Monday, August 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 169



একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৫৭+৫৮

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_57+58
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সমুদ্রের হাত ধরে চৌধুরী ম্যানশন থেকে বেরিয়ে আসে প্রণালী। তার মনে চলছিল ভিন্নরকম চিন্তা ভাবনা। বাইরে এসেই সে সমুদ্রের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপনি নিজের কাজটা পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। আমার জন্য কি সত্যিই আপনি নিজের পরিবার ত্যাগ করতে চান? দেখুন, আমি কিন্তু অসহায় নেই। আমি চাইলেই আমার বাবার কাছে গিয়ে থাকতে পারি। তাই আপনাকে আমায় নিয়ে..”

প্রণালী নিজের পুরো কথা বলার আগেই সমুদ্র তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”তোমার বিয়ে হয়ে গেছে প্রণালী। এখন তোমার দায়িত্ব আর তোমার বাবার নয়, তোমার দায়িত্ব এখন আমার।”

প্রণালী থমকে যায় সমুদ্রের কথা শুনে। সমুদ্র বলতে থাকে,”আমি জানি, তোমার বাবা একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তার সম্পদের অভাব নেই। তুমি চাইলেই তার কাছে গিয়ে থাকতে পারো। সেখানে আমার কাছে কিছুই নেই। আমার মা আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন, হয়তো আমার ব্যাংক একাউন্টও সিল করে দেবেন। আমার বাবা…তারও কোন পুঁজি নেই৷ তাই এখন বলতেই পারো যে, আমি একজন দেউলিয়া। আমি হয়তো তোমায় তোমার বাবার মতো সুখী রাখতে পারব না। তবে আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব যতটুকু পারি করার। তবে তোমার উপর আমার কোন জোর নেই। তুমি চাইলে এখনই নিজের বাবার কাছে ফিরে যেতে পারো আমি তোমায় বাধা দেব না। তবে আমি কখনোই আর আমার বাড়িতে ফিরব না। আর নাতো মেরুদণ্ডহীন পুরুষের মতো শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে ঘরজামাই হবো। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও তুমি কি করবে।”

প্রণালী দ্বিধায় পড়ে যায়। সমুদ্র তার জন্য এত ত্যাগ করল! প্রণালীর তো এখন উচিৎ সমুদ্রের পাশে থাকা। কিন্তু তারা তো সত্যিকার অর্থেই এখন দেউলিয়া। না আছে মাথার উপর ছাদ আর নাতো কোন রোজকার। কি হবে তাদের ভবিষ্যত? প্রণালী চিন্তায় পড়ে যায়। সমুদ্র যেন বুঝতে পারল প্রণালীর ভাবনা। তাই তো মৃদু হেসে বলল,”আমি কোন না কোন ব্যবস্থা ঠিকই করে নেব। তুমি শুধু আমার হাতটা ধরো।”

প্রণালীর কি হলো সে জানে না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে লাগল সে সমুদ্রকে। লোকটার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তার কাছে আর কোন উপায় নেই। প্রণালী তার দুই হাত বাড়িয়ে দিলো সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র প্রণালীর হাত শক্ত করে ধরে বলল,”আজ থেকে শুরু হলো আমাদের নতুন লড়াই। জানি, সামনের পথটা খুব একটা মসৃণ হবে না। তবে তুমি পাশে থাকলে আমি সব রকমের বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে পারব। আমি আশাবাদী পরিস্থিতি বদলাবে। আমাদেরও সুদিন আসবে।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সমুদ্র নিজের এক বন্ধুর সহায়তায় শহর থেকে দূরে মফস্বল এলাকায় একটা রুম ভাড়া নিয়েছে তাও আবার সেই বন্ধুর থেকেই টাকা ধার নিয়ে। কিছু আসবাবপত্র এবং কয়েকদিনের বাজারের টাকা সে নিজের আইফোন বিক্রি করে দিয়ে জোগাড় করেছে। আসবাপত্র বলতে বিছানা আর রান্নার জন্য একটা ম্যাজিক চুলা। এভাবেই একটা ছোট সংসার গড়ে তুলেছে সমুদ্র। প্রণালী সমুদ্রের অসহায় অবস্থা বুঝতে পারছে। সমুদ্র এবং প্রণালী দুজনেই বড়লোক ঘরের আলালের ঘরের দুলাল/দুলালী। জীবনে কখনোই তারা দরিদ্রতার মধ্যে দিয়ে যায়নি, জীবন সবসময় স্বচ্ছলতা ও আভিজাত্যপূর্ণ ছিল। তবে এখন সময় বদলেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়া দুজনের জন্যই কঠিন।

দুপুরে সমুদ্র বেড়িয়েছে চাকরির খোঁজে। প্রণালী তখন সমুদ্রের আনা ডাল, সবজি চালগুলো দেখছিল। রান্নায় সে একেবারেই পটু নয়। তাই কিছুই করতে পারছিল না। প্রণালীর ভীষণ খারাপ লাগছিল তবে নিজের জন্য নয় সমুদ্রের জন্য। তাই সে ভাবল একবার নিজের বাবা রায়ান সাহেবের সাথে কথা বলবে। তিনি নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন। তাহলেই তাদের আর এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে না। তবে সবার আগে সমুদ্রের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে।

ঘামার্ত শরীর নিয়ে সমুদ্র বাইরে থেকে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বাইরে প্রচণ্ড রোদ। এত রোদে থাকার অভ্যাস সমুদ্রের নেই। দিনরাত ২৪ ঘন্টা এসির বাতাসে থেকেছে সে। আর এই বাসায় এসি তো দূর একটা সিলিং ফ্যানও নেই। গরমে সমুদ্রের অবস্থা শোচনীয়। প্রণালী এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো সমুদ্রের কাছে। সমুদ্র পানিটা সম্পূর্ণ খেয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো। প্রণালী কিছুক্ষণ আগে পাশের বাসার ভাড়াটিয়ার থেকে একটা হাতপাখা এনেছিল। সেটা দিয়েই সমুদ্রকে বাতাস করে। সমুদ্র কিছুটা হলেও আরামবোধ করে। প্রণালী সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করে,”আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? এত গরমে থাকার অভ্যাস তো আপনার নেই আর সত্যি বলতে আমারও নেই।”

সমুদ্র একগাল হেসে বলে,”একটু আগে কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু তুমি এত সুন্দর করে বাতাস করছ যে..আর কষ্ট হচ্ছে না।”

প্রণালী নীরব থাকে স্বল্প সময়। তারপর বলে,”আপনি যদি কিছু না মনে করেন, তাহলে আমি বাবার সাথে যোগাযোগ করি? তিনি নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবেন।”

সমুদ্র রেগে যায় কথাটা শুনে। স্পষ্ট বলে দেয়,”আমি এ বিষয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না প্রণালী। আগেও বলেছি আর আবারো বলছি, আমি তোমার বাবার থেকে কোন সাহায্য নিতে পারব না। ”

“কিন্তু কেন সমুদ্র? আপনার সমস্যা তো আপনার মায়ের সাথে, আমার বাবার সাথে তো কোন সমস্যা হয়নি। আর আপনি তো নিজের বন্ধুর থেকে সহায়তা নিয়েছেন তাহলে আমার বাবার থেকে নিতে কি সমস্যা?”

“আমি আমার বন্ধুর থেকে টাকা ধার নিয়েছি। তোমার বাবার থেকে সেটা পারবো না। তাছাড়া তোমার বাবা আমাদের এই অবস্থার কথা জানলে উনি নিশ্চয়ই নিজের আদরের মেয়েকে এখানে এত কষ্টে থাকতে দিতে চাইবেন না। আর আমি তোমাকে আগেও বলেছি, আমি ঘরজামাই হয়ে থাকতে পারবো না। সেটা আমার আত্মসম্মানে আঘাত হানবে। একজন স্ত্রী হিসেবে তোমার কর্তব্য নয় কি আমার আত্মসম্মান বজায় রাখার?”

প্রণালী চুপ হয়ে যায়। সমুদ্রের এই কথার পরে সে আর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। সত্যি তো একজন স্ত্রী হিসেবে তাকে তার স্বামীর আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে হবে। সমুদ্র প্রণালীকে বলে,”তোমাকে তো একটা খুশির খবর দেওয়া হয় নি?”

“কি খবর?”

“আমার একটা চাকরির জোগাড় হয়েছে?”

প্রণালী খুশি হয়ে বলে,”সত্যি?”

“হুম। ১০ হাজার টাকা বেতন। জানি এটা খুব কম। আমাদের বাসায় কাজের লোকের বেতনও এর থেকে বেশি ছিল। তবে আপাতত আমাদের চলে যাবে। তুমি শুধু এভাবেই আমার পাশে থাকো। দেখবে একদিন আমাদের সুদিন আসবে।”

প্রণালী জোরপূর্বক হাসে। সমুদ্র হঠাৎ প্রণালীকে নিজের খুব কাছে টেনে নেয়। অতঃপর দুষ্টু হেসে বলে,”এখানে তো আমাদের ডিস্টার্ব করার মতো কেউ নেই..তো কি বলো আমাদের অসম্পূর্ণ বাসর টা এখানেই সম্পূর্ণ করি?”

প্রণালী লজ্জায় নুইয়ে পড়ে। যদিও সে এখনো মন থেকে এখনো এসবের জন্য প্রস্তুত নয়। তবে তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। লারার মৃত্যুর পর থেকে শান্তকে সে ভীষণ ভাবে ঘৃণা করে, সমুদ্রের সবসময় তার পাশে থাকায় সমুদ্রের প্রতিও ভালো লাগা তৈরি হয়েছে তবে তা ভালোবাসা অব্দি পৌঁছায় নি। কিন্তু স্বামীকে বাঁধা দিতে প্রণালী চায় না। কারণ এতে ফেরেস্তারা লানত দেয়। তাই প্রণালী আজ আর সমুদ্রকে বাঁধা দিলো না। সমুদ্র ধীরে ধীরে প্রণালীকে নিজের মধ্যে মিশিয়ে নিতে লাগল। প্রণালীর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে নিজের শার্ট খুলল, প্রণালীর বুক থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিলো। প্রণালীর গলায় ডুবিয়ে দিলো মুখ। এভাবেই ধীরে ধীরে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ত থাকে। সমুদ্র ও প্রণালী আরো কাছাকাছি আসতে থাকে। তাদের অসম্পূর্ণ বাসর সম্পূর্ণ হতে থাকে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পুষ্পা চৌধুরী বসে আছেন আরাম কেদারায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে সায়মা চৌধুরী অনেকক্ষণ থেকে বকবক করছেন। কিন্তু তিনি তার কোন কথায় কান দিচ্ছেন না। যেন ওনাকে ব্রাত্য করে রেখেছেন। সায়মা চৌধুরী কথায় কথায় বলেন,”কেমন মা তুমি? নিজের সন্তানের থেকে তোমার কাছে নিজের ইগো বড় হয়ে গেল ভাবি? তুমি মা হিসেবে জঘন্য। তোমাকে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না। কালকে ভাইয়াকে শুধু আসতে দাও। তিনি এসে সব ঠিক করবেন।”

“তোমার ভাইয়া কিছু করতে পারবে না। তার কোন ক্ষমতা নেই। আর যদি কিছু করতে চায় তাহলে তাকেও আমি বাড়ি থেকে বের করে দেব। এই বয়সে এসে নিশ্চয়ই তিনি তা চাইবেন না। আর তুমি অনেক বকবক করেছ। এখন যাও এখান থেকে। নাহলে কখন ঘাড়ধাক্কা দেব তার কোন ঠিক নেই।”

“ভাইয়া না আসা পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না।”

“বেশ থাক তাহলে। তোমার ভাইয়া আসার পর নাহয় দুই ভাই বোন একসাথে বেড়িয়ে যেও। তবে একটা কথা জেনে রেখো, যতদিন পর্যন্ত না সমুদ্র নিজে থেকে এসে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর ঐ মেয়েটাকে ছেড়ে দেবে ততক্ষণ ও এই বাড়ি তে স্থান পাবে না। আমি জানি, ও বেশিদিন ঐ মেয়ের সাথে থাকতে পারবে না। আমার ছেলের আত্মমর্যাদাই অন্যরকম, শ্বশুর বাড়িতে ঘরজামাই থাকার ছেলে ও নয়। এক না একদিন ও আমার কাছে ফিরবেই।”

“তুমি যদি সমুদ্রের আত্মমর্যাদা সম্পদ জানো তাহলে এটা জানবে যে, ও ফিরবে না। নিজের স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকবে তবুও না।”

“ফিরতে ওকে হবেই। মায়ের ভালোবাসার কাছে ঐ মেয়ের ভালোবাসা ধোপে টিকবে না।”

“দেখে নিও, প্রণালীরই জয় হবে। তুমি হেরে যাবে ভাবি।”

“আমি হারতে শিখিনি।”

“কিন্তু এই বার হারবে। চরমভাবে হারবে তুমি।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
প্রণালী ভার্সিটি থেকে ফিরলো। অনেক দেরি করেই ফিরলো। ভার্সিটিতে সামনে তার ফাইনাল পরীক্ষার জন্য টাকা জমা দিতে হবে। প্রণালীর ল নিয়ে পড়া টাকে রায়ান সমর্থন না করলেও এতদিন যাবতীয় খরচ সেই দিয়েছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। প্রণালী বিবাহিত, এখন আর বাবার থেকে সাহায্য নেয়া ঠিক দেখায় না। কিন্তু টাকার পরিমাণটা মোটেই কম নয়। প্রণালী এমনিতেই একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে। তাই অনেক খরচা। প্রণালী চায় না রায়ানের সাহায্য নিয়ে সমুদ্রকে ছোট করতে। তাছাড়া সমুদ্রের যা আত্মাভিমানী সে রাজিও হবে না। তাই এখন প্রণালীকে বড় চিন্তার মধ্যে পড়তে হয়েছে। কি করবে এখন সে? এসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় হঠাৎ তার নজর যায় পাশেই একটি শপিং কমপ্লেক্সে। হতবাক হয়েই সেদিকে তাকিয়ে থাকে। প্রণালী দেখে সমুদ্র শপিং কমপ্লেক্সে কিছু মানুষকে ড্রেস দেখাচ্ছে। প্রণালী ছুটে যায় সেদিকে। প্রণালীকে দেখে সমুদ্র অবাক হয়ে বলে,”তুমি! এখানে কি করছ?”

প্রণালী বলে,”আপনি এখানে সেলস ম্যানের কাজ নিয়েছেন সমুদ্র?”

সমুদ্র হতাশ সুরে বলে,”তুমি বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে কথা হবে।”

প্রণালী আর কথা না বাড়িয়ে ফিরে চলে। তার মন একদম খারাপ হয়ে গেছে। সমুদ্র আজ শুধুমাত্র তার জন্য এত সমস্যায় পড়ে গেছে। এত বড়লোক পরিবারের ছেলে কিনা শেষপর্যন্ত সেলস ম্যানের কাজ করছে! প্রণালী আর কিছু ভাবতে পারে না। ভীষণ কান্না পায় তার। বাসায় ফিরে সে আর কিছু খায় ওনা। না খেয়ে চুপচাপ বসে থাকে। অপেক্ষা করতে থাকে সমুদ্রের আসার।

সন্ধ্যার কিছু আগে সমুদ্র ফিরে আসে বাসায়। তার হাতে ছিল দুটো প্যাকেট। বাসায় এসে সে প্যাকেট দুটো প্রণালীর হাতে দিয়ে বলে,”তুমি তো আর রান্না করতে পারো না। তাই আমি বাইরে থেকে খাবার আনলাম। তবে এভাবে কিন্তু বেশিদিন চলা যাবে না। তুমি রান্নাবান্না শিখে নাও। কেমন?”

প্রণালী আজ আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। সমুদ্র প্রণালীকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”কাঁদছ কেন পাগলী মেয়ে? কি হয়েছে? আমি সেলস ম্যানের কাজ করছি দেখে কি তোমার খারাপ লাগছে? কি করবো বলো….জানি আমার বিদেশের ডিগ্রী আছে কিন্তু এই দেশে চাকরি পাওয়া তো এত সহজ না। আমি কত যায়গায় ঘুরেছি,কত জনের দ্বারে দ্বারে গেছি চাকরির জন্য কিন্তু পাইনি। সবাই এক্সপেরিয়েন্স চায়। হয়তো কিছুদিন অপেক্ষা করলে পেয়ে যাব কিন্তু ততদিন তো আমাদের খেয়ে বাঁচতে হবে। টাকা ছাড়া যে বাঁচা সম্ভব নয়। তাই আমি..”

“সব আমার জন্য হয়েছে। আমার জন্য আপনি এত কষ্টে আছেন। কেন আপনি আমার প্রেমে পড়লেন সমুদ্র? আমার প্রেম আপনাকে কি দিল? শুধুই কান্না। আমার প্রেম শুধুই আপনার দূর্ভাগ্যের কারণ। সব কেড়ে নিয়েছে আপনার থেকে।”

“হু, কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। কিন্তু তার বিনিময়ে আমি যা পেয়েছি সেটাও কম না। তোমার প্রেম আমায় শুধু কাঁদায় নি হাসিয়েও সে। তোমাকে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি। আমার জীবনে কখনোই সেরকম কোন উদ্দ্যেশ্য ছিল না। মমের ইচ্ছা ছিল, আমায় তার কোম্পানির দায়িত্ব দেবেন। আমিও আলাদা করে আর কিছু ভাবি নি। তবে এখন আমার একটা ইচ্ছা আছে। তোমাকে নিয়ে ছোট্ট একটা সংসার সাজাবো। আমাদের ঘর আলো করে রাজপুত্র-রাজকন্যারা আসবে। আমার এই ইচ্ছা পূরণের জন্য একটু কষ্ট তো করতে হবে। সেটা আমি করে নেব। শুধু তুমি আমার পাশে থাকো। থাকবে তো?”

প্রণালী নিজের চোখের জল মুছে বলে,”পারব।”

সমুদ্র প্রণালীর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে বলে,”আমায় একটু বাতাস করো তো৷ গরম লাগছে খুব।”

প্রণালী সমুদ্রকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে। এরপর আসে খাওয়া দাওয়ার পালা। প্রণালী দুটো থালা আনে। সেখানে খাবার বাড়ে। ভাত, ডাল আর একটু আলু ভাজি। সমুদ্র হালকা হেসে বলে,”হাতে খুব একটা টাকা ছিল না। তাই বেশি কিছুর ব্যবস্থা করতে পারি নি। তুমি আপাতত এগুলো দিয়েই ম্যানেজ করে নাও। এগুলো খেয়ে নাও। পরে নাহয়…”

“আমি এগুলো দিয়েই খেতে পারব। আপনাকে এত চিন্তা করতে হবে না।”

“তুমি তো সবই পারো। এখানেও বেশ ভালোই মানিয়ে নিচ্ছ। আমার অসুবিধা হচ্ছে। জানো, আমি না এগুলা একদম খেতে পারিনা। একটু খাইয়ে দেবে, আমার বিশ্বাস তুমি খাইয়ে দিলে আমি খেতে পারব।”

প্রণালী মৃদু হেসে সমুদ্রকে খাইয়ে দিতে থাকে। সমুদ্র খেতে থাকে আয়েশ করে। এই সাধারণ জীবন যাপনও এখন তার কাছে অসাধারণ মনে হচ্ছে। প্রণালীকে পেয়ে যেন সে জীবনে সব সুখ পেয়ে গেছে। যেই সুখের কোন তুলনাই চল না অন্য কিছুর সাথে।

প্রণালী ভাত খাওয়ানো শেষ করার পর সমুদ্র তাকে বলে,”একটা গান শুনবে?”

“জ্বি, বলুন।”

❝যদি বারে বারে একই সুরে প্রেম তোমায় কাঁদায়
তবে প্রেমিকা কোথায় আর প্রেমই বা কোথায়?

যদি দিশেহারা ইশারাতে প্রেমই ডেকে যায়
তবে ইশারা কোথায় আর আশারা কোথায়?❞

to be continue…..

একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৫৫+৫৬

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_55(ধামাকা)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

“যেই ভয়টা পেয়েছিলাম সেটাই হয়েছে টায়রা। ঐ মেয়েটা ছলাকলা করে আমার বাবাই এর মাথা খেয়েছে। এবার কি হবে?”

টায়রা মনযোগ দিয়ে শুনল পুষ্পা চৌধুরীর কথা। সেও সমুদ্রর পরিবর্তিত ব্যবহার খেয়াল করেছে। তবে সে পুষ্পা চৌধুরীকে ভরসা দিয়ে বলে,”আপনি এমন কেন বলছেন আন্টি? আপনি পুষ্পা..এত সহজে ঝুকলে তো চলবে না। আপনার বাবাই আর আপনার মধ্যে যে এসেছে তাকে সরিয়ে দিন।”

“সরিয়ে দেব?”

“হু, দিন। আঙ্কেল তো এই সময় নেই। এটাই তো সুবর্ণ সুযোগ আন্টি। সমুদ্র আর যাই বলুক, আপনার আর প্রণালীর মধ্যে যেকোন একজনকে বেছে নিতে হলে ও আপনাকেই বেছে নেবে।”

পুষ্পা চৌধুরী যেন হারানো ভরসা ফিরে পায়। তিনি বলেন,”ঠিক বলেছ তুমি। আমি এবার ঐ প্রণালী নামের পথের কাটাকে যে ভাবেই হোক না কেন আমার পথ থেকে সরিয়ে দেব। তুমি আমার সাথ দেবে তো?”

“আমি সাথ না দিলে কে সাথ দেবে আপনাকে? আমি তো আপনার পাশেই আছি, আন্টি। ঐ প্রণালীকে এবার আমি সরিয়ে দেব সমুদ্রর জীবন থেকে। সমুদ্র শুধু আমার হবে।”

~~~~~~~
সমুদ্র গোসল করে একটা তোয়ালে গায়ে পেচিয়ে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। প্রণালীও আচমকা তখন রুমে চলে এলো। সমুদ্রকে এই অবস্থায় দেখে দ্রুত সে নিজের চোখ ফিরিয়ে নিলো। সমুদ্রর মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। সে স্বাভাবিক ভাবেই ড্রেস চেঞ্জ করতে লাগল। প্রণালী পিছনে ফিরে ছিল। সমুদ্র ড্রেস পড়ে নিয়ে বলল,”এখন তাকাতে পারো আমার দিকে।”

প্রণালী তাকায় সমুদ্রর দিকে। সমুদ্র লাজুক হেসে বলে,”তুমি তো আমার স্ত্রী, পরস্ত্রী তো নও। তাহলে আমাকে এভাবে দেখে লজ্জা পেলে কেন?”

প্রণালী আমতা আমতা করতে লাগল। সমুদ্র প্রণালীর একদম কাছে এসে বললো,”ওহ বুঝেছি। এখনো আমাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এটাই কারণ না? ”

বলেই এগোতে লাগল প্রণালীর দিক। প্রণালী পিছাতে পিছাতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। সমুদ্র প্রণালীকে বাগে পায় যেন। তার হাতে হাত দিয়ে ঠোঁটে ডুবিয়ে দেয় ঠোঁট। প্রণালীর হৃদস্পন্দন আচমকা খুব বেড়ে যায়। সমুদ্রর থেকে এমন কিছু একদম আশা করে নি। ধীরে ধীরে সমুদ্রের স্পর্শ আরো গভীর হতে থাকে। সমুদ্র প্রণালীকে কোলে তুলে নেয়। তাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। প্রণালীর পেট থেকে শাড়ির আঁচলটা সরাতে যাবে এমন সময় দরজায় নক করার শব্দ হয়। সমুদ্র বিরক্ত হয় ভীষণ। এই সময় ডিস্টার্ব করলে কোন পুরুষ স্বাভাবিক থাকে? সে নিজেকে সামলে শার্টটা পড়ে নেয়। প্রণালীও নিজেকে ঠিক করে।

সমুদ্র খিটখিটে মেজাজ নিয়ে দরজা খুলে টায়রাকে দেখে ভীষণ রেগে যায়। বলে,”এই মেয়ে তুমি এখানে কি করছ? এটা কোন টাইমিং হলো?”

“মানে?”

সমুদ্র মুখ সামলায়। রেগে কি বলতে যাচ্ছিল।
“আমি ঘুমাচ্ছিলাম। তুমি ডিস্টার্ব করলা কেন টায়রা?”

টায়রা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,”তুমি বদলে গেছ সমুদ্র। আগে তো তুমি এমন ছিলে না। তাহলে এখন এমন করছ কেন?”

সমুদ্রর তো ইচ্ছা করছিল টায়রার গলা টিপে তাকে মেরে ফেলার। কিন্তু নিজের ইচ্ছেটা দমিয়ে বলল,”আমার খুব ঘুম পেয়েছে। প্লিজ আমাকে ঘুমাতে দেও। তোমার এসব ন্যাকামি দেখার টাইম আমার নেই। গো টু দা হেল।”

সমুদ্র দরজা লাগাতে গেলে টায়রা আটকে দিয়ে বলে,”কে কোথায় যাবে সেটা তো একটু পরেই দেখা যাবে। তুমি ঐ প্রণালীকে নিয়ে নিচে এসো জলদি। তোমার মম ডাকছে।”

বলেই চলে যায় টায়রা। সমুদ্র অসহায় চোখে প্রণালীর দিকে তাকিয়ে বলে,”সরি, রোম্যান্সটা ঠিক মতো করতে পারলাম না। চলো একটু নিচে যাই। মমের কথাটা শুনে আসি। তারপর মন, শরীর সব ভড়ে রোম্যান্স করব।”

প্রণালীর ফর্সা গাল লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কানও গরম হয়ে যায় এমন কথা শুনে। সে দ্রুত পায়ে চলে যেতে নিতেই সমুদ্র প্রণালীকে টেনে গালে চুমু খেয়ে বলে,”তুমি অনেক সুন্দরী প্রণালী।”

প্রণালীর কি হচ্ছে সে জানেনা। অন্যসময় হলে সে কোন পুরুষকে নিজের এত পাশে আসতে দিতো না। কিন্তু সমুদ্রকে আটকানোর সাধ্যি তার নেই। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে তার সাথে? লোকটা তার স্বামী বলে? নাকি মায়া জন্মেছে লোকটার প্রতি?

প্রণালী বোঝার চেষ্টা করল। এরমধ্যে আবার সমুদ্র তাকে নিয়ে গেল পুষ্পা চৌধুরীর সামনে। পুষ্পা চৌধুরী দুজনকে একসাথে দেখে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যান। তবে নিজেকে সামলান। তিনি তো পুষ্পা, এত সহজে ঝুঁকবেন না। তাই প্রণালীর উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠেন,”এই মেয়ে আমার ছেলের থেকে দূরে সরো।”

প্রণালী সরতে চাইলে সমুদ্র তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,”তুমি যেন কি বলার জন্য ডেকেছিলে মম। জলদি বলো তো। তোমার কথা শোনার জন্য জরুরি কাজ ফেলে এসেছি।”

পুষ্পা চৌধুরী বলেন,”এই মেয়েটার সাথে তোমার সম্পর্ক আমি আর মেনে নিতে পারছি না বাবাই। তুমি আমার ছেলে..বিয়ে করলে তুমি আমার পছন্দের মেয়েকেই করবে। কিন্তু তোমার বাবা মাঝখান থেকে এমন একটা কাজ করলেন যে..যাইহোক ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ তো আছে এখন। এই দেখো বাবাই।”

সমুদ্র অবাক হয়ে জানতে চায়,”কি এটা?”

“এটা একটা পেপার। এখানে লেখা আছে তুমি আর প্রণালী একে অপরের সাথে মানিয়ে নিতে পারছ না। ৬ মাস আগে তো ডিভোর্স হবে না তবে এখানে সই করলে সেপারেশনের ব্যবস্থা করা যাবে। তাহলে এই মেয়েটা এই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে। ৬ মাস পর নাহয় ডিভোর্স হবে কিন্তু ততদিন এই মেয়েকে আমি সহ্য করতে পারবো না। এই মেয়ে সই করে দাও।”

প্রণালী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। পুষ্পা চৌধুরী বলে,”তুমি যদি একজন ভালো মায়ের মেয়ে হও তাহলে এখনই এই পেপারে সই করবা।”

প্রণালীর কানে বাজতে থাকে কথাটা। মা তার দূর্বলতা। মায়ের সম্পর্কে এমন কথা মানবে না সে। তাই দ্রুত পেপারটা নিয়ে সই করতে উদ্যত হলো। সমুদ্র সহসা প্রণালীর হাত থেকে পেপারটা কেড়ে নিলো। প্রণালী, পুষ্পা অবাক! সমুদ্র পেপারটা ছিড়ে ফেলল। পুষ্পা চৌধুরী বলে উঠলেন,”এটা কি করলে বাবাই?”

সমুদ্র বলল,”আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, মম। তোমার সাথে অভদ্র‍তা করতে চাই না। কিন্তু প্রণালী আমার স্ত্রী, ওকে আমি সজ্ঞানে বিয়ে করেছি এবং আমি ওর সাথেই সংসার করতে চাই।”

“বাবাই..এ কি বলছ তুমি? এই মেয়ের সাথে তুমি কেন সংসার করবে?”

“কারণ আমি ভালোবাসি প্রণালীকে।”

প্রণালী অবাক হয়ে তাকালো সমুদ্রর দিকে। পু্ষ্পা চৌধুরী বললেন,”এই মেয়ে কি তোমায় কোনভাবে ব্রেনওয়াশ করেছে বাবাই? তুমি এমন করছ কেন? তুমি তো কখনো আমার অবাধ্য হওনা। এই মেয়ে ছলাকলা করে ঠিক তোমায় বশ করে নিলো।”

“আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মম, তোমার জন্য আমার মনে সবসময় বিশাল স্থান থাকবে। তবে সেই মনের কোঠায় একটু স্থান প্রণালীকে দিলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।”

“আমি এই মেয়েকে আমার ছেলের বউ হিসেবে মানি না, মানি না, মানি না।”(চেচিয়ে)

“কিন্তু আমি মেনে নিয়েছি মম। ভালো হবে যদি তুমিও মেনে নাও। কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি ওর সাথেই আমি সংসার করব।”

“তাহলে টায়রার কি হবে বাবাই? মেয়েটা তোমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে!”

“তুমি ওকে বোঝাও, আমার ওর প্রতি কোন আগ্রহ নেই। একটা ভালো ছেলে দেখে যেন বিয়ে করে নেয়। আমি আসছি।”

বলেই সমুদ্র প্রণালীকে নিয়ে যায়। পুষ্পা চৌধুরী শুধু ফুঁসতে থাকেন। এমন কিছু তিনি আশা করেন নি। তার বাবাই কি তাহলে তার হাতের বাইরে চলে গেলো!

to be continue…..

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_56(ধামাকা)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

পুষ্পা চৌধুরী নিজের রুমে বসে সমুদ্রের বলা কথা গুলো ভাবছিলেন আর ক্রোধে ফুঁসছিলেন। তার সব রাগ গিয়ে জমা হচ্ছিল প্রণালীর উপর। কারণ তার মনে হচ্ছিল প্রণালী সমুদ্রকে ভুলভাল বুঝিয়ে নিজের বশে করে নিয়েছে। তার এই অবস্থার মাঝেই তার সামনে উপস্থিত হয় টায়রা। তার হাতে ছিল একটা ট্রলি ব্যাগ। সে পুষ্পা চৌধুরীর সামনে এসে বলে,”আন্টি আমি যাচ্ছি।”

পুষ্পা চৌধুরী অবাক গলায় বলেন,”যাচ্ছ মানে? কোথায় যাচ্ছ তুমি?”

টায়রা মলিন কন্ঠে বলে,”আমি ফেলনা নই আন্টি। সমুদ্র আমাকে বলেছে আমার উপর ওর কোন আগ্রহ নেই। আমার মনে হয় না, ও আমাকে আর বিয়ে করতে চায়। তাছাড়া এখন মমও সব জেনে গেছে। মম চায় না, আমি কোন বিবাহিত ছেলেকে বিয়ে করি।”

পুষ্পা চৌধুরী অস্থির হয়ে বলেন,”তোমার মমকে আমি বোঝাবো। এটা..এটা কোন বিয়েই নয়।”

“আপনি তো চেনেন আমার মমকে। মন যা বলেছেন তার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য আমার নেই। আমি এখন আসছি৷ ভালো থাকবেন।”

বলেই টায়রা বেরিয়ে যায়। পুষ্পা চৌধুরী হাজার চেষ্টা করেও টায়রাকে আটকাতে পারেন না। এতে করে তার মাথায় রাগ আরো চেপে বসে প্রণালীর প্রতি। তিনি চিৎকার করে বলেন,”এই প্রণালী মেয়েটা এসে আমার এতদিনের করা সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিলো। প্রথমে আমার বাবাইকে আমার থেকে কেড়ে নিলো আর এখন টায়রাকেও বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য করল। এই প্রণালীকে তো আমি ছাড়ব না। এতদিন অনেক ছাড় দিয়েছি আর নয়। এবার আমি নিজের আসল রূপ দেখাব ওকে!”

~~~~~~~~~~~
সমুদ্র ও প্রণালী দুজনেই রুমের মাঝে রয়েছে। সমুদ্র প্রণালীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু প্রণালী অন্য ভাবনায় মত্ত ছিলো। লারার মৃত্যুটা সে এখনো মেনে নিতে পারে নি। এদিকে শান্তর কথাও ভাবাচ্ছে তাকে। ছেলেটা তো সুবিধার নয়। না জানি এখন কোথায় ওঁত পেতে বসে আছে সুযোগের সন্ধানে। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই আবার তার বা সমুদ্রের জীবনে সমস্যা তৈরির চেষ্টা করবে। এদিকে প্রণালী এখনো নিজের অনুভূতি নিয়ে নিশ্চিত নয়৷ সমুদ্রর ব্যবহারের আমুল পরিবর্তন তাকে ভাবাচ্ছে। সমুদ্রের প্রতি ইতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। সমুদ্র তার স্বামী জন্যই সেদিন যখন তার পাশে আসতে চাচ্ছিল তখন বাঁধা দেয়নি। কারণ এতে স্বামীর হক নষ্ট হয়। কিন্তু প্রণালীর জন্য এখনো সমুদ্রের প্রতি কোন গভীর অনুভূতি তৈরি হয়নি।

আবার সামনেই প্রণালীর ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম। অনেকদিন পড়াশোনায় মনযোগ দেয়নি সে। তাই ভাবল এখন থেকে জোরদমে পড়াশোনা শুরু করবে। প্রণালী এসব ভাবনা শেষ করে সমুদ্রের দিকে তাকায়৷ সমুদ্র তার দিকেই তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। প্রণালী বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে কথা ঘোরানোর জন্য বলে,”আচ্ছা, আপনার ড্যাড কোথায়? এসেছি থেকে ওনাকে দেখছি না! সায়মা আন্টিও তো নেই।”

“ড্যাড বিজনেস মিটিং-এ বাইরে গেছেন। দুদিন পর ফিরবে। আর ফুপি তার শ্বশুর বাড়িতে ফিরে গেছেন। তবে চিন্তা করো না, আমি ফুপিকে বলেছি আজ এসে তোমার সাথে দেখা করে যাবে। আমি তো জানি, তোমার এখানে নিজেকে বড্ড একা একা লাগে। মমও তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করে না।”

প্রণালী নীরব থাকে। এই নীরবতার মাঝেই সমুদ্র অপলক দেখতে থাকে প্রণালীকে।

★★★★★★★★★★
প্রণালী ও সায়মা চৌধুরী দুজনে এখন রান্নাঘরে অবস্থান করছে। কিছুক্ষণ আগেই সায়মা চৌধুরী এসেছেন। সায়মা চৌধুরী কিছুক্ষণ গল্প করলেন প্রণালীর সাথে। কথায় কথায় জানতে পারলেন যে, প্রণালী সেরকম রান্নাবান্নায় পটু নয় তবে রান্না শিখতে চায়। এজন্যই মূলত তিনি প্রণালীকে রান্নাঘরে নিয়ে এসেছেন রান্না শেখাতে। আপাতত তিনি মাংস রান্না করা শেখাচ্ছেন।

মুরগীর মাংসে একটু লবণ দিয়ে বলেন,”এই দেখ, এভাবে পরিমাণমতো লবণ দিতে হবে। রান্নায় লবণের পরিমাণ ঠিক না হলে কিন্তু স্বাদ ভালো হয়না। আর লবণ বেশি হলে তো খাবার মুখেই দেওয়া যায়না।”

রান্না শিখতে শিখতেই আবেগপ্রবণ হয়ে যায় প্রণালী। তার চোখের কোণে জলে ভিজে যায়। সায়মা চৌধুরী সেটা নোটিশ করে বলেন,”তোমার চোখে জল কেন প্রণালী?”

প্রণালী হাতের উলটো পিঠে চোখের জল মুছে বলে,”আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। মা বেঁচে থাকলে হয়তো তিনিই নিজের হাতে আমায় রান্না শেখাতেন।”

সায়মা চৌধুরী প্রণালীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”তুমি কোন চিন্তা করো না। আমি মাঝে মাঝেই এ বাড়িতে এসে তোমায় রান্না শেখাবো।”

তখনই পুষ্পা চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন,”রান্না শেখানোর এত শখ হলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শেখাও। আমার বাড়িতে আর এসব নাটক চলবে না।”

“ভাবি!”

পুষ্পা চৌধুরী কাউকে পরোয়া করলেন না। প্রণালীর সামনে এসে তার হাত শক্ত করে ধরে বললেন,”যবে থেকে তুমি এই বাড়িতে এসেছ তবে দেখে আমার সাজানো গোছানো সংসারটা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়ার চেষ্টা করেছ। আমার বাবাইয়ের মাথা খেয়েছ, রান্নাঘরেও নিজের দাপট দেখাচ্ছ, ক’দিন পর তো আমার সম্পত্তির দিকে হাত বাড়াবে!”

প্রণালী হতবাক হয়ে যায় পুষ্পা চৌধুরীর কথা শুনে। প্রতিবাদী কন্ঠে বলে,”আপনি ভুল ভাবছেন। আমার এমন কোন চিন্তা নেই।”

“চুপ করো মেয়ে। আমায় ঠিক ভুলের পার্থক্য বোঝাতে এসো না। অনেক সহ্য করেছি আর না। তোমাকে আমি আর এক সেকেন্ডও আমার বাড়িতে দেখতে চাই না। এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।”

বলেই তিনি প্রণালীকে রান্নাঘর থেকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকেন। সায়মা চৌধুরী তাকে আটকানোর চেষ্টা করেন কিন্তু পারেন না। পুষ্পা চৌধুরী প্রণালীকে বাড়ির গেটের বাইরে বের করে দিয়ে বলেন,”দূর হয়ে যাও এখান থেকে!”

এমন সময় সমুদ্র হঠাৎ পেছনে থেকে বলে ওঠে,”মম, এটা কি করছ তুমি?”

পুষ্পা চৌধুরী তেজ দেখিয়ে বলেন,”একদম ঠিক করেছি আমি। বাবাই, তুমি এই মেয়ের হয়ে আর কোন ফোপরদালালি করতে আসবে না। আমার বাড়িতে এই মেয়ের আর স্থান হবে না। এই বাড়িটা আমার নামে। এখানে কে থাকবে না থাকবে সেই সিদ্ধান্তও আমার।”

“প্রণালী আমার স্ত্রী। ও এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না।”

বলিষ্ঠ কন্ঠে বলে ওঠে সমুদ্র। পুষ্পা চৌধুরীও দমে যাওয়ার পাত্রী নন। তিনিও বলেন,”আমি যা বলেছি তাই হবে। এই বাড়ি আমার। তাই এখানে আমার কথাই শেষ কথা।”

সমুদ্রর মাথায় এবার জেদ চেপে যায়। সে বলে,”যদি তুমি আমার স্ত্রীকে এই বাড়িতে থাকতে না দাও, তাহলে আমিও এই বাড়িতে থাকব না, মম।”

নিজের ছেলের এত বড় ধৃষ্টতা দেখে চমকে ওঠেন পুষ্পা চৌধুরী। অবাক হয়ে বলেন,”এটা তুমি কি বলছ বাবাই? এই মেয়ের জন্য তুমি বাড়ি ছাড়বে? নিজের মায়ের থেকেও আজ এই মেয়ে তোমার কাছে বড় হয়ে গেল!”

“ও আমার স্ত্রী মম। ওকে আমি বিয়ে করেছি যখন ওর সব দায়িত্ব আমার। যেখানে ওর কোন সম্মান নেই সেখানে আমি কিভাবে থাকি?”

পুষ্পা চৌধুরী ক্রোধে অন্ধ হয়ে যান। হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে বলেন,”বেশ, তাহলে তুমিও বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে। আমি ধরে নেব, আমার ছেলে মারা গেছে!”

“মম!”

“ভাবি তুমি এসব কি বলছ!”
সায়মা চৌধুরীর অস্থির কন্ঠ।

সমুদ্র যখন হতবিহ্বল হয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন পুষ্পা চৌধুরী নির্দয়ের মতো বলেন,”এই বাড়ি থেকে বের হলে এটা ভুলে যাবে যে, আমি তোমার মম। শুধু তাই নয়, একবার এই বাড়ির বাইরে পা রাখলে এই বাড়ির দরজা তোমার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।”

সমুদ্র নিজের মায়ের এমন ব্যবহারে স্তম্ভিত। যেই মা ছোটবেলা থেকে এত ভালোবেসেছে সে কিনা এমন কথা বলছে! সমুদ্রের মাথায় জেদ চেপে বসল। সে প্রণালীর হাত শক্ত করে ধরে বলল,”চলো প্রণালী। আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকব না। সবার সাথে আমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করলাম।”

প্রণালী বলে,”যা বলছেন ভেবে বলছেন তো? এরজন্য পস্তাবেন না?”

“কখনোই না।”

বলেই সে প্রণালীর হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হতে উদ্যত হয়। পুষ্পা চৌধুরী আজ অহংকারে আর রাগে একদম অন্ধ। তিনিও আটকাচ্ছেন না। সায়মা চৌধুরী এসে কাঁদছেন তার সামনে। কিন্তু তবুও তার মন গলছে না। নিজের একমাত্র সন্তানকে তিনি চোখের সামনে বের হয়ে যেতে দিলেন!

to be continue…..

একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৫৩+৫৪

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_53
#ইয়াসমিন_খন্দকার

কেবিন নং ৩১৩ থেকে উদ্ধার হলো একটা মেয়ের ঝুলন্ত ম**রদেহ। প্রণালী ছুটে এসে বসলো মেয়েটির পাশে। মেয়েটির চোখে এখনো বিন্দু বিন্দু জলকণা জমে আছে। যা দেখে বোঝাই যাচ্ছে মৃত্যুর আগে মেয়েটা কাঁদছিল। এক বিশাল দুঃখের সমুদ্র যেন লুকিয়ে আছে এই চোখ দুটোর মাঝে।

শান্ত এলো প্রণালী আসার ঠিক কিছুক্ষণ পড়ে। এসে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,”লারা…”

লারার মুখে একটা বিদ্রুপের হাসি লেপ্টে ছিল৷ হয়তো মৃত্যুর পূর্বে এই হাসিটা সে হেসেছিল শান্তর উদ্দ্যেশ্যে। মুক্তি চেয়েছিল তো সে লারার কাছে। মেয়েটা দিয়ে গেল মুক্তি। পূরণ করল নিজের ভালোবাসার মানুষটার ইচ্ছা। জীবনে ১২ টা বছর ধরে যেই মানুষটাকে ভালোবাসছে, মৃত্যুর আগে তার ইচ্ছাটা পূরণ করে প্রমাণ দিয়ে গেল নিজের ভালোবাসার। শান্ত নিশ্চুপ, হতবাক নয়নে তাকিয়ে রইল লারার মৃতদেহের দিকে। প্রণালী লারার পাশে বসে কেঁদে চলেছে। কোথাও একটা গিয়ে এই মেয়েটার কষ্ট সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। গতকাল মেয়েটা তাকে মা*রতে গিয়েও মারেনি। আকড়ে ধরেছিল তার হাত। আর আজ নিজেকেই শেষ করছিল। এটাই কি তবে প্রেম? যেই প্রেম হাসাতে পারে, আবার কাঁদাতে পারে..এমনকি কারো জীবন কেড়েও নিতে পারে। প্রণালীর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল লারার জন্য। এরমধ্যে শুনতে পেল কিছু মানুষের কানাঘুষা। তারা বলছিল,”এরা তো পরকীয়া করেছে..এজন্যই তো বেচারি মেয়েটা আত্ম** করল। নিজের স্বামীর পরকীয়া কোন মেয়ে মেনে নিতে পারে।”

সবার আঙুল ছিল শান্ত ও প্রণালীর দিকে। প্রণালী হতবাক! পরিস্থিতি এভাবে তাকে অপরাধী বানিয়ে দিলো! প্রণালী একেবারে ভেঙে করল। এতসব মানুষের মধ্যে তাকে সমর্থন করার, তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য কি কেউ নেই? প্রণালীর বুক চিড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। এরমধ্যে হঠাৎ সে খেয়াল করল কেউ তার কাধে হাত রাখল। প্রণালী চোখের জল মুছে পিছন ফিরে তাকায়। সমুদ্র দুটো হাত বাড়িয়ে রেখেছে প্রণালীর দিকে। প্রণালী ফিরে তাকাতেই বলে,”উঠে এসো তুমি।”

প্রণালী মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত। পাগলের মতো ছটফট করছিল মেয়েটা। সমুদ্র তার দিকে হাত বাড়াতেই সে বলতে থাকে,”আমি..আমি পর** করিনি,আমার জন্য লারা মরেনি। আমি কিছু করিনি..আমি নির্দোষ। কেউ আমায় বিশ্বাস করছে না..কেউ না..”

“আমি তোমায় বিশ্বাস করি প্রণালী। তুমি উঠে এসো।”

প্রণালী যেন হঠাৎ করে একজন বিশ্বাসযোগ্য মানুষ খুঁজে পায়। সমুদ্রর বাহু ধরে উঠে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে অবির‍ত। সমুদ্র প্রণালীর চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,”যে যাই বলুক আমি জানি তুমি শান্তর সাথে..এটা অসম্ভব। তোমার চোখে ওর জন্য যে ঘৃণা আমি দেখেছি তা মিথ্যা নয়। তোমাকে সবাই দোষ দিলেও আমি তোমাকে সাপোর্ট করব।”

প্রণালীর হঠাৎ কি হলো সে জানে না। আচমকা সে জড়িয়ে ধরল সমুদ্রকে। সমুদ্রও নিস্তেজ থাকল না। প্রণালীর মাথায় ভরসায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,”সব ঠিক হয়ে যাবে।”

~~~~
পুলিশ এলো ঘটনাস্থলে। তারা এসে আশেপাশের প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের সাথে দেখা করল। শুনল তাদের কথা। প্রণালীকে রুমে এনে জোর করে ঘুমাতে বলেছে সমুদ্র। প্রণালীও শুয়ে পড়েছে বিছানায়। তবে তার ঘুম আসছিল না। লারার কথা মনে আসছিল বারবার। আর ভেসে আসছিল মানুষের বলা কথাগুলো। তার মন থেকে কেউ যেন বারবার তাকে বলছে,”তুই অপরাধী প্রণালী..তুই পাপী। তোর জন্য লারা মরেছে…”

প্রণালী শান্তি পাচ্ছিল না কিছুতেই। তবে একসময় সে ঘুমের জগতে পা রাখল। সমুদ্র চুপচাপ তার পাশেই বসে রইল।

পুলিশ শান্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করল কিছুক্ষণ। একজন অফিসার শান্তকে বলল,”আপনার স্ত্রীর সাথে কি কোন বিষয় নিয়ে আপনার ঝামেলা চলছিল যার কারণে তিনি এমন একটা স্টেপ নিলেন?”

শান্ত স্বাভাবিক ভাবে বলে,”না।”

পুলিশ অফিসার শান্তকে পরখ করে নেয় ভালো ভাবে। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছিল না তার স্ত্রীবিয়োগ ঘটেছে। কেমন যেন নির্লিপ্ত লাগছে। চোখমুখে দুঃখের লেশমাত্র নেই। কিছুক্ষণ পরেই তিনি পুনরায় শুধান,”আপনাদের বিয়ের কয়দিন হলো?”

“২ সপ্তাহ।”

“ও, নিউলি ম্যারেড কাপল। হানিমুনে এসেছিলেন বুঝি?”

“জ্বি।”

“আপনার স্ত্রীকে কি আপনি ভালোবাসতেন না?”

“এটা আবার কেমন প্রশ্ন?”

“কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর কথায় জানতে পারলাম যেই সময় আপনার স্ত্রীর ঝুলন্ত বডি উদ্ধার করা হলো সেই সময় নাকি আপনাকে অন্য এক মহিলার সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায়…”

“এই বিষয় নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাইছি না। আপনারা এখানে লারার মৃত্যুর তদন্ত করতে এসেছেন সেটাই করুন..আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তদন্ত করার দরকার নেই।”

“কিন্তু যদি আপনার ব্যক্তিগত জীবনই আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ হয় তাহলে তো আমাদের তদন্ত করতেই হবে।”

“মানে?”

“আমার জোহরীর চোখ মিস্টার শান্ত। এই পেশায় তো কমদিন পার করিনি। তাই অপরাধের গতিবিধি সম্পর্কে বেশ ভালোই ধারণা আছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা সুইসাই* নয় এটা মাডার। বাকিটা তো তদন্তের পর বেরিয়ে আসবে। তবে আপনাকে এখন আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে?”

“থানা..থানায় কেন?”

“বারে..আপনার স্ত্রী মারা গেছে তাও কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। স্বাভাবিক কথায় যাকে বলে অপমৃত্যু। আপনাকে কিছু ফর্মালিটি তো মেইনটেইন করতেই হবে। তাছাড়া আমাদের আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে আপনাকে।”

শান্ত একটু বিচলিত হলো। ভয়ও পেল কিছুটা। ঘামল বেশ। চতুর পুলিশ অফিসার শান্তর দিকে নিজের রুমাল বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”ঘামটা মুছে নিন। সামনে আরো ঘামতে হবে।”

শেষ কথাটা বিড়বিড় করে বললেন যা শান্তর কানে গেল না।

শান্ত রুমালটা নিয়ে ঘাম মুছল। তারপর রুমালটা আবার ফেরত দিলো।

~~~~~~~~
সমুদ্র প্রণালীর মাথার পাশে বসে ছিল। এমন সময় তাদের রুমে কেউ কড়া নাড়ল। সমুদ্র গিয়ে দরজাটা খুলল। দেখতে পেল একজন পুলিশ অফিসারকে। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,”মিসেস প্রণালী জাহান কি এই রুমে আছেন?”

“জ্বি, উনি আমার স্ত্রী।”

“আচ্ছা, ওনাকে একটু ডেকে দিন তো।”

“কেন?”

“কিছু জরুরি কথা বলার আছে ওনার সাথে। মিসেস লারার মৃত্যুর কেস সম্মন্ধে।”

“আমার স্ত্রী এসব ব্যাপারে কিছু জানে না। তাই ওনাকে এসব ব্যাপারে জড়াবেন না।”

“আমার তো আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি নিজেও এই ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন। আপনার স্ত্রীকে অন্য এক পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থাও পাওয়া গেল আবার তখনই সেই পুরুষের স্ত্রীর ঝুলন্ত বডি পাওয়া গেল। এরপরেও আপনি বলছেন আপনার স্ত্রীর এই কেইসের সাথে কোন সম্পর্ক নেই? শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছেন মিস্টার?”

সমুদ্র ভীষণ রেগে গেলো। কিন্তু নিজের রাগ প্রকাশ করতে পারল না। এরমধ্যে প্রণালীর ঘুম ভেঙে গেল শব্দে। সে উঠে এসে দাঁড়ালো সমুদ্রর পাশে। পুলিশ অফিসার বলে উঠল,”আপনিই তাহলে প্রণালী জাহান?”

প্রণালী বলল,”জ্বি।”

সমুদ্র প্রণালীকে ধমকে বলল,”তুমি এখানে এসেছ কেন? তোমায় না আমি রেস্ট নিতে বলেছিলাম যাও ঘুমাও।”

পুলিশ অফিসার সন্দেহের দৃষ্টিতে প্রণালীকে দেখছিল। তিনি বলেন,”আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। আপনাকে মিসেস লারার কেইসের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে।”

প্রণালী বলে,”আমি ওনার ব্যাপারে বেশি কিছু জানি না। যতটুকু জানি তা এখনই এখানেই বলতে পারি।”

“আপনি কতটুকু জানেন বা জানেন না, সেটা বের করা তো আমাদের দায়িত্ব। তাই বলছি আর কথা না বাড়িয়ে থানায় চলুন। নাহলে আপনাকে এরেস্ট করে নিয়ে যেতে বাধ্য হবো।”

প্রণালী ভয় পেয়ে যায়। এমনিতেই তার মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত ছিল। সে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল। পুলিশ অফিসার বলল,”বুঝেছি আপনি ভালো কথায় শুনবেন না। আপনাকে বোধহয় থানায় তুলে নিয়ে যেতে হবে।”

সমুদ্র গর্জে উঠে বলে,”সাহস থাকলে আমার স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে দেখান। আমি কিন্তু কাপুরুষ নই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখব না মোটেই।”

প্রণালী অবাক হয়ে দেখল সমুদ্রকে। লোকটা বারবার তাকে অবাক করে দিচ্ছে। বারবার কানে বাজছে তার বলা,”আমার স্ত্রী” শব্দটা।

to be continue…..

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_54
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সমুদ্র পুলিশের সাথে চূড়ান্ত বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়লো। সে কিছুতেই প্রণালীকে তাদের সাথে যেতে দিবে না। এদিকে পুলিশও নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে তৎপর। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রণালী বলে ওঠে,”ইন্সপেক্টর আমি আপনাদের সাথে যেতে রাজি আছি।”

সমুদ্র প্রতিবাদী কন্ঠে বলে,”না, তুমি ওদের সাথে যাবে না। তুমি চেনো না এই সব পুলিশ অফিসারদের। এরা নিশ্চয়ই ঐ শান্তর থেকে ঘুষ খেয়েছে। আমি তো শিওর,ঐ শান্তই নিজের স্ত্রীকে মে*রেছে৷ তারপর এসব নাটক করে সব দোষ তোমার উপর চাপাতে চাইছে।”

প্রণালী বলে,”এতো ভরসা করেন আমায়?”

বলেই অবাক পানে চেয়ে থাকে প্রণালীর দিকে। প্রণালী মুচকি হাসে। বলে,”আমার উপর একটু ভরসা রাখুন। আমি ভরসাটা আইনের উপর রাখছি। আমি নিজেও তো এই আইন নিয়েই পড়ি। দেখবেন যা হবে একদম ঠিক হবে। আমি জানি, আমি কোন অন্যায় করিনি।”

এই বলে সে পা বাড়ায়। সমুদ্র বলে,”আমিও যাব পুলিশ স্টেশনে। তোমাকে না নিয়ে আমি ফিরব না।”

প্রণালী পদে পদে আজ যেন অবাক হচ্ছে। সমুদ্রর এত কেয়ার তার প্রতি! এটাও হবার ছিল জীবনে। এমনটা প্রণালী হয়তো স্বপ্নেও ভাবে নি। কিন্তু বাস্তবতা যে স্বপ্নকেও হার মানায়।

~~~~~
“আপনি তার মানে লারার মৃত্যুর ব্যাপারে তেমন কিছু জানেন না তাই তো?”

“না।”

প্রণালীর স্পষ্ট উত্তর। পুলিশ ইন্সপেক্টর কৌতুহলী দৃষ্টিতে প্রণালীকে দেখতে থাকেন। কিছু সময় ভাবনা চিন্তা করে বলেন,”গতকাল রাতে আপনার স্বামী থানায় আপনার নামে মিসিং ডাইরি করেছিল। এম আই রাইট?”

প্রণালী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।

“কোথায় গিয়েছিলেন কাল আপনি?”

“ঘুরতে বেরিয়ে একা পথ হারিয়ে ফেললেন ব্যাপারটা হাস্যকর না?”

“হাস্যকর মানে?”

“হানিমুনে এসে আপনি একা একা ঘুরছিলেন কেন?”

“প্রশ্নটা ব্যক্তিগত পর্যায় চলে যাচ্ছে এটা ঠিক নয়।”

“আচ্ছা, তাহলে একটা অব্যক্তিগত কথাই বলি। গতকাল রাতে মিসেস লারা আপনাকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যায়। কি তাই তো?”

প্রণালী অবাক হয়ে বলে,”আপনারা কিভাবে জানলেন?”

“মিসেস লারার ঘর থেকে আমরা তার ডায়েরি উদ্ধার করেছি। যেখানে তিনি নিজের জীবনের সব কথা লিখে রেখেছেন গতকাল অব্দি। আর শেষ কথা গুলো আপনাকে নিয়েই। উনি আপনাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। কারণ ওনার মতে আপনি ওনার এবং ওনার স্বামীর মধ্যে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।”

“এসব বলে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন অফিসার?”

“নিজেকে বাঁচাতে আপনি আবার..”

“কখনোই না। আমি এমন কিছু করিনি। তাছাড়া লারার ক্ষতি করার কথা আমি ভাববো না। কারণ ও আমায় মা*রতে চাইলেও আখেরে আমার জীবন বাঁচিয়েছিল গতকাল। আর আমার শান্তর সাথে যা কিছু ছিল সব অতীতে। এখন আমার মনে শান্তর জন্য কোন অনুভূতি নেই। নেই বললে ভুল হবে আছে। তবে সেটা শুধুই ঘৃণা।”

পুলিশ অফিসার বলেন,”আপনার মুখের কথায় সব মানতে পারছি না। যদি আপনার সাথে সত্যি মিস্টার শান্তর কোন সম্পর্ক না থাকতো তাহলে আপনাদের একই ঘরে কিভাবে পাওয়া গেলো তাও ঘনিষ্ঠ অবস্থায়!”

“ইন্সপেক্টর! আপনি কিন্তু খারাপ দিকে ইঙ্গিত করছেন। আগে প্রমান জোগাড় করুন আমার বিরুদ্ধে তারপর কথা বলবেন।”

“২-৩ দিনের মধ্যেই মিসেস লারার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট চলে আসবে। তারপর সব সত্য জানা যাবে। ততদিন পর্যন্ত আপনার উপর আমাদের নজর থাকবে। ভুলেও শহর ত্যাগের চিন্তা করবেন না। আপনি আর মিস্টার শান্ত কিন্তু আমাদের প্রধান সাসপেক্ট।”

“আমি তাহলে এখন আসতে পারি?”

“জ্বি, আসুন।”

~~~~~~
প্রণালীর জন্য থানার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সমুদ্র। প্রণালীকে বাইরে আসতে দেখেই দৌড়ে তার সামনে গিয়ে বলে,”কি বলল পুলিশ?”

“কেইস সংক্রান্ত কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।”

“ওরা তোমায় হেনস্তা করে নি কোন ভাবে? যদি করে থাকে তো আমায় বলো। আমি ওদের..”

“ওনারা জাস্ট কেইস সম্পর্কে কিছু জরুরি প্রশ্ন করেছেন। আমায় হিউমিলিয়েট করেন নি। আপনি প্লিজ এত হাইপার হবেন না। চলুন এখান থেকে।”

সমুদ্র প্রণালীর কথা বিশ্বাস করে তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে যায়। এমন সময় শান্তর সাথে দেখা হয়ে যায়। তাকেও পুলিশ তলব করেছে। তাই সে এসেছে। শান্তকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সে প্রণালীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এইসব ঝামেলা মিটে যেতে দাও প্রণালী। তারপর আমি তোমাকে নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনব।”

সমুদ্র রেগে শান্তর কলার ধরে বলে,”ওর স্বামী এখনো মরে যায় নি। ওর দিকে নজর দেওয়ার চেষ্টাও করবি না।”

শান্ত বাকা হেসে বলে,”মরেনি, মরতে কতক্ষণ।”

বলেই গা ঝাড়া দিয়ে চলে যায়। প্রণালী সমুদ্রর পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে,”কি বলে গেলো শান্ত? ওকে আমার বিশ্বাস নেই। লারাকে হয়তো ঐ মে*রেছে। এখন যদি আপনারও কিছু করে দেয়!”

“তুমি চিন্তা করো না। ও আমার কিছু করতে পারবে না।”

প্রণালী তবুও যেন শান্তি পায়না। সে বলে,”সব হয়েছে আমার জন্য। আমি আপনার জীবনের সাথে জড়িয়ে আপনার জীবনে হুমকির তৈরি করেছি। আমি আপনার জীবন থেকে চলে যাবো। তাহলেই আপনার সব বিপদ দূর হবে। এখান থেকে ফিরেই আমি…”

সমুদ্র হঠাৎ করে প্রণালীর হাত শক্ত করে আঁচড়ে ধরে। প্রণালী ব্যাথায় কুকিয়ে উঠতেই বলে,”আর একবার যদি আমায় ছাড়ার কথা বলো তাহলে কিন্তু এর ফল ভালো হবে না। একবার যখন আমার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে তখন মৃত্যুর আগে অব্দি তোমায় ছাড়ব না।”

প্রণালী অবাক পানে চেয়ে থাকে সমুদ্রের পানে। সমুদ্রের চোখের মধ্যে যেন হারিয়ে যায়। প্রণালী দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই হয়তোবা ঐ চোখের মায়ায় ডুবে যেত সে!

~~~~~~~~
সময় কে’টে দিলো তিনদিন। এই তিনদিন অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে সমুদ্র-প্রণালীকে। পুলিশ যখন তখন তলব করেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷ সব সয়ে যেতে হয়েছে মুখ বুজে। তবে আজ অবশেষে তারা মুক্তির হাওয়া পেল। লারার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এসেছে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী লারার সাথে মৃত্যুর আগে কোন জোরজবরদস্তির প্রমাণ পাওয়া যায় নি। বা এমন কোন জিনিস যা থেকে মনে হয় এটা হ**ত্যা। তাই ডাক্তার ঘোষণা করে দিয়েছে লারার মৃত্যুটা সু**সাইডই ছিল।

এরপরই এই কেইসের মুলতবি হলো। শান্ত-প্রণালীর উপর থেকে সন্দেহের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া হলো।

আজ প্রণালী ও সমুদ্র সিলেট থেকে আবার ঢাকা ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। এখানে থাকার মতো আর মানসিকতা নেই। তাই সময় হতেই বেরিয়ে পড়লো। ঢাকায় ফিরে চৌধুরী ম্যানশনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। বাড়িতে এখনো কেইসের ব্যাপারে জানাজানি হয়নি। তবে প্রণালীর ভয় পু্ষ্পা চৌধুরীকে নিয়ে। না জানি তিনি আজ কোন নাটক করবেন। তবে প্রণালীর এখন কেন জানি সমুদ্রকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। মনে হয় সেই তাকে প্রোটেক্ট করবে। সমুদ্র দরজায় কলিং বেল বাজাতেই পুষ্পা চৌধুরী এসে দরজা খুলে দেন। যেন তিনি অনেকদিন থেকে এই অপেক্ষাতেই ছিলেন। সমুদ্রকে দেখেই তিনি জড়িয়ে ধরে বলেন,”তুমি ফিরেছ বাবাই! আমি জানি এই মেয়েটাই ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেছিল। নাহলে আমার বাবাই তার মমকে না বলে কোথাও যাবে না।”

“কেউ আমায় ভুলায় নি মম। আমি নিজের ইচ্ছাতেই গিয়েছিলাম। আমি অনেক টায়ার্ড। প্রণালী রুমে চলো।”

বলেই সে পুষ্পা চৌধুরীর সামনে নিয়ে প্রণালীর হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যায়। পুষ্পা চৌধুরী অবাক চেয়ে রয়। তার বাবাইয়ের এ কি রূপ!

to be continue…..

একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৫১+৫২

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_51
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। একটুর জন্য তার শ্বাস প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। চোখের সামনে যেন নিজের মৃত্যু স্পষ্ট দেখতে পারছিল সে। কিন্তু লারা তাকে ধাক্কা দিয়েই তার হাত ধরে টেনে আবার তাকে বাঁচিয়েছে। অতঃপর নিজেই মাটিতে বসে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। প্রণালী দম নিয়ে লারার কাঁধে হাত রাখে। লারা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণালীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমি এটা কি করতে যাচ্ছিলাম? নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার প্রণালী। এত খারাপ কিভাবে হয়ে গেলাম আমি? আমি তো এমন ছিলাম না। আমি খু**ন..”

বলেই অনবরত কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে যায় মেয়েটার৷ প্রণালী লারাকে শান্তনা দিয়ে বলে,”তোমার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি লারা। কারণ তুমি বর্তমানে যেই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ সেটা আমিও একসময় কাটিয়েছি। শান্ত আমার অনুভূতি নিয়েও ঠিক এইভাবে খেলেছিল।”

লারা বলে,”জানো আমি সেই ১২ বছর বয়স থেকে শান্তকে পছন্দ করি। আমার শৈশব, কৈশোর সব ওকে ভালোবেসেই পার করেছি। কিন্তু ও আমার ভালোবাসার কোন মূল্য দেয় নি। শুধু আমায় ব্যবহার করেছে নিজের স্বার্থে।”

“আমি সবটাই বুঝতে পারছি। শান্ত একটা জঘন্য ছেলে। ও শুধু তোমার নয় আমার অনুভূতি নিয়েও খেলেছে৷ তবে দেখো ও একদিন সবকিছুর শাস্তি পাবে। অন্যকে কষ্ট দিয়ে কখনো নিজে সুখী হওয়া যায়না। তুমি নিজেকে সামলাও লারা। আমি জানি, মুখে বলা যতটা সহজ বাস্তবটা এতটা সহজ না। আমি নিজেও এখনও অব্দি নিজেকে সামলে উঠতে পারিনি। তবুও আমি চেষ্টা করছি, তোমাকেও একই পরামর্শ দিব।”

বলে প্রণালী লারাকে শান্তনা দিতে থাকে। অতঃপর লারাকে নিয়ে আসতে থাকে। মাঝপথে শান্তর সাথে তার দেখা হয়ে যায়। প্রণালী ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় শান্তর দিকে। শান্ত লারাকে বলে,”তুমি প্রণালীর সাথে কি করছ? নিশ্চয়ই আমার বিরুদ্ধে ওর মনটা বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলে!”

প্রণালী বলে ওঠে,”লারার এমন কিছু করার প্রয়োজন নেই। কারণ এমনিতেই আমার মনে তোমার জন্য যথেষ্ট বিষ আছে। আর তুমি আমার পেছনে নিজের সময় নষ্ট না করে নিজের স্ত্রীর খেয়াল রাখো। যাকে বিয়ে করেছ তাকে পর্যাপ্ত সম্মানটুকু দাও।”

শান্ত আচমকা প্রণালীর হাত ধরে বলে,”আমি জানি, আমি যা করেছি তাতে তোমার আমার উপর এই রাগ দেখানো স্বাভাবিক। তোমার যায়গায় আমি থাকলেও আমি একই রকম ভাবে রাগ দেখাতাম। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো প্রণালী আমি সবটা বাধ্য হয়ে করেছিলাম। আমার মা আমাকে কসম দিয়েছিল তোমার উপর প্রতিশোধ না দিলে উনি নিজেকে শেষ করে দেবেন। তাই আমি বাধ্য হয়েই…তোমাকে কষ্ট দেওয়ার পর আমি একটা রাতও শান্তি পাইনি। লারাকে তো সহ্য করছি শুধু আমার মায়ের জন্য। নাহলে আমার মনে তো শুধু আর শুধু…”

“ব্যস, অনেক হয়েছে শান্ত। তোমার এসব ফাজুল বাতে বন্ধ করো। আমার এসব শোনার কোন মুড নেই। আর কোন সিনক্রিয়েট নয়। আমার হাতটা ছেড়ে নিজের স্ত্রীর হাতটা ধরো। যাকে বিয়ে করেছ তার দায়িত্ব নিতে শেখ।”

শান্ত কাতর সুরে বলে,”আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে প্রণালী। তুমি আমার জীবনটা আবার নতুন করে গুছিয়ে দাও।”

প্রণালী রেগে শান্তকে ঠাটিয়ে একটা চ*ড় মা*রে। অতঃপর লারার হাতটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,”এই মেয়েটাকে নাও, এই মেয়েটার সাথে গুছিয়ে নাও নিজের জীবন। আর কোনদিন যেন তোমাকে আমি আমার ত্রীসীমানায় না দেখি। নাহলে তোমার এমন অবস্থা করব যা তুমি ভাবতে পারছ না।”

বলেই প্রণালী হনহন করে চলে যেতে থাকে। সমুদ্র প্রণালীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে,”তুমি যাই বলো, আমি তোমারই হবো। শুধু আর শুধু তোমারই। ঐ সমুদ্র চৌধুরীর কাছ থেকে আমি তোমায় ছিনিয়ে নেবোই দেখে নিও তুমি।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
প্রণালী রিসোর্টে ফিরে আসে। সমুদ্র প্রণালীর চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিল। গোটা এলাকা চষে বেড়িয়েছে, পুলিশ ফাইলসও করেছে। তারপর ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসেছিল রিসোর্টে প্রণালী ফিরেছে কিনা দেখার জন্য।

এসেই প্রণালীকে দেখে সে যেন ধরে প্রাণ ফিরে পায়। প্রণালীর সামনে গিয়ে বলে,”কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি প্রণালী? এভাবে আমাকে না বলে কেন গেছিলে? জানো আমার কত চিন্তা হচ্ছিল।”

প্রণালীর মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল। সমুদ্রের কথায় সে তেতে উঠে বলে,”কেন? আমাকে কি আপনার পারমিশন নিয়ে সব যায়গায় যেতে হবে?”

“এভাবে বলছ কেন? আমার চিন্তা হচ্ছিল তোমার জন্য।”

“কে বলেছে আপনাকে আমার জন্য চিন্তা করতে? আমি বলেছি? বলিনি তো! তাহলে আল্লাহর দোহাই লাগে আমার জন্য এসব চিন্তা-ফিন্তার নাটক করতে হবে না। আমি কাউকে পরোয়া করি না।”

“নাটক? তোমার এসব কিছু নাটক মনে হচ্ছিল? জানো তোমাকে কোথায় কোথায় খুঁজেছি আমি? পুলিশে ডাইরি পর্যন্ত করেছি।”

“কে করতে বলেছিল এসব আপনাকে? আমি বাঁচি মরি তাতে আপনার কি? আপনাকে আমার এত চিন্তা করতে হবে না।”

সমুদ্র অস্থির হয়ে দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে প্রণালীকে শক্ত করে ধরে বলে,”তুমি স্ত্রী হও আমার। আর আমি তোমার জন্য চিন্তা করব না?”

প্রণালী হতবাক হয়ে সমুদ্রর দিকে তাকায়। সমুদ্র দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে প্রণালীর থেকে দূরে সরে এসে বলে,”ড্যাড, তোমাকে আমার সাথে পাঠিয়েছে। তোমার কিছু হলে তো উনি আমাকেই প্রশ্ন করবেন৷ তখন আমি কি উত্তর দেব? এই ভেবেই…”

প্রণালী বলে ওঠে,”বললা তো আপনাকে আমার জন্য এত চিন্তা করতে হবে না। আপনি বলেন তো আমি এখনই বন্ড পেপারে সই করে দেই? লিখে দেই যে, আমার কোন কিছু হয়ে গেলে তার দায়ভার আপনার উপর বর্তাবে না। তাহলে তো আপনি শান্তি পাবেন।”

সমুদ্র নির্লিপ্ত চোখে তাকায় প্রণালীর দিকে। মেয়েটার কি তাকে একটুও পরোয়া করে না? সে কি সমুদ্রের চোখ দেখেও বুঝতে পারছে না যে ওর চিন্তায় চিন্তায় মরে যাচ্ছিস সে? সমুদ্রর হঠাৎ করেই নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়। প্রণালী বালিশ নিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। সমুদ্র প্রণালীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তার মধ্যে থেকে চিন্তা দূর হয়না। হঠাৎ করে মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেছল এই চিন্তা তাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়ায়। এমনিতেই শান্তকে নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকছে। প্রণালীকে দেখেও কেমন জানি বিধ্বস্ত লাগছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই সমুদ্রর চোখ লেগে যায়।

মাঝরাতে হঠাৎ কারো গোঙানির শব্দে সমুদ্রের ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসে সে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেখতে পায় প্রণালী কেমন গুটিয়ে আছে। আর গোঙাচ্ছে। প্রণালীর পড়নে একটা সাদা সেলোয়াড়। সেই সেলোয়াড়ের ওড়না দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে৷ দেখে মনে হচ্ছে খুব ঠাণ্ডা লেগেছে। সমুদ্র প্রণালীর কাছে গিয়ে তার হাত স্পর্শ করেই আতকে ওঠে। হাত অস্বাভাবিক গরম। কপাল স্পর্শ করেই বুঝতে পারে মেয়েটা অসুস্থ। এরমধ্যে প্রণালীরও ঘুম ভাঙে। সমুদ্রকে নিজের এত কাছে দেখে এই অসুস্থ অবস্থাতেও সে বেশ জোরে চিতকার করে বলে,”দূরে চলে যান আমার থেকে।”

সমুদ্র যায় না। ঠায় বসে থাকে। ড্রয়ার থেকে ওষুধ বের করে এনে প্রণালীকে খাইয়ে দিতে চায়। প্রণালী সমুদ্রর হাত থেকে ওষুধটা কেড়ে নিয়ে বলে,”আমি একাই খেয়ে নিতে পারব।”

ওষুধটা খাওয়ার পর সমুদ্র প্রণালীর দিকে পানি বাড়িয়ে দেয়। প্রণালী পানিটা খেয়ে নিয়ে বলে,”ইউ ক্যান গো নাও।”

সমুদ্র তবুও যায়না। বলে,”তুমি ঘুমাও। আমি এখানেই আছি।”

“আপনাকে আর নতুন করে কোন নাটক করতে হবে না। আমার কোন দরকার হলে আমি নিজেই সেটা মিটিয়ে নেব।”

“তুমি অসুস্থ।”

“আপনি এখানে বসে থাকলে তো আমি আর সুস্থ হয়ে যাব না। প্লিজ যান এখান থেকে আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিন।”

সমুদ্র প্রণালীকে বলে,”তুমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো। এখানে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে।”

“আমি এখানেই ঠিক আছি।”

“বেশি জেদ করো না নাহলে তুলে নিয়ে যাব।”

প্রণালী অনেক কষ্টে উঠে বসে। সমুদ্র বলে,”চলো আমি তোমায় বিছানা অব্দি নিয়ে যাচ্ছি।”

“তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি একাই পারব।”

এই বলে উঠতে গিয়ে সে পড়ে যেতে নেয়। এরপর সমুদ্রই তাকে ধরে ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজে সোফায় এসে শুয়ে পড়ে।

to be continue…..

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_52
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালীর আজকের সকালটা শুরু হলো বেশ অন্যরকম ভাবে। জ্বরের প্রকোপ কমার বদলে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে তার। একটু আগেই সমুদ্র মেপে দেখল ১০২° ছাড়িয়েছে। তবে প্রণালীকে যেটা অবাক করছে সেটা হলো সমুদ্রের পরিবর্তিত ব্যবহার। মিস্টার সমুদ্র চৌধুরী, অহংকারে যার মাটিতে পা পড়ে না, মায়ের কথা ছাড়া এক পা নড়ে না সেই সমুদ্র প্রণালীর সেবা করছে। এটা প্রণালীর কাছে একটু বিদঘুটে লাগছিল। সকাল থেকে সমুদ্র প্রণালীর মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। প্রণালী কিছু বলতেও পারছে না। কারণ এই সেবার ভীষণ প্রয়োজন। তবে সমুদ্রের প্রতি অঅন্যরকম কোন অনুভূতি তার নেই৷ ছেলেটার প্রতি বিরূপ ধারণা তার প্রবল। তবে এই মুহুর্তে ছেলেটার উপর সে ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে একথা সত্যি।

সমুদ্র প্রণালীর মাথায় জলপট্টি দিয়ে বলে,”আমি তোমার খেয়াল রাখছি এসব কিছু নিয়ে আবার বেশি কিছু ভেবে নিও না। আমি জাস্ট মানবিকতার খাতিরেই..”

“আমি কিছু ভাবছি না।”–প্রণালীর স্পষ্ট জবাব। যার পরে সমুদ্রর আর কিছুই বলার থাকে না। কিন্তু এই কথাটা যেন তাকে স্বস্তি দিলো না। বরঞ্চ তার বুকে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বের হচ্ছিল। সমুদ্রর যেন খুব করে শুনতে ইচ্ছা করছিল যে প্রণালী এবিষয় গুলোকে স্পেশাল ভাবছে, ইমপ্রেস হচ্ছে তার প্রতি। কিন্তু প্রণালী তো প্রণালীই। তার মন বরফ নয় পাথর। তাই এই মনকে গলিয়ে পানি করা যাবে না। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙতে হবে৷ যা মোটেই কোন সহজ কাজ নয়।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~`
দুপুর নাগাদ প্রণালী কিছুটা সুস্থ অনুভব করল। অতঃপর বেরিয়ে পড়লো একটু বাইরে। ঘরে সবসময় থাকতে খুব দমবন্ধ লাগে। সমুদ্র প্রণালীর জন্য দুপুরের খাবার আনতে পাশেই একটু রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। প্রণালীকে রুমেই বাইরে আসতে দেখে ভীষণ রাগ হয় তার। বিড়বিড় করে বলে,”মেয়েটার কি কোন সেন্স নেই? এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে৷ এবার ওকে শিক্ষা দিতেই হবে।”

এই ভাবনা থেকে সমুদ্র প্রণালীর কাছে গেল। পিছন থেকে তার নাম ধরে ডাক দিলো। প্রণালী ফিরে তাকাতেই বললো,”তুই এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাইরে বেড়িয়েছ কেন? তোমার এখন রেস্টের প্রয়োজন।”

প্রণালীর কাছে কেন জানি সমুদ্রের এই আচরণগুলো ভীষণ অযাচিত লাগে। সোজা বাংলায় বলতে গেলে তার মনে হয় সমুদ্র তার ব্যাপারে অনাধিকার চর্চা করছে যেটা তার মোটেই ভালো লাগছে না। এইজন্য প্রণালী বেশ রেগেমেগেই বলে,”আপনাকে আমার সো কলড স্বামী হয়ে আমার খেয়াল রাখতে হবে না। আ’ম টোটালি ফাইন৷ নিজেকে নিজেই সামলাতে পারি আমি। খুব খুশি হবো যদি আপনি আমার ব্যাপারে খুব একটা ইন্টারফেয়ার না করেন।”

প্রণালীর কথায় ভীষণ রেগে যায় সমুদ্র৷ সে তো ভালোর জন্যই বলেছিল কিন্তু এই মেয়ে তো নিজের জেদ নিতেই চলে। সে-ও বা কম কিসে? তাই সমুদ্রও বলে দিল,”ওকে, ফাইন। আমি আর তোমার ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করব না। তোমার যা খুশি তুমি করো।”

বলেই রিসোর্টের দিকে পা বাড়ালো৷ যাওয়ার সময় প্রণালীর জন্য আনা খাবারটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। আর বলতে লাগল,”এইজন্যই মেয়েদের বেশি পাত্তা দিতে নেই। মাথায় উঠে বসে৷ যা খুশি করুক, আমার কি।”

প্রণালীও নিজের মতো হাঁটতে থাকে। নিজের ব্যবহার নিয়ে কখনো সে ভাবে না। ছোট থেকেই বড্ড বেপরোয়া। মায়ের মৃত্যুর পর বাবার অগাধ ভালোবাসা আর স্বাধীনতা তাকে এমন করে দিয়েছে। হুটহাট রেগে যায় আর তখন নিজের উপরেই নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কাকে কি বলে দেয় তার কোন খেয়াল থাকে না। এর আগে শান্তর ব্যাপারটা নিয়ে নিজের বাবাকেও তো কম কথা শোনায় নি। এখন সমুদ্রের সাথেও একই আচরণ শুরু করেছে!

~~~~~~~~~~
শান্ত বাথরুম থেকে বের হতেই লারা তার দিকে তোয়ালে বাড়িয়ে দেয়। শান্ত লারার দিকে একবার তাকিয়ে তোয়ালেটা হাতে নিয়ে বলে,”এসব করে আমার মন জিতবে পারবে না। তাই বলছি চেষ্টাও করো না।”

লারার গলায় কান্না আটকে আছে। সে বলে ওঠে,”আমার সাথে এমজ কেন করছ শান্ত? আমি তো ভালোবাসি তোমায়। বিয়ের পর থেকে তো আমাদের সম্পর্ক ভালোই চলছিল। বাসর রাতেও তুমি কত সুন্দর আমায় কাছে টেনে নিলে। আর এখানে এসে প্রণালীকে দেখেই আবার এভাবে বদলে গেলে!”

শান্ত তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে তোয়ালেটা লারার দিকে ছু*ড়ে বলে,”হ্যাঁ, বদলে গেলাম। কারণ তোমার কাছে আমি সেই শান্তিটা খুঁজে পাইনা যেটা আমি প্রণালীর মধ্যে খুঁজে পেতাম। এই ক’দিন আমি তোমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। নিজের মনের কাছে হেরে গেছি। তাই বলছি আমার জীবন থেকে নিজ থেকে দূরে সরে যাও।”

“পারবো না আমি। তাছাড়া প্রণালীও তো এখন অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে। তুমি ওর আশায় বসে থাকছ কেন?”

“প্রণালী বিয়ে করুক, তিন বাচ্চার মা হোক আই ডোন্ট কেয়ার। আমার শুধু ওকেই লাগবে। তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি শুধু আমাকে মুক্তি দাও।”

এই কথা বলেই শান্ত রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে লারার কানে বাজতে থাকে শান্তর বলা কথাটা। শান্ত মুক্তি চাইলো তার কাছে! ভালোবেসে চাইলে তো লারা নিজের জীবনও দিয়ে দিতে পারবে শান্তর জন্য। আর সে মুক্তি চাইছে!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
প্রণালী ঘুরতে ঘুরতে বিরক্ত হয়ে আবার কটেজেই ফিরে এলো। কটেজে নিজের রুমে প্রবেশ করে দেখল সমুদ্র সেখানে নেই। ব্যাপারটা প্রণালীকে এতোটা ভাবালো না৷ ভীষণ গরম লাগছিল। প্রণালী ভাবল গোসল করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। গোসল করতে বাথরুমে ঢুকল। গোসল শেষে একটা তোয়ালে মাথায় পেচিয়ে নিল। অতঃপর একটা কমলা রঙের সালোয়ার কামিজ পড়ে নিলো। সে এসবেই কমফোরকেউ নক করল। প্রণালী ভাবল সমুদ্র এসেছে বোধহয়। তাই দরজাটা গিয়ে খুলে দিলো। দরজা খুলতেই সে হতবাক হয়ে গেল কারণ তার সামনে সমুদ্র নয়, দাঁড়িয়ে আছে শান্ত। প্রণালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই শান্ত রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে নিলো৷ প্রণালী শান্তর এই কাণ্ডে হতবিহ্বল!

প্রণালী বলে উঠল,”কি করতে চাইছ তুমি? কেন এসেছ এখানে? বের হয়ে যাও এখান থেকে। কোন সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করো না।”

শান্ত বলল,”আমি কোন সিনক্রিয়েট করতে চাই না। আমার শুধু তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা বলা দরকার। তাই আমি বাধ্য হয়ে…”

“তুমি যাও বলছি..”

শান্ত শোনে না। প্রণালীর হাতটা ধরে তাকে কাছে টানার চেষ্টা করে। প্রণালী হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলে,”ছাড়ো আমায় নাহলে কিন্তু আমি চিৎকার করো।”

“করো চিৎকার। এতে কিন্তু তোমারই সম্মানহানি হবে, আমার কিছুই হবে না।”

প্রণালী সরে আসার চেষ্টা করল। পারল না। শান্ত আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করল। প্রণালী আর উপায় পেল না। নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য বুঝি এবার চিৎকার করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এরমধ্যেই প্রণালী টের পেলো বাইরে থেকে কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে। সমুদ্র চিৎকার করে পুরো রিসোর্টটা মাথায় তুলে দিচ্ছে। প্রণালী দরজার দিকে এগোতে যাবে তখনই শান্ত তার মুখ চেপে ধরে। এদিকে সমুদ্রর চিৎকারে আশেপাশের কয়েকজন লোক ছুটে আসে। তারা সবাই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে। সমুদ্র রেগে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েই শান্ত ও প্রণালীকে এত কাছাকাছি দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আশেপাশের সবাইও নানা কাহিনি বানানো শুরু করে। কারণ ইতিমধ্যেই অনেকে সমুদ্র-প্রণালী ও শান্ত-লারার সম্পর্কে জানে যে ওরা স্বামী-স্ত্রী। তাই অনেকেই বলতে থাকে নানা কুরুচিকর কথা। আর প্রণালী নিস্তেজ হয়ে তাকিয়ে আছে সমুদ্রর দিকে। চোখের ভাষায় বোঝাতে চাইছে সে কিছু করে নি। এরমধ্যেই একজন হঠাৎ ছুটে এসে বলে,”আপনারা সবাই এখানে ভীড় করছেন। ওদিকে ৩১৩ নং কেবিনে একটা মেয়ের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে।”

শান্ত আতংকিত হয়ে বলে ওঠে,”ঐ কেবিন তো আমার আর লারার! লারা!!”

to be continue…..

একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_48(হানিমুন স্পেশাল)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সিলেটের ব্ল্যাক মুন রিসোর্টের বাগানের দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে দুজন যুগল। এক অতীব সুন্দরী রমণী তার প্রিয় পুরুষের কাধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। তারা আর কেউ না, শান্ত-লারা। বিয়ের পর প্রথম হানিমুনে এসেছে। লারা শান্তকে বলে,”আমি ভাবতেই পারিনি শান্ত তুমি আমায় এত ভালোবাসবে। জানো, সেই ছোটবেলা থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি। সবসময় তোমাকে নিয়ে কল্পনা করেছি সংসার সাজানোর। কিন্তু মাঝখানে ঐ প্রণালীর প্রতি তোমার এত আগ্রহ দেখে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমায় বুঝি কোনদিনও আমি পাবো না। কিন্তু দেখো আজ আল্লাহ আমাদের দুজনকে মিলিয়ে দিয়েছে।”

শান্ত অন্যমনস্ক হয়ে বলে,”আল্লাহ যা চেয়েছিলেন তাই হয়েছে। প্রণালী শুধু আমার প্রতিশোধ ছিল, আমার ভাগ্য তো তুমি।”

~~~~~~~~~~
প্রণালী ও সমুদ্রও পৌঁছে গেছে হযরত শাহজালালের পবিত্র মাটি সিলেটে। ভাগ্যক্রমে তারাও এসেছে ব্ল্যাকমুন রিসোর্টে। প্রণালী দীর্ঘ যাত্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। সমুদ্র বারকয়েক তার নাম ধরে ডেকেও ঘুম ভাঙাতে ব্যর্থ হলে তার মুখে পানির ছিটা দেয়। প্রণালী বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে বলে,”কি হয়েছে?”

“কিছু হয়নি। আমরা সিলেটে পৌঁছে গেছি।”

প্রণালীও বিরক্তি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। বিড়বিড় করে বলে,”যেখানে বিয়েটাই মানি না, সেখানে হানিমুন নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কিভাবে মানব।”

সমুদ্র প্রণালীর এই কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। বলল,”আমারও ইচ্ছা ছিল না এখানে তোমার সাথে হানিমুনে আসার ইচ্ছা ছিল না। নেহাৎ ডেড অসুস্থ তাই..”

প্রণালী আর কিছু বলে না। দুজনে মিলে ব্ল্যাক মুন রিসোর্টে প্রবেশ করে। রিশেপসনিস্ট তাদের দেখেই বলে,”ওয়েলকাম টু আওয়ার রিসোর্ট। আপনারা অনেক লাকি জানেন?”

সমুদ্র বলে,”লাকি কেন?”

“আমাদের রেস্টুরেন্টে আজ একটা বিশেষ সিক্রেট উদ্বেগ নেওয়া হয়েছিল আজ আমাদের প্রথম গেস্টদের জন্য ড্রিম হানিমুন অফার ছিল। আর আপনারাই সেই কাপল।”

প্রণালী কোন আগ্রহ না দেখিয়ে বলে,”এসবের দরকার নেই। আপনারা আমাদের জন্য রুম বুক করুন দুটো।”

রিশেপসনিস্ট বলে,”দুটো কেন? আপনারা কি কাপল নন?”

প্রণালী কিছু বলার ওঠার পূর্বেই সমুদ্র বলে,”হ্যাঁ, আমরা কাপল। আর আমি আপনাদের অফার এক্সসেপ্ট করলাম।”

প্রণালী বিস্ফোরিত নয়নে তাকায়। সমুদ্র প্রণালীকে চোখ মারে। সে তো প্রণালীকে জ্বালানোর জন্যই রাজি হয়েছে। মেয়েটাকে জ্বালানোর কোন সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না৷ সে তো প্রথমে রিজেক্ট করতেই যাচ্ছিল কিন্তু যখন দেখল প্রণালী রিজেক্ট করছে তখন তাকে শায়েস্তা করার জন্যই একপ্রকার রাজি হয়েছে।

প্রণালী ও সমুদ্র তাদের জন্য বুক করা রুমে যায়। সেখানে গিয়েই প্রণালী বলতে শুরু করে,”আপনি ওনাদের ওফার এক্সসেপ্ট করলেন কেন? আর একটা রুম নেওয়ার মানে কি? বাড়িতে তো নিজের মায়ের আঁচলের তলায় ঘুরতেন। আর এখানে এসে রোমিওগিরি করছেন।”

সমুদ্র বলে,”এই শোনো, আমি মোটেই রোমিওগিরি করছি না। তোমার সাথে রোমিওগিরি করব কেন? তুমি কি নিজেকে জুলিয়েট ভাবছ? তুমি তো হলে লেডি দেবদাস!”

প্রণালী কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। সমুদ্র বিছানায় গিয়ে শুয়ে বলে,”তুমি আজ থেকে মেঝেতে থাকতে পারো।”

“আমি কেন মেঝেতে থাকব?”

“তাহলে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ো 🥵”

“আপনার কি মাথা খারাপ? আমি আপনার সাথে বেড শেয়ার করবো। কখনো না। আপনার মম তো তাহলে আমায় জ্যান্ত রাখবে না।”

“আমার মাকে কি তুমি এত ভয় পাও?”

“আমি কেন ভয় পাবো? আমি তো আপনার কথা ভেবেই বলছি। আপনার মম যদি এসব জানতে পারে তাহলে..”

সমুদ্র হঠাৎ করে উঠে বসে। তারপর বলে,”আমি একটু আসছি।”

এই বলে বাইরে এসে ভাবে কি করবে এখন। ড্যাডকে তো কথা দিয়েছিল যে, মমের সাথে যোগাযোগ করবে না। আবার মম যদি রেগে যায়। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই ফ্যাসাদে পড়ে গেল বেচারা সমুদ্র।

~~~~~~~~
প্রণালী সকালের ব্রেকফাস্ট করার জন্য ব্ল্যাক মুন রিসোর্টের সংলগ্ন একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে। এসে বসে চুপচাপ ব্রেকফাস্ট করছিল। এমন সময় সে এমন জিনিস লক্ষ্য করে যা তার চোখে জল এনে দেয়। শান্ত-লারাকে দেখতে পায় সে। তার থেকে কিছুটা দূরে বসে ওরা ব্রেকফাস্ট করছে। তাদেরকে একসাথে কতো হ্যাপি লাগছে। প্রণালীর সহ্য হলো না এই দৃশ্য। তাকে ঠকিয়ে শান্ত যে এত শান্তিতে আছে এটা অকল্পনীয়। প্রণালী বিড়বিড় করে বলল,”এই ২ বছরে তোমার মনে কি আমার জন্য বিন্দুমাত্র ফিলিংস জন্মায় নি? তুমি কি আমাকে একটুও ভালোবাসো নি শান্ত?”

এরমধ্যে লারার নজর যায় প্রণালীর দিকে। সে শান্তকে বলে,”শান্ত লুক, ওটা প্রণালী না?”

শান্ত প্রণালীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,”আরে তাই তো।”

লারা বলে,”ঠিক আমাদের পিছু করতে করতে এখান অব্দি চলে এসেছে। দাঁড়াও আমি ওর ক্লাস লাগাচ্ছি।”

বলেই সে চলতে লাগে। শান্ত বলে,”লারা দাঁড়াও”

কিন্তু লারা প্রণালীর সামনে গিয়ে বলে,”এই মেয়ে তুমি এখানে কি করছ?”

প্রণালী আচমকা এমন ঘটনায় হচকচিয়ে যায়। লারা প্রণালীকে নানা রকম বাজে কথা বলতে থাকে। প্রণালীও কম যায় কিসে। সেও লারার সাথে তর্ক করতে থাকে। এর মাঝে শান্ত এসে তার গালে ঠাস করে চড় মা*রে। প্রণালী একদম পাথরের মতো জমে যায়। এমন কিছু সে একদম আশা করে নি। শান্ত যে এমন করবে তা প্রণালীর ভাবনার বাইরে। যে শান্তকে সে এতো ভালোবাসত আজ সে তার গায়ে হাত তুলল। প্রণালীর চোখ দিয়ে ছলছল করে জল পড়তে থাকে। এরমধ্যে কোথা থেকে সমুদ্র এসে পড়ে। সে এসেই শান্তকে বলে,”কে আপনি? আর আপনার এত বড় সাহস কোথা থেকে এলো, এত অডাসিটি আপনার যে আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন। আপনাকে তো আমি।”

বলেই সমুদ্র শান্তর সাথে ফাইট শুরু করে। প্রণালী অবাক হয়ে সবটা দেখতে থাকে। এ সমুদ্রর কোন রূপ দেখছে সে? যেই সমুদ্র তাকে দেখতেই পারে না সেই আজ তার জন্য ফাইট করছে৷ এটা প্রণালীর কল্পনাও নেই।
সে শুধু অবাক হয়ে দেখছে। একটা সময় পর সমুদ্রকে আটকাতে গেলে সমুদ্র প্রণালীকে বলে,”এর এত সাহস কি করে হয় আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার এর হাত আমি ভেঙে দেব ছাড়ো আমায়।”

প্রণালী সমুদ্রর এমন বদলে যাওয়া রূপ দেখে বলে,”এটা কিভাবে সম্ভব? এতো বদল? মম কি চামচার এই রূপ!”

সমুদ্র শান্তকে মা*রতে মা-রতে মে**রেই ফেলবে এমন অবস্থা। কয়েকজন লোক এসে তাকে ছাড়িয়ে নেয়।

প্রণালী সমুদ্রর কাটা স্থানে ব্যাণ্ডেজ করতে করতে বলে,”আমার জন্য এতো লড়াই?”

“তোমার জন্য না আমার স্ত্রীর জন্য।”

“আপনার স্ত্রী কে?”

সমুদ্র হচকচিয়ে গেলেও বলে,”আমি কাপুরুষ নই সেটা প্রমাণের জন্যই।”

তখনই রেডিওতে বেজে ওঠে,”যদি অভিযোগ কেড়ে নেয় সব অধিকার
তবে অভিনয় হয় সবগুলো অভিসার
যদি ঝিলমিল নীল আলোকে ঢেকে দেয় আঁধার
তবে কী থাকে তোমার, বলো কী থাকে আমার?
যদি বারে বারে একই সুরে প্রেম তোমায় কাদাঁয়…”
to be continue…..

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_49
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী ও সমুদ্র ব্ল্যাক মুন রিসোর্টে সময় কা’টাচ্ছে। সমুদ্রর কি হয়েছে সে জানে না। না চাইতেই অনেক বার তার নজর চলে যাচ্ছে প্রণালীর দিকে। নিজের এই বদলে সে অবাক হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রণালীও সমুদ্রর হঠাৎ ব্যবহারে চমকে গিয়েছিল। যদিও সে এই ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে ইচ্ছুক নয়। তাই সে সমুদ্রের কথা বাদ দিয়ে শান্তর কথা ভাবতে থাকে। শান্তকে সে কিছুতেই এত শান্তিতে থাকতে দেবে না। শান্ত প্রণালীর গায়ে হাত তুলেছে এর পরিণাম ভালো হবে না। প্রণালী ক্ষোভে ফুসছিল। হঠাৎ করে সমুদ্র,”আহ” করে গোঙানি করে ওঠে। প্রণালী সমুদ্রর কাছে এসে বুঝতে পারে তখন শান্তর সাথে মা*রামারি করে মুখে আঘাত পেয়েছিল সেখানেই বোধহয় ব্যাথা করছে। প্রণালী সমুদ্রকে বলে,”আপনার এতো হিরোগিরি করার কি দরকার ছিল? এখন শুধু শুধু ভুগছেন। আপনার মম যদি এটা জানতে পারে তাহলে তো কেঁদে কেঁদে চোখের জলের নদী বয়ে দেবে। তার বাবাইয়ের কি অবস্থা!”

সমুদ্র আচমকা প্রণালীর ভীষণ কাছে এসে বলে,”মজা নিচ্চজ তাইনা? আমার এমন অবস্থা তো তোমার জন্যই হয়েছে। কোথায় আমায় ধন্যবাদ দেবে তা না আমাকে আরো পিঞ্চ মা*রছ!”

প্রণালী সাবধানে সমুদ্রর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বলে,”আমি তো আপনাকে আমার হয়ে মা*রামারি করতে বলিনি। আপনি নিজের ইচ্ছাতেই করেছেন। তাহলে আমি কেন আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো?”

“অকৃতজ্ঞ! যাইহোক ঐ ছেলেটা কেন থা**প্পড় মা*রল তোমাকে? কে ঐ ছেলেটা তুমি চেনো?”

প্রণালী মৌন থাকে। কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বলে,”ও আমার প্রাক্তন।”

“ও, আচ্ছা। এই সেই ছেলে যে তোমায় পোল্টি দিয়েছিল!”

প্রণালী গরম চোখে তাকাতেই সমুদ্র চুপ হয়ে যায়। অতঃপর বিছানায় শুয়ে পড়ে বলে,”আমার মাথায় খুব ব্যাথা করছে। কেউ মাথা টিপে দিলে ভালো লাগত।”

প্রণালী চুপচাপ সমুদ্রর মাথা টিপে দিতে থাকে। শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতাবশতই। এই লোকটা তার জন্য মা*রামারি করল সেখানে সে এটুকু তো করতেই পারে! ভেবেই সে সমুদ্রর মাথা টিপছিল। অন্যদিকে সমুদ্রর মধ্যে তখন অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। তার হৃদস্পন্দন হঠাৎ করেই ভীষণ বেড়ে যাচ্ছিল। প্রণালীর সান্নিধ্যে কেন এমন হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। আড়চোখে দেখতে থাকে প্রণালীকে। এই মুখশ্রী কেমন জানি তাকে শান্তি দিচ্ছে। কিন্তু এমন কেন হচ্ছে। প্রণালীর সমুদ্রের দিকে কোন নজর নেই। যদি থাকত তাহলে সে দেখতে পেত এক জোড়া চোখ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকেই দেখে চলেছে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পু্ষ্পা চৌধুরীর মাথায় আগুন জ্বলে গেছে যখন থেকে তিনি জানতে পারলেন সমুদ্র আর প্রণালী বাসায় নেই। তারা একসাথে কোথায় গেছে সেটাও তিনি জানেন না। সমুদ্রর ফোনও সুইচ স্টপ বলছে। সব মিলিয়ে ভীষণ রেগে আছেন তিনি। সায়মা চৌধুরী বিপদ বুঝতে পেরে সকাল সকাল নিজের শ্বশুর বাড়ি চম্পট দিয়েছেন। সজল চৌধুরীও বিজনেস মিটিং এর বাহানা দিয়ে চলে গেছেন। পুষ্পা চৌধুরী সহজেই বুঝতে পারছেন যে তারা সবাই মিলেই কোন প্ল্যান করে সব করেছে। টায়রা তার সাথেই আছে। পুষ্পা চৌধুরী টায়রাকে বলে,”আচ্ছা, কালকের রাতের খাবারে কি কিছু মেশানো ছিল? আমার এখনো মনে আছে ডিনার করার পর আমি দুচোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না আর।”

“জ্বি, আন্টি। আমারও তো একই অবস্থা।”

“বুঝতে পেরেছি। সব চক্রান্ত। সজল আমার থেকে আমার বাবাইকে কেড়ে নিতে চাইছে। নিজের পছন্দমতো মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে আর এখন চাইছে ঐ মেয়ের সাহায্য নিয়ে আমার বাবাইয়ের মগজ ধোলাই করতে চাইছে। আমার খুব ভয় হচ্ছে টায়রা, আমার ভোলাভালা বাবাইটাকে ঐ চতুর মেয়েটা ছলাকলা করে বশ করে নেবে না তো?”

“তুমি চিন্তা করো না, আন্টি। ঐ মেয়ে কিছুই করতে পারবে না। আমি সমুদ্রকে চিনি। দেখলে না, ও সেদিন তোমার কথায় কিভাবে আমায় প্রপোজ করল। ও শুধু আমাকে ভালোবাসে। ঐ মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকাবে না।”

“তাই যেন হয় টায়রা। আমার বাবাইকে আমি হারাতে চাই না। ঐ চতুর মেয়ের কব্জায় আমি কিছুতেই নিজের বাবাইকে ফিরতে দেব না। একবার বাবাইকে ফিরতে দাও ঐ মেয়েকে আমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।”

টায়রা খুশি হয়ে যায় পুষ্পা চৌধুরীর কথা শুনে।

~~~~~~~~~~~~~~
তপ্ত দুপুর, সমুদ্র গভীর মগ্ন। প্রণালীর ভালো লাগছিল না তাই সে নিচে ঘুরতে বের হয়। সে রিসোর্টের পাশেই একটি চা বাগানে ঘুরতে গেছিল। প্রণালী আগেও একবার বন্ধুদের সাথে সিলেটে ঘুরতে এসেছিল। তখন চা-বাগানেও ঘুরেছিল। বেশ ভালো লেগেছিল। তাই আজও চলে এসেছে। হঠাৎ করেই কেউ প্রণালীর হাত ধরে টেনে তাকে নিয়ে যায়। প্রণালী কিছু বুঝে উঠতে পারে না। কিছুক্ষণ পর নিজের চোখের সামনে শান্তকে দেখতে পায়। শান্তকে দেখে প্রণালী ভীষণ রেগে যায়। তখনকার স্মৃতি মনে পড়ে। ঠাস করে চ*ড় বসিয়ে দেয় শান্তর গালে। তাও একবার নয় পরপর পাঁচ বার। শান্ত অবাক হয়ে তাকায় প্রণালীর দিকে। বলে ওঠে,”তুমি আমায় মা*রলে প্রণালী?”

“কেন? হাত শুধু তোমার একাই আছে? আমার হাত নেই? তখন আমার স্বামীর হাতে এতগুলো থা**প্পড় খেয়ে তোমার আক্কেল হয়নি তাই না? তাই আবার চলে এসেছ আমায় বিরক্ত করতে।”

“স্বামী! তুমি বিয়ে করেছ?”

“হ্যাঁ, করেছি। কেন কি ভেবেছিলে তুমি? আমি আজীবন তোমার কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকব?”

শান্ত আচমকা প্রণালীর হাতটা ধরে বলে,”জানো, আমি লারার কাছে একটুও শান্তি পাই না। ওর মধ্যে সব সময় তোমাকে খোঁজার চেষ্টা করি। তোমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে করতে কখন তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি সেটা নিজেও জানি না। আজ আমি তোমায় মা***রার পর থেকে কতটা অনুশোচনায় ভুগছি তুমি জানো না। আমার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।”

প্রণালী হেসে বলে,”তাই বুঝি? আমাকে মে*রে তোমার আফসোস হচ্ছে? কিন্তু বিশ্বাস করো তোমায় মে*রে আমার একটুও আফসোস হচ্ছে না। বরং ইচ্ছা করছে তোমায় ঠাটিয়ে আরো একটা..”

শান্ত আচমকা প্রণালীর হাত ধরে বলে,”চলো না, আমরা অতীতের সব কিছু ভুলে যাই। আবার সবটা নতুন করে শুরু করি। দূরে কোথাও পালিয়ে যাই আমরা….তারপর সবটা আবার নতুন করে শুরু করব।”

প্রণালী শান্তকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বলে,”খবরদার! এই স্পর্ধা দ্বিতীয় বার আর দেখাতে এসো না। এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।”

শান্ত নাছোড়বান্দা। সে জোরপূর্বক প্রণালীকে জড়িয়ে ধরে। এমন সময় কোথা থেকে যেন সমুদ্র চলে আসে। শান্ত আর প্রণালীকে এত পাশাপাশি দেখে রেগে যায়।

সমুদ্র এসে এক ঝটকায় শান্ত আর প্রণালীকে দূরে সরিয়ে দেয়। সমুদ্র শান্তর কলার ধরে বলে,”তোকে না বলেছি আমার স্ত্রীর থেকে দূরে থাকতে? তাও চলে এসেছিস? সকালের মার গুলো ভুলে গেছিস?”

শান্ত বলে,”তোর স্ত্রী আমাকে ভালোবাসে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ আমার জন্য অঢেল ভালোবাসা দেখতে পারবি।”

সমুদ্র প্রণালীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি এই ছেলেটাকে এর প্রাপ্য উত্তর দিয়ে দাও।”

প্রণালী বলে,”আমার চোখে ভালো করে দেখ শান্ত, তোমার জন্য সেখানে একটুও ভালোবাসা নেই। আছে এক বুক ঘৃণা। তোমায় আমি এতটাই ঘৃণা করি যে, তোমার মৃত্যুর খবর পেলে আমি মিষ্টি বিলি করব।”

“প্রণালী!”

সমুদ্র হেসে বলে,”শুনলি তো ওর কথা। ও তোকে নয় শুধু আমাকে ভালোবাসে। তাই না প্রণালী?”

প্রণালী অবাক হয়ে যায় সমুদ্রর কথা শুনে। সমুদ্র তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে। প্রণালী কোন উত্তর দেয় না। শান্ত বলে,”ওর চুপ থাকাই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে ও তোকে ভালোবাসে না। আমি জানি ও মুখে যাই বলুক ও আসলে আমাকেই ভালোবাসে।”

প্রণালী বলে ওঠে,”তুমি ভুল ভাবছ শান্ত
আমি…আমি শুধু আর শুধু….”

থেমে,
“সমুদ্রকেই ভালোবাসি।”

কথাটা মন থেকে বলে নি প্রণালী। পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হয়েই বলেছে। আসলে তো তার মনে সমুদ্রের প্রতি কোন অনুভূতি নেই। কিন্তু সমুদ্রর কি হলো সে জানে না। প্রণালীর কথা শুনে তার হৃদয়ে শীতল বাতাস বইছিল। মন ফুল ফুটছিল।

to be continue…..

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_50(Bonus)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সমুদ্র প্রণালীর হাত ধরে তাকে শান্তর থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসে। শান্ত পেছন থেকে চেচিয়ে বলতে থাকে,”আমি ছাড়া তুমি আর কারো সাথে সুখে থাকতে পারবে না প্রণালী। তোমাকে আমার কাছে ফিরতেই হবে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”

সমুদ্র এই কথা শুনে আরো রেগে গিয়ে প্রণালীর হাত আরো শক্ত করে ধরে নিয়ে যেতে থাকে।

এই দিকে লারা দূরে থেকে এতোক্ষণ সব কিছু দেখছিল৷ শান্তর প্রণালীর প্রতি হঠাৎ এই জেগে ওঠা ভালোবাসা লারার দুঃখের কারণ হলো। লারা শান্তর সামনে এসে বলল,”তুমি কেন করলে আমার সাথে এমন?”

শান্ত লারার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। লারা চিতকার করে উঠল। বলল,”আমার ফিলিংস এর সাথে কেন খেললে তুমি? আমি কি তোমার কাছে গিনিপিগ ছিলাম? সেই ছোটবেলা থেকে আমি তোমায় ভালোবাসি শান্ত। কিন্তু তুমি কখনো আমার ভালোবাসা বুঝতে পারিনি। তবুও অবুঝ আমি তোমায় ভালো বেসে গেছি। আল্লাহর কাছে প্রতিটা মোনাজাতে আমি তোমায় চেয়েছি। আমার ভালোবাসা কতটা গভীর সেটা তুমি উপলব্ধি করতে পারবে না শান্ত। তোমার জন্য হাসতে হাসতে আমি আমার জীবন টাও দিয়ে দিতে পারি। তোমাকে বিয়ে করে তোমার সাথে সুখে সংসার করার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। কিন্তু তুমি কি করলে? আমার সব স্বপ্ন তুমি শেষ করে দিলে। আমার বিশ্বাস আমার ভালোবাসা সব নষ্ট করে দিলে। এতোটাই যখন ভালোবাসো প্রণালীকে তাহলে আমায় কেন বিয়ে করলে তুমি?”

শান্ত চেঁচিয়ে উঠে বলে,”হ্যাঁ, আমি শুধু আর শুধু প্রণালীকেই ভালোবাসি। প্রণালীকে কষ্ট দিয়ে তোমায় বিয়ে করেছি শুধু আমার মায়ের কথায়। কারণ আমার মা চেয়েছিল আমি প্রণালীর উপর প্রতিশোধ নেই যেহেতু ওর বাবা-মার জন্য আমার মা জেলে। কিন্তু এখন আমার প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেছে। এখন আমি প্রণালীকে আবার হাসিল করে নেব।”

লারা ভগ্ন মন নিয়ে বলে,”তাহলে আমার কি হবে? আমি যে তোমাকে নিয়ে এত স্বপ্ন সাজালাম তার কি হবে?”

“জানিনা, আমি কিচ্ছু জানিনা। তোমার কত টাকা লাগবে তুমি বলে দিও। কিন্তু তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইউ গো টু দ্যা হেল।”

বলেই শান্ত চলে যায়। লারা সেখানেই বসে কাঁদতে থাকে। আজ বড্ড বাজে ভাবে ঠকে গেল মেয়েটা। লারা চিতকার করে বলতে থাকে,”কি দোষ ছিল আমার? আমি তো শুধু তোমায় ভালোই বেসেছিলাম। তোমার কথাতেই তো তোমায় বিয়ে করেছিলাম আর এখন তুমি আমার সাথে এমন করছ। সব, এই সব হয়েছে ঐ প্রণালী নামের মেয়েটার জন্য। ওর জন্য আমি তোমাকে পাইনি। তাহলে আমি ওকেই সুখী থাকতে দেব না। আমি প্রণালীকে শেষ করে দেব। দুনিয়া থেকে ওর সব চিহ্ন মুছে দেব আমি।”

বলেই ভয়ানক ভাবে হাসতে থাকে সে। এই হিংসে মনোভাব কতদূর নিয়ে যাবে?!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সমুদ্র প্রণালীকে একটু দূরে নিয়ে এসে তার হাত ছেড়ে দেয়। প্রণালী যেন হাফ ছেড়ে বাসে। বারকয়েক শ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,”এভাবে টানছিলেন কেন আমায়?”

“কেন? আমার স্পর্শ তোমার ভালো লাগছিল না বুঝি? তুমি তো ঐ শান্তর সামনে বললে তুমি আমায় ভালোবাসো।”

“আপনি ভাবলেন কি করে যে আপনার মতো মানুষকে আমি ভালোবাসবো? আপনার বোধহয় আমার বলা কথা মনে নেই। আমার এসব প্রেম-ভালোবাসায় কোন বিশ্বাস নেই। ভালোবাসা শব্দটাকেই আমি ঘৃণা করি।”

সমুদ্রকে এই কথাটা বলেই প্রণালী রিসোর্টের দিকে চলে যায়। এদিকে সমুদ্রর কেন জানি ভীষণ কষ্ট হয় প্রণালীর কথাটা শুনে। সে নিজেও জানে না তার সাথে হঠাৎ এসব কি হচ্ছে। আজ শান্ত আর প্রণালীকে একসাথে দেখে সমুদ্রর তো মাথাই গরম হয়ে গেছিল। ইচ্ছা করছিল সব শেষ করে দিতে। কিন্তু এমন অদ্ভুত অনুভূতি কেন হচ্ছে তার? সমুদ্র সম্পূর্ণ এক গোলকধাঁধায় পড়ে যায়।

তবে এটা সে নিশ্চিহ্ন বুঝতে পারে তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসছে। তবে এই অনুভূতিতে তার মগজ সাড়া দিতে চাইছে না। কিন্তু বেচারা বুঝতেও পারছে না তার মন কিভাবে এই অনুভূতির মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। এই অনুভূতির নামই কি তাহলে ভালোবাসা!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সিলেটের আবহাওয়া বেশ শীতল। বিশেষ করে রাতের দিকে সেখানে ভালোই ঠান্ডা অনুভূত হয়। তখন রাত ৮ টা। প্রণালী রিসোর্টেই বসে ছিল৷ সমুদ্র অনেকক্ষণ থেকে রুমে নেই। প্রণালীর মনে চিন্তাটা এসেছিল যে এত রাতে কোথায় গেল সে। কিন্তু প্রণালী চিন্তাটাকে বেশি পাত্তা দিল না। সমুদ্রকে নিয়ে একদমই আগ্রহ দেখাতে চায় না সে।

ঘরে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল প্রণালী৷ তাই ভাবল একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসবে। এই ভাবনা থেকেই সে বাইরে চলে এলো। রিসোর্টের বাইরে এসেই প্রণালী হাঁটতে বের হলো একা একা। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারল কেউ তাকে ফলো করছে। পেছনে ফিরে তাকাতেই কেউ প্রণালীর নাকে একটা রুমাল ধরে। প্রণালী সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

এদিকে সমুদ্র ডিনার শেষে প্রণালীর জন্য খাবার নিয়ে রিসোর্টে এসে দেখতে পায় প্রণালী সেখানে নেই। সমুদ্র ভ্রু কুচকে বলে,”এত রাতে কোথায় গেল প্রণালী।”

একবার ভাবল বাথরুমে গেছে বোধহয়। কিন্তু চেক করে দেখল নেই৷ বেলকনিতে গিয়েও প্রণালীকে না পেয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। ভয়ার্ত হয়ে রিশেপসনিস্টকে জিজ্ঞেস করে। রিশেপশনিস্ট বলে,”ম্যামকে তো আমি একা একা বাইরে যেতে দেখলাম।”

সমুদ্র বেশ ভয় পায়। এত রাতে একা কিভাবে বের হল? মনে কি একটুও ভয়ডর নেই? ভেবেই সে বের হয়ে আশেপাশে খুঁজতে লাগল প্রণালীকে কিন্তু কোন লাভ হলো না। সমুদ্র চিন্তায় পড়ে গেলো যে শান্ত প্রণালীর কোন ক্ষতি করল না তো? প্রণালীর ফোন নম্বরও নেই সমুদ্রর কাছে সে ভীষণ অসহায় বোধ করতে লাগল। প্রণালীর নাম ধরে চিতকার করতে লাগল।

~~~~
প্রণালীর জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটি পাহাড়ের চূড়ায়। আরো ভালো করে খেয়াল করলে সে বুঝতে পারে তার হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। প্রণালী নিজের চোখ খুলে নিজের চোখের সামনে এক নারী অববয় দেখতে পায়। ভ্রু কুচকে বলে,”কে ওখানে?”

লারা প্রণালীর সামনে চলে আসে। প্রণালী অবাক হয়ে বলে,”তুমি! তুমি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছ? যেতে দাও আমায়।”

লারা উন্মাদের মতো হাসতে থাকে৷ যেই হাসি দেখে প্রণালী ভয় পেয়ে যায়। লারা হাসি থামিয়ে হঠাৎ করেই কাঁদতে থাকে। তার এই ব্যবহার প্রণালীর কেমন জানি লাগে। লারা প্রণালীর কাছে এসে তার হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে বলে,”জানো, আমি না একদম এমন ছিলাম না। আমার পাড়ায় গিয়ে যদি বলো এখানকার সবথেকে ভালো মেয়ে কে সবাই নিদ্বিধায় আমার নাম বলবে। আমার কি দোষ ছিল বলো? শুধু তো পাগলের মতো একজনকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু সে আমার ভালোবাসা বুঝল না। শুধু নিজের স্বার্থে আমাকে ইউজ করল। তারপরেও আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি, পাগলের মতো ভালোবাসি। কিন্তু তাকে পেতে হলে যে তোমায় আমায় মারতেই হবে। আমাকে ক্ষমা করে দিও প্রণালী। আমার এটা করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কি করব বলো? আমি যে বড্ড অসহায়। সরি।”

“না, না লারা তুমি এমন করবে না।”

লারা প্রণালীর কোন কথার তোয়াক্কা না করে তার হাতের বাধন খুলে তাকে দাড় করিয়ে পাহাড়ের একদম কিনারায় নিয়ে যায়। প্রণালী বলে,”তুমি ভুল করছ লারা। প্লিজ আমায় ছেড়ে দাও।”

“ছেড়ে দেব? যাও দিলাম ছেড়ে।”

বলেই প্রণালীকে ধাক্কা দেয়।

প্রণালী বলে ওঠে, “নাআআআআআআআ”

to be continue…..

একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_45
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সমুদ্র রেগে গিয়ে নিজের ঘরে এসে বসে থাকে। কোনভাবেই প্রণালীকে শায়েস্তা করতে না পেরে ভীষণ রেগে আছে সে। সমুদ্র নিজের কপাল চাপড়ে বলে,”মেয়েটার মধ্যে কি আছে? ওর কোন ফিলিংস হয় কি না? এত কিছুর পরেও কেউ কিভাবে এত স্বাভাবিক থাকতে পারে? ওকে জব্দ করতে গিয়ে আমি তো নিজেই জব্দ হয়ে বসে আছি।”

সমুদ্রের এমন ভাবনার মাঝে কেউ তার দরজায় নক করে। সমুদ্র বলে,”কে?”

তখনই রায়ান সাহেব বলে ওঠেন,”আমি, সমুদ্র। তোমার রায়ান আঙ্কেল। তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”

“ওহ, আঙ্কেল আপনি ভেতরে আসুন।”

রায়ান সাহেব ভেতরে এসে সমুদ্রকে বলল,”কি ব্যাপার? তুমি হঠাৎ করে সবার মাঝ থেকে চলে এল?”

“না, মানে…”

“দেখো সমুদ্র, এখন তোমার সাথে আমার মেয়ের ভাগ্য জড়িয়ে গেছে। তাই আমি তো তোমাকে অবহেলা করতে পারি না। আমি জানি, হয়তো প্রণালীকে নিয়ে তোমায় অনেক সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। কারণ প্রণালী এখন অন্য পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। আজ ওকে দেখে আমি নিজেই এটা খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছি।”

সমুদ্র কিছুই বলে না। আরো ভালো করে বলতে গেলে বলার মতো কিছুই খুঁজে পায়না। এরমধ্যে রায়ান সাহেব বলেন,”আমার মেয়েটা এমন ছিল না। হঠাৎ করেই ওর জীবেন আসা কিছু ধাক্কা ওকে এভাবে বদলে দিয়েছে বাবা। তুমি একটু ওর সাথে মানিয়ে নিও।”

সমুদ্রর কৌতুহল বাড়ে। সে তো আগে থেকেই প্রণালীর এমন ব্যবহারের কারণ জানার চেষ্টা করছিল। আর এখন রায়ান সাহেবের কথা শুনে তার এই আগ্রহ বাড়লো আরো বেশি। তাই সে বলে উঠল,”কি হয়েছে প্রণালীর সাথে যে ও এমন ব্যবহার করছে?”

রায়ান সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”আমি তোমার থেকে কিছুই লুকাতে চাই না বাবা। আমি তোমাকে সব খুলে বলছি।”

এই বলে তিনি সমুদ্রকে শান্তর ব্যাপারে, শান্ত প্রণালীর সাথে কি কি করেছে এবং কি পরিস্থিতিতে প্রণালী বিয়েতে রাজি হয়েছে সব বলেন। সব শুনে সমুদ্র বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে প্রণালীর উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে তাই সে এমন শক্ত হয়ে গেছে।

সমুদ্র যখন নিজের ভাবনায় মশগুল ছিল তখনই রায়ান সাহেব তার হাত শক্ত করে ধরে বলে,”আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে বাবা। আমি জানি ওর সাথে মানিয়ে নিতে এখন তোমার অনেক অসুবিধা হবে। আমি বাবা হিসেবে এইজন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু তোমার কাছে একটাই অনুরোধ, আমার মেয়ের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। ও কিন্তু মোটেই খারাপ মেয়ে নয়। এখন যেমন চুপচাপ আর নির্লিপ্ত দেখছ ও কিন্তু ঠিক এর বিপরীত স্বভাবের।”

সমুদ্র চৌধুরী বলে,”আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনার মেয়ের খেয়াল রাখব।”

মুখে এই কথা বললেও মনে মনে সে বলে,”প্রণালীকে স্বাভাবিক করতে হবেই। আমার প্রতিশোধ নেওয়া যে এখনো বাকি।”

তবে প্রতিশোধের কথা বললেও সমুদ্রের মন যে প্রণালীর প্রতি একটু বলেও দূর্বল হয়ে গেছে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারছে। তবে এই দূর্বলতাকে প্রশ্রয় দিতে চায় না সমুদ্র। সে ভাবছিল সবই হয়তো ইমোশন। হঠাৎ করে প্রণালীর দুঃখের কথা শুনে হয়তো তার প্রতি মায়া তৈরি হয়েছে। যেমনটা স্বাভাবিক। বাড়ির একটা কুকুর বেড়ালের প্রতিও এমন মায়া হয়। এই ভাবনা থেকেই সমুদ্র ভাবল এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আসলেই কি তাই? তার উত্তর তো সামনে পরিস্কার হবে।

~~~~~
প্রণালী সবাইকে নিজের হাতে খাবার খেতে দিচ্ছিল। এটাই নাকি চৌধুরী বাড়ির নিয়ম। যদিও রান্না বাইরের লোকই করেছে। অতিথিরা সবাই খাওয়া দাওয়া শেষে বিদায় নেয়। রায়ান সাহেবও প্রত্যুষকে নিয়ে চলে যান। আর এরপরই পুষ্পা চৌধুরী সুযোগ পেয়ে যান নিজের আসল রূপ দেখানোর। এইজন্যই তো তিনি সমুদ্রকে বলেন,”বাবাই তুমি খাওয়া দাওয়া শেষ করে টায়রাকে নিয়ে একটু বাইরে ঘুরতে যাও। মেয়েটা কতদিন পর দেশে ফিরল। দেশটা একটু ঘুরে দেখুক।”

সজল চৌধুরী বলেন,”এসব তুমি কি বলছ? তোমার ছেলের সবে সবে বিয়ে হয়েছে। আর ও কিনা নিজের বউকে ফেলে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাবে! এটা কোন আঙ্কেলে বলছ তুমি? তোমার কি কোন সেন্স নেই?”

“তোমার কোন কথা আমি শুনতে চাইনি৷ তুমি নিজের মতো খাও। আমার বা আমার ছেলের ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার আমি তোমাকে দেইনি।”

সায়মা চৌধুরী বলে ওঠেন,”ভাবি! তুমি কিন্তু এটা ঠিক করছ না। সবার সামনে ভাইয়াকে এভাবে বলার অধিকারও কিন্তু তোমার নেই।”

“তুমি নিজের সীমার মধ্যেই থাকো। অনুষ্ঠান তো মিটে গেছে। তাহলে তুমি এখানে পড়ে আছ কেন? যাও নিজের বাসায় যাও।”

সায়মা চৌধুরী অপমানিত বোধ করেন। তবুও বলেন,”এটা আমার বাবার বাড়ি। এখানে আমি যতদিন ইচ্ছা থাকব।”

পুষ্পা চৌধুরী বাকা হেসে বলেন,”কিন্তু এই বাড়িটা তো আমার নামে। তাই এখানে থাকতে চাইলে তোমার আমার কথা শুনে চলতে হবে।”

সায়মা চৌধুরী একদম চুপ হয়ে যান। খাওয়া শেষ করে সমুদ্র টায়রাকে বলে,”চলো আমরা ঘুরতে যাই।”

টায়রাও বিনাবাক্যে রাজি হয়। প্রণালীর পাথরের মতোই দাঁড়িয়ে ছিল। সমুদ্র প্রণালীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,”দেখি, তুমি কতদিন এমন সহ্য করে চলতে পারো। একদিন না একদিন তোমায় রিয়্যাক্ট করতেই হবে।”
~~~~~~
রাতে বাসায় ফিরে সমুদ্র প্রথমে নিজের রুমে ঢো মারে। সে দেখে প্রণালী তার রুমেই শুয়ে আছে। সমুদ্র রুমে প্রবেশ করে প্রণালীকে বলে,”তুমি এই রুমে কি করছ? এটা আমার রুম। বেরিয়ে যাও এখান থেকে।”

প্রণালী কোন কথা না বলে উঠে বসে। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। প্রণালী রুম থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় সমুদ্র তাকে আটকে দিয়ে বলে,”এমন কেন তুমি? তোমাকে আমি বললাম আর তুমি বেড়িয়ে যাচ্ছ। একটু প্রতিবাদ তো করতে পারো। নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা তো করতে হবে।”

প্রণালী স্বাভাবিক থেকেই উত্তর দেয়,”যা আমার নয়, তার উপর আমি অধিকার দেখাই না।”

প্রণালীর এই কথা ভীষণ হার্ট করে সমুদ্রকে। সে প্রণালীর হাত ছেড়ে না দিয়ে প্রণালীকে নিজের আরো কাছে নেয়। প্রণালী প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেয়। এক ঝটকা দিয়ে সমুদ্রকে দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর একদম স্বাভাবিক ভাবে রুম থেকে চলে যাবার চেষ্টা করে যেন কিছু হয় নি। কিন্তু এতে করে সমুদ্র আরো রেগে গিয়ে আবার প্রণালীকে নিজের কাছে টেনে নেয়। প্রণালী থমথমে গলায় বলে,”ছাড়ুন আমায়।”

সমুদ্র বলে,”না, ছাড়বো না। আজ তোমায় আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এমন পাথরের মতো হয়ে আছ কেন তুমি? কেন কিছুতেই আমি তোমায় জব্দ করতে পারি না? তোমার মধ্যে কি কোন ফিলিংস নেই।”

“না, নেই।”

প্রণালীর স্পষ্ট উত্তর।

” আমাকে অন্য কোন মেয়ের সাথে দেখলে তোমার কষ্ট হয় না?”

“না, হয়না।”

“নিজেকে তুমি আমার স্ত্রী বলে মানো না?”

“না, মানি না।”

প্রণালীর সব কথা যেন সমুদ্রর গালে এক একটা থাপ্পড়ের মতো লাগে। সমুদ্র চৌধুরী, যে নিজের সৌন্দর্য আর বংশ পরিচয়, ধন-সম্পদ নিয়ে সবসময় অহংকার করেছে। যার সাথে কথা বলার জন্য সব মেয়েরা উৎসুক থাকে তাকে কিনা এই মেয়েটা ঘোল খাওয়াচ্ছে। তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিচ্ছে না। এটা তার হজম হয় না। সমুদ্র প্রণালীর আরো কাছে যেতে চাইছিল এমন সময় পুষ্পা চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হন। এসেই দুজনকে এত কাছাকাছি দেখে রেগে যান। চিৎকার করে বলেন,”বাবাই! কি করছ তুমি? এই মেয়ের থেকে দূরে সরে আসো।”
হঠাৎ মায়ের গলা শুনে সমুদ্র ছিটকে সরে আসে। প্রণালী পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। পুষ্পা চৌধুরী সমুদ্রের কাছে এসে বলেন,”বাবাই, তুমি এই মেয়েটার এত কাছে ছিলে কেন? যাও আমার রুমে যাও।”

সমুদ্র মায়ের বাধ্য সন্তানের মতো তার কথায় চলে যায়। সে যাওয়ার পর পুষ্পা চৌধুরী প্রণালীকে বলেন,”একদম আমার বাবাইয়ের কাছে আসার চেষ্টা করবে না। তোমার উদ্দ্যেশ্য আমি বুঝি না ভেবেছ, নিজের রূপ দিয়ে ছলাকলা করে আমার বাবাইকে ভোলাতে চাইছ। এভাবে তুমি আমার বাবাইকে পাবে না। আমার বাবাই আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি না বলা পর্যন্ত ও তোমায় ছুয়েও দেখবে না। তুমি আমার থেকে আমার বাবাইকে কেড়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করো না। তুমি কিছুতেই বাবাইকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_46
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সজল চৌধুরী আর সায়মা চৌধুরী দুজনেই বসে সমুদ্র ও প্রণালীর ব্যাপারে কি করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা করছিল। সজল চৌধুরী বলেন,”আমার মনে হয় পুষ্পা যতদিন থাকবে ততদিন কিছুতেই প্রণালী আর সমুদ্রকে কাছাকাছি আসতে দিবে না।”

সায়মা চৌধুরী নিজের ভাইয়ের সাথে সহমত প্রকাশ করে বলে,”তুমি একদম ঠিক বলেছ ভাইয়া। ভাবি তো চিনে জোকের মতো ওদের পেছনে পড়ে আছে। আর প্রণালীও কেমন যেন নির্জীব থাকে সবসময়। হয়তো ভাবিকে সামলানো ওর দ্বারা সম্ভব নয়।”

সজল চৌধুরী উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠেন,”তাহলে কি করা যায় বল তো? কিভাবে আমি সমুদ্র আর প্রণালী কে কাছাকাছি আনব বল? কিভাবে আমি পুষ্পার নজরের বাইরে থেকে এমনটা করতে পারবো?”

সায়মা চৌধুরী কিছুটা ভেবে বলেন,”আমার মনে হয় না ভাবির চোখের সামনে এমন কিছু সম্ভব। তবে হ্যাঁ, তুমি যদি ওদের কে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দাও ভাবির নজর এড়িয়ে তাহলে ওদের কাছাকাছি আসা সম্ভব হবে। হাজার হোক, ওরা বিয়ে করেছে। বিয়ে শব্দটা দুই শব্দের হলেও এর গাম্ভীর্য অনেক। এই দেখো না, আমার স্বামী আমার থেকে ১০ বছরের বড় ছিল জন্য আমি তো বিয়েতে রাজিই ছিলাম না। তোমরা এক প্রকার ধরে-বেধে আমাদের বিয়ে টা দিয়েছিলে। আর এখন সেই স্বামীকেই আমি চোখে হারাই। বিয়ে হলো এমনই একটা সম্পর্ক যেটায় বাধা পড়ার পর স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি অনুভূতি এমনিতেই তৈরি হয়ে যায়। শুধু তাদের কিছু স্পেস দরকার।”

সজল চৌধুরী ভেবে বলেন,”তাহলে আমি একটা কাজ করি। ওদেরকে হানিমুনে পাঠিয়ে দেই৷ তাহলে কাজ হতে পারে? কি বলিস তুই।”

“সেটা তো ঠিক আছে। কিন্তু সবটাই করতে ভাবির নজর এড়িয়ে। কারণ ভাবি যদি একবার ওদের হানিমুনের কথা জানতে পারে তাহলে দেখবা সেখানেও বাগড়া দিতে চলে যাবে।”

“এটা তুই একদম ঠিক বলেছিস। তবে চিন্তা করিস না। এবার আমি এমন প্ল্যান করব যে সাপও মরবে আর লাঠিও ভাঙবে না।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~
পুষ্পা চৌধুরী নিজের ঘরে বসে বসে নিজের কিছু গহনা আর শাড়ি দেখছিলেন। এমন সময় টায়রা তার রুমে এসে বলে,”আন্টি? আপনি ডেকেছিলেন আমায়?”

পুষ্পা চৌধুরী এক গাল হেসে বলে,”আরে টায়রা। এসো এসো আমার পাশে বসো।”

টায়রা পুষ্পা চৌধুরীর পাশে বসে তার সাথে শাড়ি আর গহনা গুলো দেখছিল। হঠাৎ একটা ডায়মন্ড নেকলেস তার পছন্দ হয়ে যাওয়ায় সে সেটা তুলে নিয়ে বলে,”ওয়াও! এটা কত সুন্দর।”

“তোমার পছন্দ হয়েছে?”

“হ্যাঁ, আন্টি। ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”

“তাহলে তুমি এটা নিজের কাছে রেখে দাও”

“সত্যি? আমি এটা নিজের কাছে রাখব?”

“হ্যাঁ, রাখো। এমনিতেই এই সব শাড়ি গহনা আমি তো নিজের ছেলের বউয়ের জন্যই রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার আঙ্কেল যে এমন গেম খেলবে সেটা তো আমি জানতাম না।”

কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলেন,”কিন্তু তুমি কোন চিন্তা করো না টায়রা। আমার সমুদ্রর বউ তো শুধু তুমিই হবে। ঐ মেয়েটাকে আমি এমন ভাবে অপদস্ত আর টর্চার করব যে আর দুদিনও এই বাড়িতে টিকতে পারবে না।”

টায়রা বলে,”তুমি শুধু শুধু একা কেন কষ্ট করতে যাবে আন্টি? ঐ মেয়ের দায়িত্ব তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। ঐ মেয়েকে আমি এমন শিক্ষা দেব যে বুঝবে টায়রার জিনিসে নজর দেওয়ার ফল কত ভয়াবহ হতে পারে।”

এই বলেই একটা বিশ্রী রকমের হাসি দেয় টায়রা।

~~~~~~~~
প্রণালীর ভীষণ মাথা ব্যাথা করছিল। তাই সে গেস্টরুম থেকে বের হয়ে নিচে এসে কিচেনে ঢুকে নিজের জন্য কফি বানাচ্ছিল। টায়রা কিচেনে প্রণালীকে দেখে তার কাছে যায়। প্রণালী টায়রাকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। টায়রা প্রণালীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকে,”কি নির্লজ্জ মেয়ে তুমি! সমুদ্রর মতো একটা রিচ, হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে নাচতে নাচতে তার গলায় ঝুলে পড়লে। তোমার কি একটুও সেল্ফ রেস্পেক্ট নেই? এত অপমানিত হয়ে এখানে পড়ে আছ কেন?”

প্রণালী টায়রার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজের কাজ করে যেতে থাকে। এতে টায়রা রেগে গিয়ে প্রণালীকে বলে,”এত ইগো কিসের তোমার? এত ইগো কেন?”

সমুদ্র ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিতে কিচেনে এসেছিল। সেও এসে টায়রার কথা শুনে তার সাথ দিয়ে বলে,”এই মেয়েটার শুধু ইগোই আছে আর কিছু নেই। আসলে খুব বড় ছ্যাকা খেয়েছে তো। তাই এমন হয়ে গেছে। জানো, মেয়েটাকে একটা ছেলে ভীষণ বাজে ভাবে ধোকা দিয়েছে। অবশ্য ওর মতো মেয়ে এটাই ডিজার্ভ করে। কেই বা ওর সাথে সংসার করতে চাইবে। ইভেন আমিও তো খুব শীঘ্রই ওকে ডিভোর্স দেবো। আর তোমাকে বিয়ে করে নেব।”

সমুদ্র কথাগুলো প্রণালীকে জ্বালানোর জন্য বলেছিল। কিন্তু প্রণালী কারো কথায় কোন পাত্তা না দিয়ে কানে হেডফোন গুজে গান শুনতে থাকে। টায়রা গিয়ে প্রণালীর কান থেকে হেডফোন খুলে বলে,”এই কথা শুনছ না কেন? তোমার মা কি তোমায় কোন শিক্ষা দেয়নি?”

নিজের মায়ের নামে এমন কথা মেনে নিতে পারল না প্রণালী। এটা তার দূর্বলতার যায়গা। তাই অনেকদিন পর নিজের আসল খোলসে আসল। গরম কফি সম্পূর্ণ ঢেলে দিল টায়রার হাতে। টায়রা যন্ত্রণায় ওমাগো বলে চিৎকার করে উঠল। প্রণালী বলল,”ভবিষ্যতে আমার মায়ের সম্পর্কে কোন খারাপ কথা বলার আগে এই কথাটা মনে রেখো।”

টায়রা গরম চোখে দেখতে থাকে প্রণালীকে। সমুদ্র টায়রাকে বলে,”ইস, হাতের কি অবস্থা। তাড়াতাড়ি পানি দাও হাতে।”

কিন্তু প্রণালীকে সে কিছুই বলে না ব্যাপারটা নিয়ে। টায়রা রেগে গিয়ে বলে,”তুমি ঐ মেয়েটাকে কেন কিছু বলছ না? দাঁড়াও আমি আন্টিকে গিয়ে সব বলছি। তারপর দেখো কি হয়।”

এই বলে টায়রা কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।

সমুদ্র প্রণালীকে বলে,”কাজটা তুমি ঠিক করলে না। এখন দেখো টায়রা মমকে গিয়ে কি বলে। মম কিন্তু টায়রাকে অনেক ভালোবাসে। তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে না।”

প্রণালী বলে,”আমি আপনার মতো আপনার মমকে ভয় পাইনা। তাই আমার মধ্যে কোন ভয় নেই।”

এরমধ্যে টায়রা পুষ্পা চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে আসে। পুষ্পা চৌধুরীকে এনেই বলতে শুরু করে,”দেখো আন্টি এই মেয়েটা আমার হাতে গরম কফি ঢেলে কি অবস্থা করেছে। তুমি এর বিচার করো।”

পুষ্পা চৌধুরী প্রণালীর দিকে এগিয়ে এসে বলেন,”এত বড় সাহস তুমি পাও কোথায়?”

বলেই প্রণালীর গায়ে হাত তুলতে যান। প্রণালী পুষ্পা চৌধুরীর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,”ভুলেও এই কাজটা করবেন না। আমি এতদিন মুখ বুজে সবটা সহ্য করেছি তার মানে এই নয় আমি দূর্বল। আমি একজন আইনের স্টুডেন্ট। বাড়ির বউয়ের গায়ের হাত তোলার কি শাস্তি হয় জানেন? আপনাকে আমি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেইসে জেলের ভাত খাওয়াবো যদি দ্বিতীয় বার এই স্পর্ধা দেখান।”

সমুদ্র চেচিয়ে বলে ওঠে,”তোমার এত বড় সাহস তুমি আমার মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করছ?”

প্রণালী আরো জোরে চেচিয়ে বলে,”এই মমের চামচা চুপ থাকো।”

সমুদ্র হতবাক হয়ে যায়। সাথে একটু স্বস্তিও পায় যে মেয়েটা আবার আগের রূপে ফিরছে। এদিকে দরজায় দাঁড়িয়ে সব ঘটনা দেখলেন সায়মা চৌধুরী আর সজল চৌধুরী। সজল চৌধুরী সায়মা চৌধুরীকে বলেন,”দেখলি তো। বলেছিলাম না, এই মেয়েই পারবে পুষ্পাকে জব্দ করতে।”

“তাই তো দেখছি ভাইয়া। তুমি একদম ঠিক মেয়েই বাছাই করেছ। এবার খেলা জমবে।”

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_47
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী নিজের ঘরে এসে কাপড় চোপড় গোছাচ্ছে৷ বেশ অনেক হয়েছে সে আর এসব সহ্য করতে পারছে না৷ তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে আজই সে এই বাড়ি ছেড়ে আবার নিজের বাবার কাছে ফিরে যাবে। এই জন্য সে তৈরি হয়ে নিচ্ছিল। সায়মা চৌধুরী প্রণালীর রুমে এসে তাকে এভাবে তৈরি হতে দেখে অবাক হয়ে যান। প্রণালীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন,”মা, তুমি হঠাৎ রেডি হচ্ছ কেন? আবার ব্যাগ পত্রও গুছিয়ে রাখছ। কোথাও কি যাবে?”

প্রণালী একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”হ্যাঁ, আন্টি। আমি এখান থেকে আমার বাড়িতে ফিরে যাব।”

সায়মা চৌধুরীর মুখ কালো হয়ে যায়। এই মেয়েই তো এখন তাদের আশা ভরসা। তারা তো স্বপ্ন দেখছে এই মেয়েই পুষ্পা চৌধুরীকে টাইট দেবে। কিন্তু এই মেয়ে এভাবে চলে গেলে তো তাদের সব আশা শেষ হয়ে যাবে। তাই সায়মা চৌধুরী বলে ওঠেন,”তুমি এই বাড়ি থেকে কোথাও যেওনা প্রণালী। এটা তোমার বাড়ি৷ তোমাকে তো এখানেই থাকতে হবে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িই যে মেয়ের সব। শ্বশুর বাড়িতে টিকে থাকতে হবে সেটা মাটি কামড়ে হলেও।”

প্রণালী স্পষ্ট গলায় বলে,”সরি, আমি এসব পুরানো দিনের ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী নই। আমি এত লড়াই ঝগড়া করার মুডে নই। আর আমি চাই না, আমার জন্য এই বাড়িতে ফারদার আর কোন ঝামেলা হোক। আমি এমনিতেই অনেক ঝামেলার মাঝে আছি। আমি চাই না আমার ঝামেলা আরো বাড়ুক। আমার একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের ভীষণ দরকার।”

এমন সময় সজল চৌধুরী এসে বলেন,”আমি বুঝতে পারছি তুমি এখানে অতীষ্ঠ হয়ে উঠছ। তবে এখন তোমায় একটু সহ্য করতেই হবে। এটুকু সহ্য করেই দেখো জীবনে অনেক সুখী হবে।”

“আমি পারবো না আঙ্কেল। আমার আর সেই সহ্যক্ষমতা নেই।”

“ঠিক আছে। তোমায় কিছু সহ্য করতে হবে। তোমার শান্তি চাই তো? আমি তোমার শান্তির ব্যবস্থা করছি। তবে তোমায় আর বাপের বাড়ি যেতে হবে না। তুমি যাবে অন্য কোথাও?”

“অন্য কোথাও মানে কোথায়?”

“হানিমুনে।”

“কি?!”

“আমার উপর বিশ্বাস রাখো প্রণালী। আমি সব ঠিক করে দেব। কাপড় চোপড় গুছিয়ে ভালোই করেছ। আজ রাতেই তোমরা বেড়িয়ে পড়বে।”

“কিন্তু..”

“কোন কিন্তু নয়। সায়মা তুই প্রণালীকে সামলা। আমি ওদিকটা ম্যানেজ করি।”

~~~~~~~~~~~
পুষ্পা চৌধুরী টায়রার হাতে বার্নাল লাগাতে লাগাতে বলেন,”খুব লাগছে তাইনা? ইশ,ফোস্কা পড়ে গেছে। ঐ মেয়েটার সাহস দেখে আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি। প্রথমে কি সুন্দর ভেজা বিড়াল হয়ে থাকত আর সুযোগ পেতেই নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দিলো। আমাকে পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে! ও এখনো পুষ্পা চৌধুরীকে চিনে নি। ওর আমি এমন অবস্থা করব যে..”

টায়রা প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল৷ সে বলে,”আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। ঐ মেয়ের আমি এমন ব্যবস্থা করব যে ও ভাবতেই পারছে না। কিন্তু তার আগে আমাকে সমুদ্রকে নিজের করে নিতে হবে। আপনি প্লিজ এমন কোন ব্যবস্থা করুন যাতে আমি সমুদ্রকে নিজের করে পাই।”

পু্ষ্পা চৌধুরী বলেন,”আগে ঐ মেয়েকে তাড়াতে হবে।”

“না, আন্টি। আমি চাই ওর চোখের সামনে ওর বরের সাথে একান্ত সময় কা*টাতে। এভাবে ওকে ওর অবস্থানটা বুঝিয়ে দিতে চাই।”

“তুমি এমনটা চাইলে তাই হবে। বাবাইকে আমি বলে দেব তোমার সাথে একান্ত সময় কাটাতে। বাবাই তোমাকে ভালোবাসে। তাই ও নারাজ হবে না।”

টায়রা কিছু একটা ভেবে বলে,”আমার মনে হয় না সমুদ্র আমায় ভালোবাসে বলে। যদি ও সত্যি আমায় ভালোবাসত তাহলে যখন ঐ মেয়েটা যখন আমার হাতে গরম কফি ঢেলে দিল তখন প্রতিবাদ করত, ও তো এমন কিছুই করল না। কেমন নীরব দর্শকের মতো সবকিছু দেখে গেল।”

পুষ্পা চৌধুরী গর্জে উঠে বললেন,”বাবাই আমার ছেলে। আমার কথাই ওর কাছে শেষ কথা। আমি যদি ওকে বলি তোমাকে ভালোবাসতে হবে তাহলে ওকে তোমাকেই ভালোবাসতে হবে। আমার কথার অবাধ্য ও হতে পারবে না।”

পুষ্পা চৌধুরীর কথায় টায়রা ভীষণ খুশি হয়। অতঃপর মনে মনে প্রণালীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এবার দেখো মেয়ে, তোমার আমি কি অবস্থা করি।”

এই বলে সে পুষ্পা চৌধুরীকে বলে,”আন্টি আপনি একটু সমুদ্রকে ডেকে পাঠান। প্রমাণ করিয়ে দিন যে আপনার কথায় ও আমায় ভালোবাসবে।”

পুষ্পা চৌধুরী সমুদ্রকে ডেকে পাঠান। সমুদ্র আসতেই তিনি বলেন,”বাবাই, তুমি তো আমার সব কথা শোনো। আমি যদি কিছু বলতে বলি বলবে।”

“হ্যাঁ, মম। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।”

“তাহলে এক্ষুনি আমার সামনে এই গোলাপ ফুলটা দিয়ে টায়রাকে প্রপোজ করো।”

সমুদ্র হচকচিয়ে যায়। আসলে তো তার মনে টায়রার জন্য কোন ফিলিংস নেই। সে তো শুধু প্রণালীকে জ্বালানোর জন্য টায়রাকে ব্যবহার করছে। পুষ্পা চৌধুরী সমুদ্রকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলেন,”কি হলো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমি যা বলছি করো।”

সমুদ্র একপলক টায়রার দিকে তাকায়৷ ফুলটা হাতে নিয়ে টায়রার দিকে বাড়িয়ে দেয়। পুষ্পা চৌধুরী বলে ওঠেন,”এভাবে নয়। হাটু গেড়ে বসে টায়রাকে আই লাভ ইউ বলো।”

“ওকে, মম।”

সমুদ্র নিজের মায়ের কথা মতো হাটু গেড়ে বসে টায়রাকে বলে,”আই লাভ ইউ।”

টায়রা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। পুষ্পা চৌধুরী বিশ্বজয়ের মতো হেসে বলেন,”আমার বাবাই আমারই আছে।”

~~~~~~~~~~~~~~
সজল চৌধুরী সায়মা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেন,”তোকে যা বলেছিলাম করেছিস তো?”

“হ্যাঁ, ভাইয়া। আমি তোমার কথা মতো ভাবি আর ঐ টায়রা পায়রার খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি। ওরা এখন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।”

“বেশ, বেশ এটাই সুবর্ণ সুযোগ। এবার তুই যা সমুদ্রকে ডেকে আন। আমি নাটক শুরু করে দেই।”

“আচ্ছা।”

সজল চৌধুরী বিছানায় অসুস্থ হওয়ার ভান করে শুয়ে থাকেন। সায়মা চৌধুরী সমুদ্রের রুমে গিয়ে দরজা নক করতে থাকেন। সমুদ্র হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে বলে,”কি হয়েছে ফুপি? এমন উদ্ভ্রান্তের মতো দরজা ধাক্কাচ্ছ কেন?”

সায়মা চৌধুরী কান্নার সুরে বলে,”ভাইয়া খুব অসুস্থ রে সমুদ্র। তোকে ডাকছে।”

“কি হয়েছে ড্যাডের? আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”

এই বলে সমুদ্র দৌড়ে সজল চৌধুরীর রুমে যান। সজল চৌধুরী বিছানায় শুয়ে কাতড়াচ্ছেন দেখে সমুদ্র তার পাশে গিয়ে বসে বলে,”ড্যাড, তোমার কি হয়েছে? ডাক্তার আঙ্কেলকে ডেকেছ? চলো আমি তোমায় হসপিটালে নিয়ে যাই।'”

“আমি এখন ঠিক আছি। তোর ডক্টর আঙ্কেল আমায় দেখে গেছেন। তিনি বলেছেন প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল।”

“তোমাকে কতদিন না বলেছি এত টেনশন না করতে। এইজন্য তোমার প্রেশার বাড়ে। প্রেশারের ওষুধ খেয়েছ?”

সায়মা চৌধুরী তখনই পেছন থেকে বলে ওঠেন,”এটাই তো সমস্যা সমুদ্র। ডাক্তার বার বার করে বলেছেন তোর বাবাকে সে যেন সঠিক সময় ওষুধ খান। কিন্তু তোর বাবা ওষুধ খেতেই চাচ্ছেন না।”

সমুদ্র চৌধুরী নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি ওষুধ খেতে চাইছ না কেন? এভাবে চললে তো অসুস্থ হয়ে যাবে।”

“কেন খাবো আমি ওষুধ? তুই আমার কোন কথা শুনিস যে আমি তোর কথা শুনব।”

“আচ্ছা, তুমি বলো আমি কি করলে তুমি ওষুধ খাবে। আমি তাই করবো।”

সজল চৌধুরী মনে মনে হাসেন৷ এই সুযোগই তো তিনি খুঁজছিলেন,”আমি চাই তুমি প্রণালীর সাথে হানিমুনে যাও।”

“কি?!”

“হ্যাঁ, আর এই হানিমুনে যাবার সময় তোমার ফোন আমার কাছে জমা দিয়ে যাবে। ভুলেও নিজের মায়ের সাথে যোগাযোগ করবে না। নাহলে আমি ওষুধ খাওয়া বন্ধ করবে।”

“বাবা, এটা তোমার কেমন ছেলেমানুষী? আমি পারবো না তোমার কথা রাখতে।”

“তাহলে আমিও ওষুধ খাবো না।”

সায়মা চৌধুরী বলেন,”ডাক্তার বলেছে ওষুধ না খেলে তোর বাবার জীবন নিয়ে টানাটানি।”

সমুদ্র দ্বিধায় পড়ে যায়। অনেক ভেবে বলে,”ঠিক আছে,আমি রাজি।”

এই বলে সে নিজের ফোন সজল চৌধুরীর হাতে তুলে দেয় এবং সেই রাতেই প্রণালীকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে সিলেটের উদ্দ্যেশ্যে।

to be continue…

একই সুরে প্রেম আমায় কাঁদায় পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_42(Bonus)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালীকে বিদায় দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রায়ান সাহেব। প্রত্যুষ তাকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করে। যেখানে তার নিজেরই বোনকে বিদায় দিয়ে একদমই ভালো লাগছিল না। ভীষণ কাঁদছিল সবাই।

এদিকে প্রণালী গাড়িতে বসে ছিল৷ তারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে কিন্তু সে কাঁদতে পারছে না। কারণ শান্ত নামক ঠকবাজের কাছে ঠকে যাবার পর সে প্রতিজ্ঞা করেছে জীবনে আর কোন পরিস্থিতিতেই চোখের জল ফেলবে না। জীবনে যাই ঘটুক, সেটাকে আর পাত্তা দেবে না। জীবন তাকে যেখানে ভেসে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবে। আর সর্বোপরি জীবনে আর কখনো কারো প্রেমে পড়বে না। কারণ ভালোবাসা শব্দটার উপর থেকে তার বিশ্বাস চিরতরে উঠে গেছে। এজন্যই তো এমন একজনকে বিয়ে করেছে যাকে সে ঘৃণা করে। অপ্রিয় হয়েই থাকুক। এমন অপ্রিয় ব্যক্তিরাই বুঝি ভালো। অপ্রিয় ব্যক্তিদের হঠাৎ বদলে যাওয়ার জন্য কাঁদতে হয় না৷ তাদের ব্যবহারেও কষ্ট পেতে হয়না। প্রণালী প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে একই সুরে প্রেমকে সে আর সুযোগ দেবে না তাকে কাঁদানোর। তাই কখনো ভুলেও কারো প্রেমে পড়বে না। প্রণালীর এসব ভাবনার মধ্যেই সমুদ্র হঠাৎ করে বলে ওঠে,”হ্যালো, মাই ওয়াইফ। আমাকে নিজের হাজবেন্ড হিসেবে কেমন লাগছে?”

প্রণালী এক শব্দেই উত্তর দেয়,”জঘন্য।”

“তাহলে বিয়েটা করলে কেন?”

প্রণালী নিরুত্তর। কথা বলতে তার একদম ভালো লাগছে না। এদিকে সমুদ্র প্রণালীর এমন কুল রিয়্যাকশন দেখে রেগে যায়। কোথায় সে ভেবেছিল মেয়েটাকে রাগাবে জব্দ করবে কিন্তু এখান তো মেয়েটাই নিরুত্তাপ থেকে তাকে রাগিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্র প্রণালীকে রাগানোর জন্য বলে,”জানো, আমার না একটা গার্লফ্রেন্ড আছে। আর আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকেই ভালোবাসি। তোমাকে তো বিয়ে করেছি তো শুধু বাবার কথায়।”

“ভালো।”

সমুদ্র এবার আরো রেগে যায়। প্রণালীকে বেশ রেগেই বলে,”এসব জেনেও তুমি কোন রিয়্যাক্ট করছ না কেন? বাই এনি চান্স তুমিও কি কাউকে ভালোবাসো?”

সমুদ্রের কথাটা শুনেই প্রণালীর মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে ওঠে। তাকে হাসতে দেখে সমুদ্র বলে,”তুমি হাসছ কেন?”

“ভালোবাসি শব্দটার উপর আমার বিশ্বাস ভরসা কিছুই নেই। আরো ভালো করে বলতে গেলে ভালোবাসা এই শব্দটাকেই আমি প্রচণ্ডরকম ঘৃণা করি।”

“কেন? কেউ ছ্যাকা-ট্যাকা দিয়েছে নাকি?”

প্রণালী কিছু বলে না। নিশ্চুপ হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্র বুঝতে পারে এই মেয়েটাকে সে এত সহজে জব্দ করতে পারবে না৷ তাই সেও চুপ করে যায়।

…………….
প্রণালী ও সমুদ্রকে বহনকারী গাড়ি এসে পৌঁছে যায় চৌধুরী ম্যানশনের সামনে। সমুদ্র দ্রুত গাড়ি থেকে নামে। নেমেই হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতে যায়। এদিকে বাড়ির সামনেই বরণ ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সায়মা চৌধুরী। তিনি সমুদ্রকে এভাবে একা আসতে দেখে বলেন,”তুই এভাবে একা আসছিস কেন? তোর কোন আক্কেল নেই?”

পিছন থেকে সজল চৌধুরী বলেন,”ঐ ছেলের আক্কেল আর কবে ছিল।”

সমুদ্র অপমানিত বোধ করে গমগম চোখে তার বাবার দিকে তাকায়। সজল চৌধুরী রেগে বলেন,”আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে না থেকে নিজের বউকে নিয়ে এসো ইডিয়েট কোথাকার।”

সমুদ্রও সমান রাগ দেখিয়ে বলে,”তুমি আমাকে বিয়ে করতে বলেছ আমি বিয়ে করেছি। এখন আর আমার থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশা করো না।”

“সমুদ্র! তোমার এত বড় সাহস তুমি আমার মুখের উপর এভাবে বলছ?”

“হ্যাঁ, বলছি। আমাকে আর ডিস্টার্ব করো না তো। আমি অনেক টায়ার্ড এখন ঘুমাতে যাব।”

সমুদ্র চলে যেতে নিতেই সজল চৌধুরী বলে ওঠেন,”এভাবে তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আমাদের চৌধুরী বাড়ির একটা রীতি আছে। আমাদের বাড়িতে নতুন বর-বউকে বরণ করেই ঘরে তোলা হয়৷ দেখছ না, তোমার ফুপি বরণ ডালা হাতে দাঁড়িয়ে?”

সমুদ্র নিজের ফুপির দিকে একবার তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,”তাড়াতাড়ি ঐ মেয়েকে আসতে বলো। আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।”

“ঐ মেয়ে কি? স্ত্রী হয় তোমার?”

সমুদ্র বিড়বিড় করে বলে,”স্ত্রী, মাই ফুট!”

এরমধ্যে প্রণালী গাড়ি থেকে নেমে সেখানে এসে উপস্থিত হয়৷ প্রণালীকে দেখে সায়মা চৌধুরী বরণ ডালা নিয়ে এগিয়ে আসেন। দুজনকে পাশাপাশি দেখে মৃদু হেসে বলেন,”মাশাল্লাহ, কি সুন্দর মানিয়েছে তোমাদের দুজনকে।একদম রাজযোটক। কারো নজর না লাগুক।”

বলেই সায়মা চৌধুরী বরণ করতে উদ্যত হন৷ এমন সময় হঠাৎ কেউ একজন এসে হঠাৎ করে বরণ ডালাটা উলটে ফেলে দেয়। উপস্থিত সবাই চমকে ওঠে। সায়মা চৌধুরী হতবাক হয়ে বলে ওঠেন,”ভাবি তুমি!”

পুষ্পা চৌধুরী রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সজল চৌধুরী এগিয়ে এসে নিজের স্ত্রীকে বলেন,”কি করলে এটা তুমি? আর তোমার না ২ দিন পর ফেরার কথা ছিল।”

পুষ্পা চৌধুরী রেগে যান ভীষণ। কোন কিছু বাধ বিচার না করে সজল চৌধুরীর গালে ঠাস করে থা**প্পড় বসিয়ে দেন। সজল চৌধুরী সবার সামনে এভাবে অপমানিত হয়ে লজ্জায় নুইয়ে পড়েন। সায়মা চৌধুরী চিৎকার করে বলেন,”ভাবি! এটা কি করলে তুমি? ভাইয়ার গালে হাত তুললে?”

পুষ্পা চৌধুরী সায়মার উদ্দেশ্য বলেন,”তুমি চুপ থাকো। ভাইয়ের সংসারে নাক গলাতে লজ্জা করে না? দূর হও এখান থেকে।”

অত:পর পুষ্পা চৌধুরী সজল চৌধুরীর সামনে এসে তার শার্টের কলার চেপে ধরে বলেন,”আমি আরো ২ দিন পর ফিরলে তোমার খুব সুবিধা হতো তাইনা? আমাকে না জানিয়ে আমার ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে! এত সাহস তোমার।”

সজল চৌধুরী পুষ্পা চৌধুরীকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। পুষ্পা চৌধুরী দ্বিগুণ গর্জন দিয়ে বলেন,”ভুলে যেওনা এই চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের সর্বেসর্বা আমি। তুমি আমার অধীনে একজন কর্মচারী মাত্র। কারণ তোমার বাবা এই পুরো চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের দায়িত্ব আমার কাধে দিয়ে গেছেন। আর তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমার ছেলের বিয়ে এভাবে দিলে? হাউ ডেয়ার ইউ?”

প্রণালী অবাক হয়ে সবকিছু দেখছিল। সে তো বুঝতেই পারছে না তার চোখের সামনে এসব কি হচ্ছে। এদিকে সজল চৌধুরীও চুপ। তার যৌবনে করা একটা ভুলের জন্য তার বাবা তাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেছেন। এমনকি সেই কারণেই তিনি নিজের স্ত্রীর বিরোধিতাও করতে চান না। তার কথা মুখ বুজে মেনে নেন। এমনকি তার সব অপমান। কিন্তু কস্মিনকালেও ভাবেন নি তার স্ত্রী তার সাথে এমন কিছু করবে। নিজের ছেলে-ছেলের বউ সহ এতগুলো মানুষের সামনে তার গায়ে হাত তুলবে!

পুষ্পা চৌধুরী রাগে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিজের বান্ধবীর মেয়ে নিজের ছেলের বউ করবেন বলে ভেবেছিলেন। মেয়েটাকে তার বড্ড পছন্দ। অথচ সজল চৌধুরী এভাবে তার সকল পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলেন। পুষ্পা চৌধুরী ত্রস্ত পায়ে প্রণালীর সামনে গেলেন। এই মেয়েটাকে দেখে এখন তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। তিনি চিৎকার করে বলেন,”তোমাকে আমি ছেলের বউ হিসেবে মানি না। তুমি যেখান থেকে এসেছ সেখানেই ফিরে যাও।”

প্রণালী এমনিতেই বিধ্বস্ত ছিল, অনেক ক্লান্তও। তার উপর পুষ্পা চৌধুরীর এমন গলাবাজি সহ্য হলো না৷ মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল। সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার আগেই সমুদ্র ধরে নিলো। পুষ্পা চৌধুরী এই দৃশ্য দেখে রেগে গিয়ে বললেন,”ছেড়ে দাও এই মেয়েটাকে বাবাই।”

“কিন্তু মম, মেয়েটা তো পড়ে যাবে।”

“আই ডোন্ট কেয়ার বাবাই। আমি যা বলছি তাই করো। নিজের মমের অবাধ্য তো তুমি নও।”

সমুদ্র নিজের মায়ের কথায় প্রণালীকে ছেড়ে দেয়। বিধায় সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে৷ সায়মা চৌধুরী এসে প্রণালীকে আগলে নেয়।

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_43
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালীর ঘুম ভাঙলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা নরম বিছানায়৷ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সায়মা চৌধুরী তার সামনে বসে আছে। প্রণালী কাচুমাচু হয়ে বলে,”আপনি এখানে?”

সায়মা চৌধুরী আফসোরের সুরে বলেন,”এটা আমাদের বাড়ির গেস্ট রুম। ভাবি তোমাকে এখানেই থাকতে বলেছে। তিনি কিছুতেই এই বিয়েটা মানবেন না।”

“তিনি কি এই বিয়ের ব্যাপারে জানতেন না?”

“না। ভাইয়া ভাবিকে না জানিয়ে সব ব্যবস্থা করেছে। যাইহোক, তুমি এখানে বিশ্রাম নাও। আমিও এখানেই আছি। কাল সকাল সকাল চলে যাব। ভাবির এত অপমান সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। না জানি তোমাকেও কত অপমান সইতে হবে। ভাইয়ার সবটা বিবেচনা করা দরকার ছিল। ভাইয়া তো জানে ভাবি কেমন। আর ছেলেটাও হয়েছে একদম মায়ের নেওটা। মায়ের কথায় ওঠে আর বসে।”

প্রণালী কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না এসব কথার। তার এমনিতেও এসবে কিছুই যায় আসে না। সে কারো স্ত্রীর মর্যাদাও চায়না। কে তাকে অপমান করল সেটাও প্রণালীকে আর ভাবায় না। শান্তর থেকে পাওয়া আঘাত তাকে এতটাই ভেঙে দিয়েছে যে কোন কিছুই আর গায়ে লাগছে না। প্রণালীর মনে হয়, কেউ যদি তার গলা টিপে মে*রেও ফেলে তাতেও আর তার কিছু যাবে আসবে না। এতটাই অনুভূতি হীন হয়ে পড়েছে মেয়েটা। এজন্যই তো বোধহয় বলে, ভালোবাসা মানুষকে যেমন গড়তে পারে ঠিক সেই একইভাবে ভেঙে মুচড়ে দিতেও পারে!

হঠাৎ করেই গেস্টরুমের দরজায় কেউ ঠকঠক করে আওয়াজ করে। সায়মা চৌধুরী বিরক্ত সুরে প্রণালীকে বলে,”তুমি এখানে বসো। আমি দেখছি কে এসেছে।”

সায়মা চৌধুরী গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পান সজল চৌধুরীকে৷ সজল চৌধুরী প্রণালীকে গেস্টরুমে দেখে বলে ওঠেন,”ও এখানে কি করছে সায়মা? ওর না আজ বাসর রাত। ওর তো সমুদ্রের সাথে থাকার কথা।”

সায়মা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বলেন,”তোমার কি মনে হয় ভাবি ওদের বাসর হতে দেবে? যেখানে উনি এই বিয়েটাই মানতে পারেন নি।”

“এসব বললে তো হবে না সায়মা। ওদের বিয়ে হয়েছে সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না। প্রণালী যেহেতু আইনত ও ধর্মমতে সমুদ্রর স্ত্রী তাই ওদের একসাথেই থাকতে হবে। তুই প্রণালীকে নিয়ে আয়। আমি সবটা ম্যানেজ করছি।”

সায়মা চৌধুরী নিরুপায় হয়ে প্রণালীর কাছে এসে বলেন,”তুমি এসো আমার সাথে। দেখি ভাইয়া কি করতে পারে।”

প্রণালী কোন বাক্যব্যয় না করে উঠে দাঁড়ায়। সায়মা চৌধুরী তাকে নিয়ে যেতে থাকে। সমুদ্রর রুমের সামনে এসে সজল চৌধুরী দরজায় নক করতে থাকেন। সমুদ্র অবশ্য এত তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। সে শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছিল। দরজায় নক করার শব্দে বিরক্ত হয়ে বলে,”আবে কে রে!”

সজল চৌধুরী বলে ওঠেন,”আমি তোমার বাবা সমুদ্র।”

“এত রাতে কি চাই তোমার?”

“দরজাটা খোলো তারপর বলছি।”

সমুদ্র বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে। উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়৷ সজল চৌধুরী বলেন,”তোমার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই? নতুন বউকে গেস্টরুমে রেখে তুমি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ?”

“তো কি করব? মম স্পষ্ট বলে দিয়েছে এই মেয়ের থেকে যেন আমি ডিসটেন্স মেইনটেইন করে চলি। আমি তো মমের অবাধ্য হতে পারবো না।”

সজল চৌধুরী ছেলের কথায় ভীষণ রেগে গিয়ে বলেন,”মেয়েটাকে যখন তুমি বিয়ে করেছ তখন ও তোমার দায়িত্ব। তাই নিজের মায়ের কথায় না নেচে ওর দায়িত্বটা বুঝে নাও। প্রণালী মা, তুমি যাও তোমার স্বামীর রুমে প্রবেশ কর৷ এখন থেকে এই রুমে তোমারও সমান অধিকার।”

সমুদ্র বলে,”নাহ, ও এই রুমে আসবে না। মমের স্পষ্ট নির্দেশ ও যেন আমার ত্রীসীমানায় না থাকে।”

সায়মা চৌধুরী বলেন,”তুই তোর মায়ের কথা শুনে নিজের স্ত্রীর সাথে অবিচার করতে পারিস না। মেয়েটাকে সজ্ঞানে বিয়ে করেছিস তুই।”

সমুদ্র একপলক প্রণালীর দিকে তাকায়। এত কিছু হয়ে গেল তবুও মেয়েটার বিশেষ কোন হেলদোল নেই৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নিজের মতো। যেন তার এসবে কিছু যায় আসে না৷ এসব দেখে তো সমুদ্র ভীষণ চটে গেল। মনে মনে বলল,”এ কি মানুষ নাকি রোবট?”

আর সবার সামনে বলল,”আমি এত কিছু জানি না। মম যতক্ষণ না অনুমতি দিচ্ছে ততক্ষণ ওকে আমি এই রুমে থাকতে দিতে পারব না। আমাকে আর ডিস্টার্ব না করে যাও এখান থেকে।”

সজল চৌধুরী বলেন,”আমি তোমার বাবা, আমার কথাও তোমাকে শুনতে হবে। প্রণালী এই রুমেই থাকবে।”

এরমাঝেই পুষ্পা চৌধুরী সেখানে চলে আসেন। এসেই সমুদ্রের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমার বাবা তো ঠিক বলছে বাবাই। ঐ মেয়েটাকে তুমি বিয়ে করেছ, তোমার রুমে তো ওর অধিকার আছে। ওকে তোমার রুমে থাকতে দাও।”

সমুদ্র চৌধুরী নিজের মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,”মম, তুমি এই কথা বলছ! অথচ তুমিই তো এই মেয়ের থেকে আমায় দূরে থাকতে বলেছিলে। আমি তো তোমার কথামতোই কাজ করছিলাম।”

সজল চৌধুরী বলেন,”যাক! তাহলে তোমার সুমতি হলো।”

তখনই সবাইকে চমকে দিয়ে পুষ্পা চৌধুরী বলে ওঠেন,”ঐ মেয়েটাকে নিজের রুমে থাকতে দিয়ে তুমি আমার রুমে চলে এসো বাবাই। আজ সারা রাত মা-ছেলে গল্প করে কা’টিয়ে দেই।”

সায়মা চৌধুরী বলেন,”এটা তুমি কি বলছ ভাবি? আজ তোমার ছেলের বাসর রাত আর তুমি ওকে নিজের সাথে নিয়ে যাচ্ছ!”

পুষ্পা চৌধুরী রাগী গলায় বলেন,”তোমাকে না বলেছি আমার সংসারে নাক না গলাতে। নিজের নাক সামলে রাখো নাহলে সেটা কে’টে দিতে আমার একটুও হাত কাপবে না।”

এমন অপমানে সায়মা চৌধুরী চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হন। সজল চৌধুরী অনেক সাহস করে স্ত্রীর মুখের উপর বলেন,”তুমি কিন্তু কাজগুলো একদম ঠিক করছ না পুষ্পা। ছেলেটার বিয়ে হয়েছে আর এখনো ওকে আঁচলের তলে রাখতে চাইছ।”

পু্ষ্পা চৌধুরী স্পষ্ট স্বরে বলেন,”এই বিয়ে আমি মানি না। কারণ এই মেয়েকে আমার পছন্দ নয়। আমি আমার ছেলেকে আঁচলের তলেই রাখবো। যেদিন নিজের পছন্দের মেয়েকে ছেলের বউ করে আনব, সেদিন আমি ওর ভার সেই মেয়ের উপর ছেড়ে দেব। তার আগে নয়।”

এই বলে পুষ্পা চৌধুরী সমুদ্রকে বলেন,”বাবাই, তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো আমার রুমে।”

সমুদ্র মায়ের বাধ্য সন্তানের মতো বলে,”তুমি যাও মম, আমি এখনই যাচ্ছি।”

“তাড়াতাড়ি এসো।”

বলেই পু্ষ্পা চৌধুরী তার রুমের দিকে পা বাড়ান। তিনি চলে যাবার পর সমুদ্র নিজের বাবার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”শুনলে তো মম কি বলল? এখন আমাকে যেতে দাও।”

বলেই সে প্রণালীর দিকে একপলক তাকিয়েই চলে যায়। এত কিছুর পরেও প্রণালীর কোন হেলদোল নেই। সজল চৌধুরী প্রণালীর কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”কিছু মনে করো না মা।”

প্রণালী তো আদতে এসব কিছু গায়েই মাখে নি। তাই সে কোন প্রতিক্রিয়াও দেখায় না। সায়মা চৌধুরী বলেন,”এভাবে চুপ থাকলে চলবে না৷ নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে।”

প্রণালী তবুও নিশ্চুপ। একটু পর বলে,”আমি কোথায় থাকব?”

সায়মা চৌধুরী বলেন,”এটা যেহেতু তোমার স্বামীর রুম তাই এখানেই থাক।”

“ওকে।”

বলেই প্রণালী সমুদ্রের রুমের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। এসব লড়াই-টড়াইয়ে তার ইন্টারেস্ট নেই। জীবনে এমনিতেও আর কোন কিছুর পরোয়া করে না। এদিকে সায়মা চৌধুরী সজলকে বলেন,”তুমি কোন ভুল করলে না তো ভাইয়া? এই মেয়ে কিভাবে ভাবিকে জব্দ করবে?”

“সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। মেয়েটা তো অনেক প্রতিবাদী ছিল। হঠাৎ এমন চুপ হয়ে গেল কিভাবে?”

এদিকে প্রণালী ভীষণ ক্লান্ত। শুয়ে পড়তে না পড়তেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_44(Bonus)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী সকালে ঘুম থেকে উঠেই এক নতুন নাটকের সাক্ষী হয়। আর এই নতুন নাটকের নাম বৌভাত। প্রণালীর বৌভাতের জন্য বড় করে উৎসব করতে চাইছেন সজল চৌধুরী। কিন্তু সজল চৌধুরীর সাথে ক্রমান্বয়ে তর্ক করে চলেছেন পুষ্পা চৌধুরী। তিনি যেহেতু এই বিয়েটা মেনে নেন নি তাই কোন রিসেপসনও তিনি মেনে নেবেন না। এই নিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় উঠেছে। সায়মা চৌধুরী প্রণালীর কাছে এসে বলে,”দেখেছ তোমার শাশুড়ীকে? কিরকম ডাইনি মহিলা দেখেছ। এনার সামনে একদম ভেজা বিড়াল হয়ে থাকবে না। নাহলে কামড়ে শেষ করে দেবে। এনার সাথে সমানে সমানে লড়াই করতে হবে। সেইজন্য তোমায় প্রতিবাদ করতে হবে। বুঝলে?”

প্রণালী কিছু বলে না। সে এসব কিছুতে একদমই আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না। তার এই সময় একটু শান্তির দরকার যাতে করে নিজেকে সামলাতে পারে। বদলে ভাগ্যে জুটছে অশান্তি আর অপবাদ। যা তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। প্রণালী যখন এসব ভাবছিল তখনই সমুদ্র পুষ্পা চৌধুরীকে পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলে। যা শুনে আগ্নেয়গিরির মতো লাফানো পুষ্পা চৌধুরী একেবারে শীতল হয়ে যান। ঝগড়া বিবাদ থামিয়ে তিনি আসেন নিজের স্বামীর সামনে। অতঃপর বলেন,”তুমি যদি বৌভাত-টৌভাত করতে চাও, তো করতে পারো। এতে আমার কোন আপত্তি আর নেই।”

এই বলেই তিনি চলে যান। সজল চৌধুরী হঠাৎ নিজের স্ত্রীর এমন ৩৬০° বদলে যাওয়া দেখে ভীষণ অবাক হন। তবে স্বস্তিও খুঁজে পান। যাক, তাহলে একবার যখন রাজি হয়েছে তখন আর ঝামেলা করবে না। এই ভেবেই তিনি সব আয়োজন শুরু করতে হাকডাক শুরু করেন। সায়মা চৌধুরীকেও বলেন,”তুই আমার হাতে-হাতে একটু সাহায্য কর। পুষ্পা রাজি হলেও ও আমায় কোন সাহায্য করবে না। তাই তুই এখন আমার একমাত্র ভরসা।”

“তুমি এক দম চিন্তা করো না ভাইয়া। আমি তো আছি তোমার সাহায্য করাত জন্য। আমি হাতে হাতে তোমার সব কাজে সাহায্য করব।”

এরপর তিনি প্রণালীর কাছে গিয়ে বলেন,”তুমিও তৈরি হয়ে নাও। আমি এখন মেকআপের লোক ডেকে দেব। চৌধুরী বাড়ির বউ বলে কথা। বৌভাতে তো সেরকম ই সাজতে হবে। আর সমুদ্র তুইও তৈরি হয়ে থাকিস।”

বলেই তিনি চলে যান। সবাই চলে যাবার পর সমুদ্র চৌধুরী প্রণালীর দিকে তাকিয়ে শয়তানী হেসে বলে,”আজ আমি এমন চাল দেব যে দেখি তুমি আর কতক্ষণ এমন চুপ করে সব সহ্য করো। আজ তোমার সহ্যক্ষমতারই পরীক্ষা হবে আমার অপ্রিয় স্ত্রী।”

~~~~~~““
বৌভাতের আয়োজনে আজ অবশ্য তেমন কেউ আসে নি৷ যাদেরকে একদম না বললেই নয় তেমন কজনকেই ডেকেছেন সজল চৌধুরী। রায়ান সাহেব প্রত্যুষকে সাথে নিয়ে এসেছেন। এছাড়াও এসেছেন সৌভিক রায় তার পুরো পরিবারকে নিয়ে। রায়ান সাহেব এসেই নিজের মেয়ে প্রণালীর সাথে দেখা করে নেন। মেয়েকে দেখেই জড়িয়ে ধরেন অতি আদরে। মেয়েটার প্রতি ভীষণ মায়া হচ্ছে। মেয়েটার উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তারপর না জানি এখানে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে তার কষ্ট হবে। তাই রায়ান সাহেব মেয়েকে প্রশ্ন করেন,”তুমি ঠিক আছো তো মা?”

প্রণালী স্বাভাবিক ভাবেই বলে,”হুম।”

আর বেশি কিছু বলে না। মেয়েটা ধীরে ধীরে কেমন যেন অনুভূতি শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কোন কিছুতেই কোন রিয়্যাক্ট করছে না। এমন অবস্থায় মেয়েটাকে দেখে তার একদমই ভালো লাগছে না। তিনি চান মেয়েটা আবার আগের মতো হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠুক। তাই তিনি ঠিক করেছেন আজ সমুদ্রর সাথে কথা বলবেন। সমুদ্রকে সব ঘটনা খুলে বলবেন। কারণ তিনি মনে করেন এখন সমুদ্রই পারবে তার মেয়েকে আবার সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে। প্রণালীর সব দুঃখের স্মৃতি মুছে দিয়ে তার মনে নতুন সুখের স্মৃতি তৈরি করতে।

তার এই ভাবনার মধ্যেই তিনি দেখতে পেলেন সজল চৌধুরী এগিয়ে আসছেন তার দিকে। সজল চৌধুরীকে একা দেখে রায়ান সাহেব বলেন,”আপনি একা যে, বেয়ান সাহেবা কোথায়? বিয়ের অনুষ্ঠানেও ওনাকে দেখলাম না। আজও কি উনি আসবেন না?”

“এই তো আমি এসে গেছি।”

বলেই হাসি মুখে সেখানে উপস্থিত হন পুষ্পা চৌধুরী। এসে রায়ান সাহেবের সাথে বেশ ভালো ভাবেই কথা বলতে থাকেন। হাজার হোক সবার সামনে তো তাকে নিজের ভালোমানুষির অভিনয় করতেই হবে। কারণ এখানে যে তাদের বিজনেসের অনেক পার্টনারও আছে। তাদের সামনে নিজের ইমেজ খারাপ করলে চলবে না। তাতে যে লস।

প্রণালী পুষ্পা চৌধুরীর এমন নিখুঁত অভিনয় দেখে অবাক হয়। সবার সামনে কত সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে। রায়ান সাহেবকে তো এমন ভাবে বলছেন যেন সব কিছু স্বাভাবিক। অথচ এই মহিলার কাল যে রূপ সে দেখেছে! কত বড় স্পর্ধা হলে কেউ নিজের স্বামীর গায়ে হাত তোলে। প্রণালী অবশ্য এসবে বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করল না। শান্তর এতদিনের আসল রূপ সে ধরতে পারে নি৷ সেখানে অন্যরাও যে মুখোশের আড়ালে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। যার যা ইচ্ছা করুক, প্রণালীর তাতে কিছু যায় আসে না। সে তো এখন পুরো মরা মানুষের মতোই আছে। যার শুধু দেহটাই জীবিত , মন একদম মরে গেছে। তাই কোন কিছুই তার উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

~~~~~~~
বৌভাত উপলক্ষে আজ একটা পার্টি হোস্ট করা হয়েছে। যেখানে সব কাপলরা ডান্স করছে। এরমধ্যে হঠাৎ করে পুষ্পা চৌধুরী হাতে মাইক নিয়ে সবার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”আজ আমাদের এখানে একজন স্পেশাল গেস্ট আসবে। সে আর কেউ নয়। আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী টিনার মেয়ে টায়রা। টায়রাকে তো আপনাদের সাথে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। সে একজন বৃটিশ-বাংলাদেশী। যে বৃটিনেই বড় হয়েছে এবং সেখানকার একজন বড় ডান্সার। তো সবাই ওয়েলকাম করুন টায়রাকে।”

সবার সামনে এসে উপস্থিত হয় টায়রা৷ তাকে দেখেই সবাই করতালি দেয়। টায়রাকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে যায় সমুদ্র। তারপর বলে,”চলো আমার সাথে ডান্স করো।”

এদিকে সজল চৌধুরী ও সায়মা চৌধুরী দুজনেই অবাক টায়রাকে দেখে। সায়মা চৌধুরী নিজের ভাইকে বলেন,”এই টায়রা পায়রা হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল ভাইয়া? এই টা সেই মেয়েটা না, যার সাথে ভাবি সমুদ্রর বিয়ে দিতে চেয়েছিল?”

“হুম, এটাই তো সেই মেয়ে। কিন্তু এ এখানে কি করছে সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না।”

টায়রা সমুদ্রকে বলে,”হাই, সমুদ্র বেইব। কেমন আছ? আমাকে না বলে এভাবে বিয়ে করে নিলে। আর আমি তোমার আশায় কত সুদর্শন যুবককে রিজেক্ট করলাম। এখন আমার কি হবে?”

“চিন্তা করো না টায়রা সুইটহার্ট। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তুমি অবশ্যই আমাকে পাবে। আগে আমাকে নিজের রিভেঞ্জটা পুরো করতে দাও।”

এরপর দুজনেই কাপল ডান্স করে। যা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে৷ রায়ান সাহেব, প্রত্যুষ, সৌভিক রায় সবাই হতবাক। দুজন ভীষণ ঘনিষ্ঠ ভাবে ডান্স করছিল। পুষ্পা চৌধুরী ভীষণ খুশি। এইজন্যই তো তিনি বৌভাতের জন্য রাজি হয়েছিলেন। এখন তার আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে। সবই তো সমুদ্রের বুদ্ধি।

সমুদ্র টায়রার সাথে ডান্স করতে করতে আড়চোখে প্রণালীকে দেখে। সমুদ্র চৌধুরী ভেবেছিল সবার সামনে এভাবে অন্য রমণীর হাত ধরে ডান্স করলে মেয়েটা নিশ্চয়ই রিয়্যাক্ট করবে। কিন্তু এতো এখনো একদম চুপ। দেখে মনে হচ্ছে কোন কিছুতে ওর বিন্দুমাত্র কোন প্রভাব পড়ছে না।

আর আসলেও প্রণালী সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছে। সমুদ্রের প্রতি তার আলাদা কোন টানই নেই। তাই সে কার সাথে নাচল এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়৷ এই জিনিসটা সমুদ্রকে রাগিয়ে দিলো। এই মেয়েটাকে সে কোনভাবেই জব্দ করতে পারছে না। রেগে ডান্স থামিয়ে টায়রাকে একা রেখে নিজের রুমে চলে গেল সমুদ্র।

to be continue…

একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_39
#ইয়াসমিন_খন্দকার

“কাল তোমার বিয়ে। তৈরি হয়ে থাকো।”

প্রণালী হতবাক হয়ে গেলো রায়ান সাহেবের মুখে এমন কথা শুনে। প্রতিবাদের সুরে বলল,”আমি শান্ত ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না বাবা। তোমার ঠিক করা পাত্রকে তো নয়ই।”

রায়ান প্রণালীকে হুংকার দিয়ে বলে,”আমার অবাধ্য হওয়ার চেষ্টা করো না প্রণালী। এতে কোন লাভ হবে না। এতদিন তোমার অনেক বাত্তামিজি আমি বরদাস্ত করেছি কিন্তু আর না। এবার আমি তোমাকে উচিৎ শিক্ষা দেব।”

“তুমি অনেক খারাপা বাবা। তুমি কারো কথা গ্রাহ্য করো না। এখন আমি বুঝতে পারছি মা কেন তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আসলে তুমি এটারই যোগ্য। আমিও যখন তোমাকে ছেড়ে চলে যাব তখন তুমি যোগ্য শিক্ষা পাবে।”

রায়ান সাহেব আজ আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। প্রণালীর গালে ঠা**স করে চ**-ড় বসিয়ে দিলেন। আজ তার সব সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। প্রণালী এতেও দমল না। ঘরের সব জিনিসপত্র এলোপাতাড়ি এদিকে ওদিকে ছু**ড়ে দিয়ে বলল,”এই দিন দেখার জন্য আমি তোমাকে এত কষ্ট করলাম। আসলে তুমি কারো ভালোবাসা ডিজার্ভ করো না। তোমার যেখানে যাওয়ার ইচ্ছা তুমি যাও। কিন্তু যাওয়ার আগে আমার জানাজা করে যেও।”

“বাবা! তুমি কিন্তু ইমোশনাল গেইম খেলছ। এতে কোন লাভ হবে না। শান্ত ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে হলে আমার লাশ করবে আমি না।”

রায়ান সাহেবের ইচ্ছা করছিল প্রণালীকে মাটিতে পু্ঁতে ফেলতে। শান্তর বাবার ব্যাপারে সবটা জেনেও কিরকম নির্লজ্জ, অভদ্রের মতো আচরণ করছে।

রায়ান সাহেব শেষবারের মতো নিজের মেয়েকে বললেন,”তুমি নিজের ভালোটা এখনো বোঝো। আমি তোমায় বিশ্বাস করলাম। তুমিও আমার উপর বিশ্বাস করে আমার ঠিক করা পাত্রকে বিয়ে করে নাও। যদি নিজের পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করো তাহলে কিন্তু তোমায় আজীবনের জন্যই পস্তাতে হবে।”

প্রণালী এবার উত্তরে কিছু বলল না। মাথাটা যথাসম্ভব ঠান্ডা রাখল সে। রায়ান সাহেব তার রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই সে বলে উঠল,”পস্তাবো তো তখন যখন আমি তোমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করব। আমার সুখ আমি শান্তর মাঝেই খুঁজে নিয়েছি। তাই আমি বিয়ে করলেও ওকেই করব। আর অন্য কাউকে নয়।”
~~~~~~~~~~~~~
অনুরাধা দেবী ও সোহিনী আজ এলো প্রণালীর সাথে দেখা করতে। সৌভিক বাবুই তাদের আজ এখানে পাঠিয়েছেন। তাদের দায়িত্ব হলো প্রণালীকে বোঝানো।

আজ সোহিনী ও অনুরাধা দেবীকে দেখে প্রণালী একটুও খুশি হলো না৷ অনুরাধা দেবী প্রণালীর কাছে এসে বললেন,”তুমি তোমার বাবার সিদ্ধান্তটা মেনে নাও প্রণালী। শান্ত ঐ আবিরের ছেলে। তুমি তো সবটাই জানো আবিরের জন্য তোমার মা-বাবার জীবনে কি দূর্গতি নেমে এসেছিল। তারপরও তুমি কিভাবে ওর ছেলেকে বিয়ে চাইছ?”

প্রণালী নিস্তেজ গলাতেই বলল,”শান্তর বাবা দোষ করেছে শান্ত তো কিছু করেনি। তাই না? তাহলে কেন শুধু শুধু আমি আর শান্ত সাফার করব? আমরা তো একে অপরকে ভালোবাসি তাইনা?”

সোহিনী এসে প্রণালীর মাথায় হাত রেখে বলল,”আমি তোকে নিজের ছোট বোনের মতোই দেখি প্রণালী। এই দিদির একটা অনুরোধ রাখ। রায়ান আঙ্কেলের কথাটা মেনে নে। উনি তোর ভালোই চান। এই বিয়েটা করলে তুই সুখী হবি। ছেলেমানুষী করিস না একদম।”

প্রণালী তাচ্ছিল্য হেসে বলল,”নিজের ভালোবাসার মানুষকে না পেয়ে আমি কিভাবে সুখী হবো সোহিনী দিদি?”

সোহিনী প্রণালীকে বোঝানোর জন্য বলে,”তোমার ভালোবাসার মানুষটা যে সঠিক নয় প্রণালী। আর দেখ মা-বাবার আশীর্বাদ ছাড়া কোন কিছুই সুখকর হয় না। আর সমুদ্র ভাইয়াকে বিয়ে করলে তুমি সুখীই হবে।”

প্রণালী অবাক হয়ে গেল। বলল,”সমুদ্র ভাইয়া মানে? সজল আঙ্কেলের ছেলে?”

“হ্যাঁ, ওনার সাথেই তো তোমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। কেন তুমি জানো না?”

প্রণালী ধাক্কা খেলো ভীষণ। মনে করল সমুদ্রের সাথে তার প্রথম দেখার কথা। ঐ অহংকারী, নিম্ন মানসিকতার ছেলেকে তাকে বিয়ে করতে হবে! প্রণালী বিড়বিড় করে বলল,”কক্ষনো না।”

বলেই সে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। অত:পর বলল,”তোমার চয়েজের উপর আমার ভরসা উঠে গেছে বাবা। আমি ১০০% শিওর আমার চয়েজই সেরা।”

এই বলে সে ছুটে বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় রায়ান সাহেব তাকে আটকে দিলেন। বললেন,”কোথায় যাচ্ছ তুমি? বিয়ের আগে পর্যন্ত কোথাও যাওয়া হবে না তোমার।”

“বাবা, আমায় যেতে দাও। তুমি আমার সাথে এত বড় জুলুম করতে পারো না।”

“আমি কি করতে পারি আর কি পারি না সেটা এবার তুমি টের পাবে।”

বলেই প্রণালীকে টানতে টানতে তার ঘরে নিয়ে গেলেন রায়ান সাহেব। প্রণালীকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। নিজের মেয়ের সাথে এমন করে তিনিও অনেক কষ্ট পেলেন। কিন্তু মেয়ের ভালোর জন্য যে এটা করতেই হতো।

এদিকে প্রণালী সমানে চিৎকার করতে লাগল। সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু রায়ান নিষ্ঠুর হলো ভীষণ। এতদিন মেয়ের সব জেদ মেনে নিয়ে তাকে বড্ড প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই প্রশ্রয়েই মেয়ে মাথায় উঠেছে। এখন তাকে যে মাথা থেকে নামাতেই হতো। নাহলে অপেক্ষা করছে সমূহ বিপদ!
~~~~~~~

সমুদ্র যখন থেকে তার বিয়ের কথা জানতে পেরেছে তখন থেকে না, না করেই চলেছে। তার এখন মোটেই বিয়ে করার কোন ইচ্ছা নেই। কিন্তু সজল চৌধুরীও নাছোড়বান্দা। তিনি যখন একবার সুযোগ পেয়েছেন তখন সেই সুযোগের সদব্যবহার করবেনই। নিজের ছেলেকে এবার সাংসারিক দায়বদ্ধতার জালে বাধবেন সেটা একদম ঠিক করে রেখেছেন। সমুদ্র তার বাবার সামনে চিৎকার করে বলল,”মম না থাকায় এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছ তাই না? তাহলে শুনে রাখো ড্যাড, আমি এখন কিছুতেই বিয়ে করবো না। নো, নেভার।”

সজল চৌধুরী বললেন,”এসব কথায় কাজ হবে। আমি মিস্টার রায়ানকে কথা দিয়েছি যে ওনার মেয়ে প্রণালীকেই আমার ঘরের বউ করে আনব। তাই এই কথা আমি রাখবোই।”

সমুদ্র একটু স্থির হলো। বলল,”প্রণালী!”
“হ্যাঁ, সেদিন পার্টিতে যেই মেয়েটাকে দেখলে তুমি। মেয়েটা কিন্তু দারুণ সুন্দরী। ফর্সা, লম্বা, সুন্দর মুখশ্রী। তোমার সাথে দারুণ মানাবে।”

হঠাৎ করেই সমুদ্র ৩৬০° ঘুরে গিয়ে বলে,”আমি বিয়েতে রাজি। তুমি দ্রুত সব এরেঞ্জমেন্ট করো।”

“তোমার সুমতি হলো তাহলে? মেয়েটাকে তাহলে মনে ধরেছে?”

সমুদ্র মুচকি হাসলো। মনে মনে বললো,”ঐ মেয়েটা সেদিন আমাকে অনেক অপমান করেছিল। আমার গায়ে হাত অব্দি তুলেছিল। এবার আমি তার সব কিছুই সুদে আসলে উসুল করব। একবার আসুক আমার বউ হয়ে। তারপর আমি ওকে মজা দেখাবো।”

~~~~~~~
প্রণালী কাঁদতে কাঁদতে নিজের চোখের জল শুকিয়ে ফেলেছে। আর কাঁদতেও পারছে না বেচারি মেয়েটা। নিজের ভালোবাসার মানুষটার সাথে চির বিচ্ছেদ আর ঘৃণিত ব্যক্তিকে নিজের স্বামী হিসেবে বরণ করে নেয়া! ভীষণ জঘন্য এসব অনুভূতি। প্রণালী দেখতে লাগল সিলিং ফ্যানের দিকে। চোখের জল মুছে বলল,”শান্তকেই যদি না পাই তাহলে আমি আর বেঁচে কি করবো? এর থেকে ভালো আমি নিজেকেই শেষ করে দেই। ঐ সমুদ্রর মতো জঘন্য মানুষকে বিয়ে করার থেকে মরে যাবাই তো ভালো।”

বলেই সে এগিয়ে গেলো সিলিং ফ্যানের দিকে। উদ্দ্যেশ্য নিজেকে শেষ করে দেওয়া। এই সকল কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে তার কাছে যেন মৃত্যুই শ্রেয় মনে হলো। অনুভূতির মায়ের জালে বদ্ধ হলো। প্রেম তাকে কাঁদিয়েছে! প্রেমের বিরহ তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। তাইতো এমন আত্মবিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিলো রায়ান সাহেবের জেদী, চঞ্চল মেয়েটা।

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_40(ধামাকা)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী নিজের কোন বড় ক্ষতি করতে যাবে তার আগেই প্রত্যুষ তার ঘরের দরজা খুলে দিলো। প্রণালীর উদ্দ্যেশ্যে বলল,”আপু, তুমি এটা কি করছ?”

প্রণালী প্রত্যুষের দিকে তাকায়। প্রত্যুষ এগিয়ে এসে বলে,”আমি জানি তুমি শান্ত ভাইয়াকে ভালোবাসো এবং তাকেই বিয়ে করতে চাও। তাই তো আমি তোমাদের এক করার জন্যই এখানে এসেছি। এখন বাড়িতে কেউ নেই। বাবা আমাকে তোমার খেয়াল রাখতে বলে বাইরে গেছে। এই সুযোগ তুমি পালিয়ে যাও। নিজের জীবনটা নিজের মতো গুছিয়ে নাও।”

প্রণালী খুশিতে আপ্লুত হয়ে যায়। তার বাবা তাকে না বুঝলেও তার ভাই তাকে বুঝেছে। প্রণালী এগিয়ে এসে প্রত্যুষের গালে কয়েকটা চুমু খায়। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,”তোকে অনেক ধন্যবাদ ভাই। তুই আমাকে বুঝলি।”

“বাবা যেকোন সময় চলে আসবে আপি। তুই যা তাড়াতাড়ি।”

প্রণালী মাথা নাড়ায়। যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর সাথে সাথেই প্রত্যুষ প্রণালীর হাতে তার ফোন তুলে দিয়ে বলল,”বাবা তো তোমার ফোন নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। তাই তুমি আমার ফোনটা নিজের সাথে করে নিয়ে যাও আপি। এর মাধ্যমে শান্ত ভাইয়ার যোগাযোগ করো।”

প্রণালীর আবারো নিজের ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নেয়। এখন তার গন্তব্য শান্ত। শান্তর সাথে নতুন করে সে সব শুরু করবে। একসময় রায়ান সাহেবও সব মেনে নিবে এটাই তার বিশ্বাস।

~~~~~~~~~~~~
প্রণালী শান্তর সাথে ফোনে কথা বলেছে। শান্ত প্রণালীকে বলেছে কাজি অফিসের সামনে এসে বসে থাকতে। প্রণালীও তাই কাজি অফিসের দিকে পা বাড়িয়েছে। কাজি অফিসের সামনে এসে শান্তকে ফোন দিলো প্রণালী। কিন্তু শান্ত ফোনটা রিসিভ করল না। প্রণালী বারবার ফোন করতে লাগল। এক সময় শান্ত ফোনটা রিসিভ করে বলে,”আমি কিছু কারণে ঢাকার বাইরে আছি। তুমি কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে অপেক্ষা করো। আমি যথাসময়ে পৌঁছে যাব।”

“আমি তাই করবো।”

বলে প্রণালী ফোনটা রেখে দেয়। আর অপেক্ষা করতে থাকে শান্তর জন্য। তবে তার অপেক্ষার প্রহরের কোন শেষ হয়না।
~~~~~~
রায়ান সাহেব বাড়িতে ফিরে প্রণালীকে তার রুমে না দেখে ভড়কে যান। প্রত্যুষকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন কিন্তু প্রত্যুষ মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। রায়ান সাহেব অধৈর্য হয়ে বলেন,”তুমি বুঝতে পারছ না নিজের বোনকে কি বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছ। ভালো চাইলে এখনই আমাকে সব সত্য বলে দাও। নাহলে নিজের বোনের দূর্ভাগ্যের দায় তোমাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।”

প্রত্যুষ তবুও যখন চুপ থাকে তখন রায়ান সাহেব শান্তর বাবা রায়ানের ব্যাপারে রায়ান সাহেবকে সব খুলে বলেন। সব শুনে প্রত্যুষ বুঝতে পারে সে কত বড় ভুল করে ফেলেছে। তাই রায়ান সাহেবকে সব খুলে বলেন। সাথে এও বলেন প্রণালী তার ফোনটা সাথে নিয়ে গেছে। এ শুনে রায়ান বলে,”তুমি অনেক বড় ভুল করেছ৷ আশা করি, তোমার বোনের বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবার আগেই আমরা ওকে পেয়ে যাব। যাইহোক, আমি সৌভিকের সাথে কথা বলি। ও এখন নাম্বার ট্রেস করে প্রণালীর লোকেশন বের করবে।”

.
রায়ান সাহেব অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। সৌভিক বাবুর ফোনে তার ধ্যান ভাঙে। ফোনটা রিসিভ করতেই সৌভিক বাবু বলেন,”প্রণালীর লোকেশন কমলাপুর রেলস্টেশনে দেখাচ্ছে।”

“ধন্যবাদ তোকে।”

এই বলে রায়ান প্রত্যুষকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দুজনে কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে যায়। কিন্তু সেখানে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও প্রণালীকে পাওয়া যায়না। এদিকে লোকেশনও এইটাই দেখাচ্ছে। এরমধ্যেই হঠাৎ প্রত্যুষ রেলস্টেশনেই নিজের ফোনটা কুড়িয়ে পায়। রায়ান সাহেবকে এই ব্যাপারে বলতেই তার যা বোঝার বোঝা হয়ে যায়। রায়ান সাহেব বিমর্ষ হয়ে বলে ওঠেন,”মেয়েটাকে বুঝি আর বাঁচাতে পারলাম না!”

এক অসহায় পিতার কন্ঠে এমন কথা শুনে প্রত্যুষ ভীষণ কষ্ট পেলো। তার নিজেরও ভীষণ অনুশোচনা হতে লাগল। বারবার মনে হলো তার জন্যই আজ এত কিছু হয়ে যাচ্ছে। সে নিজের বাবাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেল না।

~~~~~~~
প্রণালীর চোখ খুলতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করলো একটা অন্ধকার ঘরে। বিছানায় শুয়ে ছিল সে। দ্রুত আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। তারপর শান্তর নাম নিয়ে ডাকতে থাকে। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে বধুবেশে প্রণালীর রুমে প্রবেশ করল এবং লাইট জ্বালিয়ে দিলো। প্রণালী তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল,”তুমি কে? আর শান্ত কোথায়?”

মেয়েটি বাকা হেসে বললো,”আমি লারা, আমি হলাম শান্তর হবু বউ।”

প্রণালী বড়সড় ধাক্কা খায়। হতবাক স্বরে বলে,”শান্তর হবু বউ মানে? শান্ত আর আমি একে অপরকে ভালোবাসি। তাহলে তুমি কিভাবে শান্তর হবু বউ হতে পারো?”

তখনই শান্ত সেই রুমে প্রবেশ করে বলে,”ভালোবাসা মাই ফুট। তুমি ভাবলে কি করে আমি তোমাকে ভালোবাসি?”

প্রণালী অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,”শান্ত! তুমি কি বলছ? আর এই মেয়েটাই বা কি বলছে? ওর সাথে তোমার বিয়ে মানে?”

শান্ত বাকা হেসে বলে,”সবকিছু মানে তুমি এবার বুঝতে পারবে। লারা ডার্লিং, তুমি আমার পাশে আসো।”

লারা শান্তর সামনে আসতেই তার কপালে চুমু খায়। গভীর আলিঙ্গন করে। প্রণালীর বুকে বা পাশে তীব্র ব্যাথা হতে থাকে এই দৃশ্য দেখে। সে চিৎকার করে বলে ওঠে,”এসব তুমি কি করছ শান্ত? তুমি তো আমায় ভালোবাসো তাহলে এই মেয়েটার এত ঘনিষ্ঠ কেন হচ্ছ?”

শান্ত প্রণালীর সামনেই লারাকে লিপ কিস করে। প্রণালী এসব আর সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে নেয়। ডুকরে কাঁদতে থাকে। প্রণালীকে এভাবে কাঁদতে দেখে শান্ত পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে। পৈশাচিক হেসে বলে,”কাঁদো, কাঁদো আরো কাঁদো। তুমি যত কাঁদবে আমি ততই পরিতৃপ্তি পাবো। শুধুমাত্র তোমার বাবা-মায়ের জন্য আমি আমার বাবাকে পাইনি কখনো। আমার বাবাকে এখনো জেলে থাকতে হচ্ছে। তার তুলনায় তো এটা কিছুই না।”

প্রণালী কাঁদতে কাঁদতে বলে,”তাহলে বাবাই ঠিক বলেছিল। তুমি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই…”

“হ্যাঁ, তবে তুমি বুঝতে একটু দেরি করে দিলে বোকা মেয়ে।”

প্রণালী এই ধাক্কা সামলাতে পারে না। তার মধ্যেই কয়েকজন মেয়ে ভেতরে চলে আসে। শান্ত তাদেরকে বলে,”একে নিয়ে বাইরে চলো তোমরা। ও আমার বিয়ে নিজের চোখের সামনে দেখুক।”

প্রণালী বারবার বলতে থাকে,”প্লিজ শান্ত, তুমি এমন করো না। আমাকে এভাবে ঠকিও না তুমি। এত কষ্ট আমি মেনে নিতে পারবো না।”

শান্তর মন একটুও গলে না। মেয়েগুলো শান্তর নির্দেশমতো কাজ করতে থাকে। প্রণালীকে নিয়ে বাইরে আসে। বাইরে একজন কাজি এসেছে। শান্ত প্রণালীর সামনেই লারার হাত ধরে কাজির সামনে বসে পড়ে। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে। প্রণালী ছলছল নয়নে এসব দেখতে থাকে। একসময় কাজি লারাকে কবুল বলতে বলতেই সে কবুল বলে দেয়। এরপর তিনি শান্তকে কবুল বলতে বললে শান্ত চুপ থাকে। প্রণালীর মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটে। সে শান্তকে বলে,”আমি জানি তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানতে পারবে না শান্ত। এখনই এই মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। আমাকে বিয়ে..”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে শান্ত। হাসতে হাসতে বলে,”এটা শোনার জন্যই আমি চুপ ছিলাম। তুমি ভাবছ যে আমি তোমায় ভালোবাসি? সব ছিল ড্রামা। এখনো বোঝো নি গবেট।”

প্রণালী কোন প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই শান্ত কবুল বলে দেয়। প্রণালী নিজের চোখের সামনেই তার ভালোবাসার মানু্ষটাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে। ঠকে যায় বাজেভাবে। তার প্রেমিক এখন আর তার নেই। সে এখন অন্য কারো স্বামী। প্রণালীর চোখের জল বাঁধ মানতে চাইছে না। এর মধ্যেই শান্ত বিদঘুটে হাসি দিয়ে বলে,”সবকিছু তো লাইভ দেখে নিলে। এখন কি আমাদের বাসরটাও লাইভ দেখবে?”

প্রণালী নিশ্চুপ, ভালোবাসা এখন ঘৃণায় পরিণত যেন। প্রণালী হাত তালি দেয়। শান্তকে বলে,”তুমি আজ বুঝতে পারবে না শান্ত তুমি কি হারালে। নারীর ভালোবাসা যতটা তীব্র, ঘৃণা তার দ্বিগুণ। এখন থেকে আমি শুধু তোমায় ঘৃণাই করি। ভালোবাসা বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই।”

বলেই সে এগিয়ে চলে। শান্ত বলে,”এখনই চলে যাবে? আমাদের লাইভ বাসর দেখবে না?”

প্রণালী এগিয়ে এসে শান্তকে ঠাস ঠাস করে থা*প্পড় মে*রে চলে যায়। লারা এগিয়ে এসে বলে,”তুমি ওকে কিছু বললে না কেন শান্ত?”

“আরে, ওর কথা বাদ দাও। ও এখন একটা লেজকাটা শেয়াল। কিছু করতে পারবে না।”

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_41
#ইয়াসমিন_খন্দকার

রায়ান সাহেব প্রত্যুষকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। এসেই সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছেন৷ বড্ড ক্লান্ত তিনি। নিজের মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় একদম শেষ হয়ে যাচ্ছেন। তার সামনেই অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যুষ। আজ প্রত্যুষের নিজেকেই নিজের কাছে অপরাধী মনে হচ্ছে। তার বারবার এটাই মনে হচ্ছে তার জন্যই সবটা হলো। রায়ান সাহেব নিজের ছেলের দিকে তাকিয়েই তার মনোভাব বুঝলেন। কিন্তু কিছু বললেন না এবিষয়ে। বরঞ্চ বললেন,”প্রত্যুষ, তুমি একটু তোমার সৌভিক আঙ্কেলকে ফোন করো। ওকে বলে দাও যে আমরা প্রণালীকে খুঁজে পাইনি। সৌভিক যেন সজল চৌধুরীকে সব কথা বলে দেয়। তার সামনে দাঁড়ানোর মুখ আমার নেই।”

প্রত্যুষ ফোন বের করে কল করতে যাবে ঠিক এমন সময় বিধ্বস্ত প্রণালী পা রাখে বাড়ির মধ্যে। অস্ফুটস্বরে ডেকে ওঠে,”বাবা।”

রায়ান সাহেব, প্রত্যুষ দুজনেই অবাক হয় প্রণালীকে দেখে। সাথে ভীষণ খুশিও হয়। রায়াম সাহেব উঠে গিয়ে নিজের মেয়ের কাছে যান। প্রণালীকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”তুমি ঠিক আছ তো মা?”

প্রণালী বলে ওঠে,”তোমার পছন্দ করা ছেলেকেই আমি বিয়ে করবো বাবা।”

প্রত্যুষ, রায়ান সাহেব দুজনেই অবাক। রায়ান সাহেব এবার ভালো করে নিজের মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করেন। ফোলা ফোলা দুটি চোখ দেখেই বুঝতে পারছেন কেঁদে কেঁদে মেয়েটার অবস্থা খারাপ। তিনি আর কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না তখন। মেয়ের অবস্থা দেখে তারো ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। প্রত্যুষ বাবা-মেয়ের এমন অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো। প্রণালীকে বলল,”আপি তুমি ঠিক আছ তো? তোমাকে এমন কেন লাগছে?”

প্রণালী আবার কান্না শুরু করে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমি ঠিক নেই ভাই। আমি একদম ঠিক নেই। ও আমাকে ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে একদম শেষ করে দিয়েছে রে!”

.
বাবা ভাইকে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললো প্রণালী। সব শুনে রায়ান সাহেব কিছুটা স্বস্তি পেলেন। বললেন,”যাইহোক, আল্লাহর কাছে এটাই লাখ লাখ শুকরিয়া যে ঐ শান্ত তোমার বড় কোন ক্ষতি করে নি। আমি তো ভেবেছিলাম ও তোমার কি না কি করে। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন।”

প্রত্যুষ বলে,”আপি, তুমি আর একদম ঐ শয়তান লোকটার জন্য কাঁদবে না। উনি তোমাকে ধোকা দিতে গিয়ে নিজেই ঠকে গেছেন। তুমি জিতে গেছ। দেখবে একসময় উনি খুব আফসোস করবেন এটা নিয়ে।”

প্রণালী জোরপূর্বক হাসল। রায়ান সাহেব বললেন,”ঐ শান্তর ভয়েই আমি তোমার বিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম তাড়াহুড়ো করে। কিন্তু এখন যখন সেই ভয় কে’টে গেছে তার উপর তুমি এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় আছো তাই আমাকে তো নিজের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে।”

প্রণালী বলে,”না, বাবা। তোমাকে নিজের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে না। আমি বিয়ের জন্য একদম প্রস্তুত আছি।”

“কিন্তু মা, তোমার এই অবস্থা!”

“আমি একদম ঠিক আছি বাবা। এমনিতেই আমার জন্য তোমার অনেক ফেস লস হয়েছে। আমার জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তোমায়। আমি চাই না আমার জন্য তুমি আরো কষ্ট পাও।”

রায়ান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,”আমার লক্ষী মেয়েটা কত কিছু বুঝতে শিখে গেছে।”

প্রত্যুষ বলে ওঠে,”তাহলে কি বিয়েটা হচ্ছে?”

রায়ান সাহেব এবং প্রণালী দুজনেই সম্মতি দেয়।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সজল চৌধুরী রাজকীয় ভাবে তৈরি হয়েছেন। তিনি নিজের ছেলেকেও তিনি রাজকীয় ভাবেই তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সজল চৌধুরীর পরদাদা ছিলেন একজন বিখ্যাত জমিদার। তাদের বংশের বেশ ভালোই গৌরব। পুরান ঢাকার বনেদী পরিবার বলে কথা। তাই তো তিনি চান তার ছেলের বিয়েটাই সেভাবে হোক। কিন্তু সময় সল্পতার জন্য সেটা সম্ভব না। তবে তিনি ঠিক করে রেখেছেন আপাতত কাবিনটা হবার পর তিনি বেশ ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দেবেন।

সজল চৌধুরী এই বিয়েটা যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন। যাতে তার স্ত্রীর কাছে খবর না যায়৷ এজন্য স্ত্রীর বাড়ির কোন আত্মীয় স্বজনকেও বলেন নি৷ শুধু নিজের কাছের কিছু বন্ধু-বান্ধব আর নিজের একমাত্র বোন সায়মাকে বলেছেন৷ সায়মা চৌধুরী সজল চৌধুরীর খুব আপন। সায়মা চৌধুরী নিজের ভাইয়ের এই সিদ্ধান্তে তার পাশেই আছে। কারণ তিনি নিজেও চেনেন তার ভাবিকে। তাই তিনি চান তার ভাবির অনুপস্থিতিতে বিয়েটা ভালোয় ভালোয় মিটে যাক।

সমুদ্র তৈরি হতে একটু বেশি সময় নিচ্ছিল। তাই সজল চৌধুরী বিরক্ত হয়ে তার দরজায় গিয়ে নক করতে থাকেন এবং বলেন,”আর কত সময় লাগবে তোমার? সবাই তো অপেক্ষা করছে।”

সজল চৌধুরী নক করার কিছুক্ষণ পরেই সমুদ্র চৌধুরী বেরিয়ে আসে৷ পড়নে তার কালো রঙের রাজকীয় শেরওয়ানি। মাথায় রাজকীয় টুপি। সায়মা চৌধুরী নিজের ভাতিজাকে দেখে বলে ওঠেন,”মাশাল্লাহ, কি সুন্দর লাগছে। কারো নজর না লাগুক।”

সমুদ্র বলে ওঠে,”নজর তো লাগবেই ফুফি। আমার হবু বউয়ের।”

বলেই দূর্বোধ্য হাসি দেয়।

~~~~~~~~~~~~~~~~~
প্রণালীকে বধূবেশে সাজানো হচ্ছে। গায়ে গোলাপী কালারের বেনারসি শাড়ি, সাবেকি সোনার গহনা সহ, মর্ডান হিরার গহনা এবং প্রসাধনী দিয়ে একদম পরির মতো সাজানো হয়েছে মেয়েটাকে। অনুপমা দেবী তার বড় মেয়ে স্নেহা এবং ছোট মেয়ে সোহিনী সেখানে উপস্থিত ছিল। অনুপমা দেবী নিজের বড় মেয়ে স্নেহাকে বলেন,”দেখ তো অনেক সুন্দর লাগছে না প্রণালীকে।”

স্নেহা সায় জানায়। সোহিনীও বলছে,”অনেক সুন্দর লাগছে৷ সমুদ্র ভাইয়া তো দেখে একদম পাগল হয়ে যাবে।”

সমুদ্র নামটা শুনতেই কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল প্রণালীর৷ লোকটার কথা মনে পড়ে গেল৷ লোকটার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ ছিল বিভৎস রকমের। লোকটাকে একদম তার ভালো মনে হয়না। তবে একবার নিজের সিদ্ধান্তের জন্য তাকে পস্তাতে হয়েছে। শান্তকে তো কত ভালো ভেবেছিল। অথচ সেই শান্তই কত সুন্দর অভিনয় করে গেল আর দিনশেষে তাকে বাজেভাবে ঠকালো। তাই প্রণালীর কাছে মনে হলো, সে যখন ২ বছরেও একটা মানুষকে চিনতে পারল না তখন তার একবারের দেখায় কিভাবে চিনবে? তার বাবা নিশ্চয়ই তার খারাপ চায় না। সবদিক ভেবে চিন্তেই হয়তো সমুদ্রকে চয়েজ করেছে। হয়তো সে মনের দিক থেকে এতোটাও খারাপ না যতটা প্রণালী ভাবছে৷ এমনটা ভেবেই প্রণালী আর এই সম্পর্কটাকে মেনে নিতে কোন অমত জানাচ্ছে। এমনিতেও সে যা হারানোর হারিয়েই ফেলেছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও তার মধ্যে তেমন নেই, না তো ভালো থাকার ইচ্ছা৷ শান্ত নামক পুরুষটা একদম তাকে ভেতড় থেকে গুড়িয়ে দিয়েছে। এর থেকে সুন্দর প্রতিশোধ বুঝি আর ছিলই না।

প্রণালীর ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে প্রত্যুষ এসে বলে,”বর এসে গেছে। বাবা আপিকে নিয়ে যেতে বলেছে।”

সোহিনী বলে,”হ্যাঁ, তুমি যাও। আমি প্রণালীকে নিয়ে যাচ্ছি।”

~~~~~~
মুখোমুখি বসে আছে প্রণালী ও সমুদ্র। কাজি ইতিমধ্যে বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছে। সমুদ্র আড়চোখে প্রণালীকে দেখলেও প্রণালীর দৃষ্টি মাটিতে নিবদ্ধ। যা দেখে সমুদ্রর মনে হয় মেয়েটা তাকে ইগ্নোর করছে৷ যা তার ইগোতে লাগে৷ সে মনে মনে বলে,”একবার শুধু বিয়েটা হোক। তারপর এসবকিছুর শোধ তুলব। ”

কাজি সাহেব বলেন,
“আব্দুল্লাহ রায়ানের একমাত্র কন্যা রুকাইয়া জাহান প্রণালীর সাথে মোহাম্মদ সজল চৌধুরীর একমাত্র ছেলে মোহাম্মদ সমুদ্র চৌধুরীর বিয়ে ১০ লাখ টাকা মোহরানা দ্বারা ধার্য করা হইল।”

এরপর তিনি প্রণালীকে কবুল বলতে বললে সে কিছু সময় নিয়ে কবুল বলে। সমুদ্র অবশ্য বেশি অপেক্ষা না করেই কবুল বলে। অতঃপর মনে মনে বলে,”এবার তোমার জীবনটা আমি কিভাবে হেল বানাই দেখো মিস সরি আমার মিসেস।”

to be continue…

একই সুরে প্রেম আমায় কাঁদায় পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_36
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী, প্রত্যুষকে নিয়ে আজ সৌভিকদের বাসায় এসেছে রায়ান। সৌভিক, অনুরাধাও এখন ঢাকাতেই থাকে। আজ এখানে আসার অবশ্য একটা রিজনও আছে। আজ সৌভিক অনুরাধার মেয়ে স্নেহার এনগেজমেন্ট। সেই উপলক্ষ্যেই তারা আজ মূলত এখানে এসেছে। প্রণালী তো এসেই স্নেহার সাথে দেখা করতে চলে গেছে। দুজনের মধ্যে বেশ ভালোই সম্পর্ক৷ যদিওবা স্নেহা প্রণালীর চেয়ে বয়সে বড় তবে তাদের সম্পর্কটা একদম বন্ধুর মতোই।

রায়ান আর সৌভিক একে অপরের সাথে গল্পে ব্যস্ত ছিল। প্রত্যুষ একা এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। প্রত্যুষকে একা দেখে তার পাশে আসে অনুরাধা। অনুরাধাকে দেখেই প্রত্যুষ স্মিত হাসে। প্রত্যুষ শুনেছে অনুরাধা তার মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। তাই তো অনুরাধার প্রতি আলাদা টান অনুভব করে। অনুরাধাও প্রত্যু্ষকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তার মনে পড়ে যায় প্রভার কথা। অনুরাধা নিজের চোখের কার্নিশে জমা এক ফোটা অশ্রু মুছে হাসি মুখে প্রত্যুষকে বলে,”তুমি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু খেয়েছ কি? মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না। এদিকে এসো আমি তোমাকে খেতে দিচ্ছি।”

প্রত্যুষ কেন জানি অনুরাধাকে মানা করতে পারে না। যদিও তার ক্ষিধে পায়নি তবুও সে বলে,”ঠিক আছে আন্টি।”

অনুরাধা প্রত্যুষকে নিজে খাবার বেড়ে দেয়। প্রত্যুষ বেশ আয়েস করে খেতে থাকে। প্রত্যুষকে তৃপ্তি করে ইলিশ মাছ খেতে দেখে অনুরাধা মুখ ফসকে বলে ফেলে,”প্রভারও ইলিশ মাছ পছন্দ ছিল।”

প্রত্যুষ খাওয়া থামিয়ে অনুরাধার দিকে তাকায়। অনুরাধা বুঝতে পারে সে ভুল সময় ভুল কথা বলে ফেলেছে। তাই বলে,”তুমি খাও, আমি আসছি।”

বলেই সেখান থেকে চলে আসে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সৌভিক ও রায়ানের বিজনেস পার্টনার সজল চৌধুরী সপরিবারে পৌঁছে গেল স্নেহার এনগেজমেন্ট উপলক্ষ্যে। তাকে আসতে দেখেই রায়ান ও সৌভিক এগিয়ে গেলো অভ্যর্থনা জানাতে। সজল চৌধুরীর সাথেই এসেছিল তার একমাত্র ছেলে সমুদ্র চৌধুরী। তাকে দেখে রায়ান হেসে বললেন,”কেমন আছ ইয়াং ম্যান?”

“ভালো আছি, আঙ্কেল। আপনি?”

“আমিও ভালো আছি৷ তোমার ড্যাডের কাছে তোমার ব্যাপারে শুনলাম। কিছুদিন আগেই নাকি তুমি নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরেছ। এবার বাবার ব্যবসায় হাত দাও। উনি আর কতদিন একা সামলাবেন সব?”

সজল চৌধুরী হেসে বললেন,”আমিও ওকে এই কথাই বলি।”

এভাবেই ওনারা কথাবার্তা চালিয়ে যান। এরমধ্যেই সমুদ্রর নজর আটকে যায় কাউকে দেখে। সে ঠিক দেখছে সে? ভালো ভাবে কয়েকবার পরখ করে নিলো। বিড়বিড় করে বলল,”আরে হ্যাঁ, এই মেয়েটাই তো। এর সাথেই তো সেদিন রাস্তায় ঝামেলা হয়েছিল। কিন্তু এ এখানে কি করছে?”

প্রণালী তো নিচে এসেছিল প্রত্যুষের খবর নিতে। ছেলেটা তো এমন গ্যাদারিং একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু নিচে এসেই সবার প্রথম সে সমুদ্রর মুখোমুখি হয়। আর তাতেই পুরাতন স্মৃতি তাজা হয়ে ওঠে। রাগে প্রণালীর হাত নিশপিশ করতে থাকে। সে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই রায়ান এসে প্রণালীকে বললেন,”প্রণালী এই হলো সমুদ্র চৌধুরী। তোমার সজল আঙ্কেলের ছেলে। তোমার মেবি ওকে মনে নেই। ছোট থাকেন দেখেছিলে। ও কিছুদিন আগেই নিউইয়র্ক থেকে এসেছে। আর সমুদ্র ও হলো আমার মেয়ে প্রণালী।”

সমুদ্র মনে মনে বলে,”আই সি। তাহলে এই মেয়েটা রায়ান আঙ্কেলের।”

এদিকে প্রণালীর মাথায় তো আগুন জ্বলছিল। সমুদ্রকে দেখেই তার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। এই স্পয়েল কিডটা কিনা সজল আঙ্কেলের! অথচ সজল আঙ্কেল কত ভালো মানুষ। প্রণালী বুঝতে পারে বিদেশে থেকেই হয়তো এমন স্পয়েল কিড তৈরি হয়েছে। এরইমাঝে সমুদ্র প্রণালীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,”হ্যালো প্রণালী। নাইস ঠু মিট ইউ।”

প্রণালীর তো গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল সমুদ্রর এমন ভালোমানুষি দেখে। আবার খ্যাট খ্যাট করে হাসছে। কিন্তু প্রণালী তো এই ছেলের আসল রূপ জানে। তবে সবার সামনে ভদ্রতা রক্ষার্থে প্রণালী সমুদ্রের সাথে হাত মেলায়।

তবে বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল না। প্রত্যুষকে খোঁজার বাহানায় সেখান থেকে চলো গেলো। সমুদ্রও নিজের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

প্রণালী প্রত্যু্ষকে দেখতে পেল অনুরাধার রুমে। সেখানে বসেই সে অনুরাধার সাথে গল্প করছিল। প্রণালী সেখানে গিয়ে বলে,”আন্টি, স্নেহা দিদি তোমায় ডাকছিল।”

“আচ্ছা, তুমি তোমার ভাইয়ের পাশে বসো। আমি যাই স্নেহার সাথে কথা বলে আসি।”

~~~~~
স্নেহার সাথে শহরের বিখ্যাত ডাক্তার ধ্রুবজ্যোতি রায়ের এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হয়। এরপর আসে খাওয়া দাওয়ার পালা। খাওয়া দাওয়া শেষে সৌভিক রায়ানকে বলেন,”তুই একটু এই দিকে আয় তো। তোর সাথে জরুরি কথা আছে।”

রায়ান সৌভিকের সাথে চলে যায় একটু দূরে। বলেন,”হ্যাঁ, বল। আমায় কি বলার জন্য ডাকলি?”

“আসলে এসব কথা তোকে আমি আগেই বলতে চেয়েছিলাম তারপর ভাবলাম অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পরই বলব। তুই আমায় আবিরের স্ত্রী সন্তানের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলছিলিস না? আমি খোঁজ নিয়েছি।”

রায়ান অস্থির হয়ে বললেন,”খোঁজ নিয়ে কি জানতে পারলি তুই?”

“তুই একটু শান্ত হ। আমি বলছি সব।”

এরপরেই সৌভিক রায়ানকে এক এক করে সব খুলে বলতে লাগল।

“আবিরের স্ত্রী এখন চট্টগ্রামে রয়েছে। তবে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওদের ছেলে এখন ঢাকাতেই রয়েছে। ছেলেটার ছবিও আমার কাছে কাছে। তুই দেখতে পারিস।”

বলেই রায়ানের দিকে একটা ছবি বাড়িয়ে দিলেন সৌভিক। রায়ান ছবিটা দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। হতবাক স্বরে বললেন,”শান্ত!”

সৌভিক বললেন,”তুই এনাকে চিনিস নাকি?”

“এই ছেলেটার নাম শান্ত। ও তো আমার ছেলে প্রত্যুষকে টিউশনি করাতো।”

“কি বলছিস তুই? এই ছেলে তোর ঘর অব্দি পৌঁছে গেছে! রায়ান আমি বলছি তুই ভালো করে এই ছেলের ব্যাপারে খোঁজ লাগা। আমার মনে হচ্ছে এই ছেলের কোন কুমতলব আছে। ভুলে যাস না এটা হলো আবিরের ছেলে। এ নিশ্চয়ই তোর এবং তোর পরিবারের ক্ষতি করতে চাইবে। তুই তোর ছেলে মেয়েকে দেখে রাখিস।”

রায়ান অস্থির হয়ে উঠলেন। এতদিন ধরে নিজের ছেলে-মেয়েদের আগলে রেখেছেন। তবে এবার কি তাদের উপর বিপদের আঁচ পড়তে চলেছে? এমনটা কিছুতেই হতে দেবেন না রায়ান। তার নিজের ছেলে-মেয়েকে আগলে রাখতেই হবে। রায়ানের বেশি চিন্তা হচ্ছে তার মেয়েকে নিয়ে। প্রত্যুষ শান্তশিষ্ট এবং বাধ্য ছেলে। কিন্তু প্রণালী তো হয়েছে একদম জেদি আর চঞ্চল স্বভাবের। তাছাড়া ও আবার বেছে নিয়েছে উকিলের প্রফেশন। সবদিক দিয়েই বিপদ। রায়ান আর কিছু ভাবতে পারলেন না। হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। সৌভিক বলে উঠলেন,”কি হয়েছে রায়ান? তুই ঠিক আছিস তো?”

“একদম ঠিক নেই রে। আমি আর পারবো না। প্রভাকে হারিয়ে এমনিতেই আমি সর্বহারা এখন আমার ছেলে-মেয়েই আমার সব। ওদের কিছু হলে আমার কি হবে? আবির ওর ছেলেকে আমাদের পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে। কয়দিন পর ও নিজেও জেল থেকে ছাড়া পাবে। তখন তো ও হাত ধুয়ে পড়বে আমাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”

“আমি দেখছি ঐ শান্তর ব্যাপারে যদি আরো খোঁজ খবর নেওয়া যায়। তুই শুধু নিজের ছেলে-মেয়ে দুটোর দিকে একটু বাড়তি নজর দে। আর বাকিটা তুই আমার উপরেই ছেড়ে দে ”

“তোর উপরেই সবটা ছেড়ে দিলাম সৌভিক। তুই ছাড়া যে আমার ভরসাযোগ্য কেউ নেই।”

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_37
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী আজ এসেছে শান্তর সাথে দেখা করতে। খুব শীঘ্রই প্রণালীর ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা। তাই প্রণালী চাইছে তার আগেই শান্তর সাথে রায়ানের দেখা করাতে।

শান্তর সাথে পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে প্রণালী। হঠাৎ করে সে বলে ওঠে,”শান্ত, অনেক লুকোচুরি হয়েছে। আর নয়। আমি চাই তুমি এবার বাবার সাথে দেখা করো।”

প্রণালীর মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে ভড়কে ওঠে শান্ত। আমতাআমতা করে বলে,”এত তাড়াহুড়ো না করলেই কি নয়?”

প্রণালী কোন বাঁধাই শুনতে রাজি নয়। এদিকে শান্ত বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করেই বেশ বিভ্রান্ত লাগছে তাকে। অনেক ভেবে চিন্তে শান্ত বলে,”আমি এখনো মানসিক ভাবে প্রস্তুত নই প্রণালী। আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও।”

প্রণালীর রাগ হয় ভীষণ। চাপা কন্ঠে বলে,”আর কতদিন সময় নেমে তুমি? আচ্ছা, যত খুশি টাইম নাও৷ আমি আর কিছু বলবো না।”

বলেই প্রণালী উঠে দাঁড়ায়। শান্তর উপর তার বেশ অভিমান হয়। এইজন্য সে হাটতে শুরু করে দেয় সামনের দিকে। আর শান্ত আসতে থাকে তার পিছন পিছন। এমন সময় হঠাৎ করে তার সামনে এসে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রণালী ভ্রুযুগল কুচকে ফেলে।

সে কিছু বলার আগেই গাড়ি থেকে নেমে আসেন রায়ান। এসেই অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকান প্রণালীর দিকে। প্রণালী রায়ানকে দেখে ভীষণ চমকে যায়। রায়ান হুংকার করে বলেন,”তুমি এখানে কি করছ? আর তোমার সাথে এই ছেলেটা কেন?”

প্রণালী হঠাৎ করে তব্দা খেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলো। ভাবল অনেক তো অপেক্ষা করল। আজ যখন সুযোগ এসেই গেছে তখন আর সুযোগটা যেতে দিলে চলবে না। এজন্য সে সিদ্ধান্ত নিলো রায়ানকে শান্তর ব্যাপারে সবটা খুলে বলবে। এদিকে রায়ান রাগ ভড়া দৃষ্টিতে শান্তর দিকে তাকাচ্ছিলেন। ছেলেটাকে দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। কিন্তু এ হলো আবিরের মতো একটা শয়তানের ছেলে। এ ছেলে যে মোটেই ভালো নয় সেটা সহজেই অনুমেয়। তাই রায়ান প্রণালীকে বললেন,”তুমি তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়ো।”

“বাবা…”

“বেশি কথা না বলে যা করছি তাই করো। আমি তোমার কোন কথা শুনতে চাই না।”

প্রণালী আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ করে গাড়িতে উঠে বসে। রায়ান শান্তর কাছে গিয়ে বলেন,”তোমার আসল পরিচয় আমি জানতে পেরে গেছি। আর কোনদিন যেন আমি তোমাকে আমার মেয়ে বা আমার পরিবারের কারো পাশে না দেখি। নাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”

এই বলে শান্তকে হুমকি দিয়ে তিনি চলে যান। শান্ত নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রায়ান প্রণালীকে নিয়ে চলে যান। প্রণালী চুপ করে বসে ছিল গাড়ির মধ্যে। সে ভেবে নিয়েছে এরপর বাড়িতে গিয়ে যা বলার বলবে। তাই সারা রাস্তায় সে আর কোন কথাই বলল না।

বাড়িতে পৌঁছে গিয়ে রায়ান প্রণালীকে বললেন,”তোমাকে যেন ঐ শান্ত নামের ছেলেটার পাশে আর কোনদিন না দেখি।”

“কেন বাবা?”

“আমি কোন কথা শুনতে চাই না। আমি যা একবার বলেছি সেটাই আমার শেষ কথা।”

“আমার পক্ষে তোমার কথা শোনা সম্ভব নয় বাবা। কারণ….কারণ আমি শান্তকে ভালোবাসি।”

“প্রণালী!!!”

প্রণালী একটুও দমে না গিয়ে বলতে থাকে,”তুমি এমন করছ কেন বাবা? কাউকে ভালোবাসা কি অন্যায়?”

রায়ান উত্তেজিত হয়ে যান। বলেন,”কাউকে ভালোবাসা অন্যায় না। কিন্তু শান্তর মতো ছেলেকে ভালোবাসা অন্যায়।”

“কেন অন্যায় বাবা? শান্ত মধ্যবিত্ত বলে? ওর সাথে আমাদের স্ট্যান্ডার্ড মেলে না জন্য? তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি। ছোট থেকে তো তুমি আমাকে শিখিয়েছ মানুষের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী এসব নিয়ে বৈষম্য না করার জন্য। তুমিই তো শিখিয়েছ, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। তাহলে আজ কেন তুমি আমাকে বলছ শান্তর থেকে দূরে থাকতে? তাহলে সবই কি ছিল তোমার লোক দেখানো কথা?”

“প্রণালী! তোমাকে এখন আমি এত কিছু বলতে পারব না। তুমি শুধু এটাই জেনে রেখো ঐ ছেলের পাশে যেন তোমায় আর না দেখি। নাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”

প্রণালী তবুও অদম্য! জেদ দেখিয়ে বলে,”আমি একশোবার শান্তর সাথে গিয়ে দেখা করব। দেখি তুমি কিভাবে আটকাও।”

রায়ান রেগে গিয়ে প্রথমবারের মতো প্রণালীর গায়ে হাত তুলতে যান। যদিও তিনি থেমে যান। তবুও প্রণালী খুব আঘাত পায় এই ঘটনায়। কারণ রায়ান জন্মের পর থেকে আজ অব্দি কখনো তার গায়ে হাত তুলতে চায়নি। এমনকি তার উকিল হওয়া নিয়ে এত বাকবিতণ্ডা হলেও কখনো এমন পরিস্থিতি আসে নি। অথচ আজ! প্রণালী এটা সহ্য করতে পারল না। অশ্রুসিক্ত চোখে দৌড়ে চলে গেল।

রায়ান অসহায় সুরে বলল,”আমার চিন্তাটা যদি তুমি বুঝতে তাহলে এমন করতে না মা। আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। তুমি আর প্রত্যুষ ছাড়া যে আমার কেউ নেই। তাই আমি চাই না। তোমাদের উপর কোন বিপদের ছায়া পড়ুক।”

~~~~~~~~~~~~~~`~~~~~~~~~~~
প্রণালী চুপ করে নিজের রুমে বসে আছে। এমন সময় শান্ত তাকে কল করে। শান্ত ফোন রিসিভ করতেই প্রণালী কাদো কাদো গলায় বলে,”তোমার সন্দেহই ঠিক হয়েছে শান্ত। বাবা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নেয়নি।”

শান্ত বেশ নরম গলায় বলে,”তুমি এত চিন্তা করো না। আঙ্কেল যা করছেন তোমার ভালোর জন্যই করছেন। আমি তোমার যোগ্য নই। তোমাকে তো সেটা আগেই বলেছিলাম। তুমি জোর করে সম্পর্কটা করলে।”

“আমি কোন ভুল করিনি শান্ত। তোমার থেকে আমার যোগ্য আর কেউ নেই। আমি যদি বিয়ে করি তাহলে তোমাকেই করব।”

শান্ত মৃদু হেসে বলে,”তাহলে তো এমন পরিস্থিতি আসতে পারে যে আমার আর তোমার পরিবারের মধ্যে তোমায় যেকোন একজনকে বেছে নিতে হবে। তখন তুমি কাকে বেছে নেবে? আমাকে না তোমার পরিবারকে?”

প্রণালী ধন্দে পড়ে যায়। সত্যিই সে তো ভেবে দেখেনি এমন পরিস্থিতিতে কাকে বেছে নেবে। শান্ত বলে,”তুমি তোমার ফ্যামিলিকেই বেছে নিও। কারণ আমি তোমায় সুখী জীবন দিতে পারব না।”

“আমি তোমার সাথে সুখী হতে চাই শান্ত।”

“তাহলে পারবে নিজের পরিবারকে ছেড়ে আমার কাছে আসতে? কি হলো বলো পারবে?”

প্রণালী একটু ভেবে বলে,”পারবো।”

শান্তর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে ফোনটা রেখে দেয়।

~~~~~~~~~~~““““~~~~~~~~~
রায়ান সৌভিকের সাথে আজকের ঘটনাটা নিয়ে কথা বলে। সব শুনে সৌভিক হতবাক হয়ে বলে,”আমি ভাবতেই পারছি না প্রণালীর মতো এত বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে ঐ আবিরের ছেলের ফাদে কিভাবে পড়লো। আমার মনে হয় ছেলেটা প্রণালীর মগজ বেশ ভালো ভাবেই ধোলাই করেছে।”

“কি বলছিস টা কি তুই?”

“আমি তো ভয় পাচ্ছি ঐ ছেলের কথায় প্রভাবিত হয়ে প্রণালী যদি কোন ভুল করে বসে..”

“না। আমি আমার মেয়ের কোন ক্ষতি হতে দেব না। তুই আমায় কোন উপায় বলতে পারবি?”

“একটাই উপায় আছে। ঐ ছেলের কথায় প্রভাবিত হয়ে প্রণালী কোন ভুল করার আগেই প্রণালীর বিয়ে দিতে হবে। তাহলে প্রণালীর দিকে আর ও নজর দিতে পারবে না। আর বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে হবে।”

“কিন্তু এখন এভাবে হঠাৎ করে কিভাবে বিয়ে দেব? একটা ভালো ছেলের খোঁজ তো করতে হবে।”

“আমার কাছে একটা ভালো ছেলের খোঁজ আছে।”

“কে সে?”

“সমুদ্র।”

“মানে? সোহেলের ছেলে?”

“হ্যাঁ। সোহেল বলছিল ওর ছেলের বিয়ে দিতে চায়।”

“আমাকে একটু ভাবার সময় দে।”

“ঠিক আছে। তুই সময় নিয়ে ভাব। সবদিক চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিস।”

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_38
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী নিজের ঘরে মন খারাপ করে বসে ছিল। তার মন মানসিকতা এখন একদম ভালো নেই। ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে। এইরকমই সময় রায়ান প্রবেশ করলেন নিজের মেয়ের রুমে। এসেই প্রণালীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”তুমি নাকি সকাল থেকে কিছু খাও নি? এসব কি নাটক শুরু করেছ?”

প্রণালী কোন কথাই বলে না। রায়ান প্রণালীর পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”আমি তোমার বাবা প্রণালী। আমি কি কখনো তোমার খারাপ চাইতে পারি?”

প্রণালী কাদো কাদো গলায় বলে,”আমি শান্তকে খুব ভালোবাসি বাবা। ওকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারব না।”

“শান্ত ভালো ছেলে নয় মা। তুমি বুঝতে পারছ না কেন? শান্তর বাবা কে তুমি জানো?”

“না, জানি না। আর জানতেও চাইনা। আমি বিয়েটা তো শান্তকে করব। তাহলে ওর বাবার ব্যাপারে জেনে কি করবো?”

“বিয়ে শুধু দুজনের মধ্যে হয়না মা। দুটো পরিবারের মধ্যেও হয়। শান্তর বাবা একজন মারাত্মক অপরাধী। যে অতীতে বারংবার আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে।”

প্রণালী কিছুটা অবাক হয়। তবে শান্তর প্রেমে সে বেশ ভালো ভাবেই ডুবে গেছে। তাই তো সবকিছু কে অবজ্ঞা করে বলে ওঠে,”শান্তর বাবা যেমনই হোক শান্ত খারাপ ছেলে নয়। আমি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ওকে চিনি। ওর মতো ভালো ছেলে আর দুটো হয়না। জানো, ও কোনদিন আমার অনুমতি ব্যতীত আমায় স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। সব সময় আমার ভালো মন্দের খেয়াল রেখেছে। সেই ছেলে কিভাবে খারাপ হয়?”

“তুমি ওর বাবার সম্পর্কে কিছু জানো না জন্যই এমন বলছ।”

“আমি ওর বাবার সম্পর্কে জানি না আর জানতেও চাই না। শান্ত আমাকে আগেই বলেছে ওর বাবা একজন অপরাধী, যিনি জেলের ঘানি টানছেন। ও আমার থেকে কিছু লুকায় নি বাবা। ও নিজেও ওর বাবাকে ঘৃণা করে। আমি সবকিছু জেনে ওর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি। আমি জানি ও কোনদিন আমায় ঠকাবে না। তুমি শুধু একবার রাজি হয়ে যাও বাবা।”

রায়ান রাগী স্বরে বলে,”আমি মরে যাব তবুও তোমার সাথে ঐ শান্তর সম্পর্ক মেনে নেবো না। আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি ঐ শান্ত কিভাবে তোমার ব্রেনওয়াশ করেছে।”

“তুমি ভুল বুঝছ। শান্ত এমন ছেলেই নয়।”

” আমাকে তুমি ঠিক ভুল শেখাতে আসবে না প্রণালী। পৃথিবীটা আমি তোমার থেকে বেশি দেখেছি। আমি যেটা বলেছি সেটাই শেষ কথা, শান্তর সাথে তুমি আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।”

“শান্তকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না বাবা।”

“প্রণালী! তোমার অনেক স্পর্ধা আমি সহ্য করেছি আর নয়! এবার আমি তোমাকে আর কোন সুযোগ দেব না। অনেক অবাধ্যতা করেছ তুমি আর না। আমি খুব শীঘ্রই আমার পছন্দ করা ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেব। আর এটাই আমার শেষ কথা।”

বলেই হনহন করে প্রণালীর রুম থেকে বেরিয়ে যান রায়ান। তিনি যাওয়ার পর প্রণালী নিজের ফোন বের করে। শান্তকে কল দিয়ে বলে,”তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে শান্ত।”

প্রণালীর এমন কথায় শান্ত বলে,”রিলাক্স প্রণালী। যা বলার বলো, আমি শুনছি।”

“আমার মনে হয় বাবা আমাদের সম্পর্কটা কোনদিনও মানবে না। উনি তো আমার সাথে অন্য কারো বিয়ে দিতে চাইছেন।”

শান্ত বলে,”আমার মনে হয় তোমার বাবার কথাই তোমার শোনা উচিৎ।”

“এসব তুমি কি বলছ শান্ত? তোমায় আমি কতটা ভালোবাসি তুমি জানো না?”

“আমি জানি প্রণালী। কিন্তু তোমার বাবাকে দুঃখ দিয়ে তুমি কিছু করো এটা আমি চাই না। তাই আমার মনে হয়, তুমি ওনার কথা শুনলেই ভালো করবে।”

“শান্ত, বাবা তোমাকে ভুল বুঝছে। তোমার বাবার অপরাধের কারণে তোমাকেও খারাপ ভাবছে। এই ধারণা তো ঠিক নয়। তাইনা? বাবার এই ভুল ধারণা বদলানোও সম্ভব না। তাই আমি বলছি কি আমরা বিয়ে করে নেই। বিয়ের পর বাবা যখন আমাদের সুখী দেখবে তখন এমনিতেই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। তখন তিনি এমনিতেই আমাদের এই সম্পর্ক টা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেবেন। প্রেমের সম্পর্ক গুলোতে এমনই তো হয় বলো?”

শান্ত কিছুক্ষণ ভাবে। ভাবার পর বলে,”তুমি আরো ভালো করে ভেবে দেখো প্রণালী। আমি চাই না তুমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে আজীবন পস্তাও।”

“আমি কোন ভুল করছি না শান্ত। আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি রাজি থাকলে খুব শীঘ্রই আমি তোমার হাত ধরে বেরিয়ে যেতে রাজি আছি।”

“ঠিক আছে। তুমি যা চাইছ তাই হবো। তুমি মানসিক ভাবে তৈরি হয়ে নাও। কারণ নিজের পরিবারকে ছেড়ে আসা কিন্তু সহজ নয়।”

“আমি জানি কাজটা সহজ হবে না। কিন্তু কিছু পেতে হলে যে কিছু খোয়াতেই হয় শান্ত। আমি জানি আজ আমি তোমাকে বেছে নিলে একসময় নিজের পরিবারকেও মানাতে পারব। কিন্তু আজ যদি আমি নিজের পরিবারের কথায় তোমাকে ছেড়ে দেই তাহলে আর কখনো তোমায় ফিরে পাব না।”

“আচ্ছা। আমি রাখছি।”

বলেই শান্ত ফোনটা রেখে দেয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সজল চৌধুরীর মুখোমুখি বসে আছেন রায়ান ও সৌভিক। সৌভিকই মূলত প্রণালীর জেদের কথা শুনে রায়ানকে এখানে নিয়ে এসেছেন। এদিকে সজল চৌধুরীও দ্রুত নিজের ছেলের বিয়েটা দিতে চাইছেন।

রায়ান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন,”শুনলাম আপনি নাকি নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইছেন?”

সজল চৌধুরী বলেন,”হ্যাঁ, আসলে আমার ছেলেটা ভীষণ বিগড়ে গেছে যেটা আমি বুঝতে পারছি। এর পেছনে ওর মা মানে আমার স্ত্রী সানিয়ার হাত রয়েছে। ছেলেটাকে এত স্বাধীনতা দিয়েছে যে ছেলেটা গোল্লায় গেছে। এখন আমার মনে হয় ওর স্ত্রীই ওকে ভালো করতে পারবে। কারণ বিয়ে করলে সব ছেলের মধ্যেই একটা দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। কিন্তু আমার স্ত্রী কিছুতেই এই বিয়েটা হতে দেবে না। কারণ সে তার বান্ধবীর মেয়ের সাথে সমুদ্রর বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু মেয়েটা একদম ভালো না। এখন সানিয়া কিছুদিনের জন্য লন্ডন ট্রিপে গেছে। আমি চাই এই সময়ের মধ্যে আমার ছেলের বিয়েটা দিয়ে দিতে। যাতে করে আর সমস্যা না হয়। এজন্য আমি বড় অনুষ্ঠান করব না। শুধুমাত্র কাবিনটা করাতে চাই।”

রায়ান বলেন,”আমিও খুব দ্রুততার সাথে আমার মেয়েটার বিয়ে দিতে চাইছি। আর এখন হাতের কাছে ভালো ছেলে পাওয়া মুশকিল। সমুদ্র আপনার মতো এত ভালো একজন মানুষের ছেলে। সে নিশ্চয়ই ভালোই হবে। তাই আমি চাই সমুদ্রের সাথেই প্রণালীর বিয়েটা দিতে। এখন যদি আপনি রাজি থাকেন তো আমি কথাবার্তা আগাবো।”

“আমি কেন রাজি থাকবো না? প্রণালীকে তো ছোট থেকেই দেখেছি ভীষণ ভালো একটা মেয়ে। আর আপনার সাথে আমার এতদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক এটা আত্নীয়ের সম্পর্কে পরিণত হলে তো আরো ভালো হবে।”

রায়ান ভীষণ খুশি হয়ে যান। অনেকটা নিশ্চিত বোধ করেন। সৌভিক বলেন,”তাহলে আমরা একটা কাজ করি ভালো দিনক্ষণ দেখে বিয়ের কথাটা পাকা করি।”

সজল চৌধুরী বলেন,”আমার স্ত্রী এক সপ্তাহ পর দেশে ফিরবে। তাই আমি চাইছি এক সপ্তাহের মধ্যেই কাবিনটা সেরে রাখতে। তারপর নাহয় সময় বুঝে বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে কেউ তো আর মানা করতে পারবে না।”

সৌভিক রায়ানকে প্রশ্ন করেন,”তোর কি মত?”

“আমি মিস্টার চৌধুরীর সাথে একমত। আমিও চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা হয়ে যাক।”

সজল চৌধুরী বলেন,”আগামী পরশু একটা ভালো ডেট আছে। তাহলে এই দিনই বিয়েটা হয়ে যাক?”

রায়ান সায় সাজান। অত:পর দুজন কোলাকুলি করেন।

to be continue…

একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায় পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫

0

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_33(ধামাকা)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

রায়ান সমানে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে চলেছে প্রভার সুস্থতার জন্য। সে অপেক্ষায় আছে কোন ভালো খবর শোনার আশায়। রায়ান চায় তার প্রভা আবার তার এবং তার সন্তানদের কোলে ফিরে আসুক। অবশেষে তার চাওয়া বোধহয় আল্লাহ পূরণ করল। ডাক্তার এসে বললো,”আপনার স্ত্রী এখন অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। তবে উনি অনেক দূর্বল হয়ে পড়েছেন। ওনার খেয়াল রাখবেন।”

রায়ান আল্লাহকে লাখো শুকরিয়া জানায়। এবং বলে,”আমি কি প্রভাকে দেখতে যেতে পারি?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।”

রায়ান প্রভাকে দেখতে যায়। প্রভার তখন জ্ঞান ফিরেছিল। সে প্রভার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তোমাকে আবার ফিরে পেয়ে আমি অনেক খুশি। আর তোমাকে আমার থেকে দূরে যেতে দেব না। তোমাকে আগলে রাখব। আমাদের সন্তানদের নিয়ে সুন্দরভাবে বাকি জীবন কাটাবো।”

প্রভা উত্তরে হেসে বলে,”আল্লাহ চাইলে তাই হবে। আমিও চাই তোমাদের সবার সাথে সুখে বাকিটা জীবন পার করে নিতে।”

২ মাস পর,
রায়ান ও প্রভার ছেলের নাম রাখা হয়েছে প্রত্যুষ। প্রণালী তার ভাই অন্ত প্রাণ। ভাইকে নিয়েই তার সারাদিন কে’টে যায়। প্রভার অবস্থা এখনো বেশি ভালো নয়। প্রত্যুষ হবার পর থেকেই অনেক বেশি দূর্বল সে। একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে প্রভার ইমিউনিটি সিস্টেম একেবারে কমে গেছে। তার উপর প্রত্যুষের সিজার করে জন্ম হয়েছে এবং সিজারের সাথে ইনফেকশনের সৃষ্টি হয়েছে। যা প্রথমদিকে বোঝা যায়নি। এখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। প্রভা বিছানা থেকে একদম উঠে দাঁড়াতে পারে না। তাই প্রত্যুষের দেখাশোনার জন্য একজন নার্সের ব্যবস্থা করেছে রায়ান। সেও যথাসম্ভব নিজের স্ত্রী-সন্তানের খেয়াল রাখছে।

প্রভার জন্য রায়ানের এখন অনেক চিন্তা হয়। তাই আজ নিজের অনেক জরুরি সভা থাকলেও সে আসে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখার জন্য। আর এসেই দেখল প্রভা গোঙাচ্ছে। রায়ান প্রভার মাথার পাশে বলে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? ডাক্তার ডাকবো?”

প্রভা কষ্টমিশ্রিত গলায় বলে,”আর না রায়ান। আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি আর পারছি না।”

রায়ান অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে প্রভার দিকে। প্রভার চোখেমুখে আজ কোন কষ্ট নেই। সে হাসছে। রায়ানের হাতটা ধরে বলে,”জানো আমি না তোমাকে ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি। আমার সন্তানদেরকেও আমি অনেক ভালোবাসি। তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাইনা কিন্তু……আমার হাতে মনে হয় আর বেশি সময় নেই।”

“এসব তুমি কি বলছ প্রভা? কিছু হবে না তোমার।”

প্রভা স্মিত হেসে বলে,”জানো যখন কানাডায় তোমার জীবন সংশয় চলছিল তখন আমি আল্লাহকে বলেছিলাম আমার জীবনের বিনিময়ে যেন তোমায় বাঁচিয়ে দেয়। আল্লাহ বোধহয় আমার সেই কথা শুনেছেন। তাই আমার কোন আফসোস নেই। শুধু তোমার কাছে একটাই আবদার রাখব আমার সন্তানদের তুমি দেখে রেখো। কখনো ওদের মায়ের অভাব হতে দিও না। চাইলে একটা ভালো দেখে মেয়েকে…”

“প্রভা! আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি। তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কেউ স্থান পাবে না।”

প্রভার চোখে এবার জল জমে। সে বলে,”আমি বোধহয় তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি রায়ান। আমার নিজের মৃত্যুর কথা ভেবে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। আমার কষ্ট হচ্ছে শুধু এটা ভেবে যে আমার মৃত্যুর পর তোমার কি হবে? তুমি কিভাবে সামলাবে নিজেকে? মধ্য রাতে তোমার ঘুম ভেঙে গেলে তুমি কার বুকে মাথা রেখে প্রশান্তির শ্বাস নেবে? সারাদিন সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করে এসে তুমি কার মুখ দেখে শান্তি পাবে? তোমার অগোছালো জামা-কাপড় কে গুছিয়ে রাখবে? তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কে তোমার সামনে এনে দেবে?”

রায়ানের চোখেও জল জমেছে। প্রভা রায়ানের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,”তুমি প্লিজ কেঁদো না। আমি তোমায় এভাবে দেখতে পারব না। আমি তোমার হাসিমুখ দেখতে চাই।”

“প্রভা…”

“অনেক কষ্ট করেছি আমি। আর পারছি না। এবার আমি শান্তিতে ঘুমাতে চাই।”

“তুমি ঘুমাও প্রভা। আমি এখানেই আছি।”

“রায়ান…”

“হুম বলো।”

“তোমার ইনোসেন্ট গার্ল তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”

“আমিও আমার ইনোসেন্ট গার্লকে অনেক ভালোবাসি।”

“তোমার মনে আছে আমাদের প্রথম দেখার কথা? কিভাবে ধাক্কা খেয়েছিলাম আমরা। আমি পরপারেও আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আবার তোমার সাথে ধাক্কা খেতে চাই। তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে চাই।”

রায়ান অনবরত কেঁদেই চলেছে। প্রভা৷ বলে,”এবার একটু হাসো। আমি তোমায় হাসিমুখে বিদায় দিতে চাই। ধরে নাও এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।”

রায়ান নিজের চোখের জল মুছে অল্প হাসে। হাসিতে ছিলে মলিনত্বের ছোয়া। প্রভাও হাসে রায়ানের দিকে তাকিয়ে। এরমধ্যে প্রণালী প্রত্যুষকে কোলে নিয়ে চলে আসে। প্রভা প্রণালীকে নিজের কাছে ডেকে বলে,”তোমার ভাই আর বাবাকে দেখে রাখার দায়িত্ব কিন্তু তোমার।”

প্রণালী কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। প্রভা আবারো রায়ানের দিকে তাকায়। অত:পর তার হাতটা ধরে বলে,”তাহলে আমি এবার ঘুমিয়ে পড়ি?”

রায়ান কিছু বলে না। সে বুঝতে পারছে প্রভা এবার চোখ বন্ধ করলে আর কখনো চোখ খুলবে না। রায়ান প্রভার সামনে আর কাঁদতে চায়না। নিজের প্রিয়তমাকে এভাবে বিদায়ও দিতে চায়না। প্রভা নিজের দুচোখ বন্ধ করে। রায়ান নিজ স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি।”
~~~~~~~~~~~
পুরো বাড়ি জুড়ে শোকের মাতম চলছে। অনুরাধা, সৌভিক সহ রায়ানের সকল শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়-স্বজন এসে উপস্থিত হয়েছে। তারা সকলেই প্রভার জন্য মর্মাহত। অনুরাধা তো কাঁদতে কাঁদতে কয়েকবার জ্ঞানও হারিয়েছে। প্রভার সাথে তার সেই ছোট বেলাকার বন্ধুত্ব। প্রভার এই মৃত্যু সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ছোট্ট প্রণালীও হাউমাউ করে কাঁদছে নিজের মায়ের জন্য। প্রত্যুষ, সে তো জানেই না সে কি অমূল্য সম্পদ হারিয়েছে। তবে বাচ্চাটাও আজ কাঁদছে। হয়তো সবাইকে কাঁদতে দেখে সে কাঁদছে। তবে এত সবকিছুর মধ্যেও রায়ান স্বাভাবিক আছে। সে আর কাঁদছে না। কারণ তার প্রভা যে তাকে কাঁদতে বারণ করেছে।

শেষবারের মতো প্রভাকে দেখে নিলো সে। কিছুক্ষণ পরই প্রভাকে কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রভার নিথর মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সে বলে,”ভালোবাসি, তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি। আজীবন এভাবেই ভালোবেসে যাব।”

প্রভার জানাজা অনুষ্ঠিত হলো। এরপর রায়ান প্রভার কফিন বহন করে তাকে নিয়ে কবরস্থানে রেখে আসল। যেই মেয়েটাকে সবসময় আগলে রেখেছে তাকে কিনা আজ নিজের থেকে এত দূরে রেখে আসতে হয়েছে। প্রভাকে সমাধিস্থ করে এসে আকরাম খানের মুখোমুখি হয় রায়ান। নিচু কণ্ঠে বলে,”আমি আপনাকে দেয়া কথা রাখতে পারলাম না বাবা। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিয়েন। আমি আপনার মেয়েকে আগলে রাখতে পারলাম না।”

আকরাম খান রায়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। রায়ানও এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”প্রভা আমায় একা করে কিভাবে চলে গেল? ওর কি একবারো আমার কথা মনে পড়ল না?”

রায়ানের জীবন যেন নিঃসঙ্গতায় ডুবে গেল। প্রভার সাথে ৬ বছরের সংসার যাত্রার ইতি ঘটল। রায়ান জানে বাকি জীবন তাকে এই নিঃসঙ্গতা নিয়েই কাটাতে হবে। কারণ প্রভার স্থান সে আর কাউকে দেবে না।

রায়ান বিমর্ষ মন নিয়ে বসে রইলো ঘরে। ভাবতে লাগল প্রভার কথা। তার সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্ত গুলো। পাশের ঘরের রেডিও থেকে বাজছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গান,
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না…
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে গো
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা, মিটিয়ে দেব গো
মিটিয়ে দেব লেনা দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাইবা আমায় ডাকলে”

to be continue….

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_34(নতুন অধ্যায়)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

১৮ বছর পর,
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। যেকোন সময় বৃষ্টি নামবে। আকাশও তর্জন গর্জন শুরু করে দিয়েছে। এসবের মধ্যেই হাতে ছাতা নিয়ে দৌড়ে চলেছে ২৩ বছর বয়সী এক তরুণী৷ তার চোখেমুখে খুশির ঝলক স্পষ্ট। পথিমধ্যে এক বৃদ্ধ তাকে দেখে বলে,”আস্তে দৌড়াও মা, পড়ে যাইবা তো। তোমায় এত খুশি লাগছে কিল্লাই?”

মেয়েটি হেসে উত্তর দিলো,”আমার ভাই মেডিকেলে চান্স পেয়েছে চাচা। আমি এই খুশির খবরটা পেয়েই তো এভাবে ছুটে যাচ্ছি বাড়ির দিকে। আমার ভাইটার জন্য দোয়া করবেন।”

বলেই মেয়েটি আবার দৌড়াতে শুরু করে। একদম নিজের বাড়ির সামনে এসে দম নেয়। বাড়িতে প্রবেশ করে প্রথমেই নিজের ভাইয়ের রুমে যায়। কিন্তু সেখানে তাকে দেখতে পায়না৷ মেয়েটি বুঝতে পারে তার ভাই এখন কোথায় আছে। সে ছুটে চলে যায় নিজের মায়ের রুমে। তার ভাবনাই সঠিক। নিজের মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার ভাই প্রত্যুষ। প্রণালী হেসে এগিয়ে যায় তার ভাইয়ের দিকে। প্রত্যুষের কাধে হাত রাখতেই প্রত্যুষ স্বাভাবিক ভাবে ফিরে তাকায়। প্রণালী দেখতে পায় তার ভাইটা কাঁদছে। সাথে সাথেই সে জড়িয়ে ধরে নিজের ভাইকে৷ অতঃপর শান্ত গলায় বলে,”পাগল ছেলে! আজকের মতো একটা খুশির দিনে তুই এভাবে কাঁদছিস কেন?”

প্রত্যুষ ব্যথিত কণ্ঠে বলে,”আজ মা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতো। তাই না আপি?”

প্রণালীর চোখও এবার জলে ভিজে যায়। সে তাকায় তাদের মা প্রভার ছবির দিকে। আজ ১৮ বছর হয়ে গেছে প্রভার মৃত্যুর। মাকে ছাড়া ১৮ বছর পার করে দিল তারা দুজনে। প্রণালী তো তবুও মায়ের ভালোবাসাটুকু পেয়েছিল মায়ের মুখটাও মনে পড়ে অল্পস্বল্প। কিন্তু তার হতভাগা ভাইটার তো সেই সৌভাগ্যও নেই। মাত্র ২ মাস বয়সে মাকে হারিয়েছে সে। কিন্তু মায়ের প্রতি ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি নেই। তাই তো মায়ের প্রফেশনটাই বেছে নিলো সে। প্রণালী প্রত্যুষকে জড়িয়ে ধরে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বলে,”মা যেখানেই থাকুক না কেন, তোর এই সাফল্যে অনেক খুশি হয়েছে ভাই।”

দরজায় দাঁড়িয়ে ভাই-বোনের এই সুন্দর মুহুর্ত গুলো দেখছিল রায়ান। তার চোখেও জল এসে গেছে। আজ ১৮ বছর হয়ে গেল তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলেছে। তারপর থেকে দুই ছেলে-মেয়েকে ঘিরেই তার জীবন।। রায়ানের মধ্যেও এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। চুল, দাঁড়িতে পাক ধরতে শুরু করেছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। একজন ছাপোষা বাঙালি পিতার মতোই তার অবস্থা।
প্রত্যুষের নজর যায় তার বাবার দিকে। সে বলে,”বাবা, তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে আসো।”

প্রণালীও তাকায় নিজের বাবার দিকে। রায়ান ভেতরে এসে প্রত্যুষকে অভিনন্দন জানিয়ে বলে,”আমি অনেক খু্শি হয়েছি প্রত্যুষ। আমি আশা করি তুমিও তোমার মায়ের মতো অনেক ভালো ডাক্তার হতে পারবে।”

আর কিছু না বলেই তিনি চলে যান। প্রণালী প্রত্যুষকে বলে,”ভাই তুই কি খেতে চাস বল, আমি তোকে আজ সেটাই রান্না করে খাওয়াবো।”

প্রত্যুষ সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলে,”তোর যা ভালো লাগে তাই কর, আমি সেটাই খাবো।”

~~~~~~~~~~~~~
নিজের রুমে বসে ভার্সিটির কিছু এসাইনমেন্ট করছিল প্রণালী৷ বর্তমানে সে একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট ভার্সিটিতে ল নিয়ে পড়ছে। এখন তার ফাইনাল ইয়ার চলছে। আর মাত্র কিছুদিন তারপরেই নিজের স্বপ্নকে ছুতে পারবে সে। এসব ভেবেই প্রণালী খুশি হচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে রায়ান তার রুমের বাইরে থেকে দরজা নক করে বলব,”আসতে পারি?”

প্রণালী রায়ানের হঠাৎ এমন আগমনে চমকে গেল। রায়ানকে এখানে একদমই আশা করে নি সে। কারণ ৫ বছর আগে থেকে তাদের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব চলছে। যার জন্য রায়ান প্রণালীর সাথে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলে না। প্রণালী তবুও স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,”জ্বি, আসো।”

রায়ান রুমের ভেতরে এসে নিজের মেয়েকে বলে,”কি করছ?”

“কিছু এসাইনমেন্ট করছিলাম। কিছু বলবে?”

রায়ান কিছুটা হতাশ কন্ঠে বলে,”তুমি তো জানোই প্রণালী আমি কি বলতে চাই। তোমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমার যে কত চিন্তা হয় তুমি বোঝো না? প্রভাকে হারানোর পর এখন তোমরাই তো আমার সব। আমি চাইনা তোমাদের কোন বিপদ হোক। তোমাদের সুরক্ষিত রাখার জন্য তো আমি রাজনীতি ছেড়ে দিলাম। নিজের শহর চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসলাম। এসব কিছু কেন করেছি আমি? যাতে তোমাদের উপর কোন বিপদের আঁচ না পড়ে৷ অথচ তুমি সেই বিপদকেই আমন্ত্রণ জানাতে চাইছ। তুমি কেন বোঝো না প্রণালী তোমার জন্য আমার কতটা চিন্তা হয়?”

প্রণালী রায়ানের সব কথাই শোনে কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া জানায় না। সে জানে তার বাবার ভয়টা কোথায়। প্রভার মৃত্যুর পর রায়ানের মধ্যে আপনজনকে হারানোর ভয় জেকে বসে৷ এইজন্য নিজের ছেলে-মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে সে রাজনীতি ছেড়ে দেয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বিজনেস শুরু করে। সবসময় চেষ্টা করেছে দুই ভাইবোনকে সুখী রাখার এমনকি দ্বিতীয় বার বিয়ের কথাও ভাবেন নি। প্রণালীর সাথেও রায়ানের সম্পর্ক ভালো ছিল। আসলে প্রত্যুষ ভীষণ চাপা স্বভাবের এবং খুব কম কথা বলে। সারাক্ষণ পড়ার মাঝেই থাকে। প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় পরিবারের লোকের সাথেও তার কিছুটা মানসিক দূরত্ব আছে। সেখানে প্রণালী একদম বিপরীত। চঞ্চল, প্রাণবন্ত এবং ভীষণ আনন্দময় একটি মেয়ে। যেখানে থাকে সেই জায়গাই মাতিয়ে রাখে। সাথে ভীষণ প্রতিবাদীও সে। স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়েই বড় হয়েছে। প্রণালীর ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা সে একজন বড় উকিল হবে। আর রায়ানের ঠিক এটাই পছন্দ হয়নি। কারণ এই পেশায় অনেক ঝুঁকি রয়েছে এবং রায়ান চায়না তার সন্তানদের জীবনে নতুন করে কোন সমস্যা আসুক। ঠিক এই কারণে যখন ৫ বছর আগে প্রণালী ল’ নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন থেকেই বাবার সাথে তার একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। তারপর থেকে রায়ান আর মেয়ের সাথে ঠিক করে কথা বলে না।আজ অনেকদিন পর তিনি নিজের মেয়ের সাথে নিজে থেকে কথা বলতে এসেছেন। প্রণালীও তাই নিজের বাবাকে রাগিয়ে দিতে চায়না। কিন্তু নিজের প্যাশনও সে ছাড়তে পারবে না। তাই প্রণালী এই বিষয়ে কথা বলতে চাইছিল সে। সে প্রসঙ্গ বদলে বলে,”বাবা, প্রত্যুষের এত বড় সাকসেসের কোন সেলিব্রেশন হবে না?”

“টপিক বদলানোর চেষ্টা করো না প্রণালী।”

প্রণালী বুঝতে পারে না এবার সে কি বলবে। তাই চুপ করে বসে থাকে। রায়ান বলতে থাকে,”আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার কোন কথা শুনবে না। নিজের জেদেই তুমি অটল থাকবে। তাই আমিও আর তোমাকে কিছু বলব না৷ যা ইচ্ছা করো। তোমার মাকে তো অনেক আগেই হারিয়েছ এবার আমাকে হারালেই ষোলকলা পূর্ণ হবে।”

“বাবা! এসব কেমন কথা বলছ তুমি?”

রায়ান আর কিছু না বলে প্রণালীর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে প্রণালীর মন একদম খারাপ হয়ে যায়। তাই সে উদাস মনে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সাথে করে সে নিজের ফোনটাও নিয়ে এসেছিল। সে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণ পরেই তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের দিকে তাকাতেই প্রণালীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। নাম্বারটা “প্রিয়তম” দিয়ে সেইভ করা। ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে কেউ বলে ওঠে,”নিশ্চয়ই এখন তোমার মন খারাপ?”

“তুমি কি করে বুঝলে? তোমার কাছে কি কোন সুপার পাওয়ার আছে শান্ত? সবসময় আমার মন খারাপের খবর তোমার কাছে কিভাবে পৌঁছে যায়?”

“এটাকে ট্যালিপ্যাথি বলে প্রণালী। যাদের মধ্যে ভালোবাসা বেশি থাকে তাদের মাঝে এটা বেশি কাজ করে।”

প্রণালী খুব খুশি হয় শান্তর কথা শুনে। শান্ত আর প্রণালীর মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক। তাদের প্রেম কাহিনিটাও কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর ছিল। শান্ত ছিল প্রত্যুষের হোম টিউটর। সেখান থেকেই প্রণালীর সাথে তার পরিচয়। শান্তর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব প্রণালীকে মুগ্ধ করে এবং সে শান্তর প্রেমে পড়ে যায়। শান্তকে যখন সে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করে তখন তো শান্ত কিছুতেই রাজি হয়না। কারণ সে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আর প্রণালীরা এত বড়লোক। কিন্তু প্রণালী শান্তকে ঠিকই রাজি করিয়ে নেয়। তারপর থেকে ২ বছর ধরে তারা রিলেশনে আছে। প্রণালী তো ভেবে নিয়েছে উকিল হয়ে যাবার পরই সে রায়ানকে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানাবে। আর রায়ানের কাছেও এসব ধনী-গরিবের কোন পার্থক্য নেই। তাই রায়ানও খুশি খুশি সব মেনে নেবে। আর একটা সময় রায়ান হয়তো প্রণালীর প্রফেশনটাও মেনে নেবে। এসব ভেবে প্রণালীর দুঃখী মনে সুখের সঞ্চার ঘটে এবং সে খুশি মনে শান্তর সাথে কথা বলতে থাকে।

to be continue…

#একই_সুরে_প্রেম_আমায়_কাঁদায়
#Part_35
#ইয়াসমিন_খন্দকার

প্রণালী আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই নিজের বাবা ও ভাইয়ের জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছে। প্রত্যুষ চাউমিন খেতে অনেক পছন্দ করে। তাই ব্রেকফাস্টে সেটাই করেছে প্রণালী৷ ব্রেকফাস্ট তৈরি করার পর সে গেল প্রত্যুষের রুমে। সেখানে গিয়ে প্রণালী দেখল প্রত্যুষ বই পড়ছে। এতে অবশ্য সে অবাক হয়নি। প্রত্যুষ বরাবরই এমন। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সে নামাজ আদায় করে পড়তে বসে। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া বাকি সময় পড়াশোনাই করে ছেলেটা। প্রণালী প্রত্যুষের কাছে গিয়ে বলল,”ভাই, তুই তাড়াতাড়ি বাবাকে নিয়ে নিচে চলে আয়। আমি ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি। আজ তো তোর মেডিকেলে প্রথম দিন। আমি এখন তোকে রেখে আসব।”

এই বলেই প্রণালী চলে যায়৷ প্রত্যুষের কোন কথা শোনার প্রয়োজন মনে করে না। এদিকে প্রত্যুষও কিছু বলার সুযোগটাও পায়না। সে তো পড়ে গেছে মাইনকার চিপায়। আগে তো প্রণালী আর রায়ান মিলে বাড়িটা মাথায় করে রাখত। আর যখন থেকে প্রণালীর উকিল হওয়া নিয়ে তাদের মাঝে ঝামেলা তৈরি হয়েছে তখন থেকেই তাদের মধ্যে কথাবার্তা কমে গেছে। তাদের কোন কথা বলার থাকলে তারা এভাবে প্রত্যুষকে বলে বলতে। নিজেরা মুখোমুখি হয়ে কথা বলেই না। প্রত্যুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে জানে না তার বাবা আর বোনের এই মনোমালিন্য কতদিন চলবে। সে আর বেশি না ভেবে তার বাবাকে ডাকতে যায়।

রায়ানের রুমের সামনে গিয়েই প্রত্যুষ বলে,”বাবা, আপি ব্রেকফাস্ট করতে নিচে যেতে বলেছে।”

“তুমি যাও আমি যাচ্ছি। আর আজ তো তোমার মেডিকেলে প্রথম দিন, আমি কি তোমায় নিয়ে যাব?”

“আপি নিয়ে যাবে বলেছে।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

প্রত্যুষ চলে যায়। রায়ান নিজের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রত্যুষকে দেখলেই তার প্রভার কথা মনে পড়ে। প্রত্যুষের চেহারার সাথে প্রভার চেহারার অনেক মিল। শুধু চেহারা নয় ব্যবহারেও দুজনের মধ্যে সাদৃশ্য অনেক। প্রত্যুষ যেন প্রভারই প্রতিরূপ। রায়ানের ইনোসেন্ট গার্ল প্রভার ❝ইনোসেন্ট বয়❞ এই প্রত্যুষ। শান্তশিষ্ট এবং ভদ্র, শুধু তাই নয় বেশ বাধ্য ছেলেও। রায়ান প্রণালীর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা একদম মায়ের মতো হয়নি। বেশ চঞ্চল এবং জেদি তৈরি হয়েছে।

~~~~~
ব্রেকফাস্ট শেষ করে প্রণালী প্রত্যুষকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে রওনা হয়। সেখানেই চান্স পেয়েছে প্রত্যুষ। রাস্তায় যেতে যেতে প্রণালী প্রত্যুষকে কিভাবে চলবে ফিরবে সেসব বলতে থাকে,”ভাই, তুই কিন্তু একদম বাইরের খাবার খাবি না, এসব তোর সহ্য হয়না। তোর ক্ষিধে পেলে টিফিন করে দিয়েছি সেটা খাবি। আর হ্যাঁ, সবসময় এমন আঁতেল হয়ে থাকবি না মোটেও। তোকে তো যেই পায় বোকা বানিয়ে যায়। একটু চালাক হ বুঝলি।”

“হু।”

“আরে কি হু হু করছিস? যা বলছি মন দিয়ে শোন, কেউ যদি তোকে বিরক্ত করে তাহলে আমায় এসে বলবি। তারপর আমি তাকে দেখে নেব। প্রণালীর ভাইয়ের সাথে লাগতে আসার ফল বুঝিয়ে দেব।”

প্রত্যুষ আর কিছু না বলে চুপচাপ থাকে। প্রণালী তাকে এখনো ছোট বাচ্চার মতোই ট্রিট করে। যেন সে স্কুলে পড়ে। প্রত্যুষের মনে পড়ে যায় তাদের স্কুলের দিনগুলোর কথা। প্রণালী কিভাবে সবসময় তাকে প্রটেক্ট করত। একবার একটা ছেলে প্রত্যুষকে মে’রেছিল স্কুলে, প্রণালী কোনভাবে সেটা জানতে পেরে নিজের বন্ধুদের সাথে মিলে ছেলেটাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সেই মা”র মে**রেছিল। শেষপর্যন্ত গার্জিয়ানদের কল করা হয়েছিল। এসব ভেবেই হাসতে থাকে প্রত্যুষ। তার বোন তাকে সত্যি ভীষণ ভালোবাসে।

হঠাৎ করে জ্যামে গাড়ি আটকে যায়। প্রণালী অবাক হয়ে বলে,”এই রাস্তায় তো জ্যাম হয়না। আজ হঠাৎ কি হলো?”

ড্রাইভার বলে,”সামনে খুব জটলা। মনে হয় কোন ঝামেলা হয়েছে।”

প্রণালী বলে,”ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে।”

বলেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। প্রত্যুষও তার সাথে নামে। প্রণালী সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় একজন লোককে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। প্রণালী একজনকে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে এখানে?”

“আরে দেখুন না, এই লোকটা একজন সাধারণ আইসক্রিমওয়ালা। রাস্তায় আইসক্রিম নিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় ঐ লোকটা এসে ধাক্কা দিয়ে ওনার আইসক্রিমের গাড়িটা উলটে দেয়। অল্পের জন্য উনি বেঁচে যান। আর এখন ঐ লোকটা আইসক্রিমওয়ালার উপরই চটে গেছেন। ওনার গায়ে হাতও তুলতে চাইছেন।”

প্রণালীর মাথা গরম হয়ে যায়। সে আইসক্রিমওয়ালার দিকে তাকিয়ে দেখে বেশ প্রবীণ লোক। কতটা অমানুষ হলে কেউ নিজে অন্যায় করে এমন অসহায় বৃদ্ধ লোকের উপর চড়াও হয়। ঐ যুবকটি বৃদ্ধ লোকের উপর হাত তুলতে যাবে এমন সময় প্রণালী গিয়ে তার হাত ধরে ফেলে। যুবকটি নিজের সানগ্লাস চোখ থেকে খোলে। প্রণালীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,”হু আর ইউ? এন্ড হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি?”

প্রণালী রাগী কন্ঠে বলে,”আপনি এত সাহস কোথায় পেলেন? একেই নিজে অন্যায় করেছেন এখন আবার এই অসহায় বৃদ্ধ লোকটির গায়ে হাত তুলছেন?”

যুবকটি বলে,”লুক। আমার ১ কোটি টাকার গাড়িতে ক্রাচ হয়েছে ওনার জন্য। আর আমি ওনাকে ছেড়ে দিব?”

“রাখেন আপনার গাড়ি। আপনার জন্য যে উনি মরতে বসেছিলেন সেটা দেখেন নি? ওনার জীবনের দাম কি আপনার গাড়ির থেকে বেশি।”

প্রত্যুষ বুঝতে পারে ঝামেলা বেশ ভালোই হতে চলেছে। প্রণালী বরাবরই বেশ প্রতিবাদী। তাই যাতে বড় কোন ঝামেলা না বাধায় তাই সে প্রণালীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপি, তুমি চলে আসো। ঝামেলা করিও না প্লিজ।”

প্রণালী তবুও থামে না। বলতে থাকে,”বলুন, আপনার গাড়ির দাম কি ওনার জীবনের থেকে বেশি?”

“অবশ্যই বেশি। এই গরীব লোক সমাজের কোন কাজে লাগে? যত্তসব আবর্জনা।”

প্রণালীর মাথায় এবার রাগ উঠে যায়। সে আর নিজের রাগ সামলাতে না পেরে ঠাস করে থা’প্পর বসিয়ে দেয় যুবকটির গালে। সকলে হতবাক। প্রত্যুষ মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম৷ আপি যেখানেই যাবে সেখানেই কোন না কোন ঝামেলা করবে।”

যুবকটি ক্রোধান্বিত হয়ে বলে,”তোমার এত বড় সাহস তুমি আমার গায়ে হাত তুললে? সমুদ্র চৌধুরীর গায়ে? এর পরিণাম তোমায় ভোগ করতে হবে। আই উইল সি ইউ।”

বলেই সমুদ্র নিজের গাড়িতে উঠল। তার মাথায় আগুন জ্বলছে। তার মা-বাবাও কোনদিন তার গায়ে হাত তোলে নি। আর আজ কিনা এতগুলো মানুষের সামনে একটা মেয়ে তার গায়ে হাত তুলল। সমুদ্র গাড়ি থেকে একটা মদের বোতল এনে সেই মদগুলো ছুড়ে মা*রল প্রণালীর মুখে। মদের বিশ্রী গন্ধে প্রণালীর বমি পেয়ে গেল। সমুদ্র বলল,”আমি মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না জন্য তুমি বেঁচে গেলা। তবে এত সহজে তোমায় ছেড়ে দেব ভেবো না। সমুদ্র চৌধুরীর গায়ে হাত তোলার ফল অনেক ভয়াবহ হবে।”

এই বলে সে গাড়িতে উঠে চলে গেল। প্রণালী রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে ছিল। প্রত্যুষ দৌড়ে এসে টিস্যু এগিয়ে দিল প্রণালীর দিকে। বলল,”মুছে নেও।”

প্রণালী রেগে তাকিয়ে রইল সমুদ্রের যাওয়ার দিকে। আর বলতে লাগল,”স্পয়েল কিড কোথাকার!”

প্রত্যুষ বলল,”তোমাকে আমি বলেছিলাম ঝামেলা না করতে। দেখলে তো কি হলো। বাবা এসব জানলে খুব রেগে যাবে।”

“বাবাকে কিছু বলতে হবে না। তুই গাড়িতে উঠে পড়। দেরি হয়ে যাচ্ছে। এসব স্পয়েল কিডকে নিয়ে বেশি ভাবতে হবে না।”

এই বলে সে নিজের ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে আইসক্রিমওয়ালাকে দিয়ে বলে,”এই নিন আপনার ক্ষতিপূরণ। এটা দিয়ে নতুন গাড়ি কিনে নিয়েন।”
~~~~~~~~
প্রত্যুষকে মেডিকেল কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে প্রণালী শান্তর সাথে দেখা করতে রমনায় এলো। সকালের ঘটনাটা ভেবে এখনো তার মাথায় আগুন জ্বলছে। শান্ত প্রণালীর মুখ দেখেই বুঝতে পারল সে রেগে আছে। তাই তো জিজ্ঞেস করল,”কি হয়েছে তোমার? এত রাগী লাগছে কেন?”

প্রণালী তখন শান্তকে সব খুলে বলে। সব শুনে শান্ত হেসে বলে,”তুমি সত্যিই বেশ সাহসী প্রণালী। একদম ঝাঁসি কি রাণী।”

প্রণালী বলে,”আমার এইজন্য এমন রিচ কিডদের সহ্য হয়না। বাপের টাকায় মস্তি করে বখে যায় একদম।”

“তুমিও তো রিচ কিড।”

“হ্যাঁ, কিন্তু আমি বা আমার ভাই আমাদের বাবার কড়া শাসনে বড় হয়েছি তাই বখে যাইনি। তবে বেশিরভাগ রিচ কিডই বখে যাওয়া। এইজন্য তো আমি সবসময় চাই কোন সাধারণ ফ্যামিলিতে বিয়ে করতে।”

“কিন্তু তোমার বাবা যদি কোন রিচ ফ্যামিলিতেই বিয়ে দিতে চায়?”

“বাবা এমন করবে না।”

বলেই শান্তর কাধে মাথা রাখে প্রণালী।

to be continue…