল কেন?
-যার মেয়ে বিয়ের পূর্বেই মা হতে চলেছে তার বাবা কিভাবে খুশি হবে বলেন ডাক্তার সাহেব!
অঞ্জন খুব সহজসরল মনের মানুষ। মনের ব্যথা লুকিয়ে রাখতে পারেননা। কাঁদতে কাঁদতে তাই সে শফিকাকে কথাটা বললেন।
অঞ্জন মাথায় হাত দিয়ে অসহায় প্রাণীর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সূচনাও কাঁদতে লাগলো। এদিকে শফিকা ভীষণ অবাক। বিয়ে হয়নি অথচ মা হতে চলল সূচনা! বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
কি বলছেন, আপনার মেয়ের বিয়ে হয়নি?
– না ডাক্তার সাহেবা। এখন আমি কোন মুখে যাবো গ্রামে! এলাকার লোকজনকে কি বলব? আমার তো মানসম্মান কিছুই থাকবেনা। আমাকে গ্রামের সবাই লাথি মেরে গ্রাম থেকে বের করে দিবে ডাক্তার সাহেব।
কাঁদতে কাঁদতে একটু পর অঞ্জন আবার জিজ্ঞেস করলো, ডাক্তার সাহেব সব কাগজ ভালো করে দেখেছেন তো? কোনো ভুল হয়েছে নাকি?
– ভালো করে দেখেই বলছি অঞ্জন। তোমার মেয়ে প্রেগন্যান্ট। আমি রিপোর্ট ভালো করে দেখেছি। রিজাল্ট পজিটিভ আসছে।
– কিন্তু এটা সম্ভব কিভাবে? আমার মেয়ের বিয়ে হয়নি। তার স্বামী নেই তাহলে সে মা কিভাবে হতে পারে?
শফিকা জানেন, আজকাল ভালোবাসার নামে শারীরিক মিলনের ঘটনা খুব সহজ। তাছাড়া ভয় দেখিয়ে দৈহিক চাহিদা মেটানো পুরুষের সংখ্যাও কম না সমাজে। এই ঘটনাটিকেও তিনি সেভাবেই নিলেন। কিন্তু সূচনার বাবাকে এ সম্পর্কে কিছু বলতে না চাইলেও বলতে হবে। বলাটা উচিৎ মনে হয়। বাবার মন মেয়েকে নিয়ে সবসময়ই দুর্বল। এমন কথাটা উনি হয়তো সহ্য করতে পারবেন না, কিন্তু না বললে তো আর সূচনার বাবা বুঝতে পারবেননা। তাই শফিকা বললেন,
আমি জানিনা কথাটা আপনি কিভাবে নেবেন, কিন্তু আপনার মেয়ের বয়স মা হবার জন্য পর্যাপ্ত। যদি সে কোনো পুরুষের সাথে শারীরিক মিলনে গিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই সে মা হতে পারবে।
কথাটা শুনে অঞ্জনের মাথায় যেন বাজ পড়লো। তার মেয়ে এতটা নিচে নেমে গেল! কিন্তু সূচনা তখনই কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,
না মেডাম আমি কোনো পুরুষের সাথে শারীরিক মিলনে যাইনি। আমি সত্যি বলছি মেডাম।
ডাক্তার শফিকা ভাবলেন যে হয়তো ভয়ে সে স্বীকার করতে পারছেনা। ডাক্তার শফিকা সূচনাকে শান্ত ভাবে বোঝালেন,
দেখ সূচনা, বয়সের কারণে ভুলবশত মেয়েরা এমন পথে চলে যায়। তুমি ভয় না পেয়ে সত্যটা বলো।
সূচনা কাঁদতে কাঁদতে বললো
মেডাম আমার মায়ের দিব্যি খেয়ে বলছি আমি এমন জঘন্য কাজ করিনি।
শফিকা ভীষণ অবাক হলেন। সূচনার কথায় উনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। যদি সূচনা সত্য বলছে তাহলে সূচনার গর্ভে সন্তানের ভ্রুণ জন্ম নেয়ার প্রশ্নই আসেনা। তাহলে সূচনা তার মায়ের কি মিথ্যে দিব্যি খেয়েছে?
অঞ্জন তার মেয়েকে নিয়ে বাসায় এসেছে। সূচনার মা সেই তখন থেকে অপেক্ষা করছিলেন অঞ্জনের যখন থেকে সে তার মেয়েকে নিয়ে শহরে গেছে। অঞ্জনের মোবাইলও নেই যে তার সাথে যোগাযোগ করে জানবে মেয়ের অবস্থাটা। তাই অঞ্জন কে দেখে অস্থির হয়ে যায় সে। দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
কি বলেছেন ডাক্তার? মেয়ে আমার ঠিক আছে তো?
অঞ্জন বাবু রাগে দাঁত কটমট করতে করতে জোরে এক থাপ্পড় দিলেন নিজের মেয়েকে। সূচনা থাপ্পড়ের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
– ওগো, মারছো কেন আমার মেয়েকে? কি করেছে সে?
বিস্মিত কণ্ঠে সূচনার মা জিজ্ঞেস করলো। চোখের জল মুছতে মুছতে অঞ্জন বলল,
তোমার মেয়ে এই মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে বুঝলে! মা হতে চলেছে তোমার মেয়ে। বিয়ের আগে কার সাথে অপকর্ম করে এসেছে কে জানে বল! আমি গ্রামে কি মুখ দেখাবো এখন?
কাঁদতে কাঁদতে অঞ্জন বাবু মাটিতে বসে পড়লেন। আজ নিজেকে সেই সমুদ্রের তীরে বসে থাকতে দেখছেন অঞ্জন বাবু যেখানে উনার আশেপাশে কোনো জনমানব নেই। সূচনার মা কাঁদতে কাঁদতে বেহাল। সূচনার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন,
হারামজাদি কার সাথে অপকর্ম করেছিস তুই? কে তোর এই অবস্থার কারণ? কার পাপ নিজের পেটে বড় করছিস?
সূচনা অসহায় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
মা গো, আমি জানি না মা। আমি কিচ্ছু করিনি মা বিশ্বাস কর। আমি জানিনা মা এটা কেমনে হল..!
– তাহলে মা কি তুই এমনিতেই বনে গেলি! এখন তুই বল, যদি গ্রামের লোকজন জানতে পারে তাহলে আমরা কি জবাব দিব? তুই আমাদের কে জীবিত মেরে ফেললি রে..!
কাঁদতে কাঁদতে অঞ্জন বাবু এবং তার স্ত্রী শেষ। এদিকে সূচনার পেটে আবারো ব্যথা শুরু হল। সূচনা কোনভাবে এই অসহনীয় ব্যথা সহ্য করে রাত পার করে। কিন্তু সকালে তার পেটে আবার ব্যথা উঠলো। আর আজ সকালে তার পেট কালকের তুলনায় অনেক বড় দেখাচ্ছে। ঠিক ছয়-সাত মাসের গর্ভবতী মহিলার মতো। কিন্তু একদিনে পেটের আকার এমন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া তো আজব ব্যাপার! সূচনার বাবা-মাও অবাক। অঞ্জন সূচনাকে আবার নিয়ে গেলেন ডাক্তার শফিকার কাছে।
শফিকা যখন দেখলেন সূচনার পেট এতটা ফুলে উঠেছে তখন অনেকটা ঘাবড়ে গেলেন উনি। ঘাবড়ে যাওয়ার বিশেষ কারণ আছে। সন্তান গর্ভের ভেতর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে যার কারণে পেটের আকারটাও আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু একদিনে এতটা বৃদ্ধি পাওয়া অসম্ভব। এর আগে এমন ঘটনা উনি কখনো দেখেননি। নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল শফিক সাহেবের মন-মস্তিষ্কে। কি করবেন বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি সূচনার টেষ্ট করলেন। রিপোর্ট শফিকার হাতে। শফিকা রিপোর্ট দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। রিপোর্টের মতে অহনা ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু গতকালের রিপোর্ট বলছে সে তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা। খুব অবাক হন ডাক্তার শফিকা। দুটো রিপোর্ট আবার ভালোভাবে দেখলেন। কিন্তু ফলাফল একটাই। প্রথম রিপোর্টে সূচনা তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা এবং দ্বিতীয় রিপোর্ট অনুযায়ী ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু একদিনে তিন মাসের ভ্রুণটির ছয়মাসের ভ্রুণের মতো বৃদ্ধি? এটাতো অসম্ভব! শফিকা অঞ্জনকে সবকিছু বিস্তারিত বললেন। অঞ্জন বাবু এমনিতেই খুব ভয়ে আছেন। এখন এমন কথায় উনি আরও ঘাবড়ে গেলেন। চেহারা ঘামে ভিজে একাকার। চোখ থেকে অঝোরে জল পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে অসহায় অঞ্জন শফিক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
ডাক্তার সাহেবা এর কোনো উপায় হয়না? আমি গরিব মানুষ। দুবেলা কম খাই কিন্তু গ্রামে সম্মান সহিত জীবনযাপন করি। যদি মেয়ের ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যায় তাহলে মরা ছাড়া আমার কাছে কোনো উপায় থাকবেনা সাহেব।
শফিকার মনে অঞ্জনের জন্য মায়া বোধ জাগলো। কিন্তু এখন করার কিছুই নেই। অসহায় হয়ে উনি বললেন,
এখন কোনো উপায় নেই অঞ্জন বাবু! গর্ভপাত করা খুব বড় অপরাধ। কিন্তু যদিও সূচনার গর্ভপাত করি তাহলে সে মারা যাবে কেননা গর্ভের সন্তান এখন অনেকটা বেড়ে গেছে। আমার কাছে ঘটনাটা একদম সহজ অথবা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আপনারা আপনাদের ঈশ্বরকে স্মরণ করুন। উনিই হয়তো মুক্তি দিতে পারবেন!
শফিকা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন এটি ভীষণ অস্বাভাবিক কিছু। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত দেননি অঞ্জনকে। ডাক্তার হয়ে বিজ্ঞানের বিপরীতে গিয়ে কিছু বলাটা উনার মুখে শোভা পায়না। নিরুপায় হয়ে অঞ্জন ফিরে আসেন গ্রামে। তার স্ত্রীকে সবকিছু খুলে বললেন। দুজন খুব ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়েন। বুঝতে পারছিলেন না কেন এসব হচ্ছে।
এভাবেই কয়েকদিন কাটলো। সূচনা প্রতিদিন ব্যথায় কষ্ট পায়, আর্তনাদ করে। কখনো কখনো ব্যথা খুব বেশি করে। সূচনাকে বারবার জিজ্ঞেস করলেও সে একই কথা বলছে যে সে কিছুই জানেনা। কেন, কিভাবে তার পেটে এই সন্তান এসেছে সে জানেনা। কিন্তু সূচনা তার বাবা-মাকে বলল যে,
সে রাত্রে খুব ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখেছিল সেদিন। তারপর যখন ঘুম ভাঙলো তখন থেকেই তার পেটে ব্যথা শুরু হয়।
অহনার বাবা-মা জানতে চাইলেন,
কি স্বপ্ন ছিল সূচনা?
সূচনা বলল,
আমি স্বপ্নে দেখছিলাম কয়েকজন পুরুষেরা মিলে আমাকে মাটিতে ফেলে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। তারা সবাই লাঠি দিয়ে আমার পেটে আঘাত করছে। আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম। চিৎকার করে বলছিলাম আমাকে আর মেরনা, ছেড়ে দাও আমাকে, আমি মরে যাব। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনেনি। তারা আমাকে নরপশুর মতো মারছিল। তারপর আমার ঘুম ভেঙে যায় আর আমি পেটে ব্যথা অনুভব করি বাবা। আমি প্রতিটি রাতে এই স্বপ্নটাই দেখি বাবা। স্বপ্ন দেখার পর আমার পেটের ব্যথা অনেক বেড়ে যায়।
এই স্বপ্ন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই অহনার বাবা মায়ের। কেন তার মেয়ে এমন স্বপ্ন দেখে তার কোনো জ্ঞান তাদের নেই। এদিকে গ্রামের প্রায় সবাই জেনে গেছে সূচনার কথা। সবাই মেয়ের চরিত্রের উপর দোষারোপ করে, মন্দ মন্তব্য করে। অঞ্জন বাবুকে রাস্তায় বের হলে খারাপ, নেহাত খারাপ কথা শুনতে হত। গালিগালাজ পর্যন্ত হজম করতে হত। তাই এখন ঘরের চার দেয়ালের আড়ালে থেকে শুধু কাঁদেন। এভাবে কেটে যায় ১০ দিন। সূচনার পেটে আজ ভীষণ ব্যথা উঠে। সে কোনোভাবেই ব্যথা সহ্য করতে পারছেনা। মেয়ের এমন করুণ অবস্থা দেখে মারাত্মক ভাবে ভয় পেয়ে যান তার বাবা-মা। কোনোভাবেই তারা সূচনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। সূচনা শুধু চিৎকার দিয়ে দিয়ে বলছে,
তোমরা এটা ঠিক করনি। তোমরা এর ফল অবশ্যই ভোগ করবে। এই অন্যায়ের শাস্তি তোমরা পাবেই পাবে। কেউ রক্ষা পাবেনা তোমরা…
কিছুক্ষণ পরই সূচনা একটা অদ্ভুত শিশুর জন্ম দেয়। জন্ম দিয়েই সূচনা মারা যায়। শিশুটিরও মৃত জন্ম হয়। শিশুটির সারা দেহ রক্তে ভরা, চামড়া খুব বাজেভাবে ছেড়া, চেহারা একদম বিভৎস কালো। সূচনার মা-বাবা শিশুটিকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। গ্রামের লোকেরা এসে এসে দেখে যাচ্ছিলেন বাচ্চাটাকে। সবাই ভীষণ ভয়ও পাচ্ছিল এমন অদ্ভুত বাচ্চা দেখে। সবাই যা মুখে আসছে তা বলে দিচ্ছে সূচনার বাবা-মাকে। কেউ কেউ বলছে সূচনা কোনো ভুত বা পিশাচ ছিল। কেউ কেউ সূচনার বাবা-মাকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করলেন। অঞ্জন ও তার বউ নীরব হয়ে সব সহ্য করছিলেন। কিন্তু রাত্রে ঘটলো ভীষণ বেদনাদায়ক ঘটনা। রাতের আধারে সূচনার বাবা-মা ফাঁসি লাগিয়ে আত্মহত্যা করে নেয়। চিরতরে পৃথিবী থেকে চলে যান। গ্রামের লোকজন মনে করেন লজ্জায়, লোকনিন্দার ভয়ে তারা আত্মহত্যা করেন। কিন্তু এই আত্মহত্যা এতটা স্বাভাবিক কোনো বিষয় ছিলনা যতটা গ্রামবাসী মনে করছিলেন। এই আত্মহত্যার পেছনেও ভয়ংকর কারণ লুকিয়ে ছিল।
সপ্তাহ দুয়েক পেরিয়ে যায়। গ্রামের লোকজন সূচনা, সূচনার পরিবার এবং সূচনার সাথে ঘটে যাওয়ার কথা ধীরে ধীরে ভুলে গেলেন। কিন্তু এই দুই সপ্তাহ পর ঠিক একই ভাবে স্বপ্ন দেখে আরোও সাতজন মেয়ে গর্ভধারণ করে। সাতজন মেয়ে ই ১৬ বছরের। আর স্বপ্নটাও সেটাই যেটা সূচনা দেখেছিল। কয়েকজন লোক মেয়েগুলোর পেটে সজোরে আঘাত করছে শক্ত শক্ত লাঠি দিয়ে। তারা চিৎকার করে, আকুতি মিনতি করে সেই লোকদের কাছে ক্ষমা চায়, তাদেরকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করছে কিন্তু তাদের সব অনুরোধ উপেক্ষা করে লোকেরা মেয়েগুলোকে মেরেই চলেছে। যখন স্বপ্ন ভাঙে, মেয়েরা পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে। ঠিক সূচনার মতো। ব্যথায় কাতরাতে থাকে কিন্তু কি হয়েছে, কিভাবে হয়েছে কেউ বুঝতে পারেনা। তারপরের দিন ঠিক একইভাবে মেয়েগুলোর পেট অস্বাভাবিক আকার ধারণ করে। মেয়েগুলোর সাথে সাথে তাদের পরিবারবর্গও ভীষণ ভয় পেয়ে যান।
ডাক্তাররাও ভীষণ অবাক। তাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর পূর্বে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। কোনো দৈহিক মিলন নেই অথচ মেয়েরা গর্ভবতী হচ্ছে। তাছাড়া গর্ভের সন্তান দিনদিন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠে, গর্ভবতী মেয়েটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ব্যথায় কাতরায়। একটি ভ্রুণ গর্ভে নয় মাসে যে পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এই মেয়েদের ক্ষেত্রে তা হয় মাত্র ১০ দিনে। তারপর ১০ দিন পর যখন বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসে তখন তার মৃতজন্ম হয় এবং দেহ খুব বিদঘুটে আকৃতির হয়ে যায়। সাথে সাথে গর্ভবতী মেয়েটিও মারা যায়। কিভাবে এসব সম্ভব? বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের দলেরা এর উপর বিশদভাবে গবেষণা চালায় কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেনা। তাছাড়া সব থেকে অবাক করার কথা হলো মেয়েগুলোর বাবা-মাও আত্মহত্যা করে মারা যায়। সবার আত্মহত্যা করার পদ্ধতি একই, গলায় ফাঁসি দিয়ে।
গ্রামের লোকজন খুব ভয়ে এখন দিনাতিপাত করছে। গ্রামের এমন অবস্থার খবর এলাকার আশেপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। এমন ভয় ভয় অবস্থা হয়েছে যে অন্য গ্রামের লোকজনও এখন এই গ্রামে আসতে ভয় পান। রাতের আধারে তো দূরের কথা দিনের আলোতে কেউ কেউ ঘর থেকে বেরুতে নারাজ। সবাই এটাকে অশুভ অলৌকিক শক্তির প্রভাব মনে করছেন। কিন্তু এই সমস্যার তো একটা সমাধান চাই। তাই গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারা তান্ত্রিক ডেকে সমস্যাটির সমাধান করবে।
গ্রামের কয়েকজন মিলে পাশের দুই গ্রাম পেরিয়ে একটি গ্রাম থেকে একজন তান্ত্রিককে ডেকে আনেন। উক্ত তান্ত্রিকের যথেষ্ট খ্যাতি আছে। উনি যেকোনো ভুত কিংবা পিশাচ ছাড়াতে দক্ষ। নাম শংকর তান্ত্রিক। গ্রামবাসীরা শংকর তান্ত্রিককে সাথে করে গ্রামে নিয়ে আসেন।
গ্রামে প্রবেশ করতেই উনি কেমন জানি অনুভব করলেন। বুঝতে পারলেন এই গ্রামের বায়ু পর্যন্ত দূষিত হয়ে গেছে। তান্ত্রিক গ্রামবাসীকে জানালেন এই গ্রাম এখন অনেক শক্তিশালী দুরাত্মার কবলে। গ্রামবাসীরা উক্ত কথা শুনেই ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। তাদের গায়ের লোম গুলো খাড়া হয়ে গেলো। কিন্তু শংকর তান্ত্রিক তাদের আশ্বাস দিলেন উনি সব ঠিক করে দেবেন বলে। এতে গ্রামবাসীরা কিছুটা হলেও ভয়মুক্ত হতে পেরেছে।
তান্ত্রিক তার ভুত পিশাচ তাড়ানোর কার্যপ্রণালী শুরু করলেন। কিছু বিধিবিধান গ্রামবাসীদেরকেও পালন করার জন্য বললেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শংকর তান্ত্রিক চিৎকার দিয়ে উঠে পড়লেন। ভয়ের ছাপ উনার চোখে-মুখে লেপ্টে রয়েছে। গ্রামবাসীরা কি হয়েছে জানার আগ্রহ দেখালে শংকর তান্ত্রিক হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
তোমরা কেউ রক্ষা পাবে না। এসব তোমাদের পাপের ফল। তোমাদের অন্যায়ের শাস্তি। কেউ বাঁচতে পারবেনা। ধ্বংস হয়ে যাবে এই গ্রাম। সে ধ্বংস করার জন্যই এসেছে তোদের মাঝে।
“সে ধ্বংস করার জন্য এসেছে মানে?” কে এসেছে? গ্রামের লোকজন সবাই আরো ভয় পেয়ে যায়। কে এসেছে এর উত্তর হয়তো এই তান্ত্রিক জানে। কিন্তু তান্ত্রিক এমন ভাবে পালালো যেভাবে হরিণ বাঘের ভয়ে পালায়। গ্রামবাসীরা ভীষণ অবাক এবং আতঙ্কিত। কিন্তু ভয় তখন আরোও বেড়ে যায় যখন পরেরদিন শংকর তান্ত্রিকের মৃত্যুর খবর গ্রামবাসীদের কানে আসে…
“চারমাস পর,
বিছানার উপর বসে লাল সেড়োয়ানী পরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলা করছে আদি।মনে মনে বলছে জলি আসছে না কেন?”
“ওদিকে অহনা জলিকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। বিয়ের পর আজ প্রথম জলি আদির রুমে যাবে।অহনা চেয়েছিলো একদম নতুন বউয়ের মতোন করে জলিকে সাজাতে।কিন্তু জলি তা চাই না।কারণ শাড়ির ভার জলি একদম সইতে পারে না।আর সাজগোছ তো নয়ই।তাই পাতলা দেখে একটা লাল শাড়ি অহনার কাছ থেকে পরে ঠোঁটে একটু হালকা গোলাপি রংয়ের লিপস্টিক দিয়ে আদির রুমে আসে।”
“রুমে এসে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয় জলি।যার শব্দ শুনতে পেয়ে আদি চেয়ে দেখে জলি এসেছে।এর আগে কখনো আদি শাড়িতে জলিকে দেখে নি।তাই অপলক দৃষ্টিতে জলির দিকে তাকিয়ে আছে।আদির চোখ যেন সরছেই না।আদিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জলি একটু লজ্জা পায়।লজ্জা লজ্জা মুখ করে জলি ধীর পায়ে সামনের দিকে আগাতে গেলে শাড়ির কুচিতে বেঁধে ধপাস করে নিচে পরে যায়। আর সেটা দেখে আদি জোড়ে জোড়ে হাসতে থাকে।আদিকে ওভাবে হাসতে দেখে জলি রেগে গিয়ে বলে,”
—“খুব হাসি পাচ্ছে তোর, হারামি?”
—“হুমমম।খুব হা হা হা।শাড়ি যখন সামলাতে পারিস না তখন পড়তে গেলি কেন?”
“আদি বিছানা থেকে নেমে এসে জলিকে ধরে দাড় করায়। তারপর জলির মুখটা ধরে হাসতে হাসতে বলে,”
—“শাড়ি সামলানো তোর কাজ না।”
“জলি এবার আরও বেশি রেগে যায়।রেগে গিয়ে একটানে শাড়ির কুচি খুলে ফেলে তারপর পুরো শাড়িটা খুলে দূরে ছুড়ে মারে।জলির রাগ দেখে আদি হাসি থামিয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়।”
“জলি আদির সেড়োয়ানীর কলারটা টেনে ধরে বলে,”
—“সয়তান, হারামি তোর জন্য শাড়ি পরেছিলাম আর তুই আমাকে নিয়ে হাসছিস? তোকে তো আমি..”
“জলি আদির ঠোঁটে জোড়ে একটা কামড় বসিয়ে ছেড়ে দেয়।ব্যাথা পেয়ে আদি আহ্ করে উঠলে জলি বলে,”
—“আর কখনো যদি আমাকে নিয়ে হেসেছিস তো খবর আছে।”
“তারপর জলি আদিকে ধাক্কা দিয়ে আলমারির কাছে যায়। আলমারি খুলে একটা কামিজ বের করে বিছানার উপরে এনে রাখে।আর রেগে তাড়াহুড়ো করে ব্লাউজের হুকগুলো খুলতে থাকে।হঠাৎ সামনে তাকিয়ে আয়নার ভেতরে দেখে আদি তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে।জলির ধ্যান ফেরে,”
—“হায়! হায়! কি করতে যাচ্ছিলাম আমি? আদির সামনে কিভাবে চেঞ্জ করবো?(মনে মনে)
—“কি হলো থেমে গেলি কেন? চেঞ্জ কর। তোকে শাড়িতে একটুও মানায় না ওই কামিজটাই পর।”
“জলি পিছনে ঘুরে তেড়ে আসে আদির কাছে।”
—“ওই হারামি? আমাকে কি বলদ পেয়েছিস যে তুই বলবি আর আমি তোর সামনেই চেঞ্জ করবো? যা বের হ রুম থেকে চেঞ্জ করার পর আসিস।”
“কথাটা বলে আদিকে বাইরের দিকে ইশারা করে জলি।”
“আর আদি জলিকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।তারপর খুব ভাব নিয়ে বলে,”
—“ভুলে যাস না আমার তিন সন্তানের মা তুই।তাছাড়াও এখন আমি তোর স্বামী তাই ঢং না দেখিয়ে আমার সামনেই চেঞ্জ কর!”
—“নাহহহ!”
—“হ্যাঁ!”
—“বললাম তো না।”
—“আচ্ছা বুঝেছি এভাবে মানবি না তুই।আমিই করছি।”
“কথাটা বলে আদি টেনে জলির হুক খোলা ব্লাউজটা দু’পাশে সরিয়ে দেয়।আর সঙ্গে সঙ্গে জলি আদিকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে আসে।”
“জলি আর কোনো কথা বলে না আদির উল্টো দিকে মুখ করে দাড়িয়ে থাকে।আর আদি জলিকে নিরব দেখে এগিয়ে আসে।জলির ব্লাউজটা আবার পিছনের থেকে দাড়িয়ে আস্তে করে টেনে খুলে দেয়।তারপর জলির কাঁধে থুতনিটা রেখে পেছনের থেকে জলিকে জড়িয়ে ধরে রাখে।”
—“আদি! ছেলেমেয়েরা দেখছে।”
—“দেখুক।ছোট্ট বাচ্চারা বোঝে না কিছু।”
“জলি আদির দিকে ঘুরে যায়। আদির সেড়োয়ানীর কলারটা টেনে ধরে বলে,”
—“তুই এখনো সেই লুচুই রয়ে গেলি।”
“আদি জলির হাত টেনে নিজের ঠোঁটের কাছে এনে জলির হাতে চুমু দিতে থাকে।তারপর বলে,”
—“ধূর, পৃথিবীর সব স্বামীরাই তার বউয়ের কাছে লুচু হয়।ওসব আমি ধারধারি না।আজ আমার বাসর রাত না? আমার যা ইচ্ছা আজ আমি তাই করবো।”
“কথাটা বলে জলিকে কোলে তুলে নেয়।তারপর জলিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আলোটা নিভিয়ে দেয় আদি।”
।
।
।
।
।
“খাবার টেবিলে বসে জলির বাবা-মা কথা বলছে।আদির সাথে জলির বিয়ে দিয়ে তারা খুশি হলেও অহনার কথা ভেবে খারাপ লাগছে।বেচারি অনেক কিছু করেছে জলির জন্য। আজ জলি আর জলির সন্তানরা বেঁচে আছে আবির আর অহনার জন্যই। উপর অ’লা ওদের কোলটাও ভরিয়ে দিক এটাই তাদের চাওয়া।”
“পরেরদিন সকালে,
অহনা প্রতিদিনের মতো আজও নিজের হাতে সব রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে রাখে।জলি, আদি ওরা এখনো নিচে নামে নি।আবির আর জলির বাবা-মাকে অহনা পরোটা আর আলুভাজি দিয়ে প্লেটে উঠিয়ে নিয়ে খেয়ে নিতে বলে।জলির বাবা বলে,”
—“আর একটু অপেক্ষা করলে ভালো হতো না? জলি আর আদিও আসলে।একসাথে নাস্তা করা হতো।”
“জলির বাবার কথা শুনে আবির আর অহনা মুখ টিপে হাসে।”
—“কি হলো তোমরা হাসছো কেন? আমি কি হাস্যকর কিছু বল্লাম?”
“জলির মা হাতের কনুই দিয়ে জলির বাবাকে একটা খোঁচা দেয়।তারপর বিড়বিড় করে কানের কাছে বলে,”
—“তুমি কি বোকা? মেয়েটার বিয়ে হলো। কাল যে ওদের বাসর রাত ছিলো তা ভুলে গেলে?”
—“কি যে বলো না! তিন সন্তানের বাবা-মায়ের আবার বাসর রাত।”
“জলির মা কড়া গলায় বলে,”
—“কি বললে তুমি?”
—“নাহ নাহ কিছু না!”
“সামনে তাকিয়ে দেখে জলি আর আদি নামছে তাদের তিন সন্তানকে নিয়ে।জলির কোলে মেয়ে।আর আদির দুই কোলে দুইটা ছেলে।”
—“ওইতো ওরা আসছে।”
“অহনা ঘুরে দেখেই এগিয়ে যায় আদির কাছ থেকে একজনকে নেওয়ার জন্য। নইলে যদি একটা অঘটন ঘটে যায়? কয়েকটা সিঁড়িতে উঠতেই অহনা মাথাটা ঘুরে পরে যেতে লাগে।অহনাকে সিঁড়িতে দাড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে ঢুলতে দেখে আবির ছুটে গিয়ে ধরে বসে।আর অহনা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।আবির অহনাকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে যায়।তারপর ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়।ডাক্তার এসে চেকাপ করে বলে।খুশির খবর। মিস্টি মুখ করান।অহনা মা হতে চলেছে।কথাটা শুনে আবিরের চোখে পানি চলে আসে।অহনা খুশিতে কেঁদে ওঠে। পেটে হাত দিয়ে বলে,”
—“তুই এসে গেছিস? আমি জানতাম তুই আসবি।”
“আবির এসে অহনাকে জোড়িয়ে ধরে বলে,”
—“তুমি মা হবা অহনা আর আমি বাবা।”
“জলি বলে,”
—“আমি আন্টি হবো আর আদি আঙ্কেল।”
“জলির বাবা জলির মাকে বলে,”
—“আমরা আবার দাদা-দাদি হবো।আমাদের অহনার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে।”
“আজ সবাই অনেক খুশি।কস্টের পরই যে সুখ থাকে।ওদের সকলের জীবনেও এসেছে সেই সুখ।”
“অহনা-আবির, জলি-আদি এদের সম্পর্কটাই ছিলো #অন্তরালে_তুমি_আমি’র।হাজারও বাঁধা পেরিয়ে ওরা ওদের সম্পর্ক গুলোকে টিকিয়ে রেখেছে।ভুল বুঝাবুঝি সব মিটিয়ে নিতে পেরেছে।আর তাই ওদের সকলের খুশিটার ভাগ আপনারাও নেন।অহনার সন্তান যেন সুস্থ ও সুন্দর ভাবে পৃথিবীতে আসে সেই দোয়া করেন।এতোদিন গল্পটার সাথে থাকার জন্য সবাইকে এত্তোগুলো শুকরিয়া।সবাই ভালো থাকেন।সুস্থ থাকেন।আল্লাহ হাফেজ।”
“অহনাকে কেবিনে শিফট করা হয়।কিছুক্ষণ পর অহনার জ্ঞান ফিরে আসে। চোখের সামনে অহনা আবিরকে আর জলির বাবা-মাকে দেখে উঠে বসে।আর অহনার সবকিছু মনে পরে যায়। অহনা ভাবে তখন সিঁড়ি থেকে পরে যাওয়ার পরে বাচ্চাটার কিছু হয় নি তো।আবিরের চোখে পানি দেখে অহনা কিছুটা আচ করে নিজের পেটে হাত রেখে উপলব্ধি করে তাদের সন্তানটা আর নেই।অহনা কাঁদতে থাকে আর কাঁদতে কাঁদতে বলে আমার সন্তান! আমার সন্তান! আবির অহনার কাছে আসে আর অহনাকে জড়িয়ে ধরে বলে, শান্ত হও অহনা।প্লিজ শান্ত হও।আমারা আবার সন্তান নিবো।প্লিজ এই দূর্ঘটনা’টা তুমি ভুলে যাও।”
“অহনা মানতে চাই না। কেন এমনটা হলো তাদের সাথে? আবির অহনাকে বলেছিলো সাবধানে থাকতে। কিন্তু অহনা তা পারলো না।অহনা পুরোপুরি ভাবে ভেঙে পরেছে।ভাবছে সব দোষ তারই।উত্তেজিত হয়ে অহনা নিজের হাতের স্যালাইলে টান দিয়ে খুলে ফেলে।কেবিনের মধ্যের সব জিনিসপত্র ভাংচুর করতে শুরু করে।কাঁদতে কাঁদতে অহনা মেঝেতে বসে পরে।আবির অহনাকে শান্ত করতে পারে না।যখন অহনা বসে পরে তখন অহনার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে রেখে বলে, আমরা আবার সন্তান নেবো অহনা।প্লিজ এবার একটু শান্ত হও।”
“জলির বাবা-মা এমন অবস্থায় অহনাকে ছাড়তে চাই না।আবিরকে বলে কটা দিন তাদের বাসায় অহনাকে নিয়ে থাকতে।আবিরও রাজি হয়ে যায়। অহনাকে নিয়ে জলিদের বাসায় যায়।”
“অহনা বাড়িতে এসেছে শুনে জলি খুব খুশি হয়।কিন্তু জলির রুমে আজ অহনা একবারও আসে নি।হয়তো ছোট ছোট বেবিগুলোকে দেখলে অহনা খুব ভেঙে পরবে তাই আবির অহনাকে জলির রুমে আসতে দেই নি।”
“জলির অহনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।আজ তাকে বাঁচাতে গিয়ে অহনার এই অবস্থা।কিন্তু জলিকে এখনো কেউ বলে নি অহনার বাচ্চাটা আর নেই।জলি আদিকে বলে অহনার রুমে তাকে একটু নিয়ে যেতে।তাই আদি জলিকে কোলে তুলে অহনার রুমে নিয়ে যায়।সেখানে গিয়ে জলি অহনাকে ডাকে,”
—“অহনা? এই অহনা।পরে ঘুমোস একটু আমার সাথে কথা বল না।”
“অহনা না ঘুরলে জলি অহনাকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় আর দেখে অহনার চোখে পানি।”
—“একি অহনা! তুই কাঁদছিস? এমন সময়ে কাঁদলে বাচ্চাটার উপর সেটার প্রভাব পরবে।আর বড় হয়ে তোর মতোনই কাঁদন রানী হবে।”
“জলি কথাটা বলতেই অহনা শোয়া ছেড়ে উঠে বসে আর জলিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”
—“আমার বাবুটা আর নেই জলি।আমার স্বপ্ন আশা সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।আবির আমাকে অনেকবার বলেছিলো সাবধানে থাকতে যা আমি শুনি নি।আমি পারি নি নিজের সন্তানকে বাঁচাতে।”
“কথাটা শুনে জলি একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর অহনা জলিকে ছেড়ে দিলে জলি আদির মুখের দিকে তাকায়।আর আদিকে বলে বাচ্চাদেরকে এই রুমে নিয়ে আসতে।আদি গিয়ে বাচ্চাদের এই রুমে নিয়ে আসে।তারপর জলি বিছানার উপরে তাদেরকে শুইয়ে দেয়। আর বলে,”
—“একসাথে এতোগুলো বাচ্চা সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব না।আদি বিজনেসের কাজে সবসময় বিজি থাকবে আর আমি কতটা অলস তাতো তুই খুব ভালো করেই জানিস।তাই আমি চাই এদের মধ্যে একজনকে তুই নিয়ে নে।”
“জলির মুখে এমন কথা শুনে আদি রেগে ওঠে। জলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,”
—“পাগল হয়ে গেছিস তুই? কথাটা বলার আগে আমার অনুমতি নিয়েছিস? একটা কথা শুনে রাখ জলি আমার সন্তানদের আমি শুধু আমার পরিচয়ে বড় করবো।দরকার হলে ওদের একএকজনকে দেখাশুনা করার জন্য আমি হাজারটা লোক রাখবো।তবুও আমার সন্তানদের আমি কাউকে দিতে দেবো না।”
“জলি আদিকে বুঝাতে চেস্টা করে,,,
অহনা, আবির ছাড়া তাদের সন্তানরা এই পৃথিবীতে আসতো না।আজ জলির সময় এসেছে তাদের ঋণ শোধ করবান।তাছাড়াও অহনা আজ জলিকে বাঁচাতে গিয়ে তার নিজের সন্তানকে হারিয়েছে। যেখানে জলির তিনটা সন্তান সেখানে অহনা কেন শূন্য কোলে তিলতিল করে কস্ট পেতে থাকবে?”
“সব শুনেও আদি জলির কথায় সম্মতি জানায় না।আদি চাই না তার একটা সন্তানকেও অন্য কাউকে দিতে।আদির শুধু একটাই কথা আমার সন্তান আমি অন্য কাউকে দেবো না।ওরা আমার পরিচয়ে বড় হবে।এই বিষয়টা নিয়ে জলি আর আদির মধ্যে কথা কাটাকাটি হতে থাকে।অহনা চিৎকার দিয়ে দু’জনকে ধমক দিয়ে থামায়।তারপর বলে,”
—“কি শুরু করেছো তোমরা? তোমাদের সন্তান তোমাদেরই থাকুক।আমার চাই না অন্যের সন্তান।আমি নিজে মা হতে চাই।সন্তানের সাথে মায়ের যেই নারীর টানটা থাকে নিজের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে সেই মাতৃতের সুখটা অনুভব করতে চাই।আর জলি যদি আদি রাজিও হতো আমি তোর সন্তানকে নিতাম না।কারণ আমি মা হয়ে নিজের সন্তানকে হারিয়ে বুঝেছি এটা কতোটা যন্ত্রণাদায়ক।আমি বোন হয়ে কিভাবে তোর কোল খালি করতে পারি বল?”
—“কিন্তু অহনা?”
—“কোনো কিন্তু না।উপর অ’লা চাইলে আমার শূন্য কোল ভরে দেবে।শুধু তোরা একটু দোয়া করিস আমার জন্য।আর কিচ্ছু লাগবে না।”
“আবির এতোক্ষণ দরজার কাছে দাড়িয়ে অহনার কথা গুলো শুনেছে।যা শুনে অহনার প্রতি ভালোবাসা আজ অনেকটা বেড়ে গেছে।আবির চোখের পানি মুছে রুমের মধ্যে ঢুকে জলিকে জিজ্ঞাসা করে,”
—“তো জলি তোর ছেলেমেয়েরা আমাদের কি বলে ডাকবে?”
“অহনা বলে,”
—“আমাকে খালামনি আর তোমাকে খালু।”
“আবির,”
—“নাহ! আমাকে মামা আর তোমাকে মামি।”
—“নাহ! আমি আগে যা বলেছি তাই।”
“আদি বলে ওঠে,”
—“এক মিনিট,, ওয়েট, ওয়েট তোমরা এভাবে ঝগড়া করো না। আবিরকে আঙ্কেল আর অহনাকে আন্টি বললে কিন্তু মন্দ হয় না।